এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-১৪+১৫

0
217

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_১৪
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

সেদিন পুরোটা সময়ই জ্যোতি মেহেরাজকে নিয়ে ভাবল। ভালো করে মনে করল সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসা মেহেরাজ ভাইকে।শুরু থেকেই,বলতে গেলে ছোটবেলা থেকেই মেহেরাজের ব্যাক্তিত্বকে সে সম্মান করত, শ্রদ্ধা করত। মেহেরাজ ভাই বলতেই সে, মিথি এমনকি অন্যান্যদের সামনে ও ফুটে উঠত এক আদর্শবান ব্যাক্তিত্বের চিত্র। আর সেই ব্যাক্তিত্বের কারণেই বোধহয় কিশোরী কাল হতে এই পুরুষটির প্রতি কিঞ্চিৎ দুর্বলতার ও সৃষ্টি হয়েছিল তার হৃদয়ে।কিন্তু এখন কি এই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত তার? মেহেরাজ ভাই কেনই বা নিজ থেকে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিবে? কোন ছেলে নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিজে দেয় নাকি?আর সামান্তা? সামান্তার সাথে কি সত্যিই কিছু ছিল না? জ্যোতি ভাবে কেবল। ভাবতে ভাবতেই দিন পেরিয়ে রাত হলো, রাত পেরিয়ে সকাল হলো।আর ঠিক সকাল বেলাতেই পুকুর পাড়ে দেখা হলো মেহেরাজের সাথে।জ্যোতি কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে দেখল মেহেরাজকে। এই প্রথম বোধহয় সে মেহেরাজের বাহ্যিক রূপ ও লক্ষ্য করতে লাগল। পরনের জামা হতে, কপালে পড়ে থাকা কালো চুল, এমনকি ভ্রুজোড়া,খোঁচা দাঁড়ি, বড় বড় চোখজোড়া, লালচে খয়েরি পুরু ঠোঁটজোড়া সবই সে সরু চাহনিতে লক্ষ্য করে গেল। মেহেরাজ তার চোখজোড়ার সে সরু দৃষ্টিতে লক্ষ্য করা দেখেই আড়ালে হাসল।তারপর কিছুটা এগিয়েই বুকে হাত গুঁজে দাঁড়াল জ্যোতির সামনে। ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,

“কি আশ্চর্য!বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে না পাঠাতেই প্রেমে পড়ে গেলি নাকি জ্যোতি? ”

কথাটা শুনতে দেরি হলেও জ্যোতির নজর সরাতে দেরি হলো না যেন। দ্রুত অন্যদিকে দৃষ্টি স্থির করে অস্বস্তিতে হাত ঘষল। তার এভাবে তাকানোটা উচিত হয়নি বলে মনে মনে নিজের উপর বিরক্তও হলো।তারপর অস্বস্তি আড়াল করে বলে উঠল,

“প্রেমে পরব কেন? আমি ভাবছিলাম শুধু। ”

মেহেরাজ এবারেও চাপা হাসল। জ্যোতির মুখে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,

“ ওহ, তো কি ভাবছিলি? আমি কতোটা সুন্দর তা? ”

জ্যোতি শান্ত চাহনিতে তাকাল মেহেরাজের দিকে। মাথা দুলিয়ে উত্তর দিল,

“না, তবে আপনার মতো একটা সুন্দর ছেলে আমার মতে অসুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাবই বা কেন পাঠাবে? অদ্ভুত না বিষয়টা?”

“তারমানে সত্যিই তুই আমার সৌন্দর্য নিয়েই ভাবছিলি? ”

“ না, বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর কারণ ভাবছিলাম। ”

মেহেরাজ এবারে যেন বিরক্ত হলো৷ কপাল কুঁচকে গম্ভীর গলায় বলে উঠল,

“ গর্দভ!এটা ভাবতে গিয়ে চোখ দিয়ে আমার সর্বাঙ্গ ওভাবে দেখার মতো কি ছিল? আমার সর্বাঙ্গে উত্তর লেখা ছিল কি তোর সে প্রশ্নের? ”

জ্যোতি উত্তর দিল না। আসলেই ওভাবে কেন তাকিয়েছো তার উত্তর বোধহয় তার নিজের কাছেও নেই৷ তবে তাকানোটা যে তাে মস্ত বড় বোকামো হয়েছে এই নিয়ে নিজের প্রতি বিরক্তিটা চূড়ায় পৌঁছাল। বেহায়ার মতো একটা ছেলের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকানোর কোন প্রয়োজন ছিল কি আধো?ছিল না তো। তবুুও সে বেহায়ার মতো তাকিয়ে ছিল।এই নিয়ে মনে মনে তার বিরক্তির মাত্রা ক্রমশ বাড়তেই কানে মেহেরাজের গলা,

“ যায়হোক, আমায় ড্যাবড্যাব করে এতক্ষন ধরে দেখে কি উত্তর পেলি সেটা বল।”

জ্যোতি এবারে ছোট শ্বাস ফেলল। কিছুটা নড়ে স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,

“ কোন উত্তরই পাইনি, তবে এটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি এই বিয়েটা করব না। ”

মেহেরাজের বিরক্তির মাত্রা আরো কয়েকগুণ বাড়ল। তপ্তশ্বাস ফেলে শক্ত গল্য় বলে উঠল,

“ তো কোন বিয়েটা করবি? শোন যে বিয়েটাই করিস না তুই বিয়েটা কিন্তু আমার সাথেই হবে।এটা মাথায় রাখলেই চলবে। ”

ফের জ্যোতি উত্তর দিল,

“আপনাকে বিয়ে না করার কথাই বললাম মেহেরাজ ভাই। আমি অতোটা নিষ্ঠুর নই। ”

সুচালো চাহনিতে জ্যোতির দিকে ফিরে চাইল মেহেরাজ। ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল,

“নিষ্ঠুর?নিষ্ঠুরের প্রশ্ন কেন আসছে? ”

জ্যোতি কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল। তারপর হঠাৎ নরম গলায় বলে উঠল,

“ আপনি জানেন না আসলেই?সামান্তা আপু আপনাকে ভালোবাসে মেহেরাজ ভাই। জানেন না সেটা?আর অন্যের ভালোবাসার মানুষকে কেড়ে নেওয়ার মতো অতোটাও স্বার্থপর বা বেহায়া আমি নই৷ ”

মেহেরাজের কপালের ভাজ মিলিয়ে গেল৷ পকেটে হাত গুঁজে ভরাট গলায় বলে উঠল,

“ আর আমিও অতোটা দয়ালু নই যে নিজের অনুভূতিময় কিছু ছেড়ে দিয়ে সারাজীবন হাত গুঁটিয়ে বসে থাকব৷ ”

“মানে? ”

“আমি তো তোকে আগে বুদ্ধিমতি ভাবতাম জ্যোতি। কিন্তু কে জানত তুই এতোটা গর্দভ? ”

কথাটা বিরক্তি সুরে বলেই পাশ ঘুরল মেহেরাজ। এই মেয়ের কথা শোনা মানেই মেজাজ খারাপ হওয়া।তার চেয়ে কথা না শোনাটাই সুন্দর সিদ্ধান্ত৷ তাই তো আর দাঁড়াল না। পিছনে জ্যোতির প্রশ্নোবোধক চাহনিকে পাত্তা না দিয়ে দ্রুত চলে গেল নিজ গতিতে।

.

মেহু ভার্সিটি থেকে হেঁটেই ফিরছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল হসপিটালটা। এই হসপিটালেই মেঘ ইন্টার্নি করছে। জ্যোতির বাবা যখন হসপিটালে ছিল তখন কয়েকবার দেখা হয়েছিল। মেঘের মুখটা মনে পড়তেই মুহুর্তে মনে পড়ল মেঘের যন্ত্রনামাখা কথা, বিষাদ আর যন্ত্রনাগুলো। তার চেয়েও বোধহয় মেঘের যন্ত্রনাটাি বেশি। বেশি নয় কি? সে প্রত্যাখিত হয়ো কষ্ট পেয়েছে, অন্যদিকে মেঘ তো প্রত্যাখানের সাথে সাথে এটাও জানল যে তারই ভালোবাসার মানুষ অন্য কাউকে ভালোবাসা। এটা বোধহয় সত্যিই তার যন্ত্রনার চেয়েও বেশি।কিন্তু সে কি আসলেই কিছু করতে পারে? কিছু করা যায় আধো?দুই দিকে দুইজন৷ একজন তাকে ভালোবাসে, অপরজনকে সে ভালোবাসে। ঠিক কোনদিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত মেহুর? সাঈদের দিকে? নাকি মেঘের দিকে? ভেবে পেল না। আর ভেবে পেল না বলেই বোধহয় হসপিটালের সামনে মেঘকে দেখেও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাল। দ্রুত পায়ে পার হওয়ার চেষ্টা করল নির্ধারিত স্থানটি। কিন্তু হয়ে উঠল না। তার আগেই সম্মুখে এসে দাঁড়াল মেঘ৷ পকেটে হাত গুঁজে মৃদু হেসে বলে উঠল,

“ এড়িয়ে যাচ্ছেন মিস মেহু?আপনি এতোটা অস্বস্তি ফিল করার মতো কিন্তু সত্যিই কিছু নেই। আমি কিন্তু আপনাকে দোষী ঘোষণা করছি না, করবও না। ওটা সম্পূর্ণটাই আমার অনুভূতির দোষ। আপনি বরং আগের মতোই পরিচিত হিসেবে আমার সাথে কথা বলতে পারেন৷ ক্ষতি নেই তো তাতে? ”

মেঘ কখনো আপনি সম্বোধন করে, আবার কখনো বা তুমি। এই নিয়ে অবশ্য মেহু কিছু বলল না। তবে সে সত্যি সত্যিই অস্বস্তি ফিল করল। অস্বস্তি ফিল করার মতো কিছু নেই তা মেঘ বললেও তার সত্যি সত্যিই অস্বস্তি লাগছেে। মৃদু কন্ঠে তবুও উত্তর দিল,

“ না আসলে, আপনাকে খেয়াল করিনি। নয়তো কথা বলতাম।”

“ আসলেই খেয়াল করোনি? নাকি এড়িয়ে যেতে চাইলে? আচ্ছা আমি ছ্যাঁছড়ার মতো আচরণ করছি মেহু? ভালোবাসো না জেনেও নিজ থেকে কথা বলতে চলে এলাম।যায় হোক, কেমন আছো তা বলো?”

মেহু ইতস্থত বোধ করল৷ভদ্রভাবে উত্তর দিল,

“আলহামদুলিল্লাহ,আপনি? ”

মেঘ হাসল। বলল,

“ এই যে কাঁটছে দিন। তো তোমার ভালোবাসার মানুষটির সাথে আলাপ করাবে না কখনো? আমার কিন্তু তাকে দেখার অনেক ইচ্ছে মেহু। একবার দেখা করাবে? ”

মেহু অন্যমনস্ক ছিল। হঠাৎ এই কথা শুনে কাঁপা গলায় বলল,

“ হু? মানে আসলে সে দেখা করবে কিনা জানা নেই আমার। ”

মেঘের চাহনি হঠাৎ কেমন হলো যেন। গলা যেন ধরে আসল। তবুও হাসার চেষ্টা করে শুধাল,

“আচ্ছা, সে খুব ভালো তাই না মেহু? খুব ভালোবাসে তোমায়? নিশ্চয় দেখতে ও খুবই সুন্দর? ”

মেহুর চোখ টলমল করল এবারে৷ ঠোঁটে ঠোঁট কাঁমড়ে চেষ্টা চালাল কান্না আটকানোর। কিন্তু আধৌ পারল কি? যে মানুষটাকে সে ভালোবাসে সে মানুষটাতো তাকে ভালোবাসে না। মেঘের বাকিসব প্রশ্নের উত্তর বলার মতো হলেও এই উত্তরটা যে সে বলতে পারবে না। কি করেই বা বলবে?তাই তো মেহু উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। মৃদু গলায় বলল,

“ আপনি আমার চেয়েও ভালো কাউকে ডিজার্ব করেন।নিজের জীবনটা গুঁছিয়ে নিন প্লিজ। আমি জানি আপনি আমায় অনেকটা ভালোবাসেন, হয়তো বা এই ভালোবাসাটা কুড়িয়ে নিলে আমিই সর্বোচ্চ সুখী হবো। কিন্তু আমি পারছি না, পারব কিনা তাও জানা নেই। আপনি ভালো থাকুন এটাই চাইব খালি। ”

মেঘ তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল কেবল। গম্ভীর স্বরে শুধাল,

“ হাস্যকর না মেহু? যাকে আমি চাই তাকেই পেলাম না, তার চেয়ে ভালো কেউ আসলেও আমি কি আসলেই সুখী হবো? আমার তো তার চেয়ে ভালো কাউকে চাই না, তাকেই চাই। যায় হোক, আমার সুখের কথা নাহয় বাদ থাক। তুমি সুখী হও, অনেকটুকু সুখী হও মেহু। আমার সুখটুকুও নাহয় তোমার হোক। ”

.

মেঘ আজও রাত করেই বাসায় ফিরল। পরিবার,হসপিটাল সব জায়গায় নিজেকে পার্ফেক্টলি হাজির করার চেষ্টা করলেও ভেতর থেকে যে সে বড্ড নড়বড়ে হয়ে আছে তা বোধহয় বুঝল খালি তার মা। তাই তো আজও জেগে থেকে অপেক্ষা করলেন ছেলের ফেরার জন্য। ছেলে যখন বাসায় ফিরল তখন ছেলের গা থেকে ভেসে নিকোটিনের গন্ধটাও খুব ভালো করেই বুঝলেন। কিন্তু প্রশ্ন ছুড়লেন না। চুপচাপ খেতে দিলেন ছেলেকে। তারপরই চেয়ার টেনে বসে মৃদু কন্ঠে বললেন,

“ মাকে বিশ্বাস করিস তো মেঘ?”

মেঘ খাওয়ার মাঝেই চোখ তুলে চাইল। খাওয়া থামিয়ে আলতো হেসে উত্তর দিল,

“ নিজেকে বিশ্বাস করার আগে থেকেই তোমাকে বিশ্বাস করা শিখেছি আম্মু। ”

মেঘের মা চাপা নিঃশ্বাস ফেলল। বলে উঠল,

“তবে মায়ের থেকে সবকিছু এতোটা আড়াল করা কেন মেঘ? ”

মেঘ অবাক হওয়ার ভান করল। ভ্রু কুঁচকে শুধাল,

“ কিসব বলছো আম্মু? কি আড়াল করেছি আমি? ”

“ কিছুই না? এতোটা অনিয়ম কেন তবে হঠাৎ? যে ছেলে নেশার দিকে ফিরে চাইত না সে ছেলে আজ নেশায় অভ্যস্ত হচ্ছে। কেন এসব? ”

মেঘ অনুতপ্ত হলো। ভাবল মা যে আদর্শে বড় করেছে তাকে সে আদর্শ থেকে সরে গেছে বলেই হয়তো মা রাগ করেছে। হয়তো সিগারেটের বিষয়টা টের পাওয়ার কারণেই এসব প্রশ্ন ছুড়ছেন। তাইতো বাধ্য ছেলের মতো বলে উটল,

“ স্যরি আম্মু,আর হবে না। আসলে এক ফ্রেন্ড বলল তাই সিগারেট হাতে…”

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই তার মা ফের বলে উঠল,

“শুধু আজ নয় মেঘ, আমি এই কয়েকটাদিন নিয়মিত লক্ষ্য করেছি। খাবারে অনিয়ম, চলাফেরায় অনিয়ম,ঘুমে অনিয়ম। এমনকি চোখের নিচে কালো দাগও বসেছে।খুব বেশি ভুল না হলে তুই কাঁদিস ও আড়ালে। কিন্তু কেন? ”

মেঘ চুপ থাকল। সব আড়াল করতে চেয়েও আড়াল করতে না পারার ব্যর্থতায় চুপ হয়ে গেল। তার মা আবারও বলল,

“কি হলো? বল। কেন এসব? ”

এবারেও উত্তর এল না। মেঘের মা আবারও
প্রশ্ন ছুড়ল,

“মেহেরাজরা বিয়ের প্রস্তাবটা রিজেক্ট করেছে বলে? শুধু এই কারণেই এতোটা অবহেলা নিজের প্রতি? ”

এতক্ষনে গিয়ে উত্তর দিল মেঘ। চাপা স্বরে বলে উঠল,

“শুধু না আম্মু, আমি তাকে সবটা দিয়ে ভালোবেসেছিলাম। সবটা দিয়েই চেয়েছিলাম। অথচ সে আমার দিকে তাকিয়েও দেখল না।বুঝল না আমায়। আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি আম্মু। সে অন্য কাউকে চায়, অন্য কাউকে ভালোবাসে আম্মু। এটা যন্ত্রনার নয়? যাকে আমি চাই সে অন্য কাউকে চায় এর চেয়েও যন্ত্রনার বিষয় আর কিছু হয়?”

“এতোটা কষ্ট? এতোটা ভালোবাসিস ওকে মেঘ?”

মেঘ তপ্তশ্বাস ফেলল। খাওয়া ছেড়ে উঠে বলল,

“ আম্মু, আমি ভালোবাসা বলতেই তাকে চিনেছিলাম। ভালোবাসার অনুভূতি বুঝতেই তাকে ভেবেছিলাম। কি করে ভুলি বলো? আমি জানি জোর করে ভালোবাসা হয় না, এ ও জানি তাকে আমি পাব না। আমি তাকে জোর করে পেতেও চাইছি না। কিন্তু সত্যিই আমার কষ্ট হয়। সে অন্য কাউকে ভালোবাসে এটা ভাবতেই আমি মৃত্যুসম যন্ত্রনা অনুভব করি। এর চেয়ে তো মৃত্যুই ভালো ছিল আম্মু। বলো?আমার ভাগ্যেই কেন এমনটা লেখা ছিল? কেন আমি এই যন্ত্রনার ভাগীদার হলাম?”

মেঘের মা রেগে গেল যেন। বললেন,

“ হুশশ!চুপ! একদম চুপ! আম্মু আছে না? পরিবারের এতগুলা মানুষ তোকে কতোটা ভালোবাসে ভেবেছিস? সানশাইন কতোটা ভালোবাসে? তুই সেসব না ভেবে মৃত্যুর কথাটা বলতে পারলি মেঘ? ”

মেঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজ রুমে যেতে যেতে শান্ত গলায় বলে গেল কেবল,

“ স্যরি, আর বলব না আম্মু। ”

#চলবে……

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_১৫
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

জ্যোতি বাড়ি ছেড়ে শহরে এল দুদিন হলো৷ গত দুদিন ভার্সিটিতে না গেলেও আজ বের হলো ভার্সিটিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রাস্তার পাশে রিক্সার জন্য অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে ও লাভ হলো না। খালি রিক্সা চোখে পড়ল না তার।তবে হঠাৎই দেখতে পেল রিক্সায় চড়ে আসা মেহেরাজকে। রিক্সাটা এদিকেই আসছে। জ্যোতি সরু চাহনিতে তাকিয়ে দেখল কেবল। মেহেরাজের এখন এইসময়ে আসার কারণও ভাবতে লাগল মনে মনে। ঠিক তখনই রিক্সাটা এসে থামল তার সামনে। দেখতে পেল মেহেরাজকে রিক্সা থেকে নামতে। জ্যোতি দু পা সরে অন্য জায়গায় দাঁড়াল তখন। মুহুর্তেই শুনতে পেল মেহেরাজের গম্ভীর গলা,

“ সরে দাঁড়ানোর কি আছে? তোর উপর হামলে পড়তাম আমি? ”

জ্যোতি চোখ বুঝে তপ্তশ্বাস ফেলল। মনে মনে সে চেয়েছিল মেহেরাজের সাথে এই যাত্রায় তার কথা না হোক। কিন্তু কথা হতেই হলো। এখন জবাব না দিলে নিশ্চয় বেয়াদব সম্বোধনটা খুব সুন্দর ভাবেই তার নামের আগে বসিয়ে দিবে? তাই তো ঠোঁটে ঠোঁট চেপে উত্তর দিল,

“যাওয়ার জন্য জায়গা না পেলে তখন আবার বলতেন বেহায়ার মতো একটা ছেলের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছি।তাই না মেহেরাজ ভাই? ”

মেহেরাজ ভ্রু কুঁটি করে তাকাল। ঠোঁট চেপে সন্দেহী গলায় বলে উঠল,

“ সত্যি সত্যিই তুই ছেলেদের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে থাকিস নাকি? ”

জ্যোতি মিনমিনে চোখে তাকাল এবারে। দুনিয়ায় এত কাজ থাকতে সে ছেলেদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকার মতো বিচ্ছিরি কাজটাই বা কেন করবে? এটা আধৌ কোন প্রশ্ন করা হলো? তবুও সেই প্রশ্নের উত্তর দিল জ্যোতি। স্পষ্টস্বরে বলল,

“দুনিয়ায় এত কাজ থাকতে আমি ছেলেদের রাস্তা আটকেই দাঁড়িয়ে থাকব কেন মেহেরাজ ভাই?”

“ করতেই পারিস। ”

“একদমই না। ”

মেহেরাজ হাসল কিঞ্চিৎ। জ্যোতির পাশে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,

“গুড!এবার বল মেহু কোথায়? কাল রাত থেকে কল দিয়েছি,ফোন সুইচডঅফ বলছে কেন ওর? ”

জ্যোতি এতক্ষনে বুঝতে পারল মেহেরাজের এই সময়ে এখানে আসার কারণ। মৃদু আওয়াজে উত্তর দিল,

“ মেহু আপু তো এখনো ঘুমাচ্ছে। বোধহয় ভার্সিটিতে যাবে না আজ৷ ”

প্রশ্ন এল,

“ কেন যাবে না? ”

“ বললাম তো ঘুমাচ্ছে।ঘুমে থেকে কি করে যাবে? ”

মেহেরাজ মাথা নাড়াল। পরমুহুর্তে কিয়ৎক্ষন চুপ থেকেই বলে উঠল,

“ ঠিকাছে,তাহলে তুই দুই মিনিটের মধ্যে মেহুকে গিয়ে বলে আসবি যে আমায় যাতে ঘুম থেকে উঠে কল করে। ওকে?”

জ্যোতি চোখজোড়া সরু করে তাকাল। ঠোঁট চেপে প্রশ্ন শুধাল,

”ঘুমাচ্ছে আপু। আমি কি আপুর ঘুম ভাঙ্গিয়ে বলে আসব? ”

মেহেরাজ শ্বাস টানল। ঘুম ভাঙ্গালে ছোটবোনের ঘুম হবে না এই ভেবেই দ্রুত বলল,

“ না না,ঘুম ভাঙ্গাতে হবে না। ও ঘুমাক বরং। তুই ওর পাশে একটা কাগজে লিখে দিয়ে আসবি। ওকে? ”

জ্যোতি আলতো হাসল। ছোট বাচ্চাদের ঘুম ভাঙ্গানোতে যেমন তাদের বাবা মা নারাজ থাকে ঠিক তেমনই যেন ছোটবোনের ঘুম ভেঙ্গে গেলে মেহেরাজেরও অনেকটা খারাপ লাগবে এমন একটা ভাবই স্পষ্ট হলো মেহেরাজের চাহনিতে। সত্যিই কতোটা যত্নশীল! জ্যোতি মুগ্ধ হয় এই যত্নে কিন্তু প্রকাশ করে না। শান্তা গলায় বলল,

“ আচ্ছা।”

কথাটা বলেই পিঁছু ঘুরে চলে গেল। কাজ সেরে আসল আরো কিয়ৎক্ষন পর। ঠিক তখনই মেজেরাজ হাতের ঘড়িটায় তাকাল। সময় দেখে বিরক্ত স্বরে বলল,

“এতোটা দেরি হলো কেন তোর? ”

“দেরি তো আমার হলো ভার্সিটিতে যেতে। আপনি বিরক্ত হচ্ছেন কেন? তাছাড়া অতো বেশি দেরি কোথায় হলো? যায় হোক লিখে দিয়ে এসেছি, আপনি এবার চলে যান মেহেরাজ ভাই। ”

মেহেরাজ শীতল দৃষ্টিতে চাইল। বলল,

“ তোর থেকে অনুমতি নিয়ে যাব নাকি? তাড়াতাড়ি রিক্সায় উঠ, তোর না তেরি হচ্ছে? ”

“হচ্ছে, কিন্তু এই রিক্সায় তো আপনিই এলেন তাই না? ”

ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন শুধাল মেহেরাজ,

“তো?”

“কিছ নয়। ”

কথাটা বলেই ধীর গতিতে রিক্সায় উঠে বসল জ্যোতি। পরক্ষনেই আবারও মেহেরাজও উঠে বসল সে একই রিক্সাতেই। জ্যোতি ভ্রু কুঁচকাল। দ্রুত দূরত্ব নিয়ে সরে বসে জিজ্ঞেস করল

“আপনিও যাবেন মেহেরাজ ভাই? ”

“যাচ্ছিই তো। দেখছিস না? ”

“ হু। ”

মৃদু স্বরে কথাটা বলেই জ্যোতি আরো কিছুটা সরে একদম কিনারায় বসল যেন। আর সেই দৃশ্য দেখেই মেহেরাজ ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল। শান্ত অথছ দৃঢ় গলায় শুধাল,

“ পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙ্গার প্ল্যান করছিস নাকি? আজব!তোর কি আমায় গা ঘেষাঘেষি করা টাইপ ছেলে মনে হয় নাকি বুঝলাম না? ”

.

তখন সন্ধ্যা। আঁধার আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ। জানালার এইপাশে বসে সেই চাঁদকেই দেখে গেল মেহু৷ অন্যমনস্ক হয়ে জ্যোতিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,

“জীবনে কার দিকে যাওয়া উচিত আমার? কার সাথে আমার জীবন জড়ানো উচিত জ্যোতি? আমি ক্লান্ত! প্রচুর ক্লান্ত!”

জ্যোতি বই ঘাটাঘাটি করছিল। হঠাৎ প্রশ্নে হাত থেমে গেল যেন। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে উত্তর দিল,

“ যার কাছে তুমি সবচেয়ে সুখী হবে তার দিকে। হতে পারে সেটা সাঈদ ভাই, আবার হতে পারে সেটা ঐ ডক্টর। ”

মেহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিল,

“ সাঈদ ভাইয়া আমায় ভালোবাসে না জ্যোতি। ”

জ্যোতির দুঃখ হলো। কিন্তু দুঃখ প্রকাশ করল না। শান্ত গলায় বলল,

“শেষবার একবার কথা বলে দেখতে কি ক্ষতি আপু? বলে দেখো না কথা একটিবার। প্লিজ! ”

“কথা বললেই কি সমাধাণ মিলবে? ”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যোতিও। শূণ্য আকাশে তাকিয়ে জবাব দিল,

“জানা নেই, তবে এটা চেষ্টা মাত্র।চেষ্টা করতে তো নিষেধ নেই বলো? ”

মেহু মেনে নিল এবারে। সহমত পোষণ করে বলল,

“হু! ”

কথাটা বলেই মোবাইল হাতে নিয়ে কল দিল সাঈদকে। একবার, দুইবার, তিনবার অনেকবার কল দিল। অন্যদিকে অপরপাশের সাঈদ ইচ্ছে করেই কলগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাল। যদি ফের কথা বললে মেহুর প্রতি দুর্বল হয়ে যায়? ফের যদি প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তার অনুভূতির? তাই তো যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাল। কিন্তু শেষ রক্ষে হলো কি? সেই তো কল তুলতেই হলো। আর তখন ওপাশ থেকে মেহুর গলা ভেসে আসল,

এতবার কল দিয়েছি। কল তুলছিলেন না কেন? ”

সাঈদ চোখ বুঝল সঙ্গে সঙ্গে। মিথ্যে ব্যস্তা দেখিয়ে মুহুর্তেই একটা মিথ্যে বলে বসল,

“আমি ব্যস্ত আছি মেহু। কিছু বলবে? ”

মেহু উত্তর দিল,

“হ্যাঁ কিছু কথা আছে আপনার সাথে সাঈদ ভাইয়া। ”

“ বলে ফেলো তাড়াতাড়ি, আমার কাজ আছে। ”

মেহু এবারে চুপ হয়ে গেল। ঠোঁট চেপে কিয়ৎক্ষন নিরবতার পর বলে উঠল,

“আমার সাথে কি দেখা করতে পারবেন একটু? একবার। ”

সাঈদ চোখ মেলে চাইল এবারে। ইচ্ছে করেই দেখা করার প্রস্তাবটা নাকোচ করতেই বলে উঠল,

“স্যরি মেহু, কাজ আছে বললাম তো। দেখা করাটা হয়ে উঠবে না বোধহয়। ”

মেহু ফের বেহায়ার মতো বলল,

“একবার! প্লিজ একবার সাঈদ ভাইয়া। আপনি অফিস থেকে ফেরার সময় দেখা করলেও হবে। প্লিজ! ”

সাঈদ চাপা শ্বাস ফেলল। মনে মনে কষ্ট চেপে গলায় খুশ ভাব আনার চেষ্টা করেই শুধাল,

“হঠাৎ এত দরকার? কি ব্যাপার বলো তো মেহু? ”

“কিছুই না, আপনি আসবেন না?”

সাঈদ ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল,

“আসব। ”

“সত্যিই আসবেন তো? আপনি সময় বলেন। আমি হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াব। ”

সাঈদ হাসার চেষ্টা করল। কৌতুক স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“ বিয়ের দাওয়াত দিবে নাকি মেহু? ”

“না, এমনিই কথা আছে তাই। ”

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে