Monday, August 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 251



চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৩৭+৩৮

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৩৭
লেখা : Azyah_সূচনা

“চন্দ্র সোজা হয়ে ঘুমো।এটা কেমন ভঙ্গি ঘুমানোর? পেটে চাপ পড়ছে”

বিছানায় উল্টো হয়ে শুয়ে মাত্রই চোখটা লেগে এসেছিল। মাহরুরের বাজখাই গলায় সেটা সম্ভব হলো না। একঘেঁয়েমি লাগছে। অবসন্নতায় ঘেরাও।চোখ টানছে ঘুমে।সাথে মাহরুর বাহু টানছে।উঠতে হবে।সোজা হয়ে শুতে হবে।

মল্লিকা নাকোচ করলো।বললো, “আমি এভাবেই থাকবো।”

“চন্দ্র!সোজা হ বলছি”

“ভালো লাগছে না মাহরুর ভাই।সরুন”

ধমকের সুর মিয়ে এসে অস্থির হলো। বিচলন চললো হৃদয়ে।ভালো লাগছে না?দ্রুত মল্লিকার টেনে জানতে চাইলো,

“কি হয়েছে?কেনো ভালো লাগছে না?সমস্যা হচ্ছে কোনো?ডাক্তারে যাবি চন্দ্র? ওষুধ খেয়েছিলি?..”

“না…”

“দোষ আমারই।তোর ওষুধের ব্যাপারটা আমার খেয়াল রাখা উচিত। ধুর!”

মাহরুর মাথা ঝাঁকাচ্ছে।মল্লিকা হাত এগিয়ে মাহরুরের মুখ চেপে স্থির করলো তাকে।বললো,

“থামেন!কিছু হয়নি।ঘুম পাচ্ছে।আর সোজা হয়ে শুয়ে শান্তি পাচ্ছিলাম না তাই উপুড় হয়েছি।”

“না চন্দ্র এভাবেতো চলবে না। পেটে চাপ পড়ছিলো। তোরতো বোঝা উচিত।”

পল্লবিত মুখে মল্লিকা বলে উঠে, “মাত্র আড়াই সপ্তাহ বয়স ওর।এখন আমি যেভাবে ইচ্ছে শুতে পারবো।তিনমাস পর পেটে চাপ দেওয়া যাবে না আর।জানি বলেই করেছি এই কাজ।”

মানলো না মাহরুর।নিজের মতই প্রশ্ন করে গেলো, “ডাক্তার যে বললো প্রথম তিনমাস সাবধানে চলতে হবে?”

“হ্যাঁ তাতো অবশ্যই।”

কিছু একটা ভাবতে বসলো মাহরুর। বোধগম্য হয় মল্লিকার।এখনই আবার কিছু আদেশ ছুঁড়ে বসবে।এটা করিস না,ওটা করিস না।ঘুমে ভেঙে পড়া চোখগুলো সজাগ রেখে বসে রইলো মাহরুরের অপেক্ষায়।
ভাবনা চেতনার অবসান ঘটিয়ে মাহরুর বলে,

“এই শোন।সন্ধ্যার দিকে ছাদে যাবি না।চুল খোলা রাখবি না।তোর পছন্দের ফল কি?আর খাবার?একটা লিস্ট দিস।আমি সব নিয়ে আসবো।আর কিছু খেতে ইচ্ছে করে?”

মল্লিকা ঠোঁট প্রসারিত করছিলো তার আগে মাহরুর ফোন হাতে নেয়। বৃদ্ধাঙ্গুল চালিয়ে দ্রুত গতিতে রমজান চাচার নাম্বার বের করলো।বললো,

“আমি চাচা চাচীকে ঢাকায় আনছি।এখন চাচীর অনেক প্রয়োজন।আমি অফিসে থাকি।মিষ্টিকে দেখতে হয়।তুই আর যাবি না মিষ্টিকে আনতে স্কুল থেকে ভর দুপুরে।আমি দিয়ে আসবো আর দুলাল গিয়ে আনবে।”

“এসবের কোনো দরকার নেই তো!”

“চুপ থাক!”

মাহরুরের কর্মকাণ্ড বীমূঢ় করে তুলছে।লোকটা মল্লিকার চেয়ে বেশি ছটফট করছে।কি রেখে কি করবে দিশা খুঁজে পেলো না। হেঁটে চলে আবার ভাবনায় মশগুল হয়ে উঠে।মোবাইলে খুঁটে খুঁটে দেখছে প্রথম তিনমাস একটা হবু মায়ের জন্য কি কি প্রয়োজন।লিস্ট করে ফেলে কাগজে কলমে।আবার কাছে বসে কপালে হাত রেখে দেখে। পেটে হাত রাখে।কোনো সমস্যা আছে নাকি যাচাই করতে।ডাক্তার সাজার উপক্রম।ইতিমধ্যে ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে মল্লিকাকে চুপ থাকতে বলে রমজান সাহেব আর ফরিদা বেগমের মাথায়ও প্রেশার তুলে ফেললো। কাল পরশুর মধ্যেই হাজির হবে তারাও।

কপালে হাত চেপে বসলো মল্লিকা।গতকাল বললো না?তাকে অনেক জ্বালাবে।ঠিক!এই জ্বালাতন চলবে দীর্ঘ নয়মাস। রক্তক্ষয়ী নয় মস্তিষ্কক্ষয়ী যুদ্ধ চলবে।

একহাত কোমরে আর অন্যহাতে মাথা চুলকে মাহরুর বলে,

“মাতৃকালীন ছুটি আছে। পিতৃকালীন ছুটি নেই কেনো?থাকলে ভালো হতো না?আমি তোর সাথে থাকতে পারতাম।”

“আপনি অফিসেই থাকেন ভাই।”

“কি বললি!”

“কিছুনা ঘুমাবো।শুভ রাত্রি”

__

“এখনতো সবকিছু ঠিকই গুছিয়েছেন।নিত্য নতুন আইডিয়া আসছে আপনার মাথায়।শুনলাম বিয়ে করে ফেলেছেন?আমার বেলায় সেগুলো কোথায় ছিল?আমি থাকতেতো নতুন চাকরি খোঁজার ইচ্ছেটাও জাগেনি আপনার মাথায়।নাকি আমাকে সাইড করে ওই মল্লিকার জন্য জায়গা বানাচ্ছিলেন?”

দামী পোশাক আর অলংকারে আবৃত হীরা।পরনের কাপড়ের ধরন বিলেতি। চুলগুলো অন্য রঙে রাঙিয়েছে।কেমন যেনো লাগছে দেখতে।তবে মাহরুরের মনে একবিন্দু তার প্রতি আগ্রহ জাগলো না।উল্টো তার তাচ্ছিল্যে আমর্ষ।মল্লিকাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছ থেকেই ফিরছিলো।ডাবের পানি খাওয়ানোর জন্য দোকানে বসিয়ে রেখে যে এতদিন বাদে হীরার মুখ দেখতে পাবে সেটা ভাবেনি।

হীরা আবার বললো, “এই হলো মল্লিকা? তাইতো?চিনি একে আমি।আমাদের বিয়েতে শোকাহত মুখটা দেখেছিলাম।”

মাহরুর বাকা হেসে হীরাকে প্রশ্ন করলো, “ফিরলে কবে বিলেত থেকে?”

“সেটা জেনে আপনার কি লাভ?আপনাকে মাত্র যা বললাম?মনে হচ্ছে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছেন।”

“মোটেও না।আসলে এসব ব্যাপারে কথা বলার ইচ্ছে,সময় দুটোরই বড্ড অভাব।বাবা হতে যাচ্ছি।দুআ করো”

“বাব্বাহ! খুব বদলেছেন আপনি”

“ঠিক তোমার মতন হীরা।”

কটাক্ষ করছে মাহরুর।রাগে ফুঁসতে থাকা মল্লিকার মুখটাও দেখা গেলো। লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে। মাহরুরের হৃদয় প্রসন্ন হয় এই হিংসুটে স্বভাব দেখে।

মল্লিকার হাত ধরে তাকে উঠিয়ে দাড় করালো। বিদায় নেওয়ার আগে বললো,

“তোমার জন্যও এসবই করতাম হীরা।যদি তুমি মানুষটা আমার হতে।চেয়েছিলাম তোমাকে নিয়ে সংসার সাজাতে।এটা সত্য মন থেকে ভালোবাসতাম না তোমাকে।তবে ভালোবাসতে কত সময় লাগে? একটু যত্ন? একটু আদর?একটু সমঝোতা? সব মিলিয়ে প্রেম হতো।কিন্তু হয়নি।তুমি ভালোবাসতে টাকাকে।আর যে জীবন্ত জিনিসকে ভালো না বেসে কোনো জড়বস্তুকে ভালোবাসে সেতো মানুষই না।সেও জড়বস্তু।ভালোবাসলে ভালোবাসা পেতে।ভালোবাসলে আমি তোমার সব আবদার পূর্ণ করার চেষ্টা করতাম।তুমি মজেছিলে অন্য পুরুষে।তাহলে তোমার উপর আমার কষ্টের কামাই কেনো উড়াবো?কথাগুলো বলতে চাইনি।তবে আজ বলছি।আরেকটা পরামর্শ দিচ্ছি।তোমার লোভ এখন অহংকারে পরিণত হয়েছে।সামলাও।ডুবে যাবে।দুআ করি যেনো এমন না হয়।”

হীরা রাগে ডগমগ করে বললো, “আমি আমার স্বামীর সাথে খুব ভালোই আছি মাহি।আমাকে ভালোবাসে আমার সব শখ পূরণ করে।আপনার জ্ঞান না ঝারলেও চলবে।”

কথার উত্তর দিলো মল্লিকা, “গলা নামিয়ে কথা বলুন।এত তেজ দেখানোর কোনো কারণ নেই।এত টাকা?এত ভালোবাসা?তাহলে এখানে এসেছেন কেনো?এসব আমাদের দেখাতে?…ভালোই করেছেন দেখিয়ে।আপনাকে দেখে আমাদের খুব ভালো লাগলো।নিজেদের অবস্থান আরো ভালোভাবে বুঝলাম।আমরা আপনার চেয়ে লাখগুন ভালো আছি।”

“এই মেয়ে!এই!” চেচিয়ে উঠলো হীরা।

“আসতে পারেন আপনি।আমার স্বামীর দোকানের সীমানায় পা দিয়ে রেখেছেন।বের করে দেওয়ার অধিকার আছে।দিলে আপনারই সম্মানহানি হবে।যান এখান থেকে।আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না”

অতিরিক্ত রাগ মল্লিকার জন্য ঠিক নয়। হীরা তরতর করে বিলাসবহুল গাড়ীর দরজা লাগিয়েছে।সাইসাই করে ছুটলো কোথাও। মাহরুর দেরি করলো না। মল্লিকাকে নিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরেছে।মিষ্টিকে নিয়ে রাতের খাবারটাও খেয়ে উঠলো।মল্লিকার মাথা গরম।রেগে আছে মুখে স্পষ্ট।মিষ্টিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।সকালে স্কুলে যেতে হবে।অথচ নিজে ঘুমালো না।সাথে মল্লিকাকে টেনে নিলো নিজের কাছে।আজকাল মল্লিকা পূর্বের তুলনায় বেশি আকর্ষণবোধ করে মাহরুরের প্রতি।বুকের উষ্ণতায় জড়িয়ে থাকতে চায় প্রায় সময়।পিঠ ঠেকায় মাহরুরের বুকে।চাদরে আবৃত করে নেয়।তবে কথা বললো না। রাগটা ধরে রাখলো নিজের মধ্যেই।

মাহরুরের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আটে।কানের কাছে ফিসফিস করে মল্লিকাকে তারই বলা কথা ভেঙিয়ে বললো,

“আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। হুহ”

মল্লিকা ঘাড় ঘোরায়।বলে, “মজা করছেন?”

“উহু!আমার এই দুঃসাহস?”

“অভদ্র মহিলা সে একজন।”

“জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিস মনে হচ্ছে।”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে বসলো মল্লিকা।বললো,

“আপনিও কম যান না।কি বলছিলেন?তুমি ভালোবাসলে আমিও ভালোবাসতাম।আদরে,যত্নে আরো কত কি?এখন এইসব বলার মানে কি?”

“আরেহ বাবাহ আমিতো উদাহরণ দিচ্ছিলাম।”

“এরকম উদাহরণ কেনো দিবেন?এখন আমি আছিনা?”

“আছিসতো চন্দ্রমল্লিকা।”

ঠোঁট কামড়ে ধরলো মল্লিকা।মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো।তার অভিমান কমছে না।ভালো লাগছে না। বাচ্চামোতে নেমে এসেছে।নিজেকে অনুধাবন করলো মিষ্টি রূপে।

মাহরুর বলে উঠে, “আপনার অধরজোড়া মুক্ত করবেন?”

“কেনো?”

“হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটাতাম ছুঁয়ে দিয়ে।”

“উহু!দিবো না।আপনি তৃষ্ণার্তই থাকেন।”

ক্ষুদ্র আকৃতির চক্ষু যুগল আশাহত।আধাঁরে আবছা চন্দ্রের মুখ পানে চেয়ে আছে।হাসি তার ঠোঁটে স্পষ্ট। অদ্ভুত এক পুরুষালি ঘ্রাণ ঘ্রানেন্দ্রিয়তে এসে ধাক্কা খাচ্ছে বারেবারে।মা হবে?জননী হবে আরো এক সন্তানের।তাই বুঝি আরো রূপবতী মনে হচ্ছে চন্দ্রকে?
মাহরুর সময় নিলো।চোখের তৃষ্ণা আছে নিবারণ করলো। খানিক বাদেই বললো,

“আজ যেমন আমার হয়ে দাঁড়িয়েছিস এভাবে সারাজীবন দাড়াবি?”

“যে মানুষটা পুরো একটা সংসারের হাল কাঁধে নিয়ে চলছে?কোনো অভিযোগ ছাড়া।তার জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়াবো না?সমাজের চোখে নারী দুর্বল।সৃষ্টিকর্তা আমাদের কোমল বানিয়েছেন ইচ্ছেকৃত।এই জগৎ সংসারে স্নেহ, মমতার দরকার আছে বলেই।তবে সেই কোমল নারীজাতির পাশে যখন একজন শক্ত পুরুষ এসে দাঁড়ায়?দুজনার সমন্বয়ে তৈরি হয় একটা স্তম্ভ। আপনাআপনি ওই নারী নিজের মধ্যে শক্তি অনুভব করে।আপনি আছেন বলেই আমি আছি।”

মল্লিকার এলোমেলো চুলের গভীরে হাত রেখে মাহরুর মুগ্ধ হয়ে উত্তর দেয়, “তুই আছিস বলে আমিও আছি।নাহয় ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতাম।ধুলোয় উড়ে বেড়াতো আমার অস্তিত্ব।”

“এই সুখে আমি কাউকে বাধা হতে দিবো না।আপনাকে আমার জন্যই বানানো হয়েছিলো মাহরুর ভাই। অনন্তকাল আমার হয়েই থাকবেন।”

“সত্যি বলেছিস।নাহয় এত শক্ত বাঁধ থাকার পরও দ্বিমুখী দুই নদী একত্রে এসে মিললো কেনো?”

ঠোঁট চেপে হাসি উপহার দেয় মল্লিকা।তাদের অল্পস্বল্প কথা অনেকটা প্রশান্তির।নিজেদের মধ্যে রুটিন তৈরি করেছে।অন্তত দশ মিনিট হলেও একে অপরের জন্য বরাদ্দ।রাতের আধারে আচ্ছন্ন শহরে আড়াল করে নিজেদের।ঝুড়ি খুলে বসে অতীত,বর্তমান, ভবিষ্যতের।

নিজস্ব ব্যক্তিত্বের বাহু বন্ধনে নিবদ্ধিত হয়ে যাওয়া মল্লিকা কোনো নড়চড় করলো না।নাই কোনো অনিচ্ছা প্রকাশ করলো তার পানে।ডুবিয়ে নিতে চাইলে নেক।মল্লিকা বারেবারে ডুব দিতে চায় প্রেম সাগরে।অতলে ডুবে মাহরুরের ওই হৃদয়টাকে ছুঁয়ে দেবার বড্ড ইচ্ছে।কতই পরিষ্কার আর পবিত্র হবে ওই হৃদপিণ্ডটা?কতকত স্নেহ সেখানে সঞ্চিত করা।প্রতিদিন, প্রতিরাত যে আলোময় ভালোবাসার প্রতিফলন ঘটায়?সেই হৃদয়টাকে দেখতে চায় চন্দ্রমল্লিকা।এক কোণে জমে থাকা দুঃখ নিজের সাথে নিয়ে ফিরতে চায়।

মনের এই আকুতি মুখ ফুটে বেড়িয়ে এলো। ধীমা গলায় বললো,

“কষ্ট তোমার অযোগ্য মাহরুর।কত সুখ চাই বলো?আমার জন্য বরাদ্দ সুখটুকুও তোমার জন্য চেয়ে নেবো”

বক্ষ পিঞ্জিরায় আবদ্ধ থাকা হৃদয়টা ঢিপঢিপ আওয়াজ করে যাচ্ছে।মল্লিকার কথায় যেনো স্পন্দনের গতিবেগ বাড়ালো।কথা কারো হৃদয়কে এভাবে প্রভাবিত করতে পারে?বড্ড বোকা এই হৃদয়।কখনো কথার জালে ফেঁসে কাঁদে আবার কখনো হাসে।হাত রেখে অনুভব করলো মল্লিকা সেখানটায়।

“জানো কি প্রিয়?এই দেহের সবচেয়ে অবুঝ অঙ্গ হচ্ছে হৃদয়”

ঘোর লেগে যাচ্ছে মল্লিকার বাচন ভঙ্গিতে।মাহরুর নীরবতা ভাঙ্গতে প্রস্তুত ছিল না।শুনতে চাইছিল কোকিল কণ্ঠে ওই সুমধুর বাক্যগুলো।তবে মস্তিষ্ক?সেকি অবুঝ?অহেতুক চিন্তা নিয়েই আসে। অপ্রয়োজনীয়ভাবে ভাবায়।

“আবার প্রশ্ন করছি?… দ্বিতীয়বারের মতন ভালো বাবা হতে পারবোতো?”

“কেনো পারবে না?”

“স্বল্প অভাবী মানুষ আমি”

“যত্নে অভাব আছে?”

“সেটা তুই বল”

“নেই।এতেই চলবে”

ব্যাকুলতা এসে ঘিরে ধরলো মাহরুরকে। তৃষ্ণার্ত সে।রূপবানের স্পর্শে থাকবে বলে জানান দিয়েছে।কাছে টেনে শীতল স্পর্শে উন্মত্ত করে নেয়।মধুসুধা পান করেই রেহাই দিলো তার আসমানের চাঁদকে। শুভ্র আলোর সম্মুখে লাজের মেঘ এসে হাজির। তবে বাঁধা প্রদান করেনি মাহরুরকে। তারও আবডালে প্রয়োজন এই পুরুষের সান্নিধ্য।

___

“জীবনে তোমার মাইয়া মানুষের কমতি নাই। পুরান নায়িকা,নতুন নায়িকা,আবার সাইড নায়িকা।আমার শা*লার কপাল খারাপ। বউও ঠিকমতো তাকায় না।”

দোকানের চেয়ারে পা তুলে বসে হিসেব কষছে মাহরুর। শাটার অর্ধ নামানো।রেদোয়ান এর সাথে আলোচনা করছিল বিগত দিনের কথাগুলো।বলা হয়নি তাকে।তানিয়া থেকে শুরু করে হীরা অব্দি সকল ঘটনাই খুলে বললো।তার প্রতিক্রিয়াতেই এরূপ বাক্য ছুঁড়ে রেদোয়ান।

কথার ভঙ্গিতে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো মাহরুর।চক্ষু তার কাগজে,কলমে।উত্তর দিলো,

“আমার জীবনের নায়িকা একটাই।বাকিগুলো খলনায়িকা।”

“তাতো বটেই।বাকিরা মাঝেমধ্যে আসে হাওয়া বাতাস খেতে।”

“সময়-রুচি কোনোটাই নেই তাদের দিকে তাকানোর।”

“আমার দিকে আজ অব্দি কেউ চাইলো না।যারা চেয়েছে পুলিশের কাপড়ে দেখে কপাল কুচকে নিয়েছে।”

“আমার বোন থাকতে তুমি অন্য কারো দৃষ্টি আশা করছো কি করে?”

“না! মানে এমনেই।তোমার বোন থাকতে আমার সাধ্য নেই অন্য কারো দিকে তাকানোর।কিন্তু অন্যের দৃষ্টিতেতো কোনো বাধা নেই।তাকাবে।আমাকে অনুভব করাবে আমিও সুদর্শন ”

অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মাহরুর।রেদোয়ান মজার মানুষ। বোনজামাইর চেয়ে উর্ধ্বে তাদের সম্পর্ক।এইতো কতবার আপন ভাইয়ের মতন সাহায্য করেছে।এগিয়ে এসেছে সকল বিপদে।ভাবতেই শান্তি লাগে।দুজনের মধ্যে যোগ হলো আরো একজন।রহিম মিয়া এসে উকি দিলেন।দোকানে কেউ আছে কিনা দেখতে চাইলেন। মাহরুর আর রেদোয়ানকে দেখে ভেতরে এসে বসেন হাসি মুখে।

মাহরুর বললো, “আসসালামু আলাইকুম চাচা।কি খবর?”

“আল্লাহ রাখছে।তোমারে যে পাই না এক সপ্তাহ যাবৎ?কই থাকো?”
জানতে চাইলেন রহিম চাচা।

“এইতো চাচা অফিস থেকে বাড়ি,বাড়ি থেকে দোকান।মিষ্টির আবার পরীক্ষা চলে।ওকেও সময় দিতে হয়।”

“আইচ্ছা আইচ্ছা।তয় বউ ভালো আছেনি? খাওয়ন দাওয়ন ঠিকমতো করে?”

হতাশ গলায় মাহরুর জবাবে বললো, “আর খাওয়া দাওয়া!বলে বলে খাওয়াতে হয়।”

ভাবুক ভঙ্গিতে মাথা দোলান রহিম মিয়া।বলেন,

“পরশুদিন গ্রামে যাইতাছি বুঝছো।ক্ষেত খামারি করে আমার ছোট ভাই।পুকুরে মাছও আছে। ওহান থেকা টাটকা সবজি আর মাছ আইনা দিমু।বউরে দিও। নাতিনরেও দিও,তুমিও খাইও।”

সৌজন্যমূলক হেসে মাহরুর বলে, “অবশ্যই চাচা।ভালো হবে।আজকাল ঢাকার বাজারে ফরমালিন ছাড়া কিছু পাওয়া দুষ্কর।”

“তয় তোমার ব্যবসা কেমন চলে?”

“আলহাদুলিল্লাহ চলে চাচা আপনাদের দোয়ায়”

আকস্মিক রহিম মিয়া নিরব হলেন।সাদা দাঁড়িতে আবৃত মুখটা নুয়ে ফেলেন।হয়তো কিছু ভাবছেন।মুখে সেই ভাবটা স্পষ্ট দেখা গেলো।খানিক সময় বাদে মলিন গলায় বললেন,

“তোমার চাকরিও চলে।লগে ব্যবসাও।আমার এই চিলেকোঠার ঘরটা ছাইড়া যাইবা গা তাই না?”

মন খারাপের আভাস পাওয়া গেলো রহিম মিয়ার কণ্ঠে। মায়াভরা বৃদ্ধ মুখ তার। মাহরুরের হৃদয়টাও শিরশির করে উঠলো।খারাপ লাগায় ভরে গেলো।আসলেই এক না একদিন ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে।

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মাহরুর বললো, “আপনাদের ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমারও নেই চাচা।আমাকে আমার কঠিন সময়ে মাথার ছাদের ব্যবস্থা করেছেন। ঋণী আমি আপনার কাছে।তবে মেয়েকে যে কথা দিয়েছি।ওকে একটা ঘর দিবো।বাড়ি দিবো নিজস্ব।”

“যাইও না। আমার পোলাটা বিদেশ থাকে।দেশে ফিরতে চায় না। মাইয়া বিয়া দিছি বছরে একবার আসে।আমার বুড়ি বউটা তোমার মাইয়ার লেইগা পাগল। মিষ্টিরে না দেখলে নাকি বুড়ির পেটের ভাত হজম হয়না।লাগলে ওই ছাদে তোমারে একটা সুন্দর ঘর বানায় দিমু খালি জায়গাগুলাতে।তাও এদিকেই থাকো। তমগো দেখলে শান্তি লাগে।”

চলবে….

চন্দ্র’মল্লিকা ৩৮
লেখা : Azyah_সূচনা

গতকাল রহিম চাচার কথাগুলো বেশ ভাবিয়েছে মাহরুরকে।নিজেই নিজে অপরাধবোধ ভুগেছে।এরূপ অনুভব হওয়ার কথা ছিল না।মনে হচ্ছে এক বিপদের সময় যে তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল মাহরুর তাকেই ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলো?আবার পরিবারের শখ পূরণের দায়িত্বও আছে।রহিম চাচা চাপা মানুষ। মাঝেমধ্যে দেখা হলে আবেগে দু চারটে লাইন বলেন।ওই দুই চারটে লাইনে অনেক লোকানো গল্প থাকে। আস্ত পাঁচ তলা বাড়িটা নিজ হাতে বানিয়েছেন। এখন এই বাড়িটার উপর তার কোনো অধিকার চলে না।বিদেশের মাটিতে ছেলের নিজস্ব বাড়ি আছে,গাড়ি আছে বিরাট ব্যবসা আছে।মেয়ের বিয়ে হয়েছে বিরাট পরিবারে।কমতি নেই।তারপরও বাবার ভিটা থেকে কোনো অংশ কেউই ছাড়তে রাজি না।দুই ভাই বোনের মধ্যে বিবাদ চলছে অনেকদিন।দোষী করে নিজের বাবা মাকে।তাদের যথা সময়ে চাহিদা পূরণ করলেও একটা বার এসে মুখ দেখানোর সময় নেই।গতরাতে কথাগুলো বলে কেমন যেনো কাঁদোকাঁদো মুখ হয়ে উঠেছিল তার।আভাস পেয়েছেন হয়তো। মাহরুরও একদিন পাড়ি জমাবে অন্যত্র।হয়তো তার মুখ দর্শনটাও হবে না আর।

“আমারও মায়া জন্মেছে এই চিলেকোঠায়।”

মল্লিকার কথায় মাহরুর মুখ ফিরে তাকায়।মায়া জন্মানোটাই কি স্বাভাবিক না?এখানেই তাদের নতুন জীবন এর সূচনা।এখানেই প্রণয়, পরিণয়।অল্প সময়ে বিশাল স্মৃতি ভান্ডার নিয়ে দাড়িয়ে আছে ঘরটা।

মাহরুর বললো, “এখনও বিদায়ের অনেক দেরি চন্দ্র।এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।”

মিষ্টিকে পড়তে বসিয়েছে মাহরুর।এই পরীক্ষা শেষে আরেক ক্লাস উপরে উঠবে।শিক্ষিকা নিজে কল করে বলেছেন বিশেষ দেখভাল করতে মিষ্টিকে।মল্লিকা পাশে এসে বসলো।এক গ্লাস দুধ মিষ্টির সামনে দিয়ে কঠোর গলায় বলেছে খেয়ে নিতে।

মাহরুর উঠে দাড়ালো।আরো এক গ্লাস দুধ এনে মল্লিকাকে দিয়ে বললো,

“আমার দুটো বাচ্চারই পুষ্টি দরকার।”

“দুধ পছন্দ না আমার।”

“তোর মধ্যে যার অস্তিত্ব তার পছন্দ। নাক চেপে খেয়ে নে।”

“উম!”

“চন্দ্র!”

মাহরুরের ঠান্ডা ধমকে একহাতে নাক চাপলো মল্লিকা। অন্যহাতে দুধের গ্লাস নিয়ে গটগট করে গিলে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে।

বলে, “আপনিও খান।দুইটা বাচ্চা আর বাচ্চার মাকে দেখাশোনা করার জন্যও শক্তি দরকার।”

“আমি রাতের খাবারের পর খাবো চন্দ্রমল্লিকা।আয় চুলে তেল দিয়ে দেই।”

গ্রামীণ আভায় জড়ানো তিনজনার টোনাটুনির সংসার পরিবেশ মনোরম।তাদের বিনোদনের সঙ্গী তারা একে অপরে। প্রয়োজন নেই কোনো বিলাসিতার।যত্ন করে কেশমালায় তেল দিয়ে দেওয়াটাও একটা সুখময় সময় পাড় করাচ্ছে।বাবার দেখাদেখি মিষ্টিও কোকড়া চুল এর বেনী খুলে মায়ের কোলে এসে বসলো।আবদার করেছে।আজ নিজ থেকেই চুলে তেল দিবে।চুলের গভীরে বলিষ্ঠ আঙ্গুলের স্পর্শে মস্তিষ্কে ঝিম ধরে যাচ্ছিলো।ঘুমঘুম ভাবটা এসেই পড়েছিল প্রায়।মেয়ের মর্জিতে বিতাড়িত করলো তন্দ্রাকে।চাঙ্গা করে তুললো শরীর।আজ মেয়ের চুলগুলোতে যত্ন করে তেল দিয়ে দেবে। সচরাচর চুলে তেল দেওয়ার নাম শুনলেই দৌড়ে পালায় মিষ্টি।আজ পেয়েছে হাতের কাছে তাকে।

মুখে উৎসাহের হাসি ফুটিয়ে তেল দিতে লাগলো মল্লিকা।তার ক্লান্তি দুর করার জন্য পেছনেই বসে আছে আরেকজন।

মল্লিকার তার উদ্দেশ্যে বললো,

“আমাদের যত্ন নিতে গিয়ে নিজে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন না যেনো।সামনে পথ আরো কঠিন।প্রথমবার আপনার জন্য।আগেই জানান দিচ্ছি শক্তি যোগান।”

“ভয় দেখাচ্ছিস কেনো?” মাহরুর জবাবে বললো।

“ভয় দেখাচ্ছি না। সতর্ক করছি।আমি একবার এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি।আপনি নতুন।নিজের প্রতি হেয়ালি করবেন না।আমার কথাও শুনেন না তার উপর।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।শুনবো।এখন কি করতে হবে আমার বলেন? হুকুম করেন?”

“এক গ্লাস গরম দুধ খেয়ে লম্বা ঘুম দেবেন।সকালে নাস্তা করে তবেই যাবেন অফিসে।অফিস থেকে ফিরে এক ঘণ্টা বিশ্রাম নেবেন।তারপর দোকানে যাবেন।”

“মিষ্টিকে পড়াবে কে?তোকে কে দেখবে?”

“কাল আম্মা আব্বা আসছে।আর মিষ্টিকে আমি পড়াতে পারবো।”

তেল মাখা হাতে মল্লিকার গাল চেপে ঘুরিয়ে আনলো মাহরুর। আলতো হাতে।জোর বেশি প্রয়োগ করেনি।ভনিতা করে বলতে লাগলো,

“আমার আগের চন্দ্র কই রে?তুই এমন রাক্ষসী হচ্ছিস কেনো দিনদিন। কড়কড় করে কথা বলিস।”

“আপনার আগের চন্দ্রেকে মনের কামরায় তালাবদ্ধ করে রেখেছি।”

“লজ্জা পাস না কেনো?আমাকে ভয়ও পাস না।আমার হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলাস না।”

মল্লিকা মুখ ফুলিয়ে বললো, “এই চন্দ্রকে ভালো লাগেনা বুঝি?”

মাহরুর থমকালো।চক্ষু পল্লব পিটপিট করলো।কপালে ভাবনা চেতনার রেখা।কি যেনো ভাবছে।হিসেব মেলাচ্ছে হয়তো। সর্বদার ন্যায় মল্লিকা অপেক্ষায় রইলো।ঠিক ভাবনা শেষে কিছু একটা বলবে।তাকে ভাবতে দেখলেও অদ্ভুত সুন্দর লাগে।

সময়ের অতিবাহিত করে মাহরুর বললো, “ভারী মুশকিল!আগের ভীত চন্দ্রও আমার পছন্দ।নতুন সাহসী চন্দ্রও আমার পছন্দ।”

“এখন কি করবেন জনাব?”

“এখন?তুই মাঝেমধ্যে ভীত।আবার কখনো কখনো সাহসী হয়ে যাস।দুটো চরিত্রেই ঘায়েল করিস আমায়।”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় মল্লিকা।দুইহাত তুলে নিজের গাল মুছলো।ঘটলো বিপত্তি।তেলে মাখা গাল মুছতে গিয়ে আরো তেল মাখিয়েছে।তার নিজের হাতও যে তৈলাক্ত।মল্লিকার এমন বোকামিতে মাহরুরও হোহো করে হেসে উঠে।তার শাড়ির আঁচল টেনে ধীরে ধীরে পরিষ্কার করে দিলো দুইগাল।

আর বললো, “তেলে মাখা মুখটাও যে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে রূপবান”

মল্লিকা জবাবে বলে, “এই ভালোটা ছয় বছর আগে লাগলো না কেনো?”

“তখন আমি নিজের অনুভূতির মধ্যেই গড়মিল পাকিয়ে ফেলেছিলাম।”

“এখন?”

“এখন হিসাব বরাবর।প্রথম আর শেষ ভালোবাসা আমার রূপবান আমার চন্দ্রমল্লিকা।আর কোনো নারী মাহরুরের হৃদয় স্পর্শ করতে পারবে না।” বুক ফুলিয়ে হেসে জবাব দেয় মাহরুর।

“মাহরুর হচ্ছে দিবার অম্বরে তেজস্বী রবি।”

“আর মল্লিকা রাত্রীর তামাশায় জ্বলজ্বল করা শুভ্র চন্দ্র।”

মিষ্টি বুঝেনি।বুঝার উদ্দেশ্যে মুখ ঘোরায়।তারা কি এমন ভারী শব্দ উচ্চারণ করছে?বোকা চোখে চেয়ে রইলো।মল্লিকা আর মাহরুরের চোখ পড়তেই তারা একে অপরের দিকে চেয়ে হাসে।

মাহরুর বলে, “আমার মিষ্টি আর অনাগত প্রাণ রবি-চন্দ্রের ছড়ানো নিষ্পাপ প্রভা।”

মিষ্টি এবারও অবোধ।জানতে চাইলো, “অনাগত?”

কপালে হাত রাখলো মাহরুর। ফটাফট বলে উঠলো, “ওহহো!বাচ্চাদের লিডারকেতো এই সংবাদ দেওয়াই হয়নি।এত বড় ভুল কি করে করলাম আমি?”

“কি করেছো মাহি বাবা?”

মাহরুরও মল্লিকার শাড়ির আঁচলের হাত মুছে নিল।মিষ্টির কাছে এসে হাঁটু মুড়ে বসলো।মিষ্টির হাত টেনে মল্লিকার পেটের উপর রেখে বললো,

“জানিস এখানে কি?”

“কিহ?”

“এখানে একজন আছে।একটা কুট্টি বাবু।একদম ছোট।তুই যদি ভালোমত খাওয়া দাওয়া করিস,ভালোমতন পড়ালেখা করিস।এই বাবুটা তাড়াতাড়ি বড় হয়ে তোর কাছে চলে আসবে।এসে কি বলবে জানিস?”

চক্ষু রসগোল্লার ন্যায় হয়ে গেলো মিষ্টির।গোলগোল চক্ষু প্রসারিত করে আছে।ছোট অধর জোড়া কিঞ্চিত ফাঁকা। মাহরুরের কথার প্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ফেলে বললো,

“কি বলবে?”

“বলবে আমার মিষ্টি আপু অনেক ভালো মেয়ে।তোকে আপু বলে ডাকবে।”

“আপু ডাকবে বাবা?”

“হুম”

“আমি ওকে কোলে নিতে পারবো?”

“হ্যাঁ পারবিতো।কোলে নিবি।আদর করবি।ওর আরেক মা হয়ে উঠবি। বোনতো তুই”

মিষ্টি দুহাত মায়ের পেটে রেখে মল্লিকার উদ্দেশ্যে বললো,

“ওকে এখনই আনো মা।আমি পড়ালেখা করবো।তুমি আমাকে পঁচা সবজিগুলো খেতে দিলেও খাবো।প্রতিদিন দুধ খাবো।ওকে এখনই আনো।ওকেও দিবো”

মল্লিকা জবাব দেয়, “ওর আসতেতো দেরি হবে মিষ্টি।তোর অপেক্ষা করতে হবে।”

“ও কি তোমার পেটে মা?”

“হ্যাঁ মিষ্টি”

“ওকে পেটে কেনো রাখলে?ওকে কোলে নাও।তোমার পেটে একা ভয় পাবে না?”

“তুইও এখানে ছিলি।ভয় পেয়েছিলি?”

নিষ্পাপ মুখ ফুটে বললো, “উম!…কি জানি?”

পেছন থেকে মিষ্টির গাল আলতো করে টেনে ধরলো মাহরুর।পেছনে বসে বললো,

“ও মিষ্টির ছোট্ট ভাই অথবা বোন।অনেক সাহসী।একদম ভয় পাবে না।”

“মিষ্টির ভাই,বোন কি করছে মাহি বাবা?”

“ও? ও এখন ঘুমোচ্ছে”

“আচ্ছা আচ্ছা! আস্তে কথা বলো নাহয় জেগে যাবে।হুশ”

ঠোঁটে তর্জনী আঙ্গুল চেপে চুপ থাকতে ইশারা করলো মিষ্টি।তার মুখ বলছে সম্পূর্ণ না বুঝলেও একটা বাবু আসবে তাদের কাছে সেটা বুঝেছে।তাই ভেবে খুশির আভা ফুটেছে তার মুখে।চুপ বনে রইলো যেনো অনাগত বাবু কথার আওয়াজে উঠে না যায়।

__

কর্মরত পুরুষের অবসর নেই।এক কাজের স্থানে দুই দুইটা কাজ হাতে তুলে নিয়েছে।সকালে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে দৌঁড়াতে হয়।সেখান থেকেই অফিসে।অফিস থেকে ফিরে আবার নিজের শখের ছোটোখাটো ব্যবসায় মনোযোগ দিতে হয়।আজকাল ঘণ্টার পর ঘণ্টা অফিসে বসে শান্তি পাওয়া যায় না।মাথায় চিন্তা ঘুরতে থাকে।কি করছে একা চন্দ্র? দুলালকি মিষ্টিকে আনলো স্কুল থেকে?ঠিকঠাক মতন খাওয়া দাওয়া করছেতো?কোনো প্রয়োজন হলে কি করবে?শারীরিক আর মানসিক চাপ বোঝাই হচ্ছে দিনদিন।আর এই চাপের চিন্তা মল্লিকার বেশি।একটু পরপর কল করে বলবে টেনশন করতে না।টুকটুক করে মেসেজ করা শিখেছে।মেসেজ দিয়ে ছোট্ট করে জানান দেয় ‘ আমরা ঠিক আছি ‘।সেও জানে চিন্তা করতে করতেই মাহরুর অর্ধেক শুকিয়ে যাচ্ছে।এইতো মাত্র আবার মেসেজ এলো।

ফাইলের মধ্যে হারিয়েও মেসেজটা দেখতে ভুললো না মাহরুর।

লেখা ছিল, “আম্মা,আব্বা এসেছে।দ্রুত আর সাবধানে ফিরবেন”

লম্বাটে সস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মাহরুর।যাক!অল্প চিন্তা উপসম হয়েছে।একা নয় মল্লিকা।তার শক্ত ঢাল এসে হাজির।বাবা মার মতন যত্নতো সে নিজেও নিতে পারবে না।

রমজান সাহেব আর ফরিদা বেগম এসেছেন হাত ভর্তি বাজার নিয়ে। কি পছন্দ তার?সবটাই এনেছেন। মেয়ের দিকে নজর দিতে গিয়ে ভাতিজা এর নাতনিকেও ভুলেননি।তাদের পছন্দ মোতাবেকও কিছু না কিছু এনেছেন।এসে শ্বাস অব্দি নিলেন না ফরিদা বেগম মা হওয়ার খুশি মেয়ের সাথে উৎযাপন করে হাত লাগান ঘরের কাজে।

এলোমেলো সবটা গুছিয়ে নিলেন।ভাত বসিয়েছেন।তরকারি কাটাকুটি করছেন নিজের নিপুণ হাতে।কোনো বারণ শুনেননি।

জোবেদা খাতুন আসলেন হুট করে।ঘরের মাঝে মেহমান দেখে জানতে চাইলেন কারা তারা?মল্লিকা উঠে এসে পরিচয় করিয়ে দেয়।তিনি সালাম জানিয়ে মল্লিকার হাতে এক বক্স ভর্তি বাদাম ধরিয়ে বললেন,

“এডি খাইবা দুধের লগে মিলায়।বাদাম দুধে বহুত ভিটামিন।”

“চাচী?কেন এত কিছু করতে গেলেন?”

“ওমা কি করলাম?কোমড় বেদনায় আইতেই পারি না উপরে। আইজকা দুলালরে দিয়া বাদাম আনাইছি তোমার লেইগা।”

জোবেদা খাতুন এসে বসলেন ফরিদা বেগম এর সাথে।দুইজন বয়স্ক নারী একে ওপরের সাথে আলোচনায় মশগুল হতে শুরু করলেন।তাদের দেখে হাসলো মল্লিকা।তবে মাথায় অন্য চিন্তা ভর করলো।বাবা মা এসেছে মল্লিকার কাছে থাকার জন্য।থাকবে কোথায়? ঘর একটা।তারা তিনজনই থাকে সমন্বয় করে।শিরীনের বাড়ি বেশি দুর না হলেও আসা যাওয়া ব্যাপারটা কষ্টসাধ্য। মাহরুরকে বলবে ভেবেও মত পরিবর্তন করলো মল্লিকা।এই লোকের মস্তিষ্ক চিন্তার ভান্ডার।আরো জুড়ে দিলে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে।

জোবেদা বেগমের আওয়াজ শোনা গেলো।গল্প এগিয়েছে নিজেদের অতীত জীবনের দিকে।বলে উঠলেন,

“আমার শাশুড়ি আমার পোলা পেটে থাকতে খাইবার দিতো না আমারে।কি কষ্ট কইরা যে জন্ম দিছি এই পোলারে।আর এই পোলা এখন মায়ের খবর রাখে না।”

ফরিদা বেগম মলিন গলায় বললেন, “হয়তো আপনার ছেলে কোনো কাজে ব্যস্ত। বিলেতে কারবারতো আর মুখের কথা না।”

“কি এমন ব্যস্ত? বিয়া করছে বিদেশি সাদা মাইয়ারে।দিন বেদিন ঘুরতে যায়।ঐযে ইন্টারনেটে ছবি ছাড়ে।দুলাল দেহাইলো।মাসের পর মাস এক দেশ থিকা অন্যদেশ ঘুইরা বেড়ায়।নিজের দেশে আওয়ার সময় নাই।এই জীবনে নতিপুতিগো ছুইয়া দেখবার পারলাম না।”

ফরিদা বেগম জানতে চাইলেন, “আপনার মেয়ে নাই?”

“আছে!কুমিল্লা চৌধুরী বাড়ির বউ।ভাইয়ের লগে জমিজমার অভিমান কইরা আর আহে না আমগো বাসায়।কয় বাপ মা নাকি সবটা লেইখা দিছে ভাইয়ের নামে। আমাগো দুষায়।”

দুঃখ প্রকাশ করলেন ফরিদা বেগম।এই পৃথিবীতে রক্তের সম্পর্কের মূল্য নেই।সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি পারিবারিক অবক্ষয়ও পরিলক্ষিত।কত বাবা মা ভোগে সন্তানের এক ঝলক দেখবে বলে।কত সন্তান আশাহত বসে মা বাবার ভালোবাসার পরশ পাবে বলে।কাকে দোষারোপ করবে এই ক্ষতির জন্য? পারিবারিক মনোমালিন্যের অন্ত কোথায়?অনেক যুগ আগ থেকেই চলে আসছে।কাগজের তৈরি টাকা, ধন সম্পদ এর কাছে অনুভূতিরা অত্যন্ত দুর্বল।আজকাল প্রশ্ন উঠেছে আবেগের প্রতি।বলা হয় ‘ আবেগে দুনিয়া চলে না ‘।চলে খসখসে টাকায়। প্রাচুর্যে!

মল্লিকা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো।মনে মনে ভাবলো,

“সারাজীবন টাকার পেছনে দৌড়ে মানুষ আবার এক সময় মানসিক শান্তি খোঁজে।হাহ!”

ফরিদা বেগম আকাশের দিকে চাইলেন।সন্ধ্যা হচ্ছে।মেয়েকে আড়ালে ডেকে নিচু গলায় বললেন,

“আমরা থাকবো কোথায় রে? শিরীনদের বাড়ি চলে যাই কি বলিস? কাল সকালে আসবো।”

মল্লিকা আবারো চিন্তায় পড়লো।চক্ষু পল্লব নামিয়ে ভাবলো।এটা আসলেই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।একটা ব্যবস্থা দরকার। আরচোখে চেয়ে কান পেতে শুনলেন দুই মা মেয়ের কথা জোবেদা বেগম।কোনো রকম চিন্তা না করে দুজনার মধ্যে বলে উঠলেন,

“শিরীনগো বাড়ি যাইবেন কেন?আমার ঘরে আহেন।চারটা ঘর আমার। একটায় আমরা বুড়াবুড়ি থাকি।আর দুইটা আমার পোলা মাইয়ার।আরেকটা নাতি-নাতকুরগো লেইগা বানাইছি।ওদিকে থাকবেন। আহেন ”

ফরিদা বেগম জোবেদা খাতুন এর কথার উত্তরে বললেন,

“আপা আমরা অনেকদিনের জন্য এসেছি।এভাবে কারো বাসায় থাকা কি ঠিক দেখায়?”

“কেনো ঠিক দেখাইবো না?সারাদিন দুই বেডা বেডি একলা থাকি ঘরে। এতএত গল্প করছি এতটা বছর আর কোনো গল্প খুইজা পাই না।আপনি আহেন।আমি একটা সঙ্গী পামু।আমার বুইড়া ব্যাটাও একটা সঙ্গী পাইবো।একলাই আমরা হয়তো বাকিডা জীবনও একলাই কাটান লাগবো।”

চক্ষু নত করে ফেললেন জোবেদা খাতুন শেষ বাক্যে।সোজা কথার মানুষ সে।ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে দেখেনি মল্লিকা তাকে। প্রথমে রাগী মনে হলেও পরবর্তীতে তাকে মনে হয়েছে খাঁটি মানুষ।কতটা অপেক্ষা তার চোখে?এই আশায় আছেন যদি একবার দুই সন্তানের দেখা পান?

মল্লিকা বললো,”চাচী উনি আসুক?ওনার সাথে কথা বলেই আপনাকে জানাই আম্মা আব্বা কোথায় থাকবে?”

“তোমার উনি না মানলে আমারে কইবা। মুরব্বী মানুষের কথা কেমনে ফালায় দেখমু”

জোবেদা খাতুন চলে গেলেন। ধীরে সুস্থে নিচে নেমে গেছেন।মল্লিকা হাসলো।কি সুন্দর হুমকি দিয়ে গেলেন।বয়স বাড়লেও মানুষ নিষ্পাপ বাচ্চাদের মতন হয়ে উঠে।অবুঝ হয়ে যায়। বায়না ধরে।এই সময় তাদের প্রয়োজন ছিলো ভরা সংসারের।অনেক অনেক মানুষের আনাগোনার মধ্যে জীবন যাপন করার কথা ছিল।অথচ সেই ভাগ্য কই?এত বড় বাড়ির মালিক হাওয়া সত্বেও একাকিত্ব ভোগাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

মাহরুর ফিরেছে হালকা নাস্তা সাথে নিয়ে।মল্লিকার মন মোতাবেক এসেই বিছানায় পিঠ ঠেকায়।থাকুক ঘরে মেহমান।তারা কি পর নাকি?আপন মানুষ।

চা নাস্তা এগিয়ে দিয়ে মল্লিকা বললো, “জোবেদা চাচী বলছিলো আম্মা আর আব্বাকে ওনাদের বাসায় থাকতে।কিন্তু আম্মা আব্বা সংকোচ করছেন।”

মাহরুর বিনা ভাবনা চিন্তায় বলে ফেললো, “জোবেদা চাচীর কথা শোন।আমি ইদানিং খেয়াল করছি তাদের স্বামী স্ত্রীর মন ভালো যাচ্ছে না।হয়তো পারিবারিক সমস্যা।চাচা চাচী থাকলে একটু গল্প গুজব করবে ভালো সময় কাটাবে।”

“সেটা আমিও লক্ষ্য করেছি।কথায় কথায় আম্মার সাথে বসে কত দুঃখ প্রকাশ করে গেলো।আমার জন্য এক বাক্স বাদাম এনেছে।”

মাহরুর চায়ের কাপে চুমুক রেখে বললো, “ভালো মানুষ তেনারা।”

মাহরুরের কথা রমজান সাহেব আর ফরিদা বেগমও শুনলেন।কতবার আর শিরীনদের বাড়ি থেকে আসা যাওয়া করা যায়?এক বাড়িতে থাকলে অন্তত যাতায়াত এর ঝামেলা থাকেনা। মাহরুর নিজের কষ্টটা আড়াল করে গেলো।কি পারলো জীবনে এটাই ভাবছে? শশুর শাশুড়ি পরের কথা। আপন চাচা চাচী এসেছে।তাদের অব্দি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করতে পারলো না।অন্যের ঘরে গিয়ে থাকা লাগছে।লজ্জিত সে।চোখ বুজে গরম চা গটগট করে গিলে নিঃশ্বাস ফেলে।রাতের খাবার শেষে চাচা চাচীকে রহিম মিয়ার বাড়িতে দিয়ে এসে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।আবারো প্রতিনিয়তের মতন মস্তিষ্কে চাপ দিচ্ছে।দুনিয়া জাহানের চিন্তা চেতনা।বর্তমান সময় চলছে কিছুটা অভাবে।সামনে আরেকজন আসবে।তার ভবিষ্যৎ কী হবে?

ঘাড়ে হাত রেখে দাঁড়াতেই পেছন থেকে মেয়েলী মধুর বাক্য কর্ণপাত হলো,

“সব ঠিকঠাকভাবেই হবে মিষ্টির বাবা”

চলবে..

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৩৫+৩৬

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৩৫
লেখা : Azyah_সূচনা

মধ্যিখানে আরো দুটো মাস কেটে গেছে।দিন চলছে সবসময়ের মতন এক নিয়মে। খুনসুটি,অভিমান,ভালোবাসায়।আজকাল নতুন দায়িত্ব মাথায় নিয়েছে মাহরুর। মিষ্টি এবং মিষ্টির মা দুজনকেই একসাথে নিজের ছাত্রী বানিয়েছে।পড়ায় দুজনকে।মিষ্টির অত্যাবশ্যকীয় পড়ালেখা।আর মল্লিকার জ্ঞান বাড়ানোর জন্য।নিজের পুরোনো বইগুলো পড়তে দেয়। আগ্রহ নিয়েই পড়ে সেও।দোকানের ব্যাপারে কোনো চিন্তাই করতে হয় না মাস শেষ হওয়ার আগে। ভরসাযোগ্য দুলালকে পেয়েছে। অফিসে তানিয়া থাকে ডিরেক্টরের নজরে নজরে।সেও কোনো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারেনি।শিরীনের আগমন ঘটেছে কয়েকবার।রেদোয়ান এর সাথে আলাপতো হয় দুদিন পরপরই।টাকা ফেরত দিয়েছে অর্ধেকাংশ।আরো বাকি আছে।অনেকটা হিসেব নিকেশ করেই চলছে জীবন।

দেখতে দেখতে ঈদ উল আযহা চলে এসেছে। হাট বসেছে পুরো মহল্লা জুড়ে।নানান পশুর বিশাল সমাহার।বাচ্চাদের আনাগোনা বেশি বড় মানুষের চেয়ে।

অফিস শেষে বাড়ি ফিরে মাহরুর মিষ্টিকে বললো, “আম্মাজান?”

“জ্বি মাহি বাবা?”

“রেডি হন।আপনাকে হাট দেখিয়ে আনি”

মিষ্টি এক পায়ে রাজি। স্কুল থেকে আসা যাওয়ার পথে গরু, ছাগল আর উট দেখেছে।মায়ের কাছে বায়না করেছে।কাছে যাবে।আদর করবে তাদের।তার মা হাত উঁচিয়ে না করে দেয়। উল্টো পথে নিয়ে আসে তাদের। পশুপাখি অনেক ভয় পায় মল্লিকা।সেই ইচ্ছেটা মাহরুর পূরণ করবে।

মাহরুর হাঁটু গেড়ে ঝুঁকে মিষ্টির পায়ে ছোট্ট জুতো পড়িয়ে দিলো।যাওয়ার পথে একবার মল্লিকাকে প্রশ্ন করলো, “যাবি নাকি?”

মল্লিকা উত্তর দেয়, “না বাবাহ!আপনারাই যান।আমার ভয় করে অনেক।”

মিষ্টি মল্লিকাকে ভেঙিয়ে বললো, “ভীতু মা! ভীতু মা!”

সন্ধ্যার সাজ আজ ভিন্ন।কম সমাগমের এলাকায় আজ চারিপাশে কোলাহল।বড় বড় ট্রাক বোঝাই করে আসছে কোরবানির পশু।রাস্তা ময়লায় আবৃত।আগেও ঈদ দেখেছে মিষ্টি।অন্য বাড়ির গরু ছাগল দেখতে যেতো।আদর করতো।তাদের খাওয়াতো।আজও ওই ঈদটা ফিরে এসেছে বলে বুঝলো মিষ্টি।

বললো, “মাহি বাবা?”

“হ্যাঁ?”

“আমাদের আগের বাড়িটা আছে না?যেখানে দাদী থাকতো?….ওই বাড়ির পাশে আমার একটা বন্ধু আছে।ওর নাম হলো পিচ্চি।ওদের বাড়ি যাবো।”

পিচ্চি?ভীষণ অদ্ভুত নাম।তবে মাহরুর এর বাগানবাড়ির কথা শুনে মোটেও পছন্দ হলো না।ওই রাস্তায় যাবে না।একদম না।ভয়ে নয়।চায় না অহেতুক সমালোচনার শিকার হোক। যত ঝামেলামুক্ত থাকা যায় তত ভালো।

মিষ্টিকে বললো, “ওখানে যাবো না মা।সামনে হাটে চল গরু দেখে আসি।”

“পিচ্চিদের বাড়িতেও ছোট্ট ছাগল আছে।ওরা কিনেছে।সাদা ছাগল।আমি ওকে আদর করবো।”

“তুই সাদা ছাগল দেখতে চাসতো?”

মিষ্টি মাথা উপর নিচ করে বললো, “হ্যা”

“পিচ্চিদের বাসায় মাত্র একটা ছাগল।আর হাটে অনেকগুলো ছাগল।”

“অনেকগুলো মাহি বাবা?”

মাহরুর হেসে বললো, “অনেকগুলো ছাগল।চল দেখে আসি?”

“ঠিক আছে চলো”

প্রথমে বড় আকারের পশু দিয়েই শুরু করে।লম্বা লম্বা উট দেখে চক্ষু ছানাবড়া মিষ্টির।মায়ের মতই রূপ তার।সাধারণের মধ্যেই অসাধারণ।তবে রং একেবারে মাহরুরের মতন।ফারহান ছিলো কৃষ্ণবর্ণের সুদর্শন একজন পুরুষ।তার দেহ গঠন এর কাছে চাপা রঙ ছিলো ফিকে।অথচ তার মেয়ের রং মিলে যায় মাহরুরের সাথে। অদ্ভুত লীলাখেলা সৃষ্টিকর্তার।গোল টসটসে গাল প্রায় অনেক সময় লাভ আভায় ছড়িয়ে থাকে এই বাচ্চা মেয়ের।চোখ দুটো বিশাল।অবাক হলে আরো প্রসারিত করে নেত্রদ্বয়কে।আবার ঠোঁট কামড়ে নেয়।

আদুরে কন্যা বলে উঠে তার বাবার উদ্দেশ্যে, “ও বাবা?ছাগল দেখবো না?”

বাবার আগে ‘মাহি’ শব্দটি যোগ করেনি।হয়তো এত এত পশু দেখে ঘোরে আছে।ধ্যান যায়নি।আলগোছে বলে ফেলেছে। মাহরুর খুশি হয় অনেক।হোক মাহি বাবা অথবা বাবা।দুটোই যে মিষ্টির মুখে শান্তির বাণী।

মেয়ের গালে শক্ত চুমু খেয়ে বললো, “দেখবোতো আম্মা।আগে গরু দেখি?”

“গরু দেখে ছাগল দেখবো?”

“হ্যাঁ”

মানুষের সমাগমে হাটবাজার।দরদাম কষাকষি চলছে। ঈদের বাকি চারদিন। চড়া দাম সবখানে। উচ্চবিত্তরা টাকার হিসেব না করেই কিনছে পশু।কেউ আবার স্বল্প টাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে বাচ্চাদের নিয়ে।নিজেদের সাধ্যমত পেলেই বাচ্চাদের মুখে হাসি ফোটানো যাবে।বড়দের আর ঈদ আছে? ঈদ আসে বাচ্চাদের জন্য।তাদের মুখের হাসি দেখেই ঈদের আনন্দ ভোগ করে তাদের বাবা মা।

গরু দেখার প্রতি বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই মিষ্টির।বাবার কোলে ঘাড় আঁকিয়ে বাঁকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। নিশ্চয়ই ছাগল।একটু পরপর বিড়বিড় করে ‘ সাদা ছাগল ‘ বলে। অতঃপর মাহরুর ছাগলের দিকটায়ও গেলো।এবার মিষ্টির আনন্দ দেখে কে?ভয় ভীতি কাটিয়ে নেমে যায় তরতরিয়ে কোল থেকে।গিয়ে দাঁড়ালো এক ঝাঁক ছাগলের দিকে।

বেছে বেছে একটি ছাগল মনে ধরলো তার।ধবধবে সাদা তবে মাথার অংশে একটু কালো।মিষ্টি ছাগলের মালিককে, “আংকেল আংকেল”

মালিক উঠে দাড়ায়। কোমরে গামছা পেচিয়ে বললো, “বলো খুকি?”

“ওর মাথার কালো দাগ ধুয়ে পরিষ্কার করে দেন”

হাসিতে ফেটে পড়লেন মালিক।সাথে মাহরুর আর আশপাশের মানুষও।বোকা চোখে তাকায় মিষ্টি।

মালিক বলে উঠলো, “এটাতো পরিষ্কার করা যাইবো না।”

“তাহলে?আমাকে একটা সাদা ছাগল দেন।দাগ ছাড়া”

মালিক বাচ্চার বাচ্চামো দেখে এক ঝাঁক ছাগলের মধ্যে একটি সাদা ছোট ছাগল এনে মিষ্টির সামনে দাঁড় করায়।বলে,

“এই লও ”

মিষ্টি হাত দিয়ে আদর করতে লাগলো ছাগলকে। অদ্ভুত কাণ্ড ঘটায় পরপর।চুমু দিয়ে বসে ছাগলের মাথায়। মাহরুর এগিয়ে আসে।বলে,

“আম্মা চুমু দেয়না।”

“কেনো?এই বাবু ছাগলটা সুন্দর।”

“হ্যাঁ সুন্দর কিন্তু হাত দিয়ে আদর করতে হয়।”

হাঁটু ভাঁজ করে মিষ্টির কাছে এসে বসলো মাহরুর।ছাগলের দড়ি ধরে মিষ্টি বললো মালিককে, “আংকেল ওকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাই?এইযে সামনেই আমাদের বাড়ি”

মালিক আরেকদফা হাসলেন।বললেন, “পয়সা আইনছো নি?”

“আমার বাসায় মাটির ব্যাংকে পয়সা আছে।আপনাকে দিবো?”

সরল মন মিষ্টির।এখনও বয়সের সীমা সেই কোঠায় যেখানে বাস্তবতার অমুখাপেক্ষী।ছোট মনে যতটুক বুঝেছে ততটুকুই বলেছে।সেতো জানে না তার মায়ের দেওয়া ছোট পয়সায় তার এই পছন্দের জিনিস কেনা যাবে না।

মাহরুর বললো, “পয়সা দিয়ে ছাগল কেনা যাবে না আম্মা”

“কেনো বাবা?এই ছাগলটা আমার পছন্দ হয়েছে।আমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাবো।”

মাহরুর উঠে দাড়ালো। ছাগলটি ভালোমত দেখে শুনে দাম জিজ্ঞেস করে।বলে, “দাম কেমন চাচা?”

“দাম চাইলে ১৬ হাজার।”

এতটুকু ছাগল ষোলো হাজার টাকা। সত্যিই অনেক ঊর্ধ্বগতি। ষোলো হাজার টাকা এই হাটে শুনতে ছোট অংক মনে হলেও মাহরুরের কাছে বেশিই বটে।অফিস আর দোকান সব মিলিয়ে সংসার চলে।টুকটাক শখ আহ্লাদ পূরণ হয়।তবে মন খারাপ হয়ে গেলো।

মিষ্টি বললো, “নিবো মাহি বাবা।আমি এই বাবু ছাগলকে বাড়ি নিবো।”

নেতানো মুখে মাহরুর বললো, “এখন না আম্মা।পড়ে”

“আমি এখনই নিবো!”

গলার জোর বাড়িয়ে বললো মিষ্টি।ছাগলের দড়ি ধরে টানতে শুরু করলো।তার সমান ছাগলকে টেনে নিবে?অত শক্তি আছে। মালিকও সামনে দাড়িয়ে।এভাবেই নিয়ে যাওয়া যায় না যেখানে মিষ্টির অভিভাবক কিনতে নারাজ।

মাহরুর বোঝানোর ভঙ্গিতে বললো, “আম্মা?বাবার কাছে এখন টাকা নেই।আমি তোকে কিনে দিবো পড়ে।কথা দিচ্ছি।”

“আমি টাকা দেই?আমার ব্যাংকে টাকা আছে।”

“ওই টাকা দিয়ে হবে না মিষ্টি।”

মালিক মিষ্টির হাত থেকে ছাগল ছাড়িয়ে বেধে রাখলো।শক্ত শরীরে দাড়িয়ে আছে মিষ্টি।কোনো নড়চড় নেই।চোখ টলমল করতে শুরু করলো পানিতে।ঠোঁট উল্টে আছে।বোঝা গেলো এখনই কেঁদে দিবে।

“কাঁদিস না মা।আমি বললাম আমি তোকে এর চেয়ে বড় সাদা ছাগল কিনে দিবো”

“আমার এই ছাগলটাই লাগবে। কিনে দাও না মাহি বাবা”

কেঁদে ফেলেছে মিষ্টি।গোল তুলতুলে গাল বেয়ে অনবরত অশ্রু ঝরছে।বেধে রাখা ছাগলের দড়ি আবার ধরলো।সে ছাড়বে না। মাহরুর চেষ্টা করলো আরো কিছুক্ষন।বুঝদার স্বল্পবয়সী মেয়ে তার। বোঝালে বোঝে।তবে আজ কোনো বাহানা কাজে দিলো না।প্রথমবার মিষ্টি মেয়ের জেদ দেখা গেলো। মাহরুর তাকে কোলে তুলে নিলে জোর বাড়ে কান্নার।চিৎকার দিয়ে আমার সাদা ছাগল বলে চেঁচাতে লাগলো।কান্না মাখা গাল মুছতে মুছতে মাহরুর বেরিয়ে গেলো হাট থেকে।মিষ্টি এখনও কেঁদে চলেছে।

বাড়ি ফিরে এসেছে।সিড়ি ঘর থেকেই কান্নার আওয়াজ চিনে ফেলে মল্লিকা।দৌড়ে দরজা খুলে কয়েক সিড়ি নেমে আসে। মাহরুরের কোলে মিষ্টিকে কেঁদেকেটে নাজেহাল অবস্থা দেখে বিচলিত সুরে প্রশ্ন করলো,

“কি হয়েছে?কাদঁছে কেনো ও?”

মিষ্টি মাহরুরের কোল ছেড়ে মল্লিকার কাছে লাফিয়ে পরে।বলে,

“পঁচা মাহি বাবা।আমাকে সাদা ছাগল কিনে দেয়নি।আমাকে এখন চকোলেটও দেয়না এখন।আমি একদম কথা বলবো না তার সাথে। তাকাবোও না।মাহি বাবা ভালো না”

মাহরুর মলিন মুখে চেয়ে আছে। ওষ্ঠজোড়া কিঞ্চিত ফাঁকা। পুরুষালী সুদর্শন মুখটায় মনে হলো বিষাদ ছুঁয়েছে। মিষ্টির কান্নারত গালে হাত রেখে মাহরুরের পানে চেয়ে। হুট করে পলক ফেললো মাহরুর কয়েকদফা।

বললো অত্যন্ত ধীমে গলায়, “ওকে বুঝাস যেনো কান্না না করে।টাকা থাকলে ওর চাওয়া অপূর্ণ রাখতাম না। দোকানটা নিয়ে এখন আর হাতে তেমন টাকা থাকে না।”

“আপনি কি….”

মল্লিকা বলতে যাচ্ছিলো মাহরুর কি কষ্ট পেয়েছে?রাগ হয়েছে?কথাটা পূর্ণ হওয়ার আগেই মাহরুর চোখ নামিয়ে বললো,

“দোকানে যাচ্ছি।একটু পর ফিরে আসবো।কিছু লাগবে?”

মল্লিকা মাথা দুদিকে দুলিয়ে না বোধক উত্তর দেয়। মাহরুরও এক পলক মিষ্টির দিকে চেয়ে চলে গেলো। জ্বিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভেজায় মল্লিকা।মেয়ে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে।কি করবে?কি করে বোঝাবে?এই সংসারে ভালোবাসার অভাব না থাকলেও টাকা নামক কাগজী খরখরে বস্তুটা নেই।সেতো ছোট।কি বুঝবে অভাব? মাহরুরও জানে,বুঝে।তবে কিছু ব্যাপার হৃদয়ে গিয়ে লাগে?হোক বুঝদার ব্যক্তিত্ব অথবা নাদান হৃদয়।নিজের অজান্তেই বেদনার্ত ছায়ায় ঘিরে ধরে।

দোকানে হিসাব নিকাশ করলো মাহরুর।সাথে বেতনের টাকাসহ লাভ অংশ যোগ করলো। সংসারের হিসেবটাও করেছে।এই মাসে রেদোয়ান এর টাকা দেওয়া হয়ে যাবে। দুলালের হাতে তার বেতন ধরিয়ে দিলো।কিছু টাকা বোনাসও দিয়েছে।

দুলাল বললো, “ভাইজান টাকা বেশি দিছেন।”

শান্ত কণ্ঠে মাহরুর উত্তর দেয়, “ইচ্ছে করেই দিয়েছি। ঈদ চারদিন পর।তোর ঈদ বোনাস।”

“ভাই?”

“হুম?”

“আপনার মনটা মনে হয় ভালো না।”

অগোচরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুর।ধরে ফেলেছে এই ছেলেটি। ফিকে হেসে বললো, “তেমন কিছুই না।অফিসে কাজের চাপ”

“আচ্ছা ভাই।আমি আরো ভাবলাম।আমার হাসিখুশি ভাইজানের হঠাৎ কি হইলো?”

আরো কিছু টাকা আলাদা করে পকেটে ভরে নিল।দোকান বন্ধ করে আবার হাটা দিয়েছে হাট এর দিকে। হাটতে হাটতে এসে দাঁড়ালো সেই জায়গায়।সেই ছাগলটা এখনও বিক্রি হয়নি।সেখানেই বাঁধা।নিজের চুলে হাত ফিরিয়ে মাহরুর আমতা আমতা করে ছাগলের মালিককে বললো,

“ছাগলটা কত হলে দিবেন?”

“ভাই আপনি সন্ধ্যায় আসছিলেন হেয় না?”

“জ্বি”

“আপনার মাইয়াটা কানতাছিলো।আমি মাইয়ার মন রাখুম।এক দাম কইতাছি চৌদ্দ হাজার টাকা।অন্য মানুষ হইলে পনেরো এর নিচে নামতাম না।”

আরো শঙ্কিত হয় মাহরুর।পকেটে হাত রাখে। টাকা স্বল্প।কিছু সময় দাড়িয়ে থাকলো।ভেবে চিন্তে বললো,

“সাত আট হাজারে দেবেন?”

“এটা কি কইলেন ভাই?জানেন ছাগল পালতে আমগো দুনিয়ার খরচ।আজকাল সাত আট হাজারে ছাগলের বাচ্চাও পাইবেন না।”

“আচ্ছা ভাই।” বলে ফিরে হাটতে থাকলো মাহরুর।

মালিক পেছনে চেচিয়ে বলেছে, “কিছু বাড়াইতে পারলে আইসেন ভাই”

পরাস্ত মাহরুর।একটা চেষ্টা করতে এসেছিল।অফিসে তাড়া দিচ্ছে। ল্যাপটপ দরকার।কিনতে হবে।সেই জন্যেই টাকা জমাচ্ছিলো।পুরোনো এক ল্যাপটপ বন্ধুর কাছ থেকে নেওয়ার কথা ছিলো।সেই টাকাটা মেয়ের খুশিতে ঢালার জন্য এসেও হারতে হয়।

বাড়িতে ফিরে।গেট ধরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে মল্লিকা।তাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে হাসলো মাহরুর।এগিয়ে এসে গাল টেনে দেয়।ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলো মিষ্টি ঘুমিয়ে পড়েছে।

পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে মল্লিকার কাছে জানতে চাইলো,

“খেয়েছে?”

“জোর করে দুই লোকমা খাইয়ে দিয়েছি।”

“কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।”

মল্লিকা মাহরুরের মুখোমুখি এসে বসলো।অতি সন্নিকটে। মাহরুরের প্রেমের গভীরত্বে ডুবে খোলস ছেড়েছে।লজ্জা পায় না এখন।অনেক স্বাভাবিকতা এসেছে তার মধ্যে। কাঁধের দিকে হাত রেখে উল্টে থাকা কলার সোজা করে দিলো।এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলল,

“আপনিওতো পেয়েছেন কষ্ট”

“তাতে কি?আমিতো ওর মত অবুঝ বাচ্চা না।বাচ্চা কালে যেকোনো বিষয় মনে গভীরভাবে দাগ কাটে।”

কপাল কুঁচকায় মল্লিকা।হাত সরিয়ে চুলোর দিকে চলে গেলো। প্লেটে খাবার নিয়ে এক মিনিটের মধ্যে মাহরুরের সামনে এসে বসলো। ভাত মাখছে।এক লোকমা মাহরুরের মুখের সামনে ধরে বললো,

“বেশি বেশি সবসময়।আমাদের মেয়েটা অনেক লক্ষী। আগামীকালই ভুলে যাবে।”

“এক না একদিন মনে পড়বে।”

“চুপ থাকুন আপনি।খাবার খান।”

খাবার মুখে পুরে অস্পষ্ট গলায় মাহরুর বললো, “ধমকাচ্ছিস আমায়?”

“হ্যাঁ।আমি ভেবেছি এখন থেকে আমিও শিরীন বুবুর মতন হয়ে যাবো। আপনাকে হাতে রাখতে হবেনা?”

“বড্ড পেকেছিস!আমি তোর হাতেই আছি।বাহু ছড়িয়ে বুকে টেনেও নিতে পারিস”

“আপনার কাছে যত বাজে কথা।”

মাহরুর তেরছা দৃষ্টি ফেলে বললো,

“বাজে কথা?আমাকে বেহায়ার মতোন বারবার কাছে টেনে নিস আর আমি কিছু বলতে গেলেই আমি খারাপ হয়ে যাই না?”

মাহরুরের মুখ বন্ধ করতে ভাত পুড়ে দিলো দ্রুত। নাহয় এই লোক থামবে না। হাসতে লাগলো আর বললো,

“আমি বলবো আপনি শুনবেন।আমি আপনার প্রেমিকা এর খাতা থেকে বাতিল হয়ে বউ হয়েছি এখন। ওমনি আচরণ পাবেন এখন থেকে আমার কাছে।বউ এর মতন আঁচলে বেঁধেই ঘুরাবো।”

ভাত গিলে মাহরুর উত্তর দেয়, “তোর লজ্জা ভাঙ্গানো হয়েছে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।ঠিক আছে মহারানী ঘুরান যত ঘুরানোর।আমি আজীবন ঘুরতে রাজি। দশ বারোটা বাচ্চা হওয়ার পরও মাহরুর একজন প্রেমিক পুরুষ হিসেবেই থাকবে।”

“দশ বারোটা!” চক্ষু কপালে মল্লিকার।

“কেনো?কম?অলরেডি মিষ্টি আছে।তারপর আমাদের পনেরো বিশটা বাচ্চা।মিষ্টি হলো তাদের লিডার।ওদের বিয়ে দেবো।নানা নানী,দাদা দাদী হবো।সবাইকে একসাথে বসিয়ে আমাদের প্রেম কাহিনী শুনাবো”

___

চোখ কচলে মিষ্টি উঠেছে।পাশ ফিরতেই মাকে পেলো না।অন্যদিকে ফিরেছে মাহি বাবাকে দেখার আশায়।অদ্ভুত!সেও নেই।ছোট্ট দেহ নিয়ে উঠে বসে।চোখ কচলে আবার খুঁজলো দুজনকে।একা ঘরে নিজেকে উপলদ্ধি করে লাফিয়ে নেমে যায়।পর্দা সরিয়ে ছাদে পা বাড়ানোর আগেই থেমে গেলো।তার মাহি বাবা দাড়িয়ে।পাশেই বেধে রাখা সাদা। ছাগলটাকে আদর করে খাওয়াচ্ছে তারই মা মল্লিকা।মিষ্টিকে দেখে বিশাল হাসি দিলো মাহরুর।

বললো, “দৌড়ে আয় বাবার কাছে”

খুশিতে গদগদ করতে করতে জোরে দৌড় লাগায় মিষ্টি। একলাফে মাহরুরের বুকে এসে লেপে গেলো।খুশিতে কোলে চড়েই লাফিয়ে যাচ্ছে।যত দ্রুত এসেছে তত দ্রুতই নেমে গেলো।ছাগলের গলা জড়িয়ে বললো,

“আমার বাবু ছাগল।”

ঘরের লক্ষ্মী বলে যাদের আখ্যায়িত করা হয় তারা হলো নারী।হাত খরচের টাকা জমিয়ে রাখে মল্লিকা।তার আর কিসের খরচ?ওই টাকাগুলোই মাহরুরের হাতে তুলে দিয়েছে।সকাল বেলা এক মুহূর্ত দেরি না করে মিষ্টির ইচ্ছে পূরণে বেরিয়ে গিয়েছিল।

মল্লিকা মিষ্টির উদ্দেশে বললো, “কাল বাবাকে কষ্ট দিয়েছিলি মিষ্টি।দেখ আজ তোর বাবা তোর সাদা ছাগল নিয়ে এসেছে।”

মিষ্টি মাহরুরের কাছে গিয়ে দাড়ায়। কান ধরলো।মায়ের সাথেও এমন করেছে অনেকবার। কান ধরে বললো,

“আর করবো না”

মাহরুর জমিনে বসে মিষ্টির গাল টেনে বললো, “তোর জন্য সবকিছু সব!”

কোরবানি ঈদের দিন এসেছে।মিষ্টিকে প্রথম দিন থেকেই বুঝানো হয়েছে।তার এই বাবু সাদা। ছাগলটাকে আল্লাহ্ পাকের রাস্তায় কোরবান করতে হবে। ও বেশিদিন এখানে থাকবে না।যেনো পরবর্তীতে কোনো কান্না না করে।

মিষ্টি প্রশ্ন করে, “আল্লাহ ওকে কোথায় রাখবে মাহি বাবা?”

মাহরুর উত্তরে বলেছিলো, “ওর জন্য বিশাল একটা ঘর আছে।অনেক সুন্দর।সেখানে রাখবে।ওর বাবা মার সাথে থাকবে ও”

কিছুসময় মন খারাপ করে বসে থাকলেও ওই শিশু মন মেনে যায় বাবা মার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।ঈদের দিন নিজ হাতে কোরবানি দিয়ে গোস্ত আলাদা করে মল্লিকার কাছে এনে দিলো তিন ভাগ করতে।গোস্ত সামনে এনে রাখে।কিছু সময় থমকে থাকার পর দ্রুত উঠে দাড়ায় মল্লিকা। শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে বললো,

“গোস্তগুলো একটু দূরে রাখুন।আমার ভেতরে সব গুলিয়ে আসছে।…….আমাকে ভুল বুঝবেন না।আমি এই পবিত্র জিনিসকে অবজ্ঞা করছি না।আমার বমি পাচ্ছে” বলে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো মল্লিকা।

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা ৩৬
লেখা : Azyah_সূচনা

মল্লিকার আচরণে তফাৎ।ঘরের কাজে অনীহা ছিলো না কখনো।রান্নার কাজে কাচা গোস্ত অনেকবার ছুঁয়েছে।আজ এমন কেনো? ওয়াশরুমে গিয়েছে কয়েকবার। উশখুশ ভাবটা কাটে নি। কোরবানির পর মল্লিকার এমন কথার কোনো অর্থ খুঁজে পেলো না। দূরে মুখ ঢেকে দেয়ালের সাথে লেপ্টে থাকা মল্লিকাকে দেখে নিজেই হাত দেয় কাজে। দুলালতও নেই।থাকলে বিতরণের কাজে সাহায্য করতো।

একা হাতে সামলে নিলো মাহরুর। বিপরীতদিকে মিষ্টির মনটাও খারাপ। গালে হাত দিয়ে মাহরুরের ফোনে ছাগলের ছবিটা দেখে যাচ্ছে।মেনে নিলেও এখনও ভুলতে পারেনি। খানিক সময় বাদেবাদে ঠোঁট ভেঙে আসে মেয়েটির।স্পষ্ট জানিয়েছে সে এই গোস্ত খাবে না।

গোস্ত বিতরণ করে মাহরুর মল্লিকার কাছে এসে বললো, “রান্না বসাবি না?”

বিচিত্র মুখ ভঙ্গি করে মল্লিকা বললো, “আমার কেমন যেনো লাগছে মাহরুর ভাই”

মাহরুরের কপালে আকস্মিক চিন্তার দেখা ফুটলো।স্বল্প বিচলিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে?তোর কি শরীর খারাপ?”

“জানি না। ঘাড় ব্যাথা হচ্ছে।ভেতরে সব গুলিয়ে আসছে বারবার।বমিও হয়েছে একটু আগে।আমার ভালো লাগছে না কিছুই।এই গোস্তের গন্ধ অসহ্য লাগছে।”

কপালে আঙ্গুল ঘষে মাহরুর।বুঝে উঠতে পারলো না এর কারণ কি?বললো, “চন্দ্র তোর শরীর বেশি খারাপ।ডাক্তারের কাছে যাবি?”

“না এখন কোনো দরকার নেই।ভাজাপোড়া খাওয়ার কারণে হয়তো এমন হচ্ছে।আমাকে টক কিছু এনে দিন।খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”

“লেবু খা”

“খেয়েছি তেতো লাগে।”

ঈদের একটা দিনে এমনাবস্থা কখনোই কাম্য নয়।মল্লিকার হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে দিলো।পিঠের পেছনে বালিশ রেখে কপালে হাত চেপে বললো,

“একটু চোখ বন্ধ কর।আমি দেখি কি করা যায়।”

“আমি পোলাও রান্না করেছি।আপনি কি গোস্ত বসাতে পারবেন?বিশ্বাস করেন আমার এমন অদ্ভুত না লাগলে আমি কোনোদিন আপনাকে দিয়ে রান্না করাতাম না।”

চোখের কোণে এক বিন্দু জল জমে আছে। মাহরুর বৃদ্ধাঙ্গুল এর সাহায্যে মুছে নিলো।ঘরের কাজতো সেই একা সামলায়।একদিন নাহয় মাহরুর দায়িত্ব পালন করুক?

সন্তনাদায়ক বাক্যে আওড়ায়, “তুই বিশ্রাম কর।আমি সব সামলে নিবো”

ভাবুক ভঙ্গি মাহরুরের। অসুস্থতা অস্বাভাবিক কিছুই নয়।আসে আবার চলে যায়।তারপরও উদ্বেগপূর্ন।অসুস্থ প্রিয় মানুষকে দেখতে কার চোখে সয়?রান্না বসালো।একেবারে হালকা আচে গোস্ত বসিয়ে এক দৌড়ে গোসল করতে চলে গেলো।সময় নেবে না বেশি। ততক্ষণে রান্না হতে থাকুক।মিনিট দশেক এর মধ্যে ফিরে এসেছে মাহরুর।ভেজা চুলে তোয়ালে চালাতে চালাতে মল্লিকার পানে চোখ পড়ে।ঘুমিয়ে গেছে।সাথে মিষ্টিও।

ঢাকনা তুলে গরম গরম তরকারির ঘ্রাণে তুষ্ট হলো।কোনো উৎসবে খাবার স্বাদ বুঝি দ্বিগুণ হয়?পোলাও গরম করে মিষ্টি আর মল্লিকার কাছে গিয়ে ডাকতে শুরু করে।

বলে, “মিষ্টি?চন্দ্র?উঠে যা।খেয়ে তারপর ঘুমোস।”

সম্পূর্ণ ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো না। মাহরুরের এক ডাকে চোখ মেলে চেয়েছে। পেটে ক্ষিদে।সকাল থেকে না খাওয়া।মল্লিকা ভাবলো এবার একটু খেয়ে নেবে।মুখে সচ্ছ পানির ঝাঁপটা দিয়ে এসে বসে। মাহরুর বড় থালে খাবার নিয়ে হাজির।বোঝা গেলো এই একই থালে খাবে তারা তিনজনা। গামছায় মুখ মুছে মাহরুরের কাছে এসে বসলো।

বললো, “আজকে আপনার উপর অনেক চাপ পড়ে গেলো না?আমার শরীরটা যদি ভালো থাকতো তাহলে আর এই কষ্ট করা লাগতো না আপনার।”

মাহরুর উত্তরে বলে, “বাদ দে না চন্দ্র।একদিন নাহয় করলাম।আমার দায়িত্ব আছে না তোর যত্ন নেওয়ার?তোকে অসুস্থ অবস্থায় কাজ করাবো?”

“খাইয়ে দিবেন?” স্মিথ হাসে মল্লিকা।

“হ্যাঁ আয়।”

কয়েক দানা মুখে তুলেছে সবে।গলা দিয়ে নামলো না।বুক ধড়ফড় করছে মল্লিকার। অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার আগেই দৌড়ে গিয়ে মুখ থেকে খাবার ফেলে কুলি করে আসলো।

এসে হাপিয়ে বললো, “আমি খেতে পারবো না।আমার অসস্তি হচ্ছে।”

পূর্বের তুলনায় উদ্বেগ বৃদ্ধি পায় মাহরুরের।প্লেট থেকে হাত সরিয়ে মল্লিকার সামনে দাড়িয়ে বলে, “তোর প্রেশার নেমেছে বোধহয়। একটু খাবার মুখে তুলতে পারবি না?তারপর প্রেশার মেপে আসতাম?”

“পারবো না।ভালো লাগছে না।” কাঁদো গলায় উত্তর দেয় মল্লিকা।

ঠোঁট ভেজায় মাহরুর।পরপর চিন্তা চেতনায় ওষ্ঠ কামড়ে ধরলো।কি করবে?পরপর ভেবে নিলো আগে প্রেশার মাপুক।তারপর বুঝিয়ে সুঝিয়ে খাওয়ানো যাবে। মল্লিকাকে বসতে দিয়ে মিষ্টির দিকে এগোলো।যত দ্রুত সম্ভব ওকে খাইয়ে দিয়েছে।মিষ্টি খেতে চাইলো না প্রথমে।ওর সাদা ছাগলের গোস্ত সে কিছুতেই খাবে না।অনেক মিথ্যে অজুহাতে পনেরো মিনিট সময় পার হয়।

মল্লিকা কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে।কাপড় বদলে নিয়ে মাহরুর বললো, “চল প্রেশার মাপতে যাবো।সাথে ডাক্তার দেখিয়ে আসবো”

নিভু নিভু চক্ষুজোড়া চায় মাহরুরের দিকে।দুর্বল অনুভব করছে।বললো,

“এই ঈদের ছুটিতে কোথায় পাবেন ডাক্তার?আমি একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবো।”

“ঘরে বসে না থেকে ডাক্তার দেখানো উচিত। ঔষধ নিতে হবে।তোর চোখ মুখ ডেবে গেছে।দ্রুত আয় তর্ক করবি না।করলেও আমি শুনবো না।”

মিষ্টিকে রহিম চাচাদের ঘরে রেখে রওনা হয় মল্লিকা এবং মাহরুর।পাশের দোকান থেকে একটা আচারের প্যাকেট কিনে নিয়েছে।বাহিরে আবর্জনার গন্ধে মল্লিকার অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছিল।কোনো রকম রাস্তা পেরিয়ে আসলো হাসপাতালে।কোনো ফার্মেসি খোলা নেই।ঈদের ছুটিতে বন্ধ।শুধু হসপিটালেই চব্বিশ ঘণ্টা সেবা পাওয়া যায়।মোটামুটি জন সমাগমহীন হাসপাতাল।অনেক স্টাফ এবং ডাক্তার ছুটিতে। ভাগ্যক্রমে একজন ডাক্তার পেলে দ্রুত সিরিয়াল দেয় মাহরুর।চার জনের পরই তার সিরিয়াল।মল্লিকার হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে।

“সমস্যা বলেন”

পনেরো মিনিট অপেক্ষার পর ডাক্তার তাড়াহুড়োয় প্রশ্ন ছুড়লেন।দেখে বোঝা গেলো তাড়া আছে তার।যতই হোক ঈদের দিন।পরিবারের টান আছে নিশ্চয়ই।

“স্যার আমার স্ত্রী মল্লিকা।বমি হচ্ছে, ঘার ব্যথা।কোনো খাবারের ঘ্রাণ সহ্য করতে পারছে না।খেতেও পারছে না।”

ডাক্তার প্রশ্ন করলেন, “জ্বর আছে?”

এবারে মল্লিকা বলে উঠলো, “জ্বি না জ্বর নেই।তবে ভেতরে অনেক অস্থির লাগছে।বমি বমি ভাব।আর দুর্বলও লাগছে।”

“আসুন প্রেশার মাপবো।”

ডাক্তার প্রেশার মাপলেন,হার্ট রেট, পালস রেট,ওজন সবই চেক করলেন।সরাসরি প্রশ্ন করে বসলেন, “এই মান্থে পিরিয়ড হয়েছে?”

পুরুষ ডাক্তারের কাছে এমন প্রশ্নে মাথা নুয়ে ফেলে মল্লিকা। আড়ষ্ট হলো লজ্জায়।গ্রামের মেয়ে সে।সেখানে এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা চলতো না।লুকিয়ে বেড়াতো সবার কাছে।সেই স্বভাবটা রয়ে গেছে।পাশাপাশি মস্তিষ্কে আরো একটা চিন্তা চেপে বসলো।এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আগেও গিয়েছে।

“বলুন? পিরিয়ড হয়েছে?”

মাহরুর আশ্বাস দেয়।মল্লিকা নতজানু হয়েই বলল, “এই মাসে এখনও হয়নি।”

“প্রেগনেন্সি টেস্ট দিচ্ছি।করিয়ে জানাবেন আমায়।আমি রাতে আবার বসবো। আশা করি ততক্ষনে রিপোর্ট পেয়ে যাবেন।”

ডাক্তারের কথা শুনেই পিত্তি জ্বলে উঠেছিল।মিষ্টি জন্মের আগেও ঠিক এই কথাটাই জানতে চেয়েছিল ডাক্তার।যা সন্দেহ করলো তাই। মাহরুর এর কি প্রতিক্রিয়া সেটা দেখার সুযোগই মিললো না।মল্লিকা নিজের চিন্তায় মগ্ন।

বেরিয়ে এসে টেস্ট করিয়েছে।আপাদত মাহরুর চুপচাপ আছে।শুধু কাউন্টারে কথা বলেছে টেস্ট করানোর জন্য। একটু পরপর মাথা চুলকাচ্ছে দাড়িয়ে দাড়িয়ে।এদিক ওদিক চাইছে তোতা পাখির মতন।এখনও তার মস্তিষ্ক হয়তো ধারণ করতে অক্ষম।

মল্লিকাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে মাহরুর মুখ খুললো।জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলো, “এমন হয়ে আছিস কেনো?”

মাহরুরের আওয়াজে চোখ তুলে। চট জলদি বলে ফেলে, “ডাক্তার শুধু সন্দেহ করছে।আমি জানি এমন কিছুই না। মিস্টির সময় আমার বমি হয়নি,খারাপ লাগেনি। সব খাবার খেতে পেরেছি আমি।”

মাহরুর আবার মাথায় হাত ফেরায়।মল্লিকা তার ব্যাপারে নতুন কিছু অনুধাবন করতে পারলো।কোনো বিষয়ে মাথা কাজ না করলেই এমন করে মাহরুর।

সময় নিয়ে বললো, “সব ক্ষেত্রে অবস্থা এক হয়না।বাড়ি চল।খাবার খাবি।”

“আমি খেতে পারবো না।”

“পারবি।ডাক্তার বমির ঔষধ দিয়েছে।”

দুপুর গড়িয়ে বিকেল।খাবার খেয়েছে মল্লিকা।তবে অল্প।শুয়ে আছে কাথা মুড়ি দিয়ে।পাশেই অর্ধ শোয়া মাহরুর।ডান হাতের একটা নখ বোধহয় অবশিষ্ট নেই। কামড়ে কামড়ে শেষ করে ফেলছে!মল্লিকা দু চারবার প্রশ্ন করলে একই উত্তর দেয় ‘ কিছুই হয়নি তার ‘।দেহে শক্তি নেই সাথে মুখেও।আর প্রশ্ন করলো না মল্লিকা।

____

রেদোয়ান আর শিরীন এসেছে।সাথে তার দুই ছেলে মেয়েও।মিষ্টি এত সময় অব্দি রহিম চাচার ঘরেই ছিলো। সুমাইয়া আর সায়মনের নাম শুনে এক দৌড়ে ফিরে আসে ঘরে।কোরবানির গোস্ত ফ্রিজে রেখে শিরীন মল্লিকার কপালে হাত রাখলো।

বললো, “কেমন লাগছে এখন?শুনলাম তোর শরীর ভালো না।”

সর্বাঙ্গে জোর খাটিয়ে উঠে বসলো মল্লিকা।বললো, “এখন একটু ভালো আছি বুবু।”

“ডাক্তার কি বললো?” শিরীন জানতে চায়।

মল্লিকা এদিক ওদিক চায়।নাহ!রেদোয়ান মাহরুর কেউ নেই এখানে। মেনিমুখো হয়ে উত্তর দিলো, “টেস্ট দিয়েছে বুবু।সন্দেহ করছে আমি আবার মা হতে চলেছি।কিন্তু আমার কি মনে হয় জানো এটা ভুল।আমি একবার মা হয়েছি।গতবারের সাথে কোনো লক্ষণ মিলছে না।”

‘আমি আবার মা হতে চলেছি’ শিরীনের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট ছিল।আগে পরে মল্লিকা কি বলেছে না বলেছে তাতে কিচ্ছুটি আসে যায় না। ডাক্তাররা চতুর হয়।মানুষের অর্ধেক অবস্থা মুখ দেখেই বলে ফেলে।মনে মনে নিজেকে আশ্বাস দিলো এবার ভাইয়ের ঘরে আসছে নতুন কেউ।মন বলছে তার।

মল্লিকাকে বললো, “শোন সবসময় এক লক্ষণ থাকে না।আমার দুই সন্তান।দুইজনের সময় দু রকম অনুভুতি হচ্ছিল।”

“কিন্তু বুবু?” ফ্যালফ্যাল নয়নে চাইলো মল্লিকা।

“তুই খুশি না?মাহি ভাই খুশি না?”

“এখনওতো পুরোপুরি যাচাই হয়নি।তাছারাও আমি ওনার মনোভাবটা বুঝতে পারছি না বুবু। অদ্ভুত আচরণ করছেন।মাথা চুলকয়। নখ কাটে।আবার অযথাই ছাদ থেকে ঘর, ঘর থেকে ছাদ হেঁটে বেড়াচ্ছে।”

মুখ চেপে হাসলো শিরীন।মল্লিকার কথার ধরন হাস্যকর। মাহরুরের আজগুবি চালচলনে হতচেতন সে।স্বামীর মন বুঝে উঠতে পারল না মেয়েটি।

বললো, “আমার কি মনে হয় জানিস?”

“কি বুবু?”

“ভাই আমার পাগল হয়ে গেছে” বলেই শব্দ করেই হাসলো শিরীন।

রিপোর্ট আনতে মাহরুরই গিয়েছে।একা।মল্লিকা আর শিরীন দূরের কথা রেদোয়ানকেও সাথে নেয়নি।বুক ফুলিয়ে গম্ভীর গলায় বলে গিয়েছে সে একা যেতে পারবে।শিরীনের মতে যাক!যেতে পারলে।রিপোর্ট শিরীনের মন মোতাবেক হলে যেই শক্তপোক্ত দেহ নিয়ে যাচ্ছে সেটা নিয়ে ফিরতে পারবে কিনা কে জানে?তাই ভেবে হাসলো শিরীন।

একাকী শিরীনকে হাসতে দেখে রেদোয়ান বললো, “কতবার বলেছি একটা ওঝা ডাকি। তোমার লক্ষণ আমার ভালো ঠেকছে না।”

চোখ রাঙিয়ে শিরীন বললো, “কি করেছি আমি?”

“একা একা পেত্নীদের মতন হাসছো কেনো?”

“কারণ জীবনে প্রথম বারের মতন ফুপ্পি হবো মন বলছে।আর তুমি ফুপা।সাথে খালা আর খালুও।” হাই ভোল্টেজ এর হাসি দিয়ে বললো শিরীন।

“এটা কখন হলো?”

রেদোয়ান এর প্রশ্নের ধরন দেখে অবাক না হয়ে পারলো না শিরীন। অদ্ভুত লোকতো!কখন হলো মানে কি?মুখের বিচিত্র ভঙ্গি আর কুচকানো কপালের মধ্যভাগ নিয়ে তাকিয়ে রইলো রেদোয়ান এর দিকে।ভাবছে এই লোকের সাথে কি করে তার বিয়ে হয়ে গেলো?

মাহরুর ফিরেছে ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে।সবাই গোল হয়ে বসে তার মুখের দিকে চেয়ে।বড়দের দেখাদেখি বাচ্চারাও। মাহরুরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।চোখ এড়াচ্ছে সবার।

এক পর্যায়ে তাদের দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে বলে উঠলো, “কি সমস্যা তোদের?”

শিরীন বলে, “ডাক্তার কি বললো?”

পরপর রেদোয়ান প্রশ্ন ছুঁড়ে, “রিপোর্টে কি এসেছে।”

মাহরুর ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয়, “ডাক্তার ওষুধের নাম বলেছে আর ওষুধ দিয়েছে।”

শিরীন আবার জেরা করে, “তোমার ঘরে নতুন কেউ আসছে কিনা সেটা বলো?”

কপালের ঘাম মুছে মাহরুর। আবার চুলে হাত ফেরাতে লাগলো।মল্লিকা বলে উঠলো, “দেখেছো বুবু?”

শিরীন তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছুঁড়ে বলে, “দেখেছি। দেখছি!”

পূনরায় মাহরুরের দিকে একই প্রশ্ন করলো, “কেউ আসছে কি?”

থমথমে গলায় মাহরুর উত্তর দেয়, “হ্যা”

একেক জনের একেক প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো কয়েক মিলি সেকেন্ডে।কথাটি কর্ণপাত হওয়ার সাথে সাথে মল্লিকা রসগোল্লার ন্যায় চায়।শিরীন তালি বাজিয়ে দুহাত একত্রে মুঠ করে আছে।রেদোয়ান এর ঠোঁট জুড়ে বিশাল হাসি।বোকাসোকা বাচ্চারা শুধু কিছুই বুঝলো না।
তবে বুঝলো রেদোয়ান।এখন সময় তাদের দুজনকে একাকীত্বে ছেড়ে দেওয়ার।নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করবে না?এই নতুনত্ব।সম্পর্কের নবপ্রবর্তিত রূপ। প্রস্থান করলো বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে। মাহরুর মল্লিকার দিকে চায়।আবারো সেই আগেকার রূপ?চোখ নামিয়ে রাখলে কি ভালো লাগে?

মুখে কথা ফুটে অনেক সময় বাদে। মাহরুরই আগ বাড়িয়ে বলে,

“আগেও এমন সময় পাড় করেছেন তাই না?”

“হুম”

“তাহলে অধমের মতন বসে ছিলেন কেনো?যেনো প্রথমবার মা হচ্ছেন?যেনো কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।”

ফটাফট নেত্রযুগল তুলে ধরলো মাহরুরের পানে।এগিয়ে এসে মাহরুরের হস্ত নিজের দুহাতে নিয়ে বললো,

“আপনি খুশি না তাই না?”

তোয়াক্কাবিহীন মাহরুর মল্লিকার এই প্রশ্নে।নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন রেখে বললো,

“দ্বিতীয়বারে অনীহা হয় কি করে? ডাক্তার কি বলেছে জানিস? অতিরিক্ত দুর্বল তুই।”

আঁধার ঘনিয়ে আসা মুখটা চন্দ্রের।ঠোঁটজোড়া কাপছে।নিজের কম্পনকে সঙ্গে রেখেই বলতে লাগলো,

“আগের বারও বুঝিনি। তিনমাস পর জানতে পেরেছি।তাও হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায়। মিষ্টির জন্মের সময় আমার স্বাস্থ্য ভালো ছিলো।বমি হতো না, বিচলিত অনুভব করতাম না। স্বাভাবিক ছিল তখন।”

মাহরুর এই উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলো।এমন কিছুই আশাবাদী ছিলো সে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে। দৃষ্টি গাঢ় করে বলে,

“সেই সময় রমজান চাচা একটা সুন্দর চাঁদকে তুলে দিয়েছিল। যার মধ্যে না ছিলো কোনো কলঙ্গ না কোনো ত্রুটি।ছিলো একটা উদাসী মন।তাই হয়তো অনুভব করিস নি”

“এখন কেনো অনুভব করছি এই দুর্বলতা?”

“কারণ মিষ্টির অনাগত ভাই অথবা বোন আমাদের একে ওপরের প্রতি দূর্বলতার প্রতীক।”

মাহরুর মল্লিকার হাত টেনে নেয়।মুঠ করে থাকা হাত ছাড়িয়ে নিলো।প্রথমে ডানহাত পরবর্তীতে বাম হাত। রেখা মেলাচ্ছে।হাতের তালুর এলোপাথাড়ি রেখাগুলো খুবই মনোনিবেশ করে দেখে নিচ্ছে।

মল্লিকা জানতে চাইলো, “কি দেখছেন?”

ভাবুক ভঙ্গি আর কন্ঠস্বর টেনে মাহরুর বললো, “পড়ালেখার রেখা তোর হাতে নেইরে। রাশিতে শনির দশা।সামনের বছরের মাঝামাঝি একজন আসবে।এরপরের বছরের মাঝামাঝি আরেকজন আসবে।তারপর আরেকজন।এভাবে তোর পড়ালেখা করার প্ল্যান ভেস্তে গেল।বাদ দে তুই অশিক্ষিতই থাক।”

হতবিহ্বল মল্লিকা।এই সময়তো তার অনুভূতি প্রকাশ করার কথা।প্রথম বাবা হচ্ছে।কি তার মনের হাল? তা না।সে তার আজগুবি কথার ঝুড়ি খুলেছে।

“আমার চোখে চোখ রেখে বলেন।আপনি খুশি?”

অকপটে চোখে চোখ রাখে মাহরুর।বললো, “খুশি আমি?”

“ধাঁধায় ফেলছেন”

“তোকে আমি অনেক জ্বালাবো চন্দ্র।”

কথার ধাঁধায় পড়ে বিরক্ত হয় মল্লিকা।কপাল কুঁচকে বলে, ” উফ!”

“আমি যখন বাড়ি থেকে বেরোলাম তখনই ডাক্তার আর রিপোর্ট দুটোই পেয়েছি।জেনেছি তুই মাত্র আড়াই সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা।ওই ছোট্ট জানটা আমার আর তোর অংশ?একটু একটু করে বেড়ে উঠবে।মিষ্টির খেলার সাথী আসবে।আমি স্তব্ধ ছিলাম।শূন্য লাগছে নিজেকে।হলো কি?ভাবতে পারছি না কিছু।এখন মনে হচ্ছে আমার ভেতরে সব গুলিয়ে আসছে।আমার প্রেমে পড়ে একবার কি বলেছিলি মনে আছে?মনের মধ্যে প্রজাপতি উড়ে কিনা জানতে চেয়েছিলি?আমার মনে উড়ছে।মনে, পেটে,মস্তিষ্কে সবখানে প্রজাপতি উড়ছে।”

লজ্জা সরম ধুয়োয় উড়িয়ে দিল চন্দ্রমল্লিকা। চারিপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করলো না। চট করে মাহরুরের কপালের চুল সরিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় মধ্যিখানে। কাছে এসে শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে পড়ল মাহরুরের বক্ষে। এরসময় খেয়ালহীন থাকলেও মিষ্টি এই বিষয় লক্ষ করেছে।হিংসে হলো তার।কেনো মা তার মাহি বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছে।অন্যপাশে এসে তাদের মধ্যিখানে ঢুকে বসে।

হিংসুটে গলায় বললো, “আমার মাহি বাবাকে ছাড়ো মা।”

ছাড়লো না মল্লিকা।ছাড়বে না। পূর্ন অধিকার আছে।মা মেয়ের মাঝে ফেঁসে আছে মাহরুর।মল্লিকাকে ধাক্কা দিচ্ছে মিষ্টি। আলগোছে মাহরুর তাদের মধ্যিখানে জায়গা করলো মিষ্টির জন্য।চোখের আড়ালে এক বলিষ্ঠ হাত শাড়ির অচল ভেদ করে মসৃণ পেটে হাত রেখেছে।
মিষ্টির মাথায় মাথা ঠেকায়।
প্রশান্তির চোখ বুজে বললো,

“এখানে আমরা চারজন।আজ থেকে আমরা চারজন”

চলবে…গল্পের

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৩৪

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৩৪
লেখা : Azyah_সূচনা

মাহরুর ঘোরে আচ্ছন্ন।জ্বলজ্বল করছে তার সম্মুখে মল্লিকা নয়নের মণি। ফুলে থাকা অধর আকৃষ্ট করছে।নিজের অজান্তেই এগিয়ে গেলো।কোমরে পেঁচিয়ে নিজের কাছাকাছি এনেছে অনেকটা। ত্বকে ধারালো নখের আঁচড় লাগতেই কেপে উঠলো মল্লিকা। মাহরুর ওষ্ঠের কাছাকাছি এসে চোখ বুজলেই দ্রুত গতিতে নড়চড় শুরু করলো। তৎক্ষনাৎ চোখে খুলে মাহরুর।

বলে, “কি সমস্যা তোর? স্থির থাকতে পারিস না?”

মল্লিকা দ্রুত মাথা ডানে বামে দোলায়।তড়িৎ গতিতে বললো,
“আর করবো না”

নিজেকে সংযত করে।বুক ভর্তি সাহস জুগিয়ে মাহরুরকে জরিয়ে ধরে।ভালোবাসা চেয়েছে সে।নিজ থেকে সামান্য কাছে এসে ভালোবাসার প্রকাশ করতে চাইছে।যেনো মাহরুর শান্ত হয়।রেগে না যায়।শার্ট জাপ্টে ধরে মুখ লুকায় বুকে।

সময়ের ব্যবধানে অধীরতা বেড়ে উঠছে তার ব্যাপকমাত্রায়। মল্লিকাকে শূন্য, বোধহীন করে তুলতে লাগলো। উন্মাদনা সমস্ত উজাড় করতে শুরু করেছে মল্লিকার কণ্ঠদেশে। অসহিষ্ণু মাহরুর। জ্ঞানশূন্য চন্দ্রমল্লিকা।এই স্পর্শে ভিন্ন রকমের ভালোবাসা আছে।যা বারবার মল্লিকাকে প্রশ্নবিত্ব করে।আসলেই এতটা ভালোবাসা পেয়েছে সে?কোনো স্বপ্ন নয়তো?যে মানুষটিকে ভুলেভালে চেয়েছিলো।সে আজ তার কাছে এতটা ব্যাকুল।মাহরুর আরো অধৈর্য হয়।এক নতুন প্রণয়ের বাঁধনে বাঁধা পড়ে যায় দু মানব মানবী।নিজেদের মধ্যকার ভালোবাসার ঝড় শান্ত হয় শুদ্ধ স্পর্শে। এ ছোঁয়া পবিত্র,সচ্ছ।ভালোবাসায় ভরপুর। অনুভূতির এক বিশাল সাগর।অতলে ভেসে বেড়ানো দুজন।অদৃশ্য বাঁধা কাটিয়ে বিলীন হয়েছে মাহরুরের মধ্যে।প্রেম কয়ে বলে আসেনি।অনুভব করেছে,হারিয়েছে আবার পূনরায় পেয়েছে।এই পাওয়ার স্বাদ ভিন্ন।এক বিশাল সময়ের রোষাবেশ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম।

প্রভাতের প্রারম্ভিক অংশে,

“আপনি আমাদের যত্ন নেন কিন্তু নিজের যত্নটাই নেন না।চুলের কি অবস্থা দেখেছেন?”

ঘুমন্ত মাহরুরের চুলে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে বিড়বিড় করছে মল্লিকা। প্রেয়সীর উষ্ণতা ছেড়ে ঘুমিয়েছে ঘন্টাখানেক হলো।উপুড় হয়ে শুয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে বারেবারে।মল্লিকা জেগে। সম্পূর্ণ ঘর দ্রুত উঠেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেছে। নিদ্রায় বিভোর মাহরুরের পাশে বসে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগে। চুলগুলো একদম রুক্ষ।কিছু কিছু চুলে পাক ধরেছে।মুখটাও তেমনি মলিন অযত্নে।

“আমি কত স্বার্থপর না মাহরুর ভাই?শুধু এক তরফা ভালোবাসা নিয়ে যাচ্ছি। আপনার দিকে নজর দেওয়ার সময় আজ হলো।অনেক খারাপ আপনার চন্দ্র।”

সামান্য উঠে মল্লিকার কোলে মাথা রাখলো মাহরুর।তার এরূপ জেগে থাকা একদম আশা করেনি মল্লিকা। কোমড় পেচিয়ে আবার ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে যেনো।

ঘুমমিশ্রিত গলায় মাহরুর বলে উঠে, “উহু”

“আপনি জেগে আছেন?”

মাহরুর মাথা দোলায়। হ্যা সূচক উত্তর দেয়। পুরোপুরি জেগে না থাকলেও মল্লিকার প্রত্যেকটা কথা এসে কানে বারি খেয়েছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রইল মল্লিকা। শক্ত মনস্থির করে।লজ্জা কাটিয়ে সর্বোচ্চ যত্ন দরকার এই লোকের।

এরই মাঝে মাহরুর আবার বিড়বিড় করে।বলে, “চুল টেনে দে।”

চুলের গভীরে পূনরায় হাত ডুবিয়ে মল্লিকা বলে উঠে, “একদম রুক্ষ হয়ে গেছে চুলগুলো।আগে কত সুন্দর ছিলো।যত্ন নেন না তাই না?”

আড়মোড়া দিয়ে মাহরুর নিষ্প্রতিভ ধ্বনিতে বললো, “তোর.. শোকে মূহ্যমান হয়ে গিয়েছিল চুলগুলোও ”

নম্র হাস্য ঠোঁট জুড়ে এসেছে।বলে ফেললো, “আমিতো এখন কাছেই আছি।তাহলে অযত্ন কেনো?”

মাহরুর মাথা তুলে মল্লিকার দিকে নিভু নিভু নেত্রে চায়। লালাভ বর্ণ ধারণকৃত চক্ষু মল্লিকাকে নির্জিত করে।ভয় পাবে না,লজ্জা পাবে না এই অভিপ্রায় মুহুর্তেই পালালো দৌড়ে।শেষ রজনীর কথা পুনরাহ্বান হতেই লাজে রাঙে আনন। ভিন্নপাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই মাহরুর বলে,

“এমন একটা বউ এনেছি যেকিনা সারাদিন ভয় পায়,লজ্জা পায়।সে আমার যত্ন করে না।সে একজন লোভী মহিলা।শুধু ভালোবাসা নেয়।দেয় না।তাই আমার এই অবস্থা।যাকে এনেছি আমাকে আদর যত্ন করে ভালো রাখার জন্য সেতো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায়।”

“এভাবে বলেন কেনো?আমি করবোতো যত্ন।”

“দেখবো”

“দেখিয়েন”

মল্লিকার ফুলবানুর মতন ফুলে থাকা গাল দুহাতে চেপে নিজের দিকে টেনে আনে।হালকা গোলাপি আভায় রাঙানো অধর ছুঁয়ে মাহরুর বলে,

“তোর গাঢ় নিঃশ্বাস এখনও আমার সমস্ত দেহে লেপ্টে আছে চন্দ্র।আমাকে স্বর্গীয় সস্তি দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।এমনেতেই বশ করে আছিস আমাকে।এখনতো আরো কাবু হয়ে গেলাম।তুই আমার একটা প্রিয় ফুল চন্দ্রমল্লিকা।”

মাহরুরের কথার বিনিময়ে ভাব প্রকাশের আর কি আছে?এক লাজুক হাসি ছাড়া?পলক নামিয়ে পাঁপড়ির আড়ালে লুকিয়ে ফেলা সাদার মধ্যেকার অংশে কালো মণিটা?বুকে দোলা দিতে আর কিছু প্রয়োজন আছে?হাসিতে প্রসারিত হওয়া ওষ্ঠধর বেকাবু করে প্রেমিক পুরুষ এর চক্ষুকে।

ডেকে বলে, “ও চন্দ্র?এভাবে হাসলে বুকে লাগে তো”

__

শিরীন আর রেদোয়ান এর মিটিমিটি হাসিতে চরম বিরক্ত মাহরুর।শান্তিমত সকালের নাস্তা করতে দিচ্ছে না।মাত্র এক টুকরো রুটি মুখে দিয়েছে তাদের এরকম তেরছা দৃষ্টিতে সেটাও গলা দিয়ে নামছে না।হাজার হোক আপন ছোটো বোন।ছোট! কাল যে কাজটা করেছে সেটায় মাহরুর মনে মনে অত্যন্ত খুশি হলেও শিরীনের এমন লজ্জা দেওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলো না।মল্লিকা শক্ত স্তম্ভের মতন বসে।পাখির মতন কুটুরকুটুর করে খাচ্ছে।সামনে ঝুঁকে থাকা চুলগুলোর বিরক্তিতে হাঁসফাঁস করছে।কানের পেছনে নিতে নিতে হয়রান।

মাহরুর এক পর্যায়ে বলে উঠে, “এই তোর চুল বাঁধ”

চোখ প্রসারিত করে তাকায় মল্লিকা।একজনের রাগ অন্যজনের উপর কেনো? মাহরুরের গলার ঝাঁঝ দেখে রেদোয়ান দমে গেলেও আজন্ম ঘাড়ত্যাড়া শিরীন তার কার্যে অটল।হাসি যেনো মুখ ছাড়ছে না।
সীমা অতিক্রম হলে মাহরুরের হাতে থাকা রুটির টুকরো প্লেটে রাখে জোরালো গতিতে।

শিরীনকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“চড় খাবি?”

শিরীনও বিদ্যুতের গতিতে উত্তর দেয়, “ওমা কেন?”

“মুখের অঙ্গিভঙ্গি এমন কেনো?চোখ নামিয়ে খা।হাসতে দেখলে দাঁতের পাটি তুলে ফেলবো।”

শিরীন মুখ ভেংচে উত্তর দেয়, “ঢং!আমরা যেনো কিছু বুঝি না।”

“আবার কথা বলিস!লজ্জা শরম কিছু আছে তোর?চুপচাপ খা।”

মুখ তালাবদ্ধ করে রাঙ্গামাটি শহরের তবলছড়ি থেকে সি এন জি করে ঝুলন্ত ব্রিজের দিকে রওনা হয় তারা।মিষ্টি মাহরুর আর মল্লিকা এক সি এন জিতে আর শিরীন,রেদোয়ান এবং তার ছেলে মেয়ে অন্যটায়। সাই সাই বাতাসের ঝাপটা এসে পড়ছে ছোট্ট মিষ্টির মুখে।দ্রুত নিজের ছোট্ট দুহাতে মুখ চেপে ধরলো। সি এন জি এর দ্রুতগতিতে মাহরুরের কোলে বসে বলতে লাগলো,

“মাহি বাবা?”

“হ্যাঁ মা?” দ্রুত গলায় জানতে চাইলো।কি বলতে চায় মিষ্টি?

“আংকেলকে বলো আস্তে যেতে।আমি বাতাসে উড়ে যাবো একদম”

হালকা শব্দ করে হাসে মাহরুর।সাথে মল্লিকাও।ছোট মেয়েটি বাতাসের জোরে উড়ে যাওয়ার ভয়ে আছে। মাহরুর সি এন জি চালককে বললো গতি সামান্য কমাতে।অন্যদিকে মল্লিকা শাড়ির আঁচলে আগলে নেয়।নাক মুখের উপর হালকা কাপড় নিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করলো মেয়েকে সাবধানে রাখার। মাহরুর একহাতে মিষ্টিকে অন্যদিকে মল্লিকার বাহু চেপে।মিষ্টির জন্য সামান্য বেঁকে বসলো। বাবা মায়ের দুপাশের প্রাচীরে নিরাপদ মিষ্টি।

মল্লিকা জানতে চেয়ে বললো, “এখন ভয় হচ্ছে তোর মিষ্টি?”

“না মা”

ঝুঁকে মিষ্টির গালে চুমু খেয়ে মল্লিকা আবার বলে, “আমরা কোথায় যাচ্ছি জানিস?”

“কোথায় মা?”

“ঝুলন্ত ব্রিজ।অনেক সুন্দর জায়গা।”

“ওখানে বাঘ আছে মা?”

মিষ্টির অদ্ভুত প্রশ্নে আরেকদফা হাসি উঠে মল্লিকা মাহরুরের ঠোঁটে।মল্লিকা বলে, “না এখানে বাঘ থাকে না।থাকলেও তোর মাহি বাবা বাঘকে মেরে তাড়িয়ে দিবে।”

মিষ্টি মাহরুরের দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলো, “তাই মাহি বাবা?”

মিষ্টির উৎসুক প্রশ্নের সাথে তাল মিলিয়ে মাহরুর বলে উঠে, “হ্যা অবশ্যই।মাহি বাবা থাকতে বাঘ মিষ্টিকে একদম কিছু করতে পারবে না।”

এইটুকু মেয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে।সস্তি পেলো বোধহয়।মনে মনে ধরে নিয়েছে এখন আর বাঘ তাকে কিছু করতে পারবে না।মাথা এলিয়ে দিলো মাহরুর মল্লিকার একত্রিত বাহুতে।মাথা দোলায় লাগলো আনমনে।ঘুরতে আসার আনন্দ মুখে ঝলকাচ্ছে।

সেই সুযোগে মাহরুর মল্লিকার কানের কাছে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “মিষ্টিকে চুমু দিলি মিষ্টির বাবাকে দিবি না?”

মাহরুরের কথায় মল্লিকা চোখ বড় করে চেয়ে বলে, “কিসব বলছেন আজেবাজে?”

“কি বলছি আবার?”

“চুপ থাকুন”

“গতরাতে স্বেচ্ছায় হাজার শত চুমু খেয়েছিস।তখন কি আমি বলেছিলাম চুপ থাকতে?”

কান গরম হয়ে আসলো মল্লিকার।এসব অসভ্য কথাবার্তা মাহরুর বলে আসছে বিগত রাত থেকে।মাথা খারাপ হয়েছে তার।মল্লিকা কান চেপে বললো,

“দোহাই লাগে চুপ থাকুন।সাথে মিষ্টি আছে।সামনে সি এন জি চালক।শুনে ফেললে মান সম্মান কিছুই থাকবে না।”

লুকিং গ্লাসে সি এন জি চালকের দৃষ্টি কোথায় সেটা পর্যবেক্ষণ করে নেয় মাহরুর।আরো কাছাকাছি এসে কানেকানে বললো, “তোর কি মনে হয় সি.এন.জি চালক তার বউকে চুমু খায় না?সবাই তোর মতন চন্দ্র? ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে ওনার তিন চারটে বাচ্চাকাচ্চা হবে”

দাঁতে দাঁত চেপে মল্লিকা এবার খানিক ধমকের সুরেই বলে উঠলো, “মাহরুর ভাই!”

মাহরুর ঝড়ের গতিতে মুখ সরায়।ভাই ডাকটা কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতন পড়ে প্রতিবার।বারবার।বাহিরে হাওয়া বাতাস দেখতে দেখতে বলতে লাগলো,

“তোরা নারীরা যেমন পুরুষকে বশ করতে জানিস তেমনি এক মুহূর্তে মেজাজ নষ্ট করতেও জানিস।”

ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে এসে বাজলো বিপত্তি।মা মেয়ে বেঁকে বসেছে।যাবে না এই ব্রিজে।দেখেই নাকি তাদের ভয়ে হাত পা কাঁপুনি দিচ্ছে। মাহরুর কখনও মিষ্টিকে,কখনো মল্লিকাকে বোঝানোর চেষ্টায়।প্রথমবার দুচোখ এমন কিছু দেখে যত আপ্লুত তার চেয়ে বেশি শঙ্কিত।নড়চড় করতে থাকা ব্রিজ তাদের ভয়ের মুখ্য কারণ।অন্যান্য সময়ের চেয়ে এই সময়টায় পানি অনেকটা উচুতে।প্রায় ব্রিজ ছুঁই ছুঁই।

এক পর্যায়ে এসে মাহরুর রেগে গিয়ে বললো, “এবার কিন্তু দুটোকে তুলে নিয়ে যাবো!”

“আমি যাবো না মাহরুর ভাই!” মল্লিকা কাতর গলায় বললো।

চোয়াল শক্ত করে মাহরুর বলে, “তোর ভাইয়ের….!”

বাকি কথা পূর্ন করার জন্য এখানকার জায়গা ছোট। আত্মসম্মানের ভয় আছে।শক্ত করে মল্লিকার হাত চেপে ধরে।রেদোয়ান কে আদেশ করলো,

“রেদোয়ান ছোটটাকে নিয়ে যাও।আমি বড়টাকে শায়েস্তা করে আনছি।”

রেদোয়ান চট জলদি মিষ্টিকে ঘাড়ে চড়িয়ে নেয়।বুঝ দিতে থাকে ফুপার কাধে থাকলে তাকে পানি ছুঁতে পারবে না।অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করার পরও রেদোয়ান এগিয়ে গেলো ব্রিজের দিকে।

মাহরুর মল্লিকাকে টানতে টানতে বললো, “তুইও ঘাড়ে চড়বি?”

“না না আসছি।”

“ভীতু মহিলা”

“মহিলা বলবেন না আমাকে।আপনি কিন্তু আমার চেয়ে বয়সে বড়।আমি মহিলা হলে আপনি…”

“কি আমি?আমি পুরুষ! পুরুষ শব্দে আমার কোনো সমস্যা নেই।”

“আপনি বুড়ো”

“বুলি ফুটেছে না?আজও আমি মিষ্টিকে রেদোয়ানদের ঘরে রাখবো।তারপর দেখিস তুই”

অকস্মাৎ মল্লিকার রূপ বদল।বেশি সোহাগে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ভীতু আশয় পাল্টে জেদীতা দেখানো শুরু করে দিলো?এর চেয়েতো দূরেই ভালো ছিলো?ভয় দেখালে ভয় পেত।এখন তর্কে নামছে।কিছু সময় পর নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে।মেয়ে জাতি ভীষণই অদ্ভুত মাহরুরের মতে।একটু সুযোগ পেলেই ভেজা বেড়াল থেকে বাঘিনী হতে বিন্দুকায় সময় নেয়না। স্বাভাবিক হলেও জ্বালা,লজ্জায় দূরে থাকলেও বিপদ। মাহরুর ভেবে নেয় আজ এই মল্লিকাকে এই পানিতে ভাসিয়ে জীবনভর চিন্দ্রবিলাস এর পরিবর্তে দুঃখ বিলাস করবে। সামনেতো ভারী বিপদ ঘনাচ্ছে!

এক নারীর ব্যবস্থা করে অন্য নারীর অবস্থা দেখে মাহরুর কপাল থাপ্রায়।রেদোয়ান হাঁপিয়ে উঠেছে শিরীন আর তার বাচ্চা ছানাদের ছবি তুলে দিয়ে।সুযোগ হয়নি তার সেই ছবিটা নিজেকে আনার।স্বামী আর বাবা হওয়া সত্বেও।

ঘামে ভেজা রেদোয়ানকে দেখে মায়া হলো।মাথা দুলিয়ে মাহরুর বলে উঠলো, “সব পাগল!সব পাগল! বাপের জনমে প্রথম ঘুরতে এসেছে যেনো”

হাসি দিয়ে পোজ দিচ্ছিলো।শিরীনের মুখটা ত্যাড়া হয়ে গেলো।বললো,

“সকালে তোমাকে আর তোমার বউকে দেখে হেসেছি বলে ক্ষেপে আছো তুমি না?স্বল্প বয়সী প্রেমিক প্রেমিকার মতন একে অপরের সাথে চিপকে থাকলে দোষ নেই।আমরা একটু দুষ্টুমি করলেই যত দোষ”

“কিসের মধ্যে কি? পান্তা ভাতে ঘি!….তোর যত মনে চায় ছবি তোল।আমরা হোটেলে ফিরে যাচ্ছি।”

“হ্যাঁ যাও যাও।আমি চন্দ্র নই বুঝলে।তোমার কথায় উঠবো বসবো।”

“ঝগড়াটে কোথাকার!”

মল্লিকা আজ বোকার মতোন তাকিয়ে নেই।মুখে হাত চেপে হাসছে।ভাই বোনের ঝগড়া অনেক অনেক বছর পর দেখা মিললো। এমনও সময় গিয়েছে অতীতে মল্লিকাকে মধ্যিখানে বসিয়ে দুজন অহেতুক কারণে চুলোচুলি করেছে।ছোট থেকে ভালোবাসা থাকলেও ছোটোখাটো বিষয়ে তাদের তর্ক গড়ায় বহুদূর।দুজন মারামারি করে চাচীর হাতে উত্তম মধ্যমও খাওয়া থেকে রেহাই পায়নি।

রেদোয়ানও পিছু নিচ্ছিলো মাহরুরের।শিরীন বাজখাই গলায় ডাকলো।বললো, “তুমি আমার জামাই নাকি মাহি ভাইয়ের?এক সেকেন্ডে ফিরে এসো।আমার ঘুরা শেষ হয়নি।”

রেদোয়ান মুখ বেঁকিয়ে তুচ্ছ হাসে।রেদোয়ানকে বললো, “পুলিশ হয়েও কোনো লাভ হলো না।বউকে কন্ট্রোল করা আমার থেকে শিখো।”

শিরীন আবার চেঁচায় উচ্চ আওয়াজে।বলে, “আসবে না তুমি?”

মাহরুর হাঁটছে।এবার মিষ্টি তার কোলে।প্রথমে যত ভয় করছিলো তার চেয়ে বেশি উপভোগ করেছে।লাফিয়ে বেরিয়েছে ঝুলন্ত ব্রিজ এর এদিক ওদিক।মল্লিকার ভয় সামান্য কাটলেও মনে অল্পস্বল্প শঙ্কা রয়েই গিয়েছিল।সেটাও উধাও হয়ে গেল শিরীন আর মাহরুরের ঝগড়া দেখে।ভীষণ মজা পেয়েছে এই দৃশ্যে।পুরোনো দিনের এক কথা মনে এসেছে।হেসে কুটিকুটি হতে দেখেই মাহরুর থামে।

বলে, “খুব মজা লাগছে?”

অন্য সময় মল্লিকার এই হাসিকে নিয়ে কাব্য রচনা করতো।এখন মাথাটা চড়ে আছে।রুক্ষ মুখে দাড়িয়ে।মল্লিকা হাসি থামিয়ে বললো,

“মনে আছে চাচী যে আপনাকে আর বুবুকে গাছের সাথে বেঁধে রেখেছিলো?”

বলেই অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লো মল্লিকা।ঠিক সেদিনের মতন হাসছে যেদিন লিজা বেগম এই দুঃসাহসিকতার দেখিয়েছিলেন।অযথা দুই ভাইবোন এর ঝগড়া হঠাৎ মারামারির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।দুজনকে থামাতে না পেরে আর তাদের প্রতিনিয়ত এই ঝগড়া দেখে তপ্ত গরমে খোলা আকাশের নিচে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন। ডাব গাছের দুইপ্রান্তে।সেদিনের পর থেকে একটু আধটু শিক্ষা হয় তাদের।তবে হাসির দায়ে মল্লিকা মাহরুরের আক্রমণের শিকার হয়। পিঠে কিল দিয়ে হাসির প্রতিশোধ নিয়েছিলো।

“খুব হাসি পাচ্ছে তাই না মিষ্টির মা?”

মল্লিকা আবার বললো, “আমাকে কিল দিয়েছিলেন আপনি”

“আজ তার চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু করি?”

“কি?”

“এই বিশাল জলরাশিতে ফেলে দেই?”

“আপনি খারাপ!”

“তোর মধ্যে শিরীনের আত্মা ভর করেছে আমি বুঝেছি।সমস্যা নেই মাহরুর নামের ওঝা সব জ্বীন ভূত আত্মা ছাড়িয়ে দেবে।চল”

___

“দুঃখ আমার, গেল সরে
স্বপ্ন সুখে, দিয়েছো ভরে
কতো আশার,ছোট্ট এই ঘরে
ভালোবাসার, শান্তি ঝরে
তুমি আশা ভালোবাসা..
রয়েছো হৃদয় জুড়ে…
জীবনের সঙ্গী তুমি…
কাছে রেখো মরণও পরে”

চন্দ্রে অভিমান জমেছে।কালো আধাঁরে ঢাকা সেই শুভ্র মুখ। অতশত ভালোবেসে আবার এত এত রুঢ় ব্যবহার করার কোনো মানে আছে। আজ কথা বলবে না।রাগ কি তার একারই আছে।চন্দ্রের রাগে মাহরুরের আকাশে আধার ঘনাবে।যা মাহরুরের গলায় গান শুনেও কমলো না।

মিষ্টি তালি দিচ্ছে মাহরুরের সুরালো আওয়াজ শুনে।বিছানায় অর্ধ শুয়ে জোরেজোরে গান গেয়ে শোনালো মল্লিকাকে।তাতে মল্লিকার কি?জানালার দ্বারে সিংহাসন গ্রহণ করেছে।

মাহরুর বললো মিষ্টিকে, “তোর মা হলো শাবানা।তার অনেক কষ্ট।আর আমি?আমি হলাম আলমগীর।”

“এরা কারা মাহি বাবা?”

“তুই চিনবি না আম্মা। শোন তোর মা’র মাথায় একটু সমস্যা আছে।দেখ চেয়ে কেমন মূর্তি হয়ে জানালার কাছে দাড়িয়ে আছে।আমরা যদি রাতে ভুত ভেবে ভয় পাই?”

মিষ্টি মল্লিকাকে ডাকলো।বললো, “ও মা আমরা ভয় পাবোতো”

মল্লিকা গলা উচিয়ে বললো, “পেতে থাক ভয়।”

মাহরুর আবারো রসিকতার ছলে বললো, “তোর মা আমাকে আর তোকে একটুও ভালোবাসে না।”

মিষ্টি এবার মায়ের পক্ষ হয়ে উত্তর দেয়, “ভালোবাসে,আদর করে।”

“উহু একদম আদর করে না।একদম না”

মিষ্টি অবুঝ। মাহরুরের কথার আড়ালে ধৃষ্টতা বোঝার মতন বয়স না তার। নিষ্পাপ বাচ্চা।বলে উঠলো আবার মায়ের উদ্দেশ্যে, “মা? ও মা?মাহি বাবাকে আদর দিয়ে যাও।”

নাক ফুলেফেঁপে উঠলো মল্লিকার।দ্রুত জেদী নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললো, “চুপ করে ঘুমো মিষ্টি।আসলে বকে দিবো।”

মিষ্টির গায়ে পাতলা কম্বল উড়িয়ে দিলো মাহরুর। লাইট নিভিয়ে দিলো মল্লিকাকে কোনো পাত্তা না দিয়েই।আরো একটু রাগিয়ে দিয়ে তাকে শুনিয়ে মাহরুর বললো,

“আয় আমরা ঘুমাই।তোর জন্য নতুন মা এনে দিবো।এই মা ভালো না।”

কাটকাট দাড়িয়ে কথাগুলো হজম করছে।নিজেকে শক্ত করছে।এই রাগের দৈর্ঘ্য অন্তত দুইদিন।এর আগে মাহরুরের সাথে কথা বলবে না।তাকাবে না অব্দি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে কোমরের বারোটা বেজে যাচ্ছে।বসার সুযোগ আছে।তবে বসবে না। মাহরুর আচ পেলেই কথা শুনাতে পিছুপা হবে না একফোঁটা।রাগলে কায়েম রেখে ঠায় দাড়িয়ে রইলো।

ঘাড়ে লেপ্টে থাকা চুল সুঠাম হাতের স্পর্শে সরে গেছে।উন্মুক্ত হয় গ্রিবাদেশ। সুপরিচিত ছোঁয়া। তারপরও কম্পন ধরায়। মসৃণ গর্দনে নাক ডুবিয়ে আবদ্ধ করে ফেললো চওড়া কায়ায়। সরু অধরোষ্টের একের পর এক প্রগাঢ় স্পর্শনে উন্মত্ত করে। ভেলায় ভেসে চন্দ্রমল্লিকা হাত খামচে ধরে মাহরুরের।এক মুহুর্ত নিঃশ্বাস নিতে দেবে না এই পাগলাটে পুরুষ।তার ছোঁয়ায় সত্যিই একদিন মৃত্যু হবে।

মল্লিকাকে নিজের সম্মুখে ঘুরিয়ে ঘোর লাগানো কন্ঠ তুলে বললো,

“এসে গেছি অভিমান ভাঙাতে রূপবান”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৩৩

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৩৩
লেখা : Azyah_সূচনা

শনিবার সকালটা তানিয়ার ভাগ্যে শনির দশা টেনে আনবে হয়তো।এই ভেবে আজ অফিসে তানিয়ার দর্শন হয়নি। অফিসে কদম ফেলার সাথেসাথেই ডিরেক্টরের রুমে ডাকা হয়েছে মাহরুরকে। শরিফুলের সামনে বসে গতকালের বিষয় নিয়ে কথাবার্তার শুরু হয়। মাহরুরের কথা মোতাবেক যাচাইয়ের জন্য সিসিটিভি ফুটেজ চেক করলেন তিনি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তানিয়াকে মাহরুরের ডেস্ক এর কাছে। জুম করলে আরো পরিষ্কার দেখা যায় তার হাতে কাগজ।আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য কল রেকর্ডও শুনলেন শরিফুল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুরের উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনি কি কোনো একশন নিতে চাচ্ছেন?কারণ এটা আমাদের অফিসের রেপুটেশনের ব্যাপার।অফিস কর্মস্থল।এখানে এসব অশোভনীয়।”

“একশন নিলে স্যার ভালোর চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে।সবার মধ্যে বিষয়টা জানাজানি হবে।তাছারাও মিস তানিয়া একজন মেয়ে মানুষ।উনি ভুল করেছেন এটা আমি মানছি। তবে আমি চাইনা ওনার সম্মানহানি হোক।আপনি প্লিজ মিস তানিয়ার সাথে আলাদাভাবে এই বিষয়ে আলোচনা করবেন। এতেই হবে।”

মাহরুরের চিন্তাকে সাধুবাদ জানিয়ে ডিরেক্টর শরিফুল বললেন,

“আমি নিশ্চিত করবো অফিসে কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ যেনো বজায় থাকে। থ্যাংকস মিষ্টার মাহরুর।”

“ওয়েলকাম স্যার।আসি”

তরতর করে তানিয়া অফিসে এসে প্রবেশ করলো।নিজের ভঙ্গিমায় কোনো পরিবর্তন আনেনি। ডিরেক্টরের রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই মুখোমুখি হয় মাহরুরের সাথে।আকষ্মিক সামনে পড়লে মাহরুর হচ্কচিয়ে উঠলেও তানিয়া প্রায় বিরক্ত হলো। মাহরুর অবাক। বিরক্তিকর প্রতিক্রিয়াতো তার থাকার কথা অথচ তানিয়ার ভঙ্গি বিরক্তি মাখা।মনে হলো গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই।পাশ কাটিয়ে হেঁটে নিজের ডেস্ক এর দিকে চলে গেলো মাহরুর।

শরিফুল তানিয়াকে ঝড়ের গতিতে নিজের ক্যাবিনে ডাকেন। অফিসের স্টাফ এসে জানালে তানিয়া কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও চলে গেলো ক্যাবিনের দিকে।

ডিরেক্টর শরিফুলের সামনে বসে জানতে চাইলো,

“এনি প্রবলেম স্যার?”

“প্রবলেম?আপনি জানেন না?”

“জ্বি না স্যার”

“মিস তানিয়া!এটা ভদ্র মানুষের অফিস।এখানে কাজের পাশাপাশি ভদ্রতা বজায় রাখতে হবে।আপনার নামে কমপ্লেইন্ট আছে। ওয়ার্নিইং দিচ্ছি এবার।আগামীবার এমন কিছু শুনলে ফায়ার করা হবে আপনাকে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।”

তানিয়া নিজের পক্ষপাতিত্ব করে বললো, “মিষ্টার মাহরুর নিজে থেকে এসেছেন আমার কাছে।আমার সাথে দেখা অব্দি করেছেন গতকাল রেস্টুরেন্টে।”

শরিফুল বাকা হেসে বললো, “আমি সব প্রমাণ দেখেশুনেই আপনাকে সাবধান করছি।মেয়ে মানুষ বলে বেঁচে যাবেন ভুল করেও এটা ভেবে ভুল করবেন না।ইউ ক্যান লিভ ”

অতিরিক্ত রাগে ফেটে পড়ছে তানিয়া।তাকে হাসির পাত্র করে তুললো ডিরেক্টরের কাছে?বারবার মাহরুরের ডেস্ক এর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে তাকে।কোনো স্টেপ নিতে পারছে না।অযথা নিজেই ফেঁসে যাবে।নিজের রাগকে নিজের মধ্যে সংযত করেই কাজে মনোযোগী হলো।

বিকেল বেলায় বাড়ি ফিরেছে মাহরুর।আজ রিকশা করে আশায় দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হলো।ফিরে এসে শিরিনকে বাড়িতে দেখে।অনেকদিন পর বোন এলো।ঈদের পর ছেলে মেয়ের পরিক্ষার কারণে আশা হয়নি।আজ সময় নিয়ে এসেছে।সাথে সংবাদ এনেছে।ঘুরতে যাবে।ঢাকার বাহিরে কোথাও দুইদিনের ভ্রমণ।আসা যাওয়া করতে একদিন মোট তিনদিনের জন্য।এখানে এসে মিষ্টিকেও তার দলে যোগ করলো।

বাবার কাছে এসে মিষ্টি নাদান মুখে বলতে লাগলো, “মাহি বাবা ঘুত্তে যাবো”

মাহরুর সরাসরি তীক্ষ্ম নজর দেয় শিরীনের দিকে।চোখে চোখ পড়তেই শিরীন অন্যদিকে ফিরে তাকালো।সে কিছুই জানে না এমন এক ভঙ্গি।

মিষ্টির উদ্দেশে মাহরুর বললো, “নিয়ে যাবো বাবা কিন্তু এখন না”

“না এখনই! মনিরা মাটিতে যাবে”

মিষ্টির মাটি কথাটি বোধগম্য হয়নি মাহরুরের।প্রশ্ন করলো,
“মাটি?”

শিরীন উত্তরে বললো, “আরেহ রাঙামাটি।এতবড় নাম ও উচ্চারণ করতে পারে নাকি?”

মাহরুর বললো, “তুই ওর মাথায় এই ভুতটা ঢুকিয়েছিস না?”

“একদমই না মাহি ভাই।অযথা দোষারোপ করবে না।” উল্টো ঝাঁঝ দেখিয়ে বললো শিরীন।

এখানে নির্বাক শ্রোতা মল্লিকা।মুখ দর্শনে বোঝা গেলো সেও ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে ভীষণ খুশি।হাসি মুখে মিষ্টিকে সমর্থন করছে। নিঃশব্দে! মাহরুর নাকোচ করতে চেয়ে পারলো না। ইতিমধ্যে কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টা করলো মিষ্টিকে।কিন্তু আজ সেও বেঁকে বসে।মল্লিকার দিকে চাইলে সেও হাত তাক করে।এই ব্যাপারে সে কিছুই করতে পারছে না।

মাহরুর নাক ফুলিয়ে মিষ্টিকে বললো, “তোকে চিনি পড়া খাইয়েছে তোর মনি।মাহি বাবার কথা শুনছিস না?”

“মা বলেছে এবার তোমার কথা না শুনতে।অনেক অনেক জেদ করতে।”

আসল কালপ্রিট ধরা পড়েছে।শিরীন এসবের মাস্টারমাইন্ড।আর মেয়েকে হাত করেছে মাহরুরের চন্দ্রমল্লিকা।বাচ্চাদের মন স্বচ্ছ।সত্য বলা তাদের স্বভাব।বলতে বলতে মাকে ফেলে দিয়েছে মহাবিপদে।না জানে এবার মাহরুর যমের বেশ ধারণ করে নাকি আবার!

শিরীন হাত তালি দিয়ে বাচ্চাদের উদ্দেশে বললো, “তাহলে কাল রাতে আমরা রাঙামাটি যাচ্ছি”

হইচই শুরু করলো মিষ্টি,সুমাইয়া আর সায়মন।তাদের সাথে শিরীনও বাচ্চা বনে গেছে। মাহরুরকে এড়িয়ে মল্লিকা ছাদ থেকে কাপড় আনার বাহানায় চলে গেলো।কিছুক্ষন তার দৃষ্টি সীমানায় পড়া বড্ড বিপদজনক।কি রকম চাহনি দিচ্ছিলো?যেনো চোখ দিয়ে গিলে খেয়ে ফেলবে।

বছরে দশদিন ছুটি নেওয়ার সুযোগ আছে।প্রথম চারদিন মনে হয় এই রাঙামাটি ভ্রমণেই চলে যাবে।অনেক চিন্তাভাবনা করে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ডিরেক্টরকে কল করলো।মাত্র জয়েন করেছে।এভাবে ছুটি নেওয়া ঠিক হবে?

দুরুদুরু বুক নিয়ে কল করলো। ডিরেক্টর শরিফুল কল রিসিভ করতেই মাহরুর বলে উঠে,

“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম মিষ্টার মাহরুর।এই সময় কল করলেন?মিস তানিয়া কিছু করেছে আবার?”

“জ্বি না স্যার।”

“তাহলে?”

সংশয়াপন্ন গলায় মাহরুর বললো, “আসলে স্যার..আমার ছুটি প্রয়োজন চারদিনের।আমি জানি স্যার আমি নতুন জয়েন করেছি।তারপরও পারিবারিক বিষয়..আপনি যদি”

“উম!আপনি কি ছুটিতে থেকে টাইম টু টাইম কিছু ফাইল আপডেট করতে পারবেন?”

“স্যার আমার কাছেতো ল্যাপটপ নেই।”

“না সেটার প্রয়োজন নেই। স্মার্টফোনেই আমাদের কোম্পানির মেইলে পাবেন। লগ ইন করে নিবেন।আর হ্যা যথার্থ কারণ দেখিয়ে আমাকে এখনই একটা ছুটির অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়ে দিন। ফ্রেশারদের আমি ছুটি দেই না। বাট আপনাকে আমি কয়েকমাস অবজার্ভ করেছি।নিঃসন্দেহে একজন দায়িত্ববান কর্মকর্তা আপনি।তাছাড়াও একটা বাজে ইনসিডেন্ট ঘটেছে আপনার সাথে অফিসে।সব বিবেচনা করে একবারেই রাজি হলাম।তবে ফিরে এসে ওভারটাইম করে কাজ পুষিয়ে নিতে হবে।আর হ্যা ছুটি নেওয়াকে নিজের স্বভাবে পরিণত করবেন না”

“শিউর স্যার। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

“ওয়েলকাম। বাট মেক শিউর ফাইলগুলো সময়মতো সকাল এগারোটার মধ্যে আপডেট করবেন।”

“জ্বি স্যার।”

“ওকে টেক কেয়ার।”

এক ঢের কাপড় হাতে নিয়ে শ্বাস আটকে সিড়ি ঘরে দাড়িয়ে। মাহরুরের দৃষ্টি সীমার বাহিরে থাকার কথা চিন্তা করে এসেছিল।অথচ অগ্নিমানব নিজে এসে এখানে হাজির। নিঃশ্বাসকেও বেগতিক চলাচল থেকে বিরত রেখেছে মল্লিকা।কোনোভাবে আচ পেলে খপ করে ঘাড় মটকে ধরবে এসে।খিঁচে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে।

“আমার দৃষ্টির আড়াল হতে চাচ্ছিলেন?”

ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো সমস্ত দেহ।একদম কাছে এসে মাহরুরের নিঃশ্বাস বারি খাচ্ছে।ধরা পড়ে গেলো তাহলে?এই ছোট চিলেকোঠায় আর পালাবে কোথায়?

কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো।এই মুহূর্তে মল্লিকার মুখে হাঁসি আসছে।মাঝেমধ্যে কি কর্মকাণ্ডই না ঘটিয়ে ফেলে সে? মাহরুর কাপড়ের ধের একহাতে নিয়ে পূনরায় দড়িতে ঝুলায়।সামনাসামনি দাড়িয়ে দুহাত দেয়ালে ঠেকিয়ে বন্দিনী করলো মল্লিকাকে।

সামান্য মুখ বরাবর ঝুঁকে ভারী কণ্ঠে বললো, “ঘুরতে যাবেন মিষ্টির মা?ভ্রমণ শখ জেগেছে।”

ভয় কাটিয়ে মল্লিকা বললো, “একটু নিয়ে গেলে কি হয়?আমি কক্ষনো যাইনি রাঙামাটি।”

বলে মাহরুরের দিকে চাইলো।শিখতে হবে তার চোখে চোখ রেখে কথা বলা।তাই গোলগোল চোখে চেয়েছে কালচে খয়েরী রঙের দাড়িতে আবৃত মুখমন্ডলের দিকে। মাহরুরের দৃষ্টি শীতল হয়ে আসে।বশ হয়ে যায় খুব দ্রুত। মাহরুরের ক্ষুদ্র চক্ষু জ্বালাতন শুরু করলো মল্লিকাকে।নিজের দৃষ্টি নত না করলে জ্বলসে যাবে।

ঠোঁট ভিজিয়ে মল্লিকা বললো, “ছুটি পেয়েছেন?”

“হুম”

“আমি কাপড় গুছাই?”

“আগে আমাকে গোছান।”

“আপনি যথেষ্ট গোছানো।এখন কি আপনাকেও ভাজ করে ব্যাগে নিবো?”

পরপর উত্তর দিয়ে গেলো মল্লিকা। হাসলোও বটে।মাহরুর চোখ পেতে দেখছে চাঁদের আলোয় বরাবরের মতন তার উপচে পড়া সৌন্দর্য্য। গভীর নেত্র কিছু সময় নিয়েই গ্রহণ করলো এই মহিমা।সে এক বিনাশিনী নারী। মন মস্তিষ্কে সম্পূর্ণ নিজের রাজত্ব বিস্তার করা এক বিশেষ ফুল।সময় অতিবাহিত করে বললো,

“এই রাঙামাটি ভ্রমণ আপনি সারাজীবন মনে রাখবেন মিসেস মাহরুর ইবনাত।”

___

রাতের বাস অগ্রসরিত হচ্ছে রাঙামাটির দিকে।পাশাপাশি দুটো সিটে দুই যুগল।তাদের সামনের সিটে যথাযথ নিরাপত্তার সাথে যুগলদ্বয়ের ছানাপোনাদের বসানো হয়েছে।তাদের মতে তারা বড় হচ্ছে।তাদের আলাদা সিট প্রাপ্য।বাবা মায়েদের কড়া দৃষ্টিতে ঠিকঠাক আছে তারা।রাতের খাবার খেয়ে বেরিয়েছিল তারা। ঘুমোনোর সময় আসলে মিষ্টি চলে আসে মল্লিকার কাছে।যত প্রিয় হোক বাকিরা মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে না ঘুমোলে শান্তি আসেনা।মিষ্টিকে বুকে জড়িয়ে নিজেরওতো শান্তি দরকার। মাথাটা এলিয়ে দিলো মাহরুরের কাধে।মেয়েকে সামলাবে মা আর মাকে সামলাবে মেয়ের বাবা।এটাইতো নিয়ম!
শিরীনের ঘুম ভাঙ্গে মাঝপথে।সামনের সিটে সায়মন আর সুমাইয়াকে দেখে নিয়ে চোখ যায় পাশের তিনজনের দিকে।ঘুমন্ত রেদোয়ানকে জোরেশোরে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুললো।

ধড়ফড় করা বুক নিয়ে রেদোয়ান চোখ খুলতেই শিরীন বললো,

“দেখো দেখো সুমাইয়ার বাবা এদের একসাথে কি সুন্দর দেখাচ্ছে?”

রেদোয়ান পাশে তাকায়।হাসে।পরপর নিজের স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল,

“এটা দেখানোর জন্য আমাকে এভাবে ডেকে তুলেছ তুমি?”

“হ্যাঁ!তকি?এই সুন্দর দৃশ্য মিস করে যেতে তুমি।”

রেদোয়ানও নকল করলো।শিরীনের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে বললো, “এবার আমাদেরও সুন্দর দেখাচ্ছে।ঘুমাও!বাস থামার আগে কোনো ডাকাডাকি নেই।”

“দুই বাচ্চার বাপ!ঢং করে। দূরে গিয়ে ঘুমাও”

নিভু নিভু গলায় বললো, “বেরসিক মহিলা তুমি শিরীন”

আদি প্রকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে প্রথমবার পদচারণ।চোখ জুড়ানো রূপে মুগ্ধ হতে। সবুজারণ্যে ঢাকা ওই শৃঙ্গ আর বয়ে চলা হ্রদের মিলমিশ। নৈসর্গিক এক চিত্রে নিজেদের অনুধাবন করছে তারা।মিষ্টির জন্য এটাই প্রথমবার।জন্মের পর তার শিশুকাল বলতে ছিলো একটা ঘর আর খেলার মাঠ।বাহিরের জগতের সাথে অপরিচিত। ঘোরাফেরা করেনি মল্লিকাও গ্রামের বাহিরে কখনো পা রাখাই হয়নি।যখন রেখেছে তখন অভিমানে শহরের মায়ায় জড়াতে পারেনি। মাহরুরের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই।জীবনে একবার গিয়েছিল কক্স বাজার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সফরে। রাঙামাটি এই তিনজনের চোখে নতুন।

নীল রঙের ফ্রকের সাথে কালো বেল্টের জুতো পড়েছে মিষ্টি। বাস থেকে নামার আধ ঘণ্টা আগে তার মা তাকে উচু করে ঝুঁটি বেধে দিয়েছিল।পাখির মতন মাথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো। কোথায় এলো?কি করে এলো?তার চোখেও সব বিভ্রম।
হোটেলে আসতেই রেদোয়ান এর ঘাড় টেনে ধরলো শিরীন।

রেদোয়ান স্ত্রীর এরূপ কাণ্ডে হতভম্ব হয়ে বললো, “আমি একজন পুলিশ তুমি ভুলে যাও কিন্তু”

“চুপ থাকো।আমার মনে হয় মাহি ভাই আর মল্লিকার জন্য আমাদের কিছু একটা করা উচিত।ওদের একা সময় দরকার।”

“কি করবো?”

রহস্যময় হাসলো শিরীন।মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এঁটেছে।স্বামীর সাথে মিলে এই চিন্তাকে বাস্তব রুপ দেবে।শিরীন রেদোয়ানকে আদেশ করে যেনো তাদের ঘর থেকে দূরে মল্লিকা আর মাহরুরের ঘর হয়।যেমন চিন্তা তেমন কাজ।কিছুসময় বিশ্রাম নিয়ে ঘুরতে বের হওয়ার সময় বাঁধ সাধে রেদোয়ান।

বলে, “আমার পায়ে প্রচুর ব্যথা হচ্ছে।মাহি তুমি ওদের নিয়ে আজ একটু আশপাশ ঘুরে আসবে?”

“আমিতো তেমন কিছুই চিনিনা এখানকার।” উত্তর দিলো মাহরুর।

শিরীন চেচিয়ে বলে, “আরেহ আমি চিনি চলো। আজতো আর ঝুলন্ত ব্রিজ এ যাবো না।এই আশপাশের এরিয়া ঘুরে দেখবো। চলো।এই লোক পড়ে থাক হোটেলে।”

মাহরুর শিরীনের কথার উত্তর না দিয়ে রেদোয়ানকে প্রশ্ন করলো,

“তোমার কি বেশি খারাপ লাগছে?আজ নাহয় থাক। কাল ঘুরবো নাহয়”

“আরেহ না ভাই শুধু পায়ের ব্যথা।তোমরা যাও।আমার ভালো লাগলে চলে আসবো।”

“ঠিক তো?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ যাও”

শিরীন একপলক চাইলো রেদোয়ান এর দিকে।এত বছর সংসার করেছে।চোখের ভাষা বুঝবে না?এমন হয় কি করে? ইশারা মোতাবেক কাজে লেগে পড়লো।অত আলিশান হোটেলে আসেনি তারা।খুবই সাধারণ একটা হোটেল। ছিমছাম পরিবেশ। ম্যানেজারের সাথে কথা বলে তাদের এক ফ্লোর উপরে একটা ঘর কোনো রকম ম্যানেজ করেছে।পা ব্যথার মিথ্যে বাহানা জেনো ধরা না পড়ে যায় সেই জন্য মুখে মাস্ক পড়ে বেরিয়ে গেলো।মার্কেট খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। হাটতে হাটতে এবার বোধহয় সত্যি পায়ের ব্যথা উঠবে।অবশেষে মার্কেট পেয়ে নিঃশ্বাস ফেলে রেদোয়ান।ফুল নিয়েছে অনেকগুলো।হোটেলে ফিরে মাহরুর মল্লিকার ঘর সাজিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো।নাহয় তার বউ তাকে আস্ত রাখবে না।

সন্ধ্যার সময় ফিরে আসে মল্লিকা মাহরুর আর বাকিরা।একটু পরেই সবাই রাতের খাবারের জন্য বের হবে।মল্লিকা মাহরুর তাদের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে রেদোয়ান বললো,

“মাহি ওই রুম না।তোমাদের রুম উপর তলায় শিফট করা হয়েছে।”

মাহরুর বলে উঠলো, “কেনো?হটাৎ?”

“তোমরা বাহিরে গিয়েছিলে না?তখন হোটেলের ম্যানেজার এসে বললো এই রুমের ওয়াশরুম এর নল নষ্ট আবার ঘরে কিছু রিপেয়ারিংও দরকার।ক্ষমা চেয়েছে বিরক্তির জন্য।তোমাদের লাগেজ আমি উপরে রেখে এসেছি চিন্তা করবে না।”

মাহরুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “পাশাপাশি রুমই ভালো ছিলো।”

“কি করার আর?” হেসে বললো রেদোয়ান।

“আচ্ছা রুমের চাবি দিয়েছে?দাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি।”

“না না” বলে চেচিয়ে উঠে রেদোয়ান।

“কেনো?”

“না মানে এখন উপরে গিয়ে করবে।আমাদের ঘরেই হাত মুখ ধুয়ে নাও।তারপর রাতের খাবার খেতে যাবো।”

“আচ্ছা চলো”

ফ্রেশ হয়ে খাবারের স্বাদ নিচ্ছে সকলে।পাহাড়ি অঞ্চলে স্বাদের কিছু ভিন্নতা।তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ।বড়দের মধ্যে কোনো বাছবিচার না থাকলেও বাচ্চারা বিরক্ত করলো বেশ। খাওয়ায় অরুচি।এক পর্যায়ে রাগ দেখাতে বাধ্য হয় মল্লিকা আর শিরীন।হালকা ধমকে দিয়ে খাইয়ে দিলো।

খাবারের পর্ব লুকিয়ে অলস হয়ে উঠে শরীর।ঘরের দিকে এগোলে শিরীন মিষ্টিকে কেড়ে নিলো।বললো,

“আমাদের ঘরে দুটো বেড।মিষ্টি আমাদের সাথে থাকবে।”

মাহরুর সরাসরি উত্তর দেয়, “না।আমার মেয়ে আমার কাছে থাকবে”

সুমাইয়া বললো, “মামা! মামা! দাও না মিষ্টিকে আমি ওকে দেখে রাখবো।”

“তুইতো নিজেই ছোট বুড়ি।”

“না মামা আমি পারবো তুমি দিয়েই দেখো না।”

মাহরুর ঝুঁকে মিষ্টিকে প্রশ্ন করে, “থাকবি আপু আর ভাইয়ার সাথে?”

মিষ্টি সুমাইয়ার দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলো, “গপ্পো শোনাবে?”

“হ্যাঁ আমি রাখালের গল্প জানি।”

“মাহি বাবা আমি আপার সাথে থাকবো।”

মাহরুর শিরীনের উদ্দেশে বললো, “দেখে রাখিস।কান্না করলে আমাকে কল করিস নিয়ে যাবো।”

মল্লিকার কাধে হাত রেখে তিনশত ছয় নম্বর রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে।জার্নি, ঘুরাফেরা সবটা মিলে শরীরের অবস্থা কাহিল। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখ কপালে উঠে সামনের অবস্থা দেখে।লাল সাদা গোলাপের পাঁপড়ির ছড়াছড়ি।দেখে বোঝা গেলো সময় স্বল্পতায় কেউ শুধু পাঁপড়ি ছিটিয়ে রেখেছে বিছানা আর মেঝেতে।

মাহরুরের হাত খামচে দাড়িয়ে মল্লিকা বললো, “ভুল ঘরে এসে পড়েছি বোধহয়।চলেন”

“তুই কি বোকা?ভুল ঘরে আসলে দরজা খুলতো কি করে এই চাবি দিয়ে?আমার মনে হচ্ছে এগুলো রেদোয়ান আর শিরীনের কাজ।”

লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো মল্লিকা।হাত ছেড়েছে মাহরুরের।রেদোয়ান আর শিরীনের কাজ?বুঝতে বাকি নেই এই সাজসজ্জা তাদের দুজনের জন্যেই।গলা বারবার শুকিয়ে যাচ্ছে। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিলো।

মাহরুর দুষ্টু গলায় বললো, “ভালোই হয়েছে।আমাদের তো বাসর হয়নি।”

মল্লিকার হাত ধরে ভেতরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয় মাহরুর। লাইটটা আকস্মিক বন্ধ করে দিলে ভরকে উঠে মল্লিকা।নাহয় এই মেয়ে কাপতে কাপতে অক্কা পাবে।কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে কপালে চুমু খেয়ে মাহরুর বললো,

“ভালোবাসি”

বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে মল্লিকা। মিনমিনে কন্ঠে বলে, “আমিও আপনাকে ভীষন রকমের ভালোবাসি।আগে যতটুকু বাসতাম তার চেয়ে বেশি ভালোবাসি।আমরা এভাবেই থাকবোতো সারাজীবন?”

“কেনো থাকবো না চন্দ্র?”

“ভয় করে।”

“তোর ভয়কে আমি ভালোবাসা দিয়ে জয় করে নিবো। যত্নে রাখবো তোকে আর মিষ্টিকে।আমাদের সম্পর্কে ভঙ্গুর ধরবে এমন কোনো কাজ করবো না।আমাদের এবার সম্পর্কে এগোনো উচিত চন্দ্র।”

মাথা নুয়ে মল্লিকা ছোট্ট বলে, “হুম”

“হু হা করলে চলবে না চন্দ্র।আজ সময় সুযোগ দুটোই আছে।ভালোবাসার পরশ চাই আমি।”

নেত্রবিশেষ তুলে তাকালো মাহরুরের দিকে।আনমনে নিজের একান্ত পুরুষের প্রেমে ধরে গেছে চক্ষু।যতবার মুখপানে চাওয়া হয় তার বিশ্বাস হতে কষ্ট হয় নিজেরই।পেয়েছে তাকে নিজের করে?স্বপ্ন নয়তো।তার বাকা হাঁসি বিশ্বাস যোগায়।অতি নিকটে দাড়ানো পুরুষকে হারিয়ে ফিরে পেয়েছে। মাহরুরের ইচ্ছেকে সম্মতি দিয়ে পায়ের তালু উচু করে কপালে অধর ছুঁয়ে দিলো।

মাহরুর কপাল কুঁচকায়।বলে, “এই অল্পস্বল্প ভালোবাসায় আমার পোষাবে না।তোর মাহরুর লজ্জাহীন;অবাধ্য।তার আসক্তি দ্বিগুণ!”

চলবে….

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৩১+৩২

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৩১
লেখা : Azyah_সূচনা

কিছু মানুষের জীবন চলে একই গতিতে। মধ্যেমধ্যে দিক পরিবর্তন হলেও মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে বিশেষ কোনো অবস্থানন্তর হয়না।নতুন দোকানটা দুলালের হাতে তুলে দিয়ে এসেছে।সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রহিম মিয়া মাঝেমধ্যে দেখাশুনা করবেন আশ্বাস দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কার্পণ্য বোধ করেনি মাহরুর।জীবনে যদি খারাপ মানুষের দর্শন হয়ে থাকে তাহলে ভালো মানুষও পেয়েছে অনেক।

ঈদের লম্বা ছুটি কাটিয়ে অফিসের ডেস্কএ এসে বসে।ব্যাগ থেকে ছবিটা বের করে যথাস্থানে রাখলো।কাজের ব্যস্ততায় তার মন ভালো করার খোড়াক এটি। কাগজপত্র সব পূনরায় ঘাটাঘাটি করতে করতে একটি চিরকুট হাতে পায়। মাহরুর বুঝে উঠতে পারলো না এটি কি?চিন্তা ভাবনা করে চিরকুট খুলেই দেখতে পারে এক লাইনের একটা লেখা।

“আপনি ভীষন রকমের সুদর্শন পুরুষ মিস্টার মাহরুর।যেকোনো হৃদয় আপনার উপর আটকে যেতে পারে”

তড়িৎ গতিতে চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ এসে হাজির।এই ধরনের ফাজলামো কে করতে পারে?অবশ্যই কোনো নারী? চিরকুটটি মুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় মাহরুর।নিজের কাজে মনোযোগী হয়।

কয়েক ঘন্টা পর হাতে লাঞ্চ বক্স নিয়ে ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে গেলো মাহরুর।কানে ফোন চেপে আছে।এটাও তার একটা রুটিনের মধ্যেই পড়ে।চন্দ্র আর মিষ্টি খেয়েছে কিনা না জানলে তারও পেটের ভাত হজম হবে না।ক্যান্টিনে বসে মল্লিকার উদ্দেশ্যে বললো,

“বাড়ি ফিরেছিস ঠিক মতন?”

“হ্যাঁ।মিষ্টির ক্লাস টিচার বললো কি যেনো একটা অভিভাবকদের মিটিং আছে বৃহস্পতিবার বিকেলে।আপনার থাকতে হবে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে থাকবো।খেয়েছিস তোরা?”

একই থালায় মা মেয়ে খাবার খেতে বসেছে। মাহরুরের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললো, “খাচ্ছি।”

“আমিও খাচ্ছি।আজকের খাবারটা বেশ মজা হয়েছে”

নিঃশব্দে হাসে মল্লিকা।তার এই ছোটোখাটো কথাগুলোও হৃদয়ে তৃপ্তি দেয়। যার জন্যে যতনে রান্না করা সে যদি প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় তাহলে আর কি প্রয়োজন? মাহরুর এই পন্থাটা বেশ ভালোই জানে।

মাহরুর বললো, “আচ্ছা খেয়ে নে।কোনো দরকার পড়লে কল করিস।”

“আচ্ছা।আপনি সাবধানে আসবেন”

মাহরুর খাবার শেষে সাথের একজন কলিগের সাথে কথা বলছে।সে জানালো আজ ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং ডেকেছে এমডি স্যার।কথা বলতে বলতে দুজন যারযার জায়গায় এসে মিটিং এর জন্য তৈরি হতে লাগলো। এমডি স্যার কাজের প্রতি অনেক কড়া।সবার রেসপন্স ভালো চান তিনি।রেখে যাওয়া ফাইল আবার খুলে বসতেই আরো একটি চিরকুট পায় মাহরুর।পূর্বের তুলনায় বিরক্তি দ্বিগুণ হলো।ফাজলামো নাকি?এটাও তার জন্যই এসেছে বুঝতে বাকি নেই।

“আপনার প্রশংসা করলাম।অথচ আপনি আমার লেখা চিঠি ফেলে দিলেন!কোনো জবাব দেওয়াতো দূরের কথা।”

মাহরুর এদিক ওদিক চায়।অবশ্যই আশপাশের কোনো ডেস্ক থেকে এইসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হচ্ছে।বিশেষ নজরও দেওয়া হচ্ছে মাহরুরের উপর। মাহরুর কলম হাতে নেয়।

লিখে, “ধন্যবাদ প্রশংসা করার জন্য।তবে এই প্রশংসা আমার মন জয় করতে পারলো না।আমার ঘরে আস্ত একটা চাঁদ আছে।আমার সৌন্দর্য্য সেই চন্দ্রের কাছে ফিকে। যার কাছে চাঁদ আছে তার মনোযোগ কোনোদিন পাশে জ্বল জ্বল করা অসংখ্য তারার দিকেও পড়বে না। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।আপনি নারী হন অথবা পুরুষ।অফিস একটা কাজের জায়গা রঙ্গলীলা করার নয়।”

লেখা সম্পন্ন করে ডেস্কের এক কোণে রেখে দিল। যার নেওয়ার সে এমনেই নিয়ে যাবে। এতে তার তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই।
বাড়ি ফিরেছে একটু দেরি করেই।মিটিং দীর্ঘ সময় চলেছে। এমডি জানিয়েছেন আগামীকাল সোমবার কোনো ছুটি থাকবে না।যেহেতু ঈদে লম্বা ছুটি গেছে।আসার পথে মিষ্টির জন্য কিছু না নিলে ওই বাচ্চাটাও আবার মুখ ফুলিয়ে রাখে।দোকান থেকে ফ্রুট কেক কিনে নিল।পরপর দুলালের কাছে এসেছে।

মাহরুরকে দেখে দুলাল বললো, “ভাইজান বেশি বেচাকেনা হয়নাই।”

“আরেহ আজকে মাত্র প্রথম দিন।আর কিছুদিন যাক দেখি কি হয়।”

“আচ্ছা ভাই”

“সন্ধ্যায় চা নাস্তা কিছু খেয়েছিস?”

দুলাল মলিন মুখে বললো, “না ভাই।চাচী খাইতে ডাকছিল।দোকান ফালায় কেমনে যামু।এরমধ্যে নতুন নতুন। অবহেলা করলে মুনাফা হইবো না।”

দুলালের কাধে হাত রেখে মাহরুর বলে, “দেখ।আমার এখানে কাজ করিস বলে নিজেকে বিলীন করে দিতে বলিনি। সময়মতো খাওয়া দাওয়া করবি।আর সবচেয়ে বড় কাজ হলো রহিম চাচা আর চাচী ডাকলে এক দৌড়ে যাবি দোকানের শাটার নামিয়ে।”

“আচ্ছা ভাই।”

“আচ্ছা তুই বোস।আমি বাড়ি গিয়ে দেখি তোর ভাবি কি নাস্তা তৈরী করেছে।দুজনে একসাথে খাবো।”

“আপনি মাত্র কাজ থেকা আইলেন।বিশ্রাম করবেন না?”

“করবো।তুই বোস ”

লোহার দরজায় ঝাঁকুনির আওয়াজে মল্লিকা চাবি নিয়ে দৌড়ে যায়। মাহরুর এসেছে।দরজা খুলতেই ব্যাগটা মল্লিকার হাতে ধরিয়ে ঘরের দিকে অগ্রসর হলো।মিষ্টি খাতা কলম ছড়িয়ে বসে আছে।স্কুল থেকে দেওয়া বাড়ির কাজ করতে মগ্ন। মাহরুরের উপস্থিতি টের পায়নি। মাহরুর আলতো পায়ে হেঁটে পেছন থেকে জাপ্টে ধরলে ঘাবড়ে উঠে মিষ্টি।

মায়ের দেখাদেখি বুকে থুথু ছিটিয়ে বলে, “মাহি বাবা”

“পড়ালেখা করছিস আম্মা?”

“হ্যাঁ।দেখো আমার নাম লিখেছি।”

খাতাটা এগিয়ে দিলো মিষ্টি।মিষ্টি নামটা লিখেছে।কিন্তু ভুল। মিষ্টিকে “মিশটি” করে ফেলেছে।এতটুকু মেয়ে আর কতই পারবে?তারপরও চেষ্টা করছে এটাই অনেক।

মাহরুর খাতায় সুন্দর করে তার নামটি লিখে বললো, “মিষ্টি এভাবে লিখতে হয় মা।তুই আবার চেষ্টা কর।”

“আচ্ছা”

“আচ্ছা শোন মাহি বাবার একটা কথা রাখবি?”

মিষ্টি বাচ্চাময় গোলাকৃতি চক্ষু মাহরুরের দিকে দিয়ে বললো, “কি কথা?”

ফ্রুট কেকটা মিষ্টির দিকে এগিয়ে দেয়।বলে, “এইযে এসব খাবার চিপস, চকোলেট,কেক এসব পচা খাবার।তুই জেদ করিস বলে এনে নেই।কিন্তু এগুলো খেলে কি হয় জানিস?”

পঁচা খাবার শুনে কিছুটা ভীত হয় মিষ্টি। মাহরুরের দিকে ঘুরে বললো, “কি হয় মাহি বাবা?”

“এগুলো খেলে পেটে ইয়া বড় গাছ হয়।ভালো খাবার কি জানিস? ভাত,মাছ,মাংস,সবজি।এগুলো খেলে দুই তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাবি।”

“আমার সবজি পছন্দ না মাহি বাবা।মা আমাকে জোর করে খাওয়ায়।”

“তোকে কানেকানে একটা কথা বলি শোন।”

মাহরুর মিষ্টির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, “মা যখন সবজি দিবে তখন টুপ করে চোখ বন্ধ করে খেয়ে ফেলবি।আর যদি ভালো মেয়ের মতন প্রতিদিন খাবার খাস আমি প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার চিপস, চকোলেট কিনে দিবো কেমন?”

মিষ্টি বাচ্চা সুরে বলে, “প্রতিদিন দিবে না?”

“না শুধু সোমবার আর শুক্রবার।তাহলে আর পেটে গাছ হবে না।”

মিষ্টি মাথা দোলায়।বলে, “আচ্ছা”

প্রতিদিনের ন্যায় আজও একই কাজ মল্লিকার। মাহরুর হাতমুখ ধুতে ধুতে সে চা নাস্তা তৈরি করে।আজও তাই। মাহরুর হাতমুখ ধুয়ে ঘরের কাপড়ে ফিরে এসে বসলো।

বললো, “আমাকে চা দিস না এখন।নাস্তা কি তৈরি করেছিস?”

“পুরি বানিয়েছি।আপনি খাবেন না কেনো?”

“দোকানে যাবো।দুলাল আর আমার জন্য দিয়ে দে সেখানেই খেয়ে নিব।”

মল্লিকার মুখ লটকে যায়।মাত্র এত সময়ের অফিস করে বাড়ি ফিরলো আবার চলে যাবে।মুখের ভাবভঙ্গি বজায় রেখে বললো,

“মাত্রইতো এলেন?”

“হুম।নতুন কাজ বুঝিস না একটু সাথেসাথে থাকতে হবে।তাছাড়া দুলালও নাস্তা করেনি।দিয়ে দে।”

“দিচ্ছি”

গরম গরম চা ফ্ল্যাক্সে আর বাটিতে করে পুরি দিয়ে দিলো। মাহরুর মিষ্টিকেও সাথে নেয়।বেচারি সারাদিন ঘরে থাকে। এবাড়ি আসার পর তার মাঠে খেলতে যাওয়াও হয়না তার।বাহিরের হাওয়া বাতাস দরকার।একহাতে থলে আরেক দিকে মিষ্টিকে হাতে ধরে বেরিয়ে পড়লো।

যাওয়ার পূর্বে মল্লিকার লটকে থাকা মুখ থেকে প্রশ্ন এসেছে,

“ফিরবেন কখন?”

“বেশি না চন্দ্রমল্লিকা মাত্র একঘন্টা।”

মুখশ্রীতে সীমাতিক্রান্ত রোষাবেশ।আজ থেকে বুঝি এই নিয়মই চলবে?দিবার একটা লম্বা অংশজুড়ে শুধু কাজ আর কাজ। সন্ধ্যা থেকে রাত অব্দি মাহরুরের দীপ্ত মুখমণ্ডল দেখায় সিক্ত হয়ে পড়েছে।এখন আবার নতুন কাজ!কর্ম অবশ্যই প্রয়োজন।তবে স্ত্রীকে সময় দেওয়াও প্রয়োজন। যথাসাধ্য পূরণ করে মাহরুর সময়ের কোটা।মনে পোষায় না মল্লিকার এখন।তার বচন,দৃষ্টি,স্পর্শে ধাতস্ত হয়েছে মল্লিকা। দূরে থাকলেও মন উসখুস করে।

“অভিমানে টইটুম্বুর শ্রী আরো মনোমুগ্ধকর।
তবে কেনো ভালোবাসা প্রকাশে সে অপরাগ?
স্নেহকাতর সেই রমণী কি জানে?
কোনো পুরুষ এক শুদ্ধ চন্দ্রের ক্রীতদাস।”

পুরুষালি কাব্যিক স্বর কর্ণকুহরে এসে ঝনঝন শব্দ করছে।কি সুশ্রাব্য কণ্ঠোধ্বনি!বাদামি পারের শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে পেঁচিয়ে অপেক্ষারত হলো।একপা দুপা করে এগিয়ে এসে সেই চন্দ্রের পাশেই ঠায় মিলবে ক্রীতদাস পুরুষের।যেকিনা স্বেচ্ছায় প্রেমদাসত্ব স্বীকার করেছে।

মাহরুর ঠিক চন্দ্রের ভাবনাকে সঠিক প্রতিপাদিত করে পাশে এসে দাঁড়ায়।বলে, “বললেই পারতেন?না একবার বলেই দেখতেন?সব কাজ বাদ দিয়ে আপনার আঁচলে আবদ্ধ হয়ে নিকটে বসে থাকতাম।”

মানে জর্জরিত তবে বোধশক্তি আছে বটে।বললো, “কাজে বাঁধা দিবো কেনো?”

“কাজটা আপনার চেয়ে বেশি দরকারি নয় চন্দ্রমল্লিকা।”

কথার জালে ফেলতে জানে মাহরুর। ধাঁধা লাগানো তার গভিরত্বে আচ্ছন্ন কন্ঠস্বর।ঠোঁট কামড়ে ধরে মল্লিকা।রেহাই দেয় শাড়ির আঁচলটাকে।বলে,

“আমিই বোকা।একটু খারাপ লেগেছে আপনি এসেও সাথেসাথে চলে যাওয়ায়।সেটা নিয়ে কতকিছু ভেবে নিজের মনকে কষ্ট দিয়ে বসে আছি।”

মাহরুর স্কন্ধে হাত রেখে গাঢ় নীলচে আবরণে নিজেকে সাজানো অখিলের দিকে চায়।বলে, “এই ছোটোখাটো বোকামি?অভিমান? এসবও ভালোবাসার গভীরত্ব দর্শায়।তোর নেত্রবিশেষ আমার জন্যে কতটা পিপাসু সেটা অনুভব করায়।এসব ছোটোখাটো মান অভিমান, খুনসুটিইতো আমি চাই।”

মল্লিকা প্রশ্ন করে, “আজ অফিসে কি কি করলেন? জায়গাটায় মানিয়ে নিতে পারছেনতো?”

মাহরুর ঝটপট বলে উঠে, “জানিস কি হয়েছে আজ?”

“কি?”

“আমার ডেস্কএ একজন চিরকুট রেখে গিয়েছে।হতে পারে কোনো নারী।”

বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় মল্লিকা।প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “কি লেখা ছিল চিরকুটে?”

“আমার প্রশংসা করছিলো।বলছিলো আমি নাকি সুদর্শন।আমি প্রথম চিরকুটের উত্তর দেইনি। পরবর্তীতে লাঞ্চের পর আবার উত্তর চেয়ে আরেকটা চিরকুট আসে।আমিও উত্তর দিয়েছি।”

শুভ্র চাঁদের সম্মুখভাগে একগুচ্ছ কালো মেঘ আবরণ দিয়ে দাড়িয়ে পড়ে।মস্তিষ্কে বিবাদের সৃষ্টি হচ্ছে।এক প্রেমী চিত্ত তার প্রনয়ের পুরুষকে অন্য কোনো অস্তিত্বের ছায়ায় দেখতে পারেনা।হুজুগে চিন্তাধারা এসে ধস্তাধস্তি শুরু করেছে।

মাহরুর ঘরে ফিরে যায়।দ্রুত গতিতে ফিরে এসে যান্ত্রিক ফোনটা দেখালো মল্লিকাকে।বললো, “দেখ আমি কি উত্তর দিয়েছি।”

মল্লিকা দূরে সরে দাঁড়ালো।আজ অভিমানেরা এক বিন্দু ছাড় দিচ্ছে না। বারংবার এসে ঝুকে পড়ে।জানতে চায় না মল্লিকা।কি উত্তর দিয়েছে মাহরুর।তার মানে জর্জরিত হৃদয়ের একটামাত্র জিজ্ঞাসা?কি দরকার ছিলো উত্তর দেওয়ার?

“একটাবার দেখ না চন্দ্র।এত অভিমানী হোস না আবার।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোঁখ তুলে তাকায় জ্বলজ্বল করা ফোনের স্ক্রিনে। মাহরুর চিরকুটগুলোর ছবি তুলে এনেছে। মল্লিকাকে দেখানোই মূল উদ্দেশ্য।পলক না ফেলেই মল্লিকা মাহরুরের দেওয়া জবাব পড়ে নেয়।নিজেকে আরেকদফা অতিরিক্ত ভাবার জন্য বকাঝকা করে ফেলে ইতিমধ্যেই। মাহরুরের মধ্যে কোনো রকম দোষ থাকলে সে অবশ্যই তাকে এই বিষয়ে মুখ ফুটে কিছু বলত না।

তার অনুপস্থিতেও মাহরুরের মন-মস্তিষ্কে তারই বিচরণ এটা সচক্ষে প্রমাণ পেয়ে মিষ্টি হাসে মল্লিকা। মাহরুর বললো,

“অভিমান করার অধিকার আছে তোর।তবে কোনোদিন সন্দেহ দানা বাঁধতে দিস না।সন্দেহ সংসারের ধ্বংস ডেকে আনে।”

___

মিষ্টির স্কুলে কয়েকমাস পরপর অভিভাবকের মিটিং হয়। সেখানে ডাক পড়েছে আজ মল্লিকা মাহরুরেরও।প্রতিটি বাচ্চাকে মধ্যিখানে রেখে অভিভাবকদেরও জায়গা হয়েছে স্কুলের বেঞ্চিতে। একেকজনকে ডেকে বাচ্চাদের সম্পর্কে আলোচনা করছেন ক্লাস টিচার।কয়েকজন এর পর মিষ্টির নাম ধরে ডাকা হলো।মল্লিকা, মাহরুর মিষ্টিকে সাথে নিয়ে এসে বসলো ক্লাস টিচারের সামনে। মধ্যবয়স্ক চোখে চশমা পরিহিত শিক্ষিকা একটি কাগজ এগিয়ে দিলেন।

বললেন, “আপনারা আজ এখানে উপস্থিত হয়েছেন সেটার প্রমাণ রাখার জন্য এখানে সই করেন।”

মাহরুর এবং মল্লিকা উভয়ই কাগজে সই করে শিক্ষককে এগিয়ে দিলো। কাগজে চোখ বুলিয়ে শিক্ষিকার মুখের ভঙ্গি পরিবর্তন হয়। মোটা খাতায় লিখিত মিষ্টির সব ডিটেইলস চেক করে চাইলেন মল্লিকা আর মাহরুরের মুখপানে।

বললেন, “আপনি মিষ্টির বাবা?”

মাহরুর উত্তর দেয়, “জ্বি”

“আপনার নামতো মাহরুর ইবনাত।আমাদের রেজিস্ট্রি খাতায় লেখা ফারহান সরোয়ার। গড়মিলটা কোথায় একটু স্পষ্ট করে বলবেন?”

বিব্রত বোধে গ্রাস হয় মল্লিকা, মাহরুর উভয়ে।কথাটি শুনতে এবং বুঝতে যত স্বাভাবিক।বলতে ততটাই জটিল। অন্যান্য অভিভাবকরাও চেয়ে আছে।

মাহরুর বিজড়িত হয়ে বললো, “আম! মিষ্টির বাবা ফারহান সরোয়ার মৃত।”

“আপনি কে তাহলে?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুর।বলে, “ফারহান সরোয়ার মিষ্টির বায়োলজিক্যাল ফাদার।তার অবর্তমানে আমিই মিষ্টির লিগ্যাল গার্ডিয়ান।মল্লিকা আমার স্ত্রী।”

পাশ থেকে অহেতুক এক নারী বলে উঠলো, “ম্যাডাম সৎ বাবা। হবেন বোধহয়।এই কথাটা বলতে নাকি এতক্ষন সময় নিচ্ছে” বলেই হেসে উঠলেন তিনি।

মাহরুর এর রাগ হয় কিঞ্চিত।মুখ ভর্তি বিরক্তির ছাপ। ‘ সৎ বাবা ‘ শব্দটা কর্ণকুহরে ভালো শোনাচ্ছে না।তার কথার বিপরীতে কিছু বলতে চাইলে মল্লিকা হাত চেপে থামিয়ে দিলো তাকে।

শিক্ষিকা সেই নারীর উদ্দেশে বলে উঠেন, “আপনি কি ওনাদের পরিচিত?”

উত্তরে সে বলেন, “জ্বি না।”

“তাহলে অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবে না।নিজের ভদ্রতা আর সভ্য ভাষার ব্যবহার বজায় রাখবেন।আপনাদের থেকেই বাচ্চারা শিখে।চেষ্টা করবেন তাদের ভালো কিছু শেখাতে। ভেদাভেদ নয়।”

অভিভাবকের সাথে চাইতেও রূঢ় আচরণ করতে পারলেন না শিক্ষিকা।এমন একটা কথায় মাহরুরের পাশাপাশি শিক্ষিকা নিজেও বিব্রতবোধ করেছেন।এখানে অনেক বাচ্চারা উপস্থিত।তাদের কাছে নতুন কোনো শব্দ উচ্চারিত হলে তাদের মস্তিষ্কে গেঁথে যাবে সেটা।অন্য অর্থ বের হবে।

চশমা ঠিক করে ক্লাস শিক্ষিকা মিষ্টির ভর্তি ফর্ম এগিয়ে দিয়ে বললেন,

“দুঃখিত। মিষ্টার মাহরুর আপনি এই ফর্মটায় লিগ্যাল গার্ডিয়ান এর জায়গায় আপনার নাম লিখে দিন।”

মাহরুর নিচু শব্দে উত্তর দেয়, “জ্বি”

মিষ্টির প্রশংসায় পঞ্চমুখ শিক্ষিকা।তার পেছনে আরো সময় দেয়ার কথা বলেছেন।বেশি যত্ন নিলে আরো ভালো করবে তার মেয়ে।মায়ের মতই পড়াশোনায় দুরন্ত। দশম শ্রেণী অব্দি শাখায় সবচেয়ে ভালো শিক্ষার্থীর তালিকায় মল্লিকার নাম ছিলো।সেই জ্ঞানটুকুই পূনরায় জুটিয়ে মেয়ের দিকে ঢেলে দিচ্ছে। মাহরুরের সময় হয় না।এখন আরো দ্বিগুণ ব্যস্ত।দুটো কাজ একসাথে হাতে নিয়েছে।

স্কুল থেকে বেরিয়ে মাহরুর মিষ্টির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, “দেখেছিস মা ম্যাডাম কি বললো?আরো ভালোমত পড়াশোনা করতে হবে।করলে ক্লাসে প্রথম হবি তুই।”

মিষ্টি এই বিষয়ে কিছু বললো না। হ্যা না কোনো উত্তরই দেয়নি। আকষ্মিক ভিন্নধর্মী প্রশ্নে মাহরুরকে তাক লাগায়।বলে, “সৎ বাবা কি মাহি বাবা?”

উত্তরে মাহরুর কোনো ভাষা খুজে পেল না।ইচ্ছে করেছে মিথ্যে বলে কাটিয়ে দিতে।তবে এটা মিষ্টির জন্য ভুল শিক্ষায় পরিণত হবে।
মল্লিকা মেয়েকে শাসনের গলায় বললো,

“অনেক কথা বলিস মিষ্টি। সৎ বাবা বলতে কিছু নেই।শুধু একজনই আছে সেটা হলো তোর মাহি বাবা।বুঝেছিস?”

মাহরুর বাঁধ সাধে।বলে, “আহহা চন্দ্র!তুই ওর সাথে এভাবে কেনো কথা বলছিস?ছোট মানুষ জানতে চেয়েছে।ওকে বুঝানোও যায় তাই না?”

ভারগ্রস্ত মল্লিকার মুখ।বিরক্তিতে ঠাসা।পরনের সবুজ শাড়িতে তার এরূপ মুখ দেখে মাহরুরের এটিও পছন্দ হয়ে যায়। ভুল জায়গায় ভুল চিন্তা।নড়েচড়ে উঠে সোজা হয়ে দাড়ায় মল্লিকার উত্তরের অপেক্ষায়।
হয়রান কন্ঠস্বর তুলে মল্লিকা বললো,

“ওই মহিলাটি স্কুলে আমাদের দিকে চেয়ে কিরকম হাসছিলো দেখেছেন?তার মুখের হাসিটা ভিন্ন ছিলো।যেনো আমরা কোনো লজ্জাজনক কাজ করেছি।এই সমাজে কি দ্বিতীয়বার জীবনকে সুযোগ দেওয়া অপরাধ?যেখানে আমাদের কোনো পিছুটান নেই।কোনো ভুল না করে সবখানে ভিন্ন দৃষ্টির শিকার হয়ে আসতে হচ্ছে।গ্রামে গিয়েও একই অবস্থা।বিধবা নারীদের নাকি নিজস্ব জীবন বলতে কিছু নেই।কু দৃষ্টির মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। বিধবার জীবন থেকে যখন আপনার জীবনে আসলাম তখন সবাই আপনার আর আমার চরিত্রে না বুঝেই আঙ্গুল তুললো।এলাকার মানুষ নানান কানাঘুষা করে এখন অব্দি।আজও তাই।এসব কি সারাজীবন চলবে মাহরুর ভাই?আমাদের কি সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার নেই?যদি নাই থাকে চলেন কোথাও চলে যাই।এসব মানুষের থেকে অনেক দূরে।”

চলবে…..

চন্দ্র’মল্লিকা ৩২
লেখা : Azyah_সূচনা

রাত্রির রোষপ্রবণতা ব্যয়িত হয়েছে প্রেমকথনে।যত্নশীল কন্ঠস্বর এর ব্যাখ্যায় বলে অরুচিপূর্ণ মনুষ্যের ক্লেদপূর্ণ কথায় কর্ণপাত না করাই শ্রেয়।তারা হয় বিকৃতমূর্তি।তাদের পেছনে নিজের ধারণা অপচয় নির্বুদ্ধিতা। সরলহৃদয় বুঝবার ভঙ্গিতে গর্দন দোলায়।এভাবেই ফুরায় আধার আদত যামিনী।

রবি অসমন্তরাল প্রভাস্ফূর্তি ছাইরঙা ছাদের ছোট্ট এক কক্ষ বিশিষ্ট চিলেকোঠায়। ঘূর্ণায়মান ফ্যানের ক্যারক্যার আওয়াজ সম্পূর্ণ কামরায়। রৌদ্রের প্রখরতা অত্যন্ত অল্প।গায়ে এসে মাখলেও বিশেষ কোনো টের নেই ঘুমন্ত দেহত্রয়ে।একে অন্যের সাথে মিশে স্বপ্নের ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে পরিগমনে ব্যাপৃত। অন্তরীক্ষ ভিন্ন রূপে সজ্জিত। নারাঙা রঙে নিজেকে সাজিয়েছে।গাঢ় কমলা রঙের মধ্যিমধ্যিতে আপন নীলাভ রংটা উকিঝুকি দিয়ে যাচ্ছে নভে।ভিন্নতায় পরশোভিত এই চিত্রাঙ্কনের মাঝে তন্দ্রা হালকা হয় দিনের আলোয় নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা চন্দ্রের। রোশনি বরাবর মুখ পড়তে কুঁকড়ে উঠলো মুখশ্রী।ভারী দেহ আড়মোড়া দিয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছে।হাত মুখ ধুয়ে আটা মাখতে শুরু করলো।গরম গরম পরোটা ভেজে দিবে মাহরুরকে।অন্য চুলোয় ঝুরো ডিম ভাজি করছে।

বাবার আগে মেয়ে উঠে হাজির।এক লাফে বিছানা থেকে নেমে এসেছে মায়ের সান্নিধ্যে।পা মুড়িয়ে বসে মায়ের কর্মকাণ্ড গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।তখনই আদেশ আসে,

“মিষ্টি?হাত মুখ ধুয়ে আয়”

ঘুমুঘুমু নাদান কন্ঠ মায়ের উদ্দেশ্যে বললো, “তুমিও আসো না মা?”

“সেদিন শিখিয়েছি কিন্তু কিভাবে হাত মুখ ধুতে হয়।”

মিষ্টি চঞ্চু ফুলিয়ে আবদারজনিত গলায় বললো, “তুমিও আসো”

মিষ্টির এরূপ কন্ঠে মুচকি হাসে মল্লিকা।নাহ! এতটুক বাচ্চাকে শেখানো যায়।তবে এটা আশা করা ভুল শিখানোর সাথে সাথে সে ওই কার্যে আমল করবে। বয়সে অত্যন্ত ছোট।বেশি ভার তার উপর না চাপিয়ে উঠে গেলো মল্লিকাও।

গুনগুন করতে করতে মেয়ের হাত মুখ ধুয়ে মুছে দিয়েছে। আকষ্মিক ঘর হতে মাহরুরের ফোনের আওয়াজ ভেসে আসে। মল্লিকা দুর হতে শব্দ পেয়েছে অথচ কাছে থেকে মাহরুরের ইয়াত্তা নেই। মাহরুরের বাহু ঝাঁকিয়ে বললো,

“আপনার ফোন বাজছে”

পাত্তা দিল না মাহরুর।হাত তুলে বললো, “পড়ে!”

ঘুম থেকে উঠবে না সে। ভাবসাবে ঠিক বোঝা যাচ্ছে।মল্লিকা আবার বললো, “দেখেন না কে?দরকারি হতে পারে।”

“তুই..ধরে দেখ” আধোআধো কণ্ঠে উত্তর দিলো মাহরুর।
মল্লিকা ফোন তোলে।কানে রেখে বললো, “আসসালামু আলাইকুম”

অন্যপাশ থেকে এক নারীর গলার আওয়াজ ভেসে এলো।বললো, “মাহরুর কোথায়?”

“উনি ঘুমোচ্ছে।আপনি কে?”

নারীটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বললো, “সে উঠলে আমাকে কল করতে বলবেন। ইটস আর্জেন্ট!”

“কিন্তু..আপনার পরিচয়টা?”

মুখের উপর খট করে ফোন কেটে দিলো মেয়েটি।ভারী অদ্ভুত! কথাবার্তার ভঙ্গিতে মনে হলো সে বিরক্ত মল্লিকার কন্ঠে। ঝাঁঝালো সুর।আদেশের ভঙ্গিতে বলল সবটা। সন্দিহান মল্লিকা মূর্তি হয়ে দাড়িয়ে আছে।মিষ্টি এসে মল্লিকার গায়ে ধাক্কা দিলো।

বললো, “ও মা”

ধ্যান ফিরতেই মল্লিকা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে।বলে, “হ্যা?…আয় নাস্তা করবি।”

“না মা।মাহি বাবার সাথে খাবো।”

মল্লিকা একপলক দৃষ্টি ফেলে মাহরুরের দিকে। ব্যাপারটা মাথা থেকে বের করতে পারলো না। অপেক্ষায় রইলো মাহরুরের ঘুম ভাঙ্গার।ঘুম হালকা হয় সময় নিয়ে।মুখে প্রাণজুড়ানো হাসি নিয়ে মিষ্টির চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে হাত মুখ ধৌত করার জন্য গেলো।ফিরে এসে মল্লিকার পানে চেয়েছে।কেমন যেনো ভোতা মুখটা। মাহরুর সামনে এসে দাড়ানোর পরও তাকালো না?নাস্তা দিচ্ছি কথাটি বললো না?
মাহরুর পাশ ঘেঁষে বসলো।ভাজ করে রাখা পায়ের হাঁটুতে দুহাত বেধে।পর্যবেক্ষণ করলো পুরো মুখটাকে। বিভোর তার চন্দ্রমল্লিকা।বাবার দেখাদেখি মিষ্টি নকলে ব্যস্ত।সেও একই ভঙ্গিতে বসেছে। মাহরুরের দৃষ্টি অনুসরণ করে মায়ের দিকে তাকালো।

মিনিট খানেক পর মল্লিকার ধ্যান ভাঙ্গে। অনুভব হলো দুই জোড়া চোখ তাকে ড্যাবড্যাব করে দেখছে।তাদের এমন চাহনির সাথে তার চাহনি মিললে ফিক করে হেসে ফেললো।

বললো, “এভাবে কি দেখছেন?”

মাহরুর উত্তর দেয়, “তোকে”

মিষ্টিও একই কথা বলে উঠলো, “তোকে”

মাহরুর দ্রুত মিষ্টির দিকে চেয়ে বলল, “উম!না।মা’কে কেউ তুই করে বলে?”

“তুমিতো বলো মাহি বাবা” মিষ্টি দ্রুত উত্তর দেয়।

“তোর মাতো আমার চেয়ে ছোটো মিষ্টি তাই তুই ডাকি।তুই তোর মাকে তুমি বলে ডাকবি কেমন?”

“আচ্ছা”

মাহরুরকে নাস্তা দিয়ে মল্লিকা বললো, “একজন মহিলা কল করেছিলেন।আপনাকে চাইছিলেন।”

অবোধ মাহরুর জানতে চাইলো, “মহিলা?আমাকে কোন মহিলা কল করবে?পরিচয় চাস নি?”

“হ্যাঁ জানতে চেয়েছি উনি বলেনি।ওনার কথা শুনে মনে হলো উনি বিরক্ত প্রচুর।আপনি উঠলে যেনো তাকে কল করেন সেটাও বলেছে”

মাহরুর অবিদিত।কে কল করেছে?কেনো করেছে?সে নিজেও জানে না।মল্লিকা,শিরীন ফরিদা বেগমবিহীন অন্যকোনো নারীর কাছে তার নাম্বার নেই। অপরিজ্ঞাত কারণে মোবাইল নাম্বার থাকতেই পারে নাম্বার।তবে কাজ কি মাহরুরের সাথে? সেদিন রাতেও কল এলো।কেউ কথা বললো না।আজ নাম্বার ভিন্ন।

উঠে দাঁড়িয়েছে মাহরুর। কোমরে দুহাত রেখে কিছু সময় নিলো ভাবতে।পরপর ফোন হাতে নিয়ে কল আসা নাম্বারে আবার ফোন মিলায়। আশা ছিলো একজন নারী ফোন ধরবে।অথচ কন্ঠ আসলো একজন পুরুষের।

মাহরুর বলে উঠে, “আসসালামু আলাইকুম।এই নাম্বার থেকে একজন নারী কল করেছিলেন।”

অন্যপাশ থেকে পুরুষটি বললেন, “হ্যা এই নাম্বার থেকে ম্যাডাম কল করেছিলেন আপনাকে।”

“ম্যাডাম?কোন ম্যাডাম?” জানতে চায় মাহরুর।

উত্তর এলো, “তানিয়া ম্যাডাম।আপনি ডি. বি. সি কোম্পানি লিমিটেড এ চাকরি করেন?”

“জ্বি।আর তানিয়া ম্যাডাম আমার টিমের।”

“জ্বি আমি জানি।আপনার সাথে ম্যাডামের কিছু কাজ আছে।সেই উদ্দেশেই কল করা।”

মাহরুর বললো, “আমার জানা মতে তানিয়া ম্যাডামের আমার সাথে আমার যাবতীয় কাজ অফিসে। অফিসিয়াল কোনো কাজ কি?”

“জ্বি।আপনার এখনই ব্লু লেক রেস্টুরেন্টে আসতে হবে। সাইট ভিসিট এর জন্য”

আশ্চর্য্যচকিত মাহরুর।কিসের সাইট ভিসিট?আর সেই আদেশ তানিয়া কেনো দিবে?যদি আসলেই কোনো কাজ থাকতো ডিরেক্টর নিজে কল করে জানাতো।তানিয়ার কাজ নয় এসব।খটকা লাগে মাহরুরের।

বলে উঠে, “আমি তানিয়া ম্যাডামের সাথে কথা বলতে পারি?”

পুরুষটি হচকচিয়ে বললো, “ম্যাডাম টিমের বাকি মেম্বারদের সাথে ব্যস্ত আছেন।আপনি প্লিজ আধ ঘন্টার মধ্যে চলে আসুন।”

মাহরুর ফোনটি রাখে।সম্পূর্ণ এলোমেলো কথাবর্তা। কোনোটার সাথে কোনো কথার মিল পাওয়া গেলো না।যাবে কি যাবেনা? দ্বিমুখী চিন্তার মাঝে পড়ে হটাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো তার টিমের ডিরেক্টরকে কল করা উচিত।সেই আসল তথ্য দিতে পারবে।

আর কোনো চিন্তা ভাবনা না করেই ডিরেক্টর শরিফুলকে কল করে মাহরুর। একবারে ফোনটা রিসিভ হয়নি। দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। ছুটির দিনকে কেন্দ্র করে হয়তো ফোনটা রিসিভ করছেন না।

আবার কল বাজলো মাহরুরের ফোনে।একটু আগে আসা নাম্বার থেকেই আবার কল এসেছে। বিরক্তি সহকারে মাহরুর কল রিসিভ করে।

“হ্যালো মিস্টার মাহরুর।তানিয়া বলছি”

“জ্বি..জ্বি আমাকে ক্লিয়ার করে বলবেন কিসের সাইট ভিসিট?তাও এই ছুটির দিনে?”

“শফিকুল স্যার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন।আমাদের যে নতুন প্রজেক্টটা?সেই প্রজেক্ট হেড বানিয়েছেন আমাকে।এই কাজে আপনার সাহায্য দরকার।এবার আমাদের টিমের ভালো পারফরমেন্স করতে হবে অন্যদের তুলনায়।আপনার কি ছুটির দিনে কাজ করতে বিশেষ কোনো সমস্যা?”

“সেটা হবে কেনো?আমি গতকালই অফিসে গিয়েছি। ডিরেক্টর স্যারতো প্রজেক্টের ব্যাপারে কিছু বললেন না?আর টিম লিডার আপনাকে করেছেন এই আলোচনা কখন হলো?”

ফোনের অন্যপাশ থেকে তানিয়ার ফটা কন্ঠ ভেসে আসে।বলে,

“উফফো মিষ্টার মাহরুর। ইটস ইউর জব!আপনি এভাবে জেরা করা শুরু করলেন কেনো?আপনি আসুন।এক ঘণ্টার কাজ মাত্র।ডিরেক্টর স্যারের সাথে আমার কথা হয়েছে। উনিই বলেছেন”

মাহরুর খানিক হন্তদন্ত গলায় বললো, “আচ্ছা আচ্ছা।টিমের সবাই কি সেখানে আছে?”

“হ্যাঁ আছে। কাম ফাস্ট!” কড়া আদেশ গিয়ে দ্রুত ফোন কেটে দেয় তানিয়া।

এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না মাহরুর।সকাল সকাল একটা চাপ পরে গেলো।অন্যদিকে ডিরেক্টর কল ধরছে না। দ্বিধান্বিত কোনো কাজে যাওয়ার ইচ্ছেটাও নেই।এদিক ওদিক পায়চারি করছে মাহরুর।যদি সত্যিই কাজ পড়ে থাকে?মাত্র অফিসে জয়েন করেছে। হেলামি করা একদম ঠিক হবে না।মল্লিকা যে নাস্তা দিয়েছিল প্রায় ঠান্ডার পথে।

অনবসর – ক্রিয়াশীল মাহরুরকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

“হয়েছে কি?”

“আরেহ বলিস না!আমি যে টিমে কাজ করি সেই টিমে তানিয়া নামে একটা মেয়ে আছে।কল করে বললো আজ নতুন প্রজেক্টের জন্য নাকি কাজ আছে।যেতে হবে একঘন্টার জন্য।”

“কোথায় অফিসে?”

“না ব্লু লেক রেস্টুরেন্টে।”

মল্লিকাও বিস্ময়ভরা গলায় বললো, “রেস্টুরেন্টে আবার কাজ হয় নাকি?”

“কে জানে!বড়োলোকের বিরাট করবার।”

মল্লিকা জানতে চায়, “আপনি কি যাবেন?”

“গিয়ে দেখি কি বলিস?যদি সত্যিই কাজ হয়। আমরা নিজেদের মতন ভেবে বসে থাকলেতো হবে না।”

“তাই করেন গিয়ে দেখে আসেন।না গেলে যদি আপনার বস রাগ করে।”

মাথার এদিক ওদিক চেয়ে বললো, “আচ্ছা নাস্তা দে।খেয়ে বের হই।”

__

তৈরি হয়ে ব্লু লেক রেস্টুরেন্টের এসে হাজির হয় মাহরুর।বিশাল আকারের রেস্তোরাটি বিলাসবহুল। ব্লু নামটার সাথে মিলিয়ে নীলাভ ক্যানভাসে সাজানো চার দেয়াল।লম্বা আধো বলছে রঙের গ্লাসের অপরপ্রান্তে কৃত্রিম একটা লেক দেখা যাচ্ছে। মাহরুর হিসেব মেলাতে পারলো না এটা লেক নাকি সুইমিং পুল।ওয়েটিং লাউঞ্জ এর সোফায় বসে অপেক্ষারত।হাতের ঘড়ির দিকে চেয়ে সময় গুনছে।ডেকে আনার পর কেনো তাদের কোনো খবর নেই।ফোন করা হলেও ধরছে না।আশপাশের পরিবেশে দৃষ্টি বোলাতে বোলাতে একজন ভদ্রলোক সামনে এসে দাঁড়ান।

বলেন, “আপনি মিষ্টার মাহরুর?”

মাহরুর উঠে দাড়িয়ে বললো, “জ্বি।আপনি কে?”

“আমি ডি. বি. সি কোম্পানির একজন কর্মকর্তা।”

ভ্রু কুঁচকে মাহরুর বলে উঠে, “আপনাকে অফিসে কখনো দেখা হয়নি।”

“আপনার আমার ডিপার্টমেন্ট আলাদা তাই হয়তো।তানিয়া ম্যাডাম উপরে আছে।আসুন আপনি আমার সাথে।”

মাহরুরের মনে প্রশ্ন জাগে আরো একটি।যেহেতু সে অন্য ডিপার্টমেন্ট এর তাহলে তানিয়ার সাথে কি কাজ তার?আজ সকাল থেকে এত এত প্রশ্ন উত্তর হয়ে আসছে মাহরুর প্রায় বিরক্ত। ধাঁধানো কথাবার্তা সকলের।উপরে গিয়ে নাহয় সবটা জানা যাবে।এই উদ্দেশ্যে মাহরুর লোকটির পিছু হেঁটে চলে গেলো।

উপরের ফ্লোরে ভিআইপি এরিয়া।মানুষের তেমন আনাগোনা নেই।অল্পস্বল্প সমাগমে দূরে তানিয়াকে বসে থাকতে দেখা গেলো। মাহরুরের গতি অত্যন্ত ধীর।পা দুটো ইচ্ছার বিরুদ্ধে এগোচ্ছে।

তানিয়ার সামনে এসে দাড়াতেই সে হেসে বললো, “মিষ্টার মাহরুর।প্লিজ সিট”

মাহরুর বসলো না।দ্রুত গলায় প্রশ্ন করলো, “টিমের বাকিরা কোথায়?”

“আপনি এত উতলা হচ্ছেন কেনো?একটু বসে রিল্যাক্স হন।”

মাহরুর অনিচ্ছুক।প্রথম থেকেই ব্যাপারটা বিরূপতার কাতারে পড়ে আছে।এরমধ্যে শুধু তানিয়াকে একা বসে থাকতে দেখে অভিশঙ্কা আরো বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো।

মুখোমুখি বসে দ্বৈধ গলায় জানতে চাইলো, “বলুন কাজটা কি?আমি ডিরেক্টর স্যারকে অনেকক্ষন যাবৎ কল করছি।উনি রেসপন্স করছেন না।”

তানিয়া কফির মগটা হাতে তুলে স্বাচ্ছন্দ্যে বসলো।পায়ের উপর পা তুলে। আটসাট কাপড়ে বাজে দেখাচ্ছে তাকে। মাহরুর দৃষ্টি নামিয়ে নেয়।

তানিয়া উত্তর দিলো, “আপনি জানেন না ডিরেক্টর অফ ডে- তে কল রিসিভ করেন না?”

“জ্বি না।”

“ব্যাপার না।”

“আমরা কি কাজের বিষয়ে আলোচনা করতে পারি?”

“অবশ্যই।সেটার জন্যই আপনাকে ডাকা।”

মাহরুর সাথে ব্যাগ এনেছে।যেহেতু কাজ নতুন প্রজেক্টের প্রত্যেকটা বিষয় নোট করার ব্যাপার আছে।নতুন ফাইল বের করে তানিয়াকে এড়িয়ে বললো, “বলুন”

মাহরুরের কানে মেয়েলি তাচ্ছিল্যপূর্ন হাসির আওয়াজ আসে।সামনে বসে থাকা তানিয়া মাহরুরের এরূপ আচরণে অবজ্ঞা করে হাসছে। মাহরুরের এই হাসি বোধগম্য হয়নি।চোখ তুলে তাকায় বিরক্তির সাথে।

তানিয়া মুখে হাত রেখে হাসি থামিয়ে বললো, “খুব পাংচুয়াল মানুষ আপনি মিষ্টার মাহরুর ইবনাত।কিন্তু এখানে এসবের প্রয়োজন নেই।”

মাহরুর কণ্ঠে সামান্য রুষ্টতা টেনে বলতে লাগলো, “আমাকে এখানে ডাকলেন।বললেন টিমের সকলে আছে।কাজ করতে হবে।অথচ আপনি এখানে একা।আমি অনেক সময় যাবৎ এখানে।কোনো কাজের কথা আমি এখানে হতে দেখছি না।আপনি বারবার প্রহেলিকায় ফেলছেন।”

মাহরুরের কথায় তেমন কোনো প্রতিমূর্তির পরিবর্তন দেখা গেলো না তানিয়ার।উল্টো নিজের ভঙ্গিমা বজায় রেখে বললো, “অনেক ধাঁধায় ফেলেছি আপনাকে তাই না? লেট মি ব্রেক ইট।আপনাকে আমি এখানে কিছু বিষয় আলোচনা করতে ডেকেছি।যা বলবো সরাসরি বলবো।”

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মাহরুর বললো, “জ্বি?কি বিষয়?”

“আপনার সম্পর্কে আমি ইচ অ্যান্ড এভ্রি ডিটেইলস কালেক্ট করেছি।আপনি একজন ডিভোর্সী পুরুষ। কয়েকমাস হলো নিজের চাচাতো বোনকে বিয়ে করেছেন যেকিনা উইডো ছিলো।আর আপনি যার বাবা বলে নিজেকে দাবি করেন সে আপনার মেয়ে নয় আপনার সেকেন্ড ওয়াইফ এর আগের ঘরের বাচ্চা।”

কপাল মাত্রাতিরিক্ত কপালে ভাঁজ ফেলে বললো, “হ্যা!তো?”

“আপনাকে সেদিন অফিসে কেউ একজন চিরকুট দিয়েছিল মনে আছে?”

এবার বাকা হাসে মাহরুর।বলে, “আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম এটা কোনো না কোনোভাবে আপনার কাজ।আপনার দৃষ্টি আমার জন্য মোটেও ভালো ঠেকছিল না।”

বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি তানিয়ার মুখে। গাঠ খুলছে ধীরেধীরে।তানিয়া প্রতিউত্তরে বললো,

“আপনি খুবই অ্যাটিটিউড এর সাথে চিরকুটের উত্তর দিয়েছেন।যেটা আমার পছন্দ হয়নি।কে আপনার চাঁদ?আপনার স্ত্রী?”

সোফার হাতলে নিজের হাত এলিয়ে মাহরুর তানিয়ার ভঙ্গিতেই তাকে উত্তর দিলো, “অবশ্যই আমার স্ত্রী।কেনো আপনি আশা করেছিলেন আপনি?”

“আমাকে কি চাঁদের থেকে কোনো অংশে কম মনে হয়?”

তাচ্ছিল্যপূর্ন হাসিটা তানিয়ার মুখ থেকে মাহরুরের মুখে আসলো।নিজের প্রশংসা করছে? এমনও মানুষ আছে পৃথিবীতে? মাহরুর বললো,

“না!আপনাকে আমার চোখে চাঁদের কোনো অংশই মনে হয়না।…. তবে হ্যা হতে পারেন আপনি চাঁদ,তারা, গ্রহ, উপগ্রহ,নক্ষত্র।সেটা অন্যের চোখে।আপনার ক্ষেত্রে আমি বলবো আমার চোখ নষ্ট।আমি আমার চন্দ্র ছাড়া আর কাউকে চোখে দেখতে পাইনা।”

মুখ শক্ত করে তানিয়া বলল, “চোখের ডাক্তার দেখানো উচিত আপনার!”

“আমার চোখ এর চিকিৎসা করতে পারবে এমন কেউ জন্ম নেয়নি।আপনি বরং নিজের দৃষ্টি বিশুদ্ধ করুন। অজান্তেই আপনার চোখ অন্যের প্রেমিক,অন্যের স্বামী আর অন্যের বাবার উপরে যাচ্ছে”

“আপনি অপমান করছেন আমায়?”

মাহরুর উঠে দাড়ালো।বললো, “যে যেটার যোগ্য।আমার বোঝা হয়ে গেছে আমাকে এখানে কেনো ডেকেছেন।আসি আমার কাজ বোধহয় শেষ।”

যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে তানিয়া হাত টেনে ধরে মাহরুরের।এরূপ সাহসিকতায় রেগে উঠে মাহরুর।ফিরে তাকালো তৎক্ষনাৎ।অগ্নিদৃষ্টি ছুঁড়ে তানিয়ার দিকে।

ফোঁসফোঁস করতে করতে বললো, “লজ্জা করা উচিত আপনার!পর পুরুষকে হাত লাগান কোন সাহসে?রূপ না গুণের জালে ফেলার চেষ্টা করুন।তবে আমাকে আপনার রূপ গুন কোনোটাই বশ করতে পারবে না।সরি”

সদর্পে চলতে লাগলো মাহরুর।পেছনে হতভম্ব দাড়ানো তানিয়াকে দেখার বিন্দু ইচ্ছে নেই।কত বড় নির্লজ্জ!কাজের বাহানায় রেস্টুরেন্টে ডেকে প্রেমালাপ করার চেষ্টা করছিল। অনবরত কল করতে লাগলো ডিরেক্টরকে।এক প্রকার বিরক্ত হয়েই কল রিসিভ করেছে ডিরেক্টর শরিফুল।কোনো রিস্ক না নিয়ে সবটা জানায় তাকে।ভাগ্য সাথ দিলো। মাহরুরের ফোন অটো কল রেকর্ড অন করা আছে।সাথে অতিরিক্ত সতর্কতা দেখিয়ে অফিসের সিসিটিভি চেক করার জন্যও অনুরোধ করলো মাহরুর।তাহলেই সেই চিরকুটের মালিককে স্বচক্ষে দেখতে পারবে ডিরেক্টর।আগামীকাল দেখবে বলে জানায় ডিরেক্টর শরিফুল।

বাড়ি ফিরেছে।আজ দিনটাই মাটি।মল্লিকার সাথে অসৎ হতে পারবে না। বিশ্বাসঘাতক নয় সে।তবে কিছু সত্য লুকায়িত থাকলে সেটা ভয়ঙ্কররূপে এসে হাজির হয় কোনো এক সময়ে। রাতে সবটা জানাবে ভেবেই বিকেল দিকে তার স্টেশনারী শপে এসে বসলো।দুলাল কাজ করছে বেশ মনোযোগের সাথে। রেদোয়ান এর ঋণ আছে মাথায়।তার ছোট্ট সংসারে তেমন খরচ নেই। অল্পতেই চলে যায় তিনজনের।মল্লিকা, মিষ্টির চাহিদা অত্যন্ত কম।তারা মাহরুরের ভালোবাসার প্রাচুর্যে খুশি।সারা সপ্তাহের হিসেব নিকেশ করে দেখলো সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে আয় আসছে।সামনের রাস্তায় স্কুল থাকায় এখানে স্টেশনারি এর চাহিদা বেশি। দুলালকে তার পরিশ্রমের প্রাপ্ত প্রশংসা দিয়ে বাড়ি ফেরে মাহরুর।

উকি দেওয়া চাঁদের আলোয় যে একাকী সময়টা আছে?আজ সেই সময়ে নতুন অতিথি যোগ দিয়েছে।মিষ্টি নামক অতিথি। হিংসুটে বাবা মার মতন নিজেদের মতন সময় কাটাতো। আজ মেয়েকে সাথে নিয়েছে। মাহরুর কথার অগোচরে মল্লিকাকে সবটা জানালো।

সর্বশেষ বললো, “আমাকে অবিশ্বাস করবি না চন্দ্র। আমি পুরো মানুষটাই তোর নির্ভরশীলতায় বেচে আছি।আমার জীবনে চার নারী।আমার মা,আমার বোন,আমার স্ত্রী আর আমার মেয়ে।এই সম্পর্কগুলোর উর্ধ্বে আমি আর কোনো নারীকে মৃত্যু এসে হাজির হলেও গ্রহণ করবো না।শুধু বিশ্বাস রাখিস।”

চমকপ্রদ হাসি মল্লিকার মুখে। মাহরুরের চওড়া হস্ত নিজের মুঠোয় নিবিদ্ধিত করে বললো,

“আপনার সচ্ছতাকেইতো সেই সতেরো বছর বয়স থেকে ভালোবেসে এসেছি।অনেকদিনের পুরোনো ভালোবাসা মাহরুর ভাই।অনেকটা মজবুত।না কেউ ভাঙতে পারবে না কেউ নড়বড়ে করতে পারবে।আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-২৯+৩০

0

চন্দ্র’মল্লিকা ২৯
লেখা : Azyah_সূচনা

রেদোয়ান আর শিরীন সবাইকে চমকে দিয়ে তার বাচ্চাছানাদের নিয়ে হাজির।ঈদের দ্বিতীয়দিন রাতে আসার কথা ছিলো।চলে এসেছে ভোর ছয়টায়। গভীর নিদ্রায় মগ্ন তিন দেহ ধড়ফড়িয়ে উঠেছে দরজা পেটানোর শব্দে।

মাহরুর অস্পষ্ট চোখে শিরীনকে দেখে বললো, “ভয় পাইয়ে দিয়েছিস!বাস থেকে নেমে কল করবিতো?”

শিরীন উত্তর দিলো, “বাস দিয়ে আসলে না বাস থেকে নামবো।গাড়ি ভাড়া করে এসেছি।বাস টিকেট পাইনি।”

“আগে জানাবি না বলদ মেয়ে।দাড়িয়ে থাক এখন।”

পাশে দাঁড়ানো মল্লিকা দুজনের মধ্যে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিল।অবশেষে বলে উঠলো,

“পাশের ঘরের চাবি দিন।আমি ঘর পরিষ্কার করে দেই।”

মাহরুর চাবি এনে দিলো।শিরীনের উদ্দেশে বললো, “তোরা এই ঘরে দশ মিনিট বিশ্রাম কর। আম্মার ঘরে গিয়ে পড়ে ঘুমাস।”

সুমাইয়া জেগেই আছে।সায়মন মুখ হা করে ঘুমোচ্ছে।মিষ্টির অর্ধ জাগনা। মাহরুর আর মল্লিকা দুজনে মিলে ঘর ঠিকঠাক করে দিলো। ঈদ উপলক্ষে নতুন চাদর আর গোছগাছ করাই ছিলো।শুধু একটু ঝেড়ে নিলো।

মাহরুর বিছানা ঠিক করতে করতে বলল, “হিংসুটে বড় ভাবির এর মতন করে তেজ দেখিয়ে বল?আপনার বোনের জন্য এই সাজসকালে ঘর পরিষ্কার করতে হচ্ছে।”

ঘুমটা এখনও চোখ ছাড়েনি। মাহরুরের উদ্ভট কথা শুনে সোজা হয়ে দাঁড়ায় মল্লিকা।বলে,

“আমি কেনো বলবো এই কথা।শিরীন বুবু কি আমার পর?”

হাত চালাতে চালাতে মাহরুর বলে, “না পর হবে কেনো?কিন্তু এখনতো সম্পর্ক বদলেছে।শিরীন তোর ননদ।হিরা শিরীনকে সহ্য করতে পারতো না। আসলেই মুখ ফুলিয়ে রাখতো।আমি আরো অনেককে দেখেছি শশুরবাড়ির মানুষকে পছন্দ করে না। তুইওতো বউ জাতি।তোরও একটু কুটনামি করা উচিত।”

নিজেই নিজের বোনের সাথে বউয়ের ঝামেলা বাধানোর চেষ্টায়।সুখী সুন্দর সম্পর্ক বোধহয় তার পছন্দ হচ্ছে না।আগ বাড়িয়ে আগুন লাগানোর চেষ্টা।

মল্লিকা বলে, “আমি কক্ষনো এমন করবো না।আপনার প্রাক্তন স্ত্রীতো আপনাকেই পছন্দ করতো না। বুবুকে কি করে পছন্দ করবে?”

মাহরুর হেসে উত্তর দেয়, “তা অবশ্য ঠিক।আচ্ছা কাজ শেষ আয়।”

মাটির চুলোয় রান্নার রান্না হবে।এটা মাহরুরের আবদার।তার মা থাকতে প্রতি রোজায় নতুন মাটির চুলো তৈরি করতো।ঈদের দিন সেখানেই ধোঁয়া উঠিয়ে রান্না চলতো।ঘ্রাণে মো মো করতো পুরো গ্রাম। মল্লিকাকে এক কথা দ্বিতীয়বার বলতে হয়না।এখন থেকে নয় ছোটোবেলা থেকেই আদেশ মান্য করে নিত মাথা নত করে।প্রশ্ন করতো না বিপরীতে।

বিশ্রাম শেষে শিরীনও কাজে হাত লাগায়। লাকড়ি নাড়তে নাড়তে বললো,

“কিরে চন্দ্র?ভাই যা বলে এককথায় মেনে নিস।উল্টো কোনো কথা বলিস না কেনো?”

শিরীনের কথায়ও ভিন্নতা লক্ষ্য করে মল্লিকা।সকাল বেলা হিংসুটে ভাবি হওয়ার কথা বলছিলো মাহরুর।এখন শিরীন বলছে কেনো তার ভাইয়ের কথা শুনে সব?পাগল হয়ে গেলো নাতো দুজন?কেনো সুখী সংসারে আগুন দিতে উঠে পরে লেগেছে?

মল্লিকা বলে উঠে, “তোমাদের কি হয়েছে বুবু বলোতো?সকালে একজন বলছে হিংসুটে ভাবি হতে?এখন আরেকজন বলছে ভাইয়ের সব কথা কেনো শুনি?তোমরা দুজন আপন ভাই বোন হয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করলে কেনো?আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

শিরীন আকস্মিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।হতবাক মল্লিকা। ড্যাবড্যাব চোখ শিরীনের কারণ অজানা হাসির দিকে চেয়ে আছে।

শিরীন বললো, “চন্দ্র শোন?ভাইয়া সত্যি বলে চন্দ্র অনেক বোকা।”

কপাল কুঁচকে মল্লিকা প্রশ্ন করে, “কেনো?”

“ভাইয়া তোর সাথে মজা করেছে।আর আমি?কথার কথা বললাম।স্বামীকে হাতে রাখতে হবে না? সব কথায় হ্যা হ্যা করবি না।”

“না না করলে বুঝি স্বামী হাতে থাকবে?উল্টো বিগড়ে যাবে।”

“এই যুগে এসে এত সরল সোজা হতে নেই।মাঝেমধ্যে ‘ না ‘ শব্দটা ব্যবহার করতে হয়।আমি জানি তুই সারাক্ষণ হারানোর ভয়ে থাকিস।ওই বদ্ধ বাড়িতে থাকতে থাকতে এমন হয়ে গেছিস।নিজেকে হাল্কা কর চন্দ্র।মনে রাগ,কষ্ট,অভিমান থাকলে প্রকাশ করবি।জমিয়ে রাখবি না।”

মল্লিকা সতেজ হেসে বললো, “বুবু।আমি জানি।কিন্তু জানো আমি কখনো ওনার কথা অমান্য করতেই পারবো না।তুমি বললে না মনের ভাব প্রকাশ করতে?আমার মন সায় দেয়না তার উপর রাগ দেখাতে,তার অবমাননা করতে।আমি হয়তো এই সমাজের কাছে অনেক পিছিয়ে গেছি।কিন্তু তোমার ভাই আমাকে শেখাচ্ছে।সে যতটা সাহসী আমাকেও ততটাই সাহসী করছে ধীরেধীরে।অনেক যত্ন করে হৃদয়ের আঙিনায় বীজ বপন করেছিলাম জানো? গাছটা অল্পতেই মারা যায়।দীর্ঘ ছয় বছর পর আবারও সেই গাছ সতেজ হয়ে উঠছে।যত্নে একদিন পরিপূর্ণ গাছ হয়ে যাবে বুবু।আমি হতে পারি ভীতু।কিন্তু তোমার ভাইয়ের সামনে সেটা আমার ভয় না।আমি স্বেচ্ছায় করি যা করি।”

মায়ের মতন করে মাথায় হাত বুলায় শিরীন।বুক ভরে আসছে মল্লিকার কথাগুলোয়।তাদের দুজনার গল্প ভিন্ন।তাদের জীবনটা ভিন্ন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।শিরীন দুষ্টুমির ছলে বলেছিলো মাহরুর এর সব কথা যেনো না মানে।

শিরীন বললো, “এই স্বভাবটা যেনো শুধু আমার ভাইয়ের সাথেই থাকে।আশপাশের মানুষের জন্য কঠিন হতে হবে চন্দ্র।”

“তোমরা আমার পাশে থাকলে আমি পারবো।”

কথোপকথন এর মধ্যিখানে মাহরুরের রসিক কন্ঠ ভেসে এলো। দুর থেকে দুজনকে গিট্টু পেকে বসে থাকতে দেখে বললো,

“কি কু-পরামর্শ করছিস দুজনে?আমাকেও বল।শুনি?”

শিরীন একই সুরে বলে, “তোমাকে জানানো যাবে না।আমাদের মেয়েদের কথা এসব।”

মাহরুর বললো, “যেহেতু মেয়েদের আলাপ আমি নিজ থেকে পা পিছিয়ে নিচ্ছি।তোদের কথায় অনেক প্যাচ থাকে।”

দুইজনকে স্তম্ভিত করে মুখ খুলে মল্লিকা।বলে, “কে বলেছে আমাদের কথায় প্যাচ?আমরা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছিলাম।আপনি বেশি বুঝেন”

তীক্ষ্ণ নজর ছুঁড়ে মাহরুর।পাখির মুখে বুলি ফুটেছে।কিভাবে কর্কর করে জবাব দিয়ে বসলো।কথার ধাঁচে মাহরুর গোলগোল চোখে চেয়ে। শিরীন অবাক হয়।পরপর সামান্য হাসে।তার কথা অল্প হলেও মাথায় গেঁথেছে মল্লিকার।

মাহরুর মল্লিকাকে ভালোমত পর্যবেক্ষণ করলো।চোখ তুলছে আবার নামিয়ে ফেলছে মেয়েটি।কোমরে দুহাত রেখে শিরীনের উদ্দেশ্যে বললো, “তর্ক করা শিখাচ্ছিস ওকে?”

“না না ভাইয়া আমি কিছুই শিখাইনি।” বলে উঠে দৌড় লাগায় শিরীন।
মল্লিকা ঠোঁট ভেজায়।জড়োসড়ো হয়ে উঠে দাড়িয়ে মাহরুরের দিকে এগিয়ে আসলো।

বললো,

“মুখ ফুটে বেড়িয়ে গেছে।আপনি রাগ করেছেন?”

“হ্যা” স্পষ্ট জবাব এলো মাহরুরের পক্ষ থেকে।

“আর বলবো না।”

“এখন আরো রাগ বাড়ছে।”

আহত দৃষ্টিতে তাকায় মল্লিকা।বলে, “কি করলে রাগ কমবে?”

“আদর করলে কমবে”

____

অন্যদের থেকে বেশি বোধহয় মিষ্টির মনে ধরেছে শশীদের নতুন বাড়ি।পাশের গ্রামেই।তবে আসা যাওয়ার পথ অল্প।তাড়াতাড়ি টমটমে করে পৌঁছানো যায় সেখানে।দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়ার আগেই মল্লিকা মাহরুর,শিরীন,রমজান সাহেব,ফরিদা বেগম আর শশীর পরিবার হাজির। এতএত মানুষের কণ্ঠধ্বনি দেয়ালের এপার ওপার বেজে চলেছে। আলাদা আলাদা যুগল তৈরি করে খোশগল্পে মত্ত। শশী মল্লিকাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখালো।এক তলা বাড়ি।সুন্দর করে সাজিয়েছে।চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা।ছাদে একটা দোলনাও বসিয়েছে।

সেখানে দুই বান্ধুবি মিলে গল্প করতে লাগলো। দোল খেতে খেতে শশী জানতে চায়, “এখন খুশি আছিসতো?”

স্ফুরিত মুখমণ্ডল মল্লিকার।ঠোঁটের কোণে প্রস্ফুটিত রেখা ফুটিয়ে বললো, “ভীষণ রকমের শান্তি আমার জীবনে সখী।”

“কারো খারাপ নজর যেনো তোদের উপর না পড়ে।এই দুআ করি।”

“আমি তোকে কি বলতাম মনে আছে?”

“কি বলতি?”

দোল খাওয়ার গতি বাড়িয়ে মল্লিকা বলে উঠে, “বলতাম মাহরুর ভাই ভালো মানুষ।খাঁটি একজন মানুষ।আমার প্রথম প্রেম?আমার ভালোবাসা বলে নয়।সে সত্যিই যোগ্যতার অধিকারী।আমি তার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছিলাম।আজ ওই ব্যক্তিত্বটাকে নিয়ে বাঁচছি।”

“মাঝেমধ্যে ভাগ্য সময় নেয়।তারপর যা দেয় সেটা হয় অত্যন্ত মিষ্ট।”

“জানিস সখী?পুরোনো কথা মনে পড়ে। আমার আগের সংসারটা?তারপর পড়ন্ত বিকেলে তার মুখ দেখি আমার চিন্তেরা দৌড়ে পালায়।”

কৌতূহলি শশী জানতে চায়, “তোর মাহি ভাইয়ের কি সবচেয়ে বেশি তোর ভালো লাগে?”

আকাশপানে একঝাঁক পাখি উড়াল দিচ্ছে। কিচিরমিচির শব্দে ভরিয়ে তুলছে অখিলমন্ডল। ঘোরগ্রস্ত হয় চন্দ্রমল্লিকা।ভেসে যাওয়া তুলোর মত মেঘে আচ্ছন্ন হয়।সম্পূর্ণ বেখেয়ালি।

উদাসী গলায় উত্তর দেয়, “তার কান্তিমাখা মুখের হাসিটা আছে না?সেটা আমার ভীষণ রকমের পছন্দের।”

মুচকি হেসে আবার প্রশ্ন করে শশী, “কখনো প্রকাশ করেছিস ভালোবাসা?বিয়ের পর?”

“সে একটা ভ্রম।আমি তার সামনে থাকলে ভ্রমজালে ডুবে যাই। শব্দরা ছুটি নেয়”

“মাহি ভাই প্রকাশ করে ভালোবাসা?”

“প্রতিনিয়ত অনুভব করায়।”

“মিষ্টিকে ভালোবাসে মাহরুর ভাই?”

“বোধহয় আমার চেয়ে বেশি।জানিস আমার কখনো কখনো মনে হয় সেই মিষ্টির আসল বাবা। ফারহানকে মিষ্টি পায়নি।মায়া ছিলো মেয়ের প্রতি।কিন্তু সে থাকতো সারাক্ষণ নিজের দুনিয়ায় মগ্ন।আমি তাকে খারাপ বাবা বলে কোনোদিন আখ্যায়িত করবো না।তারপরও একটা খালি স্থান ছিল জানিস?সেই স্থানটা সর্বোপরি পূর্ণ করছে মিষ্টির মাহি বাবা।”

মায়া, মোহ,ভালোবাসা আর ভ্রম সাগরে নিজেকে আবিষ্কার করছে।নীলাকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো মেঘকে নিজের সাথে তুলনা করে দিলো।আনমনে হাসলো এই ভেবে এই বিশাল অম্বর মাহরুর।সেখানে সাঁতরে বেড়াচ্ছে মল্লিকা। নির্দ্বিধায়। রাত ঘনালে যখন আধার আচ্ছন্ন হয়ে উঠবে এই আকাশ তখন চন্দ্র হয়ে চলে আসবে মল্লিকা আলো ছড়াতে।একে অপরকে পরিপূর্ণ রাখবে দিবারাত্রি সর্বক্ষণ।

অনেক সময় নিজেদের মতন সময় কাটিয়ে নিচে এসেছে শশী আর মল্লিকা।স্বামী থেকে শুরু করে শশীর শশুর শাশুড়িও অমায়িক মানুষ। দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটি এত সহজভাবে নিবেন কল্পনা করেনি মাহরুর আর মল্লিকা।খাওয়া দাওয়ার পর্ব চলছে।

হটাৎ মিষ্টি বায়না ধরলো, “মা?মাহি বাবা?আমার এমন একটা বাড়ি চাই।আমার অনেক ভালো লেগেছে এই বাড়িটা।”

মিষ্টি পরপর শশীর ছেলে সীমান্তকে বললো, “এই তোমাদের বাড়িটা আমাকে দেবে?”

শশী বলে উঠে, “এটাতো তোরই বাড়ি।তোর ভবিষ্যৎ শশুরবাড়ি।”

মিষ্টি অবুঝ স্বরে বলল, “শশুরবাড়ি কি?”

“এটা বুঝতে বড় হতে হবে তোর।এখন চটপট খেয়ে নে।”

তাদের কথোপকথন এ সবাই হাসছে।আনন্দ পাচ্ছে বাচ্চার বাচ্চামোতে। অথচ মাহরুরের মুখে অন্ধকার। ঘোর অন্ধকার।সবার চোখ এড়ালেও মল্লিকার দৃষ্টিতে সবার আগে এসেছে।কি হলো তার?এই আধার আকাশে আলোকিত করতে হাজির চন্দ্র।

এসে জানতে চাইলো নিভু নিভু গলায়, “কিছু কি হয়েছে?”

অন্যমনস্ক মাহরুর ধ্যানে ফেরে।বলে উঠে, “হুম?…না কিছু না।”

“আপনার মন খারাপ মনে হচ্ছে।”

স্বাভাবিকতা বজায় রেখে মাহরুর বলে, “কিছু হয়নি চন্দ্র।”

“আমাকে বলবেন না?”

অবশেষে সামান্য হাসি ফুটে মাহরুরের মুখে।বলে, “পড়ে বলবো।সবার সামনে বলাটা ঠিক দেখায় না।”

“আচ্ছা”

শশীদের বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়ি ফেরা অব্দি মাহরুরের মুখ ভার।সবার অগোচরে মল্লিকার প্রতিনিয়ত নজরে পড়েছে।মন উশখুশ করছে জানার জন্য।তার মুখের কালো আঁধার কতটা কাতর করছে মল্লিকাকে সে জানে না।হাসিখুশি দেখতে চায় তার অম্বরকে।রাগ দেখাক তবে হাসিখুশি থাকুক।

শিরীনদের আড্ডা চললো মধ্যরাত অব্দি।পুরোনো ঘড়ির কাঁটা ঠিক দুইটা পঁচিশে এসে থেমেছে। কাঁথা বের করে মাহরুর ঘুমানোর জন্য উদ্যত হলে হাত আটকে দেয় মল্লিকা। মাহরুরের চওড়া হাতে নিজের হাত গুজে বাড়ির উঠোনে নিয়ে এলো।

অবাক মাহরুর।তবে জানতে চায়নি কেনো মল্লিকা তাকে এখানে আনলো।দুজনেই বসেছে উঠোনে।

মল্লিকা বললো, “মন উদাস করে আছেন কেনো?”

“এটা জানতেই এখানে এনেছিস?”

“হুম”

নভোমন্ডল এর দিকে চেয়ে তারার চিকচিক দেখতে দেখতে মাহরুর বলে, “জানিস মিষ্টির আবদারটা আমার হৃদয়ে এসে লেগেছে।”

“কোন আবদার?”

“ওর একটা বাড়ি চাই।আমার বাচ্চাটার মনে ধরেছে একটা বাড়ি।আমার মনে হচ্ছে মিষ্টি ওই চিলেকোঠায় খুশি না।আমি এমন একজন বাবা হলাম কেনো?মেয়ের মুখ থেকে কথা জমিনে পড়ার আগে কেনো পূরণ করতে পারলাম না?”

মহরুরের বিসন্ন মনে খানিক ভালোবাসা দরকার। দুহাত একত্র করে বসে থাকা তাকে সান্তনা দেওয়া প্রয়োজন। মাহরুরের মাথায় হাত রেখে নিজের কাধে এলিয়ে দেয় নিজে থেকেই।এখন লাজ নয় তার মন ভালো করা মুখ্য।

মল্লিকা বলে, “এক লাফে গাছে ওঠা যায় না।আমি জানি আজকে পারছেন না একদিন ঠিকই পারবেন।আমি এটাও জানি মিষ্টির মনে ধরেছে বাড়িটা।তাই বলে জেদ ধরবে না ও।আমার মেয়েটা অল্প বয়সে যা কিছু দেখেছে?তাতে আমি বলবো সে মানিয়ে নেওয়ার মতন মেয়ে।আপনি ওকে বুঝালে ও ঠিক বুঝবে।”

আবেশে প্রেয়সীর কাধে চোখ বুজলো মাহরুর।বললো, “আমি চাই না ও মানিয়ে নেক।আমি চাই ওর সব ইচ্ছে পূরণ হোক।”

“তাহলে ওকে বলেন অপেক্ষা করতে।সঠিক সময়ে সঠিক জিনিস পাবে।বাচ্চাদের না চাইতেই যদি সব দিয়ে দেওয়া হয় বড় হয়ে ওদের মধ্যে ধৈর্য্য বলতে কিছু থাকে না।”

“সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে মিষ্টিকে।সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ দিতে হবে।জন্মের পর থেকে যে ক’টা বছর তুই আর মিষ্টি অন্ধকারে ছিলি?সবটা যেনো ধুয়ে মুছে যায়।”

মল্লিকা হেসে বললো, “আপনি এত ভালো কেনো?”

“তোর ভালোবাসায়”

“আজ আমরা তিনজন কি সুন্দরভাবে পরিপূর্ণ তাইনা?”

মাহরুর কিছুক্ষণের জন্য নীরবতায় ছেয়ে যায়। সত্যিইতো পূর্ণ তারা।অপূর্ণতা ঘুচে গেছে।আর সেটা নিজে থেকে চন্দ্র স্বীকার করছে। মিনিট দুয়েক এর নীরবতা শেষে মাহরুর বলতে শুরু করে,

“আমার বিয়ের দিন তোকে ভিন্ন রূপে দেখেছিলাম।কবুল বলতে হৃদয় ছিঁড়ে যাচ্ছিলো।আমি অন্যায় করেছি।ভীষণ রকমের অন্যায়।তারপর এলো বাসর রাত।আমি ঘরে যেতে চাইনি।আমি চাইনি নতুন ওই নারীর মুখ।তারপরও বাধ্য হয়ে গিয়েছি।হিরা অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য।রাত জেগে।তার দিকে চেয়ে দেখলাম মুচকি হাসির সাথে আমাকে দেখছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে যখন ঘুমোতে গেলাম তখন হিরা কি বলেছে জানিস?নতুন বউকে নাকি বাসর রাতে উপহার দিতে হয়।প্রথমে মনে হলো মেয়েটি চঞ্চল।যেহেতু বিয়ে করে ফেলেছি ওর জীবন নষ্ট করার অধিকার আমার নেই।আমি আশ্বাস দিলাম পরে কিছু উপহার কিনে দিবো।পরদিন আমার মায়ের কাছ থেকে ওর বাবা যে স্বর্ণ দিয়েছিল সেটা এক প্রকার বেয়াদবি করেই ফিরিয়ে নেয়।মাকে সরাসরিই বলেছিলো আমার জিনিস আমি অন্য কারো কাছে রাখতে পছন্দ করিনা।সে আবার আবদার করে।তার স্বর্ণের চেইন চাই। খটকা লাগে আমার।নতুন পরিচিত একজন মানুষের কাছে কত সহজেই আবদার করে ফেলছে।তখনও মেনে নিয়েছি।ভেবেছি স্বামী হিসেবে হয়তো অধিকার খাটাচ্ছে।ধীরেধীরে সংসার করতে শুরু করলাম।একদিন তোকে স্বপ্ন দেখেছি চন্দ্র।তোর কান্নারত মুখ স্পষ্ট দেখেছি সেই স্বপনে।আমি সেদিন থেকে এলোমেলো।পাগল হতে শুরু করেছি সেদিন থেকেই। যার সাথে সংসার শুরু করলাম সে আমার চিলেকোঠা দেখে আমাকে এক মুহূর্তে অবজ্ঞা করতে শুরু করে।নিজের বাবাকে কল করে কান্নাকাটি করে।ওর বাবা আমাকে ফোন করে বলে যে করেই হোক তার মেয়েকে নিয়ে যেনো ভালো ফ্ল্যাটে উঠা হয়। টাকাও সাধে আমাকে।আমি নেইনি। স্পষ্ট জানিয়েছিলাম স্বামীর সংসার করতে হলে স্বামী যেভাবেই রাখুক থাকতে হবে।তারপর চলতে লাগলো আমার বিষাদে ঘেরা সংসার। চাহিদা বাড়তে থাকে হিরার।আর সেই চাহিদা যথাসাধ্য পূরণ করার চেষ্টা করি।যত দেই তত চায়।একদিন জানলাম তোর ঘরে একটা ফুটফুটে কন্যা এসেছে। কতো ছট্ফট করেছি দেখার জন্য। পায়চারি করেছি হাসপাতালের বাহিরে।সাহস করতে পারিনি।তোর বাড়ির কাছে প্রায়ই আসতাম।উকি ঝুঁকি দিতাম।তোকে পেতাম না।একদিন ফারহান এর কোলে তোর মেয়েকে দেখতে পাই।সেদিন আমি নিজেকে একজন খুশি ব্যক্তি হিসেবে আবিষ্কার করেছিলাম।জানতে উসখুস করছিলাম চন্দ্রের মেয়ে অবশ্যই চন্দ্রের মতন হবে।সময় কাটে আমার ঘরে আরো বিষাদ হানা দিতে থাকে।এক সময় ভাবলাম হয়তো একটা সন্তান আমাকে ফেরাতে পারবে।হয়তো হিরা সন্তানের মায়ায় তার লোভ ভুলে যাবে।কিন্তু!হলো না।হিরা নারাজ সম্পূর্ণ বাচ্চা নিতে।অপমান করত কথায় কথায়।তারপর কি হলো জানিস?সব শেষ!তারপর থেকে আমার জীবন শুরু।তুই আমি আর মিষ্টির নতুন জীবন।পরিপূর্ণ সুখী জীবন”

চলবে….

চন্দ্র’মল্লিকা ৩০
লেখা : Azyah_সূচনা

ঈদের ছুটি শেষ। মাহরুর মল্লিকা তিনদিন আগেই ফিরেছে ঢাকায়।বেশি ছুটি পড়লেই শরীর অলস হয়ে উঠে।নিজেকে তরতাজা করতে হবে।রেদোয়ান এর সাথে কথা বলে দোকানের জন্য মালামালের ব্যবস্থা করতে হবে। হলোও তাই।রেদোয়ান দুটো দিনের বেশি ছুটি নেয় অনেক কষ্টে।ইচ্ছে হচ্ছে না তার অলস দেহের পূনরায় সেই খাটনি খাটার। তাছাড়াও মাহরুরের একজন সঙ্গী দরকার নতুন ব্যবসার।

“টাকা যোগাড় করেছো?” রেদোয়ান মাহরুরের উদ্দেশ্যে বললো।

“ব্যাংকে থাকা টাকা দিয়ে হবে না?আমি সীমিত আকারে শুরু করতে চাচ্ছি।”

“কমপক্ষে সব মিলিয়ে এক লক্ষ টাকা দরকার।এর মধ্যে ঈদ গেলো।কিভাবে কি?”

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাহরুর জানতে চাইলো, “ভুল করে ফেললাম নাতো দোকান নিয়ে?এখন এত টাকা হাতে নেই। পঞ্চাশ হাজার আছে ব্যাংকে।”

রেদোয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বলে, “ভুল করোনি। অ্যাডভান্স দিয়েছোতো?”

“হ্যা সেটা আগেই পরিশোধ করেছি। ঈদ বোনাসের টাকা দিয়ে ঈদের খরচ চালিয়েছি সব।”

রেদোয়ান বললো, “গ্রেট।আমাদের এখন হিসাব করে কাজ আগাতে হবে।এক্সট্রা কিছু লাগলে আমি ম্যানেজ করে দিবো।”

মাহরুর সরাসরি না করে দেয়।বলে, “তুমি আমাকে ঋণী করে ফেলছ।এমনেতেই চন্দ্র হাসপাতালে ছিলো তখন টাকা দিয়েছো।”

রেদোয়ান বলে, “তুমি টাকাটা ফিরিয়েও দিয়েছো দুইদিনে।আর কত টাকা দিয়েছি আমি?এই জীবনে না খেয়ে থাকলেও তুমি সাহায্য নেবে না কারো আমি জানি।এক কাজ করো যেহেতু তোমার আত্মসম্মানে বাঁধে টাকা নিতে তাহলে দোকান শুরু করো। যা লাভ হয় আমাকে ফিরিয়ে দিও কিছু টাকা।যতদিন আমার টাকা পরিশোধ না হয় আমি তোমার ব্যবসার পার্টনার।”

মাহরুর বললো, “তুমি কি রেগে যাচ্ছো আমার সাথে রেদোয়ান?”

“রাগ করার মতোই তোমার কাজকর্ম।তোমাকে আমি ভাইয়ের মতন ভাবি।সাহায্য করা আমার কর্তব্য।আর তুমি কি আমার টাকা নিয়ে পালিয়ে যাবে নাকি?আর আমি আমার টাকার গরমও দেখাচ্ছি না।সৃষ্টিকর্তা আমাকে যা দিয়েছেন তা সঠিক কাজে লাগাতে চাচ্ছি।”

অভিযোগের সুর রেদোয়ান এর।হাসলো মাহরুর।বললো, “আচ্ছা ভাই তুমি আমাকে সাপোর্ট করছো সেই হিসেবে আমি আমার আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিলাম।দরকার পড়লে তুমি আমাকে সাহায্য করো আমার নতুন কাজে কেমন?”

রেদোয়ান চলে যায় আলাপ করে।আগামীকাল দোকান গোছাবে।সব লিস্ট করে সকালেই বেরিয়ে পড়বে কেনাকাটার জন্য।সব চিন্তা ভাবনা করে এক কাপ চা নিয়ে ছাদের কোণে এসে দাঁড়ায়। চায়ে চুমুক দিয়ে মনে হলো অমৃত।প্রতিদিনই মনে হয়।তবে একটা ধন্যবাদ দেওয়া হয়না মল্লিকাকে।করা লিকারের চা।সামান্য এলাচের ঘ্রাণ ভেসে আসে। মিষ্টির ঠিকঠাক ব্যালেন্সে এই চা কে অমৃতর সাথে তুলনা একদম ভুল নয়।

“এত মজার চা কি করে করিস?”

পিছনে দাঁড়ানো মল্লিকা চমকে উঠলো। কি করে বুঝলো মাহরুর সে পিছনে দাড়িয়ে।জানতে প্রশ্ন করে, “কি করে জানলেন?”

“তোর হাতের চুড়ির আওয়াজে।”

মল্লিকা হাত তুলে দেখে।দু জোড়া চুড়ি তার দুহাতে।এতটা শব্দও করে না।তাহলে কি মাহরুরের শ্রবণশক্তি প্রখর?মল্লিকা পাশে দাড়িয়ে বললো, “এত দূর থেকে এত অল্প আওয়াজ শুনে নিলেন?”

“তোকে আমি অনুভব করি। চুড়ির আওয়াজতো একটা বাহানা মাত্র।”

মনে মনে ভাবলো মল্লিকা ‘ খাঁটি প্রেমিক পুরুষে পরিণত হয়েছে মাহরুর ভাই ‘।এতটা আগ্রহ হয়তো সেও দেখায়নি।পুরুষের প্রেম হয়তো এমনি। যথাসাধ্য উজাড় করতে পছন্দ করে।মুচকি হাসি ঠোঁটে এসে জুড়ে বসলো।এত শান্তি সামলানোর জন্য শাড়ির আঁচলও কম পড়ে যাচ্ছে।

“আগামী কাল স্টেশনারি শপটা উদ্ভোধন করবো। আশা করি সব ঠিকঠাক প্ল্যান মাফিক হবে।”

“হবে ইনশাল্লাহ।আমিও যদি কোনো কাজ করতে পারতাম?আপনার সাহায্য হতো। পড়ালেখাও বেশিদূর জানি না।নাহয় দু চারটে বাচ্চা পড়াতাম।”

“তুইতো না করলি।আমিতো চেয়েছিলাম তুই পড়ালেখা শুরু কর আবার।”

বোঝানোর সুরে মল্লিকা জবাব দেয়, “দেখেন মিষ্টি সবে স্কুলে ভর্তি হলো।আপনার নতুন চাকরি হয়েছে আর কতদিন? তারমধ্যে এই নতুন দোকানটা।সব মিলিয়ে অনেক চাপ আপনার উপর।সবকিছু একটু চলমান হোক?তারপর নাহয় আমিও পড়া শুরু করলাম।”

“হুম।ঠিক বলেছিস।চাচা চাচীকে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।”

“সব হবে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।”

দিক পরিবর্তন করে ঘুরে তাকায় মাহরুর।চন্দ্রের দিকে এক পলক তাকায়।কি সংজ্ঞা হয় এই নারীর? প্রতিনিয়ত প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হয় কেনো?যুবক বয়সে নারী সঙ্গ পছন্দ ছিলো না মাহরুরের।বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে খুব চাপা স্বভাব নিয়ে। অথচ মল্লিকার কাছে শক্তিশালী বাঁধনে আটকা পড়ে গেছে।

“আপনি সেদিন বলেছিলেন না?আপনি অনেকগুলো প্রেম করেছেন সেগুলো কি সত্যি?”

মল্লিকার প্রশ্ন কাকতালীয়ভাবে মাহরুরের মস্তিষ্কে চলা চিন্তার সাথে মিলে গেলো।বুকে হাত বেঁধে মল্লিকার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, “তোর কি মনে হয়?”

মল্লিকা মিনমিনে গলায় উত্তর দেয়, “হতেও পারে।আপনি শহর অঞ্চলে গিয়ে পড়াশোনা করেছেন।চাকরির জন্য ঢাকা থাকতেন। এখানেতো কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে।”

“অবশ্যই হতে পারে।আমি দেখতে কি খারাপ?”

“তাইতো জানতে চাইলাম।”

“আমি দেখতে কেমন চন্দ্র?”

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নেয় মল্লিকা। তালা আটলো।নিজেকে স্বাভাবিক করছে ধীরেধীরে।তবে সরাসরি বলার সাহস নেই যে মাহরুর সুদর্শন।

মাহরুর পূনরায় প্রশ্ন করে, “বল আমি দেখতে কেমন?”

উত্তর না পেয়ে মাহরুর আবার বলে, “মেজাজ খারাপ করিস না চন্দ্র।তোকে বলেছিলাম না বোবা হয়ে থাকলে ছাদ থেকে ফেলে দিবো।”

ফটাফট মল্লিকা জবাব দিয়ে বসে, “আমার চোখে আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ”

তাড়াহুড়ো করে বলেছে। জ্বিভ কাটে মল্লিকা বলেও।বেশি বলে ফেললো নাকি?এই নিয়ে চিন্তাভাবনার সমাবেশ জমতে শুরু করলো। মাহরুর মাথা নুয়ে হেসে উঠলো। অত্যন্ত স্বল্প সময়ের হাসি।কয়েক সেকেন্ডে হাওয়ায় বিলীন হয়ে গেছে।মুখটা হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক।হলদে আলোয় মাহরুরের মুখে হালকা বাদামি দাড়িগুলো বেশ ফুটে উঠেছে।এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মল্লিকা।

আকস্মিক মাহরুর বললো, “কাছে আয়”

“কেনো?”

“ভালোবাসবো”

নিদারুণ চাওয়া। মাহরুরের মধ্যকার প্রেমিক হৃদয় হুটহাট জ্বলে উঠে।কাছে পেতে চায় দুঃসাধ্য সাধন করে জিতে নেওয়া প্রিয়তমাকে। মল্লিকা নিজ থেকে আসবে না।নারী ভালোবাসা চাইলেও প্রকাশ করতে লাজে ঢেকে যায়।প্রথম ধাপ অতিক্রম করতে হয় অবাধ্য পুরুষকেই।নিজের কাছাকাছি টেনে নিয়ে কপালে কপাল ঠেকায় মাহরুর।

বলে, “এই সময়টা আমাদের একান্ত।”

সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাহরুর আবার বললো, “সুখে আছিসতো?”

মল্লিকা দ্বিধা দ্বন্দ ভুলে বললো, “ভীষণ”

“সুখে থাকার মাশুল দিতে পারবিতো?”

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে মল্লিকা বললো, “কিভাবে?”

চন্দ্রমল্লিকার সম্পূর্ণ মস্তিষ্ক শূন্য করা হয় চাঁদনী রাতে।নতুন রকমের অনুভূতির সাথে সাক্ষাৎ ঘটে।ঝড়ের গতিতে অধর ছুঁয়েছে মাহরুর।যত দ্রুত কাছে এসেছে তত দ্রুত সরেও গেছে।মল্লিকার সহনশক্তি কম।অজ্ঞান হয়ে গেলে বিপদ।

মাহরুর বললো, ” প্রেমরোগে শিরা উপশিরা টগবগ করছে। দ্রুত এসে বুকে মাথা রাখ।নিজের লজ্জাটাও নিরাবরণ করতে পারবি।”

মল্লিকা কোনোকিছু না ভেবেই মুখ লুকায় মাহরুরের বুকে।হেসে চলেছে সে। ঘনিষ্ঠতা সহ্য করতে না পেরে মূর্তি বনে থাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

“আমার সাথে স্বাভাবিক হতে হবে চন্দ্র।আমি তোর চাচাতো ভাই ছিলাম এক সময় সেটা ভুলে যা।স্বামীর চোখে দেখ।দেখবি সহজ হয়ে উঠেছে।নাহয় মিষ্টি একাই রয়ে যাবে।ওর খেলার সাথী থাকবে না কোনো।বড় হয়ে জানতে চাইবে ওর কোনো ভাইবোন নেই কেনো?”

মল্লিকার কাছ থেকে জবাব আশা করেনি মাহরুর।মাথা তুলে হালকা।তাকে তাক লাগিয়ে মল্লিকা আমতা আমতা স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি এখনই…. ভাবছেন…”

কথার অর্থ বুঝে মাহরুর উত্তর দেয়, “না।সবার আগে তোকে আবার পড়াবো।তারপর মিষ্টির জন্য একটা বাড়ি করবো।তারপর নতুন কারো আগমন ঘটবে।….জানিস আগে ভাবতাম সময় শেষ।এখন মনে হয় সামনে লম্বা একটা জীবন পড়ে আছে।….. উম!নাহ।তবে ওই একটা ব্যাপারে কোনো গ্যারান্টি নেই।নতুন কারো আগমন আগেও হয়ে যেতে পারে। আমাকেতো জানিসই।তুই কাছে থাকলে খারাপ হয়ে উঠি।কাছে আসা থেকে কোনোভাবে বাঁধা দিতে পারবি না।অনেক অপেক্ষা করেছি আর না।তোকে শীগ্রই তোকে এক নতুন মাহরুরের সাথে পরিচয় করাবো। শুধু সময় সুযোগের অভাব বুঝলি।” বলে চোঁখ টিপে মাহরুর।

____

সকাল সাতটায় বেরিয়েছে রেদোয়ান আর মাহরুর।তাদের সাথে খুব আগ্রহ দেখিয়ে দুলালও যোগ দেয়।ছোট্ট স্টেশনারি শপের উদ্ভোধন আজই।সকাল সাতটায় গিয়ে এগারোটায় সব মালামাল এনে দোকানে সাজানো শুরু করেছে তিনজনে মিলে।দাড়িয়ে তদারকী করছেন রহিম মিয়াও।এক সময় তার মুদি দোকান ছিল।অভিজ্ঞ তিনি এসব ব্যবসায়।

মল্লিকার মাথায় চিন্তার শেষ নেই।খেয়ে বের হয়নি মাহরুর।তার সাথে বাকি দুজনও অভুক্ত।দুই চুলোয় রান্না বসিয়েছে।আজ হাতে কাজ বেশি।এলাকার কিছু মানুষকে খাবার দিতে হবে। হঠাৎ আওয়াজ এলো রহিম চাচার স্ত্রীর।

“বউ! ও বউ!ঘরে আছো?”

হাত মুছে দৌড় লাগায় মল্লিকা।কোমড় ধরে দাড়িয়ে আছেন রহিম চাচার স্ত্রী। স্বাস্থ্যবান হওয়ায় সিড়ি বেয়ে উঠে হাঁফিয়ে গেছেন।মল্লিকা বললো, “চাচী আমাকে ডাকতেন?কষ্ট করে সিড়ি বেয়ে আসলেন?”

“আরেহ আইছি এমনেই।কতদিন ছাদের হাওয়া বাতাস নেওয়া হয়না।তুমি কি করতাছো?”

“আজকে ওনার দোকানের উদ্ভোধন।এলাকায় কিছু মানুষ খাওয়াবে।সাথে ওনারাও খাবে।রান্না করছিলাম চাচী।”

“ওহ হ!তোমার চাচা কইছিলো। মৌলভী দিয়া মিলাদ পরাইবো।”

“হ্যা চাচী।”

“মিঠা কিছু রানছো?”

মিষ্টি কিছুর কথা শুনে মাথা ঘুরে গেলো মল্লিকার।এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা কি করে তার মাথা থেকে বেরিয়ে যায়?মিষ্টি অত্যাবশকীয় এখানে।কপালে হাত রাখে মল্লিকা।জোবেদা খাতুন হাসলেন।

বললেন,
“আন্দাজ করছিলাম। আহো আমার লগে”

জোবেদা খাতুন মাহরুরের ঘরে ঢুকে মিষ্টিকে বললো, “কিরে বুড়ি?ভালো আছোস?”

মিষ্টি লম্বা চওড়া করে সালাম জানায় তাকে।উত্তরে বলে,
“জ্বি জ্বি”

“আইচ্ছা।আমার ঘরে আসিস মজা খাওয়ামু।”

মিষ্টি মাথা দোলায়।জোবেদা খাতুন বললেন, “ঘরে দুধ আর পোলাও চাইল আছে না?”

“হ্যা চাচী আছে।”

জোবেদা খাতুন চুলোর কাছে পিঁড়িতে এসে বসলো।বললো, “দাও দেহি।ফিরনি বানাই।চিনিও দিও লগে।”

“চাচী আপনি কষ্ট করবেন না।আমি বানিয়ে নিবো।”

“চুপ করোতো ছেমরি।এই শরীর এহনো তাগড়া আছে। ডাক্তারের ওষুধ খাইয়ার এই যত রোগ বালাই।নাইলে আমি একলা পুরা এলাকার রান্দা পারতাম।আমার হাতের ফিরনি খাইলে সারাজীবনেও স্বাদ ভুলতে পারবা না।আমার মাইয়া পুত যেই শখ কইরা খাইতো।”

মল্লিকার কোনো কথা শুনেননি জোবেদা খাতুন।বাধ্য হয়ে এক এক করে সব এগিয়ে দিতে হচ্ছে তাকে।এক ঘন্টার মধ্যে সারাঘরে ফিরনির সুভাষ ছড়িয়ে পড়ে।মিষ্টির মিষ্টি ভীষণ পছন্দ।দাত বের করে হাসতে হাসতে বাটি নিয়ে হাজির হলো।

বললো, “আমাকে দাও।আমি খাবো।”

জোবেদা খাতুন গরম গরম ফিরনি তুলে মিষ্টির পাতে দিয়ে বললো, “ঠান্ডা কইরা খাইস বুড়ি। জ্বিভ পুইড়া যাইবো নাহয়।”

মল্লিকা বলে, “চাচী আপনি এবার উঠেন। বিছানায় গিয়ে একটু বসেন।ক্লান্ত হয়ে পড়েছেনতো।”

আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ান।বলেন, “হ শরীর এলাই একটু।”

সব রান্না প্রায় শেষ।মল্লিকা একে একে বাটিতে ঢেলে তৈরি করে নিলো।জোবেদা খাতুন অনুরোধ করলো আজ দুপুরে তাদের সাথেই যেনো খেয়ে নেয়।মিষ্টির সাথে খোশগল্পে মেতে তিনি রাজি হন।এরই মাঝে মল্লিকা ফোন হাতে নিয়ে মাহরুরের নাম্বারে কল করে।

“হ্যালো…. বল!”

“হাপাচ্ছেন কেনো?” মাহরুরের ব্যস্ত কন্ঠস্বর শুনে বলে উঠলো মল্লিকা।

“আরেহ অনেক কাজ।মালামাল গুছাচ্ছি।”

“খাবার রেডি।খিচুড়ি আর গরুর গোস্ত সাথে চাচী ফিরনি রান্না করেছে।খাবেন না?সকাল থেকে না খেয়ে আছেন।”

“আচ্ছা ভালো করেছিস।আমি দুলালকে পাঠাই সবার জন্য পাঠিয়ে দে।”

মিনিট দশেক এর মধ্যে দুলাল এসে হাজির।তার ঘামার্ত মুখ দেখে মনে হলো আসলেই অনেক খাটুনি যাচ্ছে সবার উপর দিয়ে।মল্লিকা নিজেও দুলালের সাথে খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।সাথে থেকে খাইয়ে দিয়ে আসবে।কাজের ব্যস্ততায় খাওয়া দাওয়া নিশ্চয়ই এড়িয়ে যাবে মাহরুর।মাথায় ভালোভাবে কাপড় টেনে বেরিয়েছে।নতুন স্টেশনারি শপ এর সামনে এসেই মুখে হাসি ফুটলো।বেশ সুন্দর করে সাজানো। মৌলভী সাহেব এর সাথে ছোটছোট কিছু বাচ্চারাও আছে।এদের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।ঘামে ভেজা মাহরুরের অবস্থা অবসন্ন।হাসিটা নিমিষেই উধাও হয়ে গেল।

ভদ্রতাসহিত নিচু গলায় বললো, “খাবার এনেছি।”

মাহরুর ফিরে তাকায়। ময়লায় আবৃত হাত পরিষ্কার করতে করতে মাহরুর সামনে এসে বললো, “তুই এলি যে?”

“দেখতে এসেছি। কাজতো শেষ দেখা যাচ্ছে খেয়ে নিন।”

মাহরুর মৌলভী আর বাচ্চাদের দেখিয়ে বললো, “আগে হুজুর আর বাচ্চাগুলো খেয়ে নেক তারপর খাবো।মিষ্টিকে নিয়ে আয় যা।”

মেয়েকে ছাড়া নতুন কিছুর সূচনা সম্ভব?ঘরের প্রদীপকে নিয়েই নতুন পথে পা বাড়াবে মাহরুর।সফল হোক বা অসফল। সততার সাথে এগিয়ে চলার পণ করেছে মনে।স্ত্রী আর সন্তানের ইচ্ছে পূরণের প্রবল ইচ্ছে।মিষ্টিকে লাল টুকটুকে ফ্রক পড়িয়ে নিয়ে এসেছে।কোনোকিছু না ভেবে ‘ মাহি বাবা ‘ বলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলো মাহরুরের কাছে।

মাহরুর বলে উঠে, “এখন না বাবা।আমার হাতে ময়লা।হাত মুখ ধুয়ে তোকে কোলে নিবো কেমন?”

মিষ্টি মাথা দুলিয়ে বলল, “আচ্ছা।”

“তোর পদচারণায় আমার নতুন সূচনা শুভ হোক মা।তুই আমার ঘরের জান্নাত”

“বুঝিনি মাহি বাবা” অবুঝের মতন আওড়ায় মিষ্টি

“বড়ো হয়ে বুঝবি।বাবার হাত ধরে থাকবিতো সবসময়?”

“হ্যাঁ থাকবো থাকবো”

মাহরুর,রেদোয়ান আর দুলাল একে একে ফ্রেশ হয়ে কাপড় বদলে এসেছে।জোবেদা খাতুনকেও ধরে নিয়ে এসেছে।এসে মাহরুর বললো,

“খুবই ছোট আয়োজন।কিন্তু এখানে অনেক আশা আর খুশি জড়িত।সবাই দুআ করবেন।”

ছোটোখাটো দুআ মাহফিল এর মাধ্যমে স্টেশনারি শপের উদ্ভোধন হয়।জমিনে পাটি বিছিয়ে একে একে সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে মাহরুর আর রেদোয়ান।মুখে একফোঁটা বিরক্তির ছাপ নেই কারো। মাহরুরের মুখ ভঙ্গি অন্য।সব আয়োজন ভালোয় ভালোয় মিটে যাওয়ার পর মাহরুর সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।মনের মাঝে অগাধ তৃপ্তি অনুভব করছে।

সবাই চলে গেলে মল্লিকা এসে বললো, “এবার আপনারা খেয়ে নিন।”

একটা আস্ত দিন এর খাটুনি শেষে ঘরে এসে গা এলিয়ে দেয় মাহরুর।হাত পা ভীষণ রকমের ব্যথা করছে।আগেও পরিশ্রম করেছে।তবে সেটা ভিন্ন।অফিসে বসে মস্তিষ্ক ক্ষয় করেছে।আজ শারীরিক ধকল গেলো।মিষ্টি ফিরনি পেয়ে বেশ খুশি। একটু পরপর এক চামচ করে খেয়ে সুনাম গাইছে অনেকবার।মল্লিকা তেল নিয়ে আসলো। মাহরুরের পায়ের কাছে বসে বললো,

“দেখি পা এগিয়ে দেন।”

মাথায় হাত রাখা মাহরুর মল্লিকার দিকে চায়।বলে, “কি করবি?”

“দাড়িয়ে কাজ করেছেন।দোকানে দুলাভাইকে বলছিলেন পা ব্যথার কথা।মালিশ করে দেই আরাম পাবেন।”

মাহরুর বললো, “তোর কষ্ট হয়নি?একা হাতে এতগুলো মানুষের রান্না করেছিস।”

“হয়নি।আপনি পা দেন।পরশুদিন থেকে আপনার অফিস। অসুস্থ হলে কিভাবে হবে?”

“মাহরুর এত সহজে ভেঙে পরে না।”

বুক ফুলিয়ে বললো মাহরুর।পরপর হেসেও উঠলো।মল্লিকা তার কথার বিপরীতে মাথা দুলায় দুপাশে।তার ভেঙে পড়া অন্য করো না হোক মল্লিকার চোখে ঠেকেছে।কতটা কাতর আর ব্যাকুল হতে পারে সে মল্লিকা দেখেছে।নিজে থেকেই পায়ে তেল মালিশ করে দিতে লাগলো।

আর বললো, “কালতো দুলালকে সব কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে আমি কিছুক্ষন পর খাবার গরম করছি। দ্রুত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন”

মাহরুর বললো, “তোর সাথে একান্ত সময় কাটাবো না?”

একটু জোর খাটায় মল্লিকা অথচ চক্ষু নত করে বললো, “আপনি না বললেন সামনে একটা লম্বা জীবন পড়ে আছে।একান্ত সময় কাটানোর জন্য অনেক সময় আছে।আপনি আজ ঘুমোবেন!”

ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে তিনজন।আজ মল্লিকাকে ছুটি দিয়েছে।মিষ্টিকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে মাহরুর।রাত তিনটে।ফোন বাজছে অনবরত। মাহরুর একলাফে উঠে ফোন সাইলেন্ট করে।পরপর রিসিভ করে নেয়।

“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম ”

কোনো উত্তর এলো না।কিছু সময় অপেক্ষা করে মাহরুর আবার বলে, “কে বলছেন?”

মাহরুর আবার বললো, “ফোন দিয়ে কথা বলছেন না কেনো?”

এবারও ফোনের অপরপাশ নিঃশব্দ।এত সময় অপেক্ষা করে বিরক্তি ধরে যাচ্ছে। মাহরুর পূনরায় কিছু বলার জন্য মুখ খুললে খট করে ফোন কেটে দিলো সেই আগন্তুক।

চলবে….

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-২৭+২৮

0

চন্দ্র’মল্লিকা ২৭
লেখা : Azyah_সূচনা

মাহরুরের কাণ্ডে হতভম্ব মল্লিকা।নিজেই যেহেতু সিদ্ধান্ত নিবে তাহলে কেনো জানতে চাইলো সে পড়বে কিনা?ঘরে দাড়িয়ে মাথা চুলকাচ্ছে।বলছে ‘ না তোর পড়ালেখা করা উচিত ‘।কথা পোক্ত! ভাবসাব দেখে মনে হলো পাকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মল্লিকাকে কলেজে ভর্তি করিয়েই ছাড়বে।অযথা ফর্মালিটি করলো জিজ্ঞেস করে।মল্লিকার এতে মতবিরোধ আছে।এই বয়সে কোন কলেজ তাকে শিক্ষার্থী হিসেবে গ্রহণ করবে? তাছাড়াও মিষ্টি এখন ছোট।নিজে পড়তে বসে গেলে মেয়ে আর সংসার কে সামলাবে?

“দেখেন এই বয়সে আমাকে কোনো কলেজ নিবে না”

“ভোকেশনাল আছে চন্দ্র।”

“ভোকেশনাল কি?”

“এখানে যে কোনো বয়সের মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।”

“আপনি কি বলছেন?আমি পড়ালেখা শুরু করলে মিষ্টিকে কে দেখবে?সংসার কে সামলাবে?”

“আরেকটা বউ আনি?”

মাহরুরের উত্তরে চক্ষু ছানাবড়া।কি বললো সে?আরেকটা বউ!এক জনমে কয়টা বিয়ে করার শখ তার? মল্লিকাই তার দ্বিতীয় স্ত্রী। হতবুদ্ধির হয়ে চেয়ে রইলো মাহরুরের দিকে।রাগ হচ্ছে বটে।কিন্তু এই লোকের সামনে দেখানোর সাহস নেই।

মাহরুর সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়।আবার বলে, “চন্দ্র? বল না কেমন হবে?তুই পড়ালেখা করবি আর নতুন বউ মিষ্টিকে,এই সংসারকে সামলাবে।আর আমাকেও।”

মল্লিকা মুখ নত করে।চক্ষু কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে রাগে।জমিনের দিকে চেয়ে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো। মল্লিকাকে ধাক্কা দিয়ে মাহরুর একই বুলি আওড়ায়,

“বল কেমন হবে?”

“খুব খারাপ হবে মাহরুর ভাই।খুব খারাপ!আমি জানতাম ছেলে মানুষের চরিত্রে একটু আধটু খোট থাকে।আপনাকে অন্যরকম ভাবতাম।আপনিও আর পাঁচটা পুরুষের মতই বেরিয়ে এলেন।”

মল্লিকার এমন উচু গলায় চক্ষু প্রসারিত হয় মাহরুরের। তৎক্ষনাৎ নুয়েও ফেলে।

বলে, “ভাই ডেকেছিসতো?ঠিক আছে।আমি ঈদের পর আরেকটা বিয়ে করছি।ফাইনাল!”

দাতে দাত চেপে মল্লিকা বললো, “কতগুলো বউ লাগবে আপনার!”

মিষ্টির মনোযোগ টিভির থেকে বেশি সামনে লাইভ টেলিকাস্টএ।চেয়ে আছে দুজনের দিকে।চেচাচ্ছে কেনো বোঝার চেষ্টা করছে। মাহরুর একবার মিষ্টির দিকে চেয়ে আবার মুখ ফেরায় মল্লিকার দিকে।

বলে, “মেয়ের সামনে আমার সাথে উচু গলায় কথা বলছিস?”

“আপনি যেটা করছেন?সেটা মেয়ে জানলে আপনাকে কি সাবাশি দিবে?আমি ভাবতেও পারছি না আপনি এমন একটা কথা বলতে পারেন।”

“ভাবতে পারিসনি এখন ভাব।”

মাহরুর প্রত্যেকটা কথা গম্ভির সুরে বলছে। মল্লিকাও অবলীলায় বিশ্বাস করে নিচ্ছে তার কথা।

মল্লিকার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়ায়।বলে, “আব্বাকে কত আশ্বাস দিয়ে আমাকে এনেছেন।বিয়ে করেছেন।আমি বিয়ে করতে চাইনি।ওই সিদ্ধান্তটাই ঠিক ছিলো।”

মল্লিকা আবার বললো, “আমি মিষ্টিকে নিয়ে চলে যাবো গ্রামে।আমার টিকেট করুন।”

এবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মাহরুর বুঝলো।এই ভনিতা বেশিক্ষণ চললে সত্যিই চলে যাবে।ভীষণ অভিমানী। মাহরুর বুঝলো বয়স বাড়লেও বুদ্ধিটা হাঁটুর নিচে তার চন্দ্রমল্লিকার।সামান্য দুষ্টুমি বুঝে না। তাকাচ্ছেও না তার দিকে।অভিমান ভাঙ্গানোর পূর্বেই সিড়ি ঘরের কোণে দৌড় লাগায় মল্লিকা।

মিষ্টি বলে উঠলো, “মা কাদঁছে”

“না মিষ্টি মা কাদঁছে না।চোখে ময়লা পড়েছে।তুই টিভি দেখ।”

মাহরুরও বড় বড় কদম ফেলে চলে গেলো সেখানটায়। হাঁটুর উপর হাত বেঁধে বসে আছে মল্লিকা। মাহরুর মুচকি হাসলো।সেও মল্লিকার নকল করে তার পাশে বসে পড়লো।

ডেকে বললো, “শুনেন”

“আমি কিছু শুনতে চাই না।আপনি চলে যান এখান থেকে।” জবাব দেয় মল্লিকা।

মল্লিকার কাধে মাথা রাখে মাহরুর।বলে, “আমি আপনাকে ছাড়া আর কাউকে নিয়ে ভাবতেও পারি না এখন আর। বিয়েতো দূরের কথা।”

“তাহলে কেনো বললেন বিয়ের কথা?”

“সম্পর্কে শুধু ভালোবাসা থাকলেই হয়? খুনসুটি দরকার নেই?”

“তাই বলে এমন ধরনের খুনসুটি?”

“আজ এই খুনসুটি না করলে জানতে পারতাম না আপনি চিৎকারও করতে জানেন।রাগ দেখাতে জানেন।আমার মজা করার বদৌলতে আপনার রাগী মুখটাও দেখা হলো।”

“আপনার মুখ থেকে বের হওয়া সব কথাই আমার সত্য মনে হয়।”

“এমা!এটা কেমন কথা?আমি কি ফেরেশতা নাকি?আমিও মানুষ।তাও এই জাহিল যুগের। মিথ্যে আমিও বলি।”

“আমার সাথে কখনো বলবেন না।”

“আচ্ছা বলবো না।এবার চলেন।মিষ্টি চলে আসবে নাহয়।”

মাথা তুলে মাহরুর।সুন্দর করে মানিয়ে বুঝিয়ে নিয়ে এসেছে ঘরে।মিষ্টি মায়ের মুখ ভালোভাবে পরখ করছে।মা কি কাদঁছে নাকি না?কোনো প্রকার অস্রু চোখে মুখে না দেখে বাচ্চা মেয়েটিও সস্তি পায়।

মল্লিকা বললো, “আমি পড়বো।কিন্তু এখন না।আম্মা,আব্বা ঢাকা আসুক।মিষ্টি পুরোপুরি স্কুলে মনোযোগী হোক।আর আপনার চাকরিটাও।যখন দেখবো কোথাও কোনো সমস্যা নেই তখনই ভর্তি হবো।এখন মাথায় এত চিন্তা নেওয়ার কারণ নেই।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।মেনে নিলাম”

____

রোজা শুরু হয়েছে।দিন চারিতায় পরিবর্তন।পূর্বের চেয়ে বেশি ক্লান্ত মাহরুর।যতই আরামে থাকুক অফিসে ঘরের মতন শান্তি অন্য কোথাও নেই।প্রতিদিন চেষ্টা করে পায়ের গতি বাড়িয়ে আযান পড়ার আগেই বাড়ি ফিরতে।কোনোদিন পারে আবার কোনোদিন বাড়ির দরজায় আসতেই মাগরিবের আজান দেয়। ভাগ্যিস দুটো দিন ছুটি পায়। শক্তপোক্ত শরীরেও আর কত কুলায়?মল্লিকা রোজা রেখে ঘরের সব কাজ সামলায়।সেহেরীর রান্না থেকে শুরু করে ইফতার পর্যন্ত। মাহরুর বাড়িতে থাকলে সে টুকটাক সাহায্য করে।এভাবেই কাটছে মাহে রমজান।

আজ বিশতম রোজা। ভাগ্যক্রমে আজ সোমবার।বাড়িতেই আছে মাহরুর।আজ বাহির থেকেই ইফতার আনবে বলে জানালো মাহরুর।সারাদিন ঘুমিয়ে পাড় করছে মাহরুর।শুধু নামাজের সময় লাফিয়ে উঠে।আবার ঘুমিয়ে পড়ে।বিকেল বেলায় ইফতার আনার জন্য চলে গেলো।

ইফতার বসেছে জমজমাট।তিনজনে আর কতই খাবে?অল্প অল্প করে বাড়িয়ে কিছু আইটেম নিলো।পড়ে ক্ষুদা পেলে খাওয়া যাবে।কেনাকাটার সময়ই সামনের দোকানে চোখ পড়ে।ছোট্ট একটা ভাঙ্গারির দোকান।খালি করা হচ্ছে। মাহরুরের পরিচিত লোক।

মাহরুর এগিয়ে গিয়ে বললো, “মফিজ চাচা?দোকান খালি করেন কেন?”

“শহরে থাকুম না আর” মফিজ চাচা উত্তর দিলেন।

“কেন চাচা?”

“গেরামে জায়গা আছে।ওদিকেই ক্ষ্যাত খামারি করমু।এদিকে আর ভাল্লাগে না।সবাই ওদিকে আমি একলা এদিকে পইড়া আছি।আর দোকানের যেই ভাড়া!আমার ইনকামও অত না”

“ভাড়া কত চাচা?”

“নয় হাজার হাজার টাকা।”

মাহরুরের মস্তিষ্ক হুট করে জ্বলে উঠলো।নয় হাজার টাকা এই সময় মোটামুটি ভালো। নিশ্চুপ থেকে কিছুক্ষন ছক আকে মাথায়।যেই বুদ্ধিটা এসেছে মাথায় সেটা কি কাজে লাগাবে?

মফিজ চাচা বললেন, “যাই ভালা থাইকো”

“চাচা দোকান ভাড়া হয়ে গেছে নতুন কারো কাছে?”

“না কালকে টু-লেট ঝুলাইবো হুনলাম।”

“চাচা মালিকের নাম্বারটা দিতে পারবেন?”

মফিজ চাচা বুক পকেট থেকে তার ফোনটা বের করে মাহরুরের হাতে দিলো।বললো, “এদিকে সাজ্জাদ নামের একটা নাম্বার আছে।খুইজা লও।”

মাহরুর নাম্বার খুঁজে বের করে।নাম্বার নিজের ফোনে টুকে নিয়ে বিদায় দিলো মফিজ চাচাকে।সাথে তার নাম্বারটাও দিয়েছে।কোনো দরকার পড়লে যেনো তাকে কল করে। হাটতে হাটতে ফোন লাগায় সাজ্জাদ রহমানকে।টুকটাক কথা বলে নিলো।আযান দিতে আর দশ মিনিট বাকি।পায়ের গতি বাড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়।
বাড়ির ভেতরের সিড়িতে রহিম মিয়াদের বাড়িতে কাজ করা দুলালকে দেখে বললো,

“কিরে?দাড়িয়ে আছিস কেনো?”

“এমনেই ভাই।”

“এই তোর কি মন খারাপ?”

“মন খারাপ না ভাই”

দুলালের মুখ বিরস।সারাদিন বুড়ো বুড়ির সাথেই সময় কাটে।বয়স বেশি না। আঠারো উনিশের ঘরে।

মাহরুর আবার বলে, “কোনো সমস্যা হইছে নাকি রহিম চাচার সাথে?”

“না ভাই।রহিম চাচা ভালো মানুষ।আমারে সব খরচা দেয়।কিন্তু আমার এতবড় পরিবার।চলে না এট্টুকে।রহিম চাচার কাছে চাইতে শরম করে। উনিই চলে ওনার ছেলের টাকায়। ভাড়া যা পায় তাও ব্যাংকে নিয়া জমা করতে হয় প্রতিমাসে।”

সু সময়ে সঠিক মানুষ চোখের সামনে পড়ে যাওয়া।এটাও একটা ইঙ্গিত এগিয়ে যাওয়ার। মাহরুর নিজের সিদ্ধান্তে আরো একটু ভরসা পেলো।

দুলালকে বললো, “শোন ঘরে যা ইফতার কর।ইফতারের একঘন্টা পর উপরে আসবি।কথা আছে তোর সাথে।”

“আচ্ছা ভাই”

ইফতারের পর নামাজ আদায় করে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়েছে মাহরুর।শরীর ছেড়ে দেয় পুরোপুরি। মল্লিকার শান্তি নেই।ইফতার শেষেও তার কাজের অন্ত হয়না। মাহরুরের ধমকে এসে বসে।কাজ প্রয়োজন তেমন বিশ্রামও দরকার।আধ ঘন্টা পর দুলাল এসে হাজির।

মাহরুর বলে উঠে, “এসেছিস?”

“হ ভাই”

মাহরুর মল্লিকাকে ডেকে বলে, “চন্দ্র ওকে চা দিস।”

মল্লিকা আগেই যা বানিয়ে রাখে। দুলালকে দেখে ফ্লাক্স থেকে বের করে এগিয়ে দিলো দুজনকেই। মাহরুর বলে,

“মোড়ের দোকানটা খালি হয়েছে।আমি ভাবলাম ঐখানে একটা ছোট খাটো স্টেশনারী শপ ওপেন করবো।এসব দরকারি জিনিস।আমাদের এলাকায় স্টেশনারি নেই বললেই চলে।কিন্তু মানুষ পাচ্ছিলাম না।তুই পারবি করতে কাজ?”

দুলাল দ্বিমুখী প্রতিক্রিয়া দেয়।ভালো আইডিয়া।কিন্তু বললো, “আমি কাজ করতে পারবো কিন্তু ভাই রহিম চাচা আর চাচী?”

“ওনাদের বেশি কাজ না।প্রয়োজনে টুকটাক দরকার হয় তখন তুই করে দিস।যেই সময়টা খালি থাকিস তখন দোকানে বসবি।রহিম চাচার কোনো দরকার পড়লে ডেকে নিবে তোকে।আমিও বারণ করবো না।কারণ তাদের দায়িত্ব সবার আগে।”

দুলাল সম্মতি দিয়ে বললো, “ভাই আপনি রহিম চাচার লগে কথা কন।”

“চল তাহলে নিচে যাই।”

মাহরুর রহিম চাচার সাথে আলোচনা করতে নিচে এসেছে।ঘরে বসেই সবটা খুলে বললো।এটা আরো একটা সুযোগ।অল্প সময়ের সিদ্ধান্তে কাজ করার পরিকল্পনা।হুটহাট আসা বুদ্ধিটা কাজে লাগাবে বলে ভেবে নেয়।রহিম চাচাও তার এই সিদ্ধান্তে মত প্রকাশ করে।সম্মতি দেয়।তাদের আর কিই কাজ?রান্না বুয়া এসে করে দিয়ে যায়।বাজার করে দুলাল। তারও কিছু আলাদা উপার্জন হবে।রহিম চাচার সম্মতি নিয়েই হাসি মুখে ফিরলো।কানে ফোন চেপে আছে। রেদোয়ান তার শুভাকাঙ্ক্ষী, উপদেষ্টা।তাকে জানালে সেও ভালো চিন্তা বলেই মত প্রকাশ করলো।

মাহরুর বাড়ি ফেরার সাথে মল্লিকা প্রশ্ন ছুঁড়ে, “ব্যবসা করার চিন্তা করছেন?চাকরির কি হবে?”

“চাকরিতো করবোই”

“তাহলে দোকান?”

“সেটাও আমারই থাকবে।কিন্তু সেখানে কাজ করবে দুলাল। ওরও উপার্জন হলো।আমারও লাভ।”

“ভেবে চিন্তে করছেনতো?দোকানে কিন্তু আলাদা খরচ হবে।”

“শোন চন্দ্র।টাকা কামাতে হলে প্রথমে টাকা ঢালতে হয়।আমি ভেবে চিন্তেই করছি।মানুষের কিছু শখ থাকে, আহ্লাদ থাকে।আমি আমার সীমা জানি।সেটা কোনোদিন অতিক্রম করবো না।কোনোদিন বিলাসবহুল জীবনে আসক্ত হবো না।যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই।”

মাহরুর স্মিথ হাসে।হাত তুলে ডাকে মল্লিকাকে কাছে। মিষ্টিকেও পাশে বসিয়েছে।মুঠোফোন বের করে কিছু ছবি তুলে ধরলো তাদের দুজনের সামনে।মল্লিকা,মিষ্টি খুব আগ্রহ নিয়েই দেখছে।একের পর এক ছবি দেখিয়ে যাচ্ছে মাহরুর।ছিমছাম একতলা একটা বাড়ি।বেশ সুন্দর ডিজাইন।

ফোনের দিকে দৃষ্টিপাত করে মল্লিকা প্রশ্ন করে, “এটা কার বাড়ি?”

“এটা একটা বাড়ির ডিজাইন।”

“ডিজাইন দিয়ে কি করবেন?আর বাড়ি দেখেই কি হবে?”

মাহরুর বললো, “এই বাড়ির ছবিগুলো যত যত্ন করে টুকে রেখেছি?তত যত্ন করেই ঠিক এই রকম একটা বাড়ি বানাবো।তোর জন্য,মিষ্টির জন্য,আমার জন্য।”

মল্লিকা নিজের মনের ভাব সরাসরি প্রকাশ করে বললো, “আমি এই চিলেকোঠায়ও খুশি।কিন্তু আমি খুব করে চাইবো আপনার এই ইচ্ছেটা পূরণ হোক।খুব শীগ্রই হবে দেখে নিয়েন।”

“হতেই হবে চন্দ্র।দুঃখের দিন শেষ।যত সহ্য করার সয়ে নিয়েছি।এখন এই জং পড়া মস্তিষ্কটাকে ঝালাই করবো।নিত্য নতুন কাজে লাগাবো।আমি লোভ করছি না চন্দ্র।আমার শখ এটা।আমার দুটো স্বপ্ন ছিল।একটা পূরণ হয়েছে। দ্বিতীয়টা হবে ইনশাল্লাহ।”

আগ্রহী হয়ে মল্লিকা জানতে চায়, “কি সেই স্বপ্নটা?যেটা পূরণ হয়েছে?”

“তোকে পাওয়ার।তোকে কাছে পাওয়ার।মৃত্যুর আগে তোর মুখ থেকে এটা একবার শোনার ইচ্ছে ছিলো।তুই আমাকে ভালোবাসিস।এটাও বলার ইচ্ছে ছিলো তোর ভালোবাসা আমি হারেহারে টের পেয়েছি।আমিও মজেছি ওই অনুরাগে।কিন্তু ভাগ্য আমাকে আমার চাওয়ার চেয়ে বেশি দিয়েছে আমাকে।তোকে পেয়েছি।তোর বদৌলতে একটা বাচ্চা মেয়েকেও পেয়েছি।একটা সুন্দর জীবন পেয়েছি।সারাজীবন তোর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেও শেষ হবে না চন্দ্র।”

চোখে জল এসেছে মল্লিকার।অনুভব করছে মাহরুরের প্রত্যেকটা কথা। জলে টলমল নেত্র সামলে নিয়েই মল্লিকা বললো,

“আপনি যতটা কৃতজ্ঞ ততটা আমিও।আমাকে নতুনভাবে বাঁচিয়ে তুলেছেন।ওই নরক থেকে বের করে এনে নতুন জীবন দিয়েছেন।”

“চন্দ্র?সেদিন মা যদি আমাদের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যেতেন তাহলে আমাদের গল্পটা পানসে হতো তাই না?এই গল্পটা ঠিক।অনেক অনেক কষ্টের পর যখন সুখ আসে তখন বড্ড আয়োজন করেই আসে।চন্দ্র মাহরুরের গল্প এভাবেই একটা সুন্দর চিত্র বহন করে।”

“এভাবেই হয়তো প্রণয় লিখিত ছিলো”

“কি করে বোঝাবো তোকে বল?বক্ষ ভেদ করে হৃদয় দেখানোর সুযোগ পেতাম?তাহলে হয়তো পরিমাপ করতে পারতি কতটা পাগল হয়েছি আমি।কত কাতর!কত দুর্বল আমার চিত্ত তোর কাছে”

মাহরুরের তর্জনী আঙ্গুল নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মল্লিকা বললো,

“আমি জানি।বুঝি।আপনার কাছাকাছি থাকলে আমি হারিয়ে যাই।মনে হয় যেনো ভাসছি মহাশূন্যে। আপনার কথায় ভিন্ন অনুভূতি,আপনার ছোঁয়ায় অন্যরকম ভালোবাসা।আমি এসব আগে কখনো অনুভব করিনি।তাই ঘাবড়ে উঠি কখনো কখনো।”

গালে হাত দিয়ে মধ্যিখানে বসে দুজনের কথায় মনোনিবেশ করে আছে মিষ্টি।কোনো বিরক্ত করলো না তাদের।কথা বলতে দিলো।তাদের কথা শেষে একে অপরের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে মিষ্টি বলে উঠে,

“কি হয়েছে মা?মাহি বাবা?তোমরা কাঁদছো কেনো?”

দুজনেই একই সঙ্গে মিষ্টির গালে হাত রেখে হেসে উঠে।এই বাচ্চাটা ঘরের জান।তাকে ছাড়াও যে অসম্পূর্ণ মাহরুর,মল্লিকা।

মাহরুর বললো, “আমরা নতুন বাড়ি বানাবো তোর জন্য।সেই খুশিতে কাদছি।ওই বাড়ির নাম কি হবে জানিস?”

“কি হবে মাহি বাবা?”

“মিষ্টি কুঞ্জ”

“আমার নাম?” খুশিতে গদগদ হয়ে বললো মিষ্টি।

“হ্যা তোর নাম।তোর জন্যইতো বানাবো।”

“সেখানে আমি আমার স্কুলের বন্ধুদের আনবো।”

“আনিস”

___

মাসের শুরুর দিকেই তেইশ রোজা পড়েছে।বেতন পাওয়ার সাথেসাথেই অ্যাডভান্স টাকা পরিশোধ করে দোকানটা নিজের জন্য বুক করে নিয়েছে মাহরুর।এবার ঈদ খরচা দ্বিগুণ। ভাগ্যিস এবার ঈদ বোনাস পেয়েছে।নাহয় এত খরচ কুলানো যেত না। ব্যাংকের টাকা দিয়ে দোকানে নতুন মাল তুলবে।যত সম্ভব কম খরচে করার চেষ্টা করবে।দুইদিন পর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হবে।কোনো রকম দোকানটা আটকায় মাহরুর।যেকোনো সময় অন্য কেউ এসে নিয়ে নিত।সোমবার পড়ায় আজ ভাবলো ঈদের কেনাকাটা করে ফেলবে।যেমন চিন্তা তেমন কাজ। মল্লিকাকে আদেশ ছুঁড়েছে।দ্রুত তৈরি হয়ে নিতে।আজই সব কেনাকাটা শেষ করে দায়মুক্ত হবে।

এক ঘণ্টার মধ্যে মার্কেটে হাজির হয়।কেনাকাটা চলছে।এক পর্যায়ে মল্লিকা বলে উঠে,

“একটু দাঁড়াবেন?”

“কিছু নিবি?” মাহরুর জানতে চায়।

“হ্যাঁ।”

“কোথায় যাবি?চল।”

মল্লিকা সামনের পাঞ্জাবির দোকানে এসে দাঁড়ায়।খুঁজে খুঁজে একটা সাদা পাঞ্জাবি পছন্দ করলো। মাহরুরের গায়ের মাপ নিয়ে দেখছে। মাহরুর বলে উঠে,

“আমার জন্যতো ঈদের কাপড় নিয়েছি।আবার পাঞ্জাবি দেখছিস যে?”

মল্লিকা ঠোঁট কামড়ে হেসে উত্তর দেয়, “পড়ে বলবো।আপনি মাপ দিন।”

“চন্দ্র অযথা আরেকটা পাঞ্জাবি কেনো নিবো বলতো?”

“আমি নিবো।কিছু টাকা জমিয়েছি।সেটা দিয়েই কিনবো।আপনি না করবেন না দয়া করে।আরো অনেক কাজ বাকি।”

মল্লিকা রহস্যময় কথা বলছে।সরাসরি না করে দিবে তার জমানো টাকায় কিছু নিতে।সম্পূর্ণ অহেতুক।তবে মল্লিকা শুনলো না।ছোট্ট পার্স থেকে টাকা বের করে দোকানির হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।পরপর মাহরুরকে পেছনে ফেলেই আরো কিছু টুকটাক কিনে ফিরে আসে।
মাহরুর জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে,

“আবার কি কিনলি?তুই কষ্ট করে জমিয়েছিস টাকা।খরচ করার কি দরকার?পড়ে তোর দরকার হলে?”

“হবে না।”

“বড্ড জেদী হচ্ছিস তুই দিনদিন।”

মল্লিকা উত্তর দেয় না।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসে।সম্পূর্ণ সাদা পাঞ্জাবি কিনেছে।কারুকার্য বিহীন।যথাযথ উত্তরও দিচ্ছে না। মাহরুরের প্রত্যেক কথার বিপরীতে ঠোঁট টিপে হাসে।আজব!মল্লিকার এমন আচরণ অদ্ভুত লাগছে মাহরুরের কাছে।অন্যদিকে মল্লিকার মস্তিষ্কে চলছে ভিন্ন বুদ্ধি।

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা ২৮
লেখা : Azyah_সূচনা

পা টিপে মল্লিকার পদচারণ ছোট্ট চিলেকোঠার ঘরটাতে। মাহরুরের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়ানো মুশকিল।কিন্তু আজ পেরেছে।হয়তো ভাগ্য সহায়।আধার আচ্ছন্ন নিশিতে চোরের মতন হাঁটাচলা করছে।নিচের ছোট্ট বাটন ফোনের বোতাম টিপে দেখে নিলো কয়টা বাজে?রাত দুইটা। মাহরুরের ভারী ঘুম।সহজে উঠে না একবার ঘুমিয়ে পড়লে।ফোনের লাইট জ্বালিয়ে আলমারি থেকে কিনে আনা পাঞ্জাবিটা বের করে নিল।সাথে খয়েরী কাগজে মোড়ানো থলেটাও।এটায় কালো রঙের মোটা সুতো আছে।সাথে সুই।একবার মাহরুরের দিকে চেয়ে খুব সাবধানে সিড়ি ঘরের পাশে গিয়ে বসে পড়ে।লাইট জ্বালিয়ে নেয়। ঢিপঢিপ করা হৃদয় নিয়ে কাজ শুরু করে দেয়।

আশেপাশে ছড়িয়ে আছে কেচি,সুতো,কলম ইত্যাদি।হাঁটুর উপর মাহরুরের পাঞ্জাবিটা রেখে কলারে সুন্দর নকশা তৈরি করছে মল্লিকা। মাহরুরের মতই চট করে বুদ্ধিটা এসেছে মাথায়।তাকে খুশি করার ছোট্ট প্রয়াস।জানে না কেমন হবে? হাতে সময় কম।সাড়ে তিনটে বেজে যায় অর্ধেক কাজ শেষ করতে।সেহেরীর সময় হবে এখনই।নিচু হয়ে বসে এক ধ্যানে কাজ করতে করতে ঘাড় ব্যথা হয়েছে।উঠে গেলো মল্লিকা।বাকি কাজ বাড়ি গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে করবে।

সকাল সকাল মল্লিকাকে ঘুমোতে দেখে ডাকলো না আর।মিষ্টি চোখ পিটপিট করে চেয়ে আছে কাথার নিচে।মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে মাহরুর বললো, “আমি আসি।মার সাথে আবার ঘুমিয়ে পড়।উঠলে বলে দিস অফিসে গিয়েছি আমি।”

“আসার সময় জিলাপি আনবে মাহি বাবা।”

“এত মিষ্টি খাওয়া ঠিক না।আজকে অন্যকিছু”

মিষ্টি মুখ লটকে বললো, “তাহলে চিপস খাবো আজ।”

মাহরুর মাথা দোলায়।বেশি আদরে অভ্যাস খারাপ হচ্ছে।ঈদের পর ছাড়াতে হবে বাহিরের খাবারের অভ্যাস।বললো, “আচ্ছা আনবো।মাকে বলে দিস কিন্তু।”

“আচ্ছা”

__

বাড়ি ফেরার পথে বাসের টিকেট করেছে মাহরুর।আগামীকাল গ্রামে যাবে। বন্ধ শুরু নিজেকে যেনো কারামুক্ত মনে হলো।আজ অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশীই উচ্ছলতার সাথে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছে।আসার পথে সেমাই নিয়েছে ঈদের জন্য।হাটতে হাটতে রাস্তার দ্বারে একটি কসমেটিকস এর দোকানে চোখ পড়ে।বড় পোস্টারে একজন মডেল তার মেহেদী রাঙা হাত দেখিয়ে আছে।পিত্তি জ্বলে উঠলো। দাঁত দিয়ে জ্বিভ কাটে।এত বেখেয়ালি কি করে হলো মাহরুর?মেহেদী ছাড়া বাংলাদেশ কেনো বিশ্বের কোনো নারীর ঈদ পরিপূর্ণ হয়?ছোটোবেলা থেকেইতো মল্লিকার শখ।ঈদের আগে হাত ভর্তি মেহেদী লেপে ঘুরে বেড়াতো এদিক ওদিক। কিশোরী মল্লিকাকে কল্পনা করে মুচকি হাসি ফোটে ঠোঁটের কোণে।

পায়ের গতি বাড়িয়ে দোকান এর কাছে গিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে।এখানে মহিলাদের সরঞ্জাম। পুরুষ মানুষ দোকান খুলে বসেছে ঠিকই তবে অন্য পুরুষের প্রবেশে একটা মনের বাঁধা থাকবেই।

দোকানে সাহায্য করে ছেলেটি এগিয়ে এসে বললো, “কি লাগবো?”

“মেহেদী আছে না?” মাহরুর জবাবে জানতে চায়।

ছেলেটি কপাল কুঁচকায়।বিচিত্র ভঙ্গিতে বলে উঠলো, “আপনি ব্যাটা মানুষ হয়ে মেন্দি দিবেন?”

তৎক্ষনাৎ বিরক্ত হয় মাহরুর।সে কেনো দিবে মেহেদী? বিরক্তিকর মুখ বানিয়ে বললো, “আশ্চর্য্য আমি কেনো মেহেদী দিবো?আমি আমার স্ত্রীর জন্য নিতে এসেছি।তুমি এত কথা না বলে মেহেদী দাও।”

“কোনটা নিবেন?অনেক কোম্পানির আছে।”

“ভালো কোনটা?”

“অনেকগুলা ভালো ব্র্যান্ড আছে।”

‘ ব্র্যান্ড ‘ মেহেদীতেও ব্র্যান্ড।কি অদ্ভুত কথাবার্তা।মেহেদীর উপর পি এইচ ডি করা নেই মাহরুরের। ছেলেটিও কাজের চেয়ে বেশি অহেতুক কথা বলছে।

দাতে দাত চেপে মাহরুর বলে, “দোকানের সবচেয়ে ভালো?এক নাম্বার?যেটা আছে সেটা এনে নাও।”

“কিন্তু…”

“ভাই প্লিজ যাও। হাইফাই ব্র্যান্ড এর টা নিয়ে এসো।”

“হাইফাই?এটা আবার কোন ব্র্যান্ড?”

বিরক্তি রাগে পরিণত হচ্ছে।রোজা রেখে,সারাদিন অফিস করে ব্যান্ড এর তর্জমা বিশ্লেষণ করতে ইচ্ছুক নয় মোটেও। মাহরুর বললো, “এই ছেলে তোমার মালিককে ডাকো।আমি বুঝিয়ে বলছি।”

ছেলেটি মুখ বেকিয়ে বললো, “না না।আপনার সবচেয়ে ভালো মেহেদী লাগবোতো?আইনা দিতাছি দাঁড়ান আপনে।”

আহাম্মক বনে গেছে মাহরুর।ফাজলামো নাকি?এই শুদ্ধ স্পষ্ট বাংলাটা একটু আগে বুঝলেইতো এখানে সময় নষ্ট হতো না। নেহাত মাহরুরকে রাগিয়ে দিলো। ফ্যাচফ্যাচ করে বিগড়ে দিয়েছে মেজাজ।অবশেষে মেহেদীর দুটো কোণ হাতে পেয়েছে।নিয়েই হাটা ধরলো। গুনেগুনে পনেরো মিনিট নষ্ট করেছে এই ছেলে।

পাঞ্জাবিতে শিল্পকলা প্রদর্শন করতে ব্যস্ত মল্লিকা মাহরুরের গলার আওয়াজে লাফ দিয়ে উঠে।সবকিছু হন্তদন্ত হয়ে লুকিয়ে দরজা খুলে দিলো।মেহেদী মল্লিকাকে এগিয়ে দিয়ে বললো, “ধর!”

মাহরুরকে বিরক্ত মুখে দেখে মল্লিকা প্রশ্ন করে, “এমন দেখাচ্ছে কেনো আপনাকে?”

“মেহেদী যুদ্ধ করে এসেছি।তাই এমন দেখাচ্ছে।”

মেহেদী যুদ্ধ?এটা আবার কেমন কথা?মল্লিকা হিসেব মেলাতে দরজায়ই দাড়িয়ে আছে। বিস্মিত মল্লিকা।ভাবতে লাগলো তারই বুদ্ধি কম নাকি মাহরুর মজার ছলে বলে গেলো এসব? মাহরুর উল্টোঘুরে মল্লিকার হাত টেনে ঘরে নিতে নিতে বলে,

“মাথায় এত চাপ দিস না।”

“আচ্ছা আপনি কি বললেন?কিসের মেহেদী যুদ্ধ?”

“চাচা চাচী হয়তো তোকে বলেনি ছোটোবেলা থেকে তোর মস্তিষ্ক ছোট।বড় কথা আটে না।এসব নিয়ে ভাবিস না।আমি যুদ্ধ জয় করে দুটো মেহেদী এনেছি।তোর স্বামী বিজেতা”

প্রথম কথা না বুঝলেও এই কথা ঠিকই বুঝেছে মল্লিকা। উপহাস করা হচ্ছে তাকে।মল্লিকা ঠোঁট উল্টে নেয়।কম বোঝার কারণে এতবড় অপমান?

___

সকাল আটটার বাসে চেপে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে মাহরুর,মল্লিকা আর মিষ্টি।ইফতারের আগে আগে পৌঁছাতে হবে। কাউন্টারে ভিড় দেখে চোখ কপালে উঠলো।সবাই ঈদের ছুটিতে নাড়ির টানে ফিরে যাচ্ছে যারযার বাড়িতে।ভাগ্যিস সেদিন টিকেট পেয়েছে নয়তো বাড়ি যাওয়াই হতো না।

দুপুর একটা নাগাদ পৌঁছালো গ্রামে।রমজান চাচা আজ বাস কাউন্টারে এসে হাজির। তিনজনকে একসাথে পেয়ে খুশি কুলাচ্ছে না।এইতো কয়দিন আগে ঢাকা এসেছিল।অথচ আনন্দ দেখে মনে হলো কয়েক বছর দেখে না তাদের। মাহরুর বাড়ির সামনে এসে রমজান সাহেবকে বললো,

“চাচা বাড়ির চাবিটা?”

“বাড়ির চাবি দিয়ে কি করবি?”

“থাকবো কোথায় চাচা?”

“ওমা! এ কেমন কথা থাকবি কোথায়?বাড়ি চল।”

“এটাইতো বাড়ি।আমার বাড়ি।আপনার মেয়ের শশুর বাড়ি।”

মাহরুরের কথার অর্থ বুঝতে সক্ষম রমজান সাহেব। সত্যিইতো এটা এখন থেকে তার শ্বশুরবাড়ি। মাহরুরের ঘরই এখন মল্লিকার ঘর।রমজান সাহেব এর বাড়ি আর কতদূর মিনিট পাঁচেক এর রাস্তা।দৌড়ে দৌড়ে আসা যাবে।যেহেতু মাহরুর নিজের বউকে প্রথমবারের মতন নিয়ে নিজের বাড়িতেই রাখতে চাচ্ছে এতে বাঁধা দিলো না।

ফতুয়ার পকেট থেকে চাবি বের করে এগিয়ে দিয়ে বললো, “মেয়ে তার শ্বশুরবাড়িতে থাকবে মেনে নিলাম।কিন্তু ইফতার তোর শশুরবাড়িতে করতে হবে মাহি।আমি মিষ্টির জন্য খাবার দিয়া যাইতেছি।”

মাহরুর হেসে সম্মতি দেয়, “ঠিক আছে চাচা।”

“তোরা ঘরে যা।আমি তোর চাচীকে ডাইকা আনি।ঘরটা সাফ করে দিবো নে।”

“না চাচা।আমরা যতটুক প্রয়োজন করে নিবো।”

রমজান সাহেব মুখে হাসি নিয়ে পথ চলছেন।মেয়ের জীবনে আলো ফুটেছে।এই দেখে কোন বাবা না তৃপ্তি পাবে।বাড়ি ফিরে ফরিদা বেগম এর উদ্দেশ্য বললেন,

“তোমার মেয়ে, নাতনি আর মেয়ের জামাই এসেছে ওই বাড়ি।”

ফরিদা বেগম জানতে চাইলেন, “এখানে এলো না কেন?”

“মাহি চায় ওর বউ বাচ্চা ওর বাড়িতেই থাকুক।আমার মাইয়া এই সংসারটা চাইছিল।আজকে পাইছে।আমি আর বারণ করিনাই।ইফতারে আসবে।কি কি লাগবে কও?আজ ভরপুর আয়োজন করবা কিন্তু।”

“আমি আপনারে লিস্ট দিতেছি। সব বাজার থেকে আনবেন।আর রাত্রের খাবারের বাজারটাও একবারে করে ফেইলেন।”

“আচ্ছা ড্রয়ার থেকা টাকা আইনা দাও।আর একটা বড় ব্যাগ দাও।আর হ্যা মিষ্টির জন্য দুগা ভাত বসাও।”

এই ঘরটা এখনও তেমনি আছে। আধাপাকা।বড় চাচার নিজ হাতে তৈরি এই ঘরে একটা ইটও পরিবর্তন করা হয়নি।বলা হয় এখানে তার গন্ধ লেগে আছে। পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেলেও এই বাড়ির চিত্র এমনি থাকবে।আর এই ঘরটাতে নিজের সংসার পাতানোর ইচ্ছে ছিল মল্লিকার।আজ পূরণ হয়েছে।তবে ভিন্নভাবে।চাচীর কথা মনে পড়ে।যতই হোক ছোটবেলায় চাচী মল্লিকাকে নিজের মেয়ের সাথেই,মেয়ের মতন করেই ভালোবেসেছে।তারই দেওয়া নাম ‘ চন্দ্র ‘। হঠাৎ কি হলো?সেই চন্দ্র লিজা বেগমের চোখে কাঁটা হয়ে বিধতে শুরু করে।

ঘরে প্রবেশ করে প্রত্যেকটা জিনিস হাতিয়ে দেখতে শুরু করে মল্লিকা। মাহরুর পিছু ডেকে বললো, “স্মৃতিচারণ পড়ে করিস চন্দ্র।এখন একটু বিশ্রাম নে”

“এখন?”

“হ্যা এখনই।জার্নি করেছিস।এরমধ্যে রোজা।ইফতার এর সময় হতে অনেক দেরি।”

“আচ্ছা।আপনিও ঘুমোন একটু।”

__

চোখের পলকে রমজান মাস কেটে গেছে।আজ চাঁদরাত।মল্লিকার হাত চলছে তাড়াহুড়ো করে।যেভাবেই হোক আজকে পাঞ্জাবিটা তৈরি করতেই হবে।সে চায় আগামীকাল মাহরুর এই পাঞ্জাবি পড়েই ঈদের নামাজে যাক।মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন।পছন্দ হবেতো?গ্রামে বসবাসের সুবাদে টুকটাক সেলাই কাজ শিখা হয়েছিলো।সেটাই প্রদর্শন করলো মাহরুরের পাঞ্জাবির কলারে।ছেলে মানুষ অত জাঁকজমক পছন্দ করে না। মাহরুরও তাই।হালকা পাতলা কারুকাজে পাঞ্জাবির কাজ শেষ করেছে। সাদার মধ্যে কালো সুতো বেশ সুন্দর ফুটে উঠলো।মল্লিকার চোখে ভালো লাগলেইতো হবে না। মাহরুরের পছন্দ হতে হবে।

এশার নামাজ শেষে ঘরে ঢুকতেই মাহরুরের প্রশ্ন, “মেহেদী দিস নি কেনো এখনো?”

মল্লিকা উত্তরে বলে, “একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো।”

বুকে হাত বেঁধে মাহরুর ভ্রূ নাচায়।বলে, “কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুনি?”

মল্লিকা বালিশের নিচে ভাজ করে চাপা দিয়ে রাখা পাঞ্জাবিটা বের করে মাহরুরের হাতে তুলে দিলো। মাহরুর আশ্চর্য্য হয়।এটাতো সেই পাঞ্জাবীটা?কিন্তু এটার গলায় ডিজাইন আসলো কি করে? প্রশ্নবিত্ত নয়নজোড়া মল্লিকার পানে তুলে দিলে তাকে হাসতে দেখা গেলো।

মাহরুর বলে উঠে, “এই পাঞ্জাবির কলারেতো কোনো কাজ ছিলো না।”

“আমি করেছি।”

বিস্ময়বোধে পুনর্বার চোখ কপালে উঠেছে মাহরুরের। অপরপক্ষে মল্লিকা ওষ্ঠদ্বয় চেপে দাড়িয়ে। শাড়ির আঁচলে হাত কচলে চলেছে। মাহরুরের দিকে পূর্ণদৃষ্টি।ততক্ষনে দূরকল্পনা কাটিয়ে মাহরুর পাঞ্জাবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।এই চলছিলো তাহলে তার চন্দ্রের মস্তিষ্কে। মাহরুর ভেবে নিয়েছিলো এভাবেই নিজের টাকায় তাকে কিছু উপহার দিলো।দেখা শেষে স্মিথ হাসে। চমৎকার কারুকার্য।

মুগ্ধ নেত্র যুগল মল্লিকার দিকে রেখে বললো,

“কখন করেছিস এগুলো?”

“আপনি যখন অফিসে যেতেন তখন।”

“কষ্ট হয়েছে না?” মুখ মলিন করে বললো মাহরুর।

মল্লিকা অকপটে বলে উঠে, “হ্যা একটু কষ্ট হয়েছে বটে।কিন্তু আমি খুব শখ করে তৈরি করেছি আপনার জন্য।আপনি পড়বেনতো?”

উত্তরবিহীন মল্লিকাকে জড়িয়ে ধরলো মাহরুর।বললো, “পড়বো। কাল সারাদিন,সারারাত এটা পড়েই থাকবো।আমার বউ আমার জন্য শখ করে বানিয়েছে।এই পাঞ্জাবিটা আমার জীবনের বিশেষ একটা উপহার।”

উল্লাসমুখর হৃদয় নিয়ে মল্লিকা বলে উঠে, “আপনার সত্যিই পছন্দ হয়েছেতো?নাকি আমার মন রাখার জন্য বলছেন।”

“খুব খুব পছন্দ হয়েছে।তুই আমার গুনবতী বউ।এই পাঞ্জাবিটায় শুধু তোর প্রতিভা না তোর ভালোবাসার ছোঁয়াও আছে।”

মাহরুরের সাথে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে মল্লিকা।তার ছোটছোট ইচ্ছে পূরণে মরিয়া হয়ে উঠছে মল্লিকার হৃদয়ও।কতবার সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে হিসাব নেই। প্রার্থনা শুধু এতটুকুই? সর্বদা এই যোগবন্ধন অটুট থাকুক তাদের তিনজনের।

“আয় চন্দ্রবউ তোর হাতে মেহেদি দিয়ে দেই।”

“আমিই পারবো দিতে।আপনার কষ্ট করার কি দরকার?”

মাহরুর মল্লিকার গালে হাত রেখে বলল, “তোর কি দরকার ছিলো আমার জন্য এত কষ্ট করার?..আয় বেশি কথা বলিস না।”

“আপনি পারেন মেহেদী দিতে?”

বিচিত্র মুখভঙ্গি প্রকাশ করে মাহরুর উত্তর দেয়, “চেষ্টা করবো।আর নাহয় ফোনে দেখে নিবো।…কেনো?খারাপ হলে বুঝি তুই কষ্ট পাবি?”

মল্লিকা তড়িৎ গতিতে মাথা নাড়ায়।না বোধক উত্তর দিয়ে বললো,

“আপনি যেভাবেই দিয়ে দিবেন আমি খুশি।”

“আচ্ছা আয়।আমি চাচাকে কল করে বলছি মিষ্টিকে দিয়ে যেতে।ওকেও মেহেদী পড়িয়ে দেবো।”

মল্লিকা আকস্মিক বলে উঠে, “সৌভাগ্য আমাদের মা মেয়ের।”

মল্লিকার কথার বিপরীতে ভালোবাসার স্পর্শ পায় কপালে।গাঢ় ঠোঁটের স্পর্শনে লাজুক হাসে মল্লিকা।কাপড় ছেড়ে এসেছে মাহরুর।ঘরের কাপড় গায়ে দিয়ে পা গুটিয়ে বসলো।কখনো মোবাইলে কখনো মল্লিকার হাতে।চোখের মণিজোড়া এদিক ওদিক চেয়ে যাচ্ছে বারেবারে।তারপরও হাল ছাড়েনি।মেয়ে মানুষের কাজ ছেলে মানুষের জন্য দুষ্কর আর ছেলে মানুষের কাজ মেয়েদের জন্য। এভাবেই;এই নিয়মেই চলছে ধরণী।পরিপূর্ণভাবে।

প্রভাতের প্রারম্ভ। মাহরুর তৈরি গোসল করে।সকাল সাড়ে সাতটার জামায়াত। মল্লিকাকে ঈদ মোবারক জানিয়ে সর্বপ্রথম কপালে চুমু খেয়েছে।একসাথে প্রথম ঈদ তাদের।আনন্দ দ্বিগুণ।বরং তিনগুণ মিষ্টিকে নিয়ে।বেরিয়ে পড়ে নামাজের উদ্দেশ্যে।নামাজ শেষে সেই পুরোনো দিনের কথা মনে পড়লো মাহরুরের।বাবার হাত ধরে হাতে নতুন জায়নামাজ ঝুলিয়ে হেঁটে চলত প্রত্যেক ঈদে।ছেলের সাথে কোলাকোলি করতে বাবাকে হাঁটু গাড়তে হতো জমিনে। এখানের আনন্দ শেষে বাড়িতে গরম গরম সেমাই খেতে দৌড়ে যেতো দ্বিগুণ গতিতে।আজ তারা কেউই নেই।দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুর।রমজান সাহেব এর সাথে কোলাকোলি করে কবর জিয়ারত করতে গেলো বাবা মার।

ফিরে এসে দেখছে ভিন্ন পট।মা মেয়ে দুজনই তৈরি।দুজনের গায়ে একই রঙের কাপড়।দুজনের চুল অর্ধ ভেজা।মাহরুর লক্ষ করলো কোনো অংশে মল্লিকাকে মিষ্টির মা মনে হয়না।বয়স হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই চাপ মুখ, অঙ্গে স্পষ্ট নয়।

মিষ্টি দৌড়ে আসে। আধো আধো গলায় বলে, “আসসালামু আলাইকুম মাহি বাবা।”

এক ঝটকায় মিষ্টিকে কোলে নিয়ে জবাব দেয় মাহরুর, “ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা।”

“সালামি দাও?”

মাহরুর মল্লিকার দিকে চাইলো।পরপর মিষ্টির উদ্দেশ্যে বললো, “এটা তোর মা শিখিয়ে দিয়েছে না?”

মিষ্টি ধরা পড়ায় হেসে কুটিকুটি হয়ে উত্তর দেয়, “হ্যা”

পকেট থেকে নতুন চকচকে নোট বের করে মিষ্টির হাতে দিলো মাহরুর।মিষ্টি টাকা পেয়ে খুশি হলেও সেই খুশি একা ভোগ করতে রাজি নয়।

“তোকে পরীর মতন দেখাচ্ছে মিষ্টি।”

“কিন্তু আমারতো পাখা নেই মাহি বাবা।মা আমাকে রাতে গপ্পো শুনাতো তখন বলেছে পরীদের পাখা থাকে।ওরা উড়ে বেড়ায়।”

দুহাতে মিষ্টিকে তুলে হাওয়ায় উড়িয়ে মাহরুর বললো, “দেখ মিষ্টি তুইও উড়ছিস ”

মিষ্টি খুশি হয়। উচ্ছাসে চিৎকার করে বেড়ায়।তাদের দেখে হাসছে মল্লিকাও। পাখা বিহীন বাবার হাতে ভর করে মিনিট দুয়েক উড়ে ক্ষ্যান্ত হয় মিষ্টি।

আবার বলে উঠে,

“মাকে দিবে না সালামি?”

“তোর মাকে আমি আলাদাভাবে সালামি দিবো।”

মল্লিকা মাহরুরের তাকানোর ভঙ্গিতে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে।কথাটি শুনেও এড়িয়ে যায়।বলে, “সেমাই দিচ্ছি।দুজনে খেয়ে নিন। ওবাড়ি যেতে হবে আবার।”

পরিপূর্ণ ঈদের আমেজ উপভোগ করছে মিষ্টি।গ্রামের বাচ্চাদের সাথে উঠোনে খেলায় মেতেছে।বলতে গেলে তার প্রথম পরিপূর্ণ ঈদ।বিগত বছরগুলোতে ঈদ এর আনন্দ কাকে বলে সেটা তার জানা ছিলো না।যত দেরিতে আসে তত দ্রুতই চলে যায় ঈদ। সন্ধ্যা নামছে।সকাল থেকে সারাটা সময় কাটিয়েছে মল্লিকা মাহরুর রমজান মিয়ার বাসায়।আগামীকাল শিরীন আসবে।তারপর শশীদের নতুন বাড়িতে যাবে বলে সিদ্ধান্ত হলো।

মিষ্টি সারাদিন লাফালাফি করে ক্লান্ত।রাত আটটায় ঘুমিয়ে পড়েছে। অগ্যতা তার মাহি বাবার কোলে চড়ে ঘুমন্ত মেয়েটি বাড়ির দিকে রওনা হয়।বাড়ি ফিরেছে মিনিট পাঁচেক রাস্তা হেঁটে।

মিষ্টিকে শুইয়ে দিয়ে মাহরুর মল্লিকার দিকে এগিয়ে এসে বললো,

“আমাকে আজ সালামও করিসনি।বেয়াদব হচ্ছিস চন্দ্র!”

মল্লিকা কাপড় বদলে নিয়েছে।অন্যদিকে মাহরুরের গায়ে এখনও মল্লিকার দেওয়া পাঞ্জাবি।কানের দুল পাশে রেখে দ্রুত পায়ের কাছে এসে ঝুকে গেলো মল্লিকা। মাহরুর থামিয়ে দেয়।

বলে, “প্রথম কথা?পায়ে ধরে সালাম করতে নেই। দ্বিতীয় কথা পুরোনো কাপড়ে কিসের সালাম?”

বোকার মতন করে মল্লিকা প্রশ্ন করে, “এখন আবার নতুন কাপড় গায়ে দিবো?”

“জ্বি না।আপনি আসেন আমার সাথে।”

উঠোনে মিষ্টি চাঁদনী পড়েছে। মেটে রঙের উঠোন আলোকিত করতে এসেছে ঈদের চাঁদ। মাহরুর মায়ের ঘর খুঁজে পুরোনো একটা হারিকেন নিয়ে এলো।কি শখ জেগেছে কে জানে?পুরোনো দিনের মতন করে জ্বালিয়ে নিলো।মল্লিকা তার দিকে নিখুঁত দৃষ্টিতে তাকিয়ে।হারিকেন জমিনে রাখলো। চাটাই বিছিয়ে নিলো।

কাছে এসে বললো, “আয় আজ একসাথে চন্দ্রবিলাস করবো।”

মাহরুরের হাত ধরে চাটাই এর মধ্যিখানে পা গুটিয়ে বসেছে।পাশে মাহরুর।আকাশ দেখায় মগ্ন মল্লিকা।এই সুযোগে নরম গালে অধর ছোঁয়ায় মাহরুর।থতমত খেয়ে উঠা মল্লিকার পানে চেয়ে মাহরুর বললো,

“একমাসের দুরত্বে ভীষণ লোভ জেগেছিলো।তুই রাগ করিসনিতো?”

মল্লিকা হন্তদন্ত মাথা দোলায়।না বোধক উত্তর দেয়।সেতো রাগ করেনি।ভরকে উঠেছে আকস্মিক। মাহরুর আবার বললো অদ্ভুত বাণী,

“রাগ করেও আমাকে থামাতে পারবি?”

বলে হেসে উঠে মাহরুর।মাথা পাতে মল্লিকার কোলে। নিত্য দিনের প্রয়োজন তার এটা।শান্তি পায় সস্তি পায়।মনে হয় তাকে সামলানোরও কেউ রয়েছে।যত্ন করতে আছে চন্দ্রমল্লিকা। শশাঙ্কের আবছা আলোয় মুখরিত গ্রামীণ বাড়িটির মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন এক কপোত কপোতী। স্নিগ্ধতায় ঘেরা বাতাবরণে প্রেমের মধুর ডাক। শব্দহীনতায়ও গান গেয়ে যাচ্ছে।

মাহরুর ভরাট কন্ঠ টেনে বলে,

“চন্দ্র?তোর সাথে থাকলে মনে হয় এই ছোটছোট খুশিগুলো অনেক বিশাল। প্রাচুর্যে আমি ভীত হয়ে পড়ি।পূনরায় যখন তোর চোখে এক আকাশ সমান ভালোবাসা দেখি?তখন লোভী হয়ে উঠি।কেনো এতো ভালোবাসি তোকে?”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-২৫+২৬

0

চন্দ্র’মল্লিকা ২৫
লেখা : Azyah_সূচনা

মাস খানেক কেটেছে। মাহরুরের চাকরিসহ,সংসার বেশ চলছে।মিষ্টি স্কুলে মন টেকাতে পেরেছে।প্রথমবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বেশ খুশি সে।নতুন নতুন বন্ধু পাত-তেও শিখে গেছে মেয়েটা।মিষ্টি কখনো চঞ্চল কখনো চুপচাপ।বড় একটা বাড়ি ফেলে এই চিলেকোঠায় সারাদিন সময় কাঁটায়।মাঝেমধ্যে সুমাইয়া সায়মন চলে আসে এখানে।আবার মিষ্টিকে নিয়ে যায়।চলছে টোনাটুনির সংসার।সাথে একটা মিষ্টি পরী জীবনকে আলোকিত করে আছে।দায়িত্বে পিছু-পা হয়না মাহরুর। সর্বদা ঢাল হয়ে দাঁড়ায় দুইজনের জন্যে।মল্লিকা আর মিষ্টির হাসি মুখটা সামলে দেয় মাহরুরকেও।প্রথম কয়েকদিন মানিয়ে নিতে সমস্যা হলেও ইদানিং অভ্যস্ত অফিসে।ওই পরিবেশ সয়ে গেছে তারও।

মিষ্টিকে গোসল করিয়ে তৈরি করে দিচ্ছে। আজ তার মাহি বাবা বলেছে বাড়ি ফিরে বাহিরে বের হবে। আগেভাগেই যেনো ঘরের সব কাজ সেটে ফেলা হয়।দুষ্টু মিষ্টি সময় পার করছে মা মেয়ে দুজনে। মিষ্টির চুল বেঁধে দিয়ে ঘরে আসতেই ফোন বাজে।অপরিচিত নাম্বার।ফোন কি তুলবে?না তুলবে না?এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা বাজা বন্ধ হয়ে গেলো।হাফ ছেড়ে বাঁচার আগেই আবার বাজে। নিশ্চয়ই কোনো জরুরি কল।নাহয় এতবার কেনো দিবে?

ফোন ধরেই মল্লিকা বললো, “আসসালামু আলাইকুম”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম।কিরে স্বার্থপর সখী!”

“শশী?”

“হ্যা শশী। আগে কষ্টে থেকে আমায় ভুলে গিয়েছিলি।এখন সুখে থেকে আমাকে ভুলেছিস।তুই অনেক খারাপ মল্লিকা।”

মল্লিকা বললো, “দশ দিন আগে না তোর সাথে কথা বললাম।”

শশী ঢং করে বলতে লাগলো, “দশ দিনে কত ঘণ্টা হয় জানিস?তোর সাথে কথা বলার জন্য দিন হিসেব করতে হবে?”

“কি করবো বল!ওটা তোর শশুর বাড়ি।ভয় করে বারবার কল করতে।যদি তারা রেগে যায়।আমাদের আলাপ ঘণ্টার পর ঘণ্টা গড়ায় তুই জানিস না?তোর এত বড় সংসার। সামলাতে হয়।এই ভয়ে ফোন দেই না।”

“যুগ বদলেছে।এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগ।তুইতো সেখানে নেই। নাহয় ভিডিও কল দিতাম।যাই হোক।ভয় নেই কোনো যখন ইচ্ছে কল করবি। শাশুড়ি আমার আপন খালা।খুব ভালো মানুষ।”

“আলহাদুলিল্লাহ ”

“আচ্ছা শোন না। মাহরুর ভাই কেমন রে?”

মল্লিকা নির্বোধের মতন জানতে চায়, “কেমন মানে কেমন?”

উৎসুক আগ্রহী গলায় শশী প্রশ্ন করে, “স্বামী হিসেবে কেমন?”

কাছে কেউ নেই। শশী ফোনের অন্যপাশে।তারপরও লাজুক মল্লিকা মাথা নামায়। মিনমিন করে বলে, “ভালোই”

“শুধু ভালো? বল না মল্লিকা?আমরা মাহরুর ভাইকে ছোটবেলা থেকে ভাই হিসেবে দেখেছি।হুট করে তোর স্বামী হয়ে গেলো।আদর যত্ন করেতো ঠিক মত?”

“কি বলিস শশী!কেমন প্রশ্ন করলি?তুইতো এমন ফাজিল ছিলি না?”

“হয়ে গেছি।ফাজিল জামাইর পাল্লায় পড়ে আমিও ফাজিল হয়ে গেছি। মাহরুর ভাইকে লাজুক মনে হয়। শান্তও বটে।তোদের সম্পর্ক ঠিক আছেতো?”

লম্বা একটা শ্বাস ফেলে মল্লিকা।শান্ত?লাজুক? শশীর মাহরুর সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।পাগলাটে মাহরুরকে শুধু মল্লিকাই দেখেছে।ধীরেধীরে উন্মাদনার সকল সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে সে।সেটা সখীর কাছে ফাঁস করা যাবে না।নিজেদের মধ্যেই থাকুক।

“তুই এসব বাদ দিবি শশী?”

শশীর হাসির শব্দ ভেসে এলো।বললো, “আচ্ছা বাদ দে।একটা সুসংবাদ নে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে একটা বাড়ি কিনেছি আমরা।অনেক সুন্দর বাড়িটা মল্লিকা পুরো আমার স্বপ্নের মতন।তুই, মাহরুর ভাই আর আমার ছেলের বউ মিষ্টি এবারের ঈদ আমাদের বাড়িতে করবি।কোনো কথা শুনবো না আমি।আর হ্যা শিরীন আপাকেও আনবি।চাচা চাচীতো আছেই এখানে।”

“অনেক অনেক শুভেচ্ছা সখী।তোর না একটা নিজের বাড়ির শখ ছিল।বলেছিলি সাজাবি নিজের মতন করে?তোর শখ পূর্ণ হলো।” ভীষণ খুশি হয়ে বলল মল্লিকা।

“হ্যা রে।নিজের মনের মতন করে সাজিয়েছি। আসবিতো আমার ঘরে?”

“ওনাকে বলে দেখবো”

“শুধু বলে না রাজি করাবি।তোর মাহরুর ভাই যে উতলা হয়ে বিয়ে করলো তোকে? একটু ভালোবেসে বললে একটা কথাও অপূর্ণ রাখবে না দেখে নিস।”

“উফ শশী!রাখলাম আমি”

“আচ্ছা আচ্ছা।আমার নাম্বারটা সেভ করে রাখিস।”

“আচ্ছা রাখছি।”

ফোন রাখে মল্লিকা। টিভিটা খট করে বন্ধ করে দিল। খুব বাজে অভ্যাস হয়েছে এই মেয়ের।সারাদিন কার্টুন।আজকাল আবার খবর দেখার শখ জেগেছে ওর।এইটুকু মেয়ে এত এত অপরাধের বার্তা শুনে হা করে রাখে।একটু কঠোরতা অবলম্বন করে মিষ্টিকে বই সামনে ধরিয়ে দেয়।বাড়ির কাজ একা একা করতে দিয়ে নিজেও চলে গেলো গোসল করতে।

মাহরুর ফিরেছে।আজ বাড়ির ভেতরের সিড়ি দিয়ে এসেছে।রহিম চাচার বাড়ির সামনে দাড়িয়ে এই মাসের ভাড়াটা দিয়ে দিলো।ঘরে আসতে বললেও আসেনি। তাড়া আছে তার।ঘরে এসেই দরজা ধাক্কায়।অনেকক্ষন যাবৎ।কেউ দরজা খুলছে না।মনের মধ্যে হালকা ভয় হানা দেওয়ার আগেই পকেট থেকে আলাদা চাবি বের করলো।লোহার গেট এর তালা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখে ভিন্ন পরিবেশ।মা মেয়ে দুজন অযথা খিলখিল করে হাসছে।এই হাসি এতই তীব্র দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ অব্দি তাদের কানে আসেনি।

মাহরুর এগিয়ে এলো। মিষ্টিকে বললো, “অন্যদিকে তাকা।”

মিষ্টিও অন্যপাশে ফিরতেই মাথায় থাপ্পড় পড়ে মল্লিকার। মাহরুর সামান্য রাগ দেখিয়ে বললো,

“কিরে বধির মহিলা।কতক্ষন যাবৎ দরজা ধাক্কা দিচ্ছি।শুনিস না?ভয় হতে শুরু করেছিল।”

“শুনিনি।”

শান্ত করে নিজেকে মাহরুর।পকেট হাতড়ে কিছু একটা বের করতে করতে বলল, “হাত এগো ”

“কি?”

“হাত দে”

“কেনো?”

“চন্দ্র!”

ধমকের সুরে মাহরুরের মুখে ডাক শুনে দ্রুত হাত এগিয়ে দিলো। মাহরুর পকেট থেকে একটি খাম বের করে মল্লিকার হাতে রাখলো।

বললো, “নে ”

“কি এটায়?”

“আমার বেতনের টাকা।এর মধ্যে ছয় হাজার ভাড়া দিয়ে এসেছি।”

মল্লিকা আশ্চর্য্য হয়ে বললো, “এগুলো দিয়ে আমি কি করবো?”

“তোর হক আছে না?আম্মা থাকলে আম্মার হাতে দিতাম।রাখ শুনেছি নারীরা টাকা,পয়সা যত্ন করে রাখে।অহেতুক খরচা করে না।”

হঠাৎ চাচীর কথা শুনে মনটা বিসন্ন হয়ে উঠে।এক সময় ভীষণ আদর করতো মল্লিকাকে।হটাৎ কি যেনো হয়ে গেলো তার। মাহরুর ধ্যান ভাঙায়।

বলে, “চল মার্কেটে যাবো”

“মাত্র বেতন পেলেন।এখনই?”

“টাকা যেমন বাঁচার একটা মুখ্য উপাদান,তেমনি হাতের ময়লাও বটে।মাঝেমধ্যে ময়লা পরিষ্কার করতে হয়।এতে অসুখ বাঁধে না।”

“অল্প কিছু টাকা নিয়ে যাবো তাহলে।হিসাব করে খরচ করবো।অহেতুক কিছুই না”

“দ্রুত নিজের চরিত্র বদলালি? একটু আগে বলছিলি টাকা দিয়ে কি করবি?এখন বউদের মতন হিসাব শুরু করেছিস।”

“আমি কি এখন তাকাবো তোমাদের দিকে?”

হটাৎ করেই মিষ্টি বলে উঠে কথাটা।বেচারি বাবার আদেশ মতন অন্যদিকেই ঘুরে ছিলো।মাথা ফেরাতে হবে কখন সেটাতো বলেনি। মাহরুর মল্লিকা নিজেদের কথার চলে বুঝতেই পারেনি মিষ্টি এখনো অন্যপাশে ফিরে আছে। মিষ্টির কথার ধরনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মাহরুর। মল্লিকাও মুখ ছাপিয়ে হাসছে।

মাহরুর আলমারি থেকে একটা গোলাপী শাড়ি বের করে।বলে, “এটা পড়বি আজ।দ্রুত তৈরি হয়ে নে।”

“আচ্ছা”

“মিষ্টি কাপড় বদলেছে।বাকিটা আমি করছি।সুন্দর করে তৈরি হয়ে আয়”

গোলাপি রঙের শাড়িতে নিজেকে পরিপাটিভাবে সাজিয়েছে মল্লিকা।আজ খোঁপা করলো না। বিনুনী বেঁধে নিলো মাথায়।চুল পাতলা হয়ে গেছে আগের চেয়ে।তবে দৈর্ঘ্য কমায়নি।বেধে এগিয়ে এলো ঘরের দিকে। মাহরুরের দিকে না চেয়েই আয়নার সামনে দাড়ায়।খুঁজে খুঁজে কাজলটা বের চোখে পড়তে শুরু করলো মল্লিকা। ততক্ষণে মাহরুরের চোখ নিজের দিকে টেনেছে।হালকা কাজল চোখে ছুঁইয়ে। কানে একজোড়া ছোট্ট ঝুমকা পড়ে সাজগোজ পূর্ন করে।

মাহরুর পেছনে এসে দাঁড়ায়।মিষ্টি আছে সাথেই।বেহায়াপনা দেখানো অসম্ভব।তাই বলে উঠলো, “জানিস তোকে কেমন লাগছে?”

লাজুক ভঙ্গিতে মল্লিকা জানতে চায়, “কেমন?”

“শশীর বিয়ের দিন প্রথম শাড়ি পড়েছিলি।ঠিক তেমন দেখাচ্ছে।শুভ্র,মায়াবী।”

“চলুন।দেরি হচ্ছে” সরাসরি এড়িয়ে গেলো মল্লিকা।

গলির মুখে গিয়ে সি.এন.জি নিতে হবে।দুই তিন মিনিট এর রাস্তা।হেঁটে চলেছে মল্লিকা, মাহরুর আর মিষ্টির। বাবার কোলে একের পর এক প্রশ্নের বন্যা বইছে মিষ্টির মুখে। কোথায় যাচ্ছে,কেনো যাচ্ছে,কি কি কিনবে সেখানে সব। হঠাৎ পেছন ডাকে মল্লিকা।

বলে, “শুনছেন।আমাকে একশো টাকা দিবেন?”

পকেট থেকে একশো টাকা নোট বের করে মল্লিকাকে এগিয়ে দিলো।মল্লিকা আবার বললো, “ওখানে একটা মহিলা বাচ্চা নিয়ে বসে আছে।ওদের এই টাকাটা দিয়ে আসি?ওদেরও হক আছে।এতে আয়ে বরকত আসবে।”

মাহরুর স্বেচ্ছায় সম্মতি দেয়।বলে, “যা দিয়ে আয়। এটাতে অনুমতি নেওয়ার কি আছে?”

“আচ্ছা”

মল্লিকার কথায় পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বেরিয়েছে।এই টাকায় কেনাকাটা,খাওয়া দাওয়া,ঘুরাফেরা সবটা করতে হবে।এটাই আবদার মল্লিকার।আজ রাতের শহরটা ঘুরবে।আনন্দে।নিজেদেরকে সময় দেবে।একটা সুখী দম্পতির ন্যায় সবার সম্মুখে উপস্থাপন করবে।এলাকায় জানাজানি হয়েছে।মল্লিকা এখন মাহরুরের স্ত্রী।একেক জনের একেক প্রতিক্রীয়া হলেও তাতে কিছুই আসে যায়না মাহরুরের।তার মতে নিজে ভালো থাকলে জগৎ ভালো।প্রতিবেশের চিন্তা চেতনাকে দুরত্বে ঠেলে নিজেদের মতন করে বাঁচার চেষ্টা।

রিকশায় চড়ে কিছুদূর এগিয়ে মল্লিকার চোখ পড়ে রাস্তার দ্বারে কাপড়ের স্টল বসেছে।চোখ গাড়লো সেখানে।
বললো, “আমরা মার্কেটে যাচ্ছি?”

মাহরুর উত্তর দেয়, “হ্যা”

“সামনে দেখেন কতগুলো কাপড়ের দোকান।অনেক ভিড় এখানে।চলেন এখান থেকে কিনে নেই।”

“আমি মিষ্টিকে বলেছি ভালো কোনো মার্কেট থেকে কিনে দিবো।”

“আহহা!ভালো মার্কেটেও এমন কাপড়ই পাওয়া যাবে।আপনি চলুন না।অনেক অনেক কেনাকাটা করা যাবে এখান থেকে।দাম আর অবস্থান দিয়ে কি আসে যায়?জিনিস যদি সুন্দর হয় আর ভালো হয়?”

বাহিরে এসেছে।খোলামেলা পরিবেশে মল্লিকা নিজের বদ্ধ মনকেও খোলামেলা করছে।তার আবদারটাও আদুরে মনে হলো।আর বুদ্ধিমতীর মতন চিন্তাধারা অবাক করলো।মল্লিকার গাল টেনে রিকশাওয়ালাকে বলে সামনে থামাতে।

মল্লিকার কথা ঠিক।এখানে সুন্দর সুন্দর জিনিস পাওয়া যাচ্ছে।দামী গার্মেন্টস এর কাপড়গুলো তারা এনে এখানেই বিক্রি করে।সাথে সব ধরনের ঘরোয়া জিনিস। বাচ্চাদের খেলনাও আছে এখানে।এক এক করে গিন্নির বেশভূষা ধারণ করে কেনাকাটা সম্পন্ন করলো মল্লিকা।মেয়েদের বুঝি এই গুন সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত? এগারশো টাকায় দরকারি সব কিনেছে।

হাতে ব্যাগ নিয়ে আবার রিকশায় চেপেছে।ক্লান্ত চন্দ্র তার। মাহরুর টিস্যুর সাহায্যে ঘাম মুছে দেয়।আলগোছে কোমর চেপে নিয়ে বললো,

“ক্লান্ত হয়ে গেছিস না?”

“হুম অনেক।”

“ক্ষিদে পেয়েছে?”

“হ্যা”

“সামনের লেক পাড়ে যাবো।সেখানে খাওয়া দাওয়াও হবে।আর বাচ্চাদের খেলার জন্য রাইডও আছে।”

লেকের পাড়ে মনোরম পরিবেশ। উপভোগ করছে মল্লিকা।তবে একা।কাঠের টেবিলে গালে হাত রেখে একবার আধাঁরে ঢাকা নিস্তব্ধ জলরাশি দেখছে কখনও অন্যপাশে ঘুরে মিষ্টি আর মাহরুরকে।মিষ্টিকে দোলনায় দোল খাওয়াচ্ছে।কখনো ছোট ট্রেইন।আবার কখনো বাচ্চাদের খেলার রাইডে তুলছে। দুটোই শান্তির স্থান।মিষ্টিকে খেলানোর পাশাপাশি মল্লিকার দিকেও চোখে চোখে রাখছে।দুজনই তার দায়িত্ব।কোনোটাই ছেড়ে দেওয়ার মতো নয়।অন্যদিকে মল্লিকার চোখে ডান বাম উভয় দৃশ্য দৃষ্টিনন্দন। মাহরুর তার মাথার ছায়া।এই ছায়ায় চঞ্চলতায় মেতে ওই বাচ্চা মেয়েটি।এরই মধ্যে খাবার চলে এলো।

মল্লিকা গলা উচু করে ডাকে।বলে, “চলে আসুন।খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

মিষ্টিকে ডান কাঁধে তুলে নিয়ে এলো।হয়রান দুজনেই।একজন খেলাধুলা করে অন্যজন তার পেছনে দৌড়ঝাঁপ করে।হাফ ছাড়লো চেয়ারে বসে।খাবার দেখে মনে পড়লো মিষ্টিরও ক্ষুদা পেয়েছে।

বলে উঠলো, “ক্ষিদে পেয়েছে।”

মল্লিকা বললো, “এত এত দৌড়ঝাঁপ করলি কেন মিষ্টি?”

“অনেক মজা লাগছিল মা।ওই দোলনায়,ট্রেনে।”

“হয়েছে।এবার ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে হবে বলে দিলাম।কোনো বায়না চলবে না।”

“আচ্ছা মা।”

মাহরুর বললো, “অযথা বকিস মেয়েটাকে।এই বয়সে বাচ্চারা আরো দুষ্টুমি করে।সেই তুলনায় আমার মিষ্টি অনেক শান্ত।তাই না মিষ্টি?”

মিষ্টি ঠোঁট চেপে হেসে হেসে মাথা দোলায়।মিষ্টি আজ খাবার নিয়ে কোনো বায়না করেনি। মাহরুরের হাতে সুন্দরমত খেয়ে উঠেছে।যতটুক পারে। মাহরুর ঘড়ি দেখছে।রাত নয়টা বাজে।এবার বাড়ি ফেরার পালা।খাবারের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রাস্তায় আবারো একটি মেয়ে পেলো সেদিনের মতন।এক বালতি ফুল নিয়ে মুখ চেয়ে দাড়িয়ে আছে। মাহরুর দাড়ায়।বেশ কয়েকটা ফুল কিনে নিলো।

মল্লিকার কাছে এসে বললো, “আপনার জন্য।গ্রহণ করুন”

“আবার ফুল কিনলেন কেনো?”

“এত কথা বলিস কেনো তুই?নে”

আরেকটা ফুল এগিয়ে মিষ্টির দিকে দিয়ে বললো, “আর এটা আপনার”

মেয়েটি এখনও দাড়িয়ে আছে।হয়তো সুখী পরিবার দেখে থমকে আছে।হাসছে মুচকি মুচকি। মাহরুর খেয়াল করলো। মাহরুর আর কিছু টাকা মেয়েটিকে ধরিয়ে বললো,

“আমাদের একটা ছবি তুলে দিবে?”

“হ স্যার দেন।”

মোবাইল এগিয়ে দিলো মাহরুর। মিষ্টি মাহরুরের কোলে। মল্লিকাকে ডাকলে সেও সাথে এসে দাঁড়ায়।তবে দুরত্বে। মাহরুর কপাল কুঁচকায়।বাহু চেপে কাছাকাছি টেনে নিলো।

কানে কানে বললো, “দূরে দূরে থাকতে না করেছি কিন্তু চন্দ্র।”

মেয়েটি নৈপুন্য না ছবি তোলায়।তারপরও অনেকগুলো ছবি তুলেছে।বেশিরভাগ ছবি তাদের একসাথে।সবশেষে একটা ছবি মাহরুর আর মল্লিকার।অজান্তেই দুজন দুজনের দিকে চেয়ে আছে। মাহরুর হাসলো।ভীষণ মানিয়েছে তাদের দুজনকে।আর মিষ্টি সেই সৌন্দর্য্যকে দ্বিগুণ করছে।পরিপূর্ণ মনে হয় নিজেকে।আবার ভয় হয়।এই সুখটায় কারো কালো ছায়া না পড়ুক। অতিরিক্ত শান্তিও কখনো ভয়ের কারণ।সামলে নেওয়ার শক্তি প্রয়োজন।অনেক সাহস প্রয়োজন।কু নজর মোকাবেলা প্রয়োজন।মল্লিকা আর মিষ্টির উপরে যেকোনো বিপদ আসার আগে যেনো মাহরুর এসে পিঠ ঠেকাতে পারে।তবে মাহরুর এই ভেবে শান্তি পেলো অনেকটা পথ।অনেকটা অনিশ্চিত পথ পেরিয়ে উদ্দেশ্য পেয়েছে জীবনের।

বাড়ি ফিরেছে।ফেরার পথে ছবিগুলো স্টুডিওতে দিয়ে এসেছে।বাঁধাই করবে।নিজের কাছেও রাখবে।যতটা সময় এই দুইজন মূল্যবান ব্যক্তি থেকে দূরে থাকে তাদের ছবির সাহায্যে যেনো কাছাকাছি অনুভব করে।মল্লিকা আর মিষ্টি ভীষণ ক্লান্ত।ঘুমিয়ে আছে।দুজনের কপালে চুমু খেয়ে ছাদে এসে দাঁড়ালো মাহরুর।আকাশপানে চেয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষন।

আজ জন্মদাত্রী মায়ের সাথে আলাপ করা যাক?কতদিন তাকে ওই তারার ভীড়ে খোঁজা হয়না।বাবাকেও মনে পড়ে।দুজনেই যেনো আকাশ থেকে মাহরুরের চিলেকোঠার সংসারটা দেখছে।

মনে মনে বললো, “এই সস্তিটাইতো খুঁজছিলাম!আম্মা তোমার প্রতি আমার এখন কোনো রাগ নাই।হয়তো তখন বাঁধা না পেলে সুখটা দ্বিগুণ শোরগোল করে আসতো না জীবনে।তোমাকে খুব মনে পরে আম্মা।দুআ করবে নিজের ছেলের সুখী জীবনের জন্য?”

চলবে….

চন্দ্র’মল্লিকা ২৬
লেখা : Azyah_সূচনা

ছিমছাম ডেস্কটায় সুন্দর ফ্রেমে আবৃত ছবিটি রেখেছে মাহরুর।একদম নিজের চোখ বরাবর।ফোনের আওয়াজ অফিসে গুঞ্জন তুললে অনেকেই কাজে সমস্যা হয়।তাই নিয়ম সবার পার্সোনাল ফোন ভাইব্রেশন মোডে থাকবে। মাহরুর ফোনটা ভাইব্রেশন মোডে রেখে বুক পকেটে রেখেছে।যেনো বাজলে দ্রুত রিসিভ করতে পারে।মাত্রই ডিরেক্টর ফাইল দিয়ে গেলেন।বললেন এগুলো এলাইন করতে হবে।সেগুলো কম্পিউটারে টুকে রাখতে হবে।আদেশ অনুযায়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুর কাজ শুরু করে।ফাঁকে ফাঁকে ছবিটিতে চোখ বুলায়;ছুঁয়ে দেয়।নিজেকে বলে উঠে সম্পূর্ণভাবে চন্দ্রমল্লিকার প্রেমে বুদ হয়েছে সে।কেমন যেনো কিশোর প্রেমিকের মতন আচরণ তার।ছেলে মানুষী করে ফেলে তেত্রিশ বছর বয়সী একজন লোক।

“মিস্টার মাহরুর ইবনাত। ফ্রেশার রাইট?”

মেয়েলি গলায় কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে মাহরুর।সামনেই দেখলো একজন আধুনিক বেশভূষায় আবৃত নারীকে।চুলগুলো ছোট ছোট বাদামি রঙের।ছেলেদের মতন কোর্ট প্যান্ট পড়েছে।

মাহরুর বিনয়ী হাসি ছুঁড়ে নিচু গলায় বলে, “জ্বি”

মেয়েটি হাত এগিয়ে দিলো।বললো, “আমি তানিয়া”

বিব্রত বোধ করে মাহরুর।এসব হ্যান্ডশেক পুরুষের সাথে গেলেও নারীর সাথে? মাহরুরকে ভাবনা চিন্তা করতে দেখে হাত সরিয়ে নিল মেয়েটি।

বললো, “ইটস ওকে।আমি আপনার টিমের। পরিচিত হতে এসেছি।কিছুদিনের ছুটিতে ছিলাম তাই আপনার সাথে সাক্ষাৎ হয়নি।”

“ওহ আচ্ছা”

“অফিস কেমন লাগছে আপনার?”

“জ্বি খুব সুন্দর”

আলাপ আলোচনা দীর্ঘ করলো মেয়েটি।পরিচিত হলো একে অপরের সাথে।কিছু আলাপ কাজ সম্পর্কে,কিছু অন্যান্য বিষয়ে।শেষমেশ মেয়েটির চোখ পড়ে ডেস্ক এর কোনায় ছবিটিতে। অনুমতিবিহীন হাতে তুলে নেয় ফ্রেমটি। মাহরুর বিজড়িত অবস্থায় পড়ে যায়।তার এসব পছন্দ না।কারো অনুমতি ছাড়া কিছু স্পর্শ করা বেয়াদবির কাতারে ফেলে সে।

মেয়েটি ভ্রূ উচু করে জানতে চায়, “ফ্যামিলি?”

“জ্বি হ্যাঁ।আমার স্ত্রী আর মেয়ে।”

“ওহ মায় গড!আপনি একজন মেয়ের বাবা? আই কান্ট বিলিভ।”

“কেনো?”

“ইয়াং মনে হয়।”

“হয়তো।কিন্তু এটা সত্যি আমি পাঁচ বছর বয়সী একজন মেয়ের বাবা।”

ফ্রেমটি খট করে টেবিলে রাখলো তানিয়া।বললো, “নাইস। সি ইউ সুন।”

নিশপিশ করে ফ্রেমটি হাতে নিলো মাহরুর।কপাল কুঁচকে আছে। হাতের সাহায্যে ভালোমত মুছে তার ঠিক জায়গায় রেখে দিলো।ফোন বাজছে।নাম পাশের বুক পকেটে ফোনের কম্পন জানান দিলো তার হৃদয়ের কম্পন তাকে মনে করেছে।

ফোন রিসিভ করেই গলা নামায় মাহরুর।শীতল কণ্ঠে বললো,

“বলেন?”

“জানেন মিষ্টির রেজাল্ট দিয়েছে।”

“কি? সত্যিই।কি হলো রেজাল্ট?”

“ক্লাসে চতুর্থ হয়েছে আপনার মে…” বলতে বলতে থেমে যায় মল্লিকা।

“থেমে গেলি কেন?পুরো বাক্য শেষ কর চন্দ্র।এসির বাতাসে বসে মাথা গরম করতে চাচ্ছি না।”

“আপনার মেয়ে।”

“আবার পুরো লাইন বল।”

“ক্লাসে চতুর্থ হয়েছে আপনার মেয়ে” বলে হাফ ছাড়ে মল্লিকা।

“ভেরি গুড।”

“মিষ্টি কথা বলবে।”

“দে”

মিষ্টি এক প্রকার কেড়ে নিয়েছে হাত থেকে ফোন।যতক্ষণ মল্লিকার হাতে ছিলো টানাটানি করছিলো।কথা না বলে শান্তি নেই।মল্লিকা মিষ্টির কানে ফোন ধরলো।

মিষ্টি চঞ্চল ভঙ্গিতে বললো,

“মাহি বাবা”

“বল বাবা?তুই নাকি চতুর্থ হয়েছিস?”

“হ্যা..আমার ক্লাস টিচার বলেছে গুড গার্ল।পরের পরীক্ষায় আরো ভালো করে পড়তে।তখন ফার্স্ট হবো।”

“ইনশাল্লাহ।কিছু আনবো তোর জন্য?”

“হ্যা হ্যা ঐযে টিভিতে দেখায় ডেইরি!ডেইরি চকলেট।ঐটা”

“ডেইরি মিল্ক?”

“হ্যা।”

“একটা না দুইটা নিয়ে আসবো।কিন্তু একটা শর্ত আছে?”

“কি মাহি বাবা?”

“রাতে মা ভাত খাওয়াতে বসলে কোনো বায়না করা চলবে না। সব ভাত পেট পুড়ে খেলেই চকোলেট পাবি।ঠিক আছে?”

“আচ্ছা আচ্ছা।রাজি”

“মাকে দে ফোনটা।”

মল্লিকা এতক্ষন দুজনের কথা ফোনের সাথে কান চেপে শুনছিল। হটাৎ মিষ্টি সরে গিয়ে ফোন এগিয়ে দেয়।মল্লিকা বললো,

“হুম?”

“খেয়েছিস তোরা?”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা রাখি তাহলে।”

“আপনিও খেয়ে নিয়েন।অপেক্ষা করবো।”

বিশ্বজয়ের হাসি ফুটলো মাহরুরের মুখে।এই প্রথম অপেক্ষা করবো বাক্যটি যথাযথ বলেছে।এতদিন প্রেমিকা হওয়ার পাঠদান আজ কাজে লাগালো।তবে সময় থাকতেই কাজে লাগিয়েছে। মাহরুরের উত্তর দেওয়ার পূর্বেই ফোনটা রেখে দিল মল্লিকা। হবে!এই হিসেবও বাড়ি গিয়ে হবে।তবে কোনো শাস্তি নয়।ভালোবেসে হিসেব হবে।

__

প্রতিদিনের নিয়মমাফিক ঠিক টাইমেই বাড়িতে অবস্থান মাহরুরের।আর দিন কয়েক পাড় হলেই রোজার ঈদ।বাজারের লিস্ট করতে হবে। একমাসের রোজার জন্য সব কেনাকাটা করতে হবে সময় বের করে।আজ রবিবার।আগামীকাল তার ছুটি।ছুটি?এই শব্দটায় অলসতা ধরে গেলো শরীরে।ক্যালেন্ডার দেখে সময় মিলিয়ে নিলো।এই শুক্রবারেই রেদোয়ানকে নিয়ে বড় বাজারে যাবে।কেনাকাটা একবারে করে নিয়ে আসবে।রাতের খাবারের পর মাহরুর এককাপ চায়ের আবদার করলো।হুটহাট রাতের বেলা চা খাওয়ার ভুত চাপে। মল্লিকা দ্রুত বানিয়ে হাজির করলো তার সামনে।

চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, “কি কি করলি সারাদিন?”

হাতের চুড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে মল্লিকা বলে, “আমার আর কি কাজ!রান্না করি আর বাকি সময় মিষ্টিকে নিয়ে পাড় হয়।”

“তোর একা লাগে চন্দ্র?”

“না।উম! হ্যাঁ ”

“আমি না থাকলে একা লাগে?”

“সেটাতো স্বাভাবিক…”

সম্পূর্ণ রূপে নিজেকে প্রকাশ করে না মেয়েটি।আর কত সময় দেবে?আর সেই বা কত সময় নেবে অধিকার খাটাতে।বিয়ের কম সময়তো হয়নি!

“চন্দ্র তুই আমাকে মেনে নিস নি তাই না?”

বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় মল্লিকা।বলে, “এভাবে বলছেন কেনো?এমন কিছুই না।”

“নিজেকে সচ্ছ কাচের মতন আমার সামনে তুলে ধর তাহলে।আমি যেনো তোর দিকে চেয়ে,তোর কথা শুনে তোর অন্তর অব্দি ঝাঁকতে পারি।”

মল্লিকা তুচ্ছ হাসে।সময় নিয়ে বলে উঠে, “আমাকে কখনো কেউ জড়তা কাটিয়ে তুলতে সাহায্যই করেনি।বয়সে আমি পঁচিশ বছরের একজন নারী।কিন্ত কি জানেন?আমি এখনও ওই গ্রামের কিশোরী মল্লিকাতেই পড়ে আছি।ছোটোবেলা থেকে মেয়ে বলে বেড়াজালে বেধে রাখা হয়েছিল।হুট করে যখন প্রেম জন্মায় তখন আবার হারিয়ে ফেলি।আবার যখন নতুন জীবন শুরু করলাম?সেখানে আমার মতামত প্রকাশের কোনো সুযোগই ছিলো না।আমার হৃদয়টা সর্বক্ষণ বদ্ধ ঘরেই আবদ্ধ রয়েছে মাহরুর ভাই ”

মল্লিকার হাত চেপে মাহরুর বললো, “আমি দিচ্ছি মতামত প্রকাশের সুযোগ।তোর জন্য সমস্ত দরজা খোলা।কি চাই তোর?কি ইচ্ছে? বল চন্দ্র!আমি সব পূরণ করে দিবো।”

“সবতো পূরণ করছেনই।”

“তাহলে কেনো জড়তা?”

“তোমার নতুন রূপ একটা ভ্রমজাল আমার কাছে মাহরুর ভাই। শ্বাস আটকে আসে।বারবার মিলিয়ে নেই তুমিই কি সেই মাহরুর ভাই?যাকে আমি ভালোবাসতাম?”

করুন চক্ষু চন্দ্রের দিকে ছুঁড়ে মাহরুর বললো, “বাসতি?এখন বাসিস না?”

“ভুল ভাবছো।আগের ভালোবাসা ভিন্ন ছিলো।এখন ভিন্ন।”

“ভালোবাসিস?”

“হুম”

সময় ব্যয় না করেই কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায় মাহরুর।শক্তি সহকারে ঠোঁট চেপে রাখলো মল্লিকার কপালে।তাকে উল্টো ঘুরিয়ে বুকের সাথে পিঠ ঠেকায়।বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় এই পূর্ণিমা রাতে।ছাদের এক কিনারায় মাদুর পেতে বসে আছে তারা।পরিবেশ মনোরম। স্বেচ্ছায় মাহরুরের হাতের উপর হাত ছোঁয়ায় মল্লিকা।আবার দ্রুত গতিতে সরিয়েও নিলো।

বললো, “জানেন শশীরা নতুন বাড়ি কিনেছে।আমাকে দাওয়াত করে বললো এবার ঈদ গ্রামে ওদের বাড়িতে করতে।আপনি কি যাবেন?”

“তুই আবার ওই গ্রামে যেতে চাচ্ছিস?যেখানে তোকে এতকিছু সহ্য করতে হলো?”

“খারাপ কথা মনে রেখে কি করবো?সেখানে আমরা একটা ভালো সময়ও কাটিয়েছি।মনে পড়ে?”

মল্লিকার কাঁধে কপাল ঠেকিয়ে মাহরুর চোখ বুজে। নিঃশ্বাস ফেলে।ঝড় নিঃশ্বাস।সবই মনে পরে তার।কি করে ওই মফস্বলে বাল্যকাল থেকে যৌবন পেরিয়েছে।মধ্যে এক ঝড় এসে লন্ডভন্ড করেছে।

মল্লিকা আবার ধীমা গলায় জানতে চায়, “যাবেন?আগের মতই সবাই মিলে ঈদ পালন করবো।”

মল্লিকার দেহের মেয়েলি ঘ্রাণে নিজেকে জড়িয়ে বললো, “হুম যাবো।তুই যেসব কাজে খুশি থাকবি সবটাই করবো”

“ছুটি পাবেন কতদিন?”

“পঁচিশ রোজা থেকে ছুটি শুরু। ঈদের পর এক সপ্তাহ।”

“আমরা তাহলে পরদিনই চলে যাবো গ্রামে। বুবু,দুলাভাই,সায়মন, সুমাইয়াকেও নিবো।”

দুজনার একান্ত সময় আছে।এক পুরুষ প্রাণের সমগ্র দায়িত্ব পালনে দিন কাটে। ‘দায়িত্ব’ শব্দের ভেজায় ভার।ইচ্ছে হয়না কখনোকখনো।ইচ্ছে করে সারাদিন নিজের দেহকে আরাম দিতে।সমস্ত রীতিনীতি ভেঙে মন ভ্রমরা যেই ইচ্ছে পোষণ করছে তাকেই প্রাধান্য দেক।হয়না।মানুষ মানুষের কাছে বাঁধা।হারে খাটুনির পর ফিরে এসে একটু দম নেয়। অপরপক্ষে আরেক নারীও বাধ্যতায় আবদ্ধ। চুলোচকি,সংসার সামলানো আর কারো অপেক্ষা ছাড়া আছেই কি?সবই সুখে থাকার জন্যে প্রতিনিয়তর লড়াই।এই রজনীর দমকা হাওয়ায় নিজেদের মধ্যে কিছু ব্যক্তিগত সময়টাও বের করে নিতে হয়।

গল্প চলছে যুগলের। এরইমধ্যে বাচ্চা স্বরে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে ঘর বেয়ে ছাদে। কন্ঠ পরিচিত। উদ্বেগ প্রতিক্রিয়ার তৈরি হয় মল্লিকা মাহরুরের মধ্যে।একলাফে একে অপরের উষ্ণতা ছাড়িয়ে বড়বড় কদম ফেলে ঘরের দিকে কদম তোলে।দুজনার গতিই চটপটে।কেনো কাদঁছে এই চিলেকোঠার আলো? উদ্বেজনে পরিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চিত্ত। ক্রন্দনরত মিষ্টির গায়ে হাত পড়লেই বুঝা গেলো ভারী জ্বরে পুড়ছে সে।নিদারুণ ত্রাসে একে অপরের দিকে চাইছে।মিষ্টি ঘুমিয়েছে অনেক সময়।তখন এই তাপ ছিলো না। হঠাৎ কি করে জ্বর এলো?

মাহরুর তরহরি পায়ে জলপট্টি এনেছে। মল্লিকাকে দায়িত্ব দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে খুঁজতে লাগলো ঔষধ। পেয়েছেও বটে।তবে লাভ কি?মিষ্টি ছোট সে পারবে না টেবলেট জাতীয় কিছু খেতে। মাথায় চিন্তার ভার হতে শুরু করলে মাহরুর বলে,

“আমি নিচে যাচ্ছি।দেখি কোনো ওষুধের দোকান খোলা আছে কিনা।মিষ্টিকে একা সামলাতে পারবি চন্দ্র?প্লিজ!আমি যেভাবেই হোক ঔষধ নিয়ে আসবো।”

অস্থিরতায় আবৃত মল্লিকা বললো, “অনেক রাত হয়েছে এখন ঔষধ পাবেন?”

মল্লিকার কথাও ঠিক।আসলেই অনেক রাত হয়েছে।এই এলাকায় রাত এগারোটার পর সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়। হাসপাতাল এর দূরত্ব অনেক। মাহরুর হাল ছাড়লো না।বললো,

“পাবো।ফোন কাছে রাখ।আমি কল করলে দ্রুত ধরবি।”

মাহরুর ছুটে বাহিরে।মল্লিকা উচু গলায় বলতে লাগলো, “দেখে শুনে সাবধানে যাবেন।”

অন্যদিকে কুকিয়ে ওঠা মিষ্টির লালচে মুখ দেখে আহত হচ্ছে মল্লিকা বারবার।যেনতেন জ্বর নয়।ভারী জ্বর এসেছে।নরম হৃদয়ের মল্লিকার হৃদয় যেনো ধড়ফড় করা থামাচ্ছেই না।একদিকে তার কলিজার টুকরো মেয়ের জ্বর অন্যদিকে এতরাতে কোথায় ছুটলো মাহরুর?মেয়ের মাথায় গালে হাত বোলাতে বোলাতে দুআ পড়তে শুরু করলো।

পিনপিনে নিস্তব্ধতা সারা মহল্লা জুড়ে।কুকুরের দল আর ল্যাম্পপোস্টের আলো ছাড়া আর কোনো মানুষের উপস্থিতি এখানে নেই।ভয়ানক নিশ্চুপ চারিপাশ।যতদূর চোখ যাচ্ছে মাহরুরের হেঁটে চলেছে।দ্রুত হাঁটার ফলে হৃদপিণ্ড তার উঠনামার গতি দ্বিগুণ করেছে।
আশার আলো বুঝি ফুটলো।হাটতে হাটতে কখন পুরোনো ফার্মেসি এর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে নিজেও জানে না।বুকে নাম হাত ছেলে শ্বাস নিলো। ভেতরে ঢুকেই দোকানিকে বললো,

“আমার!আমার মেয়ের জ্বর।জ্বরের সিরাপ আছে না?আর থার্মোমিটার?”

দোকানী চোখ বড় করে তাকালো মাহরুরের দিকে।তার হাপানো দেখে দ্রুত এক বোতল পানি এগিয়ে তার সাথেই বললো, “আছে।বাচ্চার বয়স কত? সাড়ে পাঁচ অথবা পাঁচ বছর আট নয়মাস হবে।”

“কখন থেকে জ্বর?”

“ঘন্টাখানেক।হটাৎ জ্বর এসেছে তীব্র।ডাক্তার এর কাছে নিতে হবে ভাই?”

দোকানী বাচ্চাদের জ্বরের সিরাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এই সিরাপ খাইয়ে দিন।যদি জ্বর না কমে কাল ডাক্তার দেখাবেন।আর হ্যা থার্মোমিটার দিচ্ছি।”

থার্মোমিটার দিতে দিতে দোকানি আবার বললেন পানি খেয়ে নিতে। চিন্তিত মাহরুরকে দেখে মায়া হয়েছে তার। মাহরুর টাকা মিটিয়ে বাড়ির দিকে এক প্রকার দৌড় লাগায়।না জানে বাচ্চাটি জ্বরে কত কষ্ট পাচ্ছে?

লোহার দরজা টপকে মাহরুর ঘরে আসে।মিষ্টিকে মল্লিকার কাছ থেকে নিয়ে বুকে জোরালো।বললো, “আম্মা?কি হয়েছে আমার মা’র?দেখি?”

মিষ্টি জেগে।ঠোঁট উল্টে মাহরুরের দিকে চেয়ে রইল।কি অদ্ভুত অনুভূতি!নিজের রক্তের বন্ধন নেই। অথচ লাল আভা ছড়ানো মুখটা মাহরুরের অন্তর বিক্ষত করছে।কোনো রকম ঔষধ খাইয়েছে মিষ্টিকে।মুখেই তুলতে চাচ্ছিলো না।অল্প সময়ের ব্যবধানে পানি খাওয়ালো।

মাহরুর প্রশ্ন তোলে মল্লিকার দিকে, “জ্বর এলো কি করে?”

“আমিতো জানি না।”

“আবহাওয়াও ঠিক আছে।এই সময় জ্বর আসার কথা নয়।”

মল্লিকা আমতা আমতা করে বলল, “আজ স্কুল ছুটির পর দুটো আইস্ক্রিম খেয়েছে।জেদ করে।হয়তো সেই জন্যে।”

“খেয়াল রাখবি না!বললেই দিয়ে দিলি?ঠান্ডাও আছে দেখছি।”

“ভুল হয়ে গেছে”

নির্ঘুম রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটেছে।জ্বলজ্বল জ্বলছে দুই জোড়া চোখ।অনেক হাঁসফাঁস করে মিষ্টি ঘুমিয়ে পড়ে।ঘেমে পুরো শরীর ভিজে গেলো মিষ্টির।জ্বর ছেড়ে দিয়েছে।মল্লিকা ভেজা কাপড়ে শরীর মুছিয়ে বসে রইলো তার পাশেই।সকাল আটটায় মাহরুর মিষ্টিকে কোলে করে ডাক্তারের কাছে গেলো। কোনপ্রকার রিস্ক নেওয়া যাবেনা তার সাথে। ডাক্তারের চেকআপ শেষে ঔষধ নিয়ে বাড়ি ফেরে। মল্লিকাকে মিষ্টিকে ঠিকঠাক দেখে রাখার বিশাল ভাষণ দিয়েছে সময় নিয়ে।

___

রমজান শুরু হতে মাত্র দুইদিন বাকি। মাহরুর আর রেদোয়ান জুম্মার নামাজ শেষে বাজারে এসেছে।অনেক কেনাকাটা।কি কি লাগবে সবটাই দুজনে লিস্ট করে এসেছে। দুর থেকে দেখলে দুজনকেই পাক্কা সাংসারিক পুরুষ বলে মনে হবে। তারা সাংসারিকও বটে।বাজার করতে করতে মাহরুর জানতে চায়,

“তোমার ঈদে ছুটি আছে রেদোয়ান?”

“আমাদের আর ছুটি!পুলিশের জীবনে এসব উৎসব আমেজ বলতে কিছু নেই।আছে শুধু ডিউটি।”

“না মল্লিকা বলছিলো গ্রামে ঈদ করবে এবার।ঐযে শওকত এর বোন আছে না?শশী? ওরা বাড়ি কিনেছে।আমাদের সবাইকে দাওয়াত করলো।”

রেদোয়ান বলে, “আমারও ইচ্ছা গ্রামে যাওয়ার অনেকদিন যাই না।”

“এবার চলো নাহয় ম্যানেজ করে।”

“চাঁদ রাতে ডিউটি শেষ আমার।ঈদের চতুর্থ দিন আবার ডিউটি।”

সব বাজার একটা ছেলের হাতে তুলে দিয়ে মাহরুর টাকা পরিশোধ করে। মানিব্যাগ পাঞ্জাবির পকেটে রেখে বললো, “সমস্যা কি?ঈদের নামাজ পড়ে চলে আসবে।সবাই মিলে একসাথে একটা ঈদ করাই যায়।ঈদের দ্বিতীয়দিন নাহয় চলে গেলে।একদিন বিশ্রাম নিয়ে তারপর ডিউটি।”

“আমি আজ গিয়ে শিরীনের সাথে কথা বলবো।”

“আচ্ছা।চলো মোল্লা হোটেলে গিয়ে হালকা নাস্তা করি।”

বাড়িতে শিরীন আছে।তাই কোনো চিন্তা নেই বাড়ি ফেরার তাড়াও নেই।হোটেলে চা নাস্তা অর্ডার করে একবার ফোন করে নিয়েছে মাহরুর।কিছু লাগবে কিনা জানতে।আর চার পাঁচটা সংসারের মতই এখন মাহরুরের সংসারও চলছে।আগের চেয়ে ভালো সৃষ্টিকর্তার অশেষ মেহেরবানীতে।

রেদোয়ান এর ফরহাদ এর কথা মনে পড়তেই বলে উঠলো, “ওই পলাতক অসভ্য ফরহাদকে ধরতে পারলাম না। হুটহাট মনে পড়লেই মেজাজ বিগড়ে যায়।”

মাহরুর হাসে।বলে, “বাদ দাও।এক না একদিন দেশে ফিরবে।তখন ধরবে”

“মাহরুর।শুনো জীবনে এগোতে হবে।আমি তোমাকে আমার ভাইয়ের মতন ভাবি।তাই এই উপদেশ দিচ্ছি। ব্যাংকে টাকা জমাও।একদিন বলেছিলে তোমার স্বপ্ন একটা নিজস্ব ঘরের।যেটা তোমার একান্ত হবে?এখন থেকেই সেই স্বপ্নের জন্য তোমার প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।তোমার ঘরে এখন কোনো কষ্ট নেই।সুখ এসেছে। মল্লিকার পদচারণ সত্যিই অনেক লাকি।”

মাহরুর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে টেবিলে রাখলো।বললো, “একবার আমিও ভেবেছিলাম।পড়ে ভাবলাম অতিরিক্ত লোভ করে ফেলছি নাতো?”

“কিসের লোভ?নিজের একটা ঘর হবে সেটা লোভ না মাহরুর।আজকাল হোম লোন দেয়।দেখো তোমার একটা ছোট্ট নীর হবে।তোমার,মল্লিকার আর মিষ্টির একান্ত।”

পরপর ঠোঁটে দুষ্টু হাসি চেপে রেদোয়ান আবার বলে, “ততদিনে যদি ঘরে আরো একজন অতিথি আসে?তাহলে কিন্তু মন্দ হয়না।”

লাজুক হেসে রেদোয়ানকে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, “ফালতু কথা!”

“ওমা!কিসের ফালতু কথা?আমি চাই তোমার আর মল্লিকার একটা ছেলে হোক।পরিপূর্ণ পরিবার।”

নিজের হাসিকে সামলায় মাহরুর।মিথ্যে রাগ দেখিয়েও পারছে না।বললো, “এখন এইসব নিয়ে ভাবছি না রেদোয়ান।অনেক পথ বাকি।”

“দেরি করে ফেলো না আবার।”

“তুমি কিসব কথা নিয়ে বসলে রেদোয়ান বলোতো!আমি তোমার বউয়ের বড় ভাই হই ভুলে গেছো।”

“বড়ো ভাই বাড়িতে।বউয়ের সামনে। এখন আমরা দুজন দুজনের সমবয়সী।বন্ধু সুলভ।”

মাহরুর ঠোঁটে হাঁসি ঝুলিয়ে মাথা দোলায়।মনে মনে বলতে লাগে, “আমার বউ একটা বাচ্চা জন্ম দিয়ে সারেন্ডার করেছে।এখন ধরা দিতে চায় না।নতুন অতিথি কি আকাশ থেকে পড়বে?”

রেদোয়ান খুক খুক কেশে ধ্যান ভাঙ্গে মাহরুরের।বলে, “কি ভাবছো ভাই?”

“না কিছু না।চলো বাড়ি যাবে না?তোমার বউতো নাহয় রেগে যাবে।”

উভয়ই বাড়ি ফিরেছে।বাজার আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে যারযার বাড়িতে পরিচিত লোক দিয়ে।এবার শিরীনদের ফেরার পালা।তারা চলে যাওয়ার পর মাহরুর মল্লিকাকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।চুলোর পাড়ে বসে তার চন্দ্র। মাহরুরের পুরোনো বইগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।পড়ার চেষ্টা করছে।আশেপাশে কি হচ্ছে তাতে তার কোনো মনোযোগ নেই। ভাত বসিয়েছে চুলোয় হয়তো সেটাও ভুলে গেছে বইয়ের মধ্যে হারিয়ে।ভাতের ফেনা উত্রে পড়তে নিলে দৌড় লাগায় মাহরুর। চুলোর আচ কমিয়ে দেয়।এবার হুশ ফিরে মল্লিকার।

বলে, “খেয়াল ছিল না।”

“কি এমন পড়ছিলি বইয়ে?”

“না এমনেই দেখছিলাম।এত ভারী বই?এত কঠিন শব্দ কি করে পড়তেন আপনি?”

“এমনেই পড়তাম।”

“আমার দাত ভেঙে যাচ্ছে।”

মাহরুর কিছুক্ষন বিনা শব্দে দাড়িয়ে রইলো।কিছু একটা ভাবছে মনেমনে।মুখে ভাব দর্শন।ভাবনা শেষে মল্লিকার পাশে বসে সরাসরি বললো,

“চন্দ্র তুই পড়তে চাস? কলেজে ভর্তি হবি?”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-২৩+২৪

0

চন্দ্র’মল্লিকা ২৩
লেখা : Azyah_সূচনা

আঁধার রজনীতে গলির মোড়ে বেধড়ক পেটানো হচ্ছে এক পুরুষকে।চিৎকার যেনো না করতে পারে সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছে।মুখ বেধে।এই নিয়ে দ্বিতীয়বার।যে পুরুষকে কেউ কোনোদিন ফুলের টোকা অব্দি দেয়নি সে পরপর দুবার হামলার শিকার হয়।ধস্তাধস্তিতে হাতে থাকা সবজিগুলো জমিনে গড়িয়ে পড়েছে।পায়ের চাপায় পৃষ্ট। ব্যথায় জর্জরিত পুরুষের নাক বেয়ে রক্ত ঝরলেই চুল টেনে ধরা হয়।

“আমার মাকে জেলে ভরার শাস্তি এটা।আগামীবার তুই আর তোর রক্ষিতা আমাদের বাড়ির দিকে তাকানোর আগে একশোবার ভাববি।”

মল্লিকার নামে বাজে কথা শুনে দুর্বল আঘাতপ্রাপ্ত হাত নিজে চড় বসায় ফরহাদের গালে।মুখের বাধন খুলে ফেলে একটানে।বলে,

“জানোয়ার এর বাচ্চা বউ আমার!মুখ সামলে কথা বলবি”

আরো চটে গেলো ফরহাদ।কয়েক কিল ঘুষিতে নিজের অপমানবোধটাকে মিটিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরে চলে গেলো।সামনেই কেউ আসছে টর্চ লাইট নিয়ে।দ্রুত পালায় ফরহাদ আর বাকিরা।ঢাকা শহরে এই গলিতে এতবড় ঘটনা ঘটলো তবে কেউ টেরই পেলো না?রহিম চাচাকে আসতে দেখে উঠে দাড়ায় মাহরুর।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।শরীর পুরো জ্বালাপোড়া করছে।রহিম মিয়া লাইট মাহরুরের মুখের দিকে ধরতেই আতকে উঠেন। দ্রুত গতিতে নিজের দুর্বল বাহু এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করেন মাহরুরকে।

“ইয়া আল্লাহ!তোমারে এমনে মারলো কে মাহরুর।”

মাহরুরের চোখ জমিনে পড়ে থাকা বাজারের দিকে।ব্যথাটা গায়ে লাগছে না।কিন্তু সেগুলো দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।রহিম মিয়া বললেন,

“ওদিকে তাকায় কি দেখো?”

“বাজারগুলো চাচা।”

“তোমার এই অবস্থা তুমি বাজারের চিন্তা করো?মাথা খারাপ!”

“টাকা দিয়ে কিনেছি চাচা।”

“তুমি বাদ দাওতো।চলো বাড়ি চলো!”

রহিম মিয়া আর তাদের বাড়িতে কাজ করে সেই ছেলেটা মাহরুরকে বাড়ি এনেছে।যতক্ষণ যাবৎ মাহরুরের ব্যথাকাতর মুখ দেখছে ততক্ষন যাবৎ অস্রু জড়াচ্ছে মল্লিকা।মায়ের কান্না দেখে মিষ্টিও কান্নায় জর্জরিত। হাতে পায়ে মুখে ব্যান্ডেজ করতে লাগলো মল্লিকা।কান্না তার কিছুতেই থামছে না।

রহিম মিয়ার স্ত্রী এগিয়ে এসে বললেন,

“এই বউ তোমার মাইয়া ডরাইতাছে।ওরে দাও আমার ধারে”

মিষ্টি বলে উঠে, “আমি যাবো না।”

“আয় বেটি।দাদী লাগি তোর।মজা খাওয়ামু।আয়”

মল্লিকা নাক টানতে টানতে মিষ্টির উদ্দেশ্যে বললো, “যা দাদীর সাথে।”

মিষ্টি অনিচ্ছা সত্বেও চলে গেলো জোবেদা খাতুন এর সাথে।রহিম মিয়াও সরে গেলেন সেখান থেকে।সবার চলে যাওয়া নিশ্চিত করে মাহরুর বলে,

“এই”

উত্তর দিলো না মল্লিকা। ঠোঁট কাপছে।কি বাজেভাবে মেরেছে লোকটাকে।জায়গায় জায়গায় আঁচড়ের দাগ। মাহরুর দুহাত দিয়ে মল্লিকার গাল মুছে দিলো।বললো,

“কাঁদিস না চন্দ্র।আমি ঠিক আছি।”

“কি ঠিক আছেন দেখতেই পাচ্ছি।চোখের সামনেই আছেন।”

রাগ মিশ্রিত গলায় বলেছে মল্লিকা।বিয়ের পর প্রথম যত্নে মোড়ানো রাগ দেখে ভীষণ আনন্দও হলো বটে।লজ্জা নারীর ভূষণ।পাশাপাশি রাগ স্ত্রীর অধিকার।

মাহরুর হেসে উত্তর দেয়, “তোর আমার প্রেমটা আগের দিনের সিনেমার মতন।একবার তুই আমার জন্য চাচীর হাতে মার খেয়েছিস।তোর জন্য আমি ওই রাব্বী মিয়ার লোকের কাছে মার খেয়েছি।এখন আবার মার খেলাম তোর প্রাক্তন দেবরের কাছে। মারামারিময় প্রেম।”

মাহরুরের শেষ বাক্যে হেসে ফেলে মল্লিকা। পরক্ষনেই আবার বিষাদের ছায়া নেমে এলো মুখে। সত্যিই তার জন্য মার খেয়েছে।

চোয়াল শক্ত করে মল্লিকা বললো, “আপনি দুলাভাইকে কল করেন।বলেন সবকিছু।বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে এবার।আগে মায়া হতো এখন একদম মায়া হচ্ছে না।”

“আমার জন্য মায়া হচ্ছে?”

ঠোঁট উল্টে রইলো মল্লিকা। মাহরুর তার বাহুতে হালকা চাপড় মেরে আবার জানতে চেয়ে বললো, “বল ”

“আপনি জানেন না বুঝি?”

“না জানি না।”

“হচ্ছে মাহরুর ভাই”

কি হৃদয় শীতল করা ডাক! এতবছর পর ডাকটা শুনে মন বাগবাগ হয়ে উঠছে।তবে ঠিক এই অনুভূতির ভিন্ন কাজ করে বসে মাহরুর। গালেও ছোট্ট করে চড় দিয়ে বসলো।

মল্লিকা গালে হাত রেখে বলে, “মারলেন কেনো?….আজতো পুরো নামে ডেকেছি।”

“আবার বল”

“মাহরুর ভাই”

এবার চড় পড়ে ঠিক বিপরীতগালে।চোখ বড়বড় করে তাকালো মল্লিকা। আঘাতপ্রাপ্ত মাহরুরের সামনে যেনো বাঘিনী হয়ে উঠেছে।
মাহরুর বলে, “চোখ নামা।”

চোখ নামায় মল্লিকা।তার ইচ্ছে পূরণ করলেও দোষ!কি করবে সে তাহলে? মাহরুর বললো,

“ভাই ডাক বাদ দিবি।নাহয় মাথা ফাটিয়ে ফেলবো।আদর করে মাহরুর ডাকবি।সেই ডাকে যেনো মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয় আমার।”

আজ চাঁদ কোথায়?আকাশে দেখা মিলছে না।হয়তো নিজের স্থান পরিবর্তন করেছে।নাহয় মাহরুরের চিলেকোঠায় এই দৃশ্য দুষ্কর।চন্দ্রমল্লিকা নিজ হাতে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে মাহরুরকে। রেদোয়ানকে কল করেছে।কল করে বলেছে ফরহাদ এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।মল্লিকার এ রূপ বারবার থমকে দিচ্ছে মাহরুরকে। শিরীনও রাতেই এসে হাজির। সংবাদ পৌঁছেছে তার কাছেও ঝড়ের গতিতে।

বারবার বলছে রেদোয়ানকে, “আমার ভাইয়ের গায়ে হাত দিয়েছে।ওকে একদম ছাড় দিবে না।কি অবস্থা করে ফেলেছে আমার ভাইয়ের।”

বোনের দিকে চেয়ে মাহরুর ভাবলো। পৃথিবী মানুষে পরিপূর্ণ।কেউ শত্রু,কেউ মিত্র।কেউ আপন কেউ পর। আপনের মধ্যেও ভেদাভেদ দেখা যায়। ব্যক্তিগত ভেদাভেদ।কেউ জীবনকে একদম নিঃস্ব করে দেয় কেউ পূনরায় গড়ে দেয়। মাহরুরের জীবন ধ্বংসকারীও আছে।আবার হাত এগিয়ে জমিনে পড়ে থাকা মাহরুরকে তোলার মানুষও আছে।দিনশেষে সস্তি। শত্রুর ভয়ে গা ঢাকা না দিয়েই কাছের মানুষের সাথে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করার সস্তি।

__

আজ রমজান চাচা আর ফরিদা চাচী আসবে।এই সংবাদটা মাহরুর দিয়েছে মল্লিকাকে।খুশিতে আত্মহারা সে। সংসারের একমাস পর বাবা মায়ের দেখা পাবে।এই ভেবেই দিশে হারা দে।শওকত ঢাকা আসছে কাজে।তাদের সাথেই তারা দুজনও আসবে।খুশির সংবাদেও খুশি হতে পারছে না মাহরুর।কি জবাব দেবে তাদের?মেয়ে আর নাতনিকে এই ছোট্ট চিলেকোঠায় রাখে?তাদের থাকার ব্যবস্থা করবে কোথায়? মাথাটা ঘুরে উঠলো।মল্লিকার মুখের হাসি দেখে আর কিছু বললো না মাহরুর।নিজের চিন্তা নিজের মাথায়ই রেখেছে।মিষ্টিকে স্কুলে দিয়ে আসে।আসার পথে মল্লিকা আনে। ফরহাদ পুলিশের ভয়ে পরদিন রাতেই দুবাই পালিয়েছে।মা আর বউকে ফেলে।নিজের জানের ভয়ে এবার মা বউয়ের ভয়টাও করেনি। খুব এসেছিল মায়ের হয়ে মাহরুরের গায়ে হাত তুলতে।

“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।আমাকে যেই হালেই রেখেছেন আপনি আমার বিগত জীবনের চেয়ে হাজারগুণ ভালো।এটা আব্বা আম্মাও বুঝবে।”

পরনের শার্টটা অর্ধ খুলে হাত থেমে যায় মাহরুরের।দেয়ালের দিকে মুখ করেই এদিক ওদিক চায়।তার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলেছে মল্লিকা।পূনরায় শার্ট গায়ে দিয়ে ফিরে তাকালো।

বললো, “তুই কি করে বুঝলি আমি চিন্তা করছি?”

“আপনার কপালের ভাজ রেখে।চিন্তার রেখা।”

মৃদু শব্দ করে হাসে মাহরুর।অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললো, “চন্দ্র? তোর মাথায় এত বুদ্ধি উদয় হলো কি করে?আমার মুখ দেখে বুঝে ফেললি?তোকে আমি বোকা ভাবতাম চন্দ্র।”

মল্লিকা জানে তাকে হেয়ালি করে বলছে মাহরুর এসব।তার কি মাথায় একদমই বুদ্ধি নেই নাকি?শুধু মাহরুরের সামনে বোকা বনে যায় বলে সে বুদ্ধিহীন?যথেষ্ট বুঝশক্তি আছে তার।মনে মনে এসব ভেঙে আহত দৃষ্টিতে তাকায় মল্লিকা।

“আজকাল চোখ বড়বড় করে চেয়ে থাকিস?কি সমস্যা কি?আমি দেখতে বেশি সুন্দর হয়ে গেছি?নাকি আগের প্রেম জাগছে মনে আবার?”

” তেমন কিছুই না”

“তাহলে বলতে চাচ্ছিস আমি সুদর্শন নই?”

হতবুদ্ধি হয়ে মল্লিকা বলে, “আমিতো সেটা বলিনি।”

ঝড় নিঃশ্বাস ফেলে মল্লিকা।কোনো কথা না বলে স্থান ত্যাগ করলো।কাজ করছে আর ঘণ্টা গুনছে।কখন আসবে তারা?এতবছর নিষ্ঠুর হয়ে বাবা মার কাছে যায়নি।যেই ছোঁয়া লাগলো মাহরুরের নিষ্ঠুরতা নিঃশেষ।এখন বাবা মার দিকেও মন টানে।

দরজা দিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে এসে শিরীন বললো, “আমার চাচা চাচী আমার বাড়িতে থাকবে।যদি কেউ আটকায় আমি দেখে নিবো বলে দিলাম।আম্মা মারা যাওয়ার পর তাদের এত বছর পর দেখবো।এই অধিকার যেনো ছিন্ন না করা হয়।”

ঘরে ঢুকতে দেরি!নিঃশ্বাসটা অব্দি ছাড়েনি ভালো মতন।এসেছে জানান দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।তার আগেই হুকুম চালিয়ে দিল শিরীন।সে আসবে কেউ জানত না।দেখে অনেকটা অবাক হয়।

মাহরুর শিরীনের চুলে হালকা টান দিয়ে বললো, “আসবি জানিয়ে আসবি না?”

“কেনো?আমার ভাইয়ের বাড়িতে যখন ইচ্ছে তখন আসবো।”

“তোর নিজের ঘর সংসার নাই?”

“একা সংসার।স্বামী এই থাকে এই থাকেনা।তাই ডিঙি মারতে এসে পড়ি তোমার ঘরে।কেনো আমাকে ভালো লাগছে না বউ পেয়ে?”

“শুধু আজাইরা কথা। বোস ”

তাদের খুনসুটির মধ্যে ফোন বাজে মাহরুরের।অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে। মাহরুর রিসিভ করে সালাম জানায়।বেশ কিছুক্ষন মুখের ভাবভঙ্গি বদলে বদলে কথা বললো।শেষ অংশে এসে মুখে হাসি ফুটে।হাসিমাখা মুখ দিয়ে মল্লিকা আর শিরীনের দিকে চায়।তারাও আগ্রহী জানতে কি তার খুশির কারণ?বিনয়ের সাথে কথা বলে ফোন রাখলো।

শিরীন আর মল্লিকার দিকে চেয়ে বলল, “মনে আছে সিভি জমা দিয়েছিলাম?ওর মধ্যে একটা কোম্পানি ডেকেছে আমায়। পরশুদিন আমার ইন্টারভিউ”

মাহরুরের একক খুশি ছড়িয়ে পড়ে শিরীন আর মল্লিকার মাঝেও।শিরীন বললো, “আলহামদুলিল্লাহ।”

মাহরুর বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়।বলে, “শুধু দুআ কর”

অন্যদিকে মল্লিকা বলে উঠে, “হয়ে যাবে চাকরিটা।আপনি চিন্তা করবেন না”

মাহরুর মনে মনে বিড়বিড় করে, “আমার চন্দ্রমল্লিকা যেহেতু বলেছে আমার চাকরিটা হবেই।”

রমজান সাহেব,ফরিদা বেগম আর শওকত এসে হাজির।মেয়ের আগে ভাতিজিকে জড়িয়ে ধরলো।অনেকটা বছর।অনেক বছর এই মেয়ের দেখা মেলে না।হিংসে হলো মল্লিকার।

আজ গলা বাড়িয়ে বললো, “আমিও এখানে আছি কিন্তু”

হাসির রোল পড়ে গেলো ঘরে।এত বড় মেয়ে হিংসেতে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।মল্লিকার ভাগের আদর তাকে দিয়ে সবাই বসেছে।কেউ বিছানায় কেউ মাটিতে। শওকতকেও না খাইয়ে ছাড়বে না।মল্লিকা নিজ হাতে বাবা মায়ের জন্য মাছের ঝোল করেছে সাথে নানান রকমের ভর্তা।

চিলেকোঠার ছাদে দাঁড়িয়ে মাহরুর আর শওকত।শওকত বললো,

“কেমন আছো এখন মাহি? সুখীতো?”

“ভীষণ সুখে আছি।”

“আমার মাতো আসতে চাইছে বারবার।সাথে শশীও।”

“তো আনবে সমস্যা কোথায়?”

“আনবো সময় করে একদিন।তোমরা গ্রামে যাবে না আর?”

“যাবো।কিন্তু চাচা চাচীকে একা রাখতে চাচ্ছি না। এখানেই রাখার ব্যবস্থা করবো।”

“তোমার যা ভালো মনে হয় করো।এমনেতেই চাচা চাচীর বয়স হচ্ছে।”

“সেটাই।”

নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শেষে দুজনেই ঘরে এগোয়।রমজান সাহেব পুরো ঘরটাকে এদিক ওদিক চেয়ে দেখছেন।যা মাহরুরের দৃষ্টি গোচর হয়েছে।হয়তো তার ঘর পছন্দ হয়নি।কোনো বাবাই মেয়েকে এই অবস্থায় দেখতে চায়না।সবার সামনেই মাহরুর রমজান মিয়ার উদ্দেশে আলগোছে বলে উঠে,

“নতুন চাকরি পেলেই এই ঘরটা ছেড়ে দিবো চাচা।”

হঠাৎ মাহরুরের এহেন কথায় অবাক হলেন রমজান সাহেব।জানতে চাইলেন, “হটাৎ এমন কথা বলছিস কেনো বাজান?”

মাহরুর অপরাধীর মতন মাথা নুয়ে ফেলে।বলে, “ঘরটা ছোট আমি জানি।”

“তো কি হয়েছে?ছোট ঘরে শান্তি থাকলেই চলে।অন্তত বড় ঘরে অত্যাচারিত হওয়ার চেয়েতো লাখ গুন ভালো”

ফরিদা বেগম বললেন, “ওই জাহিলগুলা তোরে কি বাজেভাবে মারলো!কল্পনাও করতে পারছি না এমন এক সংসারে মেয়ে দিছিলাম।”

“বাদ দেন চাচী।ওর শাস্তিও ও পাবে!শুধু সময়ের অপেক্ষা।” মাহরুর বলে।

__

আজ হঠাৎ মাহরুরকে দারুন রকমের ভয় পেতে দেখা গেলো।দেখে মনে হচ্ছে কোনো বাচ্চা স্কুলে প্রথমবার পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে।ভয়ে হাতপা আসাঢ় হয়ে আসছে তার।মল্লিকা শান্তনা দেওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। চাকরিটা সে চায়। ভীষন রকমভাবে চায়।ভালো পোস্টের চাকরি।বেতনও ভালো।দু চোখের মধ্যবর্তী স্থানে আঙ্গুল চেপে বসে রইলো থম মেরে কিছুক্ষন।তাকে আর কে সামলাবে?মল্লিকা ছাড়া তার কোনো আশ্রয় আছে?

মল্লিকা পাশে এসে বললো, “সব ঠিক হবে”

মাহরুর আকষ্মিক মল্লিকার হাতদুটো ধরে বললো, “সত্যিই হবেতো চন্দ্র?আমার কিছুই নেই তোরা ছাড়া।তোদের ভালো রাখার জন্য আমার যত পরিশ্রম।”

“আপনি চাকরি না পেলেও আমরা ভালোই থাকবো।”

“এভাবে বলিস না।আমার দরকার চাকরিটা।তোর, মিষ্টির,চাচা চাচীর সব দায়িত্ব পালনের জন্য আমার দরকার।”

কাপা কাপা হাতটা মাহরুরের গালে ছোঁয়ায়। তৎক্ষনাৎ সরিয়েও নিলো।কি না কি ভাবে সে? মাহরুর আবার হাত টেনে নিজের গালে রাখলো।বললো,

“হাত সরাস কেনো? বল কি বলবি?”

“চিন্তাটা বাদ দিন।যা হবে ভালো হবে।”

মল্লিকার গাল টেনে দিয়ে গেলো।ভালোবাসার দু চারটে বাক্য আওড়িয়ে গেছে।বারবার বলে যাচ্ছে দুআ করতে। মল্লিকাও অজু করে জায়নামাজ বিছিয়ে বসে পড়ে।তাকে দেখে উৎসাহিত মিষ্টিও।জানতে চাইলে মল্লিকা তাকে জানায় তার বাবা পরীক্ষা দিতে গিয়েছে।তারা যেনো দুআ করে। মিষ্টিও মায়ের ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে ছোট্ট হাতে দুআ করতে শুরু করলো।মল্লিকার মন শান্ত হয়।অন্তত এই বাচ্চা হাতের প্রার্থনা কবুল হবে।

অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।মল্লিকা কখনো ছাদে কখনো দরজার কাছে।একটু পরই আযান হবে মাগরিবের।এখনও আসছে না কেনো মাহরুর।মিষ্টিকে টিভি অন করে বসিয়ে দিয়েছে।নাহয় প্রশ্ন করে করে টেনশন আরো বাড়িয়ে তুলবে।শেষ মুহূর্তে চাঁদের উপর দাড়িয়ে মাহরুরকে আসতে দেখে মৃদু ছটফট করে উঠে। দৌড়ে যায় দরজায়।খুলে দেয় লোহার তৈরি গেটটা। মাহরুর এসেছে বিদ্ধস্ত মুখে।মল্লিকা মুখ পড়ার চেষ্টা করলো। চাকরিটা কি হয়েছে?জানতে চাইবে?যদি না হয়? নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে মাহরুর।

মাহরুর এসেই জমিনে ব্যাগটা ফেলে দিলো। কোমড় জড়িয়ে মল্লিকাকে শূন্যে তুলেছে।নিজেকে পা দুটো হাওয়ায় ভাসতে দেখে মল্লিকা দ্রুত হাত ঠেকায় মাহরুরের কাধে।পড়ে গেলে মাজা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো। মাহরুর মুখ তুলে চেয়ে আছে মল্লিকার দিকে মোহনীয় দৃষ্টিতে।

মল্লিকা কিছু বলতে যাবে তখনই তাকে নামিয়ে দেয়।বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে বললো, “ভালোবাসি”

মাহরুরের মতিগতি বুঝে উঠতে পারছে না।এই মুহূর্তে বলছে ভালোবাসে?এই কথাকে পাশে রেখে মল্লিকা আমতা আমতা করে জানতে চাইলো, “চাকরিটা কি…”

মল্লিকার চুলে মুখ ডুবিয়ে ভারী কণ্ঠে বললো, “হয়েছে!বেতন জানিস কত? পঞ্চাশ হাজার।খুব ভালো পদ।তোর দুআ বৃথা যায়নি চন্দ্র।ধন্যবাদ তোকে”

মল্লিকা ভীষণ খুশি।গাল বেয়ে অস্রু ঝরলো।এতখন ভেতরে চেপে রাখা চিন্তারা হুড়মুড়িয়ে পালিয়েছে। আকষ্মিক মাহরুরের চুল খামচে ধরলো সেও।

বললো, “তোমার মেয়ের দুআ মাহরুর ভাই।তাকে ধন্যবাদ দিও”

চাকরি পাওয়ার প্রশান্তির চেয়ে মল্লিকার মুখে তার পূর্বের ডাক ফিরে পাওয়ার আনন্দ বেশি মনে হলো।জয়ী মনে হচ্ছে নিজেকে।একে অপরের উষ্ণতা ছেড়ে মিষ্টির কাছে ছুটে গেছে মাহরুর। দ্রুত গিয়ে কোলে বসিয়ে নেয়।

আদুরে কণ্ঠে বলে, “আমার আম্মা আমার জন্য দুআ করেছে?”

“হ্যা।তোমার পরীক্ষা পাস হয়েছে?”

“আল্লাহ তোমার দুআ ফিরিয়ে দিতে পারে?পাস হয়েছে মানে?একদম ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি।”

“ইয়ে!”

“তোর জন্য কি এনেছি জানিস?”

“কি?”

মাহরুর মল্লিকাকে বললো দরজার কাছ থেকে তার ব্যাগটা নিয়ে আসতে।আনন্দে ব্যাগটা সেখানেই ফেলে এসেছে। মল্লিকাও দ্রুত গিয়ে নিয়ে আসলো।একটা গোলাপী রঙের ছোট্ট পুতুল বের করে মিষ্টির হাতে দিয়ে বলল,

“এটা তোর।আর সামনের মাসে তোকে নিয়ে মার্কেটে যাবো।তুই যেটা কিনতে চাইবি সব তোর।”

“মাহি বাবা আমি একটা বড় পুতুল কিনবো,একটা পেন্সিল বক্স কার্টুন ওয়ালা আর একটা পরী ড্রেস সাদা রঙের।আরো অনেক কিছু কিনবো।”

“তোর যা ইচ্ছা সব কিনিস মা”

বাবা মেয়েকে ফেলে মল্লিকা শিরীনকে কল করে।জানান দেয় তার ভাইয়ের চাকরির কথা।সে একবিন্দু সেখানে থাকতে রাজি নয়।মল্লিকার বাবা মাকে নিয়ে এখনই ছুটে আসছে বললো।রমজান সাহেব আসার পথে মিষ্টি এনেছেন।সবাইকে মিষ্টি মুখ করিয়ে শিরীন বুদ্ধি দিল আজ তারা সবাই এখানে থাকবে।চিলেকোঠার ছাদে বিছানা পেতে ঘুমাবে। রেদোয়ানও আসছে।পুরোনো দিনে কারেন্ট চলে গেলে যেমন উঠোনে আসর বসতো আজ আসর বসবে ছাদে।সব আয়োজন একাই করে নিলো শিরীন। রেদোয়ানকেও বাকি কাজ বুঝিয়ে সবাই একে একে এসে বসলো খোলা আকাশের নিচে।যেথায় জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্ররা।একটা বিশাল চাঁদ।আর ঘর ভরা আনন্দ।কোমড় ধরে দাড়িয়ে সবাইকে হাসিখুশিতে মেতে থাকতে দেখে ভাবলো।

“একেই হয়তো বলে সুখী-সুন্দর পরিবার।”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা ২৪
লেখা : Azyah_সূচনা

সকাল বেলায় তিন নারী নাস্তার ব্যবস্থা করছে।খুদের ভাত করবে আজ। বুদ্ধিটা শিরীনের।বাচ্চাদের বাবারা হাতের বাবার কাছে হাত মুখ ধুয়ে নিয়েছে।শওকত আজ গ্রামে ফিরে যাবে।সাথে রমজান সাহেব আর ফরিদা বেগমও। মাহরুরও মেনে নেয়। চাকরিটা একটু সামলে নেক তারপর নিয়ে আসবে তাদের।নতুন ঘর দেখবে।এখন এত বিলাসিতা করা ঠিক হবে না।খুদের ভাত আর ভর্তা তৈরি করেই খোলা আকাশে রোদের উষ্ণতায় সকলে বসেছে। পাটি পিছিয়ে।জমিনে পা মুড়িয়ে বসেই উপভোগ করবে গরম গরম সকালের ভোজন।

ফরিদা বেগম এগিয়ে আসলেন বিদায় বেলায়।মেয়ের হাতে তিন চারটে শাড়ি দিয়ে বললেন, “আমি জানি তুই মন দিয়ে সংসার করবি।কিন্তু এই সংসারটা একটু অন্য রকম হবে।তারপরও মাহি এমন সময় এসে তোর হাত ধরেছে যখন তুই সর্বহারা ছিলি।ওর কথা মানবি।আদেশ পালন করবি।”

রমজান মিয়াও আরো কয়েক বাক্য বাড়িয়ে বললেন, “মাহি কিন্তু আমার ভাতিজা না আমার ছেলের মতন। ও একটা দায়িত্বশীল ছেলে।আমি চাই তোরা তিনজন ভালো থাক সুখে থাক।ভালো থাকিস মা।নিজের,মাহির আর মিষ্টির যত্ন নিস।আসি।”

কেদে কেটে বিদায় দিলো মল্লিকা বাবা মাকে। অদ্ভূত মিষ্টি আর তার বন্ধনও।মাকে কাদতে দেখলে সে নিজেও কাঁদে।জানতে চায় না কান্নার কারণ।বুঝে না।শুধু এতটুক জানে কান্না মানুষ এর কষ্ট থেকে আসে।নানা,নানি চলে যাচ্ছে তাই বুঝি মা কাদঁছে।সেও বুক ভাসায় কেঁদে।

রমজান সাহেব আর ফরিদা বেগমকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ফিরে এসেছে মাহরুর।মিষ্টিকে তৈরি করে স্কুলের পথে ছুটলো।মেয়েটা সাহসী হয়েছে আজকাল।স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারাও বেশ যত্নবান।প্রত্যেকটা বাচ্চাকে দেখে শুনে রাখে।সকাল দশটায় দিয়ে আসে গিয়ে।আজ বের হতে দেরি হয়ে গেছে।ফিরে এসেই দেখলো ভিন্ন চিত্র।মল্লিকা শাড়ি পড়েছে। গামছায় মোড়ানো চুলগুলো।সদ্য গোসল করে বের হয়ে কাপড় মেলছে দড়িতে।উল্টো ঘুরে থাকায় পিঠের কিছু অংশ দৃশ্যমান।এরূপ দৃশ্যে কোনো প্রেমিক পুরুষ নিজেকে ঠিক রাখতে পারে?একহাতে দড়িতে ঝোলানো কাপড় সরিয়ে এগিয়ে গেলো।প্রেমটা আবার মাথায় চড়ছে।এই মেয়ে তাকে এক মুহুর্ত সস্তি দিবে না। ঘায়েল করবে নানানভাবে।এই অহেতুক সকাল সকাল ঘায়েল করার শাস্তি দিতেই এগিয়ে গেলো মাহরুর।

পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলে হুট করে হেঁচকি তুলে মল্লিকা। ভয় পাইয়ে দিয়েছে তাকে। মাহরুর বললো, “হঠাৎ নতুন রূপে সামনে এলি কেন?আমাকে মেরে ফেলার ধান্দায় আছিস?”

মল্লিকা আশপাশের বিল্ডিংগুলোতে তাকাচ্ছে।কেউ যদি তাদের দিনের আলোয় এভাবে দেখে ফেলে?ভীষণ লজ্জার বিষয়। মাহরুরের বাধন থেকে ছাড়া পাওয়ার প্রয়াস করতে করতে বলল, “আপনিইতো বলেছেন শাড়ি পড়তে”

“উম! হ্যা।ভুলে গিয়েছিলাম।”

“এখন ছাড়েন কেউ দেখে ফেলবে”

“তো?দেখুক!”

“আপনি বুঝতে পারছেন না।”

“আমি সব বুঝতে পারছি চন্দ্র।তোর সান্নিধ্য ছাড়া আমার টিকে থাকা মুশকিল।আমাকে এত টানিস কেনো নিজের দিকে?কি আছে তোর মধ্যে বল আমায় আজ!”

মল্লিকা মিনমিনে গলায় বললো, “আমি কি করলাম?আপনি…”

“শোন!আগামী ছয়দিনের জন্য তোর কাছে আছি।সারাদিন,সারারাত!কিভাবে খাতিদারি করবি করে নে।এরপর নতুন চাকরিতে যাওয়া লাগবে।প্রতিদিন কত ঘণ্টার দূরত্ব মেনে নিতে হবে জানিস?নিজের জড়তা কাটিয়ে এখনই ভালোবেসে পুষিয়ে দে”

হাত টেনে ধরে এনেছে।ঘরে অতশত কাজ ফেলে রেখে মাহরুরের শখ চড়েছে চন্দ্রবিলাসের। মল্লিকাকে মূর্তির মতন বসিয়ে রেখে কোলে মাথা পাতে আবারো।আদেশ ছুঁড়ে কঠোরভাবে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে হবে।যতক্ষণ মাহরুরের ইচ্ছা ততক্ষন।মল্লিকা বাধ্য,বাঁধা তার হাতে। অতিরিক্ত ভালোবাসা সামলে উঠতে পারছে না। পারবেই বা কি করে?কখনো ছিলো ভাগ্যে এমন ভালোবাসা? সবইতো নতুন তার জন্য।

“আমাকে এত ভালোবাসলেন কিভাবে?”

“এভাবেই ”

“প্রথমবারে ভালোবাসলে কি হতো?আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে কষ্ট দিয়েছেন একবার।অন্যকারো সাথে ঘর বেঁধেছেন।এখন আবার এমন আচরণ করছেন?”

“তুই বাধিস নি?সম্পূর্ণ সত্যটা না জেনেই ঢেং ঢেং করে অন্যকে বিয়ে করে নিলি।এখন সহ্য কর আমার অত্যাচার।”

“অত্যাচার করবেন আমাকে?”

“যুগে যুগে পুরুষেরা নারীদের উপর অত্যাচার চালিয়ে এসেছে।আমি কেনো পিছিয়ে থাকবো।আমিও করবো অত্যাচার।”

“আগে যা করেছেন সেগুলো কি যথেষ্ট নয়?”

“পুষিয়ে দিতে চাচ্ছি”

“মানে?”

“ভালোবেসে,আদর করে।এগুলো তোর কাছে কোনো অত্যাচারের থেকে কম মনে হবে না”

ভালোবাসা আর অত্যাচার দুটো একসাথে?থাক!আর কথা বাড়াবে না মল্লিকা। মাহরুর লাগামহীন।সেটা হারেহারে টের পাচ্ছে মল্লিকা।হুটহাট কাছে এসে তার মস্তিষ্ক অচল করতে সক্ষম। সেওতো প্রেমে পড়েছিল মাহরুরের।প্রেমিক হিসেবে চন্দ্রের মাহরুর ভাই কি রকম সেটা ভাবতেও পারেনি।আজ যখন চোখের কাছে বিশ্বাস হচ্ছে না।মিলিয়ে নিচ্ছে পুরোনো মাহরুরের সাথে।

আধ ঘণ্টায় মাহরুর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো।এই সুযোগ!পালাবার। আস্তে ধীরে হাতটা মাহরুরের মাথার নিচে রেখে নামিয়ে নিলো। সাবধানতার সাথে বালিশ রেখেছে মাথার নিচে।উঠে যাওয়ার চিন্তাটা এক মিলি সেকেন্ডে ভেস্তে যায়।ঘুমের অভিনয় করে থাকা মাহরুরের জ্বলজ্বল করা চোখ দেখে শুকনো ঢোক গিলে মল্লিকা।

“পালাস কেনো তুই? বেঁধে ফেলেছি একেবারের জন্য ভুলে গেছিস?”

হেঁচকা টানে নিজের কাছাকাছি এনে হাজির করলো।মল্লিকার মাথা বালিশে ঠেকিয়ে ঘাড়ে মুখ গুজে শুয়ে পড়লো মাহরুরও। আত্মা উড়ে গেছে মল্লিকার।এত ভারী একটা মানুষ দেহের সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে আছে তার উপর। হৃদয় মনে হয় এই ভারেই বিস্ফোরিত হবে। হাড়গোড় সব ভেঙে চুরমার।মাথা কাজ কথা বন্ধ করে দিল।

মাহরুর মুখ তুলে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলতে লাগলো, “খাওয়া দাওয়া করিস না ঠিকমতো?এই অবস্থা কেনো তোর?হাড্ডি আর হাড্ডি!”

মল্লিকা ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে ফিরে রইলো।একদম কথা বলবে না আধ পাগল উন্মাদ লোকের সাথে। হুটহাট উদ্ভট কান্ড ঘটায়।পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে মাহরুর আবারো একই ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ে
বলে,

“হোক হাড্ডি আমার কি।আমার আত্মিক প্রশান্তি দরকার।সেটা এখানে পাচ্ছি।নড়চড় করলে শাস্তি দ্বিগুণ করবো চন্দ্র।এমনেতেই বিনা অনুমতিতে পালানোর চেষ্টা করেছিস।আমাকে রাগাস না বলে দিলাম।নাহয় এমনকিছু করবো যেটা সহ্য করতে পারবি না।”

উপায় বাকী রাখে? মুখের শব্দ, বাক্যতো কেড়ে নেয়ই।এখন নড়চড় এর উপরও কারফিউ জারি করেছে।এখন বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ারও কায়দা নেই। নির্ঘাত চ্যাপটা হয়ে যাবে।

___

চোখের পলকে ছয়দিন কেটে গেছে।মাসের শুরু।এক তারিখ।আজ থেকে মাহরুরের নতুন চাকরিতে যোগদান।নতুন জায়গার পরিবেশের সাথে মানানসই কাপড়ও কিনে এনেছে।যেদিন ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল সেদিনই চোখে পড়ে তাদের তাদের রহন-সহন অনেকেই উচু মাপের মানুষ। পরিচ্ছন্ন সুন্দর অফিস। চব্বিশ ঘন্টা এসি চলে।রেগে ছিলো মাহরুর।মল্লিকা এই ছয়দিন তার কোনো খাতিরদারি করেনি।কাছে আসতে নিলেই দূরে পালায়। হাল ছেড়ে দেয় মাহরুরও।নতুন শার্ট, প্যান্ট,ঘড়ি এগিয়ে দিয়ে দাড়িয়ে রইলো। মাহরুরের এক চোখ কাপড়ে অন্য চোখ মল্লিকার উপর।

চুল মুছে আয়নার সামনে দাড়িয়েই বলল, “এখন কি তোর সামনেই কাপড় বদলাবো আমি?”

মল্লিকা চট করে উত্তর দেয়, “না সেটা হবে কেনো?”

“তো সং সেজে দাড়িয়ে আছিস কেনো সামনে।বাহিরে যা।ইচ্ছে থাকলে থাকতেও পারিস।না করবো না।”

“পাগল!বদ্ধ পাগল।”

বলে বিড়বিড় করতে করতে পর্দা টেনে বাহিরে চলে গেলো মল্লিকা। মাহরুর ঠোঁট কামড়ে হাসলো।নিজের উপর সেও ভীষণ অবাক হয়।মনের অবাধ্য ইচ্ছেগুলো এভাবে প্রকাশ করে ফেলবে মল্লিকার কাছে নিজেও কল্পনায় আনতে পারেনি।

মাহরুর তৈরি।শার্ট প্যান্ট পরে ফরমাল লুকে মল্লিকার সামনে এসে দাঁড়ায়।মল্লিকা এক দেখায় মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে তার দিকে।চওড়া গরণ তার।তবে অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবান নয়।বয়সের ভারে সামান্য পেট বেরিয়েছে তবে চোখে পড়ার মতন না।হালকা বাদামি দাড়িগুলো নিজের মুখের অনুযায়ী ছাটাই করে রাখে।এক গভীর সমুদ্রের মতন মুগ্ধ নেত্র।খয়েরী রঙের শার্টে বেশ মানিয়েছে গায়ের উজ্জ্বল বর্ণে।আগেও দেখেছে অফিসের পোশাকে।আজ ভিন্ন।আজ একটু নিজেকে বেশিই ফিটফাট করে সাজিয়েছে মাহরুর।

মল্লিকার মুখের কাছে তুড়ি বাজিয়ে মাহরুর বললো, “টাই বাঁধতে জানিস?”

মল্লিকা মাথা দোলায়।সে জানেনা কি করে টাই বাঁধতে হয়।কখনো বাঁধা হয়নি।গ্রামে এসব সাহেবী বেশভূষা নিয়ে কেউ চলে না। মাহরুর হতাশ হয়।বলে,

“ভেবেছিলাম তোকে এই ডিউটি দিবো। তুইতো এটাও পারিস না। অকর্মার ঢেঁকি!”

“শিখে নিবো”

মল্লিকার এরূপ কথায় আগ্রহ প্রকাশ পায়।বুঝলো মাহরুর।সে রাজি প্রতিদিন টাই বেধে দেওয়ার ডিউটি করতে। মাহরুর বলে,

“দেখ কি করে বাঁধি।ধীরেধীরে শিখে নিবি।”

“আচ্ছা”

মল্লিকার সামনে দাড়িয়েই গলায় তাই বেধে নিলো।খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো।কিন্তু কিছুই বুঝেনি। বড্ড প্যাঁচ এখানে।মাথাটা ঘুরে গেছে প্রথম দেখায়।কিছু না বুঝে কয়েকবার দ্রুত গতিতে পলক ঝাপটায় মল্লিকা। মাহরুর পরিপূর্ণভাবে তৈরি।

জানতে চাইলো, “কেমন দেখাচ্ছে আমাকে?”

মল্লিকা মাথা নুয়ে উত্তর দেয়, “সুন্দর”

“আর?”

“আর কি? সুন্দরই দেখাচ্ছে।”

“তুই বড্ড বেরসিক চন্দ্র।মিষ্টিকে তৈরি কর।বের হবো।”

মিষ্টিও রেডি।এবার দুজনেই বের হবে।বাকিটা সময় একা থাকতে হবে মল্লিকাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসি মুখে বিদায় দিতে গিয়ে মাহরুর থেমে যায়।

বলে, “ভয় করছে রে?অনেক বড় অফিস।আমার মতন মানুষকে….”

“যেহেতু সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে আপনাকে সুযোগটা দিয়েছে।সেই এগিয়ে নিয়ে যাবে।আপনি মন দিয়ে কাজ করবেন।কোনো চিন্তা করবেন না।”

মল্লিকার কথায় সস্তি পায়।আদুরে গলায় প্রতিদিনের ন্যায় অনুমতি চায় মল্লিকার কাছে।বলে, “আসি?”

“আসুন খোদা হাফেজ।” হাসি মুখে বিদায় দেয় মিষ্টি আর মাহরুরকে মল্লিকা।

তারা যাওয়ার সাথে সাথে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাড়ায়। জানা আছে।যাওয়ার পথে একবার হলেও ফিরে তাকাবে। হলোও তাই।এক মিনিটের মধ্যে পিছু ফিরে মাহরুর। উভয়ই হাত নেড়ে বিদায় জানায় মল্লিকাকে।দুজন দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেলে শূন্যে চোখ তুলে মল্লিকা বললো,

“সব যেনো ঠিক থাকে।আর কষ্টের চিহ্ন চাই না এই জীবনে।”

__

“আপনিই মিস্টার মাহরুর ইবনাত?”

“জ্বি স্যার”

ম্যানেজার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “ফার্স্ট ডে রাইট?”

“জ্বি স্যার।”

“দেখেন প্রথমদিন।আজই কাজে হাত দেওয়ার দরকার নেই। অফিসটা ঘুরে দেখুন।সবার সাথে পরিচয় হন।আপনার ডিরেক্টর আছেন একজন সে আপনাকে সপ্তাহখানেক সময় নিয়ে সব কাজ বুঝিয়ে হ্যান্ড ওভার করে দিবে।”

“জ্বি”

মাহরুরের সিভিটা আবারো চেক করছেন ম্যানেজার সাহেব।দেখে জানতে চাইলেন, “সাত বছর আগের কোম্পানিতে চাকরি করেছেন?কখনো ইচ্ছে হয়নি জব সুইচ করার?”

“জ্বি স্যার আসলে!”

“ডোন্ট হেজিটেড।বলে ফেলুন।আমি সত্যবাদী লোক পছন্দ করি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুর বলে, “আসলে স্যার আমি গ্রামের ছেলে। পড়াশোনা সেখানেই শেষ করেছি।টানাপোড়ন এর সংসার এগোতে যে কাজটা পেয়েছি সেটাই করেছি।আমি জানতাম না আমার কাছ থেকে মিথ্যে বলে এগ্রিমেন্ট সাইন করানো হয়।যেটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।তাই এতদিন সেখানে ছিলাম।”

ম্যানেজার মাথা দোলান।বলেন, “আই সি…শোনেন মিষ্টার মাহরুর।এখানে চাকরি করতে হলে এই পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলতে হবে।তার পাশাপাশি চালাক হতে হবে। আশা করি পূর্বের বোকামি থেকে শিক্ষা নিয়েছেন।এখানে কাজের প্রতি সৎ থাকার পাশাপাশি বুদ্ধিমত্তা খাটাতে হবে। আই থিঙ্ক ইউ ক্যান ডু ইট।বেস্ট অফ লাক।”

বলেই হাত এগিয়ে দেয় ম্যানেজার। মাহরুরও সভ্যতার সাথে হাত এগিয়ে হ্যান্ড শেক করে বেরিয়ে পড়ে। ডিরেক্টর তাকে অফিস দেখাচ্ছে।তার ছোট্ট ডেস্কটাও দেখিয়ে দিল। বিলাসবহুল অফিস।কাঠের টেবিল এর সাথে আরামদায়ক চেয়ার।পুরোই স্বপ্নের মতন।তবে ভয় আছে পা পিছলে যাওয়ার। শখ পূরণ করতে চায়। তবে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিলাসিতায় অভ্যস্ত হতে ইচ্ছুক নয়।তার টিমের আরো কয়েকজনের সাথে পরিচয় হয় মাহরুর।সব শেষে দুপুরের খাবার খেয়ে নিজের ডেস্কএ কম্পিউটার এর কাছে বসতেই ফোন বেজে উঠে।বড় একটা নাম ভেসে আসছে। ‘আমার চন্দ্রমল্লিকা’।

“হ্যালো”

“হুম?”

“কি হুম? জানতে চাইবি না কিছু?”

“হ্যাঁ।খেয়েছেন?”

“হ্যা।তুই খেয়েছিস?আর মিষ্টি?স্কুল থেকে আনতে কোনো সমস্যা হয়নিতো?”

“না।আর আমরা খেয়েছি।”

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মাহরুর।এভাবে সেলফোনে একে ওপরের খোঁজ নেওয়াটাও একটা ভালোবাসা।এখন লাঞ্চ আওয়ার।কোনো কাজ নেই। মাহরুরের আজ কোনো কাজই নেই।

গাঢ় গলায় জানতে চাইলো মাহরুর।বললো, “তো বলেন আপনারা মা মেয়েরা কি করছেন?একা অনুভব করছেন নাতো?”

আপনি ডাকে মুচকি হাসলো মল্লিকা। মিষ্টিকে চেপে ধরে নিজের সাথে বললো, “মিষ্টিতো সারাদিন টিভি নিয়ে পড়ে থাকে জানেন না? পড়তেই চায় না।আর একা অনুভব করার কি আছে।আপনিতো প্রতিদিন এই সময় কাজে থাকেন।”

“আপনার মতে আমার সবসময় আপনার সাথে থাকা উচিত?”

“না সেটা হবে কেনো?”

“তাহলে কি দূরে থাকা উচিত?”

আপনাআপনি মল্লিকার মুখ ফুটে বেড়িয়ে আসল, “না কেনো? দূরে কেনো….”

বলতে বলতে থেমে যায়।ফোনের অন্যপাশে মাহরুরের হাসিটা আর চোখে পড়লো না। নিস্তব্ধতায় থেকে যায় দুজনেই কিছুক্ষণ।

মল্লিকা আবার বললো, “বিরক্ত করছি?”

“না।ফ্রি আছি”

“ফিরবেন কখন?”

“আপনি কখন দেখতে চান আমাকে?”

“আমি চাইলেই হলো নাকি? অফিসতো আমার মোতাবেক চলবে না।”

“চালিয়ে নিবো দরকার পড়লে।একটা বিষয় কি জানেন?এই অফিসে দুইদিন ছুটি।শুক্রবার আর সোমবার।কিন্তু একটা খারাপ বিষয়ও আছে।”

“সেটা কি?” মল্লিকার কন্ঠ উৎসুক শোনালো।

“যেখানে চারটা পর্যন্ত কাজ করতাম সেখানে পাঁচটা পর্যন্ত করা লাগবে।”

মুখ চুপসে গেলো। হাতে গুনে হিসাব করতে লাগলো।এই অফিসটা দূরে। পাঁচটায় বের হলে আসতে আসতে আরো বেশি সময়।মল্লিকা বুঝে উঠতে পারল না দুইদিন বন্ধে খুশি হবে নাকি এক ঘন্টা দেরিতে মাহরুর ব্যতীত থাকবে সেটায় কষ্ট পাবে।

আকস্মিক ডিরেক্টরের ডাকে মাহরুর বললো, “আমাকে ডাকছে।রাখি সাবধানে থাকিস”

“আচ্ছা।সাবধানে ফিরবেন”

মাহরুর এসেছে সন্ধ্যা ছয়টায়।এসেই একের পর এক হাঁচি দিয়ে যাচ্ছে।চোখের সাদা অংশ লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে।নাকের ডগাটাও কম যায় না। টকটকে লাল। কখনও রুমাল চেপে হাঁচি কাশির বন্যা বইছে কখনো নাক ঘষছে।এতটা ঠান্ডা লাগলো কি করে? চিরচিরা মেজাজ।প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।ঠান্ডা লাগলে কতটা বিরক্ত লাগে সেটা মল্লিকাও জানে।

আদা চা করে দিলো ফটাফট।গরম ধোঁয়া তোলা চা মাহরুরের দিকে এগিয়ে বললো, “চা খেয়ে নিন।আরাম পাবেন।”

নাক টানতে টানতে চায়ের কাপ হাতে নেয় মাহরুর।দুয়েক চুমুক দিয়ে বলতে লাগলো, “জীবনে প্রথমবার এত ঘণ্টা এসির নিচে থেকেছি।পুরো মাথা ধরে আছে।চোখ,নাক জ্বলছে।পুরো শরীর ম্যাজম্যাজ করছে।মানুষ যে কি করে করে এত ঠান্ডায় কাজ।”

এবার ঘটনা বুঝতে পেরেছে মল্লিকা। এতসময় এসির নিচে থাকার ফল।তাও প্রথমবার।আগে থেকেই মাহরুরের ঠান্ডার জোর বেশি। চাচীকে দেখতো আদা চা করে দিতে প্রায়ই।

মল্লিকা বললো, “ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে।আমি তেল গরম করে আনি? হাতে,পায়ে আর মাথায় দিয়ে দেই।”

“দে”

মাহরুর চায়ের কাপটা শেষ করতে করতে মল্লিকা কাপড়ে মুড়িয়ে গরম তেল আনলো। সরিষার তেলে ঠান্ডা একটু হলেও নিবারণ হবে।মিষ্টি বসে বসে মাহরুরের চুল টেনে দিচ্ছে।মা,মেয়ে দুজনকেই নিজের যত্নে লাগিয়ে দিলো।

মল্লিকা মাহরুরের পায়ে হাত দিলেই মাহরুর বলে উঠলো,

“পায়ে হাত দিবি।কেমন অদ্ভুত দেখায় না?বাদ দে।”

“কিছুই অদ্ভুত দেখায় না” নিচু গলায় বললো মল্লিকা।

মল্লিকার মুখ দর্শন করে মাহরুর ভাবলো হয়তো মেয়েটা চায় তার সেবা করতে।বললো, “আচ্ছা দে”

পরপর মাহরুর মিষ্টিকে আদেশ দেয়, “মিষ্টি হয়েছে।আর চুল টেনে দিতে হবে না। কাল স্কুল আছে না? ঘুমা।”

যত্ন করেই মাহরুরের হাত,পা,মাথায় তেল মালিশ করে দিতে লাগে মল্লিকা।একটু সস্তি পাচ্ছে।পেতেই হতো।বেশি অসুস্থ হলে চলবে না।একদিন কাজে গিয়েই এই অবস্থা হলে বাকিতো দিন আছে পড়ে।এই চাকরিটা কোনমতে হাতছাড়া করা যাবেই না। মাহরুর এর সেবা আর ঘরের কাজ এটে সময় গড়ায় রাত বারোটা।আজ মাহরুর বিছনায়ই ঘুমিয়ে পড়েছে।তাকে আর ডাকলো না।বিছানার অন্যপাশে গিয়ে শুয়ে পড়তেই মাহরুর ডাকে।

ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলে, “আমার পাশে আয়।”

“হুম?…জায়গা হবেনাতো।”

“হবে আয় তুই”

মিষ্টি শুয়ে আছে দেয়ালের দিকটায় সাবধানে।পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই।তার পাশেই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া তার মা।পেছনে জায়গা কম।তারপরও নিজেকে এটে নিয়েছে মাহরুর।মিষ্টি আর মল্লিকাকে কাথা উড়িয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো মল্লিকাকে আকড়ে ধরে।

মাহরুর বললো, “তোর উষ্ণতায় দেখবি কাল সকালেই আমার সর্দি কাশি সব গায়েব।”

চলবে..গল্পের

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-২১+২২

0

চন্দ্র’মল্লিকা ২১
লেখা : Azyah_সূচনা

সূর্যের তেরছা রোশনি পর্দা চিরে ছোট্ট চিলেকোঠার ঘরে প্রবেশ করছে।পাখির কিচিরমিচির জানান দিচ্ছে প্রভাতের।আজ প্রায় পুরো নগরী ঘুমন্ত।সারা সপ্তাহের ক্লান্তি মেটাচ্ছে।সুন্দর একটা দিন তাদের।ছুটির দিন।আরামের দিন।সূর্যের আলো এসে পড়ছে মাহরুরের পিঠে।তারপরও ঘুমে কোনো তারতম্য হলো না। বলিষ্ট হাতজোড়া মল্লিকার বাহুকে আবদ্ধ করে আছে।আঙ্গুলের ভাজে আঙ্গুল রেখে পুরো চন্দ্রমল্লিকাকেই আবদ্ধ করে রেখেছে নিজের হৃদগহ্বরে।অন্যদিকে মমতাময়ী মা।তার মেয়েকে নিজের বুকে লেপ্টে নিয়ে আরামদায়ক ঘুমে।হুশ নেই,টের পায়নি।তাকে পেছন থেকে কেউ এভাবে পেঁচিয়ে রেখেছে।

হাতের উপর ভার অনুভব করায় সামান্য নড়চড় করে উঠে মল্লিকা। হাঁসফাঁস লাগছে। ছট্ফট করার গতি বৃদ্ধি পেলে ঘুমঘুম কন্ঠ ভেসে আসে,

“উম! নড়চড় করিস না।”

ফটাফট মল্লিকার চোঁখের ঘুম উধাও।আওয়াজ তার পিছনে খুব কাছ থেকে আসছে।বুঝতে বাকি নেই কে এখানে। মাহরুর আরো গা ঘেষে রইলো।মল্লিকা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে। আঙ্গুলের ভাঁজ থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই মাহরুরের ঘুম ভেংগে গেল।

বিরক্তি নিয়ে বললো, “কি সমস্যা?”

“উঠবো”

পিঠে ছড়িয়ে থাকা কেশমালা একহাতে পেঁচিয়ে ধরলো মাহরুর। আলতো টানে ঘ্রাণ শুকে নিচ্ছে।ঘ্রাণে মাতোয়ারা হওয়া শেষে বলে উঠলো,

“পড়ে উঠ।আজ শুক্রবার”

“আমি আজ রান্না করবো।রহিম চাচাদের বাড়িতে রেধে পাঠাবো।উঠতে দিন”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মাহরুর।কিছুই করার নেই।ভালো চিন্তা এনেছে মাথায়।আটকানো যাবে না।মেয়ের মাকে বাদ দিয়ে মেয়েকে জরিয়ে আবার ঘুমের জগতে ডুবে যায় মাহরুর।কম খাটাখাটনি যায় না শরীরের উপর।অফিস,অফিস থেকে আবার রান্না করা।দৌড় ঝাপ করতে করতে বিশ্রাম নেওয়ার সময় কোথায়?ঘরে চাঁদ এনেছে। চাঁদকে দিয়ে কাজ করানো তার শানের পরিপন্থী।

হাতে সোনালী রঙের চুরি চকচক করছে।নাকেও আছে পুরোনো একটা নাকফুল।খোঁপা সামান্য ঝুলে আছে পিঠের দিকে।নাকে ঘাম চিকচিক করছে তারপরও কাজে কোনো অলসতা নেই।অনীহা নেই। শুক্রবার সাপ্তাহিক ঈদের দিন। মাহরুর পোলাও চাল এনেছিল।সাথে মুরগির গোস্ত।দুটোই রান্না করবে সাথে সালাদ। মাহরুরের ঘুম ভাঙ্গে এগারোটায়।একবার মুগ্ধ চোখে মল্লিকার দিকে চেয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।

তাওয়ালে হাত পা মুছতে মুছতে এগিয়ে এসেছে মাহরুর।এসেই বলল, “নাস্তা কি পাবো?নাকি নিজেই বানিয়ে খাওয়া লাগবে।”

মল্লিকার কাছে কটাক্ষের মতন লাগলো। হন্তদন্ত হয়ে বললো,

“বানিয়েছি নাস্তা।একটু অপেক্ষা করুন ডিম ভেজে দেই।”

“চা আর পরোটা খাবো।”

“আচ্ছা দিচ্ছি”

মাহরুর পাশে এসে বসলো।জানতে চাইলো, “আপনি খেয়েছেন?”

আবারো সেই আপনি ডাক।অভ্যাস হয়ে যাবে মাহরুরের সবকিছুই।এটা ভেবে মল্লিকা উত্তর দেয়, “না।মিষ্টি উঠলে খাবো ”

“আমার সাথে বসে খাবেন আজ?”

এইযে বারবার হৃদয়ে ঝংকার উঠে?এর কোনো ঔষধ নেই।মল্লিকা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।আজ তার সাথে বসেই খাবে। মাহরুরের মন প্রসন্ন হয়।হাসি মুখে চুলোয় চড়িয়ে রাখা লিকার নামিয়ে কাপে ঢালতে লাগলো।অন্যদিকে আগে থেকে বানিয়ে রাখা পরোটা চুলোয় দিয়ে ভেজে নিলো মল্লিকা।

চুলোর দ্বারেই সকালের নাস্তা করছে মাহরুর মল্লিকা।কয়েকবার মাথা ঘুরিয়ে মেয়েকেও দেখে নিলো।ছোটোবেলা থেকেই ঘুম কাতুরে তার মেয়ে।খাবার না দিয়ে ঘুমোতে দিলে সে কোনো অভিযোগ করবে না।আজ জুম্মা।নামাজ আছে।সাথে অনেক রান্নাও।

মাহরুর বললো,

“আমি খাইয়ে দিচ্ছি।তুই তোর কাজ কর”

পরম যতনে হাতে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। মাহরুরের আঙ্গুলের স্পর্শ ঠোঁটে লেগে যত অসস্তিতে পড়ছে মল্লিকা ততই চন্দ্রের ওষ্ঠ স্পর্শন দামাল হৃদয়ের জন্য প্রশান্তিদায়ক। মাহরুর ভাবে।কাবু করার মন্ত্র বোধহয় মায়ের পেট থেকেই শিখেছে এই মেয়ে।নাহয় কেনো তার অল্পস্বল্প প্রকাশ্য অনুভূতি মাহরুরকে তাড়া করবে?তাও ক্ষণিক সময়ের প্রেমের হাওয়া ছিলো সেখানে।

মাহরুর গোসল সেরে শুভ্র পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছে।চুলগুলো এখনও ভেজা।গায়ে আতর মেখে ড্যাবড্যাব চোখে আবডালে চেয়ে থাকা চোরকে ধরে ফেললো।লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে পুরুষের সৌন্দর্য্য লুফে নিচ্ছিলো।কাছে ডাকলো।

বললো, “চুল মুছে দিয়ে যা”

“আমি?”

“তো কে?চন্দ্র তোতলানো বারণ, নিশ্চুপ হয়ে থাকা বারণ পাশাপাশি আমার আদেশ পালন করার বিষয়ে এক সেকেন্ড দেরি করা যাবে না।দ্রুত আয়”

তোয়ালে হাতে মাহরুরের সামনে দাঁড়িয়েছে মল্লিকা। মাহরুর বিছানায় বসে। পিছনে মিষ্টিও উঠে দাড়ালো।এখন কি হতে চলেছে সে দেখবে আগ্রহ নিয়ে।মল্লিকা আলগোছে চুল মুছতে লাগলো। তোয়ালের আড়ালে আড়ালে মল্লিকার স্তব্ধ মুখটা দেখে দারুণ ইচ্ছে জাগে।যাহার পূর্ণতা দেওয়া অসম্ভব।এখানে যদি মিষ্টি না থাকতো? চন্দ্রের সাথে তার সম্পর্কটা আরেকটু মজবুত হতো? চট করে চুল মোছার বাহানায় তাকে কোমড় জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নিত।তার আর উপায় নেই।নিজের ইচ্ছেকে এখানেই মাটিচাপা দেয়।

মিষ্টি বলে উঠলো, “আমাকেও মা এভাবেই চুল মুছে দেয় মামা। আজ তোমাকে দিচ্ছে।”

“তুইও আয়।মেয়ে হওয়ার দায়িত্ব পালন কর।চুল মুছে দিতে মাকে সাহায্য কর।”

দায়িত্ব পালন শব্দের অর্থ বুঝলো না মিষ্টি।শুধু এতটুকুই বুঝলো তাকেও ডাকা হচ্ছে।সেও মায়ের সাথে হাত মেলাবে। বাচ্চা হাতে জোর চালালো।চুল মুছে দেওয়ার বদলে অত্যাচার করছে বেশি। মাহরুর মাথা নাড়ায়।

বলে, “হয়েছে হয়েছে আর লাগবে না।আমার সব চুল ঝড়ে যাবে নাহয়।”

মিষ্টি প্রতিউত্তরে বলে, “তুমিতো এত বড় তুমিও কি আমার মত চুল মুছতে জানো না মামা?”

মাহরুর মনে মনে বলে উঠে, “জানিরে মা।কিন্তু কি করবো বল?তোর মা আমাকে ধরা দেয় না।তাই তাকে একটু জ্বালাই।”

মনের কথা মনের সিন্দুকেই রাখে মাহরুর।তবে মুখে বললো, “নারে মিষ্টি পারি না।”

“ওহহো”

মিষ্টির কথায় হেসে ফেলে মাহরুর মল্লিকা দুজনেই। মিষ্টির নাক টেনে দিয়ে মাহরুর জানতে চায়, “কি খাবি বল?কি আনবো আসার পথে?”

“জিলাপি খাবো”

“আচ্ছা।আর শোন আমার জন্য অপেক্ষা করবি।আমি বাড়ি আসলে তিনজনে মিলে একসাথে বসে খাবো।”

মিষ্টি সামান্য লাফিয়ে বললো, “আচ্ছা মামা। টাটা”

মাহরুর হতাশ হয়ে নিঃশ্বাস ফেলে।মাথা দুদিকে নাড়িয়ে আবছা স্বরে বলল, “মামা!হাহ!”

__

জুম্মার নামাজ শেষে দুজোড়া পা রাস্তায় চলছে।দুজন পূরুষের সাদা পাঞ্জাবি ঘামে ভেজা।কেউ বলবে না গোসল সেরে বেরিয়েছে তারা। মাহরুরের পাশে রেদোয়ান।দুজনই যারযার বাড়ি যাবে।মিষ্টির আবদারের জিলাপি আর কিনতে হলো না।আজ মসজিদেই নিমকি জিলাপি দিয়েছে।

রেদোয়ান ঠাট্টা করে বললো, “বাবার মতন আচরন করছো মাহি।নিজে না খেয়ে মেয়ের জন্য নিমকি জিলাপি নিয়ে যাচ্ছো বাড়ি।দৃশ্যটা আজ প্রথম দেখলাম।”

মাহরুর হাসে।বলে, “ওকে খেতে দেখে যে তৃপ্তিটা পাবো সেটা সারা দুনিয়া খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।”

মাহরুরের বুক চাপড়ে বললো, “এটা বাবার হৃদয় মাহি।এই জায়গায় বাবা হওয়ার অনুভূতি জাগ্রহ হচ্ছে।”

“হোক আমি চাই হোক!”

রাস্তার দ্বারে দাড়ায় মাহরুর আর রেদোয়ান।একটা একটা করে সফট ড্রিংক এর বোতল কিনে নিলো দুজনেই।জুম্মার দিনে দাওয়াত এর আমেজ।পোলাও মাংস খেয়ে হজম করতে হবেতো?দোকানের পাশে একটা মহিলাকে চুরি,কানের দুল বিক্রি করতে দেখলো মাহরুর।দ্রুত পকেট হাতড়ে দেখলো টাকা আছে কিনা।দেড়শো টাকা আছে। এতে আরামসে মেয়ে আর মেয়ের মার জন্য উপহার কেনা হয়ে যাবে। রেদোয়ান দাড়িয়ে হাসলো।লোকটা অল্প দিনেই অনেক পরিবর্তিত। সাংসারিক ছিলো।কিন্তু আগের সংসারে সুখের চেয়ে দুঃখের ছায়া মুখে থাকতো সবসময়।

রেদোয়ান প্রশ্ন করে, “মাহি ব্যাংকে কত টাকা আছে?”

মুখটা মলিন হয়ে যায় মাহরুরের।দুঃখী মনে বললো, “ছিলো সত্তর হাজারের মতন।এখন চল্লিশ পয়তাল্লিশের মতন আছে।কেনো?”

“তুমি কি ব্যবসার কথা ভাববে?”

“এই অল্প ইনভেস্টমেন্ট এ ব্যবসা সম্ভব না।”

“আমি দিতে চাচ্ছি সেটাও নিবে না।বললাম লাভ হলে ফিরিয়ে দিও।তুমিতো কমার্সের স্টুডেন্ট।তোমার সাথে ব্যবসাটা যায়।আর তোমার এগ্রিমেন্ট চেক করেছি।এটা তোমাকে ভয়ে রাখার পাঁয়তারা।তুমি বললে ম্যানেজারের ঘাড়টা ধরে বসি?”

“আরেহ না ভাই।যাও চাকরিটা আছে সেটাও থাকবে না।নতুন চাকরি খুজবো পাকাপোক্তভাবে তারপরই ছাড়বো এটা।এর আগে নয়।”

“কতোটা বছর তোমাকে বোকা বানিয়ে রেখেছে মাহি।বুঝতে পারছো।এক জায়গায় থেমে আছো শিক্ষিত হওয়া সত্বেও।আমি তোমাকে উৎসাহ দিচ্ছি।মনে করো না খোচা দিয়ে বলছি।তোমার এবার অন্যকিছুতে এগোনো দরকার।আমাদের পুরুষদের নিজেকে নিয়ে কি চিন্তা?যত চিন্তা বউ বাচ্চার”

মাহরুর মাথা দোলায়।বুঝেছে রেদোয়ান এর কথা। দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিল এই নিষ্ঠুর শহরের জন্য তারও কঠোর হতে হবে।অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে।কথা শেষে রেদোয়ানকে ডাকলো। আজ দুপুরে তাদের সাথে খেয়ে যেতে।সে রাজি হয়নি।তার স্ত্রীও তার জন্য অপেক্ষায়।তাই বলে চলে গেলো।

___

শুভ্র পাঞ্জাবি দড়িতে টানিয়ে খেতে বসেছে তিনজন।পরনে সাদা বডি অয়ের।হাতের সম্পূর্ণ অংশই খোলামেলা। অনিচ্ছায় চোখ চলে যায় মল্লিকার।লজ্জাবোধ করে সাথে সাথেই।সেখানে খেয়াল নেই মাহরুরের।পোলাও গোস্ত মাখিয়ে মিষ্টিকে খাইয়ে দিচ্ছে।সামনে বসে মল্লিকা খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। মিষ্টির মুখে আরেক লোকমা পুড়ে দিয়ে মাহরুর বললো,

“চেয়ে না থেকে খাবার শেষ কর”

থতমত খেয়েছে মল্লিকা।তার দিকে না চেয়েই কি অবলীলায় বলে ফেললো।লজ্জা দিলো মল্লিকার দৃষ্টিশক্তিকে।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে মল্লিকা গিয়েছে দোতলায়।ভুলেই গিয়েছিল বাড়িওয়ালা রহিম চাচাকে খাবার দিতে হবে।খাবার খেয়ে নাকে মুখে দৌড় লাগিয়েছে। মাহরুর যায়নি সাথে।একা চলতে শিখুক।অন্যের সাথে কি করে ডিল করতে হয় মল্লিকার শেখা প্রয়োজন।সময় নিয়েই ফিরে এসেছে মল্লিকা। হাঁপাচ্ছে রীতিমত।

ঘরে ঢুকে মিষ্টির পায়ে নূপুর দেখে অবাক হলো।এটাতো ছিলো না আগে? কোথা থেকে এলো? মিষ্টি আর মাহরুরের উদ্দেশ্যে মল্লিকা বলে উঠে, “নূপুর আসলো কোথা থেকে?”

“মামা…”

বলতে বলতে থেমে যায়।থামিয়ে দেয় মাহরুর তাকে “উম?” শব্দ করে। মিষ্টিও যেনো তার ইশারা বুঝে গেছে।

বলে উঠলো,

“বাবা দিয়েছে”

ফোনে মনোনিবেশ করা মাহরুর বাকা হাসলো।মল্লিকা অবাক হবে নাকি খুশি হবে দ্বিধদ্বন্দ্বে ভুগতে শুরু করলো।মল্লিকার ঠোঁটজোড়া আপনাআপনি কিঞ্চিত ফাঁকা হয়ে আছে।এই অল্প সময়ে বুলি পরিবর্তন করে ফেলেছে?তার সাথে সাথে তার মেয়েকেও জব্দ করছে ধীরেধীরে।এই জব্দ হওয়াতে কোনো বাঁধা নেই।হাসির মাধ্যমে এই ভাবনার বহিঃপ্রকাশ করলো মল্লিকা।

মিষ্টি মাকে নূপুর দেখিয়ে বললো, “মা? মামা..না বাবা বলেছে সে আমার বাবা।আমরা আজ থেকে সবসময় একসাথে থাকবো।আর বলেছে আমাদেরকে একটা বড় বাড়ি বানিয়ে দেবে।সেখানে অনেক খেলনা থাকবে।আমারও মামা বাবাকে ভালো লাগে মা।আমরা একসাথে থাকবো?”

অদ্ভুত ডাক। মামাবাবা!খিলখিল করে হেসে উঠে দুজনেই।এতগুলো কথা বলে ছোট্ট মিষ্টি হাপিয়ে উঠেছে।ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসে পড়লো।কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে শুয়েও পড়েছে।বুঝতে বাকি রইলো না ঘুম পাগলী মেয়ে আবার ঘুমের সাগরে তলাবে। মাহরুর হাত এগিয়ে বিলি কাটতে লাগলো মিষ্টির কোকড়া চুলে।বিশ মিনিটের মাথায় ঘুমিয়ে পরে মিষ্টি।

তার নিস্পাপ মুখখানা দেখে মাহরুর মল্লিকার উদ্দেশ্যে বললো, “তোর মেয়েটাও তোর মতন জানিস?তোরও এই বয়সে কোকড়া চুল ছিলো।সারাদিন চাচীর কোলে ঘুমিয়ে থাকতি ”

“আপনার মনে আছে?”

“হুম।তোর আর শিরীনের ছোটোবেলা আমার সামনেই কেটেছে।মনে থাকবে না?”

“আচ্ছা আমি থালা বাসন গুছিয়ে নেই।”

“এই দাঁড়া!”

মাহরুর উঠে আসে মল্লিকার দিকে।এগিয়ে আসার গতি দেখেই হৃদপিণ্ড আটকে যাবে।না জানে আবার কি বলবে?কি আদেশ দিবে? মল্লিকাকে টেনে আয়নার সামনে দাঁড় করায়। আয়নায় মল্লিকার লাজুক মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে চুল সরিয়ে নিল ঘাড় থেকে।পকেট থেকে সোনালী রঙের একটা চেইন বের করে পড়াতে শুরু করে। ঘাড়ে মাহরুরের আঙ্গুলের স্পর্শে কম্পিত বদন।বারবার নিজেকে একই প্রশ্ন করতে বাধ্য করে?কেনো মাহরুর কাছে এলেই এমন অনুভূতি!

পিঠটা মাহরুরের বুক ছুঁই ছুঁই।কানের কাছে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মাহরুর বললো, “চোখ খোল”

চোখ খুলে সর্বপ্রথম মাহরুরের মুখটা চোখে পড়লো মল্লিকার।কল্পনা করলো সেইদিনগুলোর।স্বপ্ন মনে হয় সবটা।একসময় ছিলো অগাধ ভালোবাসা আর বিশাল দূরত্ব।আজ এতটা ভালোবাসা কুলিয়ে উঠতে পারছে না মল্লিকা।তারপর চোখ গেলো গলায় চেইনটিতে।সোনালী চেইন এর মাঝে একটি অর্ধচন্দ্রের লকেট।বেশ সুন্দর।

মল্লিকাকে চমকে দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাহরুর।মল্লিকার মাথার ডানদিকে নিজের মাথা এলিয়ে বললো, “স্বর্ণের না।কিন্তু আমার মনে হলো তোর গলায় এটা মানাবে বেশ।”

“আমার ওসব দামী কিছু চাইনা।”

“কিন্তু আমি চাই চন্দ্র!একদিন স্বর্ণ দিয়ে মুড়িয়ে রাখবো তোকে।তুই শুধু দুআ কর আর আমাকে ওই কিশোরী চন্দ্রের মতন ভালোবাস।”

“আপনি অনেক ভালো মানুষ।”

এতদিনে নিজের খোলস ছাড়লো মল্লিকা।ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ছড়ায়। কিছুতো বলেছে এই ননীর পুতুল!নাহয় এক সময় মাহরুর ধরেই নিত চন্দ্র সেই আকাশের চন্দ্রের মতই বোবা।

“এই ভালো মানুষের একটা ভুল আবদার রাখবি?”

“কি রকম?”

পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মিষ্টিকে দেখে নিলো।নাহ বিভোর সে ঘুমে। মাহরুর আবার মনোযোগী হয় মল্লিকায়।বলে,

“তোর ঘাড়ের তিলটায় ঠোঁট ছুঁয়ে দেই?প্লিজ!একবার।দেখ কি বাজেভাবে টানছে আমাকে।আমিও পুরুষ মানুষ!নিজেকে সামলাতে পারি না তোর কাছে থাকলে।আর সে যদি হয় তিলেতিলে আমার হৃদয়ে ছেয়ে যাওয়া নারী?তাহলে আরো সামলানো যাচ্ছে না।”

মল্লিকা ছিটকে দূরে সরে যেতে চাইলো।লোকটা তাকে মেরেই ফেলবে।কি রকমভাবে আবদার করছে।তাকে তার ইচ্ছে পূরণের অনুমতি দিলে দাড়িয়ে দাড়িয়ে নিজের প্রাণ হারাবে সে।মল্লিকার ভাবসাব বুঝলো মাহরুর।এবার বেঁকে বসে নিজেও।

বলে, “অনুমতি নিচ্ছি?কেনো?অধিকার আছে খাটাবো না?তুই আমার মতন এক তাগড়া যুবককে ভালোবাসার আগে অনুমতি নিয়েছিলি?ভাই সমতুল্য লোকের দিকে কু দৃষ্টি দিয়েছিলি চন্দ্র। শাস্তি ভোগ কর।”

বিদ্যুতের ঝটকা দিয়েছে এক মুহুর্তেই। উন্মুক্ত ঘাড়ে মুখ ডুবায়। অস্থিরতা ভরা চিত্তে খিঁচে চোখ বন্ধ করে নিলো মল্লিকা।এটা নিশ্চিত একদিন এই মাহরুরের হাতেই বধ হবে। মিনিট খানেক পর ছাড় দিল মল্লিকাকে। ঝড়ো নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

“আমার মেয়েটা জেগে যাবে বলে ছেড়ে দিলাম। আগামীবার!”

অর্ধপূর্ন বাক্যে মুখ শক্ত করে থেমে গেলো।বাকি কথা পূর্ন করলো না মাহরুর।মল্লিকা একটা মোম।যত জ্বালাবে গলতে থাকবে।আজকে এতটুকুই তার জন্য যথেষ্ট এর চেয়ে বেশি।মল্লিকা নিঃশ্বাস ফেলে নিচু গলায় আওড়ায়,

“পাগল!উন্মাদ!”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা ২২
লেখা : Azyah_সূচনা

“আপনাকে ফোন করে আমার মায়ের হয়ে ক্ষমা চেয়েছি।আপনি তারপরও তাকে এভাবে ধরে আনলেন?কই আপনাদের থানার ওসি কোথায়?আমি কথা বলতে চাই!”

ফারহানের ছোট ভাই ফরহাদ এসেছে। সুদূর দুবাই থেকে কয়েক দিনের মধ্যে মায়ের জেল খাটার সংবাদে দৌড়ে আসে। রেদোয়ান এর সামনে থানায় এসে বসে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো।

রেদোয়ান হাসে।বলে, “ওসি সাহেবের আদেশেই হচ্ছে যা হচ্ছে।শুনতে খারাপ লাগবে আপনার তারপরও বলি আপনার মা নারী নামের কলংক”

ফরহাদ এবার দ্বিগুণ রেগে গেলো।বললো, “মুখ সামলে কথা বলুন অফিসার।আমার মাকে ছেড়ে দিন।”

“ঘরে স্বামীহারা ছেলের বউকে নির্যাতন করলে কি হয় জানেন?তাছারাও সেই নারী এখন অন্যজনের বউ।আপনার মা আবার তার সম্মানহানি করার চেষ্টা করেছে।একবার সুযোগ দিয়েছি। দ্বিতীয়বার ওই নারীর স্বামী মামলা দিয়েছে।”

“কে তার স্বামী?”

“আপনাকে সেটা বলতে আমি বাধ্য নই।যদি সে মামলা তুলে নেয় আমরাও আপনার মাকে ছেড়ে দিবো”

ফরহাদ আবার জানতে চাইলো, “আপনি বলেন কে মল্লিকা ভাবির স্বামী?আমি ওনার সাথে কথা বলে ব্যপারটা মীমাংসা করার চেষ্টা করবো”

“মাহরুর ইবনাত ”

সরাসরি জবাব দেয় রেদোয়ান।ফরহাদের কপাল কুঁচকে আসলো।নামটা পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথায় শুনেছে কোথায় শুনেছে এটা ভাবতে কিছু সময় নিলো। চট করে পিত্তি জ্বলে উঠে।সেতো মল্লিকার চাচাতো ভাই। ফরহাদ উঠে দাড়ায়। রেদোয়ান এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।রাস্তায় দাড়িয়ে ভাবতে লাগলো কি করবে?

দরজায় টোকা পড়লে মাহরুর চেচিয়ে জানতে চায়, “কে?”

“আমি…ফরহাদ”

ফরহাদ নাম শুনে মল্লিকা উঠে দাড়ায়।বসে বসে মেয়েকে পড়াচ্ছিলো।সে চেনে তাকে। মাহরুরকে একটু দ্বিধায় মনে হলো। তারপরই এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। ফরহাদসহ আরো দুজন পুরুষ দাড়িয়ে।

“আপনার পরিচয়?”

“আমি ফারহান ভাইয়ের ছোট ভাই”

পুরোপুরিভাবে চিনতে পারে মাহরুর।গেট খুলে দিলো। ফরহাদসহ বাকি দুইজন পুরুষ ঢুকে পড়ল। মল্লিকাকে চোখের ইশারায় সরে যাওয়ার আদেশ দেয় মাহরুর। মল্লিকাও মিষ্টিকে নিয়ে সরে গেলো।

মুখোমুখি বসে মাহরুর জানতে চাইলো, “বলেন”

“আপনি বুঝতেই পারছেন আমি কেনো এসেছি।”

“হ্যা বুঝেছি”

“দেখেন আম্মা যেটা করেছে অনেক বড় ভুল।সত্যি বলতে আমরা কেউই চাইতাম না মল্লিকা ভাবি আমাদের সাথে থাকুক।”

“এখন নেই।তারপরও আপনার মা আমার স্ত্রীকে এতগুলো মানুষের সামনে অপমান করেছে।”

ফরহাদ দৃষ্টিনত করে বললো, “বয়স হয়েছেতো তাই মাথাটা কাজ করে না আম্মার।”

মাহরুর তুচ্ছ হাসে।বলে, “এটা বয়সের দোষ না ভাই।”

“যা হয়েছে বাদ দেন।শেষ ভুল বলে ক্ষমা করে দিন।আগামীবার এমন কিছুই হবে না।আমি গেরান্টি দিচ্ছি।মামলাটা তুলে নিন।এই টাকাটা রাখেন।” ফরহাদ একটা মোটা খাম এগিয়ে দিল।

ভ্রূদ্বয়ের মধ্যিখানে গাঢ় ভাজ পড়লো মাহরুরের। এমনেতেই নিজের জোরে একা আসেনি।সাথে দুজন পুরুষ আর টাকার জোর এনেছে। মাহরুর মুখ শক্ত করে বললো,

“আপনার প্রথম কথাগুলোর জন্য আমি একবার ভেবে দেখতাম।কিন্তু আপনি যে শেষে আমাকে টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করলেন?আমার মত বদলে দিলেন।”

“এটা কেমন কথা!টাকা সবার প্রয়োজন।”

“আমি টাকা নিয়ে মামলা তুলে দিবো?এতটা লোভী মনে হয় আমাকে।”

ফরহাদ মাহরুরকে খোঁচা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘরের চারপাশ চোখ বোলায়।দেখা শেষে হতাশ ভাবভঙ্গি দেখা গেলো তার মুখে।এবার ফরহাদও শক্ত ভঙ্গিতে বললো,

“মামলাটা তুলে নিন”

“ভেবে দেখবো”

ফরহাদ উঠে দাড়ায়।বলে, “অনেক দেমাগ আপনার!”

ভাবলেশহীন মাহরুর বলে উঠলো, “দেমাগ না। ব্যক্তিত্ব;আত্মসম্মানবোধ।টাকা আর সাথে দুয়েকজন মানুষ এনে ভয় দেখানোর চেষ্টা করা আপনার ব্যক্তিত্ব।ঠিক তেমনই”

উত্তরটা পছন্দ হয়নি ফরহাদের।চোখে মুখে হলকা ক্রোধের আভাস দেখা গেলো।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চলে গেলো সেখান থেকে। ফরহাদ চলে যেতেই বেরিয়ে আসে মল্লিকা।এসেই বরাবর দাঁড়ালো মাহরুরের সামনে।

বললো, “আপনি আজও রেগে?”

রাগ টাগ কিছুই নেই।এমন অনেকে এসেছে।অনেকে আসবে।অভাবের সংসারে হতাশা দেখিয়ে সাহায্যের নামে অপমান করবে।কিন্তু মনে হলে এই মুহূর্তে মল্লিকাকে বিরক্ত করা উচিত।

বললো, “রাগ করবো নাতো কি?ওই লোক আমাকে টাকার বাহাদুরি দেখাতে এসেছে।আমার আত্মসম্মানে লেগেছে!”

“আমি ক্ষমা চাইছি তাদের হয়ে”

এতক্ষন মিছেমিছি রাগ দেখালেও এবার সত্যি রাগ হলো। মাহরুর বললো, “তুই ক্ষমা চাচ্ছিস কেনো?”

“আমার কারণেইতো হচ্ছে সব।আমিও ওই পরিবারের একজন ছিলাম।ওই সুবাদে এই দায়ভার আমারও।”

মন বলছে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিতে। নেহাত মিষ্টি সামনে। মাহরুর দাতে দাত চিবিয়ে বললো, “তোর সাথে হিসেব নিকেশ রাতে হবে”

___

নতুন নতুন জায়গায় সিভি ড্রপ করছে মাহরুর।নিজের যোগ্যতার সাথে যায় এমন সব জায়গায়।রেদোয়ান এর ল্যাপটপে বসে কাজটি সেরে ফেললো।আজ শিরীন দাওয়াত করেছে।অফিস থেকে সবে ফিরলো মাহরুর।রেদোয়ান এর অফ ডিউটি।নানান আলোচনায় মগ্ন পুরুষ দুজনেই। বাচ্চারা খেলছে।মল্লিকা শিরীনের সাথে রান্না ঘরে তাকে সাহায্য করছে রাতের খাবারের জন্য।

মাহরুর বললো, “আমি চাইছি চাচা চাচীকেও ঢাকা আনবো।”

বুদ্ধি খেলে গেল রেদোয়ান এর মাথায়।বললো, “মাহি একটা আইডিয়া আছে।”

“কি?”

“চাচা চাচী ঢাকা আসলে তারা যেই বাড়িটায় থাকেন সেই জায়গাটা ভাড়া দিয়ে দেক।সাথে তোমাদের বাড়িটাও। এতে করে আলাদা ইনকাম হবে। তোমারও সুবিধা।তুমি যেহেতু পিতৃ ভিটা বিক্রি করতে চাও না। ভাড়া দিয়ে দেওয়াই ভালো।”

মাহরুরের কাছে ভালো লাগলো বুদ্ধিটা।তারপরও বললো, “আমাদের গ্রামটা বেশিই ভিতরের দিকে।ভাড়া আর কতই বা হবে?”

“যতই হোক মাহি।তোমাদের সংসারে কি এত খরচ?তাছারাও তুমি নতুন চাকরি খুঁজছো।আমার বিশ্বাস পেয়ে যাবে।”

মাহরুর মাথা দোলায়।দুহাতে খাবারের বাটি নিয়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে আসলো শিরীন।বাচ্চাদের একে একে ডেকে নিলো। সর্বশেষে ডাক পড়লো রেদোয়ান আর মাহরুরের।খাবার তৈরি খেয়ে নিবে।খাবার টেবিলে বসেও পুরুষের আলাপের শেষ নেই।শিরীনের ঝাঁঝালো গলায় থেমে যায় দুজনেই। মাহরুরের চোখ পড়ে মুখোমুখি বসে থাকা চন্দ্রের উপর।একহাতে খাচ্ছে অন্যহাতে গলার চেইন টানছে।এই মেয়েটাকে দেখলেই প্রেম প্রেম পায়।ইচ্ছে হয় সারাদিন জড়িয়ে বসে থাকুক। নিতান্তই ছেলে মানুষী।এই বয়সে এসব মানায়?বয়সের তোয়াক্কা না করেই টেবিলের নিচ থেকে পা এগোয় মল্লিকার পায়ে। আকষ্মিক পায়ে পা পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো মল্লিকা।

শিরীন বললো, “কি হলো তোর?”

বোকা বনে থাকা মল্লিকা আমতা আমতা করে বলল, “নাহ কিছুনা।”

ততক্ষণে বোধগম্য হয়েছে মল্লিকার এই পায়ের মালিক কে হতে পারে।তার সামনে বসে শীতল দৃষ্টি ছড়ানো মাহরুরের।খাওয়ার মাঝেমাঝেই দৃষ্টি তুলে তাকাচ্ছে।বিশাল পায়ের পাতা দিয়ে পৃষ্ট করে রেখেছে মল্লিকার পা।এই দৃষ্টির অর্থ কি?কিছু বলতে চায়?নাকি অযথাই?ভাই আর মল্লিকার এরূপ চোখে চোখে প্রেম দেখে মিটিমিটি হাসলো শিরীন।

বললো, “আজ কিন্তু তোমরা থাকছো এখানে।তাই না মিষ্টি?”

মিষ্টি সর্বদা প্রস্তুত।সুমাইয়া,সায়মনের সাথে ভালো খাতির জমেছে।কিন্তু বেঁকে বসে মাহরুর।বলে, “আমার অফিস আছে শিরীন”

“থামো কালকে সারাদেশে সরকারি ছুটি।তোমার কিসের অফিস শুনি?”

মাথায়ই ছিলো না কথাটা। মাহরুর তারপরও উপায় খুজেঁ না করার।সে থাকতে চায় না।শিরীন কোনো কথাই শুনলো না।যেহেতু বলেছে রাখবে রেখেই ছাড়বে।নতি স্বীকার করে মাহরুর। তবে বিপত্তি বাঁধে এক জায়গায়। মাহরুরকে এক ঘরে একা ফেলে রেখে অন্যঘরে বাচ্চাদের নিয়ে গেছে শিরীন।সাথে মল্লিকাও আছে।রেদোয়ান এর নাইট ডিউটি।সে খাওয়া দাওয়া শেষে চলে গেছে।পুলিশের সরকারি ছুটি হয়না।বন্ধের দিনগুলোতে তাদেরই কাজ থাকে বেশি। দশ মিনিট,আধ ঘন্টা থেকে পুরো এক ঘন্টা হতে চললো।তাদের আড্ডার শেষ নেই।কি এমন পুরোনো যুগের ঝুড়ি খুলে বসেছে?কতক্ষন অপেক্ষা করা যায়?বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো।পা বাড়ায় শিরীনের ঘরের দিকে।দরজা দিয়ে উকি দিতেই দেখলো লুডো খেলায় ব্যস্ত তারা।দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মাহরুরের দিকে চোখ পড়ে শিরীনের।

গলা উচু করে জানতে চায়, “কি চাই?”

“বউ চাই” কথাটি ঠোঁটের ডগায় এসে বসে আছে।বোনের সামনে কি নির্লজ্জ হওয়া যায়?গলা পরিষ্কার করে বললো,

“চন্দ্র আর মিষ্টি ঘুমাবে না?এখনও আসছে না যে?”

“না ওরা আজকে এখানে ঘুমাবে।আমার সাথে”

মাহরুর নিজেকে সামলাতে পারলো না।বললো, “এটা কেমন কথা!”

মাহরুরের গলার স্বরে গোলগোল চোখে চাইলো মল্লিকা। শিরীন নিজের হাসি থামানোর চেষ্টা করতে চেয়েও পারলো না।ভাইকে লজ্জা দিয়ে হেসেই ফেললো।

মাহরুর নাক ফুলিয়ে বললো, “আমি গেলাম ঘুমাতে।”

শিরীন মিষ্টির উদ্দেশে বললো, “মা আজ সুমাইয়া আপু, সায়মন ভাইয়া আর মনির সাথে ঘুমাবে?তোমায় গল্প শুনাবো।”

“হ্যা মনি।কিন্তু মা?”

মিষ্টির প্রশ্নের উত্তরে শিরীন বললো, “তোমার মাহি মামার মাথা ব্যথা।তোমার মা মামাকে ওষুধ দিয়েই চলে আসবে।তুমি থাকবে আমার সাথে?”

“মামা না বাবা।মাহি বাবা।আমি থাকবো মনি।মা তুমি বাবাকে ওষুধ দিয়ে আসো।”

বাবা ডাক শুনে ঠোঁট চেপে হাসে শিরীন। বুলিটা ভালোমতই জব্দ করেছে মিষ্টি।মিষ্টির গাল চেপে চুমু বসিয়ে দেয় শিরীন।

মল্লিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “যা রেগে যাবে নাহয়।”

“বুবু আমি এখানেই থাকি?”

“চুপচাপ ঘরে যা। মিষ্টিকে দেখছি আমি।দুই দুইটা বাচ্চা একা হাতে মানুষ করেছি। পারবো না তোর মনে হয়?”

“কিন্তু বুবু।”

“যাতো চন্দ্র”

পা টিপে টিপে পাশের ঘরের দিকে পা বাড়ায় মল্লিকা।দরজা ভেড়ানো।ভেতরে সম্পূর্ণ অন্ধকার।ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় মাহরুরকে কোথাও খুঁজে পেলো না।দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে আসে মল্লিকা। আধাঁরে চোখদুটো খুঁজতে লাগলো মাহরুরকে।ঝড়ের গতিতে এক শক্তপোক্ত হাত উড়ে এসে মল্লিকাকে ভেতরে টেনে নিলো।দরজা বন্ধ করেছে। সিটকিনি লাগিয়ে মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় মাহরুর।অতি নিকটে।দেয়ালের সাথে পিঠ ছুঁই ছুঁই মল্লিকা মাহরুরের নিঃশ্বাস চিনতে ভুল করলো না।

রাশভারী গলায় আদেশ আসলো, “চুল খোল ”

“কিহ্!”

“চুলের বাধন খুলতে বলেছি”

মল্লিকাকে কোনো প্রতিক্রীয়া করতে না দেখে নিজেই হাত বাড়ায়।খোঁপা খুলে দিল একটানে।ঠান্ডা হাত ঘাড় বেয়ে মাথায় উঠে গেল দ্রুত।সঙ্গেসঙ্গে মুঠ করে ধরেছে। শক্তি প্রয়োগ করলে মল্লিকা মৃদু আর্তনাদ করে উঠে।

মাহরুর মুখটা মল্লিকার মুখের আরও কাছাকাছি এনে বললো, “খুব শখ না আমার কাছ থেকে দূরে পালানোর?বাড়িতে থাকলেও ধরা দিস না।এখানেও!সাহস কি করে হলো আমাকে ফেলে অন্য ঘরে গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করার?”

“বুবু বলেছে”

“বুবু বলেছে?তোর নিজের বুঝ শক্তি নেই?বুঝিস না আমাকে সময় দেওয়া উচিত তোর?সারাদিন অফিস করি।বিকেলে বাড়ি ফিরলে তোর কাজের শেষ থাকে না।সারাদিন অযথা হাড়ি পাতিল নিয়ে ঘষামাজা করিস।রাতে সময়টুকু পাই না।পড়ে পড়ে ঘুমাস।আমি তোকে চাই চন্দ্র এটা মাথায় ঢুকে না তোর?”

কম্পিত গলায় মল্লিকা উত্তর দেয়, “আগামীবার থেকে খেয়াল রাখবো”

“তুই এমন কেনো করিস? বলনা চন্দ্রমল্লিকা?আমাকে ভালো লাগেনা?”

নত চোখ তুলে দিলো মাহরুরের মুখপানে। ভীষন অস্থির দেখাচ্ছে তাকে।শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ ঠিক নেই।মল্লিকা নিচু গলায় বললো,

“আমার বারবার মনে হয় আমি কোনো অপরাধ করেছি।আবার বিয়ে করে মিষ্টির বাবার সাথে অন্যায় করছি নাতো?”

ব্যথিত হলো মাহরুরের হৃদয়।তবে নিজেকে সামলে নেয়।তাদের বর্তমানে তাদের দুজনের অতীত আসবেই।আজ মিষ্টির বাবা এসেছে। কাল হিরা আসবে।একটা অদৃশ্য বাঁধা থাকবে। মাহরুর নিজের সুবুদ্ধির ব্যবহার করে মাথা ঘামালো না এই বিষয়ে। পাজাকোলে তুলে নিলো তার চন্দ্রকে।দাড়িয়ে যেনো ক্লান্ত সে। মল্লিকাকে বিছানায় বসিয়ে কোলে মাথা পাতলো।

আস্তেধীরে বলতে লাগলো, “কোনো অন্যায় করছিস না।অন্যায় হতো যদি মিষ্টির বাবা বেঁচে থাকতো।আমারও অন্যায় হতো যদি হিরাকে আমি নিজে তালাক দিতাম।আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক নয় অন্য পাঁচটা সম্পর্কের মতন।কিন্তু আমরা চাইলেই পারবো।কেউ এই সত্য খন্ডাতে পারবে না ফারহান মিষ্টির বাবা।আর হিরা আমার ছয় বছরের সঙ্গিনী ছিলো।কিন্তু জানিস চন্দ্র ওই সম্পর্কে ভালোবাসা ছিলো না।সত্যি করে বল ফারহান তোকে ভালোবাসতো?”

পুরোনো স্মৃতির কথা মনে পড়লেই আত্মা কেপে উঠে।ফারহানের মল্লিকার প্রতি অনীহা,খারাপ আচরণ মনে করতে চেয়েও করলো না।মৃত মানুষের প্রতি কিসের আক্ষেপ?মল্লিকার নীরবতা বুঝলো মাহরুর।

বললো, “জীবন আমাদের পরীক্ষা নিয়েছে চন্দ্র।অনেক কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা নিয়েছে।অতীতের কিছু স্মৃতি বহন করেই জীবনে এগোতে হবে।তোর কি মনে হয় আমার মনে হয় না আমি অন্যায় করছি?কিন্তু যে অন্যায় করেছে;দেখ তাদের কোনো আক্ষেপ নেই।তারা দিব্যি আছে।তাহলে আমরা কেনো পিছিয়ে থাকবো।তুই,আমি, মিষ্টিও ভালো থাকবো সুখে থাকবো।”

উঠে বসে মাহরুর।গলার করুনতা কাটিয়ে শীতল কন্ঠ টানে।বলে,

“বাদ দে পুরোনো কথা।আমার দিকে মনোযোগ দে দেখি?”

মল্লিকা একবার তাকায়।আবার চোখ নামায়।তাকিয়ে থাকা দায় মাহরুরের চোখে।লজ্জাবতী গাছের মতন নেতিয়ে থাকে তার সান্নিধ্যে। মাহরুর হুট করে কাছে এসে নাকে নাক ঘষে দেয়।

গভীর গলায় বলে, “তোর লজ্জা আমাকে জ্বালায়।”

সাহস নিয়ে মল্লিকা বললো, “আপনি অনেক বদলে গেছেন।”

নেশা ধরে কাছে আসলে।চন্দ্রের দেহে মাতাল করা সুভাষ রয়েছে।বুকে এসে বিধে।বেহায়া চাওয়া পাওয়া টেনে নিয়ে যায়।মল্লিকার কথার জবাবে কপালে সরু অধরের স্পর্শ উপহার দেয় মাহরুর।আর কোনো কথা শুনতে ইচ্ছুক নয় মল্লিকার মুখে।তাকে নির্লিপ্ত করতেই এই পন্থা।দুরুদুরু বক্ষস্থল কাপছে। শীতলতা শিরদাঁড়া বেয়ে চলছে মল্লিকার।পেছনে ঢলে যায় বারবার।তার দুটো হাত আবদ্ধ মাহরুরের এক হাতে।

অশান্ত চন্দ্রের উদ্দেশে মাহরুর বলে উঠে মাতাল গলায়, “আমার ছোঁয়ায় অস্থির হচ্ছিস কেনো?এই ছোঁয়াতো তোর পরিচিত”

এমন কথায় মল্লিকা চটজলদি ব্যস্ত গলায় জানতে চাইলো, “কি বলছেন?আপনি কবে ছুঁয়েছেন আমায়?”

মাহরুর ঘাড় বাঁকায়।বলে, “মিষ্টির বাবা স্পর্শ করেনি তোকে?”

মাহরুরের কথায় চুপ বনে গেলো মল্লিকা।দুটো স্পর্শই ভিন্ন।মিষ্টির বাবার স্পর্শে কোনোদিন ভালোবাসা অনুভবই করতে পারেনি সে।অন্যদিকে মাহরুর হাওয়ায় ভাসায় তাকে। বাকশক্তি কেড়ে নেয়।উত্তর মাহরুরও জানে।

মাহরুর বলে উঠলো,

“আমিও অন্য নারীকে ছুঁয়েছি।তোকেও ছুঁয়েছে অন্য পুরুষ।সেই ছোঁয়া তখন পবিত্র ছিলো।এখন আমার ছোঁয়া পবিত্র মন থেকে অনুভব করবি চন্দ্র।বিরক্ত বোধ করলে চলবে না।তোর আশপাশ এখন সম্পূর্ণ আমাকে ঘিরে হতে হবে চন্দ্র।তোকে আর তোর মেয়েকে আমি সামলে নিবো।”

হাতের স্পর্শে চুলগুলো সরিয়ে নেয় মল্লিকার মুখের সামনে থেকে। চন্দ্রের শুভ্র মুখ দর্শনে বাঁধা দিচ্ছিল।ভিন্ন তার দৃষ্টি। মাহরুরের মুখটাও নজর এড়ায়নি মল্লিকার।এলোমেলো ছোট চুলগুলো ঝাঁকড়া বেধে কপালে নুয়ে আছে।আগের থেকে স্বাস্থ্যবান হয়েছে মাহরুর।ঠোঁটগুলো বাদামী। মাঝেমধ্যে ধূমপান করায় এই অবস্থা।মল্লিকা তার নির্লজ্জ চোখদুটো সরায় মাহরুরের ওষ্ঠ থেকে।

“আজ মিষ্টি নেই সাথে।তোর ভয় করছে না?আমিতো পাগল!যদি অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়ি?কি করবি? কোথায় পালাবি?”

“আমি..আমি ঘুমাবো ”

নিঃশব্দে হাসলো মাহরুর। বোকার মতন কথাবর্তা বলে এই মেয়ে।বয়স যথেষ্ট।সাথে এক বাচ্চার মা।এখনও এত জড়তা কথায়? পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে জানেনা।

“শোন?”

“হুম?”

“শাড়ি পড়বি এখন থেকে।”

“আচ্ছা”

আচ্ছা?আচ্ছা বলেই শেষ! শাড়িটা পাবে কোথায় এটাও জানতে চাইলো না। মাহরুর নিজেকে শান্ত করে। লম্বা শ্বাস টেনে ছেড়ে দেয়।বিছানার ডান দিকে সোজা হয়ে শুয়ে একহাত ছড়িয়ে রাখলো।অন্যহাতে মল্লিকাকে টেনে পাশে শুইয়ে দিলো। খুব যত্নে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,

“পুরোনো প্রেম নতুনভাবে ধরা দিচ্ছে। তুইও ডুব দিবি এই রুপসাগরে।শুধু একটু সময়ের ব্যাপার চন্দ্র।ধীরেধীরে নিজেকে তোর মধ্যে মিশিয়ে নেবো।তুইও জানবি মাহরুরের ভালোবাসার গভীরতা কতটুক”

চলবে…