Sunday, June 29, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 307



রজনী প্রভাতে পর্ব-০৭

0

#রজনী_প্রভাতে (পর্ব-৭)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

১৩.
আজ সকালে তটিনীর একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙতেই সে ভীষণ অবাক হয়। তার বিছানায় একটা রূপবতী মেয়ে বসে আছে। তটিনীকে জাগতে দেখেই হাসল।

-‘কি ব্যাপার? বিয়ে বাড়িতে কেউ এতক্ষণ ঘুমায়?’

অপরিচিতা মেয়েটির এমন কথা তটিনীর হজম হলো না। বলা চলে কিছুটা বি’র’ক্ত হয় সে। মেয়েটি নিজের মতোই বলতে লাগল,

-‘আমি মৈথী। আয়রার ভাবী।’

তটিনী চমকে উঠল। আয়রার ভাবী মানে! রোহান তো সবে টেনে পড়ে। এই বয়সেই এত বড় মেয়েকে সে বিয়ে করল কখন! কি আবোল তাবোল বলছে মেয়েটা?

মৈথী হেসে উঠল তটিনীর ভাবুক মুখ দেখে। বলল,

-‘তুমি পিচ্চি রোহানের কথা ভাবছ? আরে ধুর! ও তো আমার ছোট দেবর। আমি ওর বড় ভাইয়ের কথা বলছি। তাযীমকে চেনো? ওর বউ।’

তটিনী পাথরের মতো জমে গেল। তাযীম বিবাহিত? কই? সে তো জানে না। অবশ্য এত গুলো বছর কোনো যোগাযোগ ছিল না। তাছাড়া বিয়ের বয়স তাযীমের আরো আগেই হয়েছে। তটিনী আর ভাবতে পারছে না। মাথা ধরছে তার। আচ্ছা! মেয়েটা মশকরা করছে না তো?

-‘মৈথী আপু দুষ্টুমি করছে রে। ওদের বিয়েটা এখনও হয়নি। আমার জন্য আটকে আছে। আমারটা শেষ হতেই ওদেরটাও হবে।’

আয়রার কথা শুনে তটিনীর মনে আরো বেশি দুঃখ জাগে। মৈথী মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। তটিনী বুঝতে পারছে না এত খা’রা’প লাগছে কেন তার? এটা কেমন অদ্ভুত না? নিজেকে আড়াল করতেই সে বলে উঠল,

-‘ওহ আচ্ছা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

-‘জলদি যা। তুই এত লেইট সব কিছুতে!’

তটিনী হাসল। ভেতর থেকেও কেউ একজন বলে উঠল,

-‘আসলেই তুই লেইট রে তটিনী! তুই একজনের জীবনে প্রবেশ করতে খুব দেরি করে ফেলেছিস।’

________________________________

আজ আয়রার হলুদ অনুষ্ঠান। বাড়িতে আয়োজন এবং অতিথি দুটোর পরিমাণই বেড়েছে। সবার সকালের নাস্তা খাওয়া হলেও তটিনীর বাকি ছিল। একা টেবিলে বসে খেতে তার ইচ্ছে করছিল না। চন্দ্রমল্লিকা তাই তাকে ডেকে নিয়ে হল রুমের সাথে লাগোয়া খোলা বারান্দায় নিয়ে বসালো। সেখানে সব ভাই বোন মিলে আড্ডা দিচ্ছিল। তটিনীকে খাবার প্লেট হাতে দেখে মোর্শেদ চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল।

-‘এই টিনী! বাড়িতে যেমন অনিয়ম করতি এখানেও তেমন শুরু করেছিস! আক্কেল জ্ঞান নেই তোর? এই সময় কেউ সকালের খাবার খায়?’

তটিনী ধ’ম’ক খেয়ে চুপচাপ বসে থাকল। পরোটা ছিড়ে মুখে দেওয়া হলো না আর তার।

-‘আশ্চর্য! বসে আছিস কেন? জলদি খাওয়া শেষ কর। এটা আবার কেমন অভ্যাস খাবার প্লেট নিয়ে বসে থাকা!’

তটিনী খাওয়া শুরু করল। ধুর! কোথাও যেন তাল কে’টে গেছে। সুর হারিয়ে গেছে। কিছুই ভালো লাগে না তার। ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে কাঁদতে। উফ! এত দুঃখ হচ্ছে কেন তার? সে আড়চোখে পাশে তাকালো। তাযীম আর মৈথী পাশাপাশি বসে আছে আর কি নিয়ে খুব হাসছে। একটু দূরে থাকায় হাসির কারণটা জানতে পারল না সে। অবশ্য জানতে চায়ও না। একটা পরোটা কোনো মতে গি’লে সে উঠে পড়ল। চলে আসতে নিলেই শুনতে পায়,

-‘এই বুচি? কোথায় যাও?’

বুচি! আবার বুচি! ভরা মজলিসে হাসির রোল পড়ে গেল। সবাই তটিনীকে নিয়ে হাসতে লাগল। কতদিন পর তাকে তাযীম বুচি বলে ডাকল! হাসবে না সবাই? তটিনীর এত ক’ষ্ট হলো! ছিঃ ছিঃ! যে মানুষ তাকে ভরা মজলিসে অ’প’মা’ন করে সে কিনা তাকে এভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে? তটিনী নিজেকে ধি’ক্কা’র জানায়। অভাব পড়েছিল? পুরুষ মানুষের অভাব পড়েছিল? এই অ’স’ভ্যটাকেই কেন মন টানলো? হায়, কি ল’জ্জা! কি ল’জ্জা!

মৈথী উঠে এলো। তটিনীকে বলল,

-‘বাহ! তোমার সব নামই তো ভারি সুন্দর। তটিনী আর বুচি।’

রা’গ সামলাতে পারল না তটিনী। শক্ত গলায় জবাব দিলো,

-‘আমার নাম তটিনী। ওসব বি’শ্রী লোকের দেওয়া বি’শ্রী নাম আমার হতে যাবে কেন?’

থমথমে একটা পরিবেশ তৈরি করে সেখান থেকে চলে আসার পর তটিনীর মনে হলো বেশ ভালো কাজ করেছে সে। হালকা লাগছে। নেই! তার মানে কোনো অনুভূতি নেই তার তাযীমের প্রতি। আহ্! শান্তি!

১৪.
রাতের আটটা বাজে তখন। এলোমেলো ভাবে শাড়ি পরে তটিনী আয়রার রুমের বিছানায় বসে আছে। রুমটা খালি। তটিনী সবার উপরে রা’গ করে পার্লারে সাজতে যায়নি। সবাই গিয়েছে শুধু সে বাকি রয়ে গেছে। শাড়ি তটিনী ভালোই পরতে পারে। কিন্তু আজ কেন যেন পারছে না। বারবার সব তালগোল পেঁচিয়ে যাচ্ছে। রা’গে তাই কোনো মতে শাড়ি পেঁচিয়ে বসে আছে। হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে বসে আছে। মেজো আপাকে কল দিবে ভাবছে। কিন্তু সংকোচ হচ্ছে। তখন তো সাথে গেল না। এখন সমস্যার কথা বলা ঠিক হবে?

তটিনীর ভাবনার মাঝেই খট করে রুমের দরজা খুলে কেউ একজন প্রবেশ করল। বাহিরের আলোর প্রতিফলনে একটু পুরুষের ছাঁয়া পড়তেই কেঁ’পে উঠল তটিনী। তাযীমকে দেখে যেন সেই কাঁ’পা’কাঁ’পি আরো বাড়ল। তাযীম অবশ্য ফিরেও তাকায় না তটিনীর দিকে। তার চোখ মুখ গম্ভীর। আয়রার বিছানার উপর কিছু প্যাকেট পড়ে ছিল সেসব নিয়েই চলে যাচ্ছিল। তার এমন ব্যবহার তটিনীর একটুও পছন্দ হলো না। বিড়বিড় করে বলল,

-‘অ’স’ভ্য একটা।’

বিড়বিড় করে বললেও বোধ হয় একটু জোরেই বলে ফেলে সে কথাটা। কেননা তাযীম শুনতে পায়। আর তাতেই দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ফিরে তটিনীর দিকে তাকালো। তটিনীর মনে ভ’য় ঢুকে গেল তাতে। পেটে চিনচিনে একটা ব্যথা হতে লাগল। তাযীমকে এগিয়ে আসতে দেখে তড়িগড়ি করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এলোমেলো শাড়ি তার খসে পড়ে যাচ্ছিল সেটা দুই হাতে আগলে ধরে। তাযীম একদম কাছাকাছি এসে বলে,

-‘কি বলেছিলে? অ’স’ভ্য?’

তটিনী কি বলবে বুঝতে পারছিল না। আসলে এত কিছু ভেবে কথাটা বলেনি। তাযীমকে রে’গে যেতে দেখে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে পড়ছে। তাযীম হাতের প্যাকেট গুলো বিছানায় রাখল। তটিনীর হাত ধরে হেঁচকা টানে তাকে নিজের বুকে এনে ফেলল। তারপরের ঘটনাটা আকস্মিক ঘটে যায়।

যাওয়ার আগে তাযীম তটিনীকে বলে যায়,

-‘এবার যত খুশি অ’স’ভ্য বলো। আই ওন্ট মাইন্ড।’

তাযীম চলে যেতেই তটিনী কেঁদে ফেলল। যেন তেন ভাবে নয়, একেবারে বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদল।

#চলবে।

রজনীপ্রভাতে পর্ব-০৬

0

#রজনীপ্রভাতে (পর্ব-৬)
লেখনিতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

১১.
ভালোবাসা আর ভালোলাগা এ দুটো আসলে কী? আচ্ছা কোনটা বেশি সুন্দর এবং বেশি অর্থ বহন করে! ভালোবাসা? এই ভালোবাসা কাকে বলে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে বহু জনের কাছে বহু উত্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু তটিনী চাইছে নিজের কাছ থেকেই এই ভালোবাসার সংজ্ঞা বের করতে। নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সে ভালোবাসা চিনতে চায়। অথচ কোনো ভাবেই বুঝে উঠতে পারছে না। আদৌ কি সে ভালোবাসে কাউকে? যদি ভালোবেসে থাকে তবে তো তার জানার কথা। যেহেতু জানে না তাই সে ভালোবাসে না তাযীমকে। আর তার তাযীমকে ভালোবাসতে হবে কেন? তাযীম কখনোই তটিনীর স্বপ্নপুরুষ হতে পারে না। দুদিন একটু বড় ভালো কথা বলেছে বলে তো আর সে সত্যিই ভালো হয়ে যায় নি।

ছাদ থেকে গান বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে। তটিনীর ইচ্ছে করছে ছাদে গিয়ে সাউন্ড বক্সটা ভেঙে আসতে। কিন্তু সব ইচ্ছে তো পূরণ হয় না। গা থেকে ভারী সাজ পোশাক ছেড়ে তটিনী সুতির সেলোয়ার কামিজ পরে নিলো। মাথা আবার ধরে আসছে। উফ! কোথায় গেলে যে একটু শান্তি পাওয়া যায়?

দরজায় নক হচ্ছে, চন্দ্রমল্লিকার গলা শোনা যাচ্ছে। তটিনী উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই চন্দ্রমল্লিকা তাকে দেখে চোখ কপালে তুলে বলল,

-‘একি! তোর এই অবস্থা কেন? সাজ তুললি কেন? ড্রেস ও চেঞ্জ করে ফেলেছিস। এই তোকে না বললাম সবাই এক সাথে ছবি তুলব। এখনও একটাও ছবি তুলতে পারলাম না তুই সব সাজ গোজ ন’ষ্ট করে বসে আছিস। এমন বেরসিক কেন তুই?’

তটিনী বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,

-‘মাথা ব্যথা করছে খুব।’

-‘সেকি! মাইগ্রেনের ব্যথাটা?’

-‘তেমনই মনে হয়।’

-‘ঔষুধ খেয়েছিস!’

-‘না।’

-‘আশ্চর্য! মাথা ব্যথা করছে আর তুই ঔষুধ না খেয়ে বসে আছিস? খাবার খাসনি বোধহয়। দাঁড়া আমি খাবার নিয়ে আসি, খালি পেটে ঔষুধ খাওয়া ঠিক নয়।’

চন্দ্রমল্লিকা চলে যেতেই তটিনী চোখ বুজল। তখন কি নাছোড়বান্দা হয়েই না ছিল তাযীম! এক প্রকার জো’র করে এনেছে তাকে। এক মুহুর্তের জন্য কত বড় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল সে! থাক, তটিনী আর সেসব ভাবতে চায় না। তার ভীষণ ক’ষ্ট হচ্ছে। এত বা’জে অনুভূতি হচ্ছে কেন তার? তাযীম তার অপছন্দের মানুষ। হুট করে পছন্দের হয়ে গেল কেন? এক অন্যরকম অ’প’রা’ধ বোধ থেকে তটিনীর চোখ ভিজে আসে। নিজেকে নিজেই তিরস্কার করে। তার মনে হতে থাকে সে এই ভুবনের সবচেয়ে বা’জে মেয়েটা। তাযীমকে ভালোবাসতে চায় সে। এর থেকে বড় অ’প’রা’ধ আর কি আছে?

———————–
পুরোনো বন্ধুদের সাথে ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল তাযীম। তখনই সেখানে উপস্থিত হয় তার ফুফাতো বোনের ননদ মৈথী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে যুক্ত আছে। হত দরিদ্রদের জন্য কাজ করে। সমাজ সেবা তার পেশা হয়ে উঠেছে বলে তাকে সমাজসেবক বললে ভুল হবে না। মেয়েটি গত দুই বছর থেকে তাযীমকে পছন্দ করে। পারিবারিকভাবে তাদের দুজনের বিয়ের আলোচনা চলছে। আয়রার বিয়ের পর হয়তো তাযীমের বিয়েও হবে। তাযীমের মা পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন আরো আগেই। মৈথীকে তাঁর খুব পছন্দ। তাই হয়তো ছেলের মত নেওয়ার কথাও ভাবছেন না। তাছাড়া এত সুন্দর, শিক্ষিতা, কর্মঠ মেয়েকে তাযীমও নিশ্চয় অপছন্দ করবে না। তাই তিনি নিশ্চিন্তে আছেন। এদিকে তাযীম তার মায়ের হাবভাব বুঝতে পেরে বেশ কয়েকবার তাকে নিজের কর্ম ব্যস্ততা দেখিয়ে এসব আলোচনা বন্ধ করতে বলেছে। তার মা তাই ছেলের সামনে এসব নিয়ে কথা না তুললেও পেছনে ঠিকই মৈথীকে ছেলের বউ করে ঘরে তোলার ব্যবস্থা করছে।

-‘আপনাকে তো দেখা যায় না আজকাল। খুব বেশি ব্যস্ত!’

তাযীম মৈথীর কথা শুনে হাসল। সেই হাসি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখলো মৈথী। ছেলেটা এত সুন্দর! এই এত সুন্দর ছেলেটা কবে তার হবে? একান্তই তার!

-‘কখন এসেছ?’ মৈথীর উদ্দেশ্যে তাযীম বলল।

-‘আরো আগেই। আপনি তখন ছিলেন না। বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন নাকি।’

তাযীমের হঠাৎই তটিনীর কথা মনে পড়ে। মেয়েটা কি রা’গ করে ফেলল খুব? এই মেয়েটাও না! এত রা’গ, জে’দ সব তার তাযীমের সাথেই করতে হয়? আশেপাশে তো কোথাও নেই। আসেনি ছাদে?

-‘কোথায় হারালেন?’

তাযীম সৌজন্যের হাসি হেসে বলল,

-‘কোথাও না। তুমি খেয়েছ! ডাকছে বোধহয় খাবার খাওয়ার জন্য। না খেলে চলো।’

-‘একসাথে খেতে বসলে যাব।’

-‘আচ্ছা চলো!’

১২.
ভোর রাতে তটিনীর ঘুম ভাঙলে ওয়াশরুম হয়ে আসে সে। পুনরায় বিছানায় শুয়ে পড়তেই দরজার বাইরে ফিসফিস করে কারো কথা বলার শব্দ শুনতে পেল। কান খাঁড়া করতেই বুঝতে পারে একজন পুরুষ আর একজন নারী কথা বলছে। নারী কন্ঠটা না চিনলেও সে পুরুষ গলাটা চিনতে পারে। তাযীম! এত রাতে কার সাথে কথা বলছে? কৌতূহল জাগে তটিনীর মনে। পাশে ঘুমিয়ে থাকা চন্দ্রমল্লিকাকে এক পলক পরখ করে নিয়ে সে বিছানা ছাড়ে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় দরজার কাছে। শুনতে পায় মেয়েটা বলছে,

-‘বিয়েটা এই ডিসেম্বরেই হচ্ছে তবে!’

-‘নট শিওর। তবে মা তো পারে না এখনই তোমাকে ছেলের বউ করে আনে।’

নারী কন্ঠের প্রাণোচ্ছল হাসির শব্দ হলো। মন ভরে হাসছে মেয়েটা। তটিনীর হুট করেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বি’শ্রী এক অনুভূতি হতে লাগল তার। মেয়েটি কে তা জানার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করতে লাগলো তার। হিল জুতোর ঠকঠক শব্দ শুনে সে বুঝতে পারল তারা প্রস্থান করছে। কি মনে করে আলতো ভাবে দরজাটা খুলে সে সামনে তাকালো। একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তবে তাযীম নেই পাশে। সে কোথায় গেল?

-‘কি ব্যাপার? ঘুমাও নি?’

তটিনী কেঁ’পে উঠল। পেছন ফিরে দেখল দেয়ালে হেলান দিয়ে তাযীম দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটাও তার অসম্ভব সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। এখনও পাঞ্জাবি ছাড়ে নি গা থেকে। শুধু হাতাটা গুটিয়ে রেখেছে। তাতে নিঃসন্দেহে তাকে সুদর্শনই লাগছে। তটিনী যে তাকে এত গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে তা তাযীম বুঝতে পারে। বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপে হাসে। চোখের ইশারায় কিছু বলে তটিনীকে। তটিনী ল’জ্জা পায় তাতে। আর একবারও তাযীমের দিকে না তাকিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।

ভেতরে এলে রুমে থাকা আয়নায় চোখ পড়ে তার। সেদিকে তাকিয়েই কিছু সময় সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অতঃপর বিছানায় বালিশের দিকে তাকায়। দোপাট্টা নামক বস্তুটা অ’ব’হে’লা’য় তার নিচে পড়ে আছে।

#চলবে।

রজনীপ্রভাতে পর্ব-০৫

0

#রজনীপ্রভাতে (পর্ব-৫)
লেখনিতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৯.
বাহিরে বের হতেই তটিনীর মনটা ভালো হয়ে গেল। আশেপাশে তেমন কেউ নেই, কি নিরিবিলি সবটা! এই এত সুন্দর আলোকসজ্জা, রঙিন কাপড়, বাহারি রঙের ফুলে সাজানো গার্ডেনে হাঁটতে অসম্ভব ভালো লাগছে তার। ভাবে দুটো ছবি তুললে মন্দ হয়না। কিন্তু ছবিটা তুলে দিবে কে? পাশে হাঁটতে থাকা তাযীমের দিকে এক পলক তাকিয়ে সে চোখ সরিয়ে নেয়। উহু! তাযীমকে বলা যাবে না। মোটেও না! তাযীমকে না বললেও তাযীম বোধহয় বুঝতে পারে। তটিনীর সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,

-‘ছবি তুলবে তটিনী?’

আহা! এমন মিষ্টি মধুর করে আগে কি কেউ তার নামটি ডেকেছিল? তটিনীর মনে হলো এই ডেকে ডেকে হলেও মানুষটা তার মন জয় করে নিতে পারবে। তটিনীর এটাও মনে হলো, আগে তাকে বুচি ডেকে তাযীম ভালোই করেছে। নয়তো সেই অল্প বয়সেই আরো কঠিন অসুখ হতো তার। আচ্ছা? তখনকার অসুখটা এখন হচ্ছে না তো? না না! চাই না তার এই অসুখ। সে সুখ কাতরে। তার শুধু সুখই লাগবে। তাই হয়তো এত মধুর আহ্বান উপেক্ষা করতে পারল সে। তাযীমকে পরোয়া না করেই গটগট পায়ে হেঁটে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। তাযীম তাতে একটুও দুৃঃখ পেল না। যেন সে জানতো এমনি হবে। আর তটিনী না বললেও চুপচাপ পকেট থেকে ফোনটা বের করে পেছন থেকেই হেঁটে চলা তটিনীর দুই তিনটা ছবি তুলে নিতে কিন্তু সে ভুলল না।

গাড়ির কাছে এসে তটিনী দেখল ভেতরে ড্রাইভার বসা আছে। উপরে উপরে তা নিয়ে খুশি হলেও ভেতরে ভেতরে তার বারবার মনে হচ্ছিল যদি সে আর তাযীম একা থাকত তবেই ভালো হতো। নিজের এই ভেতরের এই দু’ষ্ট চাওয়াকে সে তাই শা’সি’য়ে উঠল। আস্ত এক বে’হা’য়া মন বলে ভর্ৎসনা করল।

তাযীম এগিয়ে এসে পেছনের দরজাটা খুলে দিলো যখন তখন তার এই ভালো মানুষ সেজে থাকা আর হলো না। মনটা গলতে থাকে তার অবিরত। ল’জ্জায় তার মাথা নত হয়। ছিঃ ছিঃ শেষমেশ কিনা শ’ত্রুকে মন দিতে হলো? এর থেকে আর ল’জ্জাজনক কিছু আছে! তটিনী মনে মনে ঠিক করে ফেলল বাড়ি গিয়ে সে আর ফিরবে না। তমাদের বাড়ি গিয়ে থাকবে দরকার পড়লে তবুও আসবে না। সে এই পুরুষটির ধারে কাছেও আর আসবে না। অপ্রিয় মানুষটাকে ভালোবেসে মোটেও নিজেকে ক’ল’ঙ্কি’ত করবে না।

সিটে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে ফেলতেই সে অনুভব করল পাশে আরেকজন এসে বসেছে। চমকে উঠে চোখ মেলে পাশে তাযীমকে দেখে আরেক দফা চমকায় সে। হড়বড়িয়ে বলে ওঠে,

-‘আপনি এখানে কেন! সামনে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসুন।’

তাযীম সে কথার ধার ধারে না বরং হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে। তটিনী রা’গ হয়। গম্ভীর মুখে বলে,

-‘আপনাকে কিছু বলেছি।’

-‘শুনেছি।’

-‘তাহলে এখনও এখানে বসে আছেন কেন?’

তাযীম একটু নড়চড়ে বসল। খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,

-‘লিসেন! আজ সারাদিন আমার অনেক ধকল গেছে। আই আম টায়ার্ড নাও। পেছনে হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসব এখন। বিকজ আই রিয়েলি নিড রেস্ট।’

-‘বেশ, তবে আমি সামনে বসছি।’

-‘ইয়াহ শিওর ইউ ক্যান বাট আতিক মানবে না। কিরে আতিক! পাশে মেয়ে মানুষ বসলে তোর সমস্যা নেই তো?’

আতিক দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,

-‘আছে ভাই। সমস্যা আছে।’

তাযীম মুখ দিয়ে একটা আফসোসের সুর বের করে বলল,

-‘ইশ! বেচারাটা পাশে মেয়ে মানুষ নিয়ে বসতে পারে না। তটিনী? তোমাকে বোধহয় আমারই রাখতে হবে।’

তটিনী উত্তর করল না। আগের মতো চোখ বন্ধ করে একদম চুপ করে গেল। এই এতটা পথে একবারও চোখ মেলে পাশে থাকা তাযীমকে তাকিয়ে দেখলো না, কোনো কথাও বলল না। শুধু সবটা অনুভব করে গেল। পাশে থাকা অপছন্দের মানুষটাকে প্রাণ ভরে অনুভব করল।

১০.
বাড়ি এসে প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে তাযীমের হাতে তুলে দিয়ে সে বিনয়ের সাথে বলল,

-‘সব দেওয়া আছে এই ব্যাগে। নিয়ে যেতে পারেন।’

তাযীম ভ্রু কুঁচকে বলল,

-‘অর্থাৎ?’

-‘আমি আর যাচ্ছি না। তাই।’

-‘কেন?’

-‘সেটা বলার প্রয়োজন বোধ করছি না।’

-‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

তাযীম কোনো কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে গেল। তটিনী অবাক হয়ে চৌকাঠৈই দাঁড়িয়ে রইল। আশ্চর্য মানুষটার কাছে তার যাওয়া না যাওয়া নিয়ে কোনো ভাবান্তর হলো না। অথচ সে কিনা তাকে নিয়ে আনমনে কত কিছু ভেবে চলেছে।

ভাঙ্গা মন নিয়ে দরজাটা যখন বন্ধ করল তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলতেই তাযীমের হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখা গেল। তটিনী কিছু বলবে তার আগেই সে বলে উঠলো,

-‘ব্যাগে সব তো দেওয়া নেই।’

তটিনী অবাক হয়ে বলল,

-‘সব দেওয়া নেই মানে? সবই দেওয়া হয়েছে। ভালো করে দেখেছেন তো!’

-‘দেখেছি কিন্তু কিছু মিসিং। আরো কিছু আমার সাথে করে নিয়ে যাওয়ার কথা।’

-‘আর কী?’

তাযীম চমৎকার হেসে বলল,

-‘তুমি ছাড়া আর কী!’

#চলবে।

রজনীপ্রভাতে পর্ব-০৪

0

#রজনীপ্রভাতে (পর্ব-৪)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৭.
তটিনীর মাথাটা সেই সকাল থেকে হালকা ধরে আছে। গতরাতে হাবিজাবি চিন্তা ভাবনা করে ঠিক মতো ঘুমায়নি মেয়েটি। শেষ রাতে যাও চোখ লেগে এসেছিল পাঁচটা বাজতেই আবার ফুফুর ডাকাডাকিতে উঠতে হলো। সবাই মিলে একসাথে নামায আদায় করে আবারও যখন একটু ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে তখন আয়রা আর তাকে ঘুমাতে দেয়নি। ভালো সুযোগ পেয়ে তারা দুজন আনিকা, তানিয়া আর চন্দ্রমল্লিকা সহ বসে চন্দ্রমল্লিকার আনা লাগেজটা খুলল। তারপর যার যার জন্য আনা উপহার সামগ্রী যা যা ছিল সব নিজেদের মধ্যেই ভাগাভাগি করে নিলো। এরপর আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে তো আর ঘুমানো হয়নি। তাই এখন তার মাথাটা ব্যথায় টনটন করছে।

ছোট ফুফু কড়া লিকারের এক কাপ চা দিয়ে গেছেন কিছুক্ষণ আগে। তটিনী একটু একটু করে সেই কাপে চুমুক দিচ্ছে আর বাহিরের লনের দিকে তাকিয়ে আছে। চা শেষ করে উঠবে যখন তখন দেখল মেইন গেইট দিয়ে তাযীম প্রবেশ করছে। তাকে দেখে তটিনী নড়ল না। অপলক তাকিয়ে থাকে তাযীমের দিকে। তাযীমও তখনই চোখ তুলে তার দিকে তাকালো। ওমনি ধরা পড়া চো’রের মতোন তটিনী সেখান থেকে সরে পড়ল। সেখান থেকে সময় মতো সরে এলেও মাথা থেকে তার তাযীম ভূত যাচ্ছিল না। এক সকাল পুরোটা তাযীমের খেয়ালেই কাটালো। আর আশ্চর্যজনক ভাবে এরমধ্যে একটিবারও তার মাথা ব্যথা অনুভব হলো না। বরং একটু ভ’য় তারই সাথে অদ্ভুত অন্যরকম মিষ্টি একটা অনুভূতিময় চিন্তায় মত্ত ছিল। তার মনে মনে এমন এমন ভাবনা আসছিল যা সে কখনোই ভাবতে চায়নি কিংবা সেসব চাওয়ার মতোই ছিল না। অথচ আজ কোন অলক্ষে যে সে এসব ভেবে যাচ্ছে! সে তার এসব চিন্তা-ভাবনা আর অনুভূতির কথা ম’রে গেলেও কাউকে বলতে পারবে না। ভাগ্যিস, কেউ কারো মন পড়তে পারে না! নয়তো তটিনীর কী হতো?

দুপুরের দিকেই আয়োজন জমে উঠল। একে একে অনেক অতিথি আসতে লাগল। এর মধ্যে বেশির ভাগকেই তটিনী চেনে না। খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই সবাই যে যার মতো ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। কে কার আগে তৈরি হবে এমন একটা প্রতিযোগিতা লেগে যায়। সেই সকলের সাথে তটিনী তাল মিলিয়ে চলতে পারল না। সন্ধ্যার একটু পরে যখন সবাই ঝাক জমক পোশাক পরিধান করে, সুন্দর করে সেজে তৈরি, অনুষ্ঠানও শুরু হবে এমন সময়ে সে তৈরি হতে গেল। মেহেন্দি উপলক্ষে মেয়েরা সবাই লেহেঙ্গা পরবে। সবার মতো সেই লাল আর সবুজের মিশ্রণের লেহেঙ্গাটা তটিনী যখন পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালো তখন তার নিজেরই কেমন ল’জ্জা লাগছিল। বারবার মাথায় ওই একজনই এসে তাকে ল’জ্জায় ফেলছিল। একসময় ল’জ্জা শ’র’মকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল আর এসব উল্টোপাল্টা ভাববে না। মানুষটার থেকে দশ হাত দূরে থাকতে হবে কম করে হলেও। ভুলে গেলে চলবে না সে শ’ত্রু।

রুম থেকে বের হতেই তটিনীর প্রতিজ্ঞাটা নড়ে গেল। আগের মতো দুরুদুরু বুক কাঁপা, হঠাৎ দেখা হলে কেমন ল’জ্জা বা অ’স্ব’স্তিতে পড়তে হয় এই ভেবেই অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল তার। বোনদের সাথে তাই দল বেঁধে ডালা নিয়ে ছাদে গেল না। সবাই যখন উপরে উঠল নিচে যখন টুকটাক দুই একজন ঘুরছিল তখন সে ধীর পায়ে সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেল। ভারী লেহেঙ্গাটা একটু উপরে তুলে ধরে সিঁড়িতে এক পা ফেলতেই পেছন থেকে সেই ভারী গলার স্বরটা শুনতে পায়।

-‘সাহায্য লাগবে?’

আকস্মিক চিরচেনা গলা স্বরটা শুনতে পেয়ে চমকে উঠল তটিনী। চট করে পেছনে ঘুরতে নিলেই পা পিছলে পড়তে নেয় ওমনি পেছনের মানুষটা তাকে আগলে নেয়। তটিনী ধাতস্থ হয়ে দ্রুত সরে আসে মানুষটার কাছ থেকে। দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,

-‘না লাগবে না।’

তাযীম আর কিছু বলল না। তবে দাঁড়িয়ে রইল আগের মতো। তটিনীও উপরে আর উঠল না। তাযীমকে উপরে ওঠার জায়গা করে দিয়ে কিছুটা সরে দাঁড়ালো। তারপরেও যখন তাযীম গেল না তখন তটিনী তার দিকে সরাসরি তাকালো।

-‘কি হলো? যাচ্ছেন না যে!’

তাযীম যেন কৌতূক করে বলল,

-‘কোথায় যাব?’

কিছুটা বি’র’ক্ত হয়েই তটিনী জবাব দিলো,

-‘কোথায় আবার! ছাদে যাওয়ার কথা বলছি।’

-‘ওহ ছাদে! যাব তো। তুমি আগে যাও আমি পিছনে আসছি। তোমার যা অভ্যাস, বলা তো যায় না দুই সিঁড়ি গেলে আবারও না পা ফঁসকায়! আমি আগে চলে গেলে তখন ধরবে কে?’

তটিনী কথাগুলো শুনে হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল তাযীমের দিকে। না! বিন্দু মাত্র পরিবর্তন হয়নি। লোকটা সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। সুযোগ পেলে তাকে কথা শোনাতে ছাড়ে না। এখনিই আবার বুচি না ডেকে বসে এই ভেবেই সে পা বাড়ালো। প্রতি সিঁড়িতে খুব সাবধানে পা ফেলে সে ছাদে উঠল। আর সে এই পুরোটা সময় একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তাযীমের অস্তিত্ব এত কাছ থেকে অনুভব করছিল সে যে তার বাদ বাকি সব সে ভুলেই বসেছিল। কড়া পুরুষালি পারফিউমের ঘ্রাণটাও তাকে আরো বেশি বেসামাল করে দিচ্ছিল। তটিনীর হুট করেই আফসোস হচ্ছিল নিজের জন্য নয়, তাযীমের জন্য। একটা এত সুন্দর, বলতে গেলে অনেক বেশিই সুদর্শন যুবকটা এত বি’শ্রী ভাষার অধিকারী কেন? হ্যাঁ, তটিনীর কাছে তার ভাষা বি’শ্রীই লাগে। খুব খুব খুব!

৮.
মেহেন্দি অনুষ্ঠানটা বেশ জমজমাট ছিল। সবাই বেশ হৈ হুল্লোড় করছিল। বড় ছোট সবাই পুরো অনুষ্ঠানটা উপভোগ করছিল খুব করে। আর তটিনী তাদের এই আনন্দ উল্লাস দেখে দুঃখী মুখ করে বসে থাকল। তার একটা সময় বুক ভাঙা কান্না আসছিল। কিন্তু কাঁদল না। তার নিজের উপর রা’গ হচ্ছিল বারবার। একটা অভদ্র লোককে নিয়ে এত ভাবার কি দরকার তার? কেন সে এত বেশি ভাবছে তাকে নিয়ে! তার চিন্তা-ভাবনা, মন মানসিকা এমন কেন? দুদিন আগেও যার জন্য সে ফুফুর বাড়িতে আসত না, সে তাদের বাড়িতে গেলে লুকিয়ে থাকত, বড় কথা যাকে সে অনেক অনেক বেশি ঘৃ’ণা করত তাকে নিয়েই কেন এতসব ভাবছে সে? হাত পাঁ কেন ঠান্ডা হয় তার কথা ভাবলে? কেন তার কাছাকাছি গেলে বুক কাঁপে? কেন তাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে?

নাঁচ গান এসবের মাঝপথেই তটিনী ছাদ ছাড়ল। তার এসব আনন্দ সইছে না। ভালো লাগছে না কিছু।

নিচে এসে আয়রার রুমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় তটিনীকে ‘টিনী’ বলে ডেকে উঠল একজন। সেই একজনকে চিনতে তটিনীর অসুবিধা হলো না। টিনী তো একজনই ডাকে তাকে। মোর্শেদ ভাই! পেছন ফিরে দেখল মোর্শেদই দাঁড়িয়ে আছে। তবে সাথে আরো একজন মানুষও আছে। যে মানুষটার জন্য বর্তমানে তটিনীর অন্তরে শান্তি নেই। তাকে দেখেই তটিনী আবার ঘুরে দাঁড়ালো। পেছন থেকে মোর্শেদ এবার জোরে ডাকল আগের তুলনায়;

-‘টিনী, আমি ডাকছি তো তোকে!’

তটিনী পুনরায় পেছনে তাকালো। মোর্শেদ ভাই রে’গে যাচ্ছেন বোধ হয়। এই মানুষটা শান্ত থাকলেই ভালো। রা’গানো ঠিক হবে না। তাই সে আর অন্যদিকে না গিয়ে বরং মোর্শেদের কাছেই এগিয়ে এসে বলল,

-‘বলো ভাইয়া।’

-‘তুই ব্যস্ত?’

-‘না।’

-‘বেশ বেশ! তবে এক কাজ কর। যীমের সাথে একটু যা তো।’

তটিনী আকাশ থেকে পড়ল বোধ হয় এই কথা শুনে। ভ্রু কুঁচকে বলল,

-‘কার সাথে? কোথায় যাব?’

-‘আহা! তাযীমের সাথে যা। ছেলেটা একা হাতে কত কাজ করবে বল! আমার একটা কাজ থাকায় যেতে পারছি না। তুই একটু যা না।’

-‘কিন্তু কেন?’

-‘দাদীর পেটে ব্যথা উঠেছে। এখন তার ঔষুধ আনতে বাড়ি যেতে হবে।’

-‘তো! অন্য কাউকে বলো।’

-‘অন্য আর কে যাবে? যাকে বলছি সে বলছে ব্যস্ত আছে। তুই তো ব্যস্ত নেই। তুই যা না! তাযীম যাবে তো সাথে।’

-‘এখানে আশেপাশে পাওয়া যাবে না ঔষুধ টা?’

-‘দাদী বারবার বলছে সে তার ঔষুধ গুলোই খাবে। আশপাশ থেকে কিনে আনতে পারলে তো হতোই। সে আরও বলেছে বাড়িতে তার কি একটা কাপড় আছে সেটাও আনতে। তুই যা জিজ্ঞেস করে নে কোনটা। তারপর গিয়ে নিয়ে আয়।’

-‘কিন্তু আমিই কেন?’

-‘যা না! তাযীমের সাথে যা। তাযীমকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারিস।’

তটিনী মোর্শেদের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারবে কিনা সে জানে না। তবে এখন চোখ বন্ধ করলে সে ওই তাযীমকেই দেখতে পায়। তটিনী তাযীমের দিকে তাকালো। তাযীমও এতক্ষণ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। সে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। আর ওমনি ল’জ্জায় মুখ অবনত হলো তার।

#চলবে।

রজনীপ্রভাতে পর্ব-০৩

0

#রজনীপ্রভাতে (পর্ব-৩)
লেখনীতে— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৬.
আয়রার চাচাতো আর ফুফাতো বোন গুলোর আচার-আচরণ একটু অদ্ভুত। তটিনীকে কেমন বিরক্তির নজরে দেখছে। আয়রা চাইলেও তটিনীর দিকে নজর রাখতে পারছে না। এই এত এত অবজ্ঞা, অবহেলা আর একাকীত্বটা তটিনী ঠিক সইতে পারছে না। সে আয়রার বারান্দায় দোলনায় বসে আছে আর একা একা বসেই নানান চিন্তা ভাবনা করছে ভবিষ্যৎ নিয়ে। এই এত চিন্তা ভাবনার মাঝে হুট করেই তার দুষ্টু মনে তাযীমকে নিয়েও চিন্তা এলো। অ’সভ্য লোকটা কী করছে জানতে ইচ্ছে করল। নিজের কৌতূহলী মনের এই স্পর্ধা দেখে তটিনী নিজেই অবাক না হয়ে পারল না। আশ্চর্য! তাযীমকে নিয়ে সে কি করে ভাবতে পারে? ধুর! ভাবনার মাঝেই তটিনীর দৃষ্টি পড়ল বাড়ির গেটের দিকে। একটা গাড়ি ঢুকছে। গাড়িটা এক পলক দেখেই সে চিনে ফেলল। বারান্দার রেলিং ধরে ঝুলে নিচে তাকালো। গাড়ি থেকে মোর্শেদ আর আফজাল নামার পর চন্দ্রমল্লিকা নামে। তাকে দেখে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল সে।

-‘আপা!’

চন্দ্রমল্লিকা ডাক শুনে উপরে তাকায়। বোনকে দেখে হেসে হাত নাড়ায়। তটিনী আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ায় না। দৌঁড়ে রুমে ঢুকতেই আয়রা প্রশ্ন করল,

-‘কীরে! দৌঁড়ে কোথায় যাচ্ছিস?’

তটিনী সময় নেই যেন এমন ভাবে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল,

-‘মেজো আপা এসেছে!’

-‘কি বলছিস!’

আয়রা যেন হুট করেই চাচাতো, ফুফাতো বোন গুলোকে ভুলে গেল। সেও তটিনীর পিছু পিছু রওনা হলো চন্দ্রমল্লিকাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।

নিচে এসে তটিনী দেখল চন্দ্রমল্লিকাকে জড়িয়ে ধরে আছে তার মা। তা নিয়ে তাদের দাদী বেশ রে’গে আছেন। তিনি আগে নাতনিকে জড়িয়ে ধরে খোঁজ খবর নিবেন ভেবেছিলেন। ছেলের বউয়ের এই এত বড় কাজটা তিনি মেনে নিতে পারলেন না। অগত্যা অসহায় চন্দ্রমল্লিকাকে আর সবাইকে ভুলে দাদীকে নিয়ে ব্যস্ত হতে হলো। ইশারায় তটিনী আর আয়রাকে নিজের লাগেজ দেখিয়ে দিতেই দুজনে খুশি হয়ে গেল। বুঝতে পেরে যায় তারা যে রাতটা বেশ ভালো কাটবে।

লাগেজটা নিয়ে আয়রা নিজের রুমে এলো না। তটিনীকে অবাক করে সে তাযীমের রুমের দরজায় কড়া নাড়ে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে তাযীম দরজা খোলে। ছেলেটা বোধ হয় সবে মাত্রই গোসল সেড়ে বেরিয়েছে। কেন যেন তখন তাকে দেখতে তটিনীর খুব ভালো লাগছিল। কিন্তু এই এত ভালো লাগার হঠাৎ উদয় হওয়ার কারণ কী সে বুঝে পায় না। নিজের উপর খুবই বিরক্ত হয় সে। কী অদ্ভুত ব্যাপার। যে ছেলের জন্য সে এই বাড়িতে আসা বন্ধ করেছে, যার থেকে নিজেকে বছরের পর বছর লুকিয়ে রেখেছে হঠাৎ আজ তার আশেপাশে থাকতেই কত ভালো লাগছে! তাকে একবার দেখলে আবারও দেখতে ইচ্ছে করছে। এত বছরের জমিয়ে রাখা রা’গ, ক্ষো’ভ গুলো কোথাও যেন কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেছে। মোট কথা সব মিলিয়ে তটিনী নিজের কাজে খুবই ল’জ্জিত। তাই আয়রাকে ব্যস্ততা দেখিয়ে জলদি সেখান থেকে চলে এলো। পেছনে দুই ভাই বোন কি নিয়ে আলাপ চালিয়ে গেল তা আর সে জানতে পারল না।

দাদীর থেকে বিশ মিনিট সময় পর মুক্তি মেলে চন্দ্রমল্লিকার। মা, ফুফু, বাবা, চাচা সহ বাকি সব ভাই-বোনের সাথে কথা বলে উপরে আসতে আসতে তার আরো কিছুক্ষণ সময় লেগে যায়।

আয়রার সেই চাচাতো, ফুফাতো বোন গুলো চন্দ্রমল্লিকাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। আয়রার কাছে আর প্রথমের মতো ভাও না পেয়ে তার রুম ছাড়ে। তবে যাওয়ার সময় আয়রার চাচাতো বোন নুহা নিজেদের মধ্যেই বলছিল,

-‘বাহ্! এতো সুন্দর একটা মানুষ!’

তাদের ফুফাতো বোন রুশা সেটা শুনে ঠোঁট বাঁকা করে ব্যঙ্গ করে বলল,

-‘আরে ফুট! সব প্লাস্টিক!’

ইচ্ছে করেই কথাটা যেন শুনিয়ে বলল। আয়রা ভীষণ রে’গে যায়। কিছু বলবে তার আগেই চন্দ্রমল্লিকা তার হাত ধরে ফেলে। ইশারায় বোঝায় সবার সব কথা ধরতে নেই। এত এত ভালো মানুষের মধ্যে দুই তিনটা ম’ন্দ মানুষের কথা নিয়ে ভাবার এত দরকার কী?

ছোট ফুফু এসে সবাইকে চা সাথে আরো কিছু খাবার দিয়ে গেল। তটিনীর চা দেখে মনে পড়ল সন্ধ্যা থেকে এত খারাপ লাগার আরেকটা কারণ হলো চা না খাওয়া। সে ঝটফট চা হাতে নিলো। এরপর তারা তিন বোন গল্পে মেতে উঠল। একটু পরেই তানিয়া আর আনিকাও এসে পড়ল। এরপরই কাজিনদের আড্ডাটা জমে উঠল। বহু দিন পর সবাই একসাথে খুব সুন্দর একটা মুহূর্ত কাটালো।

৭.
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমানোর পালা এলো যখন, তখন দেখা গেল আয়রার ফুফাতো বোনরা আয়রার সাথে ঘুমাতে চলে আসে। আয়রা তাদের মুখের উপর মানা করতেও পারে না। এদিকে এখন তটিনী কোথায় ঘুমাবে সেই নিয়ে যত সমস্যা দেখা দিলো।

তটিনীর ঘুমানোর সমস্যাটা শেষ পর্যন্ত তাযীমের কানে গেল। তটিনী আর আয়রা তখন হল রুমে বসে আছে। তাযীম কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে কেউই খেয়াল করেনি।

-‘ঘুমাতে যাচ্ছিস না কেন আয়রা?’

আয়রা আর তটিনী দুজনেই চমকে উঠল। তাযীমকে দেখে তটিনী সোজা বসে থেকেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। ব্যাপারটায় তাযীমের একটু হাসি পায়। তটিনী স্পষ্ট দেখল তার ঠোঁটের কোণে আড়াল করতে চাওয়া হাসিটা।

-‘এই তো ভাইয়া যাচ্ছি।’

-‘শুনলাম রুম নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে!’

-‘হ্যাঁ, আসলে রুশারা বলছিল আমার রুমে ঘুমাবে। আর আমি আর তটিনী তো একসাথে ঘুমাবো বলে ঠিক করেছিলাম।’

-‘সাফাদের রুম খালি নেই?’

-‘ওরা সেখানে শোবে না।’

-‘ওহ্! বাড়িতেও কি আর রুম খালি নেই?’

আয়রা মাথা দোলায়। না, খালি নেই আর। তাযীম এক পলক তটিনীর দিকে তাকালো।মেয়েটা যে খুবই বিরক্ত আর অস্বস্তি বোধ করছে তা সে ভালোই বুঝতে পারছে।

-‘আচ্ছা, ওরা যেহেতু তোর রুমে ঘুমাবে তবে ওরা সেখানেই ঘুমাক। তুই ও’কে নিয়ে আমার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়।’

-‘ওমা! তবে তুমি কোথায় শুবে?’

তাযীম নিজের ফোনের স্ক্রিনে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,

-‘আমি চন্দ্রদের বাসায় যাচ্ছি।’

আয়রা যেন কথাটা শুনে বেশ অবাক হলো। উৎকন্ঠা নিয়েই বলল,

-‘চন্দ্র ভাইয়াদের বাসায় যাবে মানে কী! তুমি তো ভাইয়া না থাকলে সেই বাসায় যাও না।’

-‘চন্দ্র দুপুরে এসেছে। বাড়িতেই আছে। আচ্ছা, আমি যাচ্ছি, তোরা আমার রুমে চলে যা। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়। মাকে বলে রেখেছি। কেউ ডিস্টার্ব করবে না।’

তাযীম চলে যেতেই তটিনীর হুট করে কেমন খালি খালি অনুভব করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল কি যেন একটা নেই! আবার একটা নতুন ভালো লাগায়ও কেন যেন মন ছেয়ে গেল।

তাযীমের রুমটা বেশ বড়, গোছানো আর পরিপাটি। ছেলেদের রুম এত সুন্দর হয় তটিনী বোধ হয় জানত না। আফজাল আর মোর্শেদ খুব অগোছালো ধরনের। আফজাল যদিও কম মোর্শেদ যেন একটু বেশিই অগোছালো। ভাইদের অগোছালো স্বভাব দেখে তটিনী ভেবেই বসেছিল সব ছেলেই এমন। আসলে তা নয়। কিছু ছেলেও বোধ হয় ঘর গুছিয়ে রাখতে জানে।

বিছানায় যখন গা এলিয়ে দিলো তখন একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল তার। এই বালিশ আর বিছানা সব কিছুতেই তো তাযীমের ছোঁয়া আছে। উলটো পালটা চিন্তা মাথা থেকে দূর করার জন্য চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না। সেখানেও তাযীমের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল। তড়িৎ গতিতে চোখ মেলে সে মনে মনে আওড়ায়,

-‘ধুর! ধুর! ধুর!’

#চলবে।

রজনী প্রভাতে পর্ব-০২

0

#রজনী_প্রভাতে (পর্ব-২)

৪.
তটিনী আয়রার সাথে এক রুম থাকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আয়রাও বারবার করে বলেছে সে যেন তার রুমে থাকে। তটিনীও আপত্তি করল না। বরং কনের সাথে থাকার মজা সে উপভোগ করতে চাইছে। সন্ধ্যায় একে একে তটিনীর বাকি ফুপুরা আর বাড়ি থেকে বাবা-মা, চাচা-চাচীরা, ভাই-বোন সব চলে এলো। অবশ্য সব নয়, একজন তখনও এলো না। তটিনীর মেজো বোন মুনিরাহ। মুনিরাহ অবশ্য ওর বাড়ির নাম। ভালো নাম চন্দ্রমল্লিকা। চন্দ্রমল্লিকা চৌধূরী। মা শখ করে রেখেছেন। চন্দ্রমল্লিকা যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সবাই বেশ অবাক হয়। কারণ বাচ্চাটা ওজনে আর আকারে একটু বড় হয়েছিল তার উপর গায়ের রঙ যা ফর্সা! ঠোঁট দুইটা যেমন টু’ক’টু’কে লা’ল ছিল জন্মের সময় এখনও তেমন। চন্দ্রমল্লিকার লিপস্টিক লাগেনা। বোনদের মাঝে, কাজিন মহলে কিংবা বন্ধু মহলে বা পাশের বাড়ির আন্টিদের গি’ব’তেও তার এই চেরির মতো ঠোঁটটা নিয়ে কথা হয়। চন্দ্রমল্লিকার চুল গুলো ঘন কালো। চন্দ্রমল্লিকা ছোট বেলা থেকেই একটা অন্যরকম শা’স’নে বড় হয়েছে। তার বাকি বোনদের মতো সে যখন তখন বাড়ি থেকে বের হতে পারেনা। সে মেহমানের সামনে যেতে পারেনা। বাকি বোনদের মতো ফেসবুকে ছবি ছাড়তে পারেনা। সবসময় কানের নিচে কা’লি দিয়ে রাখতে হয়। দাদি সাথে থাকলে দিনে দশবার ন’জ’র কা’টানোর দোয়া পড়ে ফুঁ দেয়। এই এত গুলো কাজের কারণ হলো মেয়েটির রূপ! ছোটবেলা থেকে অ’সুখ তার লেগেই থাকে। হাদিসে বলা আছে ব’দ ন’জ’র সত্য। এই ব’দ ন’জ’র উটকে হাঁ’ড়িতে নিয়ে যেতে পারে। তবে এর মানে এটা নয় কু’সংস্কার মানতে হবে! তবে তার মা সবরকম পদ্ধতি প্র’য়ো’গ করে মেয়ের উপর। বারো বছর বয়স থেকে এই মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হয়। তা নিয়েও তার বাবা-মা ভীষণ রা’গ করতেন। আবার ছেলেরা রাস্তা ঘাটে মেয়েটাকে খুব টি’জ করতো। পরবর্তীতে আর এসব সইতে না পেরে মেয়েকে তার মামার কাছে অর্থাৎ আমেরিকাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ক’ষ্টটা কমে খানিকটা। কারণ সেখানেও ফর্সা লাল ঠোঁটের মেয়ে আছে। তবে ওই যে ঘন কালো কেশ, চেহারার আলাদা কাটিং, নম্র গলার স্বর! ওইসব কিছুর জন্য সেখানেও তার একটা অন্যরকম কদর ছিল। তবে সেখানে মেয়েটি এখানকার ব’খা’টেরা যেমন ডি’স্টা’র্ব করত সেই ডিস্টা’র্বের শি’কা’র হয়নি। মাঝে মাঝে তার মা এবং দাদীর মধ্যে তাকে নিয়ে একটা ল’ড়া’ই হয়। ল’ড়া’ইয়ের বিষয়টা হলো সে এত সুন্দর হয়েছে সব তাদের পূণ্যের ফল। মা বলে মা ভালো কাজ করেছে, দাদী বলে দাদী। দাদী সবসময় যুক্তিতে জিতে যায়। দাদী জী’ব’নে যত নামায কালাম পড়ছে তার ধারে কাছেও তো তাদের মা যেতে পারেনি এই সব বলে খোঁ’চা মারে। তারপর দাদী আরো বলেন,
-‘আমার দাদীবু আছিল সুন্দরী। একবার চাইলে মন ভরত না। তাকাই থাকার মতোন। আমগো মুনিরাহ তার মতোই হইছে। তোমার গোষ্ঠীত কে আছিল এমন সুন্দর! আমার পোলাও তো কম সুন্দর না! তার বাইচ্চা সব কয়ডায় তো ধলা হইছে। তো তোমার তো রঙ ময়লা। তোমার বংশেও সব এমন। আমগো কেউ আছেনি এইরকম! শুধু আমার মোর্শেদ আর মোর্শেদের বাপ খোরশেদ একটু কম ধলা।’

তটিনীর মা নুরাইসা শ্যাম বর্ণের। তাই বলে শ্বাশুড়ির থেকে সবসময় তাকে এমন কথা শুনতে হয়। তবে তিনি এটা জানেন যে শ্বাশুড়ি তাকে খুবই ভালোবাসেন। তবুও যখনিই এমন করে বলেন তখন সে কেঁ’দে কু’টে ঘর ভাসিয়ে দেয়। অবশ্য তটিনীর দাদী সবসময় এমনটা বলেন না। ত’র্কে টি’কতে না পারলেই দুর্ব’লতায় টা’ন মা’রে।

চন্দ্রমল্লিকা আমেরিকা থেকে আসছে আজকে। এবার একটু দেরিতেই ফিরছে সে। কারণ পড়ালেখার পর্ব শে’ষ করে আসছে। দেশে একেবারের জন্য ফিরছে কীনা সেটা এখনও নিশ্চিত নয় কেউ। তার আসার কথা ছিল আরো একমাস পরে। তবে আয়রার বিয়ে ঠিক হওয়াতে আরো আগেই চলে আসছে।
ঢাকায় আসতে তার রাত আটটা বেজে যাবে। মোর্শেদ আর আফজাল এয়ারপোর্টে গেছে তাকে রিসিভ করতে। তারা সেখান থেকে প্রথমে বাড়ি যাবে। দরকারি সব কিছু রেখে তারপর বিয়ে বাড়ি আসবে। কারণ বিয়ে বাড়ি সে’ফ থাকেনা। তার অনেক দরকারি কাগজপত্র আছে, পাসপোর্ট ভিসা আছে। সব বাড়িতে আগে ঠিক মতো রেখে আসতে হবে। নুরাইসা বেগম বারবার ছেলেকে বলেছেন সে ও সাথে যাবে। আফজাল স্পষ্ট বা’র’ণ করেছে। তা নিয়ে রা’গ করে তিনি শ্বাশুড়ির কাছে বসে ছেলের নামে বি’চা’র দিচ্ছেন। তার শ্বাশুড়ি শরীফা বেগম ও তাল মিলিয়ে বলছেন,
-‘আফজাইল্লা নিজেরে কী মনে করে! এরে ধ’ম’কা’য় ওরে ধ’ম’কা’য়! ঔষুধ আমার! আমার মনে চাইলে আমি খামু। তুই ডাক্তার তো কী মাতা কিনা ফালাইছস! আমারে ঠুইসা ঠুইসা তুই ওই সব গিলাস। ক্যারে! তোর এত সমিস্যা ক্যা! আইজ আসলে আমি আর তুমি মিলা ওর কানের নিচে থা’বড়ামু। ঠিক আছে!’

নুরাইসা বেগম চুপ করে গেলেন। আর কিছু বললেন না। শ্বাশুড়ির ভাষ্যমতে ছেলেটারে থা’ব’ড়ানোর কিছুই দেখলেন না তিনি। তার আফজাল সবাইর খেয়াল রাখে। দাদীরে একটু চা’পে রাখে কিন্তু তার নিজেরই ভালোর জন্য। এর জন্য এত বড় ছেলের গায়ে হাত তোলবার মতো তিনি কিছু দেখলেন না। শরীফা বেগম থেমে নেই। তিনি এবার চলে গেলেন মোর্শেদ এর কথায়। মোর্শেদ বিয়ে শাদি করেনা কেন সেই জন্য তাকেও গা’ল ম’ন্দ করছেন। নুরাইসা বেগম আস্তে করে বসা থেকে উঠে দ্রুত পা চালিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এলো। শরীফা বেগম তার চলে যাওয়ার পর ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আয়রার দাদীর সাথে অন্য কথা বলায়। এই মানুষটা একটু অন্যরকম। তার মুখের কথা কখন বদলে যায় টের পাওয়াও মু’শ’কি’ল।

৫.
তটিনী সারা বাড়িতে ঘুরঘুর করছে। আয়রার ফুপির মেয়েরা এসেছে। আয়রা আর তার জেঠাতো বোন ও চাচাতো বোনরা সবাই তাদেরকে সঙ্গ দিচ্ছে। আয়রা বলেছিল তাদের সাথে বসতে তবে তটিনীর একটু সংকোচ বোধ হচ্ছিল। কারণ আয়রার ফুপাতো বোন গুলোর ভাবসাবে মনে হচ্ছে তারা তটিনীর উপস্থিতি চাইছেনা। আর সেও নিজের দাম কমে যাক এমন চায়না। সে সরে এসেছে। সারা বাড়িতে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। আজকে মেহেন্দির অনুষ্ঠান করার কথা ছিল তবে সেটা কালকেই করবে। কারণ এমনিতেও হলুদ একদিন পর। অর্থাৎ পরশুদিন হলুদ। মাঝখানে একদিন গ্যাপ রেখে তারা কী আর করবে! তাছাড়া এখনও অনেকে আসেওনি। তাই আজকের প্রোগ্রামটা কালকে নিয়ে গেছে।
চারিদিকে নানান মানুষ আছে। তবে বাহিরের কেউ নয়। তাদের বাড়ির মানুষ, আয়রাদের বাড়ির মানুষ মোট কথা আয়রার দাদার ও নানার গোষ্ঠী আছে। আর কেউ নেই। তটিনীকে দেখে তার ছোট ফুপু বলল,
-‘কীরে! একা একা হাঁটছিস যে? ওদের সাথে গিয়ে কথা বল। আমি চা নাস্তা পাঠাচ্ছি। যা যা!’
-‘না ফুপু। আমি একটু ডেকোরেশন দেখতে এসেছি।’
-‘ওহ। দেখ তবে। কেমন লাগছে বলিস।’
-‘ভালোই তো লাগছে। খুব সুন্দর হয়েছে।’
-‘আচ্ছা তুই থাক। কিছু দরকার হলে বলিস। ঠিক আছে!’
-‘হুম। ফুপু মা কোথায়?’
-‘তোর মা দাদু সব আয়রার দাদুর রুমে। নিচ তলায়।’
-‘ওহ।’

ফুপু চলে যেতেই তটিনী আবারও এদিক সেদিক হাঁটতে থাকে। এক সময় নিচে নেমে আসে। ড্রয়িং রুমে তেমন কেউ নেই। সবাই কোনো না কোনো একটা রুমে বসে গল্প-আড্ডায় ব্যস্ত। সদর দরজার সামনে লাইটিং এর কাজ চলছে। তটিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। তখনিই দুই জন স্টাফ দুইটা লাগেজ আর বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ভেতরে ঢোকে। তাদের তাড়াহুড়োটা চোখে পড়ার মতোন। তারা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই আরো একজন ভেতরে প্রবেশ করল। তাকে দেখেই লাইটিং করা ছেলে পেলেরা সালাম দিল। তটিনী তখনও সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে তাই আকস্মিক ওদের কাউকে সালাম দেওয়ায় সে পেছন ফিরে তাকায়। ভরাট গলায় একটা লোক ছেলেগুলোর সালামের জবাব দিল। তটিনী ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। তার সামনে তাযীম দাঁড়িয়ে আছে। কত পরিবর্তন হয়েছে! তটিনী অপলক তাকিয়েই রইল। তাযীমের শারীরিক গঠনের উন্নতি হয়েছে। লম্বাতেও আগের তুলনায় বেশি লাগছে। ক্লিন শেইভে তটিনী তাযীমকে এই প্রথম দেখল। অসম্ভব সুন্দর লাগছে। সাদা শার্টের হাতা ফোল্ড করে রেখেছে। দেখেই মনে হচ্ছে তার সারাদিন বেশ পরিশ্রমে কেটেছে। চোখে মুখে ক্লান্তি রয়েছে। তাযীম ছেলেগুলোর সাথে কথা বলছিল কাজ আর কতদূর এই সব নিয়ে। তটিনীকে সেও খেয়াল করেনি। হঠাৎ করেই সামনে তাকাতেই তার চোখ পড়ে তটিনীর দিকে। চোখে চোখ পড়ে ক্ষণিকের জন্য। তটিনী খুব দ্রুতই চোখ সরিয়ে নেয়। তার ধারণা তাযীম তাকে চিনবেনা। তবে সে ভীষণ বোকা! যেখানে সে তাযীমকে চিনতে পেরেছে সেখানে তাযীম বুঝি তাকে চিনবেনা! তটিনীকে বহু বছর পর সামনাসামনি দেখে তাযীমও বেশ অবাক হলো। সে জানত তটিনী আসবে। তবে এভাবে হঠাৎ করেই যে তার দেখা পাবে সে ভাবেনি। তাযীম আশেপাশে তাকিয়ে দেখল আর পরিচিত কেউ নেই। সব বহিরাগত লোক যারা কাজ করতে এসেছে। সে তটিনীকে বিস্মিত করেই বলল,
-‘এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

তটিনী ভেবেছে তাযীম তাকে চিনবেও না। আর যদি চিনেও থাকে হয়তো কখনো কথা বলবেনা। কিন্তু এখানে যে ব্যপারটা উল্টো। তাযীমের সাথে কথা বলতে বা তাযীমের কথা শুনতে তার কেমন যেন লাগছে। তাযীমের ভরাট পুরুষালি কন্ঠস্বরটা তার হৃদয়ে কেমন শিহ’রণ তুলল। তাযীম আবারও বলল,
-‘এখানে একা কী করছ?’
-‘দেখতে এসেছি।’
-‘কাকে?’
-‘কাউকে না। এখানে লাইটিং এর কাজ চলছে তাই দেখছি।’
-‘যদিও এটা আহামরি দেখার কিছু না। তবে তোমার যেহেতু শখ হয়েছে দেখতে পারো। শিখে নিতেও পারো। ভবিষ্যৎে বলা তো যায় না, কখন কী কাজে লেগে যেতে পারে!’

এই লোকটার স্বভাব আর ঠিক হলো না। এমন ট’ন্ট মে’রে কথা বলে কেন লোকটা! তটিনীর রা’গ উঠে গেল। সে গুটিগুটি পায়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। প্রথমে ভাবল উপরে চলে যাবে। পরে ভাবল না, সে তার মায়ের কাছেই যাবে। তার বড় বোন তানিয়া আর আয়রার বড় বোন আনিকা ওরা শপিং এ গেছে। তাই তাদের সাথেও যে একটু বসবে তাও হচ্ছে না। তার থেকে ভালো মায়ের কাছে বা দাদীর কাছে বসে থাকবে। তটিনী সেদিকেই হাঁটা ধরে। তখন তার পেছনে অন্য কারো অস্তিত্ব সে টের পায়। পেছন ফিরে দেখে তাযীম। সে অবাকই হলো। তাযীম তার পিছু নিচ্ছে কেন! সে আবারও হাঁটা ধরল এবং খেয়াল করল তাযীমও তার পেছনেই আসছে। এবার সে দাঁড়ায় তাযীমকে কিছু বলার জন্য। তবে তাযীম পাশ কা’টিয়ে সোজা তার দাদীর রুমে ঢুকে পড়ে। তটিনী হা করে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। পরবর্তীতে নিজেকে সামলে সেও রুমে ঢোকে। দেখে তাযীমকে তার দাদী অর্থাৎ আয়রা আর তাযীমের দাদী জড়িয়ে ধরে আছেন। তার চোখে পানি। নাতিকে বহুদিন পর তিনি দেখছেন তাই এমন করে কাঁদছেন। তটিনী ভেতরে ঢুকে দেখে তার মা নেই। তবে তার দাদী আর বড় ফুপু বসে আছেন বিছানায়। সে গিয়ে বড় ফুপুর পাশে দাঁড়ায়। তাযীম একবার চোখ তুলে তটিনীর দিকে তাকালো। তাতেই তটিনী কেমন জমে গেল। সে বুঝতে পারছেনা এমন কেন হচ্ছে। তাযীম খুব সুন্দর করেই তটিনীর দাদী ও ফুপুর সাথে কথা বলল। তারা ছেলেটির আচার ব্যবহারে বেশ সন্তুষ্ট। ছেলেটি ছোটবেলা থেকেই সবাইকে মান্য করে চলে, এই সেই নানান প্রশংসা করা শুরু হলো তার। তটিনীর ভালো লাগল না এসব। এই লোক যে কেমন সেটা তার থেকে ভালো আর কেউ জানেনা। রুম থেকে সে বের হয়ে এলো। তার আসা যাওয়াতে কারো কাছে কোনো ম্যাটার করল না দেখে সে ভীষণ দুঃখ পায়। ধীরে ধীরে পা চালিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে আর ভাবতে থাকে তার মেজো আপু এলে সে আপুর সাথেই বসে থাকবে। কাউকে আপুর কাছে আসতে দিবেনা। আপুকে বলবে যে এরা তাকে দেখেও না দেখার ভান করে ছিল। সে ক’ষ্ট পেয়েছে। তটিনী ছোট্ট বাচ্চাদের মতো অ’ভি’যো’গ তৈরি করছিল। তাযীম ও যে আবার তার পেছন পেছন আসছে সে খেয়াল করেনি। হঠাৎ উপর থেকে বাচ্চা দুই তিনটা দৌঁড়ে আসে। এমন ভাবে আসে যে আকস্মিক তাদের আগমনে ঘা’ব’ড়ে গিয়ে পা স্লিপ কে’টে সে ঘুরে গিয়ে পড়ে যেতে নেয়। তবে পড়ল না। তাযীম তাকে তার শক্ত বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিল পরম যত্নে। তাযীম স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিল তটিনীর হার্টবিট বেড়ে গেছে, তী’ব্র গতিতেই হচ্ছে। ভ’য়ের চোটে তটিনীও তার গ’লা ঝা’পটে ধরল।

এইরকম দৃশ্য দেখে বাচ্চাগুলো হু হা হি হি করে হাসতে থাকে। আর ড্রয়িংরুমে উপস্থিত দুই তিনটা উঠতি বয়সি মেয়ে আর কাজের লোক হা করে তাকিয়ে থাকে। তটিনী একটু শান্ত হতেই সরে এলো তাযীমের কাছ থেকে। তাযীম তাকে বলল,
-‘ঠিক আছো!’
-‘হুম।’
-‘আমার মনে হচ্ছে ঠিক নেই। দাঁড়াও পানি নিয়ে আসছি। পানি খেলে ভালো লাগবে।’

তাযীম পানি আনতে নিচে গেল। এই ফাঁ’কে তটিনীও উপরে চলে এলো। তার চোখ মুখ ল’জ্জা’য় লা’ল হয়ে গেছে। একটু আগের পরিস্থিতি মনে করতেই তার হাত পা তখনকার থেকেও আরো বেশি ঠান্ডা হয়ে জমে যাচ্ছে। এর মধ্যেই সদর দরজা দিয়ে বাড়ির অন্যান্য পুরুষরা আর অতিথি পুরুষ যারা আছে সব ভেতরে ঢোকে, তাদের মধ্যে তটিনীর বাবা আর চাচারাও আছে। ভাগ্যিস তাদের সামনে এমন কা’ন্ড ঘটেনি।

তাযীম পানি এনে দেখে তটিনী নেই। সে বেশ রে’গে গেল। মেয়েটা এত অ’বা’ধ্য কেন? নিজের ভালো তো পা’গলেও বোঝে। এই মুহূর্তে একটু পানি খেলে তো তারই ভালো হতো। যত্তসব!
তাযীম পানির বোতলটা নিয়ে নিজের রুমে চলে আসে। রুমে ঢোকার আগে আয়রার রুমের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে। তবে তটিনীকে এখান থেকে দেখা গেল না।

#চলবে।
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

রজনীপ্রভাতে পর্ব-০১

0

রজনীপ্রভাতে (১ম পর্ব)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

ছোট ফুপির বাড়িতে বিগত কয়েকবছরেও তটিনী যায়নি। তার একটা বড় কারণ ফুপির ভাসুরের ছেলেটা। আস্ত ব’দ’মা’য়ে’শ! সবকিছুতেই তার বাড়াবাড়ি। কী কারণে যেন তটিনীকে সে ভীষণ অপছন্দ করে। অবশ্য সেটা কেবল তটিনীর মনে হয়। ওহ! ছেলেটার নামই তো বলা হলো না। ছেলেটার নাম হলো আব্দুল্লাহ আল আইমান তাযীম। খুব বড় নাম না? তবে নামটি খুবই সুন্দর, তাযীম! অর্থ শ্রদ্ধা ভক্তি করা। আশ্চর্যজনকভাবে ছেলেটি খুবই ভালো আচরণ করে সকলের সাথে। সবাইকেই শ্রদ্ধা ভক্তি করে খুব। এটা তটিনীকে মানতেই হয়। তবে তার সাথে নয়। তটিনীর মনে আছে সে যখন ক্লাশ সিক্সে তখন একদিন সে ফতুয়া আর একটা ধুতি পাজামা পড়ে সারা বাড়ি ঘুরঘুর করছিল। তাযীমের সাথে বাগানে গিয়েই দেখা হলো। তাকে দেখতেই তাযীম চোখ বড় করে ফেলল। বলল,
-‘আরে বুচি কোন ম’ন্দি’রের পু’রো’হিত তুমি? এই অনিন্দ তোদের বাসার পাশের সেই পু’রো’হিত কাকার মতো লাগছেনারে ওকে? তা খুকি পু’রো’হিত কাকা না হয় পু’রো’হিত মানুষ। তার পোশাকই হলো ধুতি। তুমি কেন পড়লে? নাকি এখন কোথাও ধিতাং ধিতাং বলে গানে নাঁচতে যাচ্ছ! কোনটা? বলো দেখি!’

অনিন্দ ছেলেটা এত হাসল! একটা অচেনা ছেলের সামনে প্রথমে বুচি বলে অ’প’মা’ন করল। তারপর বলল পুরোহিতের ড্রেস ক’পি করেছে। এই এত অপমান তার সইছিল না। অনিন্দ হাসাতে সেই অ’প’মা’নের ফলাফল চোখ থেকে মুক্তোর দানার মতো পানি পড়তে লাগল। সেই কী দৃশ্য! একটা ধুতি পরিহিতা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ভার্সিটির দুইটা ছেলে হু হা করে হাসছে। সেই কী বিকট হাসি। মনে পড়লেই গায়ে জ্বলন ধরে। এখন তটিনীর একুশ হলো। আর সেই অ’স’ভ্যে’র হয়েছে আঠাশ। বে’য়া’দ’ব’টা তার থেকে সাত বছরের বড়। এই বড় নিয়েও তার কত ভাব! তটিনী যখন নাইনে তখন একদিন এই ছোঁকড়া আবার এসেছিল। তটিনী উঠোনে দাঁড়িয়ে মুরগী ল’ড়া’ই খেলছিল। ছেলেটা এসে তটিনীকে এক ঠ্যাং তুলে দুই হাত ভাজ করে লাফাতে দেখে বলল,
-‘আরে বুচি! তুমি দেখি হাতির মত বড় হয়েছ তবুও জ্ঞান বুদ্ধিতে একদমই ছোট। এত বড় মেয়ে ধেই ধেই করে লাফাচ্ছে। খেলা রাখো আর এদিকে আসো।’

রাগে থমথমে মুখ নিয়ে তটিনী গেল। তাযীম বলল,
-‘লেবুর শরবত করে আনো তো। যা গরম পড়েছে! একেবারে মাথা খা’রা’প করা গরম।’

তটিনী শরবত করে নিয়ে আসে। কেননা যতই সে তাযীমকে অপছন্দ করুক সে তো মেহমান। মেহমানকে যত্ন না করলে তো আর হয় না। তটিনী শরবত এনে দেখল বসার ঘরে তাযীম নেই। তটিনী ভাবল চলে গেছে। সে গ্লাস নিয়ে পুনরায় রান্নাঘরে ফেরত যাচ্ছিল দোতলা থেকে তাযীম চিৎকার করে বলল,
-‘এই বুচি! শরবতটা উপরে এসে দিয়ে যাও।’

আবারও বুচি! রাগ সামলে তটিনী দোতলায় গেল। মোর্শেদ ভাই বসে আছে তাযীমের সাথে। তার হাতে কাগজ পত্র। সবসময় থাকে। মোর্শেদ ভাই সারাক্ষণ প্রোজেক্টের কাজে ব্যস্ত থাকে। এই দুনিয়াতে তার কাছে প্রোজেক্ট ছাড়া আর কিছুই প্রাধান্য পায় না। তটিনীকে দেখে বলল,
-‘টিনী! যা তো মা’কে বল এক কাপ চা দিতে।’

মোর্শেদ টিনী বলে ডাকলে খুবই সুন্দর শোনায়। ভরাট গলায় টিনী ডাকটা কী ভালো মানায়! মোর্শেদ সকলের একটা ছোট নাম দেয়। যেমন তার বড় বোন তানিয়াকে তানি বলে ডাকে, মেজো বোন মুনিরাহ’কে মুনি বলে ডাকে। তাযীমকেও ছোট করে ডাকে যীম।

তটিনী চা নিয়ে আসার পর দেখে মোর্শেদ নেই। তাযীম বসে আছে চুপচাপ। হাতে অবশ্য মোবাইল ফোন। তাযীম বলল,
-‘বুচি চা টা নিয়ে তুমি ফেরত যাও। মোর্শেদ ভাই ঘুমাতে গেছেন।’
-‘আমাকে যে চা আনতে বলল!’
-‘তিনি বলছিল যে দুইরাত ঘুম হচ্ছে না। এখন শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে। তো খবর নিয়ে জানলাম চা, কফি বেশি খাচ্ছেন। তাই আমি বারণ করলাম। বললাম এখন শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করলে চা না খাওয়াই ভালো। বিছানায় গা এলিয়ে দিলে খুবই ভালো ঘুম হবে। চা খাওয়া মানে তো বি’ষ খাওয়া। কী পরিমাণ ক্যাফেইন! তুমি এক কাজ করো, যেহেতু তুমি চা টা এনেছ তুমি খেয়ে নাও। আমার সামনে বসে খাও। দেখি চা তুমি কীভাবে খাও। চা খাওয়ার সময় তোমায় কেমন লাগে।’
-‘না এখন চা খাওয়ার সময় না।’
-‘কে বলেছে সময় না? এসবের আবার আলাদা সময় আছে নাকি! যাকে তাকে যখন তখন খেতে দেখা যায়।’
-‘আপনার মাথা। আপনি বেশি বোঝেন।’
-‘হ্যাঁ বুঝি। কারণ তোমার থেকে বয়সে আমি অনেক বড়।’
-‘বয়সে বড় হয়েছেন দেখে মাথা কিনে নেন নি।’
-‘তুমি আমার সাথে ভালো ব্যবহার করছ না।’
-‘আপনি আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেন কখন?’
-‘কি! তুমি বলতে চাইছ আমি তোমার সাথে খা’রা’প ব্যবহার করি?’
-‘তা নয় তো কী! আপনি বাড়ি বয়ে এসে সবসময় আমার সাথে এমন করেন। মজা উড়ান।’
-‘তুমি আমাকে বাড়িতে আসার খো’টা দিচ্ছ?’
-‘হুম দিচ্ছি। আবার ও দিব। মেহমান মেহমানের মতো থাকতে পারেন না!’

রাগের মাথায় তো কথাটা বলে দিল। তবে এর খেসারত তাকে দিতে হয়েছে চরম। তাযীম তার চাচির কাছে অর্থাৎ তটিনীর ফুপির কাছে বি’চা’র দিল তটিনী নাকি খুব বা’জে ব্যবহার করেছে তার সাথে। ফুপি তখন তার মায়ের কাছে বলল। মা রাতে চুল টেনে ধুমধাম মা’ই’র দিল। সেই থেকে! সেই দিন থেকে রা’গে অভিমানে ফুপির বাড়ি যাওয়া বন্ধ করল। এবং সেই বাড়ি থেকে এই বাড়িতে কেউ আসলে তাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ করল। ফুপি এসে খুব করে বোঝালো অভিমানি তটিনী বুঝল না। তাযীমকে সে অপছন্দ করত না আগে তবে তাকে দেখলে বিরক্ত হতো কিন্তু এরপর থেকে ভীষণ অপছন্দ করতে লাগল। একদিন খবর এলো তাযীমরা তাদের নতুন বাড়িতে অর্থাৎ গুলশানে চলে গেছে। মোহাম্মদপুরে তারা এখন আর নেই। তটিনী শুনেও কোনো ভাবাবেগ দেখালো না। বলা রাখা ভালো! তাযীমরা গুলশান শিফ্ট হওয়ার পরেও কিন্তু তটিনী কখনো যায়নি সেই বাড়িতে। আর না কখনো তাযীমকে চোখের দেখা দেখেছে। তার কথা হলো একটা ঝামেলার সাথে দেখা করার মানে হয় না। তার ভাষ্যমতে তাযীমের অহংকারও দিনকে দিন বেড়ে চলছিল। বুয়েট থেকে পাশ করে বের হবার পর একদিন তাদের বাড়িতে এসেছিল মিষ্টি নিয়ে। তটিনী যখন খবর পেল তখন পেছনের দরজা দিয়ে চয়নিকাদের বাড়ি চলে গেল। তটিনীদের বাড়িটি শহরের থেকে একটু দূরে। গ্রাম এলাকা বলা চলে। সে সেদিকে ধেই ধেই করে চয়নিকার সাথে সারা বিকেল পার করে সন্ধ্যার পরে বাড়িতে ফেরে। ততক্ষণে তাযীমরাও চলে গেছে। তটিনী স্ব’স্তি’র শ্বাস ফেলে!

আজ এতদিন পর ফুপির বাড়িতে যাওয়ার কারণ তার ফুপাতো বোনটার বিয়ে। তার থেকে দুই বছরের বড় হলো তার ফুপাতো বোন আয়রা। আয়রা খুব অনুরোধ করল যাওয়ার জন্য। ফুপি ফুপা সবাই বলল। এই এত অনুরোধ তটিনী ফেলে দিতে পারল না। তাই বলল সে যাবে। এবং সকলের সাথে খুব আনন্দ করবে। নিজের মনকেও বোঝালো! সে এখন বড় হয়েছে, যদি আবারও সেই তাযীমের সামনে পড়ে তো তাকে কা’টি’য়ে যাবার উপায়ও তার জানা আছে। সে এখন আর পনেরো বছরের অভিমানি তটিনী নেই।

২.
তটিনী আর তার বড় ফুপু আলেয়া বেগমকে একসাথে যেতে বলা হলো। তারা একটু আগে চলে যাবে। কারণ বড় ফুপু বাকি সবার তুলনায় বেশ বৃদ্ধ মানুষ। দেরিতে সবার সাথে গাদাগাদি করে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার বয়স সত্তরের কাছাকাছি। তিনি আট ভাই বোনের সবার বড়। তটিনীর দাদুর বয়স নব্বই এর ঘরে। আল্লাহর রহমতে এখনও জী’বি’ত আছেন, সুস্থ আছেন। তাকে আরো এক সপ্তাহ আগেই যখন আয়রাকে দেখতে এসেছিল তখনই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে বিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক করাতে তাকে আর আসতে দেওয়া হলো না। তো তটিনীদের একটু আগে যাওয়ার কারণ হলো তাদের বাড়ির বাকিদের যেতে যেতে বিকেল হবে। আর বড় ফুপুদের বাড়ির সবাইও সন্ধ্যায় যাবে। এখন ছোট ফুপু বারবার চাপ দিচ্ছে তাকে যেন আগেই নিয়ে যাওয়া হয়। তাই সবাই তাকে আর যেহেতু তটিনীর কোনো আহামরি কাজ নেই তাই তটিনীকে এক সাথে পাঠিয়ে দেয় এক গাড়ি করে। গাড়ির কথায় আসাতে এবার গাড়ি নিয়ে যে কাহিনি হলো সেটা কিছুটা বলি। আলেয়া বেগম কার, মাইক্রো এসবে চড়তে পারেনা। তো ঠিক করা হলো সিএনজিতে যাবে। তটিনীর কোনো সমস্যা নেই। কারণ সেও ফুপুর মতো বদ্ধ গাড়িতে থাকতে পারেনা। বমি করে দেয়। তাদের বাড়ির গাড়িতে অতি প্রয়োজন ছাড়া সে চড়ে না। এদিক দিয়েও দুইজন মিলেছে ভালো। এতে সবাই আরো খুশি। খামোখা গাড়িরও দুইবার আসা যাওয়া করাও লাগবেনা। তো সিএনজি ডেকে আনে মোর্শেদ। সে ঠিকানা বলে দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দিল। ভাতিজি আর ফুপু একসাথে রওনা হলো। মূল কান্ড ঘটে শেষে গিয়ে। ড্রাইভার তাদের মোড়ের মাথায় নামিয়ে দিল। বলল এই রাস্তা পর্যন্তই কথা হয়েছে। এর বেশি কিছু বলেনি। তটিনী পড়ল বি’প’দে। সে তো চেনেনা এখানের কোন দিকের বাড়িটা, সব ভুলে গেছে। সেই ছোট বেলায় এসেছিল। এখন কত কত বাড়ি হয়েছে নতুন। এর মধ্যে আরো বেশি সমস্যা হয়ে গেল। এদিকে ফুপুও জানেনা বাড়ি কোনটা। তিনি তো এমনিতেও চোখ থাকিতে অ’ন্ধ। তার উপর কালার ব্লা’ই’ন্ড। ড্রাইভার বলল তাকে এতটুকু পর্যন্তই যেতে বলা হয়েছে তবে তারা টাকা বাড়িয়ে যদি ঠিকানাটা বলে তবে সে পৌঁছে দিবে। এদিকে ঠিকানা কেউই জানেনা। অগত্যা ফুপু ড্রাইভারকে বেশ কয়েকটা গা’লি গা’লো’জ করে ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। এই ভর দুপুরে খাড়া রোদের মধ্যে ব্যাগপত্র নিয়ে দুইজন এদিক সেদিক ঘুরছে। একবার একটা বাড়ির সামনে গিয়ে ফুপি বলল,
-‘এই তো এটা, এই বাড়িটা। আয় আয়।’
তটিনী ব্যাগ পত্র টেনে বাড়িতে ঢুকতে নিলে গেইটের দাঁড়োয়ান পথ আটকায়। বলল,
-‘এই আপনেরা কে!’
ফুপু বেশ ভাব নিয়ে বললেন,
-‘আমরা কে! তুই তোর মালিকরে জিগা যা। আমরা কে! তুই জানোস না! যাই বাড়ির ছোট বউরে কইবি যে আপনের বড় বইন আছে।’

ফুপুর এতো বেশি আত্মবিশ্বাস দেখে আর ধ’ম’কা’নি শুনে দাঁড়োয়ান গেল ভেতরে, তাছাড়া আরেকটা কারণও আছে। এই বাড়িতে দুই বউ থাকে। বড় বউ আর ছোট বউ। দুই মিনিটের মাথায় ফেরত এসে বলে,
-‘এই বাইর হোন।। বাইর হোন। ছোট ভাবির তো কোনো বইন এ নাই। মি’থ্যু’ক মহিলা।’

ফুপু ঝ’গ’ড়া লেগে যাচ্ছিল রীতিমত। তটিনী বুঝল যে আসলেই ফুপুর ভুল। সে টেনে তাকে বাহিরে নিয়ে এলো। এভাবে অনেকক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে তাদের না’স্তা’না’বু’দ অবস্থা। এতক্ষণ তাদের এক মুদি দোকানদার লক্ষ্য করছিল। তিনি এসে বললেন,
-‘আপা আপনারা কি কাউরে খুঁজতেছেন?’
ফুপু ত্যক্ত হয়ে বলল,
-‘না বাসা খুঁজতেছি।’
-‘ওই একই হইল। তা কোন বাসা? আগে আসেননাই! গ্রাম থাইকা আসছেন!’
ফুপুর উঠে গেল রাগ। ফুপু ধানমন্ডিতে বিলাশ বহুল বাড়িতে আধুনিক জীবন যাপন করেন। পোশাকে আর কথাতে তিনি সাধারণই চলে। তাই বলে গ্রাম থেকে আসছেন এই কথা শুনতে পারলেন না। তেঁতে উঠলেন। বললেন,
-‘কী কইলি! গ্রাম! আমি গ্রাম থাইকা আসছি? তুই আমারে চিনস?’
-‘জ্বি না। চিনি না।’
ফুপু আবারও ঝ’গ’ড়া করতে গেলেন তবে তটিনী থামিয়ে দিল। লোকটাকে অনুরোধের স্বরে বলল,
-‘আঙ্কেল একটু সাহায্য করুন। বেশ কিছুক্ষণ একটা বাড়ি খুঁজছি পাচ্ছিনা। বেশ কয়েকবছর আগে এসেছিলাম। এখন অনেক কিছু নতুন হওয়াতে গুলিয়ে ফেলছি। কাউকে যে কল করব সেই উপায় নেই। আমার ফোনের টাকা শেষ। ফুপুর ফোনের চার্জ শেষ। কি একটা অবস্থা!’
-‘ওহ। আচ্ছা মা সমস্যা নাই। ঠিকানা জানো কিছু?’
-‘না সেটাই জানিনা। বাড়ির চেহারাও সঠিক মনে নেই। তবে জানি যে এদিকে বড় ব্যবসা আছে তিন ভাইয়ের ইট সিমেন্টের। এখানকার নামকরা নাকি। তাদের বাড়িতে বিয়ে। আমার ফুপাতো বোনের বিয়ে আর কী! ফুপার নাম হাসান শুধু এটা জানি। পুরো নাম জানিনা।’
-‘ওহ হো। আহারে, আগে বলবা না! তাদের তো সবাই চেনে। হাসান মিয়ার বড় ভাই হারুন মিয়া এবার মেয়র পদে দাঁড়াইছে। আমি চিনি তাদের সবাইরে। তবে তাদের বাড়ি তো এদিকে না। সামনের মোড়ে।’
-‘সিএনজি ড্রাইভারকে তো আমার ভাই এই মোড়ের কথাই বলছিল। গণি সাহেব রোড।’
-‘আরে না। এটা কোনো গণি সাহেব রোড না। ড্রাইভার ব’দ’মা’ই’শি করছে। দিন দুনিয়া এসব ভু’য়া মানুষে ভইরা গেছে। দাঁড়াও একটা রিকশা ডাইকা দেই। হাঁইটা যাইতে সময় লাগে দশ মিনিট। বুড়া মানুষ নিয়ে আর কত হাঁটবা!’
ফুপু এবারও বুড়া বলায় রে’গে গেলেন। তটিনী বহু ক’ষ্টে চুপ করালেন। রিকশাওয়ালাকে বলতেই সে ঠিকানা চিনে গেল। তটিনী রিকশায় উঠে সাহায্য করা সেই লোকটার প্রতি বেশ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল।

৩.
রিকশা থেকে নেমে সুন্দর সাজানো বাড়িটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তটিনী। তাদের আসলে নিজেদের ও ভুল হয়েছিল। ঐ বাড়িতে ঢোকার কোনো প্রয়োজন ছিল না। একটা বিয়ে বাড়িতে তো বিয়ে উপলক্ষে সাজসজ্জা করা হয়। আর আয়রাদের তো নাকি সেই দেখতে আসার দিন থেকে উৎসব মূখর পরিবেশ। এত বড় ভুলটা সে কেন করল! শুধু শুধু ঐ বাড়িতে যেচে পড়ে ফুপু ভাতিজি অপমানিত হয়ে এলো। যাই হোক! ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে যেতেই ছোট ফুপুকে রীতিমত দৌঁড়ে আসতে দেখা গেল। কুশলাদি করে বড় ফুপুকে নিয়ে সোফায় বসালো। তটিনীও বসে। তবে ফুপুর আজকের সেইসব ঘটনার রসনাই শুনতে তার ইচ্ছা করছিল না। তাই ছোট ফুপুকে বলল ফ্রেশ হবে। ততক্ষণে আয়রাও চলে এসেছে। দুই বোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। আয়রা তটিনীকে নিজের রুমে নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় তটিনী দেখে কাজের লোকরা ছোটাছুটি করে একটা রুম পরিষ্কার করছেন। তটিনী বলল,
-‘কী ব্যাপার! এই রুম নিয়ে যে ওরা এত দৌঁড়াদৌড়ি করছে? স্পেশাল কিছু!’
-‘আরে তাযীম ভাইয়া আসবে। জেঠা মশাইরা পরশু এলেও ভাইয়া আসেনি। তো ভাইয়া বারণ করেছিল যে এত সাফ সাফাই করা লাগবেনা। সে তখন আসবেনা বলেছিল। বলেছে একদম বিয়ের দিন আসবে, আসলেও থাকবেনা বলেছে। আর ভাইয়ার রুমে কারো যাওয়া মানা। তাই অতিথি আসলেও নিঃসন্দেহে সেই রুমে তো আর তাদের থাকতে দিতে পারবেনা তাই সেটা পরিষ্কার করেনি। এখন ভাইয়া একটু আগেই কল করে বলেছে সে আসবে। সন্ধ্যার দিকেই আসবে। তাই এমন হুলোস্থল কান্ড।’
-‘তোমার ভাইয়ের দেখছি সেই কদর!’
-‘বাড়ির বড় ছেলে। কদর হবে না! তাছাড়া তুইও তো তার বেশ কদর করিস।’
-‘কিহ! আমি?’
-‘তা নয়তো কী! তার কদর বেশি দেখেই তো তার উপর করেছিস রা’গ আর সেটা প্রয়োগ করেছিস আমার উপর। একবারও আসলি না এই কয় বছরে! আপার বিয়েতেও না!’
-‘কই বিয়েতে এসেছি তো!’
-‘সেটা তো কমিউনিটি সেন্টারে বাড়িতে তো আর না! আর কখন এলি কখন গেলি টেরও পাইনি।’

তটিনী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এটা সত্য। সে কিছুটা অ’ন্যা’য় করে ফেলেছে। সে হেসে আয়রাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘এবার সব ঠিকঠাক করে করব। সত্যি।’
আয়রা হেসে দিল। তটিনীও মনে মনে ঠিক করল আর কোনো কিছুতে সে টলবে না। সত্যিই তাকে এই বিয়েটা ইঞ্জয় করতে হবে।’

#চলবে।

চন্দ্রাণী পর্ব-৩৭ এবং শেষ পর্ব

0

#চন্দ্রাণী (৩৭-শেষ পর্ব)
চন্দ্র ভেবেছিলো যতো কষ্টই হোক সে কিছুতেই কান্না করবে না।সে কান্না করলে মা বাবা সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়বে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো তাকে যখন কবুল বলতে বলা হলো তখন চন্দ্র খেয়াল করলো সে নিরবে কেঁদে চলেছে। দু চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ে শাড়ি ভিজে যাচ্ছে।
চন্দ্রর মনে হলো কেউ বুঝি তার গলা টিপে ধরে শ্বাস রোধ করে রেখেছে। কিছুতেই গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না তার।
চন্দ্র আকুল নয়নে মায়ের দিকে তাকালো। রেহানা সবাইকে সরিয়ে মেয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে মেয়ের হাতে আলতো চাপ দিয়ে বললো, “বল মা কবুল।”

চন্দ্র নিজেকে সামলাতে পারলো না। মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো, “আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

পরবর্তী পুরোটা সময় চন্দ্র মা’কে জড়িয়ে ধরে রাখলো।রেহানার কেমন পাগল পাগল লাগছে।মনে হচ্ছে আজরাইল বুঝি তার জানটা নিয়ে নিচ্ছে। মৃত্যু যন্ত্রণা কেমন হয় রেহানা জানে না কিন্তু এই মুহূর্তে যেই যন্ত্রণা পাচ্ছে তা কোনো অংশে কম না।
এ যেনো জেনেশুনেই কষ্ট পাওয়া।

শাহজাহান তালুকদার দূর থেকে মেয়েকে দেখে যাচ্ছেন। মেয়ে ভেঙে পড়েছে, তিনি সামনে এলে আরো ভেঙে পড়বেন।
পুরুষ মানুষ বলে কথা, চাইলেও সবসময় কান্না আসে না।অথচ আজকে কেমন অবলীলায় দুই চোখ বারবার ভিজে উঠছে।কন্যা সম্প্রদানের সময় শাহজাহান তালুকদার বুকফাটা আর্তনাদ করতে লাগলেন।সারা পৃথিবী বুঝি অন্ধকার হয়ে আসছে তার।তার ঘরের আলোর প্রদীপ অন্য ঘরকে আলোকিত করতে চলে যাবে।
আহারে,এই বুঝি শেষ হয়ে গেলো মেয়ের উপর বাবা মায়ের সব অধিকার, সব দায়িত্ব।
এরপর আর অভিভাবক হিসেবে শাহজাহান তালুকদারের নামটা বসবে না।এরপরে আর কখনো মেয়েকে আগের মতো করে কাছে পাবেন না।
চিৎকার করে তিনি বললেন,”ও আল্লাহ,এতো যন্ত্রণা কেমনে সহ্য করবো গো মাবুদ। আমার কলিজে ছিড়ে যাচ্ছে গো আল্লাহ।আমার মা’কে আমি বিদায় দিয়ে দিচ্ছি নিজের হাতে!
বাবারে,আমি মানুষ হয়তো খুব খারাপ। চেয়ারম্যান হিসেবে সবার প্রিয় না হয়তো, ভাই হিসেবে খারাপ, স্বামী হিসেবে খারাপ, বন্ধু হিসেবেও খারাপ হতে পারি।
আমি বাবা হিসেবে সবসময় ভালো হতে চাইছি।নিজের সবটা দিয়ে বাবার দায়িত্ব পালন করতে চাইছি।এই পৃথিবীতে আমার বড় মেয়ের চাইতে অধিক প্রিয় কোনো জিনিস নাই,কোনো মানুষ নাই।
আমি বেহেশত কেমন হবে জানি না, তবে সবসময় মনে হতো আমার চন্দ্র আমারে বাবা বলে ডাকলে আমার কলিজা যেমন শান্ত হয়ে যায় বেহেশত ও এরকমই। আমার মেয়ে ছাড়া আমি নিঃস্ব একেবারে। আমার উপর তোমার অনেক রাগ,জেদ থাকতে পারে। আমার কোনো অপরাধের জন্য আমার মেয়েরে এক ফোঁটা কষ্ট দিও না।আমার মেয়ের চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়ালে তা আমি মাটিতে পড়তে দিই নি।আমি বুকে পেতে নিয়েছি।কোনো সময় যদি মনে হয় আমার মেয়ের সাথে তোমার চলছে না আমার মেয়েকে একটা ফুলের টোকা ও দিও না আমাকে বলো আমি আমার মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে আসবো।আজ তোমাকে আমি শুধু আমার কন্যা সম্প্রদান করছি না সেই সাথে সম্প্রদান করছি আমার কলিজা, আমার শান্তি,আমার সুখ,আমার পুরো জীবন। ওই চোখে জল গড়ালে আমার বুকে রক্তক্ষরণ হবে। আমার মেয়েকে ভালো রেখো বাবা।”

শর্মী, শুভ্র দুজনেই কাঁদছে বোনকে ধরে। পুরো বাড়িতে যেনো শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
রেহানা বিছানায় বিলাপ করে কাঁদছেন।চন্দ্রর পুরো পৃথিবী অন্ধকার লাগছে।দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসছে।ভীষণ চক্রাকারে মাথা ঘুরছে।টগর শক্ত করে চন্দ্রকে ধরে রাখলো।চন্দ্রকে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে দিলো সবাই।শাহজাহান তালুকদার জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। চন্দ্র বেহুশ হয়ে আছে।টগর সযত্নে চন্দ্রর মাথা নিজের কাঁধে নিয়ে বললো, “আমরা আসি আব্বা।”

গাড়ি চলছে।শাহজাহান তালুকদার বুক চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়েছেন।চিৎকার করে বলছেন,”ও গাড়ি থাম,আমার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে রে আল্লাহ।আমার মা’কে তোরা নিয়ে যাচ্ছিস রে।আমার মা ছাড়া আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে।আমি কিভাবে বাঁচবো গো মাবুদ।”

জগতের নিষ্ঠুর নিয়ম মেনে গাড়ি চলে গেলো নব দম্পতিকে নিয়ে। পেছনে রেখে গেলো একজন ভগ্নহৃদয় বাবাকে।

নির্ঝর পকেট থেকে টিস্যু বের করে শর্মীকে দিয়ে বললো, “আজকেই কি চোখের পানি সব শেষ করে ফেলবে?আমাদের বিয়ের দিন ও তো কাঁদতে হবে।তখনকার জন্য ও তো রাখতে হবে চোখের জল বাঁচিয়ে। ”

শর্মী কান্নার মধ্যে ও ফিক করে হেসে বললো, “গাছে কাঁঠাল,গোঁফে তেল।”

নির্ঝর আলতো করে শর্মীর হাতে চাপ দিয়ে বললো, “গাছের কাঁঠাল পাকলে ঘরে ও তুলে নিতে জানি।সে নিয়ে তুমি ভেবো না।”

টগরদের পুরো বাড়ি খালি।যেহেতু বাবা মা কেউ নেই টগরের,আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। তবুও যাদের বলেছে বিয়েতে তারা সবাই যার যার বাড়িতে ফিরে গেছে।
গাড়ি থেকে নেমে টগর চন্দ্রকে কোলে তুলে নিলো।

চন্দ্রর যখন হুশ এলো দেখলো একটা বিছানায় শুয়ে আছে। খুব সিম্পলভাবে রুমটা সাজানো। চন্দ্র বুঝতে পারলো সে এখন টগরের বাড়ি।
হুট করে চন্দ্রর বুকের ভেতরে একটা শূন্যতা চেপে বসলো।মনে হচ্ছে নিজেকে ফেলে এসেছে বাবার বাড়িতে।
পুরো বাড়ি কেমন শূন্য, জনমানবহীন।
টগরকেও দেখা যাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো চন্দ্র।বুকে কেমন তীব্র একটা ব্যথা হচ্ছে।

টগর এলো মিনিট দশেক পর। চন্দ্রকে বসে থাকতে দেখে মুচকি হেসে বললো, “আমার মহারানী তাহলে উঠলো এতক্ষণে। ”

চন্দ্র কথা বললো না। বলার মতো তার কোনো কথা নএই যেনো।টগর চন্দ্রর হাত ধরে বললো, “আজ থেকে তুমি সম্পূর্ণ আমার। কতো দিন পর আমার নিজের একটা মানুষ হলো জানো!
আমার ছন্নছাড়া জীবনে গুছানোর মতো একজন এলো।
আমাকে ভালোবাসার একজন এলো।
তুমি শুধু আমাকে একটু ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখো,আমি পৃথিবীর সব সুখ তোমার পায়ের কাছে এনে দিবো।
তুমি শুধু সারাজীবন আমার থেকো,আমি জনমে জনমে তোমার সাধনা করে যাবো।”

চন্দ্রর কেমন অস্থির লাগছে। টগরের উপর রাগ ও হচ্ছে। তাকে ব্লক করে রেখে এখন কেমন প্রেম দেখাচ্ছে। মুখ ভোঁতা করে চন্দ্র বললো, “আপনি কোনো কথা বলবেন না।আমাকে ব্লক দিয়ে রেখে এখন আবার ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে। ”

টগর হেসে চন্দ্রকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “মাঝেমাঝে খুব কাছে আসার জন্য একটু দূরত্ব করতে হয়।এই যে দুইদিন কথা বলি নি,এখন ইচ্ছে করছে বাকি জীবনটা শুধু ননস্টপ তোমার সাথে কথা বলে এই দুই দিন কথা না বলার প্রায়শ্চিত্ত করবো।”

চন্দ্র মুচকি হাসলো। টগর হাত ধরে বললো, “চলো আমার সাথে এবার,তোমার সংসার তোমাকে বুঝিয়ে দিই।”

চন্দ্র উঠলো। উঠে এসে দেখে টগর চুলায় কফি বসিয়েছে। দুইটা কাপে কফি নিয়ে টগর বললো, “চলো আমরা ছাদে গিয়ে বসি।”

চন্দ্র টগরের পিছুপিছু ছাদে গেলো।ছাদে গিয়ে একটা ছোট ধাক্কা খেলো চন্দ্র।পুরো ছাদে অসংখ্য ফুল ফল গাছ।একটা দোলনা আছে ফুল দিয়ে সাজানো।

দুজন গিয়ে দোলনায় বসলো।টগর চন্দ্রর মাথা নিজের কাঁধে টেনে নিয়ে বললো, “এই ছাদে তুমি ছাড়া কেউ আসে নি আর।এটা আমার ভীষণ স্পেশাল একটা জায়গা।তোমাকে ভেবে এই জায়গাটা আমি সাজিয়েছি। আমাদের যখন মান অভিমান হবে তখন এই দোলনায় এসে তুমি বসে থাকবে।আমি কফি নিয়ে এসে তোমার মান ভাঙাবো।
আমি সব হারানো মানুষ চন্দ্র।সর্বহারা মানুষ খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়।আমি তো তোমাকে পেয়েছি। তোমাকে ঘিরে আমার অনেক স্বপ্ন চন্দ্র।তোমাকে নিয়ে আমি বাঁচতে চাই পুরোটা জীবন। তুমি আমার হয়ে থেকো শুধু। ”

চন্দ্র চুপ করে তাকিয়ে রইলো টগরের দিকে। কি অদ্ভুত না!
একটা সময় এই মানুষটাকে বিরক্তিকর মনে হতো অথচ এখন মনে হচ্ছে এই মানুষটাই তার সবচেয়ে আপন মানুষ।
চন্দ্র টগরের হাত শক্ত করে ধরলো। টগর মুচকি হেসে গান ধরলো,
“এইভাবে যদি কেটে যায় চিরদিন
রঙে রঙে যদি হয় মনটা রঙিন
স্বপ্নের দিন যখন আসে আপনজনের ছোঁয়ায়
ভরে যায় খুশিতে তখন এ হৃদয়”

(সমাপ্ত)
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-৩৬

0

#চন্দ্রাণী(৩৬)
একটা রাত কাটলো নির্ঘুম, হতাশা,আক্ষেপের সাথে যুদ্ধ করে। টগরের দুই চোখ দিয়ে নিরবে অশ্রু ঝরছে।
যতবার মনে পড়ছে যাকে ঘরণী করবে সে তার জন্যই বাবাকে হারিয়েছে ততবারই টগরের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়।
এখন মনে হচ্ছে এই সত্যিটা না জানলেই বুঝি ভালো হতো। নিজেকে নিজে অনেক স্ট্রং মান ভাবতো টগর। এখন মনে হচ্ছে সে ভীষণ হালকা মনের মানুষ।

ভাবতে ভাবতেই রাত কাটলো টগরের। অন্ধকার কেটে আস্তে আস্তে আলো ফুটতে শুরু করেছে। সেই সাথে টগরের মনের ও সকল হতাশা কেটে যাচ্ছিলো।

নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো,”এখানে চন্দ্রর দোষ কোথায়?চন্দ্র তো কোনো কিছুর সাথে জড়িত না।কেউ একজন ওকে অতিরিক্ত ভালোবেসে যদি কোনো অপরাধ করে তার দায়ভার কেনো চন্দ্র নিবে?”

সব ভাবনা চিন্তা শেষ করে টগর সিদ্ধান্ত নিলো চন্দ্রর বাবার সাথে কথা বলবে।

শাহজাহান তালুকদার কাচারি ঘরে একা বসে আছেন।ইলেকশন আর বেশি দেরি নেই।কাদের খাঁন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবার তিনি জয়ী হবেন অতজচ বুকটা কেমন ভার লাগছে তার।
বাহির থেকে সালাম দিয়ে টগর ভেতরে এলো।টগর কে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন শাহজাহান তালুকদার। টগরকে তিনি আশা করেন নি।

মুখোমুখি চেয়ারে বসে টগর বললো, “যেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমার বাবা মা’কে, এবার তা পূর্ণ করুন চাচা।আমার বউকে আমার হাতে তুলে দিন।আমার শূন্য ঘর পূর্ণতা পাক।”

শাহজাহান তালুকদার জানতেন এরকম একটা দিন নিশ্চয় আসবে।টগর চন্দ্রকে নিতে আসবে।তবে এতো শীঘ্রই টগর সব কিছু মানিয়ে নিতে পারবে বুঝেন নি।কেমন বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে শাহজাহান তালুকদারের। মেয়েটা চলে যাবে?
তার ঘরটা খালি করে দিবে?

শাহজাহান তালুকদার বললো, “আমি তোমার চাচীর সাথে কথা বলে জানাবো।”

টগর মাথা নাড়িয়ে বললো, “না চাচা,আমার সময় নেই।আমাকে গ্রাম থেকে চলে যেতে হবে যেকোনো মুহূর্তে। হেডঅফিস থেকে যেকোনো মুহূর্তে মেইল আসবে।আমি আমার বউ নিয়ে ফিরতে চাই।আপনি চাচীর সাথে গিয়ে কথা বলে আসুন।আমি অপেক্ষায় আছি।”

এই ছেলেটা সহজে তাকে ছাড়বে না তিনি বুঝতে পেরেছেন।তাই অগত্যা উঠে গেলেন।

রেহানা রান্না ঘরে রান্না বসিয়েছে। চন্দ্র মা’কে তরকারি কেটে দিচ্ছিলো। শাহজাহান তালুকদার গিয়ে একটা মোড়ায় বসে পড়লেন।
রেহানার দিকে তাকিয়ে বললেন, “রেহানা,টগর এসেছে। ”

চন্দ্র চমকে উঠলো বাবার কথা শুনে।

রেহানা উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি বললো? ”

তালুকদার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “ওর বউ ও ফিরিয়ে নিতে চায়।দুই এক দিনের ভেতরেই নিয়ে যেতে চায় বউ করে। ”

রেহানার বুকটা কেমন খালি খালি লাগতে লাগলো। আর বুঝি মেয়েকে কাছে রাখতে পারবেন না!
মেয়ে হয়ে জন্মানোর এতো জ্বালা কেনো দুনিয়ায়!
এতো আদর ভালোবাসা দিয়ে লালন করা মেয়েটাকে অন্যের হাতে কিভাবে তুলে দিবেন তিনি?

বুকে পাথর চেপে রেহানা বললো, “মেয়ে যখন হয়েছে তখন আজ হোক আর কাল,পরের ঘরে যাবে-ই। আপনি আয়োজন করুন।”

একদিন পর বিয়ের দিন ঠিক করা হলো।

চন্দ্রর কেমন লাগছে বুঝতে পারছে না। শাহজাহান তালুকদার পুরো গ্রামের সবাইকে দাওয়াত করেছেন, আত্মীয় স্বজন সবাইকে দাওয়াত করেছেন। কানিজকে ও দাওয়াত করেছেন।

চন্দ্র মনে মনে চাইলো কানিজ যাতে বিয়েতে না আসে।একটা মুহূর্তের জন্য ও যদি তার মনটা কানিজকে দেখলে দুর্বল হয়ে যায়, তার দিকে তাকাতে চায়,মায়ায় পড়ে যায় যদি!
কি এক অদ্ভুত দোটানা চন্দ্রর।কাকে দোষ দিবে!
কানিজের দোষ আছে কি নেই চন্দ্রর জানা নেই,তবে এটুকু চন্দ্র জানে যাকে সে মা বলে ডাকে তার কোনো দোষ নেই।তাকে এক চুল পরিমাণ কষ্ট দিতে পারবে না চন্দ্র।
নাই বা পেটে ধরুক, নাই বা জন্ম দিক তবুও ছোট্ট চন্দ্রকে আদর ভালোবাসা দিয়ে তো তিনিই বড় করেছেন। সবার চাইতে বেশি করেছেন সবসময় চন্দ্রর জন্য বিনা স্বার্থে।
শুধু চন্দ্র মা বলে ডাকবে এই টুকু পেতে সারাজীবন কষ্ট করেছেন যিনি তাকে চন্দ্র ঠকাতে চায় না।

কানিজ বিয়েতে এলো না সত্যি।অবশ্য বিয়েতে আসার মতো সেই মনোবল, সাহস কোনোটাই নেই তার।
যেই মেয়েকে সে একবারের জন্য আমার বলে দাবি করতে পারবে না,তার চোখের সামনে মেয়ে অন্য কাউকে মা বলে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কান্না করবে কানিজের তখন সহ্য যদি না হয়?
সারাজীবন জীবন তাকে নানাভাবে ঠকিয়েছে,সবসময় তিনি হারিয়ে এসেছেন।
কষ্ট পেতে পেতে এখন সব গা সওয়া হয়ে গেছে। নতুন করে আর কষ্ট পেতে চান না তাই।

চন্দ্রর বিয়েতে এক জোড়া কানের দুল উপহার হিসেবে পাঠালেন কাদের খাঁনের কাছে।
টগর চন্দ্রর নাম্বার আর আনব্লক করে নি।চন্দ্র বিয়ের কথা বার্তা হওয়ার পর থেকে টগরের ফোনে ট্রাই করছে কয়েক বার।টগর যেহেতু ওকে আনব্লক করে নি রাগ করে চন্দ্র ও আর অন্য কোনো নাম্বার থেকে ট্রাই করে নি।

বিয়ের দিন সকাল থেকে চন্দ্রর কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো। বারবার মনে হচ্ছিলো বিয়েটা যদি ভেঙে যায় তবে ভালো হবে।
সকাল থেকে অতিথি আগমনে তালুকদার বাড়ি গমগম করছে।শাহজাহান তালুকদার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে ৪ টা গরু জ/বেহ করেছেন।

চন্দ্র ঘুরে ঘুরে সবকিছু নিরবে দেখছে।কতো আয়োজন তার বিয়ে উপলক্ষে। কতো মেহমান। এদের সবাইকে চন্দ্র চিনে না।
কেউ কেউ ফিসফাস করে বলছে, “পালক নেওয়া মেয়ের জন্য মানুষ এতো আয়োজন করে!বাবা,ভাবা যায় না এগুলো। ”

কেউ আবার বলছে, “পুরনো প্রেমিকার মেয়ে তো তাই মনে হয় একটু আদর বেশি। ”

চন্দ্র ঘুরছে,শুনছে,মুচকি হেসে সরে আসছে।

রেহানা মেয়েকে দেওয়ার জন্য গহনা বের করলো। চন্দ্রর বড় মামী রেহানার হাত ধরে বললো, “রেহানা,তুই এতো বোকার হদ্দ কেনো রে?”

রেহানা বুঝতে না পেরে বললো, “কেনো? কি হয়েছে ভাবী?”

এদিক ওদিক তাকিয়ে তিনি বললেন,”এই মেয়ে তো তোর নিজের না,তার উপর তোর জামাইয়ের পুরনো প্রেমিকার মেয়ে।সেই মেয়েরে কি-না তুই এতো আদর যত্ন করে পালতে গেলি!এই মেয়ে দুই দিন পর তোর থেকে মুখ ফিরাইয়া নিজের মায়ের কাছে যাইবো।পর কোনো দিন আপন হয় না।তুই এরকম বোকামি কেমনে করলি!কেমনে ভুলে গেলি বিয়ের পর চেয়ারম্যান তোরে কতো অবহেলা করছে শুধু এই মেয়ের মায়ের জন্য।
সেই মেয়েরে কি-না তুই এখন এতো গহনা দিতে চাস!আবার না-কি ওই মেয়ের নামে তোরা আলাদা করে সম্পদ ও দিয়ে রেখেছিস আগেই!তোর নিজের পেটের গুলোর কথা ভাবলি না?
এখনও সময় আছে রেহানা,এসব বাদ দে।যা করার করছস,এসব গহনা শর্মীর আর শুভ্রর বউয়ের জন্য রাখ।এই মেয়ে তোর কোনো দিন ও নিজের মেয়ের মতো থাকবে না দেখিস।”

রেহানার মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। চোয়াল শক্ত করে বললো, “ভাবী,আপনি যদি সসম্মানে এখনই বিয়ে বাড়ি থেকে চলে যান তবে আমি খুশি হবো।আমার মেয়ের বিয়েতে আপনার থাকতে হবে না। চন্দ্র আমার মেয়ে,পুরো দুনিয়ার মানুষ ও যদি আমাকে বলে চন্দ্র আমাকে ছেড়ে চলে যাবে আমি বিশ্বাস করবো না।আর যদি কখনো আমার মেয়ে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও তাতে ও আমার আক্ষেপ থাকবে না।
আমি ওকে আমার জীবনে এনেছি, ও তো নিজে যেচে আমার কাছে আসে নি। আমি আমার সুখের জন্য, শান্তির জন্য ওকে এনেছি।আমার মানসিক বিপর্যয়ের সময় আমার চন্দ্র আমাকে শান্তি দিয়েছিলো।আমি কেনো ওর থেকে প্রতিদান আশা করবো?আমি তো প্রতিদানের জন্য ওকে ভালোবাসি নি।বরং আমারই তো ওকে প্রতিদান দেওয়া উচিত। যেই মেয়েটা আমার মানসিক কষ্ট কমিয়ে দিয়েছে,নিজের আধো আধো বুলি দিয়ে আমাকে মা বলে ডেকে অশান্ত মন শান্ত করেছে। ছোট্ট দুই হাতে আমাকে ঝাপটে ধরেছে।শর্মীকে আমি পেটে ধরেছি,বুকের দুধ খাইয়েছি তাই শর্মীর আমার প্রতি ভালোবাসা হয়েছে। অথচ ওকে তো আমি পেটে ধরি নি,বুকের দুধ ও খাওয়াতে পারি নি অথচ ও আমাকে ভালোবেসেছে কারণ ছাড়া। আমার তো মনে হয় আমার পেটে যাদের ধরেছি তাদের চেয়ে ভালোবাসা বেশি পাওয়ার যোগ্য যাকে আমার চন্দ্রর।শুভ্র,শর্মীকে যদি বলা হয় আমার পেটে ধরা সন্তান তবে আমার চন্দ্র আমার বুকে ধরা সন্তান,আমার কলিজায় ধরা সন্তান। কেনো সবসময় পেটে ধরলেই নিজের সন্তান বলতে হবে,বুকের মধ্যে যাকে ভালোবাসা দিয়ে লালন করা হয় তাকে কেনো পর বলা হবে?
চন্দ্র আমার মেয়ে,সারাজীবন ও আমার মেয়েই থাকবে।তোমাদের কারো যদি মেনে নিতে অসুবিধা হয় এখনই এখান থেকে চলে যাও।আমার মাথা গরম হওয়ার আগেই বিদায় নাও।নয়তো অপমান করে বিদায় করবো।”

রেহানার এই ব্যবহারে চন্দ্রর বড় মামী রাগ করলেন।রেহানার বড় ভাই আব্দুল সাত্তার তখন বাবুর্চিদের কাজ তদারকি করছেন।স্ত্রী গিয়ে কান্নাকাটি করে বললো তার বোন তাকে অপমান করেছে,চলে যেতে বলেছে এখান থেকে। আব্দুল সাত্তার সব শুনে বললো, “রেহানা যা করেছে ভালো করেছে। তোমাকে তো কেউ বলে নি গায়ে পড়ে এতো উপদেশ দিতে আমার বোন কে। এতো বছর যখন কেউ জানতো না চন্দ্রর আসল পরিচয়, তখন তো কেউ বলে নি কেনো চন্দ্রকে এতো বেশি ভালোবাসে ওর বাপ মা।এখন কেনো এতো প্রশ্ন উঠছে তাহলে!
আজকে তো তোমার দরকার ছিল না এসব কথা বলার,ওরা যখন ওদের মেয়েকে সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দিচ্ছে, সেখানে তুমি বাহিরের মানুষ হয়ে কেনো নাক গলাতে যাও ওদের পারিবারিক কথাতে?নাকটা আরেকটু ছোট করো।আমি রিকশা ডেকে দিচ্ছি বাড়ি চলে যাও।এখানে থেকে এর কাছে প্যাঁচ লাগাবে,ওর কাছে প্যাঁচ লাগাবে এসব আমার সহ্য হবে না।ভাগ্য ভালো রেহানাকে বলেছো,চেয়ারম্যান যদি এসবের সামান্য কিছু শুনে তাহলে আমাদের পুরো গুষ্ঠিকে চলে যেতে বলবে এখান থেকে। ”

স্বামীর কাছে ও পাত্তা না পেয়ে চন্দ্রর বড় মামী চুপসে গেলেন।গুটিগুটি পায়ে আবারও ভেতরের দিকে চলে গেলেন।

বরপক্ষ থেকে মেহমান এসেছে প্রায় ১০০ এর মতো। কোনো শেরওয়ানিতে না,টগর পরেছে একটা আকাশি কালার পাঞ্জাবি। বর পক্ষের আনা লাগেজ থেকে চন্দ্রর জন্য বের হলো বেবি পিংক কালার একটা বেনারসি শাড়ি খুবই সিম্পল কাজের।
বিয়ে মানেই যেখানে লাল শাড়ি সেখানে এরকম শাড়ি দেখে কেউ কেউ দু একটা কথা বলতে বাদ দিলো না।

শর্মী ফিসফিস করে চন্দ্রকে বললো, “আপা,ভাইয়ার পছন্দ কিন্তু বেশ ভালো। ইউনিক হয়েছে তোর বিয়ের শাড়িটি। আমার কি যে ভালো লাগছে।”

চন্দ্র মুচকি হাসলো। বুকের ভেতর ভয়,উৎকন্ঠা। কেমন হবে টগরের সাথে জীবন!
খুব অন্তরঙ্গ মুহূর্তে যদি টগরের মনে পড়ে যায় যাকে সে এতো কাছে টেনে নিয়েছে তার জন্য বাবাকে হারিয়েছে টগর, তখনও কি টগর চন্দ্রকে গ্রহণ করতে পারবে!
এক মুহূর্তের জন্য যদি টগর অবহেলা নিয়ে তাকায় চন্দ্রকে সহ্য করতে পারবে?
টগর তো মুখ ফিরয়েই নিয়েছিলো চন্দ্রর থেকে,এখন মনে হচ্ছে সেটাই বুঝি ভালো হতো।
টগরের সাথে ভবিষ্যৎ কেমন কাটবে এই আশংকা বারবার মনে আসে চন্দ্রর।

চন্দ্রকে শাড়ি পরিয়ে,সাজিয়ে স্টেজে নেওয়া হলো। টগর এক নজর চন্দ্রর দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। মনে মনে বললো, “এতো সুন্দর লাগতে নেই বউ,আমি যে মাতাল হয়ে যাবো তোমার নেশায় আসক্ত হয়ে।”

রেহানা একটু পেছনে দাঁড়িয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে হচ্ছে কেউ বুঝি তার দেহ থেকে প্রাণটা আলাদা করে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। রেহানার দম বন্ধ হয়ে আসছে।আল্লাহকে বললো, “এতো কঠিন যদি নিয়ম করবে আল্লাহ মেয়েকে বিদায় দিয়ে দেওয়ার মতো, তবে মা বাবার মন পাথর করে দাও নি কেনো?
এই যন্ত্রণা কিভাবে সহ্য করবো গো আল্লাহ! ”

চলবে……
রাজিয়া রহমান

চন্দ্রাণী পর্ব-৩৫

0

#চন্দ্রাণী (৩৫)
চন্দ্রদের বাসার সবার মন মানসিকতা ভীষণ খারাপ। এরই মধ্যে দিন দুয়েক পর কাদের খাঁন এলো চন্দ্রদের বাড়িতে।বোনের মেয়েকে এক নজর দেখার জন্য মন আনচান করছে তার।
যেই সত্য শুনেছেন তিনি তারপর নিজেকে আর আটকাতে পারছেন না।

শাহজাহান তালুকদার বাড়িতেই ছিলেন।সচরাচর কেউ তার সাথে দেখা করতে এলে কাচারিঘরে আসে।কাদের খাঁন সোজা বাড়িতে চলে গেলেন।চন্দ্র তখন শুভ্রকে বসে ভাত খাওয়াচ্ছে। গতকাল রাতে শুভ্র না খেয়ে ঘুমিয়েছিলো।
আড়মোড়া ভেঙে শর্মী এসে বললো, “আপা আমাকেও খাইয়ে দে না।ভালো লাগছে না নাশতা করতে। ”

চন্দ্র বললো, “বোস এখানে, নে খা।”

শুভ্র দুই হাত নেড়ে কিছু একটা বুঝাতেই চন্দ্র হিহিহি করে হাসতে লাগলো। শর্মী হতবাক হয়ে বললো, “কি রে আপা,হাসছিস কেনো?”

চন্দ্র হেসে বললো, “শুভ্র বলতেছে তোকে যাতে না খাইয়ে দিই,তুই নাকি অলস হয়ে যাচ্ছিস।”

শর্মী হেসে ভাতের লোকমা মুখে নিলো।তারপর কিছুটা আশ্চর্য হয়ে বললো, “এক সেকেন্ড আপা।শুভ্র কিভাবে জানলো আমি কি বলেছি?ও তো….!”

শর্মী কথা শেষ করতে পারে নি। চন্দ্র হেসে বললো, “এখনো অনেক কিছুই তোর কাছে স্পষ্ট না আমি জানি।শুভ্রকে আমি সাংকেতিক ভাষা শিখিয়েছি,লিপ রিড শিখিয়েছি।শুভ্র আরো বছর তিনেক আগে থেকেই আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারে। আমরা দুজন প্রায়ই ভিডিও কলে কথা বলি।শুভ্রর থেকেই আমি সর্বপ্রথম নিয়াজের কথা জানতে পারি।নিয়াজ যতবার আমাদের বাড়িতে এসেছিলো শুভ্র দেখেছে।
তাছাড়া তুই যখন সিদ্ধান্ত নিলি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার, শুভ্রই আমাকে জানায়।শুভ্র বুঝতে পারবে না ভেবে তুই ওর কাছে গিয়ে কান্না করে মনের কষ্ট প্রকাশ করেছিলি,তোর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে শুভ্র বুঝতে পেরেছিলো তুই কি বলছিস ওকে।শুভ্রর নিরাপত্তার জন্যই ওকে আমি এই দুইটা জিনিস শিখিয়েছি।এবং ওকে বলেছি কেউ যাতে না জানে ওর এই ব্যাপার।

এমনকি আব্বা মা ও না।তাই তো বাবুল কাকা বলার আগেই আমি শুভ্রর থেকে জানতে পারি আমি যে আব্বার মেয়ে না।নিয়াজের মৃত্যুর দিনেই আব্বা আম্মা ওনাদের রুমে শুভ্রর সামনে এসব আলোচনা করে। শুভ্র সব জেনে আমাকে জানায়।”

শর্মী খেতে ভুলে গিয়েছে যেনো। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
ভাই বোনের কথার মধ্যে কাদের খাঁন এলো। গলা উঁচু করে তালুকদারকে ডাকলেন।শাহজাহান তালুকদার কাদের খাঁনকে দেখে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে। চন্দ্র কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।আগের মতো নিজের কাজ করতে লাগলো।

কাদের খাঁন বন্ধুর দিকে তাকিয়ে কি বলবে ভেবে পেলো না। এমন এক পরিস্থিতি শব্দরা গলায় এসে জমাট বেঁধে আছে অথচ বের হতে পারছে না।শাহজাহান তালুকদার কাদের খাঁনকে ঘরে নিয়ে বসালেন।চন্দ্রকে ডেকে বললেন, “চন্দ্র মা,চা নাশতার ব্যবস্থা কর তো।আমার বন্ধু এসেছে। ”

চন্দ্র ভাই বোনকে খাইয়ে উঠে গেলো রান্নাঘরে।
কাদের খাঁন কথা বলতে পারছেন না আজ।তার বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা সামনে এলে বুঝি তিনি কথা বলতে পারবেন না।

দুজনেই চুপ করে বসে থাকা যায় না, তাই শাহজাহান তালুকদার টিভি অন করে দিলেন।
কাদের খাঁন ও মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখতে লাগলো যেনো টিভি দেখতেই এই বাড়ি এসেছেন তিনি।
চন্দ্র কিছুক্ষণ পর ট্রে নিয়ে ভেতরে এলো।
চা,বিস্কুট, চানাচুর, নুডলস, নাগেটস, পানি নিয়ে এসে সালাম দিলো কাদের খাঁনকে।সালাম দিয়ে বললো, “আংকেল ভালো আছেন?”

কাদের খাঁন কোনো মতে বললো, “হ্যাঁ, ভালো। তুমি?”

চন্দ্র ঘাড় নাড়িয়ে বললো, “ভালো। ”

এরপরে আর না দাঁড়িয়ে চন্দ্র চলে গেলো। কাদের খাঁন মন খারাপ করে কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আংকেল ডাকলো মেয়েটা!
মামা বলবে না বুঝি কোনো দিন ও!
কি এক অস্থিরতা, দোটানায় মন জড়িয়ে গেলো বুঝতে পারলো না কাদের খাঁন।
উঠে দাঁড়ালো বেখেয়ালে। শাহজাহান তালুকদার উঠে এসে কাদের খাঁনের হাত ধরে বললো, “তোর যখন ইচ্ছে করবে চলে আসিস।আমার মেয়েকে আমি কোথাও দিতে পারবো না কিন্তু কারো যদি আমার মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করে সে আসতে পারে। ”

কাদের খাঁন চুপ করে বের হয়ে গেলো।

বাবুল দাশকে আজ থানা থেকে জেলখানায় নেওয়া হবে।পুলিশের জীপটা বাবুল দাশকে নিয়ে বের হওয়ার মিনিট দশেক পর চন্দ্র শাহজাহান তালুকদারের সাথে থানায় এলো বাবুল দাশকে দেখতে।
বাবুল দাশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শুনে চন্দ্রর দুই চোখ আপনাতেই ভিজে উঠলো।
চন্দ্র জানে বাবুল দাশ খারাপ লোক,খুনী, অপরাধী। অথচ তার বেহায়া মনটা কেনো জানি এই অপরাধী লোকটাকে এক নজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। ওড়নার কোণা দিয়ে চন্দ্র চোখ মুছতে নিতেই একটা টিস্যু দেখতে পেলো। টগর একটা টিস্যু এগিয়ে দিয়েছে তাকে।
কুণ্ঠিত হয়ে চন্দ্র টিস্যু নিতেই টগর বললো, “অপরাধীর জন্য চোখের জল ফেলতে নেই।”

চন্দ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বললো, “আপনার দৃষ্টিতে যিনি অপরাধী আমার দৃষ্টিতে তিনি আমার কাছের মানুষ। মানুষ কাছের মানুষের জন্যই কাঁদে।”

টগর মুচকি হেসে বললো, “তা ঠিক। ”

এরপর আর টগরকে কোথাও দেখলো না চন্দ্র।বাবুল কাকুর কথা ভেবে টগরের কথা মাথায় ছিলো না চন্দ্রর।
সন্ধ্যা বেলায় ফোন হাতে নিয়ে দেখলো টগর মেসেজ পাঠিয়েছে।

“পাথর কতটা ভারী,তারচেয়ে ও হাজার হাজার গুণ ভারী তোমার শীতল দৃষ্টি, তোমার ফিরিয়ে নেওয়া মুখ,তোমার নিঃশব্দে চলে যাওয়া।
আমি পাথর সরাতে পারি,তোমার উপেক্ষা পারি না।”

চন্দ্র মেসেজটা পড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। চন্দ্র কিছু বুঝতে পারছে না। সেই ছোট্ট বেলায় পুতুলের বিয়ে দেওয়ার মতো করে যেই বিয়ে দিয়েছিলো বাবা মায়েরা শখ করে, সেই বিয়ে কতটা কার্যকরী!
চন্দ্র কি করবে!
টগরের প্রতি তার টান,তার মনের অনুভূতি মিথ্যে না।কিন্তু এই পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করছে দূরে সরে আসতে ধীরে ধীরে।
টগরের বাবা খু//ন হলো যেখানে চন্দ্রর জন্য সেখানে চন্দ্র কিভাবে টগরের সাথে নিজের জীবন জড়াবে?
জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি পদক্ষেপে কি বাবার কথা মনে পড়লেই টগরের মনে হবে না যে চন্দ্রর জন্যই টগরের বাবা আজ এই দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেছে?
চন্দ্রর প্রতি এতো দিন টগরের যেই মনোভাব ছিলো এখনো কি তাই থাকবে?
বাবুল দাশকে টগর যেমন ভীষণ ঘৃণা করে চন্দ্রর জন্য তো ব্যাপারটা উল্টো। লোকটা সবচেয়ে নিকৃষ্ট হতে পারে কিন্তু চন্দ্র কি তার ভালোবাসা অস্বীকার করতে পারবে?

কোন ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিবে চন্দ্র?

সাতপাঁচ ভেবে চন্দ্র টগরকে কল করে। কল দিয়ে চন্দ্র হতবাক হয়।টগর তাকে ব্লক করে দিয়েছে। সব জায়গা থেকে চন্দ্রকে ব্লক দিয়েছে টগর।
সন্তর্পণে চোখের জল মুছে নিলো চন্দ্র।হোক দূরত্ব আকাশসম,লুকায়িত থাকুক ভালোবাসারা,জিতে যাক ইগো।

চলবে
রাজিয়া রহমান