Monday, June 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 237



দৃষ্টির আলাপন পর্ব-১৫+১৬

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৫
#আদওয়া_ইবশার

পুরোদমে সাত কলেজের ভর্তির জন্য প্রস্তুতি চলছে দৃষ্টির। মাথায় তার একটাই চিন্তা বাবা-মা’কে এই মুহূর্তে অখুশি রাখা যাবেনা। যেভাবেই হোক তাদের ইচ্ছে পূরণ করতে হবে। তবেই দৃষ্টি একটু ভরসা নিয়ে তাদের কাছে নিজের পছন্দের কথা তুলে ধরতে পারবে। একদিন আগে পরে হলেও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করানো যাবে। কিন্তু এখন যদি তাদের কথা না রাখতে পারে তবে কোন মুখে যাবে মা-বাবাকে রক্তিমের কথা বলতে! আর মা-বাবাই বা কোন খুশিতে তার ইচ্ছে পূরণ করতে যাবে? এর মাঝে আবার দৃষ্টি খবর পেয়েছে আজীজ শিকদার নির্বাচনে বিপুল ভোট জয় লাভ করেছে। এখন তো ওনি নিশ্চয়ই দৃষ্টিকে দেওয়া কথা রাখবে। যেকোনো সময় হয়তো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হতে পারে তাদের বাড়িতে। কথাটা যতবার ভাবছে ততবারই পুলকিত হচ্ছে দৃষ্টি।

দিলশান আরা’র পরিচিত এক ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। সেমিস্টার শেষ করে নিজ এলাকায় কিছুদিনের জন্য ছুটি কাটাতে এসেছিল। তার কাছেই দিলশান আরা অনুরোধ রাখেন মেয়েটাকে যাতে পরীক্ষার জন্য একটু ভালো ভাবে প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করে। প্রিয় ম্যাডামের আবদার বাধ্য ছাত্র হয়ে মেনে নেয় ছেলেটা। আজ চারদিন যাবৎ দৃষ্টি তার কাছে প্রতিদিন বিকেলে পড়তে যাচ্ছে। নিয়ম করে আজকেও গিয়েছিল। টানা দুই ঘন্টা পড়া শেষে সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে নিজের বাসার দিকে যাচ্ছিল দৃষ্টি। রাস্তায় নেমে কয়েক কদম আগাতেই হঠাৎ মনে হয় পিছন থেকে কেউ তাকে নাম ধরে ডাকছে। অচেনা এক ছেলে কন্ঠে নিজের নাম শুনে একটু অবাক হয় দৃষ্টি। পিছন ঘুরে দেখতে বেশভূষায় ভদ্র গোছের সম্পূর্ণ এক যুবক তার দিকে এগিয়ে আসছে। দৃষ্টি মনে করার চেষ্টা করে লোকটা তার পূর্বপরিচিত কি না। কিন্তু নাহ! এর আগে কখনও লোকটাকে দেখেছে বলে মনে হচ্ছেনা। তবে একদম অচেনা একটা মানুষ কিভাবে তার নাম জানল! দৃষ্টির ভাবনার মাঝেই ছেলেটা একদম তার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। অমায়িক হেসে বলে,

“আপনিই দৃষ্টি মেহজাবিন রাইট!”

“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে? আর আমার নাম কিভাবে জানেন?”

ছেলেটা আবারও হাসে। বলে,

“এতো প্রশ্ন একসাথে করলে কোনটার উত্তর দিব? আস্তে আস্তে বলুন। কেউ দৌড়াচ্ছেনা আপনাকে।”

চারিদিকে হুড়মুড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। লোকটা কি চোখে দেখছেনা! ভর সন্ধ্যায় একটা মেয়ে মানুষের বাড়ি যাবার তাড়া থাকবেনা! কিজন্যে একটা মেয়ে এই সন্ধ্যা বেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অচেনা একটা ছেলের সাথে রসিয়ে আলাপ করতে যাবে? ছেলেটার কমন সেন্সের বড্ড অভাব। কথাটা ভেবে একটু বিরক্ত হয় দৃষ্টি। বলে,

“আরে ভাই আমি আপনাকে চিনিনা জানিনা আপনার সাথে রাজ্যের সময় নিয়ে কথা বলতে যাব কেন? তাছাড়া সন্ধ্যা নামছে চোখে দেখতে পাচ্ছেন না? অদ্ভূত লোক!”

ছেলেটা হয়তো দৃষ্টির বিরক্তি ভাবটা বুঝতে পারে। তাই আবারও হেসে বলে,

“আরে ভাবি সাহেবা এতো অধৈর্য হলে চলবে না কি? রক্তিম শিকদারের বউ হতে হলে প্রচুর ধৈর্য্য থাকতে হবে। নাহয় কিন্তু একদিনও সংসার করার ভাগ্য হবেনা।”

হুট করে লোকটার মুখে রক্তিমের নাম শুনে বিস্মিত হয় দৃষ্টি। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে জানতে চায়,

“কে আপনি? রক্তিম শিকদারকে কিভাবে চিনেন? আর আমি যে রক্তিম শিকদারের বউ হব এটা আপনি জানেন কিভাবে?”

“আমি রক্তিমের বন্ধু। আজীজ কাকু মানে রক্তিমের বাবা আমাকে পাঠিয়েছে আপনার সাথে দেখা করার জন্য।”

এবার একটু নরম হয় দৃষ্টির আচরণ। ভাবে লোকটাকে সত্যিই হয়তো আজীজ শিকদার পাঠিয়েছে কোনো প্রয়োজনে। নির্বাচন শেষ। এবার নিশ্চয়ই আজীজ শিকদার তার কথা নিয়ে ভাবতে বসেছে। সেজন্যই হয়তো কোনো কিছু জানতে বা জানাতে লোকটাকে তার কাছে পাঠিয়েছে। আর সে কি লোকটার সাথে বাজে আচরণ করা শুরু করে দিয়েছে! একটু লজ্জিত হয় দৃষ্টি। অল্প হেসে বলে,

“স্যরি ভাইয়া। আসলে আপনাকে এর আগে কখনো দেখিনি তো তাই চিনতে পারিনি। প্লিজ কিছু মনে করবেননা!”

প্রতিত্ত্যরে লোকটাও হাসে। মাথা নাড়িয়ে বলে,

“না না। কিছু মনে করিনি। আপনার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলেও অপরিচিত ছেলের সাথে এমন ভাবেই কথা বলতো। এটা স্বাভাবিক। চলুন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি! এতে আপনারও সুবিধা হবে। আপনি সময় মতো বাড়িতেও চলে যেতে পারবেন। এদিকে আমাদের কথাও শেষ হয়ে যাবে।”

বিনিময়ে দৃষ্টিও মুচকি হেসে সম্মতি জানিয়ে এগিয়ে রাস্তার দিকে। উপরে দৃষ্টিকে দেখতে শান্ত মনে হলেও ভিতরে ভিতরে অস্থিরতায় ছটফট করছে মেয়েটা। না জানি আজীজ শিকদার কোন খবর পাঠিয়েছে! খবরটা দৃষ্টির জন্য আনন্দের হবে না কি দুঃখের? কথাটা জানার জন্য তর সইছেনা। অন্যদিকে লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে তাড়া দিয়ে জানতেও পারছেনা।

***

রূপালী চাঁদের আজ অভিমান হয়েছে। ধরণীর বুকে আলো দিতে ভিষণ অনিহা তার। মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারা গুলোও আজ চাঁদের সাথে পাল্লা দিয়ে লুকিয়ে আছে। রাস্তার দুই পাশে জ্বলতে থাকা ল্যাম্প পোস্টের আলো যেটুকু অন্ধকার সড়াতে সক্ষম হয়েছে সেটুকুই আলোকিত। পার্টি অফিসের ছাঁদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে রক্তিম শিকদার এবং আজীজ শিকদার। বাবা-ছেলে দুজনেই নিরব। আজীজ শিকদার মনে করার চেষ্টা করছেন ঠিক কতদিন আগে এমনভাবে বাবা-ছেলে একসাথে ছাঁদে দাঁড়িয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রকৃতি অনুভব করেছিল? অতীত হাতরে দেখা মিলে এমন শত শত মধুর মুহূর্ত। যে সময় গুলোতে বাবা-ছেলের মাঝে ছিল বন্ধুসুলভ এক সম্পর্ক। এমন কতশত রাত স্মৃতির পাতায় যুক্ত হয়েছে!যে রাত গুলোতে রক্তিম শিকদারের পেটে জমে থাকা সমস্ত কথা চালান হতো আজীজ শিকদারের কানে। সেই ছেলেটাই আজ কত গুলো বছর যাবৎ বাবার সাথে এক দন্ড বসেও একটু কথা বলেনা।
তবে আজ এতোদিন পর রক্তিম নিজে থেকেই পার্টি অফিসে এসে কি মনে করে যেন বাবাকে আহ্বান জানাই দুজনে মিলে একটু নিরব সময় কাটানোর জন্য। ছাঁদে আসার পর থেকে এখন পযর্ন্ত কোনো কথা বলেনি রক্তিম। শুধু নিরবে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে রাস্তায় চলতে থাকা গাড়ি গুলোর দিকে। ছেলেকে এক নজর দেখে আজীজ শিকদার নিজেই নিরবতার জাল ছিঁড়ে বলেন,

“তোমার মা’কে যত দ্রুত সম্ভব একজন সাইক্রিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে।”

তড়িৎ রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাবার দিকে তাকায় রক্তিম। কপাল কুঁচকে জানতে চায়,

“কেন?”

“ইদানিং একটু বেশিই পাগলামি করছে। এক প্রকার ঘর বন্দি করে রাখতে হচ্ছে। কখন কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে বলা যায়না।”

“আপনার কাছে কি আমার মা’কে পাগল মনে হয়? ঘরবন্দি করে রাখার মানে কি? এসব করে বুঝাতে চাইছেন সত্যি সত্যি ওনি পাগল?”

এবার রক্তিমের কন্ঠে রাগের আভাস পাওয়া যায়। হঠাৎ করে মা’কে ঘরবন্দি করে রাখার মতো একটা কথা শুনে ঠিক রাখতে পারেনা নিজেকে। রাগে এক প্রকার চেঁচিয়ে কথা গেছে বলে। বিপরীতে আজীজ শিকদার তার স্বভাবজাত গম্ভীর কন্ঠে বলে,

“শিক্ষিত হয়েও মূর্খদের মতো কথা বলনা। শুধু পাগল হলেই মানুষ সাইক্রিয়াট্রিস্টের সরনাপন্ন হয়না। তাছাড়া তোমার কি মনে হয় তার মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক? ঐ ঘটনার পর থেকে তোমার সাথে যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করে। মানলাম এক ছেলের শোকে আরেক ছেলের সাথে এমন করছে। কিন্তু এখন তো ইতির সাথেও এমন আচরণ করে। এমনকি আমাকে দেখলেও মা র তে তেড়ে আসে। এই আচরণ গুলো কি স্বাভাবিক কোনো মানুষের?”

বাবার কথার পৃষ্ঠে রক্তিম আর কোনো কথা রাখেনা। বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অভিশপ্ত জীবনের হিসেব কষতে ব্যস্ত হয়ে পরে নিরবে। আজীজ শিকদার নিজেই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে ওঠে,

“বাদ দাও সে কথা। তুমি কিজন্য ডেকেছো সেটা বলো।”

“আমার পরিচিত একজন সাইক্রিয়াট্রিস্ট আছে। শান্তর ফুফাতো ভাই। এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখব। কাল সময় করে গিয়ে দেখা করে আসবেন।”

স্নান হাসে আজীজ শিকদার। গভীর দৃষ্টিতে তাকায় ছেলের দিকে। অনুভব করার চেষ্টা করে ছেলেটার মনের ব্যথা। কিন্তু ব্যর্থ হয়। ভাবে বাবা-ছেলের মাঝে কতটা দেয়াল তৈরী হয়ে গেল! মনে হয়, ঐতো কিছুদিন আগেই ছেলেটার মুখ দেখেই মনের কথা সব বলে দিতে পারত। বাবার এমন গুণ দেখে রক্তিম আনন্দোচ্ছল হেসে জানতে চাইত, “তুমি কিভাবে আমার মনের সব কথা বুঝে যাও বাবা? কোনো জাদু-টাদু জানো না কি?” উত্তরে আজীজ শিকদার স্বহাস্যে বলতো, ” পৃথিবীর সব বাবারাই এই জাদু জানে।যেদিন আমার মতো বাবা হবি সেদিন তুই নিজেও আমার মতো এমন জাদুবলে তোর সন্তানের মনের কথা মুখ দেখে বলে দিতে পারবি।” আজ সেই বাবা-ছেলে একটুও বুঝতে পারেনা একজন আরেক জনকে। দিন কে দিন আজীজ শিকদারের মনে হচ্ছে তার ছেলেটা কেমন যেন এক রহস্য মানবে পরিণত হচ্ছে। নিজের দুঃখ-কষ্ট গুলো নিজের মাঝেই লুকিয়ে রাখতে শিখে গেছে। এমনকি বাবা-ছেলের মাঝে সম্বোধনের স্বরটাও পাল্টে গেছে। যেখানে বাবা ছেলেকে ডাকত তুই করে সেখানে এখন ডাকে তুমি করে। আর ছেলে যেখানে ডাকত তুমি করে সেখানে আজ ডাকে আপনি করে। এভাবেই বুঝি পৃথিবীর প্রতিটা বাবা-ছেলের মাঝে সময়ের সাথে সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়? না কি শুধু তাদের বেলাতেই এমনটা হয়েছে?

প্রতি বারের মতো এবারও রক্তিম ব্যর্থ জীবনের হিসেব মিলাতে। বিরক্ত হয়ে ভাবনা ঘরে তালা ঝুলিয়ে ধ্যান ফেরায় বাস্তবতায়। নিকষ কালো আকাশের দিকে তাকায় গভীর নয়নে। বুক ভরে দম নেয়। ফের নজর ঘুরিয়ে তাকায় বাবার দিকে। শান্ত কন্ঠে বলে,

“ইতু বড় হচ্ছে। আপনার কি মনে হয়না ওর বিয়ে নিয়ে এবার ভাবা উচিৎ?”

আজীজ শিকদার নিজেও এবার একটু আনমনা হয়। তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

“আমার ঘরের যে অসুস্থ পরিবেশ। সেই পরিবেশের কথা পুরো এলাকার মানুষ জানে। সাথে এও জানে, আমি আজীজ শিকদার পুরো একটা শহরের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারলেও নিজের ঘরে শান্তি ফিরানোর দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ। যে মেয়ের মা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে সবসময় নিজ ধ্যানে মজে থাকে। যার ভাই রাস্তায় রাস্তায় গুন্ডামি করে বেড়ায়। বাবা এসব সহ্য করতে না পেরে রাজনীতির ব্যস্ততা দেখিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। সেই মেয়েকে কে চাইবে বউ করে ঘরে তুলতে? আদও আমার মেয়েটা ঘরকন্নার কাজ জানে কি না সেটা তো আমি নিজেও জানিনা। আমার সেই মেয়ে কিভাবে পরের ঘরের লক্ষি হবে?”

বিষাদপূর্ণ চাঁদ-তারাহীন রাতের মতোই রক্তিমের কাছে তার বাবার প্রতিটা কথা তিক্ত মনে হচ্ছে। এতোটাই তিক্ত যা সহ্য করতে না পেরে ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুটে অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে। তার জন্য তার আশেপাশের মানুষ গুলোর করা পাপের জন্য নিষ্পাপ ছোট বোনটা মাসুল গুণবে! কথাটা ভাবতেই ইচ্ছে করছে নিজেই নিজেকে আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করে দিতে। অশান্ত মেজাজটা বাবার সামনে প্রকাশ করেনা রক্তিম। গভীর দুটো নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলে,

“ছেলে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা। আমার বোনের জন্য আমি যোগ্য পাত্র অনেক আগেই বাছাই করে রেখেছি। আমার বোন কখনো কোনো অংশে অপূর্ণ থাকবেনা ইন শা আল্লাহ।”

আজীজ শিকদার এবার যথেষ্ট অবাক হয়। চোখে-মুখে বিস্ময় খেলে যায়। আশ্চর্যান্মিত হয় রক্তিমের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,

“কে সেই ছেলে?”

একটুও কাল বিলম্ব করেনা রক্তিম। ঝট করেই বলে দেয় যার সাথে আদরের বোনের জীবন জুড়ে দেবার করে ভেবে রেখেছে তার নামটা,

“মেহেদী।”

তৎক্ষণাৎ যেন বড়সড় একটা ঝটকা খায় আজীজ। এমনভাবেই বিদ্যুতাড়িত হয়ে বলে ওঠেন,

“অসম্ভব।”

সোজাসুজি এমন নাকুচ করাই একটু আশ্চর্য হয় রক্তিম। জানতে চায়,

“কেন?”

ক্রোধান্মিত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকায় আজীজ শিকদার। বলেন,

“নিজে যেমন হয়েছো এক গুন্ডা-মাস্তান তেমন বোনের জন্যেও গুন্ডা ছেলে নির্বাচন করেছো! আমি ভাবতেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। কিভাবে পারলে তুমি এমন একটা চিন্তা করতে? কি যোগ্যতা আছে ঐ ছেলের আমার মেয়েকে বিয়ে করার?”

দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে অল্প হাসে রক্তিম। বিদ্রুপাত্মক স্বরে বলে,

“একটু আগেই না বললেন যার ভাই রাস্তায় রাস্তায় গুন্ডামি করে বেড়ায় তার জন্য ভালো কোনো ঘর থেকে প্রস্তাব আসবেনা! গুন্ডা ভাইয়ের বোনের জন্য তো কোনো এক গুন্ডা ছেলের বিয়ের প্রস্তাবেই আসবে। এটাই স্বাভাবিক। এতো ভাবাভাবি আর অবাক হবার কি আছে?”

চলবে…..

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৬
#আদওয়া_ইবশার

রক্তিমের এমন খামখেয়ালি কথায় মেজাজ উত্তপ্ত হয় আজীজ শিকদারের। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে বলে,

“আমি এখনো বেঁচে আছি। সজ্ঞানে থাকতে কখনো আমার মেয়েকে আমি অপাত্রে দান করবনা।”

বাবার কথায় রক্তিম নিজেও এবার বিরক্ত। চোখে-মুখে বিরক্তির রেশ ফুটিয়ে বলে,

“মেহেদীকে আপনার অপাত্র মনে হচ্ছে কেন? দেখতে সুদর্শন, সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। দুই ভাই আর বাবা-মা নিয়ে মাত্র চারজন সদস্যদের ছোট্ট একটা পরিবার। এর থেকে ভালো পাত্র পাবেন কোথায় আপনি?”

“শুধু এগুলো দেখলেই হবে?এক টাকাও ইনকাম আছে তার?বিয়ের পর আমার মেয়েকে খাওয়াবে কি? ঐ ছেলের রূপ আর বংশ পরিচয়ে নিশ্চয়ই আমার মেয়ের পেট ভরবেনা।”

কিছুটা তাচ্ছিল্যের সাথেই কথাটা বলেন আজীজ শিকদার। উত্তরে রক্তিম জানায়,

” ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষকে কিভাবে রাখলে সুখে থাকবে সেটা আপনার-আমার থেকেও ভালো তারা বুঝবে।”

তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। এই কথাটাই যথেষ্ট ছিল আজীজ শিকদারকে চুপ করিয়ে দেওয়া। অবাক, বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের মুখের দিকে।

“তুমি শিওর ইতি ঐ ছেলেকে ভালোবাসে?”

“গুন্ডা হতে পারি। তাই বলে বোন কি করছে, কার সাথে মিশছে এসব খোঁজ রাখবনা এতোটাও ছন্নছাড়া এখনো হয়নি। তার থেকেও বড় কথা আপনি খুব ভালো করেই জানেন, পুরো বিষয় না জেনে অযথা কোনো কিছু নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনা। আর মেহেদী এখন কিছু করেনা তাই বলে ভবিষ্যতেও করবেনা এমন কোনো কথা নেই। দায়িত্ব ঘাড়ে আসলে নিজ তাগিদে ঠিকই রোজগারের পথ খোঁজে নিবে। শুধু শুধু ছেলে বেকার, গুন্ডামি করে এমন কিছু ফালতু ইস্যু দিয়ে দুটো ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করবেন না।”

মেয়ে যেখানে নিজে থেকেই জীবন সঙ্গী ঠিক করে রেখেছে সেখানে আজীজ শিকদার আর কিই বা করতে পারে! অন্য আট-দশটা বাবার মতো অবশ্যই মেয়ের ভালোবাসায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবেননা তিনি। আর মেহেদী ছেলেটাও একেবারে খারাপ এমনও না। যথেষ্ট শিক্ষিত। নিজের ছেলেটার সঙ্গ পেয়েই চাকরি-বাকরি ছেড়ে গুন্ডামি বেছে নিয়েছে। চাইলেই ছেলেটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সঠিক পথে আনা যাবে। তাছাড়া এটাই সুযোগ। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে যেভাবেই হোক নিজের ছেলেটাকেও বাধ্য করতে হবে নতুন করে জীবনটা গড়ার।

“বন্ধু আর বোনের ভালোবাসার পূর্ণতা দেবার জন্য উঠেপরে লেগেছো। অন্যদিকে যে একটা মেয়ে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে বারবার তোমার কাছে অবহেলিত হচ্ছে তার জন্য কি একটুও মায়া হয়না? না কি সে তোমার আপন কেউ না দেখে তার ভালোবাসার মূল্য নেই তোমার কাছে?”

বাবার মুখে হটাৎ এমন কথায় চমকায় রক্তিম। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। মুখে কিছুই বলেনা। আজীজ শিকদার তবুও বুঝে যায় ছেলে কি চাচ্ছে। ঠোঁট টেনে সামান্য হেসে বলেন,

“দৃষ্টি মেয়েটার কথা বলছি আমি। এখন আবার এটা জিজ্ঞেস করোনা ওর কথা আমি কিভাবে জানলাম। যেখানে বলতে গেলে পুরো এলাকার মানুষ জানে একটা মেয়ে রাস্তাঘাটে রক্তিম শিকদারের সামনে ভালোবাসার দাবী নিয়ে দাঁড়াচ্ছে। খবরটা সেখানে রক্তিম শিকদারের বাবা হয়ে আমি জানবনা?”

অত্যধিক বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ বর্গীয় উচ্চারণ করে রক্তিম। খিঁচে বলে,

“ঐসব ফালতু বিষয় এখানে টানছেন কেন?”

“দৃষ্টি মেয়েটার ভালোবাসা যদি তোমার কাছে ফালতু মনে হয় তবে তোমার বন্ধু আর বোনের ভালোবাসাও আমার কাছে ফালতু। ঐসব ফালতু টপিকে আর কিছু বলতে এসোনা আমার কাছে।”

কথাটা শুনে কপালদ্বয়ে দুটো ভাজ পরে রক্তিমের। শান্ত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,

“কি চাচ্ছেন আপনি?”

সোজাসাপ্টা এমন প্রশ্নে মুখ ভরে হাসে আজীজ শিকদার। বলেন,

“তেমন কিছুই না।দৃষ্টি মেয়েটাও আমার মেয়ের বয়সী মিষ্টি একটা মেয়ে। দুজনই আবার দুটো ছেলেকে ভালোবাসে। তাই ভাবছিলাম আরকি যদি কারো ভালোবাসার পূর্ণতা দিতেই হয় তবে দুজনেরটাই দিব। একজন ভালোবাসা পেয়ে আজীবন সুখে কাটাবে। আর অপরজন ভালোবাসার বিরহে ছটফট করবে এমনটা তো আমি হতে দিতে পারিনা।”

এবার রক্তিম নিজেও একটু হাসে। তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,

“ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়। বারবার না। ঐসব ছলনাময়ীর ছলনায় রক্তিম শিকদার টলবেনা আর।”

“সব মেয়ে এক না।”

“কে ভালো কে খারাপ সেটাও তো কারো কপালে সীল মেরে দেওয়া নেই। তো বুঝব কিভাবে?”

“মানুষ চেনার ক্ষেত্রে তুমি বোকা হলেও আমি না। ঐ মেয়েটার চোখে আমি তোমার জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা দেখেছি। আমার মতো পুড় খাওয়া ব্যক্তির চোখ ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ না।”

এতোক্ষনের শান্ত মেজাজটা এবার বাঁধনছাড়া হয় রক্তিমের। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে এক প্রকার চেঁচিয়ে বলে,

“সমস্যা কি আপনার? আমাকে ভালো থাকতে দেখে কি আপনার ভালো লাগছেনা? আমি তো কাওকে বলিনি আমার ব্যাপারে এতো ভাবতে। তবে ভাবছেন কেন? ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন আমাকে আমার মতো?”

আজীজ শিকদার নিজেও এবার একটু চড়াও হয়। রাশভারী কন্ঠে বলেন,

“তুমি যেটাকে ভালো থাকা বলছো সেটা অন্য আট-দশটা স্বাভাবিক মানুষের কাছে অসুস্থ থাকা ছাড়া কিছুই না। একটা সুস্থ্য মানুষের জীবন কখনো এমন হতে পারেনা। আর কি সমস্যা জানতে চাচ্ছো না! সমস্যা আমার একটাই। সেটা হলো তোমার মতো ছেলের বাবা হওয়া। এখন না পারছি তোমাকে নিজের সন্তান বলে অস্বীকার করতে। আর না পারছি তোমার ছন্নছাড়া জীবন দেখেও চুপ থাকতে। অনেক করেছো। এবার অন্তত একটু দয়া করো আমার উপর! শান্তিতে বাঁচতে না দাও। অন্তত ম রা র সময় যাতে সন্তানদের সুখে দেখে শান্তিতে ম র তে পারি সেই সুযোগটা দাও। বাবা হয়ে তোমার কাছে আমার এটাই শেষ আবদার। দৃষ্টি মেয়েটাকে মেনে নাও। নতুন করে সংসার সাজাও।”

কথাগুলো শেষ করে একটু দম নেয় আজীজ শিকদার। পরক্ষনে আবারও চোয়াল শক্ত করে বলেন,

“শিকদার মঞ্জিলে যদি আবারও বিয়ের সানাই বাজে তবে আজীজ শিকদারের ছেলে-মেয়ে দুজনের বিয়ের সানাই একসাথে। বাজবে অন্যথায় না। অনেক দেখেছো তোমার দাপট আর হুঙ্কার। অনেক শুনেছি তোমার কথা। জন্ম তুমি আমাকে দাওনি। আমি দিয়েছি তোমাকে জন্ম। এবার থেকে যা বলার আমি বলব। আর যা শোনার সব তোমাকে শুনতে হবে।”

নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় রক্তিম। বড়বড় দম নিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফের গম্ভীর কন্ঠে জানতে চায়,

“শুনলাম আপনার কথা। রাজি হলাম বিয়ে করতে। কিন্তু ঐ মেয়ের পরিবার!আপনি নিজেই যেখানে মেহেদীর সাথে ইতুর বিয়ে দিতে চাচ্ছেন না। কারণ হিসেবে তুলে ধরেছেন মেহেদী বেকার, গুন্ডা। সে যদি হয় ছা-পোষা গুন্ডা তবে আমি তার ওস্তাদ। সেই আমার সাথে কিভাবে ঐ মেয়ের পরিবার বিয়ে দিতে রাজি হবে? এই কথা গুলো কি ভেবে চিন্তে আমাকে বরশির কলে বাজাতে এসেছেন! না কি আবেগে গা ভাসিয়ে ভেবেছেন পুটি মাছের বরশি দিয়ে বোয়াল ধরে ফেলবেন!”

কথাগুলো যৌক্তিক। আসলেই আজীজ শিকদারের মাথায় দৃষ্টির পরিবারের চিন্তা আসেনি। ওনি শুধু মেয়েটার কথায় তার ছেলের প্রতি ভালোবাসার প্রগাঢ়তা দেখে ছেলেটার সুন্দর একটা জীবন দেখার লোভে অন্ধ হয়ে গেছেন। এই কথাটা একবারো মাথায় আনেনি যে মেয়েটার অভিভাবক আছে। কোন দুঃখে তারা রক্তিমের মতো এমন একটা ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবে? যে ছেলে কি না পূর্বে বিয়ে করেছিল। বর্তমানে রাস্তা-ঘাটে গুন্ডামি করে বেড়ায়। পুরো সাভারবাসী যাকে এক নামে গুন্ডা-মাস্তান হিসেবে জানে সেই ছেলের সাথে কোনো ভালো পরিবারের মা-বাবা নিশ্চয়ই চাইবেনা তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে। যৌক্তিক চিন্তাধারা গুলো নিজের মাঝেই চেপে রাখেন আজীজ শিকদার। রক্তিমকে সেসব বুঝতে না দিয়ে বলেন,

“ঐসব দেখার বিষয় আমার। তুমি শুধু বলো আমার কথায় রাজি আছো কি না!”

রক্তিম নিশ্চিত ঐ মেয়ের বাবা-মা রক্তিমের আসল পরিচয় জানলে কোনোদিন মেয়ে বিয়ে দেবার কথা মুখেও আনবেনা। সেখানে রক্তিম রাজি হলেই কি আর না হলেই বা কি! তবে রাজি হলে লাভ একটা অবশ্য আছে। সেটা হলো ছেলে কথা রাখেনা এই নিয়ে বাবার মনে যে কষ্ট সেটা একটু হলেও ঘুচবে। আর দ্বিতীয়ত মেহেদীর সাথে ইতির বিয়েটা দিতে বেগ পেতে হবেনা। কথা গুলো ভেবে রক্তিম ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। বলে,

“ঠিক আছে। আপনি যদি সবটা ম্যানেজ করতে পারেন তবে আমিও পারব দ্বিতীয়বার বিয়ের পিড়িতে বসতে।”

কথাগুলো বলে আর একটুও দাঁড়ায়না রক্তিম। ছাঁদ থেকে নেমে সোজা বাইক ছুটিয়ে চলে যায় নিজের ছোট্ট কুঠিরে। আজীজ শিকদার চিন্তিত হয়ে ছাঁদেই দাঁড়িয়ে থাকে। মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে প্রয়াস চালায় সমস্যার সমাধান খোঁজে বের করার। কিন্তু কোনো বুদ্ধি খোঁজে পায়না। ভাবতে গেলেই মনে হচ্ছে সব ঝট পাকিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝেই নিরবতার জাল ছিঁড়ে আজীজ শিকদারের পাঞ্জাবীর পকেটে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে। পিনপতন নিরবতার মাঝে হঠাৎ তাড়স্বরে ফোন বেজে ওঠায় ভাবনাচ্যুৎ হয় আজীজ শিকদার। পকেট হাতরে ফোন বের করে নাম্বারটা দেখেই কুঁচকে থাকা কপালদ্বয় স্বাভাবিক হয়। ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে গম্ভীর মুখটা হাস্যজ্জল করে বলে,

“কেমন আছো মা?”

জবাবে ফোনের অপরপাশ থেকে মিষ্টি এক কন্ঠে প্রথমে সালাম ভেসে আসে,

“আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন স্যার?”

“আমি ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো?”

” আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি। তবে আমি একটা বিষয় নিয়ে অত্যন্ত দুঃখিত স্যার। আপনি যাকে আমার সাথে দেখা করার জন্য পাঠিয়েছিলেন ওনার সাথে আমার দেখা হবার পরও ঠিকঠাক কথা বলতে পারিনি। কারণ তখনই তখনই সেখানে আব্বু চলে আসে। ঠিক কিজন্য ওনাকে পাঠিয়েছিলেন সে বিষয়ে কি আমরা এখন ফোনে কথা বলতে পারি?”

দৃষ্টির কথায় হতবম্ভ আজীজ। ওনি আবার কখন কাকে দৃষ্টির সাথে দেখা করতে পাঠালো?

“আমি তো কাওকে তোমার সাথে দেখা করার জন্য পাঠাইনি। কার কথা বলছো তুমি মা? কে গিয়েছিল দেখা করতে?”

আজীজ শিকদারের কথায় এবার দৃষ্টির কপালেও চিন্তার ছাপ। ভাবুক হয়ে বলে,

“আপনি পাঠাননি? তবে লোকটা যে আপনার পরিচয় দিল! বলল আপনিই না কি কি দরকারে পাঠিয়েছিলেন!”

