চন্দ্রাণী পর্ব-১৩+১৪

0
237

#চন্দ্রাণী(১৩)
পুরো উঠানের সব পাতা,ময়লা সব কিছু তুলে ফেললো টগর। শ্যাওলা ধরা উঠানের চেহারা বদলে গেলো আস্তে আস্তে। টগর গোসল করে বের হয়ে এলো।পরনে একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট শুধু। কলিং বেল বাজতেই মেজাজ বিগড়ে গেলো টগরের।এই ভর দুপুরে কে এলো আবার!

দরজা খুলে দেখে ৩২ দাঁত বের করে নির্ঝর দাঁড়িয়ে আছে। টগরের দিকে তাকিয়ে নির্ঝর বললো, “সারপ্রাইজ দিতে চলে এলাম।”

টগর রাগান্বিত হয়ে বললো, “আপনার কি আর কোনো কাজ নেই?সারাক্ষণ আমার পেছনে লেগে থাকেন কেনো?”

নির্ঝর হেসে বললো, “আমার কাজই এটা টগর। তোমার পেছনে লেগে থাকাও আমার কাজ।আর আমার কাজ আমি ভালো করেই বুঝি।”

টগর বিরক্ত হয়ে ভেতরে সরে দাঁড়ায়। নির্ঝর কথা না বাড়িয়ে ভেতরে চলে আসে।
চন্দ্র চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে।টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “আপনাকে কি ইনভাইটেশন কার্ড পাঠাতে হবে ভেতরে আসার জন্য? ”

চন্দ্র মুচকি হাসলো।

নির্ঝর টগরের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি আসার সময় এই ম্যাডাম ও চলে এলেন।ওনার ইচ্ছে তদন্ত করা দেখার।”

টগর বললো, “আপনার যা বলার আছে প্লিজ তাড়াতাড়ি বলুন,আমার প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে।”

নির্ঝর হেসে বললো, “একেবারে কাজের কথা মনে করেছো।ক্ষিধে তো আমার ও পেয়েছে। ”

টগর বিরক্ত প্রচন্ড এই ইন্সপেক্টর তার সাথে হেয়ালি করতে চাইছে।
টগর কড়া গলায় বললো, “আপনি নিশ্চয় আমার সাথে লাঞ্চ করতে চাচ্ছেন না।”

নির্ঝর আহত স্বরে বললো, “কে বললো চাই না?আমি অবশ্যই চাই তোমার সাথে লাঞ্চ করতে। ”

টগর হতাশ হয়ে সোফায় বসে পড়লো। তার ইচ্ছে করছে নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে।

নির্ঝর সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসলো। টগরকে সে সর্বোচ্চ বিরক্ত করবে।

টগর নিজেকে সামলে বললো, “গরম ভাত আর ডিম ভাজি,চলবে?”

নির্ঝর হেসে বললো, “দৌড়াবে।”

চন্দ্র আচমকা জিজ্ঞেস করলো, “কে রান্না করবে?রান্নার কেউ আছে?”

টগর বিড়বিড় করে বললো, “আমাকে কি চোখে লাগে না?অণুবীক্ষণযন্ত্র এনে দিতে হবে?”

চন্দ্র আমতাআমতা করে বললো, “না মানে,আপনি রান্না পারেন?”

টগর চিল মুড নিয়ে বললো, “যতটা রান্না জানলে ভাত আর ডিম ভাজি দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা যায় ততটা জানি।বসুন,একবার খেয়ে দেখুন,নরমাল ডিম ভাজি না হলেও বারবিকিউ ডিম ভাজি খাবেন না হয় আমার বাড়িতে।”

চন্দ্রর ভীষণ খারাপ লাগলো। এই লোকটাকে সে যতোই অপছন্দ করুক এখন কেনো জানি খারাপ লাগছে। পুরুষ মানুষ যতোই ভালো শেফ হোক,তবুও চন্দ্রর মনে হয় বাড়ির রান্না মেয়েদেরই মানায়।
মেয়েদের হাতের রান্না মানে কেমন একটা মায়া মমতায় মাখা একটা ব্যাপার থাকে।পুরুষের রান্নায় থাকে শুধু মাত্র পেট জামিন দেওয়ার ব্যাপার।

ইতস্তত করে বললো,”কিছু মনে না করলে আমি রান্না করি?”

টগর চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলার আগে নির্ঝর হেসে বললো, “না না,মনে করার কিছু নেই।আপনি নিশ্চিন্তে রান্না করুন।”

চন্দ্র জিজ্ঞেস করলো, “কিচেন কোন দিকে?”

টগর যন্ত্রচালিতের মতো দেখিয়ে দিয়ে বললো, “ফ্রিজে মাছ মাংস অনেক কিছু রাখা আছে, দরকার মতো নিয়েন।”

চন্দ্র মুচকি হেসে চলে গেলো।
টগর নির্ঝরের মুখোমুখি বসে বললো, “আপনার সমস্যা কি?”

নির্ঝর হেসে বললো, “সেদিন খুনটা কেনো করেছিলে?তোমার হাতের ব্যাগে কি ছিলো সেদিন?”

টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “আমি জানি না কি ছিলো। আর আমি কাউকে খুন করি নি।”

নির্ঝর পায়ের উপর পা তুলে বললো, “যেই লোকটা খু/ন হয়েছে তার ফোন থেকে একটা মেসেজ পেয়েছি আমরা। মেসেজে লিখা ছিলো টগর যাতে বেঁচে ফিরতে না পারে। ”

টগর যেনো আকাশ থেকে পড়লো। হতভম্ব হয়ে বললো, “হোয়াট! ”

নির্ঝর হেসে বললো, “তবুও বলবেন আপনার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই এসবের?”

টগর বললো, “আমি বারবার, হাজার বার বলবো আমার সাথে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই।”

নির্ঝর বললো, “তুমি যে ওখানে যাবে তা কে কে জানতো?”

টগর ভেবে বললো, “নিয়াজ ছাড়া আর কেউ না।”

নির্ঝর চুপ করে ভাবতে লাগলো। নিয়াজকে তার কেমন সন্দেহ হচ্ছে। এই ছেলেটা ওভারস্মার্ট বেশ।ওকে নজরে রাখতে হবে।

চন্দ্র দ্রুত হাতে কাজ করা শুরু করে দিলো। পুরুষ মানুষকে হাত করার অন্যতম প্রধান একটা হাতিয়ার হলো ভালোমন্দ খাওয়ানো। আর টগরের এটা হতে পারে সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। যেহেতু নারীসঙ্গ বিবর্জিত মানুষ, নিজে হাত পুড়িয়ে রান্না করে খায়।তাকে কাবু করা খুব একটা অসুবিধা হবে না।

ফ্রিজ থেকে মুরগির মাংস বের করে ভিজিয়ে রেখে দ্রুত হাতে পেঁয়াজ, মরিচ কেটে নিলো।তারপর আদা,রসুন,জিরা বেটে নিলো।
রাইস কুকারে ভাত আর এক চুলায় ডাল বসিয়ে দিলো।
মশলা বেটে আলু কেটে নিলো।মাংস ভালো করে বরফ ছাড়ে নি।তবুও আর দেরি করলো না চন্দ্র।
মশলা কষিয়ে নিয়ে মাংস দিয়ে দিলো।

রান্নাঘর থেকে মাংসের ঘ্রাণ এসে নাকে লাগতেই টগর চমকে উঠলো। কতো বছর পর আজ আবার এরকম ঘ্রাণ পাচ্ছে?
মা মারা যাওয়ার পর থেকেই নিজের রান্না নিজে করে। কোনো মতে পেটে দুই মুঠো গেলেই হয় তার,এতো কষিয়ে আয়োজন করে রান্না করতে যায় না। ভাত আর আলু ভর্তা করেই বেশির ভাগ দিন চালিয়ে নেয়।ফ্রিজে মাছ মাংস সবই রাখে তবুও।যেদিন আর ইচ্ছে করে না একই খাবার রিপিট করতে সেদিন রান্না করে। যতই ভালো রান্না করুক ইউটিউব দেখে, তবুও নিজের রান্না নিজের তেমন একটা ভালো লাগে না টগরের।

নির্ঝর উঠে বসে বললো, “তোমার সাথে আমার একটা মিল আছে জানো?”

টগর কিছু বললো না। নির্ঝর নিজেই বললো, “তোমার ও মা নেই আমার ও মা নেই।যদিও আমার বাবা আছেন তবে মা মারা যাবার পর থেকেই তিনি আমার তালুই হয়ে গেছেন।আমার ১০ বছর বয়সে মা মারা যান।
তোমার মতো আমি ও নিজের রান্না নিজে করে খাই।”

টগরের হঠাৎ করে নির্ঝরের জন্য কেমন মায়া হলো। সে তো মা’কে অনেক দিন পেয়েছে কাছে এই লোকটা তো তাও পায় নি।
লোকটাকে এতো দিন যতটা খারাপ ভেবেছিলো আজ মনে হচ্ছে ততটাও খারাপ না।

চন্দ্র তরকারি নামিয়ে প্লেটে ভাত বেড়ে নিয়ে একটু ঠান্ডা হতে রাখলো।সেই ফাঁকে শসা,টমেটো, পেঁয়াজ,কাচা মরিচ কুচো করে সরিষার তেল দিয়ে হাতে মেখে সালাদ করে নিলো।
সালাদ বানাতে বানাতে চন্দ্রর মনে হলো, “যদিও এই বাড়িতে কোনো মহিলা নেই তবুও এই লোকটা বাড়িঘর গুছিয়ে রাখে বেশ।ঠিকই বলেছে সেদিন,জাতে মাতাল হলেও,তালে ঠিক আছে। এই জাতে মাতাল লোকটার থেকে নিয়াজদের সব প্ল্যান বের করতে হবে চন্দ্রর।”

খাবার সার্ভ করার পর টগর কিছুটা মুগ্ধ দৃষ্টিতে চন্দ্রর দিকে তাকালো। মেয়েটাকে দেখে মনে হয় ননীর পুতুল অথচ কাজেকর্মে বেশ গোছানো। ওর ভাবভঙ্গি, চলাফেরা দেখে একটুও মনে হচ্ছে না এই বাড়িতে প্রথম এসেছে বরং এমন দক্ষ হাতে সব করছে যেনো এই বাড়িটি তারই।

নির্ঝর খেতে বসে বললো, “বাহ,আপনার হাতে তো দেখছি জাদু আছে ম্যাডাম। খুব দ্রুতই সব আয়োজন করে ফেললেন দেখছি।”

চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “নিন আপনারা খেয়ে নিন।”

টগরের হঠাৎ করেই কেমন যেনো লজ্জা লাগছে খেতে বসতে এই মেয়েটার সামনে। যেনো এই বাড়িতে সে অতিথি এমন লাগছে।
চন্দ্র সাবলীলভাবে প্লেটে ভাত বেড়ে দিলো। তারপর মুরগির মাংস তুলে দিলো টগরের প্লেটে।

টগর ইতস্তত করে বললো, “আপনি ও বসুন না।”

চন্দ্র হেসে বললো, “না,ধন্যবাদ। আমি বাড়িতে গিয়ে খাবো।আব্বা মা অপেক্ষা করে থাকবে আমার জন্য। ”

টগর বললো, “আপনি এতো কষ্ট করে রান্না করেছেন,আর না খেয়ে যাবেন?প্লিজ বসুন।নয়তো আমার নিজেরই খারাপ লাগবে।”

চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “প্লিজ,আমার সাথে এতো ফর্মালিটি করবেন না।আমরা একই গ্রামের মানুষ। চেনাজানা থাকলে, কথাবার্তা থাকলে হয়তো আমরা বন্ধুও হতাম।তাই আমার সাথে এভাবে ফর্মাল ব্যবহার করবেন না।অন্য কোনো দিন খাবো।আজকে আপনারা খান।আপনার তো দেখছি বেড়ে খাওয়ানোর মতো কেউ নেই,আজ না হয় আমি আপনাকে বেড়ে খাওয়াই।”

নির্ঝর মিটিমিটি হাসতে লাগলো চন্দ্রর কথা শুনে। মেয়েটার হাবেভাবে বলছে সে টগরের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।

টগর আর কথা বাড়ালো না।খাবার মুখে তুলতেই টগর দ্বিতীয় বার মুগ্ধ হলো। ভীষণ ভালো রান্না করেছে মেয়েটা।আলু দিয়ে মুরগির মাংসের ঘন ঝোল সেই সাথে মুসুরি ডাল।ডালের মধ্যে আস্ত কিছু কাঁচামরিচ দিয়েছে।ভাতের সাথে চটকে খেতে অসাধারণ লাগছে।
সালাদের পাশে লম্বালম্বি করে কেটে রাখা লেবুও আছে।মাংসের বাটির উপর কিছুটা ভাজা জিরার গুড়ো ছিটিয়ে দেওয়া।এভাবেই তো মা ও দিতো।
কত বছর পর টগর আজ পেট ভরে ভাত খেলো!
জানে না টগর। খাবার পাতে তার ভিজে উঠা চোখ চন্দ্রর নজর এড়ালো না।

নির্ঝর খেতে খেতে বললো, “ফার্স্ট ক্লাস রান্না হয়েছে ম্যাডাম। বহুদিন পর পেট ভরে ভাত খাচ্ছি।”
টগর ফোঁড়ন কেটে বললো, “আপনি প্লিজ এরকম কথা বলবেন না।আপনাদের পুলিশ অফিসারদের জানা আছে আমার। নিজেদের গ্রামেই তো কতো দেখেছি অন্য কোথাও না,এই যে উনি,ওনাদের বাড়িতেও তো কতো পুলিশ অফিসার কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছেন।”

নির্ঝর হেসে বললো, “ভুল বলো নি তুমি। তবে সবাই এক রকম হয় না।আমি তোমার সাথে খেতে নিজে থেকে চেয়েছি বলে তুমি ভেবো না আমি সবসময়ই এরকম সবার সাথে। ”

টগর কিছু বললো না আর।সে তার বাসায় খেতে চেয়েছে বলে কথাটা বলে নি। অন্যান্য অফিসারদের দেখেছে এরকম সেটা বুঝাতে চেয়েছে। এখন কথা বাড়ালে মানুষটা খেতে আনইজি ফিল করবে ভেবে টগর আর কিছু বললো না।
খাওয়ার পর চন্দ্র সব কিছু ধুয়ে মুছে রান্নাঘর ও মুছে ফেললো। বাকি খাবার বক্সে ভরে ফ্রিজে রেখে দিলো।
তারপর ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বললো, “ফ্রিজে সব রেখে দিয়েছি।রাতে খাবার আগে ওভেনে গরম করে নিবেন।”

টগর কি বলবে ভেবে পেলো না। চেয়ারম্যান লোকটাকেই টগরের পছন্দ না।সেখানে তার মেয়ে এতো কিছু করলো তার জন্য। কেমন লজ্জা অস্বস্তি হচ্ছে টগরের।

চন্দ্র বুঝতে পেরে বললো, “আপনি মনে হয় লজ্জা পাচ্ছেন এখনো। লজ্জা পাবেন না প্লিজ।আমার খুব ভালো লেগেছে আপনাদের খাওয়াতে পেরে।আসলে আমার মায়ের থেকে মনে হয় আমরা দুই বোন এই স্বভাব পেয়েছি। কাউকে নিজ হাতে কিছু করে খাওয়াতে পারলে কেমন যেনো মানসিক শান্তি পাই। আমি আমার মানসিক শান্তির জন্যই এটুকু করেছি।”

টগর আর কিছু বললো না। আসলে কি বলবে তাই ভেবে পাচ্ছিলো না।

নির্ঝর আর চন্দ্র চলে যেতেই টগর ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসলো তাকে কে খুন করতে চায়?
খেলা শেষ করার সময় হয়ে গেছে তাহলে!

নির্ঝর হাঁটতে হাঁটতে বললো, “আপনি কি টগরকে ভালোবাসেন?”

আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে চন্দ্র হতভম্ব হয়ে গেলো।

নির্ঝর হেসে বললো, “না আপনার হাবভাব তেমনই মনে হচ্ছে। আর আমার মন বলছে টগরের প্রতি আপনার একটা সফট কর্ণার তৈরি হয়েছে, আপনি এর পরে ও অনেক বার যাবেন টগরের কাছে। ওকে রান্না করে খাওয়াতে। ”

চন্দ্র হতবাক হয়ে বললো, “আপনি কিভাবে বুঝলেন?”

নির্ঝর হেসে বললো, “কিছু ব্যাপার বুঝা যায় এমনিতেই। টগর খাওয়ার সময় আপনার দুই চোখ দিয়ে মায়া ঝরে পড়ছিলো। দেখে মনে হচ্ছিলো আপনার ভীষণ খারাপ লাগছে ওর জন্য। আসলে মেয়ে মানুষের মন একটু নরম বেশি তো।”

চন্দ্র কিছু বললো না। যেতে তো তাকে হবেই।টগরের থেকে তথ্য আদায় করতে হলে তাকে যেতেই হবে।

মনকে চন্দ্র প্রশ্ন করলো, “শুধু কি ইনফরমেশন পেতেই যাবো?তাহলে মনটা এমন বিষন্ন হয়ে গেলো কেনো?”

চলবে……!
রাজিয়া রহমান

#চন্দ্রাণী(১৪)
আকাশের বুকে মেঘের আনাগোনা একটানা। শুভ্র বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখলো বড় আপা আসছে।অনেকক্ষণ বাদে আপা বাড়ি আসলো।কে জানে কোথায় ছিলো!
চন্দ্র এসে আগে শর্মীর রুমে গেলো।শুভ্র ও গেলো সেখানে।
শর্মী চন্দ্রকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো, “আপা,আপারে নীলির এরকম হলো কেনো আপা?”

চন্দ্র শর্মীকে জড়িয়ে ধরলো। শর্মীর কেমন দমবন্ধ লাগছে।সকাল থেকে যদিও খুব একটা খারাপ লাগে নি সবার সাথে থাকায়।বাড়িতে এসে একা হতেই নীলির সাথে কলেজে আসা যাওয়ার কথা মনে পড়তেই শর্মীর অস্থিরতা শুরু হয়ে গেলো।
কতো খুনসুটি করত দুজন একসাথে। এখন কে যাবে শর্মীর সাথে কলেজে?
এতোক্ষণ একা একা রুমে শর্মীর অসহ্য কষ্ট হচ্ছিলো। চন্দ্র বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। শুভ্র এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো এতক্ষণ। কিন্তু ছোট আপাকে কাঁদতে দেখে নিজে এগিয়ে গিয়ে আপার হাত চেপে ধরলো। অবুঝ ছেলেটার চোখের কোণে জল।বোনকে কাঁদতে দেখে সে ও কাঁদছে।
চন্দ্র খানিক জিরিয়ে বললো, “তুই এভাবে ভেঙে পড়ছিস কেনো?”

শর্মী বললো, “আপা আমার খুব ভয় করছে।আমাদের গ্রামে এসব কি শুরু হয়েছে? আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে এরপর আমিও মা//রা যাবো।”

চন্দ্র বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “আমার সোনা বোন।এরকম করে না।তুই ভুলে যাস কেনো তুই কার মেয়ে?তোর দিকে কেউ হাত বাড়াতে হলে ১০০ বার ভাবতে হবে তুই কার মেয়ে।”

শর্মী বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো, “জানিস আপা,আমি ভেবেছিলাম এতো বড় লজ্জা বাবা মা জানার আগে আমি নিজেকে নিজে শেষ করে দিবো।আজ যখন আব্বা নীলির লা//শ দেখে কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছিলো তখন আমার বারবার মনে হচ্ছিলো যদি আমি ও এরকম করে ফেলতাম আব্বা কিভাবে আমার লাশ দেখতো?আব্বা কি নিজেকে সামলাতে পারতো? ”

চন্দ্র বললো,”এভাবে ভেঙে পড়িস না বোন।আমরা সবাই আছি।নীলির সাথে এরকম করেছে যে তাকে পুলিশ খুঁজে বের করবে।আজ না হয় কাল আসামি ধরা পড়বেই।”

শর্মী নিজেকে সামলে নিলো।

রেহানা মেয়েদের রুমে এসে দেখেন দুই মেয়ে মন খারাপ করে বসে আছে।নীলির ব্যাপারটা নিয়ে যে ওরা আপসেট বুঝতে পেরে বললেন,”ভাই বোন তিনজনই এইখানে বসে রইছস।কয়টা বাজে?তোর বাপে এখনো ভাত খাইছে?তোরা খাইছস?”

চন্দ্র উঠে বললো, “চলো মা,আব্বা কই?”

রেহানা মুখ বাঁকিয়ে বললো, “কই আর থাকবে,তার কি কোনো পাত্তা আছে?গিয়ে দেখ কাচারি ঘরে কি করে। ”

শুভ্র গেলো বাবাকে ডাকতে।চন্দ্র আর শর্মী দুজনকেই রেহানা বললো টেবিল সাজাতে।
কাজে থাকলে মন খারাপ কমবে কিছুটা।

একটা কালো টি-শার্ট পরে টগর বের হলো। নিয়াজ কল দিয়েছে টগরকে।নিয়াজ বলেছিলো তালতলায় থাকবে সে।কিছু মাল ডেলিভারি দিতে হবে রাতে।

টগর শিস দিতে দিতে গেলো।মনে মনে হিসেব কষতে লাগলো আজকের ডেলিভারিতে কতো ইনকাম হবে।
কাজটা অবশ্য টগর বেশ উপভোগ করে। এখন পর্যন্ত একবার ও সে ধরা খায় নি।এরকম চ্যালেঞ্জ নিতে তার আনন্দই হয়।

তালতলায় গিয়ে দেখে নিয়াজ আগেই দাঁড়িয়ে আছে। টগরকে দেখে এগিয়ে এলো।তারপর বললো, “এলাকা গরম এখন।সাবধানে মাল নিয়ে যাবি।”

টগর একটু ভালো করে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনার কি মন খারাপ? ”

নিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, “বুঝতেছি না কিছুই কি হইতেছে।ইদানীং নকল মাল আসে একেক চালানে বুঝলি।কাস্টমার কমপ্লেইন করে। ওই দিকে আমার কাছে যিনি সাপ্লাই করে সে বলে সে ঠিক মাল পাঠায়।তাইলে সমস্যা হইতেছে কোন জায়গায় বুঝতেছি না।”

টগর এক সেকেন্ড ভেবে বললো, “আপনি আপনার পুরো সিস্টেম আবার ভালো কইরা চেক দেন ভাই।দলের মধ্যে দুই নাম্বারি করার মতো মানুষের তো অভাব নাই বুঝেন নাই?কেউ হয়তো গাছের ও খায়,তলার ও কুড়ায়।”

নিয়াজ চমকে উঠলো টগরের কথা শুনে। আসলেই তো!
এই বুদ্ধি তো তার মাথায় আগে আসে নি।
হইতে ও তো পারে তার লোকদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে।

নিয়াজ চলে যেতে যেতে বললো, “রহিম শেখের ক্ষেতের বড় লাউ যেটাতে দেখবি নখ দিয়ে ত্রিভুজ আঁকা আছে।”

টগরকে একটা খাম দিয়ে নিয়াজ চলে গেলো। টগর আগের মতো খুশি মনে শিস দিতে দিতে লাউ কিনতে গেলো।
রহিম শেখের বাড়ি চেয়ারম্যান বাড়ির সাথে। চেয়ারম্যান বাড়ির কথা ভাবতেই টগরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। চন্দ্র মেয়েটা বেশ করিতকর্মা। দেখতেও বেশ!

ভাবতে ভাবতে নিজে নিজে আবার মুচকি হাসলো টগর। মেয়েটার কথা এতো বার কেনো ভাবছে সে?
দূর!

রহিম শেখের ক্ষেতের কাছে এসে দেখে চন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে রহিম চাচার বউ লিপি চাচীর পাশে।লিপি চাচী চন্দ্রকে বললো, “কত্তো দিন পরে তোমারে দেখছি আম্মা।ভালো আছো?”

চন্দ্র হেসে বললো, “জি চাচী ভালো আছি।”

লিপি চাচী চন্দ্রর হাতে লাউ দিয়ে বললো, “না গো আম্মা,টাকা দেওন লাগতো না।এইটা তোমারে ভালোবাইসা দিলাম।”

চন্দ্র বললো, “না না চাচী,এই কথা বলবেন না।মা রাগ হবে যদি শুনে লাউয়ের দাম নেন নাই।”

লিপি চাচী হেসে বললো, “তুমি ভাবীসাবরে কইও এইটা চাচীর তরফ থাইকা উপহারের। তোমার মা’য় কতো দিন কতো কিছু দিছে,আমাগো কি সেই ক্ষেমতা আছে তোমাগো লাইগা কিছু করার।আইজ যখন সুযোগ আইছে আমার কথাখান রাখো আম্মা।”

চন্দ্র আর কিছু বললো না। ক্ষেতের সবচেয়ে বড় লাউটা তিনি চন্দ্রর হাতে দিলেন।

টগর চমকে উঠলো যখন দেখলো লাউয়ের উপর ত্রিভুজ চিহ্ন আঁকা।নিজের মাথার চুল নিজের ছিড়তে ইচ্ছে করছে টগরের।
চন্দ্রর সামনে না গিয়ে দ্রুত সরে গেলো সেই জায়গা থেকে তালতলায়। চন্দ্রকে এই পথ ধরেই যেতে হবে।ক্ষেতের আইল দিয়ে যাওয়ার উপায় নেই কাঁদার জন্য।

চন্দ্র কিছুদূর যেতেই দেখে টগর একটা গাছতলায় বসে আছে। মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে বললো, “আপনি? ”

টগর বিস্ময়ের ভান করে বললো, “আরে আপনি? কোথা থেকে?লাউ নিতে এসেছেন বুঝি?”

চন্দ্র হেসে বললো, “হ্যাঁ, মা পাঠালো একটা লাউ নিতে। ”

টগর হেসে বললো, “আপনাকে দেখে কিন্তু বুঝা যায় না আপনি যে গ্রামের সাধারণ একটা মেয়ে।দেখলে মনে হয় অন্যরকম। ”

চন্দ্র হেসে বললো, “কেমন? ”

টগর বললো, “না কিছু না।”

চন্দ্র বুঝতে পারলো টগর কিছু লুকাতে চাইছে।তাকে এই লোকটার সাথে ভাব জমাতে হবে।তাই আগ বাড়িয়ে নিজে থেকে বললো,”আমাকে কি খুব খারাপ মেয়ে মনে হয়? ”

টগরের আর ধৈর্য কুলাচ্ছে না এসব ঢং করে কথা বলতে। অথচ এখন উপায় নেই।এই মেয়ের সাথে ধৈর্য ধরে কথা বলতেই হবে।হাতের লাউটা আদায় করতে হবে।

টগর মনে মনে ভাবলো আমার এতো খারাপ দিন কবে এলো যে একটা লাউয়ের জন্য একটা মেয়ের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হচ্ছে!

মুচকি হেসে বললো, “সত্যি বলতে আপনাকে দেখতে মনে হয় ভীষণ অহংকারী, মানে চেয়ারম্যানের মেয়ে একটা অন্যরকম ভাবসাব। অথচ আপনার সাথে মিশলে বুঝা যায় আপনি কতটা অমায়িক। ”

চন্দ্র মনে মনে বললো, “আমি অমায়িক না কি তা বুঝবে যেদিন কালসাপ হয়ে ছোবল দিবো।”

মুখে বললো, “একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে এবার। এতটা ও না যতটা বলছেন।”

দুজন হাঁটতে লাগলো। চন্দ্র টগরের সাথে ভাব জমাতে ব্যস্ত আর টগর ব্যস্ত চন্দ্রকে অন্যমনস্ক করতে। কথায় কথায় টগর চন্দ্রকে নিজের বাড়ির দিকে নিয়ে গেলো।কিছুটা গিয়ে চন্দ্রর মনে হলো ভুল রাস্তায় চলে এসেছে।
টগরকে সেই কথা বলতে টগর বললো, “এতটা পথ যখন চলে এসেছেন তখন না হয় আরেকটু চলুন।আপনি আজ আমাকে রান্না করে খাইয়েছেন,আমি না হয় আপনাকে একটু কফি করে খাওয়াবো।”

চন্দ্র বিব্রত হয়ে বললো, “না না,তা লাগবে না। অন্য কোনো দিন হবে।”

টগর নাছোড়বান্দা। মুখে কৃত্রিম অভিমান ফুটিয়ে তুলে বললো, “বুঝেছি, আপনার আমাকে ঠিক ভালো লাগছে না।অসুবিধা নেই।”

চন্দ্র লজ্জিত হয়ে বললো, “আরে না না,তা হবে কেনো?আচ্ছা চলুন।”

টগর মুচকি হাসলো। কাউকে কনভিন্স করার গুণ তো তার সেই স্কুল লাইফ থেকে আর একটা মেয়েকে সে কনভিন্স করতে পারবে না?

চন্দ্র মনে মনে ভাবলো,”ছেলেটা কি আমাকে একটু একটু পছন্দ করতে শুরু করেছে? আমার সম্পর্কে ওর ধারণা কিছুটা বদলাচ্ছে। ”

চন্দ্রর হাতের লাউটা টগর হাতে নিয়ে বললো, “কতোক্ষণ ধরে বয়ে বেড়াবেন এই বোঝা?আমার কাছে দিন এবার।”

চন্দ্র মুচকি হাসলো। টগরের জানে পানি এলো।আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো লাউয়ের গায়ে খুব সুক্ষ্মভাবে কাঁ//টা চিহ্নটা দেখা যাচ্ছে।

নির্ঝর কুসুমপুরের ২০-২৫ বছর আগের ফাইল নিয়ে বসেছে।এই গ্রামের সব হিস্ট্রি তার জানতে হবে।সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে সাধারণত ক্রাইম বেশি হয়ে থাকে।এখানেও সেইম।
দেখতে দেখতে একটা তথ্য জানতে পারলো নির্ঝর। আর জেনে বেশ অবাক হলো।

চলবে…..
রাজিয়া রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে