Thursday, June 26, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 252



চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-০২

0

চন্দ্র’মল্লিকা ২
লেখা : Azyah_সূচনা

“কিশোরী মন বোঝার আগেই হারিয়ে ফেললামরে তোকে।ছয়টা বছর চেষ্টা করেছি অন্যকে তোর জায়গায় বসানোর।পেরেছিলাম হয়তো।আবার শূন্যে হয়ে গেলো।আমি আছি এক ভ্রমজালে।আমার বুঝদার পুরুষ মন তোর চেয়ে বেশি নাদান।তোকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছি চন্দ্রমল্লিকা।কেমন আছিস কে জানে?আদৌ ভালো আছিস?আমাকে ক্ষমা করতে পারিসনি হয়তো।আমি জানি”

বুকে চিনচিন ব্যথার অনুভব হলো।এই ব্যথার কোনো ঔষধি নেই। উপশমের কোনো উপায় নেই। ব্যর্থ নিজের দায়ে। দগ্ধা হচ্ছে ভেতরটুকু।ফিরে দেখার কোনো সুযোগ নেই।নিজ হাতে মাটি চাপা দেওয়া সম্ভাব্যতা আবার জমিন খুঁড়ে বের করবে নাকি?তার চেয়ে বেশ হয় কল্পনা করুক।যে সময়টুকু পেয়েছিলো ওই অবুঝ মেয়ের সান্নিধ্যে?যখন হৃদয় ছিলো তার অনুভূতির অবান্তরে? সেই সময়ের পুনঃপ্রচার মস্তিষ্কে।

“মা বলে মেয়েদের সাংসারিক হতে হয়।বয়স দশের চৌকাঠ পেরোলে ঘরের কাজে হাত লাগাতে হয়।আমি বেশি দেরি করে ফেলেছি।আজ আমি প্রথম ভাপা পিঠা বানালাম।তোমাকে আগে খাওয়াতে চাই।”

নতুন নতুন স্মার্টফোন হাতে পেয়েছে মাহরুর।নতুন নয় পুরোনো।বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধুর ব্যবহারকৃত। আড়াই হাজার টাকায় কিনে এনেছে।প্রথম এমন যন্ত্র হাতে পেয়ে ভেতরের সব কিছু ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছিলো। অর্ধেকটা দেখেছে বাকি অর্ধেক পূর্ন হওয়ার আগেই এসে হাজির সেই কিশোরী। হাতে গরম গরম ধোঁয়া ওঠানো ভাপা পিঠা।ঘ্রাণ ভেসে আসছে মাহরুরের নাক অব্দি।

উঠে বসতে বসতে বললো, “আয় দেখি কেমন পিঠা বানিয়েছিস?”

চন্দ্রের খুশির ঠিকানা নেই।মুখ জুড়ে মায়াবী হাসির ছড়াছড়ি।যেই ইচ্ছে পোষণ করে এসেছিল সেটা বুঝি এত দ্রুত পূর্ণ হলো?প্লাস্টিকের ঢাকনা তুলে দুটো ভাপা পিঠা রাখলো মাহরুরের সামনে।সেও বসেছে মুখোমুখি।যতনে মনের কোণে জায়গা দেওয়া এক অমায়িক পুরুষকে দেখবে।

মাহরুর গরম গরম পিঠা দুইভাগ করে মুখে পুড়ে নেয়।তার খাওয়ার ধরনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে কিশোরী সান্নিধ্যে বসে। অপেক্ষার ভিড় জমলো হটাৎ।কেমন হয়েছে স্বাদ জানতে চায়।

“ভালো”

আকস্মিক চমকে উঠলো।মাত্রই মনে বিনা শব্দে যে প্রশ্ন এসেছিল সেটার উত্তর ঢাক বাজিয়ে দিলো মাহরুর। প্রতিক্রীয়াশূন্য মেয়েটি হটাৎ মুখে হাসি ফোঁটায়।ভীষণ খুশি।নিচের ওষ্ঠ দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে।

হটাৎ চোখ যায় মাহরুরের ডান পাশে রাখা ফোনটির দিকে। কৌতূহলি সুরে জানতে চাইলো, “এটাতো দামী ফোন মাহরুর ভাই।তুমি কোথায় পেলে?”

“আকার ইঙ্গিতে গরীব বলে খোটা দিচ্ছিস?আমি দামী ফোন কিনতে পারি না?”

ঘাবড়ে উঠে নরম মুখশ্রী। তড়িৎ গতিতে বলে উঠে, “না না আমি সেটা বুঝাই নি।আমার কথায় কষ্ট পেয়েছো মাহরুর ভাই?আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।”

মাহরুর হেসে উত্তর দেয়, “পাগলী মেয়ে।আমি মজা করছিলাম।শান্ত হ।”

“ঠিক আছে মাহরুর ভাই।তোমার পিঠা পছন্দ হয়েছে?”

ইতিমধ্যেই দুটো পিঠা গপাগপ গিলেছে মাহরুর।কথার মধ্যেই খেয়ে সাবার।প্রথমবার অনুযায়ী বেশ ভালো হয়েছে। মাহরুর তাকে জ্বালাতন করার উদ্দেশে বললো,

“অনেক পছন্দ হয়েছে।আর দু চারটে নিয়ে আয়।”

একই সময় কত রকম মুখের ঝলক পাওয়া যায়?মেয়েটি রূপ বদলায় ক্ষণেক্ষণে। আবারো মুখটা মলিন হয়ে গেলো। অবলীলায় চোখে চোখ রেখে বললো, “মাহরুর ভাই।আমিতো গুনে গুনে চারটা পিঠে বানিয়েছিলাম। ঘরে গুড় শেষ।একটা আব্বার একটা আম্মার।আর দুটো তোমার জন্য এনেছি।”

“আর তোরটা?”

“আমারটা তোমাকে দিয়ে দিয়েছি”

সামান্য হা করে চেয়ে রইল মাহরুর।না জেনেই ষাঁড়ের মতো খেয়ে ফেললো?জানতেও চাইলো না?চন্দ্রের ভাগের পিঠাটুকু খেয়ে নিয়েছে। অপরাধবোধ হলো খানিকটা। অদ্ভুত মেয়েটি।কে বলেছিল নিজেরটুকুও বিলিয়ে দিতে?

“তোকে আমি বলেছি তোর ভাগের পিঠা আমাকে খাওয়াতে? এখনতো খেয়ে নিলাম।তুই কি খাবি?”

“আমি খাবো না মাহরুর ভাই”

“আচ্ছা তুই আমাকে পুরো নামে ডাকিস কেনো?সবাই মাহি বলে ডাকে।”

“তোমার পুরো নামটা সুন্দর তাই ডাকি।তোমার শুনতে খারাপ লাগে?ডাকা বন্ধ করে দিবো?”

“আরেহ নাহ।ভালো খারাপের জন্য বলিনি।তোর ছোট্ট মুখে এত ভারী নাম বলতে কষ্ট হয়না?”

মাথা দোলায় চন্দ্র।বলে, “হয় না”

পরপর ঠোঁট প্রসারিত করে প্রশ্ন করলো, “আমার নামতো মল্লিকা।তুমি আমায় চন্দ্র ডাকো কেনো? চন্দ্র অর্থতো চাঁদ।আমিতো চাঁদ নই ”

“আমার মায়ের কাছ থেকে শিখেছি।সেই ছোট বেলা থেকে ‘ ও চন্দ্র ‘ বলে ডেকে পুরো মহল্লা তোলপাড় করেছে।”

“চাচিতো এখন আর আমায় চন্দ্র ডাকে না।”

“কে জানে কেনো ডাকে না। আমারতো বাপু অভ্যাস হয়ে গেছে।”

মাত্র হেলান দিয়েছিল চৌকিতে।আবার কি যেনো হলো তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে মাহরুর।সদ্য কেনা ফোনটি হাতে নিয়ে অন করে নেয়।ক্যামেরা বের করে বললো,

“চন্দ্র?এই সেলফোনে ছবি তোলা যায়।আয় তোর একটা ছবি তুলি”

চন্দ্রমল্লিকার উৎসুক নেত্রবিশিষ্ট।দ্রুত হাতে নিজের চুলগুলো সেটে নেয়।মাথায় কাপড় টানে।মুক্ত হাসি দিয়ে তাকায় ক্যামেরার দিকে। মাহরুরও কয়েক চাপে বেশ কিছু ছবি তুলে নিলো।

“দেখি দেখি কেমন হয়েছে?”

মাহরুর এগিয়ে দেয়। তর্জনি আঙ্গুল ফোনের স্ক্রিনে ছুঁয়ে ছবিগুলো দেখে নিলো।হাসিমুখ তুলে আবদার করলো,

“আমাকে এই ছবিটা বাঁধাই করে দিবে মাহরুর ভাই?”

মাহরুর সায় দিলো, “হাতে টাকা আসুক।দিবো”

“আচ্ছা আমি যাই?”

“তোকে কি আমি আটকে রেখেছি?যা”

সবশেষে করুন মুখটাও দেখা গেলো কিশোরীর।তারপরও
কোনো অভিযোগ করলো না। কাদো মুখটা অব্দি বানায়নি।

এক টুকরো কল্পনার রাজ্য থেকে নিজেকে ফেরায় মাহরুর।সব একদিনে কল্পনা করলে কি চলে?বাকি জীবন পড়ে আছে এই অলীক কল্পনার জন্য। বেঁচে থাকার খোড়াক। মানিব্যাগ বের করে পুরোনো খসখসে ছবিটা বের করে হাতে নেয়,

“তোকে আমি অবুঝ ভাবতাম চন্দ্র।অথচ আমার চেয়ে দ্বিগুণ বোধশক্তিসম্পন্ন ছিলি তুই”

___

অতীত,

“তুইতো আমার ছোটবেলার সাথী।আমাকে সাহায্য করবি?”

“কেনো করবো না?”

পুকুর ঘাটে অর্ধেক পা ভিজিয়ে বসে থাকা দুজন তরুণী। পুরোনো দিনের বন্ধুত্ব তাদের।একই সাথে কোনো মতে ম্যাট্রিক পাস করিয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের পড়ালেখার সুযোগ থাকলেও বিয়ে দিয়ে দেওয়াকে মুখ্য মনে করেন তারা।তাই আর লেখাপড়ায় এগোতে পারেনি কেউই।দুজনে যেনো একই নৌকায় ভেসে চলেছে।

“পাশের বাড়ির তনু আপুকে দেখলাম। ওনার বয়স মাত্র বিশ তার বিয়ে হয়েছে পঁয়ত্রিশ বছরের এক লোকের সাথে। গুনেগুনে পনেরো বছরের বড়।কিন্ত মাহরুর ভাই? সেতো মাত্র আমার থেকে আট বছরের বড়।আমাদের কি একসাথে মানায় না?”

“ভাই শিক্ষিত মানুষ।অবশ্যই সেও শিক্ষিত কাউকে বিয়ে করবে।তুই বরং মাহি ভাইকে নিয়ে ভাবা বন্ধ কর”

“আমাকে অবুঝ মনে করিস?আমি কখনো তাকে বিরক্ত করিনাই।অনেকবার চেয়েছি তাকে নিয়ে আর ভাববো না।কিন্তু হয় না।”

শশী মুখ ভেংচিয়ে বললো, “বড্ড অবাধ্য তোর মন”

“মাহরুর ভাই যদি আমাকে কখনো নাও মেনে নেয় আমি জোর করবো না জানিস।কিন্তু আমি তাকে নিয়ে সারাক্ষণ ভাববো।আমার ভালো লাগে।”

“ভাবতে থাক।একদিন বিরক্ত হয়ে পড়বি ভাবতে ভাবতে।”

“হবো না শশী।”

“তোরও আজ নাহয় কাল বিয়ে হবে।তোর স্বামী যদি জানতে পারে তুই অন্য কাউকে নিয়ে ভাবিস তাহলে কি হবে?”

“আমি বিয়ে করবো না শশী।”

ফরিদা বেগমের ডাকে উঠে দাড়ায় মল্লিকা।সন্ধ্যা নামবে।তাই মায়ের এই ঝাঁঝালো ডাক।বিকেলের আগে আগে ঘরে ফেরার কঠোর আদেশ।এক দৌড়ে ছুটে গেলো ঘরের দিকে। টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার দিচ্ছেন।বুঝে উঠতে পারলো না এই খাবার কার। বাবাতো তার আজ ঘরেই আছে।তাহলে?

“মা এই খাবার কার জন্য?”

“মাহির জন্য।একটু গিয়ে দিয়ে আসবি সে বাড়িতে।তোর চাচীর হাত পুড়েছে।”

মনটা খুশিতে গদগদ করে উঠলো।আরেকটা সুযোগ মাহরুরের সাথে সাক্ষাতের।সেদিন পিঠা দিয়ে আসার পর থেকে আজ পাঁচদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই।অযথা আগ বাড়িয়ে যায়নি মল্লিকা।কি দরকার বিরক্ত করার?এই তার চিন্তাধারা।কিন্তু আজতো কাজ পড়েছে।যেতেই হবে। একবার চোখ বুলিয়ে আসা হবে তার মাহরুর ভাইয়ের মুখে।
খুব সাবধানে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে হেঁটে চলেছে।ঝোল ওয়ালা তরকারি আছে এতে।বেশি ছটফট করলে যদি পড়ে যায়?

বাড়ির সামনে গিয়েই চাচীকে উঠোনে বসে থাকতে দেখে মল্লিকা বলে,

“আসসালামু আলাইকুম চাচী।”

ভার মুখে হাসি টেনে লিজা বেগম উত্তর দেন, “ওয়ালাইকুম আসসালাম।এসেছিস?”

“হ্যা চাচী।এইযে খাবারটা।মা মাহরুর ভাইয়ের জন্য দিয়েছে।”

পাশের জায়গা দেখিয়ে লিজা বেগম বললেন, “রাখ এখানে।”

এরই মাঝে বেরিয়ে আসে মাহরুর।কাধে কালো রঙের বড় একটা ব্যাগ ঝুলানো। তরিহরি করে বেরিয়ে এসে মল্লিকা দিকে চেয়ে অমায়িক হাসি দেয়। দ্রুত গতিতে মায়ের পায়ে সালাম করে বলে,

“আসি মা”

“এই দাঁড়া।খাবারটা নিয়ে যা”

“খাবার কোথা থেকে আসলো মা? আমি বললামতো গাড়ি কোথাও থামলে খেয়ে নিবো”

“নাহ নাহ অযথা টাকা খরচ।আর হোটেলের লোকেরা কি ভালো খাবার বানায়? ফরিদা রেধে পাঠিয়েছে।নিয়ে যা”

দুজনের কথোপকথন চলছে।নির্বাক শ্রোতা হয়ে দাড়িয়ে তাদের কথা শুনছে মল্লিকা।বুঝে উঠতে পারলো না কি হচ্ছে? কোথায় যাচ্ছে মাহরুর?

মাহরুর এগিয়ে আসতেই মল্লিকা জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাচ্ছ মাহরুর ভাই?”

“ঢাকা যাচ্ছিরে।”

ছ্যাঁত করে উঠলো নরম মনটা।ঢাকা অনেক দুর।এত দূর কেনো যাচ্ছে মাহরুর ভাই?আকষ্মিক কষ্টের আনাগোনা শুরু হয়ে যায় হৃদগহ্বরে।অতি মাত্রায় কাতর দৃষ্টি মাহরুরের দিকে রেখে প্রশ্ন করে,

“কেনো যাচ্ছো?”

“চাকরির জন্য।এক জায়গা থেকে ডাক এসেছে।দুআ করিস যেনো চাকরিটা পেয়ে যাই।তোর জন্য উপহার আনবো”

মাহরুর হাটতে শুরু করে মাকে আরেকবার বিদায় দিয়ে।তার পিছু পিছু হাঁটছে মল্লিকা। মাহরুর ভেবে নেয় হয়তো সে পা বাড়াবে বাড়ির দিকে।তাকে ভুল প্রমাণিত করে অনুসরণ করছে তার কদম। আচ পেয়ে মাহরুর হাটা থামায়।

পিছু ঘুরে প্রশ্ন করে, “তুইও আমার সাথে যাবি নাকি?”

“নিবে মাহরুর ভাই?”

চাঁচল্য কণ্ঠে মিশ্রিত।অধিক মাত্রায়। চট করে ধরে ফেললো মাহরুর।মেয়েটি ব্যথিত।কিন্তু কেনো?তার চলে যাওয়াটাইতো এর কারণ নয়?

শক্ত গলায় বলে, “বাড়ি যা চন্দ্র”

“তুমি কবে ফিরবে?”

কথার পিঠে প্রশ্ন।অবাক হলো মাহরুর।এই মেয়েটি কখনো এভাবে কথা বলেনি।যা আদেশ করেছে সবটা মাথা পেতে নিয়েছে।আজ এমন রূপ কেনো?

“দেরি হবে।আর চাকরিটা হয়ে গেলো অনেক দেরি হবে।”

ছলছল করছে ইতিমধ্যে নেত্রযুগল।ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস।তার আগেই নিজেকে সামলায় মল্লিকা।বলে,

“আমি অপেক্ষা করবো মাহরুর ভাই।সাবধানে যেও”

“তুই কাঁদছিস চন্দ্র?”

গলির মোড়ের আবছা আলোয় চন্দ্রমল্লিকার চোখ দুটো দৃশ্যমান।দ্রুত পিছু হতে যায়। আধাঁরে ডুবে গিয়ে বললো,

“নাহ মাহরুর ভাই।আমি খুশি হয়েছি।আমি জানি তোমার চাকরি অবশ্যই হবে।গেলাম আমি।তুমি দেখে শুনে যাবে কিন্তু।”

___

বিশটা দিন! এমনি এমনি কেটে গেছে। মাহরুর ইবনাতের কোনো খোঁজ নেই।নাহ!আছে সেটা একান্তই তার মা জানে। সেইতো জানার কথা। সাত রাজার ধন সে। মায়ের আদরের পুত্র।শুনেছে প্রতিরাতে ফোন করে নাকি খবর নেয় মায়ের। জ্বরে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া মেয়েটির কথা কি মনে পড়ে?সেকি জানে কিশোরী মনের পাশাপাশি দেহেও জ্বরের উত্তাপ। চন্দ্র থেকে জ্বলন্ত সূর্য হয়ে গেছে ছিমছাম দেহটা।কেদে ফেলে শশীর হাত চেপে।

বলে, “মাহরুর ভাইতো ভালো মানুষ।কিন্তু হঠাৎ এমন স্বার্থপরের মতন আচরণ করছে কেনো?মায়ের ফোনে একটা ফোন করতে পারতো? আমরা কি তার পর?”

