চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৪৫ এবং শেষ পর্ব

0
231

চন্দ্র’মল্লিকা ৪৫ (সমাপ্তি পর্ব)
লেখা : Azyah_সূচনা

অম্বর আজ নীলাভ রঁজিত।আঁকাবাঁকা ক্ষুদ্র নক্ষত্রে রঞ্জিত এক ভিন্ন চিত্রাঙ্কন। গোলাকার অমৃতাংশু অদ্য খেলায় মেতেছে।কালো মেঘমল্লারের আড়ালে মধ্যে-মধ্যে সুরত দর্শন হচ্ছে। মিটিমিটি জ্বলছে।চোখ নামাতেই সাক্ষাৎ হয় রাশিরাশি পুষ্পের সাথে। কুসুমায়ন ছড়িয়ে মোজাইক করা ফর্সে। সুশোভন রঙের সমারোহে প্রতীয়মান হলো যেনো আকাশ থেকে রংধনুর সাত রঙ এনে জমিনে হাজির। মরিচা হলদে বাতি জ্বলছে চারিদিকে। সৌন্দর্য যেনো পিছু ছাড়ছে না।

“ঔষধ খাও”

“খাবো না।একদম খাবো না”

চশমা পরিহিত সুঠাম দেহের এক পুরুষ ভারী বিরক্ত। শক্তপোক্ত বাহ্যিক দিক।অন্তরালে ভীষণ দুর্বল।রেগে গেলো এই সুন্দর এক সন্ধ্যায়।না চাইতেও।

কঠোর গলায় সাত বছর বয়সী মেয়ের হাত টেনে ধরে বলল, “আজ তোমার জন্মদিন।আমি চাইছি না রাগ করতে। বকা খেতে না চাইলে দ্রুত ঔষধ খাও”

“বাবা আমার ঠান্ডা নেই।তুমি কেনো বুঝতে পারছো না?”

মুখ ফুলিয়ে উত্তর দিলো মেহুল।বড্ড জেদী মেয়েটা।ঠান্ডায় শ্বাস নিতে পারে না।তারপরও কে জানে কেনো এতো অনীহা ঔষধের প্রতি?নিজের কথা মানিয়ে ছাড়ে। যেভাবেই হোক না কেনো।তবে আজ মাহরুর কোনো কথা শুনবে না।জন্মদিনে ধমক খাওয়ার জন্য যেহেতু নিজে থেকেই পা বাড়াচ্ছে। ধমকটা দেওয়াই উচিত।

মাহরুর আরো কঠিন অবয়ব ধারণ করলো।মেয়েকে টেনে নিয়ে ওষুধটা জোর করে মুখে পুড়ে দেয়।পানি দিলো সাথেসাথে।নাক ছিটকে কোনো রকম গিলে নিলো।

আর বললো, “কি বিশ্রী! ছিঃ!”

“বিশ্রী আর কার্যকর।এবার যাও।”

সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পিছু ঘুরে মাহরুর।অর্ধ দৈর্ঘ্যের কেশমালা পিঠে ছড়িয়ে আরো এক মেয়ে বসে আছে।পা ভাজ করে। যতনে প্রত্যেকটি গাছের পরিচর্যা করছে।পানি দিচ্ছে।আজ ব্যস্ত ছিলো বেজায়।গাছগুলোকে ছুঁয়ে দেখা হয়নি।বাড়ির মাঝে জন্মদিনের আয়োজনকে তোয়াক্কা না করেই গাছ গাছালির দিকে মনোযোগ দিয়ে বসে আছে।পরনে গোলাপী রঙের পোশাক।ফর্সা রঙে যেনো আরো সৌন্দর্য্য ঢেলে দিচ্ছে এই রং।

মাহরুর দুয়েক কদম এগোয়।পেছনে হাত বেঁধে দাড়ায় ঠিক তার পেছনে।একবার পিছু ঘুরে ছটফটে মেহুলকে দেখে নিলো।পূনরায় সামনে চেয়ে ডাকে।

বলে, “আম্মা?”

তৎক্ষনাৎ তেরো বছরের সেই কিশোরী ফিরে চায়। সুশ্রী মুখমণ্ডলে হাসি ফুটিয়ে বললো,

“জ্বি?….কিছু লাগবে মাহি বাবা?”

মাহরুর উত্তর দেয়, “না মা কিছু লাগবে না।কি করছিস তুই?”

“গাছগুলো দেখছিলাম। আগাছা পরিষ্কার করছি।”

“এখন কেনো?আগামীকাল করিস?এখন যা হাত মুখ ধুয়ে আয়।”

বাবার একবাক্যে উঠে দাড়ালো।হাত পা ঝেড়ে এক টুকরো হাসি উপহার দিয়ে চলে গেলো মিষ্টি।আদেশ জমিনে পড়ার আগেই মান্য করে ফেলে।সভ্য আর ভদ্রতার প্রতিমা এই মেয়েটি।অন্যদিকে মেহুলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। বদমেজাজি।তবে বেয়াদবের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার মতন নয়।

আজ মেহুলের সাততম জন্মজয়ন্তী।আগামীকাল মিষ্টির তেরোতম জন্মদিন।দুই বোন পৃথিবীতে এসেছে একদিন আগে পড়ে।একই দিনে আয়োজন হলো দুজনার জন্য।কখনো পালন করা হয়নি এই দিনগুলো। পারিবারিকভাবে সময় কাটিয়েছে একে অপরের সাথে।রহিম মিয়ার মৃত্যুর পর কোনো উৎসব উদযাপন করতে ইচ্ছেই হয়নি কখনো। চিত্তে অদৃশ্য কষ্ট। মাহরুর কথা রেখেছে।পারলো না রহিম চাচা।পাশে থাকার অঙ্গীকার দিয়েও চলে গেলো না ফেরার দেশে। একাকীত্বে ফেলে গেলো জোবেদা খাতুনকে।আজ সামান্য সামর্থ্য হয়েছে মাহরুরের।সাত বছরের কষ্টের ফল।অভাবের সংসারে একটু একটু করে নিজের সাফল্যের দিকে এগিয়েছে।তারপরও কিছু ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে।অভাব ছিলো হয়তো সাত বছরের চেয়েও বেশি সময় ধরে।তবে নিজের ঘর বেধে আজ মুক্ত মনে হচ্ছে নিজেকে।
এরই মাঝে পূনরায় দৌড়ে এলো মেহুল।হাত ধরে টেনে এনেছে বড়বোন মিষ্টিকেও।

এসেই বলল,

“বাবা তোমার মোবাইলটা দাও।ছবি তুলবো।”

মাহরুর দুজনের দিকে চেয়ে দেখে একবার। সাত বছরের এতটুক মেয়ে ছবিও তুলতে চায়।তবে তাদের দেখে মনে হচ্ছে এক জোড়া।একই রকম চেহারা।একই রকম পরিধেয় বস্ত্র।আজও মাপের বেশকম ছাড়া আর কিছুই ভিন্ন নেই তাদের মধ্যে। বিনা বাক্যে ফোনটা এগিয়ে দেয়।

বলে, “দশ মিনিটে ফিরিয়ে দিয়ে যাবেন।বুঝেছেন?”

মিষ্টি উত্তর দিলো, “ঠিক আছে মাহি বাবা।”

মেহুল ফোড়ন কেটে বললো, “উফ আপু!শুধু বাবা।মাহি বাবা না।”

মিষ্টি বললো, “আচ্ছা আমার মা ভুল হয়েছে।চল”

ধূসর পাঞ্জাবি গায়ে মাহরুর।চোখে আজকাল চশমা পড়েছে। যান্ত্রিক কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করতে করতে চোখের অবস্থা নাজেহাল।সাথে দোষ আছে বয়সেও।কম সময়তো কাঁটায়নি এই ভুবনে।কালচে খয়েরী দাড়ি আর কুচকুচে কালো চুলে পাক ধরেছে অনেকখানি।সচ্ছ কাছের চশমার আড়াল থেকে ক্ষুদ্র চক্ষু নিবেশিত হয় সামনের তিনটে ঘরের দিকে।নিজের সব শখ মিশিয়ে তৈরি করেছে ঘরত্রয়।আহামরি কোনো বিলাসিতার ছোঁয়া নেই এখানে।ছিমছাম পরিবেশ। সাজানো গোছানো।ঘর তৈরি করতে গিয়ে চিলেকোঠার সৌন্দর্যকে কোনো হানি পৌঁছায়নি।এক ঘরে জায়গা হয়েছে মেয়েলি সৌন্দর্য্যের প্রতীক।তার কন্যাদ্বয় থাকে।এক ঘরে একই সাথে বুড়ো হতে থাকা প্রেমিক যুগল।মল্লিকা আর মাহরুর।আরেক ঘরে জীবনের অনেকটা বছর একসাথে পাড় করা রমজান সাহেব এবং ফরিদা বেগম স্মৃতিচারণ করেন পুরোনো দিনের।

হুট করে মনে পড়লে।মেয়ের মায়েদের যে দেখা মিলছে না? কোথায় হারালো সে?আওয়াজ করে ডাকলো,

“চন্দ্র?”

দূর কোথা থেকে একটা সুরেলা আওয়াজ এলো, “আসছি আসছি”

বলার কয়েক সেকেন্ডের মাঝে এসে হাজির।মেয়েদের জন্মদিনে জন্মদাত্রী মা নিজেকে সাজিয়েছে সাবলীলভাবে।হাতের কাজ করা আসমানী রঙের শাড়িতে।চুলের খোঁপায় কয়েকটা ফুলও গুঁজেছে।কি আশ্চর্য্য!দুটো মেয়ের মা হওয়া সত্বেও সৌন্দর্য্য কেনো কমলো না?

মাহরুরের এরূপ প্রশ্নের জবাব দেয় তারই মস্তিষ্ক, “প্রিয় মানুষ সব রূপে, সবভাবে,সব বয়সে সুন্দর।”

মল্লিকা এগিয়ে এসে মাহরুরের পাঞ্জাবির গলা ঠিক করে দিলো।খুলে থাকা বোতাম লাগিয়ে দিয়ে বললো, “ডাকছিলেন কেনো?”

স্মিথ হেসে মাহরুর অবলীলায় জবাব দেয়, “আজ আপনাকে যে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে?সেটা জানানোর জন্যই ডেকেছিলাম।”

“আপনাকেও ভীষণ সুদর্শন দেখাচ্ছে কিন্তু।”

বোধগম্য হয় মাহরুরের।সমাজ আর তার নিজের চোখে বৃদ্ধ হতে থাকা মাহরুর মল্লিকার চোখে আজও সুদর্শন।ঠিক তার মস্তিষ্কের বলা লাইনটা মনে পড়লো।সেও সব রূপে, সবভাবে,সব বয়সে মল্লিকার চোখে সুন্দর।তার চন্দ্রমল্লিকার গভীর নয়নে বসবাস মাহরুর নামক পুরুষের।

দুজনার ব্যক্তিগত কথোপকথনে বাঁধা হলো শশী।এসে হাজির ঝটপট।মল্লিকা অবাক বনে রইলো।শশী আসবে কল্পনায়ও ভাবেনি।এত বছরে গ্রামে গিয়েই তাদের সাক্ষাৎকার মিলেছে।আজ ঢাকা এসে হাজির।একেক করে দরজা টপকে প্রিয় মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে। সর্বপ্রথম দুলাল জোবেদ খাতুনকে ধরে নিয়ে আসলেন।পরপর শিরীন আর তার ছেলে মেয়ে।সুমাইয়া আর সায়মনও বড় হয়ে গেছে।ফরিদা বেগমও তাদের সাথেই আছে।রমজান সাহেব আর রেদোয়ান নিচে মাদ্রাসার বাচ্চাদের জন্য খাবারের আয়োজনের তদারকি করতে ব্যস্ত।কিছু সময়ের মধ্যে তারাও আসবেন।

মল্লিকা অনেকদিন পর সখীকে কাছে পেয়ে খুশিতে আটখানা।কাছে গিয়েই জড়িয়ে ধরলো।বললো,

“তুই আসবি আগে বলিসনি কেনো?”

“আগে বলে এত খুশি হতি নাকি?” উত্তর দেয় শশী।

“সত্যিই আমি ভীষণ খুশি হয়েছি।চাচা চাচীকে কেনো আনলি না?আর শওকত ভাই,ভাবি?”

“তারাও আসবে একদিন সময় করে।”

শশী থেকে নজর সরিয়ে তার স্বামীর দিকে নজর যায়।সাথে সীমান্তের দিকে।সালাম জানিয়ে বললো,

“কেমন আছেন দুলাভাই?”

শশীর স্বামী উত্তর দিলো, “সেই বিয়ের প্রথমদিনের মতন ফার্স্ট ক্লাস”

মল্লিকা সীমান্তের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “কেমন আছো বাবা?”

“খুব ভালো আছি খালামণি।”

শশী বললো, “কই আমার বৌমা কই?… ইশ! আরেকটা ছেলে হতো আমার। মিষ্টি মেহুল দুজনকে বউ করে নিতাম।”

শশীর স্বামী পেছন থেকে বলে উঠলো, “আমি কিন্তু খুব ভালো গান পারি শ্যালিকা।আজ তোমার মেয়েদের জন্মদিন উপলক্ষে গান গাইবো।”

“অবশ্যই দুলাভাই আসুন”

রহিম মিয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।নিচের দুটো তলায় মাদ্রাসার এতিম শিক্ষার্থীরা।প্রথম তলায় মেয়েদের এবং দ্বিতীয়তলায় ছেলেদের।একটি বেসরকারি এনজিও তাদের খরচ বহন করছে।সাথে মাহরুরের সামান্য কিছু অনুদানে বেশ চলছে সবকিছু।রহিম মিয়ার ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই তাদের চেষ্টায় অনড়।এখনও চাই তাদের বাড়িটা।আইনি কাজের কারণে আগাতে পারছে না কেউই। মাহরুরকে হেনস্তা করার চেষ্টাও করেছে কয়েকবার। জোবেদা খাতুনের সাহায্যে মিটেছে সেই ঝামেলাও।দুলালকে আজকাল কোনো চিন্তা নেই। স্টেশনারি শপটায় নিজের সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে ব্যবসা বড় করেছে।চলছে জীবন গতানুগতিকভাবে।

একে অপরের সাথে পরিচয় পর্ব শেষ হবার পরপরই রেদোয়ান কেক নিয়ে হাজির। মাহরুর এই ধরনের কোনো আয়োজন করতে চায়নি।পরিবারের সবাই একত্রে হবে।গল্প,আড্ডায় ভালো সময় পাড় করবে এই ইচ্ছেটাই ছিলো।তবে রেদোয়ান না জানিয়ে ভাতিজিদের জন্য নিয়ে এসেছে ছোট্ট উপহার।

এসেই বলল, “কেক কাটবে দ্রুত এসো।মিষ্টি? মেহুল?”

দুই পরী এসে হাজির হলো সবার মধ্যিখানে।বাবা মায়ের সাথে মিশে উৎযাপন করেছে জম্মদিনটা। আপনজনদের মধ্যে এক মনোরম সময়।শান্তির!নিজের কথা মোতাবেক শশীর স্বামী প্রবল উৎসাহ নিয়ে সবার মাঝে আসে।সবাইকে জানান দিয়ে শুরু করলো তার কণ্ঠে গান।

“আজকের আকাশে অনেক তারা
দিন ছিল সূর্যে ভরা
আজকের জোছনাটা আরও সুন্দর
সন্ধ্যাটা আগুন লাগা
আজকের পৃথিবী তোমার জন্য
ভরে থাকা ভালো লাগা
মুখরিত হবে দিন গানে-গানে আগামীর সম্ভাবনায়
তুমি এই দিনে পৃথিবীতে এসেছো শুভেচ্ছা তোমায়
তাই অনাগত ক্ষণ হোক আরও সুন্দর উচ্ছল দিন কামনায়
আজ জন্মদিন তোমার”

উপভোগ করেছে সকলে এই গান।একটু একটু করে বেড়ে উঠা সন্তান সন্তানাদিরাও করতালি দিয়ে উঠলো।সবার মধ্যিখানে ঠোঁটে সামান্য হাসি টেনে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে মাহরুর। প্রার্থনা করছে বারবার।এভাবেই যেনো থাকে সব।সুন্দর,সচ্ছ,শান্ত। মাহরুরের শ্রান্ত মুখটা লক্ষ্য করলো মল্লিকা।সবার আড়ালে গিয়ে আলগোছে হাত আগলে নিয়েছে।কারো ভরসার শক্ত বাঁধন পেয়ে ফিরে তাকায় মাহরুর।মেয়ের মায়ের ফুটফুটে মুখ দেখে ভুলে বসলো সবটা।

রমজান সাহেব এবং ফরিদা বেগম দুই নাতনিকে একপাশে বসিয়েছেন।সাথে সায়মন আর সুমাইয়াকেও। শশীর ছেলে সীমান্তকে একা দাড়িয়ে থাকতে দেখে তাকেও ডেকে নিলো।তৃতীয় প্রজন্মকে সাথে নিয়ে একত্রে বসেন।

রমজান মিয়া বললেন সব বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে, “এইযে দেখছো তোমাদের বাবা মায়েদের?এত আনন্দ চারিপাশে?এসবের পেছনে কিন্তু তোমাদের বাবা মায়েরই বিরাট অবদান।জীবনে সফল হতে পারো আর না পারো।সবসময় বাবা মায়ের পাশে থাকবে।..বড় হবে তোমাদেরও বিয়ে হবে নিজের সংসার হবে।কিন্তু যারা তোমাদের বড় করেছে তাদের হাত ছেড়ে দিও না কিন্তু।”

মিষ্টি জবাব দিলো, “আমরা সবসময় বাবা মায়ের সাথে থাকবো নানাভাই”

সুমাইয়াও একই উত্তর দিয়ে বলে, “চেষ্টা করবো তাদের মুখ উজ্জ্বল করতে।”

একে একে বড় থেকে ছোট সকলেই হ্যাতে হ্যা মেলায়।রমজান সাহেবের কথা মান্য করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। পূনরায় মেতে উঠলো পুরো পরিবার আড্ডায়।ছেলেরা বাহিরের কাজ সেরে একত্রে বসেছে।আলাপ আলোচনা করছে।নারীরা হাতেহাতে তাদের খাবার তুলে দিলো।সাথে তাদের সন্তানদেরও। প্রত্যেকজনই কোমরে আঁচল গুঁজে কাজ করছে।পুরুষ এবং বাচ্চাদের খাওয়া শেষে মাহরুর বললো,

“চন্দ্র? এবার তোরা বসে পড়।আমরা সার্ভ করে দিচ্ছি।”

সম্পর্কে উচু নিচুর ভেদাভেদ আছে?এখানে সবাই সমান। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষদের শক্তির প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।শক্তি দর্শানো হয় কি শুধু নারীদের দাবিয়ে রাখতে?তাদের প্রতি অবিচার করতে?মূল অর্থে শক্তি দেখানো হয় সংসারের ঢাল হয়ে দাঁড়াতে। বিপদ আপদে নিজেকে শক্ত স্তম্ভ হিসেবে পেশ করতে। মাহরুরের পাশাপাশি এখানে উপস্থিত সকল পুরুষ সেটাই করলো।নিজেদের অর্ধাঙ্গিনীদেরকে খাবার পরিবেশন করছে কোনো রকম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই।তাদের মতে এখানে সম্মানহানি নয় সম্মান আরো বৃদ্ধি পাবে।তাদের সন্তানেরাও ভালো শিক্ষা পাবে।

জোবেদা খাতুন আকস্মিক কেদে উঠলেন।ভীষণ রকমের মনে পড়ছে নিজের মানুষটাকে।সুখ দুঃখের সঙ্গী।সেও অনেক সম্মান করতো স্ত্রীকে।আজ নেই।হাত তুলে বললেন,

“জামিলের বাপ আমারেও নিতে আসো।আমার একলা লাগে।”

মাহরুর এগিয়ে আসলো।বললো, “একলা লাগে মানে?আপনি আমাকে এভাবে ভুলে গেলেন?পর করে দিলেন?”

চোখ মুছে জোবেদা খাতুন বললেন, “নারে বাপ।তোমরা আছো দেইখা এতদিন বাইচা থাকার শক্তি পাইছি।নাহয় ওনার শোকে আমিও যাইতাম গা।”

“এসব কথা বলবেন না চাচী।রহিম চাচাকে আল্লাহর বেশ পছন্দ হয়েছে।তাই নিজের জিনিস নিয়ে গেছেন।আপনি আমাদের সাথে থেকেও একা অনুভব করেন কি করে?”

“করি নাতো।মাঝেমধ্যে মন বেজার হয়!”

“মন বেজার করা যাবে না।আপনার কতগুলো নাতি নাতনী।তাদের নিয়ে আপনার আরামে,গল্প করে কাটানো উচিত।”

মাহরুর এক কোণে বসে আছে মেয়েদ্বয়কে দুপাশে নিয়ে।তার চন্দ্রেরতো আজ সময়ই হচ্ছে না।খাবার দাবারের পর্ব চুকিয়ে সকলে যেখানে ক্লান্ত।গা এলিয়ে দিচ্ছে এদিক ওদিক।সেখানে শিরীন,শশী,মল্লিকা একত্রে ছাদ পরিষ্কার করেছে। তোষক আর চাঁদর বিছিয়ে আয়োজন করছে।আজ সকলে এখানে থাকবে। ঘুমোবে না বলে ভেবে নিলো।পুরোনো গল্পের ঝুড়ি খুলে বসবে। মাহরুর সবদিকে নজর দিয়েও মন আবারো খারাপের দিকে ঝুঁকে।আজ যে বাবা মাকে ভীষণ মনে পড়ছে।আকাশের দিকে চাইলো।

মনে মনে আওড়ালো, “ছেলে তোমার ভীষণ রকমের ভালো আছে মা বাবা।”

চাদর,বলিস, কাথা ছড়িয়ে সকলে বসেছে।পা ভাজ করে নিলো।এর মধ্যে কেউ কেউ আলাপ শুরুও করে দিয়েছে।এতখন দুই মেয়েকে জড়িয়ে রাখা মাহরুরও যোগ দেয় তাদের মধ্যে।মিষ্টি আর মেহুলও।আগামীকাল অফিসে বেশি কাজ করতে হবে।অফিসে পদোন্নতি হয়েছে। অতিরিক্ত আয় এর অংশ চলে যায় ঋণ পরিশোধে।এই বছরের আর কয়েকমাস বাদে ঋণের বোঝা থেকেও মুক্ত হবে মাহরুর।তবে চিন্তা আজও পিছু ছাড়লো না।থেকেই গেলো।

পারিবারিক আলাপের মধ্যে অন্যহাতে মাহরুর কিছু কাজও সম্পন্ন করে নেয়।নিজেকে খাপ ছাড়া মনে হচ্ছিল বলে দ্রুত কাজ শেষ করলো।এসে বসলো সবার মাঝে আরো একবার।রাতের গভীরত্ব বাড়ছে।সাথে অনেকের চোখে ঘুম এসে ঝুকে বসলো।যে যেখানে জায়গা পাচ্ছে গা এলিয়ে দিল।এক এক করে কথা অপূর্ণ রেখেই সকলে ঘুমের সাগরে ডুব দেয়।একা রয়ে যায় এক যুগল।দুই জোড়া জ্বলজ্বল করা চোখ।সবার দিকে চোখ বুলিয়ে মোলায়েম হাসছে।

একেঅপরের চোখাচোখি হতেই মাহরুর ধীর কন্ঠে বলল, “চন্দ্রবিলাস করবি না?”

মাহরুর রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।মল্লিকা ঠিক তার পাশে এসে দাঁড়াল।আকাশের দিকে চাওয়ার পূর্বেই মাহরুর আবদার করে,

“আপনার মাথাটা কাঁধে রেখে ধন্য করুন আমায়।”

মল্লিকা চোখ ফেরায় পেছনে।নাহ!কেউ জেগে নেই। কেউ কেউতো নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। মল্লিকা মুক্তভাবে মাথা মাহরুরের কাঁধে রাখলো।যেনো কোনো চিন্তা নেই। চারিদিক শান্তির সুভাসে মুখরিত।

এক ভরাট কন্ঠ বলে উঠে, “আজ থেকে সাত আট বছর আগের জীবনটা নিয়ে ভাবতে গেলে মস্তিষ্ক বাঁধা দেয় জানিস?বলে কেনো সেই সময়গুলো মনে করতে হবে?এরপর যে ভালো সময়টা আসলো?সেটা সুখে থাকার জন্য যথেষ্ট নয় কি?”

“ভুল কি বলে আপনার মস্তিষ্ক?আপনাকে পেয়ে আমার জীবনটা স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর হয়ে উঠেছে।এই স্বপ্ন থেকে আমার বেরোতেই ইচ্ছে হয়না।”

“কখনো বের হোস না চন্দ্রমল্লিকা।আমার এই স্বপ্নের জগতে মেতে থাক।”

“আপনিও আমাদের মধ্যেই নিবদ্ধ থাকুন।কি পেলেন?কি হারালেন সেই হিসেব করতে যাবেন না।”

“আছি! সম্পূর্ণ তিন নারীতে আবদ্ধ হয়ে আছি।”

“নারী শক্তি কি আপনাকে সস্তি দিতে সক্ষম?”

“শুধু সক্ষম? চাঁদের মেলায় বসবাস আমার।নিজেকে মনে হয় এই অম্বরের মহারাজ”

মল্লিকার পিঠে হাত বাঁধে মাহরুর।কত সংজ্ঞা দেবে সুন্দর সময়ের? শব্দভান্ডারে চলছে অভাব।খারাপের পর ভালো সময় আসে।শুনেছে আর দেখেছেও বটে। সৃষ্টিকর্তাকে লক্ষ কোটিবার ধন্যবাদ দিয়েও যেনো মনে হয় কম হয়ে গেলো। মাহরুর মুখ ঘুরিয়ে মল্লিকার দিকে চায়। কাকতালীয়ভাবে মল্লিকাও একই সময়ে তার দিকে ফিরে চাইলো।

চোখের অতল সমুদ্রে ডুবে বললো, “আমি দীপ্ত সূর্য হলে তুই শুভ্র চন্দ্র।সূর্য আর চন্দ্রের এই অলৌকিক বন্ধন অটুট থাকুক সর্বকাল।”

`সমাপ্ত`

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে