Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 253



মাতাল হাওয়া পর্ব-৮০

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৮০
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

মানুষ সবসময় চেষ্টা করে নিজের জীবনটাকে পরিকল্পনা মাফিক পরিচালনা করতে কিন্তু এই এত পরিকল্পনা ও পরিচালনার মধ্য দিয়ে এটাই ভুলে যায় মানুষের জীবন তার নিজের পরিকল্পনায় পরিচালিত হয় না। বরং মানব জীবনের সম্পূর্ণ পরিকল্পনটাই অন্য একজনের হাতে। যার পরিকল্পনার বাইরে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। আর সেই পরিকল্পনাকারীর কোনো পরিকল্পনাকে উপেক্ষা করার সাধ্য ক্ষুদ্র মানুষের নেই। অন্যথায় রওনকের পরিকল্পনা মাফিক এই সময় তার প্রিয়তমাকে নিয়ে ব্যাংককে একান্তে সময় কাটানোর কথাছিল অথচ আজ পাঁচদিন ধরে সে অবচেতন হয়ে হাসপাতালের আইসিউতে পড়ে আছে। আর এই সময়টাতে যে মানুষটার তার পাশে থাকাটা সবচাইতে জরুরী ছিল সেই মানুষটার কোনো খবর নেই। রওনকের এক্সিডেন্ট হয়েছে পাঁচদিন আগে অথচ এখন পর্যন্ত চিত্রলেখার কোনো খোঁজ নেই। সে কোথায় আছে, কোথায় গেছে সেই খবর কেউ জানে না। যেই শুনছে তার কাছেই মনে হচ্ছে মানুষটা যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এক হাতে শুরু থেকে সবটা লাবিবকে সামাল দিতে হচ্ছে। একদিকে বিজনেস, আরেকদিকে মিডিয়া, সেই সঙ্গে চিত্রলেখার মিসিং হওয়াটা সব মিলিয়ে বেশ একটা হট্টগোলের সৃষ্টি হয়েছিল যা বর্তমানে অনেকটা হালকা হয়ে এসেছে। কারণ পাঁচদিন পরে এখন পর্যন্ত না তো রওনকের জ্ঞান ফিরেছে আর না চিত্রলেখার কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রথমে লাবিবসহ অন্যরা সবাই ধরেই নিয়েছিল চিত্রলেখাকে হয়ত কেউ অপহরণ করেছে। হয়ত যেকোনো মুহূর্তেই অপহরণকারীদের ফোন আসবে মুক্তিপণ চেয়ে। চিত্রলেখা এমনিতে একজন সাধারণ মানুষ হলেও মানুষটা সাধারণ নয়। যেদিন সে বিয়ে করে জামান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিসের সিইও রওনক জামানের বউ হয়েছে সেদিন থেকেই সে আর সাধারণ কেউ নেই। রওনক জামানের বউ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার সব শত্রু বলি আর রাইভ্যাল সবার চোখের নিশানা হয়ে গেছে চিত্রলেখা। সেজন্যই রওনক যখন নিজে পারেনি তখন তার ড্রাইভার চিত্রলেখাকে বাইরে নিয়ে গেছে। যেখানে যেটা প্রয়োজন হয়েছে হয় রওনক নয় তার অবর্তমানে লাবিব সামলেছে। তবুও চিত্রলেখার একা কোথাও যাবার পারমিশন ছিল না; তার নিজের সেফটির জন্যই।

অপহরণকারীরা যেকোনো সময় মুক্তিপণের জন্য ফোন করবে এমন একটা প্রস্তুতি লাবিব আগে থেকেই নিয়ে রেখেছিল। এমনিতেই রওনকের এক্সিডেন্টের পর থেকে সব সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে লাবিবকে তবুও শুরু থেকেই একনিষ্টভাবেই সবটা সামাল দিয়ে আসছে সে। রওনকের এক্সিডেন্টের কথা শুনে বিচলিত হলেও তৎক্ষণাৎই নিজেকে সামলে নিয়েছিল সে। ঐ মুহূর্তে সবকিছু সামাল দিবে এমন কেউ নেই। এমনকি রাদিনও বাংলাদেশে নেই। লাবিবের বুঝতে সময় লাগেনি তাকেই সব সামাল দিতে হবে। বুঝতে পারার পর একমুহূর্ত সময় সে অপচয় করেনি। কিন্তু আচমকা চিত্রলেখার গায়েব হয়ে যাওয়াটা সে নিজেও হিসেব মিলাতে পারেনি। তাই টাকার ব্যবস্থা করতে ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে আগেই কথা বলে রেখেছিল সে। যদিও এই কাজে তানিয়ার বিশেষ ভূমিকা আছে। কিন্তু একদিন, দুইদিন, তিনদিন করে এক একটা দিন কেটে যাবার পর এখন বুঝতে পারছে চিত্রলেখাকে কেউ অপহরণ করেনি। অপহরণ কেস হলে নিশ্চয়ই এতদিনে ফোনকল চলে আসতো। এক একটা করে দিন যাচ্ছে আর সবার সন্দেহ গাঢ় হচ্ছে। চিত্রলেখা অপরহণ হয়নি এটা নিশিন্ত হচ্ছে সবাই। প্রথমদিন মিডিয়া জানতো না চিত্রলেখার অনুপস্থিতির কথা কিন্তু দ্বিতীয়দিন নিউজটা ফ্ল্যাশ হয়ে যাবার পর মিড়িয়ায় নতুন করে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। যে যেভাবে পেরেছে রঙ, চঙ্গ লাগিয়ে নিউজ বানিয়েছে। কিন্তু নতুন আপডেট না পেয়ে আপাতত মিডিয়াও খানিকটা ঠান্ডাই আছে। কোনোরকম নতুন ক্লু ছাড়া নতুন নিউজ করতে পারছে না। এছাড়া লাবিব সুতায় টান দেয়ার ফলে উপর মহলেও চাপে সাংবাদিকেরাও খানিকটা চুপ মেরে আছে। কারণ কেউ কেউ নিউজ বানাতে গিয়ে চিত্রলেখার পরিবার ও আর্থিক অবস্থা পর্যন্ত টান দিয়েছিল। এমনকি ওদের আচমকা বিয়ে নিয়েও নানারকম গুঞ্জণ ওঠা শুরু করেছিল। বাধ্য হয়েই লাবিবকেও উপর মহলের সাহায্য নিতে হয়েছে। পারিবারিক, স্বামী-স্ত্রীকে নিয়ে কোনোরকম রঙ মাখিয়ে নিউজ করার ব্যাপারে উপরের চাপ পেয়ে সবাই মোটামোটি ওসব নিয়ে কিছু বলছে না এইমুহূর্তে আর। কিন্তু গুঞ্জন চাইলেই তো দাবিয়ে রাখা যায় না। চারিদিকে কানাঘোষা ঠিকই চলছে। ওসবে লাবিব পাত্তা দিচ্ছে না। আপাতত টিবি চ্যানেলগুলোর হেডলাইনে কিছু আসছে না সেটাই যথেষ্ট। বাকিটা পরে দেখা যাবে। রওনকের জ্ঞান না ফিরা পর্যন্ত লাবিবের যেটা ঠিক মনে হচ্ছে আপাতত সে সেটাই করছে। নিজের পাওয়ারে যতটুকু সম্ভব সেটুকু কাজে লাগিয়েই চিত্রলেখাকে খুঁজে বের করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে লাবিব; সফল হবে কিনা আপাতত সেই ভাবনা ভাবছে না সে।

প্রথম কয়টা দিন চারিদিক সামাল দিতে অনেকটা বেগ পেতে হয়েছে লাবিবকে যার অর্ধেকটাই এখন কমে গেছে। নিউ ইয়র্কে পৌঁছেই রওনকের এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে একটা কঠিন ধাক্কা খেয়েছে তানিয়া। পৌঁছেই খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই লাবিবের সাথে যোগাযোগ করেছে। একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ফিরতি ফ্লাইট নিয়ে গতকালই ফিরে এসে পৌঁছে সে। তানিয়া চলে আসাতে যেনো লাবিবের কাঁধের বোঝা অর্ধেকটাই নেমে গেছে। এসেই লাবিবকে অফিসের দায়িত্ব থেকে ছুটি দিয়েছি সে। অফিসের সবকিছু তানিয়া এসেই নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে। এছাড়া উপায়ও নেই কোনো। লাবিবকে হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। রওনকের এক্সিডেন্টের কথা শুনে হাসপাতালে এসে পৌঁছেছে এরপর আর একমুহূর্তের জন্য হাসপাতাল তো দূরের কথা আইসিউর করিডোর ছেড়ে অন্যত্র যাবার সু্যোগ হয়নি তার। চিত্রলেখাকে খুঁজে বের করতে একশ এক ফোনকল করতে হচ্ছে তাকে। এমন অবস্থায় রওনকের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত তাকে রেখে বের হবার কথা ভাবতেও পারছে না সে, ভরসাও পাচ্ছে না।

রওনককে না জানিয়ে এমনিতে কোথাও যায় না চিত্রলেখা ওইদিন সকালে কাউকে কিছু না জানিয়ে কোথায় গেছে সেটা কেউ জানে না। এমনকি চিত্রলেখার একমাত্র প্রাণের সই আফিফাও জানে না সে কোথায় আছে। আচমকা মানুষটার এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পেছনে ঠিকঠাক কোনো লজিক দাড় করাতে পারছে না কেউ। সবাই একপ্রকার বিভীষিকাতে আছে।

এতক্ষণ একটা জরুরী ফোন কলে ছিল লাবিব। ফোনকলে কথা শেষ করেই মোবাইলটা পকেটে পুরে নিয়ে আইসিউর করিডোরে বসে অপেক্ষারত লিখনের পাশে গিয়ে বসে সে। লাবিবকে দেখে সামান্য হাসার চেষ্টা করে লিখন কিন্তু মুখে হাসি কুলায় না তার। কীভাবে কুলাবে? যার প্রাপ্তবয়স্ক বোন এমন নিরুদ্দেশ তার কি মুখে হাসি জোগানোর কথা? লিখন নিজেও নিজের মতো নানা জায়গায় চিত্রলেখার খোঁজ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু বিশেষ লাভ হয়নি। চিত্রলেখার পৃথিবীটা ছোট। দুই ভাই, এক বোন আর খালা বাদে রওনকের পরিবার। আগে অফিস করলেও বিয়ের পর থেকে অফিস করছে না সে। এছাড়া অফিসে ঐ এক লাবিব ছাড়া কারো সাথে বিশেষ কোনো শখ্যতা বা বন্ধুত্ব ছিল না তার। এছাড়া বন্ধু-বান্ধবী বলতে ঐ একজন আফিফা। এরপর অন্যকোনো বান্ধবীও নেই তার। সবসময়ই চিত্রলেখার দুনিয়াটা কেবল নিজের পরিবারকে কেন্দ্র করেই ছিল। পরিবারের বাইরে কারো সাথে কোনো ধরনের কোনো সম্পর্ক বা সখ্যতা তৈরি করেনি সে। মলিন দৃষ্টি নিয়ে লাবিবের দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-আপার কোনো খবর পাওয়া গেল লাবিব ভাই?

লিখনের প্রশ্ন শুনে সামনের দিকের দেয়াল থেকে চোখ সরিয়ে পাশ ফিরে লিখনের দিকে তাকায় লাবিব। ঐ চোখে এক অসহায় ভাইয়ের বোনের জন্য চিন্তা, অস্থিরতা, আকূলতা স্পষ্ট দেখতে পায় সে। কিন্তু এই মুহূর্তে এই অসহায় ভাইকে দেয়ার মতো কোনো শান্তনা জানা নেই লাবিবের। সে নিজের সাধ্য মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চিত্রলেখাকে সে খুঁজে না পেলেও অন্তত রওনক না ওঠা পর্যন্ত সে নিজের চেষ্টা চালিয়ে যাবে। লিখনের পায়ের উপর থাকা তার একটা হাতের উপর হাত রেখে তাকে আশস্ত করার চেষ্টা করে লাবিব বলে,

-চিন্তা করো না লিখন। আমি কোনো আপডেট পাবার সঙ্গে সঙ্গেই তোমাকে জানাবো।

-পাঁচদিন হয়ে গেল লাবিব ভাই। এখন পর্যন্ত আমার বোনটার…

লিখনের গলা ধরে আসে। আর কথা বলতে পারে না সে। মায়ের মতো বড়বোনকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের কুচিন্তা করতে চাইছে না যদিও কিন্তু কুচিন্তা তো আর না চাইলে বসে থাকে না। লিখন না চাইলেও নানারকম কুচিন্তা তার মস্তিষ্কে এসে ভর করছে। হাজার চেষ্টা করেও ওসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না সে। লিখনের হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

-আরেকটু ধৈর্য্য রাখো ভাই। আমি আমার সাধ্য মতো চেষ্টা করছি। স্যার ঠিক থাকলে হয়ত এতক্ষণে আমরা চিত্রলেখাকে পেয়ে যেতাম। তবুও আমি কোনো ত্রুটি রাখছি না লিখন।

এটা লিখন নিজেও জানে। লাবিব সত্যিই তার সাধ্য মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোনোদিকে কোনো ত্রুটি রাখছে না। আবার এটাও সত্যি রওনক সুস্থ থাকলে এতক্ষণে আকাশ, জমিন এক করে হলেও চিত্রলেখাকে খুঁজে বের করে ফেলত। আপাতত ধৈর্য্য রাখা ছাড়া কিছু করার নেই কারোই। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে লাবিব জানতে চায়,

-খালার শরীরের কি অবস্থা এখন?

-ঔষধ দিয়ে প্রেসার খানিকটা নিয়ন্ত্রনে আছে আপাতত।

চিত্রলেখাকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনার পর থেকে নারগিস বেগমের শরীরের অবস্থা ভালো নেই। প্রেসার বেড়েছে যা নামতেই চাচ্ছে না। জরুরী ভিত্তিতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল। সেখানেও লাবিব বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। চিত্রলেখার খালার চিকিৎসায় যেনো কোনো ধরনের ত্রুটি না থাকে সেদিকেও খেয়াল রেখেছে সে। রওনককে দীর্ঘদিন ধরে চিনে লাবিব। সেই চেনা জানা থেকেই তার যা মনে হয়েছে, রওনক সুস্থ থাকলে যা করত লাবিব নিজ দায়িত্বে সেটাই করেছে, করছে।

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে লিখন জিজ্ঞেস করে,

-ডাক্তাররা কি বলছে?

-যা বলার তা তো আগেই বলে দিয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা। আরও দু’দিন যাবার পর নতুন করে কিছু বলা যাবে।

আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

-আজকের মতো আসি তাহলে।

-স্যারের সাথে দেখা করবে না?

-কাল আবার আসবো।

প্রতিদিনই একবার করে এদিক আসছে লিখন রওনকের খবর নিতে, সেই সাথে নিজের বোনের কোনো আপডেট পাওয়া যায় কিনা সেই আশায়। লাবিব নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে সম্মতিতে মাথা ঝাঁকায়। লিখনকে বিদায় দিয়ে রওনকের আইসিইউর কেবিনের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। গ্লাসের দরজার এপাশ থেকেই দেখা যাচ্ছে শান্ত ভঙ্গিতেই ঘুমিয়ে আছে সে। এই বিশ্রামটা তার দরকার, ডাক্তাররাই জানিয়েছে। এক্সিডেন্টে রওনকের মস্তিষ্কে অতিরিক্ত প্রেসার পড়েছে। যার ফলে তার মস্তিষ্ক ঘুমিয়ে আছে। ডাক্তাররা জানিয়েছে সাময়িক কোমায় আছে সে। সেই সাথে এটাও জানিয়েছে দিন সাতেকের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে তার। আশা করছে, ব্রেইন তার পর্যাপ্ত বিশ্রাম পেয়ে গেলেই আবার সজাগ হবে সে। ডাক্তারদের বলে দেয়া সময়ের মধ্যে আজ পঞ্চম দিন চলছে। আগামী দু’দিনে জ্ঞান না ফিরলে ব্যাপারগুলো কমপ্লিকেটেড হতে শুরু করবে। আজ সারাদিনও আশাবাদী ছিল লাবিব, হয়ত যেকোনো সময় রওনকের জ্ঞান ফিরে আসবে। কিন্তু দিন ঢেলে যাবার পরেও যখন দেখলো কোনো হদিশ নেই তারপর থেকেই দুশ্চিন্তায় অন্ধকার লাগছে সবকিছু। মনে মনে প্রতিমুহূর্ত আল্লাহকেই ডেকে যাচ্ছে সে। এই মানুষটা থাকা, না থাকার উপর অনেককিছু নির্ভর করছে। অনেকের ভালো, মন্দ জড়িয়ে আছে এই একজন মানুষের সাথে।

চলছে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৭৭+৭৮+৭৯

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)
বিঃদ্রঃ সামনে রোমান্টিক অংশ আছে। নিজ দায়িত্বে পড়বেন।

আচমকা ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসে চিত্রলেখা। নিজেকে ধাতস্থ করতে বড় বড় করে কয়েকবার নিঃশ্বাস নেয়। খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে। স্বপ্নে দেখেছে তার পরনে একটা সাদা শাড়ি। রঙহীন ধবধবে সাদা একটা শাড়ি পরে ড্রইং রুমের ফ্লোরে বসে আছে। তাকে দেখতে বিধ্বস্ত লাগছে। ঠিক তার সামনেই একটা লাশ রাখা। লাশের মুখ দেখা যাচ্ছে না তাই নিশ্চিন্ত হয়ে বলতে পারছে না লাশটা কার। কাফনের কাপড় টেনে লাশের মুখ ডেকে রাখা রয়েছে। তবে চিত্রলেখার মন তাকে জানান দেয় লাশটা এমন কারো যে তার ভীষণ আপন। আর এই বাড়িতে একমাত্র রওনকই একজন যে একান্তই চিত্রলেখার, একান্তই তার ব্যাক্তিগত আপন মানুষ, নিজের মানুষ। এমন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখার কারণ কি বুঝতে পারছে না। বুকের ভেতর দুড়ুমদাড়ুম শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি পিটাচ্ছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বিছানার বা’পাশে তাকায় সে। কিন্তু বিছানার ওদিকটা খালি পড়ে আছে। তার একান্তই ব্যাক্তিগত মানুষটা তার পাশে নেই। গত দু’দিন ধরে বাসায় আসছে না রওনক। কাজের ভীষণ ব্যস্ততা তার। কাজের চাপে খাওয়া দাওয়াটাও ঠিকঠাক করার সময় পাচ্ছে না সে। বাড়ি না ফেরা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই চিত্রলেখার। রওনকের দায়িত্ব, কাজের চাপ সম্পর্কে যথেষ্ট আইডিয়া আছে তার। আর এইসব ব্যস্ততা যে সাময়িক সেটাও খুব ভালো করে জানে। তবে এটাও সত্যি রওনককে সে প্রতিমুহূর্ত বাড়াবাড়ি রকমের মিস করে। এমনভাবে মানুষটা তার সাথে জড়িয়ে যাবে তা চিত্রলেখা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। রওনককে ছাড়া একমুহূর্ত সময় থাকার কথা ভাবতে পারে না সে। অথচ আমরা যা না চাই আমাদের তাই করতে হয়। হাত বাড়িয়ে কপালের কাছে এসে থাকা চুলোগুলো ঠিক করে নিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। অন্যপাশে ঘুরে গিয়ে খানিকটা পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। আগের জায়গায় ফিরে গিয়ে মোবাইল ফোনটা হাতে নেয়। সন্ধ্যায় এসএমএস করে রওনক জানিয়েছিল আজ রাতেও সে বাসায় ফিরতে পারবে না। রিপ্লাইতে চিত্রলেখা লিখে দিয়েছিল অন্তত সময় মতো খাবারটা খেয়ে নিতে। একটু যেন ঘুমিয়েও নেয় সে। এরপর তখন আর রওনকের পক্ষ থেকে কোনো জবাব পায়নি সে। ফোনটা তুলে হাতে নিতেই দেখে রওনকের নম্বর থেকে নতুন এসএমএস এসে রয়েছে। নোটিফিকেশন দেখে ততক্ষণাৎই হোয়াটসঅ্যাপে প্রবেশ করে। রওনক লিখে পাঠিয়েছে, “ Sweet dreams BOW, I miss you badly. Wanna k i s s you desperately.” চিত্রলেখার চোয়াল জুড়ে একটা হাসি ফুটে ওঠে। মোবাইলের স্ক্রিনেই সময় দেখে নেয় সে। রাত আড়াইটা বাজে। মোবাইলের স্ক্রিনে থাকা দু’জনের ছবিটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর, ফোনটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে বাথরুমে চলে যায়। বাথরুম সেরে বের হবার সময় ড্রেসিং রুমের দরজাটা খুলতেই চিত্রলেখার বাড়ন্ত কদম থমকে যায়। শরীর জুড়ে হিমশীতল শিহরণ খেলতে শুরু করে। নিজেকে হালকা লাগতে লাগে। মনে হয় যেন শরীরের সমস্ত ভার হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তার। নিজেকে পালকের মতো ওজনহীন লাগতে লাগে। রওনকের কামনায় ভারী হয়ে থাকা দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়তেই চিত্রলেখার অঙ্গে অঙ্গে বিদ্যুৎ চলাচল শুরু হয়ে যায় যেন। অদৃশ্য এক চুম্বক তাকে বিছানার পায়ের কাছের কার্নিশ ঘেষে বসে থাকা পুরুষটার দিকে টানতে লাগে। বেডরুমের দুই দরজার আলাদা চাবি আছে রওনকের কাছে। বাইরের দরজা লক করলেও চিত্রলেখা ইচ্ছা করেই ভেতরের দরজাটা লক করেনি। যদি মাঝরাতে মানুষটা তার কাছে আসে। যদি হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখে মানুষটা তাকে নিজের বুকে জড়িয়ে রেখেছে। যদি কাঙ্ক্ষিত মানুষটার হাত জোড়া তাকে আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে নেয়। এমন অনেকগুলো যদির কথা ভেবেই ভেতরের দরজার লকটা সে লাগায়নি। বাইরের দরজার নবের লকটা লাগালেও ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগায়নি। চিত্রলেখার মন তাকে জানিয়েছে হয়ত মাঝরাতে, শেষরাতে বা ভোরের দিকে সে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় মানুষটা ঠিক ফিরে আসবে তার কাছে। তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে বলে। তার ভাবনাকে সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে সত্যি সত্যি রওনক এসেছে। লজ্জায় চিত্রলেখার চোয়াল সামান্য লাল হলেও, অহেতুক লজ্জা পেয়ে আসন্ন মুহূর্ত থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে একদম মন সায় দেয় না চিত্রলেখার। বরং আবেদনের এই জোয়ারে তাল মিলিয়ে ভেসে যেতে মন চাইছে তার। চিত্রলেখার শরীর জুড়ে এই চাওয়া তীব্র থেকে তীব্র হতে লাগে। তাই নিজেকে আটকে না রেখে ড্রেসিংয়ের দরজাটা পেছন দিক থেকে হাত বাড়িয়ে টেনে দিয়ে সামনে বসে থাকা মানুষটার দিকে পা বাড়ায় সে। চিত্রলেখার আচমকা কি হয়েছে সে নিজেও বলতে পারবে না। রওনককে পুরোপুরি চমকে দিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের বুকের কাছে থাকা ওড়নাটা একপাশে ফেলে দিয়ে তার কোলের উপর উঠে বসে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারে না রওনক। তার মনে হচ্ছে সবটাই বুঝি তার কল্পনা। অন্যথায় বিয়ের এতদিন পরেও কাছে আসতে লজ্জা পাওয়া তার বউটা নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছে এ যেন কল্পানার বাইরে। রওনককে কিছু বুঝার সু্যোগ না দিয়ে তার ওষ্ঠ জোড়ার দখল নেয় চিত্রলেখা। নিজেকে পুরোপুরি ছেড়ে দেয় তার জীবনের একমাত্র পুরুষটার হাতে। তার যেভাবে ইচ্ছা হয় তাকে আদরে আদরে ভারিয়ে দিক। এই মুহূর্তে রওনকের আদর ছাড়া আর কিচ্ছু চাই না চিত্রলেখার। কোনোদিন কোনোকিছুর আশা না করা, স্বপ্ন না দেখা, আকাঙ্ক্ষা না রাখা চিত্রলেখা যেন নে শা য় মেতেছে। রওনক নামক পুরুষটা চিত্রলেখার নে শা য় পরিণত হয়েছে। এই মানুষটার স্পর্শে নিজেকে মাতাল মাতাল লাগে তার। সর্বক্ষণ এই মাতাল হাওয়া’য় ভেসে বেড়াতে ইচ্ছা করে কেবল। সারাক্ষণ ইচ্ছা হয় মানুষটার স্পর্শ তার শরীরজুড়ে মাখামাখি হয়ে থাকুক।

দীর্ঘ সময় একে-অপরের একান্ত গোপন অঙ্গে ডুবে থাকার পর চিত্রলেখাকে নিজের উন্মুক্ত বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে রওনক। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকে দু’জনে। প্রিয়তমার উন্মুক্ত পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নীরবতা ভেঙ্গে রওনক বলে,

-আই ওয়াজ রিয়্যালি সারপ্রাইজড।

মুখে কিছু বলে না চিত্রলেখা। রওনকের বুকের উপর মাথা রেখে কেবল মুখ তুলে তার মুখের দিকে তাকায়। রওনক নিজেই বলে,

-তুমি এভাবে কখনো নিজে থেকে এগিয়ে আসবে, আমাকে আদর করবে; কখনো ভাবিনি।

বলেই চিত্রলেখার কপালে একটা চুমু খায় সে।

-থ্যাংকিউ মাই লাভ।

রওনকের কথা শুনে সামান্য হাসে চিত্রলেখা কিন্তু তার সেই হাসি যেন চোখ পর্যন্ত পৌঁছে না। জানতে, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে রওনকের কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করে না সে। নিজেকে আটকে রাখে আপাতত। শত ব্যস্ত থাকলেও চিত্রলেখা কখন কি করছে না করছে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি আছে তার। কোনো কারণে যে তার চন্দ্রলেখা বিচলিত সেটাও জানে। জোর করে চেপে ধরলে হয়ত এক্ষুনি সব বলে দিবে কিন্তু সে ইচ্ছা করেই চেপে ধরছে না। চিত্রলেখার জন্য একটা সারপ্রাইজ পরিকল্পনা করে রেখেছে সে। এই সপ্তাহেই তার সব ব্যস্ততাদের ইতি ঘটবে। হাতের কাজগুলো শেষ করেই লাবিবকে সব দায়িত্ব দিয়ে প্রিয়তমাকে নিয়ে দিন পাঁচেকের জন্য দূরে কোথাও ঘুরতে যাবে সব কোলাহল, ব্যস্ততাদের থেকে অনেক দূরে। যেখানে তাদের কেউ বিরক্ত করতে পারবে না। সারাক্ষণ সে তার চন্দ্রলেখায় ডুবে থাকতে পারবে। তখন জানতে চাইবে কি হয়েছে তার প্রিয়তমার। এমন কি তাকে সারাক্ষণ বিচলিত রাখছে। সেটা যাই হোক চুটকি বাজিয়ে সেই সমস্যার সমাধান করে দিবে সে, তা যত বড় সমস্যাই হোক না কেন। চন্দ্রলেখার জন্য সে সব করতে রাজি, সব করতে পারে। আর মাত্র কয়েকটা দিন কেবল।

কোচিং শেষে বাড়ি ফেরার পথে মামুনকে দেখে আচমকাই থমকে দাঁড়ায় চারু। অনেক অনেক দিন পর তাদের দেখা। মামুনকে দেখেই চারুর বুকের ভেতর ঝড়ো বাতাস বইতে আরম্ভ করে। যেকোনো সময় বৃষ্টি হয়ে তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু নামতে শুরু করবে। তবু মানুষটার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। সেদিনের ঘটনার পর অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছে সে। মামুনের কথা ভাবতে চায় না তবু বারবার মামুন নামক ভাবনারা চারুর মস্তিষ্কে ফিরে এসেছে। ঠিক ফিরে আসেনি; চারুর মস্তিষ্ক ছেড়ে যায়নি বলা যায়। সামান্য অবসর পেলেই মামুন নামক ভাবনা হানা দিয়েছে চারুর মন ও মস্তিষ্কে। তাই তো নিজেকে ঠিক রাখতে লেখাপড়ায় মন দিয়েছে সে। আবার দেখা হবার সবরকম আশা একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিল চারু। এভাবে আবার মানুষটা তার সামনে এসে দাঁড়াবে ভাবতেই পারেনি।

হাসি হাসি মুখ করে মামুন জিজ্ঞেস করে,

-কেমন আছো চারু?

-ভালো।

ছোট্ট করে জবাব দেয় চারু। এর বেশি কিছু বলতে পারে না। গলা ধরে আসছে তার। বেশি কথা বললে এক্ষুনি গলা ভার করে চোখ গলে কান্না নামতে শুরু করবে। এভাবে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে তাও মামুনের সামনে কাঁদতে চায় না সে। এমনিতেও মামুনকে সে তার চোখের পানি দেখাতে চায় না। চারু টের পায় মামুনের ঠোঁটের কোনায় লেপ্টে থাকা সামান্য হাসি দেখে তার দুনিয়া ভাংচুর হয়ে কান্না নামতে চাইছে। এমনিতেই চোখ ভার হতে শুরু করেছে। মামুন টের পাবার আগেই নিজের দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে নেয় সে। কিছুতেই মামুনকে সে তার চোখের পানি দেখাবে না। চারু চুপ করে থাকায় মামুন নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-আমি কেমন আছি জানতে চাইবে না?

মাথা ঝাঁকায় চারু। ডানে-বামে মাথা ঝাঁকিয়ে না করে। তা দেখে মামুন আরও জিজ্ঞেস করে,

-আমার উপর রাগ বুঝি?

এবারে ডানে-বামে মাথা ঝাঁকায় চারু। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মামুন বলে,

-আমি চলে যাচ্ছি চারু। এরপর হয়ত আমার আর ফিরা হবে না। এবারে একেবারের জন্যই যাচ্ছি। তাই ভাবলাম যাবার আগে তোমার সাথে দেখা করে যাই।

মামুনের কথা শুনে অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়ে মুখ তুলে তার দিকে তাকায় চারু। মামুনের মুখের হাসি আগের চাইতে সামান্য প্রশস্ত হয়। তবে মামুনের ঠোঁট হাসলেও চোখ হাসে না। বরং ওই চোখে আফসোস দেখা যায়। চারুর দৃষ্টির অবাক হওয়া মামুনের দৃষ্টি এড়ায় না। কিন্তু চারুর মুখে-ঠোঁটে কোনো কথা নেই। মামুন নিজেই বলে,

-দেখবে একদিন তোমার জীবনেও এমন কেউ আসবে যে শুধু তোমার হয়েই থাকবে, তোমাকেই ভালোবাসবে।

-আমার তো এমন কাউকে চাই না মামুন ভাই। আমার শুধু আপনাকে চাই, আপনাকেই লাগবে।

কথাটা মুখ ফুটে বলতে চায়নি চারু। কিন্তু সবসময় তো আমাদের চাওয়া, না চাওয়াতে সবকিছু হয় না। চারু না চাইতেও তার মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেছে। বেরিয়ে যাওয়া কথা তো আর ফিরিয়ে নেয়ার উপায় নেই তাই চারুও আর সেই চেষ্টা করে না। মামুনের চোখে চোখ রাখে সে। সামান্য হেসে মামুন বলে,

-তুমি তো জানোই আমি মায়াকে…

মামুন তার মুখের কথা শেষ করতে পারে না। চারু বলে,

-আপা কোনোদিন আপনাকে ভালোবাসেনি মামুন ভাই।

-আমি জানি মায়া কোনোদিন আমাকে ভালোবাসেনি। কিন্তু আমি তো তাকে ভালোবেসেছি। আমরা কাকে ভালোবাসবো আর কাকে ভালোবাসাবো না এটা যার যার চয়েজ, বুঝলে। আমি মায়াকে ভালোবাসি এটা যেমন আমার চয়েজ তেমনি মায়া আমাকে ভালোবাসে না ওটা মায়ার চয়েজ।

“আর আমি আপনাকে ভালোবাসি, এটা আমার চয়েজ মামুন ভাই।” কথাটা মনে মনে বলে চারু। মামুন নিজের মতো বলতে থাকে,
-আমি যাকে ভালোবাসি, সে ভালো আছে এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। আমি ভালোবাসি বলে তারও আমাকে ভালোবাসতে হবে ভালোবাসায় এমন কোনো শর্ত নাই। শর্ত দিয়ে ভালোবাসা হয় না চারু। তুমি ছোট মানুষ তাই এতকিছু বুঝবা না। ভালো লাগাকে ভালোবাসা মনে করতেছো।

মামুনের কথায় মাথা ঝাঁকায় চারু। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতেই বলে,

-উঁহু, ভালো লাগা আর ভালোবাসার পার্থক্য আমি বুঝি মামুন ভাই। বরং আপনি নিজেই জানেন না আসলে কোনটা ভালো লাগা আর কোনটা ভালোবাসা। আপাকে আপনি কোনোদিন ভালোবাসেন নাই। শুরু থেকেই আপাকে আপনার ভালো লাগতো। সেই ভালো লাগাকেই ভালোবাসা মনে করছেন, আদৌতে আপনি আপাকে ভালোবাসেন না। কখনো বাসেন নাই।

চারুর কথা শুনে খানিকটা তব্ধার মতো খায় মামুন। তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে হিমশিমও খায় সে। তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে চারু আরও বলে,

-আপনার কি আপার জন্য ম রে যাইতে মন চায় মামুন ভাই? এই যে আপাকে বিয়ে করবেন বলে রাতদিন এক করে স্বপ্ন দেখলেন অথচ আচমকাই একদিন আরেকজনের সাথে আপার বিয়ে হয়ে গেল। আপা এখন আরেকজনের বউ, কয়দিন পর বাচ্চার মাও হবে। এসব ভাবলে কি আপনার ম রে যাইতে মন চায় না?

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মামুন বলে,

-ম রে যাওয়া এত সহজ না চারু। যে কথা বলা যত সহজ, সে কাজ করা ততটাই কঠিন ও অসম্ভব।

-আপনি ভুল বললেন মামুন ভাই। ম রে যাওয়া মোটেও কঠিন কিছু না। আমি এক্ষুনি আপনাকে সেটা প্রমাণ করে দেখাইতে পারব।

বলেই চারু একমুহূর্ত দাঁড়ায় না। পেছন দিকে ঘুরে মেইন রোডের দিকে হাঁটা ধরে। খানিকক্ষণ আগেই যে পথ ধরে এসেছিল, সেদিকেই আগায়। চারুর আচমকা কান্ডে কয়েকমুহূর্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রয় মামুন। চারু খানিকটা এগিয়ে যাবার পর মামুনের হদিশ হয় সে আসলে কি করতে যাচ্ছে। বুঝতে পেরে আর মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে না সে। দ্রুত সামনের দিকে কদম বাড়ায়। চারু মেইন রোডের কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে কিছু একটা করে ফেলার আগেই পেছন থেকে তার হাত ধরে আটকে ফেলে মামুন। আতঙ্কে তার বুকের ভেতরটা ধুপধাপ করছে। ব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-কি পাগলামি করতেছো চারু তুমি?

মামুনের চোখে চোখ রেখে চারু বলে,

-আপনি আমাকে ভালোবাসেন না, কোনোদিন বাসবেনও না ভাবলেই আমার ম রে যাইতে মন চায় মামুন ভাই।

-কি যা তা বলতেছো এগুলা তুমি চারু?

-আপনি আমাকে বিয়ে করবেন মামুন ভাই?

চারুর আচমকা প্রশ্ন শুনে এবারে পুরোপুরি তব্ধা বনে গেছে বেচারা। শেষবারের মতো হোক আর যাই হোক, চারুর সাথে দেখা করতে আসা একদম উচিত হয়নি তার। আগেরবার দেখা হবার পর সে বুঝতে পেরে গিয়েছিল চারু তাকে পছন্দ করে এমনকি বাড়াবাড়ি রকমের পছন্দ করে। কিন্তু সে মনেপ্রানে তার মায়াকেই চেয়েছে সবসময়। এই জীবনে মায়া ছাড়া অন্য কাউকে জায়গা দেয়ার কথা ভাবতেই পারে না। সেখানে চারু তো প্রশ্নই আসে না। তবুও মনে হয়েছিল একেবারে শিফট করে যাবার আগে শেষবারের মতো চারুর সাথে দেখা করা উচিত। কিন্তু এমন কিছু হবে জানলে ভুলেও দেখা করতে আসতো না সে। যেমন চুপচাপ বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছিল এক রাতের অন্ধকারে, তেমন চুপচাপ আরেক রাতের আঁধারেই চলে যেতো সে চিরচেনা এই শহর ছেড়ে। সেটাই হয়ত ঠিক হতো। নিজেকে সামলে নিয়ে মামুন বলে,

-তোমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে চারু।

-আপনি আমাকে বিয়ে না করলে আমি এক্ষুনি গাড়ির নিচে ঝাঁপিয়ে পরব বলে দিচ্ছি।

যা বলেছে তা করে দেখাতে মামুনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে চারু। এতে মামুনের হাতের বাধন আরও শক্ত হয়। চারুকে টেনে ধরে সে কাছাকাছি। আচমকা কি হয় তার কে জানে! চারু মামুন দু’জনেই কিছু বুঝে ওঠার আগে কষে এক থাপ্পড় লাগায় মামুন চারুকে। আচমকা থাপ্পড় খেয়ে যেন নড়তেও ভুলে গেছে চারু। মুখে কোনো রা করে না সে। কেবল নিঃশব্দে দু’চোখ গলে গাল বেয়ে পানি ঝড়তে লাগে। হঠাৎ এমন কাজ কেনো করলো মামুন নিজেও জানে না। নিজের উপরেই এখন বিরক্ত সে। চারুর হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের চুলে হাত চালায়। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

-বাড়ি যাও চারু। পাগলামী বাদ দিয়ে, বাড়ি যাও।

মুখে কিছু বলে না চারু। কেবল মাথায় ঝাঁকায়। আরেকটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

-প্লিজ চারু বাড়ি যাও। আমারে এমন কঠিন পরীক্ষায় ফালাইও না, তোমার দোহাই লাগে।

-আপনি আমাকে বিয়ে না করলে আজকে নাহয় অন্যদিন, একদিন ঠিকই আমি ম রে যাব মামুন ভাই।

মামুনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে চারু। পেছনে মামুন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনের ভেতর ভয় জাগে তার। যদি সত্যি সত্যি চারু কিছু একটা করে ফেলে!

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করে বাড়িতে প্রবেশ করে চারু। কিন্তু চোখের পানি যেনো থামতেই চায় না তার। চারুকে ওমনভাবে মাথা নিচু করে ঘরে ডুকতে দেখেই সন্দেহ হয়েছিল নারগসি বেগমের কিছু একটা ঠিক নেই। মেয়ের পেছন পেছন ঘরে এলে দেখতে পান এই অবেলায় কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে সে। চারু শব্দ না করলেও ওর শরীরের ফোঁপানি নারগিস বেগমের দৃষ্টি এড়ায়নি। ডাকতে চেয়েও চারুকে ডাকেন না তিনি। চিন্তিত ভঙ্গিতে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। আচমকা কি হলো সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না। ঘর থেকে বের হবার মুখেই খালার সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় চয়নের। খালার কপালে চিন্তার ছাপ দেখে ব্যস্ত হয় জানতে চায়,

-কি হইছে খালা?

কি বলবেন বুঝে পায় না নারগিস বেগম। চয়নকে বলা ঠিক হবে কিনা সেটাও বুঝতে পারছেন না। লিখন, চয়ন দু’জনই তাদের দুই বোনের সব বিষয়ে ভীষণ পাগলাটে ধরনের। জানতে পারলেই ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু আড়াল করতেও নারগিস বেগমের মন সায় দিচ্ছে না। তাছাড়া চারুর কি হয়েছে সেটাই তিনি ঠিকঠাক জানেন না। সংকোচ করেও চারুর কথাটা চয়নকে বলেন। সবকিছু শুনে চয়ন খালাকে আশস্ত করে বলে,

-তুমি চিন্তা করো না খালা আমি দেখতেছি। আপাতত ওরে কিছুক্ষণ নিজের মতো থাকতে দাও। আমি বাড়ি ফিরে কথা বলবো। কি হয়েছে আমি দেখতেছি তুমি টেনশন কইরো না।

ব্যস্ত হয়ে এয়ারপোর্টের এদিক থেকে সেদিক দৌড়াচ্ছে লাবিব। টেনশন ও চিন্তায় বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে তার। ইতোমধ্যে কপাল ঘামতে শুরু করেছে লাবিবের। ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিজের চুলে হাত চালায় সে। একবার এদিক তাকায়, আরেকবার অন্যদিকে যদি কাঙ্ক্ষিত মানুষটার দেখা মিলে; এই আশায়। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। খুব বেশি একটা দেরি হয়নি তার তবুও মনের গহীনে একটা সংকা রয়েই যায় হয়ত মানুষটা চলে গেছে। শেষবারের মতো তাদের দেখা হবে না। এই জীবনে হয়ত সে আর নিজের মনের কথা বলার সুযোগটা পাবে না। মনের ভেতর সুপ্ত যে আশা নিয়ে এসেছিল সে তা নিরাশায় রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে লাবিবের। পরাজয়টা স্বীকার করেই নিয়েছে সে। এছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই তার কছে।

-লাবিব!

আচমকা নিজের নাম শুনে পেছন ঘুরে তাকায়। তানিয়াকে দেখতে পেয়েই ফস করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। তানিয়া বুঝতে পারে না কি করা বা বলা উচিত তার এই মুহূর্তে। ওয়েটিং এরিয়াতে বসে নিজের ফ্লাইটের সময় হবার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। এতক্ষণে তার প্লেনে থাকার কথা ছিল কিন্ত আসার পরে জানতে পারে তার নির্ধারিত সময় থেকে এক ঘন্টা ডিলে হয়ে গেছে ফ্লাইট টা। অন্যথায় এইমুহূর্তে তানিয়া এখানে থাকতো না। কিছুক্ষণ আগেই তার ফোনে রওনক কল দিয়েছিল। আসার আগেই রওনকের সাথে দেখা হয়েছে তার। তাই এইসময় রওনকের নম্বর থেকে কল পেয়ে খানিকটা অবাকই হয় সে। ইচ্ছা করেই কাউকে সঙ্গে নিয়ে এয়ারপোর্টে আসেনি তানিয়া। বিশেষ করে মীম ও মিশকাতকে না আনার জন্যই কাউকে আনেনি সে। ওরা এয়ারপোর্ট এলে কিছুতে ছেলে-মেয়েকে রেখে যেতে পারতো না সে। ওদের দু’জনের জন্মের পর কখনো ওদের রেখে একদিনের জন্যও কোথাও থাকেনি সে। তানিয়ার মনে আছে কোম্পানির একটা জরুরী কাজে একবার তাকে তিনদিনের জন্য চট্টগ্রাম যেতে হয়েছিল। তখন মীম, মিশকাতের বয়স মাত্র ১৫ মাস চলে। রওনক তাকে বলেছিল তার যাবার প্রয়োজন নেই। তার বদলে হয় সে নয় অন্যকেউ একজন চলে যাবে। কিন্তু তানিয়া চায়নি নিজের কাজটা অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে। এছাড়া অনেকেই বলেছিল বাচ্চা হবার পর তানিয়া আর আগের মতো কাজ করতে পারবেন না। তানিয়া কখনো চায়নি এই কথাটা সত্যি হোক। তাই ১৫ মাসের মীম, মিশকাতকে নিয়েই চট্টগ্রাম গিয়ে কাজ সেরে এসেছিল সে। মীম, মিশকাতের পরীক্ষা শেষ হলেই রওনক নিজে গিয়ে ওদের তানিয়ার কাছে দিয়ে আসবে কিছুদিনের জন্য।

রওনকের কল রিসিভ করে ফোন কানে তুলেই তানিয়া জিজ্ঞেস করে,

-এনিথিং রঙ?

-থ্যাং গড তোমাকে পাওয়া গেল।

-কি হয়েছে বলো তো?

-তোমায় শেষবারের মতো দেখা করে কিছু বলার জন্য কেউ একজন হন্য হয়ে এয়ারপোর্টের এই মাথা থেকে সেই মাথা দৌড়াচ্ছে। কাইন্ডলি তাকে একটু দেখা দেও।

-কার কথা বলছো বলো তো।

-একটু আশেপাশে দেখলেই বুঝবে। আমি নাম বলছি না। তুমি একটু দেখো। তাকে দেখলেই বুঝতে পারবে। আর শুনো…

-শুনছি বলো।

-কি বলতে চায় একটু মন দিয়ে শুনো প্লিজ।

-ঠিক আছে।

তানিয়ার হ্যান্ড পার্সে থাকা পানির বোতলটা লাবিবের দিকে এগিয়ে দেয়। একমুহূর্ত সময় বিলম্ব না করে তানিয়ার হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খায় সে। বোতলটা ফিরিয়ে দিতেই তানিয়া জিজ্ঞেস করে,

-তুমি এখানে!

-বলছি, বলতেই এসেছি।

-আমি শুনছি।

একমুহূর্ত সময় নিয়ে লাবিব বলে,

-আমি আপনাকে ভালোবাসি।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

তানিয়া চলে যাচ্ছে, তার যাবার পথের দিকে তাকিয়ে আছে লাবিব। বুকের ভেতরটা অদ্ভূত এক না পাওয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকলেও ভালো লাগছে তার। শুরু থেকেই সে জানে এমন একজনকে সে তার মনের আসনে বসিয়েছে যাকে হয়ত কখনো সে পাবে না। এই মানুষটাকে কখনোই নিজের করে ছুয়ে দেয়া তো দূরের কথা পাওয়া হবে না জেনেও ভালোবেসেছে। ভালোবাসা এমনই; ভালো ক্ষতির হিসেব করে ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসা এমন এক অনুভূতি যার উপর আমাদের কোনো জোর নেই। চাইলেই যেমন কাউকে আমরা ভালোবাসতে পারি না, তেমনি যাকে একবার ভালোবেসে ফেলি তাকে চাইলেই এই হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যায় না। মানুষটা আমার না হলেও দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, যুগ যুগ, অনন্তকাল মানুষটা এই পোড়া মনের কোনো এক গহীন কোনে ঠিক ঘাপটি মেরে থাকে আজীবন। তানিয়া নামক এই নারী হয়ত এইজীবনে কখনো লাবিবের ব্যাক্তিগত নারী হবে না তবে বেঁচে থাকতে কোনোদিন সে তাকে ভুলবে না। অন্যকোনো নারীতে হয়ত ওতখানি আসক্ত হতেও পারবে না সে কখনো। তবু আফসোস নেই লাবিবের। বুকের ভেতরটা বিসন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকলেও মুখে তার তৃপ্তির হাসি। অন্তত যাকে ভালোবাসে তাকে জানাতে তো পেরেছে ভালোবাসার কথাই এই বা কম কি! “আমি যাকে ভালোবেসেছি সে আমাকে কখনো ভালোবাসেনি। তোমার ভালোবাসা আমি পুঁজি করে রাখবো, জানবো অন্তত কেউ আমায় ভালোবেসেছে।“ তানিয়ার বলে যাওয়া এইকথাটা সবসময় মনে থাকবে লাবিবের।

পেছন থেকে একদম এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ায় রওনক। হাত বাড়িয়ে লাবিবের কাঁধে হাত রাখে। সামনের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই লাবিব বলে,

-থ্যাংকিউ স্যার।

রওনকের নিজের ঠোঁটের কোণেও সামান্য হাসি পরিলক্ষিত হয়।

-মনে হয় না আমি থ্যাংক্স পাবার মতো কিছু করেছি।

-আপনি না থাকলে তো আমি মানুষটাকেই পেতাম না। আর না নিজের মনের কথা জানাতে পারতাম।

রওনক নিজের মুখে স্বীকার না করলেও লাবিব জানে তানিয়াকে খুজে পাবার পেছনে অবশ্যই তার হাত আছে। অন্যথায় এই সময় তার এখানে থাকার কথা নয়।

অনেকক্ষণ আগেই তানিয়া লাবিবের চোখের আড়াল হয়ে গেছে। তারপরেও বেশ কিছুক্ষণ সেদিকেই তাকিয়ে ছিল সে। এবারে দৃষ্টি সরিয়ে এনে পাশ ফিরে রওনকের দিকে তাকিয়ে বলে,

-আমার জানা মতে আপনার এখন মিটিং এ থাকার কথা। মিটিং ফেলে এখানে কেনো?

-লাক ফেবার করলে যা হয় আর কি। যাবার পথেই ফোন এলো মিনিং টা ক্যান্সেল হয়েছে। ব্যস আমি সুযোগটা লুফে নিলাম। আমার দু’জন খুব কাছের মানুষের জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা মুহূর্ত আর আমি সেই মুহূর্তের সাক্ষী হবো না সেটা কি হয় নাকি?

দু’জনেই একমুহূর্ত নিঃশব্দ হেসে নিয়ে রওনক আরও বলে,

-চলো অফিস যাই। লাঞ্চের পর মিটিং আছে আরেকটা এটার পর আর আমাকে পাবে না। কোনো জরুরী কাজ থাকলে এখনি জানাও আজ অফিস থেকে বেরিয়ে গেলে আর পাবে না আমাকে আগেই বলে দিচ্ছি।

-ওকে বস।

রওনক যে প্রজেক্টটা নিয়ে ব্যস্ত ছিল্ সেটা কমপ্লিট হয়েছে। আজ থেকে তার কাজের ভার সামান্য কমেছে যদিও কখনোই তার কাজের প্রেসার কম থাকে না। এত বড় একটা গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক তো সে এমনি এমনি হয়নি। তাই আবার কাজের চাপ বেড়ে যাবার আগেই চিত্রলেখাকে নিয়ে কিছুদিনের জন্য দূরে কোথাও যাবার পরিকল্পনা সেরে ফেলেছে সে। আজ রাতের ফ্লাইটেই তার চন্দ্রলেখাকে নিয়ে ব্যাংকক যাচ্ছে রওনক দিন পাঁচেকের জন্য। এতদিন কাজের চাপে বউকে সে ঠিকটাক সময় দিতে পারেনি। এছাড়াও সে ভুলে যায়নি তার চন্দ্রলেখা কোনো কারণে চিন্তিত, সেটাও জানতে হবে তাকে। তাই অফিসের সমস্ত দায়িত্ব লাবিবকে বুঝিয়ে দিয়ে প্রিয়তমাকে নিয়ে হারিয়ে যাবে কিছুদিনের জন্য। এখন একটাই তাড়া তার দ্রুত অফিসের কাজ সেরে বাসায় ফিরে যাওয়া। গিয়েই চন্দ্রলেখাকে বুকের ভেতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে সে। ভাবতেই অস্থিরতা বাড়ছে তার।

প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে তানিয়া। এমন কিছু একদমই আশা করেনি সে। মানুষের জীবন তার নিজেস্ব পরিকল্পনায় চলে যায় বরং সম্পূর্ণটা বিধাতার পূর্ব পরিকল্পিত। তানিয়া চোখ বন্ধ করতেই তার চোখের পাতায় ভেসে ওঠে লাবিবের বলা কথাগুলো।

-আমি আপনাকে ভালোবাসি।

আচমকা লাবিবের মুখে এমন কথা শুনে অবাক না হয়ে পারে না সে। এতদিনের কর্ম জীবনে বেশ অনেকবার লাবিবের সাথে কাজ করা হয়েছে তার কিন্তু এখনো মনে হয়নি ছেলেটা অশুভ দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে খুব ভালো ভাবেই নিজের অনুভূতিদের আড়াল করে রেখেছিল। আচমকা লাবিবের কথা শুনে কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না।

-লাবিব… আমি…

কি বলবে শব্দ খুঁজে পেতে হিমশিম খায় তানিয়া। তাকে থামিয়ে দিয়ে লাবিব নিজেই বলে,

-আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আমি আপনাকে ভালোবাসি এটা আমার দায়। আপনাকে আমি কোনো দায় দিচ্ছি না। আপনার পক্ষ থেকে আমি কখনো কোনো ধরনের ইঙ্গিত পাইনি, ওভাবে হয়ত কখনো আপনি আমাকে লক্ষই করেননি কিন্তু আমি করেছি। আমার দৃষ্টিতে আপনি সবসময় বিশেষ সম্মানের। নিজের অজান্তেই আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি টের পাবার আগেই। যতক্ষণে টের পেলাম ততক্ষণে আমার আর ফিরে আসার রাস্তা খোলা নেই। আপনি একটু বলছি না আপনাকে আমার ভালোবাসা গ্রহণ করতে হবে। আমি শুধু চাই আপনি জানুন কেউ একজন আপনাকে ভালোবাসে, অসম্ভব ভালোবাসে। আপনি আমার হবেন না জেনেও আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনি জেনেন আমি আপনাকে ভালোবাসি এতটুকু স্বীকৃতিই যথেষ্ট আমার এই জীবন কাটিয়ে দেবার জন্য। আমি শুরু থেকেই জানি আপনাকে নিজের করে পাবার মতো সৌভাগ্য আমার নেই। এই সত্যিটা অনেক আগেই মেনে নিয়েছি আমি। আমি শুধু চাই আমার ভালোবাসার মানুষটা ভালো থাকুক; যেখানেই থাকুক, যার সাথেই থাকুক শুধু ভালো থাকুক, অনেক সুখে থাকুক। আপনার মুখের হাসিই যথেষ্ট আমার ভালো থাকার জন্য।

লাবিবের বলা কথাগুলো সুনে তানিয়া কথা বলার খৈ হারিয়ে ফেলেছিল। খানিক চুপ করে লাবিবের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে পরে তানিয়া বলে,

-আমি যাকে ভালোবেসেছি সে আমাকে কখনো ভালোবাসেনি। তোমার ভালোবাসা আমি পুঁজি করে রাখবো, জানবো অন্তত কেউ আমায় ভালোবেসেছে।

একমুহূর্ত চুপ করে থাকার পর তানিয়া বলে,

-আসি ভালো থেকো, নিজের খেয়াল রেখো।

-আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন প্লিজ।

আর কিছু না বলে নিজ গন্তব্যের দিকে পা বাড়ায় তানিয়া। নিজেকে আর ভালোবাসার অযোগ্য মনে হচ্ছে না তার। কেউ আমায় যত্ন করে ভালোবাসছে এ যেনো পরম অনুভূতি। খালি হাতে নয় ভালোবাসা নামক স্বর্গীয় অনুভূতি হৃদয়ে পুঁজি করে যাচ্ছে সে। হয়ত কোনোদিন লাবিবকে তার ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসতে পারবে না সে কিন্তু সারাজীবন লাবিবের এই ভালোবাসাকে সম্মান জানাবে সে, লাবিবের এই ভালোবাসা পুঁজি করে রাখবে।

টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ব্রেকিং নিউজ চলছে। সব ক’টা চ্যানেলে একই নিউজ। বাংলাদেশের নামকরা ব্যবসায়ী, জামান গ্রুপের কর্ণধার রওনক জামান আজ বিকেলে অফিস থেকে নিজ বাসায় ফিরে যাবার সময় গুরুতর এক্সিডেন্ট করে বর্তমানে ঢাকার এ্যাপলো হসপিটালে ভর্তি আছেন। তার বর্তমান অবস্থা কি সেটা এখনো জানা যায়নি। তার পরিবারের সদস্যরা খবর পাওয়া মাত্রই হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়েছেন কিন্তু রিপোর্টদের সাথে এখন পর্যন্ত কেউ সাক্ষাৎ করেনি তাই ভেতরকার পরিস্থিতি এখনো সবার অজানা। জানা গেছে এক্সিডেন্টের সময় ঘটনাস্থানেই ড্রাইভারের মৃ ত্যু ঘটেছে। রওনক জামানকে যখন হাসপাতালে আনা হয়ছে তখনও তার নিঃশ্বাস চলছিল কিন্তু পর্বরতী অবস্থা এখনো সবার অজানা। রিপোর্টটাররা জামান পরিবারের সদস্য বিশেষ করে রওনক জামানের স্ত্রী চিত্রলেখা জামানের সাথে দেখা করতে চাইলে রওনক জামানের এ্যাসিস্ট্যান্ট জানিয়েছেন এইমুহূর্তে পরিবারের সদস্যরা কেউই কথা বলার মতো পরিস্থিতে নেই। সময়মতো মিডিয়াকে সকল আপডেট দেয়া হবে। যে ডাক্তাররা রওনক জামানের চিকিৎসা করছেন উনারাও কেউ রিপোর্টারদের এইমুহূর্তে কোনোরকম সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে গোপন সূত্রে দুটো তথ্য জানা গেছে। এক, রওনক জামান হাসপাতালে আসার পথেই মা রা গেছেন তাই এখন পর্যন্ত মিডিয়াকে কিছু জানানো হচ্ছে না। দুই, রওনক জামানকে যেকোনো মুহূর্তে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে। অধৈর্য হয়ে সবাই অপেক্ষা করছে কখন ভেতর থেকে খবর আসবে। এরই মধ্যে গুঞ্জন উঠেছে রওনক জামানের অবর্তমানে এত বড় ব্যবসা কে দেখবে? কেউ বলছে তার বড় ভাই রাদিন জামান, কেউ বলছে তানিয়া জামান যিনি রাদিন জামানের প্রাক্তন স্ত্রী এবং জামান গ্রুপের একজন শেয়ার হোল্ডার। আবার কেউ কেউ বলছে রওনক জামানের স্ত্রী চিত্রলেখা জামান হয়ত কোম্পানির হাল ধরবে। এই সবই গুঞ্জন, সঠিক তথ্য এখনো জানা যায়নি।

বিকেল বেলায় অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে রওনকের গাড়ির ব্রেক ফেইল করে এক্সিডেন্ট হয়। তৎক্ষণাৎই দুটো পল্টি খেয়েছে গাড়িটা। ঘটনাস্থানে ড্রাইভারের মৃ ত্যু হলেও রওনককে পাওয়া গেছে র ক্তে মাখামাখি হয়ে অজ্ঞান অবস্থায়, তখনো তার নিঃশ্বাস চলছিল। হাসপাতালে আনার সঙ্গে সঙ্গে একটি মেজর অপারেশন হয়েছে তার। অপারেশনের পর তাকে রাখা হয়েছে আইসিউতে। ইতোমধ্যে অপারেশনের পর ৩ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত রওনকের জ্ঞান ফিরেনি। আইসিউর বাইরের করিডোরেই বসে আছেন দিলারা জামান, জাহানারা ও লাবিব। অবশ্য একমুহূর্ত বসার সময় নেই লাবিবের। সে ফোন কল এ্যাটেন্ড করতে ব্যস্ত। চারিদিক তাকেই সামাল দিতে হচ্ছে। খবর পেয়ে লিখন ছুটে এসেছে নিজের বোনকে সামাল দিতে। লিখনের সঙ্গে নারগিস বেগমও আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু লিখন নিয়ে আসেনি। বলে এসেছে সে পরিস্থিতি বুঝে জানাবে। সাবারাও সবাই এসেছে খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই। সবগুলো মানুষের মধ্যে একমাত্র অনুপস্থিত রয়েছে চিত্রলেখা; যাকে এই সময় রওনকের সব চাইতে বেশি প্রয়োজন। লিখন আসার পর থেকে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিত। কাকে জিজ্ঞেস করবে সে চিত্রলেখার কথা। কম করে হলেও ১০ থেকে ১৫ বার চিত্রলেখাকে ফোন করেছে সে কিন্তু বোনের ফোনটা বারবার বন্ধ আসছে। পরিবারের উপস্থিতিতে ভালোবাসার মানুষের সাথে কথা বলতে পারছে না রিপা। কিন্তু লিখনের কপালে চিন্তার ছাপ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না তার এই চিন্তার কারণ কি। একই কারণে সে নিজেও চিন্তিত। রওনকের এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে ঘন্টা পাঁচেক আগে। প্রত্যেকটা নিউজ চ্যানেল রিপোর্ট করছে অথচ চিত্রলেখার কোনো হদিশ নেই এটা আসলেই চিন্তা করার জন্য যথেষ্ট। কথা বলতে পারছে না দেখে রিপা লিখনের নম্বরের এসএমএস পাঠায়। যেখানে লেখা, “জাহানারা আন্টি জানিয়েছেন আপা নাকি সকাল বেলায় বাসা থেকে বেরিয়েছে। তুমি কি জানো সে কোথায় আছে?” রিপার পাঠানো এসএমএস টার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে লিখন, বুঝতে পারছে না কি জবাব দিবে সে। সকাল বেলায় বেরিয়ে কোথায় গেছে তার বোন? এখনো কি রওনকের এক্সিডেন্টের খবর পায়নি সে? নানারকম ভাবনা এসে ভর করছে লিখনের মস্তিষ্কের ভেতর যার কোনোটারই জাবাব নেই তার কাছে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৭৪+৭৫+৭৬

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭৪
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

বোর্ড পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেও নিয়মিত লিখনের কাছে পড়তে আসছে বৃষ্টি। তার লক্ষ ঢাকা ইউনিভার্সিটি। বাসা থেকে যদিও বলা হয়েছে সে চাইলে যেকোনো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারে। মেয়েকে পড়ানোর ক্ষমতা বৃষ্টির বাবা মুস্তফা সাহেবের আছে। কিন্তু বৃষ্টি একেবারেই হেলায় ফেলে দেয়ার মতো ছাত্রী নয়। সে তার মেধা যোগে পড়ালেখা করতে চায়। তাছাড়া লিখনের এখানে অনেক বড় একটা ভূমিকা আছে। লিখনের পথেই হাটতে চায় সে। তাই বৃষ্টিরও স্বপ্ন একদিন সে নিজেও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করবে। সেজন্য সবসময় মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখাও করেছে। মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেছে। উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টও আশা করছে ভালো হবে। তাই মনোযোগ দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। নিজের দিক থেকে কোনোরকম ত্রুটি রাখছে না কোনোধরনের।

বিগত পাঁচ মাস ধরে বাসায়ই ছোট্ট করে কোচিং সেন্টারের মতো করে ছাত্র পড়াচ্ছে লিখন। অনেক বেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়াচ্ছে তেমনটাও নয়। সামনে তার নিজের পরীক্ষা সেই প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। সর্বসাকুল্যে ৫ টা ব্যাচ পড়ায় সে তাও প্রতিদিন ২ কি ৩ টা ব্যাচ থাকে। এভাবে মিলিয়েই ৭ দিনে ৫ টা ব্যাচ কাভার দেয়। তবে বৃষ্টির এই আইডিয়াটা যথেষ্ট উপকারে দিয়েছে। এখন আর পড়ানোর জন্য বাইরে যেতে হয় না তাকে। ঘন্টা ধরে ১ জনকে ২ ঘন্টাও পড়াতে হয় না। এত অল্প সময়ে যে এতগুলো ছাত্র-ছাত্রী পড়াচ্ছে এর পেছনের অবদানটা বৃষ্টির বেশি। ওর সার্কেলের এমন কেউ বাকি নেই যে লিখনের কাছে পড়ে না। নিজের বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে ক্লাসমেট এমন কাউকে বাদ রাখেনি বৃষ্টি। সবাইকে ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে। এছাড়া এলাকায় আগে থেকেই তার একটা সুনাম ছিল। অনেকে তার কাছে ছেলেমেয়ে পড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে পড়াতে পারেনি লিখন। তাদের সবার সাথে যোগাযোগ করে বাসায় পড়ানোর বিষয়টা জানিয়েছে সে। অনেকেই তার কাছে পড়তে পাঠিয়েছে নিজ নিজ ছেলেমেয়েদের। বৃষ্টির ভাই নাঈমের ক্লাসের কয়েকজনও পড়ছে তার কাছে।

চিত্রলেখা বিয়ে করে চলে যাবার পর এসে ক’দিন থেকে গিয়েছিল। তারপর থেকে চারু খালার সঙ্গে তার ঘরেই থাকছে। প্রথমে লিখন বারান্দায় চেয়ার টেবিল দিয়ে পড়াবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু চারুর একার জন্য একটা ঘর লাগে না। তাই ও খালার সঙ্গে তার ঘরেই থাকছে। ছোটবেলা থেকেই চারুর রাতে একা ঘুমানোর অভ্যাস নেই। চিত্রলেখা চলে যাবার পর বেশ কিছুদিন একলা ঘুমালেও প্রায় রাতেই ঘুম ভেঙে গেলে পরে খালার কাছে তার ঘরে চলে যেতো। তারপর নারগিস বেগমই একদিন বলেছিল চারুকে উনার সঙ্গে থাকতে। চারু খালার ঘরে সিফট হয়ে যাওয়ার পর একটা ঘর ফেলে রাখার মানে হয় না। যদিও নারগিস বেগম বলেছিলেন চয়ন বড় হচ্ছে, লিখন তো বড় হয়ে গেছেই। ওরা দুই ভাই যেনো দুই ঘরে থাকে। এখন ওদের প্রাইভেসির দরকার আছে। লিখন আপত্তি না করলেও চয়ন বলেছিল ভাইয়ের সাথে এক ঘরে থাকতে তার আপত্তি নেই যতদিন না লিখনের বিয়ে হচ্ছে। দুইজন দুই ঘরে থাকার চাইতে লিখনকে চয়নই বলেছিল ঔ ঘরটা যেনো সে ছাত্র পড়ানোর জন্য গুছিয়ে নেয়। লিখন নিজেও ভেবে দেখেছে চয়ন ঠান্ডা ধরনের ছেলে। চুপচাপ টেবিলে বসে পড়লে টেরও পাওয়া যায় না সে যে ঘরে আছে। সেজন্যই চয়নের সাথে এক ঘরে থাকতে তারও সমস্যা হয় না। সবদিক বিচার বিবেচনা করে ঐ ঘরটাতেই এখন ছাত্র পড়ায় লিখন। আপাতত লাগছে না পরেরটা পরে দেখা যাবে। এমনিও লিখনের বিয়ে করতে অনেক দেরি আছে।

গত দুই সপ্তাহের পড়ার উপর আজ বৃষ্টির একটা পরীক্ষা ছিল। তাই জলদি পড়া শেষ হয়ে গেছে তার। যেদিন যেদিন তার পড়া থাকে। পড়ার পর খানিকক্ষণ চারুর সঙ্গে আড্ডা চলে তার। পড়ার জন্য এবাড়ি বৃষ্টির আসা যাওয়া বাড়ার ফলে চারুর সঙ্গে গভীর সখ্যতা হয়েছে বৃষ্টির। আগে ভালো সম্পর্ক থাকলেও সম্পর্ক এতখানি গভীর ছিল না দু’জনার। কিন্তু আজকাল দু’জনকে মানিকজোড় বলা যায়। তবে বিগত ক’দিন তেমন একটা কথা হয়নি দু’জনার। চারু ব্যস্ত আছে বা মাথা ধরেছে বলে এড়িয়ে গেছে বৃষ্টিকে। কিন্তু কিছু একটা যে ঠিকঠাক নেই তা ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছে বৃষ্টি। কিন্তু জানার জন্য চাপাচাপি করেনি চারুকে। দু’জনের সম্পর্ক এখন এমন যে জিজ্ঞেস না করলেও একজন আরেকজনকে ঠিকই মনের কথা জানাবে। কিন্তু মাঝে সাতদিন পেরিয়ে গেছে তাই আর ধৈর্য্য রাখতে পারছে না বৃষ্টি। চারুর কি হয়েছে তাকে সেটা জানতেই হবে। কোনো কারণে চারুটা ভালো নেই বৃষ্টির মন বলছে। আর চারুর মন খারাপ থাকলে বৃষ্টির নিজেরও ভালো লাগে না।

পরীক্ষার শীট জমা দিয়ে সোজা চারুর ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে বৃষ্টি। দরজাটা ভেজানো ছিল। মৃদু ধাক্কা দিতেই দরজাটা ভেতর দিকে হাট হয়ে খুলে যায়। বৃষ্টি যতখানি চারুকে চিনে অসময়ে ঘুমানোর অভ্যাস তার নেই। তাই এই অবেলায় ঘরের বাতি নিভিয়ে চারুকে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে দেখে অবাক না হয়ে পারে না সে। বিরক্ত না করে বেরিয়ে আসবে ভাবতেই টের পায় কাঁথার নিচে লুকিয়ে চারু সম্ভবত কাঁদছে। তাই বেরিয়ে না এসে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দেয় সে। এগিয়ে এসে চারুর মাথার কাছে বসে বৃষ্টি। এখনো কোনো কথা বলেনি সে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চুপ হয়ে গেছে চারু। নড়াচড়াও করছে না আর। কিছু না বলেই বৃষ্টি নিজেও চারুর পাশে শুয়ে পড়েছে। কাঁথাটা টেনে নিয়ে চলে যায় কাঁথার নিচে চারুর কাছাকাছি। ঘুমিয়ে থাকার ভান করেই শুয়ে আছে চারু। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বৃষ্টি বলে,

-আমি জানি তুই জেগে আছিস চারু।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে বৃষ্টি জিজ্ঞেস করে,

-কি হইছে তোর? এমন মনমরা হয়ে আছিস কেন? কথা বলতেছিস না কেন কয়দিন ধরে আমার সাথে? আমার কোনো কথায় কি কষ্ট পাইছিস?

জবাব দেয় না চারু। বৃষ্টি নিজেই বলে,

-আমাকে বলবি না তোর কি হইছে? আমি না তোর সই লাগি?

নিঃশব্দে কেঁদেই চলেছে চারু। মুখে কোনো শব্দ নেই তার। বৃষ্টি জানে কীভাবে চারুর মুখ দিয়ে কথা বের করতে হয়।

-আপা থাকলে আপাকে কি বলতি না তোর কি হইছে? আমাকে বল। দেখবি আমি সমাধান করে দিবো।

এবারে ধরা গলায় চারু বলে,

-তোমরা কেউ কিছু করতে পারবা না।

-তুই কাঁনতেছিস কেন? কেউ কি তোর মনে কষ্ট দিছে? কি হইছে আমাকে বল না চারু।

-কিছু হয় নাই আমার।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু একটা চিন্তা ভাবনা করে বৃষ্টি। ভেবে জিজ্ঞেস করে,

-তুই কি কাউকে পছন্দ করিস চারু? কাউকে ভালোবাসিস? সে কি তোরে কষ্ট দিছে? মন ভাঙছে তোর?

বৃষ্টির এই প্রশ্নের জবাব দেয় না চারু। কি জবাব দিবে? ও তো নিজেই জানে না মামুনকে সে ভালোবাসে কিনা। চারু শুধু জানে মানুষটার জন্য তার ভেতরটা ভীষণ পোড়ে। মানুষটার বিয়োগে তার ভেতরটা পুড়ে ছাড়খার হয়। মানুষটাকে একবার দেখার জন্য গলা-বুক শুখিয়ে চৌচির হয়ে যায়। মানুষটার অনুপস্থিতিতে তার মনের জমিনে চৈত্রের খড়া পড়ে। ভেতরে ভাঙচুর হয়। কিন্তু ভালোবাসে কিনা সেটা তো চারু জানে না। তাছাড়া সে ভালোবাসলেই কি আর না বাসলেই কি! মামুন ভাই তো এখনো তার মায়াকেই ভালোবাসে। আর চারু তো মায়া না। কখনো মায়া হতেও পারবে না, হতে চায়ও না। তাই মামুন ভাইও কখনো তাকে ভালোবাসবে না। তার দিকে ফিরেও তাকাবে না। এসব ভাবতেই চারুর বুক ভেঙে, চোখ গলে কান্নার বন্যা নামে। বৃষ্টি পাশ ফিরে চারুকে বুকে জড়িয়ে নেয়। মাথায় আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দেয়। তার বুকে মাথা রেখে আরও বেশি কান্নায় ভেঙে পড়ে চারু। কাঁদতে কাঁদতেই চারু নিচু কন্ঠে বলে,

-মামুন ভাই আমাকে ভালোবাসে না কেন বৃষ্টি আপু?

-মামুন ভাই!

-তুমি এই কথা কাউকে বইলো না বৃষ্টি আপু। তোমাকে লিখন ভাইয়ের কসম। কাউকে মামুন ভাইয়ের কথা বইলো না।

বৃষ্টি আর কিছু বলতে পারে না। সে চারুর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। কাউকে নিজের সবটা উজার করে ভালোবাসার পরেও মানুষটা যদি আপনার ভালোবাসা বুঝতেই না পারে, আপনার ভেতরকার দহন টের না পায় তখন ঠিক কতখানি পুড়ে সেটা বৃষ্টি খুব ভালো করেই জানে। আর কথা বলে না সে। বড় করে দু’বার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কেবল।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

কফির কাপে চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রেখে বাইরের দিকে তাকান দিলারা জামান। ধানমন্ডির একটি রুফটপ রেস্টুরেন্টে বসে আছেন তিনি। আজ সাবার সঙ্গে সকালের নাস্তা করার পরিকল্পনা করে বাইরে এসেছেন। কিন্তু সাবা এখনো এসে পৌঁছায়নি তাই অপেক্ষা করতে এক কাপ কফি অর্ডার করে নিয়েছেন। এখানে এসেই সাবাকে কল করে জানিয়েছেন তিনি পৌঁছে গেছেন। সাবা জানিয়েছে সে পথেই আছে। তার বাসা এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়।

দিলারা জামানের কফি শেষ হওয়ার আগেই এসে পৌঁছায় সাবা। ঠিক উনার মুখোমুখি অন্যপাশে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,

-সরি আন্টি আপনাকে ওয়েট করতে হলো।

-ইটস ওকে ডিয়ার।

ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলে সাবা দিলারা জামানের দিকে তাকিয়ে বলে,

-ইউ হ্যাব টু হেল্প মি আন্টি। আপনার হেল্প ছাড়া আমি এই ব্যাটেলটা জিততে পারব না। এন্ড ইউ নো এনি হাউ আই হ্যাব টু উইন দিজ ব্যাটল। আমার রওনককে চাই-ই চাই।

-কাম ডাউন মাই ডিয়ার। তোমাকে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। এবারে যা করার আমি করব। এতদিন আমি কিছুই বলিনি। ভেবেছি সময় দিলে হয়ত আমার ছেলেটা নিজে থেকেই বুঝতে পারবে। বাট আনফরচুনেটলি আই ওয়াজ রঙ। তাই এখন যা করার আমিই করব। খুব জলদি ঐ মেয়েটাকে আমি আমার রওনকের জীবন থেকে সরিয়ে দিবো। তারপর তোমাকে আমার রওনকের বউ করে নিয়ে যাবো। এন্ড আই প্রমিজ ইউ দ্যাট।

-থ্যাংকিউ সো মাচ আন্টি।

-ওহ কাম অন মাই ডিয়ার।

তানিয়া সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে। এই মাসেই তার ফ্লাইট, সে নিউইয়র্ক চলে যাচ্ছে। কবে ফিরবে তা সে নিজেও এখনো জানে না। লাস্ট ফাইলটা সিগনেচার করে তার এসিস্ট্যান্টকে হ্যান্ডওভার করে হাসি মুখে তানিয়া বলে,

-ডান, এরপর জামান গ্রুপের সঙ্গে আমার আর কোনো লেনদেন নেই।

-ভুল বললে ভাবী।

তানিয়ার কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে রওনক বলে কথাটা। তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকায় তানিয়া। এগিয়ে এসে তার মুখোমুখি অন্যপাশের চেয়ারে বসে রওনক।

-বুঝলাম না।

-সহজ হিসেব ভাবী। তুমি এখন থেকে জামান গ্রুপের ইমপ্লই নও তবে শেয়ার হোল্ডার তো আছোই।

গেল মাসেই তানিয়া ও রাদিনের ডিভোর্স হয়ে গেছে। এখনো একই বাড়িতে থাকছে তারা যদিও দু’জন দুই ঘরে। তানিয়া চাইলেই অন্যকোথাও থাকতে পারত বাচ্চাদের নিয়ে কিন্তু রওনক অনুরোধ করায় ওবাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছে। শেষ কয়টা দিন তানিয়া এখানেই থাকুক চেয়েছে রওনক। ওদের ডিভোর্সের সময় রওনকের প্রেসারেই বাধ্য হয়ে রাদিনকে তার শেয়ারের অর্ধেকটা তানিয়ার নামে লিখে দিতে হয়েছে। যদিও তানিয়া নিতে চায়নি কিন্তু রওনকের সঙ্গে পেরে ওঠাটা সহজ বিষয় নয়। জামান গ্রুপে রাদিন ১০ পার্সেন্ট শেয়ারের মালিক। যেখান থেকে ৫ পার্সেন্ট এখন তানিয়ার। তাই এদিক থেকে সে এখনো জামান গ্রুপের একজন। রওনক পুরোপুরি তানিয়াকে হারাতে চায় না। মীম, মিশকাতের মা হিসেবে এই পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকলেও রওনক তাকে চিনে। একবার চলে যেতে পারলে তানিয়া আর পেছন ফিরে তাকাবে না। সেজন্যই কোম্পানির শেয়ার দিয়ে তাকে খানিকটা বেঁধে রাখার চেষ্টা। যদিও রওনক কখনই তানিয়াকে ফিরে আসার জন্য জোর করবে না তবুও সে চায় তানিয়া সারাজীবন জামান গ্রুপের, জামান পরিবারের একজন হয়ে থাকুক। রওনকের এত এত সাফল্যের পেছনে যারা দিনরাত এক করে শ্রম দিয়েছে তানিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। তার ক্ষমতায় থাকলে রওনক আরও অনেক বেশি করত কিন্তু তানিয়া নিবে না। চরমভাবে ঠকে যাবার পর শিখেছে তাই তানিয়া যে তার আত্মসম্মান বিসর্জন দিবে না সেটা সবচাইতে ভালো জানে রওনক।

তানিয়ার কেবিন থেকে ফিরে এসে নিজের কেবিনে ঢোকার আগে সামান্য দাঁড়ায় রওনক। তাকে দেখে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় লাবিব। একমুহূর্ত লাবিবের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রওনক বলে,

-ভেতরে আসো।

লাবিবকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে নিজের কেবিনে চলে যায় রওনক। সময় বিলম্ব না করে লাবিব তার ডেস্কের উপর থাকা প্যাড নিয়ে বসের কেবিনে প্রবেশ করে। রওনকের টেবিলের কাছাকাছি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

-কি করতে কবে?

-বসো।

-জি!

-সিট ডাউন লাবিব।

লাবিবের হাতে থাকা প্যাডটা সে টেবিলের উপর রেখে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। রওনকের হাবভাব অন্যরকম লাগছে তার কাছে এইমুহূর্তে। খানিকক্ষণ লাবিবের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-ইজ এভরিথিং অলরাইট?

-বুঝলাম না স্যার!

-আমি তোমার কথা জিজ্ঞেস করছি লাবিব। আর ইউ অলরাইট?

-এবসিলিউটলি স্যার৷ আমার কি হবে?

-তুমি আমার পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট লাবিব। অনেকটা বন্ধুর মতো। প্রতিদিনের একটা সিংহভাগ সময় তুমি আমার সঙ্গে থাকো। আমি তোমার মুখ দেখলে বলতে পারি তুমি কেমন আছো। লাস্ট কয়দিন ধরে দেখছি তুমি তোমার মধ্যে নেই। ব্যাক্তি লাবিব এখানে উপস্থিত থাকলেও তোমার মন-মস্তিষ্ক অন্যকোথাও থাকে। কখনো কোনো কাজে ভুল না করা মানুষটা একটা সিঙ্গেল কাজ ঠিকঠাক করতে পারছে না। এরপরেও বলবে তুমি ঠিক আছো?

-আই এম এক্সট্রিমলি সরি স্যার। তবে আপনি একদম ভাববেন না। এরপর আর কোনো ভুল হবে না। আই প্রমিজ ইউ, মন দিয়ে কাজ করব।

-লাবিব! আমি কাজের কথা বলছি না। আমি তোমার কথা বলছি। তোমার কথা ভাবছি। আর ইউ ওকে? তুমি ভালো নেই। আই এম ওয়ারিড এবাউট ইউ। ইউ নো, ইউ আর ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট ফর মি। লাইক এ ব্রাদার, লাইক এ ফ্রেন্ড। সামওয়ান, হুম আই ক্যান রিলে। আই ক্যান ট্রাস্ট।

-আই এম সরি স্যার। আমি আমার পার্সোনাল প্রবলেমের জন্য অফিসের কাজ নষ্ট করেছি। আপনাকে টেনশন দিচ্ছি। কিন্তু আর এমন হবে না। আই এসর ইউ দ্যাট।

রওনক তৎক্ষনাৎই কিছু বলে না। একমুহূর্ত সময় নেয়। হাতের কাছে টেবিলের উপর থাকা চিত্রলেখা ও তার একটা এফর সাইজ ফটোফ্রেম হাতে নেয়। খানিকক্ষণ চিত্রলেখাকে দেখে নিয়ে ফ্রেমটা পূর্বের জায়গায় নামিয়ে রাখে। আবার লাবিবের দিকে তাকিয়ে বলে,

-আমি যে পজিশনে আছি, এই পজিশনটা যে আমার জন্য কতখানি বিপদজনক তা তুমি খুব ভালো করে জানো লাবিব। নিজের জীবন, সব সম্পর্ক, সব কিছু হাতে রেখে এই পজিশনটায় বসে আছি আমি। আমার জায়গা থেকে আমি আমার মা-ভাইকেও পুরোপুরি ভরসা করতে পারি না। তবে একদমই কাউকে ভরসা করতে পারি না তেমনও নয়। হাতে গোণা যে কয়জন মানুষকে আমি বিশ্বাস করি, যাদের উপর আমি ভরসা রাখতে পারে তন্মধ্যে তুমি অন্যতম লাবিব। তবে তোমাকেও যে না জেনেই ভরসা করি তাও নয়। তোমাকে পুরোপুরি ভরসা করার আগে অনেকদিক বিচার বিবেচনা করতে হয়েছে আমাকে। সবসময় সতর্ক থাকতে হয়েছে৷ তোমার ইন এন্ড এভ্রি মুভ সম্পর্কে জানি আমি। তোমার ফ্যামিলি লাইফ, ফ্রেন্ডসার্কেল, সোশ্যাল লাইফ এমনকি পার্সোনাল লাইফও। কাউকে ভালোবাসাটা ভুল নয়, অন্যায় নয় লাবিব। সমস্যা হচ্ছে অনেকসময় আমরা ভুল সময় নয়ত ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফেলি। আসলে ভালোবাসা বা ভালোবাসার মানুষ কোনোটাই ভুল নয়। সিচুয়েশন অনেকসময় আমাদের সঙ্গ দেয় না। কিন্তু একবার চেষ্টা না করে হাল ছেড়ে দেয়ার পক্ষে আমি নই৷ আমি যদি সেকেন্ড চান্স ডিজার্ভ করি তাহলে ঐ মানুষটাও আরেকটা চান্স ডিজার্ভ করে। সম্ভব না জেনেও ভালোবাসতে পেরেছো চলে যাবার আগে তাকে সেটা জানাবে না?

-আ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার। আপনি কি বলছেন?

-আমি সব জানি লাবিব। তুমি নিজে আমাকে জানিয়েছো কাউকে ভালোবাসো। তাকে জানাবে বলেছিলে কিন্তু জানাওনি। কেনো জানাওনি জানি না৷ কিন্তু আমার মনে হয় এখন অন্তত ভাবী চলে যাবার আগে তোমার মনের কথা তাকে জানানো উচিত।

-স স্যার আমি…

-ইটস ওকে লাবিব। আই রিয়েলি ডোন্ট হ্যাভ এনি প্রবলেম। আমি শুধু চাই ঐ মানুষটার জীবনেও এমন একজন আসুক যে তাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসবে। অন্তত নিজের ভালো লাগার কথাটা তাকে জানাও। তুমি তার জন্য কি ফিল করো এতটুকু জানার রাইট তার আছে। হয়ত এরপর কখনো সুযোগ নাও পেতে পারো। তাই সুযোগ থাকতে একবার বলেই দেখো কি হয়।

লাবিব বুঝতে পারে না কি জবাব দিবে। রওনক নিজেই আরও বলে,

-আমি কি বললাম একবার ভেবে দেখো। তবে মনে রেখো তোমার হাতে সময় বেশি নেই। জলদি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার মতে পরে আফসোস করার চাইতে এখনই একটা স্টেপ নেয়া হয়ত ভালো হবে। যাই হোক অন্তত তোমার আফসোস থাকবে না সুযোগ পেয়েও তাকে জানাওনি। একবার বলেই দেখো লাবিব।

রওনকের সামনে কিছু বলতে পারে না লাবিব। গলা দিয়ে আর কথাই বের হয় না তার। ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসে আছে সে। মস্তিষ্ক শূন্য লাগছে তার। বুঝতে পারছে না তার আসলে কি করা উচিত৷ রওনকের এডভাইস মতো সত্যি সত্যি তানিয়াকে মনের কথা জানাবে সে? এই কাজটা করা কি উচিত হবে? এইমুহূর্তে উচিত অনুচিত ভাবতে পারছে না। এটাও সত্যি তানিয়া চলে যাবার পর হয়ত সত্যি সত্যি আর সুযোগ পাবে না সে। আর হয়ত কোনোদিন তাদের দেখা হবে না। এটাই হয়ত তার শেষ ও একমাত্র সুযোগ।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

সেদিনের পর আর মামুনের সঙ্গে দেখা হয়নি চারুর। হয়তো এদিকে আসেনি সে। বা এসে থাকলেও চারুকে এড়িয়ে চলেছে। চারুর এখন একটাই চেষ্টা মামুনের কথা চিন্তা করা। কিন্তু মানুষের ধর্ম হচ্ছে তাকে যেটা করতে না করা হবে সেটাই সে বেশি করে। চারু যত মামুনের কথা না ভাবার চেষ্টা করে ততই বেশি যেনো মামুনের ভাবনারা তার মস্তিষ্কের দখল নিয়ে বসে থাকে। সমস্ত দিন লেখাপড়া, হাজার রকম কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেও কাজ হয় না। ঘুরে ফিরে মামুন নামক ভাবনারা ঠিকই চারুর মস্তিষ্কের পথ খুঁজে নেয়। একমাত্র বৃষ্টি জানে চারুর মনের অবস্থা। অন্যরা সবাই হাসিখুশি চারুকে দেখে কিন্তুর তার ভেতরকার দুঃখটা কেবল বৃষ্টি টের পায়। তাই তো সুযোগ পেলেই চারু বৃষ্টিকে খানিকক্ষণের জন্য জড়িয়ে ধরে মন হালকা করার চেষ্টা করে। বৃষ্টি নিজেই একই রোগে আক্রান্ত আরেকজন কি সান্তনা দিবে সে! তবু চেষ্টা করে চারুকে সঙ্গ দেয়ার।

ইদানিং ভীষণ বাড়াবাড়ি রকমের ব্যস্ততায় দিন কাটছে রওনকের। চিত্রলেখাকে সময় দেয়া তো দূরের কথা ঠিকঠাক নিঃশ্বাস নেয়ার সময়টাও পাচ্ছে না সে। হাজার ব্যস্ত থাকলেও তার মস্তিষ্কের ভেতর সারাক্ষণ চিত্রলেখাই থাকে। কথা বলার সময় পাচ্ছে না সে বউয়ের সঙ্গে কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারছে কোনো কারণে চিত্রলেখা চিন্তিত। হয়তো তাকে কিছু বলতে চায় কোনো কারণে পারছে না। বেশ কিছুদিন ধরেই রওনকের ফিরতে রাত হয়। যতক্ষণে সে বাসায় ফিরে ততক্ষণে অন্যরা খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়ে। সবাই শুয়ে পড়লেও চিত্রলেখা ঠিকই রওনকের অপেক্ষায় বসে থাকে। সে না ফিরা পর্যন্ত তার জন্য না খেয়ে বসে থাকে। তবে রওনক লক্ষ করেছে চিত্রলেখা লাস্ট ক’দিন ধরে ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করছে না। এমনকি রাতে ঠিকঠাক ঘুমাচ্ছেও না। হঠাৎ হঠাৎ রাতে ঘুম ভাঙলে প্রায়ই দেখে চিত্রলেখা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। দু’রাত আগেরই কথা। বাথরুমে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠলে দেখে চিত্রলেখা তার পাশে নেই। না দেখেও বলতে পারবে তার প্রিয়তমা কোথায় আছে। বাথরুমের কাজ সেরে আর বিছানার দিকে আগায় না রওনক। বিছানা রেখে বারান্দার দিকে আগায় সে। কিন্তু বারান্দায় এসে সামান্য অবাক হয়। ইদানিং রাতে ঘুম ভাঙলে পরে চিত্রলেখাকে বারান্দাতেই পাওয়া যায়। কিন্তু আজ সে বারন্দায় নেই। চিত্রলেখা কোথায় আছে দেখার জন্য রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে। নিচে কিচেনে যাবার আগে ভাবে উপরের ফ্লোরেই আরেকটা জায়গা আছে যেখানে চিত্রলেখা থাকতে পারে। সেদিকেই আগায় সে। দোতলার ঝুল বারান্দার দিকে আগায় সে। বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়েই ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে সে চিত্রলেখাকে দেখতে পেয়ে। এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে প্রিয়তমাকে জড়িয়ে ধরে রওনক। মাথার পেছন দিকে নাক ঘষে, কাঁধে মুখ গুঁজে দিয়ে বলে,

-এখানে কি করছো?

-ঘুম আসছিল না।

-তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?

-উঁহু

-তাহলে!

চিত্রলেখা কিছু বলে না। রওনক নিজেই বলে,

-ইদানিং দেখছি ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করছো না, ঠিক মতো ঘুমাচ্ছো না। আমি এপেয়ন্টমেন্ট নিয়ে দেই কাল ডাক্তার দেখিয়ে আসো?

-ডাক্তার দেখাতে হবে না, আমার কিছু হয়নি।

-আমার স্বস্তির জন্যই নাহয় দেখিয়ে আসো।

-আপনার ব্যস্ততা কমলে না হয় যাবো।

-কাল…

-প্লিজ।

রওনক আর জোর করে না। সে নিজেও বুঝতে পারছে তার চন্দ্রলেখা হয়তো শারীরিকভাবে অসুস্থ নয়। তার অসুস্থতাটা সম্ভবত মন-মস্তিষ্কের। খুব সম্ভবত কিছু নিয়ে চিন্তিত সে। রওনককে বলতে চাইছে না বা বলতে পারছে না। এক্ষুনি জোর করে না রওনক। আরেকটু সময় দেয় চিত্রলেখাকে নিজের ভেতরকার সংশয় কাটিয়ে ওঠার। যেনো সে নিজে থেকেই নিজের সমস্যার কথা জানাতে পারে। রওনক নিজেও আর কিছু বলে না। তার বুকের উপর নিজেকে ছেড়ে দেয় চিত্রলেখা। হয়তো শান্তি খোঁজার চেষ্টা করে। এই বারান্দাতেই একটা সিঙ্গেল দিভান রাখা আছে। এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখাকে বুকে নিয়েই দিভাবটাতে শুয়ে পড়ে রওনক। চিত্রলেখা বাধা দেয়ার চেষ্টা করে বলে,

-চলুন রুমে যাই।

-উঁহু, বাকি রাতটা এখানেই থাকি। একসাথে ভোর দেখবো। চাঁদ আমাদের দেখে জ্বলুক।

রওনকের মুখ চেপে ধরে চিত্রলেখা বলে,

-ইশ! আপনার মুখে কিচ্ছু আটকায় না তাই না?

নিজের মুখের উপর থেকে বউয়ের হাত সরিয়ে নিয়ে রওনক বলে,

-আমার বউ, আমি যা খুশি করব তাতে কার কি?

লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যায় চিত্রলেখার তৎক্ষণাৎ। হাত বাড়িয়ে লজ্জায় মাখোমাখো হওয়া মুখটা নিজের কাছাকাছি নিয়ে চিত্রলেখাকে কিছু বুঝার সুযোগ না দিয়ে ঠোঁট জোড়ার দখল নেয় সে। চিত্রলেখা জানে বাধা দিয়ে লাভ হবে না। বরং সে নিজেও তাল মেলায় রওনকের তালে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৭১+৭২+৭৩

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

রওনকের ব্যস্ততা কমেনি, বলা যায় বরং বেড়েছে। আগে যদিও ব্যস্ততা, কাজের প্রেসারকে তোয়াক্কা করেনি সে। কিন্তু আজকাল সারাক্ষণ কেবল মনে হয় কখন এসব ব্যস্ততাদের পাশে ঠেলে বাড়ি ফিরতে পারবে সে। আগে কখনই বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল না তার। কিন্তু আজকাল চিত্রলেখার কাছে ফিরে যাবার জন্য বুকের ভেতর ব্যাকুলতার ঝড় ওঠে তার। প্রিয়তমাকে দেখার, কাছে পাবার, ছুঁয়ে দিতে অস্থির হয়ে থাকে সে। কাজের মাঝেই যখন আপন মনে চিত্রলেখার কথা ভাবতে ব্যস্ত রওনক। তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে কেবিনের দরজায় কারো উপস্থিতি টের পায় সে। একবার নক করে দরজাটা খুলে ভেতর দিকে উঁকি দেয় লাবিব। তাকে দেখে রওনক বলে,

-কাম ইন।

এগিয়ে এসে রওনকের সামনে একটা ফাইল রেখে লাবিব বলে,

-আজ বিকেলের মিটিংয়ের ফাইল।

-ওকে।

বেরিয়ে যাবার জন্য কদম বাড়ায় লাবিব। পেছন থেকে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-ভাবী কি তার কেবিনে আছে?

-হোপ ফুলি। আমি কি খবর নিবো?

-খোঁজ নিয়ে জানাও আমাকে।

-এক্ষুনি জানাচ্ছি।

রওনকের কেবিন থেকে বেরিয়ে গিয়ে ফাইনান্স ডিপার্টমেন্টে ফোন করে লাবিব তানিয়া অফিসেই আছে কিনা জানতে।

তানিয়ার কেবিনে টোকা পড়তেই ফাইলে মুখ গুঁজে রেখেই সে বলে,

-কাম ইন।

তানিয়ার কন্ঠ শুনতে পাবার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে রওনক। মাথা তুলে তাকে দেখে হাতের ফাইলটা সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজের চেয়ার রিল্যাক্স হয়ে বসে তানিয়া। জিজ্ঞেস করে,

-এনিথিং সিরিয়াস?

এগিয়ে এসে তানিয়ার মুখোমুখি অন্যপাশের চেয়ার টেনে বসে রওনক। কোনো ধরনের ভনিতা না করে সে বলে,

-তুমি জানো এই মুহূর্তে আমার উপর কাজের কত প্রেসার যাচ্ছে। এক্ষুনি আমার প্রেসার আরও বাড়িয়ে না দিলে হচ্ছে না তোমার?

রওনকের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় সে। না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে,

-কি করলাম আমি আবার?

নিজের কোর্টের ভেতর পকেটে থাকা একটা ভাঁজ করা সাদা কাগজ বের করে তানিয়ার সামনে রাখে রওনক। সামনের দিলে ঝুঁকে সেটা হাতে নেয় তানিয়া। ভাঁজ করা কাগজটা খুলতেই বুঝতে পারে সেটা কি, সম্পূর্ণ পড়তে হয় না তাকে। আজ সকালেই রওনককে নিজের ইস্তফা পাঠিয়েছে সে ই-মেইলে। এই মাসের শেষেই রাদিনের সঙ্গে তার ডিভোর্স ফাইনালাইজ হয়ে যাবে। আগামী মাসেই দেশ ছাড়বে সে। তাই আগেই ইস্তফা পাঠিয়ে দেয়া আর কি। যদিও রওনক নিজের স্বার্থে তানিয়াকে আটকে রাখবে না কিন্তু সে চায় না কোম্পানির সবচাইতে প্রয়োজনের সময় সে চলে যাকে। কোম্পানির জন্য না হোক অন্তত তার জন্য। এত দূর আসার পেছনে তানিয়ার অবদান নেহাৎ কম নয়। তানিয়ার মতো ডেডিকেটেড মানুষ পাওয়া ভার। সে পাশে থাকলে কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে হয় রওনককে। এত বড় কোম্পানি চালাতে যে সাপোর্টটা নিজের বড় ভাইয়ের কাছে পাবার কথা ছিল সেটা এতকাল ভাইয়ের বউয়ের কাছে পেয়েছে সে। অথচ এই মানুষ আর বেশিদিন তার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাকে সঙ্গ দিবে না। রওনকের হাতে থাকলে সে তানিয়াকে এখান থেকে যেতে দিতো না। কিন্তু ঐ যে, সে স্বার্থপর হতে চায় না তার ভাইয়ের মতো। তাই তানিয়াকে আটকানোর চেষ্টাও করেনি। নিজের জীবনের সিদ্ধান্তটা তাকেই নিতে দিয়েছে। পাশে থাকার কথাও দিয়েছে। কিন্তু তানিয়া কেবল তার ভাবীই নয় ভালো বন্ধুও৷ একটা ভালো বন্ধু হারানোর বেদনা তার হৃদয়কে ঠিকই আঘাত দিয়েছে। তার হাতে থাকলে তানিয়াকে কখনই যেতে দিতো না সে।

-তুমি চলে গেলে আমি একা এত কিছু সামলাতে পারব না ভাবী।

-তোমার তো দেখছি বিয়ের পর ভারী উন্নতি হয়েছে।

-মানে!

-মানে এই যে ইমোশনাল ডায়লগ দিচ্ছো। আগে তো কখনো এসব বলতে শুনিনি। চিত্রলেখা তো দেখছি রাতারাতি বদলে দিয়েছে তোমাকে।

-আমি কিন্তু একদম মজা করছি না।

-মজাই করছো। আমাকে ছাড়াও তুমি খুব ভালো ভাবেই কোম্পানি চালাতে পারবে একথা তুমিও জানো।

-তারপরেও, তুমি পাশে থাকলে…

-আমি থাকতে চাই না রওনক। নিজের দিক ভেবে আমি কখনই কোম্পানি জয়েন করিনি। যে সাপোর্টটা তোমাকে তোমার ভাইয়ের দেয়ার কথা ছিল তার ওয়াইফ হিসেছে শূন্য জায়গাটা পূরণ করার চেষ্টা করেছি। সেই সম্পর্কটা যেহেতু আর নেই তাই তার হয়ে আমি আর কোনো দায়িত্ব পালন করতে চাই না। তার কোনো কিছুর দায় আর আমার উপর নেই।

-আমার ভাইয়ের বউ ছাড়াও মীম, মিশকাতে মা তুমি। ওরা দু’জন এই কোম্পানির ফিউচার। সে হিবেসে তোমার পজিজনটা কিন্তু হেলায় ফেলে দেয়ার মতো নয়। চাইলে একবার ভেবে দেখতে পারো। তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য আলাদা ফ্ল্যাট রেডি করে দিবো। ভাইয়ার সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতে হবে না তোমাকে।

স্মিত হেসে তানিয়া বলে,

-তোমার মনে হয় এসব অপশন আমি ভাবিনি? আমি এইসব কিছু থেকে দূরে থাকতে চাই অন্তত কিছুদিন। যদি কখনো মনে হয় আমি এখানেই ফিরে আসবো এই কোম্পানির একজন ইমপ্লই হয়ে তাহলে অবশ্যই তোমাকে জানাবো।

-সিওর?

-হান্ড্রেড পার্সেন্ট।

তানিয়ার দিকে হাত মেলে দিয়ে রওনক বলে,

-রিমেম্বার, এনি টাইম এন্ড অলওয়েজ ইউ আর ওয়েলকাম হিয়ার।

নিজের হাত এগিয়ে দিয়ে রওনকের বাড়িয়ে রাখা হাত ধরে, হ্যান্ডশেক করে তানিয়া বলে,

-আই উইল অলওয়েজ রিমেম্বার দ্যাট।

উঠে দাঁড়ায় রওনক। তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে তানিয়া বলে,

-তাড়া না থাকলে আরেকটু বসো।

-কিছু বলতে চাও?

মাথা ঝাকায় তানিয়া। পূর্বের জায়গায় বসে পরে রওনক। সে বসলে তানিয়া বলে,

-চিত্রলেখার ব্যাপারে কি ভাবছো?

-কোন বিষয়ে?

-ও অফিস জয়েন করছে কবে?

-আমি ওকে ফোর্স করতে চাই না ভাবী। ও এখনো নিজেকে তৈরি করতে পারছে না।

-কেনো? আগেও তো এখানেই কাজ করেছে তাহলে সমস্যা কোথায়?

-ইউ নো, সমস্যাটা এখানেই। ও এতদিন কোম্পানির একজন সাধারণ কম্পিউটার অপারেটর ছিল। সেখান থেকে একদিন প্রোমোশন হয়ে হঠাৎ আমার অফিসে শিফট হওয়া। তার কয়েক মাস পরেই আমাদের বিয়ে। এখন কোম্পানির একটা বড় পজিশনে জয়েন করলে সবাই বলবে বসকে পটিয়ে বিয়ে করে বড় পজিশন গেইন করেছে। সবাই ওকে নেগেটিভ ভাবে দেখবে।

-আর তুমি এসব কেয়ার করো?

-নো ওয়ে। অন্তত তুমি আমাকে চিনো। কে কি বলল তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু চন্দ্র এসব বিষয়ে খুব সেন্সিটিভ। আমি ওকে আরও ডেলিকেটলি হ্যান্ডেল করতে চাই। আমি চাই ও কোম্পানি জয়েন করুক। আমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করুক৷ বড় বড় ডিসিশন নিতে আমাকে হেল্প করুক কিন্তু জোর করে নয়। ও যখন নিজে থেকে তৈরি হবে তখনই জয়েন করবে। সবার কথাকে তোয়াক্কা না করে নিজে থেকে এগিয়ে আসবে তখনই জয়েন করবে।

-তোমাদের বিয়ের অলরেডি ৪ মাস চলছে রওনক।

-মাত্র ৪ মাস ভাবী। এখনো সম্পূর্ণ জীবন পরে আছে। শি ক্যান টেক অল দ্যা টাইম টু ম্যাক হার ডিসিশান৷ এন্ড আই এম নট গোয়িং টু ফোর্স হার।

-কিন্তু ওকে আরও শক্ত হতে হবে। নয়ত দেখা যাবে তুমি টের পাবার আগেই কোনোদিক দিয়ে কোনো দূর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমি চাই না ও সাফার করুক৷

-ডোন্ট ওয়ারি, আই ইউল অলওয়েজ প্রটেক্ট হার উইথ মাই লাইফ।

-আই ট্রাস্ট ইউ।

এবারে উঠে দাঁড়িয়ে রওনক বলে,

-বের হচ্ছি। একটা মিটিং আছে আমার।

-মিটিং শেষে কি অফিস ফিরছো নাকি বাসায় চলে যাবে?

হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে রওনক বলে,

-মিটিং শেষ হতে হতে অলমোস্ট পাঁচটা বেজে যাবে। আজ আর অফিস ফিরবো না। আই এম মিসিং হার এ লট।

মুচকি হেসে তানিয়া বলে,

-বেস্ট অফ লাক।

মিটিং শেষ করে একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছে রওনক। নিজের ঘরে বসে বই পড়তে ব্যস্ত চিত্রলেখা। গল্প, উপন্যাসের বই নয়। বিজনেস রিলিটেড বই। যদিও এখনো সে কোম্পানি জয়েন করতে মানসিক ভাবে তৈরি নয়। তবে সে বুঝে রওনক খুব করে চায় সে অফিস জয়েন করুক৷ কিন্তু বড় কোনো পজিশনে জয়েন করার মতো যোগ্যতা তার নেই সেটা সে ভালো করেই জানে। ছোট কোনো পজিশনে হলেও তাকে অফিস জয়েন করতেই হবে, অন্তত রওনকের জন্য। সে কেবল হাউজ ওয়াইফ হয়ে থাকুক সেটা রওনক চায় না। সেজন্যই ঘরে বসে থেকে সময় নষ্ট না করে মীম, মিশকাতের দেখাশুনার পাশাপাশি বিজনেস রিলেটড বইগুলো পড়ে কিছু শিখার চেষ্টায় আছে সে। নতুন করে জয়েন করার আগে অন্তত বিজনেস রিলেটেড কিছু বেসিক শিখে নিতে চায়। যা হয়ত বেটার কিছু করতে হেল্প করবে তাকে।

মীম, মিশকাতকে ভাত ঘুম দিতে তাদের নিজ নিজ ঘরে ঘুম পারিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে এসে বইয়ে মুখ গুঁজে ছিল সে৷ একটু পরেই নিচে যাবে সে নাস্তার আয়োজন দেখতে৷ আচমকাই বেড রুমের দরজা খোলার শব্দ পেতেই বই থেকে মুখ তুলে তাকায় চিত্রলেখা। রওনককে দেখতে পেয়েই মুখ জুড়ে হাসি ফুটে ওঠে তার। এই সময় তার বাসায় আসার কথা নয়৷ বরং বিগত লম্বা সময়ে রাত ৮টা /৯টার আগের বাসায় ফিরেনি সে। এমনকি কখনো কখনো রাত ১১ টাও বেজেছে তার বাসায় ফিরতে। আজ এত জলদি রওনককে বাড়ি ফিরতে দেখে খুশি হয়ে যায় সে। হাতের বইটা পাশে নামিয়ে রেখে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে যায়। হাসি মুখ করে এগিয়ে এসে রওনকের মুখোমুখি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-আজ এত জলদি?

-তোমাকে মিস করছিলাম খুব।

রওনকের কথায় চিত্রলেখার গাল লাল হয়। পেছনে থাকা হাত সামনে এগিয়ে ধরে রওনক। তার হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ। ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে বলে,

-আমার ফুলের জন্য ফুল।

দি বিজনেস টাইকুন রওনক জামানের মতো মানুষ এমন কথাও বলতে জানে কেউ নিজ কানে না শুনলে বিশ্বাসই করবে না। যেমন চিত্রলেখা নিজেও ভাবতো একটা সময় এই মানুষটার জীবনে হয়ত রসকষ নেই। অথচ তার জীবনে আসার পর টের পাচ্ছে এই লোকটার মতো করে কেউ হয়ত ভালোবাসতেই জানে না৷ চিত্রলেখাকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে আচমকাই তার গালে চুমু খায় রওনক। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলে,

-আই মিসড ইউ সো মাচ, লাভ।

আগের চাইতে আরও বেশি লাল হয় চিত্রলেখা। রওনকের তাকে কথায় কথায় বউ ডাকা, লাভ ডাকায় গলে পানি হয়ে যায় সে। আর কথা বলতে পারে না। রওনকের বুকে মুখ লুকানো ছাড়া এই লজ্জা থেকে বাঁচার পথ খুঁজে পায় না সে। আলতো আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয় রওনক প্রিয়তমাকে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

রওনকের উন্মুক্ত বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে চিত্রলেখা। চাদর টেনে নিজেদের ঢেকে রেখেছে সে। প্রিয়তমার বিবস্ত্র পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে রওনক বলে,

-তুমি চাইলে আমরা আরেকবার…

-একদম না।

চেঁচিয়ে ওঠে চিত্রলেখা। রওনকের বুক থেকে মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলে,

-একে তো অসময়ে আবার গোসল করতে হবে আমার।

-সেজন্যই তো বলছি আরেকবার হয়ে যাক।

-জি না, এখন চোখ বন্ধ করুন।

চিত্রলেখা চোখ বন্ধ করতে বলায় চোখ সরু করে নিয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কেনো?

-আমি বাথরুমে যাবো। চোখ বন্ধ করুন জলদি আর একদম তাকাবেন না বলে দিচ্ছি।

-আমার কিচ্ছু দেখা বাকি নেই। এমনকি ছুয়ে…

রওনক কথা শেষ করতে পারে না এর আগেই হাত বাড়িয়ে তার মুখ আটকে ধরে চিত্রলেখা। লজ্জায় নাস্তানাবুদ হয়ে বলে,

-ছিঃ এসব এভাবে বলে কেউ?

নিজের ঠোঁটের উপরে থাকা বউয়ের হাত সরিয়ে নিয়ে রওনক বলে,

-আমি না বললে কে বলবে?

-একদম না, চোখটা বন্ধ করুন প্লিজ। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। এতক্ষণে হয়ত মীম, মিশকাতও উঠে গেছে। সবাই সন্ধ্যার নাস্তা করবে।

-মীম, মিশকাতের খেয়াল রাখার জন্য বাসায় লোক আছে। সবাইকে নাস্তা দেয়ার লোকও আছে। একদিন তুমি ওদিকটা না দেখলেও সব হয়ে যাবে।

-জানি হয়ে যাবে কিন্তু আমি চাই না হয়ে যাক। আমি নিজে সব করতে চাই। ভুলে যাচ্ছেন মীম, মিশকাতের জন্যই কিন্তু আজ আমরা একসাথে।

-আর তোমার মনে হয় শুধু মীম, মিশকাতের জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি আমি?

-তাহলে কেনো করেছিলেন?

-এতদিনেও বুঝোনি?

-আমার ভেবে নেয়াটা তো ভুলও হতে পারে।

-আমার মুখে শুনতে চাও?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। এই মানুষটা তাকে ভালোবাসে তা নিজের আচরণ, ব্যবহারের, কাজকর্মে বুঝাতে কিচ্ছু বাকি রাখেনি সে। তবুও তার মুখে অন্তত একবার শুনতে চায় চিত্রলেখা। কিন্তু নিজে থেকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না তার। আজ সুযোগ পেয়ে সেই সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায় না সে৷ রওনক কিছু বলার আগে তাদের বেডরুমের দরজায় দড়াম করে শব্দ হয়। শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজার ওপাশ থেকে মীম বলে,

-মিমি তুমি কি এখনো ঘুমাচ্ছো?

মীমের কন্ঠ শুনতে পেয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায় চিত্রলেখা। এগিয়ে গিয়ে রওনকের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফাস কন্ঠে বলে,

-বলুন আমি বাথরুমে আছে। আর আপনি চোখ বন্ধ করুন, জলদি।

এমুহূর্তে দরজার অন্যপাশে মীম দাঁড়িয়ে না থাকলে চিত্রলেখার কথা কোনোভাবেই মানতো না সে। আজ বউয়ের অযৌক্তিক লজ্জা পাওয়া ভাঙ্গিয়েই ছাড়তো। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়েই চোখ বন্ধ করে সে। এক দৌড়ে চিত্রলেখা বাথরুমে চলে গেলে রওনক নিজেও বিছানা ছেড়ে গায়ে কাপড় জড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে রুমের দরজা খুলে মীমকে দেখে প্রশস্ত হাসে। তাকে দেখতে পেয়ে নিজের সব কয়টা দাঁত বের করে হাসে মীম। গাল ভরা হাসি নিয়ে বলে,

-ছোট পাপা!

কোলে নেয়ার জন্য হাত মেলে দিয়ে রওনক বলে,

-কাম অন চ্যাম্প।

মীমও একমুহূর্ত বিলম্ব করে না তার ছোট পাপার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। মীমকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-প্রিন্সেস কোথায়?

-নিচে, মিমির জন্য অপেক্ষা করছে। মিমিই তো প্রতিদিন আমাদের ইয়ামি ইয়ামি নাস্তা বানিয়ে দেয়।

কথা বলতে বলতেই এক নজর রুমের এদিক থেকে সেদিক চোখ বুলায় মীম, তার মিমিকে খুঁজে পাবার আশায়। রওনককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মীম নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-মিমি কোথায়?

-মিমি ফ্রেশ হচ্ছে। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই নিচে যাবে।

-চলো তাহলে আমরাও নিচে যাই।

-পাপাকে একটু ফ্রেশ হতে হবে যে। অফিস থেকে এসেছি, চট করে ফ্রেশ হয়েই নিচে জয়েন করছি।

-ওকে।

মীমের কপালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে তাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় রওনক।

চিত্রলেখা শাওয়ার শেষ করে বের হতেই রওনক বাথরুমে ঢুকে যায়। চেঞ্জিং রুমে কাপড় পরার সময় ভাবে আজ শাড়ি পরবে সে। যা ভাবা তাই করা। রওনক গোসল সেরে বেরিয়ে আসার আগে চট করে একটা কফি রঙের জমিনে সাদা রঙের ভাটিকের শাড়ি সাদা রঙের ব্লাউজ দিয়ে পরে নিচে চলে যায়। রওনক নিচে নেমে তাকে শাড়িতে দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হবে। সেই মুহূর্তের কথা ভেবেই গাল জুড়ে হাসি ফুটে ওঠে তার।

চিত্রলেখা নিচে নেমেই দেখে আজ জাহানারা নাস্তা বানিয়ে ফেলেছে। চিকেন ও এগ দিয়ে স্যান্ডুউইচ করেছে। রওনককে অসময় বাসায় দেখে ভেবে নিয়েছিল আজ হয়ত চিত্রলেখার নিচে নামতে সময় লাগবে। সেই আন্দাজ করেই নিজ উদ্যোগে নাস্তাটা বানিয়ে ফেলেছে সে। কেবল চা করাটা বাকি। ইতোমধ্যে এক দিলারা জামানকে বাদ দিয়ে এই বাড়ির প্রত্যেকে চিত্রলেখার বানানো চায়ের ভক্ত হয়ে গেছে। তাই নাস্তা বানালেও চা বানায়নি সে। এগিয়ে এসে জাহানারার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছোট্ট করে ধন্যবাদ জানায় চিত্রলেখা। হেসে দিয়ে জাহানারা বলে,

-তোমার হাতের বানানো ছাড়া তো কেউ চা খেতে চায় না তাই চা করিনি।

হাসি হাসি মুখ করে চায়ের ক্যাতলি হাতে নেয় সে। পেছন থেকে এগিয়ে এসে তানিয়া জিজ্ঞেস করে,

-কি বানানো হয়েছে আজ? ভীষণ খুদা পেয়েছে আমার।

দু’জনে একত্রেই পেছন ঘুরে দেখে তানিয়া এখনো অফিসের কাপড়ে আছে। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে মাত্রই বাসায় ফিরেছে সে। ফিরেই সরাসরি কিচেনে। জাহানারা জিজ্ঞেস করেন,

-ফ্রেশ না হয়েই খাবে?

-ফ্রেশ হওয়ার এনার্জি নেই। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি।

-বসো, আমি এক্ষুনি খাবার দিচ্ছি।

তানিয়া এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার পাশে দাঁড়ায়। অন্যরা কেউ যেনো শুনতে না পায় সেদিকে সতর্ক থেকেই বলে,

-অসময়ে গোসল ঘটনা কি?

চিত্রলেখাকে অবশ্য জবাব দিতে হয় না। তানিয়া নিজেই দুষ্টু হাসি হেসে বলে,

-ওহ আচ্ছা আজ তো কার প্রাণ ভ্রমরা যেনো বিকেলেই বাসায় ফিরে এসেছে। নিশ্চয়ই আজ বিশেষ কিছু…

-ভাবী!

তানিয়াকে কথা শেষ করতে দেয় না চিত্রলেখা। এতদিনে এই মহিলাকে চেনা হয়ে গেছে তার। লেগ পুল করার একটা সুযোগও হাত ছাড়া করে না সে। এক্ষুনি লজ্জা পাবার মতো কথাবার্তা বলে ফেলবে সে।

-হ্যাঁ, বলো শুনছি।

-আপনার খাবার রেডি।

আর কিছু বলে না তানিয়া। জানাহারা এগিয়ে এসে খাবার প্লেট এগিয়ে দিলে সেটা নিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে দুষ্টু হেসেই বলে,

-আজ বেঁচে গেলে। ঘরে যাচ্ছি ওখানেই খাবো।

তানিয়া বেরিয়ে যেতেই ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে চিত্রলেখা তা দেখে জাহানারা জিজ্ঞেস করে,

-কি হয়েছে?

-না, কিছু না তো। কিছু হয়নি।

চা বানানোয় মন দেয় সে। এরা দেবর, ভাবী কারো থেকে কেউ কম যায় না। ব দে র হাড্ডি এক একজন।

চা বানানো শেষ করে ড্রইং রুমে বেরিয়ে আসলে চিত্রলেখা দেখে রওনক নেই এখানে। মীম, মিশকাতকে জিজ্ঞেস করলে ওরা বলে সে এখনো নিচে আসেনি। আজ দিলারা জামানও নাস্তা করতে আসেননি। দেরি না করে রওনকের জন্য চা ও নাস্তা নিয়ে উপরে চলে যায় তাকে দিতে। নিজের ঘরের লিভিং রুমে ডুকে সেন্টার টেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখে শব্দ না করে। রওনক এখনো দেখেনি সে শাড়ি পরেছে। তার হুটহাট শাড়ি পরাটা রওনকের ভীষণ পছন্দ। বেডরুমে ডুকতে নিয়ে কদম থমকে যায় চিত্রলেখার। পা কেঁপে উঠলেও নিজেকে পরে যাবার আগে সামলে নেয় সে। তাদের বেডরুমের দরজা সামান্য খোলা তা দিয়েই দেখতে পা রওনকের মুখোমুখি একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে সাবা। রওনক এদিক পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে তাই সে চিত্রলেখাকে দেখতে না পেলেও সাবা পেছনে দরজার দিকে তাকালেই তাকে দেখতে পাবে। দু’জনের মধ্যে কি কথা হচ্ছে শুনতে পায় না সে। তার কানে কথা ভেসে আসলেও সেসব বুঝতে পারছে না চিত্রলেখা। কীভাবে বুঝতে পারবে? চোখের সামনে থাকা দৃশ্যটাই তো হজম করতে পারছে না সে। সামান্য এগিয়ে এসে রওনকের গলা জড়িয়ে ধরেছে সাবা। তাকে বাঁধা না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রওনক। যেনো সাবার কর্মকান্ডে পূর্ণ সমর্থন আছে তার। রওনক বাঁধা না দেয়ায় নিজের ঠোঁটটা এগিয়ে দেয় সাবা রওনকের ঠোঁটের দিকে। তাকে নিজের ঠোঁটের উষ্ণতায় জড়িয়ে নিতে। এই দৃশ্য দেখার সাহস, ক্ষমতা কোনোটাই নেই চিত্রলেখার। সাবার ঠোঁট রওনকের ঠোঁটের দখল নিতেই পেছন ঘুরে যায় সে। কোনোরকম শব্দ না করে চুপচাপ বেরিয়ে যায়, যেমন শব্দহীন এসেছি সেভাবেই। দোতলার করিডোরের শেষ মাথায় একটা খোলা বারান্দা আছে। নিঃশব্দে এখানে এসে দাঁড়ায় সে। চোখের পানি তার আপনা-আপনিই বইছে, তাদের আজ আর অনুমতির প্রয়োজন নেই। শব্দ করতে চায় না বলে বারান্দার গ্রীল ধরেছে শক্ত বাঁধনে। সব মিথ্যে, সব। তার দেখা, জানা সব মিথ্যে। তার জানা মানুষটাও। অনুভূতিগুলোও মিথ্যে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

সাবার ঠোঁট রওনকের ঠোঁট স্পর্শ করার আগেই নিজের ঠোঁটের আগে হাত তুলে ধরে সে। যার ফলে সাবার বাড়িয়ে দেয়া ঠোঁট আর রওনকের ঠোঁটকে স্পর্শ করতে পারে না, তার হাত স্পর্শ করে। একমুহূর্ত সময় নিয়ে সাবাকে পেছন দিকে ধাক্কা দেয়। আচমকা ধাক্কাটা আসায় তাল সামলাতে না পেরে পেছন দিকে ছিটকে পরে সাবা।

-রওনক!

আচমকা ধাক্কায় চেঁচিয়ে ওঠে সাবা। রওনক এগিয়ে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। বড় করে নিঃশ্বাস নেয় সে। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করছে। সাবা এখনো ফ্লোরেই বসে আছে। রওনক এগিয়ে এসে সাবার সামনে বসে খানিকটা তার দিকে ঝুঁকে তবে সতর্ক দূরত্ব বজায় রেখে ঠান্ডা কন্ঠে বলে,

-অনেকক্ষণ ধরে তোমার বুলশীট শুনতেছি কিন্তু কেনো শুনতেছি নিজেও জানি না। মেবি আমার বৌয়ের জন্য। চন্দ্র আমার লাইফে আসার পর থেকে আমার পেশেন্সের লেভেল বেড়ে গেছে বলতেই হয়। কিন্তু আমার বৌকে নিয়ে কেউ কিছু বললে সেটা আবার আমার সহ্য হয় না। সো ইউ বেটার ফা ক অফ বিফর আই ডিস্ট্রয় ইউ। আমাকে মেয়েদের সম্মান করতে শিখানো হয়েছে নাহলে এক্ষুনি এখানেই তোমাকে থাপড়ে মে রে ফেলতাম আর কেউ টেরও পেত না। তোমার মতো মেয়েকে চুটকি বাজিয়ে গায়েব করে দেয়াটা আমার জন্য কোনো বড় বিষয় নয় কিন্তু আমার চন্দ্র জানতে পারলে কষ্ট পাবে তাছাড়া আমার মা আমাকে এই শিক্ষা দেয়নি সেজন্য এই যাত্রায় বেঁচে যাচ্ছো তবে এটাই লাস্ট, গেট দিজ ইন ইউর স্মোল হেড। নাও গেট লস্ট বিফর আই চেঞ্জ মাই মাইন্ড।

ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রওনকের শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে তাকে সাবা। তার দৃষ্টিতে ভয় স্পষ্ট। মুখে স্বীকার না করলেও এই রওনককে সে ভয় পায়। সাবা উঠে যাবার আগে রওনক আরও বলে,

-আগেও বলছি আবারও বলছি এরপর যেনো তোমাকে আমার বৌ বা আমার আশেপাশেও না দেখি। আই সোয়ার সাবা আই ইউল ডিস্ট্রয় ইউ উইথ মাই ওন হ্যান্ডস। নাও গেট লস্ট ফ্রম মাই রুম।

একমুহূর্ত সময় না নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সাবা। এত অপমানে শোধ সে নিবেই। একটা রাস্তার মেয়ের জন্য তাকে অপমান করা কিছুতেই হজম করবে না সে। সময় মতো ঐ পরিচয়হীন রাস্তার মেয়েটাকে সে নিজের পথ থেকে ঠিকই সরাবে। রওনককে সে নিজের করেই ছাড়বে। দাঁতে দাঁত চেপে রওনকের ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। এক্ষুনি কিছু বললে সেটা তার নিজের দিকেই ব্যাকফায়ার করবে তাই কিছু না বলেই বেরিয়ে যায় সে।

চিত্রলেখা কোথায় আছে দেখার জন্য বেডরুম থেকে বেরিয়ে লিভিং রুমে আসতেই সেন্টার টেবিলে থাকা নাস্তার ট্রে দেখে রওনকের বুঝতে অসুবিধা হয় না তার চন্দ্র এসেছিল। নিশ্চয়ই কিছু দেখছে সে। হয়ত তাকে ভুল বুঝেছে। ভুল বুঝাটাই স্বাভাবিক। চিত্রলেখাকে খুঁজতে নিচে যায় সে। ড্রইং রুম, কিচেন কোথাও খুঁজে পায় না তার চন্দ্রকে। জাহানারা, তানিয়া এমনকি মীম, মিশকাতকে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারে না। চিত্রলেখাকে ফোন করতে নিজের মোবাইল হাতে নেয়ার জন্য প্যান্টের পকেটে হাত দিতে দেখে তার মুঠো ফোনটা সঙ্গে নেই। তাই নিজের মোবাইল ফোন আনতে আবার উপরে চলে আসে সে। নিজের ঘরে ঢুকার আগে রওনকের খেয়াল হয় একটা জায়গা আছে যেখানে হয়ত সে তার চন্দ্রকে পেতে পারে। এর আগেও বেশ কয়েকবার চন্দ্রকে ওখানে দেখেছে সে। দেরি না করে করিডোরের শেষ মাথায় থাকা বারান্দার দিকে পা পাড়ায়। বারান্দার দরজায় এসে চিত্রলেখাকে দেখতে পেয়ে নিঃশব্দে দাঁড়ায় সে। একমুহূর্ত সময় নেয় চন্দ্রকে বুঝতে। কতটুকু ভেঙে পড়েছে সে সেটা বুঝতে।

নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে ব্যস্ত চিত্রলেখা আচমকাই থেমে যায় পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে। তৎক্ষণাৎই পেছন ঘুরে দেখার চেষ্টা করে না তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কে। বরং পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা যেনো বুঝতে না পারে তাই খুব সাবধানে হাত তুলে নিজের গাল পেয়ে পরা পানি আঙ্গুলের টানে মুছে ফেলে। এক্ষুনি নিজের চোখের পানি কাউকে দেখাতে চায় না সে।

খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর এগিয়ে এসে চিত্রলেখাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রওনক। চিত্রলেখার পেটের কাছে ফাঁক গোলে হাত বাড়িয়ে পেটের কাছটায় জড়িয়ে ধরেছে সে। মুখ নামিয়ে চিত্রলেখার কাঁধে চিবুক রাখে। কেবল রওনকের নিঃশ্বাস শুনতে পায় চিত্রলেখা। কথা বলে না দু’জনের একজনও। চিত্রলেখা পরপর কয়েকবার ঢোক গিলে ধৈ ধৈ করে বুকে চিড়ে বেরিয়ে আসা কান্না গিলে ফেলার চেষ্টা করে। পরপর কয়েকবার চোখের পলক ফেলে যেনো অযাচিত অশ্রু এসে ভীড় না জমায়। এইমুহূর্তে কেঁদে ফেলে ভেঙে পড়তে চায় না সে। ভাঙতে রাজি সে তবে এক্ষুনি নয়। বেশখানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর নিস্তব্ধতাদের ছুটি দিয়ে রওনক বলে,

-প্রতিবাদ না করে, নিজের হক আদায়ে মজবুত না থেকে আড়ালে এসে চোখের পানি ফেললে হবে? নিজেরটার তোমাকেই ধরে রাখতে হবে। তুমি হাল ছেড়ে দিলে অন্যকেউ তোমাকে ঠেলে আগে চলে যাবে। তোমারটা তোমার থেকে কেঁড়ে নেয়ার চেষ্টা করবে।

আগের চাইতে আরেকটু বেশি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে তার চন্দ্রলেখাকে। রওনকের কথা শুনেই ঝড়ঝড় করে ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে যায় চিত্রলেখা। নিজেকে সামলে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেসব বিফলে যায়। চেষ্টা করেও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না সে। চিত্রলেখার কান্নার শব্দ না হলেও শরীরের কাঁপুনি ঠিকই টের পায় রওনক। প্রিয়তমা কাঁদছে সেটা জানার জন্য নিজ চোখে দেখতে হয় না তাকে, এমনকি তার কান্নার শব্দও শুনতে হয় না। চিত্রলেখা কেন্দ্রীক সবকিছু অনুভব করতে পারে সে। রওনক নিজেই বলতে থাকে,

-আমাকে আর চন্দ্রলেখা ব্যাতিত কেউ ছুঁয়ে যাবে সেটা আমি এলাও করব ভাববে কীভাবে? ওখানেই মে রে হাড্ডি গুড়া করা ফেলবো। আমি শুধু আমার চন্দ্রের। আমাকে ছুঁয়ে দেয়ার, ভালোবাসার একমাত্র দাবিদার আমার চন্দ্র। পালিয়ে এলে কেনো? আমার উপর ভরসা নেই? আমাকে বেঈমান মনে হয়? তোমাকে ঠকানোর কথা আমি ভাবতেই পারি না, ট্রাস্ট মি। আমার জন্য তুমি কাঁদবে সেটা আমি মানতেই পারব না।

চিত্রলেখার কাঁধের উপরে থাকা চুল একপাশে সরিয়ে সেখানে আলতো স্পর্শে চুমু খায় রওনক। কোমড় জড়িয়ে প্রিয়তমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে তার গাল বেয়ে পরা অশ্রুদের ঠোঁটের স্পর্শে মুছে ফেলার চেষ্টা করে। চিত্রলেখার ঠোঁটের একদম কাছাকাছি গিয়ে চোখের চোখ রেখে বলে,

-ট্রাম মি বৌ, আই লাভ ইউ মোর দ্যান মাই লাইফ।

চিত্রলেখাকে এক মুহূর্ত সময় না দিয়ে তার কাঁপতে থাকা ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁটের দখলে নিয়ে নেয় সে। প্রিয়তমাকে বুঝাতে চেষ্টা করে তার ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। চিত্রলেখার কান্নার গতি বাড়ে। একটুর জন্য ভেবেছিল মানুষটাকে বুঝি সে হারিয়ে ফেলেছে। প্রতারিত হওয়ার চাইতে মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার ভয় যেনো বেশি ঝেঁকে বসেছিল তাকে। কিন্তু মানুষটা তাকে ভালোবাসে, তার সব দিয়ে ভালোবাসে। সময় বিলম্ব না করে চিত্রলেখা নিজেও হাত বাড়িয়ে রওনকের গলা জড়িয়ে ধরে। তার ঠোঁটের ছন্দে তাল মেলায়। একে-অপরকে সঙ্গ দিয়ে ভালোবাসার সঙ্গীতে নতুন সুর তুলতে ব্যস্ত দু’জনে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৬৮+৬৯+৭০

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

-সরি বউ…

আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না চিত্রলেখা রওনককে। আচমকা কি হলো তার! এগিয়ে গিয়ে রওনকের ঠোঁট জোড়ার দখল নেয় সে। একমুহূর্ত সময় বিলম্ব না করে রওনক নিজেও তাল দেয় চিত্রলেখার ঠোঁটের ডেউয়ে। লম্বা সময় তারা একে-অপরের ঠোঁটের মায়ায় আটকে থাকার পর নিঃশ্বাস ভার হয়ে আসলে অক্সিজেন টানতেই যেন সামান্য বিরতি নেয়। তবুও কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না। চিত্রলেখাের কপালে কপাল ঠেকিয়ে বড় বড় করে নিঃশ্বাস টানে দু’জনেই। দু’জনের দৃষ্টিই একে-অপরে সীমাবদ্ধ।

চিত্রলেখাকে সামলে ওঠার কোনো সময় দেয় না রওনক। আদরে আদরে অস্থির করে দিতে ব্যস্ত হয়। এতগুলো দিন দূরে থাকাটা যেনো পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে সে। কখনো কোনো পুরুষের সংস্পর্শে না আসা চিত্রলেখাে রওনককে নিজের ভেতর পেয়ে পৃথিবীর সব কিছু যেনো ভুলে গেছে। এই মুহূর্তে রওনক, তার ছুঁয়ে দেয়া ছাড়া অন্যকিছুই ভাবতে পারছে না সে। রওনক যত গভীর ভাবে তাকে ছুঁয়ে দিতে, তার চিহ্ন রাখতে ব্যস্ত চিত্রলেখার অঙ্গে সে যেনো ততই মরিয়া হয়ে উঠছো আরেকটু বেশি তাকে কাছে পাবার নেশায়। একটা লম্বা সময় একে-অপরের উষ্ণ নরম অঙ্গে জড়িয়ে থাকার পর, একে-অপরকে নিজের সর্বোচ্চ কাছে পাওয়ায় যেনো দু’জনের শান্তি হয়েছে। চিত্রলেখাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেই বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে দম ধরার চেষ্টা করছে রওনক। চিত্রলেখারও একই অবস্থা। বেশ কিছুক্ষণ চিত্রলেখাকে বুকে নিয়ে শুয়ে থাকার পর রওনক উঠে বসে। তাকে বিছানা থেকে নামতে দেখে নিজের চোখ বন্ধ করে ফোলে চিত্রলেখা। মাথার উপর কম্বল টেনে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে। তা দেখে রওনক মুচকি হেসে চেঞ্জিং রুমে চলে যায় বিবস্ত্র অবস্থাতেই। পেছনে চিত্রলেখা তাকে দেখলো কি দেখলো না তাতে তার কিছু যায় আসে না। এখন আর তাদের মাঝে অদেখা কিছু নেই। ফ্রেশ হয়ে একটা ট্রাউজার প্যান্ট ও টি-শার্ট পরে বেরিয়ে আসে সে। চিত্রলেখা এখনো কম্বলের নিচে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। এগিয়ে এসে তার মুখের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে বলে,

-এসো।

-কোথায়!

অবাক হওয়া চিত্রলেখার কন্ঠে স্পষ্ট। গায়ের উপর থাকা কম্বলটা শক্ত করে ধরেছে সে যেনো হাত ফঁসে পরে না যায়। বলা তো যায় না রওনক নিজেই ধরে টান দিলো। এই লোককে দিয়ে কোনো ভরসা নেই। চিত্রলেখার অবস্থা দেখে হাসি পেলেও হাসে না সে।

-তোমার হাটতে কষ্ট হবে। চলো আমি ক্লিন করিয়ে দেই। তারপর ঘুমাবো।

রওনকের কথা শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়ে সে। এই লোক তাকে ক্লিক করিয়ে দিবে! সে কি লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ফেলেছে নাকি? তাড়াতাড়ি বলে,

-কোনো প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই ক্লিন হয়ে নিতে পারবো।

-ট্রাস্ট মি তুমি একদম হাটতে পারবে না। আমি জানি তোমার ভীষণ পেইন হচ্ছে। প্লিজ লেট মি হেল্প। আমি একদম বিরক্ত করবো না তোমাকে জাস্ট ক্লিন হতে হেল্প করব, নো দুষ্টুমি আই প্রমিজ।

রওনকের কথা শুনে লজ্জায় আবারও লাল হয়ে যেতে শুরু করেছে সে। নিজেকে ঢেকে রাখতে ব্যস্ত চিত্রলেখা এতক্ষণ লক্ষ করেনি রওনক হাতে করে কিছু একটা নিয়ে এসেছে। ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা বাথ্রবটা এগিয়ে ধরে বলে,

-এটা পরে নাও।

তর্কে যায় না চিত্রলেখা। বাথ্রবটা তার হাত থেকে নিয়ে বলে,

-আপনি পেছনে ঘুরে দাঁড়ান।

-ট্রাস্ট মি চন্দ্র এমন কিছু বাকি নেই যা আমি দেখিনি। সব দেখা হয়েছে গেছে আমার।

-প্লিজ!

-ওকে ফাইন।

বাধ্য হয়েই পেছন ঘুরে দাঁড়ায় সে। এমনিতেই নিজের বউয়ের লজ্জা পাওয়া সম্পর্কে ধারণা আছে তার। এখন আর নতুন করে আর লজ্জা দিতে চায় না। কিছুক্ষণ আগেই অন্তরঙ্গ হয়েছে তারা তবুও লজ্জায় ম রে যাচ্ছে চিত্রলেখা। সত্যিই তার মাথায় কোনো দুষ্টু বুদ্ধি নেই একমুহূর্তে। চিত্রলেখা যেনো ফ্রেশ হয়ে জলদি ঘুমাতে পারে সেজন্যই হেল্প করতে চায়। সে নিজেও প্রিয়তমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বিশ্রাম করতে চায়। কতগুলো রাত চন্দ্রলেখাকে জড়িয়ে না ধরে ঘুমাতে হয়েছে তাকে। সেই সব রাতের অপেক্ষাও পুষিয়ে নিতে চায় যতটা সম্ভব কাছাকাছি থেকে।

-হলো?

-এই এই তাকাবেন না প্লিজ।

কয়েক সেকেন্ড পরেই চিত্রলেখা আবারও বলে,

-হয়ে গেছে।

রওনক পেছন ফিরতেই দেখে চিত্রলেখা বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। অবাক হয়ে চিত্রলেখা জানতে চায়,

-কি করছেন?

-তোমার হাটতে কষ্ট হবে। আমি নিয়ে যাচ্ছিস।

-সমস্যা নেই, আমি হাটতে পারবো।

-পারবে জানি তবুও আমি তোমায় একটু পেম্পার করতে চাই।

-কিন্তু…

-হুঁশ।

আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না সে। বাথরুমে এসে তাকে কমডের উপর বসিয়ে দেয়ার পর রওনককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিত্রলেখা বলে,

-আপনি বাইরে যান।

-আই ওয়ান্ট টু হেল্প ইউ।

-একদম না।

চিৎকার করে ওঠে চিত্রলেখা। হাত তুলে সারেন্ডার করে রওনক বলে,

-ওকে ফাইন। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। তবে তুমি ক্লিন হয়ে আমায় ডাকবে, আমি এসে তোমায় নিয়ে যাবো। একদম হাটবে না। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।

চিত্রলেখাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে যায় সে। একটা নতুন বেড কভার নিয়ে রুমে ফিরে এসে বিছানায় থাকা বেডশীটটা পাল্টে ফেলে সে। বিছানা তৈরি করে নেয় দু’জনে ঘুমাবে বলে।

চিত্রলেখা বাথরুমের দরজা খুলতেই দেখে দরজার অন্যপাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রওনক। তাকে দরজা খুলতে দেখেই এগিয়ে এসে কিছু বলার বা করার সুযোগ না দিয়েই আবার পাঁজা কোলে তুলে নেয়। অহেতুক আর হাত পা ছোড়বার চেষ্টা করে না চিত্রলেখা। রওনকের বুকে মাথা রেখে নিচু সুরে বলে,

-আমার সত্যিই কষ্ট হবে না এতটুকু পায়ে হেটে যেতে।

-আমি জানি কষ্ট হবে না তবুও আমি তোমায় নিজের কাছাকাছি রাখতে চাই। তোমার একটু খেয়াল রাখতে চাই। একটু আদর-যত্ন করতে চাই।

চিত্রলেখা আর কথা বলে না তার ভীষণ ক্লানত লাগছে। এমনিতেই শরীর ভাঙছে তার সূক্ষ্ম ব্যথায়। এই ব্যথার কথা চাইলেই কাউকে বলা যায় না। এই ব্যথা যেমন কষ্টের তেমনি সুখেরও। অত্যান্ত ব্যাক্তিগত সুখের ব্যথা। হাত বাড়িয়ে রওনকের গলার কাছে জড়িয়ে রেখেছে সে। ঘরে ফিরে এসে চিত্রলেখাকে বিছানায় নামিয়ে দিতেই সে অবাক হয়ে বলে,

-বেডশীট!

-আমি বদলে দিয়েছি।

-ওটা কোথায় রেখেছেন? আমাকে দিন আমি ধুয়ে দেই আমি।

চিত্রলেখাকে জোর পূর্বক বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রওনক বলে,

-তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। ওটা আমি ক্লিন করে ফেলব। অন্যকেউ দেখতে পাবে না, চিন্তা করো না তুমি।

আপত্তি করতে চায় চিত্রলেখা। কেমন লজ্জার কথা সে থাকতে তার রক্তের দাগ লেগে থাকা বেডশীট রওনক পরিষ্কার করবে? ভাবতেই তো লজ্জায় পানিতে ডু বে ম রে যেতে মন চাইছে তার। এরপর মুখ দেখাবে কীভাবে তাকে সে? চিত্রলেখাকে চিন্তায় বিভোর হতে দেখে এগিয়ে গিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে রওনক বলে,

-একদম লজ্জা পাবে না। তোমার করা আর আমার করা একই কথা। আমি তুমি তো আর আলাদা নই।

লাইট বন্ধ করে দিয়ে এবারে সে নিজেও চিত্রলেখার পাশে ছুঁয়ে পরে গা ঘেষে। তাকে টেনে নেয় অনেকটা নিজের বুকের উপর। বলা যায় চিত্রলেখার শরীরের বেশিভাগ অংশ, ভার রওনকের শরীরের উপর। আরও একবার বউয়ের মাথায় চুমু খায় সে। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,

-তুমি একটু সর্তক থেকো।

-কেনো?

-খেয়াল রেখো তোমার পিরিয়ড মিস যায় কিনা। হলে আমায় জানাবে।

-মানে!

-আমরা প্রকেটশন নেইনি চন্দ্র। তোমার কনসিভ করার চান্স আছে। তাই বলছি একটু সর্তক থেকো।

রওনকের কথা শুনে দাঁতে ঠোঁট কাটে চিত্রলেখা। এতক্ষণ তো ব্যাপারটা তার মাথাতেই আসেনি। আসলেই তারা প্রটেকশন ব্যবহার করেনি। তৎক্ষনাৎই মনে মনে নিজের মাসিকের তারিখ হিসাবে করে ফেলে। হিসাব অনুযায়ী তার কনসিভ করার সুযোগ আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে বাচ্চা নেয়ার জন্য কি তৈরি সে? বাচ্চা যদি চলেও আসে তাহলে কি হবে? তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি সেটাই তো এখনো জানে না সে। এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে বাচ্চার ভবিষ্যতের কি হবে? ভাবতেই যেনো বুক কেঁপে ওঠে তার। কিন্তু এই বিষয়ে রওনকের কি ধারনা সেটা জানা দরকার। জিজ্ঞেস করবে কি করবে না দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-আপনি চান? মানে যদি আমি কনসিভ করে ফেলি তাহলে…

চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই রওনক বলে,

-তোমাকে পাবার পর আমার আর কিছু পাওয়ার বাকি শুধু একটা বাচ্চা ছাড়া। আমার রক্ত তোমার গর্ভে আসবে সেই দিনের অপেক্ষায় আমি।

মনে মনে খানিকটা নিশ্চিত হয় চিত্রলেখা। সে ভালো করেই জানে এই পরিবারে সে অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু রওনক বাচ্চা চায়, তার সঙ্গে চায় এই কথা তার মুখে শুনে খানিকটা স্বস্তি লাগছে এটা ভেবে তার সন্তানকে অনাকাঙ্ক্ষিত বা অগ্রহণ যোগ্য বলে দাবী করতে পারবে না কেউ। চিত্রলেখার চোয়াল জুড়ে ছোট্ট করে হাসি ফুটে উঠেছে। তার বন্ধ চোখের পাতায় গভীর হয়ে ঘুম নামতে আরম্ভ করেছে। তাকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যেতে লাগে রওনক নিজেও। গত ২৫ টা রাত তার ঠিকঠাক ঘুম হয়নি এই নারীর অনুপস্থিতিতে। আজ যেনো অনেক রাতের ক্লান্তি কাটার রাত।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

ইদানিং চিত্রলেখার সময় কাটে মিম ও মিশকাতের পেছনে ছোটাছুটি করে। শাশুড়ির সঙ্গে তার সম্পর্কের কোনো উন্নতি হয়নি। নানাভাবে সে চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। তাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে রাজি নন দিলারা জামান। যদিও এতে রওনকের কিচ্ছু যায় আসে না। এর মধ্যেও বেশ কিছুদিন সাবা এই বাড়িতে এসেছে। চিত্রলেখা চেষ্টা করেছে তাকে এড়িয়ে চলার। রওনক নিজেই তাকে বলেছে সাবা নিজে এসে কথা বলতে চাইলেও কোনো প্রয়োজন নেই কথা বলার। যদিও একজন মানুষ সামনে থেকে এসে কথা বলতে চাইলে তাকে কীভাবে ফিরে দিয়ে সে? এটা তো অভদ্রতা দেখায়। অন্যদিকে রওনকের কথাও অমান্য করতে পারছে না সে। তানিয়ার ভিসা প্রসেসিং চলছে। জলদিই সে আমেরিকা চলে যাবে। এর মধ্যেই লইয়ারকে দিয়ে মিম ও মিশকাতের লিগ্যাল গার্ডিয়ানশীপ রওনক ও চিত্রলেখাকে দিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে রাদিন বিশাল সিনক্রিয়েট করেছে বাড়িতে। যদিও রওনক একদম রা করেনি। ১ মাসের উপরে হতে চলল মেস্কিকো ও সিঙ্গাপুরের কাজ সেরে দেশে ফিরেছে রওনক। ফিরে আসার পর থেকে নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই ডিউরেশনে খুব কম সময় পেয়েছে তারা একে-অপরের সঙ্গে কাটানোর। এনিয়ে অবশ্য মন খারাপ করেনি চিত্রলেখা। সে জানে রওনকের উপর কাজের কত চাপ যাচ্ছে। চারদিনের জন্য গাজীপুর গিয়েছিল রওনক। আজই ফিরে আসার কথা তার। কিন্তু কখন ফিরবে সেটা জানায়নি। চিত্রলেখা ধরেই নিয়েছে গাজীপুর থেকে ফিরে অফিসে যাবে সরাসরি। অফিস সেরে একেবারে রাতেই হয়ত বাসায় ফিরবে। গতকাল রাত থেকে শরীরটা ভালো নেই তার। রাতে দু’বার বমি হয়েছিল। শরীরটা ভীষণ দূর্বল লাগছে। দু’দিন ধরে খাওয়া দাওয়ায় অরুচি ধরেছে। সকালে ঘুম ভাঙার পর টের পেয়েছে মাথা ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে টের পাচ্ছে শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। কম্বলটা মাথার উপর টেনে রেখেছে সে। বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে। এত বেলা পর্যন্ত কখনই শুয়ে থাকার অভ্যাস নেই তার। চিত্রলেখাকে নিচে না দেখতে পেয়ে ৮ টার দিকে একবার তার ঘরে এসেছিল জাহানারা। মাথা ব্যথার কথা জানিয়ে বলেছিল জাহানারা যেনো নিজে গিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আসে। তার উপর দায়িত্ব আসার পর থেকে এই পর্যন্ত একদিনও মিম, মিশকাতকে একা স্কুলে যেতে হয়নি। আজ শরীর ভালো নেই অন্যথায় সে নিজেই সঙ্গে যেতো। তবুও সে চায় না বাচ্চারা একা স্কুলে যাক। তাই জাহানারাকে বলেছে সঙ্গে যাওয়ার জন্য। তার কথা মতো সে নিজে গিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে এসেছে। নাস্তার কথা জিজ্ঞেস করলে চিত্রলেখা বলেছিল আরও কিছুক্ষণ ঘুমাবে সে। পরে উঠে খেয়ে নিবে। আবার ঘুমিয়ে পরলেও সেই ঘুম গাঢ় হয়নি তার। মাথার যন্ত্রণায় ঘুম গাঢ় হচ্ছে না। তবুও নিজেকে কম্বলের নিচে আটকে রেখেছে। চোখের সামনে অন্ধকার থাকায় আরাম লাগছে সামান্য। আধো ঘুম অবস্থায় রুমের দরজা খোলার শব্দ পেয়েছে সে। হয়ত জাহানারা এসেছে। রওনক না থাকলে সে ঘরের দরজা লক করে না। আর রওনকের কথাতেই ব্যস্ততার মধ্য দিয়েও একটু পরপর এসে চিত্রলেখাকে দেখে যায় জাহানারা। বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে বাসায় ফিরে আসার পর তার ঘরে এসে তাকে দেখে গেছে। কথা বলেনি। দরজার কাছে এসে তাকে দেখে আবার চলে গেছে। এখন আবার এসেছে। কয়েক সেকেন্ড পরেই দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ পায় সে। হয়ত তাকে দেখে চলে গেছে। আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করে সে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে কেউ একজন পেছন দিকে বিছানায় উঠে কম্বলের নিচে চলে আসে। চিত্রলেখা কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজোড়া হাত তাকে জড়িয়ে ধরে। মানুষটার হাত তার শরীরের সংস্পর্শে আসতেই টের পায় কে এসেছে। রওনককে এক্ষনই আশার করছিল না সে। মনে মনে তো ধরেই নিয়েছিল মানুষটার ফিরে আসার জন্য তাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। অন্তত সারাদিন। অথচ তাকে অবাক করে দিয়ে মানুষটা তার সঙ্গে, একদম কাছাকাছি। তাকে জড়িয়ে ধরেছে আষ্টেপৃষ্টে। একমুহূর্ত সময় বিলম্ব না করে কম্বলের নিচেই রওনকের দিকে ঘুরে তার বুকে মাথা রাখে চিত্রলেখা। রওনক কিছু বলে না৷ বউকে জড়িয়ে নেয় বুকের ভেতর। চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-এত দেরি করলেন কেনো?

-অপেক্ষা করছিলে বুঝি?

জবাব দেয় না সে। লজ্জা করে তার মুখ ফুটে অপেক্ষার কথা বলতে। তার কি আদৌ এই মানুষটার জন্য অপেক্ষা করার অধিকার আছে? এই মানুষটাকে তো তার পাওয়ারই কথা নয়। সে তো কোনোভাবেই এই মানুষটার যোগ্য নয়। চিত্রলেখা কোনো জবাব না দেয়ায় রওনক বলে,

-তোমার শরীর গরম কেনো? জ্বর এসেছে?

রওনকের বুকে মুখ রেখেই ডানে বামে মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা।

-তাহলে কী হয়েছে? রাতে খাওনি কেনো?

এমন প্রশ্ন শুনে অবাক না হয়ে পারে না। সে রাতে খায়নি একথা তার জানার কথা নয়। কীভাবে জানলো সে? গতরাতে তাদের কথা হয়নি। রওনক কীভাবে জানলো সে রাতে খায়নি প্রশ্নটা করবে এমন সময় চিত্রলেখা অনুভব করে তার পেট পাক দিয়ে বমি আসতে চাইছে। আচমকাই মাথা থেকে কম্বল সরায় সে৷ রওনক জিজ্ঞেস করতেই নেয় কি হয়েছে কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চিত্রলেখা দৌড় লাগায় বাথরুমের দিকে। বসে না থেকে রওনক নিজেও পেছন পেছন যায়। বাথরুমে ঢুকতেই দেখে চিত্রলেখা কমোডের সামনে নিচের দিকে খানিকটা ঝুঁকে বমি করছে। যেহেতু সে রাতে কিছু খায়নি তাই বমি হয়ে পানি ছাড়া কিছুই বের হচ্ছে না তার পেট থেকে। রওনক এগিয়ে এসে চিত্রলেখার চুলগুলো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। চুল যেনো মুখের সামনে না যায় সে চেষ্টা। আরেক হাতে পিঠ হাতড়ে দেয়। চিত্রলেখা বমি করে পেটের পানি বের করে শান্ত হলে পরে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-আর করবে?

বমি করে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে মুখে কিছু বলতে পারে না সে। কেবল মাথা ঝাকায়। রওনক কমোড ফ্লাশ করে দিয়ে চিত্রলেখাকে তুলে কমোডের উপরেই বসিয়ে দেয়। বেসিন কাউন্টারের কাছে গিয়ে একটা ছোট টাওয়াল ভিজিয়ে নিয়ে চিত্রলেখার কাছে ফিরে আসে।
কুলি করার জন্য পানিয়ে এগিয়ে দেয় সে চিত্রলেখাকে তারপর ভেজা টাওয়াল দিয়ে যত্নের সাথে বউয়ের মুখ মুছে দেয়। পরিষ্কার করা হয়ে গেলে চিত্রলেখাকে হাতের উপর কোলে তুলে নিয়ে রুমে ফিরে আসে। বিছামায় নামিয়ে দিয়ে কম্বলটা গায়ের উপর টেনে দিয়ে তার কপালে একটা চুমু খায় সে ছোট্ট করে। তারপর হাটা ধরে চেঞ্জিং রুমের দিকে। মিনিট বিশেক পর শাওয়ার নিয়ে কাপড় বদলে বেরিয়ে আসে সে। ফিরে এসে আবার চিত্রলেখাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরে রওনক। চিত্রলেখার চুলে নাক ঘষে বলে,

-ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখছি রাতে দেখিয়ে আসবো।

চোখ বন্ধ রেখেই চিত্রলেখা বলে,

-প্রয়োজন নেই। এমনি ভালো হয়ে যাবো আমি।

-আমার মনে হয় একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেয়া প্রয়োজন।

-সত্যি লাগবে না।

রওনক হয়ত কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে ইতস্ততবোধ করছে। তা আন্দাজ করতে পেরেই চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-কিছু বলতে চান?

-আমি ভাবছিলাম মেবি তুমি কনসিভ করেছো তাই তোমার শরীর খারাপ লাগছে। খাওয়া দাওয়া করতে পারছো না, বমি হচ্ছে তাই আর কি।

রওনকের কথা শুনে চিত্রলেখার বুকের ভেতর কিছু একটা ধড়াস করে ওঠে। মানুষটা ডেস্পারেটলি নিজের ফ্যামিলি চায়। একটা বাচ্চার কত ইচ্ছা তার! কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে পরে চিত্রলেখা বলে,

-সরি।

-কেনো?

-আম… আমার ইয়ে হয়ে গেছে। আজ ২ দিন চলছে। সেজন্যই শরীরটা খারাপ লাগছে। আমি আমি কনসিভ করিনি।

ইয়ে বলতে চিত্রলেখা কি বুঝাতে চেয়েছে তা ভালো করেই বুঝতে পারছে রওনক। এখনো তার সামনে লজ্জা পায় সে। তাই তো পিরিয়ড শব্দটা উচ্চারণ করতেও এত দ্বিধা তার। রওনক অবশ্য জোর করে না। আস্তেধীরেই নাহয় লজ্জা ভাঙবে। তার কোনো তাড়া নেই। একটা গোটা জীবন পরে আছে তাদের একত্রে পাড়ি দেয়ার।

রওনককে চুপ করে থাকতে দেখে চিত্রলেখা আবারও বলে,

-আই এম সরি।

-তুমি সরি বলছো কেনো?

-আমি কনসিভ করিনি।

-তো!

-আমি আপনার ইচ্ছা পূরণ করতে পারিনি।

-কে বলল পারোনি? যার আসার সে তার সময় মতো আসবে৷ না আসা পর্যন্ত আমরা নাহয় চেষ্টা করতে থাকবো। বোকা মেয়ে।

এক মুহূর্ত চুপ করে রওনক আরও বলে,

-এখন খাবার দিয়ে যেতে বলছি। কিছু খাওয়ার পর ঔষধ খাবে কেমন?

-না প্লিজ! আমি কিছু খাবো না।

-খেতে তো হবেই। তুমি নিজে না খেতে চাইলে আমি জোর করে খাওয়াবো।

-প্লিজ!

চিত্রলেখার প্লিজকে তোয়াক্কা না করে রওনক উঠে বসে জাহানারাকে ফোন করে বলে ঘরেই তাদের দু’জনের খাবার দিয়ে যেতে।

খাওয়া শেষ করে মুখ ভার করে রেখেছে চিত্রলেখা। রওনক হাসতে হাসতেই মুখ মুছে দেয় তার। জাহানারা এসে সব নিয়ে গেলে পরে রওনক এক গ্লাস পানি নিয়ে এগিয়ে এসে চিত্রলেখার মুখোমুখি বসে৷ আরেক হাতে থাকা ঔষধ এগিয়ে দিয়ে বলে,

-নাও, খাও।

অন্য দিকে মুখে ঘুরিয়ে নিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-খাবো না।

-সুন্দর করে বলছি খাও নয়ত কিন্তু আমি জোর করে খাওয়াতে জানি।

বাধ্য হয়েই ঔষধ টা খেয়ে নেয় সে। পানির গ্লাসটা বেডসাইড টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে রওনক এগিয়ে গিয়ে পিঠে বালিশে হেলান দিয়ে বসে চিত্রলেখাকে কাছে ডাকে। সে কাছে যেতেই তাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে নেয়। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

-এভাবেই থাকো কিচ্ছুক্ষণ।

রওনকের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করেই চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-আজ অফিস যাবেন না?

-না।

-কেনো?

-আমার বউ অসুস্থ। তার খেয়াল রাখার চাইতে জরুরী কোনো কাজ নেই আপাতত আমার।

চিত্রলেখা মুখে কিছু বলে না। কেবল শব্দহীন হাসে। এই মানুষটার বলা কথা তার ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। শিহরণের দোলা দিয়ে যায়। আবার ভয়ও লাগে তার। সারাজীবন সব এমনই থাকবো তো নাকি এইসব কিছু সাময়িক!

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭০
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

সবেই কোচিং শেষ করে বাসায় ফিরছে চারু। মেইন রোড ছেড়ে এলাকার গলিতে ঢুকেছে। প্রতিদিন এদিক দিয়ে যাওয়া আসার সময় সতর্কভাবে চারিদিকে চোখ বুলায় সে। কোথাও মামুনকে দেখা যায় কিনা সেই আশায়। কিন্তু চিত্রলেখার বিয়ের কথা জানার পর সেদিনের পরে আর মামুনকে দেখতে পায়নি সে এলাকায়। মানুষটা যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। মামুন নিজের ইচ্ছায় হারিয়েছে তাই তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হারিয়ে যাওয়া মানুষ খুঁজে পাওয়া গেলেও যে নিজে থেকে হারায় তাকে হাজার চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া যায় না। মামুনের ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছে। তাছাড়া আর কোথায়ই বা খুঁজবে সে মামুনকে? তার বাড়িতে গিয়ে আচমকা জিজ্ঞেস করলে সবাই আড়চোখ করে তাকাবে। তাই ধৈর্য্য ধরে রাখে সে নিজে থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই চারুর।

প্রতিদিনের মতোই আনমনে সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই এদিক সেদিক চোখ বুলাচ্ছে সে। যদিও জানে মামুনের দেখা মিলবে না। একটু পরপর ফস ফস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতেই বাড়ি দিকে আগায় সে৷ কিন্তু আচমকাই মাঝামাঝি এসে তার কদম থমকে যায়। গলির মোড়ের টং দোকানের সামনেই রাখা মামুনের বাইকটা। সেটাকে অনুসরণ করে টং দোকানের ভেতরে তাকাতেই চায়ের কাপ হাতে বসা মামুনকে দেখতে পায় সে। নিজের চোখের দেখা বিশ্বাস করতে নিজের সাথেই যুদ্ধ করতে হয় তাকে। চারুর পায়ের কদম আপনাআপনিই ধীর গতিতে আগাচ্ছে সামনের দিকে। ছোট ছোট কদম ফেলে বাইকটার সামনে এসে দাঁড়ায় সে। মামুন এখনো চারুকে দেখতে পায়নি। সে ব্যস্ত গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক বসাতে বসাতে টং দোকানে উপস্থিত সকলের সঙ্গে খোশগল্পে মজতে। সে টেরই পায়নি মাত্র কয়েক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে চারু নামক মেয়েটা এক পৃথিবী মুগ্ধতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ এখনো বিশ্বাস হয় না তার। চারু মনে করে সে বড় করে চোখের পলক ফেললেই মামুন গায়েব হয়ে যাবে। ঐ যে সিনেমায় দেখায় না ঠিক সেরকম৷ সিনেমায় যেমন দেখায় নায়িকা একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে অপলক নায়ককে দেখতে পায় চোখের সামনে। যেই সে পলক ফেলে ওমনিই নায়ক ধোঁয়া হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। যার সহজ অর্থ নায়িকা এতক্ষণ নিজের কল্পনায় দেখছিল তার প্রিয় মানুষটাকে। চারুর মনে হয় সে নিজেও এই মুহূর্তে একই কাজ করছে। মামুনকে এক নজর দেখতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার বক্ষপিঞ্জরে। সেই তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই চোখের সামনে মামুনকে তার বাইকটা কল্পনা করছে সে। সে যদি এক্ষুনি চোখ বন্ধ করে আবার খুলে তাহলেই দেখবে কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। না মামুন আর না তার বাইক। সব হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। আরও কিচ্ছুক্ষণ মামুনকে দেখতে চায় সে। হাওয়া মিলিয়ে যাওয়ার আগে আরও কিচ্ছুক্ষণ চোখের শান্তি করে নিতে চায়। সত্যি সত্যি কবে দেখা হবে তার তো কোনো ঠিক নেই। তাই এই মুহূর্তে কল্পনাই ভরসা। অথচ কল্পনা অবিকল বাস্তবতার মতোই অনুভূতি দিচ্ছে চারুকে। সে হাত বাড়িয়ে মামুনের বাইকের উপর হাত রেখেছে। আচ্ছা স্বপ্নে বা কল্পনায় কিছু ছুঁয়ে দেয়া যায়? অনুভব করা যায়? অথচ সে করতে পারছে। এই যে হাতের নিচে থাকা বাইকটা অনুভব করতে পারছে। একবার কি চোখটা বন্ধ করে দেখবে মামুন হাওয়ায় মিলিয়ে যায় কিনা! দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করে চারু। তার হাত জোড়া এখনো মামুনের বাইকের উপর রাখা। চোখ বন্ধ অবস্থায় এখনো সে অনুভব করতে পারছে বাইকটা। তার মানে এখনো সব ভ্যানিস হয়ে যায়নি। নিশ্চয়ই সে চোখ মেললেই মামুন নাই হয়ে যাবে সঙ্গে তার বাইকটাও। কিচ্ছুক্ষণ সময় নেয় চারু চোখ মেলার আগে। চাইলেই তো সারাদিন সে এখানে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। বরং পরিচিত কেউ তাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফেলার আগে বাড়ি যেতে হবে। অন্যথায় সে বাড়ি পৌঁছানোর আগে তার মাঝ রাস্তায় চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকার খবর হয় লিখন নয় খালার কান অব্দি পৌঁছে যাবে। ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আস্তেধীরে সময় নিয়ে চোখ মেলে তাকায় সে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সব আগের মতোই আছে। মামুন, তার বাইক কোনোটাই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি। কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে চারুর বুঝতে কি হচ্ছে। এখনো বাইকটা ধরেই দাঁড়িয়ে আছে সে। তার দৃষ্টি মামুনের মুখের উপর। এসব কল্পনা নয় বরং বাস্তব। বুঝতে পেরেই চোখ বড় হয় চারুর। তার নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে কথা বেরিয়ে আসে।

-মামুন ভাই!

বলেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে। চারুর এক ডাকেই এদিকে তাকায় মামুন। সে মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই তাদের দু’জনের চোখে চোখ পরে। চারু এখনো মূর্তির মতোই দাঁড়িয়ে আছে। মামুন এদিক তাকিয়ে চারুকে দেখতে পেয়ে, এদিকেই তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। কারো কোনো নড়াচড়া নেই। কিছুটা সময় নিয়েই যেনো দু’জন দু’জনকে দেখে নেয়। চারু ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। সে যেনো নড়তে ভুলে গেছে। হাঁটতে ভুলে গেছে। কথা বলতে ভুলে গেছে। চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে। সবই যেনো ভুলে গেছে সে এই মুহূর্তে। অন্যদিকে সগতিক হয় মামুন। অন্যদের উপস্থিতিতে তার এভাবে চারুর দিকে তাকিয়ে থাকাটা অনুচিত, মন্দ দেখায়। এতক্ষণে পাশে বসে থাকা কেউ কেউ মামুনের দৃষ্টি লক্ষ করে চারুর দিকে তাকিয়েছে। কেউ কেউ চারুর মুখে মামুনের নাম শুনে তৎক্ষনাৎই হয়ত তাকিয়েছে। হাতে থাকা চায়ের কাপ নামিয়ে রাখে সে। পকেট থেকে ম্যানিব্যাগ বের করে টাকা এগিয়ে দেয় চায়ের বিল পরিশোধ করতে। টং দোকানদার গফুর আলী আপত্তি করে বলেন,

-না মামুন ভাই আজকা আপনের থে ট্যাকা পয়সা লমু না। আমার পক্ষর থে আপনারে টিট। কতদিন পর আইলেন কন তো। আপনেরে ছাড়া কি আমার দোকানর আড্ডা জমে কওন তো?

গফুরের কথায় হেসে দিয়ে মামুন বলে,

-না গফুর ভাই তোমাদের মামুন আর বেকার নেই। বিনা পয়সায় সে কারো থেকে কিছু নেয় না এখন আর।

জোর করেই গফুরের হাতে টাকাটা গুঁজে দেয় সে। মামুনের কণ্ঠটা কেমন যেনো পাল্টে গেছে। আগের সেই অলসতা, চঞ্চলতা নেই তার কন্ঠে। একটা নতুন ভারিক্কি এসেছে যেনো সেই জায়গায়। আগে কখনো এমন শুনায়নি তার কথা। হঠাৎ এত পরিবর্তন কিসের? এগিয়ে এসে চারুর মুখোমুখি দাঁড়ায় মামুন। এক পলক চারুর বিষ্ময়ে বড় হয়ে থাকা চোখে চোখ পরে তার। পরক্ষণেই চারুর খৈ হারা নয়ন থেকে চোখ সরিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,

-কেমন আছো চারু?

মামুনের প্রশ্নে যেনো চারুর ভেতর কিছু একটা হলো। ধড়াস করে ওঠে ভেতরটা। এতক্ষণে সে খেয়াল করেছে মামুনের কেবল কন্ঠেই পরিবর্তন আসেনি। আপাদমস্তক মানুষটাই যেনো পাল্টে গেছে অনেকখানি। এই মুহূর্তে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাক মামুন আর আগের মামুনের ভেতর চোখে ধরা পরার মতো পরিবর্তন পরিলক্ষিত। সবসময় কপালের উপর চুল ফেলে রাখা মামুনের আজ কপালে চুল নেই। বরং হাতের মুঠোয় ধরতে পারা লম্বা চুলগুলো কেটে ছোট করে ফেলেছে সে। আর্মি কাটে যথেষ্ট ডিসেন্ট লাগছে তাকে দেখতে। অথচ আগে তার গেটআপে ডিসেন্ট টাচ ছিল না। সবসময় একটা এলাকার বখাটে ছেলে ভাব দেখা যেতো তার পোশাক-আশাকে। যদিও সে কখনোই বখাাটে ছিল না কিন্তু খানিকটা সেরকমই বেশ ভুষায় থাকতো আর কি। অথচ আজ তাকে দেখে ওরকম লাগছে না। মনে হচ্ছে এ যেনো অন্য কোনো মানুষ। যে অবিকল মামুনের মতো দেখতে। তার পরণে নীল রঙের জিন্স। সাদা শার্টের উপর একটা আরামদায়ক নীল রঙের হুডি পরে আছে সে। টং দোকানের ভেতর বসে থাকা অবস্থায় হুডিটা তার মাথার উপরে টানা ছিল। এগিয়ে এসে চারুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে নিজেই হুডিটা নামিয়েছে। তখনই এই আমূল-পরিবর্তনটা চারুর দৃষ্টিতে ধরা পরেছে। এই যে মাস তিনেকের ব্যবধানে তার সামনে ভিন্ন একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আজ কিন্তু চারু কি এই পরিবর্তিত মানুষটার অপেক্ষায় ছিল? সে তো তার সেই আগের মামুন ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। যার চোখে কেবল মায়ার জন্য অস্থিরতা প্রকাশ পেতো সবসময়। মায়াকে নিজের করে পাবার ব্যাকুলতা দেখা যেতো। অথচ আজ এই মানুষটার চোখে তো দূরের কথা, চোখের কোনো কোণাতেও মায়ার অস্তিত্ব নেই। মামুন ভাই কি তাহলে তার মায়াকে ভুলে গেছে? এই অল্প সময়ের ব্যবধানে! এত অল্প সময়ে কি ভালোবাসা ভুলে যাওয়া যায়? এখন কি তাহলে সে আর মায়া মায়া করে অস্থির হবে না? ব্যাকুলতার সুর তুলবেন না? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে কি এতে চারুর খুশি হওয়া উচিত? সে কখনো তার চেতন বা অবচেতনে মামুনের জীবনে তার মায়ার জায়গা নিতে চায়নি। আবার সবসময় তাকে মায়া মায়া করে অস্থির হয়ে থাকতে দেখেও মন খারাপ লাগতো তার। একটা কেমন বিষন্নতায় ভেতরটা ছেয়ে থাকতো। এমন কেনো লাগতো তার? তাহলে কি সে মনে মনে মামুনের জীবনে মায়ার জায়গাটা চায়?

আপন মস্তিষ্কে আবোলতাবোল ভাবতে ব্যস্ত চারুর খেয়ালই নেই মামুন তাকে একটা প্রশ্ন করেছিল। অনেকক্ষণ কোনো জবাব না পেয়ে মামুন ছোট্ট করে নরম সুরে আবার ডাকে,

-চারু!

এবারে যেনো ধ্যান ভেঙে বেরিয়ে আসে চারু অজানা কোনো অতল থেকে। হুড়মুড় করে জিজ্ঞেস করে,

-জি, মামুন ভাই? কিছু বলছিলেন আপনি?

-জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছো তুমি?

চারু চুপ করে তাকিয়ে রয় মামুনের মুখের দিকে। তাকে করা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তার মুখে,

-এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি মামুন ভাই? এভাবে কেউ কিছু না বলে গায়েব হয়ে যায় বলুন তো? আমি কত খুঁজেছি আপনাকে আপনি জানেন? এগলি, ওগলি করে কোনো গলির মোড় বাদ রাখিন। কেবল আপনার বাড়ি যাওয়াটা বাদ আছে। এমন লুকিয়ে ছিলেন কেনো? কার থেকে লুকিয়ে ছিলেন বলুন তো?

আগুনের ফুলকির মতো চারুর মুখ গলে বেরিয়ে আসা এক একটা প্রশ্নের তৎক্ষনাৎ জবাব দেয় না মামুন। স্মিত হাসে সে, যে হাসির কোনো শব্দ নেই কেবল চোখে দেখা যায় মানুষটা হাসছে।

-এখানে আর কার জন্য পরে থাকবো বলো তো? আমার কি নিজের বলতে কেউ আছে এখানে? কিছু কি অবশিষ্ট আছে? কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। সেজন্যই তো নিজেকে খুঁজে পেতে রাজ পথে নেমেছি আমি। ছুটে চলছি দিক থেকে দিগান্তর।

-কে বলল কেউ নেই?

অন্যদিকে তাকিয়ে সামান্য ধরা গলায় মামুন বলে,

-মায়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সব চেলে গেছে চারু। আমি শূন্য হয়ে গেছি। আমার ভেডরটা ফাঁকা হয়ে গেছে।

-আমার দিকে তাকান মামুন ভাই।

মুখটা ঘুরিয়ে এনে চারুর মুখের দিকে তাকায় সে। তারা দু’জনে মামুনের বাইকের দু’পাশে দাঁড়িয়ে। মামুন চোখ মেলে তাকালেই তাকে চমকে দিয়ে চারু বলে,

-আমাকে কি আপনার চোখে পরে না মামুন ভাই? আপনি কি দেখতে পান না আমাকে? আমার সব ব্যাকুলতা…

তৎক্ষনাৎই চোখ সরু হয় মামুনের। তা দেখে মাঝপথেই কথা বন্ধ হয়ে যায় চারুর। এই ধরনের কথাবার্তা মামুনের পছন্দ হচ্ছে না। নিচের দিকে চোখ নামিয়ে নিয়ে সে বলে,

-বাড়ি যাও চারু। অনেকক্ষণ হয় রাস্তায় দাঁড়ায় আছো। খারাপ দেখায় মানুষ দেখতেছে, বাড়ি যাও।

-মামুন ভাই…

-বাড়ি যাও চারু।

আর কিছু বলে না চারু। মামুন তার থেকে নজর সরিয়ে নিয়েছে৷ তার চোখে চোখ রাখছে না। সে কি বুঝতে পারছে চারুর ভেতরকার ভাঙন। নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে মিনমিনে সুরে জিজ্ঞেস করে,

-আমাদের কি আর দেখা হবে না মামুন ভাই?

-জানি না। হলেও হতে পারে।

-আপনি কি আবার চলে যাবেন?

-হ্যাঁ।

ঝট করেই মুখ তুলে মামুনের মুখের দিকে তাকায় চারু। কিন্তু মামুন তাকায় না৷ তার দৃষ্টি অন্যপাশের রাস্তার দিকে। না তাকালেও বুঝতে পারে চারুর দৃষ্টি তার মুখের উপর। সে মুখটা এদিক ঘুরালে দেখতে পেতো চারুর চোখে ভার হওয়া পানির উপস্থিতি। নিজের কন্ঠের স্বাভাবিকতা ধরে রাখার চেষ্টা করে চারু বলে,

-কই যাবেন আপনি?

-সেটা তোমার না জানলেও চলবে। তুমি বাড়ি যাও।

আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না চারু। তৎক্ষনাৎই বাড়ির দিকের রাস্তা মাপা শুরু করে। দ্রুত কদম ফালায় সে সামনের দিকে। জলদি সরে যাবার প্রচেষ্টায় যাতে করে পেছনে দাঁড়িয়ে মামুন যেনো টের না পায় তার গাল বেয়ে ইতোমধ্যে অশ্রুর বন্যা বইতে আরম্ভ করেছে। নিজের চোখের পানি সে কাউকে দেখাতে চায় না। এমনকি যার জন্য এই পানি তাকেও নয়।

পেছনে দাঁড়িয়ে মামুন একবার চারুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৬৫+৬৬+৬৭

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনক কখন গিয়ে পৌঁছাবে সেই চিন্তায় মনে মনে বারবার তটস্থ থাকছে চিত্রলেখা। নিশ্চয়ই পৌঁছে তাকে ফোন করবে। সেজন্য ফোনটা হাতের কাছে কাছেই রাখছে। কয়েকবার চেকও করেছে ফোনটা জেনারেল করা আছে কিনা। চার্জ আছে কিনা। যদি চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে যায় আর তখন রওনক ফোন করে তাকে না পায়। সেজন্য ফোনে ফুল চার্জ করে রেখেছে। সকাল সকাল এসে নিজে রুটি আলু ভাজি করে ভাইবোন ও খালাকে নিয়ে নাস্তা করেছে। লিখনকে বাজারে যেতে বলেছিল কিন্তু তার জরুরী ক্লাস আছে বলে সে কোনো রকম নাস্তা করেই বেরিয়ে গেছে। তাই চয়নকে বাজারে পাঠিয়েছে আজ বিরিয়ানি রান্না করার পরিকল্পনা চিত্রলেখার। তিনরাত নিজের চিরচেনা এই ঘরে ছিল না চিত্রলেখা অথচ তার মনে হচ্ছে কতশত রাত সে এই ঘরে থাকেনি। নাস্তার পর লিখন বেরিয়ে গেলে পরে চয়নকে বাজারে পাঠিয়ে দিয়ে চিত্রলেখা এখন নিজের ঘরে বসে আছে। তার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে চারু। আজ সে কোথাও যাবে না। পড়াশুনা থেকে ছুটি নিয়েছে। চিত্রলেখাও কিছু বলেনি। চারুর জন্য চিত্রলেখা তার মায়ের চাইতে কোনো অংশে কম নয় তাই সেও বাঁধা দেয়নি। বরং নিজেই ভেবেছে সে তো কয়টা দিন আছেই এখানে একটা দিন তার কাছেই থাকুক চারু। দু’দিনের দূরত্বে যত কথা জমেছে সব বলবে দু’বোনে। রওনক চলে আসার পর আবার কবে আসতে পারবে কে জানে। এবার না হয় রওনক নিজেই বলেছে এখানে এসে থাকতে পরে যদি সে অনুমতি না দেয়! এভাবে এসে থাকার সুযোগ পরে যদি না পাওয়া যায়! সবসময় তো নিজের ঘর-সংসার ফেলে চাইলেও চিত্রলেখা আসতে পারবে না।

চিত্রলেখার কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে চারু কিন্তু ঘুমায়নি সে।

-আপা!

-হু

-জানো আপা সেদিনের পর মামুন ভাই আর আমাদের বাড়ি আসেনি।

চিত্রলেখা কেবল শুনে মুখে কিছু বলে না। মামুনের জন্য খারাপ লাগে তার। আর কেউ না জানলেও সে জানে তার প্রতি মামুনের ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না। তার নিজের দূর্ভাগ্য সেই ভালোবাসা সে গ্রহণ করতে পারেনি। হয়ত মামুন তার জন্য নয় বলেই সে কখনো মামুনকে, মামুনের ভালোবাসাকে গ্রহণ করতে পারেনি, গ্রহণ করার কথা ভাবেনি।

লিখন আর রিপা একে-অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। লিখনের এমনিও কিছু বলার নেই। সে শুনতে চায়, জানতে চায় রিপার সঙ্গে রওনকের সম্পর্ক কি। রিপা ভালো করেই জানে লিখন কি জানতে চায় তার কাছে। সব বলার আগে খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালায়। ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রিপা বলতে শুরু করে,

-রওনক ভাইয়ের বাবা আর আমার বাবা বন্ধু ছিলেন। এছাড়াও জামান গ্রুপের শেয়ার হোল্ডার আবার বাবা। বিজনেস পার্টনার বলতে পারো।

-আগেরদিন তাহলে বলোনি কেনো এসব কথা আমাকে?

-আসলে তুমি এত ডিস্টার্ব ছিলে আমি তোমাকে আরও ডিস্টার্ব করতে চাইনি সেজন্য তখনই কিছু বলিনি।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে লিখন জিজ্ঞেস করে,

-এর বাইরে কি আর কিছু আছে রিপা যা আমার জানা উচিত কিন্তু তুমি আমাকে বলছো না, আমি টেনশন করব ভেবে।

লিখনকের কথা শুনে থমকে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা ঝাকায় রিপা। চোখে থাকা রাউন্ড শেপের চশমা ঠিক করার চেষ্টা করার বাহানায় নিজের নার্ভাসনেস লুকানোর চেষ্টা করে। যদিও রিপার উত্তরে লিখন সন্তুষ্ট নয় তারপরেও আর ঘাটে না সে এই বিষয়ে। রিপাকে সে খুব ভালো করেই চিনি। যদি সে কিছু আড়াল করেও থাকে তাহলে ভালোর জন্যই করেছে। লিখন কখনো দেখেনি রিপা জেনে বুঝে কারো ক্ষতি করেছে। তাই আর এই বিষয়টায় বাড়তি কথা বলে না। রিপার নিজের যখন উপযুক্ত মনে হবে সে নিজেই তাকে সব জানাবে। শুধু লিখনের একটাই চিন্তা ওর বোনটা ভালো থাকলেই হলো। রিপা সম্ভবত লিখনের মনের কথাটা বুঝতে পেরেছে তাই সামান্য কাছাকাছি এগিয়ে এসে একটা হাত ধরে বলে,

-তোমার চিন্তাটা আমি বুঝি লিখন। কিন্তু আপাকে নিয়ে চিন্তা করা এবার তুমি বাদ দিতে পারবো। আপার জন্য তোমার না ভাবলেও চলবে।

অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়ে রিপার দিকে তাকায় লিখন। অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে,

-আমার বোনের জন্য আমি চিন্তা করব না?

-তুমি আর চিন্তা না করলেও চলবে লিখন। রওনক ভাই আছে আপার জন্য।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে রিপার দিকে তাকিয়ে থাকে লিখন। কি বলতে চাইছে সে। লিখনকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয় না। রিপা নিজেই উত্তর করে তার দৃষ্টির জিজ্ঞাসা টের পেয়ে।

-রওনক ভাই মানুষটা খাটি লিখন। সে কখনো মাঝপথে আপার হাত ছাড়বে না। মানুষটার দায়িত্ববোধের কোনো সীমা নেই। আপাকে সে কখনো হেলায় ফেলবে না বরং অনেক ভালোবাসবে সবসময় এতটুকু আমি তোমাকে গ্যারিন্টি দিয়ে বলতে পারি তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।

-আমার বোন মানুষটাই এমন রিপা। পর কেও আপন করে নেবার গুন আছে আমার বোনের কিন্তু আমার চিন্তাটা তুমি বুঝবে না। রওনক জামান আর আমার বোন দু’জন দুই পৃথিবীর মানুষ। আমার বোনটা একদম সরল। কেউ চাইলে খুব সহজেই আপার সরলতার সুযোগ নিতে পারবে। কষ্ট পেলেও আমার বোন উফ করবে না, কাউকে কিচ্ছু বলবে না।

-আমাদের ঘটনাও কিন্তু একই লিখন। আমরা দুইজনও দুই পৃথিবীরই মানুষ।

-কিন্তু আমরা একে-অপরকে ভালোবাসি। জেনে বুঝে পরিকল্পনা করে আগাচ্ছি। আপার বিয়েটা আচমকা হয়েছে। সবাই যতই বলুক আপা ঐ লোকটাকে ভালোবাসে আমি তা বিশ্বাস করি না। আমার বোনকে আমি চিনি। এই বিয়ের পিছনে কোনো একটা কিন্তু আছে রিপা। আপা না বললেও আমি বুঝি আমার বোন আবার নিজেকে সেক্রিফাইজ করেছে আমাদের জন্য। কেউ আমার বোনের সরলতার সুযোগ নিচ্ছে, নিবে এই বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারি না কখনো পারবোও না।

-প্লিজ লিখন আই রিকুয়েস্ট ইউ ট্রাস্ট দ্যাম। আপার উপর বিশ্বাস রাখো সে না ভেবে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত এমনি এমনি নেয়নি নিশ্চয়ই। তাছাড়া রওনক ভাই থাকতে এমন কিচ্ছু হবে না। কেউ আপার সুযোগ নিতে পারবে না এই ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। সে কাউকে সেই সু্যোগই দিবে না। দেখবে আপাকে সবরকম প্রতিকূলতা থেকে আগলে রাখবে। তুমি অহেতুক চিন্তা করো না। একটু ভরসা করেই দেখো।

ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে লিখন। মনে মনে ভাবে, সে নিজেই যে আমার বোনের সরলতার, সমস্যার সুযোগ নিচ্ছে না তার কি গ্যারান্টি আছে? হতেই পারে এই বিয়েটা লোক দেখানো। এই বিয়ের পেছনে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে। লিখন খুব ভালো করে জানে আড়ালে অন্য কিছু থাকলেও চিত্রলেখা কখনোই তাকে সেটা জানাবে না। চিত্রলেখাকে কারো সঙ্গে নিজের চিন্তা, দুশ্চিন্তা শেয়ার করে না। বিশেষ করে ভাইবোনদের কিছু জানায় না সে দুশ্চিন্তা করবে বলে।

বিকেল থেকে চিত্রলেখার দুশ্চিন্তা বেড়েছে। এখন পর্যন্ত সে রওনকের থেকে কোনো আপডেট পায়নি। গিয়ে পৌঁছেছে কিনা কে জানে। পৌঁছে থাকলে নিশ্চয়ই তাকে একবার ফোন করতো সে। নাকি করতো না? চিন্তা করে ভেবে কিছু কুলকিনারা করতে পারে না সে। কতক্ষন লাগবে তার মেক্সিকো গিয়ে পৌঁছাতে? প্লেন তো অনেক দ্রুত যায় তাহলে কি সারাদিনেও গিয়ে পৌছেনি সে! প্লেনটা ঠিকঠাক গিয়ে পৌঁছেছে তো! পথে কোনো বিপদ হয়নি তো! অনেক সময়ই তো দেখা যায় আকাশ পথে প্লেন ক্রাশ করেছে এমন কিছু হয়নি তো! কথায় আছে শূন্য মস্তিষ্ক হচ্ছে শয়তানে ঘর। চিত্রলেখার আপাতত কিছু করার নেই এক রওনকের জন্য দুশ্চিন্তা করা ছাড়া। এক ভাবনা থেকে আরেক ভাবনার উদয় হচ্ছে তার মস্তিষ্কে। সেইসব ভাবনা থেকেই যত্তসব আজগুবি চিন্তা ভাবনা এসে তার মস্তিষ্কে খুটি গাড়ছে। আবার এও মনে হচ্ছে রওনক হয়ত পৌঁছে গেছে ইচ্ছা করেই তাকে ফোন করেনি। হয়ত তাকে জানানোটা জরুরী কিছু নয়। তাকে জানানোটা কি আসলেই জরুরী? কে সে? রওনকের আইনত বিবাহিত স্ত্রী কিন্তু এর বাইরে তার জীবনে চিত্রলেখার স্থান কোথায়? জানা নেই চিত্রলেখার। এই মুহূর্তে এসব কথা সে ভাবতেও চাইছে না। দুশ্চিন্তাদের দুই হাতে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু এতে বিশেষ কাজ হয় না। দুশ্চিন্তা একবার মস্তিষ্কে বাসা বাঁধতে পারলে সহজে দূর করা যায় না।

রাত ৮টা বাজে সবেই অফিস বিল্ডিং থেকে বেরিয়েছে লাবিব। ব্লেজারের বুক পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠায় বাধ্য হয়েই বাইকটা সাইড করে দাঁড় করায়। রওনক দেশে না থাকলে লাবিবের কাজের চাপ বেড়ে যায় শতগুন। তাকে রওনকের হয়ে অনেক কাজ সামাল দিতে হয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। আজ সারাদিনে রওনকের হয়ে তাকে তিনটা মিটিং এটেন্ড করতে হয়েছে। দুটো মিটিং এ তানিয়া ছিল তার সঙ্গে। জরুরী কিছু হতে পারে ভেবেই ফোনটা বের করে হাতে নেয় সে। স্ক্রিনে ভাসা চিত্রলেখার নাম দেখে সময় বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎই রিসিভ করে জিজ্ঞেস করে,

-কি করতে পারি মিসেস সিইও এর জন্য।

লাইনের অন্যপাশ থেকে আমতা আমতা করে চিত্রলেখা বলে,

-তোমাকে বিরক্ত করলাম বুঝি?

-একদমই নয়। কি হয়েছে চিত্রলেখা তোমাকে চিন্তিত শুনাচ্ছে? এনি প্রবলেম?

-না মানে জানতে চাইছিলাম তোমার কি উনার সঙ্গে কথা হয়েছে? না মানে উনি কি গিয়ে পৌঁছেছেন? আমাকে এখনো কিছু জানাননি। হয়ত গিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। ফোন করার সুযোগ পাননি। তোমাকে নিশ্চয়ই জানিয়েছেন কিছু?

-টেনশন হচ্ছে বুঝি হাসবেন্ডের জন্য?

-না না তেমন কিছু না প্লেন করে গেলো তাই একটু…

চিত্রলেখাকে আমতা আমতা করতে শুনে হেসে ফেলে লাবিব। মৃদু হেসে বলে,

-ইটস ওকে চিত্রলেখা। তোমার হাসবেন্ড তুমি টেনশন করতেই পারো। এতে ইতস্ততবোধ করার কিছু নেই। হি ইজ অল ইউর’স।

জড়তাদের হাতে ঠেলে এবারে চিত্রলেখা পরিষ্কার কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-তোমার সঙ্গে কি উনার কথা হয়েছে?

-স্যার তো এখনো গিয়ে পৌঁছেনি।

-এখনো পৌঁছায়নি?

-উঁহু, অলমোস্ট ২০ ঘন্টার ফ্লাইট। ভোরে গিয়ে পৌছাবেন। হোটেলে চেক ইন করতে করতে সকাল হবে।

-ওহ!

-তুমি টেনশন করো না। স্যার পৌঁছে গেলে সবার আগে তোমাকেই ফোন করবেন। উনি জানেন তুমি টেনশন করছো। উনার ফোন কলের অপেক্ষায় আছো।

“আসলেই কি উনি জানেন?” মনে মনে ভাবে চিত্রলেখা মুখের আর প্রশ্নটা করে না। এতক্ষনে খানিকটা ইজি লাগে চিত্রলেখার। ফ্লাই টাইম সম্পর্কে আইডিয়া ছিল না তার। টেনশনে মাথা কাজ করছিল না একবার গুগল করে দেখবে। রওনককে জিজ্ঞেসও করেনি সে কখন গিয়ে পৌছাবে। না জেনেই অহেতুক চিন্তা করছিল। লাবিবকে ফোন করে বিরক্ত করায় নিজেরই খারাপ লাগছে। খানিকটা লজ্জাও লাগছে।

-রাখছি তাহলে।

-চিত্রলেখা শুনো।

-হুম!

-তোমার কিছু লাগলে বা যেকোনো প্রয়োজন আমাকে বলতে পারো। স্যার আমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন তোমার খেয়াল রাখতে। তাই কিছু দরকার হলে আমাকে বলতে লজ্জা করো না কেমন? আমি ২৪ ঘন্টা তোমার সার্ভিসে এভেইলেবল আছি। একটা ফোন করলেই বান্দা হাজির হয়ে যাবে তোমার খেদমতে।

-থ্যাংকিউ।

-ইটস ওকে, ইটস মাই ডিউটি। আলসো রেস্পন্সিব্লিটি এজ এ ফ্রেন্ড। জাস্ট রিমেম্বার আই এম অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ।

মৌন হেসে লাইন কাটে চিত্রলেখা। লাইন কাটার পরেও কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে রয় সে। কখন রওনক ফোন করে জানাবে সে সুস্থ ভাবে পৌঁছে গেছেন। এতটুকু জানার জন্যই অস্থির লাগছে চিত্রলেখার। এর আগে কখনো এরকম লাগেনি তার, কখনো না।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

তিনটা রাত যেন শত শত রাতের সমান। আজ ৩ রাত পরে একত্রে নিজেদের ড্রইং রুমের মেঝেতে আসন পেতে খেতে বসেছে ওরা সবাই। অথচ সবারই মনে হচ্ছে কতশত রাত তারা একত্রে খেতে বসে না। চিত্রলেখা নিজের হাতে ওদের বেড়ে খাওয়ায় না। দুপুরে লিখন বাসায় ছিল না বলে বিরিয়ানি রান্নার প্রস্তুতি নিয়েও সেটা রাতের জন্য রেখে দিয়েছিল। চার ভাইবোনের মধ্যে লিখনটা সবচাইতে বেশি বিরিয়ানি ভক্ত। এই ছেলেকে বছরের ৩৬৫ দিন বিরিয়ানি খেতে দিলেও এর অভক্তি আসবে না। তাই লিখনকে রেখে দুপুরবেলায় বিরিয়ানি রান্না করে খেতে মন সায় দেয়নি চিত্রলেখার। লিখন যখন সমস্তদিনের ব্যস্ততা শেষ করে বাসায় ঢুকে তখন প্রথমেই তার নাকে বিরিয়ানির সুবাস লাগতেই সে সরাসরি রান্নাঘরে গিয়ে চিত্রলেখাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, আলু বেশি করে দিয়েছে কিনা। এই ছেলের সব একদিকে আর বিরিয়ানির আলু আরেকদিকে। বিরিয়ানির আলুকে লিখন যতটা ভালোবাসে ততটা রিপাকে ভালোবাসে কিনা সন্দেহ!

খাওয়া দাওয়ার এক পর্যায় লিখন বলে,

-তুমি যেহেতু কয়দিন আছো এক কাজ করি। সময় করে কাল পরশু বাসা দেখে ফেলি। কি বলো আপা?

লিখনের কথায় প্লেট থেকে মুখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। খালু আলটিমেটাম দিয়েছিল এই মাসেই বাড়ি খালি করে দিতে। একমুহূর্ত লিখনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর চিত্রলেখা পূনরায় নিজের প্লেটে মনোযোগ দিয়ে বলে,

-বাসা দেখার কোনো প্রয়োজন নাই।

-মানে!

অন্য সবার দৃষ্টি এখন খাওয়া রেখে চিত্রলেখার মুখের দিকে। আরেক লোকমা খাবার মুখে পুড়ে দিয়ে মুখ তুলে একবার একে একে সবার মুখ দেখে নিয়ে লিখনের দিকে স্থির হয়ে বলে,

-বাসা ছাড়তে হবে না। তোরা এখানেই থাকবি।

-কীভাবে?

-যেভাবে থাকতেছিস সেভাবে।

-আপা! খালু আমাদেরকে বাড়ি খালি করে দিতে বলছে।

-বলছিল। এখন আর বলবে না। বাড়ি খালি করতে হবে না।

চিত্রলেখার কথার আগামাথা কিছুই ধরতে পারে না কেউ। এদিকে চিত্রলেখা সংশয়ে ভুগছে। সে কি বলবে এই বাড়ির মালিক এখন সে! সবাই কি ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে দেখবে? অফিসের বসকে বিয়ে করে রাতারাতি বাড়ির মালিক হয়ে গেছে সে। নিশ্চয়ই অন্যরা ব্যাপারটা স্বাভাবিক বা সুন্দর চোখে দেখবে না। সবার ভেতর একটা ধারণাই তৈরি হবে। টাকার জন্য বিয়েটা করেছে সে। কিন্তু এটা তো সম্পূর্ণ সত্য নয়। টাকার লোভে সে রওনককে বিয়ে করেনি। টাকা পয়সার কোনো লোভ নেই তার। নিজের জন্য কিচ্ছু চাই না। এটা সত্যি রওনক তাকে কথা দিয়েছে তার ভাইবোনদের সব সবস্বপ্ন পূরন করতে পাশে থাকবে। কিন্তু সেটার মানে কি এই হয় যে টাকার লোভেই বিয়েটা করেছে সে! হয়ত চেতন মনে নয় কিন্তু চিত্রলেখার অবচেতন মন এটা বুঝে গিয়েছিল রওনককে বিয়ে করলে তার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। কারণ পার্থিব জীবনের যেকোনো সমস্যা অর্থের বিনিময়ে সমাধান করা যায়। আর রওনকের সেই ক্ষমতা আছে। সে চাইলে একটা চুটকি বাজিয়ে চিত্রলেখার জীবনের সব সমস্যা সমাধান করে দিতে পারে আর বলা যায় করে দিচ্ছেও। এই যেমন এইবাড়িটাই তো প্রমাণ। রওনক যখন জানতে পারলো চিত্রলেখাদের বাড়ি খালি করার আলটিমেটাম দেয়া হয়েছে সে বাড়িটাই কিনে ফেলেছে তাও চিত্রলেখার নামে। একটা কার্ড ধরিয়েছে দিয়েছে সে চিত্রলেখাকে যার কোনো লিমিট নেই। এমন জীবনের কথা তো চিত্রলেখা তার স্বপ্নেও কখনো ভাবি। অথচ আজ সব সত্যি। সব অসম্ভবকে রওনক ঠিক সত্যি করে দেখাবে তার জীবনে এটা চিত্রলেখা জানে। সে যে জিনিসের যোগ্য নয় রওনক তাকে তার যোগ্যতার চাইতে বেশি দিয়েছে, দিচ্ছে হয়ত ভবিষ্যতেও দিবে। অন্তত ততদিন যতদিন তারা একত্রে আছে।

-আপা!

-হু?

-তুমি কি কিছু লুকাইতেছো?

চিত্রলেখার মন একবার বলে সব বলে দিবে আবার মনে হয় এইমুহূর্তে কিছু বলা হয়ত ঠিক হবে না। তাই আপাতত কিছুদিন বিষয়টা চেপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মনে মনে।

-খালুর সাথে কথা হইছে আমার। আমি রিকুয়েস্ট করে বলছি আমাদের একবছর সময় দিতে৷ একবছর পর বাড়ি খালি করে দিবো।

-আর খালু মেনে নিলো তোমার কথা?

-হ্যাঁ।

এবারে লিখনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নারগিস বেগম বলেন,

-সে তো বাড়িটা বিক্রি করতে চাইছিল। তার টাকা দরকার। তাইলে তোর কথা এমনি এমনি মেনে নিলো?

-এমনি এমনি মানে নাই। আমি বলছি অন্য কোথাও থাকলে তো ভাড়া দিয়েই থাকা লাগবে। আমি নাহয় ভাড়া বাবদ যে টাকাটা আসে সেটা প্রতিমাসে দিয়ে দিবো। তারপর একবছর পরে বাড়ি খালি করে দিবো। এই কথা শুনে পরে রাজি হইছে।

লিখন আরও কিছু বলার জন্য মুখ খুললেও বলতে পারে না। তার আগে চিত্রলেখা বলে,

-এত কথার কি আছে আমি বুঝতেছি না। অন্য কোথাও থাকলে তো ভাড়া দিয়েই থাকা লাগবে। এখানে থাকলে সমস্যা কই? ভাড়া দিয়েই থাকবি তোরা। এখানে সবাই পরিচিত। তোরা দুইজন নিজ নিজ লেখাপড়া নিয়ে সারাদিন বাসার বাইরে থাকিস। বাসায় থাকে এক খালা আর চারু। দুইজন মেয়ে মানুষ পরিচিত জায়গায় থাকাই তো ভালো তাই না? আশেপাশের সবাই পরিচিত। যেকোনো দরকারে বা বিপদে আগায় আসবে। এত কথার কিছু নাই। আমি খালুর সাথে কথা বলে সমস্যা সমাধান করে ফেলছি। আর ভাড়ার টাকা নিয়ে কাউকে চিন্তা করা লাগবে না। ওটা আমি বুঝবো।

-কেমনে বুঝবা তুমি? তুমি তো এখন আর চাকরী করতেছো না।

-আমি কখনো বললাম চাকরী ছেড়ে দিছি? ছুটিতে আছি, চাকরী ছাড়িনি।

উপস্থিত কেউ আর কোনো কথা বলে না। যদিও লিখনের কাছে জিজ্ঞেস করার মতো অনেক প্রশ্নই ছিল কিন্তু এইমুহূর্তে আর এসব কথা তুলে না সে। নারগিস বেগমও বাচ্চাদের সামনে আর কিছু বলেন না।

লাবিবের কাছ থেকে জানার পরেও ভালো লাগছে না চিত্রলেখার। যদিও এখন সে জানে রওনক এখনো বিমানে আছে। তবুও মনের ভেতর সামান্য অস্থিরতা কাজ করছে। মানুষটা সুস্থ মতো পৌছে গেছে জানতে পারলেই আর কোনো চিন্তা থাকবে না তার। বিছানায় কার্নিশ ঘেষে পিঠে বালিশ দিয়ে বসেছে চিত্রলেখা। তার হাতে উপন্যাসের বই। রওনকের ভাবনায় উপন্যাসে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারছে না সে, তবুও চেষ্টা করছে মনোনিবেশ করার। চারু বড়বোনের কোল ঘেষে শুয়ে বইয়ে মুখ গুঁজে রেখেছে।

-আপা!

আচমকা চয়নের ডাকে দুই বোনই বই থেকে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকায়।

-খালা তোমাকে ডাকে।

-আচ্ছা।

বইটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে। চিত্রলেখা চারুকে বলে,

-তুই পড়তে থাক আমি আসতেছি।

খালার ঘরে এসে চিত্রলেখা দেখে নারগিস বেগম বিছানায় বসে আছেন। এগিয়ে এসে খালার মুখোমুখি বসে সে। খালা কিছু বলার আগে নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-আমাকে ডাকলা কিছু বলবা?

-দরজাটা আটকে দিয়ে আয়।

চিত্রলেখা তৎক্ষনাৎ কিছু বলে না। খালার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে গিয়ে দরজার ছিটকিনি আটকে দিয়ে ফিরে এসে পূর্বের জায়গায় বসে। নারগিস বেগমের চোখ-মুখে সিরিয়াসনেস। এবারে তিনি নিজেই জিজ্ঞেস করেন,

-সত্যিটা কি চিত্রলেখা?

-কোন সত্যি খালা?

-মানুষটার সঙ্গে এত বছর সংসার করলাম। উনাকে আমার চাইতে ভালো কেউ চিনে না। সামান্য কয়টা ভাড়ার টাকার জন্য উনি রাজি হবেন না। একবছরের ভাড়ার টাকায় যা পাবেন তার চাইতে ডের বেশি একমুঠে পাবেন বাড়িটা বিক্রি করে দিলে। বাহানা করে ভাইবোনদের বোকা বানাতে পারলেও আমারে তুই বোকা বানাইতে পারবি না। আমি তোকে পেটে ধরিনি, তোর মাও না খালা হই। কিন্তু খালা তো মায়ের মতোই তাই না? আমিও তোদেরকে নিজের সন্তানই ভাবি। কি লুকাইতেছিস তুই?

একনাগাড়ে কথা বলে থামেন নারগিস বেগম। জবাবের জন্য চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। চিত্রলেখা নিজেও জানতো। বাহানা করে ভাইবোনদের থেকে সত্য গোপন করতে পারলেও খালার চোখে সে ধুলা দিতে পারবে না। এই মানুষটা ঠিকই আন্দাজ করে ফেলবে। চিত্রলেখা আর চেষ্টাও করে না কিছু গোপন করার। আপাতত সবাইকে না হোক অন্তত খালাকে সত্যিটা তার জানানো দরকার। ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চিত্রলেখা বলে,

-খালু বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে খালা।

-তাহলে আমরা এখনো এই বাড়িতে কেন?

-এই বাড়িটা এখন… আমার নামে।

তৎক্ষনাৎ কথা বলেন না নারগিস বেগম। চিত্রলেখা নিজেই বলে,

-উনি বাড়িটা আমার নামে কিনে নিয়েছেন খালুর থেকে।

উনি বলতে চিত্রলেখা কার কথা বুঝিয়েছে তা বুঝতে সময় লাগেনি নারগিস বেগমের। খালার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চিত্রলেখা আরও বলে,

-আমি উনাকে বলিনি বাড়ি কিনতে। উনি নিজে থেকেই করেছেন কাজটা আমাকে কিছু না জানিয়েই। এক্ষুনি লিখনদের কিছু বইলো না খালা। আমি নিজেও এখনো ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিতে পারি নাই। ওরাও নিতে পারবে না। আগে আমাকে একটু সহজ হইতে সময় দাও। তারপর নাহয় ওদের বলবো। ততদিন কথাটা নিজের মধ্যেই রাখো প্লিজ!

সম্মতিতে মাথা ঝাকান নারগিস বেগম। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করেন,

-তুই ঐ বাড়িতে ভালো আছিস তো?

খালার প্রশ্নে তার মুখের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। অভ্যন্তরীণ কিছু কি টের পেয়ে গেছেন তিনি? কিন্তু সে তো কাউকে কিছু জানায়নি। এমনকি আফিফাকেও নয়। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-আমি ভালো আছি।

-সত্যি ভালো আছিস?

-এভাবে বলতেছো কেন?

-মায়ের মন তো সন্তানের জন্য সবসময় কেমন কেমন করে তাই জিজ্ঞেস করতেছি।

-তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি ভালো আছি। সত্যি, ভালো আছি খালা।

-ঐ পরিবারের সবাই তোকে মেনে নিছে তো?

সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয় না চিত্রলেখা। খালার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চিন্তাটা হয়ত আন্দাজ করতে পারছে তাই খালাকে আশ্বস্ত করে বলে,

-আমার হঠাৎ বিয়ে করাটা তোমাদের জন্য যেমন অবিশ্বাস্য ছিল, ঐ বাড়িতেও একই ঘটনা। সবার স্বাভাবিক হইতে কিছুটা সময় দরকার খালা। এছাড়া সত্যি আমি ভালো আছি এই তোমাকে ছুঁয়ে বলতেছি। উনি আমার অনেক খেয়াল রাখেন। এতখানি যতখানির হয়ত আমি যোগ্যও না।

ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়েন নারগিস বেগম। এই নিঃশ্বাসের কারণ কি ধরতে পারে না চিত্রলেখা। তবে আন্দাজ করে তার দুশ্চিন্তায় হয়তো। এই প্রসঙ্গে খালা ভাগ্নির দুজনের একজনও আর কথা বাড়ায় না।

সারারাত ঘুম হয়নি চিত্রলেখার। জোর করে ঘুমানের চেষ্টাও করেনি সে। বই পড়েই রাত পাড় করেছে। ফজরের আজান দেয়ায় বই রেখে উঠেছে সে। ফজরের নামাজ পড়ে বিছানায় ফিরে এসে আবারও বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজেছে অনেকক্ষণ হয়। ভোরে আলো ফুটতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। মোবাইল ফোনটা পেটের উপরেই রাখা। যদিও ফোন হাতের কাছে রাখার অভ্যাস নেই তার তবুও আজ ফোনটাকে দৃষ্টির আড়াল করছে না। আচমকা মেসেজ টিউনের শব্দ কানে আসতেই ফোন হাতে নিয়ে উঠে বসে। চিত্রলেখা এর আগে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করতো না। সে বলতেও পারবে না রওনক কখন তার ফোনো হোয়াটসঅ্যাপ ইন্সটল করে দিয়েছে। এবাড়ি বসার পর খেয়াল করেছে। মেসেজটা হোয়াটসঅ্যাপেই এসেছে। নোটিফিকেশন পেয়ে তৎক্ষনাৎ হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে সে। একটা ফরেন নম্বর। ইনবক্সে ঢুকতেই দেখে লেখা,

❝মাত্র পৌঁছালাম। একটা ডিনার মিটিং আছে, ওটা শেষ করে হোটেলে গিয়ে তোমায় ফোন করব। ততক্ষণ একটু শান্তি করে ঘুমিয়ে নাও। সারারাত অনেক টেনশন করেছো বরের জন্য। এখন রেস্ট করো। জলদিই আমাদের কথা হবে বউ।❞

রওনকের মেসেজটা পড়তেই চিত্রলেখার চোয়াল জুড়ে হাসি ফুটে ওঠে। কাছে না থেকে মানুষটা বলতে পারে কেউ তার জন্য ভাবছে। লাবিব ঠিকই বলেছিল সে পৌঁছেই তাকে জানাবে। তাহলে কি সত্যি সত্যি চিত্রলেখা, রওনক জামানের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কেউ?

রওনকের মেসেজের বিপরীতে কিছু একটা লেখা উচিত তার। কিন্তু কি লিখবে সে? চিন্তা ভাবনা করে রিপ্লাইতে চিত্রলেখা লিখে দেয়,

❝নিজের খেয়াল রাখবেন। আমি কলের অপেক্ষায় থাকবো।❞

আর অপেক্ষা না করে ফোনটা মাথার কাছে নামিয়ে রেখে বইটাও অন্যপাশে রাখে। এতক্ষণে চোখ ভার হয়ে ঘুম আসছে তার। দুশ্চিন্তা কেটে গেছে। এখন আর কোনো চিন্তা নেই তার, রওনক ভালোয় ভালোয় পৌঁছে গেছে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

এক সপ্তাহ ওবাড়ি থেকে এইবাড়ি ফিরে এসেছে চিত্রলেখা। সাত দিনের দিন রওনক জানিয়েছিল খুব সম্ভবত ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে সে। তাই এবাড়ি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চিত্রলেখা। যদিও সে চাইলেই রওনক ফিরে আসার দিন পর্যন্ত ওবাড়িতে থাকতে পারতো কিন্তু ইচ্ছা করেই থাকেনি। দুটোদিনই তো দেখতে দেখতেই চলে যাবে। কিন্তু ১০ দিন অতিবাহিত হয়ে যাবার পরেও সে ফিরে আসেনি। বরং মেক্সিকোর কাজ শেষ করে তাকে সিঙ্গাপুর যেতে হয়েছে। মেক্সিকো থাকা অবস্থায় সারাদিনে ফোন কল না হলেও অন্তত একটা এসএমএস পাঠিয়েছে রওনক তাকে কিন্তু সিঙ্গাপুর যাবার পর থেকে একটা কল তো দূরের কথা এসএমএসও পায়নি সে। এমনকি রওনক যেদিন সিঙ্গাপুর গিয়েছে। যাবার পরেও চিত্রলেখাকে কিছু জানায়নি। পৌঁছেছে কিনা সেই খবরটাও না। পরবর্তীতে লাবিবের মাধ্যমে জানতে পেরেছিল রওনক ঠিকঠাক পৌঁছে গেছে। কাজে ব্যস্ত আছে তাই যোগাযোগ করার সময় পাচ্ছে না। প্রথমে বুঝলেও যত দিন ঘনিয়েছে অজানা এক অভিমান চিত্রলেখার বুকের ভেতর বাসা বেঁধেছে। এত কিসের ব্যস্ততা একটা মানুষের? সে নিশ্চয়ই খাওয়া, ঘুম, গোসল, বাথরুম বাদ দিয়ে দেয়নি। এত কিছুর মধ্যে কি অন্তত ১ মিনিটের জন্য একটা কল দেয়া যায় না? খুব বেশি কিছু কি আশা করে ফেলছে সে? হয়ত। হয়ত খুব বেশিই আশা করে ফেলছে। এতখানি আশা করা তার উচিত হচ্ছে না। বিয়েটা সত্যি হলেও কিছু শর্তের ভিত্তিতে হয়েছে। এসব ভুলে গেলে তার চলবে না। যতদিন গড়িয়েছে দিনকে দিন মন মরা হয়ে যাচ্ছে সে। যতবার সুযোগ পায় হোয়াটসঅ্যাপ চেক করে রওনক ফোন করল কিনা বা একটা এসএমএস। খুব বেশি না অন্তত এতটুকু লিখে পাঠাক সে ভালো আছে। কিন্তু এতটুকুও সে পায় না। প্রতিদিনই একরাশ নিরাশা নিয়ে ঘুমাতে যায় সে একলাই। মধ্যে রাত পর্যন্ত বিছানায় গড়াগড়ি করে হঠাৎ কখন ঘুমায় নিজেও টের পায় না। কতদিন ভেবেছে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে রওনক তার পাশে শুয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই আশায় প্রতিদিনই সকাল হয় তার কিন্তু রওনক আর ফিরে না। এভাবেই এক একটা দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। আজ ২৫ দিন হয় এখনো ফিরে আসেনি রওনক। এমনকি একটা কলও আসে না। একদিকে অভিমানের পাহাড় জমেছে তার বুকে। অন্যদিকে ভয়ও লাগে মানুষটা ঠিক আছে তো! সুস্থ আছো তো! তার ফিরতে আরও দেরি হলেও সমস্যা নেই চিত্রলেখার। সে শুধু একবার নিজের কানে মানুষটার কন্ঠ শুনতে চায়। জানতে চায় সে কেমন আছে। নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রওনকের কথা ভাবতে ব্যস্ত চিত্রলেখা। শীত বেড়েছে। শৈত্যপ্রবাহ চলছে। বৈরি হাওয়া তাকে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। গায়ে কোনো গরম কাপড় জড়ায়নি সে। সুতির একটা থ্রি-পিস তার পরণে। গেল বছরের চাইতে এবছর বেশি শীত পরেছে। ঠান্ডায় তার হাড় কাপা শুরু করলেও চিত্রলেখার ইচ্ছা করছে না ভেতরে ফিরে যেতে বা গিয়ে গরম কাপড় নিয়ে আসতে। ঠান্ডা থেকে আশ্রয় নিতে নিজেকেই দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছে সে। কিন্তু এতে কি আর ঠান্ডা মানে? চিত্রলেখা যখন উদাস মনে তার ব্যাক্তিগত পুরুষের অনুপস্থিতিতে বিরহে বিভোর ঠিক সেই মুহূর্তে একজোড়া হাত তাকে চমকে দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। পুরুষালী হাত জোড়া খুব শক্ত করে পেটের কাছে জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়েছে। ভয়ে চিত্রলেখার কলিজার পানি শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও তৎক্ষনাৎই সামলে যায় সে। যখনই বুঝতে পারে তার সকল অপেক্ষাদের অবসান হয়েছে, নিজেকে ছেড়ে দেয় তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাখা মানুষটার উপর। আশ্রয় খুঁজে তার বুকে। এই মানুষটার একটু উষ্ণতা পাবার অপেক্ষাতেই তো ছিল সে এতগুলো দিন। অতঃপর এতসব দিনরাত পেরিয়ে চিত্রলেখাদের অপেক্ষাদের ছুটি মিললো। তবুও সে এখনো অভিমানে অটল। বিশাল অভিমানের এক পাহাড় জমেছে তার হৃদয়ে। তাই কথা বলছে না সে। পেছন ঘুরে তাকাবেও না। বেশ কিছুক্ষণ চিত্রলেখাকে নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখার পর রওনক বলে,

-আবার তুমি গরম কাপড় ছাড়া এভাবে ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে আছো?

একদম রা করে না চিত্রলেখা। এতক্ষণ মনে হয়েছে সে হয়ত স্বপ্ন দেখছে কিন্তু রওনকের কন্ঠ কানে আসতেই টের পায় সে স্বপ্ন দেখছে না। সত্যি সত্যিই কাঙ্ক্ষিত মানুষটার বাহুতে আছে সে। এই মানুষটার আলিঙ্গনে নিজেকে সপে দিতেই তো তার এত অপেক্ষা। এই মুহূর্তটাকে ধরে রাখতেই যেন চোখ বন্ধ করে নেয় সে। চিত্রলেখা কোনো জবাব না দেয়ায় রওনক নিজেই বলে,

-বউ! কথা বলবে না আমার সাথে?

এবারেও জবাব দেয় না সে। আরও কিছুক্ষণ চিত্রলেখাকে নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখার পর তাকে নিজের দিকে ঘুরায়। তৎক্ষনাৎই দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে ফেলে চিত্রলেখা। তার চোখের ঐ অপেক্ষা রওনককে দেখাতে লজ্জা করছে। প্রথমে কিছুক্ষণ কোমড় জড়িয়ে থাকার পর একটা হাত আলগা করে চিত্রলেখার চিবুকের নিচে রেখে মুখটা উপরের দিকে তুলে ধরে। আঙ্গুলের উপর চিবুক রেখেই চিত্রলেখার বন্ধ চোখের পাতায় চুমু খায় রওনক। দু’চোখের পাতায় ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়ার পর আলতো ভাবে ছোট্ট করে ঠান্ডায় মৃদু কাঁপতে থাকা চিত্রলেখার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় সে। কিন্তু তবুও চোখ মেলে তাকায় না চিত্রলেখা। এখনো রওনককে দেখেনি সে। দেখার সাহস হচ্ছে না তার। যদি সে চোখ মেলতেই দেখে সব স্বপ্ন। আদৌতে রওনক ফিরে আসেনি। এই জড়িয়ে ধরা, ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়া, উষ্ণতার সবটাই যদি তার স্বপ্ন হয়? আপাতত এই স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে চায় না সে। হোক স্বপ্ন বা নিজের কল্পনায় তবু আরও কিছুক্ষণ এই মানুষটার আলিঙ্গনে থাকতে চায় সে। আরও কিছুক্ষণ এই উষ্ণতায় নিজেকে মাতিয়ে রাখতে চায়। চিত্রলেখাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে আসে রওনক। এতেও কোনো নড়চড় নেই চিত্রলেখার। তাকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের গায়ে থাকা ব্লেজার কোর্টটা খুলে পাশেই ফেলে দেয় সে। চিত্রলেখার পাশে বসে আবারও জিজ্ঞেস করে,

-চোখ খুলবে না তুমি? দেখবে না আমায়?

এবারে জবাব না দিলেও মৃদু ভাবে মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। আচমকাই মৃদু ধাক্কায় তাকে পেছন দিকে বিছানায় ফেলে দিয়ে রওনক নিজে কাছাকাছি চলে আসে। একদম কাছাকাছি। এতখানি কাছাকাছি যে দু’জনের নিঃশ্বাস এক হতে কেবল মুহূর্তের অপেক্ষা। এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার গালে নাক ঘষে দেয় সে। এতেই যে চিত্রলেখার নিজেকে মাতাল লাগে। অসহ্য ভালো লাগায় ভেতরটা ছেঁয়ে যেতে থাকে তার। এই স্পর্শের জন্যই তো ম রে যাচ্ছিল সে। এই মানুষটার নিঃশ্বাসের অভাবেই তো নিজেকে ফাঁকা লাগছিল তার। চিত্রলেখার গাল, চোয়াল জুড়ে নাক ঘষে কানের কাছে গিয়ে নিচু ও ধরা কন্ঠে রওনক অনুরোধের সুরে বলে,

-প্লিজ চন্দ্র চোখ খোলো। তাকাও আমার দিকে একবার। দেখো আমি ফিরে এসেছি।

এবাবেও মাথা ঝাকায় সে।

-প্লিজ!

চিত্রলেখার মৌনতাদের সঙ্গ দিয়ে তার বন্ধ চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রুর উপস্থিতি দেখা যায়। প্রিয়তমার গালে চোখের পানির অস্তিত্বের উপস্থিত রওনককে আরও বিচলিত করে তোলে। ঠোঁট দিয়ে সেই অশ্রু শুষে নেয় সে গড়িয়ে পড়ার আগে। চিত্রলেখার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে রেখেই রওনক বলে,

-প্লিজ চন্দ্র দেখো আমায়।

বেশ কিছুক্ষণ চিত্রলেখার দেহের কাছাকাছি থেকে উঠে আসে রওনক। হাত ধরে চিত্রলেখাকেও তুলে বসায়। নিজের দু’হাতে চিত্রলেখার হাত নিয়ে বলে,

-একবার চোখ খুলে দেখো আমি এখানেই আছি। সত্যি সত্যি ফিরে এসেছি। তুমি কোনো স্বপ্ন দেখছো না। চোখ মেললেই আমি হারিয়ে যাবো না।

রওনকের কথা শেষ হতে না হতেই চোখ মেলে তাকায় চিত্রলেখা। তার মনের সংশয় কীভাবে বুঝে মানুষটা! চোখ মেলতেই চিত্রলেখা দেখে সত্যি সত্যি তার সামনে মানুষটা হাটুর উপর বসে আছে। চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখেই তার হাতের পাতায় চুমু খায় রওনক। হাত দু’টো এখনো ঠান্ডা হয়ে আছে তার। এক-এক করে দু’হাতের পাতাই ঘষে দেয় সে গরম করার প্রচেষ্টায়। সেখানেই থেমে থাকে না সে। চিত্রলেখার পায়ের পাতা নিজের হাতে তুলে নিলে তৎক্ষনাৎ তড়িৎ গতিতে পা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেও লাভ হয় না। রওনক তার শক্ত হাতে ধরে রেখেছে সেখান থেকে ছোটার উপায় নেই। বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে রওনক বলে,

-প্লিজ পায়ে হাত দিবেন না।

চিত্রলেখার ঠান্ডা হয়ে যাওয়া পা গরম করার জন্য আলতো ভাবে ঘষে দিতে থেকেই রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কেনো?

-প্লিজ আপনি পায়ে হাত দিয়েন না।

-আমি পায়ে হাত দিলে কি হবে?

-জানি না। প্লিজ ছেড়ে দিন।

বাম পা টা ছেড়ে দিয়ে ডান পায়ের পাতা নিজের হাতে তুলে নিয়ে আলতোভাবে ঘষতে থেকেই চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখে রওনক বলে,

-স্বামী স্ত্রীর পায়ে হাত দিলে পাপ হয় এসব সিনেমার ডায়লগ একদম দিবে না বলে দিচ্ছি। তুমি আপাদমস্তক আমার। তাই তোমার গাল ছুঁয়ে দিলে যেমন আমার পাপ হবে না তেমনি পা ছুলেও পাপ হবে না।

চিত্রলেখাকে আরও চমকে দিয়ে তার পায়ের পাতায় আলতো ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় রওনক। ব্যস, এতেই চিত্রলেখা গলে পানি হয়ে গেছে। জ্বলন্ত মোমের মতো গলতে শুরু করেছে সে। নিজ দেহে আর বল পাচ্ছে না সে। রওনক এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার মুখটা দুই হাতের আঁজলায় নিয়ে একদম কাছাকাছি গিয়ে থামে। তার নিঃশ্বাস চিত্রলেখার ঠোঁটের উপর আছড়ে পড়ছে এতেই যেনো কেঁপে সারা হচ্ছে সে। ঠোঁট ছুঁই ছুঁই অবস্থাতেই রওনক চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখে বলে,

-সরি বউ…

আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না চিত্রলেখা রওনককে। আচমকা কি হলো তার! এগিয়ে গিয়ে রওনকের ঠোঁট জোড়ার দখল নেয় সে। একমুহূর্ত সময় বিলম্ব না করে রওনক নিজেও তাল দেয় চিত্রলেখার ঠোঁটের ডেউয়ে। লম্বা সময় তারা একে-অপরের ঠোঁটের মায়ায় আটকে থাকার পর নিঃশ্বাস ভার হয়ে আসলে অক্সিজেন টানতেই যেন সামান্য বিরতি নেয়। তবুও কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না। চিত্রলেখাের কপালে কপাল ঠেকিয়ে বড় বড় করে নিঃশ্বাস টানে দু’জনেই। দু’জনের দৃষ্টিই একে-অপরে সীমাবদ্ধ।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৬৪

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৪
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনককে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিতে তার সঙ্গে চিত্রলেখা এসেছে। কেনো তার সঙ্গে আসতে মন চেয়েছে তার চিত্রলেখা নিজেও জানে না। হয়ত আরও কিচ্ছুক্ষন রওনকে সঙ্গ পাওয়ার লোভেই এসেছে। এয়ারপোর্ট আসার আগে মায়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছে রওনক। কোথাও যাবার আগে সবসময় মায়ের দোয়া নিয়েই বের হয় সে। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এমনিতে শক্ত একরোখা হলেও রওনক ভীষণ রকম ফ্যামিলি ম্যান। তিলত্তমা চলে যাবার পর ব্যবসাটাই রওনকের জীবনে সব হয়ে গেছে তবুও সে পরিবারকে কোনো সাইড করেনি। নিজের পরিবারের দিকেও সবসময় তার সতর্ক দৃষ্টি থেকেছে। মুখে না বললেও রওনক তার পরিবারকে অনেক ভালোবাসে। এয়ারপোর্ট টার্মিনাল টু এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারা একে-অপরের মুখোমুখি। চিত্রলেখার নার্ভাস লাগছে। বিদায় বেলায় কি বলতে হয় তার জানা নেই। জানা থাকবে কীভাবে এভাবে কখনো কাউকে বিদায় দেয়া হয়নি তার। লাবিব সঙ্গে এসেছে। সবসময় সেই আসে, কখনো কখনো সঙ্গেও যায়। তবে এবার রওনক একা যাচ্ছে। এদিকেও কিছু কাজ আছে যেগুলো রওনকের অবর্তমানে লাবিব ও তানিয়াকে সামলাতে হবে। তানিয়া একা পারবে না ভেবেই লাবিবকে রেখে যাওয়া। আবার চিত্রলেখাও আছে। যদি কোনো ইমার্জেন্সি হয় এসব অনেককিছু ভেবেই লাবিবকে এবার রেখে যাচ্ছে সে। লাবিব গাড়ি থেকে রওনকের ব্যাগ ট্রলিতে তুলতে ব্যস্ত। দিকের অন্য সময়ের চাইলে এইসময় এয়ারপোর্টে মানুষ একটু কম বলা যায় তবে একদম ফাঁকাও নয়। রওনক এতক্ষন তার ট্যাবে কিছু একটা করছিল। ট্যাবের কাজ শেষ করে সেটা গাড়ির পেছনের ছিটে রেখে দরজা আটকে দেয়। রওনা থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি চিত্রলেখা। কি বলবে সেটা বুঝতে পারছে না বলেই তার চুপ করে থাকা। এবারে রওনক এগিয়ে এসে চিত্রলেখার দুই হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। চিত্রলেখা প্রথমে হাতের দিকে তাকায় তারপর মুখ তুলে রওনকের মুখের দিকে তাকায়। আচমকাই ধক করে ওঠে তার বুকের ভেতর। এই মানুষটাকে আগামী বেশ কিছুদিন দেখতে পারবে না সে। ভাবনাটা হিট করে চিত্রলেখাকে বুকের গভীরে কোথাও। কিছু বলার তাগাদা অনুভব করে চিত্রলেখা। কিন্তু বলবে সে? সাবধানে থাকবেন, রওনক তো বাচ্চা নয় যে সাবধানে না থাকলে হারিয়ে যাবে। ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করবেন, সময় মতো ঘুমাবেন, মন দিয়ে কাজ করবেন, এসব কি আসলেই বলতে হবে? একটা প্রশ্নও যুত সই লাগে না চিত্রলেখার কাছে। এসব বললে নিশ্চয়ই রওনক হাসবে তার উপর। কাজের জন্য যাচ্ছে অবশ্যই মন দিয়েই কাজ করবে সে। নিজের বোকা বোকা চিন্তার উপর নিজেরই বিরক্ত লাগে। তাই কিছু না বলে চুপ করে থাকাই শ্রেয় ধরে নেয়। রওনক নিজেই বলুক যা বলার। তাদের দু’জনের মাঝে সামন্য দূরত্ব আছে। এক কদম এগিয়ে এসে সেই দূরত্ব ঘুচে দেয়ার চেষ্টা করে রওনক। যদিও তাদের শরীর পুরোপুরি স্পর্শ করে না। ইদানিং যথেষ্ট ঠান্ড পড়ে গেছে। চিত্রলেখার গায়ে একটা মোটা কাশ্মিরি শাল জড়ানো। শাড়ি পড়েছে সে। রওনকের আগের দিন নিয়ে আসা শাড়িগুলো থেকে হালকা গোলাপী রঙের প্রিন্টের শাড়ি। চিত্রলেখাকে চেঞ্জিং রুম থেকে শাড়িতে বের হতে দেখে রওনকের ইচ্ছা হয়েছিল সে এই ফ্লাইটটা ক্যান্সেল করে দেয়। কিন্তু করেনি, নিজেকে সামলে রেখেছে। নিজেদের কাছা আসার মূহুর্তটাকে তাড়াহুড়ো করে নষ্ট করতে চায় না সে। সময় নিয়ে চিত্রলেখাকে আদর দিতে চায় সে। সময় নিয়ে চিত্রলেখার জড়তা ভাঙতে চায়। সময় নিয়ে নিজেকে চিত্রলেখার কাছে হস্তান্তর করতে চায় সে। তাড়াহুড়ো করে নিজের জীবনের সবচাইতে বিশেষ মুহুর্তটা নষ্ট করতে চায় না সে। তাই কষ্ট হলেও নিজেকে সামলে রেখেছে।

চিত্রলেখার কপালের কাছে লেপ্টে থাকা চুল আঙ্গুলের স্পর্শে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলে,

-নিজের খেয়াল রেখো। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো। কোনো টেনশন করো না। কিছু প্রয়োজন হলে লাবিবকে বলো। ভাবীকেও বলতে পারো। খুব বেশি বোর লাগলে অফিসে যেতে পারো। আমাকে যখন ইচ্ছা হয় তখন কল দিও। কাছে না থাকলেও আমি চব্বিশ ঘন্টা তোমার জন্য ফোনে এভেইলেবল আছি, ঠিক আছে?

মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। একমুহূর্তের জন্য রওনকের চোখ থেকে চোখ সরায়নি সে। নিজের ভেতরের সংকোচকে সাইডে রেখে বলে,

-নিজের খেয়াল রাখবেন আর…

-আর!

-আমি অপেক্ষায় থাকবো।

রওনকের হাতে বাঁধন শক্ত হয়। সে বলে,

-সম্ভব হলে কালই ফিরে আসবো।

-না না তাড়াহুড়ো করতে হবে না। আপনি কাজ শেষ করেই আসবেন।

চিত্রলেখার রিয়্যাকশনে হাসি পায় রওনকের। তার আবার সময় ঘনিয়ে এসেছে বুঝতে পেরে এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার কপালে চুমু খায় রওনক। তা দেখে চোখ বড় করে তাকায় চিত্রলেখা। একবার আশেপাশে তাকায় সে। রওনক বলে,

-ইটস ওকে, আমাদের কেউ দেখছে না। আর দেখলেও তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।

বিদায় নেয়ার আগে চিত্রলেখাকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরে রওনক। লজ্জা লাগলেও ভালো লাগে চিত্রলেখার। রওনকের প্রতিটা স্পর্শ মনের ভেতর আনন্দের দোলা দিয়ে যায়। এই ভালো লাগার সঙ্গে কিছুদিন আগেও পরিচয় ছিল না তার। কিন্তু এখন সে বুঝে। এই ভালো লাগা কেবল মাত্র রওনক কেন্দ্রিক। একমাত্র রওনকের উপস্থিতি, তার স্পর্শই চিত্রলেখার মনের ভেতর এই আনন্দের ঢেউ তুলতে সক্ষম। রওনক ভেতরে চলে যাবার পরেও চিত্রলেখা কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। আচমকাই বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগে তার। মনে হয় কি যেনো একটা নেই। শূন্যতা গ্রাস করে তাকে। চিত্রলেখা টেরও পায় না তার চোখ ভার হয়। টুপ করে ডান গাল বেয়ে এক ফোঁটা পানি বেয়ে পড়ে। লাবিব দেখে ফেলার আগেই হাত বাড়িয়ে গালের পানি মুছে ফেলে এসে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাবিব সামান্য কেশে নিজের উপস্থিতি জানায়। চিত্রলেখার দৃষ্টি এখনো ঐদিকেই। আরও বেশ কিছুদিন ওদিকে তাকিয়ে থাকার পর লাবিবের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে,

-উনি কবে ফিরবেন?

স্মিত হেসে লাবিব বলে,

-কিছু বলেনি তোমাকে?

-বলেছেন, এক সপ্তাহ বা ১০ দিন লাগবে।

-হুম, ঐ রকমই।

-ওহ!

বলেই আবার ট্রার্মিনালের গেইটের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। যদিও রওনককে দেখতে পাবে না তবুও তার দৃষ্টি ওদিকেই যায় যেদিক দিয়ে কিচ্ছুক্ষন আগে রওনক গিয়েছে।

-চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।

লাবিবের দিকে তাকিয়ে সম্মতিতে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা।

খুব বেশি নয় মাত্র দু’দিন পর বাড়ি এসেছে চিত্রলেখা। অথচ মনে হচ্ছে কতদিন পর আপন ঠিকানায় ফিরছে সে। চিরচেনা সেই নীল লোহার গেটের কাছে এসে গাড়িটা থামলে চিত্রলেখা নেমে যাবার আগে লাবিব বলে,

-কিছু প্রয়োজন হলে আমায় বলো। যত রাতই হোক আমাকে একটা ফোন দিলেই হবে। ড্রাইভারের নম্বর ম্যাসেজ করে দিবো। কোথাও গেলে ড্রাইভার নিয়ে যাবে। স্যার বলে দিয়েছে এই গাড়িটা তুমি ব্যবসার করবে। আগামীকাল ১১ টার দিকে তৈরি থেকো তোমার পাসপোর্ট বানাতে দিতে যাবো।

-আর কিছু?

স্মিত হেসে লাবিব বলে,

-আপাতত আর কিছু না।

চিত্রলেখা গাড়ির পেছনের সিট থেকে নামলে তার সঙ্গে সামনের সিট থেকে লাবিবও নেমে আসে। গাড়ির ডিকি খুলে কিছু ফলের প্যাকেট বের করে নেয়। এসব দেখে চিত্রলেখা অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-এগুলো কখন কেনা হলো?

-তুমি আজ বাড়ি আসবে তাই স্যার আমাকে আগেই বলে দিয়েছিল ব্যবস্থা করে রাখতে।

-কিন্তু এসবের তো কোনো প্রয়োজন ছিল না।

-তোমার দিক থেকে হয়ত প্রয়োজন নেই তবে স্যারের দিক থেকে প্রয়োজন আছে। তার বউ বাপের বাড়ি আসবে তাও খালি হাতে, অসম্ভব।

চিত্রলেখা নীল গেইটের দিকে আগালে পেছন থেকে লাবিব বলে,

-একটা প্রশ্ন ছিল আমার।

পেছন ঘুরে চিত্রলেখা বলে,

-কি?

-আমার কি তোমাকে আপনি করে বলা উচিত?

-একদমই না। আমরা আগে যেমন ছিলাম এখনো তেমনই আছি, তেমনই থাকবো।

-কিচ্ছু আগের মতো নেই চিত্রলেখা। তুমি এখন আমার বসে ওয়াইফ।

-তবুও আমি চাই আমাদের বন্ধুত্বটা আগের মতো থাকুক। প্রয়োজনে উনার সঙ্গে আমি কথা বলে নিবো নাহ হয়? ততদিন আমরা আগের মতোই থাকি।

এই প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ায় না লাবিব। সম্মতিতে মাথা ঝাঁকায়। তারপর দু’জনে বাড়ির ভেতর অগ্রসর হয়। আচমকা চিত্রলেখাকে দেখে সবাই যেমন অবাক হয়েছে তেমন খুশিও হয়েছে। বাড়িটা যেনো জান ফিরে পেছে। চিত্রলেখার অবর্তমানে দু’দিনেই বাড়িটা নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছিল। সেই বাড়ি আবার তার চাঞ্চল্যতা ফিরে পেয়েছে। লম্বা সময় চারু চিত্রলেখাকে জড়িয়ে রেখেছে।

রাদিন নক না করেই তানিয়ার কেবিনে প্রবেশ করে। প্রচন্ড রাগে তার চোখ লাল হয়ে আছে। তানিয়া মনোযোগ দিয়ে কিছু ফাইল দেখছিল। কেবিনের দরজা খোলার শব্দ কানে আসলেও চোখে তুলে তাকায়নি দেখতে কে এসেছে। এগিয়ে এসে তানিয়ার হাতের কাছেই একটা এনভেলপ ছুঁড়ে দিয়ে রাদিস উচ্চ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-হোয়াট ইজ দিজ রাবিস তানিয়া?

রাদিনের কন্ঠ পেয়ে ফাইল থেকে চোখ তুলে তার দিকে তাকায় তানিয়া। নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে সে। রাদিন টেবিলের উপর হাত রেখে সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে,

-এক্সপ্লেইন মি, হোয়াট ইজ দিজ।

তানিয়া তার শান্তি ভঙ্গি বজায় রেখেই বলে,

-রিলাক্স রাদিন। টেক এ সিট। পানি খাবে?

পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে তানিয়া বলে,

-একটু পানি খাও তারপর কথা বলছি।

রাদিনের ইচ্ছা করছে সে গ্লাসটা তুলে আছাড় মে রে ভেঙে ফেলে। কিন্তু এমন কাজ সে করে না। চেয়ার টেনে তানিয়ার মুখোমুখি সে পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে একটানে সবটুকু পানি খেয়ে শেষ করে। গ্লাস নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই আবার জিজ্ঞেস করে,

-এসব কি তানিয়া? এসবের মানে কি?

-আমি তোমাকে ডিভোর্স দিচ্ছি।

-নো, ইউ কান্ট।

-ইয়েস আই ক্যান।

-তানিয়া!

-আমার পক্ষে আর তোমার সঙ্গে থাকা সম্ভব নয় রাদিন।

-তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করে ডিভোর্সের ডিসিশান নিতে পারো না।

-পারি রাদিন, অবশ্যই পারি। আমাকে চিট করার আগে তোমার ভাবা উচিত ছিল। একটা অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোর আগে ভাবা উচিত ছিল তোমার।

-আই লাভ হার তানিয়া। ভালোবাসা কখনই অনৈতিক হয় না।

-হয় রাদিন, ভালোবাসায় নৈতিকতা থাকে। বউ থাকতে অন্য নারীতে আসক্ত হওয়া কখনই নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। যাগ গিয়ে এইসব বিষয়ে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই না। আমার সিদ্ধান্ত আমি জানিয়ে দিয়েছি। সাইন করে আমাকে এই ঝামেলা থেকে মুক্তি দাও।

-ইউ নো হোয়াট তোমার এই সেলফিশনেসের কারণেই আমি কখনো তোমাকে ভালোবাসতে পারিনি। কারণ তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসা দিতেই পারো না।

তানিয়া রাদিনের কথার জবাবে একটা কথাও বলে না। রাদিনকে দেবার মতো হাজারটা জবাব আছে তার কাছে কিন্তু সে উত্তর করে না। এখন সব অহেতুক লাগে তার কাছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রাদিন। মনে হচ্ছে সে বেরিয়ে যাবে। বেরিয়ে যাবার আগে বলে,

-বাচ্চারা আমার কাছে থাকবে।

-বাচ্চাদের কথা তোমার না ভাবলেও চলবে। ওদের কস্টাডি আমিই পাবো। ওরা রওনকের কাছে থাকবে। তোমার মতো বাবা আমার সন্তানদের প্রয়োজন নেই।

-তানিয়া!

-তুমি এখন আসতে পারো রাদিন। আর কাগজগুলো সাইন করে দিও।

জবাবে কিছু বলে না রাদিন কেবল তাকিয়ে থাকে। তখনই দুইবার নক হয় তানিয়ার কেবিলের দরজায়। রাদিকের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই তানিয়া বলে,

-কাম ইন প্লিজ।

দরজার নব ঘুরিয়ে অর্ধেক প্রবেশ করেছে লাবিব। ওখান থেকেই তানিয়া ও রাদিনকে একে-অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার বুকের ভেতর কিছু একটা ভেঙে গেল। আমতা আমতা করে সে বলে,

-সরি, আমি পরে আসছি।

আই কন্টাক্ট ভেঙে লাবিবের দিকে তাকিয়ে তানিয়া বলে,

-ইটস ওকে এসো। আমাদের কাজ হয়ে গেছে।

ইতস্ততবোধ নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করে লাবিব। রাদিক বেরিয়ে যাবার জন্য কদম বাড়ালে পেছন থেকে তানিয়া বলে,

-এনভেলপটা নিয়ে যাও।

রাদিন আর অপেক্ষা করে না। এনভেলপটা নিয়েই বেরিয়ে যায়। লাবিব এগিয়ে এসে একটু রাদিন যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে দাঁড়ায়। তানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-আর ইউ ওকে?

তানিয়া মুখে কিছু বলে না। কথা বললেই হয়ত কেঁদে ফেলবে সে। কিন্তু সে ভেঙে পড়তে চায় না, একদমই না। একটা প্রতারকের জন্য কাঁদতে চায় না সে। ছলছলে দৃষ্টি নিয়ে লাবিবের দিকে তাকিয়ে রয় তানিয়া, মুখে কিছু বলে না।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৬১+৬২+৬৩

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

আজকের পার্টির জন্য বানানো বার কাউন্টারের সঙ্গে সামান্য সাইড হেলান দিয়ে হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মশগুল রওনক। যদিও আড্ডায় মশগুল বলা যায় না। একটু পরপরই অন্যদিকের সিড়ির দিকে দৃষ্টি যাচ্ছে তার চন্দ্র এসেছে কিনা দেখতে। এতক্ষন সময় লাগার কথা নয় যদিও তবুও অপেক্ষা করছে সে। চিত্রলেখা নার্ভাস রওনক জানে। এমন পার্টি এর আগে কখনো এটেন্ড করেনি সে। তাই তার নার্ভাস হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। চিত্রলেখার পরিস্থিতি আন্দাজ করেই তাকে সময় দিচ্ছে রওনক। সবে তো রাত হয়েছে তাড়া নেই কোনো। যদিও আকজকের রাতটা তার জন্য স্পেশাল তবুও কোনো কিছু নিয়েই চন্দ্রকে তাড়া দিবে না সে।

-দেয়ার শি ইজ মিসেস রওনক জামান।

সাদমানের মুখে মিসেস রওনক জামান শুনেই পাশ ফিরে সিড়ির দিকে তাকায় রওনক। ব্যস, আর কথা বলতে পারে না সে। রওনকের দৃষ্টি তার চন্দ্রের দিকেই আটকে গেছে। তবে এই মুহূর্তে কেবল রওনক নয়, পার্টিকে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি চিত্রলেখার দিকে আটকে আছে।

-ড্যাম গর্জিয়াস…

এতটুকুই বেরিয়ে আসে রওনকের মুখ গলে। এর বেশি কিছু বলতে পারে না সে। নিজের জায়গায় স্থির হয়ে গেছে সে। রওনকের পছন্দ করা গাউনটা পরে আসেনি চিত্রলেখা। এখন রওনক বুঝতে পারছে তৈরি হবার পরেও চিত্রলেখার বেরিয়ে আসতে এত সময় কেনো লেগেছে। চিত্রলেখার পরনে একটা কালো রঙের জর্জেটের টিস্যু শাড়ি। চিত্রলেখা হেয়ার স্টাইল চেঞ্জ করেনি, মেকাপও চেঞ্জ করেনি অবশ্য প্রয়োজন হয়নি। মেকাপে স্মোকি আই করা হয়েছে যা এই জর্জেট ফিনফিনে টিস্যু শাড়িটার সঙ্গেও দারুন লাগছে দেখতে। অর্নামেন্টসও আগেরটাই কেবল বদলেছে পরনের কাপড়। গাউনটার বদলে শাড়ি পরে এসেছে সে। জর্জেট শাড়িটার সম্পূর্ণ আঁচল, জমির নিচের দিক থেকে উপরে অর্ধকটা, বুকের কাছের অংশে ছোট ছোট স্টোন বসানো। তাই ফিনফিনে জর্জেট শাড়ি হলেও পেটের কাছটায় সামান্য অংশ ব্যতীত আর কিছুই তেমন একটা বুঝা যাচ্ছে না। ব্লাউজের হাতা কনুই পর্যন্ত যদিও জর্জেট হওয়ায় হাত বুঝা গেলে ইতস্তত লাগছে না চিত্রলেখার আগের মতো। অন্তত গাউনটার মতো তো নয়। গাউনের তো হাতাই ছিল না। কথায় আছে নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো। কেবল হাতাটাই নয় চিত্রলেখার পিঠটাও ভিজিবল এই ব্লাউজে তবে উন্মুক্ত নয়। কালো হওয়ায় সুবিধা হচ্ছে শরীরের অংশ খানিকটা বুঝা গেলে সরাসরি দেখা যাচ্ছে না। এটাই স্বস্তি। বোট গলা হওয়ায় ব্লাউজের সামনের অংশ দিয়ে চিত্রলেখা বুকের কাছের অংশ বুঝা বা দেখা যাচ্ছে না। ঐ গাউনটায় চিত্রলেখাকে ঠিক যতখানি সুন্দর লাগছিল দেখতে এই মুহূর্তে কালো রঙের জর্জেট টিস্যু শাড়িটাতে আরও হাজারগুন বেশি আউট অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড লাগছে তাকে দেখতে, অন্তত রওনকের দৃষ্টিতে। বাকি কার কাছে কেমন লাগছে তাতে রওনকের কিচ্ছু যায় আসে না। হি ড্যাম কেয়ার’স। সেই সঙ্গে চিত্রলেখার ঠোঁট জুড়ে থাকা ডার্ক রেড লিপস্টিক। ঐ লাল লিপস্টিক যেনো চিৎকার করে আহ্বান জানাচ্ছে রওনককে। এক্ষুনি গিয়ে ঐ ঠোঁট জোড়া দখল নেয়ার তাগিদ অনুভব করে রওনক। কিন্তু সে তো নড়তেই পারছে না এগিয়ে যাবে কীভাবে? চিত্রলেখাকে দেখার পর সব ভুলে গেছে যেনো। সংশয়ে, অজানা আতংকে চিত্রলেখা এখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। নেমে নিচে আসবে কিনা বুঝতে পারছে না। এত মানুষের ভীড়ে তার দৃষ্টি একজোড়া চোখকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে, রওনক। এই বাড়িতে থাকার তার একমাত্র ভিত্তি, পরিচয়, কাছে মানুষ।

সাদমান আলতো করে রওনকের কাঁধে ঝাঁকি দিলে নিজের ভাবনার জগৎ রেখে বাস্তবতায় ফিরে আসে সে। পাশ থেকে সাদমান বলে,

-গো, শি ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।

হাতে থাকা ওয়াইনের গ্লাসটা বার কাউন্টারের উপর রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে। বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে যায় চিত্রলেখার দিকে। এত সব অপরিচিত মুখের ভীর ঠেকে রওনককে এগিয়ে আসতে দেখে স্বস্তির হাসি ফুটে ওঠে চিত্রলেখার মুখ জুড়ে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ এটা ভেবেও অস্থির লাগে যদি তার দেয়া ড্রেস পড়েনি বলে রাগ হয়? রওনক কি বুঝবে ম রে গেলেও চিত্রলেখা ঐরকম শরীর দেখানো ড্রেস পরে এত মানুষের সামনে আসতে পারে না। এমনিতে শাড়িটা পাতলা ফিনফিনে ধরনের, এদিক সেদিক দিয়ে শরীর বুঝা যাচ্ছে এতেই লজ্জায় চিত্রলেখার মাটিতে মিশে যেতে মন চাইছে ঐ ড্রেসটা পরলে সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকলে লজ্জায় কেঁদেই ফেলতো সে। চিত্রলেখা ভেবে রেখেছে রওনক রাগ হলে প্রয়োজনে সারাদিন রাত ঐ ড্রেস পরে সে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। রওনক যদি একটু আগের মতো করে তার উন্মক্ত শরীরে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় তাতেও আপত্তি করবে না কিন্তু এত মানুষের সামনে ঐ ড্রেস সে পরতে পারবে না। এগিয়ে এসে চিত্রলেখার মুখোমুখি দাঁড়ায় রওনক। রওনককে এতখানি কাছাকাছি দেখেই বুকের ভেতর কিছু একটা তবলা বাজাতে শুরু করেছে চিত্রলেখার। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। রওনক কি রাগ হয়েছে তার উপর? নাকি বিরক্ত হয়েছে? তার মুখের ভাব দেখে কিছু বুঝা যাচ্ছে না। চিত্রলেখা কিছুই বুঝতে পারছে না। তাকে অবাক করে দিয়ে রওনক হাত বাড়িয়ে একটা হাত চিত্রলেখার কোমড়ে রেখে তাকে কাছে টেনে নেবার চেষ্টা করে গালে চুমু খায়। রওনকের কান্ডে পার্টিতে উপস্থিত সবাই হাত তালির সঙ্গে নানারকম উৎসাহ, উৎফুল্ল মূলক শব্দ করে। খুব বেশি সময় নেয় না রওনক। যদিও তার ইচ্ছা হচ্ছে পার্টিকে গু ল্লি মে রে চিত্রলেখাকে নিয়ে ঘরে চলে যেতে। দীর্ঘ সময়ের জন্য ঐ লাল ঠোঁট জোড়া নিজের দখলে রাখতে। ততক্ষন ছাড়বে না যতক্ষণ না তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চিত্রলেখাকে কিছু বলে না সে। পাশে দাঁড়িয়ে বাম হাতটা চিত্রলেখার শাড়ির ভেতর দিয়ে তার পেটের কাছে জড়িয়ে ধরে নিজের কাছাকাছি টেনে নেয় প্রিয়তমাকে। তার কান্ডে অবাক হয়ে মুখ ঘুরিয়ে রওনকের মুখের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। লজ্জায় ম রে যেতে মন চাইছে তার। সবাইকে দেখছে তাদের অথচ রওনকের যেনো কিচ্ছু যায় আসে না। সে বরং সবাইকে দেখাতেই ব্যস্ত চিত্রলেখা তার, একান্তই তার ব্যাক্তিগত।

রওনকের চোখের ইশারায় লাবিব সব লাইট অফ করে দিয়ে কেবল তাদের দু’জনের উপর একটা স্পটলাইট জ্বেলে দিয়েছে। উপস্থিত সকলের চোখ এখন তাদের দু’জনের দিকে স্থির। পেছন থেকে কেউ একজন রওনকের হাতে একটা মাইক দিয়ে দেখে। অন্ধকারে দেখা যায়নি ওটা কে ছিল। মাইকটা মুখের কাছে নিয়ে রওনক এতক্ষনে মুখ খুলে বলে,

-লেডিস এন্ড জ্যান্টেলম্যান হিয়ার প্রেজেন্ট মাই বিলাভেট ওয়াইফ, বেটার হাফ চন্দ্র আই মিন চিত্রলেখা রওনক জামান। আই থ্যাংকিউ অল ফর বিইং হিয়ার উইথ আজ এন্ড টু গিভ আজ ইউর লাভ এন্ড ব্লেজিংস। থ্যাংকিউ ফর ইউর প্রেজেন্স ইটস মিন্স এলট। প্লিজ ইঞ্জয় ইউর সেলফ।

রওনকের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে কড়তালিতে চারিদিক মুখোরিত হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে লাইটস অন করে দিলে তারা দু’জনে একত্রে নিচে নেমে আসে। ওরা নিচে নেমে আসলে সবার আগে এগিয়ে আসে সাদমান। চিত্রলেখার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে কি করবে ভেবে রওনকের মুখের দিকে তাকালে সে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করলে চিত্রলেখা হাত বাড়িয়ে সাদমানের হাতে হাত রাখতেই মাথা ঝুকিয়ে আলতো করে চিত্রলেখার হাতের উপরের দিকে ছোট্ট করে সৌজন্যমূলক চুমু দিয়ে সাদমান বলে,

-লুকিং গর্জিয়াস।

চিত্রলেখা বুঝতে পারে না ঠিক কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে। রওনক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় সাদমানের দিকে। তার হাত থেকে চিত্রলেখার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে,

-শি ইজ মাই ওয়াইফ।

-এন্ড শি ইজ মাই সিস্টার-ইন-ল।

-ফা…গেট অফ ম্যান।

আরও অনেকেই উপস্থিত থাকায় স্লাং ইউজ করতে নিয়েও করে না রওনক। তার অবস্থা দেখে সাদমান বলে,

-গেটিং জেলাস ম্যান।

-অফকোর্স আই ডু।

চিত্রলেখা বুঝতে পারে না আসলে এখানে কি হচ্ছে। সাদমান রওনককে বিরক্ত করতেই মূলত এমনটা করেছে। এছাড়া অন্যকোনো ইন্টেনশন নেই তার। অনেক বছরের বন্ধুত্ব তাদের। ভাইয়ের মতো সম্পর্ক। সাদমান কখনই কোনো স্টুপিড কাজ করে এই সম্পর্ক নষ্ট করবে না তা রওনক নিজেও জানে। অন্যদের সবার সঙ্গে চিত্রলেখাকে পরিচয় করিয়ে দেয় রওনক। অফিসের কেউ কেউ চিত্রলেখাকে হয়ত চিনতে পেরেছে কিন্তু রওনকের উপস্থিতিতে কারো সাহস হয় না কানাঘোষা করার। বসের বউকে নিয়ে গসিপ করলে যে চাকরী থাকবে না তা সবাই জানে। আর মন্দা চাকরীর বাজারে নিজের চাকরীর মায়া সবারই আছে। আর বাকি যারা জানে না চিত্রলেখা যে রওনকের অফিসেই চাকরী করত তাদের মাথা ব্যাথা নেই। তবে তারা চিত্রলেখাকে চিনতে, জানতে তার সম্পর্কে শুনতে আগ্রহী। তবে সবাই রওনকের পার্সোনালিটি সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানে। তার জিনিসে কেউ চোখ দিলে সেই চোখ উপড়ে ফেলতে দুইবার ভাববে না সে আর সেখানে তার বউয়ের দিকে নজর দিলে সেই ব্যাক্তিকে দুনিয়া থেকে গা য়ে ব করে দিতে এক সেকেন্ড সময় নিবে না সে। এমনি এমনি এত বড় ব্যবসা ধরে রাখেনি সে। রওনক জামানের হাত যে কত বড় তা সবার অজানা হলেও কম বেশি সবাই বুঝে রওনক জামান চাইলে তার এক ইশারায় কি করতে পারে। রওনক জামান পারে না এমন কোনো কাজ নেই। সবাই সম্মান করে তবে ভয়ও কম পায় না। রওনকের জামানের ব্যাড সাইডে আসতে রাজি নয় কেউ। তার সাথে সম্পর্ক ভালো মানে সব ঠিক। উনিশ বিশ হলেই সর্বনাশ। সবার সামনে কুল, জ্যান্টেলম্যান্ট দি রওনকের জামানের ভেতরটা যে এতখানিও পরিষ্কার নয় তা অনেকে আন্দাজ করতে পারলেও কখনো মুখ ফুটে তা প্রকাশ করার দুঃসাহস করে না।

ড্রিংসের গ্লাসের ট্রে নিয়ে একটা ছেলে এগিয়ে এলে একজন চিত্রলেখাকে ড্রিংক্স নিতে বললে সে কনফিউশনে পড়ে যায় কি করবে। সে এসব খায় না বলাটা কি উচিত হবে? সবাই নিশ্চয়ই অন্যভাবে দেখবে তাকে। এটা নিশ্চয়উ রওনক পছন্দ করবে না। কি করবে বুঝতে পারছে না এমন দৃষ্টি নিয়ে রওনকের দিকে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলছিল রওনক। সাদমান বাহু ধরে হালকা ধাক্কা দিকে তার দিকে তাকালে সাদমান ইশারা করলে চিত্রলেখার দিকে তাকায় সে। রওনকেরই একপার্টনারের ওয়াইফ ড্রিংক্স অফার করছে চিত্রলেখাকে। তার চোখ থেকে যা বুঝার বুঝে গেছে রওনক।

-এক্সকিউজ মি।

বলেই বার কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায় রওনক। বার কাউন্টারে থাকা ছেলেটাকে ইশারা করতেই সে একটা ওয়াইনের গ্লাস এগিয়ে দেয় তাকে। সেটা নিয়ে চিত্রলেখার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় সে। ওয়াইনের গ্লাসটা এগিয়ে দেয় চিত্রলেখাকে নেয়ার জন্য। অবাক দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। সে ভাবতেই পারেনি রওনক তাকে এভাবে এসব খাবার জন্য বলবে। চিত্রলেখার চোখ দেখে হাসি পেয়ে যায় রওনক। কিন্তু এইমুহূর্তে সে হাসে না। নিজের হাসি সামলে চিত্রলেখার কানের কাছে মুখ নিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,

-এটা নিতে পারো ফ্রুটিকার গ্রেপ জুস এতে কোনো এলকোহল নেই। আমি নিজেই এলকোহল নেই না তোমাকে অফার করব ভাবলে কীভাবে? সবাই ভাববে আমরা ওয়াইন খাচ্ছি আসলে ইটস জাস্ট এ সিম্পল জুস।

রওনকের কথা শুনে এবার চিতলেখার ঠোঁট জুড়ে হাসি ফুটে ওঠে। আবার সে অবাক না হয়েও পারে না। সে জানতোই রওনক এলকোহল নেয় না। আগের রাতেই তার এক কথায় বারান্দা দিয়ে সিগারেটে গোটা প্যাকেট ফেলে দেয়ার আগে দু’বার ভেবেনি। যত দেখছে সে রওনককে ততই অবাক হচ্ছে। রওনকের বাড়িয়ে রাখা হাত থেকে ওয়াইন মানে জুসের গ্লাসটা নিয়ে তার চোখ চোখ রেখে একটা সিপ নেয় চিত্রলেখা। অথচ তাকে দেখে মনে হচ্ছে সত্যি যেনো ওয়াইন খাচ্ছে। চিত্রলেখার এমন এটিটিউডে ইম্প্রস না হয়ে পারে না রওনক। এক্ষুনি সব ফেলে চন্দ্রকে নিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে মন চাইছে তার। যেখানে তাদের কেউ বিরক্ত করতে পারে না। যেখানে তার একে-অপরকে উষ্ণ আলিঙ্গে জড়িয়ে রাখতে পারবে ঘন্টার পর ঘন্টা। রওনক নিজেকে চিত্রলেখার ভেতর হারিয়ে ফেলতে পারবে। যতবার চিত্রলেখার দিকে তাকিয়েছে এই পর্যন্ত রওনকের ইচ্ছা হয়েছে ঐ ঠোঁটে একটা চুমু খায় সে। ছোট্ট করে নয় গভীরভাবে, দীর্ঘ সময় নিয়ে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

দিলারা জামান নিজের ঘর থেকে বের হোননি। তানিয়া অনেকবার করে অনুরোধ করেছিল শাশুড়িকে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে পার্টি জয়েন করতে। কিন্তু উনি নাছোড়বান্দা একবার যেই মুখে না বলে ফেলেছেন সেই সিদ্ধান্ত বেঁচে থাকতে পরিবর্তন করবেন না। তানিয়ার এতদিনের সংসার জীবনে এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে তার ভালো মতো চেনা। তাই কয়েকবার অনুরোধ করার পর সে নিজেও হাল ছেড়ে দিয়েছে। তার নিজের পার্টিতে উপস্থিত থাকাটা জরুরী। দিলারা জামানের অনুপস্থিতিকে কেউ আড়চোখে দেখার আগে কিছু একটা বাহানা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে তাকে। সাপের মতো ফনা তুলে নিজের ঘরে বসে আছেন দিলারা জামান। এইমুহূর্তে তার রাগ বেশি হচ্ছে এই ভেবে তার নিজের ছেলে একটাবার এসে তাকে ডাকেনি। তার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। একটা বাইরের মেয়ে আজ তার চাইতে বেশি হয়ে গেল বিষয়টা হজম হচ্ছে না উনার। রাগে ফুলতে থাকা দিলারা জামানের রাগের আ গু নে ঘি ডালতেই যেনো সাবার আগমন ঘটলো। রুমের দরজা লক করাছিল না। তানিয়া চলে যাবার পর একবার ভেবেছিলেন ভেতর থেকে লক করে দিবেন কিন্তু যদি রওনক আসে সেই ভাবনায় আর লক করেননি। রওনক আসেনি তবে সাবা এসেছে। দরজা ঠেলে ভেতর প্রবেশ করে দিলারা জামানের কাছাকাছি এগিয়ে যেতে যেতে সাবা খানিকটা খোচা মারা কন্ঠে বলে,

-কংগ্রাচুলেশন্স আন্টি।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সাবার দিকে তাকিয়ে দিলারা জামান জিজ্ঞেস করেন,

-ফর হোয়াট?

এগিয়ে এসে দিলারা জামানের মুখোমুখি একপায়ের উপর আরেক পা তুলে দিয়ে বসে সাবা বলে,

-আপনার ছেলে বিয়ে করেছে। বউ নিয়ে এসেছে। পার্টি করে সবাইকে সেটা জানাচ্ছেও। ইউ মাস্ট বি ভেরি হ্যাপি টুডে।

মুখটাকে বাংলার পাঁচ বানিয়ে দিলারা জামান বলেন,

-ওহ কাম অন সাবা। এই বিয়ে আমি মানি না। নাম পরিচয়হীন একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসলেই আমি আমার বাড়ির বউ বলে মেনে নিবো না। ঐ মেয়ে এই বাড়ির বউ সেদিন হবে যেদিন আমি ম রে যাবো। আমি বেঁচে থাকতে সেটা কোনোদিন সম্ভব নয়।

-কিন্তু আপনার ছেলে সেটা মানবে বলে মনে হয় না আন্টি। আপনি টেরও পাননি রওনক আমাকে করা প্রমিজ ব্রেক করে আরেকটা রাস্তার মেয়েকে বউ করে নিয়ে এসেছে।

নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সাবা আরও বলে,

-আই ইউল নট লেট হার টেক মাই ম্যান আওয়ে আন্টি। আপনার ছেলে একটা না হাজারটা বিয়ে করলেও আমাকে ওর বিয়ে করতেই হবে। এট দ্যা এন্ড অফ দ্যা ডে হি উইল বি মাইন, অনলি মাইন।

দিলারা জামান নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে সাবার একটা হাত নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে বলেন,

-আমি তোমার সঙ্গে আছি ডিয়ার।

সাবা দিলারা জামানকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-থ্যাংকিউ সো মাচ আন্টি।

রওনকের পাশ থেকে একমুহূর্তের জন্যও সরছে না চিত্রলেখা। অফিসের কিছু মুখ ব্যতীত কাউকে চিনে না সে। এমনকি কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারদেরকেও না। কে কি জিজ্ঞেস করবে চিত্রলেখা কি জবাব দিবে, যদি ভুলভাল কিছু বলে ফেলে এই ভয়ে আরও রওনকের দৃষ্টির আড়ালে যাচ্ছে না সে। তানিয়া এগিয়ে এসে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

-বউটাকে কিচ্ছুক্ষণের জন্য আমাকে ধার দাও। আমি আমার সার্কেলের সঙ্গে একটু পরিচয় করিয়ে দিই।

চিত্রলেখার হাত তানিয়ার হাতে দিয়ে রওনক বলে,

-শি ইজ অল ইউর’স নাও।

তানিয়া চিত্রলেখাকে নিয়ে সরে গেলেই তার সামনে এসে দাঁড়ায় সাবা। ডার্ক বোটল গ্রীন কালার একটা অফশোল্ডার ড্রেস পরেছে সে। ড্রেস্টটার লেন্থ তার মিড থাই পর্যন্ত। অফশোল্ডার হওয়ায় সাবার ক্লিভেজের খানিকটা উঁকি দিচ্ছে। মিড থাই থেকে শুরু করে সাবার লম্বা পা-গুলো সম্পূর্ন উন্মুক্ত। ড্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে একই কালারের পেন্সিল হিল পরেছে, এতে আরও লম্বা লাগছে সাবাকে দেখতে। ডার্ক ড্রেসের সঙ্গে মিল রেখে ডার্ক মেকাপ নিয়েছে। ডার্ক মারুন কালার লিপস্টিক লাগিয়েছে ঠোঁটে। যেকোনো পুরুষ চোখে সাবাকে এক কথায় সে ক্সি লাগছে দেখতে। যেকোনো পুরুষ বারবার ফিরে তাকাবে তার দিকে। কিন্তু রওনক সেই তাগিদ অনুভব করে না। সাবাকে কখনোই তার দৃষ্টিতে আকর্ষনী লাগেনি। তিলত্তমার পরে রওনকের দৃষ্টিতে যদি কাউকে আকর্ষনী লেগে থাকে সে একমাত্র চিত্রলেখা। সেজন্য তাকে ডার্ক মেকাপ নিতে হয় না, বডি রিভেলিং ড্রেস পড়তে হয় না। চিত্রলেখার ঠোঁটে লিপস্টিক না থাকলেও সেই ঠোঁট আকুল নিবেদনে রওনককে ডাকে সবসময়। চিত্রলেখা যদি বোরখা পরে নিজেকে ডেকে রাখে তবুও রওনকের শরীর তাকে জড়িয়ে ধরতে, উষ্ণ আলিঙ্গে নিতে নিশপিশ করে। দ্বিতীয় কোনো নারীকে দেখে রওনকের শরীরে কিচ্ছু হয় না। এক চিত্রলেখাকে দেখলেই তার নিজেকে সামলে রাখতে কষ্ট হয়, ভীষণ কষ্ট। পাজরের হাড় বেরিয়ে আসার মতো কষ্ট। চিত্রলেখাকে নিজের করে নিয়ে আসার পর থেকে এই পর্যন্ত অনেক কষ্ঠে নিজেকে সামলে রেখেছে সে। কিন্তু আর না। আজ আর সে নিজেকে আটকে রাখতে পারবে না। চিত্রলেখাকে তার চাই-ই চাই। চিত্রলেখার সবটা তার চাই। আর পারবে না সে সন্যাসি হয়ে থাকতে। তিলত্তমা চলে যাবার পর ৬ বছর সে কখনো কোনো নারী শরীরের চাহিদা অনুভব করেনি। কখনো কোনো বেগানা নারীকে নিজের সংস্পর্শে আসতে দেয়নি। সংস্পর্শে আসা তো দূরের কথা ভাবেওনি কারো কথা। সাবা নানাভাবে চেষ্টা করেছে তাকে বিছানায় নিয়ে যাবার কিন্তু কোনোদিন সফল হয়নি। আবার বিয়ে করার কথা কখনো ভাবেনি রওনক। এক চিত্রলেখাকে দেখেই মনে হয়েছিল নিজেকে সে আরেকটা সুযোগ দিতে পারে। হয়ত চিত্রলেখা তাকে তার মতো করে ভালোবাসবে, আগলে রাখবে, বুঝবে। যেমনটা সে তিলত্তমার কাছে আশা করেছিল। ভুলেও সে চিত্রলেখাকে তিলত্তমার সঙ্গে তুলনা করে না। রওনকের জীবনে এই দুই নারী সবসময় বিশেষ হয়ে থাকবে বলা বাহুল্য চিত্রলেখা এখন তার সবটা জুড়ে বিরাজমান। একসময় তিলত্তমা তার যতটুকু জুড়ে ছিল আজ চিত্রলেখা তার চাইতে অনেক বেশি জুড়ে আছে। তিলত্তমা চলে যাবার পর নতুন করে কেউ তার জীবনে আসবে সেটা রওনক কখনো ভাবেনি আর এভাবে এসে তাকে বশ করে ফেলবে সেটা তার চিন্তার অন্তরালে ছিল। একসময় রওনক যেটা ভাবেনি আজ সেটা তার জীবনের বাস্তবতা। একমুহূর্তের জন্যও চিত্রলেখা তার মস্তিষ্ক থেকে সরে না, রওনক সরাতেও চায় না। চিত্রলেখায় বিভোর থাকতে তার ভালো লাগে। এভাবেই থাকতে চায় সে।

সাবা সরাসরি এগিয়ে এসে রওনককে জড়িয়ে ধরে। বলা যায় বেহায়ার মতো নিজেকে রওনকের শরীরের উপর ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করে। রওনক চাইলেই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারে কিন্তু এত মানুষের মধ্যে হয়ত এমনটা করা উচিত হবে না তাই সৌজন্যের খাতিরে হালকা করে জড়িয়ে ধরে আবার তৎক্ষণাৎই ছেড়ে দিয়ে নিজের কোট ঠিক করতে করতে চিত্রলেখার দিকে তাকালে তাদের একে-অপরের দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়ে। তানিয়ার সঙ্গে থাকলেও অন্যদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে চিত্রলেখার চোখ বার বার এদিকেই তাকাচ্ছে রওনককে দেখতে। সাবার রওনককে জড়িয়ে ধরার দৃশ্যটা চিত্রলেখা দেখেছে তা তার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে। খারাপ লাগায় মুখ সাদা হয়ে গেছে বেচারির। তা বুঝতে পেরে মুচকি হাসে রওনক। সে এটাই চায়। রওনক নিজে যতখানি চিত্রলেখায় আসক্ত হয়ে গেছে, সে চায় চিত্রলেখাও ততখানিই তার প্রতি আসক্ত থাকুক ইনফ্যাক্ট আরও বেশি আসক্ত করতে চায় সে চিত্রলেখাকে তার প্রতি।

সাবা কিছু বলার আগে রওনকের পেছন থেকে লাবিব এগিয়ে এসে তাকে কানে মুখে কিছু বলে। কি বলেছে তা শুনতে পায়নি সাবা। লাবিব কিছু বলার পর রওনক ওখান থেকে চলে যাবার চেষ্টা করলে তার একটা হাত ধরে বাঁধা দিয়ে সাবা বলে,

-আমি মাত্রই এলাম কোথায় যাচ্ছো তুমি?

-আমার কিছু স্পেশাল গেস্ট এসেছে আই নিড টু এটেন্ট দ্যাম। আই এম সিওর ইউ উইল ম্যাক ইউর শেলফ কম্ফোর্টবেল হিয়ার।

আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে সাবার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে লাবিবের সঙ্গে চলে যায় রওনক। পেছনে দাঁড়িয়ে রাগে ফস ফস করতে লাগে সাবা। তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে রিপা বলে,

-এভাবে সবার সামনে নিজেকে অপমান না করলেও পারো আপু। যেটা তোমার না সেটার দিকে হাত বাড়িও না। অপমান ছাড়া কিছুই পাবে না। এখনো সময় আছে নিজেকে সামলে নাও। রওনক ভাই কখনো তোমার হবে না। এই সত্যিটা মেনে নাও এবার।

সাবার ইচ্ছা করে কষে ছোট বোনের গালে একটা থা প্প র লাগায় সে। কিন্তু এখন নয়। সে হাতে মা র বে না রিপাকে নিজের কাজ দিয়ে মা র বে। যেদিন সবার সামনে রওনক তাকে মেনে নিবে, বিয়ে করে বউয়ের পরিচিয় দিবে সেদিন রিপাকে এর উপযুক্ত জবাব দিবে এর আগে নয়। চোয়াল শক্ত করে রিপার দিকে তাকিয়ে সাবা বলে,

-হি ইউল বি মাইন।

শক্ত পদক্ষেপে প্রস্থান করে সাবা। সাবাদের সপরিবারে দাওয়াত করা হয়েছিল। কিন্তু আজ সকালে কিছু জরুরী কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছেন আশরাফ আহমেদ। স্বামীর অনুপস্থিতিতে আসতে মন সায় দেয়নি সানজিদা আহমেদের। উনারা সবাই ধরেই নিয়েছিলেন রওনকের সঙ্গে সাবার বিয়ে হবে। রওনককের আপত্তি ছিল তা সবাই জানতো কিন্তু সে যে এমন কাজ করবে, এভাবে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসবে তা কেউ ভাবেনি। রওনকের সঙ্গে সাবার বিয়ে হলে এর থেকেও বড় পার্টি হবার কথা ছিল। অথচ সেই রওনকের বউয়ের ওয়েকাম পার্টি অথচ বউটা সাবা নয় ভেবে আসতে মন চায়নি সানজিদা আহমেদের। আশরাফ আহমেদ ঢাকায় থাকলে হয়ত সম্পর্কের খাতিরে, ব্যবসার খাতিরে তাদের দু’জনকে আসতে হতো। কিন্তু আশরাফ সাহেব না থাকায় সুযোগ পেয়ে তিনি নিজেও আসেননি। দুই মেয়েকেও বলেছিলেন প্রয়োজন নেই আসার কিন্তু সাবা তো সাবাই। নিজের বেহায়াপনা দেখানোর জন্য হলেও আসবে। এই বাড়িতে আসতে তার কারণ লাগে না। অন্যদিকে রিপা মন থেকেই এসেছে রওনককে তার নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা জানাতে। রিপা একটুও রাগ হয়নি রওনক সাবাকে বিয়ে করেনি বলে। বরং খুশিই হয়েছে বলা যায়। নিজের বোনকে সে চিনে। রওনকের অতীত সম্পর্কেও অনেকটা জানা আছে তার। রিপা কখনোই চায়নি রওনকের জীবনে সাবার মতো কেউ আসুক। এখন ভাবলে রিপার মনে হয় চিত্রলেখাই রওনকের জন্য উত্তম জীবন সঙ্গী। যতটুকু সে লিখনের কাছে শুনেছে সবসময় তা থেকে এটাই মনে হয় রিপার, রওনকের জন্য চিত্রলেখার চাইতে ভালো কেউ হতেই পারে না।

তানিয়া তার সার্কেলের লোকজনের সঙ্গে চিত্রলেখার পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যস্ত। কিছুক্ষন আগে রওনক লাবিবের সঙ্গে কোথায় যেনো চলে গেল। তারপর পনেরো মিনিটের মতো হয়ে গেছে এখনো তাকে দেখেনি সে। এক/দুবার এদিক সেদিক খুঁজলেও না পেয়ে পরে এদিকে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করে। তার জন্য এত আয়োজন, তার উচিত এসবের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে গুছিয়ে নেয়া। যদিও তার সময় লাগবে তবুও সে চেষ্টা তো করতেই পারে। সেই চেষ্টাটা নাহয় এখান থেকেই আজকের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই শুরু হোক। সকলের উপস্থিতিতে আচমকাই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কেউ চিত্রলেখাকে। পেছন থেকে একজোড়া হাত এগিয়ে এসে চিত্রলেখার পেটের কাছে জড়িয়ে ধরতেই তার বুঝতে অসুবিধা হয় না এই হাত জোড়া কার। এত মানুষের উপস্থিতিতে রওনক ছাড়া কারো সাহস নেই তাকে জড়িয়ে ধরে। অবশ্য চিত্রলেখার বুঝা হয়ে গেছে কারো উপস্থিতিতে তো দূরের কথা আড়ালে আবডালেও রওনক দ্বিতীয় কাউকে এলাও করবে না তাকে স্পর্শ করে। রওনকের উপস্থিতিতে নিজেকে এতখানিই সুরক্ষিত অনুভব করে সে। আচমকা সবার উপস্থিতিতে রওনক এভাবে জড়িয়ে ধরায় লজ্জা গ্রাস করে ফেলে চিত্রলেখাকে। ওদের দেখে পাশে উপস্থিত সবাই-ই মুচকি হাসছে। নিজেকে সামলে নেয়ার বৃথা চেষ্টা করে মিনমিনে কন্ঠে চিত্রলেখা বলে,

-কি করছেন! সবাই দেখছে তো।

চিত্রলেখার কাঁধে মুখ রেখে রওনক বলে,

-দেখুক, আই ডোন্ট কেয়ার।

লজ্জায় মাটির ভেতর হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে চিত্রলেখার। বউ লজ্জা পাচ্ছা বুঝতে পেরে বেশি একটা সময় নেয় না রওনক। চিত্রলেখাকে এর চাইতে আরও শতশুন বেশি লজ্জা দিবে সে আজ তবে এখন নয়, আর এখানে নয়। বিশেষ কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছে সে নিজেদের জন্য। ওসব হবে তাদের ব্যাক্তিগত মুহূর্তে। চিত্রলেখার কাঁধে মুখ রেখেই রওনক বলে,

-আই হ্যাভ এ সারপ্রাইজ ফর ইউ।

-সারপ্রাইজ! (চিত্রলেখার কন্ঠে স্পষ্ট অবাক হওয়া টের পাওয়া যায়।)

-ইয়েস।

রওনক চিত্রলেখাকে ছেড়ে দিয়ে তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। তারপর বলে,

-পেছনে দেখো।

রওনকের আদেশ মতো পেছন ঘুরতেই খুশি ও আনন্দে চিত্রলেখার চোখ চকচক করে ওঠে নিজের ভাইবোন ও খালাকে দেখে। এমন একটা মুহূর্তের জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না সে। মনে করা তো দূরের কথা আশাও করেনি চিত্রলেখা আজকের পার্টিতে রওনক তার পরিবারের কাউকে ইনভাইন্ট করবে। কেবল লিখনরাই নয় আফিফাও এসেছে বাবুলকে নিয়ে। খুশিতে চিত্রলেখার চোখে পানি এসে পড়েছে। তা দেখে রওনক চিত্রলেখার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

-একদম কাঁদার চেষ্টা করবে না। তোমাকে কাঁদানোর জন্য এই সারপ্রাইজ প্লান করিনি আমি। তোমার হাসি মুখ দেখব বলে এত আয়োজন।

রওনকের আবদার মতো তার দিকে একটা অশ্রু ভেজা হাসি দিয়ে চারুকে জড়িয়ে ধরে চিত্রলেখা। আজ সকালে রওনকের কোনো বিজনেস মিটিং ছিল না। সে গিয়েছিল চিত্রলেখার জন্য সারপ্রাইজ প্লান করতে। চিত্রলেখাকে সে ভালো করেই চিনি। এই মেয়ের বুক ফাটবে তবু মুখ ফুটবে না। ইচ্ছা করলেও মুখ ফুটে বলবে না তার পরিবারকে ইনভাইট করার কথা। কিন্তু চিত্রলেখা বলুক বা না বলুক রওনক জানে তার চন্দ্র কি পেলে খুশি হবে তাই তো নিজে গিয়ে ওদের নিয়ে এসেছে। সবার জন্য শপিং করেছে। আসার সময় ওদের সালুনে দিয়ে গিয়েছিল তৈরি হতে। যেনো আজকের পার্টিতে ওদের বেমানা না লাগে। ওরা যেনো ইতস্ততবোধ না করে। ড্রাইভারকে দিয়ে একটা গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল ওদের নিয়ে আসতে। যদিও লিখন আপত্তি করেছিল তাকে এত কিছু করতে হবে না ওরা নিজেরাই ব্যবস্থা করে নিতে পারবে কিন্তু রওনক কারো আপত্তি শুনেনি। তার একটাই কথা চিত্রলেখার খুশির জন্য, মুখের হাসির জন্য সে সব করতে পারে। চিত্রলেখাকে খুশি করতে রওনকের এত আগ্রহ দেখার পর লিখন আর আপত্তি করেনি, বোনের খুশির জন্য সব মেনে নিয়েছে। অন্যথায় এখানে আসতে অনেক বেশি ইতস্তত লাগছিল তার। এই পরিবেশ তাদের জন্য নয় তা ভালো করেই জানে লিখন। চিত্রলেখা ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের ভাইবোনদের নিয়ে।

-রওনক ভাই।

-আরে রিপা যে কখন এলি তুই?

পরিচিত কারো কন্ঠ শুনতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ পাশ ফিরে তাকায় লিখন। তৎক্ষণাৎই লিখন ও রিপার একে-অপরের চোখে চোখ পরে। রওনক রিপার সঙ্গে চিত্রলেখার পরিচয় করিয়ে দেয়। সবার উপস্থিতিতে লিখন ও রিপা কথা বলে না। নিজ নিজ অবাক হওয়া চেহারা সামলে নেয়। যদিও রিপা তেমন একটা অবাক হয়নি। সে আগে থেকেই জানতো হয়ত লিখনের সঙ্গে তার এখানে দেখা হবে। অবাক হয়েছে লিখন যা তার চোখ-মুখে স্পষ্ট পরিলক্ষিত। কিন্তু এখানে রিপার সঙ্গে কথা বলার কোনো চেষ্টা করে না সে। রিপা এখানে কি করছে, রওনকের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক সব জানার সুযোগ পাবে তাই আপাতত চেপে যায়।

খানিকটা রওনকের কাছাকাছি চেপে এসে চিত্রলেখা কণ্ঠস্বর একদম খাঁদে নামিয়ে কথা বলে যেনো অন্যকেউ শুনতে না পায়। কাছাকাছি আসতে নিয়ে রওনকের শরীরের সঙ্গে চিত্রলেখার শরীর ঘেষে খানিকটা। ফিসফিসে আনন্দ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,

-থ্যাংকিউ সো মাচ।

-ইশ এতবড় সারপ্রাইজের বিনিময়ে শুধু থ্যাংকিউ? আরও বেটার কিছু কি পেতে পারি না আমি?

-কি চাই বলুন।

-যা চাই দিবে?

-যা বলবেন তাই।

-অলরাইট।

চিত্রলেখার হাত ধরে জোরে কেশে রওনক বলে,

-এক্সকিউজ মি প্লিজ, আমরা একটু আসছি।

লাবিব ও তানিয়ার দিকে তাকিয়ে রওনক ইশারা করে লিখনদের খেয়াল রাখতে। আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে চিত্রলেখাকে নিয়ে উপরে চলে যায় সে। নিজের ঘরে প্রবেশ করে তৎক্ষণাৎই দরজার সঙ্গে চেপে ধরে চিত্রলেখাকে। কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই রওনক চিত্রলেখার লিপস্টিকে লাল হয়ে থাকা ঠোঁট জোড়ার দখল নেয়। অনেকক্ষণ নিজেকে সামলে রেখেছিল সে। পার্টি শেষ হওয়া পর্যন্ত নিজেকে সামলে রাখবে বলে ভেবে রেখেছিল কিন্তু যেই চিত্রলেখা নিজে থেকে তার কাছাকাছি এসে ফিসফিস করে কথা বলল। মৃদুভাবে গা ছুঁয়ে দিল হয়ত অবচেতনেই। যেই চিত্রলেখার নিঃশ্বাস রওনকের কান স্পর্শ করলো ব্যস রওনকের সেলফ ডিফেন্স ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে তখনই। আর নিজেকে সামলে রাখতে পারবে না সে। খুব বেশি কিছু না হোক অন্তত ঐ ঠোঁট জোড়ার দখল তার চাই-ই চাই। চিত্রলেখা বুঝে উঠতে পারে না কি হচ্ছে। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ঠোঁট জোড়া বেদখল হয়ে গেছে। রওনকের আচমকা আক্রমনে প্রথমে চিত্রলেখার চোখ বড় হয়। ৩ সেকেন্ড সময় লাগে চিত্রলেখার কি ঘটছে তা বুঝতে, ধাতস্থ হতে। সে চাইলেই এখন আর নিজেকে রওনকের স্পর্শ থেকে আলদা করতে পারবে না। সেই চেষ্টাও করে না অবশ্য। বড় হয়ে থাকা চোখ গুলো রওনকের ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শের আবেশে বন্ধ করে নেয়। হাত বাড়িয়ে রওনকের গলা জড়িয়ে ধরে নিজেও তাল মেলায় রওনকের ঠোঁটের তালে। এই ঠোঁট রওনক ততক্ষণ না ছাড়ার পন করেছে যতক্ষণ না তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। আজ চিত্রলেখার রেহাই নেই। আগের চাইতে আরও হিংস হয় সে। তার হাত চলে গেছে চিত্রলেখার শাড়ির ভেতরে। রওনকের স্পর্শ যেনো আরও পাগল করে দিচ্ছে চিত্রলেখাকে। এই পাগলামী, উন্মাদনার শেষ কোথায় চিত্রলেখার জানা নেই। তবে তার মন্দ লাগছে না এভাবে নিজেকে রওনকের কাছে সপে দিতে, রওনককে নিজের দখল দিতে একটুও খারাপ লাগছে না। উষ্ণ ভালো লাগায় অঙ্গে অঙ্গে কাঁপন ধরছে তার। আরও কিছু চাই তার, আরও বেশি কিছু।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

পার্টির অবশিষ্ট সময় চিত্রলেখা আর রওনকের চোখে চোখ রাখতে পারেনি। মুখ তুলে তার দিকে তাকাতে পারেনি লজ্জায়। এভাবে সে রওনকের ঠোঁটের উষ্ণ আহবানে সাড়া দিয়ে ফেলবে ভাবতেই পারেনি। এখন লজ্জায় ম রে যেতে ইচ্ছা করছে। পার্টির প্রায় শেষের দিকে সবার থেকে বিদায় নিয়ে রওনক লাবিবকে সঙ্গে করে নিজের ঘরের অফিসে বসেছে। কি যেনো জরুরী কাজ পরে গেছে তার। ওরা পার্টি ছেড়ে যাবার কিচ্ছুক্ষন পর তানিয়াও ওদের জয়েন করেছে। চিত্রলেখা এখন বসে আছে তার নিজের ঘরে। পার্টিতে পরা শাড়িটা এখনো খোলেনি সে। রওনকের আবদার, সে ফ্রি না হওয়া অব্দি যেনো চিত্রলেখা এই শাড়িতেই থাকে। মেকাপটাও ছাড়েনি সে। বলা যায় এক কথায় পার্টির গেটাপেই আছে সে এখনো, রওনকের অপেক্ষায়। মেহমান সব চলে গেছে প্রায় ঘন্টা খানিক আগে। রওনক বলেছিল লিখনদের রাতটা থেকে যেতে কিন্তু এতে রাজি হয়নি নারগিস বেগম। এমনিতেই ওদের বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হয়নি। এবাড়িতে আসার পর থেকেই অজানা এক অস্থিরতায় অস্থির হয়ে আছেন। কতক্ষনে বাড়ি ফিরে যাবেন সেই চিন্তায় ছিলেন আসার পর থেকে। তারউপর একটা বিষয় উনার খটকা লেগেছে। রওনকের মা তথা চিত্রলেখার শাশুড়ি উনাদের সঙ্গে দেখে করেননি। যদিও সবাইকে বলা হয়েছে ইনার শরীর ভালো নেই তাই পার্টি জয়েন করতে পারছেন না, তবুও একটা খটকা থেকেই যায়। আগবাড়িয়ে নারগিস বেগম কিছু জিজ্ঞেসও করেননি। তবে এই বিষয়ে চিত্রলেখার সঙ্গে কথা আছে উনার। চিত্রলেখা জানে তার ভাইবোন, খালার মনের অবস্থা তাই কাউকে জোর করেনি থেকে যাবার জন্য। রওনকের আদেশে তার ড্রাইভার ওদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসে। যদিও লিখন বলেছিল ওরা উবার নিয়ে নিবে কিন্তু রওনককে বুঝায় সে সাধ্য কার আছে?

নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রীল ধরে সামনের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে চিত্রলেখা। মস্তিষ্কের ভেতর একটা ভাবনাই ঘুরপাক খাচ্ছে, কখন আসবে রওনক। তার অপেক্ষাতে ইতি টেনে আচমকাই চিত্রলেখাকে পেছন থেকে জড়িয়ে রওনক। সামান্য কেঁপে ওঠে চিত্রলেখা। তার কাঁধে মুখ রেখে রওনক বলে,

-আই মিসড ইউ বউ।

চিত্রলেখার গাল লাল হয়। লজ্জা পাওনা দ্বিগুণ হয়। রওনক তার হাতের বাঁধন শক্ত করে আগের চাইতে আরও বেশি। পাশের ঘরেই ছিল সে। অথচ রওনকের আচরণে মনে হচ্ছে কতদিন পর দেখা তাদের। এইসব অনুভূতি যেনো লজ্জাই দেয় চিত্রলেখাকে। বউকে লজ্জা পেতে দেখে আরেকটু বেশি লজ্জা দিতে চিত্রলেখার কানের নিচে চুমু খায় সে। চিত্রলেখার মনে হয় তার শরীরে শিহরনের ঢেউ খেলে গেল। এর আগে কখনো এমন অনুভব হয়নি তার। রওনক কাছাকাছি থাকলে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় চিত্রলেখার। এক মুহূর্ত সময় দিয়ে চিত্রলেখাকে নিজের দিকে ঘোরায় রওনক। চিবুক স্পর্শ করে মুখ উপরে তুলে ধরে। কিন্তু লজ্জায় চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে। আজ একের পর এক যা হচ্ছে এরপর আর রওনকের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখার সাহস করতে পারছে না চিত্রলেখা। মনে হচ্ছে সে চোখ মেলে রওনকের চোখের দিকে তাকালেই আজ একটা অঘটন ঘটে যাবে। যে অঘটনের পূর্বাভাস রওনক তাকে দিয়ে রেখেছে। কি হতে যাচ্ছে বা হতে পারে ভেবেই চিত্রলেখার গলা শুঁকিয়ে আসছে আসন্ন ঘটনার চিন্তায়।

-চোখ খোলো চন্দ্র।

রওনকের কথায়ও চোখ খোলে না চিত্রলেখা। দুষ্টু হাসি হেসে বলে,

-আই সোয়ার এক্ষন চোখ না খুললে আমি তোমাকে খেয়ে ফেলবো।

রওনকের হুমকি শুনে তৎক্ষণাৎ চোখ মেলে তাকায়। চিত্রলেখার চোখের অবস্থা দেখে হাসি পায় রওনকের। কেমন বড় হয়ে গেছে আতংকে। এই মেয়েটা এমন কেনো মনে মনে ভাবে সে। এতক্ষন চিত্রলেখার দুই বাহু ধরে রেখেছিল সে। ডান হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার চোয়াল স্পর্শ করে। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ঠোঁট স্পর্শ করে। দু’জনের একজনও অপরজনের দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি সরায় না। যেনো একে-অপরের চোখে আটকে গেছে তারা। আচমকাই রওনক বলে,

-আই এম সরি।

চোখ সরু হয় চিত্রলেখার। হঠাৎ এই সরির কারণ ধরতে পারে না সে। তাকে অবশ্য খুব বেশি একটা ভাবতেও হয় না। রওনক নিজেই বলে,

-একটা জরুরী কাজ পরে গেছে। আমাকে দেশের বাইরে যেতে হবে। টিকেট বুক করা হয়ে গেছে। সকাল ৮ টার ফ্লাইট।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে রওনক আরও বলে,

-হয়ত ৭ থেকে ১০ দিন লেগে যাবে আমার ফিরতে। আমি চেষ্টা করব জলদি ফিরে আসার। আমি ফিরে আসার পর আই ইউল রিয়েলি ম্যাক ইট আপ টু ইউ, আই প্রমিজ।

এতক্ষনে বুঝতে পারে চিত্রলেখা, রওনক তাকে বারবার বিশেষ কিছুর ইংগিত দিয়েছে সেটাই পিছিয়ে গেছে। সেজন্যই এই সরি বলা তার। একটা নতুন বিদেশি ব্যভারেজ বাংলাদেশে খুব জলদিই লঞ্চ করবে রওনক। সেই সংক্রান্ত কিছু কাজেই তাকে মেক্সিকো যেতে হচ্ছে। গাজীপুরে রওনকের কারখানায় তৈরি করা হলেও কাঁচামাল আসবে মেক্সিকো থেকে। এই প্রোডাক্ট লঞ্চের জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছে সে। এই প্রোডাক্টটা মার্কেটে আসার পর কোম্পানির সেল কয়েকগুন বেড়ে যাবে। কয়েক দফায় ল্যাব টেস্ট করা হয়ে গেছে। কাঁচামাল ফ্যাক্টরিতে আসার অপেক্ষায় এদিকে সবরকম প্রস্তুতি নেয়া শেষ। কাঁচামাল আসার আগে ফেইস টু ফেইস আরেকটা মিটিং করতে হবে। রওনক চেষ্টা করেছিল মিটিংটা অনলাইনে সেরে ফেলতে কিন্তু কিছু কাজ থাকে যা চাইলেই অনলাইনে করা যায় না। ফেইসভ্যালুর একটা ব্যাপার আছে। তাছাড়া তাকে ঐ কোম্পানির ফ্যাক্টরিতেও যেতে হবে। আর এই প্রজেক্টটা রওনকের জন্য অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ন তাই কোনো চান্স নিতে চায় না সে। অন্য কিছু হলে পোসপন করে দেবার আগে দুইবার ভাবতো না।

চিত্রলেখাকে চুপ করে থাকতে দেখে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-রাগ করেছো?

জবাবে কেবল মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। রওনক নিজেই আরও বলে,

-আমি জানি এই সময়টা আমার তোমার সঙ্গে থাকা উচিত বাট আই এম ইন এ টাইট সিচুয়েশান।

এক মুহূর্ত কিছু ভেবে রওনক আরও বলে,

-এক কাজ করলে কেমন হয়?

-কি?

-তুমি আমার সঙ্গে চলো।

-আমি!

-হ্যাঁ, সারাদিন তো আর আমি কাজে বিজি থাকবো না। ফ্রি টাইমে আমরা আমাদের মতো ঘুরে বেড়ালাম। এ মিনি হানিমুন।

-কিন্তু…

-কি?

-আমার তো পাসপোর্ট, ভিসা কিচ্ছু নেই।

-ও শীট!

আবার কিছু একটা চিন্তা ভাবনা করে রওনক বলে,

-লাবিবকে বলে যাবো আমি ফিরে আসার আগেই যেনো তুমি তোমার পাসপোর্ট হাতে পেয়ে যাও। ওকে?

চিত্রলেখা আবারও মাথা ঝাঁকায় সম্মতিতে। আচমকাই চিত্রলেখাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে ভেতরে ফিরে যেতে যেতে রওনক বলে,

-চলো ঘুমিয়ে পড়ি। ৮ টার ফ্লাইট আমার, ৫টার আগে বের হতে হবে।

চিত্রলেখাকে চেঞ্জিং রুমের দরজার সামনে নামিয়ে দিয়ে রওনক আরও বলে,

-থ্যাংকিউ।

-কেনো?

-আমার কথা রেখেছো। শাড়িটা পাল্টে ফেলোনি।

-ওহ!

চিত্রলেখার থেকে দু’হাত পেছনে সরে গিয়ে রওনক বলে,

-বাই দ্যা ওয়ে তোমার তো আজ এই শাড়ি পরার কথা ছিল না। আমার যতটুকু মনে পড়ে তুমি গাউন পরেছিলেন।

চিত্রলেখা নার্ভাস হয়ে পড়ে। আমতা আমতা করে বলে,

-আসলে হয়েছিল কি… আ আমি ওসব কখনো পরিনি তা তাছাড়া ঐ গাউনটায় সব দেখা যাচ্ছিল তাই তাই ওটা পরে বের হবার সাহস হয়নি আমার। সবাই তাকিয়ে থাকতো। আম আমি…

-কিন্তু ওটার সঙ্গে তো একটা এক্সট্রা পার্ট ছিল উপরের, তোমার শোল্ডার ডাকার জন্য। আমি স্পেশিয়ালি অর্ডার দিয়ে বানিয়েছি।

-কিহ! (কি তা একটু জোরেই বের হয়ে আসে চিত্রলেখার মুখ ফসকে।)

-হ্যাঁ, ওটা উপরে পরলে তোমার শোল্ডার দেখা যেতো না।

-কিন্তু আমাকে তো ওটা দেয়াই হয়নি। আমি আরও ভাবলাম ওভাবেই নিচে যেতে হবে সেজন্যই তো লাস্ট মোমেন্টে এই শাড়িটা…

চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক বলে,

-তুমি ভাবলে কীভাবে একটা অফ শোল্ডার গাউন পরে এত মানুষের সামনে তোমাকে যেতে দিবো আমি তাও যে ড্রেসে তোমার ক্লিভেজ দেখা যাচ্ছে এমন একটা ড্রেস। এই জিনিস শুধু আমি দেখবো, আমি। কেউ তোমার নগ্ন শরীরের দিকে তাকানোর আগে তার চোখ তুলে ফেলবো।

ভালো লাগা ও লজ্জার সংমিশ্রিত এক অদ্ভূত অনুভূতি অনুভব করে চিত্রলেখা। তার নার্ভাসনেস টের পেয়ে রওনক বলে,

-ইটস ওকে, আমি তো দেখেছি ব্যস আর কেউ না দেখলেও চলবে। তবে এই শাড়িটাতেও কোনো অংশকে কম কিছু লাগেনি তোমাকে। ইউ অয়েরা লুকিং আউস্টেন্ডিং টুডে। এখন যাও চেঞ্জ করে নাও তারপর শুয়ে পরি।

রওনক চেঞ্জ করতে যেতে বলার পরেও দাঁড়িয়ে থাকে চিত্রলেখা। তা দেখে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কিছু বলতে চাও?

মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা।

-তাহলে বলে ফেলো।

-আমি আপনাকে এয়ারপোর্ট দিয়ে আসি।

-দিয়ে আসতে চাও?

সম্মতিতে দ্রুত মাথায় ঝাঁকায় চিত্রলেখা।

-ঠিক আছে অবশ্যই যাবে। প্রথমবার কেউ আমাকে সি অফ করতে এয়ারপোর্ট যাবে। আই এম এক্সাইটেড।

-আরেকটা কথা।

-আরও একটা?

-হু

-বলো।

-ওখান থেকে আমি খালার বাসায় যাই?

-আমি না করলে যাবে না?

কিছু বলে না চিত্রলেখা কেবল মাথা নুইয়ে ফেলে। তা দেখে এগিয়ে এসে তাকে নিজের আলিঙ্গনে নিয়ে বলে,

-কোথাও যাবার জন্য তোমাকে আমার পারমিশন নিতে হবে না বউ। তোমার যেখানে খুশি যাবে। জাস্ট আমাকে জানিয়ে গেলেই হবে কোথায় যাচ্ছো যেনো আমার টেনশন না হয়, ব্যস এতটুকু করলেই চলবে।

রওনকের বুকে মাথা রেখেই মাথা ঝাঁকায় সে। চিত্রলেখার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রওনক বলে,

-আরেকটা কাজ করতে পারো। আমি যেহেতু থাকছি না তুমি চাইলে কয়টা দিন ওখানে থেকে আসতে পারো।

-সত্যি!

অবিশ্বাস্য চাহনি নিয়ে রওনকের বুক থেকে মাথা তুলে মুখের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। তার নাক টেনে দিয়ে বলে,

-একদম সত্যি। শুধু খালার কাছেই নয় চাইলে আফিফার কাছেও থেকে আসতো পারো। শুধু আমি ফিরে আসার আগে চলে এসো তাহলে হবে।

-কিন্তু আমি চলে গেলে মীম, মিশকাতকে কে দেখবে।

-ওদের দেখাশুনার জন্য লোক আছে চন্দ্র। তুমি ওদের কেয়ার টেকার ন,ও গার্ডিয়ান। হয়ত সম্পর্কে চাচী তবে একচুয়েলি ওদের মা তুমি। যেমন আমি চাচা হয়েও ওদের বাবা। নিজেকে সময় দাও। মীম, মিশকাতের জন্য তোমাকে নিজের খুশি সেক্রিফাইজ করতে হবে না। আমি দিবোও না তোমাকে এই কাজ করতে। বুঝতে পেরেছো?

হাসি হাসি মুখ করে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। আরও একবার তার নাক টেনে দিয়ে রওনক বলে,

-দ্যাটস মাই গার্ল।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৫৮+৫৯+৬০

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

-কেমন আছেন মামুন সাহেব?

আচমকা কারো আওয়াজ পেয়ে পেছন ফিরে তাকায় মামুন। কন্ঠটা তার পরিচিত নয়। পেছন ঘুরে রওনককে দেখে তৎক্ষণাৎ ভ্রু কুচকায় সে। তাকে দেখে মামুনের রিয়্যাকশন দেখে মৃদু হাসে রওনক। মামুনের পক্ষ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে রওনক নিজেই আবার বলে,

-ব্যস্ত না থাকলে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

এই লোকটাকে অর্থাৎ রওনকে কোনোভাবেই এখানে আশা করনি মামুন। তার সঙ্গে চিত্রলেখার বরের কি কথা থাকতে পারে? অনেক চিন্তা ভাবনার পর মামুন বলে,

-বলুন।

-এখানে নয়। আপনি কি একটু কষ্ট করে আমার সঙ্গে আসবেন? কনফিডেন্টশিয়াল কথা তাই পাবলিক প্লেসে বলতে চাইছি না।

মাথা ঝাঁকায় মামুন। রওনক আরও বলে,

-আমার গাড়িটা ওইদিকে আছে চলুন।

বাড়তি কথা বলে না মামুন। রওনকের সঙ্গে তার কোনো কথা না থাকলেও তাকে চিত্রলেখার হাসবেন্ড কি বলতে চায় তা জানার কৌতুহল অবশ্য দমিয়ে রাখতে পারছে না মামুন। সেজন্যই মূলত আপত্তি না করে সঙ্গে যাওয়া। আবার মামুন মনে মনে এটা ভাবে রওনক যা বলতে চায় সেটা কোনোভাবে চিত্রলেখার সঙ্গে সংপৃক্ত কিনা! সবকিছুই ভাবায় তাকে। ভাবনাদের হাতে ঠেলে রওনকের সঙ্গে তার গাড়িতে উঠে বসে মামুন। রওনকের ইশারায় ড্রাইভার গাড়ি চালাতে আরম্ভ করে।

-কেমন আছিস আপা?

চিত্রলেখার ফোন কল পেয়ে তৎক্ষণাৎ রিসিভ করে এই কথাটাই প্রথম জিজ্ঞেস করে লিখন।

-ভালো আছি।

-সত্যি ভালো আছো?

-কখনো আমাকে মিথ্যা বলতে শুনেছিস?

-জানি তুমি মিথ্যা বলো না কিন্তু ঠিকই কথা আড়াল করো। যে কথাটা শুনলে আমরা দুঃখ পাবো সেটা কখনোই আমাদের বলো না, নিজে নিজে একা কষ্ট পাও।

-এভাবে বলছিস কেন লিখন?

-এমনি আপা। তোমাকে মিস করছিলাম তাই হয়ত। সত্যি সত্যি একদিন বিয়ে করে তুমি শশুড়বাড়ি চলে যাবে ভাবতাম কিন্তু দিনটা এত জলদি আসবে তা কখনো ভাবিনি। এভাবে যে আচমকা আসবে সেটাও তো চিন্তা করিনি। বাড়ি ফিরলে তোমাকে দেখতে পাবো না ভাবলেই…

লিখনের গলা ধরে আসে কথাটা শেষ করতে পারে না সে। লাইনের অন্যপাশে চিত্রলেখার গাল বেয়ে ইতোমধ্যেই অশ্রু ঝড়তে শুরু করেছে। খানিক নীরবতার পর লিখন নিজেকে সামনে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-তুমি কি কাঁদতেছো আপা?

নিজের কান্না গিলে ফেলার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-ক কই না তো।

-মিথ্যা বলতে পারো না তাও কেন বলো? জানো ধরে পড়ে যাবা। তুমি এত বাজে মিথ্যা বলো আপা, তোমার থেকে চারু বেশি সুন্দর গুছায় মিথ্যা বলতে পারে। ধরতেই পারবা না ও মিথ্যা বলতেছে। আচ্ছা আপা বলো তো তুমি মিথ্যা বলতে পারো না অথচ চারুটা এমন মিথ্যুক কীভাবে হলো?

লিখনের কথা শুনে হেসে ফেলে চিত্রলেখা। হেসে ফেলে বলে,

-একদম আমার চারুকে মিথ্যুক বলবি না। চারু মিথ্যা বলে না।

-বলে আপা অনেক মিথ্যা বলে।

-তুই নিজে বলিস না ভাবছিস?

-ওমা এখন তুমি আমাকে মিথ্যুক বলবা?

-মিথ্যুক বলছি না। আমি জানি আমাকে কষ্ট না দেয়ার জন্য তোরা অনেক কিছুই আমার থেকে আড়াল করে রাখিস। এটাকে মিথ্যা বলে না রে লিখন।

-যেমন তুমি করো।

লিখনের এই কথার পিঠে আর কিছু বলে না চিত্রলেখা। এটা সত্যি, এতগুলো বছরে অনেক কথাই আড়াল করেছে সে ভাইবোনদের থেকে শুধুমাত্র ওদের কষ্ট দিতে চায় না বলে। ভাইবোনের কথা মনে পড়ছিল বলে লিখনকে ফোন দিয়েছে চিত্রলেখা। এখন তো চাইলেই যখন খুশি তখন ভাইবোনের কাছে ছুটে যেতে পারবে না সে। তার জগৎ টা এখন আর কেবল তাই ভাইবোনকে ঘিরে নেই। রওনক নামক একজন মানুষ তার জগতের আধিপত্ত লাভ করেছে। যাকে চাইলেই চিত্রলেখা আর উপেক্ষা করতে পারবে না। কথার প্রসঙ্গ ঘুরাতে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-খালা, চারু, চয়ক সবাই কেমন আছে আরে?

-তোমাকে ছাড়া যেমন থাকার কথা তেমনই আছে আপা। কেউ মুখে বলে না কিন্তু আমি জানি সবাই তোমাকে অনেক মিস করছে। কিন্তু তুমি চিন্তা করো না কয়েকটা দিন পর সবাই ঠিক সামলে উঠবে।

-হুম…

খানিকটা ইতস্ততা নিয়েই লিখন বলে,

-একটা কথা জিজ্ঞেস করি আপা?

-হ্যাঁ বল।

-তুমি সত্যি ভালো আছো তো? ঐবাড়ির সবাই তোমাকে খুশি মনে আপন করে নিয়েছে তো?

চিত্রলেখা জানতো লিখন তাকে এই প্রশ্নটা করবেই দু’দিন আগে বা পরে। নিজেকে সামলে নিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-সত্যি আমি ভালো আছি রে। আমাকে নিয়ে একদম ভাবিস না। আমি ভালো আছি।

মানুষ যখন ভালো থাকে না তখন বারবার ভালো আছি বলে নিজেকে, নিজেরে আশেপাশের মানুষগুলোকে বুঝাতে চেষ্টা করে সে ভালো আছে। চিত্রলেখা এখন যেনো সেই কাজটাই করছে। লিখন আর প্রেসার দেয় না। বোনের কথা মেনে নিয়ে বলে,

-যাই হয়ে যাক, পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক না কেনো আমি লিখন তোমার ভাই সবসময় তোমার পাশে আছি। তুমি যাই বলবে আমি তাই বিশ্বাস করব যদি সেটা মিথ্যা হয় তবুও সেটাই আমার জন্য সত্যি হবে যদি তুমি বলো। তাই কখনো নিজেকে একা ভাববে না। তোমার লিখন সবসময় তোমার পাশে আছে আপা। চারু, চয়ন এখনো ছোট কিন্তু আমি আছি।

লিখনের সঙ্গে কথা বলার পর হালকা লাগছে চিত্রলেখার। সে জানে, এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ তার সঙ্গ ছেড়ে দিলেও এই তিনজন মানুষ যাদের শরীরে একই রক্ত বইছে, চিত্রলেখার সবচাইতে আপনজন, এরা কখনো কোনো পরিস্থিতেই তার হাত ছাড়বে না। লিখনের সঙ্গে কথা বলার পর হালকা লাগছে চিত্রলেখার। হাত থেকে মোবাইল নামিয়ে রেখে সবেই বিছানায় বসেছে সে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে পেছন ফিরলে দেখে তানিয়ে প্রবেশ করছে। এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করে,

-ব্যস্ত? বিরক্ত করলাম না তো?

-একদম না, আসুন না প্লিজ।

-পার্লারের মেয়েরা চলে এসেছে। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, এসো।

তানিয়া আগে তার পেছন পেছন চিত্রলেখা হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করে,

-আমি এসব না করলে হয় না?

চিত্রলেখার কথা শুনে থেমে দাঁড়িয়ে তানিয়া বলে,

-এগুলো তো বেসিক। রাতের পার্টির জন্য তৈরি হবার আগে একটু ফেশিয়াল করে নিলে ম্যাকাপটা ভালো সেট হবে ফেইসে।

আমতা আমতা করে চিত্রলেখা বলে,

-আমি কখনো এসব করিনি।

তানিয়া এগিয়ে এসে চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে আশ্বস্ত করে বলে,

-আমি জানি। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা শুরু আছে তাই না বলো? আমি আছি তো তোমাকে শিখিয়ে দিতে। আমি চলে যাবার আগে তোমাকে সবকিছু শিখিয়ে দিয়ে যাবো যেনো আমি যাবার পর তোমার কোনো সমস্যা না হয়। যেনো কোনো পরিস্থিতে তুমি রওনকের পাশে দাড়াতে পারো। আমি চলে যাবার আগে সব বুঝিয়ে, শিখিয়ে দিয়ে যাবো তোমাকে।

এবারে চিত্রলেখা তানিয়ার হাত ধরে বলে,

-থেকে গেলে হয় না? কোনোভাবেই কি থেকে যাওয়া যায় না? মিশকাত, মীমের জন্যও না?

চিত্রলেখার অবুঝ আবদার শুনে তানিয়ার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তার হাসি দেখে বিভ্রান্ত হয় চিত্রলেখা। হাসি হাসি মুখ করেই তানিয়া বলে,

-থেকে যেতে পারলে কি আর চলে যাবার কথা ভাবতাম? আমি তো থাকতেই এসেছিলাম। চলে যাবার কথা তো কখনো ভাবিনি। যার জন্য, যার হয়ে এসেছিলাম একদিন সবকিছু পেছনে ফেলে সেই তো আমার নেই। যার আমাকে শক্ত আলিঙ্গনে ধরে রাখার কথা সেই তো কখনো আমাকে আগলে রাখেনি তাহলে কার জন্য থাকবো? কিসের আশায় থাকব?

-মীম, মিশকাত এর চাইতে বড় কারণ কি কিছু হতে পারে?

-আমি কখনোই আমার সন্তানদের বাঁধা হিসেবে দেখিনি। ওদের জন্য তো তুমি আর রওনক আছোই। ওদের নিজের বাবা যে আদর ভালোবাসা দিতে পারেনি, রওনক কখনো সেই অভাব ওদের বুঝতে দেয়নি। জন্ম দিয়েছি বলেই আমার কোনো অধিকার নেই রওনকের কাছ থেকে ওদের কেড়ে নিবো।

-আমি তো সবে এলাম। আমি কি পারবো আপনার মতো করে…

চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না নিয়ে তানিয়া বলে,

-তুমি আমার চাইতে ভালো পারবে আমি জানি। রওনক এমনি এমনি তোমাকে বিয়ে করেনি চিত্রলেখা। তোমার নিজের উপর সন্দেহ থাকলেও রওনকের সিদ্ধান্তের উপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারো।

-তুবও আমাদের সাথে না হয় থেকে যেতেন।

-থাকতাম যদি আশার কোনো আলো অবশিষ্ট থাকতো। যতদিন ছিল ততদিন ছিলাম। আমার পৃথিবীর সবটা জুড়ে অন্ধকার নেমে আসার পরেই আমি নতুন আলোর সন্ধানে নেমেছি। আমি বাঁচতে চাই চিত্রলেখা। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই। আর অন্যের জন্য নয় এবার কেবল নিজের জন্য বাঁচতে চাই। একটা মানুষ যাকে আমি মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছি শুরু থেকে। যার জন্য নিজেকে উজার করে দিয়েছি। ভালোবেসে যার সন্তানের মা হয়েছি। দিনশেষে উপলদ্ধি করলাম মানুষটা শুরু থেকে কখনোই আমার ছিল না। বিশ্বাস করো, সে যদি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলে মিথ্যা করেও বলো সে শুধু আমার। আমি তার মিথ্যাটাকে সত্যি মেনে নিয়েই থেকে যেতাম। আর সত্যি মিথ্যা খুঁজতাম না।

এরপর আর চিত্রলেখার মুখে কথা জোগায় না। আসলেই তো কিসের আশায় থেকে যাবে তানিয়া! বিয়ের পর একটা মেয়ের জীবনের সবচাইতে বড় খুটি তার স্বামী। যে মানুষটার হাত ধরে সব পেছনে ফেলে নতুন করে জীবন শুরু করে একটা মেয়ে। সেই মানুষটাই যদি নিজের না থাকে তাহলে কিসের আশা থাকবে সে? তানিয়া তো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি। তারও তো বাঁচার অধিকার আছে। ভালো থাকার অধিকার আছে।

চিত্রলেখাকে আপন ভাবনায় হারিয়ে যেতে দেখে তানিয়া হাত ঝাঁকি দিয়ে বলে,

-চলো মেয়েগুলো অপেক্ষা করছে অনেকক্ষন হয়। তোমার বর এসে যদি দেখে আমরা এখনো ফেশিয়াল শেষ করিনি তাহলে খবর আছে। কাজের ব্যাপারে কত পাংচুয়াল জানো তো।

চিত্রলেখা মাথা ঝাঁকায়। তানিয়া তার হাত ধরে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

ফেশিয়াল, মেনিকিউর, পেডিকিয়র শেষ করে নিজের ঘরে ফিরে আসতেই চিত্রলেখা দেখে তার বিছানার উপর অনেকগুলো ব্যাগ রাখা। একসঙ্গে এতগুলো ব্যাগ দেখে কৌতুহল জাগে চিত্রলেখার মনে। কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে মনে মনে কাউন্ট করে, ২২ টা ব্যাগ। কে রেখেছে এতগুলো ব্যাগ এখানে? কার এগুলো? রওনক কি ফিরে এসেছে? দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় চিত্রলেখা। আড়াইটার বেশি বাজে। রওনক যাবার আগে বলে গিয়েছিল আজ জলদিই ফিরে আসবে কিন্তু কখন ফিরবে সেটা বলে যায়নি। কিন্তু সে ফিরলে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই তাকে জানাতো। ফেশিয়াল করতে বসার আগে জাহানারা ফুফুকে চিত্রলেখা নিজেই বলেছিল রওনক ফিরলে যেনো তাকায় জানায়। ব্যাগগুলো কার, কে রেখেছে, এখানে কেনো এমন হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে চিত্রলেখার মস্তিষ্কে। আচমকাই চিত্রলেখার সব প্রশ্নের উত্তর হয়ে চেঞ্জিং রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে রওনক। তাকে দেখে অবাক হয়েছে চিত্রলেখা। অবাক হবারই কথা। চিত্রলেখাকে বিছানার কাছে দেখে এগিয়ে আসতে আসতে রওনক বলে,

-টোটাল ৪৫ টা শাড়ি আছে।

-৪৫ টা!

সামান্য অবাক হলেও বিশেষ ভাবে না চিত্রলেখা। বাসার সবাই প্লাস আত্মীয় স্বজনদের জন্য এনেছে হবে হয়ত। কিন্তু চিত্রলেখাকে অবাক হবার চুড়ান্তে পৌঁছে দিতে রওনক বলে,

-তোমার জন্য। দেখো পছন্দ হয় কিনা।

চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকায় চিত্রলেখা, রওনকের কথা শুনে। ৪৫ টা শাড়ির তার জন্য! এমনিতেই তো আলমারি ভরতি কাপড় চোপড় দিয়ে। এরপর আবার শাড়ি তাও ২ টা বা ৫টা নয় ৪৫ টা! এই লোকের কি মাথায় সমস্যা? মনে মনে ভাবলেও মুখে জিজ্ঞেস করতে পারে না রওনককে আসলেই তার মাথায় সমস্যা আছে কিনা। চিত্রলেখাকে অবাহ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনক এগিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বউকে উষ্ণ আলিঙ্গনে। আচমকা রওনকের জড়িয়ে ধরায় এবার যেনো ভেঙে পড়ে চিত্রলেখা। এই মানুষটার স্পর্শে এমন দূর্বল হয়ে যায় কেনো সে? বুকের ভেতর কিছু একটা তোলপাড় করছে। নিঃশ্বাস ভার হয়ে আসতে চাইছে চিত্রলেখার। তা বুঝতে পেরে রওনক চিত্রলেখার কাঁধে মুখ রেখে একদম কানের কাছে গিয়ে বলে,

-এখনো আমি স্পর্শ করলে তুমি কেঁপে উঠছো। এত ঘাবড়ে যাচ্ছো কেনো? আমি তো, তোমার রওনক।

বলেই চিত্রলেখার কাঁধে একটা লম্বা চুমু খায় সে। চিত্রলেখাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চিবুক ছুঁয়ে মুখ উপরের দিকে তুলে। চিত্রলেখার শরীর জুড়ে অনুভূতিদের দৌড়াদৌড়ি চলছে। লজ্জায় চিত্রলেখার লাল হয়ে যাওয়া নাকে ছোট করে ঠোঁট ছুঁয়ে রওনক বলে,

-গতকাল ঐ শাড়িটাতে খুব সুন্দর লাগছিল তোমাকে তাই আমার পছন্দ মতো কিছু আড়ং কটনের শাড়ি এনেছি, তোমার জন্য ছোট্ট একটা গিফট। একটু কারেকশন করি। ৪০ টা শাড়ি তোমার আর বাকি ৫ টা আফিফার জন্য।

-আফিফার!

চিত্রলেখার কন্ঠে স্পষ্ট অবাক হওয়া। রওনক বলে,

-হু, গতকাল আফিফা তোমাকে নিজের শাড়ি না পরিয়ে দিলে তো আমি জানতেই পারতাম না নরমাল একটা সুতির শাড়িতে তোমাকে দেখতে এত সুন্দর লাগবে। ঐ শাড়িটা তুমি রেখে দিও। আরেকদিন না হয় আমার জন্য পরো। আর ঐ শাড়িটার এক্সচেঞ্জে নতুন ৫ টা শাড়ি আমার পক্ষ থেকে আফিফার জন্য ছোট্ট একটা গিফট।

রওনকের বাহুবন্ধনে থেকেই চিত্রলেখা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার ব্যাগগুলো দেখে নিয়ে বলে,

-ছোট্ট গিফট এটা? ৪৫ টা শাড়ি। কেউ কেউ হয়ত সম্পূর্ন জীবনে ৪৫ টা শাড়ি পরার সুযোগ পায় না আর আপনি বলছেন ছোট্ট গিফট!

-৪৫ না ৪০ টা তোমার।

-এক বালতি দুধ থেকে এক গ্লাস দুধ কেউ খেয়ে ফেললে কি খুব বেশি পার্থক্য হবার কথা?

রওনক মাথা ঝাঁকায়। চিত্রলেখা বলে,

-তেমনি ৪৫ যা ৪০ ও তাই।

ভ্রু কুঁচকে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-সো আর ইউ টেকিং মাই গিফট ওর রিজেক্টিং মি?

মাথা ঝাঁকিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আমার সেই সাধ্য কোথায় আপনার দেয়া উপহার উপেক্ষা করব।

চিত্রলেখার জবাব টা পছন্দ হয় না রওনকের। সে চিত্রলেখাকে কোনো কিছুর জন্য জোর করতে চায় না, করবেও না। রওনক দুই হাতে চিত্রলেখার কোমড় জড়িয়ে রেখেছিল। একটা হাত এবারে চিত্রলেখার গালে রেখে বলে,

-ইটস ওকে, জোর করে তোমায় কিছুই করতে হবে না। তুমি নিতে না চাইলে আমি সব রিটার্ন পাটিয়ে দিচ্ছি।

চিত্রলেখা রওনকের টি-শার্ট চেপে ধরে বলে,

-প্লিজ এর প্রয়োজন নেই। আপনি শখ করে এনেছেন, অবশ্যই আমি পরবো।

-আমাকে খুশি করতে?

-না, আমি খুশি হয়েই পরবো। এর আগে কখনো কেউ আমাকে শাড়ি কিনে দেয়নি। জীবনে প্রথম কেউ দিলো আমি ফিরে দেই কীভাবে?

রওনক আর কিছু বলে না। হাসি ফুটে ওঠে তার চোয়াল জুড়ে যা চিত্রলেখাও দেখতে পায়। কিন্তু চিত্রলেখাকে নিজের থেকে আলাদা করে না সে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-আপনি কখন এলেন?

-অলমোস্ট থার্টি মিনিট হবে।

-আমাকে ডাকেননি কেনো? আমি তো ফুপিকে বলেছিলাম আপনি এলে আমাকে জানাতে।

-আমি খালাকে বলেছিলাম তোমাকে ডিস্টার্ব না করতে। আই উইল ওয়েট ফর ইউ।

চিত্রলেখ আবারও ঘড়ি দেখে জিজ্ঞেস করে,

– নিশ্চয়ই কিছু খাননি, খাবার দিতে বলি?

-তুমি খেয়েছো?

জবাব না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করে রওনক। সে জানে চিত্রলেখা দুপুরে খায়নি। এমন নয় যে ফেশিয়াল ইত্যাদি করায় ব্যস্ত ছিল সেজন্য খাবার সু্যোগ পায়নি। রওনক বাসায় ফিরে সবার আগে জাহানারাকে জিজ্ঞেস করেছিল চিত্রলেখা দুপুরে খেয়েছে কিনা। চিত্রলেখা একা খাবে না সেটা রওনক জানতো বলেই মিটিং শেষ করে বাইরে খাওয়া দাওয়া করেনি সোজা বাড়ি ফিরে এসেছে চিত্রলেখার কাছে। জবাব না দিয়ে চিত্রলেখা মাথা ঝাঁকায়।

-খাওনি কেনো?

-আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

-আমি যদি এখন না আসতাম তাহলে?

-অপেক্ষা করতাম।

-ডন্ট ইউ ডেয়ার। আজ রাগ করছি না কিন্তু এরপর সময় মতো খেয়ে নিবে প্লিজ। আমি জানি তুমি এখানে কমফোর্টেবল না, স্টিল প্লিজ ফর মি ট্রাই টু ম্যাক ইউরসেলফ কমফোর্টেবল।

জবাবে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। রওনক তাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,

-আমি নিচে যাচ্ছি। লাবিব এসেছে, আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবে। খুব খুদা লেগেছে জলদি খাবার দিতে বলো।

-আপনি যান আমি আসছি।

রওনক চলে যেতে নিয়েও থেমে গিয়ে চিত্রলেখার একটা হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-তুমি আমাকে জান বলে ডাকবে কবে?

রওনকের প্রশ্নে চিত্রলেখার বিষম উঠে যায়। তা দেখে হেসে ফেলে রওনক। চিত্রলেখার মুখটা দেখার মতো হয়েছে।

লাবিবের একেবারে পার্টিতে আসার কথা ছিল। কিছু কাজ রয়ে গেছে তাই রওনকের সঙ্গেই চলে এসেছে সে। বিয়ের দিন শেষবার দেখা হয়েছিল তাদের। তারপর আজ আবার মুখোমুখি। লাবিব বরাবরই চিত্রলেখার জন্য একজন ভালো বন্ধু। আর সবসময়ই এমন থাকবে। ফেশিয়াল আর ইত্যাদি করাতে নিয়ে তানিয়ারও আজ দুপুরের খাওয়া হয়নি। সেও রওনকদের সঙ্গেই বসেছে খেতে। তানিয়া, রওনক ও লাবিব একত্র হওয়ায় ওদের কথাবার্তা সব ব্যবসা রিলেটেডই। ওদের কথায় চিত্রলেখার কিছু বলার নেই। সে নিজের মতো খেতে আর ওদের প্লেটে খাবার তুলে দিতে ব্যস্ত। তিনজন নিজেদের মতো ব্যবসায়িক আলোচনায় এতটাই ব্যস্ত যে কারো নিজের প্লেটের দিকে খেয়াল নেই। চিত্রলেখা তুলে দিচ্ছে আর তারা খাচ্ছে। কিন্তু আলোচনার একপর্যায় তানিয়া বলে,

-তবে রওনক, আমি ভাবছিলাম কি চলে যাবার আগে চিত্রলেখাকে আমার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে যাবো।

তানিয়ার কথায় চিত্রলেখার বিষম উঠে যায়। অন্যরা যেটা লক্ষ করেনি সেটা হচ্ছে লাবিবের গলায় খাবার আটকে গেছে। তানিয়া চলে যাবে এর মানে কি! নিজের জায়গা থেকে প্রশ্নটা করতেও পারছে না লাবিব। চুপচাপ কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে পানি খেয়ে গলায় আটকে যাওয়া খাবার গিলে ফেলে সে। রওনক চিত্রলেখাকে পানি এগিয়ে দেয়। পানি খেয়ে শান্ত হয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আপনার কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।

-শিখিয়ে দিলে অবশ্যই হবে।

চিত্রলেখা রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-হবে না। ম্যাম মানে ভাবী তো ফাইনান্স দেখছেন আমি ফাইনান্সের কিচ্ছু বুঝি না। তাছাড়া আমি অফিস করলে মীম, মিশকাতকে কে দেখব?

কাউকে কিছু বলার সু্যোগ না দিয়ে তানিয়া বলে,

-মীম, মিশকাতকে দেখার লোক আছে বাসায়। প্রয়োজনে আরও লোক হায়ার করা হবে। তুমি ওদের লিগাল গার্ডিয়ান ন্যানি না যে ওদের দেখাশুনার জন্য ঘরে বসে থাকবে, নিজের ক্যারিয়ার বিষর্জন দিয়ে দিবে।

-কিন্তু…

-আগেও তো চাকরী করার পাশাপাশি ভাইবোনদের খেয়াল রেখেছো, রাখোনি?

সম্মতিতে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। তানিয়া বলে,

-তাহলে এখন কেনো বসে থাকবে? আমি একদম এলাও করব না। তোমার নিজের পরিচয় ধরে রাখতেই হবে। রওনক জামানের বউ ঘরে বসে থাকবে অসম্ভব! কাল থেকে অফিস যাবে তুমি আমার সঙ্গে। আমি আমার কাজ তোমাকে বুঝিয়ে দিবো আস্তেধীরে।

চিত্রলেখা অসহায়ের মতো রওনকের দিকে তাকালে সে বলে,

-আপাতত ওকে কিছুদিন সময় দাও ভাবী। সবার নিজের স্পেশালিটি আছে। ও ফাইনান্স না দেখলে অন্যকিছু দেখবে যেটা ও ভাবো জানে। তার আগে এই নতুন পরিবেশের সঙ্গে ইউজ টু হোক তারপর থেকে না হয় অফিস জয়েন করবে। তাছাড়া আমারও কোনো প্লান নেই ওকে ঘরে বসিয়ে রাখার। শি ক্যান জয়েন হোয়েন এভার শি ওয়ান্টস টু। জামান গ্রুপ যতটুকু আমার ততটুকু ওরও।

কথা শেষ করে চোখের ইশারায় চিত্রলেখাকে আশ্বস্ত করে রওনক। তা দেখে স্মিত হাসে চিত্রলেখা কিন্তু তার বুঝা হয়ে গেছে এখন না হোক কিছুদিন পরে তবুও তাকে অফিস জয়েন করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এসব ভেবেই চিত্রলেখার মুখের রঙ বদলে যাচ্ছে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬০
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

ঘড়িতে রাত ৮ টা বাজছে প্রায়। যদিও ডিনার পার্টি, সাধারণত এই বাড়ির ডিনার পার্টিগুলো একটু রাত করেই হ্যাঁ। তাই ইনভাইটেড গেস্টরা সাধারণত রাত ৮ টার পর বা ৯ টা নাগাদ আসে কিন্তু আজ এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। ৮ টা বাজছে প্রায় বাজেনি এখনো কিন্তু এর মধ্যেই অনেকে চলে এসেছে। এমন ঘটার পেছনের কারণটা বিশেষ এবং সহজেই অনুমেয়। শিল্পপতি, ব্যবসায়ি রওনক জামানের বউকে সরাসরি দেখার তীব্র আগ্রহ। রওনক যখন নিজের ভেরিফাইড ফেইসবুক একাউন্টে ম্যারিটাল স্ট্যাটাস আপডেট করেছে তারপর থেকেই সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। যদিও সেই পোস্টে রওনক চিত্রলেখাকে ট্যাগ করেছে কিন্তু চিত্রলেখার আইডিটা প্রাইভেট হওয়ায় কেউ তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারেনি। তাই সকলের আগ্রহের যেনো কোনো কমতি নেই। রওনকের আগের বিয়ে, ডিভোর্স সম্পর্কে সবাই কম বেশি জানে শুধুমাত্র সরাসরি কথা বলে না এই যা।

আজকের পার্টিতে আত্মীয় স্বজন সবাইকে দাওয়াত করা হয়নি যেহেতু প্রোগ্রাম বাসায় হচ্ছে। রওনকের একান্তই কাছের কিছু বন্ধু, কিছু বিজনেস পার্টনারস, কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার, আর একান্তই কাছের রিলেটিভ। কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে সাবার বাবাও একজন। যেহেতু তাদের পারিবারি সম্পর্ক গভীর তাই সাবাদের সপরিবারে ইনভাইট করা হয়েছে।

আজকের পার্টি উপলক্ষে একটা বার সেট করা হয়েছে। সব ধনের ড্রিংক্স রাখা আছে, সফট ড্রিংক্সও। সবাই তো আর এলকোহল নেয় না। বারটা পার্মানেন্ট নয় ট্রেম্প্ররারি সেট করা হয়েছে কেবল আজকের পার্টি উপলক্ষে। এদিক সেদিকের কথার পর ঝেড়ে কাশে সাদমান, রওনকের সবচাইতে কাছে বন্ধু সে। একসঙ্গে লেখাপড়া করেছে, বড় হয়েছে। রওনকের ভালো দিনে যেমন পাশে থেকেছে তেমনি সবচাইতে খারাপ দিনগুলোতেও পাশে থেকেছে। যার জন্য এত আয়োজন তাকে দেখতে আর তর সইছে না যেনো কারো। তাই গল্প, আড্ডা ভেঙে সাদমান জিজ্ঞেস করে,

-তা মিসেস রওনক জামানকে দেখতে আর কতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে?

রওনক নিজের হাত ঘড়িতে সময় দেখে। ৮ টা বাজতে চলেছে। এতক্ষনে চিত্রলেখার তৈরি হয়ে যাবার কথা। সন্ধ্যার পর সে নিজেই চিত্রলেখা দেখেনি। তার পছন্দ করে কেনা ড্রেসে চিত্রলেখাকে কেমন লাগছে দেখার অপেক্ষায় রওনক নিজেও। হাত থেকে ওয়াইনের গ্লাসটা বার কাউন্টারে নামিয়ে রেখে রওনক বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে,

-আমি দেখে আসছি আর কতক্ষন লাগবে।

সবাইকে রেখে উপরের দিকে অগ্রসর হয় রওনক। তার চন্দ্রকে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর লাগছে দেখতে। ভাবতে ভাবতেই নিজের ঘরে প্রবেশ করে সে। কিন্তু রুমে নেই চিত্রলেখা। ভেতরে এগিয়ে গিয়ে চেঞ্জিং রুমের দরকার নবে হাত রেখে ঘোরালেই খুলে যায়। এখানেই তৈরি হচ্ছে তার চন্দ্র। পার্লার থেকে দু’জন মেয়ে এসেছে সাজিয়ে দিতে। একজন চিত্রলেখাকে সাজিয়ে দিচ্ছে আরেকজন তানিয়াকে। দরজাটা খুলে যেতেই চিত্রলেখার চোখ তার সামনে থাকা বড় আয়নাটায় স্থির হয়। রওনককে দেখে চিত্রলেখার নিঃশ্বাস আটকে গেছে। স্যুট পরা রওনককে সে বহুদিন, বহুবার দেখেছে কিন্তু আজ তাকে দেখতে ভিন্নরকম লাগছে। এই ভিন্নতার কারণ কি? কালো রঙের স্যুটটা রওনকের শরীরে এমন ভাবে ফিটিং হয়ে আছে যেনো এই স্যুটটা একমাত্র তার জন্যই তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে এই স্যুটে সুদর্শন লাগবে না যতটা রওনককে লাগছে। চেষ্টা করেও নিজের চোখ ফেরাতে পারছে না চিত্রলেখা। সবসময় স্যুটের জন্য টাই পরতে দেখেছে সে রওনককে কিন্তু আজ বো-টাই পরেছে রওনক। ডান হাতে দামী একটা ঘড়ি। পায়ের শু টাই চকচক করছে। চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করে ব্যাকব্রাশ করেছে। একদিকে চিত্রলেখা অন্যদিকে রওনক। চিত্রলেখাকে দেখে তার গলায় কি যেনো একটা আটকে গেছে। অফ শোল্ডার হোয়াইট রঙের একটা গাউন কিনে এনেছিল রওনক আজকের পার্টিতে চিত্রলেখার পরার জন্য। গাউনটা চিত্রলেখার শরীরের সঙ্গে এমন ভাবে লেগে আছে যা দেখে নিজের চোখ ফেরাতে পারছে না রওনক। কোমড় সমান চুলগুলোকে ঘাড়ের উপর খোপা করা হয়েছে। সাইড থেকে কিছু চুল কার্ল করে দু’পাশে ছেড়ে রাখা হয়েছে। চিত্রলেখার কানে ডায়মন্ডের কানের দুল, হাতে ব্রেসলেট। গলাটা খালি যদিও খালি থাকবে না। রওনক নিজেই আজকের পার্টির জন্য একটা ডায়মন্ডের সেটটা কিনে এনেছিল। গলার সেটটা এখনো পরা বাকি। পার্লারের মেয়েটার হাতেই রয়েছে গলার ভারি ডায়মন্ডের সেটটা। বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে চিত্রলেখাকে দেখার পর হাত বাড়ায় রওনক সেটটা নেয়ার উদ্দেশ্যে। বলে,

-আপনি একটু বাহিরে অপেক্ষা করুন।

মেয়েটা একমুহূর্ত সময় অপচয় না করে ডায়মন্ডের সেটটা রওনকের হাতে দিয়ে চেঞ্জিং রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মেয়েটা বেরিয়ে গেলেই রওনক এসে চিত্রলেখার ঠিক পেছনে দাঁড়ায়। আয়নায় তার দু’জনই একে-অপরকে দেখতে ব্যস্ত। তৎক্ষণাৎই রওনক সেটটা চিত্রলেখার গলায় পড়িয়ে দেয় না। সামান্য এগিয়ে গিয়ে পাশের ড্রেসিং কেবিনেটে সেটটা নামিয়ে রেখে পূর্বের জায়গায় ফিরে আসে সে। হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার কোমড় স্পর্শ করে। এতেই যেনো চিত্রলেখার অঙ্গে অঙ্গে কাঁপন ধরে গেছে। শিহরনের দোলে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে চিত্রলেখা। আয়নায় সবই দেখছে রওনক। তার স্পর্শে চিত্রলেখার এই বশ হয়ে যাওয়াটা যেনো তাকে আরও বেশি পাগল করে দিচ্ছে। আরও গভীরভাবে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তার চন্দ্রকে। এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার কানের নিচে ঘাড়ে নাক রেখে নিঃশ্বাস টানে রওনক। দামী পারফিউম ও চিত্রলেখার শরীরের ঘ্রান মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। চিত্রলেখা চোখ মেলতে পারে না। সাহসই হয় না চোখ খুলে রওনকের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখার। চোখ মেললে যে রওনক তার চোখের আহ্বান টের পেয়ে যাবে। চোখ না মেললেও নিজের গায়ে লেপ্টে থাকা গাউন শক্ত করে ধরে রেখেছে চিত্রলেখা যা রওনকের দৃষ্টি এড়ায়নি। চিত্রলেখার কোমড় ছুঁয়ে থাকা রওনকের হাতের স্পর্শ আরও গাঢ় হয়। এবারে চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে আলতো করে তার উন্মুক্ত কাঁধে চুমু খায় রওনক। ছোট্ট করে নয় বরং গাঢ় চুমু, গভীর চুমু। সময় নিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে থাকে সে। রওনকের ঠোঁটের স্পর্শে চিত্রলেখার ঠোঁট কাঁপতে আরম্ভ করেছে। রওনকের ইচ্ছা করছে এক্ষুনি সে ঐ ঠোঁটের দখল নেয় কিন্তু এসবের জন্য উপযুক্ত সময় এখন নয়। চিত্রলেখাকে দেখবে বলে শহরের নামিদামি ব্যাক্তিরা নিচে অপেক্ষা করছে সেই সঙ্গে প্রেসও এসেছে। আজ তারা দু’জনে প্রথমবারের মতো একত্রে প্রেসের সামনে দাঁড়াবে। ছোটখাটো একটা ইন্টারভিউও হবে বলা যায়। আজকের তোলা ছবি আগামীকাল সকালের খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিনের পাতায় ছাপানো হবে বড় হেডলাইনের সঙ্গে। রওনক জামান সবসময়ই বিজনেস নিজের হট টপিক। তার বিয়েটা কোনো অংশে কম কিছু নয়। নিজেরা প্রথমবার একত্রে সবার সামনে আসা তাই কোনো কমতি রাখেনি রওনক। তার ওয়াইফ হিসেবে যতটুকু সম্মান চিত্রলেখার প্রাপ্য তার চাইতে অধিক দিতে চায় রওনক তাকে। চিত্রলেখার জন্য নিজের সাধ্য ও সামর্থ্যে বাইরে গিয়ে করতে ইচ্ছা করে তার। সম্পূর্ন দুনিয়া এনে পায়ের কাছে বিছিয়ে দিতে ইচ্ছা করে।

রওনক চিত্রলেখার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে মৃদু স্পর্শ করে বলে,

– ইউ আর লুকিং বিউটিফুল।

এক্মুহূর্ত থেমে আরও বলে,

-চোখ খোলো চন্দ্র।

রওনক বলার পরেও চোখ মেলায় সাহস হয় না চিত্রলেখার। রওনক আরও বলে,

-প্লিজ বউ।

তৎক্ষণাৎ চোখ মেলে তাকায় চিত্রলেখা। রওনকের এই আবেদনের কাছেই বার বার হেরে যায় সে। চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখেই তার উন্মুক্ত কাঁধে গভীর করে আবারও আরেকটা চুমু খায় রওনক। চিত্রলেখার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। অঙ্গে যেনো আ গু ন ধরে গেছে তার। কান লাল হয়ে গেছে, নাক লাল হয়ে গেছে। কোনো কিছুই রওনকের চোখ এড়ায়নি। আবার চিত্রলেখার কানে ঠোঁট স্পর্শ করে রওনক বলে,

-আই উইল ম্যাক ইট আপ টু ইউ, আই প্রমিজ। আজকের রাতটা সারাজীবন মনে থাকবে তোমার, আই প্রমিজ ইউ দ্যাট।

চিত্রলেখার কোমড় ছেড়ে দিয়ে গলার সেটটা হাতে নিয়ে পরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-ম্যা আই?

চিত্রলেখা কোনো কথাই বলতে পারে না। নিজের সম্মতি জানাতে কেবল মাথা ঝাঁকায় সে। রওনকের উপস্থিতি, তার স্পর্শে শব্দ হারিয়ে ফেলেছে বেচারি। রওনক আর অপেক্ষা না করে চিত্রলেখার খালি গলায় ডায়মন্ড জড়ানো সেটটা পরিয়ে দিতেই তার মুখ গলে বেরিয়ে আসে,

-এবসিলিউটলি গরজিয়াস!

রওনকের দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে আজ চিত্রলেখাকে দেখতে অন্যরকম সুন্দর লাগছে যদিও তার দৃষ্টিতে চিত্রলেখা সব বেশেই সুন্দর, মুগ্ধকর, চোখ জুড়ানো। চিত্রলেখার ঠোঁট এখনো কাঁপছে। সে হয়ত কিছু বলতে চায় কিন্তু পারছে না। তা আন্দাজ করতে পেরে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কিছু বলতে চাও?

সম্মতিতে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। রওনক বলে,

-বলো আমি শুনছি।

ঢোক গিলে শুকনো গলা ভিজিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে চিত্রলেখা। রওনক চিত্রলেখার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। তারা মুখোমুখি নয়। দু’জনের দৃষ্টিই আয়নায় একে-অপরের দৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ। রওনক সময় দেয় চিত্রলেখাকে নিজেকে সামলে নিতে। সামান্য সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-আফিফার ধারনা আপনি আমাকে ভালোবাসেন।

-আর তুমি কি ভাবো? তোমার কি ধারনা?

চিত্রলেখার মুখে কথা কুলায় না। সে ভাবতে চায় রওনক তাকে ভালোবাসে। কিন্তু আদৌ কি সেটা সম্ভব? রওনক তো আগেই তাকে জানিয়েছে এই বিয়ের কারণ এরপরেও ভালোবাসা আশা করাটা কি বোকামি হয়ে যাবে না? বেশি বেশি হয়ে যাবে না? এই সম্পর্কে কি চিত্রলেখার রওনকের কাছে ভালোবাসা আশা করা উচিত? এতখানি দুঃসাহস করা কি উচিত হবে তার? চিত্রলেখার পক্ষ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে রওনক নিজেই আরও বলে,

-আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কে কি ভাবছে তা দিয়ে আমার কিচ্ছু যায় আসে না চন্দ্র, ট্রাস্ট মি। আমার জন্য ইম্পর্ট্যান্ট হচ্ছে তুমি কি ভাবছো। তোমার কি ধারনা আমাদের নিয়ে। তুমি যদি মনে করো আমি তোমাকে ভালোবাসি তাহলে বাসি আর যদি ভাবো বাসি না তাহলে…

বাকিটুকু আর বলে না রওনক। এক পা পিছনে সরে গিয়ে বলে,

-আই নো ইউ আর নার্ভাস, টেক ফাইভ মিনিট’স দ্যান কাম। আই ইউল বি ওয়েটিং ফর ইউ।

আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যায় রওনক চিত্রলেখাকে রেখেই। নিজেকে সামলে নিতে সময় দিয়ে যায়। রওনক বেরিয়ে যেতেই যেন চিত্রলেখার নার্ভাসনেস বেড়ে গেছে। আয়নায় নিজেকে আপাদমস্তক দেখতে ব্যস্ত সে। ভীষণ সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে কিন্তু এর আগে কোনো এভাবে সাজেনি সে। এমন পোশাকও পরেনি। গাউনটা অফশোল্ডার হওয়ায় তার কাঁধ ও পিঠের অনেকটাই এক্সপোজ হয়ে আছে। এভাবে বাইরের মানুষের সামনে যেতে পারবে না সে। অতিরিক্ত নার্ভাসনেসের কারণে এসির নিচে দাঁড়িয়েও ঘামতে শুরু করেছে চিত্রলেখা। রওনককে দেখে সব ভুলে গিয়েছিল সে। এখন আবার একরাশ অস্বস্তি জেঁকে ধরেছে তাকে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৫৬+৫৭

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

আচমকাই চিত্রলেখাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রওনক। কিছু টের পাবার আগেই চিত্রলেখা অনুভব করে রওনক পেছন থেকে নিজের আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে তাকে। শাওয়ার দেয়ার ফলে রওনকের শরীর জুরে হিমশীতলতা বিরাজ করছে। রওনকের দেহের উষ্ণতা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে চিত্রলেখা। যার ফলে চিত্রলেখার অঙ্গের ভেতর অদৃশ্য এক কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে যা জানান দিচ্ছে আজ আর চিত্রলেখার রক্ষে নেই। একটা কঠিন সর্বনাশ বুঝি ঘটেই যাবে। এসব ভাবতেই চিত্রলেখার হাঁটু কাঁপতে আরম্ভ করেছে। হাটুর কাপাকাপি মুহূর্তেই চিত্রলেখার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। রওনকের ভাবনা মস্তিষ্ক থেকে কিছুক্ষণের জন্য জেড়ে ফেলতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল সে কিন্তু এতে লাভের লাভ কিচ্ছু হয়নি। রওনকের ভাবনা তো দূরের কথা স্বয়ং রওনককেই সে নিজের থেকে বেশিক্ষণের জন্য দূরে রাখতে সক্ষম হয়নি।

রওনক আলতো ভঙ্গিতে চিত্রলেখার উন্মক্ত কাঁধে, ঘাড়ে, কানের পেছনে ছোট্ট ছোট্ট টানে নাক ঘষে দেয়। চিত্রলেখা টের পায় তার ভেতর অজানা এক ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘূর্ণিঝড় আজ হয়ত তাকে দূর অজানায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ঝুল বারান্দার কোমড় সমান গ্রীল দেয়া আছে। নিজেকে সামলে নিতে চিত্রলেখা সেই গ্রীল আঁকড়ে ধরে শক্ত হাতে। কিন্তু কাজ হয় না বিশেষ। রওনকের এই ছোট্ট ছোট্ট স্পর্শ তাকে পাগল করে দিচ্ছে। চিত্রলেখা অনুভব করতে শুরু করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিশেষত্ব। এই যে অধিকার সমেত পবিত্রতার সহিত ছুঁয়ে দেয়া অন্য কোনো সম্পর্কে নেই। অন্য আর সব কয়টা সম্পর্কে হাজারটা নিষিদ্ধতার মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর একে-অপরকে এই ছুঁয়ে দেয়ার মধ্যে পবিত্রতা নিহিত।

রওনকের পাগল করা স্পর্শের মাঝে হারিয়ে যেতে নিয়েও নিজেকে টেনে ধরে চিত্রলেখা। সামান্য টেনেই বলে, আ…আমি শাওয়ার দিয়ে কাপড় বদলে আসি।

চিত্রলেখার কানের পেছনে নাক ডুবিয়ে রেখেই রওনক বলে, আরও কিছুক্ষণ এভাবেই থাকো প্লিজ। আমি আরেকটু তোমাকে ফিল করতে চাই, প্লিজ। প্লিজ চন্দ্র।

রওনকের এমন আকুল আবেদনের কাছে হেরে যেতে বাধ্য হয় চিত্রলেখা। এমনিতেও মনে হচ্ছে না এমন স্পর্শ পাবার পর কদম চালিয়ে অন্য কোথাও যেতে পারবে সে। তাই রওনকের হাতেই নিজেকে ছেড়ে দেয় চিত্রলেখা। যা হয় হোক, আর কোনো আপত্তি নেই তার। এর বেশি সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারবেও না। অন্যরকম এক আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে চিত্রলেখা। হাতের মুঠো আরও শক্ত হয়ে গেছে তার।

বেশ কিছুক্ষণ চিত্রলেখার কানের পেছনে নাক ঘষার পর ছোট্ট করে একটা চুমু বসিয়ে চিত্রলেখার গালের সঙ্গে গাল মিলায় রওনক। কিন্তু নিজের হাতের বাঁধন আলগা করে না। যেভাবে জড়িয়ে ধরেছিল সেভাবেই জড়িয়ে রাখে নিজের সঙ্গে। তবে এতক্ষণ রওনকের হাত চিত্রলেখার পেটের কাছে শাড়ির উপরে থাকলেও এখন একটা হাত শাড়ির নিচ দিয়ে চালান করে দিয়েছে। আলতো করে চিত্রলেখার নরম পেটে হাত রাখে সে। তবে হাত নাড়াচাড়া করে না। দেখতে না পেলেও রওনক ঠিকই অনুভব করতে পারছে তার চন্দ্র, তার স্পর্শের আবেশে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। চিত্রলেখার গালের সঙ্গে গাল মিলিয়ে রেখেই রওনক তার স্বাভাবিক সুরে কথা বলে।

-দেখো আজকের চাঁদটা কত সুন্দর।

রওনকের কথায় চিত্রলেখার হদিস হয়। আবেশে বন্ধ হয়ে থাকা চোখের পাতা মৃদু ভাবে খুলে আসমানের দিকে তাকায়। অন্ধকার আকাছে বুক জুড়ে থাকা চাঁদটা আসলেই সুন্দর। চাঁদ তো সবসময়ই সুন্দর কিন্তু আজ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে চাঁদটাকে বেশি সুন্দর লাগছে, দেখতে। কিন্তু কেনো? রওনক দেখিয়ে দিলো বলে? তার বলায় কি চিত্রলেখার চোখে চাঁদের সৌন্দর্‍্য্য বেড়ে গেল। অবাক লাগে চিত্রলেখার। স্মিত কন্ঠে চিত্রলেখা সম্মতি প্রকাশ করে বলে,

-হুম্‌ সুন্দর।

-সুন্দর তবে…

-তবে কী?

চিত্রলেখার কন্ঠে স্পষ্ট কৌতুহল। তা টের পেয়ে রওনক জবাব দিতে বিলম্ব করে না।

-আমার চন্দ্রের চাইতে বেশি না। আমার চন্দ্রের কাছে এই চান্দের সৌন্দর্য্যও ম্লান।

লজ্জায় আপনাআপনিই চিত্রলেখার গাল লাল হলো, সঙ্গে খানিকটা গরমও হলো। চিত্রলেখা টের পায় রওনকের তাকে দেয়া কমপ্লিমেন্টের কারণেই তার গাল লাল হয়েছে। লজ্জায় কলিজা কাঁপছে বেচারীর। এমনও হয় নাকি? গল্প, উপন্যাসে পড়েছে পুরুষ চরিত্র, নারী চরিত্রের কাছাকাচি এলে তার অঙ্গে অঙ্গে কাঁপন ধরে আজ যেনো সত্যি সত্যি চিত্রলেখার সঙ্গে তাই হচ্ছে। রওনকের স্পর্শে তার অঙ্গে অঙ্গে শুধু কাঁপন নয় আ গু ন ধরে গেছে। নিজ অঙ্গের এই আ গু ন কি দিয়ে নিভাবে চিত্রলেখা!

রওনক চিত্রলেখার গালের সঙ্গে গাল লাগিয়ে রাখে বেশ অনেকক্ষণ। চিত্রলেখা বুঝতে পারে আজকের মতো হয়ত সে বেঁচে গেছে রওনকের পুরুষালি থাবার হাত থেকে। একটুর জন্য নিজের সবটুকু রওনকের ধৈর্য্যের কাছে সমর্পণ করতে তৈরি হয়ে গিয়েছিল চিত্রলেখা কিন্তু আচমকাই রওনক থেমে যাওয়ায় তাকে এখনই নিজের সবটা উজার করে দিতে হচ্ছে না। কিন্তু হৃদয় গহীনে কোথাও গিয়ে চিত্রলেখা জানে খুব বেশিদিন সে নিজেকে রওনকের এসব পুরুষালি স্পর্শের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না। আজ নয়ত কাল নিজেকে উজার করে দিবে সে। সেই সময় সন্নিকটে ভেবে বুকের কাঁপন বাড়ে চিত্রলেখার।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর নীরবতা ভেঙ্গে রওনক জিজ্ঞেস বলে,

-তোমাকে এই শাড়িটাতে চমৎকার লাগছে চন্দ্র।

রওনকের মুখ গলে বেরিয়ে আসা প্রতিটা কমপ্লিমেন্ট চিত্রলেখার বুকের ভেতর গভীর করে দাগ কাটে, ভালো লাগার দাগ। এই জীবনে চিত্রলেখাকে কমপ্লিমেন্ট দেবার মতো তার কোনো ব্যাক্তিগত মানুষ কখনই ছিল না যদিও মামুনের কাছে চিত্রলেখা বিশেষের চাইতেও বিশেষ ছিল সবসময় হয়ত এখনো আছে কিন্তু চিত্রলেখা কখনো নিজের সীমানার বাইরে গিয়ে মামুনকে নিয়ে ভাবেনি। ভালোই হয়েছে ভাবেনি। মামুনকে নিজের জীবনে বিশেষ জায়গা দেয়ার পর চিত্রলেখাকে যদি রওনকের বউ হয়েই আসতে হতো তখন এই জীবনটা বিষের চাইতেও বেশি তেতো হয়ে যেতো এর চাইতে ভালোই হয়েছে চিত্রলেখা কখনো মামুনকে প্রশ্রয় দেয়নি, তাকে কখনো মিথ্যা আশা দেয়নি। নাহলে রওনকের কাছ থেকে এই মুহূর্তে পাওয়া প্রতিটা স্পর্শ চিত্রলেখাকে ভেতরে ভেতরে মে রে ফেলতো। যদিও এখনো সংশয় বিন্দুমাত্র কম নেই চিত্রলেখার ভেতর। সবসময় শুনেছে দেহের মিলনের চাইতে হৃদয়ের মিলন বেশি জরুরী সম্পর্কে। কিন্তু রওনকের সঙ্গে চিত্রলেখার এই সম্পর্কের কোথাও ভালোবাসার ছিটেফোঁটা নেই। সে রওনককে তাকে ভালো না বাসার জন্য দোষ দেয় না অবশ্য। সে তো নিজেই রওনককে ভালোবাসে না। ভালোবাসা, চারটা বর্ণ, চারটা কার চিহ্নের সম্বনয় তৈরি একটা ছোট শব্দ। কিন্তু এর গভীরতা! পৃথিবীর সবচাইতে গভীর সমুদ্র প্রশান্ত মহাসাগরকেও হার মানায় যেনো। আসলে ভালোবাসার গভীরতা কি কখনো পরিমাপ করা সম্ভব? চিত্রলেখার মন তাকে জবাব দেয়, না সম্ভব নয়। অথচ রওনকের সঙ্গে তার সম্পর্কে ভালোবাসা নামক এই গভীরতাটাই নেই। অন্যদিকে রওনকের পুরুষালি স্পর্শের আবেশে হারিয়ে যাওয়া থেকেও নিজেকে আটকে রাখতে কষ্ট হচ্ছে তার। এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা কি জানা নেই চিত্রলেখার। তবে সে জানে সে অনৈতিক কিছু করছে না, আর না নিজেকে কোনো অবৈধ কিছুর সঙ্গে জড়িয়েছে। যে কারণে আর যেভাবেই হয়ে থাকুক না কেনো রওনকের সঙ্গে চিত্রলেখার সম্পর্ক সমাজ স্বীকৃত, ধর্ম মতে সঠিক। তাই এই কাছে আসায় কোনো ভুল দেখতে পায় না চিত্রলেখা। যদিও বিনে ভালোবাসায় এতখানি এগিয়ে যেতে মনের ভেতর অজানা খচখচানির উপস্থিতি টের পায় তবু চিত্রলেখা অনুভব করতে পারে নিজের উপর থেকে ধীরে ধীরে কন্ট্রোল হারাচ্ছে সে। খুব বেশি সময় আর সে নিজেকে রওনকের পুরুষালি স্পর্শের হাত থেকে আড়াল করে রাখতে পারবে না। এক্ষুণি যদি রওনক ইন্ধন দেয় চিত্রলেখা হয়ত বিনাবাক্যব্যয়ে তার ইন্ধনে সাড়া দিবে। দু’জনে মিলে একাকার হয়ে যাবে আকাশের ঐ চাঁদকে সাক্ষী রেখে। পৃথিবীর কেউ জানবে না এক বিছানায় দু’জনের গাঢ় নিঃশ্বাস একে-অপরে বিলীন হয়ে যাবে।

-কিন্তু আমার যতটুকু মনে পড়ে এই শাড়িটা আমি তোমার জন্য কিনি। তুমি কি শপিং করতে গিয়েছিলে?

রওনকের কথার শব্দেই নিজের চিন্তার জগৎ থেকে দপ করে বাস্তবতায় আছড়ে পড়ে চিত্রলেখা। এতক্ষণ নিজের অজান্তে কি সব ভাবছিল সে ভেবে মনে মনে লজ্জায় লাল হয় সে। বউকে চুপ করে থাকতে দেখে রওনক চিত্রলেখার কানের পাতায় ছোট্ট করে ঠোঁট স্পর্শ করে বলে,

-বললে না?

আচমকা রওনকের ঠোঁটের স্পর্শে কেঁপে ওঠে চিত্রলেখা। টেনে বলে,

-ক…কী?

-খুব বেশি আমার ভাবনায় হারিয়ে যাচ্ছো বুঝি? আমি কি খুব জ্বালাচ্ছি তোমাকে?

লজ্জায় চিত্রলেখার মুখ দিয়ে কথা বের হতে চায় না। রওনকের এমন কথার কি জবাব দিবে সে? বললে তো সত্যিটা স্বীকার করা হয়ে যাবে এরপর তো লজ্জায় মানুষটার সামনে দাঁড়াতে পারবে না আর। রওনক বুঝতে পেরে এই বিষয়ে আপাতত আর লজ্জা দেয় না চিত্রলেখাকে। আগের প্রশ্নটা আবার করে সে,

– এই শাড়িটা আমি তোমার জন্য কিনি। তুমি কি শপিং করতে গিয়েছিলে?

-না না, এটা আফিফার। আমি তো থ্রিপিস পড়েই ওর বাসায় গিয়েছিলাম। আমাকে থ্রিপিসে দেখে জোর করে নিজের শাড়ি পরিয়ে দিয়ে বলল…

বাকি কথা বলতে পারে না চিত্রলেখা, থেমে যায়। রওনক তার কথার সুর টেনে বলে,

-কী বলল?

একবার ঢোক গিলে চিত্রলেখা বলে, নতুন বউদের নাকি সবসময় শাড়ি পড়ে সেজেগুজে থাকতে হয়।

-কেন? কার জন্য?

রওনক ইচ্ছা করে প্রশ্নটা করেছে। চিত্রলেখার পেটের উপর থাকা রওনকের স্থির হাতটা সামান্য নড়াচড়া করে। এই সামান্য স্পর্শেই চিত্রলেখা থরথর করে কাঁপতে লাগে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-বরের জন্য।

-আচ্ছা, তা তুমি কার জন্য শাড়ি পড়েছো?

চিত্রলেখা জবাব না দিলে রওনকের স্পর্শ গভীর হয়।

-বলো কার জন্য শাড়ি পরে নিজেকে সাজিয়েছো?

-আপনার জন্য।

আচমকাই চিত্রলেখাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় রওনক। চিত্রলেখার লম্বা চুলের খোপা হাতের টানে খুলে দেয় যার ফলাফল কিছু চুল উড়ে এসে চিত্রলেখার কপাল দখল করতে চাইলে তাদের নিজের আঙ্গুলের টানে কানের পেছনে গুঁজে দেয় রওনক। তারপর হাত বাড়িয়ে চিবুক স্পর্শ করে মুখটা উপরের দিকে তুলে ধরতেই তাদের শুভ দৃষ্টি হয় যেনো। চিত্রলেখার ঐ গভীর চোখের চাহনী থেকে কিছুতেই নয়ন সরাতে পারে না রওনক। অবশ্য সে চায়ও না নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে। চিত্রলেখাকে দেখার জন্য সর্বক্ষণ উতলা হয়ে থাকে তার ঐ নয়ন। বউয়ের চিবুক স্পর্শ করে চোখে চোখ রেখেই রওনক বলে,

-এই সাধারণ একটা সুতির শাড়িতে তোমাকে দেখতে ঠিক কতখানি সুন্দর লাগছে তা ব্যাখ্যা করার ভাষা আমার জানা নেই চন্দ্র কেবল এতটুকু বলতে পারি…

সামান্য থেমে চিত্রলেখার কানের কাছে মুখ নিয়ে রওনক আরও বলে,

-আমি ম রে যাচ্ছি তোমাকে নিজের করে একটু ছুঁয়ে দেয়ার লোভে। আমার পুরুষত্ব পু ড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে তোমাকে পাবার আশায়। এই কথা তোমার কাছে স্বীকার করতে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। আমি চাই তোমাকে, নিজের সবটুকু জুড়ে।

চিত্রেলেখার কি হলো কে জানে। আচমকাই নিজের কম্পিত দেহটা সে রওনকের উপর ছেড়ে দেয়। বুঝতে পেরে রওনক ওখানেই থেমে যায়। হয়ত আচমকাই বেশি হয়ে যাচ্ছে ভেবে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে কিন্তু তার চেষ্টা বিফলে যায়। রওনক অনুভব করে তার চন্দ্রলেখা হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। আনন্দে রওনকের পেটের ভেতর প্রজাপতি উড়তে আরম্ভ করেছে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে রওনক বলে,

-ইটস ওকে চন্দ্র, আমার কোনো তাড়া নেই। ইউ ক্যান ট্যাক টাইম। আমরা আস্তেধীরে আগাবো না হয়।

রওনকের কথা শুনে আরও বেশি লজ্জা করছে চিত্রলেখার। মাথা তুলে তাকাতেই পারবে না যেনো আর। চিত্রলেখার হাতের বাঁধন আলগা হলে রওনক ছোট্ট করে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,

-আমরা কি আজ কথা বলেই পেট ভরে ফেলবো? বিকেলের পর কিচ্ছু খাওয়া হয়নি আমার। খিদে পেটের ভেতর যুদ্ধ চলছে বউ।

রওনকের কথা শুনে চিত্রলেখা চোখ বড় করে তাকায়। চিত্রলেখার মুখের আচমকা পরিবর্তন দেখে হাসি পায় রওনকের। চিত্রলেখা বলে,

-আমি এক্ষুনি খাবার দিচ্ছি।

চিত্রলেখাকে ব্যস্ত হতে দেখে রওনক বলে,

-ইটস ওকে, তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও আমি বলছি আমাদের ডিনার লাগাতে। খাবার সার্ভ করতে করতে তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো কেমন?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। আর অপেক্ষা না করে দ্রুত বাথরুমের দিকে আগায় সে। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি আবজাব ভেবেছে অথচ মানুষটা না খেয়ে আছে সেদিকে খেয়ালই নেই তার। মনে মনে নিজেকে গালমন্দ করে চিত্রলেখা নিজের এমন দায়িত্বহীন কাজের জন্য। এমন বেখায়ালি তো সে কখনোই ছিল না তাহলে আজ কি হয়েছে তার? এই সব কি রওনকের প্রভাব? রওনককে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছে না যেনো চিত্রলেখা।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রাতের ঐ ঘটনার পর রওনকের সামনে দাঁড়াতেও লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে মন চাইছে চিত্রলেখার। জীবনে এর আগে কখনো সে এত লজ্জার সম্মুখীন হয়নি। এই ধরনের লজ্জার মুখে যে একদিন তাকেও পরতে হবে তা চিত্রলেখা তার অবচেতনেও ভাবেনি কখনো। মানুষের জীবন আসলেই তার চিন্তা ভাবনার উর্ধে। যা কখনো চিত্রলেখা নিজের জন্য চিন্তা করেনি, চায়নি আজ না চাইতেই সব পাচ্ছে। আবার আচমকা এত কিছু পেয়ে ভয়ও লাগছে বুকের ভেতর কোথায় একটা এই ভেবে এত সুখ তার কপালে সইবে তো শেষপর্যন্ত? নাকি অজানা কোনো তুফান এসে তার জীবনের এত সুখ সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে! এসব ভাবলেই অস্থিরতায় চিত্রলেখার বুকের ভেতরটা একটা অজানা ভয়, শঙ্কায় কেমন কেঁপে ওঠে। তবু চিত্রলেখা নিজেকে সামলে নেয়। এমনিতেও তার জীবনটা এই পর্যন্ত মসৃণ ছিল না তাই ভবিষ্যৎ টাও যে অনেক বেশি মসৃণ হবে তা সে খুব একটা আশা করে না। হলে ভালো নাহলেও সে ভয় পাবে না, শক্ত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। তার তো কেবল নিজের কথা ভাবলে চলবে না।

আজ রাতে বাসায় পার্টির আয়োজন করেছে রওনক, নিজের বিয়ে উপলক্ষে। কাছের একান্তই পরিচিত ও আপন জনদের সঙ্গে চিত্রলেখার পরিচয় করিয়ে দিতে চায়। একটু আগেই জাহানারা এসে জানিয়ে গেছে টেবিলে নাস্তা দেয়া হয়ে গেছে সবাই ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। রওনক তৈরি হয়ে টাই হাতে বেরিয়ে আসে। চিত্রলেখার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে টাই টা এগিয়ে দিয়ে বলে,

-আজও কি আমায় বলে দিতে হবে কীভাবে টাই বাঁধতে হয়?

কেবল মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা, মুখে কিছু বলে না। রওনকের টাই বাঁধতে ব্যস্ত চিত্রলেখা মুখ তুলে না তাকালেও বেশ অনুভব করতে পারছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দৃষ্টি তার দিকে স্থির হয়ে আছে। তাকাবে না তাকাবে না করেও একবার চোখ তুলে তাকায় চিত্রলেখা কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়। তৎক্ষণাৎই আবার চোখ সরিয়ে নেয় সে। তা দেখে রওনকের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। চিত্রলেখার টাই বাঁধা হয়ে গেলে সে পেছন দিকে সরে যেতে চেষ্টা করলে আচমকাই হাত বাড়িয়ে রওনক চিত্রলেখার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের বাহুবদ্ধ করে নেয়। রওনকের আচমকা কান্ডে অবাক না হয়ে পারে না চিত্রলেখা। আচমকা স্পর্শে চিত্রলেখার শরীর জুড়ে শিহরণ খেলে যায়। নিজেকে কাহিল লাগে চিত্রলেখার। ইচ্ছা করে নিজ দেহের সবটুকু রওনকের উপরে ছেড়ে দিতে। কিন্তু অজানা লজ্জা, শঙ্কায় ইচ্ছা করলেও এমনকাজ করতে পারে না সে। নিজেকে সামলে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়েই রওনকের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কেবল। রওনকও কিচ্ছুক্ষণ সময় নেয়। যা বলতে চায় তা বলার আগে খানিকটা সময় চোখের পিপাস মিটায়। রওনকের ঐ গভীর চোখের চাহনিতে প্রথমে হারিয়ে গিয়েছিল চিত্রলেখা তারপর আচমকাই হদিশ ফিরে পেয়ে রওনকের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলে রওনক বলে,

-একটু চোখ ভরে তোমায় দেখতে দাও প্লিজ। এভাবেই থাকো কিছক্ষণ আমার কাছে।

ইশ! রওনকের এই প্রতিটা আবদারের শেষে প্লিজ বলাটা চিত্রলেখার গায়ে কাটা দেয়। ভাইবোনেরা কখনোই কোনোকিছুর জন্য সেভাবে আবদার করেনি তার কাছে কিন্তু এই মানুষটা জীবনে আসার পর থেকে আবদারের বহার বসিয়ে দিয়েছে। তার সব আবদার যেনো এই এক চিত্রলেখার কাছেই। তারউপর তার বলার ধরণ। অমন করে বললে কেউ না করতে পারে কখনো? আর কেউ পারলেও চিত্রলেখা কখনো পারবে না। নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার আর চেষ্টা করে না, চুপ করে নিজেকে রওনকের বাহুবন্ধনেই ছেড়ে দেয়। বেশ কিচ্ছুক্ষণ এক মনে চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ওভাবে থেকেই রওনক বলে,

-আজ বাসায় পার্টি আছে।

সতর্ক হয় চিত্রলেখা। জানতে চায়,

-কিসের পার্টি?

-তোমার ওয়েলকাম পার্টি।

-আমার জন্য!

চিত্রলেখা যে অবাক হয়েছে তা তার চোখ মুখে স্পষ্ট। অবাক না হয়ে কি পারা যায়? তাকে ওয়েলকাম করার জন্য পার্টি দেয়া হচ্ছে এসবও এই জীবনে পাওনা ছিল চিত্রলেখার? স্মিত হেসে রওনক বলে,

-রওনক জামান বিয়ে করেছে এই খবর দেশবাসী জানবে না তা কি হয়?

চিত্রলেখার অবাক হওয়া যেনো বাড়লো। রওনক একটা হাত সামনে এনে চিত্রলেখার কপালের উপরে এসে পড়া চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দেয়। তার হাতটা এসে চিত্রলেখা গাল স্পর্শ করলে পরে রওনক বলে,

-তুমি এখনো বুঝতে পারছো না কার বউ হয়ে এসেছো।

চিত্রলেখা জানে সে কার জীবনে অনুপ্রবেশ করেছে কিন্তু এখনো এটা বুঝে উঠতে পারেনি রওনকের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার পরমুহূর্ত থেকে চিত্রলেখার জীবনটা ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে গেছে। এখন আর সে সাধারণ চিত্রলেখা নেই। কবুল বলে রওনকের বউ হবার পর থেকে তার জীবনটা রওনকের সাথে অতপ্রত ভাবে জড়িয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এখন সে মিসেস চিত্রলেখা রওনক জামান, যে রওনক জামানের ছবি, নিউজ প্রায় প্রতিদিনই নিউজপেপারের বিজনেস পাতায় পাওয়া যায়। এখন থেকে রওনকের পাশাপাশি চিত্রলেখার ছবিও যদি খবরের কাগজে ছাপা হয় সেটা খুব বেশি অবাক হবার মতো কোনো ঘটনা হবে না। কিন্তু এই বিষয়গুলো চিত্রলেখা এখনো ভেবেই দেখেনি। এসব তার ভাবনাতে আসেইনি। নিজের চিন্তা ভাবনার উর্ধে গিয়ে জীবন যাপন হচ্ছে তার।

রওনক বলে, আজকের পার্টিতে পরার জন্য তোমার ড্রেস, অর্নামেন্টস সব আলমিরাতে রাখা আছে। বিকালে বিউটিশিয়ানরা চলে আসবে তোমাকে সাজাতে। তুমি তৈরি হয়ে নিও। আমি একটা জরুরী কাজে যাচ্ছি, কাজ সেরে সোজা বসায় চলে আসবো পার্টির আগেই।

চিত্রলেখা কিছু বলে না। রওনকের বলা প্রত্যেকটা কথা মেনে নেয় বিনাবাক্যব্যয়ে। এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-সবাই আমাদের জন্য নাস্তা টেবিলে অপেক্ষা করছে।

-চলো যাই।

বেরিয়ে যাবার আগে রওনক আরও বলে, আমি একটা কথা ভাবছিলাম।

-কি কথা?

-আমরা দু’জন কি নিচের দিকে কোনো ফ্ল্যাটে শিফট হয়ে যাবো?

চিত্রলেখা আবারও অবাক হয় কিন্তু এবারে আর মুখ বন্ধ করে রাখে না। জিজ্ঞেস করে,

-কেনো? এখানে থাকলে কি সমস্যা?

এক মুহূর্তের জন্য চিত্রলেখা ভাবে রওনক হয়ত তাকে তার পরিবারের সঙ্গে রাখতে চায় না। কিন্তু চিত্রলেখার মনের ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে রওনক বলে,

-তুমি তো লিফটে উঠতে ভয় পাও। বাইরে গেলে বারবার সিড়ি দিয়ে ওঠা নামা করতে কষ্ট হবে। আমি চাই না তোমার কোনো কিছু নিয়ে কষ্ট হোক। আমরা সেকেন্ড ওর থার্ড ফ্লোরে শিফট হয়ে যেতে পারি। এতে করে তোমাকেও কষ্ট করে এতগুলো সিড়ি বেয়ে নাইন্থ ফ্লোরে উঠে হবে না।

-শুধু আপনি আর আমি?

-হু, শুধু আমরা দু’জনে। বাকিরা এখানেই থাকলো। দূরে তো কোথাও যাচ্ছি না। একই বিল্ডিংএ থাকবো জাস্ট ফ্লোর আলাদা।

-তারপর আপনার মা ভাববে আমি আপনাকে বশ করে ফেলেছি। আমার ইশারায় চলেন আপনি। আজ ঘর আলাদা করেছি, কাল বাড়ি আলাদা করব, এরপর হয়ত দেশও আলাদা করে ফেলবো। আপনাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবো। বা দেখা গেল আপনার সম্পত্তি বাগিয়ে নিলাম।

-কি যাতা বলছো এসব!

-আপনার কাছে যাতা লাগলেও বাকিরা এমনটাই ভাববে। একবার ভেবে দেখুন তো অন্যদের দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা একটা মেয়ে আমি, আপনার অফিসে চাকরী করেছি। সবাই কি ভাববে জানেন? চাকরী বাহানা ছিল। চাকরী করতে গিয়ে বড়লোক বসকে ফাঁসিয়েছি আমি। ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছি তার টাকা-পয়সার লোভে। কেউ বিশ্বাসই করবে না স্বয়ং রওনক জামান আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কেউ কেউ হয়ত ভাববে আপনার টাকার লোভে বিয়ের আগেই এক বিছানার আপনার সঙ্গে…

রওনক তৎক্ষণাৎ চিত্রলেখার মুখে হাত রাখে। এসব শুনতে চায় না সে। রওনক জানে চিত্রলেখা কি বুঝাতে চাইছে, বলতে চাইছে। সে নিজেও জানে তার পরিবার, আত্মীয় মহল তাদের এই বিয়েটাকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিবে না কিন্তু এতে রওনকের কিচ্ছু যায় আসে না। তবে সে ভুলেও ভাবেনি চিত্রলেখা তার মস্তিষ্কের ভেতর এসব ভাবনা পালছে। চিত্রলেখার মুখ চেপে ধরে রওনক চেঁচিয়ে ওঠে,

-জাস্ট শাটআপ চন্দ্র।

নিজের মুখ থেকে রওনকের হাত সরিয়ে দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আমি না হয় চুপ করে গেলাম কিন্তু অন্যদের তো আপনি আটকাতে পারবেন না। বাকিরা ঠিকই এমনটাই ভাববে। এর চাইতে জঘন্য কিছু ভাববে।

রওনক শক্ত হাতে চিত্রলেখার বাহু ধরে তার চোখে চোখ রেখে বলে,

-কে কি ভাবছে বা ভাববে তাতে আমি রওনক জামানের কিচ্ছু যায় আসে না। আই ডন্ট গিভ এ ফা ক টু দেয়ার থিংকিং, অল আই কেয়ার জাস্ট হোয়াট ইউ থিংক আবাউট আজ বিইং টুগেদার।

ডান হাতটা চিত্রলেখার গালে রেখে রওনক আরও বলে, প্লিজ তুমি অন্তত এভাবে ভেবো না আই রিকুয়েষ্ট টু ইউ। তুমি না চাইলে আমরা কোথাও যাবো না, এখানেই থাকবো। আই প্রমিজ বাট স্টপ থিংকিং লাইক দ্যাট।

চিত্রলেখা এই প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ায় না। বরং নিজের কন্ঠের স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বলে,

-চলুন, সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

নাস্তার টেবিলে দিলারা জামান চিত্রলেখাকে দেখে আগের দিনের মতোই কোনো কথা বলেননি। রাগে উনার শরীর রি রি করছেন কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ হতে দেননি। উনি ভেবেছিলেন পথে কাটা সহজেই উপড়ে ফেলেছেন কিন্তু ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। উনার প্লান ব্যাক ফায়ার করেছে দেখে রাগ হয়েছেন। টেবিলে বসেই রওনক আগে চায়ের কাপে তৃপ্তির চুমুক দেয়। তা দেখে সভাবশুলভই চিত্রলেখার মুখ ফোঁসকে বেরিয়ে আসে,

-খালি পেটে আগেই চা খাচ্ছেন কেনো? এসিডিটি হয়ে যাবে তো। আগে নাস্তা করুন, পরে চা খাবেন।

কথা শেষ করতেই চিত্রলেখা লক্ষ করে রওনক অদ্ভুত এক হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে চোখের ইশারায় চিত্রলেখা জানতে চায় কি? রওনক কিছু বলে না। হেসে কেবল চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে। ততক্ষণে চিত্রলেখা খেয়াল করে অন্যরা সবাই এখানেই উপস্থিত আছে। টের পেয়েই লজ্জা পেয়ে যায় সে। তানিয়া টিটকারির সুরে বলে,

-দেখলে জাহানারা খাল এতদিনে রওনক জামানকে শাসন করবার মানুষ চলে এসেছে।

তানিয়ার টিটকারি শুনে মুখ চেপে হাসেন জাহানারা। তবে এটাও লক্ষ করেন দিলারা জামান মোটেও এসব পছন্দ করছেন না। আপাতত আর কাউকে তোয়াজ করবে না তানিয়া। তার জীবনের লম্বা একটা সময় নষ্ট হয়েছে। তাই এই মুহূর্তে শাশুড়ির পছন্দ অপছন্দকে আমলে নেয় না সে।

আজকের নাস্তায় রুটি সবজি ডিম পোচ, মালেট, সেদ্ধ হয়েছে। সাধারণত ঘি দিয়ে ভাজা মচমুচে পরোটা বানানো হয়। আজ ঘি ছাড়া রুটি দেখে দিলারা জামান জিজ্ঞেস করেন,

-কিরে জাহানারা পরোটা করিসনি কেনো?

আজ রুটি করার আইডিয়াটা চিত্রলেখার ছিল। সেই জাহানারকে বলেছিল সবার জন্য রুটি করতে শুধু মিম, মিশকাতের জন্য ঘি দিয়ে পরোটা হবে। চিত্রলেখার নাম শুনলে খুশি হবেন না তা বুঝতে কিছু বাকি নেই কারো। তাই জাহানারা চিত্রলেখার নাম না নিয়ে বলেন,

-ঐ ভাবলাম সবসময় তো পরোটাই খাওয়া হয় তাই আজ…

জাহানারাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-মা, আমিই ফুপিকে বলেছি আজ সবার জন্য রুটি করতে। পরোটাও হয়েছে তবে মিম, মিশকাতের জন্য। বাকি আপনাদের সবার জন্য রুটি করিয়েছি।

চিত্রলেখার দিকে তাকানোও না তিনি। জাহানারার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

-কিরে জাহানারা আমি কি মরে গেছি নাকি যে আমার বাড়ির নাস্তায় কি বানানো হবে সেই সিদ্ধান্ত বাইরের মানুষ নিচ্ছে। নাকি তোরা ভাবছিস আমি সংসারের হাল ছেড়ে দিয়েছি?

দিলারা জামানের সূক্ষ্ম খোঁচাটা ঠিকই টের পায় চিত্রলেখা। রওনক যেনো কিছু না বলে সেজন্য আগেই তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখে। জাহানারাকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলে চিত্রলেখা নিজেই শাশুড়িকে জবাব দিয়ে বলে,

-সরি মা, আমার আপনাকে জিজ্ঞেস করে নেয়া উচিত ছিল। আপনারা সবাই ব্যস্ত কারো নিজের ডায়েটের দিকে খেয়াল নেই। আপনার ডায়াবেটিক্স আছে সেই সঙ্গে হাই প্রেসার, ভাবী এমনিও ডায়েটে থাকেন, আর উনি তো সবসময় চা বেশি খায় এতে এসিডিটির সমস্যা হতে পারে। তাই সবার দিক বিবেচনা করে ভাবলাম প্রতিদিন প্রতিদিন ঘি দিয়ে ভাঁজা পরোটা খেলে সবারই স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে। মিম, মিশকাত ছোট ওদের এক্সট্রা এনার্জি দরকার তাই ওদের জন্য ঘি দিয়ে পরোটা হবে। অতিরিক্ত জ্যাম পারুটি খেলে ওদের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাবে। তাই সবার ডায়েটের দিকে খেয়াল রেখেই নাস্তার ম্যেনুতে পরিবর্তন এনেছি।

দিলারা জামানের রাগ বেড়েই চলেছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,

-তুমি কি ডায়েটিশিয়ান হয়েছো নাকি?

-ডায়েটিশিয়ানের ডিগ্রি নেই তবে কার জন্য কোনটা ভালো সেটুকু জানি।

-আমার ভালো আমি জানি, বাইরের কাউকে আমার ভালো মন্দ ভাবতে হবে না।

এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও রওনকের পক্ষে আর চুপ করে শুনা সম্ভব নয়। এবার আর চিত্রলেখাকে সুযোগ না দিয়ে রওনক বলে,

-ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন তুমি যাকে অলরেডি দু’বার বাইরের লোক বলেছো সে আসলে কিন্তু বাইরের লোক নয়। আমার ওয়াইফ, এই বাড়ির বউ। তবে একটা কথা ভুল বলোনি, আমার মনে হয় এখন তুমি সংসারের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা নিতে পারো। তোমাকে রিপ্লেস করার সঠিক মানুষ এসে গেছে। ইউ ক্যান বি রিল্যাক্স নাও। মিহোয়েল মাই ওয়াইফ ক্যান টেকঅফ অল ইউর রিসপন্সিব্লিটিস।

ছেলের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারেন না রওনক। চোয়াল শক্ত করে দিলারা জামান বলেন,

-কি বলতে চাইছিস তুই? একটা পরিচয়হীন রাস্তার মেয়ের হাতে আমি আমার এত যত্নে গড়া সংসার ছেড়ে দিবো?

রওনক আর নিতে পারছে না। এমনিও আগের দিনের ঘটনা সে ভুলে যায়নি। শুধুমাত্র চিত্রলেখার অনুরোধের কাছে চুপ করে আছে সে। নয়ত এতক্ষণে এই বাড়িতে তুফান ডেকে ফেলতো সে। কিন্তু এই মুহূর্তে যা হচ্ছে এসবও আর মুখ বুজে সহ্য করবে না সে। হাতের মুঠো অলরেডি শক্ত হয়ে গেছে তার যা চিত্রলেখার দৃষ্টি এড়ায়নি।

-ইনাফ…

এই একটা শব্দের বেশি বলতে পারে না রওনক। সে আর কিছু বলে এর আগেই চিত্রলেখা তার মুঠো বদ্ধ করা হাত চেপে ধরে খানিকটা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে নিচু কন্ঠে বলে,

-বাচ্চারা দেখছে প্লিজ।

মিম, মিশকাতের দিকে তাকিয়ে রওনক থেমে যায়। নিজের রাগ চেপে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করে। এতক্ষণে দীদার এমন কঠিন আচরণ দেখে ওদের দু’জনেরই চোখ বড় হয়ে গেছে। এর আগে কখনো ওরা ওদের দীদাকে এভাবে রাগ করতে দেখেনি। চিত্রলেখা এমন ভাব করে যেনো কিছুই হয়নি। মিম, মিশকাততে দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,

-জলদি দু’জন লক্ষি বাচ্চার মতোর গ্লাস খালি করে ফেলো তো দেখি। আজ মিমি তোমাদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসবে।

চিত্রলেখার কথার মাঝে তানিয়া বলে,

-আজ ড্রাইভারই ওদের নামিয়ে দিয়ে আসুক তুমি বাসায় থাকো। রাতে পার্টির জন্য আমি পার্লারের এপেয়ন্টমেন্ট নিয়েছি আমাদের দু’জনের জন্য। ওরা চলে আসবে একটু পরেই।

অবাক হয়ে চিত্রলেখা বলে,

-এত জলদি? পার্টি তো রাতে।

-ওরা আসবে আমাদের ফেশিয়াল, মেনিকিউর, পেডিকিউরের আর এক্সেটরা করতে। বিকেলে বিউটিশিয়ানরা আসবে তোমার ম্যাকভারের জন্য।

মুখটা ছোট্ট করে ও করে চিত্রলেখা কিন্তু কোনো শব্দ করে না। আর কেউ কোনো কথা বলেনি। রওনকের চায়ের কাপ খালি হলে চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে বলে,

-আরেক কাপ প্লিজ।

এটা রওনকের তৃতীয় কাপ চা চলছে। নাস্তা করতে করতেই দু’কাপ চা খেয়েছে সে। চিত্রলেখা আপত্তি করে না। রওনক সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে মিম, মিশকাতের নাস্তা করা ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। দু’জনকেই বলে,

-তোমরা ব্যাগ নিয়ে আসো আজ চাচ্চু তোমাদের স্কুল দিয়ে আসবে।

চাচ্চুর কথা শুনার সঙ্গে সঙ্গেই দু’জনে নিজেদের ঘরের দিকে দৌড় লাগায় স্কুল ব্যাগ আনতে। রওনক চায়ের কাপে লাস্ট চুমুক দিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। তারপর সবাইকে বিশেষ করে চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে বলে,

-মিসেস দিলারা জামান, গতকাল আপনি একটা ঘটনা ঘটিয়েছেন। ভেবেছেন কেউ কিচ্ছু টের পাবে না। কিন্তু আপনি হয়ত ভুলে গেছেন এই বাড়ির দেয়ালেরও কান আছে আর এসব দেয়ালেরা আমার কাছে সব রিপোর্ট পৌঁছে দেয়। এই বাড়িতে কেউ কাশলেও সেটা আমার পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

দিলারা জামান একবার জাহানারার দিকে তাকান। রওনক বলতে থাকে,

-আমার ওয়াইফ চায় না এই বিষয়ে আমি আপনাকে কাউন্টার দেই তাই বেশি কিছু বলবো না শুধু এতটুকু বলবো এরপর এমন কিছু করার আগে একটু চিন্তা ভাবনা করে নিলে আমি খুশি হবো। আমার ওয়াইফকে মাত্র এক কোটি টাকার চেক দেয়ার আগে আপনার ভাবা উচিত ছিল কাকে কি দিচ্ছেন। যে নিজেই কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক তাকে এক কোটি টাকা দেয়াটা নেহাৎ হাস্যকর নয়কি? আশাকরি এরপর এমন চাইল্ডিস কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন।

চিত্রলেখা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। রওনকের ইচ্ছা করছিল সে আরও অনেক কিছু বলে কিন্তু তার চন্দ্র তাকে অনুরোধ করায় এর বেশি আগায়নি সে। নয়ত তার চন্দ্রকে অপমান করার জন্য নিজের মাকেও ছেড়ে কথা বলতো না সে। বউয়ের চোখ থেকে হাসি পেয়ে যায় রওনকের। সকলের উপস্থিতিতেই এক কদম কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে বলে,

-আমার একটা জরুরী মিটিং আছে। ওটা শেষ করেই চলে আসবো।

চিত্রলেখা কেবল মাথা ঝাঁকায়।

মিম, মিশকাত তাদের স্কুল ব্যাগ নিয়ে ফিরে এলে রওনক দু’জনকে দু’হাতে ধরে আসছি বলে দরজার দিকে আগায়। চিত্রলেখাও ওদের সঙ্গে গেইট পর্যন্ত আসে। রওনককে গেইটের কাছে আসতে দেখে তার ড্রাইভার এগিয়ে আসলে বাচ্চাদের এগিয়ে দিয়ে বলে,

-তোমরা নামো আমি আসছি।

ড্রাইভার বাচ্চাদের নিয়ে লিফটে উঠে গেলে রওনক চিত্রলেখার দিকে তাকায়। রওনকে আচমকা এভাবে তাকাতে দেখে নার্ভাস হয় চিত্রলেখা। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে,

-আপনার জন্য চা দিয়ে দিয়েছি।

চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বউয়ের গালে আলতো চুমু খেয়ে রওনক বলে,

-থ্যাংকিউ লাভ।

চিত্রলেখা চোখ বড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে অবাক হওয়া অবস্থায় রেখেই হাসি হাসি মুখ করে বেরিয়ে যায় রওনক। দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই একবার ঢোক গিলে চিত্রলেখা। আচমকাই অসম্ভব গরম লাগছে তার। নিজের গালে হাত রাখলে টের পায় পুরের যাচ্ছে যেনো সব রেখে কেবল রওনকের ঠোঁট যে জায়গাটা স্পর্শ করেছে সেখানেই জ্বর এসেছে তার। সেই সঙ্গে তার বুকের ভেতর তবলা বাজচ্ছে। এইসব অনুভূতি নিয়েই ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে চিত্রলেখা যতক্ষণ না তানিয়ে এসে ডাক দেয় তাকে। তানিয়ার ডাকেই চেতন ফিরে পায় সে।

-কি ভাবছো? অনিথিং রং?

মুখ দিয়ে কথা বের হয় না চিত্রলেখা কেবল মাথা ঝাঁকায় সে।

চলবে…