Sunday, June 29, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 309



চন্দ্রাণী পর্ব-১১+১২

0

#চন্দ্রাণী (১১)
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে কিছুক্ষণ ধরে। চন্দ্র বের হয়ে কাচারি ঘর পার হতে পারলো না তার আগেই বৃষ্টি পেয়ে বসলো তাকে।শাহজাহান তালুকদার বাবুল দাশকে বললেন লেবু চা বানাতে তাদের বাপ মেয়ের জন্য। চেয়ারম্যানের কাচারি ঘরে তিনটি রুম। একটা তার নিজের রুম,একটি গেস্ট রুম আর একটা বিরাট হলরুম।
হলরুম জুড়ে মানুষ বসে আছে দশ জনের মতো। চন্দ্র ভাবলো, এই লোকগুলো কেমন সাতসকালে চলে এসেছে। এরা শুধু মাত্র ভালোবাসার জন্যই ছুটে আসে।একজন প্রতিনিধি হিসেবে তার বাবার কতটা সফল তার প্রমাণ এরাই। সবাই নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করছে।

বাবুল দাশ চা বানাচ্ছে, চন্দ্র গিয়ে বললো, “কাকা,ভেতরের বাগানের ওই গন্ধরাজ লেবু গাছে লেবু আছে?”

বাবুল দাশ পান খাওয়া দাঁত বের করে বললো,”আপনে বসেন আম্মা।আমি এখনই যাইতেছি।”

সিরাজ হায়দার বললেন, “ভেতরের পুকুরের পাশের গাছটায় দেখিস এবার লেবু হলো কি-না। ”

বাবুল দাশ একটা ছাতা নিয়ে বের হলো লেবুগাছের দিকে। শাহজাহান তালুকদার মেয়েকে বললো,”খুব চিন্তা হচ্ছে রে মা।এবার চারদিকে যেই অবস্থা দেখছি,দিন দিন সব খারাপ হচ্ছে। ”

চন্দ্র বাবার কাঁধে হাত রেখে বললো, “চিন্তা করো না বাবা।সব ঠিক হয়ে যাবে।যা হবে ভালো হবে দেখিও।”

হঠাৎ করে বাহিরে বাবুল দাশের আর্তচিৎকার শোনা গেলো।হুড়মুড়িয়ে ঘরের সবাই বের হলো ঘর থেকে। বাবুল দাশ ছুটে এসে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। শাহজাহান তালুকদার বাবুল দাশের হাত চেপে ধরে ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে বাবুল?কি হয়েছে তোর?”

চন্দ্র এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। ভয়ে বাবুল দাশের মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। পানি খেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “স্যার,পুকুর পাড়ের আম গাছের ডালে একটা লাশ ঝুলতেছে।নীলির লাশ।”

উপস্থিত সবাই চমকে উঠলো। কি বলছে এসব?

সবাই দৌড়ে ছুটে গেলো পুকুরের দিকে।গিয়ে দেখে নীলির লাশ ঝুলছে গাছের ডালে।
মুহুর্তেই পুরো গ্রামে ছড়িয়ে গেলো এই খবর। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পুরো গ্রামের সবাই ছুটে এলো।নীলির মা এলেন আলুথালু বেশে।মেয়েকে এভাবে গাছের ডালে ঝুলতে দেখে নীলির মা সেখানেই জ্ঞান হারালেন।

শাহজাহান তালুকদারের মাথার রগ দপদপ করছে উত্তেজনায়। থানায় খবর চলে গেছে ইতোমধ্যে। টগর এসে কাচারি ঘরের সামনের পুকুর ঘাটে বসলো। চারদিকে কি হচ্ছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।গত পরশু রাতেই তো একটা খুন হলো,আজ আবার আরেকটা খুন।
এই মেয়েটাকে কে খুন করলো!

চন্দ্র আর শর্মী এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। শর্মী কাঁপছে থরথরিয়ে।কিছুক্ষণ পরেই থানা থেকে পুলিশ এলো।নির্ঝর গাড়ি থেকে নেমে দেখে শর্মী দাঁড়িয়ে আছে। একটা মৃদু শিস দিয়ে নির্ঝর মনে মনে বললো, “মাই লাকী চার্ম!এতো সুইট কেনো?দেখলেই আমার সুগার বেড়ে যায়। ”

টগরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, “তো টগর সাহেব,আবারও দেখা হয়ে গেলো! ”

টগর কটাক্ষ করে বললো, “মাই ব্যাড লাক।”

নির্ঝর হেসে বললো, “বাট মাই গুড লাক।যাই হোক আপনি এখানে কেনো?”

টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “আপনি মনে হয় ভুলে গেছেন কাকে কোন প্রশ্ন করতে হয়?আমার গ্রাম এটা,আমার গ্রামের একটা মেয়ে মারা গেছে আমি থাকবো না এখানে?”

নির্ঝর হেসে বললো, “প্রমাণ লোপাট করতে এসেছেন? ”

চন্দ্র কান খাড়া করে দূর থেকে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করলো।

টগর যারপরনাই বিরক্ত। মুখ কালো করে বললো, “পুলিশের চাকরি করা লোকগুলো এমন ত্যাঁদড় টাইপ হয় কেনো?তাদের মাথায় মগজের বদলে কি গোবর?
প্রমাণ লোপাট করার মতো ব্যাপার থাকলে দিনের আলোয় না,রাতের অন্ধকারেই করতাম।”

নির্ঝর হেসে বললো, “তাহলে স্বীকার করছেন এরকম করেন আপনি? ”

টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “৫ বছরের বাচ্চার ও এই কমনসেন্স আছে,আফসোস পুলিশের নেই।”

শাহজাহান তালুকদার এসে বললো, “স্যার আসছেন আপনি? দেখুন না কি হচ্ছে এসব?আমার তো মাথা কাজ করছে না স্যার। ”

নির্ঝর বললো, “চিন্তা করবেন না।আমি দেখছি।আপনাদের গ্রামের অনেক ঘটনা জানতে পারছি দিন দিন।
আপনাদের এই গ্রামে তো অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ক্রাইম হয়েই চলেছে। ড্রাগ,খুন,কিডন্যাপ,নারী পাচার সবকিছুর আখড়া আপনাদের গ্রাম।”

শাহজাহান তালুকদার বললো, “আপনি দেখুন তদন্ত করুন। অপরাধী যে-ই হোক যাতে ছাড় না পায়।সামনে ইলেকশন, এখনই এসব শুরু করে দিয়েছে ওরা।”

চন্দ্র আর শর্মী এগিয়ে এসে বাবার পাশে দাঁড়ালো।

নির্ঝর জিজ্ঞাসুক হয়ে তাকিয়ে রইলো। শাহজাহান তালুকদার বললো, “আমি কারো নাম নিতে চাই না।আপনি তদন্ত করুন,সব জানবেন।”

নির্ঝর টগরের দিকে তাকিয়ে বললো, “হ্যাঁ, অনেক কিছু জানার আছে বৈকি। যা জেনেছি তাতে এখনই আমার মাথা ভোঁভোঁ করে ঘুরছে।বিয়ে সাদী করি নি,এসব রহস্যের চক্করে পড়ে আমার বউকে না অগ্রীম বিধবা হয়ে যেতে হয়।”
নির্ঝর শর্মী দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। শাহজাহান তালুকদার আরেকটা সিঁড়িতে গিয়ে বসলো।

চন্দ্র মৃদু সুরে বললো, “আপনার ফ্লার্টিং স্কেল খুবই নিম্নস্তরের। ”

টগর বিরক্ত হয়ে চন্দ্রর দিকে তাকালো। এই মেয়েটাকে বড়ই অদ্ভুত মনে হয়।
তার বোনের সাথে কেউ ফ্ল্যার্ট করছে আর সে কি-না তার স্তর হিসেব করছে।

লাশ নামানোর পর দেখা গেলো লাশের হাতে একটা কাগজ আছে।সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো কি লিখা আছে এতে।নির্ঝর কাগজটা খুলে পড়লো। তারপর মুচকি হেসে কাগজটা পকেটে পুরে নিলো।

চলবে……

রাজিয়া রহমান

#চন্দ্রাণী (১২)
টগর নিজের বাসার সামনে বসে আছে। একটা হিসেব তার মাথায় ঢুকছে না।নীলি কেনো আত্মহত্যা করবে?
কিছুতেই মনে হচ্ছে না নীলি আত্মহত্যা করেছে।
বারবার মাথায় একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে টগরের।নীলি যদি আত্মহত্যা করে থাকে তবে তার হাতের মুঠোতে চিঠি এলো কিভাবে?
একটা মানুষ গলায় দড়ি দিলে সে ছটফট করবে,তখন তার সেই শক্তি বা পরিস্থিতি থাকবে না যে একটা কাগজ হাতে ধরে রাখবে।
তারপর আরেকটা কথা, নীলি কিভাবে গাছের এই উঁচু ডালে উঠলো?
যদি কোনো কিছুর সাহায্যে গাছে উঠে তাহলে সেটা কই?

একটা বড় রহস্য লুকিয়ে আছে। টগরকে সবটা জানতে হবে।তার আগে মাথা ঠান্ডা করতে হবে।
এই ইন্সপেক্টরটা ভীষণ ঘাউড়া। সবসময় টগরের সাথে লাগতে আসে।
টগরের ইচ্ছে করে ধরে নাক ফাটিয়ে দেয়।নেহাৎ পুলিশ বলে পারছে না।

টগর বাড়ির পেছনের দিকে গেলো।পুকুরে অনেকগুলো সুপারির বস্তা। সুপারি ভেজানো হয়েছে। সুপারির বস্তার ফাঁকে ফাঁকে কিছু বস্তাতে লুকিয়ে রাখা আছে টগরের প্রাণ ভোমরা।

মুচকি হেসে টগর বললো, “নির্ঝর, তোমার মতো আরো দশজন এলেও আমার টিকিটিও ধরতে পারবে না।”

বস্তার মুখ খুলে টগর একটা বোতল বের করে নিলো।তারপর আবারও আগের মতো রেখে দিলো।
বাড়ি এসে টগর একটা গ্লাস নিয়ে বসলো ঘরের সামনে সিঁড়িতে।
উঠানে অনেকটা শ্যাওলা ধরে গেছে।গাছের শুকনো পাতা পড়ে কেমন বিতিকিচ্ছিরি লাগছে সব।
একটা লুঙ্গি পরে টগর নেমে গেলো বাড়ি পরিস্কার করার কাজে।

একটা ,টুকরি নিয়ে কাদায় আটকে যাওয়া পাতাগুলো তুলে নিলো টগর। তারপর ঝাড়ু দিয়ে নিলো পুরো উঠান।

নীলির মায়ের কান্না শুনে উপস্থিত সবাই কেঁদে উঠলো। বাদ যায় নি চন্দ্র,শর্মীও।নির্ঝর বললো, “এটা একটা পরিকল্পিত খুন তালুকদার সাহেব। প্রথমত এই চিঠি, যেখানে লিখা আছে ওর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।আমি ৯৯.৯% শিওর হ্যান্ড রাইটিং এক্সপার্ট বলবে যে এটা নীলির লিখা নয়।
তর্কের খাতিরে যদি ধরি ও এটা নীলি লিখেছে, সেক্ষেত্রে আরেকটা প্রশ্ন। নীলি যদি আত্মহত্যা করে তাহলে এতো উঁচু ডালে উঠলো কিভাবে?
আমি জেনেছি নীলি গাছে উঠতে জানে না। ধরুন মেনে নিলাম সে গাছে ও উঠতে জানে।কিন্তু ফাঁস দেওয়ার পর মানুষ এতটা ছটফট করে যে এভাবে হাতের মুঠোয় কিছু ধরে রাখা অসম্ভব। ”

শর্মীর বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিচ্ছে। শাহজাহান তালুকদার বাগানে ধপ করে বসে পড়লেন।ঘেমে গেছেন তিনি। এরকম লাশ তিনি ও এই প্রথম দেখেছেন। এই মেয়েটাকে তিনি কতো বার দেখেছেন তাদের বাড়িতে শর্মীর সাথে।
সেই মেয়ের লাশ ঝুলছে তার বাগানে!

শর্মী বাবার ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন মুষড়ে পড়লো। নীলির লাশ দেখে বাবা এরকম ভেঙে পড়েছেন,সে ও তো এরকম কিছু করতে চেয়েছে, বাবা তখন কিভাবে বাঁচতো!

নির্ঝর শাহজাহান তালুকদারের সামনে মাটিতে বসে বললো, “আপনি এতো ভয় পাচ্ছেন কেনো?আপনার বাগানে মেয়েটার লাশ পাওয়া গেছে। কোনো ভাবে আপনি জড়িয়ে নেই তো?”

শাহজাহান তালুকদার হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।চন্দ্র হতভম্ব আর শর্মী ক্ষুব্ধ। শর্মীর ইচ্ছে করলো এই লোকটাকে পুকুরে চুবিয়ে ধরে কিছুক্ষণ এই রকম জঘন্য একটা কথা তার বাবাকে বলার জন্য।

নির্ঝর এক নজর শর্মীর দিকে তাকিয়ে বললো, “এটা আমার ডিউটি,যেহেতু লাশ আপনার বাগানে পাওয়া গেছে তাই আপনি ও সন্দেহভাজনের তালিকায় আছেন।”

শাহজাহান তালুকদার গম্ভীর হয়ে বললো, “বেশ,আপনি না হয় তদন্ত করে সত্যিটা বের করুন।”

নির্ঝর হেসে বললো, “আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় টগর এই কাজটা করতে পারে? ”

শাহজাহান তালুকদার বললেন, “আমার কোনো ধারণা নেই ওর ব্যাপারে। আমি জানি ও ভীষণ উচ্ছৃঙ্খল একটা ছেলে।তবে এসব খুন খারাবি করার মতো কি-না তা জানি না।তবে ওর বাবাকে আমি চিনতাম।ওর বাবা ভীষণ ভালো মানুষ ছিলেন।”

নির্ঝর উঠে দাঁড়ালো। তার টগরের কাছে যেতে হবে।কেনো জানি তার মনে হচ্ছে দুটো খুন কোনো না কোনোভাবে জড়িত।
চন্দ্র এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, “আমি কি আপনার সাথে আসতে পারি?আপনি মনে হয় টগরের সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন। আপনি যদি এলাও করেন আমি আপনার এই কেসটার সাথে থাকতে চাই।না না,কোনো ডিস্টার্ব করবো না। আপনাকে আমার কেমন বোমক্যাশের মতো লাগে। ”

এক দমে এতো কথা বলে চন্দ্র মনে মনে হাসতে লাগলো।

নির্ঝর হেসে বললো, “সত্যবতী ও আসুক তাহলে। ”

চন্দ্র আড়চোখে তাকাতেই নির্ঝর হেসে ফেললো। শর্মী আসলো না।চন্দ্র বললো, “শর্মী,তুই বাড়ি যা।শুভ্র একা আছে।”

নির্ঝর কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হয়ে বললো, “প্রেমের কোকিল যা একটু কুহু সুরে ডেকে উঠতে চাইলো,আপনি সেই কোকিলের গলা টিপে ধরলেন ক্যান আপা?”

চন্দ্রর ভীষণ হাসি পেলো। মন বলছে শর্মীর জন্য এই মানুষটা বেস্ট হবে।শর্মীর মানসিক অবস্থা এখন যেমন, কাউকে ভীষণ দরকার তাকে মেন্টালি সাপোর্ট করার জন্য। চন্দ্র সিদ্ধান্ত নিলো নির্ঝরের সাথে শেয়ার করবে এসব।

টগরদের বাড়ি যেতে যেতে চন্দ্র নির্ঝরকে সবটা জানালো।সব শুনে নির্ঝর মুচকি হাসলো শুধু।

————–

নিয়াজ বসে বসে হিসেব করছে। এমন সময় কাঙ্ক্ষিত নাম্বার থেকে টেক্সট এলো।নিয়াজ মুচকি হেসে টেক্সট পড়তে গিয়ে মুখ কালো করে ফেললো।
বিড়বিড় করে পড়লো, “তালুকদার বাড়িতে লাশ রাখতে গিয়েছো কেনো?চেয়ারম্যান তার নিজের দিকে সন্দেহের তীর দেখলে পুলিশের চাইতে বেশি আক্রমণ করে বসবে।যেখানে তুমি জানো তালুকদার এসবে নেই।তোমার এই অপেশাদারিত্ব ব্যবহারের জন্য সামনের দিকে তোমার সাথে কাজ কম হতে পারে। ”

নিয়াজের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। মেয়েটার লাশটা ও নিজেই রেখে এসেছে ওখানে যাতে সাপ ও মরে লাঠি ও না ভাঙে। পুলিশ যাতে চেয়ারম্যানকে সন্দেহ করে। তাহলে নিয়াজের সবদিকে লাভ।কিন্তু এখন দেখে ব্যাপারটা উল্টো ঘটে গেছে।

নিয়াজ ফিরতি কল দিয়ে বললো, “বস প্লিজ,আমাকে এবারের মতো একটা সুযোগ দিন।আমার ভুল হয়ে গেছে।আর কখনো এরকম হবে না।প্লিজ আমার রুটিরুজি বন্ধ হয়ে যাবে।”

ওপাশ থেকে কেমন রোবটের মতো একটা স্বর বললো, “মাইন্ড ইট।”

খট করে কল কেটে গেলো।নিয়াজের যেনো ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেলো।

চলবে…….
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-১০

0

#চন্দ্রাণী(১০)
সন্ধ্যা বেলা একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। শুভ্র পুকুর ঘাটে বসে ছিলো, শর্মী গিয়েছিলো শুভ্রকে হাত মুখ ধুইয়ে ঘরে আনবে।শ্যাওলা ধরা পিচ্ছিল সিঁড়িতে পা দিতেই পা পিছলে ৫-৬ সিঁড়ি পেরিয়ে শর্মী গিয়ে পানিতে পড়লো।
উপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে শুভ্রর অবস্থা খারাপ। শর্মী উঠে এসে ভাইয়ের হাত মুখ ধোয়ানো শেষ করে বাড়ি যায়।

চন্দ্র বোনকে ভিজে যেতে দেখে তাড়াতাড়ি শুকনো তোয়ালে এনে দিলো। জামা কাপড় পালটে শর্মী রুমে গেলো। রাতের দিকে শর্মীর প্রচন্ড ব্লিডিং শুরু হলো।

হতবাক হয়ে গেলো শর্মী। দেহের ভেতর ছোট্ট যে প্রাণ ছিলো, সে কি তবে নেই?
কলিজা কাঁপতে লাগলো শর্মীর।বিড়বিড় করে আল্লাহকে বললো, “আল্লাহ,আমাকে রহম কর। আমার মধ্যে থাকা আরেকটা প্রাণকে তুমি কেড়ে নিও না।নিতে হলে আমাকে সহ নাও,কিন্তু তাকে নিয়ে যেও না। ”

বুক ভাঙা যন্ত্রণা নিয়ে শর্মী বিছানায় গড়াগড়ি করতে লাগলো। চন্দ্র বোনের রুমে এসে দেখে শর্মী কেমন গড়াগড়ি করছে।
ব্যতিব্যস্ত হয়ে চন্দ্র শর্মীকে জড়িয়ে ধরলো। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে বোন,আমাকে বল?”

আজ আর শর্মী ভয় পেলো না,লজ্জা পেলো না।আজ আর তার কিছু হারানোর নেই।বোনের কোলে মাথা রেখে শর্মী কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আমার আর কিছু রইলো না আপা।আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমার বাবুটা চলে গেছে আমাকে ছেড়ে গো আপা।”

চন্দ্র শর্মীর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “শান্ত হ তুই বোন।একটু শান্ত হয়ে বস।”

শর্মী কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আপা আমি কিভাবে শান্ত হব?আমার তো সব শেষ হয়ে গেলো আপা।নিয়াজ ও চলে গেলো আমাকে ছেড়ে, যাকে রেখে গেলো সে ও তো এখন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ”

চন্দ্র ঠান্ডা গলায় বললো, “নিয়াজ?”

শর্মী বললো, “আমি আর নিয়াজ একে অন্যকে ভালোবাসতাম।এমনকি নিয়াজ আর আমি বিয়ে ও করে নিই।কিন্তু তার পর যখন আমি কন্সিভ করে ফেলি নিয়াজ তখন কেমন পালটে গেলো আপা।নিয়াজ বললো, এই বেবি রাখা যাবে না।কিন্তু আমি তাতে রাজি হতে পারলাম না আপা।আমার বেবি তো পাপের ফসল না।আমাদের বিয়ে হয়েছে। নিয়াজকে সে কথা বলতেই নিয়াজ বললো, ও নাকি আমাকে সত্যিকার বিয়ে করে নি,যে বিয়ে করেছে ওটার কোনো ভ্যালু নেই।সরকারি রেজিস্টারে নাম উঠে নি,ওগুলো ভুয়া কাগজ দিয়ে আমাকে নয়ছয় বুঝিয়েছে বিয়ের নাটক করেছে।ওর আসলে লক্ষ্য ছিলো আমার সাথে রাত কাটানোর। যেহেতু আমি রাজি হচ্ছিলাম না তাই আমাকে বুঝিয়েছে এবার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি ও বোকার মতো সব বিশ্বাস করেছি আপা।
আর এখন দেখ,আমার বেবিটাও চলে গেলো। ”

চন্দ্র হতাশ স্বরে বললো, “এতো বোকা মানুষ হয়?কাকে ভালোবাসলি?শত্রুর সাথে ভালোবাসা হয়?”

শর্মী মাথা নিচু করে বললো, “তখন তো আমি বা নিয়াজ কেউ-ই জানতাম না আমার বাবা আর ওর বাবা একে অপরের ছায়া ও মাড়ায় না।”

চন্দ্র হেসে বললো, “তুই সত্যি খুব বোকা রে বোন।নিয়াজ জানতো না বলছিস তুই?”

শর্মী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বোনের দিকে।

চন্দ্র মলিন হেসে বললো, “নিয়াজ সব জানতো।ও জেনে শুনেই তোর সাথে এরকম করেছে।কেনো করেছে তুই বুঝতে পারিস নি।
জানিস না ওর বাবা আর আব্বার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব। ও চেয়েছিলো তোকে গুঁটি বানিয়ে খেলবে।আব্বাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করার সব পরিকল্পনা নিয়ে ওরা মাঠে নেমেছে এবার।
শুভ্রর ব্যাপারটা মনে করে দেখ,তোর মনে হয় কে করতে পারে এসব কাজ?এটাও নিয়াজের কাজ।নিয়াজই শুভ্রকে ড্রাগ দিয়েছে।

ও চেয়েছিলো তোর প্রেগন্যান্সির খবরটা ছড়িয়ে দিয়ে আব্বার বদনাম ছড়িয়ে দিবে।আর লজ্জায় অপমানে তুই ও হয়তো কোনো স্টেপ নিবি।আব্বা তখন পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।সবার কাছে আব্বা ছোট হয়ে যাবে আর ওরা জিতে যাবে।
ওদের দীর্ঘ দিনের প্ল্যান ছিলো এসব।একটু একটু করে এগিয়েছে খাঁনেরা এবার।”

শর্মী হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। আপার সব কথা সত্যি।আপা একটা বর্ণ ও মিথ্যে বলে নি।

চন্দ্র বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, “এই যে যে ছোট্ট প্রাণটা দুনিয়ায় আসলো না বলে তোর এতো কষ্ট হচ্ছে, একবার ভেবে দেখ তো আব্বা মা’র কি তোর জন্য কম কষ্ট হতো যদি তুই ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নিতি।অথবা যখন সবাই জেনে যেতো তোর এই ব্যাপারটা। তুই তোর সন্তানের জন্য সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে দুনিয়ায় আনতি,আব্বা মাকে তখন লোকে কেমন থুথু দিতো ভেবে দেখেছিস একবার?
কেউ কি বিশ্বাস করতো তোরা বিয়ে করেছিস?না-কি যে এই কাজ করেছে সে স্বীকার করতো কিছু বল?
দিন শেষে কষ্ট আমরা সবাই পেতাম।

আমার কথা হয়তো তোর কাছে স্বার্থপরের মতো লাগছে,মনে হতে পারে আমি ভীষণ জঘন্য। তবে বাস্তবতা এটাই আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।ওই ছোট প্রাণটা এই দুনিয়ায় এলে তাকে এই সমাজের মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে দিত না।
যা হওয়ার হয়েছে, আব্বা মা কাউকে কখনো ঘুণাক্ষরেও কিছু জানানো যাবে না। আব্বা এই শক নিতে পারবে না শর্মী।”

শর্মী অঝোরে কাঁদতে লাগলো। দেহের ভেতর যে এতো দিন গুটিসুটি মেরে বসে ছিলো সে আজ চির বিদায় নিয়ে চলে গেছে সবাইকে স্বস্তি দিতে।

চন্দ্র বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, “বোন আমার, এটা ভেঙে পড়ার দিন নয়।নিজেকে শক্ত করে তোলার দিন।ভেতরে ভেতরে নদীর মতো একূল ওকূল ভেঙে গেলেও উপরে উপরে নিজেকে পাথর করে ফেলতে হবে।
এই সমাজ দুর্বলকে জায়গা দেয় না।যেই কাপুরষ কাপুরুষের মতো তোর শরীরকে নোংরা করতে চেয়েছিলো, নোংরা তুই হস নি।নোংরা হয়েছে সে।

মানুষের জীবনে কতো দুর্ঘটনা ঘটে যায়।ভেবে নিবি এটাও একটা দুর্ঘটনা তেমনই। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নে,এমনভাবে বাঁচবি যে তোকে দেখে সে নিজেই যেনো ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে। ”

শর্মী মাথা নিচু করে বললো, “আমি যে তাকে এখনো ভালোবাসি আপা।”

চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “তবুও ভুলতে হবে যে বোন।”

শর্মী বললো, “আপা, নিয়াজ কি আমার কাছে আর ফিরে আসবে না?আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি আপা, অনেক বেশি। ওকে বল না একবার ফিরে আসতে।ও একবার সরি বললেই আমি সব ভুলে যাব।”

চন্দ্র অপলক বোনের দিকে তাকিয়ে বললো, “হায়রে বোকা মেয়ে,অন্ধ হয়ে ভালোবাসলি যাকে খবর নিয়েছিস তাকে নিয়ে? ও ফিরতে চাইলেও তুই ফিরিয়ে নিবি না।কারণ নিয়াজ তোকে ঠকিয়েছে।নিয়াজ আরো ৫ বছর আগেই বিয়ে করেছে, ওর ৪ বছরের একটা ছেলে আছে ”

শর্মী চমকে উঠলো শুনে। মাথায় যেনো বাঁজ ভেঙে পড়লো ওর।চন্দ্র একটু জিরিয়ে বললো, “আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্য করেন।আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে পেছনের সব কিছু ভুলে নিজের জীবন গুছানোর চেষ্টা কর।আমি সবসময় তড় পাশে আছি।”

শর্মীর পুরো পৃথিবী যেনো থমকে গেলো।এতো বড় ধোঁকা খাবে সে কখনো ভাবে নি।নিয়াজ এতো জঘন্য মানুষ!

রাতের খাবার টেবিলে শর্মী গেলো না।চন্দ্র ও ডাকাডাকি করলো না খুব একটা। একা থাকুক কিছুক্ষণ। নিজেকে সামলাতে হলে একা একা আগে মনের সাথে যুদ্ধ করতে হবে তার।তবে শর্মীর অনুপস্থিতিতে ওর রুমে গিয়ে একটা পেইন্টিং এর মধ্যে
একটা ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়ে এলো চন্দ্র।

রাতে চন্দ্র এসে বললো, “আমি তোর সাথে শুই আজকে?”
শর্মী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, “না আপা।আজ রাতটা আমি একা থাকতে চাই।”

চন্দ্র আর বাড়াবাড়ি করলো না। শর্মী সারারাত গলাকা**টা মুরগির মতো তড়পাতে লাগলো মন ভাঙার যন্ত্রণায়।
পাশের রুমে বোনের ছটফটানি দেখে চন্দ্র কেঁদে বালিশ ভেজাতে লাগলো।
অসহ্য রকমের যন্ত্রণা লাগছে চন্দ্রর।ইচ্ছে করছে গিয়ে খু**ন করে ফেলতে নিয়াজকে।

সারারাত দুই বোনের কেউই ঘুমাতে পারে নি।

সকালে ঘুম থেকে উঠে চন্দ্র বের হয়ে দেখে শর্মী উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে।
চন্দ্র বের হলো টগরের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বুকের ভেতর রাগ,জিদ,ক্ষোভ।

চলবে……
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-০৯

0

#চন্দ্রাণী(০৯)

শাহজাহান তালুকদার বাহিরে এসে দেখে শর্মী দাঁড়িয়ে আছে। শর্মী বাবাকে দেখে যেনো বুকে বল পেলো।এতক্ষণ এই অভদ্র লোকটা কেমন জঘন্যভাবে তাকে দেখছিলো।

শর্মী বাবার উদ্দেশ্যে বললো, “আপা পিঠা পাঠিয়েছে আব্বা।”

এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে শর্মী চলে গেলো। নির্ঝর বিড়বিড় করে বললো, “এতো তাড়াহুড়ো করে যাওয়ার কি আছে,একটু না হয় বেহায়ার মতো তাকাচ্ছিলাম।সুন্দরের দিকে তাকাবো না?মানুষ তো আমি না-কি! ”

শাহজাহান তালুকদার পিঠার বাটি টেবিলে রেখে বললো, “নেন ইন্সপেক্টর সাহেব।গরীবের বাড়িতে আসছেন,খবর দিয়ে আসলে একটু ডাল ভাতের ব্যবস্থা করে রাখতাম।আমার সাথে একটু নাশতা করেন।”

নির্ঝর হেসে বললো, “ধন্যবাদ চেয়ারম্যান সাহেব।সরকার আমাকে বেতন দেয় জনগণের সেবার জন্য। তাদের বাড়িতে গিয়ে চা নাশতা খাওয়ার জন্য না।এই ইউনিফর্মটা যতক্ষণ গায়ে আছে আমি আমার নীতির সাথে আপোষ করতে পারবো না। ”

শাহজাহান তালুকদার ইমপ্রেস হয়ে বললেন,”এই পর্যন্ত যতজন ইন্সপেক্টর এসেছে আমাদের থানায়,এই প্রথম কাউকে পেলাম যে কিনা নীতির সাথে আপোষহীন। বলুন স্যার,আমার কাছে কেনো এসেছেন? ”

নির্ঝর সামনের দিকে ঝুঁকে এসে বললো, “আপনি তো এখানকার চেয়ারম্যান। আশা করছি আপনি আমার চাইতে ভালো জানবেন,গত কয়েকমাসে আপনার আশেপাশের গ্রাম থেকে ২৬ জন যুবতী নিখোঁজ হয়েছে। সর্বশেষ আপনার গ্রামের ও একটা মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে গত দুই তিন দিন আগে। এই থানার আন্ডারে যতগুলো ইউনিয়ন আছে,সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন কুসুমপুর।
আপনার গ্রামে ওপেনলি মদ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাছাড়া ড্রাগের একটা বড় গ্যাং, গ্যাং এরর মূল হোতা, সব কিছু আপনার কুসুমপুরকে কেন্দ্র করে হচ্ছে। আর গতরাতে জেলেপাড়ায় একটা খুন ও হলো।
এসবের ব্যাখ্যা কি দিবেন আপনি? ”

শাহজাহান তালুকদার সটান হয়ে বসে বললো, “দেখুন অফিসার, আমি গ্রামের সামান্য একজন প্রতিনিধি। আমার ক্ষমতা ও খুব সামান্য। আপনার পোশাকের যেই ক্ষমতা তা আমার নেই।তাই কোথায় কি হচ্ছে, কেনো হচ্ছে তার সমাধান করার ক্ষমতা ও আমার নেই।আমার ক্ষমতা আছে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করার।আমি তা করছি।আমার গ্রামে রাতে পাহারাদার রেখেছি কয়েকজন। রাত হলে তারা পুরো গ্রাম টহল দেয়।স্কুল কলেজের সামনে কোনো বখাটে যাতে আড্ডা দিতে না পারে আমার গ্রামে তার জন্য বেশ কয়েকজনের নামে আমি জিডি করে রেখেছি যারা সন্দেহজনক।
মেয়েদের যাতে ইভটিজিং করতে না পারে সে জন্য ও ব্যবস্থা করে রেখেছি।কোনো মেয়ে অভিযোগ করলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই।আমার পক্ষে যা করা সম্ভব আমি তা করি।
এখন ড্রাগ ডীলিং করে কারা,খুন করলো কে এসব ব্যাপারে আমি আসলেই জানি না।উল্টো আমি নিজেও ভিক্টিম।আমার একমাত্র ছেলে,ও বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। ওকে কে যেনো ড্রাগ দিয়েছে। আমার ছেলেকে নিয়েই আমার দৌড়াদৌড়ি ছিলো গতকাল।

আমি যদি জানতাম সবার আগে আমিই ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতাম।আপনি এসেছেন, তদন্ত করুন।যদি কোনো সাহায্য লাগে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।তবে আমার সন্দেহের কথা বলি।আমার প্রতিপক্ষ কাদের খাঁন, ওর ছেলে নিয়াজ খাঁন।যদি পারেন একটু খেয়াল রাখবেন ওদের উপর। ”

নির্ঝর বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুলে কামড়াতে কামড়াতে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “ঠিক আছে।আজ আসি।”

শাহজাহান তালুকদার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আশা করছি একদিন এই ইউনিফর্ম এর বাহিরে আপনাকে পাবো,একদিন এই গরীবখানায় এসে আমার সাথে দুটো ডালভাত খাবেন।অতিথির সেবা করার সুযোগ পাব। ”

নির্ঝর হেসে বললো, “নিশ্চয়। ”

মনে মনে বললো, “একদিন না,একটা রাগী, দেমাগি মুখ দেখার লোভে হয়তো প্রতিদিনই আসতে পারি।”

চন্দ্র এলো বাবার কাচারি ঘরে বাবাকে ভাত খেতে যাওয়ার জন্য ডাকতে।এসে দেখে শাহজাহান তালুকদার একটা ডায়েরি দেখছেন বসে বসে।
মেয়েকে দেখে ডায়েরি সরিয়ে রেখে হেসে বললেন, “আয় মা,আয়।”

চন্দ্র বসে বললো, “ভাত খাবেন না আব্বা। চলেন, মা অপেক্ষা করছে। ”

শাহজাহান তালুকদার বললো, “ভালো লাগছে না রে মা।কি হচ্ছে গ্রামে এসব।পরশু রাতে নীলি হারিয়ে গেলো, শুভ্রর এরকম একটা কান্ড ঘটলো। আজ আবার জেলেপাড়ায় একটা খুন হলো।”

চন্দ্র বাবার পাশে বসে বললো, “এতো চিন্তা করবেন না আব্বা।পুলিশ আসছে যখন তদন্ত করলে সব বের হয়ে যাবে।
সবাই বলাবলি করতেছে,গতরাতে জেলেপাড়ায় না-কি ওই মাতাল ছেলেটা গিয়েছিলো, সকালে না-কি পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে গেছে।”

শাহজাহান তালুকদার চুপ করে থেকে বললেন,”টগর! ওরে ছেড়ে দিছে আবার ও তো কাদের খাঁনের দলের লোক।ওরে কি আটকে রাখতে পারবে নাকি! ”

চন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর সিদ্ধান্ত নিলো কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলবে।টগর গতকাল শাহজাহান তালুকদারের সাথে যেই ব্যবহার করেছে, তা শুনার পর থেকে চন্দ্রর চাপা ক্ষোভ জমে আছে টগরের উপর।
এই জাত মাতাল লোকটাকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে দিবে চন্দ্র।

চলবে……
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-০৮

0

#চন্দ্রাণী(০৮)

নির্ঝরের সামনের চেয়ারে বসে আছে টগর। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ।নির্ঝর মুচকি হাসছে বসে বসে।

টগর বলেছে সে নিয়াজের একটা কাজেই নদীর পাড়ে গিয়েছিলো।

কাজটা কি জিজ্ঞেস করায় টগর জানায় নিয়াজ একটা ব্যাগ নিয়ে টগরকে যেতে বলেছিলো।টগরের কাজ ছিলো ব্যাগ নিয়ে বটতলায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া।
ব্যাগে কি তা তার জানা নেই।

নির্ঝর টগরের মুখের সামনে ঝুঁকে এসে বললো,”ব্যাগ ভর্তি কি ড্রাগ ছিলো? এরকম কেস তো তোমার এই নতুন না।”

টগর বিরক্ত হয়ে জবাব দিলো, “আমার কাজ ছিলো ব্যাগ নিয়ে যাওয়া,ব্যাগে কি সেটা তদন্ত করা না।সেটা আপনার কাজ,আপনি তদন্ত করুন।”

নির্ঝর হেসে বললো,!”তুমি বেশ স্মার্টলি হ্যান্ডেল করতে চাইছো ব্যাপারটা টগর। বাট ইউ নো,নির্ঝর ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না।এই যে টেবিলের উপর অসমাপ্ত কতগুলো ফাইল জমে আছে, সব কিছু এই কুসুমপুরকে কেন্দ্র করে। আমি এই কুসুমপুরকে কেন্দ্র করে অনেক ক্রাইমের ঘটনা শুনেছি।এখানে বলতে পারো এক প্রকার উপর মহলে অনুরোধ করে জোর করে এসেছি কুসুমপুরের রহস্য সমাধান করতে। আর আমার বিশ্বাস যেদিন সব সলভ হবে,তোমার খেলা ও শেষ হয়ে যাবে সেদিন।আমার সাসপেক্টের তালিকা খুব ছোট টগর, আর তুমি সেখানের ফার্স্ট পার্সন।”

নিয়াজ হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে এলো।টগরকে সে বিশ্বাস করে ব্যাগ নিয়ে পাঠিয়েছে, গাধাটা কতটুকু কি বলেছে কে জানে!

নিয়াজ বসতে যেতেই নির্ঝর বাঁধা দিয়ে বললো, “আপনি বাহিরে অপেক্ষা করুন,আপনাকে আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”

নিয়াজ চিন্তিত হয়ে বের হয়ে গেলো।

নির্ঝরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে হাবিলদার বারেক আলী। নির্ঝরের কথা বার্তা শুনে তার মনে হতে লাগলো এই লোক ঘাউড়া প্রকৃতির লোক যেমন তেমনই এই টগর ও ত্যাঁদড় ভীষণ। দু’জন দু’জনকে আগে থেকেই চেনে এবং কোনো একটা কারণে নির্ঝর স্যার টগরকে সন্দেহ করছে।
তবে টগর নির্ঝর স্যারকে পাত্তা দিচ্ছে না খুব একটা।

টগরকে আরেক রুমে পাঠিয়ে দিয়ে নিয়াজ কে ডেকে নিলো নির্ঝর। ঠোঁটে তার তাচ্ছিল্যের হাসি।

নিয়াজ এসে বসে সালাম দিলো।মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করতে লাগলো নতুন আসা অফিসারকে।নির্ঝর হেসে বললো, ” চা খাবেন নাকি কোক?”

নিয়াজ বিব্রত হয়ে বললো, “না স্যার,কিছু খাবো না।”

নির্ঝর হেসে বললো, “ওকে।তো বলুন,টগরকে কাল রাতে কেনো পাঠালেন ওই জায়গায়।?”

নিয়াজ ভেবে পেলো না টগর কি বলেছে।তবে সিদ্ধান্ত নিলো কৌশলে কথা বলবে।ফাঁসলে টগর ফাঁসবে,সে তো তার পক্ষে সকল এভিডেন্স তৈরি রেখেছে।

হেসে বললো, “স্যার, আমাদের চারটা নৌকা আছে ঘাতে মাছ ধরার।নৌকা,জাল আমাদের। সামনে তো নির্বাচন আমার আব্বার,তাই এই উপলক্ষে আব্বা জেলেদের জন্য কিছু কাপড় পাঠিয়েছে। ”

নির্ঝর হেসে বললো, “বাই এনি চান্স আপনার কি আমাকে দেখলে কোনো ভাবে মনে হয় দুধের বাচ্চা, যে আপনি একটা মনগড়া কথা বলবেন আর আমি বিশ্বাস করে নেবো?”

নিয়াজ বললো, “আপনি চাইলে ক্রসচেক করতে পারেন,আমি এক বিন্দু ও মিথ্যে বলছি না।”

নির্ঝর জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে ব্যাগ এমনভাবে পাঠিয়েছেন কেনো?আর কেনো ই বা টগরকে সরাসরি ব্যাগটা দিতে দেন নি।?”

নিয়াজ আগের মতো সপ্রতিভ জবাব দিলো, “টগর আসলে নেশায় চূর হয়ে থাকে,ওকে বললে ও কাকে রেখে কাকে দিয়ে দিবে নিজেও বুঝবে না।
এতগুলো কাপড় ভুল লোকের কাছে চলে যাবে।আর একবার ভুল হাতে গেলে তো ফিরিয়ে আনা যাবে না।তাই স্যার।”

নির্ঝর হেসে বললো, “আপনি ঠান্ডা মাথায় বেশ গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারেন।আই লাইক ইট।মিথ্যা কথা বললে,অপরাধ করলেও এমনভাবেই কনফিডেন্সের সাথে কথা বলা উচিত। ”

নিয়াজ জানে এসব নির্ঝর তাকে বিব্রত করার জন্য বলছে।না ঘাবড়ে বললো, “মিথ্যা কথার কিন্তু কনফিডেন্স লেভেল লো থাকে স্যার,সত্য কথার কনফিডেন্স হাই থাকে।আমি যেহেতু কোনো অন্যায় করি নি তাই ভয় পাচ্ছি না। ”

নির্ঝর টগরকে ডাকলো।টগর এসে চেয়ার টেনে বসল। নির্ঝর টগরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “ব্যাগে কি ছিলো টগর? যদি উত্তর দাও তবে সাসপেক্টের লিস্ট থেকে তোমার নাম আমি মুছে দিব।”

টগর আগের মতো শান্ত স্বরে বললো, “আমি ব্যাগ খুলে দেখি নি। আমি জানি না।আমার কাজ ছিলো ব্যাগ নিয়ে যাওয়া,আমি নিয়েছি।খুলে দেখা আমার কাজ ছিলো না।”

নির্ঝর অপলক তাকিয়ে রইলো টগরের দিকে কিছুক্ষণ। তারপর গম্ভীর হয়ে বললো, “আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো টগর।”

টগর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “শেষের পরে যদি আর কিছু থাকে আপনি তা ও দেখতে পারেন।টগর এসবের পরোয়া করে না।আর আপনাকে তো আমি কেয়ার ই করি না,আপনার মতো অফিসারদের চেনা আছে আমার। ”

নির্ঝরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। তবুও শান্ত স্বরে বললো, “টগর,৫ বছর আগে মাদক পাচারের অভিযোগ, ভার্সিটি হোস্টেল ড্রাগ সাপ্লায়ার,ড্রাঙ্ক হয়ে একজনকে আহত করা,ভাঙচুর করা সব কিছুই আমার ফাইলে আছে। তোমার জন্য আমি আমার খুব কাছের একজনকে হারিয়েছি।তোমাকে আমি ছাড়ব না।দেখে নিও টগর। ”

টগর হেসে বললো,”আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে করতে আপনার এই জন্ম কেটে যাবে।পরের জন্মে না হয় চেষ্টা করবেন।টগর কাঁচা কাজ করে না,তালে ঠিক থাকে জাতে মাতাল হলেও।”

টগর বের হয়ে গেলো। নিয়াজ হতবাক হয়ে রইলো এই কোন টগরকে দেখছে সে!
মদের নেশায় চূর হয়ে থাকা টগর ইন্সপেক্টরকে জাস্ট পাত্তাই দিলো না।

গলা খাঁকারি দিয়ে নিয়াজ বললো, “স্যার,আপনি টগরকে আগে থেকে চেনেন না-কি? ”

নির্ঝরের মুখ রাগে লাল হয়ে আছে, টেবিলের উপর থাপ্পড় দিয়ে নির্ঝর বললো, “চিনি, খুব ভালো করে চিনি।অভদ্র,অসভ্য,গোঁয়ার একটা ছেলে।রক্তে রক্তে মিশে আছে তার মদ,ড্রাগ।ওর নামে অনেক অভিযোগ আছে ভার্সিটির হলে ড্রাগ সাপ্লায়ার হিসেবে কাজ করে বলে। দুই নার জেলে ও যেতে হয়েছে। আমি ওকে ধরেছিলাম দুই বার।কিন্তু আটকে রাখতে পারি নি। অভিযোগ ছিলো কিন্তু প্রমাণ ছিলো না আমাদের কাছে। কেউ সাক্ষ্য ও দিতে চায় নি। তার উপর যাদের হয়ে কাজ করতো তাদের উপর মহলের সাথে যোগাযোগ থাকে নিশ্চয়, ছাড়া পেয়ে গেছে তাই দুই বারই।
দেশের যুব সমাজকে ধ্বংস করছে ওর মতো লোক।
আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি ওকে ঠিকই ধরবো একদিন না একদিন। ”

নিয়াজ বিড়বিড় করে বললো, “আরে শালা, এতো পুরনো পাপী দেখছি।আমি কি-না ওরে চিনতে পারি নি।”

থানা থেকে বের হয়ে নিয়াজ সিদ্ধান্ত নেয় টগরকে কাজে লাগানোর।
————–
শাহজাহান তালুকদারের কাচারি ঘরে বসে আছে নির্ঝর। আপাতত ঘরটা খালি।নির্ঝর চারদিকে তাকিয়ে দেখছে।শাহজাহান তালুকদার ওয়াশরুমে আছেন।
শর্মী হাতে করে একটা বাটি নিয়ে বাবার কাচারি ঘরে এলো।এসে দেখে পুলিশের ইউনিফর্ম পরে একজন লোক বসে আছে। ভ্রু কুঁচকে একবার তাকিয়ে শর্মি গলা উঁচিয়ে বাবা বলে ডাকতেই নির্ঝর বললো, “উনি ওয়াশরুমে আছেন।”

শর্মী অপেক্ষা করতে লাগলো এক পাশে দাঁড়িয়ে। নির্ঝর ভালো করে মেয়েটাকে খেয়াল করতে লাগলো। মেয়েটার নাকের পাশে একটা লাল তিল আছে।দুই চোখ বারবার সেই তিলের দিকেই যাচ্ছে। নির্ঝর নিজেকে ধমক দিলো মনে মনে। এখানে সে ইনভেস্টিগেট করতে এসেছে, অথচ অবাধ্য মনটা বেহায়াপনা করা শুরু করে দিয়েছে।
মনকে শান্ত করতে নির্ঝর শর্মীর পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। শর্মী আড়চোখে একবার তাকিয়ে মনে মনে বললো, “হ্যাংলামি করতে এসেছে না-কি! ”

চলবে……..

রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-০৭

0

#চন্দ্রাণী(০৭)
বটগাছের পাতার ফাঁক গলে সূর্যের আলো এসে টগরের চোখে পড়তেই টগর জেগে গেলো।
মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার।

রাতে বাড়িতে ফেরা হয় নি, টগর বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। তার মনে পড়ে সে ছিলো নদীর পাড়ে অথচ সকালে নিজেকে বটতলায় পেলো।
মাথায় অসংখ্য হিসাবনিকাশ মিলানোর চেষ্টা করছে।

জায়গায় জায়গায় থকথকে কাদা মাড়িয়ে টগর চললো বাড়ির দিকে।
পরনের টিশার্টে রাজ্যের ময়লা।

চন্দ্র বের হয়েছে শর্মীকে নিয়ে হাঁটতে। দুই বোনের মাথায় ঘুরছে ভাইয়ের ব্যাপারটা।

চন্দ্র বললো, “কাদের মিয়ার লোক ছাড়া এই কাজ কেউ করবে না শর্মী।দেখলি না আব্বা রাতে বললো যে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত শুভ্র যাতে বের না হয়।”

কাদের খাঁনের নাম শুনে শর্মির গলা শুকিয়ে গেলো। এক সময় কতো স্বপ্ন দেখেছে বাবা আর শ্বশুরকে এক করবে তারা দুজন মিলে। সব দ্বন্দ,প্রতিদ্বন্দ্বিতা সব কিছুর অবসান হবে।
অথচ আজ ভাগ্যের কি খেলা!

তবুও আমতাআমতা করে বললো, “কিন্তু আব্বা তো বলে নি কেনো এরকম কথা বলছেন তিনি,কি হয়েছিলো কিছুই তো জানি না।”

চন্দ্র বিরক্ত হয়ে বললো, “বোকা মেয়ে,এটুকু ও বুঝস না?আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু কে আর?কে করবে এসব?”

শর্মী বিড়বিড় করে বললো, “অন্য কেউ তো হতে পারে, হয়তো তৃতীয় কেউ এই কাজটা করেছে আব্বার আর কাদের আংকেলের মধ্যে ঝামেলা আরো বাড়ানোর জন্য তো কেউ করতে পারে।
এই যে হাশেম আলীও তো আছে আরেক প্রার্থী। সে হয়তো করেছে দুজনকে দুজনের শত্রু করার জন্য। ”

চন্দ্র হেসে বললো, “না না,হাশেম আলী এরকম লোক না।আল্লাহ ভীরু লোক উনি।তাছাড়া হাশেম আলী হলে আব্বা এতো গম্ভীর হয়ে যেতো না।হাশেম আলীর খুটির জোর কম।”

শর্মী মুগ্ধ হয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে বললো, “তুই কতো কিছু বুঝিস আপা,কতো কিছু জানিস।আব্বা তোকে অনেক ভরসা করে। এজন্য তোর কাছে সব সিক্রেট শেয়ার করে যা হয়তো মা ও জানে না।”

চন্দ্র হাসলো। শর্মী মিথ্যে কিছু বলে নি। আব্বার সকল একাউন্টের নমিনি চন্দ্র,সম্পত্তি যা আছে তার সব ডকুমেন্টস চন্দ্রর কাছে।যত গোপন তথ্য আছে সব মেয়েকে বলেন তিনি।
বিয়ের ১২ বছর পর আল্লাহ তাকে চন্দ্রকে দিয়েছিল, তাই সব কিছু আগে মেয়ের জন্য করেন।

চন্দ্র একটু হেটে বললো, “কাদের মিয়াকে আজ হঠাৎ আংকেল বলছিস যে?”

শর্মী চমকে উঠলো। নিয়াজের সাথে বলতে বলতে ভুল করে বলে ফেলেছিলো।তাই শুকনো হেসে বললো, “একজন বয়স্ক লোককে কি নাম ধরে বলা মানায় না-কি? ”

চন্দ্র তীর্যক হেসে বললো, “তাহলে হাশেম আলীকে কেনো আংকেল বললি না?উনি কি ছোট বাচ্চা?”

শর্মীর গলা শুকিয়ে গেলো। তবুও জোর করে বললো, “দূর আপা,ভুক ধরতে বসেছিস না-কি। বাদ দে।”

চন্দ্র বললো, “যা ই বলিস,কাদের খানের একটা ছেলে আছে না কি যেনো নাম?
ও নিয়াজ নাম,ওরে দেখলেই কেমন ষণ্ডা মতন লাগে তাই না?”

শর্মীর হার্টবিট বেড়ে গেলো। বুকের ভেতর চুরমার হয়ে গেলো যেনো মুহূর্তে। আহা নিয়াজ!কতো ভালোবাসার নিয়াজ!
কি জবাব দেবে শর্মী এই প্রশ্নের?
আপা তো ভুল বলে নি।

হাটতে হাটতে অনেক দূর চলে এলো দুজন। আবারও ঘুরে বাড়ির দিকে রওনা হলো।

চন্দ্র মনে মনে ভাবছে শর্মী কখন বলবে তার সমস্যা কি,কি হয়েছে তার!

টগর বাড়ি গিয়ে গোসল করে নাশতা বানাতে কিচেনে গেলো। ময়দা মেখে রেডি করে নিলো পিৎজা বানানোর জন্য। আজ হঠাৎ করে পিৎজা খেতে ইচ্ছে করছে।
মা যেভাবে বানিয়ে দিতো সেভাবে। মা মারা যাবার পর কতো নামি-দামি রেস্টুরেন্টের পিৎজা খেয়েছে টগর অথচ কই,মায়ের বানানো পিৎজার স্বাদ পায় নি।

ময়দার ডো করে টগর সোফায় গিয়ে একট্য কাত হলো। শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে অনেকটা পথ হেটে আসায়।
কখন যেনো ঘুমিয়ে গেলো টগর বুঝতে পারলো না। ঘুম ভাঙলো বাহিরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে।

টগরদের বাড়ির নাম সুখ নিবাস। অথচ এখানে বাস করা মানুষটার জীবনের সুখ নেই।
নারিকেল সুপারি গাছ দিয়ে ঘেরা বাড়িতে ১৫০ টি নারিকেল গাছ আছে আর সুপারি গাছের কোনো হিসেব নেই।

টগর দরজা খুললো চোখ কচলাতে কচলাতে। দরজা খুলে যাকে দেখলো তাকে দেখে কয়েকটা হার্টবিট যেনো মিস করে ফেললো সে।
পুলিশের ইউনিফর্মড হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইন্সপেক্টর নির্ঝরচ, ।
চোখের কালো সানগ্লাসটি যেনো এখনো আগেরটি রয়ে গেছে। ঠোঁটে খেলা করছে ক্রুর হাসি।
ক্লীন শেভ করা লোকটার ফর্সা মুখটায় কঠোরতা স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে।

টগরের দিকে তাকিয়ে নির্ঝর বললো,”তো,কি অবস্থা টগর সাহেব?আফটার এ লং টাইম, উই মিট এগেইন।
বলেছিলাম না,ঠিকই নজর রাখবো।
পালিয়ে এসে ও বাঁচলে না দেখলে।”

টগরের মেজাজ খারাপ হতে লাগলো। এই লোকটা কিভাবে এলো এখানে?এর পোস্টিং কুসুমপুরে হলো কেনো হঠাৎ করে?

টগরকে চুপ থাকতে দেখে নির্ঝর বললো, “আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে টগর। ”

টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “কোন অপরাধে?”

নির্ঝর হাসলো। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে পকেটে ভরে বললো, “জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে। ”

টগর আগের মতো একরোখা হয়ে বললো, “কেনো?”

নির্ঝর টগরকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে গেলো। এঘর ওঘর সবকটা রুম খুঁজলো কিছু একটা। এলাকার যারা নির্ঝরের সাথে এসেছিলো তারাই জানিয়েছে টগর ভীষণ মদ খায়,ওর বাসায় অনেক মদ আছে।
টগর নাম শুনে নির্ঝরের যদিও এই টগরের কথা মাথায় এসেছিলো কিন্তু সত্যি সত্যি যে এ হবে তা নির্ঝর ভাবে নি।
নির্ঝরকে এঘর ওঘর ঘুরতে দেখে টগর মুচকি হাসলো। মনে মনে বললো, “কোনো লাভ নেই নির্ঝর বেবি,তোমার মতো দুই পয়সার ইন্সপেক্টরের কর্ম নয় টগরের মদের আস্তানার খোঁজ নেওয়া।টগর এতো কাঁচা মাছ খায় না।”

টগরের সামনে এসে নির্ঝর বললো, “গতরাতে কোথায় ছিলে?”

টগর বুকে দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে বললো, “যেখানেই থাকি,নান অফ ইওর বিজনেস। ”

নির্ঝর হেসে বললো, “আমার বিজনেসটাই এটা টগর। তোমার অতীত রেকর্ড আমার অজানা নয়,সবাই তোমাকে না জানলেও আমি জানি তুমি কতটা ডেস্পারেট। যা জিজ্ঞেস করছি তা জবাব দাও।গতরাতে কোথায় ছিলে?”

টগর আগের মতো শান্ত স্বরে বললো, “আপনার নাকটা ভীষণ বড় হয়ে গেছে দেখছি,সব জায়গায় ঢুকে পড়ছে তাই।আমি কোথায় ছিলাম,কার সাথে ছিলাম তাতে নাক গলাচ্ছেন কেনো?পুলিশ হলেই কি এতো লম্বা নাক থাকা লাগে?মানুষের পার্সোনাল ব্যাপারে ও ঢুকে যায়।”

নির্ঝর আগের মতো শান্ত স্বরে বললো, “এখনো উত্তরটা পাই নি আমি।”

টগর বললো, “আগে আমাকে বলুন কি হয়েছে, কেনো জানতে চাচ্ছেন?”

নির্ঝর বললো, “গতরাতে কুশি নদীর পাড়ে নৌকায় দুইজন জেলে খুন হয়েছে। ”

চমকে উঠলো টগর। খুন!
কই সে তো সকালে এলো ওখান থেকে, কোনো কিছু শুনে নি তো সে।তাহলে কিভাবে কি হলো, কখন হলো?

নির্ঝর সোফার হাতলে বসে বললো,”জবাবটা এখনো পাই নি।”

টগর শান্ত স্বরে বললো, “গতরাতে আমি কুশি নদীর ওখানেই ছিলাম,রাত ওখানেই কাটিয়েছি।”

নির্ঝরের মুখটা হাসিহাসি হয়ে গেলো। টগরের হাত চেপে ধরে বললো, “বাকি কথা থানায় গিয়ে হবে,বাঘবন্দি খেলা অনেক হয়েছে। এবার সময় এসে গেছে। ”

টগর এক মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে পরনের জামা কাপড় চেঞ্জ করে নিলো।হতভম্ব অবস্থায় নির্ঝরের সাথে রওয়ানা দিলো থানার উদ্দেশ্যে।

চলবে……
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-০৬

0

#চন্দ্রাণী(০৬)
একটা সিএনজি করে শুভ্রকে বাড়িতে নিয়ে এলো।শাহজাহান তালুকদারের মাথার রগ দপদপ করছে প্রচন্ড ক্ষোভে।
শাহজাহান তালুকদার জানে এটা নিশ্চয় কাদেরের কাজ।কাদের শুভ্রকে ঘুঁটি বানিয়ে তার সাথে খেলতে চাইছে।
শাহজাহান তালুকদারের ফর্সা মুখে বিরাজ করছে রাজ্যের ক্ষোভ।দুই কান লাল হয়ে গেছে।

বাবুল দাশ কড়া লিকারের চা বানাচ্ছে স্যারের জন্য। তার ও মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। শুভ্র সবার আদরের,সবার নয়নের মণি।

শাহজাহান তালুকদার চা’য়ের কাপ হাতে নিয়ে কাচারি ঘর থেকে বের হলো। তার পরনে খাদি কাপড়ের সবুজ রঙের পাঞ্জাবি। গতকাল বড় মেয়েটা আসার পর থেকে ছেলেটা ভীষণ খুশি ছিলো।অথচ কোন সুযোগে শুভ্রর সাথে এরকম করলো কেউ?
ছেলের যেই অবস্থা জানতে ও পারবেন না তিনি কোনো দিন কে করেছে,কিভাবে করেছে।

এক বুক আক্ষেপ নিয়ে চা শেষ করে চা’য়ের কাপটা আছড়ে ভেঙে ফেললেন তিনি।
চেয়ারম্যান বাড়ির পথটার চারপাশে নানা ধরনের ফুল গাছ লাগানো আছে।শাহজাহান তালুকদার নাম জানেন না এসব গাছের,এসব বাবুল দাশই দেখাশোনা করেন।

মনের অস্থিরতা কমাতে শাহজাহান তালুকদার পায়চারি করতে লাগলো বাড়ির রাস্তায়।
পায়চারি করতে করতে দেখতে পেলো টগরকে। বিড়বিড় করে টগরকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”রাস্কেল। ”

টগর হাসতে হাসতে এসে শাহজাহান তালুকদারের পায়ের কাছে বসে বললো, “দিন তো,চেয়ারম্যান সাব,একটু পায়ের ধূলো দিন।কে জানে চেয়ারম্যান থাকাকালীন এটাই হয়তো শেষ বার আপনার থেকে পায়ের ধূলো নিচ্ছি।”

রাগে শাহজাহান তালুকদারের পিত্তি জ্বলে উঠলো। গমগমে গলায় বললো, “গেট লস্ট ইডিয়ট। ”

টগর শার্টের ভেতরে বোতলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, “আমি কিন্তু দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম,আর মাস্টার্স ও করেছি ইংরেজিতে। তবে কি স্যার,গালি দিলে বাংলায় দেন।ইংরেজিতে গালি দিলে তেমন একটা গায়ে লাগে না,কেমন আলগা আলগা একটা ভাব আছে তাতে।বাংলা গালিতে কেমন কেমন একটা মাখামাখা ভাব আছে বুঝলেন।”

শাহজাহান তালুকদার অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন,”এই মুহূর্তে এখান থেকে যাও তুমি, নাহলে খুব খারাপ হবে।”

টগর মাটির রাস্তায় পা ছড়িয়ে বসলো। তারপর হেসে বললো, “স্যারের কি মেজাজ অত্যধিক খারাপ? আমার কাছে তো আর কোনো বোতল ও নাই,আমি আবার নিজের বোতল কাউরে শেয়ার করি না। আমি আবার রুলস মেনে চলি।আপনি চেয়ারম্যান হোন আর এমপি হোন।আমি আমার বোতল কাউকে দিই না।”

শাহজাহান তালুকদারের মাথা গরম হয়ে গেলো। রাগে তেড়ে গেলেন টগরের দিকে। টগর মাটিতে শুয়ে পড়লো, তারপর হেসে বললো, “কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে। সময় খুব কমে আসছে।”

শাহজাহান তালুকদার বিস্মিত হয়ে বললো, “কিসের কাউন্ট ডাউন?”

টগর এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে দূরে সরে গিয়ে হেসে বললো, “আপনি এতো বোকা হয়ে কিভাবে এতো কিছু সামলান?এতো বছর ধরে কিভাবে রাজত্ব করছেন কুসুমপুরে? আমি তো আপনার হাতের মার খাওয়ার ভয়ে বললাম যাতে আপনি থমকে যান আর আমি সরে যেতে পারি। ”

আর না দাঁড়িয়ে টগর বোতল চেপে ধরে এক ছুটে পালিয়ে গেলো।শাহজাহান তালুকদার ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন।তার মন বলছে অন্য কথা। কাদের খাঁন নিশ্চয় কোনো কিছু করার তাল করছে, সেজন্যই টগর এই কথা বলছে।ও নিশ্চয় কিছু শুনেছে।

বিড়বিড় করে শাহজাহান তালুকদার বললো, “কাদের খাঁন,এবার আমি ও আটঘাট বেঁধে নেমেছি।এতো সহজে ময়দান থেকে সরবো না আমি।”

নিয়াজ বসে আছে তার বাবার রুমে চেয়ারের উপর। বাবাকে তার ভীষণ ভয়।
কাদের খাঁন গম্ভীরমুখে একটা বই পড়ছেন মনোযোগ দিয়ে। নিয়াজ মনে মনে বিরক্ত হয়ে বললো, “সামনে নির্বাচন আর উনি বসে বসে হ্যামলেট পড়ছে। ”

সাহিত্য চর্চা দেখে নিয়াজের শরীর জ্বলতে লাগলো।কিছু সময় পর নিয়াজ উঠতে গেলে কাদের খাঁন গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,”আমি তোমস্কে যেতে বলেছি এখানে থেকে?”

নিয়াজ আবারও ধপ করে বসে পড়লো। কাদের খাঁন ভীষণ মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলেন আবারও।
প্রায় ১৫ মিনিট পরে বই বন্ধ করে বললেন,”তোমার আর আমার দু’জনের পথ আলাদা।আমার নির্বাচন নিয়ে তোমাকে অযথা মাথা ঘামাতে হবে না।তোমার কাজ হচ্ছে তোমার অফিসে।তোমার নিজের কাজে মন দাও,আমার নির্বাচনের কাজে নিজেকে জড়িয়ো না।”

নিয়াজ বিড়বিড় করে বললো, “আমার স্বার্থ আপনি বুঝবেন না আব্বা।”

কাদের খাঁন গম্ভীরমুখে বললেন,”আর যেনো তোমাকে কোথাও না দেখি।”

নিয়াজ বাবার ঘর থেকে গম্ভীর হয়ে বের হয়ে এলো।কাদের খাঁন চেয়ারম্যান হলে নিয়াজের অনেকগুলো প্লাস পয়েন্ট আছে।নির্বিবাদে গ্রামে ড্রাগের বিজনেস করতে পারবে সে।আরো যেসব বিজনেস করার জন্য ভাবছে সব পথ ক্লিয়ার হয়ে যাবে তার।
বস ইদানীং আরেকটা প্রজেক্ট শুরু করেছে , নিয়াজ চাইছে নিজেও সেই কাজে যোগ দিতে।
নিজের বাবা চেয়ারম্যান হলে যেই সুযোগ সুবিধা হবে তা এখন তো পাওয়া যাবে না।নিজের স্বার্থে নিয়াজ বাবার নির্বাচন নিয়ে ভাবছে,তার বাবার স্বার্থে না।

চারদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। টগর ক্লান্ত, অবসন্ন দেহ নিয়ে হেঁটে আসছে।
কুসুমপুরের শেষ প্রান্তে কুশী নদী। নদীর পাড়ের দিকটায় সবগুলো ঘর জেলেদের। এই দিকটায় কেমন মাছের আঁশটে গন্ধ।
জায়গায় জায়গায় জাল শুকাতে দেওয়া, মাছ শুকাতে দেওয়া। হাতে দুইটা ব্যাগ নিয়ে টগর জেলেপাড়ায় এলো।নিয়াজ পাঠিয়েছে তাকে এগুলো নিয়ে।

বারবার মাথা ঝাড়া দিয়ে চোখ টেনে খোলার চেষ্টা করছে টগর। তারপর এগিয়ে গিয়ে বটতলায় গিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। নিয়াজ এই বটতলার কথা-ই বলেছে তাকে।ভুল হয়ে গেছে, বের হবার আগে বোতলটা না খেলেই হতো। তাহলে হেঁটে আসতে এতো কষ্ট হতো না। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলো টগর।

বেশ খানিকক্ষণ পরে একটা ছায়া মূর্তি এগিয়ে এলো। টগরের নাকের সামনে হাত দিয়ে পরখ করে নিলো ঘুমে কি-না টগর। ঘুমিয়েছে নিশ্চিত হয়ে ব্যাগ দুটো হাতে তুলে নিলো। তারপর দ্রুত পা চালিয়ে পালিয়ে গেলো।

টগর যখন উঠে বসলো তখন রাত্রি দশটার বেশি বাজে।সারা শরীর কেমন নির্জীব লাগছে তার।ইদানীং খুব বেশি মদ খাওয়া হচ্ছে।
একবার উঠে দাঁড়ালো টগর বাড়ির উদ্দেশ্যে, কিন্তু শরীর জানান দিলো তার পক্ষে সম্ভব না এখন এতো দূর যাওয়া।
আবারও আগের জায়গায় শুয়ে পড়লো টগর। মশার ঘ্যানঘ্যানানি উপেক্ষা করে ঘুমিয়ে গেলো সেখানেই।একে বলে যেখানে রাইত,সেখানে কাইত।
পুরুষ মানুষ বন্ধনহীন হয়ে গেলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।নারীর সংস্রব ছাড়া পুরুষের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়, নারী তবুও পারে পুরুষ ছাড়া থাকতে।
পুরুষের কাউকে না কাউকে লাগে সে মা হোক বা বোন অথবা বউ।

গভীর রাতে টগর জেগে গেলো। রাত্রি কয়টা বুঝতে পারলো না। দূরে নদীর পাড়ে টিমটিমে আলো দেখা যাচ্ছে। টগর সেদিকে এগিয়ে গেলো।ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে তার।নদীর পাড়ে গিয়ে দেখে অনেকগুলো নৌকা ঘাটে এসেছে। নৌকা ভর্তি মাছ প্রদীপের আলোয় চকচক করছে।

টগর তখন অতীতের স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতে লাগলো। ইলিশ মাছ ছাড়া অন্য কোনো মাছ খেতে চাইতো না বলে মা এরকম কতো মাছ কিনে নিয়ে আসতো ঘাটে গিয়ে। মাছ নিয়ে ফিরে মা যখন ডিশে করে নিয়ে টগরকে দেখাতো টগরের দুই চোখ চকচক করতো আনন্দে।
আজ মা কোথায়,সেই আনন্দ কোথায়,টগর কোথায়?
মা কি জানে তার টগর কেমন আছে?
মায়ের বাধ্য ছেলে,ভদ্র ছেলে,ক্লাসের টপার ছেলে টগরের জীবনটা কেমন মা কি জানে?
মায়ের কথা মনে হতেই সব হতাশা, ক্লান্তি, ক্ষুধা সব হারিয়ে গেলো টগরের।শুধু অনুভব করলো দুই চোখের জল টপটপ করে ঝরছে।

টগর মুছল না চোখের পানি। বহুদিন পর আজ একটু কান্না এসেছে, আরো আসুক।মন খুলে কাঁদতে চায় টগর।

চলবে……

রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-০৫

0

চন্দ্রাণী (০৫)

রান্নাঘরে সকালের নাশতা বানানোর কাজে ব্যস্ত চন্দ্র।ঝড়ের গতিতে পরোটা বানাচ্ছে সে।
বাড়িতে বানানো ঘি দিয়ে আজ পরোটা ভাজা হচ্ছে। ঘি’য়ের ঘ্রাণে চারপাশ ভরে গেছে।
রেহানা একটা পাতিলে করে আলু,বেগুন, গাজর,চিচিঙ্গা দিয়ে সবজি রান্না করছে পরোটার সাথে খাওয়ার জন্য আর সাথে আছে গরুর দুধের চা।

আজ আর শর্মীর কোনো কাজ নেই।আপা এলে শর্মীর ছুটি রান্নাঘর থেকে। আপা সুনিপুণভাবে সব সামলে নেয়।

শর্মী রান্নাঘর থেকে দূরে বসে আছে। ঘিয়ের ঘ্রাণ তার সহ্য হচ্ছে না। কি অদ্ভুত ব্যাপার, ঘিয়ে ভাজা পরোটা যার প্রিয় সে কি-না এখন ঘি সহ্য করতে পারছে না।
ওড়নার এক কোণ নাকে চেপে বসে আছে শর্মী।পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান আপাতত ক্যান্সেল। ভাগ্য তাকে নিয়ে যা করতে চায় করুক।
ভালোবেসে,বিশ্বাস করে যখন সে ভুল করেছে তখন শাস্তি তো পেতেই হবে।
ভুল মানুষকে বিশ্বাস করার খেসারত দিবে না হয়।

চন্দ্র শর্মীর দিকে তাকাচ্ছে আর পরোটা বানাচ্ছে। শর্মী কেমন আনমনা হয়ে আছে।
লজ্জায় চন্দ্র নিজে থেকে শর্মীকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ও পারছে না।
শুভ্র একটা গরম পরোটা শর্মীর কাছে নিয়ে যেতেই শর্মী নাক আরো জোরে চেপে ধরলো।একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চন্দ্র শর্মীর জন্য আটার রুটি বানালো আলাদা করে।

সবাই যখন নাশতার টেবিলে বসে নাশতা করছে শর্মী তখন নিজের রুমে বসে রুটি খাচ্ছে। চন্দ্রর মন ও অস্থির হয়ে আছে।

নাশতা শেষ করে সবাই যখন দুপুরের রান্নার আয়োজন করছে তখনই খবর এলো শর্মী বান্ধবী নীলিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাতে মা’য়ের সাথে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলো,ফেরার সময় মা মেয়ে দুজনেই রিকশা করে ফিরছিলো,তার মধ্যে পথে কারা যেনো রিকশা থেকে মা’কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে গেছে।

সকাল সকাল এরকম একটা খবর পেয়ে শর্মী যারপরনাই হতবাক। সবসময় এরকম ঘটনা আশেপাশের গ্রামে শুনেছে, কিন্তু নিজেদের গ্রামেই এরকম হবে কখনো ভাবতেই পারে নি।

বর্ষাকালের দিন,আকাশ এই হাসে এই কাঁদে অবস্থা। এতোক্ষণ ঝলমলে রোদ ছিলো, এখন আবার আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে।
শর্মী হতভম্ব হয়ে বসে আছে। নীলি কি তবে শফিকের সাথে পালিয়ে গেছে?

নীলি আর শর্মী দু’জনে এক সাথে কলেজে আসা যাওয়া করে, নীলির থেকেই শর্মী জেনেছে শফিকের কথা।
কয়েকদিন ধরে নীলি বলছিলো বাসায় বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, শফিককে ছাড়া নীলি কাউকে বিয়ে করবে না।

চন্দ্র এসে বললো, “শর্মী চল,নীলিদের বাড়ি যাই।চাচীকে দেখে আসি।”

শর্মীর হাত পা কাঁপতে লাগলো। ওই বাড়িতে গেলে যদি চাচী জিজ্ঞেস করে নীলির সাথে তো শর্মী আসা যাওয়া করতো, শর্মী আমতাআমতা করে বললো, “আপা,আমার খুব ভয় করছে।”

চন্দ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কেনো?তুই কি কিছু জানিস?”

শর্মী ঢোক গিলে বললো, “নীলির একজনের সাথে সম্পর্ক আছে আপা।শফিক নাম ওর।বাজারে যেই সুবর্ণা কসমেটিকস এর দোকান আছে, ওই দোকানে ছেলেটা চাকরি করে। নীলির বাড়িতে না-কি বিয়ের কথা হচ্ছে, নীলি বলছিলো শফিক নাকি ওকে বলেছে পালিয়ে যেতে।”

চন্দ্র শুনে বোনের হাত ধরে বললো, “চল আমার সাথে, চাচী যদি জিজ্ঞেস করে তবে যা জানিস তা বলে দিবি।”

শর্মী আর চন্দ্র দুজনেই গেলো নীলিদের বাড়িতে। শর্মীর বুক কাঁপছে দুরুদুরু করে। নীলির সম্পর্কের কথা শর্মী জানলেও শর্মীর ব্যাপার নীলি জানতো না।নিয়াজই বলেছিলো কাউকে যাতে না বলে শর্মী।নয়তো লোক জানাজানি হলে দুজনের বাবা রেগে যেতে পারে।

তখন নিয়াজের সব কথা ঠিক মনে হতো শর্মীর,সব কথাই যৌক্তিক লাগতো। এখন অবশ্য বুঝতে পারে।
এখন বুঝেছে নিয়াজ ওসব বলত নিজেকে সবার ধরাছোঁয়ার বাহিরে রাখার জন্য। এই যেমন এখন কেউ বলতে পারবে না কখনো নিয়জ আর শর্মীর সম্পর্ক ছিলো।
এতো বোকা কবে হলো শর্মী নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, কিন্তু উত্তর পায় না।

নীলির মা বুক চাপড়ে কান্না করছে। আশেপাশে বাড়ির মেয়ে বউয়েরা সবাই এসে ভীড় করেছে।
কেউ কেউ কানাঘুষা করছে কোনো ছেলের সাথে পালিয়েছে হয়তো। ছেলে আর নীলি দু’জন মিলেই এই নাটক সাজিয়েছে।
নীলির মা শর্মীর হাত চেপে ধরে বললো, “মা গো,আমার নীলু তো তোর লগেই আসা যাওয়া করতো, তুই কি কোনো দিন দেখছিলি ওরে কোনো পোলার লগে কথা কইতে?আমি তো জানি আমার মাইয়া কেমন, আমার মাইয়া এই রকম মাইয়া না।কোনো পোলার লগে এরকম আড্ডা নাই আমার মাইয়ার।”

শর্মী লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। বাবা মায়েরা আমাদের কতটা ভরসা করে, বিশ্বাস করে। তারা মনে করে তাদের সন্তান ভীষণ নিষ্পাপ।
অথচ যেদিন জানতে পারে তাদের বিশ্বাস ভুল ছিলো, বিশ্বাসের ভীত যেদিন নড়ে যায় কেমন লাগে সেদিন তাদের?
শর্মী যদি এখন বলে দেয় যে নীলির সত্যি কারো সাথে সম্পর্ক আছে তাহলে কেমন লাগবে ওনার তাহলে!

চন্দ্র বোনের হাত চেপে ধরলো আলতো করে। শর্মী জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, “না চাচী,এরকম কিছু তো আমি জানি না।”

চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “চাচী,এতো কান্নাকাটি কইরেন না।থানায় জিডি করছিলেন চাচী?”

নীলির মা কাঁদতে কাঁদতে বললো, “করছি গো মা,কিন্তু আমি জানি কোনো লাভ নাই।থানার ওরা কয় আমার মাইয়া কোনো পোলার লগে ভাগছে।”

চন্দ্র আর শর্মী নীলিদের বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো।বাহিরে এসে চন্দ্র বললো, “শফিক কোন দোকানে কাজ করে তুই চিনিস?”

শর্মী মাথা নেড়ে বললো, “হ্যাঁ, চিনি আপা।”

চন্দ্র বললো, “চল তাহলে, শফিকের সাথে দেখা করতে যাই।তাহলেই সব কনফিউশান দূর হবে,চাচী অন্তত স্বস্তি পাবে মেয়েটা ভালো আছে এই ভেবে।”

শর্মী অবাক হয়ে বললো, “কেনো আপা?তুমি কেনো যাবে?”

চন্দ্র হাটতে হাটতে বললো, “আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে, চাচী মিথ্যা বলে নি। মায়ের পাশ থেকে এতো রাতে এভাবে পালিয়ে যেতে হলে অনেক বড় কলিজা লাগে শর্মী।দেখ,নীলি তো কলেজে রোজ যায়,ও যদি পালিয়ে যেতে চাইতো তবে তো কলেজে গেলে ওভাবেই যেতে পারতো।
এভাবে মায়ের পাশ থেকে কেনো যাবে এভাবে রাতের বেলা?”

চন্দ্র আর শর্মী রিকশায় উঠে বাজারে গেলো।স্বর্ণকার গলিতে ঢুকে তিন চার দোকান পার হতেই শর্মী বললো, “এই দোকান আপা।”

দু’জনে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালো। শফিক শর্মীকে দেখে মুচকি হেসে বললো, “আপু ভালো আছেন? ”

শর্মী মাথা নেড়ে বললো, “হ্যাঁ, ভালো। আপনি? ”

শফিক হেসে বললো, “ভালো আছি।”

শর্মী আবার জিজ্ঞেস করলো, “নীলি কেমন আছে? ”

শফিক লাজুক হেসে বললো, “আজ তো কথা হয় নি আপু,গতরাত থেকে কল দিচ্ছি ধরছে না।”

শর্মীর গলা শুকিয়ে গেলো, চন্দ্র নিজেও অবাক হলো। মনে মনে সে চেয়েছে তার ধারণা যাতে মিথ্যা হয়,তাহলে অন্তত চাচী এটুকু নিশ্চিত হবেন যে তার মেয়ে সুস্থ আছে, ভালো আছে।

শর্মীর ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে শফিক বললো, “আপু,কোনো সমস্যা? ”

চন্দ্র বললো, “না ভাই,আমরা আসছি।”

দুজনে মন খারাপ করে বের হলো, সেই মুহুর্তে বাড়ি থেকে কল এলো চন্দ্রর ফোনে।
শুভ্র অসুস্থ হয়ে পড়েছে, কেমন ছটফট করছে না-কি সে।

দুই বোন হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি গেলো।শাহজাহান তালুকদার ছেলের হাত চেপে ধরে কাঁদছেন,তার মাথায় কিছু ঢুকছে না।কি হলো ছেলেটার হঠাৎ করে। চন্দ্র এসে সেই রিকশা করে ভাইকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটলো।

তার কিছুক্ষণ পর পরই শর্মী,চন্দ্রর মা,বাবা সবাই গিয়ে হাজির হল।

হাসপাতালের বাহিরে একটা সিড়ির উপর সিগারেট ধরিয়ে নিয়াজ টগরের কাঁধ চাপড়ে বললো, “শাহজালাল তালুকদারের ক্ষমতা আমি কেমনে শেষ করে দিই খালি দেখ,আমার বাপেরে বারবার নির্বাচনে হারানোর খেসারত তাকে দিতে হবে এবার সুদে আসলে।এবার আমি মারাত্মক প্ল্যান করেছি।”

টগর ভোঁসভোঁস করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো, “দূর ভাই,এসব ক্ষমতায় সুখ নাই,সুখ আছে মদের বোতলের প্রতি চুমুকে।”

নিয়াজ হাসলো মনে মনে। এই গাঁধাটাকে সাথে রাখার এই এক সুবিধা, এর ধ্যান সবসময় মদের বোতলে থাকে।এর এক কান দিয়ে কথা ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায়।
একটু আগে নিয়াজ কি বলেছে এখন জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না।
নিয়াজের অনেক প্ল্যান আছে।আস্তে ধীরে এগুবে নিয়াজ,প্রয়োজনে টগরকে ফাঁসিয়ে দিবে সে।

ডাক্তার এসে জানালো কোনো ভাবে শুভ্রর পেটে ড্রাগ গিয়েছে, আর এই ড্রাগ এতোটাই কড়া যে অনভ্যস্ত কেউ প্রথম বার নিলে মারা যেতে পারে পর্যন্ত। ভাগ্যিস শুভ্রকে দ্রুত হসপিটাল নিয়ে আসা হয়েছে।

সবাই হতভম্ব হয়ে রইলো ডাক্তারের মুখের কথা শুনে। শুব্র আর ড্রাগ?
কিভাবে সম্ভব!

চলবে……

রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-০৪

0

#চন্দ্রাণী(০৪)
সারারাত শর্মীর ঘুম হলো না। কেমন আধো ঘুম আধো জাগরণে রাত কেটে যাচ্ছিলো।বুকের ভেতর কষ্টের নীল ঢেউ।
আকাশের ওই চাঁদের দিকে তাকিয়ে শর্মীর যন্ত্রণা আরো বেড়ে গেলো। নিয়াজ ভালোবেসে বলতো,”আমার আকাশের চাঁদ তুমি। ”

মিথ্যে সব,সব ধোঁকা। ঘড়িতে সময় ২.৪৬ বাজে।শর্মী দাদীর ফোন থেকে নিয়াজ কে কল দিলো।শেষ বারের মতো নিয়াজের সাথে কথা বলতে চায় সে।

মা ভ্যারাইটিজ স্টোর নামে মোড়ের মুখে যেই দোকানটা নিয়াজ চালায়,তার পেছনের অংশে মদ,জুয়ার পসরা বসেছে।
মদের আড্ডার মধ্যমণি হচ্ছে টগর। সবাই অবাক হয়ে টগরের বোতল শেষ করা দেখছে।টগরের একটা নিয়ম আছে, তার বোতল কারো সাথে শেয়ার করা করে না সে।
এক টানে এক বোতল শেষ করে ফেলে।

মা নেই,বাবা নেই,ভাই নেই,বোন নেই।সব বন্ধন মুক্ত সে।তাকে কেউ শাসন করবার নেই।কেউ নিষেধ করার ও নেই।
যা ইচ্ছে তাই করে। প্রতিদিন ৩-৪টা বোতল নিয়ে আসে। বসে বসে বোতল শেষ করে আর বিরহের গান গায়।
জুয়াড়িরা গাঁজা দেওয়া সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে জুয়া খেলছে আর টগরের গান শুনছে।

এই যে তিন নাম্বার বোতল খালি করে টগর এখন গান গাইছে,
“মনাই সওদাগর, তোমার কোথায় বাড়ি ঘর?
আইছো হাটে কত চালান লইয়া রে,যাইবা তুমি কি সদাই লইয়া?
রূপগঞ্জের হাটে এসে,সদাই নিছো কি?
যে সদাই কিনতে আইছো মনে আছে কি?
তোমার ছেলে আর মেয়ে,আছে পন্থের দিক চেয়ে
আসবা বাবায় কত কিছু লইয়া রে,আসবে বাবায় কত কিছু লইয়া।”

দুই একজনের চোখে জল চলে এলো গানের ভাবার্থ বুঝতে পেরে।
নিয়াজ অপেক্ষা করছে একটা নতুন চালানের জন্য। ইন্ডিয়া থেকে একটা মালের স্যাম্পল আসবে আজকে।নেশার নতুন একটা আইটেম।
নিয়াজের উপর অর্ডার আছে নতুন স্যাম্পল কালেক্ট করে অফিসে জমা করে দেওয়া।

নিয়াজ অপেক্ষা করছে কল আসার জন্য।

টগর গান থামিয়ে আরেকটা বোতল নিয়ে বসলো। তার চোখের সামনে সব কেমন ঝাপসা ঝাপসা লাগছে।
জুয়ার টাকা নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেছে এদিকে।

নিয়াজ সিগারেট টানতে টানতে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎ করে ফোন বেজে উঠতেই চমকে উঠে কল রিসিভ করলো।
কিন্তু রিসিভ করে শর্মীর কণ্ঠ শুনে তার মেজাজ বিগড়ে গেলো।

ওপাশ থেকে শর্মী বললো, “নিয়াজ তুমি কি চাও আমাকে খোলাখুলি বল আজ,এরপর আমি আর কখনোই তোমাকে ডিস্টার্ব করবো না।”

রাগে,ক্রোধে নিয়াজ বললো, “আমি চাই তোরে দিয়া **গিরি করাইতে,বুঝছস তুই?কল দিলি ক্যান তুই আমারে?খবরদার আর কোনো দিন আমারে কল দিবি না।তা না হইলে আমি সারা গ্রামের মানুষরে জানামু চেয়ারম্যানের মাইয়ার পেটে বাচ্চা আসছে বিয়ার আগেই।আর শুন,তোর আর আমার বিয়ার যেই কাগজপত্র দেখছিলি তুই সব ভুয়া কাগজ, কাজী ও ভুয়া।তোর লগে আমার বিয়াই হয় নাই আইনত।”

শর্মী বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো, নিয়াজের মুখ থেকে এতো নোংরা শব্দ বের হতে পারে শর্মীর মাথায় ও ছিলো না। শর্মীর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। হাত থেকে আপনা আপনি ফোনটা পড়ে গেলো।

কখন নিজের অজান্তেই দুই চোখের জল গড়িয়ে পড়ে গাল ভিজে গেলো শর্মী জানে না।
এতটা ধোঁকাবাজি?
কিসের জন্য এরকম করলো নিয়াজ?
ঝামেলা যদি থাজে তবে ওদের দুজনের বাবার মধ্যে, সেই ঝামেলার শোধ নিতে,ক্ষমতা পাওয়ার জন্য কি-না নিয়াজ এভাবে তাকে ব্যবহার করলো?

শর্মী আলমারি খুলে নিজের কয়েকটা জামা কাপড় বের করলো। দেয়ালে লাগানো তিন ভাই বোনের ছবিটা ও ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো।

ইচ্ছে করছে শেষ বারের মতো বাবা মা আপা শুভ্রকে একবার দেখে আসতে।কিন্তু সবার রুমে তো দরজা বন্ধ শুধু শুভ্রর রুমের দরজা খোলা।

শর্মী উঠে গেলো। ভাইটাকে শেষ দেখা দেখে যাবে সে না হয়।
পা টিপে টিপে বের হলো শর্মী।শুভ্র ঘুমাচ্ছে কোল বালিশ জড়িয়ে ধরে।
অন্ধকার চোখ সওয়া হয়ে এলো।উঠানে জ্বলতে থাকা লাইটের আবছা আলোয় শুভ্রকে দেখা যাচ্ছে।
শর্মী গিয়ে শুভ্রর পাশে বসলো। তারপর ভাইয়ের হাত টেনে নিয়ে কতগুলো চুমু খেলো।
শুভ্র ঘুম থেকে জেগে গেলো।উঠে বসে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। শর্মীর মায়া হলো। অবুঝ ভাইটা বললেও বুঝবে না তার আপা কি বলছে।

মনের কষ্ট চেপে রেখে ভাইকে বললো, “আপাকে তুই ক্ষমা করে দিস ভাই।সারাজীবন তোকে আগলে রাখার যেই সংকল্প করেছিলাম আজ সেই সংকল্প ভেঙে পালিয়ে যেতে হচ্ছে তোদের মান সম্মান নষ্ট যাতে না হয় সেই ভয়ে।
এই জীবনের জন্য ভাই বোনের সম্পর্ক এখানেই শেষ। হয়তো কখনো আর খুঁজে পাবি না,অথবা কখনো খুঁজে পাবি তোর আপার প্রাণহীন দেহ।বড় আপাকে বলিস আমাকে ক্ষমা করে দিতে।”

শুভ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। শুভ্রকে শুইয়ে দিয়ে শর্মী নিজের রুমে চলে গেলো।

বাকী রাত আর শর্মী ঘুমাতে পারলো না।
ফজরের আজান হতেই শর্মী বের হলো দেখতে কেউ বের হয়েছে কি-না।
পা টিপে টিপে বের হয়ে দেখে দরজা খোলা।অবাক হয়ে শর্মী বের হলো। বের হয়ে দেখে সিড়িতে বসে আছে বড় আপা আর মা।

এতো সকালে আপা আর মা উঠে পড়েছে!
এখনো তো আলো ফুটে নি,চারদিক অন্ধকার।

রেহানা ছোট মেয়েকে দেখে বললো, “আয়,মা’র কাছে এসে বস।”

শর্মী যন্ত্রের মতো এগিয়ে গিয়ে মায়ের অন্য পাশে বসলো। রেহানা আরেক হাতে ছোট মেয়েকে ও জড়িয়ে ধরলেন।চন্দ্র মা’য়ের কাঁধে মাথা রেখে বললো, “আমাদের জীবনটা এরকমই। একবার আলোয় আলোয় ভরে যায়,আবার অন্ধকারে ডুবে যায়।
জীবনে অন্ধকার খুবই ক্ষণস্থায়ী। এই যে রাতের যে নিগুঢ় অন্ধকার ছিলো, আকাশের দিকে তাকালে দেখা যাবে আকাশ আলোকিত হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। তারপর চারদিকে তাকালে দেখা যাবে একটু একটু করে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। আমাদের সমস্যা হলো অন্ধকার থেকে আলোতে আসার জন্য যেটুকু সময় দরকার হয় আমরা সেই সময়টা অপেক্ষা করতে পারি না।আমাদের ভীষণ তাড়াহুড়ো সবকিছুতে।আর এই তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই জীবনের সবকিছু আমরা হারিয়ে ফেলি।অথচ একটু যদি ধৈর্য ধরি,আল্লাহকে ভরসা করি,সবর করা শিখে যাই,বিশ্বাস করি যে কষ্টের পর স্বস্তি আছে তাহলে সব হতাশা মুছে যাবে,সব আঘাত গা সওয়া হয়ে যাবে।শুধু অপেক্ষা করতে হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যের জন্য।
প্রকৃত মুমিন সবসময় আল্লাহর সাহায্য কামনা করে। ”

শর্মী ভীষণ চমকে উঠলো আপার কথা শুনে। আপা এসব কেনো বলছে?আপা কি কিছু জেনেছে?
কিভাবে জানবে আপা?

হঠাৎ করে এসব কথা-ই বা কেনো বলছে আপা?
কেনো জানি মনে হচ্ছে আপা এসব তাকে উদ্দেশ্য করে বলছে।
আপার কথায় কেমন ম্যাজিক আছে,শর্মীর মনের উল্টো পাল্টা সব ভাবনা চলে গেলো।

শর্মী ধীর পায়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।অযু করে ফজরের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে খাস দিলে দোয়া করলো আজ।
কতদিন পর আল্লাহর সাথে মন খুলে কথা বলেছে শর্মী জানে না।অনেকদিন ধরে নামাজ পড়ে শুধু,টুকটাক সিজদাহ্ দিয়ে উঠে যায়।যেনো পড়া দরকার তাই পড়ছে।

আজ বহুদিন পর মন থেকে আগ্রহ নিয়ে নামাজ পড়লো।

চলবে

রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-০৩

0

#চন্দ্রাণী(০৩)
ট্রেনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে চন্দ্র।মনটা ভীষণ ফুরফুরে। বাড়িতে যাওয়ার আনন্দে তার চোখ মুখ ঝলমল করছে।
বাড়ি শব্দটা কেমন এক অদ্ভুত মায়াময় ব্যাপার আছে। যত দূরেই যাওয়া হোক,যত দামী আর আরামদায়ক স্থানেই থাকা হোক,বাড়ির কথা মনে হলে সবারই মনে হয় বুকটা কেঁপে ওঠে। বাড়ি শব্দটা মনে হলেই মনে হয় কেমন শান্তিময় একটা স্থান যেখানে মায়ের গায়ের গন্ধ আছে,বাবার আদর আছে,ভাই বোনের আবদার আছে।
চন্দ্র ব্যাগ খুলে এক প্যাকেট আচার নিয়ে খেতে লাগছে।

কুসুমপুর রেলস্টেশনে শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ হলো। হাতে একটা ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে কেউ বলে নি তবুও সে জানে আজ বড় আপা আসবে।বড় আপা আসা মানে শুভ্রর জন্য ঈদের মতো ব্যাপার। প্রতিবারই বড় আপা ওর জন্য অনেক রকম খাবার নিয়ে আসে,কাপড় নিয়ে আসে।তখন দুই বোনের আদরে শুভ্রর ইচ্ছে করে সারাজীবন সময়টা ধরে রাখতে।

চন্দ্র স্টেশনে নেমেই দেখে শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে। অবুঝ শিশুর মতো তাকিয়ে রইলো শুভ্র।আপাকে নামতে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। মনের মধ্যে থাকা অস্থিরতা যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো চন্দ্রর।

বাড়িতে আজকেও রান্নাবান্নার তোড়জোড়। বাড়ির বড় মেয়ে আসছে বাড়িতে।শর্মীর মনটা বিষন্ন হয়ে আছে তার। আপার জন্য ইলিশ মাছ ভাজা হচ্ছে, শর্মীর ইলিশের ঘ্রাণ সহ্য হচ্ছে না। পেটের ভেতর কেমন মোচড় দিচ্ছে।
ওড়না নাকে পেঁচিয়ে শর্মী বসলো রান্নাঘরে। সেতারা বানু কচুর লতি কাটছেন বসে।এক ঝলক শর্মীর দিকে তাকিয়ে বললেন,”ওই ছেমরি,নাকে কাপড় বানছস ক্যান? ”

শর্মী মাছ উল্টাতে উল্টাতে বললো, “মাছের গন্ধে আমার নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসবে দাদী। ”

সেতারা বানু অবাক হয়ে বললেন,”পোয়াতি মহিলাগো মতন কথা ছেমরির।ইলিশ মাছের লাইগা পাগল নিজে অথচ এহন নাকি গন্ধ লাগে।”

শর্মী চমকে উঠলো দাদীর কথা শুনে। সর্বনাশ!তার তো এই ব্যাপারটা মাথায় ছিলো না। সে তো ভুলেই গেছে তার মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকা আরেকটা প্রাণের কথা।
কতদিন এভাবে লুকিয়ে রাখবে সে!
বড় আপার এখনো বিয়ে হয় নি,আব্বার কতো স্বপ্ন আপাকে মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর বিয়ে দিবে।আপা কতো জিনিয়াস স্টুডেন্ট সেটা শর্মীর চাইতে ভালো কে জানে!
অথচ তার জন্য আপার ও বদনাম হবে,সে না হয় নিজের জীবন নিজে ধ্বংস করে দিলো কিন্তু আপার জীবন ও তো ধ্বংস হয়ে যাবে।

ভাবতে ভাবতে নিজের দুই চোখ ভিজে উঠলো। কড়াইতে ভাজতে থাকা মাছ পুড়ে যেতে লাগলো।
রেহানা ছুটে এসে দেখে মেয়ে আনমনা হয়ে বসে আছে। তাড়াতাড়ি কড়াই চুলা থেকে নামিয়ে শর্মীর পিঠে চড় লাগালেন।
ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, “মেয়েটা এতো দিন পর আসতেছে আর তুই মাছগুলো পুড়িয়ে ফেললি?”

শর্মী আনমনা হয়ে ভাবতে বসে যাওয়ায় টের পায় নি মাছ পুড়ে গেছে। রেহানা মেয়েকে সরিয়ে মোড়ায় বসলেন।শর্মী ছুটে গিয়ে আরেকটা ইলিশ মাছ ভিজতে দিলো।

রেহানা মেয়ের চলাফেরায় পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন । কি হয়েছে মেয়েটার?
কয়েক দিন ধরেই দেখছেন খাওয়া দাওয়া করছে না।ভীষণ হাঁসফাঁস করে। বুঝতে পারছেন না কিছু তিনি।

চন্দ্র রিকশা থেকে নেমে আগে কাচারি ঘরে ঢুকলো। শাহজাহান তালুকদার থানার ওসির সাথে আলাপ করছেন।চন্দ্র ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। শাহজাহান তালুকদার মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললো, “আপনি আসছেন আম্মাজান।আমার কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেছে আপনারে দেইখা। যান আম্মা,ভেতরে যান আপনার আম্মা তো অস্থির হইয়া আছে।”

চন্দ্র ভেতরে গেলো।মুহুর্তেই রেহানার কান্নার রোল পড়ে গেলো। প্রতিবার চন্দ্র যেদিন আসে আর যেদিন যায় রেহানা এমন কান্নাকাটি শুরু করে।
চন্দ্র রুমে গিয়ে শর্মীকে খুঁজতে লাগলো। বাথরুমে ঢুকে শর্মী তখন বমি করছে।
গত রাতে একবার ঠিক করেছে সকালে উঠে সবাইকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবে যেখানে কেউ তাকে চেনে না।
সেই মতো সকালে ঘুম থেকে উঠে যায় তাড়াতাড়ি। উঠে দেখে মা রান্নাঘরে।
অবাক হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারে আপা আসবে।
মনটা আর মানলো না।কতদিন আপাকে দেখে নি,আপাকে এক নজর দেখে পরের দিন যাবে বলে ঠিক করে নিলো।

চন্দ্র বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললো, “সারাদিন কি বাথরুমেই কাটিয়ে দিবি না-কি শর্মী?”
শর্মী বাথরুমে ফ্ল্যাশ করে স্প্রে করে দেয়।তারপর হাতমুখ ধুয়ে মাথায় পানি দিয়ে বের হয়ে আসে।

চন্দ্র শক্ত করে বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আহ,শান্তি এবার।এতক্ষণ কেমন অসম্পূর্ণ লাগছিলো তোকে দেখতে না পেয়ে।”

শর্মী আলগোছে চোখ মুছলো।মনে মনে বললো, “আপা, আমাকে ক্ষমা করে দিস তুই।আমি যে পারবো না থাকতে তোদের মধ্যে। ”

চন্দ্র ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি বের করে বললো, “এই দেখ,তোর না একটা গাদোয়াল শাড়ির শখ ছিলো।দেখ আমাদের ম্যাচিং শাড়ি।কোনটা নিবি?গোলাপি নাকি মেরুন?”

শর্মী ফ্যাকাসে হেসে বললো, “তুই একটা সিলেক্ট করে দে আপা।”

চন্দ্র বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, “আপসেট কোনো কিছু নিয়ে? মাছ পুড়িয়ে ফেলায় কি রেহানা বেগম এক ডোজ দিয়েছে তোকে?”

শর্মী হাসলো।মা এমন কোনো কথা নেই যা আপাকে বলে না। বাড়ির পোষা কুকুর লালু দিনে কতবার ঘেউঘেউ করে মা তা-ও বোধহয় আপাকে জানায়।
আপার প্রতি মায়ের যেই টান,বাবার যেই আদর সেটা থেকে তাদের বাকি দুই ভাই বোনের জন্য একটু কম আছে।অবশ্য এর জন্য তাদের আক্ষেপ নেই,বরং ভালোবাসা সমান সমান হলে বোধহয় আপার প্রতি অন্যায় হতো। আপার মতো শান্ত আর ভদ্র মেয়ে পুরো গ্রামে কেউ পাবে না খুঁজে।

শর্মী বললো, “তুই বোস আপা,আমি লেবু শরবত করেছি তোর জন্য , ফ্রিজে রাখা আছে নিয়ে আসি।”

শর্মী যেতেই চন্দ্র একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। বিড়বিড় করে বললো, “আমি সব জানি বোন।তুই ভয় পাস না,তোর আপা সব ঠিক করে দিবে।”

গতকালই চন্দ্র জানতে পেরেছে বোনের সাথে নিয়াজের সম্পর্কের কথা। বোকা মেয়ে বুঝলো না নিয়াজ তাকে ব্যবহার করতে চাইছে। তবে সে বুঝেছে।আর এর ব্যবস্থা ও চন্দ্রর জানা আছে।

দুপুরে সবাই মিলে একসাথে খেতে বসলো। শর্মী খাচ্ছে আর প্লেটে চোখের জল ফেলছে।দুই চোখ কোনো বাঁধা মানছে না তার।
এটাই হয়তো বাবা মা ভাই বোনের সাথে শেষ খাওয়া।

————–

টগর বসে আছে কাদের খাঁনের কাচারিতে। হাতে কতগুলো লিফলেট। মাথার উপরে ফ্যামটা ঘটাং ঘটাং করে ঘুরছে।অথচ বাতাস গায়ে লাগছে না।টগরের পরনের নীল শার্ট ময়লা জমতে জমতে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
নিয়াজ একটা বোতল টগরের হাতে দিয়ে বললো, “যা কাম লেগে যা।সবার বাড়ি বাড়ি যাবি।”

টগর হাসিমুখে বোতলের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার আজকের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। শার্টের ভেতরে বোতলটা লুকিয়ে টগর বেরিয়ে গেলো লিফলেট বিলি করতে।
নিয়াজ টগরের গমনপথের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, “শালার কপাল।একটা ভদ্র,শিক্ষিত পোলা এমন কইরা নষ্ট হইবো কেউ কি ভাবছে কোনো দিন?”

পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে টগর সিগারেটে আগুন ধরালো।টগরের বাবা মারা যান টগরের জন্মের ৪ বছর পর আর মা মারা যায় টগর অনার্স ফাইনাল ইয়ারে থাকার সময়। তারপর থেকেই ছেলেটা কেমন যেনো হয়ে গেছে। আগে মা সহ শহরেই ছিলো। গ্রামে ফিরে এসেছে বছর তিনেক হলো।
এক মাথা লম্বা চুল, মুখভর্তি খোঁচাখোঁচা দাড়ি।পরনে একটা ট্রাউজার আর শার্ট।

বিকেলে তিন ভাইবোন রাস্তায় হাটতে বের হয়েছিলো।শর্মীর মন ভালো করতেই বের হয়েছে তিনজন। টগর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তেই চন্দ্রর নাকে লাগে গন্ধ।

বিরক্ত হয়ে চন্দ্র দাঁড়িয়ে বললো, “মাতাল না-কি লোকটা?এভাবে হাটছে কেনো? ”

টগর পেছন থেকে যেতে যেতে বললো, “জি ম্যাডাম,মাতাল।তবে জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক আছি।”

শুভ্র বোনের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো।শর্মী আবারও বমি করছে।

চলবে….
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-০২

0

#চন্দ্রাণী (০২)
ছাদের খোলা দরজা দিয়ে নিয়াজ নিচে নেমে এলো। অন্ধকার সিড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে এক ছুটে খোলা দরজা দিয়ে শর্মীর রুমে।নিয়াজ শর্মীর রুমে ঢুকতেই সদর দরজার পর্দার পাশ থেকে একটা কালো ছায়া নীরবে সরে গেলো।

দরজা বন্ধ করে নিয়াজ শর্মীকে জড়িয়ে ধরলো। উত্তেজনায় কাঁপছে শর্মী।ঠিক যেদিন নিয়াজ কে বিয়ে করলো সবাইকে লুকিয়ে সেদিনের মতো বুক ঢিপঢিপ করছে তার।

নিয়াজ রুমে ঢুকেই শর্মীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। শর্মী নিয়াজের খোলা বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বললো, “এভাবে আর কত দিন? আমার এমনটা ভালো লাগে না নিয়াজ।কবে সবাইকে জানাবে তুমি? ”

নিয়াজ শর্মীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তার অনেক কিছু।

বেশ খানিকক্ষণ দুজন অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর পর নিয়াজ শর্মীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো। তারপর পকেট থেকে একটা প্রেগন্যান্সি টেস্ট কীট শর্মীর হাতে দিয়ে বললো, “চেক করে আসো তো শর্মী।”

নিয়াজের বুকের ভেতর দামামা বাজছে।এবার তাহলে সব প্ল্যানমাফিক হবে।
গত কয়েকদিন ধরেই শর্মী বলছিলো তার শরীর ভালো লাগছে না।কেমন অস্বস্তি লাগছে খাবার খেতে। নিয়াজ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে অপেক্ষা করছে শর্মী ফিরে আসার।

একটু পর শর্মী ফিরে এলো।লাজুক হেসে নিয়াজের দিকে কীটটা এগিয়ে দিলো।নিয়াজ যখন দেখলো পজিটিভ তখনই নিজের আসল রূপে ফিরে গেলো। উদ্বিগ্ন হয়ে বললো, “এখন কি হবে শর্মী।এই অবস্থায় কিছুতেই জানানো যাবে না কাউকে আমাদের বিয়ের কথা। এখন নির্বাচন সামনে। আবার নির্বাচনের পর আমার বাপ হারুক অথবা তোমার বাপ, তখন তো মাথা এমনিতেই গরম থাকবো ওনাদের।আরো ৫-৬ মাস সময় লাগবে আমাদের। ”
শর্মীর চেহারা থমথমে হয়ে গেলো। চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো, “মাথা ঠিক আছে তোমার? ৫-৬ মাস এর আগেই তো সবাই বুঝে যাবে আমি প্রেগন্যান্ট। ”

নিয়াজ বিরক্ত হয়ে বললো, “আমি কি করবো বল আমাকে?তাইলে চল এবোরশন করিয়ে ফেলো।”

শর্মীর মাথায় যেনো বাঁজ পড়লো।এবোরশন!
শর্মী করাবে এবোরশন!যেই শর্মী মায়ের মতো মমতা দিয়ে ভাইকে বড় করেছে, বাচ্চা দেখলে যেই শর্মী কোলে তুলে নেয় সে কি-না নিজের সন্তানকে হত্যা করবে!

নিয়াজের শার্টের কলার চেপে ধরে শর্মী বললো, “কি বললা তুমি? আবার যদি এই শব্দ উচ্চারণ কর তাহলে খুব খারাপ হবে।”

নিয়াজ শর্মীর হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে বের হয়ে গেলো দরজা খুলে। শর্মী হতভম্ব হয়ে বিছানায় বসে রইলো।

দুই চোখ দিয়ে আপনাতেই পানি পড়ছে শর্মীর।নিয়াজ এসব কি বলছে!

শর্মী নিজেকে শান্ত করে নিয়াজকে কল দিলো। এখন রাগারাগি করার সময় না।নিয়াজকে ঠান্ডা মাথায় বুঝাতে হবে।

নিয়াজ শর্মীর বাসা থেকে বের হয়ে বাজারে চলে গেলো। মগার দোকানের পেছনে বসেছে নেশার আড্ডা।ইয়াবা,মদ,সিগারেট নিয়ে বসেছে কয়েকজন।
একটা বেঞ্চিতে চিৎ হয়ে শুয়ে টগর সিগারেট টানছে।এই মাত্র একটা বোতল খালি করেছে সে।নিয়াজ এসে সেই আসরে বসে গেলো।

ফোন বাজতেই নিয়াজ বিরক্ত হয়ে ফোন তুললো। তারপর সরে এলো একপাশে জঙ্গলের পাশে।

রিসিভ করে বললো, “কল দিছস ক্যান?তেজ দেখাইছস না আমারে?এখন ক্যান কল দিলি?”

শর্মী হতভম্ব হয়ে গেলো নিয়াজের মুখে এরকম কথা শুনে। এসব কি নিয়াজ বলছে তাকে?একটা মানুষের মুখের ভাষা এতো জঘন্য!

টগর টলতে টলতে জঙ্গলের এক পাশে প্রস্রাব করতে বসলো। তারপর মাথা ঘুরে সেখানেই ধপ করে পড়ে গেলো।
নিয়াজ সেদিকে এক নজর তাকিয়ে এক দলা থুথু ফেললো। শালার অভারলোড হয়ে গেছে।

শর্মী যথেষ্ট শান্তভাবে বললো, “নিয়াজ,তোমার সবাইকে জানাতে হবে আমাদের বিয়ের কথা। ”

নিয়াজ আবারও এক দলা থুথু ফেলে বললো, “কিসের বিয়ে? কার বিয়ে?”

শর্মীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কি বলছে নিয়াজ এসব?
এভাবে অস্বীকার করছে কেনো সে শর্মীকে?

নিয়াজ বললো, “দেখো শর্মী,আমার এখনো বিয়ের বয়সই হয় নি,বাচ্চাকাচ্চার দায়িত্ব নেওয়া তো পরের কথা।তাই তুমি আমার সাথে যদি থাকতে চাও তবে তোমার এবোরশন করতে হবে।তা না হলে আমি জানি না।”

শর্মী বিড়বিড় করে বললো, “জানোয়ারের ঘরে জানোয়ারই হয়।তোকে বিশ্বাস করা আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো।”

নিয়াজ হেসে বললো, “থ্যাংকস ডার্লিং। ”

কল কেটে শর্মী আছড়ে ভেঙে ফেললো ফোনটা।মথার ভেতর কেমন দপদপ করছে।
কি করবে এখন সে!
সামনে বাবার নির্বাচন, এই সময় এসব জানাজানি হলে তো!

ভাবতে পারছে না কি করবে।বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে উপরের দিকে তাকাতেই ফ্যানের দিকে নজর গেলো তার।
তখনই বুদ্ধি মাথায় এলো।

চন্দ্র ক্লাস শেষে ভার্সিটির লাইব্রেরিতে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো। শরীর ভীষণ ক্লান্ত তার।তার উপর আজকে সবগুলো ক্লাস করতে হবে।দুই ঘন্টা পর খোকন স্যারের ক্লাস।ক্লাসে এটেন্ড না করলে মনে হয় মিসাইল ছুঁড়বেন তিনি তার উপর।
কে জানে কেনো এই বদখত লোকটা তাকে ভীষণ অপছন্দ করে।
দুই ঘন্টার জন্য চন্দ্র আর হলে গেলো না।

লাইব্রেরিতে গিয়ে নিজের নোট রেডি করতে বসলো। এতে করে সময় দ্রুত কেটে যাবে।

লিমন এসে চন্দ্রর পাশে বসে ফিসফিস করে বললো, “কি রে,তুই না-কি এবারের ট্যুরে যাচ্ছিস না?”

চন্দ্র মাথা নেড়ে বললো, “হ্যাঁ যাচ্ছি না। ”

লিমন ফিসফিস করে বললো, “দূর! তুই না গেলে মজা হবে না।চল না দোস্ত।আমাদের গ্যাংটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তোকে ছাড়া।”

চন্দ্র ফিসফিস করে বললো, “আব্বার ইলেকশন আছে।আমাকে গ্রামে যেতে হবে ১০-১২ দিন পর। ট্যুর কোনো ভাবেই আমি দিতে পারবো না। ”

লিমন ব্যথিত হলো খুব।ভেবেছিলো এবার ট্যুরে গেলে সবার সামনে নীলগিরিতে উঠে চন্দ্রকে সে প্রপোজ করবে।ইউটিউব দেখে অনেকগুলো কৌশল ও শিখেছে লিমন।
চন্দ্র না গেলে কিভাবে হবে!

লিমন আরো কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু চন্দ্রর সামনে বসা ছেলেটার বিরক্তি প্রকাশ দেখে চুপ করে রইলো সে।
চন্দ্র ফোন বের করলো টাইম দেখার জন্য। এখনো একঘন্টার মতো বাকি আছে। পেটের মধ্যে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। চন্দ্র উঠে গেলো ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে।

লিমনের খপ্পর থেকে রেহাই পেয়ে স্বস্তি পেলো চন্দ্র।কয়েকদিন ধরে লিমনের ভাবভঙ্গি ওর ভালো লাগছে না।এই যে অতিরিক্ত যত্ন করা ব্যাপারটা, চন্দ্র অনুভব করে এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য আছে। সে লিমনকে সেই সুযোগ দিতে চায় না।

এক কাপ চা আর দুটো সিঙ্গারা নিয়ে চন্দ্র বসলো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। আজকেও একটা চিঠি পেয়েছে সে।চিঠি পড়ার পর থেকে চন্দ্রর মনটা অস্থির হয়ে আছে।

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চন্দ্র ক্লাসে গেলো।পরবর্তী সময়টা চন্দ্রর জন্য ভীষণ বিরক্তিকর কাটলো।

সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে চন্দ্র শুয়ে পড়লো তখন কল এলো। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখে আব্বা কল দিছে।আপনাতেই চন্দ্রর মুখ হাসিহাসি হয়ে গেলো, সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো।
চন্দ্র কল রিসিভ করতেই তার বাবা সালাম দিয়ে বললো, “আমার আম্মাজান কি আইজ বেশি ব্যস্ত আছিলো? ”

চন্দ্র যেদিন বাড়িতে কথা বলে না দিনে,রাত হলেই তার বাবা কল দেয় তাকে।সারাদিন এতো ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও মেয়ে যে কল দেয় নি সেই ব্যাপারটা বাবা মাথায় রাখে বলেই চন্দ্রর বুক আনন্দে ভরে উঠে।
বাবা বললেই যেমনটা মনে ভেসে উঠে তার বাবা ঠিক তেমনই।

শাহজাহান তালুকদার ভেজা কণ্ঠে বললো, “আম্মা এইবার কিন্তু ৪ মাস হইছে আপনে আসেন নাই।”

চন্দ্র হেসে বললো, “আব্বা,আমি আগামীকালই আসবো।ভাবছিলাম আরো ১০-১২ দিন পর যাবো কিন্তু এখন আপনার কথা শুনে আর ভালো লাগছে না।”

আনন্দিত হয়ে শাহজাহান তালুকদার বললো, “ঠিক আছে আম্ম,আমি লোক পাঠাই রাখমু স্টেশন। ”

বাড়িতে যাবার আনন্দ নিয়ে চন্দ্র শুয়ে পড়লো।

চলবে……

রাজিয়া রহমান