Thursday, June 26, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 251



চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-১৬

0

চন্দ্র’মল্লিকা ১৬
লেখা : Azyah_সূচনা

শওকত হাতাহাতি করেও পারছে না।তাকে আটকে রেখেই রাতের আধারে কয়েকজন লোক মাহরুরকে বেধড়ক মেরে যাচ্ছে।দুজন মানুষের বল পাঁচ ছয়জনকে আটকে রাখা সম্ভব?চিৎকার চেঁচামেচি করতে চাইলে মুখ চেপে ধরা হয়। রক্ত ঝরছে চোখের কোণ বেয়ে।ঠোঁট, নাকও বাদ যায়নি।এত ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যেও বুঝতে পারলো এটা রাব্বী মিয়ার লোকজনের কাজ। হয়তো সকালের কথা তাদের বিশ্বাস করাতে পারেনি।মুখে রুমাল বেধে ইচ্ছে মত লাঠিপেটা করে ফেলে রেখে গেলো মাহরুরকে। শওকতকে ছেড়ে দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে পালায়।

গলার আওয়াজ তুলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলো শওকত।তাদের গালি দেওয়া শেষে মাহরুরের কাছে আসে।

বলে,
“ভাই তোর অবস্থা ভালো ঠেকছে না একটু উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা কর।”

মল্লিকাদের বাড়ি থেকে অনেকটা কাছেই এই ঘটনা ঘটেছে।বাঘের গর্জনের মতন আওয়াজ তোলে শওকত।ডাক লাগায় ‘ রমজান চাচা ‘ বলে।গভীর রাতের নীরবতায় শওকতের গলার ধ্বনি চলে গেলো মল্লিকাদের ঘর অব্দি। ধড়ফড়িয়ে উঠেছে মল্লিকা।সাথে রমজান মিয়াও।এতরাতে বারংবার ডাকছে শওকত। নিশ্চয়ই কোনো বিপদ!মল্লিকা কেশ ছড়িয়ে দৌড় লাগায়।ভয়টা ইদানিং মগজে গেঁথে গেছে।রমজান মিয়াও দ্রুত পায়ে উঠোনে হাজির।

শওকতের পায়ে মাথা রেখে মাহরুর অস্পষ্ট গলায় বলে উঠে, “আমার চন্দ্র কে ডাক… ও…কে দেখবো আমি”

রমজান সাহেব এসে হাজির।মল্লিকা দাড়িয়ে আছে সদর দরজায়।সামনের কিছুই তার কাছে পরিষ্কার নয়। ভাতিজাকে রক্তাক্ত জমিনে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠলেন। ছুটে আসেন তাদের দিকে।

শওকত বললো,

“চাচা এখন কোনো প্রশ্ন কইরেন না।আপনার ভ্যান এর চাবি দেন।ওরে হাসপাতালে নিতে হবে।”

“এই মল্লিকা!মল্লিকা!আমার ড্রয়ার থেকা ভ্যানের তালার চাবি দে।….আমার মাহি-র কি হইলো?ওরে এমনে কে মারলো।”

ফরিদা বেগম চাবির কথা শুনে ছুটে গেছেন ঘরে।ভ্যানের তালা খুলে নিজেই টেনে এগিয়ে দিলেন শওকতের কাছে।মল্লিকার পা জোড়া আর স্থির থাকতে পারলো না।রাত দিনের হিসেব না করেই চলে গেছে সদর দরজা পেরিয়ে।জমিনে পা গুটিয়ে বসেছে মাহরুরের সন্নিকটে!রক্তে ভেজা মুখটা তার দিকে চেয়ে। বিষদায়ক এই চাহনি।কোনো কথা,বাক্য আদান প্রদান এর আগে হাজির শওকত। দুজন মিলে তুলে নিলো মাহরুরকে ভ্যানে। দুঃসাহস দেখিয়ে বাবার সামনেই মেয়ের হাত চেপে ধরেছে মাহরুর।বলতে চাইতে সাথে আসতে।

মাহরুরের অব্যক্ত কথার অর্থ বুঝে মল্লিকা বললো, “আসছি আমি।আপনি চিন্তা করবেন না”

আঘাত অনেক। তবে গুরুতর কিছুই হয়নি। উপরিভাগের ক্ষত ড্রেসিং করে দেওয়া হয়েছে।রাতের বেলায় ডাক্তার পাওয়া গেলো এটাই অনেক বড় সৌভাগ্য। ব্যান্ডেজ করে দিয়ে আজ রাত মাহরুরকে হাসপাতালে রাখবেই বলা হলো। ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়েছে। পীড়ায় আড়ষ্ট মাহরুরের চোখ মল্লিকার সন্ধানে।আরো পাঁচ ছয়জন রোগীর কোলাহলের মধ্যে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা পাওয়ার রোগটা বেশী জোরালো।সামনেই শওকত আর রমজান সাহেব আলোচনায় মগ্ন।ঘোর আলোচনা।কে করেছে?কেনো করেছে?এটাই তাদের আলোচনার মুখ্য বিষয়বস্তু। তাতে মাহরুরের কি?মার দিয়েছে, মার খেয়েছে। শোধবোধ!

মিনিট পাঁচেক পর মন বাগানে চন্দ্রমল্লিকার আগমন ঘটে।এসেই ধীমা গলায় জানতে চাইলো, “কেমন লাগছে এখন?”

রমজান সাহেব আর শওকতের নিরাপদ দূরত্ব দেখে মাহরুর উত্তর দেয়, “ভালো নারে।আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে চন্দ্র”

“তাহলে কেনো গেলেন মারতে জহিরকে?আপনি চেনেন না রাব্বী চাচাকে?”

মুখের ভঙ্গিতে পরিবর্তন হলো।যেখানে নিজের বেদনার কথা বলে মুখটা পরিশ্রান্ত হয়ে উঠেছিল সেখানে অত্যুগ্র হয়ে উঠে।

বলে, “সাহস কি করে হয় ওর তোর দিকে খারাপ দৃষ্টি দিতে?ওকে ওর যোগ্য শাস্তি দিয়েছি।ওকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজেও আঘাত পেয়েছি।কিন্তু জানিস একটা কথা?”

“কি?”

গভীর চোখে মল্লিকার দিকে চেয়ে বলল, “দেহের ব্যথার চেয়ে তুই আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিস এই ব্যথা দ্বিগুণ।আমি এত বেহায়া কি করে হলাম?”

“বিশ্রাম করুন”

“কাল বিয়ে করবো আমরা ঠিক আছে?”

চলে যাচ্ছিলো পিঠ দেখিয়ে। নিদারুণ চাওয়ায় বেশিদূর এগোতে পারেনি।আদুরে গলায় ডেকে বলছে বিয়ে করবে।গোলগোল চোখে চাইলো মাহরুরের দিকে।মল্লিকা রাজি না জানা সত্ত্বেও কি করে আবদার করে ফেললো?

“আমার বউ সাজবি না চন্দ্র? মাহরুর ইবনাতের বউ চন্দ্রমল্লিকা”

কিশোরী মনে যেই ঝড়টা তুলতো এখনও ঠিক সেই রকম তুফান উঠেছে।তার কথা,তার চলাফেরা,তার মুখখানা।আজও তেমনি আছে।ভিন্নতা এসেছে তার ইচ্ছেগুলোতে।তার কাছ থেকেই তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার প্রয়াস করে যাচ্ছে।এটা মাহরুরের নতুন রূপ।কয়লা পুড়িয়ে স্বর্ণ বেরিয়ে আসার মতই।নিত্যনতুন চালচলনে আশ্চর্যের চরম সীমায় এনে একাকী দাড় করিয়ে দিচ্ছে মল্লিকাকে।

___

“আমার ভাতিজাকে অযথা কেনো মারা হলো?আমি জানি আপনার লোকেরাই করেছে এই কাজ রাব্বী ভাই”

আজও গ্রামে পঞ্চায়েত বসে।সালিশ বিচার হয়।ঠিক তেমনি আজও বসেছে। জহির উপস্থিত সেখানে।রমজান সাহেবের প্রশ্নে রাব্বী মিয়া উত্তর দিলো,

“আপনার ভাতিজা কি করেছে শুনেননি?আমার ছেলেকে যে অযথা মারলো?”

“আপনার কাছে কি প্রমাণ আছে আমার ভাতিজা মেরেছে জহিরকে?”

রাব্বী মিয়া মাহরুরের মানিব্যাগটি ছুঁড়ে দিলো রমজান সাহেবের দিকে।নিজের হারানো মানিব্যাগ দেখে দৃষ্টি তুললো মাহরুর।সেদিন ভরে ধস্তাধস্তি করতে গিয়েই পড়ে গেছে হয়তো।

রাব্বী মিয়া সবাইকে দেখিয়ে বললো, “এইযে রমজান ভাইয়ের ভাতিজার মানিব্যাগ।আমার গ্যারেজ থেকে পেয়েছি।এখন আমি জানতে চাই কেনো আমার ছেলের সাথে এই মারামারির শুরু হলো”

পঞ্চায়েতের এক গুরুজন জানতে চাইলেন, “বলো মাহি কেনো মেরেছো?”

মুখ শক্ত করে মাহরুর উত্তর দেয়, “ওনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন!রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্যক্ত করে।পথ আটকায়।বাজে ইঙ্গিত দেয়।জিজ্ঞেস করেন ওকে মল্লিকাকে আজেবাজে নোংড়া কথা বলেনি?ঠিক সময়ে শওকত না আসলে হয়তো তাদের ক্ষতিও করতে পারতো।”

মাহরুরের কথায় সকলে জহিরের দিকে চায়।নিজেকে রক্ষা করতে জহির বলে উঠলো, “মল্লিকা আমাকে নিজে ওর কাছে ডাকছে আব্বা।আমি যেতে চায়নি।আব্বা এই মাইয়ার নিয়ত ভালো না শওকত ভাইরেও নিজের পেছনে নাচায়।এখন ওর কারণে আমি মার খেলাম।এখন দেখছি মাহি ভাইও ওর জন্য উতলা।বুঝতে পারছেন আপনারা কতগুলা পুরুষরে হাত করে রাখছে?আমার কাছেও এভাবেই আসছিলো।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায় মাহরুর।ব্যান্ডেজ করা নড়বড়ে হাত পা দিয়েই তেড়ে গেলো জহিরের দিকে।শওকত আর রমজান সাহেব এসে থামিয়ে দেয় তাকে।আঙ্গুল তুলে জেদী গলায় বলতে লাগলো,

“জবান টান দিয়া ছিড়া ফেলবো জানোয়ারের বাচ্চা!তুই নষ্ট!তুই কুলাঙ্গার।ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে নিজের দোষ মল্লিকার উপর দিচ্ছিস।মেয়েদের উপর দোষ নিয়ে নিজে বেচে যাবি বলে?”

রাব্বী মিয়া সবার মধ্যে বলে উঠেন, “দেখেছেন?দরদ দেখেছেন?আমার ছেলে যা বলছে তাতো ঠিক প্রমাণিত হলো।তেজ দেখে মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই ওদের মধ্যে কিছু চলে।এসব মেয়ে গ্রামে থাকা মানেই আমগো পোলাপানের উপর খারাপ প্রভাব পড়বো।স্বামী হারা মাইয়া কারো গলায় ঝুলতে পারলেই বাঁচে।এদের বাইর করে দেন গ্রাম থেকে”

“বের করে দিবে মানে?এই গ্রামে আমার আব্বা আর মল্লিকার আব্বার পৈতৃক ভিটা।এক পাও নড়বে না কেউ এদিক থেকে।আর আমরা কোনো ভুল করি নাই আমরা কেনো গ্রাম ছাড়বো।আপনারা গুণীজন!কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক যাচাই করেন।আর মল্লিকার সাথে আমার কি সম্পর্ক এটা নিয়ে আপনাদের না ভাবলেও চলবে।রাব্বী সাহেব বাড়াবাড়ি করলে আমিও করবো!” বলে বলে গেলো মাহরুর।

মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে লড়ায়ে জয়ী হয়েছে মাহরুর। ধৈর্যশীল পুরুষের মাঝে চাপা হাসি।কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। ফরিদা বেগম বেঁকে বসেছিলেন।হাত পা জোর করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করানো হয়েছে।এলাকার মানুষের আড়ালে কাজী সাহেব এসে হাজির।সম্পূর্ণ লুকিয়ে ছাপিয়ে চন্দ্রকে নিজের নামে লিখিয়ে নেবে। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা মল্লিকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আগে বিবাহ সম্পন্ন করতে হবে।শওকত আর শশী এসেছে। মিষ্টি অনেকটা অবাক।কি হচ্ছে এখানে?তাকে শুধু এটাই বলেছে মাহরুর।আজ থেকে সে তার মামা নয়।বাবা বলে ডাকার আবদার করেছে ওই বাচ্চা মেয়েটির কাছে।যেকিনা বাবা শব্দের অর্থই জানেনা।নিজের বাবাকে কখনো দেখেইনি।বুঝেনি।তিন কবুলে চোখের পলকে বিয়ে হয়ে গেল।মল্লিকা এখনও স্তব্ধ।সবচেয়ে বেশি সময় সেই নিয়েছে।বিশ মিনিটে কাজী সাহেবকে সামনে বসিয়ে আবারো একবার ছক কষেছে।যা করছে ঠিকতো? স্বার্থপর বলে তাকে সমাজে ধিক্কার দেওয়া হবে নাতো।সমাজ বলবে নাতো পুরোনো প্রেমে নতুন করে মত্ত হয়েছে?বাবার অনুরোধে মিষ্টির কথা ভেবে বিয়েতো করে ফেললো।এখানে আগের মতোন ভালোবাসা কোনোদিন আসবে না।কক্ষনো না!

সাধাসিধে মল্লিকা।মুখে পরনে কোথাও বধূর সাজ নেই।মাত্র যে মাহরুরের বউ হয়েছে সেই ছাপ নেই। মাহরুরের অবস্থাও ভিন্ন। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে চন্দ্রকে।মনের প্রশান্তির কাছে এই শারীরিক যন্ত্রণা তুচ্ছ অত্যন্ত তুচ্ছ।অন্য ঘরে বসে মাহরুরকে মেনে নিয়েছে চন্দ্র এটাই কি বড় পাওয়া নয়?

মাহরুর বললো, “আমি রাতে চন্দ্র আর মিষ্টিকে নিয়ে ঢাকা ফিরতে চাচ্ছি”

“আর ক’টা দিন থেকে যা বাজান?”

“না চাচা! আমি আমার স্ত্রী আর বাচ্চার সম্মানহানি এক মুহুর্ত এখানে সহ্য করবো না।আগে সহ্য করেছি কারণ অধিকার ছিলো না সাথে ছিলো পুরোনো কিছু ভুল।অনেক সহ্য করেছে ওরা।আর না।”

মাহরুরের কথাগুলো শুনে ঠান্ডা হলো রমজান সাহেবের হৃদয়। মিশ্র অনুভূতির মধ্যে দিয়ে অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে।কিন্তু পূর্ণ বিশ্বাস মাহরুরের প্রতি।আর যাই করুক নিরাশ করবে না।

মাহরুর আবার বললো, “আমাকে একটু গোছাতে দেন সবকিছু। আপনাদেরও এখানে রাখবো না।এসব নিচু মানসিকতার মানুষের মধ্যে থাকার কোনো দরকার নেই।কয়েকমাস সময় দেন আমাকে।”

___

রাত এগারোটার বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলো। ভোর পাঁচটায় শহরে এসে পৌঁছায়।পুরো ছয়ঘণ্টা সম্পূর্ণ নিশ্চুপ চন্দ্রকে দেখেছে মাহরুর।গুটিসুটি হয়ে বাসের এক কোনে জমে ছিলো বরফের মতন।অধিকার থাকা সত্বেও মাহরুর জানতে চায়নি এই নীরবতার কারণ।আনমনে ভেবে বসে ছিলো হয়তো আকস্মিক বিয়ে সে মেনে নিতে পারেনি।সবকিছু এত দ্রুততার মধ্যে ঘটে গেলো যার কারণে মস্তিষ্ক প্রায় অচল। মিষ্টিকে ঠিক আগের মতই কোলে জড়িয়ে হাঁটছে মাহরুর।অন্যহাতে ভারী ব্যাগটা।পাশেই হাঁটছে তার সহধর্মিণী,তার প্রতীক্ষার ফল চন্দ্র।অল্প স্বল্প মানুষের চলাফেরা আছে রাস্তায়।হেঁটে চলা মল্লিকার পা আকস্মিক থেমে যায়। বাগানবাড়ির দিকে নজর পড়লে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায়।এখানেই কাটিয়েছে বিগত ছয়টা বছর।খুব সুখ যে ছিলো তা নয়।কষ্টের মাঝেও মায়ায় জড়িয়ে ছিলো এই বাড়ির সাথে।

কোমল হাতে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখের পলক ফেলে মল্লিকা। স্বয়ং মাহরুর তার হাত আগলে নিয়েছে।বললো,

“ভুলে যা এই বাড়িকে।একটা কালো অতীত ভেবে ঝেড়ে ফেলে দে।এখন তোর জন্য আমার চিলেকোঠার ঘর অপেক্ষা করছে।”

বললেই ভুলে থাকা যায়না।এই কথাটাই মনে বাজলো মল্লিকার। মাহরুরের পাশ ঘেঁষে তার ছোট্ট ঘরে এসে কদম রেখেছে।সব এলোমেলো।একা ছেলে মানুষের ঘর বলে কথা। মিষ্টিকে মল্লিকার কাছে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সবটা দুহাতে গোছগাছ করে নিচ্ছে।

কোনরকম বিছানার উপর থেকে কাপড় সরিয়ে নিয়ে হাত এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আয় আমার ঘরে”

মাহরুরের এক বুক আশাকে ভঙ্গ করে দিয়ে হাতটা ধরে নি মল্লিকা। মেয়েকে নিয়ে ঘরে এসে দাড়িয়ে আছে। মাথা ঝুঁকিয়ে হাসলো মাহরুর।তার চন্দ্রের কষ্ট,অভিমান দুদিনের নয়।অনেক সময় নিজেই নিজেকে দগ্ধ করেছে অদৃশ্য অগ্নিতে।এত সহজেই সস্তির বৃষ্টি নামবে?

“ঘুমিয়ে পড়।জার্নি করে এসেছিস ক্লান্ত।”

মল্লিকা মিষ্টিকে শুইয়ে দিলো।এক নজর রাখলো মাহরুরের উপর।হয়তো চোখের ভাষায় বোঝাতে চাচ্ছে সে কি করবে? ঘুমাবে নাকি জেগে থাকবে?অব্যক্ত মনের ভাষা বুঝে মাহরুর আলমারি থেকে আলাদা চাদর বের করে জমিনে পেতে শুয়ে পড়লো।

বললো,

“এবার শান্তিতে ঘুমো।”

শরীর ক্লান্ত ভীষণ রকমের।বিছানায় পিঠ ঠেকতেই ঘুমেরা ঝেকে বসেছে চোখে।মিনিট পাঁচেক এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে মল্লিকা।নিচে সমতল জমিনে শুয়ে চন্দ্রের উপস্থিতি গভীরভাবে অনুভব করতে করতে চোখ লেগে আসে মাহরুরেরও।

মাত্র তিন ঘণ্টার ঘুম শেষে উঠে পড়তে হয়।গোসল সেরে গায়ে পোশাক জড়িয়ে নেয় মাহরুর।অফিস কামাই করেছে অনেকদিন।আজ না গেলেই নয়।গলায় টাই পড়তে পড়তে ঘুমন্ত মা মেয়েকে দেখে ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে।এগিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত চন্দ্রের দিকে এক দৃষ্টিতে চায়।ঝুঁকে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

“অভিমান কমানোর চেষ্টা করবো চন্দ্র”

ঘুম পাতলা মল্লিকার।অল্প আওয়াজেই নড়েচড়ে উঠলো। মাহরুর সরে যায়। একটু জোরেই মল্লিকাকে ডেকে তুলে।বলে, “আমি অফিসে যাচ্ছি চন্দ্র। রুটি আর ভাজি এনে রেখেছি সকালের নাস্তা।যাওয়ার পথে রবিনকে বলে যাবো দুপুরের খাবার দিয়ে যেতে মোল্লা হোটেল থেকে।রাতে এসে রান্না করবো। সাবধানে থাকিস।”

ঘুমঘুম ঘোর লাগানো গলায় মল্লিকা জানতে চাইলো, “আর আপনি?”

“আমি খেয়ে নিবো অফিসে গিয়ে।”

ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়েছে। এখনই বের হবে। অন্যদিকে কাথা গায়ে পেঁচিয়ে বসে মল্লিকা।জুতো পড়ে বাহিরে যাওয়ার আগে মাহরুর বলে উঠলো, “বাড়ির কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে নিজের পরিচয় দিবি।”

“কি পরিচয়?”

কপাল কুঁচকে নেয় মাহরুর।বুকে হাত বেধে বললো, “স্পষ্ট শব্দে বলে দিবি আমি মাহরুরের বিবাহিত স্ত্রী।”

পুরুষ মানুষ বদলায়।প্রেমে ভীষণ রকম বদলে যায়।তাদের প্রত্যেকটা শব্দ,প্রতিটা অক্ষরে ব্যক্ত হয় সেটা। মাহরুরের বদলে যাওয়া ভাবভঙ্গিও সেখানেই ইঙ্গিত করছে।এই প্রেমের অনুভূতি থেকে মল্লিকার মনও বিরত নয়।সেও এককালে যা প্রখরভাবে অনুভব করেছিলো চন্দ্রের মন সেই অনুরাগ মাহরুরের চোখেও স্পষ্ট।

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-১৫

0

চন্দ্র’মল্লিকা ১৫
লেখা : Azyah_সূচনা

“অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমার বিশ্রী রকমের বেহায়া মনতো তোকে পাওয়ার জন্য আগে থেকেই পাঁয়তারা করছিলো।আমিই থামিয়ে রেখেছিলাম চন্দ্র।এখন ভাবলাম যেহেতু একবার তোকে পাইনি? দ্বিতীয়বার চেষ্টা করতে কি যায়?আয় ভুল শুধরে নেই। তোকে আর তোর মেয়েকে নিয়ে সম্মানের সাথে বাঁচি।আমার প্রাক্তন যদি স্বার্থপর হতে পারে আমি কেনো পারবো না?….. হ্যা যদিও আমি আগে থেকেই স্বার্থপর তোর চোখে।আরেকটু হলে কিই বা আসে যায়? কিশোরী বয়সে জানতে চেয়েছিলি না তোকে বিয়ে করবো কিনা?আজ আমি জিজ্ঞেস করছি।আমাকে বানাবি তোর জীবনের ব্যক্তিগত পুরুষ?সুযোগ দিবি আরেকবার?”

শেষরাতে মাহরুরের এসব বাক্য মল্লিকার নির্ঘুম রাতের কারণ।এক মুহূর্তের জন্য চোখের পাতাকে বিশ্রাম দেয়নি। মাহরুরের বলে যাওয়া কথাগুলোতে মিশ্র অনুভূতি। দ্বিতীয় সুযোগ?এই পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় সুযোগ শব্দদ্বয় ভীষণ ভারী।সকালের কিরণ মুখে এসে পড়লে নড়চড় বিহীন শুয়ে থাকা মল্লিকা যেনো শ্বাস ছাড়লো।সারারাত ভর মাহরুরের বাক্যসমুহ আওড়িয়েছে। স্মৃতিচারণ করেছে।এরমধ্যে তার আগের সংসারটাও ছিলো।মিষ্টির জন্মদাতা বাবার মুখটাও ছিলো।চলে গিয়েও ফিরে আসার চেষ্টা কেনো করছে মাহরুর? কোথায় এনে দাড় করিয়ে দিলো।

আজ বন্ধের দিন।সকাল সকাল মিষ্টিকে ডাকলো না আর।ঘুমাক।সকালে উঠতেই চায় না মেয়েটা।অর্ধ ঘুমে কোলে তুলে স্কুলে দিয়ে আসতে হয়।ফরিদা বেগম ঘুম থেকে উঠেন সকাল ছয়টায়।এখন আটটা বাজতে চললো।রান্না ঘর থেকে থালা বাসনের আওয়াজে মল্লিকাও গেলো সেদিকেই। বেলে রাখা রুটিগুলো তুলে ভাজতে লাগলো।মায়ের সাথে টুকটাক আলাপ এর মধ্যেই পুরুষালি কন্ঠস্বর আসে।

“চাচী?”

মাহরুরের আওয়াজে তাওয়ায় হাতটা লেগে যায়। অসাবধানতা বশত।দ্রুত হাত সরিয়ে পানির নিচে দিলো মল্লিকা।বুক কাপে এখনও ওই কণ্ঠে।

ফরিদা বেগম উঠে গিয়ে বললেন, “হ্যা মাহি।আয় ঘরে আয়।”

বসার ঘরে গা এলিয়ে বসেছে মাহরুর।সকাল সকাল এসে হাজির।অনেক বেশি প্রয়োজন আর বাবা,মা জড়াজড়ি না করলে আসতে চায় না।আজ বিনা নেমন্তন্নএ এসে গেছে।ফরিদা বেগম এসে জানতে চাইলেন,

“গরম গরম রুটি ভাজছে মল্লিকা।এনে দেই?খা।”

ভেবেছিল না বলবে।মল্লিকা ভাজছে শুনে মত পরিবর্তন করে বললো,

“ঠিক আছে।দেন। সাথে ডিম ভাজতে বইলেন”

নিজ থেকে আবদার করলো বলে অবাক হয় ফরিদা বেগম। হাসিমুখেই চলে গেলেন।নাস্তা রেডি করে মাহরুরের সামনে দাড়াতেই প্রশ্ন করে মাহরুর,

“চাচা কই?”

“চা পাতা আনতে গেছে সামনের দোকানে। আইসা পড়বো।”

“আচ্ছা”

চোখ জোড়া চন্দ্রের দর্শন পেতে শুষ্ক হয়ে উঠলো। কাল রাতেইতো দেখেছে।এই নির্লজ্জ চোখের কি পোষায় না?তারই মধ্যে রমজান সাহেব এসে হাজির।স্ত্রীর হাতে চা পাতা ধরিয়ে দিয়ে এসে বসলো মাহরুরের পাশে।

“আর কিছু খাবি বাজান?”

“না চাচা। চা খাবো শুধু”

“আচ্ছা”

হাত মুছে রমজান সাহেবের দিকে পূর্ন দৃষ্টি রেখে মাহরুর বলে,

“আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো চাচা।”

“হ্যা বল”

“আপনি অনুমতি দিলে আমি চাচ্ছি চন্দ্রকে ঢাকা ফিরিয়ে নিয়ে যাবো।এখানে আসলে!…. কি বলবো?গ্রামের পরিবেশ ভালো না। মিষ্টি ছোট এমন নিম্নমানের মানুষের সাথে থেকে ওর মনে ভালো প্রভাব পড়বে না”

রমজান সাহেব আশ্চর্য্যের চরম সীমায়।এইতো দুইমাস হলো দিয়ে গেছে। আবার নিয়ে যাবে?নিশ্চয়ই এর পেছনে বিশেষ কারণ আছে।

“কেন মাহি?কোন পরিবেশ ভালো না?”

মাহরুর এক এক করে বিগত দুইমাসের ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা বলে যাচ্ছে। শওকত তাকে খবর দিয়েছে সবই।যা রমজান সাহেব এর অজানা।জহিরের ব্যপারেও বলেছে। মাহরুরের কথায় চোখ কপালে। এসবতো কিছুই জানে না সে।মল্লিকা তাদের কিছুই বলেনি।

চিন্তিত মুখে বললেন, “মাহি ঢাকায় আমি আমার মাইয়ারে ওই নরকে আবার পাঠাবো না।লাগলে আমরা গ্রাম ছাইড়া দিবো।”

“না চাচা এমন কিছুই হবে না।”

“তাইলে?তাইলে কি করবো? এভাবেতো আমার নাতনি আর মাইয়া দুজনের জন্যই চিন্তার বিষয়।আমার মাইয়াটা কি একটু শান্তি পাইবো না?যেদিকে যায় ওদিকেই এত ঝট ঝামেলা।”

“চাচা উপায় আছে”

“কি?”

এক বুক সাহস নিয়ে মাহরুর বলে উঠে, “আমি…আমি চন্দ্র আর মিষ্টির দায়িত্ব নিতে চাচ্ছি”

এক থমথমে নীরবতা বয়ে গেছে ঘরে।ফরিদা বেগমও চা দিয়ে দাড়িয়ে। শ্রবণইন্দ্রিয় সজাগ করে দাড়িয়ে থাকা মল্লিকাও স্তব্ধ।তার মতে ভীষণ সাহসিকতা দেখিয়ে ফেলেছে। অবলীলায় বিধবা মেয়ের দায়িত্ব চেয়ে বসলো বাবার কাছে। রমজান সাহেব এর মুখ অন্ধকারাচ্ছন্ন।

অনেকটা সময় নেন নীরবে।এই মাহরুরের জন্যই তার মেয়েটাকে ভাবি কথা শুনায়।মার খাইয়েছে।ওর ছোট্ট মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল।

রমজান সাহেব সরাসরি জানালেন,

“এটা সম্ভব না”

অকস্মাৎ কাতর হয়ে উঠে মাহরুর।চাচার হাত টেনে বললো, “কেনো সম্ভব না চাচা?আপনার মেয়েটা একটা ভালো জীবন প্রাপ্য না?মিষ্টির মাথায় বাবার ছায়া দরকার না চাচা?আমিতো আপনারও ছেলে।কোলে পিঠে মানুষ করেছেন।আমি কি যোগ্য না আপনার মেয়ের?নাকি এখনো আমার আর মার উপর অভিমান করে আছেন?”
“ব্যাপারটা সেটা নয় মাহি।আমার কোনো রাগ অভিমান নেই তোর আর ভাবীর প্রতি।আর আমি জানি তোর উপর দিয়ে কি গেছে।ভাবি গেলো। হিরাও তোকে ছেড়ে গেলো।আমার মনে হয় তোর জীবন নিয়ে আলাদাভাবে ভাবা উচিত।আমরা আছি আমার মেয়ের জন্য।”

রাগ নেই,অভিমান নেই কিন্তু মনে একটা চাপা কষ্ট আছে।বাবা মায়ের মন কাতর তার সন্তানের জন্য।ওই অল্প বয়সে কতটুক কষ্ট পেয়েছিলো?এরপর আর সুখের আলো দেখেনি। মাহরুর সামনের টেবিল সরিয়ে নেয় এক ঝটকায়। রমজান সাহেব এর পা জড়িয়ে ধরলো। টলমলে চোখ নিয়ে বললো,

“আমাকে আমার ভুল শুধরে নিতে দিন চাচা।পায়ে পড়ি আপনার। বিলাসিতা না দিতে পারি।সুখে রাখবো আপনার নাতনি আর মেয়েকে।”

“কি করছিস মাহি।পা ধরছিস কেনো?উঠ।উঠ বলছি”

“না চাচা আপনি রাজি না হলে আমি এক পা নড়বো না”

শক্ত পুরুষের চোখ বেয়ে জ্বল ঝরতে দেখে রমজান সাহেব।বাচ্চাদের মতন আবদার করছে। কাকুতি মিনতি ভরা তার চাহনি।হাত এগিয়ে পা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

“মল্লিকা রাজি হবে না বাজান।তুই কাঁদিস না।”

“আপনি বলেন ওকে।আপনার কথা ফেলবে না ও ”

“আমি আপনাকে বিয়ে করবো না।কিছুতেই করবো না”

আরো একটি কন্ঠস্বর শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে চায় মাহরুর এবং রমজান সাহেব দুজনেই। মাহরুরের লালচে মুখ দেখে বাকি কথা যা ভেবে চিন্তে এসেছিল সেগুলো গুলিয়ে গেলো।ঠিক এই কারণেই তার থেকে দূরে থাকার প্রয়াস করে মল্লিকা।তার মুখ,তার গলার স্বর সবটাই চম্বুকের মতন টানে। অন্তরাত্মায় কম্পন ধরায়।এত বড় একটা লোক কেঁদেকেটে মুখ লাল করেছে।ঠোঁট চেপে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে।ঘরে দৌড় লাগালো মল্লিকা।এখানে থাকলে দম আটকে যাবে।
বাড়িটা নীরব। মাহরুর আছে কিনা চলে গেছে বোঝা যাচ্ছে না।

নিজেকে ঘরবন্দী করেছে মল্লিকা।নিজেকে একাকীত্বে কিছুক্ষন সময় দিতেই এই পন্থা অবলম্বন করে।হৃদয়ে অদৃশ্য ঝড় চলছে। ধুকেধুকে মনে পড়ছে সব। দুমড়ে মুচড়ে আসছে।কখনো রাগ কখনো অভিমানে জর্জরিত মন। জানালায় ‘ ঠকঠক ‘ আওয়াজে চোখ মুছে মল্লিকা।উঠে গিয়ে মেলে দিলো জানালা।সম্মুখে মাহরুর দাড়িয়ে।

মল্লিকাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে বললো, “বিয়ে করবি না?”

“না” সোজাসুজি উত্তর দেয় মল্লিকা।

“এক সময়তো পাগল ছিলি আমার জন্য।”

“এখন সময় বদলেছে।”

“ক্ষমা করে দে চন্দ্র?একটা সুযোগ দে?”

ফুলে উঠেছে মাহরুরের মুখ।এতটা ব্যাকুল কেনো সে?কেনোই বা উতলা হয়েছে বিয়ে করার জন্য?নিজেকে সামলে মল্লিকা বললো,

“যখন সময় ছিলো তখন আমাকে ফেলে চলে গেছেন।আজ এসেছেন কেনো? দয়া দেখাতে?একা নারী আমি , একটা মেয়ের মা। সহানুভূতি দেখাতে এসেছেন?আমি বিয়ে করবো না।ধরে নিজ আপনার তালাক হয়নি।ধরে যেন মিষ্টির বাবা বেচে আছে। আগে আমাদের জীবন যেমন চলছিলো তেমনি চলুক ”

মলিন মুখে হাসলো মাহরুর বললো, “কেনো আমার ডিভোর্স হলো?কেনো মিষ্টির বাবা হুট করেই মারা গেলো?যেখানে ভাগ্য আবার সুযোগ দিচ্ছে তুই কেনো ফেলে দিচ্ছিস।দেরিতেই না হয়।আরেকবার জীবন সুযোগ দিয়েছে আমাদের।চন্দ্র নতুন করে শুরু করি সব?”

“সম্ভব না।”

“তুই চাইলে সম্ভব।”

“আপনি পাগল হয়ে গেছেন!” রাগ দেখিয়ে বললো মল্লিকা।

“সত্যি বলেছিস।পাগল আমি বিগত ছয় বছর যাবতই।যেদিন থেকে উপলদ্ধি করেছি তোর মতই তোর আমার জন্য ভালোবাসা শুদ্ধ ছিলো। খাঁটি ছিলো।না চাইতেই পেয়ে গিয়েছিলাম তাই কদর করতে পারিনি।এই পাগলামি তুইই থামাতে পারবি।আমার তোকে প্রয়োজন!ভীষণ প্রয়োজন।”

কান্নার জোর বাড়ে।হেঁচকি তুলে চন্দ্র বলে, “আমাকে আবার দুর্বল করবেন না।”

“আর আমি যে তোকে প্রতিনিয়ত চোখের সামনে দেখে দুর্বল হয়ে পড়ছি?তোকে ভেবে,কল্পনা করে?আমি স্বার্থপর!আমি খারাপ।ভালো হওয়ার সুযোগটা দে।শেষ বয়স পর্যন্ত সাথে থাকবো চন্দ্র।চল আমার চিলেকোঠার ছোট্ট সংসারে।নিজেকে পরিবর্তন করবো তোদের দুজনের মোতাবেক।এবার আমি কথা রাখবো চন্দ্রমল্লিকা।”

___

সময় পেরোচ্ছে চন্দ্রমল্লিকার উত্তরের আশায়। দুঃসাধ্য সাধন করতে উদ্যমী।নিজের মধ্য অল্প অল্প করে সাহস জুগিয়ে এসেছে এখানে। চিন্তাধারার প্যাচেও পড়েছে বহুবার।কি ভুল,কি সঠিক সেটা ভাবতেই সময় নিয়েছে।এখন আবার সময় নিচ্ছে তার চন্দ্র।কিন্তু অনিশ্চিত।উত্তর তার পক্ষে আসবে কিনা জানা নেই।উত্তর দেবে কিনা সেটাইতো অনিশ্চিত।জানালায় বেহায়া প্রেমিকের মতন এসে দাড়িয়ে থাকলেও জানালা খুলে দেয়না।নিজের করে পাওয়ার আশায় না হারিয়ে ফেলে আবার।অনুপমের ন্যায় কল্যাণীর পথ চেয়ে মাহরুর।তার মতই খালি হাতে যদি ফিরতে হয়?

“মা? ও মা? তুমি খাচ্ছো না কেনো?”

ধ্যানমগ্ন চন্দ্রের হুশ ফিরে।ভাত মেখে অন্য জগতে হারিয়ে গিয়েছিল।মেয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে বলে, “খাবো।তুই খা আগে”

“মা?”

“হুম?”

“মামাকে বলবে আমাকে মেলায় নিয়ে যেতে?আমি পুতুল কিনবো”
“মিষ্টি?তোকে না বলেছি এভাবে কাউকে বিরক্ত করতে নেই?চুপচাপ খা।আমি নিয়ে যাবো মেলায়।”

“আচ্ছা মা”

রোজই আসে মাহরুর।জানালার দ্বারে দাড়ায়।ঘরে ঢুকে না।ভয়ে ভয়ে এখানে দাড়ায়।কেউ দেখলে কানাঘুষাতো করবে অবশ্যই।কিন্তু তার চেয়ে বেশি চন্দ্রের উত্তর প্রয়োজন। কর্ণকুহরকে প্রসন্ন করা রাজিনামা প্রয়োজন।কিন্তু সে ধরা দিলে না? বারবার ফিরিয়ে দিচ্ছে।এত রুষ্টতা এলো কিভাবে চন্দ্রের মধ্যে?আজও ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলো তার মধ্যে কয়েকজন এসে ঘেরাও করে ধরলো তাকে।কিছু মানুষকে পরিচিত মনে হচ্ছে।রাব্বি মিয়ার লোক।আর বাকিরা অপরিচিত।

পরিচিত একজন এগিয়ে এসে জানতে চাইলো, “কবে এসেছো গ্রামে?”

“তিনদিন হলো এসেছি”

“ঢাকায় কি চাকরি করো?”

“আপনারা এসব প্রশ্ন করছেন কেনো?”

রহস্যময় হেসে লোকটি বললো, “না এমনেই। তোমারতো দেখা মেলে না এখন আর।অনেকদিন পর দেখলাম তাই আরকি।”

“আচ্ছা আমি আসি”

“দাড়াও! তোমাকে রাব্বী চাচা দেখা করতে বলছে।”

মুখ কালো করে মাহরুর জানতে চাইলো, “আমাকে দিয়ে ওনার কি কাজ?”

“আছে হয়তো কোনো কাজ।চলো আমাদের সাথে।”

মাহরুরের মধ্যে খানিক সন্দেহ কাজ করে।কোনোভাবে জেনে গেলো নাতো?তার ছেলেকে হসপিটালের পাঠানোর পেছনে যে মাহরুর দায়ী। কারোইতো জানার কথা নয়।সময় সুযোগ বুঝে আচ্ছামত ধোলাই দিয়ে এসেছে।আর যেনো তার নিকৃষ্ট দৃষ্টি চন্দ্রের দিকে না দিতে পারে। মাহরুর ভেবে চিন্তে তাদের সাথে চলে গেলো।জানালা ছেড়ে দৌড় লাগায় মল্লিকা।বাবার কাছে গিয়ে হাপিয়ে বলতে লাগলো।

“আব্বা মাহি ভাইরে রাব্বী চাচার লোকেরা নিয়া গেছে।আব্বা একটি গিয়ে দেখো।”

“কেনো নিয়ে গেছে?ওকে দিয়ে কি কাজ?”

“আব্বা কেনো নিয়ে গেছে এটা পড়ে শুনো আব্বা।তুমি ওদের পিছনে যাও।”

কান পেতে বসে থাকার স্বভাবটা এখনও পাল্টে নি মল্লিকার। শ্রবণশক্তি প্রখর।এই শক্তিটা বেশিরভাগ সময় কাজে না লাগলেও আজ লাগছে।ভীত, আতঙ্কিত মুখখানা।সেতো জানে কি হতে পারে সেখানে। জহিরকে মেরে তক্তা বানিয়েছে। ভ্রানাক্ষুরেও যদি টের পায় রাব্বী মিয়া?ঠিক প্রতিশোধ নেবেন।রমজান সাহেবও পায়ের গতি বাড়িয়ে পিছু নিলো।

রাব্বী মিয়ার পাশেই বসে আছে মোতালেব হোসেন।তার প্রাক্তন স্ত্রীর বাবা।তার প্রাক্তন শশুর।ঢাকায় থাকেন আলিশান বাড়ি বানিয়ে।মেয়ের কর্মকাণ্ডও নিশ্চয়ই জানেন।নাহয় বাবা ব্যতীত বিয়ে করার সাহস পায় কী করে? মাহরুর বসলো রাব্বী মিয়ার সামনে।

রাব্বী মিয়া সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, “তিনদিন আগে ভোররাতে আমার গ্যারেজের দিকে কি করছিলে?”

সরাসরি মিথ্যে জবাব দেয় মাহরুর, “ঢাকা থেকে সেদিন সকালেই ফিরেছি আমি।তবে সেটা ভোররাতে নয়।”

“কয়টায় এসেছো?”

“আটটায়।”

“তাহলে ফারুক কি তোমার প্রতিচ্ছবি দেখলো ভোররাতে?”

“হয়তো দেখেছে।আমি আটটায় ফিরেছি।”

“ওয় সত্যি বলছে রাব্বী ভাই।আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসছি ওরে বাস স্ট্যান্ড থেকা। আপনাগো গ্যারেজতো বাস স্ট্যান্ডের উল্টাপাশে।মাহি ওদিকে কি করে যাইবো?”

বলতে বলতে এগিয়ে আসলেন রমজান সাহেব।তার কথায় মাহরুরকে যাওয়ার অনুমতি দিলেও দৃষ্টি তার সন্দিহান।একটা শক্তপোক্ত প্রমাণ পেলেই হয়।যাওয়ার পথে মোতালেব হোসেন ডাকলেন।হয়তো পুরোনো সম্পর্কের দায়ে কুশল বিনিময় করতে চাচ্ছিলেন।মাহরুর পরিপূর্ণভাবে তাকে এড়িয়ে গেছে।

“ঢাকায় ফিরে যান।এখানে আপনার বিপদ।সন্দেহ করেছে যেহেতু আপনার পিছু এত সহজে ছাড়বে না”

রাতের আকাশে নক্ষত্রের মেলা।তারই নিচে সমতল ভূমিতে দাড়ানো অবাধ্য রকমের পুরুষ।তার চন্দ্রের চিন্তিত মুখ দেখে সস্তি’নুভব হলো।গাম্ভীর্য বজায় রেখে জানতে চাইলো,

“তোর চিন্তা হচ্ছে?”

অভিমান জমতে জমতে রুঢ় চন্দ্রমল্লিকার মুখখানা।অলস নেত্র মাহরুরের দিকে ছুঁড়ে বললো, “চিন্তা হবে কেনো?”

“তাহলে কেনো বলছিস চলে যেতে?আমার বিপদ হলে তোর কি?মেরে ফেলুক আমাকে।এক কাজ করি নিজেই যাই সবটা সত্যি সত্যি বলে দিয়ে আসি?”

“ইচ্ছে করে করছেন এসব?”

আবেগের বশবর্তী হয়ে মাহরুর ভিন্ন প্রশ্ন করে, “ভালোবাসিস আমায়?”

থতমত খায় মল্লিকা।আরেকবার ভালোমত দেখে নেয় সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে।এটা কোনোভাবে মাহরুর ভাই হতেই পারেনা।তার কথা বলার ধরন এমন নয়।সরল,শান্ত মানুষ।এখন উদ্ভট পাগলামো করছে।

“বাসি না”

“মিথ্যে বলছিস!সরাসরি মিথ্যে বলছিস তাও আমাকে।আমি তোকে সেই ছোটোবেলা থেকে চিনি চন্দ্র। আমার চোখে ধুলো দিবি?…. যাই হোক! কাল সকাল অব্দি সময় আছে তোর কাছে।ভেবে দেখ।দুপুরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হব।আর ফিরবো না কোনোদিন।কক্ষনো না!”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-১৩+১৪

0

চন্দ্র’মল্লিকা ১৩ + ১৪
লেখা : Azyah_সূচনা

“আমাকে চিনতে পেরেছিস?এককালে তোর জীবনে শশী নামের একজন ছিলো।তোর সখী ছিলো।আজ,এই মুহূর্তে খুব অপরিচিত মনে হচ্ছে তাই না?”

তীর্যক বাক্যসমূহ। রোষাবেশে পরিপূর্ণ।সামনে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে পুরোনো দিনের বন্ধুত্ব মনে পড়ছে।তার একজন ছোটবেলার বন্ধু ছিল সেটা বুঝি ভুলতে বসেছে।

মল্লিকা এগিয়ে আসে।জড়িয়ে ধরবে বলে।শশী থামিয়ে দেয় তাকে।আক্রোশ দেখাচ্ছে। দেখানোও জায়েজ।অন্তত তার সাথে যোগাযোগ করা উচিত ছিল।

“তুই আসবি বলে নিজের ঘর সংসার ফেলে এসে গেছি একদিনে।তোর বিয়ের দিন তোকে আমার নাম্বার দিয়েছিলাম।ওই নাম্বারটা এখনও খোলা আছে।মন বলতো একদিন কল করবি। তা আর হলো কই?তুইতো স্বার্থপর লোক মল্লিকা!”

নরম হৃদয়ে বিধেছে কথা। ঝরঝর করে কেদে ফেলে।শশী?এই বদলে যাওয়া মেয়েটা শশী?কান্না দেখে শশীর শক্ত হয়ে থাকা মুখটা একটু স্বাভাবিক হয়।তারপরও রুষ্টতা আছে এখনও।

মল্লিকা আবার এগিয়ে এসে বললো, “মাফ করে দে। পরিস্থিতি এমন ছিলো যে আমি আমার বাবা মার সাথেও ঠিকঠাক কথা বলতে পারতাম না।”

“বলে না তাড়াহুড়োর কাজ শয়তানের।তোর ক্ষেত্রেও তাই। মাহি ভাইয়ের উপর অভিমান করে না জেনে না বুঝেই এমন একজনকে বিয়ে করেছিস!দেখ কি হলো তোর জীবনে?”

“তুই কি করে জানলি?”

“চাচী মাকে বলেছিলো।আমি মায়ের কাছ থেকেই জেনেছি”

এবার বাধা দেয়নি। নির্দ্বিধায় জড়িয়ে ধরলো মল্লিকাকে।দুজনেই কেঁদে এতদিনের বিচ্ছেদের আপোস মিটিয়ে নিচ্ছে। শশীর পাশেই একটা ছোট্ট ছেলে দাড়িয়ে। মান অভিমানের পালা মিটিয়ে চোখ যায় তার দিকে।বুঝতে দেরি করেনি মল্লিকা।এটা তার শশীর ছোট পুঁচকে।
মল্লিকা ঝুঁকে বসেছে। গালে আদর দিয়ে জানতে চাইলো, “কি নাম গো তোমার?”

“সীমান্ত”

“বাহ্ বেশ সুন্দর নাম।আমি কে জানো?”

“মল্লিকা খালামণি।”

চক্ষু কপালে উঠেছে মল্লিকার।চট করে বলে ফেলে সীমান্ত।কি করে চিনলো তাকে?আনন্দে আটখানা।অন্যদিকে শশী মিটিমিটি হাসছে।
মল্লিকা বললো, “এ বাবা?তুমি আমাকে কি করে চিনলে?”

“মা আমাকে তোমার ছবি দেখিয়েছে।বলেছে তুমি নাকি মার সবচেয়ে প্রিয় সখী। মানে বন্ধু।তোমার গল্প শুনেছি।”

চওড়া হাসি ফুটে উঠেছে মল্লিকার ঠোঁটে।কি সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা।পুরোটাই যেনো শশীর চাপ। শওকত ভাইও বিয়ে করেছে।তার ঘরেও সন্তান আছে। মেয়ে সন্তান।মিষ্টি দৌড়ে এলো।অজ্ঞাত দুজনকে দেখে মায়ের ওড়না চেপে পিছনে দাড়ায়।

মল্লিকা মিষ্টিকে দেখিয়ে সীমান্ত এর উদ্দেশ্যে বললো, “দেখো সীমান্ত এটা তোমার মল্লিকা খালামনির মেয়ে।তোমার বোন”

ফোড়ন কাটে শশী।মিষ্টিকে কোলে তুলতে তুলতে বললো, “খবরদার বোন বানাবি না।ওকে আমি আমার ছেলের বউ করবো।”

“তোর ছেলের বয়স কত রে?”

“তোর বিয়ের সময় সীমান্ত আমার পেটে ছিলো।কিন্তু তোকে ওই সংবাদ দিতেই পারিনি।আমিও জানতাম না।সেই হিসেবে আমার সীমান্ত তোর মেয়ের বড়ো।তাই তাদের বিয়েতে বয়সের সমস্যা হবে না।”

বলে হেসে উঠে শশী।তার সাথে মল্লিকাও।বোকার মতন মিষ্টি আর সীমান্ত একে ওপরের দিকে চেয়ে।কি বলছে তাদের মায়েরা?সবতো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।সেখানে কান দিলো না তারা।দুজনের সাথে পরিচিত হতে লাগলো।এতখন যাবৎ আড়ালে চন্দ্রের বাধাহীন হাস্যোজ্জ্বল মুখটা গভীর নয়নে পর্যবেক্ষণ করছিলো মাহরুর।অজান্তে নিজেও হেসেছে। কেমন অদ্ভুত সস্তি আছে এই হাসিতে। গুঞ্জনে শীতল করতে হৃদয়।

“ছেলে মেয়ের বিয়ের প্ল্যান চলছে?”

অপ্রস্তুত শশী আর মল্লিকা।পিছু ফিরে তাকায়। মাহরুর তাদের দিকেই আসছে।মল্লিকার হাসি মিয়ে যায়।অন্যদিকে শশী বুঝতে পারলো না কি প্রতিক্রীয়া দেবে?কুশল বিনিময় করবে নাকি এড়িয়ে যাবে তার সখীকে ধোঁকা দেওয়ার দায়ে।

“কেমন আছিস শশী?”

“ভালো মাহি ভাই।আপনি?”

“আছি..”

এই উত্তরটাইতো দেয় মাহরুর। ‘ আছি ‘ অর্থাৎ আছে কোনরকম বেচে।না থাকার মতন করেই।তিনজনের মধ্যে অদ্ভুত নীরবতা বয়ে গেলো।সঠিক সময়ে বেখাপ্পা পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে আগমন ঘটে রমজান সাহেব এর।

এসেই মাহরুরের উদ্দেশ্যে বললেন, “মাহি? কাল খেতে আসলি না কেনো?”

“কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম চাচা।এই একটু আগে ঘুম ভেঙেছে।”সরাসরি মিথ্যে উত্তর দেয় মাহরুর।

“আচ্ছা..আয় ভেতরে আয়।এই শশী তুইও আয়।কতদিন পর এলি এই বাড়িতে।”
___

ইচ্ছের বিরুদ্ধে জীবনযাপন করতে হয়।দিনের পর দিন ইচ্ছের বিরুদ্ধেই করে আসছে।এইযে এখন?একবিন্দু ইচ্ছে নেই ঢাকা যাওয়ার।যেদিকে এই গ্রামীণ পথ ভুলে বসেছিলো।এখন থাকতে চাইছে।কারণ চন্দ্র।একমাত্র চন্দ্রমল্লিকা।তাকে নিজের করেতো এই জীবনে পাওয়া হলো না।হবে না।একটু দেখেই নাহয় শান্তি অনুভব করা যেত?তার হাসি,তার নতুন জীবন,বাবা মায়ের সাথে আনন্দে ভরা সময়গুলো।নিজের চোখের ফ্রেমে আবদ্ধ করে রাখতো?

শশী বাড়ি ফিরে গেছে। মাহরুর এখানেই।ফিরবে একটু পরে।বাস রাত নয়টায়।তখনই ছুটবে ঢাকার উদ্দেশ্যে।আবার জীবন চলবে নিরসভাবে।মনে করে তার চন্দ্রকে ধুকেধুকে মরবে। ফেসবুক ব্যবহার করেনা এমন মানুষ কমই আছে।এর মধ্যে মাহরুরও ছিলো।নিজেকে গেঁয়ো ভাবতো!ভাবতো এসব শহুরে মানুষের ব্যবহার্য জিনিস।তবে প্রয়োজনের তাগিদে সেও এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।সেখানেই চোখে পড়লো বিরাট আয়োজন।এলাহী কান্ড!ঢাকার নামকরা কমিউনিটি হলে বিয়ে হচ্ছে।আর বিয়ের পাত্রী তারই সাবেক স্ত্রী হিরা। এতদিনে বোধহয় চলেও গেছে কানাডা?আকষ্মিক রাগ মাথা চড়া দিয়ে উঠলো।ফোনটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েও আটকে যায়। মধ্যবিত্তের এসব জেদ মানায় না। দ্রুত হাতে ব্লক অপশনে ক্লিক করে চিরতরে বিদায় করেছে হিরাকে। ফোঁসফোঁস করতে থাকা মাহরুরের চোখ যায় তার আনা কাপড়গুলোর দিকে।চন্দ্র আর মিষ্টির জন্য এনেছিল।ছুঁয়েও দেখেনি সে?উল্টো আলাদা করে দূরে রেখে দিয়েছে।যেনো ফেলনা জিনিস?

ফরিদা বেগম এর চলে যাওয়ায় সুযোগ বুঝে মাহরুর বললো, “কাপড়গুলো ফেলে রেখেছিস কেনো?”

সময় নিয়ে মল্লিকা উত্তর দেয়, “আমার এসবের দরকার নেই।ঘরে পুরোনো কাপড় আছে।
“তুই আগের কাপড় পড়বি?গায়ে আসবে?আর মিষ্টিকে কি পড়াবি?তোর পুরোনো কাপড়?এগুলো যে কিনে আনলাম?তুই বলছিস তোর লাগবে না। আগেতো যে উপহার দিতাম সাদরে গ্রহন করতি।”
কণ্ঠের পরিবর্তনে বিষম খায় মল্লিকা।চোখে মুখে মৃদু রাগের আভাস।নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই মল্লিকা বললো,

“আগের দিন নেই”

“আর আমি আগের মাহরুরও নই।বদলে গেছি।আর অনুভূতিহীন যন্ত্র না আমি”

কথার অর্থ বুঝেছে?একটু একটু অবশ্যই বুঝেছে মল্লিকা।সেতো এখন আর কিশোরী নয়।না বলে বোঝালো তার মধ্যে অনুভূতি আছে। প্রখর অনুভূতি। মাহরুর লুকিয়ে মানিব্যাগটা বের করে।সেখান থেকে চন্দ্রের সেই ছবিটা বের করে এগিয়ে দিলো।

বললো, “চেয়েছিলি আমার কাছে। বলেছিলি ছবিটা বাঁধাই করে দিতে। প্রিন্ট করে রেখেছিলাম!কিন্তু তোকে পাইনি দেওয়ার জন্য।নে!”

একের পর এক চন্দ্রকে অবাক না করলেই নয়। ছবিটা হাতে নিয়ে বিস্মিত হয়।এটা সেদিনের ছবি যেদিন মাহরুর নতুন ফোন কিনেছিল। সর্বপ্রথম ছবিটা তারই তুলে। পিঠা খাওয়াতে খাওয়াতে আবদার করেছিলো যেনো ছবিটা বাঁধাই করে রাখে। স্পষ্ট মনে আছে তার।কথা রেখেছে মাহরুর।এই ছবিটা বুঝি ছয় বছর সাথে নিয়ে ঘুরেছে?বেশ পুরোনো দেখালো।

“ছবিটা রাখবি নাকি ফেরত দিয়ে দিবি?”

নিজের পুরোনো রূপটা দেখে বেশ ভালোই লাগছিলো মল্লিকার। প্রানবন্ত মুখ।হারিয়ে গেছে এখন বাস্তবের চাপে। মাহরুরের কথায় উল্টো প্রশ্ন করে বসে মল্লিকা, “রাখবো?”

“তোর ইচ্ছে।”

নাদান মুখ নামিয়ে মল্লিকা বললো, “রেখে দেই?”

“রাখ”

আগের কথা তুলতে চায়না।কিন্তু কৌতুহল থাকে মানুষের অন্তরে অন্তরে।জানতে চাচ্ছে ফারহানের মৃত্যুর কারণ। জানাটা প্রয়োজন।গলা পরিষ্কার করে মাহরুর প্রশ্ন করে, “আমাকে বলবি ফারহান কি করে মারা গেলো?….না মানে শুনেছি হুট করে মারা গেছে।”

বিষাদভারাতুর মুখে মল্লিকা বলে, “জেনে কি করবেন?”

“কিছু করার আছে?নেই! শুধু জানতে চাইছি।”

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উত্তর আসে, “রাতে বাড়ি ফিরছিলো।ছিনতাইকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে। হাতাহাতি করলে এক সময় ছুরি চালিয়ে দেয় বুকে”

শেষ কথা বলে কেপে উঠলো চন্দ্র। চোখে পড়েছে মাহরুরেরও।তবে কিছুটা সত্য সেও জানে।বাড়ি ফেরার পাশাপাশি নির্ঘাত নেশাগ্রস্ত ছিলো। প্রতিরাতে তাকে ওই এলাকায় মাতলামি করতে দেখা গেছে।নতুন কিছুই নয় এটা।কিন্তু মৃত মানুষ আর চন্দ্রের অবস্থা দেখে কথা বাড়ালো না মাহরুর।

“আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি চন্দ্র?”

“কিহ প্রশ্ন?”

“ভালোবেসেছিলি ফারহানকে কখনো?কোনো একটা মুহূর্তে?”

কঠিন হয়ে মল্লিকা জবাব দেয়, “আমার সন্তানের বাবা সে। অবশ্যই ভালোবাসতাম তাকে।”

চন্দ্রের কথার ধাঁচেই মাহরুর উত্তর দেয়, “মায়া বলে সেটাকে।ভালোবাসা না”

“হুম। আপনার চেয়ে ভালো এটা আর কেই বা বলতে পারবে।”

মাহরুরের মুখের বাক্যরা তেড়ে আসছিলো। যথাযথ উত্তর দিতে যাচ্ছিলো।এর আগেই থামিয়ে দেয় মল্লিকা।কপাল কুঁচকে বলে উঠলো, “আমি এসব ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছি না মাহি ভাই।”

একে অপরের দিকে প্রশ্ন উত্তর ছুড়াছুড়ি সমাপ্ত হয়। সময়ের ঘাটতি।রওনা হতে হবে মাহরুরকে।অবাধ্য,বেহায়া মনের বোঝা বয়ে টেনে নিয়ে যেতে হবে সেখানে। ভুলিয়ে ফুঁসলিয়ে মন জানতে চাইলো চন্দ্র কি তাকে আটকাবে? বলবে আরেকটু থেকে যেতে?এত সরাসরি নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।একেক সময় একেক গান গায় হৃদয়।এভাবে ডুবেছে চন্দ্রমল্লিকায়?তার অপ্রাপ্তি তারই শাস্তি।ভোগ করতে থাকুক বিষাদে।

ব্যাগ কাঁধে তুলে বললো, “আসি”

মিষ্টি মাহরুরের হাত টেনে বলে উঠে, “মামা চলে যাবে?আরেকটু থাকো”

মা না হোক।মেয়ে ঠিকই মাহরুরের সুপ্ত ইচ্ছের পূর্ণতা দিয়েছে।তাকে কি করে বলবে সেও থাকতে চায়।কিন্তু সম্ভব না। মাহরুর ছোট মিষ্টিকে বললো,
“আবার আসবো মামা।তুই ভালোমত থাকিস।দুষ্টুমি করিস না।”

“আমি দুষ্টুমি করি না মামা।”

“এইতো ভালো মেয়ে।আসি”

মল্লিকা ভাবলেশহীন।মূর্তির মতন দাড়িয়ে আছে।এক পলক দেখে নিলো তাকে।তবে মন ভরলো না।এই স্বাদ মিটবে না আজন্ম দেখেও।মনে মনে ভাবলো এই পুরুষের মনে তুই যে ঝড় তুলে দিলি? থামাতেও আসলি না। সারাজীবন বোধহয় এটাই বুকে দিয়ে বাঁচতে হবে।আবার কবে না কবে আসা হয়।এখন বারবার গ্রামে আসলে লোকে কেনো বাড়ির মানুষই সন্দেহের চোখে দেখবে। মাহরুরের দৃষ্টিকে কুৎসিত বলে আখ্যা দিবে।এই উপায়টাও নিজের হাতেই মাটিচাপা দিয়েছে।কেনো আসবে বারবার?কি করতে?

দরজায় দাঁড়িয়ে রমজান সাহেব এর হাতে কিছু টাকা গুজে দেয়।বলে, “মিষ্টিকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েন চাচা।এখন ওর পড়ার বয়স।”

“বাপ!আমার ব্যাংকে কিছু টাকা রাখছি।ওই টাকা দিয়েই হইবো।তুই এত চিন্তা করিস না।”

“চাচা!আম্মা থাকতে আম্মার জন্য করতাম।এখন আপনারা আমার মুরব্বী।আমার দায়িত্ব আছে।আব্বার মতইতো আপনিও।”

“তারপরও মাহি তুই আর কত করবি?তোর একটা ভবিষ্যৎ আছে।বউ আছে।সংসার আছে।”

“নাই”

“মানে?”

“কিছুনা চাচা।টাকাটা রাখেন।ভালো থাকেন আর কোনো দরকার পড়লে কল দিবেন।”

“আচ্ছা বাবা সাবধানে যাস। ফিয়ামানিল্লাহ”

যেভাবে এসেছিল ঠিক সেইভাবেই ফিরে যাচ্ছে।শুধু পাশের সিটে শূন্যতা। অদ্ভুতভাবে পরিস্থিতি তার সাথে ঠাট্টা করেছে। বাসের মোটামুটি সব সিটে দুজন বসা। মাহরুরের পাশের সিটটাই খালি।তার একাকিত্বকে আঙ্গুল তুলে বারবার অনুভব করানো হচ্ছে।ভিন্ন দৃশ্য অম্বরেও। লুকোচুরি খেলছে চাঁদ মেঘের আড়ালে। সবই নিজেকে ঘিরে ধরে নিলো মাহরুর। তপ্ত নিশ্বাসের সাথে চোখ বুজে নেয়।

“সাধ্য থাকলে আজ,এই মুহূর্তে তোকে জরিয়ে নিয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতাম।কোনো আক্রোশ থাকতো না জীবনের প্রতি। শান্তিময় বিদায় হতো আমার”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা ১৪
লেখা : Azyah_সূচনা

“এই বয়সেই বিধবা হইলি।তোর জন্য মায়া হইতাছে মল্লিকা।কেমনে জীবন কাটবো তোর।আর তুইতো মাইয়ার মা।ছেলে হইলে একটা কথা। মায়েরে কামাই কইরা খাওয়াইতো।”

“সবই আল্লাহর ইচ্ছা চাচী।”

“কি যে হইবো ভবিষ্যতে।চিন্তা হইতেছে তোর জন্য।”

“দেখা যাক চাচী।”

মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে এসেছে।বেশ খুশি মল্লিকা,মিষ্টি দুজনেই।শওকতের সাহায্যে ভর্তির সকল কার্যক্রম পূরণ করে এসেছে।নিজে বেশি শিক্ষিত না হওয়ায় ভরসা যোগ্য একজনকে নিয়েই গেছে।অনেক পরিচিত মুখ দেখলো।একেকজনের একেক প্রশ্ন।স্কুলের পোশাকের মাপ দিতে গিয়ে রুনা চাচীর দেখা মেলে। হায় হুতাশ করছে মল্লিকাকে দেখে।

শওকত কথার ছলে বললো, “মেয়ে হইছেতো কি চাচী।আজকাল মেয়েরাও চাকরি করে।”

“হ কইছে!তোমাগো চোখ ফুটছে বোনরে বড়লোক জামাইর কাছে বিয়া দিয়া।বউরে পড়ায়,চাকরি করবার দেয়।কিন্তু শেষমেশ মহিলা মানুষের ঠায় ওই চুলার পাড়েই।”

“আমার বোন জামাই ভালো মানুষ।”

“এত আধুনিক হইতে হয় না আবার।”

শওকত ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ।বুঝলো এখানে কথা বাড়ানো অহেতুক।ছোট্ট উত্তর দিল, “হয়তো!আসি।চল মিষ্টি বাড়ি গিয়ে মিষ্টি খাই”

রুনার সইলো না। অগোচরে তাদের শুনিয়েই শওকতকে বললো, “নিজের ঘরের দিকে নজর দে শওকত।অন্যের প্রতি দরদ দেখাস না এত। ঘর টিকবো না।”

বেশ বাজে রকমের ইঙ্গিত করেছে সে। খুবই জঘন্য। শওকত রেগে গেলো।মল্লিকার পাশাপাশি সে আকার ইঙ্গিতে শওকতের চরিত্রেও আঙ্গুল তুলছে। শশী আর মল্লিকা তার বোন।আপন না হোক তার দিকে ভিন্ন নজর দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসেনা।পেছন ফিরে উত্তর দিতে চাইলে মল্লিকা থামায়।

বলে, “শওকত ভাই বাদ দেন।এদের সাথে কথা বললে নিজের সম্মান নষ্ট।”

“বাজে কথা বলছে মল্লিকা।”

“এবারের মতন বাদ দেন।আবার কিছু বললে জবাব দিয়েন।”

অন্যের জীবনের প্রতি মানুষের অনেক আগ্রহ।যেই উৎসাহ নিজের জীবন নিয়েও থাকেনা।অন্যের সমস্ত ব্যপারে নাক গলিয়ে বিশেষ ধরনের আনন্দ পায়।নিজের ঘর,নিজের সংসার ভেস্তে যাক।তাতে কি?অপরের কি করা দরকার সেটা সম্পর্কে উপদেশ দিয়ে চলেছে দিনের পর দিন।বয়স বাড়তে থাকলে মানুষের মধ্যে যেনো নূন্যতম বোধগম্যতার অভাব দেখা দেয়।সামান্য একটা কথাকে টেনে লম্বা করেই ক্ষ্যান্ত হলো রুনা বেগম।এসে হাজির হয়েছে শশীদের বাড়ি।নানা আলোচনা।মুখ্য বিষয় কথার ছলে খোচা দিবেন।

শশীর মা রোকেয়াকে বললেন, “নিজের পোলারে হাতে রাইখেন ভাবি।বউ রে কইয়েন দেইখা দেইখা রাখতে।”

রোকেয়া অবাক হয়।কি এমন হয়েছে?সাথে শওকতের স্ত্রী রাত্রিও এসে হাজির।তার সামনেই নিম্নতর মস্তিষ্কের পরিচয় দিয়ে বললো, “জুয়ান মাইয়া বিধবা হইছে।এখন অনেক পোলার চোখ পড়বো। মাইয়াও চাইবো নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা কইরা কারো না কারো ঘাড়ে ঝুইলা যাইতে।”

রাত্রি কপাল কুচকে জানতে চাইলো, “কি বলতে চাচ্ছেন চাচী?”

“আরেহ রমজানের মাইয়ার কথা কই।তোমার স্বামীরে চোখে চোখে রাইখো।বেশি মিশতে দিও না মল্লিকার লগে।কহন কি ঘটে?আজকা দেখলাম ওর মাইয়ারে স্কুলে ভর্তি করায় আইলো।আবার খাওয়াইছে ফুচকা, আইস্ক্রিম।”

রাত্রি মনে মনে রেগে উঠে। নোংরা কথা শুনে জেদ চাপছে।সে জানে তার স্বামী মল্লিকার সাথে গিয়েছিল।মিষ্টিকে ভর্তির কাজে সাহায্য করতে।চোয়াল শক্ত করে বললো, “আমি আমার স্বামীরে চিনি চাচী।আর আম্মার কাছে মল্লিকার সম্পর্কেও জানসি।আপনার এসব নিয়া মাথা ঘামানো লাগবে না।আপনি নিজের মেয়ের দিকে খেয়াল দেন।”

রুনা আরো অপমানিত বোধ করলেন।অন্যদিকে রোকেয়া নিশ্চুপ।উচিত উত্তরে সেও সায় দিলো বিনাশব্দে। মল্লিকাকে নিয়ে বাজে বকছে?সেতো তার আরেক মেয়ে।রুনা বেগম তেতে উঠেন। রোকেয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
“দেখছেন আপনার বউয়ের চোপা?লাগাম টানেন না?”

রোকেয়া বললেন, “ভুলতো কিছু বলে নাই?ওইদিন দেখলাম আপনার মাইয়া জহিরের লগে ঘুরতাছে মেলায়।”

শওকত স্ত্রীর কাছে রুনা বেগমের নিচু কর্মকাণ্ডের কথা শুনে হতভম্ব।ছোট্ট একটা বিষয়!অত বড়োও না। অপমানিত বোধ করার মতন করেও সে কিছু বলেনি তাকে।এই সামান্য কথা বাড়ি অব্দি বলেছে? রাত্রির দিকে চাইলো শওকত।হয়তো এখন সেও স্বাভাবিক ভাবেই নিচ্ছে কথাগুলো। কানাঘুষা হতে হতে একদিন সেও ঠিক বিশ্বাস করে নিবে।নারী মন।নিজের স্বামীর নাম অন্যের সাথে জড়ালেই কেলেঙ্গারী হয়ে যায়।রুনা বেগমকেও চেনা আছে।মুখের উপর উত্তর দেওয়ার দায়ে পুরো মহল্লা ছড়াবে। মিথ্যেচারিতায় লিপ্ত এই নারী।মানুষ তাকে সহ্য করতে না পারলেও তার বলা কথাগুলো শুনে বেশ মনোযোগ দিয়েই।পাঁচ ছয়দিন হয়েছে মল্লিকা এখানে আসলো।এতেই এই অবস্থা।বাকিদিন আছেই পড়ে।

“তুমি কি আমাকে ভরসা করো না রাত্রি? দীঘির দিব্যি মল্লিকা আমার বোন।যেমন শশী।এই মেয়েটা জীবনে অনেক কষ্ট দেখেছে।তাই বড় ভাই হিসেবে সাহায্য করছি।” মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল শওকত।

রাত্রি আশ্বাসের হাত বাড়িয়ে বললো, “কেনো চিন্তা করছো এত?আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।আর রুনা চাচী? ওনাকে বিদায় করেছি উচিত কথা বলে আমি আর আম্মা।আর এইদিকে নজর দিবে না।”

শওকত সস্তি পায়।তবে মাথার মধ্যে একটা চিন্তা রয়েই গেলো।মল্লিকা।তার নিজের বদনাম হবেনা।হবে মল্লিকার।বিনা দোষে ফেঁসে যাবে মেয়েটা।তার চরিত্রে কাদা ছুঁড়তেও এক সেকেন্ড সময় নিবে না পাড়ার লোকেরা।
__

দুইমাস পর,

একেবারেই পড়ালেখা জানে না তেমনটাও নয়।মেয়ের হাতেখড়ি শেখানোর মতন সামর্থ্য আছে মল্লিকার।প্রতিদিন স্কুলে আনা নেওয়া থেকে শুরু করে অনেকটা চঞ্চল হয়েছে।চলার পথে অনেকের অনেক রকম কথা শুনতে হয় বলে বোরকা পড়া শুরু করে মল্লিকা।অন্যদিকে মাহরুর আগেকার নিয়ম অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে কল করে খোঁজ খবর নেয়।তবে মল্লিকার সাথে কোনো কথা হয় না।সে কি জানে কতটা ব্যথিত সে?বুঝবে কি করে।আগে বিনা শব্দে কথা বুঝে যাওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে তার চন্দ্র। রুষ্ট হয়েছে। ইনিয়ে বিনিয়ে আর কত বোঝানো যায় মাহরুর কথা বলতে ইচ্ছুক?

ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পঁয়তাল্লিশ এ এসে হাজির। বারোটায় মিষ্টির স্কুল ছুটবে।বেরিয়ে দরজায় মাকে না দেখেই কান্না জুড়ে বসবে।ভয় পায় সেই ছোট্ট হৃদয়টাও।মাকে চোখের আড়াল করে স্কুলে বসতেই চায়নি।সাহস জোগাতে কাঠখড় পোহাতে হয়েছে মল্লিকাকে।বোরকা গায়ে দিয়েই পায়ের গতি বাড়ায় স্কুলের উদ্দেশ্যে।

“কিরে মল্লিকা?”

জহিরের গলার আওয়াজে থমকে দাঁড়ায় মাঝ রাস্তায়।পা ঝুলিয়ে ভ্যানে বসে আছে। মল্লিকাকে থামতে দেখে এগিয়ে এলো।বললো,
“কি অবস্থা তোর?”

“জ্বি… ভালো!”

“তোকে বোরকার আড়ালেও চিনে ফেললাম দেখলি?তোর শরীরের গঠনও আমার চেনা”

জহিরের কথা পছন্দ হয়নি মল্লিকার।বরং বাজে আভাস পেলো।ছেলেটা এলাকায় খারাপ মানুষের তালিকায় পড়ে।রুনা চাচীর মেয়েকেও দেখেছে তার সাথে কয়েকবার।

এখান থেকে চলে যাওয়া উত্তম মনে করে মল্লিকা বললো, “জহির ভাই মিষ্টির স্কুল ছুটে যাবে।আমি আসি?”

বাঁকা হেসে জহির বললো, “আসবি?আয়!আমি অপেক্ষা করবো।তোর জন্য অলটাইম জায়গা খালি।”

আকার ইঙ্গিতে উল্টোপাল্টা বলে যাচ্ছে। নির্বোধ নয় মল্লিকাও।হাতপা শিরশির করে উঠছে।দ্রুত পায়ে চলে গেলো সেখান থেকে।একা নারী মানেই বিপদ।মানুষের কু দৃষ্টি এড়াতে পারবে না কখনো।তার চেয়ে ভালো এড়িয়ে যাওয়া।

মায়ের দেখা না পেয়ে অস্রু ঝরঝর করে পড়ছে মিষ্টির গাল বেয়ে।মাত্র পাঁচ মিনিট দেরি হয়েছে। রাস্তায় জহির না আটকালে এই দেরিটা হতো না।দৌড়ে এসে মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে।

বলতে লাগলো,
“এইযে মা?কান্না করছিস কেন বলতো?”
“তুমি দেরি করেছো কেনো মা?আমার ভয় করে।”
“কিসের ভয়?মা আছি না।আজকে একটু দেরি হয়ে গেছে।”
“তুমি যাবে না মা।বাহিরে বসে থাকবে।”
“আচ্ছা আচ্ছা।কালকে থেকে বসে থাকবো।”

আসার পথেও সেই একই কান্ড।রাস্তার দ্বারেই ছেলেপেলেদের নিয়ে বসে জহির।মুখে কুটিল হাসি।তার দৃষ্টিতে ভালো কিছুর আভাস পাচ্ছে না।দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে নেয় মল্লিকা। জহির সটাং করে এসে দাঁড়ায় আবারো সামনে। মল্লিকাকে ভরকে দিয়ে মিষ্টিকে ছিনিয়ে নিলো।

গাল চেপে বলতে লাগলো, “মল্লিকা তোর মেয়েটাও তোর মতই সুন্দর হয়েছে দেখি।তোর জামাইর জন্য খারাপ লাগছে।ইস!কি জিনিস ফেলে রেখে অক্কা পেলো।”

যেনো খুব মজার বাক্য বলেছে।সে সহ তার সাথের ছেলেগুলোও হোহো করে হেসে উঠে। নিরব জায়গাটায় কারখানা।তেমন পথ চলতি মানুষের আনাগোনা নেই। মিষ্টিকে পূনরায় নিজের কাছে নিতে চাইলে মল্লিকার হাত ছুঁয়ে দিলো জহির। বিশ্রী স্পষ্ট! ঘেন্নায় পুরো শরীর একাধারে কাপছে।

জহির বললো, “এত তাড়া কিসের?আয় তোদের হাওয়াই মিঠাই খাওয়াই।”

ভয়ে চুপসে থাকা মিষ্টির চোখ মায়ের দিকে।দুয়েকবার হাত এগিয়ে মল্লিকার কাছে যেতেও চেয়েছে।লাভ হয়নি।পুরুষ মানুষের শক্তির সাথে সে ছোট বাচ্চা পেরে উঠেনি।

মল্লিকা শক্ত গলায় বললো,
“মিষ্টিকে দিন জহির ভাই!”

“তেজের আভাস পেলাম তোর গলায় মনে হলো? স্বামিহীন বিধবার এত তেজ দেখাতে নেই।”

এতগুলো ছেলের মধ্যে নিজেকে জড়ো বস্তু মনে হলো মল্লিকার।এখানে তার বাড়াবাড়ি চলবে না।গলা উচু করলে তিলকে তাল বানাতে সময় নিবে না কেউই।কয়েক সেকেন্ডের মাঝে আরেকটি পোক্ত হাত এসে মিষ্টিকে জহিরের কোল থেকে কেড়ে নিলো।

“এসব বাদ দিয়ে কাজ কামে লাগ জহির।কতদিন বসে খাবি?”
মিষ্টিকে মল্লিকার কাছে হস্তান্তর করে বললো শওকত।

“আমার বাপ যথেষ্ট কামাই করে রাখছে ভাই।”

“বসে খাইলে রাজার ভান্ডারও ফুরায় যাবে।”
__

“একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়ে ফেলছিস মাহি।”

অফিসে বেজায় কাজের চাপ।মূলত অতিরিক্ত কাজ করে নিজের উপর ইচ্ছেকৃত জুলুম চালাচ্ছে মাহরুর।কি করবে?ঘরে ফিরবে?কিসের জন্য?একাকী থাকতেওতো দম বন্ধ হয়ে আসে।তাই আজকাল ওভার টাইম করে।টাকাও বেশি আসবে।সময় পাড় হবে।

শওকতের আকস্মিক কলে চালিত কলম থামায়।বলে, “কি হয়েছে?”

“তুই জানিস এটা গ্রাম।এখানে সবকিছু মুখে মুখে উন্নত।কিন্তু মানুষের ধ্যান ধারনা আগের মতোই রয়ে গেছে।”

মাহরুর কথার অর্থ না বুঝে বললো, “পরিষ্কার করে বলতো শওকত কি হয়েছে? চন্দ্র?ঠিক আছে ও?”

“মল্লিকার কথা বলার জন্যই কল করেছি”

আরো একটু নড়েচড়ে বসে মাহরুর। মনোযোগটা এখন পুরোটাই শওকতের কথায় স্থাপন করতে হবে।থমথমে গলায় মাহরুর বললো, “বল”

“এলাকার রুনা চাচী খেয়ে না খেয়ে মল্লিকার পেছনে পড়েছে।সে ছাড়াও আরো অনেকে সহানুভূতি দেখানোর সুযোগে উল্টোপাল্টা কথা বলে। আজকেতো বেশিই হয়ে গেছে।জহির আছে না?রাব্বি চাচার ছেলে?রাস্তা আটকে দাড়িয়ে ছিলো মল্লিকার।মনে হচ্ছিলো বাজে কিছু বলেছে।এভাবে চলতে থাকলে মল্লিকা কিভাবে টিকবে এখানে?এরচেয়ে ভালো তোদের সাথে ঢাকায় থাকতো। অন্তত এসব সহ্য করতে হতো না ওর।”

হাতে রাখা বলপেন বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে মুচড়ে ভেঙে ফেলে।শরীরে ঐশ্বরিক জোর এসেছে যেনো। শওকতের প্রত্যেকটা কথা পরিষ্কার শুনে উত্তর দিলো,
“ফোন রাখ”
___

এলাকায় হইচই পড়েছে।রাব্বি মিয়া রাগে ক্ষোভে আগুনের গোলা হয়ে ঘুরছেন এদিক ওদিক।ছেলে ভর্তি হাসপাতালে।মেরে আধমরা করেছে কেউ রাতের আধাঁরে।তলব করছেন সবার বারিবারি গিয়ে।সালিশ ডেকেছেন।খোজ নিতে কার এত বড় দুঃসাহস।আধাঁরে চোরের মতন তার ছেলেকে এভাবে মারলো? ছেলের কাছে জানতে চেয়েও পারেনি।শুধু এতটুকুই জেনেছে রাতে গ্যারেজে আড্ডা দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেখানেই। ভোরের দিকে আকস্মিক হামলা চলে তার উপর।আশপাশে থাকা তার চ্যালাদেরও সেখানে দেখতে পায়নি।

অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে স্লোগান দেওয়ার মতোন করে বলে যাচ্ছেন, “একবার যদি ধরতে পারি আমার ছেলের এই অবস্থা কে করেছে?ওর চৌদ্দ গুষ্টিকে জেলের ভাত খাওয়াবো”

রাস্তায় দাড়িয়ে হুংকার শুনছেন রমজান মিয়াও।কে করেছে কে জানে?রমজান সাহেব নিজেও অবাক।ভাবনা চিন্তা শেষ করে রওনা হলেন বাজারের দিকে। রেশন শেষ ঘরে।টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনবে। হাতে ব্যাগ নিয়ে হাঁটছেন রমজান মিয়া।বড় ভাইয়ের বাড়ির দিকে চেয়ে চেয়ে যেতেই ভিন্নতা লক্ষ করেন।ভেতরে ঢুকে যান নিশ্চিত হওয়ার জন্য।দরজায় তালা নেই।কিন্তু সেতো ভালোভাবে তালা দিয়ে রাখেন।প্রতি রাতে এসে দেখেও যান।তাহলে?চোর পড়লো নাতো? দরজায় হাত রাখতেই খুলে গেলো। ভেতরে চোখ পড়তেই অবাক হন অভ্যন্তরের দৃশ্যে। মাহরুর ঘুমিয়ে আছে বিছনায় উপুড় হয়ে।সে কখন এলো?এই প্রশ্নটাই রমজান সাহেবের মনে সর্বপ্রথম আসে।

মাহরুরের বাহু ধাক্কা দিয়ে তাকে জাগায় রমজান সাহেব। আড়মোড়া হয়ে উঠতেই রমজান সাহেবকে দেখে মাহরুর বললো, “আসসালামু আলাইকুম চাচা”

বিহ্বল রমজান সাহেব বললেন, “ওয়ালাইকুম আসসালাম।তুই বাড়ি কখন আসলি?”

ফোনে সময় চেক করে মাহরুর বললো, “সকাল আটটায় এসেছি।”

“ওহ আচ্ছা!জানাবি না তুই আসবি।এভাবে হুট করে আসলি। বাড়িও গেলি না।”

“চাচা সকালে বিরক্ত করতে চাইনি।…..বাহিরে হইচই কিসের?”

“ওই আর বলিস না। ভোর চারটা পাঁচটার দিকে রাব্বি সাহেবের ছোটো ছেলেরে কে জানি মারধর করছে।বেচারা হাসপাতালে ভর্তি।”

ঘুমের রেশ কাটেনি।এই কথাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলো না।ছোট্ট করে উত্তর দিলো, “ওহ”

মাহরুর এসেছে শুনে হুট করে পা জোড়া চলতে লেগেছিল মল্লিকার।ঠিক দরজার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে থেমে গেলো।নিজেকে নিজে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।কেনো এতো তাড়াহুড়ো দেখালো? মাহরুরকে দিয়ে তার কি কাজ?তার আগমন কি আদৌ এত গুরুত্বপূর্ণ?সারাদিন ঘুম শেষে এসেছিল মাহরুর।রাতে খেয়ে দেয়ে বিদায় নিল।চোখদুটো চন্দ্রবিলাস করতে পারেনি। তৃষ্ণার্ত চাতকের মতই ফিরে গেলো বাড়ি।তার চলে যাওয়া নিশ্চিত হয় মিষ্টির মাধ্যমে।এতখন মাহরুরের সাথেই ছিলো।তাকে ঘুম পাড়িয়ে জানালার দ্বারে দাড়াতেই ভুত দেখার মতন চমকে উঠলো।ভয়ে দুয়েক কদম পিছিয়ে যায় মল্লিকা।আধাঁরে জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখের অধিকারীকে চিনতে ভুল করেনি।

গম্ভীর গলা থেকে প্রশ্ন আসলো, “কেমন আছিস?”

ভয় দুর হতেই মল্লিকা এগিয়ে এসে দাঁড়ায়।বলে, “আপনি এখানে কি করছেন?”

“এমনেই দাড়িয়ে আছি”

“আচ্ছা”

জানালার গ্রিলে হাত রাখতেই আর্তনাদ করে উঠে মাহরুর।হাত ঝাড়া দিচ্ছে বারবার। ব্যথায় নীলচে হয়ে যাওয়া হাত দেখে হৃদয় কেপে উঠে মল্লিকার।জানতে চাইলো,

“ব্যথা পেলেন কি করে?”

“মারামারি করেছি।জীবনে প্রথম কাউকে মনের স্বাদ মিটিয়ে পিটিয়েছি।ভালো লাগছে।”

মল্লিকার চক্ষু রসগোল্লার ন্যায় হয়ে গেলো। ঘটনা এক এক করে জুড়ে যাচ্ছে।আরো এগিয়ে এসে নিচু শব্দে জানতে চাইলো, “জহিরকে আপনি মেরেছেন?”

“হ্যা!”

কি স্বাভাবিকভাবেই না বলছে মাহরুর।ভনভন করে উঠলো মাথাটা।কথা নেই বার্তা নেই এসে একজনকে মেরে হাসপাতালে পাঠালো?
“কেনো মেরেছেন?”

“আমার ইচ্ছে!তুই এত কথা বলিস কেনো?”

“কিন্তু…”

“চুপ! আর শোন?রমজান চাচার সাথে কথা বল।তোকে ঢাকা ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। মিষ্টিকে ওখানেই কোনো সরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো।”

আকাশ থেকে পড়লো মল্লিকা।হুটহাট এমন কথার মানে কি?নিজেই ফিরিয়ে এনে নিজেই বলছে ঢাকা নিয়ে যাবে?তবে মাহরুরের মুখ দেখে মনে হলো না সে মজা করছে।মুখে স্পষ্টতার ছাপ।ভিন্ন দেখাচ্ছে তাকে।

“কেনো যাবো ঢাকা?”

“আমি বলেছি তাই!”

“কোন অধিকারে বলছেন আপনি?আপনি বললেই চলে যাবো নাকি?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুর।মুখের কাঠিন্য কমিয়ে আনলো তৎক্ষনাৎ।আবদারের সুরে আকাশ ছোঁয়া আবদার করে ফেললো,

“আমার বউ হয়ে যাবি?”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-১১+১২

0

চন্দ্র’মল্লিকা ১১ + ১২
লেখা : Azyah_সূচনা

দরজা পেটানোর আওয়াজে ত্যক্ত বিরক্ত রেহালা বেগম। কোমরের ব্যথার কারণে বিছানা থেকে মাটিতে পা ফেলতে চান না।সারাদিন শুয়ে বসে জং ফেলেছেন।গাধার খাটুনি খাটার জন্যতো চন্দ্র আছেই।ছোট বউটারও কোনো সাড়াশব্দ নেই।সারাদিন নিজের ঘরে তার প্রবাসী ছেলের সাথে ভিডিও কলে পড়ে থাকে।কোনো কাজকর্মে হাত দিলে হাত ক্ষয় হবে। সৌন্দর্য্য নষ্ট হবে।এটা মতামত তার।

“ছোটো বউ! ও ছোট বউ!দরজায় কে আসছে দেখবা না নাকি আমারই উঠন লাগবো?”

মৌ চেঁচায় নিজের ঘর থেকে।বলে, “আমি ব্যস্ত আছি আম্মা”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন রেহালা।নিজেই ভারী দেহ নিয়ে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে।যেতে যেতে বলছেন, “কার মরা মরছে! এমনে দরজা ধাক্কাস যে?”

দরজা খুলতেই চোখের সামনে তিনচার জন মানুষ দেখে ভরকে উঠে।তার চেয়ে আশ্চর্য্যজনক তাদের পোশাক।সহজ ভাষায় পুলিশের পোশাক।দুজন মহিলা এবং বাকিরা পুরুষ।সকলেই পুলিশের পোশাকে।অবাক রেহালা বেগম প্রশ্ন করলেন,

“কি চাই?”

“আপনার নাম রেহালা সরোয়ার?”

“হ”

“মল্লিকা সরোয়ার আপনার কি হয়?”

“আমার মৃত পোলার বউ।”

রেদোয়ান বললো,

“আপনার নামে মামলা আছে। নির্যাতন মামলা।মল্লিকা সরোয়ার আর মিষ্টি সরোয়ার এর উপর অমানবিক অত্যাচার আর মারধর করার মামলা।”

চক্ষু কপালে উঠেছে রেহালার।বুকের ভেতরে ধ্বক করে উঠলো। ভয় বেগতিক। আত্মার পানি শুকানোর আগে কান্না জুড়ে দিলেন, “হায় আল্লাহ!এই মাইয়াডারে আমি নিজের মাইয়ার মতন পালছি।জামাই মরার পর ওর এই বাড়িতে রাইখা পালতাছি।ওই আমার এই পরিণাম করলো!”

কপালে হাত রেখে দরজায় বসে পড়লেন। মরা কান্না জুড়েছে।যেনো চন্দ্র নয় সে ভুক্তভুগী। অভিনয়ে মাস্টার ডিগ্রি অর্জিত নারীর দিকে চেয়ে হাসলো রেদোয়ান।

বললো, “খুব কষ্ট হচ্ছে আপনাকে দেখে।”

মুখ তুলে রেহালা বেগম বললেন, “আমারে অত্যাচার করছে ওই মাইয়া।আমার পোলারে অকালে খাইছে।আমারে খাওয়ন দিতে চায় না। কাম করায় হারাদিন।”

“ভুক্তভুগী আপনি অথচ আপনার বৌমার গায়ে আঘাতের চিহ্ন।কাজ করতে করতে হাত দুটো শুষ্ক।সঠিক পুষ্টির অভাব।”

রেহালা বেগম উঠে দাঁড়িয়েছে।এভাবে পুলিশের সাথে তার জোর চলবে না।চেচিয়ে ডাকলেন মৌকে।বললেন ছোট ছেলেকে কল করতে।সে সামনে এসে মূর্তির মতন দাড়িয়ে আছে।কোনোভাবেই কল করবে না স্বামীকে। শ্বাশুড়ি,মল্লিকা আর মিষ্টিকে ঘর ছাড়া করতে পারলেই বাঁচে সে।

“ওই আমার ছোট বউ।আপনারাই জিগান ওরে।”

মৌ এর পানে চেয়ে রেহালা বেগম বললেন, “ছোট বউ!এই সাহেবগোরে কও বড় বউ আমারে কি নির্যাতন করতো! কও”

মৌ একবার পুলিশ আরেকবার শাশুড়ির দিকে চায়।তার ভাবভঙ্গি আগের মতই।ঘরে পুলিশ এসেছে।তাতে তার কিছুই আসে যায়না।সে নির্দোষ।সেতো কিছুই করেনি।তাই তার ভয়ের কোনো কারণ নেই। মৌ বললো,

“আমি এসব জানি না।আমাকে টানবেন না।”

রেদোয়ান বললো, “আপনিতো এই বাড়িরই ছোট বউ।আর আপনি বলছেন আপনি কিছু জানেন না?”

“না”

“আমাদের সাথে দেমাগ দেখানো যাবে না।আপনার নামে কোনো কমপ্লেইন্ট নেই।আপনার জন্য মঙ্গল এটাই হবে সত্যি সত্যি বলে দিন এই ঘরে কি চলে”

যাও একটু চিন্তা হচ্ছিলো সেটাও নিমিষেই উধাও।বাঁচা গেলো। শাশুড়ি মা আশাভরা চোখে চেয়ে আছে ছোট বউয়ের দিকে।এখনই তার পক্ষ হয়ে কথা বলবে।তবে চোখ উল্টে নেয় মৌও।

বলে, “আপনারা যা শুনছেন ঠিকই শুনছেন। আম্মা ভাবীরে মারতো। ঘর থেকে বের করে দিতে চাইতো।”

ঘরের শত্রু বিভীষণ। অগ্নিদৃষ্টি মৌ এর দিকে।এবার তিনি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেই মৌ এর দিকে তেড়ে যান।চুলের মুঠি ধরে চড় দিতে চাইলে নারী কনস্টেবল এসে থামায় তাকে।

রেদোয়ান বললো, “কত সন চলে এটা জানেন?দুই হাজার।আগের দিনে বউ পেটানো অত্যাচার করার দিন শেষ।এখন আইন কঠোর।যোগ্য শাস্তি পাবেন এর।”

রেহালাকে থানায় নেওয়া হয়েছে।তার পক্ষে কিছু করার মতন কেউ নেই। মৌও কোনোদিন আসবে না।ছেলে বিদেশ। সর্বহারা হয়ে বিলাপ করতে করতে চলে গেলো।রেদোয়ান থানার ঝামেলা সেরে এসেছে হসপিটালে।মল্লিকার ঘুমের রেশ কাটেনি।মায়ের হাত ধরে বসে থাকা মিষ্টির দিকে একটা চকোলেট এগিয়ে দিয়ে বললো,

“মিষ্টি?আম্মু”

“জ্বি আংকেল”

“তুমি জানো তুমি একটা সাহসী মেয়ে?”

অবুঝের মতন চাইলো মিষ্টি রেদোয়ান এর দিকে।সাহসী বলছে?কিন্তু কেনো? চন্দ্রমল্লিকা তাদের কথার গুঞ্জনে হালকা চোখ মেলে। কানটাও সজাগ করলো।

রেদোয়ান উত্তর দেয়, “এইযে তুমি কি সুন্দর করে বললে তোমার দাদী পঁচা।তোমার মাকে কষ্ট দিয়েছে,ব্যথা দিয়েছে।আমি তাকে শাস্তি দিয়ে এসেছি।তাইতো তোমাকে সাহসী বলেছি।এই চকোলেট তোমার উপহার।”

ধীশক্তি জ্বলে উঠে মল্লিকার।যা শুনলো সেটার পরিণাম ভয়ঙ্কর।সম্পূর্ণ চোখ মেলে ডাকলো রেদোয়ানকে।বললো,

“দুলাভাই?কি বললেন?”

“কি খবর মল্লিকা?”

“দুলাভাই আপনি মাত্র কি বললেন?”

মাহরুর আসে।খাবার এনেছে নিজে রেধে। ক্যাবিনে প্রবেশ করে মল্লিকার ঘাবড়ে উঠা সরল মুখে নজর যায়। টিফিন ক্যারিয়ার পাশে রেখে এগিয়ে আসে।কপাল কুঁচকে দাড়ায় পাশে। রেদোয়ান মাহরুরকে লক্ষ করতে গিয়ে প্রশ্নের জবাব দিতে ভুলে গেছে।পূনরায় মুখ ফেরায় মল্লিকার দিকে।

বলে, “তোমার শ্বাশুড়িকে জেলে ভরেছি।ফাজিল একটা মহিলা!”

“কেনো দুলাভাই?কিসের ভিত্তিতে?” জোরেই বললো মল্লিকা।

“তোমাকে অত্যাচার করার ভিত্তিতে।”

“সে আমায় অত্যাচার করেনা।”

রেদোয়ান আজ খোচা দিল মাহরুরকেও।শুনিয়ে বললো, “তোমার ক্ষত অন্য কারো চোখে পড়ুক না পড়ুক।ডাক্তার আর পুলিশের চোখে ঠিকই পড়েছে।আর এই মিষ্টি মা আমাকে সাহায্য করেছে অপরাধীর বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে।তার একটা শাস্তি পাওয়া দরকার।”

কেদে ফেলে মল্লিকা।তার কান্না দেখে তৎক্ষনাৎ মাহরুরের হৃদয় মুষড়ে উঠলো। চন্দ্রের অজানা কান্না তাকেও মর্মবেদনা দিতে শুরু করলো।মল্লিকা বলে উঠে,

“আমাকে ঘরছাড়া করলেন দুলাভাই?”

তার কথা বিধলো দুজনের কাছেই কাটার মতন।অপরাধীকে শাস্তি দিতে গিয়ে পরবর্তী পরিস্থিতি কি করে ভুলে যায়?রেদোয়ান বলে,

“তোমার ঘর নেই?গ্রামে যাবে।রমজান চাচা তোমার বাবা এখনও বেচে আছে।”

“আমার বাবা কিভাবে নিজের পেট চালায় আমি জানি!তার কাধে আমি আর কোনো বোঝা দিতে চাই না।কেনো করলেন বলেন?আমি বলেছিলাম আপনাকে?”

মাহরুর আর রেদোয়ান একে অপরের দিকে চাইলো।রমজান সাহেব চেয়েছিলেন মেয়েকে নিয়ে আসতে।মেয়ে আসলে তবে না? মাহরুর ফোন বের করে।নাম নিতে না নিজেই রমজান সাহেবের কল।দ্রুত ধরে।অপরপাশে মেয়ের খবর পৌঁছে গেছে তার কানে।জানতে চাচ্ছেন তীব্রভাবে।কি অবস্থা তার।মল্লিকার দিকে ফোন এগিয়ে দিলো কথা বলার জন্য।

“মারে?তোর বাপের যা আছে তাই দিয়ে তোর আর তোর মেয়েরে দেখভাল করতাম।তুই আসলি না।”

“আব্বা এসব কথা কেনো বলো?আমি ভালো আছি”

কান্নারত রমজান সাহেব বলেন, “এতই ভালো আছিস যে আজ হাসপাতালে তুই। ফিরা আয় মা।আমার ছেলে আমার সংসারে কোনো কমতি রাখে নাই।”

বাবার কথায় অবাক হয় মল্লিকা।ছেলে কোথা থেকে আসলো?সেই উত্তর জানতেই প্রশ্ন করে মল্লিকা রমজান সাহেবকে।বলে, “ছেলে মানে?”

“আমার ভাতিজা।হীরার টুকরা ভাতিজা।প্রতি মাসে এই বুড়াবুড়ির জন্য খরচা পাঠায়।ভাবি মরার পরও এই চাচারে মনে রাখছে।…আর মা আমি জমিটা বেইচা দিছি।অর্ধেক টাকা মাহিরে দিয়া বাকি অর্ধেক রাখছি।তোর আর তোর মাইয়ার ভবিষ্যৎ দিব্যি হইয়া যাইবো এই টাকায়।তুই ফিরা আয়।ওই নরকে থাকিস না”

এত বছরে আরেকবার হয়তো চন্দ্রের প্রখর নজর দেখলো নিজের দিকে।চোখে চোখ মেলাতে পারলো না।নামিয়ে নিলো।বাবা মেয়ের কথা অজানা তার।লুকিয়ে রাখা কিছু কথা চন্দ্রমল্লিকার কাছে ফাঁস হয়েছে সেটা টের পায়নি।অজানা মাহরুর নিচে ফর্সের দিকে দৃষ্টিপাত করে।

____

“কি গো ভাইয়া?আমার বাড়ির দিকেতো ভুল করে তাকাও না। হঠাৎ কি হলো?দিনে রাতে সামনে আগমন ঘটছে তোমার এবাড়িতে?”

বোনের তীর্যকপূর্ণ কথা।অর্থ থেকে বিবশ নয় মাহরুর।লজ্জা হলো তার এমন কথায়। শিরীনও জানে মাহরুর কেনো আছে এখানে।চন্দ্র;তার চন্দ্রের জন্য।ভুলিয়ে ফুঁসলিয়ে চন্দ্র মল্লিকাকে এখানে এনে রেখেছে শিরীন। ও বাড়ির পথ ভুলে যাওয়ার কড়া আদেশ শিরীনের।ভুলে যেতে বলেছে তেতো বাক্যে যে কোনোদিন ওই বাড়ির বউ ছিলো সে।সম্পর্ক জুড়ে স্বামীর জন্য।যেখানে স্বামী নেই সেখানে আর কোনো সম্পৃক্তি নেই।আর অত্যাচারে অতিষ্ট হওয়ার পরতো আরো নয়।

রেদোয়ান বললো, “আহা শিরীন লজ্জা দিও না তোমার ভাইকে।দুর্বল হৃদয়ের মানুষ সে।তুমি গিয়ে মল্লিকাকে চা দিয়ে এসো”

শিরীন চলে গেলো।বেশি বেশি খাবার নিয়েছে প্লেটে।সব গিলাবে।না চাইলেও খাইয়ে ছাড়বে।নিজের উপর এত অনীহা এই মেয়ের?সেও বড়বোন।মুখে রাগের ছাপ নিয়ে গেলো মল্লিকার কাছে।বললো,

“এইযে ফল দেখছিস?এগুলো সব খাবি।আধ ঘন্টা পর চা আর পরোটা দিবো। সেগুলো বিনা বাক্যে খেয়ে উঠতে হবে”

অসহায় নেত্রপাত করে মল্লিকা।জানে শিরীনের স্বভাব।বেশি না তিন বছরের বড় বয়সে।অথচ ভাবসাব মায়েদের মতন।মল্লিকা ডেকে উঠে,

“বুবু?”

“কোনো কথা না চন্দ্র।খেয়ে ওঠ।আমি মিষ্টিকে খাইয়ে আসি।”

“এত খাবার কি করে খাবো বুবু?”

“মুখ দিয়ে খাবি।”

হাসতে চাইলো মল্লিকা।পারলো না।হাসি আসার মূল কারণ শিরীনের ভঙ্গি। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে।এমনি সে।বিয়ের পর গিন্নি হয়েছে।দুটো ফুটফুটে সন্তানের মা।তারপরও স্বভাব চরিত্রে কোনো পরিবর্তন নেই। দুর বসার ঘর থেকে আরো একটি কন্ঠস্বর ভেসে আসছে।চন্দ্রের মনের শান্তি আর অশান্তি।দুটোর মিশ্রণে তৈরি মানব।এখনও সর্বাঙ্গ কম্পিত করে তার কন্ঠস্বর।মন মস্তিষ্ক বেয়ে চলে পেছনের দিকে। স্মৃতিরা ফিরে আসতে চায়।কিন্তু জোর চালিয়ে থামায় চন্দ্রমল্লিকা।চেয়েছিলো তার স্বামীর মধ্যে খুঁজতে মাহরুরকে।লোকটা পেরে উঠেনি।রক্তের পরিচয় দিয়ে মায়ের মতই নির্মম,নির্দয় ছিলো সেও। তবে তার মৃত্যু? নড়বড়ে চন্দ্রকে পুরপুরি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।মাঝেমধ্যে নিজেকে প্রশ্ন করে সে।

“কেনো এই কপালে সুখ সইলো না”

ফলগুলোতে রুচি আসছে না।কিন্তু কঠোর আদেশ।খেতে হবে।ফিরে এসে ঠিক তদারকি করবে শিরীন। খুক খুক কাশির আওয়াজ শুনতে পেয়ে অন্যমনস্কতা কাটে। মাহরুর এসেছে। উপস্থিতি জানান দিলো অহেতুক কেশে।ভাবনায় মগ্ন ছিলো চন্দ্রমল্লিকা।

“আসবো?”

“জ্বি”

বড়ো একটা বিছানা।দুজন দুই কোণায় বসে।মল্লিকার গায়ে ওড়ানো কম্বলটা গুটিয়ে তার দিকে দেয় মাহরুর।মুখোমুখি বসে।একটাই আশা একটা পরিপূর্ণ কথোপকথন হোক তাদের মধ্যে।স্বাদ মিটে না যে।

“বাড়ি ফিরবি?টিকেট করবো?”

মাহরুরের দিকে না চেয়েই উত্তর দেয়, “ফিরতে চাই না।”

“তাহলে এখানে কোথায় থাকবি?”

“জানি না”

মায়ার অতলে ডুব দিচ্ছে চক্ষু।প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছে চন্দ্র।প্রেম জেগেছে ভুল সময়ে। মিথ্যে আশ্বাসে বক্ষ পিঞ্জিরায় বদ্ধ হৃদয়।হাত শূন্য। সবকিছুতো আগেই বিনষ্ট হয়েছে।ঠিক করার উপায় নেই।

“রেগে থাকিস না।”

“আমি রেগে নেই।আপনি আম্মাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করুন।উনি বয়স্ক মানুষ”

শেষ কথাটি আবদারের সুরে বলেছে মল্লিকা।খানিক আদেশের আভাসও মিশ্রিত ছিলো।আর অন্যের প্রতি অগাধ মায়া। অপরাধীর জন্য মায়া যার সে কতটা মায়াবী হবে?

“করবো ব্যবস্থা।তার আগে আমার একটা শর্ত আছে।”

স্বভাবতঃই প্রশ্ন আসে, “কি শর্ত?”

“তুই বাড়ি ফিরবি আর আমি রেদোয়ানকে বলে মামলা তুলে নিবো।”

অবসাদে চাইলো মাহরুরের দিকে। বিচিত্র শর্তে চোরাবালিতে পতিত করার চেষ্টা।উত্তর আসলো,

“ওটা আমার সংসার।আপনি বুঝতে পারছেন না।”

“কিসের সংসার?”

“আমার স্বামীর সংসার।আমার সংসার।”

“তোর স্বামী কোথায়?”

মুখে উঁচিয়ে ছিলো। মাহরুরের পরবর্তী প্রশ্নের উত্তর দেবে বলে।তার আর উপায় রাখলো না। নেহাত চোখ নামায় মল্লিকা।

“যেখানে স্বামী নেই সেখানে সংসার নেই।আর যেখানে সম্মান নেই ওই সংসারে থাকার কোনো মানেই হয় না।ফিরে যাবি তুই।আমি টিকেট করবো”

“আপনারা যা ভালো মনে করেন।আমার জীবনতো অন্যের সিদ্ধান্তেই চলেছে সবসময়।”

দৃষ্টি শীতল করে মাহরুর। ভ্রূ জোড়া কাছাকাছি এসেছে চন্দ্রের কথায়।বলে উঠলো,

“অনেকটা বদলে গেছিস আবার কিছুটা আগের মতোই রয়ে গেছিস চন্দ্র।আমায় আর আগের মত পুরো নামে ডাকিস না।তুমি থেকে আপনিতে পদোন্নতি হয়েছে আমার।…..চিন্তা করিস না।তোর দোষ দিবো না।আমি জানি এই অপরাধের একমাত্র অপরাধী আমি।কোনোদিন ক্ষমা করিস না আমাকে।”

চলবে…..

চন্দ্র’মল্লিকা ১২
লেখা : Azyah_সূচনা

“বুবু?”

কায়ার ক্ষীণত্ব কাটিয়ে নিজ থেকে রান্না ঘরের দিকে এসে দাঁড়িয়েছে মল্লিকা। গতদিন পর্যন্ত পানির গ্লাস অব্দি ধরতে হাত কাঁপছিলো।হাসপাতালের বিছানার ছোঁয়া পেয়ে যেনো দুর্বলতা আরো ঘিরে ধরেছিল তাকে।রোগীদের মধ্যে থেকে রোগ বেড়েছিল।এখন সুস্থ মনে হচ্ছে।এসেছিল একই গান আওড়াতে।তাকে যেনো ওই বাড়িতে ফিরতে দেওয়া হয়। শিরীনের বিকট আওয়াজ আর চড় দেওয়ার ভয়ে আর কথাটি মুখ ফুটে বলা হলোনা।ভয় আছে তবে অনেক ভালোবাসাও আছে।তার এই তিক্ত মুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নরম ব্যক্তিত্বটাকে সকলে চেনে।

“উঠে এসেছিস কেনো?কিছু লাগবে?”

অনেকদিন পর শাড়ি ছেড়ে সেলোয়ার কামিজ জড়িয়েছে চন্দ্র।শিরীন মুখ ফিরে চাইতেই দেখলো ওই ছোট্ট চন্দ্রকে।কিশোরী থেকে নারী হওয়ার পর মুখমণ্ডলে ভিন্নতা আসলেও ভিন্নতা আসেনি তার গড়নে।স্বাস্থ্যবতী হয়েছে মা হওয়ার পর তবে চোখে পড়ার মতন নয়।কে বলবে?পঁচিশ বছরের এক নারী সে?

ততক্ষনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মল্লিকা।বললো, “কিছু লাগবে না।একা ভালো লাগছিলো না।”

“দুপুরে কি খাবি বল?”

“এত কষ্ট করা লাগবে না আমার জন্য বুবু।”

“উফ চন্দ্র!তুইও মাহি ভাইয়ের মতন।”

ছ্যাঁত করে উঠে হৃদয়। সত্যিই সে মাহরুর ভাইয়ের মতন?একই ব্যক্তিত্ব তাদের?তাহলে কেনো মিলন হলো না?ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়তি একে অপরের সামনে এনে দাড় করায়। অনুভূতি নিয়ে খেলা করে।

“হিরা ভাবি কোথায়?”

শিরীন আরচোখে তাকায়।হয়তো এমন প্রশ্ন আশা করেনি চন্দ্রমল্লিকার কাছে।শিরীনের দৃষ্টি দেখে মল্লিকা ততক্ষনাত বলে উঠে,

“না মানে!মাহি ভাই দুদিন পুরোটাই হাসপাতালে ছিলো।গতকাল অফিস করে এখানেই এসে থেকেছে। ভাবিকে দেখলাম না তার সাথে।তাই জিজ্ঞেস করেছি”

খুন্তি নাড়তে নাড়তে মলিন গলায় শিরীন বলতে লাগলো, “কি বলবো?জীবনটা ভালো চলছে না আমার ভাইয়ের। মৃত মানুষের নামে গীবত করা উচিত না।যদি সে নিজের মা হয় তাহলেতো আরো না।”

“কি হয়েছে বুবু?” জানতে চাইলো মল্লিকা।

“আমার ভাইও ঠিক তোর মতই।চোখে সুখের দেখা পেলো না।বিয়ের আগে অভাবের কষ্ট বিয়ের পর কষ্ট যেনো দ্বিগুণ হয়।তুইতো ততদিনে নিজের সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলি।এরপর ওই মহিলা!আমার মা যাকে ঘরের বউ করে এনেছিল?আমার ভাইটাকে শান্তি দিলো না।”

এক তরকারি রান্না শেষে আরেক চুলোয় ডিম ভাজতে ভাজতে শিরীন আবার বললো, “মানুষের শখ আহ্লাদ থাকে। পূরণ করতে চায়।কিন্তু ওই শখ আহ্লাদ যখন লোভে পরিণত হয় তখন মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়রে চন্দ্র।সেই লোভটা ছিলো হিরা ভাবির।মা যখন মোতালেব চাচাকে বলেছে আমার ছেলে শিক্ষিত, ঢাকায় বিরাট চাকরি করে,নাম ডাক আছে তার সেখানে তখন অজান্তে তারাও লোভে পড়ে।তারপর কি হলো?ভাইয়া যখন তার সকল আবদার পূরণে ব্যর্থ হলো?মায়ের মিথ্যের দায় বহন করতে হয় মাহি ভাইকে।”

ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে আছে মল্লিকা। বিস্তারিত শুনছে মাহরুরের বৈবাহিক জীবনের।কিন্তু হিরা কোথায় এটা এখনও অজানা।মল্লিকা বললো,

“ভাবি এখন কোথায়?”

“আমার ভাইকে নিঃস্ব করে অন্যের ঘর আলোকিত করছে।মাসখানেক আগে তালাক নামায় সই নিয়ে নতুন জীবনসঙ্গীর সাথে প্রবাসে পাড়ি জমায়।”

শিরীনের কথার বিপরীতে কেমন প্রতিক্রীয়া দেওয়া উচিত?নিজের কানকে এখন অব্দি বিশ্বাস করাতে পারেনি।মল্লিকা কল্পনায় বেঁচেছে এতদিন।ভেবেছে নতুন সঙ্গিনীকে নিয়ে বেশ আয়েশেই জীবন চলছে মাহরুরের। কোনোদিনতো ভালোই বাসেনি মল্লিকাকে।যাও একটু মায়া ছিলো সেটাও বোধহয় স্ত্রীর মোহ ভুলিয়ে দিয়েছে।হিংসে হতো!তাদের একত্রে কল্পনা করে নিজে নিজেই জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়েছে।নিজের মনকে মানিয়েও নিয়েছে এক সময়। চেয়েছিলো নির্দয় পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে তার স্বামী ফারহানকে ফিরিয়ে আনতে।আরেকবার ভালোবাসার দুঃসাহস করেছিলো।জেদ চেপেছিলো।যে তাকে ভালোবাসেনি তার জন্য কিসের দরদ?

“ভাই তোর জন্য তার সাধ্যের মধ্যে লড়াই করেছে।কিন্তু কি জানিস?রক্তের কাছে আত্মার সম্পর্ক ফিকে পড়ে যায়।কোনোদিন বিয়ে করবে না এটাই জানিয়েছিল আম্মাকে।তবে মা জেদ ছাড়লো না।মৃত্যুর হুমকি দিয়ে……”

বলতে বলতে থেমে যায় শিরীন। অনুভূতি তারও আছে।গলায় তারও কথা দলা পাকিয়ে যায়।তবে নিজের চেয়ে বেশি অনুভূতির স্তব্ধ সাগরে ডুবিয়ে দিলো চন্দ্রকে। নির্বিকার চিত্তে শুনলো শিরীনের কথা।তবে কি মাহরুর ভাই চেষ্টা করেছিলো?

___

মিষ্টিকে বুকে জরিয়ে আছে মল্লিকা। সাথেই সুমাইয়া তার বাড়ির কাজ সারছে।সায়মন মিষ্টিকে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে।সবার সাথে মিশলেও মিষ্টি মায়ের মতোই বোকাসোকা মেয়ে।এখন পর্যন্ত স্কুলে ভর্তি করানো হয়নি তাকে।সেই ভাগ্যটাই হয়নি বলা চলে।অন্যদিকে সায়মন পড়ালেখায় পটু। এতশত কথা কিছুই মিষ্টির মাথায় ঢুকলো না।

সায়মন বললো, “খালামণি?মিষ্টি কথা বলেনা কেনো?ওকে আমি কবিতা বলতে বললাম তাও বলছে না।”

অসহায় মুখে সায়মনকে বললো, “ওতো কবিতা পারেনা বাবা”

“কেনো পারেনা খালামণি?”

সায়মন ছোট।বাচ্চা মনে কতইতো কৌতূহল। জানার ইচ্ছে।মল্লিকার খারাপ লাগলো।মেয়েকে কবিতা পর্যন্ত শেখাতে পারেনি।সায়মনের এতে কি দোষ?সুমাইয়া এর মাঝে বলে উঠে,

“মিষ্টি ছোট তাই কবিতা পারেনা।আমরা ওকে শেখাবো কেমন?”

সায়মনও সায় দিয়ে মাথা দোলায়।বলে, “ঠিক আছে আপু”

সুমাইয়া মিষ্টিকে নিজের সামনে বসায়।সায়মনের বই বের করে শিক্ষকতা শুরু করলো।মিষ্টিকে পড়াবে।মল্লিকার মুখে হাসি ফুটলো।সুমাইয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

“আমার মায়ের কি বড় হয়ে শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?”

সুমাইয়া উত্তর দেয়, “হ্যা খালামণি।”

“আমার মামা একজন ভালো শিক্ষিকা হবে ইনশাল্লাহ!”

বলেই ঘরে প্রবেশ করলো মাহরুর।অবাধ্য হৃদয় বাঁধা মানে? বেহায়া হয়ে বারবার ছুটে আসে।কু-পুরুষের ন্যায় ছট্ফট করে কাঙ্ক্ষিত নারীর দিকে দৃষ্টিপাত করতে। লোকে বলবে স্ত্রী ত্যাগ করার সাথে সাথেই অন্য নারীতে আসক্ত?এই পুরুষের দোষ আছে নিশ্চয়ই।তারা কি জানে?এই নারী তার কতকাল পূর্বের মায়াবতী?একে অপরের সাথে মন বেধে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো দৈহিকভাবে।মনটা পড়ে আছে এখনও ওই গ্রামীণ মেঠো পথেই পড়ে আছে।দোষ একটাই।কিশোরী মনের প্রখরতা হেলাফেলা করেছে।পুরুষ হয়েও জোর খাটিয়ে নিজের করে নিতে পারেনি তাকে।

কাঁধের ব্যাগটা সোফায় রাখে মাহরুর।এলোমেলো চুলগুলো হাতের সাহায্যে আঁচড়ে পেছনে ঠেলে দিয়ে বসলো বাচ্চা ছানাদের মধ্যে এসে।মিষ্টি আর সায়মনকে একসাথে উরুতে বসিয়ে আদর ঢেলে দিচ্ছে।চুমু খাচ্ছে একের পর এক।আজকাল চন্দ্র তাকায় না মাহরুরের দিকে।সামনে পড়লেই চোখ নামিয়ে নেয়।হয়তো ঘৃণায়;আক্রোশে।

“আগামী কালকের টিকেট করেছি।”
“হুম?আমাকে বলছেন?”
“হ্যা। আগামীকাল গিয়ে দিয়ে আসবো।”
“আমি একাই যেতে পারতাম”
“বেশি সাহস দেখাস না চন্দ্র।এই সাহসটা নিজের শ্বাশুড়ীর সামনে দেখালে এই অবস্থা হতো না।”

চন্দ্রকে ধমকে দেওয়ার সুযোগ জীবনে কমই এসেছে।আদেশ অমান্য করার পাত্রী সে নয়।কোনো ‘টু’ শব্দ ছাড়াই মেনে নেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা তার মধ্যে পরিলক্ষিত।তবে একেবারেই যে আসেনি তা নয়। মাহরুরের ক্ষেত্রে চন্দ্রের চরিত্র ভিন্ন।প্রেমে মত্ত হওয়া হৃদয় যেনো আরো বাধ্য ছিলো তার। মাঝেমধ্যে টুকটাক বিষয়ে কঠোর হতো মাহরুর।সেও ঠিক এমনি মলিন মুখ বানাতো কিন্তু মেনে নিত বিপরীতে কোনো প্রশ্ন উত্তর না করেই।যেমন এখন।

“এখন বাড়ি যাচ্ছি। কাল রেডি থাকিস। ও বাড়ি থেকে কাপড় আনা লাগবে না।তোর কাপড় বাহিরে রাখা আছে।দেখে নিস।আসি” বলে চলে গেলো মাহরুর।যাওয়ার একবার ফিরে তাকিয়েছে বটে।
__

বাসের বেগমমাত্রায় দেহ দুল্যমন। মাহরুরের বুকে নিঃশব্দ ঘুমিয়ে মিষ্টি। পুরোপুরি তার মধ্যেই লেপ্টে আছে।অতি নিকটে বসে আছে চন্দ্রও।তবে মধ্যিখানে একটা ব্যারিকেট টানা।পুরুষের দেহ চওড়া হয়।ছোট বাসের সিটে জায়গার কমতি।এরমধ্যে বড় ব্যাগটা অসস্তি দিচ্ছে তাকে।তাতে কি চন্দ্র তাদের সাথে চলতে থাকা আকাশের চন্দ্র দেখতে ব্যস্ত।ছোটবেলায় মনে হতো চাঁদটাও তাদের সাথে চলে।আজ বিচিত্রভাবে চন্দ্র তার সাথে।তার পাশের সিটে বসে পারি জমাচ্ছে চেনা পরিচিত নীরে।

বিগত একঘন্টা হলো তারা রওনা হয়েছে।এতটা চুপচাপ হলো কি করে এই মেয়েটা?একদম নিস্তব্ধ।নিঃশ্বাস ব্যতীত আর কোনো হেলদোল লক্ষ করা গেলো না। মাহরুরের হৃদয় ছটফট করে।যেমন আজ থেকে ঠিক ছয় বছর পূর্বে চন্দ্রের মন উতলা ছিলো তার জন্যে।সেই মৃদু চঞ্চলতা এসে থেমে যেনো মাহরুরের মুখোমুখি?

“কিছু খাবি চন্দ্র?”
“উহু”
“ক্ষিদে পেলে বলিস”
“ঠিক আছে।”

এড়ানো কথা। ভাবভঙ্গি থেকে পরিষ্কার কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই তার মধ্যে।তাও ব্যাকুলতা থামাবে কি করে? হৃদয়কে বললো আনমনে যখন তার জন্য কাতর হওয়ার সঠিক সময় ছিলো?তখন কেনো হলো না?
আবারও দূর্বশ মুখে বলে উঠে, “সেখানে গিয়ে কান্নাকাটি করবি না।চাচা,চাচী কষ্ট পাবে। হাসিখুশি থাকবি।তোর দিন ফিরছে।ভালো থাকার দিন।পিছনে যা ফেলে আসছিস ভুলে যাস কেমন? মেয়েটাকে নিয়ে একটা সুস্থ জীবন যাপন কর ”

মল্লিকা এখনও চেয়ে আকাশপানে।মনমরা ভঙ্গিতে উত্তর আসে, “আমি পেছনে ফেলে রেখে আসা বন্ধ ঘরে আবার ফিরে যাচ্ছি”

মাহরুর থমকায়। বিস্মিত হয়।অতিরিক্ত আগ্রহ দেখিয়ে জানতে চাইলো, “তাহলে কি তুই গ্রামে যেতে চাস না?”

“যাওয়া ছাড়া আরতো কোনো উপায় দেখি না”

আবেগ প্রবন হচ্ছে।গলা খাদে নামিয়ে মাহরুর বললো, “আমাকে ক্ষমা করবি চন্দ্র?আমি অনেক বড় একটা অপরাধী।তোকে আশা দিয়েছি।আবার ভঙ্গ করেছি।কিন্তু বিশ্বাস কর আমার হাতে কিছু ছিলো না।আমি তোর অনুভূতির সম্মান করেছি তখন।বিশ্বাস কর আমায়”

উত্তর দিলো না।হেয়ালি করলো সোজাসুজি মল্লিকা।রাগ নাকি কষ্ট?মুখ দেখারও উপায় নেই।কি করে বুঝবে মাহরুর? মিষ্টিকে সাবধানে কোলে রেখেই হাত জোড় করলো।বললো,

“আমাকে আর আমার মাকে ক্ষমা করে দে।কারো হৃদয়ভঙ্গ করার দায় নিয়ে মৃত্যুটা অনেক যন্ত্রণার হবে।”

“আমার কোনো রাগ নেই।যদি থেকেও থাকে?ক্ষমা করার চেষ্টা করবো মাহি ভাই।”

হতাশা নিয়ে প্রশ্ন করে, “শুধু মাহি?”

“হুম”

দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার যাত্রা শেষ হয় মফস্বলে।বাস থেকে নেমেই পা জোড়া থমকায় দুজনার।অলিগলি পরিবর্তিত হয়েছে। মাহরুর- মল্লিকা উভয়ের এখানে আসাযাওয়া কম।এক সময় এই স্থানটি ছিলো কত আপন।ঠিক ছয় বছর আগে জোড়ায় জোড়ায় ত্যাগ করেছিল এই আধ পাকা রাস্তা।অভিমানে,কষ্টে।আজ ফিরেছে তবে আলাদা।মল্লিকা ফিরে চায়নি কোনোদিন।মায়ের মৃত্যুর আগে একবার এসেছিল মাহরুর।এরপর সেও বিমুখ হয়।

“চল” শব্দে মল্লিকার মস্তিষ্ক সচল হয়।অর্থাৎ আবার কিছু পথ হেঁটে নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে হবে। হাটতে হাটতে কল করে মাহরুর।রমজান মিয়াকে। জানাতে তারা এসে গেছে।পরপর রেদোয়ানকে কল করেও তাদের পৌঁছে যাওয়ার সংবাদ দিল।

“মা?আমার আম্মারে কত দিন পর দেখলাম!আমার নাতনি কই?”

মাহরুর ঘুমন্ত মিষ্টিকে এগিয়ে দেয় রমজান সাহেব এর কাছে। ফরিদা বেগম মেয়েকে জরিয়ে ধরে আছেন।নানার আদরে ফুটফুটে মেয়েটা চোখ পিটপিট করলো।চোখে আলো পড়তেই চোখ কচলে নেয়।শরীরের জোর কমেছে বয়সের জোরে।আজকাল হুটহাট কেদে ফেলেন রমজান সাহেব।যেমনটা এখন।কান্নায় ভেংগে পড়ছেন বাবা মা উভয়েই।কতদিনের তৃষ্ণা মিটলো।আদর ভালোবাসা
বিনিময়ের শেষ পর্যায়ে
মাহরুর বলে,
“আসি চাচা”
ফরিদা বেগম বললেন, “তুই কোথায় যাস? খাবি না?”
“না চাচী।বাড়ি যাবো।….অনেকদিন যাই না”
“খেয়ে যা অন্তত!”
“রাস্তায় খেয়েছি।একটু ঘুমাই গিয়ে।ক্ষিদে পেলে এসে খেয়ে নিবো। চাবিটা দিন”
রমজান সাহেব বললেন, “এখানেই বিশ্রাম করতি?”
“না চাচা। বাড়িই যাবো”

এক এক পদচারণ নড়বড়ে।যেনো কেউ পায়ে পাথর বেঁধেছে।বুকের অস্থিরতা বাড়ছে বাড়ির কাছাকাছি এসে।তারপরও এসে পৌঁছায়।যেখানে হাসি,কান্নার সমারোহ ছিলো। অতীত পুরোটা কেটেছে।আজ খাখা করছে আঙিনা।ভয়ঙ্কর শব্দহীনতা বিরাজমান।শুকনো ঢোক গিলে ভেতরে আসলো মাহরুর। উঠোনে ধুলা পড়া পুরোনো মোড়ায় বসে পড়লো ধপ করে।

অন্তরের গভীর থেকে ডাক আসলো, “আম্মা!”

ব্যাস!চোখ টলমলে হয়েছে নোনাজ্বলে।বক্ষ ভেদ করে হৃদয় বেরিয়ে আসবে আসবে ভাব।এদিক ওদিক চাইলো মাহরুর।মা নেই।তার শব্দ নেই।তার অস্তিত্ব নেই।চার বছর আগে কাধে করে রেখে এসেছে সেখানে। যেখান থেকে কেউ ফিরে আসেনা।

“আম্মা…আমার অপেক্ষা করো?অনেকদিন পর এসেছি।ক্লান্ত আমি,ক্ষিদে পেয়েছে।খাবার দিবে না?….আম্মা তোমার উপর আমার অভিমান ছিলো।কিন্তু তুমিতো আমার মা। রাগ থাকতে পারি আমি?….তুমি জেদটা না করলে আজ সব ঠিক থাকতো না আম্মা?আমাকে দেখো কি অবস্থা আমার? চন্দ্রকে দেখো?আমরা কেউ ভালো নেই।আম্মা আসবে একবার?……আসো আবার সব ঠিক করে নেই।ভুলগুলো শুধরে ফেলি আম্মা।”

চলবে….

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-১০

0

চন্দ্র’মল্লিকা ১০
লেখা : Azyah_সূচনা

কতই তো হৃদয় ভাঙ্গে প্রতিদিন।আবার ভেঙে যাওয়া টুকরোগেলো তুলে জোড়াতালি দেয়। বিচ্ছেদের বেদনায় ভুগেছে অনেকে যুগ যুগ ধরে।আবার উঠে দাঁড়িয়েছে ঢলমলে পা নিয়ে।সবই দ্বিপাক্ষিক।কেউ দুঃখ দিয়ে সুখ পায়।কেউ নিজের সুখটা উজাড় করেও দুঃখী।সম্মুখে নিরপরাধ মানুষকে আগুনে পুড়তে দেখে প্রেমিক হৃদয় সস্তি পায় কখনো?মিষ্টির মুখে তার মায়ের দুর্দশার গল্প শুনে হাহাকার করছে ভেতরটা।এবারও তার করার মতন কিছুই নেই।কোনো অধিকার নেই।যখন ছিলো সুযোগ তখনও ঠিকঠাক সদ্ব্যবহার করতে জানেনি মাহরুর।

“চন্দ্র এসেছিল মাহি ভাই?”

শিরীনের প্রশ্নের জবাবে মাহরুর ছোট্ট করে উত্তর দেয়, “হু”

“কেমন আছে ও?”

ছোট্ট আয়নায় চেয়ে শেভ করতে করতে হাতটা থেমে যায়।কেমন আছে এর উত্তরটা শিরীনের কাছেও ভালো লাগবে না। হায় হুতাশ করবে। মাহরুরের হৃদয়ের বেদনা বাড়বে।কি দরকার?বাদ দিলো মাহরুর।

পূনরায় হাত চালাতে চালাতে বললো, “আছে ভালোই”

চট করে শিরীন বলে উঠে, “আমার মনে হয়না মাহি ভাই ভালো আছে।স্বামী মরা মেয়ের শশুরবাড়িতে ভালো থাকাটা অসত্য।”

“হুঁম।”

ভাইয়ের ছোট্ট ছোট্ট উত্তর বড় গল্প বলছে।সেটা ভালোভাবেই বুঝেছে শিরীন।একই সাথেতো বেড়ে উঠা। চাল চলন সবটাই মুখস্ত।যেমন শিরীন কিছু মুখ ফুটে বলার আগে মাহরুর বুঝে ফেলতো।ঠিক একইভাবে ভাইয়ের গোমড়া মুখের আড়ালে কি সেটা শিরীনের বোধগম্য।

“মাহি ভাই?”

“বল শুনছি”

গলা ভেজায় শিরীন।লম্বা একটা শ্বাস টেনে বললো, “চন্দ্রকে নিয়ে…আবার ভাববে?”

ব্লেডটা গালে গেঁথে গটগট করে রক্তপাত শুরু হয়।সাদা ফেনার মাঝে লাল টকটকে রক্ত!চমকায় মাহরুর।কথার ঝাঁপটায় হাত ফস্কে গেছে। ভড়কেছে শিরীনও।তাকে সুযোগ না দিয়েই তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে লাগে মাহরুর।

খানিক উচু গলায় বলে, “আজেবাজে বকবি না শিরীন।”

“তুমি আগে কাঁটা জায়গায় মলম লাগাও”

এন্টিসেপটিক ক্রিম গালে লাগিয়ে দেয়।ভীষণ রকমের বিরক্ত সে।ভীষণ!শিরীনের এমন কথা নগদ তার মনে অসাধু ইচ্ছের জাগরণ করছে সেটা জানে? লাগাম শক্ত করে টানতে হবে।

শিরীন বললো, “কি আজেবাজে বললাম?চন্দ্র সেখানে ভালো নেই।আর এখানে তুমি।দুজন মিলে যাও।এতেই তোমাদের দুজনের সুখ”

শব্দ করে দুহাত মিলিত করে শিরীনের সামনে মাহরুর।হাত জোড় করার ভঙ্গিতে।শক্ত মুখ আর করুন গলা নিয়ে বললো, “আর এই বিষয়টা কোনোদিন তুলবি না।হাত জোড় করে বলছি।বাড়ি যা”

শিরীন একটি জেদী। চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলা তার আগের স্বভাব।তবে ভালো কাজেই ধারালো মুখ ব্যবহার করে। সরাসরি ভালোবাসা প্রকাশের ঘাটতি আছে তার মধ্যে।সেও রাগী সুরে বলল,

“হ্যা বলবো না!আমার কি?চন্দ্র আর ওর নিস্পাপ বাচ্চাটাকে জাহান্নামে পড়ে থাক। তুমি মানসিক কষ্টে আছো।আর চন্দ্র পুরো মেয়েটাই আস্ত একটা কষ্ট।…..কি ভেবেছো ওর পিঠের দাগ আমি দেখিনি?শাড়িতে লুকিয়ে রাখলেই দৃষ্টির আড়াল হয়? আজকালতো আপনজন থেকেও বেচারি নিজেকে আড়াল করে বেড়ায়।ধ্বংস হতে থাকুক তারা।তুমি এবারও হাতে হাত রেখে তামাশা দেখো!”

আকাশ ছোঁয়া ভাবনা। চন্দ্র কি সাধারণ?সে আকাশের চাঁদ।হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়না।যত কাছে মনে হবে?সেই চিন্তা থেকেও দূরে তার অবস্থান।ধরতে গেলে আরো দূরে সরবে।যেমন বলেছিলো চন্দ্রকে।বয়সে আমাকে ধরতে পারবি না।যত কাছে আসবি আমি লাফিয়ে আরো দূরে চলে যাবো। ইতিহাস পুনঃপ্রচার হয়। চন্দ্র থেকে পালিয়ে বেড়ানো মাহরুর এর কাছে সেই চন্দ্রই অধরা।

__

“মা!মা চোখ খুলো?কি হয়েছে মা?”

ক্ষুদ্র দুটো হাত মায়ের গাল চাপ্রাচ্ছে।দাদী ধাক্কা দেওয়ায় মাথায় আঘাত পেয়েছে চন্দ্র। অর্ধজ্ঞান অবস্থা! পরিশ্রান্ত দেহ।মেয়ের কথা কান অব্দি পৌঁছালেও কোনো প্রতিক্রীয়া দিতে লাগলো না।
বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে মুখে পানি ছিটায় মিষ্টি।মায়ের কাছ থেকেই শিখেছে এটাও।দাদী অজ্ঞান হওয়ায় তার মাও এই পন্থা অবলম্বন করেছিলো।কাজ হলো না। দিশেহারা মিষ্টি দাদীকে ডাকে।সেও গুরুত্বহীন।

বলে, “মরবে তোর মা।এরপর তোকে দেখাবো”

“দাদী আমার মা মরবে না।মাকে একটু ডাকো দাদী!”

“যা এদিক থেকে।”

নিজের ভার নিজেরই বহন করতে হবে চন্দ্রের।মেয়ের জন্য হলেও বেচে থাকা আবশ্যক।তাকে হারালে মেয়েটার কত অধঃপতন আসবে?কল্পনার বাহিরে।বারংবার নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাড়ায় কোনোমত। ইতিমধ্যে মাকে উঠতে দেখে মিষ্টি এসে হাজির। দুর্বল হাতে মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে আসে বাড়ির বাহিরে। বেশিদূর এগোতে পারলো না।দরজার সামনে আসতেই টলমল করে পা।পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলায়।

আকস্মিক মিষ্টি চেচিয়ে উঠলো।ডাকলো, “মামা! মামা!”

রেদোয়ান ও মাহরুর উভয়ই দ্রুত গতিতে মাথা ঘোরায়। অবাধ্য মনটা বুঝি এই ডাক শোনার জন্যই মিছে বাহানা দিয়ে নিয়ে এসেছিল চন্দ্রদের বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে। আড্ডাতো তার স্বভাবে নেই।তবে?রাস্তার অপরপাশে মিষ্টি আর চন্দ্রকে দেখে বুকটা ধ্বক করে উঠে। কাচ নির্মিত চায়ের কাপটা জমিনে পড়েছে। রেদোয়ানকে ফেলেই এগিয়ে গেছে।

গেট ধরে দাড়িয়ে থাকা চন্দ্রের দিকে চেয়ে নেয় একবার।এখানে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে।তবে প্রশ্ন করলো মিষ্টিকে।ওই যথাযথ উত্তর দেবে,

“কি হয়েছে মিষ্টি?”

“মামা … মা অসুস্থ।দাদী বলেছে মরে যাবে।তুমি কিছু করো মামা!”

ভয় হুড়মুড় করে বেড়ে উঠলো।এসব ফালতু কথা শুনেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। রেদোয়ান কিছু বলতে চাচ্ছিল।তার আগেই মাহরুর বলে,

“রেদোয়ান একটা গাড়ি ডাকো জলদি!আর মিষ্টিকে কোলে নাও।”

মাহরুরকে দেখে চন্দ্রের অবস্থা উন্নতির বদলে অবনতির দিকে গেলো।শরীর প্রায় নিষ্প্রাণ! এর মাঝে অতীত বর্তমানের সকল স্মৃতি মাথায় চড়ছে।

মাহরুর হাত এগিয়ে বললো, “রাগ দেখাবি না।এখন তোর সুস্থতা তোর অভিমানের চেয়ে বেশি জরুরি।আয় আমার সাথে।”

চন্দ্র চোখ বুজে। মাথা দোলায় দুপাশে।সে যেতে ইচ্ছুক নয়।বিনা আওয়াজে না বোধক উত্তর দিলো। মাহরুরকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে শরীর আর সাথ দিলো না।মাথা ঘুরে উঠেছে তীব্রভাবে।সামলে নেওয়ার জন্য শক্তপোক্ত হাত জোড়া আছে।এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলো। রেদোয়ান গাড়ি ডেকেছে। চন্দ্রকে নিয়ে উঠে গেলো দ্রুত।বুকে মাথা পেতেছে?তাও ইচ্ছেকৃত না।অজ্ঞান অবস্থায় বুকে লেপ্টে আছে চন্দ্র।এই মুহূর্তে যে অনুভূতিটা হচ্ছে সেটা ভাষায় বোঝানো অসম্ভব।মাথা থেকে পা অব্দি সম্পূর্ন শূন্য মাহরুর। চন্দ্রের শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা হতে দেখা গেলো।ঘনঘন নিঃশ্বাস টানছে।জ্ঞানহীন চন্দ্রকে ক্ষণিকের জন্য নিজের ভেবে চেপে ধরলো নিজের সাথে। মরুর বুকে এক ফোঁটা পানির সন্ধান।মনের মধ্যে পুষে রাখা চন্দ্রকে কাছে পেয়ে বেহায়াপনা করলো।ছলেবলে হাহাকারটা থামুক।ভাবতে লাগলো এভাবেই মৃত্যু হলে জীবন নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকতো না মাহরুরের।

“চন্দ্র!আমার চন্দ্র।এত কষ্ট কেনো করছিস?তুই শুদ্ধ,পবিত্র।তোর ভাগ্যে রাজ্যের সমস্ত সুখ থাকার কথা।”

পাশে বসা মিষ্টি মাহরুরের হাত টেনে ধরলো।বললো, “মামা।মার কি হয়েছে?”

“কিছু হয়নি মিষ্টি।মা একদম ঠিক আছে”

“তাহলে মার চোখ বন্ধ কেনো?”

“তোর মা ক্লান্ত।তাই একটু ঘুমাচ্ছে। দেখবি একটু পরই জেগে উঠবে”

___

“রক্ত শূন্যতা,শরীর অনেক দুর্বল।”

চন্দ্রের চেকআপ শেষে এটাই জানালেন ডাক্তার। সেলাইন লাগিয়ে রেখেছেন।বহুদিনের এই দুর্বলতা।ডাক্তার আরো জানান অন্তত দুইদিন ভর্তি রাখতে হবে।আরো অনেক চেকআপ বাকি।তবে এখন সুস্থ আছে এটাই সস্তিদায়ক বাক্য।

একজন নার্স এসে জানতে চাইলেন, “আপনি পেশেন্টের কি হন?”

এখানে থমকে দাড়ায় মাহরুর।কি সম্পর্ক তাদের?কিছু বলে পরিচয় দেওয়ার মতোন কেউই না সে। নার্স অপেক্ষা করছে। রেদোয়ান শিরীনকে কল করে মাত্রই ফিরলো। মাহরুরকে নিরুত্তর দেখে রেদোয়ান বললো,

“নার্স আমি পেশেন্টের ভাই।বলুন কি সমস্যা?”

রেদোয়ান এর গায়ে পুলিশি পোশাক দেখে নার্স বললো, “পেশেন্টের গায়ে আঘাতের চিহ্ন।আমরা সন্দেহ করছি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স।আপনিতো পুলিশ?”

“জ্বি”

“আসুন আমার সাথে।ডাক্তারের সাথে কথা বলবেন।”

মাহরুর এগিয়ে আসতে চাইলে তাকে থামিয়ে দিল নার্স।বললো, “আপনি এখানেই থাকুন”

মিষ্টি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে।এই ছোট্ট মনে মায়ের জন্য কি অগাধ ভালোবাসা।এখনও এই পৃথিবীকে চেনেছি ঠিকভাবে।শুধু একটাই অনুভূতি আছে।ভালোবাসা।বড় হলে আরো অনুভূতিরা যোগ দিবে।ঘৃনা,রাগ আরো কত কি? মাহরুর নিদ্রায় নিম্মজিত মিষ্টির পানে চেয়ে ভালো বয়েসটা তারও এখানে এসে থেমে যেতো?পৃথিবীর মায়াজালে জড়াতে হতো না তাহলে। কঠিনতার পরিবর্তে সরল জীবন যাপন করতো।

“রেদোয়ান একটা সাহায্য চাইবো”

মিনমিনে গলায় বললো মাহরুর।তারই প্রেক্ষিতে জানতে চাইলো রেদোয়ান।কি রকমের সাহায্য?বললো,

“বলো কি সাহায্য।আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে অবশ্যই করবো।”

“চন্দ্রকে ওয়ার্ড থেকে একটা ক্যাবিনে শিফট করতে চাইছি।কিন্তু হাতে অত টাকা নেই।আমাকে কিছু টাকা উধার দিতে পারবে?”

ছোটবোনের স্বামীর কাছে খুবই লজ্জিত হয়ে টাকা চাচ্ছে মাহরুর।দেয়ালে পিঠ না ঠেকলে এই দিনটা আসতো না।যে টাকা আছে সেটা দিয়ে আগামী দুদিনের ক্যাবিন ভাড়া হবে না। তাছাড়াও আরো অনেক খরচ আছে।

আরো একটু সবিনয়ে মাহরুর বললো, “আজ ব্যাংক বন্ধ। রবিবার ব্যাংক খুললে আমি নাহয় টাকাটা ফেরত….”

“চুপ থাকো মাহরুর।আমি আগেই সব টাকা পরিশোধ করে এসেছি রিসিপশনে।আর ক্যাবিনে শিফট করার কথা?এটা আমার মাথায় আছে।রাত নয়টায় একটা ক্যাবিন খালি হবে সেখানে চন্দ্রকে শিফট করে দিবো।”

“অনেক ধন্যবাদ তোমাকে ধন্যবাদ ভাই”

“কেমন যেনো তুমি মাহি।আপনকে আপন ভাবতে পারো না।”

রেদোয়ানের অভিযোগ আজকের নয়।পুরোনো দিনের।যেদিন থেকে বোন জামাই না একজন শুভাকাঙ্ক্ষী একজন বন্ধু হিসেবে জেনেছে সেদিন থেকেই।তার ভাষ্যমতে মাহরুর নিজের বোনকে অব্দি পর করে দিয়েছে।

___

“চন্দ্র”

পরিশ্রান্ত চোখ তুলে দেখলো।ডাকটা এসেছে সদর দরজা থেকে।জ্ঞান ফিরেছে। মেয়েটাকে চোখ খুলেই নিজের পাশে পেয়েছে।এইতো সস্তি। সস্তির মাঝে ঝড় তুলে দেওয়ার মতন আওয়াজের আগমনে বোবা হয়ে রইলো চন্দ্র।

“এখন কেমন লাগছে?”

ভাঙ্গা গলায় জবাব দিলো, “ভালো”

চন্দ্রমল্লিকাকে চমকে দিয়ে মাহরুর বলে উঠে, “মন আর দেহ উভয়ের ক্ষত সারতে সময় লাগে।তুই বলছিস ভালো আছিস তুই?”

কেনো দরকারি মুহূর্তে কারো আগমন হতে হবে?চাচ্ছিলো একটু কথা বলতে?দুয়েক বাক্য ছাড়িয়ে গল্প টেনে আনতে।হলো না।নার্স এসেছেন।চারুকে ঘুমের ইনজেকশন দেবেন।তার ঘুম দরকার।লম্বা একটা বিশ্রাম দরকার।তাই। চন্দ্রমল্লিকারও এতে সায় আছে।ঘুমিয়ে পড়লে আর মাহরুরের অস্তিত্ব অনুভব করবে না।পুড়তে হবে না।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটা প্রশ্ন নিজ থেকেই করলো, “মিষ্টি দুপুর থেকে না খাওয়া।ওকে যদি একটু কষ্ট করে খাইয়ে দিতেন উপকার হতো আমার”

মাহরুর ঠান্ডা স্বরে উত্তর দেয়, “খাইয়েছি”

রাত বাড়ছে।নির্ঘুম দুটো চোখ কতক্ষন?কতঘন্টা একদিকে চেয়ে?সেটা বোধয় কেউ জানে না। ক্যাবিনের দরজা খোলাই রেখেছে মাহরুর।রেদোয়ান বাহিরে।চলে যেতে বললে সে উত্তরে বলেছিলো নাইট ডিউটি করার অভ্যাস আছে।সে পারবে বিনা ক্লান্তিতে রাত জগতে।বুকে হাত বেঁধে চন্দ্রের দিকে চেয়ে থাকা মাহরুরের মন বলে উঠলো,

“বেহায়া তুই!অন্যের স্ত্রী আর অন্যের মায়ের দিকে চেয়ে আছিস।বুকে জরিয়েছিলি।”

নিজের কঠিন ভাব ভঙ্গি বজায় রেখে নিজেকেই নিজে উত্তর দিলো, “বেশ করেছি!”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৮+৯

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৮ + ৯
লেখা : Azyah_সূচনা

দিবা রাত্রির আবর্তনে নবীন বর্ষের আগমন।রূপ বদলেছে এই পারিপাশ্বিক অবস্থার সাথেসাথে প্রকৃতিও।এক নয়ের সমন্বয়ে বয়েস এখন ঊনবিংশ।একবার দর্শনের ইচ্ছায় কাতরে উঠেছে হৃদয়।হৃদয় মরুভূমি কন্ঠ শুনতে।নির্দোষ উভয় মানব মানবী।তবে দুঃখের ভাগটা শুধু একজনের কেনো?জীবনটা গল্প হলে কেমন হতো?পরিশেষে সুখের সমাপ্তি থাকতো।

‘ পরিবার ‘ কখনো সরল আবার কখনো অত্যন্ত জটিল শব্দ। দূর চোখে দেখতে জোট বন্ধন। কাছে এলেই দুর্বোধ্য।ভিন্ন ভিন্ন মানুষ, চরিত্র আর সম্পর্কে গড়ে ওঠা একটা ঘর।যেখানে এই মানুষগুলোর বসবাস।সমস্যা আছে, মতবিরোধ আছে।তারপরও সংঘবদ্ধ। সেটি একে অপরের প্রতি টান,ভালোবাসা।এই ঘরে বিষদানা ফুটে উঠলে করলার চেয়ে তেতো হয়ে উঠে সম্পৃক্তি। মাহরুর ও মল্লিকার দু পরিবারের মধ্যেও বিষাক্ততা মিশে গেছে। সম্পর্কের রুঢ় অবনতি।দেখা নেই সাক্ষাৎ নেই।রেগে গিয়ে অনেকবার ছেলেকে দেখতে চেয়েও পারেননি লিজা বেগম।ঢাকা গিয়েছিলেন মেয়ের কাছে। মাহরুরকে ফেরাতে পারেনি।শক্ত মূর্তির মতন জমিনে গেড়ে আছে পা জোড়া।ফিরবে না।মায়ের অহেতুক ইচ্ছা পূরণ করতে সে রাজি নয়।

“শুভ জন্মদিন সখী”

উদাস মন আলোকিত হয়। শশী এসেছে।এই একটা মানুষ যার প্রতি বছর মনে থাকে মল্লিকার জন্মদিন।ঠিক সময়ে চলে আসে।বিয়ের পরও এসেছে আজ।নেত্র তুলে তাকায় শাড়িতে পরিপূর্ণ নারী রূপে শশীকে।বিয়ের পর থেকেই শাড়ি পরে।দেখতে বড় দেখায়।চারমাস পর দেখলো তাকে।চোখ জুড়িয়ে আসে।জড়িয়ে ধরতে চাইলে শশী থামায়।

বলে, “এই এই থাম!তোর জন্য কি এনেছি জানিস?”

“কি?”

“মানুষ জন্মদিনে কেক কাটে।আমিও তোর দুলাভাইকে বলে তোর জন্য কেক এনেছি।আয় বসার ঘরে”

ভাগ্য করে একজন স্বামী পেয়েছে শশী। খাঁটি পুরুষ মানুষ।প্রতি সপ্তাহে দুয়েকবার নিজের ফোন দিয়ে রমজান সাহেবের নাম্বারে কল দেয়। শশীর সাথে কথা বলিয়ে দেয় মল্লিকার। কলেজেও ভর্তি করিয়েছে।শিক্ষিত মানুষের ভিন্ন চিন্তাধারা।পড়া আর সংসারের চাপে বাপের বাড়ির রাস্তা ভুলে যাওয়ার উপক্রম শশীর।

“আসসালামু আলাইকুম দুলাভাই”

“এইতো মল্লিকা।কেমন আছো?”

“ভালো।আপনি কেমন আছেন?আর বাড়ির সবাই?”

আরিফ উত্তর দেয়, “একদম ফার্স্ট ক্লাস।সবার দোয়ায়।তোমার নাকি আজ জন্মদিন?তোমার বান্ধুবি এক সপ্তাহ আগ থেকে বলে বলে আমার কানের পোকা পচিয়ে ফেলেছে।বাধ্য হয়ে ছুটি নিয়ে আসলাম”

শশীর দিকে চাইলো মল্লিকা।কনুই এর গুতা দিয়ে বললো, “কিরে?কেনো জ্বালিয়েছিস দুলাভাইকে।আমরা জন্মদিন পালন করি কখনো?”

“করিস নাতো কি হয়েছে।এবার করবি? অষ্টাদশ পেরিয়েছিস বিশেষভাবে পালন কর”

বয়স বাড়লে কি হবে? মাহরুর ভাইকে পাওয়া যাবে?সেতো আরো দেড় বছর লাফিয়ে দূরে চলে গেলো।ধরা ছোঁয়ার বাহিরে চলে গেছে।মনে পড়ে না হয়তো তার চন্দ্রের কথা।ভুলে গেছে জাদুর নগরী ঢাকায়।

খোশগল্পে মেতে উঠলো শশী আর মল্লিকা। সর্বপ্রথম জিজ্ঞেস করলো, “মাহি ভাইয়ের কোনো খোঁজ আছে?”

“নাহ।হয়তো হারিয়ে গেছে কোথাও?”

“ফোন করেনা?”

“আব্বার ফোনে ফোন করেছিল কয়েকবার।আমাকে চায়নি”

স্বাভাবিক মুখ মল্লিকার। তারপরও একরাশ হতাশার ছাপ। অপ্রসন্নতা ঘেরা। ড্যাবড্যাব চোখের চাহনি শূন্যে।না জানে কত কষ্ট পুড়ে রেখেছে হৃদ গভীরে?

“এখনও ভালোবাসিস?”

“ভালোবাসা অপেক্ষার সাথে তীব্র হয়েছে।”

মল্লিকার কথার ধাঁচে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে শশী। হঠাৎ উঠে গেলো। আরিফের কাছ থেকে ফোন চেয়ে এনেছে।মল্লিকার পাশে বসে বললো,

“নে একটা কল দে।”

“কাকে?”

“তোর মাহরুর ভাইকে।”

নাম্বারটি মুখস্ত। ঠথস্ত।বাবার নাম্বারে যতবার কল এসেছে।ততবার একটু একটু করে টুকে নিয়েছে। দ্বিধায় থমকালো মল্লিকা।কল করা উচিত হবে?হতে পারে মাহরুর ভাই ব্যস্ত। শশীর জোরাজোরিতে কলটা মিলায় কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে।

“হ্যালো”

ব্যস্ত কন্ঠস্বর শুনে ধ্বক করে উঠে মল্লিকার হৃদপিণ্ড।বুকে হাত চেপে ধরে মল্লিকা।গলায় জট পাকিয়ে আসছে পরবর্তী কথা।

“হ্যালো কে বলছেন?”

এবারও উত্তর দিতে পারলো না মল্লিকা।ঝিম ধরে যাচ্ছে মাথায়।নিঃশ্বাসের আওয়াজে চট করে ধরে ফেললো মাহরুর।আগেও কল করে এভাবেই নির্বাক ছিলো সেই কন্যা।

ব্যস্ততা কাটিয়ে নরম গলায় ডাকলো, “চন্দ্র”

মাহরুরের ডাক মল্লিকার সমস্ত জট খুলে দিয়েছে।মুখ ফুটে বেড়িয়ে আসল, “কেমন আছো মাহরুর ভাই?”

“আছি….মোটামুটি”

মাহরুরের গলার স্বরে পরিবর্তন আসে শেষ কথাটায়।ভালো থাকার আড়ালে লুকিয়ে রাখা ক্লান্তিকে এড়ানোর চেষ্টা করছে।

“ভুলে গেছিস আমায় চন্দ্র?”

এই প্রশ্নতো মল্লিকার করার কথা।সেতো রোজ মনে করে তার মাহরুর ভাইকে।সে নিজেই ভুলে গেছে।

“তোমার কি মনে হয়?”

“আমি জানি না।রমজান চাচাকে কল করলে একটাবারও কথা বলতে আসিসনি।কেনো?আমার উপর রেগে আছিস?”

“আমি তোমার উপরে রেগে নেই মাহরুর ভাই। তুমিওতো কথা বলতে চাওনি।”

মাহরুরের বোধগম্য হলো দুজনেই একই নৌকায় ভেসে আসছে। উভয়েই চেয়েছিলো কথা বলতে।তবে বাঁধা ছিলো বিশাল।কাজের আড়ালে চোখ যায় ক্যালেন্ডারে।তারিখটা চিরচেনা। নীরব থেকেই বারবার মনে করতে চাইলো।কি আজ?চোখ বুজে মস্তিষ্কে জোর দেয়। খট করে মাথায় এসেছে।আজ চন্দ্রের জন্মদিন।

“জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা চন্দ্র”

প্রতীক্ষার দুঃখ কেড়ে এক চিলতে হাসি উপহার দিয়েছে মাহরুর।তার মনে ছিলো মল্লিকার জন্মদিনের কথা? আপ্লুত হয়ে উঠে মল্লিকা। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নেয় অল্প সময়ের জন্য।

মাহরুর প্রশ্ন করে, “তোর কত বছর হলোরে?”

“উনিশ”

“বাহ্!চন্দ্র বড় হয়ে গেছে”

“হুঁ”

“কি করছিস?”

“আমিতো দেড় বছর যাবত অপেক্ষাই করছি মাহরুর ভাই।আমার আর কোনো কাজ নেই।ফিরে এসো মাহরুর ভাই।আমার চেয়ে বেশি চাচী কান্না করে তোমার জন্য। অন্ততঃ তার জন্য ফেরো। ইদানিং শরীর ভালো থাকে না তার। কাল খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম তোমাদের বাড়িতে। দরজায় দাড়িয়ে ছিলাম। চাচী খাবারগুলো নেয়নি।খাওয়া দাওয়া করেনা ঠিকমতো।তুমি চাচীর কথা মেনে নাও।”

মল্লিকার এতগুলো কথার বিনিময়ে মাহরুর প্রশ্ন করে, “তুই কি জানিস আম্মা আমার কাছে কি চায়?”

“না মাহরুর ভাই।আর আমি জানতেও চাই না।আমার ভুলের কারণে তোমাদের মধ্যে মনোমালিন্য চলছে।তুমি এসে মানিয়ে নাও চাচীকে।সে সত্যিই অসুস্থ।সেই সুবাদে আমিও তোমাকে একটু দেখে নিবো”

___

তিনদিন দোটানায় ভুগে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাহরুর।ফিরবে গ্রামে।এতটা রাগ দেখানো আবার বাড়াবাড়ি। নিশ্চয়ই মা এতদিন তার বিয়ের ব্যপারটা ভুলে গেছে।এক ঘণ্টার চিন্তায় টিকেট কিনে আনলো।জমিয়ে রাখা টাকা নিয়ে মার্কেটে টুকটাক কেনাকাটা করে বাসে উঠেছে।ওই মেয়েটাও অপেক্ষায়।তাকে আর কষ্টে রাখা অন্যায় হবে।এবার নিয়ে একটা ব্যবস্থা করবেই।গতবার অল্পতে রেগে গিয়েছিল বলে পরিস্থিতি খারাপ হয়।এইবার নাহয় সময় নিয়ে বোঝাবে মাকে।ছেলের ভালোবাসায় নিশ্চয়ই মানবেন।সবটা ঠিকঠাক করার আশা নিয়েই সকাল নয়টায় সেই পুরোনো গ্রামের গলিতে এসে পৌঁছায়।

“মাফ করে দাও আম্মা”

“কথা বলবি না তুই।এতদিন পর মনে পড়ছে আম্মার কথা?”

মায়ের কোলে জোর জবদস্তি মাথা পেতে শুয়েছে মাহরুর।যেমনি হোক।এটা চিরশান্তির জায়গা।ঢাকা এসেছিলেন দুইবার।ছেলে দেখা দিয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য।

“মনে পড়েছে।তাইতো বেশিদিনের ছুটিতে এসেছি।পুরো পনেরো দিন থাকবো।”

মিথ্যে রাগ দেখিয়ে লিজা বেগম বললেন, “তোর মালিক তোকে ছুটি দিলো এতদিনের?”

“কেনো দিবে না?এতদিন ওভার টাইম কাজ করেছি। ছুটির দিনেও ছুটি নেইনি।সব ছুটি জমিয়ে এবার অনেকদিন গ্রামে আরাম করবো”

“কর আরাম!”

“আম্মা দুপুরে টক ডাল আর শুটকি ভর্তা করবে?ঢাকায় খাবারের স্বাদ পাইনা”

ছেলের মাথা তুলে উঠে পড়লেন লিজা বেগম।আবদার করেছে।তাও এতদিন পর।পূরণ না করে পারে?আয়োজন করতে লাগলেন সবকিছুর। মাহরুর সারারাত ঘুমিয়ে এসেছে।দেহে ক্লান্তি নেই বললেই চলে।হাত মুখ ধুয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসে।

লিজা বেগমকে বলে, “আম্মা আমি চাচাদের বাড়ি যাচ্ছি।এগুলো দিয়ে আসি”

“কি এগুলা?”

“এইতো সবার জন্য টুকটাক এনেছি জিনিস। তোমারটা রাতে দিবো।”

“এতদিন পর আসছিস বলে বারণ করছি না।কিন্তু খবরদার!ওই মাইয়ার দিকে যেনো চোখ না যায়”

মায়ের কথা কানে তুললো না।রাগ দেখানো থেকে বিরত থাকার পণ করে এসেছে।সে দেখতে চায় চন্দ্রকে। এতোটা দিনে কি তার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে নিশ্চয়ই। অপ্রাপ্ত বয়স থেকে প্রাপ্ত বয়সে পদার্পণ করা কন্যাকে কেমন দেখাবে দেখার জন্যে মনটা উশখুশ করলো।নিজেকে চলার পথে প্রশ্ন করেছে মাহরুর।কিসের এত তাড়া?কেনো এই অল্প সময়ের পথকে দীর্ঘ মনে হচ্ছে? চন্দ্রকে দেখবে বলে?সেতো ভালোওবাসে না চন্দ্রকে।তার মতন অনুভব করে না।তাহলে? মায়াটা কি এক ধাপ উপরে উঠলো তাহলে?

স্বাস্থ্যবতী এক মেয়ের দেখা মিলল।রোগা পাতলা গড়ন পরিবর্তিত হয়েছে। নারী রূপে ফুটে উঠার পূর্ব মুহূর্ত। রঙটা যেনো আরো উজ্জ্বলতায় ঝলকাচ্ছে। উচ্চতায় ব্যাপক পরিবর্তন।শুনেছে আঠারোর পর উচ্চতা বাড়ে না। তাহলে চন্দ্রের ক্ষেত্রে ভিন্ন কেনো?এক-দেড় বছর একটা মেয়েকে এত পরিবর্তন করতে পারে? বিপরীত দিকে মাহরুর ভাই দৃষ্টি গোচর হতেই ভ্রমে ডুবে যায় মল্লিকা।মন বলে দিলো তোর অনুরোধেই ফিরেছে।এই মুখ দর্শনের জন্যেই চোখ শুকিয়ে মরুভূমি হচ্ছিলো। কাছে এসে বলার জন্য তাড়না দিচ্ছে।

“এক বছর কেনো একশত বছর সময়ও তোমাকে আমার হৃদয় থেকে মুছতে পারবে না।”

সেটা মনের মধ্যেই রয়ে গেলো। ফরিদা বেগম গলা খাঁকারি দিয়ে মেয়েকে সরিয়ে নেন। মাহরুরকে ঘরে ডেকে নিলেও পুরোনো কথা তিনি ভুলেননি।কোনোভাবেই দুজনকে একে ওপরের মুখোমুখি করবেন না।সময় পেরোয় আর চন্দ্রের দেখা মিলল না। মেঘেরা আড়াল করে লুকিয়ে দেখছে তাকে। মাহরুরের নজরে যেনো গ্রহণ লেগে যাবে।হতাশ মাহরুর ফিরে আসে।

“তোর অপেক্ষা এখনও শেষ হয়নি চন্দ্র।তোর চোখ অল্প সময়ে অনেক কথা বলেছে আমায়।এতদিনেও তোর কোনো অভিযোগ নেই আমার প্রতি।আমার থেকে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মরিয়াও হোস নি।নিজের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যাচ্ছিস।আমাকে পেয়ে তুই না,তোকে পেয়ে আমি ভীষণ সৌভাগ্যবান হবো।অনেক ধৈর্য শেখার বাকি তোর থেকে।চেষ্টা করবো আমি।তোর মাহরুর ভাই চেষ্টা করবে যেনো তোর অপেক্ষারা ব্যর্থ না যায়।”

লেখাটি পড়ে মল্লিকা আনমনে হেসে ফেলে।একই পূর্ণতা পাওয়ার আগাম বার্তা? চন্দ্রমল্লিকার পূর্ণতা সমাবেশ? আন্দোলিত হৃদয়কে থামানোর কোনো পথ নেই।স্বল্প খুশি এলাহীভাবে উৎযাপন করতে শুরু করেছে।

___

মোতালেব হোসেন এসেছেন।সাথে আরো চারজন মানুষ নিয়ে।ঘরে পুরুষ মানুষ বলতে মাহরুর। মুরুব্বী হিসেবে লিজা বেগম।ছেলের আসার চারদিনের মাথায় তাদের ডেকে হাজির। চিনতে ভুল করলো না মাহরুর।খুব ভালো করেই চেনেন মোতালেব হোসেনকে।মায়ের দিকে কঠিন দৃষ্টি ছুঁড়ে চোয়াল শক্ত করে বসে রইলো।

লিজা বেগম চা নাস্তা এগিয়ে দিয়ে বললো, “দেখেন ভাই।লাখে একটা আমার ছেলে।আপনার অপছন্দ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।”

মোতালেব হোসেন তাল মিলিয়ে উত্তর দেন, “আপা আপনার ছেলেরে আমরা আগেই দেখে পছন্দ করছি।নাহয় বিয়ের প্রস্তাব দেই?”

“তা অবশ্য ঠিক।মেয়েরে বিয়ে দিছি ঢাকায়।আমার ছেলেও বিরাট চাকরি করে ঢাকায়।বিয়ের পর হিরাকেও সাথে নিয়ে যাবে।”

একেকটা কথায় বারংবার চমকিত মাহরুর।মায়ের মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।এমনভাবে কথা বলছে যেনো বিয়ে ঠিকঠাক।এতগুলো মানুষের সামনে কোনো রকম সমস্যা তৈরি করতে চাইছে না বলেই দমে আছে।

মোতালেব হোসেন বললেন, “আমরা কি কথা পাকা ভাববো তাহলে?”

“আমার কোনো আপত্তি নাই ভাইজান।” লিজা বেগম দ্রুত সম্মতি দেন।

এবার মুখ খুললো মাহরুর।আর সহ্য হচ্ছে না এসব যন্ত্রণা।জেদকে আটকে থমথমে গলায় বললো, “চাচা আমাদের সময় দরকার একটু।এতবড় সিদ্ধান্ত এভাবেই নেওয়া যায় না।”

মোতালেব সাহেবের কপালে ভাজ পড়লো।দৃষ্টি তুলে তাকান লিজা বেগমের দিকে।লিজা বেগম দ্রুত মাহরুরের দিকে চেয়ে বললেন,

“কিসের ভাবাভাবি?হিরা হইলো আসল হিরা। খুব লক্ষী মাইয়া।দেখবি তোর সংসার গুছায় রাখবো।”

মোতালেব হোসেন বললেন, “আপনারা দুয়েকদিন সময় নেন।বিয়েতে আমরা ঝামেলা করবো না বেশি।যদি সব ঠিক হয় আগামী শুক্রবার জুম্মার দিনে তারিখ পাকা করেন আপা।”

থরথর কাঁপছে শরীরটা। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হবে যেনো।মোতালেব সাহেব আর বাকিরা দৃষ্টি সীমানার বাহিরে যেতেই চেয়ার তুলে অন্যখানে ছুঁড়ে ফেলে মাহরুর।

“তোমার মাথা থেকে এই ভুত নামেনি আম্মা!আমি এসেছিলাম সব ঠিকঠাক করতে।আর তুমি এদের বাড়ি এনে হাজির করেছো?কি পেয়েছোটা কি?আমি করবো না এই বিয়ে ”

“কাকে করবি ওই কালনাগিনীকে।আমার ছেলেটারে আমার থেকে দূরে করছে যে মাইয়া?”

“আম্মা!আমি চন্দ্রকে যদি বিয়ে নাও করতে পারি তারপরও মোতালেব হোসেনের টাকার কাছে বিক্রি হবো না।সারাজীবন একা থাকবো।”

“আমি কথা দিয়া ফেলছি মাহি”

“রাখো তোমার কথা আম্মা।আর কি বললে বিরাট চাকরি করে তোমার ছেলে? দশ হাজার টাকা বেতন আমার।থাকা খাওয়া সব মিলিয়ে মাসের শেষে হিমশিম খাই।”

ছেলেকে মানানোর জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করেন লিজা বেগম। কেঁদে উঠলেন।পিঠ দেখিয়ে চলে যাওয়া ছেলের পানে নাটকীয়ভাবে বললেন, “তুই যদি বিয়েটা না করিস আমার মরা মুখ দেখবি।আর যদি তোর পছন্দ ওই চন্দ্র হয়।তাহলে হয় আমি থাকবো নয় চন্দ্র। এই কিরা কাটলাম।”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা ৯
লেখা : Azyah_সূচনা

পারিবারিক সমস্যা এক পর্যায়ে এসে বিরাট আকার ধারণ করে। মনোমালিন্য নামক ছোট বিষয়বস্তু থেকে শুরু হয়ে অনেক দূর এগিয়ে যায়। কর্ণকুহরে শুনতে স্বাভাবিক মনে হয়।তবে জটিলতার চরম পর্যায়ে।জোরতো স্ত্রী জাতির উপর হয়ে আসছে।নরম বলে জোর খাটিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয় তাদের উপর।এখানে পরিস্থিতি ভিন্ন। অনুভূতির ফাঁদে ফেলে স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টায় লিজা বেগম।তার মতে সে সঠিক।ছেলের ভবিষ্যতে যেনো কোনো অভাব না থাকে সেই ব্যবস্থা করছেন তিনি।তার ভাষ্যমত এটাই।পারিবারিক যুদ্ধ আর মায়ের বারবার মৃত্যুর কথা শুনতে শুনতে মাহরুরের মস্তিষ্ক জঞ্জালে পূর্ন। দিশেহারা পথিকের ন্যায় অবস্থা।

একদিকে চন্দ্র অন্যদিকে তার মা। মধ্যিখানে আবদ্ধ সে নিজে। বুঝাতে বুঝাতে দিন পাড় করলেও মায়ের কোনো নড়চড় নেই। অন্ন ত্যাগ করেছেন।মেয়েকে ডাকিয়ে এনেছেন ঢাকা থেকে। বিয়ের ব্যাপারে সালিশ করবেন।

সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রেদোয়ান শাশুড়ি মার উদ্দেশ্যে বললো, “আম্মা মাহরুর একজন শিক্ষিত মানুষ।আজ নাহয় ওর কামাই অল্প।উপর ওয়ালা চাইলে একদিন সাফল্যের মুখ দেখবে।সেটাও নিজের চেষ্টায়।আপনার এই জেদটা ছেড়ে দিলেই ভালো হয় আম্মা।”

“আমি মোতালেবকে কথা দিয়ে ফেলেছি জামাই ”

“আমরা ক্ষমা চেয়ে নিবো আম্মা।”

মাহরুর চেয়ারে বসে থাকা মায়ের কাছে এসে জমিনে বসে।মায়ের হাতটা চেপে ধরে।যদি মনটা একটু নরম হয়?বললো,

“ও আম্মা?কি দোষ চন্দ্রের মধ্যে বলো? মিথ্যে বলবে না আম্মা।তুমিও জানো চন্দ্র খারাপ না।আর আমি কি করবো অন্যের ধনসম্পদ দিয়ে? বলো।তুমি তোমার ছেলেকে আর কয়টা বছর সময় দাও আমি দ্বিগুণ পরিশ্রম করবো।এই ধন সম্পদ আমাদেরও হবে।”

“আমি চন্দ্রকে তোর সাথে বিয়ে দিবো না।তোর বাপ কত কষ্ট করছে ওদের জন্য জানিস?এই ভাইয়ের দেখা শুনা থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত সব নিজে করছে।কোনো কাজ কাম করতো না রমজান।বসে বসে অন্ন ধ্বংস করছে।ভাইয়ের প্রতি এত দরদই আমাদের আজ সর্বহারা করেছে।”

শিরীন উত্তর দেয় মায়ের কথায়, “কেমন স্বার্থপরের মতন কথা বললা আম্মা?একটা ঘর আছে, ঘরে খাওয়ার জন্য তিনবেলা খাবার আছে।আর কি চাই?এত লোভ করা ভালো না আম্মা”

পূনরায় কাঁদতে লাগলেন লিজা বেগম।বলতে লাগেন, “এই দিন আসছে আমার।ছেলে কথার অবাধ্য হয় আর মেয়ে লোভী ডাকে।”

“এত বড় একটা ছেলেকে বিয়ের জন্য জোর করাও কি ঠিক নাকি?”

শিরীনকে থামিয়ে দেয় রেদোয়ান।একটা বাক্য মস্তিষ্কে নিতে রাজি নন লিজা বেগম। এ কেমন জেদ?ধরে বেঁধে নিজের ছেলের জীবন ভেস্তে দিচ্ছে।চন্দ্র আর মাহরুরের জীবনে ঝড় না তুলে ক্ষ্যান্ত হবেন না। লন্ডভন্ড করেই থামবে সব।

“এই জনমে বোধহয় মিলন মুশকিল চন্দ্র।তোর অপরাধী আমি। প্রার্থনা কর যেনো ভয়ঙ্কর শাস্তি পাই।”
___
বর্তমান,

“মিষ্টিকে পাচ্ছি না।আমাকে একটু সাহায্য করবেন?”

মেয়েলি গলার আওয়াজ পৌঁছেছে কর্ণ অব্দি। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে থাকা মাহরুরের কোনো হেলদোল দেখা গেলো না।যেনো কিছুই শুনতে পায়নি।

“আপনি কি মিষ্টিকে আজ দেখেছেন?”

সময় পেরোয়।উত্তর আসেনি।সামান্য দুরত্বে দাঁড়িয়েও কি শব্দ যাচ্ছে না তার কানে?আবার ডাকলো,
মাহি ভাই?”

পূনরায় একই বাক্যে ফিরে চায় মাহরুর। ভীষণ বিরক্তিকর চাহনি। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়ালো। হাতদুটো ট্রাউজারের পকেটে গুঁজেছে।

শাড়ি পরিহিত নারীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে, “কে মাহি?”

মলিন মুখ খন্ড। একেবারে নিরস।চোখের নিচে কালো কুচকুচে কালি পড়া।চোখে পড়ার মতন দুর্বল অঙ্গ।এমন একজন দাড়িয়ে সামনে।মিষ্টির মা সে। চিন্তিত, বিধ্বস্ত।মেয়ের জন্য হৃদয় ভীত। মহরুরের প্রশ্নে চোখ নামায়।এই অদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর হয়না।

মাহরুর এগিয়ে আসে। ভিড়িয়ে থাকা দরজা মেলে দিলো তার সামনে।তিনটে বাচ্চা একে অপরকে জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শিরীনের ছেলে ও মেয়ে।এরমধ্যে মিষ্টিও আছে।সহি সালামতে মেয়েকে দেখে যেনো হৃদয় শীতল হলো।বুকে এতক্ষন ভারী পাথর এটে ছিলো।এত অভিমানী হলে হয়? এইটুকু মেয়ে!সামান্য কষ্ট পেলেই মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে।হুমকি দেয় বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার।আজ ভেবেই বসেছিলো অভিমান করে কোথাও চলে গেছে।এবার সস্তি পেলো।ঘরে প্রবেশ করে মেয়েকে কোলে নেওয়ার জন্য উদ্যত হলে থামায় মাহরুর।

বলে, “ঘুমাচ্ছে ঘুমাক আর কিছুক্ষণ”

নিচু গলায় উত্তর আসলো, “সন্ধ্যা হচ্ছে বাড়ি ফিরতে হবে”

“ওই বাড়ি যেখানে তোকে অযথা অত্যাচার করা হয়?তোর মেয়েকে না খাইয়ে রাখা হয়?গায়ে হাত তোলা হয়?সেই বাড়িতে ফেরার এত তাড়া?”

“হুম”

“হুম?তুই জানিস মিষ্টিকে এখানে কেনো এনেছি?আমি জানতাম মিষ্টির খোঁজ করতে করতে ওর মাও এসে হাজির হবে এখানে।আর ওর মার সাথে আমার দরকারি কথা আছে”

“আমার হাতে সময় কম মাহি ভাই।মিষ্টিকে নিয়ে যাই।অন্য একদিন আসবো”

হাসছে মাহরুর।সামনে দাড়ানো নারীর কথার তাচ্ছিল্য করছে।কোনো কৌতুক বলেছে কি?অযথা হাসির কোনো মানে হয়না।

হাসি থামিয়ে মাহরুর বলে, “তুই আবার আসবি?এটাও আমার বিশ্বাস করতে হবে?”

“এত কথা আগ বাড়ানো হচ্ছে কেনো?আমি আমার মেয়েকে নিয়ে বাড়ি যেতে চাই”

কন্ঠ খাদে নামায় মাহরুর।বলে উঠে, “কেনো পড়ে আছিস এই নরকে?কে আছে তোর এখানে আপন বলে?গ্রামে ফিরে যা চন্দ্র”

রুহ কেপে উঠে ‘ চন্দ্র ‘ ডাকে।অনেক দিন,অনেক কাল এই ডাক নিষিদ্ধ ছিলো। পুরোনো ক্ষত তাজা হওয়ার আগেই নিজেকে কঠিনত্যের আবরণ টানে।বলে উঠে,
“স্বামীর সংসার ফেলে যেতে চাই না।”

“যেখানে তোর কোনো মূল্য নেই,তোর সন্তানের কোনো মূল্য নেই সেটা কেমন স্বামীর সংসার?”

মিষ্টিকে কোলে তুলে চন্দ্র।বুকের সাথে লেপ্টে নেয়।এই বাচ্চাটা তার বেচে থাকার শেষ সম্বল।একে আকড়ে নিয়েই পাড়ি দেবে কঠিন পথ।যাওয়ার আগে বললো,

“আমি কোনকিছুর দিকে হাত বাড়ালে খুব শক্ত করেই আকড়ে ধরি। ঢিল দেওয়ার সুযোগ রাখিনা।সেইভাবেই আমার মেয়ে আর সংসারকে আকড়ে ধরেছি। মৃত্যুর আগ অব্দি ছাড়ছি না”

অতিশয় আকুলতা মিশিয়ে মাহরুর বলে, “আমার জেদ নিজের উপর কেনো?”

মাহরুরের কথায় আকাশ থেকে পতিত হয় মল্লিকা।জেদ?কিসের জেদ?সেকি আদৌ রেগে আছে?নাতো।একদমই নয়।উত্তর দিলো সেই ভঙ্গিতেই, “আমি কেনো জেদ দেখাবো?মাহি ভাই আপনি ভুল ভাবছেন।…আসি”

মাহরুর ভাই থেকে মাহি ভাই;তুমি থেকে আপনি?চোখে মরিচ পড়ার মতন জ্বালাপোড়া করলো।এই মুখটা কখনোই দেখতে চায়নি।এত অভিমান?পরপর নিজের উপর হাসলো মাহরুর। চন্দ্রের এমন মুখ, কথাবার্তায় বিপরীতে তার প্রশ্ন তোলা কতটা সমীচীন?পুরুষ হয়েও হাত গুটিয়ে বসে ছিলো? অকর্মা পুরুষ!
__

মা মেয়েকে রাত পৌনে আটটায় ঘরে ঢুকতে দেখে তেরে আসেন রেহালা।পূর্বের আঘাতের জায়গায় আরো সজোড়ে আঘাত করে বসেন।বলেন,

“নর্তকী তোরা মা মাইয়া?পথে নাচতে যাস?আমার চায়ের সময় হইছে মনে নাই?”

চন্দ্র আবেদনের সুরে বললো, “আম্মা মিষ্টির সামনে এইরকম শব্দ ব্যবহার করবেন না।আমাকে বলেন আমি শুনে নিবো।”

চন্দ্রের চুলের মুঠ শক্ত করে চেপে ধরে।বলে, “আমার মুখে মুখে তর্ক করস! কালনাগিনী।কুলাঙ্গার! বিয়া কইরা ঘরে পা রাখতে না রাখতে আমার পোলার ব্যবসা ডুবাইসোস। মাইয়া জন্ম দেওয়ার এক বছরে আমার পোলাটা খাইলি।আর কি চাস তুই ডায়নি?আমারে খাবি?খা! তোর আর তোর মাইয়ার জীবন নরক বানাইয়া তবেই আমি মরমু”

এখানের পরিবেশটাই তেতো!নতুন কিছু নয়।সহ্যের সীমা আগেই অতিক্রম করেছে।এখন নির্যাতন সীমা রেখার বাহিরে।ঘরের সব কাজ করে চন্দ্র।কাজের লোকের চেয়েও নিম্নে তার অবস্থান।ছোট জা সারাক্ষণ পায়ের উপর পা তুলে খাচ্ছে।তার স্বামীর সংসারেইতো চলে এই সংসার। কর্তাধর্তা সেই।

“এখানে পড়ে আছিস কেনো জানি না?আমার মরা পোলার ভাগের সম্পত্তি পাওয়ার লোভে এখনও মাইয়া নিয়া পইড়া আছোস।একটা কথা কান খুইলা শুইনা রাখ।এক কানা কড়িও পাবি না তোরা।”

দাদী চলে গেলে নির্শব্দ কান্নায় শব্দ জড়িত হয়।মায়ের সাথে এত খারাপ আচরণ কেনো করে দাদী।এটাই পাঁচ বছর বয়সী মিষ্টির প্রশ্ন।বাবা শব্দটা বোঝার আগেইতো তার বাবা চলে গেছে।মাও ঠিকঠাক যত্ন করতে অক্ষম। মিষ্টিকে দুপুরে বেচে যাওয়া ভাত খাইয়ে ঘুম পাড়ায় চন্দ্র।জানালার গ্রিল আকড়ে চন্দ্র বলতে লাগলো,

“আব্বা বলেছিলো আমাকে মিষ্টির বাবা তোমার থেকে হাজার গুন বেশি সুখে রাখবে।রাজরানী বানাবে।কই?কিছুইতো হলো না।সে আমাকে ভালোবাসতো না।শুধু চাহিদা মেটাতো নিজের।মিষ্টি জন্মের পর যাও তার মনে মায়া জন্মেছে।ওই মায়া নিয়েই আজীবনের জন্য ঘুমিয়ে গেলো।….তুমি গেলে আর আমায় দুঃখের কালো রঙ ঘিরে ফেললো মাহরুর ভাই।”

মাহরুরের বিয়ের দিন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল চন্দ্র। ছটফট করেছে মাটিতে পড়ে।পাগলের ন্যায় প্রলাপ করেছে।দেখেছে সবাই সবটা।সবার মায়া হলেও মন গলেনি লিজা বেগমের।গলায় ছুরি ধরে কার্য সিদ্ধি লাভ করেন তিনি সেইদিন।এত প্রয়োজন জীবনে শখ আহ্লাদ পূরণের?এত দরকার বিলাসিতা?ওই অপেক্ষারত মেয়েটিকে বুঝতেই দিলো না তার এই অপেক্ষা অহেতুক।কেড়ে নেওয়া হবে সবকিছু তার থেকে।কান্না জমে যায় এক মুহূর্তে। শরীর শক্ত হয়ে উঠে।নিজের চোখের সামনে মাহরুরকে কবুল বলতে শোনে কঠিন হয়ে দাড়িয়ে।যেখানে অধিকার তার ছিলো।তার নামে লিখিত হওয়ার কথা ছিল মাহরুরের।পাশে বসা নারীর পরিবর্তে চন্দ্রের থাকার কথা ছিল।কেমন যেনো বদলে যায় চন্দ্র। অসহায় মাহরুরকে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও দেয়নি।একমাসে অন্যের সাথে সংসার গড়ে দেয় তার বাবা।মেয়েকে এভাবে ফেলে রাখলেও চলবে না।অন্যের যত্নে ঠিকই পুরোনো ঘা ভুলে যাবে চন্দ্রমল্লিকা।

মিষ্টিকে তার জায়গায় পেয়েছিলো।বাড়ির লোহার দরজায় আনমনা।সেই জানায় তার মাকে আজ অমানুষের মতন মারা হয়েছে।পিঠ বেয়ে রক্ত ঝরেছে।মা চিৎকার করে কেঁদেছে বেদনায়।এত নির্মমতা?ওই কোমল চাঁদের উপর?ওই শুদ্ধ চাঁদ যে আলোকিত করতে জানে।নিজে আধাঁরে তলিয়ে। ভালোবাসতে জানে অপেক্ষা করতে জানে। চন্দ্রের স্বামীর মৃত্যুর পরও মেয়ের জন্য পড়ে আছে।বাবা মায়ের কাছে অব্দি যাচ্ছে না।মায়ের কষ্টে মেয়েটিও ব্যথিত।বাচ্চা মনের ব্যথা আজীবনের প্রখর হয়।দাগ কাটে আজীবনের জন্য।ধীরেধীরে সেটা ঘৃণায় প্রবর্তিত হয়।

তমসাবৃত নির্জন কক্ষের চারদেয়ালে পুরুষালি ঢুকরে কান্নার ধ্বনি বাড়ি খায়। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এই আওয়াজ আসছে।কতটা কষ্টে পুরুষ কাদে?কতটা আর্তনাদ থাকলে?আপন ভুলের মাশুল এই প্রকার?হার মানছে সমস্ত কিছু।বুক ফিরে হৃদপিণ্ড বেরিয়ে আসবে?

“আমাদের আবার আগমন হবে এই পৃথিবীতে?আবার আসবো দুজন দু দেহে?আবার প্রেমে পড়বো।সে বার তোকে সবকিছুর বিনিময়ে ছিনিয়ে নিবো।এই চিলেকোঠায় আমাদের একটা সংসার হবে তখন। মিষ্টি হবে আমার আর তোর অংশ।হবে এমনটা চন্দ্র?”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৬+৭

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৬
লেখা : Azyah_সূচনা

অতীত,

আসমান হতে বাদল বিন্দু ঝরুক। রৌদ্রের উত্তাপ হোক , সাথে সস্তির প্রতিচ্ছায়াও। অনুভূতি গুঞ্জন তুলুক এই দামাল বাতাবরণে। আঁচলে লুকিয়ে রাখা চন্দ্রের চাঁদনী ছড়িয়ে পড়ুক মাহরুরের রুহের অভ্যন্তরে। সর্বত্র গ্রাস করে নেওয়া মাহরুরও অনুভব করুক এই দহন।বুঝুক কি করে অনুরক্ত করছে নরম হৃদপিণ্ডকে নিজের দিকে।

কবুল বলে বিয়ে সম্পন্ন হয়। শশী এখন এক বিবাহিত রমণী। একটু হাসি, একটু কান্নার মাঝেই জমে উঠেছে পরিবেশ। মল্লিকার নজর তার মাহরুর ভাইয়ের উপর।শওকত ভাইয়ের সাথে হাত নাচিয়ে কোনো বিষয়ে ঘোর আলোচনায় মগ্ন।শান্ত মল্লিকার মনটা আকস্মিক ভীত হয়ে উঠে। মাহরুরের শুভ্রতায় জমে যাওয়া মস্তিষ্ক জ্বলে উঠেছে। ঢাক ঢোল পিটিয়ে স্মরণ করালো।কি বলেছিলো মাহরুরকে?যান্ত্রিক ফোনের মাধ্যমে কি রকম বাক্য প্রেরণ করেছিলো?এত সহজেই ভুলে গেলে হয়? বেহায়া নির্লজ্জ মেয়ের মতন একজন পুরুষকে ‘ ভালোবাসি ‘ বলার দুঃসাহস করে ফেলেছে।এখন নেই কোনো পথ পালাবার।চক্ষু আড়াল করতে চাইছে না আবার চোখে চোখ রাখার সাহসটা মাত্রই হারালো।চোখে চোখ পড়ে যায় হুট করে। তড়িৎ গতিতে ঘুরে যায় চন্দ্র।তার এমন কাণ্ড মাহরুরের চোখ এড়ায়নি।আসার পর থেকেই মেয়েটা অদ্ভুত ব্যাবহার করছে।দূরে দূরে থাকছে।লোকলজ্জায়?নাকি নিজস্ব লজ্জায়!

“আমাকে ভুলে যাবি নাতো সখী?”

বিদায় বেলায় শোক।হৃদয়ে পাথর চেপে কেউ বিদায় দিচ্ছে তার মেয়েকে,বোনকে আর কেউ তার খেলার সাথী,তার সখীকে।মল্লিকার প্রশ্নে হাউমাউ করে কেদে উঠল শশী।কাজল লেপ্টে নাজেহাল অবস্থা।ভাবতেই অবাক লাগছে কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে পুকুর পাড়ে আড্ডা দেওয়া হবে না।আচার খেতে খেতে এদিক ওদিক চড়িয়ে বেড়ানো হবে না।বদলে যাবে সমস্ত রূপ রং।থাকবে একাকিত্ব।

“ভালো থাকিস মল্লিকা।আমি কোনোদিন ভুলবো না তোকে।প্রশ্নই আসেনা।”

“তুইও ভালো থাকিস।নিজের যত্ন নিস”

“মল্লিকা সাহসী হ।নিজের জন্য বাঁচতে শিখ।একদিন তোর সকল ইচ্ছে পূরণ হবে।”

আকা বাকা মেঠো পথে পদচারণ মল্লিকার। শশীর বিদায় হয়েছে ঘন্টাখানেক আগে।বাড়ির চাবি হেফাজতে রেখেছে মাহরুরদের বাড়িতে।যদি বিয়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। নিরাপদ না একদমই।ফরিদা বেগম সেই উদ্দেশ্যেই মল্লিকাকে পাঠান ও বাড়ি। মল্লিকাদের বাড়ি থেকে দুই মিনিটের দূরত্ব মাহরুরদের বাড়ি।

“চন্দ্র দাড়া”

যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত পোহায়। প্রবাদ বাক্যটি যথাযথ।চাচ্ছিলো না মাহরুরের মুখোমুখি হতে।ঘুরে ফিরে তাই হচ্ছে বারেবারে।

মাহরুর এগিয়ে এসে জানতে চাইলো, “আমাদের বাড়ি যাচ্ছিস?”

“হ্যা আম্মা বাড়ির চাবি রাখতে দিয়েছিল চাচীকে।সেটাই নিতে যাচ্ছি।”

মাহরুরের হাতে থাকা মিষ্টির বাক্স মল্লিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“এই মিষ্টিটা নিয়ে যা।মাকে গিয়ে বলবি বিয়ের মিষ্টি শশীর বাবা দিয়েছে।”

মল্লিকা মাথা দোলায়। হ্যা ,না , আচ্ছা কোনো উত্তর দিলো না মুখ দিয়ে।তার পরিবর্তন দৃষ্টি গোচর হচ্ছে।চোখে চোখ রাখছে মা।আগেতো ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকতো।

“তোর মধ্যে আমি পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি চন্দ্র।”

“ভয় হয়”

“আবার ভয়!কেনো ভয় হয় চন্দ্র? আগেতো এমন ছিলো না।”

ছোট্ট করে জবাব দেয়, “হুম”

বুকে হাত বাঁধলো মাহরুর। দৃষ্টিতে তীক্ষ্মতা এনেছে।নত চক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রাখা লাজ স্পষ্ট বুঝতে পারছে মাহরুর।তবে এখনও বুঝলো না তার অনুভূতিগুলো। কেরোসিন ঢেলে বললো,

“সেদিন ফোনে কি বলেছিলি আমাকে? হ্যা?”

“বাবা বিয়ে দিতে চাইছে”

“আর?”

“আর কিছুনা মাহরুর ভাই”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে মাহরুর।রাশভারী কণ্ঠে বলে উঠে, “অনেক সাহস না?”

কাদো কাদো গলায় মল্লিকা উত্তর দেয়, “আমাকে ক্ষমা করে দাও মাহরুর ভাই।আমি ওই কথাটা আর কক্ষনো বলবো না”

আধারে মুচকি হাসে মাহরুর।লুকিয়ে ছাপিয়ে। সম্পূর্ণ শব্দহীনভাবে।আচ যেনো না পায় চন্দ্র।এরকম গম্ভীর গলায় কথা বলে সামান্য ভয় দেখালো তাকে।

___

“আম্মা কিছু কথা ছিলো?”

লিজা মুখ মুখ তুলে চাইলেন। চাল ডাল রৌদ্রে শুকাতে দিয়েছেন। ঝুম বৃষ্টি নাজেহাল অবস্থা করে রেখেছে ঘরের সবকিছু।এমনেতেই অভাবের সংসার।ছেলের চাকরিতে একটা ছোট আশার প্রদীপ জ্বলেছে।

“বল বাজান”

মায়ের পাশে মোড়া পেতে বসলো মাহরুর।খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চলেছে।কিভাবে শুরু করবে? শব্দে গড়মিল।ভাবুক ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে লিজা বেগম বললেন,

“কি হইছে বাজান?কোনো সমস্যা?ঢাকায় ঠিকঠাক মতন আছিসতো?”

“হ্যা আম্মা।ঢাকায় সব ঠিক আছে।চাকরিও ভালোই চলছে।”

“তাইলে?কি বলতে চাস? বল?”

নিজেকে যথাযথ প্রস্তুত করে মাহরুর বললো, “আম্মা আমি চাচ্ছিলাম তুমি রমজান চাচার কাছে যাও। চন্দ্রর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।”

মুখটা ভার হয়ে আসলো লিজা বেগমের।হাত সরিয়ে গম্ভির মুখে জানতে চাইলেন, “কার বিয়ের প্রস্তাব নিয়া যাবো?”

“আম্মা?….আমার।”

যেমনটা আচ করেছিলো। তিক্ততায় ভরে উঠলো লিজা বেগমের সর্ব মুখশ্রী। তেতিয়ে উঠেন।ঝড়ের গতিতে উত্তর দিলেন, “অসম্ভব!আমি ওই মাইয়ার সাথে তোর বিয়ে দিবো না।”

মার রাগী সুরের বিপরীতে মাহরুর শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো, “কেনো আম্মা? চন্দ্র ভালো একটা মেয়ে।অনেক লক্ষী।ওর মধ্যে আমি খারাপ কিছুই দেখিনা।তাছারাও ঘরের মেয়ে।”

একই সুর বজায় রেখে লিজা বেগম উত্তর দেন, “ওই মাইয়ার নজর তোর জন্য আগে থেকেই ভালো না।কেমন বেহায়ার মতোন তাকায় তোর দিকে।ছিঃ! ভাইগো দিকে এমন নজর দেয় কেউ?”

“আম্মা?তুমি না চন্দ্রকে ভালোবাসতে? হঠাৎ ওর প্রতি তোমার মতামত পরিবর্তন হলো কি করে?”

“হইবো না?আমার সোনার টুকরা ছেলের দিকে প্রেমের নজর নেয়। ওর চরিত্রে খোট আছে।”

“এগুলা কেমন কথা আম্মা?কই প্রেমের নজর দিলো।আমাদের মধ্যে কিছুই নেই।প্রেম ভালোবাসার কোনো সম্পর্কই নেই।আমি ভাবলাম এক না একদিন কাউকে বিয়ে করতেই হবে।করলে চন্দ্রকেই করি।অন্য মেয়ে ঘরে আনবো কেমন হবে জানা নেই।”

লিজা বেগমের রাগ দ্বিগুণ হলো।কথার ঝাঁজ বাড়িয়ে বললেন, “কি কেমন কথা?এসব আমারে বুঝাইতে আসবি না।যে মাইয়া ভাইয়ের দিকে এমন নজরে তাকাইতে পারে ওর চরিত্র কি ভালো নাকি?বিয়ের আগে কিসের পিরিত।”

“আমার কথাওতো সেটা।বিয়ের আগে আমাদের মধ্যে কোনো প্রেম নেই।বিয়েটা করলেই নাহয়…..থাক বাদ দাও আম্মা।তুমি চন্দ্রকে নিয়ে বেশি বেশি খারাপ ধারণা পুষে ফেলেছো।”

“শোন মাহি।তুই আমার একমাত্র ছেলে।তোর বোনকে বড়মাপের লোকের সাথে বিয়ে দিছি।তোর ভবিষ্যতটাও আমি ঠিক করে দিয়েই যাবো।মোতালেব ওর মাইয়ার জন্য তোকে চাইসে।এক বাপের এক মাইয়া।বাপ মার পর সবকিছু ওই পাইবো।আমিও মোতালেবকে কথা দিছি ”

আত্মসম্মান বোধে লাগলো মাহরুরের।এতটা অধঃপতন তার!এতটা!এখন টাকার কাছে বিক্রি হতে হবে তাকে? সম্পত্তির লোভে বিয়ে করতে হবে?মা সম্মানিত।বড় গলায় কিছু বলার সাহস নেই।তারপরও রুষ্ট হয়ে মাহরুর বললো,

“এতবড় একটা ছেলেকে তুমি তার মতামত ছাড়াই বিয়ের জন্য কথা দিয়ে এসেছো?একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করোনি আম্মা?”

“আমি জানিতো।ওই নষ্ট মাইয়া তোরে জাদু করছে।ওর হইয়া মায়ের সাথে এমনে কথা বলিস?এইজন্য পেটে পিঠে পালসি?আগেতো আমার আদেশ মুখ থেকে শব্দ না বের কইরাই মাইনা নিতি ”

“আম্মা এখানে চন্দ্র আসলো কোথা থেকে?আর আমি কোনোদিন তোমাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিয়েছি?কোনোদিন অমান্য করেছি?আমি শুধু তোমার কাছে এমন একটা প্রস্তাব রাখলাম যেটা কিনা সম্ভব। এতে খারাপের কিছুই দেখছি না।কোনো প্রেম পিরিত নেই আমাদের মধ্যে।মেয়েটার জন্য মায়া হয় ব্যাস এইটুকুই।কিন্তু তুমিতো আমাকে বিয়ে না মেয়ের বাবার কাছে বিক্রি করে দেওয়ার চিন্তায় আছো”

লিজা বেগম কাদতে কাদতে বললেন,

“দেস নাই।এখন দিবি।ওই মাইয়ার পাল্লায় পইড়া আমারে একদিন ঘর ছাড়াও করবি।তোর বাপ যাওয়ার পর যে কষ্ট কইরা পালসি।এই প্রতিদান?তোর ব্যপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না আমি?আমি নাকি আমার ছেলেরে বেইচা দিতেছি?”

___

বর্তমান,

“মামা ঔষধ খাও।জ্বর কমে যাবে ”

মামার ভাগ্নি এসেছে।মাথাটা সম্পূর্ণ হেজাবে আবৃত।মাঝেমধ্যেই দেখা যায় সুমাইয়াকে।সারাদিন মাদ্রাসায় থাকে।মামার জ্বরের খবর পেয়ে আজ পড়া কামাই করে এসেছে। জলপট্টি দিয়ে জ্বর সারাতে চাইছে।
জ্বালাপোড়া করছে চোখ।শক্ত দেহটা পুরোপুরি দুর্বল। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়েছে মাহরুর।ফলাফল স্বরূপ বিছানায় পিঠ।

শিরীন এগিয়ে এসে বললো, “ভাইয়া আগে কিছু খেয়ে নাও।তারপর ঔষধ খেও”

“খেতে ইচ্ছে করছে নারে।”

“এগুলো বললে হবেনা।তোমার জ্বর একশত দুই ডিগ্রি। কাল রাতেও কিছু খাওনি তাই না?”

করুন মুখ বানিয়ে মাহরুর জবাবে বলে, “ক্ষিদে নেইতো। বরং ঔষধটা দে খেয়ে নেই।”

“খালি পেটে ঔষধ খাওয়া যাবেনা ভাইয়া। একটু কিছু মুখে দাও”

শিরীন মানবে না। খাইয়ে ছাড়বে।নিজের ঘর সংসার সামলে ঠিকই চলে আসে আবার বোনের দায়িত্ব পালন করতে।ভাই হিসেবে তার কথা রাখাও অত্যন্ত জরুরী।এরচেয়ে বেশি কিছু করার সাধ্যও যে নেই।নুডুলস এনে রান্না করেছে। চামচের সাহায্যে মুখে তুলে খাইয়ে দিলো।কয়েক চামচ খেয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় মাহরুর।আর খেতে পারছে না।নাপা ট্যাবলেট খেয়ে আবার বিছানায় নেতিয়ে পরে।হাত বাড়িয়ে সুমাইয়া আর সায়মনকে জড়িয়ে ধরেছে।এদিক ওদিক এর গল্প করে সময় পার করতে লাগলো।

“আমরা আজ মামার সাথে থাকবো।মামার জ্বর”

রেদোয়ান ছেলে মেয়ের কথা শুনে স্ত্রীর দিকে চাইলো।এসেছিল মাহরুরকে সাথে নিতে।পারেনি।অবশেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে স্ত্রী সন্তানদের নিয়েই ফিরবে।একা একা জ্বরে পুড়তে রাজি তারপরও এক কদম বাহিরে ফেলবে না।পাথরের তৈরি একটা মানুষ। সন্তানদের আবদারে হুট করে সিদ্ধান্ত বদলায় রেদোয়ান।এখানে একটা ঘর। কোনভাবেই তাদের রাখা সম্ভব না।

ছেলে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললো, “এক কাজ করো।তোমরা বাড়ি যাও।রহিমা খালা আছে।আমি তোমার মামার সাথে থাকবো আজ।তার সেবা যত্ন করবো ঠিক আছে?কালকেই দেখবে তোমার মামা সুস্থ”

বাবার বুঝানোর ভঙ্গি চমৎকার।তাছাড়াও তারা দুজনই বাধ্য সন্তান।বাবার কথা মতন যেতে রাজি হয়। রেদোয়ান তাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে দিয়ে পূনরায় ফিরে এসেছে মাহরুরের চিলেকোঠায়।সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।কাপতে দেখা গেলো মাঝেমধ্যে। গায়ে কম্বল জড়িয়ে পাশেই শুয়ে পড়ে রেদোয়ান।সেও ঘুমে বিভোর হলে চোখ খুলে মাহরুর।

“এই মুহূর্তে তোকে খুব মনে পড়ছে চন্দ্র।একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেইতো আমি সুস্থ হয়ে যাই!….আচ্ছা?কেমন রে তোর হাতের ছোঁয়া?শীতল নাকি উত্তপ্ত?”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা ৭
লেখা : Azyah_সূচনা

অতীত,

“আমি বিকালের বাসে ঢাকা ফিরছি।”

“মানে?তুই না এক সপ্তাহের জন্য আসছিস?”

মাহরুর ভারী গলায় উত্তর দিলো,

“ইচ্ছে ছিলো আম্মা।এখন মিটে গেছে”

“ওই চরিত্রহীন মাইয়ার কারণে আমারেও এখন চোখের সামনে সহ্য হইতাছে না তোর?”

আবারো লিজা বেগম চন্দ্রকে টেনে আনলেন এই প্রসঙ্গে। রাগটা দ্বিগুণ হয় মাহরুরের।কথায় কথায় চন্দ্র।কি এমন দোষ করেছে মেয়েটা?খারাপ মেয়েদের মতন গায়ে পড়ে থাকে?নাকি আজেবাজে নোংরা ইঙ্গিত দেয়?তাহলে কেনো কালি ছুঁড়ছে তার মা ওর চরিত্রে।সংবরণ করলো রাগ হাত মুঠ করে। দ্রুত গতিতে স্থান ত্যাগ করে বেরিয়ে যায় বাড়ির বাইরে।

লিজা বেগমের জেদ চেপেছে।এই ব্যাপারের হ্যাস্তনস্ত করতেই হবে।মাথায় কাপড় টেনে পা বাড়ান মল্লিকাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।সঠিক সময় বেছে নিয়েছেন।এই মুহূর্তে রমজান সাহেব বাড়িতেই আছেন।তার কাছে গিয়েই মেয়ের কুকীর্তি ফাঁস করবেন।

“রমজান!এই রমজান!কই তোমরা?”

কর্কশ স্বরে বেরিয়ে এলো রমজান সাহেব।তার সাথেসাথে এসেছে ফরিদা বেগম আর মল্লিকাও।উঠোনে দাড়িয়ে ডেকে চলেছেন বাড়ির সবাইকে।

রমজান সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, “ভাবি?এইতো বলেন কি হয়েছে?এই সময় আমাদের বাড়িতে?”

“হ্যা তোমাদের বাড়ীতেতো এখন আবার আসা যাইবো না।তোমারে আমি ভাই ভাবছিলাম।তুমিতো ভাই হইয়া পিঠে ছুরি মারলা।তাও নিজের মাইয়ারে দিয়া!”

রমজান সাহেব পুরোপুরি নির্বোধ।কি বলছেন সবটাই অজানা।পাশে ফরিদা বেগমও আশ্চর্যচকিত।অবাক আর ভয়ের মিশ্রণে ঠায় দাঁড়িয়ে চন্দ্রও।

“ভাবি কি বলছেন?আমি কি করেছি?আর মল্লিকা?”

“এটা তোমার মাইয়ারে জিজ্ঞেস করো কি করছে।এমন মাইয়া কেমনে জন্ম দিলা?আমার মাইয়ারে দেখছো?ওইযে বিয়া দিছি একটা টু শব্দ করে নাই।”

এবারও কথার অর্থ বুঝতে অক্ষম সকলে।রমজান সাহেব ভাবীর উদ্দেশ্যে বললেন, “ভাবি ঘরে আসেন। পাড়ার মানুষ খারাপ ভাববো।ঘরে আইসা সবটা বলেন।”

“এই কলংকিত ঘরে আমি ঢুকবো না।সাহস কি করে হয় তোমার মাইয়ার?আমার ছেলের দিকে চোখ দেওয়ার।তাও আবার কুনজর।প্রেম প্রেম খেলতে আসে আমার ছেলের সাথে।আমার জামাইর টাকায় খাইয়া অন্তর ঠান্ডা হয় নাই?এখন মাইয়ারে আমার ছেলের পিছনে লাগাইছো?”

ভাবির মুখের ভাষা অতিরিক্ত ঘৃনামিশ্রিত।এই রূপতো আগে দেখেননি।রমজান সাহেব এবং ফরিদা বেগম উভয়েই কিংকর্তব্যবিমূঢ়।যেটা ভাবি বলল সেটা কি সত্যি?মল্লিকা এমন কাজ করতে পারে?

ফরিদা বেগম অগ্নিচক্ষু ছুড়লেন মল্লিকার দিকে। ভীত জড়ো হয়ে উঠা মল্লিকার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। স্তব্ধ পরিবেশে আবারো লিজা বেগমের আওয়াজ শোনা গেলো।

“আমার ছেলেরে বিয়া করার শখ জাগছে তোমার মাইয়ার।ওর লাগাম টানো।আমি জীবনেও এই বিয়া হইতে দিবো না। চরিত্রহীন মাইয়া।এই বয়সেই পিরিত করে। আরতো দিন আছে পইড়া।”

লিজার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই ফরিদা বেগম মল্লিকার গালে ঠাটিয়ে চড় মারলেন।চুলের মুঠি ধরে প্রশ্ন করলেন,

“কি করসস? হ্যা!কি বলে তোর চাচী?”

অস্রুরা বাঁধ মানে?দেহ আর মন উভয়ের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে মুক্ত দানার মতন ঝড়ছে অবোধ কন্যার গাল বেয়ে। কাকুতি ভরা মুখে জানালো, “আম্মা আমি কিছু করি নাই।”

“করিস নাই?তোর চাচী বানায় কথা বলছে?”

ফরিদা বেগম মল্লিকাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ছড়ি নিয়ে আসেন। দৃষ্টি বন্ধ করে মল্লিকার উপর সব অপমানের ঝাল মেটাতে শুরু করলেন।ব্যথায় মাটিতে লুটিয়ে পড়া মল্লিকা মুখে বারবার একই কথা আওড়িয়ে যাচ্ছে, “আম্মা আমি কিছু করিনি”

মল্লিকাদের বাড়ির পাশ দিয়ে হেটে চলা শওকত আর মাহরুর চেঁচামেচির আওয়াজ পেলো। ঘটনা জানতে দ্রুত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে।দৃষ্টি সামনের দিকে তুলতেই মল্লিকাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে ভরকে উঠে।সামনেই লিজা বেগম আর রমজান সাহেব দাড়িয়ে।পিত্তি জ্বলে উঠে মাহরুরের।যেটা আন্দাজ করছে সেটা যেনো না হয়। দৌড়ে এগিয়ে চাচীর হাত থেকে ছড়ি ফেলে দেয়।

গর্জন তুলে জানতে চায়, “হচ্ছেটা কি?ওকে মারছেন কেনো?”

“ওর মতন মাইয়ারে মাইরা গাঙ্গে ভাসায় দেওয়া উচিত।”

“চুপ থাকো আম্মা!অনেক বলছো!”

ছেলের ধমকে চোখ দুটো গোলাকৃতি ধারণ করে।মুখ ঘুড়িয়ে নিজের বাড়ির দিকে চলে গেলেন। অর্ধজ্ঞান মল্লিকার মাথা তুলে নিজের পায়ের উপর রেখে মাহরুর গাল চাপড়ায়,

“চন্দ্র?এই চন্দ্র! ওঠ।”

ঠোঁট প্রসারিত করছে মল্লিকা।তবে মুখ দিয়ে কোনো শব্দ এলো না।ব্যথায় জর্জরিত হয়ে বুঝি বাকশক্তি হারিয়েছে।দ্রুত উঠানামা করা নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই নেই।

“চাচা চন্দ্র উঠছে না।ওকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।”

রমজান সাহেবের হুশ ফিরে।যতই হোক এক মাত্র মেয়ে।এসেই বুকে জড়িয়ে নিলেন। ক্ষ্যান্ত ফরিদা বেগম এখনও ফোঁসফোঁস করছেন।রমজান সাহেবকে সুযোগ না দিয়েই কোলে তুলে নেয়।পায়ের দ্রুততা বাড়িয়ে ছুটলো ডাক্তারের কাছে।

“চাচা!চন্দ্র কিছুই করেনি। আম্মা না জানি কোন জনমের দুশমনি বের করছে আপনার সাথে।আমি!আমি বলেছিলাম আম্মারে চন্দ্রকে বিয়ে করার কথা। চন্দ্রের কোনো দোষ নাই চাচা।দোহাই লাগে ওকে অত্যাচার করবেন না।আমার দোষ আমারে মারেন”

চন্দ্রের জ্ঞান ফিরেছে।কালো ওড়নায় নিজেকে লেপ্টে বাবার হাত ধরে চলে গেলো।বাবার বাহুর সহায়তায় হাঁটার সাহসটা পাচ্ছে হয়তো।তার যাওয়ার পানে বিনা পলক ফেলে চেয়ে রইলো মাহরুর।আজ হৃদয় পুড়তে শুরু করলো।নিজের দোষে অন্যজন শাস্তি পেয়েছে?এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া বোধহয় ঠিক হয়নি। পারিবারিক বিষয়ে এগোতে খুব বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে। যার ফল চন্দ্রের শরীরের আঘাত।মায়ের মনে এত আক্রোশ চন্দ্রকে নিয়ে?সাবলীল একটা মেয়ে। যথেষ্ট ভদ্র। মাহরুর আর শওকত ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকাতে দেখেনি কোনোদিন।

শওকত মাহরুরের পাশে দাড়িয়ে বললো, “বিনা দোষে মেয়েটি হয়ে গেলো কলঙ্গিত”

মাহরুর মনে মনে বললো, “হয়তো ভালোবেসে হয়েছে কলংকিত”

আসাঢ় পা জোড়াকে টেনে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে।টিকেট কেটেছে বিকেল পাঁচটার। সাড়ে চারটা বাজে।ঘরে ঢুকে মাকে মুখ ভার করে বসে থাকতে দেখলো মাহরুর।কোনো কথা বলেনি।কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে পূনরায় মায়ের ঘরে আসে।সালাম করে ছোট্ট শব্দে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো।আড়ালে মল্লিকার বাড়ির কাছে গিয়েছে।বাড়ির পেছন ঘুরে চন্দ্রের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে কেদে বুক ভাসানো মেয়ের দিকে চাইলো।দুঃখে শক্ত করে চোখ বুজে নেয়।বালিশে মুখ গুজে হেঁচকি তুলছে বারবার।

মাহরুর ডাকলো,

“চন্দ্র?”

মাহরুরের কন্ঠস্বরে লাফিয়ে উঠে মল্লিকা।চারিপাশে মাথা ঘুড়িয়ে খুঁজতে লাগলো।সর্বশেষ নজর গেলো জানালার দ্বারে।ঝড়ের গতিতে এগিয়ে এসে মল্লিকা বলে,

“এখানে কেনো এসেছো মাহরুর ভাই?চাচী জানলে অনেক রাগ করবে।তোমাকে বকবে।”

নাকের ডগা লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে।চোখের সাদা অংশে লাল রেখা।মুখ ফুলে গেছে অনেকটা।এলোমেলো চুলে বিদ্ধস্ত দেখালো চন্দ্রকে।সেখানে কিনা মাহরুরের জন্য চিন্তে করতে এই মেয়ে?

“আমার কথা ভাবছিস?আমার জন্য তোকে কত কষ্ট পেতে হলো”

“আমি ভুল করেছি মাহরুর ভাই।তাই শাস্তি পেয়েছি।”

“এখানে দোষতো আমার ছিলো চন্দ্র আমিই মাকে বলেছিলাম”

“কি বলেছিলে মাহরুর ভাই?”

এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে মাহরুর।এই কথাটা আপাদত চন্দ্রকে না বলাই শ্রেয়।কে জানে ভবিষ্যৎ!অযথা মনে আশা পুষে বসবে।জবাবে মাহরুর বলে,

“কিছু না।আমার উপর রেগে আছিস তুই?”

কন্নামিশ্রিত ভারী গলায় উত্তর দেয় মল্লিকা, “একদমই না”

“ঢাকা ফিরে যাচ্ছি।ভালো থাকিস।”

“ফিরবে কবে?”