গভীর ভাবনায় পরে যায় আজীজ শিকদার। ওনার আর বুঝতে দেরী হয়না ঐ মুহূর্তে মেয়েটার বাবা উপস্থিত না হলে বড় ধরনের কোনো বিপদ হয়ে যেতে পারত। মেয়েটা তাদের জীবনের সাথে জুড়ে যাবার আগেই তাদের শত্রু নিষ্পাপ মেয়েটারও শত্রু হয়ে গেল! ঐ লোকটার যদি খারাপ কোনো উদ্দেশ্য থাকে তবে তো আজ সফল না হতে পেরে আবারও পিছু নিবে। শুধু শুধু তাদের বাপ-ছেলের শত্রুতার জন্য একটা অবুঝ মেয়ে বিপদের সম্মুখিন হবে! নাহ, কিছুতেই এটা হতে দেওয়া যাবেনা। যত দ্রুত সম্ভব তাদের কিছু একটা করতে হবে।

“শুনো মা। তুমি তো অনেক বুঝদার একজন মেয়ে তাইনা! কিন্তু তোমার ঐভাবে রাস্তা-ঘাটে আমার ছেলের পিছনে ঘোরাফেরা উচিৎ হয়নি। রক্তিমের শত্রুর অভাব নেই। এমনকি আমারও রাজধানীর সুবাদে যথেষ্ট শত্রু আছে। ওরা যদি এখন তোমাকে রক্তিমের কাছের কেউ ভেবে কোনো ক্ষতি করে ফেলে! ঐ লোকটাকে আমি পাঠাইনি। আমার যদি কোনো প্রয়োজন পরতোই তবে সরাসরি ফোনেই তোমার সাথে যোগাযোগ করতাম। এভাবে রাস্তায় যদি আর কখনো অপরিচিত কেউ আমার বা রক্তিমের পরিচয় দিয়ে তোমাকে কোথাও যেতে বলে একদম যাবেনা। বুঝতে পেরেছো আমার কথা?”

আজীজ শিকদারের কথায় দৃষ্টির মাঝে ভীতি সঞ্চার হয়। অজানা এক আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। ভাবে সত্যিই আজকে বাবা না থাকলে বড়সড় কোনো বিপদ হতে পারত। আল্লাহ সহায় ছিল বলেই হয়তো সুস্থ্যভাবে বেঁচে ফিরেছে। কথাটা ভেবে তৎক্ষণাৎ মনে মনে শুকরিয়া জানায় সৃষ্টিকর্তার নিকট। পরক্ষনে আজীজ শিকদারের কথায় সাই জানিয়ে বলে,

“আসলে আমি বুঝতে পারিনি। আর কখনো এমন কোনো বোকামি করবনা স্যার।”

দৃষ্টির মনের ভয় টের পায় আজীজ শিকদার। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,

“আচ্ছা মা! আমি ভেবেছিলাম তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব। কিন্তু এখন তো চিন্তা হচ্ছে তোমার বাবা-মা কি রক্তিমকে মেনে নিবে?”

এবার যেন এক চিন্তার সুতো কেটে আরেক চিন্তায় এসে পরল দৃষ্টি। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই জিজ্ঞেস করে,

“আপনার ছেলের সাথে কথা বলেছেন? ওনি কি রাজি হয়েছে?”

ভরসা দেবার মতো করে আজীজ শিকদার অল্প হেসে বলেন,

“ও নিয়ে তুমি এতো ভেবোনা। তোমার ঐদিকটা আগে বলো কিভাবে কি করব। আমার ছেলেকে কিভাবে রাজি করাতে হবে সেটা আমার চিন্তা। ওকে রাজি করিয়ে সঙ্গে নিয়ে তবেই যাব আমি তোমাদের বাড়ি।”

আজীজ শিকদারের কথা শেষ হতেই প্রচণ্ড উৎসাহের সাথে কিছুটা চেঁচিয়ে বলে দৃষ্টি,

“আইডিয়া পেয়েছি একটা।”

হঠাৎ এমন অভিব্যক্তিতে কিছুটা হতচকায় আজীজ শিকদার। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে জানতে চায়,

“কি আইডিয়া?”

দীর্ঘ দশ মিনিট সময় ব্যয় করে বুঝিয়ে দৃষ্টির মাথায় চলা পুরো বিষয়টা সম্পর্কে আজীজ শিকদারকে অবগত করতে সক্ষম হয় দৃষ্টি। আজীজ শিকদার সবটা শোনার পর রসাত্বক হেসে বলে,

“আরে বাহ্! তোমার মাথায় তো দেখছি দারুন বুদ্ধি। মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে আমার বদলে তোমাকেই এমপি পদে দাঁড় করাতে হবে।”

কথাটা শুনে একটু শব্দ করেই হেসে ফেলে। পরক্ষনেই ধাতস্থ হয়ে সামলে নেয় নিজেকে। দরজার ফাঁক গলিয়ে সতর্ক দৃষ্টি পরোখ করে নেয় কেউ আবার তার কথা বা হাসি শুনে ফেলল কি না।

চলবে…..

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-১৩+১৪

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৩
#আদওয়া_ইবশার

মিষ্টি এক সকাল। বাতাসে হালকা শীত শীত আমেজ। শৈত্যপ্রবাহ খুব বেশি দূরে না। এইতো আর কিছুদিন। হেমন্ত মশাই এখনই তল্পিতল্পা গুছিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিদায় নেবার। তার বিদাইয়ের খুশিতে শীত মহাশয়’ও ধুমধাম প্রস্তুতি নিচ্ছে নাইয়োর আসার। মানুষজনকে এখনই সকাল-সন্ধ্যা নিয়ম করে জানিয়ে দিচ্ছে তার আগমনী বার্তা। সকাল সকাল দৃষ্টি বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে কাওকে কিছু না বলেই। উদ্দেশ্য আজীজ শিকদারের পার্টি অফিস। ভেবেছিল সকাল সকাল নিশ্চিন্তে নিজের কাজ সমাপন করে বাসার কেউ তার অনুপস্থিতি বোঝার আগেই আবার ফিরে যাবে। কিন্তু তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে এতো তাড়াতাড়িই করে ফেলেছে যে,পার্টি অফিসে এখনো তালা ঝুলছে। নেতা আসার আগেই দুয়ারে জনতা এসে হাজির। কতক্ষণ অফিসের সামনে চিন্তিত বদনে পায়চারি করে কাটিয়ে দেয় দৃষ্টি। কাটায় কাটায় ঠিক দশটা বাজতেই দূর থেকে দেখতে পায় কয়েকজন লোক এদিকেই এগিয়ে আসছে। মুখ গুলো দৃষ্টি গতকাল সমাবেশে দেখেছে। তাই আর চিনতে অসুবিধা হয়নি ওনারা এই পার্টি অফিসের লোক। দ্রুত পায়ে কিছুটা আড়ালে সড়ে দাঁড়ায় দৃষ্টি। লোক গুলো অফিসে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই সেখানে উপস্থিত হয় আজীজ শিকদার। সাথে রক্তিম শিকদার নেই দেখে একটু আশ্বস্ত হয় দৃষ্টি। চট করে বেরিয়ে আসে আড়াল থেকে। দ্রুতগতিতে দুই,তিন পা এগিয়ে আবার থেমে যায় অজানা এক সংকোচে। নিজ মনেই ভাবে কাজটা কি তার ঠিক হচ্ছে? একটু বেশিই কি পাগলামি হয়ে যাচ্ছেনা! পরোক্ষনে আবারও নিজ মনেই ভাবে, ভালোবাসা আর যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য সব করা যায়। এই দুটো জায়গায় ভয়, লজ্জা, সংকোচ থাকলে কখনো জয়লাভ করা যায় না। মন থেকে সমস্ত ভাবনা ঝেড়ে মাথা ঝাকায় দৃষ্টি। বুক ফুলিয়ে দম নেয় দীর্ঘক্ষণ। বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে হালকা করে। মনে সাহস জুগিয়ে এগিয়ে যায় অফিসের প্রবেশদ্বারে। দরজার সামনে যেতেই আটকে দেয় একজন। ঘাবড়ে যায় দৃষ্টি। প্রায় আজীজ শিকদারের বয়সী একজন লোক দরজায় হাত ঠেকিয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে তাকিয়ে। জানতে চায়,

“কি ব্যাপার! কি চায় এখানে?”

একটু অপ্রস্তুত দেখায় দৃষ্টিকে। কি বলবে ভেবে পায়না। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শুকনো ঢোক গিলে বলে,

“জ্বি মানে! আজীজ শিকদারের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

কিছু একটা ভেবে আবারও প্রশ্ন করে লোকটা,

“আজীজ শিকদারের কাছে কি দরকার?”

ঠিক তখনই ভিতর থেকে কোনো এক পুরুষালী গলা শুনতে পায় দৃষ্টি। বলছে,

“কি ব্যাপার জাফর ভাই! কার সাথে কথা বলছেন? কে এসেছে?”

তৎক্ষণাৎ দৃষ্টির সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা উত্তর দেয়,

“একটা মেয়ে এসেছে। বলে কি না আপনার সাথে দেখা করবে।”

কথাটা শুনতে পেয়ে আজীজ শিকদার নিজেই বেরিয়ে আসে ভিতর থেকে। অত্যন্ত নম্র কন্ঠে সালাম দেয় দৃষ্টি। হাসি মুখে সালামের জবাব দেয় আজীজ শিকদার। দুই পা এগিয়ে এসে স্বহাস্যে জানতে চায়,

“বলো মা! আমার কাছে কি দরকারে এসেছো তুমি?”

কন্ঠে একটু অস্বস্তি নিয়ে মাথা নিচু করে দৃষ্টি বলে,

“আপনার সাথে আমার একটা জরুরী কথা ছিল স্যার। যদি অনুমতি দিতেন তবে বলতাম!”

মেয়েটার এতো নম্র আচরণ দেখে মুগ্ধ হয় আজীজ শিকদার। অভয় দিয়ে বলে,

“আচ্ছা! যা বলার বলো। কিন্তু এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে লোকে মন্দ ভাববে। নির্ভয়ে তুমি ভিতরে এসে আমার সাথে বসে সবটা বলতে পারো,

আজীজ শিকদারের সাবলীল আচরণে দৃষ্টির এতোক্ষণের অস্বস্তিটা যেন কর্পূরের ন্যায় উড়ে যায়। প্রফুল্ল চিত্তে আজীজ শিকদারের পিছন পিছন ভিতরে গিয়ে মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসে। একবার পুরো রুমটাতে নজর বুলিয়ে দেখে নেয় মানুষজনের উপস্থিতি। আজীজ শিকদার সহ ইতিমধ্যেই সাত-আটজন চলে এসেছে। এতো গুলো মানুষের সামনে কথাটা বলতে একটু অস্বস্তিদায়ক অনুভূতি হলেও জড়তা ভেঙ্গে বলে দৃষ্টি,

“আপনার কাছে আমার একটা আবদার আছে স্যার।”

“কি আবদার?”

জানতে চায় আজীজ শিকদার। দৃষ্টি আবারও বলে,

“আপনি তো এবার এমপি পদে নির্বাচন করছেন! প্রায় সব জনগণের দুঃখ-কষ্ট দেখে ওনাদের আশ্বস্ত করেছেন নির্বাচিত হবার পর সব সমস্যার সমাধান করবেন। একজন সাধারণ জনগণ হিসেবে আমারও আপনার কাছে একটা আবদার আছে। যদিও আমি আপনার এলাকার ভোটার না। এমনকি এখনো কোনো এলাকারই ভোটার হয়নি। তবে আমার খালার বাসা এখানে। আপনি যদি আমার আবদারটা রাখেন তবে আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে আমার খালামনির বাসার সব গুলো ভোট পাইয়ে দিব।”

দৃষ্টির এমন কথায় একটু অবাক হয় আজীজ শিকদার। মেয়েটাকে দেখে ওনি প্রথমেই একটু হলেও বুঝতে পেরেছিল একটা চঞ্চল পাখি। তবে প্রথম দিকের একদম নম্র আচরণ দেখে আবার মনে হয়েছিল মেয়েটা একদম শান্তশিষ্ট। এখন আবার কথা শুনে মনে হচ্ছে চঞ্চলা হরিণী। একেক সময় একেক রকম মনে হচ্ছে। ভাবনায় পরে গেছেন আজীজ শিকদার মেয়েটাকে ঠিক কি বলে আখ্যায়িত করবেন! দৃষ্টিকে নিজের দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজের ভাবনাটা এক পাশে রেখে আবারও হেসে জবাব দেন আজীজ শিকদার,

“আচ্ছা! আগে বলো শুনি তোমার কি আবদার। যদি সাধ্যের মাঝে হয় তবে অবশ্যই রাখব।”

“না না! আগে বলা যাবেনা। আবদারটা খুব বেশি কিছু না। অবশ্যই আপনার সাধ্যের মধ্যেই। আপনি আগে কথা দিন আমার আবদার রাখবেন তবেই আমি বলব।অন্যথায় বলার পর যদি আপনি না রাখেন তবে আমি খুব কষ্ট পাব।”

দৃষ্টির কথার ধরনে শব্দ করে হেসে ফেলেন আজীজ শিকদার। দলের অন্য লোক গুলোর মুখের ভাব-ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে কাজ ফেলে বাচ্চা এক মেয়ের সাথে নেতার এমন খোশগল্পে তারা বিরক্ত। তবে সেদিকে দৃষ্টি বা আজীজ শিকদার কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

“আচ্ছা রাখব। এবার বলো শুনি কি আবদার!”

এবার একটু নড়েচড়ে বসে দৃষ্টি। আবারও উপস্থিত সকলের দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখে নেয় সকলকে। পরপর কয়েকটা ঢোক গিলে শুকনো গলাটা ভিজিয়ে নেয়। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে একদমে বলে,

“আমি আপনার ছেলে রক্তিম শিকদারকে ভালোবাসি। কিন্তু আপনার বদরাগি ছেলে আমার ভালোবাসার কোনো মূল্যই দিচ্ছেনা। সে কখনো বুঝতেই চায়না আমার অনুভূতি গুলোকে। নিরুপায় হয়ে এখন আপনার কাছে এসেছি আমি। আমার আবদারটা হলো আপনি যদি এমপি পদে জিততে পারেন তবে আপনার ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিবেন। দয়া করে এখন আবার আমাকে ভুল বুঝে আপনার ছেলের মতোই দূর দূর করবেন না। আমার এই আবদার আপনাকে রাখতেই হবে।”

কি বলবে আজীজ শিকদার! নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছেনা। বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে গিয়ে একদম স্তব্ধ। শুধু আজীজ শিকদার একা না। উপস্থিত প্রতিটা মানুষেই বাকরুদ্ধ। একটু আগে যেন দৃষ্টি কোনো আবদার রাখেনি। সরাসরি একটা বো মা ফাটিয়েছে পার্টি অফিসে। যার কবলে পরে প্রত্যেকেই অনুভূতিশূণ্য জড়বস্তুর ন্যায় ঠাই বসে আছে নিজ নিজ জায়গায়। পাঁচ মিনিট, মিনিট। ঠিক এভাবে সময় গড়াতে গড়াতে কতক্ষণ হয়েছে সেদিকে কারো খেয়াল নেয়। দৃষ্টি নিজেও সাহস জুগিয়ে ফট করে কথা গুলো বলে দিলেও এখন ভয়, লজ্জায় জড়োসড়ো। মাথা নিচু করে খিঁচে চোখ বন্ধ রেখে কলিজা ফাটানো একটা ধমক খাবার অপেক্ষায়। তবে দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে কানে পৌঁছায় আজীজ শিকদারের শান্ত গলা,

“তোমার নাম কি মা?”

মাথাটা কিঞ্চিৎ উচু করে এক পলক তাকায় আজীজ শিকদারের মুখের দিকে। পরপর আবারও নিচু মস্তকে মিনমিনে স্বরে জবাব দেয়,

“দৃষ্টি। দৃষ্টি মেহেজাবিন।”

“বাড়ি কোথায়?”

“ময়মনসিংহ। বাবা সাদেক দিলোয়ার। মা দিলশান আরা। আমরা দুই ভাই বোন। আমি এবার ভার্সিটি এডমিশন দিয়েছি। আপাতত রেজাল্টের অপেক্ষায়। আর আমার ভাই দিহান সে ক্লাস ফাইভ এর স্টুডেন্ট।”

এক নাগাড়ে কথা গুলো গড়গড় করে বলে থামে দৃষ্টি। আবার এক পলক আজীজ শিকদারের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে,

“আপনি হয়তো আবারও আমার ফ্যামিলি সম্পর্কে কিছু জানতে চাইতেন। তাই আগেই বলে দিয়েছি সবকিছু। কিছু ভুল করে থাকলে স্যরি।”

আজীজ শিকদারের থমথমে মুখে এবার একটু হাসি দেখা দেয়। আবারও প্রশ্ন করেন,

“বয়স কত তোমার।”

“কিছুদিন আগেই আঠারো হয়েছে।”

“আর আমার ছেলের বয়স কত জানো?”

দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে না জানায় দৃষ্টি। একটু চুপ থেকে আজীজ শিকদার বলেন,

“এই ডিসেম্বরে ত্রিশ পূর্ণ করে একত্রিশে পা রাখবে। তোমার থেকে গুণে গুণে বারো বছরের বড়।”

এরপর আরও একটু থামে। গভীর একটা নিশ্বাস নিয়ে স্বরণ করিয়ে দেয় নির্মম এক সত্য,

“তাছাড়া সবথেকে বড় কথা আমার ছেলে বিবাহিত। পাঁচ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় ওর স্ত্রী মা রা গেছে। এখন তুমি বলো। রক্তিম বিবাহিত। তোমার আগেই তার জীবনে এক নারীর আগমন ঘটেছে। হয়তো সে এখন পৃথিবীতে নেই। তবে তাকে ঘিরে যে স্মৃতি গুলো তৈরি হয়েছিল সেগুলো এখনো তাজা। যে পুরুষের সবটা জুড়ে তোমার আগে অন্য এক নারীর বসবাস ছিল তাকে তুমি মানতে পারবে?আর তোমার পরিবার! তারা কখনো তোমার মতো এতো অল্প বয়সী সুন্দরী একটা মেয়েকে কখনো আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিবে? তোমার বয়সটা অল্প মা। এই পৃথিবীর ভালো-মন্দ কিছুই এখনো জানোনা তুমি। আমি চাইনা তোমার মতো ফুটফুটে একটা চাঁদ আবেগপ্রবল হয়ে ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে মৃ ত্যু র আগ পযর্ন্ত জীবন নিয়ে আফসোস করুক। তোমার জীবনটা মাত্র শুরু। এখনই ঠিক-ভুল কোনো কিছু বিচার না করে এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবেনা।”

সম্পূর্ণ কথা গুলো অত্যন্ত মনযোগ সহকারে শুনে দৃষ্টি। কিয়ৎক্ষণ মৌনতা বজায় রেখে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে মাথা উচু করে বলে,

“আমি আপনার ছেলের অতীত সম্পর্কে প্রথম থেকেই সব জানি স্যার। আমার ঐসব নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। কারণ যা ছিল তা অতীত। অতীত ধরে বসে থাকলে আমাদের চলেনা। তবুও যদি ওনার স্ত্রী বেঁচে থাকতো আর যদি ওনারা সেপারেশনে থাকত আমি তবুও আপনার ছেলের পিছু ঘুরতাম না এটা ভেবে যে, হয়তো কোনো একদিন দুজন সব ভুলে আবার এক হতে পারে। কিন্তু এখন তো সে সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এসব জেনে বুঝে কখনো কারো প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়না স্যার। বয়স ভেদেও কখনো ভালোবাসা আসেনা। আমি শুধু জানি আমি আপনার ছেলেকে ভালোবাসি। এবং সেই ভালোবাসার গভীরতা ঠিচ কতটুকু হলে একটা মেয়ে এভাবে নির্লজ্জের মতো সেই ছেলেটার বাবার সামনে বসে অকপটে সবটা স্বীকার করতে পারে একবার ভাবুন। আর বাকী রইল আমার পরিবারের কথা। আমার পরিবারের যদি মনে হয় ঐসব অতীত, সমাজ সম্পর্ক, বয়স এগুলোর ঊর্ধ্বে তাদের মেয়ের সুখ তবে অবশ্যই মানবে। আপনি শুধু বলুন আপনি আমাকে নিজের ছেলের পুত্রবধূ হিসেবে মানবেন কি না আর আপনার ছেলেকে মানাবেন কি না। বাকীটা আমার পরিবারের দিক সম্পূর্ণ আমি সামলে নিব।”

সর্বদা শান্ত মস্তিষ্কে সব কিছু সামাল দেওয়া আজীজ শিকদার এবারও শান্ত। নিজের একমাত্র বাউন্ডুলে ছেল কেন্দ্রিক এতো বড় একটা ঘটনার পরও যথেষ্ট শান্ত দেখাচ্ছেন তাকে। অল্প বয়সী একটা মেয়ে এভাবে সম্পূর্ণ নিয়ম নীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসার লোভে ছেলের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখছে। বিষয়টা উপস্থিত সকলের কাছে অষ্টম আশ্চর্য মনে হলেও আজীজ শিকদারকে এমন নির্লিপ্ত দেখে তারা আরও বিস্মিত। হজম হচ্ছেনা বিষয়টা কারো। দৃষ্টির মতো অন্য সবাই ভেবেছিল হয়তো মেয়েটাকে ধমকে বের করে দিবে। কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টো। আজীজ শিকদার আবারও প্রমাণ দিল নিজের ধৈর্যের। এবং সব শেষে সবাইকে একদম অবাকতার চরম পর্যায় পৌঁছে দিয়ে বলল,

“আচ্ছে বেশ! তুমি যদি তোমার পরিবারকে মানাতে পারো আর আমার ছেলের সাথে সংসার করতে পারো। তবে আমি কথা দিচ্ছি, নির্বাচনের পর এই বিষয়ে রক্তিমের সাথে কথা বলব আমি।”

আজীজ শিকদারের কথাটা বলতে দেরি। কিন্তু দৃষ্টির ঠোঁটের কোণে প্রাপ্তির উল্লাসে এক ফালি হাসি উকি দিতে একটুকুও দেরী করেনি। বরং চিকন ঠোঁট দুটোর সাথে হেসে ওঠে নির্মল চোখ দুটোও। এক লাফে দাঁড়িয়ে স্লোগান দেওয়ার মতো করে বলে,

“আমার শশুর সবার ভাই।”

অফিসে থাকা অল্প বয়সী ছেলে গুলো হয়তো এই আধ পাগল মেয়েটার এমন স্লোগানে মজা পায়। যার দরুন নিজেরাও মিটি মিটি হেসে বলে,

“আজীজ ভাই, আজীজ ভাই।”

চলবে……..

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৪
#আদওয়া_ইবশার

সময় বহমান। প্রতিটা সূর্যাস্তের সাথে গত হচ্ছে এক একটা দিন। দৃষ্টি, তুসীর ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তুসী বহু সাধনার পর নিজের জন্য একটা আসন জয় করে ফেলেছে। কিন্তু ব্যর্থ দৃষ্টি। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের জন্য আসন তৈরী করতে পারেনি। তবে এই নিয়ে দৃষ্টির মনে কোনো প্রকার আফসোস নেই। কিন্তু মেয়ে চান্স পায়নি এই নিয়ে সাদেক সাহেব আর দিলশান আরা’র আফসোসের অন্ত নেই। একই সমবয়সী দৃষ্টি তুসী দুজন খালাতো বোন। তুসীর বাবা সামান্য একজন সরকারি কর্মকর্তা আর মা গৃহিনী। আর দৃষ্টির বাবা ব্যবসায়ী মানুষ হলেও যথেষ্ট উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। মা একজন সরকারি কলেজের প্রভাষক। এই বিষয় গুলো নিয়ে ভাবতে গেলে আত্মীয়-স্বজন সবাই নিশ্চিত দিয়ে বলতো তুসী চান্স না পেলেও দৃষ্টি ঠিকই চান্স পেয়ে যাবে। কিন্তু হলো তার সম্পূর্ণ উল্টোটা। মেয়ের এই ব্যর্থতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না দিলশান আরা। মেয়ে চান্স পায়নি এই দুঃখের থেকেও বড় দুঃখ কর্মস্থলের পরিচিতদের, আত্মীয়-স্বজনের সামনে মুখ দেখাবে কিভাবে? মেয়েটা যে শেষ মুহূর্তে এসে এতো বড় একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতির মাঝে ফেলবে ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি দিলশান আরা। চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পরে আছে বিছানায়। বিকেলের দিকে দৃষ্টি দিহানকে সাদেক সাহেব গিয়ে নিয়ে এসেছে ঢাকা থেকে। বাড়িতে এসেই অপরাধি মুখে মায়ের সামনে উপস্থিত হয়েছিল দৃষ্টি। তবে মেয়ের সাথে একটা শব্দ পযর্ন্ত উচ্চারণ করেনি দিলশান আরা। কতক্ষণ মা’কে মানানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি দিলশান আরা। বাবা কথা বললেও তার কথায় মন খারাপের লেশ ঠিক বুঝতে পেরেছে দৃষ্টি। দিহানটাও আসার পর থেকে নিশ্চুপ হয়ে আছে। বাড়ির থমথমে পরিস্থিতি দেখে লাফালাফির সাহস পাচ্ছেনা।

নিজের রুমে এসে বিছানায় বসে বুক ফুলিয়ে দম ছাড়ে দৃষ্টি। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য মনে মনে সম্পূর্ণ দায়ী করে রক্তিম শিকদারকে। ঐ পাতি নেতার চিন্তায় বিভোর থেকেই তো দৃষ্টির এডমিশন প্রস্তুতি খারাপ হয়েছে। হবে নাই বা কেন!সর্বক্ষণ মাথার মাঝে পোকার মতো ঘুরঘুর করেছে। এমনকি পরীক্ষার হলে গিয়ে পর্যন্ত ঐ গুন্ডাটার কথা ভেবেছে। এসবের মাঝে দৃষ্টির রেজাল্ট বড়সড় একটা লাড্ডু হবেনা তো কি হবে! পাষাণ পুরুষটা তার আলাভুলা মনটা কেড়ে নেবার পাশাপাশি শান্তিটুকুও কেড়ে নিয়েছে। এরপরও তার প্রতি একটু দয়ার নজর দিচ্ছেনা। কোন আদলে গেলে দৃষ্টি ঐ পাষন্ড পুরুষটার অমানবিক আচরণের সুষ্ঠ বিচার পাবে?

গোটা একটা সন্ধ্যা কেটে যাবার পর রাতের খাবারের সময় গম্ভীর মুখাবয়বে মেয়ের দিকে তাকায় দিলশনা আরা। মায়ের ফোলা চোখ দুটো দেখে এবার একটু মন খারাপ হয় দৃষ্টির। সর্বক্ষণ সব কিছু নিয়ে দাম্ভিকতার চূড়ায় রানীর হালে বসে থাকা মা’টা যে তার এমন রেজাল্ট কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা বুঝতে পারে দৃষ্টি। অপরাধবোধে মায়ের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারেনা। মাথা ঝুকিয়ে তাকিয়ে থাকে প্লেটের দিকে। ক্ষণকাল পর শুনতে পায় মায়ের গম্ভীর্য আওয়াজ,

“পাবলিকে হয়নি তাই বলে এটা ভেবোনা আর কোনো চেষ্টা না করেই তোমাকে আমি সাধারণ কোনো কলেজে ভর্তি করিয়ে দিব। সাত কলেজের জন্য প্রস্তুতি নাও। এবার অন্তত আমার মান-সম্মানের দিকটা ভেবে হলেও পড়াই একটু মনযোগ দিয়ো।”

হতাশার একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে দৃষ্টির বুক চিড়ে। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় নিরবে খেয়ে যাচ্ছেন সাহেব সাহেব। নিরব থেকেই যেন মেয়েকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন ওনি নিজেও স্ত্রীর কথায় একমত। এই মানুষ দুটো আজীবন শুধু সম্মান আর টাকার পিছনেই ছুটল। একটাবার হয়তো কখনো ভাবেনি ছেলে-মেয়ে দুটো কি চায়। স্কুল,কলেজ এমনকি সাবজেক্ট পযর্ন্ত নিজেরা বাছাই করে দিয়েছে। একবারও এটা ভাবেনি তাদের চাপিয়ে দেওয়া সাবজেক্টে মেয়েটা কতটুকু পারদর্শী। উল্টো যদি নিজে থেকে কিছু বলতে যেতো তখন শুনিয়ে দিতো সেই চিরপরিচিত কথা, “বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপ চায়না। আমরা যা করি তোমাদের ভালো ভেবেই করি।” দৃষ্টি বুঝেনা এই চাপিয়ে দেওয়া জিনিস গুলোতে তারা সন্তানের ভালো কোথায় খোঁজে পায়! তবুও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা। কারণ জানে সে মুখে একটা কথা উচ্চারণ করলে সেটা নিয়ে পরবর্তীতে বাবা-মায়ের মাঝে তর্কবিতর্ক এক পর্যায়ে ঝগড়ায় রূপ নিবে। তার থেকে ভালো চুপ থাকা।

****

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন আজ। পুরো বাংলাদেশ জুড়ে নির্বাচনী আমেজ। প্রতিটা কেন্দ্র থেকে শুরু করে রাস্তায় রাস্তায় আইন শৃংখলা বাহিনী টহল দিচ্ছে। সকলের একটাই আশা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হোক ভোটদান। সুষ্ঠ একটা নির্বাচন হোক। রক্তিম সহ তার দলের সকল ছেলেরা প্রতিটা কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেখছে কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা হচ্ছে কি না। তবে এখন পযর্ন্ত সব ঠিকঠাক। নিয়মতান্ত্রিক ভোটদান চলছে প্রতিটা কেন্দ্রে। লিয়াকত বিল্লার লোকজন এখন পযর্ন্ত কোনো ব্যঘাত ঘটায়নি। বিষয়টা রক্তিমের কাছে ঠিক লাগছেনা। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে সব। ২ নং ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে এসব নিয়েই ভাবছিল রক্তিম। ঠিক তখনই মেহেদী এসে উপস্থিত হয়। রাস্তার এক পাশে বাইক রেখে চিন্তিত মুখে অগ্রসর হয় রক্তিমের দিকে। মেহেদীর চিহ্নিত মুখ দেখে রক্তিম নিজেও একটু চিন্তিত হয়। জানতে চায়,

“ঐদিকে সব ঠিকঠাক? না কি কোনো ভেজাল করেছে?”

“আপাতত সব শান্ত। কিন্তু চিন্তার বিষয় তো এটাই। তোর কি মনে হয় লিয়াকত বিল্লা এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকার মানুষ! যে একটা হাঁচি দিতে গেলেও নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করে সে কি না নির্বাচনের দিন গুহাই বসে আছে! আর ঐ শু’য়’র মাসুম বিল্লাও ভ্যানিস।”

এতোক্ষন নিরবে যা নিয়ে ভাবছিল সেই একই চিন্তা মেহেদীর মাথায়। ডান হাতে ঘন দাড়িতে আবৃত গাল চুলকে রক্তিম বলে,

“ঝড় আসার পূর্বে প্রকৃতি শান্তই থাকে। সবাইকে সচেতন থাকতে বল। শা’লা কা পু রু ষে র জাত কা পু রু ষ। এদের কাজই হলো পিছন থেকে ছুরি মা রা।”

রক্তিমের কথায় সম্মতি জানায় মেহেদী। মাথা ঝাকিয়ে বলে,

“হয়তো ভেবেছে প্রথমে শান্ত থেকে আমাদের বুঝাবে কোনো ঝামেলা করবেনা। এটা নিশ্চিত হয়ে যখন আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব তখনই হামলে পরবে। শা লা র এতো বুদ্ধি থাকে কোথায়?”

এই প্রেক্ষিতে আর কিছুই বলেনা রক্তিম। ভাবুক হয়ে জানতে চায়,

“ধামসোনা ইউনিয়নের দিকে কারা কারা আছে? ঐদিকে কিন্তু ভোটার বেশি। সব ঠিকঠাক আগাচ্ছে কি না খোঁজ নে।”

***
বিকেল চারটা পযর্ন্ত সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণের পর এখন একে একে সকল কেন্দ্রে ভোট গণনা চলছে। আস্তে আস্তে একেক কেন্দ্র থেকে ফলাফল প্রকাশ পাচ্ছে। এক কেন্দ্রে একজন জয়ী হলে অপর কেন্দ্রে হচ্ছে অন্যজন। সঠিক খবর এভাবে জানা সম্ভব না। যতক্ষণ পযর্ন্ত মোট ভোট গণনা শেষ না হচ্ছে ততক্ষণ পযর্ন্ত কিছুই বলা যাচ্ছেনা। তুমুল উৎকন্ঠা আর দুশ্চিন্তার সাথে পার হচ্ছে প্রতিটা সেকেন্ড। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে। নির্বাচন অফিসের সামনে খোলা জায়গায়, স্কুল মাঠে, কলেজ মাঠে প্রতিটা খোলা জায়গায় ভীর জমিয়েছে সকল দলের লোকজন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটা সময় প্রকাশিত হয় ফলাফল। পাঁচ লক্ষ পয়তাল্লিশ হাজার সাতশত শুরুটি ভোটের মধ্যে তিন লক্ষ একুশ হাজার ছয়শত তিরাশি ভোট পেয়ে জয় লাভ করেছে স্বতন্ত্র প্রার্থী আজীজ শিকদার। অন্যদিকে ক্ষণকালীন সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থী লিয়াকত বিল্লা পেয়েছে এক লক্ষ বাইশ হাজার নয়শত নিরানব্বই ভোট। বাকি ভোট গুলো পেয়েছে অপজিট তিন দলের প্রার্থীরা।

ফলাফল ঘোষণার পরপরই উল্লাসে মেতে ওঠে আজীজ শিকদারের দলের লোকজন। রাকিব, শান্ত, জাবির সহ দুই-একজন মিলে আজীজ শিকদারকে কাঁধে উঠিয়ে নেয়। ছেলেদের এমন পাগলামিতে মুচকি হাসে আজীজ শিকদার। চোখে-মুখে প্রাপ্তির উচ্ছাস নিয়ে তাকায় দূরে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তিমের দিকে। পাষাণ হতে হতে ছেলেটা এতোটাই পাষাণ হয়ে গেছে যে এতো বড় একটা জয়ের পরও কেমন শান্ত স্থির নির্জীবের মতো দাঁড়িয়ে আছে সকলের অলক্ষ্যে। আজীজ শিকদারের দৃষ্টি লক্ষ্য করে মেহেদী তাকায় সেদিকে। এগিয়ে গিয়ে মুখে হাসি নিয়ে কাঁধ চাপড়ে বলে,

“কি রে বেটা! জিতে গেলি তো। এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মিষ্টির অর্ডার দে তাড়াতাড়ি।”

“হার-জিতের কিছুই তো এখনো হয়নি। খেলা সবে শুরু। ভুলে গেছিস ঠিক কোন উদ্দেশ্যে মেয়র সাহেবকে এমপি বানালাম? তাছাড়া আমার কাছে কিছুই ঠিক লাগছেনা। দেখিস নি ফলাফল জানার পরও কেমন শান্ত ভঙ্গিতে জায়গা ছাড়ল লিয়াকত বিল্লা। নিশ্চিত কোনো না কোনো নিরব ফাঁদ পেতে রেখেছে।”

“কিন্তু কি সেটা?”

মুখ থেকে হাসি সড়িয়ে চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে মেহেদী। তার এমন বোকার মতো প্রশ্নে কপাল কুঁচকায় রক্তিম,

“সেটা জানতে পারলে কি এখনো এভাবে বসে থাকি? তুই যেখানে আমিও সেখানে। তবে জানব কিভাবে ঐ শা লা কোন ফাঁদ পেতেছে? না কি আমি তার মেয়ের জামাই যে আমাকে সব বলে দিবে!”

ঠোঁট কামড়ে মিটিমিটি হাসে মেহেদী। মাথা ঝাকিয়ে বলে,

“দেখ ভাই!শুধু শুধু ঐ দৃষ্টি নামের বাচ্চা মেয়েটার মন ভেঙ্গে লিয়াকত বিল্লার ডা ই নি মেয়ের দিকে নজর দিস না। পরে দেখা যাবে বাচ্চা মেয়েটার অ ভি শা পে বাসর রাতেই লিয়াকত বিল্লার ডা ই নি মেয়ে তোর রক্ত চু ষে খাবে।”

হুট করে দৃষ্টির প্রসঙ্গ আসতেই বিরক্ত হয় রক্তিম। তবে মনে মনে এও ভাবে আজ কিছুদিন যাবৎ মেয়েটা একদম বিরক্ত করছেনা তাকে। এমনকি চোখের সামনেও আসছেনা। আধ পাগল মেয়েটার আবার কোনো বিপদ হলো না তো! রক্তিমকে নিশ্চুপ দেখে মিটিমিটি হাসে মেহেদী। টিটকারি মেরে বলে,

“কি রে! বাসরের কথা শুনে আবার কল্পনা করা শুরু করে দিয়েছিস না কি? তা সেই কল্পনার বাসরে তোর সাথে বউ সাজে কে? দৃষ্টি!”

চলবে…

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-১১+১২

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১১
#আদওয়া_ইবশার

সারাদিনের দৌড়-ঝাপের পর ঘরে ফিরে ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয় রক্তিম। উপুড় হয়ে শুয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে গভীর একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। মেহেদী হাতে থাকা খাবারের প্যাকেটটা টেবিলের এক কোণে রেখে নিজের গা থেকে ঘার্মাক্ত শার্ট ছাড়াতে ছাড়াতে জিজ্ঞেস করে রক্তিমকে,

“শুয়ে পরলি যে! খাবি না?”

“খিদে নেই। তুই খেয়ে নিস।”

চোখ বন্ধ রেখে ওভাবেই শুয়ে থেকে ক্ষীণ স্বরে জানিয়ে দেয় রক্তিম। ভ্রু কুঁচকায় মেহেদী। জানতে চায়,

“তা কি খেয়ে পেট ভরেছিস? সিগারেটের ধোয়া!”

জবাব দেয়না রক্তিম। চুপচাপ সেভাবেই পরে থাকে বিছানায়। শরীর ক্লান্ত থাকায় এটুকু সময়েই তার চোখে ঘুম ঘুম ভাব চলে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে এবার একটু বিরক্ত হয় মেহেদী। বলে,

“খাবি না ঠিক আছে। তাই বলে কি শার্টটাও পাল্টাবিনা? বাইরে থেকে এসেই ল্যাদার মতো শুয়ে পরছিস! তোর গা থেকে ঘামের গন্ধ বের হচ্ছে। ওঠ, দ্রুত শার্ট পাল্টে ফ্রেশ হয়ে ঘুমা। নইলে তোর ঘামের দুর্গন্ধে আমার ঘুম হারাম হবে আজ।”

তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবে থেকেই ঠোঁট টেনে হাসে রক্তিম। নিজের প্রতি নিজেই তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে বলে,

“যার ভিতরে পুরোটাই গন্ধযুক্ত নর্দমা হয়ে আছে। তার আর শরীর পরিষ্কার করে কি হবে? সেই তো ভিতরের দুর্গন্ধযুক্ত আবরণ থেকেই যাবে।”

নিস্পল চোখে রক্তিমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ে মেহেদী। ক্রস্থ পায়ে বাইরে থেকে কোনোমতে হাত-মুখ ধুয়ে এসে শুয়ে পরে রক্তিমের পাশে। খাবারের প্যাকেটটা টেবিলে ওভাবেই পরে থাকে অবহেলায়। রক্তিমের কথায় মেহেদীর’ও খাবার ইচ্ছে মিটে গেছে। বিকেলের ঘটনা গুলো স্বরণ হয় মেহেদীর। একজন মা কতটা উন্মাদ হলে এভাবে নিজের সন্তানকে আঘাত করতে পারে!

****

রক্তিম শিকদারের কাছে এতো বাজে ভাবে অপদস্থ হবার পরও দমে যায়নি দৃষ্টি। মনের কোণে অল্প অভিমান জমা হলেও তা ঝেড়ে ফেলে পরোক্ষনেই এটা ভেবে, ঐ পাষাণ পুরুষটার মনে তার জন্য এখনো ভালোবাসার জন্ম হয়নি। যার হৃদয়ে ভালোবাসা নেই তার আচরণে কষ্ট পেয়ে পিছু হটা নেহাত বোকামি ছাড়া কিছুই না। দৃষ্টি হাল ছাড়েনি। ভয় পেয়ে পিছিয়েও যায়নি। সময়ে অসময়ে দাঁড়িয়ে গেছে রক্তিম শিকদারের সামনে ভালোবাসা জাহির করতে। নিষ্ঠুর মানুষটার মন জয় করতে না পারলেও সেই দিনের মতো এমন ঐদ্ব্যত্য আচরণ আর পায়নি। কোনো এক অজানা কারণে রক্তিম দ্বিতীয়বার মেয়েটার সাথে বাজে আচরণ করতে পারেনি। হয়তো মনের কোণে কোথাও একটু অনুতপ্ততার লেশ উকি দিয়েছিল। অনুভব করতে পেরেছিল তার থেকে বয়সে এতো ছোট একটা মেয়ের কথায় উত্তেজিত হয়ে এতোটা খ্যাঁপাটে আচরণ করাটা ঠিক হয়নি। মেয়েটার বয়স কতই বা হবে! সতেরো কি আঠারো। এর থেকেও বেশি হলে ঊনিশ। এই বয়সী মেয়েরা বড্ড আবেপ্রবল হয়। এরা ঠিক ভুল বিচার করতে জানেনা। চোখের সামনে যা ভালো লাগে তাই নিজের করতে মরিয়া হয়ে যায়। দৃষ্টি মেয়েটাও ঠিক তেমন ধরনের মেয়েই। আবেগে গা ভাসিয়ে এসেছে রক্তিম শিকদারকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে। ঘটে যদি বুদ্ধি-সুদ্ধি কিছু থাকত তবে নিশ্চয়ই দেশে হাজার হাজার সুদর্শন ছেলে থাকতে রক্তিমের মতো এমন চালচুলোহীন একটা গুন্ডা, মাস্তানকে প্রেমের প্রস্তাব দিতনা।

ফুরফুরে এক বিকেল। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ডুবি ডুবি ভাব করছে। আকাশ জুড়ে রক্তিম আভা। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে দূর আকাশের দিকে আনমনে তাকায় দৃষ্টি। দিনের শেষ প্রহরে আকাশের এমন আগুন রাঙা সাজ দেখে ভাবে, একেই বুঝি বলে গোধূলি লগ্নের কনে দেখা আলো। ঊর্ধ্বগগণ থেকে মুখ সরিয়ে পাশে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় দিহানের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যস্ত তুসী। ছেলেটা যা দেখছে সেটা সম্পর্কেই জানতে চাচ্ছে। এটা কার বাসা, ওটা কার গাছ একের পর এক প্রশ্ন করতে করতে পাগল বানিয়ে ফেলছে তুসীকে। মুচকি হাসে দৃষ্টি। ভাইটা তার বরাবরই প্রশ্ন করতে পারদর্শী। সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে রাস্তার এপাশ-ওপাশ তাকায় দৃষ্টি। বেহায়া মনটা না চাইতেও হয়তো খোঁজে বেড়ায় অতি প্রিয় একটা মুখ। যদি একবার দেখা পেত নির্লজ্জ চোখ দুটোর তৃষ্ণা মিটতো হয়তো।

হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেকটা দূর চলে এসেছে তারা। বাসার গলি পেরিয়ে একেবারে মেইন রোডের কাছাকাছি। চারিদিকে পোস্টার, মাইকিং এর উচ্চ শব্দ জানান দিচ্ছে কাছেই হয়তো কোথাও একটা জনসমাবেশ হচ্ছে।
দৃষ্টি শুনেছে রক্তিম শিকদারের বাবা এমপি পদে নির্বাচনে লড়ছেন। সেটাও না কি ছেলের জেদে। কথাটা মনে পরতেই আনমনে প্রশ্ন করে তুসীকে,

“তুসু! রক্তিম শিকদারের বাবার নাম যেন কি?”

আবার সেই রক্তিম শিকদার! এই মেয়ে কি রক্তিম শিকদার ছাড়া আজ-কাল কোনো কথা খোঁজে পায়না? বিরক্ত হয় তুসী। অনিহা নিয়ে আঙুল তুলে দেয়ালে লাগানো একটা পোস্টার দেখিয়ে বলে,

“নিজেই দেখে নে।”

তুসীর হাত অনুসরণ করে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় সাদা-কালো পোস্টারে হাস্যজ্জল এক মুখ। গাল জোরে শুভ্র দাড়ি। ঠোঁটে লেগে আছে নির্মল হাসি। কপাল কুঁচকায় দৃষ্টি। ভাবে, লোকটা কি সুন্দর হাসে!অথচ এই লোকের ছেলে ওমন গুমরা মুখো কেন? বোনের দেখাদেখি দিহানও একটু এগিয়ে এসে পোস্টারে নজর দেয়। গুটি গুটি বাংলা অক্ষরে লেখা গুলো শব্দ করে পড়ে। পরোক্ষনে ভাবুক হয়ে প্রশ্ন করে,

“আচ্ছা আপু! ঐ রক্তিম শিকদার কে?”

মাথা কাত করে ঠোঁট চেপে হাসে দৃষ্টি। বলে,

“সিনেমায় হিরো দেখিস না! রক্তিম শিকদার হলো সেই হিরো। তবে সিনেমার না রিয়েল হিরো।”

দৃষ্টির এমন কথায় মুখ বাকায় তুসী। বিরবির করে বলে,

“হিরো! হাহ্! রাক্ষসের হিংস্র থাবা থেকে কোনোমতে জান নিয়ে ফিরে এসেও এখনো শিক্ষা হয়নি। নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার!”

বোনের জবাবে অবাক হয় দিহান। বাচ্চা ছেলেটার মনে কৌতূহল জাগে বোনের ভাষায় সেই রিয়েল হিরো রক্তিম শিকদারকে নিয়ে। আবার অল্প একটু সন্দেহও হয়। বোন না আবার তাকে ছোট ভেবে মিথ্যা বলে বোকা বানাতে চাইছে। চোখ পিটপিট করে জানতে চায়,

“ওনি কি সত্যিই হিরো? তুমি দেখেছো ওনাকে? আচ্ছা বলো তো শুনি রিয়েল হিরো দেখতে কেমন?”

ঠোঁট চেপে আবারও হাসে দৃষ্টি। শরীর দুলিয়ে বলে,

“মুখে শুনে কি আর বুঝা যায় কেমন হিরো? বাস্তবে দেখা আর মুখে শোনার মাঝে বিস্তর তফাৎ।”

“তাহলে আমি দেখব সেই হিরোকে।”

“সত্যি দেখবি?”

সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন করে দৃষ্টি। ঘনঘন উপর-নিচ মাথা দুলিয়ে সাই জানায় দিহান। প্রফুল্ল হাসে দৃষ্টি। কাধ ঝাকিয়ে বলে,

“ঠিক আছে। চল তাহলে রিয়েল হিরো দেখিয়ে নিয়ে আসি তোকে।”

ভাই-বোনের কথোপকথন শুনে কপাল চাপড়ায় তুসী। কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

“জাহান্নামে যা তোরা দুইটা। আমি কিছুই বলবনা। কিন্তু খবরদার! তোদের সাথে আমাকে টানবিনা।”

কথা শেষ করে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়না তুসী। দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরে উল্টো পথে। সেদিকে তাকিয়ে মুখ বাকায় দৃষ্টি। হাক ছেড়ে বলে,

“যা যা। যেখানে খুশি সেখানে যা। কি ভেবেছিস?তোর মতো মেয়ে আমার সাথে না থাকলে রক্তিম শিকদারের খোঁজ পাবনা! আমার ভাইকে তার হবু দুলাভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে তবেই বাসায় যাব আমি।”

স্কুল মাঠে বিশাল জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে আজীজ শিকদারের পক্ষ থেকে। উত্তাল জনগণের সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বুক টানটান করে চিরায়িত গম্ভীর স্বরে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে রক্তিম শিকদার। উৎসুক জনগণের নজর সেদিকেই। বাবার হয়ে রক্তিম শিকদার নিজে জনগণের কাছে প্রতিজ্ঞা রাখছে এলাকার উন্নয়নের লক্ষ্যে। গিজগিজ করা মানুষের ভীড় ঠেলে একপাশে ভাইয়ের হাত ধরে দাঁড়ায় দৃষ্টি। জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের দিকে। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে তার স্মিত হাসি। বক্তৃতার মাঝে মাঝে একটু বিরতি নিয়ে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছে রক্তিম। শ্যামবর্ণ বলিষ্ঠ দেহে কালো শার্টটা ঘামে চিটচিটে হয়ে আছে। দূর থেকেই তা দৃষ্টির চোখে ভাসে। সেদিকে নজর রেখেই ভাইয়ের হাতে মৃদু চাপ প্রয়োগ করে দৃষ্টি। এক হাত উচিয়ে ইশারায় দেখায়,

“রিয়েল হিরো দেখতে চেয়েছিলি না! ঐ দেখ রিয়েল হিরো।”

মঞ্চে বক্তব্যরত শ্যামাঙ্গ পুরুষটার দিকে তাকায় দিহান। অপলক চোখে কতক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রক্তিমকে পরখ করে বলে,

“এই লোক তো আধ বুড়ো। গায়ের রংটাও কালো। একে তোমার কাছে হিরো মনে হয়?”

বিস্ময়ে চোখ দুটো বৃহদাকৃতির হয় দৃষ্টির। যে পুরুষটার প্রেমে দিন-রাত মজে থাকে দৃষ্টি। সেই পুরুষটার সম্পর্কে নিজের ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে যারপরনাই অবাক হয়। অসহায় চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ওনাকে তোর সত্যি সত্যি বুড়ো মনে হয়? আর কালো বলছিস কাকে? মোটেও ওনি কালো না। শ্যাম বর্ণের শ্যামাঙ্গ পুরুষ ওনি। ওনার গায়ে এই রংটাই কত সুন্দর মানিয়েছে! শ্যাম বর্ণ না হয়ে গায়ের চামড়া সাদা হলে বরং আরও কুৎসিত দেখাত।”

বোনের যুক্তি গুলো মানতে নারাজ দিহান। চোখে-মুখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বলে,

“আরে ধুর! তুমি তো দেখি হিরোই চিনোনা। আবার আমাকে নিয়ে আসছো হিরো দেখাতে! শুনো, হিরোদের চোখ হবে সুন্দর ভাসা ভাসা। হিরোরা না হাসলেও তাদের চোখ হাসবে। আর চুল হবে স্টাইল করে কাটা। জেল দিয়ে চুল গুলো সেট করা থাকবে। আর না হয় সিল্কি চুল গুলো কপালে ঢেউ খেলবে। দাড়ি থাকবে ট্রিম করে কাটা। আর ওনাকে দেখো! চুল গুলো কেমন পাগলের মতো আউলাঝাউলা হয়ে কাকের বাসার মতো দেখাচ্ছে। মনে হয় কতদিন ধরে শ্যাম্পু করেনা। মুখ ভর্তি দাড়ি- গুফ। দাড়ি গুলো যদি আর কয়েক ইঞ্চি বড় আর সাদা হতো তবে একদম রবীন্দ্রনাথের মতো লাগত। ওনাকে কোনোভাবেই হিরো বলা যায়না। তবে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বিরহী কবিতা লেখা কবি বলা যায়।”

এতটুকু একটা ছেলের মুখে এমন বিশদ বর্ণনা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টি। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন। ফ্যালফ্যাল নয়নে শুধু তাকিয়ে থাকে ভাইয়ের মুখের দিকে। শেষ পযর্ন্ত কি না নিজের মায়ের পেটের ভাইটা তার পছন্দকে এভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করল! এই দুঃখ কিভাবে মেনে নিবে দৃষ্টি?

চলবে…..

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১২
#আদওয়া_ইবশার

হঠাৎ করেই রক্তিমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাকিবের নজর যায় দৃষ্টির দিকে। দেখতে পায় বাচাল মেয়েটা একটা পিচ্চি ছেলের সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে। কথা বললে ভুল হবে। এক প্রকার আঙুল উচিয়ে তর্ক করে যাচ্ছে। দাঁত দিয়ে নিম্নোষ্ঠ কামড়ে ভাবে রাকিব, আধ পাগল মেয়েটা এই ফুটফুটে বাচ্চা ছেলেটাকেও রেহাই দিলনা। নিশ্চয়ই এখানে এসেছিল আবার রক্তিম শিকদারকে জ্বালাতে। কিন্তু এতো গুলো মানুষের মাঝে রক্তিমের নাগাল না পেয়ে এই বাচ্চা ছেলেটার মাথা নষ্ট করছে। এই মেয়ের এলেম আছে বলতে হয়। বারবার রক্তিম শিকদারের কাছে অপদস্থ হয়েও ঘুরেফিরে তার পিছেই আসবে।

দৃষ্টির থেকে নজর ঘুরিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দলের অন্যান্য ছেলেদের অবস্থান দেখে নেয় রাকিব। মেহেদী সহ সকলেই রক্তিমের আশেপাশেই আছে। তাছাড়া পুলিশ ও আছে এখানে। রক্তিম শিকদার বা আজীজ শিকদারের উপর ভরা মঞ্চে আচমকা হামলা করার কোনো পরিস্থিতি নেই। নিশ্চিত হয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু একটা ইঙ্গিত দিয়ে নেমে পরে মঞ্চ থেকে। লাফিয়ে কয়েক কদমে ঠিক দৃষ্টির পিছনে এসে দাঁড়ায়। স্ব-হাস্য স্বরে বলে,

“কি ব্যাপার ললনা! রক্তিম শিকদার মনে হয় ডোজ কম দিচ্ছে তোমাকে! গলা টি’পা এন্টিডোজ তোমার মতো পুঁচকে ভালোবাসা নামক ভাইরাসরে ঘায়েল করতে পারলনা। বড়োই ভাবনার বিষয়।”

আচমকা পেছন থেকে কারো গলার আওয়াজ পেয়ে কপাল কুঁচকে পিছন মুখে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় রাকিব দাঁত কপাটি বের করে হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। বিরক্ত হয় দৃষ্টি। চোখ পাকিয়ে বলে,

“এই আপনার সাহস তো দেখি কম না! জনসভার এতো এতো কাজ রেখে শরীরে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছেন। ফাঁকিবাজ চামচা একটা।”

চামচা সম্বোধনে আজকে আর রাগেনা রাকিব। বিগলিত হেসে বলে,

“একটু সাইডে আসো। কথা আছে।”

“কি কথা?”

সন্দিহান কন্ঠে জানতে চায় দৃষ্টি। উত্তরে রাকিব তাড়া দিয়ে বলে,

“আরে আসোই না! না আসলে শুনবা কেমনে?”

“কি কথা এখানেই বলুন।”

দৃষ্টির কন্ঠে স্পষ্ঠ রাকিবের কথায় সাথে যাবার অনিহা প্রকাশ পাচ্ছে। রাকিব বলে,

“এতো গুলো মানুষের সামনে বলা যাবেনা। সিক্রেট কথা।”

খ্যাঁটখ্যাঁটে চামচার হঠাৎ এমন ভালো মানুষী আচরণ! হজম হয়না দৃষ্টির। নিশ্চয়ই বদটা মনে মনে কোনো শয়তানি ফন্দি এটেছে তাকে নাস্তানাবুদ করার। তবে সেও জানেনা দৃষ্টি কেমন চিজ। উল্টাপাল্টা কিছু করলে সাথে সাথেই চেঁচিয়ে সভায় উপস্থিত প্রতিটা মানুষকে দিয়ে গণধুলাই খাইয়ে ছাড়বে দৃষ্টি। নাক-মুখের নকশা পাল্টে গেলে ঠিক বুঝবে দৃষ্টির সাথে ইতরামি করার সাজা কেমন ভয়ানক। কথাগুলো ভেবে নিজেকে একটু আশ্বস্ত করে দিহানের হাত টেনে এগোই দৃষ্টি। তৎক্ষণাৎ রাকিব বলে,

“সাথে আবার এই মসিবত টেনে আনছো কেন? ঝগড়া শেষ হয়নি এটার সাথে?”

চোখ পাকায় দৃষ্টি। রাগি স্বরে বলে,

“কোন সাহসে আমার ভাইকে মসিবত বলছেন আপনি? আর একবার আমার ভাইকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বললে একেবারে মাথা ফাটিয়ে দিব।”

একটু ভড়কায় রাকিব। থমথম খেয়ে বলে,

“এটা তোমার ভাই! আমি আরও ভাবছিলাম ঝগড়া করার জন্য কোনো বাড়ি থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছো। তা ভাইকে সাথে নিয়ে এখানে এসেছো কেন?”

সত্যি কথাটা বলতে গিয়েই টুপ করে জ্বিভের ডগা পযর্ন্ত বেরিয়ে আসা কথাটা গিলে নেয় দৃষ্টি। কপট রাগি ভাবে বলে,

“তা জেনে আপনার কি? কিজন্য ডেকেছেন আগে সেটা বলুন। আপনার মতো এতো আজাইরা প্যাচাল পারার সময় নেই আমার।”

বাব্বাহ্! বলে কি মেয়ে। এতো দেখি ভূতের মুখে রাম নাম। যে মেয়ে পারলে দিন-রাতের চব্বিশ ঘন্টায় রক্তিম শিকদারের পিছনে ঘুরে নিজের আজাইরা সময় কাজে লাগায়। সে না কি আবার বলে তার সময় নেই। কথাটা মনের মাঝেই চেপে রাখে রাকিব। এই হাফ পাগল মেয়ের সাথে বেশিক্ষণ থাকা যাবেনা। যা বলতে এসেছে সেটা সম্পূর্ণ করে দ্রুত কেটে পরাই মঙ্গল। সচেতন চোখে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখে নেয় কেউ তাদের দেখছে কি না। নাহ্! আপাতত কারো ধ্যান এদিকে নেই। সকলেই রক্তিম শিকদারের কথা গিলতে ব্যস্ত। আবারও দু-পাটি দাঁত বের করে হাসে রাকিব। দৃষ্টির দিকে কিছুটা ঝুকে ফিসফিসিয়ে বলে,

“শুনো সুন্দরী! তোমারে একটা ভালো বুদ্ধি দেই। ঐ জড় বস্তুর ন্যায় ইস্তাপ কঠিক হৃদয়ের অধিকারী রক্তিম শিকদারের পিছনে অযথা সময় নষ্ট না করে একটু আমার দিকে দেখো। তুমি রাজি থাকলে আমাদের প্রেম জমে ক্ষীর হইতে বেশিক্ষণ লাগবেনা। ঐসব প্রেমের ব্যাপারে ভালো ধারণা আছে আমার। কথা দিচ্ছি একদম ঠকবানা।”

কথাটা শেষ করে আবারও ঠোঁট কামড়ে হাসে রাকিব। রাগে গা-পিত্বি জ্বলে ওঠে দৃষ্টির। ঝাড়ি মেরে বলে,

“যেই না চেহারা তার নাম রাখছে আবার পেয়ারা। সাহস কত বড়! রক্তিম শিকদারের ভাবি স্ত্রীকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়! আবার দাঁত বের করে হাসে! কি বিচ্ছিরি হলুদ দাঁত! আমার তো দেখেই বমি চলে আসছে। মুখ বন্ধ করুন।”

গরম গরম এমন একটা অপমানে থমথম খেয়ে যায় রাকিব। তৎক্ষণাৎ মুখের হাসি হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যায়। কিছুটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বিরবির করে বলে,

“তার চেহারা থেকে মনে হচ্ছে ডালিমের রস বেয়ে বেয়ে পরছে। নেহাত আমি ভদ্র একটা ছেলে দেখে একটা মেয়ের ভালোবাসা না পাবার কষ্টে একটু বুক জ্বলেছে আমার। সহমর্মিত দেখিয়ে তাই প্রেমের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আর এই মেয়ে বিনিময়ে আমার কচি চেহারা আর সুন্দর হাসিটা নিয়ে অপমান করল! অভদ্র, অসভ্য মেয়ে জাতি কোথাকার।”

নিজেকে একটু ধাতস্থ করে গলা উচিয়ে চোখ রাঙিয়ে আবারও বলে রাকিব,

“এই মেয়ে! তুমি জানো রোজ রোজ কতশত মেয়েরা আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়? সেই শত শত মেয়ের ক্রাশকে তুমি এইভাবে অপমান করলা! আমার প্রেমিকারা যদি এই কথা জানতে পারে তোমার চুল একটাও আস্তো থাকবেনা বলে দিলাম।”

মুখ বাকায় দৃষ্টি। ব্যঙ্গ করে বলে,

“খালি কলসি সবসময় বাজে বেশি। ধন্যবাদ বিষয়টা আবারও প্রমাণ করার জন্য।”

পূণরায় অপমান! এসব কি মেনে নেওয়া যায়? যে ছেলেটাকে এক প্রকার রক্তিম শিকদারের বাঁ-হাত বলা চলে সেই সুদর্শন ছেলেটাকে এভাবে অপমান করছে মেয়েটা। এর প্রতিশোধ তো নিতেই হয়। কিন্তু কিভাবে নিবে? ভাবতে ভাবতেই চক করে মাথায় আসে কয়েকমাস আগেই না তার নাম্বারে এক অচেনা মেয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিল! সেটা দেখিয়েই তো এই মেয়ের মুখের উপর অপমানের জবাব ছুড়ে দেওয়া যায়। ভেবেই পকেট হাতের ফোন বের করে বলে,

“আমি ফাঁকা কলসি না! খারাও। দেখাইতেছে কে ফাঁকা কলসি আর কে ভরা কলসি। এই যে দেখো। দেখো এইটা কি। মেয়েরা ফোনে পযর্ন্ত প্রেমের প্রস্তাব দিয়া আমারে পাগল করে ফেলে। আর তুমি রক্তিম শিকদারের পিছনে বেহায়ার মতো ঘুরেও পাত্তা পাওনা। সেই তুমি কি না আমারে ফাঁকা কলসি বলো! এবার দেখো কে ফাঁকা কলসি আর কে ভরা কলসি।”

চোখের সামনে ফোনের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করা ম্যাসেজটা দেখার পর রাকিবের কোনো কথায় আর দৃষ্টির মস্তিষ্কে পৌঁছায় না। অবাক নেত্রে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ফোনের দিকে। এ তো সেই ম্যাসেজ। যেটা রক্তিম শিকদারকে দিয়েছিল দৃষ্টি। বিনিময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ফিরতি ম্যাসেজ ও পেয়েছিল। আর ভেবেছিল রক্তিম শিকদার কিভাবে তাকে এমন ম্যাসেজ ছিল। কিন্তু ঘটনা যে একেবারে উল্টো এটা কে জানতো? রক্তিম শিকদার সেদিন তার সাথে তো বড় একটা বেঈমানি করল! নিজের নাম্বার বলে তাকে এই চামচা রাকিবের নাম্বার দিল?

দৃষ্টি-রাকিব দুজনের কারোর কোনো কথার আগা-মাথা বুঝতে পারছেনা দিহান। অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে তাদের কান্ড। এর মাঝে বোনকে আবার এমন ফিজড হয়ে থাকতে দেখে একটু চিন্তিত হয়। ভাবে এই লোকটা আবার খারাপ কিছু দেখাল কি না তার বোনকে। কিছুটা ভয় পেয়ে যায় ছেলেটা। দৃষ্টির হাত ঝাকিয়ে বলে,

“আপু! আমার আর হিরো দেখার ইচ্ছে নেই। চলো আমরা ফিরে যায়।”

চোখ-মুখ থমথমে দৃষ্টির। অপলকে এখনো তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে। তা দেখে বিজয়ের হাসি হাসে রাকিব। স্বগর্বে বুক ফুলিয়ে বলে,

“কি? প্রমাণ দেখে এখন মুখের কথা হাওয়া হয়ে গেছে?”

অস্বভাবিক থমথমে দৃষ্টিতে রাকিবের দিকে তাকায় দৃষ্টি। শক্ত কন্ঠে বলে,

“আপনাদের পাতি নেতা রক্তিম শিকদার যে কতটা লয়্যাল তার লয়্যালিটির প্রমাণ আজকে আমি দিব। কঠিন বোঝাপড়া আছে রক্তিম শিকদারের সাথে আমার।”

নির্বাচনের আর মাত্র দুদিন বাকী।জনসভা শেষে বাবার সাথে নিরবে কিছু আলোচনা সাড়তে সোজা পার্টি অফিসে চলে যায় রক্তিম। এতো এতো মানুষের মাঝে দৃষ্টি আর সাহস করে ওঠতে পারেনি রক্তিমের মুখোমুখি দাঁড়ানোর। তবে পিছু নিয়েছে ঠিকই। স্কুল মাঠ থেকে পায়ে হেঁটে মাত্র দুই মিনিটের পথ অতিক্রম করলেই পার্টি অফিস। মেইন রোড সংলগ্ন অফিসটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে মনে মনে অন্য এক বুদ্ধি আঁটে দৃষ্টি। মত পরিবর্তন করে। রক্তিমের সাথে আর দেখা করবেনা। যা করার কালকেই করবে। কথাটা ভেবে কুটিল হেসে ভাইকে নিয়ে প্রস্থান করে দৃষ্টি। বাসায় পৌঁছনোর আগ পযর্ন্ত পুরোটা পথ দিহান বোনকে হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখে ফেলেছে। রক্তিম শিকদার কে? ঐ বুড়ো লোকটাকে কেন তার বোনের চোখে হিরো মনে হয়? আর ঐ ছেলেটাই বা কে যে তার বোনের সাথে এতোক্ষন ঝগড়া করল! এতো এতো প্রশ্নের জবাবে দৃষ্টি শুধু একটা কথায় বলেছে,

“সময় হলে সব জানতে পারবি।”
বোনের জবাবটা ঠিক পছন্দ হয়নি দিহানের। অসন্তুষ্ট মুখে হাঁটতে হাঁটতে কিছু একটা ভেবে নিজ থেকেই অল্প চমকায়। হাঁটার গতি থামিয়ে বোনের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে জানতে চায়,

“আপু! তুমি কি ঐ বুড়ো লোকটার প্রেমে পরেছো?”

ভাইয়ের এমন প্রশ্নে থমথম খেয়ে যায় দৃষ্টি। আমতা আমতা করে বলে,

“আরে ধুর! এমন কিছুই না। প্রেম-ভালোবাসার বুঝিস কিছু তুই? অযথা না বুঝে পাকনামি করবিনা একদম।”

দিহানের ঠিক বিশ্বাস হয়না কথাটা। সে ছেলেটা ছোট হতে পারে। কিন্তু আজ কালকার ছেলে-মেয়েরা কি এতো অবুঝ হয় না কি? তারা ক খ শিখার আগেই প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলে। আর দিহান কি না তার বোনের হাবভাব দেখেও বুঝবেনা বোন ঐ বুড়ো লোকটার প্রেমে পরেছে কি না!

চলবে…..

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-১০

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১০

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ মনোনীত স্বতন্ত্র প্রার্থী আজীজ শিকদার এলাকায় বেরিয়েছেন নির্বাচনী প্রচারণায়। বরাবরই আজীজ শিকদার শান্তি প্রিয় মানুষ। সর্বদা সর্বস্থরের জনগণের সাথে সহজেই মিশে যাওয়া আজীজ শিকদার চান না এই নির্বাচনী কোনো কর্মকান্ডে জনসাধারণের কোনো প্রকার অসুবিধা হোক। যার জন্য নাম মাত্র দলের কিছু লোকজন নিয়ে ভোট চাইতে বেরিয়েছে মানুষের দুয়ারে। রক্তিম আসেনি বাবার সাথে। তার বদলে মেহেদী এসেছে। সকাল থেকে একটানা বিকেলের আগ পযর্ন্ত যে কয়টা এলাকা পেরেছে মানুষের সুবিধা অসুবিধার কথা শুনে আশ্বাস দিয়েছেন ক্ষমতা হাতে আসলে সমাধান তিনি করবেন। নির্বিঘ্নে প্রচারণা শেষে ফেরার পথে মুখোমুখি হয় ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী লিয়াকত বিল্লার সাথে। নিজের দলবল নিয়ে লিয়াকত বিল্লা ভোট চাইতে এদিকেই আসছেন বুঝতে পেরে রাস্তার এক পাশে থেমে যায় আজীজ শিকদার। মেহেদীর দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে হুশিয়ারী দেন,

“ওরা আসছে। চুপচাপ পাশ কাটিয়ে যাবে সবাই। কারো মুখ দিয়ে যেন কোনো শব্দ না বের হয়। আমি কোনো ঝামেলা চাইনা।”

রুশপূর্ণ দৃষ্টিতে মেহেদী এতোক্ষন লিয়াকত বিল্লার পাশে থাকা মাসুম বিল্লার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়েছিল। মনে মনে ভাবছিল, “শা’লা রক্তিম শিকদারের হাতে উত্তম ধোলাই খেয়েও সোজা হয়নি। নির্লজ্জের মতো চ্যাপ্টা হওয়া মুখ নিয়েই বেরিয়ে পরেছে বাপের সাথে ভোট চাইতে।” নিশপিশ করছে মেহেদীর হাত-পা। রক্তিমের সেদিনকার রক্তাক্ত দেহটা ভেসে উঠছে চোখের তারাই। ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে বাপ-ছেলে দুটোর কলিজা বের করে মেপে দেখতে কত বড় হয়েছে। যার দাপটে রক্তিম শিকদারকে মা’রা’র সাহস করেছিল। ঠিক তখনই কানে আসে আজীজ শিকদারের হুশিয়ারি সংকেত। চোখ দুটো বন্ধ করে বড় বড় দুটো শ্বাস টেনে সামলে নেয় নিজেকে। ভদ্র ছেলের মতো মাথা কাত করে সাই জানায় আজীজ শিকদারের কথায়। আবারও শান্ত ভঙ্গিতে হেটে যায় সামনের দিকে সকলেই। সামনে আজীজ শিকদার। পিছনে মেহেদী, জাবির, রাকিব সহ আজীজ শিকদারের দলের কয়েকজন সিনিয়র রাজনীতিবিদ।

লিয়াকত বিল্লা আজীজ শিকদারকে এগিয়ে আসতে দেখে কূটিল হেসে ছেলের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করে। বাবার ইশারা পেয়ে সাথে সাথে মাসুম বিল্লা দলের ছেলেদের নিয়ে স্লোগান শুরু করে লিয়াকত বিল্লার নামে। সাথে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে ফুসলানো শুরু করে মেহেদীদের।

মুখোমুখি দুটো দল। একদল শান্ত ভঙ্গিতে এড়িয়ে যেতে চাইছে বিরোধী দলটাকে। আর অপর দল পথ আগলে আকাশ-পাতাল ভারী করে তুলছে লিয়াকত বিল্লার জয়ের ধ্বণীতে। আজীজ শিকদার এক পলক লিয়াক বিল্লার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সরে আসতে চাইলে হাত ধরে আটকে দেয় লিয়াকত বিল্লা। আমুদে কন্ঠে বলে,

“আরেহ মেয়র সাহেব যে! যাচ্ছেন কোথায়? আসেন একটু সুখ-দুঃখের আলাপচারিতা করি। অনেক দিন পর দেখা হলো আপনার সাথে। সেই যে লাস্ট নিজের ছেলের জান ভিক্ষা চাইতে আমার বাড়ি গিয়ে পায়ের কাছে হামলে পরেছিলেন এরপর কতদিন হয়ে গেল আপনাকে দেখিনা। বর্তমানে আপনি যতই নিজের ছেলের কথায় উস্কানি পেয়ে আমার বিরোধীতা করতে আসেন। তবুও তো আমার এলাকার মেয়র। আর আমি হলাম একই এলাকার এমপি। একজন সচেতন এমপি হিসেবে আপনার খোঁজ-খবর নেওয়া আমার কর্তব্য। কি বলিস তোরা?”

শেষের প্রশ্নটা নিজের দলের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় লিয়াকত বিল্লা। সাথে সাথে সমস্বরে হৈচৈ করে প্রত্যেকে বলে ওঠে,

“ঠিক ঠিক।”

মেহেদী ফুঁসছে। লিয়াকত বিল্লার প্রতিটা কথা তার ধৈর্যের পারদ গলিয়ে দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত পিষে বাপ-ছেলের দিকে তাকায়। কি বিচ্ছিরি হাসি দুটোর!সহ্য হয়না মেহেদীর। খ্যাঁপা ষাড়ের মতো তেড়ে আসতে নিলেই হাত টেনে ধরে আজীজ শিকদার। গরম চোখে তাকিয়ে ইশারায় পিছিয়ে আসতে বলে মেহেদীকে। নিরুপায় মেহেদী ফুঁস ফুঁস করে শ্বাস নেয় শুধু। বাঁধাগ্রস্থ হয়ে করতে পারেনা কিছু।

মেহেদীকে টেনে নিজের পিছনে সরিয়ে মুখে মুচকি হাসি টেনে লিয়াকত বিল্লার দিকে তাকায় আজীজ শিকদার। শান্ত কন্ঠে বলে,

“দলবল নিয়ে নিশ্চয়ই ভোট চাইতে এসেছেন বুঝতে পেরেছি। হাতে সময় কম। এর মাঝে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাচ্ছিনা। দাওয়াত রইল ভাই। নির্বাচনের পর না হয় একদিন জমিয়ে আলাপচারিতা করা যাবে!”

“জনগণের কাছে হাত পেতে ভোট চাওয়া আপনার মতো দু-টাকার মেয়রের কাজ। আমার বাবার মতো একজন সফল এমপির কাজ না। গিয়েছিলেন তো বর্তমান দলের হয়ে মনোনয়ন চাইতে। লাভটা কি হলো! সেখানেই আমার বাপের কাছে হেরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঘুরছেন-ফিরছেন। কি মনে হয়?বাঘের সাথে লড়ে জিততে পারবেন তো! না কি গো-হারা হেরে হাতে চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকবেন?”

মাসুম বিল্লার কথায় রোল পরে যায় হাসির। শরীর দুলিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে হেসে আজীজ শিকদারকে অপদস্থ করতে মত্ত হয় প্রত্যেকে। ধৈর্যের বাধ ভাঙে মেহেদীর। চোখ রাঙিয়ে এগিয়ে এসে কলার চেপে ধরে মাসুম বিল্লার। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“আর একটা শব্দ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলে তোর জ্বিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব শো’য়’রে’র। তোর বাপ একটা শো’য়’র আর সেই বাপের সন্তান তুই জন্ম নিছিস কু’ত্তা হয়ে। কবে যানি রক্তিম শিকদারের হাতে ম’রে বেওয়ারিশ লা’শের মতো পরে থাকিস রাস্তা-ঘাটে।”

মুহূর্তেই শুরু হয়ে যায় দুই দলের সংঘর্য। হাতাহাতির এক পর্যায়ে দূর থেকে ইটের টুকরো ছুড়ে কেউ আজীজ শিকদারকে টার্গেট করে। দক্ষ হাতের নিশানা হেরফের হয়না। ঠিক আজীজ শিকদারের কপাল ছুঁয়ে মাটিতে পরে ইটের টুকরোটা। সাথে সাথে ঝরঝরিয়ে কপাল বেয়ে গড়িয়ে পরে তাজা রক্ত। ঘটনার আকস্মিকতায় থমকে যায় মেহেদী সহ, রাকিব, জাবির দলের অন্য সব সিনিয়র রাজনীতিবিদরাও। ছোটখাট কথা কাটাকাটি এক পর্যায়ে রূপ নেই বড়সড় দাঙ্গায়। ঝড়ের গতিতে খবর পৌঁছে যায় রক্তিম শিকদারের কানে। যে আজীজ শিকদার অশান্তি হবে বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল বিরোধী দলকে সেই আজীজ শিকদার রুশের তোপে পরে কপাল ফাটিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে। কপাল বেয়ে যে গলগলিয়ে তাজা রক্ত গড়িয়ে পরছে সেদিকে কারো ধ্যান নেই। ব্যস্ত সকলেই বিরোধী দলের আক্রমণ ঠেকাতে। ঠিক সেই মুহূর্তে কোথা থেকে যেন রক্তিম এসে আগলে ধরে আজীজ শিকদারকে। বসিয়ে দেয় নিজের বাইকের পিছনে। রক্তিম, শান্ত দুজনের মাঝে বসিয়ে এক টানে বাইক ছুটিয়ে পৌঁছে যায় নিকটবর্তী হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছোট্ট একটা বেন্ডেজ করে দেয় আজীজ শিকদারের কপালে। যতটা রক্ত ঝরেছে সেই তুলনায় ক্ষত খুব একটা গভীর নই ডাক্তার জানিয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাবাকে শান্তর সাথে বাড়ি পাঠিয়ে নিজে ক্ষতটাস্থলে যেতে উদ্যত হতেই মেহেদী ফোন করে জানায় পুলিশ এসে সামলে নিয়েছে সবটা। কতক্ষণ ফাঁপা হুমকি দিয়ে দুই দলকে শান্ত করে আবারও চলে গেছে পুলিশ। দলের অন্য কারো কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না খোঁজ-খবর নিয়ে নিশ্চিত হয়ে রক্তিম নিজেই বাবাকে পৌঁছে দিতে যায় শিকদার মঞ্জিলে। আজীজ শিকদারের বেন্ডেজ করা কপালের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে রক্তিম। চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে নিজ মনে প্রতিজ্ঞা করে,

“তোমার শরীর থেকে ঝরা প্রতি ফোটা রক্তের শোধ আমি তলব বাবা। যে বা যারা তোমার গায়ে হাত তোলার সাহস করেছে তাদের একটাকেও ছাড়বনা আমি।”

****

বিরোধী দলের আক্রমনে জখম হয়েছে আজীজ শিকদার।কথাটা শিকদার মঞ্জিলে পৌছাতে সময় লাগেনি খুব একটা। বিশাল বড় বাড়িটাই থাকা তিনজন সদস্যই খবরটা শোনার পর থেকে কেঁদে-কেটে অস্থির। বিলাপ জুড়েছে রেহানা বেগম। বুকের ভিতর ভয় জমেছে ছেলের মতো আবার স্বামীকে না হারাতে হয়।বাড়ির সহকর্মী কাকলির মা, ইতি দুজন মিলেও শান্ত করতে পারছেনা রেহানা বেগমকে। এমন পরিস্থিতির মাঝেই রক্তিম আজীজ শিকদারকে নিয়ে উপস্থিত হয় শিকদার মঞ্জিলে। স্বামীর মাথায় বেন্ডেজ দেখে আরও ভেঙ্গে পরে রেহানা বেগম। পাশে দাঁড়ানো রক্তিমকে দেখে শোকটা যেন পরিণত হয় ক্রোধে। স্বামীকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি রক্তিমের সামনে গিয়ে দুই হাতে একের পর এক এলোমেলো চড় বসিয়ে বলতে থাকে,

“তুই খু’নি। শুধু খু’নি না একটা রা’ক্ষ’স তুই। দশ মাস পেটে ধরে এক রা’ক্ষ’স জন্ম দিয়েছি আমি। প্রথমে আমার ছেলেকে খেয়েছিস। এখন আমার স্বামীর দিকে নজর দিয়েছিস!আগে যদি জানতাম বড় হয়ে এমন রাক্ষসে পরিণত হবি তুই সেই আতুর ঘরেই গলা টিপে মে’রে ফেলতাম তোকে। কেন করছিস? কেন করছিস আমার সাথে এমন? কি ক্ষতি করেছি আমি তোর? কেন আমার সব সুখ কেড়ে নিচ্ছিস তুই? তোকে জ’ন্ম দেওয়াই আমার পাপ হয়েছে। সবথেকে বড় পাপ করেছি তোর মতো কু’লা’ঙ্গার জন্ম দিয়ে।”

স্ত্রীর এমন পাগলামিতে ধমকে ওঠে আজীজ শিকদার। কাজ হয় না কোনো। ধমকে যেন রেহানা বেগম আগের থেকেও আরও ক্ষিপ্র হয়ে ওঠেন। অবলীলায় একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছেন রক্তিমের গায়ে। মায়ের সকল আঘাত, অভিযোগ চোখ বুজে সহ্য করে নেই রক্তিম। একটা টু শব্দ পযর্ন্ত করেনা। ইতি, আজীজ শিকদার দুজন মানুষ টেনেও ছাড়াতে পারেনা রেহানা বেগমকে। দুর্বল শরীরটাতেই যেন কোনো এক অদৃশ্য অ’শু’র বস করেছে।

আজীজ শিকদারের খোঁজ নিতে ঘটনা স্থল থেকে ছুটে এসেছিল মেহেদী। শিকদার মঞ্জিলে পা দিয়েই চোখের সামনে এমন একটা দৃশ্য দেখে থমকে যায় মেহেদী। রুদ্ধশ্বাসে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ছুটে আসে রক্তিমের কাছে। তিনজন মানুষের শক্তির কাছে অবশেষে হার মানতে হয় রেহানা বেগমকে। মায়ের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায়না রক্তিম। মাথা নিচু করেই বেরিয়ে যায় বাড়ি ছেড়ে। পিছন থেকে আজীজ শিকদার অসহায় কন্ঠে ডাকে ছেলেকে। ফিরে তাকায়না রক্তিম।

চলবে…..

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-৮+৯

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৮
#আদওয়া_ইবশার

ভাইয়ের মাথার কাছে বসে চুলে আলতো হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে ইতি। একটু দূরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অপলক চোখে ইতির সেই কান্না দেখে যাচ্ছে মেহেদী। আজ কতদিন পর প্রিয় মুখটা দেখতে পাচ্ছে সে! তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো প্রেয়সীর অশ্রুসিক্ত মুখ দেখেই তৃষ্ণা নিবারণে ব্যস্ত। মেয়েটা যে ভাইয়ের শোকে কান্নায় অস্থির সে কান্নাটুকু চোখে পরছেনা মেহেদীর।একদম কাটায় কাটায় সাতদিন হয়ে গেছে রক্তিম হাসপাতালে এডমিট। যে ছেলে মেডিসিনের তীব্র গন্ধে এক ঘন্টা স-জ্ঞানে হাসপাতালে টিকতে পারেনা সেই ছেলে আজ টানা সাতদিন যাবৎ দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে পরে আছে হাসপাতালের বেডে। সেটাও শুধুমাত্র আজীজ শিকদারের শর্তে। সেদিন ছেলের মুখে আগামী নির্বাচনে এমপি পদে দাঁড়ানোর কথা শুনে কিছুক্ষণ ভেবে শর্ত জুড়ে দেয় কয়েকটা। প্রথম শর্ত ছিল যতদিন ডাক্তার বলবে ততদিন রক্তিমকে হাসপাতালে থাকতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। উত্তরে রক্তিম কিছুক্ষণ মৌন থেকে প্রথম শর্তে রাজি হয়েছিল। সাথে এটাও জানিয়ে দিয়েছিল দ্বিতীয় শর্তে দুনিয়া উল্টে গেলেও সে রাজি হবেনা। নিরুপায় হয়ে তখন আজীজ শিকদার মেনে নেই। ছেলে তার হাসপাতালে থাকতে রাজি হয়েছে এটাই অনেক। অন্যথায় দেখা যেতো জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই বারণ-কারণ না মেনেই চলে যেতো হাসপাতাল ছেড়ে।

একনাগাড়ে কাঁদতে কাঁদতে ইতির মাথা ব্যাথা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরপর নাক টানার শব্দ হচ্ছে। রক্তিম বারবার বারন করা সত্বেও কান্না থামাচ্ছেনা দেখে এবার একটু বিরক্ত হয় সে। তবুও স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

“আমি তো মরে যায়নি ইতু। এতো কান্না কেন করতে হচ্ছে? অসুস্থ হয়ে যাবি এবার।”

ভাইয়ের মুখে মরার কথা শুনে আৎকে ওঠে ইতি। কপট রাগ দেখিয়ে শাসনের স্বরে বলে,

“তুমি কখনো আমাকে একটুও শান্তিতে থাকতে দিবেনা ভাইয়া? সবসময় দুশ্চিন্তায় ফেলে রাখো। এখন আবার আজেবাজে কথা বলছো! এবার কিন্তু তোমার প্রতি খুব রাগ হচ্ছে আমার।”

বোনের রাগ দেখে অল্প হাসে রক্তিম। বলে,

“ঠিক আছে। আর উল্টাপাল্টা কিছু বলবনা। তবুও এবার কান্না থামা। আমি এখন একদম ঠিক আছি। অনেক্ষন হয়ে গেছে এসেছিস। বাড়ি যা এবার। মা দুশ্চিন্তা করবে তোকে নিয়ে।”

মায়ের কথা স্বরণ হতেই আরও এক দলা বিষাদ এসে ইতির মনে ভীর করে। বুঝে পায়না সে তাদের মা এতো হারামি কিভাবে হলো? সন্তানের এমন মরন দশা শুনেও কোনো মা পারে বুকে পাথর বেঁধে ঘরে বসে থাকতে! অন্য কোনো মা না পারলেও তাদের মা পেরেছে। ইতি যখন গিয়েছিল রেহানা বেগমকে জিজ্ঞেস করতে হাসপাতালে আসবে কি না, তখন রেহানা বেগম অত্যন্ত শীতল কন্ঠে উত্তর দিয়েছিল, “মরে গেলে খবর দিও। শেষ দেখা দেখে আসব।” মায়ের জবাবে বুক কেঁপেছিল ইতির। বিস্ফোরিত নয়নে টলমলে অশ্রু নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল মায়ের দিকে। খোঁজে পায়নি কিছু বলার ভাষা। সেই হৃদয়হীন, পাষাণ মায়ের কথা মনে পরতেই অভিমানে ফেঁপে ওঠে অষ্টাদশী ইতির মন জমিন।

“ঐ পাষাণ মহিলার কারো জন্য কোনো দুশ্চিন্তা হয়না। যাবনা আমি বাড়িতে এখন।”

বোনের অভিমানী কথায় আবারও একটু হাসে রক্তিম। তবে এবারের হাসিটা ছিল বেদনামিশ্রীত ক্লেশের হাসি। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। কিছুটা উদাস চিত্তে জবাব দেয়,

“এভাবে বলতে নেই ইতু। মা তো মা’ই হয়। মা আবার কখনো পাষাণ হতে পারে না কি? ওনি আমাদের দশ মাস গর্ভে ধরে যে যন্ত্রণা সহ্য করে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন তার ঋণ এই তো আমরা দিতে পারবনা। পাষাণ কিভাবে বলি সেই মানুষটাকে? ওনি ওনার দিক থেকে একদম ঠিক। আমাকে নিয়ে অযথা ওনাকে কষ্ট দিস না। তুই ছাড়া বর্তমানে মা’কে দেখে রাখার কেউ নেই।সেই তুই এই যদি ওনাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলিস তাহলে যাবে কোথায় ওনি?”

উত্তরে কিছু বলেনা ইতি। শুধু নিরবে অশ্রু ঝরে যায় আবারও পল্লব বেয়ে। হাসপাতালে আরও কিছুটা সময় একান্তে ভাইয়ের সাথে কাটানোর পর ইতিকে মেহেদীর সাথে পাঠিয়ে দেয় রক্তিম বাড়ি যাবার জন্য। মন না চাইলেও ভাইয়ের বারণে আর থাকতে পারেনা ইতি। ইতিকে দেখার পর থেকেই একটু কথা বলার জন্য হাঁসফাঁস করছিল মেহেদী। কিন্তু রক্তিমের ভয়ে তার ধারেকাছে যাবার সাহস টুকুও করতে পারেনি। শুধু দূর থেকেই ব্যকুল নয়নে অপলক দেখে গেছে প্রেয়সীকে। এবার বাড়ি পৌঁছে দেবার উছিলায় একান্তে ইতিকে একটু কাছে পাবার সুযোগ পেয়ে খুশিতে নেচে ওঠে মেহেদীর মন। প্রফোল্ল চিত্তে ইতিকে ঠিকঠাক পৌঁছে দিবে বাড়িতে এই বলে বন্ধুকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।

ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাত ধরে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে দুজন। কারো মুখে কোনো রা নেই। মেহেদীর প্রেমিক হৃদয় ব্যকুল হয়ে যাচ্ছে প্রেয়সীকে কিছু বলতে। কিন্তু কি থেকে কি শুরু করবে ভেবে পায়না। অবশেষে ইতির কান্নার দরুন ফুলে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে এগিয়ে দেয় তার দিকে। একটু অবাক হয় ইতি। হাঁটা থামিয়ে চোখ তুলে তাকায় মেহেদীর দিকে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায়,

“কি?”

একটু বিচলীত বোধ করে মেহেদী। জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বলে,

“চোখের পানি, নাকের পানি একাকার হয়ে মুখের দশা কি হয়েছে দেখেছো? লোকে দেখলে নির্ঘাত কোনো ভূত ভেবে ভয়ে স্টোক করে বসবে। রুমালটা দিয়ে মুখ মুছে নাও”

মেহেদীর কাঁচুমাচু মুখের পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইতি। তর্জনীর সাহায্যে নাক ঘষে দৃষ্টি ফিরিয়ে পূণরায় হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয়,

“লাগবেনা। ধন্যবাদ।”

অসহায় নয়নে ইতির যাবার পানে তাকায় মেহেদী। পরপর নিজেও হেঁটে ইতির পাশাপাশি গিয়ে খপ করে ডান হাতটা নিজের বা হাতের মুঠোয় পুড়ে নেয়। রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে,

“আর হাঁটতে হবেনা। দাঁড়াও রিকশা ডেকে নিচ্ছি।”

“দুটো ডাকবেন।” ইতির কথা বুঝতে না পেরে জানতে চায় মেহেদী,

“হু!”

“রিকশা দুটো ঠিক করতে বলেছি।”

“কেন?”

“কারণ আপনার সাথে এক রিকশায় যাবনা আমি।”

কাটকাট স্বরে জবাব দেয় ইতি।হতাশ হয়ে মাথা নাড়ায় মেহেদী। ফুস করে দম ছেড়ে বলে,

“এক জিনিস নিয়ে কতদিন এভাবে রাগ করে থাকা যায়? তোমার কি মনে হচ্ছেনা এবার একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে!”

জবাব দেয়না ইতি। শক্ত মুখে শুধু তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে। নিরুপায় হয়ে মেহেদী দুটো রিকশায় ঠিক করে। একটাতে ইতিকে উঠিয়ে দিয়ে অন্য রিকশায় নিজে ওঠে পিছু পিছু যায় ইতির।

শিকদার মঞ্জিলের সামনে রিকশা থামতেই পিছু না তাকিয়ে সোজা বাড়ির ভিতর চলে যায় ইতি। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে মলিন মুখে ভাড়া মিটিয়ে উল্টো পথে হাঁটা ধরে মেহেদী। তখনই শুনতে পায় পিছন থেকে ইতির কন্ঠ,

“এই সামরিক বিচ্ছেদ এখন সইতে পারছেন না। তবে চিরস্থায়ী বিচ্ছেদ কিভাবে সহ্য করবেন?”

প্রশ্ন শুনে পিছনে ঘুরে তাকায় মেহেদী। চোখে ভাসে ইতির অশ্রুসিক্ত নয়ন। কাঁপন ধরে বুকে। অবাক হয় মেহেদী। আশ্চর্য তো! কতক্ষণ আগেই তো এই মেয়েটার চোখে ভাইয়ের জন্য অশ্রু দেখল। কই, তখন তো এভাবে মেহেদীর বুকে কাঁপন ধরেনি প্রেয়সীর অশ্রুসিক্ত চোখ দেখে। তবে এখন কেন এমন হচ্ছে? ঐ সু-নয়নার গভীর দুই চোখে এখনকার অশ্রুটুকু তাকে ঘিরে বলেই কি এমনটা হচ্ছে? হবে হয়তো এমন কিছু একটাই। মেহেদীকে ভাবনার সাগরে বুদ হয়ে থাকতে দেখে আবারও বলতে শুরু করে ইতি,

“আমার ভাই আমার বাবা কেমন মানুষ, আমাকে নিয়ে তাদের কেমন চিন্তা সেটা নিশ্চয়ই তুমি খুব ভালো করেই জানো। ওরা কোনোদিন তোমাকে মেনে নিবেনা। এখন হয়তো বলতে পারো আমার ভাই তো তোমার থেকেও দুই ধাপ এগিয়ে। তার সাথে থেকেই তুমি এমন হয়েছো। তবে কেন মেনে নিবেনা!উত্তরটা আমিই বলে দিচ্ছি। তোমার যে একটা ছোট বোন আছে তুমি কখনো চাইবে সেই বোনটাকে তোমার মতো কোনো এক বাউন্ডুলে ছেলের সাথে বিয়ে দিতে? নিশ্চয়ই চাইবেনা। ভাইয়েরা নিজেরা হাজার খারাপ হলেও বোনের জন্য সবসময় বেস্ট কাওকেই খোঁজে। যাতে তার বোনটা সমাজের চোখে মাথা উচু করে বাঁচতে পারে। কোনো দুঃখ, কষ্ট যেন বোনকে এসে ছুঁয়ে যেতে না পারে। আমার ভাইও তেমনটাই চাইবে। আর বাবা! তার কথা না হয় বাদই দিলাম। এই সহজ সত্যি গুলো আমি জানি তুমিও জানো। কেউ কখনো মানবেনা আমাদের এই অসম সম্পর্ক। তবে কেন শুধু শুধু মায়ার গভীরে তলিয়ে গিয়ে বিচ্ছেদের যন্ত্রণাটা আরও গাঢ় করব? তার থেকে এটাই ভালো হবেনা এখন থেকেই একটু একটু দূরে সরে গিয়ে বিচ্ছেদের যন্ত্রণাটা সইয়ে নেওয়া!”

এক জায়গায় জড় বস্তুর মতো ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে মেহেদী। বলার মতো কিছুই খোঁজে পায়না। ছলছল নয়নে ইতি কিছুক্ষণ মেহেদীর দিকে তাকিয়ে থেকে জবাব না পেয়ে এক ছুটে চলে যায় বাড়ির ভিতর। ঠিক তখনই অনুভব হয় মেহেদীর বুকের ভিতরে চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে। আস্তে করে ডান হাতটা বুকের কাছে নিয়ে চেপে ধরে। পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে বিরবির করে উচ্চারণ করে,

“তোমার সাথে বিচ্ছেদের আগে মরন হোক আমার। ঐ বিচ্ছেদের হৃদয়পোড়া যন্ত্রণার থেকে বোধ করি মৃত্যু যন্ত্রণা সহজ হবে আমার জন্য।”

****
পনেরো দিনের মাথায় পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে নিজের ঠিকানায় ফিরে এসেছে রক্তিম শিকদার তার সেই চিলেকোঠার মতো ছোট্ট রুমটাতে। কেটে যায় আরও কিছু সময়। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। জনগণের দোরগোড়ায় খবর পৌঁছে গেছে মেয়র আজীজ শিকদার এবার এমপি পদে নির্বাচন করবেন। শহরের আনাচে কানাচে প্রতিটা চায়ের স্টল, মোদি দোকান সব জায়গায় গরম গরম চায়ের কাপ হাতে বৃদ্ধ থেকে শুরু করে তরুণ যুবক দলের মুখেও নির্বাচনী সমাচার। টানটান উত্তেজনা ছড়িয়ে পরেছে এখনই সবার মাঝে। আজীজ শিকদারকে এমপি হিসেবে পাশে পাবে খবরটাই জনগণ যতটা খুশি তার থেকেও দ্বিগুণ উত্তেজিত এটা ভেবে লিয়াকত বিল্লার সাথে টক্কর দিয়ে আদও আজীজ শিকদার জিততে পারবে কি না। এই উছিলায় আবার না শান্তিপূর্ণ সাভারের রাজপথে রক্তের বন্যা বয়ে যায়। লিয়াকত বিল্লা কেমন কুটিল মনস্কের মানুষ এটা এলাকাবাসী কম বেশি সকলেই জানেন। সব জেনেও চুপ থাকে শুধু ক্ষমতার দাপটে কেউ পেরে উঠবেনা বলে। তবে এবার যেহেতু রক্তিম শিকদার নিজে তৎপর হয়ে লিয়াকত বিল্লার বিরুদ্ধে নিজের বাবাকে নির্বাচনে দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেই ভিত্তিতে মনের কোণে অল্প হলেও আশার আলো জ্বলছে সকলের। এবার শুধু অপেক্ষা লিয়াকত বিল্লার পতন দেখার।

****
সেদিন রক্তিমের এতো বড় একটা দুর্ঘটনার খবর শোনার পর চাইলেও ছুটে যেতে পারেনি দৃষ্টি রক্তিমের কাছে। শুধু গুমরে মরেছে সর্বক্ষণ রক্তিমের চিন্তায়। আবেগী মন লুকিয়ে লুকিয়ে কত রাত যে নির্ঘুম কেঁদে কাটিয়েছে সেই হিসেব হয়তো বেখায়ালী দৃষ্টির’ও অজানা। তার প্রতিটা দীর্ঘশ্বাস নিরব বাতাসকে জানিয়ে দিতো রক্তিমের জন্য কতটা হাহাকার তার বক্ষমাঝে। নিজের মনের উচাটন পরিবারের চোখে ফাঁকি দিয়ে সামলেছে দৃষ্টি নিজেই। অবচেতন মন তার বারবার সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি জানিয়েছে, খুব দ্রুত শেষ হোক এই আগুনের দিন। এক পশলা প্রশান্তি নিয়ে ঝুম বৃষ্টি নামুক তার শহরে অতি সত্তর।

দৃষ্টির সেই আর্জি শুনেছে বিধাতা মাস তিনেক পর। মানসিকতা, আধ্যাত্মিক অশান্তি সঙ্গে নিয়ে কোনোমতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে দৃষ্টি। এরপরই মরিয়া হয়ে ওঠেছে আবারও খালার বাসায় বেড়াতে যাওয়ার জন্য। মেয়ের এমন বেড়াতে যাবার জন্য ব্যাকুলতা দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছেন সাদেক সাহেব, দিলশান আরা দুজনেই। যখন দেখল মেয়ের সাথে ছেলেটাও পাগল হয়ে আছে খালার বাড়ি বেড়াতে যাবার জন্য তখন নিরুপায় হয়ে সাদেক সাহেব কাজের এক ফাঁকে ছেলে-মেয়ে দুটোকে দিয়ে আসেন ঢাকায়। তাদের গাড়িটা সাভার ঢোকার সাথে সাথেই দৃষ্টির ব্যকুল নয়ন জোড়া জানালার কাচ গলিয়ে রাস্তার আনাচে-কানাচে খোঁজে গেছে রক্তিমের গম্ভীর্যতায় ঘেরা কঠোর মুখটা। কিন্তু পায়নি কোথাও। খালার বাসায় পৌঁছনোর পরও এক জায়গার স্থির হতে পারেনি দৃষ্টি। ধুপপুক মনে শুধু খোঁজে গেছে বাইরে যাবার সুযোগ। তার এই অস্থিরতা বাইরে থেকে কেউ দেখে লক্ষ্য করতে না পারলেও ঠিক তুসী লক্ষ্য করে। কারণ দৃষ্টির এমন ব্যকুল হয়ে ঢাকায় ছুটে আসার কারণ সবার কাছে অস্পষ্ট থাকলেও তুসীর কাছে তা একদম জলের মতো পরিষ্কার। একমাত্র রক্তিম শিকদারকে একটা নজর দেখার জন্যই দৃষ্টির এতো দূর ছুটে আসা সেটা অজানা নই তুসীর। তবুও অবাক হয় তুসী। মেনে নিতে পারেনা চোখের দেখায় পরিচিত এক গুন্ডা মাস্তানের জন্য দৃষ্টির এমন অস্থিরতা। তবে কি সত্যিই ভালোবাসা মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়! তুসীর চোখে তো এই মুহূর্তে দৃষ্টিকে একদম নিঃস্বই মনে হচ্ছে। যেন নদীর ভাঙনে সব হারিয়ে একদম সর্বহারা পথিক দৃষ্টি।

ছেলে-মেয়েকে খালার বাসায় পৌঁছে দিয়ে খুব বেশিক্ষন থাকেনি সাদেক সাহেব। ব্যবসার কাজে তাড়া দেখিয়ে ভাই-বোন দুজনকে সাবধানে থাকতে বলে বেরিয়ে পরে আবার ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে। বাবা বিদায় নিতেই দৃষ্টি যেন হাপ ছেড়ে বাঁচে। নিজেকে স্থবির করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“তুই থাক বাসায়। আমি তুসুকে নিয়ে আমাদের এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করে আসি। সেও ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। জানা দরকার তার পরীক্ষা কেমন হয়েছে। কাল তোকে নিয়ে আবার ঘুরতে যাব কেমন!”

বোনের জবাবে দিহান কিছু বলতে যাবে তার আগেই দৃষ্টি তুসীর হাত ধরে এক প্রকার টেনে নিয়ে বেরিয়ে পরে বাসা থেকে। পিছন থেকে শিউলী বেগম হা হুতাশ করেন এতোদূর জার্নি করে এসে একটুও বিশ্রাম না নিয়ে এভাবে বেরিয়ে যাওয়ায়।

প্রায় আধ ঘন্টা যাবৎ অলিতে-গলিতে খোঁজ করেও রক্তিমের সন্ধান পায়না দৃষ্টি। হাঁটতে হাঁটতে হাপিয়ে গেছে তুসী। কিন্তু দৃষ্টির মাঝে ক্লান্তের লেশমাত্র নেই। সে এখনো একমনে রক্তিমকে খোজায় বিভোর। দৃষ্টির হাত টেনে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে বুক ভরে দম ছাড়ে তুসী। হাপাতে হাপাতে বলে,

“আর কতক্ষণ এভাবে খুঁজবি? ওনি হয়তো কোনো কাজে অন্য কোথাও গেছে। এভাবে পুরো দিন খোঁজেও লাভ নেই। চল বাড়ি ফিরে যায়।”

তৎক্ষণাৎ তুসীর কথার বিরোধীতা করে ওঠে দৃষ্টি। অটুট স্বরে বলে,

“না। ওনি এখানেই আছে। খোঁজে বের করবই আমি ওনাকে।”

বিরক্ত হয় তুসী। মুখ দিয়ে ‘চ’ বর্গিয় উচ্চারণ করে বলে,

“আরে ভাই আমার কথাটা বিশ্বাস কর তুই। তোকে তো আমি ওনাকে খুঁজতে নিষেধ করছিনা। সামনে নির্বাচন। ওনার বাবা এমপি পদে দাঁড়াবে। সেই নির্বাচনের প্রচারণার জন্যই হয়তো অন্য কোথাও গেছে।”

ক্ষীণ আশার আলোয় জ্বলজ্বল করা হৃদয় ঝুপ করে আধার নেমে আসে দৃষ্টির। তমসাচ্ছন্ন মুখটা নিচু করে গভীর নিঃশ্বাস ছাড়ে। তার এতো ব্যকুলতা, এতো অস্থিরচিত্তে এই এতো দূর এসে লাভ কি হলো? নিষ্ঠুর পুরুষটার দেখায় পেলনা। কে জানে কোথায় গিয়ে ঘাপটি মেরে আছে ঐ পাষাণ হৃদয়ের মানুষটা। হাতাশায় জর্জরিত হয়ে কান্না পায় দৃষ্টির। দু-চোখের কার্নিশ বেয়ে হয়তো দুই-এক ফোটা অশ্রুও গড়িয়ে পরে। আরও একবার প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বৃদ্ধাঙ্গুলীর সাহায্যে চোখের জলটুকু মুছে নেয় দৃষ্টি। ক্ষীণ স্বরে তুসীকে বলে,

“চল।” দুই-তিন কদম হাঁটতেই হঠাৎ কানে আসে কেউ একজন ভাই বলে কাওকে ডেকে ওঠেছে। তৎক্ষণাৎ পা জোড়া থেমে যায় দৃষ্টির। অস্থিরচিত্তে ফিরে তাকায় ঐ ডাকের উৎস ধরে। ঠিক তখনই চোখে কাঙ্ক্ষিত সেই মুখটা। সাথে সাথেই ভারী হয়ে আসে দৃষ্টির নিঃশ্বাস, চঞ্চলতা বাড়ে চোখে-মুখে। সেই সাথে বাড়ে হৃদয়ে চলা ধিমি আওয়াজ। তাদের থেকে কিছুটা দূরেই একটা চায়ের দোকানের সামনে বাইক থেকে নামছে রক্তিম। উষ্কখুষ্ক চুল তার এলোমেলো। চোখে-মুখে লেপ্টে আছে রাজ্যের ক্লান্তি। বাইক থেকে নেমে দাঁড়াতেই জাবির এক কাপ চা এগিয়ে দিয়েছে রক্তিমের দিকে। সিগারেটে পুড়া ঠোঁট দুটো চায়ের কাপে ডুবিয়ে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টায় রক্তিম। ঠিক তার থেকে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে যে তার প্রেমে মত্ত এক ব্যকুল হৃদয়ের অষ্টাদশী কন্যা তাকে দেখে চোখের তৃষ্ণা নিবারণে মত্ত সেটা কি জানে রক্তিম! মানুষটা আগের থেকে একটু শুকিয়ে গেছে বুঝি! হ্যাঁ, দৃষ্টির চোখে তো তাই মনে হচ্ছে। গভীর নয়নে খুটিয়ে খুটিয়ে নিখুঁত ভাবে রক্তিমের একদম পা থেকে মাথা পযর্ন্ত পরোখ করে নেয় দৃষ্টি। সেই সাথে খেয়াল করে তার হৃৎপিন্ডের ধুকপুক শব্দটা বেড়েই যাচ্ছে। মেসামাল হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাস। কেমন করে কাঁপন ধরছে হৃদয়ে। মুখ হা করে লম্বা লম্বা কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় দৃষ্টি রক্তিমের দিকে। কাছ থেকে দেখে পূণরায় লক্ষ্য করে রক্তিমের বিস্তর পরিবর্তন। ক্লান্তির ছাপটা চোখে-মুখে স্পষ্ঠ রক্তিমের। বাতাসের দাপটে রক্তকিমের এলোমেলো চুল গুলো কপালের ডান পাশেম থেকে উড়ে যেতেই চোখে বিঁধে লম্বা একটা কাঁটা দাগ। এটা বুঝি সেই দুর্ঘটনার সময় হয়েছে ! কেমন তাজা হয়ে আছে দাগটা এখনো। মন্থর গতিতে দু-পা এগিয়ে যায় দৃষ্টি। নিজের খেয়াল ভুলে চিন্তা চেতনার উর্দ্ধে গিয়ে একদম মুখোমুখি দাঁড়ায়। দলের ছেলেদের সাথে কথায় মশগুল রক্তিম নিজের সামনে কাওকে দাঁড়াতে দেখে একটু থামে। দেখতে পায় এক রমনী দৃষ্টিতে কিছু একটা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মেয়েটাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে ঠিক মনে করতে পারছেনা রক্তিম। তার এই ভাবনার মাঝেই অবিশ্বাস্য এক কান্ড ঘটিয়ে দেয় দৃষ্টি। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় রক্তিমের কপালের সেই কাটা জায়গা টুকু। সাথে সাথে বিদ্যুৎ পৃষ্ঠের মতো চমকে দু কদম পিছিয়ে যায় রক্তিম। বিস্ফোরিত নয়নে রক্তিম সহ উপস্থিত সকলেই তাকায় রক্তিমের দিকে।

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৯
#আদওয়া_ইবশার

জানা নেই চেনা নেই এমন একটা মেয়ে এসে হুট করে রক্তিম শিকদারের কপাল ছুঁয়ে দিল বিষয়টা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে সকলের। অত্যাধিক বিস্ময়ে যেন চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ।

“কি চাই?”

কয়েক মুহূর্তের নিরবতা টুকু চূর্ণবিচূর্ণ করে জলদগম্ভীর কন্ঠে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে রক্তিম। ঠিক তখনই যেন চৈতন্যের উন্মেষ ঘটে দৃষ্টির। বুঝতে পারে অজানা এক ঘোরের মধ্যে থেকে কেমন বোকামিটা করেছে। সহসা লজ্জায় মাথা নত করে ফেলে। কয়েক পল সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে মাথা তুলে তাকায় আবার। স্বভাবে চঞ্চলতা এনে জড়তা কাটিয়ে বলে,

“নিশ্চয়ই চিনতে পারেন নি আমাকে! আচ্ছা অসুবিধা নেই। আমিই চিনিয়ে দিচ্ছি।মনে আছে তিন-চার মাস আগে আপনার কাছে এসেছিলাম একটা ছেলে আমাকে বিরক্ত করে সেই বিচার নিয়ে!”

“তা মনে থাকবেনা আবার! ভাইয়ের মনে না থাকলেও আমাদের খুব ভালো করেই মনে আছে তোমাকে।যে হারে বিনা দোষে অপমান করেছো মেয়ে তা এ জন্মে ভোলার নই”

রাকিবের কথায় চোখ ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায় দৃষ্টি। মিটিমিটি হেসে বলে,

“এই না হলে রক্তিম শিকদারের চমচা! আপনাদের কাজই তো হলো রক্তিম শিকদার ঘটিত খুটিনাটি সব কিছু নখদর্পণে রাখা। আপনার কাজে আমি খুবই আপ্লুত মিস্টার চামচা।”

আবার! আবারও এই মেয়ে সয়ং রক্তিম শিকদারের সামনে তার ছেলেদের অপমান করে যাচ্ছে! তাও যে সে অপমান না। একেবারে সরাসরি চামচা পদবিতে অপমান। অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে আছে রাকিবের। মাথা ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দলের অন্য ছেলে গুলোকেও তার অপমানে মিটমিট হাসতে দেখে ফুঁসে ওঠে রাকিব। ঔদ্ধত্য হয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই হাত টেনে আটকে দেয় মেহেদী। মজার ছলে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,

“তা এতোদিন পর কিজন্যে এসেছো? মাঝে যে বিরাট একটা সময় পেরিয়ে গেল সেই সময় টুকুতে তো আমার মনে হয় ঐ ছেলেটার সাথে তোমার ভাব-ভালোবাসা হয়ে একেবারে বিয়ের পিরিতে বসে যাবার কথা।”

মাথাটা অল্প কাত করে লাজুক হাসে দৃষ্টি। রক্তিমের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,

“আপনার মুখে ফুল চন্দন পরোক ভাইয়া। যদি এমন হতো তবে আমার থেকে খুশি বোধহয় আর কেউ হতনা।”

“তারমানে একপাক্ষিক ভাব-ভালোবাসা হয়ে গেছে! তাহলে আবার রক্তিম শিকদারের কাছে কেন এসেছো?”

ভ্রু নাচিয়ে জানতে চায় মেহেদী। এবার একটু তমসা দেখা দেয় দৃষ্টির মুখের আদলে। অভিযোগের স্বরে বলে,

“হোক ভাব-ভালোবাসা। তাই বলে কি ভুলে যাব ঐ লোকটা আমাকে কি পরিমাণ জ্বালিয়েছে? অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ করতে নেই তাইনা ভা-ই-য়া!”

শেষের কথাটুকু রক্তিমের দিকে তাকিয়ে টেনে টেনে বলে দৃষ্টি।এবার যেন রাকিব একটু সুযোগ পেল দৃষ্টিকে নাস্তানাবুদ করার। তাচ্ছিল্যের সাথে বলে ওঠল,

“ইভটিজারের উপর ক্রাশ খাইয়া তলে তলে টেম্পু চালাও আবার ভাইয়ের কাছে আসো বিচার চাইতে? দুই মুখো সাপ তো কয় এই তোমার মতো মাইয়া গুলারেই। আমি বুঝিনা বা’ল ক্যান যে বিজ্ঞানীরা তোমাদের মতো ইচ্ছাধারী রেখে অবলা প্রাণীদের দুই-মুখো সাপ বলে চিহ্নিত করল!”

আবার এই দুটোতে সেই প্রথম দিনের মতো ঝগড়া বেঁধে যাবে বুঝতে পেরে রাকিবকে ঝাড়ি দিয়ে থামিয়ে দেয় মেহেদী। সেই প্রথম দিনের মতো আজও রক্তিম নির্বিকার। চা শেষ করে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে। রক্তিমের হয়ে মেহেদী’ই জানতে চায়,

“আচ্ছা বলো। তা কি শাস্তি চাও সেই ছেলের? আর কে সে? এবার নাম-ঠিকানা জেনে এসেছো তো?”

“শুধু নাম-ঠিকানা নই। একদম হালচাল সবই জেনে এসেছি। তার থেকেও বড় কথা সে এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনেই আছে।”

স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেয় দৃষ্টি। তার এহেন কথায় আবারও অবাক হয় প্রত্যেকে। এখানেই আছে মেয়েটার সামনে! কই এখানে তো তারা ছাড়া আর কেউ নেই। তাহলে কি তাদের মাঝেই কেউ সেই ছেলে! হতবম্ভ হয়ে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে প্রত্যেকে। রক্তিম ও এক নজর নিজের ছেলেদের দিকে তাকায়। সে নারী বিদ্বেষী হলেও তার দলের একটারও যে চরিত্র ঠিকঠাক নেই তা খুব ভালো করেই জানে রক্তিম। এজন্যই মেয়েটার কথা একদম ফেলে দেওয়া যায়না। এই ভেজাল দ্রুত দূর করতে শেষমেশ রক্তিম নিজেই মুখ খুলে,

“কে সেই ছেলে?”

হাত উচিয়ে রক্তিমের দিকে তাক করে দৃষ্টি। তৎক্ষণাৎ যেন ছোটখাট একটা বিস্ফোরণ ঘটে যায় সেখানে। নিরুদ্যম প্রতিটা দৃষ্টি এসে স্থির হয় রক্তিমের দিকে। সেই সাথে রক্তিম নিজেও চমকায়। হাতে থাকা সিগারেট ঠোঁটের কাছে নিতে গিয়েও থেমে যায়। সেসবে কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনা দৃষ্টি। নিজ মনে বলতে থাকে,

“এই লোকটাই আমাকে গত তিনটা মাস যাবৎ বিরক্ত করে যাচ্ছে। আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। সবটুকু শান্তি কেড়ে নিয়েছে আমার জীবন থেকে। রাতের পর রাত শেষ হয়ে যায় এই লোকের চিন্তা আমাকে ঘুমাতে দেয়না। খেতে গেলে গলা দিয়ে খাবার নামেনা। পড়তে বসলে বইয়ের পাতায় তার ছবি ভেসে ওঠে। আমাকে এতো এতো অশান্তির মাঝে ডুবিয়ে রেখে সে ঠিকই নিশ্চিন্তে গুন্ডামি করে বেড়াচ্ছে। আমার প্রতি এতো বড় অন্যায় করে কি ওনি পাড় পেয়ে যাবে? আমি এর বিচার চাই। কঠোর বিচার চাই।”

এতো বড় চমক! এতো বড় ভেলকি বাপ জীবনেও দেখেনি কেউ। মাথাটা কেমন ভনভন করে ঘুরছে। নেশা না করেও মনে হচ্ছে নেশা ধরে গেছে প্রত্যেকের

আবারও বলতে শুরু করে দৃষ্টি,

“প্রেম-ভালোবাসার সংজ্ঞা আমি জানিনা। তাই ঠিকমতো বলতেও পারছিনা আপনার প্রতি আমার এই অদ্ভুত অনুভূতির আসল নামটা কি। যেটা বলতে পারব বা বলতে চাই সেটা হলো আমার আপনাকে প্রয়োজন। একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য, শান্তিতে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য আপনাকে আমার প্রয়োজন। এলাকার সবার কাছে গুন্ডা হিসেবে পরিচিত এই আপনিটা সময়ের সাথে সাথে আমাকে একদম নিঃশেষ করে দিচ্ছেন। আমার জীবনটা খুব বাজে ভাবে আপনি কেন্দ্রিক হয়ে ওঠেছে। আমি নিরুপায়। একদম অসহায় হয়ে আপনার কাছে এসেছি। মনের ভিতর চলা অশান্ত ঝড়টুকু এলোমেলো শব্দে আপনার কাছে ব্যক্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছি। কিন্তু সেটাও পারছিনা। ঠিক কিভাবে কোন শব্দে বললে আপনি আমাকে বুঝবেন তা ভাবতে ভাবতেই মাথার ভিতর সব জট পেকে গেছে। আপনি কি আমার এই এলোমেলো শব্দ গুলোর মাঝে কোথাও আপনার প্রতি আমার হৃদয়ে তৈরি হওনা প্রগাঢ় অনুভূতিটুকু খোঁজে পাচ্ছেন না? যদি পেয়ে থাকেন তবে আমার হাতটা ধরুন। আপনার উষ্ণ স্পর্শে একটু বাঁচার কারণ খোঁজে নিতে দিন আমাকে। বিনিময়ে আজীবন এই ছন্নছাড়া আমিটা আমার ভিতরে জমিয়ে রাখা সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিব আপনাকে। একবার শুধু আমার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরুন! কথা দিচ্ছি কখনো এই হাত ছাড়তে পারবেন না। আমি ছাড়তে দিবনা। শেষ নিঃশ্বাস পযর্ন্ত সবটুকু শক্তি দিয়ে আকড়ে ধরব আপনাকে।”

পূর্ণ দৃষ্টিতে রক্তিমের চোখের দিকে তাকিয়ে এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে থামে দৃষ্টি। ডান হাতটা বাড়িয়ে ধরে রক্তিমের দিকে বুক ভরা আশা নিয়ে। চোখে তার আকুতি। রক্তিম স্থির থাকতে পারেনা আর। দৃষ্টির হৃদয় নিংড়ানো আকুল আবেদন আর অনুভূতিতে ঠাসা চোখের চাহনি কিছুই রক্তিমকে এলোমেলো করতে পারেনা। এই সব কিছু ছাপিয়ে শক্ত, পাষাণ হৃদয়ের মানুষটাকে এলোমেলো করে দেয় এক বিবর্ণ অতীত। দৃষ্টির প্রতিটা কথার তালে রক্তিমের চোখের তারাই স্পষ্ঠ হয়ে ভাসে অতীতের টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি। হাঁসফাঁস লাগে রক্তিমের। হৃদয়ে জ্বালা ধরে। সাথে জ্বলে ওঠে চোখ দুটো। থরথর করে কেঁপে ওঠে পুরুষালী শরীরটা। একটু একটু করে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সে বুঝতে পারে তা। সহসা চোখ দুটো বন্ধ করে সর্ব শক্তি দিয়ে মুঠো করে নেয় হাত দুটো। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় ঘনঘন। সে চায়না। কিছুতেই চায়না ঐ সর্বনাশা অতীত আবার সামনে আসুক। নতুন করে আবার শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত তাজা হোক। মুঠো করে রাখা হাত দুটো দিয়ে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে। পাগলের মতো আশেপাশে তাকায়। রক্তিমের এমন অস্থিরতা ভয় ধরিয়ে দেয় দৃষ্টির মনে। সাথে উপস্থিত রক্তিমের ছেলে গুলোও আৎকে ওঠে। সর্বদা শান্ত মাথায় সব কিছু হেন্ডেল করা রক্তিম শিকদার একবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খ্যাপা রক্তিমে পরিণত হলে কতটা দুর্ভোগ নেমে আসতে পারে তা একমাত্র দৃষ্টি ছাড়া উপস্থিত কারো অজানা নই। অবুঝ দৃষ্টি বুঝতে পারেনা রক্তিমের হঠাৎ এমন আচরণের কারণ। কিছুটা ভয় পেলেও সেই একইভাবে হাতটা বাড়িয়ে রাখে রক্তিমের দিকে। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে মেহেদী। মনের মাঝে অল্প সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে যায় রক্তিমের দিকে। সংকোচ নিয়েই হাত রাখে অশান্ত রক্তিমের কাঁধে। সহসা হিংস্র চোখে পিছু ফিরে তাকায় রক্তিম। কিছুটা ভয় পেয়ে কাধ থেকে হাত নামিয়ে পিছু হটে যায় মেহেদী। আবারও চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় রক্তিম। জোড়ে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নেয় জ্বিভের ডগায়। এতোক্ষন ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা চোখ দুটো নিমিষে একদম স্বাভাবিক, শীতল করে ফিরে তাকায় দৃষ্টির দিকে। সরাসরি রক্তিমের নজর তার দিকে পরায় একটু কেঁপে ওঠে দৃষ্টি। এলোমেলো হয় ভিতরে ভিতরে। বা-হাতে পরনের জামা খামচে ধরে সামলে নেয় নিজেকে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে অটল হয়ে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের শীতল চোখে। তার এমন সাহসে অভিভূত হয় রক্তিম। চরম ভাবে আশ্চর্য হয়ে ভাবে, তার চোখে চোখ রাখার মতো এতো সাহস এই মেয়ে পেল কোথায়। কিন্তু সেটা প্রকাশ করেনা মুখে। ভয়ংকর শীতল কন্ঠে জানতে চায়,

“বাড়ি কোথায়?”

উত্তর দিতে গিয়ে একটু টালমাটাল হয় দৃষ্টি। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে বলে,

“ময়মনসিংহ।”

“এখানে কি?”

“খালার বাসা।”

এবার যেন সবটা সচ্ছ জলের মতোই পরিস্কার হয়ে যায় রক্তিমের কাছে। বিদ্রুপাত্বক হেসে ভাবে, মেয়ে তাহলে কিছুই জানেনা তার সম্পর্কে, তার অতীত সম্পর্কে। জানলে নিশ্চয়ই আগুনের সামনে এসে বলতনা “আমাকে পুড়াও।” ঘাড় নাড়িয়ে ঠোঁট গোল করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রক্তিম বলে,

“আমার এলাকার অতিথির অসম্মান হোক তা আমি চাইনা। বেড়ানো শেষে চুপচাপ লক্ষি মেয়ের মতো বাবা-মায়ের কোলে ফিরে যাবে।”

হিমশীতল কন্ঠে ঠান্ডা হুমকি ছুড়ে বাইকে ওঠে বসে রক্তিম। যেই স্টার্ট দিয়ে এখান থেকে যেতে নিবে ঠিক তখনই শুনতে পায় দৃষ্টির অবিচল কন্ঠ,

“আর যদি না যায় কি করবেন তবে?”

এতোক্ষনের ধরে রাখা মেজাজটা আর ঠিক রাখতে পারেনা রক্তিম। তড়িৎ বাইক থেকে নেমে কোনো আগাম বার্তা ছাড়াই গলা চেপে ধরে দৃষ্টির। দূর থেকে তা দেখে আৎকে ঔঠে তুসী। ফুপিয়ে ওঠে মুখে হাত দিয়ে। বলশালী হাতের বাঁধনে কন্ঠনালী চেপে আসে দৃষ্টির। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায় আকম্মিক আক্রমণে। হিতাহিত জ্ঞান ভুলে আশ্লেষে ফেটে পরে রক্তিম। হুঙ্কার ছুড়ে বলে,

“খুন করে ফেলব একদম। দুটো খুনের রেকর্ড অলরেডি হয়ে আছে। এবার না হয় তিন নাম্বারটাও হয়ে যাবে। জানের মায়া থাকলে আর কখনো আমার সামনে আসবেনা।”

কথাটা শেষ করে এক প্রকার ছুড়ে ফেলে রক্তিম দৃষ্টিতে। গলায় রক্তিমের জানামতে খুব শক্ত করে না ধরলেও দৃষ্টির নাজুক শরীর ঐটুকু আঘাতই নিতে পারেনা। কাশির সাথে চোখ গড়িয়ে পানি পরে অনর্গল। শখের পুরুষের থেকে ভালোবাসার বদলে এমন আঘাত উপহার পাবে কল্পনায় ছিলনা তার। জ্বালা ধরে অন্তঃকরণে। তবুও হাসে দৃষ্টি। হাসি-কান্নার সংমিশ্রণে বলে,

“মারুন। ভালোই হবে আমার। ধুকে ধুকে মরার থেকে না হয় আপনার হাতে একেবারেই মরলাম। এই উছিলায় হলেও তো আপনার একটু স্পর্শ পাব। ভালোবাসার মানুষের হাতে মৃত্যু সবার ভাগ্যে জুটেনা। আমি না হয় হলাম সেই ভাগ্যবতী। যার মরন অস্ত্র হবে ভালোবাসা।”

চলবে….

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-৬+৭

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৬
#আদওয়া_ইবশার

অত্যধিক বিস্ময়ে হেঁচকি ওঠে যায় দৃষ্টির। চোখ দুটো গোলগোল মার্বেলের মতো আকৃতি করে ফোনের দিকে তাকিয়ে সমান তালে হেঁচকি দিয়ে যাচ্ছে। রক্তিম শিকদার তার ম্যাসেজের এমন একটা রিপ্লাই দিবে এটা কি আদও সম্ভব! এতোদিন যে শুনে এলো রক্তিম শিকদার প্রথম স্ত্রী হারিয়ে সর্বদা নারী জাতির থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলে। তবে কি সে কথা মিথ্যে? ভাবনার আকুল সাগরে ডুবে থাকা দৃষ্টির ধ্যান ভঙ্গ হয় ছোট ভাই দিহানের কথায়। বোনের রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল দিহান। তখনই দেখতে পায় হেঁচকির তোড়ে বোনের বেহাল দশা। ঝটপট রুমে প্রবেশ করে জানতে চায় দিহান,

“কি ব্যাপার আপু! তুমি না কি শিবলীদের ছাদ থেকে আচার চুরি করে খেয়েছো? আম্মু কি তোমাকে আচার বানিয়ে খাওয়ায় না? না খাওয়ালে আমাকে বলতে আমি বাজার থেকে কিনে এনে খাওয়াতাম। শুধু শুধু কেন চুরি করে মানসম্মান ডুবাতে গেলে?”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় দৃষ্টি। থম ধরে বসে থেকে মনে করার চেষ্টা করে সে কখন শিবলীদের ছাদে গেল আর কখন আচার চুরি করে খেল? তার জানা মতে সে তো আজ সারাদিন ঘর থেকেই বের হয়নি। তবে আচার কখন চুরি করল!,

“আমি কখন আচার চুরি করে খেলাম? এই কথা কে বলেছে তোকে? ঐ বুড়ি সফুরা খানম?”

প্রশ্নটুকু করে একটু থামে। কিছু একটা ভেবে বিরক্তি প্রকাশ করে আবারও বলে,

“আমি বুঝিনা ঐ বুড়ির কিসের এতো দন্দ আমার সাথে! এক পা কবরে চলে গেছে এখনো কূটনামি কমায়নি। হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ের সাথে লেগে থাকে সবসময়।”

সে কথার কোনো জবাব দেয়না দিহান। জানতে চায়,

“হেঁচকি কমে গেছে?”

হেঁচকির কথা মনে হতেই সাথে মনে পরে ভাইয়ের আগমনে রক্তিম শিকদারের ঘটনা পুরোটাই মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিলো কিছুক্ষণের জন্য। আশ্চর্য হয় দৃষ্টি। বিস্মিত চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে ওমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা কিভাবে তার মাথা থেকে সরে গেল। তাও এক লহমায়,

“হ্যাঁ কমে গেছে। কিন্তু কিভাবে?”

বুক ফুলিয়ে হাসে দিহান। শার্টের কলার ঝাকিয়ে বলে,

“দেখেছো তোমার ভাই কত বড় ম্যাজিসিয়ান! এক চুটকিতে তোমার হেঁচকি হাওয়া করে দিয়েছি।”

কথা শেষ করে প্রফুল্ল চিত্তে হেলতে দুলতে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। তাজ্জব বনে তখনো ঠাই বসে থাকে দৃষ্টি। কিছু সময় পর নিজেকে ধাতস্থ করে ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবে। পরপর ঝটপট হাতে একটা বার্তা পাঠিয়ে দেয় রক্তিমের নাম্বারে,

“কে আপনি?”

আবারও দৃষ্টিকে অবাক করে দিয়ে ঐপাশ থেকে ফিরতি জবাব আসে,

“যার জন্য তুমি পাগল হয়ে আছো আমি সেই পুরুষ সুন্দরী।”

না। এটা কিছুতেই সম্ভব না। এ রক্তিম হতে পারেনা। বার কয়েক মাথা ঝাকায় দৃষ্টি। ভাবে হয়তো ঐদিন রক্তিম তাকে অন্য কারো নাম্বার দিয়ে বোকা বানিয়েছে। না হয় রক্তিমের ফোন অন্য কারো হাতে। রক্তিম শিকদার কখনো তার ব্যক্তিত্বের বাইরে গিয়ে এমন রিপ্লাই দিতে পারেনা। প্রশ্নই আসেনা।

****
অগোছালো ছোট্ট একটা রুম। আসবাব বলতে আছে কেবলমাত্র একটা ছোট্ট খাট একটা টেবিল আর একটা আলনা। বিছানা এলোমেলো। আলনায় পুরুষ মানুষের কয়েকটা শার্ট, প্যান্ট। সেগুলোও ভাজহীন অগোছালো করে রাখা। টেবিলের উপর একটা প্লেট, একটা গ্লাস, একটা জগ। সাথে একটা খাবারের বক্স। এই ছোট্ট কবুতরের খোপের মতো এক রুমের বাসাটাই রক্তিমের শিকদারের দিন শেষে মাথা গুজার স্থান। গত দুটো বছর যাবৎ এখানেই কাটছে তার প্রতিটা নির্ঘুম রাত। হাতে গুণা কয়েকটা জিনিস আর চারপাশের দেয়াল গুলো জানে রক্তিমের এক একটা দীর্ঘশ্বাসের গল্প।

এলোমেলো বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে রক্তিম। চোখ দুটো বন্ধ। পাশেই উদাস চিত্তে এক হাটু মুড়িয়ে আধশোয়া হয়ে আছে মেহেদী। নিচে মেঝেতে রাকিব, জাবির,শান্ত একেকজন একেক ভঙ্গিমায় শুয়ে, বসে। কতক্ষণ পরপর শোনা যাচ্ছে তাদের চাপা স্বরের গুঞ্জন। আচমকা রক্তিমের বন্ধ চোখের পল্লব আলগা হয়। অলস ভঙ্গিমায় ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় মেহেদীর দিকে। ভরাট কন্ঠে বিরক্তির মিশেলে বলে,

“তোর গালে কি মাম্প হয়েছে?”

কিছু একটা ভাবনায় মগ্ন ছিল মেহেদী। হুট করে এমন একটা প্রশ্নে একটু চমকায়। পরোক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,

“না। হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করলি কেন?”

“মেয়েদের মতো গাল ফুলিয়ে বসে আছিস কেন তবে?”

প্রলম্বিত এক নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে মেহেদীর বুক চিরে। মনে মনে বলে,

“সেই কারণ যদি জানতি, তবে এতোক্ষণে হয়তো তোর সাথে আমার সম্পর্কের সমীকরণটা এমন থাকতনা। হয় আমাদের বন্ধন আরও মজবুত হতো না হয় একেবারে ছিন্ন হতো।”

ভাবনায় এটা থাকলেও মুখে উত্তর দেয় অন্য কথা,

“তেমন কিছুনা। এমনিতেই ভালো লাগছেনা। আব্বা আজকেও চিল্লাপাল্লা করেছে কতক্ষণ, কেন কোনো চাকরি করিনা, দোকানেও বসিনা। ভালো লাগেনা এসব।”

জবাবে মৌনতাকে বেছে নেয় রক্তিম। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বন্ধুর বিষন্ন মুখের দিকে। দুনিয়ায় যদি কোনো ব্যক্তি থেকে থাকে যে রক্তিম শিকদারকে একটু হলেও বুঝে। চেষ্টা করে তার ভিতরে থাকা কষ্ট গুলোকে কিন্চিৎ হলেও কমাতে। তবে সে ব্যক্তি হলো এই মেহেদী নামের ছেলেটা। যেখানে নিজের মা’ও রক্তিমকে দূরে ঠেলে দিয়েছে সবার মতো। সেখানে এই বোকা ছেলেটা বন্ধুত্বের দায়ে থেকে গেছে তার সাথে। ঢাল হয়ে পাশে থাকে প্রতিটা দিন। বাবা-মায়ের হাজার নিষেধ বারণ সত্বেও গুন্ডা বন্ধুর সঙ্গ ছাড়েনি। বরং সে নিজেও তার সাথে থেকে সাধারণ মানুষের কাছে হয়েছে গুন্ডা।

“খারাপ কি বলে? করছিস না কেন কিছু? বাপের একমাত্র ছেলে হয়ে চাকরি না কর। অন্তত বাপের ব্যবসায় হাত লাগা। অযথা আমার মতো এক খুনি, মাস্তানের পিছনে ঘুরে নিজের জীবন নষ্ট করিস না।”

মুহূর্তি শান্ত মেজাজটা খিঁচিয়ে ওঠে মেহেদীর। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,

“আমি আমার বাপ মায়ের একমাত্র সন্তান। সেজন্য আমাকে হয় চাকরি করতে হবে নাহয় বাপের ব্যবসা সামলাতে হবে। আর তোর বাপের তো গোয়াল ভর্তি ছানা তাইনা? এজন্য তোর এসবে কোনো টেনশন নাই। তোর বাপ-মায়েরও নাই। তোর বাপের সব কিছু দেখভাল করার জন্য তো গোয়ালভর্তি ছানা আছেই। তোর গুন্ডামি করে বেড়ালেও চলবে।”

বাবা-মায়ের কথা স্বরণ হতেই একটু অন্যমনস্ক হয় রক্তিম। ধূর্ত চোখের কুচকুচে কালো মনি দুটো একদম স্থির। কন্ঠ অত্যন্ত শীতল রেখে উত্তর দেয়,

“ছিল তো। গোয়াল ভরা না থাকলেও একটা ছিল। যাকে নিজের হাতে মেরে খুনি হয়েছি আমি। খুনিরা কখনো কোনো মানুষের দায়িত্ব নিতে পারেনা। কিন্তু তুই তো আর খুনি না। তোর এভাবে আমার সাথে থাকা মানায় না।”

চোখ-মুখ খিঁচিয়ে নেয় মেহেদী। এই ভাই-বোন দুটো পেয়েছে টা কি তাকে? একজন দুপুরে এক নাটক করে মাথা ব্যথা বানিয়ে দিয়েছে। সেই ব্যথা সাড়াতে এসেছে একটু নিরিবিলি নিজের মতো থাকতে সেটাও হতে দিলনা তার ভাই। মেজাজ খিঁচিয়ে চওড়া গলায় খ্যাঁকিয়ে ওঠে মেহেদী,

“বা’লে’র কথা কইয়োনা আমারে। তোমার এই কথা শুনতে শুনতে কানের পোকা সব মরে গেছে আমার। নিজে যেটা পারবেনা সেটা নিয়ে অন্য মানুষরে জ্ঞান দিতে আসবে। যত্তসব ভন্ডামি।”

মেহেদীকে রাগে ফুসতে দেখে শুকনো হাসে রক্তিম। শোয়া থেকে ওঠে বসে। বালিশের নিচ থেকে সিগারেট বের করে একটা বাড়িয়ে দেয় মেহেদীর দিকে। অন্য দিকে ফিরে থমথমে মুখে হাতে বাড়িয়ে সিগারেট নেয় মেহেদী। পুড়ো ঠোঁটের ভাজে সিগারেট রেখে লাইটার দিয়ে আগুন ধরায় রক্তিম। কাজটা করার ফাকে এক পলক দেখে নেয় নিচে বসে থাকা তিনজনকে। এক টান দিয়ে নাক মুখ দিয়ে ধোয়া উড়াতে উড়াতে গমগমে স্বরে জানতে চায়,

“তিন মাথা একসাথে করে কি রাজকার্য করছিস?”

প্রশ্নটা কানে যেতেই হুড়মুড়িয়ে তিন মাথা আলাদা করে ছিটকে বসে তিনজন। রাকিব বোকা হেসে মাথা চুলকে বলে,

“কিছুটা ভাই।”

রাকিবকে অস্বীকার যেতে দেখে পাশ থেকে ফট করে জাবির বলে দেয়,

“আমাদের রাকিব ভায়া আবার নতুন প্রেমিকার সন্ধান পাইছে ভাই। তাও আবার পাখি নিজে থেকে এসে ধরা দিছে। আহ! কি সেই মাখো মাখো প্রেমকথন!”

একটু থমকায় রক্তিম। আচমকা শক্ত হয়ে ওঠে চোখ-মুখ। চোয়াল শক্ত করে শানিত কন্ঠে বলে,

“কতবার বলেছি ঐসব ছলনাময়ীর পাল্লায় পরবিনা কেউ। এরা কাল সাপের থেকেও ভয়ংকর হয়। একেবারে বরবাদ করে দেয় পুরুষের জীবন।”

পাশ থেকে তৎক্ষণাৎ জবাব দেয় মেহেদী,

“সব মেয়ে এক হয়না। যদি এক রকম হতোই তবে তোর আর আমার মা এখনো নিজের কথা না ভেবে স্বামীর সংসারে পরে থাকতনা হাজার ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে।”

খাটের হেডবোর্ডে হেলান নিয়ে আবারও চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় রক্তিম। দম ছাড়ে বুক ফুলিয়ে। জলন্ত সিগারেট আঙুলের ভাজে নিয়ে সেই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়েই কপাল চুলকাতে চুলকাতে বলে,

“কাচ যেমন ভাঙলে জোড়া লাগেনা। তেমন বিশ্বাস ও একবার একবার ভেঙ্গে গেলে আর কারো প্রতি তৈরী হয়না। নারী জাতির কাছে একবার যে ঠকে সে জানে এরা কতটা ভয়ংকর।”

“তোর বিশ্বাস ভেঙেছে কিন্তু আমাদের তো ভাঙ্গেনি। তবে আমরা কেন নারী বিদ্ব্যেশি হব?”

লম্বা দুটো দিয়ে সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশটুকু ফিল্টারে ফেলে মেহেদীর দিকে তাকায় রক্তিম। গম্ভীর চোখ দুটো অপলক রেখে শান্ত অথচ অত্যন্ত ধারালো স্বরে জানতে চায়,

“তোর সত্যিই বিশ্বাস আছে নারী জাতির উপর? বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবি কখনো ঠকবিনা?”

কিছু একটা হয়তো ছিল রক্তিমের কন্ঠে। যার দরুন অল্প ঘাবড়ায় মেহেদী। জ্বিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে স্থিমিত স্বরে জানায়,

“এই মনে যে নারীর প্রতিচ্ছবি আঁকা আছে আমার বিশ্বাস, সে নারী কখনো আমার বিশ্বাস ভাঙবেনা।”

রক্তিমের ঠোঁট দুটো অল্প বিস্তর ফাঁক হয়। গম্ভীর মুখে তবে কি অধরা হাসির দেখা মিলল! নিচে বসেই গভীর নয়নে রক্তিমের মুখ পর্যবেক্ষণ করে হাসি খোজার প্রয়াস চালায় রাকিব, জাবির, শান্ত। তবে না! কিছুই পাওয়া যায়না। হতাশ হয় তিনজনই। দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকায় একে অপরের মুখের দিকে। ঠিক তখনই শুনতে পায় রক্তিমের কন্ঠ নিঃশৃত বাক্য,

“যদি তোর মনে সত্যিই এতোটা বিশ্বাস থেকে থাকে। তবে কথা দিলাম আমি। তোর মনে যে নারীর প্রতিচ্ছবি সে নারী তোর।”

এমন একটা জবাব একটুও আশা করেনি মেহেদী। সেই আশাহীন জবাব পেয়ে বুক কাঁপে মেহেদীর। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়। দৃষ্টি হয় চঞ্চল। ঘনঘন ঢোক গিলে শুকিয়ে আসা গলাটা ভিজানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। মনে মনে ভাবে,
“যদি জানতি সেই নারী তোর আদরের ছোট বোন তবে কখনো এমন কথা দিতে পারতিনা।” মুখে জবাব দেয় অসাঢ় কন্ঠে,

“যে কথা কখনো রাখতে পারবিনা এমন কথা কখনো দিস না।”

কপালে গুটি দুয়েক ভাজ পরে রক্তিমের। শ্লান ভরাট স্বরে জানতে চায়,

“আমার জানা মতে আমি কাওকে কখনো এমন কোনো কথা দেইনি যে কথা রাখতে পারিনি। তবে তোর কেন মনে হচ্ছে তোকে দেওয়া কথা রাখতে পারবনা?”

“এমনি।” ছোট্ট স্বরে জবাব দিয়ে আর কিছু বলার সুযোগ দেয়না মেহেদী। চুপচাপ বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। সেদিকে অপলক তাকিয়ে থাকে রক্তিম। কিয়ৎ সময় পের হতেই এবার সত্যি সত্যিই রক্তিমের ঠোঁটের কোণে দুর্বোধ্য সেই হাসির রেখে দেখা দেয়। যা দেখে অবাকের চরম পর্যায় গিয়ে কিছু বলতে ভুলে যায় নিচে বসা তিনজন। শুধু ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে দেখে মহামূল্যবান সেই হাসি।

চলবে…..

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৭( প্রথম অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

দিন যায়, রাত আসে। সেই রাত শেষে আবারও এক নতুন দিনের সূচনা হয়। এভাবেই কেটে যায় মাসের পর মাস। সুখ-দুঃখ দুটোকেই সারথী করে সময় এগিয়ে যায় নিজের মতো করে আপন নিয়মে। দৃষ্টি, তুসী দুজনের পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছে অনেক দিন আগেই। দুজনেই সর্বোচ্চ জিপিএ নিয়ে উত্তির্ণ হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষার সময়টাও অতি নিকটে। সেদিন রক্তিমের নাম্বার থেকে এমন রিপ্লাই পেয়ে আর যোগাযোগ করার সাহস পায়না সে। তবে সময় যত গড়াচ্ছে ততই মনে হচ্ছে রক্তিম নামক মানুষটা তার সর্বত্র জুড়ে বিরাজ করছে। দিন কে দিন গাঢ় হচ্ছে অনুভূতি। প্রগাঢ় হচ্ছে হৃদয়ের তোলপাড়। তনুমন উতলা সিক্ত হচ্ছে নব্য প্রেমের ছোঁয়ায়। মনে হয় মনটা আর তার মাঝে নেই। পরে আছে সাভারে গুন্ডা রক্তিম শিকদারের কাছে। এই এতো এতো অনুভূতির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ দৃষ্টি। ইচ্ছে করে এক ছুটে ময়মনসিংহ ছেড়ে পালিয়ে যেতে রক্তিমের কাছে। চোখে চোখ রেখে প্রগাঢ় স্বরে বলতে,
“আপনাকে ছাড়া আমি ভালো নেই। নিঃস্ব হয়ে গেছি আপনার প্রেমে। আমাকে প্লিজ আপনার শক্ত বুকে ঠাই দিয়ে একটু নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে দিন গুন্ডা মশাই!”

কিন্তু পারছেনা। এই এতো এতো অসহ্য বেহায়া অনুভূতিদের নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখে চুপটি করে দিন পার করতে হচ্ছে। অনুভূতিদের জাতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছে নব্য প্রেমে সিক্ত হওয়া হৃদয়।

জানালার কার্নিশ ঘেষে উদাস চিত্তে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে দৃষ্টি। মেঘলা আকাশ। টুকরো টুকরো মেঘ গুলো উড়ে যাচ্ছে নিজের মতো করে। মাঝে মাঝে দুই-একটা পাখি ডানা মেলে মনের সুখে উড়ছে মেঘেদের সাথে পাল্লা দিয়ে। পিছন থেকে কেউ হঠাৎ কাধে হাত রাখায় আকাশ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পেছন ঘুরে তাকায় দৃষ্টি। দিলশান আরা দাঁড়িয়ে আছে। চঞ্চল মেয়েটা এভাবে চুপটি করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে ভাবে হয়তো কিছু একটা নিয়ে মন খারাপ মেয়ের। জিজ্ঞেস করে,

“কি ব্যাপার? এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কিছু নিয়ে মন খারাপ?”

ধাতস্থ হয় দৃষ্টি। নিজেকে স্বাভাবিক করে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলে,

“কিছুই হয়নি আম্মু। একটানা পড়তে ভালো লাগছিলো না তাই এখানে দাঁড়িয়েছিলাম। তুমি স্কুল থেকে কখন এসেছো?”

মেয়ের কথা বিশ্বাস হয়না দিলশান আরা’র। তবুও কোনো প্রশ্ন না করে উত্তর দেয়,

“মাত্রই এলাম। একটানা পড়তে কে বলেছে তোমাকে? মাঝে মাঝে দিহানের সাথে বাইরে থেকে একটু ঘুরে এসো। মাইন্ড ফ্রেশ হবে।”

দ্বিমত করেনা দৃষ্টি। মাথা ঝাকিয়ে সায় জানিয়ে বলে,

“আচ্ছা যাব। তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। দুপুরে খাইনি আমি। তোমার সাথে খাব।”

কোনো রা ছাড়াই বেরিয়ে যায় দিলশান আরা। একটা সরকারি কলেজে বাংলা প্রভাষক হিসেবে গত সাত বছর যাবৎ যুক্ত দিলশান আরা। কর্ম জীবনের ব্যস্ততার কারণে চাইলেও সবসময় ছেলে-মেয়ে দুটোকে ঠিকঠাক সময় দিতে পারেনা। ছুটির দিন ছাড়া দুপুরে একসাথে খাওয়ার সুযোগটাও হয়ে ওঠেনা। দৃষ্টির বাবা সাদেক সাহেবের ময়মনসিংহ শহরেই নিজস্ব ছোটখাট একটা গার্মেন্টস ফেক্টরি। বাবা ব্যস্ত ব্যবসায়ীক কাজে আর মা ব্যস্ত শিক্ষকতাই। দৃষ্টি, দিহান দুই ভাই-বোনের দিন কাটে একা একাই। বাসায় সারাদিন তারা দুজন ভাই-বোন আর একজন কাজের লোক ছাড়া কেউ থাকেনা। দৃষ্টি সাদেক সাহেব, দিলশান আরা দুজন কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের মেয়ে হিসেবে হয়েছে একদম বিপরীত ধাচের। স্বভাবে অত্যন্ত চঞ্চল এই মেয়ের চঞ্চলতা নিয়ে মাঝে মাঝে বাবা-মা দুজনের মাঝে চলে বাক বিতন্ডতা। দোষারোপ করে একে অপরকে। তাদের ব্যস্ততার কারণে মেয়েটা শাসন বারণ না পেয়ে এমন চঞ্চল হয়েছে। তবে কিছুই করার থাকেনা। দুই সন্তানের সুন্দর একটা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সাদেক সাহেব টাকার পিছনে না ছুটে পারেনা ছেলে-মেয়ে দুটোকে সময় দিতে। আর না পারে দিলশান আরা নিজের যোগ্যতা, মেধা লুকিয়ে রেখে শুধু স্বামী-সংসার সন্তান নিয়ে দিন কাটাতে। দিলশান আরার মতে প্রতিটা মেয়ের প্রয়োজন আলাদা ভাবে নিজের একটা পরিচয় গড়ে তোলা। মাথা উচু করে সমাজে চলতে গেলে শুধু চার দেয়ালের মাঝে বন্দি থেকে সংসার সামলালেই হয়না। তার জন্য প্রয়োজন হয় নিজেকে যোগ্য হিসেবে সমাজের সামনে উপস্থাপন করা। দিলশান আরার এই ভাবনাতেই অসন্তুষ্ট সাদেক সাহেব। স্ত্রীকে বারবার বুঝানোর চেষ্টা করে, সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু হতে পারেনা। জবাবে দিলশান আরাও জানিয়ে দেয়, তার ছেলে মেয়ে সঠিক শিক্ষা আদর্শ নিয়েই বড় হচ্ছে। যেটুকু চঞ্চলতা আছে মেয়ের মাঝে পুরোটাই বয়সের দোষ। ঠিক এভাবেই দুজন দুজনের জায়গা থেকে বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করিয়ে একটা সময় ক্লান্ত হয়ে ছিটকে আসে এসব আলোচনা থেকে। তবে সময় তো আর থেমে থাকেনা। বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতেই কাটে দুই ভাই-বোনের দিন। তবুও কখনো তারা বাবা-মায়ের প্রতি কোনো অভিযোগ রাখেনি। চঞ্চল দৃষ্টির স্বভাবে থাকলেও ভালো করেই বুঝতে পারে বাবা-মায়ের দিকটা। সে জানে বাবা এবং মা দুজন দুজনের জায়গা থেকে ঠিক। এবং তারা যা করছেন তা শুধুমাত্র তাদের দুই ভাই-বোনের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই করছেন।

অনেক দিন পর একটু সময় পেয়ে ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়ে দিলশান আরা দুপুরের খাবার খেয়ে গল্প আড্ডায় পার করে সন্ধ্যার আগ পযর্ন্ত পুরোটা সময়। মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে দৃষ্টিও কিছু সময়ের জন্য ভুলে যায় রক্তিমের কথা। ছোট বাচ্চাদের মতোই ভাই-বোন দুজন মায়ের দুই পাশে বসে উগলে দেয় মনে জমে থাকা সমস্ত কথা। সন্ধ্যার কিছুটা পর পর সাদেক সাহেব বাড়িতে এসে স্ত্রী সন্তানদের একসাথে হাসি খুশি বসে আনন্দ করতে দেখে প্রশান্ত হৃদয়ে নিজেও যোগ দেয় তাদের সাথে। বহুদিন পর বাবা-মা দুজনকে একসাথে পেয়ে বিগলিত হয় ভাই-বোন দুজন। রাজ্যের যত আবদার, অভিযোগ, অভিমান জমে থাকা কথা সব প্রকাশ করে বাবা-মায়ের কাছে। সন্তানের পড়াশোনা, নিজেদের কর্ম জীবনের ব্যস্ততা সমস্ত চিন্তা চেতনা এক পাশে রেখে কেটে যায় সুন্দর কিছু সময়।প্রাপ্তির খাতায় যুক্ত হয় স্বরণীয় এক মুহূর্ত। জমজমাট আড্ডা শেষ হয় একেবারে রাতের খাবারের সময়। সকলে মিলে একসাথে খাওয়া শেষে যে যার রুমে যায় ঘুমানোর উদ্দেশ্যে। সুন্দর একটা সময় কাটানো শেষে রুমে এসে ফুরফুরে মনে ঘুমাতে যায় দৃষ্টি। ঠিক তখনই বেজে ওঠে তার ফোন। বিছানার কাছ থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে দেখতে পায় কলটা এসেছে তুসীর নাম্বার থেকে। মুখ ভেংচায় দৃষ্টি। বিরবির করে বলে,

“আমি কল দিলে ধরতে চায়না। ধরলেও এমন ভাবে কথা বলে যেন অচেনা কেউ বিরক্ত করছি তাকে। এখন কেন আমাকে কল দিচ্ছিস। ধরবনা আমিও। দেখ কেমন লাগে।”
ফোনটা সাইলেন্ট মোডে রেখে ঘুমিয়ে যায় নিশ্চিন্তে।

সকালে ঘুম ভাঙ্গে মায়ের ডাকে। কাক ডাকা ভোরে দু-চোখ থেকে ঘুম সরেনা দৃষ্টির। দিলশান আরা কতক্ষণ ঠেলেঠুলে মেয়েকে উঠিয়ে ফোন ধরিয়ে দেয় হাতে। বলে যায় জরুরি কল। কথা বলে যেন। কোনোমতে ফোন কানে ঠেকিয়ে ঘুমে জড়িয়ে আসা কন্ঠে সাড়া দেয় দৃষ্টি,

“হ্যালো কে?”

তৎক্ষণাৎ ফোনের অপর পাশ থেকে ভেসে আসে তুসীর ব্যগ্র কন্ঠ,

“এখনো আপনার ঘুম কাটেনি শেহজাদী! ঘুমান। শান্তির ঘুম ঘুমান আপনি। এদিকে আপনার রাজ কুমার বুলেটের আঘাতে বুক ঝাঝরা করে হাসপাতালে মৃ’ত্যু’র সাথে পাঙ্গা লড়োক।”

সকাল সকাল এমন একটা সংবাদে কিংকর্তব্য বিমূঢ় দৃষ্টি। হতবম্ভ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করে তুসীর কথাটুকু। ফাঁকা মস্তিষ্ক ঘটনার সারসংক্ষেপ ধরতে পারেনা এখনো। নিজেকে একটু ধাতস্থ করে প্রশ্ন ছুড়ে,

“কি বলছিস? কার কি হয়েছে?”

এবারও শোনা যায় তুসীর রাগি কন্ঠের ব্যাঙ্গাত্বক জবাব,

“আপনার পেয়ারের হিরো রক্তিম শিকদারের উপর গত রাতের আগের রাতে কারা যেন হামলা করেছিল। গুলি লেগেছে বুকে। শরীরের আরও বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন। ঘটনা এতোক্ষন শোনা না গেলেও অবস্থার অবনতি হওয়াই পুরো এলাকায় রটনা হয়ে গেছে। কেউ কেউ তো আবার বলছে বাঁচার না কি কোনো সম্ভাবনা নেই।”

চলবে…..

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৭ (শেষ অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

আচমকা এমন একটা সংবাদে স্তম্ভিত দৃষ্টি। অনুভূতিহীন কেটে যায় কিছু সময়। পরপরই মনে হয় বুকের ভিতর একটু একটু করে সৃষ্টি হচ্ছে বেসামাল যন্ত্রণা। সকালের ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়াতেও ঘামছে সে। অন্তর্দাহে পুড়ছে মন জমিন। কিভাবে কি হলো কিছুই জানেনা। শুধু জানে সে যন্ত্রণা নামক এক অথৈ সাগরে ডুবে যাচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে গভীর অতলে। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে,

“আমি যাব।”

ফোনের অপর প্রান্তে থাকা তুসী এমন একটা জবাবে কপাল কুঁচকায়। জানতে চায়,

“কোথায় যাবি?”

দৃষ্টির হৃদয়ে সৃষ্ট যন্ত্রণাটুকু কান্না হয়ে ফুলে ফেঁপে দু-চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরতে চাইছে। চোখ দুটো কেমন জ্বালাপুড়া শুরু করেছে এখনই। কিছু বলতে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করে তার কন্ঠ দিয়েও কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা। শরীর জুড়ে কাঁপুনি অনুভূত হচ্ছে। কোনোমতে নিজেকে সামলায় সে। ধরা গলায় অস্ফুটে বলে,

“সাভার যাব আমি। রক্তিম শিকদারের কাছে।”

মেজাজ খিঁচিয়ে আসে তুসীর। পাগল মেয়ে বলে কি ?কোথাকার কোন গুন্ডা মাস্তানের দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সে না কি ময়মনসিংহ ছেড়ে ঢাকায় আসবে! অত্যন্ত রূঢ় স্বরে জবাব দেয়,

“মাথার স্ক্র কি সব গুলো ঢিলা হয়ে গেছে তোর? আমি তোকে ফোন করে খবরটা দিয়েছি যাতে তুই অন্তত একটু হলেও উপলব্ধি করতে পারিস রক্তিম শিকদার সাধারণ কোনো মানুষ না। এই লোকের মতো গুন্ডা, মাস্তানের মৃত্যু সর্বক্ষণ কাধে চড়ে নাচে। শুধু এদের না এদের সাথে যারা নিজেকে একবার জড়িয়ে নেয় তাদের জীবনও অনিশ্চিত। বাচ্চা না তুই দৃষ্টি। সব বুঝিস। এক পলকের দেখায় কখনো প্রেম হয়না। তাছাড়া তুই নিজেও হয়তো জানিস না রক্তিম শিকদার কি হয় তোর? আর রক্তিম শিকদার! সে তো তোকে চিনেই না। তবে কেন এতো অস্থিরতা তোর?”

সত্যিই তো! এক পলক চোখের দেখায় আসলেই কি কাওকে ভালোবাসা যায়? কি হয় রক্তিম শিকদার তার? এই নামহীন একটা সম্পর্কের জন্য কিসের এতো ছটফটানি তার? দৃষ্টি না হয় দিয়ে দিল তার অনুভূতি গুলোর নাম ভালোবাসা। কিন্তু রক্তিম শিকদার! সে কি কখনো দৃষ্টির হৃদয়ের কথা জানতে পারবে? দৃষ্টির মতো তার মনেও কি কখনো এমন বেসামাল অনুভূতির সৃষ্টি হবে দৃষ্টির জন্য! আর কিছুই ভাবতে পারেনা দৃষ্টি। ভাবতেও চায়না কিছু। দু-চোখ উপচে গড়িয়ে পরে বিন্দু বিন্দু অশ্রু কণা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মনে হয় কোনো এক বিষ পোকা কামড়ে ধরেছে বুকের বা পাশে। ছটফট করে দৃষ্টি এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু পারেনা। বরং আরও গাঢ় হয়ে ওঠে যন্ত্রণা। নিম্নোষ্ঠ কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালায় দৃষ্টি। নাক টেনে করুন সুরে বলে,

“তুই বুঝবিনা আমার হৃদয়ে এই মুহুর্তে কি চলছে। রক্তিম শিকদার কে বা কেমন লোক কিছুই জানিনা আমি। আর জানতে চাই ও না। আমি শুধু জানি আমার বুকের ভিতর ভিষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার। রক্তিম শিকদার!এই নামটাতেই বড্ড দূর্বল হয়ে গেছি আমি। নিজের অনুভূতিদের নিজেই সামলে রাখতে পারছিনা। কত শাসিয়েছি মনকে কিন্তু মন আমার কথা শুনেনা। তুই বিশ্বাস কর তুসী,যখনই মনে পরে তার কথা ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুড়ে ছুটে চলে যায় তার কাছে। সেই মানুষটার এমন একটা সংবাদ শুনে আমার ভিতরে কি চলছে একবার বোঝার চেষ্টা কর। ভাব আমি কি পরিস্থিতিতে আছি। ভালোবাসা কখনো ধর্ম, কর্ম মেনে হয়না তুসী। নির্দিষ্ট একজনের প্রতি ভালোবাসা নামক অনুভূতিটা এমনিতেই চলে আসে। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। আমি জানি আমার মন জানে রক্তিম শিকদার কি আমার কাছে। তুই আর কখনো আমার অনুভূতি গুলো নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে কষ্ট দিস না প্লিজ।”

থমকে যায় তুসী। মন থেকে উপলব্ধি করে দৃষ্টির প্রতিটা কথা। বুঝতে পারে মেয়েটার মনে সৃষ্টি হওয়া অনুভূতির প্রগাঢ়তা। সহসা চোখ দুটো বন্ধ করে প্রলম্বিত শ্বাস টানে। বলে,

“যে পথে পা বাড়িয়েছিস সেই পথ পুরোটা কাঁটায় ভরা বুঝতে পারছিস তুই? মানলাম তোর অনুভূতি মিথ্যে নই। রক্তিম শিকদার ও মেনে নিল তোকে। কিন্তু খালামনি আর খালুজান? তুই তাদের একমাত্র মেয়ে। তারা কখনো চাইবে একটা গুন্ডার সাথে নিজেদের আদরের মেয়ের বিয়ে দিতে? ওরা যদি মেনে না নেয় তখন সইতে পারবি তো বিচ্ছেদের যন্ত্রণা?”

ক্লেষ্ঠ হাসে দৃষ্টি। শুকনো খড়খড়ে ঠোঁট দুটো জ্বিভের ডগায় ভিজিয়ে বলে,

“আম্মু-আব্বুর কাছে যদি সব কিছুর উর্দ্ধে তাদের মেয়ের সুখ থাকে তবে মেনে নিবে। আর না হলে তো নাই। সব কিছু জেনে নিজ থেকেই যখন আগুনে ঝাপ দিয়েছি তখন না হয় সহ্য করলাম পুড়ে ছাই হবার যন্ত্রণা।”

****

সাভার স্পেশালাইজড হাসপাতালের তৃতীয় তলার ১০৩ নাম্বার কেবিনের সামনে রক্তিম শিকদারের কিছু কাছের মানুষের ভীড় জমেছে। কিছুক্ষণ আগেই তাকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। আগের থেকে অবস্থার উন্নতি হয়েছে কিছুনা। গত রবিবার আনুমানিক রাত দেড়টার দিকে রক্তিমের উপর হামলা হয়। জরুরি একটা কাজ সেড়ে দলের ছেলেদের বিদায় দিয়ে একাই বাইক চালিয়ে নিজের ঠিকানায় ফিরছিল রক্তিম। ঠিক সেই মুহুর্তে ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোথা থেকে যেন বুলেটের আঘাত এসে ঝাঝড়া করে দেয় রক্তিমের বুক। তৎক্ষণাৎ বাইক থেকে ছিটকে পরে রক্তিম। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই মুখোশধারি কয়েকজন ঝাপিয়ে পরে তার উপর। নির্মম ভাবে পিটিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বেহুশ রক্তিমকে ফেলে যায় রাস্তার পাশে। রাতের শেষ প্রহরে এক দল তরুণ যুবক এই রাস্তা ধরেই নিজেদের বাড়ি ফিরছিল। তখনই দেখতে পায় রক্তাক্ত অবস্থায় এক লোক পরে আছে। ছেলে গুলো প্রথমে ভয়ে কাছে না আসলেও কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে অনেক ভেবে মনে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে যায়। উল্টো হয়ে পরে থাকা দেহটা ঠেলে সোজা করতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে রক্তিম শিকদারের রক্তাক্ত মুখ। বুকের পাশ থেকে তখনও অবিরাম ধারায় তাজা রক্ত গড়িয়ে পরছিল। বেদনায় ক্লিষ্ট রক্তিমের চোখের পাতা একটু একটু করে কেঁপে উঠছিলো।যুবক দল নিজ উদ্যোগে রক্তিমের পকেট হাতরে ফোন বের করে জানিয়ে দেয় দলের ছেলেদের কাছে এই খবর। খবরটা একজনের কানে পৌঁছনোর কয়েক মিনিটের মাথায় ঝড়ের গতিতে ছুটে আসে প্রত্যেকে। নিয়ে যাওয়া হয় রক্তিমকে হাসপাতালে। আজীজ শিকদার ছেলের এমন করুন অবস্থার কথা জানতে পেরে কাওকে কিছু না জানিয়ে রাতের অন্ধকারেই ছুটে আসে হাসপাতালে। কিন্তু ছেলেকে দেখতে পারেনা এক নজর। ওনার আসার আগেই রক্তিমকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। অস্ত্রপচার করে বুক থেকে বুলেট বের করতে পারলেও কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেনা ডাক্তার। টানা চব্বিশ ঘন্টা আইসিইউ এ অচেতন থাকার পর আজ জ্ঞান ফিরে তার। তবে বুকের আঘাতের কারণে এখনো ঠিকমতো কথা বলতে পারছেনা।

ফিনাইলের তীব্র গন্ধে কপাল কুঁচকে চোখ বন্ধ করে পরে আছে রক্তিম। তার কাছে মনে হয় পৃথিবীর সবথেকে বাজে গন্ধ যদি কোথাও থেকে থাকে তবে সেটা এই হাসপাতাল নামক জায়গায় মেডিসিন আর ফিনাইল এর তীব্র গন্ধ। অসহ্যকর এই গন্ধ কয়েক মিনিটের ভিতর মাথা ব্যাথা ধরিয়ে দেয় রক্তিমের। সুস্থ্য স্বাভাবিক অবস্থাতেই সে কখনো হাসপাতালে পাঁচ মিনিটের বেশি টিকতে পারেনা। সেখানে এমন অসুস্থ অবস্থায় কিভাবে থাকবে? একেতো শরীরের কাটাছেড়ার যন্ত্রণা। তার উপর এসব উটকো গন্ধে মাথা ব্যাথার সাথে পেট গুলিয়ে মুখ ভরে বমি আসতে চাইছে। দাঁতে দাঁত খিঁচে সহ্য করে চুপচাপ পরে আছে রক্তিম। নিরব কেবিনে হঠাৎ কারো পদচারনায় ভাবে হয়তো কোনো নার্স বা ডাক্তার এসেছে। চোখ বন্ধ অবস্থায় ভারি স্বরে জানতে চায়,

“আমাকে এখানে আর কতদিন স থাকতে হবে?”

“যতদিন পযর্ন্ত পুরোপুরি শরীর সুস্থ্য না হচ্ছে ততদিন। এর থেকে বেশিদিন থাকার ইচ্ছে থাকলে আবার কারো গুলির সামনে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে যান। বুক ঝাঝড়া করে আবার না হয় আসবেন হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে আরাম করার জন্য।”

কোনো নার্স বা ডাক্তারের গলার আওয়াজের পরিবর্তনে চিরচেনা বাবার গম্ভীর স্বরের জবাব পেয়ে একটু চমকায় রক্তিম। ভারি হয়ে আসা চোখের পল্লব ঝাপটে খুলে ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকায় আজীজ শিকদারের দিকে। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারও চোখ বুজে নেয়। জ্ঞান ফেরার পর থেকে শত চেষ্টায় টেনেটুনেও বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছেনা রক্তিম। মনে হয় চার পাশের সমস্ত কিছু ঘুরছে। রাজ্যের ঘুম জমে আছে চোখের পাতায়।

“কেমন লাগছে এখন?”

আজীজ শিকদারের কন্ঠ এবার যথেষ্ট নরম শোনায়। শারীরিক বেদনা ভুলে বুকের ভিতর এক টুকরো প্রশান্তি উপলব্ধি করে রক্তিম। বাঃহিক দিক থেকে সবার কাছে পরিচিত পাষাণ হৃদয়ের রক্তিম শিকদারের মনটা যে প্রতিনিয়ত জন্মসূত্রে পাওয়া আপন মানুষ গুলোর একটু ভালোবাসার জন্য সর্বক্ষণ কাঙ্গাল হয়ে থাকে এই খবর একমাত্র রক্তিম শিকদার ছাড়া কেউ জানেনা। মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে সে ঠিক জানে এখনো সে এতোটা পাষাণ হয়ে উঠতে পারেনি যতটা পাষাণ হলে বাবা-মায়ের জন্য মন ছটফট করেনা।

“ভালো।” অস্ফুট স্বরে জবাব দেয় রক্তিম। ছেলের দিকে তাকিয়ে হতাশাভরে নিঃশ্বাস ছাড়ে আজীজ শিকদার। মন্থর গতিতে এগিয়ে এসে রক্তিমের মাথার কাছে একটা টুল টেনে বসে। নিচের দিকে কিছুক্ষণ চুপ থেকে কন্ঠে অসহায়ত্ব ঢেলে বলতে থাকে,

“আমি নিজে রাজনীতিতে পা বাড়ালেও কখনো চাইনি আমার ছেলেরা রাজনীতিতে আসুক। অথচ আমার কানের কাছে রাজনীতি নামটা উচ্চারিত হলেই শরীরের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে এখনো। চোখে ভাসে শহস্র স্বপ্ন। যে আমার হাতে শত শত তরুণ রাজনীতিবিদের জন্ম সেই আমি শুধুমাত্র উপজেলাল মেয়র হয়ে থামিয়ে দিয়েছি পথচলা। পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে আর সামনে আগানোর সাহস পায়নি। এটুকুও ছেড়ে দিতাম যদি রক্তের সাথে রাজনীতি নামটা মিশে না যেতো। তোমাকে সামরিক বাহিনীতে দিয়ে এলাকা থেকে বের করলাম। ইচ্ছে ছিল সংগ্রামকে পিএইচডির জন্য বিদেশ পাঠিয়ে দিব। মেয়ে দুটোকে যত দ্রুত সম্ভব পাত্রস্থ করব। কারণ এক আমি রাজধানীর সাথে জড়িয়ে মনে হতো পুরো পরিবারের ধ্বংস ডেকে নিয়ে এসেছি। সর্বক্ষণ ভয় হতো তোমাদের নিয়ে। যদি কখনো কেউ কোনো ক্ষতি করে দেয়! আমার সুন্দর পরিবারটায় যদি ধ্বস নেমে আসে! ভাগ্যের পরিহাসে সেই ধ্বংস নেমে আসলোই আমার সুখের পরিবারে। এর জন্য আমি কখনো তোমাকে দায়ী করিনি আর করবও না। তবে তুমি ঐ ধ্বংস লিলার পরও থামোনি। সেই আমার ভয় সত্যি করে পা বাড়িয়েছো বি-পথে। এলাকার মানুষের ভালো করতে গিয়ে মারামারি কাটাকাটি করে সবার কাছে গুন্ডা নামে পরিচিত হয়েছ। তোমাকে দমাতে না পেরে রাগে দুঃখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললাম। তুমিও আমার মুখের কথা শুনে তাই করলে। একটাবার আমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে আমার ভিতরের কষ্ট গুলো দেখলেনা। লিয়াকত বিল্লা কতটা ভয়ংকর সেটা আমি জানতাম। যখন শুনলাম লিয়াকত বিল্লার ছেলের গায়ে হাত তোলার অপরাধে তুমি জেলা তখন আর বাবা হয়ে স্থির থাকতে পারিনি। ছুটে গিয়েছিলাম তার কাছে মাথা নত করেও যদি কোনোমতে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে এই দন্দ মিটাতে পারি! একবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিলাম। পরদিন আবার যেতাম আমি। সন্তানের জীবনের থেকে বাবা-মায়ের কাছে সম্মান কখনো বড় হতে পারেনা। তবে তার আগেই তোমার প্রিয় জনগণ আন্দোলন করে ছুটিয়ে আনল তোমাকে। ঘুমন্ত বাঘকে জাগিয়ে উস্কানি দিয়ে লেলিয়ে দিল তোমার উপর। আমি শতভাগ নিশ্চিত তোমার উপর এই আক্রমণ লিয়াকত বিল্লা করিয়েছে।”

“সেটা আমিও জানি।”

বাবার এতো গুলো কথার পর জবাব দেয় রক্তিম। কথার মাঝে বাধা পরায় ছেলের প্রতি রুষ্ট হয় আজীজ শিকদার। নিচু স্বর কিছুটা উচু করে বলে,

“কথা শেষ করতে দাও আমাকে। এরপর তোমার যা ইচ্ছা বলো।”

চুপ থেকে সম্মতি দেয় রক্তিম। আজীজ শিকদার কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলতে থাকে,

“আজ ভাগ্যের জুড়ে বেঁচে গেলেও লিয়াকত বিল্লা কখনো সুস্থ্য ভাবে বাঁচতে দিবেনা। এক সন্তান হারিয়ে আমার ঘরটাতে যে শূণ্যতা এখনো বিরাজ করছে সেই একই শূন্যতা আমি আর চাইনা। গত দুটো বছর তো কত আবদার করলাম তোমার কাছে। কোনোটাই রাখলেনা। আজকে শেষ একটা আবদার করব। বলতে পারো বাবা হয়ে সন্তানের কাছে অনুরোধ রাখব। আমার অনুরোধটা রাখবে?”

“কি?” একই ভাবে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থেকে জানতে চায় রক্তিম। আজীজ শিকদারের দৃষ্টি চঞ্চল হয়। কথাটা বলতে একটু দ্বিধা কাজ করে। তবুও সেই দ্বিধাটুকু কাটিয়ে বলে ওঠে,

“লিয়াকত বিল্লার কাছে মাফ চেয়ে ঝামেলা চুকিয়ে নাও। এটা তোমার কাছে এক অসহায় বাবার অনুরোধ। আমার কথা না ভাবলেও নিজের বোনটার কথা একটু ভাবো। সে তোমার ক্ষতি করতে না পেরে যদি তোমার বোনের কোনো ক্ষতি করে দেয়?”

কথাটা কানে পৌঁছাতেই তড়িৎ দু-চোখের পাপড়ি আলগা হয়ে যায় রক্তিমের। দৃষ্টিতে অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকায় বাবার দিকে। শুভ্র রাঙা পাঞ্জাবী পরিহিত ভদ্রলোককে আজীবন জেনে এসেছে দিলখোলা মানুষ হিসেবে। রাজনীতিতে জড়ালেও কখনো অন্য কোনো দলের সাথে কোনো প্রকার ঝামেলা করেনি নিজে থেকে। সর্বক্ষণ নিজেকে জনগণের সেবায় উৎসর্গ করেছে। সেই লোক কিভাবে নিজের সন্তানকে অন্যায়ের প্রতি মাথা নত করতে বলে? ভেবে পায়না রক্তিম। কিছু পল চুপচাপ বাবাকে দেখে নিয়ে গলা উচু করে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দলের ছেলেদের ডাকে। সাথে সাথেই ব্যাথায় কুঁকিয়ে ওঠে। একটু বিচলিত হয় আজীজ শিকদার। সেদিকে পাত্তা দেয়না রক্তিম। চোখ-মুখ খিঁচিয়ে ব্যাথা হজম করে দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকা রাকিবের উদ্দেশ্যে বলে,

“মেহেদীকে ডাক।”

তৎক্ষণাৎ দরজা থেকেই বেরিয়ে যায় রাকিব। এর কিছুক্ষণ পরই হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে ঢুকে মেহেদী। তাকে দেখেই রক্তিম আদেশ ছুড়ে,

“ঐদিনের ভিডিও স্ক্রিপ্টটা তোর কাছে আছে না?”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় মেহেদী। আবারও আদেশ ছুড়ে রক্তিম,

“মেয়র সাহেবকে দেখা ওটা।”

একবার রক্তিমের মুখের দিকে আর একবার আজীজ শিকদারের মুখের দিকে তাকায় মেহেদী। পরপর দ্রুত ফোন হাতে এগিয়ে যায় আজীজ শিকদারের দিকে। চোখে-মুখে অসন্তুষ্টির লেশ আজীজ শিকদারের। মনে মনে হতাশ হয় অনেক। এতোক্ষন নিজের উনুভূতি ব্যক্ত করার পরও ছেলের মুখে বাবা ডাকের বদল মেয়ের সাহেব শুনে মনটা বিষিয়ে ওঠে। হতাশ মুখেই তাকায় মেহেদীর ধরে রাখা ফোনের স্ক্রিনে। ফোনে চলা ভিডিওটা দেখে থমকে যায় তৎক্ষণাৎ। বাবার থমথমে মুখ বিবর দেখে তাচ্ছিল্য হাসে রক্তিম। শ্লেষাত্বক স্বরে বলে,

“এখনো বলবেন ঐ জানোয়ারের কাছে মাফ চেয়ে ঝামেলা মিটিয়ে নিতে?”

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়না আজীজ শিকদার। উল্টো জানতে চায়,

“এসব পুলিশের কাছে দিচ্ছো না কেন?”

“কোন পুলিশের কাছে? যে পুলিশ লিয়াকত বিল্লা নিজের পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়?”

সহাস্যে জানতে চায় রক্তিম। মেহেদী এতোক্ষনে বাবা-ছেলের মাঝ থেকে মিহি স্বরে বলে,

“পুলিশ সব জানে কাকু। পুলিশের সহযোগীতা নিয়েই লিয়াকত বিল্লা এতো বড় কাজ গুলো অনায়াসে করতে পারছে।”

“এখন কি করবে তুমি?”

আজীজ শিকদারের চোখে এবার একটু তেজ দেখতে পায় রক্তিম মেহেদী দুজনেই। বুঝতে পারে রক্তিম আদর্শবান মেয়র আজীজ শিকদার এতো বড় একটা অপকাজের প্রমাণ নিজ চোখে দেখে ফুসে ওঠছে লিয়াকত বিল্লার প্রতি। আঘাতে জর্জরিত ফোলা ঠোঁট দুটো অল্প ছড়িয়ে হাসে রক্তিম। জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে শিয়ালের মতো ধূর্ত চোখ দুটো। ভাবলেশহীন স্বরে জবাব দেয়,

“বিষধর সাপের বিষদাঁত একেবারে গুড়ি থেকে উপরে ফেলতে হবে। এর জন্য আগামী সংসদ নির্বাচনে আপনাকে এমপি পদে লিয়াকত বিল্লার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। আশা করি এতে আপনার কোনো আপত্তি থাকবেনা।”

চলবে…..

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-৪+৫

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৪ ( প্রথমাংশ )
#আদওয়া_ইবশার

“আপনাদের মাঝে রক্তিম শিকদার কে?”

প্রতিদিনের মতো আজও নিজের দলবল নিয়ে রাস্তায় বাইকে হেলাল দিয়ে দাঁড়িয়েছিল রক্তিম। টুকটাক দলের ছেলেদের সাথে কথা হচ্ছিলো লিয়াকত বিল্লাকে নিয়ে। এর মাঝেই হঠাৎ এক মেয়ে কন্ঠের রিনরিনে স্বরে রক্তিমের নাম শুনে কথা থামিয়ে ফিরে তাকায় সকলেই। দেখতে পায় ঐদিন রাস্তায় গলা ছেড়ে গান গাওয়া মেয়েটাই খোঁজ করছে রক্তিমের। এই মেয়ের রক্তিমের সাথে আবার কি কাজ! যেখানে আজ পযর্ন্ত কোনো মেয়ে রক্তিমের আশেপাশে ঘেষার সাহস পায়নি সেখানে এই মেয়ে রক্তিমের খোঁজ করার সাহস কিভাবে পেল! কথাটা ভেবেই একটু অবাক হয় সকলেই। তবে রক্তিম নিরুত্তাপ। একটা মেয়ের মুখে নিজের নাম শুনেই তার কোনো হেলদুল নেই। নির্বিকার ভাবে আয়েশী ভঙ্গিতে হাতে থাকা সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে। রক্তিমের দিকে এক পলক তাকিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে মেহেদী,

“রক্তিম শিকদারের কাছে কি দরকার তোমার?”

এমন প্রশ্নে একটু বিরক্ত হয় দৃষ্টি। এমনিতেই এতোদূর দৌড়ে এসে হাপিয়ে গেছে। হাতে খুবই অল্প সময়। এই অল্প সময় টুকুর মাঝেই যা করার করে চলে যেতে হবে তাকে। এমতাবস্থায় মেহেদীর প্রশ্নটা তার কাছে মনে হচ্ছে অযথা তার সময় নষ্ট করার ফন্দি। ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতেই দৃষ্টি জবাব দেয়,

“সেটা আপনাকে বলব কেন? যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দিন।”

কথাটা বলে আড়চোখে এক পলক রক্তিমের দিকে তাকিয়ে তার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করে। এইটুকু একটা মেয়ের মুখে এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথার জবাব শুনে একটু বুঝি থমকায় রক্তিম। রোদ চশমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা তিক্ষ্ণ চোখ দুটো ঘুরিয়ে এক পলক দেখে নেয় মেয়েটাকে। সেটাও সকলের অগোচরে। দৃষ্টির মুখে এমন জবাব শুনে যারপরনাই অবাক উপস্থিত প্রতিটা ছেলে। চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ফের তাকায় দৃষ্টির দিকে। হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ের কাছে এভাবে অপদস্থ হয়ে চুপচাপ বসে থাকবে রক্তিম শিকদারের দলবল। এটা কি মানা যায়! মেহেদী বিস্ময় কাটিয়ে কিছু বলার আগেই খ্যাঁকিয়ে ওঠে রাকিব,

“অ্যাই মেয়ে! কার সামনে দাঁড়িয়ে এমন বেয়াদবের মতো কথা বলছো জানো তুমি? এক রত্তি একটা মেয়ে এক আঙুলে তুলে আছাড় মারলেই চেপ্টা হয়ে যাবে। এই মেয়ের আবার এতো পাওয়ার!”

উত্তরে দৃষ্টি কিছু বলতে যাবে এর মাঝেই রক্তিম হাত উচিয়ে সকলকেই এক ইশারায় থামিয়ে দেয়। ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে গম্ভীর কন্ঠে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“আমি রক্তিম শিকদার। কি দরকার?”

জবাব পেয়ে খুশিতে আত্মহারা দৃষ্টি। সে তো আগে থেকেই জানতো কোনটা রক্তিম। এতোক্ষন অহেতুক এই প্রশ্নপর্ব চালিয়ে যাবার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল রক্তিমের থেকে একটা জবাব পাওয়া। অবশেষ সেটা পেয়ে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতোই আনন্দ হচ্ছে দৃষ্টির। কিন্তু আনন্দটা বেশিক্ষণ চেহারায় ধরে রাখেনা। টুপ করে সবটুকু আনন্দ গিলে নিয়ে মুখে দুঃখি দুঃখি ভাব এনে রক্তিমের দিকে এগিয়ে যায় এক কদম। কাঁদো কাঁদো মুখ ভঙ্গিতে বলে,

“আমি খুব অসহায় হয়ে আপনার খোঁজ করতে এসেছি ভাই। সবার কাছে শুনেছি কেউ যদি কোনো মেয়েকে উত্তক্ত করে তবে আপনি না কি তার বিচার করেন! গত তিনটা দিন যাবৎ এক ছেলে আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে ভাইয়া। আমি খেতে পারিনা, ঘুমাতে পারিনা। শান্তিতে কোথাও একটু বসতেও পারিনা। সবসময় ঐ ছেলের চিন্তা মাথায় ঘুরে। আপনি দয়া করে এর একটা বিহিত করুন। নইলে এই যন্ত্রণা সইতে না পেরে আমি মরে যাব একেবারে।”

এমন এক অভিযোগে একটু থমকায় সকলেই। চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে ওটা রক্তিমের। অত্যন্ত শীতল স্বরে জানতে চায়,

“ছেলেটা কে?”

“আমি তো জানিনা ভাইয়া।”

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে জবাব দেয় দৃষ্টি।তার এহেন জবাবে বিরক্ত হয় দলের সবগুলো ছেলে। তিরিক্ষি মেজাজে রাকিব আবারও থমকে বলে ওঠে,

“এই মেয়ে ফাজলামি পাইছো? জানোনা তো এতোক্ষন কুমিরে কান্না করে কি বলেছো ঐসব? একটা ছেলে তোমাকে বিরক্ত করে, অথচ ছেলেটা কে সেটাই তুমি জানোনা! অদ্ভূত সব কথাবার্তা।”

পাশ থেকে জাবির রাকিবের কথার তালে বলে,

“আমি আগেই বুঝতে পেরেছি এই মেয়ে পাগল। না হলে ঐদিন মাঝ রাস্তায় ঐভাবে গলা ছেড়ে গান গাইতো না। আর না আজ এমন অহেতুক কথাবার্তা বলতো।”

নিজেকে পাগল বলায় দৃষ্টির রাগ হয় খুব। কিন্তু প্রকাশ করেনা তা। একবার শুধু কটমট দৃষ্টিতে রাকিব, জাবিরের দিকে তাকিয়ে মুহুর্তে মুখটা অসহায় করে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে বলে,

“গান হলো মনের খোরাক। গান গাইলে মন ভালো থাকে। আপনিই বলুন ভাইয়া, গলা ছেড়ে গান গেয়ে নিজের মন ভালো করার ব্যক্তিস্বাধীনতা কি আমার নেই? আর যে ছেলেটা আমাকে বিরক্ত করে তার নাম জানিনা। তবে দেখলে ঠিকই চিনবো। এখন আমি কিভাবে নাম না জেনে বলব কে সেই ছেলে? এই যুক্তিসঙ্গত কারণ গুলো না বুঝেই ওনারা আমাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করে ফেলল। এটা কি ঠিক করল? আজকে আমি অসহায় ভুক্তভোগী দেখেই তো আপনাদের কাছে সাহায্য চাইতে আসলাম। সেই আপনারাই যদি এখন আমাকে সাহায্য না করে উল্টাপাল্টা কথা বলেন তবে আমার মতো অসহায় মেয়েরা যাবে কোথায়?”

দৃষ্টির এতোগুলো কথা শুনে একটু নরম হয় সকলেই। প্রথমে কিছুটা থমথম খেলেও নিজেদের সামলে নিয়ে মেহেদী বলে,

“কষ্ট পেয়ো না ছোট আপু। আসলে আমরা বুঝতে পারিনি। আচ্ছা! ঐ ছেলেকে আবার দেখলে তো চিনতে পারবে তাই না!”

উপর নিচ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় দৃষ্টি। সাথে সাথেই মেহেদী চড়াও হয়ে বলে,

“ঠিক আছে। তবে চলো আমার সাথে। পুরো এলাকায় চিরুনি তল্লাশি করে হলেও আজকে দিনে দিনে ঐ ছেলেকে খোঁজে বের করব আমি। এরপর রক্তিম শিকদার নিজের হাতে ঐ স্কাউন্ড্রেল এর বিচার করবে। চলো চলো।”

সহসা আতকে ওঠে দৃষ্টি। তড়িৎ মাথা নাড়িয়ে বলতে থাকে,

“না না। আপনাদের সাথে যাওয়া যাবেনা।”

তার এমন কথায় চোখ-মুখ কুঁচকে নেয় সকলেই। নিরবতা ভেঙে আবারও রক্তিমই জানতে চায়,

“কেন?”

“ওনাদের সাথে গেলে এলাকার লোক আমার নামে বদনাম রটাবে। বলবে এক দল গুন্ডার সাথে আমি মেয়ে হয়ে দিন দুপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আরও বিভিন্ন কথা বলবে।ঐসব আমি মুখেও আনতে চাইনা।”

ফুস একটা একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে রাকিব। হতাশ ভঙ্গিতে বলে,

“তাহলে এখন কি করবে? এই মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের সাথে কথা বললেও মানুষ দেখে বদনাম রটাবে। তার থেকে বরং এক কাজ করো। বাসায় গিয়ে চোখে সরিষা তেল লাগিয়ে ইচ্ছমতো কতক্ষণ কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পরো। পরে যদি আবার কখনও ঐ ছেলে বিরক্ত করতে আসে তখন তার থেকে জেনে নিয়ো এভাবে, ” ওহে আমার রাতের ঘুম হারাম করা জনাব! আপনার নামটা কি একটু জানতে পারি? অনুগ্রহ করে আপনার নামটা বললে রক্তিম শিকদারকে বলে আপনাকে সিন্নি খাওয়াতাম।”

রাকিবের কথার ধরনে হু হু করে হেসে ওঠে উপস্থিত সকলেই। ব্যতিক্রম শুধু রক্তিম আর দৃষ্টি। চোখ-মুখ শক্ত করে রাকিবকে ধমকে ওঠে দৃষ্টি,

“একদম চুপ করুন আপনি। মাথা ভর্তি গোবর নিয়ে কিভাবে রক্তিম শিকদারের দলে কাজ করেন আপনি? আপনার থেকে তো আমার আট বছরের ছোট ভাইয়ের মাথায় আরও বেশি বুদ্ধি।”

তরতজা এমন এক অপমানে থমথম খেয়ে যায় রাকিব। কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দৃষ্টির দিকে। রাকিবের এমন অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসে সকলেই। সেদিকে আর পাত্তা দেয়না দৃষ্টি। হঠাৎ কিছু একটা মনে হয়েছে এমন একটা ভাব করে রক্তিমের দিকে ফিরে তাকায়। জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,

“একটা বুদ্ধি পেয়েছি।”

“কি বুদ্ধি?”

জানতে চায় জাবির। সেদিকে এক পল তাকিয়ে দৃষ্টি আবারও রক্তিমের দিকে ফিরে তাকায়। ফট করে বলে ফেলে,

“আপনার নাম্বারটা দিন।”

চলবে…..

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৪ ( দ্বিতীয়াংশ)
#আদওয়া_ইবশার

এমন নির্দ্বিধায় অকপটে রক্তিমের নাম্বার চাওয়ায় উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত। গোলগোল নয়নে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে থাকে দৃষ্টর মুখের দিকে। রক্তিম শিকদার’ও কিন্চিৎ অবাক হয়। কিন্তু সেটা প্রকাশ করেনা। গম্ভীরচিত্তে জানতে চায়,

“আমার নাম্বার দিয়ে কি করবে?”

“আবার কখনো যদি ঐ ছেলেটা বিরক্ত করতে আসে তখন সাথে সাথে আপনাকে ফোন করে জানিয়ে দিব। আপনি দলবল নিয়ে গিয়ে ঐ ছেলেকে কেলিয়ে আসবেন।”

নিঃসংকোচে জবাব দৃষ্টির। পাশ থেকে ফুরন কেটে রাকিব বলে,

“এর জন্য ভাইয়ের নাম্বার নিতে হবে কেন তোমার? আমাদের যে কারো একজনের নাম্বার নিলেই তো হয়। ভাই কি সবসময় ফ্রি হয়ে ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকে না কি? যে তুমি ফোন করলে ওমনি ভাই রিসিভ করে তোমার কথা শুনে দৌড়ে চলে যাবে!”

কটমট দৃষ্টিতে রাকিবের দিকে তাকায় দৃষ্টি। ঝাঝালো স্বরে বলে,

“হ্যা আপনাদের নাম্বার নিয়ে বিপদে পরে কল দেই।এরপর উপকারের নাম করে আপনারাই প্রতিদিন ফোন করে আমাকে ডিসটার্ব করুন। কি ভেবেছেন চিনিনা আমি আপনাদের? এক একটা বদের হাড্ডি, মেয়ে দেখলেই ছুক ছুক করা স্বভাবের ধামড়া বেটা-ছেলে!”

এমন তরতজা একটা মনগড়া মিথ্যা অপবাদে প্রত্যেকের কুঠোর ছেড়ে চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম। এক জায়গায় ঠাই দাঁড়িয়ে রক্তিম শিকদারের ছেলেদের বারবার এভাবে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে অপমান করার মতো দুঃসাহস পায় কোথায় এই মেয়ে? অত্যাধিক রাগ হয় উপস্থিত প্রতিটা ছেলের। দৃষ্টির দিকে তেড়ে আসে রাকিব। আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে বলে,

“সাহস কত বড়! আর একটা উল্টাপাল্টা কথা বললে জ্বিভ টেনে ছিড়ে দেখিয়ে দিব আমরা কি জিনিস।”

মুখ বাঁকায় দৃষ্টি। আড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলে,

“অ্যাহ্! দুই টাকার মুরোদ নেই আবার কোটি টাকার বিছানায় ঘুমানোর স্বপ্ন দেখে। চামচিকা চামচিকার মতোই থাকুন। এতো পাওয়ার দেখাতে আসবেন না বলে দিলাম। নইলে আমিও এক একটার মেইন পয়েন্টে মেরে দেখিয়ে দিব দৃষ্টি কি জিনিস।”

এতোক্ষন পর্যন্ত সব কিছু চুপচাপ সহ্য করে গেলেও এবার আর চুপ থাকেনা রক্তিম। স্ব-স্বরে ধমকে ওঠে দৃষ্টিকে,

“এই মেয়ে চুপ!”

ব্যাস! দৃষ্টি নামক বাচাল কন্যার মুখ বন্ধ করার জন্য রক্তিম শিকদারের জোরালো কন্ঠের এক ধমকই যথেষ্ট। হুট করে এমন একটা ধমক খেয়ে চুপসে যায় দৃষ্টি। ভয়ে লাফিয়ে উঠে অন্তরাত্বা। বুকে থুথু দিয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে ঘনঘন চোখের পলক ঝাপটায়। ভিতু চোখে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রক্তিম দু-পা এগিয়ে আসে। তৎক্ষণাৎ কয়েক কদম পিছিয়ে যায় দৃষ্টি। রক্তিম বুঝতে পারে তার ধমক কাজে দিয়েছে। ভয় পেয়েছে মেয়েটা। মেহেদীর পকেট থেকে এক প্রকার ছু মেরে কলম নিয়ে খাঁবলে ধরে দৃষ্টির হাত। আবারও কেঁপে ওঠে দৃষ্টি। ভয়ে মুখ দিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজ বের হয়। তাদের থেকে একটু দূরে মোটা মেহগনি গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তুসীও কাঁপে রক্তিম শিকদারকে দৃষ্টর কাছাকাছি দেখে। সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে আর্জি জানায়,

“আল্লাহ! আল্লাহ প্লিজ এবারের মতো মাথা মোটাটাকে বাঁচিয়ে দাও।”

সকলকে অবাক করে দিয়ে দৃষ্টির হাতের মুষ্টি খুলে কলমের খচখচ খোঁচাতে লিখে দেয় রক্তিম নিজের নাম্বারটা। মুহুর্তেই ঝলমলিয়ে হাসি ফোটে দৃষ্টির ওষ্ঠপুটে। কাজটুকু কয়েক সেকেন্ডে শেষ করে আবারও পিছিয়ে যায় রক্তিম। দুজনের মাঝে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে হুমকি ছুড়ে দৃষ্টির দিকে,

“যা চেয়েছো দিয়েছি। জানের মায়া থাকলে আশা করি এই নাম্বারে অপ্রয়োজনীয় কোনো কল আসবেনা। আর একটা কথা। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার ছেলেদের যা নই তাই বলে অপমান করলে। আজকে কিছুই বললাম না। দ্বিতীয়বার যদি এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চিরতরে জবান বন্ধ করে দিব।”

ঠান্ডা মাথার এমন ভয়ংকর হুমকিতে একটু ভয় ডুকে যায় দৃষ্টির মনে। পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে মনে মনে ভাবে, “এ কোন জল্লাদের প্রেমে পরলি রে তুই দৃষ্টি? দুনিয়াতে এতো এতো ভালো মানুষ থাকতে সাক্ষাৎ জমের দোয়ারে এসে ভীড়লি! না জানি এই গুন্ডা হিরো কবে তোর প্রাণপাখিটা উড়িয়ে দেয়।”

জোর করে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় দৃষ্টি। কাওকে আর কিছু বলতে না দিয়ে যেমন দৌড়ে এসেছিল তেমন গতিতেই দৌড় লাগায়। চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে দৃষ্টির প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকে দলের ছেলেরা। কপাল কুঁচকে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে মেহেদী জানতে চায়,

“এতো সহজে মেয়েটাকে নিজের নাম্বার দিয়ে দিলি তুই!”

“তো কি করতাম! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঐসব ফালতু কথাবার্তা শুনে মাথার পোকা মারতাম?”

কাটকাট স্বরে জবাব রক্তিমের। জবাবটা একটুও মনঃপুত হয়না কারো। অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের মুখের দিকে। কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পায়না।

দৃষ্টিকে দৌড়ে আসতে দেখে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে তুসী।কাছাকাছি দাঁড়িয়ে উৎকন্ঠা নিয়ে জানতে চায়,

“ঠিক আছিস তো তুই? ঐ গুন্ডাটা কিছু করেনি তো! এতো কাছে এসে কি করছিল তোর?”

তুসীর মুখে গুন্ডা ডাকটা শুনে কপাল কুঁচকায় দৃষ্টি। নিচের ঠোট দাঁত দিয়ে কামড়ে চোখ পাকিয়ে বলে,

“তুই কাকে গুন্ডা ডাকছিস? দুদিন পর সম্পর্কে যে তোর দুলাভাই হবে সেই সম্মানীয় মানুষটাকে কোন মুখে গুন্ডা ডাকিস তুই? বেয়াদব মেয়ে!”

তাজ্জব বনে যায় তুসী। ঘনঘন দুপাশে মাথা নাড়ে। হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

“পাগল কখনো পুরোপুরি সুস্থ্য হয় না কথাটা ভুলে গেছিলাম আমি। তুই আবার মনে করিয়ে দিলি। মরবি তুই। খুব শিগ্রই মরবি। যেদিন ঐ রক্তিম শিকদারের চোখের আনলে ভস্ম হবি সেদিন গিয়ে এসব পাগলামি বন্ধ করবি। এর আগে না।”

তুসীর কথা পাত্তা দেয়না দৃষ্টি। সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আপন খুশিতে মত্ত হয়। নিজের হাতটা তুসীর চোখের সামনে তুলে ধরে বলে,

“এটা কি বল তো?”

“কি?” জানতে চায় তুসী। তৎক্ষণাৎ ছোটখাট এক চিৎকারে নিজের উল্লাস প্রকাশ করে বলে,

“রক্তিম শিকদারের নাম্বার। বুঝতে পারছিস আমি কতটা জিনিয়াস! তুড়ি বাজিয়ে নাম্বার জোগাড় করে ফেললাম। তাও আবার সয়ং রক্তিম শিকদার নিজে লিখে দিয়েছে। এবার তো আমার প্রেম জমে ক্ষীর হবে। কেউ আটকাতে পারবেনা আমাদের প্রেম।”

অত্যাধিক বিস্ময়ে তুসীর আঁখিযুগল ছানাবড়া।,

“ফাজলামি করছিস আমার সাথে! তুই বললি আর ওমনি রক্তিম শিকদার নিজের নাম্বার দিয়ে দিল? কেমনে কি করেছিস তুই?”

মিটিমিটি হেসে জবাব দেয় দৃষ্টি,

“বলা যাবেনা। সিক্রেট।”

****
একসময় মানুষের পদচারনায়,উৎসবমোখর আনন্দে, খিলখিল হাসির শব্দে সর্বদা মুখোরিত থাকা শিকদার মঞ্জিল গত পাঁচ বছর যাবৎ নিশ্চুপ। বাইরে থেকে দেখলে কখনো মনেও হয়না রাজপ্রাসাদের মতো দেখতে এই বাড়িতে কোনো মানুষ বসবাস করে। ভিতরে ডুকলে মনে হয় প্রতিটা দেয়াল, আসবাবপত্র নিজের দুঃখবিলাসে ব্যস্ত। হাতে গুণা কয়েকটা মানবপ্রাণ যেন কোনো অনুভূতি শূণ্য কাঠের পুতুল। অথচ একটা সময় এই বাড়ির পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেও মনে মনে ভাবতো, “ইশ! যদি কখনো আমি এই বাড়ির মানুষ গুলোর মতো সুখী হতে পারতাম।” সেই বাড়ির পাশ দিয়েই বর্তমানে মানুষ হেঁটে গেলে হয়তো সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা জানায়, “হে প্রভু! আর কারো জীবনে তুমি এমন কালো অধ্যায় দিয়োনা। যে অধ্যায় মানুষের জীবন থেকে সম্পূর্ণ সুখ চুষে নিয়ে পুরো বাড়িময় শোকের ছায়ায় আবৃত করে নেয়।” আজীজ শিকদার বলতে গেলে দিনের পুরোটা সময় নিজের সমাজসেবা মূলক কাজে বাইরে থাকেন। সবসময়ের মতো বাড়িতে থেকে যায় শুধু তিনটা প্রাণ। শিকদার মঞ্জিলের কর্তৃ রেহানা বেগম, সর্ব কনিষ্ঠ কন্যা ইতি আর একমাত্র বাড়ির কাজে সাহায্য করা কাকলির মা। তিনজন তিনজনের মতো করেই পরে থাকে বিশাল বাড়ির তিন কোণায়। রেহানা বেগম এক ছেলেকে হারিয়ে জগত সংসারের সব কিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। রক্তিম, সংগ্রাম দুটো ছেলেই নিজের পেটের সন্তান। সমান আদর-যত্নে দুজনকেই ছোট থেকে বড় করে তুলেছে। সেই আদরের দুই সন্তানের একজনও তার কাছে নেই। ছোট সন্তানের খুনের দায়ে বড় সন্তানকে দূরে সরিয়েছে নিজেই। গুটা দুনিয়ার কাছে রক্তিম শিকদার নির্দোষ প্রমাণিত হলেও নিজের মায়ের কাছে এখানো সে দোষী। ছোট ভাইয়ের খুনি। সেই খুনি ছেলেকে রেহানা বেগমের কাছে টেনে নেবার প্রশ্নই আসেনা। বরং সামনে পরলে ছেলেকে যতটা কথার আঘাতে জর্জরিত করতে পারে ততই যেন নিজের মনে শান্তি মিলে।

নিজের রুমে বসেই কিছু একটা ভাবনায় মশগুল ছিলেন রেহানা বেগম। নিঃশব্দে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ায় ইতি। কতক্ষণ চুপচাপ মা’কে দেখে নিয়ে মৃদু স্বরে ডেকে ওঠে,

“মা।” হঠাৎ ডাকে খানিক চমকায় রেহানা বেগম। ভাবনার সুতা ছিড়ে বেরিয়ে আসে। অনুভূতি শূণ্য চোখ দুটো ঘুরে তাকায়। মাসটপে ধরা দেয় ছোট মেয়ের মলিন মুখের আদল।দৃষ্টিজোড়া চঞ্চল হয়। বুকের ভিতর সৃষ্টি হয় অদম্য এক ঝড়। হাসফাস করে মাতৃমন আরেকটা বার মা ডাক শোনার জন্য। গত পাঁচটা বছর যাবৎ মধুর এই মা ডাকটাও খুব একটা শুনতে পাননা তিনি। অথচ পাঁচ বছর আগের স্মৃতি ঘাটলেই দেখা যায় মা ডাক শুনতে শুনতে রাত শেষে নতুন ভোর আসত রেহানা বেগমের জীবনে। আবার সেই মা ডাক শুনতে শুনতেই দিন শেষে রাত্রি গভীর হতো। ছোট ছেলে সংগ্রাম দুই মেয়ে স্মৃতি, ইতি, পুত্রবধূ জেরিন প্রতিটা কথার আগে তাদের মা না ডাকলে যেন শান্তি লাগতনা। রক্তিম অফ ডিউটিতে যতটা সময় পেতো পুরোটা সময় কিছুক্ষণ পরপর ফোনকলে মায়ের সাথে মন খুলে কথা বলত। সেও অন্যদের মতোই প্রতিটা কথার শুরুতে এবং শেষে মা শব্দটা উচ্চারণ করতোই। সেই দিন গুলো এখন শুধু জমে আছে স্মৃতির খাতায়। মাঝখানে কতশত দিন গেল। রেহানা বেগমের মাতৃ হৃদয়টা মা ডাক শুনে তৃষ্ণা মিটাতে ব্যর্থ। বড় মেয়ে স্মৃতির বিয়ে হয়ে গেছে। বাবার বাড়ির শোক ভুলে স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত সে। সারাদিনে একবারও সময় হয়না মা’কে ফোন করে মা বলে একটু ডাকার। আর ছোট মেয়ে বড় ভাই বাড়িতে না থাকার জন্য মা’কে দায়ী করে কাছে থেকেও সারাক্ষণ দূরে সরে থাকে। রেহানা বেগমের মাঝে মাঝেই মনে হয় অনর্থক বেঁচে থেকে শ্বাস নিয়ে শুধু শুধু বিশুদ্ধ অক্সিজেন নষ্ট করছেন। তার বেঁচে থাকা আর না থাকাই কিছুই হবেনা এ পৃথিবীর কারো। যে নারীর সন্তান থেকেও নেই। সুখের সংসার পূর্ণ হয় অসুখে। স্বামী নামক আস্থাভাজন মানুষটাও সর্বক্ষণ দেখিয়ে যায় শুধু নির্লিপ্ততা। সে নারীর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়না। কিন্তু মরতেও পারেনা। আত্মহত্যা যে মহাপাপ। বুক ভরা বেদনা, হাহাকার, তৃষ্ণা নিয়েই কাটাতে হবে বাকীটা জীবন।

ইতি এখনো তাকিয়ে আছে মায়ের মুখের দিকে জবাবের আশায়। কন্ঠ কাঁপে রেহানা বেগমের। গলার কাছে কথারা এসে গিট পাকিয়ে থাকে। বহুকষ্টে ভাঙ্গাস্বরে তীব্র চেষ্টার পর বলতে পারেন,

“হু!”

সাথে সাথে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ইতির। মায়ের দুঃখ গুলো সে বুঝে।এতোটা কাছে থেকে মেয়ে হয়ে মায়ের দুঃখ বুঝবেনা এতোটা পাষাণ মেয়ে তো আর ইতি না। কিন্তু সবটা বুঝেও তার কিছুই করার থাকেনা। তার কাছে সবসময় মনে হয় মায়ের এই কষ্ট পাওয়াটা পুরোটাই মায়ের স্বভাবের জন্যই হচ্ছে। যে বা যারা চলে যাবার কোনো না কোনো উছিলায় তারা তো চলেই গেছে। সেই চলে যাবার দায়ে কাছে থাকা সন্তানকে দায়ী করে দূরে ঠেলে দেওয়াটা পা দিয়ে ঠেলে লক্ষি বিদায় করার মতো হয়ে গেল না! যেখানে পুরো শহর জানে রক্তিম নির্দোষ। নিজের ভাই, স্ত্রী খুনের পিছনে রক্তিমের কোনো হাত নেই। সেখানে মা হয়ে রেহানা বেগম কেন এটা বিশ্বাস করতে পারেনা? কেন এভাবে দূরে ঠেলে দিল রক্তিমকে? ইতির বরাবরই মনে হয়, শুধুমাত্র তার মা ভাইকে দূরে ঠেলে দেবার কারণেই ভাইটা তার একজন আদর্শবান মানুষ থেকে গুন্ডা মাস্তানে পরিণত হয়েছে। ঠিক এই জায়গাটা থেকেই মায়ের প্রতি ইতির অভিমান।এ বিষয়ে যতবার মা’কে বুঝানোর চেষ্টা করেছে ঠিক ততবার মা তাকেও কথার আঘাতে জর্জরিত করে দূরে সরে যেতে বাধ্য করেছে। তবুও ইতি কিছুদিন যেতেই বেহায়ার মতো বারবার আসে বুঝাতে। যেমনটা এসেছে আজকে।

নিঃশব্দে মায়ের পাশে বসে কাধে মাথা রাখে ইতি। সহসা এক টুকরো প্রশান্তিতে চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় রেহানা বেগম। বুক ভরে টেনে নেয় শান্তির নিশ্বাস।করেছেন
“কাল যখন ভাইয়া বাড়িতে এসেছিল এক ধ্যানে কিভাবে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল! একটু কথা বললে কি এমন হতো মা?”

সহসা বন্ধ চোখ জোড়া খুলে তাকায় রেহানা বেগম। তড়িৎ নিজের কাধ থেকে মেয়ের মাথাটা নামিয়ে দেয়। শক্ত চোখে তাকিয়ে বলেন,

“আবারও ঐ খুনির সাফাই গাইতে এসেছিস আমার কাছে?”

ইতির চিত্ত বিগলিত হয়। মায়ের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে অশ্রুস্বজল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

“আর কত মা? আর কত! আর কত এভাবে কষ্ট দিবে ভাইয়াকে? শুধু যে ভাইয়া একাই কষ্ট পাচ্ছে এমনটাও না। তার মতো সমান কষ্ট তুমিও পাচ্ছো। তবে কেন এতো রাগ তোমার? কেন তুমিও কষ্ট পাচ্ছো ভাইয়াকেও কষ্ট দিচ্ছো। তুমি চাইলেই কিন্তু আমাদের বাড়িটা একটু হলেও আগের মতো হতে পারে মা। ভাইয়া জীবনটাকে সুন্দরভাবে সাজাতে পারে। ও তোমার ছেলে মা। তোমার প্রথম সন্তান। যার মুখ থেকে তুমি প্রথম মা ডাক শুনেছিলে। তোমার সেই ছেলে রাজপ্রাসাদের মতো নিজের বাড়ি রেখে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। নিজের পরিচয় নিজের বাবার পরিচয় সব দূরে ছুড়ে গুন্ডা পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছে মানুষের কাছে। তোমার কি একটুও কষ্ট হয়না তার জন্য? এখনো সময় আছে মা। তুমি চাইলেই আবারও ভাইয়ার জীবনটা নতুন মোড় নিতে পারে। আমাদের সবার জীবনে আবারও শান্তির বর্ষণ নামতে পারে। প্লিজ মা সময় থাকতে থাকতে সব ঠিক করে নাও। আর নষ্ট হতে দিওনা ভাইয়াকে। প্লিজ!”

ইতির আহাজারিতে থমকে থাকে রেহানা বেগম। অপলকে তাকিয়ে থাকে মেয়ের কান্নারত মুখের দিকে। একসময় জড়বস্তুর মতোই অসাঢ় কন্ঠে বলে ওঠে,

“আচ্ছা! সব ঠিক করে দিব। কাছে টেনে নিব তোর গুন্ডা ভাইকে। বিনিময়ে আমি কি পাব? ফিরে আসবে আমার মরে যাওয়া ছোট ছেলেট সংগ্রাম শিকদার? ফিরে পাব আমার আদর্শবান বড় ছেলে আর্মি ক্যাপ্টেন রক্তিম শিকদারকে? যে রাতে নিজের বড় ছেলের হাতে ছোট ছেলে খুন হয়েছে সেই রাতের স্মৃতিটুকু মুছে যাবে আমার মন-মস্তিষ্ক থেকে? উত্তর দে। পাব আমি আমার হারিয়ে ফেলা সুখ গুলো?”

শেষের কথা গুলো বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে যান রেহানা বেগম।দু-হাতে ইতির কাধ ঝাকিয়ে একই প্রশ্ন করতে থাকেন বারবার। উত্তর দেবার মতো ইতি কোনো শব্দ খোঁজে পায়না। মায়ের চিৎকারের সাথে সাথে সে নিজেও চিৎকার করে কাঁদে। একসময় মায়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বেরিয়ে যায় রুম থেকে। এসেছিল সব ঠিক হয়ে যাবে এমন একটা আশা নিয়ে। অথচ যেতে হলো বুক ভরা যন্ত্রণা নিয়ে।

চলবে…….

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৫
#আদওয়া_ইবশার

অলস দুপুর। সূর্যটা একেবারে মাথার উপর। অসহ্য রকম গরম পরেছে। দুই ক্লাস বাদ রেখেই গরমে টিকতে না পেরে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ইতি। রাস্তায় আসতেই দেখতে পায় দূরে মেহেদী দাঁড়িয়ে আছে। ইতিকে বেরোতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে তার দিকে। একদম ইতির সোজাসুজি দাঁড়িয়ে ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। গরমে ছেলেটার ফর্সা মুখের আদল লাল হয়ে আছে। কপালের পাশ দিয়ে চিকন ঘামের রেখা নামছে। এক পলক সেদিকে তাকিয়ে উল্টো পথে হাটা ধরে ইতি। হতবম্ভ হয় মেহেদী। কয়েক পল ইতির গমনপথে তাকিয়ে থেকে তড়িৎ এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে। সাথে সাথেই শুনতে পায় ইতির ঝাঝালো স্বর,

“মাঝ রাস্তায় একটা মেয়ের হাত ধরতে লজ্জা করেনা? অসভ্য পুরুষ কোথাকার!”

ইতির এহেন আচরণে ব্যথিত হয় মেহেদী। অসহায় মুখে তাকিয়ে জানতে চায়,

“এমন করছো কেন আমার সাথে? কি করেছি বলবে তো একবার!”

“আগে হাত ছাড়ুন।”

শক্ত কন্ঠে বলে ইতি। অধৈর্য্য হয় মেহেদী। হাতের বাঁধন আরও জোরালো করে নাছোড়বান্দা হয়ে বলে,

“আগে আমার কথার জবাব দাও। পরে হাত ছাড়ব কি না ভেবে দেখব।”

চোখ পাকায় ইতি। বলে,

“আমি কিন্তু চিৎকার করে লোক জড়ো করব। গণপিটুনি খাওয়ার আগে হাত ছাড়ুন”

“করো। আমিও দেখি রক্তিম শিকদারের বন্ধুর গায়ে টাচ করার মতো কলিজা কার আছে।”

ভাবলেসহীন জবাব মেহেদীর। নিম্নোষ্ঠ কামড়ে কতক্ষণ মেহেদীকে দেখে ইতি জবাবে বলে,

“রক্তিম শিকদারের বন্ধুর গায়ে টাচ করার কলিজা নেই কারো। অথচ রক্তিম শিকদারের বোনের হাত ধরার কলিজা ঠিকই আপনার আছে তাই না! খবরটা তো রক্তিম শিকদারের কানে পৌঁছেতে হয়। সে না হয় এসে মেপে দেখল তার বন্ধুর কলিজাটা কত বড়।”

কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরে যেতে দেখে একটু বিরক্ত হয় মেহেদী। পরপরই বিরক্তি ভাবটা ঝেড়ে ফেলে হাতের জোড়ালো টানে ইতিকে আরো একটু কাছে টেনে নেই। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে দুজনের। প্রগাঢ় অনুভূতির মিশেলে ডাকে মেহেদী,

“এই ইতু!”

ছোট্ট একটা ডাকেই জমে যায় ইতি। মনে জমে থাকা অভিমানটুকু গলতে শুরু করে একটু একটু করে। এই ছেলে আস্ত এক জাদুকর। যখনই ইতি ভাবে একটু রেগে কিছুদিন দূরে থেকে শাস্তি দিবে, ঠিক তখনই এমন করে নিজের জাদুবলে সব ভেস্তে দেয়। কিন্তু এবার তো তাকে গলে গেলে চলবেনা। শক্ত রাখতে হবে নিজেকে। পর পর কয়েকটা ঢোক গিলে শান্ত রাখার প্রয়াস চালায় নিজেকে। চোখ ফিরিয়ে নেয় মেহেদীর থেকে। তৎক্ষণাৎ দুহাতের আজলায় ইতির মুখটা ধরে নিজের দিকে ফিরায় মেহেদী। ব্যকুল হয়ে জানতে চায়,

” এতো নিষ্ঠুর কেন তুমি? আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছো!কি করেছি? আমার অপরাধ কি? কেন এভাবে ইগনোর করছো একবার বলো আমাকে। প্রয়োজনে শাস্তি দাও, মারো। তবুও এভাবে অবহেলা করোনা জান প্লিজ!”

“ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে। তাই এভাবে অবহেলা করছি। উত্তর পেয়েছেন? এবার দয়া করে ছাড়ুন আমাকে। নইলে কিন্তু এখন সত্যি সত্যি চিৎকার করে লোক জড়ো করব।”

বহুকষ্টে নিজের অনুভূতি গুলোকে দমিয়ে শক্ত কন্ঠে জবাব দেয় ইতি। একটু থমকায় মেহেদী। পরোক্ষণে ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুটিয়ে বলে,

“মজা করছো না! আরে বাবা তোমার এই মজা যে আমাকে শান্তিতে নিঃশ্বাস টুকুও নিতে দিচ্ছেনা বুঝতে পারছো তুমি? অনেক হয়েছে মজা। এবার এসব থামাও। একটু স্বাভাবিক হয়ে দুটো কথা বলে আমার মনটা শান্ত করো।”

এক ঝটকায় মেহেদীর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে পিছিয়ে যায় ইতি। ঝাঝালো স্বরে মৃদু চিৎকারের সাথে বলে,

“আমি তো সবসময় মজা করি। কখনও আমার কোনো কথা তোমার কাছে সিরিয়াস মনে হয়েছে? এক বিন্দু পরিমাণ মূল্য কখনো আমাকে বা এই সম্পর্কটাকে দিয়েছো? যদি দিতে তাহলে আমার কথা একবার হলেও ভেবে দেখতে। এভাবে আমার ভাইয়ের পিছু নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় গুন্ডামি না করে নিজেও ভালো হতে আমার ভাইকেও ভালো হওয়ার পরামর্শ দিতে। কিন্তু কি করছো তুমি? সেই আমি যা নিষেধ করি তাই। একই ভাবে গুন্ডামি আর মাস্তানি। তোমার না আছে নিজেকে নিয়ে ভাবনা না আমাকে আর না আমার ভাইকে নিয়ে। তুমি শুধু মুখেই ভাইয়াকে নিজের প্রাণের বন্ধ বলো। প্রকৃত পক্ষে বন্ধু হলে এভাবে তাকে খারাপ কাজে এপ্রিশিয়েট করতে না। আমাকেও তো ভালোবাসো না। ভালোবাসলে অন্তত আমাকে পাওয়ার চিন্তা তোমার মাথায় থাকত। কিভাবে নিজেকে যোগ্য করে আমার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সেই চিন্তা থাকত। কিন্তু কয়? কিছুই তো নেই তোমার মাঝে। তবে কেন শুধু শুধু ভালোবাসতে যাব তোমাকে? যাতে ভবিষ্যতে তোমাকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় নিঃশেষ হতে পারি?”

উত্তরে নিরবতাকেই বেছে নেয় মেহেদী। কিছুই বলেনা। শুধু শান্ত চোখে তাকিয়ে দেখে প্রিয়তমার অশান্ত রূপ। প্রায় মিনিট পাঁচেক সময় পর ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে বলে,

“কোনটাকে খারাপ কাজ বলছো তুমি? রাস্তা-ঘাটে মেয়েদের উত্তক্ত করা বখাটেদের শায়েস্তা করাটা খারাপ কাজ? না কি অসহায় মানুষের গলায় পারা দিয়ে তাদের রক্ত চুষে খাওয়া পিশাচদের শায়েস্তা করাটা খারাপ কাজ? অন্যায়ের প্রতি সোচ্চার হওয়া যদি খারাপ হয় তবে ভালো কি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া?”

“এসবের জন্য দেশে আইন আছে। তোমাদের তো কেউ বিচার করার দায়িত্ব দেয়নি। আইনের লোক না হয়েও অপরাধির শাস্তি দেওয়াটা এক প্রকার অপরাধ।”

তাচ্ছিল্য হাসে মেহেদী। শ্লেষাত্মক স্বরে বলে,

“আইন! হাহ্! কোন আইনের কথা বলছো তুমি? যে আইন সর্বদা টাকার কাছে বিক্রি সেই আইন? যে আইন একটা মেয়ে ধর্ষিত হবার পর এসে তদন্ত করার নামে হাজারটা নোংরা কথা বলে মেয়েটাকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে সে আইন?”

ইতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায়না মেহেদী। একটা রিকশা ডেকে ইতির সামনে দাড় করিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায় প্রিয়তমার রাগ ভাঙ্গানোর কথা ভুলে। অসহায় নয়নে ইতি শুধু তাকিয়ে দেখে মেহেদীর প্রস্থান। ব্যর্থতার নিঃশ্বাস ছাড়ে বুক ফুলিয়ে।

****

আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেছে দৃষ্টি ঢাকা ছেড়ে ময়মনসিংহ নিজের বাড়িতে এসেছে। সাময়িক ছুটি কাটিয়ে আবারও শুরু হয়ে গেছে পড়াশোনা। লেগে গেছে ভর্তি যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার কাজে। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ মন টিকছেনা তার বইয়ের মাঝে। মাথায় কতক্ষণ পর পর কিলবিলিয়ে উঠছে রক্তিম শিকদার নামক প্রেম পোকা। কিছু একটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে সর্বক্ষণ বলছে, “রক্তিম শিকদারের নাম্বার নিজের কাছে থাকতেও এখনো বোকার মতো কিসের জন্য বসে আছিস তুই? যাতে অন্য কোনো মেয়ে এসে তোর আগেই ভাগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এজন্য?”

দৃষ্টি বিরক্ত। নিজেই নিজের প্রতি চরম ভাবে বিরক্ত। তার এক মন বলে,পড়াই মন দে। ঢাকায় কোনো একটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেলে কপাল খুলবে তোর। সবসময় তোর হিরোর কাছাকাছি থাকতে পারবি। আরেক মন বলে, দেরি করে লাভ নেই। এখনই মনের কথা বলে দে। এই এক মনের দুই ভাবনা নিয়ে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা তার। না হচ্ছে পড়া আর না হচ্ছে প্রেম। কি করবে সে! বইয়ের মাঝে মাথা ঠেকিয়ে ভাবে কিছুক্ষণ। পর পর ওঠে গিয়ে বিছানায় অবহেলায় পরে থাকা ফোনটা হাতে তুলে নেয়। কল লিস্টে ঢুকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে “My real hero” নামে সেইভ করে রাখা নাম্বারটার দিকে। যে নাম্বারে অসংখ্যবার কল দিতে গিয়েও আবার কেটে দিয়েছে। অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়িয়ে তুসীর নাম্বারে ডায়াল করে। অপরপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই তুসীকে কিছু বলতে না দিয়ে দৃষ্টি হাহাকার করে ওঠে,

“তুসুরে! আমি মরে যাচ্ছি। প্লিজ বাঁচা আমাকে।”

তুসী নিজেও বইয়ের মাঝে ডুবে ছিল। হঠাৎ দৃষ্টির ফোন পেয়ে যতটা না বিরক্ত হয়েছে তার থেকেও বেশি ত্যক্ত তার কথা শুনে। বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে বিরক্ত প্রকাশ করে বলে,

“আচ্ছা! তো মর। কখন মরছিস একটু বলে দে এখন। তাহলে আগেভাগেই রওনা দিব আমরা। নইলে ঢাকার যে জ্যাম। দেখা যাবে তোর মুখটা এক পলক আমাদের না দেখিয়েই কবর দিয়ে দিবে। শেষ দেখা দেখতে না পেয়ে পরে আফসোস করতে হবে।”

এহেন জবাবে ফুসে ওঠে দৃষ্টি। রাগ-দুঃখ দুটোর মাঝে পরে দোলাচলে ভেসে বলে,

” হা’রা’মি কু’ত্তা কষে একটা লাথি খাবি তুই। আমি মরে যাচ্ছি আমার যন্ত্রণায়। কোথায় একটু আমাকে শান্তনা দিবে, বুদ্ধি দিবে। তা না করে কখন মরব সেটা জানতে চায়! আমার খালা তোর মতো এমন নিমক হা’রা’মি কিভাবে পেটে ধরল।”

“সেটা তোর খালাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। অযথা আমার কানের কাছে কাও কাও করে মেজাজ নষ্ট করবিনা। পড়ছি। ফোন রাখ।”

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথা গুলো বলে তুসী নিজেই ফোন কেটে দেয়। আশাহত হয়ে তাজ্জব বনে কতক্ষণ বসে থাকে দৃষ্টি। মনে মনে ফুসে ওঠে তুসীকে যা মনে এসেছে তাই বলে বকে ধমকে নিজেকে একটু শান্ত করে। এরপর আবারও মনোনিবেশ করে ফোনে। আগে পরে কোনো কিছু না ভেবেই গানের দুটো লাইন টাইপ করে পাঠিয়ে দেয় নাহিদের নাম্বারে,

প্রেমে পরেছে মন প্রেমে পরেছে,
অচেনা এক মানুষ আমায় পাগল করেছে।

ছোট্ট বার্তাটা পাঠিয়ে অদম্য এক আনন্দ হয় দৃষ্টির মনে। প্রাণখোলা হেসে ফুরফুরে মনে আবারও বইয়ে নজর দেয়। জটিল একটা অংকের সমাধান করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। একদম শেষ পর্যায় আসতেই টুং করে নোটিফিকেশন বেজে ওঠে ফোনের। সাথে সাথেই ধরফরিয়ে ওঠে দৃষ্টি। মন ছুটে যায় অংক থেকে। কাজটা নিশ্চয়ই সীম কোম্পানির। এছাড়া আর কারো না। বুকে থুথু দিয়ে সীম কোম্পানিকে বকতে বকতে ফোন হাতে তুলে নেয়। লক খুলে ম্যাসেজ অপশনে ঢুকতেই ছানাবড়া হয়ে যায় চোখ দুটো। রক্তিমের নাম্বার থেকে ফিরতি ম্যাসেজ এসেছে! এ ও সম্ভব! দ্যা গ্রেট গুন্ডা রক্তিম শিকদার নিজের ব্যক্তিত্বের বাইরে গিয়ে দৃষ্টির ম্যাসেজের রিপ্লাই দিয়েছে! বিশ্বাস হয়না দৃষ্টির। নিজেকে সামলে ঝটপট হাতে টাচ করে ম্যাসেজটা পুরোপুরি সো করে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অপ্রত্যাশিত এক গানের কিছু লাইন,

‘কীবা তোমার নাম গো কন্যা বাড়ি কোন গেরাম?
গ্রাম ঠিকানা যদি জানিতাম,
আমি তোমার বাড়ি ঘটক পাঠাইতাম।
আমি তোমারে বউ বানাইতাম।’

চলবে…….

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-২+৩

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২
#আদওয়া_ইবশার

ফুরফুরে এক সকাল। মৃদুমন্দ বাতাসের তোড়জোড়ে রোদের তেজ একদম নেই। তূর্ণার স্বামী সাইফুল তার দুই শালীকা দৃষ্টি, তুসীকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। তিনজনই বিভিন্ন কথার তালে তালে এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তার কিণার ঘেষে। কিছুদূর যেতেই দৃষ্টির চঞ্চল দৃষ্টিজোড়া থমকে যায় এক জায়গায়। তাদের থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরেই রক্তিম শিকদার তার দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তার জ্বলন্ত সিগারেট। বাইকে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ধূসর রাঙা ঠোঁট দুটোর ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট রেখে ধোয়া উড়িয়ে বিষাক্ত করছে নির্মল বাতাসটুকু। এই দৃষ্টিকটু দৃশ্যটুকুও মুগ্ধতা নিয়ে দেখে যাচ্ছে দৃষ্টি। তার মনে হচ্ছে পৃথিবীতে যত সুন্দর দৃশ্য আছে তার মধ্যে অন্যতম একটা হলো রক্তিম শিকদারের সিগারেট খাওয়ার দৃশ্য। কত সুন্দর দক্ষতার সাথে সিগারেটে এক একটা টান দিচ্ছে! ধোয়া গুলোও কি সুন্দর নিপুণ শিল্পের মতো কুন্ডুলি পাকিয়ে উড়ে যাচ্ছে! কারো সিগারেট খাওয়ার স্টাইল বুঝি এতো সুন্দর হতে পারে? জানা নেই দৃষ্টির। সে শুধু জানে, সবার কাছে গুন্ডা হিসেবে পরিচিত এই রক্তিম শিকদারের প্রতিটা জঘণ্য থেকেও জঘণ্যতম কাজ গুলো তার কাছে নিপুণতার সাথে ধরা দিচ্ছে।

দৃষ্টিকে হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে কিছুটা অবাক হয় সাইফুল, তুসী দুজনেই। জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে সাইফুল জানতে চায়,

“কি ব্যাপার শালিকা! দাঁড়িয়ে গেলে যে!”

ধ্যান ভাঙ্গে দৃষ্টির। ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও এক পলক রক্তিমের দিকে তাকায়।দৃষ্টির তাকানো অনুসরণ করে তুসী সেদিকে তাকাতেই দেখতে পায় দলবল সহ রক্তিম শিকদারকে। যা বোঝার বুঝে যায়। বিরবির করে বলে ওঠে,

“কাম সাড়ছে! সিন্নিও বাড়া মোল্লাও খাড়া।”

ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির ঝিলিক নিয়ে দৃষ্টি রক্তিমের থেকে নজর সরিয়ে সাইফুলকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“একটা গান শুনবেন ভাইয়া?”

সাথে সাথেই নারাজ কন্ঠে বলে ওঠে তুসী,

“তোর কর্কশ কন্ঠের গান শুনে এখন কান পