শুক্রবার বিকেলে রাকিব ভাই সহ মিলিদের বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। দোতলা ছিমছাম একটা বাড়ি। দোতলা পুরোপুরি কমপ্লিট হয়নি। বাড়ির সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে একপাশে ছোট একটা ফুলের বাগান। আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়ালের চারপাশ ধরে নানান রকম ফলের গাছ। দোতলা এখনো কমপ্লিট হয়নি। দুটো ঘরের কাঠামো তুলে রাখা হয়েছে।
আসার পথেই মিষ্টি কিনে এনেছি। সেগুলো একটা কমবয়সী মেয়ে এসে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেছে। বসার ঘরে মিলির বাবা আর বড় ভাই আছেন। আমাকে টুকটাক প্রশ্ন করলেন।
তা বাবাজি বাড়ি কোথায় আপনার?
জ্বী বরিশালে।
চাকরি যেন কোথায় করেন।
আমি কোম্পানির নাম বললাম।
এটার অফিস কোথায়?
গাজীপুরে।
বাবাজি যেন কি পাস দিছেন?
বি,এ পাস করেছি।
মাশাআল্লাহ।
বাড়িতে কে কে আছেন?
কাছের বলতে তেমন কেউ নাই। এক দূর সম্পর্কের মামা আছেন। দাদী আর চাচারা আছেন। খুব একটা যোগাযোগ নেই।
আচ্ছা।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে মিলি ঢুকল শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে।
মিলির এক ভাবি ঢুকল পেছনে পেছনে। উনি মিলি বসার পর পেছন থেকে ঘোমটা একটু টেনে মুখটা বের করে দিলেন।
রাকিব ভাই বললেন,
মাশাআল্লাহ।
আমি হা হয়ে গেলাম।
এতো সুন্দর দেখতে কোনো মানুষ হয় নাকি!এই মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দেবে এনারা?
ভাবি বললেন,
আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।
রাকিব ভাই বললেন,
আপনার পুরো নামটা যেন কি?
মোছাঃ শাহরিন মিলি।
সুন্দর নাম।
রাকিব ভাই আমাকে বললেন,
ভাই কিছু জানতে চাইলে বলেন।
আমি রাকিব ভাইকে বললাম,
আমার তেমন কোনো প্রশ্ন নাই।
মিলি ওর ভাবির কানে কানে কি যেন বলল।
উনি বললেন,
আপনারা বরং নিজেরা একা কথা বলুন।
আমাকে ছাদে নিয়ে যাওয়া হলো। কিছুক্ষণ পরেই মিলি এলো।
আপনি ভালো আছেন?
জ্বি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
আলহামদুলিল্লাহ।
আমার সম্পর্কে সবকিছু জানেনতো?
জ্বি শুনেছি।
আপনার বিয়েতে আপত্তি নেই?
নাহ। অতীত নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে আপনি হয়তো আমার সম্পর্কে সবটা জানেন না। আমি খুব সাধারণ পরিবারের ছেলে। ছোটখাটো একটা চাকরি করি। গাজীপুরে একটা একরুমের বাসায় ভাড়া থাকি। আমার সম্পত্তি বলতে কিছু নাই,মানে জমিজমার কথা বলছি। আপনি বিয়েতে রাজীতো?
আমার আপত্তি নেই।
তাহলে দিনতারিখ ঠিক করে ফেলি?
জ্বি, বাবার সাথে কথা বলুন।
সাতদিনের মধ্যে মিলির সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। মিলিকে নিয়ে উঠলাম আমার একরুমের ছোট্ট বাসায়।
এসব জ্বীন ভুত কখনো মানুষের সাথে থাকে না। এসব আমি বিশ্বাস করি না।
হিহি।
হাসছেন কেনো, হাসির কিছু বলিনি।
আমার সাথে কিন্তু আসলেই জ্বীন আছে।
আচ্ছা ডাকুন আপনার জ্বীনকে। উনিও তো আমাদের সাথেই এ বাসাতে থাকবেন আজ থেকে। আমার সাথে আলাপ পরিচয় করিয়ে দেন।
আপনি বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু সবাই বিশ্বাস করে।
এই পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ। এক একজন একেকরকমের মতে বিশ্বাস রাখে। তাদের বিশ্বাস তো আর আমি বদলাতে পারবো না।
আমার আগের স্বামী কিন্তু বিয়ের পরদিন মারা গেছে।
শুনেছি।
কিভাবে মারা গেছে শুনবেন?
এসব কথা থাক। আপনি এখন ঘুমান। ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে। ঘরটা ভীষণ এলোমেলো। একটাই ঘরতো। রান্না খাওয়া সব এখানে। আপনার কষ্ট হবে এভাবে থাকতে।
আমার কষ্ট হবে না। আমি গুছিয়ে ফেলব।
একটা কথা বলব?
জ্বি বলেন।
আপনি এতো সুন্দর, এতো সুন্দর কোনো মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে কখনো ভাবিনি।
মিলি আমার কাছে সরে এসে বলল,
আপনিও সুন্দর। এখন গলার হারটা খুলে দিনতো। এসব খুব ভারি লাগছে।
মিলি তার মাথায় দেয়া লাল ওড়না সরিয়ে আমার দিকে পেছন ফিরে বসল। আমি কাঁপা হাতে ওর গলারটা খুলতে চাইছি। কিছুতেই খুলছে না। মিলি খিলখিল শব্দে হাসছে। আমি সাহস করে ওর ঘাড়ে আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম। ও আমার দিকে ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
মিলি আমার ছোট্ট এক রুমে খুব সুন্দর করে সংসার পাতলো। ঘরের একপাশে সুন্দর একটা কাপড় রাখার আলনা রাখল। আরেকপাশে ছোট একটা মিটসেফে রান্নার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখল। সাইড টেবিলে সুন্দর একটা ঘড়ি রেখেছে। ঘড়িটার নীচের দিকে একটা ছেলে একটা মেয়েকে পেছন থেকে জড়িয়ে আছে। খাটের পাশের টেবিলেটায় বেশ কিছু গল্পের বই রাখল। ওগুলো ও বাড়ি থেকেই নিয়ে এসেছে সাথে করে।
মেয়েটা দারুণ গোছানো। নিজেও পরিপাটি থাকে। ওকে দেখলে মনে হয় না ওর মধ্যে অশুভ কিছুর বাস আছে।
মিলির অস্বাভাবিকতা প্রথম ধরা পড়ল একদিন রাতে। আমি আর মিলি বসে আছি। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলো। মিলি বলল,
মোমবাতি আছে?
হুম, আমি আনছি,তুমি বসে থাকো।
আমি উঠে গেলাম ম্যাচ আর মোম আনতে। হাতরে হাতরে এগোচ্ছি। হঠাৎ মিলি বলল,
বায়ে সরে যান। দরজা বা দিকে।
আমি একটু বা দিকে সরে এগোলাম। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মিলি কিভাবে দেখছে সারা ঘরতো ঘুটঘুটে অন্ধকার।
তুমি আমাকে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছো ?
হুম,আমি অন্ধকারে দেখতে পাই।
ও মিথ্যা বলেনি। মিলি অন্ধকারে দেখতে পায়,অনায়াসে হাঁটা চলা করতে পারে। এমনকি তরকারি কাটা ,খাবার বাড়া এসব টুকটাক কাজ আলো ছাড়াই করে ফেলে। ও মাঝে মাঝেই অকারণে হিহি করে হাসে। একা একাই কথা বলে। আবার হঠাৎ হঠাৎ মন খারাপ করে থাকে।
যখন ওর মন খারাপ থাকে তখন আমার সাথে তেমন কথা বলে না। ওর চোখ ফোলা থাকে। আমি বুঝি ও লুকিয়ে কান্না করেছে।
যেই আমি এসব জ্বীন, ভুত, জাদুটোনা বিশ্বাস করতাম না সেই এখন মাঝে মাঝে ভাবি সত্যি কি মিলির সাথে খারাপ কিছু আছে?
একদিন কাজ শেষে বাসায় ফিরে দেখি ও অসময়ে শুয়ে আছে। আমি বুঝলাম ওর মন খারাপ। কারণ আমার সাথে কোনো কথা বলেনি। উঠে চুপচাপ খাবার বেড়ে দিয়েছে।
আমি বললাম,
তোমার মনখারাপ?
হুম।
আমাকে কারণটা বলা যায়?
আপনি তো বিশ্বাস করবেন না।
আচ্ছা বলো, বিশ্বাস করব।
মিলি আগ্রহ নিয়ে পা গুছিয়ে আরাম করে বসল। যেন কোনো মজার রুপকথার গল্প বলবে।
আমার না একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আমি মাঝে মাঝে মানুষের অতীতের বিশেষ কোনো ঘটনা বলতে পারি।
কিভাবে পারো। তোমার সাথে থাকা জ্বীন বলে দেয়?
হি হি হি।
হাসো কেন?
আচ্ছা হাসবো না। শোনেন,জাফর লোকটা কিভাবে মারা গেলো বলি।
আমি আজ আর না করলাম না।
আচ্ছা বলো।
মিলি এমনভাবে বলছে যেন খুব স্বাভাবিক কোনো ঘটনা।
লোকটা বাসর রাতে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে সোজা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। লোকটার মুখ থেকে একটা বাজে গন্ধ আসছে। হয়তো নেশা করেছে। আমার দমবন্ধ লাগতে শুরু করল। বলা নেই, কওয়া নেই এভাবে অচেনা কেউ জড়িয়ে ধরলে কেমন লাগে বলুন?
হুম, খারাপ লাগারই তো কথা।
হঠাৎ আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। আমি গরগর করে বললাম,মানে কেউ একজন বলিয়ে নিলো, জলজ্যান্ত মেয়েটাকে মেরে ফললেন,আর কেউ কিছু জানলো না।
লোকটা ছিটকে সরে গেল। চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
আমি বলেই গেলাম,
আপনি ওর পরিচিত। ওর সাথে বাজে কাজ করেছেন। ছেড়ে দিলে সবাইকে বলে দিতো তাইনা!
জাফর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
কিসব উলটা পালটা বকতেছো।
সারারাত অত্যাচার করে তারপর গলা টিপে মেরে বস্তায় করে ভোররাতে সোজা নদীতে। লাশ কোথায় ভেসে চলে গেলো । কেউ কিছু টের পেলো না।
জাফর দাঁড়িয়ে টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি ঢেলে খেলো। তারপর বিস্তারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। এতো বছর আগের ঘটনা আমি কিভাবে হরহর করে বলে দিচ্ছি তাই ভেবে ঘামতে শুরু করল। ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
আজকে আমাদের বাসররাত। আর তুমি ভয় দেখাইতেছো কেন?
আমি হি হি করে হেসে ফেললাম।
ঘটনাতো সত্য। সত্যি কিনা বলেন।
তোমার মাথায় গন্ডগোল আছে।
তারপর বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বাইরে হৈচৈ কান্নাকাটি। জাফর স্ট্রোক করেছে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম।
এসব বলে তুমি কি মজা পাও মিলি। জাফর লোকটার হয়তো প্রেশার হাই ছিল। বিয়ে বাড়ির টেনশন,রিচ ফুড খাওয়া,তার ওপর নেশা করা এসব কারণে স্ট্রোক করেছিল।
মিলি আহত চোখে তাকাল।
আপনি বিশ্বাস করেন নাই তাইতো।
হুম। আমাকে বলছ বলছ,আর কাউকে এসব বলবা না ঠিক আছে?
হুম।
মিলি আর ওসব বলেনি। কিন্তু আমি কিভাবে কিভাবে যেন এই বিষয়টা মাথা থেকে সরাতে পারলাম না। মিলিকে আমার একটু একটু ভয় লাগতে শুরু করল। ও যখন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু খোঁজে আমার ভয় করে। আমি মনেপ্রাণে বলতে থাকি মিলি যেন আমার অতীত বলতে না পারে। ওকে আমি আর ভয় পেতে চাই না।
বিয়ের ছয়মাসের মাথায় সুখবর পেলাম। মিলি মা হতে চলেছে। খুশিতে আমার চোখে পানি চলে আসল। কেউ না থাকা আমার একজন রক্তের কেউ আসবে। আমার সন্তান। মিলির প্রতি আমার ভীষণ খেয়াল রাখতে হয়। ও খুব অনিয়ম করে। একা একা থাকতে খারাপ লাগে ওর।
একদিন আমার শশুর এসে মিলিকে নিয়ে গেলেন। এ সময় নাকি মেয়েদের মায়ের কাছে থাকতে হয়। নিয়মিত চেক আপ করাও হলো। ডাক্তার বললেন সবকিছু স্বাভাবিক আছে। কিন্তু মিলির ব্যথা উঠলো ডেটের দেড়মাস আগেই। প্রচন্ড ব্যথা হলো সারারাত। কিন্তু নরমাল ডেলিভারি হলো না। কিসব জটিলতা দেখা দিলো। শেষে ডাক্তার সিদ্ধান্ত নিলেন সিজার করার। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে মিলি আমাকে ডেকে বলল,
আপনার কোনো দোষ নাই। বাচ্চাটা দৌড়ে আপনার বাইকের সামনে চলে আসছিল। আপনি নিজেকে অপরাধী ভাববেন না।
আমি কেঁপে উঠলাম। সেই কলেজ জীবনের ঘটনা। মামার বাইক নিয়ে বাজারে গেছি। মামির একটা ঔষধ গ্রামের ঔষধের দোকানে পাচ্ছিনা। তাই মামা তার বাইক দিয়ে উপজেলায় পাঠালেন। মামা দোকানে ব্যস্ত। ঔষধ নিয়ে ফেরার পথে বকখালির মোড়ে গাড়ি ঘুরিয়েছি মাত্র একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা হুট করে দৌড় দিয়ে এসে পড়ল বাইকের সামনে। তারপর ছিটকে একপাশে পড়ে গেল। আমি ব্রেক কষে দাঁড়ালাম । বাচ্চাটাকে হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু পেছনে ফিরতেই দেখলাম কিছু মানুষ হৈ করতে করতে ছুটে আসছে।
ধর ধর ধর,শালাকে পুঁতে ফেলব আজ।
খুব ভয় পেয়েছিলাম। জোরে বাইক টেনে চলে এসেছিলাম। পরে খবর পেয়েছি বাচ্চাটা মারা গেছে। আমি চুপ করে থাকলাম। কাউকে কিছু জানাইনি। কিন্তু সেই দহন আজো আমাকে তাড়া করে। কিন্তু এই কথা মিলি কিভাবে জানল!
একজন ইন্টার্ন ডাক্তার এসে জানালো রক্ত রেডি রাখতে। মা আর বাচ্চা দুইজনের কন্ডিশন ক্রিটিকাল।
সব চিন্তা ছেড়ে দিয়ে খোদাকে ডাকলাম।
খোদা আমার মিলির আর বাচ্চাটার যেন কিছু না হয়।
ডাক্তাররা চেষ্টা করল কিন্তু মিলিকে বাঁচাতে পারলো না। আমার কোলে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান আর কিছু অমিমাংসিত প্রশ্ন দিয়ে মিলি চলে গেলো ওপারে।
**
রুজাইফার বয়স এখন দশ চলে। আমাদের বাপ বেটির সংসার বেশ কেটে যাচ্ছে। রুজাইফা দেখতে ঠিক মিলির মতো হয়েছে। আমার মুখে ও ওর মায়ের গল্প শোনে। আমি যখন মিলির কথা বলি ওর চোখেমুখে একটা আলো ছড়িয়ে পড়ে। মাকে যেন ও দেখতে পাচ্ছে।
আমরা এখন নিজেদের বাড়িতে থাকি। চাকরি ছেড়ে দিয়েছি অনেক আগেই। রুজাইফাকে বড় করতে গিয়ে চাকরি করা হয়নি। ব্যবসা শুরু করেছিলাম। এখন নিজের দোকান আছে।
রুজাইফাকে ওর নানা নানী নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু ওকে ছাড়া আমি বাঁচব কিভাবে। তাই নিজেই ওকে লালনপালন করছি।
কয়দিন হয় আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে নতুন এক পরিবার উঠেছে। সেখানে প্রায়দিন একটা বাচ্চা ছেলে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে আর বলে,
আমাকে ছেড়ে দাও,আর মেরো না। আর ভুল করবো না।
খোঁজ নিয়ে জানলাম ছেলেটার নিজের মা নেই। চার পাঁচ বছর বয়স হবে। বাবা আবার বিয়ে করেছে। সৎমাটা ছেলেটাকে দুই চোখে দেখতে পারে না।
রোজ রোজ কান্না শুনি। ভীষণ মায়া হয়। একদিন বাইরে লোকটার দেখা পেয়ে বলেই ফেললাম,
এতটুকু একটা ছেলেকে আপনার ওয়াইফ এভাবে পেটায়,এটাতো ঠিক না।
লোকটা চটে উঠল,
আরে মশাই,এটা আমার পারিবারিক বিষয়। আপনি কথা বলার কে? মা ছেলেকে শাসন করে না! সৎ মা বলেই খারাপ লাগছে। নিজের মা হলে কেউ কিছু বলতো না।
আর কি বলব। মনখারাপ হয়ে গেল। আহারে বাচ্চা ছেলেটা।
একদিন বাজার করে ফিরছি। রুজাইফাও আছে। বাসায় ঢুকতে যাব। দেখলাম সিঁড়ির গোড়ায় ছেলেটা মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রুজাইফাকে চকোলেট কিনে দিয়েছিলাম। ও ছেলেটাকে বলল,
চকোলেট খাবে?
উহু।
আরে নাও। কিছু হবে না। আমার ভাই থাকলে ওকেতো চকোলেটের ভাগ দিতাম।
ছেলেটা চকোলেট হাতে নিলো। ওর মুখটায় হাসি ফুটে উঠল। হঠাৎ ওর মা এসে হাত থেকে চকোলেট কেড়ে নিয়ে মারতে শুরু করল।
ফকির কোথাকার। এখন মানুষের থেকে চেয়ে খাওয়া শুরু করছিস। কি দেখাচ্ছিস, তোকে খেতে দেইনা।
আমি হতচকিত হয়ে গেলাম। তাকিয়ে দেখলাম রুজাইফা একপাশে সরে গিয়ে চোখ বড় বড় করে মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মাথার দুপাশের রগ ফুলে উঠেছে। তারপর অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। মহিলা হঠাৎ বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ল। আর্তনাদ করতে থাকল,
উফ! মরে গেলাম। কেউ যেন কলিজাটা খামচে ধরেছে।
কিছু সময় পর রুজাইফার মুখ স্বাভাবিক হলো। ও হাসছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ওকে এখন ঠিক মিলির মতো দেখতে লাগছে।
আমার ওয়াইফ মিলিকে আজকাল আমার একটু ভয় ভয় লাগে। এই ভয় আগে ছিলো না। নতুন হয়েছে। বিয়ের আগেও শুনেছিলাম মিলির ওপর জ্বীনের আছর আছে। সেই জ্বীন চায় না মিলির কারো সাথে বিয়ে হোক। এজন্যই মিলির প্রথম স্বামী বিয়ের পরদিন স্ট্রোক করে মারা যায়। আসলে স্ট্রোক একটা উছিলা, ঐ জ্বীন মিলির বরকে মেরে ফেলেছিলো। নাহলে সুস্থ সবল মানুষ কেনো হঠাৎ বিয়ের রাতে স্ট্রোক করতে যাবে।
অনেকেতো নাকি এটাও বলত যে মিলির সাথে ঐ জ্বীন নিয়মিত শারীরিক সম্পর্ক করে। মিলির পেটে ঐ জ্বীনের বাচ্চাও ছিল। সেটা পরে মিলি নষ্ট করেছে। এসব আমি শুনেছিলাম মিলির সাথে আমার বিয়ের কথা যখন চলছিলো সে সময়।
আমি অবশ্য এসব জ্বীন ভুতে বিশ্বাস করি না। তাইতো এসব কথায় কান না দিয়ে মিলিকে বিয়ে করেছি। তবে এখন মাঝে মাঝে ওকে আমার ভয় লাগে।
আমার পরিচয় দিয়ে নিই। আমি মোকাদ্দেস। গরীব পরিবারের ছেলে। অবশ্য পরিবার বলতে তেমন কেউ নেই আমার। মা বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন লঞ্চ ডুবিতে। আমার দাদা বাড়ি ছিলো বরিশাল। আমরা থাকতাম ঢাকায়। বাবা একটা ছোট চাকরি করতেন। একবার আমার দাদি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। নানিমা সেসময় আমাদের দেখতে ঢাকায় এসেছেন। চার বছরের আমাকে নানির কাছে রেখে মা আর বাবা গেলেন বরিশালের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাড়ি পৌঁছানোর আগেই লঞ্চ ডুবিতে মারা যান দু’জনেই।
সেই থেকে নানির কাছে রয়ে গেলাম। সেই নানিও মারা গেলেন আমার চৌদ্দ বছর বয়সে। আমার মা ছিলেন নানির একমাত্র সন্তান। তাই কাছের বলতে আর কেউ রইলোনা । দাদী অসুস্থ মানুষ,থাকেন চাচাদের সংসারে। আমাকে রাখবেন কিভাবে। নানী মারা যাবার পর দূর সম্পর্কের এক মামার কাছে থেকে এস এস সি পাস করে ঢাকা চলে আসি। এখানে এসে টিউশনি করে, মানুষের দোকানে কাজ করে বি এ পাস করেছি। এখন একটা বিস্কিট কোম্পানির কেরানির পোস্টে চাকরি করছি।
বিয়ে থা করার কথা ভাবতে ভাবতে বয়স ত্রিশ পেরিয়ে গেছে। আসলে আমার জন্য যে মেয়ে দেখবে এমন কাছের কেউ নেই। একরুম আর বারান্দাওয়ালা একটা বাসায় একাই থাকি। নিজেই রান্না করে খাই। কেরোসিনের চুলায় ভাত, আলু সিদ্ধ,ডিমভাজি করে খাই। মাঝে মাঝে বাইরে হোটেলেও খেয়ে নিই যখন রান্না করতে ভালো লাগে না। তো একদিন অফিস থেকে ফিরে ভাত রাঁধতে গিয়ে মার পড়ে হাত পুড়ে গেলো। পরদিন অফিসে গেলে আমার কলিগ রাকিব ভাই বললেন,
এভাবে কি চলে নাকি মিয়া, এবার একটা বিয়েশাদী করে ফেলেনতো।
আমাকে মেয়ে দেবে কে?
কি যে বলেন। এই দেশে মেয়ের অভাব আছে নাকি। আপনি শুধু হ্যা বলেন।
আমি কি বলব । শুধু হাসলাম,যার মানে দেখেন।
খুব সুন্দর একটা মেয়ে আছে। সিনেমার নায়িকাদের মতো দেখতে। বাবার অবস্থাও ভালো। দেখলেই পছন্দ হবে আপনার।
এমন মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দেবে?
কথাতো এইখানেই ভাই। আপনাকে খুলেই বলি তবে। বিয়েশাদীর ব্যাপার। লুকিয়ে রাখা ঠিক হবে না। মেয়েটার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সংসার হয়নি একদিনও।
আমি একটু দমে যাই।
ওহ। একদিনো সংসার হয়নি কেনো?
ছেলেটা বিয়ের রাতেই মারা যায়। স্ট্রোক করেছিল।
ইশ! খুব দুঃখজনক ঘটনা।
হুম আরও দুঃখজনক হলো এই ঘটনার পর সবাই ভাবতে শুরু করল মেয়েটার কোনো দোষ আছে। অলক্ষুনে মেয়ে আরকি। ওর জন্য বরটা মারা গেছে।
এমন আবার হয় নাকি এখনও। এসব কুসংস্কার এখন কেউ মানে?
আপনার যা কথা! হয় মানে। অহরহ হচ্ছে। কত বিচিত্র কারণে যে মেয়েদের বিয়ে ভাঙে। এই যে এই মেয়েটার আর বিয়েই হচ্ছে না। পাত্র পক্ষ আসে,দেখে পছন্দ করে কিন্তু এসব কথা শোনার পর বিয়ে ভেঙে দেয়।
এটাতো ঠিক না। জীবন মৃত্যু সব খোদার হাতে। কে কখন মারা যাবে কেউ বলতে পারে না। এই যে আমি আপনার সাথে কথা বলছি, এখুনি আমার মৃত্যু হতে পারে। সেখানে আপনার তো কোনো হাত নেই।
আপনি এভাবে ভাবছেন কিন্তু সবাইতো এমন করে ভাবতে পারে না। আপনাকে একটু হলেও চিনি বলেই এই মেয়ের কথা বললাম। মেয়ের বাড়ির লোকজন মেয়েটাকে নিয়ে ভীষণ টেনশনে আছে। বিবাহযোগ্য মেয়েকে আর কতদিন ঘরে রাখবে। আপনি দেখেন। মেয়ে যদি পছন্দ হয়তো কথা ফাইনাল করব। পছন্দ না হলে আরও মেয়ে আছে।
আমার একটু আগ্রহ হলো। মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। মেয়ে নাকি ভীষণ সুন্দরী। সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ সব মানুষেরই কম বেশি আছে। আমিও এর বাইরে না। আর তাছাড়া আমার যেহুতু এসব কুসংস্কার নিয়ে মাথাব্যথা নাই তাই বললাম,
এই মেয়েটাকেই দেখি তাহলে।
আচ্ছা আমি ডেট ঠিক করে জানাব। মেয়ের বাসায় কথা বলে নিই।
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৪৪ (শেষ পর্ব)
#মেহরিন_রিম
মাথায় হাত দিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে বসে আছে সায়ান। তার আশেপাশে বসে আছে পূর্ণ, ফাইজা,মোহনা। মাঝখানে টি টেবিল এর উপর বসে খেলছে প্রজ্জল। মোহনা আর ফাইজা টাকা গোনায় ব্যাস্ত, পূর্ণ সায়ান কে এমন চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বলে ওঠে,
_এমন প্যাঁচার মতো মুখ করে বসে আছিস কেন তুই?
সায়ান মাথা থেকে হাত নামিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
_তাহলে কি নাচবো আমি? শা*লা সবার আগে প্রেম করলাম আমি কিন্তু বিয়ে করে নিলি তোরা। আমি আর কতকাল নিঃসঙ্গ জীবন পার করবো?
ফাইজা হাসতে হাসতে বলে,
_তা তুমি বিয়ে করে নিচ্ছোনা কেন ভাইয়া? মেয়েতো তোমার সামনেই বসে আছে।
_মেয়েতো সমস্যা না,সমস্যা তো মেয়ের বাপ।
মোহনা রেগে গিয়ে বলে,
_আমার বাবাকে নিয়ে একদম বাজে কথা বলবেন না।
_তাহলে কি বলবো আর? উনি মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছেনা কেন! আরে ওনার কি ইচ্ছে করেনা নাতি নাতনির নানা হতে!
মোহনা কড়া চোখে তাকায় সায়ান এর দিকে। তারপর ফাইজার দিকে টাকাগুলো দিয়ে বলে,
_এখানে দশহাজার আছে।
ফাইজা টাকাটা নিয়ে বাকি টাকাগুলো একসাথে নিয়ে বলে,
_মোট হলো ত্রিশহাজার। এবার প্ল্যান করতে হবে এগুলো দিয়ে আমরা কি কি করবো.. আগেই বলে রাখি, আমার ছেলেকেও কিন্তু ভাগ দিতে হবে।
সবাই এবার প্লান করতে শুরু করে টাকা দিয়ে কি কি করবে। টাকাগুলো সব আদৃত এর থেকেই নেওয়া হয়েছে।
মোহনা কিছুটা হতাশ হয়ে বলে,
_ইশাকে ছাড়া আড্ডা জমছে না। ওকে নিয়ে আসতে পারতাম!
মোহনার কথা শুনে সবাই শব্দ করে হেসে দিলো। সবার হাসি দেখে ছোট্ট প্রজ্জল ও ফিক করে হেসে দিলো।
_____
বিছানার ঠিক মাঝখানে বসে আছে ইশা, আদৃত বসে আছে সামনের সোফায়। গত পনেরো মিনিট যাবৎ একইভাবে বসে ইশার দিকে তাকিয়ে আছে।
ইশা এবার বেশ বিরক্ত হয়ে বলে,
_আপনি কি সারারাত এভাবেই বসে থাকবেন?
_তাহলে…কি করবো?
সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় আদৃত। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ইশার পাশে বসে পড়ে। ইশা শুকনো ঢোক গিলে অন্য দিকে চোখ সরিয়ে নেয়।
_ইশা, এখন থেকে তুমি সবসময় চোখে মোটা করে কাজল পড়ে থাকবে বুঝলে।
ইশা অবাক হয়ে বলে,
_সবসময় কেন পড়বো? আর এখনকার মেয়েরা কাজল নয় চোখে আইলাইনার বেশি পড়ে।
_তোমাকে এখনকার মেয়েদের মতো হতে বলিনি, আমার পছন্দের হলেই চলবে।
আদৃতের চোখের দিকে তাকায় ইশা, ইদানিং ওর কথাগুলো শুনতে বেশ ভালোই লাগে। কিছু সময় পর আদৃত চোখ নামিয়ে নিয়ে বলে,
_ইশা,আই ওয়ান্ট আ পারমিশন ফ্রম ইউ..
এইটুকু শুনেই ইশার মস্তিষ্ক অনেক কিছু ভেবে নিলো। চোখ নামিয়ে নিয়ে কাপাকাপা গলায় বললো,
_ক কিসের পারমিশন?
আদৃত ইশার দিকে কিছুক্ষন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
_এত লাল নীল হওয়ার মতো কিছু বলিনি আমি, আর তুমি যেটা ভাবছো তার জন্য আমি পারমিশন নিতে যাবো না।
ইশা চোখ বড়বড় করে বলে,
_আ আজব তো,আমি কিছু বলেছি আপনাকে?
মৃদু হাসে আদৃত। ইশার দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে ওর চোখে চোখ রেখে বলে,
_আই জাস্ট ওয়ান্ট টু ক্রাই, অনুমতি দেবে প্লিজ?
ইশা কিছু বুঝতে না পেরে সামান্য ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আদৃত আর এক মুহূর্ত ও অপেক্ষা করলো না, ইশার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ইশার এখন কি বলা উচিৎ সে বুঝতে পারছে না। আদৃত ইশার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
_একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে প্লিজ..
ইশা কাপাকাপা হাত ছোঁয়ায় আদৃতের মাথায়। চুলের মাঝে ধীরে ধীরে আদৃতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আদৃত এবার আকষ্মিকভাবে ইশার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,
_মা ঠিক এইভাবেই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো জানো তো। ইন ফ্যাক্ট যখন মা অনেক বেশি অসুস্থ, সেই সময়ও আমাকে কিছু বুঝতে দিতো না। হাসিমুখে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতো। মায়ের কখনো কোনো কথা বলার সঙ্গি ছিলো না। মা থাকলে তোমায় পেয়ে অনেক খুশি হতো নিশ্চই।
চোখ চুপ করে রইলো আদৃত, কাঁদবে বললেও সে একটুও কাঁদেনি। তবে চোখে জল চলে আসছে ইশার। অনেক চেষ্টা করেও আটকাতে পারছেনা নিজেকে।
নিজের গালে শীতল কিছু অনুভব করতেই চোখ খুলে তাকায় আদৃত, ইশার চোখে জল দেখা মাত্রই তড়িঘড়ি করে উঠে বসে। ইশার দু’গালে হাত রেখে বলে,
_হেই..কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?
ইশা আদৃতের দিকে টলমলে চোখে তাকিয়ে বলে,
_আপনি জানেন আমার মন কত বড়, অন্য কাউকে কষ্ট পেতে দেখলে আমারো কষ্ট হয়।
আদৃত ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলে,
_আচ্ছা,তাহলে আমার জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে?
_তো আপনি এত ইমোশনাল কথা বলছেন কেন!
_তাহলে রোম্যান্টিক কথা বলবো?
_আমি কি সেটা বলেছি?
এবার কিছুটা শব্দ করে হেসে ওঠে। যা দেখে ইশা সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। আদৃত তার হাসি থামিয়ে ইশার কপালের সঙ্গে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলে,
_কাজল ল্যাপটানো চোখে কিন্তু তোমায় আরো সুন্দর লাগে। তবে তুমি যে লজ্জাও পাও,এটা কিন্তু জানা ছিলোনা।
_কে বলেছে আমি লজ্জা পাচ্ছি?
_পাচ্ছো না?
_উম হু..
_তাহলে তো তোমাকে আরো বেশি লজ্জা দেওয়া দরকার।
ইশা আদৃতকে সরিয়ে দিয়ে নামতে গেলেই আদৃত তাকে আটকে দেয়। পিছন থেকে ইশাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
_উম হু, পালাতে পারবেনা।
থেমে যায় ইশা। কিছুক্ষন পর আদৃত বলে ওঠে,
_ইশা..
_হুম।
_ভালোবাসো আমায়?
_জানিনা..
_নো প্রব্লেম, আমি ভালোবাসা আদায় করে নেবো।
মুচকি হাসে ইশা। তাই হবে হয়তো, আদৃত আগে থেকে ভালোবেসেছে। ইশা নাহয় এখন থেকে বাসলো। যেই মানুষটা ওকে এতটা ভালোবাসে,তাকে ভালো না বেসে থাকার কোনো কারণ ই নেই।
_____
চার বছর পর….
_ভাইয়া তোমার হাতেও কিন্তু নাম লিখতে হবে, এই আপু ওনার হাতে বড় করে মোহনা নামটা লিখে দিন তো।
মেহেন্দি পড়ানো মেয়েটাও ইশার কথায় মুচকি হেসে সায়ান এর হাতে মোহনা নামটা লিখে দিলো।
মোহনা আর সায়ান এর বিয়ে হয়েছে আরো দু বছর আগে, তবে মোহনা অনার্স কমপ্লিট করার পর বিয়ের অনুষ্ঠান করা হচ্ছে।
ইশা হাসিমুখে অন্যদিকে যেতে নিলেই আদৃত এসে তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেয়। রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,
_তুমি কি ভুলে গেছো যে তুমি প্রেগন্যান্ট? ছোটাছুটি না করে একটু চুপচাপ বসে থাকতে পারোনা?
_আরে আমার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড এর বিয়ে বলে কথা, আমি বসে থাকলে চলে?
আদৃত কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে উপস্থিত হয় প্রজ্জল,ফাইজা আর পূর্ণ।
প্রজ্জল সামনের দিকে গাল ফুলিয়ে হাটছে, আর পূর্ন,ফাইজা তার পিছনে ছুটছে।
প্রজ্জল ইশার সামনে আসতেই ইশা তাকে আদর করে দিয়ে বলে,
_কি হয়েছে পুচকু? এত রেগে আছো কেন?
_আমি কারো সাথে কথা বলবো না।
_কিন্তু কেন?
_আদৃত চাচ্চু তোমাকে গান শোনায়। বাবাই আম্মু কে গান শোনায়। আমিও দুটো নতুন গান শিখেছি,কিন্তু আমাল গান কেউ শুনছেই না।
মোহনা পাশ থেকে নিজের মেহেদী পড়া হাতদুটো থেকে চোখ সরিয়ে প্রজ্জল এর দিকে তাকিয়ে বলে,
_আমার কাছে আইডিয়া আছে, এইযে তোমার পিপির পেটে যেই বাবুটা আছেনা? তুমি ওকে যত খুশি গান শোনাও।
ইশা কিছুটা হতাশ হয়ে বলে,
_তুই যা ভেবে কথাটা বলছিস তা আর হচ্ছেনা রে মেহু..
_কেন কেন?
আদৃত প্রজ্জল এর গালে হাত বুলিয়ে বলে,
_কারণ প্রজ্জল এর একটা ছোট্ট ভাই আসছে।
পূর্ন, ফাইজা সহ উপস্থিত সকলে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে প্রজ্জল এর দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে বলে উঠলো,
_ব্যাড লাক…
প্রজ্জল রেগে গিয়ে বুকে হাত গুজে মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। তা দেখে সবাই আরো জোড়ে হাসতে শুরু করলো।
আদৃত এসে ইশার পাশে বসতেই ইশা ওর হাতটা নিজের পেটের উপর রেখে বলে,
_আদৃত..
_হুম বলো..
_ও আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি তাইনা?
আদৃত ইশার চোখে চোখ রেখে বলে,
_যদি হয়েও থাকে,তবুও সেটা তোমার জন্য। এই প্রাপ্তির সঙ্গে তুমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এই প্রাপ্তি হলো, তুমিময় প্রাপ্তি~~
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৪৩
#মেহরিন_রিম
_আর কতো সাজাবে বলোতো আপু? আচ্ছা তোমরাই তো বলো নাকি,আমি এমনিতেই অনেক সুন্দর। আমিও জানি, আমি এমনিতেই বেস্ট। তাহলে এতো সাজগোজ এর কি দরকার? এতো সাজগোজ করে ওনাদের সামনে গেলে তারা কি ভাববে বলো তো?
এভাবেই একের পর এক কথা বলে চলেছে ইশা। আর ফাইজা তার কথার কোনো পরোয়া না করে তাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিচ্ছে। একসময় ফাইজার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে গাল ফুলিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে ইশা। বেশ ভালোই লাগছে দেখতে, তবে ইশার নিজেকে কোনো শো পিস মনে হচ্ছে। সাজিয়ে গুছিয়ে মানুষের সামনে প্রদর্শন করবে এমন।
সেইদিনের ঘটনার পর কেটে গেছে আরো দেড় বছরের বেশি সময়। ফাইজা এখন তার শশুর বাড়িতেই থাকে। তাতে অবশ্য ইশার বেশ মন খারাপ হয়, বাড়িটা একদম ফাকা ফাকা লাগে। ফায়াজ আবারো বিদেশে চলে গেছে, কথা আছে নেক্সট টাইম এসে সেও বিয়ে করবে।
ইশার এইচ এস সি এক্সাম শেষ হওয়ার পর এডমিশন এর জন্য বেশ ব্যাস্ত সময় কেটেছে। তবে সেই পরিশ্রম এর ফলও পেয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে খুশিতে গত এক সপ্তাহ নাচতে নাচতেই পার করেছে।
তবে এরই মধ্যে ঘটে যাচ্ছে আরো বড় ঘটনা। কাল রাতে রুকসানা বলেছে আজকে নাকি ইশাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। সেই জন্যই ফাইজা সকাল সকাল এই বাড়িতে চলে এসেছে। বিয়ে করতে ইশার খুব বেশি প্রবলেম নেই, তবে ছেলে পছন্দ হতে হবে। ইশা বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে ছেলের কথা, ফাইজা বলেছে সে জানেনা।
ইশাও বেশ এক্সাইটেড এই নিয়ে, হতেই তো পারে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। চোখে চোখ পড়তেই ইশা লজ্জা পেয়ে যাবে, এমন আরো অনেক ফিল্মি সিন কল্পনা করছে ইশা।
_ফাইজা হলো তোমার? তোমার ছেলেকে সামলাও, আমি আর পারছিনা।
কথাটা বলেই পূর্ণ হাপাতে হাপাতে ঘরে ঢুকলো, কোলে পাঁচ মাসের একটা বাচ্চা। তার নাম প্রজ্জল, পূর্ণ আর ফাইজার ছেলে। পূর্ণর গলার আওয়াজ শুনে ফাইজা যাওয়ার আগেই ইশা উঠে গিয়ে কোলে নিলো প্রজ্জল কে। ওকে আদর করতে করতে বললো,
_এই পুচকু দেখ না তোর মা আমাকে একদম শো পিস বানিয়ে দিচ্ছে,তুই একটু বকে দে তো।
_ইশা ওকে আমার কাছে দে, তোর সাজ নষ্ট করে ফেলবে। কত কষ্ট করে সাজালাম। আর এইযে তুমি, এইটুকু বাচ্চাকে সামলাতে পারোনা?
ফাইজার কথা শুনে পূর্ন কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
_এতক্ষন ধরে তো আমিই সামলাচ্ছি। সে খাবেনা, কোলে থাকবেনা, বসবে না, শুয়েও থাকবে না। তাহলে আমি করবো টা কি?
ইশা প্রজ্জল এর গাল টেনে দিয়ে হাসতে হাসতে বলে,
_তুমি কিন্তু শুধু শুধুই ওর নামে বদনাম করছো ভাইয়া। ওর মতো ভদ্র বাচ্চা দুটো আছে নাকি? তাইনা মিমি, দেখ আমি তোর দলে।
_কি দুষ্টু ছেলে! এতক্ষন আমার কাছে থেকে দুষ্টুমি করছিল। আর এখন তোমার কাছে গিয়ে কি শান্ত!
ফাইজা প্রজ্জল কে ইশার কাছ থেকে নিয়ে বলে,
_থাকবে না আবার, ওনার সঙ্গী কে পেলে আর কাউকে লাগে নাকি? দুজনেই তো সেইম।
_আপু নিয়ে গেলে কেন? দাওনা আমার কাছে..
_উম হু, একদম না। আজ সারারাত তুই ই সামলাস ওকে, আমি ঘুমোবো শান্তিতে। কিন্তু এখন না।
ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো ইশা। ফাইজা আর পূর্ণ বাইরে চলে গেলো প্রজ্জল কে নিয়ে। এখন বেশ বোরিং লাগছে ইশার, জানতে ইচ্ছে করছে ছেলেটা কে! ফাইজা বলেছিল ছেলেটাকে নাকি ইশা চেনে, আর সে ইশাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে। এমন ছেলে কে হতে পারে? একবার রিফাত এর কথা মাথায় এলো, পরক্ষণেই মনে পড়লো সে তো আরো ছয়মাস আগেই বিয়ে করেছে। তাহলে কে হতে পারে?
_____
ফাইজা ইশাকে নিয়ে সোফায় বসালো, ইশাও একদম ভদ্র মেয়ের মতো নিচের দিকে তাকিয়েই সোফায় বসলো। সামনে থাকা বাক্তির দিকে এখনো তাকানো হয়নি।
পাশের সোফায় থাকা শাহাদাত সাহেব জহির এর দিকে তাকিয়ে বললেন,
_ইশাকে বোধ হয় আমি আরো দশ বছর আগে দেখেছিলাম একবার। কত বড় হয়ে গেছে ও..
জহির সাহেবও মুচকি হাসলেন। ব্যাবসায়িক সূত্রে শাহাদাত এর সঙ্গে তার আলাপ অনেক আগে থেকেই। তবে আদৃত যে তারই ছেলে এটা জানা ছিলোনা। আদৃত সেদিন ইশাকে ঐ কথাগুলো বলার পর থেকে নিজের মাঝেও কিছু অনুশোচনা হচ্ছিল তার। শাহাদাত সাহেব নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন অনেক আগেই, আর সেই ভুলের শাস্তিও পেয়েছেন। তবে ছেলে হিসেবে বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যাবহার করাটা হয়তো আদৃতের উচিৎ হচ্ছে না। তাই এর পর থেকে আদৃতও চেষ্টা করেছে শাহাদাত সাহেবের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার।
_তা মা আমিতো তোমাকে চিনি। কিন্তু তবুও পাত্রপক্ষ হিসেবে নাম জিজ্ঞেস করা উচিৎ। বলো, নাম কি তোমার?
ইশা মৃদু স্বরে উত্তর দেয়,
_ইসরাত আনজুম ইশা।
_মাশাল্লাহ। আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করা নেই, আদি তুই কিছু বলবি?
নামটা শুনে ভ্রুকুঞ্চিত হলো ইশার। এবার আর নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ তুলে তাকালো সামনের দিকে, সেখানে একজোড়া চোখ আরো আগে থেকেই তার দিকে তাকিয়ে ছিল।
তবে সেই মানুষটিকে দেখার পর ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে ইশা। আদৃত! এখানে! কেন? কি করে? উনি পাত্র! এটা কি করে সম্ভব!
নিজের বর্তমান রূপ মুহূর্তেই ভুলে যায় ইশা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
_আম্মু আমি তোমাকে বলেছিলাম,ইদানিং চোখে কম দেখছি। কিন্তু এখন তো চোখে ভুলভাল জিনিস দেখছি। আমি ঠিক আছি তো?
সবাই ইশার কথা শুনে একসঙ্গে হাসতে শুরু করে। ফাইজা ইশার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
_তুই যা দেখছিস একদম ঠিক দেখছিস, চোখে কিচ্ছু হয়নি বুঝলি?
ইশা এবার বিস্ফোরিত চোখে আদৃত এর দিকে তাকায়। পূর্ণ সবার উদ্দেশ্যে বলে,
_আমার মনে হয় ওদের একটু আলাদা কথা বলা উচিৎ। বড়রা এখানে আলোচনা করুক ততক্ষণ।
সবাই পূর্ণর সঙ্গে সম্মতি জানালো। ফাইজা আদৃত এর উদ্দেশ্যে বলে,
_ভাইয়া আসুন আমার সঙ্গে..ইশা তুইও আয়।
ফাইজা বোকার মতো প্রশ্ন করলো,
_কোথায় যাবো?
ফাইজা কড়া চোখে তাকায় ইশার দিকে। ইশা ঘোরের মধ্যে ফাইজার পিছন পিছন হাটতে লাগলো।
ফাইজা আদৃত আর ইশাকে ঘরে নিয়ে এসে বলে,
_তোমরা কথা বলো আমি আসছি।
ফাইজা বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। ইশা এখনো হা করে তাকিয়ে আছে আদৃত এর দিকে। আদৃত এবার ইশার কিছুটা সামনে এসে তার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে,
_এভাবে হা করে তাকিয়েই থাকবে?
ঘোর কাটলো ইশার। সঙ্গে সঙ্গে সে আদৃত এর হাতের দিকে তাকায়, আরেকটা আদৃত এর মুখের দিকে তাকিয়ে তার হাতে বেশ জোড়ে চিমটি কাটে।
_আউচ.. এই মেয়ে কি করছো!
ইশা গালে হাত দিয়ে বলে,
_তার মানে এটা স্বপ্ন নয়! এই,আপনি এখানে কেন এসেছেন?
_ঘাস কাটতে..
ইশা বোকা বোনে গিয়ে আদৃত এর দিকে তাকায়। আদৃত এবার মুখে কিছুটা রাগী আভা ফুটিয়ে বলে,
_এমন বোকার মতো প্রশ্ন করলে এমন উত্তর ই পাবে।
_সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু আপনি কোন দুঃখে আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন?
আদৃত মেকি হেসে উত্তর দেয়,
_মানুষ কেন বিয়ে করে ইশা?
_মানুষ বিয়ে করে…
থেমে যায় ইশা,চোখ বড়বড় করে আদৃত এর দিকে তাকাতেই আদৃত বলে ওঠে,
_এভাবে তাকানোর কি আছে? মানুষ বিয়ে করে একজন লাইফ পার্টনার পাওয়ার জন্য,যার সাথে সে সারাজীবন কাটাবে। আমিও সেই জন্য বিয়ে করতে চাইছি..
_সে আপনি করতেই পারেন,কিন্তু আমাকে কেন?
আদৃত ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দেয়,
_বিকজ আই লাভ ইউ.. সিম্পল।
ইশা মাথা ঘুড়ে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। আদৃত এর দিকে তাকিয়ে বলে,
_আমার কানে মেবি প্রবলেম হচ্ছে। কি বললেন আপনি?
আদৃত ইশার দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে বলে,
_বললাম আই লাভ ইউ..শুনেছো এবার?
আবারো আদৃত আগের স্থানে চলে এসে বলে,
_এসব প্রেম ট্রেম আমার পছন্দ নয়। আগেই বলেছিলাম, যাকে ভালোবাসি তাকে সরাসরি বিয়ে করবো। আর সেটাই করছি। আমাকে রিজেক্ট করার কোনো কারণ তোমার কাছে নেই, আর তুমি করবেও না এটাও আমি জানি। সো গেট রেডি টু বি মাই ওয়াইফ মিস ইশা।
আদৃত এবার ইশার কাছে এসে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
_বাই দা ওয়ে,আই লাইক ইওর নেগেটিভ মাইন্ড ইশা। তুমি যেই কারণটা ভেবেছিলে সেটাও কিন্তু ভুল নয়।
ইশা চোখ বড়বড় করে আদৃত এর দিকে তাকাতেই সে মুচকি হেসে ঘড় থেকে বেড়িয়ে যায়। ইশা শুকনো ঢোক গিলে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।
ইশা বুঝতে পারছে না তার এই মুহূর্তে কি রিয়েকশন দেওয়া উচিৎ। আদৃত এত স্বাভাবিক ভাবে তাকে আই লাভ ইউ বলে দিলো! কি করে? আর আদৃত ঠিক ই বলেছে, তাকে রিজেক্ট করার কোনো কারণ ও ইশার কাছে নেই। তাদের মধ্যে সেই আগের ঝগড়ার সম্পর্কটাও এখন বদলেছে, দুজনেই এখন বেশ বন্ধুসুলভ আচরণ করে।
তবে এমন কিছু ইশার কল্পনার ও বাইরে ছিল। তাই পরিস্থিতি বুঝতে বুঝতে তার আরো অনেক সময় লেগে যায়। শাহাদাত সাহেব আজকেই বিয়ের ডেট ঠিক করতে চেয়েছিলেন, তবে জহির সাহেব তাতে আপত্তি জানিয়েছেন। ইশার মতামত না শুনে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।
প্রজ্জল কে কোলে নিয়ে সোফায় বসে আছে ইশা। আর তার সামনে সকলে অতি উৎসাহ নিয়ে তার উত্তর শোনার অপেক্ষায় রয়েছে। ফাইজা এবার গাল থেকে হাত সরিয়ে উঠে দারিয়ে বিরক্তির সুরে বললো,
_আর কতো অপেক্ষা করাবি বল তো..
জহির সাহেব ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
_তোর কোনো আপত্তি..
_বাবাই…তোমরা যা ভালো মনে করবে তাই করো। আমার কোনো আপত্তি নেই।
আর এক সেকেন্ড ও সেখানে বসলো না ইশা। প্রজ্জল কে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। হুট করে তার ভীষণ লজ্জা লাগছে,যেটা তার সাধারণ রুপের সঙ্গে একটুও মিলছে না। এটাই কি তবে প্রেমে পড়ার পূর্বাভাস?
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৩৯ (বোনাস পর্ব) (প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য উন্মুক্ত)
#মেহরিন_রিম
অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটলো। উভয় পক্ষের সম্পতিতে কবুল বলার মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা। ফাইজা হয়তো একসময় ভাবতেই পারেনি এই দিন তার জীবনে আসবে। তবে ঐযে, তার ভাগ্যে হয়তো পূর্ণর নামটা অনেক আগে থেকেই লেখা ছিল। তাই তাদের পরিণতি টাও হয়েছে ততটাই সুন্দর।
পূর্ণর সঙ্গে তার বোন আসতে চেয়েছিল,তবে ছোট বাচ্চা থাকায় তার পক্ষে আসাটা সম্ভব হয়নি। আর পূর্ণ নতুন জামাই হিসেবে একা শশুর বাড়িতে থাকতেও ইতস্তত বোধ করছিল, তাই আদৃত আর সায়ান কেও থাকতে বলেছে। সায়ান আগে থেকেই রাজি ছিল কারণ ফাইজার বিয়ে উপলক্ষে মোহনাও এ বাড়িতেই আছে। তবে আদৃত কিছুটা আপত্তি জানিয়েছিল,পরবর্তীতে রুকসানা জোড় করায় আর কিছু বলতে পারেনি।
শালা শালিদের আবদার মিটিয়ে অবশেষে ঘরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয় পূর্ণ। ঘড়ে ঢুকেই বুকে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পূর্ণ। এরপর দড়জা লক করে বিছানার দিকে তাকায়। ঘরটা খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো। বিছানার উপর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লাভ শেইপ আকা আর তার মধ্যে (F+P) লেখা। তার ঠিক পিছনেই হাটু ভাজ করে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে ফাইজা। মুখের উপর নাক অবধি লম্বা ঘোমটা টানা।
পূর্ণ স্মিত হেসে এগিয়ে যায়, ফাইজা সামনে বসে বলে,
_বিয়ে করলে যে এত ঝামেলা পোহাতে হয় সেটা জানলে ঠিকই পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলতাম।
ঘোমটার আড়াল থেকেও ফাইজার হাসিমাখা মুখখানা সামান্য দেখা গেল। পূর্ন মুচকি হেসে তার ঘোমটা মাথার উপর তুলে দিতেই ফাইজাও ধীরে ধীরে তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। ঠিম তখনি পূর্ণ বলে ওঠে,
_আরে,তাকালে কেন?
ফাইজা অবাক হয়ে বললো,
_তো,কি হয়েছে?
_তুমি আবার নিচের দিকে তাকিয়ে থাকো।
ফাইজা কিছু না বলে আবারো আগের মতো নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। পূর্ণ এবার ধীরেধীরে তার থুতনি টে হাত দিয়ে মুখটা উপরে তুলে বললো,
_মাশাল্লাহ…এইযে এবার ঠিক আছে।
ফাইজা এবারো ফিক করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে বললো,
_শুধু মাশাল্লাহ বললে চলবে না, নতুন বউয়ের মুখ দেখলে কিছু উপহার দিতে হয়।
_পুরো আমিটাই তো তোমার উপহার। যেকোনো ভাবে ইউজ করতে পারো আমাকে,আই ডোন্ট মাইন্ড।
_পূর্ন.. এসব বললে চলবে না,আমার উপহার দাও।
_আচ্ছা চোখ বন্ধ করে হাত পাতো।
ফাইজা পূর্ণর কথামতো চোখ বন্ধ করে হাত পাতলো। পূর্ণ বিছানা থেকে উঠে কিছু একটা এনে তার হাতে দিয়ে চোখ খুলতে বললো। ফাইজা হাসিমুখে চোখ খুললেও উপহার টি দেখে তার হাসি মিলিয়ে গেলো। চমকিত চোখে পূর্ণর দিকে তাকিয়ে বললো,
_বই!
_হ্যা বই..আগের বইটা তো পড়েছিলাম ই। তাই এই নতুন বইটা,ভীষণ ইন্টারেস্টিং। আমি দু পেজ পড়েছিলাম, তারপর রেখে দিয়েছি। ভাবলাম বিয়ের দিন রাতে একসাথে পড়বো,ভালো হবেনা বলো?
ফাইজা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললো,
_মানে আমরা সারারাত জেগে বই পড়বো?
_হ্যা,কোনো সমস্যা আছে?
ফাইজা দাঁত কিড়মিড় করে তাকায় পূর্ণর দিকে। তারপর পূর্ণদ হাতটা টেনে বইটা ঠাস করে হাতের উপর রেখে বলে,
_নাহ কোনো সমস্যা নেই। তুমি পড়ো বই,আমার ঘুম পেয়েছে। আমি ঘুমোবো..
_আচ্ছা ঠিক আছে ঘুমোও,এমনিতেও সারাদিন এ অনেক ধকল গেছে তোমার উপর দিয়ে।
ফাইজা এবার আরো বেশি অবাক হয়ে যায় তার সঙ্গে রেগেও যায়। ফাইজা চোখ সরিয়ে নেয় পূর্ণর থেকে। মাথায় থাকা ওড়নাটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে নেমে দাঁড়ায়। আবারো পূর্ণর দিকে তাকায়,তবে তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। ফাইজা কটমট চোখে তার দিকে তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিল এর সামনে গিয়ে টুলটা টেনে বসে পড়ে।
পূর্ণ এতক্ষন ঠোট কামড়ে নিজের হাসি আটকে রেখে ফাইজার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে। তবে এখন তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়বে। হাতে থাকা চুড়িগুলো টেনে টেনে খুলছে আর ড্রেসিং টেবিল এর উপর ছুড়ে ফেলছে। গলার হারটা নিয়েও টানাটানি করছে তবে খুলতে পারছে না।
পূর্ণ এবার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ফাইজার দিকে। ফাইজা নিচের দিকে তাকিয়ে থাকায় পূর্ণর অবস্থান লক্ষ্য করেনি।
ফাইজা এখনো হারটা নিয়ে টানাটানি করছে। পূর্ণ মুচকি হেসে ওর হাতটা সরিয়ে দেয়। ফাইজা চোখ তুলে তাকায় আয়নার দিকে। পূর্ণর ঠোঁটের কোণে হাসি স্পষ্ট, ফাইজা ছোটছোট চোখে তাকিয়ে থাকে আয়নার দিকে। পূর্ণ সেকেন্ডের মধ্যেই হারটা খুলে এনে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দেয়। স্থির কণ্ঠে বলে,
_ম্যাডামের আমার উপর রাগ হয়েছে বুঝি?
_র রাগ হতে যাবে কেন?
পূর্ন নিজের চোখে থাকা চশমাটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দেয়। এরপর ফাইজার দু’কাধে হাত রেখে আয়নার দিকে তাকায়। দুজনেই এখন দুজনকে আয়নায় দেখতে পাচ্ছে। পূর্ণ বাকা হেসে বলে,
_চশমা পড়লে নাকি আমাকে ভীষণ ভদ্র ভদ্র লাগে, তাই ভেবেছি চশমা পরে সবসময় নিজের ভদ্র রুপটাই প্রকাশ করবো। তবে তোমার বোধ হয় আমার ভদ্র রুপটা পছন্দ হচ্ছে না।
কিছুটা ঝুকে আসে পূর্ণ। ধীরেধীরে ফাইজার খোপায় থাকা ক্লিপগুলো খুলতে শুরু করে,কয়েক মিনিটের মধ্যে ক্লিপগুলো খুলেও ফেলে। এরপর আয়নার দিকে তাকিয়ে খোপাটা এক টানে খুলে ফেলে। কোমড় অবধি চুলগুলো ছড়িয়ে পরে,কিছুটা চুল সামনেও এসে পড়ে। পূর্ন সম্পূর্ন চুল একপাশে সরিয়ে ফাইজার ঘাড়ে মুখ ডোবায়,চোখ বন্ধ করে নেয় ফাইজা। পূর্ণ এবার ফাইজার কাণের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
_আমার অভদ্র রুপটা দেখতে চান ম্যাডাম।
ফাইজা আমতা আমতা করে বলে,
_আ আমি ব বলেছি কিছু?
_না বললে এখন বলো।
এক ঝটকায় পূর্ণকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় ফাইজা। অন্য দিকে ঘুড়ে বলে,
_বই পড়বে না তুমি?
পূর্ণ শব্দ করে হেসে ফাইজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ফাইজার গলা জড়িয়ে তাকে কিছুটা কাছে টেনে নিয়ে বলে,
_বই পড়া ছাড়াও অনেক ইম্পর্টেন্ট কাজ আছে, সেগুলো আগে কমপ্লিট করা উচিৎ?
এবার আর কথা বলতে পারলো না ফাইজা। পূর্ণ দিকে তাকাতেও পারলো না,তাই নিজের আশ্রয় খুজে নিলো পূর্ণর বুকে। মুচকি হাসে পূর্ন, অত:পর তার প্রেয়সী কে জড়িয়ে নেয় নিজের সঙ্গে। আজ রাতটা নাহয় তাদের নামেই হোক।
____
সোফায় সারিবদ্ধভাবে বসে আছে আদৃত,সায়ান, ফায়াজ। আর তার অপর পাশেই বসে আছে ইশা আর মোহনা। ঝামেলা হয়েছে এখানেই, ছেলেরা তিনজন আর মেয়েরা দুজন। ছেলেদের দলে একজন বেশি হয়ে যাচ্ছে।
ইশা দোড়ে গিয়ে ওর হাত ধরে আটকে দিয়ে বলে,
_না না না,আজকে তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না। সেই তো ভাবির সাথেই কথা বলতে যাবে। একদিন কথা না বললে কিছু হবে,এসো এখানে।
_কিন্তু মেম্বার তো মিলছে না।
_কোনো সমস্যা নেই,তুমি থাকবে নিরপেক্ষ দলে। আর নাহলে ছেলেদের দলেই থাকো। আমরা মেয়েরা দুজন ই যথেষ্ট। তাইনা মেহু?
মোহনা উচ্চস্বরে বলে,
_ইয়েস ইয়েস।
#চলবে
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৪০
#মেহরিন_রিম
_বসলাম তো। এবার বল কি খেলবি?
ইশা টি টেবিল থেকে অনেকগুলো চিরকুট হাতে নিয়ে বললো,
_এইযে এগুলোর মধ্যে একেকটা টাস্ক লেখা আছে। যার ভাগ্যে যেটা পড়বে তাকে সেটাই করতে হবে।
আদৃত বিরক্ত হয়ে বলে,
_এসব বাচ্চাদের খেলায় আমি নেই।
ইশা ভেংচি কেটে ভাব দেখিয়ে বলে,
_কেউ আগে থেকেই পালিয়ে যেতে চাইলে সমস্যা নেই।
_ওহ হ্যালো,আমি পালিয়ে যাচ্ছি না ওকে। ঠিক আছে খেলবো আমিও।
মোহনা এবার বলে ওঠে,
_ঠিক আছে ফার্স্ট এ ফায়াজ ভাইয়া। বড় থেকেই শুরু হোক।
ফায়াজ একটা চিরকুট তুললো। ইশা সেটা নিয়ে জোড়ে জোড়ে পড়লো,
_এখানে লেখা আছে সবাইকে আইসক্রিম খাওয়াও। ভাইয়া, এবার আমাদের আইসক্রিম খাওয়াতে হবে। হি হি..
_এটা কিন্তু ঠিক নয়।
মোহনা বললো,
_কেন ঠিক নয় হ্যা? লেখা আছে যখন খাওয়াতেই হবে।
_আচ্ছা বাবা কালকে খাওয়াবো। এখন আমি বাইরে যেতে পারবো না।
সবাই রাজি হলো। এবার চিরকুট ওঠাবে ইশা। ইশা চোখ বন্ধ করে একটা চিরকুট তুললো। আদৃত সেটা ওর হাত থেকে নিয়ে পড়তে লাগলো,
_ড্যান্স করতে হবে।
ইশা খুশিতে লাফিয়ে উঠে বললো,
_এটাতো আমার জন্য কোনো ব্যাপার ই না।
সায়ান পাশ থেকে বলে ওঠে,
_ওমা ইশা, এবার তোমার পার্টনার কে হবে?
ইশা মুচকি হেসে বললো,
_এক মিনিট ওয়েট করো।
কথাটা বলেই ইশা ওর ঘড়ে গিয়ে ওর সাইজের একটা টেডি নিয়ে এসে বললো,
_এইযে আমার টিংটিং..আমার পার্টনার।
সবাই একসঙ্গে বললো,
_এটা!
_হ্যা..তোমরা শুধু দেখতে থাকো।
কথাটা বলে ইশা টেডিটা সোফার উপর রেখে ওড়না কোমড়ে বেধে নাচার জন্য উদ্যত হলো। ফোন হাতে নিয়ে
“আমি যে তোমার,শুধু যে তোমার” গানটা চালিয়ে দিয়ে টেডির সঙ্গে নাচতে লাগলো।
সবাই ওর নাচ দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। টেডিকে পার্টনার বানিয়ে এত সুন্দর করে কি করে নাচছে ইশা!
ইশার নাচ শেষে সবাই হাততালি দিলো। সায়ান অবাক হয়ে বললো,
_তুমি কি আগে থেকে প্রাকটিস করে এসেছিলে নাকি?
ফায়াজ হাসতে হাসতে বলে,
_ও তো ঘরে বসে এই কাজই করে।
_ভাইয়া…
সবাই হাসতে লাগলো এবার। ইশা সোফায় বসে চিরকুটগুলো আদৃত এর দিকে এগিয়ে দিলো। আদৃত এবার একটা হাতে নিয়ে নিজে থেকে ইশার দিকে দিলো। ইশা সেটা হাতে নিয়ে পড়ে,
_প্রেমিক/প্রেমিকাকে কিভাবে প্রপোজ করেছো বা করবে?
সায়ান বেশ উৎসাহিত হয়ে বলে,
_একদম পারফেক্ট। আদি অ্যাকটিং করে দেখা এবার।
আদৃত ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
_আমি কখনো কাউকে প্রপোজ করিনি আর করবো ও না।
ইশা অবাক হয়ে বলে,
_কেন?
আদৃত ইশার দিকে তাকিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসে বলে,
_কারণ আমি যাকে ভালোবাসি তাকে সরাসরি বিয়ে করবো। সো, এই টাস্ক বাদ।
সায়ান আফসোস এর সুরে বলে,
_বাদ দাও ইশা,ওকে দিয়ে এসব হবেনা।
ইশাসহ উপস্থিত সবাই হাসতে শুরু করে। আদৃত একদৃষ্টিতে ইশার সেই মনভোলানো হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই আদৃতের ঠোঁটে থাকা হাসিটা মিলিয়ে যায়। ইশার ঠোঁটের এই হাসিটাও হয়তো আর খুব বেশি সময় থাকবে না, কাল সকালে যা হবে তারপর হয়তো এই হাসিটা দীর্ঘসময় ধরে তার মুখে দেখা যাবে না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আদৃত, ইশার কষ্ট হলেও সত্যিটা তাকে জানতে হবে।
_____
সকলে একসাথে সকালে নাস্তা শেষ করেছে। ছেলেরা সকলে সোফায় বসে আছে আর মেয়েরা কেউ কেউ রান্নাঘরে আর কেউ কেউ ডাইনিং টেবিলে বসে গল্প করছে।
পূর্ণ একনজর আদৃতের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কিছু জিজ্ঞেস করে। আদৃত ও তাতে হ্যা সূচক জবাব দেয়। পূর্ণ এবার উঠে দাঁড়িয়ে রান্নাঘর এর দিকে এগিয়ে বলে,
_আম্মু,কাকি একটু ড্রইং রুমে আসবেন প্লিজ। ইশা,ফাইজা তোমরাও এসো।
পূর্ণর সঙ্গে সবাই ড্রইং রুমে এসে দাঁড়ালো। জাফর,জহির আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। রুকসানা পূর্ণর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো,
_কি হয়েছে পূর্ণ? সবাইকে এক যায়গায় জড়ো করলে যে? কিছু বলবে?
_জি কাকি,ফাইজা তুমি এদিকে এসো।
ফাইজা এসে পূর্ণর পাশে দাঁড়ায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় পূর্ণর দিকে তবে সে তাকায়নি। পূর্ণ আদৃতের দিকে তাকাতেই আদৃত উঠে দাঁড়িয়ে কাউকে কল করে বলে,
_নিয়ে এসো ওকে।
সবাই অবাক হয়ে ওদের কাজ দেখছে। দু মিনিটের মধ্যেই আদৃতদের বয়সী একটা ছেলে আরেকটা ছেলের ঘাড় ধরে বাড়ির ভিতরে ঢোকে। পূর্ণ ওকে সামনে এনে বলে,
_ও হচ্ছে রিয়াজ, এখন পর্যন্ত পাঁচবার জেল খেটে বেড়িয়েছে।
ছেলেটা ফাহমিদার দিকে একনজর তাকায়। ফাহমিদা কাপাকাপা গলায় পূর্ণর উদ্দেশ্যে বলে,
_ও ও এখানে কি করছে?
_কেন আম্মু,চেনেন নাকি ওকে?
ইশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছিল। তা দেখে আদৃত বলে,
_ইশা,তুমি চেনো ওকে?
_বোধ হয় রাস্তায় অনেকবার দেখেছি।
পূর্ন এবার ফাহমিদার দিকে তাকিয়ে বলে,
_দেখার ই কথা,এতদিন ধরে ফলো করছে তোমায়।
জাফর এবার ওদের মাঝে বলে,
_তোমরা কি বলছো একটু স্পষ্টভাবে বলবে?
_সেটা হয়তোবা অন্য কেউ ভালো বলতে পারবে। (পূর্ণ)
সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফাহমিদা আতঙ্কিত স্বরে বলে ওঠে,
_আমি চিনিনা ওকে,চিনিনা।
পূর্ণ বাঁকা হেসে বলে,
_আমি কি বলেছি আপনি ওকে চেনেন?
উপস্থিত কারোর মাথায় এইসব কিছুই ঢুকছে না। রিয়াজ নামের ছেলেটা পূর্ণ কাছে গিয়ে হাত জোড় করে বলতে থাকে,
_আমি কিছু করিনি স্যার, এই (মাহমিদা) মহিলা আমাকে যা করতে বলেছে আমি তাই করছিলাম শুধু।
_কি করতে বলেছে উনি তোমায়? (আদৃত)
_উনি বলেছে এই মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে কোথাও গুম করে ফেলতে যেন কেউ খুজে না পায়। তাই জন্যই তো ও কোথায় কোথায় যায় সেগুলো ফলো করেছি।
সকলে বিস্ফোরিত চোখে ফাহমিদার দিকে তাকায়। ফাহমিদা মাথা নিচু করে নিজের নজর লুকোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। রুকসানা চোখ বড়বড় করে ফাহমিদার দিকে তাকিয়ে বলে,
_ভাবী ও কি বলছে এসব?
পূর্ণ এবার কিছুটা কড়া গলায় বলে,
_আপনি কি সবটা বলবেন আম্মু নাকি আমি বলবো?
ফাহমিদা কটমট চোখে পূর্ণর দিকে তাকায়,তবে কোনো উত্তর দেয়না। পুর্ণ এবার বলে,
_বেশ উনি যখন বলবেন ই না তখন আমিই বলছি। ওনার ইচ্ছে ছিলো ফায়াজ ভাইয়ার সঙ্গে ইশার বিয়ে দেবেন, ফলে কাকার সব সম্পত্তি দিনশেষে ফায়াজ এর ই হয়ে যাবে। কিন্তু ওনার পরিকল্পনা সফল হয়নি, যার ফলে ওনার মাথায় চিন্তা ঢুকে যায়। কাকার যেহেতু কোনো ছেলে নেই,তাই তার সম্পত্তির কিছু ভাগ ফায়াজের এমনিতেই পাওয়ার কথা। কিন্তু ওনার তাতে চলবেনা ওনার চাই সবটা। তাই উনি ইশাকেই সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেন।
ফাহমিদা পূর্ণর কথা মাঝে বলে ওঠে,
_হ্যা হ্যা বেশ করেছি। একটা বাইরের মেয়ে কেনো সবকিছু পেয়ে যাবে?
_হ্যা বাইরের মেয়ে। ইশা তো আমাদের পরিবার এর ই কেউ নয়। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে ও, আর ও কিনা এত সম্পত্তির মালিক হয়ে যাবে?
রুকসানা আতঙ্কিত চোখে ফাহমিদার দিকে তাকিয়ে বলে,
_ভ ভাবী আপনি কিসব আজেবাজে কথা বলছেন? ভ ভাইয়া আপনি ভাবিকে নিয়ে যান এখান থেকে।
_সত্যি কথা তো আমি বলবোই। নিজের কখনো সন্তান হবেনা বলেই তো রাস্তা থেকে এই মেয়েকে তুলে এনেছিলে।
_ভাইয়া আপনি দয়া করে ভাবীকে এখান থেকে নিয়ে যান…আমি আপনার পায়ে পরছি।
জাফর কড়া চোখে ফাহমিদার দিকে তাকিয়ে তাকে নিয়ে ঘড়ে চলে যায়।
আদৃত এতক্ষন কেবলই ইশার দিকে তাকিয়ে ছিলো। এত বড় একটা সত্যি কি ও সহ্য করতে পারবে? আদৃত চোখ সরিয়ে নেয়,ইশার দিকে এই মুহূর্তে তাকিয়ে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।
ইশা রুকসানার সামনে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলে,
_আম্মু,কাকি এগুলো কি বলে গেলো?
রুকসানা ইশার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে,
_ওসব কথায় কান দিসনা মা। ত তুই আমার মেয়ে, আমার মেয়ে তুই।
ইশা রুকসানার হাতটা নিজের মাথার উপর রেখে বলে,
_সত্যিটা বলো আম্মু। আমি কি তোমাদের মেয়ে নই?
রুকসানা এবার মুখ চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করেন। ইশার যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে। তবে তার চোখে একফোঁটা ও পানি নেই। ফাইজা নিজেও এতক্ষনে কাঁদতে শুরু করেছে। পূর্ণ তাকে চোখের ইশারায় কিছু বোঝাতেই সে ইশার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
_এসব কথা মনে রাখিস না বোন। তুই ছোট আম্মু আর ছোট আব্বুর ই মেয়ে।
ইশা ফাইজার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে পাথর এর ন্যায় জহির সাহেব এর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
_বাবাই, আমার আসল বাবা মা কে?
জহির সাহেব নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন। ইশা এবার কিছুটা উচ্চস্বরে বলো,
_বলছো না কেন? বলো আমার আসল বাবা মা কে?
রুকসানা এবার কাঁদতে কাঁদতে বলে,
_আমরা জানিনা মা। আমরা শুধু এইটুকুই জানি তুই আমাদের মেয়ে।
চোখ থেকে নোনাজল গড়িয়ে পরে ইশার। তার নিজের বাবা মা কে তা সে জানেনা। এতবছর ধরে যাদের নিজের বাবা মা বলে জেনে এসেছে তারা ওর নিজের মা বাবা নয়। বিষয়টা মেনে নেওয়া কি খুব সহজ?
কয়েক সেকেন্ড সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো ইশা। এরপর ছুটে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। ফাইজা ওকে আটকাতে গেলে আদৃত বাধা দিয়ে বলে,
_যেওনা ফাইজা, ইশার এখন কিছুক্ষন একা থাকা প্রয়োজন।
পূর্ণ এই বিষয়টা আগে থেকে জানতো না। তবে আদৃত কে দেখে মনে হলো সে এসব আগে থেকেই জানে, কিন্তু কি করে?
#চলবে
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৪১+৪২
#মেহরিন_রিম
সকাল গড়িয়ে এখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। আলোর আভা কমে গিয়ে ক্রমশ অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে আকাশ। তবে ইশার মনে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে আরো অনেক্ষন আগে। সেইযে সকাল বেলা ঘরে ঢুকেছে, এখন পর্যন্ত সবাই শত চেষ্টা করেও তাকে বের করতে পারেনি। রুকসানা এতক্ষন ধরে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পরছেন। জাফর আর ফাহমিদা আরো আগেই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছেন, ফায়াজ তাদের বের করে দিয়েছে বললেই চলে। বাবা মায়ের কার্যকলাপে লজ্জায় তার মাথা কাটা যাচ্ছে। রুকসানা আর জহির এর সামনে যাওয়ার সাহসটুকুও পাচ্ছে না।
সকলের চেষ্টাই বৃথা যাচ্ছে। সবাই অনেককিছু বলে ইশাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে শুধু আদৃত বাদে। সেও এতকিছুর মাঝে নিরবতা পালন করছে। সোফায় বসে গম্ভীর ভঙ্গিতে কিছু ভেবে চলেছে। পূর্ণ এসে তার কাধে হাত রাখতেই ভাবনা থেকে বেড়িয়ে পিছনে তাকায় সে।
পূর্ণ আদৃত এর পাশে বসে বলে,
_আই থিংক,তোর এবার ইশাকে সত্যিটা জানানো উচিৎ। এতটা যখন জেনেই গেছে তাহলে বাকিটাও জানুক।
আদৃত চুপ করে রইলো। পূর্ণ আবারো তার কাধে হাত রেখে বললো,
_যা আদি।
আদৃত এবার একনজর পূর্ণর দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পা বাড়ালো ইশার ঘরের দিকে।
সেখানে রুকসানা,ফাইজা বারবার দড়জায় ধাক্কা দিচ্ছেন, তবে ইশা কোনো কথাই বলছে না। মাঝখানে শুধু একবার বলেছিল,
_তোমরা চলে যাও এখান থেকে।
আদৃত এর পিছনে পূর্ণ ও এসেছিল। পূর্ণ ফাইজাকে চোখের ইশারা করতেই সে রুকসানা কে নিয়ে কিছুটা পাশে সরে যায়।
আদৃত দড়জার সামনে গিয়ে হালকা টোকা দিয়ে বলে,
_ইশা, আমার তোমাকে কিছু বলার আছে। দড়জাটা খোলো প্লিজ।
দড়জা খুললো না ইশা। আদৃত এবার জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
_ইশা, তুমি তোমার মায়ের কাছে যেতে চাও?
ইশা এতক্ষন দড়জার পাশেই হাটুতে মুখ গুজে বসেছিল। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে গেছে এখন। তবে আদৃত এর শেষ কথাটা শুনতেই মাথার টনক নড়ে ওঠে তার। দ্রুতগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে দড়জা খুলে দেয় সে।
আদৃত জানতো ইশা এবার দড়জা খুলবেই,তবে ইশার দিকে তাকাতেই বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। এতটা বিদ্ধস্ত অবস্থায় কখনো ইশাকে দেখতে হবে এটা কল্পনাও করে নি সে।
ইশাকে দড়জা খুলতে দেখেই রুকসানা তার কাছে যেতে চাইলে পূর্ণ তাকে আটকে দেয়। মাথা নাড়িয়ে বোঝায় এখন ওর কাছে যাবেন না।
ইশা আদৃত এর দিকে তাকিয়ে এলোমেলোভাবে বলে,
_আপনি জানেন আমার মা কে? নিয়ে চলুন না আমাকে তার কাছে। আমি শুধু একবার দেখবো তাকে।
আদৃত চোখ সড়িয়ে নেয় ইশার থেকে। ক্ষীণ স্বরে বলে,
_সত্যি তুমি দেখতে চাও।
_হ্যা চাই।
_বেশ তাহলে চলো আমার সাথে।
কথাটা বলে আদৃত ইশার হাত ধরে ওকে গাড়ির কাছে নিয়ে যায়। ইশা কিচ্ছু বলছে না,শুধু আদৃত এর সঙ্গে হেটে চলেছে। যেন কোনো ঘোরের মধ্যে আছে সে।
আদৃত ইশাকে গাড়িতে উঠতে বললে সে তাৎক্ষণিক গাড়িতে উঠে বসে। আদৃত ও এবার ড্রাইভিং সিট এ বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। আকাশ এখন পুড়োপুড়িই অন্ধকারাচ্ছন্ন। চাঁদের খুব সামান্য অংশই দৃশ্যমান।
দুজনের মধ্যে কোনো কথা নেই। আদৃত নির্বাক হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, আর ইশা উৎকণ্ঠা মনে অপেক্ষা করছে তার মাকে দেখার জন্য।
খুব বেশি সময় চললো না গাড়ি, পাঁচমিনিট পরেই গাড়ি এসে থামলো সেই আশ্রমের সামনে। ইশার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আদৃত এর দিকে। তার চোখের চাহনিতে এই প্রশ্ন স্পষ্ট,”আমাকে এখানে কেনো নিয়ে এসেছেন?”
আদৃত গাড়ি থেকে নেমে ইশাকেও নামতে বললো। ইশা অবাক চোখে আদৃতের দিকে তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। আদৃত এবার বেশ শক্ত করে ইশার হাত ধরলো।
এরপর যেদিকে নিয়ে গেলো তা ইশার জন্য একদমই অপরিকল্পিত ছিল। আশ্রমের পাশেই ছোট একটি কবরস্থান। মূলত এই আশ্রমে থেকে যারা মারা যায়,যাদের পরিবার বলে কিছু নেই তাদের এখানে কবর দেওয়া হয়।
এই যায়গায় ইশা আগেও একবার এসেছে,সেদিনও আদৃত তার সঙ্গেই ছিল।
গত দু মাস আগে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন আয়শা। এটা জানতে পারার পরই ইশা আদৃত এর সঙ্গে এসেছিল এখানে, আয়শাকে ভীষণ আপন মনে হতো ইশার। তাকে হারিয়ে মনে হয়েছিল যেন নিজের খুব আপনজনকে হারিয়েছে, কে জানতো তার ধারণা আসলেই সত্যি হবে?
আজও সেই একই কবরের সামনে এনে দাঁড়ালো আদৃত। এবার মুখ খুললো ইশা। আদৃতের দিকে তাকিয়ে কাপাকাপা গলায় বললো,
_আপনি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন? আপনি তো বললেন আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাবেন।
_…
_চুপ করে আছেন কেন? নিয়ে চলুন না আমার মায়ের কাছে।
আদৃত চোখ তুলে ইশার দিকে তাকিয়ে বললো,
_যার কাছে আসতে চেয়েছিলে তার কাছেই নিয়ে এসেছি তোমায়।
ইশা বিস্ফোরিত চোখে আদৃত এর দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই আয়শার কবরের দিকে তাকালো। কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হ্রাস পেতেই সেই জায়গায় বসে পড়লো ইশা। আদৃত এখনো নির্বাক। বেশ কয়েক মিনিট এভাবেই অতিবাহিত হলো। এবার আদৃত দীর্ঘশ্বাস ছেড়েই বলতে লাগলো,
_আন্টি যখন হসপিটালে এডমিট ছিলেন তখন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। আমি খবর পেয়েই ছুটে যাই সেখানে,আর তখন ই তিনি আমায় সব সত্যিটা জানান।
___
আদৃত আয়শার বেড এর পাশে একটা চেয়ারে বসে ছিল। আয়শা সেই মুহূর্তে বেশ ভালোই বুঝতে পারছিলেন তার হাতে আর বেশি সময় নেই। আদৃত এর হাত ধরে তিনি বলতে শুরু করেন,
_এই কথাগুলো আমি কাউকে জানতে দেইনি বাবা, আজ তোমায় বলছি। আমার মতো খারাপ মা বোধহয় পৃথিবীতে দুটো নেই, যেই পাপ কাজ আমি করেছি তার জন্য হয়তো ওপারে আমাকে অনেক শাস্তিও পেতে হবে। তবে বিশ্বাস করো,আমি আমার সন্তানের ভালোর জন্যই এমন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমার স্বামী যখন আমাকে তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, তখন ছুটে গিয়েছিলাম বাপের বাড়িতে। সেখানেও ঠাই হয়নি আমার, দুরদুর করে তাড়িয়ে দেয় আমায়। রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতে শুরু করি,তার কয়েকদিন এর মধ্যেই বুঝতে পারি আমার মধ্যে আরো একটা প্রাণ আছে। নিজের জন্য না হলেও সেই ছোট্ট প্রাণ এর জন্য যে আমায় বাঁচতেই হতো। ভিক্ষা করে তা সম্ভব ছিলোনা, মানুষের বাড়িতে কাজ করতে শুরু করি। তবে সময় পেরোনোর সাথে সাথে তাও আমার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। আবারো সেই রাস্তায় বসে ভিক্ষা করতে হয়, আর এভাবেই কেটে যায় নয় মাস। আমার কোলজুড়ে আসে এক ফুটফুটে মেয়ে। কেউ দেখলে বুঝবেই না এ যে এক রাস্তার ভিখারির মেয়ে। নিজে খাওয়া দাওয়া না করতে পারায় মেয়ে আমার বুকের দুধ পেতোনা, ওকে যে বাহিরের দুধ কিনে খাওয়াবো তাও সম্ভব ছিলোনা। খিদের জন্য মেয়ে আমার সারাদিন কাঁদত,ওর এই কান্না আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব ছিলোনা। এরই মধ্যে একদিন খোজ পাই এক দম্পতীর, আমার পাশেই দাঁড়িয়ে এক লোকের কাছে বলছিল তারা বাচ্চা দত্তক নিতে চায়। লোভ সামলাতে পারিনি আমি, আমার মেয়ে একটা ভালো পরিবার পাবে। সুখের কোনো কমতি থাকবে না তার। তবে আমি তাদের নিজের পরিচয় জানাতে চাইনি,আমি চাইনি আমার মেয়ে আমাকে কখনো খুজে পাক। সেই আপু রোজ এক জায়গা থেকে বাড়ি ফিরতেন, আমি একদিন ওনাকে দেখতে পেয়ে রাস্তার পাশে আমার মেয়েকে রেখে দূড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। যখন আমি ওকে রেখে আসছিলাম,মেয়েটা আমার চিৎকার করে কাঁদছিল। বুকে পাথর চেপে আমি লুকিয়ে ছিলাম সেদিন। আমার পরিকল্পনাই সত্যি হলো, আপু আমার মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলেন। হয়তো অনেক খোজ করেছেন আমার,কিন্তু পাননি। অবশেষে মেয়েটাকে তিনি নিজের কাছেই রেখে দিলেন, তিনিও মা হতে পারলেন আর আমার মেয়েটাও একটা সুন্দর জীবন পেলো।
আদৃত এতক্ষন মনোযোগ দিয়ে আয়শার কথা শুনছিল। তবে আয়শা এসব কথা তাকে কেন বলছেন সেটা বুঝতে পারছিল না। আয়শা কিছুক্ষন থেমে রইলেন, এরপর আদৃত এর দিকে তাকিয়ে বললেন,
_ইশা যেদিন দ্বিতীয়বার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল সেদিন ওর বাম পায়ের জোড়া আঙুল দেখে বুক কেপে ওঠে আমার। মনের সন্দেহ থেকে ওর ডান হাতের কব্জির কিছুটা উপরে থাকা জন্ম দাগের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠি আমি। তবুও আমার মনে সন্দেহ ছিল, তবে সেই সন্দেহও কেটে যায় যেদিন ও ওর মাকে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে।
আদৃত অবাক হয়ে বলে,
_আপনি বলতে চাইছেন..
_হ্যা বাবা। ইশার জন্মদাত্রী মা আমি, আমার নাড়িছেঁড়া ধন ও। তোমায় এই কথাটা জানিয়ে রাখলাম। তবে আমি জীবিত থাকা অবস্থায় এটা ইশাকে জানতে দিওনা। আমার মৃত্যুর পরে যদি ও কখনো সত্যিটা জানতে পেরে নিজের মায়ের খোজ করে,তবে ওকে জানিও সবটা। ওকে বলো, পারলে যেন এই মাকে ক্ষমা করে দেয়।
____
চোখ বন্ধ করে নেয় ইশা। মুহূর্তেই যেন তার মনের মাঝে তীব্র রাগ ভর করে। উঠে দাড়িয়ে আদৃতের সামনে যায়। ওর শার্টের কলার চেপে ধরে বলে,
_আপনি আমায় কথাগুলো আগে জানাননি কেন?
_আন্টি নিষেধ করেছিল..
_ওনার কথা কেন শুনবেন আপনি? কেন?
হঠাৎ করেই মুখের রাগী আভা কেটে গেলো ইশার। করুণ স্বরে বললো,
_কেন বললেন না আদৃত? আমিতো একবার নিজের মা কে ‘মা’ বলে ডাকতে পারতাম। তাকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম। আপনি ভুল করলেন,অনেক বড় ভুল।
ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো ইশা। এই চোখের জলের সঙ্গে যদি কষ্টগুলো ও জীবন থেকে চলে যেত!
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আদৃত, ইশার দিকে এগিয়ে এসে আলতো হাতে তাকে জড়িয়ে নেয় নিজের সঙ্গে। আদৃতের বুকে মাথা রেখে আরো জোড়ে কেঁদে ওঠে ইশা। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে,
_কেন বললেন না আমাকে,কেন..
চোখ বন্ধ করে নেয় আদৃত। মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা যেদিন নিজের মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিল সে। আজ তো ইশার পাশে আদৃত আছে, কিন্তু সেদিন তো আদৃতের পাশে কেউ ছিলোনা। আচ্ছা, ইশার কষ্টটা কি আদৃতের চেয়েও বেশি?
বেশ কিছুক্ষন সময় কেটে যায়। ইশার কান্নার রেশ ও কমে আসে কিছুটা। আদৃত ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
_ইশা,বাসায় যেতে হবে এবার।
আদৃত ইশাকে আলগা ভাবেই ধরেছিল। তাই ইশা খুব সহজেই তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারে। এরপর আয়শার কবরের দিকে তাকিয়ে করুন সুরে বলে,
_আর কিছুক্ষন থাকি?
ইশার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় আদৃত। থাকুক আরো কিছুক্ষন,তাতে যদি ইশার কষ্ট কিছুটা কমে।
____
রুকসানা কে আয়শার ব্যাপারে সব কথা পূর্ণ ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে। সবাই এখন ড্রইং রুম এ বসে ইশার ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে।
কলিং বেল এর আওয়াজ পেয়ে ফাইজা ছুটে গিয়ে দড়জা খুলে দেয়। আদৃত ওকে চোখের ইশারায় বলে ইশাকে ভিতরে নিয়ে যেতে। অতিরিক্ত কান্নাকাটির ফলে চোখমুখ ফুলে গেছে ইশার। ফাইজা ওকে নিয়ে এসে সোফায় বসাতেই রুকসানা ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন। ইশার আর এখন কান্না পাচ্ছেনা, প্রায় এক ঘন্টা টানা কান্না করেছিল তাই হয়তো এমন হচ্ছে। রুকসানা নিজের চোখ মুছে বলেন,
_ইশা মা, তুই সেই সকাল থেকে কিছু খাসনি। এবার অন্তত কিছু খেয়ে নে,শরীর খারাপ করবে তো।
_আমার খিদে নেই।
ইশা সোফা থেকে উঠে ধীর পায়ে নিজের ঘরে চলে যায়। রুকসানা এবার জহির এর সামনে গিয়ে বলেন,
_ইশা আমাকে আম্মু বলে ডাকছেনা কেন? তুমি একটু ওকে গিয়ে বলোনা আমাকে আম্মু বলে ডাকতে।
কথাটা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন রুকসানা। আদৃত এবার নিরবতা ভেঙে বলে,
_আঙ্কেল আপনি আন্টি কে নিয়ে ঘড়ে যান। আর ফাইজা তুমি ইশাকে গিয়ে কিছু খাইয়ে দেও,না খেতে চাইলে জোড় করে খাওয়াও।
কথাটা বলে গেস্ট রুমের দিকে চলে যায় আদৃত,কালকেও সায়ান আর ও এই রুমেই ছিল।
_____
_আসতে পারি?
আদৃত এর কথায় ফাইজা এসে ইশাকে জোড় করে সামান্য কিছু খাইয়ে দিয়েছিল। তারপর অনেকটা সময় পেড়িয়ে গেছে। এখন ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁইছুঁই। ইশা নিজের বিছানায় হাটুতে মুখ গুজে বসে ছিল,দড়জাটা লাগানো হয়নি। দড়জায় নক পেয়ে ইশা চোখ তুলে তাকিয়ে আদৃতকে দেখতে পায়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
_আসুন।
আদৃত ভিতরে এসে বিছানার একপাশে বসে পড়ে। ইশা কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
_এত রাতে আমার ঘরে? কিছু বলবেন?
ইশা বেশ উৎসাহ নিয়ে মাথা নাড়ে। আদৃত বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে,
_চার বছরের একটা ছেলে, সারাদিন মায়ের পিছনে ঘুরে বেড়াতো। সবাই বলতো একদম মায়ের নেওটা। নিজের আপন বলতে ছেলেটা শুধু নিজের মাকেই ভাবতো। কারণ বাবার আদর সে পায়নি বললেই চলে। এমন না যে বাবা দূড়ে থাকতেন। বাবা খুব কাছেই ছিলেন, একই বাড়িতে থাকতেন। তবে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে। ছেলেটা একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে তার বাবাও তাকে আদর করা শুরু করে,এর কারণও আছে বটে। তার দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। ফলে সারাজীবন যেই স্ত্রী কে অবহেলা করেছেন, অত্যাচার করেছেন তার প্রতি খুব ভালোবাসা বেড়ে যায়। তবে ঐযে, ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ দা লাস্ট ইম্প্রেশন। সেই ছেলেটার ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছিল, বাবা আদর করতে চাইলেও তার কাছে যেতোনা ছেলেটা। তার জন্য তার মা ই যথেষ্ট ছিল। আর আল্লাহ ছেলেটার কাছ থেকে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকেই কেড়ে নিলো।
ইশা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো আদৃতের কথা। আদৃত ইশার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,
_ছেলেটা কে জানতে চাও?
ইশা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে। আদৃত কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
_ছেলেটা বর্তমানে তোমার সামনে বসে আছে।
ইশা অবাক চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে আদৃত এর দিকে। এরপর নরম সুরে জিজ্ঞেস করে,
_কি হয়েছিল আন্টির?
_ক্যান্সার, চেষ্টা করা হয়েছিল বাঁচানোর তবে সম্ভব হয়নি।
আদৃত আর ইশা দুজনেই চুপ করে থাকে কিছুক্ষন। এরপর আদৃত নিজে থেকেই বলে,
_তুমি জানতে চেয়েছিলে না আমি সেদিন কলেজ এর প্রোগ্রামে কাকে দেখে অমন রিয়েক্ট করেছিলাম?
_হ্যা।
_বাবার দ্বিতীয় ওয়াইফ। শুনেছিলাম তিনি আবার বিয়ে করেছেন,হয়তো তার মেয়েকে নিয়েই এসেছিল।
আবারো নিরবতা ভর করে দুজনের মাঝে। কিছুক্ষন পর আদৃত মৃদু হেসে বলে,
_তোমাকে এতকিছু কেন বলছি জানো?
ইশা মাথা নেড়ে না সূচক উত্তর দেয়।
_বাস্তবতা উপলব্ধি করানোর জন্য। এই মোমেন্ট এ হয়তো তোমার মনে হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে দুঃখী। তবে বাস্তবে তেমনটা নয়, তোমার চেয়ে অনেক দুঃখী মানুষ এই পৃথিবীতে আছে। অনেকের মা বাবা নেই। আবার অনেকের থেকেও নেই,যেমন আমি। একটা কথা বলো তো, আঙ্কেল আন্টির ব্যাবহার এ তোমার কখনো এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়েছে তুমি তাদের মেয়ে নও?
_নাহ..
_ইশা,ওনারা তোমার নিজের মা বাবা নয়। তবুও তুমি ওনাদের থেকে যে ভালোবাসা টা পেয়েছো আমিতো আমার নিজের বাবার থেকেও তা পাইনি। তুমি তো অনেক ভাগ্যবতী যে এমন একটা পরিবার পেয়েছো।
ইশা চুপ করে রইলো। আদৃত আবারো বলে,
_একটা কথা মাথায় রেখো, তুমি হচ্ছো এই বাড়ির মেইন এনার্জি। তুমি হাসিখুশি থাকলে সবাই ভালো থাকে, একবার আন্টির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছো তার কি অবস্থা হয়েছে? তুমি জেনে শুনে তাদের এতটা কষ্ট দেবে?
ইশা মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দেয়।
_তাহলে জীবনটাকে উপভোগ করার চেষ্টা করো। যারা তোমার আশেপাশে আছে তাদের নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করো।… রাত হয়েছে,ঘুমিয়ে পরো এখন। গুড নাইট।
_____
সবার সকালের ব্রেকফাস্ট করা শেষ, তবে ইশা আসেনি। ফাইজা একবার ঘরে গিয়ে দেখেছিল ও ঘুমোচ্ছে তাই আর ডাকেনি। রুকসানার সঙ্গে হাতেহাতে কাজ করে দিচ্ছে ফাইজা। আর আদৃত,পূর্ণ জহির এর সঙ্গে সোফায় বসে আছে। ফায়াজ ও ওদের সঙ্গেই ছিলো। আদৃত চুপচাপ বসে কিছু নিয়ে চিন্তা করছে, আদতেও কি ওর বলা কথাগুলো কাজে দেবে?
আরো পাঁচমিনিট যেতেই ইশা চোখ ডলতে ডলতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে তার চিরচেনা ভঙ্গিতে বললো,
_আম্মু খিদে পেয়েছে,খেতে দাও কিছু।
রুকসানা ফাইজা সহ উপস্থিত সকলে চমকিত চোখে ইশার দিকে তাকালো। রুকসানা মুখ চেপে ধরে নিজের কান্না নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করেন, ইশাকে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেই ইশা বেশ বিরক্তি নিয়ে বলে,
_আদর করার অনেক সময় পাবে আম্মু,পালিয়ে যাচ্ছিনা আমি। এখন আমায় খেতে দাও।
রুকসানা চোখ মুছে ইশার জন্য খাবার আনতে গেলেন। ফাইজা অবাক হয়ে ইশার পাশে এসে বলে,
_কি ব্যাপার বলতো ইশা, হুট করে তুই স্বাভাবিক কি করে হয়ে গেলি?
ইশা ঘাড় ঘুড়িয়ে সোফায় বসে থাকা আদৃত এর দিকে তাকায়। আদৃত ও তখন তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। ইশা সামান্য হেসে বলে,
_জানিনা। শুধু বুঝতে পারলাম, আই শুড ইনজয় মাই লাইফ ইন এনি সিচুয়েশন।
সকলের নজর এড়িয়ে মুচকি হাসে আদৃত। ফায়াজ সোফা থেকে উঠে এসে ইশার পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
_আম্মুর কাজের জন্য আমি তোর কাছে ক্ষমা চাইছি বোন, পারলে ক্ষমা করে দিস।
ইশা কিছুটা ভাবনা চিন্তা করে বলে,
_উমমম,একটা শর্তে।
_কি শর্ত?
_জলদি আমার জন্য ভাবী নিয়ে আসো। আই ওয়ান্ট অনেক মানুষের ভালোবাসা।
সকলে এবার একসঙ্গে হেসে দেয়। ফায়াজ ইশার মাথায় গাট্টা মেরে ওকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
_পাগলি একটা, আচ্ছা নিয়ে আসবো। খুশি এবার?
_অ..নে…ক..
ফাইজা মুখ ফুলিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
_আ হা হা হা… আমিতো মনে হয় বানের জলে ভেসে এসেছি!
ফায়াজ ওর দিকে আরেক হাত বাড়িয়ে বলে,
_আচ্ছা তুইও আয়..
ফায়াজ এবার অন্য হাতে ফাইজা কে জড়িয়ে ধরে। ভাই-বোনেদের এমন ভালোবাসা দেখে সকলের ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। তা দেখে ইশার মুখেও হাসি ফুটে ওঠে, আদৃত সত্যিই বলেছিল। ইশাই এই বাড়ির এনার্জি, ও ভালো থাকলেই বাড়ির সকলে ভালো থাকে, থাকবে।
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৩৭
#মেহরিন_রিম
ইশার কথা শুনে রিফাত যেন আকাশ থেকে পরলো। ইশা চোখের ইশারায় তাকে হাতের দিকে তাকাতে বলল। রিফাত ইশার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার অনামিকা আঙুলে হালকা গোলাপি রঙের স্টোন বসানো আংটি। রিফাত শুকনো ঢোক গিয়ে ইশার দিকে তাকিয়ে বললো,
_ত ত তুই এনগেইজড কি করে হলি? আমি তো কিছুই জানতাম না।
_জানবে কি করে! আসলে আব্বু আম্মু এখনো কাউকেই জানায়নি বিষয়টা আর আমিও জানাইনি। আব্বুর এক বন্ধুর ছেলের সাথে আরো চার বছর আগেই আমার এনগেইজমেন্ট হয়ে আছে,যদিও সেটা ভার্চুয়াল। বিদেশে থাকে তো তাই, এমনকি আমি ওনাকে এখন পর্যন্ত দেখিও নি জানো।
এবার ইশা কিছুটা লজ্জা পাওয়ার ভাব নিয়ে বলে,
_তবে না দেখলে কি হয়েছে,আমিতো মনে মনে তাকে বর হিসেবে মেনেও নিয়েছি।
রিফাত হতাশ হয়ে বললো,
_তুই সত্যিই এনগেইজড?
_হ্যা গো,নাহলে তোমার মতো হ্যান্ডসাম ছেলেকে কেউ রিজেক্ট জরতে পারে বলো?
রিফাতকে হতাশ হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইশা আবারো বললো,
_থাক ভাইয়া,তুমি মন খারাপ করোনা। আমি বরং তোমার সাথে আমার এক ফ্রেন্ড এর কথা বলিয়ে দেবো,ভীষণ সন্দরি জানো তো!
রিফাত কিছুটা খুশি হয়ে বলে,
_সত্যি?
_হ্যা হ্যা সত্যি।
রিফাত আচ্ছা বলে ইশার থেকে ফুলটা নিতে চাইলে ইশা বাধা দিয়ে বলে,
_সুন্দর তো ফুলটা। থাক আমার কাছে।
রিফাত সেখান থেকে চলে যেতেই ইশা মোহনার দিকে তাকিয়ে দেখে সে অতি কষ্টে নিজের হাসি আটকে রেখেছে। রিফাত কিছুটা দূরে চলে যেতেই সে উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বলে,
_মনে মনে বর বানিয়ে ফেলেছো তাইনা?
_একদম…
ইশা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
_দেড়ি হয়ে গেলো রে, অন্য একদিন দেখা করাবো আন্টিমনির সাথে। আজ বাসায় যাই বরং।
মোহনা হাসি থামাতে চেষ্টা করে বললো,
_চল।
বলেই বাসার দিকে হাটা শুরু করলো ইশা এবং মোহনা। এদিকে আদৃতের মাথা ভনভন করে ঘুরছে। কি বলে এই মেয়ে! ও আবার এনগেইজড হলো কবে?
রিফাত এর চিন্তা মাথা থেকে নেমে গেলেও এবার তার চেয়ে আরো বড় চিন্তা মাথায় চলে এলো। কার সাথে এনগেইজমেন্ট হয়েছে ইশার!
ইশা আর মোহনা কিছুদূর চলে যেতেই আদৃত বাইকের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওর এত প্রশ্নের উত্তর একজনই দিতে পারবে। আর অপেক্ষা করতে পারলো না আদৃত, ফোন বের করে ফাইজার নম্বরে ডায়েল করলো। দুটো রিং হতেই কলটা রিসিভ করলো ভাইয়া।
_হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম। ফাইজা আমি আদৃত..
_হ্যা ভাইয়া বলুন,কোনো দরকার?
_ইশা কি এনগেইজড?
ফাইজা অবাক হয়ে বলে,
_মানে! ও এনগেইজড হতে যাবে কেনো?
আদৃত এবার ফাইজাকে কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা খুলে বললো। সবটা শুনে ফাইজা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে দম ফাটিয়ে হাসতে লাগলো। ফাইজার হাসির শব্দ শুনে আদৃত ভ্রু কুঁচকে বলে,
_আরে তুমি হাসছো কেন?
_হাসবো না আবার? আপনি ভেবে নিয়েছেন ইশা সত্যি সত্যি এনগেইজড?
_তো ও নিজেই তো রিফাতকে বললো।
_আরে ভাইয়া, ওর হাতে যে রিংটা আছে ওটা আমার ভাইয়ের দেওয়া। ভাইয়া আমাদের দুজনকেই সেইম রিং কিনে দিয়েছিল, আর এই আইডিয়া টাও ভাইয়ার ই দেওয়া। কেউ প্রপোজ করলে তাকে বলে দেবো আমি এনগেইজড,তাহলে আর সে কখনো বিরক্ত করবেনা। সেই আইডিয়া ফলো করেই ইশা এই কাজ করে, স্কুল এ থাকতেও ওকে কয়েকজন প্রপোজ করেছিল। তখন ও একই কথা বলেছে,যে আমি এনগেইজড।
ফাইজার কথা শুনে আদৃত হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ফাইজা নিজের হাসি থামিয়ে বললো,
_এত চাপ নিয়েন না ভাইয়া,আপনার লাইন এখন পর্যন্ত ক্লিয়ার আছে।
কথাটা বলে আবারো হাসতে লাগলো ফাইজা। আদৃত অন্যহাতে মাথা চুলকিয়ে বলে,
_আমি এখন রাখছি হ্যা।
_ঠিক আছে।
ফোনটা কেটে দিলো আদৃত। আর ফাইজা ফোনটা হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে পূর্ণকে কল দিলো, মজার কথাটা তাকেও জানানো উচিৎ।
____
এরই মাঝে আরো বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। আদৃত অনেক চিন্তা করেছে কিভাবে ইশার সাথে বন্ধুত্ব করা যায় কিন্তু কিছুই তার মাথায় আসছেনা। অবশেষে একটা বুদ্ধি আসে তার মাথায়,সেই অনুযায়ী ই কাজ করবে সে।
ফাইজা পূর্ণর ব্যাপারে এখনো ইশাকে কিছুই বলেনি, কিছুটা লজ্জাই পাচ্ছে বলতে। ইশা ওকে ফোনে কথা বলতে কয়েকবার দেখেও নিয়েছিল,তবে অত বেশি কিছু জিজ্ঞেস ও করেনি।
কলেজ শেষে বাইরে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছিলো ইশা আর মোহনা। তখনি তাদের সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। ইশা চেনে এই গাড়িটা,এটা আদৃতের গাড়ি এটা ধরতে তার খুব বেশি সময় লাগেনি। ড্রাইভিং সিটের পাশে জানালা খোলা থাকায় আদৃতকে ভালো করেই দেখা যাচ্ছিল। তবে মোহনার নজর ঠিকই পিছনের সিটের দিকে যায়,সেখানে সায়ান বসে বসে ফোনে কোনো একটা গেইমস খেলছে। গাড়ি থামার পরই সায়ান গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে মোহনার সামনে এসে দাঁড়ায়। মোহনা অবাক হয়ে বলে,
_আপনি এখানে কি করছেন?
_আমি নিজেও জানিনা।
_জানেন না মানে?
আদৃত এবার গাড়ি থেকে নেমে ইশার সামনে দাঁড়ায়, সে মাস্ক পড়া থাকায় আশেপাশে থাকা লোকজন খুব বেশি খেয়াল করেনি। আদৃত মোহনার উদ্দেশ্যে বলে,
_আমি নিয়ে এসেছি, আর এখন তোমরাও যাবে আমার সঙ্গে।
ইশা অবাক হয়ে বলে,
_কোথায় যাবো? এই আপনি কি আমাদের কিডন্যাপ করার প্ল্যান করছেন নাকি? আমি কোথাও যাবোনা আপনার সঙ্গে।
_না গেলে সারপ্রাইজ ও মিস করবে।
সায়ান এবার আদৃতের দিকে তাকিয়ে বলে,
_তুই আমাকেও বললি সারপ্রাইজ,কিন্তু কি সারপ্রাইজ সেটাই তো বুঝলাম না।
_মেইন সারপ্রাইজ ই তোদের দুজনের জন্য। (সায়ান আর ইশাকে উদ্দেশ্যে করে)
_আমি যাবোনা..
আদৃত ইশার দিকে তাকিয়ে বলে,
_লাস্ট বার বলছি, যেতে পারো.. যারা যাবি গাড়িতে উঠে বস(সায়ান এর দিকে তাকিয়ে বলে)
আদৃত গাড়িতে উঠে বসার পর সায়ান আর মোহনাও গাড়িতে উঠতে যায়। ইশা হতভম্ব হয়ে বলে,
_মেহু তুইও যাবি!
মোহনাও সায়ান এর সাথে পিছনে গিয়ে বসে পড়লো। ইশা এবার বাধ্য হয়ে আদৃত এর পাশে সিটে উঠে বসে পড়লো। সারপ্রাইজ এর কথা শুনে যেতেও ইচ্ছে করছে বটে,তবে সেটা প্রকাশ করা যাবেনা।
আদৃত মাক্স এর আড়ালে মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
____
কোনো একটা পার্কের সামনে এসে গাড়ি থামালো আদৃত। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো সায়ান,মোহনা,ইশা। আদৃত ও নামলো গাড়ি থেকে। সবাই একসঙ্গে অবাক হয়ে আদৃতের দিকে তাকালো। আদৃত চোখে থাকা সানগ্লাসটা খুলে সবাইকে চোখের ইশারায় একটু সামনে বামপাশে থাকা বেঞ্চের দিকে তাকাতে বললো।
আদৃতের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো সবাই। সঙ্গে সঙ্গেই তাদের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। কারণ বেঞ্চে ফাইজা আর পূর্ণ পাশাপাশি বসে হেসেহেসে কথা বলছে। ইশা আর সায়ান ধীর পায়ে হেটে যথাক্রমে ফাইজা আর পূর্ণর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
পূর্ন,ফাইজার মধ্যে কেউই ওদের এখানে আশা করেনি। দুজনে একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকায় আরেকবার একে অপরের দিকে তাকায়।
ইশা কিছুক্ষন হা করে দুজনের দিকে তাকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
_নেহি… নেহি…নেহি…
ওর দেখাদেখি সায়ান ও একই কাজ করে। আশেপাশের মানুষ ওদের দিকে অবাক হয়ে দাঁড়ায়। পূর্ণ কটমট চোখে সায়ান এর দিকে তাকায় বলে,
_এমন করতেছিস কেন?
_তাহলে কেমন করবো ভাই? তুমি তলে তলে টেম্পো চালাবা আর আমরা জানতেও পারবো না?
ইশাও ফাইজার দিকে তাকিয়ে ঠোট উল্টে বলে,
_তোমার থেকে এটা আশা করিনাই আপু।
মোহনা এসে পূর্ণ আর ফাইজার দিকে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে বলে,
_ও মাই গড ও মাই গড! নতুন একটা কাপল!
ফাইজা ইশার হাত ধরে বলে,
_আমি না তোকে আজকেই জানাতে চেয়েছিলাম বোন..
পূর্ণ সায়ান এর দিকে তাকিয়ে বলে,
_কিন্তু তোরা এখানে কি করে এলি,তাও একসাথে?
সায়ান উত্তর দেওয়ার আগেই মোহনা বলে,
_আরে আমাদের তো আদৃত ভাইয়া নিয়ে এসেছে, বললো আমাদের সারপ্রাইজ দেবে।
ইশা ফাইজার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলে,
_তুমি এটা ঠিক করোনি আপু,আমি তোমাকে কিছুতেই ক্ষমা করবো না।
ফাইজা একনজর পূর্ণর দিকে তাকায়। পূর্ণ এবার ইশার উদ্দেশ্যে বলে,
_কেন ইশা? আমাকে কি তোমার আপুর পাশে মানায় না?
ইশা পূর্ণকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরখ করে বলে,
_ঠিক তা নয়,ভালোই মানিয়েছে।
_তাহলে আর সমস্যা কোথায়? আচ্ছা,জেনেই যখন গেছো তখন একটা ট্রিট তো তোমার পাওয়া উচিৎ তাইনা? ঠিক আছে,আমি আজকে সবাইকে আইসক্রিম খাওয়াচ্ছি।
ইশা আর সায়ান একে অপরের দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে বলে ওঠে,
_তাহলে ঠিক আছে।
এবার সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলো। ইশা যে এত সহজে রাগ কমিয়ে নেবে এটা ফাইজা আশা করেনি,তবে এখন সে খুশিই হয়েছে।
পূর্ণ সায়ান কে নিয়ে সবার জন্য আইসক্রিম আনতে চলে গেলো। মোহনা তখনি ফাইজার সামনে এসে উৎসাহ নিয়ে বললো,
_জানো আপু,আরেকটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটেছে আজকে।
_কি ঘটনা?
_নিরব ভাইয়া ইশাকে প্রপোজ করেছে!
ফাইজা অবাক হয়ে ইশার দিকে তাকিয়ে বলে,
_তুই এক্সেপ্ট করলি?
ইশা নিচের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেয়ে বলে,
_হ্যা, কালই কাজি অফিসে গিয়ে আমরা বিয়ে করে নিচ্ছি। তোমরা সবাই ইনভাইটেড।
#চলবে
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৩৯ (বোনাস পর্ব) (প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য উন্মুক্ত)
#মেহরিন_রিম
অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটলো। উভয় পক্ষের সম্পতিতে কবুল বলার মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা। ফাইজা হয়তো একসময় ভাবতেই পারেনি এই দিন তার জীবনে আসবে। তবে ঐযে, তার ভাগ্যে হয়তো পূর্ণর নামটা অনেক আগে থেকেই লেখা ছিল। তাই তাদের পরিণতি টাও হয়েছে ততটাই সুন্দর।
পূর্ণর সঙ্গে তার বোন আসতে চেয়েছিল,তবে ছোট বাচ্চা থাকায় তার পক্ষে আসাটা সম্ভব হয়নি। আর পূর্ণ নতুন জামাই হিসেবে একা শশুর বাড়িতে থাকতেও ইতস্তত বোধ করছিল, তাই আদৃত আর সায়ান কেও থাকতে বলেছে। সায়ান আগে থেকেই রাজি ছিল কারণ ফাইজার বিয়ে উপলক্ষে মোহনাও এ বাড়িতেই আছে। তবে আদৃত কিছুটা আপত্তি জানিয়েছিল,পরবর্তীতে রুকসানা জোড় করায় আর কিছু বলতে পারেনি।
শালা শালিদের আবদার মিটিয়ে অবশেষে ঘরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয় পূর্ণ। ঘড়ে ঢুকেই বুকে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পূর্ণ। এরপর দড়জা লক করে বিছানার দিকে তাকায়। ঘরটা খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো। বিছানার উপর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লাভ শেইপ আকা আর তার মধ্যে (F+P) লেখা। তার ঠিক পিছনেই হাটু ভাজ করে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে ফাইজা। মুখের উপর নাক অবধি লম্বা ঘোমটা টানা।
পূর্ণ স্মিত হেসে এগিয়ে যায়, ফাইজা সামনে বসে বলে,
_বিয়ে করলে যে এত ঝামেলা পোহাতে হয় সেটা জানলে ঠিকই পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলতাম।
ঘোমটার আড়াল থেকেও ফাইজার হাসিমাখা মুখখানা সামান্য দেখা গেল। পূর্ন মুচকি হেসে তার ঘোমটা মাথার উপর তুলে দিতেই ফাইজাও ধীরে ধীরে তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। ঠিম তখনি পূর্ণ বলে ওঠে,
_আরে,তাকালে কেন?
ফাইজা অবাক হয়ে বললো,
_তো,কি হয়েছে?
_তুমি আবার নিচের দিকে তাকিয়ে থাকো।
ফাইজা কিছু না বলে আবারো আগের মতো নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। পূর্ণ এবার ধীরেধীরে তার থুতনি টে হাত দিয়ে মুখটা উপরে তুলে বললো,
_মাশাল্লাহ…এইযে এবার ঠিক আছে।
ফাইজা এবারো ফিক করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে বললো,
_শুধু মাশাল্লাহ বললে চলবে না, নতুন বউয়ের মুখ দেখলে কিছু উপহার দিতে হয়।
_পুরো আমিটাই তো তোমার উপহার। যেকোনো ভাবে ইউজ করতে পারো আমাকে,আই ডোন্ট মাইন্ড।
_পূর্ন.. এসব বললে চলবে না,আমার উপহার দাও।
_আচ্ছা চোখ বন্ধ করে হাত পাতো।
ফাইজা পূর্ণর কথামতো চোখ বন্ধ করে হাত পাতলো। পূর্ণ বিছানা থেকে উঠে কিছু একটা এনে তার হাতে দিয়ে চোখ খুলতে বললো। ফাইজা হাসিমুখে চোখ খুললেও উপহার টি দেখে তার হাসি মিলিয়ে গেলো। চমকিত চোখে পূর্ণর দিকে তাকিয়ে বললো,
_বই!
_হ্যা বই..আগের বইটা তো পড়েছিলাম ই। তাই এই নতুন বইটা,ভীষণ ইন্টারেস্টিং। আমি দু পেজ পড়েছিলাম, তারপর রেখে দিয়েছি। ভাবলাম বিয়ের দিন রাতে একসাথে পড়বো,ভালো হবেনা বলো?
ফাইজা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললো,
_মানে আমরা সারারাত জেগে বই পড়বো?
_হ্যা,কোনো সমস্যা আছে?
ফাইজা দাঁত কিড়মিড় করে তাকায় পূর্ণর দিকে। তারপর পূর্ণদ হাতটা টেনে বইটা ঠাস করে হাতের উপর রেখে বলে,
_নাহ কোনো সমস্যা নেই। তুমি পড়ো বই,আমার ঘুম পেয়েছে। আমি ঘুমোবো..
_আচ্ছা ঠিক আছে ঘুমোও,এমনিতেও সারাদিন এ অনেক ধকল গেছে তোমার উপর দিয়ে।
ফাইজা এবার আরো বেশি অবাক হয়ে যায় তার সঙ্গে রেগেও যায়। ফাইজা চোখ সরিয়ে নেয় পূর্ণর থেকে। মাথায় থাকা ওড়নাটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে নেমে দাঁড়ায়। আবারো পূর্ণর দিকে তাকায়,তবে তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। ফাইজা কটমট চোখে তার দিকে তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিল এর সামনে গিয়ে টুলটা টেনে বসে পড়ে।
পূর্ণ এতক্ষন ঠোট কামড়ে নিজের হাসি আটকে রেখে ফাইজার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে। তবে এখন তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়বে। হাতে থাকা চুড়িগুলো টেনে টেনে খুলছে আর ড্রেসিং টেবিল এর উপর ছুড়ে ফেলছে। গলার হারটা নিয়েও টানাটানি করছে তবে খুলতে পারছে না।
পূর্ণ এবার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ফাইজার দিকে। ফাইজা নিচের দিকে তাকিয়ে থাকায় পূর্ণর অবস্থান লক্ষ্য করেনি।
ফাইজা এখনো হারটা নিয়ে টানাটানি করছে। পূর্ণ মুচকি হেসে ওর হাতটা সরিয়ে দেয়। ফাইজা চোখ তুলে তাকায় আয়নার দিকে। পূর্ণর ঠোঁটের কোণে হাসি স্পষ্ট, ফাইজা ছোটছোট চোখে তাকিয়ে থাকে আয়নার দিকে। পূর্ণ সেকেন্ডের মধ্যেই হারটা খুলে এনে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দেয়। স্থির কণ্ঠে বলে,
_ম্যাডামের আমার উপর রাগ হয়েছে বুঝি?
_র রাগ হতে যাবে কেন?
পূর্ন নিজের চোখে থাকা চশমাটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দেয়। এরপর ফাইজার দু’কাধে হাত রেখে আয়নার দিকে তাকায়। দুজনেই এখন দুজনকে আয়নায় দেখতে পাচ্ছে। পূর্ণ বাকা হেসে বলে,
_চশমা পড়লে নাকি আমাকে ভীষণ ভদ্র ভদ্র লাগে, তাই ভেবেছি চশমা পরে সবসময় নিজের ভদ্র রুপটাই প্রকাশ করবো। তবে তোমার বোধ হয় আমার ভদ্র রুপটা পছন্দ হচ্ছে না।
কিছুটা ঝুকে আসে পূর্ণ। ধীরেধীরে ফাইজার খোপায় থাকা ক্লিপগুলো খুলতে শুরু করে,কয়েক মিনিটের মধ্যে ক্লিপগুলো খুলেও ফেলে। এরপর আয়নার দিকে তাকিয়ে খোপাটা এক টানে খুলে ফেলে। কোমড় অবধি চুলগুলো ছড়িয়ে পরে,কিছুটা চুল সামনেও এসে পড়ে। পূর্ন সম্পূর্ন চুল একপাশে সরিয়ে ফাইজার ঘাড়ে মুখ ডোবায়,চোখ বন্ধ করে নেয় ফাইজা। পূর্ণ এবার ফাইজার কাণের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
_আমার অভদ্র রুপটা দেখতে চান ম্যাডাম।
ফাইজা আমতা আমতা করে বলে,
_আ আমি ব বলেছি কিছু?
_না বললে এখন বলো।
এক ঝটকায় পূর্ণকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় ফাইজা। অন্য দিকে ঘুড়ে বলে,
_বই পড়বে না তুমি?
পূর্ণ শব্দ করে হেসে ফাইজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ফাইজার গলা জড়িয়ে তাকে কিছুটা কাছে টেনে নিয়ে বলে,
_বই পড়া ছাড়াও অনেক ইম্পর্টেন্ট কাজ আছে, সেগুলো আগে কমপ্লিট করা উচিৎ?
এবার আর কথা বলতে পারলো না ফাইজা। পূর্ণ দিকে তাকাতেও পারলো না,তাই নিজের আশ্রয় খুজে নিলো পূর্ণর বুকে। মুচকি হাসে পূর্ন, অত:পর তার প্রেয়সী কে জড়িয়ে নেয় নিজের সঙ্গে। আজ রাতটা নাহয় তাদের নামেই হোক।
____
সোফায় সারিবদ্ধভাবে বসে আছে আদৃত,সায়ান, ফায়াজ। আর তার অপর পাশেই বসে আছে ইশা আর মোহনা। ঝামেলা হয়েছে এখানেই, ছেলেরা তিনজন আর মেয়েরা দুজন। ছেলেদের দলে একজন বেশি হয়ে যাচ্ছে।
ইশা দোড়ে গিয়ে ওর হাত ধরে আটকে দিয়ে বলে,
_না না না,আজকে তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না। সেই তো ভাবির সাথেই কথা বলতে যাবে। একদিন কথা না বললে কিছু হবে,এসো এখানে।
_কিন্তু মেম্বার তো মিলছে না।
_কোনো সমস্যা নেই,তুমি থাকবে নিরপেক্ষ দলে। আর নাহলে ছেলেদের দলেই থাকো। আমরা মেয়েরা দুজন ই যথেষ্ট। তাইনা মেহু?
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৩৪
#মেহরিন_রিম
শত্রুরা যেন পিছুই ছাড়ছেনা আদৃতের। যাদেরকে সহ্য করতে পারেনা তাড়াই বরং বারবার চোখের সামনে চলে আসছে। দশদিনের গ্যাপ নিয়ে একটা কনসার্ট করছে, কিন্তু এখানে নিরবের দেখা পাওয়ার কোনো মানে হয়! একেতো রিফাত এর কথা মাথা থেকে বের হচ্ছেনা, তার উপর নিরব কে দেখে আরো মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে আদৃতের। কনসার্ট চলাকালীন টাইমে খেয়াল না করলেও কনসার্ট শেষ হওয়ার কিছুক্ষন আগে দেখতে পায় নিরব এবং তার কিছু বন্ধুকে।
ব্যাস,মেজাজ টা তখনি বিগড়ে যায়। কনসার্টে আসা লোকজন বিশেষ করে মেয়েরা সেলফি তোলার অনেক চেষ্টা করছিল,কিন্তু আদৃতের এখন এই ক্রাউড এর মধ্যে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই। স্টেজ এর পিছন থেকে তাই কোনোভাবে বেড়িয়ে যায় আদৃত, অতঃপর সকলে হতাশ হয়ে চলে যায়।
একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে কনসার্ট ছিল, আদৃত সেখান থেকে বেড়িয়ে বাইক নিয়ে একটু সামনে চলে আসে। রাত হয়ে যাওয়ায় এখানে খুব একটা মানুষ নেই, তার উপর অন্ধকারে কেউ তাকে তেমনভাবে চিনতে পারবে না। একটা লেক এর পাশে বসে পকেট থেকে সিগারেট এর প্যাকেট টা বের করে আদৃত। মাথাটা একটু হালকা করা প্রয়োজন, সিগারেটে আগুন ধরিয়ে টান দিতে যাবে তখনি দেখতে পায় নিরব এবং তার বন্ধুরা এইদিকেই আসছে। বিরক্ত হয় আদৃত, বারবার সামনে চলে আসছে কেনো এরা? ওদের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সিগারেট এর ধোয়া ছাড়লো আদৃত। পকেট থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রোল করতে শুরু করে, তবে ফোনের দিকে তার বেশিক্ষণ খেয়াল থাকেনি। নিরব এবং তার তিনজন বন্ধু আদৃত এর থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে পড়ে,তারাও এখানে আদৃত কে খেয়াল করেনি। নিরবের সাথে থাকা একটা ছেলেকে আদৃত এর আগেও কলেজে দেখেছে।
আদৃত ফোনের দিকে চোখ রেখেই ওদের কথা শোনার চেষ্টা করলো।
নিরবকে খানিকটা মুড অফ করে থাকতে দেখে তার পাশে থাকা ছেলেটি তাকে সামান্য ধাক্কা দিয়ে বলে,
_একবার ছ্যাকা খেয়ে তোর এই অবস্থা ভাই! আর আমিতো এখন পর্যন্ত কতগুলো ছ্যাকা খাইলাম,কই আমি তো একদম ঠিক আছি।
নিরবকে চুপ করে থাকতে দেখে ছেলেটা আবারো বলে,
_আচ্ছা তুই সিরিয়াস রিলেশন এ যেতে চাস তাই তো? তাহলে তেমন মেয়ের সাথে যা।
নিরব ভ্রু কুঁচকে বলে,
_কেমন মেয়ে?
নিরবের অন্য পাশে থাকা আরেকটি ছেলে বলে,
_আরে মেয়েতো তোর চোখের সামনেই থাকে,তুই দেখতেই পারিস না।
_ক্লিয়ারলি বলবি তোরা?
_ও ইশার কথা বলছে, দেখ আই থিংক মেয়েটা যথেষ্ট সিরিয়াস থাকবে রিলেশনশিপ নিয়ে। আর ও তো তোকে অনেক আগে থেকেই লাইক করে,এটা তুই একটু হলেও জানিস।
_দেখ ফালতু কথা বলবিনা।
_ফালতু কথা কই বললাম ভাই? তুইও এখন সিঙ্গেল,আর ইশাও হয়তো সিঙ্গেল। তাহলে প্রবলেম টা কোথায়? আমার মনে হয় তুই একবার প্রপোজ করলেই ও এক্সেপ্ট করে নেবে।
_আর যদি না করে?
_সেটা তো আলাদা কথা,কিন্তু ট্রাই করতে ক্ষতি কি?
_বলছিস?
_হ্যা বলছি।
বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় আদৃত। হাতে থাকা ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। অন্যহাতে থাকা সিগারেট টা চেপে ধরায় হাতে ছ্যাকা লাগতেই সেটা দূড়ে ছুড়ে ফেলে দেয় আদৃত। অসহ্য লাগছে তার, কোথায় মাথা ঠান্ডা করতে এখানে বসেছিল সেখানে হলো উল্টোটা।
দ্রুতপায়ে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিলো আদৃত, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি স্পীড এ বাইক চালাচ্ছে সে। বাহিরের শীতল বাতাসেও তার মাথা বিন্দুমাত্র ঠান্ডা হচ্ছেনা।
বাইক গ্যারেজে রেখে লিফট এ উঠে পড়লো আদৃত। চুল টেনে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। দড়জা খুলে ফ্লাট এ ঢুকে শব্দ করে দড়জা আটকে দেয় সে। ডাইনিং রুমের লাইট জ্বলছে আর বাকি সব লাইট নেভানো। আদৃত নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় বসে দুহাতে মাথা চেপে ধরে। আজকের দিনটাই খারাপ তার জন্য। সকালে রিফাত এর ঘটনা, আর এখন নিরব তো সব সীমাই ছাড়িয়ে গেলো। যদিও সেদিন ইশার কথা শুনে মনে হয়নি তার মনে নিরব এর জন্য কোনো ফিলিংস অবশিষ্ট আছে, তবুও ভয় হচ্ছে আদৃত এর।
কিছুক্ষন আগে পর্যন্ত রিফাত কে নিজের শত্রু মনে হচ্ছিল আদৃতের কাছে,তবে নিরব কে এখন তার চেয়েও বড় শত্রু মনে হচ্ছে। কি করা উচিৎ তার? বলে দেবে ইশাকে তার মনের কথা? কিন্তু কি করে? যার সাথে ঝগড়া ছাড়া কোনো কথা বলেনি এখনো তাকে কি করে ভালোবাসার কথা বলবে?
বেশ চিন্তায় পরে গেলো আদৃত,মায়ের কথা মনে পরছে খুব। মায়ের কথা ভাবতেই একজনের কথা মনে পরলো আদৃতের। মাথা থেকে হাত সরিয়ে কিছুক্ষন চিন্তা করলো, মনে হলো সেই ব্যাক্তি আদৃতকে কিছু উপায় বলতে পারবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো আদৃত,কাল ই যাবে তার সাথে কথা বলতে।
____
পূর্ণর সামনে নিজের কান্না নিয়ন্ত্রন করলেও বাড়িতে এসে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। কথাগুলো কিভাবে বলেছে সেটা কেবল ফাইজাই জানে। অতি কষ্টে আটকে রাখা কান্নাগুলো যেন এখন আর বাঁধ মানছে না। ইশার কিছুটা মাথা ব্যাথা থাকায় সে নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছে,নাহলে সে এতক্ষনে ঠিকই ফাইজার ঘরে চলে আসতো।
হাটুতে মুখ গুজে কাঁদছে ফাইজা। আগের চেয়েও যেন এখন বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। আগে জানতো পূর্ণ তাকে ভালোবাসেনা,তাই নিজের মনকে শান্ত রাখতে পেরেছিল। কিন্তু এখন কি করে শান্ত হবে, যেখানে সে নিশ্চিত পূর্ণ তাকে ভালোবাসে। যদি তাকে নাই পাওয়ার ছিলো, তাহলে কেন নতুন করে আশা জেগেছিল মনে?
রাতে আর খাওয়া হলোনা ফাইজার,কাঁদতে কাঁদতে একসময় ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়লো সে। এই সময়টুকুই হয়তো কষ্টগুলো ভুলে থাকতে সক্ষম হবে সে।
___
জানালা থেকে আসা সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় ফাইজার। চোখ খুলে মাথা তুলতেই বুঝতে পারে তার মাথা ভার হয়ে আছে। বিছানায় হাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। এত আলো তার ভালো লাগছে না,তাই গিয়ে জানালার পর্দা টেনে দেয় সে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দড়জা খুলে দেয় সে। ইশা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি দেখে নিচে চলে আসে। রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে পায় রুকসানা অনেক ধরণের নাস্তা বানাচ্ছেন। ফাইজা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
_এত কিছু কার জন্য করছো ছোট আম্মু? ছোট আব্বু আসবে নাকি?
রুকসানা ফাইজার দিকে তাকিয়ে বলে,
_না না তোর ছোট আব্বু নয়। ভাইয়া ভাবি আসছে, কতদিন পর আসছে বলতো!
ফাইজা চোখ বড়বড় করে বলে,
_আব্বু আম্মু আসছে?
_হ্যা..
_কখন? আমি তো কিছু জানিনা।
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৩৫+৩৬
#মেহরিন_রিম
ফাহমিদার কথা শুনে রুকসানা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে হাসতে শুরু করলো। ফাহমিদা অবাক হয়ে তাকাতেই রুকসানা হাসি থামিয়ে বললো,
_আপনি পারেন ও ভাবি, ফায়াজ এর সঙ্গে ইশার বিয়ে! হাসালেন..
তাদের কথার মাঝে এবার জাফর বললো,
_হাসির কি আছে এখানে? মেয়েকে তো একদিন বিয়ে দেবেই,তাহলে পরিবার এর মধ্যে বিয়ে দিলেই তো ভালো হয়।
_আপনি নিজেও জানেন ভাইয়া, ফায়াজ এর কাছে ফাইজা আর ইশা দুজনেই সমান। আর ইশাও ওকে বড় ভাই হিসেবে যথেষ্ট ভালোবাসে। এত সুন্দর সম্পর্কটা কে আমি নষ্ট করতে চাইছিনা..
ফাহমিদা আরো কিছু বলবে তার আগেই ফাইজা তার কাছে গিয়ে হাত ধরে বলে,
_আরে ছোট আম্মু তুমি ছাড়তো,আম্মু তো মজা করছিল। তাই না আম্মু?
ফাহমিদা কড়া চোখে ফাইজার দিকে তাকায় তবে রুকসানা ফাইজার কথা শুনে হেসে টেবিলে সবকিছু গোছাতে শুরু করে। ফাহমিদা ফাইজার উদ্দেশ্যে কিছু বলার আগেই ফাইজা তার হাত ধরে দাড় করিয়ে বলে,
_আম্মু এক্ষুনি আমার সঙ্গে ঘরে চলো, মাথা নষ্ট হয়ে গেছে তোমার।
ফাইজা ফাহমিদার হাত ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে দড়জা আটকে দিতেই ফাহমিদা রাগান্বিত স্বরে বলে,
_তুই বললি কেন আমি মজা করছিলাম?
_তোমার সম্মান বাঁচানোর জন্যই বলেছি।
_মানে?
_তুমি জানোনা ভাইয়া একটা মেয়েকে আগে থেকে ভালোবাসে,দেশে ফিরে তো তাকেই বিয়ে করবে বলেছে। আর সেখানে তুমি এসেছো ইশার সঙ্গে ওর বিয়ে দিতে!
_পছন্দ করেছে তো কি হয়েছে,বিয়ে তো আর করে ফেলেনি।
_আম্মু প্লিজ,আর নিচে নেমোনা।
_ফাইজা,আমি তোর মা। আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারিস না তুই।
_এটাই তো,তুমি আমার মা বলেই তোমার এসব কার্যকলাপে আমার লজ্জা লাগে। ভাইয়া তো এসব কিছু জানেই না,জানলে কি হবে বুঝতে পারছো?
ফাহমিদা প্রতিত্তরে কিছু বলার আগেই ফাইজা আবারো বলতে শুরু করে,
_আমি তোমার মেয়ে মা, তোমার কি মনে হয় আমি তোমার প্ল্যান সম্পর্কে কিছু জানিনা? সবই জানি আমি, ছোট আব্বুর বেশিরভাগ সম্পত্তি ইশার নামে করা,আর এটাই তুমি সহ্য করতে পারছো না। নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পারলে ঘুরেফিরে সবটা তোমরাই পেয়ে যাবে। সেইজন্যই তো ইশার সঙ্গে ভাইয়ার বিয়ে দিতে চাইছো তাইনা?…
_ফাইজা…অনেক বেশি কথা বলছিস আজকাল।
_বাধ্য হচ্ছি বলতে। কখনো কোনো কিছু নিয়ে তোমাদের কিচ্ছু বলিনি আমি, কিন্তু এই বিষয়ে আর একবারো কথা বললে আমি সবকিছু ভাইয়াকে জানাতে বাধ্য হবো। তোমার ছেলে এগুলো জানতে পারলে কিন্তু আর কখনো দেশে ফিরবে না আম্মু,এইটুকু সিওর থাকতে পারো।
_আমাকে হুমকি দিচ্ছিস তুই?
_ধরে নাও তাই।
আর এক সেকেন্ড ও রুমে দাঁড়ালো না ফাইজা। দড়জা খুলে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে, আর ফাহমিদা একই যায়গায় দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসতে থাকলেন।
____
ফাহমিদা আর জাফর ডাক্তার দেখিয়ে সেখান থেকেই বাড়ি চলে যাবে। ফাইজা বোধহয় একমাত্র মেয়ে যে কিনা বাবা মায়ের সঙ্গে থাকতে চায়না, তাদের থেকে দূড়ে থাকলেই সে ভালো থাকে। যথেষ্ট শক্ত মনের মেয়ে ফাইজা, তবে সবসময় সেটা ধরে রাখা যায়না। কিছু কিছু সময় সেও নিজেকে সংযত রাখতে পারেনা। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে ইশার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে ফাইজা। ইশার সঙ্গে থাকলে কষ্ট করে হলেও নিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতে সক্ষম হয় সে।
ইশা বসেবসে ফোনে গেইমস খেলছিল। ফাইজা তেল দেওয়া শেষে হাত ধুয়ে আসতে যাবে তখনি দেখে তার ফোনটা বাজছে। সাইলেন্ট করা বোধ হয় তাই শুনতে পায়নি। ফাইজা ফোনটা রিসিভ করে বলে,
_হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
_…..
_হ্যালো? কে বলছেন?
_……
ফাইজা ভ্রু কুচকে ফোনটা সামনে আনে, একটা অপরিচিত নম্বর। ফাইজা আরো কয়েকবার হ্যালো বলার পরও কোনো উত্তর না পেয়ে বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দেয়। বিছানার উপর ফোনটা রেখে হাত ধুয়ে এসে দেখে একই নম্বর থেকে একটা মেসেজ এসেছে। ফাইজা মেসেজ চেক করে দেখে,
_একবার দেখা করতে চাই আমি। একই জায়গায়,বিকেল ৫ টায়। থাকবে প্লিজ..
হৃদয় জুড়ে আবারো বিষাদ ছড়িয়ে যায়। মেসেজ টা থেকে বেড়িয়ে বিছানায় বসে পরে ফাইজা, কলটাও তাহলে পূর্ণই করেছিল। কিন্তু সে যাবেনা, ফোনটা হাতে নিয়ে ‘না’ লিখেও মেসেজ সেন্ড করলো না ফাইজা। যাওয়া উচিৎ?
____
গতকালকের সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ফাইজা এবং পূর্ণ। তবে আজ তারা মুখোমুখি দাঁড়ায়নি,দুজনে পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে। অনেক জল্পনা কল্পনার পর ফাইজা এসেছে পূর্নর কথায়,পূর্ণ জানতো ফাইজা আসবে।
পূর্ণ পাশ ফিরে ফাইজার দিকে তাকিয়ে বলে,
_বলতে বলছো? তাহলে শুধু আমিই বলবো আজ, তুমি শুনবে।
ফাইজা তাকায়নি পূর্ণর দিকে,পূর্ণ এবার বুকে হাত গুজে ফাইজার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,
_জানো আমি না কখনো জীবন নিয়ে খুব বেশি ভাবি ই নি।শুধু ভেবেছি, আমি স্বেচ্ছায় এই প্রফেশনে এসেছি, আর এখানে থেকে মৃত্যুকে ভয় পেলে চলবে না। বাবা-মা এর বয়স হয়েছে,আর আমি না থাকলেও আমার বোন ওদের দেখে রাখবে এটা আমার বিশ্বাস। তাই আমি নির্ভয়ে যেকোনো রিস্ক নিতে পেরেছি। আমার মনে হয়েছে,কারোর জীবন আমার সঙ্গে জড়িয়ে থাকলে আমি কাজে মনোযোগ দিতে পারবোনা,এই রিস্কগুলো নিতে পারবোনা। আর সেই কারণেই আমি এসব থেকে নিজেকে দূড়ে সরিয়ে রেখেছি, তবে হ্যা তোমার কথাও কোনো অংশে ভুল ছিলোনা।
থামলো পূর্ণ, বড় নিঃশ্বাস নিয়ে আবারো বললো,
_আমি অনেক বুঝিয়েছি নিজেকে, আমি যেমনটা চেয়েছিলাম সবটা সেভাবেই হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরে গিয়ে আমার মনে হলো, আমারো জীবন নিয়ে ভয় করা উচিৎ।
এরক্ষনে এই প্রথম পূর্ণর দিকে তাকালো ফাইজা। পূর্ন আবারো বললো,
_ফাইজা আমার না হুট করে ভীষণ বাঁচতে ইচ্ছে করছে, তবে একা নয়…তোমার সঙ্গে। নিজেকে সুরক্ষিত রাখার একটু বেশিই চেষ্টা করবো নাহয়। যেসব জায়গায় একা যেতাম সেখানে অন্য একজনকে সাথে নিয়ে যাবো নিজের সেফটির জন্য। নিজেকে ঠিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো…
ফাইজা চুপচাপ কেবল পূর্নর কথা শুনছে। পূর্ণ এবার “এক সেকেন্ড” বলে বেঞ্চে থাকা ব্যাগ থেকে সেই বইটা বের করে ফাইজার সামনে ধরে বললো,
_অন্য মেয়েদের চেয়ে তোমাকে একটু বেশি ই চিন্তায় থাকতে হবে। হয়তো হুট করে আমার কোনো খোজ পাবেনা, তখন ধৈর্য ধরে আমার ফেরার অপেক্ষায় থাকতে হবে। আমি ঠিক আছি কিনা ভেবেই তোমার দিনের অর্ধেক সময় কেটে যাবে, নিশ্চিন্তে তুমি কখনোই থাকতে পারবেনা। দিনশেষে আমি তোমার সামনে এসে দাঁড়ালে স্বস্তি পাবে তুমি। আমি জানি, তুমি এই সবগুলোর জন্য প্রস্তুত। তবুও জিজ্ঞেস করছি, এতটা স্যাক্রিফাইস স্বিকার করে ভালোবাসবে আমায়?
ফাইজা এখনো চুপ করে আছে। পূর্ন এবার কিছুটা অসহায় ভঙ্গিতে বলে,
_একটার জায়গায় প্রয়োজনে দুটো রিভলভার সাথে রাখবো..
এতক্ষন চুপ করে থাকলেও এবার ফিক করে হেসে দিলো ফাইজা। মুখে হাত দিয়ে নিজের হাসি লুকোনোর চেষ্টা করলো। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
_মেয়েদের গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করতে হয়।
_ইউনিক মানুষ ইউনিকভাবেই প্রপোজ করে।
_তাই না? আর আমি কেনই বা এক্সেপ্ট করবো তোমাকে? কম কষ্ট দিয়েছো আমায়?
বইটা বেঞ্চের উপর রেখে দিলো পূর্ণ। এরপর ফাইজার দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে মৃদু হেসে বললো,
_কষ্ট যখন আমি দিয়েছি,এবার ভালোবাসার সুযোগটাও আমাকেই দাও।
ফাইজা কিছুটা ধরা গলায় বললো,
_বলো আর কখনো কষ্ট দিবে না আমায়, তাহলে ভেবে দেখবো।
মাথা নাড়লো পূর্ণ। ফাইজা এবার আর সামলাতে পারলো না নিজেকে, পূর্ণকে জাপটে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো সে। পূর্ণ বাধা দিলোনা, কাঁদুক একটু। মাঝে মাঝে কান্নাও সুখের হয়।
____
গতকাল অফিসের কাজে ব্যাস্ত থাকায় আর সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষের কাছে আসা হয়নি আদৃতের। তাই আজ অফিসের কিছু কাজ সেরেই চলে এসেছে আশ্রমে। সেদিন রাতে আয়শার কথাই মনে পড়েছিল, হয়তোবা উনি কোনো সাজেশন দিতে পারবেন। তাই ওনার কাছেই যাচ্ছে আদৃত।
আশ্রম এ ঢুকে আশেপাশে তাকিয়ে আয়শাকে খোজার চেষ্টা করলো আদৃত,তবে তাকে কোথাও দেখা গেলো না। ভিতরে যেতেও কিছুটা আনইজি ফিল হচ্ছে। তাই কয়েক মিনিট আশ্রমের উঠানের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো। ভাগ্য ভালো ছিলো আদৃতের,মিনিত দু’একের মধ্যেই আয়শা আশ্রমের ভিতর থেকে বেড়িয়ে এলো কোনো এক কাজে। আদৃত তাকে দেখতে পেয়েই খুশি হয়ে উঠানের মাঝে আয়শার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়শা আদৃতের দিকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করব বললো,
_তুমি..
_আমি আদৃর আন্টি, সেদিন ইশার সাথে..
_ওহ হ্যা,মনে পড়েছে। কেমন আছো বাবা?
আদৃত মুচকি হেসে বললো,
_খুব একটা ভালো নয়।
আয়শা চিন্তিত হয়ে বললেন,
_ওমা কেন?
_ভালো থাকার সাজেশন এর জন্যই এসেছি আপনার কাছে।
_আমার কাছে, আচ্ছা তুমি দাড়াও আমি চেয়ার নিয়ে আসছি।
কথাটা বলে আয়শা আশ্রমের ভিতর থেকে দুটো চেয়ার নিয়ে এলেন। আদৃত গিয়ে বসার পর আয়শাও পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। আদৃতের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
_এবার বলো কি হয়েছে, দেখি তোমার কোনো সাহায্য করতে পারি কিনা।
আদৃত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। নিজের ব্যাক্তিগত জীবনের কথা সে কাউকে খুব বেশি জানায় না। তবে আজকে আয়শার কাছে বলতে কোনো দ্বিধাবোধ করছে না সে। অত:পর, একে একে সবকিছু খুলে বললো আয়শাকে।
তবে আশ্চর্যজনক ভাবে সবটা শোনার পর আয়শা কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন। আদৃত সবকিছু বলার পড় কিছুটা থেমে আবারো আয়শার উদ্দেশ্যে বললো,
_আমি কি করবো সেটাই বুঝতে পারছিনা আন্টি,তাই আপনার কাছে..
_ইশাকে ভালোবাসো তুমি?
সামনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় কথা বললেন আয়শা। আদৃত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছোট করে উত্তর দিলো,
_হ্যা..
আয়শা অদ্ভুত ভাবে আদৃত এর দিকে তাকিয়ে বললেন,
_কি করে নিশ্চিত হচ্ছো? ভালোবাসা তো কদিন বাদে ফুঁড়িয়েও যেতে পারে।
আদৃত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
_আপনি হঠাৎ এমন কথা জিজ্ঞেস করছেন যে..
তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো আয়শা। চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,
_আমাকেও তো একজন ভালোবেসেছিল। আমার জন্য বাড়ি পর্যন্ত ছেড়েছিল। ছোট্ট টিনের ঘরে আমাদের সুখের কোনো কমতি ছিল না। তবে সেই সুখ, ভালোবাসা সবই ছিল ক্ষণস্থায়ী। ভালোবাসা ফুড়িয়ে গেলো, আর আমার প্রয়োজন ও। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো বাড়ি থেকে।
আদৃত এর দিকে তাকালো আয়শা, শক্ত গলায় বললো,
_তোমার ভালোবাসা যে স্থায়ী হবে তার কি কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবে?
আদৃত নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
_আপনার সাথে যা হয়েছে তা অবশ্যই ভালো হয়নি। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে তো তা নাও হতে পারে আন্টি। আমি ইশাকে কতটা ভালোবাসি জানিনা। কিন্তু ভালো থাকার জন্য, ভালোভাবে বাঁচার জন্য আমার ওকে চাই।
মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলো আয়শার, হঠাৎ করেই তার মুখের কঠিন ভাব কেটে গেলো। মুচকি হেসে আদৃতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
_তাহলে যাকে ভালোবাসো তাকে একেবারে নিজের কাছেই নিয়ে এসো।
আদৃত অবাক হয়ে বললো,
_আপনি কি কোনোভাবে বিয়ে করার কথা বলছেন?
_অনিশ্চিত সম্পর্কের চেয়ে সেটা ভালো নয় কি?
_কিন্তু ইশা এখনো অনেকটা ছোট,ওর মা বাবাই বা এত কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিতে যাবে কেন?
_ঠিকই বলেছো। তাহলে মনে সাহস জুগিয়ে বলে দাও নিজের মনের কথা।
_ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা হলো সাপেনেউলে সম্পর্ক। সেখানে আমি এমন কিছু কি করে বলি আন্টি?
_তাহলে বন্ধুত্ব করো ওর সঙ্গে, ইশার সাথে বন্ধুত্ব করা কিন্তু খুব একটা কঠিন কাজ নয়।
_চেষ্টা করে দেখতে পারি।
আয়শা মুচকি হেসে বললেন,
_এতো চিন্তা করোনা, যে তোমার তাকে তোমার থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবেনা।
স্মিত হাসলো আদৃত। কিছুটা শান্তি লাগছে এখন, আয়শার সাথে আরো কিছুক্ষন কথা বলে আশ্রম থেকে বেড়িয়ে আসে আদৃত। তবে বাইকের কিছুটা দূড়ে থাকতেই দেখতে পারে ইশা আর মোহনা এদিকেই আসছে। এখন ইশার সামনে পড়ার ইচ্ছে নেই,তাই একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আদৃত।
_আমি তোকে আন্টিমনির কথা বলেছিলাম না? আন্টিমনি এই আশ্রমেই থাকে,চল আজ তোর সঙ্গে দেখা করাবো তার।
_হ্যা চল, অনেকতো গল্প বললি আন্টিমনির। এবার একটু সামনাসামনি ও দেখে নেই।
কথাটা বলে রাস্তা পার হতে যাবে তখন তাদের সামনে এসে হাজির হয় রিফাত। ইশাকে দেখে মেকি হেসে বলে,
_বাসায় যাচ্ছিস বুঝি?
ইশা হেসে উত্তর দেয়,
_হ্যা ভাইয়া,কলেজ থেকেই ফিরছি।
রিফাত এক হাত পিছনে রেখেছিল। ইশাকে এদিকে আসতে দেখেই পাশের গাছ থেকে একটা ফুল ছিড়ে এনেছে সে। রিফাত কিছুটা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলে,
_আসলে তোকে কয়েকদিন ধরেই একটা কথা বলবো ভাবছি,কিন্তু বলা হয়ে উঠছে না।
মোহনা ইশার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলো। ইশা রিফাত এর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
_আরে ভাইয়া বলে দাও কি বলবে,এত লজ্জা পাচ্ছো কেন?
রিফাত এবার সাহস সঞ্চয় করে ইশার সামনে হাটু গেড়ে বসে ফুলটা এগিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,
_ফুলের ন্যায় দেখতে তুমি, চাঁদ মাখা সেই হাসি….
সত্যি করে বলছি আমি,তোমায় ভালোবাসি!..
হা করে রিফাতের দিকে তাকিয়ে রইলো মোহনা। ঘাড় ঘুরিয়ে ইশার দিকে তাকিয়ে দেখলো তার ও একই অবস্থা। রিফাত দাঁত বের করে হেসে বললো,
_ইশা,কিছু বল..
মুখ বন্ধ করে নেয় ইশা। তারপর তড়িঘড়ি করে বলে,
_আরে কি করছো,ওঠো ওঠো..
রিফাত উঠে দাড়ানোর পর ইশা চট করে ওর হাত থেকে ফুলটা নিয়ে নেয়। মেকি হেসে বলে,
_ফুলটা খুব সুন্দর..প্রপোজ টাও খুবইইই সুন্দর ছিলো। কিন্তু..
_কিন্তু?
ইশা হতাশ ভঙ্গিতে নিজের বাম হাতটা উপরে তুলে বলে,
_আমিতো এনগেইজড…
#চলবে
_তোর ফোন কোথায় রাখিস? ভাবি বললো তোকে ফোনে পাচ্ছে না। আর আমিও জানতাম না তো,ভাবি ভোরবেলা ফোন দিয়ে বললো ভাইয়ার হাটু ব্যাথাটা একটু বেড়েছে তাই ডাক্তার দেখাতে আসছে। এইতো এক্ষুনি চলে আসবে, তুই একটু হাতেহাতে কাজ করে দে না মা। না থাক,তুই গিয়ে বরং ইশাকে ডেকে দে। বন্ধ পেয়ে আর ঘুম থেকেই ওঠার নাম নেই।
_হুম যাচ্ছি।
ফাইজা রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে ইশার রুমের দিকে যেতে লাগলো। তবে তার চিন্তা হচ্ছে, আদতেও কি তারা ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যেই আসছে নাকি অন্য কাজে? ভাবতে ভাবতেই ইশার ঘরে চলে এলো ফাইজা,এখন ইশাকে ঘুম থেকে ওঠানোও আরেকটা যুদ্ধ..
দশমিনিট এর মধ্যেই ফাইজার বাবা মা অর্থাৎ জাফর সাহেব এবং ফাহমিদা বাড়িতে প্রবেশ করলেন। রুকসানা তাদের আপ্যায়নে ব্যাস্ত,ফাইজাও তাকে কিছু কাজে সাহায্য করছে। তবে তার নজর বাবা মায়ের দিকে, তাদের হাবভাব ভালো ঠেকছে না। নিজেরা ফিসফিস করে কোনো বিষয়ে আলোচনা করছে।
ইশাকে ঘুম থেকে ওঠাতে ব্যার্থ হয়েছে ফাইজা,আজ ছুটির দিন তাই সে বারোটার আগে ঘুম থেকে উঠবেনা। টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে জাফর আর ফাহমিদা কে ডেকে আনলো ফাইজা। তাড়াও হাসিমুখে ডাইনিং টেবিল এ বসে নাস্তা করতে করতে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললো। তবে ফাইজা আছে অন্য চিন্তায়, আর তার ধারণা সত্যি প্রমাণিত হলো কিছুক্ষন পরেই।
ফাহমিদা রুকসানার উদ্দেশ্যে বললেন,
_ইশা তো বড় হচ্ছে,ওর বিয়ের কথা কিছু ভেবেছো নাকি?
রুকসানা হেসে উত্তর দেয়,
_ওর তো এখনো বিয়ের বয়স ই হয়নি ভাবি। আগে ভার্সিটি তে উঠুক,তারপর ভাববো এই নিয়ে।
ফাহমিদা জাফর এর দিকে একনজর তাকিয়ে আবারো রুকসানার দিকে তাকিয়ে বললো,
_বলছিলাম যে, আমাদের মেয়ে আমাদের কাছে থাকলেই ভালো হয়না?
_ভাবি ঠিক কি বলতে চাইছেন বুঝলাম না..
_আমার ছেলেও তো বড় হয়েছে, তাই ভাবছিলাম ফায়াজ এর সঙ্গে ইশার বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হয়।
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৩২
#মেহরিন_রিম
দ্বিতীয় ক্লাস করার কথা থাকলেও মোহনার আর আজকে কলেজে যেতে ইচ্ছে করেনি। সায়ান কে বলেছে আজকে সে ঘুড়তে যাবে। সায়ানও আর মানা করেনি, এই কদিনে মোহনার সঙ্গে কথা না বলতে পারায় সে নিজেও অস্থির হয়্ব উঠেছিল। তাই আজ তাড়া ঘুরবে ফিরবে মজা করবে। মোহনার একটু চিন্তা হচ্ছিল,যদি পরিবারের কেউ দেখে ফেলে? পড়ে ভাবলো তার বাবা অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছেন,আর মা বাসা ফাকা রেখে কোথাও বের হবেনা। তাই চিন্তার তেমন কোনো কারণ নেই।
অত:পর যেই ভাবা সেই কাজ,দুজনে মিলে কলেজ শেষ হওয়ার সময় পর্যন্ত ঘুরবে।
ইশা মোহনারকে ইচ্ছে করেই বলেছিল সে আজ কলেজে যাবেনা। তবে এমন কিছুই নয়, ইশা দিব্যি সুস্থ এবং নাচতে নাচতে কলেজে এসেছে। রাতে অনেক চিন্তা ভাবনার পড়ে সায়ান কে ফোন দেওয়ার চিন্তা করেছিল ইশা। কিন্তু সায়ান এর নম্বর না থাকায় বহু কষ্টে আদৃত এর নম্বর খুজে বের করে তাকে কল দেয়,আর তার কাছ থেকে সায়ান এর নম্বর কালেক্ট করে।
সায়ানের সাথে কথা বলার পর ইশা বুঝতে পারে তার ধারণাই ঠিক ছিলো। মোহনা পুড়ো কথা না শুনেই সায়ান কে ভুল বুঝেছে। তখন ই ইশা প্ল্যান করে আজকে মোহনাকে একা একা কলেজে পাঠাবে,আর তখনই সায়ান এসে ওকে নিয়ে গিয়ে সব সত্যিটা খুলে বলবে।
একদিক থেকে খুশি হলেও একা একা ক্লাস করতে মোটেই ভালো লাগছে না ইশার। সে যথেষ্ট মিশুক হলেও মোহনা ছাড়া কারোর সাথেই খুব বেশি কথা বলেনা। ক্লাসমেট হিসেবে যতটা বলার ততটাই বলে, আর কলেজে তো আগের ফ্রেন্ডদের ও পাচ্ছেনা। তাই পুড়ো ক্লাস চুপচাপ বসে ক্লাস করতে হয়েছে ইশাকে।
ছুটির পরও ভালো লাগছে না ইশার,আজকে আর কোনো ব্যাচ নেই। তাই এখান থেকেই বাসায় যাবে,মোহনা যেহেতু আসেনি তাই তাকে একা একাই যেতে হবে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ইশা। কলেজের বাইরে বের হতেই বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো আদৃত কে। ইশা ভেংচি কেটে অন্যদিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,
_এই লোকের কি কোনো কাজ নেই?
_তোমার চেয়ে বেশি কাজ আছে আমার।
ইশা পাশ ফিরতেই দেখতে পেলো আদৃত বুকে হাত গুজে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এত আস্তে বললো কথাটা তাও আদৃত শুনে ফেললো! আর উনি তো এখন ই বাইকের পাশে ছিলো,এখানে এলো কি করে?
হা করে তাকিয়ে এসব ভাবতে লাগলো ইশা। আদৃত মনে মনে হেসে ইশার মুখের সামনে তুড়ি বাজাতেই তার চিন্তা ভঙ্গ হলো। সঙ্গে সঙ্গে ইশা চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো।
আদৃত চোখে থাকা সানগ্লাস টা খুলে বললো,
_এবার বলো, রাত বারোটার সময় আমার ঘুম নষ্ট করলে কেন?
ইশা কপাল কুঁচকে বলে,
_এই যুগে রাগ বারোটার সময় কোন ব্যাক্তি ঘুমায়?
_সায়ান এর নম্বর নিয়েছিলে কেন?
_আপনার বন্ধুকেই জিজ্ঞেস করে নেবেন।
কথাটা বলেই পায়ের কদম ফেলে সামনে এগোতে থাকে ইশা। আদৃত তার সঙ্গে যেতে যেতে বলে,
_তোমার কি মনে হয় আমি না জেনে এসেছি?
_সব জানতে আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?
_ঘটকালি করা আবার কবে থেকে শুরু করলে তুমি?
ইশা হাঁটা থামিয়ে আদৃতের দিকে তাকিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
_ঘটকালি কোথায় করলাম আমি?
_এইযে মিলিয়ে দিলে দুজনকে,ঘটকালি ই তো করলে।
_মোটেই না। ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে, একটা ভুল ধারণার জন্য ওরা আলাদা হয়ে যাবে এটা তো হতে পারেনা তাইনা!
_তুমি এতো সিওর হচ্ছো কি করে যে ওরা আসলেই একে অপরকে ভালোবাসে?
_মোহনা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড,তাই ওর দিকটা তো আমি বুঝতে পারবোই। আর সায়ান ভাইয়াকে দেখেও আমার তেমনটাই মনে হয়েছে।
_দেখেই বুঝে গেলে ও মোহনাকে ভালোবাসে?
_এগুলো বোঝা যায়,কিন্তু আপনি বুঝবেন না।
মুখ ঘুরিয়ে মুচকি হাসলো আদৃত। তার হাসি দেখে ইশা সন্দিহান চোখে তাকালো। আদৃত ইশার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখন ই তার পিছন থেকে একটা ছেলে ইশার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
_ইশা না?
ইশা ঘাড় বাঁকিয়ে আদৃত এর পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেলো সেখানে হাস্যজ্জল মুখে দাঁড়িয়ে আছে রিফাত। ইশা তাকে দেখে অবাক হয়ে তাকালো। আদৃত ও ইশার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো রিফাতের দিকে। রিফাত এতক্ষনে ইশার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
_কিরে? চিনতে পারিসনি আমাকে?
ইশা এবার হেসে বলে,
_আরে কি বলো! চিনবোনা কেনো? কিন্তু তুমি না ক্যানাডা ছিলে,দেশে কবে আসলে?
_এসেছি দুদিন হলো, আমার কাজিন এই কলেজেই পড়ে। ওকেই নিতে এসেছিলাম, কিন্তু তোর সাথেও দেখা হয়ে গেলো। কেমন আছিস বল..
_আমি তো অলওয়েজ ভালোই থাকি ভাইয়া।
_বাসায় আসিস না কেনো? আগে তো আমাদের বাসায় এসেই বসে থাকতি।
আদৃত বিস্ফোরিত চোখে ইশার দিকে তাকালো, এই মেয়ে কিনা পড়াশোনা নিয়ে ব্যাস্ত থাকে! এটাও বিশ্বাস করতে হবে? ইশা একবার আড়চোখে আদৃত এর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। রিফাত এখনো আদৃত কে তেমনভাবে খেয়াল ই করেনি। রিফাত তার হাসি চওড়া করে বলল,
_আমিতো তোকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারিনি, কত বড় হয়ে গেছিস। তবে হ্যা,এখন কিন্তু তুই আগের চেয়েও বেশি সুন্দর হয়ে গেছিস।
_আগে অসুন্দর ছিলাম বুঝি?
_তা কখন বললাম,তুইতো ছোট থেকেই অনেক কিউট।
ইশা নিজের বিনুনি ঝাপটা মেড়ে ভাব নিয়ে বললো,
_আই নো আই এম সো কিউট..
আদৃত ছোটছোট চোখে রিফাত এর দিকে তাকিয়ে আছে, তার কথাবার্তা আদৃত এর কাছে কেমন যেনো অসহ্য লাগছে। এত প্রশংসা করার কি আছে আজব!
রিফাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
_ছুটি হয়ে গেছে তাইনা? আচ্ছা আমি যাই হ্যা, বাসায় আসিস কিন্তু।
_তুমিও এসো,আম্মু খুশি হবে।
রিফাত বিরবির করে বললো,
_মনে হচ্ছে যেতেই হবে।
_কিছু বললে?
_নাহ তো,আচ্ছা যাবো।
রিফাত ইশার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে চলে গেলো কলেজের ভিতরে। রিফাত এর বলা কথাটা ইশার কর্ণগোচর না হলেও আদৃত তা স্পষ্টভাবেই শুনতে পেরেছে। রিফাত চলে যেতেই আদৃত ইশার দিকে তাকিয়ে বললো,
_কে ও?
_আমাদের প্রতিবেশী,ভাইয়া অনেকদিন পর ক্যানাডা থেকে ফিরেছে। ওয়েট,আপনি জিজ্ঞেস করছেন কেন?
আদৃত কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই ইশা কথা ঘুরিয়ে বললো,
_আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন এখানে?
_রাস্তাটা তোমার কেনা নয়।
ইশা মুখ ফুলিয়ে বললো,
_আচ্ছা থাকুন আপনি এখানে দাঁড়িয়ে।
কথাটা বলেই ইশা ভেঙচি কেটে চলে গেলো সেখান থেকে। আদৃত মাথা চেপে ধরে বিরক্তিসূচক ‘চ’ উচ্চারণ করলো। বেশ ভালো মেজাজে এসেছিল, আর এখন মেজাজ টা একদমই বিগড়ে গেলো। আর দাঁড়িয়ে রইলো না আদৃত, বাইকে উঠে নিজের ফ্লাটে চলে এলো।
____
অনেকদিন পড়ে কাজ থেকে একটু ছুটি পেয়েছে পূর্ণ। নিজের ফ্লাটে বসে সেদিনের সেই বইটা উল্টেপাল্টে দেখছে সে,তবে পড়াটা ঠিক হয়ে উঠছে না।
ফোনটা বেজে উঠতে পাশ ফিরে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায় পুর্ন। আননোন নম্বর দেখে কিছুক্ষন সেদিকে তাকিয়ে থেকে ফোনটা রিসিভ করলো সে।
অপর পাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো,
_হ্যালো..
_জি কে বলছেন?
_আমি.. ফাইজা।
পূর্ণ ফোনটা আবার সামনে এনে চেক করলো। না এটাতো ফাইজার নম্বর নয়। পূর্ন ফোনটা কানে ধরতেই ফাইজা বললো,
_এটা আগের নম্বর নয়,নতুন নম্বর। ভাবলাম আগের নম্বর ব্লক করে রেখেছো কিনা।
_কোনো দরকার?
ফাইজা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
_ঐ বইটা দিতে পারবে আমাকে? অনেক খুজেছি,কিন্তু পাইনি কোথাও।
মুখে হাসি নিয়ে হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো ফাইজা। নদীর পাশেই একটা বেঞ্চে চোখ বন্ধ করে বসে ছিলো পূর্ন। ফাইজার কণ্ঠ শুনে চোখ খুলল সে,ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই তার হৃদয়ে এক শীতল বাতাস বয়ে গেলো।
ফাইজা কখনোই সেভাবে সাজগোজ করেনা,আজও করেনি। আকাশি রঙের সেলোয়ার কামিজ এর সঙ্গে হালকা লিপস্টিক আর কপালে ছোট্ট একটা টিপ। এই সাধারণ রূপেও যেন ফাইজাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে পূর্ণর কাছে।
পূর্ণ তার দৃষ্টি সরিয়ে সৌজন্যমূলক হেসে বলল,
_তেমন দেড়ি হয়নি, বসো।
ফাইজা মুখের উপর চলে আসা চুলগুলো কানের পিছনে গুজে পূর্ণর পাশে এসে বসলো। তবুও তাদের মাঝে অনেক দূরত্ব,দুজনে বেঞ্চের দুই প্রান্তে বসে আছে। পূর্ণ আবারো একনজর তাকালো ফাইজার দিকে,ঠোঁটের কোণে তার মিষ্টি হাসি লেগেই আছে। প্রফুল্ল মনে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে সে। চোখ সরিয়ে নিলো পূর্ণ,আজকেই ফাইজাকে কেন এত খুশি থাকতে হবে? তাকে এমন আনন্দিত দেখে ভেবে আসা সব কথাগুলো গলায় আটকে যাচ্ছে পূর্ণর। তবে কঠিন হতেই হবে,ফাইজা তার প্রতি আরো দূর্বল হয়ে যাওয়ার আগে তাকে আটকাতে হবে। যেই স্বপ্নের কোনো ভবিষ্যৎ নেই,সেই স্বপ্ন বুনে কষ্ট পেতে দেওয়া যাবেনা ফাইজাকে।
বড় নিঃশ্বাস নিয়ে পূর্ণ ফাইজার দিকে তাকিয়ে বললো,
_চা খাবে?
কিছুটা দূড়ে একটা গাছের নিচে ফ্লাক্স নিয়ে বসে চা বিক্রি করছিলো একজন বৃদ্ধ লোক। তার কাছ থেকেই দু’কাপ লালচা নিয়ে বেঞ্চে এসে বসলো পূর্ণ। একটা কাপ ফাইজার দিকে বারিয়ে দিতেই সে কাপটা নিয়ে “থ্যাংক ইউ” বললো।
অতঃপর আবারো নিরবতা। যায়গাটা বেশ নির্জন,কোনো শব্দ নেই চারপাশে। মাঝেমধ্যে কয়েকজন বাচ্চা এসে ছোটাছুটি করছে। নিরবতার মাঝেই তাদের চায়ের কাপটা খালি হলো। ফাইজা ওয়ান টাইম কাপটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে পূর্ণর দিকে তাকালো। তার হাতে বা বেঞ্চে কোনো বই বা ব্যাগ না দেখে বললো,
_বইটা আনোনি?
হাতে থাকা কাপটা ফেলে দিয়ে ফাইজার দিকে তাকালো পূর্ণ। ছোট করে উত্তর দিনো,
_উম হু..
ফাইজা অবাক হয়ে বললো,
_কেন?
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো পূর্ণ। উঠে দাড়িয়ে ফাইজার সামনে এসে প্যান্টের পকেটে হাত গুজে থমথমে গলায় বললো,
_কারণ আমি তোমাকে এখন যেই কথাগুলো বলবো,তা শোনার পর তুমি আমার থেকে বইটা নেবেনা।
ঠোঁটে লেগে থাকা হাসিটা ধীরেধীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগলো ফাইজার। পূর্ণ জীভ দিয়ে নিজের ঠোট ভিজিয়ে বললো,
_ফাইজা আমি জানি তুমি কেনো হুট করে এতটা বদলে গেছো,তবে আমি তোমার মাঝে এই বদল টা চাইনা। তাই তোমাকে কিছু কথা বলা খুব প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
কিছুটা থামলো পুর্ণ। ফাইজার দিকে তাকিয়ে কথা বলাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে তার জন্য। তাই উল্টো ঘুড়ে নদীর দিকে মুখ করে দাড়ালো পূর্ন। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবারো বললো,
_সেদিন আমার কপাল কি করে কেটেছিল যানো?
উত্তর দিলোনা ফাইজা। পূর্ণ ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে একনজর তাকিয়ে আবারো সামনে তাকিয়ে বললো,
_ঐ এলাকাটা খুব একটা ভালো নয়। দিনের আলো সরে গেলেই রাতের আধারে ওখানে শুরু হয় অনৈতিক কাজ। মাদকদ্রব্য সাপ্লাই এর একটা গ্যাং ছিলো ওরা, অনেকদিন ধরে খোজ চালিয়ে ফাইনালি তাদের গোডাউন এর খোজ পেয়েছিলাম। সেদিন ওদের ধরার কোনো প্ল্যান ছিলোনা, আমি জাস্ট লাস্ট বারের মতো সিওর হতে গিয়েছিলাম। ব্যাস, কোনভাবে খবর পেয়ে আমার উপর অ্যাটাক করার প্ল্যান করে তারা। আমার পরিচয় জানতে পেরে যায়, আর সেই অনুযায়ী কাজ করে। লোকজন থাকেনা সেখানে খুব একটা,কিন্তু দলের কোনো লোক তোমাকে ঐদিকে আসতে দেখে নিয়েছিল। তাই আমার দিকে পাথর ছুড়ে মেরে পালিয়ে যায় সেখান থেকে। ওরা ধরাও পরেছে, তবে তাদের মধ্যে এক দুজন তখনো বাইরে ছিল। ওদের আমার উপর অনেক রাগ,এর আগেও একবার ওদের ব্যাবসা নষ্ট করেছিলাম। তাই প্রতিশোধ নিতে আমার উপর যেকোনো সময় হামলা করতে পারতো। সেইজন্যই দু’তিনদিন আমাকে পালিয়েও থাকতে হয়েছিল। ভাগ্য ভালো,তারাও খুব জলদিই ধরা পড়ে যায়।
ফাইজা এতক্ষন মনোযোগ দিয়ে পূর্ণর কথা শুনছিল। পুর্ন এবার তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলে,
_ভাবছো তো,তোমাকে কেন বলছি এসব?
ফাইজার দিকে তাকিয়ে পূর্ণ আবারো বলতে লাগলো,
_জাস্ট একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলাম আমার লাইফ এর। এটা কিছুই না, এরচেয়ে অনেক বেশি রিস্ক নিয়েও আমায় চলতে হয় মাঝেমধ্যে। আমার পরিচয়, আমার কাজ সম্পর্কে কেউ খুব বেশি অবগত নয়। তবে যারা জানতে পেরে যায়,তারা প্রতিনিয়ত ই আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো পূর্ণ,তারপর আবারো বললো,
_আদৃত তোমাকে কথাগুলো অন্যভাবে বলেছে আমি সেটাও জানি। আর তাই তোমাকে কথাগুলো জানানো দরকার ছিলো।
ফাইজা এবার উঠে দাঁড়ালো। পূর্ণর চোখে চোখ রেখে বললো,
_এখন সবটা স্পষ্টভাবেই শুনলাম। তো,আর কিছু বলবে?
_আর কিছু বলবো মানে? ফাইজা তুমি আমার কথাগুলো এখনো বুঝতে পারছো না। দিনের অর্ধেক সময় রিভলভার নিয়ে থাকতে হয় আমাকে। লাইফ রিস্ক নিয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়। আমার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই ফাইজা, তুমি বুঝতে পারছো এগুলো?
_হুম বুঝতে পারছি,তো?
_যেখানে আমার নিজের ই লাইফের কোনো গ্যারিন্টি নেই, সেখানে আমি অন্য কারোর জীবনের সাথে নিজেকে কি করে জড়াবো বলতে পারো?
_কি চাও তুমি?
পূর্ণ অবাক হয়ে তাকালো ফাইজার দিকে। এরপর থমথমে গলায় বললো,
_ফাইজা তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে, তুমি অনেক ভালো ছেলে পাবে জীবনে। আমার কথা ভেবে নিজের জীবনটা নষ্ট করোনা, তুমি যা চাও তা কখনো সম্ভব হবে না।
_হয়ে গেছে তোমার কথা বলা?
পুর্ন কোনো উত্তর দিলোনা। ফাইজা তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললো,
_একটা কথা জানো কি? মুখে না বললেও,তুই আমায় বড্ড বেশি ভালোবাসো।
পুর্ণ অবাক চোখে তাকালো ফাইজার দিকে। ফাইজা পূর্ণর চোখে চোখ রেখে বললো,
_হ্যা, ভালোবাসো তুমি আমায়। অনেক অনেক বেশি ভালোবাসো। নাহলে আজকে এখানে দাঁড়িয়ে যে কথাগুলো বলছো,সেগুলো কখনো বলতে পারতে না। তোমার সব কথাই বুঝলাম আমি, কিন্তু আমায় একটা কথা বলতো। তোমার প্রফেশন এ যে বাকি লোকগুলো আছে,তাদের কি কোনো লাইফ রিস্ক নেই? অবশ্যই আছে, কিন্তু এর কারণে কি তারা সারাজীবন একা থেকেছে? থাকেনি,কিন্তু তুমি একা থাকতে চাইছো। কারণ এটাই যে তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমি জীবনে কষ্ট পাই এটা তুমি চাওনা।
কথাগুলো ঠিক ই বলেছে ফাইজা। পূর্ণ তার কথায় বারে বারে শুধু অবাকই হচ্ছে,ফাইজা কি করে এতকিছু বুঝে ফেললো?
_কিন্তু তুমি এটা বুঝতেই পারলে না যে, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে হবো যদি তুমি আমার সঙ্গে থাকো। সেদিন অতো মানুষের সামনে আমাকে অপমান করলে, যানো আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। তোমাকে ঘৃণা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। তারপরেও আমি তোমাকেই ভালোবেসে গেছি, তোমায় কখনো পাবোনা জেনেই ভালোবেসেছি। আর আদৃত ভাইয়া যখন আমাকে তোমার ওভাবে চলে যাওয়ার কারণ বললো, তারপর থেকে ভালোবাসাটা আরো বেড়ে গেছে। নতুন করে তোমায় পাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলাম আমি,আর তুমি কতো সহজে বলে দিলে নতুন করে জীবন গুছিয়ে নিতে!
কঠিন গলায় কথাগুলো বলা শুরু করলেও এখন গলা আটকে আসছে ফাইজার। থেমে গিয়ে নিজের কান্না নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করে বললো,
_তবে তুমি যা চাও তাই হবে, আমি আর কখনো তোমায় নিজের করে পাওয়ার আশা করবোনা পুর্ণ। কিন্তু আমার ভালোবাসাকে অপমান করার অধিকার তোমার নেই। আমি তোমায় গোপনেই ভালোবাসবো,বাধা দিতে পারবেনা তুমি।
তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো ফাইজা। পুর্ণর দিকে তাকিয়ে বললো,
_গোপনেও মন উজাড় করে ভালোবাসা যায়, তবে সেটা প্রকাশের জন্য সময় প্রয়োজন। কি ভাগ্য আমার, সেই সময় সুযোগ কোনোটাই পেলাম না।
_ফাইজা আমি..
ফাইজা হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো পূর্ণকে। মুচকি হেসে বললো,
_থাক আর কিছু বলতে হবেনা। চিন্তা নেই,আমি নিজে থেকে আর তোমার সামনে আসবোনা। ভালো থেকো..
পিছনে ফিরে তাকালোনা ফাইজা,হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে দ্রুতপায়ে স্থান ত্যাগ করলো সে। আর পূর্ন? সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো একই স্থানে। কানের কাছে একটা কথাই বাজছে,”আমি নিজে থেকে আর তোমার সামনে আসবোনা”। এটাই তো চেয়েছিল পূর্ণ,তবে কেন এতটা কষ্ট হচ্ছে তার! কিছুই করার নেই, এই কষ্ট সে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছে।
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৩০
#মেহরিন_রিম
আজ দুদিন পড়ে কলেজ এ এসেছে মোহনা। এই দুদিনে সায়ান তাকে কত শত বার কল করেছে তার হিসেব নেই, কিন্তু একটা কল ও রিসিভ করেনি মোহনা। মোটা হওয়ার কারণে জীবনে অনেকের থেকে অনেক কথা শুনেছে সে, ছোট বেলায় কষ্ট পেলেও বড় হওয়ার পর আর এগুলো নিয়ে ভাবে নি,কারোর কথা কানেও নেয়নি। কিন্তু সায়ান তাকে নিয়ে এভাবে হাসছিলো,বিষয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা মোহনা। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিজের ওজন কমাবে, ফিট হয়ে দেখিয়ে দেবে সায়ান কে। এই লক্ষ্যে গত দুদিনে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়াও করেনি, বাবা মা জিজ্ঞেস করলেও তাদের কোনো উত্তর দেয়নি।
কলেজে আসার ইচ্ছে না থাকলেও ইশা তাকে জোড় করে নিয়ে এসেছে। তবে মোহনা মনে মনে ভেবেই রেখেছে, সায়ান কোনোভাবে তার সামনে চলে এলে সে স্পষ্ট জানিয়ে দেবে তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না রাখতে। সে থাকুক তার জিড়ো ফিগার এর মেয়েদের নিয়ে।
আজ এক পিরিয়ড আগেই ছুটি দিয়ে দেওয়ায় সবাই মাঠে এসে আড্ডা দিচ্ছে, আবার কেউ কেউ ক্লাসরুম এ বসে পড়ছে। ইশা আর মোহনার ব্যাচ থাকায় তাড়াও মাঠেই ঘোরাফেরা করছে, কিছুক্ষন পরে এখান থেকেই পড়তে চলে যাবে। ইশা তার অভ্যাস অনুযায়ী বকবক করছে, তবে মোহনা কলেজে আসার পড় থেকে প্রয়োজন ব্যাতীত একটা কথাও বলেনি। অন্যসময় ব্যাগে করে চিপস, চকলেট নিয়ে আসে,আর আজকে একবার পানিও খেতে দেখলোনা মোহনা কে। ইশা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে,কিন্তু মোহনা কোনো উত্তর ই দেয়নি।
একেতো গতকাল রাতে না খাওয়ার মতো করেই সামান্য কিছু খেয়েছিল,তার উপর সকালেও কিছু না খেয়ে কলেজে আসায় প্রচুর দূর্বল লাগছে মোহনার। শরীরে কোনো বল পাচ্ছে না,হঠাৎ চারপাশ অন্ধকার হয়ে যেতেই পাশে থাকা গাছে হাত রেখে নিজেকে সামলে নেয় মোহনা। ইশা দ্রুত তাকে গাছের নিচে বসিয়ে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বেড় করে তার দিকে এগিয়ে দেয়। মোহনা কাপাকাপা হাতে পানিটা নিয়ে খেতেই ইশা বেশ রেগে গিয়ে বলে,
_মেহু তুই যদি এখন না বলিস কি হয়েছে তাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা।
মোহনা পানির বোতলটা ইশার দিকে এগিয়ে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো।
_মেহু এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে।
_আমি কি খুব বেশি মোটা ইশা?
ছলছল চোখে ইশার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে মোহনা। ইশা অবাক হয়ে যায় কথাটা শুনে। সে সবসময় মোহনাকে মোটা বলে খ্যাপায়, আর মোহনা রেগে যায় তাতে। তবে ইশা কখনো এই নিয়ে আফসোস করতে দেখেনি মোহনাকে। বরং নিজেই সবসময় বলে, “আমি তোদের সবার চেয়ে বেশি কিউট”। সেই মেয়ের মুখে এমন কথা আশা করেনি ইশা। নরম সুরে বলে,
_মেহু, কেউ কিছু বলেছে তোকে?
মোহনা এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলোনা। ইশাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো সে। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
_আমি মোটা বলে কি আমাকে একটুও ভালোবাসা যায়না ইশা?
_আমিতো নিজে থেকে কারোর কাছে ভালোবাসা চাইনি ইশা, তাহলে কেন…
কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো মোহনার। ফোঁপাতে ফোঁপাতেই ইশার কাছে বললো সেদিনের কথা। ইশার এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো,তাই সে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
_তুইতো ভুল ও ভাবতে পারিস তাইনা? হয়তো উনি অন্য কিছু নিয়ে হাসছিলেন!
_আমি কিচ্ছু ভুল ভাবিনি ইশা। উনি এতদিন ধরে শুধু আমার ইমোশন নিয়ে খেলছিলেন। আচ্ছা আমি কি দোষ করেছি বলতো, আমিতো যেচে ওনার সাথে কথাও বলতে যাইনি।
ইশা চুপ করে রইলো,সায়ান কে সে যথেষ্ট ভালো মনে করেছিল। কিন্তু মোহনার কথার সঙ্গে তো তার কিছুই মিলছে না।
মোহনা নিজের চোখের জল মুছে বললো,
_তুইতো জানিস ইশা, আমি ডায়েট করার কতো চেষ্টা করেছি। কিন্তু এতে কোনো লাভ হয়না,বরং আরো অসুস্থ হয়ে পরি। আমিতো ইচ্ছে করে মোটা হতে চাইনা, হরমোনাল প্রবলেম এর কারণে না চাইতেও মোটা হয়ে যাই। আব্বু আম্মু জোড় করে খাওয়ায় যেন সুস্থ থাকতে পারি,আর আমি কি মোটা বলে কোনো কাজ করতে পারিনা বল? আমিতো সবই করতে পারি, তবুও কেন মানুষ আমাকে অন্যভাবে দেখে? বলতে পারিস আমি কি করবো? কি করলে আর অন্যদের কাছে হাসির পাত্র হতে হবেনা আমায়?
_মেহু আমার এখনো মনে হচ্ছে তুই ভুল ভাবছিস।
_হাহ,ভুল তো আমি এতদিন ভেবে এসেছি। তবে এখন আমি ঠিকটা বুঝতে পারছি। তুই দেখিস ইশা, যে করেই হোক আমি স্লিম হবো,তারপর আর উনি আমায় নিয়ে হাসতে পারবে না।
_পাগল হয়ে গেছিস তুই? এবার আমি বুঝতে পারছি, নিশ্চই দুদিনে খাওয়া দাওয়া করিসনি তাই মাথা ঘুড়ে যাচ্ছে। তুইতো এমন মেয়ে না মেহু, কারোর জন্য নিজেকে চেঞ্জ করার কোনো প্রয়োজন নেই। এসব আজেবাজে চিন্তা করলে কিন্তু আমি আন্টিকে সবকিছু বলে দেবো। এখন চল,ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খাবি আগে।
_আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা ইশা।
_কোনো কথা নয়,চল আমার সাথে।
মোহনা আর কিছু না বলে ইশার সাথে ক্যান্টিনে চলে গেলো, আর কিছুক্ষন না খেয়ে থাকলে সত্যি সত্যি ই সেন্সলেস হয়ে যাবে।
_____
_আসবো?
আদৃত অফিসে নিজের কেবিনে বসে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিল। কারোর গলার আওয়াজ শুনে দড়জার দিকে তাকাতেই পূর্ণকে দেখে মৃদু হেসে বললো,
_আয়,জিজ্ঞেস করছিস কেন?
পূর্ণ ভিতরে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। আদৃত ওর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,
_কোথায় ছিলি তুই? ফোন ধরিস না,কোনো খোজ নাই। কোথায় যে উধাও হয়ে যাস তুই সেটাই বুঝতে পারিনা।
পূর্ণ ও হাসলো এবার। পানিটা খেয়ে বললো,
_দুদিনে ফিরতে পেরেছি এটাই অনেক। আর বলিস না, আম্মা কয়েকদিন ধরে এত চাপ দিচ্ছে বিয়ের জন্য। একদম কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে, কিছু বলেই বোঝাতে পারতেছি না।
_ভালো তো,বিয়ে করে নিলেই পারিস। তাহলে আন্টিও খুশি হয়ে যাবে।
_হাহ, আমার যে লাইফ। কোনো মেয়ে আমার সাথে থাকবে বলে তুই মনে করিস?
_থাকতো,তবে তুই নিজেই রাখিস নি।
_একটা সত্যি কথা বল তো।
_হুম।
_ফাইজা কে কিছু বলেছিস তুই?
অবাক হওয়ার মতো কথা হলেও আদৃত একটুও অবাক হলোনা। বরং চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললো,
_বলেছি,তো?
_আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম। কাজটা তুই ঠিক করিস নি আদি।
_আমি যা করি ভেবে চিন্তেই করি,অন্তত তোর থেকে ভালো বুঝতে পারি।
নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো আদৃত। পূর্ণ ও তাহলে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্বের শেষে আদৃত ও নিজের মনকে বুঝতে সক্ষম হয়েছে। ইশা আশেপাশে থাকলে তার ভালো লাগে,ইচ্ছে করে সবসময় তাকে নিজের সামনে বসিয়ে রেখে তার বকবক শুনতে। তার কাজল চোখের মায়ায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে বারংবার, এই সবকিছুর কারণ আবিষ্কার করতে পেরেছে আদৃত। দেড়িতে হলেও মেনে নিয়েছে নিজের অনুভূতিকে।
_তাহলে? আমি বিয়ে করি না করি,তোর বিয়ে খেতে পারছি বল।
আদৃতের হাসি আরো প্রশস্ত হতে দেখে পূর্ণ বললো,
_হাসছিস কেন? তুই যে মেয়েটাকে ভালোবাসিস,বলেছিস ওকে?
_ঐটুকু মেয়েকে আমি প্রপোজ করবো? নো ওয়ে..
_তাহলে,কি করবি?
আদৃত টেবিলে থাকা পেপারমেট টা ঘুরিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললো,
_জানিনা। যেভাবে চলছে সব সেভাবেই চলুক,ক্ষতি কি?
পূর্ণ মনেমনে হাসলো। আদৃতকে ভালোবাসা প্রকাশ করতে বলছে। যেখানে কিনা সে নিজেই নিজের ভালোবাসার কথা কখনো মুখ ফুটে বলতে পারলো না,হয়তো কখনো পারবেও না। এমনটা হয়তো তার ভাগ্যেই লেখা ছিলো।
#চলবে
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৩১
#মেহরিন_রিম
ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁইছুঁই। রুমের সব লাইট নিভিয়ে বিছানায় বসে ল্যাপটপে কিছু মেইল চেক করছে আদৃত। ফোনটা তার হাতে নাগালের বাহিরে ছিলো তার উপর ভাইব্রেশন এ। প্রথমবার কল আসায় সে টের পায়নি, দ্বিতীয়বার ফোন ভাইব্রেট হওয়ায় বিরক্তিসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফোনের দিকে তাকায় আদৃত। ফোনটা উল্টো থাকায় আরো বিরক্ত হয়, বাধ্য হয়ে ল্যাপটপ টা পাশে রেখে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা হাতে নিতেই বিরক্তি কেটে গিয়ে বিষ্ময় থেকে যায় মুখে। অন্য হাত দিয়ে চোখ ডলে আবারো স্ক্রিনের দিকে তাকায়। সে ঠিকই দেখছে, স্ক্রিনে ইশার নামটা স্পষ্ট। নম্বরটা অনেক আগেই সেইভ করা ছিলো। কিন্তু ইশা এত রাতে কল করছে!
এর ভাবনার মাঝে ফোনটাই রিসিভ করা হলোনা,তার আগেই কেটে গেলো। মুখ থেকে বিরক্তিসূচক ‘চ’ উচ্চারণ করে আদৃত বললো,
_কেটে গেলো কলটা! কিন্তু ও এত রাতে আমাকে কল করবে কেন?
আদৃত কলব্যাক করবে কিনা ভাবতে ভাবতেই আবারো কল এলো ইশার নম্বর থেকে। এবার আর দেড়ি করলো না আদৃত,সঙ্গে সঙ্গে কলটা রিসিভ করলো।
এই নিয়ে তিনবার কল দিলো ইশা। আগের দুবার রিং হতে হতে কল কেটে যাওয়ায় ইশা এবার কল নিয়ে নিজে নিজে বলছিল,
_এবার যদি কল না রিসিভ করেছেন তো..
_কি করবে?
আদৃতের কণ্ঠ পেয়ে কথা থেমে যায় ইশার। ফোনটা সামনে এনে দেখে ১০ সেকেন্ড আগেই কলটা রিসিভ হয়েছে। ইশা চোখ খিঁচে বন্ধ করে জীভে কামড় দিলো। ফোনটা কানে ধরে বললো,
_আসলে আগেও দুবার কল দিয়েছিলাম তো তাই..
_এতকিছু আপনাকে বলতে পারবো না, আগে আমাকে নম্বরটা দিন।
_কিন্তু…
_দিন না প্লিজ,অনেক বেশি দরকার।
ইশার আকুতির স্বরে আর কথা বাড়াতে পারলোনা আদৃত। সায়ান এর নম্বরটা দিতেই ইশা খুশিতে থ্যাংক ইউ বলে কলটা কেটে দিলো।
আদৃত আর কিছু বলার সুযোগ ই পেলোনা। আদৃত এখনো বুঝতে পারছেনা ইশা সায়ান এর নম্বর দিয়ে কি করবে। একবার ভাবলো সায়ান কে কল করে জিজ্ঞেস করবে, পড়ে কিছু একটা ভেবে আর কল করলোনা। বিছানায় বসে ল্যাপটপে আরো কিছু কাজ করে ঘুমিয়ে পড়লো।
______
ইশা বলেছে আজকে সে কলেজে যাবেনা। মোহনা ঘুম থেকে উঠে অনেকবার জোড় করলেও রাজি হয়নি সে, বলেছে প্রচণ্ড পেটে ব্যাথা তাই যেতে পারবে না কলেজে। মোহনার যেতে ইচ্ছে করছিল না কলেজে তবে আগেও দুদিন যায়নি তাই আজ না গিয়ে উপায়ও নেই। তাই বাধ্য হয়ে একা একাই কলেজে যাচ্ছে মোহনা।
সোমবারে তাদের এলাকায় সকল দোকান বন্ধ থাকায় রাস্তা বেশ ফাকাই থাকে। কলেজ খুব একটা দূড়ে নয়,তাই রিক্সায় না উঠে হেটেই কলেজে যাচ্ছে সে। মুখ গোমড়া করে হাটতে হাটতেই দেখতে পায় সায়ান রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে তাকাতেই মনটা আরো বিগড়ে যায় মোহনার,নিচের দিকে তাকিয়ে ব্যাগটা খামচে ধরে হাঁটা শুরু করে সে। খুব বেশিদূর এগোতে পারেনি। মোহনার দিকে চোখ পড়তেই সায়ান তার সামনে এসে দাঁড়ায়, কপাল তার ইষৎ ভাজ স্পষ্ট। গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোহনার দিকে। মোহনার টলমলে চোখে নিচের দিকদি তাকিয়ে ছিলো,নিজের ইমোশন মোটেই দেখাতে চায়না সে।
নিচের দিকে তাকিয়েই পাশ কেটে চলে যেতে নিলে সায়ান আবারো তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মোহনা এবার তার দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে,
_সমস্যা কি? পথ আটকাচ্ছেন কেন?
_প্রশ্নটা তো আমার করা উচিৎ,তোমার সমস্যা কি?
_দেখুন ভালোয় ভালোয় বলছি সরে যান,আমি কিন্তু চিৎকার করবো।
_ওহ রিয়েলি! করো চিৎকার,কে নিষেধ করেছে। তবে এখানে যদি আমি তোমার ছবিগুলো পোস্টার করে লাগিয়ে রাখি তাহলে কেমন হবে?
মোহনার রাগটা আরো বেড়ে যায়। খানিকটা উঁচু গলায় বলে,
_যা খুশি করুন আপনি। ঐ একটাই তো হাতিয়ার পেয়েছেন, আর তা দিয়েই আমার সঙ্গে মজা করছিলেন আপনি। আমি কিছুতে ভয় পাইনা এখন।
সায়ান চোখমুখ শক্ত করে একবার মোহনার দিকে তাকায়। তারপর বাইকে উঠতে উঠতে কড়া গলায় বলে,
_বাইকে বসো।
_মানে? আমি আপনার বাইকে কেনো উঠতে যাবো?
_দেখো মোহনা,রাগ বাড়িও না আমার। নাহলে কিন্তু..
_ভয় দেখাচ্ছেন আমায়? বললাম না আমি আপনাকে ভয় পাইনা। আর আমাকে যে বাইকে উঠতে বলছেন, আমার মতো মোটা মেয়েকে নিয়ে আপনি বাইক চালাতে পারবেন?
সায়ান এবার রাগী চোখে মোহনার দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে,
_আর একটা কথা বললে কিন্তু কোলে তুলে বাইকে বসাবো। লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি,নিজে থেকে উঠে বসো।
মোহনা সায়ানকে এর আগে কখনো এত রাগ করতে দেখেনি। মন মনে অভিমানের পাল্লা আরো ভারি হলো, কোথায় মোহনা রাগ করে থাকবে সেখানে কিনা সায়ান নিজেই রেগে যাচ্ছে। তবে অভিমান এর চেয়ে ভয়টা বেশি হওয়ায় আর কিছু বলতে পারলোনা মোহনা। মুখ ফুলিয়ে বাইকে উঠে বসলো। সায়ান ও কিছু না বলেই বাইক স্টার্ট দিলো।
_____
কলেজ থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে একটা পার্কে বসে আছে মোহনা। সায়ান তার সোজাসুজি একটা বেঞ্চে বুকে হাত গুঁজে বসে আছে।
মোহনা এতক্ষন নিজের কান্না আটকে রাখলেও এখন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলোনা। সায়ানের দিকে একনজর তাকিয়ে আবারো নিজের দিকে নজর রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
_কিছু হলেই তো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে শুরু করে দাও। সেখানে এতো রাগ কোথা থেকে পাও তুমি?
সায়ানের কথায় কোনো উত্তর দিলোনা মোহনা। নিচের দিকে তাকিয়েই বললে,
_এখানে কেনো নিয়ে এসেছেন আমাকে? আমি আপনার সাথে কোনো কথা বলতে চাইনা,যেতে দিন আমায়।
সায়ান উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
_তিনতিনে তিন হাজারের বেশি মেসেজ করেছি, কত শত বার কল করেছি তার কোনো হিসেব নেই। আর তুমি কিনা তখন থেকে যাই যাই করছো।
মোহনা সায়ান এর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আহত কণ্ঠে বললো,
_কেন করেছেন কল? আমি বলেছি? আমার মতো মোটা মেয়েকে…
_কি তখন থেকে মোটা মোটা করে চলেছো? আমি কিছু বলেছি তোমাকে?
মোহনা তাচ্ছিল্যের সুলভ হেসে পাশে তাকিয়ে বললো,
_সামনে না বললেও আড়ালে তো ঠিকই বলে বেড়ান।
_সেদিনের কথা সবটা শুনলে তুমি এমনটা করতে না মোহনা।
মোহনা অবাক হয়ে তাকায় সায়ান এর দিকে। সায়ান তার দিকে তাকিয়ে সেদিনের কথা বলতে লাগলো।
___
_হাসছিস কেন তুই?
পূর্ণর কথায় সায়ান হাসি থামিয়ে দিয়ে বলে,
_ব্যাপারটা আমিও অনেক ভেবেছি বুঝলি। যেখানে আমি সবসময় স্লিম মেয়ে পছন্দ করতাম সেখানে মোহনার প্রতি কি করে এতটা মায়া জন্মে গেলো বুঝতেই পারলাম না।
_যাক তাহলে তুইও প্রেমে পড়েই গেলি।
সায়ান হেসে বলে,
_আসলেই,বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি মেয়েটাকে। এবার শুধু সুযোগ বুঝে বলে দিতে পারলেই হয়।
___
_আর তুমি সবটা না শুনেই চলে গিয়েছিলে।
মোহনা হা করে সায়ান এর কথা শুনছিলো। পরক্ষণেই ঐ মেয়েটির কথা মনে পড়তেই আমতা আমতা করে বললো,
_আ আর ঐ মেয়েটাকে নিয়ে যে বলছিলেন,কত সুন্দরি সে।
সায়ান মোহনার হাতে হাত রেখে বলে,
_ওটা তো এমনিতেই বলেছিলাম। আসলে তো আমি এই হাতির বাচ্চাকেই ভালোবাসি।
এবার হাতির বাচ্চা বলায় রাগ হলোনা মোহনার। বরং সায়ান এর মুখে সরাসরি ভালোবাসার কথা শুনে কিছুটা লজ্জা পেলো সে। সায়ান হাতটা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হতাশার সুরে বলে,
_আর আপনি কিনা কতকিছু ভেবে বসে আছেন। ভাগ্যেস আমি এমন একটা শালী পেয়েছি।
মোহনা অবাক হয়ে বললো,
_ইশা আপনাকে বলেছে এগুলো?
_আজ্ঞে হ্যা,নাহলে তো জানতেই পারতাম না কিছু।
ফাইজা নিজের মাথায় গাট্টা মেরে অসহায় দৃষ্টিতে সায়ান এর দিকে তাকিয়ে রইলো। সায়ান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
_হয়েছে আর এমন স্যাড লুক দিতে হবেনা। সকালে কিছু খাওয়া হয়েছে নাকি এখনো অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন?
মোহনা নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো অর্থাৎ কিছু খায়নি সে। সায়ান হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
_ফার্স্ট ক্লাস শেষ হতে এখনো ২০ মিনিট বাকি। সেকেন্ড ক্লাস করতে চাইলে জলদি কিছু খেয়ে কলেজে যাবে। এখন আর একটা কথা বললে কিন্তু..
আর কিছু বলতে হলোনা সায়ান কে। মোহনা তার আগেই উঠে দাঁড়িয়ে সায়ান এর পাশে এসে দাঁড়ায়। দুহাত দিয়ে চোখ মুছে মেকি হেসে বলে,
_চলুন..
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_২৭
#মেহরিন_রিম
এসএসসির রেজাল্ট দেওয়ার অনেকগুলো দিন পেড়িয়ে গেছে। ইশা,মোহনা তাদের কলেজেই ভর্তি হয়েছে। ইশার অন্য কলেজে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও মোহনার জন্য এখানেই থেকে গেছে। আজ তাদের নবীন বরণ অনুষ্ঠান। আদৃতকে এখন প্রায়ই কলেজে দেখা যায়, ইশা সেটা খেয়াল করলেও কিছু বলেনা। সেলফি তোলার আশা সে এমনিতেও ছেড়ে দিয়েছে, লাগবেনা তার অনেক অনেক লাইক। তবুও এই লোকের কাছে গিয়ে সে সেলফি তোলার রিকুয়েস্ট করবেনা। নিরব কে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে ইশা, যতটা না বললেই ঠিক ততটাই কথা বলে। নিরবের ও পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। এখন অ্যাডমিশন এর প্রিপারেশন নিচ্ছে, তবুও কলেজে আসাই হয়।
ইশা যে স্বেচ্ছায় নিরবের থেকে দূড়ে থাকছে এটা বুঝতে পেরে আদৃত মনে মনে শান্তি পেয়েছে। নিজের অনুভূতি নিয়ে সে এখনো দ্বিধার মধ্যে আছে। তাই সময় কে নিজের মতোই চলতে দিচ্ছে, এর মাঝে যে তার অনুভূতিরা আরো প্রখর হয়ে উঠছে তার খুব একটা খেয়াল নেই আদৃতের।
সায়ান আর মোহনার সম্পর্ক ঠিক আগের মতোই রয়েছে। টুকটাক ঝগড়ার মধ্যেই দিন কেটে যাচ্ছে, বিশেষ করে ঝগড়ার সূত্রপাত টা মোহনাই করছে। সায়ান এখনো তাকে ডিরেক্টলি কিছু বলছেনা,এই কারণেই মোহনা ছোটখাটো বিষয়ে রেগে যাচ্ছে। তবে সেই রাগ খুব বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনা,সায়ান ঠিক কিছু না কিছু করে তার রাগ ভাঙিয়ে দেয়। মোহনা নিজেও বুঝতে পারছে, ধীরে ধীরে সায়ান তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
ফাইজার বিষয়টা নিয়ে পূর্ণ সেদিন অনেক্ষন চিন্তা করেছে, তবে কোনো উত্তর পায়নি। ফাইজা তাকে জ্ঞজ্ঞজ্ঞজ্ঞগতুমি করে বলছে, তাকে দেখে অস্বস্তিতে পরছে না বিষয়গুলো ভাবাচ্ছে পূর্ণ কে। কপালের ক্ষত অনেকটাই কমে গেছে, ব্যান্ডেজ খুলে এখন সাধারণ ব্যান্ড এইড দেওয়া আছে ক্ষতস্থানে। সেদিন দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে নয় বরং পাথর এর আঘাতেই কপাল কেটে গিয়েছিল পূর্ণর। খুব কাছে গিয়েও ছেলেদুটো সেদিন হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল,যদিও খুব বেশিদিন পালাতে পারেনি। কদিন পড়েই তাড়া ধরা পরে গিয়েছিল। পূর্ণ আরো অবাক হয়েছে এই বিষয়ে ফাইজা কোনো প্রশ্ন না করায়। একবার জিজ্ঞেস করার পর আর জিজ্ঞেস করেনি এই ক্ষত নিয়ে, কেন হয়েছে কিভাবে হয়েছে কিছুই বলেনি। সে কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে কিনা জানা নেই পূর্ণর। তবে তার ধারণা অনুযায়ী ফাইজার কিছু জানার কথা নয়।
আদৃতের সাথে কলেজের পুড়নো শিক্ষক দের বেশ সখ্যতা তৈরি হয়েছে,সবাই যেনো তাকে চোখে হারাচ্ছে। সব স্টুডেন্ট দের কাছে তার প্রশংসা করে বেরাচ্ছে। বিজনেস সামলাচ্ছে তার উপর এত ভালো গান করে। একটু এদিক সেদিক হলেই টিচার রা আদৃত এর উদাহরণ দেখায়, এতে প্রচুর বিরক্ত ইশা। কলেজের যেকোনো প্রোগ্রাম এ প্রিন্সিপাল স্যার নিজে আদৃতকে আমন্ত্রন জানাবেন,তেমন আজকেও জানিয়েছে। আদৃত ও হাসিমুখে রাজি হয়ে গেছে। আদৃত এর কিছুকিছু বিষয়ে এই পরিবর্তনগুলো বেশ ভাবাচ্ছে সায়ানকে, পূর্ণ খুব একটা মাথা না ঘামালেও সায়ান এ নিয়ে অনেক চিন্তা করেছে। তবে আদৃতের কাছে জিজ্ঞেস করলে সে কোনো উত্তর দিবেনা।
সায়ান আদৃত এর সঙ্গেই এসেছে,তাদের আসতে কিছুটা দেড়িই হয়ে গেছে। ইশা নাচের জন্য রেডি হচ্ছে, আজ সে গান করবেনা, ইচ্ছে নেই তাই। শুধু নাচবে তাও চারজন মিলে আর সেখানে গান গাইবে আদৃত, এটা শোনার পরে সে থাকতেই চাইছিল না। তবে দলের বাকি সবাই ভীষণ খুশি,আর ইশা নেতৃত্ব দেওয়ায় সে বেরিয়েও যেতে পারবে না। তাই বাধ্য হয়ে নাচতেই হবে।
ফাইজা মাঠের অন্যদিকে দাঁড়িয়ে ছিলো, সায়ান আর আদৃতকে আসতে দেখে কিছুটা আন্দাজ করেছে যে এখানে পূর্ণ ও আসবে। সেদিনের পর আর পূর্ণর খোজ নেওয়া হয়ে ওঠেনি, ফোন নম্বরটা আছে ফাইজার কাছে। যদিও সেই নম্বর এখনো ইউজ করে কিনা সেটা জানা নেই। আর ইউজ করলেও, পূর্ণকে কল দিয়ে খোজ নিতে মনটা খচখচ করছিলো তাই আর খবর নিতে পারেনি।
ফাইজার ধারণা ঠিক ই ছিলো। আদৃতেরা ভিতরে যাওয়ার পাঁচমিনিট পরেই পূর্ণ ঘড়ির দিকে নজর রেখে প্রবেশ করে কলেজে। ফাইজা তার কিছুটা সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। পূর্ণ কে আসতে দেখেই তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ফাইজা। পূর্ণ হাতের ঘড়ি থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই ফাইজাকে দেখতে পায়।
_কেমন আছো এখন? কপালের ক্ষতটা কমেছে?
আবারো অবাক হয় পূর্ণ। ফাইজার কণ্ঠে কোনো জড়তা নেই, সে পূর্ণকে দেখার পরও একদম স্বাভাবিক রয়েছে। ফাইজা যে এখানে আসবে সেটা অবশ্য আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল পূর্ণ।
_কী হলো বলো! ব্যাথা কমেছে?
পূর্ণকে চুপ থাকতে দেখে আবারো কথাটা বললো ফাইজা। পূর্ণ এবার চোখের পলক ফেলে কিছুটা শান্ত কণ্ঠে বললো,
_ঠিক আছি আমি। আর সেদিনের জন্য থ্যাংকস।
_থ্যাংকস বলার মতো কিছুই নেই। আর যাই হোক, আমার মধ্যে একটু হলেও মনুষ্যত্ব আছে।
পূর্ণ কিছু না বলে চলে যেতে নিলেই ফাইজা নিজের জায়গায় স্থির থেকে স্মিত হেসে বলে,
_আমায় এতটা ইগনোর না করলেই পারো।
এক ঝটকায় পিছনে ফিরে তাকায় পূর্ণ। ফাইজাও ঘাড় ঘুরিয়ে তার চোখে চোখ রাখে। চোখ নামিয়ে আবারো সামান্য হাসলো ফাইজা। অত:পর আরো একবার পূর্ণ দিকে তাকিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। আর পূর্ণ কেবলই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার যাওয়ার দিকে।
_____
আদৃর ভেবেছিল তাদের অনেকটাই দেড়ি হয়ে গেছে। যদিও সেটা সত্যি নয়, সবে মাত্র অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। নাচগান শুরু হবে আর কিছুক্ষন পড়ে। আজ গিটার নিয়ে নয়,হারমোনিয়াম বাজিয়েই গান গাইবে। হারমোনিয়াম বাজানোটা খুব ছোট বেলায় মায়ের কাছে শিখেছে আদৃত। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মাঠের দিকে চোখ যায় আদৃত এর। সেখানে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলার দিকে তাকাতেই চোখ আটকে যায় তার। চোখদুটো ধীরেধীরে লাল বর্ণ ধারণ করতে থাকে,চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। পূর্ণ আর সায়ান তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। আদৃতকে হঠাৎ অন্যরকম হয়ে যেতে দেখে সায়ান একবার পূর্ণর দিকে তাকিয়ে আদৃতের হাতে সামান্য ধাক্কা দিয়ে বলে,
_আদি? কি দেখছিস ওদিকে?
ধ্যান ভাঙে আদৃত এর। চোখ সরিয়ে নিয়ে আবারো তাকায়, না সে ঠিকই দেখছে। দাঁতে দাঁত চেপে নিচের দিকে তাকিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলে,
_ঐ মহিলা এখানে কি করছে?
আদৃত এর দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকালে পূর্ণ আর সায়ান দুজনেই অবাক হয়ে যায়। আদৃতের হঠাৎ এমন আচরণ এর কারণ স্পষ্ট হয়ে যায়। সায়ান আতঙ্কিত চোখে পূর্ণর দিকে তাকায়। পূর্ণ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আদৃত কে কিছুটা পাশে নিয়ে গিয়ে বলে,
_কাম ডাউন আদি। হয়তো ওনার মেয়ে এই কলেজে পড়ে তাই এসেছেন। তুই ওনার দিকে খেয়াল না করলেই তো হয়..
আদৃত কিছুটা উচ্চস্বরে বলে ওঠে,
_নো ওয়ে পূর্ণ। উনি এখানে থাকবেন আর আমি স্টেজ এ উঠে গান গাইবো? ইম্পসিবল…
কথাটা বলেই আদৃত দ্রুত পায়ে অন্যদিকে চলে যায়। সায়ান পূর্ণর পাশে এসে বলে,
_আরে ওকে যেতে দিলি কেন? আটকাতে পারলি না?
পূর্ণ বিরক্তিসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
_তোর মনে হয় ওকে এখন কেউ আটকাতে পারবে?
ইশা শাড়ি পরে সাজগোজ শেষ করে এদিকেই দাঁড়িয়ে ছিল। আদৃতকে হঠাৎ এমন অদ্ভুতভাবে চলে যেতে দেখে কিছুটা খটকা লাগে তার। যতটুকু শুনতে পেলো তাতে বুঝতে পারলো আদৃত হয়তো কোনো ব্যাক্তির জন্য রেগে আছে। তাহলে কি আদৃত গান গাইবে না? একমুহূর্তের জন্য খুশি হয়েও ঠিক খুশি হতে পারলোনা ইশা। মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগলো। স্টেজ এ তাকিয়ে দেখলো টিচাররা তাদের বক্তব্য দিচ্ছেন। এখন নাচগান শুরু করতে দশমিনিট তো লাগবেই। আর কিছু না ভেবেই আদৃত যেদিকে গিয়েছে সেই দিকে এগোলো ইশা। কলেজ গেইট এইদিকে না তার মানে আদৃত বেরিয়ে যায়নি। ক্যাম্পাসের পাশে পুকুরের দিকেই গিয়েছে সে। যেতে গিয়ে দু বার থামলো ইশা। পরিশেষে শুকনো ঢোক গিলে পা বাড়ালো।
ঠিক ই ধরেছিল ইশা। আদৃত পুকুরের পাশের বেঞ্চে দু হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। ইশা ধীর পায়ে তার সামনে এসে দাড়ালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা খাঁকড়ি দিয়ে বললো,
_এহেম এহেম…
#চলবে
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_২৮
#মেহরিন_রিম
মেয়েলি কণ্ঠস্বর কানে আসতেই ভ্রুযুগল সঙ্কুচিত হলো আদৃতের। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখলো ইশা এদিক ওদিক তাকিয়ে নজর আড়াল করার চেষ্টা। আদৃত ইশাকে দেখতে পেয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ইশা এখনো শাড়ির কিছুটা অংশ আঙুলে প্যাঁচাচ্ছে আর আশপাশে তাকাচ্ছে। আদৃত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে কড়া গলায় বললো,
_তুমি এখানে কি করছো?
হঠাৎ আদৃতের গলা শুনে কিছুটা কেপে উঠলো ইশা। শুকনো ঢোক গিলে তাকালো আদৃতের দিকে, তার ভ্রুযুগল এখনো কুঁচকানো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম বিদ্যমান, দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাগ নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে সে। ইশা এত সাহস নিয়ে এসেছিল,কিন্তু এখন তার কিছুই খুঁজে পাচ্ছেনা। কি বলবে এখন? কেনো এসেছে? না আসলেই বোধহয় ভালো হতো। আরো বিভিন্ন কথা মনেমনে আওড়ালো ইশা। তবে এখন চুপ করে থাকলে চলবে না। তাই বড়বড় নিঃশ্বাস নিয়ে যথাসম্ভব সাহস সঞ্চয় করে বললো,
_আপনি চলে এলেন কেনো এভাবে?
আদৃত একনজর ইশার দিকে তাকিয়ে বললো,
_তোমার জানার দরকার নেই।
কথাটা ইশার কাছে বেশ অপমানের মনে হলেও সে আবারো আদৃতের উদ্দেশ্যে বললো,
_হ্যা হ্যা,আমার এমনিতেও কোনো দরকার নেই। তবে আপনি তো গান গাইবেন বলেছেন কিনা,তাই আপনি না থাকলে আবার অনেকে কষ্ট পাবে। তাই বলতে এসেছিলাম।
চোখ বন্ধ করে দুই আঙুল কপালে স্লাইড করলো আদৃত। তারপর বিরক্তির সূরে বললো,
_আমি না থাকলে অনুষ্ঠান নষ্ট হয়ে যাবে না,যাও এখন।
কথাটা বলে আবারো বেঞ্চে বসে পড়লো আদৃত। হঠাৎ যেন ইশার মনে বিশাল সাহস চলে এলো। সে আদৃতের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
_আচ্ছা আপনি কি অন্য কারোর জন্য গান গাইতে চাইছেন না? লাইক কোনো শত্রু বা…
_ইশা আই সেইড গেট আউট অফ হেয়ার..
ইশার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই আদৃত উঠে দাঁড়িয়ে কিছুটা জোড়েই বললো কথাটা। অন্যসময় হলে হয়তো ইশা ভয়ে পালাতো,তবে আজ কোনো কারণে তার ভয় করছে না। ইশা আবারো ঢোক গিলে বললো,
_দেখুন এভাবে ঝাড়ি দেওয়ার কিছুই বলিনি। কলেজে তো আমারো কত অপছন্দের মানুষ আছে যাদের আমি সহ্য করতে পারিনা। এখন তাদের জন্য কি আমি পালিয়ে যাচ্ছি? যাচ্ছিনা তো। তাদের দিকে না তাকালেই হয়, আমি আমার মতো থাকছি তাড়া তাদের মতো।
_জ্ঞান দেওয়ার কি হলো? আর যদি দিয়েও থাকি তাতে দোষের কি আছে? হ্যা আপনি আমার চেয়ে বড় হতে পারেন, তবে ছোটদের থেকেও অনেক কিছু জানার থাকে। আর কোথায় লেখা আছে যে ছোটরা বড়দের কিছু বোঝাতে পারবে না?
কিছুটা থামলো ইশা। আদৃতের চোখে চোখ রেখেই কথাগুলো বলেছে সে। এবার ভীতু চোখে আদৃতের দিকে তাকালো,আদৃত কিছু বলছেনা দেখে ইশা আবারো বললো,
_আমি তখন স্পষ্ট শুনলাম আপনি বলছিলেন, উনি এখানে থাকলে আপনি কিছুতেই স্টেজ এ উঠবেন না। কাকে দেখে এমন বলেছেন আমি জানিনা, তবে আপনি যে কাউকে এত ভয় পাবেন সেটা ভাবিনি।
_হোয়াট? আমি কাকে ভয় পাচ্ছি?
_এইযে যার জন্য অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে এলেন। যদি তাকে ভয়ই না পাবেন,তাহলে তার থেকে পালাচ্ছেন কেন?
আদৃতের দিকে তাকিয়েই বললো ইশা। আদৃত নিজের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ইশার চোখের দিকে,মোটা করে কাজল লাগানো দুটি চোখে। এই চোখ দুটোই পাগল করে দিচ্ছে আদৃত কে। এর আগে বিদায় অনুষ্ঠান এর দিনও এভাবে কাজল পড়েছিল ইশা, এর মাঝেও দু একদিন পড়েছিল তবে খুব বেশি নয়। ইশার প্রশ্নের দিকে খেয়াল না করে আদৃত তার চোখের দিকেই তাকিয়ে রইলো। অদ্ভুত এক কথা বলতে ইচ্ছে হলো ইশাকে, “তুমি সবসময় এভাবে কাজল পড়োনা কেন?”
কথাটা নিজের মনেই থেকে গেলো,মুখ ফুটে সেটা বলা হলোনা। আদৃতের নজর খেয়াল না করলেও তাকে চুপ করে থাকতে দেখে অবাক হলো ইশা। সঙ্গে আরো কিছুটা সাহস পেয়ে বললো,
_আপনি থাকলেন কি না থাকলেন তাতে আমার কিছুই যায় আসেনা। আমার এমনিতে ইচ্ছে হলো তাই বললাম কথাটা। বাকিটা আপনার ব্যাপার, চাইলে আসবেন না চাইলে আসবেন না। অ্যাজ ইয়োর খায়েশ।
ইশার থেকে চোখ সরিয়ে নিলো আদৃত,এভাবে একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছেনা। ইশা আর আদৃতের কথার অপেক্ষা না করে উলটো দিকে ঘুড়ে পা বাড়ালো। তবে আদৃতের কিছু না বলা তার মনে ভীতির সৃষ্টি করছে। উনি কি রেগে গেলেন আমার কথায়? রাগলে রাগুক আই ডোন্ট কেয়ার। আর কিছু না ভেবে স্টেজ এর পিছনে গিয়ে দাড়ালো ইশা।
নাচের বাকি মেয়েরাও সেখানে অপেক্ষা করছে। ম্যাম তাদেরকে খুঁজেছিল তবে ইশাকে না পাওয়ায় অন্য এক ছেলে আবৃত্তি করতে উঠেছে স্টেজ এ। সে নামলেই তাড়া যাবে। সায়ান আর পূর্ণ সামনের দিকের চেয়ারেই বসে ছিল। জয়নাল স্যার এসে সামনে দাঁড়াতেই তাড়া দুজন উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। স্যার ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম’ বলে নিজের চশমাটা ঠিক করে আশেপাশে তাকিয়ে আদৃতকে দেখতে না পেয়ে বললেন,
_তা আদৃত কোথায়? একটু আগেই তো দেখলাম এখানে।
পূর্ণ সায়ান এর দিকে একবার তাকিয়ে নিচু স্বরে বলতে নিলো,
_স্যার আসলে আদৃত বোধ হয়..
_আরে ঐতো আদৃত।
পাশে তাকিয়ে হেসে কথাটা বললেন স্যার। পূর্ণ আর সায়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো আদৃত গম্ভীর মুখ করে এদিকে আসছে। সায়ান এর মুখ আপনা আপনি খুলে গেলো। হা করে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
_ইয়ে ক্যাসে হুয়া ভাই?
পূর্ণ ও আদৃতের দিকে তাকিয়ে একইভাবে বললো,
_আই ডোন্ট নো..
ছেলেটির আবৃত্তি করাও শেষ হয়ে গেছে। এবার ইশাদের স্টেজ এ যাওয়ার পালা। আদৃতকে আসতে দেখে অজান্তেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো ইশার। আদৃত তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিলো ইশা।
অত:পর সকলে একসঙ্গে স্টেজ এ উঠলো। আদৃত স্টেজ এর একপাশে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরলো, আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচ শুরু করলো ইশা এবং বাকি মেয়েরা।
পুড়োটা সময় আদৃতের নজর ছিলো ইশার দিকে। স্টেজ এর সামনে কারা আছে তার দিকে সে খেয়ালই করেনি, ইশার কথা অনুযায়ী কাজটি করেছে আদৃত। সামনে তাকিয়ে কোনোভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত সেই ব্যাক্তির দিকে চোখ পড়লে যে স্থির হয়ে থাকতে পারবে না সেটা ভালো করেই জানে আদৃত। অবশ্য সেসবের কথা মাথাতেও নেই আদৃতের। গান গাওয়ার মাঝে সে কেবলই মুগ্ধ নয়নে ইশাকে দেখছে।
সকলের হাততালির আওয়াযে হুশ ফিরলো আদৃতের। চোখের পলক ফেলে নিচের দিকে তাকিয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ইশাসহ বাকিরাও ধন্যবাদ বলে স্টেজ থেকে নেমে এলো। নামার সময় একবার পাশ ফিরে আদৃতের দিকে তাকিয়েছিল ইশা, পরমুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নেমে আসে। আদৃত ও নেমে যায় স্টেজ থেকে। সায়ান হাসিমুখে হাততালি দিলেও পূর্ণর নজর ছিলো আদৃত এর দিকে। ইশাকে পুকুরের দিকে যেতে দেখেছিল পূর্ন, তাহলে ইশার কথাতেই আদৃত চলে এলো!
অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কিছুক্ষন আগে। আদৃত স্টেজ থেকে নেমে কোথায় গেছে খেয়াল করেনি কেউ। স্টুডেন্ট রা নিজেরা আনন্দ করছে এখন, রঙ মাখাচ্ছে কেউ কেউ। সায়ান এক সাইডে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের দিকেই তাকিয়ে ছিল। পুর্ন ওর পাশে এসে ধাক্কা দিয়ে বললো,
_কিরে,ওদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি দেখছিস?
_আরে ভাই,ঐ মেয়েটাকে দেখ? কি সুন্দর! একদম জিরো ফিগার। তার সঙ্গে হাইটও মাশাল্লাহ। ঐ মেয়েটার বড় বোন হবে বোধ হয় তাইনা?
_তুই আর ভালো হবিনা তাইনা? আর মোহনার সঙ্গে কি করছিস তুই? তুই কি ভেবেছিস,লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করবি আর আমরা কেউ জানতে পারবো না?
পূর্ণর কথা শুনে সায়ান হঠাৎ হো হো করে হাসতে লাগলো।
সায়ানকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার কাছেই আসছিল মোহনা। তবে কিছুটা দূড়ে থাকতেই সায়ান এর কথা শুনে সেখানেই দাঁড়িয়ে যায় সে। খুব রাগ হয়েছিল তখন। তবে এখন সায়ান কে এভাবে হাসতে দেখে আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়াতে পারলো না মোহনা। চোখ থেকে নোনাজল গাড়িয়ে পড়তেই অন্যদিকে ঘুড়ে ছুটে চলে যায় একটা ক্লাসরুম এ।
#চলবে
#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_২৯
#মেহরিন_রিম
স্টেজ থেকে নেমে আবারো পুকুরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো আদৃত,সম্পূর্ন স্বাভাবিক সে। ক্ষনিক আগের রাগের লেশমাত্র তার মাঝে নেই তার চোখেমুখে। এমনটা হওয়া তার জন্য অস্বাভাবিক। কিছুক্ষন আগে রাগে সবকিছু ভাঙচুর করতে ইচ্ছে হচ্ছিল,সেখানে এখন সে শান্ত। হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক, কোনো চিন্তাই যেন তাকে ছুতে পারছে না। এমনটা কি করে হলো? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে আদৃত।
ইশার বলা কথাগুলো ভেবেছিলো আদৃত,ইশা চলে যাওয়ার পর একদৃষ্টিতে কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টায় সফল ও হয়েছে, যার কারণেই স্টেজ এ উঠেছে। ঐটুকু মেয়ের কথার এতটা প্রভাব পড়লো যে নিজের চিরচেনা রূপ থেকেই সরে এলো। শান্ত মস্তিষ্কেই পিছনে হাত গুজে কথাগুলো ভাবছে আদৃত। তার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে মনে হতেই ঘুড়ে তাকায় আদৃত। ধারণা সঠিক, কয়েক হাতের ব্যাবধানে ইশা দাঁড়িয়ে আছে। খুব বেশি অবাক হলোনা আদৃত, এমনিতেই তার মনে হচ্ছিল ইশা আসলে আসতেও পারে।
ইশা মাত্রই এসেছিল,আদৃত কে ঘুড়তে দেখে সে কয়েক সেকেন্ড একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর কিছুটা সামনে এগিয়ে বললো,
_আপনি তো বলেছিলেন যাবেন না,তাহলে গেলেন কেনো?
আদৃত তাচ্ছিল্যের সুলভ হেসে বললো,
_ওহ হ্যালো, আমি তোমার কথায় গিয়েছি এমনটা ভাবার কোনো কারণ যেই। আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই গিয়েছি দ্যাটস ইট।
ইশা পাশ ফিরে সামান্য ভেংচি কেটে বিরবির করে বললো,
_আপনি যে জীবনেও স্বিকার করবেন না এটা জানা আছে আমার।
_এই,কি বললে?
_ক ক কই? কিছু বলিনি তো। কিন্তু আপনার পারমিশন থাকলে,একটা কথা বলবো?
_সব কথা তো পারমিশন না নিয়েই বলছো।
_তাও অবশ্য ঠিক। কিন্তু কথাটা হচ্ছে গিয়ে, আপনি কাকে দেখে ওভাবে রেগে চলে এসেছিলেন?
_আগেই বলেছি,তোমার এতসব জানার দরকার নেই।
_আপনার আম্মুর সঙ্গে কখনো যদি দেখা হতো,আমি সত্যিই জিজ্ঞেস করতাম জন্মের পর আপনার মুখে মধু দেয়নি কেন? আপনার সঙ্গে তো ভালোভাবে কথাই বলা যায় না,যাই বলিনা কেন তাতেই প্রবলেম।
ইশার কথায় হাসি সরিয়ে নিলো আদৃত। তবে পরমুহূর্তেই অনাকাঙ্ক্ষিত একটি প্রশ্ন করে বসলো,
_তুমি নিজেও তো পালিয়ে যাচ্ছিলে ঐ ছেলেটাকে দেখে।
আদৃত এর প্রশ্নে ইশার মনে পড়লো কিছুক্ষন আগের কথা। নিরবকে কলেজে আসতে দেখেই সে বন্ধুদের থেকে অন্যদিকে চলে গিয়েছিল,আদৃত সেটাও দেখে ফেলেছে!
_আমি কারোর থেকে পালিয়ে যাইনি।
আদৃত কোন ধরণের কথা বলছে তা ওর মাথাতেই নেই। বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আবারো বললো,
_তাহলে? উবে গেল তোমার সো কলড ভালোবাসা?
ইশা আদৃতের পাশে এসে দাঁড়িয়ে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
_সেটা কি বলেছি আমি?
_তা না হলে ওকে দেখে অন্যদিকে চলে গেলে কেন?
_জানিনা.. আর আপনি আমাকে এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? আপনি তো অনেক বড় আমার থেকে,তাই আপনার তো এসব বিষয় আরো ভালো জানার কথা।
_কিভাবে?
_কেন? কখনো ভালোবাসেন নি কাউকে?
ইশার প্রশ্নে যেন বাস্তবে ফিরে এলো আদৃত। মনের অজান্তেই কিসব জিজ্ঞেস করছিল! বিভ্রান্তি প্রকাশ না করে আদৃত ছোট করে উত্তর দেয়,
_জানিনা..
_জানেন না মানে? এটা কোনো উত্তর হলো? ভালোবাসতে গেলে না কনফিডেন্স লাগে। আমি কিন্তু ভীষণ কনফিডেন্স ছিলাম শুধু বলতে পারিনি।
আদৃত ইশার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো। ইশা তার দিকে তাকিয়ে বললো,
_সময় থাকতে না বললে আপনিও আমার মতো তাকে হারিয়ে ফেলবেন। একটা সাজেশন দেই,কাউকে ভালোবাসলে সরাসরি গিয়ে বলে দিয়েন,নাহলে পরে পস্তাবেন।
কথাটা বলে একটু পিছনে তাকাতেই দেখলো ফাইজা মাঠের বিভিন্ন জায়গায় তাকে খুজছে। ইশা আদৃতের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে বললো,
_আপু আমাকে খুজছে, আমি গেলাম। আর হ্যা,আসার জন্য থ্যাংক ইউ নট।
চলে গেলো ইশা,আর আদৃত একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। ধীরেধীরে যেন নিজের অনুভূতিগুলোর মানে বুঝতে পারছে সে। নিজের মনে পুষে রাখা সব প্রশ্নের উত্তরগুলো পাচ্ছে আদৃত। আর তারই সঙ্গে ইশার বলা শেষ কথাগুলো ভেবে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে তার। সত্যিই কি তাই? সময় পেড়িয়ে গেলে পস্তাতে হবে!
_____
ফাইজা আর ইশা কলেজ থেকে বেড় হতে যাবে তখন ই সায়ান তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ইশার উদ্দেশ্যে বলে,
_ইশা তুমি মোহনাকে দেখেছো? আসলে আমি অনেক্ষন ধরে খুজে চলেছি,কোথাও পাচ্ছি না। ফোন করলাম,ফোন টাও বন্ধ।
_না ভাইয়া আমি তো..
_হ্যা হ্যা আমি দেখেছি। এইতো কিছুক্ষন আগে,মোহনা বলছিল ওর শরীরটা ভালো লাগছে না তাই বাসায় চলে যাচ্ছে। ইশাকে খুজে পাচ্ছিল না তাই আমাকে বলে গেছে। আর ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে হয়তো তাই ফোন ধরতে পারছেনা।
ফাইজার কথা শোনার পর আর এই নিয়ে মাথা ঘামালো না সায়ান। কিন্তু মোহনা তো কখনো এভাবে না বলে চলে যায়না, আরো আজকে সায়ান ওকে বলেছিল একটা জায়গায় ঘুড়তে নিয়ে যাবে। শরীর খারাপ লাগছিলো বলে না জানিয়ে চলে গেলো?
কিছুটা চিন্তা হচ্ছে সায়ান এর। তবে সেটা প্রকাশ না করে ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেলো সেখান থেকে। সায়ান চলে যেতেই ফাইজা ইশার উদ্দেশ্যে বললো,
_উনি বোধহয় মোহনা কে আসলেই ভালোবাসে রে ইশা। দেখলি না, মেহু চলে গেছে শুনে মুখটা কেমন কালো হয়ে গেলো?
_আমারো তাই মনে হচ্ছে। কি জানি, যদি তেমনটা হয় তাহলে তো ভালোই। মানুষটা ভালোই আছে, মিস্টার করলা যে এমন বন্ধু কি করে পেলো সেটাই বুঝতে পারি না।
_এই মিস্টার করলা টা কে রে?
_কেন? ঐযে মিস্টার আদৃত, ওনার সাথে এই নামটাই মানায়। কিন্তু ওনার এই দুজন বন্ধু বেশ ভালো, সায়ান ভাইয়া তো বেশ হাসিখুশি।
_আর আরেকজন?
_আর ঐযে পূর্ণ ভাইয়া,তিনিও ভালোই আছেন। কত সুন্দর করে কথা বলে, কি দেখে যে তারা এমন একজন বন্ধু বানিয়েছে?
পূর্ণর কথা শুনে মনে মনে হাসলো ফাইজা। সত্যিই পূর্ণ অনেক সুন্দর করে কথা বলে, পরিস্থিতির সঙ্গে ভালো করে মানিয়ে নিয়ে কথা বলতে পারে, যা তার বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়।
_কোথায় হারিয়ে গেলে আপু? মেহু নাকি চলে গেছে, তাহলে দাঁড়িয়ে আছো কেন? বাসায় যাবে না?
_হুম,হ্যা চল।
_____
দুপুর গড়িয়ে রাত হয়েছে,তবে মোহনা সেই যে কলেজ থেকে ফিরে ঘরে ঢুকেছে তার আর বের হওয়ার কোনো নামগন্ধ ও নেই। দুপুরে কিছু না খেয়েই ঘরে চলে এসেছে। সন্ধ্যা তার মা এসে অনেক্ষন ডেকেছে,মোহনা তবুও ঘর থেকে বেড় হয়নি।
রাতে খাবার সময় হতেই মোহনার বাবা এসে দড়জায় নক করতে লাগলেন।
_মোহনা? মা কি হয়েছে তোর? দুপুরেও নাকি কিছু খাসনি? এতক্ষন তো তুই না খেয়ে থাকতে পারিস না মা, এবার তো শরীর খারাপ করবে।
এর আগে তার মা ও এসে রাতে খাবারের জন্য ডেকে গিয়েছেন। এখন আবার বাবাও এসে খাওয়ার কথা বলতেই মোহনার মেজাজ টা বিগড়ে যায়। রুমের ভিতর থেকেই রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে বলে,
_সমস্যা কি তোমাদের? কখন থেকে খেয়ে নে খেয়ে নে কি শুরু করেছো এসব? একদিন না খেলে তোমার মেয়ে মরে যাবেনা। খাবোনা আমি,কিচ্ছু খাবোনা। চলে যাও তোমরা এখান থেকে।
#চলবে
[রিচেক করা হয়নি,ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন।
হ্যাপি রিডিং।]