“জানি না”

মাহরুরের মুখখানায় দৃষ্টি ফেরায় মল্লিকা। অপরাধবোধে আচ্ছাদিত সে।মল্লিকা ঠোঁট কামড়ে আরো কয়েক বিন্দু ঝরালো চোখ থেকে। নীরবতা কাটিয়ে বলে,

“আমি কষ্ট পেয়েও তোমাকে ঘৃনা করতে পারছি না মাহরুর ভাই।আমি জানি তুমিও ইচ্ছে করে আমাকে কষ্ট দাওনি।তুমি যাও।সহি সালামতে যাও।”

দরজায় করাঘাতের আওয়াজে ঘাবড়ে উঠে।দরজার অপরপাশে থেকে বাবার গলার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। মাহরুরও শেষ বিদায় নিয়ে সরে গেলো।মল্লিকা চোঁখ মুছে।দরজা খুলে দিতেই রমজান সাহেব থমথমে মুখে দাড়িয়ে আছেন।মল্লিকা দৃষ্টি নত করতেই খপ করে হাত ধরে ফেললেন মল্লিকার।টেনে নিয়ে গেলেন বসার ঘরে। উচ্চস্বরে স্ত্রীকে ডাকলেন।

বললেন, “সাহস কত তোমার আমার মাইয়ার গায়ে হাত দাও।একটা মাইয়া আমার।আর আমার জীবনে কিচ্ছুই নাই।ছোট বয়সে নাহয় একটা ভুল করছে তাই বইলা এমনে মারবা?তুমি না মা?আমার চেয়ে বেশিতো তোমার কলিজা জ্বলার কথা।”

স্ত্রীকে শাসিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন।কাছে বসিয়ে বলতে লাগলেন, “কই কই ব্যাথা পাইছিস মা? বল?তোর কষ্ট হচ্ছে?”

বাবার আদুরে গলায় ‘ মা ‘ ডাকে মোমের মতন গলতে শুরু করলো।বুকে মাথা পেতে কাঁদতে লাগলো আবারো।বললো,

“আমার কষ্ট হচ্ছে না আব্বা।তুমি আমাকে ভুল বুঝো না।”

কন্যার মাথায় হাত ফেরায় রমজান মিয়া।এই মেয়েটা তার নয়নের মনি।একজন সন্তান বলে নয়।স্বভাব চরিত্রে অনন্য।মেয়ের নামে বাজে কথাগুলো মনে পড়ে নিজেও কেদে উঠলেন।

“আমিতো নিজেই চাইছিলাম আমার ভাতিজাকেই মেয়ের জামাই করতে।কিন্তু কে জানতো ভাবি আমাদের এত ঘৃনা করে?তুই চিন্তা করিস না মা।আমি তোরে আরো ভালো ছেলের কাছে বিয়ে দিবো। তোরে সে ঘরের রানী বানাবে।”

“আব্বা তোমার কাছে একটা আবদার করি?”

“বল মা”

“আমারে এখন বিয়ে দিও না।আর কয়টাদিন তোমাদের কাছে রাখো?”

___

বর্তমান,

“দেখেন ভাই আপনার সাথে হিরার যে সম্পর্ক ছিলো সেটা এখন আর নেই। কাল আমাদের বিয়ে। আশা করি কোনো ঝামেলা করবেন না।”

পাশে দাড়িয়ে রেদোয়ান কটমট করে বলে উঠে, “চোরের মন পুলিশ পুলিশ।এত ভয় পাচ্ছেন কেন আপনারা?”

মারুফ রেগে উঠে। হিরার হবু স্বামী।বিয়েতে পুরোনো কোনো কথা যেনো না আসে সেই ব্যাপারেই হুশিয়ারি করতে এসেছে
মাহরুর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রেদোয়ান এর দিকে তাকায়।বলে,

“আপনি কে?”

“পুলিশ”

মারুফ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়।গলা নামালো খানিকটা। হিরার সাথে তার সম্পর্ক তিন বছরের। মাহরুরের সাথে বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও সম্পর্কে জড়িয়েছে দুজনে।সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় পড়ে ছিলো এতদিন।তারপরও মনে অজানা ভয়।তাদের মিথ্যে ফাঁস হলে বেশ ভুগতে হবে।

মারুফ মাহরুরের কাধে হাত রাখে।তেরছা নজরে তাকালো মাহরুর।মারুফ বললো,

“দেখেন ভাই ভালোবাসা ব্যতীত সংসার হয়না।আপনাদের সংসারটা জোর জবরদস্তির ছিলো।এক না একদিন ভেঙে যেত।হয়তো আপনারা একে অপরের জন্য সঠিক ছিলেন না।আমরা নতুন জীবন শুরু করতে চলেছি।আপনিও এগোন আপনার জীবনে”

কথাগুলো বলেছে স্বাভাবিকভাবেই। মাহরুরের উত্তরের অপেক্ষায়।রেদোয়ান মাথায় চড়ে বসে আছে।আওয়াজ তুললেই পুলিশগিরি দেখাবে। মাহরুর মারুফের হাতের দিকে চেয়ে বলল,

“কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে কথা বলুন।”

সঙ্গেসঙ্গে হাত সরায় মারুফ। মাহরুরকে দেখে যতটা শান্ত স্বভাবের মনে হয় তার চেয়ে বেশ তেজ মনে হলো গলায়। রেদোয়ানও অবাক। স্বাভাবিকতা বজায় রেখে মেজাজ দেখালো।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুর বলে, “মস্তিষ্ক যথাযথ চলে আমার। বিকৃত নয়।কি ভেবে চিন্তে এসেছেন কে জানে?আপনার হবু স্ত্রীর অবশ্যই জানার কথা তার প্রাক্তন স্বামী কেমন।তার থেকে আমার স্বভাব চরিত্র এর সার্টিফিকেটটা নিয়ে এসেছেনতো?”

চুপ বনে রইলো মারুফ। হিরার সাথে কথা হয়েছে।কিন্তু মাহরুর সম্পর্কে জানার আগ্রহ আসেনি কোনোদিন।এরই মধ্যে রেদোয়ান বলে উঠলো,

“আপনার হিরা আপনিই রাখেন।অযথা আসবেন না আমাদের সময় নষ্ট করতে।”

মারুফ চলে যেতে নিলে মাহরুর বলে উঠে, “যে যেমন মানুষকে ভাবেও তেমন।এতদিন কোনো রাগ ছিল না।এখন রাগ হচ্ছে আপনার প্রতি।ডিভোর্স হয়েছে মানে কাহিনী শেষ।আবার কেনো একই কথা বারবার তুলে আনেন।বিয়ে করেন। শুভকামনা।অন্যের সংসারে ঝামেলা করে কি পাবো? হিরাকে?কি করবো এমন স্ত্রী দিয়ে যেকিনা আমারই না?উল্টো আপনার আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।আপনার প্রেমিকাকে এতদিন নিজের স্ত্রীর পরিচয় নিয়ে পেলেছি।আমার চোখের সামনে আসবেন না নেক্সট টাইম আপনারা কেউই।”

“আপনিও নিজের জীবনে কাউকে জায়গা দিন মিস্টার মাহরুর।ভালো থাকবেন”

ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে মাহরুর।অতি মাত্রায় রাগ।কপালে নীল রগ ফুটে উঠে।মাত্র জ্বর সেরেছে।অফিসের যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার পূর্বেই মেজাজটা পুরো বিগড়ে দিয়ে গেলো।কেনো এতো ভয়? পরকীয়া করেছে বলে?

রেদোয়ান বললো, “এরপর?এরপর কি করবে মাহরুর?আগে বাড়বে জীবনে?নাকি থেমে থাকবে?”

“জানি না” একবাক্যে সরাসরি উত্তর দেয় মাহরুর।

“ভেবেছো কিছু?সামনে অনেকটা পথ বাকি।”

“হাটতে পারবো।”

“একা?”

“পারবো”

মুখ ঘুরিয়ে নিলো রেদোয়ানের সামনে থেকে। শার্টের বোতাম লাগিয়ে ব্যাগ তুলে বেরিয়ে যায়।অফিস কামাই করলে বেতন কেটে রাখে। নূন্যতম মনুষ্যত্ব নেই এদের। জান যাবে কিন্তু কাজ বাদ দেওয়া যাবেনা। হাঁটার পথে বাগানবাড়িটায় চোখ বুলায়।আজও মিষ্টির দেখা নেই। পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।মন বলে উঠলো,

“রেদোয়ান কি জানে আমি একা চলবো না বাকিটা পথ।আমার সাথে আমার চন্দ্রের জমিয়ে রেখে যাওয়া এক সমুদ্র স্মৃতি আছে।বাঁচিয়ে রাখবে আমাকে”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-০৫

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৫
লেখা : Azyah_সূচনা

নারী প্রেম কতটা গভীর?কতখানি? পরিমাপ করার মতন?নাকি সীমারেখার বাহিরে?মনের অজান্তেই চন্দ্রমল্লিকার এই নব্য অনুরাগ ভাবতে বাধ্য করছে।যদি হয় তার ভালোবাসা যথাযথ?তাহলে মাহরুরও চেষ্টায় পিছিয়ে থাকবে না।তাকে অপছন্দেরতো কারণ নেই। সৌন্দর্য তার বাহ্যিক দিক। মনটা পানির মতন সচ্ছ। অনুভূতিহীন মাহরুর।তবে এই স্থির প্রতিক্রীয়া বদলাতে কতক্ষন?শুধু একটু প্রয়াসের দরকার।তবে ভয় আছে। ডগমগ করবে নাতো সেই বালিকার কদম?বয়সের তারতম্যে মন্দ হয়ে উঠবে নাতো সবটা?আর পরিবার?তারা কি মেনে নিবে?মহা মুশকিল।এক মন বলছে এগোতে।আরেক মন বলছে দশ কদম পিছিয়ে দিতে।এসবই মোহ।সময়ের সাথে কেটে যাবে।অদ্ভুত এই চন্দ্র।জ্বালায় না তাকে।একদম বিরক্ত করেনা।আজ কত কষ্ট পেলে ফোন করে?কত সাহস হলে বলে ‘ ভালোবাসি ‘।কথা জানে ভালো ছোটবেলা থেকেই।তবে বেশকিছু দিন যাবত ধরন পাল্টেছে।কি করবে?কি করবে না?এই ভাবতে বসে গেছে মাহরুর রাতের গভীরে।অনেকদিন হলো মেসে উঠেছে।সে ছাড়াও আরো চারজন থাকে এখানে।ঘুম আর আসবে না।চন্দ্রের মায়াময় গলায় ‘ ভালোবাসি ‘ কথাটা মস্তিষ্কে গেঁথেছে।এভাবে আগে কেউ কখনো বলেনি।বলার সুযোগ কই?তবে কি ধীরেধীরে চন্দ্রবিলাসে নামলো মাহরুরের মনোসত্তা?ভালোবাসি উক্তিটি গ্রাস করতে লাগলো?

“আমাকে চোরাবালিতে ফেলে দিলি চন্দ্র। নিজের জং ধরা অনুভূতিশক্তিকে সচল করতে পারছি না।আমার কি তোকে নিয়ে ভাবা উচিত?”

__

চায়ের আড্ডা সচরাচর হয় না।আজ হচ্ছে।অল্প বেতনের চাকরিতে ঘর চলে এটাই অনেক। বন্ধু বান্ধবের আনাগোনা কম মাহরুরের।এটা নতুন নয়।শুরু থেকেই।তার মতে বন্ধুদের সাথে চলতে হলে কাধে কাঁধ মেলাতে হয়।আপাদত সেই কাঁধটাও তার ভঙ্গুর। মিথ্যে আশ্বাসে কাটিয়ে দেওয়া ছয় বছরে কোনো উন্নতি নেই। লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে চাকরিতে এনেছিল।ফলাফল এখানে শূন্য।কত জায়গায় নতুন চাকরির জন্য চেষ্টা করেছে।সেখানেও ফলাফল শূন্য। শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি মুঠোভর্তি টাকাও দরকার এখানে।টাকার বিনিময়ে টাকা কেনা যাকে বলে।জীবন বাঁচাতে এখানেই পড়ে থাকতে হচ্ছে।

রেদোয়ান বললো, “ভাই আমিতো তোমার সমবয়সী প্রায়।আমার সাথে শেয়ার করতে পারো।কি এমন হয়েছে যে ভাবি তোমাকে ছেড়ে চলে গেলো?”

বোন জামাইর এমন প্রশ্নের জবাবে কি বলবে?এখানে সত্যটা যে ভিন্ন।কথা ঘুরিয়ে নিজের দিকে নিলো।বললো, “আমার দোষে”

“মিথ্যে বলবে না।আমি অনেককিছু আচ করতে পারছি।নিজেকে হাল্কা করো মাহি।আমাকে বিশ্বাস করো না?তোমার বোনের স্বামী আমি।এতটা বছর সংসার করছি।তোমাকে দেখছি।আমাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়না?”

মাহরুর নাছোড়বান্দা। বলবে না যেহেতু পণ করেছে।তাকে মেরে কেটেও কথা বলানো যাবে না। রেদোয়ান ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে।বলে,

“শুনেছি তোমার স্ত্রী নাকি তালাকের একমাসের মাথায় অন্য কারো সাথে ঘর বাঁধতে চলেছে? সবকিছু এত দ্রুত ভুলে গেলো সে?আর তুমি বলছো তোমার দোষ।এখানে হিসাবে গড়মিল আছে।আমি চাইলে তদন্ত করে আরো অনেককিছুই বের করতে পারি।তবে তোমার মুখে শুনতে চাই।”

“তুমি তদন্ত করেই বের করো।আমি কারো সম্মানহানি করতে রাজি না।”

পিছু হটে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রেদোয়ান।মুখে বাঁকাচোরা হাসি।কি দিয়ে তৈরি এই লোক?কোন মাটির মানুষ?সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে কি মজা পায়?

“এসবের পেছনে মল্লিকা নয়তো?”

এত বছর পর মল্লিকার নামটা অন্য কারো মুখে শুনে হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠে।ক্ষুদ্র চক্ষু রেদোয়ানের দিকে ছুঁড়ে।কি বোঝাতে চায় সে?বুঝেও বুঝলো না রেদোয়ান। ইচ্ছেকৃত বলে উঠে,

“হয়তো মল্লিকার প্রতি তোমার ভালোবাসার কারণেই হিরা ভাবি তোমাকে ছেড়ে গিয়েছে!”

চোয়াল শক্ত করে মাহরুর। কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, “আমাকে দুই নৌকায় মাঝি মনে হয়?একজনকে ভালোবাসবো আর অন্যজনের সাথে সংসার?”

“তাহলে কেনো গেলো তোমার বউ!”

“সে ভালোবাসতো না আমাকে।আমার মা তাকে মিথ্যে বলে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছে।জানো না তুমি? সবইতো জানো।”

“আরো বিস্তারিত জানতে চাই।”

“বলতে পারবো না রেদোয়ান”

শব্দ করে হাত রাখে টেবিলে রেদোয়ান।যেনো তার সামনে কোনো আসামি। জবানবন্দী নেওয়া হচ্ছে তার।যে করেই হোক তথ্য চাই। তবে এই আসামির প্রতি তার বিশেষ মায়া।তাকে বাঁচানোর জন্যই তার অন্তরে জমিয়ে রাখা কথা গুলোর খোলাসা চায়।

“তুমি যখন জানতে তোমার বউ পরকীয়ায় লিপ্ত!দামী কাপড়,গাড়ি,বাড়ি,আলিশান জীবনের জন্য উন্মাদ।তারপরও কেনো সংসার করলে তার সাথে?সে তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে কেনো ছুঁড়ে ফেলোনি তাকে?”

রেদোয়ান এর কথায় মোটেও অবাক হয়নি মাহরুর।পুলিশ ডিপার্টমেন্টএ আছে সে।এসব তার কাছে বা হাতের খেল। হিরাকে অন্য পুরুষের সাথে ঘুরতে দেখে সেই সর্বপ্রথম জানিয়েছিল মাহরুরকে।সেদিন কথা কাঁটায় মাহরুর।ভাই বলে চালিয়ে দেয় নিজের স্ত্রীর প্রেমিককে।

রেদোয়ান এর প্রশ্নের বিপরীতে মাহরুরও প্রশ্ন করে, “সে কেনো ছেড়ে যায়নি?”

“সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো ওই মহিলা।”

“আমিও দিয়েছি সুযোগ।কারণ দোষ আমার ছিলো। স্বামী হিসেবে আমার কর্তব্য ছিল না তার সব আবদার পূরণ করার?আমি পেরেছি? তাইতো সে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।”

বিরক্ত সুরে রেদোয়ান বলে উঠে, “তুমি পরকীয়াকে সমর্থন করছো?তুমি তাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছো।”

“সম্মানে দুনিয়া চলে না।”

“আর মল্লিকা?”

ধীরেধীরে শক্ত মুখ ছেড়ে দিয়েছে।ঠিক এখানটাইতো রাগ দেখাতে পারেনা।এখানে অচল পুরোটা মাহরুর।মিয়ে এলো কন্ঠস্বরটাও।বললো,

“চন্দ্র আমার অপ্রাপ্তির এক সুন্দর পৃষ্ঠা”

“এখনও ভালোবাসো?”

বাঁকা হাসলো মাহরুর।আঙ্গুলের সাহায্যে কাঠের টেবিলে আকাঝুকি করতে করতে আবার বলল,

“আমার কোনো অনুভূতি ছিলো না ওর প্রতি।কিন্তু মায়া হতো।এইটুকু মেয়ে ভালোবাসার কথা বলতো আমায়।তারপরও সুযোগ দিয়েছিলাম ওকে।সে সৎ ব্যবহারও করেছে।আমি পারিনি। স্বার্থপরের মতন ওয়াদা ভঙ্গ করেছি।যেদিন থেকে স্বার্থপর হলাম সেদিন থেকেই আমার হৃদয় খোঁজে সেই ছোট্ট চন্দ্রকে।সামলে নেই অবাধ্য হৃদয়কে। বোঝাতে চাই আমি এখন অন্যের ভালোবাসার ভাগীদার। চন্দ্রকে নিয়ে ভাবা হয়তো তার প্রতি অন্যায় হবে।কিন্তু তার চেয়ে বড় অন্যায় যে আমি চন্দ্রের সাথে করেছি?সেই মাশুল কে দিবে? নিশ্চয়ই আমি।দেখো কিভাবে নিয়তি খেল খেললো। অস্রু বৃথা যায় না রেদোয়ান।রুহের হায় লাগে।হয়তো চন্দ্র ভুলে গেছে আমাকে।তবে একটা কথা বলবো।শুদ্ধ ছিলো চন্দ্র।তার ভালোবাসা।কলংক ছিলাম আমি।আজ ধুঁকে ধুঁকে মরছি।রেহাই দেওয়ার কেউ নেই।”

___

অতীত,

গ্রাম্য অঞ্চলে বিয়ের রমরমা পরিবেশ।আগের ঐতিহ্য এখনো বজায় রাখা হয় এখানে। বাড়ির সাজসজ্জাটাও সম্পূর্ণ গ্রামীণ।সময়ের সাথে মানুষের চিন্তা উন্নত হলেই কিছু ক্ষেত্রে পুরোনো স্মৃতি বহন করে আনন্দ পায়। ভাবধারা বজায় আছে শশীদের বাড়িতে।পালন করা হচ্ছে সব ধরনের নিয়ম নীতি। মাত্রই হলুদ গোসল হয়েছে।মল্লিকা আনন্দিত।বেশ আনন্দিত।আজ তার আনন্দ হওয়ার কারণ দুটো।আরেকটি কষ্টের।আগামীকাল সখি পারি জমাবে অন্যত্র।ভালোবাসায় ভাগ পড়বে।অন্যকে সময় দেবে তার চেয়ে বেশি।সংসারের মায়াজালে আবদ্ধ কিশোরী হয়ে উঠবে নারী।

কপকপা ঠান্ডায় কাপতে থাকা শশীকে মোটা কম্বলের মাঝে জড়িয়ে ধরলো মল্লিকা।গামছা দিয়ে দ্রুত কেশ মুছে দিচ্ছে যতনে।বিয়েটা বড্ড মুশকিল বৃষ্টির মৌসুমে।

“গরমকাল আসলেই বিয়ে করতি শশী?”

“মানুষের বিয়ে খেয়েছি।কত আনন্দে।এখন বুঝতে পারছি কত মজা।পুরো জমে যাচ্ছিরে মল্লিকা।এখনতো শীতকালও না।”

“তোর জন্য আদা চা আনি?”

“আনলে ভালো হয়।কিন্তু সবাইতো ব্যাস্ত।”

“চিন্তা করিস না।আমি বানিয়ে আনছি আমাদের বাড়ি থেকে।তুই একটু বিছানায় পিঠ ঠেকা।”

কাজ টুকটাক মায়ের কাছে শিখেছে মল্লিকা। মাহরুর ভাইকে চিত্তে অবস্থান দেওয়ার পর আরো আগ্রহী হয়েছে ঘরের কাজে।মনের বিশাল ইচ্ছে নিজ হাতের রান্না খাওয়াবে।কিন্তু কাজ করার বেশি কাজ বাড়িয়ে ফেললো এই মুহূর্তে।গরম চা পড়েছে হাতে। জ্বলনিতে কুঁকড়ে যাচ্ছে।বাড়িতে কেউ নেই।মা শশীদের বাড়ি।দ্রুত গিয়ে নিজে নিজেই টুথপেস্ট লাগিয়েছে হাতে। ব্যথাকাতর হাত নিয়েই কোনো রকম চা ফ্লাক্সে করে শশীদের বাড়ি চলে গেলো।

“হাত পুড়লি কি করে?”

“মহারানী তোমার জন্য চা করতে গিয়ে পুড়েছে।”

“কি যে করিস না মল্লিকা।এতদিন মন পুড়িয়েছিস এখন হাতটাও পুড়িয়ে নিলি।”

“এ কিছুনা।এই সামান্য কষ্টের চেয়ে আমার খুশিটা দ্বিগুণ”

“মাহি ভাই আসছে বলে?”

লজ্জাবতী গাছের ন্যায় নেতিয়ে জবাব দেয় মল্লিকা, “হ্যা ”

“শওকত ভাইয়া ভালো একটা কাজ করেছে।”

“ঠিক তাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।”

রাত পেরিয়ে যেতেও সময় নিলো না। বান্ধুবির সাথেই ছিলো মল্লিকা।গল্প গুজব করে সময় কাটিয়েছে। আজইতো চলে যাবে মেয়েটা।কষ্ট হবে।হুটহাট কেঁদেছে কয়েকবার।তারপর নিজের মনকে বুঝিয়েও নিয়েছে।মেয়ে হয়ে জন্ম!বাবার ঘর ত্যাগ করতেই হবে।সব বদলাবে দুনিয়াতে।এই নিয়ম খোদ সৃষ্টিকর্তার তৈরি। খন্ডানোর ক্ষমতা মাটির তৈরি মানুষের নেই। ভোর সাতটায় ঘুমের ঘোরে কর্ণ জেগে উঠে মল্লিকার।তার চাচির গলার স্বর।অর্থাৎ মাহরুরের মা লিজা বেগমের।

নারী কণ্ঠে একটা মধুর কাব্য ভেসে এলো, “মাহি এসেছে সকাল পাঁচটায়।একটু বিশ্রাম নিয়েই চলে আসবে এবাড়ি”

কেশ নেতিয়ে ছিলো বিছানার কোনে।নিদ্রা নীড়ে তোষামোদ সর্বাঙ্গ। অকস্মাৎ তোড়জোড় শুরু হলো।মাহি হোক আর মাহরুর।সেতো এক।একই মানব।নাম এসে বাড়ি খায় হাওয়ার মতন।লক্ষ্যহীন হয় চেতনারা। বিদ্যুৎ বয়ে যায় কায়ায়।লাফিয়ে উঠার দরুনে চুলগুলো দোল খাচ্ছে।দুহাতের সাহায্যে চোখ ডলে নেয়।নিজেকে পূনরায় আশ্বস্ত করে চাচীর গলার আওয়াজ সত্যতো?নাকি প্রটিরাতের মত মাহরুর ভাই আসছে তার হৃদ এর আঘাতে মলম প্রশমিত করতে।কান পাতে। মনোযোগ পূর্ণ দেয় বাহিরের কোলাহলে। হ্যা! সত্যিই চাচী কথা বলছে।কয়েকবার মাহরুর ভাইয়ের নামও নিয়েছে।

__

“আমাকে কেমন লাগছে?”

বউয়ের সাজে সজ্জিত শশী মল্লিকার সামনে এসে সটাং করে দাড়ায়। উদ্দীপিত হয়ে জানতে চায় তাকে কেমন দেখাচ্ছে। ‘ এক টুকরো সৌন্দর্য্যের প্রতীক’ এই উক্তিটি মুখ থেকে উচ্চারণ করে মল্লিকার চোখ জলে টইটুম্বুর হয়।এতটাই বেশি যে চোখের সামনে শশীর বধূ রূপটা ঝাপসা হয়ে আসলো।

মল্লিকার বেয়ে চলা অস্রুদানা মুছে আদেশের সুরে বলল, “যা তৈরি হয়ে আয়।এত সুন্দর করে সাজবি যেনো দেখেই মনে হয় বউয়ের একমাত্র আপন সখী”

মায়ের হাতে প্রথমবার শাড়ি পড়েছে। শশী আর মল্লিকা আগে থেকেই পণ করেছিলো একে অপরের বিয়েতে শাড়ি পড়বে। পাতলা কিশোরী বদনে আসমানী রঙের শাড়ি শোভা পেলো।ঢিলেঢালা ব্লাউজ মায়ের নিপুণ হাতে সেফটিপিন দিয়ে আটকে নিয়েছে।এবার সাজসজ্জার পালা। পরিপাটি বিনুনী বেঁধেছে ঘন চুলে।মাহরুরের চিন্তা সম্পূর্ণ মাথা থেকে বের করে কাজল পড়তে মনোযোগী হয়।মুখে সামান্য পাউডার মেখে ছোট্ট একটা টিপ দিয়ে দশ মিনিটে তার সাজসজ্জা সমাপ্ত।
আশপাশ ভালোমত তাকিয়ে পা বাড়ালো মল্লিকা শশীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।মাঝপথে বাঁধা হয় এক কন্ঠ।যেনো কেউ মুখ দিয়ে তীর ছুঁড়ে মারলো।

“চন্দ্র”

লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে তাকালো কণ্ঠের মালিকের দিকে।পরনে আসমানী রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত মাহরুর ভাই সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছে। ঘোরে পড়ে গেলো মল্লিকা।এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।এই পোশাকটা বেশি সুন্দর নাকি মাহরুর ভাই? অদ্ভুতভাবে রংটা মিলে গেছে মল্লিকার সাথে।মুখোমুখি দাড়ানো দুজন মানুষ স্থির। মাহরুরও সময় দিচ্ছে যেনো।তাকে দেখে নেওয়ার।চোখ জুড়ানোর।

“তুই চন্দ্রতো নাকি অন্য কেউ?”

কন্ঠনালীতে আটকে আসা শব্দগুলোর সাথে যুদ্ধ করলো মল্লিকা।জোরপূর্বক বের করে আনলো।তারপরও ভাঙ্গা শব্দ,

“কে..কেনো মাহরুর…ভাই?”

“তোতলাচ্ছিস কেনো?”

“ভয় ক…করছে মাহরুর ভাই”

কি অদ্ভুত কথা বার্তা?এই পরিবেশে ভয়ের কোনো কারণ দেখছে না মাহরুর। বিচিত্র মেয়ের অনুভূতিও বিচিত্র। মাহরুর উত্তরে বলে,

“কাকে ভয় পাচ্ছিস?”

“তোমাকে”

আরো আশ্চর্য্য দৃষ্টি ছুঁড়ে মাহরুর বললো, “আমি কি বাঘ নাকি ভাল্লুক?”

নত জানু হয়ে থাকা মল্লিকা আড়ষ্ট হচ্ছে আরো।নেতিয়ে পড়ছে যেনো জমিনে। ঘাবড়িয়ে উঠছে বারবার।ভিন্ন অনুভূতির স্বীকার। বোধশক্তি শূন্যের কোঠায় এসে দাড়ালো।

মাহরুর নরম কণ্ঠে বললো, “তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই একটা পরিপূর্ন নারী।আমার চোখের সামনে বড় হওয়া ছোট মেয়েটি না। মানিয়েছে শাড়িতে।সুন্দর লাগছে তোকে চন্দ্র”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-০৪

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৪
লেখা : Azyah_সূচনা

কতোটা দিন পেরোলো। মিষ্টি নামক মিষ্টি মেয়েটার দেখা নেই।গুনে রেখেছে মাহরুর। এগারোদিন হয়েছে।না গেটে দেখা যায় না বারান্দায়। কোথায় হারিয়ে গেল বাচ্চাটা?বাচ্চাদের সাথে খেলতেও আসেনা। চকোলেটগুলো বুক পকেটে থেকে থেকে নষ্ট হয়ে যাবে।তবে চকলেটের মালিকের দেখা নেই।আজও বিরস,পরাস্ত হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।

সিড়ি বেয়ে ঘরে দিকে চাইতেই মুখ জুড়ে বিস্ময়।ঘরের বাতি জ্বলছে।এটা নতুন কিছু নয়।হিরা থাকাকালিন এই দৃশ্য ছিলো রোজকার।কিন্তু এখন?এই সময় কে আসতে পারে? হন্তদন্ত পায়ে এগোলো দরজার দিকে।বিছানায় বসে খেলা করা বাচ্চাকে দেখে বুঝতে বাকি রইলো না কে এসেছে।কানে ভাসছে হাঁড়ি পাতিল এর আওয়াজ।জুতো খুলে ঘরে প্রবেশ করেই সায়মনকে কোলে তুলে নেয়।

আদর দিয়ে বলতে থাকে, “মামা?কখন এসেছো?”

“একটু আগে এসেছি মামা”

পকেটে রাখা চকোলেট দুটো সায়মনের দিকে এগিয়ে দিলো। মাটিতে বসে তরকারী কাটা মেয়ের দিকে চাইতেই বিদ্রুপ দৃষ্টির শিকার হয়।রেগে আছে বুঝি?শিরীন ঝাঁঝালো গলায় বলতে লাগলো,

“খাওয়া দাওয়া নেই শুধু কাজ আর কাজ।কতবার বলেছি আমার বাড়ি এসে খেয়ে যেতে।কে শুনে কার কথা?আমিতো পর।”

“আহা রেগে যাচ্ছিস কেনো?আর তোকে কে বলেছে রান্না করতে?”

রাগী চোখে তাকালো শিরীন।বললো, “বড় ভাই বলে রাগ করার অধিকার তোমারই আছে?আমার নেই।ভাইকে ক্ষুধার্থ দেখলে আমারও কলিজা পুড়ে!”

“তোকে কে বলেছে আমি ক্ষুধার্থ?মোল্লা হোটেলে প্রতিদিন খাই”

“কত খাও আমি জানি।রান্না করে দিবো প্রতিদিন এসে।কোনো কথা বলবে না।হাত মুখ ধুয়ে আসো।আমি চা দিচ্ছি।”

পাগলাটে স্বভাবের বোন।অল্প বয়সে বিয়ে করে এই শহরে এসেছিল।এখন তার বোন দুই সন্তানের জননী।স্বামী,সংসার বাচ্চা সব একহাতে সামলে নিচ্ছে।কেউ সত্যি বলেছিলো পুরুষের আগে নারী বুঝদার হয়ে উঠে।অল্প বয়সে সবটা সামলে নেয়।মেয়েলি হাতের চা খায় না কিছুদিন হতে।আজ বোন এসেছে।কাপের পরিবর্তে মগ ভর্তি চা নিয়েছে।সাথে টোস্ট বিস্কুট।নিজে খাচ্ছে সাথে সায়মনকে যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে।

একপর্যায়ে মাহরুর প্রশ্ন করে, “সুমাইয়াকে আনলি না কেনো?”

“ও মাদ্রাসায়।ওর বাবা বাড়ি যাওয়ার পথে ওকে বাড়ি নিয়ে যাবে।”

“আচ্ছা আচ্ছা।”

নিরব হলো দুজনেই।সায়মনের সাথে ব্যস্ত হচ্ছে মাহরুর।খুব ভালোভাবে ভাগ্নে, ভাগ্নিকে।মৌনতা ভেঙে শিরীন বললো,

“ভাবি আর ফিরবে না?”

“নাহ”

“ডিভোর্সের পরও বোঝাপড়ার জন্য কিছু সময় দেওয়া হয়।তোমরা সেই সময়টাও নিলে না কেনো?”

“সুযোগ দেয়নি তোর প্রাক্তন ভাবি”

ভাইয়ের মুখে নতুন শব্দ।তোর ভাবি থেকে তোর প্রাক্তন ভাবি হয়েছে।হবেই না কেনো?সংসার ভেঙে চুরমার। বর্তমান থেকে প্রাক্তন।অথচ মাহরুরের মুখে কোনো গ্লানির চিন্হ নেই।একটা শক্ত মনের মানুষ আগে থেকেই।জীবনের উত্থান পতন দেখেছে। গাধার খাটুনি খেটে সুখের মুখটা দেখতে পেলো না। এরচেয়ে গ্রামে দিন এনে দিন খাওয়া সেই সময়টাই ভালো ছিলো।বাবা চলে গেলো। মাহরুরের বিয়ের দুই বছরের মাথায় মাও চলে গেলো।আর কি আছে জীবনে বাকি?

“আমাদের বাড়ির নিচের ঘরটা খালি আছে।আমি জানি তোমাকে হাজার বললেও তুমি আমার সাথে এসে থাকবে না।তুমি নাহয় ওই ঘরটায় উঠো।অন্তত তোমাকে চোখের সামনে তো পাবো ভাইয়া”

“তুই কেনো বুঝিস না।বোনের শ্বশুরবাড়িতে এভাবে থাকা যায় না।”

“সুমাইয়ার বাবাকে তুমি এই চিনলে এত বছরে?ভাবি যাওয়ার পর থেকে এখানে এসে তোমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।তোমার আত্মসম্মান বোধের কথা বিবেচনা করে আমি থামিয়ে রেখেছি।”

“ভেবে দেখবো।”

শিরীন চলে গেছে।রান্না করে রেখে যাওয়া খাবার টুকু তৃপ্তি সহকারে খেয়ে উঠে মাহরুর।আজকাল নতুন অভ্যাসে ধরেছে। বদঅভ্যাস। সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস। আসক্ত নয় সে।মাথা ভার হলে দুয়েকটা খেয়ে উঠে।আজও তাই।আকাশের চন্দ্রে মনোনিবেশ করে কিছুক্ষন যাবৎ।কয়েক দল মেঘ ঢেকে দিচ্ছে বারবার।আবার ফুটে উঠছে তার শুভ্র সৌন্দর্য।মনে পড়লো তার নিজের চন্দ্রের কথা। মানবাকৃতির চন্দ্র।তার মুখেও দেখা যেত এই মেঘের ঘনঘটা।আবার হুট করেই ফুটে উঠতো চন্দ্রসুধা।

“আয় চন্দ্র তোকে কল্পনা করি”

___

অতীত,

ক্রন্দনে মুখ ভিজেছে।পায়ের ব্যথার চেয়ে দ্বিগুণ মনের ব্যাথা।পায়ের চোটতো শুধু একটা বাহানা মাত্র। মাহরুরের উঠোনে বসে কেঁদে চলেছে মল্লিকা।ব্যস্ত দেখাচ্ছে তার বাবা মাকেও।আজ বিদায়ের দিন। অনিশ্চিত যাত্রা।ফেরার কোনো যুতসই সময় নেই। চিৎকার চেঁচামেচি নেই। নিঃশব্দে অস্রু বিসর্জন দিচ্ছে মল্লিকা। মাহরুরও তার সামনে ঠায় দাড়িয়ে। কয়বার শান্তনা দিতে এসেছিলো।লাভ হয়নি।শীতকালে ব্যথা বেশি লাগে গায়ে।তবে এই পীড়া ভিন্ন। মাহরুরের বিচক্ষণ নজরে এই বেদনাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।আজ প্রথম বোধহয় খারাপ লাগলো কিশোরী মেয়েটির জন্য।ছোট্ট হৃদয় কি জানে কি চাচ্ছে সে?অনেক উচুতে হাত বাড়িয়েছে। সম্ভবের মধ্যেও অসম্ভবের আভাস।কি করবে তার চন্দ্রের জন্য?কি করে থামাবে তাকে?

পায়ের ব্যথা নিয়েও উঠে দাড়ালো।সবার চোখের আড়ালে একটা চিরকুট পুড়ে দিলো মাহরুরের ব্যাগে।সবার দৃষ্টি এড়াতে পারলেও মাহরুরের নজরে ধরা দিয়েছে সেই চুরি। বাস স্ট্যান্ডে কাকুতি ভরা মুখে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটির মুখের দিকে শেষবার চাইলো।তারপর মিনিট দশেকের মধ্যে বিশাল বাসের চার চাকা ত্বরান্বিত গতিতে দূরত্ব বাড়াতে লাগলো।মাথা বের করে একবার পিছু দেখা হয়েছে। দুরত্বের সাথে ঝাপসা হয়ে যাওয়া তরুণীর অবয়ব।

“শহরের ব্যস্ততায় আমাকে ভুলে যাবে?আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মাহরুর ভাই।কিন্তু আমি জানি তোমার চাকরিটা বেশি জরুরি।তুমি ভালো থাকবে। চন্দ্র অপেক্ষায় রইলো”

কি সুন্দর হাতের লেখনী!তার সাথে মিশ্রিত তার এলোমেলো অনুভূতি। হীনমন্য মাহরুর।তাকে বলে দিয়েছে সেও অপেক্ষা করবে।কিন্তু এরপর?তাকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে?ফেলে রেখে কষ্ট দেওয়াওতো অন্যায়। মাহরুর কি অনুভব করতে পারছে তার চলে যাওয়া কতটা ক্ষতবিক্ষত করছে চন্দ্রের হৃদয়কে?বুঝলে হয়তো চাকরি ভেস্তে দিত।

“আমি বুঝতে পারছি না চন্দ্র আমার কি করা উচিৎ?তোর এগিয়ে রাখা হাতে নিজের হাত বাড়াবো? নাকি ফিরিয়ে দেবো।তুই সত্যিই লক্ষী একটা মেয়ে।এটাও সত্য তুই যে ঘরে যাবি সেই ঘর আলোকিত করবি।তারপরও একটা কিন্তু রয়ে যায়রে চন্দ্র।”

__

দশম শ্রেণীতে ভালো নাম্বারে পাশ করেছিলো মল্লিকা।পড়ালেখায় ছিলো দুরন্ত।ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে। ‘টাইম অ্যান্ড টাইড ওয়েট ফর নোন’ সময় আর নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।তারা হয় নিজের মার্জিত মালিক।চলে যেতে দ্বিধাবোধ করে না।কিন্তু অপেক্ষা? সময়তো চলে যায়।তবে অপেক্ষারত মানুষটা যে স্থির। যার জানা নেই এই প্রতীক্ষার অবসান কবে?মাসের পর মাস পেরিয়ে যাচ্ছে এই অপেক্ষায়।হুমায়ূন আহমেদ স্যার এক উক্তি রেখে গিয়েছেন, “অপেক্ষা হলো শুদ্ধতম ভালোবাসার একটি চিহ্ন।”

ঘূর্ণায়মান ঘড়িকে দেখে আর কত বুঝানো যায় মনকে?মনে পড়ে মাহরুর ভাইকে।ভীষণ মনে পড়ে। মধ্যেমধ্যে কান্নায় ভেঙে পড়া মল্লিকা বেঁচে আছে এই বিশ্বাস নিয়ে মাহরুর ভাই ফিরবে।তাকে সময় দিয়েছে।ওই সময়ের মূল্য সেও দিবে।

তার মন খারাপে যোগ দিলো আরেকজন।হাসি মাখা লাজুক মুখ।আজ সে একা আসেনি।তার বাবা মাও এসেছে।চুল হাওয়ায় উড়িয়ে টেবিলে হাত রেখে আনমনে বসে থাকা মল্লিকা তাকায় শশীর দিকে।প্রশ্ন করে,

“এত খুশি কেনো তুই?”

আবারো লাজুক হাসলো শশী।মাথা নামিয়ে ঠোঁট কামড়ে বসেছে।কি এমন প্রশ্ন করেছে মল্লিকা তাই ভেবে পেলো না।লজ্জার কি আছে এখানে?বাহু ঝাঁকিয়ে পূনরায় প্রশ্ন করে,

“বলছিস না যে?”

কন্ঠ খাদে নামিয়ে শশী উত্তর দেয়, “সেদিন আমাকে দেখতে এসেছিল।আমাকে পছন্দ হয়েছে।আগামী মাসে বয়স আঠারো হলেই বিয়ে।”

চক্ষু ছানাবড়া মল্লিকার। তড়িৎ গতিতে জিজ্ঞেসা করলো, “তাই তুই এত খুশি?”

“হ্যাঁ রে।আমার মামাতো ভাই হয়।আমি তাকে দেখেছি।গোছানো মানুষ।”

“তাকে পছন্দ করিস?”

“না তেমনটা নয়। তবে অপছন্দ করিনা।তার বয়সও বেশি না।পাশের গ্রামেই থাকে তারা।”

দুঃখ যেনো দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেলো।আগামী মাসে শশীর বয়স আঠারো হবে।তারপরই তার বিয়ে।সখীর বিয়েতে আনন্দিত হওয়ার বদলে দুঃখী হয় মল্লিকা পরবর্তী সময়ের জন্য।বিয়ে হলেও তাকে চলে যেতে হবে দূরে।পাশের বাড়ি থেকে পাশের গ্রাম?না চাইতেই হুহু করে কেদে ফেললো মল্লিকা।

বললো, “তুইও আমাকে ছেড়ে চলে যাবি শশী?”

হাসি মাখা বদন মিয়ে যায়। শশীও হঠাৎ আবেগ প্রবন হয়ে উঠে। সত্যিইতো? তারও চলে যেতে হবে।দ্রুত গতিতে মল্লিকাকে জড়িয়ে ধরলো।

বললো, “আমি বিয়ে করবো না।আমি তোকে ছেড়ে যাবো না কোথাও!”

“এটা কি বললেই হয়? মাহরুর ভাইকে আটকাইনি তার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। তোকেও আটকাবো না।আমি চাই সবাই সুখে থাকুক।তোরা দুজনই আমার ভীষণ প্রিয়।আমার সাথে অন্ততঃ দেখা করতে আসিস শশী”

দুজনেই বাবা মার পাশে এসে বসেছে।আলাপ আলোচনা চলছে বিয়ের।দাওয়াত করতে এসেছেন সর্বপ্রথম রমজান সাহেব ও তার পরিবারকে।একমাস আগেই জানিয়ে দিলেন।আসতে হবে।
রমজান সাহেব নিজ থেকে শশীর বাবার দিকে মিষ্টি এগিয়ে দিয়ে বললেন,

“আলহামদুলিল্লাহ ভীষণ খুশি হয়েছি।সবার ছেলে মেয়েরা সুখে থাকুক।এটাইতো আমাদের চাওয়া।”

“হ্যা ভাই সাহেব।ছোট করেই বিয়েটা করবো।অত বড় আয়োজন না হলেও আপনারা সবসময় থাকবেন কিন্তু।” শশীর বাবা উত্তর দিল।

রমজান সাহেব বললেন, “অবশ্যই। শশীতো আমারও মেয়ে নাকি?সেই ছোট বেলা থেকে দেখেছি বাচ্চাটাকে। কতো বড়ো হয়ে গেলো।”

মুরব্বীদের কথায় মুখরিত ঘরটা।বিয়ের সমস্ত বিষয়ে যেনো আজই আলোচনা করে ফেলছেন।রমজান সাহেবও নিজের ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব তুলে নেন।কথায় কথায় রমজান সাহেব বলে উঠলেন,

“আমার মেয়েটাকেও একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিবো খুব দ্রুত।দুআ রাখবেন।”

“তা যা বলেছেন।অল্প বয়সে বিয়েটা হয়ে গেলেই ভালো। সংসারটা বুঝে নিয়ে এগিয়ে নিতে পারবে।”

রমজান সাহেব সায় দিয়ে বললেন, “শশী মার বিয়েটা মিটলে আমিও পুরো দমে ছেলে খোঁজা শুরু করে দেবো”

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত পড়লো কথাটি মল্লিকার কর্ণকুহরে।সাথেসাথে কাঁপুনি ধরে গেছে। একি বললো বাবা?তাকেও বিয়ে দিয়ে দিবে! হৃদপিণ্ডটা দ্রুত বেগে ছুটছে।এখনই বোধহয় মৃত্যু হবে। দাঁড়িয়ে ছটফট করতে লাগলো মল্লিকা। মাহরুর ভাইতো সময় দিয়েছে,নিয়েছে।এর আগেই বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কথা কেনো বলছে। শশী বুঝতে পারে তার অবস্থা। হাত চেপে দ্রুত অন্য ঘরে নিয়ে গেল।

আর্তনাদ করে মল্লিকা বলতে লাগলো, “আমি মরে যাবো শশী।আমি মরে যাবো!আমার মাহরুর ভাইকে চাই।এনে দে শশী।”

“থাম মল্লিকা।কেউ শুনতে পাবে।”

“তুই বুঝতে পারছিস না। তুইও মাহরুর ভাইয়ের মতন আমাকে ছোট ভাবিস?আমি! আমাকে একবার মাহরুর ভাইয়ের সাথে কথা বলিয়ে দে।হাত জোড় করি তোর কাছে!”

বাবার বিনা অনুমতিতে তার ফোন হাতে নিয়েছে।গলা শুষ্ক হয়ে উঠতে লাগলো একটু পরপর।পানি খাওয়ার সুযোগ নেই।চোরের মতন তার প্রত্যেকটি কদম।দেয়াল ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো রাতের একটা বাজে।এতটা সময় জেগে বাবা মায়ের ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা করেছে।সৌভাগ্যবশত ছোট্ট বাটন ফোনটা আজ ঘরে না বসার ঘরে রেখেছে। তিন রুম বিশিষ্ট আধাপাকা ঘরে নিঃশ্বাস ফেললেও টের পাওয়া যায়।আজতো দুঃসাহস করে ফেলেছে মল্লিকা।না পারতে এক গ্লাস পানি নিয়ে খেয়ে ফেললো।শব্দ যেনো না হয় সেখানেও খেয়াল রেখেছে।
দুরুদুরু বুক নিয়ে ফোন মেলায় সেই কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে।

“আসসালামু আলাইকুম চাচা।এত রাতে ফোন করলেন?সব ঠিক আছেতো?”

তরতর করে সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠে মল্লিকার।মাহরুর ভাইয়ের ঘুমঘুম কন্ঠ লোমহর্ষক। অন্যদিকে চিন্তায় পড়ে গেছে মাহরুর।রমজান চাচার নাম্বার থেকে কল এসেছে।ফোন করে কোনো কথা বলছে না। আকষ্মিক কান্নার শব্দ ভেসে এলো অন্যপাশ থেকে।মল্লিকা হেঁচকি তুলে বললো,

“মাহরুর ভাই”

কন্ঠস্বর অস্পষ্ট।কান্নার জোরে গলা জড়িয়ে আসছে। মাহরুর বললো,

“চন্দ্র?কি হয়েছে? কাঁদছিস কেনো?”

“মাহরুর ভাই…বাবা”

“কি হয়েছে চাচার?”

নাক টেনে টেনে মল্লিকা বললো, “আমাকে..আমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে বাবা। শশীর বিয়ে আগামী মাসে।বাবা…বলেছে আমাকেও ওর পরেই বিয়ে দিবে..ছেলে খুঁজবে আমার জন্য”

কথাগুলো বলতে দীর্ঘসময় নিয়েছে। এমনভাবে কাদঁছে মেয়েটা!কথাও গলায় আটকে আসছে। মাহরুর সর্বপ্রথম তাকে থামানোর প্রয়াস করে বলে,

“চন্দ্র? শোন!শান্ত হ।কিসের বিয়ে?কবে বলেছে দিবে বিয়ে?”

“শশীর বিয়ের পরই। মাহরুর ভাই তুমিতো আমাকে সময় দিয়েছো।বাবা কেনো এরই আগে আমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে।আমি বিয়ে করবো না মাহরুর ভাই।আমি পারবো না বিয়ে করতে।আমাকে বাঁচাও।আমি অন্যের ঘরে যাবো না কক্ষনো!পায়ে পড়ি তোমার”

মিনতি করছে চন্দ্রমল্লিকা। কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা নাজেহাল। এরকম করেতো মাহরুরের বিদায়ের দিনও কাদেনি।বুঝে উঠতে পারল না মাহরুর।কি করবে?কি করে শান্ত করবে তাকে?

নরম গলায় মাহরুর বলে, “বিয়ে বললেই হয়ে যায়না।আমি কথা বলবো চাচার সাথে।এটা কি তোর বিয়ের বয়স?”

“আমি তোমাকে ভালোবাসি মাহরুর ভাই”

“কি বললি?”

“ভালোবাসি!”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-০৩

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৩
লেখা : Azyah_সূচনা

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে হিরা এবং মাহরুর।রাস্তার মোড়ে হঠাৎ ডেকে থামানো হয়েছে তাকে।পূর্বে কয়েকবার কল করেছিলো মাহরুরকে। অফিসের কাজে খেয়াল করা হয়নি।ফোন ব্যাক করার আগেই সামনে এসে হাজির হয় তার তথাকথিত প্রাক্তন স্ত্রী।

“এখানে দাড়িয়ে আছো কেনো হিরা?কি হয়েছে?”

নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো হিরা। মাহরুরের কন্ঠে মুখ তুলে তাকায়। একি?মুখে অপরাধবোধের ছাপ দেখা যাচ্ছে যে?

“কোনো সমস্যা?আমাকে খুলে বলো। সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করবো”

“আমাকে ক্ষমা করে দিন।প্লিজ আমার প্রতি কোনো আক্ষেপ রাখবেন না।”

মাহরুর হেসে জিজ্ঞেস করলো, “ব্যাস এতটুকু ব্যাপার?আমার কোনো আক্ষেপ নেই।বরং তুমি আমাকে ক্ষমা করো আমি তোমাকে ভালো রাখতে পারিনি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সত্যটা বলার জন্য উদ্যত হয় হিরা, “আমি বিয়ে করছি।বিয়ের পর আমার হবু স্বামীর সাথেই কানাডা চলে যাবো।এটাই বলতে এসেছিলাম।আমি চাই না আপনি অন্য করো কাছ থেকে এই খবর পান।নতুনভাবে জীবন শুরু করতে যাচ্ছি মাহি।আমার প্রতি কোনো আক্ষেপ রাখবেন না।আপনার সাথে কাটানো সময় সুন্দর ছিলো।তবে সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন।ভুলবশত কয়েকবার আমাদের কাছে আসা হয়েছে….”

“এসব পুরোনো কথা।বাদ দিলে ভালো হয়।তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা।”

“আপনি রেগে নেই আমার উপর?”

“রেগে থাকার কথা ছিল?”

“হয়তো ছিলো।আপনাকে এভাবে মাঝ পথে ফেলে রেখে চলে গেলাম।”

অন্তর জবাব দিলো, “যেমন কর্ম তেমন ফল।শক্ত পুরুষকে ফেলে রেখে যাওয়ায় অনুশোচনায় ভুগছে হিরা।একদিন সেও এক কিশোরীকে দিশেহারা করে তার চক্ষু সম্মুখে অন্যের হয়েছিলো ”

তবে মুখ আওড়ায় অন্য বাণী, “আমার কোনো রাগ নেই, আক্ষেপ নেই।তুমি ভালো থাকো। সবাই ভালো থাকুক”

চেষ্টায় কি কমতি ছিলো বিগত ছয় বছরে?এক নারী মনে ছুরি চালিয়েছিলো।আরেক নারীকে মিথ্যে সম্পর্কে বেধে ক্ষতবিক্ষত করতে চায়নি।আর পাঁচটা সংসারের মতোই চালাতে চেয়েছিলো নিজের সংসারের চাকা। ভালোবাসায় না হোক মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছিলো।এক বছরের ব্যবধানে হিরার রূপ বদলায়।বিতৃষ্ণা আসতে থাকে মাহরুরের প্রতি।তার যত্ন, দায়িত্বশীলতার চেয়ে বেশি চোখে বাজে তার অসহায়ত্ব। পাঁচটা পূর্ণ করার অসমর্থ।এরপর শুরু হয় তাদের দূরত্ব।মেনে নিয়েছে মাহরুরও।এখন থেকে নতুন জীবন সূচনার পালা। একাকীত্বে ভুগে।জেদী মনকে মানিয়ে নিয়েছে।তার এই জীবন চালনায় তার সঙ্গ হবে তার কল্পনা।

প্রতিদিন এই পরিবেশটা দেখতে দেখতেই বাড়ি ফেরা হয়।বিকেলের শেষভাগে।কোলাহল থাকে এই নির্বোধ শহরে। অফিস থেকে বাড়ির দূরত্ব বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট। মধ্যবিত্ত জীবনে যানবাহনের ভাড়া বাঁচিয়ে মনে হয় এক রাজপ্রাসাদ কেনো যাবে।হেঁটে হেঁটে পাড়ি দেয় কংক্রিডের সরণি।হাঁটলে নাকি শরীর ভালো থাকে।এটাও টাকা বাঁচানোর এক ওজনদায়ক বাহানা মাত্র।যাওয়ার পথে একটু এগোলেই বাগানবাড়িটার দেখা মেলে।তার খুব পছন্দের একজনের বাড়ি। বাগানবাড়ির দরজার কাছে পা দুটো থমকেছে খানিক সময়ের জন্য। নিরাপদ দূরত্বে সামান্য উকি ঝুঁকিও দিলো। কোথায় মিষ্টি মেয়েটা?দরজার কাছে দেখা যাচ্ছে না যে?পকেটে করে দুটো চকোলেট এনেছিল তার উদ্দেশ্যে।হটাৎ মনে পড়লো বাড়ির পাশের ছোটো খোলা জায়গার কথা।এখানে খেলে মিষ্টি।তার সমবয়সীদের সাথে।কদম পিছিয়ে সেখানে নজড় বুলায়।নাহ!এখানেও নেই।আজ বোধহয় খেলতে আসেনি সে। চকোলেট দুটো পূনরায় বুক পকেটে রেখে হাটা শুরু করে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

___

অতীত,

“মাহরুর এসেছে”

এই কথাটি কতটা আনন্দে আত্মহারা করে তুলেছে মল্লিকাকে? কেউ জানে?জানে না।সে প্রকাশ করছে না।বুঝতে দিচ্ছে না বুকে চেপে রাখা ঝড়।এখনই হয়তো বিস্ফোরণ ঘটবে মেয়েলি হৃদপিণ্ডের। কম্পিত চিত্তে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মল্লিকার নজর বাবার ঘরের দিকে।সেখানেই বসে আছে পা গুটিয়ে তার মনের মানুষ।পরনে কালো রাঙা উলের সোয়েটার জড়িয়ে।হাত দুটো একে ওপরের সাথে মিলিত। সম্পূর্ণ দৃষ্টি মল্লিকার বাবা রমজান সাহেবের দিকে।আলাপ আলোচনায় মগ্ন চাচা ভাতিজা।পুরুষালি স্বর সুর তুলছে ঘরের আনাচে কানাচে।এতদিন পর চক্ষু দর্শন হয়েছে বলে কি তাকে পূর্বের তুলনায় বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে?নাকি সে আগ থেকেই রূপবান পুরুষ?

“জানুয়ারি থেকে চাকরিতে যোগ দিচ্ছি চাচা।প্রথমে বেতন অল্প কিন্তু তারা আশ্বাস দিয়েছে কাজের সাথে লেগে থাকলে বেতন বাড়বে।”

“খুশি হইছি বাজান।তুইতো একমাত্র সম্বল তোর মায়ের।” রমজান সাহেব উত্তর দিলেন।

“দুআ করবেন চাচা।চাকরিটা পাকাপোক্ত হয়ে গেলে মাকে নিয়ে যাবো সাথে।একা একা এখানে কি করে থাকবে। শিরীনটাও নেই।”

মাহরুরের বাহু চাপড়ে রমজান সাহেব বললেন, “তুই কোনো টেনশন করবি না।তুই যতদিন না ঢাকায় সব ঠিকঠাক করতে পারস আমরা ভাবীরে এই বাড়ি আইনা রাখবো।আম্মা মরার পর এই ভাবীই আমারে মায়ের মতন পালসে।ভাবীর প্রতি আমারও দায়িত্ব আছে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুর উত্তর দেয়, “আপনারা আছেন বলেই আমি নিশ্চিন্ত ”

“তা ঢাকায় এতদিন কোথায় ছিলি?”

“শিরীনের শশুরবাড়িতে চাচা।আমি থাকতে চাইনি।আমারে জোর করে রেখেছে।ওর শশুর ভালো মানুষ।বললো নিজের বোনের বাড়ি থাকতে ভাই অন্য কোনো জায়গায় কেন থাকবে।আমিও চোখের সরম দেখায় ভালোমন্দ বাজার করে দিয়েছি মাঝেমধ্যে।”

“ভালো করছিস বাজান।যতই হোক মাইয়ার শশুরবাড়ি।”

পুরুষের নেত্র জোড়া এদিক ওদিক ঘুরল।কাউকে খুঁজছে হয়তো। যার খোঁজ করছে সেতো পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে। বিচক্ষণ চোখ দুটো ফর্সা পা দুটো দেখতে ভুল করলো না।আনমনে হেসে ফেলে।নিজ থেকে ব্যাগ থেকে প্যাকেট বের করে প্রশ্ন করলো,

“চাচী আর চন্দ্র কই চাচা?ডাকেন আপনাদের জন্য উপহার এনেছি”

রমজান সাহেব চমকালেন।বললেন, “মাত্র চাকরি পাইলি?এখনই এসবের কি দরকার ছিল?”

“সুসংবাদ পেয়েছি চাচা তাই ভাবলাম।আর এতে বেশি টাকা খরচ যায়নি।”

রমজান সাহেব স্ত্রী আর মেয়েকে আওয়াজ তুলে ডাকলেন।ফরিদা বেগম এসে হাজির হলেও মল্লিকা আসতে সময় নিচ্ছে।ভয় পাচ্ছে আজ। ক্যালেন্ডারে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো মাসটা। ডিসেম্বর এর তিন তারিখ।তার মানে মাত্র একমাস? একমাসও পুরোপুরি নেই।তারপর মাহরুর ভাই শুরু বিশ দিন নয় অনেক অনেক দিনের জন্য চলে যাবেন সেই শহরে।কোমল মন দ্বিধায়।তার আগমনে খুশি হবে?নাকি আবার চলে যাওয়ার শোক পালন করবে?

মায়ের ডাকে ঘরে আসতে বাধ্য হয় মল্লিকা।বাবার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।আড়াল করতে চাইছে খানিকটা নিজেকে।এক এক করে একটি পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি এগিয়ে দিল মাহরুর রমজান সাহেবের দিকে।আর শাড়িটি দিয়েছে ফরিদা বেগমের দিকে।তাদের উভয়ের মুখে একই কথা। ‘ কি দরকার ছিলো? ‘ মাহরুর অগ্রাহ্য করে। শখ করে এনেছে। এতে টাকা পয়সার হিসেব করলে হবে?

“চন্দ্র?এখানে আমার পাশে এসে বস”

এমন ডাকে কেপে উঠলো চন্দ্রমল্লিকা।নিজের দিকে আসার আহ্বান করছে।ভিন্ন এই ডাক।তবে মনে হলো সারাজীবনের জন্য পাশে ডাকছে। গুটিগুটি পায়ে এক কোনায় এসে বসে।তবে দুরত্বে।

একটি প্যাকেট তার দিকে এগিয়ে বললো, “এটা তোর।পছন্দ হয় কিনা দেখ”

গাঢ় নীল রঙের সেলওয়ার কামিজটা সুন্দর।সাদা সুতোয় কারুকার্য করা। ওড়নাটা সাদা নীলে মিশ্রিত।মন বললো মাহরুr যেমন সুন্দর তেমনি সুন্দর তার মন।তার চেয়ে বেশি সুন্দর তার পছন্দ। হাত বুলিয়ে পছন্দ হওয়া ড্রেসটা দেখে নিচ্ছে মল্লিকা।একটা খাদ তাকে সুন্দর জিনিসে তৃপ্তি দিতে পারছে না। মাহরুর এসেছে এর থেকে বেশী মাহরুর চলে যাবে।এটাই ভাবাচ্ছে তাকে।

“পছন্দ হয়েছে?”

“হ্যা মাহরুর ভাই”

রমজান সাহেব এবং ফরিদা বেগম তাদেরও বেশ পছন্দ হয়েছে।ফরিদা বেগম মাহরুরের জন্যে চায়ের ব্যবস্থা করতে গিয়েছেন।রমজান সাহেবও উঠে দাঁড়ান।ভাতিজা শখ করে কিছু এনেছে।এখনই পড়ে দেখবেন।এলাকা জুড়ে সবাইকে জানাবেন তার ঢাকায় চাকরি হয়েছে।গ্রাম্য অঞ্চলে শহরে চাকরি বিশাল ব্যাপার।শিক্ষিতদের সংখ্যা কম।এর মধ্যে মাহরুরের নামটা বেশ জমকালো সবার কাছে।

“তোর নাকি জ্বর হয়েছিলো চন্দ্র?”

“হ্যা।তুমি কি করে জানলে?”

“একটু আগে চাচা বললো।কেনো পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে শুনিসনি বুঝি?”

কাচুমাচু হয়ে গেলো লজ্জায়।সে জানে?মল্লিকা এতক্ষন পর্দার আড়ালে লুকিয়ে ছিল?উত্তর আসলো না আর মুখ ফুটে।চোখ নামিয়ে অপরাধীর মতন বসে আছে।

মাহরুর হেসে বললো, “কখনো বড়দের মতন আচরণ করে আমাকে ভাবাস।আবার কখন নির্বোধের মতন করিস!অনেক বোকা তুই চন্দ্র।”

বিপরীত প্রসঙ্গ তোলে মল্লিকা।জিজ্ঞেস করে, “তুমি একবারের জন্য ঢাকা চলে যাচ্ছো মাহরুর ভাই?”

“উমমম। হ্যা বলতে পারিস।কিন্তু ছুটিতে আসবো।”

“আমাদের দেখা হবে না মাহরুর ভাই?বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনতো প্রতি বৃহস্পতিবার আসতে।এখন কি সেটাও হবে না?”

“ঢাকা অনেক দুর।আমার বিশ্ববিদ্যালয় কাছাকাছি ছিলো।প্রতি সপ্তাহে আসা হচ্ছে না আর।”

শীতকালে বারবার কালবৈশাখীর কালো মেঘের দেখা দেয়।আকাশে নয় রমণীর মুখে। চন্দ্রের উজ্জ্বল মুখকে ঢেকে দেয় বারবার।এই মেয়েটি দাবি করে ভালোবাসার।অল্প বয়সের আবেগ বলে বারবার বাদ দিতে চাইলেও তার আচরণ?সেটা মাহরুরকে দোটানায় ফেলে।কষ্ট দিতে চায় না মেয়েটিকে।সে যা চাইছে তা কি আদৌ সম্ভব?মুখ ফুটে সবটা বলেও না।আবার তার চোখ বিশাল এক উপন্যাস আওড়ায়।

“চল মেলায় যাবো। শশীকেও ডাক।”

“আমি যাবো না”

কপাল কুঁচকায় মাহরুর।সরাসরি প্রত্যাখ্যান? সেতো মাহরুরের সাথে থাকার জন্য বাহানা খুঁজতো।আজ এমন রূপ? অদ্ভুত!চোখে মুখে অভিমান। মাহরুর তোয়াক্কা না করেই বললো,

“আমি তোর মতামত জানতে চাইনি।দৌড়ে গিয়ে শশীকে ডাক”

লম্বা চওড়া এক যুবকের দুইপাশে হাঁটছে দুজনে।মল্লিকা আর শশী। শশী ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মল্লিকার দিকে চাইছে বারবার।অন্যদিকে মুখটা ভার চন্দ্রমল্লিকার।তাদের দুজনকে দুপাশে রাখার মূল উদ্দেশ্য হলো তাদের বাচাল মুখ।একসাথে থেকে বকবক করে কান পাকিয়েছে মাহরুরের।মাথা ব্যাথা উঠার আগেই বিভক্ত হয় তারা। শশীর চিন্তা মল্লিকাকে নিয়ে। মাহরুর ভাই মেলায় নিয়ে যাচ্ছে।ঘোরাতে। এতে তার খুশি সাত সমুদ্র তের নদীর পারে হওয়ার কথা।সে কেনো মনমরা?

মুখের ভঙ্গি চুপসান রেখেই সারাটা বিকেল পাড় করে চন্দ্রমল্লিকা।তাকে দেখে শশীও উপভোগ কার্য থেকে বিরত।আজ মল্লিকার মাহরুর ভাই তাকে ফুচকা খাইয়েও খুশি করতে পারেনি?দুজনকে দুই জোড়া কানের দুলও কিনে দিলো।তাতেও লাভ হলো না?মল্লিকার মন বোঝা বেশ কঠিন হয়ে উঠছে বাল্যকালের সখীর কাছেও।

আকস্মিক উঠে দাঁড়ালো মল্লিকা। অনুমতি চেয়ে বললো, “মাহরুর ভাই সামনের দোকানটায় যাবো।”

“কিছু নিবি?”

“হ্যাঁ”

“আচ্ছা চল”

“না তুমি আর শশী এখানে দাড়াও।আমি একা যাবো”

যেতে চাইছে মাহরুর সাথে।তবে বিনয়ের সুরে মল্লিকা বারণ করে।বেশি দূরে যাচ্ছে না সে।চোখের সামনেই আছে। মাহরুর সামান্য এগিয়ে দাড়ায়।গোলগোল চোখে দেখছে বই খাতার দোকানে দাড়ানো চন্দ্রকে।ফিরে এসেছে গাঢ় খয়েরী রঙে মোড়ানো ডায়রি হাতে নিয়ে সাথে একটি বলেন।

খানিকটা সময় নিয়ে বললো, “তুমিতো চলে যাবে মাহরুর ভাই।এটা তোমার জন্য”

বিস্ময়বোধ ঘিরে ফেলে মাহরুরকে।এতটুক মাথায় এমন চিন্তা এলো কি করে?নাকি সেই ভুল ভাবছে।ছোটোবেলা থেকে ছোটো চন্দ্র ছোট চন্দ্র বলতে বলতে তার মস্তিষ্কে এটাই গেথেছে।তার চিন্তার আড়ালে বড় হয়ে যাওয়া চন্দ্রের দিকে খেয়াল রাখতে পারেনি।

“এগুলো কেনো এনেছিস চন্দ্র?”

“তোমার জন্য। আমাকেওতো তুমি উপহার দিয়েছো।”

“আমি চেয়েছি তোর কাছে?পাকামো করিস কেনো?আর টাকা পেলি কোথায়?”

শশীর বড় ভাইয়ের আগমনে তার কথার মাঝে বাঁধা আসে। শশীকে নিয়ে এসেছে শওকত।বাড়িতে মেহমান এসেছে। মাহরুরের সাথে কুশল বিনিময় করে তাদের বিদায় দেয়। পূনরায় চন্দ্রের দিকে চাইলে শশী ফিরে এসে বলে,

“এক বছর ব্যাংকে টাকা জমিয়েছিল।সেটা কাল রাতে ভেঙেছে আপনাকে উপহার দিবে বলে” বলেই ভাইয়ের পেছনে ভো দৌড় লাগায় শশী।

রাগের আভাস দেখতে পেলো মাহরুরের মুখে।এই রাগ যে তারই বোকামির ফল?সেটা বোধগম্যতার বাহিরে নয় মল্লিকার।ভয় হলো সামান্য।চোখের ইশারায় পিছু হাঁটতে বলে হাটতে থাকে মাহরুর।কিছু পথ হেঁটে থেমে যায় মাহরুর।সাথে মল্লিকাও।তার দিকে ঘুরে বুকে হাত বাঁধলো।

বিরক্তির সাথে বললো, “এমন কেন করিস?কি সমস্যা তোর?”

“তুমি জানো মাহরুর ভাই।”

“না আমি জানি না।তুই বল।আমার মধ্যে কি পেয়েছিস?”

“তুমি ভালো মানুষ মাহরুর ভাই।তাই ভালো লাগে তোমাকে।”

চন্দ্রের ঝটপট উত্তরে চোখ বুজে কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাহরুর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পরক্ষনেই বললো,

“ভালো লাগা সময়ের সাথে কমে যাবে।এই বয়সটা এমনি।তুই দেখে নিস আজ থেকে আরো দুই তিন বছর পর আর আমাকে ভালো লাগবে না।”

“তুমি নাহয় দুই তিন বছর অপেক্ষা করে দেখো মাহরুর ভাই।যদি তোমার কথা ঠিক হয় আমাকে শাস্তি দিও।আমাকে তুমি কেনো ছোট ভাবো। ভালো লাগা অনুভব করার জন্যেওতো মনকে স্বাবলম্বী হতে হয়।ছোটোবেলা থেকে তোমাকে ভাই হিসেবে দেখেছি মাহরুর ভাই। হটাৎ এই পরিবর্তন এলো কি করে?”

চন্দ্রের মুখে বড়বড় কথা শুনে ভ্রূ উচুতে উঠেছে।নাহ সেই ভুল ছিল।এটা ছোট চন্দ্র না।উত্তরে বলে,

“আমি বলিনি এই পরিবর্তন আনতে।”

“আমি এনেছি।এখানে তোমার কোনো দোষ নেই।আমি মায়ের কাছে শুনেছি মেয়েদের নাকি অল্প বয়সে প্রখর বুঝ শক্তি চলে আসে।আমাকে অবুঝ ভাববে না।”

শক্ত মুখে মাহরুর প্রশ্ন করলো, “তো এখন কি চাস তুই?”

“আমি কিছুই চাইনা মাহরুর ভাই।তুমি মাঝেমধ্যে আমার সাথে কথা বলো।দেখা করো।শুধু অন্য কাউকে বিয়ে করো না।আমি জানি তোমার বিয়ের বয়স হচ্ছে।”

“বিয়ে করবো না?সারাজীবন চিরকুমার থাকবো তোর জন্য?”

ঠোঁট কামড়ে নেয় মল্লিকা। পূর্বপ্রস্তুতি নিতে লাগলো। নড়েচড়ে তত্পর করলো নিজেকে।অধিক ধীমা আওয়াজে বললো,

“আমাকে বিয়ে করবে?”

কতকালীয়ভাবে মিলে গেলো মাহরুরের চিন্তার সাথে।মনে মনে একবার ভেবেছিল হয়তো এমন কোনো প্রশ্ন আসবে।যে মেয়ে সাহস করে ভালোবাসা ভালো লাগার প্রকাশ করতে পারে?সে বিয়ের কথাও বলতে পারে।

“এক না একদিন বিয়ে করতেই হবে আমাকে।সেটা কাকে করবো সময় বলে দেবে।কিন্তু! তুই বললি না আমাকে দুই তিন বছর অপেক্ষা করতে?যা করলাম অপেক্ষা।ঢাকা যাবো কিছুদিন পর।কবে ফিরবো জানা নেই।হয়তো বছরে ঈদের ছুটিতে আসবো।এসে যদি দেখেছি তুই বদলে গেছিস।নিজের কথা রাখতে পারিস নি।শাস্তি ভয়াবহ হবে।”

চলবে…