Saturday, August 16, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 245



কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-০২

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_২
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

(অনুমতি ব্যতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

চলন্ত ট্রেনটা থেমে যাওয়ায় মেহবিন পুরোনো এক তিক্ত স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলো। সেদিনের পর তার জীবনটা আরো ছয় বছর এগিয়েছে। এখন মেহবিন মুসকান নামের আগে ডক্টর যুক্ত হয়েছে। সে এখন ডক্টর মেহবিন নামে পরিচিত। বেলা এগারোটায় ট্রেনটা থেমেছে। সে আস্তে ধীরে তার ব্যাগ নিয়ে ট্রেন থেকে নামলো গন্তব্য তার মহুয়াপুর নামক গ্রামে। সেখানের সরকারি হাসপাতালের ডক্টর হিসেবে দুদিন পর তার জয়েন হওয়ার কথা। এখানে তার পরিচিত কেউ নেই তাই সকাল সকাল এসেছে যদি আজ ঘর ভাড়া পাওয়া যায়। নাহলে আবার ফিরে যেতে হবে। আর বাধ্য হয়ে কোয়াটারে থাকতে হবে কিন্ত সে চায়না সেখানে থাকতে। তাইতো দুদিন আগেই এসেছে। হাতের ট্রলি ব্যাগ আর কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে সে রিক্সা খুঁজতে লাগল। একটা জায়গায় কয়েকটা রিক্সা দেখে সেখানে গিয়ে একজন রিক্সাচালক কে জিজ্ঞেস করল,,

“মহুয়াপুর গ্ৰামে যাবেন?”

রিক্সাচালক দাঁত কেলিয়ে বলল,,

“হ যামু তয় পঞ্চাশ টাহা ভাড়া।’

“সমস্যা নেই চলুন।”

তখন পাশ থেকে আরেকজন রিক্সাচালক বললেন,,

“আফা ও আপনার কাছে বেশি টাহা চাইতেছে মহুয়াপুরের ভাড়া ত্রিশ টাহা।আপনি নতুন দেইখা ও আপনার থেইকা বেশি চাইছে। আমি এহন ঐদিকেই যামু।আপনে আমারটায় আসেন আমি আপনারে পৌঁছায়ে দিতাছি।”

“তোর রিক্সায় যাইবো কেন ? উনি আমারে জিগাইছে তাই আমিই যামু। আফা আপনে ত্রিশ টাহাই দিয়েন।”

মেহবিন এতোক্ষণ দুজনের কথা শুনছিল। বুঝতে পারলো নতুন দেখে টুপি পরানোর চেষ্টা করছিল। তবে আরেকজন সৎ রিক্সাচালক কে দেখে ওর মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। মেহবিন প্রথম জন কে বলল,,

“নিঃসন্দেহে আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মানে আপনার রিক্সাতেই যেতাম। কিন্তু আপনি একটু লাভ করতে গিয়ে আমাকে নেওয়ার সুযোগ টা হাত ছাড়া করলেন। আমি ওনার রিক্সায় যাবো এটা ওনার সততার পুরস্কার। তবে আপনাকে একটা কথা বলি দয়া করে এই জিনিসটা করবেন না। নতুন দেখে তার কাছে থেকে বেশি টাকা নেবেন না। কারণ সে যদি জানতে পারে আপনি তার থেকে বেশি টাকা নিয়েছেন। তাহলে তার মনে আপনাকে নিয়ে একটা বিরুপ ধারনা হবে। এরপরে আপনাকে দেখলেও আপনার রিক্সায় যেতে চাইবে না।কারন তারা আপনার প্রথম ব্যবহার ভুলবে না। আমাদের সাথে ভালো বা খারাপ কিছু হলে আমরা খারাপটাই বেশি মনে রাখি। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।

এ কথা শুনে রিক্সাচালকটা মাথা নিচু করলেও বাকি রিক্সাচালকদের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। যার রিক্সায় যাবে সেই লোকটা মেহবিনের কাছে গিয়ে বলল,,

“আফা ব্যাগটা আমারে দেন। আমি উঠাই দিতাছি আপনে বসেন।”

মেহবিন হেঁসে লোকটাকে ব্যাগ দিয়ে রিক্সায় উঠে বসলো। লোকটা ব্যাগ উঠিয়ে দিয়ে রিক্সা চালাতে লাগলো। হুট করেই রিক্সাচালক বলল,,

“আপনে কিছু মনে কইরেন না আফা। ও একটু ঐরকমই নতুন কেউরে দেখলে একটু টাকা বাড়ায় নেয়। এমনিতে ভালো মানুষ । আসলে খালি রিক্সা চালায় খায় তো যদি দশ বিশ টাহা কইয়া বেশি নিতে পারে।”

মেহবিন মুচকি হাসলো গ্ৰামের মানুষেরা এরকমই সহজ-সরলই হয়। সে একজন রিক্সাচালক হয়েও আরেকজন রিক্সাচালক এর গুনগান করছে। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“আপনার নাম কি ভাই?”

“আমার নাম আবুল মিয়া!”

“আচ্ছা আবুল ভাই আপনিও রিক্সা চালান আপনি তো টাকা বাড়িয়ে বললেন না। উল্টো টাকা বাড়িয়ে বলাতে প্রতিবাদ করলেন।”

“আমার এতো টাহার দরকার নাই। আমি একজন কৃষক আমার একটু জমি আছে ক্ষেতের কামের পাশাপাশি রিক্সা চালাই। কারন ঐটুকু জমিতে তেমন ভালো আয় হয় না। রিক্সা চালাইয়া আর ঐ জমি থেইকা যা আয় হয় তা দিয়াই সংসার ভালো মতো চইলা যায়। তাছাড়া আমার আব্বা আমারে ছোটবেলায় একবার কইছিলো। জীবনে চাইলে অনেক রোজগার করতে পারবি কিন্তু অসৎ পথে কিছু করলে সেটা ধইরা রাখতে পারবি না আর সুখী ও হবি না। সৎ পথে রোজগার করলে হয়তো কম টাকা রোজগার করতে পারবি কিন্তু দিনশেষে সুখী হবি। অসৎ পথ বাইছা নিবি মানে আল্লাহ তোর ওপর নারাজ হইবো। সৎ পথে থাকবি আল্লাহ তোর ওপর খুশি হইবো। এরপর থেইকা আমি নিয়্যত করছি জীবনে নুন ভাত খাইলেও অসৎ পথে রোজগার করুম না। জীবন তো আল্লাহ একটাই দিছে অসৎ পথে না কামাইয়া, সৎ পথে একটু কম খাইয়া আল্লাহরে খুশি কইরা নিজেও একটু সুখী হইয়াই মরলাম।”

কথাটা শুনে মেহবিনের মনে প্রশান্তি ছেয়ে গেল। মেহবিন বলল,,

“আল্লাহ তায়ালা আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করবেন ইনশাআল্লাহ।রাসূল(সাঃ) বলেছেন,
“সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল,আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে!
[সহীহ বুখারী:০১]

“এইডা আমি জানি ছোটবেলায় পরেছিলাম এহন সময় নাই পরার। আইচ্ছা আপনি কাগো বাড়ি যাইবেন?”

“আসলে আমি এখানের কাউকে চিনি না ঢাকা থেকে এসেছি । এখানের হাসপাতালে আমি ডাক্তার হিসেবে জয়েন করবো দুদিন পর। যদি বাসা ভাড়া পাওয়া যায় এই জন্য দুদিন আগেই আসলাম।”

“তারমানে আপনে ডাক্তার।”

“জি !”

“কিন্তু আমগো গ্ৰামে তো কোন বাড়ি ভাড়া দেয় না।”

“তাহলে কি করে হবে? একটা বাসার দরকার আমার। এখানে তো আর পরিচিত কেউ নেই।”

“আরে আপনি চিন্তা কইরেন না আমগো চেয়ারম্যান খুব ভালো। শহর থেইকা কেউ দুই দিনের জন্য আইলে হেগো বাড়িতেই থাকে। হেগো বাড়িও অনেক বড় সেই আগেকার জমিদার গো মতো।”

“আমি তো আর দুদিন থাকবো না আবুল ভাই। এখানেই থাকবো কতদিন তার ঠিক নেই। অন্যের বাড়িতে থাকাটা ভালো দেখায় না। আপনি একটু দেখেন না কেউ বাসা ভাড়া দেবে কি না।”

“আইচ্ছা সমস্যা নাই আমি খোঁজ লাগামু নে। ভাই যখন ডাকছেন তাহলে এই ভাই আপনারে সাহায্য করবো। ততক্ষণ আপনে বরং আমার বাড়ি চলেন পরাই আইসা পরছি আর পাঁচ মিনিট লাগবো।”

এই মুহূর্তে ওর কি করা উচিত জানা নেই। হুট করে এভাবে অপরিচিত মানুষের বাড়ি যাওয়া কি ঠিক হবে। ভাবতে ভাবতে আবুল মিয়া বলে উঠলো,,

“এই কুদ্দুস দৌড়াইয়া কই যাস?”

মেহবিন দেখলো চল্লিশ বছর বয়সি এক লুঙ্গি আর ফতুয়া পরিহিত লোক আবুল মিয়ার কথা শুনে দাঁড়িয়ে পরলো। আর কুদ্দুস নামক লোকটা বলল,,

“আর কইস না ঐ চেয়ারম্যানসাবের এর পাগল মাইয়া আজ আবার সিড়ি থেইকা পইরা মাথা ফাটাই ফালাইছে। কিন্তু তারে যে ডাক্তার দেহে হে শহরে গেছে। তাই হাসপাতালে যাইতেছি ডাক্তার আনতে হেতিরে তো আর হাসপাতালে নিবো না ডাক্তারই আনা লাগবো। হেতি তো আবার সব ডাক্তার আর রক্ত সহ্য করবার পারে না।মেলা রক্ত পরতাছে কি যে করি?”

“ও আইচ্ছা তোর আর হাসপাতালে যাওয়া লাগবো না আমার রিক্সায় যে আছে হেও একজন ডাক্তার শহর থেইকা আইছে। আমি চেয়ারম্যান বাড়ি লইয়া যাইতেছি। কি আফা পারবেন তো।”

মেহবিন তখন বলল,,

“জি পারবো। আমার কাছে সবকিছুই আছে। আপনি চেয়ারম্যান বাড়ি চলেন আবুল ভাই। আর আপনি আমার বড় আবুল ভাই আমাকে তুমি বা তুই করে বইলেন।

“হেইডা কওয়া যাইবোনে। লও এহন যাই আর কুদ্দুস তুই ও যা আমরা আসতেছি।”

কুদ্দুস নামক লোকটা এক দৌড়ে চলে গেল। আবুল ও চলল মেহবিন কে নিয়ে কয়েক মিনিটের মাথায় ওরা পৌঁছে গেল। মেহবিন রিক্সা থেকে নেমে সামনে তাকাতেই দেখলো আবুল ঠিকই বলেছিল কোন জমিদার বাড়ির থেকে কম না। আগেকার জমিদারদের বাড়ির মতো বাড়িটি দুই তালা বিশিষ্ট। মেহবিন আবুল এর সাথে চলতে লাগলো । সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই কতগুলো মুখকে দেখতে পেল সবাই বেশ চিন্তিত বোঝা যাচ্ছে। যার মাথা ফেটে গেছে সে সোফায় বসে আছে তার পাশে একজন কাপড় দিয়ে রক্ত পড়া যায়গায় চেপে ধরে রেখেছে। মেহবিন ঢুকতেই কুদ্দুস বলল,,

“ওই যে চেয়ারম্যানসাব ডাক্তার আইসা পরছে।”

চেয়ারম্যান সদর দরজায় তাকালেন। রিক্সাচালক আবুলের সাথে একটা কালো বোরকা হিজাব পড়া একটা মেয়ে। মেহবিন মেয়েটাকে দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলো। তখন চেয়ারম্যান বললেন,,

“সাবধানে মিশুর রক্তে ফোবিয়া আছে‌। আর ও কিন্তু সবাইকে ওর ট্রিটমেন্ট করতে দেয় না আঘাত ও করতে পারে।”

মেহবিন ওর ব্যাগ খুলে সব বের করতে করতে বলল,,

“চিন্তা করবেন না আমি পারবো। আপনার মেয়ে কি অজ্ঞান হয়ে গেছে না এখনো জ্ঞান আছে।”

তখন মিশু নামক মেয়েটা থেমে থেমে বলল,,

“আম্ আমমি এত্ টটাও দূররর্বল না আররর ভীতততউ ও না শু শুধু রররক্ত সহ্য ককককরতে পারিহ্ না। তাআআই চো’চোখ বব্ বন্ধ করর্ রে
আ আছি।”

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“বাহ তাহলে তো তুমি বেশ সাহসী। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি ভীতু। তো দেখি তুমি কেমন সাহসী একটু চোখ খুলো তো।”

মেহবিনের কথা শুনে মিশু নামক মেয়েটার কেন যেন ভয়টা কমে গেল। তবুও রক্তে যেহেতু ফোবিয়া তাই ভালোভাবেই না তুতলিয়ে বলল,,

“না না আমি চোখ খুলবো না। রক্ত রক্ত রক্ত!”

“ওকে ওকে রিল্যাক্স চোখ খুলতে হবে না। আমি তাহলে রক্ত মুছে ফেলি তারপর তুমি চোখ খুলো ঠিক আছে।”

তখন মিশু আদুরে গলায় বলল,,

“আচ্ছা ঠিক আছে কিন্তু তুমি কিন্তু ব্যাথা দেবে না। আর হ্যা ওষুধ ও দেবে না খুব জ্বালাপোড়া করে আমার একটু সহ্য ও হয় না।”

“আরে তুমি না সাহসী এই একটু জ্বালাপোড়া সহ্য করতে পারবে না। সাহসী মেয়েরা যাই হয়ে যাক না কেন কোন কিছু তে ভয় পায় না। ভয় পায় তো ভীতুরা সাহসী মেয়েরা কোন কিছুতে ভয় পায় না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে আমিও ভয় পাবো না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

মেহবিন যে কাপড় ধরে রেখেছিল তাকে বলল মাথাটা সোজা করে ধরতে। আঘাত পেয়েছে কিন্তু গভীর ক্ষত হয় নি এই জন্য চিন্তার কারণ নেই। মেহবিন আস্তে আস্তে রক্ত পরিষ্কার করতে লাগলো যেই না ওষুধ লাগালো মেয়েটা চিৎকার করে মেহবিনের বা হাতে কামড় দিয়ে ধরে রইলো হুট করে এমন হওয়ায় বাড়ির সবাই হতভম্ব। মেহবিন একটু আওয়াজ করে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিল। তখন চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,,,

“মিশু কি করছো কি? ডাক্তার ব্যাথা পাচ্ছে তো ছাড়ো ওনাকে।”

বাবার কথা কানে যেতেই মিশু ছেড়ে দিল। হাত ছাড়া পেতেই মেহবিন দেখলো হাতে কামড়ের দাগ বসে গেছে রক্ত ও বের হচ্ছে হালকা হালকা। মেহবিন একবার হাত বুলিয়ে তারপর বলল,,

“তো এবার কি ওষুধ দিয়ে তোমার ব্যান্ডেজটা করতে পারি।”

মেহবিনের এমন কথায় সকলে ওর দিকে অবাক চোখে তাকালো। মিশু নিজেও এখন চোখ খুলে মেহবিনের দিকে তাকালো। মেহবিন কে দেখে মিশু একদম শান্ত হয়ে গেলো। মিশুর কি হলো মেহবিনের চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। মেহবিন যত্ন সহকারে ওষুধ লাগিয়ে দিলো মিশু আর একটা শব্দও করলো না।এটা সবাইকে বেশ অবাক করলো কারন মিশু আঘাত সহ্য করতে পারে না। মেহবিন চেয়ারম্যান সাহেব কে একটা কাগজে ওষুধের নাম লিখে দিয়ে ওগুলো আনিয়ে নিতে বলল। সব কাজ শেষে মিশুকে বলল,,

“বাহ তুমি তো দেখি সাহসী হয়ে গেলে!”

তখন মিশু বলল,,

“হুম তোমায় দেখে।”

মেহবিন হাসলো আর বলল,,

“ভালো তো এখন কিছু খেয়ে ওষুধ খাও তারপর একটা ঘুম দাও দেখবে ব্যাথা অনেক কমে যাবে।”

“উঁহু আমি যাবো না তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবো তুমি কতো সুন্দর।”

“তাই বুঝি কিন্তু তুমি আমার থেকেও সুন্দর শুধু একটু অগোছালো। এখন নিজের রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।

“আচ্ছা নেব যদি তুমি আমার বন্ধু হও তবে!”

“যদি না হই তাহলে?”

“তাহলে আমি কিছুই করবো না এই যে বসে রইলাম।”

“আচ্ছা ঠিক আছে হবো তোমার বন্ধু।”

“তাহলে হাত মেলাও।”

বলেই মিশু হাত এগিয়ে দিল। মেহবিন ও এগিয়ে দিল কিন্তু মিশু মেহবিনের হাত ধরে জোরে জোরে নাড়াতে লাগলো আর খিলখিল করে হাসতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর মেহবিনের হাত ছেড়ে বলল,,

“এটাকে বলে মিশুর হ্যান্ডশেক। এখন তাহলে আমি রুমে যাই আর হ্যা তুমি আমার বন্ধু হলে আমার সব কথা শুনবে ঠিক আছে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

মিশু হেঁসে উঠল হয়তো কেউ ওর কথা শুনবে এই জন্য। তখন চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,,

“আরিফা যাও মিশুকে নিয়ে ওপরে যাও। আর ওকে কিছু খায়িয়ে দাও।”

আরিফা নামক মহিলা মিশুকে নিয়ে চলে গেল। মেহবিন একবার ভালো করে মিশুকে দেখলো বয়স উনত্রিশ কি ত্রিশ হবে কিন্তু মনে হলো একটা পাঁচ বছরের অবুঝ বাচ্চা। যদিও ওর মনে আছে কুদ্দুস বলেছিল চেয়ারম্যান এর পাগল মাইয়া তাই তো কামড় খেয়েও কোন রিয়াক্ট করেনি। চেয়ারম্যান সাহেব হুট করে বললেন,,

“আপনাকে ধন্যবাদ সবকিছুর জন্য এবং দুঃখিত ও সবকিছুর জন্য! আসলে ও একটু অসুস্থ।

“এটা আমার দায়িত্ব ছিল। ডাক্তারদের দায়িত্বই মানুষের সেবা করা। তাছাড়া আপনার মেয়ের কথা শুনেই বুঝেছিলাম সে স্বাভাবিক নয়। তাই দুঃখিত হওয়ার কারন নেই।”

“তা আপনাকে তো এর আগে কোনদিন এ গ্ৰামে দেখিনি? আপনার নাম?

“আমি ডক্টর মেহবিন আজই এসেছি গ্ৰামে। আপনি তো এই এলাকার চেয়ারম্যান তাই না?

“হুম এই এলাকার চেয়ারম্যান শেখ শাহনাওয়াজ। তবে আমি সবার কাছে চেয়ারম্যানসাহেব নামেই পরিচিত।

“ওহ আচ্ছা। তাহলে আজ উঠি।”

তখন আবুল এগিয়ে এসে বলল,,

” চেয়ারম্যান সাব একটা কথা ছিল। আসলে এই উনি দুইদিন পর আমগো হাসপাতালে ডাক্তারি করবো। এহানে ওনার চেনা জানা নাই তাই আগেই আইছে যদি কোন ঘর ভাড়া পাওয়া যায় হের লাইগা।”

“তাহলে আপনার এখানে আসা উচিত হয় নি। আপনাকে দেখে শহরের মনে হচ্ছে। শহরে ছেড়ে এখানে আসাটা আমার উচিত হয় নি। কয়েক মাস আগেই এখানের হাসপাতালের একজন ডাক্তার খুন হয়েছিল। তাছাড়া হাসপাতালের ডাক্তারদের কোয়াটারের ব্যবস্থা আছে তো।

এ কথা মেহবিন বলল,,

“আসলে আমার শহরের থেকে গ্ৰামের মানুষদের সেবা করার বেশি ইচ্ছে। তাছাড়া যে ডক্টর খুন হয়েছে নিশ্চয়ই কারো বারা ভাতে ছাই দিয়েছিল তাই তার সাথে এরকম হয়েছে। আমি এসেছি মানুষের সেবা করতে। সবথেকে বড় কথা আমি কোয়াটারে থাকতে চাইনা তাই একটা বাসা খুঁজছি।”

“আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আপনি আমাদের সাথে আমাদের বাড়িতে থাকতে পারেন। এখান থেকেই হাসপাতালে যাবেন। আমাদের বাড়িতে অনেক গুলো রুম ফাঁকা আছে।”

“দুঃখিত আপনার প্রস্তাব গ্ৰহন করতে পারছি না । আপনার আপত্তি না থাকলেও আমার আপত্তি আছে এখানে থাকতে। আপনি যদি অন্য কোথাও একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেন তাহলে বেশ উপকৃত হতাম।

তখন চেয়ারম্যান সাহেব এর পাশে এসে আরিফা নামক মহিলা বললেন,,

“একা একটা মেয়ে গ্ৰামে একা থাকাটা ভালো দেখায় না। তাছাড়া গ্ৰামে একা একটা মেয়ে থাকাটাও রিক্স।কখন কি হয়ে যায়।

“আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি একা থাকতে পারবো। আমার অভ্যেস আছে‌। আল্লাহর রহমতে এটুকু সাহস আছে রাতে একটা গাছের নিচেও থাকতে পারবো। তাছাড়া আমার সুরক্ষার জন্য আমি নিজে যথেষ্ট। চেয়ারম্যান সাহেব যদি সাহায্য করতে পারেন তাহলে করবেন নাহলে আমি নিজেই খুঁজে নিচ্ছি। এতো বড় গ্ৰাম একটা না একটা ঘর তো নিশ্চয়ই পাবো থাকার জন্য। যদি তাও না হয় তাহলে বাধ্য হয়ে কোয়াটারে থাকতে হবে এই আর কি।

কথাটা বলেই মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকালো। ওকে তাকাতে দেখে শেখ শাহনাওয়াজ চোখ নিচু বললেন,,

“আপনি আজ যা করলেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আপনার বাড়ি খুঁজতে হবে না। যেহেতু আপনি এখানে থাকতে চাইছেন না তাহলে আমার আরেকটা বাড়ি আছে। হাফ ওয়াল ওপরে টিনশেড বাথরুম সব ভেতরেই টিনশেড হলেও বাড়িটা বেশ সৌখিনভাবেই বানিয়েছিলাম। ওখানে কেউ থাকে না আপনি চাইলে সেখানে উঠতে পারেন।

একথা শুনে চেয়ারম্যান বাড়ির সকলে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল‌। কারন বাড়িটা তার অনেক শখের সে এখন অব্দি কাউকে ও বাড়িতে থাকতে দেয় নি। আর আজ একটা অচেনা মেয়েকে সেই বাড়িতে থাকতে দিচ্ছে। এ কথা শুনে আরিফা বেগম বললেন,,

“ও বাড়িতে কেন? আজ পর্যন্ত এই বাড়ির কাউকে ও বাড়িতে থাকার অনুমতি দেন নি। তাছাড়া একটা মেয়ে একা কিভাবে ও বাড়িতে থাকবে।”

“দিই নি বলে মনে দেব না তা তো কোন কথা নেই তাই না। আচ্ছা বাদ দাও তুমি। এবার আপনি বলুন আপনার আপত্তি নেই তো?”

“না কোন আপত্তি নেই বরং এটা আমার জন্য প্লাস পয়েন্ট। কারন ওটা যদি আপনার বাড়ি হয়ে থাকে তারমানে দ্বিতীয় চেয়ারম্যান বাড়ি।আমি ওখানে একা থাকলেও আপনার কথা ভেবেই কেউ আমাকে ডিসটার্ভ করবে না। তবে হ্যা বাড়ি ভাড়া কিন্তু নিতে হবে আপনাকে। কতো দিতে হবে সেটা যদি বলতেন?

তখন চেয়ারম্যান সাহেব হেঁসে বললেন,,

“না দিলেও সমস্যা হতো না কারন ওটা এমনিই পরে আছে। আপনি যেহেতু দিতেই চাইছেন তাহলে দুই হাজার টাকা দিয়েন।”

“মাত্র দুই হাজার?”

“কেন কম হয়ে গেল বুঝি!”

“ঢাকার তুলনায় তা একটু হলো আর কি! যাই হোক শুকরিয়া সবকিছুর জন্য ‌।

“পেমেন্ট মাস শেষে করলেই হবে এডভান্স করতে হবে না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

“দুপুর তো হয়েই এলো আপনি বরং এখানে দুপুরের খাবার খেয়ে নিন । আপনার বাড়ি পরিস্কার করাই আছে শুধু ঝাড়ু দিতে হবে টেনশন করবেন না।”

“ধন্যবাদ কিন্তু আমার খিদে পায় নি। আমি বরং আপনার বাড়িতে গিয়ে দেখি কতটা করতে হবে। আপনি বরং বাড়ির চাবিটা দিন আমাকে।

শেখ শাহনাওয়াজ নিজের রুম থেকে চাবি নিয়ে এলেন আর বললেন,,

“আমার শখের একটা অংশ ঐ বাড়ি। আশা করছি বেশ যত্নেই থাকবে।”

এ কথা শুনে মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“আমি কোন বাচ্চা নই চেয়ারম্যান সাহেব। ভয় নেই আপনার বাড়ি ভেঙ্গে ফেলবো না। তবে হ্যা কোন সময় আমি থাকতে যদি ভূমিকম্পে বাড়ি ভেঙ্গে যায় তাহলে তার দায় আমি নিতে পারবো না। আসছি সবকিছুর জন্য শুকরিয়া।”

বলেই মেহবিন আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। পেছনে আবুল ও বের হলো। মেহবিন যেতেই সবাই চেয়ারম্যান বাড়ির সকলে তাকিয়ে রইল শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে। তা দেখে শাহনাওয়াজ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“ও বাড়িটা এমনিতেও পরে থাকে তার থেকে যদি কেউ থাকে তাহলে বাড়িটার একটু যত্ন হবে। সবথেকে বড় কথা মেয়েটা মিশুর জন্য যেটুকু করেছে তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। মিশুর বন্ধু হয়েছে তার জন্য এটুকু করাই যায়।”

তখন আরিফা জামান বললেন,,

“আচ্ছা আজ পর্যন্ত আপনার কথা মেনে নিই নি কখনো হয়েছে আজ ও মেনে নিলাম। কিন্তু আরবাজ ও কি মেনে নেবে?”

“আরবাজ শাহনাওয়াজ আমার সন্তান। সব শুনে নিশ্চয়ই মেনে নেবে।”

“আপনাদের বাপ ব্যাটার ব্যাপার আমি বুঝি না। আর কুদ্দুস আসেনা কেন মিশুকে তো ওষুধ খাওয়াতে হবে। মেয়েটার যে স্বভাব না খেয়েই ঘুমিয়ে পরে নাকি।”

_________________

আবুল এসেই রিক্সা চালাতে শুরু করলো কিছু দূর যেতেই আবুল বলল,,

“এতো ভালো বাড়িতে থাকবার কথা কইছিল চেয়ারম্যানসাহেব তাও আবার আপত্তি করলা কেন তুমি ‌‌?

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“আসলে আবুল ভাই আমার একটা ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে। ওনাদের বাড়িতে থাকলে নিশ্চয়ই না চাইতেও একটা নিয়মের ভেতরে থাকতে হবে। সব থেকে বড় কথা একটা ভুল পেলে তখন উনারা কথা শোনাতে ছাড়বেন না। যেটা আমার পোষাবে না কারন আমি নিজেই আমার মর্জির মালিক।”

“হুম বুঝছি তোমার বাড়ি পরিস্কার করতে হইবো না আমি আমার বউরে কইয়া দিতাছি হেই পরিস্কার কইরা দেবনে। এমনিতেও অনেক দূর থেইকা আইছো তুমি একটু আরাম করো।”

“শুধু শুধু ভাবিকে কেন কষ্ট দিবেন আবুল ভাই আমি পারবো।”

‘তুমি না আমারে ভাই ডাকো তাইলে আমি আমার বইনের জন্য এইটুকু পারুম না। নামো আমার বাড়ি আইসা পরছে তুমি কয়টা খায়া লও আজ আমার বউ সকালে কই মাছ রানছিল। তার রান্ধন অনেক মজা।”

আবুলের কথা বলার ভঙ্গিতে মেহবিন হেঁসে ফেললো। আবুল রিক্সা থেকে ব্যাগ নিয়ে ডাকতে লাগল,,

“ফাতেমার মা ও ফাতেমার মা! কই গেলা তুমি দেহো কেরা আইছে তোমার বাড়ি।”

আবুলের হাঁক ডাকে ওনার বউ বের হয়ে আসলো। আর বের হয়ে তার স্বামীর সাথে ব্যাগ আর একটা মেয়েকে দেখে চমকে উঠলেন আর কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললেন,,

“আপনে আরেকটা বিয়া কইরা নিয়াইছেন। আপনে এমনটা করতে পারলেন। ঐ ফাতেমা কোনে গেলি দ্যাখ তোর বাপ তোর জন্য নতুন মা নিয়াইছে এহন আমারে এই বাড়ি থেইকা বাইর কইরা দিব।”

বলেই মহিলাটা কেঁদে উঠলেন। এটা দেখে মেহবিন আর আবুল দু’জনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। এদিকে মায়ের কথা শুনে ফাতেমাও বের হয়ে এসেছে। আবুল ব্যাগ রেখে দৌড়ে গিয়ে ফাতেমার মাকে বলল,,

“আসতাগফিরুল্লাহ নাউযুবিল্লাহ কি কও এইসব আমি কেন বিয়া করুম? তুমি কি মরছো নাকি।”

‘তারমানে আমি মরি নাই দেইখা বিয়া করেন নাই‌। ওরে নিয়াইছেন আমি মরলে ওরে বিয়া করবেন।”

“আসতাগফিরুল্লাহ নাউযুবিল্লাহ কি কও এইসব।”

মেহবিন না চাইতেও হেঁসে ফেললো গ্ৰামের মেয়েরা কি এরকমই সহজ সরল। মেহবিন এবার এগিয়ে গিয়ে বলল,,

“ভাবি চিন্তা করবেন না আমাকে আবুল ভাই বিয়ে করার জন্য আনে নি। সে তার বউকে অনেক ভালোবাসে তাই অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ভাববেও না। আসলে আমি আজই গ্ৰামে এসেছি চেয়ারম্যান বাড়ির আরেকটা বাড়িতে ভাড়ায় উঠেছি। আবুল ভাই আমার সাথেই ছিল তাই এখানে নিয়ে এসেছে।”

তখন ফাতেমার মা হেঁসে বলল,,

“তুমি সইত্য কইতেছো?”

“হুম সত্যি বলছি।”

“ফাতেমার বাপ আপনের আগে কইবেন না আমারে।’

‘তুমি কইতে দিলা কখন। তোমার মাথায় যে গোবর আছে হেইডা জাইনাই তো আমি তোমারে বিয়া করছিলাম।

“আপনে আবার আমারে,,

“আচ্ছা বাদা দাও যাও খাওন বাড়ো। ডাক্তার আফায় আমগো লগে খাইবো। তারপর তুমি আর ফাতেমা গিয়া বাড়িঠা পরিস্কার কইরা দেও। ততক্ষনে ডাক্তার আফায় আরাম করুক।”

তখন ফাতেমা নামক মেয়েটা বলল,,

“তারমানে আপনি ডাক্তার?”

‘হুম!”

“আপনি জানেন আমারও শখ একদিন ডাক্তার হমু।”

“বেশ তো মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করো ইনশাআল্লাহ একদিন ডাক্তার হবে। তা কোন ক্লাসে পড়?”

“ক্লাস এইটে ।”

তখন আবুল বলল,,

‘হইছে আবার পরে গপ্পো করিস। ফাতেমা যা ওনারে কলপারে নিয়া যা।”

মেহবিন হাত মুখ ধুয়ে ওদের সাথে খেতে বসলো। মেহবিন জানতে পারলো আবুলের একটা ছেলেও আছে ক্লাস থ্রিতে পরে এখন সে স্কুলে আছে। খাওয়া শেষ করে মেহবিন ও গেল তাদের সাথে নিজের ঘর নিজেও না হয় একটু পরিস্কার করুক। আবুল আর ওনার বউ মানা করেছিল কিন্তু ও শুনেনি। আবুল ওদেরকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। পাকা রাস্তা থেকে একটা গলির মতো কাঁচা রাস্তা আছে সেদিক দিয়ে দুই তিন মিনিট গেলেই চেয়ারম্যানসাহেব এর বাড়ি। চারদিকে সিমেন্ট এর বর্ডার করা একটা বাড়ি। হাফওয়াল ওপরে টিনশেড গেটের সামনে দাড়াতেই মেহবিনের ভেতরে একটা শীতল বাতাস বয়ে গেল। ওর বাড়ির সামনেই রাস্তার ওপাশে অনেক গুলো বাড়ি সবগুলোই টিনশেড এর। কিন্তু এই বাড়ির ডানে বামে আর কোন বাড়ি নেই। মেহবিন চাবি দিয়ে প্রথমে গেটের তালা খুললো এই বাড়ির তালা খুলতে দেখে রাস্তার ওপাশে থেকে কিছু মহিলাবিন্দু বের হয়ে এগিয়ে এলেন। মেহবিন বাড়ির ভেতরে ঢুকলো তখন পেছন থেকে এক মহিলা ফাতেমার মাকে জিজ্ঞেস করলেই মেহবিন এর কথা জানালো আর এখানে থাকবে বলল। মেহবিন আর দাড়ালো না সে গিয়ে বাড়ির তালা খুললো সামনে বারান্দা চারদিকে লোহার গ্ৰিল দেওয়া। দুটো রুম করা বাড়িটায় বারান্দায় একপাশে বাথরুম আরেক পাশে রান্না ঘর বলতে গেলে গ্ৰামের মধ্যে শহরের ছোঁয়া। রুমের তালা খুলে মেহবিন বুঝলো বাড়ির পেছন দিকেও বারান্দা আছে আর পেছনে বড় একটা পুকুর আছে। তাছাড়াও বাড়িটা বেশ পরিস্কার মাসে বা পনেরোদিনে পরিষ্কার করা হয়। গ্ৰামের মাঝে এরকম একটা জায়গায় বাড়ি সত্যি চমৎকার। সবশেষে মেহবিনের মনে হলো রেডিমেট ফ্ল্যাটের মতো। দুই ঘরে দুইটা খাট একরুমে চেয়ার টেবিল আলমারি। আরেকটা রুমে ড্রেসিং টেবিল আর আলনা। চেয়ারম্যান সাহেব সৌখিন ভাবে যে বানিয়েছে তাই এরকম। তিনজন মিলে বাড়িটা পরিস্কার করে নিল। ফাতেমা আর ফাতেমার মা চলে গেল। মেহবিন পুরো বাড়িটা আরো একবার দেখলো। ফোনে একটা মেসেজ আসতেই মুচকি হেঁসে রিপ্লাই করলো,,

“আমি আমার গন্তব্যের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে গিয়েছি।”

~ চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-০১

0

কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_১
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

“তুমি যেই মেয়ের জন্য আমার মেয়েকে রিজেক্ট করছো। কিন্তু সত্যি তো এটাই সেই মেয়েটা এই বাড়ির কেউ নয়। ও আমার মেয়ে নয়। এমনকি ওর সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্কও নেই।’

যাদের এতকাল নিজের মা বাবা বলে জানতো। হুট করেই এতবছর পর সে আসল সত্য জানতে পারলো। আসলে এরা তার আপন মা বাবা নয়, এই বাড়িটা তার নয়, এমনকি এ পরিবার টাও তার নয়। এরকম একটা পরিস্থিতিতে একটা মানুষের কি আচরণ করা উচিত। এটা জানা নেই মেহবিনের? কিন্তু সে নিজের সম্পর্কে জানার পরেও দুই হাত ভাঁজ করে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের মানুষ গুলোর দিকে। এই মানুষগুলোই তার পরিবার হিসেবে সকলে জানতো। যে পরিবার কে এতকাল নিজের পরিবার হিসেবে জানলো, যে বাড়িটা কে নিজের বাড়ি বলে জানলো,যাদেরকে এতকাল নিজের বাবা মা বলে জানলো। আসলে তারা মেহবিনের আপন কেউ নয়‌। হুট করেই এত বড় সত্য জানতে পেরে পুরো আহমেদ ভিলা একদম শান্ত হয়ে গেছে। অথচ এই বাড়িটায় আজ সকাল থেকেই অনুষ্ঠানের আমেজ ছিল। এখন সবার দৃষ্টি মেহবিনের দিকেই কিন্তু তার কোন রিয়াকশন নেই। হুট করেই মেহবিনের মা সাবিনা আহমেদ বললেন,,

“এসব কি বলছেন আপনি? দয়া করে চুপ করুন।”

এ কথা শুনে মিস্টার আলম আহমেদ ক্ষিপ্ত কন্ঠে আবার ও বললেন,,

“কেন ? আমি কেন চুপ করবো। এটা তো সত্যি এই মেয়েটা আমাদের কেউ নয়। এই মেয়েটাকে আমরা রাস্তায় পেয়েছিলাম। আমাদের গাড়ির সাথে ভুলবশত ধাক্কা লেগে এক্সিডেন্ট হয়েছিল। যার জন্য ওকে আমরা আমাদের সাথে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ওকে এনে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। ওকে না আনলে নিজের মেয়ের এতো বড় সর্বনাশ দেখতে হতো না। আজ এই মেয়ের জন্য আমার মেয়ের হওয়া বিয়ে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কারণ ছেলে জানালো তার আমার মেয়ে শিলাকে নয় এই মেয়েটাকে পছন্দ।”

“এখানে ওর দোষ কোথায়? মেহবিন তো বলেনি তাকে পছন্দ করতে। এখানে মেহবিনের কোন দোষ নেই।”

“তুমি চুপ করো। রাস্তার মেয়ের জন্য তুমি আমার সাথে তর্ক করছো।”

“মেহবিন রাস্তার মেয়ে নয়। ও আমার মেয়ে শুনেছেন আপনি।’

বলতে বলতেই সাবিনা আহমেদ মেহবিনের সামনে গিয়ে কেঁদে উঠলেন। মেহবিন ছিল সবার থেকে দূরে ড্রাইনিং টেবিলের ওখানে। মেহবিন এখনো চুপচাপ হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার মা নামক মানুষটার দিকে। মিসেস সাবিনা মেহবিনকে জরিয়ে ধরে আবার ও কেঁদে দিলেন আর কান্না মাখা কন্ঠে বললেন,,

“তুই আমার মেয়ে মেহবিন! কি হয়েছে আমি তোকে জন্ম দিই নি? কিন্তু আমি তো তোকে তোর সাত বছর বয়স থেকে লালন পালন করেছি। আমি তোর মা মেহবিন। যে যাই বলুক তুই আমার সন্তান।”

বাকি সবাই কি বলবে সকলেই ব্যাপারটায় হতভম্ব হয়ে আছে। একটু আগেই যে মেয়েটাকে নিয়ে সবাই রাগ পোষন করছিল এখন তার জন্য মায়া কাজ করছে। কিন্তু এর মাঝে সব থেকে খারাপ লাগছে প্রতীকের তার জন্যই এতোবছরের রাজ সামনে এসেছে । সে যদি মেহবিন কে না পছন্দ করে শিলাকে পছন্দ করতো তাহলে এই ঘটনা ঘটতোই না।

ফ্ল্যাশব্যাক,,,

আলম আহমেদ আর প্রতীকের বাবা বিজনেস পার্টনার। তারা এই সম্পর্ক টাকে মজবুত করার জন্য ঠিক করে তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেবেন। মেহবিন আর শিলা এক বছরের ছোট বড়। আলম আহমেদ তার মেয়ে শিলার সাথে প্রতীকের বিয়ের কথাবার্তা বলেন। প্রতীক মেয়ের সাথে আলাদা দেখা করতে চায় এটা নিয়ে কেউ দ্বিমত করেনি । মেয়েকে একা কিভাবে পাঠাবে তাই মেহবিন কেও শিলার সাথে পাঠায়। মেহবিন প্রথমে রাজি না হলেও মায়ের জোরাজুরিতে রাজি হয়ে যায়। মেহবিন ভালোমতো বোরকা হিজাব নিকাব বেঁধে যায়। আর শিলা একটা সুন্দর থ্রিপিস তার সাথে হিজাব। প্রতীক ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল প্রতীকের প্রথম নজর যায় মেহবিনের দিকে যদিও তার চেহারা দেখেনি তবে ধার্মিক মেয়ে দেখে তার ভালো লাগে। অতঃপর ওদের পরিচয় হয় প্রতীক আর শিলা কথা বলতে থাকে। মেহবিন ফোন বের করে কিছু একটা করতে থাকে। এমনকি একবার তাকিয়ে প্রতীকের দিকে আর তাকায় নি। খাওয়ার অফার করলে মেহবিন জানিয়ে দেয় সে কিছু নেবে না শুধু এক কাপ কফি ছাড়া। তাই বাধ্য হয়ে প্রতীক ওর জন্য কফি আর নিজেদের জন্য খাবার অর্ডার করলো। কফি আসলেই ওদের কে কথা আর খেতে বলতে বলে ও রেস্টুরেন্টের অন্য জায়গায় চলে গেল। খাওয়া হয়ে গেলে যেন ওকে ফোন করে সেটাও বলে গেছে। শিলা নিজের অনেক কথাই বললো কিন্তু প্রতীক কেন যেন সেই স্বল্পভাষী মেহবিনের কথাই ভাবলো। কিন্তু পরক্ষনে নিজেকে ধাতস্থ করতে ভাবলো তারা বাবা শিলার সাথে বিয়ের কথা বলেছে মেহবিনের সাথে নয়। এভাবেই চলতে লাগলো কিন্তু বারবার মেহবিনের আচরণগুলোই চোখের সামনে ভেসে উঠতো। এই জন্য প্রতীক শিলার সাথে বেশি ফোনে কথা বলতে শুরু করল । তবুও মেহবিন কে মাথা থেকে বের করতে পারছিল না। দশ দিন পর আজ একেবারে পাকা কথা বলার দিন ছিল।সবাই আজ আহভেদ ভিলায় আলম আহমেদ এর ভাই বোন ও তাদের পরিবারের লোকজন ছিল। কিন্তু প্রতীকের পক্ষে শিলাকে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল তাই হুট করেই সে বলে উঠলো তার শিলাকে নয় মেহবিন কে পছন্দ। এতেই যেন আহমেদ ভিলায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। শিলা আর আলম আহমেদ রেগে গেলেন। এরপর প্রতীক আর আলম আহমেদ এর মাঝে কথা কাটাকাটি হলো একপর্যায়ে তিনি বলে উঠলেন মেহবিন ওনার নিজের মেয়ে নয়।”

বর্তমান,,

সাবিনা আহমেদ মেহবিন কে জরিয়ে ধরে কাঁদছেন কিন্তু মেহবিনের কোন প্রতিক্রিয়া নেই সে স্তব্ধ হয়েই আছে। শিলা এতক্ষন রেগে থাকলেও মেঘের জন্য তার এখন খারাপ লাগছে। ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছে দুজনে শিলার চোখ দিয়েও দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। কিন্তু প্রতীকের দিকে তাকাতেই মেহবিনের জন্য কষ্টটা রাগে পরিনত হলো। এতদিনে শিলা প্রতীককে ভালোবেসে ফেলেছিল ও ভাবলো মেহবিনের জন্যই এমনটা হলো। কিছুক্ষণ ওভাবেই থাকার পর মেহবিন সাবিনা আহমেদ কে ধরে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিল। সাবিনা আহমেদ কান্না মাখা কন্ঠে বলল,,

“মেহবিন তুই কষ্ট পাচ্ছিস? একদম কষ্ট পাবি না।আর তুই স্তব্ধ হয়ে আছিস কেন?”

মেহবিন সাবিনা আহমেদ এর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,,

“স্তব্ধ হয়ে কোথায় আছি? আমি তো শুধু চুপ হয়ে আছি। কারন এই বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। সবথেকে বড় কথা কি জানো মামনি? সত্য থেকে কখনো পালানো যায় না। আর কিছু সত্য থেকে তো একেবারেই নয়। আমি কিছু ভুলি নি মামনি সাত বছরের বাচ্চা কিছু ভুলে না। এক্সিডেন্ট হয়েছিল তো কি হয়েছিল? এক বছর কথা বলতে পারছিলাম না তো কি হয়েছিল? পুরোনো কথা মনে করতে গেলে একটু হায়পার হয়ে যেতাম কারন পুরোনো কিছু আমার সহ্য হতে চাইতো না। সব মনেছিল আমার কিন্তু যখন স্বাভাবিক হলাম তখন তোমরা এই আমাকে জানতে চাও নি। তাই আজ এই অবস্থা।

এই মুহূর্তে মেয়েটা মুচকি হাসছে ব্যাপারটা সবাইকে অবাক তো করলো বটে কিন্তু সাবিনা আহমেদ এর বুকে যেন আরো আগুন জ্বালিয়ে দিল। তিনি বুঝতে পারলেন মেয়েটা ভেতরে ভেতরে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। মেহবিন মায়ের দিকে তাকিয়ে তার চোখ মুছিয়ে দিল। আর বলল,,

“উঁহু কান্না নয় আমার খুব ঘুম পাচ্ছে এখন। এদিকে একটু মিটিয়ে নিই তারপর একটা ঘুম দিব। এই সময়টায় একটু ঘুমের প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। ”

সবার থেকে দূরে দেখে কেউ কিছু শুনতে পেল না‌। মেহবিন এবার প্রতীকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,,

“আমি যদি ভুল না হই তাহলে আমাদের দেখা একবার হয়েছিল তাও আবার আপুর সাথে। আর আজ হলো। সেদিন আমার চেহারা টা অব্দি আপনি দেখেন নি। আজ দেখলেন তাহলে আমায় কিভাবে পছন্দ করতে পারেন আপনি? সবথেকে বড় কথা এই দশদিন এ কি করে বুঝলেন আপনার আপুকে নয় আমাকে পছন্দ। এতো তাড়াতাড়ি কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে এটা আমার মনে হয় আপনার মোহ ছাড়া কিছু নয়।”

প্রতীক মাথা নিচু করে বলল,,

“তুমি ঠিক বলেছো কিন্তু আমি প্রথম দেখাতেই তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছি। তোমার চেহারা দেখিনি ঠিকই কিন্তু তোমার ব্যবহারে আচরনে মুগ্ধ হয়েছি । যা শিলার ক্ষেত্রে একবার ও আসেনি। আমি ওর সাথে কথা বলতাম কিন্তু ফিল,,

“আমি আর কিছু শুনতে চাই না মিস্টার আপনি যা বলছেন তা সম্ভব নয়। তাছাড়া,,

তখন আলম আহমেদ বললেন,,

‘হয়েছে আর ভালোগিড়ি দেখাতে হবে না। তুমি এখন এখান থেকে চলে গেলেই আমি খুশি হবো। নিজের রুমে যাও। আমরা আমাদের পারিবারিক বিষয় বুঝে নেব তোমায় ভাবতে হবে না।”

মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওপরে চলে গেল। সাবিনা আহমেদ অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন। এরপর শিলা প্রতীকের সামনে গিয়ে ইচ্ছে মতো অপমান করলো আলম আহমেদ ও বাদ রইলেন না। প্রতীক তার পরিবার নিয়ে চলে গেল। আলম আহমেদ স্তব্ধ হয়ে সোফায় বসে পরলেন বড়রা সবাই ব্যাপারটা জানতো তাই কোন রিয়াক্ট করলো না। কিন্তু ছোটরা কিছু জানতো না শিলা ওর বাবার সামনে গিয়ে বলল,,

“আজ এটা কি বললে তুমি পাপা মেহবিন আমার বোন নয় ,তোমার সন্তান নয়। তাহলে ছোটবেলায় কেন বলেছিলে ও আমার বোন। কেন বলেছিলে ও একটা জায়গায় থেকে হাড়িয়ে গিয়েছিল কয়েকবছর পর তোমরা ফিরে পেয়েছো। আমি তোমাদের মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতাম ওর সাথে আমাদের কোন কিছু মিল নেই কেন? তোমরা কেন বলেছিলে ব্যতিক্রম হয় তাই এরকম। আজ বুঝতে পারছি সব। ও যদি আমার বোন না হয়েই থাকে তাহলে তোমরা ওকে এখানে এনেছো কেন?”

তখন আলম আহমেদ বললেন,,

“আমার ভুলের জন্য!”

“মানে?”

“মানে আমি আর সাবিনা একটা কাজ থেকে ফিরছিলাম। একটু বেখেয়ালে গাড়ি চালাচ্ছিলাম ।আর মেহবিন আমার গাড়ির সামনে পরেছিল। কিভাবে কি হয়েছিল সেটা আমি নিজেও জানি না। ও খুব মাথায় আর পায়ে আঘাত পেয়েছিল। ওকে হাসপাতালে নিলে ডাক্তার দেখে কিন্তু অদ্ভুত ভাবে মেহবিন কিছু বলতে পারে না। কিন্তু ডাক্তার বলে ও বোবা নয় হয়তো অতিরিক্ত টেনশন আর ভয় থেকে কথা বলতে পারছে না। ওকে সবসময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতে হবে। নাহলে হয়তো আর কোনদিন কথা বলবে না। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না মেয়েটাকে চিনি না জানি না । মেহবিন তোমার মায়ের আঁচল খুব শক্ত করে ধরেছিল তোমার মায়ের খুব মায়া হয় তাই তোমার মা বলে ওকে নিয়ে আসতে আমাদের সাথে। এমনিতেও সাবিনা আর মা হতে পারবে না বলে আমি ওকে নিয়ে আসি। তোমাকে বললে তুমি কিভাবে রিয়াক্ট করো তাহলে মেয়েটার ওপর খারাপ প্রভাব পরতে পারে। মেয়েটার অবস্থার জন্য আমরা দায়ী ছিলাম। তাই তার ভালোর জন্য তোমাকে বলেছিলাম তোমরা বোন। ”

সব শুনে শিলা একটু কষ্ট পেল তবে মুখ ফুটে বলল,,

“মেহবিন এসব জানতো তাইনা? তাই তো আজ কোন রিয়াক্ট করলো না তাই না।”

“আমি জানি না। ডাক্তার বলেছিল ও ওর নাম ছাড়া বাকি সব হয়তো ভুলে গেছে। কারন ও যখন কথা বলতে পারতো না তখন ওকে আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম ওর পরিচয় কি লিখে দিতে কিন্তু ও ওর নাম ছাড়া আর কিছু লিখতে পারতো না। মা বাবার কথা শুনলেই হায়পার হয়ে যেত।তাই ডাক্তার ওকে পুরোনো জিনিস মনে করাতে না করেন এতে ওর ক্ষতি হতো। তাই ওকে পুরোনো সব বাদ দিয়ে আমরা ওর মা বাবা হিসেবে পরিচিত হই আর তুমি ওর বোন এটা ওর পরিবার ব্যস এটুকুই।

শিলা আর কিছু বললো না ওপরে চলে গেল। সকলে নিজেদের উত্তর এমনিতেই পেয়ে গেল। শিলা রুমে যাওয়ার আগে মেহবিনের রুমে উকি দিল মেহবিন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে মুখ দিয়ে। এই মুহূর্তে শিলার মেঘকে সহ্য হচ্ছে না তাই আর ভেতরে গেল না। রাতে সকলকে খাবার খাওয়ার জন্য ঠিক দেওয়া হলো বাদ যায়নি মেহবিন ও। কিন্তু মেহবিন আসেনি বলেছে সে খাবে না।কেউ জোর ও করেনি। তবে সাবিনা আহমেদ মেহেবিনের রুমে গেলেন ওর সাথে থাকবে বলে। সাবিনা আহমেদ গিয়ে দেখলেন মেহবিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তিনি গিয়ে বললেন,,

“মেহবিন তুই কি ঘুমিয়ে গেছিস?”

“আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না প্লিজ একা ছেড়ে দাও।”

“খিদে পায়নি তোর ?”

“খিদে পেলে নিশ্চয়ই নিচে গিয়ে খেতাম তাইনা। ”

“তুই এতো সহজে সব কিভাবে মেনে নিতে পারিস?”

“কারন আমি সহজ জীবন পছন্দ করি।”

“তোর পরিচয় কি মেহবিন? আমি জানতে চাই। তোর যদি সব মনেই থাকে তাহলে কেন তুই আমাদের বললি না?”

এবার মেহবিন চোখ খুললো । এতক্ষন চোখ বন্ধ করেই সে জবাব দিচ্ছিল। এখন সে উঠে সাবিনা আহমেদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলল,,

” আমার পরিচয় যদি বলি তাহলে আমি মেহবিন মুসকান নামক একজন মানুষ। আর তোমরা যদি তার মা বাবা না হও তাহলে সে এতিম। এই পৃথিবীতে এখন তার জানামতে হয়তো আপন বলতে কেউ নেই।”

“সেদিন কি হয়েছিল মেহবিন তুই রাস্তায় ওভাবে এসেছিলি কেন?”

“একটু বাঁচার আশা নিয়ে। যাই হোক মাথায় হাত বুলিয়ে দাও আমি ঘুমাবো। তখন ঘুম আসেনি আমার এখন একটু ঘুমাতে দাও।”

সাবিনা আহমেদ আর কিছু বললেন না। মেহবিন ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু সত্যি কি ঘুমালো নাকি ঘুমের ভান ধরে পরে রইলো কে জানে।

অতঃপর এক নতুন সকালের আগমন। মেহবিন ফজরের নামায আদায় করে নিল সাবিনা আহমেদের সাথে। মেহবিন গিয়ে তার পড়ায় মনোযোগ দিল এবার সে ঢাকা মেডিকেল এ পড়ছে এবার এমবিবিএস ফাস্ট ইয়ার তিনমাস হলো ভর্তির। দেখতে দেখতে এভাবেই তিন দিন কেটে গেল। সব আত্মীয় স্বজন সবাই চলে গেছে নিজেদের বাড়ি। এ তিনদিনে মেহবিনের সাথে সাবিনা আহমেদ ছাড়া আর কেউ কথা বলেনি। এমন কি একসাথে বসে খাবারও খায় নি। মেহবিনই সবার শেষে খেয়েছে হয়তো অন্যদের কে ফেস করতে চায় নি। আজ সকালে ব্রেকফাস্ট করার জন্য মেহবিন কে ডেকেছেন আলম আহমেদ। মেহবিন ও চুপচাপ এসেছে সবাই চুপচাপ খাচ্ছে খাওয়া দাওয়া শেষ করে শিলা হুট করেই বলল,,

“একজন অনাথের আঠারো বছর হয়ে গেলে তার আর অনাথ আশ্রমে থাকার নিয়ম নেই। তাই না পাপা?”

শিলার কথা শুনে সবাই চমকে উঠলো শুধু চমকালো না মেহবিন। আলম আহমেদ বললেন,,

“হুম আমি তো সেটাই জানি। কিন্তু হুট করে তুমি এটা কেন বলছো?

“না এভাবেই কিছু না।”

তখন মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,

“কথা টা দ্বারা কি বোঝাতে চাইছো আপু?”

“তুই তেমন কোন ইম্পোর্টেন্ট মানুষ নস যে তোর প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। রাস্তার মানুষ রাস্তার মানুষের মতোই থাক। একদম আমার সাথে কথা বলতে আসবি না।”

তখন সাবিনা আহমেদ মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন,,

“শিলা ভদ্র ভাবে কথা বল।”

“রাস্তার মেয়ের সাথে কিভাবে কথা বলবো তা নিশ্চয়ই তোমার থেকে শুনবো না। অবশ্য তোমাকে কি বলবো তুমি তো আবার রাস্তার মেয়েটাকেই বেশি ভালোবাসো কি না। আমার তো মনে হয় তুমিও ওর মতো রাস্তাতেই থাকতে কোন এক সময় তাই তো এতো খাতির।”

মেহবিন একথা শুনে রেগে শিলার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,

“মুখ সামলে কথা বলো উনি তোমার মা এটা ভুলে যেও না।”

“আমার মুখের ওপর কথা বলার সাহস তোকে কে দিল। আমার নখের যোগ্যও নস তুই। এতোদিন আবার বাবার টাকায় ফুটানি মেরেছিস। সেদিন মাকে বলছিলি তুই অনাথ আমি শুনেছি তখন তুই অনাথ। তারমানে তোর সব মনেছিল। মানে তুই ভালো একটা জীবন পাওয়ার জন্য মিথ্যা বলেছিস আর অভিনয় করেছিস তোর নাম ছাড়া কিছুই মনে নেই। এতো লোভ তোর এতো লোভ। যার জন্য লোভে পরে তুই প্রতীককেও নিজের হাতে করে নিলি। সেদিন আবার ভালো সাজলি।”

“না জেনে কোন কথা বলবে না আপু।”

“তোর মতো অনাথের কাছে থেকে আবার কি জানতে হবে। লোভী একটা তোদের রাস্তার মেয়েদের লোভ তো হবেই নিশ্চয়ই তোর মাও তোর মতো লোভী ছিল আর রাস্তার মেয়ে ছিল।

মেহবিন এতক্ষন শান্ত স্বরে কথা বললেও এবার রেগে শিলার গাল চেপে ধরলো। আর চিৎকার করে বলল ,,

“এই শিলা আহমেদ আমার মায়ের আজেবাজে কিছু বলবে না। নাহলে এখানেই পুতে রেখে দেব।”

সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি হলো যে কেউ কিছু ঠাহর করতে পারল না। এদিকে শিলার গাল মনে হচ্ছে এখনি শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাবে। শিলার মা এলেন মেহবিন কে ছাড়াতে কিন্তু মেহবিন ছাড়লো না। আলম খান বেশ রেগে গেলেন তিনি শক্ত হাতে মেহবিন কে ছাড়িয়ে ছুড়ে মারলেন। কিন্তু কোথায় মারলেন সেটা দেখলেন না। ওখানে একটা অ্যাকুরিয়াম ছিল একটা। মেহবিন অ্যাকুরিয়ামের সাথে গিয়ে ধাক্কা লেগে মাথা ফেটে একটু রক্ত পরতে লাগলো। তা দেখে মিসেস আহমেদ দৌড়ে গিয়ে মেহবিনকে ধরেন। রক্ত দেখে সবাই একটু হতভম্ব হয়ে যায় তবুও শিলার আর আলম আহমেদ এর রাগ কমে না। আলম আহমেদ রেগে বললেন,,

“ভুলে যেও না তুমি কে? তোমার সাহস কি করে হয় আমার মেয়েকে আঘাত করার?”

মেহবিন এ কথা শুনে মিসেস আহমেদ কে ছাড়িয়ে আলম আহমেদ এর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,

“না আমি ভুলে যাই নি আমি কে! ভুলে যাই নি বলে আপনাকে আমি কখনো আপুর মতো তুমি করে সম্মোধন করতে পারি নি। ভুলে যাই নি বলে আপনাকে আপুর মতো কোনদিন জরিয়ে ধরিনি। ভুলে যাই নি বলেই আপনার কখনো আদর স্নেহ না পেলেও একটা টু শব্দ করি নি। ভুলে যাই নি বলে আপনার সব ভুল আর অবহেলা মেনে নিয়েছি। ভুলে যাই নি বলে কখনো আপনার কাছে কোন কিছু আবদার করি নি।”

আলম আহমেদ মেহবিনের কথা শুনে ভাবতে লাগলো সত্যি মেহবিন আগ বাড়িয়ে কিছু চায় নি। মিসেস আহমেদ সর্বদা মেহবিনের প্রয়োজনীয় জিনিস এর বন্দোবস্ত করে রাখতেন। প্রয়োজন ছাড়া মেহবিন কখনো শখের জন্য চেয়ে টাকাও নেয় নি। কিন্তু তিনি দমতে চাইলেন না। তাই তিনি বললেন,,

“সবকিছু ঠিকঠাক পেলে আবদার কে করে?”

তখন মেহবিন তাচ্ছিল্য হেঁসে বলল,,,

“সত্যিই কি সবকিছু পেয়েছি আমি। আবদার বলতে বোঝেন তো পছন্দের জিনিস তাদের তৎক্ষণাৎ চাই। আর সেটা যেন পাওয়া যায় তাই ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা মায়ের কাছে আবদার করে। কিন্তু মনে করুন তো আপনি আমার পছন্দের জিনিস আগ বাড়িয়ে কখনো দিয়েছেন। আমার তো মনে পরে না। আপুর আইসক্রিম খেতে মনে চেয়েছে বলে আমারও যে আইসক্রিম খেতে মনে চাইবে এটা ধারনা করা ভুল। শপিং এ গেলে সবাই পছন্দ করে যেটা ধরিয়ে দিতো আমি সেটাই নিতাম এর মানে এটা নয় যে আমার ঐ জিনিস গুলোই পছন্দ অন্য পছন্দ হয় নি। সবার পছন্দ এক কখনোই হয় না। যাই হোক সেসব বাদ দিন।

এবার শিলা বলল,,

“তোকে এতো ভালো একটা জীবন দিয়েছে সেটাই যথেষ্ট নয় কি?”

“কেন দিয়েছে সেটা তোমার পাপাকে জিজ্ঞেস করোনি? তোমার পাপা নিজের স্বার্থপরতার জন্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তার গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয়েছিল আর মামনির জন্য এখানে আনে নি। সত্যি তো এটাই তোমার পাপা একটা স্বার্থপর!

একথা শুনে শিলা হতভম্ব হয়ে গেল। আলম খান ও একটু ভয় পেল কিন্তু তিনি দমলেন না। তিনি বললেন,,,

“আমি কি স্বার্থপরতা করেছি এখন দেখছি কারো ভালো করাও ভুল।”

“নিয়ত সঠিক হলে ভালো করা ভুল নয় কিন্তু সত্যি তো এটাই আপনি স্বার্থপরতার জন্য এখানে এনেছিলেন। গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট হলে আপনারা হাসপাতালে নিয়ে যান ঠিকই কিন্তু তার কিছুক্ষণ পর পুলিশ ওখানে গিয়ে আপনাদের জেরা করলে আপনি পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে মিথ্যে বলেন যে আমি আপনার সন্তান। কিন্তু পুলিশ এর বিশ্বাস হয় না তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে আপনি তার আগে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আপনার কথা মানতে বলেন এমনিতেও কথা বলতে পারছিলাম না। এই সুযোগ এ আপনার আমার মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলাটাই তার জন্য প্লাস পয়েন্ট ছিল। তারা যাওয়ার আগে আপনাকে ওয়ারনিং দিয়ে যায় বাসায় গিয়েও চেক করবে আপনি মিথ্যা বলছেন কি না। আর করেছিলোও তাই। এই জন্যই আপনি এই নাটক সাজান আমার ভালোর জন্য নয় নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য। আমি যেন নিজের পরিচয় কাউকে না বলি এর জন্য আপনি আমাকে বলেছিলেন সব মনে থাকলেও যেন আমি মা বাবার নাম না উচ্চারণ করি । তাদের কথা শুনে হায়পার হয়ে যেতাম এটা আপনার শেখানো বুলি ছিল। যদিও আপনার কথায় আমি হায়পার হতাম না সত্যি সত্যিই হায়পার হয়ে যেতাম। আপনি কি ভেবেছেন আমি আমার ব্য্যাপারে সব শুনেও চুপ থাকবো শুধু ভালো জীবন পাওয়ার জন্য না এটা আমি না। কারন আমার মা আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে সত্যের মোকাবেলা করতে হয়। শুধু আপনার কথা ভেবেই আমি চুপ ছিলাম কারন কোথাও না কোথাও গিয়ে আপনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। আর শিলা আহমেদ তুমিও তোমার পাপার মতোই একটা স্বার্থপর যখন তোমাদের স্বার্থে আঘাত লাগলো তখন দেখিয়ে দিলে তো নিজেদের বাবা মেয়ের আসল রুপ। আর হ্যা আমার মা কোন লোভী নয় আর রাস্তার মেয়েও নয়। সে ছিল রানী আর আমার আইডল কারন সে আর যাই হোক নিজের স্বার্থপরতার জন্য কাউকে ইউস করতে শেখায় নি।”

এটুকু বলেই মুচকি হেঁসে কপালে হাত দিল মেহবিন এখন রক্ত পরছে না কিন্তু রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। সে ওপরে চলে গেল কিন্তু নিচে তিনটি মানুষ সব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। শিলা রেগে তার বাবার দিকে চাইলো। আলম আহমেদ মাথা নিচু করে রইল কারন মেহবিনের সব কথাই সত্য ‌ কিছুক্ষণ পর মেহবিন বোরকা হিজাব নিকাব বেঁধে একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে নিচে নামলো। এটা দেখে কারোরই বুঝতে বাকি নেই মেহবিন চলে যাচ্ছে। মিসেস আহমেদ মেহবিনের সামনে গিয়ে বলল,,

“এসব কি মেহবিন? তুই কোথাও যাবি না।”

” যে স্থানে অপমান হয় সেই স্থান থেকে প্রস্থান করাই উত্তম।”

তখন শিলা বলল,,

“তোর মনে হয় না তুই এখান থেকে বেরিয়ে বড় একটা ভুল করছিস।”

তখন মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“মেহবিন তার জীবনে বড় ভুল দুবারই করেছিল। সেই ভুল মেহবিন আর করবে না। বরঞ্চ আজ এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আমার সবথেকে ভালো একটা সিদ্ধান্ত। বারো বছর আশ্রয় দেওয়ার জন্য শুকরিয়া সবাইকে। আর সবকিছুর জন্য ও শুকরিয়া।

মেহবিন দুই পা বাড়ালো মিসেস আহমেদ গিয়ে মেহবিন কে জরিয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। আর বললেন,,

“তুই কোথায় যাবি কিভাবে থাকবি?”

মেহবিন তাকে ছাড়িয়ে বলল,,

“চিন্তা করো না সেদিন আলম আহমেদ এর কথা শুনেই বুঝেছিলাম এই বাড়িতে আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিছু না কিছু করে এই খারাপ সময় টা কাটিয়ে নিতে পারবো। তবে তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবো তো আমি। আমি কি আমার মামনি কে ভুলে যেতে পারি। সবকিছুর জন্য শুকরিয়া মামনি। নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ আর হ্যা আমার জন্য দোয়া কোরো।”

“আমার দোয়া সবসময় তোর সাথে আছে। কিন্তু তুই কিভাবে,,

“আল্লাহ ভরসা মামনি। আল্লাহ তায়ালা উত্তম কর্মবিধারক। আল্লাহর ওপর ভরসা করা মানুষগুলো কখনোই খালি হাতে ফিরে আসে না –
”অবশ্যই বিশ্বাসীরা সফল হয়েছে”
( সূরা মুমিনুন-০১)।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

যে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। (সূরা আত-তালাক্ব:৩)

নিশ্চয় আল্লাহ (তার উপর) নির্ভরকারীদের ভালবাসেন। (সূরা আলে-ইমরান:১৫৯)

আপাতত কিছু দরকার নেই,আল্লাহ আমাকে
অনেক ধৈর্যশীল করে দিক, খা’রাপ মুহূর্তগুলো
সহ্য করার জন্য। একদিন তো আমিও প্রশান্তির হাসি হাসবো ইনশাআল্লাহ।

বলেই মেহবিন চলে গেল। তিন জোড়া চোখ শুধু দেখেই গেল কিছু বলতে পারলো না। মেহবিনের গন্তব্য এখন কোথায় সেটা মেহবিনই শুধু জানে হয়তো কোন অজানা গন্তব্যের দিকে।

~ চলবে,,,

পথ হারা প্রজাপতি পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0

#পথ_হারা_প্রজাপতি(অন্তিম পর্ব)
#Israt_Bintey_Ishaqu(লেখিকা)

রাযীন ভাইয়া?
সাফিরার অস্ফুট স্বরে রাযীন সারা দেয় না। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাই আগে ওয়াশরুমের কাজ শেষ করে এসে আবারো ডাকলো। এবার কাজ হলো। রাযীনের ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ মেলে তাকিয়ে বলল,
–” এতো রাতে ডাকছো কেন? দিলা তো আমার সুন্দর ঘুমের তেরোটা বাজিয়ে।
সাফিরা মিনমিনে গলায় বলল,
–” ভাইয়া আপনি এখানে ঘুমিয়েছেন কেন? আপনার রুমে গিয়ে ঘুমান নাই কেন?

রাযীন ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
–” আমাদের বাড়ি, আমার ব‌উ, আমার যেখান মন চায় সেখানে ঘুমাবো। তোমাকে বলে নিতে হবে?

“আমার বউ” কথাটা যেন কান গরম করে দিল সাফিরার। এই সম্বোধন আগে কখনো করেনি রাযীন। প্রথম বার করায় সারা শরীর শিরশির করে উঠলো। এ কেমন অনুভূতি? কাউকে বলে বুঝানোর মতো নয়। তারউপর তুমি সম্বোধন! একসাথে এতো গুলো স‌ইতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে সাফিরার।
রাযীনের পরবর্তী কথা,
–” বেয়াদব মেয়ে! স্বামীকে ভাই ডাকে কেউ? আর যেন না শুনি!
–” ভাইয়া বলেই তো সব সময় ডাকি।
–” আমি বলেছিলাম ডাকতে?
–” না।
–” তবে? আর ডাকবে না। যদি ভুল করেও ডাকো তাহলে শা*স্তি পেতে হবে! কথাটা যেন মনে থাকে।
মাথা কাত করে সাফিরা বলল,
–” আচ্ছা।
রাযীন আবারো ঠিকঠাক হয়ে শুয়ে পড়ল। আর বলল,
–” অনেক রাত হয়েছে শুয়ে যাও।
সাফিরা একটু দূরত্ব নিয়ে শুয়ে পড়লো।
.
.
সাফিরার আহত স্থানের সেলাই কাটা হয়েছে। এখন কাটা দাগটা স্পস্ট বোঝা যাচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মন খারাপ হয়ে যায় সাফিরার। তবুও ফোনের জন্য বেশি খারাপ লাগছে। একটু আধটু ফোন ইউজ না করলে সময় গুলো বড্ড বেশি বোরিং লাগে।

শুক্রবার ছুটির দিন মিনহাজ আর রাযীন ঘুরতে বেরিয়েছে। ঢাকা বসুন্ধরা সিটিতে এসেছে তারা। রাযীন বিশেষ করে এসেছেন ফোন কিনার জন্য আর মিনহাজ তার কিছু কেনাকাটা করার জন্য।
রেস্তোরাঁয় বসে বার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে খেতে
মিনহাজ জিজ্ঞাসা করল,
–” কিরে কতদূর আগালি?
রাযীন মিনহাজ এর ইঙ্গিত বুঝতে না পেরে বলল,
–” কিসের?
–” ভাবির সাথে সবকিছু ঠিক করে নেওয়ার?
–” চেষ্টা করছি দেখা যাক কি হয়।
–” ইনশা আল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে।
–” হুম ইনশা আল্লাহ।
.
রাযীন আগের মতো আর বকাঝকা করে না সাফিরাকে। তবে খুব কম কথা বলে। পড়াশোনা করতে ও জোর করে না। সময় মত পড়িয়ে দেয়, এরপর সাফিরার ইচ্ছা হলে পড়ে না হলে পড়ে না।

সাফিরা ঘুমানোর জন্য বিছানা ঝেড়ে নিল।
ঘুমানোর আগে বিছানা ঝাড়া সুন্নত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমানোর আগে বিছানা ঝাড়তে উৎসাহিত করেছেন। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
যখন তোমাদের কেউ শয্যা গ্রহণ করবে, তখন সে যেন নিজ লুঙ্গীর একাংশ দ্বারা তার বিছানাটা ঝেড়ে নেয়। কারণ, সে জানে না যে, তার অনুপস্থিতিতে কি কি জিনিস সেখানে এসেছে‌। [১]
.
সাফিরা বিছানা ছেড়ে মশারী টাঙানোর সময় রাযীন রুমে এসে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়! রাযীনের এহেন কান্ডে চমকে উঠে সাফিরা। মশারীর দুই কোনা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কাছে এসে রাযীন বলল,
–” আর বাকি দুই কোনা কি লাগাবে না?
সাফিরা আবার দুই কোনা লাগিয়ে নেয়। এরমধ্যে রাযীন মশারীর ভিতরে ঢুকে মশারীর চারিদিক সুন্দর করে গুঁজে দিল। তারপর আরাম করে শুয়ে বলল,
–” এই লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে দেও।

রাত বারোটা বাজে। সবাই সবার রুমে ঘুমিয়ে আছে। তাই নিশ্চিন্তে রাযীন শুয়ে আছে। সাফিরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
–” দাঁড়িয়ে থেকে মশার কামড় খাবে নাকি ঘুমাতে আসবে?
সাফিরা ধীর পায়ে এগিয়ে আসে বিছানায়। বুক তার টিপটিপ করছে। রাযীনের কর্মকাণ্ড গুলো মেনে নিতে খানিকটা বেগ পেতে হচ্ছে। হঠাৎ এমন আচরণ কেন করছে রাযীন? বুঝতে পারছে না সাফিরা।

প্রায় এক মাস যাবত এমনি চলছে। এখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে সাফিরা। আগের মতো আন‌ইজি ফিল হয় না। বরং অন্যর‌কম এক ভালোলাগা কাজ করে। সাফিরার যখন পড়া কমপ্লিট করতে লেইট হয় তখন বিছানা ঝেড়ে মশারী টাঙিয়ে অপেক্ষা করে রাযীন। তাছাড়া সাফিরার সাথে অনেক কথা বলে। সাফিরার মন খারাপ থাকলে কারণ জিজ্ঞাসা করে মন ভালো করার চেষ্টা করে।
তবে সবার সামনে আগের মতোই থাকে রাযীন! যেন সে সাফিরাকে পছন্দ করে না।
প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও পরে সেটা বুঝতে পারে সাফিরা। তবে এই লুকোচুরি খেলার কারণ খুঁজে পায় না সাফিরা। সে তো তার বিয়ে করা বউ, তাবে এই লুকোচুরির আশ্রয় কেন নেয় রাযীন?

একদিন তামান্নার রুমে খাবার পানি শেষ হয়ে যায়। পানির জগ নিয়ে ডাইনিংয়ে আসে পানি নিতে। পানি নেওয়ার এক পর্যায়ে দেখতে পায় এদিক ওদিক তাকিয়ে রাযীন সাফিরার রুমে ডুকছে! যেন সে চু*রি করতে যাচ্ছে লুকিয়ে!
সবাই জানে রাযীন সাফিরাকে পড়ানোর জন্য তার রুমে যায়। পড়িয়ে আবার চলে আসে, থাকে না। কিন্তু এই মাঝ রাতে এভাবে যেতে দেখে তামান্নার মনে সন্দেহ জাগে। যদিও তারা স্বামী-স্ত্রী কিন্তু রাযীন তো আর মানে না।

এরকম কয়েকরাত দেখে তামান্না সিউর হলো রাযীন তাকে মেনে নিয়েছে ব‌উ হিসেবে। তাই আর ব্যাপারটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলো না।
কিন্তু একদিন রাযীন রুমের বাল্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নতুন বাল্ব লাগাতে লম্বা টুলের উপর দাঁড়িয়ে সাফিরা কে বলল, যে লাইনে বাল্ব লাগাবে ঐ লাইনের সুইচ অফ করে দিতে। কিন্তু ভুলবশত সাফিরা অন্য লাইনের সুইচ অফ করে দিয়ে চলে গেল। এদিকে রাযীন বাল্ব লাগাতে গিয়ে হঠাৎ বাল্ব জ্বলে ওঠায় হাত থেকে ফেলে দিল! নিচে পরে ভেঙে চুরমার বাল্ব! ভীষণ রা*গ হলো রাযীনের। আর তাই রা*গ মিটাতে সাফিরা কে ডেকে এনে ইচ্ছা মতো বকাঝকা করেছে।
যার কারণে সাফিরা নিজের রুমে এসে অনেক কান্নাকাটি করে। সে জানে তার ভুল হয়েছে তাই বলে এভাবে বকবে রাযীন?
তামান্না সবকিছু দেখে রাযীনের উপর প্রতি*শোধ নিতে সাফিরা কে বলল,
–” নিষ্ঠুর রাযীন ভাইয়া শুধু শুধু তোকে কতগুলো ঝাড়ি দিল। তোকে যদি ব‌উ হিসেবে মানতো তাহলে কি এভাবে ঝাড়ি দিতে পারতো? উহু পারতো না। তোর জন্য অনেক মায়া হচ্ছে রে। আজকে এতিম বলে ভাইয়া তোকে এরকম ব্যবহার করতে পারছে!

সাফিরা চোখের পানি মুছে বলল,
–” ব্যবহার করছে মানে?
–” দেখিস না? যখন যা ইচ্ছা তাই করছে তোর সাথে!

সাফিরাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল তামান্না। সাফিরা তামান্নার বলা কথা গুলো ভাবতে থাকে। প্রতিদিনের মত রাতের বেলা যখন রাযীন ঘুমাতে আসে। তখন সাফিরা বলল,
–” আমাকে এভাবে ব্যবহার করছেন কেন? আমি এতিম বলে? আমার কেউ নেই বলে যাচ্ছে তাই করে চলেছেন। আমাকে কি মানুষ বলে মনে হয় না আপনার? এবাড়িতে আসার পর থেকে আপনার অত্যাচারে গুমরে মর*ছি আমি! প্লিজ দয়া করুন আমাকে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না আপনাকে!
–” কি করেছি আমি তোমার সাথে? তুমি যেন ভালো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারো তার জন্য দিনরাত তোমাকে পড়াশোনা করিয়েছি।
পড়াশোনা করার জন্য সাশন করেছি এগুলো আমার অত্যাচার?
খেতে না দিয়ে পরে আবার নিজেই নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছি এগুলো অত্যাচার?
স্বামীর অধিকার নিয়েও তোমাকে ব্যাড টাচ করিনি তাহলে কোনটা কে তুমি ব্যবহার সম্বোধন করছো বলো?
সাফিরা চুপ করে রইলো। রাযীন আর কথা না বাড়িয়ে হাতে থাকা শপিং ব্যাগ টা সাফিরাকে দিয়ে চলে যায় রুম থেকে। শপিং ব্যাগ টা খুলে দেখে নতুন মোবাইল ফোন! দেখে বেশ দামী মনে হচ্ছে। আবারো কান্না করে দেয় সাফিরা। তামান্নার ফাঁদে পা দিয়ে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে সাফিরা। এখন বুঝতে পেরে অনুসোচনায় দগ্ধ হচ্ছে।
সাথে সাথে দৌড়ে রাযীনের রুমে যায় কিন্তু রাযীন নিজের রুমে নেই। বাড়ির মেইন গেট ভিতর থেকে বন্ধ করা। তাই ছাদে গিয়ে দেখে একপাশে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাযীন।
সাফিরা দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে জাপটে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আর মাফ চেয়ে বলে,
–” আমাকে মাফ করে দিন। এরকম জগন্য বাক্য আমি আর কখনো মুখেও উচ্চারণ করবো না ইনশা আল্লাহ।

রাযীন সামনে ঘুরে বলল,
–” মাফ করে দিয়েছি।
এতো গুলো দিন স্ত্রীর হক আদায় না করার জন্য আমাকেও মাফ করে দাও?
–” মাফ করে দিয়েছি।
তারপর নিজের স্ত্রীকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাযীন। এ এক অদ্ভুত সুখের মুহূর্ত।
.
.
অতঃপর রাযীন সাফিরাকে মেনে নিয়েছে শুনে করিম সাহেব আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, এতিম শিশুদের খাওয়ানোর আয়োজন করেন।
রাযীনের কাজিনরা বাসর ঘর সাজিয়, তারপর সবকিছু নতুন করে শুরু হয় রাযীন আর সাফিরার জীবনে।

কয়েক মাস পর তামান্নার ও বিয়ে হয়ে যায়। শশুর বাড়ী গিয়ে স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সবাই সবার জীবনে ভালোবাসা খুঁজে নেয়।

রেফারেন্স:
[১] (সহীহ বুখারী, হাদীস (৬৩২০)

#সমাপ্ত

পথ হারা প্রজাপতি পর্ব-০৭

0

#পথ_হারা_প্রজাপতি(৭)
#Israt_Bintey_Ishaqu(লেখিকা)

অফিস শেষ করে সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে রাযীন। বাসায় ফিরেই দেখে আফরোজা বেগম কান্না করেছেন। পাশে করিম সাহেব থমথমে মুখ করে বসে আছেন। কাছে গিয়ে আফরোজা বেগম কে জিজ্ঞাসা করলো,
–” কি হয়েছে? কান্না করতেছো কেন?
–” সাফিরা আজকে বাসায় ফিরে নাই! তোকে কতোবার কল করলাম কল রিসিভ করলি না কেন? আল্লাহ না করুন মেয়েটার কোন ক্ষতি হলো না তো?
বলতে বলতে আফরোজা বেগম আবার চোখের পানি ফেলছেন। করিম সাহেব বললেন তিনি সাফিরার কলেজ পর্যন্ত খুঁজে এসেছেন কিন্তু কোথাও খুঁজে পাননি। তখন রাযীন বলল,
–” আব্বা পুলিশে ডায়রী করলে না কেন?

করিম সাহেব বললেন,
–” টেনশনে কিছু মাথায় আসে নাই।

রাযীন আর কিছু না বলে গাড়ি নিয়ে খুঁজতে বের হবে বলে বাড়ির মেইন গেট দিয়ে বের হতে নিবে তখন সাফিরা কে আসতে দেখে! একজন মহিলা তাকে ধরে নিয়ে আসতেছে আরেকজন পুরুষ সাথে। রাযীন এগিয়ে গিয়ে বলল,
–” কোথায় ছিলি সারাদিন?
পাশের ভদ্রলোক বললেন,
–” উনি অসুস্থ! আগে বাসায় যেতে দিন।
রাযীন বিচলিত হয়ে বলল,
–” কি হয়েছে?
ভদ্রলোক আবারো বললেন,
–” আগে বাসায় যেতে দিন?
তারপর রাযীন বলল,
–” আসুন।
.
কলেজ থেকে ফেরার পথে ছিনতাই/কারী সাফিরার ফোন ছিন/তাই করে দৌড় দেয়। তখন সাফিরা ফোনের জন্য পিছুপিছু দৌড়ে যায়। মেয়ে মানুষ হয়ে তো আর ছিনতাই/কারীর সাথে দৌড়ে পারা যায় না। উল্টো বেখেয়ালে রাস্তায় দৌড়ে সিএনজির সাথে এক্সি/ডেন্ট করে! কপাল কে/টে যায়! যার জন্য পাঁচটা সেলাই লাগে। তাছাড়া হাতের কিছু অংশ ছি/লে গেছে এবং হিজাবের অংশ ছিঁড়ে গেছে।
যারা তাকে ধরে নিয়ে এসেছে বাসায় তারা সাফিরা কে হসপিটালে নিয়ে যায়।
সাফিরার যখন জ্ঞান ফিরে তখন ঠিকানা বললে তারা বাসায় নিয়ে আসে।

সম্পদ আত্মসাৎকারী বা ছিনতাই/কারী নিঃসন্দেহে কবীরা গোনাহগার ও মহাপাপী এবং তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শা/স্তি[১]
আদালতে বিচারক তাদের অপরাধের মাত্রা অনুপাতে শাস্তি নির্ধারণ করবেন। সেটি জে/ল বা জরিমানা বা উভয়টি হ’তে পারে। কিন্তু সকল বিদ্বানদের ঐক্যমতে তার হাত কা/টা যাবে না [২]
কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘লুণ্ঠনকারী, ছিনতাই/কারী ও আত্মসাৎকারীর হাত কর্তন করা হবে না [৩]
তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যের মাল ছিন/তাই করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয় [৪]
হাসান বাছরী ও ইয়াস বিন মু‘আবিয়ার মধ্যে ছিনতাইকারীর হাত কাটা নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে তারা খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীযের নিকট পত্র প্রেরণ করেন। তিনি উত্তরে লিখেন ছিনতাই/কারীর হাত কা/টা যাবে না। বরং তার পিঠে চাবুক মার এবং তাকে ব/ন্দী কর। [৫]
মানুষ যদি সবসময় মৃ/ত্যুর কথা স্মরণে রাখতো তাহলে অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকতো।
.
.
আফরোজা বেগম সাফিরাকে উপকারী ব্যাক্তিদের নাস্তার ব্যবস্থা করলেন। নাস্তা খাওয়া শেষে তারা
চলে যেতে উদ্যত হলে রাযীন বলল,
–” হসপিটালে নিশ্চয়ই অনেক টাকা খরচ হয়েছে? যদি বলতেন তাহলে আমি টাকা দিয়ে দিতে চাই।

তারা বলতে না চাইলে করিম সাহেব বিনয়ের সাথে বললেন,
–” আপনাদের জাযাকুমুল্লাহু খাইরান। আপনাদের মতো কিছু ভালো মানুষ আছে বলেই আজো পৃথিবীটা সুন্দর। না হয় যেভাবে প্রতিদিন দূর্ঘট/না ঘটে চলেছে, তাতে ভালো মানুষরা ঘর থেকে বের হতে পারতো না, কখন কি হয়ে যায় এই ভয়ে। তাই আজকে আপনারা টাকাটা রাখুন আবার কারো বিপদে উপকার করতে পারবেন ইনশা আল্লাহ।

অতঃপর তাদের সমস্ত খরচ মিটিয়ে দেয় রাযীন। তারপর রাত বেরে যাচ্ছে বলে চলে যায় তারা।
.
সাফিরাকে সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে বলেছে ডাক্তার। আফরোজা বেগম সাফিরাকে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেও ক্ষ/ত স্থান দেখে বুকটা যেন ফে/টে যাচ্ছে। এতিম মেয়েটার কপালে কি সুখ নেই? এই ভেবে ভয় তার।
সাফিরা নিরবে শুয়ে আছে, মাথা যন্ত্রনা করছে খুব। পাশে হাত বুলিয়ে সূরা কালাম পড়ে ফুঁ দিয়ে দিচ্ছে আফরোজা বেগম। তামান্না একবার এসে দেখে গেছে সাফিরাকে।
তারপর রাযীন এসে বকাঝকা করে গেছে! এই জন্য যে একটা ফোনের জন্য পিছুপিছু দৌড়াতে গেল কেন সাফিরা? ফোন তো পেল‌ই না উল্টো নিজের ক্ষ/তি করে আসলো। জবাবে নিরব র‌ইলো সাফিরা।
ফোনটা আফরোজা বেগম কিনে দিয়েছিল সাফিরাকে। অবসর সময়ে ইসলামিক বই বা বিভিন্ন হাদীস সম্পর্কে জানতে পারে এই ফোনের মাধ্যমে। তাই ফোনটা অনেক প্রিয় ছিল সাফিরার।

রাতের খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল সাফিরা। সাথে ঘুমের ঔষধ থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো। আফরোজা বেগম সাথে ঘুমাতে চেয়েছিলেন কিন্তু সাফিরা না করে। কারণ সাফিরা জানে করিম সাহেব কখনো স্ত্রীকে ছাড়া থাকেন না। স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসেন কিনা।
সাফিরার সাথে না পেরে আফরোজা বেগম বললেন,
–” তাহলে দরজা ভেজিয়ে ঘুমাস। আমি রাতের বেলা এসে দেখে যাব তোকে। আল্লাহ না করুন ব্যাথার জন্য যদি জ্বর আসে।
–” ঠিক আছে তুমি ভেজিয়ে দিয়ে যাও।
আফরোজা বেগম তাই করলেন।
.
.
গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে আছে তখন, রাযীন পা টিপে টিপে সাফিরার রুমে আসে!
সাফিরা ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রাযীন ধীরে ধীরে সাফিরা পাশে গিয়ে বসে। কাঁপা কাঁপা হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। খুব মায়া হচ্ছে মেয়েটার জন্য। তাকিয়ে রইল অপলক। কপালের ক্ষ/ত স্থানে চুম্বন এঁকে দিল!
সকালে অফিস আছে ভেবে পাশে শুয়ে পড়ল! রাতে ঘুম না হলে অফিস করতে কষ্ট হবে তাই ঘুমানো প্রয়োজন।
আফরোজা বেগম আর করিম সাহেব তাহাজ্জুদ নামায আদায় করার জন্য রাতের শেষ তৃতীয়াংশে উঠেন।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রিয় নবীজি (সা.)-এর উদ্দেশে কোরআন কারিমে বলেন, ‘এবং রাত্রির কিছু অংশ তাহাজ্জত কায়েম করো, ইহা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে—মাকামে মাহমুদে। [৬]

রাতের ইবাদত প্রসঙ্গে কোরআন মাজিদে আরও রয়েছে, ‘হে কম্বলাবৃত! রাতে দণ্ডায়মান হও কিছু অংশ বাদ দিয়ে; অর্ধরাত্রি অথবা তার চেয়ে কিছু কম অথবা তার চেয়ে বেশি এবং কোরআন তিলাওয়াত করো সুবিন্যস্তভাবে ও স্পষ্টভাবে। আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। নিশ্চয়ই ইবাদতের জন্য রাত্রিতে ওঠা প্রবৃত্তি দমনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল। নিশ্চয়ই দিবাভাগে রয়েছে তোমার দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা। তুমি নিজ পালনকর্তার নাম স্মরণ করো এবং একাগ্রচিত্তে তাতে নিমগ্ন হও। [৭]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘হে বস্ত্রাবৃত! ওঠো, সতর্ক করো, আপন পালনকর্তার মাহাত্ম্য ঘোষণা করো, স্বীয় পোশাক পবিত্র করো এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো। অন্যকে কিছু দান করে অধিক প্রতিদান আশা করবে না। আর তোমার পালনকর্তার উদ্দেশে ধৈর্য ধারণ করো। [৮]

আফরোজা বেগম অযু করে এসে সাফিরাকে দেখতে এসে দেখেন দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করা! বন্ধ দেখে তিনি আশ্চর্য হলেন। সাফিরাকে তো বলেছিলেন দরজা বন্ধ করতে না। কেন করলো তাহলে? তিনি আর এই মুহূর্তে মাথা ঘামালেন না। সাফিরাকে ডাকলেন ও না। এমনিতেই অসুস্থ ডাকাডাকি করে ঘুম ভাঙ্গালে মাথায় আঘাত পেতে
পারে তাই তিনি চলে গেলেন।

ফজরের আযানের ধ্বনি শুনে দ্রুত উঠে বসে রাযীন। সাফিরা ঘুমে থাকতে থাকতে রুম ত্যাগ করে।
সকালে অফিসে চলে গেল। আফিস থেকে ফিরে নিজের রুমেই থাকলো। সাফিরাকে একবার গিয়ে জিজ্ঞাসা ও করলো না শরীরের কি অবস্থা? সাফিরা আসা করছিল তাকে অন্তত জিজ্ঞাসা করবে রাযীন কিন্তু করে নাই দেখে সামান্য মন খারাপ হলো।

দ্বিতীয় দিন আবারো সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন রাযীন সাফিরার রুমে আসে! দেখে ঘুমিয়ে আছে সাফিরা। দ্বিতীয় দিন ও এক‌ই কাজ করলো। সাফিরার পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে র‌ইলো।

আজকে সাফিরা ঘুমের ঔষধ খায়নি, ঘুমের ঔষধ খাওয়া ভালো না বলে। তাই মাঝ রাতে ওয়াশরুমে যাবে বলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। শোয়া থেকে উঠে বসে, পাশে তাকাতেই ড্রিম লাইটের আলোয় পাশে রাযীনকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে কিছুটা দূরে সরে গেল। বিয়ে হয়েছে প্রায় তিন বছর হতে চলল কিন্তু রাযীনকে তার পাশে কখনো দেখেনি! আজকে এভাবে দেখে কপালে নাকের ডগায় চিকন ঘাম বের হতে শুরু হলো!.…

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।

রেফারেন্স:
[১] (শূরা ৪২/৪২; মুত্বাফ্ফেফীন ৮৩/১-৬)
[২] (ইবনু কুদামাহ, মুগনী ১২/৪১৬)
[৩] (দারেমী হা/২৩৭৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৪০২)
[৪] (আহমাদ হা/১৫১১২; মিশকাত হা/৩৫৯৬; ইরওয়া হা/২৪০৩)
[৫] (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৮৬৬৫)।
[৬] (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ৭৯)
[৭] (সুরা-৭৩ মুজ্জাম্মিল, আয়াত: ১-৮)
[৮] (সুরা-৭৪ মুদ্দাচ্ছির, আয়াত: ১-৭)

পথ হারা প্রজাপতি পর্ব-০৬

0

#পথ_হারা_প্রজাপতি(৬)
#Israt_Bintey_Ishaqu(লেখিকা)

অতীত,
দুপুরের রান্না শেষে মনোয়ারা বেগম পুকুর ঘাটে গিয়েছেন হাড়ি পাতিল ধোঁয়ার জন্য। ধুয়ে এসে রোদে শুকাতে দিয়ে সাফিরার কাছে গেলেন। সাফিরা পেয়ারা গাছে বসে পেয়ারা খাচ্ছিলো। তার স্কুল কোচিং সবকিছু বন্ধ তাই আরাম করে গাছের ডালে বসে আছে, পাশে রুমানার সাথে গল্প করছে। মনোয়ারা বেগম বাঁশ ঝাড়ের থেকে একটা কঞ্চি নিয়ে সাফিরা কে ভয় দেখিয়ে বলে, নিচে নামবি নাকি এটা দিয়ে তোকে ফিডামু? (পিটাবো) বেইন্নাবেলা থেইক্কা কাম করতাছি, (সকালবেলা থেকে কাজ করতেছি) আমার আতে আতে একটু কাম করবি তা না, (আমার হাতে হাতে কাজ)
ট‌ই ট‌ই করে পাড়া বেরাচ্ছিস! আমি তোর এসব সহ্য করতাছি, পরের মায় পিছা দিয়া বাইরাইয়া কাম করাইবো দেখিস। ( শাশুড়ি মা ঝাড়ু দিয়ে মেরে কাজ করাবে।) সাফিরা মায়ের ভয়ে উপরের ডালে উঠে দাঁড়ায়। আর বলে, কালকে থেকে তোমার হাতে হাতে সব কাজ করে দিব আম্মা।
মেয়ের কথা শুনে আরো রেগে গেলেন মনোয়ারা বেগম। বললেন, তোর কালকে আর জীবনে আইতো না। তোদের বাপ তো সারছে! এই বলে চোখের পানি ফেলে ঘরের দিকে চলে গেলেন।

সাফিরা একটু অলস প্রকৃতির মেয়ে। প্রায় সময় বলে মাকে সাহায্য করবে কিন্তু সেই দিন আর মনোয়ারা বেগমের ভাগ্যে জুটে না।
মনোয়ারা বেগম চোখের পানি মুছে ঘথের কাছে গিয়ে দেখেন দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করা। দরজা ধাক্কা দিতে দিতে বললেন, এই সিনথিয়া ঘরো কি করতাছোস তুই? দরজা বন্ধ করছোস কেন? দরজা খুল।
অনেকক্ষণ ধরে ডাকার পরেও যখন সিনথিয়া দরজা খুললো না তখন মনোয়ারা বেগম বিলাপ করতে শুরু করেন। আর্তনাদ শুনে সাফিরা দৌড়ে আসে, আসেপাশের প্রতিবেশীরা দৌড়ে আসে।
তারপর সাফিরার পাশের ঘরের চাচারা এসে কাঠের দরজা কেটে ঘরে ডুকে। সিনথিয়া কে খুঁজতে দ্বিতীয় রুমে গিয়ে দেখে ফ্যানের সঙ্গে ফাঁ/স দিয়ে আত্মহ/ত্যা করেছে মেয়েটা! মেয়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো মনোয়ারা। সাফিরা আপু বলে চিৎকার। এই খবর বাতাসের মতো ছড়িয়ে গেল এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম। খবর পেয়ে কয়েক গ্রামের মানুষ বাড়িতে চলে এলো।
মনোয়ারা বেগমকে কেউ শান্ত করতে পারছেন না। মেয়ের জন্য পাগল প্রায় তিনি। শেষে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
গ্রামের মানুষ পুলিশকে খবর দিলেন। ঘন্টা খানেক পর পুলি/শ চলে এলো, এসে গ্রামের মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো, সাফিরা কে জিজ্ঞেস করলো কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারলো না। শুধু যা দেখেছে তাই বলল।
তারপর পুলিশ সিনথিয়ার লা/শ নিয়ে চলে গেল।
মৃত্যুর সঠিক কারণ জানার জন্য ময়নাতদন্ত বা পোস্টমর্টেম করা হয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখে জানা যায় সিনথিয়া তিন মাসের গর্ভবতী ছিল! এ ব্যাপারে মনোয়ারা বেগম বা সাফিরা কিছু জানতো না। তাই গ্রামের মানুষজন শুনে সিনথিয়ার পরিবারকে যা-তা কথা বলতে শুরু করল। বলল,
সিনথিয়া ন/ষ্টা, বিয়ের পূর্বেই অবৈধ সম্পর্ক করে পেটে বাচ্চা পয়দা করছে! আরো কত কথা। এসব কথা সহ্য করতে না পেরে মনোয়ারা বেগম স্ট্রোক করে মৃত্যু বরণ করেন!
সাফিরার বাবা হাই স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন। খুব সুন্দর ভাবে চলছিল তাদের জীবন। একটা রোড এক্সিডেন্ট এ তিন বছর আগে সাফিরার বাবা মারা যান, তারপর থেকে মনোয়ারা বেগম মেয়ে দুটো কে আগলে জীবন পার করেন। আফরোজা বেগমের আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো আলহামদুলিল্লাহ। তাই বোনকে যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগিতা করেন এবং কি সিনথিয়া কে ছেলের বউ করবেন বলে ঠিক করেন। কথা হয় করিম সাহেব এবং আফরোজা বেগম হজ্জ পালন করে এসে তাদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করবেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে হলো তার উল্টো বড় মেয়ের আত্মহত্যা, গ্রামের কিছু মানুষের কটুক্তি মেনে নিতে না পেরে মনোয়ারা বেগম পরপারে পাড়ি জমান।

করিম সাহেব আর আফরোজা বেগম হজ্জ পালন করতে সৌদি আরব গিয়েছেন। তাই এমন পরিস্থিতিতে সাফিরা একা হয়ে পড়ে। খবর পেয়ে রাযীন আসে। খালাম্মার দাফন কাফন শেষ করে সাফিরা কে সাথে করে নিয়ে যেতে চায় ঢাকা তাদের বাসায়। তখন গ্রামের মানুষ বাঁধা দিয়ে বলল, তোমার বাপ মা হজ্জ করতে গেছে তাই একটা যুবতী মেয়েকে এভাবে নিয়ে যেতে পারবে না! রাযীন তখন রুক্ষ গলায় বলল,
–” আমি নিয়ে না গেলে ও কার কাছে থাকবে এখানে? থাকলেও ওর সিকিউরিটি কে দিবে?
তখন গ্রামের মানুষজন বলল, তুমি যে ওর কোন ক্ষতি করবা না সেটা কিভাবে বুঝবো? তোমার বাসায় বাপ মা নাই তাই এই পরিস্থিতিতে আমরা এভাবে যেতে দিতে পারুম না।
তখন রাযীন বলল,
–” তাহলে কি চান আপনারা? আমি ওকে এখানে একা রেখে চলে যাই?
মেম্বার সাহেব গ্রামের মানুষজনের সাথে একমত হয়ে বললেন,
–” তুমি মাইয়াটা কে বিয়ে করো! তাহলেই সমাধান হবে।
রাযীন বিয়ে করতে রাজি হয় না। তখন গ্রামের মানুষ একরকম জোর করেই রাযীনের সাথে সাফিরার বিয়ে দিয়ে দেয়!
তারপর রাযীন সাফিরা কে নিয়ে ঢাকা তাদের বাড়িতে যায়। হজ্জ পালন করে করিম সাহেব আর আফরোজা বেগম এসব শুনে কষ্টে ভেঙ্গে পড়েন। তারপর ধীরে ধীরে ভাগ্য কে মেনে নেন। রাযীন কে বুঝান সাফিরা কে মেনে নেওয়ার জন্য। কিন্তু ওরকম ভাবে জোর করে বিয়ে দেওয়ায় মেনে নিতে পারে না রাযীন।
.
.
এক‌ই সাথে দুটো অন্যায় দুনিয়ার বুকে করে গেল সিনথিয়া। না পেল ইহকাল আর না পাবে পরকাল।
যার কারণে হাসিখুশি পরিবারটি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। ঘরে ভাতি (লাইট) দেওয়ার ও কেউ র‌ইলো না। দোরগোড়ায় তালা ঝুলে গেল চিরস্থায়ী।
অধৈর্য মানুষকে আত্মহত্যার পথে নিয়ে যায়। মানবজীবনে ধৈর্যের চেয়ে কল্যাণকর আর কিছু নেই। ধৈর্যের মাধ্যমে অনেক কঠিন বাস্তবতাকে সহজে মেনে নেওয়া যায়। সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা হলো যারা ধৈর্যশীল তাদের সঙ্গে আল্লাহর বিশেষ সঙ্গ থাকে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘হে মুমিনরা!
তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। [১]

একবার রাসুল (সা.) আনসার সাহাবিদের কিছু লোককে বলেন, ‘যে ব্যক্তি ধৈর্য ধরে, তিনি (আল্লাহ) তাকে ধৈর্যশীলই রাখেন। আর যে অমুখাপেক্ষী হতে চায়, আল্লাহ তাকে অভাবমুক্ত রাখেন। ধৈর্যের চেয়ে বেশি প্রশস্ত ও কল্যাণকর কিছু কখনো তোমাদের দান করা হবে না। [২]
.
.
বর্তমান,
তামান্নার বাবা মা তাকে আর করিম সাহেবের বাসায় রাখতে চাইছিলেন না। তামান্না দের বাড়ি কলেজ থেকে প্রায় তিন ঘন্টার পথ। তাই করিম সাহেবের বাসায় থেকে পড়াশোনা করার জন্য তার মা দিয়েছেন। মেয়ের স্বভাবের জন্য তারা পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু করিম সাহেব আর আফরোজা বেগম তাদেরকে বুঝিয়ে তামান্না কে আবার নিয়ে আসেন।
অন্যদিনের মতো স্বাভাবিক চলছিল সবকিছু। রিমা কিছুদিন থেকে শশুর বাড়িতে চলে গেছে। সাফিরা আর তামান্না কলেজে আসা যাওয়া করে। রাযীন অফিস করে, রাতের বেলা সাফিরা কে পড়াশোনায় সাহায্য করে। করিম সাহেব অবসর সময়ে ইসলামিক বই পড়েন। আফরোজা বেগম ঘরের টুকটাক কাজ সবার খেয়াল রাখেন। এখন সাফিরা আর তামান্না ও তাকে কাজে সাহায্য করে।
.
একদিন কলেজ শেষে তামান্না বাসায় চলে আসে। কিন্তু সাফিরা আসে না। আফরোজা বেগম মনে করেন হয়তো মিমের সাথে তাদের বাসায় গিয়েছে। কিন্তু মিম কে কল করে জানতে পারে তাদের বাসায় যায়নি তারচেয়ে বড় কথা মিম একটু অসুস্থ বলে কলেজে যায়নি। এ কথা শুনে আফরোজা বেগম দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে অথচ সাফিরার আসার নাম নেই। করিম সাহেব কলেজ পর্যন্ত যায় কিন্তু পায় না সাফিরাকে। আফরোজা বেগম রাযীনকে কল করে কিন্তু রাযীন কল রিসিভ করে না.……

#চলবে ইনশা আল্লাহ।

রেফারেন্স:
[১] (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৫৩)
[২] (বুখারি, হাদিস : ৬৪৭০)

পথ হারা প্রজাপতি পর্ব-০৫

0

#পথ_হারা_প্রজাপতি(৫)
#Israt_Bintey_Ishaqu(লেখিকা)

বাম দিকে কোনায় একটা ছোট রুম আছে যেখানে রাযিনকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে তামান্না কে রুমে রেখে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দেয় রাযীন! তামান্নাকে আজকে একটা শিক্ষা দিবে বলে ঠিক করে নেয় রাযীন। এর আগেও অনেকবার সাবধান করেছে কিন্তু তামান্না শুনে নাই। তাই আজকে এর বিহিত করবেই।
তামান্না ভেতর থেকে দরজায় অনেক ধাক্কাতে থাকে রাগে দুঃখে কান্না করে বলতে থাকে, ভাইয়া আমি আর এরকম করবো না। দরজাটা খুলে দিন প্লিজ? তামান্নার দরজা ধাক্কানো আর আর্তনাদে ছোট বাচ্চারা চলে আসে। তখন রাযীন তাদের বলল,
–” তোমাদের একটা কাজ দিলে করতে পারবে?
বাচ্চা গুলো কিছু বুঝতে না পেরে ফেলফেল করে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর যে ছেলেটা সবার বড় সেই ছেলেটা বলল,
–” কি কাজ? ভিতরে কে আছে? দরজা খুলে দেই?
রাযীন কাছে গিয়ে বসে বলল,
–” ভিতরে একটা দুষ্টু মেয়ে আছে। আমাকে খুব বিরক্ত করে সে জন্য বন্দি করে রেখেছি। তোমরা দেখবে কেউ যেন দরজা খুলে না দেয়। ঠিক আছে?
ছেলেটা মাথা কাত করে সম্মতি জানায়। তারপর রাযীন বলল,
–” তোমরা চকলেট পছন্দ করো?
পিছন থেকে ছোট মেয়ে বলল,
–” আমি চকলেট খাব।
–” আচ্ছা ঠিক আছে বিয়ে শেষে আমি তোমাদের সবাইকে চকলেট কিনে দিব ইনশা আল্লাহ।
তারপর রাযীন পুনরায় গিয়ে বিয়ের কাজে মনোযোগী হল।

বিয়েতে আগত অতিথিদের খাওয়া দাওয়া তারপর বিয়ে, কনে বিদায় সবকিছু মিলিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সবকিছু ঠিকঠাক ভাবেই সম্পূর্ণ হয় আলহামদুলিল্লাহ। মাগরিব নামায পড়ে বড়রা যখন ফ্রি হয়ে বসে চা নাস্তা খাচ্ছে তখন তামান্না ছাড়া পেয়ে বসার ঘরে ছুটে আসে। অবস্থা তার করুন। সাজগোজের দশা খারাপ। চোখের কাজল লেপ্টে, কান্না করে ফুলিয়ে ফেলেছে। তামান্নার মা দৌড়ে এসে মেয়ে ধরে আর্তনাদ শুরু করেন। মেয়ের সাথে খারাপ কিছু হয়েছে মুহুর্তেই ভেবেনিলেন। মানুষের মন সেকেন্ডের মধ্যেই কতো শত ভালো মন্দ কথা ভেবে ফেলে সেই জানে।
তামান্নার বাবা এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
–” কি হয়েছে মা? কোথায় ছিলি তুই? কতোবার তোকে এদিক ওদিক খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না। ভাবলাম বিয়ে বাড়ীতে কোথাও হয়তো আছিস, আনন্দ করছিস তাই অতো মাথা ঘামায়নি।

তামান্না তার মা’কে জরিয়ে ধরে কান্না করে দেয়। যার কারণে রুবিনা বেগম আরো ভয় পেয়ে গেলেন। উত্তেজনা হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে?
তামান্না কান্নাজড়িত কন্ঠে রাযীন ভাইয়া বলে আবার কান্না করা শুরু করলো।
সবাই রাযীনের নাম শুনে হতবাক। তখন পিছন থেকে রাযীন এসে দাঁড়ায়। সবাই রাযীনের দিকে তাকিয়ে থাকে। করিম সাহেব উঠে গিয়ে তামান্না কে জিজ্ঞাসা করে কি করেছে রাযীন? পিছন থেকে রাযীন বলল,
–” আমি বলছি।
তারপর তামান্না কিভাবে বিরক্ত করে রাযীন কে সেসব কথা বলে আজকের সবটা বলল রাযীন।
সবকিছু শুনে তামান্নার বাবার লজ্জায় মাথা নত হয়ে গেল। আজকে মেয়ের কারণে এতোটা লজ্জায় পড়বেন ভাবতেও পারেন নাই তিনি।
রুবিনা বেগম রাগ সামলাতে না পেরে মেয়ের গালে সজোরে থাপ্পর দিলেন। আরো দিতে গেলে আফরোজা বেগম গিয়ে ধরলেন। রুবিনা বেগম কে দূরে সরিয়ে নিলেন। তামান্না গালে হাত দিয়ে, মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলতে লাগলো।

জাসমিন বেগমের স্বামী মানে রাযীনের বড় ফুফা বসা থেকে উঠে এসে সবাইকে শান্ত হতে বললেন।
তারপর তিনি সবাইকে বসতে বলে তামান্নাকে ও বসতে বললেন। তারপর ইসলামের রেফারেন্স দিয়ে বললেন,
–” আল্লাহ্‌ তায়ালা সূরা নুরে বলেন, আর মুমিন নারীদেরকে বল, “তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে” এবং “তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করবে”। আর “যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না”। “তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে”।

আর “তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজদের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাই এর ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে, অধীনস্থ যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে নিজদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে”। আর “তারা যেন নিজদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে”। হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।

উপোরুক্ত আয়াতে আল্লাহ্‌ তায়ালা নারীদের কে কিছু নীতিমালা দিয়েছেন যেগুলো সবগুলোই সামাজিক আমরা কথা বলব ঘরের বাহিরে পর্দা নিয়ে। আয়াতে হিজাবে ও বোরকার ব্যাপারে কিছুই বলেনি। বরং আল্লাহ্‌ তায়ালা ঘরের বাহিরে পর্দার ব্যাপারে বলেছেন “যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না” এবং বলেছেন “তারা যেন নিজদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে” দুটি কথায় সহজে বুঝতে পারা যায় নারীদেরকে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশে নিষেধ করা হয়েছে, সুতরাং ঘরের বাহিরে নিজের সৌন্দর্যকে আবৃত করে তারপর বের হওয়া আর তাদের সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখার নামই পর্দা। তাই মা পর্দা মেনে চলো, এই দুনিয়া কিছুই না। আমাদের সকলকে একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে কাজেই মৃত্যুর পূর্ব প্রস্তুতি নিতে আমাদের ইসলামের সকল বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। আজকে তোমার কারণে তোমার বাবা মায়ের মাথা নিচু হয়েছে তাই তোমার বাবা মায়ের কাছে মাফ চেয়ে বলো, আর কখনো এমন কাজ করবে না যে কাজে আল্লাহ পাক নারাজ হন। তোমার বাবা মায়ের মাথা নত হয়।

অতঃপর তামান্না নিজের ভুল বুঝতে পেরে মা বাবার কাছে মাফ চেয়ে নেয়। আল্লাহ তাআলার কাছে ত‌ওবা করে নেয়।
.
.
রাযীন আর এখানে থাকলো না, বিয়ের পরের দিনেই চলে গেল নিজেদের বাড়ি ঢাকায়। বাকিরা মেয়েকে শশুর বাড়ী থেকে নিয়ে আসা পর্যন্ত থাকবে।
বিয়ের জন্য অফিস থেকে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়েছিল রাযীন। কিন্তু ছুটি শেষ হ‌ওয়ার আগেই যখন অফিসে গেল।
লাঞ্চ আওয়ারে মিনহাজ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
–” কিরে মানুষ ছুটি চেয়েও ছুটি পায় না আর তুই ছুটি শেষ হ‌ওয়ার একদিন আগেই চলে এসেছিস? ব্যাপার কি? বিয়ে ঠিকঠাক মতো সম্পূর্ণ হয়েছে তো?
–” হুম বিয়ে ঠিকঠাক মতোই হয়েছে।
–” তাহলে চলে এলি কেন?
তামান্নার ব্যাপারটা সবটা বলে রাযীন বলল, তাই আর ওখানে থাকতে ইচ্ছা করে নাই।
মিনহাজ সবটা শুনে বলল,
–” আচ্ছা তোর যে ব‌উ…

ব‌উ কথাটা বলতেই রাযীন কেমন করে তাকালো মিনহাজ এর দিকে। তাই মিনহাজ বলল,
–” মানে তোর খালাতো বোন। উনি ও কি পর্দা করেন?
রাযীন শান্ত স্বরে বলল,
–” হুম।
–” তোর সামনে ও করে?
রাযীন খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল,
–” না।
–” কেন করে না?
খাবার খাওয়া থামিয়ে রাযীন বলল,
–” ও আমার বিয়ে করা বউ! ও কেন আমার সামনে পর্দা করবে?

মিনহাজ মুচকি হেসে বলল,
–” তাহলে মানছিস ও তোর বিয়ে করা বউ?
জবাবে রাযীন কিছু বলল না, চুপ করে খাওয়াতে মনোযোগ দিল।
খাবার খাওয়া শেষে মিনহাজ আবার বলল,
–” তুই মানিস আর নাই মানিস উনি তোর বিয়ে করা বউ। আজকে তোর ফুফাতো বোন তোর সামনে বে-পর্দায় ঘুরে বেড়ায় বলে তোর রাগ হচ্ছে অপরদিকে তোর খালাতো বোন সেও তোর সামনে বে-পর্দায় ঘুরে বেড়ায় সেটা তোর কাছে মোটেও খারাপ লাগছে না তাই বুঝা যায় এটাই হালাল সম্পর্কের পাওয়ার বুঝলি?

রাযীন আগে কখনো এভাবে ভেবে দেখেনি। তাই এখন চুপ করে বসে রইলো। তারপর যখন অফিস থেকে বাসায় ফিরলো তখনো তার মাথায় এসব ঘুরপাক খেতে শুরু করলো। রাতে ঘুম ও ঠিকঠাক মতো হলো না।
এর দুদিন পর বাসার সবাই ফিরে এলো। সাফিরা কে পড়ানোর মাঝে মাঝে রাযীন তাকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করলো…..

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।

রেফারেন্স:
(১) (সূরা আন-নূর-৩১)

পথ হারা প্রজাপতি পর্ব-০৪

0

#পথ_হারা_প্রজাপতি(৪)
#Israt_Bintey_Ishaqu(লেখিকা)

নিজের রুমে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সাফিরা। এই দুনিয়ায় তার মা-বাবা, বোন কেউ র‌ইলো না। আর কে আছে তার মতো এমন অভাগী? মা বাবা বোন সবার কত্ত আদরের ছিল সাফিরা অথচ আজকে অন্যের বাসায় দিন কাটাতে হচ্ছে তাকে। তার জীবনটা তো এমন হ‌ওয়ার কথা ছিল না। এগুলো যত‌ই ভুলে থাকতে চায় ততোই কেউ না কেউ মনে করিয়ে দেয়। মানুষ গুলো কি বুঝে না? সাফিরার বড্ড কষ্ট হয়। মানুষ গুলো এতো নিষ্ঠুর কেন?

ফ্লোরে বসে খাটের উপর মাথা রেখে অঝোরে কাঁদছে সাফিরা। কাঁদতে কাঁদতে একসময় চোখের পানি শুকিয়ে আসে। কিন্তু ওভাবেই বসে থাকে। দশ পনেরো মিনিট পর পেয়ারা মাখা খাওয়ার জন্য আফরোজা বেগম এসে দরজা করাঘাত করে কিন্তু সাফিরা কোন সাড়া শব্দ করে না। তাই আফরোজা বেগম ভাবলেন সাফিরা বোধহয় ঘুমিয়ে আছে সে জন্য তিনি আর বেশি ডাকাডাকি করলেন না।
এর ঘন্টা খানেক পর ফোনের রিং টোন শুনে মাথা তুলে সাফিরা। ফোন হাতে নিয়ে দেখে তার বান্ধবী মিম কল করেছে। কলেজ জীবন থেকে মিমের সাথে পরিচয় সাফিরার। দু’জন খুবই ভালো বান্ধবী। কলেজ শেষে এক‌ই কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছে তারা যেন একসাথে পড়াশুনা করতে পারে সে জন্য। মিমের মা খুব আদর করে সাফিরা কে। যাই হোক কল রিসিভ করে সালাম দেয় সাফিরা।
সালামের জবাব দিয়ে মিম বলল,
–” জানিস আমার জন্য মামা একটা বিয়ের ঘর এনেছেন। কিন্তু পাত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে আমার পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু আমি আম্মুকে কিছুতেই বুঝাতে পারছি না। আচ্ছা তুই একটু গগআম্মুকে বুঝিয়ে বলবি? আমি জানি আম্মু তোর কথা শুনবে ইনশা আল্লাহ। কিরে তুই কিছু বলছিস না কেন?গল্পের
–” হুম।জ্ঞজ্ঞ
–” কি হুম?
–” আচ্ছা ঠিক আছে।
–” সাফি তুই কি আবারো কান্না করেছিস?
সাফিরার কন্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারে মিম। নিশ্চয়ই সাফিরা কান্না করেছে। তাই উদগ্রীব হয়ে উঠে জিজ্ঞেস করে কেন কান্না করেছে? কেউ কিছু বলেছে নাকি অতীতের কথা মনে করে কাঁদছে সাফিরা? উত্তরে সাফিরা কিছু বলে না। এই সময় গুলোতে কাছের মানুষজন যদি এসে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে? তাহলে আরো বেশি কান্না চলে আসে। তাই সাফিরা কান্না দমাতে ঠোঁট কামড়ে চুপ করে রইলো। মিম বুঝতে পারে তাই বলল,
–” এই বিশাল পৃথিবীটা যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি তোর সামান্য কষ্ট গুলো মুছে দিতে পারবেন না? অবশ্য‌ই পারবেন। আল্লাহ তাআলার উপর থেকে আস্থা, বিশ্বাস হারাবি না একদম। একদিন দেখবি ভাইয়া নিজের ভুল বুঝতে পারবেন, তখন তোকে মেনে নিবেন।
কোরআন আছে,
হে ঈমানদারগণ, তোমরা সবর ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন। [১]
তাই আল্লাহ তাআলার কাছে চাইতে থাক নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কাউকে নিরাশ করেন না। যখন তোর দুঃখগুলো ভুলিয়ে দিবেন তখন তুই নিজেই বলবি, হে আল্লাহ, আমি তো কখনো আপনাকে ডেকে ব্যর্থ হইনি।
আচ্ছা সাফি দুপুরের খাবার খেয়েছিস?
সাফিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” গোসল করে নামায পড়বো। আমার জন্য দুআ করিস। এখন রাখি পরে কথা বলবো ইনশা আল্লাহ।
–” আচ্ছা আচ্ছা তাড়াতাড়ি যা।
আসসালামু আলাইকুম।
–” ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
.
.
করিম সাহেবের বড় বোন জাসমিন, তার ছোট মেয়ের বিয়ে। জাসমিন এক সপ্তাহ আগে, একমাত্র ভাই এবং তার পরিবারকে চলে যাওয়ার জন্য বললেও রাযীনের অফিস এবং ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা ক্ষতি হবে ভেবে করিম সাহেব বোনকে কথা দিয়েছে, আল্লাহ চাহেতু বিয়ের দু’দিন আগে যাবে। আর তাই রিমা বাপের বাড়ি চলে এসেছে একসাথে সবাই যাবে বলে।
আজকে সেই দিন। আফরোজা বেগম সবাইকে তাড়া দিচ্ছেন তৈরি হ‌ওয়ার জন্য। ধীরে ধীরে সবাই তৈরি হয়ে ডয়িং রুমে চলে আসে। মেয়েরা সবাই পরিপূর্ণ পর্দা করলেও তামান্না বোরকার সাথে ফ্যাশনেবল হিজাব পরেছে যা দ্বারা পরিপূর্ণ পর্দা হয় না। প্রথম প্রথম করিম সাহেব আর আফরোজা বেগম তামান্না কে বুঝাতেন পরিপূর্ণ পর্দা করার জন্য। কিন্তু তামান্না নাছোড়বান্দা কথা শুনে না তাই আল্লাহ তায়ালার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা কাউকে হেদায়েত দান না করলে সাধ্য নেই কারো দ্বীনের পথে আনার। তবে দ্বীনের দাওয়াত দিতে হবে। যাই হোক বিয়ে বাড়িতে তারা গিয়ে দুপুরে পৌঁছায়। যোহরের নামায আদায় করে খাওয়া দাওয়া করে নেয়। তারপর বড়রা নিজেদের মতো কথাবার্তা বলে, মেয়েরা মেয়েদের মতো করে মজা করে। তবে যাই করে না কেন ইসলামের পরিপন্থী হবে এমন কিছু যেন না হয় তা বড়দের আদেশ।

দুই দিন যাবত সাফিরার মন ভালো নেই এরমধ্যে বিয়ে বাড়ি এসেছে। সারা বাড়ি জুড়ে মেহমানদের সমাগম। গ্রামের বাড়ি বলে আশেপাশের লোকজন ও এসেছে, বৃদ্ধদের পান সুপারি দেওয়া হয়েছে তারা আরামে খাচ্ছেন আর কথাবার্তা বলছেন। তাই সাফিরা একটু নিরিবিলি পরিবেশে থাকার জন্য ছাদে গিয়ে বসে থাকে একাকী। রাতের বেলা জোছনার আলোয় আলোকিত হয়ে আছে ছাদ। চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল লাগছে সাফিরা মুখশ্রী। এক ধ্যানে মগ্ন হয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে সাফিরা। পিছনে রাযীন এসে দাঁড়ায় কিন্তু সাফিরা তা টের পায় না। সাফিরা কে দেখতে পেয়ে কি করবে ভেবে পায় না রাযীন। এখানে রাযীনের সমবয়সী কোন ছেলে নেই যে তার সাথে সময় কাটাবে। সে জন্য ছাদে আসে রাযীন। কিন্তু সাফিরাকে দেখতে পেয়ে ছাদের দরজার কাছেই থেমে ভাবতে থাকে কি করবে?

কিছুক্ষণ ভেবে সামনে এগিয়ে যায়। পিছন থেকে বলে কিরে ফাঁকিবাজ! রাতের বেলা একা একা এখানে কি করছিস? বিয়ের উসিলায় তো পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিস একদম।
হঠাৎ কারো কথা শুনতে পেয়ে ভয়ে লাফিয়ে উঠে সাফিরা। বুকে হাত দিয়ে ধম নিতে শুরু করে। বুকে স্পষ্ট ধুকপুকুনির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
সাফিরা কে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাযীন আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে ত্যারা চোখে তাকিয়ে বলল,
–” কিরে কথা বলছিস না কেন? কি হয়েছে?
সাফিরা ছোট করে বলল,
–” ভয় পেয়েছি।
–” কেন?
–” তুমি হঠাৎ এসে কথা বলায়।
তখন আকস্মিক সাফিরার গালে হাত রেখে রাযীন বলল,
–” তুই দেখছি ভীতুর ডিম!
রাযীনের এমন স্পর্শে কেঁপে উঠে সাফিরা। ছিটকে দূরে সরে যেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে আটকে রেখেছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রাযীন শুকনো কাশি দিয়ে ছাদের অন্য পাশে চলে যায়। এই সুযোগে দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে যায় সাফিরা। সাফিরার যাওয়ার শব্দ শুনে সেদিকে তাকায় রাযীন। নিজের কাজে নিজেই হতভম্ব সে।
.
.
বিয়ের দিন,
ছেলেরা ছেলেদের মতো আর মেয়েরা মেয়েদের মতো করে সাজতে ব্যস্ত। একদিকে ব‌উকে সাজানো হচ্ছে। অন্যান্য মেয়েরা রঙিন পোশাক পরে হিজাব নিকাব পরলেও সাফিরা বোরকার সাথে ছয় পার্ট হিজাব, নিকাব পরে। রুমের এক কোনায় বসে থেকে বৌয়ের সাজানো দেখছে সে। তাছাড়া বেশিরভাগ সময় নামেরা কে কোলে নিয়ে সময় পার করছে সাফিরা। বিয়ে বাড়ি এসে রিমা নিশ্চিন্তে মজা করছে কারণ খাওয়া আর ঘুমের সময়টা বাদ দিয়ে নামেরা সাফিরার কাছেই থাকছে। সাফিরার ও বোরিং লাগছে না নামেরার জন্য।

বরযাত্রী আসার পর তাদের আপ্যায়নের তদারকি করছে রাযীন। তাদের কি প্রয়োজন তা হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছে। তার বড় ফুফির বড় ছেলে নেই। তাই ফুফাতো বোনের মামাতো ভাই হিসেবে সেই দায়িত্ব পালন করছে। এর মধ্যে রাযীন কে সাহায্য করার অজুহাতে তামান্না তার পিছুপিছু ঘুরছে! একেই তো কীসব সাজগোজ করেছে পর্দার “প” ও নেই তার‌উপর রাযীন কে বিরক্ত করছে। এক সময় রাযীন সহ্য করতে না পেরে তামান্নার হাত ধরে টেনে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে! হাত খুব শক্ত করে ধরায় তামান্না ব্যাথা পেয়ে বলল,
–” ভাইয়া ছাড়ো আমার খুব লাগছে।
কিন্তু তামান্নার কথা পাত্তা না দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে রাযীন।….

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।

রেফারেন্স:
(১) [সুরা বাকারা : ১৫৩]

পথ হারা প্রজাপতি পর্ব-০৩

0

#পথ_হারা_প্রজাপতি(৩)
#Israt_Bintey_Ishaqu(লেখিকা)

বোনের শাস্তি বোনকে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? মেয়েটা তো আর কোন দোষ করেনি তাহলে ওকে কেন শাস্তি দিচ্ছিস? দিনের পর দিন।
এসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না বলে উঠে দাঁড়ায় রাযীন। যাওয়ার আগে বলে যায়,
–” বোনের মতো যে বোনের চরিত্র হবে না তার কি গ্যারান্টি আছে?
অতঃপর মিনহাজকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হানহান করে নিজের কেবিনে চলে যায় রাযীন। মিনহাজ মাথা নেড়ে মনে মনে বলে যতদিন না রাযীন মন থেকে মেয়েটাকে মেনে নিচ্ছে ততদিন কেউ তাকে বোঝাতে পারবে না।
.
.
নতুন অবস্থায় তেমন ক্লাস হয় না বলে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসে সাফিরা আর তামান্না। যদিও তারা একসাথে আসে না কারণ তামান্না নিজেই মিশতে চায় না সাফিরার সাথে। সাফিরা এতিম বলে তাকে হিংসা করে এরিয়ে চলে। তারচেয়ে বড় কথা হলো রাযীন কে পছন্দ করে, তাকে বিয়ে করতে চায় তামান্না!
কিন্তু সাফিরার জন্য তার স্বপ্ন পূরণে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। সেই কারণে সাফিরাকে এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চায় তামান্না!

সাফিরা গোসল করে এসে ফোন হাতে নিয়ে বসে। তখন তামান্না এসে বলল,
–” কিরে কি করছিস?
সচরাচর সাফিরার রুমে তামান্না আসে না। আজকে আসতে দেখে একটু অবাক হয়ে চুপ করে থাকে।
তামান্না হাসি হাসি মুখ করে বলে,
–” তোর সাথে একটা জরুরী কথা আছে।
তারপর সাফিরার পাশে বসে দুঃখি ফেইস করে বলল,
–” রাযীন ভাইয়া তো তোকে একদম পছন্দ করে না তাই বিয়েটা মানে না! আর কোনদিন মেনে ও নিবে না। তাই তোর জীবনটা সুন্দর করে সাজিয়ে দিব আমি! আমার বান্ধবীর বড় ভাই কাতার থাকে। খুবই ভালো বেতনের চাকরি করে। বান্ধবীকে তোর ছবি দেখাতেই ও পছন্দ করে ফেলল। নিজে থেকেই বলল, ওর ভাইয়ের বউ করে নিয়ে যাবে তোকে!

তামান্নার কথা সবটাই মনোযোগ দিয়ে শুনলো সাফিরা। কিন্তু কিছু বলল না। তামান্না আবার নিজ থেকেই বলল,
–” কিরে কিছু বলছিস না যে?
সাফিরা ফোন বন্ধ করে টেবিলের উপর রেখে ফ্যান বন্ধ করতে করতে বলল,
–” হঠাৎ আমাকে নিয়ে এতো ভাবছিস দেখে বিস্ময়ে হতবাক আমি। তাই কি বলবো খুঁজে পাচ্ছি না রে। যাই হোক জাযাকিল্লাহু খাইরান আমার জন্য এতোটা ভাববার জন্য। আমি ভেবে তোকে জানাবো।
–” ঠিক আছে আমি তাহলে যাই এখন।

তামান্না চলে যাওয়ার পর বাথরুম থেকে অযু করে এসে যোহর নামায আদায় করে নেয় সাফিরা।
ঈমান লাভের পর ইসলামি শরিয়তের আবশ্যিক ইবাদত ও দ্বীনের মূল ভিত্তি হলো নামায। আর বেহেশতে প্রবেশের চাবি হলো নামায। এ কারণেই ঈমান লাভের পর মুসলমানের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো নামায।
সাফিরার খালামনি আর খালু ভীষণ ধার্মিক মানুষ মা শা আল্লাহ। তাদের এক মেয়ে এবং দুই ছেলে। তাঁরাও মা বাবার শিক্ষায় বড় হয়েছে, যদিও ছোট ছেলে এখনো ছোট তাও বাবা মায়ের কথা মতোই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। কিন্তু একটা ব্যাপারে রাযীন মা বাবার অবাধ্য। সাফিরা কে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ না করা! এর পিছনে যথাযুক্ত কারণ আছে বলে মনে করে রাযীন।
.
.
সূর্য যখন পশ্চিম দিকে ডুবু ডুবু তখন সাফিরা, রাযীন এর ছোট ভাই আহম্মেদকে নিয়ে যায় চারা গাছ রোপণের জন্য।
কলেজ থেকে ফেরার পথে ভ্যান গাড়িতে বিভিন্ন ফলের চারা গাছ বিক্রি করতে দেখে সেখান থেকে লেবু আর পেয়ারার চারা গাছ কিনে আনে। সকাল কিংবা বিকাল বেলা চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তাই সূর্য ডুবার অপেক্ষায় ছিল সাফিরা।

রাযীন এর বাবা করিম সাহেব ঢাকায় দু’তলা বাড়ি করেছেন। তিনি খুব শৌখিন মানুষ। প্রতি তলায় দুটো ফ্লাট। ভাড়া দেয়ার জন্য বাড়ি করেন নি, করেছেন নিজেরা থাকার জন্য। নিজে শৌখিন, তার বাড়িটাও শৌখিন। চারপাশে বারান্দা, নিচতলার ফ্লাটের ড্রইংরুম থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। গেটের পূর্ব দিকে দারোয়ানের জন্য পাকা টিনশেডের একটা রুম। গাড়ি রাখার গ্যারেজ নেই। বারান্দার কড়িডোর বেশ বড়। তারই একপাশে গাড়ি থাকে। পুরো বাড়িটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পশ্চিম পাশে ফল, ফুলের বাগান। বাকি জায়গাটা ফাঁকা রেখেছেন ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা করার জন্য। ভবিষ্যতে নাতি-নাতনি, মানে এক মেয়ে এবং দুই ছেলের বাচ্চাকাচ্চা খেলাধুলা করবে চিন্তা করে এই ব্যবস্থা।
প্রায় সময় বাগানের পরিচর্যা করে সাফিরা। ছোট বেলা থেকে বাগান করার খুব শখ তার। এখানে এসে সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। তাই বাগানে দেখছে এই দুটো গাছ নেই, সে জন্য দুটো গাছ কিনে আনলো। তাছাড়া পেয়ারা খুব পছন্দ সাফিরার। সাফিরাদের গ্রামের বাড়িতে বড় একটা পেয়ারা গাছ ছিল। পেয়ারা গুলো খুবই মিষ্টি আর ভেতরে গোলাপী রঙের হতো। সাফিরা গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে পেয়ারা পেরে খেত। লাস্ট যখন পাশের বাড়ির রুমানা কে নিয়ে পেয়ারা খাচ্ছিল তখন মায়ের চিৎকার শুনে দৌড়ে যায়। ঘরে গিয়ে দেখে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত লাশ হয়ে আছে সাফিরার বড় বোন সিনথিয়া!
.
.
অফিস থেকে ফিরে নিজের রুমেই থাকলো রাযীন। আজকে মন মেজাজ ভালো নেই বলে সাফিরা কে পড়াতে যায়নি। এতে সাফিরা ও বেশ খুশি হলো।
খাবার টেবিলে সবাই এক সাথে খেতে বসলে দুপুরে বলা তামান্নার কথাটা তুলে সাফিরা! এদিকে রাগে মুখ চোখ কালো করে তামান্না। আফরোজা বেগম
চক্ষু বিস্ফোরিত করে বলল,
–” এসব কি তামান্না! তুই কি জানিস না সাফিরা এ বাড়ির বউ? তবুও কেন পরপুরুষের কথা ওর কাছে গিয়ে বলিস তুই?
করিম সাহেব ও বললেন,
–” সত্যি ই তো এগুলো কি মা?

তামান্না করিম সাহেবের মেজ বোনের মেয়ে। আর সাফিরা, আফরোজা বেগমের বড় বোনের মেয়ে। দুজনকেই খুব স্নেহ করেন তিনি। তাই আদর করে দুজনকেই মা বলে ডাকেন।
করিম সাহেবের জিজ্ঞাসায় থতমত খেয়ে যায় তামান্না। সে ভাবেনি সবার সামনে এভাবে সবকিছু বলে দিবে সাফিরা। ঢিমে যাওয়া গলায় বলল,
–” মামা আসলে ভাইয়া তো সাফিরা কে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করছে না, তাই আমি ভাবলাম….

এতোক্ষণ সবটা নীরবে সহ্য করলেও এবার রেগে গেল রাযীন। বলল,
–” সবাই কি খেতে বসছো নাকি আলোচনার সভা নিয়ে বসছো?
তারপর সবাই চুপ হয়ে গেল আর রাযীন তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে চলে গেল। তামান্না ও তাই করলো, ও এখন পালাতে পারলে বেঁচে যায়।

আজকে রাযীন পড়াতে আসেনি বলে বিছানা ঝেড়ে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সাফিরা। তখন আহম্মেদ এসে বলল,
–” আপু ভাবী আসবো?
সাফিরার এক হাতে বিছানার ঝাড়ু অন্য হাত কোমরে রেখে বলল,
–” তোকে না বলেছি এমন অদ্ভুত ডাকে ডাকবি না আমাকে?
আহম্মেদ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
–” তোমাকে এভাবে ডাকার পিছনে তো লজিক আছে! এমনি এমনি তো আর ডাকছি না বলো? আগে তুমি আমার আপু ছিলে তারপর ভাইয়া তোমাকে বিয়ে করলো! আগের আপু বর্তমানের ভাবী। তাহলে কি দাঁড়ালো? আপু ভাবী!

সাফিরা ঝাড়ু রেখে মশারী টাঙ্গাতে টাঙ্গাতে মজা করে বলল,
–” তোর ভাই তো আমাকে ব‌উ হিসেবে মানেই না তাহলে ভাবী কিভাবে হলাম?
আহম্মেদ একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে থেকে বলল,
–” আচ্ছা আমাকে একটু বড় হতে দাও। ততোদিন তুমি অপেক্ষা করতে পারবে না?
–” কি হবে বড় হয়ে?
–” তখন আমি তোমাকে বিয়ে করে নিব!
–” তবে রে….
আহম্মেদ দৌড়ে পালায়। এদিকে সাফিরা হাসতে হাসতে শেষ। যদিও মুখ চেপে হাসছে। তবুও বেশ অনেক দিন পর মনটা একটু ফুরফুরে হলো। আজকে ঘুমটাও ভালো হবে ইনশা আল্লাহ।
.
.
সাফিরা আর তামান্না কলেজ থেকে ফিরে দেখে রাযীন এর বড় বোন রিমা এসেছে শশুর বাড়ি থেকে। তার দুই মেয়ে বড় মেয়ে নিপুণ আর ছোট মেয়ে নামেরা। ছোট্ট নামেরাকে দেখে কোলে তুলে নেয় সাফিরা। বাচ্চা মেয়েটা খুবই সুন্দর মা শা আল্লাহ। সাফিরা কে অনেক পছন্দ করে। এ বাড়ি আসলে সাফিরা সারাক্ষণ কোলে নিয়ে রাখে। বাচ্চারা কোল অনেক পছন্দ করে তাই সাফিরা কে ভীষণ পছন্দ করে নামেরা।
তামান্না বসে কথা বলছে রিমার সাথে। আফরোজা বেগম কাজের বুয়া কে নিয়ে মেয়ের জন্য ভালো মন্দ রান্না করছেন। কথায় কথায় রিমা বলে ফেলল,
–” সিনথিয়া এমনটা না করলে আজকে রাযীনের ও
ফুটফুটে বাচ্চা থাকতো! সিনথিয়া যে কেন করলো আল্লাহ জানেন?

প্রিয় বড় বোনের কথা মনে হতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না সাফিরা। নামেরা কে রিমার কোলে দিয়ে দৌড়ে চলে যায়….

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।

পথ হারা প্রজাপতি পর্ব-০২

0

#পথ_হারা_প্রজাপতি(২)
#Israt_Bintey_Ishaqu(লেখিকা)

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সাফিরা, অবস্থা বেগতিক দেখলে এক দৌড় দিবে বলে ঠিক করে নেয় মনে মনে। এদিকে কটমট করে এগিয়ে আসে রাযীন!
যেই না সাফিরা দৌড় দিতে উদ্যত হয় অমনি পড়ার টেবিলের একপাশে লম্বা হাত রেখে পথ আটকে দাঁড়ায়! ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায় সাফিরা। জানে না আজকে তার কপালে কি আছে? কেন যে ফটর ফটর করতে গেল? এখন সব ঘুম চোখ থেকে উধাও হয়ে গেছে। একটু আগে উধাও হলে কি এমন ক্ষতি হতো ঘুমের? সব দোষ ঐ ঘুমের, তা না হলে কি সে অমন কথা বলতে পারতো?

দাঁতে দাঁত চেপে রাযীন বলল,
–” খুব সাহসী হয়ে গেছিস দেখছি! আমার মুখে উপর কথা বলতে দুবার ভাবলি না? আমি ঠিক কি করতে পারি ভুলে গেছিস?
সাফিরা দৃষ্টি নামিয়ে নরম গলায় বলল,
–” দুঃখিত ভাইয়া, আমি আসলে ঘুমের জন্য এগুলো বলে ফেলছি। আর কখনো এমন ভুল হবে না।
টেবিল থেকে হাত সরিয়ে একটু দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে রাযীন বলল,
–” আজকে যদি আমি তোকে ছেড়ে দেই তাহলে দ্বিতীয়বার আবারো ভুল করবি তাই আজকে তোর শাস্তি উমমম, একটু ভেবে বললো,
তুই চেয়ারে বসে ঘুমাবি।

তারপর পুনরায় ফোন হাতে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ে রাযীন! দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে বসে পড়ে সাফিরা। এটা আজকে নতুন না এরকম শাস্তি প্রায়ই পেতে হয় তাকে! তাই আজকে আর কান্না পেল না একটু হাসিই আসলো। ভেবেছিল এর থেকেও কঠিন শাস্তি দিবে রাযীন।

আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত চারদিক। সাফিরা পড়ার টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। রাযীনের ঘুম ভেঙ্গে যায় আজানের ধ্বনি কানে পৌঁছাতে। হাই তোলে উঠে বসে, কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল সোফায় তার মানে নেই। সামনে তাকাতে দেখে সাফিরা পড়ার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায়। যাওয়ার সময় দরজা অনেক শব্দ করে লাগিয়ে যায়, যার ফলে সাফিরার ঘুম ভেঙে যায়। মাথা তুলে তাকিয়ে আশেপাশে দেখতে পায় রাযীন নেই। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে বুঝতে পারেন রাযীন মসজিদে গিয়েছে।
সাফিরা ও উঠে ফ্রেশ হয়ে অজু করে ফজর নামাজ পড়ে নেয়। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
আরাম স্থান পেয়ে নিমিষেই ঘুম চোখের পাতায় নেমে আসে।
.
.
সকাল বেলা রাযীন অফিসে যাওয়ার সময় আফরোজা বেগম বললেন,
–” তোর সাথে সাফিরা কে নিয়ে যা। ওর কলেজের পথ দিয়েই তো যাবি, নামিয়ে দিস।
রাযীন ফোনে দৃষ্টি রেখেই বলল,
–” আমরা পায়ে হেঁটে কলেজে গিয়েছি আর ওর প্রাইভেট কারে করে যেতে হবে? রিক্সা করে চলে যেতে বলো।
এই বলে বেড়িয়ে যায় রাযীন। আফরোজা বেগম মন খারাপ করে পিছনে ফিরলে দেখতে পায় ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাফিরা। আফরোজা বেগম বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলেন,
–” হাসছিস কেন?
–” তোমার কান্ড দেখে হাসবো না তো কাঁদবো? খালামনি। আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছো যেন তোমার ছেলের মনে ধরে আমাকে। অথচ ফলাফল সেই শূন্যের কোঠায়। প্লিজ খালামনি এরকম করো না। আমার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। আল্লাহ ভরসা এই নিয়ে দুশ্চিন্তা করি না আমি। তুমিও দুশ্চিন্তা করা বন্ধ করো।

রাযীন গাড়িতে উঠবে তখন দেখে তামান্না গাড়িতে বসে আছে! রাযীন কে দেখে আমতা আমতা করে বলল,
–” ভাইয়া আমাকে একটু কলেজে নামিয়ে দিবেন প্লিজ?
তামান্না কে দেখে আবারো মেজাজ খারাপ হয়ে গেল রাযীনের। চাপা রাগের গনগনে গলায় বলল,
–” কার পারমিশন নিয়ে গাড়িতে উঠেছিস তুই?
নাম বলছি!
তামান্না ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে যেই গাড়ি থেকে নামতে যাবে তখন সাফিরা বাড়ির মেইন গেট দিয়ে বের হয়ে আসে। রাযীন সাফিরা কে দেখতে পেয়ে তামান্না কে বলল,
–” গাড়িতে বস আমি কলেজে নিয়ে যাব!
তামান্না হতভম্ব হয়ে ঠিক হয়ে বসে, সাফিরা কে দেখতে পায়নি সে। তারপর রাযীন সামনে ড্রাইভারের সাথের সিটে বসলে ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দেয়।
পিছন থেকে সাফিরা দেখলো রাযীন তামান্না কে তার গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ তার বেলায় বলল, রিক্সায় করে যেতে। যা সাফিরার মনে অনেক কষ্ট দিল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে রিক্সাওয়ালা মামাকে হাতে ইশারা দিয়ে বলল,
–” মামা যাবেন?
রিক্সাওয়ালা মামা বললেন,
–” ক‌ই যাইবেন?
–” তো… কলেজ।
–” হ যামু।

এদিকে দুটো গলি পেরিয়ে গাড়ি থামিয়ে তামান্না কে নামতে বলে রাযীন! তামান্না আবারো কিছু বুঝতে না পেরে বসেই থাকে গাড়িতে। রাযীন ধমকে উঠলে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নামে তামান্না।
রিক্সায় করে চলে যা বলে গাড়ি নিয়ে চলে যায় রাযীন! ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে রাস্তার মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে তামান্না। তার সাথে আজকে কি হচ্ছে এসব? কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিল আজকে? পিছন থেকে রিক্সার হর্ন দিয়ে যাচ্ছে, তামান্না মাঝ রাস্তা থেকে সরছে না বলে রিক্সার ড্রাইভার বললেন, কি আফা আর কোন গাড়ি খুইজ্জা ফাইলেন না রিক্সার নিচে নি মারতে আইছেন?
নিজেকে সামলে নিয়ে রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় তামান্না। তারপর সাফিরার কথা মনে হতেই অন্য গলিতে ঢুকে যায়। কেননা সাফিরা যদি তাকে রাস্তায় দেখতে পায় তাহলে বুঝে যাবে রাযীন তাকে মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছে। যা তার কাছে খুবই লজ্জার হবে।

কলেজে পৌঁছে ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে বান্ধবীদের সাথে কথা বলছে সাফিরা। ক্লাস শুরু হতে আরো দশ মিনিট বাকি। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলো তামান্না কে কলেজ গেইট দিয়ে ঢুকতে। তামান্না আর সাফিরার ডিপার্টমেন্ট আলাদা তাই তামান্না তার ডিপার্টমেন্টের দিকে চলে গেল। সাফিরা মনে মনে ভাবলো রাযীন হয়তো তামান্না কে গাড়ি করে কোথাও ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল। তা না হলে সাফিরার আগে তামান্নার পৌঁছানোর কথা কলেজে।

সাফিরা ভুলে গিয়েছে কারো প্রতি কখনো খারাপ ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়। মানুষের প্রতি যে কোনো বিষয়ে ভালো ধারণা পোষণ করা উত্তম ইবাদতের সমতুল্য। কুরআন এবং হাদিসে মানুষের প্রতি খারাপ বা মন্দ ধারণা পোষণকে গোনাহের কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক ধারণা থেকে দূরে থাক। কারণ কোনো কোনো ধারণা পাপ। আর তোমরা একজন অন্যজনের গোপনীয় বিষয়ে খোঁজ নিও না। আর একজন অন্য জনের গিবত করো না। [১]
অযথা কারো প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করে গোনাহগার হওয়া থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। হাদিসে পাকে প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে উপদেশই দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে- হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ ধারণাভিত্তিক কথা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। তোমরা একে অপরের দোষ অনুসন্ধান করো না। আর তোমরা একে অপরের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করো না। এবং পরস্পর শত্রুতা ও দুশমনি পোষণ করো না।

পরক্ষনেই মনে কুরআন এবং হাদিসের কথা মনে হতে নিজেকে বকা দিয়ে, মনে মনে আল্লাহ তাআলা কাছে মাফ চেয়ে নিল সাফিরা।
.
.
রাযীন আর তার কলিগ বন্ধু মিনহাজ একসাথে ক্যান্টিনে বসে। চাকরির সুবাদে দুজনে খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছে।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এক সময় মিনহাজ বলল,
–” বয়স তো কম হচ্ছে না আর কতদিন এভাবে থাকবি? হয় মেয়েটাকে ছেড়ে দে নয়তো মেনে নে! এভাবে তো আর জীবন চলবে না। মেয়েটার ও তো একটা ভবিষ্যত আছে। তোর জন্য তো মেয়েটা আটকে আছে!

রাযীন কোক পান করছিল মিনহাজ এর কথায় থেমে গিয়ে ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলল,
–” আটকে আছে মানে?

আজকে সকাল বেলা মিনহাজ যখন অফিসের জন্য বাসা থেকে বের হয় তখন আফরোজা বেগম কল করে মিনহাজ কে সুপারিশ ধরে। রাযীন কে যেন সে একটু বুঝায়। তাই এসব কথা তুলে মিনহাজ।
মিনহাজ কে চুপ করে থাকতে দেখে রাযীন নিজেই বলে,
–” মেয়েটা নিজের প্রয়োজনে আমাদের বাড়িতে আছে। কেউ তাকে আটকে রাখেনি। ওর মুখের দিকে তাকালে ওর সেই ন*ষ্ট বোনের কথা মনে পড়ে যায় আমার!….

#চলবে ইনশা আল্লাহ

রেফারেন্স:-
[১] (সুরা হুজরাত : আয়াত ১২)

পথ হারা প্রজাপতিগল্পের পর্ব-০১

0

পথ_হারা_প্রজাপতি
#Israt_Bintey_Ishaqu(লেখিকা)

চিকেনের লেগ পিস আর নান রুটি দিয়ে খুব মজা করে খাচ্ছিলো সাফিরা। হঠাৎ রাযীন এসে সাফিরার প্লেট দুটো কেড়ে নিয়ে বললো,
–” লজ্জা করে না তোর? একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ও চান্স পেলি না, অথচ এখানে বসে বসে কব্জি ডুবিয়ে খাচ্ছিস!

তারপর আফরোজা বেগম কে উদ্দেশ্য করে বলল,
–” আম্মা আজকে ওর খাবার খাওয়া বন্ধ! আমি যদি শুনেছি ওরে তোমরা কেউ খাবার খেতে দিয়েছো তাহলে আমি কি করবো ভেবে দেখো!গল্পের জ্ঞ

এই বলে গটগট পায়ে প্রস্থান করলো এখান থেকে। এদিকে রাগে দুঃখে চোখের পানি টলমল করছে সাফিরার। তাই সবার থেকে চোখের পানি আড়াল করতে দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়। সবাই দেখলে কি ভাববে? বলবে খাবারের জন্য কাঁদছে! বিশেষ করে তামান্না যদি দেখে তাহলে উল্লাসে মেতে উঠবে তা তো সে হতে দিতে পারে না, কখনোই না।

কিছুক্ষণ পর আফরোজা বেগম দরজায় কড়াঘাত করে বলল,
–” সাফিরা আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে এসেছি তাড়াতাড়ি খেয়ে নে মা!
খালামনির এই কান্ড দেখে খুব হাসি পাচ্ছে সাফিরার। একমাত্র ছেলেকে এতো ভয় পায় যে শাসন ও করতে পারে না। যদি ছেলে রাগ করে বাসা থেকে চলে যায় সে জন্য। অথচ আফরোজা বেগম কিনা স্বপ্ন দেখে সাফিরাকে তার….! সো ফানি হা হা হা!

সাফিরা দরজা খুলে তার খালামনি কে বলল,
–” একদিন না খেয়ে থাকলে আমার কিছুই হবে না খালামনি তুমি বরং এগুলো নিয়ে যাও। তুমি তো জানো আমি না খেয়ে খেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। এখন আর কোন কষ্ট হয় না।
তখন তামান্না এসে বলল,
–” মামি তুমি ভাইয়ার অবাধ্য হয়ে সাফিরাকে খাবার দিচ্ছ? ভাইয়া জানলে কি হবে ভেবে দেখেছো?

আফরোজা বেগম রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
–” সাফিরার খাবার খাওয়া বন্ধ হলে তো তোর‌ও খাবার খাওয়া ও বন্ধ তামান্না! তুই কি কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিস? পাস নাই তো, তাহলে তোর মুখ দিয়ে কিভাবে কথা বের হয় লজ্জা করে না তোর?

আফরোজা বেগম এর কথায় রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তামান্না চলে গেল। সাফিরা ড্যাম শিউর এ কথা এক সময় না এক সময় রাযীনের কানে তুলবে তামান্না! তখন সাফিরার নাজেহাল অবস্থা করবে রাযীন! তাই আফরোজা বেগম কে সাফিরা বলল,
–” এসবের মধ্যে তুমি এসো না, তবুও কথা শুনো না আমার ভাল্লাগে না।
এই বলে দরজা লাগিয়ে বেডে গিয়ে বসে নিজে নিজে রাযীনের গোষ্ঠী উদ্ধার করতে শুরু করলো। তারমধ্যে একটা হাস্যকর কথা বলল,
যেমন তার নাম তেমন তার ব্যবহার আর দেখতেও। “রাযীন” অর্থ- গম্ভীর্যশীল।
. কেন যে খালামনিরা উনার নাম “রাযীন” রাখতে গেল? আল্লাহ তাআলা জানেন।
এ জীবনে বোধহয় এই লোকটার থেকে আমি ছাড়া পাবো না
.
বিকাল বেলা,
সাফিরা ঘুমিয়ে ছিলো দরজার ঠাসঠুস শব্দে ঘুম ছুটে দৌড়ে পালাতে বাধ্য হলো। আড়মোড়া ভেঙে দরজা খুলে দেখে রাযীন কতো গুলো মোটা মোটা ব‌ই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভিশন বিরক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সাফিরা। কিন্তু রাযীন এক ধমক দিয়ে বলল,
–” তোর চেহারা দেখতে এখানে এসেছি আমি? ব‌ই গুলো ধর?
সাফিরা হাতে নিতে,
রাযীন বলল,
–” ফ্রেশ হয়ে এসে পড়তে বস, আমি আসছি পড়াতে!

সাফিরা কিছু না বলে চুপচাপ ব‌ইগুলো টেবিলে ধিরাম করে রাখে। পিছন থেকে রাযীন বলে উঠে,
–” ব‌ই’কে যত্ন করিস না বলেই আজকে তোর এই দশা। আজকে যদি পড়া না পারিস তাহলে দেখবি তোর একদিন কি আমার যতদিন লাগে!

অতঃপর ফ্রেশ হয়ে এসে পড়তে বসে সাফিরা রাযীন এখনো আসেনি। সাফিরা ব‌ই গুলো উল্টে পাল্টে দেখে বড় করে ঢোক গিলে। কারণ সব কেমন কঠিন লাগছে তার কাছে। বিশেষ করে হিসাববিজ্ঞান বিষয়টি, এতো দিন বাংলায় অঙ্ক করে এসেছে আর এখন কিনা সব ইংরেজিতে করতে হবে! সে মনে করে এই একটা বিষয় তার জীবনকে তেজপাতা বানিয়ে ছাড়বে তা আর বুঝতে বাকি নেই।

রাযীন শুকনো কাশি দিয়ে রুমে এসে সাফিরার মুখোমুখি চেয়ারে বসে বলল,
–” এখন একাউন্টিং সাবজেক্ট টা বের কর। প্রথমে জাবেদা গুলো ইংরেজিতে শিখবি। তারপর অঙ্কে যাবো।

এদিকে সাফিরার মাথা ঘুরছে যেই ইংরেজিকে সে বরাবরই ভয় পেয়ে এসেছে সেই ইংরেজি এখন তার প্রাণপ্রিয় হিসাববিজ্ঞানে ঢুকে গেলো! এটা মেনে নিতে পারছে না সে, এমনিতেই সারাদিন ধরে না খেয়ে আছে। তার উপর এই নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অচিরেই সে চেয়ার থেকে ধপাস করে নিচে পরে গেল!
.
বেশ কিছুক্ষণ পর পিটপিট করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে রাযীন রাগি মুখশ্রী করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সাফিরা কাঁদো কাঁদো মুখশ্রী করে বলল,
–” ভাইয়া আমি আর পড়বো না। খালামনি কে বলো আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে!
বলতে না বলতেই রাযীন তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে বলল,
–” একটা থাপ্পড় দিয়ে বিয়ের ভুত মাথা থেকে ছাড়িয়ে দিব। কতোবার বিয়ে করার শখ তোর?বেয়াদব মেয়ে কোথাকার। লজ্জা করলো না নিজের মুখে বিয়ের কথা বলতে?

এতো বড় ধমক খেয়ে হুশ ফিরল সাফিরার, মনে মনে বলে,
–” আমি কার কাছে কি বলে ফেললাম হায় আল্লাহ! এখন এগুলো বলে আমায় কথা শুনাতে ছাড়বেন না ভাইয়া।

সাফিরার ভাবনার মাঝে রাযীন বলে,
–” হাঁ কর!

সাফিরা চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। স্বপ্ন দেখছে কিনা সেটাই ভাবছে। না হয় কি এই দিনের বেলা জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে? এর মধ্যে রাযীন ধারাজ গলায় বলল,
–” চোখ দুটো দিয়ে কি ভষ্ম করে দিবি নাকি! এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, এরপর পড়তে বসবি।
সাফিরা কাঁদো কাঁদো মুখশ্রী করে চুপচাপ খাবার খেয়ে নিল।
.
.
ঘরির কাঁটায় রাত দুইটা বেজে দুই মিনিট। ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আসছে সাফিরার চোখ দুটো। কিন্তু রাযীনের জন্য ঘুমাতে পারছে না। অসহায় মুখে একবার ঘড়ির দিকে তো আরেকবার বিছানার দিকে তাকায় সাফিরা। সাফিরা পড়া শুনতে না পেয়ে রাযীন মোবাইল ফোন থেকে চোখ সরিয়ে সাফিরাকে বলল,
–” কিরে তোর পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি না কেন?

সাফিরা আর থাকতে না পেরে অসহায় ভাবে বলল,
–” ভাইয়া আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, সকাল সকাল উঠে আবার বাকি পড়াটা কমপ্লিট করব।

রাযীন সময় দেখে বলল,
–” আর ত্রিশ মিনিট পড়। ততোক্ষণে আমার অফিসের কাজ কমপ্লিট হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ।
–” আমার রুমেই কাজ কমপ্লিট করতে হবে? তোমার রুমে গিয়ে করলে কি সমস্যা? আমার এখন বোর্ড পরীক্ষা চলছে না যে রাত জেগে এভাবে পড়াশোনা করতে হবে। আর মানতে পারছি না তোমার এই অত্যাচার! আমাকে একটু শান্তি দাও।

এতটুকু বলে মুখ চেপে ধরে সাফিরা। ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে মাথা আউলা ঝাউলা হয়ে গেছে তার, তা না হলে বাঘের মুখে দাঁড়িয়ে এমন সাহসীকতা দেখায় সে?
এদিকে ফোন বন্ধ করে কটমট করে এগিয়ে আসে রাযীন!…..

#চলবে?