Monday, August 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 250



তবুও মনে রেখো পর্ব-০৩

0

#তবুও_মনে_রেখো।[০৩]

৬,
চাকরির ইন্টার্ভিউ দিয়ে বাড়ি ফিরছে রাহনাফ। হাতে একটা ফাইল যার ভিতরে ওর শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমান। মানে সার্টিফিকেট। এই নিয়ে চারটা ইন্টার্ভিউ দেওয়া হলো। ডানহাতে গলার টাইটা একটু আলগা করে নিলো। আজকের আবহাওয়া বেশ থমথমে। আকাশে রোদের দেখা না থাকলেও গরম পড়েছে বেশ ভালোই। আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে লম্বাশ্বাস নিলো রাহনাফ। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রিক্সার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রায় বিশ মিনিট অতিবাহিত
হওয়ার পরেও কোন রিক্সা পেল না। তাই ধীর পায়ে হাটতে লাগলো। কিছুদূর আসার পরেই পরিচিত একটা মুখ দেখে দাঁড়িয়ে পরে রাহনাফ। মৃদু হেসে এগিয়ে গেলো তার কাছে।

ডিবেট ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহের। ছোটবেলা থেকেই যেকোন ডিবেটে অংশগ্রহণ করে সে। জিতেছে অনেক পুরষ্কার। পেয়েছে জাতীয় খ্যাতি। তাই ক্লাবে যে কোন ডিবেট প্রতিযোগীতার আগে তার ডাক পরে। আজও এসেছিলো তার জন্যেই। সামনেই জাতীয় স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগীতা তাই ক্লাব থেকে তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাস্তার এপাশ ওপাশ দেখতে লাগলো মেহের। তখন তার চোখ আটকে যায় রাহনাফের দিকে। রাহনাফ হাসি মুখে তার দিকে এগিয়ে আসছে। রাহনাফ মেহেরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“হাই। কেমন আছেন? ”
“ভালো। আপনি কেমন আছেন?”
“এই তো ভালো। এখানে কি করছেন?”
“ক্লাবে আসছিলাম। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“চাকরির ইন্টার্ভিউ দিয়ে আসলাম।”
“আচ্ছা” মেহের রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো রিক্সা আসছে কি না। রাহনাফ এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার মেহেরের দিকে তাকালো। আসলে এখন কি বলা উচিৎ সেটা বুঝতে পারছেনা সে। তবে কথা যে তাকে বলতেই হবে। এতদিন পর মেয়েটার দেখা পেয়েছে কিছু বলবেনা এমন হতে পারেনা। এই মুখটা একপলক দেখার জন্যে দিনরাত ছটফট করে তার মন। এত সহজে তাকে যেতে দেওয়া যাবে না। মেহেরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো কি বলা যায়। রাহনাফকে এভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেহের বলল,
“কি দেখছেন?
“আপনাকে?”
অবাক হলো মেহের। বলল,
” আজ কি প্রথম দেখছেন?”
” আপনাকে যখনই দেখি নতুন লাগে।”
“আচ্ছা।
“হ্যাঁ। চলুন সামনে হাটি এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো।
“হ্যাঁ চলুন। দুজনে পাশাপাশি হাটতে লাগলো। রাহনাফ বলল,
” গতকাল ভোরের আলো পত্রিকায় আপনার লেখা গল্প পড়ছিলো রাহি। আপনি কি লেখালেখি করেন?”
“একটু আকটু।”
“বই বের হয়েছে আপনার?”
“না । তবে খুব তাড়াতাড়ি হবে। ”
“একটা কথা রাখবেন লেখিকা সাহেবা?”
“বলেন।”
“আপনার প্রথম অটোগ্রাফটা না হয় আমায় দিবেন।”
“এখনো বই নিয়ে ভাবিনি আর আপনি অটোগ্রাফ চাইছেন?”
“আমি তো বইতে আপনার অটোগ্রাফ চাইনি।
“তাহলে কোথায়?”
রাহনাফের খুব করে বলতে ইচ্ছে করলো,
“আপনার প্রথম অটোগ্রাফটা আমাদের কাবিননামায় চাই লেখিকা সাহেবা।” কিন্তু মুখে বলতে পারলোনা। আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো শুধু। মেহের তার হাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো।মানুষটার হাসি সত্যিই অনেক সুন্দর। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো মেহের। সামনের দিকে তাকিয়ে আনমনেই হাসলো। ছেলেটা একটু বেশীই সুন্দর। আড়চোখে আপাদমস্তক দেখতে লাগলো মেহের।রাহনাফের পুরো মুখটা ঘামে একাকার। কিছু চুল কপালে লেপ্টে আছে। দাঁড়িগুলো ছোট ছোট করে কাটা। গালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। মেহেরে দৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্যে স্থির হয়ে রইলো রাহনাফের গালের দিকটায়। মনে মনে বলল,”ছেলেটার সৌন্দর্য চোখে পড়ার মতো।” মুখে বলল,
” আজ একটু বেশীই গরম।”
“বেশীক্ষণ থাকবে না। মনে হচ্ছে এখনি বৃষ্টি নামবে।”
কিছুক্ষণ পর জোরে হওয়া বইতে শুরু করলো সাথে ঝিরঝিরি বৃষ্টি। রাহনাফ আর মেহের একটা দোকানে আশ্রয় নিলো। ধীরে ধীরে বৃষ্টির বেগ বাড়তে শুরু করলো। ইলশেগুঁড়ি থেকে মুশলধারায়। মেহের হাত বাড়িয়ে দিলো বৃষ্টি বিলাশ করতে। বৃষ্টির পানি পরছে মেহেরের হাতে। মেহেরের চোখ মুখে খুশির ঝিলিক। রাহনাফ সেইদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। দেখতে লাগলো বৃষ্টিবিলাশী এই রমণীকে। মনের ভিতর থেকে কেউ যেন বলে উঠলো,
“শহর জুড়ে বৃষ্টি নামুক।তুমি খুঁজে নিও ঠাই।প্রতিটি বৃষ্টির কণায় লেখা থাকুক, শেষ অবধি তোমাকে চাই।”

৭,
প্রায় আধ ঘন্টা যাবৎ ফোর ডি মডেলের সুপার কম্পিউটারের সামনে বসে আছেন প্রফেসর খাইরুল মামুন। গভীর মনোযোগ সহকারে কম্পিটারের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। শুধু একটা সংকেত। একটা সংকেত পেলেই তার লক্ষটা আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে। তার এতদিনের স্বপ্ন আজ প্রায় পূরণ হতে যাচ্ছে। এই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে তাকে পরিবার পরিজন থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। নিজ দেশ, নিজের জন্মভূমি ছেড়ে পরে আছে ইংরেজদের দেশে। আজ প্রায় ত্রিশ বছরের কাছাকাছি হবে ভাটির দেশে পা রাখেনি। আসলে দেশে ফিরার সময়টা হয়ে উঠেনি। এবার তার লক্ষে পৌঁছালে ফিরে যাবে নিজ দেশে।

পৃথিবী বদলে গেছে অনেক। অনেক এগিয়ে গেছে বিজ্ঞানও। গ্রাম বলতে এখন আর সবুজ শ্যামল ফিরোজা রুপালি দৃশ্য মেলেনা। শহর আর নগর সভ্যতায় ধ্বংশ হচ্ছে সবুজ শ্যামল প্রকৃতি। শস্যশ্যামল মাঠ ঘাটে আজ তৈরী হচ্ছে বড় বড় কারখানা। যেখানে আর্টিফিশিয়াল কালচার মিডিয়ামে মানুষের খাবারের জন্যে শস্য উৎপাদন করা হয়। যাতে থাকে সেই পরিমান নিউট্রিসেন্স যা একজন মানুষের প্রয়োজন তার বাড়তি একটুও না। কলকারখানার ধোয়া বাতাশে কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছে। যার কারনে রোগ জিবানুর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার অন্যতম কারন হলো প্রয়োজনীয় পরিমান অরন্যের অভাব। কার্বনডাইঅক্সাইড থেকে অক্সিজেন এ রুপান্তর করার জন্যে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের পাওয়ার প্ল্যান্ট আবিষ্কার করছে। যা সূর্যের আলো আর বাতাশ থেকে কার্বনডাইঅক্সাইড শোষন করে প্রচুর পরিমানে অক্সিজেন দেয়। এই পাওয়ার প্ল্যান্ট বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে তবুও এতে যেন আমরা প্রয়োজনীয় পরিমান অক্সিজেন পাচ্ছি না। এজন্যে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর খাইরুল মামুন হক এমন একটা আবিষ্কারের কথা বলেন যা অসম্ভব কে সম্ভব করবে। যা দিয়ে পৃথীবির পুরো বায়ু মন্ডলকেই পাল্টে দেওয়া যাবে।

প্রফেসর খাইরুল মামুন হক প্রায় তেইশ বছর যাবৎ যে বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করছেন তা হলো এনএম ট্রি। Nucleus Modifier tree. যেই গাছ তার ক্ষমতা বলে পরমানুর নিউক্লিয়াস বিভাজন করে পদার্থের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের যে সিংহভাগ কার্বনডাইঅক্সাইড আছে তাকে শোষন করে অক্সিজেন বানিয়ে নিতে পারবে ওই গাছ। অবশিষ্ট কার্বনকে নিউক্লিয়াস বিভাজন ঘটিয়ে পরিণত করবে হাইড্রোজেন এ, যা থেকে পরিণত হবে পানি। শুধু তাই নয়, এই গাছগুলোর উচ্চতা রাখা হবে হাফ কিমি। ফলে এই ধরনের গাছ থেকে পৃথিবীর ধূলিঝড় থেকেও আড়াল পাওয়া যাবে।

রাত দুইটা পঁয়তাল্লিশ। প্রফেসর খাইরুল মামুন তার কম্পিটারে শেষমেশ এনএম ট্রির ডিএন এ বিটা ভার্সনের নয়শত সাতাত্তরটা বাগ ফিস্কিং করার কাজে সবে মাত্র শেষ করে ফেললেন। তার সুপার কম্পিটারের ফোর ডি মডেলে সুন্দর ভাবে দেখাচ্ছে কিভাবে সময়সাপেক্ষে বেড়ে উঠবে গাছটা। না আর কোন ভুল নেই।চার হাজার তিনশত আটাশিটা ক্রোমোজোম তাতে আরো কয়েকলাখ জিন সব নির্ভুল। এবার ঘুৃমাতে যাওয়ার পালা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন খাইরুল মামুন। লম্বা হাই তুলে ল্যাব থেকে বেড়িয়ে গেলেন।

ঘুমানোর জন্যে চোখ দুটি বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক মায়াবিনীর মুখ। মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন,

” শূন্যতা একদিন পূর্নতা পাবে ইনশাআল্লাহ। শুধু সময়ের অপেক্ষা”

উঠে বসলেন খাইরুল মামুন। সেন্টার টেবিল থেকে মোবাই নিয়ে কল দিলেন তার প্রিয়সীর নাম্বারে। দুই বার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হলো।
“কেমন আছিস রুপা?”
অতি প্রিয় সেই গম্ভীর কন্ঠটা শুনে চোখ বন্ধকরে ফেলল রুপা। চোখের কোল বেয়ে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করেই রুপা বলে,
“খাইরুল ভাই।”
বুকের বা পাশটায় তীক্ষ্ণ এক ব্যাথা অনুভব করলেন খাইরুল মামুন। দীর্ঘ সময় নিয়ে বললেন,
“রুপা।”
দুজনের বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলো। মনে তাদের হাজারো কথার ফুয়ারা কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছেনা। শুধু একে অপরকে অনুভব করায় ব্যস্ত তারা। মৌনতা ভেঙে খাইরুল মামুন বললেন,
“কি করছিস রুপা?”
” তোমার ফেরার অপেক্ষা করছি খাইরুল ভাই।”
কথাটা খাইরুল মামুনের বুকে আঘাত করলো। চোখ বন্ধ করলেন তিনি। বললেন,
” আর মাত্র কয়েকটা দিন ব্যাস। তোর এই অপেক্ষার অবসান ঘুচবে তবে।”
” অবশেষে তুমি ফিরবে?”
” ফিরতে তো আমাকে হবেই রুপা।”
” আর কতদিন অপেক্ষায় প্রহর কাটাবো আমি।”
” এইবার বসন্তে ফিরবো যে।”
” এই বসন্তে।” বলেই মৃদু হাসলো রুপা। হাসলেন খাইরুল মামুনও। রুপার হাসি মুখটা কল্পনা করলেন তিনি। বললেন
“হাসছিস রুপা।”
রুপা কিছু বললো না। এই চৌত্রিশ বছর বয়সে এসেও সে টিন এজ আরদের মতো লজ্জার মাথা নুইয়ে নিলো। চোখ মুখে লজ্জার লাভা ফুটে উঠলো। খাইরুল মামুন যেন তার লজ্জা রাঙা মুখটা দেখে ভারি খুশি হলেন। মৃদু হেসে বললেন,
“একি রুপা তুই লজ্জা পাচ্ছিস?”
“খাইরুল ভাই।”
“বিয়ের পরও কি আমায় ভাই ডাকবি?”
“তোমাকে বোধহয় আর বিয়ে করা হবেনা খাইরুল ভাই?”
“এটা কেমন কথা বলছিস রুপা?
” ভুল বললাম কি?”
” আমার দেশে ফিরার একমাত্র কারন তুই।”
“এমন কথা বলো না,যার জন্য নিজেকে আফসোস করতে হয়। মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যেতে পারে, শুধু নিতে পারে না কথার ভার, ভুলতে পারে না কথার মার। ছোট্ট একটা কথার মারেই তো কত মানুষ জীবন থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। তোমাকে ভালোবেসে দুই যুগ ধরে অপেক্ষ করছি খাইরুল ভাই। বিয়ের জন্যে তো আমৃত্যু অপেক্ষা করতে হবে। তুমি দেখে নিও খাইরুল ভাই, তোমার আর দেশে ফিরে আসা হবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন, যদি অন্তর থেকে কাউকে ভালোবাসো তাহলে বেদনা প্রাপ্তি নিশ্চিত।” এই ভালোবাসার সম্পর্কটা ঠিক দাঁড়িপাল্লার মতো। দুদিককে সমান সমান ভার না চাপালে ব্যালেন্স যেমন সমান থাকে না, তেমনি জীবনের দাঁড়িপাল্লাতো দুজনের প্রচেষ্টা আন্তরিক এবং সৎ হতে হবে না হলে ব্যালেন্স ঠিক থাকবে না। এই কারণেই সঙ্গী বা সঙ্গিনী সৎ এবং আন্তরিক না হলে আঘাতপ্রাপ্তি এবং দুর্ঘটনা ঘটা নিশ্চিত। বিশ্বাস শব্দটা খুব ছোট হলেও বাস্তবে খুব ভারী। তাই সঠিক মানুষকে বিশ্বাস না করলে জীবনে প্রতি পদে বিনা অপরাধে চরম আঘাত সহ্য করতে হয়।শরীরের সবচেয়ে মূল্যবান অঙ্গ হলো হৃদয় যেখানে স্থান পাওয়ার অধিকার সকলের থাকে না। আমি তোমাকে আমার হৃদয়ে স্থান দিয়েছি খাইরুল ভাই তাই হয়তো আমার অপেক্ষার প্রহর এত ভারী।”
“তুই কি বলতে চাইছিস, আমি তোকে তোর মতো করে ভালোবাসিনি।”
“হয়তো, আবার হয়তো না। তুমি সবসময় নিজেকে গুরুত্ব দিয়েছো। তাইতো এই আটাশ বছরে একবারের জন্যেও দেশে ফিরোনি। সবসময় বলে এসেছে আমার রিসার্চটা শেষ হলেই চলে আসবো। যেটা আজও শেষ হলো না। আচ্ছা খাইরুল ভাই তোমার গবেষণা শেষ হবে তো।”
খাইরুল মামুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
” নিজেকে নিঃশেষ করে কাউকে কিছু দিতে নেই। নিজের জন্যে কিছু রাখতে হয়। তোকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছি নিজের বলতে আছে শুধু এই স্বপ্নটা। এটা না থাকলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবরে রুপা।”
“আমি খুব বোকা বুঝলে খাইরুল ভাই। নিজের মূল্য নিজেকেই দিতে হয়। অন্যকেউ দিবে এমনটা আশা করাই বৃথা।”
” রাগ করছিস। ভালোবাসার জমিতে ভালোবাসাই চাষ হোক। অবহেলা নয়, ভালোবাসা থাক।”
অঝর ধারায় জল পড়তে লাগলো রুপার চোখ থেকে। কল কেটে মোবাইল বিছানার উপর রেখে বালিশের নিচ থেকে ডাইরি বের করলো। ডাইরিতে হাত বুলিয়ে চোখের পানি মুছে কলমের আচর কটলো,
“অভিমানী মন করে অকারণ,
আশায় এই প্রতীক্ষা।
বুঝবে একজন
তার অভিমান।
ঘুচে যাবে সব অপেক্ষা।
সময় বড় নিষ্ঠুর
সুযোগ দেয় না ভরপুর,
করে নির্মম প্রহার;
অভিমান জমে গিয়ে
প্রস্তরে রূপান্তরিত হয়ে;
আঁচড় কাটাই হয় দুষ্কর।
কত অব্যক্ত যন্ত্রণা
কত স্বপ্ন হারিয়ে যায় সময় কালে।
বোকা মন শুধু খুঁজে ফিরে তবু,
কেউ একজন আসবে বলে।
যদি আর না ফিরে আসো
আমায় তবুও মনে রেখো।”

৮,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর ওই আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে মেহের। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির ছিটা এসে পড়ছে মেহেরের চোখমুখে। সেদিকে হুস নেই তার। আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে ভাবছে এটা কি আধো হওয়ার ছিলো। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্যে সে মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। আজ সকালে আলিহানের বাড়ি থেকে মৌয়ের জন্যে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। সেখানে রাহনাফ ও তার বাবা মাও ছিলো। মূলত আলিহান আর রাহনাফরা যৌথ পরিবার।যেহেতু আলিহান আর মৌ একে অপরকে পছন্দ করে তাই কোন কথা কিংবা চাওয়া পাওয়ার বিষয়টা উঠে নি। বিয়ের দিন তারিখ সবই ঠিক হয়। আনন্দে মেতে উঠে মেহের। মৌকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“শেষ পর্যন্ত তুই ও তোর ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পাবি। আর মাত্র কয়েকটা দিন।”
মৌ লজ্জায় মাথা নিচু করে মৃদু হাসে। আলিহান সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে।তার মুখেও হাসির রেখা। রাহনাফ এবাড়িতে আসার পর থেকেই মেহেরকে দেখছিলো। মেহেরের উপর থেকে তার চোখ যেন সরছিলোই না। এই ব্যাপারটা খেয়াল করে রাহনাফের বাবা আরমান হাসান। তিনি সৈয়দা মাহবুবাকে বলেন,
“আমার কিছু বলার আছে।”
সৈয়দা মাহবুবা আরমান হাসানের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝার চেষ্টা করেন। তারপর বলেন,
“হ্যাঁ বলুন।”
আরমান হাসান একবার মেহেরের দিকে তাকান তারপর রাহনাফের কাধে হাত রেখে বলেন,
” ছেলে হিসাবে আমাদের দুটো ছেলেই রত্ন। আলিহান যেহেতু আপনার বড় মেয়েকে পছন্দ করেছে এই ব্যাপারে আমাদের পরিবারের কোন দ্বিমত নেই। তবে আমাদের এই ছেলের জন্যে আপনার ছোট মেয়েকে চাচ্ছি।”
আরমান হাসানের কথা শুনে সবাই তার দিকে তাকায়। মেহের ও রাহনাফ একে অপরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আরমান হাসান যে এমন একটা প্রস্তাব দিবে সেটা কেউই ভাবতে পারেনি। রাহি হেসে বলে,
” ভাইয়ার সাথে মেহের আপুর দারুন মানাবে।”

রাহনাফ রাহির দিকে একপলক তাকিয়ে মেহেরের দিকে তাকায়। মেহেরের চোখমুখে বিরক্তি। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সৈয়দা মাহবুবার দিকে। হয়তো সৈয়দা মাহবুবার মতামত জানতে চায়ছে সে। রাহনাফ আরমান হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” বাবা, এসব তুমি কি বলছো। আমরা এখানে আলিহানের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছি আমার জন্যে নয়।”
আরমান হাসান রাহনাফের কাধে রাখা হাতটা পিঠে নামিয়ে নেন। রাহনাফের পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন,
” কেন তোর এতে আপত্তি আছে? দেখ মেহেরকে আমার পছন্দ হয়েছে। তাই তোর আপত্তি থাকলেও শুনবোনা।”
রাহনাফ কোন জবাব দেয়না না নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার বাবার মুখের দিকে। রাহনাফের মা বলেন,
” মেহেরকে আমারও খুব পছন্দ হয়েছে। আপা আপনি না করবেন। আমার ছেলেটা খুব দায়িত্ববান। আপনার মেয়েকে যত্নে রাখবে।”
সৈয়দা মাহবুবা একবার মেহেরের দিকে তাকালেন। মেহের তখন ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেরের চোখে চোখ পড়তেন মুচকি হাসলেন সৈয়দা মাহবুবা। তারপর আরমান হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আপনাদের দুটো ছেলেকেই আমার বেশ পছন্দ। মেহেরের সাথে রাহনাফের বিয়েটা হলে মন্দ হয়না।”
সৈয়দা মাহবুবা কথা শুনে সকলে বেশ খুশি হলেন শুধু মাত্র মেহের ছাড়া। মৌ দুহাত তুলে বলল আমিন। আলিহান একহাতে রাহনাফকে জড়িয়ে ধরলো। রাহনাফের দৃষ্টি তখন অপর পাশে বসে থাকা রমণীর দিকে। মেহের চোখ ছোট ছোট করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার মায়ের এই সিদ্ধান্তে খুশি নয় সে। রাহনাফের চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্ট আরো গাঢ় করলো।

মাথায় শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে ভাবনার ছেদ ঘটে মেহেরের। কোনদিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলো কে হতে পারে। বুঝবেই না কেন? ছোট থেকে এই একটা হাতই তো তাকে আগলে রেখেছে। সুখের সঙ্গী আর বিপদে ঢাল হয়ে পাশে থেকেছে। গাঢ় অন্ধকারে দৃষ্টি রেখে মেহের বলল,
“এমন সিদ্ধান্ত কেন নিলে মা?”
সৈয়দা মাহবুবা মেহেরের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
” রাহনাফ খুব ভালো ছেলে। তোকে অনেক ভালো রাখবে।”
” কিন্তু আমি যে তার সাথে থাকার চেয়ে তোমার সাথে বেশী ভালো থাকবো মা।”
সৈয়দা মাহবুবা হাসেন। বলেন,
” স্বামির যত্ন পেলে আমায় ভুলে যাবি।”
মায়ের কথা শুনে মেহেরের রাগ হয়। গলার স্বর শক্ত করে বলে,
” কেন সবসময় শুধু অন্যের কথা ভাবো বলতো। একবার কি নিজের জন্যে ভাবতে পারোনা। মৌয়ের বিয়ে হলে এ বাড়ি ছেলে চলে যাবে। মামা ফিরে এলে রুপা খালাও চলে যাবে। আমাকেও বিয়ে দিয়ে তাড়াতে চাও। তোমার কি হবে তখন? একা একা কি করে থাকবে তুমি মা। এখন বলোনা যে, সবাই যেভাবে থাকে সেই ভাবেই থাকবে। তোমার সাথে সবার তুলনা হয়না মা। সবার জীবনে জীবন সঙ্গী আছে তোমার নেই। যৌবনে যে পুরুষ ভালোবেসে আদর করে বুকে আগলে রাখে বৃদ্ধ বয়সে সে হয় বেচে থাকার শক্তি, অবলম্বন। একে অপরের কষ্টের ভাগিদার হয় তারা। আচ্ছা মা জিবন নিয়ে তোমার আফসোস হয়না?”
মেহেরের কথা শুনে দুচোখ সিক্ত হয়ে উঠে সৈয়দা মাহবুবার। তিনি জানতেন ঠিক এই কারনেই মেহের বিয়ে করতে রাজি হবে না। কিন্তু তা কি করে হয়। বিয়ে তো মেহেরকে করতেই হবে। রাহনাফের চেয়ে ভালো ছেলে বোধহয় মেহেরের জন্যে আর পাবেনা । সৈয়দা মাহবুবা বলেন,
” আমার জিবন থেকে আমি যা পেয়েছি তাতেই খুশি। তোর মতো একটা মেয়ে পেয়েছি যে আমার সব সময় খেয়াল রাখে এটা কি আমার কম বড় পাওয়া বল।”
মেহের সৈয়দা মাহবুবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
” তোমার মতো করে তোমার খেয়াল রাখতে পারি কই? প্লিজ মা বিয়েটা ভেঙে দাও।”
“এটা হয়না মা। এমনটা বলিস না। আমাকে তোর কাছে অপরাধী করে দিস না। এখন যা ঘুমা। আর হ্যাঁ কাল কিন্তু রাহনাফের সাথে দেখা করতে যাবি।”
“মা,,,
“আমি আর কিছু শুনতে চাইনা। আমার সিদ্ধান্ত বদল হবে না। বিয়ের জন্যে তৈরী হয়ে যা।”
সৈয়দা মাহবুবা নিজের ঘরে চলে যান। মেহের দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অন্ধকারছন্ন বৃষ্টিভেজা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে,
“আমরা সবাই সার্থপর মা। কেউ নিজেকে ভালো রাখতে সার্থপর হয় আর কেউ আপনজনদের ভালো রাখতে স্বার্থপর হয়। তবে সত্যি এটাই আমরা সবাই স্বার্থপর।

পরেরদিন বিকালবেলা, মেহের বারান্দায় বসে আনা ফ্রাঙ্কের ডাইরি বই পড়ছে। বইয়ের পাতায় তার এতটাই মনোযোগ যে সেই কখন মৌ তাকে এক কাপ চা দিয়েছে যেটা এখন ঠাণ্ডা হয়ে শরবতে পরিণত হয়েছে। এখনো পর্যন্ত চায়ের কাপে এক চুমুক ও দেওয়া হয়নি। একমনে বই পড়ছে। মাঝে মাঝে নিজেকে আনার সাথে তুলনা করছে। ইহুদীদের প্রতি তৈরী করা এডলফ হিটলারের নিয়ম কানুন ওর তাদের উপর হওয়ার হিটলারের অত্যাচারের কথা যতবার পড়ছে ততবারই হিটলারের প্রতি ঘৃনায় মনটা ভরে উঠছে। আনার জন্যে কষ্ট হয় খুব। ফুটফুটে সুন্দর চঞ্চল একটা মেয়ের কি করুন পরিণতিই না হয়েছিলো। কষ্টে দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে।নিজের মনকে শক্ত করে আবার বই পড়ায় মনোযোগ দেয় মেহের।

মৌ এসে মেহেরের সামনে থেকে বইটা ছিনিয়ে নেয়। মেহেরের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায় মৌয়ের উপর রাগ হয় মেহেরের। মৌয়ের দিকে তাকিয়ে কঠিন কিছু বলবে তার আগেই মৌ বলে উঠে,
“আম্মু তোকে ডাকছে।”
“কি দরকার।”
“সেটা গেলেই দেখতে পারবি।” মিটিমিটি হাসে মৌ।
” হাসছিস কেন?”
” এমনি, এখন চল তো চল আম্মু অপেক্ষা করছে।”
মেহের আর মৌ সৈয়দা মাহবুবার রুমে যায়। মেহেরকে দেখে সৈয়দা মাহবুবা বললেন,
” আয় বস এখানে।” মেহের বিছানায় বসলো। সৈয়দা মাহবুবা আলমারি থেকে একটা কালো শাড়ি বের করে মৌয়ের হাতে দিয়ে মেহেরকে বললেন,
” গ্রীন ভিলেজ রেস্টুরেন্টে রাহনাফ তোর জন্যে অপেক্ষা করবে। মৌ এই শাড়িটা ওকে পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিবি তো।বাসায় তো সারাক্ষণ খালাম্মা সেজে থাকে। আজ একটু সুন্দর করে সাজিয়ে দিবি।”
মৌ হেসে বলে,
” তুমি একদম চিন্তা করোনা আম্মু। এমন সুন্দর করে সাজিয়ে দিবো যে আমার দেবরটা চোখই ফেরাতে পারবেনা।”
মেহের কড়া চোখে মৌয়ের দিকে তাকালে মৌ বলে,
” দেখছো আম্মু কেমন করে তাকাচ্ছে।”
সৈয়দা মাহবুবা হাসলেন। মেহেরের গালে হাত বুলিয়ে বললেন,
” তোরা যা এখান থেকে। মৌ ওকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিবি। রাহনাফ আসলো বলে।”
মৌ বলল,
” রাহনাফ কি বাড়িতে আসবে?”
” না রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করবে।”
সৈয়দা মাহবুবা মোবাইল হাতে নিয়ে বিছানায় বসেন। মৌ আর মেহের চলে যায়। রুমে এসে বিছানায় বসে জোরে জোরে শ্বাস নেয় মেহের। মৌ মেহেরের কাধে হাত রাখে। মেহের বলে,
” এই রাহনাফকে আমি ছাড়াবোনা।”
” ছাড়তে বলছে কে? ভালোবাসার শিকলে বেধে ফেল।”
মৌ হাসে আর বলে। মেহের কড়া চোখে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
” খুব মজা লাগছে তাইনা।”
“একদম। এখন উঠতো তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।”
মেহের উঠে দাঁড়ায়। তারপর রেডি হয়।
পরনে কালো শাড়ি আর খোলা চুল। দুহাত ভর্তি কালো চুড়ি কানে ঝুমকো চোখে গাঢ় কাজল। দেখতে অপরুপ লাগছে মেহেরকে। মৌ মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আজ তো রাহনাফ তোর প্রেমে পড়বেই পড়বে।”

চলবে,,,,,,
মাহফুজা আফরিন শিখা।

তবুও মনে রেখো পর্ব-০২

0

#তবুও_মনে_রেখো। [০২]

৪,
ভোরের আলো ফুটে উঠার সাথে সাথে ঘুম ভাঙে মৌয়ের। অলসতা কাটিয়ে উঠে বসে সে। কাধে হাত রেখে মাথা দুদিকে ঘুরিয়ে নেয়। পাশে তাকাতেই মেহেরের ঘুমন্ত মুখখানা দেখতে পায়। একহাত বালিশে অন্যহাত পেটের উপর রেখে ঘুমাচ্ছে। মেহেরের ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মৌ। কতটা নিষ্পাপ আর আদুরে লাগছে তাকে। মৃদু হেসে মেহেরের গাল টিপে দিলো। ঘুমের ঘোরেই নাক চোখ কুচকালো মেহের। হাত সড়িয়ে নিলো মৌ। কাল সারারাত ঘুম হয়নি তার। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেই কেটেছে তার রাত। চারদিন হলো তারা গ্রামে এসেছে। সেদিন নানার অসুস্থতার কথা শুনে সকলে গ্রামে ছুটে আসে। গতকাল আলিহানের সাথে কথা হয়েছে তার। এভাবে না জানিয়ে আসার জন্যে তার উপর বেশ রেগে আছে আলিহান। ঠিকমতো কথাও বলে নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছাড়লো মেহের। চারিদিকে তখন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। সোনার রবি দেখা যাচ্ছে পূব আকাশে। পাখিরা দল বেধে গান গেয়ে উড়ে যাচ্ছে দূর আকাশে। মৌ উঠোনে এসে দাঁড়ালো। অনেক জায়গা জুড়ে বিভিন্ন সবজি গাছ লাগানো আছে তাতে আবার হরেক রকম সবজি ঝুলছে। প্রশান্তিতে ভরে গেলো মন। শহরে এমন দৃশ্য দেখাই যায়না। যদিও কেউ কেউ ছাদে সবজির চাষ করে। তবে শহুরে মানুষ ছাদে সবজির চেয়ে ফুলের চাষ করতে বেশী পছন্দ করে। মৌ পুরো বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলো এমন সময় পিছন থেকে মামি বললেন,
” এত সকাল সকাল বাগানে কি করস মৌ।”
” কিছু না মামি। এমনি ঘুরে দেখছিলাম।” মৃদু হেসে জবাব দিলো মৌ।”
” সেই যে শহরে গেলি আর তোর দেখা পাওন গেলো না। রবিন মাঝে মাঝে আইসা আমাদের উপর চেঁচামেচি করতো। তোর ঠিকানা চাইতো।”
মামির কথা শুনে মৌ’য়ের হাসি মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলে। মৌ বলল,
” আমার ঠিকানা দিয়ে সে কি করবে?”
” তোরে ফিরিয়া আনবার চাইতো। ওর নাকি তোরে ছাড়া ভালো লাগে না এখন। একা একা কার ভালো লাগে?”
মৌয়ের ভালো লাগছিলো না এসব কথা শুনতে। সে মামিকে বলল,
” যখন কাছে থাকতে চেয়েছিলাম তখন কেন দূরে সড়িয়ে দিলো? তখন সে আমার কথা ভাবেনি।”

কথা শেষ করে উল্টোদিকে রাস্তায় হাটতে থাকে মৌ। পুরোনাম সামিরা জান্নাত মৌ। এটাই ওর গ্রাম। এখানে জন্ম এখানেই শৈশব কাটিয়েছে সে। মৌয়ের মা শাকিলা আর মাহবুবা ছেলেবেলার বন্ধু। শাকিলা আর রবিন একে অপরকে ভালোবেসে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করে। বছর তিন যেতেই সন্তানসম্ভবনা হয় শাকিলা। শাকিলা বয়স তখন কত? ষোলো কিংবা সতেরো। গর্ভঅবস্থায় নানা জটিলতা দেখা দেয় তার। ডক্টর তাকে গর্ভপাত করাতে বলে না হলে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি আছে। রবিন রাজি হলেও রাজি হয়না শাকিলা। সে সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবে জেদ করে বসে। এটা নিয়ে অনেক ঝামেলাও হয় শাকিলা আর রবিনের মাঝে। তাদের এই ঝামেলার ইতি ঘটে মৌয়ের জন্মের সময় শাকিলার মৃত্যু দিয়ে। সদ্য জন্ম নেওয়া মৌ তার বাবার কাছে হয়ে উঠে মায়ের খুনি। মুখও দেখেনি রবিন তার নবজাতক সন্তানের। শাকিলাকে হাড়িয়ে রবিন হয়ে উঠে পাগল প্রেমিক। দিনের বেলা রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে রাখতো কারো সাথে কথা বলতো না আর রাতভর মদ খেয়ে কখনো পরে থাকতো রাস্তার ধারে আবার কখনো তাকে পাওয়া যেতো শাকিলার কবরের পাশে। তখন সেই নবজাত শিশু মৌকে মাহবুবা আর নওশাদ বুকে টেনে নেয়। তাকে আদর স্নেহ দিয়ে বড় করতে থাকে। তার দুবছর পর মাহবুবা সন্তানসম্ভবনা হয়ে পরে। সেই অবস্থায় নওশাদও তাকে ছেড়ে চলে যায়। এলোমেলো হয়ে যায় মাহবুবার জিবন। বাড়ির এক কোনে অনাদরে অযত্নে বড় হতে থাকে মৌ। মৌ এর বয়স যখন ছয় বছর তখন সে তার বাবার কাছে চলে যায়। রবিনের তখনো মেয়ের উপর থেকে রাগ পরেনি। সে কারনে অকারনে মৌয়ের গায়ে হাত তুলতো। ঠিকমতো খেতে দিতনা।তাই ফিরে আসে মাহবুবার কাছে মৌ। তারপর একদিন মাহবুবা তাকে আর মেহেরকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমায় শহরের বুকে। সেখানে সে সৈয়দা মাহবুবার সন্তান হিসাবে বড় হয়ে উঠে। ভালোই কাটছিলো তাদের শহুরে জিবন। সৈয়দা মাহবুবা যখন চাকরি জয়েন করলো তখন তাদের দেখা শুনার জন্যে একজন মাধ্যবয়স্ক মহিলাকে রাখা হলো। কারন দুটো বাচ্চা বাড়িতে একা রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। সারাদিন খেলাদুলা আর খুনসুটিতে কেটে যাচ্ছিল তাদের সময়। সময় প্রবাহমান, সে বদলায়। কারো জন্যে থেমে থাকেনা। বড় হতে লাগলো মৌ আর মেহের একে অপরের বোন, বন্ধু হয়ে। একদিন হঠাৎ করেই রুপা ব্যাগপত্র নিয়ে হাজির হয় সৈয়দা মাহবুবার বাড়ি। সৈয়দা মাহবুবা তখন মৌ আর মেহেরকে পাড়াচ্ছিলেন। রুপাকে দেখে মেহের আর মৌ যেমন খুশি হয়েছে তেমনি অবাক হয়েছিলেন সৈয়দা মাহবুবা। তিনি ওদের দুজনকে নিজেদের ঘরে যেতে বললে ওরা চলে যায়। রুপা সৈয়দা মাহবুবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
” তোমার এই চোট্ট বাড়িটায় আমার আশ্রয় হবে না আপা? ”
সৈয়দা মাহবুবা অবাক হয়নি। সে রুপাকে একনজর দেখে বললেন,
” বাড়িতে ফিরে যায় রুপা। এটা তোর পাগলামির বয়স নয়।”
” আমি আর ওই বাড়িতে যাবো না আপা।”
” কেন যাবিনা।”
” সবাই আমাকে বিয়ের জন্যে জোর করছে কিন্তু তারা জানেনা আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। খাইরুল ভাইকে আমি কথা দিয়েছি আপা। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে আমি বিয়ে করবো না।”
” খাইরুল কি তোকে কথা দিয়েছে?
” না। সে শুধু জানতে চেয়েছে, আমি অপেক্ষা করতে পারবো কি না।”
” কতদিন?”
“বলেনি।”
“তাহলে কার জন্যে অপেক্ষা করবি তুই রুপা। কিসের উপর ভরসা করে থাকবি তুই?”
” আমার ভালোবাসার উপর। সে কোন দিন ফিরে না আসলেও আমি অপেক্ষা করবো। ভলোবাসি তাকে। আপা, দেখো আমার এই প্রতিক্ষাই তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে।”
সৈয়দা মাহবুবা কিছুক্ষণ রুপার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কতটা বিশ্বাস ভরসা নিজের ভালোবাসার উপর। অথচ কোনদিন হাতে হাত রেখে হাটেনি একাকি নির্জন রাস্তায়, ঘুরেনি কোনদিন বসে হুডখোলা রিক্সায়। চোখে চোখ রেখে কখনো বলা হয়নি ভালোবাসি প্রিয় তোমায়। তবুও কতটা বিশ্বাস করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সৈয়দা মাহবুবা।

__________________
মেহেরের ঘুম ভাঙে মুঠোফোনের শব্দে। বিছানা হাতরে মোবাইল হাতে নিয়ে স্কিনে তাকায়। স্কিনের উপর জ্বলজ্বল করছে মামু নামটা। ঘুম ছুটে যায় মেহেরের। অধরে ফুটে হাসি। কল রিসিভ করে অভিমানী সুরে বলে,
” এতদিনে আমার কথা মনে পরলো তোমার মামা?”
“ব্যস্ত ছিলাম।”
“তুমি তো সমসময়ই ব্যস্ত থাকো।”
“হ্যাঁরে পাগলি। কেমন আছিস বল?”
” ভালো আছি মামা। তুমি দেশে আসবে না? প্লিজ মামা ফিরে এসো। রুপা খালা আজও তোমার অপেক্ষায় দিনগুনে।”
ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন খাইরুল মামুন। বলেন,
” রুপাকে বলে দিস, সে যেন আমার জন্যে আর অপেক্ষা না করে।”
“কেন করবে না মামা? তুমি কি তাহলে আর আসবেনা?”
“জানিনা।”

খাইরুল মামুনের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় মেহের। মেহেরের খুব কষ্ট হয়। কষ্টে চোখে জল আসে। মামা তাহলে আসবে না। রুপা খালা কি তাহলে সারাজীবন শুধু অপেক্ষা করেই যাবে। বুকের ভিতরে ভিষন যন্ত্রণা অনুভব করে মেহের। রুপা খালাকে সে কি বলবে? মামা আর কখনো ফিরে আসবে না তুমি বিয়ে করে নাও। না। এটা বলতে পারবেনা মেহের। আগে যখন মামা বলতো সে খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসবে তখন দৌড়ে গিয়ে রুপাখালার গলা জড়িয়ে বলতো মামার দেশে আসার কথা। রুপা খালা লজ্জা পেতো তখন। লজ্জায় মুখ ঢাকতো দুহাতে। মেহের তাকিয়ে থাকতো রুপা খালার মুখের দিকে। লজ্জা পেলে তাকে কত সুন্দর দেখায়। দেখতে খুব ভালো লাগে। মনে মনে ভাবে মেহের, মামাকে তো ফিরে আসতেই হবে না হলে রুপা খালার কি হবে? তাকে কে বিয়ে করবে। রুপা খালার কথা ভাবলে তার কষ্ট হয় খুব। মেহের বলে
” পরিবারের থেকেও কি তোমার কাজ বেশী আপন মামা?”
“এটা আমার স্বপ্ন।”
“আর রুপা খালা?”
” আমার ভালো থাকার কারন।”
“তাহলে সব ছেড়ে চলে আসছো না কেন?”
” আমার হাত পা যে বাধা। স্বপ্ন ছুতে ন। পারলে মরেই যাবো হয়তো। এত সময় পরিশ্রম অপেক্ষ আশা আকাঙ্ক্ষা সব বিফলে যাবে।পারবোনা আমি।”
” কেন পারবেনা মামা?”
” যে স্বপ্ন পূরণ করতে পাড়ি দিয়েছি হাজার মাইল সেটা অপূর্ণ রাখি কি করে?”
“স্বপ্ন, এই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে এতগুলো বছর পারিবার পরিজন এমনকি নিজের একান্ত প্রিয় মানুষটার থেকে দূরে আছো তুমি। তুমি ভালো আছো তো মামা?”
“হ্যাঁ, ভালো আছি।”
“কিভাবে? এই তো বললে তোমার ভালো থাকার কারন রুপা খালা। সে তো আমার কাছে নেই।”
“আমি হাজার মাইল দূরে থেকেও জানি রুপা আমার। তাহলে আমার ভালো না থাকার কারন আছে কি?”
জবাব দিতে পারলো না মেহের। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল রুপা আসছে। মেহের রুপাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“খালা এসো। বসো আমার পাশে।”
রুপা মেহেরের পাশে গিয়ে বসলো। জিগ্যেস করলো,
” কার সাথে কথা বলিস?
“মামা, তুমি কথা বলবে? এই নাও। মোবাইল রুপার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “তোমরা কথা বল আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।” রুপাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহের ওয়াশরুমে চলে যায়। এদিকে রুপা মোবাইল হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নির্বিকার বসে থাকে। রাগ হয় মেহেরের উপর। কি দরকার ছিলো ওকে মোবাইল ধরিয়ে দেওয়ার। লম্বা শ্বাস নিয়ে মোবাইল কানের কাছে ধরে বলে,
“হ্যালো।”
” কেমন আছিস রুপা?”
“তুমি যেমনটা রেখছো?”
” কেন এত অপেক্ষা করছিস?”
“সেদিন কি বলেছিলে মনে আছে তোমার?”
“সেদিনের কথা ধরে আজও বসে আছিস?”
“কেন থাকবো না।”
“তখন আবেগের বসে অনেক কথাই বলেছি। এখন আর কোন আবেগ নেই। তুই বিয়ে করে নি রুপা।”
“লোকে হাসবে।”
“কেন?”
“আমার বয়স কতো জানো? চৌত্রিশ বছর। এই বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসলে লোকে হাসবে।”
“যদি আমি কখনো তোর সামনে এসে দাঁড়াই তাহলে আমাকে বিয়ে করবি রুপা। নাকি লোক লজ্জায় ভয়ে পালিয়ে যাবি?”
” তোমার মতো বুড়োকে আমি বিয়ে করবোনা।”
“তাহলে অপেক্ষা করছিস কেন?”
” জানিনা।”
“বিয়ে করেনি রুপা। আমার জন্যে অপেক্ষা করিসনা। আমি শূন্যহাতে ফিরবো না।”
“তুমি পূর্ণতা পাও খাইরুল ভাই। আর আমাকে পূর্ণতা দাও। তোমার অর্ধাঙ্গিনী রুপে আমায় পূর্ণতা দাও খাইরুল ভাই।

৫,
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নিকোটিনের ধোয়া উড়াচ্ছে রাহনাফ। দু আঙুলের মাঝে সিগারেট নিয়ে ফুঁকছে আর মুখের ধোয়া উড়িয়ে দিচ্ছে উপরের দিকে। উপরের উঠতে গিয়ে অন্ধকারের মিলিয়ে যাচ্ছে সে ধোয়া। আজকের আকাশটা একটু বেশীই কালো। ঘন কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত আকাশ। আকাশে আজ চাঁদের দেখা নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটা নিচে ফেলে দিলো। দুচোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা মেয়ের প্রতিচ্ছবি। মেহের। হ্যাঁ, এই মেহেরকেই সে দেখেছিলো প্রফেসর খাইরুল মামুন হক এর ল্যাপটপে। দিনটা ছিলো রবিবার। ইউনিভার্সিটি অফ বাসাতেও কোন কাজ নেই তাই সে প্রফেসর খাইরুল মামুন হক এর ল্যাবে যায়। রাহনাফ ছিলো তার প্রিয় ছাত্র তার উপর বাঙালি এজন্য বোধহয় স্যার তাকে একটু বেশীই পছন্দ করতেন। স্যারের ল্যাবে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছে রাহনাফ। সেদিন গিয়েছিলো খাইরুল স্যার যে নিউক্লিয়ার গাছ নিয়ে গবেষণা করছেন সেটা সম্পর্কে জানতে। রাহনাফ যখন ল্যাবে পৌঁছালো তখন খাইরুল স্যার তার ফাইভ জি কম্পিউটারের সামনে বসে কিছু করছিলেন আর তার পাশেই তার পুরনো ল্যাপটপের স্কিনে দেখা যাচ্ছিলো একটা মেয়ের ছবি। একটু ভালো করে খেয়াল করে দেখতে পেল তখন ভিডিও কনফারেন্স চলছিল। স্যার কাজ করছিলেন আর মেয়েটা দেখছিলো। রাহনাফ প্রথমে ভেবেছিল মেয়েটা হয়তো তাদের ডিপার্টমেন্টের কোন স্টুডেন্ট হবে। সে সেখানেই দাড়িয়ে দেখছিলো মেয়েটাকে। এমন মায়াবিনী মুখ ছিলো মেয়েটার যে রাহনাফ শুধু মেয়েটাকেই দেখে যাচ্ছিলো। পরে তাদের কথোপকথন থেকে বুঝতে পারলো মেয়েটা বাংলাদেশের। আর সে জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ার ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট নয়। সে তো বিজ্ঞানই পছন্দ করেনা। তার পছন্দ ইতিহাস। সেদিন সেই এক ঝলক দেখার পর মেয়েটা তার মনের গভীরে এমনভাবে ভালোলাগার বীজ বপন করেছে যে রাহনাফ ইংল্যান্ড ছেলে ভাটির দেশে চলে আসে। তবে রাহনাফ কি জানতো এত সহজে তার দেখা পাবে? সেদিন আলিহানের সাথে ওর হবু শ্বশুর বাড়ি গিয়ে মেহেরকে দেখে খুব অবাক হয়েছিলো। স্যার বলেছিলেন, মেহের তার একমাত্র ভাগ্নি তাহলে মৌ? মৌ কে? বেশী ভাবতে পারলোনা রাহনাফ। গভীর ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে রাহনাফ বলে,

“ভালোবাসি, বাগানের ঝরে যাওয়া ফুল। ভালোবাসি,
মেঘলা নদীর কুল। ভালোবাসি, উড়ন্ত এক ঝাক পাখি।
ভালোবাসি, তোমার ওই দুই নয়নের আখি।”

রাহনাফের ভাবনার মাঝেই বেলকনিতে আসলো আলিহান। আলিহান রাহনাফের কাধে হাত রেখে জিগ্যেস করলো,
” পাগল প্রেমিক। মেয়েটার কথা ভাবছিস?”
“হ্যাঁ।”
আলিহান রাহনাফের কাধ থেকে হাত সরিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো। বুকের উপর হাত ভাজ করে বলল,
” সারাক্ষণ শুধু মেয়েটার কথা ভাবেই যাবি। মেয়েটার খোঁজ করবিনা।”
“না।”
“যার জন্যে সুদূর যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে চলে আসলি তার খোঁজ করবি না। আচ্ছা তোর মাথায় চলছে টা কি?”
” আমার ভালোবাসার টানে সে নিজেই ছুটে আসবে।”
” ও আচ্ছা তাই নাকি। তা সে কবে আসবে শুনি?”
“তুই তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে নি তাহলেই তোর আমার রাস্তা ক্লিয়ার।”
“তাহলে আমি তোর পথের কাটা।”
” হুম।”
আলিহান রেগে যায় রাহনাফের কথায়। সে রেগে জিগ্যেস করে,
” মেয়েটা কে শুনি?”
“তোর শালিকা।”
“শালিকা মানে! মেহের।” আশ্চর্য শুনায় আলিহানের কণ্ঠস্বর।
“হ্যাঁ, মেহের। এত অবাক হচ্ছিস কেন?”

রাহনাফ বেলকনি ছেড়ে রুমে চলে আসে। আলিহান সেখানেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু একটা মনে পরতেই সে রুমে চলে আসে।রাহনাফ তখন ওয়াশরুমে ছিলো। আলিহান বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে। রাহনাফ ওয়াশরুমে থেকে চুল মুছতে মুছতে বের হয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে থাকা আলিহানকে একপলক দেখে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিছানা থেকে আলিহান বলে,
” মৌ একবার বলেছিলে ওদের মামা ইংল্যান্ডের এক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।”
” হ্যাঁ ওদের মামাই প্রফেসর খাইরুল মামুন হক।”
“তুই তো বলেছিলে প্রফেসরের একমাত্র ভাগ্নির প্রেমে পরেছিস।”
“এখানে আসার আগ পর্যন্ত আমিও সেটাই জানতাম।”
বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে টিশার্ট ঝাড়া দেয় আলিহান। রাহনাফের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
” প্রেমে পরার মতো আর কোন মেয়ে পাইলি না। শেষ পর্যন্ত আমার শালিকার প্রেমেই পরতে হলো। যাই হোক আমি যাই ঘুম পাচ্ছে।”
রাহনাফ আলিহানের দিকে ঘুরে বলে,
“আজকের রাতটা এখানে থাক। ছোট বেলার মতো একসাথে ঘুমাই দুই ভাই।”
“ওকে।” জাম্প দিয়ে বিছানায় শুয়ে পরে আলিহান। রাহনাফ মৃদু হেসে লাইট বন্ধকরে আলিহানের পাশে শুয়ে পরে।

সকালবেলা আফিয়া বেগমের ডাকে ঘুম ভাঙে রাহনাফের। দুহাতে চোখ কচলে উঠে বসে। আফিয়া বেগম কফির মগ সেন্টার টেবিলে রেখে রাহনাফের পাশে গিয়ে বসলেন। আদুরে হাতে রাহনাফের মাথায় হাত বুলিয়ে জিগ্যেস করেন,
“ঘুম কেমন হয়েছে?”
রাহনাফ মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে,
“ভালো।”
আফিয়া বেগম রাহনাফের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
” তোর বাবা একটা মেয়ে দেখছে তোর জন্যে। আমরা সবাই মেয়েটার ছবি দেখেছি ভারি মিষ্টি মেয়ে। আমাদের সকলের পছন্দ হয়েছে। এবার তোর পছন্দ হলেই কথা বলবো। আমরা চাই আলিহান আর তোর বিয়েটা একদিনেই হোক।”
রাহনাফ উঠে বসলো। মায়ের মুখোমুখি বসে বলল,
” আগে চাকরির খোঁজ করি তারপর নাহয় বিয়ের কথা ভাবা যাবে।”
” চাকরি পরেও পাওয়া যাবে।”
“তা যাবে কিন্তু বিয়ে করে বউকে খাওয়াবো কি?”
“আমাদের কি কোন অভাব আছে যে তুই বউকে খাওয়ানোর কথা ভাবছিস।”
“তা নেই তবে যখন কনে পক্ষের লোক প্রশ্ন করবে ছেলে কি করে কখন কি বলবে, ছেলে শিক্ষিত বেকার। বাবার ঘাড়ে বসে খায়।”
“তোর সাথে তর্কে পারবো না কখনোই।”
“তর্ক না এটা যুক্তি।
“হয়ছে হয়ছে। উঠে দাঁড়ান আফিয়া বেগম। বলেন,
“ফ্রেশ হয়ে নিয়ে আয় সবাই অপেক্ষা করছে এক সাথে নাস্তা করবি।”

চলবে,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

তবুও মনে রেখো পর্ব-০১

0

#তবুও_মনে_রেখো। [০১]
#মাহফুজা আফরিন শিখা।

১,
ভোরের আলো ফুটে উঠার সাথে সাথে ঘুম ভেঙে যাওয়া সৈয়দা মাহবুবার বরাবরের অভ্যাস৷ বিছানায় বসে আযানের জবাব দিয়ে বিছানা ত্যাগ করেন। তারপর অজু করে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষ হলে বেলকনিতে চলে যান।এই সময়টায় তিনি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নীরব আকাশের সাথে মনের কথা বলেন। সময়টা তার নিজের , একলা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে জিবনের সমস্ত হিসাব নিকাশ করে।জিবনের অর্ধেকটা সময় তার গ্রামেই কেটেছে তাইতো শহুরে হাওয়া তার এতদিনের অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারেনি। তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে অতীতের কথা ভাবেন। নওশাদ যে তাকে ছেড়ে চলে গেছে মাঝে মাঝে এই কথাটা মন মানতেই চায়না৷ কি করেই বা মানবে! নওশাদ যে তার স্বামী, প্রথম প্রেম তাকে ভুলে যাওয়া কি এতটাই সহজ। নওশাদ তাকে নাই ভালোবাসলো সে তো ভালোবেসেছিল, মন প্রান উজার করে ভালোবেসেছিল৷ তাইতো কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা অভিনয় সেটা টেরও পায়নি সৈয়দা মাহবুবা৷ তবে এসবের জন্যে তিনি নিজেকেই দোষ দেন বরাবর। তিনি মনে করেন নওশাদকে নিজের কাছের ধরে রাখার ক্ষমতা তার ছিলোনা৷ দোষ তার নিজের৷ সে ভালোবাসতে পারেনি। না হলে নওশাদ কেন তাকে সন্তানসম্ভাবনা অবস্থায় ছেড়ে চলে যাবে? নওশাদের চলে যাওয়ার পর কতটা একা হয়ে পড়েছিল সে৷ প্রসবকালে যে মানুষটাকে তার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন ছিলো সেই পাশে ছিলো না কত কষ্টে দিন কেটেছে। সেদিনের ঊনিশ বছরের যুবতী থেকে আজ এখানে একজন সু’প্রতিষ্ঠিত নাগরিক হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে তাকে কম অপমান লাঞ্জনা সহ্য করতে হয়নি৷ মাঝে মাঝে এইসব কথা ভেবে দু’চোখের কোল ভরে আসে সৈয়দা মাহবুবার৷ তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে শাড়ির আচলে চোখ মুছেন সৈয়দা মাহবুবা। তাকে কাঁদলে চলবে না। তার চোখে অশ্রু মানায় না৷ সে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের মা৷ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধা হলেন একজন না। যে সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারেন। বাড়ির ভিতরে সে মা আর বাহিরে বাবা। মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই জিবনের সমস্ত না পাওয়ার কথা ভুলে যান তিনি৷ তার আর নওশাদের একমাত্র কন্যা মেহেরের মুখের দিকে তাকালেই বুকটা ধুক করে উঠে তার। মেহের একদম বাবার রুপ পেয়েছে৷ গায়ের রংটা নওশাদের চেয়ে একটু চাপা হলেও মায়াবী তার মুখখানা৷ এই মেয়েকে নিয়েই তার জিবন৷ জিবনের এই পাওয়া না পাওয়া ব্যর্থতার মাঝে মেহের যেন তার একটুকরো স্বর্গ। মেহের শুধু দেখতেই বাবার মতো হয়নি রাগ জেদ আর বুদ্ধিতেও নাওশাদের চেয়ে কম নয়৷ মেহেরের বয়স যখন সাত বছর তখন নওশাদের সাথে তার প্রথম দেখা হয়। বাংলা সিনেমার বাবাদের মতো সেও মেহেরকে নিজের কাছে টেনে নিতে চায়৷ মেহের সেদিন নওশাদের কাছে যায়নি। আসলে সে চিনতেই পারেনি এটা তার বাবা।নওশাদ সেদিন কেঁদেছিল। মেয়ের এমন প্রত্যাখান সে মেনে নিতে পারেনি৷ তারপর থেকে রোজ আসতো মেহেরের স্কুলের সামনে তাইতো গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে শহরের বুকে৷ তারপর আর গ্রামে পা দেওয়া হয়নি। মেহের আজ বিশ বছরের কুমারী মেয়ে৷ মেয়েকে নিয়ে বড্ড চিন্তা সৈয়দা মাহবুবার৷ বাবার প্রতি রাগ আর ঘৃনায় পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে মেহের। এখনো পর্যন্ত তার কোন ছেলে বন্ধু নেই। ভুলেও কখনো বাবার কথা বলেনা। এমনকি মেহেরের সামনে যখনি নওশাদের কথা উঠে তখনি রেগে যায়। তাই এই বাড়ির কেউ কখনো নওশাদের কথা তুলে না। অতীতের কথা মনে হলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সৈয়দা মাহবুবা। সূর্যের আলো পৃথীবির বুকে ছড়িয়ে পরতেই বেলকনি ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান। তারপর সকলের জন্যে নাস্তা তৈরী করেন। সৈয়দা মাহবুবা এবং মেহের ছাড়াও এই বাড়িতে আছে আরো দুজন, রুপা এবং মৌ। রুপা সৈয়দা মাহবুবার মামাতো বোন আর মৌ, বন্ধুর মেয়ে।

রুপার ডাকে ঘুম ভাঙে মেহেরের। চোখ কচলে হাই তুলে উঠে বসতেই সামনে রুপাকে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে ফেলে মেহের। প্রশ্ন করে,
” তুমি সকাল সকাল আমার রুমে কি করছো? মৌ কোথায়?”
” ঘুমাচ্ছে।”
“কোথায়?”
” নিজের রুমে। তোর সাথে রাতভর ভুতের মতো ঘুরবে নাকি।”
দুহাতে মাথার চুল বাধতে বাধতে মেহের বলে,
” একা একা কাজ করছিলে তাই কোম্পানি দিতে এলাম। এখন আমাকেই কথা শুনাচ্ছো। তাই বলি করো ভালো করতে নেই।”
মেহের চলে যায়। রুপা ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে টেবিলের উপর পরে থাকা খাতাগুলো গুছিয়ে নেয়।

_____________
মৌ ঘুমাচ্ছে। পাশেই ওর মোবাইল ভাইব্রেট করছে। বিছানা হাতরে একটা বালিশ খুঁজে নিয়ে সে মাথার উপর রেখে বলল,
“মেহু তোর ফোন বাজছে। তাড়াতাড়ি রিসিভ কর আমার ঘুমের বারোটা বাজাস না।”
রুমে প্রবেশ করার সময় মৌ’এর কথা শুনে মেহের বলে,
” আমার না তোর ফোন বাজছে।”
” এই সকাল সকাল আবার কার কি হলো।”
” তোর গুড মর্নিং চুমু বাকি পরছে। তাড়াতাড়ি উঠ আর দিয়ে দে। নাহলে বেচারা আলিহান আবার বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না।”
ঘুম ভাঙে মৌ’এর। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। একটা বালিশ মেহেরের দিকে ছুঁড়ে বলে,
” ছি, মেহু এসব কি কথা বলছিস।”
মেহের বালিশ ধরে বিছানায় রাখে। বলে,
“আমি বললে ছিঃ তাইনা। নিজেরা যখন মোবাইলে চুমু ছোড়াছুড়ি করো তখন কিছুনা।”
” চুমু ছোড়াছুঁড়ি করে কেমনে।”
মেহের মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কল রিসিভ কর আগে।”
মৌ কল রিসিভ করে।ওয়াশরুমে চলে যায় মেহের। ওদের এই প্রেম আলাপনের মাঝে সে থাকতে চায়না। ভিডিও কলে কথা বলার সময় আলিহান মাঝে মাঝে ফ্লাইং কিছ দেয় আর মৌ তখন লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে। মৌ’য়ের সামনে থেকে মৌকে লজ্জায় ফেলার কোন ইচ্ছেই নেই মেহেরের। মেহের চলে যেতেই মৌ বলে,
” এত সকাল সকাল কি বলবে বলো। আমার ঘুম হয়নি ঘুমাবো।”
“ভাবি আমি রাহি বলছি। ” মোবাইলের স্কিনে একটা মেয়ের ছবি দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে মৌ। প্রশ্ন জাগে মেয়েটা কে? ভাবি কথাটা মাথায় আসতেই নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে মৃদু হাসে। ওপাশ থেকে মেয়েটা বলে,
” কেমন আছো ভাবি?”
” ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
” ভালো। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলো তোমাকে দেখার। ভাই কখনো নিয়ে যায়নি আমাকে। তাই আজ সকাল সকাল তোমাকে বিরক্ত করলাম। নাও ভাইয়ের সাথে কথা বলো।”
মৌ আর কিছু বলার সুযোগ পেলনা। মেয়েটা আলিহানের হাতে মোবাইল দিলো। মৌ আলিহানকে জিগ্যেস করলো,
” মেয়েটা কে?”
” আমার ছোট বেলার গার্লফ্রেন্ড।”
” মানে।”
” আমার কাজিন রাহি।”
“আচ্ছা তাই বলো। আমি ভাবলাম,,,
“কি ভাবছিলে, সত্যিকারের গার্লফ্রেন্ড। হা হা হা।”
” না ঠিক তা নয়। এখন রাখছি।”
” দেখা হচ্ছে বিকালে।”

২,

বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছেন সৈয়দা মাহবুবা। মিষ্টি কালারের শাড়ি পরে গায়ে কালো শাল জড়িয়ে রেখেছেন।মাথায় চুলগুলো খোপা করা। সামনের কিছু চুলে পাক ধরেছে তার। চুলে পাক ধরাকে অনেকেই বয়সের ছাপ হিসেবে ধরে নেয়। বয়স বাড়লে চুল পাকবে এটাই স্বাভাবিক। আবার অনেকেই বলে থাকে অভিজ্ঞায় চুল পাকে। আজকাল চোখেও ঝাপসা দেখেন তিনি। তাই পাওয়ারওয়ালা চসমা পরেছেন। উচ্চমাধ্যমিকের অংকের শিক্ষিকা তিনি। ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরছেন। বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখদুটি বন্ধ করে নেন সৈয়দা মাহবুবা। মনে পরে তার সে বিষাদময় অতীতের কথা। নওশাদের সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর বাড়ির সবাই বিয়ের জন্যে চাপ দিতে থাকে তাকে। তখন সৈয়দা মাহবুবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করা নিয়ে আপত্তি করলে কেউ আর কখনো তাকে বিয়ে কথা বলেন না। কিন্তু গ্রাম বাসিরা তার নামে নানা কথা রটাতে থাকে। মেয়ের দোষ আছে বলেই স্বামি তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কেমন মেয়ে স্বামিকে নিজের কাছে রাখার ক্ষমতা নাই। প্রথমে খারাপ লাগলেও কিছু বলতেন না সৈয়দা মাহবুবা। কারন যারা সামনে এসে দু একটা সান্তনার বাণী শুনায় দূরে গিয়ে তারাই সমালোচনা করে। সকলের তিক্ত কথা হজম করে নেন। সবার সব অপমান মুখ বুঝে সহ্যকরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিলতিল করে বড় করেছেন তিনি মেহেরকে। আর মেহেরকে বুঝিয়েছেন এক দিন এই সমাজও তাদের সম্মান দিবে। বড় করে শ্বাস ত্যাগ করেন সৈয়দা মাহবুবা। আজ তার সব কষ্ট সার্থক। তিনি এখন গর্ব করে বলতে পারবেন,

– আমি স্বতঃস্ফূর্ত, স্বতন্ত্র একজন নারী। একজন একক মা। একটা সুন্দরী কন্যার মা আমি, যাকে আমি একা হাতে লালন পালন করেছি। এবং একজন চল্লিশ বছরের মহিলা যে এই বাংলাদেশের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক। হ্যাঁ আমি গর্ব করে বলতে পারি, আমি তাকালপ্রাপ্ত একজন মেয়ে। আমার জিবন এবং শরীরের ত্রুটি রয়েছে।”

জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না। তাই, মা হওয়ার পর যদি বিবাহবিচ্ছেদ কিংবা বৈধব্যের অঘটন ঘটে, তাহলেও বিরহে অশ্রুবিসর্জন নয়, একলা মা হয়েও দায়িত্ব নিয়ে পূর্ণ আনন্দ উপভোগ করা যায়। এমন উত্তরণের কাহিনি বহু ছবিতেই তুলে ধরা হয়েছে।আমাদের সমাজ আজও সিংগল মাদার-এর বিষয়টিকে খুব সহজে মেনে নিতে পারেনি। সন্তানকে বড়ো করার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে, পুরুষের সাহায্য ছাড়া মহিলারা অক্ষম বলে মনে করে আমাদের সমাজ। হাজারো প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয় একলা মায়েদের। অবশ্য, সিংগল মাদার হওয়া কঠিন জেনেও, শুধু মনের জোরে লড়াই জারি রেখেছেন অনেকে। তার অন্যতম উদাহরণ হলো সৈয়দা মাহবুবা। সৈয়দা মাহবুবা যেদিন প্রথম মেহেরকে স্কুলে ভর্তি করাতে যান তখন সেখানেও তাকে অপমানিত হতে হয়। স্কুলের এক শিক্ষক তার চরিত্রের দিকে আঙ্গুল তুলে। মেহের সৈয়দা মাহবুবার পাপের ফল এটা বলতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন নি। স্কুলের শিক্ষকদের অনেক বুঝিয়েও সৈয়দা মাহবুবা সেদিন মেহেরের বাবার পরিচয় আড়াল করতে পারেন নি। বাধ্যহয়েই তাকে মেহেরের বাবার নাম বলতে হয়। হ্যঁ মেহেরের সাথে ওর বাবার সম্পর্ক এটাই। একটা সার্টিফিকেট। এর বাইরে কিছুনা। সার্টিফিকেটে বাবার নামের জায়গায় গুনে গুনে এগারো অক্ষরের একটা নাম লিখে মেহের এটাই ওর সাথে ওর বাবার সম্পর্ক।

৩,
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পরখ করছে আর বিড়বিড় করছে মেহের। মৌ খাটের উপর পা তুলে বসে মেহেরকে দেখছে আর হাসছে। মেহের আয়নার মৌয়ের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে,,
” খুব হাসি পাচ্ছে তাইনা। আমার ঘুম ভাঙিয়ে এখন যাবি বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে। অভিশাপ দিলাম, ব্রেক আপ হয়ে যাবে। ”
” শকুনের দোয়ায় গরু মরে না।” মৌ একগাল হেসে বলল। মেহের গম্ভীর কন্ঠে বলে,
” তুই গরু নাকি?”
” তুই শকুন হলে আমাী গরু হতে আপত্তি নাই।”
” শকুন তোর সতিন। আমি কেন হবো।”
মৌ কিছু বলবে তখনি ওর সেলফোনটা বেজে উঠে। মৌ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আলিহান মনে হয় এসে পরেছে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে মেহু।”

আরো দশ মিনিট পর মেহের রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে আসে। ড্রয়িংরুমে তখন চলছিলো চায়ের আসর। সুফায় আলিহান সহ আরো তিনজন বসে আছে যাদের কাউকে মেহের চিনেনা। মেহের সবাইকে একনজর দেখে নিলো। আলিহানের পাশে বসা মেয়েটি দেখতে একটু বাচ্চাদের মতো। মোটা গুলোমুলো গাল তার। সাজগোজও সাধারণ। উল্টোপাশে বসা ছেলেমেয়ে দুটোর মুখ দেখতে পেলো না। রুপা আর মৌ আলিহানের পাশে সিঙ্গেল সুফায় বসে চা খাচ্ছে। মেহেরকে দেখে আলিহান বলল,
” আরে শালিকা সাহেবা, আসেন আসেন আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।”
মেহের মৃদু হেসে আলিহানের পাশে গিয়ে বসলে আলিহান সবার সাথে মেহেরের পরিচয় করিয়ে দিলো। আলিহানের পাশে বসা গুলুমুলো মেয়েটয় রাহি অপর পাশে বসা রাহনাফ আর আরুশি। রাহি আর রাহনাফ আলিহানের কাজিন। আরুশি রাহনাফের বড় মামার মেয়ে। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর সবাই মিলে বেড়িয়ে যায় বাড়িতে থাকে শুধু রুপা একা।সৈয়দা মাহবুবাও কোন একটা কাজে বাহিরে গেছেন। একা বাড়িতে মনটা বিষন্ন লাগছিলো রুপার তাই সে নিজের রুমে চলে আসে। বালিশের নিচথেকে ডাইরি বের করে সেটাতে কলমের আচর কাটে,

” এক পৃথিবীর সব ক’টা ফাগুন জড়ো করে ফুলদানির কোলাজে সাজিয়ে রেখেছি। অপেক্ষা কেবল অপেক্ষা আমার। ঐ আকাশ রঙের শাড়ি আর খোঁপায় দুধ-সাদা রঙের বেলী পরে, লাল টুকটুকে সূর্যটাকে কপালে বসিয়ে অপেক্ষা করছি তোমার।”

____________
মেহেরদের বাসা থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে একটা পার্কে আসে সবাই মিলে। পার্কটা ছোট হলেও মানুষের আনাগোনা অনেক বেশী। পার্কের এক পাশে বয়ে চলেছে নদী। নদীর কিনারে বসে সবাই মিলে। ওদের থেকে কিছুটা দূরে বসে আছে আরো কয়েকজন ছেলে। তাদের একজনে গিটার বাজাচ্ছে আর গান গাইছে অন্য আরেকজন ভিডিও করছে। কেউ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত তো কেউ গান শুনায় ব্যস্ত। মেহের সে দিকে তাকিয়ে গান শুনছে। গিটারে সুর তুলে খুব সুন্দর করে গান গাইছে, এই সুন্দর স্বর্নালী সন্ধ্যায় একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু। মনোযোগ দিয়ে শুনলো পুরো গানটা। সম্ভবত এই গান ইউটিউব চ্যানেল ফেসবুক পেজে আপলোড করবে। ছেলেটার গানের গলা বেশ ভালোই। মেহের পূর্ণ নজরে পরখ করছে ছেলেদের। এর মধ্যেই মেহের খেয়াল করছে রাহনাফ তাকে দেখছে। মেহেরের চোখে চোখ পড়তেই সে নিজের দৃষ্টি সড়িয়ে অন্যদিকে তাকায়। বিরক্ত বোধ করে মেহের। ছেলেদের এমন স্বভাব তার কোন কালেই পছন্দ হয়নি। ছেলেটাকে কিছু বলবে এমন পরিস্থিতিও নেই। আরুশি রাহনাফের সাথে চিপকে বসে আছে। আলিহান বলল,
” আমরা ট্রিপে যাওয়ার প্ল্যান করছি। তোমরা কি যাবে আমাদের সাথে? প্রশ্নটা করলো মৌয়ের দিকে তাকিয়ে। মৌ বলল,
” কোথায় যাবে?” প্রশ্ন করে মৌ।
“এখনো ঠিক করা হয়নি। ঢাকার বাইরে কোথাও যাবো। আসলে রাহনাফ আর আরুশি অনেকদিন পর দেশে ফিরলো। আরুশি কিছুদিন পর চলে যাবে তাই ভাবছি কোথাও ঘুরে আসি ওদের নিয়ে।”

” কেন? কোথায় ছিলো এতদিন?”
রাহনাফের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো মেহের। রাহনাফ এবার পূর্ন দৃষ্টিতে তাকালো মেহেরের দিকে। এই প্রথম দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আলিহান বলল,
” ইংল্যান্ড থাকতো ওরা। আরুশির পুরো পরিবার সেখানেই থাকে। রাহনাফ ও পড়াশুনার জন্যে ওর মামার কাছে চলে যায়।”
” পড়াশুনার জন্যে দেশের বাহিরে কেন যেতে হবে? আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কি ভালো নয়?”
“ভালো। তবে এতটাও ভালো নয় যতটা আপনি ভাবছেন।” মেহেরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে রাহনাফ।”
রাহনাফের কথাটা মনে হয় বুকের গভীরে লাগলো মেহেরের। বুকের ভিতর হঠাৎ করেই সব গোলমাল হয়ে গেলো। এতক্ষণের গুছিয়ে নেওয়া কথাগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেলো। চোখ নামিয়ে নিলো সে। আগে তো কখনো এমন হয়নি। সবার চোখে চোখ রেখে কথা বলেছে সে। ডিবেটে হাজার হাজার মানুষের সামনে বক্তব্য দিয়েছে। কখনো নিজেকে বিভ্রান্ত মনে হয়নি। আজ হচ্ছে কেন? রাহনাফ কি তবে সত্যিই বলছে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার তেমন উন্নত নয়। নাহলে কেন প্রতিবছর এত এত ছাত্রছাত্রী দেশের বাহিরে যাবে পড়াশুনার জন্যে? উত্তর পেল না মেহের। চোখ তুলে তাকালো রাহনাফের দিকে। রাহনাফ তখন আলিহানের সাথে কথা বলছে। মৌ বলে
” তাহলে চল কক্সবাজার যাই।”
আপত্তি জানালো রাহি।বলল,
” পানি আর বালু দেখার জন্যে কক্সবাজার যাবো না। চল না চট্টগ্রাম কিংবা সিলেটে যাই। পাহাড়ের স্থবিরতা, শান্ত স্নিগ্ধ রুপ দেখে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় নেই! পাহাড় তার সুবিস্তৃত অকৃপন সম্ভারে প্রকৃতিকে করেছে মহীয়ান। ভাবতেই মন কেমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে।”
আলিহান রাহির কান টেনে বলল,
“আজকাল একটু বেশীই রোমাঞ্চিত হচ্ছিস। ঘটনা কি?”
রাহি আলিহানের হাত সড়িয়ে বলে,
” কোন ঘটনা নেই ভাই। আমার পাহাড় খুব ভালো লাগে। প্লিজ ভাইয়া নিয়ে চলনা।”

রাহির এমন আবদার শুনে মৃদু হাসলো রাহনাফ। সে বলল,
“তাহলে তাই হোক”
ঠিক করা হলো চট্টগ্রাম যাবে এবং সেটা আগামি পরশু।

সেদিন আর ট্রিপে যাওয়া হলোনা। আলিহান আর রাহনাফ যখন মৌ’দের নিতে আসলো তখন দেখলো ওদের বাসার গেটে তালা ঝুলছে। মৌ’কে কয়েকবার কল করলো আলিহান প্রতিবারই নাম্বার বন্ধ তাই দুজনে গেটের সামনে অপেক্ষা করতে লাগলো। সময় বয়ে যেতে লাগলো। মৌ’কে আরো কয়েকবার কল করলো তারপর মেহেরের নাম্বারে কল দিলো। রিং হওয়া সত্বেও কল রিসিভ করলো না মেহের। রাগ হলো আলিহানের। রাগে মোবাইল ছুড়ে ফেলতে গিয়েও ফেলল না। চিন্তা এসে ভর করলো মাথায়। তিন বছরের রিলেশন আলিহান আর মৌ’য়ের। মৌ আগে কখনো এমন করেনি হঠাৎ করে উধাও হওয়ার কারন বুঝতে গিয়ে দুশ্চিন্তা ঝেকে বসলো আলিহানের মাথায়। মেহেরের নাম্বারে অনবরত কল দিতে লাগলো। আশ্চর্য! কল রিসিভ করছে না কেন মেহের। রাহনাফ আলিহানকে বলল,
“এরা হঠাৎ করে গেলো কোথায়?”
“বুঝতে পারছিনা।”
প্রায় এক ঘন্টা পর পাশের বাসার এক ভদ্রলোকের দেখা পেলো। তিনি বাজার থেকে ফিরছিলেন। রাহনাফ লোকটার সামনে গিয়ে তাকে সালাম দিয়ে জিগ্যেস করলো,
“আপনি বলতে পারবেন এই বাসার সবাই কোথায় গেছে?”
লোকটার মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। তিনি বললেন,
“মাহবুবার বাবা খুবই অসুস্থ। আজ ভোরে সবাই মিলে মাহবুবার গ্রামে গেছে।”
রাহনাফ মাহবুবাকে চিনতে পারলোনা। সে আলিহানের দিকে তাকালো। আলিহান বলল,
” আন্টির গ্রাম কোথায়? মানে বিভাগ জেলা জানেন কিছু? ”
“সেটা তো বলতে পারলাম না বাবা।”
“আচ্ছা, চাচা ধন্যবাদ আপনাকে।”
লোকটা চলে যাওয়ার পর রাহনাফ গাড়িতে বসলো। আলিহানকে বলল,
” মৌ হয়তো ব্যস্ত আছে। এত দুশ্চিন্তা করতে হবে না। গাড়িতে বস।”
“কোথায় যাবি এখন?”
“বাড়ি ফিরে যাই। ট্রুরে তো আর যাওয়া হবে না।”
মাথা নাড়ালো আলিহান। রাহনাফের পাশের সিটে বসতেই সাই সাই করে চলে গেলো গাড়ি।

চলবে,,,,,

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৪৫ এবং শেষ পর্ব

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৪৫ (সমাপ্তি পর্ব)
লেখা : Azyah_সূচনা

অম্বর আজ নীলাভ রঁজিত।আঁকাবাঁকা ক্ষুদ্র নক্ষত্রে রঞ্জিত এক ভিন্ন চিত্রাঙ্কন। গোলাকার অমৃতাংশু অদ্য খেলায় মেতেছে।কালো মেঘমল্লারের আড়ালে মধ্যে-মধ্যে সুরত দর্শন হচ্ছে। মিটিমিটি জ্বলছে।চোখ নামাতেই সাক্ষাৎ হয় রাশিরাশি পুষ্পের সাথে। কুসুমায়ন ছড়িয়ে মোজাইক করা ফর্সে। সুশোভন রঙের সমারোহে প্রতীয়মান হলো যেনো আকাশ থেকে রংধনুর সাত রঙ এনে জমিনে হাজির। মরিচা হলদে বাতি জ্বলছে চারিদিকে। সৌন্দর্য যেনো পিছু ছাড়ছে না।

“ঔষধ খাও”

“খাবো না।একদম খাবো না”

চশমা পরিহিত সুঠাম দেহের এক পুরুষ ভারী বিরক্ত। শক্তপোক্ত বাহ্যিক দিক।অন্তরালে ভীষণ দুর্বল।রেগে গেলো এই সুন্দর এক সন্ধ্যায়।না চাইতেও।

কঠোর গলায় সাত বছর বয়সী মেয়ের হাত টেনে ধরে বলল, “আজ তোমার জন্মদিন।আমি চাইছি না রাগ করতে। বকা খেতে না চাইলে দ্রুত ঔষধ খাও”

“বাবা আমার ঠান্ডা নেই।তুমি কেনো বুঝতে পারছো না?”

মুখ ফুলিয়ে উত্তর দিলো মেহুল।বড্ড জেদী মেয়েটা।ঠান্ডায় শ্বাস নিতে পারে না।তারপরও কে জানে কেনো এতো অনীহা ঔষধের প্রতি?নিজের কথা মানিয়ে ছাড়ে। যেভাবেই হোক না কেনো।তবে আজ মাহরুর কোনো কথা শুনবে না।জন্মদিনে ধমক খাওয়ার জন্য যেহেতু নিজে থেকেই পা বাড়াচ্ছে। ধমকটা দেওয়াই উচিত।

মাহরুর আরো কঠিন অবয়ব ধারণ করলো।মেয়েকে টেনে নিয়ে ওষুধটা জোর করে মুখে পুড়ে দেয়।পানি দিলো সাথেসাথে।নাক ছিটকে কোনো রকম গিলে নিলো।

আর বললো, “কি বিশ্রী! ছিঃ!”

“বিশ্রী আর কার্যকর।এবার যাও।”

সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পিছু ঘুরে মাহরুর।অর্ধ দৈর্ঘ্যের কেশমালা পিঠে ছড়িয়ে আরো এক মেয়ে বসে আছে।পা ভাজ করে। যতনে প্রত্যেকটি গাছের পরিচর্যা করছে।পানি দিচ্ছে।আজ ব্যস্ত ছিলো বেজায়।গাছগুলোকে ছুঁয়ে দেখা হয়নি।বাড়ির মাঝে জন্মদিনের আয়োজনকে তোয়াক্কা না করেই গাছ গাছালির দিকে মনোযোগ দিয়ে বসে আছে।পরনে গোলাপী রঙের পোশাক।ফর্সা রঙে যেনো আরো সৌন্দর্য্য ঢেলে দিচ্ছে এই রং।

মাহরুর দুয়েক কদম এগোয়।পেছনে হাত বেঁধে দাড়ায় ঠিক তার পেছনে।একবার পিছু ঘুরে ছটফটে মেহুলকে দেখে নিলো।পূনরায় সামনে চেয়ে ডাকে।

বলে, “আম্মা?”

তৎক্ষনাৎ তেরো বছরের সেই কিশোরী ফিরে চায়। সুশ্রী মুখমণ্ডলে হাসি ফুটিয়ে বললো,

“জ্বি?….কিছু লাগবে মাহি বাবা?”

মাহরুর উত্তর দেয়, “না মা কিছু লাগবে না।কি করছিস তুই?”

“গাছগুলো দেখছিলাম। আগাছা পরিষ্কার করছি।”

“এখন কেনো?আগামীকাল করিস?এখন যা হাত মুখ ধুয়ে আয়।”

বাবার একবাক্যে উঠে দাড়ালো।হাত পা ঝেড়ে এক টুকরো হাসি উপহার দিয়ে চলে গেলো মিষ্টি।আদেশ জমিনে পড়ার আগেই মান্য করে ফেলে।সভ্য আর ভদ্রতার প্রতিমা এই মেয়েটি।অন্যদিকে মেহুলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। বদমেজাজি।তবে বেয়াদবের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার মতন নয়।

আজ মেহুলের সাততম জন্মজয়ন্তী।আগামীকাল মিষ্টির তেরোতম জন্মদিন।দুই বোন পৃথিবীতে এসেছে একদিন আগে পড়ে।একই দিনে আয়োজন হলো দুজনার জন্য।কখনো পালন করা হয়নি এই দিনগুলো। পারিবারিকভাবে সময় কাটিয়েছে একে অপরের সাথে।রহিম মিয়ার মৃত্যুর পর কোনো উৎসব উদযাপন করতে ইচ্ছেই হয়নি কখনো। চিত্তে অদৃশ্য কষ্ট। মাহরুর কথা রেখেছে।পারলো না রহিম চাচা।পাশে থাকার অঙ্গীকার দিয়েও চলে গেলো না ফেরার দেশে। একাকীত্বে ফেলে গেলো জোবেদা খাতুনকে।আজ সামান্য সামর্থ্য হয়েছে মাহরুরের।সাত বছরের কষ্টের ফল।অভাবের সংসারে একটু একটু করে নিজের সাফল্যের দিকে এগিয়েছে।তারপরও কিছু ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে।অভাব ছিলো হয়তো সাত বছরের চেয়েও বেশি সময় ধরে।তবে নিজের ঘর বেধে আজ মুক্ত মনে হচ্ছে নিজেকে।
এরই মাঝে পূনরায় দৌড়ে এলো মেহুল।হাত ধরে টেনে এনেছে বড়বোন মিষ্টিকেও।

এসেই বলল,

“বাবা তোমার মোবাইলটা দাও।ছবি তুলবো।”

মাহরুর দুজনের দিকে চেয়ে দেখে একবার। সাত বছরের এতটুক মেয়ে ছবিও তুলতে চায়।তবে তাদের দেখে মনে হচ্ছে এক জোড়া।একই রকম চেহারা।একই রকম পরিধেয় বস্ত্র।আজও মাপের বেশকম ছাড়া আর কিছুই ভিন্ন নেই তাদের মধ্যে। বিনা বাক্যে ফোনটা এগিয়ে দেয়।

বলে, “দশ মিনিটে ফিরিয়ে দিয়ে যাবেন।বুঝেছেন?”

মিষ্টি উত্তর দিলো, “ঠিক আছে মাহি বাবা।”

মেহুল ফোড়ন কেটে বললো, “উফ আপু!শুধু বাবা।মাহি বাবা না।”

মিষ্টি বললো, “আচ্ছা আমার মা ভুল হয়েছে।চল”

ধূসর পাঞ্জাবি গায়ে মাহরুর।চোখে আজকাল চশমা পড়েছে। যান্ত্রিক কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করতে করতে চোখের অবস্থা নাজেহাল।সাথে দোষ আছে বয়সেও।কম সময়তো কাঁটায়নি এই ভুবনে।কালচে খয়েরী দাড়ি আর কুচকুচে কালো চুলে পাক ধরেছে অনেকখানি।সচ্ছ কাছের চশমার আড়াল থেকে ক্ষুদ্র চক্ষু নিবেশিত হয় সামনের তিনটে ঘরের দিকে।নিজের সব শখ মিশিয়ে তৈরি করেছে ঘরত্রয়।আহামরি কোনো বিলাসিতার ছোঁয়া নেই এখানে।ছিমছাম পরিবেশ। সাজানো গোছানো।ঘর তৈরি করতে গিয়ে চিলেকোঠার সৌন্দর্যকে কোনো হানি পৌঁছায়নি।এক ঘরে জায়গা হয়েছে মেয়েলি সৌন্দর্য্যের প্রতীক।তার কন্যাদ্বয় থাকে।এক ঘরে একই সাথে বুড়ো হতে থাকা প্রেমিক যুগল।মল্লিকা আর মাহরুর।আরেক ঘরে জীবনের অনেকটা বছর একসাথে পাড় করা রমজান সাহেব এবং ফরিদা বেগম স্মৃতিচারণ করেন পুরোনো দিনের।

হুট করে মনে পড়লে।মেয়ের মায়েদের যে দেখা মিলছে না? কোথায় হারালো সে?আওয়াজ করে ডাকলো,

“চন্দ্র?”

দূর কোথা থেকে একটা সুরেলা আওয়াজ এলো, “আসছি আসছি”

বলার কয়েক সেকেন্ডের মাঝে এসে হাজির।মেয়েদের জন্মদিনে জন্মদাত্রী মা নিজেকে সাজিয়েছে সাবলীলভাবে।হাতের কাজ করা আসমানী রঙের শাড়িতে।চুলের খোঁপায় কয়েকটা ফুলও গুঁজেছে।কি আশ্চর্য্য!দুটো মেয়ের মা হওয়া সত্বেও সৌন্দর্য্য কেনো কমলো না?

মাহরুরের এরূপ প্রশ্নের জবাব দেয় তারই মস্তিষ্ক, “প্রিয় মানুষ সব রূপে, সবভাবে,সব বয়সে সুন্দর।”

মল্লিকা এগিয়ে এসে মাহরুরের পাঞ্জাবির গলা ঠিক করে দিলো।খুলে থাকা বোতাম লাগিয়ে দিয়ে বললো, “ডাকছিলেন কেনো?”

স্মিথ হেসে মাহরুর অবলীলায় জবাব দেয়, “আজ আপনাকে যে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে?সেটা জানানোর জন্যই ডেকেছিলাম।”

“আপনাকেও ভীষণ সুদর্শন দেখাচ্ছে কিন্তু।”

বোধগম্য হয় মাহরুরের।সমাজ আর তার নিজের চোখে বৃদ্ধ হতে থাকা মাহরুর মল্লিকার চোখে আজও সুদর্শন।ঠিক তার মস্তিষ্কের বলা লাইনটা মনে পড়লো।সেও সব রূপে, সবভাবে,সব বয়সে মল্লিকার চোখে সুন্দর।তার চন্দ্রমল্লিকার গভীর নয়নে বসবাস মাহরুর নামক পুরুষের।

দুজনার ব্যক্তিগত কথোপকথনে বাঁধা হলো শশী।এসে হাজির ঝটপট।মল্লিকা অবাক বনে রইলো।শশী আসবে কল্পনায়ও ভাবেনি।এত বছরে গ্রামে গিয়েই তাদের সাক্ষাৎকার মিলেছে।আজ ঢাকা এসে হাজির।একেক করে দরজা টপকে প্রিয় মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে। সর্বপ্রথম দুলাল জোবেদ খাতুনকে ধরে নিয়ে আসলেন।পরপর শিরীন আর তার ছেলে মেয়ে।সুমাইয়া আর সায়মনও বড় হয়ে গেছে।ফরিদা বেগমও তাদের সাথেই আছে।রমজান সাহেব আর রেদোয়ান নিচে মাদ্রাসার বাচ্চাদের জন্য খাবারের আয়োজনের তদারকি করতে ব্যস্ত।কিছু সময়ের মধ্যে তারাও আসবেন।

মল্লিকা অনেকদিন পর সখীকে কাছে পেয়ে খুশিতে আটখানা।কাছে গিয়েই জড়িয়ে ধরলো।বললো,

“তুই আসবি আগে বলিসনি কেনো?”

“আগে বলে এত খুশি হতি নাকি?” উত্তর দেয় শশী।

“সত্যিই আমি ভীষণ খুশি হয়েছি।চাচা চাচীকে কেনো আনলি না?আর শওকত ভাই,ভাবি?”

“তারাও আসবে একদিন সময় করে।”

শশী থেকে নজর সরিয়ে তার স্বামীর দিকে নজর যায়।সাথে সীমান্তের দিকে।সালাম জানিয়ে বললো,

“কেমন আছেন দুলাভাই?”

শশীর স্বামী উত্তর দিলো, “সেই বিয়ের প্রথমদিনের মতন ফার্স্ট ক্লাস”

মল্লিকা সীমান্তের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “কেমন আছো বাবা?”

“খুব ভালো আছি খালামণি।”

শশী বললো, “কই আমার বৌমা কই?… ইশ! আরেকটা ছেলে হতো আমার। মিষ্টি মেহুল দুজনকে বউ করে নিতাম।”

শশীর স্বামী পেছন থেকে বলে উঠলো, “আমি কিন্তু খুব ভালো গান পারি শ্যালিকা।আজ তোমার মেয়েদের জন্মদিন উপলক্ষে গান গাইবো।”

“অবশ্যই দুলাভাই আসুন”

রহিম মিয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।নিচের দুটো তলায় মাদ্রাসার এতিম শিক্ষার্থীরা।প্রথম তলায় মেয়েদের এবং দ্বিতীয়তলায় ছেলেদের।একটি বেসরকারি এনজিও তাদের খরচ বহন করছে।সাথে মাহরুরের সামান্য কিছু অনুদানে বেশ চলছে সবকিছু।রহিম মিয়ার ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই তাদের চেষ্টায় অনড়।এখনও চাই তাদের বাড়িটা।আইনি কাজের কারণে আগাতে পারছে না কেউই। মাহরুরকে হেনস্তা করার চেষ্টাও করেছে কয়েকবার। জোবেদা খাতুনের সাহায্যে মিটেছে সেই ঝামেলাও।দুলালকে আজকাল কোনো চিন্তা নেই। স্টেশনারি শপটায় নিজের সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে ব্যবসা বড় করেছে।চলছে জীবন গতানুগতিকভাবে।

একে অপরের সাথে পরিচয় পর্ব শেষ হবার পরপরই রেদোয়ান কেক নিয়ে হাজির। মাহরুর এই ধরনের কোনো আয়োজন করতে চায়নি।পরিবারের সবাই একত্রে হবে।গল্প,আড্ডায় ভালো সময় পাড় করবে এই ইচ্ছেটাই ছিলো।তবে রেদোয়ান না জানিয়ে ভাতিজিদের জন্য নিয়ে এসেছে ছোট্ট উপহার।

এসেই বলল, “কেক কাটবে দ্রুত এসো।মিষ্টি? মেহুল?”

দুই পরী এসে হাজির হলো সবার মধ্যিখানে।বাবা মায়ের সাথে মিশে উৎযাপন করেছে জম্মদিনটা। আপনজনদের মধ্যে এক মনোরম সময়।শান্তির!নিজের কথা মোতাবেক শশীর স্বামী প্রবল উৎসাহ নিয়ে সবার মাঝে আসে।সবাইকে জানান দিয়ে শুরু করলো তার কণ্ঠে গান।

“আজকের আকাশে অনেক তারা
দিন ছিল সূর্যে ভরা
আজকের জোছনাটা আরও সুন্দর
সন্ধ্যাটা আগুন লাগা
আজকের পৃথিবী তোমার জন্য
ভরে থাকা ভালো লাগা
মুখরিত হবে দিন গানে-গানে আগামীর সম্ভাবনায়
তুমি এই দিনে পৃথিবীতে এসেছো শুভেচ্ছা তোমায়
তাই অনাগত ক্ষণ হোক আরও সুন্দর উচ্ছল দিন কামনায়
আজ জন্মদিন তোমার”

উপভোগ করেছে সকলে এই গান।একটু একটু করে বেড়ে উঠা সন্তান সন্তানাদিরাও করতালি দিয়ে উঠলো।সবার মধ্যিখানে ঠোঁটে সামান্য হাসি টেনে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে মাহরুর। প্রার্থনা করছে বারবার।এভাবেই যেনো থাকে সব।সুন্দর,সচ্ছ,শান্ত। মাহরুরের শ্রান্ত মুখটা লক্ষ্য করলো মল্লিকা।সবার আড়ালে গিয়ে আলগোছে হাত আগলে নিয়েছে।কারো ভরসার শক্ত বাঁধন পেয়ে ফিরে তাকায় মাহরুর।মেয়ের মায়ের ফুটফুটে মুখ দেখে ভুলে বসলো সবটা।

রমজান সাহেব এবং ফরিদা বেগম দুই নাতনিকে একপাশে বসিয়েছেন।সাথে সায়মন আর সুমাইয়াকেও। শশীর ছেলে সীমান্তকে একা দাড়িয়ে থাকতে দেখে তাকেও ডেকে নিলো।তৃতীয় প্রজন্মকে সাথে নিয়ে একত্রে বসেন।

রমজান মিয়া বললেন সব বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে, “এইযে দেখছো তোমাদের বাবা মায়েদের?এত আনন্দ চারিপাশে?এসবের পেছনে কিন্তু তোমাদের বাবা মায়েরই বিরাট অবদান।জীবনে সফল হতে পারো আর না পারো।সবসময় বাবা মায়ের পাশে থাকবে।..বড় হবে তোমাদেরও বিয়ে হবে নিজের সংসার হবে।কিন্তু যারা তোমাদের বড় করেছে তাদের হাত ছেড়ে দিও না কিন্তু।”

মিষ্টি জবাব দিলো, “আমরা সবসময় বাবা মায়ের সাথে থাকবো নানাভাই”

সুমাইয়াও একই উত্তর দিয়ে বলে, “চেষ্টা করবো তাদের মুখ উজ্জ্বল করতে।”

একে একে বড় থেকে ছোট সকলেই হ্যাতে হ্যা মেলায়।রমজান সাহেবের কথা মান্য করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। পূনরায় মেতে উঠলো পুরো পরিবার আড্ডায়।ছেলেরা বাহিরের কাজ সেরে একত্রে বসেছে।আলাপ আলোচনা করছে।নারীরা হাতেহাতে তাদের খাবার তুলে দিলো।সাথে তাদের সন্তানদেরও। প্রত্যেকজনই কোমরে আঁচল গুঁজে কাজ করছে।পুরুষ এবং বাচ্চাদের খাওয়া শেষে মাহরুর বললো,

“চন্দ্র? এবার তোরা বসে পড়।আমরা সার্ভ করে দিচ্ছি।”

সম্পর্কে উচু নিচুর ভেদাভেদ আছে?এখানে সবাই সমান। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষদের শক্তির প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।শক্তি দর্শানো হয় কি শুধু নারীদের দাবিয়ে রাখতে?তাদের প্রতি অবিচার করতে?মূল অর্থে শক্তি দেখানো হয় সংসারের ঢাল হয়ে দাঁড়াতে। বিপদ আপদে নিজেকে শক্ত স্তম্ভ হিসেবে পেশ করতে। মাহরুরের পাশাপাশি এখানে উপস্থিত সকল পুরুষ সেটাই করলো।নিজেদের অর্ধাঙ্গিনীদেরকে খাবার পরিবেশন করছে কোনো রকম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই।তাদের মতে এখানে সম্মানহানি নয় সম্মান আরো বৃদ্ধি পাবে।তাদের সন্তানেরাও ভালো শিক্ষা পাবে।

জোবেদা খাতুন আকস্মিক কেদে উঠলেন।ভীষণ রকমের মনে পড়ছে নিজের মানুষটাকে।সুখ দুঃখের সঙ্গী।সেও অনেক সম্মান করতো স্ত্রীকে।আজ নেই।হাত তুলে বললেন,

“জামিলের বাপ আমারেও নিতে আসো।আমার একলা লাগে।”

মাহরুর এগিয়ে আসলো।বললো, “একলা লাগে মানে?আপনি আমাকে এভাবে ভুলে গেলেন?পর করে দিলেন?”

চোখ মুছে জোবেদা খাতুন বললেন, “নারে বাপ।তোমরা আছো দেইখা এতদিন বাইচা থাকার শক্তি পাইছি।নাহয় ওনার শোকে আমিও যাইতাম গা।”

“এসব কথা বলবেন না চাচী।রহিম চাচাকে আল্লাহর বেশ পছন্দ হয়েছে।তাই নিজের জিনিস নিয়ে গেছেন।আপনি আমাদের সাথে থেকেও একা অনুভব করেন কি করে?”

“করি নাতো।মাঝেমধ্যে মন বেজার হয়!”

“মন বেজার করা যাবে না।আপনার কতগুলো নাতি নাতনী।তাদের নিয়ে আপনার আরামে,গল্প করে কাটানো উচিত।”

মাহরুর এক কোণে বসে আছে মেয়েদ্বয়কে দুপাশে নিয়ে।তার চন্দ্রেরতো আজ সময়ই হচ্ছে না।খাবার দাবারের পর্ব চুকিয়ে সকলে যেখানে ক্লান্ত।গা এলিয়ে দিচ্ছে এদিক ওদিক।সেখানে শিরীন,শশী,মল্লিকা একত্রে ছাদ পরিষ্কার করেছে। তোষক আর চাঁদর বিছিয়ে আয়োজন করছে।আজ সকলে এখানে থাকবে। ঘুমোবে না বলে ভেবে নিলো।পুরোনো গল্পের ঝুড়ি খুলে বসবে। মাহরুর সবদিকে নজর দিয়েও মন আবারো খারাপের দিকে ঝুঁকে।আজ যে বাবা মাকে ভীষণ মনে পড়ছে।আকাশের দিকে চাইলো।

মনে মনে আওড়ালো, “ছেলে তোমার ভীষণ রকমের ভালো আছে মা বাবা।”

চাদর,বলিস, কাথা ছড়িয়ে সকলে বসেছে।পা ভাজ করে নিলো।এর মধ্যে কেউ কেউ আলাপ শুরুও করে দিয়েছে।এতখন দুই মেয়েকে জড়িয়ে রাখা মাহরুরও যোগ দেয় তাদের মধ্যে।মিষ্টি আর মেহুলও।আগামীকাল অফিসে বেশি কাজ করতে হবে।অফিসে পদোন্নতি হয়েছে। অতিরিক্ত আয় এর অংশ চলে যায় ঋণ পরিশোধে।এই বছরের আর কয়েকমাস বাদে ঋণের বোঝা থেকেও মুক্ত হবে মাহরুর।তবে চিন্তা আজও পিছু ছাড়লো না।থেকেই গেলো।

পারিবারিক আলাপের মধ্যে অন্যহাতে মাহরুর কিছু কাজও সম্পন্ন করে নেয়।নিজেকে খাপ ছাড়া মনে হচ্ছিল বলে দ্রুত কাজ শেষ করলো।এসে বসলো সবার মাঝে আরো একবার।রাতের গভীরত্ব বাড়ছে।সাথে অনেকের চোখে ঘুম এসে ঝুকে বসলো।যে যেখানে জায়গা পাচ্ছে গা এলিয়ে দিল।এক এক করে কথা অপূর্ণ রেখেই সকলে ঘুমের সাগরে ডুব দেয়।একা রয়ে যায় এক যুগল।দুই জোড়া জ্বলজ্বল করা চোখ।সবার দিকে চোখ বুলিয়ে মোলায়েম হাসছে।

একেঅপরের চোখাচোখি হতেই মাহরুর ধীর কন্ঠে বলল, “চন্দ্রবিলাস করবি না?”

মাহরুর রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।মল্লিকা ঠিক তার পাশে এসে দাঁড়াল।আকাশের দিকে চাওয়ার পূর্বেই মাহরুর আবদার করে,

“আপনার মাথাটা কাঁধে রেখে ধন্য করুন আমায়।”

মল্লিকা চোখ ফেরায় পেছনে।নাহ!কেউ জেগে নেই। কেউ কেউতো নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। মল্লিকা মুক্তভাবে মাথা মাহরুরের কাঁধে রাখলো।যেনো কোনো চিন্তা নেই। চারিদিক শান্তির সুভাসে মুখরিত।

এক ভরাট কন্ঠ বলে উঠে, “আজ থেকে সাত আট বছর আগের জীবনটা নিয়ে ভাবতে গেলে মস্তিষ্ক বাঁধা দেয় জানিস?বলে কেনো সেই সময়গুলো মনে করতে হবে?এরপর যে ভালো সময়টা আসলো?সেটা সুখে থাকার জন্য যথেষ্ট নয় কি?”

“ভুল কি বলে আপনার মস্তিষ্ক?আপনাকে পেয়ে আমার জীবনটা স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর হয়ে উঠেছে।এই স্বপ্ন থেকে আমার বেরোতেই ইচ্ছে হয়না।”

“কখনো বের হোস না চন্দ্রমল্লিকা।আমার এই স্বপ্নের জগতে মেতে থাক।”

“আপনিও আমাদের মধ্যেই নিবদ্ধ থাকুন।কি পেলেন?কি হারালেন সেই হিসেব করতে যাবেন না।”

“আছি! সম্পূর্ণ তিন নারীতে আবদ্ধ হয়ে আছি।”

“নারী শক্তি কি আপনাকে সস্তি দিতে সক্ষম?”

“শুধু সক্ষম? চাঁদের মেলায় বসবাস আমার।নিজেকে মনে হয় এই অম্বরের মহারাজ”

মল্লিকার পিঠে হাত বাঁধে মাহরুর।কত সংজ্ঞা দেবে সুন্দর সময়ের? শব্দভান্ডারে চলছে অভাব।খারাপের পর ভালো সময় আসে।শুনেছে আর দেখেছেও বটে। সৃষ্টিকর্তাকে লক্ষ কোটিবার ধন্যবাদ দিয়েও যেনো মনে হয় কম হয়ে গেলো। মাহরুর মুখ ঘুরিয়ে মল্লিকার দিকে চায়। কাকতালীয়ভাবে মল্লিকাও একই সময়ে তার দিকে ফিরে চাইলো।

চোখের অতল সমুদ্রে ডুবে বললো, “আমি দীপ্ত সূর্য হলে তুই শুভ্র চন্দ্র।সূর্য আর চন্দ্রের এই অলৌকিক বন্ধন অটুট থাকুক সর্বকাল।”

`সমাপ্ত`

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৪৪

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৪৪
লেখা : Azyah_সূচনা

“আমাকে আর ভালো লাগে না তাই না?”

অভিমানী নারী সুর বাতাসে ভেসে এলো কর্ণকুহরে।শীতল কুণ্ডলীর ন্যায়। মৌসুম এসেছে প্রেমের,প্রণয়ের।প্রণয়ের পথে অনেকটা এগিয়ে তারা।তারপরও চিত্ত ডাকে।অনুভব করায় নব অনুরাগের সুরভী। মাহরুর ঘুরে তাকালো অকপটে।মল্লিকার দর্শনে মাহরুরের মাথার উপর ভরা হলদে শশাঙ্ক বিদ্যমান। মাহরুর হাত তোলে।এগিয়ে দেয়।

ডেকে নেয়, “আয়?”

মল্লিকাও বিনাবাক্যে সান্নিধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। লম্বাটে দম ফেলে আরো দূরত্ব ঘুচায় হাতের টানে।খোঁপা করা চুলের সামনের ভাগে কিছু কেশ এলোমেলো। ললাটের বিচ্ছিন্ন চুল তর্জনী আঙ্গুলের সাহায্যে সরিয়ে নেয়।

বলে, “আমার মেয়েরা ঘুমিয়েছে?”

চোখ পিটপিট করে মল্লিকা মাথা উপর নিচ দোলায়। হ্যা সূচক উত্তর দেয়। মাহরুর জড়িয়ে ধরলো বক্ষস্থলে।তার চন্দ্রমল্লিকাকে।বললো,

“নাদুস নুদুস হয়েছিস।যেটা আমি হাজার বলেও করতে পারিনি সেটা আমার মেয়ে এসে করে দেখিয়ে দিল।তবে আরেকটু মোটা হলে আরো ভালো লাগবে তোকে।”

“আরো মোটা হবো?”

“হুম!আরো মোটা হওয়ার জন্য আরেকজন সন্তানের আগমন দরকার।”

এক পলকে মাথা তুললো মল্লিকা। দুহাত তুলে না করে।বলে, “আর না।এই দুজনকে এখনই সামলাতে কষ্ট হয়।”

“আরেকজন সন্তানের জন্য আরেকজন মা আনি?”

“ফালতু কথা বলবেন না।আপনার স্বভাব খারাপ হচ্ছে দিনদিন।”

“স্বভাব তোর দোষেই খারাপ হয়েছে।”

মুক্ত হস্ত বিচরণ চালালো মল্লিকার কেশমালায়।একটানে খোঁপা খুলে মুক্ত করেছে কুচকুচে রেশমি চুল।আগের তুলনায় ঘনত্ব কম। তবে মোলায়েম।সময়ের সাথে বদলে যাওয়া মল্লিকাকেও অনুভবের দেয়ালে আবদ্ধ করা হয়ে গেছে। সত্তগাতস্বরূপ দুই তনয়ায় প্রতিধ্বনিত এই ধূসর চিলেকোঠা।

“চন্দ্র?”

আবেদনময় ডাকে ধীমা জবাব দেয় মল্লিকা, “হুম?”

“কলি থেকে ফুল হতে দেখেছি তোকে।আজকের সময়টা ভিন্নরকম সুন্দর।”

“শত অপ্রাপ্তির মাঝেও পূর্ণতা অনুভব হয় তাই না?”

“তাতো বটেই।”

মাতাল সুভাষ মাহরুরের ঘ্রানেন্দ্রিয়কে প্রবলভাবে আকর্ষণ করছে।পরিপূর্ণ এই সৌরভে মাতোয়ারা হতে মুখ ডোবায় মল্লিকার কেশমালায়।প্রমত্ত হলো।বয়সের দোষ নেই। মন বললো মাহরুরের।এসবই প্রেম নামক রোগের দোষ। দিনক্ষণ, বয়সসীমা কোনোটাই তোয়াক্কা করেনা।বেহায়া হতে বাধ্য করে।

নিজের সাথে খিঁচে লেপ্টে রাখে মল্লিকাকে।বলে, “নারীর চুলের ঘ্রাণ কি প্রাকৃতিক?”

“উম!.. কিছুটা।তবে সবই দোকান থেকে কেনা কৃত্রিম সুবাসিত শ্যাম্পুর ঘ্রাণ।”

“যে এই ধরনের সুবাসিত শ্যাম্পু তৈরি করেছে সে নিশ্চয়ই জানে পুরুষের দুর্বলতা।এটা নির্ঘাত কোনো নারীর কাজ।”

মল্লিকা ফিক করে হেসে উঠে।বলে, “পুরুষেরওতো হতে পারে?”

“কোন পুরুষ নিজের মাথা নিজে নষ্ট করতে যাবে বলতো বোকা চাঁদ?”

“আপনি!”

মল্লিকার মাথার উপর নিজের মাথা শক্তভাবে ঠেকিয়ে দাড়িয়ে রইলো মাহরুর।আজকাল বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে।নিজেদের মধ্যে সময় কম পাওয়া যায়।কত সুন্দর দিন ছিলো?একে অপরের সাথে প্রতিরাতে চন্দ্রবিলাস হতো। সময়গুলো চলে গিয়ে নতুন যে সময় উপহার দিয়েছে?সেটাও কম সুখদায়ক নয়! দোটানায় পড়ে যায় মাঝেমধ্যে।কোন সময়টা বেশি সুন্দর?

মল্লিকাকে চমকে হুট করে হেসে উঠে মাহরুর। নীরবতা কাটিয়ে বলে,

“একটা উদ্ভট চিন্তা এসেছিল মাথায় জানিস।পড়ে বাস্তবতা এসে ঠাটিয়ে একটা চড় দিলো।আমি সব ভুলে গেলাম।”

স্বভাবতঃই প্রশ্ন আসে মল্লিকার তরফ থেকে, “কি চিন্তা এসেছিল?”

“জানিস চন্দ্র?এই শহরটা মায়ার শহর।এখানে মায়া জন্মালেও ভালোবাসা জন্মাবে না।যেখানে কালো সাদা অতীত কেটেছে সেই অর্ধপাকা রাস্তাটায় পড়ে আছে আমাদের মন।ভাবছিলাম গতকাল।এই চিলেকোঠাকে আমাদের চির আস্তানা বানিয়ে নিলে কেমন হয়?”

“খুব ভালো হয়।”

“পুরোনো ঘরটাকেই নতুনভাবে সাজিয়ে মিষ্টি আর মেহুলকে উপহার দেওয়ার একটা সুপ্ত বাসনা এসে হাজির হয়েছিল।পরপর মস্তিষ্ক বললো অর্থের বেজায় অভাব।”

মল্লিকা পূনরায় মুখ তুলে তাকায়।এভাবে জাপ্টে নিঃশ্বাস নেওয়া গেলেও কথা বলা যায় না।বললো,

“এই চিলেকোঠাকে আমাদের চির আস্তানা বানিয়ে নিন।খুব সুন্দর করে সাজাবো।নিজেদের মতন করে।এই শহরে বড় বড় ইমারত থাকলেও অনুভূতির বড্ড অভাব।মিষ্টি মেহুল এটাই জানবে বাবা মায়ের বাল্যকাল যেখানে কেটেছে সেখানে তাদের নিজের একটা বাড়ি আছে।দাদী বাড়ি, নানী বাড়ি।আর এই শহরে আছে একটা চিলেকোঠা।”

“কিভাবে সাজাবি?”

“হরেক রকমের ফুলের মেলা বসাবো এখানে।আকাশের রংধনুর সাত রঙ এনে ঢেলে দিবো।”

“তাহলেতো কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।”

“আমিও করবো!আমাকে একটা কাজ খুঁজে দিন।দুজন মিলে উপার্জন করলে আমরা পারবো।”

ললাটে গাঢ় স্পর্শ আঁকে মাহরুর।পরপর কপোলে। সারা মুখশ্রীতে বর্ষণ করে অনুরাগের। ঘাড়ে মুখ গুজে মাহরুর বললো,

“আমার অস্পষ্ট জল্পনাকে যে বাস্তবিক রূপ দিয়ে দিলি ”

___

অফিস ফিরতি পথে আজ নিজের ঘরে নয় রহিম মিয়ার ঘরে এসে হাজির মাহরুর। বেতন পেয়েছে।পূর্বের তুলনায় টাকার অংক একটু বেশি।ঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীসহ ফল এনেছে জোবেদা খাতুন ও রহিম মিয়ার জন্যে।হাসিমুখে বিনয়ের সাথে ঘরে এনে রাখলো।ঘরে প্রবেশ করতেই দেখা গেলো রহিম মিয়া ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। মাহরুরকে দেখতে পেয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে বসতে বললো।তাদের ইশারা ইঙ্গিতের মধ্যেই
জোবেদা খাতুন বলেন,

“কি দরকার আছিলো এসব আনার?”

“দরকারতো ছিল না চাচী।তবে ইচ্ছে হলো। আপনারাতো ঘরে ফল পড়ে থাকলেও খাবেন না।না থাকলে আনিয়ে খাবেন না।তাই আজ ভাবলাম আপনাদের সামনে বসে খাইয়ে যাই।”

জোবেদা খাতুন হেসে বললেন,

“আচ্ছা বহো!.. কি খাইবা?শরবত দিমু নাকি চা?”

“চা খাবো চাচী। ঠান্ডা পড়ছে আপনার হাতের আদা চা হলে মন্দ হয়না।”

“বও আনতাছি।”

জোবেদা বেগম রান্না ঘরে চা করতে লাগলেন। রান্নাঘর থেকে বসার ঘর মুখোমুখি। সর্বদা রহিম চাচা ও চাচীর দেখভালের কাজে নিয়োজিত সুমিকে ডাকলো মাহরুর।

অনুরোধ করলো, “আমার ব্যাগ আর জিনিসপত্রগুলো একটু তোমার ভাবির কাছে দিয়ে আসতে পারবে?”

সুমি উত্তর দেয়, “হ ভাই পারমু।দেন”

“ধন্যবাদ।আর হ্যা ভাবিকে বলবে আমি নিচে আছি।কিছুক্ষন পর আসবো। আমার চা গরম করা দরকার নেই।”

“আচ্ছা ভাইজান”

দীর্ঘ ফোনালাপ এর পর রহিম নিয়া এসেছেন।এসেই হালচাল জেনে নিলেন একে ওপরে। মাহরুর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করলো,

“কার সাথে কথা বলছিলেন চাচা?”

“ফারুকের সাথে।”

“ফারুক?”

“ঐযে সামনে মাদ্রাসা আছে না?এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ।”

“আচ্ছা আচ্ছা”

মাহরুর আর প্রশ্ন করলো না।হতে পারে ব্যক্তিগত ব্যাপার। জোবেদা বেগম তিন কাপ চা আর হালকা নাস্তা এসে হাজির হন বসার ঘরে।অন্যদিকে রহিম মিয়া নিজ থেকেই বলতে শুরু করেন।

বলেন, “যেই অবস্থা দেখতেছি মনে হয় বেশিদিন বাঁচুম না।আগে থেকেই ব্যবস্থা করলাম।ওই মাদ্রাসায় বেশিরভাগ বাচ্চা এতিম।খাওয়া দাওয়ায় কষ্ট।থাকার জায়গাটাও পোষাচ্ছে না। অধ্যক্ষ কইলো এনজিও এর সাথে আলাপ করতে হইবো।যারা এই এতিম বাচ্চাদের জন্য কাজ করে।আমি একটা মাথায় ছাদ দিকে বাকি কাজ নাকি এনজিও এর মানুষ করবো।”

“আচ্ছা ভালো খবর।তবে বেশিদিন বাঁচবেন না এটা কেমন কথা চাচা?”

“মানুষ মরণশীল” হেসে উত্তর দিলেন রহিম মিয়া।

চায়ের কাপে একের পর এক চুমুক বসিয়ে যাচ্ছে মাহরুর।মনের মধ্যে একটা কথা আনচান করতে লাগলো।বলবে কি?বলেও কোনো লাভ হবেনা এখন।তারপরও মনের হাসফাস ভাবের কাছে বাধ্য হচ্ছে বারেবারে।মস্তিষ্ক তাড়না দিচ্ছে।আনমনে ভাবনা চিন্তার জেরে ধাতস্ত করলো নিজেকে।একবার বলেই দেখুক।

বললো, “চাচা একটা কথা বলতাম যদি কিছু মনে না করেন?”

রহিম মিয়া ঝুঁকে চায়ের কাপ টেবিলে রাখলেন। মাহরুরের কথায় দৃষ্টি তুলে বললেন, “হ্যা বলো।মনে করার কি আছে?”

“নাহ চাচা কথাটা অন্যরকম।তাই ভাবলাম….”

ইতস্তত বোধ করতে থাকা মাহরুরকে আশ্বাস দেয় রহিম মিয়া।বলে,

“নির্দ্বিধায় বইলা ফেলোতো”

“চাচা মনে একটা ইচ্ছা এসেছে।আপনার চিলেকোঠায় আমার অনেক স্মৃতি, উত্থান পতন। আপনারাও সময়ের সাথে আমার অনেক আপন হয়ে উঠেছেন।আমি চাই না ওই চিলেকোঠা ছেড়ে যেতে।”

রহিম মিয়া সুর মিলিয়ে বললেন, “আমিওতো চাই না বাপ”

“আমি ভাবছিলাম… আপনিতো বাড়ি বিক্রি করবেন না।আর ছাদে অনেক জায়গা খালি পড়ে আছে।সুন্দর ঘর তৈরি করা যাবে।ওই চিলেকোঠাটা যদি….”

কথাটা পূর্ণ করতে পারছে না মাহরুর।এত চিন্তা চেতনার পর গলায় আটকে আসছে শব্দ।কেমনভাবে নেবেন সে?খারাপ ভাবতে পারে?
রহিম মিয়া নরম হৃদয়ের হওয়া সত্বেও বিশেষ বুঝদার। চট করে ধরে ফেললেন।বললেন,

“তুমি ওই চিলেকোঠায় নিজের ঘর করতে চাও?”

আরো যেনো অপরাধবোধ ঘিরে ধরলো।রহিম চাচা বুঝে গেছেন।ভুল করে ফেললো নাতো? মাহরুর নীরব রইলো।রহিম মিয়া নিজ থেকেই আবার বলতে লাগলেন,

“আমিতো নিজেই চাইছিলাম তোমারে চিলেকোঠা দিয়া যামু।”

মাহরুর প্রশ্ন করলো, “আমাকে কেনো দিবেন চাচা?আমি চাচ্ছিলাম ওই চিলেকোঠার ছাদটার ন্যায্য মূল্য আদায় করে নিজের করে নিতে।বাকি বাড়ি আপনারই থাকবে।আপনি যেহেতু বাড়িটা মাদ্রাসায় দিয়ে দিবেন? ছাদটা নাহয়….. চাচা আপনি মনে কষ্ট নিচ্ছেন নাতো?”

রহিম মিয়া বললেন, “আরেহ কিযে কও।আমি কেনো কিছু মনে করমু। শোনো আমি তোমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ।কে কেমন মানুষ বুঝি।তবে নিজের পোলারে বুঝতেই ভুল করলাম।হয়তো নিজের রক্ত ভাইবা অন্ধের মতন বিশ্বাস কইরা ফেলছিলাম।আর তুমিতো আমার সম্পত্তি হাতায় নিবা না।”

“চাচা!আমি এই ভাবনা চিন্তায়ও আনতে পারি না।আমি শুধু চাচ্ছিলাম।ওই চিলেকোঠাটাকে নিজের পরিবারের জন্য নিজের মতন করে সাজাতে।”

“বুঝছি মাহি।তোমার প্রস্তাবে আমার কোনো আপত্তি নাই।কিন্তু একটা ওয়াদা দাও আমারে?”

মাহরুর অবাক নয়নে চাইলো।প্রশ্ন করলো, “কি ওয়াদা চাচা?”

“আমরা যদি কোনোদিন নাও থাকি।এই বাড়িটা আর এই বাড়িতে যে এতিম বাচ্চাগুলা থাকবো সবসময় দেইখা রাখবা?”

ভয় পেয়ে বসেছিলো মাহরুর।রহিম মিয়ার কথায় সস্তি আসলো।রহিম মিয়ার দুহাত চেপে বললো, “এই বাড়িটা সবসময় মিয়া মঞ্জিল নামেই থাকবে।আপনারা থাকাকালীন।আপনাদের অনুপস্থিতিতেও।আমি আপনাকে ওয়াদা দিচ্ছি আপনার ইচ্ছে পূরণ হবে।আপনি যে ওই বাচ্চাগুলোর মাথার উপর একটা ছায়া দিতে চাচ্ছেন এই সিদ্ধান্তে আমি আপনার পাশে আছি সবসময়।শুধু আদেশ করবেন।”

মাহরুর স্বল্প বিরতিতে আবার বললো, “তবে চাচা আমার এখনও সামর্থ্য হয়নি।যেদিন হবে সেদিন ওই চিলেকোঠাকে সাজাবো নিজের মতন করে।ততদিন আপনাদেরও আমার পাশে থাকতে হবে।”

“ইনশাল্লাহ”

একটা বোঝা হালকা করে ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে মাহরুর।শান্ত হৃদয় শোনাবে মল্লিকাকে।যেনো যুদ্ধ জয় করেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের দরজায় এসে দাড়ালো।অন্যদিন মাহরুরের ফিরে আসা বুঝে নেয় মল্লিকা।আজ বুঝলো না। মাহরুরের পায়ের আওয়াজও তার কান অব্দি পৌঁছায়নি।গল্প মেতেছে মুঠোফোনে। মাহরুর চুপচাপ বসে তার আলাপ শুনতে লাগলো।কোনো শব্দ করেনি আর।মিষ্টিকেও ইশারা করে থামিয়ে দেয়।

অন্যদিকে মল্লিকা ফোন কাউকে বলছে, “আমার মেয়েটাকে দেখতেও আসলেন না?এত পর হয়ে গেছি আমি?ছয়মাস হতে চললো।এত স্বার্থপর হয়ে গেলেন কি করে?”

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর আসে, “মেয়ে মানুষ ঘর সংসার ফেলে আসা সম্ভব?কত চেয়েছি একবার আসি।হলো না।”

মল্লিকা বলে, “তা হবে কি করে?আমরা গরীব মানুষ আমাদের বাড়ি আসা যায় নাকি?”

শশী মল্লিকাকে ধমকে বললো, “এসব কথা দ্বিতীয়বার বলবি না।আর কি আপনি আপনি করছিস?”

“তো কি করবো?আপনি আগে বলতেন আমি স্বার্থপর।আপনাকে ভুলে গেছি।এখন কে স্বার্থপর আর কে ভুলে গেছে দেখে নেন।”

“ঢং করিস না মল্লিকা। স্বাভাবিকভাবে কথা বল।”

“বলবো না!”

“সখী রাগ করিস না।আমি আসবো।খুব শীগ্রই আসবো।”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে মল্লিকা।ভীষণ মনে পরে শশীকে।সংসারের ব্যস্ততায় মুখ ফুটে বলা হয়না।তাদের সখ্যতাতো দিন দুয়েক এর নয়?পুরোনো শক্ত বাধন।দুরত্বে থেকেও একে ওপরের কথা মনে পড়ে বেশ।ফোন কেটে পেছনে ফিরতেই ভরকে উঠলো।মল্লিকার ভীত মুখ দেখে মিষ্টি হেসে উঠে।তার দেখাদেখি না বুঝে মেহুলও হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো।নকল করে বড় বোনের।

বড়বড় চোখে মাহরুরের দিকে চেয়ে মল্লিকা বললো, “কখন এলেন?”

“আপনি যখন ফোনে ব্যস্ত ছিলেন তখন।” জবাব দেয় মাহরুর।

“আচ্ছা।হাত মুখ ধুয়ে আসুন।বসে আছেন যে?”

মাহরুরের মুখে বিরক্তির ছাপ ভেসে উঠে।বলে তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছুঁড়ে, “কার সাথে কথা বলছিলি?প্রেমিক নয়তো?”

মাহরুরের এরূপ বাক্য কর্ণপাত হতেই চক্ষু রসগোল্লার ন্যায় হয়ে গেলো মল্লিকার।

বললো, “কিসব আজেবাজে বকছেন!”

“তাহলে কার সাথে এমন অভিমান করে কথা বলছিলি?”

“শশীর সাথে।”

“তুই শশীর সাথে প্রেম করিস?”

হা হয়ে রইলো মল্লিকা।পাগল টাগল হয়ে যায়নিতো এই লোক?কিসব কথা বলে যাচ্ছে! মাহরুর মল্লিকার মুখ দেখে বললো,

“মুখে মাছি পড়বে!…. ওহ না!এখনতো রাত।মুখে মশা ঢুকবে ”

মল্লিকা মাহরুরের দুষ্টুমি ধরে ফেলে।একই সুরে বলে, “আপনাকে না বলেছি মস্তিষ্কে চাপ কম দিবেন?বেশি কাজ করার ফলে এখন হলোতো বিপদ!আমি এই পাগল স্বামী নিয়ে কিভাবে সংসার করবো?”

বেশিক্ষণ নিজের গম্ভীর ভাবভঙ্গি ধরে রাখতে পারেনি মাহরুর।মল্লিকার বিপরীত জবাবে ফিক করে হেসে উঠেছে।পূর্বের ন্যায় আবারো মাথায় ছোট্ট করে চাপড় দেয়।

বলে, “কথা শিখেছিস অনেক।”

“আপনার ছায়াতলে থেকেই এই অবস্থা আমারও”

প্রতিদিনের মতোই সন্ধ্যা ব্যতীত হচ্ছে।আজকাল মেয়েদেরকে ফেলে দোকানে যেতে ইচ্ছেই হয় না।তবে কাজও অত্যন্ত জরুরি।মেয়েদের জন্য ধার্যকৃত সময় তাদের দিয়েই তারপর নিজের দায়িত্বের দিকে এগোয়।দুজনকে একসাথে সামনে বসিয়ে মাহরুর বললো,

“অফিসে আমাকে মানুষ কি বলেছে জানিস?”

মল্লিকাও জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলো, “কি?”

মেহুলের গাল টেনে দিয়ে বললো, “এই পাজি মেয়েটা আমার মুখের উপর যে নকশা করেছে সেটা দেখে সবাই হাসছিলো।আর বলছিলো নতুন নতুন বাবা হলে এমনি হয়”

বোধহয় এমন কথা মেহুলের পছন্দ হয়নি।ছোট্ট হাত তুলে বাবার হাতের উপর চাপড়াতে শুরু করেছে।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জোরেশোরে কান্না শুরু করে দিলো।অহেতুক!অযথা!
মাহরুর কোলে তুলে নিতে চাইলে ছট্ফট শুরু করে।মল্লিকা এসে কোলে তুলে নিলো তাকে।মায়ের কাধে মাথা এলিয়ে হেঁচকি তুলে যাচ্ছে।

মাহরুর এমন অবস্থায় বললো, “আমি কি ভুল কিছু বলেছি?কান্না করলো কেনো?আর মেহুল কি আমাদের কথা বুঝেছে?”

“বুঝেছে কিনা জানি না।তবে তৈরি থাকুন। মেহু মোটেও মিষ্টির মতন না।তার লক্ষণ দেখে বোঝা যাচ্ছে ভীষণ রকমের জেদী হবে এই মেয়ে।”

চলবে…

[দুঃখিত পর্বটা এলোমেলো হয়েছে]

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৪৩

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৪৩
লেখা : Azyah_সূচনা

হীনতার সংসার বেশ ভালো না হলেও।চলছে! অন্যান্য মাসের চেয়ে ব্যতিরেক সময়টা। অতিরিক্ত কাজ থেকে আজ রেহাই পেলো।একমাসের বেতন নিয়েছে বলে ছয়মাস অতিরিক্ত কাজ করে উসুল করলো মাহরুর।আজ ডিরেক্টর শরিফুল রেগে গেছেন মাহরুরের উপর।অহেতুক বাড়তি কাজ কেনো? তারাতো তাকে বলেনি বেশি কাজ করতে?কয়টা টাকা বেশি পাওয়ার আশায় যে মাহরুর নিগ্রহ শুরু করেছে সেটা কি আর ডিরেক্টর বুঝবে?ঘরের খরচ,মিষ্টির স্কুলের বেতন, মেহুলের দেখভাল থেকে শুরু করে বাদবাকি সবকিছু মিলিয়ে বিগত ছয়মাস গিয়েছে দুর্বিষহ।আজ মেয়েটার মুখে প্রথমবারের মতন খাবার তুলে দিবে।শুনেছে মানুষ নাকি ঘটা করে আয়োজন করে এই দিনে।কে জানে নিয়ম নাকি কুসংস্কার? মাহরুরের এসব চেতনা মস্তিষ্কে আনার সময় নেই।

এক সপ্তাহের বাজার হাতে হাঁটছে রেদোয়ান আর মাহরুর।নিজের প্রতি অভিযোগ জানালো।এখনও অফিসের প্রয়োজন মোতাবেক ল্যাপটপ কিনতে পারেনি।

রেদোয়ান উত্তরে বলে, “টাকা হলে অবশ্যই কিনে নিবে।
তাড়াহুড়োরতো কিছু নেই”

“টাকাটা হবে কখন?একই নিয়মেই চলছে সব!”

“জীবনের উপর এত নিরাশ হয়ো না মাহরুর।খারাপ কিছুর মধ্যেও ভালোর আশা করতে হয়।”

“আমার নিজের জন্য চিন্তা নেই।নাই চন্দ্রের জন্য।ওকে আমি দুমুঠো ভাত খাইয়ে রাখলেও কোনোদিন অভিযোগ করবে না।আমার যত দুশ্চিন্তা আমার মেয়েদের জন্য।সামনে ওদের একটা ভবিষ্যৎ আছে।”

“হচ্ছেতো মাহি।ধীরেধীরে আরো হবে।আগে কোনো পথ ছিলো না।এখন আশার আলো আসে তোমার ঘরে।ভালো চাকরি পেয়েছো।নিজের ব্যবসা করছো।সময় লাগবে কিন্তু সাফল্যের মুখ দেখবে আমি জানি।” কাধে হাত রেখে বলল মাহরুর।

মাহরুর মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো।এই দীর্ঘশ্বাস অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এসেছে।কথা বাড়ালো না।বললো,

“বাড়ি চলো। চা খাবে”

“সেখানেইতো যাচ্ছি।কেনো তুমি জানো না?”

“নাতো”

“ভাইজির মুখে স্বয়ং তার মনি খাবার তুলে দিবে।গিয়ে দেখবো শিরীন আর আমার ল্যাদা বাচ্চারা সেখানে হাজির।”

বসতে শিখেছে মেহুল।ধীরেধীরে হাত পা নড়চড় করে। মেহুলের সাথে মিষ্টিটা হয়ে উঠেছে লক্ষী বাচ্চা। বোনের দায়িত্ব ঘাড়ে নিচ্ছে।মায়ের সাথেসাথে নিজেও দেখভাল করে ওর।আজকাল সে ভীষণ ব্যস্ত। মাহরুর পড়াতে পারে না।স্কুল থেকে আসার পথে শিক্ষিকার বাসায় পড়ে তারপর ফিরে।শুধু খাবারের অনীহাটাই রয়ে গেলো। মাহরুর তাকে মেহুলের দোহাই দিয়ে দিয়ে খাওয়ায়।

ঘরে এসে দেখলো তার কন্যাদ্বয় একই সাথে;একই ধরনের কাপড় পড়ে বসে আছে।শুধু মাপের তফাৎ। মাহরুরকে চোখে পড়তেই কি যেনো হলো। মেহুল হাত তুলে দিলো।কোলে চড়বে বলে নিঃশব্দে ইশারা করে যাচ্ছে।তার দেখাদেখি নকল করলো মিষ্টি।

আর বললো, “মেহু তুমিতো কথা বলতে পারো না।দেখবে আমি এখন কথা বলে মাহি বাবাকে ডেকে নিবো।”

এই সময়টায় মাহরুর তাড়াহুড়োয় থাকে।কখন হাত মুখ ধুয়ে এসে একজোড়া চাঁদকে বুকে জড়াবে।আজও তাই।হাত মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে একটানে শার্ট পাল্টে নেয়। টিশার্ট পড়ে বিছানার মধ্যিখানে বসেছে।একপাশের উরুতে এসে বসলো মিষ্টি অন্যকোলে মেহুল।নব্য চঞ্চলতায় মেতে মেহুল হাত পা তুলে মাহরুরের মুখ বরাবর এসে হাজির।ছোট্ট হাতে খামচে ধরলো দুইগাল।মিষ্টির মায়া হলো। মেহুল হাত সরিয়ে নিতেই গালে হাত বুলিয়ে দেয়।

বলে, “তুমি ব্যাথা পেয়েছো মাহি বাবা?”

“প্রথমে ব্যথা পেয়েছিলাম।এখন আমার বড় মেয়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছে।সব ব্যথা ভ্যানিশ!”

“তাই?”

“হ্যাঁ।”

মিষ্টি বুদ্ধিমতির মতন বলে উঠলো, “মেহুতো ছোট মাহি বাবা।না বুঝে ব্যথা দিয়েছে।”

মাহরুর মিষ্টির মুখে বুঝদার কথা শুনে ভ্রুদ্বয় উচু করে। চমকিত খানিকটা।হয়তো মেয়েরা খুব তাড়াতাড়িই বড় হয়ে যায়।এই ভাবনার মাঝে আসলো আরেক ভাবনা।এই দুজনকে একদিন বিদায় দিতে হবে।অন্যের ঘর আলোকিত করবে তারা।একা রয়ে যাবে মাহরুর আর মল্লিকা।এসব চিন্তায় মন খারাপ হতেই নিচ্ছিলো ঠিক তখন কল্পনায় মাহরুর নিজের মাথায় নিজে চাপড় মারলো।মনে মনে বললো এখনও অনেক দেরি মেয়েদের বিয়ের।এখন এসব ভাবার সময় না।

শিরীন বাবা মেয়েদের মধ্যিখানে বলে উঠে, “বাপকে পেলে আর কোনো হুশ থাকে না দুই বুড়ির।এইযে আমি কতক্ষন যাবৎ এসেছি?একটা বার যদি আমার কোলে আসতো? তাকালোও না একবার।”

“তুই যে ঝগড়ুটে” মাহরুর জবাব দিলো।

“বেশি কথা বলবে না ভাইয়া।এই বয়সে মারামারি করতে চাও নাকি?”

“আমি একটা দিলে পাঁচতলার নিচে গিয়ে পড়বি”

“আমার ব্যাকআপে আমার জামাই আছে।”

রেদোয়ান এর দিকে চাইলো সকলে।ততক্ষনে রেদোয়ান হাত সারেন্ডার করেছে।সে এসবে নেই মাথা নেড়ে বলে দিলো।নিজেকে সরিয়ে নিলো ভাই বোনের যুদ্ধর মধ্যে থেকে।শিরীন জোর করেই মেহুলকে কোলে নিয়েছে।রমজান সাহেব,ফরিদা বেগম এবং রহিম মিয়া ও জোবেদা খাতুনও এসেছেন। দুলালও আসবে কিছুক্ষনের মধ্যে।

মেহুলের মুখে নিজ হাতে খাবার তুলে দিলো শিরীন।প্রথমবারের মতন ভিন্ন কোনো খাবারের স্বাদে নাক মুখ কুচকে নেয় মেহুল।তার বাচ্চা মুখে এমন প্রতিক্রিয়া দেখে সবাই একত্রে হেসে উঠলো।ফরিদা বেগম মল্লিকাকে বুঝিয়ে পড়িয়ে দিতে লাগলেন।কি করে খাওয়াতে হবে তাকে।আগামীকাল তারা ফিরে যাবেন।তাই আগেই তাগাদা দিলেন।
মল্লিকা আকস্মিক হেসে উঠে।মেয়ের হাসি দেখে ফরিদা বেগমও মুখ কুচকে নেয়।

বলে, “কি হলো?হাসছিস কেনো?”

হাসি থামিয়ে উত্তর দেয় মল্লিকা, “আম্মা তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো আমি নতুন মা নই।আগেও এসব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি।কাকে শেখাচ্ছ?”

কপালে হাত রাখেন ফরিদা বেগম। সত্যিইতো! মিষ্টিকে লালন পালন করেছে মল্লিকা।সেখানে শেখানো পড়ানোর কিছু নেই।মিষ্টির জন্ম থেকে বেড়ে উঠার সময়কালে তাদেরকে কাছে পায়নি রমজান সাহেব এবং ফরিদা বেগম। হাতে গোনা যাবে।মাত্র দুই থেকে তিনবার দেখা হয়েছে। বাগানবাড়িতে তাদের আসা যাওয়া ছিলো রেহালা বেগমের কাছে অপছন্দনীয়।একবার সরাসরি বারণও করেছিলো।সেই চিন্তায় হয়তো মেয়ের মা হওয়ার সময়টাকে উপভোগ করতে অনেকটা পেছনে পড়ে গেছে।

মল্লিকা মাকে জড়িয়ে ধরলো।কি করে যেনো বুঝে গেলো মায়ের মনের ভাবনা।জড়িয়ে বলতে লাগলো,

“আম্মা!পুরোনো কথাগুলো আর পূনরায় মনে করবে না।”

ফরিদা বেগমও উত্তরে বলেন, “ওসব আমি মনে করলেও গায়ে মাখি না।”

“আর ক’ টাদিন থেকে যেতে?”

“মেয়ের শশুরবাড়িতে আর কতদিন বল!আবার আসবো।তুই তোর মেয়েগুলোকে সামলে নিস কিন্তু।”

“আমাকে কে সামলাবে মা?”

“মাহি আছে না?”

“আর ওনাকে?” লাজুক স্বরে প্রশ্ন করে মল্লিকা।

“তোরা আছিস কি করতে?”

হাস্যোজ্জ্বল দুটো মুখ।দুজনেই নারী। কন্যা সন্তানের জননী।কারো স্ত্রী।তাদের চেয়ে ভালো একে ওপরের মনের ভাব কে বুঝতে পারবে?চোখে চোখে অনেক বুঝ দিয়ে যাচ্ছেন ফরিদা বেগম।যা পূর্বের সংসারে দিতে পারেননি।সেতো অভিজ্ঞ। অভিজ্ঞতার ঠিকঠাক প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি মেয়ের সংসারে।যেখানে ছিলো মেয়ের মুখ দর্শন দুষ্কর।

___

অনেকদিন পর আজ ছুটির মুখ দেখেছে।সারাদিন ঘুমাবে।আজ মেয়েদের সাথেও সময় একটু কমই কাটানো হবে।দরকার পড়লে মল্লিকাকে আদেশ করবে খাবারটা মুখে তুলে দেওয়ার জন্য।মহারাজ সেজে বিছানা নামক সিংহাসনে পুরো শরীর এলিয়ে দিয়েছে।উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমদেরকে তাড়া করছে যেনো দ্রুত এসে হাজির হয়।তার পিঠের উপরে আরেকজনের অবস্থান। মেহুল এর।বাবার পিঠে চড়িয়ে বসিয়েছে তাকে মিষ্টি।ওজন বেশি নয়।কোনো রকম অসস্তি হলো না মাহরুরের। ভাবান্তরবিহীন একইভাবে শুয়ে আছে।মাঝেমধ্যে ধারালো নখ বসাচ্ছে বাবার উন্মুক্ত পিঠে।এবার বুঝি পিত্তি জ্বলে মাহরুরের।

মল্লিকার উদ্দেশে বলে সামান্য মাথা উচু করে, “ওর নখ কেটে দিতে পারিস না।গতকাল মুখে আঁচড় বসিয়েছে। আজ পিঠের ওপর নকশা করছে”

মল্লিকা তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বললো, “মেয়ের এতটুকু অত্যাচার সহ্য হয়না।আমি পেটে নিয়ে মাসের পর মাস ঘুরেছি।”

“আমাকে একা ব্যাথা দেয় সেটা কথা না।ওর নিজের মুখেও নখের দাগ।”

মল্লিকা সরাসরি উত্তর দিলো, “আজ আপনি নখ কেটে দিবেন।”

মেহুল মাথা আকিয়ে বাঁকিয়ে শুনলো। ধপ করে নিজেও বাবার পিঠে উপর হয়ে শুয়ে পড়ল। আহ্লাদ দেখাচ্ছে হয়তো।মিষ্টিও পিছিয়ে নেই।পাশে এসে একই ভঙ্গিতে শুয়ে পড়েছে। দুজনার একত্রিত ভার বহন করে আছে মাহরুর।

বললো, “দেখেছিস কি চালাক?ব্যথা দিয়ে এখন আদর দেখাচ্ছে।….আর বড় জন আরো একধাপ এগিয়ে। ছোটোজন ভুল করে বড়জন ভুলের উপর পর্দা দেয়।”

“উফ চুপ থাকেন!কি সুন্দর লাগছে আপনাদের তিনজনকে।আপনার ফোনটা কোথায়?একটা ছবি তুলি ”

মাহরুর বাম হাত তুলে আঙ্গুলের ইশারায় ফোনের স্থান দেখালো।উত্তর দিতেও আলসেমি লাগছে।উপরে দুজনকে মনে হলো কম্বলের মতন।আরামে আবেশে চোখ বুজে পূনরায়।

মল্লিকা ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নেয়।সেও যোগ দিবে তাদের মধ্যে।পাশে গিয়ে বসতে চাইলেই দুলাল আসে।দরজা ধরে হাঁপাতে লাগলো।মুখ দেখে মনে হলো ভীষণ ভীত।মল্লিকা হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়।এগিয়ে যায়।

জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে, ” দুলাল? কি হয়েছে?”

“ভাবি!”

মৃদু ঘুমটা যখনই চক্ষে এসে ধরা দিচ্ছিলো ঠিক তখনই দুলালের অস্থির গলায় মাহরুরের কান খাড়া হয়।খুবই সাবধানতার সাথে হাত পেছনে মুড়িয়ে দুই কন্যাদ্বয়কে নামালো পিঠ ঠেকে।

ইতিমধ্যে নিঃশ্বাসের গতি স্বাভাবিক করে দুলাল বললো, “চাচা অজ্ঞান হইয়া গেছে।ওনার ছেলে ফোন দিছিলো।পড়ে কয়জন লোক পাঠাইছে।তারা নাকি এই বাড়ি কিনা নিবো।এই কথা শুইনা রহিম চাচা অজ্ঞান হইলো।চাচী ভাইরে ডাকে।”

বিস্ফোরিত নয়ন মাহরুর আর মল্লিকার।এক মুহুর্ত দেরি করলো না।পাশ কাটিয়ে উঠে গেছে।গায়ে জড়িয়েছে টি শার্ট।কদমের দ্রুততা বাড়িয়ে দোতলায় পা বাড়ায়। মল্লিকা মেহুলকে কোলে তুলে নেয়।নিচে গেলো। মিষ্টিও পিছু নিল বাবা মায়ের।

দুলালকে পাঠানো হয়েছে ডাক্তার ডাকতে। মাহরুর মাটিতে লুটিয়ে থাকা রহিম মিয়ার মাথা তুলে নিজের কোলে রাখলো।পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে বারংবার।জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা।মল্লিকা একহাতে মেহুল অন্যহাতে সামলাচ্ছেন ক্রন্দনরত জোবেদা খাতুনকে।শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।ডাক্তার আসলো বিশ মিনিটের মাথায়। পর্যবেক্ষণ করলো বেশ সময় নিয়ে।

রহিম মিয়াকে ইনজেকশন দেওয়া শেষে কঠোর গলায় ডাক্তার মাহরুরের উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনি কি ওনার ছেলে?…. এই বয়সে ওনার এত চাপ কিসের?দেখে শুনে রাখতে পারেন না।ভাগ্য ভালো অতবড় কোনো বিপদ হয়নি।”

মাহরুর ধমকটুকু হজম করে নেয়। সবিনয়ে বলে, “আমি ওনার ছেলে নই ডাক্তার।”

থতমত খেয়ে ডাক্তার বলেন, “অ্যাম রিয়েলি সরি।”

“সমস্যা নেই ডাক্তার।আমি ওনার ছেলের মতনই।কি হয়েছে চাচার একটু বলবেন?”

“অনেক বেশি স্ট্রেসড উনি।কোনো বিষয়ে অনেক চিন্তা করছিলেন।তাছারাও আগের মেডিসিনগুলোও সময়মতো নিচ্ছেন না।”

রহিম মিয়ার বাড়িতে কাজ করেন আরো এখন মেয়ে।ডাক্তারের কথা শুনে বললেন, “চাচাজান এর ওষুধ দেওয়ার দায়িত্ব আমার।তিনদিন ধইরা ওষুধ নিয়া পিছনে ঘুরতাছি।খায় না।খালি কয় এমন কুলাঙ্গার পোলা জন্ম দিছি আমার ওষুধ খায়া বাঁচন লাগবো না আর। বাচ্চাগো মতন জেদ করছে।হইলো তো বিপদ!”

মাহরুর বললো, “আমাকে ডাক দিতে?”

“মনে আসিলো না ভাইজান”

ডাক্তার বললেন, “আপনাদের পারিবারিক কলহ থেকে ওনাকে কিছু সময়ের জন্য দূরে রাখুন।আগের ওষুধ চলবে।নতুন দিয়ে যাচ্ছি। আনিয়ে নেবেন।সাথে পুষ্টিকর খাবার। উনি ঠিক আছেন।আমি আসি”

মাহরুর উঠে দাড়ালো।ডাক্তারের সাথে হাত মিলিয়ে তার সম্মানীটা দিয়েছে।পরপর বললো, “ধন্যবাদ স্যার”

রহিম মিয়া ঘুমোচ্ছেন। মাহরুর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ভাবলো। যার আছে সে মূল্য দেয় না। যার নেই সে হাহাকার করে।রহিম মিয়ার পাশ থেকে সরে জোবেদা খাতুন এর কাছে এসে বসে।

বলে, “বলেনতো চাচী আসলে কি হয়েছিল?”

কান্নার জোর বাড়িয়ে জোবেদা খাতুন উত্তর দিতে লাগলেন, “আমার পোলায় লোকজন পাঠাইছে।তারা আয়া আমগো পুরা বাড়ি দেইখা গেছে।এক সপ্তাহের মধ্যে নাকি নগদ টাকা পরিশোধ কইরা বাড়ি কিনা নিবো।”

“এসব আপনার ছেলে ওই দেশে বসে করছে?”

“হ।এই লোকগুলারে নাকি ফোন কইরা কইছে বাড়ি বেচবো।দেইখা আইতে।দলিলে সই করানো নাকি তার কাছে ওয়ান টু এর ব্যাপার।”

“আপনাদের হুমকি দিয়েছে?”

“গলার সুরতো ওই রকমই ”

মল্লিকার দিকে এক পলক চায় মাহরুর।এই মুহূর্তে শান্তনার পাশাপাশি একটা সমাধান দরকার।এভাবে চলতে থাকলে প্রতিনিয়ত মানুষ এসে বিরক্ত করবে।কথায় বোঝা যাচ্ছে রহিম মিয়ার ছেলে বাড়ি বিক্রি না হওয়া অব্দি ক্ষ্যান্ত হবে না।অবশ্যই কোনো কারণ আছে এর পেছনে।কোনো বিশাল কারণ।

মাহরুর জোবেদা খাতুনকে বললেন, “একটু নিজের মনকে শক্ত করুন।একটা জিডি করে রাখুন পাশের থানায় যেনো কেউ বারবার আপনাদের কেউ বিরক্ত না করে।তাছারাও ছেলেকে এক বাক্যে বলে দিন বাড়ি আপনারা বিক্রি করছেন না।তার সাথে কিছুদিন কথা বন্ধ রাখুন। আপনাআপনি ভুত নেমে যাবে।”

“আমিতো মা।কলিজা জ্বলে আমার।”

“তাইতো বললাম শক্ত হতে।আমার কথায় কিছু মনে করবেন না।আমি আপনাদের ভালোর জন্য বলছি”

“আইচ্ছা!তোমার চাচার হুশ ফিরুক।কথা কমু।”

“আরেকটা কথা চাচী।দলিল সযত্নে রাখবেন।”

___

মধ্যে কেটে গেছে আরো কয়েক দিন। রহিম মিয়া মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। মাহরুরকে সাথে নিয়ে গিয়ে থানায় জিডি করেছে জোবেদা খাতুন।সাথে ছেলে বিমুখীও হয়েছেন।কথা বলেননি একদমই।পরিষ্কার গলায় জানান কোনোভাবেই বাড়ি বিক্রি হবে না।

ছাদে পাটি বিছিয়ে মা মেয়েদের আড্ডা চলছে। বালিশের সাহায্যে বসিয়ে রাখা মেহুলের এক বিন্দু সস্তি নেই।বারেবারে এদিক ওদিক হামাগুড়ি দিয়েই চলেছে মেয়েটি।আজকাল সে ভীষণ দুরন্ত;চঞ্চল।মিষ্টি এমন ছিলো না।যেখানে বসানো হতো সেখানেই বসে থাকতো চুপচাপ। রোদ পোহাতে পোহাতে চোখ পড়ে কোমরে দুহাত রেখে দাড়িয়ে থাকা মাহরুরের দিকে।কখনো হাত তুলে শূন্যে কিছু আকাঝুকি করছে।কখনো মাথা বাঁকিয়ে ভাবছে।তাদের ঘরের পাশেই বিশাল জায়গা।পুরোটা জায়গা খালি।কে জানে খালি জায়গায় চেয়ে মাহরুর কি দেখছে?

মল্লিকা ডাকলো নরম কণ্ঠে, “মিষ্টির বাবা?”

হুশ ফিরলো যেনো মাহরুরের।পিছনে ফিরে বললো, “হ্যা?.. বল”

“কি করছেন একা দাড়িয়ে?”

মাহরুরও এসে যোগ দেয়।পাটিতে পা ভাজ করে বসলো।কেটে রাখা আপেলের টুকরো মুখে পুড়ে দিয়ে বললো, “দেখছিলাম আর ভাবছিলাম এই খালি জায়গায় আরো সুন্দর তিনটে ঘর হবে।”

মল্লিকা জবাব দেয়, “হবে কিন্তু করবে কে?রহিম চাচার ছেলে?সেতো বাড়ি বিক্রির জন্য পাগল।”

“সেটা অবশ্য ঠিক”

“আপনি তাহলে শূন্যে আকাআকি কেনো করছিলেন।”

“ভাবছিলাম কেমন ডিজাইন হতে পারে।”

মল্লিকা আবারো প্রশ্ন করলো, “যেখানে বাড়ি থাকবে কিনা নিশ্চয়তা নেই সেখানে ডিজাইন ভেবে কি হবে?আপনি ভেবেই বা কি করবেন?”

“হুম” ছোট্ট করে উত্তর দেয় মাহরুর।

গম্ভীর মাহরুরের মুখখন্ড। নেত্র পল্লব নিম্নে ঝুঁকে আছে।মস্তিষ্কে কোনো চিন্তা থাকলে ঘাড় চেপে বসে থাকে।মল্লিকা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো তাকে।ভাবুক তার ভঙ্গি।

মিনিট খানেক পর প্রশ্ন করলো, “আপনি কিছু ভাবছেন কি?”

“হুম?…না!”

চলবে….

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৪২

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৪২
লেখা : Azyah_সূচনা

“আগে থেকে পরিষ্কার করছি একটা কথা চন্দ্র।কখনো ভাববি না আমি আমার নিজের মেয়েকে মিষ্টির চেয়ে বেশি ভালোবাসবো। ধারণাটা কোনোদিন মস্তিষ্কে আসতে দিবি না। মেহুল ছোট হতে পারে ওরদিকে একটু বেশি যত্ন দেখাবো।তবে মিষ্টির ক্ষেত্রেও কোনো অনীহা হবে না।ভুলে যাস না সবার আগে মিষ্টিই আমাকে বাবা বলে ডেকেছে।আর ওই ডাকটা আমার কাছে সর্বদা অমূল্য থাকবে।”

চক্ষু ফেরায় মল্লিকা।মাত্রই মাহরুরের রাশভারী কন্ঠ এই বাক্যগুলো ছুঁড়েছে।কর্ণপাত হতেই মস্তিষ্ক জাগ্রত হলো। হঠাৎ করে এমন বলার কি অর্থ দাঁড়ায়?কেনো আসছে হুট করে এসব কথা?

মল্লিকা তৎক্ষনাৎ উত্তর দেয়।বলে, “আমি কল্পনায়ও এটা ভাবতে পারিনি আপনি মিষ্টি আর মেহুলের মধ্যে ভেদাভেদ করবেন।”

নিশির আধাঁরে সাদা রোশনি জ্বালানো চিলেকোঠার ঘরটায়।অনেকদিন পর এই ঘরটায় নিজেদের অবস্থান।ভালো লাগায় ভরপুর।এর মধ্যে মাহরুরের বাক্যযুগলকে কঠোর মনে হলো। কাঠিন্যর আভাস পাওয়া গেলো।

মাহরুর উত্তর দেয়, “মানুষের মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।ভাবতে না চাইলেও ভাবনা চলে আসে।”

“কখনো না। মিষ্টিও আপনার মেয়ে আর মেহুলও।”

“সেটাই নিজের মাথায় গেঁথে ফেল।আর কেউ কটূক্তি করতে এলে তার মস্তিষ্কেও গেড়ে দিবি।”

মল্লিকা মলিন মুখে বলে, “রাগ করছেন কেনো?”

“রাগ করছি না।কঠোর হয়ে বলছি।এসব ব্যাপারে একটু রুক্ষতা অবলম্বন করতে হয়।নাহয় মিষ্টভাষা মানুষ বেশিদিন মনে রাখে না।”

মেহুলকে মাহরুরের কোলে তুলে দিলো মল্লিকা।এখানে চলবে তার রুক্ষতা?একদমই নয়।মল্লিকা মিনমিনে গলায় আওড়ায়,

“আপনার রুষ্ট – মিষ্ট সকল কথাই আমার মনে থাকে।”

মাহরুর ইচ্ছেকৃত জানতে চাইলো, “কেনো?”

বিনা দ্বিধায় মল্লিকা জবাব দেয়, “কারণ আমি আপনার জীবনে বিশেষ একজন।”

মাহরুর উত্তর দিলো, “আমার জীবনে বিশেষ দুইজন।একজন আমার কোলে আরেকজন তোর পাশে হা করে ঘুমিয়ে আছে।”

মল্লিকা কপাল কুঁচকে বললো, “অনীহা করছেন আমায়?”

ভাবলেশহীন মাহরুর বললো, “করছি।তো?”

“করলেও লাভ নেই।অনন্তকাল আমার সাথেই থাকতে হবে।”

লম্বা শ্বাস টেনে নেয় মাহরুর।দ্রুত ছেড়েও দিলো। মেহুল এর ছোট্ট হাত মাহরুরের বলিষ্ঠ তর্জনী আঙ্গুল চেপে আছে।ঘুমোচ্ছে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে। এতো চোখের শান্তি। নীরবতা চলছে সম্পূর্ণ কামরা জুড়ে।মল্লিকা দেখছে একে একে তিনজনকে।

সময়ের ব্যবধানে মাহরুর বলে, “দ্রুত সুস্থ হ চন্দ্র।যত্নের প্রয়োজন আমার।ভীষণ রকমের ক্লান্ত আমি”

মাহরুরের নিদারুণ চাওয়া।মল্লিকা ভাবলো এখন কি দুঃখ পাওয়া উচিত মাহরুরের এরূপ কথায়?তবে হলো না।বেশ ভাল লাগলো তার এই কথাটা।নিজে থেকে যত্ন চাইছে।এই কথাটিও ভালো লাগায় ঘেরাও করতে পারে?হয়তো পারে।এক দীর্ঘশ্বাস মল্লিকাকে শক্ত করলো।দ্রুত কাটাতে হবে কায়ার অদৃশ্য অসুখ। দেবীরূপে তার একান্ত মানবের বাহু জড়িয়ে সামলে নিতে হবে।বলে মা হওয়া সহজ নয়।কত কষ্ট! কত যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়।বাবা হওয়া কি এতই সহজ? শারীরিক নয় মানসিক যন্ত্রণা বলেও কিছু আছে।

“আপনার এই চাওয়া খুব শীগ্রই পূর্ণ করবো।এবার আপনার যত্ন পাওয়ার পালা।”

পুরো দমে অফিসের কাজে মজেছে মাহরুর। ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিজের উপর জুলুম চালাচ্ছে।সুযোগ দেওয়া যাবে না কাউকে।অনেকবার সাহায্য করেছে ডিরেক্টর।কথা দিয়েছে যেহেতু সেটা পূর্ন করার দায়িত্ব তারই।এরমাঝে যোগ হলো আরেক দুঃখ।নিজের ফুটফুটে সন্তানকে সময় দিতে পারছে না।অনেক কাজ পেন্ডিং।বাড়ি ফিরে দেরিতে।এসেই দেখে ঘুমিয়ে আছে তার হৃদয়ের দুই অংশ।ফরিদা বেগম আর রমজান সাহেব থাকায় অনেকটা চিন্তা কমেছে।সামলে নেয়।

সন্ধ্যা সাতটায় সম্পূর্ণ অফিস খালি।এমডি স্যার,কয়েকজন সিনিয়র আর কিছু স্টাফ ছাড়া কেউ নেই।যান্ত্রিক কম্পিউটার এর সামনে বসে আঙ্গুলের সাহায্যে কি বোর্ডের কি চাপছে।ঠিক তখনই তার ডিরেক্টর শরিফুলের আগমন।

এসে বললেন, “মিষ্টার মাহরুর?”

“জ্বি স্যার” তড়িৎ গতিতে উত্তর দেয় মাহরুর।

“আপনি কি ল্যাপটপ কিনতে পেরেছেন?”

দৃষ্টি নত করে মাহরুর মাথা দোলায়।বলে, “না স্যার।”

“ল্যাপটপ দরকার।আমি অফিসের পুরোনো একটা ল্যাপটপ আপনাকে দিচ্ছি।আপনি আপাদত সেটায় কাজ করেন।একটু পুরোনো মডেল।আপনি কিনলেই ফিরিয়ে দেবেন।কোনো সমস্যা আছে?”

“না স্যার কোনো সমস্যা নেই।”

“আচ্ছা যাওয়ার পথে নিয়ে যাবেন।”

“ওকে স্যার।”

শরিফুল চলে যেতে নিয়েও ফিরে আসেন।বলেন, “ওহ হ্যা?আপনার মেয়ে কেমন আছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ স্যার ভালো আছে।”

“ওকে একদিন আসবো।ইউ টেক কেয়ার।বায়”

চারিদিকে শীতশীত ভাব।তোড়জোড় চলছে নতুন মৌসুমকে বরণের।বাতাসের সাথে মিশে আসে এক নিত্য সুভাষ।প্রেম পায় এই ঘ্রাণে।পকেটে হাত গুজে হাঁটতে হাঁটতে হাসলো মাহরুর। অভ্যন্তরীণ অনুভূতি আশ্চর্য্যতম। বয়েস বেড়ে দাঁড়িয়েছে চৌত্রিশে।আর অন্তর কিনা নব্য প্রেমিকের বেশ ধরেছে?এই সময়টা ভীষণ অদ্ভুত।কিশোরী মল্লিকার ন্যায় হৃদয়ে প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে।অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথ দৈর্ঘ্যের মাঝে কত অনুভূতিরা ভিড় জমাতে শুরু করলো।ইচ্ছে হচ্ছে দুজনায় হাতে হাত রেখে উপভোগ করুক রাতের শহর।অল্প বয়সী প্রেমিক যুগলের ন্যায় করুক কিছু অবুঝ কর্মকাণ্ড।যা হবে অন্যের চোখে ছেলেমানুষী।

ঘ্রাণেন্দ্রি়য়তে ভেসে এলো ফুলের সুভাস।আর দর্শনশক্তিতে একগুচ্ছ চন্দ্রমল্লিকা ফুল।কোনো ভাবনাবিহীন কদম এগোয় সেখানে।টাকার কমতি।সেখানে তোয়াক্কা না করে কিনে নিল একটা ফুল।

ফুল বিক্রেতা বৃদ্ধা নারী মুচকি হেসে জানতে চাইলেন, “প্রেমিকার লেইগা নিবেন?”

মাহরুর ফটাফট এক কদম পেছনে হটে বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে বললো,

“দেখেন কাকী?আমাকে দেখলে মনে হয় আমি কারো প্রেমিক?”

“হইবো না কেরে?মেলা সুন্দর চেহারা।”

“আপনিও কিন্তু সুন্দর কাকী?” দুষ্টুমির সুরে বললো মাহরুর।

“যাহ!কি কয় না কয়।নিবেন কার লেইগা হেইডা কন দেহি?”

“আমার রূপবানের জন্য নেবো।”

দাঁত বের করে হেসে বৃদ্ধা জবাব দিলেন, “তয় আমি কি ভুল কিছু কইছি? প্রেমিকাইতো।”

“প্রেমিকা না আমার মেয়েদের মায়ের জন্য নিবো।আর হ্যা চন্দ্রমল্লিকা ফুল দিবেন।আমার রূপবানের নাম চন্দ্রমল্লিকা।”

যেনো বৃদ্ধা বেজায় খুশি হলেন। চট জলদি দুটো টকটকে লাল চন্দ্রমল্লিকা ফুল নিয়ে স্কচটেপে মুড়িয়ে মাহরুরকে দিলেন।

আর বললেন, “তিরিশ টাকা”

মাহরুর একশো টাকার একটা নোট বের করে দিলো তাকে।বৃদ্ধা বললেন,

“ভাংতি নাই।আজকে বেচাকিনি হয় নাই।”
“রাখেন পুরোটাই।আর এখন বাড়ি চলে যান।ঠান্ডা পড়ছে ধীরেধীরে।”

“আমারে দিলেন পুরা টাকা?”

“হ্যাঁ”

“আইচ্ছা”

একশত টাকা এই যুগে বড় অংক বলে ধরা হয়না।ছুঁয়ে দিলেই উধাও।তবে বৃদ্ধা নারী ওই টাকাই তুষ্ট।অল্প সময়ে যেনো তার সাথে জীবনের টুকটাক কথা আদান প্রদান হয়ে গেলো।হাসি মুখে বিদায় নিয়ে আর মিনিট পাঁচেক এর পথ হেঁটে বাড়ি ফিরেছে মাহরুর।

আওয়াজ দিতে দিতে আসলো মাহরুর।বললো, “আমার বাচ্চাদুটো কি করে?”

মিষ্টি লাফিয়ে উঠে। ঝাঁপ দেয় মাহরুরের কোলে।চুপচাপ মেহুল।কান অব্দি আওয়াজ হয়তো পৌঁছেছে।তবে তার কি সাধ্য আছে ঝাঁপ দেওয়ার?চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খুঁজছে আসলো কোথা থেকে তার বাবার আওয়াজটা।ফরিদা বেগম মাহরুরকে দেখেই দ্রুত চা বসিয়ে দিলেন চুলোয়।মল্লিকা কাঁধের ব্যাগ নিয়ে জায়গামতো রেখে দিয়েছে। মাহরুর মিষ্টিকে নামায়। ঝড়ের গতিতে হাত মুখ ধুয়ে ফিরে এলো আরেকজনের কাছে।বড় মেয়েকে একপাশে রেখে ছোট মেয়েকেও কোলে নেয়।

মল্লিকার পানে চেয়ে বললো, “আজ ঘুমায় নি কেনো? ওতো রাত জাগে না।”

মল্লিকা কাপড় ভাজ করতে করতে উত্তর দিলো, “কে জানে?হয়তো আপনার অপেক্ষায় ছিল।”

মিষ্টিও আহ্লাদী গলায় বলে উঠলো, “আমিও অপেক্ষা করছিলাম মাহি বাবা।”

“আমি জানিতো মা।তুই আর মেহুল বাবু আমার জন্য অপেক্ষা করে।আর কেউ করে নাকি?”

মিষ্টি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললো, “কেউ করে নাহ!”

মল্লিকা ফোড়ন কেটে বললো, “যে অপেক্ষা করেনা তার জন্যই আবার ফুল আনা হয়।”

ফরিদা বেগম মুখে আঁচল চাপলেন।হাসছেন হয়তো আবডালে।মাহরুর এর দৃষ্টিগোচর হয়।মল্লিকা অজ্ঞাত। মনভোলা।এটাও ভুলতে বসেছে পাশেই তার মা জননী বসে। অবলীলায় বলে ফেললো কথাটি। মাহরুর চোখ রাঙায়।ইশারা করে ফরিদা বেগম এর দিকে।মল্লিকা তড়বড় দাঁত দিয়ে জ্বিভ কাটলো।মুখ ঘুরিয়ে ধীর গতিতে অন্যদিকে ঘুরে গিয়েছে।

যত রাতই হোক আজ দোকানে যেতে হবে।ভাড়া দেওয়ার সময় এসেছে। মাহরুর চা খেয়ে চলে গেলো।দুলাল এর সাথে বসে আছে দোকানের মালিক।এসে গেছে ভাড়া আদায় করতে।
মাহরুর গিয়ে সবার প্রথমে হাত মেলালো। সালাম জানিয়ে বললো,

“সাজ্জাদ ভাই এ মাসের ভাড়াটা এখন দিতে পারছি না। জানেনইতো আমার মেয়ে হয়েছে। হাসপাতালে অনেক খরচা গেছে।আপনি কোনোভাবে এই মাসটা…”

“সামনের মাসেতো দ্বিগুণ হইবো টাকা” সাজ্জাদ এর কথার ভঙ্গিতে বোঝা গেলো মাহরুরের কথায় তিনি সন্তুষ্ট নন।টাকার ক্ষেত্রে তিনি কোনো সমস্যা দেখেন না।

মাহরুর বুঝতে পেরে বললো, “আচ্ছা ভাই আমার এডভ্যান্স এর টাকা থেকে কেটে রাখুন।অনেক সমস্যায় না পড়লে মাসের এক তারিখেই টাকাটা দিয়ে দিতাম।”

সাজ্জাদ ছোট্ট করে উত্তর দিলো, “হুম”

“কিছু মনে করবেন না ভাই।”

“আচ্ছা। আসি তাহলে।”

“ঠিক আছে ভাই।”

__

“আমার মল্লিকা বনে,
যখন প্রথম ধরেছে কলি
আমার মল্লিকা বনে।
তোমারো লাগিয়া তখনি, বন্ধু
বেঁধেছিনু অঞ্জলি।
আমার মল্লিকা বনে, আমার মল্লিকা বনে,
যখন প্রথম ধরেছে কলি
আমার মল্লিকা বনে।”

মাহরুরের কণ্ঠে মাতাল মল্লিকার অন্তর। পলকবিহীন আধাঁরে মুখ চেয়ে।চোখের নিচের স্পষ্ট কালি যে বেমানান।রোগা দেখাচ্ছে মুখটা।তবে কণ্ঠে সমস্ত মাধুর্য্য ঢেলে ভেলায় ভাসালো চন্দ্রমল্লিকাকে।কতদিন!কতদিন পর এভাবে একত্রে মুখোমুখি দুজন?

মাহরুর থেমে গেলো।মল্লিকা বললো, “থামলেন কেনো?ভালো লাগছিলো তো ”

“প্রেমালাপ করতে চাইছি।” সোজাসুজি জবাব দেয় মাহরুর।ভারী কণ্ঠে।

মল্লিকা ওষ্ঠধরের উপরে হাত রেখে হাসলো। ক্ষণিকের জন্য নামিয়ে নেওয়া দৃষ্টি তুলে পূনরায়।বলে,

“হঠাৎ এই ইচ্ছে কেনো?”

“কি জানি!আজ শীতের এক দমকা হাওয়া শরীর ছুঁতেই নিজের মধ্যে ভিন্নতা অনুভব করলাম।সারা রাস্তা হেসেছি।কি ইচ্ছে হচ্ছে আমার জানিস?”

“কিহ?”

“আবার নতুন করে প্রেমের সূচনা করি।ধরে নেই তুই আমায় চিনিস না।আমি তোকে চিনি না।কোনো সম্পর্ক নেই আমাদের মধ্যে।অন্যভাবে গল্পটা সাজাবো।তুই হবি অষ্টাদশী যুবতী আমি হবো তাগড়া যুবক।হুট করে শীতের এক সন্ধ্যায় আমাদের দেখা হবে।এক বিশাল গাছের নিচে। যার পাতাগুলো শুকিয়ে লুটিয়ে থাকবে জমিনে।”

আগ্রহী মল্লিকা শুনতে ব্যস্ত ছিলো। মাহরুরের থেমে যাওয়া দেখে গাল থেকে হাত নামায়।বলে, “তারপর?”

“তারপর তুই বল।কিভাবে গল্পটা এগোনো যায়?”

চিন্তন জগতে ডুব দিলো মল্লিকা।মুখখানা তুলেছে সামান্য শূন্যে।নেত্র পল্লব পিটপিট করে জোর দিচ্ছে মস্তিষ্ককে।আজ মাহরুর অপেক্ষায় মুখ চেয়ে রইলো।ভাবুক একটু।তার এই ভাবুক মুখটাও বেশ সুন্দর।
মল্লিকা দীর্ঘ সময় পর মুখ খুলে,

“তারপর আমাদের দেখা হতেই থাকলো।একবার, দু’বার,বারবার।ঠিক সেই জায়গাটায় যেখানে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিলো।”

মাহরুর তাল মিলিয়ে বললো, “তারপর একদিন আমাদের দুজনেরই মনে হলো?এই বারেবারে দেখা কি কাকতালীয়?নাকি প্রকৃতির কোনো ইঙ্গিত?”

মাহরুরের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। মাহরুর মুখ গুজলো তার ঘাড়ের উপরিভাগে।বিচরণ চালায়। মৃদু কম্পিত মল্লিকা জবাব দেয়, “নাহ! কাকতালীয় নয়। প্রকৃতি আমাদের ইঙ্গিত দিচ্ছে।যা আমরা একইসাথে বুঝে অনুভব করবো।”

মাহরুর বলে, “এতোদিনতো দেখা হলো। আজ নাহয় কথা হোক?প্রথম কদম আমিই এগোবো।”

“আমি প্রথমে অসস্তি অনুভব করবো।চোখ এড়াবো বারেবারে।তারপর আপনার কথার ছলে ফেঁসে দুয়েক বাক্য আমিও আওড়াবো”

“প্রতিদিনের দেখা কথায় রূপান্তরিত হবে।কথা থেকে শুরু হবে গল্প।বন্ধুত্ব হবে।”

“তারপর আমাদের একে অপরের অভ্যাস হয়ে যাবে।”

“অভ্যাসটা বদঅভ্যাসে পরিণত হয়ে বুঝে নিবো চন্দ্রকে নিয়ে বুকের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে অন্যরকম অনুভূতি।তবে অনুভূতি প্রকাশে করে ফেলবো বিলম্ব”

লম্বা নিঃশ্বাস নেয় মল্লিকা।কি যে ভালো লাগছে তার!এই আলাপন ভীষণ সুন্দর।তাল ছেড়ে দিল না। বরাবরের মতই উত্তর দিল,

“অনুভূতি যেদিন জানান দেবেন?আমি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে খড়খড়ে জমিনের দিকে চেয়ে থাকবো।আমাদের মধ্যে কি কোনো সমস্যা হবে?”

“একদম না। ঝামেলাবিহীন গল্প হবে।” কাটকাট গলায় উত্তর দেয় মাহরুর।

“আপনি আমার উত্তরের আশায় থাকবেন?”

“অপেক্ষায় শুকিয়ে পাড় করবো এক আস্ত রৌদ্রজ্জ্বল মৌসুম।”

“এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় সেই মৃত গাছে নতুন করে সবুজ পাতা আসবে।”

মাহরুর প্রশ্ন করে, “তারপর?”

“তারপর সেই বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় ভিজে একাকার হয়ে স্বীকৃতি দিবো ভালোবাসাকে”

“বিশ্বজয়ের হাসি মুখে দ্রুত তোকে নিজের নামে লিখিয়ে নেবো।যত ঝড় আসুক,বাদল আসুক।কেড়ে নিয়ে এই চিলেকোঠায় সুখের সংসারে মজবো।”

কল্পনার জগতে হারায় দুজনায়।নিজেদের অনুভব করছে গল্পে।এই গল্পের অংশ তারা দুজন।পরিচয় থেকে পরিণয় সবটাই দুজনার বদ্ধ চোখের সামনে স্পষ্ট।এতটা গভীর কি করে হয় এই কল্পনা।চোখের ফ্রেমে ভাসছে নতুন চিত্র।মনে হলো ওই জগতেই আছে।আশপাশ শূন্য।লম্বা শুকনো গাছ তলায় একেক অপরের দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করে চেয়ে আছে।

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৪১

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৪১
লেখা : Azyah_সূচনা

“গাড়ির ধর্মঘট এখনই হওয়া লাগতো!ফরিদা কত ছটফট করছে মাইয়াটার লেইগা!ওরা মানুষের বিপদ আপদও বুঝে না।সব বাস বন্ধ কইরা রাখছে।”

দীর্ঘ দশ দিন পর হাজির রমজান সাহেব এবং ফরিদা বেগম।মেয়ের আর নাতনির কথা শুনে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন। দূরপাল্লার বাসগুলো আকস্মিক ধর্মঘট শুরু করে।ট্রেন ব্যবস্থা নেই।প্রতিদিন কাউন্টারে গিয়ে খবর নিয়েছিলেন রমজান সাহেব। অবশেষে আসতে পেরেছেন ঢাকা।মেয়েকে দীর্ঘদিন পর বুকে জড়িয়ে সাহস দিলেন।ফরিদা বেগমও নিজের কান্না লুকান।

বলেন, “পরীক্ষা চলতাছে তোদের।সুখের জীবনে সামান্য পরীক্ষা মাত্র।ধৈর্য্য ধর!দেখবি সব ঠিক হইয়া যাইবো।”

মল্লিকা উত্তর দিলো, “তাই যেনো হয় আম্মা”

মাহরুর নাস্তা আনতে বাহিরে গিয়েছে।অনেকটা পথ জার্নি করে সরাসরি হসপিটালে এসেছে রমজান সাহেব আর ফরিদা বেগম। সারা রাস্তা না খেয়ে আছেন।আসার পথে দুলাল কল করলো।

বললো, “আসসালামু আলাইকুম ভাই”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কিরে?”

“ভাই ভাবি ঠিক আছে?আর আমার ভাইঝি?”

“আলহামদুলিল্লাহ”

“ভাই আমি অনেক মেহনত করতাছি।আপনি দোকান নিয়ে কোনো টেনশন করবেন না।আপনার মাইয়ার বদৌলতে দোকানে রহমত আইছে। বিক্রি কিনি অনেক ভালো।”

এর বিপরীতে মাহরুর উত্তর দিলো ভিন্ন।বললো, “তোর মতন একজন পাওয়া সত্যিই সৌভাগ্যের।অনেক বড় হ দুলাল।”

“কি যে কন ভাই? আপনারা জলদি ফিরা আহেন।আমি এদিকে সব সামলায় নিমু।”

“আচ্ছা।রাখছি”

মাহরুর ফিরে এসেছে।চা নাস্তা সবটা ফরিদা বেগম এবং রমজান সাহেবকে দিলো।রমজান সাহেব নিজের পরিবর্তে মাহরুরের শুকনো মুখ দেখে বিষণ্ণ হন।হাত টেনে নিজের কাছে বসিয়ে মাথায় হাত রেখে যতনে আদর দিলেন।

বললেন, “এক্কেরে ভাইজানের মতন হইছিস তুই।আমার বড় ভাইটা আছিলো এত দায়িত্ববান।আম্মা, আব্বা থেকা শুরু কইরা আমারে মানুষ করছে।নিজের সংসার একহাতে সামলাইছে ক্ষেত খামারি কইরা।তোর লগে কোনো অন্যায় হইবো না।তুই চিন্তা করিস না।ভালোর ফল ভালো পাবি।হইতে পারে একটু দেরিতে।”

ছোট করে উত্তর দেয় মাহরুর, “হুম চাচা”

“অফিসে যাস?”

“চারদিন যাই নাই। বাকিদিনগুলা অর্ধেক বেলা কাজ করেছি।”

“তোর মালিক কেমন?”

“আলহাদুলিল্লাহ চাচা ভালো।আমি ভাবি এই ভালো মানুষগুলো না থাকলে আমার কি হতো?”

“চিন্তা করিস না বাপ।”

“চাচা মেহুলের আকীকা দেওয়া হয় নাই এখনো।পড়ে দিলে হবে না?”

“হ হইবো।আগে মাইয়াটা আহুক সুস্থসবলভাবে তোর কাছে।তারপর”

___

গুনে গুনে পঁচাত্তর হাজার টাকা বিল এসেছে এই কয়দিনে। সমস্ত খরচ মিলিয়ে।বিশাল রকমের একটা ধাক্কা।এই কথাটি মাহরুরকে জানিয়ে তাকে অভাবের সমুদ্রে ফেলার আগেই ডাক্তার এসে জানালেন তার মেয়েকে আজ সন্ধ্যায় তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।আজকাল দ্বিমুখী অনুভূতি মধ্য দিয়েই যাচ্ছে।কখনো বাবা হওয়ার সংবাদ খুশির জোয়ারে ভাসানোর পূর্বেই সন্তানকে ছুঁয়ে দেখতে না পারার বিষাদ এসে হাজির।অপরদিকে মোটা অংকের হাসপাতালের বিল শুনে মাথায় হাত রাখার পূর্বেই খুশির সংবাদ দেওয়া হয় তাকে।তার মেহুলকে আজ প্রথমবারের মতন ছুঁয়ে দেখতে পারবে। নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে গেছে সে।মস্তিষ্ক থমকে গেলো।অচল হয়ে পড়েছে।আশপাশের কোলাহল যেনো শুনেও শুনছে না।

বিহ্বল হয়ে দাড়িয়ে থাকা মাহরুরের কাধে হাত রাখে রমজান সাহেব।আকষ্মিক হুশ ফিরল।রমজান সাহেব এর দিকে চেয়ে বলল, “কিছু লাগবে চাচা?”

“না।কিছু লাগবে না কিছু দিতে এসেছি।”

“কি?”

“আমার ছোট নাতনিকে সালামি দিতে চাই। বড়জনেরও জন্মদিন ছিল।ওকেও কিছু না কিছু দিবো।”

কথার ভাজ ঠিকই বুঝেছে মাহরুর।স্মিথ হাসলো।বললো, “সালামি শব্দটা বোঝার জন্য আপনার নাতনিরা অত বড় হয়নি চাচা।যখন হবে তখন দিয়েন।”

“এখনই দিবো।পড়ে যদি সময় না পাই?মৃত্যু কি কইয়া বইলা আসে?”

“আপনি হাজার বছর বাঁচবেন চাচা।তবে এখন আমি আপনার সালামি গ্রহণের অনুমতি আমার মেয়েদেরকে দিবো না।”

“নানা নাতিনের মধ্যে কথা কওয়ার তুই কে?”

মাহরুর পূনরায় হাসলো।বললো, “ওদের বাবা”

“অত কথা কইও না। আমার নাতনিরা কখন আসবো?তাই বল”

“আসবে কিছু সময় পর।”

সময় অতিবাহিত হয়। মাহরুর নিজের কথায় অটল।রমজান সাহেব দেখেছেন তার কপালে চিন্তার রেখা। খুব আত্মসম্মানবোধ তার।তাইতো নাতনীদের সালামি দেওয়ার বাহানায় মাহরুরকে সাহায্য করতে চেয়েছেন।কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হলো না মাহরুরের জেদে।কোনো সাহায্য নেবে না খুব আগে থেকেই পণ করেছিলো।
হাসপাতালের বারান্দায় দাড়িয়ে কল করলো ডিরেক্টর শরিফুলকে।

ফোন রিসিভ করে শরিফুল বলে উঠলেন,

“হ্যালো মাহরুর।”

“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম।কেমন আছেন?শুনলাম বাবা হয়েছেন?মেনি মেনি কংগ্র্যাচুলেশন।”

“থ্যাংক ইউ স্যার।”

“কেমন আছে আপনার মেয়ে?শুনলাম বাচ্চাটাকে ভ্যানটিলেটরে রাখা হয়েছে?আসলে আপনিতো জানেন আমি দেশের বাহিরে ছিলাম।নাহয় অবশ্যই হাসপাতালে আসতাম।”

মাহরুর ডিরেক্টর শরিফুল এর কথায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুরে বলল,

“ইটস ওকে স্যার।আপনি দুআ রাখবেন শুধু।”

“আপনার মেয়েকে কি বের করে আনা হয়েছে ভ্যানটিলেটর থেকে?”

“সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে আজ আমার মেয়েকে আমার কাছে দেওয়া হবে।”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

মাহরুর ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, “স্যার আমার…. মানে একটা রিকোয়েস্ট করার জন্য আপনাকে কল করা।”

“শিউর। বলুন কি সাহায্য করতে পারি?” জবাবে বললেন শরিফুল।

“স্যার আমার আগামীমাসের বেতনটা কি এই মাসে কোনোভাবে দেওয়া সম্ভব?….স্যার প্লিজ কিছু মনে করবেন না।আমি এভাবে বলতাম না কথা। দশদিন যাবৎ হাসপাতালে আছি। বিল মেটাতে একটু হিমশিম খাচ্ছি।আমি আগামীমাস থেকে কোনো ছুটি নেবো না স্যার।দরকার পড়লে ওভার টাইম করবো।”

মাহরুরের সমস্ত কথা শুনলেন শরিফুল।সময় নিয়ে উত্তর দিলেন,

“আপনাকে আমি একজন দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে চিনি। এভাবেই বেতন আগে আগেতো দেওয়া যায় না।তারপরও আমি আপনার মেয়ের জন্য বেতন আগে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।আপনি আগামীকাল এসে একটা অঙ্গীকারনামায় সাইন করবেন।সাথে টাকাটা নিয়ে যাবেন।”

আবেগে আপ্লুত হয়ে মাহরুর উত্তর দেয়, “আপনার কৃতজ্ঞতাগুলো আমি কখনো ভুলবো না স্যার। থ্যাংক ইউ সো মাচ”

“ইটস ওকে মিষ্টার মাহরুর।আমিও একজন মেয়ের বাবা।কিছু ক্ষেত্রে প্রফেশনাল লাইফে পার্সোনাল জিনিসগুলোকেও প্রাধান্য দিতে হয়।”

“জ্বি স্যার। থ্যাংক ইউ ওয়ান্স এগেইন”

___

পৃথিবীর বুকে এত সুন্দর মুহুর্ত আর দুটো মনে হয় নেই।প্রথম প্রশান্তি পেয়েছিলো মল্লিকা আর মিষ্টিকে পেয়ে।দ্বিতীয় প্রশান্তি আজ আসতে চলেছে।ছোট্ট কেবিন ভর্তি মানুষ।সবার মুখে হাসি। দরজার সামনে জায়গাটা খালি করে রেখেছে।যেনো কোনো মহারানীর আগমন হবে। মহারানী নয় সে রাজকুমারী বটে।অনেক অপেক্ষা অনেক সাধনার পড়ে আসছে।কিসের টাকার চিন্তা?কিসের হয়রানি?এক মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যাবে মেয়ের মুখ দেখে।রহিম মিয়া এসেছেন মিষ্টি নিয়ে।এতদিন মিষ্টির আয়োজন করা হয়নি।দুঃখের ছায়া ছিলো সর্বখানে।আজ খুশি সকলে। সুখের সময় মুখ মিষ্টি করা আবশ্যকীয়।

প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে তার ফুটফুটে কন্যাকে নিয়ে হাজির মল্লিকা।বক্ষে জাপ্টে নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসেছে।জানে সে।অনুভব করে। মাহরুরের কদম এগোবে না।নিজেই এসে তুলে দিল তাদের দুজনার অংশকে তার পিতার কোলে।

মাহরুর সবাইকে তাক লাগিয়ে বলে উঠলো, “আমি বসে নেই।”

মল্লিকা জানতে চাইলো, “কেনো?”

“এতটুকু বাচ্চা কোলে নেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই চন্দ্র।”

সবাই হেসে উঠলো একাধারে।সাথে মল্লিকাও।সে নিপুণ এই কাজে।প্রথম সন্তানকে নিজেইতো কোলে পিঠে মানুষ করেছে সেই অল্প বয়সে। মাহরুর বেডে একপা তুলে ভাজ করে বসলো।বুকে সাহস যুগিয়ে কোলে নিয়েছে মেয়েকে।

“আপনার মেয়ে আপনার দিকে চেয়ে আছে দেখুন”

গোলগোল চোখ গুলো।গালের দুই অংশ লালচে। ড্যাবড্যাব করে মাহরুরের দিকে চেয়ে আছে।চেনার চেষ্টা করছে বুঝি?নাকি রক্তের টান অনুভব করছে।অন্যদিকে মাহরুর নির্বাক।মুখের শব্দরা ছুটি নিলো এই মাত্র।বাবা হওয়ার অনুভূতিটা এমন কেনো?শিরশির করছে সর্বাঙ্গ।

আকস্মিক ঠোঁট ভেঙে আসে মাহরুরের। আটকাতে চাচ্ছে নিজেকে। যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।পলক ঝাপটে চোখের পানি সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলো।ছোট্ট তুলতুলে গালে ঠোঁট ছুঁয়ে নিস্তার দিলো সমস্ত অস্থিরতার।

মিষ্টি বাবার পাশেই বসে।তার ছোট আঙুল বোনের গাল ছুঁয়ে দেওয়ার সাথেসাথে মেহুল চোখ ফেরায়।এবার মনোযোগ গেলো বড় বোনের দিকে।আনন্দে উচ্ছাসিত হয়ে মিষ্টি বললো,

“আমাকে দেখছে মা?মাহি বাবা?….বাবুটা আমাকে দেখছে।”

ইতিমধ্যে চোখের জল এর বিরুদ্ধে জয়ী হতে সক্ষম মাহরুর।মিষ্টিকে বললো, “তুই ওর বড় বোন না?চিনে ফেলেছে তোকে দেখলি?”

“ও আমাকে চেনে মাহি বাবা?”

“হ্যাঁ চেনে।কেনো চিনবে না? মেহুল এর একমাত্র বড় বোন মিষ্টি।”

এমন কথায় ক্ষিপ্ত হলো সুমাইয়া,সায়মন দুজনে।তাদের কেনো বাতিল করা হলো লিস্ট থেকে?দুজনেই ধেইধেই করে এগিয়ে আসে।

বলে,
“আর আমরা?”

মাহরুর ভ্রু উচু করে দেখলো দুজনকে।হাসতে হাসতে বললো, “সরি মামা ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দে।”

সুমাইয়া, সায়মন এগিয়ে আসে।কথা নুয়ে দেখতে লাগলো বোনকে।পরপর মাহরুর ওই অবুঝ শিশু মেহুলের দিকে চেয়ে বলল,

“দেখ মেহুল এই দুজন হচ্ছে তোর সুমাইয়া আপু আর সায়মন ভাইয়া।তোর ঝগড়াটে ফুপ্পীমনির ছেলে মেয়ে।”

মাহরুরের এমন কথায় সকলে হাসছে।শুধু শিরীন ব্যতীত।সেও তেড়ে এলো। ছো মেরে নিজের ভাতিজিকে কেড়ে নিয়ে বলতে লাগলো,

“আমার সাথে তোমার খোচাখোচি না করলেই নয়?”

“তুই মানুষটাই এমন।”

শিরীন মেহুলের দিকে চেয়ে বলল, “আমি ভালো তাই না ফুপ্পীমনি?”

একে একে সবার কোলে যাচ্ছে মেহুল।সবার দিকেই একই ভঙ্গিতে চায়।যেনো অনেক দিনের পরিচয়। কান্নাকাটি বিহীন ঘুরে এলো আপন মানুষের কাছ থেকে। মাহরুরের চোখ সরে না।অবশেষে মায়ের কোলে এসে প্রাণজুড়ানো হাসি দিলো।এই হাসিতে মুগ্ধ চারিপাশ।
মিষ্টি আর মেহুলকে একসাথে জড়িয়ে নিয়ে মল্লিকা বললো,

“মেয়েরাতো মায়েদেরকে পরিপূর্ণ করে তাই না?আজ থেকে আমাদের দল ভারী হলো।…আমরা তিনজন মিলে বাবার অনেক খেয়াল রাখবো ঠিক আছে?”

মিষ্টি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।আবার জানতে চায়, “আমরা কবে বাড়ি যাবো মা?আমার বন্ধুদের বলতে হবেতো।মিষ্টির ছোট বোন এসেছে।”

জবাব দিলো মাহরুর।বললো, “আমরা আগামীকাল বাড়ি ফিরবো। এখন তুই ভালো মেয়ের মতন মনির সাথে যা।খেয়ে দেয়ে দ্রুত ঘুমাবি।ঠিক আছে?”

“আচ্ছা মাহি বাবা।আমি বোনের জন্য ঠিকমত ভাত খাবো। মনিকে জ্বালাবো না।”

“এইতো!আমার ভালো মেয়ে মিষ্টি।”

মাহরুর রেদোয়ানকে ইশারা করলো।রাত হচ্ছে।এখনই ফিরতে হবে।রমজান সাহেবকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। ফরিদা বেগম আর মাহরুর হাসপাতালেই থাকবে। একটু আগে দুলাল খাবার আর মাহরুরের কাপড় দিয়ে গেছে। এখান থেকেই অফিসের জন্য রওনা হতে হবে।বিকেলে ডিসচার্জ করে নিয়ে যাবে মল্লিকা আর নতুন সদস্যকে।

___

বেতন আর জমানো কিছু টাকা মাত্র।সামনের মাসের অগ্রীম বেতন নেওয়া হয়েছে।ঘরের বাজার বাকি,নতুন সদস্যের জন্য কেনাকাটা বাকি,তার আকীকা বাকি,দোকান ভাড়া বাকি।আগামী মাস কীভাবে চলবে এই চিন্তায় পথ হাঁটছে মাহরুর।এই জীবন থেকে ‘ চিন্তা ‘ নামক শব্দটা থেকে রেহাই কবে পাবে?কবে এক কাপ চায়ে চুমুক রেখে বলবে ‘ আহ! আমার কোনো চিন্তা নেই ‘।এক মুঠোয় পঁচাত্তর হাজার টাকা আলাদা করে নিয়েছে।আসার পথে টুকটাক কেনাকাটা করে নিলো। হাতে টাকার পরিমাণ অত্যন্ত স্বল্প।আজ আবার অফিস ব্যাগের ভারটা বেশি মনে হলো।অন্যহাতে ঘাড় চেপে হেঁটে এলো হাসপাতালে।আগেই বিলটা মিটিয়ে নেক।এত যন্ত্রণা সহ্য হয় না।বিশ্রাম দরকার!
হাসপাতালের বিলটা মিটিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে ক্যাবিনের দিকে এগিয়ে এলো।তার স্ত্রী আর ছোট্ট বুড়ি তৈরি।ফরিদা বেগম গোলাপি তোয়ালেতে যতনে তাকে মুড়িয়ে নিয়েছেন।কপালে কালো টিপ দিয়েছেন।বাহিরে ঠান্ডা মৃদু হাওয়া বইছে।মাথায় ছোট্ট টুপিও পড়িয়ে দিলেন। মাহরুর হাত মুখ ধুয়ে আসলো।

ফরিদা বেগম তার কোলে মেহুলকে দিতে চাইলে মাহরুর বললো,

“এখন দিয়েন না চাচী।অফিস থেকে ফিরেছি।কাপড়ে ময়লা, জীবাণু থাকবে।”

ফরিদা বেগম বুঝলেন।বললেন, “তাইলে একবারে বাড়ি গিয়া গোসল কইরা নিও কোলে।”

মাহরুর ফোন লাগায় শিরীনকে।মিষ্টিকে নিয়ে তাদের বাড়ির দিকে রওনা হতে। রেদোয়ানকেও কল করেছে।মিনিট দশেক এর মধ্যে ডাক্তারের সাথে কথা বলে ফিরে এলো।

এসে বললো, “তৈরি সবাই?”

মল্লিকা মিষ্টি হেসে উত্তর দেয়, “হ্যা”

মাহরুর বললো, “বোস।আমি গাড়ি ডাকছি”

কোনো রকম ট্যাক্সি পেয়েছে।আজকাল উবার, পাঠাও এর যুগ। পুরোনো হলুদ রঙের ট্যাক্সি দেখা যায় না।আগে গ্রামে নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই এরিয়াটায় বহুবার দেখেছে ট্যাক্সি।আজ বোধহয় ভাগ্য সহায় হলো। হাসপাতালের সামনে যাত্রীদের পৌঁছে দেওয়ার জন্য ট্যাক্সি আর সি.এন.জি এর সমাহার।বাড়ি বেশি দুরত্বে নয়।অল্প টাকায় ভাড়াটাও মিটে গেলো। সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে বেরিয়ে এসেছে হাসপাতাল থেকে।নানুর কোলে আরামসে ঘুম যাচ্ছে মেহুল।অপরদিকে আলগোছে মল্লিকার হাত শক্ত করে চেপে মাহরুর।
বাড়ির ঠিক দ্বারপ্রান্তে এসে গাড়ি থেমেছে।সচ্ছ গ্লাসের অন্যপ্রান্তে চোখ পড়তেই দেখা মিললো রহিম মিয়া আর দুলালের।রহিম মিয়া পেছনে হাত বেঁধে দাড়িয়ে আছেন হাসিমুখে।গাড়ি দেখতেই দুলাল দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে দরজাটা খুলে দিল।

বললো, “ভাই আহেন।আপনাগো ব্যাগ কই?দেন।আমি সব উপরে নিয়া যাইতাছি।”

মাহরুর উত্তর দিলো, “দিচ্ছি। দাঁড়া।”

রহিম মিয়া বললেন, “তোমার চাচী হেই কহন রাইন্দা রাখছে।আজকে বুয়ারে দিয়া রান্দায় নাই।নিজেই করছে সব।এত দেরি করলা কেন?”

মাহরুর উত্তর দেয়, “অফিস থেকে ফিরে তারপর এসেছি চাচা।”

“ওহ আচ্ছা।আমার বুড়ির আবার ধৈর্য্য নাই বুঝলা।আমারে আধা ঘণ্টা আগ থেইকা দরজায় দাড় করায় রাখছে।”

মাহরুর আবেগপ্রবন হয়ে পড়ে প্রায়ই।রহিম মিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল, “আপনাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেও শেষ হবে না।”

কথার মধ্যিখানে দেখা মিললো ফরহাদ এর স্ত্রী মৌ এর।তার ঘরেও ছেলে সন্তান এসেছে একজন।একই এলাকায় থাকা সত্বে মাঝেমধ্যেই সাক্ষাৎ হয়ে যায়।মল্লিকার সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলো। মাহরুর মুখ শক্ত হয়ে গেল আপনাআপনি। মৌকে এগিয়ে আসতে দেখে কপাল কুচকে নিলো মাহরুর।

পুরোনো কথা ভুলে মৌ বললো, “আসসালামু আলাইকুম মল্লিকা ভাবি?”

মল্লিকা উত্তর দেয়, “ওয়ালাইকুম আসসালাম।কেমন আছো?..আর আম্মা?”

গা যেনো জ্বলে উঠে মাহরুরের।কেনো জানতে হবে এসব মানুষের কথা?কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে রইলো।

মৌ উত্তর দিলো, “ভালো আছি।আপনার?”

“হ্যাঁ।আমার মেয়ে” জবাব দেয় মল্লিকা।

“মাশাআল্লাহ।”

মাহরুরের রুক্ষ মুখের দিকে চেয়ে মৌ বললো, “এখানে একটা কাজে এসেছিলাম।আসি তাহলে।ভালো থাকবেন।”

রহিম মিয়া,দুলাল আর ফরিদা বেগম আগেই উঠে গেছেন কয়েক সিড়ি। মল্লিকার সাথে মাহরুর।তাকে সাপোর্ট দিয়ে আনতে হবে। প্রথমবার সি.সেকশনের ফলে সে এখনও অনেকটা দুর্বল।এক সিঁড়ি উঠেই ক্লান্ত হয়ে পড়লো মল্লিকা। রেলিংয়ে হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পাঁচ তলায় উঠতে অনেক সমস্যা পোহাতে হবে তাকে।মল্লিকাকে চমকে দিয়ে পাঁজাকোলে তুলে নেয় মাহরুর। আকষ্মিক নিজেকে শূন্যে ভাসতে দেখে ভরকে উঠলো।

বললো,

“কি করছেন?কষ্ট হবে আপনার!”

সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে মাহরুর বলতে লাগলো, “বয়স হচ্ছে বলে কি দুর্বল ভেবেছিস?বাহুতে এখনো তোর মতন দশটা চন্দ্রকে সামলানোর শক্তি আছে।”

চলবে…গল্পের

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৪০

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৪০
লেখা : Azyah_সূচনা

অপেক্ষারত এক যুগল।তাদের অনাগত প্রাণকে বরণ করবে এই চিলেকোঠায়।জানাবে এই ছোট্ট পুরোনো ঘরে অভাব আছে কিন্তু কমতি নেই।কিসের কমতি নেই যখন আধোআধো গলায় জানতে চাইবে সে?তখন জবাব আসবে ‘ প্রেম,ভালোবাসা,আদর,যত্ন,সম্মান’ এসবের কমতি নেই।যদি জানতে চায় তাহলে অভাব কিসের?উত্তর দিবে আবারো অভাব আছে খরখরে একটা কাগজী বস্তুর। যাহার প্রয়োজন আছে তবে অপ্রয়োজনীয়।শিখাবে অল্পতে তুষ্ট থাকা কত প্রয়োজনীয়।শিখাবে এসির কৃত্রিম বাতাসের চেয়ে জোঁছনা রাতের দমকা যাওয়া প্রশান্তির।দামী পোশাকের চেয়ে কারো ভালোবাসায় আনা কমদামী পোশাকের মূল্য।ভিন্নভিন্ন ঘরে একাকীত্বে ভোগার চেয়ে একই কামরায় ঠাসাঠাসি করে একে অপরের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করার মাঝে কত প্রসন্নতা।

অষ্টম মাসের প্রথম সপ্তাহে আরও একটু ভালোলাগায় সিক্ত হলো মল্লিকা। পেটে হাত বুলিয়ে মুচকি হাসলো।ভাবলো আর মাত্র ক’ টা দিন।আর ক’ টাদিন?মল্লিকার হাসিকে মিয়ে দিয়ে প্রচন্ড রকমের খারাপ লাগায় পুরো দেহ মুষড়ে আসলো।বুক ধড়ফড় করতে শুরু করলো। ক্ষণিকের মধ্যে এলোমেলো লাগছে সব। খাটের কোণায় হাত রেখে বসে পরে তীব্র ব্যাথায়।

মিষ্টি উঠে আসে।মাকে ডেকে বললো, “মা? ও মা? কি হয়েছে?”

অস্থির গলায় মল্লিকা বললো, “মিষ্টি!”

“মা মা! তোমার কি হয়েছে”

জোরেজোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, “আমার ফোনটা দে মিষ্টি!”

মিষ্টি দৌড়ে যায়। মায়ের ফোন খুঁজে এনে ধরিয়ে দিলো।অল্প সময়ে পুরো শরীর ভিজে যাচ্ছে ঘামে।কপাল বেয়ে অনবরত ঘাম ঝরতে লাগলো। মিষ্টি ভয় পাবে। যথাসাধ্য চাইছে যেনো অবস্থা হাতের বাহিরে না যায়।

কাপতে কাঁপতে মাহরুরকে কল করে। দুয়েকবার ফোন বাজতেই মাহরুর কল ধরলো।মল্লিকা বললো,

“মাহরুর… মাহরুর ভাই..!”

বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিলো অফিস থেকে।মল্লিকার এমন ভারী অস্থির গলা ফোনে পেয়ে ভরকে উঠে। হন্তদন্ত হয়ে বললো,

“কি হয়েছে চন্দ্র?তোর কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেনো?”

নিজেকে বহু কষ্টে সামলে নিয়ে মল্লিকা উত্তর দেয়,

“আপনি..যেখানেই আছেন দ্রুত আসুন।..আমাদের হাসপাতালে যেতে হবে।”

“চন্দ্র!চন্দ্র শান্ত থাক আমি আসছি।আমি জোবেদা চাচী আর রহিম চাচাকে পাঠাচ্ছি।চন্দ্র! আমি আসা পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিস একটু”

মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।আজ হেঁটে নয় রিকশা নিলো।ভাড়া অব্দি জানতে চাইলো না।কল মেলায় রহিম চাচাকে।দ্রুত উপরে যাওয়ার অনুরোধ করলো।পরপর রেদোয়ান আর শিরীনকে।তারপর বুকে হাত রেখে দুলালকে কল করে বললো,

“দুলাল দোকান বন্ধ কর।একটা গাড়ি ভাড়া কর দ্রুত।তোর ভাবিকে হাসপাতালে নিতে হবে।দ্রুত কর!”

“জ্বি ভাইজান!”

মিষ্টি চেচিয়ে কাদঁছে।চোখের সামনে মাকে এভাবে দেখতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।দুহাত মুঠ করে মা মা বলে বিড়বিড় করছে একটু পর।আগামীকাল তার জন্মদিন।ছোটোখাটো একটা আয়োজন করবে বলে ভেবেছিল।সেই আশা আর দেখছে না।সেটা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই মিষ্টির।তার মাকে চাই তার। হাসপাতালে মিষ্টিকে সামলানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়লো।শিরীন মিষ্টিকে বুকে জরিয়ে এদিক ওদিক হাটাহাটি করছে।

চেয়ারে বসে থাকা থমথমে মাহরুর এর কাছে রেদোয়ান গিয়ে বললো,

“ওপর ওয়ালার উপর ভরসা রাখো।”

আকস্মিক মাহরুর বললো, “চন্দ্রের ডেলিভারি ডেট আজ থেকে আরো তিন সপ্তাহ পরের ছিলো।এখনও সময় হয়নি। হঠাৎ কি হলো রেদোয়ান!”

রেদোয়ান চুপ বনে গেছে মাহরুরের কথায়।সময়ের আগে চলে আসাটা সবার ভাবনার কারণ।অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে মল্লিকাকে।বুকের গতি একেবারেই ঠিক নেই মাহরুরের।শূন্য মনে হচ্ছে সবকিছু।শরীর সম্পূর্ণ ভার হয়ে আছে।চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে কয়েকবার।চোখ বুজে সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি করতে করতে শ্বাস আটকে আসার উপক্রম।শান্তি মিলবে না কিছুতেই।

একজন ডাক্তার বেরিয়ে এলেন পঁয়ত্রিশ মিনিট পর।এসেই জানতে চাইলেন মল্লিকার স্বামী ও পরিবারের নাম। মাহরুর একলাফে এগিয়ে গেছে।

ডাক্তার বললেন, “মেয়ে হয়েছে।তবে বেবি প্রি ম্যাচুওর। ভেন্টিলেটরে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”

“ডাক্তার আমি দেখতে পারবো?আমি কি ওকে ছুঁয়ে দিতে পারবো?”

“জ্বি না মিষ্টার মাহরুর।যতদিন বেবি স্ট্যাবল না হচ্ছে যতদিন মা ব্যতীত আর কেউ ছুঁতে পারবে না। দুর থেকে দেখতে পারবেন।”

পৃথিবী থমকে যেতে আর কি দরকার? কয়েকটা বাক্য মাহরুরের স্তম্ভকে নাড়িয়ে তুললো।হৃদপিণ্ড এত জোরেজোরে ধকধক করছে যেনো বিস্ফোরণ ঘটাবে।দেখতে পারবে?তাও দুর থেকে।ওই ছোট্ট জানটাকে ছুঁয়ে দিতেও পারবে না। নিয়তির কি তাদের সুখ সইছিলো না?মল্লিকা ঠিক আছে কিনা জেনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মাহরুর। রেদোয়ানকে জড়িয়ে বলতে লাগলো,

“আমি খুশি হব নাকি কাঁদবো আমি বুঝতে পারছি না রেদোয়ান।আমার বাচ্চাটা সুস্থ হয়ে আমাদের কাছে ফিরবেতো?”

বহু কষ্ট করে মিষ্টিকে ঘুম পাড়িয়ে বরাদ্দকৃত কেবিনে রেখে এসেছে জোবেদা খাতুন এর কাছে। মাহরুরকে কাঁদতে দেখে শিরীন এগিয়ে এসে ভাইয়ের চুলে হাত বুলিয়ে বলে,

“কেনো আসবে না?আজকাল এসব হয় ভাইয়া।তুমি চিন্তা করো না।”

রেদোয়ান বললো, “ভাই শক্ত হও।তোমাকে এভাবে কাঁদতে দেখলে মল্লিকা আর মিষ্টিও ভেঙে পড়বে।”

এক বুক অস্থিরতা নিয়ে মাহরুর বললো, “আর পারি না!”

___

ঘণ্টাখানেক কেটে গেছে ইতিমধ্যে।গলা শুকিয়ে কাঠ। মল্লিকাকে এখনও ক্যাবিনে শিফট করা হয়নি। ডাক্তার জানিয়েছে সময় লাগবে। এনেসথেসিয়া এর প্রভাবটা অল্প কমলেই ক্যাবিনে আনা হবে।মিষ্টিকে একবার দেখে হাতে মুখে গ্লাভস আর মাস্ক পড়ে নিলো মাহরুর।নিজেকে সম্পূর্ণ নীল আবরণে ঢেকে চলে গেলো এন. আই. সিউ রুমটার দিকে।একটাবার কি দেখবে না তার নবজাতককে?চোখ আর হৃদয় শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাচ্ছেতো! মৃদু কম্পিত কদমে হেঁটে এসেছে। নার্সের কড়া আদেশে গ্লাসের অন্যপাশ থেকে আঙ্গুল তুলে দেখালো।

বললো, “এটা আপনার বাচ্চা”

একদম ছোট একটা শরীর। মাহরুরের একহাতের সমান হবে। কত বড় বড় নল লাগিয়ে রাখা হয়েছে নাকে মুখে।মাথা ভর্তি চুল।শ্বাস নিচ্ছে একটু পরপর। ধবধবে ফর্সা লালচে মুখটা ঘুরিয়ে আছে ঠিক তার বাবার মুখ বরাবর। ঘুমিয়ে আছে বুঝি?আবারো চোখ ছলছল করে উঠে মাহরুরের।

গ্লাসে হাত রেখে অস্পষ্ট কম্পিত স্বরে ডাকল, “বাবা…”

চোখ ভরে দেখতেও দিলো না।মিনিট পাঁচেক মাত্র অধিকার?তাও আবার নিজের সন্তানকে দেখার?সরিয়ে নেওয়া হলো মাহরুরকে। পৃথিবীটা কেমন যেনো এলোমেলো লাগছে। ডাক্তার এর সাথে কথা বলেছে।সে জানান যখন বাচ্চা পুরোপুরি স্ট্যাবল হবে?কোনো সাপোর্ট ছাড়া নিঃশ্বাস নিতে পারবে তখনই তাকে ভেন্টিল্যাটর থেকে বের করে আনা হবে।আরো জানিয়েছেন মল্লিকার জ্ঞান ফিরেছে। বাচ্চার কাছে নিজে যাওয়া হবে তাকে সর্বপ্রথম।ত্রিশ মিনিট পর ক্যাবিনে শিফট করা হবে।

অপেক্ষারত সকলেই। মাহরুর হাতে তুলে মিষ্টিকে খাইয়ে দিচ্ছে। মুখে খাবার পুড়ে মিষ্টি বললো,

“বাবু কখন আসবে মাহি বাবা?”

বারবার হৃদয়ের ক্ষত জ্বলে উঠে।মিষ্টির উত্তরে মাহরুর বললো,

“তুই দুআ কর মা।দেখবি তোর দুআতে দ্রুতই চলে আসবে।”

“আচ্ছা মাহি বাবা?বাবুটা দেখতে কেমন?”

“একদম তোর মতন।তোর বোন”

“তাহলে কি ও আরেক মিষ্টি?”

“হ্যাঁ আরেক মিষ্টি।”

“আমি ওকে দেখবো বাবা।ওকে এনে দাও”

মিষ্টির মাথায় হাত রেখে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো মাহরুর।বললো, “খুব শীগ্রই এনে দিবো”

খুশির সময়গুলো দ্রুতগতিতে যায়।আর অপেক্ষার প্রহর হয় আরো বিষণ্ণতা বাড়ায়। এতটা মর্মপীড়া অল্পস্বল্প উপশম হলো মল্লিকার মুখ দেখে।শরীরটা কেমন নিথর দেখাচ্ছে।নিঃশ্বাস চলছে,চোখ পিটপিট করছে,কথাও বলতে চাইছে। মাহরুরকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো।

নিজের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে মুখ থেকে আওয়াজ বের করে বললো, “মিষ্টি…”

মাহরুর মল্লিকার হাত চেপে ধরে।ঠান্ডা শীতল নরম হাতটা।বলে, “মিষ্টি আছে।রেদোয়ান ওকে নিয়ে একটু বাহিরে গেছে।”

মল্লিকা ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “আমার বাচ্চাটাকে…ওরা ওখানে রেখেছে কেনো?”

মাহরুর নিজেকে শক্ত করে বললো, “সময়ের আগে চলে এসেছে ও।তাই কিছুদিন ভ্যানটিলেটরে রাখতে হবে”

“ভ্যানটিলেটর কি?”

শীতল চাহনি মাহরুরের।মল্লিকা জানে না ভেন্টিল্যাটর কি জিনিস।হয়তো মিষ্টির জন্মের সময় এমন কিছুর সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে।মল্লিকার চুলে হাত বুলিয়ে মাহরুর বলে উঠে,

“যেসব বাচ্চারা সময়ের আগে জন্ম নেয় তাদের যেনো কোনো সমস্যা না হয় সেই জন্য ছোট্ট কাচের ঘরে তাদেরকে রাখে।”

মল্লিকা ঢুকরে কেঁদে উঠলো।বললো, “ওর..ওর নাকে….পাইপ দিয়ে রেখেছে… ও কষ্ট পাচ্ছে।ওর কিছু হবে নাতো? মাহরুর..!”

কষ্টে জর্জরিত হৃদয়টা অঙ্গের পীড়ার চেয়েও দ্বিগুণ।মনের মধ্যেখানে অজানা ভয় নিশপিশ করছে।কি হবে?মল্লিকা সম্পূর্ণ অজ্ঞ এইসব বিষয়ে। মাহরুরেরও তেমন জানা ছিলো না।হাত পায়ের কাপুনি বেড়েছে ইন্টারনেটে প্রি ম্যাচিওর বাচ্চার সমস্ত তথ্য গ্রহণ করে।
মাহরুর লম্বাটে নিঃশ্বাস ফেলে।শক্ত থাকার ভনিতা এখানে করতেই হবে।উত্তরে বললো,

“আজকালের যুগে টেকনোলজি অনেক উন্নত চন্দ্র।আমি ইন্টারনেটে দেখেছি।কিছু হবে না আমাদের মেয়ের।”

“আমি ওর কাছে আবার কখন যাবো?”

“ডাক্তার বললো দুই ঘণ্টা পর।একটু ঘুমো দেখি এখন।”

এখন বুঝি পেটের ব্যথাটাও অনুভব হলো। এনেসথেসিয়ার প্রভাব কমছে।যন্ত্রণা তীব্র থেকে তীব্র হবে।কাতর গলায় বললো,

“অনেক ব্যথা।সহ্য হচ্ছে না।”

“আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করছি?ব্যথা নাশক কোনো ঔষধ দেওয়া যাবে কিনা?”

মাহরুর দৌড়ে গেলো বাহিরে।আশেপাশে নার্সদের প্রশ্ন করছে।তারা সকলেই বললো দেওয়া যাবে না।তাও সঠিক তথ্যর জন্য ডাক্তারের চেম্বারের দিকে দ্রুত কদমে হেঁটে যায়।কিছু সময় পর অনুমতি পায় প্রবেশ করার।

মাহরুর বিনয়ের সুরে বললো, “স্যার আমার স্ত্রীর অনেক কষ্ট হচ্ছে।ওকে ব্যথানাশক কোনো ঔষধ দেওয়া যাবে?”

“আমরা পেইন কিলার ইনজেকশন দিয়েছি মিষ্টার মাহরুর।”

“তাহলে ব্যথা কমছে না যে?”

ডাক্তার সাহেব হাসলেন।বললেন, “একটা সুস্থ দেহের অংশে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে।এত সহজেই ব্যথা কমে যাবে?পেইন কিলার অল্প সস্তি দিবে শুধু।আমরা একটু পর ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে যাবো।”

“স্যার আরেকটা প্রশ্ন?”

“জ্বি শিউর”

“আমার মেয়েটা স্যার? ও সত্যিই ঠিক আছেতো?”

ডাক্তার চক্ষু নামান।চোখের চশমা খুলে পাশে রেখে আবারো মাহরুরের দিকে চাইলেন।বললেন,

“দেখেন মিষ্টার মাহরুর।একটা বাচ্চা যখন প্রি ম্যাচিওর হয় তখন ডাক্তার শুধু পারে তাকে সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার। ভ্যানটিলেটরে রেখে মায়ের গর্ভের মতন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা।কিন্তু যতই হোক মায়ের গর্ভ মায়ের গর্ভই।কোনো যান্ত্রিক শক্তি এর সাথে শতভাগ মিলতে পারবে না।তবে আমি একটু আগে চেক করেছি।আপনার বেবি ঠিক আছে।একটু একটু করে ভ্যানটিলেটরের সাথে মানিয়ে নিচ্ছে।ইনশাল্লাহ খুব শীগ্রই আপনাদের কাছে চলে আসবে”

__

একদিন?দুইদিন?নয়টা দিন কেটে গেছে। দিবা রাত্রি পাল্লা দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে।খেয়াল করেনি কারো।হাসপতালকে নিজের ঘর বলে মনে হচ্ছে।রাতের আঁধারে পাঁচ তলা ক্যাবিন থেকে নিচে রাস্তার দিকে চেয়ে রইল মাহরুর।বুকে হাত ভাজ করে আছে।মাথা ভার ভার মনে হচ্ছে।প্রতিদিন একই প্রশ্ন।একই জবাব।তার মেয়েটাকে কবে দেওয়া হবে?প্রতিদিন একই উত্তর আসে যেদিন পুরোপুরি তাকে স্ট্যাবল মনে হবে সেদিনই।দিন রাতের পালা বদলে নয়টা দিন কেটেছে অথচ মেয়েকে একটাবার কোলে তুলতে পারলো না?বুকে জড়াতে পারলো না?নিচের রাস্তা থেকে চোখ তুলে আকাশের দিকে চাইলো। পলকহীন চেয়ে কিছু কথা আওড়ায় মনে মনে।এই আলাপন গোপন। মাহরুরের মন ব্যতীত আর কেউ জানেনা।

আকস্মিক একজন নার্স এসে বললেন, “মিসেস মল্লিকা?”

মাহরুর ঘুরে তাকায়।মল্লিকা ঘুমিয়ে ছিলো নার্সের ডাকে লাফিয়ে উঠেছে। মাহরুর বললো, “জ্বি সিস্টার?”

“বেবিকে খাওয়াতে হবে।আপনার স্ত্রীকে নিতে এসেছি।”

মল্লিকা বেড থেকে পা নামায়। মাহরুর সাহায্য করলো তাকে। নার্স তাকে ধরে নিয়ে গেলো এন. আই. সিউ এর দিকে।প্রতিদিন চেয়ে থাকে মল্লিকার যাওয়ার পানে।বুকটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়।আর কিছুদিন তার মেয়ে দূরে থাকলে বোধহয় হৃদয়ের রক্তিম আভা সরে গিয়ে কয়লার রঙ ধারণ করবে।

পনেরো বিশ মিনিট পর মল্লিকা ফিরে এসেছে। মাহরুর তার কাছে এসে বসলো।ফল কাটছে। নিঃশব্দে। নীরবতায়। কাটাকুটি শেষ করে মুখে তুলে খাইয়ে দিল।

চরম হতাশা নিয়ে বললো, “হিংসে হয় তোকে।প্রতিদিন তিন থেকে চারবার ওর কাছে যাস।ছুঁয়ে দেখিস।আর আমি? আমিওতো বাবা।আমাকে কেনো দেয় না।”

মল্লিকা হাত বাড়ালো মাহরুরের মুখের পানে। দুহাতের সাহায্যে টেনে কপালে চুমু খায়।মল্লিকা ব্যতীত কারোই অনুমতি নেই। অকস্মাৎ মাহরুর ফলের প্লেট খট করে পাশে রাখে। উদ্বিগ্ন হয়ে লুটিয়ে পড়ে মল্লিকার বাহুতে।জড়িয়ে ধরে পুরুষালি কান্নার আভাস পাওয়া গেলো। হৃদয়টা ঢিপঢিপ করছে মল্লিকার। মাহরুরকে কাঁদতে দেখেনি কোনোদিন।এত দুর্বল করে ফেললো কেউ তাকে?যে তার অস্রু থামছেই না?

বুকে জড়িয়ে চুলের ভাজে হাত বুলাতে থাকে মল্লিকা।এতটা দিনতো তাকে সামলে এসেছে।আজ নাহয় মাহরুরকে সামলে নেক?

“আপনি আমাদের মেয়ের নাম ভেবেছেন?”

অস্পষ্ট আওয়াজে মাহরুর বললো, “অনেক আগেই ভেবে রেখেছি”

“আমাকে বলেননি কেনো?”

“ভুলে গিয়েছিলাম”

মল্লিকা ঠাট্টা করে বললো, “বাহরে! এখনই মেয়ের মাকে ভুলে যাচ্ছেন।মেয়েকে পেলে আর চিনবেনই না”

ব্যথিত;কান্নারত মুখে হাসি ফুটলো।মনে মনে হিংসুটে বলে আখ্যা দিলো মল্লিকাকে।মাথা তুলে দুহাতের সাহায্যে নিজের মুখ মুছে নিয়ে বললো,

“তোকি? তুই পুরোনো হয়েছিস।তোকে ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক না?”

চমকিত মল্লিকা দ্রুত জবাব দেয়, “আমি আমার মেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবো।তখন দেখবো!”

“আমাদের মেয়েদের রেখে যাস।”

“ওরা আমার মেয়ে।মায়ের অধিকার বেশি।”

“মেয়েদের উপর বাবাদের অধিকার বেশি থাকে।”

“না এটা চলবে না।”

“আলবৎ চলবে!”

মল্লিকার ঝগড়ার মধ্যেও মিষ্টির কথা মনে পড়লো।আজ মেয়েটা আসেনি।অভিমান করেছিলো গতকাল।কেনো তার পুঁচকে বোনকে দেখতে দেওয়া হচ্ছে না। করিডোরে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করেছে।মায়ের পিছু নিয়েছিলো।সাথে যাবে দেখবে বোনকে।শিরীনের বাড়িতেই থাকে সে। আজ আসেনি।

মল্লিকা বললো, “মিষ্টি আজ আসলো না যে?”

“শিরীন ইচ্ছে করেই পাঠায়নি।বাচ্চা মানুষ বুঝবে না বায়না করবে বোনকে দেখার জন্য।আবার হসপিটালের পরিবেশে ওর না থাকাই ভালো।”

“কাল আনবেন ওকে।”

“আচ্ছা”

“মেয়ের নামটা বলেন জনাব”

“মাহরুর,মল্লিকা,মিষ্টি আর মেহুল”

একবার শুনেই নাম পছন্দ হয়েছে মল্লিকার।মনে হলো যেমন ‘ ম ‘ শব্দের সমাহার।মল্লিকার ঠোঁট জুড়ে এক চিলতে হাসি ফুটেছে।এই নামকে সেও অনুমোদন দিলো।তাদের মেয়ের নাম হবে ‘ মেহুল ‘।মিষ্টি মাহরুর ইবনাত এর সাথে যোগ হয় আরো একজন মেহুল মাহরুর ইবনাত।

নীরবতা কাটিয়ে মাহরুর বললো,

“তিন নারীতে সংসার আমার।”

চলবে….

চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৩৯

0

চন্দ্র’মল্লিকা ৩৯
লেখা : Azyah_সূচনা

জীবনে আর নতুন কি হয়েছে?পুরোনো নিয়মেই চলছে যখন থেকে দায়িত্ব ঘাড়ে পড়েছে।টাকা কামাও আর জমাও।আলাদা ব্যাংক একাউন্ট খুলে এসেছিল সেইদিন।মিষ্টি আর নতুন সদস্যের জন্য।আপাদত সেখানে অনাগত সন্তানের প্রাথমিক সব খরচা মেটানোর জন্য মাসে মাসে টাকা রাখছে।সাথে মল্লিকার প্রতিনিয়ত এর চেকআপের জন্য।যেনো সে পৃথিবীতে আসার পর কারো কাছে হাত পাততে না হয়। ভালোয় ভালোয় চলে আসুক মাহরুর আর চন্দ্রমল্লিকার কোলে।

সপ্তম মাসে পদার্পণ করা মল্লিকা কিছুটা অগোছালো। আহ্লাদে আটখানা।মিষ্টির সময় যত শক্ত ছিলো এখন ততটাই দুর্বল।মনে গেঁথে গেছে একটা বিষয়।তাকে সামলানোর জন্য আছে একটা শক্ত সম্ভ।আদরে আদরে অলসতা ধরে গেছে।কথা শুনে না।খাওয়া দাওয়ায় অনীহা।আজ মাহরুর রাগ দেখাতে বাধ্য হলো।ছোটোখাটো ঝগড়া করেছে মল্লিকার সাথে।এড়িয়ে যাবে তার চন্দ্রকে।একটু গুরুত্বহীনতায় ভুগলেই লাইনে চলে আসবে বদ মেয়েটা।দুই দুইটা বাচ্চার মা হতে চলেছে।তারপরও বুঝশক্তি নেই?

“কি করেন?”

অফিসের লাঞ্চ আওয়ারে অপেক্ষায় বসে ছিলো।ফোন করবে না চন্দ্র? তা কি করে হয়?ফোন আসলেও মাহরুর নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখলো।

উত্তর দিলো বটে, “কাজ করছি”

“খেয়েছেন?আজ তরকারি কেমন হয়েছে বললেনও না”

“কেনো তুই চেখে দেখিসনি?”

“আমি আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।আপনি খেয়েছেন জেনেই খেতে বসতাম।”

আরো রাগ চড়ে মাহরুরের।ঘড়িতে দুপুর আড়াইটে বাজে।এখনও খাওয়া হয়নি মল্লিকার। বিগড়ে যাওয়া মেজাজকে সংযত না করতে পেরে সামান্য ধমকের সুর প্রয়োগ করলো।

বললো, “তুই আমার নতুন বউ?আমি না খেলে তুই খাবি না? চড়িয়ে দাঁত ফেলে দিবো যদি এক্ষণ ফোন রেখে খেতে না বসিস!”

আহ্লাদী কণ্ঠে প্রশ্ন এলো, “পুরোনো হয়ে গিয়েছি না?”

“হ্যাঁ হয়েছিস!কতবার বলেছি দুপুর একটা থেকে দুইটার মধ্যে খাবার খেতে। মিষ্টিকেও না খাইয়ে রেখেছিস?”

“না ওকে খাইয়েছি।”

“তোর দুপুরের খাওয়ার পর ওষুধ আছে তুই এটা ভুলে যাস কেনো বারবার?আমার কথাকি শুনবি না চন্দ্র!কত বোঝানো যায় একজনকে।”

“জোর করে খাওয়া যায়? ইচ্ছের একটা ব্যাপার আছে।”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে মাহরুর।চোয়াল শক্ত করে বললো, “চাচা চাচীকে গ্রামে যেতে দেওয়াই ভুল হয়েছে আমার।তারা থাকলে অন্তত আমার চিন্তা কম হতো।”

“খাচ্ছি এখন। চেচাবেন না।”

“কি চেচাবো না!একটার পর একটা ভুল করে যাস।আদরে আদরে বাঁদর হচ্ছিস।তোর সাথে কঠোরতা অবলম্বন করা ছাড়া উপায় নেই।আসতে দে আজকে বাড়ি।”

মাতৃত্বকালীন সময়ে বুঝি অন্য সময়ের তুলনায় বেশি অভিমান জমে?কারো অত্যুগ্র বাক্য এসে হৃদপিণ্ডে করাঘাত করে? মাহরুর সহজে রাগে না।তবে তার রাগের বেশ দেখেছে মল্লিকা।কিভাবে রাগের বশে জহিরকে মেরে তক্তা বানিয়েছিল?আবার রেহালাকে শায়েস্তাও করেছে। চাপা রাগ তার।তবে মল্লিকা সম্পূর্ণ নির্দোষ।কত চেষ্টা করলো নিজের যত্ন নেবে।পারে না।ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করতে গেলেও মনের বিরুদ্ধে করা যায় না।মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। অন্যপাশের ক্ষ্যাপা মানুষটা ফোন কেটে দিয়েছে।

মিষ্টিকে ডাকলো মল্লিকা।নিজের কাছে বসিয়ে বললো, “জানিস তোর মাহি বাবা আমাকে বকেছে”

“কেনো মা?মাহি বাবা আমাকে কখনো বকে না।”

“কিন্তু তোর মাকে বকেছে।”

“আমি কি মাহি বাবাকে বকে দিবো মা?তুমি কষ্ট পেয়েছো?”

মল্লিকা নিজের পেটে হাত রেখে বলল, “বাবুটা কষ্ট পেয়েছে।”

ছোট্ট কপালে ভাজ পড়লো।এত বড় দুঃসাহস?মিষ্টির অনাগত ভাই অথবা বোনকে কষ্ট দিলো?মিষ্টি বললো, “মাহি বাবাকে ফোন করো।আমি বাবাকে বকবো।বাবুকে কেনো কষ্ট দিলো? ও যদি এখন রাগ করে?আমাদের কাছে না আসে?…মা তুমি ফোন করো।”

মল্লিকার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আটলো।নিজে পারবে না মাহরুরের সাথে।তকি?মিষ্টি ঠিকই উসুল করে নিবে।বাবা মেয়ে বুঝে নিবে।ততক্ষনাত ফোন হাতে নেয়।ফোন করে মিষ্টির কানে ধরিয়ে দিলো।আরো একবার ফোন পেয়ে মাহরুর হাসে।হয়তো ক্ষমা চাইতে ফোন করেছে।নিশ্চয়ই এতক্ষনে খাওয়া করে নিয়েছে মল্লিকা।

ফোন ধরেই বললো, “হ্যালো”

“মাহি বাবা!”

আশা ছিলো চন্দ্রের মিনমিনে গল্প শুনবে।হলো ভিন্ন।মিষ্টির মিঠা কন্ঠ শুনছে।তবে আজ মিষ্টির কন্ঠে পরিবর্তন। আদুরে ভাবটা নেই।কেমন রুক্ষ গলায় বললো মাহি বাবা।

মাহরুর উত্তর দেয়, “হ্যা বাবা?”

“তুমি মাকে কেনো বকেছো?…মাকে বকলে আর আমাদের বাবুটাও কষ্ট পেলো।মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।আমি ওকে বসে দেখছি।”

দ্বিরুপ প্রতিক্রিয়া এর মধ্যে গোলগাল পেকে গেলো।মিষ্টির কথায় ফিক করে হেসে ফেলবে নাকি মল্লিকা মেয়ের কাছে বাবার নামে নালিশ করেছে সেই বিষয়ে মল্লিকাকে মনেমনে গালমন্দ করবে?দুটোই হলো একই সাথে। ওষ্ঠেজুড়ে হাসি ফুটলো মেয়ের শাসনে আর মল্লিকার এমন কাণ্ডে কপাল কুঁচকে গেল তৎক্ষনাৎ।মেয়েকে হাতিয়ার বানিয়েছে!আজ সত্যিই মল্লিকাকে মাহরুরের অভিমান থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।

“কথা বলছো না কেনো মাহি বাবা?কেনো কষ্ট দিলে বাবুকে?”

“আমাকে ক্ষমা করে দে আম্মা।আমি বাড়ি ফিরে বাবুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো।”

“আর মার কাছে?”

মাহরুর সময় নিয়ে উত্তর দেয়, “হুম চাইবো”

“কানে ধরবে?”

“হ্যাঁ ধরবো।”

এরই মাঝে মিষ্টি তার নিজের আবদার রাখতেও ভুললো না।বলে ফেললো,

“আচ্ছা আজ চকোলেট আনবে কিন্তু”

“আচ্ছা মা।”

__

মল্লিকা গাল ফুলিয়ে রাখলে তাকে মাঝেমধ্যেই ‘ ফুলন দেবী ‘ বলে সম্বোধন করেছে মাহরুর। এখনতো মাহরুরই মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।আসার পর থেকে ঘণ্টার পর ঘন্টা কেটে গেলো।মুখে বিশাল আকারের তালা।মল্লিকার ফুলন দেবী এর পুরুষবাচক শব্দ বের করে নিতে বেশি সময় লাগলো না।নাম দিলো মনে মনে।ফুলন দেব।মল্লিকার ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের মতন করে মাহরুরের পেছন পেছন ছুটতে পারবে না। গোলগোল নেত্রজোড়াকে নিজের হাতিয়ার বানালো।যা এখন মাহরুরের রাগ ভাঙার আগ অব্দি তার উপরই থাকবে।তাতেও বিশেষ কোনো লাভের আশঙ্কা দেখতে পায়নি মল্লিকা।
আবারো নিজের প্রথম হাতিয়ার মিষ্টিকে কাজে লাগালো।

বলল, “তোর বাবাকে বল আজ দোকানে যেতে না।”

মিষ্টিও মায়ের আদেশ পালন করলো বিনা প্রশ্নে। মাহরুরের দিকে চেয়ে বলে উঠে, “যেও না মাহি বাবা”

মাহরুর জবাবে বলে, “তোর মাকে বল যা বলার নিজে বলতে।অন্যকে কেনো বাহক বানায়?”

মিষ্টি আশ্চর্য্য হয়ে প্রশ্ন করলো, “বাহক?”

মল্লিকা মুখ বেঁকিয়ে বলে উঠে, “তোর বাবা কি জানে না তুই ছোট?এত কঠিন ভাষা কেনো ব্যাবহার করে তোর সাথে।আবার আমার সাথে কঠিন আচরণও করে।”

মাহরুর বললো, “তোর মার বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে।ওই সতেরো বছরের কিশোরীর মতন আহ্লাদী হচ্ছে।”

“তোর বাবাকে বল বউদের আহ্লাদী হতে হয়।যদি সে হয় তার বাচ্চাদের মা তাহলে আরো বেশিবেশি আহ্লাদী হতে হয়।”

মাহরুর প্যান্টের পকেটে ফোন রাখতে রাখতে বললো, “ন্যাকামো দেখলে আর বাঁচি না।”

“ঠিক আছে।করলাম না ন্যাকামো।একটুও আহ্লাদ করবো না।কারো সাথে কথাও বলবো না।আমাকে এখন ভালো লাগবে কেনো? মোটা হয়ে গেছি।বিশ্রী দেখায়।এজন্যই আজকাল আমার উপর মানুষ রাগ থাকে।তোর বাবাকে বল আজকে থেকে সব বাদ।আমি মুখ তালাবদ্ধ করলাম।”

এতোটা জেদী কি করে হলো? মল্লিকাকে সর্বদা শান্ত আর বুঝদার হিসেবে জেনে এসেছে মাহরুর। দুষ্টুমির স্বভাবটা অব্দি ছিলো না তার মধ্যে।গ্রামীণ ভীত সন্ত্রস্ত কিশোরী হিসেবেই জানতো। নারীরূপে অভিভূত হওয়ার পরও এরকম আচরণই লক্ষণীয় ছিলো।

মাহরুর বলে উঠে, “এরকম করে রাগ উঠাস কেনো আমার?তোর বুঝা উচিত।আমি আমার মাথায় অনেক চিন্তা নিয়ে ঘুরি।জানিস তুই।সবটা মুখ ফুটে বলি না বলে আমি খুব শান্তিতে আছি?একটা সংসার সামলানো সহজ?নিজের যত্ন কেনো নিতে বলি?তোর মধ্যে আরো একটা প্রাণ আছে।কেউ দেখলে বলবে তুই সপ্তম মাসের অন্তঃসত্ত্বা?নিজের মুখটা দেখেছিস? যথাসাধ্য চেষ্টা করছি তোর যেনো কোনো সমস্যা না হয়। দৃষ্টিশক্তি থাকতেও যে অন্ধ তাকে আর কিইবা বলা যায়।আজ যতই অভিমান কর চন্দ্র।আমি গলবো না।নিজের যত্ন না নিলে আমিও এই মুখ তালাবদ্ধ করলাম।”

_____

রহিম মিয়ার ঘর থেকে চেঁচামেচির শব্দ ভেসে এলো।কোনো বিষয়ে উত্তেজিত হয়ে আলোচনা করছেন। মাহরুরের পা থমকে যায় রহিম চাচার অর্ধ ভেড়ানো ঘরের দরজায়।কারো কথা এভাবে লুকিয়ে শোনা ভালো না।তারপরও মাহরুরের পা যেনো গেড়ে গেলো।মস্তিষ্ক জানতে চাইছে কেনো এমন চেঁচামেচি?কি কারণ?রহিম চাচার পরপর জোবেদা বেগমের মৃদু কান্নার আভাস পাওয়া গেলো। মাহরুর এবারে চমকায়।দরজার পাশের ডাইনিং রুমে বসে কথা বলছেন।সবটা পরিষ্কার না হলেও বোঝা যাচ্ছে অনেক কথাই।কান্না শুনে ভেতরে ঢুকতে চাইলেই ফোনে কারো গলার আভাস শুনলো।সেও একইভাবে উত্তেজিত। পুরুষালী গলা।রাগ দেখিয়ে কিছু একটা বলছে।

মাহরুর আর ভেতরে গেলো না।তবে চিন্তা হচ্ছে।এই বয়সে এতো পেরেশানি ঠিক নয়।ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো অদৃশ্য অধিকারবোধে।মিনিট দশেক পর কথা শেষ হয়েছে। মাহরুর এবার দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে এসে বললো,

“আসসালামু আলাইকুম”

দুজন অর্ধ বৃদ্ধ নারী পুরুষ বসে আছে।রহিম মিয়া কপালে হাত রেখে ডাইনিং টেবিলে আর জোবেদা খাতুন এর শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন।

মাহরুরকে দেখে দুজনই ভারী পরিশ্রান্ত কণ্ঠে সালামের উত্তর নেয়। মাহরুর কোনো কিছু না ভেবেই প্রশ্ন করলো,

“কি হয়েছে চাচা?..চাচী?”

মাহরুরের প্রশ্নে নির্বিকার হয়ে উঠলেন দুজনেই। অপরাধীর ন্যায় চোখ নামিয়েছেন। নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরলো চার দেয়ালের মধ্যে। মাহরুর গলা ভেজায়।তাদের এমন চুপ থাকা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মাহরুর এগিয়ে গেলো জোবেদা খাতুন এর দিকে। তিনিই একমাত্র যেকিনা নির্দ্বিধায় বলে ফেলবেন।

জোবেদা খাতুন এর পাশে বসে মাহরুর পূনরায় জানতে চাইলো,

“বলেন না চাচী কি হয়েছে?আমি আপনাদের ছেলের মতন।বিশ্বাস রাখুন।আমি এই বিশ্বাস ভঙ্গ করবো না।”

রহিম মিয়া উত্তর দিলেন, “বইলা কোনো লাভতো হইবো না।”

মাহরুর তার দিকে দৃষ্টি নিবেশ করে বললো, “লাভ লোকসান এর হিসেব পড়ে।আগে জানতে হবে।সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবতে হবে।পরবর্তীতে কি হলো না হলো দেখা যাবে।”

সাদা লম্বা দাড়িয়ে হাত বুলিয়ে স্ত্রীর দিকে ইশারা করলেন রহিম মিয়া।বললেন, “তোমার চাচীরেই জিগাও।”

মাহরুরও দ্রুত জোবেদা খাতুন এর উদ্দেশে বললো, ” বলেন চাচী?”

জোবেদা বেগমের কুচকে পড়া মুখ বেয়ে আরো কয়েক রেখা অস্রুজল দেখা গেলো।বললো,

“আমার পোলায় কইছে বাড়িটা বেইচা দিতে।তারারা নাকি কোনোদিন দেশে ফিরবো না।বাড়ি রাইখা কি লাভ?”

রমজান মিয়া তাল মিলিয়ে বললেন, “পোলায় ফোন দিছিলো।কইতাছে তোমরা বাচবা কতদিন?কেউ না থাকলে এই বাড়িটা দখলে যাইবো গা।এই কারণে বেইচা দিয়া টাকা সব ব্যাংকে রাখবার কইসে।”

মাহরুর খানিকটা কঠোর গলায় বললো, “ভবিষ্যৎ কী কেউ দেখেছে?আগেই ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েতো লাভ নেই।”

“আমি এই ঘরটা আমার টাকায় তৈরি করছি।আমার শখ আছিলো এই বাড়ির কোনো ভাগ আমার পোলা মাইয়ার নামে যাইবো না।ওদের দুইজনের নামে দুইটা জমি আছে গেরামে।আমরা যাওয়ার পর এটা এতিমখানার বাচ্চাগো লেইগা দিয়া দিমু।জীবনে জানতে অজান্তে পাপ করছি। এতিম বাচ্চাগো মাথায় একটা ছাদ দিতে পারলে মরার পরও দুআ পামু।আমার উসিলায় আমার সন্তানরাও পাইবো”

“ভালো সিদ্ধান্ত চাচা।”

“কিন্তু আমার পোলায় মানবো না মাহি।”

“এটাই কি কারণ চাচা?যে আপনারা না থাকলে এই বাড়ি কি হবে?নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?”

চটজলদি একটা বিষয় পাকড়াও করে ফেলায় হতবিহ্বল দেখালো রহিম মিয়াকে।জোবেদা খাতুন আর সে একে ওপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে।কেউ কোনো উত্তর দিলো না।

মাহরুর সন্দিহান গলায় বললো, “আমার মনে হচ্ছে এখানে একটা কারণ না।আরো কিছু কারণ অবশ্যই আছে।বাড়ি বিক্রির জন্য তাগাদা দেওয়ার পেছনে।”

পরাজিত হয়ে রহিম মিয়া বললেন, “ওর নাকি টাকা লাগবো। দশ লাখ”

মাহরুর হাসলো।এই হাসি তাচ্ছিল্যের।বললো, “বিদেশি টাকায় দশ লক্ষ কোনো ব্যাপার না চাচা।কিন্তু বাংলাদেশে অনেক বড় অংক।আপনার ছেলেকে বুঝতে ভুল করছেন ”

রহিম মিয়া আর জোবেদা বেগম চাইলেন মাহরুরের দিকে।তার বলা কথার অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারেননি। প্রশ্নবিত্ব চোখে চেয়ে রইলেন। মাহরুর উচিত কথা সময়-ক্ষণ ভেবে বলে না।হোক আপন হোক পর।

বাধহীনভাবে বলে উঠলো, “হতে পারে সে আপনার ছেলে।আমি যে কথাটা বলবো আপনার কষ্ট হবে।তারপরও শুনুন চাচা।আপনার ছেলে বাড়িটা বিক্রি করতে বলছে কারণ এই বাড়ির সম্পূর্ণ টাকা তার চাই। দশ লক্ষ টাকা লাগবে,বাড়ি দখল হয়ে যাবে এসব বাহানা মাত্র।”

একটু থেমে আবার বললো, “আমার কথায় কষ্ট পেলে দু চারটে থাপ্পড় দিন আমায়।তারপরও আমি যা বলছি তাই ঠিক। মিলিয়ে নেবেন।”

তাদের মুখেই শুনেছে মাহরুর। বিলেতে স্থায়ী রহিম মিয়ার ছেলে।অনেক বছর যাবত।সেখানে নিজস্ব বাড়ি আর ব্যবসা আছে।তার সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ করেই এমন উক্তি ছুঁড়েছে মাহরুর।যে লোক বিদেশে এত এত অর্থের মালিক সে নিশ্চয়ই দশ লক্ষ টাকার জন্য বাড়ি বিক্রি করতে বলবে না। মাহরুরের কথায় পূনরায় নীরব হয় দুজনে।জং ধরা মস্তিষ্কে জোর দিলো। মাহরুরের কথায় ভুল নেই কোথাও।যুক্তি আছে।

আশাহত চোখে রহিম মিয়া জানতে চাইলেন, “কি করমু?তুমিই কিছু বুদ্ধি দাও।আমি বাড়িটা হারাইতে চাই না।”

মাহরুর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো, “আপনাদের পারিবারিক বিষয়ে আমি আসলে খারাপ দেখায় চাচা”

“না বাবা খারাপ দেখায় না।আমার বাড়িটা বাঁচাইতে সাহায্য করো।”

মাহরুর কিছু সময় অতিবাহিত করে বললো, “বাড়ি কার নামে চাচা?”

“এখনও আমার নামেই আছে।”

“আচ্ছা।আপনি নিজের নামেই রাখুন।যে যাই বলুক কারো কথায় বাড়ির কাগজে অথবা অন্যকোনো কাগজে সই করবেন না।”

“মাহি শুনো আরেকটা কথা।আমার পেনশনের টাকা ছাড়াও আরো কিছু টাকা ব্যাংক থেকে সরানো হইসে”

“ব্যাংক থেকে টাকা সরানো এত সহজ না চাচা।”

“সহজ।আমি জানি আমার ছেলেই সরাইছে।ওর কাছে সব তথ্য আছে।আমি নিজে ব্যাংকে এই অঙ্গীকারনামা দিছিলাম আমার অনুপস্থিতিতে আমার ছেলে যেনো টাকা নিতে পারে।”

“এটাইতো ভুল করলেন চাচা।আপনি ব্যাংকে যাবেন।গিয়ে বলবেন আপনি ছাড়া যেনো আর কেউ আপনার একাউন্ট থেকে টাকা নিতে না পারে।হোক আপনার ছেলে বা অন্য কেউ”

“আচ্ছা।” সম্মতি দিলেন রহিম মিয়া।

মাহরুর উঠে দাড়ায়।বিদায় নিয়ে বলে, “সতর্ক হলেই হবে কোনো চিন্তা করবেন না।কোনো দরকারে আমাকে ডাকবেন।আমি হাজির থাকবো।আর কান্নাকাটি করা চলবে না কিন্তু চাচী।”

__

কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মাহরুর।আসলে ঘুমোয়নি। ঘুমোনোর নাটক করছে।একটা মাত্র ঘরে একজনকে কত এড়িয়ে যাওয়া যায়?অন্তত চোখাচোখি হয়।এই চোঁখের চাহনিটাই দুর্বল করে ফেলে মাহরুরকে।মল্লিকার মলিন চক্ষু জ্যোতি হৃদয়ে এসে তীরের মতন বিধে। উপেক্ষা করার সাহসে কুলায় না।মন বলে,

“কাছে যা।বুকে জড়িয়ে নে।দেখ কি রূপবতী হয়েছে তোর চন্দ্রমল্লিকা?”

নিজের হৃদয়ের লাগাম টানতে আগে অবাধ্য চোখকে মল্লিকার থেকে সরিয়ে নেয়।না দেখবে না মন গলবে। মল্লিকাও মুখ ফুলিয়ে।এই লোক কি তাকে মানাবে না?আরাম করে সিংহাসনে বসে নয় শুয়ে পড়লো যে? মহাশয়ের মিথ্যে রাগের বালাইয়ে ধরেছে।কি এমন করেছে সে?একটু নিজের অযত্ন?তাও কি শখে?এই নিয়ে কত তোলপাড়।
তৃতীয়বারের মতন মিষ্টিকেই হাতিয়ার বানালো।কানে কানে শিখিয়ে দিলো,

“মাহি বাবাকে বল মা কাদঁছে।তুমি তার সাথে রেগে আছো বলে।”

মিষ্টি উত্তর দেয়, “তোমার চোখে পানি নেই মা। কোথায় কাঁদছো?”

এইটুকু মেয়েকে এত বুদ্ধিমতী কে হতে বলেছে?মল্লিকা ঢোক গিলে। মিছেমিছি কাদো মুখ বানিয়ে বললো,

“এখন কাঁদবো।যা গিয়ে বল”

মিষ্টিও একলাফে মাহরুরের চাদর টেনে সরিয়ে দেয়।বলে, “মা কাদঁছে।”

“কাঁদুক!” সোজা জবাব এসেছে।

এবার মিথ্যে কাদো মুখটা সত্যিসত্যি ক্রন্দনে সিক্ত হতে শুরু করলো। মুখ ঘুরিয়ে নেয়।লাইট নিভিয়ে অন্যদিকে ঘুরেই শুয়ে পড়েছে।রাতের গভীরতা বাড়ছে ক্রমশ।মল্লিকার চোখে ঘুম নেই। মাহরুরকে পিঠ দেখিয়ে শুয়ে থাকতে থাকতেও ক্লান্ত।পেটের ভার একজায়গায় দেওয়া উচিত হবে না।তাই সামান্য ঘুরল।রাগ,অভিমান বাচ্চার বাবার উপর।বাচ্চার উপর নয়।পিছু ঘুরে চাইতেই চমকে উঠলো।মাথার একদিকে হাত মুঠ করে ঠেকিয়ে আছে মাহরুর। বারংবার পলক ফেলছে মল্লিকার দিকে চেয়ে।অভিমানে মল্লিকার মুখ কুচকে আসে।অন্যদিকে ফিরতে চাইলে মাহরুর থামিয়ে দিল।

বললো, “বিবাহিত পুরুষেরা কোনোদিন জিততে পারে?তাও তার একমাত্র বউয়ের কাছে?ভুল করেও জিতে যাওয়া যেনো বউদের বউগত অধিকার।”

মাহরুরের কথার বিনিময়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মল্লিকা।উত্তর দিলো না। মাহরুরকে এড়াতে চোখ বন্ধ করে নেয়।মল্লিকার কপালে আঙ্গুল স্পষ্ট করে মাহরুর বললো,

“আমার দুটো সন্তান।অথচ দুজনের একজনও জানে না তাদের মা গাঁধী,পাগল!”

চলবে….