Saturday, July 12, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 254



মাতাল হাওয়া পর্ব-৬৪

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৪
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনককে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিতে তার সঙ্গে চিত্রলেখা এসেছে। কেনো তার সঙ্গে আসতে মন চেয়েছে তার চিত্রলেখা নিজেও জানে না। হয়ত আরও কিচ্ছুক্ষন রওনকে সঙ্গ পাওয়ার লোভেই এসেছে। এয়ারপোর্ট আসার আগে মায়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছে রওনক। কোথাও যাবার আগে সবসময় মায়ের দোয়া নিয়েই বের হয় সে। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এমনিতে শক্ত একরোখা হলেও রওনক ভীষণ রকম ফ্যামিলি ম্যান। তিলত্তমা চলে যাবার পর ব্যবসাটাই রওনকের জীবনে সব হয়ে গেছে তবুও সে পরিবারকে কোনো সাইড করেনি। নিজের পরিবারের দিকেও সবসময় তার সতর্ক দৃষ্টি থেকেছে। মুখে না বললেও রওনক তার পরিবারকে অনেক ভালোবাসে। এয়ারপোর্ট টার্মিনাল টু এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারা একে-অপরের মুখোমুখি। চিত্রলেখার নার্ভাস লাগছে। বিদায় বেলায় কি বলতে হয় তার জানা নেই। জানা থাকবে কীভাবে এভাবে কখনো কাউকে বিদায় দেয়া হয়নি তার। লাবিব সঙ্গে এসেছে। সবসময় সেই আসে, কখনো কখনো সঙ্গেও যায়। তবে এবার রওনক একা যাচ্ছে। এদিকেও কিছু কাজ আছে যেগুলো রওনকের অবর্তমানে লাবিব ও তানিয়াকে সামলাতে হবে। তানিয়া একা পারবে না ভেবেই লাবিবকে রেখে যাওয়া। আবার চিত্রলেখাও আছে। যদি কোনো ইমার্জেন্সি হয় এসব অনেককিছু ভেবেই লাবিবকে এবার রেখে যাচ্ছে সে। লাবিব গাড়ি থেকে রওনকের ব্যাগ ট্রলিতে তুলতে ব্যস্ত। দিকের অন্য সময়ের চাইলে এইসময় এয়ারপোর্টে মানুষ একটু কম বলা যায় তবে একদম ফাঁকাও নয়। রওনক এতক্ষন তার ট্যাবে কিছু একটা করছিল। ট্যাবের কাজ শেষ করে সেটা গাড়ির পেছনের ছিটে রেখে দরজা আটকে দেয়। রওনা থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি চিত্রলেখা। কি বলবে সেটা বুঝতে পারছে না বলেই তার চুপ করে থাকা। এবারে রওনক এগিয়ে এসে চিত্রলেখার দুই হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। চিত্রলেখা প্রথমে হাতের দিকে তাকায় তারপর মুখ তুলে রওনকের মুখের দিকে তাকায়। আচমকাই ধক করে ওঠে তার বুকের ভেতর। এই মানুষটাকে আগামী বেশ কিছুদিন দেখতে পারবে না সে। ভাবনাটা হিট করে চিত্রলেখাকে বুকের গভীরে কোথাও। কিছু বলার তাগাদা অনুভব করে চিত্রলেখা। কিন্তু বলবে সে? সাবধানে থাকবেন, রওনক তো বাচ্চা নয় যে সাবধানে না থাকলে হারিয়ে যাবে। ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করবেন, সময় মতো ঘুমাবেন, মন দিয়ে কাজ করবেন, এসব কি আসলেই বলতে হবে? একটা প্রশ্নও যুত সই লাগে না চিত্রলেখার কাছে। এসব বললে নিশ্চয়ই রওনক হাসবে তার উপর। কাজের জন্য যাচ্ছে অবশ্যই মন দিয়েই কাজ করবে সে। নিজের বোকা বোকা চিন্তার উপর নিজেরই বিরক্ত লাগে। তাই কিছু না বলে চুপ করে থাকাই শ্রেয় ধরে নেয়। রওনক নিজেই বলুক যা বলার। তাদের দু’জনের মাঝে সামন্য দূরত্ব আছে। এক কদম এগিয়ে এসে সেই দূরত্ব ঘুচে দেয়ার চেষ্টা করে রওনক। যদিও তাদের শরীর পুরোপুরি স্পর্শ করে না। ইদানিং যথেষ্ট ঠান্ড পড়ে গেছে। চিত্রলেখার গায়ে একটা মোটা কাশ্মিরি শাল জড়ানো। শাড়ি পড়েছে সে। রওনকের আগের দিন নিয়ে আসা শাড়িগুলো থেকে হালকা গোলাপী রঙের প্রিন্টের শাড়ি। চিত্রলেখাকে চেঞ্জিং রুম থেকে শাড়িতে বের হতে দেখে রওনকের ইচ্ছা হয়েছিল সে এই ফ্লাইটটা ক্যান্সেল করে দেয়। কিন্তু করেনি, নিজেকে সামলে রেখেছে। নিজেদের কাছা আসার মূহুর্তটাকে তাড়াহুড়ো করে নষ্ট করতে চায় না সে। সময় নিয়ে চিত্রলেখাকে আদর দিতে চায় সে। সময় নিয়ে চিত্রলেখার জড়তা ভাঙতে চায়। সময় নিয়ে নিজেকে চিত্রলেখার কাছে হস্তান্তর করতে চায় সে। তাড়াহুড়ো করে নিজের জীবনের সবচাইতে বিশেষ মুহুর্তটা নষ্ট করতে চায় না সে। তাই কষ্ট হলেও নিজেকে সামলে রেখেছে।

চিত্রলেখার কপালের কাছে লেপ্টে থাকা চুল আঙ্গুলের স্পর্শে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলে,

-নিজের খেয়াল রেখো। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো। কোনো টেনশন করো না। কিছু প্রয়োজন হলে লাবিবকে বলো। ভাবীকেও বলতে পারো। খুব বেশি বোর লাগলে অফিসে যেতে পারো। আমাকে যখন ইচ্ছা হয় তখন কল দিও। কাছে না থাকলেও আমি চব্বিশ ঘন্টা তোমার জন্য ফোনে এভেইলেবল আছি, ঠিক আছে?

মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। একমুহূর্তের জন্য রওনকের চোখ থেকে চোখ সরায়নি সে। নিজের ভেতরের সংকোচকে সাইডে রেখে বলে,

-নিজের খেয়াল রাখবেন আর…

-আর!

-আমি অপেক্ষায় থাকবো।

রওনকের হাতে বাঁধন শক্ত হয়। সে বলে,

-সম্ভব হলে কালই ফিরে আসবো।

-না না তাড়াহুড়ো করতে হবে না। আপনি কাজ শেষ করেই আসবেন।

চিত্রলেখার রিয়্যাকশনে হাসি পায় রওনকের। তার আবার সময় ঘনিয়ে এসেছে বুঝতে পেরে এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার কপালে চুমু খায় রওনক। তা দেখে চোখ বড় করে তাকায় চিত্রলেখা। একবার আশেপাশে তাকায় সে। রওনক বলে,

-ইটস ওকে, আমাদের কেউ দেখছে না। আর দেখলেও তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।

বিদায় নেয়ার আগে চিত্রলেখাকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরে রওনক। লজ্জা লাগলেও ভালো লাগে চিত্রলেখার। রওনকের প্রতিটা স্পর্শ মনের ভেতর আনন্দের দোলা দিয়ে যায়। এই ভালো লাগার সঙ্গে কিছুদিন আগেও পরিচয় ছিল না তার। কিন্তু এখন সে বুঝে। এই ভালো লাগা কেবল মাত্র রওনক কেন্দ্রিক। একমাত্র রওনকের উপস্থিতি, তার স্পর্শই চিত্রলেখার মনের ভেতর এই আনন্দের ঢেউ তুলতে সক্ষম। রওনক ভেতরে চলে যাবার পরেও চিত্রলেখা কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। আচমকাই বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগে তার। মনে হয় কি যেনো একটা নেই। শূন্যতা গ্রাস করে তাকে। চিত্রলেখা টেরও পায় না তার চোখ ভার হয়। টুপ করে ডান গাল বেয়ে এক ফোঁটা পানি বেয়ে পড়ে। লাবিব দেখে ফেলার আগেই হাত বাড়িয়ে গালের পানি মুছে ফেলে এসে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাবিব সামান্য কেশে নিজের উপস্থিতি জানায়। চিত্রলেখার দৃষ্টি এখনো ঐদিকেই। আরও বেশ কিছুদিন ওদিকে তাকিয়ে থাকার পর লাবিবের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে,

-উনি কবে ফিরবেন?

স্মিত হেসে লাবিব বলে,

-কিছু বলেনি তোমাকে?

-বলেছেন, এক সপ্তাহ বা ১০ দিন লাগবে।

-হুম, ঐ রকমই।

-ওহ!

বলেই আবার ট্রার্মিনালের গেইটের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। যদিও রওনককে দেখতে পাবে না তবুও তার দৃষ্টি ওদিকেই যায় যেদিক দিয়ে কিচ্ছুক্ষন আগে রওনক গিয়েছে।

-চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।

লাবিবের দিকে তাকিয়ে সম্মতিতে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা।

খুব বেশি নয় মাত্র দু’দিন পর বাড়ি এসেছে চিত্রলেখা। অথচ মনে হচ্ছে কতদিন পর আপন ঠিকানায় ফিরছে সে। চিরচেনা সেই নীল লোহার গেটের কাছে এসে গাড়িটা থামলে চিত্রলেখা নেমে যাবার আগে লাবিব বলে,

-কিছু প্রয়োজন হলে আমায় বলো। যত রাতই হোক আমাকে একটা ফোন দিলেই হবে। ড্রাইভারের নম্বর ম্যাসেজ করে দিবো। কোথাও গেলে ড্রাইভার নিয়ে যাবে। স্যার বলে দিয়েছে এই গাড়িটা তুমি ব্যবসার করবে। আগামীকাল ১১ টার দিকে তৈরি থেকো তোমার পাসপোর্ট বানাতে দিতে যাবো।

-আর কিছু?

স্মিত হেসে লাবিব বলে,

-আপাতত আর কিছু না।

চিত্রলেখা গাড়ির পেছনের সিট থেকে নামলে তার সঙ্গে সামনের সিট থেকে লাবিবও নেমে আসে। গাড়ির ডিকি খুলে কিছু ফলের প্যাকেট বের করে নেয়। এসব দেখে চিত্রলেখা অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-এগুলো কখন কেনা হলো?

-তুমি আজ বাড়ি আসবে তাই স্যার আমাকে আগেই বলে দিয়েছিল ব্যবস্থা করে রাখতে।

-কিন্তু এসবের তো কোনো প্রয়োজন ছিল না।

-তোমার দিক থেকে হয়ত প্রয়োজন নেই তবে স্যারের দিক থেকে প্রয়োজন আছে। তার বউ বাপের বাড়ি আসবে তাও খালি হাতে, অসম্ভব।

চিত্রলেখা নীল গেইটের দিকে আগালে পেছন থেকে লাবিব বলে,

-একটা প্রশ্ন ছিল আমার।

পেছন ঘুরে চিত্রলেখা বলে,

-কি?

-আমার কি তোমাকে আপনি করে বলা উচিত?

-একদমই না। আমরা আগে যেমন ছিলাম এখনো তেমনই আছি, তেমনই থাকবো।

-কিচ্ছু আগের মতো নেই চিত্রলেখা। তুমি এখন আমার বসে ওয়াইফ।

-তবুও আমি চাই আমাদের বন্ধুত্বটা আগের মতো থাকুক। প্রয়োজনে উনার সঙ্গে আমি কথা বলে নিবো নাহ হয়? ততদিন আমরা আগের মতোই থাকি।

এই প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ায় না লাবিব। সম্মতিতে মাথা ঝাঁকায়। তারপর দু’জনে বাড়ির ভেতর অগ্রসর হয়। আচমকা চিত্রলেখাকে দেখে সবাই যেমন অবাক হয়েছে তেমন খুশিও হয়েছে। বাড়িটা যেনো জান ফিরে পেছে। চিত্রলেখার অবর্তমানে দু’দিনেই বাড়িটা নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছিল। সেই বাড়ি আবার তার চাঞ্চল্যতা ফিরে পেয়েছে। লম্বা সময় চারু চিত্রলেখাকে জড়িয়ে রেখেছে।

রাদিন নক না করেই তানিয়ার কেবিনে প্রবেশ করে। প্রচন্ড রাগে তার চোখ লাল হয়ে আছে। তানিয়া মনোযোগ দিয়ে কিছু ফাইল দেখছিল। কেবিনের দরজা খোলার শব্দ কানে আসলেও চোখে তুলে তাকায়নি দেখতে কে এসেছে। এগিয়ে এসে তানিয়ার হাতের কাছেই একটা এনভেলপ ছুঁড়ে দিয়ে রাদিস উচ্চ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-হোয়াট ইজ দিজ রাবিস তানিয়া?

রাদিনের কন্ঠ পেয়ে ফাইল থেকে চোখ তুলে তার দিকে তাকায় তানিয়া। নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে সে। রাদিন টেবিলের উপর হাত রেখে সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে,

-এক্সপ্লেইন মি, হোয়াট ইজ দিজ।

তানিয়া তার শান্তি ভঙ্গি বজায় রেখেই বলে,

-রিলাক্স রাদিন। টেক এ সিট। পানি খাবে?

পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে তানিয়া বলে,

-একটু পানি খাও তারপর কথা বলছি।

রাদিনের ইচ্ছা করছে সে গ্লাসটা তুলে আছাড় মে রে ভেঙে ফেলে। কিন্তু এমন কাজ সে করে না। চেয়ার টেনে তানিয়ার মুখোমুখি সে পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে একটানে সবটুকু পানি খেয়ে শেষ করে। গ্লাস নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই আবার জিজ্ঞেস করে,

-এসব কি তানিয়া? এসবের মানে কি?

-আমি তোমাকে ডিভোর্স দিচ্ছি।

-নো, ইউ কান্ট।

-ইয়েস আই ক্যান।

-তানিয়া!

-আমার পক্ষে আর তোমার সঙ্গে থাকা সম্ভব নয় রাদিন।

-তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করে ডিভোর্সের ডিসিশান নিতে পারো না।

-পারি রাদিন, অবশ্যই পারি। আমাকে চিট করার আগে তোমার ভাবা উচিত ছিল। একটা অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোর আগে ভাবা উচিত ছিল তোমার।

-আই লাভ হার তানিয়া। ভালোবাসা কখনই অনৈতিক হয় না।

-হয় রাদিন, ভালোবাসায় নৈতিকতা থাকে। বউ থাকতে অন্য নারীতে আসক্ত হওয়া কখনই নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। যাগ গিয়ে এইসব বিষয়ে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই না। আমার সিদ্ধান্ত আমি জানিয়ে দিয়েছি। সাইন করে আমাকে এই ঝামেলা থেকে মুক্তি দাও।

-ইউ নো হোয়াট তোমার এই সেলফিশনেসের কারণেই আমি কখনো তোমাকে ভালোবাসতে পারিনি। কারণ তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসা দিতেই পারো না।

তানিয়া রাদিনের কথার জবাবে একটা কথাও বলে না। রাদিনকে দেবার মতো হাজারটা জবাব আছে তার কাছে কিন্তু সে উত্তর করে না। এখন সব অহেতুক লাগে তার কাছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রাদিন। মনে হচ্ছে সে বেরিয়ে যাবে। বেরিয়ে যাবার আগে বলে,

-বাচ্চারা আমার কাছে থাকবে।

-বাচ্চাদের কথা তোমার না ভাবলেও চলবে। ওদের কস্টাডি আমিই পাবো। ওরা রওনকের কাছে থাকবে। তোমার মতো বাবা আমার সন্তানদের প্রয়োজন নেই।

-তানিয়া!

-তুমি এখন আসতে পারো রাদিন। আর কাগজগুলো সাইন করে দিও।

জবাবে কিছু বলে না রাদিন কেবল তাকিয়ে থাকে। তখনই দুইবার নক হয় তানিয়ার কেবিলের দরজায়। রাদিকের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই তানিয়া বলে,

-কাম ইন প্লিজ।

দরজার নব ঘুরিয়ে অর্ধেক প্রবেশ করেছে লাবিব। ওখান থেকেই তানিয়া ও রাদিনকে একে-অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার বুকের ভেতর কিছু একটা ভেঙে গেল। আমতা আমতা করে সে বলে,

-সরি, আমি পরে আসছি।

আই কন্টাক্ট ভেঙে লাবিবের দিকে তাকিয়ে তানিয়া বলে,

-ইটস ওকে এসো। আমাদের কাজ হয়ে গেছে।

ইতস্ততবোধ নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করে লাবিব। রাদিক বেরিয়ে যাবার জন্য কদম বাড়ালে পেছন থেকে তানিয়া বলে,

-এনভেলপটা নিয়ে যাও।

রাদিন আর অপেক্ষা করে না। এনভেলপটা নিয়েই বেরিয়ে যায়। লাবিব এগিয়ে এসে একটু রাদিন যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে দাঁড়ায়। তানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-আর ইউ ওকে?

তানিয়া মুখে কিছু বলে না। কথা বললেই হয়ত কেঁদে ফেলবে সে। কিন্তু সে ভেঙে পড়তে চায় না, একদমই না। একটা প্রতারকের জন্য কাঁদতে চায় না সে। ছলছলে দৃষ্টি নিয়ে লাবিবের দিকে তাকিয়ে রয় তানিয়া, মুখে কিছু বলে না।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৬১+৬২+৬৩

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

আজকের পার্টির জন্য বানানো বার কাউন্টারের সঙ্গে সামান্য সাইড হেলান দিয়ে হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মশগুল রওনক। যদিও আড্ডায় মশগুল বলা যায় না। একটু পরপরই অন্যদিকের সিড়ির দিকে দৃষ্টি যাচ্ছে তার চন্দ্র এসেছে কিনা দেখতে। এতক্ষন সময় লাগার কথা নয় যদিও তবুও অপেক্ষা করছে সে। চিত্রলেখা নার্ভাস রওনক জানে। এমন পার্টি এর আগে কখনো এটেন্ড করেনি সে। তাই তার নার্ভাস হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। চিত্রলেখার পরিস্থিতি আন্দাজ করেই তাকে সময় দিচ্ছে রওনক। সবে তো রাত হয়েছে তাড়া নেই কোনো। যদিও আকজকের রাতটা তার জন্য স্পেশাল তবুও কোনো কিছু নিয়েই চন্দ্রকে তাড়া দিবে না সে।

-দেয়ার শি ইজ মিসেস রওনক জামান।

সাদমানের মুখে মিসেস রওনক জামান শুনেই পাশ ফিরে সিড়ির দিকে তাকায় রওনক। ব্যস, আর কথা বলতে পারে না সে। রওনকের দৃষ্টি তার চন্দ্রের দিকেই আটকে গেছে। তবে এই মুহূর্তে কেবল রওনক নয়, পার্টিকে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি চিত্রলেখার দিকে আটকে আছে।

-ড্যাম গর্জিয়াস…

এতটুকুই বেরিয়ে আসে রওনকের মুখ গলে। এর বেশি কিছু বলতে পারে না সে। নিজের জায়গায় স্থির হয়ে গেছে সে। রওনকের পছন্দ করা গাউনটা পরে আসেনি চিত্রলেখা। এখন রওনক বুঝতে পারছে তৈরি হবার পরেও চিত্রলেখার বেরিয়ে আসতে এত সময় কেনো লেগেছে। চিত্রলেখার পরনে একটা কালো রঙের জর্জেটের টিস্যু শাড়ি। চিত্রলেখা হেয়ার স্টাইল চেঞ্জ করেনি, মেকাপও চেঞ্জ করেনি অবশ্য প্রয়োজন হয়নি। মেকাপে স্মোকি আই করা হয়েছে যা এই জর্জেট ফিনফিনে টিস্যু শাড়িটার সঙ্গেও দারুন লাগছে দেখতে। অর্নামেন্টসও আগেরটাই কেবল বদলেছে পরনের কাপড়। গাউনটার বদলে শাড়ি পরে এসেছে সে। জর্জেট শাড়িটার সম্পূর্ণ আঁচল, জমির নিচের দিক থেকে উপরে অর্ধকটা, বুকের কাছের অংশে ছোট ছোট স্টোন বসানো। তাই ফিনফিনে জর্জেট শাড়ি হলেও পেটের কাছটায় সামান্য অংশ ব্যতীত আর কিছুই তেমন একটা বুঝা যাচ্ছে না। ব্লাউজের হাতা কনুই পর্যন্ত যদিও জর্জেট হওয়ায় হাত বুঝা গেলে ইতস্তত লাগছে না চিত্রলেখার আগের মতো। অন্তত গাউনটার মতো তো নয়। গাউনের তো হাতাই ছিল না। কথায় আছে নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো। কেবল হাতাটাই নয় চিত্রলেখার পিঠটাও ভিজিবল এই ব্লাউজে তবে উন্মুক্ত নয়। কালো হওয়ায় সুবিধা হচ্ছে শরীরের অংশ খানিকটা বুঝা গেলে সরাসরি দেখা যাচ্ছে না। এটাই স্বস্তি। বোট গলা হওয়ায় ব্লাউজের সামনের অংশ দিয়ে চিত্রলেখা বুকের কাছের অংশ বুঝা বা দেখা যাচ্ছে না। ঐ গাউনটায় চিত্রলেখাকে ঠিক যতখানি সুন্দর লাগছিল দেখতে এই মুহূর্তে কালো রঙের জর্জেট টিস্যু শাড়িটাতে আরও হাজারগুন বেশি আউট অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড লাগছে তাকে দেখতে, অন্তত রওনকের দৃষ্টিতে। বাকি কার কাছে কেমন লাগছে তাতে রওনকের কিচ্ছু যায় আসে না। হি ড্যাম কেয়ার’স। সেই সঙ্গে চিত্রলেখার ঠোঁট জুড়ে থাকা ডার্ক রেড লিপস্টিক। ঐ লাল লিপস্টিক যেনো চিৎকার করে আহ্বান জানাচ্ছে রওনককে। এক্ষুনি গিয়ে ঐ ঠোঁট জোড়া দখল নেয়ার তাগিদ অনুভব করে রওনক। কিন্তু সে তো নড়তেই পারছে না এগিয়ে যাবে কীভাবে? চিত্রলেখাকে দেখার পর সব ভুলে গেছে যেনো। সংশয়ে, অজানা আতংকে চিত্রলেখা এখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। নেমে নিচে আসবে কিনা বুঝতে পারছে না। এত মানুষের ভীড়ে তার দৃষ্টি একজোড়া চোখকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে, রওনক। এই বাড়িতে থাকার তার একমাত্র ভিত্তি, পরিচয়, কাছে মানুষ।

সাদমান আলতো করে রওনকের কাঁধে ঝাঁকি দিলে নিজের ভাবনার জগৎ রেখে বাস্তবতায় ফিরে আসে সে। পাশ থেকে সাদমান বলে,

-গো, শি ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।

হাতে থাকা ওয়াইনের গ্লাসটা বার কাউন্টারের উপর রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে। বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে যায় চিত্রলেখার দিকে। এত সব অপরিচিত মুখের ভীর ঠেকে রওনককে এগিয়ে আসতে দেখে স্বস্তির হাসি ফুটে ওঠে চিত্রলেখার মুখ জুড়ে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ এটা ভেবেও অস্থির লাগে যদি তার দেয়া ড্রেস পড়েনি বলে রাগ হয়? রওনক কি বুঝবে ম রে গেলেও চিত্রলেখা ঐরকম শরীর দেখানো ড্রেস পরে এত মানুষের সামনে আসতে পারে না। এমনিতে শাড়িটা পাতলা ফিনফিনে ধরনের, এদিক সেদিক দিয়ে শরীর বুঝা যাচ্ছে এতেই লজ্জায় চিত্রলেখার মাটিতে মিশে যেতে মন চাইছে ঐ ড্রেসটা পরলে সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকলে লজ্জায় কেঁদেই ফেলতো সে। চিত্রলেখা ভেবে রেখেছে রওনক রাগ হলে প্রয়োজনে সারাদিন রাত ঐ ড্রেস পরে সে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। রওনক যদি একটু আগের মতো করে তার উন্মক্ত শরীরে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় তাতেও আপত্তি করবে না কিন্তু এত মানুষের সামনে ঐ ড্রেস সে পরতে পারবে না। এগিয়ে এসে চিত্রলেখার মুখোমুখি দাঁড়ায় রওনক। রওনককে এতখানি কাছাকাছি দেখেই বুকের ভেতর কিছু একটা তবলা বাজাতে শুরু করেছে চিত্রলেখার। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। রওনক কি রাগ হয়েছে তার উপর? নাকি বিরক্ত হয়েছে? তার মুখের ভাব দেখে কিছু বুঝা যাচ্ছে না। চিত্রলেখা কিছুই বুঝতে পারছে না। তাকে অবাক করে দিয়ে রওনক হাত বাড়িয়ে একটা হাত চিত্রলেখার কোমড়ে রেখে তাকে কাছে টেনে নেবার চেষ্টা করে গালে চুমু খায়। রওনকের কান্ডে পার্টিতে উপস্থিত সবাই হাত তালির সঙ্গে নানারকম উৎসাহ, উৎফুল্ল মূলক শব্দ করে। খুব বেশি সময় নেয় না রওনক। যদিও তার ইচ্ছা হচ্ছে পার্টিকে গু ল্লি মে রে চিত্রলেখাকে নিয়ে ঘরে চলে যেতে। দীর্ঘ সময়ের জন্য ঐ লাল ঠোঁট জোড়া নিজের দখলে রাখতে। ততক্ষন ছাড়বে না যতক্ষণ না তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চিত্রলেখাকে কিছু বলে না সে। পাশে দাঁড়িয়ে বাম হাতটা চিত্রলেখার শাড়ির ভেতর দিয়ে তার পেটের কাছে জড়িয়ে ধরে নিজের কাছাকাছি টেনে নেয় প্রিয়তমাকে। তার কান্ডে অবাক হয়ে মুখ ঘুরিয়ে রওনকের মুখের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। লজ্জায় ম রে যেতে মন চাইছে তার। সবাইকে দেখছে তাদের অথচ রওনকের যেনো কিচ্ছু যায় আসে না। সে বরং সবাইকে দেখাতেই ব্যস্ত চিত্রলেখা তার, একান্তই তার ব্যাক্তিগত।

রওনকের চোখের ইশারায় লাবিব সব লাইট অফ করে দিয়ে কেবল তাদের দু’জনের উপর একটা স্পটলাইট জ্বেলে দিয়েছে। উপস্থিত সকলের চোখ এখন তাদের দু’জনের দিকে স্থির। পেছন থেকে কেউ একজন রওনকের হাতে একটা মাইক দিয়ে দেখে। অন্ধকারে দেখা যায়নি ওটা কে ছিল। মাইকটা মুখের কাছে নিয়ে রওনক এতক্ষনে মুখ খুলে বলে,

-লেডিস এন্ড জ্যান্টেলম্যান হিয়ার প্রেজেন্ট মাই বিলাভেট ওয়াইফ, বেটার হাফ চন্দ্র আই মিন চিত্রলেখা রওনক জামান। আই থ্যাংকিউ অল ফর বিইং হিয়ার উইথ আজ এন্ড টু গিভ আজ ইউর লাভ এন্ড ব্লেজিংস। থ্যাংকিউ ফর ইউর প্রেজেন্স ইটস মিন্স এলট। প্লিজ ইঞ্জয় ইউর সেলফ।

রওনকের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে কড়তালিতে চারিদিক মুখোরিত হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে লাইটস অন করে দিলে তারা দু’জনে একত্রে নিচে নেমে আসে। ওরা নিচে নেমে আসলে সবার আগে এগিয়ে আসে সাদমান। চিত্রলেখার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে কি করবে ভেবে রওনকের মুখের দিকে তাকালে সে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করলে চিত্রলেখা হাত বাড়িয়ে সাদমানের হাতে হাত রাখতেই মাথা ঝুকিয়ে আলতো করে চিত্রলেখার হাতের উপরের দিকে ছোট্ট করে সৌজন্যমূলক চুমু দিয়ে সাদমান বলে,

-লুকিং গর্জিয়াস।

চিত্রলেখা বুঝতে পারে না ঠিক কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে। রওনক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় সাদমানের দিকে। তার হাত থেকে চিত্রলেখার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে,

-শি ইজ মাই ওয়াইফ।

-এন্ড শি ইজ মাই সিস্টার-ইন-ল।

-ফা…গেট অফ ম্যান।

আরও অনেকেই উপস্থিত থাকায় স্লাং ইউজ করতে নিয়েও করে না রওনক। তার অবস্থা দেখে সাদমান বলে,

-গেটিং জেলাস ম্যান।

-অফকোর্স আই ডু।

চিত্রলেখা বুঝতে পারে না আসলে এখানে কি হচ্ছে। সাদমান রওনককে বিরক্ত করতেই মূলত এমনটা করেছে। এছাড়া অন্যকোনো ইন্টেনশন নেই তার। অনেক বছরের বন্ধুত্ব তাদের। ভাইয়ের মতো সম্পর্ক। সাদমান কখনই কোনো স্টুপিড কাজ করে এই সম্পর্ক নষ্ট করবে না তা রওনক নিজেও জানে। অন্যদের সবার সঙ্গে চিত্রলেখাকে পরিচয় করিয়ে দেয় রওনক। অফিসের কেউ কেউ চিত্রলেখাকে হয়ত চিনতে পেরেছে কিন্তু রওনকের উপস্থিতিতে কারো সাহস হয় না কানাঘোষা করার। বসের বউকে নিয়ে গসিপ করলে যে চাকরী থাকবে না তা সবাই জানে। আর মন্দা চাকরীর বাজারে নিজের চাকরীর মায়া সবারই আছে। আর বাকি যারা জানে না চিত্রলেখা যে রওনকের অফিসেই চাকরী করত তাদের মাথা ব্যাথা নেই। তবে তারা চিত্রলেখাকে চিনতে, জানতে তার সম্পর্কে শুনতে আগ্রহী। তবে সবাই রওনকের পার্সোনালিটি সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানে। তার জিনিসে কেউ চোখ দিলে সেই চোখ উপড়ে ফেলতে দুইবার ভাববে না সে আর সেখানে তার বউয়ের দিকে নজর দিলে সেই ব্যাক্তিকে দুনিয়া থেকে গা য়ে ব করে দিতে এক সেকেন্ড সময় নিবে না সে। এমনি এমনি এত বড় ব্যবসা ধরে রাখেনি সে। রওনক জামানের হাত যে কত বড় তা সবার অজানা হলেও কম বেশি সবাই বুঝে রওনক জামান চাইলে তার এক ইশারায় কি করতে পারে। রওনক জামান পারে না এমন কোনো কাজ নেই। সবাই সম্মান করে তবে ভয়ও কম পায় না। রওনকের জামানের ব্যাড সাইডে আসতে রাজি নয় কেউ। তার সাথে সম্পর্ক ভালো মানে সব ঠিক। উনিশ বিশ হলেই সর্বনাশ। সবার সামনে কুল, জ্যান্টেলম্যান্ট দি রওনকের জামানের ভেতরটা যে এতখানিও পরিষ্কার নয় তা অনেকে আন্দাজ করতে পারলেও কখনো মুখ ফুটে তা প্রকাশ করার দুঃসাহস করে না।

ড্রিংসের গ্লাসের ট্রে নিয়ে একটা ছেলে এগিয়ে এলে একজন চিত্রলেখাকে ড্রিংক্স নিতে বললে সে কনফিউশনে পড়ে যায় কি করবে। সে এসব খায় না বলাটা কি উচিত হবে? সবাই নিশ্চয়ই অন্যভাবে দেখবে তাকে। এটা নিশ্চয়উ রওনক পছন্দ করবে না। কি করবে বুঝতে পারছে না এমন দৃষ্টি নিয়ে রওনকের দিকে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলছিল রওনক। সাদমান বাহু ধরে হালকা ধাক্কা দিকে তার দিকে তাকালে সাদমান ইশারা করলে চিত্রলেখার দিকে তাকায় সে। রওনকেরই একপার্টনারের ওয়াইফ ড্রিংক্স অফার করছে চিত্রলেখাকে। তার চোখ থেকে যা বুঝার বুঝে গেছে রওনক।

-এক্সকিউজ মি।

বলেই বার কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায় রওনক। বার কাউন্টারে থাকা ছেলেটাকে ইশারা করতেই সে একটা ওয়াইনের গ্লাস এগিয়ে দেয় তাকে। সেটা নিয়ে চিত্রলেখার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় সে। ওয়াইনের গ্লাসটা এগিয়ে দেয় চিত্রলেখাকে নেয়ার জন্য। অবাক দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। সে ভাবতেই পারেনি রওনক তাকে এভাবে এসব খাবার জন্য বলবে। চিত্রলেখার চোখ দেখে হাসি পেয়ে যায় রওনক। কিন্তু এইমুহূর্তে সে হাসে না। নিজের হাসি সামলে চিত্রলেখার কানের কাছে মুখ নিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,

-এটা নিতে পারো ফ্রুটিকার গ্রেপ জুস এতে কোনো এলকোহল নেই। আমি নিজেই এলকোহল নেই না তোমাকে অফার করব ভাবলে কীভাবে? সবাই ভাববে আমরা ওয়াইন খাচ্ছি আসলে ইটস জাস্ট এ সিম্পল জুস।

রওনকের কথা শুনে এবার চিতলেখার ঠোঁট জুড়ে হাসি ফুটে ওঠে। আবার সে অবাক না হয়েও পারে না। সে জানতোই রওনক এলকোহল নেয় না। আগের রাতেই তার এক কথায় বারান্দা দিয়ে সিগারেটে গোটা প্যাকেট ফেলে দেয়ার আগে দু’বার ভেবেনি। যত দেখছে সে রওনককে ততই অবাক হচ্ছে। রওনকের বাড়িয়ে রাখা হাত থেকে ওয়াইন মানে জুসের গ্লাসটা নিয়ে তার চোখ চোখ রেখে একটা সিপ নেয় চিত্রলেখা। অথচ তাকে দেখে মনে হচ্ছে সত্যি যেনো ওয়াইন খাচ্ছে। চিত্রলেখার এমন এটিটিউডে ইম্প্রস না হয়ে পারে না রওনক। এক্ষুনি সব ফেলে চন্দ্রকে নিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে মন চাইছে তার। যেখানে তাদের কেউ বিরক্ত করতে পারে না। যেখানে তার একে-অপরকে উষ্ণ আলিঙ্গে জড়িয়ে রাখতে পারবে ঘন্টার পর ঘন্টা। রওনক নিজেকে চিত্রলেখার ভেতর হারিয়ে ফেলতে পারবে। যতবার চিত্রলেখার দিকে তাকিয়েছে এই পর্যন্ত রওনকের ইচ্ছা হয়েছে ঐ ঠোঁটে একটা চুমু খায় সে। ছোট্ট করে নয় গভীরভাবে, দীর্ঘ সময় নিয়ে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

দিলারা জামান নিজের ঘর থেকে বের হোননি। তানিয়া অনেকবার করে অনুরোধ করেছিল শাশুড়িকে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে পার্টি জয়েন করতে। কিন্তু উনি নাছোড়বান্দা একবার যেই মুখে না বলে ফেলেছেন সেই সিদ্ধান্ত বেঁচে থাকতে পরিবর্তন করবেন না। তানিয়ার এতদিনের সংসার জীবনে এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে তার ভালো মতো চেনা। তাই কয়েকবার অনুরোধ করার পর সে নিজেও হাল ছেড়ে দিয়েছে। তার নিজের পার্টিতে উপস্থিত থাকাটা জরুরী। দিলারা জামানের অনুপস্থিতিকে কেউ আড়চোখে দেখার আগে কিছু একটা বাহানা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে তাকে। সাপের মতো ফনা তুলে নিজের ঘরে বসে আছেন দিলারা জামান। এইমুহূর্তে তার রাগ বেশি হচ্ছে এই ভেবে তার নিজের ছেলে একটাবার এসে তাকে ডাকেনি। তার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। একটা বাইরের মেয়ে আজ তার চাইতে বেশি হয়ে গেল বিষয়টা হজম হচ্ছে না উনার। রাগে ফুলতে থাকা দিলারা জামানের রাগের আ গু নে ঘি ডালতেই যেনো সাবার আগমন ঘটলো। রুমের দরজা লক করাছিল না। তানিয়া চলে যাবার পর একবার ভেবেছিলেন ভেতর থেকে লক করে দিবেন কিন্তু যদি রওনক আসে সেই ভাবনায় আর লক করেননি। রওনক আসেনি তবে সাবা এসেছে। দরজা ঠেলে ভেতর প্রবেশ করে দিলারা জামানের কাছাকাছি এগিয়ে যেতে যেতে সাবা খানিকটা খোচা মারা কন্ঠে বলে,

-কংগ্রাচুলেশন্স আন্টি।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সাবার দিকে তাকিয়ে দিলারা জামান জিজ্ঞেস করেন,

-ফর হোয়াট?

এগিয়ে এসে দিলারা জামানের মুখোমুখি একপায়ের উপর আরেক পা তুলে দিয়ে বসে সাবা বলে,

-আপনার ছেলে বিয়ে করেছে। বউ নিয়ে এসেছে। পার্টি করে সবাইকে সেটা জানাচ্ছেও। ইউ মাস্ট বি ভেরি হ্যাপি টুডে।

মুখটাকে বাংলার পাঁচ বানিয়ে দিলারা জামান বলেন,

-ওহ কাম অন সাবা। এই বিয়ে আমি মানি না। নাম পরিচয়হীন একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসলেই আমি আমার বাড়ির বউ বলে মেনে নিবো না। ঐ মেয়ে এই বাড়ির বউ সেদিন হবে যেদিন আমি ম রে যাবো। আমি বেঁচে থাকতে সেটা কোনোদিন সম্ভব নয়।

-কিন্তু আপনার ছেলে সেটা মানবে বলে মনে হয় না আন্টি। আপনি টেরও পাননি রওনক আমাকে করা প্রমিজ ব্রেক করে আরেকটা রাস্তার মেয়েকে বউ করে নিয়ে এসেছে।

নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সাবা আরও বলে,

-আই ইউল নট লেট হার টেক মাই ম্যান আওয়ে আন্টি। আপনার ছেলে একটা না হাজারটা বিয়ে করলেও আমাকে ওর বিয়ে করতেই হবে। এট দ্যা এন্ড অফ দ্যা ডে হি উইল বি মাইন, অনলি মাইন।

দিলারা জামান নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে সাবার একটা হাত নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে বলেন,

-আমি তোমার সঙ্গে আছি ডিয়ার।

সাবা দিলারা জামানকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-থ্যাংকিউ সো মাচ আন্টি।

রওনকের পাশ থেকে একমুহূর্তের জন্যও সরছে না চিত্রলেখা। অফিসের কিছু মুখ ব্যতীত কাউকে চিনে না সে। এমনকি কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারদেরকেও না। কে কি জিজ্ঞেস করবে চিত্রলেখা কি জবাব দিবে, যদি ভুলভাল কিছু বলে ফেলে এই ভয়ে আরও রওনকের দৃষ্টির আড়ালে যাচ্ছে না সে। তানিয়া এগিয়ে এসে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

-বউটাকে কিচ্ছুক্ষণের জন্য আমাকে ধার দাও। আমি আমার সার্কেলের সঙ্গে একটু পরিচয় করিয়ে দিই।

চিত্রলেখার হাত তানিয়ার হাতে দিয়ে রওনক বলে,

-শি ইজ অল ইউর’স নাও।

তানিয়া চিত্রলেখাকে নিয়ে সরে গেলেই তার সামনে এসে দাঁড়ায় সাবা। ডার্ক বোটল গ্রীন কালার একটা অফশোল্ডার ড্রেস পরেছে সে। ড্রেস্টটার লেন্থ তার মিড থাই পর্যন্ত। অফশোল্ডার হওয়ায় সাবার ক্লিভেজের খানিকটা উঁকি দিচ্ছে। মিড থাই থেকে শুরু করে সাবার লম্বা পা-গুলো সম্পূর্ন উন্মুক্ত। ড্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে একই কালারের পেন্সিল হিল পরেছে, এতে আরও লম্বা লাগছে সাবাকে দেখতে। ডার্ক ড্রেসের সঙ্গে মিল রেখে ডার্ক মেকাপ নিয়েছে। ডার্ক মারুন কালার লিপস্টিক লাগিয়েছে ঠোঁটে। যেকোনো পুরুষ চোখে সাবাকে এক কথায় সে ক্সি লাগছে দেখতে। যেকোনো পুরুষ বারবার ফিরে তাকাবে তার দিকে। কিন্তু রওনক সেই তাগিদ অনুভব করে না। সাবাকে কখনোই তার দৃষ্টিতে আকর্ষনী লাগেনি। তিলত্তমার পরে রওনকের দৃষ্টিতে যদি কাউকে আকর্ষনী লেগে থাকে সে একমাত্র চিত্রলেখা। সেজন্য তাকে ডার্ক মেকাপ নিতে হয় না, বডি রিভেলিং ড্রেস পড়তে হয় না। চিত্রলেখার ঠোঁটে লিপস্টিক না থাকলেও সেই ঠোঁট আকুল নিবেদনে রওনককে ডাকে সবসময়। চিত্রলেখা যদি বোরখা পরে নিজেকে ডেকে রাখে তবুও রওনকের শরীর তাকে জড়িয়ে ধরতে, উষ্ণ আলিঙ্গে নিতে নিশপিশ করে। দ্বিতীয় কোনো নারীকে দেখে রওনকের শরীরে কিচ্ছু হয় না। এক চিত্রলেখাকে দেখলেই তার নিজেকে সামলে রাখতে কষ্ট হয়, ভীষণ কষ্ট। পাজরের হাড় বেরিয়ে আসার মতো কষ্ট। চিত্রলেখাকে নিজের করে নিয়ে আসার পর থেকে এই পর্যন্ত অনেক কষ্ঠে নিজেকে সামলে রেখেছে সে। কিন্তু আর না। আজ আর সে নিজেকে আটকে রাখতে পারবে না। চিত্রলেখাকে তার চাই-ই চাই। চিত্রলেখার সবটা তার চাই। আর পারবে না সে সন্যাসি হয়ে থাকতে। তিলত্তমা চলে যাবার পর ৬ বছর সে কখনো কোনো নারী শরীরের চাহিদা অনুভব করেনি। কখনো কোনো বেগানা নারীকে নিজের সংস্পর্শে আসতে দেয়নি। সংস্পর্শে আসা তো দূরের কথা ভাবেওনি কারো কথা। সাবা নানাভাবে চেষ্টা করেছে তাকে বিছানায় নিয়ে যাবার কিন্তু কোনোদিন সফল হয়নি। আবার বিয়ে করার কথা কখনো ভাবেনি রওনক। এক চিত্রলেখাকে দেখেই মনে হয়েছিল নিজেকে সে আরেকটা সুযোগ দিতে পারে। হয়ত চিত্রলেখা তাকে তার মতো করে ভালোবাসবে, আগলে রাখবে, বুঝবে। যেমনটা সে তিলত্তমার কাছে আশা করেছিল। ভুলেও সে চিত্রলেখাকে তিলত্তমার সঙ্গে তুলনা করে না। রওনকের জীবনে এই দুই নারী সবসময় বিশেষ হয়ে থাকবে বলা বাহুল্য চিত্রলেখা এখন তার সবটা জুড়ে বিরাজমান। একসময় তিলত্তমা তার যতটুকু জুড়ে ছিল আজ চিত্রলেখা তার চাইতে অনেক বেশি জুড়ে আছে। তিলত্তমা চলে যাবার পর নতুন করে কেউ তার জীবনে আসবে সেটা রওনক কখনো ভাবেনি আর এভাবে এসে তাকে বশ করে ফেলবে সেটা তার চিন্তার অন্তরালে ছিল। একসময় রওনক যেটা ভাবেনি আজ সেটা তার জীবনের বাস্তবতা। একমুহূর্তের জন্যও চিত্রলেখা তার মস্তিষ্ক থেকে সরে না, রওনক সরাতেও চায় না। চিত্রলেখায় বিভোর থাকতে তার ভালো লাগে। এভাবেই থাকতে চায় সে।

সাবা সরাসরি এগিয়ে এসে রওনককে জড়িয়ে ধরে। বলা যায় বেহায়ার মতো নিজেকে রওনকের শরীরের উপর ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করে। রওনক চাইলেই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারে কিন্তু এত মানুষের মধ্যে হয়ত এমনটা করা উচিত হবে না তাই সৌজন্যের খাতিরে হালকা করে জড়িয়ে ধরে আবার তৎক্ষণাৎই ছেড়ে দিয়ে নিজের কোট ঠিক করতে করতে চিত্রলেখার দিকে তাকালে তাদের একে-অপরের দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়ে। তানিয়ার সঙ্গে থাকলেও অন্যদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে চিত্রলেখার চোখ বার বার এদিকেই তাকাচ্ছে রওনককে দেখতে। সাবার রওনককে জড়িয়ে ধরার দৃশ্যটা চিত্রলেখা দেখেছে তা তার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে। খারাপ লাগায় মুখ সাদা হয়ে গেছে বেচারির। তা বুঝতে পেরে মুচকি হাসে রওনক। সে এটাই চায়। রওনক নিজে যতখানি চিত্রলেখায় আসক্ত হয়ে গেছে, সে চায় চিত্রলেখাও ততখানিই তার প্রতি আসক্ত থাকুক ইনফ্যাক্ট আরও বেশি আসক্ত করতে চায় সে চিত্রলেখাকে তার প্রতি।

সাবা কিছু বলার আগে রওনকের পেছন থেকে লাবিব এগিয়ে এসে তাকে কানে মুখে কিছু বলে। কি বলেছে তা শুনতে পায়নি সাবা। লাবিব কিছু বলার পর রওনক ওখান থেকে চলে যাবার চেষ্টা করলে তার একটা হাত ধরে বাঁধা দিয়ে সাবা বলে,

-আমি মাত্রই এলাম কোথায় যাচ্ছো তুমি?

-আমার কিছু স্পেশাল গেস্ট এসেছে আই নিড টু এটেন্ট দ্যাম। আই এম সিওর ইউ উইল ম্যাক ইউর শেলফ কম্ফোর্টবেল হিয়ার।

আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে সাবার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে লাবিবের সঙ্গে চলে যায় রওনক। পেছনে দাঁড়িয়ে রাগে ফস ফস করতে লাগে সাবা। তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে রিপা বলে,

-এভাবে সবার সামনে নিজেকে অপমান না করলেও পারো আপু। যেটা তোমার না সেটার দিকে হাত বাড়িও না। অপমান ছাড়া কিছুই পাবে না। এখনো সময় আছে নিজেকে সামলে নাও। রওনক ভাই কখনো তোমার হবে না। এই সত্যিটা মেনে নাও এবার।

সাবার ইচ্ছা করে কষে ছোট বোনের গালে একটা থা প্প র লাগায় সে। কিন্তু এখন নয়। সে হাতে মা র বে না রিপাকে নিজের কাজ দিয়ে মা র বে। যেদিন সবার সামনে রওনক তাকে মেনে নিবে, বিয়ে করে বউয়ের পরিচিয় দিবে সেদিন রিপাকে এর উপযুক্ত জবাব দিবে এর আগে নয়। চোয়াল শক্ত করে রিপার দিকে তাকিয়ে সাবা বলে,

-হি ইউল বি মাইন।

শক্ত পদক্ষেপে প্রস্থান করে সাবা। সাবাদের সপরিবারে দাওয়াত করা হয়েছিল। কিন্তু আজ সকালে কিছু জরুরী কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছেন আশরাফ আহমেদ। স্বামীর অনুপস্থিতিতে আসতে মন সায় দেয়নি সানজিদা আহমেদের। উনারা সবাই ধরেই নিয়েছিলেন রওনকের সঙ্গে সাবার বিয়ে হবে। রওনককের আপত্তি ছিল তা সবাই জানতো কিন্তু সে যে এমন কাজ করবে, এভাবে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসবে তা কেউ ভাবেনি। রওনকের সঙ্গে সাবার বিয়ে হলে এর থেকেও বড় পার্টি হবার কথা ছিল। অথচ সেই রওনকের বউয়ের ওয়েকাম পার্টি অথচ বউটা সাবা নয় ভেবে আসতে মন চায়নি সানজিদা আহমেদের। আশরাফ আহমেদ ঢাকায় থাকলে হয়ত সম্পর্কের খাতিরে, ব্যবসার খাতিরে তাদের দু’জনকে আসতে হতো। কিন্তু আশরাফ সাহেব না থাকায় সুযোগ পেয়ে তিনি নিজেও আসেননি। দুই মেয়েকেও বলেছিলেন প্রয়োজন নেই আসার কিন্তু সাবা তো সাবাই। নিজের বেহায়াপনা দেখানোর জন্য হলেও আসবে। এই বাড়িতে আসতে তার কারণ লাগে না। অন্যদিকে রিপা মন থেকেই এসেছে রওনককে তার নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা জানাতে। রিপা একটুও রাগ হয়নি রওনক সাবাকে বিয়ে করেনি বলে। বরং খুশিই হয়েছে বলা যায়। নিজের বোনকে সে চিনে। রওনকের অতীত সম্পর্কেও অনেকটা জানা আছে তার। রিপা কখনোই চায়নি রওনকের জীবনে সাবার মতো কেউ আসুক। এখন ভাবলে রিপার মনে হয় চিত্রলেখাই রওনকের জন্য উত্তম জীবন সঙ্গী। যতটুকু সে লিখনের কাছে শুনেছে সবসময় তা থেকে এটাই মনে হয় রিপার, রওনকের জন্য চিত্রলেখার চাইতে ভালো কেউ হতেই পারে না।

তানিয়া তার সার্কেলের লোকজনের সঙ্গে চিত্রলেখার পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যস্ত। কিছুক্ষন আগে রওনক লাবিবের সঙ্গে কোথায় যেনো চলে গেল। তারপর পনেরো মিনিটের মতো হয়ে গেছে এখনো তাকে দেখেনি সে। এক/দুবার এদিক সেদিক খুঁজলেও না পেয়ে পরে এদিকে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করে। তার জন্য এত আয়োজন, তার উচিত এসবের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে গুছিয়ে নেয়া। যদিও তার সময় লাগবে তবুও সে চেষ্টা তো করতেই পারে। সেই চেষ্টাটা নাহয় এখান থেকেই আজকের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই শুরু হোক। সকলের উপস্থিতিতে আচমকাই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কেউ চিত্রলেখাকে। পেছন থেকে একজোড়া হাত এগিয়ে এসে চিত্রলেখার পেটের কাছে জড়িয়ে ধরতেই তার বুঝতে অসুবিধা হয় না এই হাত জোড়া কার। এত মানুষের উপস্থিতিতে রওনক ছাড়া কারো সাহস নেই তাকে জড়িয়ে ধরে। অবশ্য চিত্রলেখার বুঝা হয়ে গেছে কারো উপস্থিতিতে তো দূরের কথা আড়ালে আবডালেও রওনক দ্বিতীয় কাউকে এলাও করবে না তাকে স্পর্শ করে। রওনকের উপস্থিতিতে নিজেকে এতখানিই সুরক্ষিত অনুভব করে সে। আচমকা সবার উপস্থিতিতে রওনক এভাবে জড়িয়ে ধরায় লজ্জা গ্রাস করে ফেলে চিত্রলেখাকে। ওদের দেখে পাশে উপস্থিত সবাই-ই মুচকি হাসছে। নিজেকে সামলে নেয়ার বৃথা চেষ্টা করে মিনমিনে কন্ঠে চিত্রলেখা বলে,

-কি করছেন! সবাই দেখছে তো।

চিত্রলেখার কাঁধে মুখ রেখে রওনক বলে,

-দেখুক, আই ডোন্ট কেয়ার।

লজ্জায় মাটির ভেতর হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে চিত্রলেখার। বউ লজ্জা পাচ্ছা বুঝতে পেরে বেশি একটা সময় নেয় না রওনক। চিত্রলেখাকে এর চাইতে আরও শতশুন বেশি লজ্জা দিবে সে আজ তবে এখন নয়, আর এখানে নয়। বিশেষ কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছে সে নিজেদের জন্য। ওসব হবে তাদের ব্যাক্তিগত মুহূর্তে। চিত্রলেখার কাঁধে মুখ রেখেই রওনক বলে,

-আই হ্যাভ এ সারপ্রাইজ ফর ইউ।

-সারপ্রাইজ! (চিত্রলেখার কন্ঠে স্পষ্ট অবাক হওয়া টের পাওয়া যায়।)

-ইয়েস।

রওনক চিত্রলেখাকে ছেড়ে দিয়ে তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। তারপর বলে,

-পেছনে দেখো।

রওনকের আদেশ মতো পেছন ঘুরতেই খুশি ও আনন্দে চিত্রলেখার চোখ চকচক করে ওঠে নিজের ভাইবোন ও খালাকে দেখে। এমন একটা মুহূর্তের জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না সে। মনে করা তো দূরের কথা আশাও করেনি চিত্রলেখা আজকের পার্টিতে রওনক তার পরিবারের কাউকে ইনভাইন্ট করবে। কেবল লিখনরাই নয় আফিফাও এসেছে বাবুলকে নিয়ে। খুশিতে চিত্রলেখার চোখে পানি এসে পড়েছে। তা দেখে রওনক চিত্রলেখার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

-একদম কাঁদার চেষ্টা করবে না। তোমাকে কাঁদানোর জন্য এই সারপ্রাইজ প্লান করিনি আমি। তোমার হাসি মুখ দেখব বলে এত আয়োজন।

রওনকের আবদার মতো তার দিকে একটা অশ্রু ভেজা হাসি দিয়ে চারুকে জড়িয়ে ধরে চিত্রলেখা। আজ সকালে রওনকের কোনো বিজনেস মিটিং ছিল না। সে গিয়েছিল চিত্রলেখার জন্য সারপ্রাইজ প্লান করতে। চিত্রলেখাকে সে ভালো করেই চিনি। এই মেয়ের বুক ফাটবে তবু মুখ ফুটবে না। ইচ্ছা করলেও মুখ ফুটে বলবে না তার পরিবারকে ইনভাইট করার কথা। কিন্তু চিত্রলেখা বলুক বা না বলুক রওনক জানে তার চন্দ্র কি পেলে খুশি হবে তাই তো নিজে গিয়ে ওদের নিয়ে এসেছে। সবার জন্য শপিং করেছে। আসার সময় ওদের সালুনে দিয়ে গিয়েছিল তৈরি হতে। যেনো আজকের পার্টিতে ওদের বেমানা না লাগে। ওরা যেনো ইতস্ততবোধ না করে। ড্রাইভারকে দিয়ে একটা গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল ওদের নিয়ে আসতে। যদিও লিখন আপত্তি করেছিল তাকে এত কিছু করতে হবে না ওরা নিজেরাই ব্যবস্থা করে নিতে পারবে কিন্তু রওনক কারো আপত্তি শুনেনি। তার একটাই কথা চিত্রলেখার খুশির জন্য, মুখের হাসির জন্য সে সব করতে পারে। চিত্রলেখাকে খুশি করতে রওনকের এত আগ্রহ দেখার পর লিখন আর আপত্তি করেনি, বোনের খুশির জন্য সব মেনে নিয়েছে। অন্যথায় এখানে আসতে অনেক বেশি ইতস্তত লাগছিল তার। এই পরিবেশ তাদের জন্য নয় তা ভালো করেই জানে লিখন। চিত্রলেখা ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের ভাইবোনদের নিয়ে।

-রওনক ভাই।

-আরে রিপা যে কখন এলি তুই?

পরিচিত কারো কন্ঠ শুনতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ পাশ ফিরে তাকায় লিখন। তৎক্ষণাৎই লিখন ও রিপার একে-অপরের চোখে চোখ পরে। রওনক রিপার সঙ্গে চিত্রলেখার পরিচয় করিয়ে দেয়। সবার উপস্থিতিতে লিখন ও রিপা কথা বলে না। নিজ নিজ অবাক হওয়া চেহারা সামলে নেয়। যদিও রিপা তেমন একটা অবাক হয়নি। সে আগে থেকেই জানতো হয়ত লিখনের সঙ্গে তার এখানে দেখা হবে। অবাক হয়েছে লিখন যা তার চোখ-মুখে স্পষ্ট পরিলক্ষিত। কিন্তু এখানে রিপার সঙ্গে কথা বলার কোনো চেষ্টা করে না সে। রিপা এখানে কি করছে, রওনকের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক সব জানার সুযোগ পাবে তাই আপাতত চেপে যায়।

খানিকটা রওনকের কাছাকাছি চেপে এসে চিত্রলেখা কণ্ঠস্বর একদম খাঁদে নামিয়ে কথা বলে যেনো অন্যকেউ শুনতে না পায়। কাছাকাছি আসতে নিয়ে রওনকের শরীরের সঙ্গে চিত্রলেখার শরীর ঘেষে খানিকটা। ফিসফিসে আনন্দ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,

-থ্যাংকিউ সো মাচ।

-ইশ এতবড় সারপ্রাইজের বিনিময়ে শুধু থ্যাংকিউ? আরও বেটার কিছু কি পেতে পারি না আমি?

-কি চাই বলুন।

-যা চাই দিবে?

-যা বলবেন তাই।

-অলরাইট।

চিত্রলেখার হাত ধরে জোরে কেশে রওনক বলে,

-এক্সকিউজ মি প্লিজ, আমরা একটু আসছি।

লাবিব ও তানিয়ার দিকে তাকিয়ে রওনক ইশারা করে লিখনদের খেয়াল রাখতে। আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে চিত্রলেখাকে নিয়ে উপরে চলে যায় সে। নিজের ঘরে প্রবেশ করে তৎক্ষণাৎই দরজার সঙ্গে চেপে ধরে চিত্রলেখাকে। কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই রওনক চিত্রলেখার লিপস্টিকে লাল হয়ে থাকা ঠোঁট জোড়ার দখল নেয়। অনেকক্ষণ নিজেকে সামলে রেখেছিল সে। পার্টি শেষ হওয়া পর্যন্ত নিজেকে সামলে রাখবে বলে ভেবে রেখেছিল কিন্তু যেই চিত্রলেখা নিজে থেকে তার কাছাকাছি এসে ফিসফিস করে কথা বলল। মৃদুভাবে গা ছুঁয়ে দিল হয়ত অবচেতনেই। যেই চিত্রলেখার নিঃশ্বাস রওনকের কান স্পর্শ করলো ব্যস রওনকের সেলফ ডিফেন্স ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে তখনই। আর নিজেকে সামলে রাখতে পারবে না সে। খুব বেশি কিছু না হোক অন্তত ঐ ঠোঁট জোড়ার দখল তার চাই-ই চাই। চিত্রলেখা বুঝে উঠতে পারে না কি হচ্ছে। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ঠোঁট জোড়া বেদখল হয়ে গেছে। রওনকের আচমকা আক্রমনে প্রথমে চিত্রলেখার চোখ বড় হয়। ৩ সেকেন্ড সময় লাগে চিত্রলেখার কি ঘটছে তা বুঝতে, ধাতস্থ হতে। সে চাইলেই এখন আর নিজেকে রওনকের স্পর্শ থেকে আলদা করতে পারবে না। সেই চেষ্টাও করে না অবশ্য। বড় হয়ে থাকা চোখ গুলো রওনকের ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শের আবেশে বন্ধ করে নেয়। হাত বাড়িয়ে রওনকের গলা জড়িয়ে ধরে নিজেও তাল মেলায় রওনকের ঠোঁটের তালে। এই ঠোঁট রওনক ততক্ষণ না ছাড়ার পন করেছে যতক্ষণ না তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। আজ চিত্রলেখার রেহাই নেই। আগের চাইতে আরও হিংস হয় সে। তার হাত চলে গেছে চিত্রলেখার শাড়ির ভেতরে। রওনকের স্পর্শ যেনো আরও পাগল করে দিচ্ছে চিত্রলেখাকে। এই পাগলামী, উন্মাদনার শেষ কোথায় চিত্রলেখার জানা নেই। তবে তার মন্দ লাগছে না এভাবে নিজেকে রওনকের কাছে সপে দিতে, রওনককে নিজের দখল দিতে একটুও খারাপ লাগছে না। উষ্ণ ভালো লাগায় অঙ্গে অঙ্গে কাঁপন ধরছে তার। আরও কিছু চাই তার, আরও বেশি কিছু।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

পার্টির অবশিষ্ট সময় চিত্রলেখা আর রওনকের চোখে চোখ রাখতে পারেনি। মুখ তুলে তার দিকে তাকাতে পারেনি লজ্জায়। এভাবে সে রওনকের ঠোঁটের উষ্ণ আহবানে সাড়া দিয়ে ফেলবে ভাবতেই পারেনি। এখন লজ্জায় ম রে যেতে ইচ্ছা করছে। পার্টির প্রায় শেষের দিকে সবার থেকে বিদায় নিয়ে রওনক লাবিবকে সঙ্গে করে নিজের ঘরের অফিসে বসেছে। কি যেনো জরুরী কাজ পরে গেছে তার। ওরা পার্টি ছেড়ে যাবার কিচ্ছুক্ষন পর তানিয়াও ওদের জয়েন করেছে। চিত্রলেখা এখন বসে আছে তার নিজের ঘরে। পার্টিতে পরা শাড়িটা এখনো খোলেনি সে। রওনকের আবদার, সে ফ্রি না হওয়া অব্দি যেনো চিত্রলেখা এই শাড়িতেই থাকে। মেকাপটাও ছাড়েনি সে। বলা যায় এক কথায় পার্টির গেটাপেই আছে সে এখনো, রওনকের অপেক্ষায়। মেহমান সব চলে গেছে প্রায় ঘন্টা খানিক আগে। রওনক বলেছিল লিখনদের রাতটা থেকে যেতে কিন্তু এতে রাজি হয়নি নারগিস বেগম। এমনিতেই ওদের বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হয়নি। এবাড়িতে আসার পর থেকেই অজানা এক অস্থিরতায় অস্থির হয়ে আছেন। কতক্ষনে বাড়ি ফিরে যাবেন সেই চিন্তায় ছিলেন আসার পর থেকে। তারউপর একটা বিষয় উনার খটকা লেগেছে। রওনকের মা তথা চিত্রলেখার শাশুড়ি উনাদের সঙ্গে দেখে করেননি। যদিও সবাইকে বলা হয়েছে ইনার শরীর ভালো নেই তাই পার্টি জয়েন করতে পারছেন না, তবুও একটা খটকা থেকেই যায়। আগবাড়িয়ে নারগিস বেগম কিছু জিজ্ঞেসও করেননি। তবে এই বিষয়ে চিত্রলেখার সঙ্গে কথা আছে উনার। চিত্রলেখা জানে তার ভাইবোন, খালার মনের অবস্থা তাই কাউকে জোর করেনি থেকে যাবার জন্য। রওনকের আদেশে তার ড্রাইভার ওদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসে। যদিও লিখন বলেছিল ওরা উবার নিয়ে নিবে কিন্তু রওনককে বুঝায় সে সাধ্য কার আছে?

নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রীল ধরে সামনের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে চিত্রলেখা। মস্তিষ্কের ভেতর একটা ভাবনাই ঘুরপাক খাচ্ছে, কখন আসবে রওনক। তার অপেক্ষাতে ইতি টেনে আচমকাই চিত্রলেখাকে পেছন থেকে জড়িয়ে রওনক। সামান্য কেঁপে ওঠে চিত্রলেখা। তার কাঁধে মুখ রেখে রওনক বলে,

-আই মিসড ইউ বউ।

চিত্রলেখার গাল লাল হয়। লজ্জা পাওনা দ্বিগুণ হয়। রওনক তার হাতের বাঁধন শক্ত করে আগের চাইতে আরও বেশি। পাশের ঘরেই ছিল সে। অথচ রওনকের আচরণে মনে হচ্ছে কতদিন পর দেখা তাদের। এইসব অনুভূতি যেনো লজ্জাই দেয় চিত্রলেখাকে। বউকে লজ্জা পেতে দেখে আরেকটু বেশি লজ্জা দিতে চিত্রলেখার কানের নিচে চুমু খায় সে। চিত্রলেখার মনে হয় তার শরীরে শিহরনের ঢেউ খেলে গেল। এর আগে কখনো এমন অনুভব হয়নি তার। রওনক কাছাকাছি থাকলে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় চিত্রলেখার। এক মুহূর্ত সময় দিয়ে চিত্রলেখাকে নিজের দিকে ঘোরায় রওনক। চিবুক স্পর্শ করে মুখ উপরে তুলে ধরে। কিন্তু লজ্জায় চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে। আজ একের পর এক যা হচ্ছে এরপর আর রওনকের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখার সাহস করতে পারছে না চিত্রলেখা। মনে হচ্ছে সে চোখ মেলে রওনকের চোখের দিকে তাকালেই আজ একটা অঘটন ঘটে যাবে। যে অঘটনের পূর্বাভাস রওনক তাকে দিয়ে রেখেছে। কি হতে যাচ্ছে বা হতে পারে ভেবেই চিত্রলেখার গলা শুঁকিয়ে আসছে আসন্ন ঘটনার চিন্তায়।

-চোখ খোলো চন্দ্র।

রওনকের কথায়ও চোখ খোলে না চিত্রলেখা। দুষ্টু হাসি হেসে বলে,

-আই সোয়ার এক্ষন চোখ না খুললে আমি তোমাকে খেয়ে ফেলবো।

রওনকের হুমকি শুনে তৎক্ষণাৎ চোখ মেলে তাকায়। চিত্রলেখার চোখের অবস্থা দেখে হাসি পায় রওনকের। কেমন বড় হয়ে গেছে আতংকে। এই মেয়েটা এমন কেনো মনে মনে ভাবে সে। এতক্ষন চিত্রলেখার দুই বাহু ধরে রেখেছিল সে। ডান হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার চোয়াল স্পর্শ করে। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ঠোঁট স্পর্শ করে। দু’জনের একজনও অপরজনের দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি সরায় না। যেনো একে-অপরের চোখে আটকে গেছে তারা। আচমকাই রওনক বলে,

-আই এম সরি।

চোখ সরু হয় চিত্রলেখার। হঠাৎ এই সরির কারণ ধরতে পারে না সে। তাকে অবশ্য খুব বেশি একটা ভাবতেও হয় না। রওনক নিজেই বলে,

-একটা জরুরী কাজ পরে গেছে। আমাকে দেশের বাইরে যেতে হবে। টিকেট বুক করা হয়ে গেছে। সকাল ৮ টার ফ্লাইট।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে রওনক আরও বলে,

-হয়ত ৭ থেকে ১০ দিন লেগে যাবে আমার ফিরতে। আমি চেষ্টা করব জলদি ফিরে আসার। আমি ফিরে আসার পর আই ইউল রিয়েলি ম্যাক ইট আপ টু ইউ, আই প্রমিজ।

এতক্ষনে বুঝতে পারে চিত্রলেখা, রওনক তাকে বারবার বিশেষ কিছুর ইংগিত দিয়েছে সেটাই পিছিয়ে গেছে। সেজন্যই এই সরি বলা তার। একটা নতুন বিদেশি ব্যভারেজ বাংলাদেশে খুব জলদিই লঞ্চ করবে রওনক। সেই সংক্রান্ত কিছু কাজেই তাকে মেক্সিকো যেতে হচ্ছে। গাজীপুরে রওনকের কারখানায় তৈরি করা হলেও কাঁচামাল আসবে মেক্সিকো থেকে। এই প্রোডাক্ট লঞ্চের জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছে সে। এই প্রোডাক্টটা মার্কেটে আসার পর কোম্পানির সেল কয়েকগুন বেড়ে যাবে। কয়েক দফায় ল্যাব টেস্ট করা হয়ে গেছে। কাঁচামাল ফ্যাক্টরিতে আসার অপেক্ষায় এদিকে সবরকম প্রস্তুতি নেয়া শেষ। কাঁচামাল আসার আগে ফেইস টু ফেইস আরেকটা মিটিং করতে হবে। রওনক চেষ্টা করেছিল মিটিংটা অনলাইনে সেরে ফেলতে কিন্তু কিছু কাজ থাকে যা চাইলেই অনলাইনে করা যায় না। ফেইসভ্যালুর একটা ব্যাপার আছে। তাছাড়া তাকে ঐ কোম্পানির ফ্যাক্টরিতেও যেতে হবে। আর এই প্রজেক্টটা রওনকের জন্য অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ন তাই কোনো চান্স নিতে চায় না সে। অন্য কিছু হলে পোসপন করে দেবার আগে দুইবার ভাবতো না।

চিত্রলেখাকে চুপ করে থাকতে দেখে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-রাগ করেছো?

জবাবে কেবল মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। রওনক নিজেই আরও বলে,

-আমি জানি এই সময়টা আমার তোমার সঙ্গে থাকা উচিত বাট আই এম ইন এ টাইট সিচুয়েশান।

এক মুহূর্ত কিছু ভেবে রওনক আরও বলে,

-এক কাজ করলে কেমন হয়?

-কি?

-তুমি আমার সঙ্গে চলো।

-আমি!

-হ্যাঁ, সারাদিন তো আর আমি কাজে বিজি থাকবো না। ফ্রি টাইমে আমরা আমাদের মতো ঘুরে বেড়ালাম। এ মিনি হানিমুন।

-কিন্তু…

-কি?

-আমার তো পাসপোর্ট, ভিসা কিচ্ছু নেই।

-ও শীট!

আবার কিছু একটা চিন্তা ভাবনা করে রওনক বলে,

-লাবিবকে বলে যাবো আমি ফিরে আসার আগেই যেনো তুমি তোমার পাসপোর্ট হাতে পেয়ে যাও। ওকে?

চিত্রলেখা আবারও মাথা ঝাঁকায় সম্মতিতে। আচমকাই চিত্রলেখাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে ভেতরে ফিরে যেতে যেতে রওনক বলে,

-চলো ঘুমিয়ে পড়ি। ৮ টার ফ্লাইট আমার, ৫টার আগে বের হতে হবে।

চিত্রলেখাকে চেঞ্জিং রুমের দরজার সামনে নামিয়ে দিয়ে রওনক আরও বলে,

-থ্যাংকিউ।

-কেনো?

-আমার কথা রেখেছো। শাড়িটা পাল্টে ফেলোনি।

-ওহ!

চিত্রলেখার থেকে দু’হাত পেছনে সরে গিয়ে রওনক বলে,

-বাই দ্যা ওয়ে তোমার তো আজ এই শাড়ি পরার কথা ছিল না। আমার যতটুকু মনে পড়ে তুমি গাউন পরেছিলেন।

চিত্রলেখা নার্ভাস হয়ে পড়ে। আমতা আমতা করে বলে,

-আসলে হয়েছিল কি… আ আমি ওসব কখনো পরিনি তা তাছাড়া ঐ গাউনটায় সব দেখা যাচ্ছিল তাই তাই ওটা পরে বের হবার সাহস হয়নি আমার। সবাই তাকিয়ে থাকতো। আম আমি…

-কিন্তু ওটার সঙ্গে তো একটা এক্সট্রা পার্ট ছিল উপরের, তোমার শোল্ডার ডাকার জন্য। আমি স্পেশিয়ালি অর্ডার দিয়ে বানিয়েছি।

-কিহ! (কি তা একটু জোরেই বের হয়ে আসে চিত্রলেখার মুখ ফসকে।)

-হ্যাঁ, ওটা উপরে পরলে তোমার শোল্ডার দেখা যেতো না।

-কিন্তু আমাকে তো ওটা দেয়াই হয়নি। আমি আরও ভাবলাম ওভাবেই নিচে যেতে হবে সেজন্যই তো লাস্ট মোমেন্টে এই শাড়িটা…

চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক বলে,

-তুমি ভাবলে কীভাবে একটা অফ শোল্ডার গাউন পরে এত মানুষের সামনে তোমাকে যেতে দিবো আমি তাও যে ড্রেসে তোমার ক্লিভেজ দেখা যাচ্ছে এমন একটা ড্রেস। এই জিনিস শুধু আমি দেখবো, আমি। কেউ তোমার নগ্ন শরীরের দিকে তাকানোর আগে তার চোখ তুলে ফেলবো।

ভালো লাগা ও লজ্জার সংমিশ্রিত এক অদ্ভূত অনুভূতি অনুভব করে চিত্রলেখা। তার নার্ভাসনেস টের পেয়ে রওনক বলে,

-ইটস ওকে, আমি তো দেখেছি ব্যস আর কেউ না দেখলেও চলবে। তবে এই শাড়িটাতেও কোনো অংশকে কম কিছু লাগেনি তোমাকে। ইউ অয়েরা লুকিং আউস্টেন্ডিং টুডে। এখন যাও চেঞ্জ করে নাও তারপর শুয়ে পরি।

রওনক চেঞ্জ করতে যেতে বলার পরেও দাঁড়িয়ে থাকে চিত্রলেখা। তা দেখে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কিছু বলতে চাও?

মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা।

-তাহলে বলে ফেলো।

-আমি আপনাকে এয়ারপোর্ট দিয়ে আসি।

-দিয়ে আসতে চাও?

সম্মতিতে দ্রুত মাথায় ঝাঁকায় চিত্রলেখা।

-ঠিক আছে অবশ্যই যাবে। প্রথমবার কেউ আমাকে সি অফ করতে এয়ারপোর্ট যাবে। আই এম এক্সাইটেড।

-আরেকটা কথা।

-আরও একটা?

-হু

-বলো।

-ওখান থেকে আমি খালার বাসায় যাই?

-আমি না করলে যাবে না?

কিছু বলে না চিত্রলেখা কেবল মাথা নুইয়ে ফেলে। তা দেখে এগিয়ে এসে তাকে নিজের আলিঙ্গনে নিয়ে বলে,

-কোথাও যাবার জন্য তোমাকে আমার পারমিশন নিতে হবে না বউ। তোমার যেখানে খুশি যাবে। জাস্ট আমাকে জানিয়ে গেলেই হবে কোথায় যাচ্ছো যেনো আমার টেনশন না হয়, ব্যস এতটুকু করলেই চলবে।

রওনকের বুকে মাথা রেখেই মাথা ঝাঁকায় সে। চিত্রলেখার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রওনক বলে,

-আরেকটা কাজ করতে পারো। আমি যেহেতু থাকছি না তুমি চাইলে কয়টা দিন ওখানে থেকে আসতে পারো।

-সত্যি!

অবিশ্বাস্য চাহনি নিয়ে রওনকের বুক থেকে মাথা তুলে মুখের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। তার নাক টেনে দিয়ে বলে,

-একদম সত্যি। শুধু খালার কাছেই নয় চাইলে আফিফার কাছেও থেকে আসতো পারো। শুধু আমি ফিরে আসার আগে চলে এসো তাহলে হবে।

-কিন্তু আমি চলে গেলে মীম, মিশকাতকে কে দেখবে।

-ওদের দেখাশুনার জন্য লোক আছে চন্দ্র। তুমি ওদের কেয়ার টেকার ন,ও গার্ডিয়ান। হয়ত সম্পর্কে চাচী তবে একচুয়েলি ওদের মা তুমি। যেমন আমি চাচা হয়েও ওদের বাবা। নিজেকে সময় দাও। মীম, মিশকাতের জন্য তোমাকে নিজের খুশি সেক্রিফাইজ করতে হবে না। আমি দিবোও না তোমাকে এই কাজ করতে। বুঝতে পেরেছো?

হাসি হাসি মুখ করে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। আরও একবার তার নাক টেনে দিয়ে রওনক বলে,

-দ্যাটস মাই গার্ল।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৫৮+৫৯+৬০

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

-কেমন আছেন মামুন সাহেব?

আচমকা কারো আওয়াজ পেয়ে পেছন ফিরে তাকায় মামুন। কন্ঠটা তার পরিচিত নয়। পেছন ঘুরে রওনককে দেখে তৎক্ষণাৎ ভ্রু কুচকায় সে। তাকে দেখে মামুনের রিয়্যাকশন দেখে মৃদু হাসে রওনক। মামুনের পক্ষ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে রওনক নিজেই আবার বলে,

-ব্যস্ত না থাকলে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

এই লোকটাকে অর্থাৎ রওনকে কোনোভাবেই এখানে আশা করনি মামুন। তার সঙ্গে চিত্রলেখার বরের কি কথা থাকতে পারে? অনেক চিন্তা ভাবনার পর মামুন বলে,

-বলুন।

-এখানে নয়। আপনি কি একটু কষ্ট করে আমার সঙ্গে আসবেন? কনফিডেন্টশিয়াল কথা তাই পাবলিক প্লেসে বলতে চাইছি না।

মাথা ঝাঁকায় মামুন। রওনক আরও বলে,

-আমার গাড়িটা ওইদিকে আছে চলুন।

বাড়তি কথা বলে না মামুন। রওনকের সঙ্গে তার কোনো কথা না থাকলেও তাকে চিত্রলেখার হাসবেন্ড কি বলতে চায় তা জানার কৌতুহল অবশ্য দমিয়ে রাখতে পারছে না মামুন। সেজন্যই মূলত আপত্তি না করে সঙ্গে যাওয়া। আবার মামুন মনে মনে এটা ভাবে রওনক যা বলতে চায় সেটা কোনোভাবে চিত্রলেখার সঙ্গে সংপৃক্ত কিনা! সবকিছুই ভাবায় তাকে। ভাবনাদের হাতে ঠেলে রওনকের সঙ্গে তার গাড়িতে উঠে বসে মামুন। রওনকের ইশারায় ড্রাইভার গাড়ি চালাতে আরম্ভ করে।

-কেমন আছিস আপা?

চিত্রলেখার ফোন কল পেয়ে তৎক্ষণাৎ রিসিভ করে এই কথাটাই প্রথম জিজ্ঞেস করে লিখন।

-ভালো আছি।

-সত্যি ভালো আছো?

-কখনো আমাকে মিথ্যা বলতে শুনেছিস?

-জানি তুমি মিথ্যা বলো না কিন্তু ঠিকই কথা আড়াল করো। যে কথাটা শুনলে আমরা দুঃখ পাবো সেটা কখনোই আমাদের বলো না, নিজে নিজে একা কষ্ট পাও।

-এভাবে বলছিস কেন লিখন?

-এমনি আপা। তোমাকে মিস করছিলাম তাই হয়ত। সত্যি সত্যি একদিন বিয়ে করে তুমি শশুড়বাড়ি চলে যাবে ভাবতাম কিন্তু দিনটা এত জলদি আসবে তা কখনো ভাবিনি। এভাবে যে আচমকা আসবে সেটাও তো চিন্তা করিনি। বাড়ি ফিরলে তোমাকে দেখতে পাবো না ভাবলেই…

লিখনের গলা ধরে আসে কথাটা শেষ করতে পারে না সে। লাইনের অন্যপাশে চিত্রলেখার গাল বেয়ে ইতোমধ্যেই অশ্রু ঝড়তে শুরু করেছে। খানিক নীরবতার পর লিখন নিজেকে সামনে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-তুমি কি কাঁদতেছো আপা?

নিজের কান্না গিলে ফেলার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-ক কই না তো।

-মিথ্যা বলতে পারো না তাও কেন বলো? জানো ধরে পড়ে যাবা। তুমি এত বাজে মিথ্যা বলো আপা, তোমার থেকে চারু বেশি সুন্দর গুছায় মিথ্যা বলতে পারে। ধরতেই পারবা না ও মিথ্যা বলতেছে। আচ্ছা আপা বলো তো তুমি মিথ্যা বলতে পারো না অথচ চারুটা এমন মিথ্যুক কীভাবে হলো?

লিখনের কথা শুনে হেসে ফেলে চিত্রলেখা। হেসে ফেলে বলে,

-একদম আমার চারুকে মিথ্যুক বলবি না। চারু মিথ্যা বলে না।

-বলে আপা অনেক মিথ্যা বলে।

-তুই নিজে বলিস না ভাবছিস?

-ওমা এখন তুমি আমাকে মিথ্যুক বলবা?

-মিথ্যুক বলছি না। আমি জানি আমাকে কষ্ট না দেয়ার জন্য তোরা অনেক কিছুই আমার থেকে আড়াল করে রাখিস। এটাকে মিথ্যা বলে না রে লিখন।

-যেমন তুমি করো।

লিখনের এই কথার পিঠে আর কিছু বলে না চিত্রলেখা। এটা সত্যি, এতগুলো বছরে অনেক কথাই আড়াল করেছে সে ভাইবোনদের থেকে শুধুমাত্র ওদের কষ্ট দিতে চায় না বলে। ভাইবোনের কথা মনে পড়ছিল বলে লিখনকে ফোন দিয়েছে চিত্রলেখা। এখন তো চাইলেই যখন খুশি তখন ভাইবোনের কাছে ছুটে যেতে পারবে না সে। তার জগৎ টা এখন আর কেবল তাই ভাইবোনকে ঘিরে নেই। রওনক নামক একজন মানুষ তার জগতের আধিপত্ত লাভ করেছে। যাকে চাইলেই চিত্রলেখা আর উপেক্ষা করতে পারবে না। কথার প্রসঙ্গ ঘুরাতে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-খালা, চারু, চয়ক সবাই কেমন আছে আরে?

-তোমাকে ছাড়া যেমন থাকার কথা তেমনই আছে আপা। কেউ মুখে বলে না কিন্তু আমি জানি সবাই তোমাকে অনেক মিস করছে। কিন্তু তুমি চিন্তা করো না কয়েকটা দিন পর সবাই ঠিক সামলে উঠবে।

-হুম…

খানিকটা ইতস্ততা নিয়েই লিখন বলে,

-একটা কথা জিজ্ঞেস করি আপা?

-হ্যাঁ বল।

-তুমি সত্যি ভালো আছো তো? ঐবাড়ির সবাই তোমাকে খুশি মনে আপন করে নিয়েছে তো?

চিত্রলেখা জানতো লিখন তাকে এই প্রশ্নটা করবেই দু’দিন আগে বা পরে। নিজেকে সামলে নিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-সত্যি আমি ভালো আছি রে। আমাকে নিয়ে একদম ভাবিস না। আমি ভালো আছি।

মানুষ যখন ভালো থাকে না তখন বারবার ভালো আছি বলে নিজেকে, নিজেরে আশেপাশের মানুষগুলোকে বুঝাতে চেষ্টা করে সে ভালো আছে। চিত্রলেখা এখন যেনো সেই কাজটাই করছে। লিখন আর প্রেসার দেয় না। বোনের কথা মেনে নিয়ে বলে,

-যাই হয়ে যাক, পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক না কেনো আমি লিখন তোমার ভাই সবসময় তোমার পাশে আছি। তুমি যাই বলবে আমি তাই বিশ্বাস করব যদি সেটা মিথ্যা হয় তবুও সেটাই আমার জন্য সত্যি হবে যদি তুমি বলো। তাই কখনো নিজেকে একা ভাববে না। তোমার লিখন সবসময় তোমার পাশে আছে আপা। চারু, চয়ন এখনো ছোট কিন্তু আমি আছি।

লিখনের সঙ্গে কথা বলার পর হালকা লাগছে চিত্রলেখার। সে জানে, এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ তার সঙ্গ ছেড়ে দিলেও এই তিনজন মানুষ যাদের শরীরে একই রক্ত বইছে, চিত্রলেখার সবচাইতে আপনজন, এরা কখনো কোনো পরিস্থিতেই তার হাত ছাড়বে না। লিখনের সঙ্গে কথা বলার পর হালকা লাগছে চিত্রলেখার। হাত থেকে মোবাইল নামিয়ে রেখে সবেই বিছানায় বসেছে সে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে পেছন ফিরলে দেখে তানিয়ে প্রবেশ করছে। এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করে,

-ব্যস্ত? বিরক্ত করলাম না তো?

-একদম না, আসুন না প্লিজ।

-পার্লারের মেয়েরা চলে এসেছে। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, এসো।

তানিয়া আগে তার পেছন পেছন চিত্রলেখা হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করে,

-আমি এসব না করলে হয় না?

চিত্রলেখার কথা শুনে থেমে দাঁড়িয়ে তানিয়া বলে,

-এগুলো তো বেসিক। রাতের পার্টির জন্য তৈরি হবার আগে একটু ফেশিয়াল করে নিলে ম্যাকাপটা ভালো সেট হবে ফেইসে।

আমতা আমতা করে চিত্রলেখা বলে,

-আমি কখনো এসব করিনি।

তানিয়া এগিয়ে এসে চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে আশ্বস্ত করে বলে,

-আমি জানি। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা শুরু আছে তাই না বলো? আমি আছি তো তোমাকে শিখিয়ে দিতে। আমি চলে যাবার আগে তোমাকে সবকিছু শিখিয়ে দিয়ে যাবো যেনো আমি যাবার পর তোমার কোনো সমস্যা না হয়। যেনো কোনো পরিস্থিতে তুমি রওনকের পাশে দাড়াতে পারো। আমি চলে যাবার আগে সব বুঝিয়ে, শিখিয়ে দিয়ে যাবো তোমাকে।

এবারে চিত্রলেখা তানিয়ার হাত ধরে বলে,

-থেকে গেলে হয় না? কোনোভাবেই কি থেকে যাওয়া যায় না? মিশকাত, মীমের জন্যও না?

চিত্রলেখার অবুঝ আবদার শুনে তানিয়ার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তার হাসি দেখে বিভ্রান্ত হয় চিত্রলেখা। হাসি হাসি মুখ করেই তানিয়া বলে,

-থেকে যেতে পারলে কি আর চলে যাবার কথা ভাবতাম? আমি তো থাকতেই এসেছিলাম। চলে যাবার কথা তো কখনো ভাবিনি। যার জন্য, যার হয়ে এসেছিলাম একদিন সবকিছু পেছনে ফেলে সেই তো আমার নেই। যার আমাকে শক্ত আলিঙ্গনে ধরে রাখার কথা সেই তো কখনো আমাকে আগলে রাখেনি তাহলে কার জন্য থাকবো? কিসের আশায় থাকব?

-মীম, মিশকাত এর চাইতে বড় কারণ কি কিছু হতে পারে?

-আমি কখনোই আমার সন্তানদের বাঁধা হিসেবে দেখিনি। ওদের জন্য তো তুমি আর রওনক আছোই। ওদের নিজের বাবা যে আদর ভালোবাসা দিতে পারেনি, রওনক কখনো সেই অভাব ওদের বুঝতে দেয়নি। জন্ম দিয়েছি বলেই আমার কোনো অধিকার নেই রওনকের কাছ থেকে ওদের কেড়ে নিবো।

-আমি তো সবে এলাম। আমি কি পারবো আপনার মতো করে…

চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না নিয়ে তানিয়া বলে,

-তুমি আমার চাইতে ভালো পারবে আমি জানি। রওনক এমনি এমনি তোমাকে বিয়ে করেনি চিত্রলেখা। তোমার নিজের উপর সন্দেহ থাকলেও রওনকের সিদ্ধান্তের উপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারো।

-তুবও আমাদের সাথে না হয় থেকে যেতেন।

-থাকতাম যদি আশার কোনো আলো অবশিষ্ট থাকতো। যতদিন ছিল ততদিন ছিলাম। আমার পৃথিবীর সবটা জুড়ে অন্ধকার নেমে আসার পরেই আমি নতুন আলোর সন্ধানে নেমেছি। আমি বাঁচতে চাই চিত্রলেখা। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই। আর অন্যের জন্য নয় এবার কেবল নিজের জন্য বাঁচতে চাই। একটা মানুষ যাকে আমি মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছি শুরু থেকে। যার জন্য নিজেকে উজার করে দিয়েছি। ভালোবেসে যার সন্তানের মা হয়েছি। দিনশেষে উপলদ্ধি করলাম মানুষটা শুরু থেকে কখনোই আমার ছিল না। বিশ্বাস করো, সে যদি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলে মিথ্যা করেও বলো সে শুধু আমার। আমি তার মিথ্যাটাকে সত্যি মেনে নিয়েই থেকে যেতাম। আর সত্যি মিথ্যা খুঁজতাম না।

এরপর আর চিত্রলেখার মুখে কথা জোগায় না। আসলেই তো কিসের আশায় থেকে যাবে তানিয়া! বিয়ের পর একটা মেয়ের জীবনের সবচাইতে বড় খুটি তার স্বামী। যে মানুষটার হাত ধরে সব পেছনে ফেলে নতুন করে জীবন শুরু করে একটা মেয়ে। সেই মানুষটাই যদি নিজের না থাকে তাহলে কিসের আশা থাকবে সে? তানিয়া তো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি। তারও তো বাঁচার অধিকার আছে। ভালো থাকার অধিকার আছে।

চিত্রলেখাকে আপন ভাবনায় হারিয়ে যেতে দেখে তানিয়া হাত ঝাঁকি দিয়ে বলে,

-চলো মেয়েগুলো অপেক্ষা করছে অনেকক্ষন হয়। তোমার বর এসে যদি দেখে আমরা এখনো ফেশিয়াল শেষ করিনি তাহলে খবর আছে। কাজের ব্যাপারে কত পাংচুয়াল জানো তো।

চিত্রলেখা মাথা ঝাঁকায়। তানিয়া তার হাত ধরে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

ফেশিয়াল, মেনিকিউর, পেডিকিয়র শেষ করে নিজের ঘরে ফিরে আসতেই চিত্রলেখা দেখে তার বিছানার উপর অনেকগুলো ব্যাগ রাখা। একসঙ্গে এতগুলো ব্যাগ দেখে কৌতুহল জাগে চিত্রলেখার মনে। কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে মনে মনে কাউন্ট করে, ২২ টা ব্যাগ। কে রেখেছে এতগুলো ব্যাগ এখানে? কার এগুলো? রওনক কি ফিরে এসেছে? দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় চিত্রলেখা। আড়াইটার বেশি বাজে। রওনক যাবার আগে বলে গিয়েছিল আজ জলদিই ফিরে আসবে কিন্তু কখন ফিরবে সেটা বলে যায়নি। কিন্তু সে ফিরলে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই তাকে জানাতো। ফেশিয়াল করতে বসার আগে জাহানারা ফুফুকে চিত্রলেখা নিজেই বলেছিল রওনক ফিরলে যেনো তাকায় জানায়। ব্যাগগুলো কার, কে রেখেছে, এখানে কেনো এমন হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে চিত্রলেখার মস্তিষ্কে। আচমকাই চিত্রলেখার সব প্রশ্নের উত্তর হয়ে চেঞ্জিং রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে রওনক। তাকে দেখে অবাক হয়েছে চিত্রলেখা। অবাক হবারই কথা। চিত্রলেখাকে বিছানার কাছে দেখে এগিয়ে আসতে আসতে রওনক বলে,

-টোটাল ৪৫ টা শাড়ি আছে।

-৪৫ টা!

সামান্য অবাক হলেও বিশেষ ভাবে না চিত্রলেখা। বাসার সবাই প্লাস আত্মীয় স্বজনদের জন্য এনেছে হবে হয়ত। কিন্তু চিত্রলেখাকে অবাক হবার চুড়ান্তে পৌঁছে দিতে রওনক বলে,

-তোমার জন্য। দেখো পছন্দ হয় কিনা।

চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকায় চিত্রলেখা, রওনকের কথা শুনে। ৪৫ টা শাড়ির তার জন্য! এমনিতেই তো আলমারি ভরতি কাপড় চোপড় দিয়ে। এরপর আবার শাড়ি তাও ২ টা বা ৫টা নয় ৪৫ টা! এই লোকের কি মাথায় সমস্যা? মনে মনে ভাবলেও মুখে জিজ্ঞেস করতে পারে না রওনককে আসলেই তার মাথায় সমস্যা আছে কিনা। চিত্রলেখাকে অবাহ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনক এগিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বউকে উষ্ণ আলিঙ্গনে। আচমকা রওনকের জড়িয়ে ধরায় এবার যেনো ভেঙে পড়ে চিত্রলেখা। এই মানুষটার স্পর্শে এমন দূর্বল হয়ে যায় কেনো সে? বুকের ভেতর কিছু একটা তোলপাড় করছে। নিঃশ্বাস ভার হয়ে আসতে চাইছে চিত্রলেখার। তা বুঝতে পেরে রওনক চিত্রলেখার কাঁধে মুখ রেখে একদম কানের কাছে গিয়ে বলে,

-এখনো আমি স্পর্শ করলে তুমি কেঁপে উঠছো। এত ঘাবড়ে যাচ্ছো কেনো? আমি তো, তোমার রওনক।

বলেই চিত্রলেখার কাঁধে একটা লম্বা চুমু খায় সে। চিত্রলেখাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চিবুক ছুঁয়ে মুখ উপরের দিকে তুলে। চিত্রলেখার শরীর জুড়ে অনুভূতিদের দৌড়াদৌড়ি চলছে। লজ্জায় চিত্রলেখার লাল হয়ে যাওয়া নাকে ছোট করে ঠোঁট ছুঁয়ে রওনক বলে,

-গতকাল ঐ শাড়িটাতে খুব সুন্দর লাগছিল তোমাকে তাই আমার পছন্দ মতো কিছু আড়ং কটনের শাড়ি এনেছি, তোমার জন্য ছোট্ট একটা গিফট। একটু কারেকশন করি। ৪০ টা শাড়ি তোমার আর বাকি ৫ টা আফিফার জন্য।

-আফিফার!

চিত্রলেখার কন্ঠে স্পষ্ট অবাক হওয়া। রওনক বলে,

-হু, গতকাল আফিফা তোমাকে নিজের শাড়ি না পরিয়ে দিলে তো আমি জানতেই পারতাম না নরমাল একটা সুতির শাড়িতে তোমাকে দেখতে এত সুন্দর লাগবে। ঐ শাড়িটা তুমি রেখে দিও। আরেকদিন না হয় আমার জন্য পরো। আর ঐ শাড়িটার এক্সচেঞ্জে নতুন ৫ টা শাড়ি আমার পক্ষ থেকে আফিফার জন্য ছোট্ট একটা গিফট।

রওনকের বাহুবন্ধনে থেকেই চিত্রলেখা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার ব্যাগগুলো দেখে নিয়ে বলে,

-ছোট্ট গিফট এটা? ৪৫ টা শাড়ি। কেউ কেউ হয়ত সম্পূর্ন জীবনে ৪৫ টা শাড়ি পরার সুযোগ পায় না আর আপনি বলছেন ছোট্ট গিফট!

-৪৫ না ৪০ টা তোমার।

-এক বালতি দুধ থেকে এক গ্লাস দুধ কেউ খেয়ে ফেললে কি খুব বেশি পার্থক্য হবার কথা?

রওনক মাথা ঝাঁকায়। চিত্রলেখা বলে,

-তেমনি ৪৫ যা ৪০ ও তাই।

ভ্রু কুঁচকে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-সো আর ইউ টেকিং মাই গিফট ওর রিজেক্টিং মি?

মাথা ঝাঁকিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আমার সেই সাধ্য কোথায় আপনার দেয়া উপহার উপেক্ষা করব।

চিত্রলেখার জবাব টা পছন্দ হয় না রওনকের। সে চিত্রলেখাকে কোনো কিছুর জন্য জোর করতে চায় না, করবেও না। রওনক দুই হাতে চিত্রলেখার কোমড় জড়িয়ে রেখেছিল। একটা হাত এবারে চিত্রলেখার গালে রেখে বলে,

-ইটস ওকে, জোর করে তোমায় কিছুই করতে হবে না। তুমি নিতে না চাইলে আমি সব রিটার্ন পাটিয়ে দিচ্ছি।

চিত্রলেখা রওনকের টি-শার্ট চেপে ধরে বলে,

-প্লিজ এর প্রয়োজন নেই। আপনি শখ করে এনেছেন, অবশ্যই আমি পরবো।

-আমাকে খুশি করতে?

-না, আমি খুশি হয়েই পরবো। এর আগে কখনো কেউ আমাকে শাড়ি কিনে দেয়নি। জীবনে প্রথম কেউ দিলো আমি ফিরে দেই কীভাবে?

রওনক আর কিছু বলে না। হাসি ফুটে ওঠে তার চোয়াল জুড়ে যা চিত্রলেখাও দেখতে পায়। কিন্তু চিত্রলেখাকে নিজের থেকে আলাদা করে না সে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-আপনি কখন এলেন?

-অলমোস্ট থার্টি মিনিট হবে।

-আমাকে ডাকেননি কেনো? আমি তো ফুপিকে বলেছিলাম আপনি এলে আমাকে জানাতে।

-আমি খালাকে বলেছিলাম তোমাকে ডিস্টার্ব না করতে। আই উইল ওয়েট ফর ইউ।

চিত্রলেখ আবারও ঘড়ি দেখে জিজ্ঞেস করে,

– নিশ্চয়ই কিছু খাননি, খাবার দিতে বলি?

-তুমি খেয়েছো?

জবাব না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করে রওনক। সে জানে চিত্রলেখা দুপুরে খায়নি। এমন নয় যে ফেশিয়াল ইত্যাদি করায় ব্যস্ত ছিল সেজন্য খাবার সু্যোগ পায়নি। রওনক বাসায় ফিরে সবার আগে জাহানারাকে জিজ্ঞেস করেছিল চিত্রলেখা দুপুরে খেয়েছে কিনা। চিত্রলেখা একা খাবে না সেটা রওনক জানতো বলেই মিটিং শেষ করে বাইরে খাওয়া দাওয়া করেনি সোজা বাড়ি ফিরে এসেছে চিত্রলেখার কাছে। জবাব না দিয়ে চিত্রলেখা মাথা ঝাঁকায়।

-খাওনি কেনো?

-আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

-আমি যদি এখন না আসতাম তাহলে?

-অপেক্ষা করতাম।

-ডন্ট ইউ ডেয়ার। আজ রাগ করছি না কিন্তু এরপর সময় মতো খেয়ে নিবে প্লিজ। আমি জানি তুমি এখানে কমফোর্টেবল না, স্টিল প্লিজ ফর মি ট্রাই টু ম্যাক ইউরসেলফ কমফোর্টেবল।

জবাবে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। রওনক তাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,

-আমি নিচে যাচ্ছি। লাবিব এসেছে, আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবে। খুব খুদা লেগেছে জলদি খাবার দিতে বলো।

-আপনি যান আমি আসছি।

রওনক চলে যেতে নিয়েও থেমে গিয়ে চিত্রলেখার একটা হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-তুমি আমাকে জান বলে ডাকবে কবে?

রওনকের প্রশ্নে চিত্রলেখার বিষম উঠে যায়। তা দেখে হেসে ফেলে রওনক। চিত্রলেখার মুখটা দেখার মতো হয়েছে।

লাবিবের একেবারে পার্টিতে আসার কথা ছিল। কিছু কাজ রয়ে গেছে তাই রওনকের সঙ্গেই চলে এসেছে সে। বিয়ের দিন শেষবার দেখা হয়েছিল তাদের। তারপর আজ আবার মুখোমুখি। লাবিব বরাবরই চিত্রলেখার জন্য একজন ভালো বন্ধু। আর সবসময়ই এমন থাকবে। ফেশিয়াল আর ইত্যাদি করাতে নিয়ে তানিয়ারও আজ দুপুরের খাওয়া হয়নি। সেও রওনকদের সঙ্গেই বসেছে খেতে। তানিয়া, রওনক ও লাবিব একত্র হওয়ায় ওদের কথাবার্তা সব ব্যবসা রিলেটেডই। ওদের কথায় চিত্রলেখার কিছু বলার নেই। সে নিজের মতো খেতে আর ওদের প্লেটে খাবার তুলে দিতে ব্যস্ত। তিনজন নিজেদের মতো ব্যবসায়িক আলোচনায় এতটাই ব্যস্ত যে কারো নিজের প্লেটের দিকে খেয়াল নেই। চিত্রলেখা তুলে দিচ্ছে আর তারা খাচ্ছে। কিন্তু আলোচনার একপর্যায় তানিয়া বলে,

-তবে রওনক, আমি ভাবছিলাম কি চলে যাবার আগে চিত্রলেখাকে আমার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে যাবো।

তানিয়ার কথায় চিত্রলেখার বিষম উঠে যায়। অন্যরা যেটা লক্ষ করেনি সেটা হচ্ছে লাবিবের গলায় খাবার আটকে গেছে। তানিয়া চলে যাবে এর মানে কি! নিজের জায়গা থেকে প্রশ্নটা করতেও পারছে না লাবিব। চুপচাপ কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে পানি খেয়ে গলায় আটকে যাওয়া খাবার গিলে ফেলে সে। রওনক চিত্রলেখাকে পানি এগিয়ে দেয়। পানি খেয়ে শান্ত হয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আপনার কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।

-শিখিয়ে দিলে অবশ্যই হবে।

চিত্রলেখা রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-হবে না। ম্যাম মানে ভাবী তো ফাইনান্স দেখছেন আমি ফাইনান্সের কিচ্ছু বুঝি না। তাছাড়া আমি অফিস করলে মীম, মিশকাতকে কে দেখব?

কাউকে কিছু বলার সু্যোগ না দিয়ে তানিয়া বলে,

-মীম, মিশকাতকে দেখার লোক আছে বাসায়। প্রয়োজনে আরও লোক হায়ার করা হবে। তুমি ওদের লিগাল গার্ডিয়ান ন্যানি না যে ওদের দেখাশুনার জন্য ঘরে বসে থাকবে, নিজের ক্যারিয়ার বিষর্জন দিয়ে দিবে।

-কিন্তু…

-আগেও তো চাকরী করার পাশাপাশি ভাইবোনদের খেয়াল রেখেছো, রাখোনি?

সম্মতিতে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। তানিয়া বলে,

-তাহলে এখন কেনো বসে থাকবে? আমি একদম এলাও করব না। তোমার নিজের পরিচয় ধরে রাখতেই হবে। রওনক জামানের বউ ঘরে বসে থাকবে অসম্ভব! কাল থেকে অফিস যাবে তুমি আমার সঙ্গে। আমি আমার কাজ তোমাকে বুঝিয়ে দিবো আস্তেধীরে।

চিত্রলেখা অসহায়ের মতো রওনকের দিকে তাকালে সে বলে,

-আপাতত ওকে কিছুদিন সময় দাও ভাবী। সবার নিজের স্পেশালিটি আছে। ও ফাইনান্স না দেখলে অন্যকিছু দেখবে যেটা ও ভাবো জানে। তার আগে এই নতুন পরিবেশের সঙ্গে ইউজ টু হোক তারপর থেকে না হয় অফিস জয়েন করবে। তাছাড়া আমারও কোনো প্লান নেই ওকে ঘরে বসিয়ে রাখার। শি ক্যান জয়েন হোয়েন এভার শি ওয়ান্টস টু। জামান গ্রুপ যতটুকু আমার ততটুকু ওরও।

কথা শেষ করে চোখের ইশারায় চিত্রলেখাকে আশ্বস্ত করে রওনক। তা দেখে স্মিত হাসে চিত্রলেখা কিন্তু তার বুঝা হয়ে গেছে এখন না হোক কিছুদিন পরে তবুও তাকে অফিস জয়েন করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এসব ভেবেই চিত্রলেখার মুখের রঙ বদলে যাচ্ছে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬০
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

ঘড়িতে রাত ৮ টা বাজছে প্রায়। যদিও ডিনার পার্টি, সাধারণত এই বাড়ির ডিনার পার্টিগুলো একটু রাত করেই হ্যাঁ। তাই ইনভাইটেড গেস্টরা সাধারণত রাত ৮ টার পর বা ৯ টা নাগাদ আসে কিন্তু আজ এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। ৮ টা বাজছে প্রায় বাজেনি এখনো কিন্তু এর মধ্যেই অনেকে চলে এসেছে। এমন ঘটার পেছনের কারণটা বিশেষ এবং সহজেই অনুমেয়। শিল্পপতি, ব্যবসায়ি রওনক জামানের বউকে সরাসরি দেখার তীব্র আগ্রহ। রওনক যখন নিজের ভেরিফাইড ফেইসবুক একাউন্টে ম্যারিটাল স্ট্যাটাস আপডেট করেছে তারপর থেকেই সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। যদিও সেই পোস্টে রওনক চিত্রলেখাকে ট্যাগ করেছে কিন্তু চিত্রলেখার আইডিটা প্রাইভেট হওয়ায় কেউ তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারেনি। তাই সকলের আগ্রহের যেনো কোনো কমতি নেই। রওনকের আগের বিয়ে, ডিভোর্স সম্পর্কে সবাই কম বেশি জানে শুধুমাত্র সরাসরি কথা বলে না এই যা।

আজকের পার্টিতে আত্মীয় স্বজন সবাইকে দাওয়াত করা হয়নি যেহেতু প্রোগ্রাম বাসায় হচ্ছে। রওনকের একান্তই কাছের কিছু বন্ধু, কিছু বিজনেস পার্টনারস, কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার, আর একান্তই কাছের রিলেটিভ। কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে সাবার বাবাও একজন। যেহেতু তাদের পারিবারি সম্পর্ক গভীর তাই সাবাদের সপরিবারে ইনভাইট করা হয়েছে।

আজকের পার্টি উপলক্ষে একটা বার সেট করা হয়েছে। সব ধনের ড্রিংক্স রাখা আছে, সফট ড্রিংক্সও। সবাই তো আর এলকোহল নেয় না। বারটা পার্মানেন্ট নয় ট্রেম্প্ররারি সেট করা হয়েছে কেবল আজকের পার্টি উপলক্ষে। এদিক সেদিকের কথার পর ঝেড়ে কাশে সাদমান, রওনকের সবচাইতে কাছে বন্ধু সে। একসঙ্গে লেখাপড়া করেছে, বড় হয়েছে। রওনকের ভালো দিনে যেমন পাশে থেকেছে তেমনি সবচাইতে খারাপ দিনগুলোতেও পাশে থেকেছে। যার জন্য এত আয়োজন তাকে দেখতে আর তর সইছে না যেনো কারো। তাই গল্প, আড্ডা ভেঙে সাদমান জিজ্ঞেস করে,

-তা মিসেস রওনক জামানকে দেখতে আর কতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে?

রওনক নিজের হাত ঘড়িতে সময় দেখে। ৮ টা বাজতে চলেছে। এতক্ষনে চিত্রলেখার তৈরি হয়ে যাবার কথা। সন্ধ্যার পর সে নিজেই চিত্রলেখা দেখেনি। তার পছন্দ করে কেনা ড্রেসে চিত্রলেখাকে কেমন লাগছে দেখার অপেক্ষায় রওনক নিজেও। হাত থেকে ওয়াইনের গ্লাসটা বার কাউন্টারে নামিয়ে রেখে রওনক বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে,

-আমি দেখে আসছি আর কতক্ষন লাগবে।

সবাইকে রেখে উপরের দিকে অগ্রসর হয় রওনক। তার চন্দ্রকে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর লাগছে দেখতে। ভাবতে ভাবতেই নিজের ঘরে প্রবেশ করে সে। কিন্তু রুমে নেই চিত্রলেখা। ভেতরে এগিয়ে গিয়ে চেঞ্জিং রুমের দরকার নবে হাত রেখে ঘোরালেই খুলে যায়। এখানেই তৈরি হচ্ছে তার চন্দ্র। পার্লার থেকে দু’জন মেয়ে এসেছে সাজিয়ে দিতে। একজন চিত্রলেখাকে সাজিয়ে দিচ্ছে আরেকজন তানিয়াকে। দরজাটা খুলে যেতেই চিত্রলেখার চোখ তার সামনে থাকা বড় আয়নাটায় স্থির হয়। রওনককে দেখে চিত্রলেখার নিঃশ্বাস আটকে গেছে। স্যুট পরা রওনককে সে বহুদিন, বহুবার দেখেছে কিন্তু আজ তাকে দেখতে ভিন্নরকম লাগছে। এই ভিন্নতার কারণ কি? কালো রঙের স্যুটটা রওনকের শরীরে এমন ভাবে ফিটিং হয়ে আছে যেনো এই স্যুটটা একমাত্র তার জন্যই তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে এই স্যুটে সুদর্শন লাগবে না যতটা রওনককে লাগছে। চেষ্টা করেও নিজের চোখ ফেরাতে পারছে না চিত্রলেখা। সবসময় স্যুটের জন্য টাই পরতে দেখেছে সে রওনককে কিন্তু আজ বো-টাই পরেছে রওনক। ডান হাতে দামী একটা ঘড়ি। পায়ের শু টাই চকচক করছে। চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করে ব্যাকব্রাশ করেছে। একদিকে চিত্রলেখা অন্যদিকে রওনক। চিত্রলেখাকে দেখে তার গলায় কি যেনো একটা আটকে গেছে। অফ শোল্ডার হোয়াইট রঙের একটা গাউন কিনে এনেছিল রওনক আজকের পার্টিতে চিত্রলেখার পরার জন্য। গাউনটা চিত্রলেখার শরীরের সঙ্গে এমন ভাবে লেগে আছে যা দেখে নিজের চোখ ফেরাতে পারছে না রওনক। কোমড় সমান চুলগুলোকে ঘাড়ের উপর খোপা করা হয়েছে। সাইড থেকে কিছু চুল কার্ল করে দু’পাশে ছেড়ে রাখা হয়েছে। চিত্রলেখার কানে ডায়মন্ডের কানের দুল, হাতে ব্রেসলেট। গলাটা খালি যদিও খালি থাকবে না। রওনক নিজেই আজকের পার্টির জন্য একটা ডায়মন্ডের সেটটা কিনে এনেছিল। গলার সেটটা এখনো পরা বাকি। পার্লারের মেয়েটার হাতেই রয়েছে গলার ভারি ডায়মন্ডের সেটটা। বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে চিত্রলেখাকে দেখার পর হাত বাড়ায় রওনক সেটটা নেয়ার উদ্দেশ্যে। বলে,

-আপনি একটু বাহিরে অপেক্ষা করুন।

মেয়েটা একমুহূর্ত সময় অপচয় না করে ডায়মন্ডের সেটটা রওনকের হাতে দিয়ে চেঞ্জিং রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মেয়েটা বেরিয়ে গেলেই রওনক এসে চিত্রলেখার ঠিক পেছনে দাঁড়ায়। আয়নায় তার দু’জনই একে-অপরকে দেখতে ব্যস্ত। তৎক্ষণাৎই রওনক সেটটা চিত্রলেখার গলায় পড়িয়ে দেয় না। সামান্য এগিয়ে গিয়ে পাশের ড্রেসিং কেবিনেটে সেটটা নামিয়ে রেখে পূর্বের জায়গায় ফিরে আসে সে। হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার কোমড় স্পর্শ করে। এতেই যেনো চিত্রলেখার অঙ্গে অঙ্গে কাঁপন ধরে গেছে। শিহরনের দোলে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে চিত্রলেখা। আয়নায় সবই দেখছে রওনক। তার স্পর্শে চিত্রলেখার এই বশ হয়ে যাওয়াটা যেনো তাকে আরও বেশি পাগল করে দিচ্ছে। আরও গভীরভাবে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তার চন্দ্রকে। এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার কানের নিচে ঘাড়ে নাক রেখে নিঃশ্বাস টানে রওনক। দামী পারফিউম ও চিত্রলেখার শরীরের ঘ্রান মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। চিত্রলেখা চোখ মেলতে পারে না। সাহসই হয় না চোখ খুলে রওনকের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখার। চোখ মেললে যে রওনক তার চোখের আহ্বান টের পেয়ে যাবে। চোখ না মেললেও নিজের গায়ে লেপ্টে থাকা গাউন শক্ত করে ধরে রেখেছে চিত্রলেখা যা রওনকের দৃষ্টি এড়ায়নি। চিত্রলেখার কোমড় ছুঁয়ে থাকা রওনকের হাতের স্পর্শ আরও গাঢ় হয়। এবারে চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে আলতো করে তার উন্মুক্ত কাঁধে চুমু খায় রওনক। ছোট্ট করে নয় বরং গাঢ় চুমু, গভীর চুমু। সময় নিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে থাকে সে। রওনকের ঠোঁটের স্পর্শে চিত্রলেখার ঠোঁট কাঁপতে আরম্ভ করেছে। রওনকের ইচ্ছা করছে এক্ষুনি সে ঐ ঠোঁটের দখল নেয় কিন্তু এসবের জন্য উপযুক্ত সময় এখন নয়। চিত্রলেখাকে দেখবে বলে শহরের নামিদামি ব্যাক্তিরা নিচে অপেক্ষা করছে সেই সঙ্গে প্রেসও এসেছে। আজ তারা দু’জনে প্রথমবারের মতো একত্রে প্রেসের সামনে দাঁড়াবে। ছোটখাটো একটা ইন্টারভিউও হবে বলা যায়। আজকের তোলা ছবি আগামীকাল সকালের খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিনের পাতায় ছাপানো হবে বড় হেডলাইনের সঙ্গে। রওনক জামান সবসময়ই বিজনেস নিজের হট টপিক। তার বিয়েটা কোনো অংশে কম কিছু নয়। নিজেরা প্রথমবার একত্রে সবার সামনে আসা তাই কোনো কমতি রাখেনি রওনক। তার ওয়াইফ হিসেবে যতটুকু সম্মান চিত্রলেখার প্রাপ্য তার চাইতে অধিক দিতে চায় রওনক তাকে। চিত্রলেখার জন্য নিজের সাধ্য ও সামর্থ্যে বাইরে গিয়ে করতে ইচ্ছা করে তার। সম্পূর্ন দুনিয়া এনে পায়ের কাছে বিছিয়ে দিতে ইচ্ছা করে।

রওনক চিত্রলেখার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে মৃদু স্পর্শ করে বলে,

– ইউ আর লুকিং বিউটিফুল।

এক্মুহূর্ত থেমে আরও বলে,

-চোখ খোলো চন্দ্র।

রওনক বলার পরেও চোখ মেলায় সাহস হয় না চিত্রলেখার। রওনক আরও বলে,

-প্লিজ বউ।

তৎক্ষণাৎ চোখ মেলে তাকায় চিত্রলেখা। রওনকের এই আবেদনের কাছেই বার বার হেরে যায় সে। চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখেই তার উন্মুক্ত কাঁধে গভীর করে আবারও আরেকটা চুমু খায় রওনক। চিত্রলেখার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। অঙ্গে যেনো আ গু ন ধরে গেছে তার। কান লাল হয়ে গেছে, নাক লাল হয়ে গেছে। কোনো কিছুই রওনকের চোখ এড়ায়নি। আবার চিত্রলেখার কানে ঠোঁট স্পর্শ করে রওনক বলে,

-আই উইল ম্যাক ইট আপ টু ইউ, আই প্রমিজ। আজকের রাতটা সারাজীবন মনে থাকবে তোমার, আই প্রমিজ ইউ দ্যাট।

চিত্রলেখার কোমড় ছেড়ে দিয়ে গলার সেটটা হাতে নিয়ে পরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-ম্যা আই?

চিত্রলেখা কোনো কথাই বলতে পারে না। নিজের সম্মতি জানাতে কেবল মাথা ঝাঁকায় সে। রওনকের উপস্থিতি, তার স্পর্শে শব্দ হারিয়ে ফেলেছে বেচারি। রওনক আর অপেক্ষা না করে চিত্রলেখার খালি গলায় ডায়মন্ড জড়ানো সেটটা পরিয়ে দিতেই তার মুখ গলে বেরিয়ে আসে,

-এবসিলিউটলি গরজিয়াস!

রওনকের দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে আজ চিত্রলেখাকে দেখতে অন্যরকম সুন্দর লাগছে যদিও তার দৃষ্টিতে চিত্রলেখা সব বেশেই সুন্দর, মুগ্ধকর, চোখ জুড়ানো। চিত্রলেখার ঠোঁট এখনো কাঁপছে। সে হয়ত কিছু বলতে চায় কিন্তু পারছে না। তা আন্দাজ করতে পেরে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কিছু বলতে চাও?

সম্মতিতে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। রওনক বলে,

-বলো আমি শুনছি।

ঢোক গিলে শুকনো গলা ভিজিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে চিত্রলেখা। রওনক চিত্রলেখার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। তারা মুখোমুখি নয়। দু’জনের দৃষ্টিই আয়নায় একে-অপরের দৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ। রওনক সময় দেয় চিত্রলেখাকে নিজেকে সামলে নিতে। সামান্য সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-আফিফার ধারনা আপনি আমাকে ভালোবাসেন।

-আর তুমি কি ভাবো? তোমার কি ধারনা?

চিত্রলেখার মুখে কথা কুলায় না। সে ভাবতে চায় রওনক তাকে ভালোবাসে। কিন্তু আদৌ কি সেটা সম্ভব? রওনক তো আগেই তাকে জানিয়েছে এই বিয়ের কারণ এরপরেও ভালোবাসা আশা করাটা কি বোকামি হয়ে যাবে না? বেশি বেশি হয়ে যাবে না? এই সম্পর্কে কি চিত্রলেখার রওনকের কাছে ভালোবাসা আশা করা উচিত? এতখানি দুঃসাহস করা কি উচিত হবে তার? চিত্রলেখার পক্ষ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে রওনক নিজেই আরও বলে,

-আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কে কি ভাবছে তা দিয়ে আমার কিচ্ছু যায় আসে না চন্দ্র, ট্রাস্ট মি। আমার জন্য ইম্পর্ট্যান্ট হচ্ছে তুমি কি ভাবছো। তোমার কি ধারনা আমাদের নিয়ে। তুমি যদি মনে করো আমি তোমাকে ভালোবাসি তাহলে বাসি আর যদি ভাবো বাসি না তাহলে…

বাকিটুকু আর বলে না রওনক। এক পা পিছনে সরে গিয়ে বলে,

-আই নো ইউ আর নার্ভাস, টেক ফাইভ মিনিট’স দ্যান কাম। আই ইউল বি ওয়েটিং ফর ইউ।

আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যায় রওনক চিত্রলেখাকে রেখেই। নিজেকে সামলে নিতে সময় দিয়ে যায়। রওনক বেরিয়ে যেতেই যেন চিত্রলেখার নার্ভাসনেস বেড়ে গেছে। আয়নায় নিজেকে আপাদমস্তক দেখতে ব্যস্ত সে। ভীষণ সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে কিন্তু এর আগে কোনো এভাবে সাজেনি সে। এমন পোশাকও পরেনি। গাউনটা অফশোল্ডার হওয়ায় তার কাঁধ ও পিঠের অনেকটাই এক্সপোজ হয়ে আছে। এভাবে বাইরের মানুষের সামনে যেতে পারবে না সে। অতিরিক্ত নার্ভাসনেসের কারণে এসির নিচে দাঁড়িয়েও ঘামতে শুরু করেছে চিত্রলেখা। রওনককে দেখে সব ভুলে গিয়েছিল সে। এখন আবার একরাশ অস্বস্তি জেঁকে ধরেছে তাকে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৫৬+৫৭

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

আচমকাই চিত্রলেখাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রওনক। কিছু টের পাবার আগেই চিত্রলেখা অনুভব করে রওনক পেছন থেকে নিজের আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে তাকে। শাওয়ার দেয়ার ফলে রওনকের শরীর জুরে হিমশীতলতা বিরাজ করছে। রওনকের দেহের উষ্ণতা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে চিত্রলেখা। যার ফলে চিত্রলেখার অঙ্গের ভেতর অদৃশ্য এক কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে যা জানান দিচ্ছে আজ আর চিত্রলেখার রক্ষে নেই। একটা কঠিন সর্বনাশ বুঝি ঘটেই যাবে। এসব ভাবতেই চিত্রলেখার হাঁটু কাঁপতে আরম্ভ করেছে। হাটুর কাপাকাপি মুহূর্তেই চিত্রলেখার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। রওনকের ভাবনা মস্তিষ্ক থেকে কিছুক্ষণের জন্য জেড়ে ফেলতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল সে কিন্তু এতে লাভের লাভ কিচ্ছু হয়নি। রওনকের ভাবনা তো দূরের কথা স্বয়ং রওনককেই সে নিজের থেকে বেশিক্ষণের জন্য দূরে রাখতে সক্ষম হয়নি।

রওনক আলতো ভঙ্গিতে চিত্রলেখার উন্মক্ত কাঁধে, ঘাড়ে, কানের পেছনে ছোট্ট ছোট্ট টানে নাক ঘষে দেয়। চিত্রলেখা টের পায় তার ভেতর অজানা এক ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘূর্ণিঝড় আজ হয়ত তাকে দূর অজানায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ঝুল বারান্দার কোমড় সমান গ্রীল দেয়া আছে। নিজেকে সামলে নিতে চিত্রলেখা সেই গ্রীল আঁকড়ে ধরে শক্ত হাতে। কিন্তু কাজ হয় না বিশেষ। রওনকের এই ছোট্ট ছোট্ট স্পর্শ তাকে পাগল করে দিচ্ছে। চিত্রলেখা অনুভব করতে শুরু করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিশেষত্ব। এই যে অধিকার সমেত পবিত্রতার সহিত ছুঁয়ে দেয়া অন্য কোনো সম্পর্কে নেই। অন্য আর সব কয়টা সম্পর্কে হাজারটা নিষিদ্ধতার মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর একে-অপরকে এই ছুঁয়ে দেয়ার মধ্যে পবিত্রতা নিহিত।

রওনকের পাগল করা স্পর্শের মাঝে হারিয়ে যেতে নিয়েও নিজেকে টেনে ধরে চিত্রলেখা। সামান্য টেনেই বলে, আ…আমি শাওয়ার দিয়ে কাপড় বদলে আসি।

চিত্রলেখার কানের পেছনে নাক ডুবিয়ে রেখেই রওনক বলে, আরও কিছুক্ষণ এভাবেই থাকো প্লিজ। আমি আরেকটু তোমাকে ফিল করতে চাই, প্লিজ। প্লিজ চন্দ্র।

রওনকের এমন আকুল আবেদনের কাছে হেরে যেতে বাধ্য হয় চিত্রলেখা। এমনিতেও মনে হচ্ছে না এমন স্পর্শ পাবার পর কদম চালিয়ে অন্য কোথাও যেতে পারবে সে। তাই রওনকের হাতেই নিজেকে ছেড়ে দেয় চিত্রলেখা। যা হয় হোক, আর কোনো আপত্তি নেই তার। এর বেশি সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারবেও না। অন্যরকম এক আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে চিত্রলেখা। হাতের মুঠো আরও শক্ত হয়ে গেছে তার।

বেশ কিছুক্ষণ চিত্রলেখার কানের পেছনে নাক ঘষার পর ছোট্ট করে একটা চুমু বসিয়ে চিত্রলেখার গালের সঙ্গে গাল মিলায় রওনক। কিন্তু নিজের হাতের বাঁধন আলগা করে না। যেভাবে জড়িয়ে ধরেছিল সেভাবেই জড়িয়ে রাখে নিজের সঙ্গে। তবে এতক্ষণ রওনকের হাত চিত্রলেখার পেটের কাছে শাড়ির উপরে থাকলেও এখন একটা হাত শাড়ির নিচ দিয়ে চালান করে দিয়েছে। আলতো করে চিত্রলেখার নরম পেটে হাত রাখে সে। তবে হাত নাড়াচাড়া করে না। দেখতে না পেলেও রওনক ঠিকই অনুভব করতে পারছে তার চন্দ্র, তার স্পর্শের আবেশে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। চিত্রলেখার গালের সঙ্গে গাল মিলিয়ে রেখেই রওনক তার স্বাভাবিক সুরে কথা বলে।

-দেখো আজকের চাঁদটা কত সুন্দর।

রওনকের কথায় চিত্রলেখার হদিস হয়। আবেশে বন্ধ হয়ে থাকা চোখের পাতা মৃদু ভাবে খুলে আসমানের দিকে তাকায়। অন্ধকার আকাছে বুক জুড়ে থাকা চাঁদটা আসলেই সুন্দর। চাঁদ তো সবসময়ই সুন্দর কিন্তু আজ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে চাঁদটাকে বেশি সুন্দর লাগছে, দেখতে। কিন্তু কেনো? রওনক দেখিয়ে দিলো বলে? তার বলায় কি চিত্রলেখার চোখে চাঁদের সৌন্দর্‍্য্য বেড়ে গেল। অবাক লাগে চিত্রলেখার। স্মিত কন্ঠে চিত্রলেখা সম্মতি প্রকাশ করে বলে,

-হুম্‌ সুন্দর।

-সুন্দর তবে…

-তবে কী?

চিত্রলেখার কন্ঠে স্পষ্ট কৌতুহল। তা টের পেয়ে রওনক জবাব দিতে বিলম্ব করে না।

-আমার চন্দ্রের চাইতে বেশি না। আমার চন্দ্রের কাছে এই চান্দের সৌন্দর্য্যও ম্লান।

লজ্জায় আপনাআপনিই চিত্রলেখার গাল লাল হলো, সঙ্গে খানিকটা গরমও হলো। চিত্রলেখা টের পায় রওনকের তাকে দেয়া কমপ্লিমেন্টের কারণেই তার গাল লাল হয়েছে। লজ্জায় কলিজা কাঁপছে বেচারীর। এমনও হয় নাকি? গল্প, উপন্যাসে পড়েছে পুরুষ চরিত্র, নারী চরিত্রের কাছাকাচি এলে তার অঙ্গে অঙ্গে কাঁপন ধরে আজ যেনো সত্যি সত্যি চিত্রলেখার সঙ্গে তাই হচ্ছে। রওনকের স্পর্শে তার অঙ্গে অঙ্গে শুধু কাঁপন নয় আ গু ন ধরে গেছে। নিজ অঙ্গের এই আ গু ন কি দিয়ে নিভাবে চিত্রলেখা!

রওনক চিত্রলেখার গালের সঙ্গে গাল লাগিয়ে রাখে বেশ অনেকক্ষণ। চিত্রলেখা বুঝতে পারে আজকের মতো হয়ত সে বেঁচে গেছে রওনকের পুরুষালি থাবার হাত থেকে। একটুর জন্য নিজের সবটুকু রওনকের ধৈর্য্যের কাছে সমর্পণ করতে তৈরি হয়ে গিয়েছিল চিত্রলেখা কিন্তু আচমকাই রওনক থেমে যাওয়ায় তাকে এখনই নিজের সবটা উজার করে দিতে হচ্ছে না। কিন্তু হৃদয় গহীনে কোথাও গিয়ে চিত্রলেখা জানে খুব বেশিদিন সে নিজেকে রওনকের এসব পুরুষালি স্পর্শের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না। আজ নয়ত কাল নিজেকে উজার করে দিবে সে। সেই সময় সন্নিকটে ভেবে বুকের কাঁপন বাড়ে চিত্রলেখার।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর নীরবতা ভেঙ্গে রওনক জিজ্ঞেস বলে,

-তোমাকে এই শাড়িটাতে চমৎকার লাগছে চন্দ্র।

রওনকের মুখ গলে বেরিয়ে আসা প্রতিটা কমপ্লিমেন্ট চিত্রলেখার বুকের ভেতর গভীর করে দাগ কাটে, ভালো লাগার দাগ। এই জীবনে চিত্রলেখাকে কমপ্লিমেন্ট দেবার মতো তার কোনো ব্যাক্তিগত মানুষ কখনই ছিল না যদিও মামুনের কাছে চিত্রলেখা বিশেষের চাইতেও বিশেষ ছিল সবসময় হয়ত এখনো আছে কিন্তু চিত্রলেখা কখনো নিজের সীমানার বাইরে গিয়ে মামুনকে নিয়ে ভাবেনি। ভালোই হয়েছে ভাবেনি। মামুনকে নিজের জীবনে বিশেষ জায়গা দেয়ার পর চিত্রলেখাকে যদি রওনকের বউ হয়েই আসতে হতো তখন এই জীবনটা বিষের চাইতেও বেশি তেতো হয়ে যেতো এর চাইতে ভালোই হয়েছে চিত্রলেখা কখনো মামুনকে প্রশ্রয় দেয়নি, তাকে কখনো মিথ্যা আশা দেয়নি। নাহলে রওনকের কাছ থেকে এই মুহূর্তে পাওয়া প্রতিটা স্পর্শ চিত্রলেখাকে ভেতরে ভেতরে মে রে ফেলতো। যদিও এখনো সংশয় বিন্দুমাত্র কম নেই চিত্রলেখার ভেতর। সবসময় শুনেছে দেহের মিলনের চাইতে হৃদয়ের মিলন বেশি জরুরী সম্পর্কে। কিন্তু রওনকের সঙ্গে চিত্রলেখার এই সম্পর্কের কোথাও ভালোবাসার ছিটেফোঁটা নেই। সে রওনককে তাকে ভালো না বাসার জন্য দোষ দেয় না অবশ্য। সে তো নিজেই রওনককে ভালোবাসে না। ভালোবাসা, চারটা বর্ণ, চারটা কার চিহ্নের সম্বনয় তৈরি একটা ছোট শব্দ। কিন্তু এর গভীরতা! পৃথিবীর সবচাইতে গভীর সমুদ্র প্রশান্ত মহাসাগরকেও হার মানায় যেনো। আসলে ভালোবাসার গভীরতা কি কখনো পরিমাপ করা সম্ভব? চিত্রলেখার মন তাকে জবাব দেয়, না সম্ভব নয়। অথচ রওনকের সঙ্গে তার সম্পর্কে ভালোবাসা নামক এই গভীরতাটাই নেই। অন্যদিকে রওনকের পুরুষালি স্পর্শের আবেশে হারিয়ে যাওয়া থেকেও নিজেকে আটকে রাখতে কষ্ট হচ্ছে তার। এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা কি জানা নেই চিত্রলেখার। তবে সে জানে সে অনৈতিক কিছু করছে না, আর না নিজেকে কোনো অবৈধ কিছুর সঙ্গে জড়িয়েছে। যে কারণে আর যেভাবেই হয়ে থাকুক না কেনো রওনকের সঙ্গে চিত্রলেখার সম্পর্ক সমাজ স্বীকৃত, ধর্ম মতে সঠিক। তাই এই কাছে আসায় কোনো ভুল দেখতে পায় না চিত্রলেখা। যদিও বিনে ভালোবাসায় এতখানি এগিয়ে যেতে মনের ভেতর অজানা খচখচানির উপস্থিতি টের পায় তবু চিত্রলেখা অনুভব করতে পারে নিজের উপর থেকে ধীরে ধীরে কন্ট্রোল হারাচ্ছে সে। খুব বেশি সময় আর সে নিজেকে রওনকের পুরুষালি স্পর্শের হাত থেকে আড়াল করে রাখতে পারবে না। এক্ষুণি যদি রওনক ইন্ধন দেয় চিত্রলেখা হয়ত বিনাবাক্যব্যয়ে তার ইন্ধনে সাড়া দিবে। দু’জনে মিলে একাকার হয়ে যাবে আকাশের ঐ চাঁদকে সাক্ষী রেখে। পৃথিবীর কেউ জানবে না এক বিছানায় দু’জনের গাঢ় নিঃশ্বাস একে-অপরে বিলীন হয়ে যাবে।

-কিন্তু আমার যতটুকু মনে পড়ে এই শাড়িটা আমি তোমার জন্য কিনি। তুমি কি শপিং করতে গিয়েছিলে?

রওনকের কথার শব্দেই নিজের চিন্তার জগৎ থেকে দপ করে বাস্তবতায় আছড়ে পড়ে চিত্রলেখা। এতক্ষণ নিজের অজান্তে কি সব ভাবছিল সে ভেবে মনে মনে লজ্জায় লাল হয় সে। বউকে চুপ করে থাকতে দেখে রওনক চিত্রলেখার কানের পাতায় ছোট্ট করে ঠোঁট স্পর্শ করে বলে,

-বললে না?

আচমকা রওনকের ঠোঁটের স্পর্শে কেঁপে ওঠে চিত্রলেখা। টেনে বলে,

-ক…কী?

-খুব বেশি আমার ভাবনায় হারিয়ে যাচ্ছো বুঝি? আমি কি খুব জ্বালাচ্ছি তোমাকে?

লজ্জায় চিত্রলেখার মুখ দিয়ে কথা বের হতে চায় না। রওনকের এমন কথার কি জবাব দিবে সে? বললে তো সত্যিটা স্বীকার করা হয়ে যাবে এরপর তো লজ্জায় মানুষটার সামনে দাঁড়াতে পারবে না আর। রওনক বুঝতে পেরে এই বিষয়ে আপাতত আর লজ্জা দেয় না চিত্রলেখাকে। আগের প্রশ্নটা আবার করে সে,

– এই শাড়িটা আমি তোমার জন্য কিনি। তুমি কি শপিং করতে গিয়েছিলে?

-না না, এটা আফিফার। আমি তো থ্রিপিস পড়েই ওর বাসায় গিয়েছিলাম। আমাকে থ্রিপিসে দেখে জোর করে নিজের শাড়ি পরিয়ে দিয়ে বলল…

বাকি কথা বলতে পারে না চিত্রলেখা, থেমে যায়। রওনক তার কথার সুর টেনে বলে,

-কী বলল?

একবার ঢোক গিলে চিত্রলেখা বলে, নতুন বউদের নাকি সবসময় শাড়ি পড়ে সেজেগুজে থাকতে হয়।

-কেন? কার জন্য?

রওনক ইচ্ছা করে প্রশ্নটা করেছে। চিত্রলেখার পেটের উপর থাকা রওনকের স্থির হাতটা সামান্য নড়াচড়া করে। এই সামান্য স্পর্শেই চিত্রলেখা থরথর করে কাঁপতে লাগে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-বরের জন্য।

-আচ্ছা, তা তুমি কার জন্য শাড়ি পড়েছো?

চিত্রলেখা জবাব না দিলে রওনকের স্পর্শ গভীর হয়।

-বলো কার জন্য শাড়ি পরে নিজেকে সাজিয়েছো?

-আপনার জন্য।

আচমকাই চিত্রলেখাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় রওনক। চিত্রলেখার লম্বা চুলের খোপা হাতের টানে খুলে দেয় যার ফলাফল কিছু চুল উড়ে এসে চিত্রলেখার কপাল দখল করতে চাইলে তাদের নিজের আঙ্গুলের টানে কানের পেছনে গুঁজে দেয় রওনক। তারপর হাত বাড়িয়ে চিবুক স্পর্শ করে মুখটা উপরের দিকে তুলে ধরতেই তাদের শুভ দৃষ্টি হয় যেনো। চিত্রলেখার ঐ গভীর চোখের চাহনী থেকে কিছুতেই নয়ন সরাতে পারে না রওনক। অবশ্য সে চায়ও না নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে। চিত্রলেখাকে দেখার জন্য সর্বক্ষণ উতলা হয়ে থাকে তার ঐ নয়ন। বউয়ের চিবুক স্পর্শ করে চোখে চোখ রেখেই রওনক বলে,

-এই সাধারণ একটা সুতির শাড়িতে তোমাকে দেখতে ঠিক কতখানি সুন্দর লাগছে তা ব্যাখ্যা করার ভাষা আমার জানা নেই চন্দ্র কেবল এতটুকু বলতে পারি…

সামান্য থেমে চিত্রলেখার কানের কাছে মুখ নিয়ে রওনক আরও বলে,

-আমি ম রে যাচ্ছি তোমাকে নিজের করে একটু ছুঁয়ে দেয়ার লোভে। আমার পুরুষত্ব পু ড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে তোমাকে পাবার আশায়। এই কথা তোমার কাছে স্বীকার করতে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। আমি চাই তোমাকে, নিজের সবটুকু জুড়ে।

চিত্রেলেখার কি হলো কে জানে। আচমকাই নিজের কম্পিত দেহটা সে রওনকের উপর ছেড়ে দেয়। বুঝতে পেরে রওনক ওখানেই থেমে যায়। হয়ত আচমকাই বেশি হয়ে যাচ্ছে ভেবে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে কিন্তু তার চেষ্টা বিফলে যায়। রওনক অনুভব করে তার চন্দ্রলেখা হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। আনন্দে রওনকের পেটের ভেতর প্রজাপতি উড়তে আরম্ভ করেছে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে রওনক বলে,

-ইটস ওকে চন্দ্র, আমার কোনো তাড়া নেই। ইউ ক্যান ট্যাক টাইম। আমরা আস্তেধীরে আগাবো না হয়।

রওনকের কথা শুনে আরও বেশি লজ্জা করছে চিত্রলেখার। মাথা তুলে তাকাতেই পারবে না যেনো আর। চিত্রলেখার হাতের বাঁধন আলগা হলে রওনক ছোট্ট করে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,

-আমরা কি আজ কথা বলেই পেট ভরে ফেলবো? বিকেলের পর কিচ্ছু খাওয়া হয়নি আমার। খিদে পেটের ভেতর যুদ্ধ চলছে বউ।

রওনকের কথা শুনে চিত্রলেখা চোখ বড় করে তাকায়। চিত্রলেখার মুখের আচমকা পরিবর্তন দেখে হাসি পায় রওনকের। চিত্রলেখা বলে,

-আমি এক্ষুনি খাবার দিচ্ছি।

চিত্রলেখাকে ব্যস্ত হতে দেখে রওনক বলে,

-ইটস ওকে, তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও আমি বলছি আমাদের ডিনার লাগাতে। খাবার সার্ভ করতে করতে তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো কেমন?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। আর অপেক্ষা না করে দ্রুত বাথরুমের দিকে আগায় সে। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি আবজাব ভেবেছে অথচ মানুষটা না খেয়ে আছে সেদিকে খেয়ালই নেই তার। মনে মনে নিজেকে গালমন্দ করে চিত্রলেখা নিজের এমন দায়িত্বহীন কাজের জন্য। এমন বেখায়ালি তো সে কখনোই ছিল না তাহলে আজ কি হয়েছে তার? এই সব কি রওনকের প্রভাব? রওনককে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছে না যেনো চিত্রলেখা।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রাতের ঐ ঘটনার পর রওনকের সামনে দাঁড়াতেও লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে মন চাইছে চিত্রলেখার। জীবনে এর আগে কখনো সে এত লজ্জার সম্মুখীন হয়নি। এই ধরনের লজ্জার মুখে যে একদিন তাকেও পরতে হবে তা চিত্রলেখা তার অবচেতনেও ভাবেনি কখনো। মানুষের জীবন আসলেই তার চিন্তা ভাবনার উর্ধে। যা কখনো চিত্রলেখা নিজের জন্য চিন্তা করেনি, চায়নি আজ না চাইতেই সব পাচ্ছে। আবার আচমকা এত কিছু পেয়ে ভয়ও লাগছে বুকের ভেতর কোথায় একটা এই ভেবে এত সুখ তার কপালে সইবে তো শেষপর্যন্ত? নাকি অজানা কোনো তুফান এসে তার জীবনের এত সুখ সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে! এসব ভাবলেই অস্থিরতায় চিত্রলেখার বুকের ভেতরটা একটা অজানা ভয়, শঙ্কায় কেমন কেঁপে ওঠে। তবু চিত্রলেখা নিজেকে সামলে নেয়। এমনিতেও তার জীবনটা এই পর্যন্ত মসৃণ ছিল না তাই ভবিষ্যৎ টাও যে অনেক বেশি মসৃণ হবে তা সে খুব একটা আশা করে না। হলে ভালো নাহলেও সে ভয় পাবে না, শক্ত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। তার তো কেবল নিজের কথা ভাবলে চলবে না।

আজ রাতে বাসায় পার্টির আয়োজন করেছে রওনক, নিজের বিয়ে উপলক্ষে। কাছের একান্তই পরিচিত ও আপন জনদের সঙ্গে চিত্রলেখার পরিচয় করিয়ে দিতে চায়। একটু আগেই জাহানারা এসে জানিয়ে গেছে টেবিলে নাস্তা দেয়া হয়ে গেছে সবাই ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। রওনক তৈরি হয়ে টাই হাতে বেরিয়ে আসে। চিত্রলেখার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে টাই টা এগিয়ে দিয়ে বলে,

-আজও কি আমায় বলে দিতে হবে কীভাবে টাই বাঁধতে হয়?

কেবল মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা, মুখে কিছু বলে না। রওনকের টাই বাঁধতে ব্যস্ত চিত্রলেখা মুখ তুলে না তাকালেও বেশ অনুভব করতে পারছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দৃষ্টি তার দিকে স্থির হয়ে আছে। তাকাবে না তাকাবে না করেও একবার চোখ তুলে তাকায় চিত্রলেখা কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়। তৎক্ষণাৎই আবার চোখ সরিয়ে নেয় সে। তা দেখে রওনকের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। চিত্রলেখার টাই বাঁধা হয়ে গেলে সে পেছন দিকে সরে যেতে চেষ্টা করলে আচমকাই হাত বাড়িয়ে রওনক চিত্রলেখার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের বাহুবদ্ধ করে নেয়। রওনকের আচমকা কান্ডে অবাক না হয়ে পারে না চিত্রলেখা। আচমকা স্পর্শে চিত্রলেখার শরীর জুড়ে শিহরণ খেলে যায়। নিজেকে কাহিল লাগে চিত্রলেখার। ইচ্ছা করে নিজ দেহের সবটুকু রওনকের উপরে ছেড়ে দিতে। কিন্তু অজানা লজ্জা, শঙ্কায় ইচ্ছা করলেও এমনকাজ করতে পারে না সে। নিজেকে সামলে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়েই রওনকের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কেবল। রওনকও কিচ্ছুক্ষণ সময় নেয়। যা বলতে চায় তা বলার আগে খানিকটা সময় চোখের পিপাস মিটায়। রওনকের ঐ গভীর চোখের চাহনিতে প্রথমে হারিয়ে গিয়েছিল চিত্রলেখা তারপর আচমকাই হদিশ ফিরে পেয়ে রওনকের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলে রওনক বলে,

-একটু চোখ ভরে তোমায় দেখতে দাও প্লিজ। এভাবেই থাকো কিছক্ষণ আমার কাছে।

ইশ! রওনকের এই প্রতিটা আবদারের শেষে প্লিজ বলাটা চিত্রলেখার গায়ে কাটা দেয়। ভাইবোনেরা কখনোই কোনোকিছুর জন্য সেভাবে আবদার করেনি তার কাছে কিন্তু এই মানুষটা জীবনে আসার পর থেকে আবদারের বহার বসিয়ে দিয়েছে। তার সব আবদার যেনো এই এক চিত্রলেখার কাছেই। তারউপর তার বলার ধরণ। অমন করে বললে কেউ না করতে পারে কখনো? আর কেউ পারলেও চিত্রলেখা কখনো পারবে না। নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার আর চেষ্টা করে না, চুপ করে নিজেকে রওনকের বাহুবন্ধনেই ছেড়ে দেয়। বেশ কিচ্ছুক্ষণ এক মনে চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ওভাবে থেকেই রওনক বলে,

-আজ বাসায় পার্টি আছে।

সতর্ক হয় চিত্রলেখা। জানতে চায়,

-কিসের পার্টি?

-তোমার ওয়েলকাম পার্টি।

-আমার জন্য!

চিত্রলেখা যে অবাক হয়েছে তা তার চোখ মুখে স্পষ্ট। অবাক না হয়ে কি পারা যায়? তাকে ওয়েলকাম করার জন্য পার্টি দেয়া হচ্ছে এসবও এই জীবনে পাওনা ছিল চিত্রলেখার? স্মিত হেসে রওনক বলে,

-রওনক জামান বিয়ে করেছে এই খবর দেশবাসী জানবে না তা কি হয়?

চিত্রলেখার অবাক হওয়া যেনো বাড়লো। রওনক একটা হাত সামনে এনে চিত্রলেখার কপালের উপরে এসে পড়া চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দেয়। তার হাতটা এসে চিত্রলেখা গাল স্পর্শ করলে পরে রওনক বলে,

-তুমি এখনো বুঝতে পারছো না কার বউ হয়ে এসেছো।

চিত্রলেখা জানে সে কার জীবনে অনুপ্রবেশ করেছে কিন্তু এখনো এটা বুঝে উঠতে পারেনি রওনকের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার পরমুহূর্ত থেকে চিত্রলেখার জীবনটা ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে গেছে। এখন আর সে সাধারণ চিত্রলেখা নেই। কবুল বলে রওনকের বউ হবার পর থেকে তার জীবনটা রওনকের সাথে অতপ্রত ভাবে জড়িয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এখন সে মিসেস চিত্রলেখা রওনক জামান, যে রওনক জামানের ছবি, নিউজ প্রায় প্রতিদিনই নিউজপেপারের বিজনেস পাতায় পাওয়া যায়। এখন থেকে রওনকের পাশাপাশি চিত্রলেখার ছবিও যদি খবরের কাগজে ছাপা হয় সেটা খুব বেশি অবাক হবার মতো কোনো ঘটনা হবে না। কিন্তু এই বিষয়গুলো চিত্রলেখা এখনো ভেবেই দেখেনি। এসব তার ভাবনাতে আসেইনি। নিজের চিন্তা ভাবনার উর্ধে গিয়ে জীবন যাপন হচ্ছে তার।

রওনক বলে, আজকের পার্টিতে পরার জন্য তোমার ড্রেস, অর্নামেন্টস সব আলমিরাতে রাখা আছে। বিকালে বিউটিশিয়ানরা চলে আসবে তোমাকে সাজাতে। তুমি তৈরি হয়ে নিও। আমি একটা জরুরী কাজে যাচ্ছি, কাজ সেরে সোজা বসায় চলে আসবো পার্টির আগেই।

চিত্রলেখা কিছু বলে না। রওনকের বলা প্রত্যেকটা কথা মেনে নেয় বিনাবাক্যব্যয়ে। এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-সবাই আমাদের জন্য নাস্তা টেবিলে অপেক্ষা করছে।

-চলো যাই।

বেরিয়ে যাবার আগে রওনক আরও বলে, আমি একটা কথা ভাবছিলাম।

-কি কথা?

-আমরা দু’জন কি নিচের দিকে কোনো ফ্ল্যাটে শিফট হয়ে যাবো?

চিত্রলেখা আবারও অবাক হয় কিন্তু এবারে আর মুখ বন্ধ করে রাখে না। জিজ্ঞেস করে,

-কেনো? এখানে থাকলে কি সমস্যা?

এক মুহূর্তের জন্য চিত্রলেখা ভাবে রওনক হয়ত তাকে তার পরিবারের সঙ্গে রাখতে চায় না। কিন্তু চিত্রলেখার মনের ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে রওনক বলে,

-তুমি তো লিফটে উঠতে ভয় পাও। বাইরে গেলে বারবার সিড়ি দিয়ে ওঠা নামা করতে কষ্ট হবে। আমি চাই না তোমার কোনো কিছু নিয়ে কষ্ট হোক। আমরা সেকেন্ড ওর থার্ড ফ্লোরে শিফট হয়ে যেতে পারি। এতে করে তোমাকেও কষ্ট করে এতগুলো সিড়ি বেয়ে নাইন্থ ফ্লোরে উঠে হবে না।

-শুধু আপনি আর আমি?

-হু, শুধু আমরা দু’জনে। বাকিরা এখানেই থাকলো। দূরে তো কোথাও যাচ্ছি না। একই বিল্ডিংএ থাকবো জাস্ট ফ্লোর আলাদা।

-তারপর আপনার মা ভাববে আমি আপনাকে বশ করে ফেলেছি। আমার ইশারায় চলেন আপনি। আজ ঘর আলাদা করেছি, কাল বাড়ি আলাদা করব, এরপর হয়ত দেশও আলাদা করে ফেলবো। আপনাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবো। বা দেখা গেল আপনার সম্পত্তি বাগিয়ে নিলাম।

-কি যাতা বলছো এসব!

-আপনার কাছে যাতা লাগলেও বাকিরা এমনটাই ভাববে। একবার ভেবে দেখুন তো অন্যদের দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা একটা মেয়ে আমি, আপনার অফিসে চাকরী করেছি। সবাই কি ভাববে জানেন? চাকরী বাহানা ছিল। চাকরী করতে গিয়ে বড়লোক বসকে ফাঁসিয়েছি আমি। ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছি তার টাকা-পয়সার লোভে। কেউ বিশ্বাসই করবে না স্বয়ং রওনক জামান আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কেউ কেউ হয়ত ভাববে আপনার টাকার লোভে বিয়ের আগেই এক বিছানার আপনার সঙ্গে…

রওনক তৎক্ষণাৎ চিত্রলেখার মুখে হাত রাখে। এসব শুনতে চায় না সে। রওনক জানে চিত্রলেখা কি বুঝাতে চাইছে, বলতে চাইছে। সে নিজেও জানে তার পরিবার, আত্মীয় মহল তাদের এই বিয়েটাকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিবে না কিন্তু এতে রওনকের কিচ্ছু যায় আসে না। তবে সে ভুলেও ভাবেনি চিত্রলেখা তার মস্তিষ্কের ভেতর এসব ভাবনা পালছে। চিত্রলেখার মুখ চেপে ধরে রওনক চেঁচিয়ে ওঠে,

-জাস্ট শাটআপ চন্দ্র।

নিজের মুখ থেকে রওনকের হাত সরিয়ে দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আমি না হয় চুপ করে গেলাম কিন্তু অন্যদের তো আপনি আটকাতে পারবেন না। বাকিরা ঠিকই এমনটাই ভাববে। এর চাইতে জঘন্য কিছু ভাববে।

রওনক শক্ত হাতে চিত্রলেখার বাহু ধরে তার চোখে চোখ রেখে বলে,

-কে কি ভাবছে বা ভাববে তাতে আমি রওনক জামানের কিচ্ছু যায় আসে না। আই ডন্ট গিভ এ ফা ক টু দেয়ার থিংকিং, অল আই কেয়ার জাস্ট হোয়াট ইউ থিংক আবাউট আজ বিইং টুগেদার।

ডান হাতটা চিত্রলেখার গালে রেখে রওনক আরও বলে, প্লিজ তুমি অন্তত এভাবে ভেবো না আই রিকুয়েষ্ট টু ইউ। তুমি না চাইলে আমরা কোথাও যাবো না, এখানেই থাকবো। আই প্রমিজ বাট স্টপ থিংকিং লাইক দ্যাট।

চিত্রলেখা এই প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ায় না। বরং নিজের কন্ঠের স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বলে,

-চলুন, সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

নাস্তার টেবিলে দিলারা জামান চিত্রলেখাকে দেখে আগের দিনের মতোই কোনো কথা বলেননি। রাগে উনার শরীর রি রি করছেন কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ হতে দেননি। উনি ভেবেছিলেন পথে কাটা সহজেই উপড়ে ফেলেছেন কিন্তু ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। উনার প্লান ব্যাক ফায়ার করেছে দেখে রাগ হয়েছেন। টেবিলে বসেই রওনক আগে চায়ের কাপে তৃপ্তির চুমুক দেয়। তা দেখে সভাবশুলভই চিত্রলেখার মুখ ফোঁসকে বেরিয়ে আসে,

-খালি পেটে আগেই চা খাচ্ছেন কেনো? এসিডিটি হয়ে যাবে তো। আগে নাস্তা করুন, পরে চা খাবেন।

কথা শেষ করতেই চিত্রলেখা লক্ষ করে রওনক অদ্ভুত এক হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে চোখের ইশারায় চিত্রলেখা জানতে চায় কি? রওনক কিছু বলে না। হেসে কেবল চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে। ততক্ষণে চিত্রলেখা খেয়াল করে অন্যরা সবাই এখানেই উপস্থিত আছে। টের পেয়েই লজ্জা পেয়ে যায় সে। তানিয়া টিটকারির সুরে বলে,

-দেখলে জাহানারা খাল এতদিনে রওনক জামানকে শাসন করবার মানুষ চলে এসেছে।

তানিয়ার টিটকারি শুনে মুখ চেপে হাসেন জাহানারা। তবে এটাও লক্ষ করেন দিলারা জামান মোটেও এসব পছন্দ করছেন না। আপাতত আর কাউকে তোয়াজ করবে না তানিয়া। তার জীবনের লম্বা একটা সময় নষ্ট হয়েছে। তাই এই মুহূর্তে শাশুড়ির পছন্দ অপছন্দকে আমলে নেয় না সে।

আজকের নাস্তায় রুটি সবজি ডিম পোচ, মালেট, সেদ্ধ হয়েছে। সাধারণত ঘি দিয়ে ভাজা মচমুচে পরোটা বানানো হয়। আজ ঘি ছাড়া রুটি দেখে দিলারা জামান জিজ্ঞেস করেন,

-কিরে জাহানারা পরোটা করিসনি কেনো?

আজ রুটি করার আইডিয়াটা চিত্রলেখার ছিল। সেই জাহানারকে বলেছিল সবার জন্য রুটি করতে শুধু মিম, মিশকাতের জন্য ঘি দিয়ে পরোটা হবে। চিত্রলেখার নাম শুনলে খুশি হবেন না তা বুঝতে কিছু বাকি নেই কারো। তাই জাহানারা চিত্রলেখার নাম না নিয়ে বলেন,

-ঐ ভাবলাম সবসময় তো পরোটাই খাওয়া হয় তাই আজ…

জাহানারাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-মা, আমিই ফুপিকে বলেছি আজ সবার জন্য রুটি করতে। পরোটাও হয়েছে তবে মিম, মিশকাতের জন্য। বাকি আপনাদের সবার জন্য রুটি করিয়েছি।

চিত্রলেখার দিকে তাকানোও না তিনি। জাহানারার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

-কিরে জাহানারা আমি কি মরে গেছি নাকি যে আমার বাড়ির নাস্তায় কি বানানো হবে সেই সিদ্ধান্ত বাইরের মানুষ নিচ্ছে। নাকি তোরা ভাবছিস আমি সংসারের হাল ছেড়ে দিয়েছি?

দিলারা জামানের সূক্ষ্ম খোঁচাটা ঠিকই টের পায় চিত্রলেখা। রওনক যেনো কিছু না বলে সেজন্য আগেই তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখে। জাহানারাকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলে চিত্রলেখা নিজেই শাশুড়িকে জবাব দিয়ে বলে,

-সরি মা, আমার আপনাকে জিজ্ঞেস করে নেয়া উচিত ছিল। আপনারা সবাই ব্যস্ত কারো নিজের ডায়েটের দিকে খেয়াল নেই। আপনার ডায়াবেটিক্স আছে সেই সঙ্গে হাই প্রেসার, ভাবী এমনিও ডায়েটে থাকেন, আর উনি তো সবসময় চা বেশি খায় এতে এসিডিটির সমস্যা হতে পারে। তাই সবার দিক বিবেচনা করে ভাবলাম প্রতিদিন প্রতিদিন ঘি দিয়ে ভাঁজা পরোটা খেলে সবারই স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে। মিম, মিশকাত ছোট ওদের এক্সট্রা এনার্জি দরকার তাই ওদের জন্য ঘি দিয়ে পরোটা হবে। অতিরিক্ত জ্যাম পারুটি খেলে ওদের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাবে। তাই সবার ডায়েটের দিকে খেয়াল রেখেই নাস্তার ম্যেনুতে পরিবর্তন এনেছি।

দিলারা জামানের রাগ বেড়েই চলেছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,

-তুমি কি ডায়েটিশিয়ান হয়েছো নাকি?

-ডায়েটিশিয়ানের ডিগ্রি নেই তবে কার জন্য কোনটা ভালো সেটুকু জানি।

-আমার ভালো আমি জানি, বাইরের কাউকে আমার ভালো মন্দ ভাবতে হবে না।

এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও রওনকের পক্ষে আর চুপ করে শুনা সম্ভব নয়। এবার আর চিত্রলেখাকে সুযোগ না দিয়ে রওনক বলে,

-ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন তুমি যাকে অলরেডি দু’বার বাইরের লোক বলেছো সে আসলে কিন্তু বাইরের লোক নয়। আমার ওয়াইফ, এই বাড়ির বউ। তবে একটা কথা ভুল বলোনি, আমার মনে হয় এখন তুমি সংসারের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা নিতে পারো। তোমাকে রিপ্লেস করার সঠিক মানুষ এসে গেছে। ইউ ক্যান বি রিল্যাক্স নাও। মিহোয়েল মাই ওয়াইফ ক্যান টেকঅফ অল ইউর রিসপন্সিব্লিটিস।

ছেলের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারেন না রওনক। চোয়াল শক্ত করে দিলারা জামান বলেন,

-কি বলতে চাইছিস তুই? একটা পরিচয়হীন রাস্তার মেয়ের হাতে আমি আমার এত যত্নে গড়া সংসার ছেড়ে দিবো?

রওনক আর নিতে পারছে না। এমনিও আগের দিনের ঘটনা সে ভুলে যায়নি। শুধুমাত্র চিত্রলেখার অনুরোধের কাছে চুপ করে আছে সে। নয়ত এতক্ষণে এই বাড়িতে তুফান ডেকে ফেলতো সে। কিন্তু এই মুহূর্তে যা হচ্ছে এসবও আর মুখ বুজে সহ্য করবে না সে। হাতের মুঠো অলরেডি শক্ত হয়ে গেছে তার যা চিত্রলেখার দৃষ্টি এড়ায়নি।

-ইনাফ…

এই একটা শব্দের বেশি বলতে পারে না রওনক। সে আর কিছু বলে এর আগেই চিত্রলেখা তার মুঠো বদ্ধ করা হাত চেপে ধরে খানিকটা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে নিচু কন্ঠে বলে,

-বাচ্চারা দেখছে প্লিজ।

মিম, মিশকাতের দিকে তাকিয়ে রওনক থেমে যায়। নিজের রাগ চেপে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করে। এতক্ষণে দীদার এমন কঠিন আচরণ দেখে ওদের দু’জনেরই চোখ বড় হয়ে গেছে। এর আগে কখনো ওরা ওদের দীদাকে এভাবে রাগ করতে দেখেনি। চিত্রলেখা এমন ভাব করে যেনো কিছুই হয়নি। মিম, মিশকাততে দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,

-জলদি দু’জন লক্ষি বাচ্চার মতোর গ্লাস খালি করে ফেলো তো দেখি। আজ মিমি তোমাদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসবে।

চিত্রলেখার কথার মাঝে তানিয়া বলে,

-আজ ড্রাইভারই ওদের নামিয়ে দিয়ে আসুক তুমি বাসায় থাকো। রাতে পার্টির জন্য আমি পার্লারের এপেয়ন্টমেন্ট নিয়েছি আমাদের দু’জনের জন্য। ওরা চলে আসবে একটু পরেই।

অবাক হয়ে চিত্রলেখা বলে,

-এত জলদি? পার্টি তো রাতে।

-ওরা আসবে আমাদের ফেশিয়াল, মেনিকিউর, পেডিকিউরের আর এক্সেটরা করতে। বিকেলে বিউটিশিয়ানরা আসবে তোমার ম্যাকভারের জন্য।

মুখটা ছোট্ট করে ও করে চিত্রলেখা কিন্তু কোনো শব্দ করে না। আর কেউ কোনো কথা বলেনি। রওনকের চায়ের কাপ খালি হলে চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে বলে,

-আরেক কাপ প্লিজ।

এটা রওনকের তৃতীয় কাপ চা চলছে। নাস্তা করতে করতেই দু’কাপ চা খেয়েছে সে। চিত্রলেখা আপত্তি করে না। রওনক সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে মিম, মিশকাতের নাস্তা করা ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। দু’জনকেই বলে,

-তোমরা ব্যাগ নিয়ে আসো আজ চাচ্চু তোমাদের স্কুল দিয়ে আসবে।

চাচ্চুর কথা শুনার সঙ্গে সঙ্গেই দু’জনে নিজেদের ঘরের দিকে দৌড় লাগায় স্কুল ব্যাগ আনতে। রওনক চায়ের কাপে লাস্ট চুমুক দিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। তারপর সবাইকে বিশেষ করে চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে বলে,

-মিসেস দিলারা জামান, গতকাল আপনি একটা ঘটনা ঘটিয়েছেন। ভেবেছেন কেউ কিচ্ছু টের পাবে না। কিন্তু আপনি হয়ত ভুলে গেছেন এই বাড়ির দেয়ালেরও কান আছে আর এসব দেয়ালেরা আমার কাছে সব রিপোর্ট পৌঁছে দেয়। এই বাড়িতে কেউ কাশলেও সেটা আমার পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

দিলারা জামান একবার জাহানারার দিকে তাকান। রওনক বলতে থাকে,

-আমার ওয়াইফ চায় না এই বিষয়ে আমি আপনাকে কাউন্টার দেই তাই বেশি কিছু বলবো না শুধু এতটুকু বলবো এরপর এমন কিছু করার আগে একটু চিন্তা ভাবনা করে নিলে আমি খুশি হবো। আমার ওয়াইফকে মাত্র এক কোটি টাকার চেক দেয়ার আগে আপনার ভাবা উচিত ছিল কাকে কি দিচ্ছেন। যে নিজেই কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক তাকে এক কোটি টাকা দেয়াটা নেহাৎ হাস্যকর নয়কি? আশাকরি এরপর এমন চাইল্ডিস কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন।

চিত্রলেখা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। রওনকের ইচ্ছা করছিল সে আরও অনেক কিছু বলে কিন্তু তার চন্দ্র তাকে অনুরোধ করায় এর বেশি আগায়নি সে। নয়ত তার চন্দ্রকে অপমান করার জন্য নিজের মাকেও ছেড়ে কথা বলতো না সে। বউয়ের চোখ থেকে হাসি পেয়ে যায় রওনকের। সকলের উপস্থিতিতেই এক কদম কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে বলে,

-আমার একটা জরুরী মিটিং আছে। ওটা শেষ করেই চলে আসবো।

চিত্রলেখা কেবল মাথা ঝাঁকায়।

মিম, মিশকাত তাদের স্কুল ব্যাগ নিয়ে ফিরে এলে রওনক দু’জনকে দু’হাতে ধরে আসছি বলে দরজার দিকে আগায়। চিত্রলেখাও ওদের সঙ্গে গেইট পর্যন্ত আসে। রওনককে গেইটের কাছে আসতে দেখে তার ড্রাইভার এগিয়ে আসলে বাচ্চাদের এগিয়ে দিয়ে বলে,

-তোমরা নামো আমি আসছি।

ড্রাইভার বাচ্চাদের নিয়ে লিফটে উঠে গেলে রওনক চিত্রলেখার দিকে তাকায়। রওনকে আচমকা এভাবে তাকাতে দেখে নার্ভাস হয় চিত্রলেখা। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে,

-আপনার জন্য চা দিয়ে দিয়েছি।

চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বউয়ের গালে আলতো চুমু খেয়ে রওনক বলে,

-থ্যাংকিউ লাভ।

চিত্রলেখা চোখ বড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে অবাক হওয়া অবস্থায় রেখেই হাসি হাসি মুখ করে বেরিয়ে যায় রওনক। দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই একবার ঢোক গিলে চিত্রলেখা। আচমকাই অসম্ভব গরম লাগছে তার। নিজের গালে হাত রাখলে টের পায় পুরের যাচ্ছে যেনো সব রেখে কেবল রওনকের ঠোঁট যে জায়গাটা স্পর্শ করেছে সেখানেই জ্বর এসেছে তার। সেই সঙ্গে তার বুকের ভেতর তবলা বাজচ্ছে। এইসব অনুভূতি নিয়েই ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে চিত্রলেখা যতক্ষণ না তানিয়ে এসে ডাক দেয় তাকে। তানিয়ার ডাকেই চেতন ফিরে পায় সে।

-কি ভাবছো? অনিথিং রং?

মুখ দিয়ে কথা বের হয় না চিত্রলেখা কেবল মাথা ঝাঁকায় সে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৫৪+৫৫

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৪
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনক এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তার চন্দ্রলেখাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। তার কান্ডে একদম বোকা বনে যায় চিত্রলেখা। এমন কিছুর জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না সে। রওনক এই পর্যন্ত চলে আসবে তার জন্য সেটাই তো আশা করেনি সেখানে জড়িয়ে ধরা তো দূরের কথা। রওনক কোনো কথা বলে না। নিঃশ্চুপ আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখে কেবল প্রিয়তমাকে। রওনকের বুকের ধুক ধুক কম্পন চিত্রলেখা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে। এতখানি কাছাকাছি আছে দু’জনে যে একে-অপরের প্রতিটা হৃৎস্পন্দন টের পাওয়া যাচ্ছে।

রওনক চিত্রলেখাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। বেচারি চিত্রলেখা রওনকের বাহু বন্ধনে প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিল। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গিয়েছিল তার। খানিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ধাতস্থ হয় সে। ততক্ষণে কে এলো দেখার জন্য ভেতর ঘর থেকে ড্রইং রুমের দিকে এগিয়ে এসেছে আফিফা। কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন মানুষের একে-অপরকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখার দৃশ্য দেখে সে ড্রইং রুমের দরজায়ই দাঁড়িয়ে পড়ে আর এদিক এগিয়ে আসে না। মূলত বিরক্ত করতে চায় না বলেই তার থমকে যাওয়া। সন্তপর্ণে পর্দা টেনে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ততক্ষণে আফিফার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে চিত্রলেখা। অন্যদিকে রওনকের কোনো বাস্তবতার খেয়াল নেই। সে যেনো তার প্রিয়তমাকে ছাড়তে রাজি নয়। বাহু আলগা হলেই যেনো ফাঁক গলে চিত্রলেখা হারিয়ে যাবে খাঁচা ভেঙে পালিয়ে যাওয়া পোষ না মানা পাখির মতো। বান্ধবীর উপস্থিতি টের পেয়েই সচিকত হয় চিত্রলেখা কিন্তু তৎক্ষনাৎই দু’হাতে ঠেলে রওনককে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে না। মানুষটা যেভাবে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে তাকে, ততে করে চেষ্টা করলেও নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে বলে মনে হয় না চিত্রলেখার। কিন্তু বুঝতে পারে সে কিছু একটা হয়েছে। অন্যথায় এমন হুটহাট জড়িয়ে ধরবে কেনো মানুষটা তাকে? পরমুহূর্তেই আবার খেয়াল হয় বিয়ে করে নিয়ে যাবার পর থেকে নিজের যে রূপের বহিঃপ্রকাশ করছে মানুষটা তার সামনে। এই লোককে দিয়ে এমন কান্ড আহামরি বড় বিষয় না। তবুও কোথায় গিয়ে যেনো চিত্রলেখা একটা অদৃশ্য খটকা অনুভব করতে পারে। তার অবচেতন মনে সন্দেহের জাগরণ ঘটে। মানুষটা পুরোপুরি ভালো নেই। কিছু তো একটা হয়েছে। আরও খানিকটা সময় দেয় চিত্রলেখাকে রওনককে যাতে করে সে নিজে থেকেই স্বাভাবিক হতে পারে৷ কিন্তু মনে হচ্ছে না রওনক আজ আর তাকে ছাড়ার কোনো পরিকল্পনা করছে। এভাবে তো সারারাত দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাই ওভাবে রওনকের বুকে থেকেই চিত্রলেখা মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-আপনি ঠিক আছেন? কি হয়েছে আপনার?

চিত্রলেখার কথায় যেনো বাস্তবতার হদিস হয় রওনকের। এতক্ষণ তার মন, মস্তিষ্ক কোনোটাই যেনো এখানে উপস্থিত ছিল না। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই চিত্রলেখার মুখটাও সে ঠিকঠাক দেখেনি তবে তার উপস্থিতি অনুভব করেছে। এতেই প্রিয়তমাকে নিজের আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিয়েছে এক মুহূর্ত অন্যকিছু চিন্তা না করে। তার দেহটা এখানে উপস্থিত থাকলেও সে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিল চিত্রলেখার আলিঙ্গনে। চিত্রলেখাও যে তাকে তাল দিয়ে জড়িয়ে ধরবে এতখানি অবশ্য আশা করেনি রওনক।

রওনকের হদিস হলেও সে চিত্রলেখাকে নিজের বাহু থেকে আলগা করে না। ওভাবে জড়িয়ে রেখেই জিজ্ঞেস করে,

-তুমি আমাকে ছেড়ে চলে আসছো কেনো?

রওনকের কথায় কোথায় যেনো খটকা লাগে চিত্রলেখার। ছেড়ে চলে আসছে এর মানে কি? সে কখন তাকে ছেড়ে চলে আসলো? রওনকের কথার আগাগোড়া ধরতে পারে না চিত্রলেখা। কিন্তু এই কথা ক্লিয়ার হওয়া প্রয়োজন। সবে মাত্র শুরু হওয়া একটা সম্পর্কের শুরুতেই কোনো ভুল বুঝাবুঝিকে স্থান দিতে চায় না চিত্রলেখা। এবারে নিজেকে রওনকের বাহুর বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা চালায় সে। তা টের পেয়ে রওনক বলে,

-আই ওন্ট লিভ ইউ।

-প্লিজ ছাড়ুন আমাকে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

চিত্রলেখার দমবন্ধ হয়ে আসছে শুনে ইচ্ছা না থাকা স্বত্তেও নিজের বাহু আলগা করে রওনক। চিত্রলেখাকে ছেড়ে দিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। রওনকের মুখের দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গেই চিত্রলেখার বুকের ভেতর কিছু একটা হলো। এই কিছু একটা কি তা সে জানে না। মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে অদৃশ্য এক সুখানুভূতি খেলে যায় চিত্রলেখার হৃদয়ের ভেতর তার নিজের অজান্তেই। এক মুহূর্ত রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর নিজেকে সামলে নেয় চিত্রলেখা। হাত বাড়িয়ে রওনকের একটা হাত ধরে সে। চিত্রলেখার বাম হাতটা রওনকের ডান হাত স্পর্শ করতেই আহ! মূলক ব্যথা পাবার শব্দ করেও তৎক্ষনাৎই আবার মুখ বন্ধ করে নেয় সে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেয়ালে হাত বারি দিয়েছিল রওনক। সেজন্যই তার হাতে ব্যথা যা রওনক টেরও পাচ্ছে না এখন। এই মুহূর্তে তার জন্য সকল ব্যথা বেদনার উর্ধ্বে হচ্ছে তার চন্দ্রলেখা। রওনককে শব্দ করতে দেখে আগ্রহ ভরে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-কি হয়েছে?

-নাথিং।

এক সেকেন্ড রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার সেই আগের জায়গায়ই হাত ধরে চিত্রলেখা। এবারে আর ব্যথা পেলেও শব্দ করে না রওনক, গিলে ফেলার চেষ্টা করে। চিত্রলেখা রওনকের হাত ধরে তাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গিয়ে ড্রইং রুমের সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলে,

-চুপচাপ এখানে বসে থাকুন আমি আসছি।

চিত্রলেখার এমন স্বাভাবিক আচরণে খানিকটা অবাক হয় রওনক তবে তার ভালোও লাগে। ভালো লাগায় ভেতরটা আচ্ছন্ন হতে থাকে।

দ্রুত পা ফেলে কিচেনে চলে যায় চিত্রলেখা। ফ্রিজ থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে জলদিই ফিরে আসে। পানির গ্লাসটা রওনকের দিকে এগিয়ে দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-পানিটা খান।

রওনক আপত্তি করে না। হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিয়ে একটানে সবটুকু পানি খেয়ে গ্লাস ফাঁকা করে। ফাঁকা গ্লাস রওনকের হাত থেকে নিতে নিতে চিত্রলেখা বলে,

-এভাবে একবারে পানি খেতে নেই। তিনবারে খেতে হয় জানেন না?

রওনক কোনো কথা বলে না। চুপচাপ চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়। চিত্রলেখাও চুপ করে থাকায় ড্রইং রুমে স্তব্ধতা বিরাজমান। এই নীরবতা ভেঙে চিত্রলেখাই জিজ্ঞেস করে,

-আপনি বাসায় যাননি?

রওনকের গায়ে এখনো সকালের পরিধানের কাপড় দেখে চিত্রলেখা ভাবে সে হয়ত বাসায় যায়নি সারাসরি এখানে চলে এসেছে। রওনক কোনো জবাব দেয় না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রয় চিত্রলেখার মুখের দিকে। তা দেখে খানিকটা অস্থির লাগে চিত্রলেখার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চিত্রলেখাই জিজ্ঞেস করে,

-আপনি জানলেন কীভাবে আমি এখানে আছি?

এবারেও জবাব দেয় না রওনক।

-কথা বলছেন না কেনো? কখন ফিরেছেন আপনি? আমাকে ফোন করেননি কেনো?

চিত্রলেখা যে জবাব না পেয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছে তা তার কন্ঠে স্পষ্ট। বিষয়টা ভালো লাগছে রওনকের। বিয়ে করে নিয়ে যাবার পর থেকে যে মেয়েটা প্রয়োজনের বাইরে বাড়তি একটা শব্দও বলেনি তার সঙ্গে অথচ এখন অনর্গল প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করে যাচ্ছে তাকে। চিত্রলেখা তাকিয়ে আছে রওনকের মুখের দিকে। তাদের দৃষ্টি একে-অপরে সীমাবদ্ধ। আচমকাই রওনকের নরম দৃষ্টি খানিকটা শক্ত হয়। নিজের ঘরে দেখে আসা চেকটার কথা মনে পড়ে যায় তার। চিত্রলেখাকে দেখে সব ভুলে গিয়েছিল সে কিছুক্ষণের জন্য। দৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে চোয়ালও শক্ত হয় রওনকের খানিকটা। চিত্রলেখার উপর নয়, নিজের মায়ের উপর। হাতের মুঠো শক্ত করে এবারে রওনক পাল্টা প্রশ্ন করে চিত্রলেখাকে,

-হোয়াই ডিড ইউ লিভ মি?

-মানে?

-বাড়ি ছেড়ে আসছো কেনো তুমি?

-বাড়ি ছেড়ে!

বিড়বিড় করে চিত্রলেখা। সে কখন বাড়ি ছেড়ে আসলো? তাকে বাইরে যাবার পারমিশন তো সকালে রওনক নিজেই দিয়ে গেল। তাহলে এখন এমন করছে কেনো কিছুই বুঝতে পারে না বেচারী। চিত্রলেখাকে চুপ করে থাকতে দেখে রওনক তাড়া দেয়।

-এন্সার মি। কে তোমাকে সাহস দিলো আমাকে ছেড়ে আসার? (রওনকের কন্ঠে রাগ, উৎকন্ঠা খানিকটা ভয় ও অসহায়ত্বও টের পায় চিত্রলেখা।)

-আমি আপনাকে ছেড়ে আসিনি।

মিনমিনে সুরে জবাব দেয় চিত্রলেখা। তা শুনে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-তাহলে এখানে কি করছো তুমি?

-আপনিই তো সকালে আসতে বলেছিলেন।

-আমি?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। রওনক সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে তাকালে চিত্রলেখা পরিষ্কার করে বলে,

-আপনিই তো সকালে বলেছিলেন আমি চাইলে বের হতে পারি। তাই…

এবারে খেয়াল হয় রওনকের সে নিজেই সকালে বলে গিয়েছিল চিত্রলেখা চাইলে বের হতে পারে। ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা করে আসতে পারে। চিত্রলেখা তাকে ছেড়ে চলে গেছে এই ভাবনা মস্তিষ্কে উদয় হতেই বাকি সব ভুলে গিয়েছিল সে।

রওনক বলে, কিন্তু তুমি তো তোমার খালার বাসায় যাওনি। কেনো যাওনি?

-বিয়ের পর প্রথমবার বাবার বাড়ি যেতে হয় বরকে সঙ্গে নিয়ে। আপনাকে ছাড়া আমি একা গেলে ওরা সবাই হয়ত আপনাকে ভুল ভাবতো।

-যেমন?

-ভাবতো আমরা গরীব তাই হয়ত আপনি ওটা নিজের শশুরবাড়ি বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করছে তাই আমার সঙ্গে যাননি। আর…

বাকিটুকু না বলেই চুপ করে যায় চিত্রলেখা। রওনক আঁচ করতে পেরে নিজেই বলে,

-আর তুমি চাও না তোমার ভাইবোনেরা আমায় ভুল বুঝুক, তাই তো?

দ্রুত মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। সেই সঙ্গে মুখটাও নিচের দিকে করে রেখেছে সে। এতক্ষণে খানিকটা হাসি ফুটে ওঠে রওনকের মুখে। তবুও আর কিছুটা ক্লিয়ার হওয়া দরকার তার। তাই জিজ্ঞেস করে,

-আমি তো তোমায় বলেছিলাম সন্ধ্যের আগে বাসায় ফিরে যেতে। যাওনি কেনো?

-আসলে…

চিত্রলেখার অবশ্য এখানে কোনো দোষ নেই৷ সব দোষ আফিফার। আফিফাই তাকে আটকে রেখেছে। বিকেল গড়িয়ে পড়ার সময়ই চিত্রলেখা বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আফিফা তাকে ফিরে যেতে দেয়নি।

বিকেলের ঘটনা,

চিত্রলেখা বাড়ি ফিরার উদ্যোগ নিলে তাকে বাঁধা দিয়ে আফিফা বলে,

-আজ এখানেই থেকে যা তুই।

আফিফার এমন কথায় কেমন কেমন করে যেন তাকায় চিত্রলেখা। তার চাহনি দেখে আফিফা বলে,

-আরে তোর বর তো এখানে নেই। জরুরী কাজে শহরের বাইরে গেছে হতেই পারে সে আজ ফিরলো না। একা একা ওখানে থাকার চাইতে আজকের রাতটা নাহয় আমার কাছে থেকে যা।

-উনি বলে গেছেন ফিরে আসবেন।

-যদি কোনো কাজে আটকে যায়। তুই তো উনার সঙ্গে কাজ করেছিস। জানিস না? এর আগে কখনো এমন হয়নি একদিনের কাজে গিয়ে ২/৪ দিন আটকে যায়নি?

মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায় চিত্রলেখা। এমন হওয়াটা আহামরি অবাক হওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়। এর আগে বহুবারই এমন হয়েছে। ২ দিনের কাজে গিয়ে ৭ দিন আর ৭ দিনের কাজে গিয়ে ১৫ দিন আটকে গিয়েছিল রওনক দেশের বাইরে। আজও এমন কিছু হলে বিন্দুমাত্র অবাক হবে না সে। কিন্তু তারপরেও চিত্রলেখার মন তাকে সায় দিচ্ছে না। তার মন বলছে মানুষটা ফিরবেই। ২/৪ ঘন্টা দেরি হলেও ফিরবে। কিন্তু লজ্জায় নিজের মনের এই শক্ত মনে হওয়াটা বান্ধবীর মুখের উপর বলতে পারেনি সে।

চিত্রলেখাকে দোনোমনা করতে দেখে পরে আফিফাই বলে,

-যদি চলেও আসে তোকে না পেয়ে তো ফোন করবেই সমস্যা কোথায়? তখন না হয় চলে যাবি।

আফিফার শেষের কথাটা ভালো লাগে চিত্রলেখার। রওনক ফিরে এসে তাকে না পেলে নিশ্চয়ই ফোন করবে। তবুও মনের ভেতর খচখচানি রয়ে যায় খানিকটা। বারবার মস্তিষ্ক তাকে জানায় রওনক বলে গিয়েছিল সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফিরে যেতে। সে ফিরে এসে তাকে যেনো পায়। ফিরে এসে তাকে দেখতে না পেয়ে কি রাগ হবেন মানুষটা? নাকি কষ্ট পাবে? মনের ভেতর খচখচানি, দোনোমনা নিয়েই থেকে যায় চিত্রলেখা। যদিও থেকে যাবার মতো ইচ্ছা তার একদমই নেই তবুও আফিফার জোরের কাছে হাল ছাড়তে হয় তাকে।

থেকে যাবার কারণ বিস্তারিত খুলে বলার সঙ্গে সঙ্গে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-আপনি আমাকে ফোন করেননি কেনো? ফোন করলেই তো আমি নিজেই চলে যেতাম। আপনাকে কষ্ট করে আসতে হতো না।

-তোমার ফোন কথায়?

-আমার ফোন! ঘরেই আছে।

-কতগুলো কল দিয়েছি জানো? খবর আছে?

নিজের ফোনটা বের করে চিত্রলেখার হাতে দেয় দেখতে। কল লগে দৃষ্টি রাখতেই চিত্রলেখা দেখে রওনকের ডায়েল লগে চিত্রলেখার নাম সবার উপরে। পাশেই দেখা যাচ্ছে ৩৫ বার ডায়েল করা হয়েছে নম্বরটা। একটা হার্টবিট মিস করে চিত্রলেখা। সেই সঙ্গে একবার ঢোকও গিলে সে। তার মনে পড়ে বাবলু ঘুমাচ্ছিল বিকেলে। বাবলুর ঘুম যেনো না ভেঙে যায় তাই নিজের ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিল। সেই সাইলেন্ট জেনারেল করার কথা আর মনে ছিল না তার।

-আসার সময় কাউকে কিছু বলে আসোনি কেনো?

-বলেছি তো।

-কাকে বলেছো? খালা তো কিছু বলতে পারলেন না।

-আসলে আমি যখন বের হচ্ছিলাম তখন খালাকে খুঁজে পাইনি। অন্য একজন বলল উনি নাকি গ্রোসারি কিনতে গেছে তাই ঐ মেয়েটাকে বলে এসেছিলাম খালাকে জানাতে।

রওনক আর এই প্রসঙ্গে কথা বাড়ায় না। বরং বলে, বাসায় চলো, আমি নিতে এসেছি তোমাকে।

-এক মিনিট আমি ব্যাগ নিয়ে আসি।

চিত্রলেখা ভেতরের দিকে চলে যায়। ফিরে আসে বাবলু ও আফিফাকে সঙ্গে নিয়ে। বাড়িতে আজ আফিফার শাশুড়ি নেই। গ্রামের বাড়ি গেছেন। আফিফার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে বাবলুকে চিত্রলেখার কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে নেয় রওনক। তার এই স্বাভাবিক আচরণে মুগ্ধ হয় চিত্রলেখা। বাবলুর গালে চুমু খেয়ে রওনক বলে,

-আঙ্কেল সরি খালি হাতে চলে আসার জন্য। নেক্সট টাইম অবশ্যই আঙ্কেল আপনার জন্য অনেকগুলো গিফটস নিয়ে আসবে।

তবুও রওনকের মন আপত্তি করে। সে তার মানিব্যাগ খুলে কচকচে পাঁচটা হাজার টাকার নোট বের করে বাবলুর হাতে দেয়। এখন বাবলু সব ধরতে পারে। তাই বাবলুর হাতের মুঠোয় টাকাগুলো গুঁজে দেয় রওনক। তা দেখে আফিফা আপত্তি করার চেষ্টা করে বলে,

-প্লিজ এসবের কোনো প্রয়োজন নেই।

-একদম না, আমার আর বাবলুর মাঝে অন্যকারো হস্তক্ষেপ চলবে না আগেই বলে রাখছি। এটা দিয়ে বাবলু নিজের পছন্দ মতো যা ইচ্ছা কিনবে। তাই না বাবলু?

রওনকের কথা শুনে বাবলু এমন ভাবে হাসছে যেনো সব কথা সে বুঝতে পারছে। আফিফার দিকে তাকিয়ে রওনক আরও বলে,

-আমি একদমই টাকার গরম দেখাচ্ছি না। শো-অফও করছি না। ছোটবেলা থেকে দেখেছি নতুন মেহমানকে গিফট দিতে হয়। বাবলুকে তো আমি আজ প্রথম দেখলাম তাই সে আমার জন্য আজকেই আসা নতুন মেহমান। আমি কেবল আমার করণীয়টা করছি এর বেশি কিছু নয়।

রওনকের এত সাধারণ হওয়াটা, এত সাধারণ আচরণ চিত্রলেখাকে প্রতিমুহূর্ত কেবল মুগ্ধই করে যাচ্ছে। এইসব মুগ্ধতারা চিত্রলেখার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে।

বাবলুর গালে আরেকটা চুমু খেয়ে তাকে আফিফার কোলে ফেরত দিয়ে রওনক বিদায় নিয়ে বলে,

-আজ আসছি। অন্যদিন সময় নিয়ে আসবো।

চিত্রলেখা ভীষণ অবাক হয়েছে রওনকের এমন নরম আচরণ দেখে যে বান্ধবীর থেকে ঠিকঠাক বিদায় নেবার কথাটাও তার মস্তিষ্কে আসেনি। ডিনারের সময় হয়ে যাওয়ায় ভদ্রতা বশত আফিফা জিজ্ঞেস করে,

-ডিনারটা করে গেলে খুশি হতাম।

রওনকই জবাবে বলে, দুঃখিত আজ আপনাকে খুশি করতে পারছি না। তবে কথা দিচ্ছি আরেকদিন এসে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া করব। আফটার অল আমার একমাত্র বউয়ের বেস্ট ফ্রেন্ডের বাসা মানে আমার আরেকটা শশুরবাড়ি। জামাই আদর নিতে তো অবশ্যই আসবো।

রওনকে জবাব একা চিত্রলেখা নয় আফিফাও খুশি হয়ে যায়। চিত্রলেখা চিন্তা করে পায় না দি রওনক জামান এসব কি বলছে! তার ডিকশনারিডে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া করব এই ধরনের শব্দ, কথাও আছে! ওরা বেরিয়ে যাবার আগে আফিফা চিত্রলেখাকে জড়িয়ে ধরে নিচু আওয়াজে বলে,

-তুই আমার কথা মিলিয়ে নিস। আমি যা বললাম ঠিক তাই।

চিত্রলেখার মুখে আপাতত কথা নেই। বিষ্ময় আর মুগ্ধতায় এই মুহূর্তে কথা বলতে ভুলে গেছে সে। বিষ্মিত চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে নিয়ে আফিফার বাসা থেকে বেরিয়ে যায় রওনক৷ হাত ধরে রেখেই চিত্রলেখাকে গাড়ির সামনের সিটে বসিয়ে দিয়ে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে। রওনক গাড়ি চালানো শুরু করতেই চিত্রলেখা বলে,

-একটা প্রশ্ন করি?

চিত্রলেখার কথায় রওনক কোনো কথা বলে না কেবল পাশ ফিরে তাকায়। এতক্ষণ যে মানুষটার কথায়, ব্যবহারে মুগ্ধতায় তলিয়ে ছিল চিত্রলেখা এখন সেই মানুষটার দৃষ্টির চাহনি দেখে মিহিয়ে যায় সে। ঐ চোখের ভাষা বদলে গেছে। ওখানে কুসুম নরম যে ভাব ছিল সেটা বদলে সূর্যের কঠিন তাপ অনুভূতি দেখা যাচ্ছে। মুহূর্তেই মিহিয়ে যায় চিত্রলেখা। করতে চাওয়া প্রশ্নটা গিলে ফেলে ঢোক গিলার সঙ্গে। রওনক একটা কথাও বলে না গাড়িতে।

দু’জনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বেড রুমে, মুখোমুখি। রওনকের হাতে চেকের পাতাটা। যা দেখে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে চিত্রলেখা। রওনক এখনো কোনো কথা বলেনি। সেই যে আফিফার বাসা থেকে বেরিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে তা এখনো খোলেনি। আর এদিকে রওনকের হাতে চেকের পাতাটা দেখে চিত্রলেখা কি জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না৷ বেশ খানিকটা সময় মৌন যুদ্ধের পর নীরবতা ভেঙে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-উইল ইউ প্লিজ এক্সপ্লেইন মি হোয়াট ইজ দিজ?

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

দু’জনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বেড রুমে, মুখোমুখি। রওনকের হাতে চেকের পাতাটা। যা দেখে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে চিত্রলেখা। রওনক এখনো কোনো কথা বলেনি। সেই যে আফিফার বাসা থেকে বেরিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে তা এখনো খোলেনি। আর এদিকে রওনকের হাতে চেকের পাতাটা দেখে চিত্রলেখা কি জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না৷ বেশ খানিকটা সময় মৌন যুদ্ধের পর নীরবতা ভেঙে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-উইল ইউ প্লিজ এক্সপ্লেইন মি হোয়াট ইজ দিজ?

একবার ঢোক গিলে চিত্রলেখা। কোনো জবাব না পেয়ে রওনক চেকের পাতাটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে চিত্রলেখা আচমকাই তার একটা হাত ধরে বাঁধা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-এটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন আপনি?

-যে এটা তোমাকে দিয়েছে তাকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি এর মানে কি? তুমি তো জবাব দিবে না আমাকে তাই তাকেই জিজ্ঞেস করবো।

-না, আপনি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।

-কেনো?

চিত্রলেখা চুপ করে রয়। ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রওনক আবার বেরিয়ে যাবার জন্য সামনের দিকে কদম বাড়ালে চিত্রলেখা এবার দুই হাতে তার হাত ধরে রাখে খানিকটা শক্ত করে।

-লিভ মাই হ্যান্ড চন্দ্র৷ আই ওয়ান্ট ড্যাম এন্সার।

-আমি বলছি।

রওনক এটাই চাইছিল। মাকে গিয়ে প্রশ্ন করার আগে সে চাইছিল চিত্রলেখা নিজেই তাকে জানাক ঘটনা কি ঘটেছে। কারণ মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করলে সে যে সত্যিটা বলবে এর কোনো গ্যারান্টি নেই। নিজের মাকে রওনক সবচাইতে ভালো করে চিনে। যদিও সে জানে ঘটনা কি ঘটেছে তবুও চিত্রলেখার মুখ থেকে শুনতে চায় সে।

এবারে রওনক চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে নিয়ে বিছানায় বসায়। নিজে পাশে বসে চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-বলো আমি শুনছি।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে চিত্রলেখা বলে, সকালে মা আমাকে ডেকে ছিলেন উনার ঘরে।

-তারপর?

-এই চেকটা দিয়ে…

চিত্রলেখার মন সায় দেয় না রওনককে এসব বলতে। এসব শুনার পর নিশ্চয়ই রওনক চুপ করে বসে থাকবে না তার মতো৷ নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করবে যা চিত্রলেখা চায় না। তার জন্য মা-ছেলের ভেতর দ্বন্দ্ব হোক তা একদমই চায় না চিত্রলেখা। মা-ছেলের সম্পর্কের ভাঙনের কারণ হতে নারাজ সে। বেঁচে থাকতে চিত্রলেখার বাবা-মা তাকে এই শিক্ষা দেয়নি। দিলারা জামান যাই বলুক না কেনো চিত্রলেখা তেমন মেয়ে নয় যেমনটা উনি ভাবছেন। নিশ্চয়ই আজ নয়ত কাল উনার এই ধারণা পাল্টে যাবে, এমনটাই আশা করছে চিত্রলেখা।

চিত্রলেখা কিছু বলছে না দেখে রওনক তাড়া দিয়ে বলে, স্পিক আপ চন্দ্র।

-চেকটা দিলেন ব্যস আর কিছু না। নতুন বউকে সবাই গিফট দেয় না? এটাও গিফট।

চিত্রলেখার কথা শুনে তৎক্ষনাৎ হেসে ফেলে রওনক। যদিও এটা হাসার সময় নয় কিন্তু সে না হেসে পারে না। হাসিটা তার নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এসেছে। অবশ্য চিত্রলেখা বলেছেও একটা হাস্যকর কথা। রওনককে এভাবে হাসতে দেখে অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। বেচারী বুঝতে পারে তার মিথ্যা ধরে পড়ে গেছে। হাসতে হাসতেই চেকের পাতা চিত্রলেখার মুখের সামনে তুলে ধরে রওনক। আচমকা যেমন হাসতে শুরু করেছিল, তেমনি আচমকাই হাসি থামি দিয়ে বলে,

-এটা তোমার জন্য গিফট না আমার জীবন থেকে বের করে দেয়ার মূল্য সেটুকু বুঝাবার মতো বোধবুদ্ধি যে আমার আছে তা নিশ্চয়ই তুমিও জানো। এই চেকটা ধরিয়ে দিয়ে কি বলেছে তোমাকে? আমার জীবন থেকে বেরিয়ে যেতে নাকি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে? আর কি অফার করেছে আমার মা তোমাকে?

চিত্রলেখার জবাব দিতে হয় না। রওনক নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দিয়ে বলে, আমার জীবন থেকে চলে যাবার জন্য বলা হয়েছে নিশ্চয়ই, দূরে কোথা। আমার নাগালের বাইরে যেনো আমি তোমাকে কখনো খুঁজে না পাই।

রওনকের কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে চিত্রলেখা। সে চাইলেও এই মানুষটার কাছ থেকে সত্য গোপন করতে পারবে না। হাজার চেষ্টা করেও মিথ্যা বলতে পারে না চিত্রলেখা। বললেও ধরা খেয়ে যায়। তবে চিত্রলেখা একদমই আশা করেনি রওনক যে মাত্র দু’দিন হলো তার জীবনে এসেছে এই মানুষটাও তার মিথ্যা ধরে ফেলতে পারবে। অবাক হয় চিত্রলেখা।

রাগে রওনকের মস্তিষ্কের ভেতরের প্রতিটা শিরা উপশিরা ফেটে যাচ্ছে যেনো। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে যা খালি চোখেই দ্রষ্টব্য। রওনকের পক্ষে আর নিজের রাগ চেপে রাখা সম্ভব নয়। মায়ের রাগ-অভিমান আছে ঠিক আছে কিন্তু এমন কিছু সে একদমই আশা করেনি। এর জবাব তার চাই। মাকে প্রশ্ন করতে আবার উঠে দাঁড়ায় রওনক। কিন্তু জায়গা থেকে সরতে পারে না । সে সরে যাবার আগেই চিত্রলেখা তার হাত ধরে ফেলে। বাঁধা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-আবার কোথায় যাচ্ছেন?

-মিসেস দিলারা জামানকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি আমার ওয়াইফকে এভাবে অপমান করার মানে কি?

রওনকের ধরে রাখা হাতটা আগের চাইতে আরও শক্ত করে ধরে চিত্রলেখা বলে,

-না আপনি যাবেন না। কাউকে কোনো প্রশ্ন করবেন না দয়া করে।

-প্রশ্ন করব না? তোমাকে, আমার ওয়াইফকে ইন্সাল্ট করা হয়েছে আর আমি জবাব চাইবো না? এতটা কাপুরুষ তো আমি নই যে বসে বসে আমার বউকে অপমানিত হতে দেখবো। ইম্পসিবল।

-কেউ আমাকে অপমান করেনি। কিচ্ছু বলেনি। আপনার কাউকে…

চিত্রলেখা কথা শেষ করতে পারে না এর আগেই রওনক বলে,

-তোমাকে তোমার পরিবার তুলে কথা বলা হয়েছে। তোমার চরিত্র নিয়ে কথা বলা হয়েছে। তোমার শিক্ষা, এথিক্স নিয়ে কথা শুনানো হয়েছে আর তুমি আমাকে বলছো আমি কিছু বলবো না।

রওনক সব জানে শুনে তব্ধা খায় চিত্রলেখা। অবাক হওয়াটা চিত্রলেখার চোখ-মুখে ভেসে উঠেছে। তা দেখে রওনক বলে,

-তুমি কী ভেবেছিলে, তুমি আমাকে কিছু বলবে না আর আমি কিছু জানতেও পারবো না? এই বাড়ির দেয়ালেরও কান আছে বুঝলে? ওসব দেয়ালেরাও আমার পর্যন্ত খবর পৌঁছে দেয়। তুমি চাইলেও আমার থেকে কিছু লুকিয়ে রাখতে পারবে না, বুঝেছো? নাও লিভ মাই হ্যান্ড। আমাকে আর দায়িত্ব পালন করতে দাও।

চিত্রলখা রওনকের হাত ছেড়ে দেয় ঠিকই কিন্তু তাকে বেরিয়ে যাবার সুযোগ দেয় না। দু’হাত জোড় করে অনুরোধের সুরে মাথা নিচু করে বলে,

-আমি আপনার কাছে হাত জোড় করছি প্লিজ আপনি কাউকে আমার জন্য কিচ্ছু বলবেন না।

চিত্রলেখাকে এভাবে অনুরোধ করতে দেখে রওনকের সমস্ত রাগ পানি হয়ে গেল মুহূর্তেই। এগিয়ে এসে চিত্রলেখার জোড় করে রাখা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় রওনক। অনেকটা এক-অপরের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে দু’জনে। এবারে রওনক নিজেও মৃদু সুরেই জিজ্ঞেস করে,

-কেনো জিজ্ঞেস করবো না?

-আমি চাই না আমার জন্য আপনার মায়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক খারাপ হোক। আমি সত্যিই এমন কিছু চাই না। উনার বলা আমাকে সব কথা আমি ভুলে গেছি যখন আপনি আমার হয়ে কথা বললেন সেই মুহূর্তে আমি সব ভুলে গেছি। কারো থেকে আমার কোনো জবাব চাই না সত্যি বলছি। আমি চাই না আমার হয়ে আপনি আপনার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করুন, খারাপ ব্যবহার করুন। এসব করলেও তো তার আমার প্রতি খারাপ ধারণাই তৈরি হবে। উনি ভাববেন আমি আপনার কাছে উনার নামে নালিশ করেছি। আপনাদের ঝগড়ার জন্য আমিই দায়ী হবো। এসব দায় আমার চাই না। আপনি কাউকে কিচ্ছু বলবেন না প্লিজ রওনক।

কথা বলতে বলতেই চিত্রলেখার চোখ ভারী হয়ে গেছে, খানিকটা লালও। রওনকের মনের ভেতর তুফান চলছে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে আটকে রাখছে।

-আ…আমার বাবা-মা আমাকে খারাপ শিক্ষা দেয়নি বিশ্বাস করুন। আপনার টাকা-পয়সার প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। আমি…আমি লোভী নই।

এই কথাটা বলতে গিয়ে হোচট খায় চিত্রলেখা। রওনক জানে তার মা চিত্রলেখাকে কি কি বলেছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পর রওনক জাহানারাকে ফোন করে সব জেনে নিয়েছে। জাহানারা নিজেও অপেক্ষা করছিল রওনকের ফিরে আসবার। জরুরী কাজে সে চট্টগ্রাম গিয়েছিল তাই দিনের বেলায় ফোন করে কাজের মাঝে ছেলেকে বিরক্ত করেননি। কারণ এসব শুনার পর যে রওনক কাজে মন দিতে পারবে না তা জাহানারা ভালো করেই জানতেন। আর জানতেন বলেই সারাদিনে রওনককে কিছু জানানি ফোন করে, বরং তার বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করেছেন। অথচ সেই অপেক্ষা করাটাই যেনো কাল হয়েছে।

-বিশ্বাস করুন আমি লোভী নই।

এই কথাটা রিপিট করতেই চিত্রলেখার চোখে ভারী হয়ে থাকা পানি গাল বেয়ে পড়ে। রওনক আর সব সহ্য করতে পারলেও তার চন্দ্রলেখার চোখের পানি সে সহ্য করতে পারবে না। কাউকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবে না সে তবুও চন্দ্রের চোখে পানি চাই না তার। চিত্রলেখার চোখে পানি দেখে রওনকের যেনো কি হলো। হাত বাড়িয়ে দু’হাতের পাতায় চিত্রলেখার মুখ নিয়ে কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার গাল বেয়ে পড়া চোখে পানি নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে শুষে নেয় রওনক। এই চোখের পানি নিচে পরতে দিবে না সে। নিজের ঠোঁট দিয়ে প্রিয়তমার চোখের পানি শুষে নিয়ে রওনক বলে,

-আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না প্লিজ তুমি কেঁদো না। তুমি যা বলবে আমি তাই করব, আই প্রমিজ বউ।

কথা বলতে বলতেই রওনক তার কপাল ঠেকায় চিত্রলেখার কপালে। খানিকটা সময় অতিবাহিত হবার পর দু’জনে টের পায় তারা একে-অপরের কতখানি নিকটে। রওনকে নিজের এতটা কাছে আবিষ্কার করে আঁতকে ওঠে চিত্রলেখা। শরীর কেঁপে ওঠে তার। অদৃশ্য শিহরণ খেলে যায় চিত্রলেখার অঙ্গ জুড়ে। চিত্রলেখার অঙ্গের কাঁপন টের পেয়ে রওনকের ভেতরে কি যেনো হয়ে গেল। বাম হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের একদম কাছাকাছি নিয়ে আসে। ততটুকু কাছাকাছি, যতটুকু কাছাকাছি আসলে পরে দু’জন মানুষের মাঝে আর কোনো দূরত্ব অবশিষ্ট থাকে না। রওনকের ডান হাত এখনো চিত্রলেখার গাল স্পর্শ করে আছে। সেই হাতেই রওনক তার চন্দ্রলেখার মুখটা উপরের দিকে তুলে ধরে ঠোঁট জুগলের দখল নেয়। চিত্রলেখা বাঁধা দেয় না। রওনক আলতো স্পর্শে চুমু খেতে থাকে তার চন্দ্রলেখার ঠোঁটে। এক মুহূর্তের জন্যও দখল ছাড়ে না। একই অবস্থায় থেকে কদম বাড়ায় রওনক। দু’কদম এগিয়ে চিত্রলেখা সমেত বিছানায় হেলে পড়ে। চিত্রলেখার কোমড়ে থাকা হাত এবার মাথার পেছন দিকে নিয়ে যায়। প্রথম দিকে আলতো ভঙ্গিতে চুমু খেলেও এখন খানিকটা গতি বাড়িয়েছে সে। চুমুর তালে তালে শুষে নিচ্ছে প্রিয়তমার ওষ্ঠ যুগল। নিজের ঠোঁট দিয়ে প্রিয়তমার ঠোঁটের সুধা পানে ব্যস রওনক হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার বুকের কাছে লেপ্টে থাকা শাড়ির আঁচল সরায়। রওনকের স্পর্শে এখনো ধাতস্থ হয়নি চিত্রলেখা। প্রাণপণ চেষ্টায় বিছানা খামচে ধরেছে সে। অনেকটা সময় চিত্রলেখার ঠোঁটে ডুবে থাকার পর রওনক চিত্রলেখার চিবুক, গলায় আলতো চুমু দিতে দিতে নিচের দিকে নামে। চিত্রলেখার বুকে ডুবে থাকা রওনকের একটা হাত যখন তার শাড়ির কুচি টেনে খুলে ফেলে তখন আচমকা চিত্রলেখা বলে ওঠে, আমি এখনো তৈরি নই, প্লিজ।

তৎক্ষণাৎ রওনকের বাড়ন্ত হাত থমকে যায়। উপরের দিকে এগিয়ে এসে চিত্রলেখার কপালে একটা চুমু খেয়ে পাশে গা এলিয়ে দেয় সে। তাড়াহুড়ো করে রওনক নিজেও আগাতে চায় না। তখন চিত্রলেখাকে কাঁদতে দেখে তার কি যেনো হয়ে গিয়েছিল। তাই নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি সে। এমনি বিয়ের পর থেকে কি যেনো হয়েছে তার। চিত্রলেখাকে দেখলেই নিজেকে সামলে রাখতে কষ্ট হয় তার। অনেক নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেই নিজেকে আটকে রেখেছে রওনক। কষ্ট হচ্ছে তবুও নিজেকে সামলে রেখেছে সে। চিত্রলেখার অনুমতি ছাড়া কিছুই করবে না রওনক। এমন তো নয় একটা মাত্র রাতের ব্যাপার, একরাত করলাম আর জীবন কেটে গেল। রওনকের সারাজীবন প্রতিটা রাত চিত্রলেখাকে নিজের করে চাই। তার চন্দ্রলেখার দেহের উষ্ণতা চাই। ব্যাক্তিগত অঙ্গের উত্তাপ চাই। আর সমগ্র জীবন পাবার লোভে শুরুর দিকের এই কয়েকটা রাত বিসর্জন দিতে রাজি সে খুশি মনে, নির্ধিদায়। কোনো তাড়া নেই তার। চিত্রলেখার পাশে শুয়ে বড় বড় করে কয়েকবার নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে পরে রওনক। তাকে উঠে যেতে দেখে চিত্রলেখাও উঠে বসে পেছন থেকে জিজ্ঞেস করে,

-কোথায় যাচ্ছেন?

বাথরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে রওনক বলে, শাওয়ার নিতে যাই। তুমি তো এখনই কিছু করতে দিচ্ছো না তাই আপাতত শাওয়ার নিয়েই নাহয় নিজেকে শান্ত করি।

রওনকের কথা শুনে লজ্জায় ম রে যেতে মন চাইছে চিত্রলেখার। ইচ্ছা হচ্ছে গায়েব হয়ে যেতে। লোকটা এমন কেন? যে মানুষটা কথার বানেই তাকে মুহূর্তে ঘায়েল করে ফেলতে পারে সেই মানুষটার হাতে নিজেকে পুরোপুরি সপে দিলে কি করবে সে? জানতে ইচ্ছে হয় চিত্রলেখার। এসব ভাবনা চিত্রলেখার মস্তিষ্কে উদয় হতেই পরমুহূর্তে নিজেকে নিজেই ধমক লাগায় সে। এসব কি আবোলতাবোল ভাবছে সে! নিজের ভাবনার উপর নিজেই অবাক না হয়ে পারে না। আগের চাইতে আরও বেশি লজ্জায় চিত্রলেখার গাল লাল হতে আরম্ভ করেছে। হাত বাড়িয়ে গাল ধরতেই চিত্রলেখা অনুভব করে তার লাল খানিকটা গরমও হয়ে গেছে। চিত্রলেখার নিজের অজান্তেই তার হাত নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে। যেখানে কিছুক্ষণ আগে রওনক নিজের ঠোঁটের উষ্ণতা মাখিয়ে দিয়ে গেছে। নিজের ঠোঁট ছুঁয়েই যেনো চিত্রলেখা রওনকের অদৃশ্য চুমু অনুভব করতে পারছো এখনো। চিত্রলেখার মনে হচ্ছে এখনো রওনকে ঠোঁট তার ঠোঁট স্পর্শ করে আছে। আর ভাবতে পারছে না সে। লজ্জায় সত্যি সত্যি ম রে যেতে মন চাইছে তার। এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। সেজন্য বিছানা ছেড়ে আগে শাড়ি ঠিকঠাক করে নেয়। আবার কুচি দিয়ে আঁচল ঠিক করে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। ওসব ভাবনা আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য খোলা হাওয়া প্রয়োজন তার তাই বারান্দায় এসে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। কিছু আকাশ দেখেলেই ওসব চিন্তা-ভাবনা তার মস্তিষ্ক ছেড়ে পালাবে। বারান্দায় এসে খোলা আকাশের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। তবুও যেনো রওনক তার মস্তিষ্ক থেকে বেরই হতে চায় না। এই মানুষটাকে কি চিত্রলেখা চাইলেই নিজের ভাবনা থেকে সরাতে পারবে? আদৌ কি সম্ভব? চিত্রলেখা রওনকের কথা ভাববে না তা কি হয়?

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৫২+৫৩

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

সকাল সকাল রিপার ফোন পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে লিখন। কি হয়েছে কে জানে! সকাল সকাল ফোন দিয়ে রিপা জানায় সে লিখনদের এলাকাতেই আছে লিখন যেনো চট জলদি তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসে। গতকাল রাতেও দেখা হয়েছে ওদের হঠাৎ কি হলো যে এই জরুরী তলব! সময় বিলম্ব না করে কোনোরকম তৈরি হয়ে নিয়েই আজ বেরিয়ে পড়ে লিখন, এমনকি সকালের নাস্তাটাও খায়নি। জরুরী কাজ আছে বলে খালি মুখেই বেরিয়ে পড়েছে। অথচ চিত্রলেখা থাকলে এই কাজ করতে পারতো না লিখন। যত জরুরী কাজই থাকুক না কেনো নাস্তা করেই বের হওয়া লাগতো তার। নাস্তা না করে বের হবার মতো দুরসাহস লিখনও করতে পারতো না চিত্রলেখার উপস্থিতিতে। মানুষের উপস্থিতি এমনই জিনিস। একজন মানুষের থাকা না থাকায় অনেক কিছু বদলে যায়। অনেকগুলো জীবন বদলে যায়, বদলে যায় জীবনের গল্পগুলো। ঠিক বদলে যায় না নতুন মোড়ের সংযোগ ঘটে জীবনে।

রিপার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগে লিখন। বলা যায় একপ্রকার দৌড়েই এসেছে সে। লিখনকে হাঁপাতে দেখে নিজের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিয়ে রিপা জিজ্ঞেস করে,

-তুমি কি দৌড়ায় আসছো নাকি?

হাঁপাতে হাঁপাতেই লিখন জবাব দেয়, হু।

-কেন?

-তুমি দাঁড়ায় আছো তাই।

-আমি দাঁড়ায় আছি তো কি হইছে? আমাকে কি ছেলেধরা তুলে নিয়ে যাবে নাকি যে তোমাকে দৌড়ায় আসতে হবে।

লিখন আর জবাব করে না, পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নেয়া। এই সুযোগেই রিপা বলে,

-জরুরী কথা আছে তোমার সঙ্গে।

-সব শুনবো আগে রিকশা নিই, এলাকা থেকে বের হই তারপর সব শুনছি।

রিকশাটা এলাকা ছেলে নিউমার্কেটের দিকে অগ্রসর হলে লিখন জিজ্ঞেস করে,

-বলো এবার তোমার জরুরী কথা শুনি।

রিপা সিরিয়াস চাহনি নিয়ে পাশ ফিরে লিখনের মুখের দিকে তাকায়। প্রেমিকার চোখের চাহনি দেখে খানিকটা সন্দেহ হয় তার কিন্তু ঘটনা কি হতে পারে ভেবে কিছু পায় না সে। লিখনকে অবশ্য আবার কিছু জিজ্ঞেস করা লাগে না। রিপা নিজেই বলে,

-রওনকের ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বোনের কি সম্পর্ক?

-কোন রওনক ভাই? তার সাথে আমার বোনের কেন কোনো সম্পর্ক থাকতে যাবে?

-সম্পর্ক তো অবশ্যই আছে। সম্পর্ক না থাকলে কি এভাবে হুট করে কেউ বিয়ে করে নেয়?

-বিয়ে!

লিখনের বুঝতে একটু সময় লাগে রিপা রওনক জামান তথা চিত্রলেখার বরের কথা বলছে।

-ও আচ্ছা তুমি আপার বস মানে জামান গ্রুপের সিইও রওনক জামানের কথা বলছো?

-তো আর কার কথা বলবো? তোমার বোনের তো তার সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে।

-হ্যাঁ, কিন্তু তুমি তাকে কীভাবে চিনো?

-আমার বাবা ব্যবসায়িক সুত্রে জামান গ্রুপের সঙ্গে আছেন। রওনক ভাইকে আমি আমার জন্মের পর থেকে চিনি। গতকালই ভাইয়া তার ফেসবুক আইডিতে ম্যারিটাল স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তোমার সঙ্গে দেখা করে বাসায় যাবার আরও অনেক পরে দেখেলাম রওনক ভাই যাকে বিয়ে করেছে সে আর কেউ নয় চিত্র আপা, তোমার বোন।

-ওহ!

লিখন বুঝতে পারে না এই মুহূর্তে তার কি বলা উচিত। রিপাও চুপচাপ হয়ে যায় আর কিছু বলে না। আচমকা কথার মাঝে চুপ করে যেতে দেখে লিখন জিজ্ঞেস করে,

-কি হয়েছে এমন চুপ হয়ে গেলে যে? সব ঠিক আছে তো?

-না, কিছু না। তুমি আমার কথায় রাগ করো না যেন। আমি ভাবলাম আপার হয়ত রওনক ভাইয়ার সঙ্গে আগে থেকেই কোনো সম্পর্ক ছিল তাই এভাবে বিয়ে করে ফেললেন দু’জনে। রওনক ভাইকে তো ছোটবেলা থেকে চিনি এভাবে হুটহাট বিয়ে করে ফেলার মতো মানুষ সে নয়। তাই খানিকটা খটকা লাগলো। সেই কৌতূহল থেকেই ছুটে এলাম জানতে। তুমি রাগ করোনি তো?

-না।

এই প্রসঙ্গে তারা কেউ আর কথা বাড়ায় না। তবে মনে মনে রিপা খানিকটা বিচলিত। চিত্রলেখার জন্য খানিকটা চিন্তাও হয় তার। রওনকদের বাড়ির কারো কথা ভাবছে না সে এই মুহূর্তে। বরং তার মস্তিষ্ক জুড়ে আছে সাবা। নিজের আপন মায়ের পেটের বোনকে রিপা চিনে। সাবা যে এত সহজে রওনকের পিছু ছাড়বে না তা রিপার অজানা নয়। রওনককে দু’দিন ধরে নয় অনেক বছর ধরে পছন্দ করে সাবা। আসলে পছন্দ নয়। রওনকের পাওয়ার, নাম, টাকা পয়সা দেখে তাকে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে আছে সে। দি রওনক জামান নামটার যে পাওয়ার রয়েছে সেটা সাবার চাই। পৃথিবীতে রওনকের নামের ব্যবহার একমাত্র তার বউ সবচাইতে বেশি করতে পারবে। মিসেস রওনক জামানই এই নামের দাবীদার হতে পারবে। এই নাম, ফেইম আর পাওয়ারের ভীষন লোভ সাবার। যেকোনো কিছুর বিনিময়েই হোক না কেনো সাবার রওনককে চাই-ই চাই। রওনককে পাবার জন্য চিত্রলেখাকে আঘাত করতেও দুইবার ভাববে না সাবা। আর রিপার ভয়টা এখানেই। সাবা নিজের জেদের বসে চিত্রলেখার কোনো ক্ষতি না করে ফেলে। লিখন আর কথা বাড়ায় না, কিছু জিজ্ঞেসও করে না কিন্তু এতটুকু বুঝতে পারে রিপা কিছু ভেবে বিচলিত হয়ত এই মুহূর্তে তাকে বলতে চাইছে না। সেজন্য আগবাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেসও করে না। সময় হলে বা রিপার মন চাইলে সে নিজে থেকেই বলবে।

চিত্রলেখা দাঁড়িয়ে আছে দিলারা জামানের সামনে। কিঞ্চিৎ ভয়ে হাটু কাঁপছে তার। এই ভয় বা হাঁটু কাপাকাপির কারণ তার জানা নেই। খানিকক্ষণ আগে নিজের ঘরে বসে ছিল চিত্রলেখা। রওনক বেরিয়ে যাবার পরপরই তানিয়াও অফিস চলে গেছে। মীম, মিশকাত চলে গেছে স্কুলে। এই মুহূর্তে বাসায় আছে দিলারা জামান, জাহানারা আর চিত্রলেখা। যদিও হেল্পিং হ্যান্ডেরা অনেকজনই আছে। এত মানুষের উপস্থিতিতেও নিজেকে একা লাগছে তার। যতক্ষণ রওনক ছিল ততক্ষণ অবশ্য নিজেকে একা লাগেনি কিন্তু রওনকটা বেরিয়ে যাবার পর থেকেই আর কিছু ভালো লাগছে না তার। নিজেকে অনেক নিঃসঙ্গ লাগছে। একাই ঘরে বসেছিল সে আচমকা জাহানারা উপস্থিত হয়ে জানায় শাশুড়ী তাকে তলব করছে। এই কথা শুনার সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটু কাঁপতে আরম্ভ করেছে তার। সেই কাপাকাপি এখনো চলছে। দিলারা জামান বসে আছেন একটা সিঙ্গেল সোফা চেয়ারে। উনার বসার ভঙ্গিটা ভীষণ রিলাক্সিং। আয়েশ করে বসে আছেন তিনি পেছন দিকে হেলান দিয়ে। চিত্রলেখা উনার থেকে কম করে হলেও পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি নিচের দিকে। দিলারা জামানের ভাব দেখে মনে হচ্ছে উনি কলেজের প্রিন্সিপাল। চিত্রলেখা সেই কলেজেই পড়ালেখা করে। সে হয়ত বড় ধরনের কোনো অপরাধ করে ফেলেছে তাই তাকে শাস্তি দেবার জন্য ডাকা হয়েছে। দু’জনের একজনের মুখেও কথা নেই। চিত্রলেখার সঙ্গে জাহানারাও এসেছিল কিন্তু দিলারা জামান তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওর সঙ্গে আমি একান্তে কথা বলতে চাই এই বাক্য দিলারা জামানের মুখ গলে বের হতেই সেখান থেকে প্রস্থান করেছে জাহানারা। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকবার পর দিলারা জামান বলেন,

-সামনে এসো।

শাশুড়ীর আদেশে এক কদম সামনে আগায় চিত্রলেখা। দিলারা জামান উনার অপসিটে থাকা চেয়ার ইঙ্গিত করে বলেন,

-ওখানে বসো।

চিত্রলেখা নিঃশব্দে পা বাড়ায়। এগিয়ে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ে। সে বসতেই তাকে পুলিশের মতো জেরা শুরু করেন। উনার প্রথম প্রশ্নটাই হচ্ছে,

-তোমার বাবা কি করেন? ব্যবসা না কোনো ছোটখাটো চাকরী?
এমন প্রশ্নে খানিকটা বিব্রত হয় চিত্রলেখা। তার বিব্রত হওয়াটা চোখেমুখে ভেসে উঠেছে। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে দিলারা জামান তাগাদা দিয়ে বলেন,

-এন্সার মি। কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে।

জবাব দিতে হিমশিম খায় চিত্রলেখা। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে মিনমিনে সুরে বলে,

-আমার বাবা নেই।

-নেই বলতে? তোমাদের ছেড়ে চলে গেছে নাকি মারা গেছে। স্পষ্ট করে কথা বলো।

-মারা গেছেন?

-ও! আই সি। আর তোমার মা, সে কি করেন? হাউজ ওয়াইফ না কিছু করেন?

-আমার মাও মারা গেছে।

-তুমি তাহলে এতিম!

এতিম শব্দটা যেন দিলারা জামান ভীষণ তাচ্ছিল্য ভরে উচ্চারণ করলেন। কথাটা বুকের ভেতর গিয়ে গভীর আঘাত করলো তাকে। চিত্রলেখার মনে পড়ে না শেষ কবে কেউ তাকে এভাবে এতিম বলেছিল। তার এতখানি জীবনে এর আগে কেউ তাকে এভাবে এতিম বলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়নি। খালা কোনোদিন বলা তো দূরের কথা বুঝতেও দেয়নি ওরা এতিম। চিত্রলেখার চোখ ভার হয়ে আসতে চাইলো। কোনোরকমে নিজেকে সামলায় সে। এই ধরনের কথায় কেঁদে ফেলার মতো বয়স তার নেই। তাছাড়া অল্পে কেঁদে ফেলার স্বভাব চিত্রলেখার নেই। দিলারা জামান উনার প্রশ্ন করা চালিয়ে যান।

-তোমার কি আর ভাইবোন আছে?

মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। তৎক্ষণাৎই তিনি জিজ্ঞেস করেন,

-কয় ভাইবোন তোমরা? তোমার বড় কেউ কি আছে?

-চারজন, আমিই সবার বড়।

-হুম, তোমরা তো এতিম তাহলে তোমাদের দেখাশুনা কে করেছে? আই মিন ফাইনানশিয়াল দিকটা কীভাবে ম্যানেজ করেছো?

-আমরা আমার খালার কাছে মানুষ হয়েছি।

-আই সি, খালার কাছে আশ্রিতা থেকেছো। আমার ছেলের রুচির এত অধপতন কবে হলো?

দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে চিত্রলেখা। জীবনে অনেকবার তাকে এতিম শব্দটা শুনতে হয়েছে। এতে অবশ্য তার আপত্তি নেই কিন্তু আশ্রিতা শব্দটা কখনো শুনতে হয়নি তাকে, আজই প্রথম। কারো মুখ থেকে শুনতে যে এই শব্দটা ধারালো অস্ত্রের চাইতেও বেশি আঘাত করতে পারে তা জানাছিল না চিত্রলেখার, আজই প্রথম টের পেলো কি ধারালো এই একটা শব্দ। বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে সক্ষম। চিত্রলেখার কানে আশ্রিতা শব্দটাকে পৃথিবীর সবচাইতে জঘন্য শুনাচ্ছে। মনে হচ্ছে এর আগে কেউ তাকে এমন জঘন্য কথা বলেনি। গা কাঁপুনি দিয়ে কান্না আসতে চাইছে তার কিন্তু চিত্রলেখা কাঁদবে না। তাকে দুঃখ দেয়া সহজ হলেও কাঁদানো ভীষণ কঠিন।

-রওনকের সঙ্গে তোমার পরিচিয় হলো কীভাবে? কতদিনের পরিচয় তোমাদের?

-আমি উনার কোম্পানিতে চাকরী করতাম।

-কি বললে তুমি? তুমি আমাদের কোম্পানির ইমপ্লই!

দিলারা জামানকে দেখে বুঝা যাচ্ছে উনি অবাক হয়েছে চিত্রলেখার পরিচয় শুনে। অবাক হওয়া সুরেই বলেন,

-ও মাই গুডনেস!

এক মুহূর্ত থেমে তিনি আরও বলেন, দেখো মেয়ে আমি এত ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কথা বলতে পারবো না তাই সরাসরিই বলছি। তুমি যদি টাকা-পয়সার লোভে আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে থাকো তাহলে আমাকে বলতো পারো। আমি বুঝতে পারছি তোমার পারিবারিক অবস্থা ভালো নয়, অভাবে বড় হয়েছো। ভাইবোনদের মধ্যে তুমি সবার বড় সো ছোটদের দায়িত্ব তোমার উপর। আমি বুঝি বিশ/ত্রিশ হাজার টাকার বেতন দিয়ে এতগুলো মানুষের পেট চালানোটা কষ্টটকরই বটে। তাই হয়ত ভেবেছো পয়সাওয়ালা কাউকে ফাঁসিয়ে নিতে পারলে একনিমিশেই তোমার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। অবশ্য ঠিকই ভেবেছো। আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না খারাপও বলছি না। বাবা-মা মরা এতিম মেয়ে। তোমাকে তো ভালো-মন্দ শেখানোর মানুষ ছিল না তাই ভালোটা শিখতে পারোনি। যা করার করে ফেলেছো ওসব নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাচ্ছি না বরং তোমাকে সুন্দর একটা অফার দিচ্ছি। আমি তোমাকে একটা চেক লিখে দিচ্ছি। চেকটা নিয়ে রওনককে কিছু না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আমার ছেলেকে আমি সামলে নিবো। পুরুষ মানুষের কি আছে বউ একটা গেলে আরেকটা আসবে। রওনকও আবার বিয়ে করে নিয়ে নতুন করে সংসার করবে। অবশ্যই তোমার মতো কারো সঙ্গে নয়। আমার ছেলের বউ হবার কোনো যোগ্যতাই তোমার নেই। রওনকের বউ হতে নূন্যতম একটা স্ট্যান্ডার দরকার বুঝলে। কবুল বললাম বিয়ে হলে গেল আর বিয়ে হয়ে গেছে বলেই যে এই বিয়ে বয়ে বেড়াতে হবে এর কোনো মানে হয় না। তোমাকে তো আমার ছেলে অন্যদের সামনে প্রেজেন্টও করতে পারবে না। কেনো যে আমার ছেলেটা তোমার মতো নাম পরিচয়হীন একটা মেয়েকে বিয়ে করতে গেলো আমি বুঝতেই পারছি না। আমার ছেলে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো একটা কাজ করে ফেললো আমি মানতেই পারছি না। যাগ গিয়ে যা হবার তা হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো সময় আছে সব ঠিক করে নিতে পারবো। এখনো সব কিছু হাত ফোঁসকে বেরিয়ে যায়নি। চেকটা নিয়ে তুমি বিদায় হও আমার ছেলের জীবন থেকে।

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিলারা জামান আরও বলেন, আমার কথা শেষ হয়েছে এখন তুমি আসতে পারো।

চিত্রলেখা উঠে দাঁড়ালে দিলারা জামান বাঁধা দিয়ে আরও বলেন, এক মিনিট দাঁড়াও।

উঠে গিয়ে উনার বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা চেক বই বের করে তাতে কিছু লিখেন। স্বাক্ষর করে চেকের পাতাটা ছিঁড়ে চিত্রলেখার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,

-এক কোটি টাকার চেক লিখে দিলাম আশা করি এই টাকা দিয়ে তোমার ও তোমার ভাইবোনদের জীবন সুন্দর ভাবেই কেটে যাবে। অবশ্য তোমার মতো মেয়ের মূল্য এত বেশি নয় কিন্তু কি করবো বলো আমার মনটা বড় তাই কার্পন্য করলাম না টাকা দিতে। এর পরেও যদি কিছু লাগে আমাকে জানাবে কেমন?

চিত্রলেখার হাতের কাছে চেকটা ধরে রেখেছেন দিলারা জামান। তবুও হাতের মুঠ খুলে চেকের পাতাটা নিচ্ছে না দেখে এবারে তিনি জোর করেই চেকটা চিত্রলেখার হাতে গুঁজে দিলেন। আর বলেন,

-ইউ ক্যান গো নাও।

চিত্রলেখা যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমনি নিঃশব্দেই বেরিয়ে গেলো। দিলারা জামানের ঘরের দরজা দিয়ে বের হতেই চিত্রলেখা জাহানারার মুখোমুখি পড়ে। চলে যেতে বলা হলেও রুমের বাইরে ঠিকই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। জাহানারাকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে চিত্রলেখা। কিন্তু কোনো কথা হয় না তাদের। নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। মেকি হেসে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করে নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হয় চিত্রলেখা।

রওনকের ফেরার কথা ছিল সন্ধ্যা নাগাদ। কিন্তু তার ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা বেজে গেছে। বাসায় ফিরেই সরাসরি নিজের ঘরে গিয়েছে সে বউকে দেখতে। চিত্রলেখাকে দেখার জন্য রীতিমত ছটফট লাগছে তার। একটু জড়িয়ে ধরার জন্য অস্থির বিস্থির লাগছে। কিন্তু নিজের ঘরে আসতেই রওনক দেখে চিত্রলেখা এখানে নেই। হয়ত বাথরুমে আছে চিন্তা করে গায়ের কোটটা খুলে রাখে। পানি খাবার জন্য গ্লাস হাতে নিলেই তার দৃষ্টি আটকায় গ্লাসের পাশে থাকা একটা ভাঁজ করা কাগজে। রওনক দেখেই বুঝতে পারে এটা কোনো সাধারণ কাগজ নয়। এইধরনের কাগজের সঙ্গে পরিচিত সে। আচমকাই বুকের ভেতরটা মোচড়ে ওঠে তার। গ্লাস্টা নামিয়ে রেখে কাগজটা হাতে নেয় সে। ভাঁজ খুলতেই দেখে একটা চেকের পাতা। স্বাক্ষর দেখে রওনকের বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না এই চেকটা কার। সময় ঘনায় কিন্তু তার চন্দ্রের দেখা মিলে না। খানিক সন্দেহ হয় রওনকের। সে গিয়ে বাথরুমের দরজার নবে হাত রেখে ঘুরাতেই দরজাটা খুলে যায়। চিত্রলেখা এখানে নেই। বেরিয়ে এসে বারান্দার ডু মারে রওনক কিন্ত এখানেও নেই তার চন্দ্রলেখা। চেকের পাতাসহ নিচে নেমে আসে সে। ড্রইং রুমে তার সঙ্গে দেখা হয় জাহানারার। তাকে দেখেই রওনক জিজ্ঞেস করে,

-চন্দ্র কোথায় খালা?

-ছোট বউ তো তার ঘরেই আছে।

-ঘরে নেই খালা। লাস্ট কখন দেখে ছিলে ওকে?

-সকালে, ভাবী…

জাহানারা বাকি কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই রওনক চেকের পাতাটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-মা এটা দিয়ে আমার চন্দ্রকে চলে যেতে বলেছে তাই না?

জাহানারা মাথা নিচু করে ফেলে। আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না রওনক। বেরিয়ে যেতে নিলে পেছন থেকে জাহানারা জিজ্ঞেস করেন,

-এই তো এলে আবার কোথায় যাচ্ছো?

-বউকে আনতে যাচ্ছি খালা।

রওনক চিত্রলেখাকে খুঁজতে বেরিয়ে গেলে পেছনে জাহানারা মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন, আল্লাহ আপনি সহায় হোন। মেয়েটা যেনো সহি সালামতে থাকে আপনি দেখবেন মাবুদ।

চিত্রলেখা কখন বেরিয়ে গেছে তিনি বলতেই পারবেন না। বেশ কয়েকবার গিয়ে দরজা নক করেছিলেন, খাবার জন্য ডেকেছিলেন কিন্তু চিত্রলেখা দরজা না খোলায় ফিয়ে এসেছেন তিনি। মন ভালো নেই তাই হয়ত একা থাকতে চায় ভেবে আর বিরক্ত করেননি কিন্তু এদিকে যে উনার চোখ ফাঁকি দিয়ে মেয়েটা বাড়ি থেকেই বেরিয়ে গেছে তা জাহানারা বলতেই পারবেন না। এখন আফসোস লাগছে উনার। চিন্তাও হচ্ছে চিত্রলেখার জন্য।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

সারাদিন নিজের ঘর থেকে বের হয়নি সাবা। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। এমনকি সারাদিন ঘরের দরজাও খোলেনি। কিছু খায়ওনি। সানজিদা বেগম বেশ কয়বার মেয়ের দরজায় কান পেতে ছিলেন কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় কিনা শুনতে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি। সারাদিন পর নিজের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সাবা। আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলতে তুলতে ড্রইং রুমের দিকে এগিয়ে আসে। মেয়েকে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচেন যেন সানজিদা বেগম। এমন মেয়ের মা হয়ে বেচারি যেনো ফেঁসে গেছেন। প্রায়ই মনের ভেতর খানিকটা আফসোসের জন্ম হয়। তার পেটে থেকে জন্ম নেয়া মেয়েটা এমন ব দ হলো কেনো? উনার ছোট মেয়ে রিপা তো এমন হয়নি। ভালো মেয়ে, ভালো মানুষ হবার যত গুণ আছে সব রিপার মধ্যে বিদ্যমান। যার ছিটেফোঁটাও বড়জনের মধ্যে নেই।সাবাটা এমন কেনো হলো! দুঃখ লাগে উনার। দীর্ঘশ্বাসও আসতে চায় বুক উপচে। কিন্তু নিজের পেটে ধরা সন্তান যতই বদমেজাজি হোক না কেনো ফেলে তো দিতে পারবেন না। এত কষ্ট সহ্য করে জন্ম দিয়েছেন তো আর ফেলে দেবার জন্য নয়।

মেয়েকে এগিয়ে আসতে দেখে সানজিদা বেগম উনার পাশে গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা অল্প বয়সী কাজের মেয়ে মুক্তাকে বলেন,

-জলদি গিয়ে খাবার গরম করে টেবিলে দে।

সাবা এগিয়ে এসে মায়ের পাশে ধপাস করে বসে শরীর ছেড়ে দেয়। সানজিদা বেগম পাশ ফিরে মেয়ের মুখের দিকে তাকালে সাবাই আগে বলে,

-আমাকে কড়া করে এক কাপ কফি দিতে বলো তো।

-সে না হয় বললাম। কিন্তু তুই আমাকে বল এটা কোনো কাজ করলি তুই?

হাই তুলতে তুলতে সাবা বলে, কি করলাম?

-কি করছিস তুই জানিস না?

-কাম অন আম্মু। এসব ড্রামা বাদ দিয়ে কি বলতে চাও স্ট্রেইট বললেই পারো। আমি জানি কি জানি না সেটা তো শুনলেই বুঝতে পারবো।

ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সানজিদা বেগম বলেন,

-সারাটা দিন আমাকে এভাবে টেনশন দেয়ার অর্থ কি?

-আমি তোমাকে কখন টেনশন দিলাম? হোয়াট রাবিস আর ইউ টকিং এবাউট?

-আই এমন নট টকিং এনি রাবিস, ইউ আর ডুইং রাবিস। সারাদিন ঘরের দরজা দিয়ে বসেছিলি এটা কি আমাকে টেনশন দেয়া নয়?

-আমি আমার বেডরুমে আছি এটা নিয়ে তুমি কেনো টেনশন করবে?

-টেনশন করব না বলছিস? তোর জন্য আমি টেনশন করব না? আমি তোর মা, তোর জন্য টেনশন করব না?

-আবার ড্রামা করছো তুমি আম্মু। আমি জানতে চাইছি কেনো টেনশন করবে? এমন তো নয় যে আমি বাসার বাইরে ছিলাম আমাকে ফোনকলে পাওয়া যাচ্ছিলো না সারাদিন তাই টেনশন করেছো। এমন হলে মানতে পারতাম। কিন্তু সেটা তো নয়। আমি বাসায়ই ছিলাম সারাদিন। ইনফ্যাক্ট নিজের ঘরেই ছিলাম এরপরেও তোমার টেনশন করার কারণ কি আমি বুঝতে পারছি না। আমাকে একটু বুঝাও প্লিজ। আর বুঝাতে না পারলে কিছু বলো না।

ফস করে আবারও একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সানজিদা বেগম বলেন,

-তুই গতকাল রাতে ভাঙচুর করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলি গরম মাথায়। এরপর বাসায় ফিরে কারো সঙ্গে কোনো কথা বললি না। ভালো-মন্দ কিছু বললি না। ওখানে কি হয়েছে না হয়েছে কিচ্ছু জানালিও না। রওনক সত্যি সত্যি বিয়েটা করেছে কিনা এসব কিছু না জানিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলি। সেই দরজা সকালেও খুলিসনি। সমস্তদিন পার করে এখন বেরিয়ে এসেছিস। তোর এমন কান্ডে আমার টেনশন হবে না? টেনশন হবার মতো কিছু করিসনি তুই?

সোজা হয়ে বসে সাবা বলে, কাম অন আম্মু। আমাকে তুমি চেনো না? নিজের কোনো ক্ষতি করতে কখনো দেখেছো আমাকে? মাথা গরম হয়ে গেলে একটু ভাঙচুর করি এটা সত্যি কিন্তু নিজের ক্ষতি করার মতো মেয়ে আমি নই। আমাকে তো তুমি জন্ম দিয়েছো। এত বছর বড় করার পরেও চিনতে পারোনি? সেজন্যই বলি আমি তোমার না পাপার মেয়ে। আমার পাপাই আমাকে ভালো চিনে। তাকে দেখো তো আমাকে নিয়ে তোমার মতো অহেতুক চিন্তা করছে কিনা। সে ঠিকই চিলে আছে কারণ সে জানে তার মেয়েও চিল করছে। রাগ হবে ভাঙচুর করব মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে, ব্যস। এত টেনশন করার কিছু নেই। এত বেশি টেনশন করলে তুমি পাপার আগে বুড়ো হয়ে যাবে বুঝলে? তারপর তোমাকে আমার মা কম দাদী বেশি লাগবে দেখতে। সো তুমিও চিল করো

সানজিদা বেগম কিঞ্চিৎ রাগি রাগি দৃষ্টি করে মেয়ের দিকে তাকালে তার ঐ তাকানোকে উপেক্ষা করে সাবা বলে,

-প্লিজ এখন তুমি যাও আগে আমাকে কড়া করে এক কাপ কফি বানিয়ে দাও। শরীরটা কেমন টলছে আমার এখনো।

উঠে যাবার উদ্যোগ নিয়েও বসে রন সানজিদা বেগম। শরীর টলছে শুনে মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন, শরীর টলছে কেনো? তুই কি স্লিপিং পিলস নিয়েছিলি?

-না নিলে এত ঘুমালাম কীভাবে দিনভর?

-এসবের মানে কি? রওনক…

সানজিদা বেগমকে কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়ে সাবা বলে,

-রওনক যা করেছে করেছে। আপাতত ওসব নিয়ে ভাবছিনা আমি।

-তাহলে কী ভাবছিস?

-রওনককে আমার হতেই হবে। রওনক আমারই হবে বাই হুক ওর বাই কুক। ওকে আমি এত সহজে ছাড়ছি না। মিসেস রওনক জামান আমিই হবো এখন না হয় ক’দিন পরেই সই কিন্তু হবো আমিই। আমার পছন্দের জিনিস অন্য কেউ নিয়ে নিবে তা আমি বেঁচে থাকতে কোনোদিন হতে দিবো না। রওনক এই সাবার হবেই।

মেয়ের কথা শুনে সামান্য ঘাবড়ে যান সানজিদা বেগম। খানিক ধরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন, কী করবি তুই?

মৃদু হেসে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সাবা বলে, এখনই তোমাকে কোনো টেনশন করতে হবে না। যখন করব তখন দেখা যাবে। এখন আর কোনো কথা বলো না তো। যাও আমার কফিটা বানিয়ে আনো। আই নিড এ কাপ কফি ব্যাডলি।

সানজিদা বেগম কড়া করে দু’টো কথা বলতে চেয়েছিলেন মেয়েকে। কিন্তু এই মুহূর্তে বলে লাভ নেই ভেবে থেমে গিয়ে নিজেকে সংযত করেন। পরে এই বিষয়ে বুঝািয়ে বলা যাবে। এটা সাবার নতুন নয় অনেক পুরোনো অভ্যাস। নিজের মন মতো কিছু না হলেই সে স্লিপিং ট্যাবলেট খেয়ে মরার মতো পড়ে পড়ে ঘুমায়। কিন্তু আজ স্লিপিং ট্যাবলেট খাওয়ার চাইতে সানজিদা বেগমের বেশি টেনশন লাগছে মেয়ের কথা শুনে। এখন কেবল মাথায় এই ভাবনাই আসছে সাবা সামনে কী করবে? নিজের মেয়েকে তো তার অচেনা নয়। এই মেয়ে যে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে কি করতে পারে তা সানজিদা বেগম ভালো করেই জানেন। এসব ভেবেই মনের ভেতর আপাতত কু ডাকছে উনার। দুশ্চিন্তার ছাপ কপালে নিয়েই কিচেনে যান উনি মেয়ের জন্য কফি বানাতে। এই মুহূর্তে এক কাপ চা উনারও দরকার। মেয়ের কথাবার্তা শুনে মাথা ধরে গেছে একদম। মস্তিষ্কে চাপ পড়েছে। চা খেলে যদি এই চাপ কমে কিছুটা।

একাই বসেছিল সাবা কফির অপেক্ষায়। তখনই সেখানে এসে উপস্থিত হয় রিপা। তাকে কাজের মেয়েটা জানিয়েছে সাবা ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে। তৎক্ষনাৎ খবরটা দিতে পারেনি নইলে রিপাও মাকে বলা সাবার কথাগুলো শুনতে পেতো। সোফায় হেলান দিয়ে চোখের উপর হাত রেখে প্রায় আধা শোয়া ভঙ্গিতে বসে শুয়ে আছে সাবা। সন্তপর্ণে এগিয়ে এসে অন্যপাশের সোফায় বসে রিপা। সে ভেবেছিল সাবা হয়ত তার আগমন টের পায়নি। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ঐ অবস্থায় বসে থেকেই রিপাকে চোখ মেলে না দেখেই সাবা বলে,

-কিছু বলতে চাইলে বলে ফেল নয়ত নিজের ঘরে যা। বিরক্ত করিস না আমাকে।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে রিপা বলে,

-তুমি রওনক ভাইয়ের আশা ছেড়ে দাও। উনাদের বিরক্ত করো না। ওদের ভালো থাকতে দাও।

ছোট বোনের কথা শুনে একদমই হকচকায় না সাবা। চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে সহজ ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসে সে। রিপার চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বলে,

-কি বলতে চাইছিস?

-তুমি রওনক ভাইকে বিয়ে করার আশা ছেড়ে দেও। উনার বউটা অনেক ভালো। তার কোনো ক্ষতি করো না প্লিজ।

-তুই চিনিস নাকি মেয়েটাকে? মেয়েটা কেমন, কি করত না করত ডিটেইলস কিছু জানিস পাস্ট সম্পর্কে? আমাকে বল তো সব শুনি। মেয়েটার কি আগে কোনো বয়ফ্রেন্ড-ট্রেন ছিল নাকি? একটু ডিটেইলস বল তো যা জানিস।

সাবার কথা শুনে ভরকে যায় রিপা। সে কি বলতে চাইলো আর সাবা তাকে কি জিজ্ঞেস করছে। নিজেকে সামলে নিয়ে রিপা বলে,

-আমি কীভাবে চিনবো? আমি চিনি না রওনক ভাইয়ের বউকে।

-না চিনলে জানলি কীভাবে মেয়েটা ভালো?

-উনাকে নাই চিনতে পারি কিন্তু রওনক ভাইকে তো চিনি। ভালো মেয়ে না হলে কি রওনক ভাই বিয়ে করতো নাকি? যাকে নয় তাকে কি রওনক ভাই নিজের বউ বানাবে?

-তার মানে বলতে চাইছিস আমি ভালো মেয়ে নই তাই রওনক আমাকে বিয়ে করেনি।

-সেটা আমার চাইতে তুমি ভালো জানো আপু।

সাবার এই মুহূর্তে একদম রিপার সঙ্গে তর্ক করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। সে এমনিতেই মনে মনে ছক কষতে ব্যস্ত তাই এই মুহূর্তে কারো সঙ্গেই কোনো ধরনের তর্কে জড়ানোর মুড নেই তার। তাই আর এই প্রসঙ্গে কথা না টেনে বরং কথার ইতি টানতে সাবা বলে,

-তোর কথা শুনতে ভালো লাগছে না। আমার সামনে থেকে উঠে যা, গেট লস্ট।

রিপাও তর্কে জড়ায় না। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে বিনাবাক্যব্যয়ে। কিন্তু চলে যাবার আগে আরেকবার বলে,

-যা বললাম মাথায় রেখো। ওরা বিয়ে করে সুখে আছে, ওদের সুখে থাকতে দাও। কারো কোনো ক্ষতির কারণ হয়ও না। ওদের ভালো থাকতে দাও।

সাবাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই প্রস্থান করে রিপা। পেছনে সাবা আবার আগের ভঙ্গিতে শুয়ে বসে চোখ ঢাকে হাতে। রওনককে সে এত সহজে ছাড়বে না। যেকেনো মূল্যে সে রওনকের বউ হয়েই ছাড়বে। তার রওনককে চাই-ই চাই। সেজন্য হাজারটা মেয়েকে পথ থেকে সরিয়ে দেয়ার আগে দু’বার ভাবার অবকাশ নেই তার।

চিত্রলেখা ও আফিফা কথা বলছিল। আচমকাই পরপর তিনবার এক নাগাড়ে কলিংবেল বেজে ওঠায় সতর্ক হয় দু’জনেই। এই সময় আফিফার বাসায় আসার মতো কেউ নেই। আফিফার বর শান্ত থাকে চট্টগ্রাম। এখানে আফিফা তার শাশুড়ি ও ৬ মাসের বাচ্চা নিয়ে থাকে। পরপর কয়েকবার কলিংবেল বাজায় আফিফা দরজা খোলার জন্য উঠতে নিলে তার হাত ধরে বাঁধা দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-দাঁড়া আমি দেখি।

-আমি দেখছি তো।

-বললাম তো আমি দেখি।

চিত্রলেখা আর আফিফার আপত্তি শুনে না। বিছানায় থেকে নেমে শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতেই দরজার দিকে আগায়। পীপহোলে চোখ রেখে সঙ্গে সঙ্গেই দরজাটা খুলে দেয় সময় বিলম্ব না করে। চিত্রলেখা দরজা খুলে দিয়ে বিষ্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে বিস্মিত কন্ঠে যেই বলে,

-আপনি!

রওনক এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তার চন্দ্রলেখাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। তার কান্ডে একদম বোকা বনে যায় চিত্রলেখা। এমন কিছুর জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না সে। রওনক এই পর্যন্ত চলে আসবে তার জন্য সেটাই তো আশা করেনি সেখানে জড়িয়ে ধরা তো দূরের কথা। রওনক কোনো কথা বলে না। নিঃশ্চুপ আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখে কেবল প্রিয়তমাকে। রওনকের বুকের ধুক ধুক কম্পন চিত্রলেখা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে। এতখানি কাছাকাছি আছে দু’জনে যে একে-অপরের প্রতিটা হৃৎস্পন্দন টের পাওয়া যাচ্ছে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৫০+৫১

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫০
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

শেষরাতে চিত্রলেখার ঘুম হয়েছে ছাড়া ছাড়া। হয়ত জায়গা পরিবর্তনের জন্য এমনটা হয়েছে। হুট করে জায়গা পরিবর্তন হয়ে এডজাস্ট হতেও খানিকটা সময় লাগে। প্রথমে অবশ্য গভীর ঘুম হয়েছিল তার কিন্তু মাঝরাতে যে অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেছে এরপর চিত্রলেখার চোখের পাতায় ঘুম নামতে সময় লাগাটা স্বাভাবিক ব্যাপারই। অবচেতনে বারবার মনে হয়েছে এই বুঝি রওনক আবার তাকে নিজের আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে নিলো। এই বুঝি কিছু একটা হয়ে গেল তাদের মাঝে। এই আতংকেই চিত্রলেখার ঘুম আর গাঢ় হয়নি। কারো বিছানা ছেড়ে উঠে যাওয়াটা টের পেয়েছে চিত্রলেখা। কিন্তু তৎক্ষণাৎই চোখ মেলে তাকায়নি সে। বুঝতে পারে রওনক উঠেছে হয়ত। এই ঘরে এমনিতেও তারা দুইজন ব্যাতীত আর কেউ নেই। সকাল সকাল নববিবাহিতের ঘরে অন্য কারো আসার কথাও না। রওনক বাথরুমে ঢুকে গেছে টের পেয়েই চোখ মেলে তাকায় চিত্রলেখা। রুমের লাইট এখনো নিভানো। পাশ ফিরে দেখে তার ধারণাই ঠিক, রওনক উঠে গেছে। সময় দেখার জন্য মোবাইল হাতে নিলেই দেখে ভোর ৬টা বাজে। চিত্রলেখার ঘুম পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে আজ আর এখন ঘুম আসবে না বেশ বুঝতে পারছে অবশ্য আর চেষ্টাও করে না সে ঘুমাবার। পিঠে বালিশ দিয়ে উঠে বসে। বেশ কিছুক্ষণ পর টাওয়ালে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে রওনক। এগিয়ে এসে চিত্রলেখার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,

-আমি কি তোমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম?

স্নিগ্ধ রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভুলে গেছে যেনো চিত্রলেখা। এত কাছ থেকে এর আগে কখনো কাউকে দেখা হয়নি তার। চিত্রলেখার মন তাকে বারবার জানান দেয় সামনে বসে থাকে এই সুপুরুষ একান্তই তার ব্যাক্তিগত। এই মানুষটার উপর একচ্ছত্র তার অধিকার। স্থির নয়নে রওনককে দেখতে ব্যস্ত চিত্রলেখার মুখের সামনে তুড়ি বাজায় রওনক। আচমকা শব্দে দৃষ্টির স্তব্ধতা কাটে চিত্রলেখার। নিজের কাজেই লজ্জা পেয়ে যায় সে। থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কিছু বললেন?

মৃদু হাসে রওনক। চিত্রলেখার কপালের উপর চলে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে,

-আমার জন্য তোমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো বুঝি?

মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। মুখে বলে, আমার তো সকাল সকালই ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। সকালের নাস্তা বানানো, দুপুরের রান্না করা কত কাজ থাকে এই সময় আমার।

রওনক যেনো আরেকটু কাছ ঘেষে বসলো। চিত্রলেখার কানের নিচে হাত রেখে স্পর্শ করে বলল,

-অভ্যাস পরিবর্তন করো। এখন আর তোমাকে সকাল সকাল উঠতে হবে না। আরাম করে ঘুমাবে যতক্ষণ তোমার মন চাইবে। কেউ কিচ্ছু বলবে না। এইবাড়িতে কারো সাহস নেই আমার বউকে প্রশ্ন করে।

-আর আপনার মা?

প্রশ্নটা ইন্টেনশনালি করেনি চিত্রলেখা। মুখ ফোঁসকে বেরিয়ে গেছে। রওনক স্বাভাবিক থেকেই জবাব দেয়,

-মাকে আমি সামলে নিবো। তাছাড়া কিছুদিন গেলেই দেখবে সে তোমাকে মন থেকে মেনে নিয়েছে। তোমাকে চিনতে শুরু করলে, জানতে শুরু করলেই ভালোবেসে ফেলবে।

চিত্রলেখা ভাবলেশহীন চাহনি করে রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে ভাবে, “আসল মানুষটার ভালোবাসাই তো কখনো আমার ভাগ্যে ঝুটবে না তাহলে অন্যরা আমাকে ভালোবাসলো কি বাসলো না তাতে কি আসে যায়?”

চিত্রলেখাকে ভাবলেশহীন তাকে থাকতে দেখে বাহু ধরে ঝাঁকি দিয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে, কি ভাবছো এতো?

-হ্যাঁ!

-কি ভাবছো এতো?

-না, কিছু ভাবছি না।

-আচ্ছা ঠিক আছে থাকো তাহলে আমি বের হচ্ছি।

-এত সকালে কোথায় যাচ্ছেন?

-দুটো রাউন্ড মেরে আসি। এই বডিটা তো এমনি এমনি বিল্ড হয়নি। মেইনটেইন করা লাগে তো। এমনি দিন জোগিং এর পর জিমে যাই আজ জিম যাবো না কয়টা রাউন্ড দিয়েই চলে আসবো। তুমি ততক্ষণে আরেকটু ঘুমিয়ে নাও। ইউ উইল ফিল ফ্রেশ।

চিত্রলেখা লক্ষি মেয়ের মতো শান্ত ভঙ্গিতে রওনকের কথা শুনে মাথা ঝাঁকায়। বউকে কিছু বুঝার সুযোগ না দিয়েই এগিয়ে গিয়ে কপালে চুমু খায় সে। আচমকা রওনকের চুমু খাওয়ায় চিত্রলেখার চোখ বড় হয় তা দেখে রওনক বলে, আমার খুব বেশি হলে এক ঘন্টা লাগবে। এসে তোমার হাতে এককাপ চা খাবো, বানিয়ে রেখো প্লিজ।

চিত্রলেখা মুখে কিছু বলতে পারে না। কেবল মাথা ঝাঁকায়। তবে মনে মনে ভাবে “এই চায়ের জন্যও বুঝি আমাকে বিয়ে করেছেন।” রওনক মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায়। যাবার আগে তার হাতের ভেজা টাওয়ালটা চিত্রলেখার হাতে দিয়ে বলে,

-রেখে দিও।

চিত্রলেখা ওখানেই বসে থেকে রওনকের যাবার দিকে তাকিয়ে থাকে।

চিত্রলেখাকে রান্নাঘরে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ে জাহানারা। এগিয়ে এসে মমতাময় আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয় আদরের রওনক বধূকে। ব্যস্ত হয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে চিত্রলেখাকে বসিয়ে দিয়ে বলেন,

-তুমি আসতে গেলে কেন? আমাকে আওয়াজ দিলেই তো হতো। কিছু লাগবে মা তোমার?

চিত্রলেখা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে জাহানারা জোরপূর্বক আবার বসিয়ে দেয়। বসে থেকেই চিত্রলেখা বলে,

-আপনি একদম ব্যস্ত হবেন না আমার জন্য। আমার কিছু লাগবে না। আমি শুধু উনার জন্য চা বানাতে এসেছি।

-রওনকের জন্য?

মাথায় ঝাঁকায় চিত্রলেখা। জাহানারা বলে,

-চা তো বানানো হচ্ছে তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। রান্নার কাজের জন্য লোক আছে। তুমি শুধু আরাম করো।

-না না আমিই বানাবো। উনি আমার হাতে বানানো চা খাবেন বলে গেছেন। আমি বানাই প্লিজ। কোথায় কি রাখা আছে আমাকে দেখিয়ে দিলেই হবে। আমি নিজেই বানাতে পারবো।

জাহানারা আর কথা বাড়ায় না। নিজে পাশে দাঁড়িয়ে চাপাতি, দুধ, চিনি এগিয়ে দেয়। চিত্রলেখা খুব যত্নের সাথে চা বানায়। চা বানাতে বানাতেই জাহানারার সঙ্গে কথা হয় তার। টুকটাক সবার সম্পর্কে কমবেশি বলেন জাহানারা। শুধু চা বানিয়েই ক্ষ্যান্ত দেয় না চিত্রলেখা। জাহানারার সঙ্গে নাস্তা বানানোতেও হাত লাগায়। অন্য আরো দু’জন কাজের লোক আছে যারা কেবল রান্নার কাজই করে। জাহানারা কেবল দেখাশুনা করে। তাকেও নিজের হাতে কিছু করতে হয় না তেমন একটা। তার দায়িত্ব কাজের লোকেরা ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা সেটা খেয়াল রাখা। সবাইকে দিয়ে কাজ করানো, সবার সবকিছু ঠিক মতো হচ্ছে কিনা সবকিছু তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব জাহানারার। নাস্তা বানানো কাজে হাত লাগাতে লাগাতে রওনকের কি পছন্দ না পছন্দ জেনে নেবার চেষ্টা করে চিত্রলেখা। প্রকাশ না করলেও চিত্রলেখা মনেপ্রাণে নিজেকে রওনকের বউ মেনে নিয়েছে তা সে মুখে স্বীকার করুক বা না করুক।

তানিয়া নিজের ঘরে অফিসে যাবে বলে তৈরি হয়ে কিছু ফাইল ঘাটছে। নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করে রাদিন। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

-আজ অফিস যাবে তুমি?

রাদিনের শব্দ পেয়ে এক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়ে আবার নিজের কাজে মন দেয় তানিয়া। আগে অবশ্য যেদিন রাদিন বাসায় ফিরতো তানিয়া অফিস স্কিপ করতো প্রিয়তমকে সময় দেয়ার জন্য। কিন্তু এখন আর আগের মতো কিছু নেই তার জীবনে। কাজ করতে করতে তানিয়া জিজ্ঞেস করে,

-কিছু লাগবে তোমার? এই ঘরে তো তোমার কিছু নেই।

-আমার কি এই ঘরে আসার পারমিশন নেই?

-এই ঘরে তো তোমার কিছু নেই। প্রয়োজন না থাকলে এই ঘরে এসে তোমার কি কাজ বলো?

রাদিন বুঝতে পারে না হঠাৎ তানিয়ার কি হলো? এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। তানিয়া বিছানায় বসে থেকে ফাইল ঘাটতে থাকলেও রাদিনকে ঠিকই লক্ষ করেছে। তানিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে রাদিন জিজ্ঞেস করে,

-কী হয়েছে তোমার?

-কিছু কি হবার কথা?

-গতকাল আসার পর থেকে দেখছি তুমি কেমন আনইউজুয়াল বিহেভ করছো।

-সেটা কেমন?

-এজ ইফ আই এম নট ইউর হাজবেন্ড।

ফাইল হাত থেকে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায় তানিয়া। রাদিনের চোখেচোখ রেখে বলে,

-তুমি কি আসলেই আমার হাজবেন্ড?

-কি বলতে চাও? আমি তোমার হাজবেন্ড নই? কাম অন তানিয়া হোয়াট হেপ্পেন টু ইউ? স্পিকআপ।

-আমি আর এই লোকদেখানো সম্পর্কটা বয়ে বেড়াতে চাই না রাদিন। ইটস হাই টাইম উই শুড গেট সেপারেট। যে সম্পর্কে ভালোবাসা নেই এমন একটা ভিত্তিহীন সম্পর্কে অহেতুক একে-অপরকে আটকে রাখার কোনো মানেই হয় না। অন্তত আমি চাই না আর এমন সম্পর্কে আটকে থাকতে।

-তাহলে কি চাও তুমি?

-আমার অলরেডি এডভোকেটের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে রাদিন। তুমিসহ একদিন গিয়ে ডিভোর্সের সবকিছু ফাইনাল করে ফেলবো।

-হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ডিভোর্স তানিয়া?

-ডিভোর্সের মানে নিশ্চয়ই তুমি জানো। আমাকে আলাদা করে ব্যাখ্যা করতে হবে না।

রাদিনের আচমকা কি হলো সে তানিয়ার বাহু চেপে ধরে শক্ত করে। দাঁত চিবিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-তুমি আমাকে ডিভোর্স দিবে?

-অবশ্যই দিবো। তোমার সঙ্গে এক সংসারে থাকার মতো আর কোনো সম্পর্ক আমাদের মাঝে অবশিষ্ট নেই রাদিন।

-মানে!

তানিয়া এক মুহূর্ত সময় নেয়। এভাবে ভনিতা করতে ভালো লাগছে না তার। তাই এসব ভনিতা, ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলা বাদ দিয়ে সরাসরি বলে।

-শুনো রাদিন আমি তোমার সঙ্গে ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কথা বলতে পারবো না। তাই অন দ্যা পয়েন্ট বলছি তুমি যতই আড়াল করতে চাও না কেন সত্য সারাজীবন আড়ালে থাকে না। সত্যকে চাইলেই আড়াল করে রাখা যায় না। একদিন না একদিন সত্য তার আত্ম প্রকাশ করবেই। আমি জানি তোমার পুরোনো প্রেমিকা আবার তোমার জীবনে ফিরে এসেছে। এমনকি তুমি তোমার প্রেমিকাকে নিয়ে নতুন করে সংসার পাতার প্লান করছো। আমি কেবল তোমার পথটা সহজ করে দিচ্ছি আর কিছু না। তোমার লাভ লাইফে আমি বাঁধা হতে চাই না। যে আমাকে ভালোবাসে না সম্পর্কের দোঁহাই দিয়ে তাকে আটকে রাখার মতো দূর্বল আমি নই। তাছাড়া তোমার দয়া দেখানো সম্পর্কটাও আমি চাই না। তুমি ভেবেছিলে দয়া করবে আমাকে। এখানে তোমার স্ত্রীর পরিচয় নিয়ে থাকবো আর তুমি অন্যদিকে কাজের নাম করে প্রেমিকাকে নিয়ে ভিনদেশে নতুন করে সংসার সংসার খেলবে। কিন্তু আই এম সরি রাদিন ডিয়ার, তোমার এই লোকদেখানো দয়াটা আমি নিতে পারছি না। এতটূকু দূর্বল আমি নই যে আমাকে তোমার পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। বরং তুমি লোকচক্ষুর, লোকে কি বলবে এই ভয়ে যে কাজটা করতে পারছো না আমি সেটাই করবো। তোমাকে এই সংসার নামক যাযাবরের জীবন থেকে মুক্তি দিবো। আমি চাই তুমি মুক্ত হয়ে জীবন যাপন করো।

তৎক্ষণাৎ রাদিনের মুখে কথা কুলায় না। সে তানিয়ার বাহু ছেড়ে দিয়ে পাশে বিছানায় বসে পড়ে ধপাস করে। তানিয়া নিজেই বলে,

-সত্য এমনই রাদিন। হয় মানুষকে ভেঙ্গে ফেলে নয় শক্ত করে দেয়। তুমি হয়ত ভাঙবে না, তোমার মতো মানুষেরা ভাঙে না। তুমি, তোমরা কেবল অন্যদের ভাঙতে জানো। কিন্তু আফসোস আমি ভেঙ্গে যাইনি। তোমার এই সত্যটা আমাকে শক্ত করে দিয়েছে ততখানি যতখানি তুমি ভাবতেও পারবে না।

-তোমাকে রওনক বলেছে এসব তাই না?

-তোমার নিজের ভাইকে তুমি ততটুকু চিনো না যতটুকু আমি চিনি, জানি। রওনক মুখপাতলা মানুষদের মতো নয় যে একটা কিছু জানলো, দেখলো আর ওমনি বলে দিলো। বরং শুরু থেকে সব জেনেও সে আমাকে কিছু জানায়নি। জানিয়েছে তবে যখন জানানোর প্রয়োজন হয়েছে তখন। কিন্তু ও জানানোর অনেক আগে থেকেই বিষয়টা আমি জানি। তোমাকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্তটা একান্তই আমার। এখানে রওনক কেনো অন্যকারো কোনো হাত নেই। অনেক আমি তোমার কথা ভেবেছি, সংসারের কথা ভেবেছি, এখন একটু নিজের কথা ভাবতে চাই যা তোমার সঙ্গে বিয়ে হবার পর থেকে ভাবতে পারিনি, আসলে ইচ্ছা করেই ভাবিনি। কিন্তু এখন আমি নিজেকে প্রায়োরিটি দিতে চাই। নিজের জন্য বাঁচতে চাই।

-নিজেকে প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে বাচ্চা দুটোর কথা ভুলে যাচ্ছো তুমি। আমরা আলাদা হয়ে গেলে ওদের কি হবে একবার ভেবেছো? এত সেলফিশ হয়ে গেলে তুমি?
-একদম আমার দিকে আঙ্গুল তোলার চেষ্টা করবে না। তুমি নিজে ওদের কথা ভাবোনি। আমি মা বলে সব আমার উপর চাপিয়ে দিয়ে তুমি বেঁচে যাবে ভাবছো? ওদের কথা ভাবা যতটা আমার দায়িত্ব ততটা তোমারও। কই তুমি তো ওদের কথা ভাবোনি। তাহলে আমি কেন ভাববো?

-আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে আমার ছেলেমেয়েদের কথা ভাবতে হবে না। আমার বাচ্চাদের আমি সামলে নিবো।

এমন সিরিয়াস কথাবার্তার মধ্যেও রাদিনের কথা শুনে হেসে ফেলে তানিয়া। সে হাসতে চায়নি মূলত রাদিনের কথা শুনে বেফাঁস হাসি বেরিয়ে গেছে তার। হেসে নিয়ে তানিয়া বলে,

-তুমি সামলাবে বাচ্চাদের? রিয়েলি রাদিন! তোমার ছেলেমেয়েরা কোন ক্লাসে পড়ে, কোন সেকশনে পড়ে সেটা জানো তুমি? ওদের ক্লাস টিচারকে চিনো? স্কুলের ফোন নম্বর আছে তোমার কাছে? স্কুল বাদে ওরা কে কোন ধরনের এক্টিভিটি ক্লাস করতে যায় সেসব জানো? তুমি কি জানো তোমার দুই ছেলেমেয়ের একজনেরও আর্ট করতে ভালো লাগে না। ওদের পেইন্ট করতে ভালো লাগে না। ওদের ধারণা তুমি পেইন্ট করো বলেই আমাদের সময় দাও না, আমাকে সময় দাও না, ওদেরকে সময় দাও না। ওদের কোনো প্যারেন্টস মিটিংয়ে তুমি যাও না। ওরা মনে করে তুমি পেইন্ট না করে ওদের চাচার মতো ব্যবসা করলে, আমার মতো অফিস করলে অন্তত দিনশেষে বাসায় ফিরে ওদের সময় দিতে, উইকেন্ডে ওদের নিয়ে ঘুরতে যেতে যেমনটা বাবা না হয়েও রওনক করে সবসময়। রওনক তার হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও অন্তত দু’ঘন্টা সময় হলেও তোমার ছেলেমেয়ের জন্য বরাদ্দ রাখে অথচ তুমি নিজেকে দেখো নিজের ছেলেমেয়ে সম্পর্কে তোমার কোনো আইডিয়াই নেই। কীভাবে থাকবে? তুমি তো ব্যস্ত নিজের প্রেম, পরকীয়া নিয়ে। আমাকে বাদ দাও তোমার তো নিজের মা, নিজের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকানোর সময়টাও নেই আর সেই তুমি আমার দিকে আঙ্গুল তুলছো? ছেলেমেয়ে সামলাবে বলে চ্যালেঞ্জ করছো! হাস্যকর রাদিন, যেটা তুমি করতে পারবে না সেটা বলাও উচিত না। আমার ছেলেমেয়ের কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাদের ডিভোর্সের পরে মীম, মিশকাতের দায়িত্ব আমিই পাবো। আমি অলরেডি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমার ছেলেমেয়ে কোথায় থাকবে, কার কেয়ারে থাকবে। রওনক চাচা হয়েও যতখানি ওদের বাবা হতে পারবে তুমি বাবা হয়েও তা পারবে না। তোমাকে ওদের কথা ভাবতে হবে না। আমার ছেলেমেয়েদের চিন্তা করতে আমি এখনো বেঁচে আছি রাদিন।

রাদিন উঠে দাঁড়ায়। তানিয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,

-তুমি বলতে চাইছো আমার বর্তমানে আমার ছেলেমেয়ের দায়িত্ব রওনক পালন করবে?

-অবশ্যই পালন করবে। তুমি আমাদের জীবনে থেকেও তো বিশেষ লাভ হচ্ছে না। আমাদের ডিভোর্সের পর তোমার থেকে আমি তেমন কোনো আশা রাখছি না। তুমি বরং আমাদের কথা বাদ দিয়ে নিজের কথা ভাবো। আমাদের ডিভোর্সটা যে তোমার জন্য খুব ভালো কিছু বয়ে আনবে না সেটা হয়ত এখনই আন্দাজ করতে পারছো। তাই এসব বাদ দিয়ে নিজের কথা ভাবো তুমি।

রাদিন আরও কিছু বলার জন্য মুখ খোলে কিন্তু তানিয়া আর তাকে কিছু বলার সুযোগ দেয় না। বাঁধা দিয়ে নিজেই বলে, আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি রাদিন। এখন আর তোমাকে সময় দিতে পারছি না। তোমার কিছু লাগলে জাহানারা খালাকে বলো উনি ব্যবস্থা করে দিবেন। আজকাল আমি একটু ব্যস্ত আছি। পরশুর এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখবো, তুমি সময় বের করে রেখো। আমাদের যেহেতু সরাসরি কথা হয়েই গেলো আমি আর ডিভোর্সিটা হোল্ডে রাখতে চাই না। তোমার থেকে যত জলদি সম্ভব মুক্তি চাই আমার। আমার জীবনের আর একটা মুহূর্তও আমি আর তোমার পেছনে অপচয় করতে রাজি নই। আমার জীবনটা এখন থেকে শুধুই আমার, আমার ছেলেমেয়ের। এখানে তোমার আর কোনো জায়গা নেই।

তানিয়া আর সুযোগ দেয় না রাদিনকে কিছু বলার। বিছানায় ছড়িয়ে থাকা ফাইলগুলো চাপিয়ে রেখে বেরিয়ে যায় সে। রাদিন ওখানেই থম ধরে দাঁড়িয়ে রয়।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

নাস্তা তৈরি হয়েছে কিনা দেখানার জন্য কিচেন আসতেই তানিয়া দেখে জাহানারার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে চিত্রলেখা। সকাল সকাল চিত্রলেখাকে কিচেনে দেখে টিটকারির সুরে তানিয়া বলে,

-সকাল সকাল নতুন বউয়ের বর রেখে কিচেনে কি করা হচ্ছে?

তানিয়ার কন্ঠ পেয়ে চিত্রলেখার সঙ্গে সঙ্গে জাহানারাও পেছন ফিরে তাকায়। জা এর কথা শুনে চিত্রলেখার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে যায় তৎক্ষণাৎই। জাহানারা কিছু বলেন না কেবল মুখ টিপে হাসেন। এগিয়ে এসে চিত্রলেখার চিবুক স্পর্শ করে মুখটা উপরের দিকে তুলে তানিয়া আরও বলে,

-বাহ! চোখ-মুখে তো এখনো রাতের আবেশ মাখামাখি হয়ে আছে দেখছি। বর বুঝি খুব আদর দিয়েছে রাতভর।

ইতস্ততকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায় চিত্রলেখা। এভাবে কেউ কখনো লজ্জা দেয়নি তাকে। আমতা আমতা করে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলার চেষ্টা করে,

-কি যে বলেন না ম্যাম!

-ওমা! ম্যাম বলছো কাকে? এখানে তোমার ম্যাম কে?

-আপনি!

-আমি তোমার ম্যাম হতে যাবো কেন ভাই? জা কে কেউ ম্যাম বলে ডাকে নাকি?

-না মানে আসলে এতদিনের অভ্যাস, অফিসে তো ম্যাম বলেই ডাকি।

-অফিসে ডেকেছো বলে কি বাসায় ডাকবে নাকি? মাথা কি খারাপ হয়েছে নাকি? ভাসুরের বউকে কেউ ম্যাম বলে? আর যেন না শুনি এসব ম্যাম ট্যাম ডাকতে।

-তাহলে কি ডাকবো আপনিই বলে দিন।

-অবশ্যই তোমার বর যা ডাকে তাই ডাকবে।

-সে কি ডাকে আমি তো জানিনা।

হেসে ফেলে তানিয়া, স্বচ্ছ ও মন খোলা হাসি। হাসি সামলে বলে,

-ভাইয়ের বউকে তো সবাই ভাবীই ডাকে। রওনকও তাই ডাকে, তুমিও নাহয় ডেকো।

মুখে কিছু বলে না চিত্রলেখা কেবল মাথা ঝাঁকায়। এগিয়ে এসে আগ্রহ ভরে তানিয়া আবার জিজ্ঞেস করে,

-তা কি করা হচ্ছে শুনি?

চিত্রলেখা কিছু বলার আগে পাশ থেকে জাহানারা বলেন,

-আমি এত করে না বললাম কিন্তু শুনলোই না আমার কথা। বলে কিনা রওনকের জন্য নিজে চা বানাবে।

-না করছো কেন খালা? নিজের বরের জন্য বানাতে চাইলে অবশ্যই বানাবে। শুনেছি তুমি নাকি পৃথিবীর সবচাইতে বেস্ট চা বানাও। এক কাপ আমাকেও দিও খেয়ে দেখবো কেমন খেতে তোমার হাতের ওয়ার্ল্ড বেস্ট চা।

চিত্রলেখার মুখে কথা কুলায় না। কি বলবে ভেবে মনে মনে হিমশিম খায় সে। তানিয়া নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-আর কি করছিলে?

-উনি তো জগিং করতে গেছে তাই একটু লেবুর শরবত করছিলাম।

-বাহ! স্বামীর খেয়াল রাখা হচ্ছে। বেশ ভালো। তবে শুধু খেয়ালই রেখো না সঙ্গে লাগামটাও ধরে রেখো।

তানিয়ার কথার আগামাথা বুঝে না চিত্রলেখা। আপাতত এইসব বিষয়ে কথা বাড়ায় না দু’জনের একজনও। জাহানারার উপস্থিতিতে সমস্যা না থাকলেও অন্যান্য কাজের লোকেরা আশেপাশেই আছে তাই এইমুহূর্তে এসব কথা বলার উপযুক্ত সময় ও পরিবেশ এটা নয় ভেবেই আর এই প্রসঙ্গে কেউ কিছু বলে না।

তানিয়া আরও বলে,

-তুমি তোমার বরের জন্য নাস্তা বানাও আমি যাই দেখি মীম, মিশকাত স্কুলের জন্য তৈরি হয়েছে কিনা।

আচমকাই মীম, মিশকাতের কথা শুনতে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে চিত্রলেখার নিজের ভাইবোনদের কথা মনে হয়ে। এতদিন তো সে নিজেই ভাইবোনগুলোর সকল বিষয়ের খেয়াল রেখেছে। আজ থেকে তো সে আর নেই ওদের সবকিছুর খেয়াল রাখতে। ভাবতেই বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে তার। বিশেষ করে চারুর জন্য। চারুটা এমনিতে বড়দের মতো ভাব নেয়, ফটর ফটর কথা বলে, পাকামোও করে বেড়ায় কিন্তু নিজের যেকোনো কাজের সময় তার বড়বোনের সহায়তা চাই। বড়বোনকে ছাড়া কোনো কাজই করতে পারে না সে। চিত্রলেখা তাড়া না দিলে স্কুলের জন্য তৈরি হতে মন চায় না চারুর। কোনো কাজও করতে ইচ্ছা হয় না। অথচ আজ থেকে চারুকে নিজের সব কাজ একাই করতে হবে। আবার ক্ষেত্র বিশেষে লিখন, চয়নের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। তার আচমকা চলে আসায় চারুটা বুঝি হুট করেই বড় হয়ে যাবে। কিন্তু চিত্রলেখা কখনো চায়নি চারুটা তার মতো করে দায়িত্বের যাতাকলে পড়ে বড় হয়ে যাক। অথচ চিত্রলেখা না চাইলেও এমনটাই হবে।

তানিয়া কিচেন থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে চিত্রলেখা বাঁধা দিয়ে বলে,

-আমি আসি আপনার সাথে? ওদের সঙ্গে তো আমার এখনো দেখা হলো না।

-নাস্তার টেবিলে দেখা হবে। এখন যা করছিলে করো, রওনক চলে আসবে যেকোনো সময়। আগে বর পরে সব।

তানিয়া কিচেন থেকে বেরিয়ে ছেলেমেয়েদের ঘরে যাবার জন্য উপরে যেতে নিলেই রওনকের আগমন ঘটে। দেবরকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে তানিয়া। দেবরের লেগপুল করতে বলে,

-তোমার তো কপাল খুলে গেলো রওনক।

-হঠাৎ এই কথা বলছো যে ভাবী?

-বউ সকাল সকাল চা বানাচ্ছে দেখে এলাম।

-চন্দ্র কোথায়?

-কিচেনে, তোমার জন্য নাস্তা বানাচ্ছে।

-আই সি, তাহলে তো গিয়ে দেখে আসতে হচ্ছে কি বানানো হচ্ছে আমার জন্য।

-যাও গিয়ে দেখে আসো। পরম সৌভাগ্য তোমার।

চিত্রলেখা রওনকের জন্য লেবুর শরবত বানাতে ব্যস্ত। সন্তপর্ণে কিচেন প্রবেশ করে রওনক যেন বউ টের না পায়। তাকে দেখে জাহানারা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিলে রওনক আগেই ইশারা করে যেনো কেউ কোনো কথা না বলে। ইশারা করে সবাইকে বেরিয়ে যেতে। চিত্রলেখাকে বুঝতে না দিয়ে বেরিয়ে যায় জাহানারা। তার সঙ্গে অন্য দু’জন কাজের লোকও বেরিয়ে যায় ইশারায়। আচমকা এগিয়ে এসে চিত্রলেখাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রওনক। একমুহূর্তের জন্য ঘাবড়ে যায় চিত্রলেখা। কিন্তু তৎক্ষণাৎই আবার সামলে নেয় নিজেকে। রওনক মুখ বাড়িয়ে চিত্রলেখার কাঁধের উপর রেখে জিজ্ঞেস করে,

-কী করা হচ্ছে এত মনোযোগ দিয়ে?

ঘাবড়ে গিয়ে একমুহূর্তের জন্য চুপ করে রয় চিত্রলেখা। রওনক জিজ্ঞেস করে,

-ভয় পেয়েছো বুঝি?

-ভয় পাবো না? এভাবে জড়িয়ে ধরে কেউ? আমি তো ভাবলাম কে না কে।

চিত্রলেখাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চিবুক স্পর্শ করে মুখটা উপরে তুলে রওনক বলে,

-কার এতবড় সাহস আমার বউকে জড়িয়ে ধরে। তাও আমার বর্তমানে। কার ঘাড়ে কয়টা মাথা শুনি? দুনিয়া থেকে গায়েব করে দিবো না।

চিত্রলেখা চুপ করে রয়। রওনক তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়ায় ঘর্মাক্ত রওনককে দেখে চিত্রলেখার মুখে আর কথা কুলায় না। রওনকের কপাল জুড়ে থাকা ঘাম যেনো তার সৌন্দর্য্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। চিত্রলেখা নিজের অজানতেই তার ওড়নার আঁচল টেনে রওনকের কপাল জুড়ে থাকা ঘাম মুছে দেয়। রওনক চিত্রলেখাকে চমকে দিয়ে তার গালে একটা চুমু খায়। এতে চিত্রলেখার গাল লাল হলো, চোখে লজ্জার বাহার নেমে এলো। লজ্জায় লজ্জাবতি গাছের মতো নুইয়ে আসতে চাইলো যেনো বেচারি।

নাস্তার টেবিলে বাড়ির অন্য সবার সাথে দেখা হয়েছে চিত্রলেখার। মীম, মিশকাতের আগ্রহের শেষ নেই চিত্রলেখাকে নিয়ে। রওনককে ওরা ছোট পাপা বলে ডাকে তাই চিত্রলেখাকে কি বলে ডাকবে সেটা নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই দু’জনের। রওনক বলেছে ওরা যা ইচ্ছা ডাকতে চায় ডাকতে পারে। দু’জনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিমি বলে ডাকবে চিত্রলেখাকে। রাদিনের সঙ্গেও কুশল বিনিময় হয়েছে চিত্রলেখার কিন্তু একমাত্র দিলারা জামানই কোনো কথা বললেননি। নাস্তার টেবিলে চিত্রলেখার হাতে বানানো চা খেয়ে সবাই প্রসংশা করেছে। রওনক পরপর দুই কাপ চা খেয়েছে। এমনকি নাস্তার পর উপরে যাবার সময় জাহানারাকে বলে গেছে কাউকে দিয়ে আরেক কাপ চা উপরে পাঠিয়ে দিতে। তার বউয়ের হাতে বানানো চা বলে কথা এক কাপ খেয়ে পোষায় না।

নিজের ঘরে এসে তৈরি হয়ে নেয় রওনক। চেঞ্জিং রুম থেকে টাই হাতে বেরিয়ে এসে চিত্রলেখার মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। টাইটা বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-টাই বাঁধতে পারো?

-কখনো বাঁধা হয়নি।

-ট্রাই করে দেখো, আমি বলে দিচ্ছি কীভাবে বাঁধতে হয়।

চিত্রলেখা আপত্তি করে না। রওনকের বলে দেয়া মোতাবেক টাই বেঁধে দেয়। প্রথম চেষ্টায় ঠিকঠাকই বাঁধতে পেরেছে সে। টাই বাঁধা ঠিক হওয়ায় রওনক বলে,

-এত সুন্দর করে টাই বেঁধে দিলে এর বিনিময়ে তো তোমাকে কিছু দেয়া উচিত।

-কি!

রওনক চিত্রলেখাকে কিছু বুঝার সুযোগ দেয় না। বুঝে উঠার আগেই আলতো ভঙ্গিতে ছোট্ট করে চিত্রলেখার ঠোঁটে চুমু খায় রওনক। ছেড়ে দিয়ে বলে,

-তোমার রিওয়ার্ড।

রওনকের কান্ডে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চিত্রলেখা। তা দেখে হাসি পায় রওনকের। মৃদু হেসে বলে,

-আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি।

-কবে আসবেন?

চিত্রলেখাকে বিচলিত হতে দেখে আগের চাইতে আরও বেশি হাসি পায় রওনকের। এগিয়ে এসে বউয়ের গালে হাত রেখে বলে,

-চিন্তা করো না তোমাকে একা রেখে আপাতত আমি নিজেও বেশি সময় দূরে থাকতে পারবো না। সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে আসবো তোমার কাছে।

রওনকের এসব কথায় চিত্রলেখার বুকের ভেতর কি যেনো হয়। ডেউ ওঠে শিহরণের। মানুষটা এমন ভাবে বলে যেনো সে একান্তই তার ব্যাক্তিগত। রওনক নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-কোথাও যেতে চাও?

-আমি আবার কোথায় যাবো?

-ভাইবোনদের সাথে দেখে করে আসতে পারো চাইলে।

-সত্যি যাবো?

-যেতে চাইলে অবশ্যই যাবে। যখন যেখানে যেতে মন চাইবে যাবে। আমি ড্রাইভারকে বলে দিবো। আমাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে আসবে। তুমি যখন চাও বাইরে নিয়ে যাবে তোমাকে। তবে প্লিজ সন্ধ্যার আগে ফিরে এসো, আমি যেনো বাসায় ফিরেই তোমার মুখটা দেখতে পাই।

চিত্রলেখা মাথা ঝাঁকায়। রওনক আরও বলে,

-ওহ বলতে ভুলে গিয়েছিলাম তোমার জন্য একটা গিফট আছে।

-গিফট! আমার জন্য? কি?

-একমিনিট দেখাচ্ছি।

রওনক চেঞ্জিং রুমে গিয়ে একটা এনভেলপ নিয়ে ফিরে এসে সেটা চিত্রলেখার হাতে দিয়ে বলে,

-তোমার গিফট।

-এর ভেতর কী আছে?

-খুলে দেখো।

চিত্রলেখা এনভেলপটা খুলতেই ভেতর থেকে একটা দলিল বেরিয়ে আসে। কৌতূহল নিয়ে দলিলটা চেক করে সে। চিত্রলেখার চোখ বড় হয়। দলিল পড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-এসব কী?

-পড়ে বুঝতে পারোনি কিছু?

-এটা কি করেছেন আপনি!

-কি করেছি?

-আমি না বুঝতে পারছি না কিছু।

রওনক এগিয়ে এসে চিত্রলেখার বাহু ধরে বলে,

-রিলাক্স চন্দ্র, এত ঘাড়বে যাচ্ছো কেনো?

-কিন্তু…

চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক বলে,

-ইটস জাস্ট এ লিটল গিফট ফর ইউ ফ্রম মি। আই ক্যান ডু মাচ মোর ফর ইউ।

-এসব তো আমি চাইনি।

-গিফট কি কেউ চেয়ে নেয়? আমার ইচ্ছা হয়েছে আমি দিয়েছি ব্যস।

-তাও এটা…

রওনক দু’হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার গাল ছুঁয়ে বলে,

-তুমি রওনক জামানের ওয়াইফ, গেট ইউজ টু দিজ। আরও একটা জিনিস দেয়া বাকি তোমাকে।

-আবার কি!

রওনক তার মানিব্যাগ থেকে একটা ক্রেডিট কার্ড বের করে চিত্রলেখার হাতে দিয়ে বলে,

-এখন থেকে এটা তোমার। এনি টাইম ইউজ করবে, যা লাগবে কিনবে, যত খুশি টাকা তুলবে আমাকে কোনো হিসাব দিতে হবে না। আমি হিসাব চাইবোও না কখনো।

আমতা আমতা করে চিত্রলেখা বলে,

-এটা আমাকে কেনো দিচ্ছেন? এসব দিয়ে আমি কি করব?

-তোমার লাগবে তাই দিচ্ছি।

-না, আমি এটা দিয়ে কি করবো? আমার এসব কার্ড, টাকাপয়সা কিচ্ছু লাগবে না।

-লাগবে না বললেই তো হলো না। একশবার লাগবে। একটু পর ভাইবোনদের দেখতে যাবে, খালি হাতে যাবা নাকি? আমি সারাদিন থাকবো না, তোমার কিছু দরকার হলে এটা ইউজ করবে।

রওনক তার মানিব্যাগ থেকে কিছু ক্যাশ বের করে চিত্রলেখার হাতে গুঁজে দিয়ে বলে,

-এগুলোও হাতে রাখো কাজে লাগবে।

-এত টাকাপয়সা আমাকে কেনো দিচ্ছেন আপনি? আমার এসব চাই না বিশ্বাস করুন।

-এভাবে বলছো কেনো? আমি তো তোমার সেফটি, প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে দিচ্ছি। আমি না থাকলে তোমার যদি কিছু প্রয়োজন হয় তুমি আনিয়ে নিবে। টাকা ছাড়া কীভাবে আনাবে?

-আমার কিছু লাগবে না। এসব আমার চাই না। আপনি প্লিজ নিয়ে যান এগুলো।

চিত্রলেখা কার্ড, টাকা ফেরত দেয়ার চেষ্টা করলে রওনক ধমকে ওঠে তাকে।

-চুপ! শান্ত হয়ে আমার কথা শুনো। এমন করছো কেনো তুমি? আমার অবর্তমানে তোমার যদি কিছু প্রয়োজন হয় তখন কীভাবে ম্যানেজ করবে তুমি? তোমার যা লাগবে আমি সবই ব্যাবস্থা করে দিবো কিন্তু তারপরেও প্রত্যেকের একটা ব্যাক্তিগত নিড থাকে সেজন্যই দিয়ে যাচ্ছি। এগুলো রাখো তোমার কাজে লাগবে ট্রাস্ট মি।

চিত্রলেখা আর কিছু বলে না। তার কথা যে রওনকের সামনে ধোপে টিকবে না বুঝতে পেরে চুপ করে যায় সে। তবে ভেতরে ভেতরে ভীষণ ইতস্তত সে। এভাবে রওনকের থেকে টাকা বা কার্ড নেয়াটা ঠিক লাগছে না তার। চিত্রলেখা টাকার জন্য রওনককে বিয়ে করেনি। অথচ কেউ দেখলে ভাববে টাকার জন্যই হয়ত সে রওনককে বিয়ে করেছে। এই চিন্তাটা মাথায় আসাতেই মস্তিষ্কের ভেতরটা আউলে যাচ্ছে চিত্রলেখার। রওনক হয়ত বুঝতে পারে। চিত্রলেখার বাহু ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজে পায়ের উপর ভর দিয়ে নিচে বসে মুখ তুলে বউয়ের দিকে তাকায়। বলে,

-তোমার মাথার ভেতর যেসব উল্টাপাল্টা ভাবনা আসছে সব ঝেড়ে ফেলো। কে কি ভাবলো, কে কি ভাববে এসবে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার জন্য শুধু তুমি ম্যাটার করো, তোমার ভালো থাকা ম্যাটার করে। সো সব ভুলে যাও।

রওনক উঠে দাঁড়িয়ে চিত্রলেখার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলে,

-আসছি, সাবধানে থেকো।

বেরিয়ে যেতে নিয়ে থেমে গিয়ে আচমকাই চিত্রলেখাকে জড়িয়ে ধরে রওনক। এমন কান্ডে অবাক হয় চিত্রলেখা। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় তার। রওনক চিত্রলেখার কানে বিড়বিড় করে কার্ডের পিন বলে দিয়ে আরও বলে, পিন ছাড়া কার্ড ইউজ করবে কীভাবে? আসছি, নিজের খেয়াল রেখো বউ।

ফি-আমানিল্লাহ, বলে ওখানেই দাঁড়িয়ে রয় চিত্রলেখা। নিজের হাতে থাকা রওনকের দিয়ে যাওয়া কার্ড ও টাকার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই সঙ্গে রওনকের দিয়ে যাওয়া দলিলগুলোতে আরেকবার চোখ বুলায়। খালুর বাড়িটা চিত্রলেখার নামে কিনে নিয়েছে রওনক, এগুলো সেই বাড়ির দলিল। এখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে রায়বাজারের ঐ একতলা বাড়িরটার মালিকানা এখন থেকে চিত্রলেখার। রওনক কখন এসব করেছে ঘুনাক্ষরেও কিছু টের পায়নি সে। তাছাড়া চিত্রলেখা বাড়ি কেনার কথা কিছু বলেওনি তাকে। রওনক যে এমন কিছু করবে ভাবতেই পারেনি চিত্রলেখা। মস্তিষ্কের ভেতর সব কেমন তালগোল পাকিয়ে আসছে তার। কনফিউজড হয়ে যাচ্ছে চিত্রলেখা, জীবন সহজ হচ্ছে না কঠিন কিছুই বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে রওনক নামক একটা গোলক ধাঁধায় আটকে আছে সে। চারিদিক কেবল অর্থবিত্ত, নামের প্রাচুর্যে ঘেরা।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৪৭+৪৮+৪৯

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

নিজের ঘরের কাঁথার তলায় মুখ ঢেকে শুয়ে আছে চারু। নারগিস বেগম কয়েকবার করে ভাত খাওয়ার জন্য ডেকেছেন কিন্তু আসেনি। তাই বোনকে ডাকতে দুই ভাই তার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে। লিখন চারুর মাথার কাছে দাঁড়িয়েছে। চয়ন দাঁড়িয়েছে পায়ের কাছটায়। চারু আপাদমস্তক কাঁথায় মুড়ানো। লেপ, কম্বল গায়ে দেয়ার মতো শীত এখনো নামেনি। ফ্যানের ভলিউম কমিয়ে মোটা কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমানো যায়। আর কয়দিন পরেই হয়ত শীত তার চাদরে ঢেকে নিবে পুরোপুরি। তখন আর মোটা কাঁথায় শীত মানবে না, নামাতে হবে লেপ, কম্বল। চয়ন পায়ের কাছে কাঁথায় ছোট্ট করে টান দিয়ে বলে,

-কিরে আয় ভাত খাবি।

চয়নকে সঙ্গ দিয়ে লিখনও বলে, আয় অল্প কয়টা ভাত খাবি। কত দেরি হয়ে গেল বল তো। অল্প একটু খেয়ে তারপর ঘুমা।

চারু ওঠে না, কথাও বলে না। এমনি দিন চিত্রলেখার উপস্থিতিতে রাত ১০ টার মধ্যেই সবার খাওয়া হয়ে যেতো। আজ তার অনুপস্থিতি যেন সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। চারু কাঁথার তলায় ফুপিয়ে কাঁদছে। কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে। সবসময় কথার খৈ ফুটা চারু নিজের দূর্বলতা ভাইদের দেখাতে চায় না। কিন্তু আচমকাই মায়ের মতো বড় বোনের এভাবে চলে যাওয়া পোড়াচ্ছে তাকে। চিত্রলেখা চিরকাল তাদের সঙ্গে থাকবে না এটা জানা কথা কিন্তু ঘটনাটা যে এমন আচমকা ঘটবে সেটাও ভাবেনি কখনো। বোন বিদায় দেয়ার আগে মানসিক যে প্রস্তুতিটুকু চারুর দরকার ছিল সেটুকু সুযোগও সে পায়নি। অন্তত একটাদিন আগে জানতে পারলেও হয়ত নিজেকে সামলে নিতে পারতো, নিজেকে বুঝ দিতে পারতো। কিন্তু সে সুযোগ সে পায়নি।

অনেক ডাকাডাকির পরেও চারুর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। লিখন জানে কী করলে চারু কথা শুনবে। তাই চারুকে শুনিয়ে বলে,

-চয়ন এক কাজ কর আমার ঘর থেকে মোবাইলটা নিয়ে আয়। আপাকে ফোন দিয়ে বলি চারু রাতে ভাত না খেয়ে শুয়ে পরছে। যা ফোনটা নিয়ে আয় তো।

বলেই চয়নকে চোখ মারে। চয়ন বুঝতে পারে এটা ভাইয়ের নাটল। সেও সঙ্গ দিয়ে বলে,

-এখনই আনতেছি।

তৎক্ষনাৎই কাঁথা থেকে বেরিয়ে উঠে বসে চারু। লিখনের একটা হাত ধরে বলে,

-আপারে ফোন দিও না ভাইয়া প্লিজ।

চারুর ফুলে লাল হয়ে যাওয়া চোখ দেখে দুই ভাই এগিয়ে এসে পাশে বসে। লিখনকে জড়িয়ে ধরে এবারে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে চারু। দুই ভাইয়ের বুঝতে অবশ্য অসুবিধা হয় না বোনের কান্নার কারণ কি। তবুও চারুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে লিখন জিজ্ঞেস করে,

-কি হইছে চারু কাঁদতেছিস কেন?

-তোমরা কি একদিন হুট করে আমারেও আপার মতো দূরে পাঠায় দিবা?

-না পাঠাবো। তোরে আমরা বিয়ে দিবো না।

মুখ তুলে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায় চারু। কান্না স্থগিত করে জিজ্ঞেস করে,

-সত্যি বিয়ে দিবা না?

-তুই বিয়ে করতে চাইলে দিবো নাইলে দিবো না।

আবার লিখনকে জড়িয়ে ধরে চারু বলে,

-তোমরা আমারে কোনোদিন বিয়ে দিও না ভাই। আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে পারবো না।

চারুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে লিখন বলে,

-আচ্ছা দিবো না। এখন আয় ভাত খাবি।

চারু আবার মুখ তুলে বলে, আপার কি আমাদের জন্য খারাপ লাগতেছে না ভাইয়া? আপা তো বলছিল কোনো বিয়ে করবে না। আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবে না। এই ঘরে আপাকে ছাড়া আমি একলা কেমন ঘুমাবো? আপারে জড়ায় না ধরলে তো আমার ঘুম হয় না ভাই।

স্থগিত হওয়া চারুর কান্না আবার গতি পায়। এবার আর লিখনের মুখে জবাব কুলায় না। কি বলবে সে? তার নিজেরই তো বুকের ভেতরটা কামড়াচ্ছে। এবারে চয়ন বলে,

-আপা যদি জানতে পারে তার পিছনে আমরা তার জন্য কানতেছি তাহলে কিন্তু আপাও কষ্ট পাবে। সে তো আমাদের জন্যই বিয়ে করবে না বলছি। এখন না হয় নিজের জন্য ভাবছে। আমাদের তো উচিত আপার জন্য খুশি হওয়া। দেখবি কালকে দিনের বেলায়ই আপা দেখা করতে আসবে।

-আপার কি এখন আর আমাদের জন্য সময় থাকবে?

চয়ন এগিয়ে এসে চারুর মাথায় ছোট্ট করে গাট্টা মেরে বলে, আপার জীবনে আমাদের ৩ জনের চাইতে বেশি কেউ না। দেখবি আপা শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের কাছে ছুটে আসবে। এখন আয় ভাত খাবি।

-খুদা নাই আমার।

চারু আপত্তি করলে দুই ভাই তাকে টেনে নিয়ে যায় ভাত খাওয়াতে। চিত্রলেখা থাকতে কখনো ওদের না খেয়ে রাতে ঘুমাতে দেয়নি। চারুকে কখনো কোনোকিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি। আজ তার অবর্তমানে ওরা সেই দায়িত্ব পালনেরই চেষ্টা করছে। যদিও ওদের তিনজনেই চিত্রলেখা কখনো কোনোকিছুর কমতি হতে দেয়নি। নিজের সাধ্যের মধ্যে সবটুকু করার চেষ্টা করছে। খাওয়া, পরায় কমতি থাকলেও ভালোবাসা কমতি কোনোদিন হতে দেয়নি চিত্রলেখা।

শাশুড়ির প্রেসার মেপে নিজের ঘরে ফিরতেই তানিয়া দেখে তার ঘরেই বসে আছে রাদিন। তাকে দেখেই উঠে দাঁড়ায় সে। এগিয়ে এসে বউয়ের মুখোমুখি দাঁড়ায়। কিন্তু তাকে খানিকটা অবাক করে দিয়ে তানিয়া পাশ কেটে চলে যায়। বিছানায় গিয়ে বসে, ল্যাপটপটা কোলে নিয়ে তাতে মনোযোগ দেয়। আচমকা তানিয়ার আচরণে এমন পরিবর্তনের আভাস পেয়ে অবাক না হয়ে পারে না সে। তৎক্ষনাৎই অন্যকিছু ভাবে না সে। হয়ত অল্প কিছুদিনের কথা বলে গিয়ে বেশ লম্বা সময় পর আসায় বউয়ের অভিমান হয়েছে, এমনটাই ধরে নেয় রাদিন। স্বাভাবিক থাকবার চেষ্টায় রাদিন পেছন ঘুরে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কেমন আছো? মীম, মিশকাত কি ঘুমিয়ে পড়েছে?

নিজের কাজ করতে করতেই তানিয়া জবাব দেয়।

-এখনো মীম, মিশকাতের ঘুমানোর সময় হয়নি জানো না? নাকি নিজের ছেলেমেয়েদের রুটিন অজানা তোমার?

তানিয়াকে করা কেমন আছো প্রশ্নটা যে সে সরাসরি এড়িয়ে গেল তা বুঝতে রাদিনের বিশেষ অসুবিধা হয়নি। কিন্তু আচমকা তানিয়ার ভেতরকার এই পরিবর্তনের কারণ ধরতে পারছে না। তবে সন্দেহ মনের ভেতর ঠিকই উকি দিচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে হয়ত রওনক তানিয়াকে তার ও শবনমের বিষয়টা জানিয়েছে আবার মনে হচ্ছে হয়ত জানায়নি। রাদিন এক্ষুনি আর তানিয়াকে ঘাটায় না। পরে একান্তে সময় পাওয়া যাবে। তখন নাহয় এসব নিয়ে কথা বলা যাবে। মান-অভিমানও ভাঙানো যাবে।

-আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

বলে যেই রাদিন চেঞ্জিং রুমের দিকে আগায় তানিয়া বলে,

-তোমার সব জিনিসপত্র আমি তোমার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি। এই ঘরে আর তোমার কিচ্ছু নেই।

ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে রাদিন। কপাল সামান্য কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

-আমার ঘরে! এটা কার ঘর তাহলে?

-এটা আমার ঘর।

-তোমার আমার ঘর কি আলাদা?

ল্যাপটপটা কোল থেকে নামিয়ে উঠে এসে রাদিনের মুখোমুখি দাঁড়ায় তানিয়া। তার চোখের দিকে তাকিয়ে যথেষ্ট শক্ত করেই বলে,

-তুমি আমি কখনই একজন ছিলাম না। শুধু একটা সম্পর্কের বোজা বয়ে বেরিয়েছি এতকাল। এখন আর এসব লোকদেখানোর প্রয়োজন নেই।

হাত উঁচু করে দরজা দেখিয়ে তানিয়া আরও বলে,

-তোমার ঘরে তোমার সবকিছু রাখা আছে। আর কিছু লাগলে জাহানারা খালাকে বললেই হবে। নাও এক্সকিউজ মি প্লিজ, আমি জরুরী কাজ করছি।

রাদিন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়া দিয়ে তানিয়া বলে,

-লিভ রাদিন৷ আই নিড টু ওয়ার্ক।

বাধ্য হয়েই নিজের ঘর ছাড়তে হয় রাদিনকে। এই মুহূর্তে কথা বাড়াতে চায় না সে। তার পেছন পেছন দরজার পর্যন্ত এসে তানিয়া আরও বলে,

-একটু পরেই সবাই ডিনারে বসবে যদি খেয়ে এসে না থাকো তাহলে ইউ ক্যান জয়েন।

রাদিনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার মুখের উপরেই দরজাটা আটকে দেয় তানিয়া।

রওনকের বুকে মাথা রেখেই কখন যেনো চিত্রলেখার চোখের পাতায় ঘুম নেমে এসেছে। ঠিক ঘুম নয় তন্দ্রা লেগেছে। রওনক আর সরায় না যদি ঘুম ভেঙে যায় ভেবে৷ প্যান্টের পকেটে থাকা মোবাইলটা বেজে উঠতে তৎক্ষনাৎই বের করে। কল রিসিভ করে কানে তুলতেই অন্যপাশ থেকে তানিয়া বলে,

-ডিনার করবে না?

-তোমরা করে ফেলো ভাবী।

-সেকি কথা! তোমরা খাবে না? এই না বলে গেলে খুদা লেগেছে তোমার?

-চন্দ্রর চোখ লেগেছে। ও উঠলে পরে নাহয় আমরা খেয়ে নিবো। তোমরা অপেক্ষা না করে খেয়ে ফেলো।

-ও আচ্ছা। তাহলে আমাদের ডিনারের পরে নাহয় তোমাদের জন্য টেবিল সাজিয়ে দিবো৷

-এত কষ্ট করতে হবে না। ট্রে তে করে কাউকে দিয়ে উপরে পাঠিয়ে দাও। আমরা নাহয় ঘরেই খেয়ে নিবো আজ।

-ঠিক আছে।

রওনক ফোন রাখতেই টের পায়। চিত্রলেখা সজাগ হয়ে গেছে। নিজেকে রওনকের বুকে আবিষ্কার করে খানিকটা ইতস্তত বোধ করে। তৎক্ষনাৎই সরিয়ে গিয়ে বসে। ভেজা চুল হাত খোপায় বাঁধতে নিলে রওনক বাঁধা দিয়ে বলে,

-এক মিনিট, বেঁধো না।

বাথরুম গিয়ে একটা টাওয়াল নিয়ে ফিরে আসে সে। চিত্রলেখা টাওয়াল দেখে বলে,

-আমাকে দিন, আমি মুছে নিচ্ছি।

রওনক তার কথা শুনে না। বউকে কাছে টেনে নিয়ে যত্ন করে তার চুল মুছতে মুছতে বলে,

-এতটুকু আমায় করার সুযোগ দাও প্লিজ। আউ ওন্ট ডিজাপয়েন্ট ইউ।

রুমের দরজায় কেউ নক করতেই রওনক গিয়ে খুলে দেয়। জাহানারা নিজে এসেছেন ওদের খাবার নিয়ে। উনাকে দেখে রওনক বলল,

-তুমি কষ্ট করে আসতে গেলে কেন বলো তো? অন্যকাউকে পাঠিয়ে দিতে।

এগিয়ে এসে চিত্রলেখার চিবুক স্পর্শ করে চুমু খায় জাহানারা। বলেন,

-আমার রওনকের বউয়ের দায়িত্ব কি আমি অন্যকারো হাতে ছাড়তে পারি?

চিত্রলেখা কেবল মুচকি হাসার চেষ্টা করে। ওদের খাবার দিয়ে জাহানারা চলে গেলে রওনক বলে,

-উনি আমার বাবার দূরত্ব সম্পর্কের বোন হয়। আমার বুঝ হওয়ার পর থেকে উনাকে আমাদের বাড়িতে দেখছি। সম্পর্কে আমাদের ফুফু হলেও আমরা খালা বলেই অভ্যস্ত। মায়ের সঙ্গে সবসময় বোনের মতো করে থেকেছেন তাই আমরা ছোট থেকে খালা বলেই ডেকেছি। উনিও কখনো আপত্তি করেননি। আমাদের জন্য উনি আমাদের পরিবারেরই একজন সদস্য। আমি ভাইয়া অনেক সময় মাকে কাছে পেতাম না তখন এই জাহানারা খালাই নিজের ঘুম বিসর্জন দিয়ে রাতের পর রাত আমাদের খেয়াল রেখেছেন। মায়ের অবর্তমানে মায়ের আদর, স্নেহ দিয়েছেন। আমাদের খেয়াল রেখেছেন।

ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রওনক আরও বলে,

-ভাবী কখনো উনাকে ছোট করে দেখননি। জানি তোমাকে আমার আলাদা করে বলে দিতে হবে না তবুও বলছি উনার দিকে খেয়াল রেখো। আমরা ছাড়া মানুষটার আর কেউ নেই।

চিত্রলেখা রওনককে আশ্বস্ত করে বলে,

-আপনি চিন্তা করবেন না আমি খালার খেয়াল রাখবো।

-আমি জানতাম তুমি রাখবে। এখন এসো ডিনারটা সেরে ফেলি।

একটু উসখুস করে চিত্রলেখা বলে, আমার না খুদা নেই।

ভ্রু কুঁচকে তাকায় রওনক জিজ্ঞেস করে, শাওয়ার নিতে গিয়ে কি পানি খেয়েছো?

চোখ বড় বড় করে তাকায় চিত্রলেখা, সেই সঙ্গে মাথা ঝাকায়। রওনক জিজ্ঞেস করে, তাহলে খুদা থাকবে না কেনো? আজ সারাদিনে ঠিকঠাক খেয়েছিলে কিছু?

এবারেও মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। রওনক হাত ধরেই টেনে নিয়ে যায়। বাইরের রুমে খাবার দিয়ে গেছেন জাহানার। চিত্রলেখাকে ইতস্তত করতে দেখে রওনক জিজ্ঞেস করে, কিছু বলতে চাও?

মাথা দুলিয়ে চিত্রলেখা বলে, আগে চারুকে একটা ফোন করি? ওরা খেলো কিনা…

চিত্রলেখার গলা ধরে আসে। তা টের পেয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে, আসার পরে ফোন করোনি বাসায়?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। অবাক কন্ঠে রওনক বলে, ফোন দাওনি কেনো? ওরা নিশ্চয়ই ফোন কলের অপেক্ষায় আছে। এত বোকা তো তোমাকে ভাবিনি!

চিত্রলেখা জবাব দিতে পারে না। আসার পর রওনকের মায়ের রিয়্যাকশন দেখে সব ভুলে গিয়েছিল সে। মনটাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল এই বাড়িতে যে সে গ্রহণযোগ্য নয় তা জানতে পেরেই মূলত মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাই আর মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফোন করেনি। ঐ সময় তার কন্ঠ শুনলেই ওরা বুঝে ফেলতো এদিকে কিছু একটা ঘটেছে। তাই বলা যায় ইচ্ছা করেই ফোন করেনি সে। কিন্তু এখন খাওয়ার কথা উঠতেই বুক ভার হয়ে কান্না পাচ্ছে তার। যদিও আজ রাতের খাবার সে রান্না করে দিয়ে এসেছে কিন্তু কাল থেকে কে ওদের রান্না করে খাওয়াবে? ভাইবোনগুলো তো ওর হাতের রান্নার পাগল।

রওনক বলে, তুমি কথা বলে আসো তারপর একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করবো আমরা।

চিত্রলেখা আর সময় বিলম্ব করে না। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। চারুকেই ফোন লাগায়। একবার রিং হতেই কল রিসিভ হয়। বোনের কল পেয়ে কেঁদে ফেলে চারু। যদিও সে কাঁদতে চায়নি কিন্তু নিজেকে সামলেও রাখতে পারেনি। একটু করে সবার সঙ্গেই কথা হয় চিত্রলেখার। কথা শেষ করে ওখানেই থম ধরে বসে রয়। চারুর কান্না, খালার কান্না দুই ভাইয়ের ভারী হয়ে আসা কন্ঠ শুনে চিত্রলেখা নিজে কাঁদেনি। ও কেঁদে ফেললে ওরা আরও ভেঙে পড়তো। তাই নিজেকে আটকে রেখেছে। রওনক এতক্ষণ দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। একমিনিট সময় অপেক্ষা করে এগিয়ে আসে সে। চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে নিয়ে যায় ডিনার করতে। এক্ষুনি কিছু বলে না রওনক চিত্রলেখাকে। নিজেই প্লেটে খাবার তুলে নেয়। ভাত মাখিয়ে প্রথম লোকমাটা বউয়ের মুখের সামনে ধরে বলে,

-হা করো আমি খাইয়ে দিচ্ছি। আজ আর তোমাকে কষ্ট করে নিজের হাতে খেতে হবে না। তোমার মন খারাপের রাতগুলোতে নেয় আমি তোমার একটু বেশি যত্ন করবো৷ একটু বেশি খেয়াল রাখবো। তুমি কেবল আমায় সেই সুযোগ দিও।

চিত্রলেখা একপলক রওনকের চোখের দিকে তাকায়। তারপর বাধ্য মেয়ের মতো মুখ খুলে লোকমাটা নেয়। কি হলো তার কে জানে হুরহুর করে চোখ ঙেভে কান্না পেয়ে গেল। চিত্রলেখা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। চোখ ভাসিয়ে কেঁদে ফেলল। রওনক বাঁধা দিলো না। সেই সঙ্গে ভাত খাওয়ানোও বন্ধ করলো না। সে নিজের কাজ করতে থাকলো, চিত্রলেখাকেও কাঁদতে দিলো।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

খাওয়া দাওয়ার পর বেডরুমে ফিরে এসে রওনক চিত্রলেখাকে বলে, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।

চিত্রলেখা আগ্রহ ভরে তাকিয়ে থাকে। কি দেখাবে তা দেখার জন্য। রওনক এগিয়ে গিয়ে বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ছোট রিমোট বের করে। রুমের একদিকের দেয়াল জুড়ে পর্দা। সেদিকে প্রেস করতেই অটোমেটিক পর্দা সরে যেতে লাগলো। অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। পর্দা দু’পাশে সরে যেতেই বেরিয়ে আসলো সম্পূর্ণটা থাই করা। আর ওদিকে ঝুল খোলা বারান্দা। রওনক আবার রিমোট টিপে পর্দা আটকে দিয়ে বলল, এটা অটোমেটিক। তোমার সুবিধার জন্য জানিয়ে রাখলাম।

রিমোটটা জায়গা মতো রাখতে রাখতে রওনক আরও বলে, অনেক রাত হলো, আসো শুয়ে পড়ি। তুমি হয়ত টায়ার্ড।

বলতে বলতেই রওনক বিছানার বাম পাশটায় প্রায় শুয়ে পড়েছে। চিত্রলেখাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে, কি হলো? দাঁড়িয়ে আছো কেন? আসো ঘুমাই।

একবার ঢোক গিলে চিত্রলেখা মিনমিন করে বলল, আমরা এক বিছানায়ই ঘুমাবো?

চিত্রলেখার প্রশ্ন শুনে রওনক উঠে বসে। বলে,

-হাসবেন্ড ওয়াইফ তো এক বিছানাতেই ঘুমায় তাই না?

-কিন্তু আমাদের একসাথে ঘুমানোটা কি দরকার? না মানে আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি বাইরের ঘরের সোফায় বা এখানে নিচেও ঘুমাতে পারবো। আমার কোনো সমস্যা নেই।

চিত্রলেখার কথা শুনে কেমন কেমন করে যেনো তাকায় রওনক। মুখে হাসি ভাব রেখে বলে,

-আমরা কি সিনেমা করছি? আমি বেডে ঘুমাবো, তুমি ফ্লোরে। কাম অন চন্দ্র। উই আর ম্যারিড কাপল। দিজ ইজ নট এ জোক এন্ড উই আর নট জোকিং হিয়ার। উই আর ম্যারিড ফর দ্যা লং লাইফটাইম।

তারপরেও গড়িমসি করে চিত্রলেখা। এবারে রওনক সামান্য শক্ত না হয়ে পাড়ে না। চোয়াল শক্ত করে বলে, তুমি কি চাইছো আমি উঠে গিয়ে তোমায় কোলে করে বেডে নিয়ে আসি। ইফ ইউ ওয়ান্ট আই ক্যান ডু দ্যাট হ্যাপিলি।

চিত্রলেখা তৎক্ষনাৎ তটস্থ হয়। খানিকটা ঘাবড়েও যায়। রওনক যে এমন কাজ করার আগে দুইবার ভাববে না সেটা তার বুঝা হয়ে গিয়েছে তাই আপত্তি করে বলে, না না এর প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই শুয়ে পরছি।

ছোট ছোট কদম ফেলে বিছানায় গিয়ে বসে চিত্রলেখা, রওনকের দিকে পিঠ করে। পেছন দিকে রওনক বসে থেকেই জিজ্ঞেস করে, তুমি এই পাশে শুতে চাইলে আমি ওপাশে শুতে পারি, আই ডন্ট মাইন্ড।

-না না লাগবে না। যেকোনো একপাশ হলেই আমার চলবে। কোনোপাশেই সমস্যা নেই আমার।

-ভেরি গুড।

বলেই হাত বাড়ায় রওনক। তার পাশেই রুমের লাইটের সুইচ বোর্ড। লাইট অফ করে দিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালায় সে। একদমই মৃদু হলদেটে লাইটিং। অনেকটা নিয়ন আলোর মতো। শুয়ে পড়েছে রওনক পেছনে না ঘুরেও তা টের পায় চিত্রলেখা। বুকের ভেতর কেমন ধুকধুক করছে তার অকারণেই। একজন পুরুষের সঙ্গে একঘরে, একবিছানায় থাকতে হবে ভাবতেই বুকের ভেতর অদৃশ্য তোলপাড় হয় তার। শুয়ে পড়ার আগে এক ঢোক পানি খায় সে। তারপর বুকে জড়িয়ে রাখা ওড়নাটা দলা পাকিয়ে বালিশের পাশে রাখে। চিত্রলেখার পরণে খুবই কমফোর্টেবল নাইটসুট। পাজামা ও শার্ট। এমনকি রওনকও একই ধরনের পোশাক পরেছে। টিভিতে, সিনেমায় দেখা যায় নারী চরিত্ররা নাইটি পড়ে কিন্তু রওনক তাকে তেমন কিছু দেয়নি। ভাগ্য ভালো দেয়নি নয়ত লজ্জায় মাটিতে ঢুকে পড়তে হতো তাকে। ওসব নাইটির চাইতে এই পোশাকটা যথেষ্ট মানসম্মতও। না পেট বের হয়েছে, না হাঁটু বের হয়েছে আর না বুক, পিঠ দেখা যাচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে এর সঙ্গে ওড়না নেই। স্কার্ফ হলেও ভালো হতো। তবে সমস্যা নেই চিত্রলেখা ড্রেসের ওড়না দিয়ে কাজ চালিয়ে নিয়েছে। আস্তেধীরে বিছানার কার্নিশ ঘেষে শুয়ে পড়ে চিত্রলেখা। কিং সাইজের বিছানাটা দু’জন মানুষের জন্য যথেষ্টের চাইতেও বেশি। চিত্রলেখার মনে হয় এই বিছানাটা হয়ত কিং সাইজের চাইতেও বড়। এতে অবশ্য ওর জন্যই ভালো হয়েছে। হাত পা সামান্য এদিক সেদিক হলেও সেটা রওনক পর্যন্ত পৌঁছাবে না। তাছাড়া চিত্রলেখার শোয়া খারাপ নয়। ঘুমের মধ্যে পাশের জনের উপর হাত পা তুলে দেয়ার অভ্যাস তার নেই। বরং দেখা যায় ঘুমের মধ্যে কমই হাত পা ছোড়ে সে। শান্ত হয়েই ঘুমায়। এদিক থেকে নিজের উপর বিশ্বাস আছে তার। কেবল বিশ্বাস নেই পেছন দিকে বিছানার অপর প্রান্তে শুয়ে থাকা মানুষটার উপর। কখন কি করে বলা মুশকিল। এখনো মানুষটাকে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছে না সে।

চুপচাপ শান্ত হয়েই শুয়ে থাকে চিত্রলেখা একদম গুটিশুটি মেরে। বিছানার একদম কার্নিশ ঘেঁষেই শুয়েছে আরেকটু সামান্য এদিক হলে ধপাস করে নিচে পড়ে যাবে। তবুও ওভাবেই শুয়ে থাকে। পেছনে রওনকের সাড়াশব্দ নেই। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে সামান্য স্বস্তি পায় চিত্রলেখা। কিন্তু তার স্বস্তি পাওয়া মিনিটও অতিক্রম করতে পারে না। আচমকাই পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার পেটের কাছে ধরে টেনে নেয় রওনক নিজের কাছে। আচমকা টান দেয়ায় চিত্রলেখা কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। তার পিঠ গিয়ে ঠেকলো রওনকের বুকের সঙ্গে। অস্ফুটস্বরে চিত্রলেখা বলল, কী করছেন?

রওনক মুখটা চিত্রলেখার মাথার কাছাকাছি নিয়ে এলো। তার বাম হাতটা এখনো চিত্রলেখার পেটে জড়িয়ে রাখা শক্ত বাঁধনে। ডান হাত বাড়িয়ে রওনক চিত্রলেখার খোলা চুলগলো উপরের দিকে তুলে দিয়ে তার ঘাড় উন্মুক্ত করে। মুখ বাড়িয়ে কানের কাছে গিয়ে রওনক ফিসফিস করে বলে, বউকে কাছে টানছি।

চিত্রলেখার উন্মুক্ত ঘাড়ে আলতো করে চুমু খায় রওনক। খুব গভীর করে নয়, ছোট্ট করে। প্রথম স্পর্শে নিজের অভুক্ততা নয় ভালোবাসা প্রকাশ করতে চায় সে। আচমকা রওনকের এমন কাছে আসায় ঘাবড়ে গেছে চিত্রলেখা। হয়ত এখনই এমনটা আশা করেনি সে। চিত্রলেখার ইতস্তত বুঝতে পেরে তাকে স্বাভাবিক করতে রওনক বলে, তুমি কি ভেবেছিলে আমাদের ভেতর কিছুই হবে না? উই আর লিগ্যালি ম্যারিড। তুমি আমার বউ। উই ক্যান গেট ইনটিমেট। বিয়ে করেছি বউয়ের সঙ্গে কিছু হবে না, কিছু করব না এসব মুভিতে হয় বাস্তবে নয় বুঝলে। এন্ড ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন বলে রাখি আমি কিন্তু বিয়ের আগে বলিনি তোমায় স্পর্শ করব না, তোমার কাছে যাবো না, তোমাকে কাছে টানবো না। এমন কোনো এগ্রিমেন্ট আমাদের হয়নি। এন্ড লেট মি ক্লিয়ার মাইসেল্ফ, আই উইল ডেফিনিয়েটলি গেট ক্লোজ টু ইউ। অলসো উই উইল গেট ইনটিমেট।

চিত্রলেখা এমনিতেই দলা পাকিয়ে ছিল। রওনকের মুখে এসব কথা শুনে আরও নুইয়ে যেতে থাকে। এসব শুনতে হবে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। ইশ! ভীষণ লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে বেচারী। বউয়ের লজ্জা পাওয়া চোখে না দেখতে পেলেও বেশ টের পাচ্ছে রওনক। ভালোই লাগছে তার। এমনিতেই চিত্রলেখাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে রওনক। এবারে আরও খানিকটা বুকের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা করে বলে, ছয় বছর চন্দ্র। ছয় বছর পর কারো সঙ্গে বিছানা শেয়ার করছি, নিজের ঘর শেয়ার করছি, নিজেকে শেয়ার করছি। ছয় বছর, সিক্স লং ইয়ারস। তুমি বুঝবে না আমার অবস্থাটা।

কথাটা চিত্রলেখাকে কোথায় গিয়ে যেনো স্পর্শ করলো। একটা মানুষ চাইলেই নিজের শরীরিক চাহিদা মিটাতে পারতেন অথচ সয়ে গেছেন। কখনো কোনো অনৈতিক সম্পর্কে জড়ায়নি। চিত্রলেখা ভাবে, সে কি আসলেই এত ভালো একজন মানুষের যোগ্য!

আজকের মতো যথেষ্ট হয়েছে ভাবে রওনক। প্রথম রাতেই চিত্রলেখাকে এর বেশি বিরক্ত করবে না ভাবে সে। রওনক চিত্রলেখার মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে বলে, তবে ডন্ট ওয়ারি আজ তোমায় একদম বিরক্ত করব না। আই নো তুমি টায়ার্ড। তাই আর একটুও বিরক্ত করছি না, ঘুমিয়ে পড়ো তবে দূরে গিয়ে নয়। আমার বুকে থাকো, এতে আমার ঘুমটা ভালো হবে। আমাকে একটু শান্তি করে ঘুমাতে দাও তো।

চিত্রলেখা কিছুই বলে না। সরে যাবারও চেষ্টা করে না। মানুষটা আপাদমস্তক মুগ্ধতায় মোড়ানো। চিত্রলেখার নিজেরও ভালো লাগছে এই মানুষটার আলিঙ্গনে থাকতে। যদিও অস্বস্তি লাগছে তবুও একদম মন্দ লাগছে না। বরং মনের ভেতরে ভালো লাগার মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে একটু একটু করে। নতুন সম্পর্ক, নতুন স্পর্শ, নতুন অনুভূতিদের সঙ্গে পরিচয়। সবটা ইতস্ততকর, অস্বস্তিকর হলেও কোথাও একটা ভালো লাগা কাজ করছে। ওভাবেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে চিত্রলেখার জানা নেই। গভীর ও গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেছে সে।

চিত্রলেখার গভীর ঘুম আলগা হয় আচমকা কারো নিবিড় স্পর্শে। একমুহূর্তের জন্য ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু তৎক্ষনাৎই মস্তিষ্ক তাকে জানিয়েছে চারু নয় রওনকের সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমিয়েছে সে আজ। তার জীবন আর আগের মতো নেই, সব বদলে গেছে। এখন সে বিবাহিত, পাশের পুরুষটার তারউপর সম্পূর্ণ অধিকার আছে। চিত্রলেখার ঘুম আলগা হতেই সে টের পায় রওনকের হাত অবাধ্যের মতো তার দেহের বিভিন্ন অঙ্গে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। যদিও চিত্রলেখার গায়ের কাপড় গায়েই আছে কেবল রওনকের হাত চলে গেছে তার কাপড়ের ভেতর। কোথাও শক্ত স্পর্শ করছে কোথাও বা আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে রওনকের ভারী নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে চিত্রলেখার উন্মুক্ত বক্ষ ও গলায়। উঠে এসে রওনক তার কানের নিচে চুমু খাচ্ছে। সে চোখ মেলেনি। বিছানা খামচে ধরেছে। ইতোমধ্যে চিত্রলেখারও নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে। রওনক এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার কপালে চুমু খায়। তারপর কানের কাছে গিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

-সরি, আজ তোমায় একদম ডিস্টার্ব করতে চাইনি বিশ্বাস করো। কিন্তু নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি শেষ পর্যন্ত। আই এম ডাইং হিয়ার ট্রাস্ট মি। প্লিজ একবার একটু কাছে আসো এরপর একদম বিরক্ত করব না, আই প্রমিজ। সিক্স লং ইয়ারস চন্দ্র আমি কাউকে ছুঁয়ে দেখিনি। নারী স্বাদ জানা এই শরীরটা কারো সংস্পর্শে যায়নি। এখন আর পারছি না। তুমি আমার জীবনে এসে সব বদলে দিয়েছো, সব। আমাকে উল্টে-পাল্টে একদম ঘেটে দিয়েছো। ইটস অল ইউর ফল্ট।

চিত্রলেখা কিচ্ছু বলতে পারে না। শক্ত পাথরের মতো হয়ে গেছে যেনো। তবে রওনকের প্রতিটা স্পর্শ তার অঙ্গে অঙ্গে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। শিরায় শিরায় যেন আগুন জ্বলছে। সেই সঙ্গে শিরদাঁড়া বেয়ে হিমশীলত করা অনুভূতিও বয়ে যাচ্ছে। নিজেকে মাতাল মাতাল লাগছে চিত্রলেখার। রওনক নিজে মাতাল হাওয়ায় মেতেছে সেই সঙ্গে তাকেও মাতিয়েছে৷ বিছানা ছেড়ে চিত্রলেখা রওনককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। নিজের শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। রওনক এতটুকু সম্মতি পেয়ে বউয়ের কাঁপতে থাকা অধর জোড়া নিজের দখলে নেয়। গভীর ও নিবিড় স্পর্শে, গাঢ় চুমু খায় লম্বা সময় নিয়ে। খানিকক্ষণ আদর দিয়ে, কিছুক্ষণ হিংস্রভাবে ঐ ঠোঁটের সুধা পানে ব্যস্ত রওনক যেনো এই পৃথিবীর কোথাও নেই। তারা ভাসছে যেনো সৌরজগতের মহাশূন্যে। দীর্ঘ স্পর্শের পর আচমকাই রওনক চিত্রলেখার ঠোঁট ছেড়ে উঠে বসে। জোরে জোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস ছাড়ে। চিত্রলেখা নড়ে না, চোখও মেলে না। অন্যদিকে কাত হয়ে কুঁচকে যায় আবারও। লজ্জায় সমস্ত শরীর মাখামাখি হয়ে আছে তার৷ রওনক উঠে গিয়ে খানিকটা পানি খায়। তার নিজের সাইডের বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার নিয়ে বারান্দায় চলে যায় সে। তখনই উঠে বসে চিত্রলেখা। তারও তীব্র পানির পিপাসা পেয়েছে। বুকের ভেতর এখনো বাদ্যযন্ত্র বাজছে। কেউ পাশে এসে বসলেই শব্দ শুনতে পাবে। তবে কোথাও গিয়ে মানুষটার জন্য মায়া হয় তার। এতগুলো বছর একটা মানুষ নিজেকে সবরকম চাহিদা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ভাবতেই রওনকের জন্য কষ্ট লাগে তার। ইচ্ছা হয় বলতে, আমি আছি। বিছানা থেকে নেমে পানি খায় চিত্রলেখা। আবার শুয়ে পড়তে নিয়েও শুয়ে পড়ে না। কি ভেবে যেনো চিত্রলেখা নিজেও বারান্দার দিকে আগায়। শব্দহীন হেটে বারান্দায় আসতেই দেখতে পায় রওনক জ্বলন্ত সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ব্যস্ত। বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে অন্য পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। এর মধ্যেই তার উপস্থিতি টের পেয়ে সিগারেটে টান দিতে দিতেই মুখ ঘুরিয়ে বউয়ের দিকে তাকায় রওনক। চিত্রলেখার কি হলো কে জানে! ঐ চাহনি দেখে একটা হার্টবিট মিস হলো তার। রওনকের দৃষ্টির গভীর চাহনি দেখে শরীর হালকা হয়ে এলে যেনো। তবু নিজেকে সামলে নেয় সে। রওনক বলে,

-দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কাছে আসো।

মাথা ঝাঁকিয়ে চিত্রলেখা বলে, সিগারেটের গন্ধটা সহ্য হয় না আমার৷

-ফেলে দিতে বলছো?

-না না আমার জন্য ফেলতে হবে না।

-আর যদি একেবারেই ছেড়ে দেই?

-আমার জন্য?

-হু, তোমার জন্য।

-ছেড়ে দিবেন?

-দিতে পারি কিন্তু বিনিময়ে আমি কী পাবো?

চিত্রলেখা স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। কি বলবে বুঝতে পারে না। এই মানুষটাকে বিনিময় দেয়ার সাধ্য কি তার আছে? রওনক তার হাতের সিগারেটটার আগুন নিভিয়ে বারান্দা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। এরপর একে একে লাইটার ও সিগারেটের প্যাকেটটাও ফেলে দেয়। সব ফেলে দিয়ে বলে,

-ফেলে দিলাম তোমার জন্য। বিনিময়ে একটা জিনিস চাই দিবে?

-কী?

রওনক এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার চোয়াল স্পর্শ করে। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ঠোঁট স্পর্শ করে বলে, এই ঠোঁট জোড়া আমায় দিয়ে দাও। পারমিশন দাও আমি যখন খুশি ছুঁয়ে দিতে পারবো। আই প্রমিজ সব ছেড়ে দিবো।

চিত্রলেখা জমে গেছে। জবাব দিতে পারে না। আমতা আমতা করে বলে, আমি যাই, ঘুম পাচ্ছে।

এক কদম পিছিয়ে গিয়ে রওনক বলে,

-সত্যি ঘুম পাচ্ছে নাকি পালাতে চাইছো?

চিত্রলেখা জবাব দিতে পারে না। আসলে সে পালানোর জন্যই ঘুমের বাহানা করেছে। রওনক বলে, সত্যি ঘুম না পেয়ে থাকলে একটু পাশে থাকো। আমার তোমাকে কিছু বলার আছে।

আচমকাই রওনকের চেহারার রঙ পাল্টে যায়। তাকে সিরিয়াস দেখাচ্ছে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

আচমকাই রওনকের চেহারার রঙ পাল্টে যায়। তাকে সিরিয়াস দেখাচ্ছে। তার মুখের ভাব দেখে চিত্রলেখার চোখ-মুখও শক্ত হয় খানিকটা। রওনক একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, কাছে এসো।

চিত্রলেখা আপত্তি করে না। তার দিকে রওনকের বাড়িয়ে রাখা হাতটা হাত বাড়িয়ে ধরে। বউকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে পেছন থেকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলে,

-আটবছর আগে তিলত্তমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আমার। আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে। পারিবারিক পছন্দেই বিয়ে হয়েছিল আমাদের। চাপে পড়ে বিয়ে করেছিলাম এমন নয়। সবসময় লেখাপড়া নিয়ে সিরিয়াস থাকার ফলাফল কখনো প্রেম করা হয়ে ওঠেনি আমার। তাই সেভাবে পার্সোনাল কোনো চয়েজ ছিল না বলতে পারো। এছাড়া বাবা-মায়ের উপর ভরসা ছিল আমার জন্য উনারা নিশ্চয়ই বেস্ট কাউকেই বেছে আনবেন। সত্যি কথা বলতে তিলত্তমাকে দেখে আমারও পছন্দ হয়েছিল। তাই আর আপত্তি করিনি। বলতে পারো ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে। ওর আগে আমার জীবনে কোনো মেয়ে আসেনি। সি অয়াজ মাই ফাস্ট লাভ। মাই ফাস্ট লেডি।

রওনকের মুখে “সি অয়াজ মাই ফাস্ট লাভ” শুনে চিত্রলেখার বুকের ভেতর কোথায় গিয়ে যেনো কথাটা বিধলো। কিন্তু কেনো বিধলো তা বুঝতে পারলো না সে। রওনক বলতে থাকে নিজের মতো করে।

-সুখেই ছিলাম আমরা। ওকে ভালোবাসতে কোনো কমতি রাখিনি আমি। নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে ভালোবাসার চেষ্টা করেছি। ওর যেনো কোনো কিছুর কমতি না হয় সেদিকে খেয়াল রেখেছি। ওর কি লাগবে না লাগবে খেয়াল রাখতাম। ও কি পছন্দ করে, কোনটা অপছন্দ করে সব, সবদিকে আমার নজর থাকতো। বলতে পারো ওই সময় তিলত্তমার ভালোবাসায় অন্ধ ছিলাম আমি বা এমনও বলতে পারো তিলত্তমাকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসতাম। শুধু আমি একা নই, তিলত্তমাও আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। ওর জীবনেও আমার আগে কেউ আসেনি। ওর জীবনের প্রথম পুরুষ ছিলাম আমি।

“আপনি তো আমার জীবনেও প্রথম পুরুষ। কেউ তো কোনোদিন আমায় স্পর্শ করতে পারেনি। আমার মনের দরকার কড়াও নাড়তে পারেনি কিন্তু এই যে আপনি জড়িয়ে আছেন আমার আষ্টে-পৃষ্টে, আমার মনের ভেতর ঝড় তুলে দিচ্ছেন। আপনার গন্ধ মিশে আছে আমার সমস্ত শরীর জুড়ে। অথচ আপনার জীবনের প্রথম নারী আমি নই।” কথাটা মনে মনেই আওড়ায় চিত্রলেখা। রওনকের মুখে তার প্রথম ভালোবাসার কথা শুনে চিত্রলেখার মুখে খানিকটা অন্ধকার নামলো যেনো কিন্তু তা রওনকের অজানা থেকে গেল।

এতটুকু বলে একটু থামে সে। এই সুযোগে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে, তাহলে সেই মানুষটা এখন কোথায়? সেই ভালোবাসা এখন কোথায়?

মেকি হাসে রওনক, চিত্রলেখা সেই হাসি দেখতে পায় না কিন্তু শুনতে পায়। রওনক বলে,

-এত সুখ, ভালোবাসা হয়ত আমার কপালে ছিল না বা সয়নি তাই হারিয়ে গেছে। তিলত্তমা অনেক ভালো একটা মেয়ে, এত ভালো তুমি নিজে ওর সঙ্গে না মিশলে বুঝবে না আসলে। আমার থেকে শুনলে মনে হবে একটা সময় ভালোবাসতাম, আমার ওয়াইফ ছিল তাই হয়ত বাড়িয়ে বলছি কিন্তু একদম সত্যি বলছি বিশ্বাস করো অনেক ভালো একটা মেয়ে ছিল। মানুষ হিসেবে যত ভালো ছিল তার চাইতেও বেশি ভালো ছিল ওর মনটা। সহজেই যে কাউকে আপন করে নিতে পারতো।

চিত্রলেখার আগ্রহ বাড়ে রওনকের কথা শুনে। তার জানতে ইচ্ছা হয় কেন এই মানুষটা হারিয়ে গেল? কার দোষে হারিয়ে গেল? আগ্রহ দমিয়ে রাখতে না পেরে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-বলুন না এত ভালো মানুষটা আপনার জীবন থেকে হারিয়ে গেল কেনো? আপনার এত ভালোভাসা তুচ্ছ করে মানুষটা চলে গেল কেনো?

-বলছি তো একটু ধৈর্য রাখো। সব বলবো তোমাকে। আমি চাইনা আমার ব্যাক্তিগত জীবনের গল্পটা তুমি অন্য কারো মুখ থেকে শুনো তাই আমি নিজেই সব বলবো তোমাকে। আজ, এখনই বলবো।

একমুহূর্ত থেমে রওনক বলতে থাকে নিজের ব্যাক্তিগত জীবনের গল্পটা।

-আমি পড়ালেখা শেষ করে আসার পরপরই বাবার ব্যবসা জয়েন করি। যেহেতু আমার আল্টিমেট গোলই ছিল পারিবারিক বিজনেস জয়েন করা তাই দেশে ফিরে আমি সময় নষ্ট করিনি। তাছাড়া বাবা অবসর নেয়ার আগে তার থেকে আমার অনেককিছু শিখার ছিল। ভাইয়া নিজের পছন্দের ক্যারিয়ার আগেই চুজ করে নিয়েছিল। আমি নিজের ইচ্ছায় বিজনেস জয়েন না করলেও আমাকে বিজনেস জয়েন করা লাগতোই। আমি জয়েন করার কয়েক মাসের মাথায় বাসা থেকে জানানো হয় বাবা-মা আমার জন্য পাত্রী দেখছেন। আমার কোনো চয়েজ থাকলে জানাতে পারি নয়ত উনারা নিজেদের পছন্দ মতো দেখবেন। আমার যেহেতু কোনো চয়েজ ছিল না তাই আমি তাদের উপরেই সবটা ছেড়ে দিয়ে বিজনেসে মন দিলাম। উনারা আমার জন্য তিলত্তমাকে সিলেক্ট করলেন। পারিবারিক ভাবে ধুমধাম করে আমাদের বিয়ে হলো। স্বপ্নের মতো করে বিয়ের প্রথম বছরটা কাটলো আমাদের। ভালোবাসা, ভালোলাগা, মগ্ধতার কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু সেইসব ভালোবাসা, ভালোলাগা, মুগ্ধতায় ভাটা পড়লো একবছর পর। বাবার শরীর খারাপ হতে লাগলো। বিজনেসের সব দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দিলেন। আমি দিনরাত এক করে বিজনেস সামলাচ্ছি। আমার ধ্যান-জ্ঞান সবটা জুড়ে কেবল বিজনেস বিজনেস আর বিজনেস। আমি জানতাম ওই সময়টাতে আমি তিলত্তমাকে যথেষ্ট সময় দিতে পারছিলাম না সেজন্য আমার সরিও ফিল হতো। আমি বহুবার ওকে সরি বলেছি। কত রাত ও আমার অপেক্ষা করতে করতে না খেয়ে ডাইনিং টেবিলেই ঘুমিয়েছে। কখনো মধ্যরাতে, কখনো শেষরাতে, কখনো ভোরবেলায় বাড়ি ফিরলে দেখতে পেতাম আমার অপেক্ষা করতে করতে হয় ডাইনিং টেবিলে নয় ড্রইং রুমের সোফায় ঘুমাচ্ছে। আমি সরি বলতাম। প্রথম প্রথম তিলত্তমা কিছু বলতো না কিন্তু দিনের পর পর এমন হতে থাকলে পরে ও আপত্তি জানায়। আমার সরি না আমাকে চায় সে, আমার সময় চাই তার। আমার বুঝদার তিলত্তমা হঠাৎই অবুঝ হয়ে গেল। সে আর বুঝতে চায় না। তার শুধু আমাকে চাই। কিন্তু আমি পারছিলাম না ওকে সময় দিতে। ওর বুঝতে না চাওয়া আস্তে আস্তে সন্দেহের রূপ নিলো। আমি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত বিজনেসের কাজে বাসার বাইরে থাকতাম, ঢাকার বাইরে থাকতাম, দেশের বাইরে থাকতাম। ও ভাবতে শুরু করলো আমার জীবনে হয়ত অন্য কারো আগমন ঘটেছে। ভাবতে শুরু করলো আমি ওকে চিট করছি। অনেক বুঝিয়েছি ওকে। কিন্তু একদিন এসবের চুড়ান্ত হলো। আমার এক বিজনেস পার্টনার মিস মেলিসা আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আসলেন। উনার থাকার ব্যবস্থা করা হলো লা মেরিডিয়ানে। লম্বা ফ্লাইটের পর ভীষণ ক্লান্ত ছিলেন তিনি। তাই দেখা করতে গিয়েছিলাম আমি। আমার উনাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট যাবার কথা ছিল কিন্তু জরুরী মিটিং পরে যাওয়ায় আমি যেতে পারিনি। সেদিন রাতেই আমাদের চিটাগং যাবার কথা। মিটিং শেষ করে আমি যখন ওখানে যাই আমার পিএ সোনিয়া সঙ্গে ছিল। তিলত্তমার এক ফ্রেন্ড আমাদের দেখে ফেলে ওকে জানায় আমি একটা মেয়েকে নিয়ে হোটেলে গিয়েছি। হন্তদন্ত তিলত্তমা ওখানে গিয়ে পৌঁছায়। ওর মতে ওর সন্দেহ সত্যি হলো। আমি ওকে চিট করছি। বিজনেসের নাম করে মেয়ে নিয়ে হোটেলে থাকছি। কিছুতেই আমি ওকে বিশ্বাস করাতে পারিনি সোনিয়ার সঙ্গে আমার কোনো এফেয়ার নেই। আমরা বিজনেস রিলেটেড কাজে ওখানে গিয়েছিলাম। আমার কোনো কথাই শুনলো না। উল্টো ক্লাইন্টের সামনেই তার আপ্যায়নে ওপেন করা শ্যাম্পেইনের বোতলের সবটুকু ও আমার গায়ে ঢেলে দিলো। আমি কিচ্ছু বলিনি। ভেবেছিলাম বুঝিয়ে বললেই ওর ভুল ভাঙ্গবে। কোনো কিছুর বিনিময়ে ওকে আমি হারাতে চাইনি। কিন্তু বলে না ভাগ্যে না থাকলে সেখানে জোর খাটিয়েও কাজ হয় না। তিলত্তমা আমার নসিবে ছিল না। সেইরাতেই রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। আমি ওকে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু লাভ হয়নি। সোনিয়াকেও ফায়ার করে দিয়েছিলাম। যেনো তিলত্তমা আমাকে অহেতুক সন্দেহ না করে। কিন্তু সন্দেহ এমন এক জিনিস এর বীজ একবার মনের জমিনে বোপন হয়ে গেলে সবকিছু ছারখার না করা পর্যন্ত পিছু ছাড়ে না। বাড়ি ছেড়ে যাবার সাতদিনের মাথায় ও আমাকে ডিভোর্স লেটার পাঠায়। এরপরেও আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওকে ফিরিয়ে আনার কিন্তু…

এক মুহূর্ত চুপ থেকে রওনক আরও বলে, অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ওকে ফেরাতে পারিনি আমি। ওর সন্দেহের কাছে আমার সব ভালোবাসা তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। শেষমেশ আমার ভীষণ অভিমান হলো, ও কেনো আমার ভালোবাসা বুঝলো না? কেনো বুঝলো না আমার জীবনে ও ছাড়া কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। আমার অভিমানের পাল্লা ভারী হলো, আমিও ওকে ফিরে আনার চেষ্টা বাদ দিলাম। যে নিজে থেকে ফিরতে চায় না আমি আমার ভালোবাসার দোহাই দিয়ে তাকে আর ফেরাতে চাই না। অভিমান করে আমিও ওর পাঠানো ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিলাম। একটা সাইনের বিনিময়ে আমার জীবন থেকে আমার ভালোবাসার মানুষটা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল।

কথা শেষ করে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো রওনক। চিত্রলেখা বলল, তারপর আপনাদের আর দেখা হয়নি?

-না।

-কেনো?

-তিলত্তমা নিউইয়র্ক চলে গেছে। ওখানে যাবার ছয় মাস পরেই আবার বিয়ে করেছে। এখন ওর দুটো বাচ্চাও আছে।

একমুহূর্ত চুপ থেকে কিছু ভেবে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-আপনার কি আফসোস হয়?

-আফসোস? হয় তবে তিলত্তমার জন্য নয়।

-তাহলে?

-আমার আফসোস হয় বাচ্চা দুটোর জন্য। ও ভুল বুঝে চলে না গেলে বাচ্চা দুটো আজ আমার হতো। আমাকে বাবা বলে ডাকতো। ও আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে চলে না গেলে এতগুলো বছর আমার একাকী কাটাতে হতো না। আমার জীবনটা ভরে থাকতো। সব থাকতো আমার।

চিত্রলেখার মুখে আর কথা কুলায় না। মানুষটা সত্যি ভালোবাসতো, ভুল ভাবছে সে বাসতো না হয়ত এখনো বাসে। চাইলেই কি ভালোবাসা ভুলে যাওয়া যায়? ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যাওয়া যায়? ভালোবাসার মানুষটা জীবনে থাকুক বা না থাকুক চাইলেও তাকে ভুলে যাওয়া যায় না, সেই ভালোবাসাও ভুলে যাওয়া যায় না। মানুষ পারে না ভুলে যেতে। তাই তো এতগুলো বছর পরেও রওনক তিলত্তমাকে ভুলে যায়নি, তার ফেলে যাওয়া সেই ভালোবাসা ভুলে যায়নি। রওনকের জীবনে ভালোবাসা নামক অধ্যায়ে তিলত্তমার নাম খোদাই করা হয়ে গেছে। সেখানে চিত্রলেখা কোনোদিনও জায়গা পাবে না।

রওনকের হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে চিত্রলেখা বলে, আমার ঘুম পাচ্ছে।

তৎক্ষণাৎই তাকে পাঁজা কোলে তুলে নেয় রওনক। হাত-পা ছোঁড়ার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে, আমাকে নামান প্লিজ।

-নামিয়ে দিবো জায়গা মতো গিয়ে।

চিত্রলেখা হাত-পা নাচিয়েও কাজ হয় না। রওনক বিছানায় এসে কোল থেকে নামিয়ে শুইয়ে দেয়। কিছু বুঝে উঠার আগেই কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলে, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।

সরে গিয়ে রওনক চলে যেতে নিলে চিত্রলেখা পেছন থেকে জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাচ্ছেন?

-শাওয়ার নিতে। নাহলে আজ আর ঘুমাতে পারবো না। ইটস টু হট ফর মি।

রওনক আর দাঁড়ায় না, শাওয়ার নিতে চলে যায়। পেছনে চিত্রলেখা বেচারী লজ্জায় পানি পানি হয়ে যায়। তার নিজেরও মনে হচ্ছে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। লজ্জায় বালিশে মুখ লুকানোর চেষ্টা করে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪৪
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

এবারেও মাথা ঝাকায় তবে মৃদু ভাবে। ইতোমধ্যে চিত্রলেখার শরীর জমে ক্ষীর, পাথর হয়ে আসছে যেনো। শরীর জুড়ে কাঁপুনিও শুরু হয়ে গেছে। এই কাঁপুনি সম্ভবত রওনক টের পেয়েছে। তাই তো তার চোয়াল জুড়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি। চিত্রলেখার অঙ্গের কাঁপুনি আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিতে হাত বাড়িয়ে তার গাল স্পর্শ করে রওনক, নিবিড়ভাবে। চিত্রলেখা উপলব্ধি করে এই স্পর্শ ভীষণ বাড়াবাড়ি রকমের গাঢ়, স্পর্শকাতর। তার অঙ্গের কাঁপন বাড়ে। মনে হয় শরীরের ভেতরে থাকা হাড়ও কাঁপছে। এই পর্যায়ে চিত্রলেখার দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড় হয়। এই বুঝি এক্ষুনি দমবন্ধ হয়ে যাবে তার। নিচের দিকে আরেকটু ঝুঁকে রওনক। চিত্রলেখার একদম সন্নিকটে এসে কথা বলে। তার কথার সঙ্গে মুখ-নাক গলে বেরিয়ে আসা শ্বাস-প্রশ্বাস গিয়ে বারি খায় চিত্রলেখার নাকে ঠোঁট ও চিবুকে। রওনক বলে,

-বউ মানে বুঝো তো? এক ঘরে থেকেছি, এক বিছানায় ঘুমিয়েছি, এক সঙ্গে রাত কাটিয়েছি। এরপরেও বলবে কোনো মাথা ব্যথা নেই?

চিত্রলেখার মুখে কথা নেই। স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে কেবল। নড়তে ভুলে গেছে সে, কথা বলতেও ভুলে গেছে। রওনকের স্পর্শ আরও প্রগাঢ় হয়, আরও নিবিড় হয়।

চিত্রলেখা কিচ্ছু বলতে পারে না। কথারা সব দলাপাকিয়ে রয় তার কন্ঠ নালির কাছে। মুখ খুললে বড়জোর কাই কুই করতে পারবে কিন্তু স্পষ্ট কথা বের হবে না। এমন কিছুর জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না সে। রওনক তাকে একদম বুঝতে দেয়নি কিছুই। অন্য আর সব স্বামী-স্ত্রীর একে-অপরের কাছাকাছি আসাটা স্বাভাবিক হলেও তাদের এতকাছে আসাটা কি স্বাভাবিক! তাদের সম্পর্কে কি এমন কিছু হওয়ার কথা ছিল? মস্তিষ্ক শূন্য অনুভব করে চিত্রলেখা। কিছুই ভাবতে পারে না। কীভাবেই বা ভাববে? এমনটা এর আগে কখনো ঘটেনি তার সঙ্গে। একজন পুরুষের এমন আচমকাই কাছে আসা। তাকে নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে দেয়া। এসব তো কখনো ভাবেনি চিত্রলেখা। অথচ ঘটছে, স্বপ্নে নয় বাস্তবে।

বেশ কিছুক্ষণ ওভাবে থেকেই রওনক যেমন আচমকা চিত্রলেখার শরীরের উপর ঢলে পড়েছিল, সেভাবে আচমকাই উঠে পড়ে। উঠে পড়ে চিত্রলেখার একটা হাত ধরে তাকেও তুলে বসায়। এগিয়ে গিয়ে টি-টেবিলের উপরে থাকা পানির জার থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নিয়ে প্রথমে নিজে খায় খানিকটা। তারপর সেই এটো গ্লাস নিয়েই ফিরে এসে চিত্রলেখার মুখোমুখি দাঁড়ায়। গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলে,

-আই হোপ আমার এটো খেতে তোমার সমস্যা নেই। হাজবেন্ড ওয়াইফ তো গ্লাস শেয়ার করতেই পারে।

চিত্রলেখা ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কথাই বলতে পারে না বেচারী। রওনক আজ কঠিন জব্ধ করেছে তাকে। এখনো চিত্রলেখার শরীরের শিরায় শিরায় শিহরণ বইছে। এসব অনুভূতির সঙ্গে তার পূর্ব পরিচয় না থাকায় নিজেকে সামলে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। চেষ্টা করেও কাজ হচ্ছে না। রওনক মানুষটা একের পর এক চমক দিয়েই যাচ্ছে তাকে। সুযোগ দিচ্ছে না চিত্রলেখাকে ধাতস্থ হবার। বউয়ের শূন্য দৃষ্টি দেখে রওনক নিজেই পানির গ্লাসটা চিত্রলেখার ঠোঁটের কাছে নিয়ে গিয়ে বলে,

-টেক এ্যা সিপ।

চিত্রলেখা আপত্তি করে না, বাঁধা দেবারও চেষ্টা করে না। ওমনিই রওনকের বাড়িয়ে ধরা গ্লাস থেকে তার হাত দিয়েই এক ঢোক পানি খায়। এর বেশি আপাতত তার গলা দিয়ে নামবে না। রওনকও জোড় করে না। পাশেই বিছানায় গ্লাসটা নামিয়ে রেখে হাত বাড়িয়ে আঙ্গুলের স্পর্শে চিত্রলেখার ঠোঁটে লেগে থাকা পানি মুছে দেয়। তৎক্ষনাৎই চিত্রলেখার শরীর জুড়ে শিহরণ খেলে যায়। এনাকন্ডা যেমন পেঁচিয়ে ধরে। এই অনুভূতি, শিহরণ চিত্রলেখাকে ঠিক একইভাবে পেঁচিয়ে ধরেছে। এত শক্তভাবে ধরেছে যে তার দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে খানিকক্ষণ একান্তে থাকা বড্ড প্রয়োজন। এই মানুষটার সামনে থাকলে কখন যেনো সত্যি সত্যি চিত্রলেখা নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। তারপর দমবন্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে। কিন্তু রওনকের থামাথামি নেই। চিত্রলেখার বাহু ধরে তাকে তুলে দাঁড় করায়। কপালের কাছে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো রওনক তার আঙ্গুলের টানে ঠিকঠাক করে কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলে,

-বুঝতে পারছি তোমার জন্য বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। গেট ইউজ টু দিজ। এখন থেকে এমনই হবে। আমি একটুও থামবো না, পেছনও হটবো না। এগিয়ে যাবো আরও প্রবল গতিতে।

চিত্রলেখা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। তার দৃষ্টিভ্রম কাটাতে রওনক চোখের সামনে হাত নিয়ে তুড়ি বাজায়। এতে চিত্রলেখার ধ্যান ভাঙ্গে। এবারে রওনক বলে,

-বাথরুমে যাও, টেক এ্যা হট শাওয়ার। তারপর ডিনার করবো। তারপরেরটা পরে দেখা যাবে।

চিত্রলেখাকে থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কিছু বলতে চাও?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। রওনক বলে,

-বলো।

আমতা আমতা করে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-আমরা দু’জন কি একঘরে মানে এই ঘরে একসাথে থাকবো?

-অফকোর্স। তুমি কি আলাদা থাকতে চাও?

চিত্রলেখা ভেবে পায় না কি বলবে। রওনক অবশ্য তাকে সুযোগও দেয় না কিছু বলার। সে কিছু বলার আগে রওনক নিজেই বলে,

-আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ ইটস নরমাল যে আমরা একঘরে থাকবো। বরং একঘরে না থাকলেই ব্যাপারটা এবনরমাল হয়ে যাবে।

চিত্রলেখার বুকের ভেতরের ধুকপুকানি বাড়ে। এসব তো আগে ভেবে দেখেনি সে। একঘরে থাকা, দু’জনের একে-অপরের সংস্পর্শে আসা। এই বিষয়গুলো চিত্রলেখার চিন্তা ভাবনায় আসেইনি। হয়ত আরও কিছু বলার ছিল তার। কিন্তু আপাতত আর সুযোগ দেয় না রওনক। বরং তাড়া দিয়ে বলে,

-যাও, শাওয়ার নিয়ে আসো। ততক্ষণে আমি একটু ওদিকটা দেখে আসি। ওখানে কি পরিস্থিতি চেক করি। ভাবীর সঙ্গেও একটু কথা বলে আসি মনে হলো কিছু বলতে চায়।

তবুও চিত্রলেখা দাঁড়িয়ে রয়। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনক হাত ধরেই টেনে নিয়ে যায়। বাথরুমে যাবার জন্য আগে চেঞ্জিং রুমে ঢুকতে হবে। দরজা খুলে রওনকসহই ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে ঢুকে অস্ফুট স্বরে চিত্রলেখা বলে,

-এটা তো বাথরুম না।

কাছাকাছি থাকায় রওনক শুনে ফেলে। জবাবে বলে,

-এটা আমাদের চেঞ্জিং রুম।

হাত বাড়িয়ে বাম দিকের একটা দরজা দেখিয়ে আরও বলে,

-ওটা আমাদের বাথরুম।

চিত্রলেখা মুখ ঘুরিয়ে একবার বাথরুমের দরজাটা দেখে তারপর চেঞ্জিং রুমে চোখ বুলায়। আসলেই পয়সাওয়ালা মানুষের ব্যাপার স্যাপারাই আলাদা। চিত্রলেখা কিছুক্ষণ আগে মনে মনে যা ভাবছিল ঠিক তাই। এই রুমটা বেডরুমের তুলনায় বেশ ছোট তবে একদম ছোটও বলা যায় না। রুমের দুই পাশের দেয়াল জুড়ে কাভার্ড করা। একদম উপর থেকে নিচ পর্যন্ত। রওনক এগিয়ে গিয়ে খুলে দেখায়। ইতোমধ্যে রওনক তার জন্য কিছু কেনাকাটাও সেরে ফেলেছে। সেইসব কাপড়চোপড় দেখিয়ে বলে,

-তোমার জন্য কিছু কেনাকাটা করেছি। আপাতত দু চারদিন এগুলো দিয়ে চালাও। আমার হাতে কিছু জরুরী কাজ আছে। সেসব শেষ করে তোমায় নিয়ে শপিংয়ে বের হবো। তোমার যা যা লাগবে সব কিনে নিও। আর যদি চাও তুমি একা গিয়েও কিনতে পারবে সমস্যা নেই। একা না পারলে আমি নিয়ে যাবো জাস্ট আমাকে একটু ফ্রি হতে দাও। দু’পাশের দেয়াল জুড়ে কাভার্ড। অন্যপাশের দেয়ালে একটা স্ট্যান্ড ড্রেসিং মিরর রাখা। তার পাশের কাভার্ডটা খুলে রওনক বলে,

-তোমার মেকাআপ আইটেম, জুয়েলারি সব এখানে আছে।

-কিন্তু আমি তো মেকাআপ করি না।

চিত্রলেখার কথা শুনে হেসে ফেলে রওনক। বলে,

-এখানে খুব বেশি কিছু নেই। আমারও মেকাআপ সম্পর্কে তেমন আইডিয়া নেই। জাস্ট কিছু লিপস্টিক আর কিছু বেসিক আইটেম। এর বাইরে কিছু লাগলে তুমি নিজে গিয়ে কিনে নিও।

থামতে নিয়ে রওনক যোগ করে,

-ওহ! তোমার জন্য আমি নিজের পছন্দে কিছু পারফিউন নিয়েছি। ট্রাই করে দেখো তোমার পছন্দ হয় কিনা।

চিত্রলেখাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনক নিজেই একটা নাইট সুট বের করে হাতে দিয়ে বলে,

-গো প্লিজ।

হাতের কাপড় দেখে চিত্রলেখা বলে,

-এটা পরবো?

-হুম, রাত করে এখন নিশ্চয়ই শাড়ি বা থ্রিপিস পরবে না।

-আমার থ্রিপিস পরে ঘুমানোর অভ্যাস আছে।

-অভ্যেস বদলাও। এখন থেকে ঘুমানোর সময় নাইট সুট পরে ঘুমাবে।

-আমি থ্রিপিস পরেই ঘুমাই।

-নো।

রওনক একপ্রকার জোর করেই ঠেলে চিত্রলেখাকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দেয়। তৎক্ষনাৎই সরে যায় না। খানিকক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে যদি কোনো প্রয়োজন হয় সেই চিন্তা করে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর রওনক নিজে থেকেই দরজায় একবার টোকা দিয়ে বলে,

-তোমার প্রয়োজন হবে এমন সবকিছু রাখা আছে। ফিল ফ্রি টু ইউজ এভ্রিথিং। আমি নিচে যাচ্ছি তুমি আরাম করে, সময় নিয়ে শাওয়ার নাও। আর কিছু লাগলে আমায় ডেকো।

চিত্রলেখা ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। চারিদিকে চোখ বুলায় আসলেই সব আছে। এমনকি প্রয়োজনের চাইতে বেশি আছে। ব্রাশ থেকে শুরু করে স্যানিটারি আইটেমও রাখা আছে। এসব দেখে কিঞ্চিৎ লজ্জা অনুভব করে চিত্রলেখা। তখনই দরজায় আবার টোকা পরে। চিত্রলেখা ভেবেছিল রওনক হয়ত চলে গেছে। দরজায় টোকা পরতেই তটস্থ হয় সে। বাইরে থেকে রওনক বলে,

-একটা কথা বলার ছিল। বেসিনের কলের পানি অটো বের হয়। হাত দিলেই পানি আসবে। যদি কনফিউজড হয়ে যাও তাই বলতে আসলাম। এবার সত্যি সত্যি যাচ্ছি।

চিত্রলেখা এতক্ষণে খেয়াল করে আসলেই তো কলটা আর সাধারণ কলের মতো নয়। রওনকের বলে দেয়া কথা মতো কলের নিচে হাত দিতেই অটো পানি বের হচ্ছে। এটা দেখে চিত্রলেখার চোখ বড় হয়, গোলও হয়। মিরের দিকে তাকায় সে। আর কি কি দেখার বাকি আছে তার চিন্তা করে চিত্রলেখা। আবার এও ভাবে এসব কি সত্যি সত্যি হচ্ছে তার সঙ্গে নাকি সব স্বপ্ন? এই ঘুম ভাঙ্গবে আর দেখবে সবই স্বপ্ন, কিছুই বাস্তব না।

রওনক নিজের ঘর থেকে বের হতেই মুখোমুখি হয় সাবার।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনক নিজের ঘর থেকে বের হতেই মুখোমুখি হয় সাবার। ঘরের দরজায় ওকে দেখেই রওনক জিজ্ঞেস করে,

-তুমি এই সময় এখানে?

জবাব না দিয়ে হাত তুলে নিজের ফোনের স্ক্রিনে ভাসতে থাকা রওনকের বিয়ের আপডেট স্ট্যাটাস দেখিয়ে সাবা পাল্টা জিজ্ঞেস করে,

-এসব কি? এসবের মানে কি?

রওনকের অবশ্য সাবার ফোনের দিকে তাকানো লাগে না। সে এমনিই আন্দাজ করতে পারছে সাবা তাকে কি দেখাতে চাইছে। সেটা বুঝতে পেরে রওনক বলে,

-আমি যতটুকু জানি তুমি যথেষ্ট শিক্ষিত। সামান্য একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়তে পারছো না?

-এটা একদম মজা করার সময় নয় রওনক। আই ওয়ান্ট আন্সার। এসবের মানে কি? তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। হাউ…

সাবাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক বলে,

-ওয়েট এ মিনিট। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার কথা তো কখনোই হয়নি। আমি কি কখনো বলেছি তোমায় বিয়ে করবো? এন্ড লেট মি টেল ইউ ক্লিয়ারলি মজা করার মতো কোনো রিলেশন আমাদের নেই। না আগে ছিল, না এখন আছে আর না ইন ফিউচার হবে। ইউ আর জাস্ট এ নোবাডি টু মি। সো গেট লস্ট ফ্রম হিয়ার।

চলে যেতে নিয়ে আবার দাঁড়ায় রওনক। ওয়ার্নিং দেয়ার সুরে আরও বলে,

-রিমেমবার ওয়ানথিং তোমাকে যেনো কখনো আমি আমার বউয়ের আশেপাশে না দেখি। যদি দেখেছি কখনো আমার বউকে হ্যারেজ করার ট্রাইও করছো ট্রাস্ট মি তোমাকে জাস্ট গায়েব করে ফেলবো আমি। তখন আর এটা দেখবো না তোমার বাবা কে বা কি তার পরিচয়। ইউ উইল সি দ্যা ওয়ার্স্ট অব মি। আর যদি কিছু বলার থাকে মাকে গিয়ে বলো। তোমার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই। আই ডিডেন্ট প্রমিজ ইউ এনিথিং।

-কিন্তু আন্টি আমায় কথা দিয়েছিল আমি তোমার বউ হবো। আমাকে ছাড়া তুমি অন্যকাউকে বিয়ে করতে পারো না।

-আমি কি পারি তা অলরেডি করে দেখিয়েছি।তোমার আর কিছু বলার থাকলে সেটা গিয়ে তোমার আন্টিকে জিজ্ঞেস করো। যেহেতু আমি তোমায় কোনো কথা দেইনি সো এসব দায় আমার নয়। যে কথা দিয়েছে তাকে জিজ্ঞেস করো। অযথা আমার সময় নষ্ট করতে আসবে না। আমার প্রতিটা সেকেন্ড অনেক মূল্যবান। আই এম নট এ ভেগাবন্ড লাইক ইউ। নাও গেট গেস্ট।

রওনক আর দাঁড়ায় না ওখানে। নিচে নেমে যায়। সাবা ওখানে দাঁড়িয়েই ফনা তোলা সা পে র মতো ফসফস করতে থাকে। রাগে শরীর রি রি করছে তার। মন চাইছে এই মেয়েটাকে অর্থাৎ চিত্রলেখাকে জানে মে রে ফেলতে। এত বড় সাহস তার এতদিনের স্বপ্নে এভাবে পানি ঢেলে দেয়। রওনকের বউ হবার যোগ্যতা একমাত্র তার আছে। ওর হাত থেকে রওনককে ছিনিয়ে নেয়ার দুঃসাহস যে করেছে তাকে এর শেষ দেখিয়ে ছাড়বে সাবা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে। সবকিছু অসহ্য লাগছে তার। দিলারা জামানের ঘরে যাবার জন্য নিচে নামতে নিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে সে। রওনক কাকে বিয়ে করেছে একবার সামনাসামনি না দেখলে হচ্ছে না। তাই আশপাশ দেখে নেয় কেউ আছে কিনা। কেউ না থাকায় চট করেই রওনকের ঘরে ঢুকে পরে সে। কিন্তু ঘরে কাউকে দেখতে পায় না। না পেয়ে বেরিয়ে আসতে নিয়ে আবার থমকে দাঁড়ায়। এগিয়ে গিয়ে চেঞ্জিং রুমের দরজায় আড়িপাতে সাবা। ভেতরে কারো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। নব ঘুরালেই দরজা খুলে যায়। প্রথমে উঁকি দিয়ে দেখে নেয় কেউ আছে কিনা। কিন্তু এখানেও কেউ নেই। চেঞ্জিং রুমে প্রবেশ করতেই পানির শব্দ কানে আসলে বুঝতে পারে রওনকের সো কল্ড ওয়াইফ শাওয়ারে আছে। ফনা তোলা সা পে র মতো আবারও ফসফস করতে লাগে সে। ইচ্ছা তো করছে এক্ষুনি গিয়ে এত্তগুলো কথা শুনিয়ে মাথা ফা টি য়ে দিতে। কিন্তু সেই উপায় আপাতত সাবার নেই। চাইলেও এই মুহূর্তে এমনটা করতে পারে না সে। রওনক মাত্রই তাকে সতর্ক করে গেছে তাই এক্ষুনি কিছু করতে পারছে না। তবে বেরিয়ে আসার আগে একটা শ য় তা নি অবশ্য করে। বাথরুমের দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দেয়। অকাজটা করেই সাবা নিজের বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে খানিকক্ষণ শ য় তা নি হাসি হাসে। তারপর সন্তপর্ণে বেরিয়ে আসে এমনভাবে যেন কেউ টের না পায় সে এই ঘরে এসেছিল।

রওনক তানিয়ার ঘরে যাবার আগে একবার কিচেনে যায়। সচরাচর সে কিচেনে আসে না। তাই জাহানারা রওনককে দেখেই ব্যস্ত হোন। জিজ্ঞেস করেন,

-কিছু লাগবে বাবা? তুমি আসলে কেনো? আমায় ডাকতে।

-আমার কিছু লাগবে না খালা। দেখতে এলাম আজ ডিনারের আয়োজন কি।

জাহানারা জবাব দেয়ার আগে পেছন থেকে তানিয়া বলে,

-বাহ! আজ দেখি জামান গ্রুপের সিইও এর পদধূলি আমাদের কিচেনে পড়েছে। এ তো দেখছি পরম সৌভাগ্য আমাদের। তা হঠাৎ এই আগমনের কারণটা কি বউ নাকি রওনক?

নিজের কথায় তানিয়া হেসে ফেলে। তাকে সঙ্গ দিয়ে রওনকও মৃদু হাসে। বলে,

-দেখতে এলাম আজকের প্রিপারেসন কি।

-ও তাই বুঝি? বলো খালা কি রান্না করেছো। নতুন বউ আসা উপলক্ষে কি কি স্পেশাল আইটেম হলো।

কাঁচুমাচু করে জাহানারা বললেন,

-না মানে হঠাৎ করে বউ এমন সময় আসলো আমি জানলে আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতাম। এই অল্প সময়ে আলাদা করে বিশেষ কিছু করা হয়নি। আজকের ম্যনুতে ডাল, পোয়া মাছ, মুরগীর ঝোল, ডিমের চাসনী, রুই মাছের দো-পেয়াজা আর সালাদ ছিল আমি কেবল সঙ্গে সামান্য পোলাও করে দিলাম। সাদা ভাতও আছে। আর চুলায় একটু পায়েস বসিয়েছি নতুন বউয়ের মুখে মিষ্টি কিছু দিতে।

বলেই মুখটা ছোট করে ফেললেন জাহানারা। রওনক চিত্রলেখাকে নিয়ে এমন সময় বাড়ি এসেছে যে ততক্ষণে ডিনার তৈরি করা হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে বিশেষ কিছু রান্না করার প্রস্তুতি যদি নেয়ও অনেক দেরি হয়ে যাবে। রাত ১০ টার কিছু আগে বা পর দিয়ে এই বাড়ির সবার ডিনার করার অভ্যাস। এখন অন্যকিছু রান্না করতে গেলে রাত ১২ টা বেজে যাবে সবার ডিনারে বসতে। এমনিতেই বাড়ির আবহাওয়া গরম। এর মধ্যে জাহানারার মন সায় দেয়নি এক্ষুনি জলদি জলদি কিছু করতে। এতে দিলারা জামান হয়ত আবারও সিন ক্রিয়েট করবেন। তা ভেবেই আর আগ বাড়িয়ে কিছু করেননি তিনি। দীর্ঘদিন ধরে এই বাড়িতে আছেন। কার মেজাজ কেমন তা সবচাইতে ভালো জানেন। জাহানারা খালার শুকনো মুখ দেখে রওনক বলে,

-যথেষ্ট আছে খালা এর বেশি কিছু লাগবে না। যথেষ্ট করেছো। তাছাড়া তোমাদের ছোট বউটা অনেক লক্ষি বুঝলে মরিচ পোড়া দিয়ে ভাত দিলেও আপত্তি করবে না।

অবাক হয়ে জাহানারা বলেন,

-ওমা সেকি কথা! নতুন বউকে মরিচ পোড়া দিয়ে ভাত দিবো কেন? রওনকের বউ মানে হচ্ছে এই বাড়ির রাণী সে কিনা খাবে মরিচ পোড়া দিয়ে ভাত! অসম্ভব। আমি জাহানারা বেঁচে থাকতে তা কোনোদিনও হবে না।

জাহানারার সঙ্গে দুষ্টুমি করতে তানিয়া মুখে মলিন ভাব টেনে বলে,

-ও রওনকের বউ রাণী আর আমি বুঝি দাসী।

নিজের জিহ্ব কেটে জাহানারা বলেন,

-এমা ছিঃ ছিঃ আমি কি তা বলেছি নাকি? তুমিও তো এই বাড়ির আরেক রাণী।

তানিয়া হেসে ফেলে। তার হাসি দেখে জাহানারা বিভ্রান্ত নয়। তবুও সে হাসে। গাল ভরে হাসে। প্রাণ খুলে হাসে। অনেকদিন এভাবে মন উজার করে হাসা হয় না তার। হেসে নিয়ে বলে,

-আমি তোমার সঙ্গে মজা করছিলাম খালা।

স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে জাহানারা। ওরা কিচেন থেকে বেরিয়ে আসতে নিলে জাহানারা তানিয়াকে পেছন ডেকে জিজ্ঞেস করে,

-ডিনারটা সার্ভ করে দেই?

রওনক বলে,

-সার্ভ করতে থাকো। তোমাদের নতুন বউ এখনো শাওয়ারে। ওরে হয়ে গেলে পরে একসাথে খাবো।

তানিয়া দুষ্টুমির ছলে বলে,

-তা তো নতুন বউ রেখে এখন এখানে কেনো?

-তোমার সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি।

-আমাদের জন্য সময় আছে এখন তোমার কাছে?

রওনক হাত জোড় করে বলে,

-প্লিজ ভাবী তুমি এটলিস্ট মজা নিও না।

-বারে আমার একমাত্র দেবর তুমি। ইনফ্যাক্ট দেবর বাদ সব চাইতে ভালো বন্ধু। আমি তোমার লেগ পুল করব না তো কে করবে শুনি?

জোড় করা হাত কপালে ছুঁয়ে রওনক বলে,

-আচ্ছা বত্ত্ব যত খুশি লেগ পুল করো। কিন্তু চলো আগে জরুরী কথা আছে সেটা সেরে নিই। চন্দ্রলেখার শাওয়ার হয়ে যাবে জলদিই। একা না আবার ভয় পায়।

-বাহ! কি প্রেম! আমার দু’চোখ ধন্য হয়ে গেল এমন প্রেমের স্বাক্ষী হতে পারে।

-ভাবী প্লিজ!

তানিয়া খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। তাকে এভাবে মন ভরে হাসতে দেখে রওনকেরও ভালো লাগে। মানুষটা তার প্রাপ্য পায়নি। চরম ঠকে গেছে। রওনকের সাধ্য থাকলে তাকে জিতিয়ে দিতো। কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। নিজের ভাইয়ের কৃতকর্মে ভীষণ আফসোস তার। সারাজীবন আফসোস করলেও এর শোধ হবে না। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চায় রওনকের কিন্তু সন্তপর্ণে তা গোপন করে সে।

ওরা বেরিয়ে যেতে নিয়েও রওনক দাঁড়িয়ে পড়ে। তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে তানিয়া জিজ্ঞেস করে,

-দাঁড়িয়ে পড়লে যে?

-এক মিনিট ভাবী। খালা এদিক আসো তো।

জাহানারা এগিয়ে আসতেই রওনক তার একটা হাত ধরে বলে,

-অফিসে জরুরী কাজের প্রেসার যাচ্ছে এই মুহূর্তে আমি চাইলেও ছুটি নিয়ে বাসায় থেকে চন্দ্রলেখাকে সময় দিতে পারব না। ও এই বাড়িতে নতুন। আমাদের বাড়ির কোনো কিছু সম্পর্কেই ওর কোনো ধরনের আইডিয়া নেই। মায়ের রিয়্যাকশন তো দেখেছোই। খুব জলদিই সে আমার বউকে আপন করে নিবে তা আমার মনে হচ্ছে না। মায়ের সময় লাগবে বুঝতে পারছি। ভাবীও যেহেতু অফিসে বিজি থাকবে তাই বাড়িতে একমাত্র তুমিই আমার ভরসা। যাকে ভরসা করে আমি চন্দ্রলেখাকে রেখে গিয়ে শান্তিতে অফিস করতে পারবো। কাজে মন দিতপ পারব। তুমি ওর দিকে খেয়াল রেখো খালা। আমার বউটা একদম কাঁদা মাটি। কেউ যেচে এসে বিনা কারণে দু’টো চর মা র লেও জানতে চাইবে না ওকে কেনো চর মা রা হলো। বরং ধরেই নিবে ওর দোষ আছে তাই চর পরেছে গালে। হাজার কষ্ট হলেও উফ বলবে না। আমি চাই না ওর বিন্দুমাত্র কষ্ট হোক।

রওনককে আশ্বস্ত করে জাহানারা বলেন,

-তুমি একদম চিন্তা করো না। তোমার অবর্তমানে আমি নতুন বউয়ের সম্পূর্ণ খেয়াল রাখবো। ওর যেনো কোনো সমস্যা না হয়, কোনো কষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবো। সবসময় আদর যত্নে রাখবো।

-থ্যাঙ্কিউ খালা। আমার অনেক বড় টেনশন কমিয়ে দিলে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

-এসব কি হচ্ছে আন্টি? এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। আপনি আমায় কথা দিয়েছিলেন রওনকের বউ যদি কেউ হয় সেটা আমি হবো। তাহলে এসব কি?

