Sunday, June 29, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 308



চন্দ্রাণী পর্ব-৩১+৩২

0

#চন্দ্রাণী (৩১)
কারো মায়ায় পড়ে যাওয়ার মতো ভয়ংকর নেশা দ্বিতীয় কিছু নেই।নির্ঝর মুগ্ধ হয়ে শর্মীকে দেখছে। মেয়েটার চোখের নিচে পড়া কালিটাও কেমন আদুরে লাগছে নির্ঝরের কাছে।
এতো মায়া কেনো একটা মানুষের জন্য জন্মাবে হুটহাট?

ভাবতে ভাবতে ঘোর লেগে গেলো নির্ঝরের। আকাশের ওই সাদা মেঘের মতো মন ছুটে চলেছে। ঘোর কাটলো টগরের কথা শুনে। টগর স্পষ্ট সুরে বললো, “যে কারণে এসেছি আজ সেটা বলছি।আপনার বাসার সবাই এখানে উপস্থিত আছে তো চেয়ারম্যান সাহেব?”

টগর সটান হয়ে বসেছে চেয়ারে,কপালের উপর কয়েকটা এলোমেলো চুল অবহেলায় পড়ে আছে।
হাতে একটা ঘড়ি,পরনে একটা আকাশি কালার শার্ট।শাহজাহান তালুকদার তাকিয়ে আছে টগরের দিকে। এই ছেলেটাকে আজকে কেমন অন্য রকম লাগছে। সবসময় যেমন ঘোর লাগা একটা দৃষ্টি ছিলো আজ তেমন মনে হচ্ছে না।

শাহজাহান তালুকদার বললো, “সবাই বলতে আমার কর্মচারী বাবুল দাশ তো নেই আর কাজ করার মহিলা একজন এখনো আসে নি।”

নির্ঝর জিজ্ঞেস করলো, “বাবুল দাশ কোথায়?আর কাজের মহিলা?”

শাহজাহান তালুকদার বললো, “বাবুল কোথায় গিয়েছে আমি জানি না আর কাজের মহিলা এখনো আসে নি।আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। ”

টগর বললো, “অসুবিধা নেই,মেইন কালপ্রিট যে সে এখানেই আছে।”

চন্দ্র বাবা মা’র দিকে তাকালো। তার বিশ্বাস, ভরসা সব দিন দিন কেমন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। রেহানার দুই চোখ ছানাবড়া।
শর্মী প্লেট বাটি গুছিয়ে রাখছিলো রান্নাঘরে। টগরের কথা শুনে সে-ও চমকে উঠলো। কি বলছে টগর!

শাহজাহান তালুকদার নড়েচড়ে বসে বললো, “কে অপরাধী আর কে অপরাধী না,সেটা তুমি জানো কীভাবে? এটা পুলিশের দায়িত্ব, কোনো জাত মাতালের না।যে নিজেই কিনা মাতাল হয়ে থাকে,বাড়িতে মদ দিয়ে ভরিয়ে রাখে।তুমি কি ভেবেছো আমি জানি না তোমার বাড়িতে কোথায় মদের গোপন আস্তানা? ”

নির্ঝর বললো, “কি বলছেন আপনি? ”

শাহজাহান তালুকদার বললো, “ইন্সপেক্টর, যাকে আপনি সাথে করে নিয়ে এসেছেন সে যে একজন মাতাল তা তো আপনি জানেন নিজেই।ওর বাড়িতে মদের কারখানা বলতে পারেন।সে এসেছে অপরাধী খুঁজতে। ”

টগর হেসে বললো, “প্রমাণ করতে পারবেন?”

শাহজাহান তালুকদার বললো, “নিশ্চয়। ”

নির্ঝর দুইজন কনস্টেবলকে শাহজাহান তালুকদারের সাথে পাঠিয়ে বললো, “ওনার সাথে যাও,গিয়ে দেখে আসো ওনার কথা কতটা সত্য।”

শাহজাহান তালুকদার উঠে দাঁড়ালো। রেহানা বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শাহজাহান তালুকদার চলে যাওয়ার পর টগর বললো, “এভাবে তাকাবেন না চাচী আম্মা,এটা তো প্রাচীন যুগ না।প্রাচীন যুগ হলে এতক্ষণে আমি ভস্ম হয়ে যেতাম।”

রেহানা হিসহিসিয়ে বললো, “এখানে কেনো এসেছো তুমি? তোমার উদ্দেশ্য কি?”

টগর বললো, “আমার উদ্দেশ্য একটাই আম্মা,আমি আমার বউকে ফেরত চাই।”

রেহানা চমকে উঠলো। চেহারা মুহূর্তে পাংশুবর্ণ লাভ করলো। নিজেকে সামলে বললো, “কিসের বউ?কার বউ?”

টগর হেসে বললো, “মনে নেই আম্মা?কথা ছিলো আমার পুতুলের ১৮ বছর হলে আমার হাতে তুলে দেওয়া হবে। তারপর কি হলো আম্মা?”

টগর পকেট থেকে একটা ছবি বের করে রেহানার সামনে দিলো।
রেহানার হাত পা কাঁপতে লাগলো। পুরো পৃথিবী যেনো কাঁপছে। চন্দ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।তাকে জানতে হবে সবটা।

রেহানা শান্ত স্বরে বললো, “কি বলছো এসব?”

টগর হাসতে লাগলো। রেহানার মনে হচ্ছে তার কানে যেনো কেউ বিষ ঢেলে দিচ্ছে। এই ছেলেটা এভাবে হাসছে কেনো?
চন্দ্র এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো,এবার কি তাহলে সত্যি সত্যি মেয়েকে হারিয়ে ফেলবে?
নিজেকে নিজে সামলাচ্ছে রেহানা।না তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না।কিছুতেই না।

সিতারা বানু রেহানার দিকে তাকিয়ে বললো, “ও রেনু,কি বলছে এই পোলা?কি হইছে রে?”

রেহানা শান্ত স্বরে বললো, “কিছু হয় নি আম্মা।আপনি চিন্তা করবেন না।রুমে গিয়ে বিশ্রাম নেন।”

নির্ঝর বললো, “না দাদী,কোথাও যাবেন না।এখানেই বসুন।আজকে সব নাটকের যবনিকাপাত হবে। সব সত্যি সবাই জানতে পারবে।”

শর্মী এসে টেবিল থেকে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ালো।তার মাথায় ঢুকছে না কোনো কিছু। কিসের কথা বলছে এরা এসব?

রেহানা বললো, “কিসের নাটকের কথা বলছেন?”

নির্ঝর বললো, “নিয়াজের মৃত্যু রহস্য চাচী,গ্রামে ড্রাগের ব্যবসা কে করে সব কিছুই আজ সবাই জানতে পারবে। ”

রেহানা বললো, “নিয়াজের মৃত্যুর সাথে আমাদের কি সম্পর্ক? আর ড্রাগ ব্যবসায়, এসবের সাথে আমাদের কেনো জড়ানো হচ্ছে? এখানে কেনো এসব কথা আসছে?”

টগর মুচকি হেসে বললো, “রক্ষক যখন ভক্ষক হয় তখন এর চাইতে বেশি কি আশা করা যায় বলেন?”

কিছুক্ষণ পর শাহজাহান তালুকদার এলো কনস্টেবলদের সাথে। দুইজন কনস্টেবল হাতে চারটি বোতল নিয়ে এলো।

শাহজাহান তালুকদার বললো, “এগুলো কোথায় পেয়েছে আপনার কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করুন।”

টগর একটা বোতলের ছিপি খুলে একটা গ্লাসে ঢেলে চন্দ্রর সামনে এগিয়ে দিলো। তারপর বললো, “খান এটা।”

শাহজাহান তালুকদার রাগান্বিত হয়ে বললো, “ফাজলামো হচ্ছে না-কি? আমার মেয়ে কেনো এসব হারাম জিনিস মুখে নিবে?এসব কি হচ্ছে ইন্সপেক্টর?
আর ছেলেটা কেনো এতো কথা বলছে?ও কে যে পুলিশ কেসের ব্যাপারে কথা বলবে?কিসের ভিত্তিতে বলছে এসব ও?”

টগর মুচকি হেসে পকেট থেকে নিজের সি আই ডির ব্যাজটা বের করে শাহজাহান তালুকদারের সামনে রাখলো।
এক নজর সেই ব্যাজের দিকে তাকিয়ে শাহজাহান তালুকদার আর রেহানা দুজনেই চমকালো।শর্মী এগিয়ে এসে ব্যাজ হাতে তুলে নিলো।তারপর বিস্মিত হয়ে একবার কার্ডের দিকে আরেকবার টগরের দিকে তাকালো।
এই লোকটা একজন সি আই ডি অফিসার!
শর্মীর বিশ্বাস হচ্ছে না।

টগর বললো, “চন্দ্র,আপনি এটা খান।”

চন্দ্র বিব্রত হয়ে তাকালো টগরের দিকে। এই মানুষটা কি বলছে এসব।
শাহজাহান তালুকদার ক্রুদ্ধ হয়ে বললো, “আমার মেয়ে এসব খাবে না।”

টগর বললো, “চন্দ্র,আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন,আপনি আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার চাইতে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী অন্য কেউ না আপনার। ওনারাও না।”

চন্দ্র বাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এই সেই বাবা চন্দ্রর,অথচ কতো রহস্যময় বাবা।
চন্দ্র ভাবতো বাবা তার কাছে স্বচ্ছ কাঁচের মতো। অথচ এখন মনে হচ্ছে বাবা যেনো গোলকধাঁধা। যেখানের কোনো দিশা খুঁজে পাবে না সে।
ভালোবাসা কি এতোটাই অন্ধ করে তোলে মানুষকে?
শুধু চন্দ্রকে ভালোবাসে বলেই বাবা এরকম করছে?

চলবে…..?
রাজিয়া রহমান

#চন্দ্রাণী (৩২)
স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসে সোনালি তরল পানীয়। শাহজাহান তালুকদারের দুই চোখে উৎকণ্ঠা। রেহানার দুই চোখে ক্রোধ।
চন্দ্র বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।বাবার উপর যেই রাগ ছিলো সেই রাগটা হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেলো।পিতৃ স্নেহের কাছে হেরে গেলো। আস্তে করে গ্লাসটা ঠেলে দিলো টগরের দিকে। টগর অবশ্য জানতো এরকম কিছুই হবে।চন্দ্র বাবার কথার বাহিরে যাবে না।
গ্লাসটা নির্ঝর শাহজাহান তালুকদারের সামনে দিয়ে বললো, “আপনি না হয় খেয়ে দেখুন।”

শাহজাহান তালুকদার হতভম্ব
এদের ব্যবহার কেমন উগ্র মনে হচ্ছে তার কাছে। এদের প্ল্যান কি শাহজাহান তালুকদার কিছুই বুঝতে পারছে না। তার বুক কাঁপছে ভয়ে।এতো বছর পরে এসে ভয় তাকে এভাবে কাবু করে ফেলবে ভাবতে পারেন নি তিনি।
বহুদিন পর নিজেকে ভীষণ ক্লান্ত মনে হচ্ছে তার।বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে নাকে কপালে।
রেহানা স্বামীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো, “চন্দ্রর বাপ,আপনি এরকম ভেঙে পড়তেছেন কেনো?”

শাহজাহান তালুকদার ভরসাহীন চোখে মেয়ের দিকে তাকালো। চন্দ্রর মনে হচ্ছে তার কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এতো যন্ত্রণা কেনো হচ্ছে? আর কতক্ষণ চন্দ্র নিজেকে সামলে রাখতে পারবে চন্দ্র জানে না।
কান্নারা সব দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে জমেছে।
বুক কেমন শূন্য শূন্য লাগছে চন্দ্রর।এই জগৎ সংসার সবই মিথ্যে মায়া শুধু।

চন্দ্র নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো বাবার দিকে।

নির্ঝর বললো, “আপনি চেক করে দেখুন না এটা কি!”

শাহজাহান তালুকদার মানুষ চেনেন।এরা এতো কনফিডেন্স নিয়ে বলছে যখন তখন নিশ্চয় কোনো ঘাপলা আছে।এই বোতলে কিছু থাকলে ওরা এভাবে বলতো না।

গ্লাস তুলে নিয়ে এক চুমুক মুখে দিতেই বুঝতে পারলো শাহজাহান তালুকদার আসল কাহিনি। বোতল ভর্তি সফট ড্রিংকস। এরা এতো নিশ্চন্ত কেনো এবার বুঝতে পারছে।

টগর নিজের কার্ড এগিয়ে দিলো শাহজাহান তালুকদারের দিকে।
নির্ঝর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনার নামে আমাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে চেয়ারম্যান সাহেব। ইউ আন্ডার এরেস্ট। ”

শাহজাহান তালুকদার নিজের অপরাধ কি বুঝতে পারছেন না।
হতবাক হয়ে তাকাতেই টগর বললো, “কুসুমপুরে ড্রাগ বিজনেস, নিয়াজ,নীলির খু//নের জন্য আপনাকে এরেস্ট করা হলো।”

শাহজাহান তালুকদার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। চন্দ্র মনে মনে বলছে সত্যিটা বলো বাবা।আর চুপ করে থেকো না।

শাহজাহান তালুকদার এক মুহূর্ত কি যেনো ভাবলো।তারপর রেহানার মুখের দিকে তাকালো। রেহানার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই।যা বুঝার বুঝে নিলো শাহজাহান তালুকদার।
উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “চলুন,যাওয়া যাক।”

চন্দ্র উঠে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। শক্ত করে ধরে বললো, “না আব্বা,আব্বা কোথাও যাবেন না আপনি। আপনি কিছু করেন নি আমি জানি। কেনো অযথা নিজের কাঁধে দোষ নিচ্ছেন?”

শাহজাহান তালুকদার বললো, “আমার মায়ের কাছে আমি নির্দোষ হলেই চলবে গো মা।সারা পৃথিবী আমাকে দোষী ভাবুক।আমার আফসোস নেই আর।”

শর্মী কাঁদতে লাগলো নিরবে।নির্ঝর একবার টগরের দিকে তাকালো। টগরের চোখ হাসছে।নির্ঝর শাহজাহান তালুকদারকে নিয়ে বের হলো।
টগর বের হলো ঘর থেকে। দুই পা গিয়ে আবার পিছিয়ে এলো।চন্দ্রর সামনে এসে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “এই চোখে আমি কান্না দেখতে চাই না,আমার জন্য ভালোবাসা দেখতে চাই। আপনি যদি কখনো কাঁদেন তাহলে আমাকে পেয়ে খুশিতে কাঁদবেন।”

চন্দ্রর ভীষণ রাগ হলো। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিতেই টগর চন্দ্রর ঠোঁটে আলতো করে আঙ্গুল দিয়ে বললো, “উহু,একটা কথা ও বলবেন না।নাটকের শেষ পর্ব এখনো বাকি আছে। ”

চন্দ্রকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টগর চলে গেলো।

কাচারি ঘরের সামনে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ততক্ষণে চারদিকে ছড়িয়ে গেছে চেয়ারম্যানকে পুলিশ ধরেছে নিয়াজের খুনের জন্য।

কাচারি ঘরের সামনে এসে নির্ঝর কিছুক্ষণ দাঁড়ায় চেয়ারম্যানকে নিয়ে। চেয়ারম্যান এদিক ওদিক কিছুক্ষণ দেখলো।তারপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, “চলুন।”

নির্ঝর বললো,”আসুন।”

গাড়িতে উঠে নির্ঝর বসলো শাহজাহান তালুকদারকে নিয়ে। গাড়ি অপেক্ষা করছে টগরের জন্য। টগর একটা সিগারেট ধরিয়েছে।সিগারেটে দুই টান দিয়ে টগর ফেলে দিলো সিগারেট।
পেছনে তাকিয়ে দেখে চন্দ্র আর শর্মী দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে।

লোকজন সবাই নানা কথা বলতেছে।সবার কথা টগরের কানে আসছে।টগর গাড়িতে উঠতে যাবে সেই মুহূর্তে বাবুল দাশ ছুটতে ছুটতে এলো।

টগরের হাত চেপে ধরে বললো, “আমি, আসল অপরাধী আমি স্যার। আপনি আমারে এরেস্ট করেন।”
উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। চন্দ্র,শর্মী বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলো বাবুল দাশের দিকে।

শাহজাহান তালুকদার কিছু বলার আগে বাবুল দাশ বললো, “আমি আপনার নুন খাইছি স্যার।আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আমজ করতে পারবো না।আমাকে ক্ষমা করে দিন।”

শাহজাহান তালুকদারকে ছেড়ে দেওয়া হলো।কাচারি ঘরের সামনে চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা করা হলো।আশেপাশের মানুষ সবাই এসে হাজির। বাবুল দাশের মতো সহজ সরল বোকাসোকা একটা লোক সব কিছুর মাস্টার মাইন্ড এটা কারো বিশ্বাস হচ্ছে না।

চন্দ্র এক ছুটে গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, “মা,আব্বাকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। আসল অপরাধী না-কি বাবুল কাকা।আব্বা নির্দোষ। ”

রেহানা ফ্লোরে লেপটে বসে আছে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “তোর বাপ যে নির্দোষ তা আমি জানি গো মা।”

চন্দ্র মায়ের হাত ধরে বললো, “কিসের এতো ভয় তোমাদের মা?আমাকে নিয়ে? ভয় পেও না মা।তোমরা আমার বাবা মা,সারা দুনিয়ার মানুষ এসে যদি বলে তোমরা আমার আপন বাবা মা না আমি তবুও বিশ্বাস করবো না।আমার মা তুমি মা।তুমি আর আব্বা ছাড়া আমার কেউ নেই।আমি সব জানি মা।”

রেহানার দুই চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেলো।মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রেহানা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।

সিতারা বানু কিছু বুঝতে পারছে না। ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো এই বউ একটা কথা ও বললো না, একটু চোখের পানি ও ফেললো না।অথচ এখন মেয়ের কথা শুনে কাঁদছে কেনো?
চন্দ্রর কথার মানে তার কাছে পরিস্কার না।

রেহানা চন্দ্রর হাত চেপে ধরে বললো, “তুই আমার মেয়ে,তুই শুধু আমার মেয়ে মা।আমি তোকে কোথাও যেতে দিমু না।তুই আমার শূন্য কোলে আলো নিয়ে এসেছিস।তুই আসার পর আমি জীবনের সব সুখ ফিরে পাইছি।আমি তোরে হারাতে পারমু না।আমার কাউরে লাগবো না মা তুই ছাড়া। ”

শর্মী ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। কি শুনছে এসব সে?
কিছুই বুঝতে পারছে না।

সব কিছুর পেছনে তাহলে কি কারণ ছিলো?
আপা কি বললো এসব?

বাবুল দাশ একেবারে শান্ত হয়ে বসে আছে।কাদের খাঁন ও এসে হাজির হয়েছে।
নির্ঝর বললো, “শুরু করো বাবুল দাশ।”

বাবুল দাশ শাহজাহান তালুকদারের দিকে এক নজর তাকালো। তারপর মাটির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি বাবুল দাশ। নিচু জাতের মানুষ আমি। হান্নান চৌধুরীর বাড়িতে আমি কাজ করতাম।হান্নান চৌধুরীর বাপ হানিফ চৌধুরীর উদ্যোগে আমি আইএ পাশ করি।এরপর আর পড়ালেখা করতে পারি নাই।”

হান্নান চৌধুরীর নাম শুনে কাদের খাঁন নড়েচড়ে বসলো। কানিজের স্বামী হান্নান চৌধুরী।

বাবুল দাশ বলতে লাগলো, “হান্নান স্যার বিয়ের পর থেকে কানিজ ভাবীর সাথে দুর্ব্যবহার করতো। ওদের বাড়ির সবাই-ই ভাবীর সাথে ভীষণ খারাপ ব্যবহার করতো।
একে একে দুটো কন্যা সন্তানের জন্মের পর কানিজ ভাবী একেবারে ভেঙে পড়ে। ভাবী যখন আবার গর্ভবতী হয় তখন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। খেতে পারতো না কিছুতেই।তার উপর ভাইজানের হাত তো কথায় কথায় ভাবীর গায়ে উঠতো। এতো অত্যাচার সহ্য করে ও কেনো পড়ে ছিলেন উনি আমি জানি না।
মাঝেমাঝে আমাকে দিয়ে দোকান থেকে পান সুপারি আনাতেন বমি ভাব হলে খাবেন বলে। তৃতীয় বার ভাবীর অসুস্থতা ভীষণ বেড়ে যায়।ভাবীকে একবারের জন্য ওরা কেউ ডাক্তারের কাছে নেয় নি।
সবাইরে ফাঁকি দিয়ে ভাবী একদিন আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছিলো। ফেরার পর খালাম্মা ভাবীকে একটা লাথি দিছিলো কোন সাহসে ডাক্তার দেখিয়েছে এই অপরাধে।
আমি গরীব মানুষ, চাইলেও কিছু করতে পারতাম না।মনে মনে ভাবতাম এইবার ও যদি মেয়ে হয় আমি মেয়েটারে নিয়ে পালাইয়া যামু ওরা কিছু করার আগে।
আবারও একটা মেয়ে হইলো। এতো সুন্দর একটা মেয়ে হইলো আমি ভাবছি সবাই সব ভুলে গেছে বুঝি মেয়ের দিকে তাকিয়ে। অথচ ভুল ভাবছি।বাবুর চার মাস বয়সের সময় একদিন দুপুরে দেখলাম খালাম্মা আর ভাইজান চুপি চুপি বাবুরে কোলে নিয়ে বের হইছে।আমি ও পিছু নিলাম।ওরা একটা হাসপাতালে নিয়ে বাচ্চাটারে বিক্রি করে দিলো।
কষ্টে আমার তখন বুক ফেটে যাচ্ছিলো।
আমি এরপর যারা বাচ্চাটা কিনছে তাদের পিছু নিই।আর পিছু নিয়েই চেয়ারম্যান সাবের বাসা পর্যন্ত যাই।
এরপর থেকে সুযোগ পেলেই ওনাদের বাসার সামনে ঘুরাঘুরি করতাম।ওনারা তখন ঢাকায় থাকতো।

মেয়ের নাম দিলো চন্দ্র।চন্দ্র রাখারই কথা, এতো সুন্দর একটা মেয়ে সে চন্দ্র নয়তো কি?
নিজের উপর খুব রাগ হইতো আমার। যদি আগের দুইটা বাচ্চার উপর নজর রাখতাম তাহলে ওদের ঠিকানা ও জানতাম।
চন্দ্ররে দত্তক নেওয়ার দুই মাস পর আমি চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে যাই বাসায় কাজের জন্য। ততদিনে ছোট্ট পুতুলটার উপরে আমার ভীষণ মায়া জন্মে গেছে। ওরে দেখার লোভেই আমি চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায় কাজ নিই।উনি তখনও চেয়ারম্যান হন নাই যদিও। ”

শাহজাহান তালুকদার নিরবে কাঁদছে। এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন তিনি।তিনি চান না কেউ জানতে পারুক চন্দ্র তার জন্ম দেওয়া সন্তান না।এই ভয়ে তিনি মেয়েকে নিয়ে বাড়িতেও আসেন নি প্রথমে। কাউকে কিছু জানান নি।আজ সবাই জেনে গেলো,মেয়েটাও জানবে।এরপর কি মেয়ে আর তাকে বাবা বলে ডাকবে?
কিসের একটা অসহ্য চাপা যন্ত্রণা সারা শরীর ছেয়ে গেলো তার।
চন্দ্র,তার কলিজার টুকরো মেয়ে। মেয়ে অভিমান করে হারিয়ে যাবে না তো এবার!
কাদের খাঁন বুক চেপে ধরলেন।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। এমন লাগছে কেনো?
চন্দ্র,মানে তালুকদারের বড় মেয়ে তার আপন বোনের মেয়ে!
বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি।আশেপাশের সবাই চুপ হয়ে আছে।মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে বাবুল দাশের কথা সবাই।

চলবে……
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-২৯+৩০

0

#চন্দ্রাণী(২৯)

চন্দ্র শর্মীকে কোথাও না পেয়ে চিন্তায় পড়ে গেলো। এতো রাতে শর্মী কোথায় গেলো?
বেশ খানিকটা সময় কেটে যাওয়ার পর চন্দ্রর হঠাৎ করে কি মনে পড়তেই ছাদের দিকে ছুটলো। ছাদ ছাড়া সবখানেই খোঁজা হয়েছে।
চন্দ্রর ধারণা সত্যি হলো। ছাদে গিয়ে দেখে শর্মী ফ্লোরে বসে আছে। সামনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কতোগুলো কাগজ।

চন্দ্রকে দেখে শর্মী মলিন হেসে বললো, “শেষ করে দিলাম আপা।তার সব স্মৃতি শেষ করে দিলাম।আমার জীবন থেকে তার সব ছায়া মুছে ফেললাম।আল্লাহ যাকে আমার ভাগ্যে রাখে নি তার স্মৃতি রেখে কি করবো আমি? ”

চন্দ্র বললো, “ভাগ্যে যা আছে তা মেনে নিতে শিখ।যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে। ”

শর্মী আগুনের দিকে তাকিয়ে বললো, “ভালো? কোন ভালো আপা?
সেই ভালো যা আমার বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে? আমার ভালোবাসার মানুষকে কেড়ে নিয়েছে?
আমার মন ভেঙে খানখান করে দিয়েছে? এতো ভালো কেনো হলো আপা?আমি তো এতো ভালো চাই নি আমার। আরেকটু কম হলেও তো ক্ষতি হতো না। ”

চন্দ্র বোনের পাশে বসে বললো, “আজ যা কষ্ট মনে হচ্ছে তোর দেখবি একদিন সেই কষ্ট তোর জীবনে সুখ হয়ে ধরা দিবে।
আজ যা হারিয়ে ভাবছিস সর্বহারা তুই,একদিন বলবি তা হারানোয় বুঝি জীবন এতো সহজ হয়েছে, সুন্দর হয়েছে।
বিষধর সাপ যতোই পোষ মানুক না কেনো,বিষদাঁত ফুটাতে কিন্তু সে ভুলে না।মনে রাখিস।”

শর্মী কিছু বললো না।

চন্দ্র বললো, “তোর এই জামার সাথের ওড়না কই?”

শর্মী বললো, “রুমেই আছে। ”

চন্দ্র বললো, “চল আমাকে দেখাবি।”

শর্মী বুঝতে পারলো না ওড়না দেখার কি আছে? তবুও বোনের সাথে নিচে নেমে গেলো।
নিচে গিয়ে দেখে সত্যি শর্মীর ওড়না বারান্দায় আছে। চন্দ্র এক মুহূর্ত ভেবে নিজের রুমে গেলো। খুঁজতে গিয়ে দেখে তার ওড়নাটাই নেই।

খাটের উপর বসে চন্দ্র মাথা চেপে ধরে বসে রইলো। ভালো লাগছে না তার।কিছু ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে যেনো একটা গোলকধাঁধায় ঘুরছে সে।
কে নিলো তার ওড়না?

বাহিরে শাহজাহান তালুকদারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘরে ঢুকেই চন্দ্রকে ডাকলেন।
চন্দ্র বাহিরে এসে দেখে এলাহি আয়োজন। কাচ্চি বিরিয়ানি , চিকেন চাপ,মিষ্টি।
শাহজাহান তালুকদার স্ত্রীকে চেয়ারে বসিয়ে বললেন, “একটা সময় তোমার প্রতি ভালোবাসার কমতি ছিলো, যত্নের কমতি ছিলো। আমার অবহেলা, আমার দুর্ব্যবহার সহ্য করে তুমি আমার হাত ধরে এই পর্যন্ত এসেছ।আমার সকল ভুল নিজ গুণে ক্ষমা করে দিয়েছো।আমার দেওয়া আঘাতকে তুমি ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছ।
আমি তোমার কাছে কতটা ঋণী তা কেউ না জানলেও আমার আল্লাহ জানে।
আজ আমি তোমার সাথে করা সব অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাই রেহানা।”

আজ কানিজের সাথে কথা বলে আসার পর শাহজাহান তালুকদার সিদ্ধান্ত নিলো যেই মানুষ্টা আজ পর্যন্ত তার সাথে সংসার করে যাচ্ছে, তার সব বিপদে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার প্রতি ভালোবাসা,কৃতজ্ঞতা প্রকাশ স্বরূপ তাকে একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাক।কখনো তাকে এভাবে স্পেশাল ফিল করানো হয় নি।আজ না হয় একটু ছেলেমানুষী করেই তাকে খুশি করবেন।

পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা গোলাপ বের করে হাটু গেড়ে বসলেন শাহজাহান তালুকদার।
চন্দ্র দ্রুত হাতে ফোন নিয়ে ভিডিও করতে শুরু করলো।
এরকম আনন্দময় একটা মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী না করলেই নয়।

রেহানার দুই চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে।সিতারা বেগম একটা চেয়ারে বসে ছেলের কর্মকাণ্ড দেখছেন।তার একরোখা, একগুণ ছেলেটার জীবনে কতো উত্থান পতন ঘটেছিলো তিনি তো সব কিছুর সাক্ষী ছিলেন।

রাতে সবাই মিলে কেক কাটলো।হৈহল্লা করে সবাই মিলে খাবার খেলো।
চন্দ্র একবার ভাবলো মা’কে জিজ্ঞেস করবে টগরের কথা। পরক্ষণে মত বদলালো।
যে মা পেটের সব কথা তাকে না বললে শান্তি পেতো না,সেই মা যখন এটা চেপে গেছে তবে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। চন্দ্রকে সেই কারণ খুঁজে বের করতে হবে।

টগর বিছানায় শুয়ে আছে। মাথার ভেতর শুধু চন্দ্র চন্দ্র করছে।এতো কেনো উতলা লাগছে?
কবে চন্দ্রকে বাড়িতে নিয়ে আসবে?
শাহজাহান তালুকদার কি এতো সহজে মেনে নিবে সবটা?
টগর ভাবতে ভাবতে চোখ বুজলো।তন্দ্রা লেগে এসেছে টগরের।সেই মুহূর্তে অস্পষ্ট খট করে শব্দ হতে টগরের তন্দ্রা কেটে গেলো। চোখ বুঁজেই টের পেলো বিপদ আশেপাশেই আছে। মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে টগর কান পেতে রইলো আততায়ীর আক্রমণের অপেক্ষায়।
আজকে আবারও হামলা করবে টগরের ভাবনাতে ছিলো না। শোঁ করে একটা শব্দ হতেই টগর লাফিয়ে সরে গেলো। ছু//রি গিয়ে তোশকের মধ্যে গেঁথে গেলো।টগর লাফিয়ে নেমে এসে ঝাপটে ধরার আগেই হামলাকারী বোরকার পকেট থেকে আরেকটা ছু//রি বের করে টগরের ডান হাতে আঘাত করলো। বাম হাত দিয়ে টগর ডান হাত চেপে ধরে দুই পা পিছিয়ে গেলো।আততায়ী সামনে এগুতে যেতেই ল্যাং মেরে টগর তাকে ফ্লোরে ফেলে দিলো।
বিদ্যুতের গতিতে আক্রমনকারী স্থান ছেড়ে পালালো।
টগর পিছন নিলো না আর।এই বোরকা পরা মানুষটা কে টগর বুঝে গেছে।

ডান হাত গভীরভাবে কে//টে গেছে। আগে ফার্স্ট এইড নিতে হবে। তারপর নির্ঝরকে কল দিতে হবে।এতো সব বিপদের মধ্যে ও টগরের মন ভীষণ আনন্দিত লাগছে।
টগর ভেবে পেলো না এতো উৎফুল্ল হওয়ার কি আছে?
একটা মানুষকে ফিরে পাবে বলে এতটা আনন্দ কেনো লাগছে?নিজের মানুষ হলে বুঝি এরকমই হয়?

নিজের মানুষ! একটা নিজের মানুষের জন্য টগর কখনো তো এতো উদগ্রীব হয় নি।কাউকে কখনো পেতে ইচ্ছে করে নি।অথচ আজ মন কেমন করছে! নিজের এই বালখিল্যতায় নিজেই লজ্জা পেলো টগর।
হাতে ব্যান্ডেজ করে আপন মনে বললো, “আপনি আমার দূরে থাকা ভীষণ আপনজন চন্দ্র।”

চলবে……
রাজিয়া রহমান

#চন্দ্রাণী(৩০)

অবশেষে সকাল হলো। দীর্ঘ একটা রাত পার হয়ে সকাল হলো। রাতের অন্ধকার কেটে যাওয়ার সাথে সাথে কেটে গেলো চন্দ্রর জীবনের অনেক হিসাব নিকেশ।
চন্দ্র বসে আছে উঠানে একটা মোড়া নিয়ে।
আকাশ ভীষণ অন্ধকার হয়ে আছে। যেকোনো মুহূর্তে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে।চন্দ্র অপেক্ষা করছে বৃষ্টির জন্য।

রেহানা উঠানের চুলা ঢাকছে প্লাস্টিকের কাগজ দিয়ে। বৃষ্টি এলে চুলা ভিজে যাবে।চুলা ঢাকতে ঢাক্তে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, “খিচুড়ি খাবি চন্দ্র?”

চন্দ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, “খাবো।”

রেহানা চিৎকার করে শর্মীকে ডেকে বললেন,”শর্মী ফ্রিজ থাইকা গরুর গোস্ত আর ইলিশ মাছ বাইর কইরা ভিজা।তোর আপা খিচুড়ি খাইব।”

রেহানার কথা শেষ হতেই বৃষ্টি নামলো। ঝুম বৃষ্টি। রেহানা এক দৌড়ে ঘরে চলে গেলো। মেয়েকে বসে থাকতে দেখে ডাকতে লাগলো। চন্দ্র উঠছে না দেখে আবারও নেমে এলো উঠানে। হাত ধরে টানতে টানতে মেয়েকে ঘরে নিয়ে গেলো রেহানা।

ঘরে গিয়েই চন্দ্র মা’কে জড়িয়ে ধরলো। তারপর রেহানা কিছু বুঝে উঠার আগেই চন্দ্র হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। রেহানার বুকটা কেঁপে উঠলো। কেনো কাঁদছে তার মেয়ে?

অস্থির হয়ে রেহানা বললো, “ও মা,কি হইছে তোর?এতো কান্দো কেনো মা?কষ্ট হইতাছে তোর? কি হইছে মা’রে কও না মা।”

চন্দ্র কাঁদতে কাঁদতে বললো, “তুমি এমন কেনো মা?কেনো এমন তুমি?

রেহানা অস্থির হয়ে বললো, ” কেমন আমি?কি হইছে?”

চন্দ্র কিছু বললো না। শুভ্র চন্দ্রর কান্না দেখে নিজেও কান্না করতে লাগলো। রেহানা ভীষণ অস্থির হয়ে গেলো। চন্দ্র কাঁদছে!তার বড় মেয়ে,তার কলিজার টুকরো মেয়ে।

চন্দ্র কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। রেহানা শুভ্রর গলা টি//পে ধরলেন।অবুঝ ছেলেটা গোঁগোঁ শব্দ করতে লাগলো। রেহানার মাথায় খু//ন চেপেছে যেনো।ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন,”কি বলেছিস তুই?কি করেছিস তুই?চন্দ্র কাঁদছে কেনো?সকালে ও তোর রুমে গিয়েছিলো।কি হয়েছে আমার মেয়ের?কাল রাত থেকে ও এতো অস্থির হয়ে আছে কেনো?”

শুভ্রর দুই চোখ টলমল হয়ে গেছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। শর্মী দ্রুত ছুটে এসে মা’কে টানতে লাগলো। সিতারা বানু ও ছুটে এলেন।
অনেক ধস্তাধস্তির পর রেহানাকে সরাতে পারলো দু’জনে। সিতারা বানু রেগে গিয়ে বললেন, “দুনিয়ার সব মানুষ দেখি সারাজীবন পোলার জন্য পাগল হয়,একটা মাত্র পোলা হইলে তারে চোখের মনি কইরা রাখে।আল্লাহ তোমাগোরে শুধু ব্যতিক্রম বানাইলো।মাইয়া কান্দে দেইখা পোলারে এমন কইরা গলা টিইপ্যা ধরে?
কিয়ের এতো আদর মাইয়ার লাইগা?মাইয়া কোন খেতের মুলা?”

রেহানা চিৎকার করে উঠলো। রেহানার দুই চোখ রক্তাক্ত হয়ে আছে। এক্ষুনি যেনো দুই চোখ বেয়ে জল নয় রক্ত ঝরবে।
ভীষণ রেগে বললো, “আমার বড় মেয়ে আমার সব আম্মা।আমার কলিজার পুরোটা আমার বড় মেয়ে।আমার চন্দ্র।চন্দ্ররে নিয়ে আর একটা বাজে কথা ও কইবেন না আম্মা।চন্দ্ররে নিয়ে একটা বাজে কথা যে কইবো তার জিভ আমি ছিঁড়ে ফেলবো।আমার অশান্তি, কষ্ট, যন্ত্রণাময় জীবনে আমার চন্দ্র এসেছিলো রহমত হয়ে। স্বামীর করা সকল আঘাতের মলম ছিলো আমার মেয়ে।আমার মেয়ে আসার পর থেকে আমি স্বামীর আদর ভালোবাসা সব একটু একটু করে ফিরে পাইছি।আমার চন্দ্র আমারে যতটা ভালোবাসে বাকি দুইটা তার এক ফোঁটা ও ভালোবাসতে পারবে না জীবনে। আমার মেয়ের চোখে পানি,আপনি বুঝবেন না আম্মা আমার কলিজা কে//টে রক্ত বের করলেও এতো কষ্ট হতো না আমার মেয়ের কান্না দেখে আমার যেই কষ্ট হচ্ছে।
পুরো দুনিয়া একদিকে আর আমার মেয়ে একদিকে। ”

সিতারা বানু চুপ হয়ে গেলেন।আজ নতুন না,এসব পাগলামি তো অনেক আগে থেকেই দেখছেন তিনি।

শর্মী শান্ত স্বরে বললো, “মা, ভাইরে মারতেছো কেনো?ভাই আপাকে কি করবে?ও কথা বলতে পারে না,কিছু বুঝে ও না।ও নিজেই তো আপার কান্না দেখে কান্না করতেছে।ওর উপর রাগ দেখিয়ে কি লাভ আছে মা?”

রেহানা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। বাহিরের ঝুম বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি জানি না। আমি কি করছি আমি জানি না।আমার চন্দ্র কান্দে ক্যান তাইলে?আমার মা ক্যান কান্দে?আমার সহ্য হয় না।”

শর্মী মা’কে কিছু না বলে রান্না বসাতে গেলো।কিছুক্ষণ পর মা যদি দেখে রান্না হয় নি তাহলে আবার শর্মীকে ধরবে।
ছাতা মাথায় দিয়ে বাবুল দাশ এলো।শর্মী হেসে বললো, “কাকু,খিচুড়ি খাইবেন বসেন।”

বাবুল দাশ নতজানু হয়ে বললো, “না গো জননী, তোমরা তো গোমাংস দিয়ে… ”

শর্মী হেসে বললো, “আরে না,আপনার জন্য আমি মুরগির মাংস দিয়ে রান্না করেছি।ভয় পাইয়েন না কাকু।”

বাবুল দাশ হাসলো। এই মেয়ে দুটোকে এজন্য বাবুল দাশের এতো বেশি ভালো লাগে। এরা সব খেয়াল করে। এতো ভালোবাসার প্রতিদান কি দিতে পারবেন তিনি কোনো দিন? তার মতো গরীব, কাজের লোকের প্রতি ওদের যে ভালোবাসা তার প্রতিদান কি হয় কিছু দিয়ে?

বাবুল দাশ খেয়ে চলে যেতেই শাহজাহান তালুকদার এলেন ঘরে। বৃষ্টি থেমেছে। রোদ ও উঠে গেছে। রেহানা থমথমে মুখ করে বসে আছে। তালুকদার বুঝতে না পেরে শুভ্রর দিকে তাকালো। পরক্ষণেই মনে হলো শুভ্র তো কিছু বলতে ও পারবে না।শর্মীকে ইশারা করতেই শর্মী চন্দ্রর রুমের দিকে দেখালো।তারপর ইশারা করলো দরজা নক করতে।

শাহজাহান তালুকদার গিয়ে মেয়ের দরজা নক করলেন।তারপর মেয়েকে কোমল গলায় বললেন,”মা,মা গো।দরজা খোলো গো মা।পিতার আকুল আবেদন অগ্রাহ্য করো না।”

শর্মী মুচকি হাসতে লাগলো। শাহজাহান তালুকদার মা মা বলে ডাকতেই লাগলেন।সিতারা বানুর বিরক্তি লাগছে।তার বুড়ো ছেলে কেমন নাটক করছে।বউ কেমন গম্ভীর হয়ে বসে আছে। অথচ নাতিনটা বের হচ্ছে না।

খানিকক্ষন পর শাহজাহান তালুকদার সুর করে বললেন,”ও মা,মাগো ফুল পরানের পরী।
তোমার জন্য রাখছি মাগো ফুলের বিছানা করি”

খুট করে দরজা খুলে চন্দ্র বের হলো। তারপর বাবাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। রেহানার বুকের কাঁপন বন্ধ হয়ে গেলো। মেয়ের মুখ দেখে নির্ভার হলেন।

খেতে বসলো সবাই। খিচুড়ি মুখে দিয়ে চন্দ্র চোখ বন্ধ করে ফেললো। ভীষণ ভালো হয়েছে খিচুড়ি। হুট করে মনে পড়ে গেলো টগরের কথা। আচ্ছা টগর কি খাচ্ছে? এরকম বৃষ্টি হলে ওর ও কি খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করে?
কে করে দেয় ওকে খিচুড়ি?

চন্দ্রর ভাবনায় ছেদ ঘটলো বাহিরে ইন্সপেক্টর নির্ঝরের আওয়াজে। নির্ঝর চেয়ারম্যান সাহেব কে ডাকছে।
চেয়ারম্যান সাহেব উঠে গিয়ে দেখলেন টগর আর নির্ঝর দাঁড়িয়ে আছে।
মুহূর্তেই চেয়ারম্যানের হাসিমুখ কঠোর হয়ে গেলো। কঠোর গলায় বলে,”আসুন ভেতরে আসুন।”

ভেতরে এসে টগর অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সবাই খেতে বসেছে।চন্দ্র এক নজর টগরের দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো।টগরের সাথে চোখাচোখি হওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব না এই মুহূর্তে। কেমন যেনো অনুভূতি শূন্য লাগছে চন্দ্রর। চন্দ্র জানে না কি হবে,কি হতে চলেছে। কি করবে চন্দ্র?
টগরের প্রতি মনের দুর্বলতা চন্দ্র অস্বীকার করতে পারবে না তেমনি বাবার সিদ্ধান্তের বাহিরেও যেতে পারবে না।
কিছুতেই চন্দ্রর পক্ষে সম্ভব না বাবাকে কষ্ট দেওয়া।
কিন্তু!
বাবা মা কেনো তার কাছে এতো কিছু লুকিয়েছে?
বুঝতে পারছে না চন্দ্র কিছু।

নির্ঝর আর টগর ও জয়েন করলো সবার সাথে।
টগরের যদিও কোনো ইচ্ছে ছিলো না বসার কিন্তু শর্মীর পাশের চেয়ারে বসার সুযোগ নির্ঝর মিস করতে চাইলো না।অগত্যা টগরকেও বসতে হলো নয়তো নির্ঝর লজ্জা পাবে।খাওয়ার পর চন্দ্র উঠলো নিজের রুমে যাওয়ার জন্য, সেই মুহূর্তে টগর বললো, “চন্দ্র,বসুন এখানে।কোথাও যাবেন না।”

শাহজাহান তালুকদার চমকে স্ত্রীর দিকে তাকালো। রেহানা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো টগরের দিকে।
চন্দ্র হতভম্ব!
বাবার সামনে টগর এরকম আদেশের সুরে কথা বলার সাহস পাচ্ছে কিভাবে?
হতবাক শর্মী ও।

টগর স্পষ্টভাবে আবারও বললো, “চন্দ্র,আমার বাম পাশের এই চেয়ারে এসে বসুন।আমি বসতে বলেছি আমার পাশে,দাঁড়িয়ে থাকবেন না।”

চন্দ্র ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো বাবা মা’র দিকে।বাবার দুই চোখে হতভম্বের চাপ,মা’য়ের চোখে ক্রোধ।

চলবে…..
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-২৭+২৮

0

#চন্দ্রাণী (২৭)
আকাশে মেঘের আনাগোনা। টগর উঠানে নেমে এলো। রাত প্রায় দশটা বাজে।মন কেমন আনচান করছে হুট করে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো টগর। মন বলছে অন্ধকার থেকে কেউ তাকে দেখছে।
কিন্তু কে!
তবে কি যার অপেক্ষায় ছিলো টগর সে এসেছে!
বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে টগর ঘরে ফিরে এলো।
ঘরে গিয়ে তৈরি হয়ে নিলো টগর। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি লেগে আছে তার।

চন্দ্র বাড়ি থেকে বেরিয়েছে খানিকক্ষণ আগে। তাকে যেভাবেই হোক টগরের বাড়িতে যেতে হবে। টগরকে সাবধান করতে হবে। টগরের থেকে ছবির রহস্য জানতে হবে।না হলে চন্দ্র শান্তি পাবে না।
মন থেকে ভয়-ডর সব উধাও হয়ে গেলো চন্দ্রর।এতো রাতে একটা ছেলের কাছে যাচ্ছে ভেবে একটুও ভয় লাগছে না তার।
জীবন তাকে নিয়ে যেই খেলা খেলতে শুরু করেছে তার কাছে এসব কিছুই না।

চন্দ্র বোরকা পরে বের হয়েছে যাতে কেউ না চিনতে পারে তাকে।
আব্বাকে দেখেছে ঘরে নেই।আব্বা না থাকায় চন্দ্রর জন্য বের হতে অসুবিধা হয় নি।টগরের ফোনটা যদি অন থাকতো তাহলে আর এতো রাতে চন্দ্রকে বের হতে হতো না।

দরজায় ঠকঠক শব্দ হতেই চমকে উঠে টগর। ঘরের সব জানালা খুলে রেখেছে সে।সব রকম আক্রমণের জন্য তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে টগর।
কিন্তু শত্রু এভাবে দরজায় কড়া নাড়বে তা টগর ভাবে নি।

নিজের উত্তেজনা সামলে নিয়ে টগর উঠে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই দেখে আপাদমস্তক ঢাকা একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে সামনে।
এক মুহূর্তের জন্য টগর ভীষণ চমকালো।
এ-কে তো টগর এক্সপেক্ট করে নি এই মুহূর্তে!

অস্ফুটস্বরে বললো, “আপনি এখানে!এতো রাতে একা আমার বাড়িতে!
কি হয়েছে? ”

চন্দ্র হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “বলছি,আগে একটু জিরিয়ি নিই।এক গ্লাস পানি!”

টগর দ্রুত পানি এনে দিলো চন্দ্রকে।ঢকঢক করে সবটা পানি পান করলো চন্দ্র।মেইন রাস্তা থেকে টগরের বাড়ি একটু ভেতরের দিকে। বাড়ির রাস্তায় নামতেই চন্দ্রর কেমন ভয় ভয় লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো আশেপাশে কে আছে যেনো।

টগর নরম সুরে বললো, “ভয় পেয়েছেন না-কি?আপনি তো যথেষ্ট সাহসী মেয়ে,এভাবে ভয় তো আপনার পাওয়ার কথা না। ”

চন্দ্র চমকে বললো, “আপনি কিভাবে জানলেন?”

টগর হেসে বললো, “যেই মেয়ে রাতের অন্ধকারে আমার আর নিয়াজের পিছু নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ে ডকুমেন্টারি করতে পারে, একটা টপ চ্যানেলের ক্রাইম রিপোর্টার হতে পারে। সে ভয় পাবে এটা আমি বিশ্বাস করবো?”

চন্দ্র ভয়াবহভাবে চমকালো এবার।ইতস্তত করে বললো, “আপনি কিভাবে জানলেন? ”

টগর হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে বললো, “আপনি যে একজন শখের মিতিন মাসী সেটা আমি সন্দেহ করেছি যেদিন ইন্সপেক্টর নির্ঝরের সাথে আপনি আমার বাড়িতে এসেছেন।তারপর যেদিন টিভিতে একটা ডকুমেন্টারি প্রচার হলো সেদিন আমার সর্বপ্রথম সন্দেহ হলো আপনাকে।আর সেই সন্দেহ দৃঢ় বিশ্বাসে রূপ নিলো তারপরই।আপনি যখন আমার বাসায় ক্যামেরা ফিট করে রেখেছিলেন।”

চন্দ্র ভীষণ বিব্রত হলো।এতটা সে আশা করে নি। সে যে ক্রাইম রিপোর্টার এটা সে কাউকে জানায় নি। অথচ এই মানুষটা জেনে গেলো!
কিভাবে?

টগর হেসে বললো, “আচ্ছা বলুন, এতো রাতে কি মনে করে? নিশ্চয় সিরিয়াস কিছু হয়েছে! ”

চন্দ্রর ভীষণ অবাক লাগলো। এই মানুষটাকে সে এতো যেমন মাতাল,ছন্নছাড়া,লাগামহীন ভেবেছিলো এখন মনে হচ্ছে এই মানুষটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান।
মনে হচ্ছে সব তার ভান।নয়তো কিভাবে জানবে সে চন্দ্রর সম্পর্কে!

নিজেকে সামলে চন্দ্র বললো, “আপনার অনেক বড় বিপদ। আমার মনে হচ্ছে আপনার মৃ//ত্যু ঝুঁকি আছে। ”

টগর হেসে বললো, “আমার বিপদের কথা চিন্তা করে আপনি এতো রাতে ছুটে এসেছেন? ”

চন্দ্র কিছু বললো না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, “আপনার কাছে আমার কিছু জানার আছে। ”

টগর বললো, “কি বলুন।”

চন্দ্র ছবিটা বের করলো। তারপর টগরের দিকে বাড়িয়ে দিলো ছবিটা।
এক দৃষ্টিতে টগর ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
তার মাথা ঝিমঝিম করছে।

এই ছবি চন্দ্রর কাছে কিভাবে গেলো!
চন্দ্র কি তাহলে!

হতচকিত হয়ে টগর চন্দ্রর দিকে তাকালো।

চন্দ্র বললো, “এই ছবিতে আপনি কিভাবে এলেন?আমার পাশের এই ছেলেটা কে?আপনি এই ছবিতে কেনো?”

টগর মুচকি হাসলো। তারপর উঠে গিয়ে নিজের এলবাম নিয়ে এলো।
এলবাম খুলে একটা ছবি বের করলো। চন্দ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।

টগর ম্লানসুরে বললো, “আপনি যাকে আমি ভেবেছেন, তা আমার না আমার বাবার ছবি।আমি দেখতে হুবহু আমার বাবার মতো হয়েছি।”

চন্দ্রর হুঁশ হলো ততক্ষণে। আসলেই তো!এটা তো তার ছোট বেলার ছবি।সেখানে যদি টগর এখনকার বয়সী হয়ে থাকে তাহলে তো এতো বছরে টগরের আরো বয়স্ক হয়ে যাওয়ার কথা।তার বাবার বয়সী হওয়ার কথা।আর আব্বা মা ও তো এই ছবিতে ভীষণ অল্পবয়সী।
এই ব্যাপারটা চন্দ্রর মাথায় এলো না কেনো?

টগরের বের করা ছবিতে চন্দ্র এবার স্পষ্ট টগরের মুখ দেখতে পাচ্ছে। এই একটা ছবিতে টগরের শুধু মুখে রুমাল দেওয়া নেই।

টগর বললো, “আমার মা আমাকে কখনো বলেন নি মেয়েটি আপনি ছিলেন।সবসময় বলতেন খুব ছোট বেলায় আমাকে একটা পরীর সাথে বিয়ে করায়।
তারপর পরীটা উড়ে উড়ে তার পরীর রাজ্যে চলে যায়।ঠিক কেনো পরীটা আমাকে ছেড়ে চলে যায় মা আমাকে তা জানায় নি।এই ছবিটি ছাড়া আমার কাছে আর অন্য কোনো ছবি নেই।আপনার আব্বা মা সহ কোনো ছবি ও নেই।আমি অনেক খুঁজেছি একটা সময় জানতে যে কে সেই মেয়েটা যে আমার বউ।ছোট বেলায় বিয়ে হওয়ার পর কেনো সে হারিয়ে গেলো আমি জানি না।”

চন্দ্রর পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে যেনো।কি শুনছে সে এসব!
আব্বা কেনো এতো কিছু লুকাচ্ছে তার কাছ থেকে?
আব্বার সাথে তাহলে টগরদের সাথে ও ভালো সম্পর্ক ছিলো।অনেক ভালো সম্পর্ক না থাকলে তো ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিতেন না ছোট বেলাতেই।
তাহলে কি এমন হয়েছিলো যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়!

টগর মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে চন্দ্রর দিকে। চন্দ্রর ইচ্ছে করছে পাখি হয়ে উড়ে যেতে এখান থেকে। লজ্জায় টগরের দিকে তাকাতে পারছে না চন্দ্র।
আচমকা সাঁই করে একটা গুলি ছুটে এলো তীরের বেগে। চোখের পলকে টগর চন্দ্রকে নিয়ে ডিগবাজি দিয়ে ফ্লোরে পড়ে গেলো। গুলি এসে দেয়ালে লাগলো।

চলবে…..
রাজিয়া রহমান

#চন্দ্রাণী (২৮)
বাহিরে ভীষণ হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। অনেক মানুষের চিৎকার, হৈহল্লা ভেসে আসছে।চন্দ্র টগরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে।তার এই ছোট্ট জীবনে এতটা ভয় সে পায় নি এর আগে।ঝুঁকি সে অনেক বারই নিয়েছে।কিন্তু কখনো এভাবে ভয় পায় নি।টগর চন্দ্রকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে বললো, “আপনার কোথাও লাগে নি তো?”

চন্দ্রর দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছিলো। টগর শক্ত করে চন্দ্রর হাত ধরে বললো, “একবার আপনাকে হারিয়েছি।এবার যখন ফিরে পেয়েছি তারপর আর হারাতে দিবো না।এই শূন্য সংসার আপনি ফিরে এলেই পরিপূর্ণ হবে। আমার এই অন্ধকার ঘরে আপনিই হবেন আলোকবর্তিকা।”

চন্দ্র কিছুই বুঝতে পারছে না। সবকিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। দরজায় করাঘাত শুনে টগর চন্দ্রর হাত ধরে দরজা খুলতে গেলো। নির্ঝর বললো, “স্যার,ও পালিয়েছে। একজন মহিলা ছিলো মনে হয়, তার ওড়নার কিছুটা… ”
নির্ঝর কথা শেষ করতে পারলো না। চন্দ্রকে টগরের সাথে দেখে হুট করে চমকে উঠলো।

চন্দ্র বুঝতে পারছে না সে আর কতো অবাক হবে!
তাহলে ইন্সপেক্টর ও জানতো টগর যে সি আই ডি অফিসার?
অথচ এমন ভাবে অভিনয় করে গিয়েছে যেনো একে অন্যের শত্রু তারা!

টগর মুচকি হেসে বললো, “আপনার ভাবী,অবাক হচ্ছেন না-কি?”

নির্ঝর হেসে বললো, “উনি যে ভাবী হবে তা আমি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলাম কিন্তু এতো শীঘ্রই ভাবী হবেন তা ধারণা করতে পারি নি।শুভ কাজটা সারলেন কবে?আমার রাস্তা তাহলে ক্লিয়ার করে দিলেন?”

চন্দ্রর মাথায় কারো কোনো কথা ঢুকছে না।তার চোখ নির্ঝরের হাতে থাকা ওড়নার অংশে নিবদ্ধ হয়ে আছে।

প্রদীপের নিচে কি অন্ধকার তাহলে!

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চন্দ্র বের হয়ে এলো। হনহনিয়ে বাড়ির দিকে যেতে লাগলো। পিছনে টগর ও এলো চন্দ্রর পিছু পিছু।
একবারের জন্য ও চন্দ্র পেছনে তাকালো না।তালুকদার বাড়ির সামনে আসতেই টগর থেমে গেলো।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে টগর বাড়ি ফিরে গেলো।

নির্ঝর বসে আছে সোফায়। টগর ফিরতেই নির্ঝর বললো, “স্যার…”

টগর বললো, “আপনি এখন আসুন অফিসার।আমার একটু ভাবনা চিন্তা করার সময় লাগবে।আগামীকাল কথা হবে।”

নির্ঝর আর টগরকে বিরক্ত না করে চলে গেলো সেখান থেকে। টগর বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। মাথা ব্যথা করছে তার।সব ব্যথা চাপিয়ে সবচেয়ে ভাবাচ্ছে চন্দ্রর ব্যাপারটা। চন্দ্র!
তার চন্দ্র?
এই সেই চন্দ্র যে কি-না তার বউ?
কখনো কি টগর ভেবেছিলো তাকে আবারও ফিরে পাবে?
ভাবে নি!
টগর ভেবেছিলো সে সারাজীবন তার কল্পনা হয়েই থেকে যাবে।মনে কতো আকাঙ্ক্ষা ছিলো টগরের একটা বার তাকে দেখার।একটা বার জানার যে কে ছিলো সে-ই মেয়ে!
অথচ জানতে পারে নি টগর সে কি-না তার সামনেই ছিলো।
আজ সব কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে।টগর চন্দ্রর ভাবনা ভাবতে গিয়ে সব ভুলে গেলো। তার মাথার উপর কি বিপদ তাও টগর ভুলে গেলো।

কানিজ ডাইনিং টেবিলের সামনে এলো।ভাইজান বসে আছেন গম্ভীর হয়ে। কানিজ বললো, “ভাইজান,আমি চলে যাবো।”
কাদের খাঁন নরম সুরে বললো, “আজকের দিনটা থেকে গেলে হয় না?
আজকেও ও কি তোর পুরনো রাগ ধরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে? ”

কানিজ বললো, “আমি শপথ করেছি ভাইজান। যে জাহান্নামে তোমরা আমাকে ফেলেছো সেই জাহান্নামে আমি আজীবন জ্বলে পুড়ে মরবো তবুও তোমাদের কাছে এসে থাকবো না।তোমাদের অহংকার যেমন তোমাদের কাছে সবার আগে আমার শপথ ও আমার কাছে।”

কাদের খাঁন একটা হতাশার নিশ্বাস ফেললো। সরকারি চাকরিজীবী জামাই পেয়ে খোঁজ খবর না নিয়ে কানিজকে বিয়ে দিয়েছিলো।
বিয়ের পর আস্তে আস্তে জানতে পারে মানুষ নামের পিশাচের কাছে বোনকে দিয়েছে।
পান থেকে চুন খসলেই কানিজের গায়ে হাত তুলতো ওরা।কতো বার গিয়েছিলেন কানিজকে ফিরিয়ে আনতে ওদের বাড়ি থেকে, পারেন নি।কানিজ প্রতিজ্ঞা করেছিলো মরে গেলে ওই বাড়িতে মরবে তবুও আর বাবার বাড়ি আসবে না।
তারপর?
একে একে তিনটা কন্যা সন্তানের জন্ম দিলো কানিজ। আর কানিজের শাশুড়ী কন্যা সন্তান হওয়ার অপরাধে তিনটা মেয়েকেই দত্তক দিয়ে দেয়।এরপর একটা ছেলে জন্ম নেয়,কিন্তু কানিজকে ছেলের কাছে যেতে দেয় নি ওরা।জন্মের ২ মাস পর ছেলেটাও মারা যায়।
শেষে আরেকটি মেয়ে জন্ম নিলে কানিজ মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যায়।স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে মেয়ে নিয়ে আলাদা থাকে।
বাবা মারা যাবার পর বাবার একটু সম্পদ ও কানিজ নেয় নি।কাদের খাঁন বুঝতে পারেন নি এভাবে বোন অভিমান করবে।বুঝতে পারলে কোনো দিন বোনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে দিতেন না।
কতো বার বোনকে বুঝিয়েছেন ওদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য, কিছুতেই রাজি হয় নি।উল্টো বাবা ভাইয়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। নিজেকে নিজে শাস্তি দিয়েই চলেছে কানিজ।একটা মাত্র বোনের মেয়ে তাকে কখনো এই বাড়িতে আনে নি কানিজ।
কাদের খাঁন হিসেব করে দেখলো তার জীবনে সব আসলে ব্যর্থতা, অপ্রাপ্তি দিয়ে ভরপুর।

চন্দ্র বাড়িতে ফিরে দেখে রেহানা ঘরের সামনে সিড়িতে বসে আছে। মেয়েকে দেখে ছুটে এলেন মেয়ের কাছে।তারপর অস্থির হয়ে বললেন,”কই ছিলি তুই?কোথায় গিয়েছিলি আমাকে না বলে? আমাকে একবার বলে গেলি না কেনো তুই? এতো রাতে বোরকা পরে কোথা থেকে এলি?”

চন্দ্র জবাব না দিয়ে বললো, “শর্মী কই মা?”

রেহানা এক নজর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “শর্মী কই মানে?ও তো ওর রুমে মনে হয়। আমি দেখি নি তো ওকে।কেনো কি হয়েছে? ”

চন্দ্র বললো, “আমাকে শর্মীর কাছে যেতে হবে মা।”

চন্দ্র ছুটে শর্মীর কাছে গেলো।শর্মীর রুমের দরজা ভেজানো।চন্দ্র দরজা খুলে দেখে শর্মী রুমে নেই।চন্দ্র শর্মীকে খুঁজলো এদিক ওদিক। রেহানা ধড়ফড়িয়ে উঠে বললো, “কি হইছে রে মা?এরকম করতেছস কেনো তুই?শর্মী কই গেলো?তোর আব্বা ও তো ঘরে নাই।”

চন্দ্র কিছু বললো না। এই ওড়নাটা শর্মীর ওড়না। চন্দ্র এবার ঢাকা থেকে আসার সময় শর্মীর আর ওর জন্য একই রকম জামা এনেছিলো।শর্মীর গায়ে আজকে এই জামা দেখেছে চন্দ্র।

চলবে……
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-২৫+২৬

0

#চন্দ্রাণী (২৫)

খামের ভেতর অনেকগুলো ছবি। বিয়ের শাড়ি পরে চন্দ্র বসে আছে। মুখে আলপনা আঁকা।
লাল রঙের বেনারশী শাড়ি পরনে।পাশেই বর সেজে বসে আছে একজন মুখে রুমাল দেওয়া,পরনে শেরওয়ানি।
ছেলেটা কে?
চন্দ্র বুঝতে পারছে না। সবগুলো ছবিতে ছেলেটার মুখে রুমাল দেওয়া।
কি আশ্চর্য!
বর সেজেছে বলে কি মুখে রুমাল দিয়ে বসে থাকতে হবে?
খুব একটা মানুষ নেই ছবিতে। তবে যারা আছে তাদের দেখে চন্দ্রর আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে যেতে চাইছে।
একটা ছবিতে চন্দ্রর বাবা আছে ওর আর বরের পাশে।শাহজাহান তালুকদার, রেহানা বেগম, আরো একজন মহিলা।
সবচেয়ে হতভম্ব করার ব্যাপার হচ্ছে এই ছবিতে চন্দ্রর আর বরের পাশে একটা ছবিতে টগর ও আছে।
একটা ছবিতে চন্দ্র,পাশে বর বসে আছে, বাবা মা, টগর, এক মহিলা সহ সবাই মিলে একটা গ্রুপ ছবি তোলা।
চন্দ্র আর সহ্য করতে পারছে না। মাথার ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে চন্দ্রর।
কেউ তাকে কিছু জানায় নি কেনো?
এই ছেলেটা কে?কাকে প্রশ্ন করবে চন্দ্র?
কি লুকাচ্ছে বাবা মা তার থেকে?
চন্দ্র সবসময় ভাবতো বাবা মা তার কাছে সবচেয়ে বেশি ফ্রি।অথচ এখন মনে হচ্ছে বাবা মা’কে সে এখনো চিনতেই পারে নি। কিন্তু টগর কিভাবে এই ছবিতে এলো?

চন্দ্রর সব রাগ গিয়ে পড়লো টগরের উপর। টগর সব জানে।জেনেও কেনো সে চন্দ্রকে কিছু বলে নি?
সবাই চন্দ্রর সাথে মজা নিচ্ছে?

একটা ছবি নিজের কাছে রেখে চন্দ্র সব আগের মতো রেখে দিলো। মোবাইলটা ও পেলো ওখানেই।মোবাইলটা বের করে চন্দ্র ছবিটা নিয়ে বাড়ির দিকে গেলো।

শর্মীর রুমের দরজা বন্ধ।ভেতরে শর্মী বসে আছে রুম অন্ধকার করে। জানালায় মোটা পর্দা দেওয়া। মাথার উপর খুব স্পীডে ফ্যান ঘুরছে।
শর্মীর দুই চোখ যেনো বাঁধা মানছে না।এ কি যন্ত্রণা তার,কাউকে কিছু বলতে পারছে না সহ্য ও করতে পারছে না।
ভাগ্য কেনো তাকে নিয়ে এভাবে খেলছে?

নিয়াজ খুবই জঘন্য লোক, অথচ ওর মৃ//ত্যু সংবাদ শর্মীকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে।
কেনো এরকম লাগছে?মনে হচ্ছে তার দেহে প্রাণ নেই।ওই জঘন্য লোকটাকে কেনো এরকম পাগ//লের মতো ভালোবেসেছে শর্মী!
যে তাকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিলো,সবার কাছে ছোট করতে চেয়েছিলো তার জন্য কেনো আজ শর্মী দুই চোখে বর্ষণ হচ্ছে?
মন এতো অবাধ্য হলো কেনো?
কেনো সহ্য হচ্ছে না শর্মীর এসব?
কেমন ডুকরে কাঁদছে শর্মী।

শর্মীর রুমের দরজার বাহিরে চন্দ্র নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। তার বোনটা যে মনের ক্ষত লুকিয়ে রাখতে চাইছে চন্দ্র বুঝতে পারলো। তাই নিজেও আর শর্মীকে ডাকলো না।

রুমে গিয়ে চন্দ্র টগরকে কল দিলো।টগরের ফোন সুইচ অফ।কয়েকবার ট্রাই করেও পাচ্ছে না চন্দ্র।
বাধ্য হয়ে বিকেলে তৈরি হয়ে নিলো টগরের বাড়িতে যাওয়ার জন্য।
কাচারি ঘরের সামনে যেতেই দেখলো বাবুল দাশ দাঁড়িয়ে আছে। গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবছে।চন্দ্র বাবুল দাশকে দেখে হেসে বললো, “কি হইছে কাকু?”

বাবুল দাশ কোমল গলায় বললো, “কি আর হবে গো মা জননী। গরীবের কিছুই হয় না।না মরণ হয় আর না বাঁইচা থাকন।”

চন্দ্র হেসে বললো, “আব্বার সাথে ঝগড়া হইছে বুঝি?”

বাবুল দাশ মাথা নিচু করে বললো, “ভগবান জানেন আমার মনে আপনেগো লাইগা কতো ভালোবাসা। মানুষরে আমি জানাইতে চাই না।আমার ভগবান জানলেই হইলো। অথচ স্যারে আমারে কয় আমি না-কি আপনেগো খেয়াল রাখি না।”

চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “আব্বার ওসব রাগের কথা। পাত্তা দিয়েন না তো কাকু।”

বাবুল দাশ বললো, “আপনে কি কোনোখানে যাইতেছেন?”

চন্দ্র বললো, “আমি একটু টগরের কাছে যাইতেছি কাকা।”

বাবুল দাশ বললো, “জননী, দুপুরে খাওয়া হয় নাই।একটু যদি খাওনের ব্যবস্থা কইরা দিতেন।”
চন্দ্র এক মুহূর্ত চিন্তা করে আবারও বাড়িতে এলো।

বাবুল দাশের জন্য চন্দ্র খাবারের ব্যবস্থা করে বের হতে যেতেই শাহজাহান তালুকদার এলো। চন্দ্রর ইচ্ছে করছে না বাবার সাথে কথা বলতে এই মুহূর্তে। কেনো বাবা তার কাছে কোনো কিছু এভাবে গোপন করতে চাইছে?
এই কি চন্দ্রর সেই বাবা যার কাছে সবকিছুর উর্ধ্বে তার চন্দ্র।
আজ কেনো মনে হচ্ছে সে এই বাবাকে চেনে না।আসলেই বাবাকে চেনে না চন্দ্র।নয়তো সারাজীবন জেনে এসেছে যেই কাদের খাঁন তাদের শত্রু অথচ আজ বাবার ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছিলো বাবা আর কাদের খানের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিলো।
তাহলে কেনো বাবার সাথে সম্পর্ক এতো খারাপ হলো, কেনো দুজনের যোগাযোগ নেই এখন?
কই কখনো তো জানতে পারে নি এসব কিছু!

চন্দ্র বের হতে গেলো,শাহজাহান তালুকদার মেয়েকে ডাকলেন।
বাহিরে তখন রোদ মরে এসেছে। কেমন সোনালি রঙা রোদ।সেই আলোয় চন্দ্রকে অদ্ভুত রকম সুন্দর লাগছে।

শাহজাহান তালুকদার বললেন, “আমি একটু কাদের খাঁন এর বাড়িতে যাবো। তুই ও চল আমার সাথে। ”

চন্দ্র অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, “আমি একটু বের হবো আব্বা।”

শাহজাহান তালুকদার জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় বের হবে এখন?”

চন্দ্র কিছু বললো না। মুহূর্তেই শাহজাহান তালুকদার চমকে উঠে বললেন,”তুই টগরের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিস না তো?”

চন্দ্র কিছু বললো না। আব্বার ব্যবহার তার কাছে ভীষণ খাপছাড়া লাগছে হঠাৎ করে।

শাহজাহান তালুকদার ঠান্ডা মাথায় বললেন,”চন্দ্র মা,আমি চাই না তুমি টগরের সাথে কথা বার্তা বলিস।ওই ছেলেটা একটা আস্ত মাতাল,অভদ্র,ড্রাগ এডিকটেড। এই ধরনের ছেলের সাথে আমার মেয়ে মিশবে এটা আমার পছন্দ না মা।”

চন্দ্র কিছু বললো না। তাকে যেতেই হবে,যেই ছবি বাবা লুকিয়ে রেখেছে সেই ছবির কাহিনি চন্দ্রকে জানতেই হবে।টগর ছাড়া অন্য কেউ পারবে না চন্দ্রকে এই সত্যি জানাতে।তাছাড়া টগরকে সাবধান করতে হবে।

চন্দ্র বললো, “কাকু কে নিয়ে যান আব্বা।আমি যেতে পারবো না। ”
শাহজাহান তালুকদার বললেন, “তুমি এবং শর্মী দুজনেই আমার সাথে যাবে,ব্যস।”

চন্দ্র অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালো। বাবার গলা শুনে শর্মী ও বের হয়ে এলো। বাবা কি বলছে চিৎকার করে!

বাহিরে আসতেই শাহজাহান তালুকদার বললো, “শর্মী,তৈরি হয়ে নাও।আমরা খাঁনদের বাড়িতে যাবো।নিয়াজের লাশ এসেছে। এটা সামাজিকতা পালন করা।গ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে আমার দায়িত্ব। তোমরা আসো আমার সাথে। ”

শর্মীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেমন একটা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো।
বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজি হয়ে গেলো। এটাই শেষ দেখা হবে নিয়াজের সাথে শর্মীর।এক সময় যার সাথে সংসার সাজানোর স্বপ্ন দেখেছিলো এই দুই চোখে, আজ সেই দুই চোখে তাকে শেষ দেখা দেখতে যাচ্ছে। যার হাত ধরে ওই বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিলো আজ তার লাশ দেখতে যাবে!
এর থেকে নির্মম আর কি হতে পারে!
চন্দ্র নিয়াজদের বাড়িতে যাওয়ার সময় পথে বাবার আড়ালে টগরকে কল দিতে লাগলো। আশ্চর্য, ফোন সুইচ অফ!
চিন্তায় চন্দ্রর গলা শুকিয়ে আসছে।টগরের কিছু হয়ে যায় নি তো।

সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ আগে।টগর সবেমাত্র বাড়িতে এসেছে। নিয়াজের লাশ আনা হয়েছে বাড়িতে খানিকক্ষণ আগে। টগর তার আগেই চলে এসেছে ওই বাড়ি থেকে। মাথার ভেতর অনেকগুলো হিসেবনিকেশ ঘুরপাক খাচ্ছে বারেবারে। এক মগ ব্ল্যাক কফি নিয়ে টগর বসলো শান্ত হয়ে। নিজেকে শান্ত করতে হবে।
খেলা ঘুরে গেছে। এবার একে একে সবার মুখোশ খুলে দিতে হবে।

টগর ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।অনেকগুলো কাজ জমেছে তার।দ্রুত হাতে কিছু ফাইল রেডি করলো,তারপর সব মেইল করে পাঠালো হেড অফিসে।কিছু ডকুমেন্টস প্রিন্ট করে ডুপ্লিকেট হিসেবে সরিয়ে রাখলো।
মাথার ভেতর অজস্র চিন্তা। যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে তার।
টোপ দিয়ে এসেছে সে এবার মাছ বঁড়শিতে গাঁথার পালা।
টগর জানে মেইন কালপ্রিটকে আজকে হাতেনাতেই ধরতে পারবে সে।
যদিও তার হাতে অনেক প্রমাণ আছে তবুও সে চায় হাতেনাতে ধরতে।

কতো হিসেব বাকি আছে! গোঁজামিল দিয়ে মা যা বুঝিয়ে গেছে, সেই গোঁজামিলের ফাঁকফোকর দিয়ে অনেক সত্য বের হয়ে এসেছিলো। টগর কখনো মা’কে কিছু বলে নি।
মা কষ্ট পাবে,ভয় পাবে ভেবে সবসময় চুপ করে ছিলো।

আজ মা নেই,তার জন্য ভাবার কেউ নেই।কি অদ্ভুত!
এই পৃথিবীতে এতো কোটি কোটি মানুষ অথচ তাকে নিয়ে একটু ভাবার মতো কেউ নেই,কেউ থাকবে না কখনো!

বাবার ছবিটা বুকে টেনে নিলো টগর। নিজেকে নিজে বললো, “না আমি ভেঙে পড়বো না।কিছুতেই না।”

নিজের সিআইডি’র ব্যাজটা এক নজর দেখে মুচকি হাসলো টগর। এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে।শপথ নিয়েছিলো এই দেশের সেবা করবে বলে, সেই শপথ টগর রাখবেই।

নিজেকে ধাতস্থ করে টগর ফোন চেক করলো। চার্জ শেষ হয়ে সেই কখন ফোন অফ হয়ে গেছে টগরের জানা নেই।ফোন চার্জে বসিয়ে টগর রান্না করতে গেলো।
চাল আর ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি বসিয়ে দিয়ে টগর আবারও ল্যাপটপের কাছে এলো।চন্দ্রর কথা মনে পড়ছে হঠাৎ করে। মেয়েটা ভীষণ ভালো রান্না করে। কেমন আদুরে একটা মেয়ে।কাছাকাছি এলেই টগরের ইচ্ছে করে বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখে।অথচ প্রথম প্রথম ওকে ও ওর বাবার মতো জঘন্য মনে হয়েছে। ভুল বুঝেছে না বুঝে।
মনে মনে হাসতে লাগলো টগর । ল্যাপটপে আবারও একটা ভিডিও প্লে করলো টগর। কেমন দ্রুত হাতে চন্দ্র তার রুমে ক্যামেরা ফিট করছে।আরো একবার টগর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো।বোকা মেয়ে জানে না,টগরের পুরো বাড়ি সিসি ক্যামেরার আওতাধীন। যেই ক্যামেরা মেয়েটা সেট করেছে,সেই ক্যামেরা টগর বহু আগেই ব্যবহার করে এসেছে বিভিন্ন অপারেশনে।
সিংহের গুহায় এসেছে সে সিংহকে শিকার করতে!

চলবে……..
রাজিয়া রহমান।

#চন্দ্রাণী (২৬)

অস্তমিত সূর্যটার মতো নিয়াজের অবস্থা। কিছুক্ষণ পরেই বিলীন হয়ে যাবে।এই নশ্বর পৃথিবীতে ধীরে ধীরে মুছে যাবে নিয়াজের নাম।
খাটিয়ার উপর পড়ে আছে নিয়াজের লাশ।শর্মীর দুই চোখে শ্রাবণ ধারা।শর্মী দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে লাশের খাটিয়ার দিকে।
কি এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আছে শর্মী!
যাকে বিশ্বাস করেছে,বিয়ে করেছে অথচ তার মৃত্যুতে শর্মী একটু শোক প্রকাশ করে মন খুলে কাঁদতে পারছে না।
তাকে শেষ দেখা দেখতে পারবে না।সে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ হতে পারে কিন্তু তবুও আজ মন বলছে শেষ বার যদি তাকে এক নজর দেখতে পারতো। মন এতো বেহায়া কেনো,কে জানে!
নয়তো যেই মানুষ শর্মীর সাথে এতো অন্যায় করেছে,এতো কষ্ট দিয়েছে শর্মীকে তাকে দেখার জন্য কি-না মন উতালা হয়ে আছে।
কেনো বারবার সেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে!
নিয়াজের আদর,নিয়াজের ভালোবাসা সব কেমন মনে পড়ছে বারবার।
কি ভীষণ ভালোবাসা নিয়ে বুকের মধ্যে ঝাপটে ধরত ধরতো নিয়াজ।চুমুতে চুমুতে শর্মীকে অস্থির করে তুলতো।

এতো আদর করার মানুষ কিভাবে শেষে এসে এভাবে ধোঁকা দেয়!
কিভাবে সব শেষ করে দিলো!

চন্দ্র এসে শর্মীর কাঁধে হাত রেখে বললো, “এতো ভেঙে পড়িস না শর্মী।আমি জানি তোর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বোন।কিন্তু যেটা ধ্রুব সত্যি সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় তো নেই।তুই এভাবে কান্নাকরলে সবার সন্দেহ হবে কিন্তু। ”

শর্মী কি উত্তর দিবে জানে না।সে জানে সবাই দেখলে সন্দেহ করবে কিন্তু সে যে সহ্য করতে পারছে না।

চন্দ্র শর্মীকে একা ছেড়ে দিয়ে সরে গেলো সেখান থেকে। কাঁদুক ও,নিজের ভেতরের সব যন্ত্রণা নিয়াজের লাশের সাথে সাথে দাপন করে দিক।

ভেতরের দিকে কান্নার রোল উঠেছে। আত্মীয় স্বজন সবাই এসেছে।
চন্দ্র বাবাকে খুঁজতে গেলো।কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলো শাহজাহান তালুকদার সোফায় বসে দেয়ালে থাকা আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।
চন্দ্র আড়াল থেকে আয়নাতে লক্ষ্য করলো।মিষ্টি কালার শাড়ি পরনে একজন মহিলা বসে আছে একটা রুমে। নিরবে চোখের পানি মুছে চলেছে। শাহজাহান তালুকদার পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখছে।
চন্দ্র এসে বললো, “আব্বা।”

চমকে উঠে শাহজাহান তালুকদার বললো, “হ্যাঁ মা।বল।”

চন্দ্র কিছু বললো না। চলে গেলো সেখান থেকে। তার হঠাৎ করে মনে পড়লো টগর এখানে থাকতে পারে কোথাও হয়তো।
চন্দ্র চলে যেতেই শাহজাহান তালুকদার উঠে দাঁড়ালো। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে করতে সবে মাত্র রুম খালি হয়েছে। এখন আর ওই রুমে কেউ নেই। আজ আর ভয় পেলো না শাহজাহান তালুকদার। যা হারানোর তা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন বহু বছর আগেই।
আজ আর হারানোর কিছু নেই। কিন্তু অতীতের সেই বিচ্ছেদের যন্ত্রণা তিনি আজও ভুলেন নি।

শাহজাহান তালুকদার এসে দাঁড়াতেই রুমে থাকা মহিলাটি আতঙ্কিত হয়ে গেলো। অস্ফুটস্বরে বললো, “তুমি এখানে!”

মুচকি হেসে তালুকদার বললো, “তোমার জন্য কানিজ।”

কানিজ গম্ভীর হয়ে বললো, “বাজে কথা বলো না,এসব ফাতরামি করার বয়স নেই তোমার এখন।”

তালুকদার বিছানার এক পাশে বসে বললো, “ফাতরামি করছি না কানিজ,করলে তো বহু আগেই করতাম।সেই যেদিন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তুমি আমাকে ছেড়ে সরকারি চাকরিজীবী পাত্রর গলায় মালা পরালে, অথচ আমাকে চিঠিতে লিখলে যে আমি যাতে আগের দিন ঢাকায় চলে যাই।তুমি বিয়ের দিন পালিয়ে আসবা।

আমিও বোকার মতো তোমার কথা বিশ্বাস করলাম কানিজ। অথচ বুঝতে পারি নি আমি গ্রামে থাকলে ঝামেলা করতে পারি ভেবে তুমি চালাকি করে আমাকে গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছ।”

কানিজের মুখে মেঘের ছায়া নেমে এলো।এসব কথা তার শুনতে ইচ্ছে করছে না।

মুখ ভোঁতা করে বললো, “সুখে থাকার অধিকার সবার আছে তালুকদার, আমার ও আছে।তুমি ছিলে তখন ছন্নছাড়া মানুষ। কি ছিলো তোমার বলো তো?
চালচুলোহীন একটা মানুষের হাত আমি ধরবো কোন ভরসায়?”

শাহজাহান তালুকদারের দুই চোখে বিষাদের ছোঁয়া। গলা ভারী হয়ে এসেছে। মুচকি হেসে বললো, “সুখে থাকার অধিকার তোমার আছে কানিজ,তাই বলে আমাকে স্বপ্ন দেখিয়ে সেই স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে কেনো তোমাকে সুখী হতে হলো?
আমাকে বলেই দিতে না হয় আমাকে ভালোবাসো না।আমাকে কেনো ভালোবাসার আশ্বাস দিয়েছিলে?
আমি তো অপেক্ষায় ছিলাম।দুই দিন রেলস্টেশনে ঠাঁয় বসে ছিলাম।শুধু যেকোনো সময় তুমি চলে আসবে ভেবে।সস্তায় এক রুমের একটা বাসা ঠিক করে রেখেছিলাম।ছোট ছোট দুটো পাতিল কিনে রেখেছিলাম।একটা বালিশ একটা তোশক। সব তোমার পছন্দ মতো করে রেখেছিলাম যাতে আমাদের ছোট্ট সংসারে এসে তুমি অবাক হও আগেই সব রেডি দেখে।

শুধু বিলাসিতা, উচ্চবিত্ত স্বামী চেয়েছিলে তুমি, আমার ভালোবাসা চাইলে না!
তো এখন,স্বামী, বিলাসিতা নিয়ে খুব সুখে আছো নিশ্চয়?
স্বামীর ভালোবাসা পেয়েছ কি?”

কানিজ জবাব দিলো না। কি বলবে সে!
কিভাবে বলবে সেদিন পালাতে গিয়ে আব্বার হাতে ধরা পড়ে যায় কানিজ।বড় ভাইজান আর আব্বার ধমকের সামনে কানিজের কিছু করার ছিলো না। কাদের ভাইজান নিজেই তো তাকে শাসিয়েছে যদি পালানোর চিন্তা করে থাকে তবে আব্বা আম্মা বি//ষ খাবে বলে ঠিক করেছে।এখন সিদ্ধান্ত কানিজের হাতে।
কানিজ পারে নি নিজের ভালোবাসার মানুষের হাত ধরতে।আব্বার সম্মানের কথা ভেবে কানিজ পারে নি।

শাহজাহান তালুকদার উঠে দাঁড়ালো। তারপর ম্লান সুরে বললো, “তোমাকে কতো বছর পরে দেখলাম কানিজ জানো?খুব ইচ্ছে ছিলো তোমার সাথে একবার দেখা করে জিজ্ঞেস করার আমার দোষ কোথায় ছিলো। তোমার উত্তর আমি জানতে চাই না।তোমাকে পাই নি,তুমি আমাকে ঠকিয়েছো এই আক্ষেপ আমার আছে কানিজ। আমার সারাজীবন এই আক্ষেপ থেকে যাবে নিজেকে উজাড় করে ভালোবেসে ও আমি তোমাকে পাই নি।তুমি ঠান্ডা মাথায় আমার সব স্বপ্ন খু//ন করেছো।
সংসার আমার ও হয়েছে, সন্তান হয়েছে। নিজে চেয়ারম্যান হয়েছি।কেনো হয়েছি চেয়ারম্যান কানিজ জানো?
শুধু তোমার আব্বা আর ভাইকে দেখানোর জন্য। যেদিন আমি তোমার আমার ভালোবাসার কথা তোমার আব্বাকে জানিয়েছিলাম,তোমার আব্বা বলেছিলো তুমি চেয়ারম্যানের মেয়ে,আমি তোমার লেভেলের মানুষ না।তোমার আব্বার অহংকার ভেঙে দিতে আমি চেয়ারম্যান হয়েছি।
যতবার ইলেকশন আসে,ততবারই আমার মনে পড়ে যায় তোমার আব্বার অহংকারী সেই কথাগুলো। তুমি আমাকে ঠকিয়েছ সেই কষ্ট আমার আছে। তবে তারচেয়ে বেশী মনে সুখ আছে আমার একজন স্ত্রী আছে। যে আমাকে ঠিক আমার মতো করে বুঝে।
বিয়ের পর প্রথম প্রথম মাঝরাতে আমার ছটফটানি দেখে সে কখনো রাগ করে বলে নি প্রাক্তন প্রেমিকার কথা মনে করে কষ্ট পাচ্ছি কেনো!
সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সবসময় আমাকে স্বান্তনা দিয়ে বলেছে সব ঠিক হয়ে যাবে,আমার ভালোবাসা, যত্ন দিয়ে আপনার মনের সব ক্ষত মুছে দিবো।

ক্ষত সে মুছে দিয়েছে কানিজ।শুধু আক্ষেপ হলো কেনো আমি তোমার মতো ভুল মানুষকে ভালোবাসলাম?
কেনো আমি অপাত্রে নিজের ভালোবাসা দান করলাম।
এই যে আজকে আমি এসেছি এখানে,তোমার সাথে কথা বলছি তা আমার স্ত্রীর জন্য। সে-ই আমাকে পাঠালো একটা বার তোমার সাথে কথা বলতে। মনে যেসব প্রশ্ন আছে সব জিজ্ঞেস করে নিজেকে হালকা করতে।

তোমার সাথে কথা বলতে বসে আমার মনে পড়লো এখানে না এসে আমি আমার স্ত্রীর সাথে, সন্তানদের নিয়ে সন্ধ্যায় চা,বিস্কিটের আড্ডায় বসলে মনে হয় বেশি শান্তি পেতাম।তোমার সাথে কথা বলতে বসে আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে।
আসছি কানিজ।”

শাহজাহান তালুকদার বের হয়ে গেলো রুম থেকে।বাহিরে এসে দেখে শর্মী একটা সোফায় বসে আছে। চন্দ্রকে দেখতে পেলো না।কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো শাহজাহান তালুকদারের। মেয়েটা কোথায় গেলো!
শর্মীকে জিজ্ঞেস করতেই শর্মী বললো, “আপাকে তো আমি ও দেখছি না আব্বা।”

পকেট থেকে ফোন বের করে চন্দ্রকে কল দিলেন তিনি। পর মুহুর্তে চন্দ্র ছুটে এলো। দুই মেয়ের হাত ধরে শাহজাহান তালুকদার বের হয়ে এলেন।
কানিজের বিয়ের পর থেকেই কাদের খাঁনের সাথে শাহজাহান তালুকদারের বন্ধুত্ব ছিন্ন হয়ে যায়। একে অন্যের শত্রু হয়ে যায় দুজনেই।

তালুকদার চলে যেতেই কানিজ বালিশে হেলান দিয়ে বসলো।
সুখে কি কানিজ থাকতে পেরেছে আজও কোনো দিন!
চাকরি করা স্বামী পেয়েছে সবাই জানে,কিন্তু মাতাল স্বামী পেয়েছে তা কয় জন জানে?
বউকে টাকা পয়সা সোনা দিয়ে ভরিয়ে রাখে সবাই জানে,অথচ বিয়ের পর থেকে বিভিন্ন মেয়েদের সাথে মেলামেশা করে এটা কয়জন জানে!
জানে না,কেউ জানে না।অভিমান করে কানিজ আব্বা,ভাইদের জানায় নি এসব।কি হবে জানিয়ে, সবশেষে তারা না হয় তাকে নিয়ে যাবে,তাতে কি যাকে হারিয়েছে কানিজ তাকে ফিরে পাবে?
কানিজ নিজেকে নিজে শাস্তি দিতে চেয়েছে। শেষ দিকে আব্বা ভাইজান জানতে পেরে যখন শত চেষ্টা করেও কানিজকে ওই বাড়ি থেকে আনতে না পেরে কষ্টে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছিলো।আব্বা চিঠি পাঠিয়ে, লোক পাঠিয়ে ও খালি হাতে ফিরে আসতো।
কানিজ তখন শান্তি পেতো।আব্বা বুঝুক,ভালো করে বুঝুক। কষ্ট পাক আব্বা।যেই কষ্ট আব্বা কানিজকে দিয়েছে তার ছিঁটেফোঁটা আব্বাকে ফেরত দিতে পেরে কানিজ খুশি হতো। বিয়ের পর কানিজ আর আসে নি বাপের বাড়িতে। আব্বা মারা যাবার দুই দিন আগে এসেছিলো।
তালুকদার কি কখনো জানতে পারবে এসব!
না জানাই ভালো। তালুকদার স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সুখে আছে সুখে থাকুক।
আল্লাহ তাকে স্বামী দিয়ে ও সুখ দেয় নি,সন্তান দিয়ে ও না।এই ভালো করেছে আল্লাহ।সব কষ্ট দিক তাকে।
নিজেকে নিজে কষ্ট পেতে দেখলে আনন্দিত হয় কানিজ।

চন্দ্র অনেক খুঁজে ও টগরকে খুঁজে পেলো না।এমন কাউকে পেলো ও না যাকে জিজ্ঞেস করতে পারে টগরের কথা।
তিনজনই বাড়ির দিকে যাচ্ছে। অথচ তিন জনের মনেই তিন রকমের চিন্তা।

চলবে…..
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-২৩+২৪

0

#চন্দ্রাণী (২৩)
আকাশে মেঘের আনাগোনা বেশ ভালো দেখা যাচ্ছে। মেঘের গা ঘেঁষে এক ফালি রোদ এসে নিয়াজের মুখের উপর পড়লো।
গভীর মনোযোগ দিয়ে নির্ঝর নিয়াজের ডেডবডি পর্যবেক্ষণ করছে। নিয়াজের পরনে একটা আকাশীরং টি-শার্ট আর ধূসর রঙের জিন্স প্যান্ট।
গু/লি বুক ফুঁড়ে বের হয়ে গেছে। হয়তো পানিতে পড়েছে বুকটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে।
গু/লিটা পেলে জানা যেতো কোন পি///স্তল থেকে শ্যু/ট করা হয়েছে।

ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি লেগে আছে নিয়াজের। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে ও বেশ উৎফুল্ল ছিলো নিশ্চয়। নির্ঝরের আফসোস হলো নিয়াজের জন্য ভীষণ। সে যেই মানুষটাকে দারুণভাবে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আস্তাকুঁড়ে, কারো কাছে সেই মানুষ পরম আরাধ্য। যস্র একটু ছোঁয়া পেতে কেউ কেউ আজীবন তপস্যা করতে ও রাজি।
প্রেম,ভালোবাসা ব্যাপারটা এমন কেনো!
কেউ পায় না আবার কেউ হেলায় হারায়।কেনো ভুল মানুষের সাথেই ভালোবাসা হয়?

নিয়াজের পকেট সার্চ করে কিছু পাওয়া গেলো না।নিয়াজের ওয়ালেট ও না।
নির্ঝরের সন্দেহ হতে লাগলো। এটলিস্ট ওয়ালেট তো সাথে থাকার কথা। একটা বাড়তি সুতাও নেই সাথে। ফোন ও না।

নিয়াজকে পুলিশ খুঁজছিলো সেদিন রাতের নিউজটা দেখার পর থেকে।সেই নিয়াজ এখানে খুন হলো কেনো?
তবে কি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বের হয়ে আসবে বলে নিয়াজকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছে কেউ?
নিয়াজকে পেলে নিশ্চয় অনেক তথ্য বের হয়ে আসতো।

নিয়াজের ডে/ড বডি ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। নির্ঝর লাশ পাঠিয়ে দিয়ে নিয়াজদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।

টগর চা নিয়ে এসেছে। বাবুল দাশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে টগরকে পর্যবেক্ষণ করছে। এতো দিন এই ছেলেটাকে সবসময় মাতাল বলে মনে হয়েছে অথচ আজকে তাকে অন্য রকম লাগছে কেনো?
এর চোখের ভাষা যেনো অন্য রকম। কেমন করে তাকিয়ে আছে চেয়ারম্যান সাহেবের দিকে।
চন্দ্র পুরো বাড়ি ঘুরছে।বিশেষ করে নিয়াজের স্ত্রীর সাথে দেখা করতে চাইছে।
ভেতরের দিকে অনেক মানুষ দেখতে পেলো।নিয়াজের খু/নের কথা শুনে হয়তো আত্মীয়রা আসছে।এর মধ্যে একজন মহিলাকে দেখলো আলুথালু বেশে ফ্লোরে বসে আছে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে। কেউ একজন তার মাথায় তেল পানি দিচ্ছে।
দেখেই বুঝতে পারছে চন্দ্র মহিলা নিয়াজের মা হবে।চন্দ্রর খানিকটা আফসোস ও হলো। কেনো এরকম ভুল পথে যায় মানুষ?
যেখানে তার জন্য বাবা মা পরিবার সবাইকে কষ্ট পেতে হয়।
এদিক ওদিক দেখে একজন বয়ষ্ক মহিলাকে জিজ্ঞেস করলো চন্দ্র,”নিয়াজের স্ত্রী কোথায়?”

মহিলা বললো, “আপনি কে?ক্যান আপনি জানেন না ওর বউ তো আইজ এক বছর ধইরা বাপের বাড়িতে থাকে। আর আইবো না না-কি। এখন তো আর আসবোই না এই জীবনের জন্য। ”

চন্দ্র চলে গেলো। তার আর দেখার কিছু নেই।চন্দ্র ভেতরের দিকে যেতে নিতেই টগর এলো। এসে চন্দ্রর সাথে গল্প জুড়ে দিলো।চন্দ্রর বুকের কাঁপুনি থামছে না।টগর আড়চোখে চারদিকে তাকাচ্ছে। খানিক পরে দেখতে পেলো বাবুল দাশ দরজার আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে আছে। টগরের ভীষণ হাসি পেলো।চন্দ্রকে বুঝতে দিলো না বাবুল দাশ এসে পাহারা দিচ্ছে যে।
চন্দ্রর কিছুক্ষণ পর মনে পড়লো আব্বা আছেন এখানে।আব্বা যদি দেখেন তাহলে খারাপ ভাবে নিবে ব্যাপারটা।
চন্দ্র টগরের সাথে কথা শেষ করে ভেতরে গেলো।

এরইমধ্যে নির্ঝর এলো নিয়াজদের বাড়িতে।এসে দেখে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী একই সাথে বসে আছে। দুজনের সামনে চায়ের কাপ রাখা আছে।
মরা বাড়িতে নাকি চুলা জ্বালায় না।এরা চা খাচ্ছে?
নির্ঝরের মাথায় এই প্রশ্নটা এলো কেনো সেটা ও সে বুঝতে পারছে না। কোনো রকম প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে ভেতরে গেলো। হাসিমুখে বললো, “দুজন একসাথে, বাহ!
দেখতে তো ভালোই লাগছে।”

শাহজাহান তালুকদার গম্ভীর হয়ে বললেন,”কিছু জানা গেছে ইন্সপেক্টর? ”

নির্ঝর বললো, “নিয়াজকে গু//লি করা হয়েছে। ডেড বডি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। আমি এসেছি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে। ”

কাদের খাঁন সোজা হয়ে বসে বললো, “বসুন ইন্সপেক্টর। ”

নির্ঝর সোফায় বসতে বসতে চারদিকে তাকালো।বেশ সুন্দর করে সাজানো ঘরটা।এই ঘরটার বিশেষত্ব সম্ভবত এটা যে কেউ আসলেই আগে চারদিকে চোখ বুলায় এর সৌন্দর্য দেখতে।
নির্ঝর ও ব্যতিক্রম না।চারদিকে তাকিয়ে বললো, “নিয়াজ সম্পর্কে যা যা জানেন সবটা আমাকে বলুন,আমাদের ইনভেস্টিগেশনের জন্য সব জানা দরকার আমার। আশা করছি এখন আর কোনো কথা লুকাবেন না,কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন না।”

কাদের খাঁন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আমার কখনোই কিছু লুকানোর মতো ছিলো না,এখনো নেই।কি জানার আছে আপনার? ”

নির্ঝর জিজ্ঞেস করলো, “নিয়াজ কাদের সাথে চলাফেরা করতো? আপনি ও জানেন,গ্রামের সবাই ও তেমন জানে নিয়াজ কি কাজের সাথে জড়িত ছিলো।ওর কাছে কারা কারা আসতো, ও কাদের সাথে কথা বলতো? ”

চন্দ্র আর টগর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে ভেতরের দিকে।
কাদের খাঁন এক নজর টগরের দিকে তাকিয়ে বললো, “ও তো বাড়িতে তেমন একটা থাকতো না।বাড়িতে ওর সাথে টগর ছাড়া অন্য কেউ কখনো দেখা করতে আসতো না।সবসময় টগরই আসতো।অন্য দুই একজন দুই একবার এসেছে হয়তো আমার অতটা খেয়াল নেই তাদের। ”

চন্দ্র এক নজর টগরের দিকে তাকালো। মনে মনে বললো, “সব মিথ্যে হোক,টগর সব অপরাধের উর্ধ্বে হোক।এই মানুষটার দিকে তাকালে কেনো আমার এমন লাগে?আমি নিজেও জানি সে ক্রাইমের সাথে জড়িত তবিও কেনো আমার বুকের ভেতরে এমন উথাল-পাতাল ঝড়।কেনো এতো হাহাকার হচ্ছে? ”

টগর আগের মতো নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে। নির্ঝর টগরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সেই হাসি বলে দিলো তুমি আবারও ফেঁসে গেছো।

টগরের চেহারায় কোনো অভিব্যক্তি নেই,কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।যেনো তাকে নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। কিছুই জানে না সে।

নির্ঝর জিজ্ঞেস করলো, “নিয়াজের রুমটা আমি একটু চেক করতে পারি?”

কাদের খাঁন অনুমতি দিয়ে দিলো।নির্ঝর টগরকে বললো, “এবার কে বাঁচাবে তোমাকে?”

টগর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “আপনি যা যা জানতে চান বলুন,আমি আর কিছু লুকাবো না।নিয়াজ,নিয়াজের বস সম্পর্কে যতটুকু জানি সবই বলবো আপনাকে।
চন্দ্র চমকে উঠলো টগরের এই সহজ স্বীকারোক্তি শুনে।নিজের অজান্তেই দুই চোখ টলমল হয়ে গেলো।

চন্দ্রর টলমল চোখের দিকে তাকিয়ে টগর মুচকি হাসলো। মনে মনে বললো, ” তুমি আমার জন্য কেনো কাঁদছো বোকা মেয়ে?ভুল মানুষের সাথে মনের লেনাদেনা করতে নেই জানো না?আমাদের হৃদয়ের লেনাদেনা এই জন্মে হবে না।তুমি ওই দূর আকাশের চাঁদ,আমি বামুন হয়ে কিভাবে হাত বাড়ানোর দুঃসাহস করবো?”

শাহজাহান তালুকদার উঠে দাঁড়িয়েছে। চন্দ্র কাদের খানের থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলো।

ফেরার সময় চন্দ্রর কাছে বাবাকে কেমন গম্ভীর মনে হলো। হয়তো নিয়াজের আব্বার সাথে কিছু হয়েছে তাই গম্ভীর হয়ে আছে।চন্দ্র আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। তার নিজের ও ভালো লাগছে না। কেনো সব এলোমেলো লাগছে এরকম!
সে নিজেও তো চেয়েছে টগরের থেকে সবটা জানতে,অথচ কেনো আজ তার এতো অস্থির লাগছে টগরের স্বীকারোক্তি শুনে।
কেনো মন বলছে টগরের কাছে ছুটে যেতে।এই অবাধ্য মনকে ফেরাবে কিভাবে চন্দ্র?

চলতে চলতে চন্দ্রর হঠাৎ করে মনে হলো টগরের সামনে কোনো বিপদ নেই তো!
নিয়াজ তো একটা চুনোপুঁটি ছিলো আসল রাঘব বোয়াল নিজেকে নিরাপদে রাখার জন্য যদি টগরকেও শেষ করে দেয়!

চলবে….
রাজিয়া রহমান

#চন্দ্রাণী (২৪)

চন্দ্র বাড়িতে এসে ফোন খুঁজতে লাগলো। কোথায় রেখেছে ফোনটা?
টগরকে কল দিয়ে সাবধানে থাকতে বলতে হবে।আশ্চর্য, চন্দ্র কোথাও তার ফোনটা খুঁজে পাচ্ছে না। নেই নেই,কোথাও নেই।
চন্দ্র খুঁজতে খুঁজতে বাবার রুমের দিকে গেলো।বাহিরে থাকতেই শুনতে পেলো বাবার চাপা কণ্ঠ। সেই কণ্ঠে গভীর আঘাত ফুটে উঠছে।
বাহিরে থেকে চন্দ্র কিছুই স্পষ্ট শুনতে পেলো না।

চন্দ্র গিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসলো। শর্মী শসা কুচি করছে।অদ্ভুত রকমের শান্ত লাগছে চন্দ্রর কাছে শর্মীকে।গভীর মনোযোগ দিয়ে শর্মী শসা কুচি করছে। চন্দ্র কি দিয়ে কথা জিজ্ঞেস করবে খুঁজে পেলো না।শর্মীর মনের অবস্থা কেমন তা আগে জানা উচিত।

এদিক ওদিক তাকিয়ে শুভ্রকে না দেখে জিজ্ঞেস করলো, “শুভ্র কোথায় রে?”

শর্মী শান্ত স্বরে বললো, “আব্বার রুমে।”

চন্দ্র জিজ্ঞেস করলো, “কি করছে ওখানে?”

চপিং বোর্ড থেকে চোখ না তুলেই শর্মী বললো, “ও তো আব্বার রুমেই ছিলো। মা’র কাছে বসে ছিলো।আব্বা বাহিরে থেকে এলো সবেমাত্র তোর সাথে, তারপর রুমে গেলো।”

চন্দ্র হালকা হেসে বললো, “কি রান্না হয়েছে আজ,খুব ক্ষুধা লেগেছে। ”

শর্মী যন্ত্রের মতো বললো, “মা গরুর মাংস রান্না করেছে।বড় বড় করে আলু দিয়ে লাল লাল গরুর মাংস। আর চিংড়ি মাছ দিয়ে লতি।”

চন্দ্র হেসে বললো, “ইশ,এলার্জিতে এলার্জিতে ধুল পরিমাণ আজ।”

শর্মী কিছু বললো না। শাহজাহান তালুকদারের রুমের দরজা খুলে গেলো।শুভ্র আর রেহানা বের হয়ে এলো। শুভ্রর মুখ থমথমে হয়ে আছে। কোনো সমস্যা হয়েছে শুভ্রর?
নিজের কষ্ট হলেই শুভ্রর মুখটা এমন দেখায়।

চন্দ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শর্মীকে বললো, “ভাইয়ের কি হয়েছে রে,ওর মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেনো?”

চকিতে শর্মী ভাইয়ের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ আগেও তো হাসিমুখে ছিলো। মাকে রান্না করতে দেখে শর্মীর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলো কিছুক্ষণ। শর্মী বুঝতে পেরে একটা বাটিতে চার পিস মাংস আর তিন পিস আলু নিয়ে দিয়েছে ভাইকে।তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে মায়ের কাছে গিয়েছিলো। হঠাৎ কি হলো?

শর্মী চিন্তিত হয়ে বললো, “ঠিকই তো ছিলো আপা।আম্মাদের রুমে কি হয়েছে যার জন্য ও এমন করে আছে?আব্বা আম্মা কোনো কথা বললে তা তো ও বুঝবে না যে কোনো কথাতে কষ্ট পাবে।তাহলে? ওনারা তো আর মারামারি করবে না যে ও তার জন্য এভাবে মন খারাপ করে থাকবে।”

চন্দ্রর দুই চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। পরমুহূর্তে মনে পড়তেই শর্মীকে জিজ্ঞেস করে, “আমার ফোনটা দেখেছিস?”

শর্মী মাথা নাড়িয়ে না বলে। চন্দ্র আবারও জিজ্ঞেস করে, “তোর কাছে টগরের ফোন নাম্বার আছে?”

শর্মী মাথা নাড়ায়।চন্দ্র আবারও অস্থির হয়ে যায় টগরের চিন্তায়।শর্মী চন্দ্রর এই অস্থিরতা দেখে জিজ্ঞেস করে, “কোনো সমস্যা হইছে আপা?”

চন্দ্র অস্থিরচিত্তে বললো, “আমার মন কেমন করছে।টগরের নিশ্চয় কোনো বিপদ সামনে। ”

শর্মী কিছুক্ষণ চন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বললো, “তুই কি টগরকে নিয়ে একটু বেশি ভাবছিস না আপা?যতটা না ভাবলেও চলে, তার চাইতে ও একটু বেশি চিন্তা করছিস মনে হয়। ”

চন্দ্র থতমত খেয়ে গেলো শর্মীর কথা শুনে।শর্মী ভুল কিছু বলে নি।সে নিজেও বুঝতে পারছে। সে তো টগরকে অপছন্দ করতো, শত্রু ভাবতো।কিন্তু সেই মনোভাব কিভাবে এতো দ্রুত বদলে গেলো!
কেনো মন টগরের উপর মুগ্ধ হচ্ছে?
টগর কে?একজন মাতাল,একজন ড্রাগ সেলার,একজন খারাপ লোক।
অথচ মন কি-না তার জন্য কাঁদছে।

সেই প্রথম যেদিন টগর চন্দ্রকে তার বাড়িতে সাথে করে নিয়ে গিয়ে একা বাসায় চন্দ্রর টগরের সাথে আনইজি লাগতে পেরে একটা মেয়েকে ডেকে এনেছে যাতে চন্দ্র বিব্রত না হয়।তখনই কেনো জানি মনে হয়েছে যে মানুষ একটা মেয়ের একা পেয়ে সুযোগ না নিয়ে তার সম্মান, তার স্বস্তির কথা চিন্তা করে আরেকটা মেয়েকে ডেকে আনে সে খারাপ মানুষ হতে পারে না।

সেই প্রথম চন্দ্র মুগ্ধ হলো টগরের প্রতি।

একটা মানুষ মায়ের পেট থেকে খারাপ হয়ে আসে নি।পরিস্থিতি তাকে খারাপ হতে বাধ্য করেছে।হয়তো সৎসঙ্গে গেলে আবারও ভুল পথ থেকে ফিরে আসবে।
চন্দ্র চায় টগর ভালো হয়ে যাক।কেনো চায়?
তার উত্তর চন্দ্র জানে না।

শর্মীর দিকে তাকিয়ে বিষন্ন স্বরে বললো, “আমি জানি আমাকে এরকম কাজে মানায় না।কিন্তু আমি কি করবো শর্মী।আমি মনকে মানাতে পারছি না।টগর ভীষণ একা একজন মানুষ। একটু ভালোবাসা, একটু যত্ন পেলে আমার মনে হয় সে সেরে উঠবে।সব অন্যায় ছেড়ে দিবে।আমার কোনো দায় নেই ওকে ভালো করার,তবুও আমার মন ওকে ভালো বানাতে চায়।আমার মনটা এমন কেনো আমি জানি না।”

শর্মী মনে মনে হাসলো। মনে মনে বললো, “আপা,তুই তো আজীবন এমনই ছিলি।কারো কষ্ট সহ্য করতে পারতি না।একবার রমজান ঈদের আগের দিন কিছু লোক এলো আমাদের গ্রামে।নদীতে ঘর ভেঙে গেছে।বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে সাহায্য চাইতে এসেছিলো।টাকা পয়সা,খাবার,পুরনো কাপড় সব কিছুই নেয় ওনারা।সেই ঈদে অনেক দোকান ঘুরে তুই গোলাপি রঙের একটা জামা নিয়েছিলি।
সাহায্য চাইতে আসা লোকদের কথা শুনে, তোর বয়সী একটা মেয়েকে দেখে মা’র দেওয়া পুরনো জামা কাপড়ের সাথে নিজের ঈদের জামা জুতা দিয়ে দিলি।মা যত নিষেধ করলো শুনলি না।আব্বার থথেকে সেই ঈদের সালামি অগ্রিম নিয়ে ওদের দিয়েছিলি।
বাসায় ভিক্ষা করতে মহিলারা এলে এখনও জিজ্ঞেস করে মা’কে আপনার বড় মেয়ে আসে নাই বাড়িতে।
ওনারা চালের জন্য এলে এক মুঠো চাল দেওয়ার পরিবর্তে তুই এক পট করে চাল দিতি।
দাদী বলতো তোর মতো পাঁচ ঘর থেকে চাল দিলি মানুষের আর ভিক্ষা চাইতে হবে না সেদিন।তুই যে টগরের দুঃখে এভাবে জড়াবি না তা তো হবে না।”

দুপুরের খাবারের পর সবাই নিজের রুমে শুয়ে ছিলো। চন্দ্র ফোন খুঁজতে খুঁজতে কাচারি ঘরে গেলো।সকালে নিয়াজের মৃ//ত্যু সংবাদ দিতে আব্বার কাছে কাচারি ঘরে গিয়েছিলো তারপর আর ফোন আনে নি ওখান থেকে হঠাৎ করে মনে পড়েছে চন্দ্রর।
কাচারি ঘরে গিয়ে দেখে ঘর খালি।শাহজাহান তালুকদার ঘরে আছেন।বাবুল দাশ নেই কাচারি ঘরে। চন্দ্র অনেকক্ষণ খুঁজে চাবি পেলো।

আলমারি খুলে চন্দ্র ভেতরের ড্রয়ার টান দিলো।ড্রয়ারে তালা দেওয়া। চাবি এখানে নেই আলমারির চাবির সাথে।
চন্দ্র খুঁজতে লাগলো চাবি।সকালে আব্বা চাবি এখানেই কোথাও রেখে গেছেন।খুঁজতে খুঁজতে চাবি পেলো শাহজাহান তালুকদারের চশমার বক্সের মধ্যে।

ড্রয়ারে অনেকগুলো ব্যাগ ভর্তি কাগজপত্র। সব ব্যাগের উপর নাম লিখে রাখা আছে।
চন্দ্র ফোন খুঁজতে খুঁজতে একটা ব্যাগ পেলো চন্দ্র লিখা।
ব্যাগটা খুলতেই কিছু কাগজপত্র পেলো।মেয়ের নামে দেওয়া কিছু জায়গা জমি,দোকানের দলিল পত্র সব এখানে রাখা।
আপনমনে খুঁজতে খুঁজতে চন্দ্র কিছু ছবি খুঁজে পেলো।
ছবির দিকে এক নজর তাকিয়ে বুক কেঁপে উঠলো চন্দ্রর।এগুলো কার ছবি!
এই ছেলেটা কে বর সেজে?
মেয়েটা সে?
কিন্তু তার তো মনে নেই এরকম কিছু, কখনো কেউ বললো না তো এরকম কিছুর কথা।
চন্দ্র জানে না তার জন্য এরকম কতো চমক অপেক্ষা করছে।

চলবে…
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-২১+২২

0

#চন্দ্রাণী (২১)
চন্দ্র অস্থির হয়ে বসে রইলো নিয়াজের মেসেজের আশায়।কিন্তু মেসেজ এলো না।অপেক্ষা করতে করতে শর্মী ঘুমিয়ে গেলো।ঘুম এলো না চন্দ্রর চোখে। দুই চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু কিন্তু মস্তিষ্ক বারবার জানান দিচ্ছে কিছুতেই ঘুমানো যাবে না।
ঘুমন্ত শর্মীর মুখের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। আহা বেচারি!
কতো স্বপ্ন দেখেছিলো নিয়াজকে নিয়ে। বুঝতে পারে নি অপাত্রে ভালোবাসা দান করছে।আর যখন বুঝলো তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
এই মুখোশের দুনিয়ায় ভালোবাসা যেনো স্বপ্ন।চাইলেই পাওয়া যায় না।

ফজরের আজান হচ্ছে চারদিকে,চন্দ্র ঘুমাচ্ছে না।আরো একটা মানুষ ও ঘুমাচ্ছে না। টগর সে।সে ব্যস্ত তার হিসেব মেলাতে।
ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি তার।সামনে ল্যাপটপে একটা ভিডিও প্লে করে রেখেছে।

শর্মীর ঘুম ভেঙে গেলো হঠাৎ করে। ধড়ফড়িয়ে উঠে দেঝে চন্দ্র সেই আগের মতো বসে আছে। লজ্জা পেলো শর্মী।আপা বসে আছে তার কাজে অথচ সে কি-না ঘুমিয়ে গেছে।
চন্দ্র হেসে বললো, “কোনো ছবি আসে নি।মনে হচ্ছে না ছবি পাঠাবে,তোকে সম্ভবত ভয় দেখাতে চাইছে।তবে ও যেই ছেলে ওকে বিশ্বাস নেই।”

শর্মীর বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটা হচ্ছে যেনো।কেমন একটা অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকজুড়ে।আব্বা যদি একবার এসব কিছু জানতে পারে আব্বার সামনে শর্মী দাঁড়াবে কিভাবে?
আব্বা কি সহ্য করতে পারবে মেয়ের এই বেহায়াপনা?
আব্বা ম//রেই যাবে লজ্জায় অপমানে।সারা গ্রাম জেনে যাবে এরপর।

শর্মীর কেমন দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছে। চন্দ্র উঠে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে। বোনের বুকে পিঠে মালিশ করতে করতে বলে,” তুই একদম চিন্তা করবি না।তোর আপা বেঁচে আছে। আমি থাকতে তোর কোনো ভয় নেই।আমি যা করার করবো।”

শর্মীর বুক ফেটে কান্না আসছে।বুক উজাড় করে ভালোবাসার পরেও কেনো ভাগ্য তাকে এভাবে ঠকালো।সে তো ছলনা করে নি,ধোঁকা দেয় নি।নিজেদের শত্রু জেনেও ছেড়ে দেয় নি।মন থেকে ভালোবেসেছিলো।অথচ বিনিময়ে কি পাচ্ছে সে!

শর্মীর আর সহ্য হচ্ছিলো না এতো কিছু। চন্দ্র সময় নিয়ে বোনকে সামলায়।এই সময়টা ভীষণ নাজুক সময়। শর্মীকে ভালো করে কাউন্সেলিং করতে হবে। তা না হলে শর্মী আবারও ভুল পদক্ষেপ নিতে পারে।
চন্দ্র নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “দেখ,আগে তোকে শক্ত হতে হবে।এই পরিস্থিতি এতটা সেনসেটিভ আমি জানি।কিন্তু যাই হয়ে যাক,নিয়াজ যা-ই করুক তোকে সাহস রাখতে হবে মনে। আব্বার কাছে যদি ছবি পাঠায় নিয়াজ তখন কি হবে?
আব্বা খুব মানসিক আঘাত পাবে।ধর তোর সাথে অভিমান করবে,নিয়াজ ট্র‍্যাপে ফেলে চাইবে আব্বাকে ইলেকশন থেকে বিরত রাখতে।
তুই যদি ভবিষ্যতে এসব হবে ভেবে মনে মনে কোনো ভুল স্টেপ নেওয়ার চিন্তা করিস তবে মনে রাখিস,তোর এসব ছবি দেখলে আব্বা হয়তো কষ্ট পাবে কিন্তু তোর ভুল পদক্ষেপে আব্বা দুনিয়া থেকে চলে যেতে পারে। আব্বা কতটা নরম মনের মানুষ তোর নিশ্চয় অজানা না?তোর মনে আছে কখনো আমার তোর কোথাও আঘাত লাগলে,রক্ত বের হলে আব্বা পাগলের মতো কান্না করতো?
সেই কয়দিন বাড়ি থেকে কবুতরের মাংস ফুরাতো না।কবুতর খেতে রক্ত হয় এই ভেবে আব্বা সবসময় কবুতর আনতো আমাদের খাওয়াতে।
তোর মনে আছে, তোর একবার ওজন অনেকটা বেড়ে যাওয়ায় তুই সিদ্ধান্ত নিলি ডায়েট করার।৪ মাস তুই ডায়েট করলি,ভাত খেলি না।সেই ৪ মাস আব্বা ও ভাত খায় নি তোর মনে আছে?
সেই তুই যদি ঘুণাক্ষরেও ভাবিস যে এই লজ্জা নিয়ে আব্বার সামনে যেতে পারবি না এরচেয়ে পৃথিবী ছেড়ে যাবি তো আব্বা কি করবে তখন?
আর মেইন কথা নিয়াজ এটাই চায় বুঝলি?
নিয়াজ চায় তুই একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেল।তাতে আব্বা ভেঙে পড়ুক আর ওরা জিতে যাক।পরিস্থিতি যাই হোক নিজেকে শান্ত কর।এটাও মনে রাখবি আব্বার ইলেকশনে জিতে যাওয়ার একটা ধাপ।তুই যদি হেরে যাস আব্বা ও হেরে যাবে।তুই যদি সাহস রাখিস মনে বিপদ মোকাবিলা করার তো আব্বা জয়ের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাবে।”

শর্মীর কেমন মন হালকা হয়ে গেলো বোনের কথা শুনে।সে সত্যিই আবারও একটা ভুল ভাবনা ভেবে ফেলেছিলো।আপার কথা ম্যাজিকের মতো কাজ করলো।
শর্মী বোনকে ছেড়ে দিয়ে বললো, “এখন আমরা কি করবো? ”

চন্দ্র বললো, “ইন্সপেক্টরের সাথে কথা বলতে হবে।নিয়াজকে পুলিশ খুঁজছে জানিস তো।ইন্সপেক্টরের জানা উচিত নিয়াজের এই কান্ড। ”

চন্দ্র নির্ঝর কে কল দিলো।নির্ঝর তখনও বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। ফোন বাজতেই উঠে বসে রিসিভ করে হ্যালো বলতেই শুনলো ওপাশ থেকে মেয়েলী একটা কণ্ঠ। চেনা চেনা লাগছে নির্ঝরের।
চন্দ্র পরিচয় দিয়ে বললো নিয়াজের কথা। রাতে শর্মীকে যা যা বলেছে সেসব বললো।
নির্ঝর অবাক হয়ে বললো, “নিয়াজ কল করেছে? কোন নাম্বার থেকে? ওর ফোনটা অফ,ওর সিম কার্ড ও ব্যবহার করছে না।ওর নতুন নাম্বার আমাকে এক্ষুনি সেন্ড করুন।ওর লোকেশন বের করতে হবে এক্ষুনি। ”

চন্দ্র সাথে সাথে নিয়াজের ফোন নাম্বার পাঠিয়ে দিলো।
দ্রুত তৈরি হয়ে নির্ঝর বের হয়ে গেলো বাসা থেকে।নাম্বারটা পাঠিয়ে দিলো লোকেশন জানার জন্য। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে সে।শর্মী কে এভাবে থ্রেট করছে নিয়াজ!এতো বড় স্পর্ধা ওর!

নিয়াজকে একবার ধরতে পেলে নির্ঝর কি কি মামলা দিবে ওর নামে সেসব ভাবছে।
চোখের সামনে শর্মীর বিরক্তি নিয়ে তাকানো মুখখানা ভেসে উঠছে।নির্ঝরের বুকের ভেতরে কেমন ঝড় উঠলো হঠাৎ করে। কোমল,নির্মল মুখখানা বুঝি এখন আষাঢ়ের আকাশের রূপ নিয়েছে!
নিশ্চয় খুব কান্না করছে।কখনো কি নির্ঝরের ভাগ্য হবে শর্মীর চোখের জল মুছে দেওয়ার?

জানে না নির্ঝর। থানায় গিয়ে জানতে পারলো নিয়াজের লাস্ট লোকেশন কুশি নদী দেখাচ্ছে। নির্ঝর আবারও কল দিলো,রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না কেউ।
নির্ঝর আবারও কল দিলো নিয়াজের নাম্বারে যত ইনকামিং এবং আউটগোয়িং কল হয়েছে, ডিটেইলস আনার জন্য।

মাথায় রাগ চেপে বসেছে নির্ঝরের। কিছুতেই আর নিয়াজকে ছাড়বে না সে।

চলবে……
রাজিয়া রহমান

#চন্দ্রাণী (২২)
নির্ঝরের সামনে কয়েকটা কাগজ ছড়িয়ে রাখা।গভীর মনোযোগ দিয়ে নির্ঝর দেখছে।নিয়াজের ফোনে একটা নাম্বার থেকেই কল এসেছে সবসময়।
কিছুক্ষণ ভাবলো নির্ঝর। এরপর নিয়াজের আগের নাম্বারের কল লিস্ট নিয়ে বসলো। ওখানেও এই নাম্বারটা আছে।কিন্তু কল ডিউরেশন খুবই কম বলে নির্ঝর এই নাম্বার তখন স্কিপ করে গেছে।
নির্ঝর নাম্বারটায় কল দিলো।রিং হলো কিন্তু রিসিভ করলো না কেউ।

কিছুক্ষণ ভেবে নির্ঝর সেই নাম্বারের ডিটেইলস আনার জন্য বললো।

মিছেমিছি এক সময় টগরকে সন্দেহ করেছে সে।নীলির মৃ/ত্যুর কোনো সমাধান ও করতে পারলো না।নির্ঝরের নিজের উপর নিজের রাগ হচ্ছে। কেনো কোনো ক্লু পাচ্ছে না সে?

তার উপর নীলির মৃত্যুর আগের রাতে যেই খু/ন হলো তার ও সমাধান হয় নি।নিজেকে কেমন লুজার মনে হচ্ছে নির্ঝরের।
চোখে যখন আঁধার দেখছে নির্ঝর সেই সময় থানায় ফোন এলো নদীতে এক জেলের জালে একটা লাশ উঠেছে। আর লাশটা নিয়াজের।নির্ঝর ভয়ানকভাবে চমকালো।নিয়াজের লাশ মানে!
এক মুহূর্ত দেরি না করে নির্ঝর বের হয়ে গেলো।যেতে যেতে চন্দ্রকে কল দিয়ে সবটা জানালো।

শর্মী তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রর ভেজা কাপড় শুকাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইন্সপেক্টরের কল এসেছে শুনে শর্মী আর ভেতরে এলো না।মন কেমন করছে।কে জানে নিয়াজ হয়তো সবাইকে সব দেখিয়েছে সেটাই বলছে ইন্সপেক্টর।
শর্মী বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলো। মা উঠানে বসে ইলিশ মাছ কা/টছে।দাদী বসে বসে মরিচের বোঁটা ছাড়াচ্ছে।মনার মা উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। কতো ব্যস্ত সবাই সবার কাজে অথচ কেউ জানে না তাদের মধ্যে থেকেও একটা মেয়ের বুকের ভেতরে বিষাদের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
নিজেকে বড় অসহায় লাগছে।
মানুষ এরকম ছলনা কিভাবে করতে পারে? ভালোবাসা নামক অভিনয় করে কিভাবে?

বাবুল দাশ এসে শর্মীকে ডেকে বললো, “জননী, এক কাপ কড়া লিকারের চা দিতে পারো?”

শর্মী বাবুল দাশের দিকে তাকালো।বাবুল দাশ শর্মীর শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর নরম স্বরে বললো, “আইচ্ছা থাক লাগবে না।”

শর্মী মলিন হেসে বললো, “কেনো কাকু?আপনি একটু বসেন আমি চা করে দিচ্ছি। ”

বাবুল দাশ নরম স্বরে বললো, “আমার জননীর কি মনটা খারাপ, এরকম মুখ কালো করে তো থাকে না আমার মা।”

শর্মীর কেমন মায়া হলো।না সব মানুষ এক রকম হয় না,কেউ কেউ সত্যি সত্যি ভালোবাসে।এই যে বাবুল কাকা,বুঝ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবার সাথে আছেন।বাপ মা নেই,বিয়ে থা করে নি।সেই কোন কালে শাহজাহান তালুকদার তার মা’য়ের চিকিৎসার সময় সাহায্য করেছেন,তারপর মা মরে যাওয়ার পর থেকে চেয়ারম্যানের কাছে পড়ে আছে।
ওই যে জমিলা আজ কতো বছর ধরে পড়ে আছে এই বাড়িতে।কোনো প্রতিদান চায় না এখন আর।প্রতিদিন নিজে থেকেই শর্মীর চুলে তেল লাগিয়ে দেয়।
এরাও তো ভালোবাসে।

এদের ভালোবাসা কি সুন্দর, কোনো ছলনা নেই,অভিনয় নেই।
ভাবতে ভাবতে শর্মী বের হলো। ভেতরে তখনও চন্দ্র ফোনে কথা বলছে।শর্মী বের হয়ে এলো। বাহিরে এসে দাঁড়াতেই চন্দ্রর চিৎকার শুনতে পেলো।আব্বা আব্বা করে চন্দ্র চিৎকার করতে করতে বের হলো ঘর থেকে। বাবুল দাশ বললো, “স্যার তো কাচারি ঘরে গো মা।কি হইছে?”

হাঁপাতে হাঁপাতে চন্দ্র বললো, “কাকু,নিয়াজ আছে না,ওর নাকি খুন হইছে। ওর লাশ আজ সকালে পাইছে পুলিশ। ”

শর্মীর হাত থেকে চায়ের পাতিল পড়ে গেলো মাটিতে। বাবুল দাশ তার জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। সবাই সবার জায়গায় স্থির শুধু হতভম্ব হয়ে গেলো শর্মী।
চন্দ্র দাঁড়ালো না আর,ফোন হাতে নিয়ে এক ছুটে গেলো বাবা কে খবর দিতে।
শাহজাহান তালুকদার কিছু কাগজপত্র দেখছে বসে বসে। চন্দ্র হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো, “আব্বা,নিয়াজের মা///র্ডার হয়েছে। ”

শাহজাহান তালুকদার চমকে গেলেন।নিয়াজ!
নিয়াজ নেই মানে!শাহজাহান তালুকদার কাশতে লাগলো। চন্দ্র ছুটে গিয়ে বাবার জন্য পানি আনে।
চন্দ্র পানি আনতে গিয়ে চন্দ্র এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায়।
তারপর পানি এনে দেয় বাবাকে। শাহজাহান তালুকদার নিজের সামনে রাখা কাগজপত্র সব কিছু তাড়াহুড়ো করে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে একটা ছবি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে চন্দ্রর সামনে পড়ে যায়।
পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি।
চন্দ্র ছবিতে চোখ বুলায়।ছোট্ট একটা মুখ দেখা যাচ্ছে।

হেসে উঠে চন্দ্র,এটা তার ছবি।চন্দ্র বললো, “আমি গুছিয়ে রাখতেছি,আপনি বসেন আব্বা।”

শাহজাহান তালুকদার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “না লাগবে,তুই যা বাড়িতে। আমি সব রাখতেছি।আর বাবুলরে বল আসতে।খাঁনের সাথে দেখা করতে যাবো।”

চন্দ্র অবাক হয়ে বললো, “খানের সাথে! ”

শাহজাহান তালুকদার হেসে বলে, “তার এতো বড় শোকের দিন এখন,যতই শত্রুতা থাকুক তবুও মানুষ তো আমরা! তুই ও আয় না আমার সাথে। বাবা মেয়ের একটু ঘুরাঘুরি ও হয়ে যাবে।”

চন্দ্র এক মুহূর্ত ভাবতে লাগলো। মন বলছে যাওয়া উচিত, একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে সে।কিন্তু শর্মীর কাছে ও থাকা উচিত এখন।শর্মীকে রেখে যেতেও ইচ্ছে করছে না।

পরমুহূর্তে মনে হলো বাড়িতে সবাই আছে এখন,শর্মীকে একটা কাজে ব্যস্ত রাখলেই হবে।চন্দ্র জানালো সে ও যাবে।
চন্দ্র চলে গেলো বাড়ির দিকে। শাহজাহান তালুকদার সব ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে গায়ের পাঞ্জাবি বদলে নিলেন।
বাবুল দাশ ২ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলো। তার মনটা খারাপ। শর্মীকে কেমন বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকতে দেখেছেন।এই মেয়ে দুটো তার বড় আদরের। একজনকে ঘাড়ে আর একজনকে কোলে নিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়াতেন।এদের জন্য ঘোড়া হতেন।দুজনকে সাঁতার ও শিখিয়েছেন তিনি।লম্বাচওড়া এই বাবুল দাশ এই দুইটা পরীর ছানার সামনে এলে একটুখানি হয়ে যেতেন নুয়ে। তার কাছে এরাই তার প্রতিমা। তিনি হিন্দু ওরা মুসলমান হতে পারে কিন্তু তার প্রতি মেয়ে দুটোর অথবা মেয়েদের জন্য তার ভালোবাসার বিন্দুমাত্র কমতি নেই।

শাহজাহান তালুকদার জিজ্ঞেস করলেন,”মন খারাপ কেনো তোর?”

বাবুল দাশ হেসে বললো, “কিছু না, এমনেই।চলেন।”

চন্দ্র ও তৈরি হয়ে এলো। এক ছুটে গিয়ে একটা থ্রিপিস পরে এসেছে গায়ের টপস পালটে।
কেমন একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে চন্দ্রর।

বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কাদের খানের বাড়িতে হাজির হলো। এই বাড়িতে কখনো আসা হয় নি চন্দ্রর।সবসময় বাহিরে থেকে দেখেছে।কখনো ইচ্ছে হয় নি ভেতরে এসে দেখার।বুঝদার হওয়ার পর থেকেই দেখছে বাবার সাথে লড়াই এদের সাথে।

ড্রয়িং রুমে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে কাদের খাঁন।কাদের খাঁনের এই বাড়িটি বাহির থেকে বুঝা যায় না কতটা জৌলুশপূর্ণ। ভেতরে এসে চন্দ্রর চক্ষু কপালে। পুরো বাড়ি ইইন্টেরিয়র দিয়ে ডিজাইন করা।
বিশাল বড় এই বাড়িটিতে নানান রকম শোপিস,লাইটিং দিয়ে সাজানো।
দেখেই মনে হয় ভীষণ রুচিশীল মানুষ। চন্দ্রর কেমন ভালো লাগতে শুরু করলো। শাহজাহান তালুকদারকে দেখেই কাদের খাঁন উঠে দাঁড়ালো। দুজন হ্যান্ড শেক করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই।নিরবতা ভেঙে কাদের খাঁন বললো, “বস তালুকদার।”

শাহজাহান তালুকদার সোফায় বসতে বসতে বললো, “কিভাবে এসব হলো?”

কাদের খাঁন বিমর্ষ সুরে বললো, “এ তো হওয়ারই ছিলো, আমি ছেলেকে মানুষ করতে পারি নি তালুকদার। অমানুষ হয়ে গেছে আমার ছেলে।শাস্তি পেয়েছে। তালুকদার, তবুও কেনো আমার বুকটা এরকম খাঁখাঁ করছে বল তো?বেঁচে থাকতে আমি কখনো ওকে প্রশ্রয় দিই নি,কখনো কোনো সাহায্য করি নি।কখনো ভালো করে কথা বলি নি অথচ আজ ইচ্ছে করছে ছেলেটার সাথে একটু কথা বলি।
আমাকে গতকাল খবর পাঠিয়েছে টগরকে দিয়ে একজন ভালো ল’ইয়্যার দেখার জন্য। আমি সোজা নিষেধ করে দিয়েছি।যেই ছেলে অসৎসঙ্গে পড়ে খারাপ কাজে যুক্ত হয় সেই ছেলের জন্য আমি একটা কাজ ও করতে রাজি না।এতো দিন তো মন দুর্বল হয় নি আজ কেনো এমন লাগছে বলো তো?মনে হচ্ছে আমি যদি এতটা কঠোর না হতাম ছেলেটা বেঁচে থাকতো।
আবার বিবেক বলছে যা হয়েছে ঠিক হয়েছে, পাপের শাস্তি পেতেই হয় এভাবে।একটা অপরাধী কমেছে সমাজ থেকে এটাও তো আনন্দের ব্যাপার। ”

চন্দ্র অবাক হলো নিয়াজের বাবার কথা শুনে। এই মানুষটাকে সে সবসময় খারাপ জেনে এসেছে। অথচ তার চিন্তা ভাবনা কতো উন্নত। এরকম একটা মানুষের ছেলে হয়ে নিয়াজ এতটা বখে গেলো!

শাহজাহান তালুকদার বললো, “তুমি সেই আগের মতোই আছো নীতিবান।”

কাদের খাঁন মৃদু হেসে বললো, “নীতিবান হয়ে লাভ কি হলো তালুকদার, ছেলেকে তো মানুষ করতে পারলাম না।”

চন্দ্রর হঠাৎ করে মনে হলো তার বাবা আর কাদের খাঁন একে অন্যকে যেনো খুব ভালো করে চেনে।কিন্তু কিভাবে?যদি ভালো করে চিনেই থাকে তবে এতো শত্রুতা কেনো?

চন্দ্র এসব ভাবছে সেই মুহূর্তে টগর এসে চন্দ্রর পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, “কি ভাবছেন?”

চমকে উঠে চন্দ্র তাকিয়ে দেখে টগর দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। টগরকে দেখতেই বুকের ভেতরে কেমন একটা কাঁপুনি শুরু হলো চন্দ্রর।কেমন লজ্জা এসে ভর করলো তার মধ্যে। আশ্চর্য তো,চন্দ্র বুঝতে পারছে না এরকম বুকের ভেতরে ধুকপুক করছে কেনো।

টগর চন্দ্রর খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। টগরের বডি স্প্রের মৃদু ঘ্রাণ পাচ্ছে চন্দ্র।কেমন জানি লাগছে চন্দ্রর।

নিজেকে নিজে ধমক দিলো চন্দ্র।সে তো টিনএজ মেয়ে না,তবুও কেনো এমন হচ্ছে তার।

টগর হেসে বললো, “কথা বলবেন না বলে ঠিক করেছেন নাকি?”

চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “না তা না,আপনি এখানে?কখন এলেন?”

টগর হেসে বললো, “আপনি এসেছেন, আমি আসবো না তা কি হয়?”

চন্দ্র ভ্রুকুটি করতেই হেসে বললো, “আচ্ছা রাগবেন না প্লিজ, আমি অনেক আগেই এসেছি। গেইট দিয়ে আপনি ঢুকার সময় এক নজর দেখে ছুটে এলাম আপনার সাথে দেখা করতে। ”

চন্দ্রর নিজেকে কেমন লাজুকলতা মনে হচ্ছে। এরকম তো সে ছিলো না। টগর তার সাথে দেখা করতে এসেছে শুনে এমন লজ্জায় লাল হওয়ার কি আছে!

টগর হেসে বললো, “আপনার দুই গাল পাকা টমেটোর মতো হয়ে গেলো যে হঠাৎ করে, কোনো কারণে কি আপনি লজ্জা পাচ্ছেন?”

চন্দ্র নিজেকে সামলে বললো, “না ওসব কিছু না,রোদের মধ্যে হেটে এসেছি তাই আরকি।”

টগর হেসে বললো, “আপনাকে একেবারে লজ্জাবতী লতার মতো লাগছে।ভীষণ সুন্দর। ”

চন্দ্র হেসে সরে গেলো সেখান থেকে। সে খেয়াল করেছে আব্বা তিন চারবার তার দিকে তাকিয়েছে। বাবুল কাকা আব্বার পেছনে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এর আগে কারো সাথে চন্দ্রকে কথা বলতে দেখে নি, তাই দুজনেই অবাক হচ্ছে।
দুজনেই কি মনে করবে ভেবে চন্দ্র সরে গেলো ভেতরের দিকে।শাহজাহান তালুকদার বিরক্তি নিয়ে টগরকে দেখছে।টগর হাসিমুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।সে শাহজাহান তালুকদারের সাথে তাকিয়ে থাকার এই খেলাটা খেলতে চায়।কতক্ষণ তিনি তাকিয়ে থাকতে পারে তার দিকে।

শাহজাহান তালুকদার চমকে গেলেন কিছুক্ষণ পর।একটু আগে এই ছেলেটার চোখে যেই সারল্য ছিলো মুহুর্তেই সেই চোখে রাজ্যের কঠোরতা ফুটে উঠলো কিভাবে!
এ যেনো অন্য মানুষ!
এই মাতালের সাথে চন্দ্রর এরকম হাসিমুখে কিসের কথা,কিভাবে চেনে সে চন্দ্রকে?
টগরের সাথে কথা বলতে গিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া শাহজাহান তালুকদার, বাবুল দাশ কারোর নজর এড়ায় নি।

শর্মীকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ছোট মাছ কাটতে।বুকের ভেতর ক্ষণে ক্ষণে ঝড় উঠছে শর্মীর।নিয়াজ নেই,নিয়াজ আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।কি আশ্চর্য, শর্মীর তো খুশি হওয়ার কথা।তবুও কেনো বুকটা এমন কেঁপে উঠছে।যেই মানুষ তার ভালোবাসাকে অপমান করেছে, তাকে সবার চোখে খারাপ বানাতে চেয়েছে তার জন্য মনের ভেতর কোথায় এখনো কিছুটা ভালোবাসা লুকোনো ছিলো?
কোথায় ছিলো?
কেনো ছিলো?
কেনো শর্মীর এতো কষ্ট হচ্ছে?
একটা মিথ্যে বিয়ে বিয়ে খেলা খেলেছে নিয়াজ তার সাথে। অথচ শর্মী কি অবলীলায় তাকে স্বামী বলে জেনেছে।

সেই প্রতারককে কেনো মনে পড়ছে!
কেনো চোখে জল আসতে চাইছে?ভালোবাসা এতো অদ্ভুত কেনো?

চলবে……

রাজিয়া রহমান।

চন্দ্রাণী পর্ব-১৯+২০

0

#চন্দ্রাণী(১৯)
টগর বসে আছে কাদের খানের সামনে। সাদা ধবধবে একটা পাঞ্জাবি পরে কাদের খান একটা বই নিয়ে বসে আছেন।
উঁকি দিয়ে টগর দেখলো শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর লিখা দূরবীন উপন্যাসটি হাতে নিয়ে বসে আছেন তিনি।
মনে মনে ভাবলো টগর এদের বাপ ছেলের অবস্থা ও ধ্রুব আর তার বাবার মতো। ধ্রুবর বাবার নামটা কি ছিলো যেনো?
মনে পড়ছে না টগরের।আশ্চর্য, এরকম তো হয় না কখনো। মা মারা যাওয়ার আগেও তো পড়েছে টগর।এই তো সেদিন,অথচ এখনই ভুলে গেলো!
মাথার ভেতর আটকে রইলো ব্যাপারটা। ধ্রুবর বাবার নাম না জানা অবদি স্বস্তি পাবে না টগর।
আচ্ছা কাদের খানকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে?
না তা কেমন দেখাবে আবার!

এসব ভাবতে ভাবতে কাদের খান বই থেকে চোখ নামিয়ে টগরের দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি এখানে?তা তোমার গুরু কোথায়? ”

টগর লাজুক হেসে বললো, “কাকা আপনি তো সবই জানেন গ্রামের অবস্থা। নিয়াজ ভাই আমাকে পাঠিয়েছে আপনার কাছে। একজন ভালো উকিলের সাথে যাতে আপনি কথা বলে রাখেন।”

কাদের খান হাসলো। টগর অবাক হয়ে দেখছে।এই লোকের ছেলের মাথায় কতো বড় বিপদ ঝুলে আছে তিনি তা বুঝতে পারছেন না?
লোকটার হাসি সুন্দর, মুখ থেকে জর্দার খুব সুন্দর একটা ঘ্রাণ পাচ্ছে।
কাদের খান হেসে বললো, “দেখো বাপু,আমি এসবের মধ্যে নেই।আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। আমার শান্তি আমি আমার এই সঙ্গী বইয়ের মধ্যে খুঁজে পাই।আমি নিয়াজকে বলেছি তার কাজ করতে, আমার কাজ আমি করবো।সে আমার ছেলে হতে পারে কিন্তু আইনের উর্ধ্বে কেউ না।নিয়াজ যদি কোনো দোষ করে থাকে তাহলে তার শাস্তি পাওয়া উচিত তার।আমার ছেলে বলে কি সাত খুন মাফ হয়ে যাবে না-কি! ”

টগর চমকে গেলো কাদের খানের কথা শুনে। সে জানতো বাপ ছেলের মধ্যে বনিবনা নেই তাই বলে এতটা কড়াকড়ি আশা করে নি টগর।

টগর কিছু বলার আগে কাদের খান বললো, “তুমি এখন যাও,আমি পড়ছি।পড়ার সময় কোনো কথা আমি পছন্দ করি না।”

টগর উঠে দাঁড়ালো।তারপর বের হয়ে এলো।বাড়িতে এসে দেখে চন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে ঘরের সামনে। চন্দ্রকে দেখে টগরের মনটা হঠাৎ করেই ভালো হয়ে গেলো। চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বসে আছি আপনার জন্য। ”

টগর ঘরের দরজা খুলতে খুলতে বললো, “কোনো বিশেষ প্রয়োজন? ”

চন্দ্র চোখ নাচিয়ে বললো, “কেনো,বিশেষ প্রয়োজন না হলে কি আপনার সাথে দেখা করা যাবে না?”

টগর হেসে ফেললো চন্দ্রর কথা বলার একসেন্ট শুনে।
তারপর বললো, “না তা না,আপনি তো ব্যস্ত মানুষ। কোনো কাজ ছাড়া যে আমার সাথে আড্ডা দিতে আসবেন না তা আমি জানি।”

চন্দ্র বললো, “হ্যাঁ, কাজেই তো এসেছি। আপনার হাতের পিৎজা খেতে এলাম।আর হ্যাঁ, এই যে আপনার জন্য আমার মা কিছু খাবার পাঠিয়েছে। রাতে গরম করে খেয়ে নিবেন।”

টগর বক্সটা হাতে নিয়ে খুললো।পোলাও আর রোস্টের মিষ্টি একটা সুঘ্রাণ নাকে এসে নাড়া দিতেই টগর লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে বললো, “এক্সট্রিমলি সরি,রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব না বুঝলেন।এতো দারুণ স্মেল আসছে খাবারটা থেকে আমি এখনই খেতে বসে যাচ্ছি। ”

চন্দ্রর দুই চোখ আনন্দে চকচক করে উঠলো। টগরকে বসতে বলে চন্দ্র ছুটে গিয়ে কিচেন থেকে প্লেট চামচ নিয়ে এলো।
প্লেটে বেড়ে নিয়ে ওভেনে দিয়ে গরম করে নিলো।সেই ফাঁকে রান্না ঘর থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে নিজের ব্যাগে পুরে ফেললো।
টগর এক লোকমা মুখে নিয়ে বললো, “ভীষণ ভালো হয়েছে। ভাববেন না বাড়িয়ে বলছি,সত্যি বলছি।”

খাবারের স্বাদে টগর অভিভূত হয়ে গেলো। চন্দ্রর কেমন যেনো মায়া হতে লাগলো টগরের জন্য। এই মানুষটা যতই খারাপ হোক,কেউ চোখের সামনে খাবার কষ্ট পাচ্ছে চন্দ্রর তা সহ্য হবে না।তাই টগরের বাড়ি আসতে গেলে খালি হাতে আসতে ইচ্ছে করে না।চন্দ্রর ইচ্ছে করে অনেকগুলো আইটেম রান্না করে টগরকে খাওয়ায়।টগরের তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া মুখটা দেখে।
নিজের হাতে কি খায় না খায় কে জানে,ভাতটুকু যদি শান্তি মতো খেতে না পারা যায় প্রতিদিন তাহলে কি ভালো লাগে না-কি!
অথচ এই লোকটার সে সুবিধা নেই।
সৃষ্টিকর্তা কেনো মানুষকে এতো তাড়াতাড়ি বাবা মা হারা করে দেয়?মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো চন্দ্র টগরের দিকে।

টগর হেসে বললো, “আপনি কিন্তু আমার অভ্যাস খারাপ করে দিচ্ছেন। এখন আর আমার নিজের রান্না খাবার মুখে রোচে না,আপনার খাবার ছাড়া। প্রতিদিন আপনার আনা খাবার আমি কই পাবো বলেন? ”

চন্দ্র মন্ত্রমুগ্ধের মতো বললো, “আমামে রেখে দিন আপনার কাছে, আপনাকে রান্না করে খাওয়াবো প্রতিদিন আমি। ”

চন্দ্রর কথা শুনে টগর বিষম খেলো।চন্দ্রর ও ঘোর কেটে গেলো টগরের বিষম খাওয়া দেখে।তাড়াতাড়ি টগরকে গ্লাসে করে পানি এগিয়ে দিলো চন্দ্র।টগর পানি খেয়ে স্বস্তির শ্বাস নিলো।

চন্দ্র বুঝতে পারলো না সে কি বলে ফেললো যা শুনে টগর বিষম খেয়েছে!
টগরকে জিজ্ঞেস করতেই টগর হেসে ফেললো। কিছু বললো না।

চন্দ্র কিছুক্ষণ উসখুস করে বললো, “আপনার ওয়াশরুমটা?”

টগর বললো, “আমার রুমেই এটাচড আছে,ওই যে ওটা আমার রুম।”

চন্দ্র চলে এলো টগরের রুমে।বইয়ের ফাঁক থেকে ক্যামেরাটা বের করে দ্রুত নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো।তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে নিজের চোখেমুখে পানি দিয়ে বের হয়ে এলো।
কাজ উদ্ধার করে চন্দ্র বললো, “আমি আসি এবার তাহলে? ”

টগর খাওয়া শেষ করে প্লেট চামচ কিচেনে নিতে নিতে বললো, “আরেকটু বসুন না,পিৎজা খাবেন বলেছিলেন।”

চন্দ্র হেসে বললো, “আরে না,আমি এমনিই বলেছিলাম।”

টগর বললো, “চলুন আপনাকে এগিয়ে দিই,সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ”

চন্দ্র কিছু বললো না। ক্যামেরাগুলো যেভাবে রেখে গিয়েছিলো সেভাবেই আছে দেখে স্বস্তি পেয়েছে চন্দ্র।টগর টের পায় নি ক্যামেরার কথা। অবশ্য চন্দ্র এমনভাবে রেখেছে টগর আর ১ সপ্তাহ থাকলেও টের পেতো না।

কিছুটা পথ যেতেই চন্দ্র বললো, “কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?”

টগর হেসে বললো, “নিশ্চয়। ”

চন্দ্র আমতাআমতা করে বললো, “আপনার সাথে মিশলে বুঝা যায় আপনি খুব ভদ্র একজন মানুষ, শিক্ষিত। তাহলে কেনো মদের নে*শায় আকণ্ঠ ডুবে থাকেন আপনি? আমি যতোদূর জানি নিয়াজ খুব একটা ভালো মানুষ না অথচ তার সাথে আপনি মেলামেশা করেন। কেনো জানতে পারি?হতে পারে অতিরিক্ত অধিকারবোধ দেখাচ্ছি। কিন্তু না জেনে ও শান্তি পাচ্ছি না আমি।”

টগর বিমর্ষ হয়ে বললো, “কি করবো বলুন?এভাবে বেঁচে থাকা যায়?বাবাকে হারিয়েছি খুব অল্প বয়সে। মা’কে নিয়েই আমার পৃথিবী ছিলো। মা’কে হারিয়ে ফেলার পর আমার সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। আমি আসলে অনেক বেশি মা’য়ের ন্যাওটা ছিলাম।মা ছাড়া আমি একেবারে অচল হয়ে যাই।
জানেন,বড় হওয়ার পরেও আমি কখনো নিজে পছন্দ
করে একটা শার্ট পরি নি।মা আমার সব কিছু করে দিতো।আমি ছাড়া মা’য়ের ও কেউ ছিলো না। বাবা হটাৎ করে মারা যাওয়ায় মা ও আমার উপর নির্ভর হয়ে যায়। কি এক অজানা ভয়ে আমাকে চোখের আড়াল করতেন না কে জানে। এমনকি আমি মা মারা যাওয়ার পরেই সর্ব প্রথম গ্রামে আসি আমার জীবনে। তার আগে আমি জানতাম আমাদের গ্রামের বাড়ি আছে। কিন্তু ঢাকার বাড়ি ছেড়ে মা কখনো আসেন নি।নানার বাড়ি,মামার বাড়ি কারো বাড়িতে যাই নি আমি কখনো। সবাই আমাদের বাসায় যেতো ঢাকায়,আমরা কোথাও যেতাম না।
মা ভয় পেতো যদি আমার কিছু হয়ে যায়।

অথচ আমার মা আজ আমাকে ছেড়ে কোথায় শুয়ে আছে কে জানে!
আমি পুরো এলোমেলো হয়ে গেলাম।মা’কে ছাড়া আমি অচল।নিজেকে ভীষণ নিঃস্ব লাগতো। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করতো না। কষ্ট ভুলে থাকার জন্যই আমাকে এলকোহল নিতে হয়।”

চন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “আপনি নিজেও নিশ্চয় বুঝতে পারেন যে এলকোহল কোনো সমাধান না।”

টগর বললো, “বুঝতে তো পারি কিন্তু নিজেকে মানাতে পারি না। একদিন হয়তো পারবো,সেদিন একেবারে ভালো হয়ে যাবো।”

চলবে……
রাজিয়া রহমান

#চন্দ্রাণী(২০)
চন্দ্রকে বাড়ির সামনে পর্যন্ত দিয়ে এসে টগর দ্রুত পায়ে হেঁটে এলো নিয়াজের সন্ধানে। এসে দেখে নিয়াজ নেই।টগর অবাক হলো। নিয়াজ এখান থেকে কোথায় গেলো কিছু না বলে?

মনঃক্ষুণ্ন হয়ে টগর নিজের বাড়িতে এলো।মাথায় হাজারো চিন্তা খেলা করছে তার।নিয়াজের ভাবনা কিছুতেই মাথা থেকে দূর করতে পারছিল না।

চন্দ্র বাড়িতে গিয়ে আগে ভিডিও রেকর্ড দেখতে বসে গেলো।চন্দ্র নিশ্চিত ছিলো নিয়াজ নিশ্চয় টগরের বাড়িতে যাবে।
কিন্তু হতাশ হয়ে গেলো যখন দেখলো কোনো ফুটেজেই নিয়াজের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে না।
চন্দ্র আশাহত হয়ে বসে পড়লো।
মন কিছুটা খারাপ হলেও আবার মনে মনে ভালো ও লাগছে এই ভেবে যে টগর হয়তো অতটাও খারাপ না যতটা সে ভাবছে।

পরমুহূর্তেই নিজের ভাবনায় নিজে লজ্জা পাচ্ছে চন্দ্র।টগর ভালো হোক বা খারাপ তাতে তার কি আসে যায়!
সে কেনো কিশোরী মেয়েদের মতো এসব নিয়ে ভাবছে?
নিজের এই বালখিল্যতায় নিজেই লজ্জা পেলো চন্দ্র।

ল্যাপটপ নামিয়ে রেখে ছাদে চলে গেলো।মাগরিবের আজান দিবে এখন।এলো চুলে চন্দ্র ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।সিতারা বানু উঠানে মোড়া পেতে বসে পান ধুচ্ছেন।ছাদে নাতনিকে দেখে ডেকে বললেন,”লম্বা লম্বা চুলডি ছাইড়া ছাদে গিয়া খাড়াই আছস কোন আক্কেলে,আজান দিবো এখন।তাড়াতাড়ি নাইমা আয়।সোমত্ত মাইয়া,জ্বিনে আছর একবার লাগলে বিয়া সাদী হইবো আর?”

শর্মী ঘরের সামনের সিড়িতে বসে থেকে হাসতে হাসতে বললো, “না হোক বিয়ে সাদী,আমার বাপের কি কম আছে না-কি দাদী?বইসা বইসা খাইলেও আমাদের ৭ প্রজন্ম খাইতে পারবো।”

চন্দ্র হাসতে হাসতে বললো, “আমরা দুই বোন বিয়া করমু না দাদী।আজীবন বাপের বাড়িতে থাকমু।”

বলেই দুই বোন হাসতে লাগলো খিলখিল করে। সিতারা বেগম অভিমান করে বললেন,”হ,আমার পোলার অন্নধ্বংস কর দুই বোইন মিইল্লা।এতো কইরা ছেলেরে কইতাছি চন্দ্ররে বিয়া দেওনের লাইগা।বিয়ার বয়স চইলা গেলে পরে আর কেউ পুছব নি?”

শাহজাহান তালুকদার ঘর থেকে বের হতে হতে বললেন,”মা,প্রতিদিন ৫-৬টা বিয়ের প্রস্তাব আমি প্রত্যাখ্যান করে দিই আমার চাঁদের।আমার চাঁদরে তো আর যার-তার হাতে তুলে দেওন যায় না।চাঁদরে নিতে হইলে পোলারে হইতে হইবো আকাশের মতো।
সবাই কি চাঁদের যোগ্য হয় মা?”

সিতারার মুখ ভার হয়ে গেলো। মেয়ে নিয়ে এতো আহ্লাদ তার ভালো লাগে না।আশেপাশের সব মানুষ সিতারা বানুকে জিজ্ঞেস করে চেয়ারম্যানের বড় মেয়ের বিয়া হয় না ক্যান।মানুষ তো বুঝে না চেয়ারম্যান যদি পারতো তার বড় মেয়েরে বুকের ভেতরে লুকাইয়া রাখতো।
সিতারা বানু বুঝতে পারেন না চন্দ্রকে কেনো এতো বেশি ভালোবাসে বাপ মা দু’জনেই। দুই মেয়ে নিয়ে ঢাকা থেকে যেদিন শাহজাহান বাড়িতে এলো তখন চন্দ্রর বয়স ৪বছর আর শর্মীর ১ বছর। রেহানা আর শাহজাহানের বিয়ের ১২ বছর পরে চন্দ্রর জন্ম হয়।
সিতারা বানুর এখনো স্পষ্ট মনে আছে রেহানার সন্তান না হওয়ার আহাজারি কেমন ছিলো। বারবার কন্সিভ করতো আর আপনাতেই এবোরশন হয়ে যেতো।
এরপর ওরা ঢাকায় চলে যায় ডাক্তার দেখাতে। তারপর?

ভাবতেই সিতারা বানুর কান্না আসে।চন্দ্র পেটে আসার খবরটা ও শাহজাহান তাকে জানালো না,কাউকে জানালো না।
ছেলের মাথায় ঢুকছে নজর লেগে বউয়ের বাচ্চা হয় না।সিতারা বানু তখন খুব কষ্ট পেয়েছেন। ছেলে তাকেও জানালো না!
তিনি ও কি বাহিরের মানুষ যে তাকে বলা যাবে না!
কতো বড় পাষণ্ড হলে নিজের মায়ের কাছে লুকিয়ে যায় এরকম একটা সুখবর। ছেলে কি জানে না তার মা ও তো আল্লাহর কাছে কতো দোয়া করতেন ছেলের ঘরে যাতে সন্তান দেয় আল্লাহ।
চন্দ্রর ৩-৪ মাসের সময় ছেলের মুখ থেকে জানতে পারেন তার নাতনি হয়েছে।

নাতনিকে একটু দেখতে কেমন হাপিত্যেশ করেছেন অথচ ছেলে নাতনিকে নিয়ে বাড়ি আসে নি লোকে নজর দিবে বলে।
অবশ্য ছেলের ভাবনাকেও দোষ দিতে পারেন না।ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে তো ভয় পাইবোই।

আবার শর্মী হলো অথচ শর্মীর জন্মের পর জানতে পারলেন তার আরেক নাতনি হইছে।পেটে থাকতে জানতে পারেন নাই।

দুই মেয়েকে নিয়ে কি যে চিন্তা ছেলের।মাঝেমাঝে সিতারা বানু ভীষণ রাগ হতেন।বাড়ি আসার পর কাজের লোক দুইজন রাখলেন মেয়েদের দেখার জন্য।
লোকের কতো নিন্দেমন্দ তখন।মানুষ বলতো দুনিয়ায় আর কারো যেনো বাচ্চা হয় নাই। সিতারা বানু কতো দিন ছেল্রর সাথে এসব নিয়ে ঝগড়া করেছেন। আসলে তার ও হিংসে হতো।তাদের সময় একা হাতে ৫-৬টা বাচ্চা সামলে সংসারের কাজ ও করতে হতো নিজেকেই।কাজের মেয়ের কথা তো স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না।আর এখনকার বউয়েরা এতো সুবিধা ভোগ করে মানতে পারেন না তিনি তাই।

সিতারা বানুর এসব ভাবনার মধ্যে চন্দ্র এসে বললো, “তোমার অযুর পানি দাদী।অযু করে নাও।”

সিতারা বানু অযু করে ঘরে গেলেন।

রাতে বিছানায় শুয়ে টগর নিয়াজের কথা ভাবছে।কয়েকবার কল দিয়েছে নিয়াজকে,কিন্তু ফোন অফ।চিন্তা হচ্ছে টগরের ভীষণ। পুলিশ ধরে ফেলে নি তো আবার!
ভাবতে ভাবতে চোখে তন্দ্রামতো এলো তখনই ভয়ংকর একটা স্বপ্ন দেখলো।
স্বপ্নে দেখলো একটা ফুটফুটে পরীর মতো মেয়ে বাবুকে সে ঘাড়ে বসিয়ে উঠোনে ছুটোছুটি করছে আর পেছন পেছন চন্দ্র একটা শাড়ি পরে ছুটছে। চন্দ্রর হাতে একটা বাটিতে খাবার। চেঁচিয়ে চন্দ্র বলছে বাবুকে দাও ওর খাওয়া হয় নি এখনো।
বাবু খিলখিল করে হাসছে।

হঠাৎ করেই টগরের তন্দ্রা কেটে গেলো। শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসে হাঁপাতে লাগলো টগর।
কি ছিলো এটা!
এসব কি দেখছে সে!
পরমুহূর্তে মনে হলো এসব অবচেতন মনের কল্পনা। বিকেলে চন্দ্রর বলা কথাটা অবচেতন মন ভুলতে পারে নি।নিজের অজান্তেই মনের একটা অংশ হয়তো এসব নিয়ে ভাবছে এজন্যই এই স্বপ্ন।
নিজের স্বপ্নের কথা ভেবে নিজেই হাসলো।তারপর উঠে গুনগুন করে গাইতে লাগলো, “বামুন কি আর হাত বাড়ালে চাঁদের দেখা পায়?”

বাকি রাত আর টগর ঘুমাতে পারলো না। হিউম্যান সাইকোলজির একটা বই নিয়ে বসে বসে রাতটা কাটালো।

শর্মী আর চন্দ্র শুয়ে শুয়ে গল্প করছে।সেই মুহূর্তে শর্মীর ফোন বেজে উঠলো। একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছে। শর্মী রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে নিয়াজ খিকখিক করে হেসে বললো, “কেমন আছো শর্মী ডার্লিং? কি মনে করছো আমাকে পুলিশ খুঁজতেছে এই সুযোগে তুমি নিশ্চিন্ত হইবা?তোমার বাপ শান্তিতে ইলেকশন করবো?
তোমার আমার সব ছবি,ভিডিও আমি তোমার বাপেরে পাঠামু ভাবতেছি।তোমার বাপের খুব অহংকার না, সব গুড়িয়ে দিমু আমি।’

শর্মী শান্ত স্বরে বললো, ” তুমি কি চাও?”

নিয়াজ হেসে বললো, “চাই তো অনেক কিছু।তোমার তুল**তুলে দে**হ,তোমার বাপের চেয়ারটা এই দুইটা হলেই আপাতত চলে। আমি ১০০%শিওর আমার নামে পুলিশের কাছে তোমার বাপ অনেক কিছু বলছে।এজন্যই পুলিশ আমাকে খুঁজতেছে।”

শর্মী ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভয় পেলো।নিয়াজের কথা তার মাথায় ছিলো না। ভেবেছিলো পুলিশ ধরে শয়*তানকে শায়েস্তা করবে অথচ এখন দেখছে ও বেশ আরামে আছে।

নিয়াজ আবারও বললো, “রাখছি ডার্লিং, তোমার বাপকে ছবি পাঠাই নিই।”

শর্মী কিছু বলার আগেই কল কেটে গেলো। শর্মী আতঙ্কিত হয়ে চন্দ্রকে সব খুলে বললো। সব শুনে চন্দ্র ও অবাক।আব্বা যদি এসব ঘুণাক্ষরেও টের পায় কতো কষ্ট পাবে সেটা ভেবেই চন্দ্র আৎকে উঠলো।

ফোনে মেমোরি কার্ডটা লাগিয়ে নিয়াজ শিস দিতে লাগলো। নৌকার মাঝি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো, “ভাইজান কি ম্যালা খুশি?”

নিয়াজ বললো, “দূর ব্যাটা।খুশির দেখলি কি!আসল খুশি হমু আমার বাপ চেয়ারম্যান হইলে।তার জন্য যা করা দরকার তা করতেছি।”

নদীর বুকে খোলা নৌকায় বসে আছে নিয়াজ।টগরের ডেরা তার খুব একটা পছন্দ হয় নি।ভাগ্যিস তার বস তাকে এই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো বলে।
মনোযোগ দিয়ে ফোন টিপছে নিয়াজ,সেই মুহূর্তে একটা গুলি সাঁই করে এসে নিয়াজের হৃৎপিন্ড ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেলো।
ঝপাৎ করে দেহখানা নদীতে গড়িয়ে পড়লো।

চন্দ্র ছুটে গেলো বাবার রুমে।গিয়ে দরজা নক করতেই শাহজাহান তালুকদার উঠে এলেন।চন্দ্র আমতাআমতা করে বললো, “আব্বা আপনার ফোনটা একটু দিবেন,আমার একটু কাজ ছিলো। ”

আব্বার ফোন হাতে নিয়ে চন্দ্র আর দাঁড়ালো না।ছুটে এলো বোনের রুমে। দুই বোন মিলে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন নিয়াজের পাঠানো ছবি আসবে।
অথচ তারা জানে না নিয়াজ আর সেই অবস্থায় নেই।আর কখনো ছবি আসবে না।

চলবে…..
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-১৭+১৮

0

#চন্দ্রাণী(১৭)
নির্ঝর হেসে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছেন মিস শর্মীলা তালুকদার? ”
শর্মী মুখ ভোঁতা করে, “ভালো। ”
নির্ঝর বললো, “মুড অফ মনে হচ্ছে? ”

শর্মী অগ্নিশর্মা হয়ে বললো, “আপনার কি তাতে?আপনার কাজ যা,তা করুন।অন্যের মুড নিয়ে ভাবতে নিশ্চয় আসেন নি।”

নির্ঝর মাথা নাড়িয়ে বললো, “তা ঠিক।আচ্ছা আমরা কাজের কথায় আসি।নীলির সাথে আপনার কেমন সম্পর্ক ছিলো? মানে আপনাদের বন্ধুত্ব কেমন ছিলো?”

শর্মী মন খারাপ করে বললো, “নীলি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো না হয়তো কিন্তু আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো। একইসাথে কলেজে আসা যাওয়া করতাম আমরা দুজনেই। একইসাথে আসা যাওয়া করতে করতে একে অন্যর ভালো বন্ধু হয়ে যাই।নীলি প্রায় সময় আমাদের বাড়ি আসতো ছুটির দিন হলে।সকাল থেকে গল্প,আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় চলে যেতো। ”

নির্ঝর জিজ্ঞেস করলো, “আপনার ফ্যামিলি মেম্বাররা নীলিকে কিভাবে নিতো?তার আসা যাওয়া এসব।যা সত্যি তা বলবেন।”

শর্মী অবাক হয়ে বললো, “আপনি কি আমার পরিবারের মানুষদের সন্দেহ করছেন নাকি? দেখুন আমার মা নীলিকে অনেক পছন্দ করতো। নীলি এলে মা ধরে ওর চুলে তেল লাগিয়ে দিতো।
আমরা একইসাথে দুপুরে খেতাম আব্বাসহ।এমনকি আমার আব্বা তো নীলিকে কখনো একা বাড়িতে যেতেও দিতো না।বাবুল কাকাকে দিয়ে ওকে বাড়ি পাঠাতো। ”

নির্ঝর বললো, “বুঝতে পেরেছি,এজন্যই নীলির লাশ দেখে আপনার বাবা এমন ভেঙে পড়েছে।”

শর্মীর চোখ ছলছল করতে লাগলো।

নির্ঝর বললো, “নীলির কারো সাথে রিলেশন ছিলো? ”

শর্মী এক মুহূর্ত থেমে বললো, “হ্যাঁ ছিলো শফিক নামে একজনের সাথে। তবে শফিক ভাই আর যা হোক এই কাজ করতে পারে না।”

নির্ঝর বললো, “এতো কনফিডেন্স? ”

শর্মী বললো, “নীলি যেদিন হারিয়ে যায় পরদিন সকালে আপা আর আমি শফিক ভাইয়ের দোকানে যাই।আমাকে দেখে শফিক ভাই মিষ্টি করে হাসলো। উনি নিজেই বলেছেন আগের রাত থেকে নীলিকে ফোনে পাচ্ছেন না।নীলির বাড়িতে বিয়ের কথা চলছিলো।শফিক ভাই ওকে পালিয়ে যেতে ও বলেছিলো।নীলি যদি ওনার সাথে পালাতো রাতে উনি নিশ্চয় পর দিন দোকানে আসতেন না কাজে।”

নির্ঝর বললো, “আপনার আপার মনে হচ্ছে এসব ব্যাপারে বেশ ইন্টারেস্ট? ”

শর্মী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “আপনি নিশ্চয় আমার আপাকে সন্দেহ করছেন না?”

নির্ঝর হেসে বললো, “সত্যি বলতে আমি আপনাকেও সন্দেহ করছি।আমার কাজই সন্দেহ করা।তবে তাই বলে ভাববেন না ব্যক্তিগত জীবনে ও আমি এরকম।সেখানে আমি অন্য মানুষ। ”

শর্মী বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই হেসে বললো, “আপনি এতো শিওর হচ্ছেন কিভাবে শফিকের ব্যাপারে? হতে ও তো পারে ও নিজেকে সন্দেহ মুক্ত রাখতে আপনার সাথে অভিনয় করেছে?”

শর্মী ইতস্তত করে বললো, “হতে পারে হয়তো তবে আমার মনে হচ্ছে না এরকম কিছু হয়েছে। সব মানুষ তো এক না,কেউ কেউ সত্যি সত্যি ভালোবাসে।নীলির মৃত্যুর খবর শোনার পর শফিক ভাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন,উনি হাসপাতালে আছেন।”

নির্ঝর জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কিভাবে জানলেন?”

শর্মী বললো, “আপা খবর নিয়েছে।”

নির্ঝর বললো, “আপনি যেতে পারেন,দরকার হলে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসবো।”

শর্মী যেতে নিতেই নির্ঝর পেছন থেকে বললো, “কেউ কেউ কিন্তু সত্যি ভালোবাসতে পারে, আমি ও তাদের দলে।”

শর্মী পেছনে তাকিয়ে বললো, “আমাকে এসব বয়ার মানে কি?”

নির্ঝর হেসে বললো, “এমনি,জানিয়ে রাখলাম।আপনি জানেন না তো তাই।”

শর্মী আর দাঁড়ালো না।

চ্যানেল স্বদেশে বেলা বারোটায় একটা বিশেষ ভিডিও প্রচার করা হলো।কুসুমপুর নামক এক সীমান্তবর্তী গ্রামে অবাধে কেমন ড্রাগ বিক্রি হচ্ছে।
পুরো দেশের মানুষ হতবাক হয়ে দেখছে।আর এর ক্রেতারা সবাই ১৫ বছর বয়সী কিশোর থেকে শুরু। কেউ দোকানদারির আড়ালে ড্রাগ বিক্রি করছে,কেউ বা স্টেশনে কুলির কাজে আড়ালে ড্রাগ বিক্রি করছে।কেউ রিকশাচালক, কেউ ভিক্ষুক। একজন এক ছদ্মবেশে আছে।

নির্ঝর হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে। যাদের সন্ধানে সে লোক লাগিয়ে রেখেছে, আজ টিভিতে তাদের সন্ধান দিচ্ছে তাকে।অনুষ্ঠান চলাকালীন নির্ঝরের কেবিনের টেলিফোন বাজতে শুরু করলো। একের পর এক উপর মহল থেকে ফোন আসছে।

নির্ঝরের কান ব্যথা হয়ে গেলো শুনতে শুনতে। সবার এক কথআ,আজকে দিনের ভেতরেই এদের সবাইকে থানায় পুরতে হবে বলে অর্ডার দিচ্ছে।
নির্ঝর ভাবতে লাগলো, এই ভিডিও রেকর্ড করেছে কে?
চ্যানেল স্বদেশ বলছে তাদের নিজস্ব ক্রাইম রিপোর্টার এই ব্যাপারে নিজে অনুসন্ধান চালাচ্ছে।

বিড়বিড় করে নির্ঝর বললো, “এই কুসুমপুর জায়গাটার সব মানুষ কেমন মুখোশধারী বলে মনে হয়। কে ভালো আর কে অপরাধী কিছুই বুঝতে পারছি না।একে তো উপর মহলের চাপ ছিলো এতো দিন এখন আবার এই চ্যানেলের জার্নালিস্ট। এভাবে টিভিতে এসব প্রচার হলে তো জনগন পুলিশকে ভরসা করবে না।অথচ এসব চ্যানেল তাদের টিআরপির জন্য সব কিছু করতে পারে। ”

নিয়াজ টিভিতে এই অনুষ্ঠান দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেলো। মুহুর্তেই তার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো যেনো। টিভিতে যাদের গোপনে ভিডিও করে দেখানো হচ্ছে এরা সবাই তো নিয়াজের লোক।
নিয়াজের মনে হলো তার প্রাণ বুঝি এখনই চলে যাবে।পুলিশ ওদের ধরতে পারলে নিয়াজের নাম জেনে যাবে পুলিশ। এরপর?
নিয়াজ আর ভাবতে পারছে না।সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।
গতকাল রাতে টগরকে নিয়ে এদের সবার কাছে গিয়েছিলো নিয়াজ,আর আজকেই এই নিউজ।কে গতকাল রাতে তাদের পিছু নিয়েছিলো?
না-কি টগর এই কাজ করেছে?কিন্তু টগর কেনো করবে?ওর ও তো রোজকার করার পথ এটা।

নিয়াজের ফোন বাজছে।ভয়ে নিয়াজ রিসিভ করছে না।চেক না করে ও নিয়াজ বুঝতে পারছে কে কল দিয়েছে।বসকে কিভাবে সামলাবে নিয়াজ?

চলবে….
#চন্দ্রাণী(১৮)
চন্দ্র দুপুরে খেতে বসে বললো, “আব্বা,কাদের খানের ছেলেটারে তো পুলিশ খুঁজতেছে শুনছেন? ”

শাহজাহান তালুকদার চিন্তিত হয়ে বললেন,”হ্যাঁ, শুনছি রে মা।কি যে হচ্ছে এলাকায় এসব কিছুই বুঝি না।সামনে নির্বাচন এরই মধ্যে দেখ কতো ভেজাল। একের পর এক ঝামেলা লেগেই আছে। কি হবে কে জানে!”

শর্মী বললো, “আপনি এতো চিন্তা কইরেন না আব্বা।গ্রামের সব মানুষ জানে আপনি কেমন মানুষ। আপনি চেয়ারম্যান হইলে সবার কতো সুবিধা তা কি মানুষের অজানা না-কি!
আপনার মতো কয়জন আছে যে গ্রামের মানুষের কথা এতো চিন্তা করে। রাতে হইলে আপনি বাবুল কাকাকে নিয়ে গ্রামে পরিদর্শনে যান।কোনো দিন তো দেখি নি সরকারি কোনো জিনিস বাড়িতে আমাদের জন্য রাখতে।সবই তো মানুষের জন্য করেন।”

শাহজাহান তালুকদার মুচকি হেসে বললো, “আমার ছোট মেয়েটা বড় বেশি সহজ সরল। মা রে,এখন যুগটাই এরকম যে কারো হাতে যদি ১হাজার টাকার একটা নোট ধরিয়ে দেয় কেউ,মানুষ তাকেই ভোট দিবে যে টাকা দিয়েছে। ১৫ বছর ধরে আমি কি করেছি একটা ১হাজার টাকার নোটের কাছে আমার সব পরিশ্রম বিক্রি হয়ে যাবে।মানুষ এটা ভাববে না এরপর কি হবে,আজকের ১হাজার টাকাই সবকিছুর উর্ধ্বে চলে যাবে। ”

চন্দ্র বললো, “আব্বা,এতো চিন্তার কি আছে আপনার? ”

শাহজাহান তালুকদার শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন,”আল্লাহ আমারে একটা ছেলে দিছে অথচ তার খেয়াল রাখা লাগে অন্যদের।এই যে আমার নির্বাচন, ও যদি সুস্থ থাকতো ও নিজেই তো আমার নির্বাচনের কাজে সাহায্য করতো। নিজের মানুষ বাহিরের মানুষ দিয়ে কাজ করানোর অনেক ফারাক রে মা।”

চন্দ্রর মুখ মলিন হয়ে গেলো বাবার কথা শুনে। শুভ্র আপনমনে খেয়ে যেতে লাগলো।
নরম সুরে চন্দ্র বললো, “আপনি চিন্তা কইরেন না আব্বা।আপনার ছেলে হতে পারি নি হয়তো কিন্তু মেয়ে বলে যে হাতে চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকবো তেমন মেয়ে হই নি।
এই হাতে যেমন ১০০ মানুষের জন্য রাঁধতে পারি তেমনি এই হাতেই ১০০ মানুষকে কন্ট্রোল করতে পারি।
এই মুখ দিয়ে যেমন মানুষের সাথে মিষ্টি করে কথা বলতে পারি তেমনি এই মুখেই আবার প্রতিবাদ করতে পারি আব্বা।”

শাহজাহান তালুকদার অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।এই মেয়েটাকে কেমন অচেনা লাগছে তার আজ।কেমন শান্ত কণ্ঠ, দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর।
এই মেয়ের মধ্যে কার ছায়া দেখতে পাচ্ছেন যেনো তিনি!
বহু বছর ধরে যাকে ভুলে থাকতে চেয়েছেন তাকেই কেনো বারবার মনে পড়ছে!

চন্দ্র খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে গেলো। শুভ্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো বোনের চলে যাওয়ার দিকে।রেহানা আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলো।

দুপুরের খাবারের বেশ খানিক পরে চন্দ্র,শর্মী,শুভ্র বের হলো গ্রামের রাস্তায়। ঠিক করলো গ্রামের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু করবে।হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের শেষ মাথায় গেলো। এক বাড়ি এক বাড়ি করে তিন ভাই বোন ঢুকছে আর লিফলেট বিতরণ করছে।
চন্দ্র মিষ্টি মুখে সবার সাথে হেসে কথা বলছে।বৃদ্ধাদের সাথে বসে পান সুপারি খাচ্ছে।
শর্মী তাকিয়ে ভাবতে লাগলো ও কখনো আপার মতো এরকম সাহসী হতে পারবে কি-না! ওর মনের বল কখনো এরকম হবে কি-না! আপা কি সুন্দর করে সব ম্যানেজ করতে পারে।

এক দিনেই ওরা ১০ বাড়িতে যাবে বলে ঠিক করলো। ১০ টা বাড়িতে যাওয়ার পর ক্লান্ত হয়ে আবার বাড়ির দিকে পা বাড়ালো তিন জন।এক এক বাড়িতে প্রায়৭-৮ টা,১০-১২ টা করে ঘর আছে।এতো মানুষের সাথে কথা বলতে অনেক এনার্জি লাগে।শর্মী কথা না বলেও ক্লান্ত হয়ে গেলো অথচ চন্দ্র কেমন ফিট এখনো। কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই তার মধ্যে।
শর্মী বললো, “আপা আজকে আর না।আবার আগামীকাল। ”

চন্দ্র হেসে বললো, “আচ্ছা অসুবিধা নেই।শোন,আমি একটা প্ল্যান করেছি কিন্তু।”

শর্মী জিজ্ঞেস করার আগেই চন্দ্র বললো, “গ্রামে একটা খেলাধুলার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করবো ।নির্বাচন তো চলে এলো।”

শর্মী জিজ্ঞেস করলো, “কেমন প্রতিযোগিতা? ”

চন্দ্র বললো, “আরে,ইউটিউবে, ফেসবুকে দেখিস না গ্রামের মানুষদের নিয়ে নানা ধরনের খেলার ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের টার্গেট হবে ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী মহিলাদের আর অপশনাল হিসাবে হবে বাচ্চাদের। ”

শর্মী জিজ্ঞেস করলো, “পুরুষরা বাদ যাবে কেনো?”

চন্দ্র হেসে বললো, “পুরুষ মানুষ যেকোনো মুহূর্তে রঙ বদলে ফেলতে পারে তাই।তাছাড়া, পুরুষেরা মোটামুটি মাথায় সেট করেই রাখে কাকে ভোট দিবে তারা।মহিলারা যেহেতু এসব পলিটিক্স কম বুঝে তাই ওরা যেখানে আনন্দ পায়,ভালো কোনো উপহার পায়,তাদের বাচ্চাদের মুখে হাসি দেখতে পায় সেদিকে ঝুঁকে যায়।
আমরা এদের টার্গেট করে প্ল্যান করবো বসে কেমন ধরনের খেলার ব্যবস্থা করা যায় আর উপহার কি হবে।”

শর্মী হেসে বললো, “আপা,তুই আসলেই জিনিয়াস। আমার গোবর মাথায় এতো বুদ্ধি নেই।”

চন্দ্র হাসলো।টগরের সাথে দেখা করতে হবে একবার তার।

টগর চিন্তিত হয়ে নিয়াজের সাথে কথা বলছে।নিয়াজের নামে সার্চ ওয়ারেন্ট বের হয়েছে। নিয়াজ আছে আপাতত টগরের সাথে এক গোপন আস্তানায়।

টগর টেবিলে আলতো করে চাপড় দিয়ে বললো, “এটা ঠিক কিভাবে হলো আমি এখনো বুঝতে পারছি না। আমরা ঠিক যেখানে যেখানে গিয়েছি ঠিক সেখানে সেখানেই গেলো ওই সাংবাদিক।
অন্য কোনো কাউকে কিন্ত দেখায় নি, আবার আমাদের লিস্টের কেউ বাদ ও যায় নি।
কেউ কি আমাদের পিছু নিয়েছিলো তাহলে?
নিয়াজ চমকে উঠে। আসলেই তো!
তার তো শত্রুর অভাব নেই।হতেও তো পারে।

চলবে…..
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-১৫+১৬

0

#চন্দ্রাণী(১৫)
রাস্তা থেকে বাড়ি খানিকটা দূরে। টগর চন্দ্রকে হাসানোর জন্য বিভিন্ন গল্প করছিলো আর চন্দ্র মনে মনে ভাবছিলো,”কে বলবে এই হাসিখুশি প্রাণবন্ত ছেলেটা ক্রিমিনাল,নেশাখোর? ছন্নছাড়া হয়ে গেলে কি মানুষ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না আর? ”

টগর বিরক্ত নিজের উপর নিজে। একটা মেয়েকে ইমপ্রেস করা এতো টাফ?
আগে তো মনে হয় নি এরকম।কতো মেয়েই তো একবার একটা পজিটিভ সাইন পাবার অপেক্ষায় থাকতো। অথচ এই মেয়েকে কি-না সামান্য কফি খাওয়াতে রাজি করাতে গিয়ে ঘাম ছুটে গেলো, সেই সাথে কতো নাটক যে করতে হলো!
উফ বাবা!
কেমনে মানুষ প্রেম করে? কতটা অভিনয় প্রতিভা থাকলে মানুষ প্রেম করতে পারে টগর তাই ভাবছে।

চন্দ্রর কেমন আনইজি লাগছে। সকালে এসেছিলো তখন ইন্সপেক্টর নির্জর সাথে ছিলো, এখন আর কেউ সাথে নেই।এই লোকটা যদি চন্দ্রকে মেরে ফেলে?
অথবা যদি নিয়াজকে খবর দেয়?
কোন ভরসায় এলো চন্দ্র এখানে? বাড়িতে কাউকে তো বলে ও আসে নি যে এই বাড়িতে আছে।

নিজের বোকামির জন্য নিজের চুল নিজের ছিড়তে ইচ্ছে করছে চন্দ্রর।টগর লাউটা হাতে নিয়ে সোজা রান্নাঘরে চলে গেলো। তারপর চন্দ্রকে বসতে বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।সুপারি বাগানটার পরে টগরের ছোট চাচার বাড়ি।ওই বাড়িতে গিয়ে চাচাতো বোন রিমিকে ডেকে আনলো।

চন্দ্র একা একা বসে রইলো। তার ভীষণ ভয় হচ্ছে। টগর ঘর থেকে বের হতেই চন্দ্রর মনে হলো ও বুঝি নিয়াজকে খবর দিতে গেছে।
কেমন আতংকিত লাগছে চন্দ্রর।

নিজেকে নিজে সাহস দিয়ে চন্দ্র বললো, “এতো ভেঙে পড়ছো কেনো?এর চাইতে দুঃসাহসিক কাজ ও তো তুমি করেছো চন্দ্র।শান্ত হও।”

মন বারবার ভয় পাচ্ছে অথচ মস্তিষ্ক বারবার বলছে কিছু হবে না,তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।

মন ও মস্তিষ্কের এই দোলাচলে ভুগতে ভুগতে টগর ফিরে এলো। রিমি চন্দ্রকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। টগর বললো, “আমার মেহমান উনি।একা একা বোর হবে ভেবে তোকে নিয়ে এলাম।তোরা গল্প কর,আমি কফি নিয়ে আসছি।”

রিমি তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। চন্দ্র বিব্রত হয়ে বললো, “কেমন আছেন আপনি? ”

রিমি বিড়বিড় করে বললো, “ভালো আছি,আপনি? ”

চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কি নাম আপনার?”

রিমি বললো, “রিমি,আপনার নাম?”

চন্দ্র বললো, “আমি চন্দ্রাণী তালুকদার।”

রিমি তখনও হতভম্ব। টগর ভাইয়ের ঘরে একটা মেয়ে,কিছুতেই রিমি হিসেব মেলাতে পারছে না।এই মেয়েটাকে রিমি চেনে ও না।দেখে মনে হচ্ছে শহরের মেয়ে।কথাবার্তা,ভাবভঙ্গি সবই আলাদা।

রিমি এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, “আপনি কি টগর ভাইয়ের স্পেশাল কেউ?”

চন্দ্র বুঝতে না পেরে বললো, “কেমন? ”

রিমি গলা নামিয়ে বললো, “লাভার না-কি আপনি ওনার?”

চন্দ্র লজ্জিত হয়ে বললো, “আরে না,কি বলছেনে এসব?”

রিমি অবিশ্বাসের সুরে বললো, “মিথ্যা কথা কইবেন না আপা।কেউ না হইলে টগর ভাই এমনে এমনে কাউরে বাড়িতে আনে?আবার তার লাইগা কফি ও বানাইতে যায়?টগর ভাই তার ঘরে কাউরে জায়গা দেয় না।আমাগোরে ও না।মাঝেমাঝে আমার মা, আমি আসি এই বাড়িতে।যতই চেষ্টা করি একটু কিছু করে দেওয়ার,উঠান বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে দেওয়ার, ঘরটা মুছে দেওয়ার কিছুতেই উনি রাজি হন না।এমনকি গল্প করতে ও আসতে দেন না কাউরে।
একটা কাজের মেয়েও রাখতে চান না।পুরাই মহিলা মানুষ এভয়েড করে চলেন। অথচ সেখানে আপনাকে নিজে নিয়ে এলো?কিছু না কিছু তো আছেই।”
চন্দ্র হেসে বললো,”বিশ্বাস করুন,এরকম কিছুই না।উনি আমার পরিচিত শুধু। তাছাড়া এক গ্রামের মানুষ যখন একজন অন্যজনের বাড়ি আসতেই পারে। ”

টগর রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে কা*টা জায়গা বরাবর লাউটা আলাদা করে ফেললো। তারপর দ্রুতহাতে সবগুলো প্যাকেট বের করে নিলো।লাউটা আবারও আগের মতো জোড়া দিয়ে রেখে কফি বানাতে বানাতে মনে পড়লো এই লাউ যখন ওরা বাড়িতে নিয়ে রান্না করার জন্য কা*টতে যাবে তখন তো বুঝা যাবে এটা আগেই কাটা ছিলো।ফ্রিজ থেকে ফ্রোজেন করে রাখা পিৎজা বের করে ওভেনে দিলো টগর।
তারপর রান্নাঘরের দরজা খুলে দিলো যাতে ওদিকে শব্দ যায়।এরপর তাকের উপর থেকে শিল/পাটা ফেলে দিলো লাউয়ের উপর। মুহূর্তেই খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেলো লাউটা।

ধপ করে ভারী কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে রিমি আর চন্দ্র দুজনেই ছুটে গেলো রান্নাঘরের দিকে। গিয়ে দেখে টগর অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

চন্দ্রকে দেখে লজ্জিত হয়ে বললো, “এক্সট্রিমলি সরি চন্দ্রাণী,আসলে আমার সাথে ধাক্কা লেগে পাটাটা পড়ে গেলো নিচে।আপনার লাউটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। ”

চন্দ্র উদ্বিগ্ন হয়ে বললো, “না না,ছি!ওসব নিয়ে ভাববেন না।আপনার কোথাও লাগে নি তো?আপনি ঠিক আছেন?”

টগর হেসে বললো, “আমি ঠিক আছি।প্লিজ কিছু মনে করবেন না আপনি। ”

চন্দ্র হেসে বললো, “কি যে বলেন। সামান্য একটা লাউ ছিলো।”

টগর মনে মনে বললো, “আপনার কাছে যেটা সামান্য লাউ আমার কাছে সেটা অসামান্য জিনিস। ”

পিৎজা বেক হতেই ওভেন থেকে বের করে নিলো টগর। তারপর ট্রে-তে করে কফি,পিৎজা সাজিয়ে সার্ভ করলো।
রিমি তখনও অবাক। টগর ভাই আজ প্রথম তার হাতের পিৎজা খাওয়াচ্ছে তাকে।অথচ কতো দিন ওরা সবাই মিলে বলেছিলো কখনোই রাজি হয় নি।রেষ্টুরেন্ট থেকে হোম ডেলিভারিতে ওদের বাড়ি পাঠিয়েছে। সবসময় বলতো আমার ছন্নছাড়া জীবন গুছিয়ে দিতে যে আসবে আমার জীবনে,তাকে খাওয়াবো আমার নিজের হাতের পিৎজা।
এই কি সেই তাহলে?

কফি খেতে খেতে চন্দ্র বললো, “আপনি পিৎজা ও বানাতে পারেন?”

রিমি ফোঁড়ন কেটে বললো, “আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না,ভাইয়া কখনোই ওনার বানানো পিৎজা আমাদের কাউকে খাওয়ায় নি।সবসময় বলতো যে তার বউ হবে তাকে খাওয়াবে শুধু।আজকে আপনার সুবাদে খেতে পারলাম। ”

টগর আড়ষ্ট হয়ে গেলো রিমির কথা শুনে। এটা ঠিক যে তার একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো এটা।কিন্তু আজকে চন্দ্রকে বাসায় এনে শুধু কফি খাওয়াতে ইচ্ছে করলো না। তাই বলে রিমি এরকম কিছু ভেবে নিবে তাও টগরের ধারণায় ছিলো না।

চন্দ্র বিব্রত হয়ে বললো, “আমি উঠি,বাসায় চিন্তা করবে।”

টগর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “চলুন,আপনাকে এগিয়ে দিই।রিমি,তুই চলে যা।”

রিমি বের হতে হতে বললো, “উনি কে টগর ভাই?”

টগর হেসে বললো, “চিনিস না তো তুই ও?উনি চেয়ারম্যান সাহেবের বড় মেয়ে।অবশ্য গ্রামে থাকে না উনি তাই চিনিস না। ”

চন্দ্র হাটতে হাটতে ভাবতে লাগলো টগরের কথা। ছেলেটাকে যতটা খারাপ ভেবেছে তা না।অনেক ভদ্র মনে হচ্ছে। অন্তত একা বাসায় চন্দ্রর খারাপ লাগবে ভেবে একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছে এই ব্যাপারটা চন্দ্রর ভীষণ ভালো লেগেছে। মানুষটার সবই ভালো অথচ কেনো এসব খারাপ কাজে জড়িয়ে গেলো?
অথচ এরকম একজন লয়্যাল মানুষ সব মেয়েই এক্সপেক্ট করে।

টগরের ভীষণ রিল্যাক্স লাগছে।কাজটা যতটা কঠিন হবে ভেবেছিলো ততটাই সহজ হয়েছে।পথেই ফোন এলো টগরের।রিসিভ করতেই নির্ঝর বললো, “টগর বলছো?”

টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “হ্যাঁ বলছি,বলুন।”

নির্ঝর বললো, “আচ্ছা, তোমার বাবার যে স্বাভাবিক মৃত্যু হয় নি জানো তুমি? ”

টগর শান্ত স্বরে বললো, “হ্যাঁ জানি।”

নির্ঝর বললো, “আমাকে তো বল নি এই কথা? আমি তো জানতাম তোমার বাবা স্বাভাবিকভাবেই মারা গেছেন।”

টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “আপনি তো জিজ্ঞেস করেন নি।আর এটা বলার মতো কোনো ঘটনা না।সেই সময় পুলিশ তদন্ত করে কোনো কিছু পায় নি।”

নির্ঝর বললো, “এই সময় পেতে ও পারে টগর। ”

টগর একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, “আমার আর কোনো আশা নেই এসব ব্যাপারে। আমার মা থাকতে যদি জানা যেতো তাহলে হয়তো আমার আগ্রহের অন্ত থাকতো না।আমার মা এই কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছেন। এখন আর এসব জেনে কি হবে বলেন?আমার বাবা মা কেউ-ই ফিরে আসবে না।দুনিয়ার আদালতের বিচার আমার আর চাই না।বিচার হবে ওই দুনিয়ায় গেলে।প্রতিটি ধূলো কণা পরিমাণ সবকিছুর বিচার হবে।”

নির্ঝর বললো, “তুমি না চাইলেও আমি এর তদন্ত করবো।”

চলবে…

রাজিয়া রহমান

#চন্দ্রাণী(১৬)
শর্মী ফেসবুকে নিজের একটা ছবি আপলোড করলো। সাদাকালো একটা ছবি।এক গোছা চুল আলগোছে বাম গালের উপর ছড়িয়ে আছে। কানে গোঁজা একটা ফুল।

নির্ঝর মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ছবিটির দিকে।একটা মেয়ে এতটা স্নিগ্ধ কেনো হবে?যেনো আকাশে উড়ে বেড়ানো মেঘ,কেমন শান্তি শান্তি লাগে তাকালেই।নির্ঝর কমেন্ট করলো,”কারো সাদাকালো ছবি,কারো জীবনের রঙিন স্বপ্ন হয়ে ধরে দেয়।”

কমেন্টটা নিয়াজের নজরে আসে। শর্মী ছবি আপলোড করে আর কমেন্ট চেক করে নি। কাজে ছিলো।বিকেলে হঠাৎ কল আসায় কল রিসিভ করে চমকে উঠলো শর্মী।নিয়াজ নতুন একটা নাম্বার থেকে কল দিয়েছে তাকে।হ্যালো শব্দটা শুনে শর্মীর কেমন সারা শরীর কেঁপে উঠলো।

এক মুহূর্তের জন্য ভালো লাগলেও পরক্ষণে বিষের মতো জ্বালা ধরে উঠলো সর্বাঙ্গে যেনো।অত্যন্ত কর্কশ গলায় বললো, “কে আপনি? কাকে চাই?”

নিয়াজ খিকখিক করে হেসে বললো, “চিনতে পারো নি ডার্লিং? তোমার ভা*তার বলছি।”

শর্মী কেমন গা ঘিনঘিন করতে লাগলো এই ধরনের বাক্য শুনে।অথচ এই লোকটা কেমন মুখোশ পরে শর্মীকে ভালোবাসায় মজিয়েছিলো।

নিজেকে শান্ত রেখে শর্মী বললো, “আমি এখন আর এসব কুত্তা পালি না।”

নিয়াজের গালে যেনো জুতার বাড়ি মেরেছে এমন ফিল হলো। শর্মী এই ধরনের কথা বলতে পারলো?
নিয়াজের মাথায় রক্ত উঠে গেলো।বিড়বিড় করে বললো, “শা*লীর তেজ দেখি বাড়তেছে দিনদিন।পেটে অবৈধ বাচ্চা আসছে,মনে ভয় আসে নাই এখনো? ”

শর্মী হেসে বললো, “আমি বিশ্বাস করেছিলাম,আমার আল্লাহ তো জানে সেটা। আমার চিন্তা না করলেও চলবে।”

নিয়াজ খিকখিক করে বললো, “ক্যান,নতুন ইন্সপেক্টর কি ভালো করে চিন্তা করে না-কি? শালার চেয়ারম্যানের মাথায় সব জিলাপির প্যাচ।ইন্সপেক্টরকে হাত করতে এবার নিজের মেয়ে লাগাই দিছে।”

শর্মী রেগে গিয়ে বললো, “আমি তো দেখছি সেলিব্রেটি হয়ে গেছি,মানুষের কতো আজাইরা সময় থাকলে বসে বসে আমাদের ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করে। তবে আমার না এতো সময় নেই।আশেপাশে অনেক কুকুর আছে তো,তাদের ঘেউঘেউ অনেক শুনি।তাই ফোনে আবার ঘেউঘেউ শোনার ইচ্ছে নেই।রাখছি।”

কল কেটে শর্মী নাম্বার ব্লক করে দিলো।তার কেমন শান্তি শান্তি লাগছে এভাবে জবাব দিতে পেরে।যেমন কুকুর তেমন মুগুর না হলে হবে না।একটা বিশ্বাসঘাতককে কেনো সুযোগ দিবে?

কিন্তু ইন্সপেক্টরকে নিয়ে এসব কথা কেনো বললো নিয়াজ?

দেয়ালে ঘুসি মেরে নিয়াজ একটা গালি দিলো শর্মীকে।এতো তেজ তার?দুই দিন আগেও যেই মেয়ে ফোন করে কান্নাকাটি করতো তার এতো বদল কিভাবে?
কিচ্ছু হচ্ছে না নিয়াজের প্ল্যান মতো। ভালো লাগছে না নিয়াজের কিছু।সব গুবলেট হয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিলো শর্মীর ব্যাপারটা নিয়ে একটা ধামাকা হবে কিন্তু এখনো কিছুই হচ্ছে না। শর্মী কি তাহলে এবোর্শন করিয়ে ফেললো?
আবার ভেবেছিলো নীলির লাশ দিয়ে চেয়ারম্যানের ব্যাপারে মানুষের মনে সন্দেহ ঢুকাবে কিন্তু তাও হলো না।উল্টো সবাই বলাবলি করছে চেয়ারম্যান এই কাজ কিছুতেই করবে না।কেউ তাকে ফাঁসাতে চাইছে।

নিয়াজের কেমন অশান্তি লাগছে।মনে হচ্ছে কিছুই করতে পারছে না সে।
সব মাল ডেলিভারি দিয়ে টগর এলো নিয়াজের সাথে দেখা করতে।গেঞ্জির ভেতর থেকে একটা বোতল বের করে খুলে চুমুক দিয়ে খেয়ে নিলো অর্ধেকটা। তারপর বললো, “বুঝলেন ভাই,এই দুনিয়ায় কোনো শান্তি নাই।শান্তি শুধু এই ম**দের বোতলে আছে।”

নিয়াজ বিরক্ত হয়ে বললো, “বাজে বকিস না।মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।”

টগর হেসে বললো, “একটা বোতল খোলো, সব মিটে যাবে।”

নিয়াজ কিছু বললো না।টগর পুরো বোতল শেষ করে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লো। নিয়াজ দুই তিন বার পা দিয়ে লাথি দিয়ে ডাকলো।টগরের হুঁশ হলো না।

টেবিলের উপর রাখা নিয়াজের ফোনটা বাজতেই নিয়াজ রিসিভ করতে এগিয়ে গেলো।

ওপাশ থেকে একটা ভারী স্বর ধমকের সুরে বললো, “গাছের ও খাবে,তলার ও কুড়াবে?মাল কিভাবে পালটায়?কে পালটায়?বেশ কয়েকদিন ধরে এই কমপ্লেইন আসছে।”

নিয়াজ আমতাআমতা করে বললো, “বস,আমি নিজেও বুঝতেছি না।”

ওপাশ থেকে রাগী মানুষটা বিরক্ত হয়ে বললো, “এভাবে হলে তোমাকে তো রাখা যাবে না।”

নিয়াজ মিনমিন করে বললো, “আমি আমার পুরো সিস্টেম চেক করতেছি বস।আমার একটা আবদার ছিলো আপনার কাছে। ”

ওপাশের মানুষটা বললো, “আগে নিজের সিস্টেমের সমাধান কর এরপর আমার সাথে কথা বলতে এসো।”

খট করে নিয়াজের মুখের উপর ফোন কেটে গেলো।নিয়াজ মুখ ভোঁতা করে বসে রইলো।মাথায় ঢুকছে না কাকে সন্দেহ করবে সে?
তার সাপ্লায়ার তো ৮ জন।এদের মধ্যে কে প্রতারণা করছে?
কিভাবে বুঝবে নিয়াজ?

টগরের দিকে চোখ যেতেই নিয়াজ আবারও গিয়ে দু-তিনটে লাথি দিয়ে ডাকতে লাগলো। সাড়া না পেয়ে এক মগ পানি এনে ঢেলে দিলো টগরের গায়ে।টগর লাফিয়ে উঠে বসতেই নিয়াজ বললো, “আমার একটা হেল্প লাগবে তোর।”

টগর দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বললো, “কি হেল্প?”

নিয়াজ কিছুক্ষণ ভেবে বললো, “আমার সাথে কে প্রতারণা করতেছে সেটা বের করতে হবে খুঁজে। আমি এই দায়িত্ব তোকে দিলাম।”

টগর টলতে টলতে বললো, “ওক্কে বস,কাজ হয়ে যাবে।আমাকে একটা সিগারেট দিতে পারেন?”

নিয়াজ বললো, “দিচ্ছি এনে।”

নিয়াজ বের হয়ে গিয়ে টগরের জন্য সিগারেট নিয়ে এলো।এই মাতালটার ব্রেইন ভালো নিয়াজ জানে।মাতাল ম*দের লোভে সব করতে পারে।
সিগারেট ধরিয়ে টগর বললো, “আমার সাথে আপনি ও যাবেন কিন্তু,এক সাথে যাবো।আমি তো আপনার লোকদের চিনবো না।”

নিয়াজ বললো, “বেশ,তাহলে রাতে বের হবো।”

রাতে টগর আর নিয়াজ দুজনেই গেলো।নিয়াজ আড়ালে থাকলো,টগর কাস্টমার সেজে সবার থেকে মা*ল নিলো।
একজনের ব্যবসা এক স্পটে। টগর ভাবতো শুধু তার মতো বাউন্ডুলেরাই এসব করছে অথচ এখন দেখছে এদের মধ্যে কেউ কেউ আছে অতি ভদ্রলোক।

চেক করে দেখে সবার মাল-ই ভালো, অরিজিনাল মাল।
নিয়াজ এক দলা থুথু ফেলে বললো, “শা*লারা,সবদিন মনে হয় এরকম দু নাম্বারি করে না।”

টগর বললো, “আমারে তো চেক করলেন না।আমি ও তো হইতে পারি।”

নিয়াজ মনে মনে বললো, “তুই যে জাত মাতাল,নিজেই মানুষরে নেশা করতে কস।তুই আবার কি নকল মাল বেচবি। ”

মুখে বললো, “তোরে পরীক্ষা সবার আগে করছি। ”

টগর হাঁ হয়ে গেলো শুনে।

পরের দিন সকাল বেলা চন্দ্র টগরের বাসায় গেলো টগরের জন্য নাশতা বানিয়ে নিয়ে। আজ সাথে শর্মীকে নিয়ে গেলো।
টগর সবেমাত্র কফিতে চুমুক দিচ্ছে।পরনে একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর খালি গা।
দরজা নক হতেই টগর উঠে দরজা খুললো।মুহূর্তেই
লজ্জায় লাল হয়ে গেলো টগর চন্দ্রকে দেখে।চন্দ্র চোখ বন্ধ করে বললো, “আমি চোখ বন্ধ করে রাখছি কিন্তু,আপনি নার্ভাস হবেন না।”

এক ছুটে গিয়ে টগর টি-শার্ট পরে এলো।তারপর মুচকি হেসে বললো, “আসুন ভেতরে। ”

চন্দ্র হাসতে হাসতে বললো, “আসলে আমার বোন যখন শুনলো আমি গতকাল আপনার সাথে এসে গল্প করেছি ও বায়না শুরু করলো ওকে ও নিয়ে আসতে হবে।গতকাল আমি রান্না করেছি শুনে আজ আপনার জন্য নাশতা বানিয়ে এনেছে ও নিজেই।আমি জানি আপনি বিব্রত হবেন তার জন্য আগেই বলছি আমার বোন আমার মায়ের মতো। আমার মা সবাইজে রান্না করে খাওয়াতে পছন্দ করে। আমি ও করি আমার বোন ও করে। তাই শুরু করলো আসবে এখানে।আপনি কষ্ট করে আপনার ওই কাজিনকে ডেকে আনুন ন্স গতকাল যিনি এসেছিলেন।”

টগর হতভম্ব হয়ে বললো, “ঠিক আছে।”

বের হয়ে টগর মনে মনে বললো, “এদের কি মাথা খারাপ না-কি? এতো গায়ে পড়া স্বভাব কেনো?আমি কি বলেছি আসতে?”

টগর বের হতেই চন্দ্র ছুটে গেলো টগরের রান্নাঘরে। রান্নাঘরের উপরের শেল্ফের ওপর একটা ছোট ক্যামেরা ফিট করে আরেক ছুটে গেলো টগরের রুমে।
শর্মী বাহিরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলো।

টগরের রুমের চারদিকে খুঁজতে খুঁজতে চন্দ্র দেখলো একটা বইয়ের সারি টগরের আলমারির উপরে।সেখানে একটা বইয়ের ভেতর আরেকটা ক্যামেরা রেখে এলো চন্দ্র।
তিনটি ক্যামেরা নিয়ে এসেছে।শেষ ক্যামেরাটা সেট করার আগেই টগর চলে এলো।

ভীষণ বিরক্তি নিয়ে টগর কথা বলতে লাগলো। চন্দ্র মনে মনে হাসলো।টগরের বিরক্তি চন্দ্র স্পষ্ট বুঝতে পারছে।অথচ তার কেমন জানি ভালো ও লাগছে টগরকে বিরক্ত করতে।
চন্দ্র বেশ খানিক সময় কাটিয়ে বের হলো শর্মীকে নিয়ে। টগর রিল্যাক্স মুডে চন্দ্রর আনা বক্সটা নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে বসলো। এরপর ঢাকনা খুলতেই দেখে ঘি দিয়ে ভাজা পরোটার পাশে গরুর মাংস ভুনা।পরোটা র‍্যাপিং করে এনেছে যাতে ঝোলে মাখামাখি না হয়ে যায়।

টগরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বহুদিন পর কেউ তাকে এভাবে যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। মেয়েটার প্রতি বিরক্ত হলেও রান্না খেয়ে টগরের বিরক্তি মুছে গেলো।গরুর মাংসের স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো।
টগরের মনে হলো এটা চন্দ্রর রান্না।গতকাল কোনো এক ফাঁকে টগর বলেছিলো ঝালঝাল করে গরুর মাংসের ভুনা তার পছন্দ।
সত্যি সত্যি আজ তাই নিয়ে এসেছে মেয়েটা।

যেতে যেতে পথে শর্মী বললো, “আপা,রান্না করলি তুই,আমার নাম দিলি কেনো?”

চন্দ্র হেসে বললো, “পাগল, আমাকে নয়তো হ্যাংলা মেয়ে ভাববে।মনে করবে আমি বুঝি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তাই তার জন্য এসব করছি।”

শর্মী হেসে বললো, “এতো উতলা হয়ে কেনো তবে সাত সকালে বাজার থেকে তাজা মাংস আনালি?ফ্রিজের মাংস রান্না করিস নি তাজা মাংসের স্বাদ আলাদা বলে। ”

চন্দ্র বিরক্ত হয়ে বললো, “বেশি বুঝিস তুই? আমি আমার কাজ করছি।আর মানুষ হিসেবে মানবতা,অথবা বলতে পারিস যেহেতু ওনার মা নেই তাই একটু মায়া হচ্ছিলো বলেই এটুকু করেছি।”

শর্মী হাসলো।সে জানে তার বোনের মনটা অনেক নরম।কারো মা বাবা নেই শুনলে চন্দ্র ভীষণ মন খারাপ করে। কিন্তু কেনো জানি তার মনে হচ্ছে এখানে অন্য কিছুও আছে।
দুই বোন এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে বাড়ি এসে দেখে নির্ঝর এসেছে। নীলির ব্যাপারটা নিয়ে শর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছে।
শর্মী মুখ ভোঁতা করে বসলো নির্ঝরের সাথে কথা বলতে। এই লোকটার কমেন্ট সে রাতে দেখেছে।দেখে মনে হয়েছে লোকটা ভীষণ বাজে।শর্মী তক্ষুনি তার আইডি লক করে ফেলে যাতে এই লোক আর তার ছবি দেখতে না পারে,কমেন্ট করতে না পারে।

চলবে…..
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-১৩+১৪

0

#চন্দ্রাণী(১৩)
পুরো উঠানের সব পাতা,ময়লা সব কিছু তুলে ফেললো টগর। শ্যাওলা ধরা উঠানের চেহারা বদলে গেলো আস্তে আস্তে। টগর গোসল করে বের হয়ে এলো।পরনে একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট শুধু। কলিং বেল বাজতেই মেজাজ বিগড়ে গেলো টগরের।এই ভর দুপুরে কে এলো আবার!

দরজা খুলে দেখে ৩২ দাঁত বের করে নির্ঝর দাঁড়িয়ে আছে। টগরের দিকে তাকিয়ে নির্ঝর বললো, “সারপ্রাইজ দিতে চলে এলাম।”

টগর রাগান্বিত হয়ে বললো, “আপনার কি আর কোনো কাজ নেই?সারাক্ষণ আমার পেছনে লেগে থাকেন কেনো?”

নির্ঝর হেসে বললো, “আমার কাজই এটা টগর। তোমার পেছনে লেগে থাকাও আমার কাজ।আর আমার কাজ আমি ভালো করেই বুঝি।”

টগর বিরক্ত হয়ে ভেতরে সরে দাঁড়ায়। নির্ঝর কথা না বাড়িয়ে ভেতরে চলে আসে।
চন্দ্র চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে।টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “আপনাকে কি ইনভাইটেশন কার্ড পাঠাতে হবে ভেতরে আসার জন্য? ”

চন্দ্র মুচকি হাসলো।

নির্ঝর টগরের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি আসার সময় এই ম্যাডাম ও চলে এলেন।ওনার ইচ্ছে তদন্ত করা দেখার।”

টগর বললো, “আপনার যা বলার আছে প্লিজ তাড়াতাড়ি বলুন,আমার প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে।”

নির্ঝর হেসে বললো, “একেবারে কাজের কথা মনে করেছো।ক্ষিধে তো আমার ও পেয়েছে। ”

টগর বিরক্ত প্রচন্ড এই ইন্সপেক্টর তার সাথে হেয়ালি করতে চাইছে।
টগর কড়া গলায় বললো, “আপনি নিশ্চয় আমার সাথে লাঞ্চ করতে চাচ্ছেন না।”

নির্ঝর আহত স্বরে বললো, “কে বললো চাই না?আমি অবশ্যই চাই তোমার সাথে লাঞ্চ করতে। ”

টগর হতাশ হয়ে সোফায় বসে পড়লো। তার ইচ্ছে করছে নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে।

নির্ঝর সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসলো। টগরকে সে সর্বোচ্চ বিরক্ত করবে।

টগর নিজেকে সামলে বললো, “গরম ভাত আর ডিম ভাজি,চলবে?”

নির্ঝর হেসে বললো, “দৌড়াবে।”

চন্দ্র আচমকা জিজ্ঞেস করলো, “কে রান্না করবে?রান্নার কেউ আছে?”

টগর বিড়বিড় করে বললো, “আমাকে কি চোখে লাগে না?অণুবীক্ষণযন্ত্র এনে দিতে হবে?”

চন্দ্র আমতাআমতা করে বললো, “না মানে,আপনি রান্না পারেন?”

টগর চিল মুড নিয়ে বললো, “যতটা রান্না জানলে ভাত আর ডিম ভাজি দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা যায় ততটা জানি।বসুন,একবার খেয়ে দেখুন,নরমাল ডিম ভাজি না হলেও বারবিকিউ ডিম ভাজি খাবেন না হয় আমার বাড়িতে।”

চন্দ্রর ভীষণ খারাপ লাগলো। এই লোকটাকে সে যতোই অপছন্দ করুক এখন কেনো জানি খারাপ লাগছে। পুরুষ মানুষ যতোই ভালো শেফ হোক,তবুও চন্দ্রর মনে হয় বাড়ির রান্না মেয়েদেরই মানায়।
মেয়েদের হাতের রান্না মানে কেমন একটা মায়া মমতায় মাখা একটা ব্যাপার থাকে।পুরুষের রান্নায় থাকে শুধু মাত্র পেট জামিন দেওয়ার ব্যাপার।

ইতস্তত করে বললো,”কিছু মনে না করলে আমি রান্না করি?”

টগর চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলার আগে নির্ঝর হেসে বললো, “না না,মনে করার কিছু নেই।আপনি নিশ্চিন্তে রান্না করুন।”

চন্দ্র জিজ্ঞেস করলো, “কিচেন কোন দিকে?”

টগর যন্ত্রচালিতের মতো দেখিয়ে দিয়ে বললো, “ফ্রিজে মাছ মাংস অনেক কিছু রাখা আছে, দরকার মতো নিয়েন।”

চন্দ্র মুচকি হেসে চলে গেলো।
টগর নির্ঝরের মুখোমুখি বসে বললো, “আপনার সমস্যা কি?”

নির্ঝর হেসে বললো, “সেদিন খুনটা কেনো করেছিলে?তোমার হাতের ব্যাগে কি ছিলো সেদিন?”

টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “আমি জানি না কি ছিলো। আর আমি কাউকে খুন করি নি।”

নির্ঝর পায়ের উপর পা তুলে বললো, “যেই লোকটা খু/ন হয়েছে তার ফোন থেকে একটা মেসেজ পেয়েছি আমরা। মেসেজে লিখা ছিলো টগর যাতে বেঁচে ফিরতে না পারে। ”

টগর যেনো আকাশ থেকে পড়লো। হতভম্ব হয়ে বললো, “হোয়াট! ”

নির্ঝর হেসে বললো, “তবুও বলবেন আপনার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই এসবের?”

টগর বললো, “আমি বারবার, হাজার বার বলবো আমার সাথে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই।”

নির্ঝর বললো, “তুমি যে ওখানে যাবে তা কে কে জানতো?”

টগর ভেবে বললো, “নিয়াজ ছাড়া আর কেউ না।”

নির্ঝর চুপ করে ভাবতে লাগলো। নিয়াজকে তার কেমন সন্দেহ হচ্ছে। এই ছেলেটা ওভারস্মার্ট বেশ।ওকে নজরে রাখতে হবে।

চন্দ্র দ্রুত হাতে কাজ করা শুরু করে দিলো। পুরুষ মানুষকে হাত করার অন্যতম প্রধান একটা হাতিয়ার হলো ভালোমন্দ খাওয়ানো। আর টগরের এটা হতে পারে সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। যেহেতু নারীসঙ্গ বিবর্জিত মানুষ, নিজে হাত পুড়িয়ে রান্না করে খায়।তাকে কাবু করা খুব একটা অসুবিধা হবে না।

ফ্রিজ থেকে মুরগির মাংস বের করে ভিজিয়ে রেখে দ্রুত হাতে পেঁয়াজ, মরিচ কেটে নিলো।তারপর আদা,রসুন,জিরা বেটে নিলো।
রাইস কুকারে ভাত আর এক চুলায় ডাল বসিয়ে দিলো।
মশলা বেটে আলু কেটে নিলো।মাংস ভালো করে বরফ ছাড়ে নি।তবুও আর দেরি করলো না চন্দ্র।
মশলা কষিয়ে নিয়ে মাংস দিয়ে দিলো।

রান্নাঘর থেকে মাংসের ঘ্রাণ এসে নাকে লাগতেই টগর চমকে উঠলো। কতো বছর পর আজ আবার এরকম ঘ্রাণ পাচ্ছে?
মা মারা যাওয়ার পর থেকেই নিজের রান্না নিজে করে। কোনো মতে পেটে দুই মুঠো গেলেই হয় তার,এতো কষিয়ে আয়োজন করে রান্না করতে যায় না। ভাত আর আলু ভর্তা করেই বেশির ভাগ দিন চালিয়ে নেয়।ফ্রিজে মাছ মাংস সবই রাখে তবুও।যেদিন আর ইচ্ছে করে না একই খাবার রিপিট করতে সেদিন রান্না করে। যতই ভালো রান্না করুক ইউটিউব দেখে, তবুও নিজের রান্না নিজের তেমন একটা ভালো লাগে না টগরের।

নির্ঝর উঠে বসে বললো, “তোমার সাথে আমার একটা মিল আছে জানো?”

টগর কিছু বললো না। নির্ঝর নিজেই বললো, “তোমার ও মা নেই আমার ও মা নেই।যদিও আমার বাবা আছেন তবে মা মারা যাবার পর থেকেই তিনি আমার তালুই হয়ে গেছেন।আমার ১০ বছর বয়সে মা মারা যান।
তোমার মতো আমি ও নিজের রান্না নিজে করে খাই।”

টগরের হঠাৎ করে নির্ঝরের জন্য কেমন মায়া হলো। সে তো মা’কে অনেক দিন পেয়েছে কাছে এই লোকটা তো তাও পায় নি।
লোকটাকে এতো দিন যতটা খারাপ ভেবেছিলো আজ মনে হচ্ছে ততটাও খারাপ না।

চন্দ্র তরকারি নামিয়ে প্লেটে ভাত বেড়ে নিয়ে একটু ঠান্ডা হতে রাখলো।সেই ফাঁকে শসা,টমেটো, পেঁয়াজ,কাচা মরিচ কুচো করে সরিষার তেল দিয়ে হাতে মেখে সালাদ করে নিলো।
সালাদ বানাতে বানাতে চন্দ্রর মনে হলো, “যদিও এই বাড়িতে কোনো মহিলা নেই তবুও এই লোকটা বাড়িঘর গুছিয়ে রাখে বেশ।ঠিকই বলেছে সেদিন,জাতে মাতাল হলেও,তালে ঠিক আছে। এই জাতে মাতাল লোকটার থেকে নিয়াজদের সব প্ল্যান বের করতে হবে চন্দ্রর।”

খাবার সার্ভ করার পর টগর কিছুটা মুগ্ধ দৃষ্টিতে চন্দ্রর দিকে তাকালো। মেয়েটাকে দেখে মনে হয় ননীর পুতুল অথচ কাজেকর্মে বেশ গোছানো। ওর ভাবভঙ্গি, চলাফেরা দেখে একটুও মনে হচ্ছে না এই বাড়িতে প্রথম এসেছে বরং এমন দক্ষ হাতে সব করছে যেনো এই বাড়িটি তারই।

নির্ঝর খেতে বসে বললো, “বাহ,আপনার হাতে তো দেখছি জাদু আছে ম্যাডাম। খুব দ্রুতই সব আয়োজন করে ফেললেন দেখছি।”

চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “নিন আপনারা খেয়ে নিন।”

টগরের হঠাৎ করেই কেমন যেনো লজ্জা লাগছে খেতে বসতে এই মেয়েটার সামনে। যেনো এই বাড়িতে সে অতিথি এমন লাগছে।
চন্দ্র সাবলীলভাবে প্লেটে ভাত বেড়ে দিলো। তারপর মুরগির মাংস তুলে দিলো টগরের প্লেটে।

টগর ইতস্তত করে বললো, “আপনি ও বসুন না।”

চন্দ্র হেসে বললো, “না,ধন্যবাদ। আমি বাড়িতে গিয়ে খাবো।আব্বা মা অপেক্ষা করে থাকবে আমার জন্য। ”

টগর বললো, “আপনি এতো কষ্ট করে রান্না করেছেন,আর না খেয়ে যাবেন?প্লিজ বসুন।নয়তো আমার নিজেরই খারাপ লাগবে।”

চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “প্লিজ,আমার সাথে এতো ফর্মালিটি করবেন না।আমরা একই গ্রামের মানুষ। চেনাজানা থাকলে, কথাবার্তা থাকলে হয়তো আমরা বন্ধুও হতাম।তাই আমার সাথে এভাবে ফর্মাল ব্যবহার করবেন না।অন্য কোনো দিন খাবো।আজকে আপনারা খান।আপনার তো দেখছি বেড়ে খাওয়ানোর মতো কেউ নেই,আজ না হয় আমি আপনাকে বেড়ে খাওয়াই।”

নির্ঝর মিটিমিটি হাসতে লাগলো চন্দ্রর কথা শুনে। মেয়েটার হাবেভাবে বলছে সে টগরের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।

টগর আর কথা বাড়ালো না।খাবার মুখে তুলতেই টগর দ্বিতীয় বার মুগ্ধ হলো। ভীষণ ভালো রান্না করেছে মেয়েটা।আলু দিয়ে মুরগির মাংসের ঘন ঝোল সেই সাথে মুসুরি ডাল।ডালের মধ্যে আস্ত কিছু কাঁচামরিচ দিয়েছে।ভাতের সাথে চটকে খেতে অসাধারণ লাগছে।
সালাদের পাশে লম্বালম্বি করে কেটে রাখা লেবুও আছে।মাংসের বাটির উপর কিছুটা ভাজা জিরার গুড়ো ছিটিয়ে দেওয়া।এভাবেই তো মা ও দিতো।
কত বছর পর টগর আজ পেট ভরে ভাত খেলো!
জানে না টগর। খাবার পাতে তার ভিজে উঠা চোখ চন্দ্রর নজর এড়ালো না।

নির্ঝর খেতে খেতে বললো, “ফার্স্ট ক্লাস রান্না হয়েছে ম্যাডাম। বহুদিন পর পেট ভরে ভাত খাচ্ছি।”
টগর ফোঁড়ন কেটে বললো, “আপনি প্লিজ এরকম কথা বলবেন না।আপনাদের পুলিশ অফিসারদের জানা আছে আমার। নিজেদের গ্রামেই তো কতো দেখেছি অন্য কোথাও না,এই যে উনি,ওনাদের বাড়িতেও তো কতো পুলিশ অফিসার কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছেন।”

নির্ঝর হেসে বললো, “ভুল বলো নি তুমি। তবে সবাই এক রকম হয় না।আমি তোমার সাথে খেতে নিজে থেকে চেয়েছি বলে তুমি ভেবো না আমি সবসময়ই এরকম সবার সাথে। ”

টগর কিছু বললো না আর।সে তার বাসায় খেতে চেয়েছে বলে কথাটা বলে নি। অন্যান্য অফিসারদের দেখেছে এরকম সেটা বুঝাতে চেয়েছে। এখন কথা বাড়ালে মানুষটা খেতে আনইজি ফিল করবে ভেবে টগর আর কিছু বললো না।
খাওয়ার পর চন্দ্র সব কিছু ধুয়ে মুছে রান্নাঘর ও মুছে ফেললো। বাকি খাবার বক্সে ভরে ফ্রিজে রেখে দিলো।
তারপর ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বললো, “ফ্রিজে সব রেখে দিয়েছি।রাতে খাবার আগে ওভেনে গরম করে নিবেন।”

টগর কি বলবে ভেবে পেলো না। চেয়ারম্যান লোকটাকেই টগরের পছন্দ না।সেখানে তার মেয়ে এতো কিছু করলো তার জন্য। কেমন লজ্জা অস্বস্তি হচ্ছে টগরের।

চন্দ্র বুঝতে পেরে বললো, “আপনি মনে হয় লজ্জা পাচ্ছেন এখনো। লজ্জা পাবেন না প্লিজ।আমার খুব ভালো লেগেছে আপনাদের খাওয়াতে পেরে।আসলে আমার মায়ের থেকে মনে হয় আমরা দুই বোন এই স্বভাব পেয়েছি। কাউকে নিজ হাতে কিছু করে খাওয়াতে পারলে কেমন যেনো মানসিক শান্তি পাই। আমি আমার মানসিক শান্তির জন্যই এটুকু করেছি।”

টগর আর কিছু বললো না। আসলে কি বলবে তাই ভেবে পাচ্ছিলো না।

নির্ঝর আর চন্দ্র চলে যেতেই টগর ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসলো তাকে কে খুন করতে চায়?
খেলা শেষ করার সময় হয়ে গেছে তাহলে!

নির্ঝর হাঁটতে হাঁটতে বললো, “আপনি কি টগরকে ভালোবাসেন?”

আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে চন্দ্র হতভম্ব হয়ে গেলো।

নির্ঝর হেসে বললো, “না আপনার হাবভাব তেমনই মনে হচ্ছে। আর আমার মন বলছে টগরের প্রতি আপনার একটা সফট কর্ণার তৈরি হয়েছে, আপনি এর পরে ও অনেক বার যাবেন টগরের কাছে। ওকে রান্না করে খাওয়াতে। ”

চন্দ্র হতবাক হয়ে বললো, “আপনি কিভাবে বুঝলেন?”

নির্ঝর হেসে বললো, “কিছু ব্যাপার বুঝা যায় এমনিতেই। টগর খাওয়ার সময় আপনার দুই চোখ দিয়ে মায়া ঝরে পড়ছিলো। দেখে মনে হচ্ছিলো আপনার ভীষণ খারাপ লাগছে ওর জন্য। আসলে মেয়ে মানুষের মন একটু নরম বেশি তো।”

চন্দ্র কিছু বললো না। যেতে তো তাকে হবেই।টগরের থেকে তথ্য আদায় করতে হলে তাকে যেতেই হবে।

মনকে চন্দ্র প্রশ্ন করলো, “শুধু কি ইনফরমেশন পেতেই যাবো?তাহলে মনটা এমন বিষন্ন হয়ে গেলো কেনো?”

চলবে……!
রাজিয়া রহমান

#চন্দ্রাণী(১৪)
আকাশের বুকে মেঘের আনাগোনা একটানা। শুভ্র বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখলো বড় আপা আসছে।অনেকক্ষণ বাদে আপা বাড়ি আসলো।কে জানে কোথায় ছিলো!
চন্দ্র এসে আগে শর্মীর রুমে গেলো।শুভ্র ও গেলো সেখানে।
শর্মী চন্দ্রকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো, “আপা,আপারে নীলির এরকম হলো কেনো আপা?”

চন্দ্র শর্মীকে জড়িয়ে ধরলো। শর্মীর কেমন দমবন্ধ লাগছে।সকাল থেকে যদিও খুব একটা খারাপ লাগে নি সবার সাথে থাকায়।বাড়িতে এসে একা হতেই নীলির সাথে কলেজে আসা যাওয়ার কথা মনে পড়তেই শর্মীর অস্থিরতা শুরু হয়ে গেলো।
কতো খুনসুটি করত দুজন একসাথে। এখন কে যাবে শর্মীর সাথে কলেজে?
এতোক্ষণ একা একা রুমে শর্মীর অসহ্য কষ্ট হচ্ছিলো। চন্দ্র বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। শুভ্র এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো এতক্ষণ। কিন্তু ছোট আপাকে কাঁদতে দেখে নিজে এগিয়ে গিয়ে আপার হাত চেপে ধরলো। অবুঝ ছেলেটার চোখের কোণে জল।বোনকে কাঁদতে দেখে সে ও কাঁদছে।
চন্দ্র খানিক জিরিয়ে বললো, “তুই এভাবে ভেঙে পড়ছিস কেনো?”

শর্মী বললো, “আপা আমার খুব ভয় করছে।আমাদের গ্রামে এসব কি শুরু হয়েছে? আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে এরপর আমিও মা//রা যাবো।”

চন্দ্র বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “আমার সোনা বোন।এরকম করে না।তুই ভুলে যাস কেনো তুই কার মেয়ে?তোর দিকে কেউ হাত বাড়াতে হলে ১০০ বার ভাবতে হবে তুই কার মেয়ে।”

শর্মী বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো, “জানিস আপা,আমি ভেবেছিলাম এতো বড় লজ্জা বাবা মা জানার আগে আমি নিজেকে নিজে শেষ করে দিবো।আজ যখন আব্বা নীলির লা//শ দেখে কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছিলো তখন আমার বারবার মনে হচ্ছিলো যদি আমি ও এরকম করে ফেলতাম আব্বা কিভাবে আমার লাশ দেখতো?আব্বা কি নিজেকে সামলাতে পারতো? ”

চন্দ্র বললো,”এভাবে ভেঙে পড়িস না বোন।আমরা সবাই আছি।নীলির সাথে এরকম করেছে যে তাকে পুলিশ খুঁজে বের করবে।আজ না হয় কাল আসামি ধরা পড়বেই।”

শর্মী নিজেকে সামলে নিলো।

রেহানা মেয়েদের রুমে এসে দেখেন দুই মেয়ে মন খারাপ করে বসে আছে।নীলির ব্যাপারটা নিয়ে যে ওরা আপসেট বুঝতে পেরে বললেন,”ভাই বোন তিনজনই এইখানে বসে রইছস।কয়টা বাজে?তোর বাপে এখনো ভাত খাইছে?তোরা খাইছস?”

চন্দ্র উঠে বললো, “চলো মা,আব্বা কই?”

রেহানা মুখ বাঁকিয়ে বললো, “কই আর থাকবে,তার কি কোনো পাত্তা আছে?গিয়ে দেখ কাচারি ঘরে কি করে। ”

শুভ্র গেলো বাবাকে ডাকতে।চন্দ্র আর শর্মী দুজনকেই রেহানা বললো টেবিল সাজাতে।
কাজে থাকলে মন খারাপ কমবে কিছুটা।

একটা কালো টি-শার্ট পরে টগর বের হলো। নিয়াজ কল দিয়েছে টগরকে।নিয়াজ বলেছিলো তালতলায় থাকবে সে।কিছু মাল ডেলিভারি দিতে হবে রাতে।

টগর শিস দিতে দিতে গেলো।মনে মনে হিসেব কষতে লাগলো আজকের ডেলিভারিতে কতো ইনকাম হবে।
কাজটা অবশ্য টগর বেশ উপভোগ করে। এখন পর্যন্ত একবার ও সে ধরা খায় নি।এরকম চ্যালেঞ্জ নিতে তার আনন্দই হয়।

তালতলায় গিয়ে দেখে নিয়াজ আগেই দাঁড়িয়ে আছে। টগরকে দেখে এগিয়ে এলো।তারপর বললো, “এলাকা গরম এখন।সাবধানে মাল নিয়ে যাবি।”

টগর একটু ভালো করে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনার কি মন খারাপ? ”

নিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, “বুঝতেছি না কিছুই কি হইতেছে।ইদানীং নকল মাল আসে একেক চালানে বুঝলি।কাস্টমার কমপ্লেইন করে। ওই দিকে আমার কাছে যিনি সাপ্লাই করে সে বলে সে ঠিক মাল পাঠায়।তাইলে সমস্যা হইতেছে কোন জায়গায় বুঝতেছি না।”

টগর এক সেকেন্ড ভেবে বললো, “আপনি আপনার পুরো সিস্টেম আবার ভালো কইরা চেক দেন ভাই।দলের মধ্যে দুই নাম্বারি করার মতো মানুষের তো অভাব নাই বুঝেন নাই?কেউ হয়তো গাছের ও খায়,তলার ও কুড়ায়।”

নিয়াজ চমকে উঠলো টগরের কথা শুনে। আসলেই তো!
এই বুদ্ধি তো তার মাথায় আগে আসে নি।
হইতে ও তো পারে তার লোকদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে।

নিয়াজ চলে যেতে যেতে বললো, “রহিম শেখের ক্ষেতের বড় লাউ যেটাতে দেখবি নখ দিয়ে ত্রিভুজ আঁকা আছে।”

টগরকে একটা খাম দিয়ে নিয়াজ চলে গেলো। টগর আগের মতো খুশি মনে শিস দিতে দিতে লাউ কিনতে গেলো।
রহিম শেখের বাড়ি চেয়ারম্যান বাড়ির সাথে। চেয়ারম্যান বাড়ির কথা ভাবতেই টগরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। চন্দ্র মেয়েটা বেশ করিতকর্মা। দেখতেও বেশ!

ভাবতে ভাবতে নিজে নিজে আবার মুচকি হাসলো টগর। মেয়েটার কথা এতো বার কেনো ভাবছে সে?
দূর!

রহিম শেখের ক্ষেতের কাছে এসে দেখে চন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে রহিম চাচার বউ লিপি চাচীর পাশে।লিপি চাচী চন্দ্রকে বললো, “কত্তো দিন পরে তোমারে দেখছি আম্মা।ভালো আছো?”

চন্দ্র হেসে বললো, “জি চাচী ভালো আছি।”

লিপি চাচী চন্দ্রর হাতে লাউ দিয়ে বললো, “না গো আম্মা,টাকা দেওন লাগতো না।এইটা তোমারে ভালোবাইসা দিলাম।”

চন্দ্র বললো, “না না চাচী,এই কথা বলবেন না।মা রাগ হবে যদি শুনে লাউয়ের দাম নেন নাই।”

লিপি চাচী হেসে বললো, “তুমি ভাবীসাবরে কইও এইটা চাচীর তরফ থাইকা উপহারের। তোমার মা’য় কতো দিন কতো কিছু দিছে,আমাগো কি সেই ক্ষেমতা আছে তোমাগো লাইগা কিছু করার।আইজ যখন সুযোগ আইছে আমার কথাখান রাখো আম্মা।”

চন্দ্র আর কিছু বললো না। ক্ষেতের সবচেয়ে বড় লাউটা তিনি চন্দ্রর হাতে দিলেন।

টগর চমকে উঠলো যখন দেখলো লাউয়ের উপর ত্রিভুজ চিহ্ন আঁকা।নিজের মাথার চুল নিজের ছিড়তে ইচ্ছে করছে টগরের।
চন্দ্রর সামনে না গিয়ে দ্রুত সরে গেলো সেই জায়গা থেকে তালতলায়। চন্দ্রকে এই পথ ধরেই যেতে হবে।ক্ষেতের আইল দিয়ে যাওয়ার উপায় নেই কাঁদার জন্য।

চন্দ্র কিছুদূর যেতেই দেখে টগর একটা গাছতলায় বসে আছে। মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে বললো, “আপনি? ”

টগর বিস্ময়ের ভান করে বললো, “আরে আপনি? কোথা থেকে?লাউ নিতে এসেছেন বুঝি?”

চন্দ্র হেসে বললো, “হ্যাঁ, মা পাঠালো একটা লাউ নিতে। ”

টগর হেসে বললো, “আপনাকে দেখে কিন্তু বুঝা যায় না আপনি যে গ্রামের সাধারণ একটা মেয়ে।দেখলে মনে হয় অন্যরকম। ”

চন্দ্র হেসে বললো, “কেমন? ”

টগর বললো, “না কিছু না।”

চন্দ্র বুঝতে পারলো টগর কিছু লুকাতে চাইছে।তাকে এই লোকটার সাথে ভাব জমাতে হবে।তাই আগ বাড়িয়ে নিজে থেকে বললো,”আমাকে কি খুব খারাপ মেয়ে মনে হয়? ”

টগরের আর ধৈর্য কুলাচ্ছে না এসব ঢং করে কথা বলতে। অথচ এখন উপায় নেই।এই মেয়ের সাথে ধৈর্য ধরে কথা বলতেই হবে।হাতের লাউটা আদায় করতে হবে।

টগর মনে মনে ভাবলো আমার এতো খারাপ দিন কবে এলো যে একটা লাউয়ের জন্য একটা মেয়ের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হচ্ছে!

মুচকি হেসে বললো, “সত্যি বলতে আপনাকে দেখতে মনে হয় ভীষণ অহংকারী, মানে চেয়ারম্যানের মেয়ে একটা অন্যরকম ভাবসাব। অথচ আপনার সাথে মিশলে বুঝা যায় আপনি কতটা অমায়িক। ”

চন্দ্র মনে মনে বললো, “আমি অমায়িক না কি তা বুঝবে যেদিন কালসাপ হয়ে ছোবল দিবো।”

মুখে বললো, “একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে এবার। এতটা ও না যতটা বলছেন।”

দুজন হাঁটতে লাগলো। চন্দ্র টগরের সাথে ভাব জমাতে ব্যস্ত আর টগর ব্যস্ত চন্দ্রকে অন্যমনস্ক করতে। কথায় কথায় টগর চন্দ্রকে নিজের বাড়ির দিকে নিয়ে গেলো।কিছুটা গিয়ে চন্দ্রর মনে হলো ভুল রাস্তায় চলে এসেছে।
টগরকে সেই কথা বলতে টগর বললো, “এতটা পথ যখন চলে এসেছেন তখন না হয় আরেকটু চলুন।আপনি আজ আমাকে রান্না করে খাইয়েছেন,আমি না হয় আপনাকে একটু কফি করে খাওয়াবো।”

চন্দ্র বিব্রত হয়ে বললো, “না না,তা লাগবে না। অন্য কোনো দিন হবে।”

টগর নাছোড়বান্দা। মুখে কৃত্রিম অভিমান ফুটিয়ে তুলে বললো, “বুঝেছি, আপনার আমাকে ঠিক ভালো লাগছে না।অসুবিধা নেই।”

চন্দ্র লজ্জিত হয়ে বললো, “আরে না না,তা হবে কেনো?আচ্ছা চলুন।”

টগর মুচকি হাসলো। কাউকে কনভিন্স করার গুণ তো তার সেই স্কুল লাইফ থেকে আর একটা মেয়েকে সে কনভিন্স করতে পারবে না?

চন্দ্র মনে মনে ভাবলো,”ছেলেটা কি আমাকে একটু একটু পছন্দ করতে শুরু করেছে? আমার সম্পর্কে ওর ধারণা কিছুটা বদলাচ্ছে। ”

চন্দ্রর হাতের লাউটা টগর হাতে নিয়ে বললো, “কতোক্ষণ ধরে বয়ে বেড়াবেন এই বোঝা?আমার কাছে দিন এবার।”

চন্দ্র মুচকি হাসলো। টগরের জানে পানি এলো।আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো লাউয়ের গায়ে খুব সুক্ষ্মভাবে কাঁ//টা চিহ্নটা দেখা যাচ্ছে।

নির্ঝর কুসুমপুরের ২০-২৫ বছর আগের ফাইল নিয়ে বসেছে।এই গ্রামের সব হিস্ট্রি তার জানতে হবে।সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে সাধারণত ক্রাইম বেশি হয়ে থাকে।এখানেও সেইম।
দেখতে দেখতে একটা তথ্য জানতে পারলো নির্ঝর। আর জেনে বেশ অবাক হলো।

চলবে…..
রাজিয়া রহমান