শশী উত্তর দেয়, “হয়তো সে ব্যাস্ত।তুই কাঁদিস নাতো”

“আমার কান্না পাচ্ছে অনেক কি করবো?”

“মাহি ভাই আসলে তার সামনে বসে কাঁদিস”

দুহাতের পিঠের সাহায্যে চোঁখদুটো মুছে মল্লিকা বলে উঠলো, “কক্ষনো না। মাহরুর ভাই আমাকে ছিঁচকাদুনে ভাববে।”

“বোকার মতন আচরণ করিস আর কথা বলিস পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতন।কেমন রে তুই মল্লিকা?”

স্মিথ হাসির রেখা এসে জড়ো হয় মল্লিকার ঠোঁটে। স্বল্পক্ষণের।এসেই চলে গেলো।বললো,

“জানিস তনু আপু বাড়ি এলে আমার সাথে কথা হয়।সে তার সংসারের কত আলাপ করে আমার সাথে। একদিন কথায় কথায় এটাও বলেছে পুরুষ মানুষ নাকি অত্যন্ত জটিল অংক। এরা যা বলে সাথেসাথে শুনতে হয়।অযথা কাদতে হয় না।বোকার মতন আচরণ করতে হয় না তাদের সামনে। ধৈর্য্য ধরা অনেক জরুরী।আমিও সেটাই চেষ্টা করছি।”

“এত যে চেষ্টা করছিস?শেষমেশ কি পাবি তাকে?”

“জানি নাতো”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-০১

0

চন্দ্র’মল্লিকা ১
লেখা : Azyah (সূচনা)

“এই যুগে এসে এত স্বল্প আয়ের মানুষের সাথে আর যাই হোক;সংসার করা যায়না।আপনি তালাকনামায় সই করে দিন।নিজেও মুক্ত হন আমাকেও মুক্ত করুন”

মাহরুর ইবনাতের চক্ষু সম্মুখে তালাক নামা। ইংরেজিতে যাকে বলে ডিভোর্স পেপার। খরখরে কাগজে কালিতে খচিত কিছু লেখা।সেগুলো পড়ে দেখার কোনো দরকার নেই এখানে। জানা আছে সবটাই।এত বিশ্লেষণ জেনে আর কি হবে?ছয় বছরের সংসারের ইতিনামা এটা। দীর্ঘশ্বাসের সাথে দৃষ্টি তোলে আরেকবার। হিরার দিকে।

হিরা রুঢ়।দেখেও দেখলো না মাহরুরের করুন দৃষ্টি। বিরক্তি নিয়ে বললো, “তিন বেলা খাইয়ে পড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেয়েও উর্ধ্বে কিছু আছে।কত শখ ছিল আমার।আপনার মা মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আমাকে বউ করে আনে।আমাকে রাজরানী বানিয়ে রাখবে।রাখলো কোথায়?এই ছোট্ট পুরোনো আমলের চিলেকোঠায়?জানেন আজ পর্যন্ত আমি বাচ্চা নেইনি কেনো?আমি চাচ্ছিলাম না আমার সন্তান আমার মতই কষ্ট করুক।তার ছোটছোট শখ আহ্লাদ পূরণ না হোক।দিনদিন অবস্থার উন্নতি হয় অবনতি হচ্ছে।আপনি আমাকে ভালো রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন কিন্তু হচ্ছে না মাহি।আমাকে মুক্ত করুন।”

কয়েকবার চোখের পলক পড়ে মাহরুরের।এই মুহূর্তে মন আর মস্তিষ্ক উভয়ই কোনো চিন্তাভাবনা থেকে বিরত থাকতে চাইছে।কোনো অনুভূতি নেই তার।কোনো আক্রোশ,কষ্ট নেই।এক না একদিন হিরা ছেড়ে যাবে।এটা বিয়ের প্রথম দিনই জেনেছে সে।শুধু প্রশ্ন একটাই তার নিজের মনের বিরুদ্ধে তাকে সবটা দিয়ে পূর্ণ রাখতে চেয়েছে।অবশেষে পারলো না?

লাল রঙের আবরণে আবৃত কলম তুলে সই করলো। স্বাভাবিক গলায় হিরার উদ্দেশ্যে বললো, “ফিরে আসতে চাইলে আসতে পারো।কিন্তু সময়ের একটা সীমা থাকবে এখানে।”

“কঠিন কিছু কথা বলবো।মনে কষ্ট নিবেন না।আপনি সারাজীবন আমার অপেক্ষা করলেও ফিরবো না আমি।”

“ঠিক আছে।”

ছয় বছরে কতদিন হয়?কত ঘন্টা?কত সেকেন্ড? মস্তিকে যেনো বেশি চাপ না পড়ে তাই বছরের হিসেব রাখে মানুষ। চিলেকোঠার ছাদটায় হেলান দিয়ে বসেছে মাহরুর। খটখট আওয়াজ আসছে ঘর থেকে।ছয় বছরের সঙ্গিনী যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতিতে। আটকানোর সাধ্য নেই।চেয়েছিলো একটা সংসার।ভালোবাসায় না হোক।সম্মানে,হাসিতে?সেটাও হলো না?কেনো? দুরাকাশের চাঁদের দিকে চাইতেই কর্নে নারী কণ্ঠ এসে বারি খায়,

“চলে যাচ্ছি ভালো থাকবেন।আমাকে ক্ষমা করবেন পারলে”

এক চিলতে হাসি নিয়ে হিরার সামনে এসে দাঁড়ায় মাহরুর।না রাগ দেখিয়ে বিদায় দিবে না কষ্ট।হাসিমুখে বিদায় দেবে।সেতো দারিদ্র্য নামক জঞ্জাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে যাচ্ছে।

“দেখা করো সময় হলে কেমন?স্বামী স্ত্রী না হোক একে অপরের পরিচিত হিসেবে সাক্ষাৎ হতেই পারে।”

“হয়তো চাইলেও হবে না।আমি আগামী মাসে কানাডা যাচ্ছি”

“ওহ!আচ্ছা সাবধানে যাবে।”

উচু স্থানে দাড়িয়ে ল্যাম্পপোস্ট এর আলোয় এগিয়ে চলা নারীর দিকে চেয়ে রইল মাহরুর।কালো লাগেজে ভরে ছয় বছরের বন্ধুত্ব নিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টির আড়ালে যেতেই পা বাড়ালো ঘরের দিকে।ছোট্ট ছিমছাম ঘরটা।এখানে অস্তিত্ব ছিলো দুজনের।কিছু মুহূর্ত আগেও। এখন থেকে আজীবন একাকিত্বকে সাথে নিয়ে থাকবে মাহরুর।কালো আস্তরণ পড়া ঢাকা স্টিলের পাতিল হাতে তুলে নিল।দুপুরে বেচে যাওয়া ভাত আর একটু ডাল আছে।খাওয়ার রুচি নেই।কিন্তু এগুলো নষ্ট করা তার স্বভাব বিরোধী।কালচে চুলোয় গরম করে নির্লিপ্ত খেয়ে নেয়।চোখ বুজে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে।

“কাউকে কাঁদিয়ে ভালো থাকা যায়?”

___

ক্লান্ত বিকেলে হেঁটে চলেছে রাস্তায় মাহরুর।চেক শার্টটা ভিজে লেপ্টে আছে শরীরে। অফিসের কালো ব্যাগটাও আজ কাঁধে বেশ ভারী মনে হচ্ছে।শরীর দূর্বল তাই? হাটতে হাটতে পা জোড়া থামে একটা বাড়ির কাছে।নাম ‘ বাগানবাড়ি ‘।লোহার দরজায় ছোট্ট বালিকার দেখা মিলতেই পায়ের গতি বাড়ায়।

“এই মিষ্টি!মিষ্টি?এখানে বসে আছিস কেনো?”

পাঁচ বছরের আনমনা মেয়েটি চোখ তুলে তাকায়।সবুজ ফ্রক গায়ে গালে হাত রেখে সদর দরজায় বসে ছিল। মাহরুরকে দেখে চোখ তুলে।কাপড় ঝাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে।ঝুঁকে বসলো মাহরুর।

গাল টেনে দিয়ে বললো, “কেমন আছিস?তোকে অনেক দিন পর দেখলাম”

বাচ্চা কন্ঠস্বরে মিষ্টি উত্তর দেয়, “ভালো আছি মামা”

“দুপুরে খেয়েছিস?”

খাওয়ার কথা শুনতেই মুখটা চুপসে গেলো মিষ্টির। শিশু মনে কষ্ট জমেছে।ভার বহন করতে পারবে কি?অভিমান করে বললো,

“আজ সরষে ইলিশ রান্না হয়েছে।আমিতো কোনো মাছ খাই না।তবে আমার ইলিশ অনেক পছন্দের।দাদীর কাছে চেয়েছিলাম দেয়নি।তাই রাগ করে ভাত খাইনি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুর।চোখটা শক্ত করে বুজেছিলো সামান্য ক্ষনের জন্য।পরপর খুলেই উঠে দাড়ালো।সামান্য নিচু হয়ে হাতটি ধরে মিষ্টির।বলে,

“চল আমার সাথে”

“কোথায় যাবো মামা?মা আমাকে না দেখলে বকে দিবে কিন্তু”

ততক্ষনে দুজোড়া পা চলমান।খানিকটা চলার গতিতে স্থিরতা আসলো।পূনরায় এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে উত্তর দিলো,

“ইলিশ খাবি না? মামা আজ বেতন পেয়েছি।মোল্লা হোটেলে গিয়ে দুজনে মিলে ইলিশ খাই চল”

টিনের চারদেয়ালে ঢাকা ছোট্ট হোটেলটি বেশ জনপ্রিয়।বাঙালি খাবারের জন্য সর্বদা জমজমাট থাকে।সব শ্রেণীর মানুষের আনাগোনা।সেখানেই কাঠের তৈরি টেবিলে মুখোমুখি বসেছে মাহরুর আর মিষ্টি।হোটেলের ছেলেকে ডেকে প্রশ্ন করলো,

“রবিন সরষে ইলিশ আছে?”

“না ভাই ইলিশ ভাজা আছে আর দোপেঁয়াজা”

রবিনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মিষ্টির দিকে চেয়ে মাহরুর প্রশ্ন করে, “ইলিশ ভাজা খাবি? সরষে অনেক ঝাল হয় তুই খেতে পারবি না।”

মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় মিষ্টি।উত্তর দেয়, “খাবো মামা”

দুই পিস মাছের সাথে গরম গরম ভাত। ভাগ্যিস বেতনটা পেয়েছে আজ।নাহয় মেয়েটির মুখে হাসি ফুটানো হতো না। তৃপ্তি পাচ্ছে চোখ দুটো।মিষ্টি মেয়েকে হাসতে দেখে। শার্টের হাতা গুটিয়েছে।যত্ন করে মাছ বেছে দিচ্ছে মিষ্টিকে।তার নাকি মাছ বেশি পছন্দ আগ্রহ দেখে ভেবেছিলো এক পিস মাছে হবে না।কিন্তু মাহরুরকে হাসিয়ে এই ছোট্ট মাছের টুকরো শেষ করতে পারলো না। বাকিটা মাহরুরের পাতেই পড়েছে।পকেটে রাখা টিস্যুর সাহায্যে মিষ্টির মুখটা মুছে তাকে কোলে তুলে নেয়।খাবারের টাকা মিটিয়ে হাটতে লাগলো তাদের বাগানবাড়ির দিকে।

কিছু পথ আগেই ভরকে উঠে মাহরুর।শাড়ি পরিহিতা এক রমণীকে দেখে। মাহরুর চেনে তাকে।ভীষণ ভালোভাবেই চেনে। হুড়মুড়িয়ে তাদের দেখে এগিয়ে এলো।এই তাড়াহুড়োর কারণটাও জানা আছে। শাড়ির আঁচল সামলে এসে মিষ্টিকে ছিনিয়ে নেয়।বুকে চেপে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে যেনো।

ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করলো ছোট্ট মেয়েকে, “কোথায় চলে গিয়েছিলি তুই?তোকে আমি সারা মহল্লা খুঁজছি।সন্ধ্যা পড়ছে খেয়াল আছে তোর?”

“আমি মামার সাথে ইলিশ ভাজা খেতে গিয়েছিলাম মা। দাদীতো দিলো না।” উত্তর দেয় মিষ্টি।

মিষ্টির মা মাথা ঝুকায়। ভাজে কুচকে থাকা কপাল নিয়ে চোখ বুজলো।কি ভয়টাই না পেয়েছিলো।তার মেয়েটা বড্ড অভিমানী। দাদীর সাথে অভিমান করে দরজায় বসেছিলো।হটাৎ তাকে না দেখতে পেয়ে ভরকে যায়।একদিন রাগ দেখিয়ে বলেছিলো মিষ্টি ‘ থাকবো না এই বাসায়।আমাকে কেউ ভালোবাসে না।একদিন চলে যাবো ‘ ছোট্ট মেয়ের কথা তখন কানে না নিলেও আজ ভীষণ রকমের ভয় হানা দিয়েছিল অন্তরের গভীরে।মা মেয়ের দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে থাকা নির্বাক মাহরুর।একই বোধহয় বলে ভালোবাসার টান।মেয়ের টানে এদিক ওদিক ফিরতে থাকা মেয়েকে দেখে মুখের সস্তি।

মাহরুর নিজ থেকে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে মিষ্টির মাকে,

“কেমন আছিস?”

“জ্বি ভালো।আপনি?”

“আছি।বাড়ি যাস?”

“না”

“আমিও যাই না।” স্বাভাবিক কণ্ঠেই উত্তর দেয় মাহরুরও।

উত্তর দিচ্ছে।তবে সম্পূর্ণ মেয়ের দিকে মনোযোগী হয়ে। গালে লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। মাহরুরওতো দিয়েছিল পরিষ্কার করে। বোধহয় তার পরিষ্কারে ঘাটতি রয়ে গিয়েছিলো।যেটা তার মমতাময়ী মার চোখে স্পষ্ট ঠেকেছে।

__

“এসেছে মহারানী!কই! কার সাথে রাস্তায় নষ্টামি করতে গিয়েছিলি মা মেয়ে?”

দাদীর এমন রুঢ় বাক্যে মায়ের দিকে তাকায় মিষ্টি।তার দাদী মোটেও ভালো না।শুধু রাগ দেখায়।মাকে ব্যথা দেয়।তার মায়ের যে তার জন্য কোনো সময় নেই।সারাদিন কাজে ব্যস্ত সে।একাকী বাচ্চা মেয়েটা মাকে চায়!সেটা কি সে বোঝে?আশপাশে ঘুরাফেরা করলেই বকে দেয়।

“আমি ইলিশ খেতে গিয়েছিলাম দাদী।”

মেয়েকে চেপে ধরে।ইশারা করে না করে কিছু বলতে। মেয়েটিও যেনো মায়ের ইশারা বুঝলো চুপ করে গেলো।রেহালা দাঁত কিড়মিড় করে প্রশ্ন করলো,

“ইলিশ! কোথায় গিয়েছিলি ইলিশ খেতে? কার সাথে গিয়েছিলি?”

“আম্মা খেতে চেয়েছিল।কিভাবে খাবে?ওর কাছে টাকা আছে?বাহিরেই বাচ্চাদের সাথে খেলতে খেলতে মাঠে দিকে চলে গিয়েছিল।ধরে এনেছি।”

“শখ কত!ইলিশ খাবে? মাইয়া জন্ম দিয়েছ ঘরে বসিয়ে ইলিশ আর মজার মজার খাবার খাওয়ার জন্য নাকি?দুইবেলা কপালে ভাত জোটে এটাই শুকরিয়া আদায় কর!”

বলতে বলতে চলে গেলেন রেহালা।শক্ত মুখে চেয়ে থাকা মায়ের গালে হাত বুলিয়ে মিষ্টি বললো, “তুমি কষ্ট পেয়েছো মা?তুমি আমাকে বকলেও কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি।তুমি কষ্ট পেও না”

ফিক করে হেসে মেয়েকে জড়িয়ে নিলো বুকে।বললো, “বোকা মেয়ে।আমিতো তোকে মিছেমিছি বকি।আমিও তোকে অনেক ভালোবাসি।”

“মামা অনেক ভালো মা!আমাকে এত্ত বড় ইলিশ মাছ খাইয়েছে।”

“এভাবে কারো সাথে গিয়ে কিছু খেতে হয়না মিষ্টি। লোকে খারাপ বলবে।ভালো অভ্যাস না।”

“আমি যাইনি।আমাকে মামা নিয়ে গেছে।”

“আচ্ছা আগামীবার যাবি না।এখন আয় মাথায় তেল দিয়ে বিনুনী করে দেই”

জীবনে হয়তো কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি এমন পরিস্থিতি আসবে জীবনে।একরাশ স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল এই ঘরে।সেটা যে বিয়ের এক বছরে ভেঙে চুরমার হবে কে জানতো? নারীরাই নারীর চির শত্রু।কথাটি যে বলেছে হয়তো সে এই সমাজ,এই পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞানী।অনেকটা জ্ঞান অর্জন করেইতো বলেছে।অনেকাংশে সত্যি বলেছে।এই যুগে এসে কন্যা সন্তানের প্রতি এত ক্ষোভ?সারাদিন কাজ করে মেয়ের পেটে দুমুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্য?এটা কেমন জীবন?কেমন স্বভাব আচরণ মানুষের?

___

অতীত,

“কাউকে ভালোবাসলে মনের মধ্যে প্রজাপতি উড়ে?”

শীতের দুপুরে পুকুরপাড়ে ক্লান্ত মাহরুর। পুকুরের দিকে ইট ছুঁড়ে মজার খেলায় একাকী মত্ত ছিলো। মেয়েলি কণ্ঠে ফিরে চায়।সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় এর পরীক্ষা শেষে এসেছে নিজের পুরোনো বাড়িতে।এখানেই আপন পরিজনের বসবাস।

তেরছা হাসে মাহরুর।এইটুকু মেয়ে ভালোবাসার প্রকাশ করতে কি অদ্ভুত সংজ্ঞাই না দিলো। প্রজাপতি উড়ে মনে?কথাটি ভেবে আরেকদফা হাসে।উঠে দাঁড়িয়ে পেছনে হাত বেঁধে দাঁড়ালো। লজ্জিত মুখশ্রীর দিকে চেয়ে বলল,

“তোর বয়স কতোরে?”

“সতেরো”

“বয়সটা প্রজাপতি উড়ানোর জন্যে অনেক কম”

“বয়স বাড়লে তোমাকে পাবো?”

“তখন আমার বয়স হবে তোর থেকে দ্বিগুণ।আমাকে ছুতে পারবি না কখনো চন্দ্র।”

আঁধার ঘনিয়ে এলো সুশ্রী মুখমণ্ডলে।যতই বড় হোক সে।কখনোই মাহরুরকে ধরতে পারবে না।যত এগোবে তত দূরে যাবে।

“তাহলে আমি কি সারাজীবন নিঃসঙ্গ রয়ে যাবো?” মাথা তুলে প্রশ্ন করে।

“তা কেনো হবে?সময়মত নিজের যোগ্য কাউকে পাবি।আর এখন যে কথা বলছিস সেটা ভুলে যাবি। হাসবি বড় হয়ে।কি বোকামিটাই না করতি।বলদ মেয়ে একটা!” বলে হাসিতে ফেটে পড়লো মাহরুর।

অপমানজনক এই হাসি।কিশোরী মনে ছুরিআঘাত।এই বয়সে আঘাতটা বেশ গাঢ়ভাবেই লেগেছে।তারপরও মুখ স্বাভাবিক রাখলো।সেতো পন করেছে। মাহরুরকে না পেলে সঙ্গীহীন থাকবে সারাজীবন।দেখা যাক তার ইচ্ছে পূরণ হয় নাকি মাহরুরের কথা।

পুরোনো স্মৃতির ঘোর কাটলো মাহরুরের।উত্তেজিত মেয়েলি গলায়।দরজা ধরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে।দেখে বোঝা গেলো ভীষণ অস্থির সে।পাঁচ তলা বেয়ে উঠে অস্থিরতার ঊর্ধ্বগতি।

“মাহি ভাই!”

“শিরীন?এতরাতে এখানে কি করছিস?”

প্রশ্নের উত্তর দিলো না শিরীন।এই প্রশ্নের চেয়ে তার প্রশ্ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।বিছানার কোণে বসতে বসতে বললো,

“ভাবি চলে গেছে?”

“হ্যাঁ”

“তুমি তাকে আটকাওনি মাহি ভাই?”

উঠে বসেছিলো শিরীনকে দেখে।ভেবেছিল অন্য কোনো কারণে তার আগমন।এখন তার কথা শুনে মনে হলো এতো বিশেষ কোনো কারণ না তার সাথে অস্থির হওয়ার।মাথার পেছনে হাত ঠেকিয়ে পূনরায় শুয়ে পড়লো। তাচ্ছিল্যময় হেসে বললো,

“আটকানোর পথ বন্ধ।”

“কেনো মাহি ভাই?ছয় বছরের জীবন সঙ্গীকে ফেলে রেখে যেতে ছয় সেকেন্ড সময় নেয়নি হিরা ভাবি।আর তুমি এত স্বাভাবিক আছো কি করে?”

“সম্পর্কটা জোর জবরদস্তির ছিলো।আমার জন্মদাত্রী মা মিথ্যের সাহায্য নিয়ে ওই নির্দোষ মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছে।আমি জানতাম আজ হোক কাল সে আমাকে ছেড়ে যাবে।আমি পূর্বপ্রস্তুত ছিলাম।”

চলবে…..

ঐশ্বর্যের উপাখ্যান পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0

#ঐশ্বর্যের_উপাখ্যান
#পর্ব-০৭ (অন্তিম পর্ব)
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

গভীর রাত। চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই ঐশ্বর্যের। ল্যাপটপে হাতের আঙুল দ্বারা করে চলেছে কাজ। ঠিক তখনই তার মুঠোফোন বেজে উঠলো বিকট শব্দ করে।

কাজে ব্যাঘাত ঘটায় ঐশ্বর্যের ভ্রু আপনাআপনি কুঁচকে গেলো। দ্বিতীয়বারের মতো আবারও মুঠোফোন বেজে উঠতেই রিসিভ করলো সে।

আন-নন নাম্বার দেখে ঐশ্বর্য সালাম দিলো। ওপাশ থেকে পুরুষালী রুক্ষ গলা শুনা গেলো। সালামের উত্তর দিয়ে পুরুষটি আদেশ করল, ‘পাঁচ মিনিটের ভিতরে নিচে আসো।’

গলা চেনা চেনা লাগলো ঐশ্বর্যের। কিন্তু অপরিচিত ব্যক্তির এহেন প্রস্তাবে বিরক্ত হলো অনেক। কন্ঠে গাম্ভীর্য ঢেলে বলল, ‘হু আর ইউ ম্যান?’

ওপাশ থেকে বলল, ‘সেটা দেখার জন্যে হলেও নিচে আসো।’

অগত্যা ঐশ্বর্য মুঠোফোন কানে চেপে ধরে নিজের কক্ষ থেকে বের হলো। ডোয়িং রুম গভীর অমানিশাতে ডুবে। চুপিচুপি পা ফেলে আগাতে লাগলো দরজার দিকে। দরজায় হাত রাখতেই জ্বলে উঠলো সব বাতি। পুরো ডোয়িং রুম আলোকিত হলো মুহুর্তের মধ্যেই। ঐশ্বর্যের কানে ভেসে এলো একাধিক মানুষের একসাথে বলা ‘শুভ জন্মদিন, শুভ জন্মদিন, শুভ জন্মদিন!

কান থেকে মুঠোফোন নামিয়ে অবাক চোখে পিছু ফিরে তাকালো ঐশ্বর্য। নিজের চক্ষে যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মা বাবা ভাই বোনদের সাথে অনল শিকদার দাড়িয়ে আছে। শুধু তা-ই নয় আরও কতো মানুষজন। এতো মানুষ বাড়িতে অথচ সে টেরই পেলো না!

তুর এগিয়ে এসে হাত টেনে নিয়ে গেলো ঐশ্বর্যকে। ঐশ্বর্য চারিদিকে চোখ ভুলিয়ে দেখলো। কি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে সবকিছু। সব কি তারই জন্য?

রুদ্র ও তটিনী মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো। শুভেচ্ছা জানালো আঠাশ তম জন্মদিনের। তটিনী ঐশ্বর্যের কপালে চুমু দিয়ে কেকের কাছে নিয়ে গেলো। এক সাইডে ঐশ্বর্যের পরিবার ও আরেক সাইডে অনল ও তার পরিবার দাড়ালো। তটিনী ও রুদ্র এক পাশ থেকে ঐশ্বর্যের হাতে হাত রাখলো। অপর পাশ থেকে হাত রাখলো অনল ও তার মা ইলমা খান। কেক কেটে ঐশ্বর্য প্রথম নিজের মা বাবাকে খাইয়ে দিলো। সবাইকে একটু একটু খাওয়ানোর পর অনলের পালা। ঐশ্বর্য প্লেটে কেক নিয়ে ঐশানীর হাতে দিয়ে বলল, ‘নেতাকে দিয়ে আয়।’

ঐশানী সরে গেলো। ঐশ্বর্য ঐতিহ্যের দিকে তাকাতেই ঐতিহ্যও সরে গেলো। তুরের দিকে তাকিয়ে যা বুঝলো আজ কেউ তার কথা শুনবে না। অগত্যা নিজেই এগিয়ে গেলো অনলের দিকে। অনলের ঠোঁটের কোণে উঁকি দিচ্ছে হাসির ঝলক। হয়তো সে এরকমই একটি মুহূর্তের অপেক্ষা করছিল। ঐশ্বর্য প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার কেক!’

‘আমি তো জানতাম যার জন্মদিন সে নিজে সবাইকে কেক খাইয়ে দেয়!

ঐশ্বর্য আশ্চর্য হয়ে তাকালো। চোখে চোখ পড়তেই অনল চোখ মারলো। ঐশ্বর্য চোখ বড়বড় করে ফেললো। ততোক্ষণে পিছে এসে দাড়িয়েছে দু’টি পরিবার। তুর ঐশ্বর্যের হাত থেকে প্লেট নিয়ে নিলো। অনলের মা (নাম মনে নাই🥺) একটি বক্স এগিয়ে দিলেন। সেটা খুলে অনল ডায়মন্ডের আংটি বের করলো। তটিনী ঐশ্বর্যের হাত উপরে তুললো। ঐশ্বর্য ঘোরের মধ্যে এনগেজড হয়ে গেলো। সে নিজেও যে কিভাবে আংটি পড়িয়েছে তা নিজেও বুঝতে পারেনি।

আংটি পড়ানো শেষে তুর চামচে কেক নিয়ে ঐশ্বর্যকে বললো অনলকে খাইয়ে দিতে। ঘোরের মধ্যেই ঐশ্বর্য খাইয়ে দিলো। অনল চমৎকার করে হেসে নিজেও খাইয়ে দিলো। ব্যস হয়ে গেলো ঐশ্বর্য ও অনলের এনগেজমেন্ট!

ঘোরের মধ্যে এনগেজমেন্ট হলেও বিয়ে কিন্তু হলো জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে। ঐশ্বর্য কখনো যা স্বপ্নেও ভাবেনি। হাজারো রমনীর ক্রাশ অনল শিকদারকে চোখের পলকে নিজের সাথে বেঁধে নিলো সে।

বিয়ের আগে একদিন ফোনে আশ্চর্যজনক একটি বিষয় জানতে পারলো ঐশ্বর্য। তার স্বামী নাকি তাকে অনেক আগে থেকে পছন্দ করতো! সেটা শুনে ঐশ্বর্য অজ্ঞান হয়ে গেছিল। পাক্কা এক ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরেছিল বেচারির।

তারপরের ঘটনা আরও লম্বা। বিয়ের দিন বুঝদার ঐশ্বর্য কেঁদেকেটে একাকার। তার মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে৷ অনল বউয়ের দিকে টিস্যু এগিয়ে দিতে দিতে একেকজনকে ধরে বলছে তার বউয়ের কান্না থামাতে। কিন্তু কেউ তো এগিয়ে এলোই না বরং ধমক দিতে লাগলো। অনল যখন নিজের বোন অনামিকাকে বলল, ‘তোর ভাবিকে বল কান্না থামাতে।’

তখন অনামিকা রেগে বলেছিল, ‘তুমি নিজে আগে নাক টানা বন্ধ করো। পারলে দুজনে মিলে গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদো!

অনল ঐশ্বর্যকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কাঁদছো কেন?’

ঐশ্বর্য নাক টেনে বলল, ‘আপনি কাঁদছেন কেন?’

তাদের কাঁদা কাদির পর এলো মিডিয়ার বিষয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েকমাস আগে যাকে নিয়ে অনেকে বাজে কথা বলতো তারা চমকে গেলো। সেই মেয়েটিকেই অনল শিকদার বিয়ে করেছে! সবার জন্য অবিশ্বাস ব্যাপার!

*
বিয়ের পর ঐশ্চর্য শিকদার বাড়ি থেকেই অফিসে যাতায়াত করতো। অনল তখন রাজনীতিতে সবটুকু দিয়ে রাজত্ব করছে। তারপর?

তারপর বছরের পর বছর আসলো। ২০৪৫ সাল থেকে ২০৫০ সাল হলো। প্রথমবার বাবা হওয়ার স্বাদ লাভ করলো অনল শিকদার!

এবার চলুন আপনাদের প্রিয় রুদ্র-তটিনীর দিকে ফেরা যাক। রুদ্র ইরফান আগের থেকে একটু বয়স্ক হয়ে গেছে। চামড়া আগের মতো থাকলেও গাল কিছুটা ডেবে গেছে। তটিণী আজকাল স্বামীর মতো চশমা ব্যবহার করছে। কিন্তু দিনশেষে দুজন দুজনকে ভালোবেসে ভালো আছে!

তুর ২০৪৬ সালে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিল। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে পা রাখে। তারপর? আজ তার বিয়ে। ঐশ্বর্য দুমাসের বাচ্চা ও তার নেতা সাহেবকে নিয়ে এসেছে বাবার বাড়ি। বাবার বাড়ি কেন বলছি?

আরে আপনানা বুঝতে পারেন নি? ঐতিহ্যের সেই ওয়ান এন্ড অনলি ক্রাশ আর কেউ না বরং আমাদের তুর! হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। ঐতিহ্যের সাথেই তুরের শুভ বিবাহ হতে চলেছে!

সাদা গ্রাউন, চুলে দোপাট্টা জড়িয়ে প্রিন্সেসের মতো সেজেছে তুর। মুখের সামনে দিয়ে কাপড় দেওয়া। সেজন্য চোখ ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। ঐতিহ্য সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে। কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। ঐতিহ্য ও তুর ফটাফট কবুল বলে দিলো। ব্যস হয়ে গেলো আরও একটি বিয়ে।

এবার চলুন আমাদের রুদ্রের ছোট রাজকন্যার দিকে যাওয়া যাক। ঐশানী মামা ও চাচার মতো ডাক্তারি পড়ছে। বর্তমানে ইন্টার্নি করছে সে। কিছু বছর পর তারও বিয়ে হবে কোনো এক রাজকুমারের সাথে।

আমাদের ছোট্ট সদস্য হলো ঐশ্বর্য ও অনলের পুত্র অগ্নি শিকদার! যে বর্তমানে বাবার কোলে হিসু করে শুয়ে আছে চুপটি করে। অনল নিজের শার্টের দিকে তাকালো। পেমপাস পড়ানোর কারণে তেমন নষ্ট হয়নি। কিন্তু একফোঁটা হলেও তার পোশাকে পড়েছে। অনল অসহায় চোখে ঐশ্বর্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করলো।

আমাদের সবার প্রিয় ঐশ্বর্য তখন একমাত্র ভাইয়ের পাশে বসে সবার সাথে গসিপ করতে ব্যস্ত। ঐশ্বর্য কালো গ্রাউন পড়েছে। বয়স বাড়লেও সৌন্দর্য কমে যায়নি। বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন।

অনলের সাথে চোখাচোখি হতেই অনল অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। ঐশ্বর্য বুঝেও চোখ সরিয়ে নিলো। ভাব এমন আমি কিছু দেখিনি। অনল বউয়ের মতলব বুঝতে পারলো। বিয়ের পর থেকে ঐশ্বর্য এখন পর্যন্ত কোনো সুযোগ বাদ রাখেনি যা করে নিজের স্বামীকে বিরক্ত করা যায়। সে মূলত প্রতিশোধ নিচ্ছে। কেন অনল প্রথম থেকে বললো না পছন্দ করে? তাহলে কি ঐশ্বর্য এমন কষ্ট পায়?’

অনলের অসহায়তা দেখে হয়তো মায়া হলো তার একমাত্র পুত্র অগ্নির। সে বিকট চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। ঐশ্বর্য ছেলের চিৎকার শুনে এক দৌড়ে চলে আসলো। অনলকে ধমক দিয়ে বলল, ‘আপনি কি করেছেন ওকে?’

অনল অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু করিনি, পেমপাস নষ্ট হয়ে গেছে। পাল্টে দাও ঠিক হয়ে যাবে।’

ঐশ্বর্য কটমট করে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি চেঞ্জ করাতে পারলেন না?

‘এতোক্ষণ তো এজন্যই তোমাকে ডাকছিলাম। পেমপাস কোথায় আমি তো জানি না।’

অনলের অসহায় গলা। ঐশ্বর্য গটগট পা পেলে চলে গেলো। অনল বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘নেতাকে দিয়ে পেমপাস পাল্টানো! নেতাকে ধমক দেওয়া! জাতি মেনে নিবে না ঐশ্চর্য!

এইতো, এভাবেই চলতে লাগলো আপনাদের প্রিয় ঐশ্বর্যের উপাখ্যান!

সমাপ্ত🤍

ঐশ্বর্যের উপাখ্যান পর্ব-০৬

0

#ঐশ্বর্যের_উপাখ্যান
#পর্ব-০৬
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

অনিক শিকদারের সাথে যে ডিল করেছিল সেটার জন্য পুনরায় মিটিং করতে হচ্ছে। মিটিংয়ে অনিক শিকদারের সাথে অনিল শিকদারকেও উপস্থিত থাকতে হবে। তারা বাপ ছেলে ইতিমধ্যে মিটিং রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে। রুদ্র ব্যস্ত পায়ে এসে মিটিং রুমে প্রবেশ করলো৷ এখন অপেক্ষা ঐশ্বর্যের জন্য। অনল হাত ঘড়িতে সময় দেখলো, মিটিং শুরু হবে পুরো দশটার দিকে৷ এখন বাজে নয়টা আটান্ন। অর্থাৎ আরও দুমিনিট বাকি।

ঠিক দশটার সময় ঐশ্বর্য গটগট করে মিটিং রুমে প্রবেশ করলো। অফিসিয়াল ড্রেসে পাক্কা বিজনেস উইমেন্স লাগছে দেখতে। সবাইকে সালাম দিয়ে সে রুদ্রের বাম সাইটে বসে পড়লো।

মিটিং শুরু করলো রুদ্র। রুদ্র নিজের প্রজেক্ট দেখালো। জরুরি কথা বললো কিছু। তারপর অনিক শিকদার নিজেদের প্রজেক্ট দেখালেন। অনল নিজের মতামত বলল। সবশেষে রুদ্র তাকালো ঐশ্বর্যের দিকে। কিন্তু নির্লিপ্ত ঐশ্বর্য। রুদ্র মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু বলার নেই আপনার মিস ঐশ্বর্য?’

ঐশ্বর্য হাত ঘড়িতে তাকালো। সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, ‘সাড়ে দশটা বাজতে আরও পাঁচ মিনিট বাকি। তারপরই আমি আমার প্রজেক্ট সহ সব প্লান বলবো। আপনারা প্লিজ অপেক্ষা করুন।

ঠিক সাড়ে দশটার সময় মিটিং রুমে প্রবেশ করলেন ঈশানী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির সিও তটিনী ইফফাত ঐশি! সবাই দাড়িয়ে গেলো। রুদ্র বুকে হাত চেপে ধরলো। তার সুন্দরী বউ আজ মিটিংয়ে উপস্থিত হবে অথচ সে নিজেই জানতো না! ঐশ্বর্য এগিয়ে এসে তটিণী-র হাত ধরলো। মেয়ের হাত ধরে তটিনী সিও’র চেয়ারে বসলো।

ঐশ্বর্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, সি ইজ মাই কোম্পানি সিও তটিনী ইফফাত ঐশি। মাই ওয়ান এন্ড অনলি মাম্মি।

রুদ্রের কোম্পানির ম্যানেজার থমথমে গলায় বললেন, ‘আগে তো কখনো বলেন নি!

ঐশ্বর্য ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল, ‘আগে বললে সবাই চমকে যেতে পারতেন না।’

সবার দিকে তাকিয়ে তটিনী নিজের কথা শুরু করলো। ঐশ্বর্য একের পর এক ফাইল প্রজেক্ট এগিয়ে দিলো। তটিনী সেগুলো কি নিখুঁত ভাবে প্রেজেন্ট করলো। রুদ্র অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। সাথে মারাত্মক খুশি হচ্ছে যে তার মেয়ে নিজের মাকে কতোবড় একটি সম্মানীয় স্থানে এনে দাড় করিয়েছে। রুদ্র মনে মনে বলল, ‘অনেক বড়ো হও মা, আরও বড়ো হও। মায়ের মতো হও।’

তটিণী-র পড়োনে জামদানী শাড়ি। গুছিয়ে পরিপাটি করে নিজেকে সাজিয়েছে আজ সে। কোথাও এক বিন্দুও খুত নেই। ঠোঁটে লেপ্টে থাকা লিপস্টিকও ভীষণ পারফেক্ট ভাবে দিয়েছে। রুদ্র বার-বার মিটিং থেকে মনোযোগ হারাচ্ছে। এমন সুন্দরী বউ সামনে থাকলে মিটিংয়ে মন দেওয়াটাই মুশকিল হবে তার জন্য।

মিটিং শেষ করে সবাই কনফারেন্সে রুম থেকে বের হলো। অনল শিকদার তটিণীর সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলে চলেছে। একটু দূরত্ব থেকে দাড়িয়ে দেখছে তারা বাবা মেয়ে। ঐশ্বর্য মনে মনে বলল, ‘আর সবার মতো এই নেতাও আমার মায়ের প্রতি ক্রাশ খায়নি তো?’

রুদ্র মনে মনে বলল, ‘এতো দেখছি মেয়েকে পটানোর আগে মেয়ের মাকে পটিয়ে নিচ্ছে!

অনিক শিকদার এসে রুদ্রের সাথে হাত মিলালেন। বিদায় নিয়ে তাকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেলো।

অনল বিদায় নিয়ে বাবার পিছু পিছু চলে গেলো। তটিনী বাবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভীষণ ভালো ছেলে। তোমার চয়েস একদমই বাজে নয় ঐশ্বর্য। পটাতে পারলে পটিয়ে নাও।’

ঐশ্বর্য আড়চোখে নিজের বাবাকে দেখে নিয়ে জায়গা ত্যাগ করলো। রুদ্র এগিয়ে এসে কোমড়ে হাত রেখে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘আ’ম ইমপ্রেস সুন্দরী!’

তটিনী হেসে বলল, ‘এতোটুকুতেই?’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আরও কিছু বাকি রেখেছো?’

তটিনী কাঁধে দু-হাত রেখে বলল, ‘এখনও কতো কিছু দেখা বাকি আপনার। জাস্ট অপেক্ষা করুন। বলেই তটিনী হাই-হিলের খটখট শব্দ তুলে চলে গেলো।

রুদ্র মাথা চুলকিয়ে হাসলো। সে অপেক্ষায় আছে বাকিসব দেখার জন্য।

*
শিকদার পরিবারের বর্তমান জেনারেশনের সবচেয়ে বড়ো ছেলে অনল শিকদার। ছোট বোন অনামিকা শিকদার ও মাকে নিয়ে তার পরিবার। পাশাপাশি রয়েছেন তার চাচা, ফুফুরা। যারা কি না তারই বাড়ির পাশে বাড়ি বানিয়ে স্থানীয় হয়ে বসে আছেন। মোটকথা তারা বলতে গেলে এক পরিবারের মতো।

অনলের বাবারা দুই ভাই ও দুই বোন। বড়ো হলেন অনিক শিকদার, ছোট হলেন অনন্ত শিকদার। বোন দুজন হলেন ‘অবন্তী শিকদার ও অতসী শিকদার। অনন্ত শিকদারের আবার দুই ছেলে, অন্তিম শিকদার ও অভিক শিকদার৷ অবন্তী শিকদারের স্বামীর নাম সাখাওয়াত হোসেন। তাদের দুই মেয়ে, ‘সাবিহা হোসেন ও সামিয়া হোসেন। অতসী শিকদারের স্বামীর নাম রবিন আহমেদ। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে, ‘রুপম আহমেদ ও রাখি আহমেদ।

এই হলো শিকদার বংশের ও তাদের ছেলেমেয়েদের ডিটেইলস৷ এবার আসি রুদ্র ইরফানের বংশে। রুদ্রের বাবারা দুই ভাই ছিলেন। তাহসিন ইরফান ও তাহের ইফফাত। তাহসিন ইরফানের স্ত্রীর নাম রুবা নাহার। তাদের দুই ছেলে ‘রুদ্র ইরফান ও রাজ ইরফান। রুদ্র ২০১৯ সালে ভালোবেসে বিয়ে করে ঘরে তুলে তটিনী ইফফাত ঐশি’কে। যে তার চাচা তাহের ইফফাতের একমাত্র মেয়ে ছিল। তাহের ইফফাতের স্ত্রীর নাম ঈশানী। তাহের মারা যান বউ-বাচ্চা রেখে। ঈশানী ছেলে মেয়ে নিয়ে তাহসিন ইরফানের পরিবারে ঠাঁই পান। যতোটা আপন হোক এক সময় না এক সময় দ্বন্দ্ব এসে যায়। ঈশানী সারাজীবন কষ্ট করলেন ছেলে মেয়েকে বড়ো করতে। তার মেয়ে তটিনী ইফফাত ঐশি বড়ো হলো। এইচএসসি পর বাবার রেখে যাওয়া ফ্ল্যাটে উঠলো তাদের নিয়ে। টিউশনি করে সংসারের হাল ধরলো। ভালোবাসার মানুষ তাহেরের আমানত রক্ষা করতে অনেক কষ্ট করেছেন ঈশানী। কিন্তু দিনশেষে শূন্যতা অনুভব হতো। একটা শক্ত হাতের অভাববোধ করতেন তিনি। তাহেরকে মনে করে কান্না করতেন।

তুরফান ইফফাত ঐক্য। তটিণী-র একমাত্র ছোট ভাই। আদরে বাঁদর হওয়া ছেলেটা যখন বুঝতে পেরেছিল এই জগৎ-সংসারে বাবা নামক ছায়াটা ঠিক কতোটা জরুরি ঠিক সেদিন থেকেই আহ্লাদীপনা বাদ দিলো। তারপর থেকে সে আর মায়ের কাছে এটা-ওটার বায়না করেনি। অবুঝ ছোট্ট ছেলেটি যেনো নিমিষেই বড়ো হয়ে গেছিল। বোন বিয়ে দেওয়ার পর মা আরও একা হয়ে গেলো। তুরফান তখন অথৈ সাগড়ে পড়লো। সারাদিন মেডিক্যাল দৌড়াদৌড়ি করে বাসায় এসে মায়ের বিষন্ন মুখ দেখতে একদম ভালো লাগতো না তার।

মাঝে মধ্যে তুরফান নিজের বাবার প্রতি অভিযোগ করতো। কেন এতো তাড়াতাড়ি আকাশের তারা হলো সে?’ মায়ের বিষন্নতা দূর করতে তুরফান ঠিক করলো বিয়ে করবে। কিন্তু তার জন্য আগে স্বাবলম্বী হতে হবে। তারজন্য আরও কতোবছর লাগবে। ততোদিন কি তার মা এমন বিষন্নতা নিয়েই থাকবে?

তুরফান ক্লাসের ফাঁকে যতোটুকু সময় পেতো টিউশনি করাতো। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আলাদা সময় বের করে নিজের মাকে দিলো। বিকেলের বিষন্ন সময়টা ছেলের হাতে হাত রেখে কাটতে লাগলো ঈশানীর। ছেলে বড়ো হতে থাকলো। এক সময় বিয়ে করলো। ছেলেমেয়ে হলো। কিন্তু ঈশানী রইলেন না। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

বাংলাদেশের আবহাওয়ায় শরৎকাল বিরাজমান। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাশফুলে বেড়াতে এসেছে তুরফান। কাশফুল ছুঁয়ে দেখতে দেখতে তার নিজের মাকে মনে পড়ে গেলো। বহু বছর আগে ২০২৪ সালে এমনই একটি শরৎের দিনে তারা বেড়াতে এসেছিল কাশফুলে। তুলা হয়েছিল বড়সড় একটি ফ্যামিলি ফটো। ফ্রেমে বাধিয়ে সেটা রাখা হয়েছে প্রত্যেকের কাছে। নিজের মুঠোফোন বের করে ডকুমেন্টস চেক করলো তুরফান। ঘেঁটে বের করলো অনেক পুরনো সেই ফটোফ্রেমের ডকুমেন্টস। ক্লিক করতেই স্কিনে ভেসে উঠলো হাসিখুশিতে ভরপুর একটি চমৎকার ফ্যামিলির মানুষদের। যারা আজ সময় ও যুগের তালে তাল মিলিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন শহরের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়!

(চলবে)

ঐশ্বর্যের উপাখ্যান পর্ব-০৫

0

#ঐশ্বর্যের_উপাখ্যান
#পর্ব-০৫
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

গ্রীষ্মের দুপুরে রৌদ্রজ্বল দিনে রুদ্রের হাত ধরে ছোট কন্যা ঐশানীর কলেজে প্রবেশ করলো তটিনী। পিছনে ঐশ্বর্য, ঐতিহ্য ও তুর কথা বলতে বলতে আসছে। ঐশানী সকালেই কলেজে এসেছে। তাকে আপাতত দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। তটিনীর দিকে তাকিয়ে হাসলো রুদ্র। তটিণী ভ্রু কুঁচকে বলল ‘হাসছেন কেন?’

রুদ্র কানে ফিসফিস করে বলল, ‘এই বয়সে এসে ছেলেমেয়ের বয়সী বাচ্চাদের পটাতে এমন সেজে এসেছো নাকি? আমিই তো বারবার কাৎ হচ্ছি!

তটিনী বাহুতে ঘুষি মেরে বলল, ‘ফাজিল।’

রুদ্র হেসে সামনে পা বাড়ালো। তখনই ঐশানীকে দৌড়ে আসতে দেখা গেলো একঝাঁক বন্ধুদের সাথে। তটিনী পিছে পড়ে গেছে। রুদ্রকে সব মেয়েরা ঘিরে ধরলো। বলাবাহুল্য তার মেয়ের বান্ধবীরা আজ প্রথম রুদ্রকে দেখছে। ঐশানী সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা আমার..

‘তোর ভাই?’

ঐশানী হতভম্ব হয়ে জিহ্ব কাটলো। পুনরায় আরেকজন বলল, ‘তোর এমন হট ইয়াং ভাই আছে বলিস নি তো!

তটিনীরা তখন চলে এসেছে। তুর মুখ টিপে হেসে বলল, ‘বললে কি করতেন?’

মেয়েটি নিজের কালার করা চুল গুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘একটা চান্স নিতাম আরকি।

তটিনী দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা তাই নাকি? তাকে এতো পছন্দ হয়েছে আপনার?’

‘অফকোর্স, হি ইজ ভেরি থ্রিলড এন্ড হ্যান্ডসাম বয়!

রুদ্র হতভম্ব! মেয়ের জন্য কলেজে পা রেখে এভাবে বউয়ের চোখে অপরাধী হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি। এমনিতেই তার বউটা সকাল থেকে চটে আছে। কি হবে এবার?’

তটিনী দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি জানেন আমি তার কে হই?’

মেয়েটি ভাবুক স্বরে বলল, ‘কি আর হবেন? হয়তো বোন বা বন্ধু!

তটিনী এবার মারাত্মক রেগে গেলো। রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আরও লাগান চুলে বিদেশি প্রডাক্ট! আরও হ্যান্ডসাম হোন। রূপবতী ভাই আমার!

রুদ্র অসহায় চোখে তাকালো। তটিনী জায়গা ত্যাগ করলো তুরকে সাথে নিয়ে। মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘উনি এমন রেগে গেলেন কেন?’

এবার কথা বলল ঐশ্বর্য, ‘দ্যাট উইমেন্স ইজ দিস হট এন্ড হ্যান্ডসাম বয় কি ওয়ান এন্ড অনলি ওয়াইফ!

মেয়েটি অবাক হয়ে তাকালো। রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হোয়াট!

রুদ্র কিছু না বলে বউয়ের পিছু ছুটলো। ঐশানী মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘শেষ পর্যন্ত তুই আমার মাম্মি পাপার দিকে নজর দিলি? মাম্মি তো এবার মারাত্মক কষ্ট পেয়েছে। তুই বাহিরে ছেলেদের সাথে ফ্লাট করিস কর, কিন্তু আমার পাপার সাথে করবি কেন? তোর বাবার বয়সী সে লুজার গার্ল!

মেয়েটি চোখমুখ অন্ধকার করে তাকালো। দুঃখীত স্বরে বলল, ‘আমি বুঝতে পারিনি ইয়ার।

ঐশানী সেটা কানে তুললো না। সে বাকিদের নিয়ে চলে গেলো। ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্যের সামনে মেয়েটি একা দাড়িয়ে আছে। ঐশ্বর্য হাত গুটাতে গুটাতে বলল, ‘কি যেনো বলছিলে?’

মেয়ে ভয় পেয়ে বলল, ‘স্যরি আপু আমি বুঝতে পারিনি।’

ঐতিহ্য এগিয়ে এসে বলল, ‘আর করবে ছেলেদের সাথে ফ্লাট?’

মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে না করে দৌড় দিলো গেইটের দিকে। ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্য একসাথে হু হা করে হেসে উঠলো। ঠিক তখনই গেইট দিয়ে ঢুকলো দুটো টয়েটো কার। ঐশ্বর্য সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মঞ্চের দিকে চলে গেলো।

*
অনল শিকদারের কার কলেজের গেইট দিয়ে ঢুকতেই হুলস্থুল পড়ে গেলো। পুরো কলেজের স্টুডেন্ট ভীড় জমালো গেইটের কাছে। গাড়ি পার্ক করার পর গাড়ি থেকে বের হলো অনল শিকদার। উঁহু আর সব নেতাদের মতো মুজিব কোর্টে নয়! কালো শার্ট ও ডেনিম প্যান্ট পড়োনে। হাতে কালো কোর্ট ক্যারি করে চোখে রোদচশমা পড়ে গটগট করে হেঁটে আসছে সে। পাশ দিয়ে আসছে দুজন সিকিউরিটি। মঞ্চের দিকে আসতেই দুজন ছাত্রী ফুল দিয়ে আমন্ত্রণ জানালো। প্রিন্সিপাল স্যার ফুলের মালা গলায় পড়িয়ে দিলেন। ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত সমস্ত ছেলেরা চিল্লিয়ে বলতে লাগলো,-

‘আমার ভাই তোমার ভাই
অনল ভাই অনল ভাই!
আমার নেতা তোমার নেতা
অনল শিকদার অনল শিকদার।’

‘অনল শিকদার মঞ্চের সামনের চেয়ারের মধ্যে একটিতে বসলেন। সাইডে বসা কলেজের স্যার-ম্যামরা।

প্রিন্সিপাল স্যারের কানে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ক স্যার ফিসফিস করে বললেন, ‘কি যুগ আসলো। আগে নেতারা মুজিব কোর্ট পড়ে চলাফেরা করতেন। আর এখন!

প্রিন্সিপাল গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘আগের যুগ আর নেই। এখন ২০৪৫ সাল, সবকিছু পাল্টে গেছে। নেতারা মুজিব কোর্ট পড়বে না কেন? পড়ে তবে সবসময় না। এখানে তো আর ভাষণ দিতে তাকে ডাকা হয়নি। আমন্ত্রণ জানানে হয়েছে প্রধান অতিথি হিসাবে। সে ছাত্র ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কথা বলবে। রাজনীতি নিয়ে নয়!

ফিসফাস বন্ধ হলো। অনুষ্ঠানে উপস্থাপকের কাজ করছেন এই কলেজেরই একজন ম্যাম। তিনি মাইক হাতে নিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলেন। একে একে সবাই নিজেদের পারফরমেন্স করতে লাগলো। রুদ্র ও তটিণী বসেছে দ্বিতীয় সারির চেয়ারে। তুর, ঐতিহ্য সবাইকে দেখা গেলেও ঐশ্বর্যকে দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য এখন দেখা যাবেও না। তাকে ঐশানী জরুরি দরকারে নিয়ে গেছে।

একেক জনের পারফরম্যান্সের পর একেকজন ব্যক্তব্য দিচ্ছেন। পঞ্চম জনের ব্যক্তব্যের পর আসলো ঐশানীর গান গাওয়ার পালা। মাইকে ঐশানীর নাম ঘোষণা করতেই ধুতিশাড়ি পড়া ঐশানীকে গ্যালারিতে দেখানো হলো। অসম্ভব মায়াবতী মেয়েটি মঞ্চে উঠে প্রথমে সবার দিকে তাকিয়ে নিজের গ্যাঁজ দাঁত বের করে হাসলো। চোখের চশমা ঠিক করে গান গাওয়ার প্রস্তুতি নিলো।

দু মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন ঐশানী গান গাইলো না তখন সবার ফিসফাস করা শুরু হলো। ঐশানী বারবার চারিদিকে তাকাচ্ছে। উপস্থাপিকা ম্যাম মাইক হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এনি প্রব্লেম?’

‘হ্যাঁ ম্যাম। আপ্পিকে ছাড়া গাইতে পারবো না। কারণ আপ্পি ভায়োলেন বাজাবে।’

ঠিক তখনই দেখা গেলো ঐশ্বর্যকে। ভায়োলেন হাতে নিয়ে মঞ্চের উপরে উঠে এসেছে সে। মুহুর্তের মধ্যে সবার নজর কেড়ে নিলো ঐশ্বর্য। কেউ একবার অনলের দিকে তাকাচ্ছে তো কেউ ঐশ্বর্যের দিকে। সবার মনে একটাই প্রশ্ন দুদিন আগে যে দুজনকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় উঠলো সেই দু’জনই আজ সামনাসামনি। কিন্তু কতো নির্লিপ্ত!

রুদ্র ও তটিণী অল দ্যা বেস্ট জানালো। ঐশ্বর্য মঞ্চের পেছনে চলে গেলো। সেখান থেকেই ভেসে আসতে লাগলো ভায়োলেনের সুমধুর স্বর। তার তালে তালে গান গাইতে লাগলো ঐশানী। ভায়োলেনের স্বর যেনো সবাইকে বশ করে নিয়েছে। সবার মধ্যে এক ধরনের নিস্তব্ধতা। অনল শিকদার চোখ থেকে রোদ চশমা খুলে নিলেন। গান শেষ হতেই ঐশ্বর্য মঞ্চে উঠে আসলো। অনলের সাথে চোখাচোখি হতেই দেখতে পেলো নেতা সাহেবের ঠোঁটের কোণে উঁকি দিচ্ছে এক ঝলক হাসি। যা নিমিষেই মিলিয়ে গেলো। ঐশ্বর্য মঞ্চ থেকে নেমে গেলো। স্যার ম্যামরা ঐশানীর গানের প্রশংসা করলেন। সাথে ঐশ্বর্যের অসম্ভব সুন্দর ভায়োলেন বাজানোর ও।

রুদ্রকে মেসেজ দিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলো ঐশ্বর্য। তার প্রচুর হাসফাস লাগছে। অনল শিকদারকে চোখের সামনে দেখে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। যার সামনে কখনো পড়তে চায় না তার সামনেই তাকে পড়তে হচ্ছে বার-বার। এ কেমন নিয়তি?’

ঐশানীর গান শেষ হতেই ব্যক্তব্য রাখেলন অনল শিকদার। ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলেই সংক্ষিপ্ত ভাবে ব্যক্তব শেষ করলেন তিনি। তার ব্যক্তব্যের পরই অনুষ্ঠান শেষ। সম্বর্ধনা জানিয়ে অনল শিকদারকে সম্মানের সাথে বিদায় দিলো পুরো কলেজ চত্বর। মোড়ে ঐশ্বর্যের গাড়ি দাড় করানো। অনল শিকদারের টয়েটো গাড়ি তার গাড়িকে অতিক্রম করে গেলো। ঐশ্বর্য স্পষ্ট দেখতে পেলো গাড়ির কাচ নামিয়ে অনল শিকদার তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে চলে গেলো।

এসব কিসের ইঙ্গিত? বুঝতে পারে না ঐশ্বর্য।
শুধু সে জানে অনল শিকদার আর যাই হোক তাকে অন্তত পছন্দ করবে না। যেখানে অল্প বয়সী সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মেয়েরা এর জন্য পাগল, সেখানে তার মতো সাতাশ বছরের তরুণীর চান্স পাওয়া তো বড়োই দুষ্কর।

(চলবে)

ঐশ্বর্যের উপাখ্যান পর্ব-০৪

0

#ঐশ্বর্যের_উপাখ্যান
#পর্ব-০৪
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

দরজার সামনে অগ্নিশর্মা হয়ে দাড়িয়ে আছে তটিনী। ঐশানী ভয়ে কুঁকড়ে তুরের এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ঐশ্বর্য ঐতিহ্যের কাঁধে ভর দিয়ে দাড়িয়ে আছে। তটিনী অর্ধ হুশ হীন ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার এতোটা অধঃপতন ঘটছে ভাবতে পারিনি। আমি সবাইকে বড়ো মুখ করে বলতাম, আমার ছেলেমেয়েরা আর যাই হোক কখনো নেশা করেনা! কিন্তু তুমি? যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলছো। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা কি খুব জরুরি ঐশ্বর্য?’ জড়ানো গলায় ঐশ্বর্য বলল, ‘এটা ২০৪৫ সাল মাম্মি। এখন সবাই এগুলো…

ঐশ্বর্যের কথা শেষ হওয়ার আগেই তটিনী থাপ্পড় বসালো। ঐশ্বর্য মেঝেতে ঢলে পড়ে গেলো। বাকি তিনজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমরাও কি তার মতো ওসব গিলে এসেছো?’

ঐতিহ্য ও ঐশানী দ্রুত মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। কাঁদো কাঁদো স্বরে ঐশানী বলল, ‘আমি কখনোই ওসব খাবো না মাম্মি। ওসবে যাবো ও না।’

ঐতিহ্যও গলা মিলিয়ে বলল, ‘কখনো যাবো না মাম্মি।’

‘দুজন নিজেদের ঘরে যাও, আর তোমাদের মাতাল আপ্পিকেও নিয়ে যাও।’

ঐশানী ও ঐতিহ্য তাদের আপ্পিকে ধরে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। বাঘিনীর সামনে একা দাড়িয়ে আছে তুর। হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘বড়ো মা..

‘তুমি ঐশ্বর্যের সবসময়ের সঙ্গী তুর। অফিস টাইম ছাড়া ও সবসময়ই তোমার সাথে ঘুরাফেরা করে। ও আগে থেকে ড্রিংক করে রাইট?’

তটিনীর কর্কশভাবে করা প্রশ্নে তুর ঘাবড়ে গেলো। কিন্তু সত্যি না বলে উপায় নেই। অগত্যা স্বীকার করলো, ‘হ্যাঁ।’

তটিনী দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘তুমি নিজেও ওর সাথে ড্রিংক করো?’

তুর তড়িঘড়ি করে মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘না বড়োমা আমি কখনো করিনি।’

‘তাহলে ওর সাথে যেতে কেন?’

তুরের চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। বেচারি ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে বলল, ‘আমি ওকে সবসময়ই মানা করতাম। ও ড্রিংক করতো তবে ততোটা না যতোটা করলে নেশা হয়ে যায়। কখনো যদি নেশা হয় তো আমি ম্যানেজ করে নিতাম।’ ঐশ্বর্য এজন্যই আমাকে সবসময়ই নিজের সঙ্গে রাখতো।’

তটিনী হাত তালি দিয়ে বলল, ‘বাহ্ তালিয়া! কি মহৎ কাজ করে বেড়াচ্ছো তুমি। তোমার মা বাবাকে তো তোমার এরকম মহৎ কাজ সম্পর্কে জানানো উচিত। তারা অভিভাবক তাদেরও তোমার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানার রাইট আছে তাই না?’

তুর কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘আর হবেনা এরকম বড়ো মা। প্লিজ মা বাবাকে বলো না, প্লিজ!

তটিনী গম্ভীর স্বরে বলল, ‘তোমার পার্টনারের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আজ সবার খাওয়া বন্ধ!’

তুর তড়িৎ গতিতে জায়গা ত্যাগ করলো। তটিণী রাগে গজগজ করতে করতে রুমে ঢুকলো। রুদ্র তখনও বাসায় ফেরেনি। এই একটা মানুষ ছাড়া তাকে কেউ সামলাতে পারে না। রাত দশটার পর রুদ্র বাড়িতে আগমন করলো। আজ অনেক ধকল গিয়েছে বেচারার উপর। ক্লান্ত মুখ দেখে তটিনী কিছু বলতে পারলো না। মানুষটা জানলে নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পাবে?’

রাতে খাবার টেবিলে ছেলেমেয়েদের না দেখতে পেয়ে অবাক হলো রুদ্র। প্লেট সামনে নিয়ে অপেক্ষা করলো। কিন্তু না তার সন্তানেরা আজ খাবার টেবিলের ছায়াও মারালো না। তটিনী পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলল, ‘ওরা বাহিরে থেকে ঘুরেফিরে খেয়ে এসেছে। আপনি খেয়ে নিন।’

‘তুমি খেয়েছো?’

‘না!

অগত্যা রুদ্র প্লেটে বেশি করে ভাত নিলো। চেয়ার টেনে তটিনীকে বসিয়ে দিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলো। তটিনী খাবার চিবাতে চিবাতে স্বামীর কাঁধে দুহাত রাখলো। কাঁধে মাথা রেখে বলল, ‘এতো ভালোবাসেন কেন?’

রুদ্র হেসে বলল, ‘তুমি ভালোবাসো বলে আমিও ভালোবাসি ঐশি।’

‘আপনি একদম পাল্টাননি রুদ্র ভাই!’

রুদ্র খাবার চিবাতে পারলো না। তার গলায় খাবার আটকে গেলো। কাশতে কাশতে নাজেহাল অবস্থা হলো। তটিনী পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে সেটা পান করলো। দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘প্লিজ! ছেলেমেয়ে বড়ো হয়ে গেছে। এবার তো ভাই ডাকা বন্ধ করো!

তটিনী খিলখিল করে হেসে বলল, ‘আমি তো ইচ্ছে করে ডাকি মাঝে মধ্যে। আমাদের প্রণয়ের শুরুর কথা মনে পড়ে? তখনের সময় গুলো কতো সুন্দর ছিলো তাই না?

রুদ্র পুনরায় খাবার মুখে তুলে দিয়ে বলল, ‘এখন কি সুন্দর নয়?’

‘সুন্দর, তবে আগের মতো আমরা আর নেই। কয়েকদিন পর মেয়ে বিয়ে দিয়ে বুড়ো হয়ে যাবো।’

রুদ্র বলল, ‘যে সময়ে যেটা মানায়। আমাদের শরীর ফুরিয়ে যাবে। যৌবন শেষ হবে। চামড়া কুঁচকে যাবে। কিন্তু আমাদের ভালোবাসা বেঁচে থাকবে। ভালোবাসা কখনোই ম*রে না আমার বোকা ঐশি!

খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে উঠে পড়লো রুদ্র। রুমের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘জলতি আসো আ’ম ওয়েটিং ফর ইউ বেবি!’

তটিনী মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘বুড়ো বয়সে ভীমরতি!

রাত গভীর থেকে গভীর হলো। তটিনী ভালবাসার চাদরে মুড়িয়ে গেলো সবসময়ের মতো। রুদ্র চোখ বন্ধ করার আগে ফিসফিস করে বলল, ‘ঐশি? আমার ভালোবাসাময় সুন্দরী বউ! তুমি সবসময়ই আমার কাছে সুন্দরী থাকবে।’

*
সকালে সব ঠিকঠাক। ঐশ্বর্যের রাতের কথা তেমন মনে নেই। তুরের থেকে সবকিছু শুনে সে নিজে হতভম্ব হয়ে গেলো। তওবা করলো জীবনে আর কখনো ওসব ছুয়ে দেখবে না। নাস্তার টেবিলে বসে ফিসফাস করতে লাগলো চারজন। আলোচনার বিষয় কিভাবে তটিণী-র কাছে ক্ষমা চাইবে ঐশ্বর্য?’

রুদ্র অফিসিয়াল পোশাকে তৈরি হয়ে টেবিলে বসলো। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে গুড মর্নিং বললো। তুরকে দেখে বলল, ‘মামনি দিনকাল কেমন যাচ্ছে?

তুর হেসে বলল, ‘ফাস্ট ক্লাস ইয়াং ম্যান!

রুদ্র চুলে হাত ভুলিয়ে হাসলো। তটিনী আড়চোখে নিজের স্বামীকে দেখে নিলো। চুলে বিদেশি প্রডাক্ট ইউজ করার কারণে রুদ্রের চুল বরাবরের মতোই কালো। থাকবে না কেন? মাথায় একটাও সাদা চুল কারো চোখে পড়ার আগে রুদ্র চুলে বিদেশি প্রডাক্ট ইউজ করে। তাও জেন্স পার্লারে গিয়ে। ভাবা যায় এসব!

ঐশানী বলল, ‘আজ কলেজে অনুষ্ঠান পাপা। তোমরা যাবে না?’

রুদ্র খেতে খেতে উত্তর দিলো, ‘অফকোর্স! কেন নয়?’

ঐশানী উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘কে কে যাবে তাহলে?’

রুদ্র খেতে খেতে জবাব দিলো, ‘আমরা সবাই!

ঐশানী হাত তালি দিয়ে বলল, ‘অনেক মজা হবে। জানো পাপা আমি গান করবো! আপ্পির থেকে যে গানটা শিখেছিলাম কয়েকদিন আগে? ওটা।

রুদ্র মেয়ের মাথায় হাত ভুলিয়ে দিলো। ‘কনগ্রেচুলেশন বেটা।’

তটিনী জেলি লাগাতে লাগাতে বলল,, ‘আপনার না অফিস?’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তো? দু ঘন্টার ভিতরে অফিস থেকে ফিরবো। তারপর একসাথে আমার মামনির কলেজে যাবো। হবে তো?’

ঐশানী হাত তালি দিয়ে বলল, ‘খুব হবে।’

তটিনী মুচকি হেসে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। এই লোকটার দিকে তাকানো যাবে না। দেখা যাবে ছেলেমেয়েদের সামনে কোনো অকাজ করে বসবে। হলোও তাই। তটিনীর চোখে চোখ পড়তেই রুদ্র চোখ মারলো সবার আড়ালে। ‘

তটিনী লজ্জায় লাল হয়ে গেলো সেই প্রেম হওয়ার সময় যেরকম ভাবে হয়েছিল। লজ্জায় লাল হওয়া তটিণী-র লজ্জা বাড়িয়ে দিতে রুদ্র ছেলেমেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘বাচ্চারা? তোমাদের মা ও আমার প্রেম কিভাবে হয়েছিল জানো?’

ঐশ্বর্য তুমুল আগ্রহ দেখালো, ‘কিভাবে পাপা?’

সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। রুদ্র টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে বলল, ‘তোমাদের মা আমার প্রেমে পড়েছিল উপন্যাস পড়ে। তাই না ঐশি?’

তটিনী আচমকা কিছু মনে পড়তেই রেগে বলল, ‘আপনি সে-ই ব্যক্তি যে আমার উপন্যাসের বই ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। মনে আছে সব আমার। বদলোক কোথাকার!

রুদ্র অবাক হয়ে বললো ‘সব ছেড়ে তোমার এটা মনে পড়লো? আরে আমাদের প্রেম কিভাবে হয়েছিল সেটা ওদের বলো!

তটিনী চোখে কৌতুক নিয়ে তাকালো। হালকা হেসে বলল, ‘বাচ্চারা তোমাদের বাবার নাম আমার ফোনে ‘বায়ুদূষণকারী রুদ্র ভাই’ নামে সেভ করার মাধ্যমে আমাদের প্রেম হয়েছিল!

রুদ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। সে ভাবতে পারেনি তার এতো সুন্দরী আহ্লাদী বউ তাকে এভাবে বাঁশ দিবে! ঐশ্বর্যসহ বাকিরা মুখ টিপে হাসছে। রুদ্র চটজলদি বের হয়ে গেলো। ছেলেমেয়েদের সামনে এমন অপমান মানা যাচ্ছে না। গাড়িতে বসে নিজের বাঁশময়ী বউয়ের ফোন বার্তা পাঠালো, ‘তোমাকে আমি দেখে নিবো সুন্দরী!’

(চলবে)

ঐশ্বর্যের উপাখ্যান পর্ব-০৩

0

#ঐশ্বর্যের_উপাখ্যান
#পর্ব-০৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

দুপুরের পর একজোট হলো চারজন। তুর ঐশ্বর্যের বাবার বন্ধুর মেয়ে। পরিচয় না দিলে যারা চিনেনা তারা বোনই মনে করে। তাছাড়া তুর রুদ্রকে বড়ো বাবা ও তটিনীকে বড়ো মা বলে ডাকে।

সাদা কলেজ ড্রেসে আবরিত ঐশানী বেনী দুলিয়ে হেঁটে চলেছে ভাইয়ের হাত ধরে। ঐতিহ্য বোনের চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে মুছে আবার পড়িয়ে দিলো। ঐশানী হেসে ভাইয়ের হাত জড়িয়ে ধরলো।

গাড়ি অফিসে রেখে এসেছে ঐশ্বর্য। তারা চারজন এবার দুপুরের খাবার খাবে একটি রেস্টুরেন্টে। খাবার খেতে বসে কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে ঐশানী বলল, ‘তোমাকে তো বলাই হয়নি আগামীকাল আমাদের কলেজে অনুষ্ঠান আছে। সেখানে অনল শিকদার আসবে।

ঐশ্বর্য খাবার খেতে খেতে বলল, ‘তো?’

ঐশানী অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি খুশি হওনি?’

‘দেখ সে কোথায় গেলো নাকি গেলে না সেটা খুঁজ রাখার দায়িত্ব আমার না। আর না আমি তার এমন কেউ লাগি।’

‘তুমি তাকে পছন্দ করো না?’

ঐশ্বর্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘পছন্দ করলেই যে পিছনে ঘুরতে হবে তার কোনো মানে নেই। আমার তাকে পছন্দ ছিলো বলেছি। এবার তাকে পাবো কি না বা সে আমাকে পছন্দ করে না সেটা তার বিষয়। সবসময়ই যে ভালোবাসা বা পছন্দ দুপাক্ষিক হবে এমন কোনো মানে নেই ঐশানী।

তুর খাবার চিবাতে চিবাতে বলল, ‘সে যদি বিয়ে করে নেয় তোর কষ্ট হবে না?’

ঐশ্বর্য চমৎকার করে হেসে বলল, ‘কষ্ট হবে কেন? ভালোবাসার মানুষ তার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে সুখে থাকবে। আমি তো অনেক খুশি হবো।’

তুর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘দীর্ঘ পাঁচ বছর একটা মানুষকে ভালোবেসে একা কাটাচ্ছিস। অথচ সে কখনো তোর দিকে চেয়েও দেখেনি। অনেক তো হলো এবার নিজের কথা একটু ভাব না।’

ঐশ্বর্য জবাব দিলো না। তুর জানে কোনো জবাব আসবে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ঐতিহ্য বলল, ‘একটা মেয়েকে দেখে ক্রাশ খেয়েছি আপ্পি। পটাবো কেমনে?’

‘তুই যার উপর ক্রাশ খেয়েছিস তারও ক্রাশ আছে গিয়ে দেখ।’

তুরের মাথায় চাপড় মেরে ঐতিহ্য বলল, ‘নেই, তার বিষয়ে আমি সব জেনে নিয়েছি।’

তুর মাথায় হাতে রেখে বলল, ‘বাহ ভালো তো।’

হ্যাঁ সবাই তোর মতো না, যে অনল শিকদারের পিছে দৌড়াদৌড়ি করবে।’

‘আমি অনল শিকদারের পিছে দৌড়াদৌড়ি করি?’

ঐতিহ্য ভাব নিয়ে বলল, ‘তা নয়তো কি? তুই আপ্পির সাথে অনল শিকদারের পিছে দৌড়াদৌড়ি করিস না?’

তুর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘দৌড়াদৌড়ি করলেও পাত্তা পাবো না, পেলে ঐশ্বর্য পেতে পারে। আমার কোনো চান্স নেই।’

ঐতিহ্য হেসে বলল, ‘সমবেদনা ডেয়ার।

ঐশ্বর্য বিরক্ত হয়ে বলল, ‘চুপ কর। অন্য কিছু নিয়ে কথা বল।

খাওয়া শেষ করে চারজন রিকশা নিলো। চিরপরিচিত জলাশয়ের কাছে পৌছালো। জলাশয়টা অনেক ছোট। পদ্মফুলে ভরপুর জলাশয়টা চারজনের অনেক প্রিয়। কারে মন খারাপ হলে কাউকে খুঁজে বের করতে হয়না। কারণ তাদের চারজনেরই মন খারাপ থাকলে এখানে এসে বসে থাকে। যা তাদের মা বাবা থেকে শুরু করে পুরো গোষ্ঠী জানে।

জলাশয়ের জলে পা ভিজিয়ে বসলো চারজন। ঐশ্বর্য জলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে জানেনা তার ভবিষ্যতে কি অপেক্ষা করছে। অনল শিকদারকে ছাড়া হয়তো সে মরে যাবে না। কিন্তু অনুভুতি মরে যাবে হয়তো। এতোটা ডুবে যাবে সে নিজেও জানতো না। মানুষটার সাথে তার কখনো সামনাসামনি কথা হয়নি। চোখে চোখ পড়েনি কখনো। গতকালই তাদের প্রথম কথা হলো। অনল শিকদার যদি একবার বুঝতে পারতেন একজন বাবার রাজকন্যা কি নিদারুণ দুঃখ পুষে চলেছে বছরের পর বছর, শুধু তারই জন্য! বুকে ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে আছে একটি ইশারার।

*
সন্ধ্যার দিকে চারজন অফিস থেকে গাড়ি করে বারে পৌঁছালো। রঙ বেরঙের আলোয় একে অপরের সাথে ডান্স করতে লাগলো। কেউ এখানে আসে আনন্দ করতে। কেউ আসে দুঃখ ভুলে থাকতে। কেউ বা অভ্যাস বসত।

লাল পানি গলায় ঢেলে ঐশ্বর্য থম মেরে বসে রইলো। মাথা ঝিমঝিম করছে। সে মাতাল হয়নি। কিন্তু আরেকটু গিললেই হয়ে যাবে। অগত্যা ঐশ্বর্য ড্রিংক রেখে দিলো। হেলেদুলে দাড়িয়ে নাচতে লাগলো গানের তালে তালে।

বারে মানুষের অভাব নেই। নাচতে নাচতে কোমড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কারো স্পর্শ পেয়ে থমকে গেলো ঐশ্বর্য। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে হাতের মালিকের দিকে তাকালো।

হুডি পড়ার কারণে মুখ অস্পষ্ট। ঐশ্বর্য মুখ দেখতে চেষ্টা করতেই হাতের মালিকটি ঐশ্বর্যের হাত টেনে বাহিরে নিয়ে যেতে লাগলো। ঐশানী, ঐতিহ্য ও তুর তখন ডান্সে মগ্ন। হুডি পড়া ব্যক্তিটি বাহিরে এসে থামলো। ভিতরের থেকে বাহিরে আরও অন্ধকার বিরাজ করছে। সোডিয়ামের আলো এদিকে নেই বললেই চলে। ব্যক্তিটি হুডি মাথা থেকে ফেলে দিলো। অন্ধকারের জন্য মুখ দেখতে পারছে না ঐশ্বর্য। ব্যক্তিটা ধীরে ধীরে ঐশ্বর্যের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিলো। ঝিমঝিম ভাব থেকে তখন নেশা হয়ে গেছে। ঐশ্বর্য চোখে দুটো করে দেখতে লাগলো। ব্যক্তিটি বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত ভুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘এতো পাগলামি? কবে থেকে এতো ভালোবাসলে?’

ঐশ্বর্য জবাব দিতে পারলো না। ব্যক্তিটি কপালে দীর্ঘ চুম্বন করলো৷ কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আর কখনো ড্রিংক করবে না। আমি কিন্তু অনেক রাগ করবো, হুম?’

ঐশ্বর্য জড়িয়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘হু আর ইউ ম্যান?’

ব্যক্তিটি হেসে বলল, ‘জেনে যাবে খুব শীগ্রই।

ঐশ্বর্যকে গাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে ব্যক্তিটি ঐশ্বর্যের ঘড়িতে চাপ দিলো। লক খুলে কানেক্টে হলো ঐতিহ্যের সাথে। সাথে সাথে আবার ডিসকানেকটেড করে দিলো। হঠাৎ করে ঐশ্বর্যের কল পেয়ে ঐতিহ্য তুর ও ঐশানীকে নিয়ে বের হয়ে আসলো। বারে না পেয়েই মূলত বের হয়ে এসেছে তারা। গাড়িতে ঐশ্বর্যকে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো তিনজন। ঐতিহ্য ড্রাইভ করতে লাগলো। তুর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঐশ্বর্যকে ধরে বসে আছে। ঐশানী ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘আপ্পির তো পুরো নেশা হয়ে গেছে। মাম্মি জানতে পারলে মে*রেই ফেলবে।’

ঐতিহ্য মৃদু ধমক দিয়ে বলল, ‘চুপ কর। আমরা কি জানতাম আপ্পি ওসব খাবে? কখনো তো খায় না।

তুর মনে মনে বলল, ‘হাঁদারাম! তোর বোন তোর সামনে খায় না বলে কি কখনো খায়নি? আমার সাথে যখন যায় তখন তো দেদারসে গিলে। শালী নিজেও দেবদাসী হচ্ছে, সাথে আমাকেও বানাচ্ছে!

তুরের মনের কথা কেউ শুনলো না। কিন্তু ঐতিহ্য গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, ‘তুই কি আমাকে গালি দিচ্ছিস?’

তুর হতভম্ব হয়ে বলল, ‘কখন দিলাম?

ঐতিহ্য লুকিং গ্লাসে এক পলক তাকিয়ে বলল, ‘তোর মুখের রিয়েকশন দেখে মনে হচ্ছে।’

ঐশানী চোখের চশমা ঠিক করে বলল, ‘দেখে গাড়ি চালাও ব্রো, আজ কপালে শনি রবি মঙ্গল সব আছে।

ঠিক তখনই ঐশানীর মুঠোফোন বেজে উঠলো। স্কিনে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘মাম্মি কল দিয়া ব্রো।’

ঐতিহ্য কল লাউডে দিতে বলল। কল লাউডে দিতেই অপাশ থেকে ভেসে এলো তটিণী-র চিন্তিত স্বর, ‘কোথায় তোরা? সবকটা একসাথে কিসের পার্টি করছিস? তিশাপু কল দিচ্ছে বার-বার। তুর তোদের সাথে তো?’

ঐশানী মিনমিন স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ মা আপুও আমাদের সাথে। আমরা প্রায় চলে এসেছি। তুমি চিন্তা করো না।

ফোন রেখে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ঐশানী। তাদের গাড়িকে ওভারটেক করে গেলো একটি কালো টয়েটো কার। কারে বসা ব্যক্তিটি মনে মনে হেসে বলল, ‘তুমি অনেক বোকা ঐশ্বর্য। নাহলে কি এমন করো? এতো পাগল কেন তুমি? তোমার পাগলামি বাড়ুক, কিন্তু সেটা আমার সামনে। সবার সামনে তোমার অসম্মান আমি মানতে পারি না ঐশ্বর্য। খুব শীগ্রই তোমার যতটুকু অসম্মান হয়েছে তা ফেরত পাবে। আমি কথা দিলাম!

(চলবে)

ঐশ্বর্যের উপাখ্যান পর্ব-০২

0

#ঐশ্বর্যের_উপাখ্যান
#পর্ব-০২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

ভোরের আলো ফুটে গেছে। নামাজ পড়ে তটিনী নিজের কন্যার রুমের দিকে অগ্রসর হলো। ঐশ্বর্য তখন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছে। তটিনী দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। মেয়ে বড়ো হয়েছে কিন্তু আজও দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে শিখেনি। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলো তটিনী। গতকাল অনেক রেগে গেছিলো সে। কি বলতে কি বলেছে মনে নেই। মেয়েটা নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে! তটিনী জানে তার মেয়ে সব বুঝে। যা করে বুঝেশুনে করে। কিন্তু সমাজের কথাও আমাদের ভাবতে হয়। মেয়েটা বিয়ে করছে না। ভালো পরিবারের সন্তান সেজন্য অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসে। ওইরকম একটা ঘটনা নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর আর কি ভালো পাত্রের খুঁজ পাবে তারা?

তটিনীর ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ঐশ্বর্য ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘মাথায় হাত ভুলিয়ে দাও মাম্মি।

তটিনী হাত ভুলিয়ে দিতে দিতে মেয়ের কপালে চুমু খেলো। বলল, ‘অফিসে যাবে না আজ?’

ঐশ্বর্য লাফিয়ে উঠে বসলো। তটিনী হেসে বলল, ‘ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও। নাস্তার টেবিলে তোমার পাপা অপেক্ষা করছেন।’

ঐশ্বর্য মাথা নাড়িয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো। তটিনী মেয়ের রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ডাইনিং টেবিলে তখন তার দুই সন্তান ও স্বামী অপেক্ষায় বসে আছে।

তটিনীকে আসতে দেখেই রুদ্র এক পলক তাকালো। নারীটির বয়স বেড়েছে। চামড়ায় ভাজ পড়েছে। কিন্তু আজও তার কাছে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। এই অদ্ভুত সুন্দর লাগাটা হয়তো ভালোবাসা!

বাটার খেতে খেতে ঐশানী চোখের চশমা ঠিক করে বলল, ‘আপ্পি কোথায় মাম্মি?’

তটিনী মেয়ের পাশে বসে বলল, ‘ফ্রেশ হয়ে আসছে।’

ঐতিহ্যকে তখন হেলেদুলে আসতে দেখা গেলো। কানের হেডফোন গলায় ফেলে দিয়ে ‘গুড মর্নিং’ বলে রুদ্রের পাশে বসে গেলো। তটিনী বাচ্চা ও স্বামীর প্লেটে নাস্তা তুলে দিতে লাগলো। রুদ্র নিজের প্লেট থেকে প্রথমে একটু খাইয়ে দিলো তার ছোট রাজকন্যা ‘ঐশানী ইরফানকে। তারপর খাওয়ালো ‘ঐতিহ্য ইরফানকে। তখনই বাবার অপর পাশে এসে বসলো ঐশ্বর্য। রুদ্র হেসে নিজের বড়ো রাজকন্যার মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিলো। তটিনী তখন ঐশ্বর্যের প্লেটে নাস্তা তুলে দিতে ব্যস্ত। রুদ্র উঠে গিয়ে নিজের বউয়ের মুখে নাস্তা তুলে দিলো।

এইতো এটাই তাদের পরিবার। আর এই দৃশ্যটা তাদের বাড়ির প্রতিদিনের দৃশ্য। তটিনী সবাইকে নাস্তা দিয়ে নিজেও বসে পড়লো। প্লেটে খাবার নিতে গিয়ে তার মনে পড়লো তিনজন মানুষকে।

বউয়ের মন খারাপ দেখে রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কি হলো?’

তটিনী মন খারাপ করে বলল, ‘মা-বাবা কবে আসবেন বলুন তো?

রুদ্র মুচকি হাসলো। খাবার চিবাতে চিবাতে বলল, ‘রাজের বউয়ের ডেলিভারির পর আসবেন।’

তটিনী মুখ গুমড়া করে বলল, ‘একেক জন একেক জায়গায়! সবাই একসাথে থাকলে ভালো হতো। রাজটাও না চাকরি নিয়েছে তো নিয়েছে তাও চট্টগ্রামে! আপনার ব্যবসাতে ওরে ঢুকিয়ে দিন। নিজেদের ব্যবসা থাকতে পরের হসপিটালে চাকরি করবে কেন?’

রুদ্র পানি পান করে জবাব দিল, ‘তোমার আদরের দেবর সেটা মানলে তো। তিনি চাকরি করবেন নিজের যোগ্যতায়। তারপর শখ মিটে গেলে ব্যবসাতে আসবেন কি না ভেবে দেখবেন।

*
রাজ ইরফান। বিয়ের পনেরো বছর পর বাবা হচ্ছে। প্রব্লেম কারোরই ছিল না। সেজন্য ডাক্তার বলেছিলেন ধৈর্য ধরতে। সেই ধৈর্যের পর আরও কয়েকটা দিন। তারপর বাবা হওয়ার খুশি লাভ করতে চলেছে তারা।

তুরফান ইফফাত ঐক্য! তটিনীর একমাত্র ছোট্ট ভাইটি আজ দুই সন্তানের পিতা। ছেলের বয়স বারো ও মেয়ের বয়স আট। আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে ঈশানী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান। তুরফান আজও নিজের কাছে তার মায়ের লেখা সেই ডায়েরি যত্ন করে রেখে দিয়েছে। মায়ের বয়স হয়েছিল। সেজন্য চলে গেছেন। মনকে বুঝ দিতে পারলেও মাঝে মধ্যে মানতে পারে না তুরফান। আল্লাহ আরও কিছু দিন তার মাকে বাচিয়ে রাখলে পারতেন।

কারো মৃত্যুর উপর আমাদের হাত থাকে না। সবাইকেই একদিন চলে যেতে হয়। কেউ কারো জন্য থেকে যায় না, কখনো না!

ঢাকার একটি হসপিটালে ডাক্তার হিসেবে কর্মরত তুরফান। তার সংসার চলে যাচ্ছে এভাবেই। রাজও চট্টগ্রামের একটি হসপিটালে ডাক্তার হিসবে কর্মরত। দু’জন একসাথে বড়ো হয়েছে। একসাথে পড়েছে। আজ দুজনেই ডাক্তার দুই শহরের।

*
ঐশ্বর্য অফিসিয়াল ড্রেসে নিজেকে আবরিত করে নিলো। সাদা শার্ট ও কালো প্যান্টে একজন বিজনেস উইমেন্স লাগছে। অবশ্য সে একজন সফল বিজনেস উইমেন্স!

হাইহিল পড়ে নিয়ে হাতে কোর্ট নিয়ে হ্যান্ড ব্যাগ ক্যারি করে গাড়িতে বসলো ঐশ্বর্য। সে নিজেই ড্রাইভিং করতে পারে। তার পাপা অনেক আগেই বের হয়ে গেছেন অফিসের উদ্দেশ্যে। আজ বিশেষ একটা মিটিং রয়েছে দশটার দিকে। সেজন্য তাড়াহুড়ো না করে ধীরেসুস্থে বের হচ্ছে সে।

ঐশ্বর্য গাড়ি স্টার্ট দিবে তখনই দুজন এসে বসলো তার গাড়ির পিছনের সিটে। ঐশ্বর্য লোকিং গ্লাসে তাদের দেখে নিলো। তাদের আলাদা আরও তিনটে গাড়ি রয়েছে। ওরা চাইলেই আলাদা গাড়ি করে ভার্সিটি বা কলেজে চলে যেতে পারে। কিন্তু না! ঐতিহ্য বাইক বা কার নিয়ে সবসময় যাতায়াত করলেও মাঝে মধ্যে ঐশানীকে নিয়ে ঐশ্বর্যের গাড়িতে উঠে পড়ে। তাদের নাকি মাঝে মধ্যে বোনের থেকে লিফট নিতে ভালো লাগে।

এবং বড়ো বোন হিসাবে ঐশ্বর্যের উচিৎ প্রতিদিনই তাদের কলেজ বা ভার্সিটিতে পৌঁছে দেওয়া!

ঐশ্বর্য এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে। ঐশানী কলেজ ড্রেসের ফিতা ঠিক করতে করতে বলল, ‘কলেজ শেষ হলে আমাকে নিতে আসবে কিন্তু আপ্পি।’

ঐতিহ্য গেইম বাদ দিয়ে বলল, ‘আমাকেও!

ঐশ্বর্য হেসে বলল, ‘মিটিং তাড়াতাড়ি শেষ হলে দুটোকেই গাড়িতে তুলে নিবো। তারপর…?

ঐতিহ্য ও ঐশানী একসাথে বলল৷ ‘পার্টি হবে!’

ঐশানীকে তার কলেজে নামিয়ে দিয়ে তারপর ঐতিহ্যকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিলো ঐশ্বর্য। ঘড়িতে সময় দেখে নিলো, দশটা বাজতে আর মাত্র বিশ মিনিট বাকি আছে।

হাতের স্মার্ট ওয়াচে হাতের একাধিক স্পর্শ দিয়ে কানেক্টে হলো তার বাবার সাথে। রুদ্র ফাইল দেখতে দেখতে স্কিনে এক পলক তাকিয়ে বলল, ‘কুইক চলে আসো।’

‘আ’ম কামিং পাপা।’

ঐশ্বর্য হাতের ওয়াচে আবারও চাপ দিলো। রিসিভ হতেই শুনা গেলো তুরের ঘুম জড়ানো কন্ঠস্বর।

‘কি ইয়ার এতো সকালে কি চাই তোর?’

ঐশ্বর্য সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে বলল, ‘দুপুরে ঐশানীর কলেজের সামনে চলে আসিস।’

ডিসকানেকটেড হতেই তুর ঘুম ভুলে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘ইয়া হু পার্টি হবে।’

ঐশ্বর্য পনেরো মিনিটের মাথায় অফিসে পৌঁছালো। লিফটে চড়ে বারো তলায় পৌছে গেলো দুমিনিটে। বাকি তিন মিনিটে পিএর কাছ থেকে ফাইল নিয়ে গটগট করে পৌছালো কনফারেন্স রুমে।

এইবারের মিটিংটা হচ্ছে অনল শিকদারের বাবার কোম্পানির সাথে। যদিও সেটাতে অনল শিকদার নিজেও যুক্ত আছে। ঐশ্বর্য ভাবছে নিশ্চয়ই অনল শিকদারের জানা নেই যে ডিলটা হতে চলেছে সেটা ঐশ্বর্যেরই কোম্পানির সাথে! বা অনল শিকদার কখনো ভাবেনি যে ঐশ্বর্যের মতো ছ্যাচড়া ও প্রেম নিবেদন করে বেড়ানো মেয়ে কখনো বিজনেস উইমেন্স হতে পারে!

ঐশ্বর্য অনিক শিকদারের সাথে ডিলে সাইন করে বাঁকা হাসলো। পাখি নিজ থেকে বারবার জড়িয়ে যেতে চাইছে। সে সুযোগ কেন নিবে না?’

মিটিং থেকে বেরিয়ে আসতেই অনিক শিকদার পিছন থেকে ডাকলেন। ঐশ্বর্য দাড়িয়ে রইলো। অনিক শিকদার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কালো ফ্রেমের সানগ্লাসে ঢাকা চোখের মেয়েটিকে এক পলক দেখে নিলেন। তারপর বিনিময়ের সাথে বললেন, ‘তুমি সে-ই যে গতকাল আমার ছেলের সমাবেশে বিয়ের প্রস্তাব রেখেছিলে!

ঐশ্বর্য কিছু বললো না, অনিক শিকদার হেসে মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আরও সফল হও। তুমি যাদের পিছনে ঘুরছো একদিন তারা তোমার পিছনে ঘুরবে। বেস্ট অফ লাক মামনি।’

(চলবে)

ঐশ্বর্যের উপাখ্যান পর্ব-০১

0

#সূচনা_পর্ব
#ঐশ্বর্যের_উপাখ্যান
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

নিজের ছোট বোনের বয়ফ্রেন্ডকে টাংকি মারছিস, লজ্জা করছে না তোর?’

‘তুরের প্রশ্নে দমলো না ঐশ্বর্য। বরং দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘বয়ফ্রেন্ড তখন হয় যখন দুজন দুজনের সাথে একটা সম্পর্কে যায়। সে দিক থেকে তুই একা একা নিজেকে অনল শিকদারের গফ ভাবলে তো আর সত্যিই গফ হয়ে গেলিনা তাই না?

তুর কিঞ্চিৎ মন খারাপ করে বলল, ‘সে যাই হোক আমি তাকে তোর আগে থেকে পছন্দ করি। সেটা জেনেও তুই তাকে কিভাবে পটাতে চাইছিস ঐশ্বর্য?’

ঐশ্বর্য তুরের কথার জবাব দিলো না। তারা দুজন দাড়িয়ে আছে একটি বিশাল সমাবেশের পিছনে। এই বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে একজন তরুণ নেতার জন্য। যার নাম ‘অনল শিকদার। তরুণ এই ছাত্রনেতা সদ্য এমবি হয়েছেন। অনল শিকদার একত্রিশ বছরের একজন যুবক। ফর্সা চেহারাতে সবসময়ই একটা ঝলক খেলে যায়।

ঐশ্বর্য ও তুর নিজেদের ঝগড়া বাদ দিয়ে সমাবেশের দিকে এগিয়ে আসলো। তখনই গেইট দিয়ে ঢুকলো একে একে দু’টো টয়েটো কার। গাড়ি গুলো থামতেই তা থেকে বেরিয়ে আসলেন তরুণ নেতা অনল শিকদার। যারা সমাবেশের আয়োজন করেছিল তারা হাত তালি দিয়ে ফুলের মালা পড়িয়ে স্বাগতম জানালো।

ভীড়ের মধ্যে থেকে এক পলক অনলকে দেখার জন্য উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ঐশ্বর্য ও তুর। শুধু তারা নয় আরও অনেক মেয়ে রয়েছে যারা তাদের ক্রাশকে দেখতে এসেছে। তারমধ্যে থেকে সম্ভবত ক্লাস নাইনে পড়ে এমন একটি কিশোরী চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘আই লাভ ইউ অনল। উইল ইউ লাভ মি?’

তুর হতভম্ব হয়ে তাকালো। চারিদিকে মানুষের সমাগম। কিশোরী মেয়ের চিৎকার তেমন কানে পৌঁছালো না কারো। আর পৌঁছালেও পাত্তা না দিয়ে সবাই হাসবে। কিশোরীটি পাত্তা না পেয়ে মুখ কাঁদো কাঁদো করে দাড়িয়ে রইলো। ঐশ্বর্য জনদরদী! সেই দরদের খাতিরে সে মেয়েটির কাঁধে হাত রাখলো।

‘তোমার নাম কি?’

কিশোরীটি ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রেখে বলল, ‘সুভা।’

ঐশ্বর্য অবাক হওয়ার বান করে বলল, ‘সুভা!, তুমি জানো সুভা কে?’

সুভা নামক কিশোরীটি মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। ঐশ্বর্য হেঁসে বলল, ‘হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস পড়া হয়?’

‘না।’

‘আজ গিয়ে পড়বে। হুমায়ূন আহমেদের অপেক্ষা উপন্যাস কিনে নিয়ে যাবে। তারপর সেটা পড়ে তোমার অনুভূতি জানাবে কেমন?’

সুভা থমথমে গলায় বলল, ‘কিন্তু আপু সেটা পড়ে আমার লাভ কি?’

ঐশ্বর্য চমৎকার করে হেসে বলল, ‘অনল শিকদারের প্রিয় লেখক হলেন হুমায়ূন আহমেদ। আর অপেক্ষা উপন্যাসটিতে ‘সুভা’ নামক চরিত্র আছে।’

সুভা নামক কিশোরীটির চোখমুখ এবার উজ্জ্বল হলো।

*
মঞ্চে উঠেছে অনল শিকদার। চারিদিকে হৈচৈ পড়ে গেছে সবার। মাইক প্রস্তুত করা হলো। অনল শিকদার এবার তার মহামূল্যবান ভাষণ দিবেন জনতার উদ্দেশ্যে।

‘উইল ইউ ম্যারি মি? আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন নেতা সাহেব?’

পুরো মাঠ নিস্তব্ধতা ধারণ করেছে৷ এতোক্ষণের হৈচৈ থেমে গেছে। মিডিয়া ঐশ্বর্যের দিকে ক্যামেরা ঘুরিয়ে রেখেছে। ঐশ্বর্যের হাতে একটি মিনি মাইক। যা দিয়ে সে একের পর এক প্রস্তাব দিয়ে চলেছে অনল শিকদারের উদ্দেশ্যে।

ঐশ্বর্য পুনরায় বলল, ‘আপনি কি আমার পূর্ণতা হবেন নেতা সাহেব?’

অনল থমথমে ভাব নিয়ে নিজের পিএ সোহানের দিকে তাকালো। সোহান মুখ কাচুমাচু করে বলল, ‘আমি কিছু জানিনা স্যার!

অনল কিছু বলার আগে শুনা গেলো সেই একই কন্ঠে বলা প্রস্তাব, ‘আপনি কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি নেতা সাহেব?’

অনল শিকদার ফেঁসে গেলো৷ চরিত্রে আজ পর্যন্ত কেউ দাগ লাগাতে পারেনি। প্রথম কোনো মেয়ে দাগ লাগানোর পথে রয়েছে। অনল লম্বা শ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করলো৷ এরকম অনেক মেয়ে তাকে পছন্দ করে। কিন্তু কেউ কখনো এই মেয়েটার মতো পদক্ষেপ নেয়নি৷ মাইক হাতে নিয়ে অনল ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘নাম কি মেয়ে?’

‘ঐশ্বর্য ইরফান।’

‘আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখীত, আপনার প্রস্তাব আমার পক্ষে রাখা সম্ভব নয়।’

চারিদিকে হৈচৈ পড়লো আবারও। ঐশ্বর্য মন খারাপ করে বলল,’কেন সম্ভব নয়?’

অনল থমথমে গলায় বলল, ‘আ’ম অলরেডি এনগেজড!

সবাই অবাক হলো। অনল শিকদারের মতো নেতা এনগেজড অথচ কেউ জানতো না। ঐশ্বর্য আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। দৌড়ে বের হয়ে গেলো ভরা মাঠের চত্বর থেকে। পিছে পিছে তুর দৌড় দিলো।

একের পর এক ফোন আসছে ঐশ্বর্য ও তুরের মোবাইলে। দৌড়ানোর এক ফাঁকে তুর ফোন রিসিভ করলো। কল দিয়েছে তার বড়ো বাবা রুদ্র ইরফান।’

তুর সালাম দিলো। রুদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘তাকে যেভাবে পারো ধরে নিয়ে এসো!’

ফোন ডিসকানেক্ট হতেই তুর ঐশ্বর্যকে খুঁজতে লাগলো। এতো তাড়াতাড়ি কোন জঙ্গলে গিয়ে লুকালো কে জানে!

এদিকে অনল শিকদারের মোবাইলে একের পর এক কল এসে চলেছে। বাধ্য হয়ে সে মাইক হাতে নিয়ে বলল, ‘আ’ম স্যরি অল। আমি এনগেজড নই। মেয়েটা যাতে কখনো আমার সম্পর্কে আর না ভাবে সেজন্য মিথ্যা বলেছি।’

ব্যস বন্ধ হয়ে গেলো সব ফোনকল। নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লো সব। নেতা অনল শিকদারের জন্য পাগল ঐশ্বর্য ও বাদ পড়লো না। অনেকে ছিঃ ছিঃ করছে। অনেকে সাহসের প্রশংসা করছে। কিন্তু তার দার ধারে না ঐশ্বর্য। সে নিজের মতো চলতে ব্যস্ত। বাসায় ফিরবে সন্ধ্যার পর। সে জানে আজ তার কপালে শনি আছে। মা তাকে আজ কি করবেন কেউ বলতে পারছে না। বাবা একটা ধমক দিয়ে আর কিছু বলবে না।

সন্ধ্যা তখন ছ’টা। তুরকে মেসেজে নিজের অবস্থান জানিয়ে দিলো ঐশ্বর্য। তুর তৎক্ষনাৎ এসে উপস্থিত হলো। সে নিজে অনল শিকদারকে এতো পছন্দ করে না যতোটা না ঐশ্বর্য করে। অনল শিকদার শুধু তার ক্রাশ মাত্র। কিন্তু আজকাল ঐশ্বর্যের সাথে লাগতে বেশি বেশি বলতো। কিন্তু সে ভাবেনি ঐশ্বর্য এতো সিরিয়াস অনল শিকদারকে নিয়ে।

তুরকে দেখে ঐশ্বর্য হাসলো। তুর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘কেন এমন করতে গেলি?’ অপমানিত হলি তো?’

ঐশ্বর্য এক গাল হেসে বলল, ‘বাঁচবোই বা ক’দিন? যতোদিন বাঁচি যা চা-ই তাই যাতে পাই সেই চেষ্টা করবো। আফসোস নিয়ে ম*রবো কেন?’

‘তাই বলে..!

‘নিজের মনের ভেতর আফসোস থাকতো। যে আমি অনল শিকদারকে কখনো মনের কথা বলতে পারিনি! আজ থেকে সেই আফসোস থাকবে না আর। আমার বলার দরকার ছিল বলেছি। আগে থেকেই জানতাম এরকমই কিছু হবে। সো চিল।

তুর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই পাগল মেয়েটাকে নিয়ে যে সে কি করবে! বয়সে তার থেকে সাত বছরের বড়ো। তুরের বিশ, ঐশ্বর্যের সাতাশ। বিয়ে দিতে অনেক চেষ্টা করেছেন সবাই, কিন্তু ঐশ্বর্য বিয়ে করবে না। সে বাবার বিজনেস দেখছে। স্বাবলম্বী হচ্ছে। কিন্তু তাতে কি? সব মা বাবা-ই তো চান তাদের সন্তানকে কারো না কারো সাথে জড়িয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে। সেটা কে বুঝাবে এই একগুঁয়ে বদমেজাজি মেয়েটিকে?’

সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঐশ্বর্য বাড়িতে পা রাখলো। দরজা আগে থেকেই খুলে রাখা। টিপটিপ করে পা পেলে যে-ই না সে ঢুকলো অমনি তার পায়ের কাছে এসে পড়লো খুন্তি। দু পা পিছিয়ে গেলো ঐশ্বর্য। সামনে এসে দাড়ালো তার সুন্দরী স্মার্ট মাম্মি ‘তটিনী ইফফাত ঐশি।’ ওয়াইফ অফ রুদ্র ইরফান।’

তটিনী হিসহিসিয়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘এসব করার জন্য তোমাকে বড়ো করেছি?’ এসব করবে বলে তোমাকে এতো প্রশ্রয় দিতাম?

ঐশ্বর্য মাথা নিচু করে ফেললো। সে জানে সে ভুল করেছে। কিন্তু নিজের মনের কথা সে আগে শুনেছে।মস্তিষ্ক অবশ্য বলেছে এতে মা বাবার সম্মান নিয়ে টানাটানি হতে পারে। কিন্তু সে আগে মনের কথা শুনলো। এবার মস্তিষ্কের সাথে যুদ্ধ করবে!

(চলবে)

মাতাল হাওয়া পর্ব-৮১ এবং শেষ পর্ব

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৮১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

রাত সাড়ে ১০ টার মতো বাজে ঘড়িতে। আইসিইউর কেবিনের বাইরে ট্রান্সপারেন্ট দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা রওনকের দিকে তাকিয়ে আছে তানিয়া, লাবিবের পাশে। বেশ কিছুক্ষণ মৌন থেকে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে তানিয়াই প্রথমে বলে,

-রওনক টার জলদি ফেরা ভীষণ জরুরী।

তানিয়ার কথার প্রেক্ষিকে কিছু বলে না লাবিব। সে এখনো রওনকের দিকেই তাকিয়ে আছে। ঘড়ির কাটা টিক টিক করে এগিয়েই চলেছে, সেই সঙ্গে এক একটা মুহূর্ত এগিয়ে যাচ্ছে। এই সময়টাকে বেঁধে রাখা গেলে হয়ত খুব ভালো হতো। কিন্তু আফসোস সময়কে বেঁধে রাখার কোনো উপায় নেই। মানুষকে সম্পর্ক নামক দোহাই দিয়ে বেঁধে রাখা গেলেও সময়কে কোনোভাবেই বেঁধে রাখা যায় না। আর না সময় নিজের গতির পরিবর্তন করে। হতাশ ভঙ্গিতে নিজের চুলে হাত চালায় লাবিব। একটু আগেই যে তালে তানিয়া নিঃশ্বাস ছেড়েছিল, একই তালে হতাশা মিশ্রিত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাপা ঠোঁটে বলে,

-আমার ভয় লাগছে।

তানিয়া জানে লাবিবের এই ভয় অযৌক্তিক নয়। এই মানুষটার সাথে কেবল গুটি কয়েক মানুষ নয় বরং অনেকগুলো মানুষ, তাদের জীবন, একটা গোটা জামান ইন্ডাস্ট্রিস জড়িয়ে আছে। এই মানুষটার অবর্তমানে কি হবে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দিনের কথা ভেবেই লাবিবের এই ভয় পাওয়া। লাবিবকে কি শান্তনা দিবে বুঝে পায় না তানিয়া। সে নিজেও কি ভয় পাচ্ছে না? পাচ্ছো তো। প্রকাশ করতে পারছে না তবে ভয় সে নিজেও পাচ্ছে। রওনক মানুষটা তার আশেপাশের মানুষগুলোর জীবনে অনেক গুরত্বপূর্ণ একজন। ঠিক উপন্যাসের প্রধান চরিত্রদের মতো, যে চরিত্রের অনুপস্থিতিতে মূল গল্প তার খৈ হারাবে সেরকম গুরুত্বপূর্ণ।

-ভয় পেও না লাবিব, ভয় পেও না। রওনক ঠিক ফিরবে।

বিড়বিড় করে বলে কথাগুলো তানিয়া, যেনো তার নিজের বলা কথা সে নিজেই পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। বিশ্বাস করতে চায় কিন্তু কোথায় যেনো একটা কিন্তু থেকেই যায়। মৃ ত্যু র উপর মানুষের হাত থাকলে কেউ কখনোই মৃ ত্যু কে বেছে নিতো না। সবাই কেবল বেঁচে থাকতে চায়, সুখে থাকতে চায়।

সামনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে এনে তানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে লাবিব বলে,

-জানি না কি হবে। আমার সত্যি ভয় করছে।

একমুহূর্ত থেমে লাবিব তার কথায় আরও যোগ করে বলে,

-আমি কি একটু আপনার হাতটা ধরতে পারি? প্লিজ!

অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়ে সামনের দিক থেকে চোখ নামিয়ে লাবিবের মুখোমুখি তাকায় তানিয়া। সে জানে, ভুলে যায়নি এইমুহূর্তে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই পুরুষ তাকে ভালোবাসে। যে ভালোবাসাকে আঁজলা ভরে গ্রহণ করার ক্ষমতা তার নেই। আবার চাইলেও সে একবার জেনে যাবার পর এই ভালোবাসা অস্বীকারও করতে পারছে না। ভালোবাসাটা বড়ই ব্যাক্তিগত অনুভূতি। ভালোবাসা কারো বাঁধা মানে, কোনো নিষেধ বুঝে না। একবার কোনো মন কাউকে ভালোবেসে ফেলার পর নিজের মতো ভালোবাসতেই থাকে। তানিয়া জানে, বুঝতে পারছে লাবিব কখনো তার সামনে নিজের ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসবে না তবুও এই যে জেনে যাওয়াটা, জানার পর কিছু করতে না পারাটা ভীষণ কষ্টদায়ক। বাকিটা জীবন যতবার লাবিবের সাথে তার দৃষ্টির আদান-প্রদান হবে, লাবিবের ভালোবাসা গ্রহণ করতে না পারার, তার ভালোবাসার বিনিময়ে তাকে ভালোবাসতে না পারার অনুশোচনা একটা জীবন ভর প্রতিমুহূর্ত তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। কারণ সে জানে ভালোবাসার মানুষটার থেকে ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা না পাওয়াটা কতখানি পীড়াময়। কতখানি বুক জ্বালাপোড়া করার মতো অশান্তির। কতখানি নিঃশ্বাস ভার হওয়া।

লিফট কল করে দাঁড়িয়ে আছে লাবিব, তানিয়া পাশাপাশি। নীরবতাদের শব্দের প্রহারে চূর্ণবিচূর্ণ করে তানিয়া বলে,

-আজকের রাতটা নাহয় আমি থেকে যাই রওনকের কাছে। তুমি বাসায় গিয়ে রেস্ট করো। তোমার নিজেরও বিশ্রাম করাটা জরুরী লাবিব। এই সময় তুমি বা আমি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সমস্যা বাড়বে। তাই আজ না হয় আমি…

তানিয়াকে কথা শেষ করতে না দিয়ে লাবিব বলে,

-বাসায় গিয়ে আমার রেস্ট হবে না। এখানেই ঠিক আছি আমি। স্যারের জ্ঞানটা ফিরুক, উনি বাসায় ফিরুক তারপর না হয় একেবারেই বিশ্রাম করা যাবে। আপনি বাসায় যান। আমার থেকে আপনার বিশ্রাম বেশি প্রয়োজন। ওদিকটা তো আপনাকেই একলা হাতে সামাল দিতে হচ্ছে।

-চিত্রলেখার কোনো খবর পেলে লাবিব?

-নাহ!

লাবিবের কন্ঠের হতাশা বাড়ে। এই না টা বলতে তার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে। চিত্রলেখা কেবল রওনকের বউ সে জন্য নয়, লাবিবের অনেক ভালো একজন বন্ধুও সে। নিজের সবটুকু চেষ্টা করেও তার বন্ধুকে খুঁজে বের করতে পারছে না। শেষপর্যন্ত পাবে কিনা সেই আশাও রাখতে পারছে না। এতগুলো মানুষ তাকিয়ে আছে তার দিকে অথচ কাউকে দেয়ার মতো কোনো আশা, ভরসা নেই তার কাছে। বড় অসহায় লাগে নিজেকে লাবিবের। লিফটটা খুলে গেলে ভেতরে প্রবেশ করে লাবিবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তানিয়া বলে,

-আসছি, নিজের খেয়াল রেখো।

লাবিব জবাব দেয়ার সুযোগ পায় না। সে কিছু বলার আগেই লিফটের দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকেই লাবিব মনে মনে আওড়ায়, “আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন, আমার ভালোবাসার মানুষ।“

তানিয়াকে বিদায় দিতে না দিতেই একটা জরুরী কল এটেন্ড করতে হয় লাবিবকে। ফোনকলে কথা শেষ করে রওনকের কেবিনের দিকে আগায় সে। কিন্তু খানিকিটা কাছাকাছি আসতে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় রওনকের কেবিন থেকে দ্রুত কদমে ব্যস্ত হয়ে নার্সকে বের হতে দেখে। নিজের কদমের জোর বাড়িয়ে কেবিনের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় সে। ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে তার পেছন থেকে এগিয়ে এসে একজন নার্স বলে,

-আপনি বাইরে থাকুন প্লিজ। এখন ভেতরে যাবেন না। ডাক্তার সাহেব ভেতরে আছেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই।

লাবিব বুঝতে পারে না হচ্ছে টা কি! সামান্য কয়েক মিনিটের ব্যবধানে কি হয়ে গেল এমন? ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-কি হয়েছে? স্যার ঠিক আছে তো?

-পেশেন্টের জ্ঞান ফিরে এসেছে।

-সত্যি!

খুশি হবে না অবাক বুঝতে পারে না লাবিব। তাকে আশস্ত করে নার্স জানায়,

-জি, ডাক্তার চেকআপ করছেন। চেকআপ হয়ে গেলে পরে আপনাকে ভেতরে ডাকা হবে ততক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করুন।

নার্স লাবিবকে বাইরে রেখে ভেতরে চলে গেলে, সে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ডাক্তার নার্সের জন্য রওনককে দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে। তাই কানে শুনা কথা এখন অব্দি বিশ্বাস হচ্ছে না তার। নিজ চোখে দেখার পরেও হয়ত বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। তবুও অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষমান সে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার সরতেই লাবিব ট্রান্সপারেন্ট দরজার এই পাশ থেকে দেখতে পায় রওনক কথা বলছে। লাবিবের নিজের অজানতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। এতক্ষণ খেয়ালই হয়নি তার তানিয়া তো একটু আগেই গেল, নিশ্চয়ই বেশি একটা দূরে যায়নি সে। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন লাগায় সে তানিয়াকে রওনকের জ্ঞান ফেরার কথা জানাতে। তানিয়াকে জানিয়ে দেয় কাউকে এক্ষুনি কিছু না জানাতে। আগে রওনকের সাথে কথা বলবে তারপর সবাইকে জানানো হবে তার জ্ঞান ফিরার কথা। তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে তাকে একাই হাসপাতালে ফিরে আসতে বলে। তানিয়ার সাথে কথা বলা শেষ করতে না করতেই লাবিব দেখতে পায় কেবিনের দরজা দিয়ে ডাক্তার বেরিয়ে আসছে। ডাক্তারের কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে লাবিব জানতে চায়,

-এখন স্যারের কী অবস্থা বুঝছেন?

-কথাবার্তা স্বাভাবিক আছে। কাল কিছু টেস্ট করাবো। সবগুলো টেস্টের রেজাল্ট যদি নরমাল থাকে তাহলে আর চিন্তার কোনো কারণ থাকবে। আর কোনো ভয়ও থাকবে না।

হ্যান্ডশেক করার উদ্দেশ্যে ডাক্তারের দিক হাত বাড়িয়ে দিয়ে লাবিব বলে,

-থ্যাংকিউ সো মাচ ডক্টর।

হাসি মুখ করে ডাক্তার বলে,

-ইটস ওকে, সব টেস্ট হয়ে যাওয়া অব্দি জামান সাহেব আইসিইউতেই থাকবেন। রেজাল্ট সব নরমাল আসলে তারপরে না হয় কেবিনে শিফট করে দেয়া হবে।

-আমি কি ভেতরে যেতে পারব?

-অবশ্যই। উনি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছেন।

-থ্যাংকিউ এগেইন ডক্টর।

আইসিইউর দরজার ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই লাবিব দেখে রওনক এদিকেই তাকিয়ে আছে। কেনো আর কার জন্য তাকিয়ে আছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। রওনকের বেডের মাথার দিকটা তুলে দেয়া হয়েছে। আধশোয়া অবস্থায় শুয়ে আছে সে। এইভিতে স্যালাইনের সাথে মেডিসিন যাচ্ছে এখনো। লাবিব কাছাকাছি এগিয়ে এসে দাঁড়াতেই তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-চন্দ্র কোথায়? আমার এক্ষুনি ওকে চাই। কল হার রাইট নাও।

তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে হিমশিম খায় লাবিব। মাত্রই জ্ঞান ফিরেছে তাও টানা পাঁচদিন কোমায় থাকার পর। এক্ষুনি এমন একটা নিউজ তাকে দেয়া উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছে না সে। মনে মনে নিজেকে উদ্ভট গালাগাল দেয় লাবিব ডাক্তারের থেকে আগেই কিছু জেনে না নেয়ার জন্য।

-লাবিব!

-আপনার এখন রেস্ট বেশি দরকার।

-লাবিব, আমার চন্দ্রকে লাগবে। আই ওয়ান্ট হার নাও।

কীভাবে চিত্রলেখার মিসিং হওয়ার খবর জানাবে সেই কথা গুছাতে মনে মনে হিমশিম খায় লাবিব। কথা গুছিয়ে নিতে চোখ বন্ধ করে নিজের কপালে হাত ঘেষে নেয়। ইতোমধ্যে ধৈর্য হারাতে শুরু করেছে রওনক। লাবিব কোনো জবাব দিচ্ছে না দেখে দাঁত চেপে আবার তাকে ডাকে।

-লাবিব! চন্দ্র কোথায়?

-জানি না।

কথাটা বলতে চায়নি লাবিব। বেফাঁস বেরিয়ে গেছে তার মুখ গলে নিজেকে আটকানোর আগেই। লাবিবের কথা শুনে চোখ সরু করে তার দিকে তাকায় রওনক। ঠান্ডা কন্ঠে জানতে চায়,

-জানি না মানে? আর ইউ ইন ইউর সেন্স?

-আমি একা না, আমরা কেউই জানি না চিত্রলেখা কোথায় আছে? কেমন আছে? কিছুই জানি না।

-হোয়াট দ্যা ফা ক আর ইউ টোকিং লাবিব!

রওনক উত্তেজিত হতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু এইমুহূর্তে তার উত্তেজিত হওয়া একদম ঠিক হবে না। আরেক কদম তার কাছাকাছি এগিয়ে দাঁড়ায় লাবিব। রওনককে ঠান্ডা করার প্রচেষ্টা বলে,

-প্লিজ আপনি উত্তেজিত হবে না। আমি চেষ্টা চালাচ্ছি চিত্রলেখাকে খুঁজে বের করার। কিন্তু…

-কিন্তু কী?

-অনেক চেষ্টা করেও এখন পর্যন্ত কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। এখন অব্দি কেউ কোনো আপডেট দিতে পারছে না।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে রওনক। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে লাবিবের প্রেসার বাড়তে আরম্ভ করে দিয়েছে। মনে মনে আগের চাইতে আরে বেশি জঘন্য গালাগাল দেয় সে নিজেকে। এখনই না বললেও চলতো। বললেই পারতো চিত্রলেখা বাসায় আছে, সকালে আসবে। এতে অন্তত রাতটা সময় পাওয়া যেতো। এমন হতে পারতো সকাল অব্দি চিত্রলেখাকে খুঁজে পাওয়া গেল। একটা ব্লান্ডার করে ফেলেছে সে। হাতের তালু ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। কিছুক্ষণ চুপ করে অন্যমনষ্ক হয়ে থাকার পর রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কখন থেকে মিসিং আমার চন্দ্র?

-আপনার যেদিন এক্সিডেন্ট হলো সেদিন থেকেই।

-কয়দিন?

-পাঁচদিন আগে এক্সিডেন্ট হয়েছে আপনার। আজ সিক্সথ ডে।

-ছয়দিন!

-জি।

-কোনো আপডেট?

-এখন পর্যন্ত কোনো আপডেট নেই। কেউ জানে না চিত্রলেখা কোথায় গেছে, কেনো গেছে।

-ওর মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করেছো?

-করিয়েছি, লাস্ট লোকেশন বাসারটাই দেখায়। খুব সম্ভবত বাসা থেকে বের হবার আগেই নিজের ফোনটা অফ করে ফেলেছিল সে। তাই নতুন কোনো লোকেশনের আপডেট পাওয়া যায়নি।

-পুরো ঘটনাটা খুলে বলো তো। কোথা থেকে আর কীভাবে মিসিং হলো।

-জাহানারা আন্টি জানিয়েছেন ওইদিন সকালবেলায় আপনি অফিসের জন্য বেরিয়ে যাবার ঘন্টাখানিক বাদেই কাউকে কিছু না জানিয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছে চিত্রলেখা। সঙ্গে ডাইভারকেও নেয়নি। এমনকি জাহানারা আন্টিকেও জানায়নি কোথায় যাচ্ছে, কখন বাসায় ফিরবে। এমন ভাবেই বেরিয়েছে যেনো কেউ তাকে দেখতে না পায়। এমনকি ঐ বাসায়ও যায়নি। লিখনরাও জানে না চিত্রলেখা কোথায় আছে। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম হয়ত কিডন্যাপিং কেইস আপনার তো শত্রুর অভাব নেই। তবে তেমনটাও হয়নি। আমি চেষ্টা করেছিলাম চিত্রলেখার মিসিংয়ের ব্যাপারটা যেনো মিডিয়াতে লিক না হয় কিন্ত…

রওনকের বুঝতে অসুবিধা হয় না লাবিব কি বলতে চাইছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আরও কিছু একটা ভাবে সে। তারপর জিজ্ঞেস করে,

-আমার মোবাইলটা কোথায়?

নিজের ব্লেজারের ভেতর দিককার পকেট থেকে একটা নতুন মোবাইল ফোন বের করে রওনকের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে লাবিব বলে,

-এক্সিডেন্টের সময়ে আপনার ফোনটা ভেঙ্গে গিয়েছিল তাই নতুন একটা ফোন কিনে সিমটা চালু করে রেখেছি আমি আমার কাছে।

-ভালো করেছো।

লাবিবের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে তাতে ব্যস্ত হয় রওনক। প্রথমেই একটা ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে নেয় সে। তারপর তার ব্যাক্তিগত ইমেইল টা কানেক্ট করে একজনকে ফোন করতে হবে। তার একটা ফোন কলই যথেষ্ট চিত্রলেখা এইমুহূর্তে কোথায় আছে, কেমন আছে সেই ইনফরমেশন বের করতে। ইমেইল কানেক্ট করে নম্বর লোড হবার আগেই একটা ইমেইল আসার নোটিফিকেশনে তার নজর আটকায়। তৎক্ষণাৎই ইমেইলের ইনবক্সে যায় সে। অতিবাহিত হওয়া প্রতিমুহূর্তের সাথে রওনকের চোখ-মুখের ভঙ্গি পরিবর্তন হতে থাকলে তা দেখে লাবিব চিন্তিত কন্ঠে জানতে চায়,

-এনি প্রবলেম স্যার?

আরও কিছুক্ষণ নিজের মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ফোনটা লাবিবের দিকে এগিয়ে দেয় রওনক। ভ্রু কুচকে তার হাত থেকে ফোনটা নেয় লাবিব। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখতেই দেখতে পায় চিত্রলেখার পাঠানো ইমেইল। বলা যায় ইমেইলের মাধ্যমে চিঠি লিখে রেখে গেছে সে রওনকের জন্য। চিত্রলেখার রওনককে পাঠানো ইমেইলটা এরূপ,

আমি চলে যাচ্ছি। দয়া করে আমাকে খোঁজার চেষ্টা করবেন না। আমি জানি, আমি চাইলেই আপনার দৃষ্টির আড়ালে যেতে পারবো না। আপনি সবসময় ছায়ার মতো আমার সাথেই আছেন। কিন্তু আমি আর আপনার ছায়ায় থাকতে চাই না। আমার সকল দায়দায়িত্ব থেকে অনেক আগেই আমাকে মুক্তি দিয়েছেন সব নিজের কাঁধে নিয়ে, সেই ভরসাতেই চলে যাচ্ছি। আপনি আছেন, আমি না থাকলেও চলবে। আর কোনোদিন কোনোভাবে আমাদের দেখা না হোক। আমি কখনো আপনার মুখোমুখি হতে চাই না। যদি হয়েও যাই তাহলে আগেই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন প্লিজ। আমার শেষ অনুরোধ, ভুলে যাবেন আমাকে। আমি কখনো আপনার জীবনে এসেছিলাম ভুলে যাবেন। প্লিজ আমাকে খুঁজবেন না। আমি যেখানেই থাকি, যেমনই থাকি না কেনো জানবেন আমি শুধু আপনাকেই ভালোবেসেছি। আপনার পর আর কেউ আসবে না আমার জীবনে। যা পেয়েছি আপনার থেকে তা আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকবো না হয়। ভালো থাকবেন, নিজের খেয়াল রাখবেন। আমার সব দোয়া আপনার জন্য।

-আপনার চন্দ্রলেখা।

চিত্রলেখার ইমেইলটা কয়েকবার করে পড়ে লাবিব যেনো নিজের চোখে দেখা লেখা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে রওনকের দিকে তাকায় সে। অন্যদিকের দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে রওনক। সামান্য ধরে আসা কন্ঠে লাবিব জানতে চায়,

-আপনি খুঁজবেন না চিত্রলেখাকে?

-না।

-কেনো!

-যাকে ভালোবাসা দিয়ে আটকে রাখতে পারিনি। যে নিজে থেকে হারিয়ে যেতে চায় তাকে কি দিয়ে আটকাবো আমি? জোর করে ভালোবাসা আদায় করা যায় না লাবিব। এই কথা তোমার থেকে ভালো কে জানে বলো?

-কিন্তু চিত্রলেখা আপনাকে ভালোবাসে।

আর কোনো জবাব দেয় না রওনক। জবাবের আশায় লাবিব পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও রওনক রা করে না। নিঃশ্বাস গাঢ় হয়েছে তার। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। ইচ্ছা করছে হাতের কাছে যা আছে সব ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলতে, পৃথিবীতে আ গু ন জ্বালিয়ে দিতে। কিন্তু সে কিছুই করবে না। যে সইচ্ছায় চলে যেতে চায় তাকে সে আটকে রাখবে না। জোর করে, আটকে রেখে কারো ভালোবাসা আদায় করা যায় না। বিয়ের পর থেকে প্রতিটা মুহূর্ত চিত্রলেখাকে সে নিজের ভালোবাসা বুঝিয়েছে। এরপরেও যদি সে চলে যেতে চায় তাহলে রওনকের কিছুই করার নেই। কোনোদিনও নিজের ভালোবাসার দাবি নিয়ে, সম্পর্কের দোহাই দিয়ে চিত্রলেখার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে না সে। চিত্রলেখার সাথে পথচলার বুঝি এখানেই সমাপ্তি।

-রওনক!

আচমকা তানিয়ার ডাকে ভাবনার অতল থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসে রওনক। তানিয়াকে দেখে ম্যাকি হাসার চেষ্টা করে যা আসলে কাজে দেয় না। তানিয়ার দৃষ্টিতে সবার আগে রওনকের লাল হয়ে থাকা ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে শূন্যতায় ডুবে যাওয়া চোখ জোড়া ধরা পরে। যারা জানান দেয় সে ভালো নেই। তার ভালো থাকার দিনগুলো ফুরিয়ে গেছে। আর কোনোদিন ভালো থাকবে না সে। তার জীবনের সব ভালো মুছে গেছে।

ঘরের দক্ষিন দিকের জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রলেখা। অন্ধকার রাতে নিঃসঙ্গ, একলা চাঁদটাকে দেখতে ব্যস্ত সে। এইমুহূর্তে সে নিজেও ঐ চাঁদটার মতোই নিঃসঙ্গ আর ভীষণ একলা। তবে তার এই একাকীত্বের দায়ভার একান্তই তার নিজের। এই একাকীত্ব চিত্রলেখার নিজের বেছে নেয়া। তাই বাকি জীবন তাকে একলাই কাটাতে হবে ভালোবাসার মানুষের থেকে অনেক দূরে। এই জীবনে আর সে কোনোদিন মানুষটাকে দেখতে পাবে না। যতবার চিত্রলেখার মনে পড়েছে সে আর কোনোদিন রওনককে দেখতে পাবে না, একটু ছুঁয়ে দিতে পারবে না, ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় তার চোখ গলে গাল বেয়ে অশ্রু ঝড়েছে। বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চিত্রলেখা নিজের সাথেই বলে,

-আমার আর কিছুই করার ছিল না। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আপনার ক্ষতি হতে দেখতে পারতাম না।

চিত্রলেখা চলে গেছে রওনকের জীবন থেকে তাকে ভালোবাসা নামক মাতাল হাওয়ায় পুরোপুরি উন্মাদ করে দিয়ে। যে উন্মাদনা আরোগ্য নেয়। এতখানি ভালো তো সে তিলোত্তমাকেও কোনোদিন বাসেনি। এই মাতাল হাওয়া থেকে বের হবার পথ জানা নেই রওনকের। এমনকি সে এটাও জানে না, কোনোদিন সে চিত্রলেখা নামক এই মাতাল করা অনুভূতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে কিনা। তবে মুখে যাই বলুক না কেনো অবচেতন মনে সে নিজেও কোনোদিন চিত্রলেখা নামক এই মাতাল হাওয়া, এই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে চায় না। যে কয়টা দিন বেঁচে থাকবে তার হৃদয় দেয়ালে চিত্রলেখার নামটাই খোদাই করা থাকবে ভালোবাসা নামক মাতাল হাওয়া হয়ে, উন্মাদনা হয়ে।

ভালোবাসা সম্পূর্ণ অনুভূতিটাই নে শা র মতো। আর নে শা করলে তো সর্বনাশ হবেই। ভালোবাসা নামক মাতাল করা নে শা রওনক, চিত্রলেখা দু’জনেরই সর্বনাশের ডাক দিয়ে ফেলেছে। এখন এই আ গু নে জ্বলে পু ড়ে ছা ড় খা র হওয়া ছাড়া কারো কিচ্ছু করার নেই। কারণ এরপর হয়ত আর কোনোদিন তারা একে-অপরের মুখোমুখি হবে না। দূর থেকেই ভালোবাসা তাদের পো ড়া বে। মৃ ত্যু কারোই হবে না তবুও দু’জনেই প্রতিমুহূর্ত পু ড়ে ম র বে একে-অন্যের শূন্যতায়, একে-অপরের অভাবে। কারণ ভালোবাসা যে মাতাল হাওয়া।

সমাপ্তি।
প্রথম পরিচ্ছদের সমাপ্তি এখানেই।