দিলারা জামান কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। লজ্জায় বারবার মাথা নুইয়ে আসছে উনার। সাবা বলেই চলল,

-আপনি তো জানেন আমার জন্য কত ভালো ভালো বিয়ের প্রপোজাল প্রায়ই আসে। সুপারস্টার থেকে শুরু করে পলিটিক্যাল ফ্যামিলি কিন্তু শুধুমাত্র আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সবাইকে রিজেক্ট করেছি আন্টি। আমি তো রওনকের বউ কম আপনার পুত্রবধূ হওয়ার স্বপ্ন বেশি দেখেছি। আপনি তো এসবই জানেন। আপনি থাকতে এসব কীভাবে হলো আন্টি? আপনি কেনো রওনককে আটকালেন না? পাপা আমাকে অনেকবার ওয়ার্ন করেছিলেন রওনকের বিষয়ে বারবার ভাবতে বলেছিলেন কিন্তু আমি আমার ডিসিশানে অটল ছিলাম শুধুমাত্র আপনার ভরসায়। এখন আমি পাপাকে কি জবাব দিবো আপনিই বলুন। আমার এতখানি ফেইস লস হয়ে গেল। রিলেটিভস, ফ্রেন্ডস সবাই জানে রওনকের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। আমি কারো কাছে লুকাইনি। এখন আমি কীভাবে সবাইকে ফেইস করবো আন্টি? এর আগে কখনো কেউ আমাকে এতটা ইন্সাল্ট করা তো দূরের কথা কারো সাহস হয়নি আমাকে রিজেক্ট করে। আমি এই ইন্সাল্টটা কীভাবে মেনে নিই? চুপ করে থাকবেন না কিছু বলুন আন্টি, প্লিজ। ফর গট সেইক আপনি কিছু বলুন। রওনক বিয়ে করেছে অথচ আমাকে না অন্য একজনকে এটা আমি কীভাবে মেনে নিই। কথা বলুন আন্টি।

একটানা কথা বলে ন্যাকা কান্নায় ভেঙে পড়ে সাবা। কান্নার শব্দ হলেও তার চোখে পানি নেই। এতে দিলারা জামানের অনুশোচনা বাড়ে। আগের চাইতে আরও বেশি লজ্জাবোধ করেন তিনি। উঠে গিয়ে নিজের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ান। কাউকে দেখা যায় কিনা এদিক সেদিক তাকান। কাউকে দেখতে না পেয়ে গলা উঁচু করে জাহানারাকে ডাকেন। উনার দু’ডাকেই হাতের কাজ ফেলে ছুটে আসেন জাহানারা। সামনে এসে দাঁড়ালেই দিলারা জামান বলেন,

-রওনককে এক্ষুনি আমার ঘরে আসতে বলো, এক্ষুনি।

-কি করতে চাও?

-ভাবছি আপাতত বাসায়ই একটা পার্টি দেই। কাছের সবার সঙ্গে চন্দ্রর পরিচয় করাই। সবাই জানুক, দেখুক আমার ওয়াইফকে। পরিচয় পর্বটা সেরে ফেলতে চাই।

-কারো কি দেখতে বাকি রেখেছো? যা করলে তুমি! অবশ্য এতটাও তোমার কাছে আশা করিনি আমি। হঠাৎ এই আমূল-পরিবর্তনের কারণ কি সত্যি করে বলো তো রওনক।

-পরিবর্তন কোথায় দেখলে?

-পরিবর্তন হয়নি বলছো?

-না তো।

-৪ ঘন্টাও হয়নি বউ নিয়ে এসেছো অথচ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে অন্ততকাল ধরে সংসার করছো দু’জনে। বউ ছাড়া মুখে কোনো কথাই নেই। প্রেমের নদীতে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছো। আর বলছো পরিবর্তন হয়নি।

-আমি তো সবসময়ই এমন ছিলাম ভাবি। এটা কি নতুন কিছু? আগে কখনো দেখেছিলে আমি তিলত্তমাকে ভালোবাসিনি বা ওর প্রাপ্য সম্মান দেই নি।

-তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা এখন বলো তাহলে আমায় কি করতে হবে? আর কবে পার্টি রাখতে চাইছো? বাসায় না করে সেনাকুঞ্জ বা চীন মৈত্রীতেও তো করতে পারি।

তানিয়া ইচ্ছা করেই তিলোত্তমা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার সূক্ষ্ম চেষ্টা করে। রওনক বলে,

-এখনই না ভাবী। চন্দ্র এসবে ইউজ টু না। প্রথমেই এত বড় আয়োজন দেখলে ঘাবড়ে যাবে। একটু সময় যাক ও নিজেকে আমাদের পরিবেশে, সোসাইটিতে মানিয়ে গুছিয়ে নিক তারপর দেখা যাবে। রওনক জামানের বউ সে সোশিয়াল গেদারিং তো ওর জীবনের একটা নিত্য অংশ হয়ে দাঁড়াবে। আজ এই বিজনেস পার্টি তো কাল সেই রিলেটিভের প্রোগ্রাম। এসব চলতেই থাকবে। আগে ওকে একটু ইজি হতে দাও।

-তাও অবশ্য মন্দ বলোনি। কবে পার্টি রাখবে সেটা তো বললে না।

-পরশু রাতের ইভেন্ট। কালকের দিনটা আমি ব্যস্ত থাকবো, চিটাগং যাওয়া লাগবে। বন্দরে একটা মিটিং এটেন্ড করে সন্ধ্যা নাগাদই ফিরে আসবো। তাই পরশুর আয়োজন হবে।

-তোমাদের শপিংটাও কি সেরে ফেলবো? তোমার চন্দ্র কী পরবে?

মৃদু হেসে রওনক বলে,

-তুমি পার্টির দিকটা দেখো, গেস্ট ইনভাইট, ক্যাটারিং, ডেকোরেশন সবাইকে অলরেডি আমার বলা হয়ে গেছে। কিছু গেস্ট বাকি ওটা তুমি কাল দেখে নিও আর দেখবে সব যেনো ঠিকঠাক হয়। লাবিব অবশ্য তোমাকে হেল্প করবে। বাকি চন্দ্র কী পরবে তা অলরেডি আমি ঠিক করে ফেলেছি।

-কখন করলে?

-ইউ নো মি ভাবী। আমি কাজ ফেলে রাখি না।

-তা তো দেখতেই পারছি। সব নিজেই করে ফেলেছো। বাকিটা নিয়ে টেনশন নিও না ওটা আমি সামলে নিবো।

-আই নো। মায়ের ঘরে যাবো, তুমি যাবে?

-চলো যাই। আগ্নেয়গিরি পর্বত সামলে আসি।

-মা জানে তার পেছনে তুমি এসব বলো?

দু’জনেই হেসে ফেলে। অগ্রসর হয় দিলারা জামানের ঘরের দিকে। তানিয়ার ঘর থেকে বের হতেই তাদের দেখা হয় জাহানারার সঙ্গে। ওদের দেখেই রওনককে বলেন,

-আপা তোমাকে ডাকছেন।

রওনক মায়ের ঘরের দরজায় দু’বার নক করে। যদিও দরজা খোলা তবুও ভদ্রতা বশত নক করা। তার পেছনেই তানিয়া। রওনক ভেতরে প্রবেশ করে মায়ের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, আমায় ডেকে ছিলে?

দিলারা জামানের পাশেই সাবা বসা কিন্তু রওনক যেনো ওকে দেখেও দেখলো না এমন একটা ভাব তার মুখের। ছেলের উপর আজ যারপরনাই বিরক্ত দিলারা জামান। রাগি রাগি কন্ঠে বললেন, তুই বল আমাকে আমি এখন ভাই সাহেবকে কি জবাব দিবো?

-কিসের জবাব?

রওনকের কথা শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়লেন দিলারা জামান। সাবার ফিচেল কান্নার গতি বাড়ে। তানিয়া আঁড়চোখে দেখার চেষ্টা করে এমন যে হেঁচকি তুলে কাঁদছে চোখে পানিটানি আছে কিনা। অথচ সাবার চোখে পানির বালাই নেই। দেখে মনে হচ্ছে কান্না করে করে হেঁচকি তুলে ফেলেছে। মনে মনে বিরক্ত হয় তানিয়া একটা মেয়ে এমন চূড়ান্ত পর্যায়ের অসভ্য কীভাবে হতে পারে ভেবে। এর কি নূন্যতম আত্মসম্মানবোধ নেই নাকি! ভাবে তানিয়া। অবশ্য সে নিজেই স্বামী, সংসারের মোহে এতকাল কতবার, কতজায়গায় নিজের আত্মসম্মান বলি দিয়েছে সেখানে সাবা তো চূড়ান্ত পর্যায়ের ন্যাকা, অসভ্য মার্কা মেয়ে। এর আত্মসম্মান না থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং তানিয়া অবাক হতো যদি দেখতো ওর ভেতর আত্মসম্মান আছে। এই মেয়ের চাইতে চন্দ্র মনে মনে থুক্কু বলে তানিয়া। রওনকের মুখে চন্দ্র, চন্দ্রলেখা শুনতে শুনতে তার মুখ দিয়েও একই নাম বেরিয়ে আসছে। এই সাবা তেদর মেয়েটার চাইতে চিত্রলেখার আত্মসম্মানবোধ ডের বেশি। তানিয়া খুশি হয় রওনক এই সাবা টাবাকে প্রশ্রয় দেয়নি বরং চিত্রলেখাকে বিয়ে করেছে। জীবনে সুখী হতে গেলে এমন একজন সঙ্গী থাকাটা অতি-আবশ্যক। সাবার মতো মেয়েরা কাউকে সুখী করতে জানে না। এরা জানে কেবল ন্যাকামি আর শো-অফ। নিজের স্বার্থ ছাড়া এরা চোখে আর কিছুই দেখতে পায় না।

ছেলের কথা শুনে অবাক হয়ে দিলারা জামান বলেন, কিসের জবাব মানে?

-সেটাই তো জানতে চাচ্ছি তুমি আশরাফ আঙ্কেলকে কিসের জবাব দিবে?

-তুই হেয়ালি করছিস আমার সঙ্গে?

-একদমই না। তুমি পরিষ্কার করে না বললে তো আমি বুঝবো না।

দিলারা জামান হাইপার হয়ে যাচ্ছেন। এমনিতেই হাই প্রেসারের মানুষ উনি। উনার এত উত্তেজিত হওয়াটা ঠিক নয়। তানিয়া এগিয়ে এসে বলে,

-রওনক মা হয়ত সাবার সঙ্গে তোমার বিয়ের বিষয়টা বুঝাতে চাইছেন।

ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রওনক বলে,

-আমি অলরেডি কয়েকবার এই কথাটা ক্লিয়ার করেছি। বারবার একই কথা বলতে আমার একদম ভালো লাগে না।

নিজের প্যান্টের পকেটে থাকা মোবাইলটা বের করে রওনক কাকে যেনো কল লাগায়। অন্যপাশে কল রিসিভ হলে রওনক বলে,

-আসসালামু আলাইকুম আয়রাফ আঙ্কেল। সরি রাত করে আপনাকে বিরক্ত করছি। একচুয়েলি ইম্পর্ট্যান্ট বলেই কলটা করা। আপনি হয়ত খবর পেয়েছেন আমি বিয়ে করে ফেলেছি। আমার মা খুব টেনশন করছেন আপনাকে কীভাবে মুখ দেখাবেন, কি জবাব দিবেন ভেবে। মায়ের দিকটা ক্লিয়ার করতে আমার আপনাকে রাত করে বিরক্ত করা। আমার মা সম্ভবত সাবাকে কথা দিয়েছিল আমার সঙ্গে ওর বিয়ে হবে। কিন্তু আমি কখনো সাবাকে এমন কোনো কথা দেইনি। যাকে দিয়েছি আজ সে আমার ওয়াইফ, আমার বাড়িতেই আছে, আমার সঙ্গে। মা সাবাকে বা আপনাদের কি কথা দিয়েছিল আমার থেকে কিছু কনফার্ম না হয়েই। সম্পূর্ণটাই একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং। এসবে আমার কোনো দায় নেই। তারপরেও বিষয়টা যেহেতু আমি রিলেটেড তাই আমি মায়ের হয়ে আপনাকে সরি বলছি। আই হোপ আমি আমার দিকটা ক্লিয়ার করতে পেরেছি। আর আঙ্কেল সাবা এই মুহূর্তে আমাদের বাসায় আছে, ভালো আছে। ও কীভাবে এসেছে জানি না। সঙ্গে গাড়ি না থাকলে আমি ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিবো আপনি চিন্তা করবেন না। জামান গ্রুপের একজন সম্মানিত শেয়ারহোল্ডার আপনি। আপনার জন্য আমি এতটুকু করতেই পারি। গুড নাইট আঙ্গেল।

ফোনটা পকেটে রেখে রওনক মায়ের উদ্দেশ্যে বলে, এই প্রসঙ্গে আর কোনো কথা হবে না।

চেঁচিয়ে ওঠেন দিলারা জামান। বলেন, তুই সবার সামনে আমাকে ছোট করছিস রওনক।

-একদম না। বরং তুমি আমাকে ছোট করেছো। হাসির পাত্র বানিয়ে ফেলেছো। তারপরেও আমি তোমার সম্মান বাঁচানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু এরপরেও যদি তুমি একই কাজ করো তাহলে এরপর আর কারো সম্মান দেখার সময় আমার থাকবে না। আমার ব্যাক্তিগত জীবনে অন্যকারো ইন্টাফেয়ার আমি একদম সহ্য করব না। আমি আমার মতো করে, আমার বউকে নিয়ে শান্তিতে থাকতে চাই, ব্যস।

মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে রওনক তানিয়াকে বলে, কষ্ট করে খালাকে বলো মায়ের প্রেসারটা চেক করে লাগলে আরেকটা প্রেসারের ঔষধ দিয়ে দিতে। আর ড্রাইভারকে বলো আপদটাকে ওর বাসায় দিয়ে আসতে। ডাইনিং টেবিলে আমি আর কোনো উটকো ঝামেলা চাই না।

সাবা আর কোনো কথা বলে না। এত অপমান এর আগে কোনো ফেইস করেনি সে। গায়ে জ্বালা ধরে গেছে ওর। কোথাকার না কোথাকার একটা মেয়ের জন্য রওনক তাকে অপমান করছে। আশরাফ আহমেদের মেয়েকে রিজেক্ট করছে। রওনককে এর চরম মূল্য দিতে হবে। ফণা তোলা সা পে র মতো ফসফস করতে করতেই বেরিয়ে যায় সাবা।

সাবার যাওয়ার দিক ইশারা করে তানিয়া রওনককে বলে, তোমার আপদ বিদায় হয়েছে।

-আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া। এক কাজ করলে কেমন হয় বলো তো ভাবী।

-কি কাজ? (আগ্রহ ভরে জিজ্ঞেস করে তানিয়া।)

-সিকিউরিটিকে বলে রাখলাম আমি বাসায় থাকা অবস্থায় যেনো এই মেয়েটাকে এলাও না করে।

তানিয়া আর হাসি চেপে রাখতে পারে না। ভাবীর হাসি দেখে রওনক বলে, হেসো না প্লিজ। সি ইজ সাচ এ পেইন ইন দ্যা হেড।

চিত্রলেখা বেশ সময় নিয়েই শাওয়ার দিয়েছে। এই বাড়িতে প্রবেশ করার পর থেকে একে একে যা দেখছে সব মিলিয়ে শরীরে ক্লান্তি জেঁকে বসেছে। তাই অতিরিক্ত সময় নিয়েই শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল সে। শুধু শরীর নয় মনটারও যেনো গোসল হয়ে গেছে। যথেষ্ট ফুরফুরে লাগছে। কাপড় বদলে ভেজা চুল টাওয়ালে জড়িয়ে নিয়ে চিত্রলেখা যেই নব ঘুরিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করে ওমনি সতর্ক হয় সে। দরজাটা খুলছে না। টের পায় দরজা আটকে গেছে। দু’হাত বাড়িয়ে ভেতরের দিকে জোরে টানে তবুও কাজ হয় না। দরজাটা লক হয়ে গেছে। নবের লকটা কি আটকে গেলো? এখন কীভাবে বের হবে সে? চিত্রলেখা একবার চারদিকে চোখ বুলায়। বন্ধ বাথরুমে আটকা পড়ে গেছে সে। ভাবতেই মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে আসতে লাগে তার। নিঃশ্বাস ভারী হতে শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। আরও কয়েকবার নব ধরে টানে সে। জোরে জোরে বারিও দেয় কয়টা। সেই সঙ্গে ডাকেও,

-কেউ আছেন? এই যে শুনছেন আমি বাথরুমে আটকে গিয়েছি। এই যে… আপনি কি ঘরে আছেন? শুনছেন আমি ডাকছি। এই যে শুনুন…

আগের চাইতে আরও জোরে দরজা পেটায় চিত্রলেখা। তৎক্ষনাৎই তার মনে পড়ে রওনক তখন বলে গেল সে নিচে যাচ্ছে। সে কি এখনো ফিরে আসেনি? এখন থেকে তো তার আওয়াজ বাহির পর্যন্ত পৌঁছাবে না। বাথরুমের বাইরে চেঞ্জিং রুম, তারপর বেড রুম, তারপর লিভিং এরপর বেরিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে। এদিকে কেউ না আসলে তো টের পাবে না সে বাথরুমে আটকে আছে। এখন কি উপায় হবে? ভাবতেই চিত্রলেখার চোখ-মুখ শুকিয়ে আসতে লাগে। জলদি এখান থেকে বের না হলে যেকোনো মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেলব সে। চিত্রলেখার অস্থিরতা বাড়ে। সজোরে দরজায় বারি দিয়ে আর্তচিৎকার করতে লাগে,

-এই যে শুনছেন। আমি আটকে গেছি। এই যে, রওনক, রওনক আপনি কোথায় প্লিজ দরজা খুলুন আমি আটকে গেছি। রওনক প্লিজ আমাকে বের করুন এখান থেকে। রওনক…

তানিয়া রওনকের কথপোকথন চলাকালীনই বাসায় প্রবেশ করে রাদিন। ঐ ঘটনার পর আজই প্রথম দেখা হলো রাদিন ও তানিয়ার। আগের সময় হলে এতক্ষণে প্রিয়মানুষটার কাছে ছুটে যেতো সে। কিন্তু আজ রাদিনকে দেখে আর ওখানে দাঁড়ায় না। প্রস্থান করার সময় রওনককে বলে যায়, আমি মায়ের প্রেসারটা চেক করি গিয়ে।

ততক্ষণে রাদিন এগিয়ে এসেছে রওনকের মুখোমুখি। জিনিস করে, ঘটনা কি সত্যি নাকি রে?

-কোন ঘটনা?

-তুই বিয়ে করেছিস?

-করেছি তো।

-কাউকে কিছু না জানিয়ে, কোনো শলাপরামর্শ ছাড়া বিয়ে করে ফেললি?

-কাকে জানাতে হবে? কার সঙ্গে শলাপরামর্শ করবো?

-মা আছে, আমি আছি…

বড়ভাইকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক বলে,

-বিয়ে তো আমি করবো তাহলে তোমাদের কেনো বলতে হবে? আর তোমার মনে হয়, তুমি নিজে যা করেছো এরপর আমাকে শলাপরামর্শ দেয়ার এখতিয়ার রাখো? যে নিজের বিবাহিত জীবনটা ধরে রাখতে পারলো না সে আমাকে বিয়ের পরামর্শ দিবে হাস্যকর কথা বললে ভাইয়া। এসব বাদ দিয়ে বলো এতদিন পর কি মনে করে বাড়ি ফিরলে?

রাদিনের মুখে কথা কুলায় না। রওনকের অবশ্য তার আগমনের কারণ জানার তেমন আগ্রহ নেই। কথার কথা বলেছে সে। তাই নিজেই বলে, বাদ দাও আমাকে তোমার কিছুই বলতে হবে না। এটা আমার একার বাড়ি নয়। মন চেয়েছে এসেছো। কিন্তু সরি এখন আর তোমাকে সময় দিতে পারছি না। আমার বউ অপেক্ষা করছে। এক্সকিউজ মি, প্লিজ।

রওনক বেডরুমে ডুকতেই চিত্রলেখার কন্ঠ শুনতে পায়। তাকে ডাকছে, রওনক আপনি কোথায়? প্লিজ আমাকে বের করুন, দরজাটা খুলুন। এই যে শুনছেন?

একমুহূর্ত দাঁড়ায় না সে। দৌড় লাগায় ভেতরের দিকে। বেডরুমে চিত্রলেখাকে না দেখতে পেয়ে চেঞ্জিং রুমে ডুকলেই টের পায় তার চন্দ্রলেখা বাথরুমে আটকে আছে। ভেতর থেকে চিত্রলেখার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। দরজায় সজোরে বারি দিয়ে বলছে, রওনক আপনি কোথায়? রওনক…

রওনক বাইরে থেকে দরজাটা খুলে দিলেই দেখে চিত্রলেখা ভয়ে কেঁদে ফেলেছে। সে কিছু বলার আগেই ভীত-সন্ত্রস্ত চিত্রলেখা ঝাঁপিয়ে পড়ে রওনকের বুকের উপর। তাকে জড়িয়ে ধরে চিত্রলেখা বলে, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন আপনি? জানেন কখন থেকে ডাকছি আমি আপনাকে? আমি আটকে গিয়েছিলাম। দরজাটা…

রওনকও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার চন্দ্রলেখাকে। একটা হাত মাথায় রেখে বলে, হুস, এখন সব ঠিক আছে। আমি চলে এসছি। ভয়ের আর কোনো কারণ নেই৷ কিচ্ছু হবে না। এই যে আমি, তোমার রওনক চলে এসেছে।

চিত্রলেখা অনেকটা মন্থর হয়ে এসেছে। রওনক ভীত-সন্ত্রস্ত চিত্রলেখাকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। এতে চিত্রলেখাও আপত্তি করে না। সে এই মুহূর্তে আতংকিত। রওনক যত্নেরসহীত বউকে কোলে নিয়ে ঘরে ফিরে আসে। পিঠে বালিশ দিয়ে বসে চিত্রলেখাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখে। তাকে ভরসা দেয়ার চেষ্টা করে সে আছে সবসময়, সবরকম পরিস্থিতিতে। রওনকের বুঝতে অসুবিধা হয় না কাজটা কে করতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে এসব প্রসঙ্গ তোলে না। বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখা চিত্রলেখার চাদিতে চুমু খায় পরম যত্নে। সেই সঙ্গে বলে,

-আই এম সরি। আর কখনো লেইট হবে না, আই প্রমিজ বউ।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৪২+৪৩

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

লিখন বাড়ি ফিরলেই দেখে তাদের ড্রইং রুমে বৃষ্টি বসে আছে। সঙ্গে নাঈমও আছে অবশ্য। লিখনকে দেখেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় বৃষ্টি। ওদের দু’জনকে এই সময়ে দেখে অবাক হয় লিখন। জিজ্ঞেস করে,

-তোমরা এই সময়ে? সব ঠিকঠাক তো?

বৃষ্টি কিছু বলে না। তাকিয়ে থাকে লিখনের মুখের দিকে। তাকে দেখে বিধ্বস্ত লাগছে খানিকটা। ক্লান্তও লাগছে। চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে কোথাও কিছু একটা ঠিক নেই। পাশ থেকে নাঈম বলে,

-আপুর পড়ায় কি যেন সমস্যা হয়েছে সেটা দেখতে আসছে আপনার কাছে।

-ও আচ্ছা, ঘরে আসো বৃষ্টি দেখায় দিচ্ছি।

বৃষ্টি কিছু বলে না। পেছন পেছন তার ঘরে এসে উপস্থিত হয়। লিখন বলে,

-তুমি বসো, কি সমস্যা বের করো আমি কাপড়টা পাল্টে হাত-মুখ ধুয়ে আসতেছি।

-আচ্ছা।

বলে মাথা ঝাকায় বৃষ্টি।

লিখন হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসেই বলে,

-কি সমস্যা দেখি।

এতক্ষণে বৃষ্টি বলে,

-আপনাকে ক্লান্ত লাগছে। আজ নাহয় থাক। আমি নাহয় আরেকদিন এসে সমস্যা ঠিক করে নিয়ে যাবো।

-উঁহু, রাত করে যেহেতু আসছো তার মানে জরুরী। কোথায় সমস্যা বলো আমি দেখায় দিচ্ছি।

বৃষ্টি খাতা খুলে সমস্যা দেখায় লিখনকে। কিন্তু তার দৃষ্টি লিখনের মুখেই। পড়ার সমস্যাটা বাহানা মাত্র। সে এসেছে লিখনকে দেখতে। চারুর কাছে খবর পেয়েছে চিত্রলেখার আচমকাই বিয়ে হয়ে গেছে। এই খবর পাবার পর থেকেই অজানা কারণে লিখনের জন্য অস্থির লাগছে তার। তাই লিখন কেমন আছে, ঠিক আছে কিনা দেখতেই পড়ার বাহানায় ছুটে এসেছে। নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি।

সমস্যা সমাধান করে দিয়ে লিখন জিজ্ঞেস করে,

-আর কিছু?

মাথা ঝাকায় বৃষ্টি। লিখন আরও বলে,

-এটা তো সহজই, আগেও করাইছি তোমাকে।

-ভুলে গেছিলাম মাঝে অনেকদিন প্রাকটিস করি নাই তো।

-প্রাকটিস না করলে তো চলবে না। সব ভুলে যাবা। নিয়মিত প্রাকটিস করবা কেমন?

-আচ্ছা।

বৃষ্টি তবুও বসে থাকে। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে লিখন। ১০ টা বাজে। তাই বলে,

-চলো বাসায় দিয়ে আসি।

এতক্ষণে হদিস হয় বৃষ্টির। লিখনের প্রতি এতটাই মনোনিবেশ করে ফেলেছিল যে সময়ের হদিস হারিয়ে ফেলেছিল। আচমকাই উঠে দাঁড়িয়ে বই খাতা গুছিয়ে নিতে নিতে বৃষ্টি বলে,

-দরকার নেই। নাঈম আছে, আমরা চলে যেতে পারব।

-অনেক দেরি হয়ে গেছে বৃষ্টি।

-সমস্যা নেই, এইটুকুই তো রাস্তা আমরা যেতে পারব।

লিখন আর কথা বাড়ায় না। এমনিও তার সত্যি ক্লান্ত লাগছে। এসে বৃষ্টিকে না দেখলে এতক্ষণ হয়ত ঘুমিয়ে পড়তো সে। বৃষ্টি ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বলে,

-আসি, আপনি বিশ্রাম করুন।

মাথা ঝাকায় লিখন। শুয়ে পড়বে ভেবেও বৃষ্টির পেছন পেছন ড্রইং রুম পর্যন্ত এগিয়ে আসে ওদের বিদায় জানাতে। কিন্তু ড্রইং রুমে আসতেই দেখে নাঈম নেই। চারু জানায় অনেকক্ষণ আগেই বাসায় চলে গেছে সে। বৃষ্টি একাই বেরিয়ে যেতে নিলে বাঁধা দিয়ে লিখন বলে,

-চলো আমি দিয়ে আসি।

-না না দরকার নেই। আমি একাই যেতে পারব।

লিখন কিছু বলার আগে নারগিস বেগম বলেন,

-কত রাত হইছে দেখছিস? এতরাত করে একা যাবে মেয়ের সাহস কত! যা তো বাবা তুই দিয়ে আয়।

-যাইতেছি খালা।

বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে লিখন আরও বলে,

-চলো।

এখানে আর কিছু বলে না বৃষ্টি। বাইরে বেরিয়ে বলে,

-আমি সত্যি একা যেতে পারব। আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না।

-আমার সঙ্গে যাইতে কোনো সমস্যা?

-না তো।

-তাহলে এত আপত্তি করতেছো কেন?

-আপনি ক্লান্ত।

বলেই মাথা নামিয়ে ফেলে বৃষ্টি। লিখন বলে,

-আসলেই আমি ক্লান্ত। তাই বলে এতটাও না যে এই সময় তোমাকে একা ছেড়ে দিবো।

বৃষ্টি বিড়বিড় করে বলে, আমি তো চাই আপনি সবসময় আমার পাশে থাকেন।

-কিছু বললা?

-না, কিছু না।

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বৃষ্টি বলে,

-আপার জন্য কি আপনার মন খারাপ?

স্মিত হাসে লিখন। বলে,

-সামান্য। তুমি কীভাবে বুঝলা?

-আপনার মুখ দেখলেই আমি বলতে পারি।

-কী বলতে পারো?

-কখন আপনার মন ভালো থাকে আর কখন খারাপ থাকে।

সামান্য শব্দ করে হাসে লিখন তবে মন খুলে নয়। বৃষ্টি আর এই প্রসঙ্গে কোনো কথা বলে না। লিখনকে ঘাটাতে চায় না সে। নিজের মতো থাকলে ঠিক সামলে উঠবে, বৃষ্টি জানে।

বৃষ্টিদের বাসার সামনে এসে লিখন বলে,

-বাসায় যাও।

গেইট দিয়ে ভেতরে যাবার আগে বৃষ্টি বলে,

-আপনি মন খারাপ করবেন না। দেখবেন আপার সঙ্গে সব ভালো হবে। আপা অনেক ভালো একজন মানুষ। উনার সঙ্গে সব ভালো ভালোই হবে।

-তাই যেন হয় বৃষ্টি।

-তাই হবে দেখে নিয়েন।

-হুম, এখন বাসায় যাও তুমি। আর বেশি দেরি হলে খালাম্মা চিন্তা করবেন।

-আসি।

-হুম।

বৃষ্টি ভেতরে চলে গেলেও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে লিখন। ঢাকার শহরে রাত ১০ টা অনেক রাত নাহলেও এই সময়ে পথে ঘাটে বিশেষ করে এলাকার ভেতরের দিকে তেমন একটা মানুষ বাইরে থাকে না। যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের দূর্ঘটনা ঘটাটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বৃষ্টি উপরে গিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় দেখতে লিখন আছে না চলে গেছে। বারান্দা দিয়ে নিচের দিকে তাকালেই দেখতে পায় লিখন এদিকেই তাকিয়ে আছে। মুখে কোনো কথা বলে না বৃষ্টি কেবল হাত নাড়ায়। লিখন বৃষ্টিকে নিজের ঘরের বারান্দায় দেখেই যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ ধরেই হাটা শুরু করে।

ছেলের চোখ-মুখের কনফিডেন্স দেখে দিলারা জামান পেছনের সোফায় বসে পড়েন। উপস্থিতি কারো মুখে কোনো কথা নেই। চিত্রলেখার ভীষণ নার্ভাস লাগছে। এত নার্ভাস এর আগে জীবনে কখনো লাগেনি। বোর্ড পরীক্ষার সময়ও না। বোর্ড পরীক্ষা দিতে বসে যদি দেখে প্রশ্নপত্রের একটি প্রশ্নও কমন পড়েনি তখন যেরকম নার্ভাস হওয়ার কথা এই মুহূর্তে তারচাইতেও কয়েকগুন বেশি নার্ভাস চিত্রলেখা। আর এমন মুহূর্তে রওনকের তার হাত ধরে রাখায় ইতস্ততের চাইতে বেশি ভালো লাগছে। খানিকটা ভরসা পাওয়া যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে তানিয়া বলে,

-তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরে যাও। ওকে নিয়ে ঘরে যাও রওনক।

তৎক্ষনাৎই দিলারা জামান বলেন,

-একমিনিট। আমার কথা তো এখনো শেষ হয়নি।

-এখন থাক মা। পরে নাহয়…

তানিয়াকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক বলে,

-ইটস ওকে ভাবী। বলো শুনছি।

-এই মেয়েটা কে?

-মাত্রই তো বললাম আমার ওয়াইফ, চিত্রলেখা।

-বউ বললেই বউ হয়ে যায় না রওনক।

-ডন্ট বি সিলি মা। বউ বললেই কেউ বউ হয়ে যায় না তা আমিও জানি। বিয়ে করলে বউ হয়। আর আমি ওকে বিয়ে করেই আমার বউ বানিয়েছি। ইট হেজ এ প্রোসিজার এন্ড আই অলরেডি ডান দ্যাট।

-বিয়েতে যে পরিবারের উপস্থিতি জরুরী এটা জানিস তো?

-জানি। ভাবী উপস্থিত ছিল আমার বিয়েতে।

দিলারা জামান মুখ তুলে একবার তানিয়ার মুখের দিকে তাকান। পুনরায় ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,

-বেশ। তা তোর বউ হওয়া ছাড়াও মেয়েটার নিশ্চয়ই অন্য পরিচয় আছে। বাবার নাম আছে, বংশ পরিচয় আছে।

-ওর পরিচয় ও নিজেই মা। একজন মানুষের পরিচয় সে নিজে। বাবার নাম, বংশ পরিচয় কারো আসল পরিচয় হতে পারে না।

তাচ্ছিল্যের সুরে দিলারা জামান বলেন,

-জামাম গ্রুপ কি মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে ইনভেস্ট করছে নাকি? তোর মুখে ফিল্মি ডায়লগ শুনতে পাচ্ছি।

রওনক বুঝতে পারছে মা তাকে ইচ্ছা করেই পোক করছে। এই ধরনের কথা বলতে যে তার মা ওস্তাদ তা রওনকের জানা। তাই ক্ষেপে না গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে,

-আইডিয়া মন্দ নয়। অবশ্যই এই বিষয়ে ভাববো। তবে আপাতত তোমার পারমিশন থাকলে আমরা ঘরে যাই?

-আমার কথা শেষ হয়নি রওনক।

রওনক চিত্রলেখাকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও তার পাশে বসে পড়ে রিলাক্স ভঙ্গিতে। তারপর বলে,

-ভাবী তোমরাও বসো।

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-বলো তোমার কথা, শুনছি।

-তুই নিশ্চয়ই ভুলে যাসনি আমি অলরেডি সাবার বাবাকে কথা দিয়ে রেখেছি।

-কিসের কথা?

-তোর আর সাবার বিয়ের কথা।

এমন কথা শুনে নিচের দিকে মুখ করে রাখা চিত্রলেখা এবারে মুখ তুলে রওনকের দিকে তাকায়। তার দৃষ্টি দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভীষণ অবাক হয়েছে সে। রওনক চিত্রলেখার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

-আমি তো কখনো বলিনি সাবাকে বিয়ে করবো। আমার থেকে কনফার্ম না হয়ে কেনো কাউকে কথা দিয়েছো? এটা তো আমার হেডেক নয়। আমি ছোট বাচ্চা নই যে তুমি আমার জন্য মেয়ে পছন্দ করবে আমি তাকে বিয়ে করে ফেলবো। লাইফটা আমার তাই ডিসিশনটাও আমি নিবো কাকে বিয়ে করব আর কাকে করব না।

-আমি তো মা রওনক! তোর হয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার রাইট আমার নেই?

-এসব ইমোশনাল কথা আমার সঙ্গে বলে লাভ নেই তা আগেই জানিয়েছিলাম তোমায়। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার জন্য কোনটা ইম্পর্ট্যান্ট আমার বিয়ে করা না সাবাকে বিয়ে করা। আই গেস তোমার মনে আছে। তখনই তোমার বুঝে যাওয়া উচিত ছিল আমি বিয়ে করলেও সাবাকে কখনো বিয়ে করবো না।

-সাবার মধ্যে কি সমস্যা? আমার পছন্দের কোনো ভ্যেলু নেই তোর কাছে?

উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে রওনক। অনেক চেষ্টা করেছে সে নিজের টেম্পার না হারাতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত খানিকটা টেম্পার হারায় সে। খানিক উচ্চ স্বরে বলে,

-করেছিলাম তো তোমাদের পছন্দে বিয়ে। তারপর কি হলো মনে নেই তোমাদের? ভুলে গেছো? মানুষ এক জীবনে হাজারটা বিয়ে করে না। এক বউ চলে গেলে আরেকটা বিয়ে, ওটা চলে গেলে আরেকটা দিজ ইজ নট লাইফ। এটলিস্ট আমি এমন না। বিয়েটা ছেলে খেলা নয় আমার জন্য।

-অতীতে যা হয়েছে ওটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট ছিল রওনক।

-আর সেই এক্সিডেন্টটা আমি আবার করতে চাই না। নট এনি মোর। তোমাদের পছন্দকে প্রায়োরিটি দিয়ে বিয়ে করেছিলাম। তারপর যা হয়েছে সেজন্য আমি তোমাদের কাউকে দোষ দেই না। কারণ যা হয়েছে সেটা আমার ভাগ্যে লেখা ছিল, এখানে কারো হাত নেই। একবার যেহেতু তোমাদের কথা শুনেছি এবার নাহয় আমাকে আমার মতো করতে দাও। আমার লাইফ আমি কার সঙ্গে স্পেন্ড করব সেই ডিসিশানটা আমাকেই নিতে দাও। লেট মি লিভ প্লিজ।

স্তব্ধ নয়নে চিত্রলেখা কেবল রওনকের দিকে তাকিয়ে রয়। এমনিতেই বেচারীর মনচাইছে মাটি ফাঁক হয়ে তাতে সে ডুকে যাক। এখন যেনো আরও স্তব্ধ হয়ে গেল।

দিলারা জামান বলেন,

-তোর এই ডিসিশানটা যে কোম্পানির উপর প্রভাব ফেলবে বুঝতে পারছিস?

-কোম্পানির চিন্তা তোমার না করলেও চলবে। আমি কোনো বাচ্চা নই যে হুজুগের বশে কাজ করে ফেলেছে। অনেক চিন্তা ভাবনার পরেই বিয়েটা করেছি। আর তুমি যদি মনে করো আমাকে কোম্পানি ছাড়তে হবে, বাড়ি ছাড়তে হবে তাহলে আগেই বলে রাখি এসব ইমোশনাল ডায়লগ দিয়ে কাজ হবে না তা তুমিও ভালো করে জানো। এই বাড়ি প্লাস জামান গ্রুপের ফিফটিফাইভ পার্সেন্ট শেয়ার হোল্ডার আমি, রওনক জামান। সো কেউ চাইলেই আমাকে আমার পজিশন থেকে সরাতে পারবে না। এমনকি তুমিও না।

দিলারা জামান আর কথা বলেন না। রাগে উনার চোয়াল শক্ত হয়। রওনক আরও বলে,

-তোমার আরও কিছু বলার থাকলে পরে কথা হবে। আপাতত আমি চন্দ্রলেখাকে নিয়ে ঘরে যাচ্ছি। এসব ওর জন্য বেশি হয়ে গেছে। সি নিড’স টু রিলাক্স।

তানিয়ার দিকে তাকিয়ে রওনক আরও বলে,

-আমরা ঘরে যাচ্ছি ভাবী।

-কিছু লাগলে আমায় বলো।

বসে থাকা চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে উঠায় রওনক। হাত ধরে টেনে উপরের দিকে অগ্রসর হয় তারা। চিত্রলেখা মাথা নিচু করে রেখেছে। রওনক একবার পেছন ফিরে চিত্রলেখার নিচু করে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আবার সামনের দিকে তাকায়। এই মুহূর্তে চিত্রলেখার মস্তিষ্কের ভেতর অনেক কিছু ঘুরছে। সবকিছু মিলে জগাখিচুরি হয়ে গেছে যেন। নিজেকে শান্ত করা প্রয়োজন। কীভাবে শান্ত করবে চিত্রলেখার জানা নেই। এই জগৎ টা যে তার নয় বেশ টের পাচ্ছে। রওনক জামানের মতো একজন মানুষের জন্য সে কোনোদিক দিয়েই উপযুক্ত নয় তা এই বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই টের পেয়ে গিয়েছে চিত্রলেখা। তারা দু’জন ভিন্ন দুই জগতের মানুষ। একে-অপরের পাশে তাদের কোনোভাবেই মানায় না। গোটা জীবন একসঙ্গে কাটানো তো দূরের কথা, একটাদিনও এই মানুষটার সঙ্গে থাকার যোগ্যতা তার নেই। চিত্রলেখা হয়ত মস্তবড় ভুল করে ফেলেছে। এমন একটা ভুল যা শুধরে নেবার কোনো রাস্তা নেই বা হয়ত আছে। কিন্তু রওনক কি অনুমতি দিবে এই ভুল শুধরে নেবার?

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

সিড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে উঠতে রওনক বলে,

-তোমার কি হাটতে কষ্ট হচ্ছে? আমি কি তোমায় ক্যারি করব?

তৎক্ষনাৎই চিত্রলেখার বাড়ন্ত কদম থমকে যায়। মুখ তুলে রওনকের মুখের দিকে তাকায় সে। অবাক হয়ে চিত্রলেখার চোখগুলো গোল গোল হয়ে গেছে। এক্ষুনি মনে হয় কোটোর থেকে বেরিয়ে আসবে। চিত্রলেখার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে হাসি পায় রওনকের কিন্তু এই মুহূর্তে সে হাসে না। নিজের মুখোভঙ্গি স্বাভাবিক ধরে রাখে। জিজ্ঞেস করে,

-এনিথিং রঙ?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। মুখে বলে,

-আমার হাটতে কষ্ট হচ্ছে না।

-আমার তোমাকে ক্যারি করতে একটুও কষ্ট হবে না।

বলেই আবার দু’জনে উপরের দিকে আগায়। দোতলায় উঠেই করিডর ধরে ডান দিকে এগিয়ে গেলেই রওকনের রুম। দোতলার এই পাশটায় রওনক থাকে। অন্যপাশে মিম ও মিশকাতের ঘর। দিলারা জামান, তানিয়া দু’জনেই নিচ তলায় থাকেন। নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে রওনক। দরজাটা ভেতরের দিকে ঠেলে দিয়ে চিত্রলেখাকে বলে,

-দিস ইজ ইউর বেডরুম। নো একচুয়েলি তোমার একার নয়, আমাদের। আওয়ার বেডরুম।

চিত্রলেখার মুখে কোনো কথা নেই। কেবল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। রওনকের ভেতরে যে এমন সাইডও আছে তা চিত্রলেখার চিন্তা ভাবনায় কখনো ছিল না। অবশ্য থাকার কথাও নয়। সে কখনই রওনককে নিয়ে আলাদা করে ভাবেনি। ভাবার মতো কোনো সম্পর্ক তাদের ছিল না আগে কখনো। চিত্রলেখার হাত ধরে রেখেই তাকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে রওনক। ঢুকতেই চিত্রলেখা দেখে তারা একটা ব্যাক্তিগত লিভিং রুমে প্রবেশ করেছে। রুমের ডান পাশে দেয়াল জুড়ে সোফা বসানো আর বাম পাশে একটা টেবিল পেছনে দেয়াল কেবিনেট। ব্যাক্তিগত অসিফ সেটআপ দেখলেই বুঝা যায়। চিত্রলেখাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে রওনক বলে,

-আমার বন্ধুরা কখনো আসলে এখানে বসে আড্ডা দেয়া হয়। এছাড়া ওপাশে বসে আমি অফিসের কাজ করি। বাসা থেকে অফিস করলেও এখানেই কাজ করা হয়। আমার পারসোনাল অফিস বলতে পারো। চিত্রলেখা মনে মনে ভাবে সে ঠিকই ধরেছে। এগিয়ে গিয়ে রওনক আরেকটা দরজা খোলে। রওনকের বেডরুম৷ এতদিন তার একার ছিল, আজ থেকে তাদের দু’জনের। চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে নিয়ে বেডরুমে প্রবেশ করতে করতে রওনক বলে,

-ওয়েলকাম টু মাই লাইফ, মাই ওয়ার্ল্ড। ওয়েলকাম।

চিত্রলেখা চুপ করেই রয়। কথা নেই তার মুখে। রওনক নিজেই চিত্রলেখার বাহুতে ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে দেয়। নিচের দিকের মধ্যখানে। পা ঝুলিয়ে বসে আছে চিত্রলেখা। তাকে বসিয়ে দিয়ে রওনক বলে,

-তুমি একটু বসো, আমি এক্ষুনি আসছি।

রওনক ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে। সে চলে যেতেই চিত্রলেখা চারিদিকে চোখ বুলায়। একদম সিম্পল গেটআপ রুমের। দেয়ালের রঙ অফহোয়াইট। দেয়ালের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে বিছানায়ও একই রঙের চাদর বিছানো। বিছানার ডান পাশটায় দু’জনের জন্য দু’টো সিঙ্গেল সোফা চেয়ার সঙ্গে ছোট টি-টেবিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রুমটা দেখতে ব্যস্ত চিত্রলেখা। বিছানার ডানপাশে অনেকটা জায়গা ফাঁকা রয়েছে তারপরেই দেয়াল জুড়ে পর্দা ফালানো। পর্দাগুলোও অফহোয়াইট রঙের। ওখানে সম্ভবত জানালা আছে তাই পর্দা লাগানো। কিন্তু এত বড় জানালা! ভাবে চিত্রলেখা। কারণ সম্পূর্ণ দেয়াল জুড়ে পর্দা। বিছানার ঠিক অপজিট দেয়ালে একটা মস্তবড় টেলিভিশন ফিট করা। আসার সময় বাইরের ঘরের দেয়ালে ছবির ফ্রেম লাগানো দেখেছে চিত্রলেখা কিন্তু এই ঘরের দেয়ালে কোনো ছবির ফ্রেম নেই। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে তার অবাক লাগে। বেশি অবাক লাগে এটা দেখে যে এই ঘরে না আছে একটা আলমারি আর না ড্রেসিং টেবিল। কাপড়চোপড় রাখার জন্য কি তাহলে আলাদা ঘর আছে? ভাবে চিত্রলেখা। অবশ্য কাপড়চোপড় রাখার আলাদা ঘর থাকলে সে একটুও অবাক হবে না। এত বড়লোক মানুষের সবকিছু আলাদা হওয়ারই কথা। ওদের মতো তো এক ঘরে সব থাকার কথাও নয়। ওরা তো দুই রুমের একটা বাসায় ৪/৫ জন থাকতে পারে। কিন্তু বড়লোকদের তো ২ জন মানুষের জন্যও ডুপ্লেক্স কম হয়ে যায়। সেই তুলনায় এই বাড়ির সদস্য সংখ্যা একদম কম মনে হয়নি চিত্রলেখার। মুগ্ধ হয়ে বিষ্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে ঘর দেখতে ব্যস্ত চিত্রলেখার বিষ্ময় কাটে দরজা খোলার শব্দে। রওনক বেরিয়ে এসেছে। গায়ের কাপড় বদলে গেছে তার। চিত্রলেখার জানতে আগ্রহ হয় ঐ দরজার ভেতর ওখানে কি আরেকটা ঘর, যেখানে রওনকের কাপড়চোপড় রাখা আছে। জানতে আগ্রহ হলেও সে কিছু জিজ্ঞেস করে না। তার দ্বারা সম্ভব হবেও না নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করার। রওনকে এগিয়ে এসে চিত্রলেখার মুখোমুখি বসে পড়ে। ফ্লোরে পায়ের উপর ভর দিয়ে বসে মুখ তুলে চিত্রলেখার চোখে চোখ রাখে সে। হাত বাড়িয়ে নিজের দু’হাতের মুঠোয় চিত্রলেখার হাত আঁকড়ে ধরে। আতংকে সংকুচিত হয়ে আসে চিত্রলেখা। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। টের পায় ক্রমশ নিঃশ্বাস নিতে কিঞ্চিৎ কষ্ট হচ্ছে তার। শরীর কাঁপতে আরম্ভ করেছে। চেষ্টা চালায় কিন্তু নিজেকে সামলে নিতে হিমশিম খায় সে। রওনক জিজ্ঞেস করে,

-আপসেট?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। রওনক আবারও জিজ্ঞেস করে,

-নিচের সিচুয়েশনটার জন্য আই এম সরি। আমি চাইনি এমন কিছু হোক তারপরেও… কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি আমি থাকতে কেউ কখনো তোমাকে ছোট করতে পারবে না। অলওয়েজ, যেকোনো পরিস্থিতিতে আমি সবসময় তোমাকে প্রোটেক্ট করবো, কথা দিচ্ছি। আমি থাকতে আমার চন্দ্রলেখাকে কেউ কষ্ট দিতে পারবে না। কাউকে আমি এলাও করবো না, আই প্রমিজ।

অস্ফুটস্বরে চিত্রলেখা বলে,

-আমার নাম চিত্রলেখা, চন্দ্রলেখা নয়।

ডান দিকে তাকিয়ে ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকায় রওনক। আগের চাইতে আরও শক্ত করে হাত ধরে বলে,

-অন্য সবার জন্য তুমি চিত্রলেখা হলেও আমার জন্য তুমি চন্দ্রলেখা।

-চন্দ্রলেখা!

-হ্যাঁ, তুমি আমার চন্দ্রলেখা। চাঁদ ছাড়া যেমন রাত অসম্পূর্ণ তেমনি তোমাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে রওনক আরও বলে,

-তবে শুধু আমার জন্য। তোমায় চন্দ্রলেখা কেবল আমি ডাকবো, অন্যকারো এই নামে ডাকার পারমিশন নেই।

রওনকের কথায় অদৃশ্য কাঁপন ধরে চিত্রলেখার অঙ্গে। এই কাঁপন নগ্ন চোখে দেখতে পাওয়া যায় না, কেবল অনুভব করা যায় হৃদয় দিয়ে। অদৃশ্য কাঁপনে চিত্রলেখার ঠোঁট যুগল মৃদু কাপে। রওনক তার দৃষ্টি সরায় না। স্থির নয়নে তাকিয়ে রয়। যেনো জনম জন্মান্তরের না দেখতে পাবার পিপাসা মিটাতে ব্যস্ত সে। চিত্রলেখার কম্পিত ওষ্টদয় যেন রওনককে বলতে চায় তার দৃষ্টি সরিয়ে নিতে। ঐ দৃষ্টির মোহময় এই চাহনি আর সইছে না তার পরাণে। কিন্তু ঠোঁট তাকে সঙ্গ দেয় না। ফলাফল কিচ্ছু বলতে পারে না সে রওনককে।

নিজের দৃষ্টির চাহনি দিয়েই বুঝি চিত্রলেখাকে বশ করার প্রতিজ্ঞা করেছে সে। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থাকার পর রওনক বলে,

-তুমি কি জানতে না আমার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল?

এতক্ষণে রওনকের কথায় ঘোর কাটে চিত্রলেখার। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে মাথা ঝাকায় সে। ফস করে আবারও নিঃশ্বাস ছেড়ে রওনক বলে,

-অফিসে কম বেশি সবাই জানে আমি ডিভোর্সি। আগে একটা বিয়ে হয়েছিল আমার। সেটা ডিভোর্স হয়ে গেছে। শুনোনি?

-না।

-তিনবছরে কখনো শুনোনি?

-আমি আসলেে এই ধরনের গসিপে কখনো বসতাম না। অনেকেই সিনিয়রদের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে গসিপ করতো কিন্তু আমি কখনো ওখানে বসতাম না। কারো পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগে না, রুচিতে আটকায়। তাই কখনো জানা হয়নি।

-অফিসের সবাই কম বেশি জানে বিষয়টা তাই ধরেই নিয়েছিলাম তুমিও জানো। আর জেনেই রাজি হয়েছো আমায় বিয়ে করতে।

চিত্রলেখা কিছু বলার মতো খুঁজে পায় না। রওনক নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-রাগ করেছো? কষ্ট পেয়েছো?

জোরে জোরে মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। বলে,

-আপনার আগের বিয়ে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই, কোনো মাথা ব্যথা নেই।

-কোনো মাথা ব্যথা নেই!

অবাক হয় রওনক। চিত্রলেখা বলে,

-না।

-ওহ রিয়েলি?

তৎক্ষনাৎই উঠে দাঁড়ায় রওনক। চিত্রলেখাকে কিছু বুঝার সুযোগ না দিয়েই পেছন দিকে বিছানায় ঠেলে দেয়৷ সঙ্গে সে নিজে চিত্রলেখার উপরে চলে আসে। চিত্রলেখার শরীর জুড়ে রওনক জড়িয়ে আছে। মুখের ঠিক উপরেই মুখ তবে এদিকটায় খানিক দূরত্ব রয়েছে। এবারে রওনক বলে,

-কোনো সমস্যা নেই?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা।

-কোনো মাথা ব্যথা নেই?

এবারেও মাথা ঝাকায় তবে মৃদু ভাবে। ইতোমধ্যে চিত্রলেখার শরীর জমে ক্ষীর, পাথর হয়ে আসছে যেনো। শরীর জুড়ে কাঁপুনিও শুরু হয়ে গেছে। এই কাঁপুনি সম্ভবত রওনক টের পেয়েছে। তাই তো তার চোয়াল জুড়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি। চিত্রলেখার অঙ্গের কাঁপুনি আরও খানিকটা বাড়াতে হাত বাড়িয়ে তার গাল স্পর্শ করে রওনক, নিবিড়ভাবে। চিত্রলেখা উপলব্ধি করে এই স্পর্শ ভীষণ বাড়াবাড়ি রকমের গাঢ়, স্পর্শকাতর। তার অঙ্গের কাঁপন বাড়ে। মনে হয় শরীরের ভেতরে থাকা হাড়ও কাঁপছে। এই পর্যায়ে চিত্রলেখার দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড় হয়। এই বুঝি এক্ষুনি দমবন্ধ হয়ে যাবে তার। নিচের দিকে আরেকটু ঝুঁকে রওনক। চিত্রলেখার একদম সন্নিকটে এসে কথা বলে। তার কথার সঙ্গে মুখ-নাক গলে বেরিয়ে আসা শ্বাস-প্রশ্বাস গিয়ে বারি খায় চিত্রলেখার নাক, ঠোঁট ও চিবুকে। রওনক বলে,

-বউ মানে বুঝো তো? এক ঘরে থেকেছি, এক বিছানায় ঘুমিয়েছি, এক সঙ্গে রাত কাটিয়েছি। এরপরেও বলবে কোনো মাথা ব্যথা নেই?

চিত্রলেখার মুখে কথা নেই। স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে কেবল। নড়তে ভুলে গেছে সে, কথা বলতেও ভুলে গেছে। রওনকের স্পর্শ আরও প্রগাঢ় হয়, আরও নিবিড় হয়।

চলবে…

error: ©<b>গল্পপোকা ডট কম</b>