পথ হারা প্রজাপতি পর্ব-০৩

0
220

#পথ_হারা_প্রজাপতি(৩)
#Israt_Bintey_Ishaqu(লেখিকা)

বোনের শাস্তি বোনকে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? মেয়েটা তো আর কোন দোষ করেনি তাহলে ওকে কেন শাস্তি দিচ্ছিস? দিনের পর দিন।
এসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না বলে উঠে দাঁড়ায় রাযীন। যাওয়ার আগে বলে যায়,
–” বোনের মতো যে বোনের চরিত্র হবে না তার কি গ্যারান্টি আছে?
অতঃপর মিনহাজকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হানহান করে নিজের কেবিনে চলে যায় রাযীন। মিনহাজ মাথা নেড়ে মনে মনে বলে যতদিন না রাযীন মন থেকে মেয়েটাকে মেনে নিচ্ছে ততদিন কেউ তাকে বোঝাতে পারবে না।
.
.
নতুন অবস্থায় তেমন ক্লাস হয় না বলে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসে সাফিরা আর তামান্না। যদিও তারা একসাথে আসে না কারণ তামান্না নিজেই মিশতে চায় না সাফিরার সাথে। সাফিরা এতিম বলে তাকে হিংসা করে এরিয়ে চলে। তারচেয়ে বড় কথা হলো রাযীন কে পছন্দ করে, তাকে বিয়ে করতে চায় তামান্না!
কিন্তু সাফিরার জন্য তার স্বপ্ন পূরণে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। সেই কারণে সাফিরাকে এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চায় তামান্না!

সাফিরা গোসল করে এসে ফোন হাতে নিয়ে বসে। তখন তামান্না এসে বলল,
–” কিরে কি করছিস?
সচরাচর সাফিরার রুমে তামান্না আসে না। আজকে আসতে দেখে একটু অবাক হয়ে চুপ করে থাকে।
তামান্না হাসি হাসি মুখ করে বলে,
–” তোর সাথে একটা জরুরী কথা আছে।
তারপর সাফিরার পাশে বসে দুঃখি ফেইস করে বলল,
–” রাযীন ভাইয়া তো তোকে একদম পছন্দ করে না তাই বিয়েটা মানে না! আর কোনদিন মেনে ও নিবে না। তাই তোর জীবনটা সুন্দর করে সাজিয়ে দিব আমি! আমার বান্ধবীর বড় ভাই কাতার থাকে। খুবই ভালো বেতনের চাকরি করে। বান্ধবীকে তোর ছবি দেখাতেই ও পছন্দ করে ফেলল। নিজে থেকেই বলল, ওর ভাইয়ের বউ করে নিয়ে যাবে তোকে!

তামান্নার কথা সবটাই মনোযোগ দিয়ে শুনলো সাফিরা। কিন্তু কিছু বলল না। তামান্না আবার নিজ থেকেই বলল,
–” কিরে কিছু বলছিস না যে?
সাফিরা ফোন বন্ধ করে টেবিলের উপর রেখে ফ্যান বন্ধ করতে করতে বলল,
–” হঠাৎ আমাকে নিয়ে এতো ভাবছিস দেখে বিস্ময়ে হতবাক আমি। তাই কি বলবো খুঁজে পাচ্ছি না রে। যাই হোক জাযাকিল্লাহু খাইরান আমার জন্য এতোটা ভাববার জন্য। আমি ভেবে তোকে জানাবো।
–” ঠিক আছে আমি তাহলে যাই এখন।

তামান্না চলে যাওয়ার পর বাথরুম থেকে অযু করে এসে যোহর নামায আদায় করে নেয় সাফিরা।
ঈমান লাভের পর ইসলামি শরিয়তের আবশ্যিক ইবাদত ও দ্বীনের মূল ভিত্তি হলো নামায। আর বেহেশতে প্রবেশের চাবি হলো নামায। এ কারণেই ঈমান লাভের পর মুসলমানের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো নামায।
সাফিরার খালামনি আর খালু ভীষণ ধার্মিক মানুষ মা শা আল্লাহ। তাদের এক মেয়ে এবং দুই ছেলে। তাঁরাও মা বাবার শিক্ষায় বড় হয়েছে, যদিও ছোট ছেলে এখনো ছোট তাও বাবা মায়ের কথা মতোই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। কিন্তু একটা ব্যাপারে রাযীন মা বাবার অবাধ্য। সাফিরা কে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ না করা! এর পিছনে যথাযুক্ত কারণ আছে বলে মনে করে রাযীন।
.
.
সূর্য যখন পশ্চিম দিকে ডুবু ডুবু তখন সাফিরা, রাযীন এর ছোট ভাই আহম্মেদকে নিয়ে যায় চারা গাছ রোপণের জন্য।
কলেজ থেকে ফেরার পথে ভ্যান গাড়িতে বিভিন্ন ফলের চারা গাছ বিক্রি করতে দেখে সেখান থেকে লেবু আর পেয়ারার চারা গাছ কিনে আনে। সকাল কিংবা বিকাল বেলা চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তাই সূর্য ডুবার অপেক্ষায় ছিল সাফিরা।

রাযীন এর বাবা করিম সাহেব ঢাকায় দু’তলা বাড়ি করেছেন। তিনি খুব শৌখিন মানুষ। প্রতি তলায় দুটো ফ্লাট। ভাড়া দেয়ার জন্য বাড়ি করেন নি, করেছেন নিজেরা থাকার জন্য। নিজে শৌখিন, তার বাড়িটাও শৌখিন। চারপাশে বারান্দা, নিচতলার ফ্লাটের ড্রইংরুম থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। গেটের পূর্ব দিকে দারোয়ানের জন্য পাকা টিনশেডের একটা রুম। গাড়ি রাখার গ্যারেজ নেই। বারান্দার কড়িডোর বেশ বড়। তারই একপাশে গাড়ি থাকে। পুরো বাড়িটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পশ্চিম পাশে ফল, ফুলের বাগান। বাকি জায়গাটা ফাঁকা রেখেছেন ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা করার জন্য। ভবিষ্যতে নাতি-নাতনি, মানে এক মেয়ে এবং দুই ছেলের বাচ্চাকাচ্চা খেলাধুলা করবে চিন্তা করে এই ব্যবস্থা।
প্রায় সময় বাগানের পরিচর্যা করে সাফিরা। ছোট বেলা থেকে বাগান করার খুব শখ তার। এখানে এসে সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। তাই বাগানে দেখছে এই দুটো গাছ নেই, সে জন্য দুটো গাছ কিনে আনলো। তাছাড়া পেয়ারা খুব পছন্দ সাফিরার। সাফিরাদের গ্রামের বাড়িতে বড় একটা পেয়ারা গাছ ছিল। পেয়ারা গুলো খুবই মিষ্টি আর ভেতরে গোলাপী রঙের হতো। সাফিরা গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে পেয়ারা পেরে খেত। লাস্ট যখন পাশের বাড়ির রুমানা কে নিয়ে পেয়ারা খাচ্ছিল তখন মায়ের চিৎকার শুনে দৌড়ে যায়। ঘরে গিয়ে দেখে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত লাশ হয়ে আছে সাফিরার বড় বোন সিনথিয়া!
.
.
অফিস থেকে ফিরে নিজের রুমেই থাকলো রাযীন। আজকে মন মেজাজ ভালো নেই বলে সাফিরা কে পড়াতে যায়নি। এতে সাফিরা ও বেশ খুশি হলো।
খাবার টেবিলে সবাই এক সাথে খেতে বসলে দুপুরে বলা তামান্নার কথাটা তুলে সাফিরা! এদিকে রাগে মুখ চোখ কালো করে তামান্না। আফরোজা বেগম
চক্ষু বিস্ফোরিত করে বলল,
–” এসব কি তামান্না! তুই কি জানিস না সাফিরা এ বাড়ির বউ? তবুও কেন পরপুরুষের কথা ওর কাছে গিয়ে বলিস তুই?
করিম সাহেব ও বললেন,
–” সত্যি ই তো এগুলো কি মা?

তামান্না করিম সাহেবের মেজ বোনের মেয়ে। আর সাফিরা, আফরোজা বেগমের বড় বোনের মেয়ে। দুজনকেই খুব স্নেহ করেন তিনি। তাই আদর করে দুজনকেই মা বলে ডাকেন।
করিম সাহেবের জিজ্ঞাসায় থতমত খেয়ে যায় তামান্না। সে ভাবেনি সবার সামনে এভাবে সবকিছু বলে দিবে সাফিরা। ঢিমে যাওয়া গলায় বলল,
–” মামা আসলে ভাইয়া তো সাফিরা কে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করছে না, তাই আমি ভাবলাম….

এতোক্ষণ সবটা নীরবে সহ্য করলেও এবার রেগে গেল রাযীন। বলল,
–” সবাই কি খেতে বসছো নাকি আলোচনার সভা নিয়ে বসছো?
তারপর সবাই চুপ হয়ে গেল আর রাযীন তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে চলে গেল। তামান্না ও তাই করলো, ও এখন পালাতে পারলে বেঁচে যায়।

আজকে রাযীন পড়াতে আসেনি বলে বিছানা ঝেড়ে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সাফিরা। তখন আহম্মেদ এসে বলল,
–” আপু ভাবী আসবো?
সাফিরার এক হাতে বিছানার ঝাড়ু অন্য হাত কোমরে রেখে বলল,
–” তোকে না বলেছি এমন অদ্ভুত ডাকে ডাকবি না আমাকে?
আহম্মেদ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
–” তোমাকে এভাবে ডাকার পিছনে তো লজিক আছে! এমনি এমনি তো আর ডাকছি না বলো? আগে তুমি আমার আপু ছিলে তারপর ভাইয়া তোমাকে বিয়ে করলো! আগের আপু বর্তমানের ভাবী। তাহলে কি দাঁড়ালো? আপু ভাবী!

সাফিরা ঝাড়ু রেখে মশারী টাঙ্গাতে টাঙ্গাতে মজা করে বলল,
–” তোর ভাই তো আমাকে ব‌উ হিসেবে মানেই না তাহলে ভাবী কিভাবে হলাম?
আহম্মেদ একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে থেকে বলল,
–” আচ্ছা আমাকে একটু বড় হতে দাও। ততোদিন তুমি অপেক্ষা করতে পারবে না?
–” কি হবে বড় হয়ে?
–” তখন আমি তোমাকে বিয়ে করে নিব!
–” তবে রে….
আহম্মেদ দৌড়ে পালায়। এদিকে সাফিরা হাসতে হাসতে শেষ। যদিও মুখ চেপে হাসছে। তবুও বেশ অনেক দিন পর মনটা একটু ফুরফুরে হলো। আজকে ঘুমটাও ভালো হবে ইনশা আল্লাহ।
.
.
সাফিরা আর তামান্না কলেজ থেকে ফিরে দেখে রাযীন এর বড় বোন রিমা এসেছে শশুর বাড়ি থেকে। তার দুই মেয়ে বড় মেয়ে নিপুণ আর ছোট মেয়ে নামেরা। ছোট্ট নামেরাকে দেখে কোলে তুলে নেয় সাফিরা। বাচ্চা মেয়েটা খুবই সুন্দর মা শা আল্লাহ। সাফিরা কে অনেক পছন্দ করে। এ বাড়ি আসলে সাফিরা সারাক্ষণ কোলে নিয়ে রাখে। বাচ্চারা কোল অনেক পছন্দ করে তাই সাফিরা কে ভীষণ পছন্দ করে নামেরা।
তামান্না বসে কথা বলছে রিমার সাথে। আফরোজা বেগম কাজের বুয়া কে নিয়ে মেয়ের জন্য ভালো মন্দ রান্না করছেন। কথায় কথায় রিমা বলে ফেলল,
–” সিনথিয়া এমনটা না করলে আজকে রাযীনের ও
ফুটফুটে বাচ্চা থাকতো! সিনথিয়া যে কেন করলো আল্লাহ জানেন?

প্রিয় বড় বোনের কথা মনে হতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না সাফিরা। নামেরা কে রিমার কোলে দিয়ে দৌড়ে চলে যায়….

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে