ঐশ্বর্যের উপাখ্যান পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
204

#ঐশ্বর্যের_উপাখ্যান
#পর্ব-০৭ (অন্তিম পর্ব)
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

গভীর রাত। চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই ঐশ্বর্যের। ল্যাপটপে হাতের আঙুল দ্বারা করে চলেছে কাজ। ঠিক তখনই তার মুঠোফোন বেজে উঠলো বিকট শব্দ করে।

কাজে ব্যাঘাত ঘটায় ঐশ্বর্যের ভ্রু আপনাআপনি কুঁচকে গেলো। দ্বিতীয়বারের মতো আবারও মুঠোফোন বেজে উঠতেই রিসিভ করলো সে।

আন-নন নাম্বার দেখে ঐশ্বর্য সালাম দিলো। ওপাশ থেকে পুরুষালী রুক্ষ গলা শুনা গেলো। সালামের উত্তর দিয়ে পুরুষটি আদেশ করল, ‘পাঁচ মিনিটের ভিতরে নিচে আসো।’

গলা চেনা চেনা লাগলো ঐশ্বর্যের। কিন্তু অপরিচিত ব্যক্তির এহেন প্রস্তাবে বিরক্ত হলো অনেক। কন্ঠে গাম্ভীর্য ঢেলে বলল, ‘হু আর ইউ ম্যান?’

ওপাশ থেকে বলল, ‘সেটা দেখার জন্যে হলেও নিচে আসো।’

অগত্যা ঐশ্বর্য মুঠোফোন কানে চেপে ধরে নিজের কক্ষ থেকে বের হলো। ডোয়িং রুম গভীর অমানিশাতে ডুবে। চুপিচুপি পা ফেলে আগাতে লাগলো দরজার দিকে। দরজায় হাত রাখতেই জ্বলে উঠলো সব বাতি। পুরো ডোয়িং রুম আলোকিত হলো মুহুর্তের মধ্যেই। ঐশ্বর্যের কানে ভেসে এলো একাধিক মানুষের একসাথে বলা ‘শুভ জন্মদিন, শুভ জন্মদিন, শুভ জন্মদিন!

কান থেকে মুঠোফোন নামিয়ে অবাক চোখে পিছু ফিরে তাকালো ঐশ্বর্য। নিজের চক্ষে যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মা বাবা ভাই বোনদের সাথে অনল শিকদার দাড়িয়ে আছে। শুধু তা-ই নয় আরও কতো মানুষজন। এতো মানুষ বাড়িতে অথচ সে টেরই পেলো না!

তুর এগিয়ে এসে হাত টেনে নিয়ে গেলো ঐশ্বর্যকে। ঐশ্বর্য চারিদিকে চোখ ভুলিয়ে দেখলো। কি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে সবকিছু। সব কি তারই জন্য?

রুদ্র ও তটিনী মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো। শুভেচ্ছা জানালো আঠাশ তম জন্মদিনের। তটিনী ঐশ্বর্যের কপালে চুমু দিয়ে কেকের কাছে নিয়ে গেলো। এক সাইডে ঐশ্বর্যের পরিবার ও আরেক সাইডে অনল ও তার পরিবার দাড়ালো। তটিনী ও রুদ্র এক পাশ থেকে ঐশ্বর্যের হাতে হাত রাখলো। অপর পাশ থেকে হাত রাখলো অনল ও তার মা ইলমা খান। কেক কেটে ঐশ্বর্য প্রথম নিজের মা বাবাকে খাইয়ে দিলো। সবাইকে একটু একটু খাওয়ানোর পর অনলের পালা। ঐশ্বর্য প্লেটে কেক নিয়ে ঐশানীর হাতে দিয়ে বলল, ‘নেতাকে দিয়ে আয়।’

ঐশানী সরে গেলো। ঐশ্বর্য ঐতিহ্যের দিকে তাকাতেই ঐতিহ্যও সরে গেলো। তুরের দিকে তাকিয়ে যা বুঝলো আজ কেউ তার কথা শুনবে না। অগত্যা নিজেই এগিয়ে গেলো অনলের দিকে। অনলের ঠোঁটের কোণে উঁকি দিচ্ছে হাসির ঝলক। হয়তো সে এরকমই একটি মুহূর্তের অপেক্ষা করছিল। ঐশ্বর্য প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার কেক!’

‘আমি তো জানতাম যার জন্মদিন সে নিজে সবাইকে কেক খাইয়ে দেয়!

ঐশ্বর্য আশ্চর্য হয়ে তাকালো। চোখে চোখ পড়তেই অনল চোখ মারলো। ঐশ্বর্য চোখ বড়বড় করে ফেললো। ততোক্ষণে পিছে এসে দাড়িয়েছে দু’টি পরিবার। তুর ঐশ্বর্যের হাত থেকে প্লেট নিয়ে নিলো। অনলের মা (নাম মনে নাই🥺) একটি বক্স এগিয়ে দিলেন। সেটা খুলে অনল ডায়মন্ডের আংটি বের করলো। তটিনী ঐশ্বর্যের হাত উপরে তুললো। ঐশ্বর্য ঘোরের মধ্যে এনগেজড হয়ে গেলো। সে নিজেও যে কিভাবে আংটি পড়িয়েছে তা নিজেও বুঝতে পারেনি।

আংটি পড়ানো শেষে তুর চামচে কেক নিয়ে ঐশ্বর্যকে বললো অনলকে খাইয়ে দিতে। ঘোরের মধ্যেই ঐশ্বর্য খাইয়ে দিলো। অনল চমৎকার করে হেসে নিজেও খাইয়ে দিলো। ব্যস হয়ে গেলো ঐশ্বর্য ও অনলের এনগেজমেন্ট!

ঘোরের মধ্যে এনগেজমেন্ট হলেও বিয়ে কিন্তু হলো জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে। ঐশ্বর্য কখনো যা স্বপ্নেও ভাবেনি। হাজারো রমনীর ক্রাশ অনল শিকদারকে চোখের পলকে নিজের সাথে বেঁধে নিলো সে।

বিয়ের আগে একদিন ফোনে আশ্চর্যজনক একটি বিষয় জানতে পারলো ঐশ্বর্য। তার স্বামী নাকি তাকে অনেক আগে থেকে পছন্দ করতো! সেটা শুনে ঐশ্বর্য অজ্ঞান হয়ে গেছিল। পাক্কা এক ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরেছিল বেচারির।

তারপরের ঘটনা আরও লম্বা। বিয়ের দিন বুঝদার ঐশ্বর্য কেঁদেকেটে একাকার। তার মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে৷ অনল বউয়ের দিকে টিস্যু এগিয়ে দিতে দিতে একেকজনকে ধরে বলছে তার বউয়ের কান্না থামাতে। কিন্তু কেউ তো এগিয়ে এলোই না বরং ধমক দিতে লাগলো। অনল যখন নিজের বোন অনামিকাকে বলল, ‘তোর ভাবিকে বল কান্না থামাতে।’

তখন অনামিকা রেগে বলেছিল, ‘তুমি নিজে আগে নাক টানা বন্ধ করো। পারলে দুজনে মিলে গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদো!

অনল ঐশ্বর্যকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কাঁদছো কেন?’

ঐশ্বর্য নাক টেনে বলল, ‘আপনি কাঁদছেন কেন?’

তাদের কাঁদা কাদির পর এলো মিডিয়ার বিষয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েকমাস আগে যাকে নিয়ে অনেকে বাজে কথা বলতো তারা চমকে গেলো। সেই মেয়েটিকেই অনল শিকদার বিয়ে করেছে! সবার জন্য অবিশ্বাস ব্যাপার!

*
বিয়ের পর ঐশ্চর্য শিকদার বাড়ি থেকেই অফিসে যাতায়াত করতো। অনল তখন রাজনীতিতে সবটুকু দিয়ে রাজত্ব করছে। তারপর?

তারপর বছরের পর বছর আসলো। ২০৪৫ সাল থেকে ২০৫০ সাল হলো। প্রথমবার বাবা হওয়ার স্বাদ লাভ করলো অনল শিকদার!

এবার চলুন আপনাদের প্রিয় রুদ্র-তটিনীর দিকে ফেরা যাক। রুদ্র ইরফান আগের থেকে একটু বয়স্ক হয়ে গেছে। চামড়া আগের মতো থাকলেও গাল কিছুটা ডেবে গেছে। তটিণী আজকাল স্বামীর মতো চশমা ব্যবহার করছে। কিন্তু দিনশেষে দুজন দুজনকে ভালোবেসে ভালো আছে!

তুর ২০৪৬ সালে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিল। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে পা রাখে। তারপর? আজ তার বিয়ে। ঐশ্বর্য দুমাসের বাচ্চা ও তার নেতা সাহেবকে নিয়ে এসেছে বাবার বাড়ি। বাবার বাড়ি কেন বলছি?

আরে আপনানা বুঝতে পারেন নি? ঐতিহ্যের সেই ওয়ান এন্ড অনলি ক্রাশ আর কেউ না বরং আমাদের তুর! হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। ঐতিহ্যের সাথেই তুরের শুভ বিবাহ হতে চলেছে!

সাদা গ্রাউন, চুলে দোপাট্টা জড়িয়ে প্রিন্সেসের মতো সেজেছে তুর। মুখের সামনে দিয়ে কাপড় দেওয়া। সেজন্য চোখ ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। ঐতিহ্য সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে। কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। ঐতিহ্য ও তুর ফটাফট কবুল বলে দিলো। ব্যস হয়ে গেলো আরও একটি বিয়ে।

এবার চলুন আমাদের রুদ্রের ছোট রাজকন্যার দিকে যাওয়া যাক। ঐশানী মামা ও চাচার মতো ডাক্তারি পড়ছে। বর্তমানে ইন্টার্নি করছে সে। কিছু বছর পর তারও বিয়ে হবে কোনো এক রাজকুমারের সাথে।

আমাদের ছোট্ট সদস্য হলো ঐশ্বর্য ও অনলের পুত্র অগ্নি শিকদার! যে বর্তমানে বাবার কোলে হিসু করে শুয়ে আছে চুপটি করে। অনল নিজের শার্টের দিকে তাকালো। পেমপাস পড়ানোর কারণে তেমন নষ্ট হয়নি। কিন্তু একফোঁটা হলেও তার পোশাকে পড়েছে। অনল অসহায় চোখে ঐশ্বর্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করলো।

আমাদের সবার প্রিয় ঐশ্বর্য তখন একমাত্র ভাইয়ের পাশে বসে সবার সাথে গসিপ করতে ব্যস্ত। ঐশ্বর্য কালো গ্রাউন পড়েছে। বয়স বাড়লেও সৌন্দর্য কমে যায়নি। বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন।

অনলের সাথে চোখাচোখি হতেই অনল অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। ঐশ্বর্য বুঝেও চোখ সরিয়ে নিলো। ভাব এমন আমি কিছু দেখিনি। অনল বউয়ের মতলব বুঝতে পারলো। বিয়ের পর থেকে ঐশ্বর্য এখন পর্যন্ত কোনো সুযোগ বাদ রাখেনি যা করে নিজের স্বামীকে বিরক্ত করা যায়। সে মূলত প্রতিশোধ নিচ্ছে। কেন অনল প্রথম থেকে বললো না পছন্দ করে? তাহলে কি ঐশ্বর্য এমন কষ্ট পায়?’

অনলের অসহায়তা দেখে হয়তো মায়া হলো তার একমাত্র পুত্র অগ্নির। সে বিকট চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। ঐশ্বর্য ছেলের চিৎকার শুনে এক দৌড়ে চলে আসলো। অনলকে ধমক দিয়ে বলল, ‘আপনি কি করেছেন ওকে?’

অনল অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু করিনি, পেমপাস নষ্ট হয়ে গেছে। পাল্টে দাও ঠিক হয়ে যাবে।’

ঐশ্বর্য কটমট করে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি চেঞ্জ করাতে পারলেন না?

‘এতোক্ষণ তো এজন্যই তোমাকে ডাকছিলাম। পেমপাস কোথায় আমি তো জানি না।’

অনলের অসহায় গলা। ঐশ্বর্য গটগট পা পেলে চলে গেলো। অনল বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘নেতাকে দিয়ে পেমপাস পাল্টানো! নেতাকে ধমক দেওয়া! জাতি মেনে নিবে না ঐশ্চর্য!

এইতো, এভাবেই চলতে লাগলো আপনাদের প্রিয় ঐশ্বর্যের উপাখ্যান!

সমাপ্ত🤍

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে