Sunday, June 29, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 310



চন্দ্রাণী পর্ব-০১

0

#চন্দ্রাণী(০১)
রাজিয়া রহমান

১.
ইউপি নির্বাচনের প্রচারণা চলছে সীমান্তবর্তী কুসুমপুর গ্রামে।জায়গায় জায়গায় নির্বাচনের বিভিন্ন পোস্টার। গ্রামের ৩ বারের চেয়ারম্যান শাহজাহান তালুকদারের কাচারি ঘরে ভীড় ভীষণ। দলে দলে লোকজন আসছে আর যাচ্ছে। বাবুল দাশ দফায় দফায় চা বানাচ্ছে। তার চোখে মুখে উপচে পড়ছে বিরক্তি। নির্বাচন এখনো প্রায় এক মাসের বেশি দেরি।কুসুমপুরে নির্বাচন এলেই কেমন উৎসব উৎসব ভাব হয়।

কাচারি ঘরের বাহিরে বড় পুকুর ঘাটে বসে আছে শুভ্র।শাহজাহান তালুকদারের দুই মেয়ে এক ছেলে।
বড় মেয়ে চন্দ্রাণী তারপর শর্মী আর সবার ছোট শুভ্র।

শুভ্র একটা বড়শী নিয়ে বসে আছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত সে।
তার মনযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে শর্মী দৌড়ে এলো। এসেই শুভ্রর হাত ধরে টেনে নিতে লাগলো বাড়ির দিকে।কাচারি ঘরের অনতিদূরে চেয়ারম্যানের ঘর।
শুভ্র দুই এক বার আপার হাত ছাড়িয়ে ছুটে বের হয়ে যেতে চাইলো কিন্তু আপার শক্ত করে ধরে রাখা বন্ধন ছেড়ে বের হতে পারলো না অথবা কে জানে হয়তো ইচ্ছে করেই বের হলো না।

শর্মী শুভ্রকে চেয়ারে বসিয়ে একটা ষ্টীলের থালায় করে এক থালা ভাত নিয়ে এলো তারপর ভাইকে লোকমা ধরে ভাত খাইয়ে দিলো।

শুভ্র গোঁগোঁ করতে করতে ভাত খেলো।শর্মীর দুই চোখে জল।তার শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী ভাইটাকে কে দেখবে শেষ কালে?বোনেরা তো বাবার ঘরে অস্থায়ী মেহমান। কোনো মেয়ে কি এরকম একটা ছেলেকে বিয়ে করে থাকতে চাইবে?
তা না হলে বাবা মা মারা গেলে ওর কি হবে!

রেহানা রান্নাঘরে বড় ডেকচিতে মাংস কষাচ্ছে।আরেক চুলায় মুগডাল ভাজছে। মুগডালে ভাজা গন্ধে শুভ্র উসখুস করতে লাগলো। শর্মী ভাইকে শান্ত হতে ইশারা করে পাশে ঢেকে রাখা বাটিতে দেখালো ওর জন্য ভাজা মুগডাল রাখা আছে।

রেহানা হাঁক দিয়ে বললেন,”শর্মী তোর হলো?ভাইকে খাওয়াতে দিনের অর্ধেক কাটিয়ে দিলে বাকি কাজ করবি কখন?আমার কি দশ হাত নাকি?
কয়দিক সামলাবো আমি!
আল্লাহ আমার কপালে এসব ঝামেলা লিখে দিছে।”

শর্মী দ্রুত গেলার জন্য ইশারা করলো শুভ্রকে। শুভ্র মজা পেয়ে হাসতে লাগলো। শর্মী মুগ্ধ হয়ে ভাইয়ের হাসি দেখতে লাগলো। আহারে!
কেমন চাঁদের মতন মুখ, আল্লাহ কত রূপ দিয়ে বানিয়েছে। অথচ তার ও খুঁত দিয়ে দিয়েছে। শুভ্রর যেদিন জন্ম হলো, উথাল-পাতাল জোছনা ছিলো সেই রাতে।সবাই বলাবলি করতে লাগলো চেয়ারম্যানের ঘরে আল্লাহ চান্দের টুকরো দিছে।

শুভ্র পেটে হাত দিয়ে দেখালো পেট ভরে গেছে আর খাবে না।

শর্মী আর জোর করলো না।।ইদানীং তার নিজের ও খেতে ইচ্ছে করে না,কেমন বমি পায় খেতে গেলে। গপাগপ চোখ বন্ধ করে নিজে বাকি দুই লোকমা খেয়ে ছুটলো রান্নাঘরে।এর বেশি খেলে বমি করে দিবে জানে শর্মী। ছুটতে ছুটতে টের পেলো অন্তর্বাসের ভেতর লুকিয়ে রাখা ছোট বাটন ফোনটা দুই বার ভাইব্রেট করেছে।

মেসেজ এসেছে বোধহয়। এখন চেক করার সময় নেই, দেরি হলে রেহানা মেয়ের পিঠে হাতা ভাঙবে।

বারান্দায় বসে সুপারি কাটতে কাটতে সেতারা বানু বললেন, “আস্তে দৌড়া রে ছেরি,সোমত্ত মাইয়া এমনে ছুটতে নাই।লোকজন দেখলে খারাপ কইবো।”

শর্মী কিছু বললো না, দাদীর সাথে কথা বলার সময় নাই তার।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখে রেহানা হাত পুড়িয়ে বসে আছে। শর্মী মা’কে সরিয়ে দিয়ে পিড়িতে বসে।রেহানা বসে বসে শাপ শাপান্ত করতে থাকে মনার মা’কে। আজ দুই দিন মনার মা কাজে আসে না।
পাশে বসে পাটায় শুকনো মরিচ বাটতে বাটতে জমিলা বললো, “এরপরেও তো আপনে ওরে বেশি পছন্দ করেন।যাওনের কালে এটা ওইটা দিয়া দ্যান।”

রেহানা মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, “তুই চুপ থাক।আমি ভালো কইরা বুঝি কার কোনটা দরকার। তোর বুড়া বাপের লাইগা যে মাসে মাসে পনেরশ টাকা পাঠাই তোর বেতনের বাহিরে,তখন কেউ কিছু কয়?নিজেরটা নিয়া খুশি থাক।মনার মা’র স্বামী নাই,ঘরে তিনটা পোলাপান। মা বাড়িত গেলে সব পোলাপানই ছুইট্টা আসে দেখতে মা কি নিয়া আসছে।সেখানে যদি কিছু না দেখে পোলাপানের মন খারাপ হয়।সারাদিন মা’রে না দেখনের কষ্ট পোলাপান ভুইলা যায় মায়ের কাছে খাওন দেখলে।”

জমিলা কথা বাড়ায় না।ভাবী মিছা কথা কয় নাই।জমিলার মা যখন লোকের বাড়ি কাজ করতো, তখন জমিলারা দুই বোন ও এমন করে অপেক্ষা করতো।বেশির ভাগ দিনেই মা এক থালা ভাত নিয়ে ফিরতো।এক থালা ভাত চারজন মানুষ ভাগ করে খেতো।
চোখের সামনে সেসব ভাসতে থাকে জমিলার।দুই চোখ ভিজে উঠে।

শর্মী তাড়া দিয়ে বলে,”খালা,তাড়াতাড়ি করেন।মাছ ভাজতে হইবো আপনার। ”

রেহানা হাতে ফুঁ দিচ্ছে। শুভ্র মা’য়ের হাতে ফুঁ দেওয়া দেখে কি মনে করে বার্না মলমটা নিয়ে এলো।

বারান্দা থেকে দেখে সেতারা বানু বললেন, “বোবা,হাবা হইলে কি হইবো, মায়ের কষ্ট ঠিকই বুঝে। ”

শর্মী তেঁতে উঠলো ভাইয়ের নামে এরকম শব্দ ব্যবহার করতে শুনে। দুই বোনের চোখের মনি এই ভাই।দুজনের কেউ-ই ভাইকে কেউ মন্দ কথা বললে সহ্য করতে পারে না।

রেহানা ইশারা করে শর্মীকে চুপ থাকতে বলে শাশুড়ির উদ্দেশ্য বললেন, “জগতের নিয়ম এইডাই আম্মা।এই যে আপনের পোলা এতো ব্যস্ত মানুষ হইয়াও ঘরে আইসা আগে আপনের ঘরে যায়,আপনের কি লাগবো না লাগবো শুনে বাবুল রে দিয়া সব আনাইয়া রাখে অথচ দেখা যায় ঘরে মাছ নাই অথবা তেল নাই।কিন্তু সেসব আনানোর কথা ভুলে যায়।”

সেতারা বানু বিরক্ত হন।এই বউটা মুখে মুখে সবসময় চোপা করে। মুখ ঝামটা মেরে বলেন,”এইরকম চোপা করবা না,মাইয়ারা তোমার থাইকা এগুলাই শিখবো।পরে বিয়ার পর আর ওরা স্বামীর ঘর করতে পারবো না চোপার জন্য। বেবাক মানুষ তো আমার মতো না মাইন্না নিবো।আমার পোলা যেটুকু করে ওই টুকুই। তুমি তো পানিও দাও না।”

রেহানা হাতে ভালো করে মলম দিয়ে বললো, “আমি তো পানি দিই না,আরো তো তিনজন আছে আপনার পুত্রবধূ। তারা তো সবাই আপনার খেদমত করতে উদগ্রীব হয়ে থাকে।তাগো ঘরে যান।তা তো যান না।”

সেতারা বানু মুখে লাগাম দেয়।এখন কথা বাড়ানোর সময় না।সবাই কে তার চেনা আছে।রেহানার মুখে বিষ হইলেও মনে কিছু নাই।বরং তার জন্য অনেক মায়া।অন্যরা মুখে মিষ্টি কথা কয় কামের বেলা কেউ না।সব কয়টা হাড়ে মাংসে বজ্জাত।পোলাগুলা ও তেমন ভিজা বিড়াল।মিনমিন করে বউ গো সামনে। মায়ের জন্য যে কিছু করবে সেই মুরোদ নাই।

শর্মীর ফোন আবারও ভাইব্রেট করে। গরম তেলে কাতলা মাছের টুকরো ছাড়তে ছাড়তে শর্মী টের পায় কল এসেছে এবার।এদিকে উঠে যাবার ও সুযোগ নাই।মাছ ভাজার গন্ধ পেয়ে শুভ্র রান্নাঘরের খুঁটির সাথে এসে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।

শর্মী মাছ উল্টাতে উল্টাতে ভাবে আজকে খুব রাগ হবে নিয়াজ।সকাল থেকে কোনো কথা বলতে পারে নি, একটা মেসেজ ও দেয় নি।বাবু নিশ্চয় রেগে বোম হয়ে থাকবে।

রেহানা মেয়েকে সাবধান করে বললো, “দেইখা মাছ ছাড়,হাত পুড়বি গরম তেলে আবার আমার মতো। এই সংসারে আইসা শুধু জইলা পুইড়া মরলাম।কারো কাছে দাম পাইলাম না।”

শর্মী মুচকি হাসতে থাকে যেদিন আব্বার সাথে যেদিন মনোমালিন্য হয় মা এরকম কথ বলা শুরু করে।

শর্মী একটা বাটিতে বড় সাইজের এক টুকরো মাছ তুলে দিয়ে শুভ্রর হাতে দেয়।শুভ্রর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে যায় মাছ দেখে।গরম মাছে হাত দিয়ে গোঁগোঁ করে উঠে। দুই চোখ ভিজে উঠে নিমিষেই।
তাড়াতাড়ি ঠান্ডা পানির বালতি এগিয়ে দেয় শর্মী।

রেহানা চুপ করে দেখে।এই অবুঝ ছেলেটাকে নিয়ে তার দিনরাত চিন্তা।কিছুই বুঝে না এই ছেলেটা।

শর্মীর ফোন আবারও ভাইব্রেট হচ্ছে। জমিলা এখনো মরিচ বাটছে।শর্মী তাড়া দিয়ে বললো, “খালা তাড়াতাড়ি করেন।আমার হাতে এখনো কত কাম।আপনি মাছ ভাজতেন তাও আমি ভাজতাছি।ঘর ও গুছাইতে হইবো আমার। ”
রেহানা উঠে বললো, “আমি যাই ঘর গুছিয়ে রাখি।”
রেহানা উঠে যেতে শর্মী বাথরুমের নাম করে উঠে যায়।তারপর ফোন বের করে নিয়াজকে কল দেয়।

একরাশ বিরক্তি নিয়ে নিয়াজ কল রিসিভ করে বলে, “এতক্ষণ পর সময় হইছে তোমার? নির্বাচন করবে তোমার বাপ।কিন্তু ব্যস্ততা তোমার। মনে হয় এবার তুমি দাঁড়াইবা।”

শর্মী ফিসফিস করে বললো, “আজকে উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র,উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ওসি ওনারা সবাই দুপুরে আমাগো বাড়িতে খাইবো।এরজন্য একটু ব্যস্ত কাজকর্ম নিয়ে। ”

নিয়াজ হেসে বললো, “শালারা আস্ত হারাম**।আমার বাপের থাইকা ও খায়,তোমার বাপের থাইকা ও খায়।তবে এবার তোমার বাপ জিতবো না। আমার বাপেই জিতবো।”

শর্মী হেসে বললো, “আকাশে চাঁদ উঠলে যেমন সবাই দেখবো, ভোট হইলেও সবাই দেখবো কে জিতে।রাখি এখন।”

নিয়াজ বললো, “রাইতে আসমু কিন্তু। ”

লজ্জায় শর্মী লাল হয়ে কল কেটে দেয়।তারপর বের হয়ে যায় বাথরুম থেকে।

মেহমান আসতে আসতে বিকেল হয়ে যায়। সবাই পেটভরে খেয়ে রান্নার ভীষণ তারিফ করে। রেহানার বুক গর্বে ভরে যায়।তার দুই মেয়েই রান্নাবান্না করতে পছন্দ করে। আর দুজনের রান্নার হাতই ভালো।

বাবুল দাশ রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে খেতে খেতে বললো,”বৌদি, তোমার মেয়ের রান্দন একেবারে দ্রৌপদীর মতন। এমনে এমনে কি আমি মা কই!”

রেহানা ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকে বলেন, “আপনেরে কইছি না আমারে এসব হিন্দুয়ানী নামে ডাকবেন না।ভাবী কইবেন নাইলে আপা কইবেন।আর এমনে বাড়ির ভিতরে আইতে নিষেধ করছি না।”

বাবুল দাশ সরল হেসে বললো, “বৌদি, আমি এতো বছর এই বাড়িতে কাম করি আইজ পর্যন্ত আপনের দিকে তাকাই নাই।আপনে যে আমার লগে দেখা দিবেন না ওইটা আমার মাথায় আছে।আমি তো শুধু আমার মা জননীগো দেখতে আসি।”

শর্মী বাবুল দাশের প্লেটে আরেক পিস খাসির মাংস দিয়ে বললো, “কাকু আরাম কইরা খান।এই বাটিতে রসগোল্লা রাখা আছে,খাইবেন কিন্তু।”

বাবুল দাশে চোখে পানি চলে এলো। এই বাড়ির মেয়ে দুইটা এতো বেশি ভালো!

রাতে রেহানা নিজের রুমে শুয়ে ছিলো। শুভ্র ঘুমিয়ে গেছে সন্ধ্যার দিকে। শর্মী অপেক্ষা করছে নিজের রুমে নিয়াজের জন্য।
নিয়াজের বাবা কাদের খাঁন আর শাহজাহান তালুকদার দুজনেই প্রতিদ্বন্দ্বী। টানা তিন বার কাদের খাঁন শাহজাহান তালুকদারের প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছে,তিনবারেই হেরেছে। এবার চতুর্থ বার ও নির্বাচন করবে।

শর্মী জানে না এর ভবিষ্যৎ কি!
একে অন্যের ছায়া মাড়ায় না ওনারা।অথচ শর্মী কি-না ওকেই ভালোবাসলো।
যদিও শর্মী জানতো না নিয়াজ কার ছেলে।নিয়াজ ও হয়তো জানতো না।
অথচ ভাগ্য তাদের মিলিয়ে দিতে এক জায়গায় নিয়ে এসেছে।

চলবে…….

এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#অন্তিম_পর্ব
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

মেহেরাজ যখন সাঈদকে বিয়েতে রাজি করানোর উদ্দেশ্যে তাদের বাড়ি পৌঁছাল ঠিক তখনই সম্মুখীন হলো এক কঠিন সত্যের। সাঈদ নির্বিকার ভাবে তার দিকে এগিয়ে দিল কয়েকটা রিপোর্ট। যে রিপোর্ট দেখে সে এটা স্পষ্ট যে সাঈদের ব্রেইন টিউমার। অথচ এতোটা কাছের বন্ধু হয়েও এই সত্যটা সে এতকাল ধরে জানত না।অবাক হয়ে কেবল তাকিয়ে থাকল সাঈদের দিকে৷ সাঈদ সে দৃষ্টি দেখে হাসল। কাঁধে চাপড় মেরে পাশে বসেই বলল,

“বোনকে সুখী দেখতে চাসতো? তো যার জীবনের নিশ্চায়তা নেই তার সাথে বোনের বিয়ে দিলে কি তোর বোন সুখী হবে? হবে না সুখী। আর আমার জীবনের খুব বেশিদিনের নিশ্চায়তাও নেই। এই অল্প সময়ের জন্য মেহুকে আমার জীবনে না জড়ানোটাই বেটার না? তবে মেঘ ছেলেটা কিন্তু সবদিক দিয়েই ভালো। মেহুর বিয়েটা বরং মেঘের সাথেই হোক৷ আমি অন্তত মরার আগে ওর বিয়েটা দেখে যাই দোস্ত? প্লিজ রাজি করা তুই মেহুকে।তোর কথা ও ফেলবে না নিশ্চয়। ”

কথাগুলো সাঈদ হাসি হাসি মুখে বললেও মেহেরাজের বুক ভার হয়ে এল। নিঃশ্বাস যেন আটকে আসতে চাইল। নিজেরই সবচেয়ে কাছের বন্ধুর জীবন সম্পর্কিত এই চরম সত্যটি বিশ্বাস করতে কষ্ট অনুভব করল ভীষণ করে৷ আর সে কষ্ট সমেতই মুহুর্তেই জড়িয়ে ধরল সাঈদকে। অভিযোগের সুরে বলল,

“আমার থেকে এতগুলো দিন এসব লুকিয়ে গেলি কেন? কি হলো বল? কেন লুকিয়ে গেল? ”

সাঈদ বোকা বোকা হাসল। মাথা চুলকে বলল,

“কাউকেই জানাইনি দোস্ত৷ আজ এই প্রথম তোকেই বললাম। আব্বুও জানে না এই বিষয়ে। আমার একটা অনুরোধ রাখবি? ভেবে নে শেষ অনুরোধ প্লিজ। মেহু আর মেঘ ছেলেটার বিয়েটা দেখতে চাই। প্লিজ দোস্ত!”

মেহেরাজ উত্তর দিল না। শুধু হৃদয় ভার হওয়া অনুভূতি নিয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে রাখল। একা থাকলে বোধহয় এতক্ষনে কান্নাও ভীড় করত চোখে। এতোটা হাসিখুশি, এতোটা চঞ্চল ছেলেটা।অথচ এই ছেলেটার জন্যই এই কঠিন নিয়তি? ভাবতেই বুক ছিড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। সাঈদ অবশ্য থেমে থাকল না। বারবার বলে গেল কেবল একটি কথাই। মেহুর বিয়ের কথা। মেঘের সাথে যাতে মেহুর বিয়েটায় মেহেরাজ রাজি করায় এই-সেই।অবশেষে মেহেরাজও মানল তা৷ বন্ধুকে বলে এল, সে রাজি করাবে।আর বিয়েটাও শীঘ্রই সম্পন্ন করার চেষ্টা করবে।

.

সে অনুযায়ী রাতে বাসায় ফিরে মেহুর রুমে গিয়ে কতক্ষন নিস্তব্ধ হয়ে বসে ও থাকল মেহেরাজ। মুখ দিয়ে যেন রাজি করানোর জন্য একটা শব্দও আসতে চাইল না তার। গলা যেন কঠিন! তবুও বহুচেষ্টার পর মেহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝাল,

“মেহু?মেঘ ছেলেটা কি ভালো নয়? তোর কি মনে হয়? সে তোকে কতটুকু ভালোবাসে মেহু? ”

মেহু নিষ্প্রভ চাহনিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে শুধাল,

“হয়তো অনেকটুকুই, যা আমার আন্দাজেরও বাইরে। তবে আমি তার ভালোবাসার গভীরতা অনুমান করার চেষ্টা করিনি কখনো ভাইয়া।”

“ একটা সত্য কি জানিস মেহু?আমাদেরকে যে ভালোবাসে তাকে জীবনসঙ্গী করলে আমরা কখনোই ঠকবো না। আমি যতটুকু জানি সে তোকে নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। নিঃসন্দেহে সে তোকে সুখী রাখবে। আর, বাবা মায়েরও ইচ্ছে ছিল মেঘের সাথেই তোর বিয়েটা হোক।”

“তুমি কি চাও ভাইয়া? বিয়েটা হোক বা আমি যাতে এই বিয়েতে যাতে রাজি হই এটাইতো বলতে চাইছো তাইনা ভাইয়া? কিন্তু সত্যটা হলো আমি চাইলেও রাজি হতে পারছি না ভাইয়া। আমার সময় প্রয়োজন। এতোটা তাড়াতাড়ি আমি পারব না সবটা সামলে নিতে।একটু সময় কি দেওয়া যায় না? ”

“সময় দেওয়া যাবে না কেন? আমি তোকে জোর করিনি মেহু।”

মেহু মাথা নাড়াল। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,

“জ্যোতিকে কবে বিয়ে করছো ভাইয়া?ও তো রাজি হয়েছে বিয়েতে। মুখে না বললেও এর মানেটা হলো ও তোমায় ভালোবাসতে শুরু করেছে! ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে ভীষণ। বাসায় থেকে থেকে বেধহয় আরও একা হয়ে যাচ্ছি ভাইয়া।বিয়ে করে ওকে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসো প্লিজ!”

মেহেরাজ দিমত করল না অবশ্য। চুপচাপ বেরিয় এল কেবল ঘর ছেড়ে।

.

মেহেরাজ আর জ্যোতির বিয়েটা সম্পন্ন হলো খুবই কম আয়োজনে, কম সময়ে, সাধারণভাবেই। জ্যোতির বুক ধড়ফড় করল। আজ থেকে সে মেহেরাজের বিবাহিত স্ত্রী ভাবতেই কেমন এক অনুভূতি কাজ করল। আর সে অনুভূতি তীক্ষ্ণ হলো যখন তাকে বিছানায় বউ সাঁজে বসিয়ে দিয়ে যাওয়া হলো। তীব্র অস্থিরতায় অস্থির অনুভব হলো।অপেক্ষা করল মেহেরাজের আগমনের। অবশেষে সে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঘরে প্রবেশ করল মেহেরাজ। ঘরে ডুকেই প্রথমে জ্যোতির দিকে তাকাল।লাল শাড়িতে আর বউ সাজে মোহনীয় বোধ হলো তার কাছে এই মেয়েটিকে।মনে হলো যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রমণীটি তার সম্মুখেই বসে আছে । দু পা বাড়িয়েই বিছানার কাছে গিয়ে গলা ঝাড়ল সে। গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

“ এতদিন এতো ঘাড়ত্যাড়ামি দেখিয়ে আজ এমন ভদ্রভাবে বসে আছিস? আশ্চর্য!”

জ্যোতি মিনমিনে চাহনিতে মাথা তুলে চাইল। ভদ্রভাবে বসে না থেকে কি তার এখন থইথই করে নাচার কথা?আশ্চর্য!চাপা শ্বাস ফেলে মেহেরাজের দিকে সেভাবে তাকিয়ে থাকতেই মেহেরাজ পাশে বসল। বুকের বা পাশে হাত রেখেই বলে উঠল,

“ উহ ওভাবে তাকবি না জ্যোতি। বুকে কেমন জানি অনুভূত হয় আমার। এমনিতেই তোকে এই সাজে দেখেই বুকের ভেতর কেমন একটা করছে দেখ। ”

কথাটা বলেই জ্যোতির এক হাত নিজের বুকে চেপে ধরল। জ্যোতির দৃষ্টি আগের মতোই থাকল। তা দেখেই মেহেরাজ বলে উঠল,

“ ওভাবে তাকিয়ে আছিসই কেন?আশ্চর্য!”

জ্যোতি কিছু বলল না। তবে হাত ছাড়িয়ে নিল কেবল। মেহেরাজ হাসল কেবল৷ জ্যোতির হাতটা পুনরায় হাতের মাঝে নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়াল আলতো করে।আর সে স্পর্শেই কেঁপে উঠল জ্যোতি। মেহেরাজ তা খেয়াল করল। ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

“ এমন করছিস যেন অনেক কিছু করে ফেলেছি তোর সাথে। কিছু কি করেছি আমি? ”

জ্যোতির মুখ লালাভ হয়ে উঠল যেন। কৃষ্ণ বর্ণীয় মুখ রক্তিম হলো হঠাৎ। আর সেই রক্তিমতা ডাকতেই প্রসঙ্গ পাল্টানোর উদ্দেশ্যে নিয়ে ঠোঁট চেপে বলল,

“ আপনি তো রেগে ছিলেন মেহেরাজ ভাই ? হঠাৎ রাগ সব চলে গেল? ”

মেহেরাহ হাসল মৃদু। বলল,

“ বউয়ের সামনে অতো রাগ করা চলে না৷ তাই রাগরাও বোধহয় পালিয়ে গেছে৷ শুধু থেকে গেল কিছু অপ্রকাশিত অনুভূতি। ”

জ্যোতি ঠোঁটে ঠোঁট চাপল। নিচের ঠোঁট কামড়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,

“ হ্ হু?”

মেহেরাজ মোহনীয় নজরে চাইল জ্যোতির পাতলা মিহি ঠোঁটজোড়ার দিকে। কিছুটা এগিয়ে বসে হুট করেই বলল,

“ নিচের ঠোঁট কামড়ে রেখেছিস যে? আশ্চর্য?তুই কি ঠোঁট লুকাতে চাইছিস জ্যোতি? ”

কথাটা শুনেই জ্যোতি মেহেরাজের দিকে নজর রাখতে পারল না। তার আগেই তার ঠোঁটজোড়ার দখল নিল অপরজোড়া পুরু পুরুষালি ঠোঁট। জ্যোতির নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ঘন হলো যেন। হৃদয়ে যেন তোলপাড় অনুভূতি বয়ে গেল।আর সে তোলপাড় অনুভূতিকে স্থগিত রেখে মেহেরাজ তার ঠোঁট ছাড়ল আরো কিয়ৎক্ষন পর।নিঃশব্দে হেসে জ্যোতির মুখের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল জ্যোতির লজ্জ্বায় লাল হওয়া রক্তিম মুখ। লজ্জ্বানত মুখ! মেহেরাজ বাঁকা হাসল। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

“ এইটুকুতে এত লজ্জ্বা? তুই এমনভাবে লজ্জ্বায় লাল হয়ে যাচ্ছিস যেন আমি সাংঘাতিক কিছু করে বসেছি জ্যোতি। ”

জ্যোতি মুখ তুলল না।মেহেরাজ ফের বাঁকা হাসল। ঠোঁট বাঁকিয়ে শুধাল,

“আজ রাতটা তোর জন্য স্মরনীয় হবে জ্যোতি।তুই প্রতি মুহুর্তে শিহরিত হবি যা ভাবলে।তোর শরীর-মন সমস্তটা জুড়েই অনুভূতির বেসামাল প্রবাহ বইবে৷ শিরায় শিরায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভূতির শিহরণ বইবে।সে শিহরনের জন্য হলেও লজ্জ্বাটা তুলে রাখ প্লিজ!”

.

তার পরদিনই বেশ ভোরেই ঘুম ছেড়ে উঠল মিথি।নিজের বাড়িতে না ঘুমিয়ে মিথিদের এই টিনের ঘরে, স্যাঁতস্যাঁতে বিছানায় ঘুমিয়েছিল মেহুও। মিথির উঠে যাওয়া টের পেয়েই বোধহয় ঘুম ভাঙ্গল তারও। ঘুমুঘুমু চোখে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

“গুড মর্নিং মিথি। আজ এত সকালে উঠলি?”

মিথি ঠোঁট উল্টে বলে উঠল,

“ ভেঙ্গে গেল ঘুম আপু। আরো কিছুক্ষন ঘুমানো ঠিক ছিল না বলো? যায় হোক, তুমি উঠলে কেন?”

মেহু হাসল অল্প৷ বলল,

“আমারও ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাইরে বের হবি মিথি? ভোরের হাওয়া শরীরের জন্য ভালো জানিস তো?”

চটফট উত্তর এল মিথির,

“আমি তো এক পায়ে রাজি বাইরে বের হতে। বের হবে? ”

মেহু মুহুর্তেই রাজি হলো। তারপর আর দেরি হলো না। দুইজনই বের হলো প্রকৃতির সুন্দর হাওয়া অনুভব করতে। তখন অবশ্যই কেউই ঘুম থেকে উঠেনি।চারপাশ বেশ নিরব, জনমানবশূণ্য। বিয়েবাড়ির ঝামেলায় আগের দুদিন কারোরই ভালো করে ঘুম হয়নি বলেই হয়তো আজ সবাই এত আরামে ঘুমাচ্ছেে।এতে অবশ্য মিথি খুশিই হলো। দাদী উঠে গেলে নিশ্চয় এতক্ষনে তাকে নিষেধ করতো বের হতে? মিথি এই নিয়ে আনন্দিত। হাঁটতে হাঁটতে বললও মেহুকে,

“জানো আপু?দাদী এই সময়ে ঘুম ছেড়ে উঠলে হাজারটা বকাঝকা করত। এরচেয়ে আমরা চুপচুপি চলে এসে ভালো করেছি না বলো? যায়হোক, বাড়ি গিয়ে কিন্তু একেবারে নাক ডেকে ডেকে তিনঘন্টা ঘুমাব। বুঝলে? ”

মেহু হেসে উঠল। কতদিন পর যেন এভাবে হাসল৷ মেয়েটার কথা সত্যিই হাসাতে পারে। হাসতে হাসতে,কথা বলতে বলতেই দুইজনে পা বাড়াল আরে অনেকদূর। তারপর পৌঁছাল গ্রামের নদীটিতে। সকালের এই পরিবেশে নদীটা দেখতে সত্যিই সুন্দর বোধ হলো। কিনারায় দুটো নৌকাও বাঁধা রয়েছে। মেহু পা বাড়িয়ে বলল,

“নৌকার মাঝি কোথায় মিথি? নৌকা চড়বি? ”

মিথি এপাশ ওপাশ তাকাল। কিন্তু মানুষজন নেই। বোধহয় খুব ভোর বলেই কেউই নেই। মন খারাপ হলো যেন তার এই কারণে।ঠোঁট উল্টে শুধাল,

“ নৌকার মাঝি তো দূর আপু, কোন মানুষই নেই এইখানে। এর থেকে বাড়ি চলো তো আপু, আরামে ঘুম দিব আবারও। ”

মেহুরও মুখ চুপসে এল যেন।মৃদু স্বরে বলল,

“উহ মিথি দাঁড়া না। কত সুন্দর পরিবেশ না দেখ? আমি কখনো নৌকায় উঠিনি। একবার নৌকায় উঠি? নৌকায় বসে নদীর পানি ছুঁবো। কত সুন্দর অনুভূতি না?”

মিথির চোখ চকচক করে উঠল। আসলেই সুন্দর অনুভূতি। কিন্তু দাদীর নিষেধাজ্ঞার জন্য কোনকালেই নদীতে আসা হয়নি, নৌকাতে চড়াও হয়ি। কারণ একটাই সে সাঁতার পারে না। দাদী অবশ্য অনেক করে বলেছিলও সাঁতার শিখতে। কিন্তু অলস মিথি কোনকালেই সেই কথা পাত্তা দিলে তো?তাই তো নৌকায় উঠে চড়ার স্বপ্নটাও স্বপ্নই থেকে গিয়েছিল। কিন্তু আজ তো কোন নিষেধ নেই। তাই খুশিমনেই মেহুর কথাতে রাজি হলো নাচতে নাচতে। মেহু হাসল মিথির এমন চঞ্চলতা দেখে। পরমুহুর্তে কিনারায় নৌকা বাঁধা আছে দেখে দুই পা বাড়িয়ে সাবধানে নৌকায় উঠে বসল। পিঁছু পিঁছু গিয়ে বসল মিথিও। দুষ্টুমি করে নৌকার মাঝে থাকা বৈঠা নিয়ে নড়চড় করল অনেকটা সময়। আর মানসিক অবসাদে ভুগা মেহু চোখ বুঝে অনুভব করে গেল প্রকৃতিকে। কি সুন্দর পরিবেশ! শীতল হাওয়া!এক হাতে অনবরত ছুঁয়ে গেল নদীর পানি। আর এই চোখ বুঝে প্রকৃতিকে অনুভব করতে করতে টেরই পেল না যে মাঝির বাঁধা নৌকার অল্প মজবুত বাঁধনটা সেই কবেই আলগা হয়ে খুলে গিয়েছে।নৌকা কিনারা থেকে চলে এসেছে বহুদূর! বলা চলে নদীর মাঝখানে। কিন্তু সেটা সে টের পেল বহুপরে৷ অনেকটা সময় পর বন্ধ রাখা চোখের পাতা খুলে চাইতেই হঠাৎ টের পেল নৌকাটা অনেকদূরে এসে গিয়েছে।অথচ নৌকাটা তো সে বাঁধা ছিল দেখেছিল। মেহু দীর্ঘশ্বাস ফেলল যেন। একনজর মিথির দিকে তাকিয়েই বলল,

“মিথি? নৌকার বাঁধনটা কি করে খুলল?নৌকাটা যে এতদূর এসে গিয়েছে দেখিসনি? এখন পাড়ে কি করে যাব আমরা?”

মিথি আপন মনে নদীতে ভাসা শাপলা নিতে ব্যস্ত ছিল। সেও খেয়াল করেনি বিষয়টা।আর না তো খেয়াল করল মেহুর বলা কথাটার অর্থ! ফুল নিতে ব্যস্ত হয়েই অন্যমনস্ক স্বরে মজা করে বলে উঠল,

“নৌকা তো বাঁধা ছিল আপু। বাঁধন কে খুলবে বলতো? আচ্ছা আপু?নদীতে কি ভূত আছে?”

কথাটা বলেই হেসে কিছুটা ঝুকল অল্প দূরের একটা ফুল নিতে।কিন্তু ফুলটা বেশি দূরেই বলেই দাঁড়িয়ে,নৌকার কিনারায় এক পা রেখে ফের ঝুকে গেল নিচের দিকেই। মেহু ছোটছোট চোখে তা খেয়াল করেই দ্রুত বলল,

“কি করছিস কি মিথি? পরে গে…..”

মেহুর কথাটা সম্পূর্ণ হতে পারল না। তার আগেই ঘটে গেল অপ্রত্যাশিত ঘটনা। মিথি হুড়মুড়িয়ে পরে গেল নদীর পানিতে। সাঁতার না পারা মিথি তখন নদীর মাঝখানটায় হাত ঝাপ্টাল বারবার। আকস্মিক এই ঘটনায় মেহুর মস্তিষ্ক ও শূণ্য বোধ হলো যেন। সেই তো নৌকায় আসার ইচ্ছে পোষণ করেছিল। যদি ইচ্ছেটা না প্রকাশ করত তাহলে তো এমন কিছুই হতো না। কথাগুলো ভেবেই মিথির বর্তমান অবস্থা দেখে আর কিছু না ভেবে মুহুর্তেই মিথিকে বাঁচাতে পানিতে ঝাপ দিল সে নিজেও।মাথায় কেবল একটা কথায় ঘুরল যে মিথিকে বাঁচাতে হবে। অথচ মস্তিষ্কে এই কথাটা একবারও এল না যে, সে নিজেও সাঁতার পারে না। অতঃপর বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টা চালাতে চালাতেই তলিয়ে গেল দুটো মেয়ের শরীর ! প্রাণোচ্ছল প্রাণ! অথচ আশপাশে কেউই টের পেল না। কেউ জানল না, এই মুহুর্তটাতেই, এই ক্ষনটাতেই, এই জায়গাটাতেই দু-দুটো মেয়ে পানি থেকে উঠতে কতোটা চেষ্টা করেছে, কতোটা লড়াই করেছে।বাঁচার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চিৎকারও করেছে!কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি হলো?শুধু একটা মুহুর্ত পর নদীর মাঝখানে তলিয়ে যেতে যেতেই রেখে গেল পৃথিবীতে তাদেরই শেষ স্মৃতিটুকু!

.

পরিশিষ্ট-

দেখতে নাদুশ-নুদুস দুটো বাচ্চা মেয়ে সোফায় পা দুলিয়ে বসে আছে।বয়স এই ছয় কি সাত বছর হবে।কিয়ৎক্ষন পর পর দুইজনই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখছে তাদেরই সামনে বসে থাকা তাদের আম্মুর ক্লান্ত চেহারাকে। অবশেষে ঠোঁট ফুলিয়ে তাদের মধ্যেরই একজন জিজ্ঞেস করল,

“ আব্বু আসলে একেবারেই খাব আম্মু।খাবার নিয়ে বসে থেকো না পিজ। ”

জ্যোতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবারে। মেয়ের কথা শুনে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। দশ বছর পূর্বে মেহেরাজ আর তার বিয়ের পরেরদিন যে সংবাদ শুনে এতোটা দুঃখ পেয়েছিল সে দুঃখ বছর সাত পূর্বে জম্মানো এই জমজ কন্যা দুটিই গুঁছিয়ে দিয়েছিল কিছটা।নাটকীয় বোধ হলেও সত্য হলো,এদের মাঝে একজন দেখতে একদম মেহুর মতোই, আর অন্যজন মিথির মতো দেখতে হয়েছে।তাই তো সে এই দুইজনকে মেহু আর মিথিরই অন্যরূপ ভাবে। মেহু আর মিথির মৃত্যুতে যা কিছু হারিয়েছিল জ্যোতি তা না পেলেও কোথাও যেন একটা তৃপ্তি ফিরল এই দুইজনের হাত ধরে। একজনের নাম মিহি, অপরজনের নাম জুহি।কিন্তু সবকিছুর পরেও আশ্চর্যের বিষয় যা তা হলো, মিথির মতো দেখতে যে অর্থ্যাৎ জুহি স্বভাবে একদম শান্ত, বুঝদ্বার একটা বাচ্চা! অন্যদিকে মেহুর মতো দেখতে যে অর্থ্যাৎ মিহি স্বভাবে চঞ্চল,প্রাণবন্ত! যেন মিথিরই অন্য রূপ! জ্যোতি মাঝেমাঝে মিহির উপর বিরক্ত হয় ঠিকই কিন্তু পরমুহুর্তেই যখন আবার মিথির কথা স্মরণ হয় তখন কেন জানি আর রাগ থাকে না। ইচ্ছে করে দুইজনকেই আগলে নিয়ে সর্বক্ষন বসে থাকুক। যেন কেউ আর নতুন করে না হারায়। মেহু আর মিথির মতোই যেন এরাও তাকে আর একা করে রেখে চলে না যায়।জ্যোতির চোখ টলমল করল। ঠোঁট চেপে কান্না আটকাতেই জুহি এগিয়ে এল। নরম স্বরে বলল,

“খাবার খাশ্ ছি না বলে কান্না করছো আম্মু? জুহি স্যরি। অনেক স্যরি। কান্না করো না পিজ। ”

ততক্ষনে এগিয়ে এল মিহিও। জ্যোতির গালে নরম ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে চুমু খেল শব্দ করে। পরমুহুর্তেই মায়ের গলা জড়িয়ে বলল,

“একদম কান্না করে না বাবুর আম্মুটা! এই দেখো চুমু দিয়ে দিলাম। আদর দিয়ে দিলাম তো? কাঁদে না হু?”

জ্যোতি হাসি চেপে চোখ রাঙ্গিয়ে চাইল মিহির দিকে।যখন খুব বেশি মন খারাপ হয় কিংবা কান্না পায় তখন মেহেরাজ এভাবেই তার গালে চুমু খেয়ে কথাগুলো বলে। আর সে কথাগুলোই শুনে শুনে একদম মুখস্ত করে ফেলেছে মিহি। আর যখনই তার কান্না পায় তখনই এভাবেই বাবাকে অনুকরণ করে একিভাবে এসব বলে ফেলে। বহুবার ধমক কিংবা চোখ রাঙ্গিয়ে ও এই কথাগুলো বলা থেকে মিহিকে বিরত করতে পারল না জ্যোতি । এবারেও পারল না। মিহি ঠোঁট উল্টে ফের বলল,

“ কি আচ্ চর্য! আমি কি করেছি? তুমি ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন আম্মু? এই জুহি?আমি খারাপ কিছু বলেছি?”

জুহি বিনিময়ে কিছু বলতেই নিচ্ছিল। ঠিক তখনই কলিংবেলের আওয়াজ আসল কানে। মুহুর্তেই দুইজন ছুটে গেল দরজার সামনে। চঞ্চল গলায় সমস্বরে বলল,

“আব্বু এসে গেছে আম্মু! ”

জ্যোতি মৃদু পায়ে গিয়ে দরজা খুলল। চোখে পড়ল মেহেরাজের ক্লান্ত মুখ। জ্যোতির দিকে চেয়ে হেসে দিয়েই ঝুঁকে আগলে নিল তার দুই কন্যাকে। দুইজনের তুলতুলে গালে চুমু দিয়ে মশগুল হলো তাদের গল্পে।জ্যোতি বাবা মেয়েদের সেসব খুনশুটি দেখে আর দাঁড়াল না। দরজা লাগিয়ে চলে গেল রুমে। বিছানায় মেহেরাজের টিশার্ট, টাউজার, তোয়ালে রেখে গিয়ে দাঁড়াল বেলকনিতে। আকাশের পানে চেয়ে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে পড়ল মেহুর কথা! কতোটা আপন ভাবত সে এই মেয়েটাকে। নিজের বড়বোন না থাকা সত্ত্বেও এই মেয়েটাকে সে বড়বোনের মতোই ভালোবেসেছিল। বড়বোনের মতোই সমীহ করত। আজ যদি মেহু বেঁচে থাকত তাহলে নিশ্চয় খুব সুন্দর হতো সবটা?আর যদি মিথি বেঁচে থাকত? এতদিনে নিশ্চয় মিথির চঞ্চলতায় পরিপক্বতা আসত? কে জানে! জ্যোতির চোখ ফের টলমল করল এসব ভাবতে ভাবতেই। কিন্তু তার মাঝেই হঠাৎ কোমড়ে টের পেল উষ্ণ হাতের স্পর্ষ। স্পর্শটা চেনা বলেই নড়চড় করল না জ্যোতি। স্থির সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল। মেহেরাজ এবারে মুখ গুঁজল জ্যোতির ঘাড়ে। দুইহাতে কোমড় আঁকড়ে ধরে পুরু ঠোঁটে চুমু আঁকল জ্যোতির ঘাড়ে। ফিসফিসিয়ে বলল,

“ কি হলো? আজ মিসেস জ্যোতির চেহারায় এতোটা বিষন্নতা? ভালোবাসা লাগবে নাকি চুমু ?আচ্ছা, তুই কি আমার চুমু পাওয়ার লোভে ইচ্ছে করেই মন খারাপ করে থাকিস জ্যোত?”

জ্যোতি উত্তর দিল না। মেহেরাজ জ্যোতিকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ঘুরাল। দুইহাত দিয়ে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল জ্যোতির কোমড়। নিজের মধ্যকার দূরত্ব গুঁছিয়ে ঠোঁট ছোঁয়াল জ্যোতির গালে। বলল,

“এই যে শুনুন আমার কন্যাদের আম্মি?এই যে চুমু দিয়ে দিলাম?আর মন খারাপ করবেন না। হুহ?”

জ্যোতি মৃদু হাসল এবারে। মেহেরাজও হাসল। পরমুহুর্তেই কি ভেবে নিজের হাতের মুঠোটা জ্যোতির সামনে ধরল। ভ্রু নাড়িয়ে বলল,

“ তোর জন্য? ”

জ্যোতি তাকাল একনজর। বলল,

“কি এতে মেহেরাজ ভাই? ”

মেহেরাজ রেগে গেল যেন। গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

“বলব না। ”

পরমুহুর্তেই বিড়বিড় করে বলল,

“আমারই দুই বাচ্চার মা হয়ে আমাকেই ভাই ডাকতেছে! প্লিজ এর চেয়ে আমায় মেরে ফেলো খোদা।আমি এই অপবাদ আর নিতে পারছি না। নয়তো এই মেয়ের মাথায় একটা থাপ্পড় মারো।”

জ্যোতি সরু চাহনিতে কিছুক্ষন তাকিয়েই যেন বুঝতে পারল তার ভুল। এই ভাই ডাকার জন্য বিয়ের পর থেকেই মেহেরাজের কত নিষেধাজ্ঞা, কত বারণ! তবুও কেন জানি ভাই ডাকটা তার মুখে চলেই আসে।হেসে মৃদু আওয়াজে বলল,

“আচ্ছা স্যরি, আর বলব না। এবার বলুন। ”

মেহেরাজ গম্ভীর করল মুখটা। জ্যোতির দিকে চেয়ে ভরাট স্বরে বলল,

“এক মুঠো প্রণয়!তোর জন্যই!”

কথাটা বলেই হাতের মুঠো খুললো। মুঠোটা খালিই। জ্যোতি জানত মুঠোটা খালিই থাকবে। বিয়ের পর থেকে এই কথাটা সে অসংখ্যবার শুনেছে।অসংখ্যবার দেখেছেে।তবুও জেনেবুঝে এই উত্তরটা পেতেও ভালো লাগে। আজ ও লাগল। কোথাও যেন সুপ্ত ভালো লাগারা উড়ে উড়ে গেল। বলে গেল, এক মুঠো প্রণয়!মেহেরাজের হৃদয়ে এক মুঠো প্রণয়! শুধু তারই জন্য!

#সমাপ্ত

এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-১৭

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_১৭
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

সময় গড়াল আরো একমাস। মেহু হোস্টেল ছেড়ে বাসায় ফিরে গিয়েছেও একমাস হলো।আর এই একমাসে তার শারিরীক, মানসিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটল। চোখের নিচে কালি বসেছে৷ এমনকি খাওয়া-দাওয়া না করার ফলে আগের থেকে শুকনোও দেখাল মুখ। জ্যোতি অবশ্য এই একমাসে অনেকবারই এই বাসায় এসেছে, মেহুর সাথে দেখা করে গিয়েছে। অবশ্য এর মাঝে মেহেরাজের সাথেও সাক্ষাৎ হয়েছে অসংখ্যবার। সব মিলিয়ে মেহেরাজের প্রতি সে অল্প দুর্বলতাটা এখন দৃঢ় হলো যেন। মানুষটার কথা, কথা বলার ভঙ্গি, আচার আচরণ, চলাফেরা সবতেই যেন একরাশ মুগ্ধতা কেবল। মানুষটাকে দেখলেই বোধহয় আজকাল হৃদয়ের ভেতর প্রেমানুভূতি অনুভূতি হয়। কেমন কেমন যেন করে উঠে ভেতরটা। কিন্তু সেসবের কিছুই প্রকাশ পায় না বাহিরে। কেবল প্রকাশ পেল বিয়ের প্রস্তাবে সে রাজি এইটুকুই। তিনদিন আগেই দাদী যখন ফের জিজ্ঞেস করেছিল বিষয়টা নিয়েই তখনই রাজি হওয়ার এই মতামতটা জানিয়েছিল সে। আর তারপর থেকেই মেহেরাজদের বাসাতে একবারও পা ফেলেনি। এমনকি মেহুর সাথে আলাপ করতেও আসেনি। কোথাও যেন সমুদ্রসমান অস্থিরতা আর লজ্জ্বারা জড়ো হয়েছে খুব করে। কিন্তু অবশেষে আজ আসতেই হলো মেহুর কল পেয়েই। এসেই মেহুর মুখচোখের এই বেহাল দশা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনেক বুঝিয়ে দুপুরের খাবারটা খাইয়ে চলে যাবে ঠিক সেসময়ই দেখা মিলল মেহেরাজের। জ্যোতি আড়চোখে একবার তাকিয়েই দৃষ্টি সরাল দ্রুত। যেন হৃৎস্পন্দন খুব দ্রুতভাবে বাড়ল। হৃদয়ের ভেতর যেন কেমন একটা অনুভূতি হলো তার। আর সে অনুভূতিকে লুকায়িত রাখার জন্যই কিছু না বলে বের হতে চাইলে মেহেরাজ বলে উঠল,

“কি আশ্চর্য। তুই আমায় দেখে এমনভাবে নজর সরালি কেন? আবার লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়েও যাচ্ছিস? কি ব্যাপার? প্রেমে ট্রেমে পড়ে গেছিস নাকি আমার? ”

জ্যোতি শ্বাস ফেলল কেবল।সে কথা না বললেও যে মেহেরাজ আগ বাড়িয়ে কিছু না কিছু বলবেই তা যেন সে জানতই।অন্তত এই এক মাসের অভিজ্ঞতায় সে ভালো করেই জানত। কিন্তু এমন কিছু যে শুনতে হবে সেটা ভাবেনি সে। হতাশ হলো যেন। পিছু ঘরে মেহেরাজের দিকে একবার তাকিয়েই শুধাল,

“আমার কি আপনার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে উচিত মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,

“ ছিঃ!একটা ছেলের দিকে তুই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে যাবি কেন তুই?”

“তাহলে নিশ্চয় নজর সরিয়ে নেওয়া উচিত। তাই না? ”

মেহেরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বুকে হাত গুঁজে জ্যোতির দিকে তাকিয়েই বাঁকা হেসে বলল,

“কিন্তু তোর নজর সরানো তো লাজুকভঙ্গিতে ছিল। সমস্যা তো ওখানেই।”

জ্যোতি যেন ধরা পড়া গেল। অস্বস্তি হলো ভীষণ করে। তবুও অস্বস্তি চেপে রেখে জিজ্ঞেস করল,

“ মানে?”

মেহেরাজ ফের বাঁকা হাসল। জ্যোতির দিকে কিছুটা ঝুকে ফিসফিস করে শুধাল,

“মানে অবশ্য বেশি কিছু নয়। শুধু তোর চোখের দৃষ্টিতে প্রেমপ্রেম ভাব দেখা যাচ্ছে এইটুকুই। ”

জ্যোতি ভ্যাবচ্যাঁকা খেয়ে গেল। সত্যিই চোখের দৃষ্টিতে প্রেমপ্রেম ভাব ফুটে উঠছে? সত্যি সত্যিই কি তার হৃদয়ের ভেতরের ধড়পড় করা অনুভূতিটা চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয় উঠছে?তাহলে যে এরচেয়ে লজ্জ্বার আর কিছু হয় না। মুহুর্তেই দৃষ্টি সরাল অন্যত্র।জিজ্ঞেস করল,

“ হ্হু? স্ সত্যি? ”

“মিথ্যে কেন বলব আমি? ”

জ্যোতি পালাতে চাইলে এবারে। দ্রুত চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে বলে উঠল,

“ আমি আসছি। ”

চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেও যেতে পারল না জ্যোতি। তার আগেই হাত চেপে ধরল মেহেরাজ। বলল,

“উহ!তুই প্রেমপ্রেম দৃষ্টিতে তাকাতেই পারিস। নো নিষেধাজ্ঞা!শত হোক তোরই তো উডবি! তাই না? ”

জ্যোতির জবাব এল না অবশ্য। সে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকল কেবল। মেহেরাজ দু পা বাড়িয়ে জ্যোতির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

“তবে আমি ভেবেছিলাম তুই আমার প্রেমে পিছলে পড়তে পড়তে যুগ কাটিয় দিবি। কিংবা আমি বুড়ো হয়ে যাব তোকে বউরূপে পেতে পেতে।কিন্তু এদিক থেকে তুই কিন্তু খুব কম সময়ই নিয়েছিস জ্যোতি। আমাকে আর ভালোবাসাহীনতায় বুড়োও হতে হলো না বল? ”

কথাটুকু বলেই জ্যোতির হাত ছাড়তেই জ্যোতি দ্রুত পা বাড়াল। যেন পালিয়ে বাঁচল সে৷ মেহেরাজ সেদিক পানে তাকিয়ে হাসল শুধু। পা বাড়িয়ে মেহুর রুমের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ কানে মেহুর কান্নার স্বর। সাথে কিছু কথা,

“ কেন এমনটা করলের সাঈদ ভাইয়া?আমায় ভালোবাসলে কিইবা ক্ষতি হতো বলুন? কি এমন ক্ষতি হতো? এইটুকু ভালোবাসা কি দেওয়া যেত না আমায়? আমি বাঁচতে পারছি না এই ভালোবাসাহীন জীবন নিয়ে। বেঁচে থাকতে পারছি না। আপনাকে চাইলেও আমি ভুলতে পারছি না। কেন পারছি না? এতোটা ভালো আপনাকেই কেন বাসলাম আমি? আমার জীবনটা বিচ্ছিরি হয়ে গেছে!বিচ্ছিরি হয়ে গেছে!শুধু আপনাকে ভালোবেসে। ”

মেহেরাজ সবটাই শুনল দরজার বাইরে তাকিয়ে। মুহুর্তেই যেন সবটাই স্পষ্ট হয়ে উঠল তার কাছে। মেহুর এমন গুটিয়ে যাওয়া, কান্না, গুমড়ে মরা, অসুস্থ হওয়া, জীবনের অনিয়ম সবকিছুর কারণই যেন একমুহুর্তেই স্পষ্ট হয়ে উঠল। মুহুর্তেই তপ্তশ্বাস ফেলল সে৷ তারই একমাত্র বোন কষ্টে গুমড়ে মরছে অথচ সে এই কারণটা টেরই পেল না। একবারও বুঝে উঠল না তার এই ছোট বোনটি তারই কাছের বন্ধুটিকে ভালোবেসে এতোটা কষ্ট পাচ্ছে?মেহেরাজ আগ বাড়িয়ে মেহুর কাছে গেল না আর। সিদ্ধান্ত নিল সাঈদের বাবার সাথে কথা বলবে।সে অনুযায়ী পরদিন সাঈদের বাবার সাথে সাক্ষাৎ ও করল সে৷ আর সে সাক্ষাৎয়ে সাঈদের বাবার থেকে যে তথ্যটি পেয়ে সে চমকাল তা হলো সাঈদও মেহুকে ভালোবাসে। ছোটবেলা থেকেই বাবা-ছেলে বন্ধুস্বরূপ থাকার ফলে সাঈদ সবকিছুই শেয়ার করত বাবার সাথে। সেভাবে এই বিষয়টাও শেয়ার করেছিল বাবার সাথে। কিন্তু বিষয়টা যে এই পর্যায়ে এসে ঠেকেছে তা তিনি বুঝতেই পারেননি। সে সাথে অবাক হলেন মেহুর এই বেগতিক অবস্থার কথা শুনেও। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলের বিয়েটা খুব শীঘ্রই সারবেন। তাও মেহুর সাথেই!

.

সাঈদ তখন বিছানায় বসা।এক হাতে একটা ড্রিংকের গ্লাস অন্য হাতে মেহুর হাস্যোজ্জ্বল একটা ছবি। ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসার পরও ফিরিয়ে দেওয়াটা বোধহয় আরো বেশি যন্ত্রনার। ঠিক সে যন্ত্রনায় বুকের ভেতর জ্বলন অনুভব করল সাঈদ। একনজরে মেহুর হাস্যোজ্জ্বল ছবিটার দিকে চেয়েই তপ্তশ্বাস ফেলল।ঠিক সেসময়ই ঘরে ডুকলেন সাঈদের বাবা রায়হান সাহেব৷ ছেলের এহেন দশা দেখে ভ্রু জোড়া খানিকটা কুঁচকেই চাইলেন৷ পর মুহুর্তে সে দৃষ্টি শীতল করে নিয়ে পাশে বসলেন। গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,

“ সবাই তোমার মা হয় না সাঈদ! আর সব প্রেমিকই তোমার বাবার মতো কষ্ট পায় না।মেয়েটাকে তুমি ভালোবাসো, সেও তোমায় ভালোবাসে৷ তবে কিসে এত বাঁধা? ”

সাঈদের মাঝে ভাবাবেগ দেখা গেল না যেন। আগের মতোই তাকিয়ে রইল মেহুর সে হাস্যোজ্জ্বল ছবিটায়। রায়হান সাহেব তা দেখে মৃদু হাসলেন। ফের বললেন,

“আমি সবার আগে এটা মান্য করি যে ভালোবাসা মানেই বিশ্বাস সাঈদ। যাকে ভালোবাসো তাকে বিশ্বাস করো না এটা বলবে না নিশ্চয়?”

সাঈদ এবারে তাকাল বাবার দিকে। বলল,

“বিশ্বাস যদি ভেঙ্গে যায় আব্বু?যদি তোমার মতোই পরিণতি আমারও…”

কথাটা বলা শেষ করতে পারল না সাঈদ। তার আগেই তার বাবা বলে উঠল,

“আমি এইটুকু নিশ্চিত যে মেয়েটা তোমার বিশ্বাস ভাঙ্গবে না কোনদিন। এতোটা ভালোবাসার পর কেউ বিশ্বাস ভাঙ্গতে পারে না সাঈদ। আর তুমি যদি তোমার মায়ের কারণেই এমনটা ভেবে থাকো তাহলে বলব যে তোমার মা আমাকে কখনো ভালো বাসেইনি। শুধু বেটার অপশন ভেবে আমাকে বিয়ে করেছিল সে। পরমুহুর্তে যখন নিজের মনকে কিংবা অনুভূতিকে গুরুত্ব দিল তখন খুব বেশি দেরি হয়ে গেল।দেরি হলেও অবশ্য সে মনের ইচ্ছেটাকেই প্রাধান্য দিয়েছিল শেষমেষ। মাঝখান থেকে আমি আর তুমি তার জীবনের একটা খুচরো অংশ হয়ে গিয়েছিলাম আরকি। তবে সে যদি আমায় ঠকিয়ে, লুকিয়ে নিজের মনের ইচ্ছে পূরণ না করে আমায় একবারও জানাত? আমি কিন্তু কখনোই তাকে নিষেধ করতাম না সাঈদ। ”

“ তুমি কখনো দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা ভাবলে না কেন আব্বু? যে তোমায় ঠকিয়েছে তার বিরহে সারাজীবন নষ্ট করার কি মানে হয় বলো?”

তার বাবা মৃদু হাসল। উত্তরে বলল,

“তুমি যাকে ভালোবাসবে তাকে তুমি কখনো ছোট ভাবতেই পারবে না সাঈদ। সে হাজারটা দোষ করলেও তোমার কাছে তখন সে দোষগুলো জঘন্য বলে অনুভব হবে না। তুমি তাকে চাইলে ও খারাপ ভাবতে পারবে না। এটাই সত্য!আর এই কারণেই তার সাথে বিচ্ছেদের এত বছর পরও আমি তাকে অন্য কারো সামনে অপমানিত হতে দেখতে পারি না, খারাপ বলতে পারি না, অসম্মান করতে পারি না।হয়তো তার দিক থেকে সে ঠিকই ছিল সাঈদ।সেসব বাদ দাও বরং, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শুধু তোমাকে জানানোর অপেক্ষায় ছিলাম। ”

সাঈদ ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,

“কি সিদ্ধান্ত?”

জবাব এল,

“তোমার বিয়ের সিদ্ধান্ত।বয়স হলো তো আমার বলো?এই বাসায় যা তোমার সাথে রাতে কিংবা সকালে ব্রেকফাস্টের সময় দু চারটে কথা বলা। দিনশেষে কেমন ফাঁকা ফাঁকা না এই বাসাটা বলো?তাই ভাবলাম তোমার বিয়েই উত্তম সিদ্ধান্ত!”

সাঈদ হাসল। কৌতুক স্বরে বলে উঠল,

“ধুরর!মজা করছো আব্বু?আমি যে বিয়ের বিরুদ্ধে তুমি জানো না তা?”

গম্ভীর স্বরে বলল তার বাবা,

“মজা না সাঈদ। এটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। আশা রাখি তুমি তোমার আব্বুর সিদ্ধান্তে অমত করবে না? ”

সাঈদ মিনমিনে চাহনিতে চাইল। ছোটবেলায় মা চলে যাওয়ার পর থেকে বাবাই তার সব। বলা চলে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের লোকটি তার বাবা। যাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, সবচেয়ে বেশি সমীহ করে চলে সে হলো তার বাবা। তার বাবা তার বাবার আগেও তার বন্ধু। আর তাই তো এই বাবাকে মায়ের কারণেই এতোটা কষ্ট পেতে দেখেছে বলেই সে তার মাকে এতোটা ঘৃণা করে! কিন্তু এই এতো ভালোবাসার, এত সমীহ করে চলা মানুষটির কোন সিদ্ধান্তকেই সে এই পর্যন্ত না করেনি। তাইতো সরাসরি না বলতে পারল না। ক্লান্ত স্বরে শুধাল,

“ বিয়ের এত তাড়া কেন আব্বু?সময় তো আছেই বিয়ের জন্য। তাই না? ”

“ কারণ তোমার বিরহে আমার পূত্রবধুর জীবনটা কষ্টময় হয়ে উঠেছে দিনের পর দিন। আমি চাই না সে তোমার বিরহে আর কষ্ট পাক। ”

সাঈদ ভ্রু উচাল। জিজ্ঞেস করল,

“ আবার মজা করছো?বিয়ে না করতে চাইলে কি জোর করে দিবে তুমি?”

“ একদমই নয়।যদি মনে করো তোমার জোর করে বিয়ে দিচ্ছি তো জোর করেই বিয়ে দিচ্ছি ধরে নিতে পারো।তবে বিয়েটা খুব শীঘ্রই হচ্ছে সাঈদ। আমি খুব শীঘ্রই বাসাটা পরিপূর্ণ দেখতে চাই।”

সাঈদ ভ্রু কুঁচকাল। কপাল কুঁচকে বলে উঠল,

“এসবের মানে কি আব্বু? আমি তো আর ছোট নেই যে জোর করে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিবে আমার উপর। ”

“তুমি খুব ভালো করেই জানো এটা চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত নয়৷ চোখ বুঝে মনকে একবার জিজ্ঞেস করো বরং। উত্তরটা আশা রাখি তুমি পেয়ে যাবে সাঈদ। ”

এটুকু বলেই তার বাবা বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আর একটাও কথা না বলে দ্রুত রুম ছেড়ে বের হলো সে।অপরদিকে সাঈদ চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল কেবল। হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন? হঠাৎ এসবই বা কেন বলে গেল তার বাবা?

.

পার হলো আরো দিন পনেরো। আশ্চর্যজনকভাবে এই পনেরো দিনে জ্যোতি যতবারই মেহেরাজদের বাসায় এসেছে বা মেহেরাজের সাথে দেখা হয়েছে ততবারই মেহেরাজ তাকে এড়িয়ে গিয়েছেে।আগে যেমন নিজ থেকে কথা বলত এই পনেরো দিনে ছেলেটি একবারও তার সাথে কথা বলেনি নিজ থেকে।বরং জ্যোতি বলতে চাইলেও এড়িয়ে গেছেই কেবল। জ্যোতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।মেহেরাজকে সামনে পাওয়া মাত্রই স্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করে উঠল,

“ বিয়েতে হ্যাঁ বলার পরই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন কেন মেহেরাজ ভাই?এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন আমাকে?”

মেহেরাজ অন্যদিকে তাকাল। গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল,

“ বলতে ইচ্ছুক নই আমি। ”

জ্যোতি চাপা শ্বাস ফেলে মেহেরাজের দিকে তাকাল। তার কেন জানি মনে হচ্ছে মেহেরাজ বিয়ের প্রস্তাবটা ভুলবশতই দিয়েছিল হয়তো। আর এখন সে বিয়ের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলে দেওয়াতে সে ভুলটা হয়তো বুঝতে পেরেছে। আর তাই হয়তো মনে মনে পস্তাচ্ছে বিয়র প্রস্তাবটা দিয়েছে বলে। কিন্তু তাই বলে এড়িয়ে যাওয়ার কি আছে? সরাসরি বলে দিলেই তো হতো যে সে জ্যোতিকে বিয়ে করতে চায় না। জ্যোতি কি জোর করবে তাকে? এসব ভেবেই জ্যোতি জিজ্ঞেস করল,

“আমায় বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার এই সিদ্ধান্তটা নিয়ে আপনাকে কি এখন পস্তাতে হচ্ছে মেহেরাজ ভাই? আপনি কি কোনভাবে ফিরিয়ে নিতে চাইছেন প্রস্তাবটা? সমস্যা নেই। আপনি বললেই আমি দাদীকে নাহয় ব… ”

মেহেরাজের চোয়াল শক্ত হলো। দাঁতে দাঁত চেপে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বলল,

“ কি সমস্যা তোর?”

“ হ্ হু?আমার মনে হচ্ছিল আপনি বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার এই সিদ্ধান্তটা নিয়ে সাফার করছেন। তাই জিজ্ঞেস করে নেওয়াটা ভালো নয়?কনফিউশন দূর করা উচিত নয়?

মেহেরাজ বুকে হাত গুঁজে দাড়াল। ভ্রু উঁচিয়ে বলে উঠল,

“ কনফিউশনের মতো কিছু তো আমি দেখছি না। বিয়ে তোকেই করছি আমি। আর কিছু? ”

“ আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি ঝোকের বশে প্রস্তাবটা দিয়ে এখন সাফার করছেন।”

মেহেরাজ বিরক্ত হলো যেন। রাশভারী কন্ঠে কপাল কুঁচকে বলল,

“একই কথাই বলছিস বারবার৷ আশ্চর্য! ”

জ্যোতি আকস্মিক প্রশ্ন ছুড়ল,

“আপনি কি রেগে আছেন মেহেরাজ ভাই?”

“রেগে থাকার মতো কিছু করেছিস কি তুই?”

জ্যোতি বিরক্তিস্বরে কথা শুনে মুখ কালো করে। নিঃশ্বাস ফেলে নিষ্প্রই কন্ঠে বলল,

“আপনি বোধহয় আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয় মেহেরাজ ভাই। এতক্ষন ধরে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আসছি!”

কথাটা বলেই পিঁছু ঘুরল চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ঠিক তখনই মেহেরাজ গম্ভীর গলায় বলল,

“দাঁড়া!”

ঘাড় বাকিয়ে তাকাল জ্যোতি৷ অস্ফুট স্বরে বলল,

“হ্ হু?”

মেহেরাজ লম্বা শ্বাস ফেলল৷ কিয়ৎক্ষ চুপ থেকে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে ভরাট গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“তোর উচিত ছিল না আমায় সাঈদ আর মেহুর বিষয়ে সবটা বলা? উচিত ছিল কিনা বল? ”

জ্যোতি বুঝতে পারল যেন সবটা। বলল,

“ হয়তো উচিত ছিল। ”

“হয়তো না, অবশ্যই উচিত ছিল এটা।আমি বারবার জিজ্ঞেস করার পরও বলিসনি তুই। ”

জ্যোতি নিশ্চুপ থাকল। কিয়ৎক্ষন পর উত্তর দিল,

“ একজন আপনার বোন, অপর জন বন্ধু।আপনার সাথে সাঈদ ভাইয়ের সম্পর্ক নষ্ট হবে… ”

“ সম্পর্ক নষ্ট হবে ভেবে জানাসনি। এটাই তো?অথচ যদি আমি এসব না জেনেই মেহু আর মেঘের বিয়েটা দিয়ে বসতাম? মেহু সারাজীবন ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়ার আপসোস করত। আর আমি ওর কাছে সারাজীবনের জন্য অপরাধী হয়ে যেতাম। ”

জ্যোতি মিনমিনে চাহনিতে চেয়ে শুধাল,

“আমি ভুল করেছি বুঝলাম।আমার কি এখন ক্ষমা চাওয়া উচিত আপনার কাছে মেহেরাজ ভাই? নাকি শাস্তি দিবেন?”

মেহেরাজ ফের চোয়াল শক্ত করল। মুখ টান টান করে উত্তর দিল,

“ মেহেরাজ নিজস্ব পন্থায় শাস্তি আদায় করে ফেলে। তোকে সেসব ভাবতে হবে, তোর এখন আপাতত একটা কাজ। মেহুকে সাঈদের সাথে বিয়েতে রাজি করাবি।”

জ্যোতি নিষ্প্রভ স্বরে উত্তর দিল,

“মেহু আপু সাঈদ ভাইকে ভালোবাসে, সেক্ষেত্রে মেহু আপু তো রাজি হবেই। কিন্তু সাঈদ ভাই?”

“সেটা তোকে না ভাবলেও চলবে।তুই শুধু মেহুকে রাজি করাবি। ”

কথাটা বলেই মেহেরাজ চলে গেল।

.

তখন রাত একটা। অথচ মেহুর চোখে ঘুম নামল না। শুধ কিছু দীর্ঘশ্বাস আর দুঃখ তার সঙ্গী হলো। এই দীর্ঘশ্বাস আর দুঃখবিলাশের মাঝেই হঠাৎ ফোন বাঁজল। সাঈদের কল। সেদিনের পর প্রায় দেড়মাস হতে চলল সে একবারও কল দেয়নি সাঈদকেে।এতদিন পর হঠাৎ কল পেয়ে অবাক হলেও কল তুলল সে। শুনতে পেল ওপাশে সাঈদের গলা,

“ভালো আছো মেহু? ”

বাবার কাছেই মেহুর শারিরীক, মানসিক এরুপ অবস্থার কথা শুনেছিল সাঈদ। তবুও সাহস করে কল করা হয়ে উঠেনি। জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠেনি কেমন আছে এই মেয়েটা। অবশেষে নিজের অস্থিরতাকে দমিয়ে না রাখতে পেরেই কল করেই বসল৷ জিজ্ঞেস ও করল। বিনিময়ে উত্তর পেল,

“আমাকে তো কল করতে নিষেধ করেছিলেন সাঈদ ভাইয়া।তাহলে আপনি কেন কল দিয়েছেন এখন? কি প্রয়োজনে সাঈদ ভাইয়া?”

“কেমন আছো তা জানতেই কল দিলাম। ”

মেহু হাসল কিঞ্চিৎ। বলল,

“ কেমন আছি তা জেনেই বা কি করবেন আপনি? ”

সাঈদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর স্বরে শুধাল,

” জানার কোন প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না?”

মেহু আক্ষেপ নিয়ে বলল,

“ আপনি তো আমায় ভালোবাসেন না। তারপরও প্রয়োজন থাকাটা হাস্যকর নয় সাঈদ ভাইয়া?”

সাঈদ উত্তর দিল না। বিনিময়ে বলল,

“শুনলাম নিজের প্রতি খুব অযত্ন করছো?খাওয়াদাওয়া কেছো া ঠিকভাবে?নিজের শরীরকে কেন কষ্ট দিচ্ছো শুধুশুধু? নিজের যত্ন নাও মেহু। ক্ষতিটা তো তোমারই হচ্ছে। তাই না?”

মেহু কেঁদে ফেলল এবারে। সাঈদের প্রতি দুর্বলতাটা যেন তড়তড় করে বেড়ে উঠল। তাই তো সে দুর্বলতার সীমারেখা আঁকতে বলল,

“ আমি আপনার প্রতি দুর্বল সাঈদ ভাইয়া। এসব বলে আর আমার দুর্বলতা বাড়াবেন না। ভালোই যখন বাসবেন না তখন দুর্বলতা কেন বাড়াচ্ছেন?”

সাঈদ কথা বাড়াল না এবারে। চাপাস্বরে বলল,

“রাখলাম তাহলে?টেইক কেয়ার মেহু। ”

#চলবে…..

এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-১৬

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_১৬
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

তখন প্রায় রাত দশটা। সাঈদ বলেছিল আটটার সময়ই আসবে। অথচ এল না। মেহু এই দুই ঘন্টা যাবৎই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকল সাঈদ আসবে এই ভেবে৷বারবার হাত ঘড়িতে সময় দেখে অপেক্ষা করে গেল। বার কয়েক কল ও করেছে সাঈদকে। কিন্তু সাঈদ কল তোলা তো দূর উল্টো দুই চারবার কল দেওয়ার পর থেকে তার ফোন সুইচডঅফ শোনাচ্ছে৷ মেহু হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবারে। কনকনে শীতে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতেই সাঈদের বদলে সেখানে উপস্থিত হলো মেঘ৷ ক্লান্ত চেহারা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলল,

“ এই শীতে এত রাতে এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন মেহু? ”

মেহু চমকাল পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে৷ চোখ তুলে চেয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল মুহুর্তেই,

“ আপনি? আপনি এখানে কেন? ”

মেঘ মৃদু হাসল। নেমে আসা রিক্সাটিকে ইঙ্গিত করেই বলল,

“হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরছিলাম।রিক্সা দিয়ে যাওয়ার সময় হুট করেই তোমার দেখা পেলাম তাই ভাবলাম কথা বলে যাই। ”

“ ওহ। ”

“দাঁড়িয়ে আছো কেন বললে না তো?”

মেহু চাপা শ্বাস ফেলে এদিক ওদিক তাকাল।রাস্তার দিকে একবার চেয়ে ভাবল এবারে হয়তো সাঈদ আসবে৷ কিন্তু এল না সে৷ পুনরায় হতাশ হয়ে মেহু উত্তর দিল,

“ উনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আসবেন বলেছিলেন উনি। তাই। ”

মেঘ ভ্রু জুড়ে কুঁচকে প্রশ্ন শুধাল,।

“উনি মানে? ”

পরক্ষণেই আবার কিছু মনে পড়েছে এমন ভাব ধরে তৎক্ষনাৎ বলল,

“ওহ ওহ, তোমার ভালোবাসার মানুষ।স্যরি স্যরি।”

“স্যরি বলার মতো কিছু নেই তো।”

মেঘ অল্প হাসল। চোখের সামনে তারই ভালোবাসার মানুষ অন্য কারোর জন্য অপেক্ষা করছে।বুকের ভেতর যেন ভার অনুভব করল৷ নিঃশ্বাসও বোধহয় আটকে আসল। কিন্তু বাস্তবতা তো কঠিন! যাকে আমরা চাই তাকে আমরা পাই না। যা কিছু আমরা ভালোবাসি তা কিছু আমাদের থাকে না। এই নির্মম বাস্তবতা মনে করেই নিষ্প্রভ চাহনিতে তাকাল মেহুর মুখে। মুহুর্তেই চোখে পড়ল শীতের দাপটে কাঁপতে থাকা মেহুর কম্পমান ঠোঁট ! মেঘ মোহময় দৃষ্টিতে ক্ষানিক সময় তাকিয়ে থাকল সেই ঠোঁটজোড়ার দিকে। পরিস্থিতি অন্যরকম হলে সে এই ঠোঁট ছোঁয়ার আশাও রাখত হয়তো হৃদয়ে। কিন্তু আজ সে আশা নেই। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে সে কথা মনে করেই নজর সরাল দ্রুত! ঠান্ডার প্রকোপে মেহু হাতে হাত ঘষছে দেখেই বলল,

“ ঠান্ডায় কাঁপছো তো তুমি। এত শীতে বাইরে দাঁড়ানো তো ঠিক নয়। তুমি বরং উনি এখানে আসলে তখনই নিচে নামতে। ”

বিনিময়ে মেহু বলল,

“না, না। ঠিক আছে। ঠান্ডা তো তেমন লাগছে না।”

মেঘ ভ্রু উঁচাল। জিজ্ঞেস করল,

“সত্যিই লাগছে না? আমি তো স্পষ্ট দেখছি তুমি ঠান্ডায় কাঁপছো, হাতে হাত ঘষছো, এমনকি তোমার ঠোঁটজোড়াও কম্পমান!”

মেহু উত্তর দিল না। সত্যিই ঠান্ডা লাগছে। সাঈদ কল করার পর কম্বলের নিচ থেকেই অনেকটা হুড়মুড় করে নেমে এসেছিল সে। তাই আসার সময় শালটাও নিয়ে আসা হয়নি। রুমে তখন জ্যোতি আর রিতুও ছিল না। নয়তো ঠিকই মনে করিয়ে শালটা দিয়ে দিত হয়তো। মনে মনে শালটা না আনার জন্য আপসোস করতেই মেঘ ফের বলল,

“ পরনে শীতের পোষাকও নেই?এভাবে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসা বোধহয় ভালোবাসার মানুষের জন্যই সম্ভব হয় তাই না মেহু? তোমার ভালোবাসাটা সত্যিই সুখের হোক। আমি মন থেকে দোয়া করি। ”

মেহুর মনের ভেতর থাকা আপসোসটা হঠাৎই নিভে গেল। তৈরি হলো অপরাধবোধ! একটা মানুষ এতোটা ভালোবাসার পরও তাকে ভালো না বাসাটা অপরাধ না? অপরাধই তো! কিন্তু তার উপায় আছে?নেই তো। চাপা শ্বাস ফেলতেই মেঘ নিজের পরনের জ্যাকেটটা খুলে তার দিকে এগিয়ে বলল,

“ আচ্ছা উনি আসা পর্যন্ত তো এই শীতের মধ্যে অপেক্ষা করবে তাই না? কিছু মনে না করলে আমার জ্যাকেটটা পরে নিতে পারো মেহু। এইভাবে শীতে কাঁপতে হবে না তাহলে। ”

মেহু মুহুর্তেই উত্তর ছুড়ল,

“ না না, আমার শীত করছে না তেমন। ”

“ জ্যাকেটটা আমার বলেই কি পরে নিতে অসুবিধা হবে? ”

মেহুর অপরাধবোধ, অস্বস্তি ফের বাড়ল। মৃদু স্বরে বলল,

“একদমই না ! আপনার শীত করবে না? তাছাড়া সত্যিই আমার শীত লাগ্ে..”

বাকিটা বলা হয়ে উঠল না। তার আগেই মেঘ বলে উঠল,

“ আমরা যাদের ভালোবাসি তাদেরকে আমরা ততোটাই বোঝার চেষ্টা করি যতোটা হয়তো আমরা আমাদের নিজেদেরকেও বুঝি না মেহু। তাই সেক্ষেত্রে এতকাল ধরে একটু হলেও তোমায় বুঝতে পারিনি এটা বলো না৷ অন্তত শীত লাগছে না বলে সে ধারণাটা মিথ্যে প্রমাণ করো না প্লিজ! ”

মেহু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেঘের প্রতিটা কথায় যন্ত্রনার আভাস যেন সে স্পষ্টই টের পেল। তবুও সহানুভূতি দেখাতে ইচ্ছে হলো না। ইচ্ছে হলো না বিনিময়ে কোন সান্ত্বনা দিতে। শুধু নিষ্প্রভ গলায় বলল,

“আমায় ভুলে যান প্লিজ। আমি চাই না যে যন্ত্রনায় আমি ভুগছি সে যন্ত্রনাটাই আমার কারণে কেউ পেয়ে থাকুক!”

মেঘ হাসল আলতো। নিজের হাতে থাকা জ্যাকেটটা এবারে মেহুর উপরে জড়িয়ে দিয়ে কিছুটা ঝুঁকে বলল,

“আরেহ বোকা মেয়ে,ভুলা সম্ভব হলে কেউ যেচে গিয়ে বিষাদ যন্ত্রনা বহন করে থাকে নাকি ? ”

.

জ্যোতি চেয়ারে বসে। তার মনোযোগ সম্পূর্ণটা বইয়ের মাঝেই পড়ে আছে। ঠিক তখনই তার ফোনটা বেঁজে উঠল। একনজর চেয়ে দেখল মেহেরাজের কল। কেন জানি না কল তুলল না সে ইচ্ছে করেই। এরপরও অবশ্য কল এল। একবার, দুইবার, তিনবার বেশ অনেকবার। অবশেষে না পেরে জ্যোতি কল তুললই। বলল,

“আপনি? ”

ওপাশে মেহেরাজ বোধহয় চরম বিরক্ত হলো। কিংবা হয়তো রেগেও হেল। দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,

“হু, আমিই। কেন তোকে কি অন্য কেউও কল করে জ্যোতি? ”

“ অন্য কেউ মানে? মিথি, দাদী, মিনার ভাই উনারা তো কল করেই থাকেন। কেন?”

মেহেরাজ ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। উত্তরে বলল,

“গুড!এখন থেকে আমিও কল করব। আজকের মতো যদি কল না তুলে থাকিস তাহলে কিন্তু খারাপ হবে!”

জ্যোতি প্রশ্ন ছুড়ল,

“আপনি কেন কল দিবেন? ”

“ মন চায় তাই। মনের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয় বল?”

“কিন্তু আপনি.. ”

মেহেরাজ ফের বিরক্ত হলো৷ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গ টেনে বলে উঠল,

“ উহ!কিসের কিন্তু? বিয়েতে রাজি হচ্ছিস না কেন? কতকাল অপেক্ষা করব আমি তোর মতামতের জন্য?”

আকস্মিক কথাটায় জ্যোতি থমকাল। ফের বিয়ের কথাটা মনে উঠতেই জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজাল। অস্ফুট স্বরে বলল,

“ হ্ হু?”

মেহেরাজ গম্ভীর গলায় শুধাল,

“ কানে শুনিস না নাকি? আশ্চর্য! ”

জ্যোতি চোখ বুঝল। শান্ত গলায় বলে উঠল,

“আপনি কল রাখুন মেহেরাজ ভাই৷ ”

“ পুড়ে যাওয়া হাত নিয়ে কল করেছি৷ তুই সেই কলই মুখের উপর রেখে দেওয়ার কথা বলছিস?কি বেয়াদব মেয়ে! ”

ফের চোখ মেলে তাকাল জ্যোতি। নরম গলায় জিজ্ঞেস করল মুহুর্তে,

“ হাত পুড়ল কি করে আপনার? ”

মেহেরাজ তপ্তশ্বাস ফেলল। ভরাট গলায় জিজ্ঞরস করল,

“জেনে কি করবি? হাতে এসে ঔষুধ লাগিয়ে দিয়ে যাবি? ”

“ উহ, জানতে চাইলাম শুধু মেহেরাজ ভাই। ”

ফের ভরাট গলায় প্রশ্ন এল,

“তো তোরই বা জানার এত আগ্রহ কেন হচ্ছে? ”

জ্যোতি দাঁতে দাঁত চাপল। বসা ছেড়ে উঠে স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,

“ ভদ্রতা দেখিয়ে জানতে চাইছি, হয়েছে? এবার বলুন কি করে পুড়ল হাত? ”

“ আমার কাছে তোর এই মিথ্যে ভদ্রতা পছন্দ হলো না। তাই উত্তর টাও দিলাম না। ”

কথাটা বলেই মেহেরাজ কল রাখল দ্রুত। অপরপ্রান্তে জ্যোতি তখন আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইল ফোনের দিকে। অদ্ভুত! লোকটা সত্যিই অদ্ভুত!এতকালের চেনা মেহেরাজ ভাই আর এখনকার মেহেরাজ ভাই যেন পুরোপুরিই ভিন্ন! কি আশ্চর্য!

.

মেহু ফিরে এসেই শরীর এলিয়ে দিল বিছানায়। বিষাদের ভরা মনটা নিয়েই জ্যোতির উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

“ জ্যোতি? সাঈদ ভাইয়া আসল না। এতোটা সময় আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম, কিন্তু এল না। আরো একটা কথা কি জানিস?ঐ যে ডক্টর মেঘের সাথেই দেখা হলো মাত্র।”

জ্যোতি অবাক হলো। সে ভেবেছিল এতোটা সময় মেহু সাঈদের সাথেই ছিল। হয়তো নিজেদের মধ্যকার বোঝাপড়া গুলো বুঝে নিচ্ছে নিজেদের মতো করে৷ কিন্তু সাঈদ আসেনি শুনেই অবাক হলো যেন।বলল,

“সত্যিই আসে নি?

“না, জ্যোতি জানিস?ভাইয়ার ডান হাতের দুটো আঙ্গুলে গরম তেল লেগে পুড়ে গিয়ে ফোসকা হয়ে গেছে৷ আমি হয়তো কাল বাসায় চলে যাব।ভাইয়াই বা ঐ হাত দিয়ে রান্নাবান্না কি করে করবে বল? জানিস জ্যোতি?আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভাবছি একেবারেই হোস্টেল ছেড়ে বাসায় চলে যাব। আজকাল আর কিছুই ভালো লাগে না আমার।একা একা লাগে ভীষণ, অথচ আমার চারপাশে কিন্তু মানুষের অভাব নেই জ্যোতি। অদ্ভুত না? ”

জ্যোতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শান্ত স্বরে বলে উঠল,

“ না, অদ্ভুত না আপু। নির্দিষ্ট কোন মানুষের শূণ্যতায় ভুগলে চারপাশে শত সহস্র মানুষ থাকলেও তোমার শূণ্যতা সে মানুষটা ছাড়া কেউ পূরণ করতে পারে না। এটাই হয়তো স্বাভাবিক! কিন্তু আজকের কাজটা বোধহয় সাঈদ ভাই সত্যিই উচিত করেননি। এইভাবে ঠান্ডার মধ্যে দুইদুই ঘন্টা অপেক্ষা করালেন শুধু শুধু?না আসার হলে বলেই দিতে পারতেন। ”

“ আচ্ছা যদি কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়িস যে তুই একজনকে ভালোবাসিস, আর অন্য একজন তোকে ভালোবাসে। কাকে চয়েজ করবি জ্যোতি? ”

জ্যোতি চোখ বুঝল। উত্তরে বলল,

“দাদী সবসময় বলেন, ‘যে তোকে ভালোবাসে তাকেই সবসময় জীবনসঙ্গী করবি। যাকে তুই ভালোবাসবি তাকে না বিয়ে করে যে তোকে ভালোবাসে তাকে বিয়ে করলেই দেখবি সুখী হবি। ’আর দাদীর এই কথাটাই বোধহয় সত্যিই মেহু আপু। ”

মেহু সবটাই চুপচাপ শুনল। ঠিক তখনই মনে পড়ল মেঘের কথাটা। লোকটা সত্যিই তাকে এতোটা ভালোবাসে? বিষয়টা ভেবেই তপ্তশ্বাস ফেলতেই জ্যোতি বলল,

“সাঈদ ভাইকে কল দিয়েছিলে আপু? একবার কল দিয়ে দেখবে?”

“অনেকবার দিয়েছি জ্যোতি। কল তুলেননি উনি! উনি আসবেন বলেও আসলেন না কেন জ্যোতি? আরেকবার কি কল দিয়ে দেখব? ”

কথাটা বলেই ফের কল দিল মেহু। অদ্ভুত ভাবে এতক্ষনে সাঈদ কল তুলল। কিন্তু কোন কথা বলল না।তাই মেহুই প্রশ্ন ছুড়ল প্রথমে,

“এতক্ষন কল তুলছিলেন না যে?আপনি এমনটা কেন করলেন সাঈদ ভাইয়া? আসবেন বলে এতোটা সময় আমায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন কেন শুধু শুধু? ”

মেহুর প্রশ্ন গুলো শুনেই ওপাশে সাঈদ চাপা শ্বাস ফেলল। সে ইচ্ছে করেই আসেনি মেহুর সামনে।মেহু কেন দেখা করতে চেয়েছে তা কিছুটা হলেও অনুমান করতে পেরেই সে আসে নি। আসার সিদ্ধান্ত নিয়েও শেষ পর্যন্ত আসেনি। বোধহয় নিজের ইচ্ছেতেই আসেনি। তাইতো ঠোঁটে ঠোঁটে চেপে মুহুর্তেই একটা মিথ্যে বলল সে,

“ একটা জরুরী কাজ পড়ে গেছিল। স্যরি, বলতে একদমই ভুলে গেছিলাম তোমায়। ”

মেহুর মুখটা চুপসে গেল। তীব্র মন খারাপ নেমে এল সঙ্গে সঙ্গেই। মৃদু আওয়াজে শুধাল,

“ ওহ। ”

সাঈদ ব্যস্ততা দেখিয়ে শোনাল,

“রাখছি তাহলে? আর কখনো কল করো না মেহু। ”

মেহু বেহায়ার মতো তবুও বলে উঠল,

“একটা কথা জানতে চাই সাঈদ ভাইয়া। ফোন রাখবেন না।সত্যিই কি ভালোবাসতেন না আমায়? ”

সাঈদ এবারে চোখ বুঝল।কিছুটা বিরক্তির স্বরেই বলল সে,

“না বাসতাম না।এক কথা কয়বার বলা লাগে মেহু?”

ফের প্রত্যাখিত হয়ে নিচের ঠোঁট কাঁমড়ে কান্না আটকাল মেহু। জিজ্ঞেস করল,

“কেন বাসেন না ভালো? আপনি কি অন্য কাউকে ভালোবাসেন সাঈদ ভাইয়া? আপনার প্রেমিকা আছে?”

সাঈদ হাসল মৃদু।মেহেরাজের সাথে তার কলেজজীবন থেকে বন্ধুত্ব।মেহুকে তখন অতোটা খেয়ালই করেনি সে। তারপর কলেজ জীবন শেষে পাড়ি দিয়েছিল অন্য দেশে। সেখানে অবশ্য কলড রিলেশনশীপে জড়িয়েছিল একটা মেয়ের সাথে। বলা চলে মেয়েটা সে ভার্সিটির সেরা সুন্দরী মেয়ে ছিল। আর সেই সৌন্দর্যের মৌহেই বোধহয় সাঈদ মেয়েটাে সাথে রিলেশনে জড়িয়েছিল। কিন্তু সম্পর্কটা বড়জোর ছয়মাস নিতেও যেন দমবন্ধ লাগল সাঈদের। সে সৌন্দর্যের মোহ যেন কেঁটে গেল মাস কয়েকেই।তবে সম্পর্কটা ভেঙ্গেছিল মেয়েটারই প্রতারণার কারণে৷ ঠিক তার মায়েরই মতো করে মেয়েটাও তাকে ঠকিয়ে অন্য এক সম্পর্কে জড়িয়েছিল। এতে অবশ্য সাঈদ তার বাবার মতো অতোটাও কষ্ট পায়নি। হয়তো মন থেকে ভালোবাসেনি বলেই সে প্রতারণা তাকে খুব একটা পীড়া দেয়নি। তবে এটা ঠিক যে, সে নারীর প্রতি বিশ্বাসটা সেই ঘটনার পর থেকে আরো বেশি করে হারিয়েছে।তারপর অবশ্য কেন জানি দেশে ফেরার পর থেকে এই মেয়েটার প্রতি তার আকর্ষন জম্মাল। কেন জানি একটা অদৃশ্য বিশ্বাসও তৈরি হলো। কিন্তু কে জানে, বিশ্বাস ভাঙ্গতে কতক্ষন?বাবাও তো তার মাকে অনেকটা বিশ্বাস করত৷ বিশ্বাস কি শেষে ভাঙ্গেনি? ভেঙ্গেছে!খুবই মর্মান্তিক ভাবে তার বাবা বিশ্বাস হারিয়েছে। সাঈদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।সে চায় না নিজেরই বাবার মতো করে কাউকে পাহাড়সম ভালোবেসে সমুদ্রসমান কষ্ট পেতে। তাই তো ঠোঁট চেপে উত্তর দিল,

“হ্যাঁ অন্য কাউকেই ভালোবাসি।আর কিছু বলবে? ”

“সত্যিই?”

“হ্যাঁ, সত্যি! রাখছি কল তবে? প্লিজ আর বিরক্ত করো না আমায়। ”

“আমি তাকে দেখতে চাই প্লিজ!”

“বিশ্বাস করছো না? ওকে। ছবি পাঠাচ্ছি। তুমি চাইলে মেহেরাজকে জিজ্ঞেস করতে পারো।রাখছি। ”

কথাটা বলেই কল রাখল সাঈদ। কিয়ৎক্ষন পরই দুটো ছবি এল। নিঃসন্দেহেই মেয়েটি সুন্দরী!মেহু কিয়ৎক্ষন আধুনিক পোশাক পরিহিত সেই মেয়েটির ছবির দিকে তাকিয়ে থাকল। পরক্ষনেই মেহেরাজকে একটা ছবি পাঠিয়ে কল করিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“ ভাইয়া?তোমায় যে একটা ছবি পাঠালাম?তাকে কি চেনো তুমি?কে সে ভাইয়া?”

ওপাশে মেহেরাজ বোধহয় কিছুতে ব্যস্ত ছিল। এমন প্রশ্ন শুনে বোনের পাঠানো ছবিটা দেখতেই মনে পড়ল সাঈদ এই মেয়েটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল অনেককাল আগে। সাঈদের প্রেমিকা ছিল! তাই অস্ফুট স্বরে উত্তর দিল,

“ সাঈদের প্রেমিকা হয়। কেন? ”

মুহুর্তেই বুকের ভেতর যন্ত্রনা অনুভব করল মেহু। কল রেখে জোরে জোরে শ্বাস ফেলল বার কয়েক।নিজেকে এক মুহুর্তের জন্য ব্যাপক বেহায়া ও বোধ হলো অবশ্য। সাঈদ অন্য কাউকে ভালোবাসে এটা জানার পরও তার পেঁছনে পড়ে থাকাটাকে নিঃসন্দেহে বেহায়ার মতো কান্ডকারখানা বলে না?বলে!তবুও বোধহয় কষ্টের পরিমাণ কমল না।ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর শত চেষ্টা করেও পারল না। জ্যোতি পাশ থেকে জড়িয়ে ধরলেও কান্না থামল না তার৷নিঃশব্দে কেঁদে গেল কেবল সে। ঠিক তখনই কানে এল,

“হ্যালো? ”

মেহু চমকাল।এটা মেঘেরই গলা। ঠিকভাবে খেয়াল করে দেখল ফোন হাতে নিয়েই কাঁদতে কাঁদতে ভুলে মেঘের কাছেই কল চলে গিয়েছে। সে কলটাই রিসিভড করে ওপাশ থেকে মেঘের কন্ঠের আওয়াজ আসল। ফের মেঘ বলল,

“কলটা কি ভুলেই এসে গিয়েছে? ”

মেহু তীব্র যন্ত্রনায় ছটফট করল। এই মুহুর্তে কথা বলার মতো অবস্থা নেই জেনেই কল রাখতে নিতেই হঠাৎ মনে হলো কয়েকদিন আগে বোধহয় মেঘও এই যন্ত্রনাটাই ভোগ করেছিল। বলেছিল ও,“ভালোবাসার মানুষ ভালো না বাসলেও,ভালোবাসার মানুষ অন্য কাউকে ভালোবাসে এটা শোনার কষ্টটা ঢের বেশি!”আসলেই যে যন্ত্রনাটা খুব বেশি তা টের পেল মেহু। কিন্তু কিছুই বলল। মেঘ আবারও বলল,

“শুনতে পাচ্ছো মেহু?”

মেহু নিষ্প্রভ স্বরে উত্তর দিল,

“পাচ্ছি।”

মেঘ চমকাল। মেহু কান্নারত স্বর শুনেই যেন বুঝে ফেলল মেহু যে কেঁদেছে।মুহুর্তেই প্রশ্ন ছুড়ল আকুল স্বরে,

“কাঁদছো তুমি? এই মেহু? কাঁদছো কেন তুমি? কিছু হয়েছে কি তোমার?কি হয়েছে মেহু? ”

মেহু কান্না থামানোর চেষ্টা করল কেবল। বলল,

“হ্হু? না, কাঁদছি না তো৷ ”

“আমি জানি তুমি কাঁদছো। মিথ্যে বলো না! ”

মেহু এবারে কান্না থামানোর চেষ্টা করল না। বরং কান্নার গতি বাড়ল খুব করে৷ কাঁপা স্বরে কাঁদতে কাঁদতেই বলে উঠল সে,

“ আমার অনুভূতির বয়স খুব একটা দীর্ঘ নয় মেঘ, তবে আপনার অনুভূতিটা বোধহয় সত্যিই অনেক দীর্ঘ সময়ের৷ এই দীর্ঘ সময়ের অনুভূতির পরও যখন জানলেন আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি তখন কি খুব বেশি যন্ত্রনা হয়েছিল? মনে হয়েছিল কি নিঃশ্বাস বন্ধ আসছে?জীবন থেমে আসছে বোধ হচ্ছিল? ”

“হঠাৎ এসব? ”

মেহু ফের কান্নারত গলায় কোনভাবে বলল,

“ একটা কথা আছে জানেন মেঘ? কেউ একজন বলেছিল যে পৃথিবীতে আমরা যাকে যতটুকু কষ্টই দিয়ে থাকি সেটা ঘুরেফিরে কোন না কোন ভাবে আমরা ফেরত পাবই! আমি এতোগুলো দিনেও আপনার যন্ত্রনাটা অনুভব করতে না পারলেও এখন পারছি! আপনার জন্য বোধহয় মায়াও হচ্ছে আমার! আমায় ক্ষমা করে দিবেন, এতোটা কষ্ট দেওয়ার জন্য সত্যিই আমি ক্ষমা চাই। প্লিজ ক্ষমা করে দেন আমায়। ”

কথাগুলো বলেই কল কাঁটল মেহু। কাঁদতে কাঁদতে ফের জড়িয়ে ধরল জ্যোতিকে। উহ!কতোটা যন্ত্রনা, কতোটা কষ্ট তার হৃদয়ে। কেউ কি টের পাচ্ছে এই যন্ত্রনা, এই বিষাদ?পাচ্ছে?

.

মিথি রাতে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিল। তার আগেই মনে হলো আজ তার আব্বার খোঁজ নেওয়া হয়নি। তাইতো ছুটে ঘর ছেড়ে বের হয়ে আব্বার ঘরে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল৷তার ছোট আম্মায় দরজা খুলে দিতে পা টিপে টিপে তার আব্বার রুমের সামনেই দাঁড়াল। অস্ফুট স্বরে বলল,

“কেমন আছেন আব্বা? ”

মিথির আব্বা তাকাল। গম্ভীর গলায় বলল,

“ তুই? ভেতরে আয় মিথি। ”

মিথি ভেতরে এল না।ওখান থেকেই চঞ্চল স্বরে বলল,

“ আপনার এত কিসের চিন্তা আব্বা? কেনই বা চিন্তা করেন? চিন্তা করে শরীর তো আপনারই অসুস্থ হলো। ”

“ ভেতরে না এসে ওখান থেকেই কথা বলছিস কেন? আমি কি বারণ করেছি ভেতরে আসতে? ”

মিথি ভেতরে আসল। ছোটবেলা থেকে আব্বাকে সে যে ভয়টা পেত তা এই কয়দিনেই বেশ কেঁটে গেছে।তাই তো এতোটা স্বাভাবিক চঞ্চল স্বরে কথা বলছে সে। বলল,

“ উহ নাহ!তবে এই ঘরে আসা হয়না বলেই আসতে চাই নি। ভালো আছেন এখন আব্বা?”

“ ভালো না থেকে উপায় কি? ”

মিথি মিষ্টি হাসল। আব্বার পাশে বসে শুধাল,

“ আপনি আর চিন্তা করবেন না কিন্তু আব্বা। আমি আর জ্যোতি মাকে কখনো তেমন ভাবে পাই-ইনি। এমন না যে আপনাকেও পেয়েছি৷ তবুও আব্বা ডাকটা অন্তত হারাতে চাই না বুঝলেন? সবসময় সুস্থ থাকবেন আব্বা নাহয় আপনার সাথে কথা বলব না। ”

তার আব্বা হাসল এইবারে। মিথির দিকে তাকিয়ে বলল,

“ মিথি? তুই যে অনেকটা বোকা মেয়ে এটা কি জানিস তুই? ”

মিথি ঠোঁট উল্টাল। আব্বার দিকে চেয়ে বলে উঠল,

“ বোকার মতো কি করেছি আব্বা?আপনি আমায় এভাবে বোকা সম্বোধন করতে পারেন না। আমি কিন্তু যথেষ্ট বুদ্ধিমতী!”

তার আব্বা ফের হাসল। প্রসঙ্গ পাল্টে গম্ভীর স্বরে বলল,

“ জানিস মিথি?মাঝে মাঝে আমারও একদম আদর্শ বাবা হতে মন চায়। ইচ্ছে করে তোর আর জ্যোতির ভালো বাবা হতে। কিন্তু যখনই এসব ভাবি তখনই আমার মনে পড়ে তোদের মায়ের মুখ! আমি পারিনা তার প্রতি ঘৃণা মুঁছতে!”

মিথির চঞ্চলতা হঠাৎ মিইয়ে গেল। বাবার দিকে চেয়ে জবাব দিল,

“আব্বা? আমারে বোকা বললেন না আপনি
আসলে আপনিই বোকা।আম্মার প্রতি আপনার ঘৃণা আছে মানলাম আমি, কিন্তু আম্মার দোষটা আপনি শুধু শুধুই আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন না আব্বা? আমরা কি কোন ভুল করেছিলাম আব্বা?কেন আম্মার পর আব্বার স্নেহও হারালাম আমরা বলুন?”

তার আব্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবারে। উপরের দিকে চেয়ে বলল,

“ আমি সত্যিই বোধহয় বোকারে মিথি! বহুদিন নিঃসঙ্গতায় ভুগতে ভুগতে আমার মনে হয়েছিল আমি একা!পুরো বিশ্বে আমি একা কেবল!আমাকে আমার মেয়েরাও চায় না এর চেয়ে কষ্টের কিছু হয়?কতোটা দূরত্ব সবার সাথে আমার!”

মিথি উঠে দাঁড়াল। ফের বলল,

“ধুররর!ভুল ভাবছেন আপনি আব্বা।জানেন আব্বা? আমি ছোট থেকেই আপনাকে ভয় পেতাম আব্বা৷ আপনার ধমক খাওয়ার ভয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পালাতাম সবসময়। কিন্তু সত্যটা হলো আমি আপনাকে মন থেকে ভালোওবাসতাম! মাঝেমাঝে আপসোস করতাম আমার আব্বা এমন কেন। কখনো বিরক্ত হয়ে আপনাকে আপন মনে কথাও শুনিয়েছি।আপনি গ্রামের হাইস্কুলরর গণিতের শিক্ষক! আমি সে জেনে যখন হাইস্কুলে ভর্তি হলাম? তখন থেকেই গণিত বইটা নিয়ে পরে থাকতাম খুব করে। ধারণা হতো যে আমি ক্লাসে সব অংক ফটাফট করে দিলেই বুঝি আব্বা সুন্দর করে আমার প্রশংসা করবে।সুন্দর ভাবে কথা বলবে আমার সাথে।কিন্তু সেসব কিছুই হতো না।মাঝেমাঝে আপনার এই রাগভ তবে আপনার মেয়েরা যে আপনাকে চায় না এটা ডাহা মিথ্যে! এই যে আজ নরম গলায় কথা বললেন, আমি কত সহজে আপনার সাথে মিশে গেলাম দেখলেন?সবসময় এমন ভাবেই কথা বলবেন আব্বা?”

#চলবে…..

এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-১৪+১৫

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_১৪
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

সেদিন পুরোটা সময়ই জ্যোতি মেহেরাজকে নিয়ে ভাবল। ভালো করে মনে করল সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসা মেহেরাজ ভাইকে।শুরু থেকেই,বলতে গেলে ছোটবেলা থেকেই মেহেরাজের ব্যাক্তিত্বকে সে সম্মান করত, শ্রদ্ধা করত। মেহেরাজ ভাই বলতেই সে, মিথি এমনকি অন্যান্যদের সামনে ও ফুটে উঠত এক আদর্শবান ব্যাক্তিত্বের চিত্র। আর সেই ব্যাক্তিত্বের কারণেই বোধহয় কিশোরী কাল হতে এই পুরুষটির প্রতি কিঞ্চিৎ দুর্বলতার ও সৃষ্টি হয়েছিল তার হৃদয়ে।কিন্তু এখন কি এই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত তার? মেহেরাজ ভাই কেনই বা নিজ থেকে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিবে? কোন ছেলে নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিজে দেয় নাকি?আর সামান্তা? সামান্তার সাথে কি সত্যিই কিছু ছিল না? জ্যোতি ভাবে কেবল। ভাবতে ভাবতেই দিন পেরিয়ে রাত হলো, রাত পেরিয়ে সকাল হলো।আর ঠিক সকাল বেলাতেই পুকুর পাড়ে দেখা হলো মেহেরাজের সাথে।জ্যোতি কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে দেখল মেহেরাজকে। এই প্রথম বোধহয় সে মেহেরাজের বাহ্যিক রূপ ও লক্ষ্য করতে লাগল। পরনের জামা হতে, কপালে পড়ে থাকা কালো চুল, এমনকি ভ্রুজোড়া,খোঁচা দাঁড়ি, বড় বড় চোখজোড়া, লালচে খয়েরি পুরু ঠোঁটজোড়া সবই সে সরু চাহনিতে লক্ষ্য করে গেল। মেহেরাজ তার চোখজোড়ার সে সরু দৃষ্টিতে লক্ষ্য করা দেখেই আড়ালে হাসল।তারপর কিছুটা এগিয়েই বুকে হাত গুঁজে দাঁড়াল জ্যোতির সামনে। ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,

“কি আশ্চর্য!বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে না পাঠাতেই প্রেমে পড়ে গেলি নাকি জ্যোতি? ”

কথাটা শুনতে দেরি হলেও জ্যোতির নজর সরাতে দেরি হলো না যেন। দ্রুত অন্যদিকে দৃষ্টি স্থির করে অস্বস্তিতে হাত ঘষল। তার এভাবে তাকানোটা উচিত হয়নি বলে মনে মনে নিজের উপর বিরক্তও হলো।তারপর অস্বস্তি আড়াল করে বলে উঠল,

“প্রেমে পরব কেন? আমি ভাবছিলাম শুধু। ”

মেহেরাজ এবারেও চাপা হাসল। জ্যোতির মুখে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,

“ ওহ, তো কি ভাবছিলি? আমি কতোটা সুন্দর তা? ”

জ্যোতি শান্ত চাহনিতে তাকাল মেহেরাজের দিকে। মাথা দুলিয়ে উত্তর দিল,

“না, তবে আপনার মতো একটা সুন্দর ছেলে আমার মতে অসুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাবই বা কেন পাঠাবে? অদ্ভুত না বিষয়টা?”

“তারমানে সত্যিই তুই আমার সৌন্দর্য নিয়েই ভাবছিলি? ”

“ না, বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর কারণ ভাবছিলাম। ”

মেহেরাজ এবারে যেন বিরক্ত হলো৷ কপাল কুঁচকে গম্ভীর গলায় বলে উঠল,

“ গর্দভ!এটা ভাবতে গিয়ে চোখ দিয়ে আমার সর্বাঙ্গ ওভাবে দেখার মতো কি ছিল? আমার সর্বাঙ্গে উত্তর লেখা ছিল কি তোর সে প্রশ্নের? ”

জ্যোতি উত্তর দিল না। আসলেই ওভাবে কেন তাকিয়েছো তার উত্তর বোধহয় তার নিজের কাছেও নেই৷ তবে তাকানোটা যে তাে মস্ত বড় বোকামো হয়েছে এই নিয়ে নিজের প্রতি বিরক্তিটা চূড়ায় পৌঁছাল। বেহায়ার মতো একটা ছেলের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকানোর কোন প্রয়োজন ছিল কি আধো?ছিল না তো। তবুুও সে বেহায়ার মতো তাকিয়ে ছিল।এই নিয়ে মনে মনে তার বিরক্তির মাত্রা ক্রমশ বাড়তেই কানে মেহেরাজের গলা,

“ যায়হোক, আমায় ড্যাবড্যাব করে এতক্ষন ধরে দেখে কি উত্তর পেলি সেটা বল।”

জ্যোতি এবারে ছোট শ্বাস ফেলল। কিছুটা নড়ে স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,

“ কোন উত্তরই পাইনি, তবে এটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি এই বিয়েটা করব না। ”

মেহেরাজের বিরক্তির মাত্রা আরো কয়েকগুণ বাড়ল। তপ্তশ্বাস ফেলে শক্ত গল্য় বলে উঠল,

“ তো কোন বিয়েটা করবি? শোন যে বিয়েটাই করিস না তুই বিয়েটা কিন্তু আমার সাথেই হবে।এটা মাথায় রাখলেই চলবে। ”

ফের জ্যোতি উত্তর দিল,

“আপনাকে বিয়ে না করার কথাই বললাম মেহেরাজ ভাই। আমি অতোটা নিষ্ঠুর নই। ”

সুচালো চাহনিতে জ্যোতির দিকে ফিরে চাইল মেহেরাজ। ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল,

“নিষ্ঠুর?নিষ্ঠুরের প্রশ্ন কেন আসছে? ”

জ্যোতি কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল। তারপর হঠাৎ নরম গলায় বলে উঠল,

“ আপনি জানেন না আসলেই?সামান্তা আপু আপনাকে ভালোবাসে মেহেরাজ ভাই। জানেন না সেটা?আর অন্যের ভালোবাসার মানুষকে কেড়ে নেওয়ার মতো অতোটাও স্বার্থপর বা বেহায়া আমি নই৷ ”

মেহেরাজের কপালের ভাজ মিলিয়ে গেল৷ পকেটে হাত গুঁজে ভরাট গলায় বলে উঠল,

“ আর আমিও অতোটা দয়ালু নই যে নিজের অনুভূতিময় কিছু ছেড়ে দিয়ে সারাজীবন হাত গুঁটিয়ে বসে থাকব৷ ”

“মানে? ”

“আমি তো তোকে আগে বুদ্ধিমতি ভাবতাম জ্যোতি। কিন্তু কে জানত তুই এতোটা গর্দভ? ”

কথাটা বিরক্তি সুরে বলেই পাশ ঘুরল মেহেরাজ। এই মেয়ের কথা শোনা মানেই মেজাজ খারাপ হওয়া।তার চেয়ে কথা না শোনাটাই সুন্দর সিদ্ধান্ত৷ তাই তো আর দাঁড়াল না। পিছনে জ্যোতির প্রশ্নোবোধক চাহনিকে পাত্তা না দিয়ে দ্রুত চলে গেল নিজ গতিতে।

.

মেহু ভার্সিটি থেকে হেঁটেই ফিরছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল হসপিটালটা। এই হসপিটালেই মেঘ ইন্টার্নি করছে। জ্যোতির বাবা যখন হসপিটালে ছিল তখন কয়েকবার দেখা হয়েছিল। মেঘের মুখটা মনে পড়তেই মুহুর্তে মনে পড়ল মেঘের যন্ত্রনামাখা কথা, বিষাদ আর যন্ত্রনাগুলো। তার চেয়েও বোধহয় মেঘের যন্ত্রনাটাি বেশি। বেশি নয় কি? সে প্রত্যাখিত হয়ো কষ্ট পেয়েছে, অন্যদিকে মেঘ তো প্রত্যাখানের সাথে সাথে এটাও জানল যে তারই ভালোবাসার মানুষ অন্য কাউকে ভালোবাসা। এটা বোধহয় সত্যিই তার যন্ত্রনার চেয়েও বেশি।কিন্তু সে কি আসলেই কিছু করতে পারে? কিছু করা যায় আধো?দুই দিকে দুইজন৷ একজন তাকে ভালোবাসে, অপরজনকে সে ভালোবাসে। ঠিক কোনদিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত মেহুর? সাঈদের দিকে? নাকি মেঘের দিকে? ভেবে পেল না। আর ভেবে পেল না বলেই বোধহয় হসপিটালের সামনে মেঘকে দেখেও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাল। দ্রুত পায়ে পার হওয়ার চেষ্টা করল নির্ধারিত স্থানটি। কিন্তু হয়ে উঠল না। তার আগেই সম্মুখে এসে দাঁড়াল মেঘ৷ পকেটে হাত গুঁজে মৃদু হেসে বলে উঠল,

“ এড়িয়ে যাচ্ছেন মিস মেহু?আপনি এতোটা অস্বস্তি ফিল করার মতো কিন্তু সত্যিই কিছু নেই। আমি কিন্তু আপনাকে দোষী ঘোষণা করছি না, করবও না। ওটা সম্পূর্ণটাই আমার অনুভূতির দোষ। আপনি বরং আগের মতোই পরিচিত হিসেবে আমার সাথে কথা বলতে পারেন৷ ক্ষতি নেই তো তাতে? ”

মেঘ কখনো আপনি সম্বোধন করে, আবার কখনো বা তুমি। এই নিয়ে অবশ্য মেহু কিছু বলল না। তবে সে সত্যি সত্যিই অস্বস্তি ফিল করল। অস্বস্তি ফিল করার মতো কিছু নেই তা মেঘ বললেও তার সত্যি সত্যিই অস্বস্তি লাগছেে। মৃদু কন্ঠে তবুও উত্তর দিল,

“ না আসলে, আপনাকে খেয়াল করিনি। নয়তো কথা বলতাম।”

“ আসলেই খেয়াল করোনি? নাকি এড়িয়ে যেতে চাইলে? আচ্ছা আমি ছ্যাঁছড়ার মতো আচরণ করছি মেহু? ভালোবাসো না জেনেও নিজ থেকে কথা বলতে চলে এলাম।যায় হোক, কেমন আছো তা বলো?”

মেহু ইতস্থত বোধ করল৷ভদ্রভাবে উত্তর দিল,

“আলহামদুলিল্লাহ,আপনি? ”

মেঘ হাসল। বলল,

“ এই যে কাঁটছে দিন। তো তোমার ভালোবাসার মানুষটির সাথে আলাপ করাবে না কখনো? আমার কিন্তু তাকে দেখার অনেক ইচ্ছে মেহু। একবার দেখা করাবে? ”

মেহু অন্যমনস্ক ছিল। হঠাৎ এই কথা শুনে কাঁপা গলায় বলল,

“ হু? মানে আসলে সে দেখা করবে কিনা জানা নেই আমার। ”

মেঘের চাহনি হঠাৎ কেমন হলো যেন। গলা যেন ধরে আসল। তবুও হাসার চেষ্টা করে শুধাল,

“আচ্ছা, সে খুব ভালো তাই না মেহু? খুব ভালোবাসে তোমায়? নিশ্চয় দেখতে ও খুবই সুন্দর? ”

মেহুর চোখ টলমল করল এবারে৷ ঠোঁটে ঠোঁট কাঁমড়ে চেষ্টা চালাল কান্না আটকানোর। কিন্তু আধৌ পারল কি? যে মানুষটাকে সে ভালোবাসে সে মানুষটাতো তাকে ভালোবাসে না। মেঘের বাকিসব প্রশ্নের উত্তর বলার মতো হলেও এই উত্তরটা যে সে বলতে পারবে না। কি করেই বা বলবে?তাই তো মেহু উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। মৃদু গলায় বলল,

“ আপনি আমার চেয়েও ভালো কাউকে ডিজার্ব করেন।নিজের জীবনটা গুঁছিয়ে নিন প্লিজ। আমি জানি আপনি আমায় অনেকটা ভালোবাসেন, হয়তো বা এই ভালোবাসাটা কুড়িয়ে নিলে আমিই সর্বোচ্চ সুখী হবো। কিন্তু আমি পারছি না, পারব কিনা তাও জানা নেই। আপনি ভালো থাকুন এটাই চাইব খালি। ”

মেঘ তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল কেবল। গম্ভীর স্বরে শুধাল,

“ হাস্যকর না মেহু? যাকে আমি চাই তাকেই পেলাম না, তার চেয়ে ভালো কেউ আসলেও আমি কি আসলেই সুখী হবো? আমার তো তার চেয়ে ভালো কাউকে চাই না, তাকেই চাই। যায় হোক, আমার সুখের কথা নাহয় বাদ থাক। তুমি সুখী হও, অনেকটুকু সুখী হও মেহু। আমার সুখটুকুও নাহয় তোমার হোক। ”

.

মেঘ আজও রাত করেই বাসায় ফিরল। পরিবার,হসপিটাল সব জায়গায় নিজেকে পার্ফেক্টলি হাজির করার চেষ্টা করলেও ভেতর থেকে যে সে বড্ড নড়বড়ে হয়ে আছে তা বোধহয় বুঝল খালি তার মা। তাই তো আজও জেগে থেকে অপেক্ষা করলেন ছেলের ফেরার জন্য। ছেলে যখন বাসায় ফিরল তখন ছেলের গা থেকে ভেসে নিকোটিনের গন্ধটাও খুব ভালো করেই বুঝলেন। কিন্তু প্রশ্ন ছুড়লেন না। চুপচাপ খেতে দিলেন ছেলেকে। তারপরই চেয়ার টেনে বসে মৃদু কন্ঠে বললেন,

“ মাকে বিশ্বাস করিস তো মেঘ?”

মেঘ খাওয়ার মাঝেই চোখ তুলে চাইল। খাওয়া থামিয়ে আলতো হেসে উত্তর দিল,

“ নিজেকে বিশ্বাস করার আগে থেকেই তোমাকে বিশ্বাস করা শিখেছি আম্মু। ”

মেঘের মা চাপা নিঃশ্বাস ফেলল। বলে উঠল,

“তবে মায়ের থেকে সবকিছু এতোটা আড়াল করা কেন মেঘ? ”

মেঘ অবাক হওয়ার ভান করল। ভ্রু কুঁচকে শুধাল,

“ কিসব বলছো আম্মু? কি আড়াল করেছি আমি? ”

“ কিছুই না? এতোটা অনিয়ম কেন তবে হঠাৎ? যে ছেলে নেশার দিকে ফিরে চাইত না সে ছেলে আজ নেশায় অভ্যস্ত হচ্ছে। কেন এসব? ”

মেঘ অনুতপ্ত হলো। ভাবল মা যে আদর্শে বড় করেছে তাকে সে আদর্শ থেকে সরে গেছে বলেই হয়তো মা রাগ করেছে। হয়তো সিগারেটের বিষয়টা টের পাওয়ার কারণেই এসব প্রশ্ন ছুড়ছেন। তাইতো বাধ্য ছেলের মতো বলে উটল,

“ স্যরি আম্মু,আর হবে না। আসলে এক ফ্রেন্ড বলল তাই সিগারেট হাতে…”

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই তার মা ফের বলে উঠল,

“শুধু আজ নয় মেঘ, আমি এই কয়েকটাদিন নিয়মিত লক্ষ্য করেছি। খাবারে অনিয়ম, চলাফেরায় অনিয়ম,ঘুমে অনিয়ম। এমনকি চোখের নিচে কালো দাগও বসেছে।খুব বেশি ভুল না হলে তুই কাঁদিস ও আড়ালে। কিন্তু কেন? ”

মেঘ চুপ থাকল। সব আড়াল করতে চেয়েও আড়াল করতে না পারার ব্যর্থতায় চুপ হয়ে গেল। তার মা আবারও বলল,

“কি হলো? বল। কেন এসব? ”

এবারেও উত্তর এল না। মেঘের মা আবারও
প্রশ্ন ছুড়ল,

“মেহেরাজরা বিয়ের প্রস্তাবটা রিজেক্ট করেছে বলে? শুধু এই কারণেই এতোটা অবহেলা নিজের প্রতি? ”

এতক্ষনে গিয়ে উত্তর দিল মেঘ। চাপা স্বরে বলে উঠল,

“শুধু না আম্মু, আমি তাকে সবটা দিয়ে ভালোবেসেছিলাম। সবটা দিয়েই চেয়েছিলাম। অথচ সে আমার দিকে তাকিয়েও দেখল না।বুঝল না আমায়। আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি আম্মু। সে অন্য কাউকে চায়, অন্য কাউকে ভালোবাসে আম্মু। এটা যন্ত্রনার নয়? যাকে আমি চাই সে অন্য কাউকে চায় এর চেয়েও যন্ত্রনার বিষয় আর কিছু হয়?”

“এতোটা কষ্ট? এতোটা ভালোবাসিস ওকে মেঘ?”

মেঘ তপ্তশ্বাস ফেলল। খাওয়া ছেড়ে উঠে বলল,

“ আম্মু, আমি ভালোবাসা বলতেই তাকে চিনেছিলাম। ভালোবাসার অনুভূতি বুঝতেই তাকে ভেবেছিলাম। কি করে ভুলি বলো? আমি জানি জোর করে ভালোবাসা হয় না, এ ও জানি তাকে আমি পাব না। আমি তাকে জোর করে পেতেও চাইছি না। কিন্তু সত্যিই আমার কষ্ট হয়। সে অন্য কাউকে ভালোবাসে এটা ভাবতেই আমি মৃত্যুসম যন্ত্রনা অনুভব করি। এর চেয়ে তো মৃত্যুই ভালো ছিল আম্মু। বলো?আমার ভাগ্যেই কেন এমনটা লেখা ছিল? কেন আমি এই যন্ত্রনার ভাগীদার হলাম?”

মেঘের মা রেগে গেল যেন। বললেন,

“ হুশশ!চুপ! একদম চুপ! আম্মু আছে না? পরিবারের এতগুলা মানুষ তোকে কতোটা ভালোবাসে ভেবেছিস? সানশাইন কতোটা ভালোবাসে? তুই সেসব না ভেবে মৃত্যুর কথাটা বলতে পারলি মেঘ? ”

মেঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজ রুমে যেতে যেতে শান্ত গলায় বলে গেল কেবল,

“ স্যরি, আর বলব না আম্মু। ”

#চলবে……

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_১৫
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

জ্যোতি বাড়ি ছেড়ে শহরে এল দুদিন হলো৷ গত দুদিন ভার্সিটিতে না গেলেও আজ বের হলো ভার্সিটিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রাস্তার পাশে রিক্সার জন্য অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে ও লাভ হলো না। খালি রিক্সা চোখে পড়ল না তার।তবে হঠাৎই দেখতে পেল রিক্সায় চড়ে আসা মেহেরাজকে। রিক্সাটা এদিকেই আসছে। জ্যোতি সরু চাহনিতে তাকিয়ে দেখল কেবল। মেহেরাজের এখন এইসময়ে আসার কারণও ভাবতে লাগল মনে মনে। ঠিক তখনই রিক্সাটা এসে থামল তার সামনে। দেখতে পেল মেহেরাজকে রিক্সা থেকে নামতে। জ্যোতি দু পা সরে অন্য জায়গায় দাঁড়াল তখন। মুহুর্তেই শুনতে পেল মেহেরাজের গম্ভীর গলা,

“ সরে দাঁড়ানোর কি আছে? তোর উপর হামলে পড়তাম আমি? ”

জ্যোতি চোখ বুঝে তপ্তশ্বাস ফেলল। মনে মনে সে চেয়েছিল মেহেরাজের সাথে এই যাত্রায় তার কথা না হোক। কিন্তু কথা হতেই হলো। এখন জবাব না দিলে নিশ্চয় বেয়াদব সম্বোধনটা খুব সুন্দর ভাবেই তার নামের আগে বসিয়ে দিবে? তাই তো ঠোঁটে ঠোঁট চেপে উত্তর দিল,

“যাওয়ার জন্য জায়গা না পেলে তখন আবার বলতেন বেহায়ার মতো একটা ছেলের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছি।তাই না মেহেরাজ ভাই? ”

মেহেরাজ ভ্রু কুঁটি করে তাকাল। ঠোঁট চেপে সন্দেহী গলায় বলে উঠল,

“ সত্যি সত্যিই তুই ছেলেদের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে থাকিস নাকি? ”

জ্যোতি মিনমিনে চোখে তাকাল এবারে। দুনিয়ায় এত কাজ থাকতে সে ছেলেদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকার মতো বিচ্ছিরি কাজটাই বা কেন করবে? এটা আধৌ কোন প্রশ্ন করা হলো? তবুও সেই প্রশ্নের উত্তর দিল জ্যোতি। স্পষ্টস্বরে বলল,

“দুনিয়ায় এত কাজ থাকতে আমি ছেলেদের রাস্তা আটকেই দাঁড়িয়ে থাকব কেন মেহেরাজ ভাই?”

“ করতেই পারিস। ”

“একদমই না। ”

মেহেরাজ হাসল কিঞ্চিৎ। জ্যোতির পাশে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,

“গুড!এবার বল মেহু কোথায়? কাল রাত থেকে কল দিয়েছি,ফোন সুইচডঅফ বলছে কেন ওর? ”

জ্যোতি এতক্ষনে বুঝতে পারল মেহেরাজের এই সময়ে এখানে আসার কারণ। মৃদু আওয়াজে উত্তর দিল,

“ মেহু আপু তো এখনো ঘুমাচ্ছে। বোধহয় ভার্সিটিতে যাবে না আজ৷ ”

প্রশ্ন এল,

“ কেন যাবে না? ”

“ বললাম তো ঘুমাচ্ছে।ঘুমে থেকে কি করে যাবে? ”

মেহেরাজ মাথা নাড়াল। পরমুহুর্তে কিয়ৎক্ষন চুপ থেকেই বলে উঠল,

“ ঠিকাছে,তাহলে তুই দুই মিনিটের মধ্যে মেহুকে গিয়ে বলে আসবি যে আমায় যাতে ঘুম থেকে উঠে কল করে। ওকে?”

জ্যোতি চোখজোড়া সরু করে তাকাল। ঠোঁট চেপে প্রশ্ন শুধাল,

”ঘুমাচ্ছে আপু। আমি কি আপুর ঘুম ভাঙ্গিয়ে বলে আসব? ”

মেহেরাজ শ্বাস টানল। ঘুম ভাঙ্গালে ছোটবোনের ঘুম হবে না এই ভেবেই দ্রুত বলল,

“ না না,ঘুম ভাঙ্গাতে হবে না। ও ঘুমাক বরং। তুই ওর পাশে একটা কাগজে লিখে দিয়ে আসবি। ওকে? ”

জ্যোতি আলতো হাসল। ছোট বাচ্চাদের ঘুম ভাঙ্গানোতে যেমন তাদের বাবা মা নারাজ থাকে ঠিক তেমনই যেন ছোটবোনের ঘুম ভেঙ্গে গেলে মেহেরাজেরও অনেকটা খারাপ লাগবে এমন একটা ভাবই স্পষ্ট হলো মেহেরাজের চাহনিতে। সত্যিই কতোটা যত্নশীল! জ্যোতি মুগ্ধ হয় এই যত্নে কিন্তু প্রকাশ করে না। শান্তা গলায় বলল,

“ আচ্ছা।”

কথাটা বলেই পিঁছু ঘুরে চলে গেল। কাজ সেরে আসল আরো কিয়ৎক্ষন পর। ঠিক তখনই মেজেরাজ হাতের ঘড়িটায় তাকাল। সময় দেখে বিরক্ত স্বরে বলল,

“এতোটা দেরি হলো কেন তোর? ”

“দেরি তো আমার হলো ভার্সিটিতে যেতে। আপনি বিরক্ত হচ্ছেন কেন? তাছাড়া অতো বেশি দেরি কোথায় হলো? যায় হোক লিখে দিয়ে এসেছি, আপনি এবার চলে যান মেহেরাজ ভাই। ”

মেহেরাজ শীতল দৃষ্টিতে চাইল। বলল,

“ তোর থেকে অনুমতি নিয়ে যাব নাকি? তাড়াতাড়ি রিক্সায় উঠ, তোর না তেরি হচ্ছে? ”

“হচ্ছে, কিন্তু এই রিক্সায় তো আপনিই এলেন তাই না? ”

ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন শুধাল মেহেরাজ,

“তো?”

“কিছ নয়। ”

কথাটা বলেই ধীর গতিতে রিক্সায় উঠে বসল জ্যোতি। পরক্ষনেই আবারও মেহেরাজও উঠে বসল সে একই রিক্সাতেই। জ্যোতি ভ্রু কুঁচকাল। দ্রুত দূরত্ব নিয়ে সরে বসে জিজ্ঞেস করল

“আপনিও যাবেন মেহেরাজ ভাই? ”

“যাচ্ছিই তো। দেখছিস না? ”

“ হু। ”

মৃদু স্বরে কথাটা বলেই জ্যোতি আরো কিছুটা সরে একদম কিনারায় বসল যেন। আর সেই দৃশ্য দেখেই মেহেরাজ ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল। শান্ত অথছ দৃঢ় গলায় শুধাল,

“ পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙ্গার প্ল্যান করছিস নাকি? আজব!তোর কি আমায় গা ঘেষাঘেষি করা টাইপ ছেলে মনে হয় নাকি বুঝলাম না? ”

.

তখন সন্ধ্যা। আঁধার আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ। জানালার এইপাশে বসে সেই চাঁদকেই দেখে গেল মেহু৷ অন্যমনস্ক হয়ে জ্যোতিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,

“জীবনে কার দিকে যাওয়া উচিত আমার? কার সাথে আমার জীবন জড়ানো উচিত জ্যোতি? আমি ক্লান্ত! প্রচুর ক্লান্ত!”

জ্যোতি বই ঘাটাঘাটি করছিল। হঠাৎ প্রশ্নে হাত থেমে গেল যেন। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে উত্তর দিল,

“ যার কাছে তুমি সবচেয়ে সুখী হবে তার দিকে। হতে পারে সেটা সাঈদ ভাই, আবার হতে পারে সেটা ঐ ডক্টর। ”

মেহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিল,

“ সাঈদ ভাইয়া আমায় ভালোবাসে না জ্যোতি। ”

জ্যোতির দুঃখ হলো। কিন্তু দুঃখ প্রকাশ করল না। শান্ত গলায় বলল,

“শেষবার একবার কথা বলে দেখতে কি ক্ষতি আপু? বলে দেখো না কথা একটিবার। প্লিজ! ”

“কথা বললেই কি সমাধাণ মিলবে? ”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যোতিও। শূণ্য আকাশে তাকিয়ে জবাব দিল,

“জানা নেই, তবে এটা চেষ্টা মাত্র।চেষ্টা করতে তো নিষেধ নেই বলো? ”

মেহু মেনে নিল এবারে। সহমত পোষণ করে বলল,

“হু! ”

কথাটা বলেই মোবাইল হাতে নিয়ে কল দিল সাঈদকে। একবার, দুইবার, তিনবার অনেকবার কল দিল। অন্যদিকে অপরপাশের সাঈদ ইচ্ছে করেই কলগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাল। যদি ফের কথা বললে মেহুর প্রতি দুর্বল হয়ে যায়? ফের যদি প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তার অনুভূতির? তাই তো যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাল। কিন্তু শেষ রক্ষে হলো কি? সেই তো কল তুলতেই হলো। আর তখন ওপাশ থেকে মেহুর গলা ভেসে আসল,

এতবার কল দিয়েছি। কল তুলছিলেন না কেন? ”

সাঈদ চোখ বুঝল সঙ্গে সঙ্গে। মিথ্যে ব্যস্তা দেখিয়ে মুহুর্তেই একটা মিথ্যে বলে বসল,

“আমি ব্যস্ত আছি মেহু। কিছু বলবে? ”

মেহু উত্তর দিল,

“হ্যাঁ কিছু কথা আছে আপনার সাথে সাঈদ ভাইয়া। ”

“ বলে ফেলো তাড়াতাড়ি, আমার কাজ আছে। ”

মেহু এবারে চুপ হয়ে গেল। ঠোঁট চেপে কিয়ৎক্ষন নিরবতার পর বলে উঠল,

“আমার সাথে কি দেখা করতে পারবেন একটু? একবার। ”

সাঈদ চোখ মেলে চাইল এবারে। ইচ্ছে করেই দেখা করার প্রস্তাবটা নাকোচ করতেই বলে উঠল,

“স্যরি মেহু, কাজ আছে বললাম তো। দেখা করাটা হয়ে উঠবে না বোধহয়। ”

মেহু ফের বেহায়ার মতো বলল,

“একবার! প্লিজ একবার সাঈদ ভাইয়া। আপনি অফিস থেকে ফেরার সময় দেখা করলেও হবে। প্লিজ! ”

সাঈদ চাপা শ্বাস ফেলল। মনে মনে কষ্ট চেপে গলায় খুশ ভাব আনার চেষ্টা করেই শুধাল,

“হঠাৎ এত দরকার? কি ব্যাপার বলো তো মেহু? ”

“কিছুই না, আপনি আসবেন না?”

সাঈদ ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল,

“আসব। ”

“সত্যিই আসবেন তো? আপনি সময় বলেন। আমি হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াব। ”

সাঈদ হাসার চেষ্টা করল। কৌতুক স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“ বিয়ের দাওয়াত দিবে নাকি মেহু? ”

“না, এমনিই কথা আছে তাই। ”

#চলবে….

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-১২+১৩

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_১২
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

সময় চলল নিজস্ব গতিতে। আজ জ্যোতির বাবাকে হসপিটাল থেকে ছাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। তাই মিথি আর তার ছোট আম্মাও সব গোঁছগাছ করে হাজির হলো হসপিটালে। মিথি চঞ্চল স্বভাবি৷ ইতোমধ্যেই এক দুইবার হসপিটাল ঘুরে মেঘকে খুঁজে ফেলেছে। শুধু যে আজই খুঁজছে এমন নয়। এই দুই তিনদিনে সে নিয়মিত খুঁজেছে মেঘকে। দেখা ফেলেই নিজ থেকে লাফিয়ে গিয়ে কথা বলে এসেছে।কেন জানি না লোকটার কথা বলার ধরন হতে, চলাফেলা, ভদ্র স্বভাব সবটাই তার মন কাড়ল। তাই তো এই অল্প সময়েও সে এতবার নিজ থেকে খুঁজেছে এই লোককে, কথা বলেছে, হেসেছে। সে জানে এটা তার কিশোরী বয়সের সাময়িক ভালোলাগা! তবুও সবটা জেনেশুনেই সে ভালোলাগাকে বাঁধা না দিয়ে প্রশ্রয়ই দিয়ে গেল সে। আজও ব্যাতিক্রম হলো না।সকাল থেকে দুই চারবার খুঁজে অবশেষে হসপিটালের বাইরেই দেখা মিলল মেঘের।সাথে সেদিনের ছোট্ট বাচ্চাটা আর একটা বোরকা পরিহিত মেয়ে।মিথি অবশ্য কথায় কথায় মেঘের থেকে বাচ্চাটার নামও জেনে নিয়েছে। সানশাইন!নিঃসন্দেহে মিষ্টি নাম। মিথি আর দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়েই গাল টিপল সানশাইনের। পরক্ষনে ভালো করে তাকিয়ে বুঝল তার পরনে স্কুল ড্রেস। বোধহয় স্কুলেই যাচ্ছে। প্রশ্ন ছুড়ল হাসি হাসি গলায়,

“ হেই কিউটবাচ্চা, কেমন আছো? স্কুলে যাচ্ছো তুমি? ”

বাচ্চাটা আজও সেদিনের মতো গোলগোল চোখ করে তাকাল মিথির দিকে। স্বভাবে সে মেঘের মতোই গম্ভীর বলা চলে। মিথির এই গম্ভীর স্বভাবটাই কেন জানি ভালো লাগে খুব করে।আর বোধহয় এই কারণেই এই অল্প সময়েও সে মেঘের প্রতি ভালো লাগা অনুভব করল।মিথি হাসল। সানশাইনের উত্তর না পেয়ে হেসে পুনরায় আবারও বলল,

“আমি মিথি। মনে নেই? ঐদিন দেখা হয়েছিল তো। দেখোনি তোমার পাপার সাথে?”

সানশাইন এবারেও উত্তর দিল না। বরং গাল ফুলিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে থাকল। মিথিও এবারে গাল ফুলিয়ে নিল।কথা বলার উদ্দেশ্যে সানশাইনের নাম জানা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করল,

” আচ্ছা, তোমার নাম কি বলো?”

মিথি ভেবেছিল এবারে উত্তর আসবে সানশাইনের থেকে। কিন্তু তাকে হতাশ করে দিয়ে এবারেও উত্তর এল না। অপরদিকে মেঘ এতক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁগিয়ে এসব দেখলেও এবারে গিয়ে বিরক্ত হলো।তার ধারণা মিথি নামক মেয়েটা আসলেই বেশি বেশি কথা বলে। এই কটাদিন সে এটা স্পষ্টভাবে খেয়াল করেছে।আজও ব্যাতিক্রম হলো না তার খেয়াল করার। কিন্তু বিষয়টা হলো তার আবার এমন বকবক করা মেয়ে পছন্দ নয়। সে বরাবরই চুপচাপ স্বভাবী, শান্ত মেয়ে পছন্দ করত। তাই তো এবারেও বিরক্ত হলো। কপালে ভাজ তুলে বলল সে,

“ ওর নাম সানশাইন বলেছিলাম একবার।ভুলে গেছো?”

মেঘের বিরক্তিকে ছাপিয়ে গিয়ে মিথি দ্বিগুণ বিরক্ত হলো যেন। চোখমুখ কুঁচকে বলে উঠল,

“ আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি আমি?আপনি কেন কথা বলছেন?আশ্চরায!ওকে জিজ্ঞেস করেছি না আমি?”

মেঘ ঠোঁট চেপে শ্বাস ফেলল। গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

“ তো তুমি কি ওর সাথে আড্ডা দিবে এখন?”

মিথি ভ্রুকুটি করে তাকাল মেঘের দিকে। বিরক্তির শীর্ষে পৌঁছে যাওয়ার ভঙ্গি দেখিয়ে বলে উঠল,

“কি আশ্চর্য ডক্টরসাহেব।আপনার সাথে কথা বলছি আমি? বলছি না তো। আপনি চুপ থাকুন দয়া করে। ”

মেঘের মুখ থমথমে হয়ে এল এবারে অপমানে। তার চেয়ে প্রায় সাত বছরের ছোট হয়েও তার মুখের উপর কিভাবে কথা বলছে এই মেয়ে। কোনরকমে দাঁতে দাঁত চেপে সেই অপমানটা সহ্য করতেই মিথি ফের চঞ্চল গলায় শুধাল,

“হেই সানশাইন, কথা বলছো না যে? পছন্দ হয়নি আমায়? আমি কি খারাপ? খারাপ না তো,কথা বলো প্লিজ।দুঃখ পাচ্ছি তো আমি।”

এবারে বোরকা পরিহিত মেয়েটা হাসল কিঞ্চিৎ। অল্প ঝুঁকে সানশাইনকে বলে উঠল,

“কি হলো কথা বলছো না কেন সানশাইন? ও তো খুব মিষ্টি দেখতে দেখো? একদম তোমার মতোই। তোমার বন্ধু হিসেবে পার্ফেক্ট না ও?আম্মু বলছি, ওর সাথে কথা বলো।”

সানশাইন এবারে মাথা নাড়াল হঠাৎ। মিথি আশা নিয়ে গোলগোল করে তাকাল। বুঝল পাশের মেয়েটা মেঘের ভাবি অর্থ্যাৎ সানশাইনের মা।মায়ের কথা নিশ্চয় ফেলবে না সে?এবারে নিশ্চয় কথা বলবে।কিন্তু ফের হতাশ করে সানশাইন তার আম্মুকে বলে উঠল,

“ ওর নাম কি আম্মু? ”

মিথি এবারেও গোল গোল চোখ করে চাইল। নিজ থেকেই গদগদ স্বরে উত্তর দিল,

“মিথি। মিথি আমার নাম।”

সানশাইন গাল ফুলিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ ও তো বড়, ওর সাথে ফ্রেন্ডশীপ কিভাবে হবে আমার? ”

মিথি এবার কাঁদো কাঁদো ভাব নিল। সানশাইনের মায়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,

“ আপু, ও কি আমায় ইগ্নোর করছে? আমায় জিজ্ঞেস না করে আপনাকে কেন জিজ্ঞেস করছে ও?”

হেসে উঠল এবারে সানশাইনের মা। মিথি মেয়েটাকে তার এই কয়েক মিনিটেই বেশ মনে ধরল যেন। হেসেই উত্তর দিল,

“ তেমন নয়। ও আসলে অপরিচিত বলেই কথা বলছে না তোমার সাথে।পরিচিত হলে মিশে যেত এতোটা সময়ে। ”

মিথি ঠোঁট উল্টে বলল,

“আচ্ছা,আজ তো চলে যাব। পরে কোন সময় ঠিক পরিচিত হয়ে নিব। হুম সানশাইন? তখন কিন্তু বন্ধু হবে আমার। ওকে?”

সানশাইন এবারে কথা বলল।কপাল কুঁচকে ঠোঁট নেড়ে শুধাল,

“ তুমি এমন হাসো কেন খালি? ”

মিথি মিষ্টি করে হেসে উত্তে দিল,

“তোমার কথা শোনার অপেক্ষায়। ”

সানশাইন বিশেষ গুরুত্ব দিল না যেন। ফের গাড়িতে উঠে বসে বলল,

“ আমি তো এখন স্কুলে যাব। তোমার সাথে কথা বলা হবে না। ”

মিথি গাল ফুঁলিয়ে শ্বাস ফেলল। কিছুটা সময় পর অবশ্য সানশাইন আর তার মা চলে গেল চোখের সামনে দিয়ে। মিথি সেদিক পানে একবার তাকিয়ে এবার মেঘের দিকে তাকাল।হতাশার স্বরে বলল,

“আপনি কি জানেন সানশাইন আপনার মতোই স্বভাবী? ”

মেঘ ভ্রু কুঁচকাল। একনজর মিথির দিকে তাকিয়ে ফের নজর সরাল। পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,

“নাহ তো, জানতাম না। তোমার থেকে জানলাম মিথি। ”

মিথি লাফিয়ে মেঘের পিছু পিছু পা বাড়াল। চঞ্চল গলায় শুধাল,

“ আপনার বাচ্চা হলেও কি সে আপনার মতোই গম্ভীর হবে ডক্টরসাহেব?ধরুন আপনার ডজনখানেক বাচ্চা হলো, আর সবাইই আপনার মতোই মুখ গোমড়া করে সবসময় বসে থাকবে। ভাবতে পারছেন বিষয়টা কি সাংঘাতিক?আপনি বরং এখন থেকেই নিজেকে পাল্টে ফেলুন ডক্টরসাহেব।”

মেঘের হঠাৎই হাসি ফেল মেয়েটার কথাতে। মেয়েটার বোকাবোকা কথা গুলো সত্যিই হাস্যকর। তবুও অবশ্য হাসল না সে। হাসি চেপে গিয়৷ বিড়বিড় করে শুধাল,

“ বাচ্চার মায়েরই দেখা নেই জীবনে, আবার বাচ্চা!”

বিড়বিড় করে বললেও মিথি শুনে নিল। বলে উঠল,

“ উহ! এত অধৈর্য্য হওয়ার কি আছে?বাচ্চার মাও আসবে, বাচ্চাও আসবে।তবে সঠিক সময়ে। বুঝলেন ডক্টরসাহেব?”

মেঘ ঘুরে তাকাল।ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ তুমি কিসে পড়ো মিথি? এতো পাকাপাকা কথা কে শেখায় তোমায়?”

“ কি আশ্চর্য!ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি বুঝলেন? এমন বয়সী মেয়েরা কি অবুঝ হয়? যদি অবুঝ ভেবেও থাকেন তবে বুঝবেন সে ভান করছে। বুঝলেন? ”

“ তুমি যে বেশি কথা বলো জানো?”

“ বেশি কথা?আমি কি বাচাল? আমি তো আপনার মুখ ভার দেখেই মন ভালো করার জন্য বেশি বেশি কথা বলছি। আপনি এটাকে বেশি কথা বলা ভেবে নিলেন?আজকাল মানুষের ভালোও করতে নেই।”

মেঘ ফের গম্ভীর গলায় বলল,

“ অপ্রয়োজনীয় কথা বলো। ”

মিথিও এবারে চঞ্চল গলা থেকে গলাটা গম্ভীর করল। মৃদু আওয়াজে উত্তর দিল,

“ সবসময় প্রয়োজনের কথাই বা বলতে হবে কেন বলুন? জীবন কি শুধু প্রয়োজনের জন্যই ঝুলে থাকে পৃথিবীতে? ”

মেঘ ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,

“বাহ!বড়দের মতোও কথা বলতে পারো তুমি?”

মিথি ছোট বাচ্চাদের ন্যায় গাল ফুলাল। বলল,

“কেন পারব না?যায় হোক, ভালো থাকবেন ডক্টরসাহেব। আজকের পর আপনার সাথে দেখা হবে কিনা জানা নেই বুঝলেন?এইজন্যই আমি আপনাকে সকাল থেকে খুঁজে খুঁজে হাফিয়ে গেছি।”

মেঘ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“এতো খুঁজার কি আছে? ”

মিথি ফিক করে হেসে দিল। বলল,

“না খুঁজলে আপনার এই সুন্দর রূপখানা দেখা হতো বলুন?”

মেঘ বিরক্ত হলো। কপাল কুঁচকে এবারে উত্তর না দিয়ে পা বাড়াল। মিথির থেকে আরো কয়েক কদম পেরিয়েও গেল মুহুর্তেই। মিথি পেছনে দাঁড়িয়েই বলে উঠল আবারও,

“ডক্টরসাহেব শুনুন?আপনাকে কিন্তু সাদা এপ্রোনে সত্যিই দারুণ লাগে বুঝলেন? ”

মেঘ শুনল ঠিক। তবে ফিরে চাইল না। এসব কিশোরী মেয়েদের এমন পাগলামো সম্পর্কে সে অবগত বলেই এসবকে আর বিশেষ পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করল না৷ সে তো ভালোবাসেই একজনকে৷ তবুও অন্যজনের ভালো লাগাকে পাত্তা দেওয়ার মানে হয়?এসব ভাবতে ভাবতে হসপিটালে ডুকতে দেখা মিলল মেহুর সাথে। ফের বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠল। চেপে রাখা দুঃখ যেন জেগে উঠল। মেঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।পা বাড়িয়ে বলল

“মেহু?কেমন আছো?”

মেহু অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছিল। হঠাৎ কারো গলা শুনে তাকাল। বলল,

“ হু?আছি, ভালো আছি।আপনি? ”

মেঘ কৌশলে প্রশ্নরটা এড়িয়ে গেল। এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে বলল,

“ মেহেরাজ ভাই এসেছে? দেখছি না যে?কোথায়?”

মেহুও চোখ বুলাল এদিক ওদিক। বলল,

“আছে বোধহয় কোথাও। জ্যোতি, মিথি,চাচা চাচী সবাই ই তো গ্রামে ফিরবে।সাথে বোধহয় ভাইয়াও যাবে।”

মেঘ ছোট করে উত্তর দিল,

“ওহ।

.

হসপিটালের বাইরেই মেহেরাজের দেখা মিলল। জ্যোতি গিয়ে দাঁড়াল মেহেরাজের সামনে। মৃদু আওয়াজে বলে উঠল,

“ আপনাকে কষ্ট করে যেতে হবে কেন মেহেরাজ ভাই? আপনার যাওয়ার প্রয়োজন নেই।আমরা তো যেতেই পারব।”

মেহেরাজের মেজাজ যেন আগে থেকেই খারাপ ছিল। এহেন কথা শুনে মেজাজটা আরো খারাপ হলো বোধহয়। তবুও পকেটে হাত ডুকিয়ে শীতল গলায় জিজ্ঞেস করল,

“আমার প্রয়োজন অপ্রয়োজন কি তুই ঠিক করে দিবি জ্যোতি? ”

জ্যোতি থতমত খেল। উত্তরে বলল,

“ সেভাবে বলতে চাইনি, কিন্তু আপনার এখানে কাজ ফেলে আমাদের সাথে যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজনও তো নেই। তাই না?না গেলে তো আপনারই সুবিধা হবে।”

মেহেরাজ গলা গম্ভীর। অন্যদিকে ফিরে শুধাল,

“আমার সুবিধাটা আমি ভালো বুঝব নাকি তুই ভালো বুঝবি? ”

জ্যোতি এবারে উত্তর দিল না। হুট করেই মনে হলো মেহেরাজ ভাই রেগে আছে।কিন্তু কেন রেগে থাকবে?সে কি খারাপ কিছু বলেছে?প্রশ্ন করল,

“ আপনি কি রেগে আছেন মেহেরাজ ভাই? আমি কি রেগে যাওয়ার মতো কিছু বলে ফেলেছি?”

মেহেরাজ আগের মতোই অন্যদিকে ফিরে থাকল। বিরক্তির সুরে বলে উঠল,

“ ভেবে দেখ তুই। ”

জ্যোতি ভেবে দেখল। উত্তর দিল,

“ আমার ভেবে দেখা বলছে আমি তেমন কিছু বলিনি।”

মেহেরাজ এবার ত্যাড়া চাহনিতে একনজর তাকাল জ্যোতির দিকে। শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল,

“আমার ভেবে দেখা বলছে তুই তেমন কিছু বলেছিস। একবার নয়, বারংবার!”

“ কি বলেছি?”

“ সেসব জেনে তোর বিশেষ লাভ হবে? ”

জ্যোতি শান্তস্বরে উত্তর দিল,

“না। তবে কৌতুহল জাগল তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

মেহেরাজ ভ্রু নাচাল। বলল,

“ অতি কৌতুহল ভালো নয় জ্যোতি।দেখা গেল কৌতুহলের বশে তুই গভীর কোন সত্য জেনে গেলি। সেক্ষেত্রে তো ক্ষতিটা আমারই তাই না?”

কথাটা বলেই ফের বলে উঠল,

”সর সামনে থেকে। ”

জ্যোতি সরে গেল। মেহেরাজ অবশ্য আর দাঁড়াল না। দ্রুত চলে গেল তাকে পাশ কাঁটিয়ে।

.

সাঈদ রাস্তা দিয়ে এলোমেলো হয়ে হাঁটছিল বিকালে। হঠাৎই দেখা মিলল রাস্তার অপরপ্রান্তে হাঁটতে থাকা মেহুকে। চোখমুখ শুকনো।কেমন জানি মলিন চেহারা। সে ছুটে গেল, জিজ্ঞেস করল,

“মেহু তুমি? মুখচোখের এই হাল? ভালো আছো মেহু?”

মেহু চোখ তুলে চাইল। তাচ্ছিল্য নিয়ো শুধাল,

“ ভালো থাকব না কেন সাঈদ ভাইয়া? অবশ্যই ভালো আছি। ”

সাঈদ কথা বলার জন্য আকুল হলো। ফের বলল,

“আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করলে না যে?”

ফের তাচ্ছিল্যমাখা উত্তর এল,

“ভালোই তো থাকবেন তাই না?খারাপ থাকার তো কোন কারণ নেই। ”

সাঈদের গলা নিষ্প্রভ। উত্তর দিল,

“ তা ঠিক।তবে খারাপ থাকার কোন কারণ না থাকা সত্ত্বেও আমি ভালো থাকতে পারছি না। ”

মেহু ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

“ কেন? ”

সাঈদের নিষ্প্রভ গলা হঠাৎই উৎফুল্লময় হয়ে উঠল। নিজের দুঃখ চেপে রেখে চঞ্চল স্বরে শুধাল,

“ এই যে তুমি বিয়েটা করছো না?দাওয়াত খেতে পারছি না তো। তাছাড়া তুমি বিয়ে করলে বিয়েতে কতগুলো মেয়ে পটাতে পারতাম ভেবে দেখেছো একবারও? সেসবও তো ভেস্তে দিলে! ”

মেহু হাসল কিঞ্চিৎ। বলল,

“ আপনার জীবনে তো মেয়ের অভাব নেই সাঈদ ভাইয়া। তবুও মেয়েদের জন্য মন খারাপ করাটা হাসির ব্যাপার। ”

সাঈদ ফের মেকি দুঃখ দেখিয়ে নিয়ে বলল,

“ তুমিও তো আজকাল আর পাত্তা দিচ্ছো না মেহু। কত কষ্ট পাচ্ছি জানো? ”

মেহু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। বলল,

“ আমার পাত্তা না দেওয়াতে কষ্ট পাচ্ছেন? হাস্যকর! আপনার জীবনে এত এত মেয়ের ভীড়ে আমি কিছুই নই সাঈদ ভাইয়া।ভালো থাকুন, আমার কিছু কাজ আছে।যেতে হবে।”

কথাটা বলেই যত দ্রুত সম্ভব সাঈদকে পাশ কাঁটিয়ে চলে গেল মেহু। সাঈদ তাকিয়ে রইল তার যাওয়ার দিকে। বুকের বা পাশে হাত রেখে সেদিকে তাকিয়ে থেকেই বিড়বিড় করে বলে উঠল,

“ এত মেয়েদের ভীড়েও আমি কেবল তোমাকেই খুঁজি মেহু৷ এত মেয়ের মাঝেও তুমিই কিন্তু আমার জন্য সব!বুঝলে না!”

#চলবে….

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_১৩
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

জ্যোতি বাড়ি এসেই দাদীর থেকে জানত পারল সবটা। মেহেরাজের সে বিয়ের প্রস্তাবের কথাটা। দাদীর থেকে আরো জানতে পারল দাদীও নাকি সেই প্রস্তাবে রাজি। শুধু তার মতামত নেওয়া বাকি! অথচ সে এতদিন কিছুই জানত না। জ্যোতি তপ্তশ্বাস ফেলল। কিয়ৎক্ষন বিষয়টা নিয়ে ভাবতেই মাথায় এল সামান্তার কথা। সামান্তার সাথে যদি মেহেরাজের কিছু থেকে থাকে তাহলে তার জন্য কেন বিয়ের প্রস্তাব দিল? আশ্চর্য! তৎক্ষনাৎ সে মোবাইলটা হাতে নিয়েই কল দিল মেহেরাজকে। অপেক্ষা করল ওপাশ থেকে কল তোলার। কিন্তু কল তুলল না মেহেরাজ। বরং কিয়ৎক্ষন পর নিজেই কল করল। জ্যোতি কল তুলেই সর্বপ্রথম বলল,

“ আপনি কোথায় মেহেরাজ ভাই? গ্রাম ছেড়ে শহরের জন্য রওনা দিয়েছেন? ”

গম্ভীর স্বরে উত্তরের বিনিময়ে প্রশ্ন ছুড়ল মেহেরাজ,

“কেন?”

“দেখা করব। সময় হবে আপনার? ”

ফের গম্ভীর গলায় উত্তর এল,

“ হবে৷ ”

জ্যোতি ছোট শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল,

“আপনি কি আপনাদের বাড়িতে?”

“হ্যাঁ। ”

“আমি আসছি তাহলে। ”

কথাটা বলেই জ্যোতি পা চালাল। কিয়ৎক্ষন পর পৌঁছেও গেল মেহেরাজদের বাড়িতে। নিচ থেকে মেহেরাজকে দেখা গেল ছাদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাই আর অপেক্ষা করল না। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গিয়ে মেহেরাজের সামনে গিয়েই দাঁড়াল৷ হাত ভাজ করে বলল,

“ দাদী বলেছে আপনি বিয়ের প্রস্তাব রেখেছেন। আপনি কি সত্যিই দাদীর কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন মেহেরাজ ভাই? ”

মেহেরাজ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে ছিল। কথাটা শুনে একদম স্বাভাবিকভাবেই তাকাল। যেন স্বাভাবিক একটা প্রশ্নই ছিল। ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,

“ তো আমার ভূত দেওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।”

জ্যোতি সরু চোখে তাকাল। শুধাল,

“ তার মানে দিয়েছেন?”

মেহেরাজ ডান ভ্রু উঁচু করল। প্রশ্ন ছুড়ল,

“দিয়েছি, তো? ”

জ্যোতি স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করল,

“কেন দিয়েছেন? ”

মেহেরাজ এই স্পষ্ট গলায় প্রশ্নটাকে পাত্তা দিল না। গা ছাড়া ভাব নিয়ে উত্তর দিল,

“মন চেয়েছে তাই। ”

“ মানে? ”

এবারে দাঁতে দাঁত চাপল মেহেরাজ। বিয়ের প্রস্তাব দিলে কি এত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়? আশ্চর্য! বিরক্তির স্বরে বলল,

“ মানুষ বিয়ের প্রস্তাব কেন দেয়? অবশ্যই বিয়ে করার জন্যই তাই না? ”

জ্যোতি এবারে সরু চোখে তাকাল। তার কাছে যেন বোধগম্য হলো না বিষয়টা। জিজ্ঞেস করল,

“ আপনি আমায় বিয়ে করতে চাইবেনই বা কেন? ”

মেহেরাজ ফের বিরক্ত হলো।ফোন পকেটে রেখে জ্যোতির দিকে দুই পা বাড়িয়ে হঠাৎই ঝুঁকে গেল। জ্যোতির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

“ তাহলে কি করতে চাইতাম? জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে?”

জ্যোতি স্পষ্ট চাহনি, স্পষ্ট কথা হঠাৎ নড়চড় হলো যেন। দ্রুত দুই পা পিঁছিয়ে বলে উঠল,

“ আমি সেভাবে বলতে চাইনি মেহেরাজ ভাই।”

জ্যোতির কাজ দেখে মেহেরাজ চাপা হাসল এবারে। অন্যদিকে তাকিয়ে ভরাট গলায় বলে উঠল,

“ তো এখানে কেন এসেছিস? বিয়ে করবি না, বিয়েতে রাজি নোস এসব বলতে? শোন জ্যোত তুই রাজি হলেও বিয়েটা হবে, না হলেও হবে। এসব বলে লাভ নেই। ”

জ্যোতি নাবোধক মাথা দুলাল, যার অর্থ সে এসব বলতে আসেনি। জবাব দিল,

“আমি এসব বলতে আসিনি। ”

ভ্রু নাচিয়ে বলল,

“তাহলে তুই বিয়েতে রাজি এটা বলতে এসেছিলি? ”

“সামান্তা আপুর সাথে আপনার সম্পর্ক ছিল তো মেহেরাজ ভাই? তাহলে হঠাৎ আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব কেন? ”

মেহেরাজ গম্ভীর চাহনিতে তাকাল। হাত ভাজ করে উত্তর দিল,

“সামান্তার সাথে আমার যে সম্পর্ক আছে তাতে তো বিয়ের মতো কোন সম্ভাবনা দেখছিনা আমি,আর তোকে বিয়ের প্রস্তাব না দেওয়ারও কোন বিষয় চোখে পড়ছে না। তো?তুই কি এই বিষয়টা জানার জন্যই লাফিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসলি? আশ্চর্য! ”

কথাটা বলেই বিরক্তে কপাল কুঁচকাল মেহেরাজ। মুহুর্তেই পা বাড়িয়ে দ্রুত পাশ কাঁটিয়ে গেল জ্যোতিকে। জ্যোতি তখনই স্থির দাঁড়িয়ে। আধো স্পষ্ট উত্তর কি দিয়ে গেল মেহেরাজ ভাই?

.

সাঈমা নামের মধ্যবয়স্কা মহিলাটির পরনে সবুজ রাঙ্গা একটা শাড়ি আর কালো রাঙ্গা শাল। দেখতে তাকে এখনো কমবয়সী রমণীদের মতোই সুন্দরী বোধ হচ্ছে৷ অবশ্য বাহ্যিক রূপের দিক দিয়ে তাকে দেখে বোঝা যায় ও না তার সাঈদের বয়সী একটা ছেলে ও আছে। নিঃসন্দেহেই বলা চলে সে অতি সুন্দরী! শুধু যে সুন্দরী তাই নয়, রূপের দিক দিয়ে সে সত্যিই অপরূপা। আর বোধহয় সে রূপের কারণেই একই নারীতেই দুইভাই আসক্ত হয়েছিল গভীর ভাবে।একজন ছিল রমণীর সবচেয়ে কাছের বন্ধু, অপরজন ছিল সে বন্ধুরই বড়ভাই।ভাগ্যের খেলায় ভার্সিটিতে পড়ার সময়ই তার বিয়ে হলো সে কাছের বন্ধুরই বড়ভাইয়ের সাথে। অন্য পরিচয় বললে রায়হান সাহেব অর্থাৎ সাঈদের বাবার সাথে। কিন্তু বিয়েটা বোধহয় তার জন্য সুখকর হলো না। সেই বিয়ের পরই হুট করে উপলব্ধি করল সে তার কাছের বন্ধুকেই ভালোবেসেছিল নিজেরই অজান্তে।তারপরই শুরু হলো সাংসারিক অশান্তি।রায়হান নামের মানুষটার সাথে স্বাভাবিক ভাবে বৈবাহিক সম্পর্ক, শারিরীক সম্পর্ক গড়ে উঠলেও বোধহয় মন থেকে মেনে নিতে পারল না সে রায়হান সাহেবকে। এর মাঝেই জম্ম নিল ছোট্ট সাঈদ।দেখতে বোধহয় ছেলেটা তার মতোই ফর্সা আর সুদর্শন হয়েছে। তাকে দেখলে যেমন আর পাঁচ-দশটা ছেলে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকত তো তাকিয়েই থাকত ঠিক তেমনই তার ছেলেটাকেও মেয়েরা গিলে খায় চোখ দিয়ে। ছেলেটা রূপে তার মতোই সুন্দর ভেবে সাঈমা মনে মনে অল্প হাসল। কিন্তু মনের দিক থেকে কি আধৌ তার মতো? নিশ্চয় না। এত ভালোবাসা পাওয়ার পরেও তার ছেলে নিশ্চয় তার মতো করে কাউকে ঠকাবে না?সমুদ্রসমান ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে নিশ্চয় বিন্দু সমান ভালোবাসার পেঁছনে দৌড়াবে না মনকে প্রশ্রয় দিয়ে? সাঈমা চোখ বুঝে রাখল এসব ভেবেই। কেন জানি না হঠাৎই তার মনে হচ্ছে এই বৃহৎ জীবনে সে একা! কেবলই একা!সে বহুকাল আগে রায়হানকে ঠকিয়ে সম্পর্কে জড়িয়েছিল রায়হান সাহেবেরই ছোটভাই, অন্যদিকে নিজেরই কাছের ছেলে বন্ধু রাশেদ সাহেবের সাথে। রায়হানের অনুপস্থিতিতে একই বাড়িতে অবাধ মেলামেশাও করেছিল রাশেদের সাথে।কতদিন ছোট অবুঝ সাঈদের সামনেই দুইজন দুইজনকে চুমু খেয়েছিল, জড়িয়ে ধরিয়েছিল। এমনকি সবচেয়ে জঘন্যতম পাপ হিসেবে প্রেমে অন্ধ হয়ে শারিরীক সম্পর্কেও জড়িয়েছিল সে৷ তখনকার ছোট সাঈদ মায়ের সাথে তার চাচার এই অবাধ মেলামেশা, জড়িয়ে ধরা,চুমু খাওয়ার অর্থ না বুঝলেও এখন তার কাছে সেসবের অর্থ স্পষ্ট। সে দেখেছে মা চলে যাওয়ার পর বাবা কতোটা কষ্টে কাঁটিয়েছে একেকটা দিন, একেকটা রাত। সে দেখেছে বাবার চোখের পানি। সে বুঝেছিল তার বাবা কতোটা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছিল এই সাঈমা নামক মহিলাটিকে। অথচ দিনশেষে তার বিনিময়ে সে নিজের ভালোবাসার রমণীর থেকে পেল কেবল প্রতারণা, ছলনা!তার বাবা বোধহয় আজও এই মহিলাটিকে ভালোবাসে। নয়তো কেন এই মহিলা দেশে ফিরলে এই বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও কিছু বলে না? কেন এইটুকুও অসম্মান করে না এই মহিলাটাকে? এতোটা সম্মান কি আসলেই এই মহিলার প্রাপ্য? প্রাপ্য নয়! এইটুকু সম্মানও তার প্রাপ্য নয় বোধ হয়।

সাঈমা নামের ভদ্রমহিলা বসা ছেড়ে উঠল এবারে।কয়েকদিন পরই আবার ফিরে যেতে হবে এ দেশ ছেড়ে অন্যদেশে। এইদেশে সাঈদের জম্মদিনের আগে আগেই প্রতিবছর ফেরেন তিনি। আর যায় হোক, সন্তানের প্রতি তার ভালোবাসাটা বোধহয় মিথ্যে নয়। তাই তো রায়হান সাহেবের কাছেও আকুতি মিনতি করে ছেলের সাথে সময় কাঁটানোর অনুমতি নিয়েছিল বছর কয়েক আগে। রায়হান সাহেব উনাকে সন্তানের মা হিসেবে সে অনুমতি দিতে দুইবারও ভাবেননি বোধহয়।ভদ্রমহিলা মাঝেমাঝে অনুতপ্ত হয়। মনে হয় তার আসলে রায়হান সাহেবকেই ভালোবাসাটা উচিত ছিল। এতোটা সহজ- সরল, এতোটা ভালোবাসতে পারা মানুষটাকে ঠকানো যায়? অথচ সে ঠকিয়েছে। জঘন্যতম ভাবে ঠকিয়েছে সে।

এসব ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসল। দু পা বাড়িয়ে সাঈদের রুমে গেলেন তিনি। রুমে না পেয়ে বেলকনিতে যেতেই দেখা মিলল। নরম গলায় বলে উঠলেন তিনি,

“ তোমার জন্য রান্না করেছি সাঈদ৷ খাবে না? ”

সাঈদ পিঁছু ঘুরে চাইল। মাথা চেপে চোখ বুঝল মুহুর্তেই। কেন জানি মা নামক মহিলাটিকে দেখলেই তার মাথায় আগুন জ্বলে৷ মেজাজ খারাপ হয়। চোখের সামনে ভেসে উঠে ছোটবেলায় মা-চাচার সে মাখোমাখো সম্পর্ক। সে সম্পর্ক অবশ্য উনাদের মতে ভালোবাসা, প্রেম নামে আখ্যায়িত হলেও সাঈদের চোখে তা একটা নোংরা সম্পর্ক, বিচ্ছিরি চিত্র ছাড়া কিচ্ছু নয়। তবুও সাঈদ রাগ নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা চালাল। বলল,

“ কেন রান্না করেন? বলেছি আমি আপনাকে?আপনার রান্না করা খাবার খাওয়ার থেকে না খেয়ে মরে যাওয়া ভালো নয়? ”

ভদ্রমহিলা হাসলেন মৃদু। বললেন,

“ তুমি আমার সন্তান হও। তোমার জন্য রান্না করা যায় না?”

সাঈদের রাগ যেন আকাশ ছুঁয়ে গেল। তবুও দাঁতে দাঁত রাগ নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা চালিয়ে বলল,

“ না যায় না, রান্না করবেন না। আমি আপনাকে ঘৃণা করি, শুধু এবং শুধুই ঘৃণা করি। বুঝতে পারছেন না? ”

ভদ্রমহিলা এবারে মৃদু হাসল৷ উত্তরে বলল,

“ তুমি আমায় ঘৃণা করো আর কবার বলবে পাগল ছেলে? জানি তো সেটা আমি৷ কিন্তু আমি তো তোমায় ভালোবাসি। মায়েরা কি তাদের ছেলেমেয়েদের ভালো না বেসে পারে সাঈদ? ”

সাঈদের মুখ টানটান হলো৷ চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল যেন। রাগে হাত মুঠো করে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন উত্তর ছুড়ে দেওয়ার আগেই তার মা নামক মহিলাটির ফোনে কল আসল। ভদ্রমহিলা ফোনের স্ক্রিনে তাকাল তৎক্ষনাৎ। সাঈদ সে দৃশ্য দেখে তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল। বলল,

“ আপনার প্রিয় প্রেমিক কল করেছে নাকি? আচ্ছা আপনার লজ্জ্বা করে না একবারও? কি করে এই মুখটা দেখান আপনি মিসেস সাঈমা? এক প্রেমিকের সাথে জীবন কাঁটাতে সব ছেড়ে পালিয়ে গেলেন, তারপর সে থাকা অবস্থাতেও আবার প্রাক্তন স্বামী-সন্তানের কাছেও ফিরে আসেন সন্তানস্নেহ দেখাতে। আশ্চর্য! এই সন্তানস্নেহ আগে কোথায় ছিল? আর আপনার বর্তমান স্বামীই বা কেমন মানুষ? আশ্চর্য! ”

সাঈদ কথাগুলো বলে আর একমুহুর্তও দাঁড়াল না। রুমের ভেতরে এসেই চোখের সামনে যা পেল তাই ছুড়ে মারল ফ্লোরে। রাগে দুঃখে চোখ লাল করে নিজের চুল টেনে ছেড়ার প্রচেষ্টা চালাল। কিছু্টা সময় আগেও সে মেহুর কথাই ভাবছিল। মেহুর ভালোবাসার আকুতি,চোখের দৃষ্টি! একবার মনে মনে ভেবেছিলও বোধহয় মেহুর অনুভূতিকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা। কিন্তু এই মুহুর্তে এসে আবারও সেই ভাবনা বাতিল করল সে৷ সে মেয়েজাতিকে ঘৃণা করে।এসব সম্পর্কে ঘৃণা করে।শুধু এবং শুধুই ঘৃণা! যদি মেহুও ঠকিয়ে যায় তাকে? তার পরিণতিও কি তার বাবার মতোই হবে?বাবার মতোই মৃতের মতোই বাঁচতে হবে তাকে?সাঈদ চোখ বুঝল। সে প্রশ্রয় দেবে না, কিছুতেই না। দূরে পালাতে হবে তাকে, মেহুর থেকে অনেকটা দূরে। কিশোর বয়সের মতো প্রেম-ভালোবাসায় অস্থিরতা তাকে মানায় না। মেহু যখন সত্যিই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার থেকে তারও উচিত মেহুর দিকে না ঝোঁকা।একটুও না!

.

গভীর রাত। মেঘের চোখে ঘুম নামল না। অস্থিরতায় ছটফট করল প্রতিটা মুহুর্তে। যন্ত্রনা!বুকের ভেতরে জ্বলন্ত দহনের যন্ত্রনা। নিজেরই ভালোবাসার মানুষ অন্য কাউকে ভালোবাসে এটা জানার পর অবশ্য যন্ত্রনা না হওয়াটা অস্বাভাবিক। মেঘ আজও ঘুমাতে পারল না তাই। যন্ত্রনায় ছটফট ছটফট করতে করতেই হঠাৎ মোবাইলটা হাতে নিল। অস্থিরতা কমাতে মেহুর নাম্বারে ম্যাসেজ দিল,

“ আমি এসেছিলাম সুখ কুড়াতে।
কে জানত তুমি আমায় এতোটা দুঃখ উপহার দিবে?এমনটা জানা থাকলে তো আমি কখনোই তোমাকে আমার সাথে জড়ানোর চিন্তা করতাম না। কখনোই না৷ আমার সুখটাই কেড়ে নিলে যে তুমি। এই নিষ্ঠুর তম কাজটা করার আগে কি একবারও ভাবতে পারতে না তুমি? কেন ভাবলে না আমার কথা? ”

অপরপ্রান্তে মেহুর চোখেও তখন ঘুম নেই। হঠাৎ ম্যাসেজ টোন শুনে মোবাইলে হাতে নিয়ে দেখল সেই আননোন নাম্বারটা। হঠাৎই কেন জানি নিজের অজান্তেই মেঘের নামটাই মাথায় আসল। অস্ফুট স্বরে বলল,

“মেঘ! ”

ঠিক তখনই সে নাম্বারটায় কল করল মেহু। ওপাশে অস্থিরতায় ছটফট করা ব্যাক্তিটা কল তুলতে দেরি করল না অবশ্য। কিন্তু কল তুলেও নিশ্চুপ থাকল। অপেক্ষা করল নিজের ভালোবাসার রমণীর কণ্ঠ শোনার। ঠিক তখনই মেহু বলল,

“ আপনি মেঘ, তাই না? ”

মেঘ উত্তর দিল না। চুপচাপ শুনে উপলব্ধি করল মেহুকে৷ চোখ বুঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই ফের কানে আসল মেহুর কন্ঠ,

“ হ্যালো, শুনছেন আপনি? ”

মেঘ ধরে আসা গলায় উত্তর দিল,

“শুনছি।”

“আপনি মেঘ?”

“হ্যাঁ। ”

মেহু ফের প্রশ্ন করল,

“ পরিচয় গোপণ রেখে ম্যাসেজ দিতেন কেন? ”

মেঘের আহত গলায় উত্তর আসল,

“ পরিচয় দিয়ে প্রেমবাক্য শোনানোর তো অনুমতি নেই মেহু।যায় হোক, ঘুমাওনি এখনো? ”

“ না, আপনি ও তো ঘুমাননি। ”

মেঘ আবারও নিশ্চুপ হয়ে গেল। কিয়ৎক্ষন নিরব থেকেই হঠাৎ আকুল স্বরে বলে উঠল,

“ মেহু? আমি পারছি না। আমি সত্যিই পারছি না। আমায় কি একটিবার সুযোগ দেওয়া যায় না মেহু? তোমার হৃদয়ে এইটুকুও ভালোবাসা কি আমার নামে হবে না? প্লিজ!আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো ভাবলেই। আমি বাঁচতে পারছি না মেহু। বাঁচতে পারছি না।যাকে নিয়ে সবটা স্বপ্ন সাঁজিয়েছিলাম তাকে ভুলা এতোটাই সহজ? আমি সত্যিই পারছি না। প্রতিটা মুহুর্তই মৃত্যুযন্ত্রনা অনুভব করছি আমি মেহু। ”

মেহু কেঁপে উঠল ওপাশের আকুল স্বর শুনে৷ লোকটা কি কাঁদছে? ছেলেমানুষ হয়েও লোকটা কাঁদছে?তার জন্যই কাঁদছে? মেহু শুকনো ঢোক গিলল এবারে। সেও তো নিরুপায়। সত্যিই নিরুপায় সে। তারপর হঠাৎই মনে পড়ল নিজেরই সেদিনকার আকুল হয়ে সাঈদের কাছে ভালোবাসা ভিক্ষে চাওয়ার কথা! স্নরণে এল সেদিনকার যন্ত্রনা, কান্না সবটাই! মেঘেরও কি একই কষ্টটাই হচ্ছে এখন? নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তারই মতো? মেহুর শ্বাস ঘন হলো ক্রমশ। ওপাশের লোকটার আকুল স্বর শোনা সত্ত্বেও কোন উত্তর না দিয়ে কাঁপা হাতে দ্রুত কল কাঁটল সে৷

#চলবে…

এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-১১

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_১১
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

ব্যস্ততায় আর চিন্তায় নির্ঘুমভাবে কাঁটল আরো চারটে রাত। জ্যোতির বাবার অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে চারদিন আগেই।অবশ্য সেদিনই গ্রাম থেকে ছুটে এসেছিল ছোট মিথি, তার দাদী এবং তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীও।এই চারটে দিন হসপিটাল ছাড়া বাকিটা সময় নাবিলাদের বাসাতেই থেকেছেন উনারা। জ্যোতির বাবা যদিও এখন আগের থেকে সুস্থ তবুও হসপিটাল থেকে ছাড়ানে হয়নি। ধারণা অনুযায়ী আর তিন চারদিন পরই হসপিটাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবেন উনাকে। মিথি অবশ্য এই কটা দিন বাবার খুব কাছে কাছেই ছিল। যেন বাবার একদম বাধ্যগত আদর্শ মেয়ে। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না। হসপিটালে রাতের বেলায় মিনার থাকলেও সকাল সকালই মেহু আর জ্যোতির সাথে হসপিটালে এসে উপস্থিত হয়েছে মিথিও। শর্ত ছিল সে বাবাকে দেখে মিনারের সাথে ফের মেজেরাজদের বাসায় ফিরে যাবে। সে শর্তানুযায়ী বাবাকে একবার দেখে নিয়ে মিনারের সাথে বেরিয়েও গেল। কিছুটা দূরে এসে রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে হঠাৎই মিনারের মনে পড়ল একটা প্রয়োজনীয় ঔষুধ কেনার কথা৷ তাই মিথিকে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেই দ্রুত গেল ঔষুধটা কিনে নিয়ে হসপিটালে পৌঁছে দিতে। মিথি না করল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে এপাশ ওপাশ দেখতে লাগল।কিন্তু কিছুটা সময় পরই যেন বিস্ময়কর কিছু দেখে চোখের চাহনি বদলে এল। দেখতে পেল কিছুটা দূরে দাঁড়ানো এক যুবককে। এই যুবকটিকে সে ভালোভাবে না চিনলেও অল্প হলেও চেনে।এই হসপিটালেরই মেহেরাজ ভাইয়ের পরিচিত এক ইন্টার্ন ডক্টর।তার মনে আছে এখনও, তিনদিন আগেই একবার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মেহেরাজ ভাই। কিন্তু সেসব কথা মুখ্য নয়, মুখ্য হলো এই লোক হসপিটালের সামনের রাস্তাতেই একজন ডক্টর হয়ে সিগারেট ফুঁকছে কি নির্ভয়ে। কতোটা বিচ্ছিরি আর জঘন্য!প্রথমদিন কান্নাকাঁটির দাপটে খেয়াল না করলেও পরে যখন এই ছেলেটাকে সে খেয়াল করেছিল তখন সাদা এপ্রোনে মারাত্মক সুদর্শন বোধ হয়েছিল। কিশোরী মন বোধ হয় ছেলেটার গম্ভীর চোখমুখের চাহনি, ভদ্রভাবে কথা বলা, এসবে আকৃষ্টও হয়েছিল। কিন্তু কে জানত এই ছেলের এমন একটা অভদ্র রূপ ও আছে? এ অভদ্র গুণ নিয়ে এই ছেলে আবার নাকি হবে ডক্টর? ডক্টর হয়ে আবার করবে নাকি মানুষের চিকিৎসা? নাক মুখ কুঁচকাল মিথি। দুই পা এগিয়ে এসেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়েই ডাকল সেই অল্প পরিচিত ডক্টরকে। গলা উঁচিয়ে বলল,

“এই যে ডক্টরসাহেব, শুনুন এই যে?”

মেঘ প্রথমেই তাকাল না। পরমুহুর্তেই চোখ মুখ কুঁচকে নিয়ে পিঁছু ফিরে তাকিয়ে দেখল মিথিকে। দেখতে পিচ্চি পিচ্চি ফর্সা ধবধবে মেয়েটা।নাম জানে না ঠিক সে।তবে তিনদিন আগেই জেনেছিল এই মেয়েটা মেহেরাজদের পরিচিত। এই কয়েকদিনে দুই-চারবার দেখেছেও সে এই মেয়েকে। বাবার জন্য প্রথমদিন কেঁদেকেঁটে চোখ ভাসাতেও দেখেছিল অবশ্য। নিশ্চয় বয়স খুব অল্প। নয়তো কেউ জনসম্মুখে এমন করে কাঁদে? স্মিত হাসল সে৷ ভদ্রতা দেখাতে সিগারেটে শেষবার টান দিয়েই ফেলে দিল দ্রুত। পা দিয়ে সিগারেটের শেষাংশ টা রাস্তায় ফিষে ফেলে বলল,

“ কিছু বলবে? ”

মিথি আরো দুই পা এগিয়ে এল। ভ্রু কুঁচকে কোমড়ে হাত রেখে শুধাল,

“ছিঃ ছিঃ!আপনি না একজন ইন্টার্ন ডক্টর? সত্যিই ডক্টর তো আপনি? ”

মেঘ ভ্রু উঁচু করল। মাঝরাস্তায় এটা কেমন প্রশ্ন?ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,

“কেন? সন্দেহ হচ্ছে তোমার?আমার গায়ে সাদা এপ্রোন চোখে পড়ে না?”

মিথি ফোঁড়ন কেঁটে শুধাল,

“সাদা এপ্রোন গায়ে দিলেই সবাই ডক্টর হয়ে যায় নাকি? আজব! ”

মেঘের বিরক্ত লাগল। একেই হসপিটালে মেহুকে দেখে পুরাতন দুঃখ সতেজ হয়ে উঠেছে।তার উপর এসব প্রলাপ যেন এই মুহুর্তে বিরক্তকর কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবুও কপাল কুঁচকে গম্ভীর স্বরে শুধাল,

“কি বলতে চাইছো তাহলে? আমি ডক্টর না? এত বছর এত পড়ালেখা করে এত পরীক্ষা পার হওয়ার পর আমি ভুয়া ডক্টর এটা বলতে চাইছো?”

“ অবশ্যই। নয়তো সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছিলেন কেন?একজন ডক্টর হয়ে কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে মনের সুখে সিগারেটে টানে? ”

মেঘের বিরক্তি শীর্ষে পৌঁছাল যেন। এই মেয়েকে এখন কি করে বুঝাবে সে সিগারেটে কেন সুখটান দিচ্ছে? আধো বলার মতো কিছু? প্রিয়তমার বিরহে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে সিগারেট ফুঁকছে এটা শুনতে নিশ্চয় বিদ্ঘুটেই লাগবে?সে বিদ্ঘুটে উত্তরটা তাই দিল না মেঘ। বলল,

“কেন? ডক্টররা কি সিগারেট টানে না? ”

মিথি হার মানল না। ফের গলা উঁচিয়ে বলল,

“কেন টানবে? কোন সুখে টানবে? রোগীদের রোগ দূর করার সুখে? ”

মেঘের গলা হঠাৎ একদম ঠান্ডা হয়ে এল। অন্যমনস্ক হয়ে শীতল স্বরে শুধাল,

“ সুখে নয়, দুঃখে।”

“আশ্চর্য!কি এমন দুঃখ থাকবে যে সিগারেট টানতে হবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে? ”

মেঘ নিষ্প্রভ ভাবে চাইল এবারে মিথির দিকে। ঠোঁট চেপে মৃদু হেসে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ কেন?ডক্টরদের দুঃখ থাকতে নেই নাকি? ”

মেঘের কথাটায় আর হাসিটায় কি ছিল কেজানে হঠাৎ মিথির মন খারাপ হয়ে এল। মনে হলো এই লোকটার সত্যি সত্যিই বিশাল দুঃখ! কিন্তু কি এমন দুঃখ? মৃদু স্বরে বাধ্য মেয়ের মতো শুধাল,

“ থাকতেই পারে, কিন্তু আপনার দুঃখটা কি? ”

মেঘ আবারও হাসল। বলল,

“তুমি ছোট, ওসব দুঃখ সম্পর্কে বুঝবে না। ”

মিথি কিয়ৎক্ষনের জন্য শান্তরূপ ধারণ করলেও আবার জ্বলে উঠল যেন। তীক্ষ্ণ চাহনি ফেলে বলে উঠল,

“ কে ছোট? আমার বয়স ষোল। আপনি জানেন?আমার বয়সী বান্ধবীদের যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের এতদিনে এক-দুটো বাচ্চাও হয়ে গেছে।”

মেঘ এবারে সজোরেই হেসে উঠল। হঠাৎ খেয়াল করল তার মন খারাপ ভাব কেঁটে যাচ্ছে। হসপিটালে মেহুকে দেখে যে মেঘ জমেছিল মনের কোণে তা যেন হুট করেই উবে যেতে শুরু করেছে।হাসি হাসি গলাতেই শুধাল,

“ আর তোমার? ”

মিথি মুখ ভেঙ্গাল।বলল,

“ বিয়ে হলে এতদিনে নির্ঘাত দুই তিন বাচ্চার জননী হয়ে যেতাম।বুঝলেন? বিয়ে হয়নি দেখেই জননী হতে পারলাম না এখনো।”

মেঘের এবার দমফাটা হাসি পেল। ইচ্ছে হলো জোরে জোরে হেসে উঠতে। কিন্তু পারল না। কোন রকমে হাসি চেপেই ভ্রু কুঁচকে বলল,

“ নিজেই এখনো বাচ্চা! সে কিনা আবার দুই তিন বাচ্চার জননী হবে।সিরিয়াসলি? ”

“ কি আশ্চর্য! এতোটা অবাক হওয়ার মতো কি আছে?”

মিথি বিরক্তিসুরে কথাটা বললেও পরমুহুর্তেই থেমে তাকাল সামনের দিকে। একটা সাদা রংয়ের গাড়ি তাদের পাশেই দাঁড়িয়েছে। সে গাড়ি থেকেই দ্রুত নেমে বের হলো এক বাচ্চা ছেলে। গোল গোল চোখ দিয়ে একবার মিথি তো একবার মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল,

“পাপা,কাজ শেষ তোমার? ”

মিথি অবাক হলো। এই অল্পবয়স্ক,সুদর্শন ছেলেটা এই বয়সেই এক বাচ্চার বাপ হয়ে বসে আছে? কি আশ্চর্য! বার কয়েক বাচ্চা ছেলেটা আর মেঘের দিকে তাকাল চোখ গোল গোল করে।হ্যাঁ, অনেকাংশেই এদের দুইজনের চেহারার মিল পরিলক্ষিত। তার মানে সত্যি সত্যিই দুইজনে বাপ ব্যাটা। মিথি যেন দুঃখ পেল। তবুও বলল,

“ আপনি এই বয়সেই বাচ্চার বাপ হয়ে যেতে পারলেন ডক্টরসাহেব? আপনাকে দেখে তো লাগেই না। ”

মেঘ হাসল। ঝুঁকে গিয়ে সামনের বাচ্চা ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

“ কি লাগে না? ”

“ আপনি যে বাচ্চার বাপ তা তো লাগেই না৷ সিরিয়াসলি?বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। ”

মেঘ ফের হাসল। মিথির কথাটাই ফের তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,

“ কি আশ্চর্য! এতোটা অবাক হওয়ার মতো কি আছে? যথেষ্ট বয়স হয়েছে না আমার বাপ হওয়ার? ”

মিথি তখনও গোলগোল চোখে তাকিয়ো থাকল মেঘের দিকে আর মেঘের কোলের বাচ্চাটার দিকে। যেন সত্যিই বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য না। মেঘ সে দৃষ্টি দেখেই হেসে দিল। উত্তরে বলল,

“ ভাই আর ভাবির ছেলে। এখনও বাপ হওয়ার সাহসটা করে উঠতে পারিনি বুঝলে পিচ্চি? ”

মিথি এবারে হেসে উঠল। পরমুহুর্তেই কিছুটা দূরে মিনারকে দেখে দ্রুতই সে স্থান ছেড়ে এগিয়ে গেল মিনারের দিকে। মেঘ একবার তাকাল ঠিক তবে পরমুহুর্তেই নজর সরাল।নজর সরাল না কেবল তার কোলের বাচ্চা ছেলেটা। আধো গলায় জিজ্ঞেস করল,

“মেয়েটা কে পাপা? নাম কি?”

মেঘ ঠোঁট চেপে উত্তর দিল,

“ নাম তো জানা নেই, এমনিই পরিচিত বলতে পারো। ”

.

তখন সন্ধ্যা। মেহু বাসা ছেড়ে হোস্টেলে ফিরেছে আজই।তবুও ভার্সিটি থেকে ফিরে জ্যোতির সাথে ফের হসপিটালে আসল ।জ্যোতির দাদী আজ বাড়ি ফিরে যাবে মিনারের সাথে। যদিও মিথি আর তার ছোট আম্মা অর্থ্যাৎ তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী একেবারে তার বাবাকে হসপিটাল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার দিনই যাবে৷তবে বাড়ির দিকটা ভেবে দাদী আজই চলে যাবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী যাওয়ার আগে একবার নিজের ছেলেকে দেখে যাবেন। তাই জ্যোতি আর সে বাসায় না গিয়ে হসপিটালেই আসল। পাশাপাশি মেহু -জ্যোতি দুইজনে বসে অপেক্ষা করল হসপিটালে দাদীর আসার। পরমুহুর্তেই কি মনে করে মেহুকে জিজ্ঞেস করল,

“ সাঈদ ভাই আর যোগাযোগ করেনি মেহু আপু? ”

আকস্মিক প্রশ্নে অবাক হলো মেহু। পরমুহুর্তেই আবার সামলে নিয়ে উত্তর দিল,

“ করেছিল তো। ”

জ্যোতি কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল। পরক্ষনেই বলল,

“ সাঈদ ভাইয়ের সাথে একবার দেখা করবে আপু?যদি সরাসরি কথা বলে সবটা ঠিক হয়ে যায়? ”

মেহু ব্যঙ্গসুরে বলল,

“দেখা করে কি হবে? ভালোবাসা ভিক্ষা চাইব জ্যোতি? ”

“ হতে পারে সাঈদ ভাই তোমায় ভালোবাসে আপু কিন্তু জানাতে চায় না। হতে পারে না?”

মেহুর উত্তর এল,

“উনার কথা অনুযায়ী পারে না৷ উনি আমায় ভালোবাসে না জ্যোতি। উনি আর পাঁচ দশজন মেয়ের মতোই দেখেছেন আমায়। আর পাঁচ দশজন মেয়ের মতোই ফ্লার্টিং করে গেছেন আমার সাথে। এর চেয়ে বেশি কিছুই হয়তো ছিল না। ”

“ কিন্তু..”

মেহু বলতে দিল না জ্যোতিকে। থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল,

“আর কিছু নয় জ্যোতি। আমায় দুর্বল করে দিস না প্লিজ। আমি উনার থেকে সরতে চাইছি যে কোন মূল্যে। কান্না থেকে, কষ্ট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইছি। নয়তো ফের আবার দুর্বল হয়ে পড়ব। ”

জ্যোতি এবারে আর কথা বাড়াল না । চুপ হয়ে গেল।উঠে গিয়ে বাবাকে আড়ালে একবার দেখে আসতেই সম্মুখীন হলো মেহেরাজের। কানে এল মেহেরাজের গম্ভীর গলা,

“ মেহুর সাথে সারাক্ষন কি কথা হয় তোর?আমি জানি তুই ওর মন খারাপের বিষয়ে সবটা জানিস। অথচ এড়িয়ে যাস। ও কি কাউকে ভালোবাসে জ্যোতি? প্লিজ আমায় বল।”

জ্যোতি মৃদু হাসল। কারো ব্যাক্তিগত কথা তার অনুমতি অনুযায়ী বলাটা ঠিক হবে কিনা তা ভেবে নিয়েই বলল,

“ ধরে নিন এবারও এড়িয়ে গেলাম। তবে একটা সাহায্য করবেন মেহেরাজ ভাই? একটা সত্যি কথা বলুন, সাঈদ ভাইয়ের কি কারো সাথে রিলেশন আছে? কিংবা কখনো কোন মেয়েকে ভালোবেসেছেন উনি?”

মেহেরাজের মেজাজ খারাপ হলো কাঙ্ক্ষিত উত্তর না পেয়ে। অফিস থেকে ফেরার পথে একবার হসপিটাল দিয়ে এসেছিল জ্যোতির বাবাকে দেখার জন্যই। এখানে এসে জ্যোতি আর মেহুকে কথা বলতে দেখে আবারও তার মনে হলো জ্যোতি সবটা জানে। কিন্তু জ্যোতি উত্তর দিল না এবার ও। কত বড় বেয়াদব হলে মুখের উপর এভাবে এড়িয়ে যাওয়ার কথা বলে।পরমুহুর্তেই আবার জ্যোতির মুখে ফের সাঈদের কথা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে এল যেন মেহেরাজের।মেজাজ খারাপটা যেন এবারে শীর্ষে পৌঁছাল। শক্ত গলায় হলেও মৃদু আওয়াজে শুধাল,

“ আমি কি ওর সার্ভেন্ট? ওর খোঁজখবর সব হাতে নিয়ে বসে আছি আমি? ”

জ্যোতি শক্ত গলা শুনে ছোট শ্বাস ফেলল।নরম গলায় শুধাল,

“ আপনি উনার কাছের বন্ধু মেহেরাজ ভাই। কাছের বন্ধু হয়ে এইটুকু খবর জানেন না এটা তো অদ্ভুত শোনায়। ”

মেহেরাজের গলা আরো দৃঢ় হলো। একদম শান্ত গলায় অথচ দৃঢ় স্বরে শুধাল,

“ ভেবে নে তোর মতোই এড়িয়ে গেলাম আমিও। ”

কথাটা বলেই মেহেরাজ পিছু ঘুরে চলে গেল দ্রুত। নিজের উত্তরটাই ফের ফেরত পেয়ে থমথমে হয়ে এল জ্যোতির মুখ।কি আশ্চর্য! সে কি খারাপ কিছু জিজ্ঞেস করেছে?

.

জ্যোতির দাদী সব গোঁছগাছ করেই কথা বলছিলেন নাবিলার মায়ের সাথে। কথা হচ্ছিল মূলত জ্যোতির বিয়ের বিষয়ে। বাবার এহেন অসুস্থতা, মেয়েদের এভাবে ভেঙ্গে পড়া নিজের চোখেই সবাই দেখেছে।এমন নয় যে জ্যোতির দাদী পড়ালেখা পছন্দ করেন না। তিনি মনেপ্রাণে চান তার নাতনিরা পড়ালেখা করুক, প্রতিষ্ঠিত হোক, তার মুখ উজ্জ্বল করুক। কিন্তু বিয়ের সম্বন্ধ নিয়েও তার ভাবনা ঠুনকো নয়। এই যে নাবিলার মায়ের কাছ থেকেই কিছুটা সময় আগেই যে বিয়ের প্রস্তাবটা পেলেন তা নেহাৎই খারাপ নয়। ভালো ভাবে বিবেচনা করলে উত্তম সম্বন্ধ!সে বিবেচনার মাঝপথেই হঠাৎ সেখানে এসে হাজির হলো মেহেরাজ। শান্ত গলায় শুধাল,

“আপনার সাথে আলাদাভাবে আমার কিছু কথা আছে দাদী। শুনবেন?”

দাদী হ্যাঁ বললেন। রাজি হয়ে অন্যপাশটায় যেতেই মেহেরাজ গিয়ে দাঁড়াল তার সামনে৷ এক নজর তাকিয়ে বলে ফেলল,

“ আমি জ্যোতিকে বিয়ে করতে চাই দাদী। আপনার কি মত এই বিষয়ে? আশা রাখি আমি খুব অযোগ্য বিবেচিত হবো না আপনার বিবেচনায়। তাই না? ”

#চলবে……

এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-১০

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_১০
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

তখন ভোর। হসপিটালের বেডেই জ্যোতির বাবার নিস্তেজ দেহটা৷ চোখ বুঝে আছে৷রিপোর্ট আর ডক্টরের কথানুযায়ী উনার হৃদপিন্ডের একটি করোনারি ধমনি আটানব্বই শতাংশ সংকীর্ণ হয়ে যাওয়াতে হার্ট এ্যাটাক করেছেন। সমাধানস্বরূপ করোনারি বাইপাস সার্জারি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ জ্যোতির দাদীর সঞ্চয় আর বাবার এতদিনের দেওয়া টাকা থেকে জ্যোতিরা যা সঞ্চয়ে রেখেছিল সেসব মিলিয়ে অপারেশনের খরচ মিটে যাবে।জ্যোতি এক মুহুর্ত বাবার দিকে তাকিয়েই থেকেই ফের বেরিয়ে আসল হসপিটালের করিডোরে।ঠিক তখনই মিনার এসে দাঁড়াল পাশে। মৃদু স্বরে বলল,

“ এতো চিন্তা করছিস কেন? দেখবি সবটা ঠিক হয়ে যাবে। ”

জ্যোতি নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।অন্যমনস্ত হয়ে মৃদু আওয়াজে শুধাল,

“ মিথিটা খুব কান্না করছিল মিনার ভাই। খোঁজ নিয়েছিলে ওর?”

মিনার আশ্বাস দিল। বলল,

“ দাদী আছে তো। সামলে নেবে। তুই চিন্তা করিস না।”

জ্যোতি ছোট ছট চোখে চাইল। নিজের চিন্তান্বিত মুখ কারো সম্মুখে তুলে ধরতে চাইল না হয়তো। তাই তো সামনে থেকে সরে যাওয়ার জন্য বলল,

“ ওর সাথে কথা বলা উচিত এখন।একবার কল করে আসি? ”

মিনার উত্তর দিল,

“আমি কল করেছি একটু আগে জ্যোতি। তুই শুধু শুধু এত চিন্তা করছিস।”

“ করছি না চিন্তা।”

“ তোর মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। ”

জ্যোতি সে প্রসঙ্গ বদলাতে চাইল৷মৃদু আওয়াজে মিনারের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,

“ আব্বার অপারেশনটা আজই হবে তাই না? ”

“ সব ঠিকঠাক হলে আজই হবে।”

জ্যোতির চাহনি নিষ্প্রভ। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,

“ ওহ।খেয়েছিলে কিছু মিনার ভাই? কাল রাতে নিশ্চয়ই তুমি বা চাচা কারোরই খাওয়া হয়নি। তোমরা বরং বাইরে কোথাও খেয়ে নাও মিনার ভাই।”

মিনার বাঁধ সাধল।উত্তরে বলল,

“ না,এখন খাব না । মামার জ্ঞান ফেরার পর নাহয় খেয়ে নিব।”

এরপর আর কথা হলো না মিনারের সাথে। চুপচাপ একপাশে বসে থাকল জ্যোতি।একবার তাকিয়ে দেখল মিনার, মেহেরাজ, তার চাচা আর মেহেরাজের চাচাদের। এতগুলো মানুষ এসে হাজির যে মানুষটার জন্য। অথচ সেই মানুষটাই এখন সজ্ঞানে নেই। জ্যোতি মোবাইল নিয়ে একবার মিথিকে কল দিল।ওপাশ থেকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কল তুলল মিথি। জ্যোতি নরম গলায় শুধাল,

“আব্বা ঠিক হয়ে যাবেন মিথি। চিন্তা করিস না হুহ?আব্বা খুব শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে।”

মিথি বোধহয় কথাটাতে আশ্বস্ত হলো না। চাপা ক্রন্দনরত সুরে শুধাল,

“জ্যোতি? আমি আব্বাকে দেখতে যাব।দাদী নিয়ে যাবে বলেছে আমায়। এখন রওনা দিলে আব্বার সার্জারির আগে আগেই পৌঁছে যাব না আমি?”

“তোর আসার প্রয়োজন নেই মিথি। আব্বা দ্রুতই সুস্থ…”

জ্যোতি বাকিটা বলার আগেই মিথির জেদি স্বর আসল ওপাশ থেতে,

“ আমি যাব জ্যোতি। তোর কেন নিষেধ একে?দাদী বলেছেন নুসাইবাদের বাসায় উঠবে ওখানে গিয়ে। তোর তো সমস্যা হবে না।”

“ উহ, আমি তা বলিনি মিথি। আচ্ছা দাদী নিয়ে আসলে নিষেধ নেই। খেয়ছিস রাত থেকে?”

“না। ”

“খেয়ে নে হুহ?এখানে এসে আব্বাকে দেখতে হবে না? খেয়ে তারপর রওনা দিবি হুহ?”

ওপাশ থেকে এবারে উত্তর এল না। জ্যোতি ফোন রাখল চোখ বুঝে। পরের কয়েক ঘন্টা সেভাবেই স্থির হয়ে বসে থাকল। হঠাৎ জানতে পারল তার বাবার জ্ঞান এসেছে৷ তবুও সাহস করে কে জানি না যাওয়া হলো না বাবার সামনে। অস্বস্তি, অনুতাপে স্থির বসে থেকে হাত কচলাতে লাগল কেবল। ঠিক তখনই টের পেল পাশাপাশি বসা মেহেরাজের উপস্থিতি। কানে এল তার গম্ভীর স্বর,

“ বসে আছিস কেন এখনো?চাচার জ্ঞান ফিরেছে জানিস না?”

জ্যোতি নিষ্প্রভ স্বরে উত্তর দিল,

“জানি মেহেরাজ ভাই। ”

মেহেরাজ ভ্রু কুঁচকাল। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ দেখা করবি না?”

“আব্বা সুস্থ হওয়ার পর দেখা করব একেবারে। ”

মেহেরাজ এবারে সত্যিই বিরক্ত হলো জ্যোতির উপরে। গম্ভীর স্বরে শুধাল,

“এটা কোন ধরণের কথা? তোর বাবা অসুস্থ, সন্ধ্যার পর অপারেশন হবে অথচ তুই দেখা করে আসবি না এর আগে?”

দৃঢ়গলায় জবাব দিল জ্যোতি,

“নাহ।”

মেহেরাজ কপাল কুঁচকে নিল। শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে বলে উঠল,

“এটা ঘাড়ত্যাড়ামি হচ্ছে না জ্যোতি? সব জায়গায় তোর এই ঘাড়ত্যাড়া ভাব দেখানোটা কতোটুকু যুক্তিযুক্ত মনে হয় তোর? ”

নিষ্প্রভ কন্ঠে উত্তর দিল জ্যোতি,

“এক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত নয় জানি আমি। তবুও যাব না। ”

মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করল এবারে,

“ কারণটা কি?তোর রাগ, জেদ নাকি ক্ষোভ?এমন একটা পরিস্থিতিতেও রাগ, জেদ আর ক্ষোভকেই প্রাধান্য দিচ্ছিস? ”

জ্যোতি ঠোঁটে ঠোঁচ চাপল। স্থির চাহনিতে মেহেরাজের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,

“ সংকোচ। ”

“ সংকোচকে বেশিসময় গুরুত্ব দিতে নেই। ”

জ্যোতি মাথা নাড়াল এবারে। বলল,

“ আমি কয়েকবার দেখে এসেছি আব্বাকে। এই মুহুর্তে যাওয়াটা ঠিক কতোটা যুক্তিযুক্ত বুঝে উঠছি না তাই। যায় হোক আপনি কাজ ছেড়ে এখানে পড়ে আছেন। অসুবিধায় পড়ে গেলেন তাই না?”

মেহেরাজের গলা দৃঢ় হলো। উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,

“ আমার মনে হয় না কারোর বিপদে পাশে থাকলে অসুবিধায় পরতে হয়। চাচারা না থাকলেও আমি থাকতামই।”

জ্যোতি মাথা তুলে তাকাল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। প্রশ্ন ছুড়ল,

“কেন?”

“এটুকু দায়িত্ব আমার আছে তাই৷ ”

কথাটা গম্ভীর স্বরে দিয়েই চলে গেল মেহেরাজ। জ্যোতি একবার সেদিকে তাকিয়েই নজর সরাল। চোখ বুঝল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।আসলেই কি বাবার চোখে চোখ মেলানোর এতোটা সংকোচকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত? এতদিনকার রুক্ষ ব্যবহার গুলোতো ক্রমশ হয়ে আসছিলই ছোটবেলা থেকে৷ সে তো ইচ্ছে করেই বাবার সাথে খারাপ ব্যবহার করত না। তবুও এতোটা সংকোচ বোধ কেন? তবুও কেন এতোটা দ্বিধা হচ্ছে আব্বার চোখের সামনে যেতে?

.

হসপিটালে কেবল জ্যোতি আর মেহেরাজই থাকল দুপুরে। মিনার আর জ্যোতির চাচা মেহেরাজের চাচাদের সাথেই তাদের বাসায় গেল কিছুটা সময় আগে। নির্ঘুম রাত, এতদূর ছোটাছুটি তার উপর না খেয়ে থাকা। এতোটা দখলের পর খাওয়া আর গোসলের জন্যই মূলত মেহেরাজে চাচাদের সাথে আসা। সে উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমে গিয়ে গোসলও সেরে নিল মিনার। অন্য পোশাক না থাকায় সে পোশাকই পুনরায় পরিধান করতে হলো। আর সে কারণেই সম্মুখীন হতে হলো উদ্ভট এক প্রশ্নের,

“একি, আপনার জন্য বাইরে সবাই অপেক্ষা করছেন। আর আপনি এখনো গোসল সারেননি। সে একই পোশাকেই বসে আছেন? ”

মিনার চোখ গোল গোল করে তাকাল। গোসল সেরে বের হয়েই তোয়ালে দিয়ে চুল মুঁছে নিয়ে রুমের একটা চেয়ার টেনে বসেছিল সে। সেই মুহুর্তেই রুমের মধ্যে সামান্তা আসল। অবশ্য সামান্তার আসাটা দেখে তাে অতোটাও অবাক লাগেনি যতোটা এই কথা গুলো শুনে লাগল। এখনও তার ভেজা চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে আসছে কপাল বেয়ে। সত্যিই কি বুঝা যাচ্ছে না সে গোসল করেছে? মৃদু হেসে ভদ্র ভাবে বলল,

“ আমার মাথার চুল ভেজা। তুমি বোধহয় খেয়াল করোনি সামান্তা। ”

সামান্তা চোখ ছোট ছোট করে চাইল এবারে। সত্যিই খেয়াল করেনি সে। একই পোশাকে দেখেই ভেবে নিয়েছিল এই লোক এখনো গোসল করেনি।মৃদু স্বরে বলল,

“ ওহ যাক, গোসল করেছেন তাহলে। আপনাকে আব্বু ডেকেছেন খাওয়ার জন্য। হসপিটালে ও যেতে হবে বোধহয় তাই। ”

মিনার উঠে দাঁড়াল। উত্তরে দ্রুত বলল,

“ ওহ। আসছি এক্ষুনি। ”

সামান্তাও চলে যেতে নিচ্ছিল। পরমুহুর্তেই ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“ আপনার নামটা ভুলে গেছি।কি যেন নাম আপনার?”

মিনার শান্ত গলায় উত্তর দিল,

“মিনার।”

সামান্তা মাথা নাড়াল দ্রুত। বলল,

“হ্যাঁ মনে পড়েছে, জ্যোতি আর মিথির মুখে শুনেছি। ”

মিনার অল্প হাসল এবারে। মাথার চুল গুলোকে হালকা ঝাড়া দিয়ে বের হয়ে আসল রুম ছেড়ে।মনে মনে ভাবল, মেয়েটা নিঃসন্দেহে সুন্দরী।ফর্সা ত্বক, বড় বড় চোখ, লম্বা চুলের অধিকারিনী। এক কথায় তাকে সুন্দরী সম্বোধন ছাড়া অন্য কোন সম্বোধন দেওয়া যায় না বটে। আর সুন্দরী মেয়েদের আশপাশে বেশিক্ষন ভদ্র ছেলেদের থাকতেও নেই বোধহয়।

#চলবে…

এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-০৯

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_০৯
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

মিথিকে স্বভাবত বেশ চঞ্চল আর চতুর প্রকৃতির দেখালেও আসলে সে বোকা। বলা চলে নরম মনের মেয়ে। তাই তো ছোটবেলা থেকে যে বাবাকে ভয় পেত, মার খাওয়ার ভয়ে বাবার সামনে পর্যন্ত যেত না সে বাবারই অসুস্থতা দেখে আহাজারি করে কাঁদতে লাগল। আর যায় হোক ছোটবেলা থেকে সে পিতামাতা বলতে শুধু বাবাকেই চিনেছে, জেনেছে। মাকে তো তার মনেও পড়ে না। এমনকি মায়ের মুখটাও মনে নেই।মারুক, শাসন করুক তবুও বাবাকে বাবা হিসেবে চিনত তো? দেখতে তো পেত?মাকে তো সে চিনেও না। মা যেমন ছুড়ে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলেন বাবা কিন্তু সেভাবে তাদের ছুড়ে ফেলেও দেয়নি। এদিক থেকে বাবা শত খারাপ হলেও মায়ের থেকে ভালো নয় কি? মিথি আওয়াজ তুলে কাঁদতেই থাকল এসব ভেবে। ওপাশে জ্যোতি বারংবার প্রশ্ন করলেও উত্তর এল না মুখে। গলা দিয়ে শব্দ বের হতে চাইল না।তবুএ সবশেষে অস্ফুট স্বরে শুধু এইটুকু বলল,

“ আ ব্ বা! আব্বারে হসপিটালে নিয়ে গেছে জ্যোতি।আব্বা খুব অসুস্থ! ”

কথাটা শুনেই ঠোঁট চাপল জ্যোতি।এতদিনের সূক্ষ চিন্তাটা, আশংকটা যেন সত্যি হয়ে গেল। কিছুটা হলেও বুঝা হয়ে গেল সবটা। মিথিকে উত্তরে কি বলা উচিত ঠিক বুঝে আসল না তার। মিথির মতো বোধহয় তারও কান্না পেল। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো আব্বার সম্পর্কে। কিন্তু এই মুহুর্তে মিথিকে কিছু জিজ্ঞেস করা মানেই মেয়েটা দ্বিগুণ গতিতে কান্না শুরু করবে। তাই শুকনো ঢোক গিলে নরম স্বরে বলল,

“কিছু হবে না মিথি। চিন্তা করিস না,সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি মিনার ভাইকে কল দিয়ে সবটা জেনে নিই হুহ? রাখি?”

শেষের শব্দটা অনেকটাই নরম হয়ে শুধাল জ্যোতি। মিথির কান্নার বেগ বোধহয় সেই নরম স্বর শুনেই বেড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতেই কল রেখে ছুটে গেল দাদীর কাছে৷ ওপাশে জ্যোতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ সঙ্গে সঙ্গে কল দিল মিনারকে।মিনার কল তুলল না।একবার, দুবার তিনবার অসংখ্যবার কল দিল। অথচ কল তুলল না সে। অবশেষে বাড়ির অন্যদের কাছেই কল করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত তার ছোট চাচার কাছ থেকে জানতে পারল তার বাবা স্ট্রোক করেছেন।অবস্থা খুব বেগতিক বলেই ওখানকার হসপিটালে রাখেনি। অবশেষে শহরের হসপিটালে আনারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।সাথে মিনার আর তার চাচাই আসবেন৷ জ্যোতি সমস্তটা শুনে চুপ রইল। অবশেষে কল রেখেই চোখ বুঝে নিল। মনে হলো কোথাও একটা ছায়া সরে যাচ্ছে। কোথাও যেন জীবনের নিশ্চায়তা বিলীন হয়ে যাচ্ছে৷নিঃশ্বাস যেন ঘন হয়ে আসল। ইচ্ছে হলো মিথির মতোই বিলাপ জুড়ে কান্না করতে।কিন্তু পারল না।শুধু চোখজোড়া লালাভ হয়ে টলমল করল। তবুও সামনে রিতু আছে বলেই কাঁদল না। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু প্রার্থনা করল ভালো হয়ে যাক তার বাবা৷ এবার সুস্থ হলেই সে সুন্দর করে কথা বলে আসবে বাবার সাথে। বাবা যতই শক্ত হোক সে নমনীয়তা দেখাবে বাবার সামনে।বাকি সব মেয়ের মতো বাবার যত্নও করবে। এসব কথা ভেবেই ঠোঁট কাঁমড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল জ্যোতি।রিতু বোধহয় সে দৃশ্য দেখেই জিজ্ঞেস করে উঠল,

“জ্যোতি? কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন? ”

জ্যোতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার দ্বারে গেল। বলল,

“আব্বা স্ট্রোক করেছে রিতু। শহরের হাসপাতালেই আনছে।আনতে আনতে বোধহয় আরো রাত হবে তাই না?হোস্টেল থেকে অতো রাতে বের হতে দেবে? ”

রিতু অবাক হলো। পরমুহুর্তেই জ্যোতির দিকে পা বাড়িয়ো কাঁধে হাত রাখল। নরম গলায় বলল,

“ বলে রাখলে দেবে না কেন?তুই চিন্তা করিস না জ্যোতি, ঠিক হয়ে যাবে। ”

রিতু আশ্বাসের সুরে কথাটা বললেও জ্যোতি খুব একটা শান্তি পেল না।ফের কল দিল মিনারের ফোনে।মিনার কল তুলল এবারে।জানাল, জ্যোতির বাবাকে নিয়ে এম্বুলেন্সে করে তারা রওনা হয়েছে। এখানে শহরে চেনা পরিচিত বলতে কেবল গ্রামের প্রতিবেশি হিসেবে মেহেরাজদের পুরো পরিবারই।থাকার সমস্যার কথা ভেবে তাই জ্যোতির ছোট চাচা মেহেরাজের চাচাদেরও জানিয়েছে বিষয়টা।খুব দ্রুতই এসে পৌঁছাবে তারা।

এটুকু জানানোর পরই মিনার ব্যস্ত হয়ে কল কাঁটতে নিল। জ্যোতি উদাসীন গলায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল,

“ মিনার ভাই?আমি এখানে অপেক্ষা করব। এসে একবার জানিও আমায় মিনার ভাই। আমি আব্বাকে না দেখা পর্যন্ত ছটফট করব। প্লিজ, আমায় এসে একবার নিয়ে যাবে? ”,

মিনার ভরসা দিল,

“ এত চিন্তা করছিস কেন?মামার কিছু হবে না জ্যোতি। আমি পৌঁছালেই তোকে জানাব। ”

“ আমি অপেক্ষায় থাকব মিনার ভাই। জানিও আমায়। ”

মিনার এবারে ফের কথা বলল না। রেখে দিল কল। জ্যোতি ফোনের স্ক্রিনে একপলক চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।উপর দিয়ে স্থির থাকলেও ভেতরে যেন তার গুমোটবাঁধা চিন্তার বাস। অনেকটা রাত পর্যন্ত প্রায় সেভাবেই চিন্তা নিয়ে কাঁটাল সে৷ অপেক্ষা করল মিনারের ফোনকলের। কিন্তু অনেকটা সময় কেঁটে যাওয়ার পর ও মিনারের কল আসল না। বরং তার বদলে কল আসল মেহেরাজের। জ্যোতি অবশ্য আননোন নাম্বার হওয়াতে জানল না এটা মেহেরাজের কল। মিনারের কল ভেবেই দ্রুত কল তুলল। ওপাশ থেকে শোনা গেলা মেহেরাজের ব্যস্ত গলা,

“ হসপিটালে কি এখন ই যাবি জ্যোতি? ”

মেহেরাজ খবরটা তখনই ওর চাচাদের কাছ থেকে পেয়েছিল। এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল জ্যোতিকে কল করে জানানো উচিত খবরটা। পরমুহুর্তে চিন্তা করবে ভেবেই আর জানায়নি। কিন্তু জ্যোতি যে বিষয়টা আগেই জেনেছে তা জানতে পেরেছে চাচারা সহ জ্যোতির বাবাকে হসপিটালে এডমিট করানোর সময়ই। তারপরই মিনারের কথা শুনে জ্যোতির নাম্বার নিয়ে ছুটে আসল এখানে।তবুও যেন অস্থিরতা কমল না।অস্থিরতাটা কি জ্যোতিকে নিয়েই? বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে নিশ্চয় মেয়েটা ভেঙ্গে পরেছে?ভাবনাটা বোধহয় সত্যিই হলো। ওপাশ থেকে জ্যোতির বিনয়ী স্বরে প্রশ্ন আসল,

“আপনি জানেন কি আব্বা কেমন আছে?”

মেহেরাজ উত্তর দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে পেল। এডমিট করিয়েই তো চলে এসেছে।আর কিছু জানাও হয়ে উঠেনি। তাই উত্তর না দিয়েই বলল,

“ তোর হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি জ্যোতি৷ এখানে কথা বলে নিয়েছি, তুই নেমে আয়। ”

জ্যোতি অপেক্ষা করল না এবারে। মেহুর ভাই আর চেনাজানা ভালো বলেই মেহেরাজের পরিচিতি আছে এখানে।সে অনুযায়ী বলতে গেলে, মেহেরাজের কথানুযায়ী এত রাতেও হোস্টেল থেকে তাকে যাওয়ার অনুমতিটা সহজেই দিয়ে দিবে এটা স্বাভাবিক৷ জ্যোতি ঘড়িতে সময় দেখল। বুঝল রাত একটা পেরিয়ে গেছে।জ্যোতি আর দাঁড়াল না। রিতুকে বলেই দ্রুত নেমে গেল। রাস্তার আলোতে মেহেরাজকে দেখে এগিয়ে গিয়ে ফের বলল,

“আব্বা কেমন আছেন মেহেরাজ ভাই? ”

মেহেরাজ গম্ভীর গলায় উত্তর দিল,

“ হসপিটালে এডমিট করিয়েই এসেছি এখানে। বাকিসব ওখানে গেলে জানা যাবে জ্যোতি। ”

জ্যোতি ঠোঁট চেপে নিঃশ্বাস ফেলল। নরম গলায় বলল,

“ মিনার ভাই না এসে আপনাকে পাঠাল যে?”

“ ও চেনে?তাছাড়া ও বললেই তোকে যেতে দিত? ”

জ্যোতি কথা বলল না এবারে। কিয়ৎক্ষন পর বলল

“ আমি হসপিটালে যাব মেহেরাজ ভাই। নিয়ে যাবেন আমায়? ”

মেহেরাহ এদিক ওদিক তাকিয়ে রিক্সা খুঁজল। বলল,

“ নিয়ে যেতেই এসেছি। ”

জ্যোতি আর কিছু বলল না। অবশেষে মেহেরাজ রিক্সাম পেতেই উঠে বসতে বলল। জ্যোতি চুপচাপ উঠে বসল। পাশাপাশি উঠে বসল মেহেরাজও৷ ভরাট গলায় জিজ্ঞেস করল,

“রাতে খেয়েছিস? ”

নিষ্প্রভ কন্ঠে উত্তর দিল জ্যোতি,

“খাবার খেতে ইচ্ছে হয়নি। ”

“ তুই খাবার না খেলে তো চাচা সুস্থ হয়ে যাবে না জ্যোতি।”

ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যোতি। উত্তে দিল,

“জানি। ”

এরপর অবশ্য বাকিটা পথ আর কথা হলো না কারোরই।তবুও পাশাপাশি বসে যেন উপে দিয়ে স্বাভাবিক থাকা জ্যোতির সমস্ত হাহাকার টের পেল মেহেরাজ। বয়ে গেল তার মাঝেও অস্থিরতার শীতল স্রোত!

.

মেহু আজও ঘুমাল না। হুট করেই তার সমস্ত ঘুম উধাও হয়ে গেল বলেই বোধ হলো তার। তার উপর মেহেরাজ সেই কখন বেরিয়েছিল এখনও ফেরেনি। কেন গিয়েছে, কোথায় গিয়েছে কিছুই জানল না।শুধু জানাল একটা দরকারে যাচ্ছে। মেহু বসে বসে অপেক্ষা করল ভাইয়ের ফেরার জন্য। ঠিক তখনই কল এল সাঈদের৷ এত কষ্ট, এত অভিমানের পরেও মেহু কলটা না তুলে পারল না।ওপাশ থেকে পুরুষালি গলাটা শুধাল,

“কেমন আছো মেহু?”

মেহু তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল৷ জানাল,

“সেটা তো আপনার জানার প্রয়োজন নেই। ”

সাঈদ ওপাশে তপ্তশ্বাস ফেলল।জানার প্রয়োজন নেই?সত্যিই কি জানার প্রয়োজন নেই? এই যে সেদিন এতোটা কান্না করে তার কাছে ভালোবাসা ভিক্ষা চাইল সেদিনের পর সাঈদের দিনগুলোও খুব ভালো কেঁটেছে?সেই কান্নাভেজা গলাটার কথা ভেবেই কি সকাল থেকে রাত প্রতিটাক্ষন অস্থিরতায় কাঁটায়নি সে?মেহেরাজের কাছ মেহুর জ্বরের কথা শুনে কি তার একটিবার কল করে খোঁজ নিতে মন চায়নি?চেয়ছিল তো। তবুও অনেক কষ্টে নিজেকে দমন করেছিন। আজ যেন সে দমন করাটা আর খাটল না।নিয়ন্ত্রন রাখতে পারল না আর নিজের উপর। তাই তো অস্থিরতা মেটাতে কল করে বসল মেহুকে। সাঈদ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কথাগুলো ভাবল। প্রসঙ্গ বদলে বলল,

“ মেহু?ছেলেটাকে নিষেধ করে দিলে? ”

মেহু উত্তর দিল,

“আমি করিনি, ভাইয়া বলেছে।কেন?”

“ছেলেটা তোমায় ভালোবাসত। ”

মেহু হাসল। বলল,

“ভালো তো আমিও আপনাকে বাসতাম সাঈদ ভাইয়া। ”

সাঈদ এবারে কিঞ্চিৎ হাসল। কৌতুক স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“এখন বাসো না আর?”

মেহু শক্ত গলায় জবাব দিল,

“ বাসি না। ”

সাঈদ এবারেও হাসল। গলায় রসিকতা টেনে বলল,

“জাস্ট দুদিনেই ভালোবাসা শেষ?আমার থেকেও ফার্স্ট দেখছি তুমি!”

মেহুর ভালো লাগল না কথাগুলো। বিপরীতে বলে উঠল,

“এত রাতে কল দিয়েছেন কেন?এসব বকবক করার জন্য? আমি নিশ্চয আপনার প্রেমিকা নই সাঈদ ভাইয়া যে কল দিয়ে যখন তখন এসব বকবক করবেন।”

সাঈদ এবারও রসিকতা নিয়ে শুধাল,

“ প্রেমিকা হতে চেয়েছিলে তো? ”

ফের শক্ত গলায় জবাব দিল মেহু,

“এখন আর চাই না। ”

সাঈদ এবারে চুপ হয়ে গেল। কিয়ৎক্ষন পর হঠাৎই সব রসিকতা বাদ দিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠল,

“ জানো মেহু? আমার মনে হচ্ছে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছি না।কি যন্ত্রনার বিষয়।”

“ রাখছি, ঘুমাব৷ ”

সাঈদের মন খারাপ হলো। এতদিন পর এটুকু কথাতে কি তার অস্থিরতা মিটল? জানা হলো কি মেহু কেমন আছে? নাহ তো।তাই কথা বলার জন্য নতুন প্রসঙ্গ খুঁজে বলে উঠল হাসি হাসি গলায়,

“আমি তোমাদের বিয়ের জন্য সত্যিই উৎফুল্ল হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। ”

মেহু বিরক্ত হলো খুব।জিজ্ঞেস করল,

“ হ্যাঁ তো?”

সাঈদের গলাটা এবার নরম শোনাল। জিজ্ঞেস করল,

“ তুমি ভালো আছো মেহু?”

মেহু উত্তর দিল না। মুখের উপরই কলটা রেখে দিল। যাকে ভালোবাসবে না, যার সাথে সম্পর্কে জড়াবে না কখনো তার সাথেই কেন এই রাতদুপুরে কথা বলতে হবে? তার খোঁজটাই কেন নিতে হবে?তাকে কি ফের আরো বেশি দুর্বল করে দিতে চায় সাঈদ?

#চলবে….

এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-০৮

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_০৮
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

পুরো একসপ্তাহ মেহু ঘরবন্দি হয়েই কাঁটাল। না হোস্টেলে ফিরে গেল না তো ভার্সিটিতে গেল এই সাতটা দিন।চারদিন হলো মেয়েটা জ্বরও বাঁধিয়েছে শরীরে।এর মাঝে অবশ্য জ্যোতি এসেছিল একবার। মেহুর সাথে অনেকক্ষন সময় কাঁটিয়ে চলে গিয়েছিল।মেহেরাজ চিন্তিত হলো বোনের এই বেহাল দশা দেখে। হঠাৎ কিই হলো? কেন এমন হয়ে গেল মেহু? কিছু বুঝে আসল না৷ তবে এইটুকু বুঝল যে মেহুর সম্বন্ধে সবটাই জ্যোতি জানে। তবুও ইচ্ছে করেই তাকে কিছু বলছে না। মেহেরাজ মনে মনে বিরক্ত হলোও জ্যোতির উপর। চোখেমুখে সে বিরক্তির রেশ ফুটিয়েই রিক্সা থেকে নামল সে। ভাড়া মিটিয়ে বোনের জন্য কিনে নিল ফুসকা,কাঁচের চুড়ি আর বেলিফুলের সুগন্ধী মালা। সে জানে এসব পেলে তার বোন কিছুতেই মন খারাপ করে থাকতে পারবে না। হাসিমুখে সেসব নিয়ে পুণরায় রিক্সা নিয়ে বাসায় পৌঁছাল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে কলিং বেল বাঁজাতেই দরজা খুলল মেহু। পরমুহুর্তে মেহুর থেকে কিছুটা পেঁছনে দেখা মিলল এক অনাকাঙ্খিত মুখের। জ্যোতি দাঁড়িয়ে৷সদ্য অফিস থেকে ফেরা মেহেরাজ একবার তাকিয়েই নজর সরাল সঙ্গে সঙ্গে।আলতো হাতে বোনের কপাল ছুঁয়ে বুঝার চেষ্টা করল জ্বর আছে কি নেই। বোধ হলো এখন মেহুর শরীরে জ্বর নেই৷ তাই আগ বাড়িয়ো কিছু জিজ্ঞেস না করে চোখমুখে ক্লান্তি নিয়ে হাতের জিনিসগুলো মেহুর হাতে ধরিয়ে দিল।পা বাড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল জ্যোতিকেও।যাওয়ার আগে শুধু মেহুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“ ফুসকা, চুড়ি আর বেলিফুলের মালা পেয়েও মন খারাপ করতে নেই মেহু। তাহলে ভাবব তুই এসব পেয়ে খুশি হসনি৷”

কথাটা বলেই চলে গেল নিজের ঘরে। শার্ট খুলে, তোয়ালে নিয়ে ডুকল ওয়াশরুমে৷ এই শীতের মধ্যেও গোসল সারল।পরমুহুর্তে টাউজার আর ছাঁইরঙ্গা টিশার্টের উপর জ্যাকেট পরে রুম ছেড়ে বের হলো৷ ভেজা চুল গুলোতে ঝাড়া দিয়ে বসার ঘরে চোখ বুলিয়ে চলে গেল মেহুর ঘরে। গম্ভীর গলায় বলে উঠল,

“মেহু? তোকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করব।আমার ঘরে আয় তো। ”

জ্যোতি তাকাল একবার দুইজনের দিকে। ভাবল তার সামনে বলতে পারবে না বলেই হয়তো মেহেরাজ মেহুকে নিজের ঘরে ডাকছে৷ এর থেকে ওকে ঘর ছেড়ে যেতে বললেই তো হতো। সে কি দাঁড়িয়ে থাকত কথা শোনার জন্য? তাই আর দাঁড়াল না৷ যেখানে নিজের উপস্থিতি অস্বস্তিজনক সেখান থেকে সরে আসাটাই উত্তম।তাই পা বাড়িয়ে নিয়েই বলল,

“ আপনারা কথা বলুন মেহোরাজ ভাই। আমি বাইরে আছি। ”

মেহেরাজ ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল এবারে। গম্ভীর স্বরে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে শুধাল,

“ তোকে যেতে বলিনি আমি। ”

জ্যোতি মাথা নাড়াল।উত্তরে বলে উঠল,

“জানি। কিন্তু আমার কারণেই তো নিজের ঘরে ডাকছেন আপুকে। আপুর শরীর খারাপ তাই মনে হলো এখানে কথা বললেই ভালো হবে। ”

মেহেরাজ ছোট শ্বাস টানল।তখন মেহুর কপালে হাত রেখেই বুঝেছল মেহুর শরীরে জ্বর নেই।তাই ডেকেছিল।কিন্তু নির্দিষ্ট ভাবে জ্যোতির জন্যই তো ডাকেনি। ভরাট গলায় শুধাল,

“ তোর কারণে কেন ওকে ঘরে ডাকব?”

জ্যোতি তাকাল মেহেরাজের দিকে৷ সরাসরি দৃষ্টি মিলিয়েই বলে উঠল,

“ আমাকে এই ঘর ছেড়ে বের হওয়ার কথা বলতে পারছেন না বলেই হয়তো।”

রাশভারী কন্ঠে উত্তর এল,

“ বলার হলে তোকে সরাসরিই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলতাম আমি। ”

জ্যোতি অল্প হাসল। মৃদু আওয়াজে বলল,

“ হয়তো ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে বলেননি। হতেই পারে।”

মেহেরাজ বিরক্ত হলো। বিরক্তির মাত্রটা বেশি বলেই কপালে ভাজ নিয়ে চাইল জ্যোতির দিকে। তাচ্ছিল্য নিয়ে ভরাট স্বরে বলল,

“ যার মাঝে ভদ্রতার ভ নেই সে মেয়ে যে ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে কি বলা উচিত-অনুচিত তা নিয়ে উল্টোপাল্টা ভাববে এটা স্বাভাবিক।”

জ্যোতি তীক্ষ্ণ চাহনিতে চাইল এবারে।ভদ্রতার ভ নেই? মানে সে কি চরম মাত্রার অভদ্র?মেহেরাজ তার সম্বন্ধে এই কথাটা কেন বলল? কি অভদ্রতা করেছে সে?চোখমুখে হঠাৎ তেজ দেখা গেল। শক্ত গলায় স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,

“ হ্যাঁ, আমি অভদ্র। ”

কথাটা বলেই পা ঘুরিয়ে চলে যেতে নিলেই মেহু বলে উঠল,

“ ভাইয়া তো তোকে যেতে বলেনি জ্যোতি। বস এখানে।”

জ্যোতির গলা মুহুর্তেই পাল্টে গেল। নরম গলায় বলল,

“ বাইরেই তো আছি। একটু হেঁটে আসি না আপু?”

মেহু হাসল এইবারে। মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলতেই জ্যোতি বেরিয়ে গেল নিজের মতো। মেহেরাজ সেদিক পানে একবার তাকিয়েই নজর সরাল। ধীর পায়ে বোনের দিকে এগিয়ে এসেই ফের হাত রাখল মেহুর কপালে।ত্বকের উষ্ণতা অনুভব হলো না খুব করে। মৃদু কন্ঠে বলল,

“জ্বর ছেড়েছে মেহু?”

মেহু মাথা নাড়াল।উত্তরে বলল,

“হ্যাঁ ভাইয়া। ”

মেহেরাজ মৃদু হাসল।বিছানার উপরই অবহেলায় পড়ে আছে তার আনা বেলিফুলের মালাটা আর চুড়িগুলো। একবার সেগুলো দেখে নিয়েই বলল,

“ এতোটা মন খারাপ? এসবেও মন খারাপ সারল না?ভাইয়াকে বল না কেন মন খারাপ। ”

মেহু চুপ রইল এবারে। এই কটাদিনে সবসময়ই মেহেরাজ জানতে চেয়ে তার কাছে মন খারাপ কেন, কি কারণে। তবুও বলা হয়নি। ভাইয়ের এমন আকুলতা দেখে আপসোস হলো মেহুর।মন খারাপ ভুলানোর এত চেষ্টা, এত ভালোবাসা, এত যত্ন সবকিছুর পরেও কিনা সে একজনের ভালোবাসা না পাওয়ার অভাবে হা-হুতাশ করছে?তার কি ভালোবাসার মানুষের অভাব আছে?জ্যোতি মেয়েটাও কতো ভালোবাসে তাকে, তার চাচা-চাচীরা কতোটা ভালোবাসে, তার ভাই কতোটা ভালোবাসে৷ এতজনের ভালোবাসার পরও তার কাছে কিনা গুরুত্ব পেল শুধু একজনের ভালোবাসাটাই? মেহু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেহেরাজ ফের জিজ্ঞেস করল,

“তুই কি অন্য কাউকে ভালোবাসিস মেহু? কারোর সাথে সম্পর্কে আছিস?আমাকে বল। ট্রাস্ট মি, আমি না করব না। মেনে নিব তোদের সম্পর্কটা। প্লিজ বল,তবুও এভাবে মনমরা হয়ে থাকিস না। বল না, কাউকে ভালোবাসিস?”

মেহু চমকাল।উত্তর না দিয়ে ফের জিজ্ঞেস করল,

“হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে? ”

মেহেরাজ চিন্তিত চাহনিতে তাকাল। নরম স্বরে বলতে লাগল,

“ আমি তোকে নিয়ে চিন্তিত মেহু। এই কয়দিন দিনরাত ভেবে চলেছি তোর এই অসুস্থতা, ঘরবন্দি জীবন নিয়ে৷কি হয়েছে হঠাৎ?কেউ কিছু বলেছে মেহু?কেন এমন করছিস? কারো সাথে কিছু হয়েছে? নাকি মেঘের সাথে বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে? আমিই তো প্রথম থেকেই বলেছি তুই না বললে কিছুই হবে না মেহু। ভাইয়ার উপরে এটুকুও বিশ্বাস নেই? আমি মেঘকে বলেই দিয়েছি এটা সম্ভব নয়। তবুও এভাবে থাকিস না। প্লিজ!”

“ওটাতো বাবামায়ের ইচ্ছে ছিল ভাইয়া। তুমি নিষেধ করলে কেন? আমি কি একবারও অমত জানিয়েছিলাম?

“ মনের বিরুদ্ধে বিয়ে করে সুখী হতিস না মেহু। বাবা মায়ের ইচ্ছে ছিল ঠিক তবে বাবা মায়ের এও ইচ্ছে ছিল যাতে তাদের মেয়েটা সুখে থাকে, ভালো থাকে। তো কোনটাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত? ”

মেহু এবারে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।বলল,

“আমি কখনোই কাউকে বিয়ে করতে চাইনা ভাইয়া।”

বোনের কান্না দেখে মাথায় হাত বুলাল মেহেরাজ। আলতো স্বরে বলল,

“ আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিলি না যে? কাউকে ভালোবাসিস?”

মেহু এবারেও উত্তর দিল না। কি উত্তর দিবে? সে ভালোবাসে ঐ সাঈদ নামক লোকটাকে এই কথাটা?

.

বাসার দরজাটা খোলাই ছিল। জ্যোতি কিয়ৎক্ষন সোফায় বসে পুরো বাসাটা চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিল। বেশ গোছাল।শুনেছে মেহেরাজ চাকরীতে জয়েন করার পর এই একবছরই হয়েছে মেহু বাসা ছেড়ে হোস্টেলে থাকে। অবশ্য এতে নাকি প্রথমে মেহেরাজ ভাই রাজি হয়নি। পরে অবশ্য বোনের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে পারেননি বলেই বোনকে হোস্টেলে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী ধরতে গেলে প্রায় একবছর হলো মেহেরাজ একাই এই বাসাতে থাকে। অথচ বাসা দেখে বুঝা যায় না এখানে একটা ছেলে থাক । সবকিছুই কতোটা গোছাল রেখেছে ছেলে হয়েও৷জ্যোতি মনে মনে বোধহয় প্রশংসাও করল মেহেরাজের এই গুণটার। সবকিছুতেই পার্ফেক্ট! শুধু তার সাথেই গ্রামের সেই ওড়নার ঘটনার পর থেকে কেমন একটা ব্যবহার করে।ভুল বুঝেই বলে ফেলেছিল নাহয়। তার বিনিময়ে কি সে কম কিছু শুনেছে?জ্যোতির মস্তিষ্ক উত্তর দিল, না। বরং তার চেয়ে বেশিই শুনেছে সে৷ তাও এই ব্যাক্তির গুণে মুগ্ধ হচ্ছে সে?প্রশংসা করছে মনে মনে?কথাগুলো একবার ভাবতেই জ্যোতির রাগ হলো। শুধু শুধুই রাগ হলো। বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তৎক্ষনাৎ।চোখে পড়ল দরজা পেরিয়ে আসা সামান্তাকে। চোখেমুখে উৎফুল্লতা। হাতে একটা বক্স। বোধহয় খাবারের বক্স। জ্যোতি মিনমিনে চোখে চেয়ে থাকতেই সে এগিয়ে এল। মৃদুস্বরে শুধাল,

“জ্যোতি?তুমি এখানে?”

জ্যোতি মৃদু হাসল।ভদ্রভাবে উত্তর দিল,

“মেহু আপুর জ্বর শুনেছিলাম৷ তাই দেখতে এলাম। কেমন আছেন আপু?”

সামান্তা উত্তরে বলল,

“ ভালোই আছি। তুমি?”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

সামান্তা উৎসুক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“মেহু আপু কোথায়?আর রাজ ভাইয়াই বা কোথায়?দেখেছো জ্যোতি? ”

“মেহু আপুর ঘরেই আছে আপু৷ উনারা হয়তো কোন প্রয়োজনীয় বিষয়ে কথা বলছেন তাই এখানে বসে আছি আপু।”

সামান্তার মুখ চুপসে এল বোধহয়।বলল,

“ আমি তো রাজ ভাইয়াকে ফিরতে দেখেই তড়িঘড়ি করে আম্মুর বানানো খাবার বক্সে করে নিয়ে আসলাম। ঠান্ডা হয়ে যাবে যে।”

জ্যোতি বিস্ময় নিয়ে চাইল। সামান্তা আর মেহেরাজ ভাইয়ের মাঝে যে কিছু আছে তা সে সেদিন ছাদের সে চিঠিটা, মেহেরাজের প্রতি সামান্তার চাহনী থেকেই আন্দাজ করেছিল। তবে এখন এই যে মেহেরাজকে দেখার আকুলতা, কতক্ষনে ফিরছে তা খেয়াল করেই ছুটে আসা এসব থেকে নিশ্চিত হলো। উত্তর দিল,

“উনারা রুমেই। ডাকতে পারেন আপু৷ ”

“প্রয়োজনীয় কথা বলছেন বললে না?যদি রাগ করে?”

“আপনার উপস্থিতিতে কিছু বলবে না হয়তো মেহেরাজ ভাই।”

সামান্তা উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“ কেন বলবে না? ”

“ভালোবাসার মানুষদের উপর আমরা বিরক্ত হতে পারিনা কখনো তাই।”

“মানে?”

জ্যোতি আচমকা প্রশ্ন করল স্পষ্ট গলায়,

“মেহেরাজ ভাইকে ভালোবাসেন তো আপনি? ”

সামান্তা চমকাল, অবাক হলো খুব করে।মুহুর্তেই জিজ্ঞেস করল,

“ তুমি কি করে জানলে ? ”

জ্যোতি স্মিত হাসল৷ গম্ভীর স্বরে বলল,

“জেনে গেলাম কোনভাবে৷আপনি রুমে গিয়ে দেখুন আপু। আমি একটু ছাদ থেকে আসছি। ”

সামান্তা মিনমিনে চোখে তাকিয়ে থাকল। কি আশ্চর্য!কি করে জানল জ্যোতি?

.

জ্যোতি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গেল।একনজর ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখল।সন্ধ্যা সাতটা। আশপাশে আঁধার নামলেও ছাদে মিটমিট করা আলো। একনজর তাকাল আশপাশে৷ ছাদটা নিঃসন্দেহেই সুন্দর। সন্ধ্যানামা শহরে তিনতালা বাড়ির ছাদ থেকে রাস্তার যানবাহনগুলো চোখে পড়ল সর্বপ্রথম।শীতল বাতাসে শিহরন বইল লোমকূপ জুড়েও।সে কারণেই পরনের শালটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়েই কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে থাকল আঁধার ঘেরা আকাশে। পরমহুর্তেই কি মনে করে বাড়িতে কল করল। কিন্তু কল তুলল না দাদী বা মিথি কেউই। জ্যোতি পরপর দুবার কল দিল। পরে বাধ্য হয়ে মিনারকেই কল দিল। কল রিসিভড হলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। বলল,

“আসসালামুআলাইকুম মিনার ভাই,বাড়ি ফিরেছো?”

মিনার অল্প হেসে উত্তর দিল,

“ ফিরলাম মাত্র, কিছু বলবি? ”

“ মিথিটা বোধহয় ঘুমোচ্ছে। কল তুলছে না। বাড়ির সবাই কেমন আছে? ”

“ ভালোই আছে সবাই৷ মিথি তো আজ পড়ছে দেখে আসলাম। খুব মন দিয়ে৷ দাদী বোধহয় পড়া নিয়ে বকেছে।”

জ্যোতি ছোট শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল,

“ ওহ, আব্বা কেমন আছে জানো? ”

“ভালো আছেন যদিও দেখা হয়নি মামার সাথে তিনদিন যাবৎ। তুই শুধু শুধু চিন্তা করিস না৷ ওরকম বুকে ব্যাথা তো গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেমের কারণেও হতে পারে৷ সিরিয়াস কিছু না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ ছোটছোট করে চাইল জ্যোতি। মৃদুস্বরে বলল,

“তেমনটা হলেই ভালো মিনার ভাই। ”

“হ্যাঁ।”

“ তোমার চাকরির ইন্টার্ভিউ ছিল না কয়েকদিন আগে? কি হলো তার মিনার ভাই?”

মিনার তিক্ততা প্রকাশ করল। বিরক্ত সুরে বলল,

“চাকরি করার ইচ্ছে চলে গেছে।ব্যবসায় হাত দেব।”

“আচ্ছা, রাখলাম তাহলে মিনার ভাই? নিজের যত্ন নিও। ”

“ হু রাখ।”

জ্যোতি রেখে দিল কল৷ পরমুহুর্তেই অনুভব করল তার পেছনে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে। একমুহুর্তের জন্য বোধহয় শিউরেও উঠল। সন্ধ্যার আঁধারনামা শহরে একা ছাদে মিটমিটে আলোর মধ্যে হুট করে কেই বা উপস্থিত হবে তার পেছনে? শুকনো ঢোক গিলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পেছন ঘুরে চাইল সে। মানুষটা মেহেরাজই। বুকে হাত গুঁজে ছাদের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কালো রংয়ের জ্যাকেট আর টাউজার পরনে৷ ভেজা চুল থেকে টপাটপ পানিও গড়াচ্ছে কপালে।কেন জানি মিটমিটে আলোতে এই পুরুষটাকে এই রূপে বিমুগ্ধ মনে হলো জ্যোতির কাছে।পরমুহুর্তেই কি যেন বুঝে উঠে নজর সরাল দ্রুত। কানে আসল মেহেরাজের গলায় বলা,

“ সব ছেড়েছুড়ে এই অন্ধকারে ছাদে এসে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আশ্চর্য!”

জ্যোতি তাকাল না এইবারে। উত্তরে বলল,

“ দেখতে এলাম আপনাদের ছাদটা।”

বিরক্ত স্বরে ফের কথা আসল,

“ দেখার প্রয়োজনটাই বা কি?তোর জন্য শুধু শুধু আমায় এতদূর আসতে হলো। ”

জ্যোতি স্পষ্টভাবেই জিজ্ঞেস করল,

“কেন আসলেন?”

“ মেহু খুঁজছিল তোকে৷ তুই তো আর বলে আসিসনি যে তুই এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকবি। আর মেহু অসুস্থ বলে তুই রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসে আমায় ধন্য করলি। এখন কি অসুস্থ মেহুকে পাঠাতাম তোকে খুঁজতে?”

জ্যোতির খারাপ লাগল। শুধু শুধুই খাটাল ওদের।বোধহয় বলে আসাটা উত্তম হতো। তাই মৃদু আওয়াজে বলল,

“ বলে আসাটা উচিত ছিল হয়তো আপুকে।কিন্তু সামান্তা আপুকে তো বলেছিলাম আমি।”

মেহেরাজ ফের বিরক্ত হলো যেন। বলল,

“ সামান্তা সহজ সরল মেয়ে, তোর কথা হয়তো অতো মন দিয়ে শুনেইনি। তাই ভুলে গিয়েছে হয়তো।”

জ্যোতি ঠোঁটে ঠোঁট চাপল। এক মুহুর্তের জন্য তার ভাবা হয়ে গেল যে মেহেরাজ ভাই আর সামান্তা আপুর ভালোবাসাটা খুবই চমৎকার ভালোবাসা। তাইতো নির্দ্বিধায় ভালোবাসার মানুষটার সম্বন্ধে সহজ সরল সম্বোধন নিয়ে কথা বললেন। অবশ্য মেহেরাজ দায়িত্ববান ছেলে। ভালোবাসার মানুষকে নিশ্চয় অন্যের সামনে দোষী প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগবে না।মৃদু হাসল জ্যোতি এসব ভেবে।বলল,

“হতেও পারে। উনি আপনার জন্য তখন খুবই উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন।”

ভ্রু জোড়া কুঁচকে রেখে মেহেরাজ শুধাল,

“মানে? ”

“ আপনি তো জানেন সবটা৷ তবুও এমনভাবে মানে জিজ্ঞেস করছেন যেন কিছুই জানেন না।”

মেহেরাজ দৃঢ় চাহনিতে তাকাল জ্যোতির মুখপানে। তার দিকে মেয়েটার দৃষ্টি নেই। গম্ভীরে স্বরে শুধাল,

“আমি যা জানি তা তোর জানার কথা নয়। ”

জ্যোতি ঠোঁটে ঠোঁট চাপল। দুইজন মানুষের প্রেম নিয়ে কথা বলাটা বোধহয় ব্যাক্তিত্বহীনতা বোঝায়। আর যায় হোক যেকোন জায়গা দুইজনের ব্যাক্তিগত প্রসঙ্গে নাক না গলানোটাই উত্তম। তাই প্রসঙ্গ বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

“ সেই প্রসঙ্গ বরং বাদ দিন মেহেরাজ ভাই।আপনি আমায় একটা কথা বলবেন?সাঈদ ভাই কি কাউকে ভালোবাসেন? কারোর সাথে প্রেম আছে উনার ? ”

হুট করেই মুখভঙ্গি পাল্টে গেল মেহেরাজের। বিরক্তির ছাপের জায়গায় এবার রাগ এসে ভীড় করল যেন। মুখ টানটান হলো। মনে পড়ল সেদিন রাতে রেস্টুরেন্টের সামনে সাঈদ আর জ্যোতি সহ সাক্ষাৎয়ের কথাটা। মনে মনে কি রাগ হলো? ইর্ষা করল নিজেরই প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে? এত মানুষ থাকতে জ্যোতিকেই বা কেন তারই বন্ধুর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে হবে? আর কেউ কি নেই? মেহেরাজ রাগ সামলে নিল। চেহারা শিথীল করে ঠান্ডা গলায় শুধাল,

“ কেন?কারোর সাথে প্রেম থাকলে কি তুই কষ্ট পাবি? ”

জ্যোতি উত্তর দিল,

“হয়তো পাব।পাওয়ারই কথা।”

কথাটা বলেই চলে গেল জ্যোতি। মেহেরাজ সে যাওয়ার পানে তাকিয়ে কপাল কুঁচকাল। সাঈদের প্রেম থাকলে জ্যোতি কেন কষ্ট পাবে ?পরমুহুর্তেই এক ভয়ানক চিন্তা আসল মাথায়। জ্যোতি কি কোনভাবে সাঈদকে ভালোবাসে?কোনভাবে ও সাঈদের প্রতি দুর্বল? মেহেরাজ মাথা চাপল দুইহাতে। চোখ বুঝে নিল জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে। আশ্চর্য জনক ভাবে তার নিজের উপরই হঠাৎ রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে হলো নিজের দুইগালে দুই থাপ্পড় বসাতে৷ কোথাও বোধহয় যন্ত্রনাও অনুভব হলো।বিষাদময় যন্ত্রনা।হৃদয়ে বুনা সদ্য প্রস্ফুটিত প্রণয় ঝরে যাওয়ার যন্ত্রনা।

.

জ্যোতি মেহুদের বাসা থেকে হোস্টেলে নিজের রুমে ফিরল সাড়ে আটটায়। মেহু ব্যাতীতও সেই রুমে আরো একটা মেয়ে ছিল। মেয়েটার নাম রিতু। বয়সে তার বয়সীই। ভাগ্যক্রমে একই ভার্সিটিতে, একই ইয়ারে হলেও তাদের ডিপার্টমেন্টটাই শুধু ভিন্ন। রিতু মেয়েটাও মেহুর মতোই সহজ সরল। আর সহজ সরল বলেই হয়তো জ্যোতির কাছে এই দুটো মেয়ে এতোটা পছন্দের। তাই ফিরতে না ফিরতেই মেহুর সব খবর জানাল রিতুকেও। রিতু হাসল মৃদু। বলল,

“ পরেরবার আমি আর তুই একসাথেই মেহু আপুকে নিয়ে আসতে যাব জ্যোতি। কতদিন একসাথে আড্ডা হয় না।”

জ্যোতি মাথা নাড়াল সম্মতি জানিয়ে। কিন্তু কিছু একটা বলতে নিতেই নিজের ফোনটা বেঁজে উঠল। জ্যোতি স্ক্রিনের চাইল। বাড়ির নাম্বার। মুহুর্তে কল তুলতেই ওপাশ থেকে শোনা হেল মিথির কান্নারত স্বর। জ্যোতির বুকটা ধ্বক করে উঠল। অস্থিরতা, আতংক সব যেন ঘিরে ধরল এক মুহুর্তেই। দ্রুততার সঙ্গে বলল,

“ এই মিথি? এই?কাঁদছিস কেন এভাবে?কি হয়েছ?এই উত্তর দে।”

#চলবে…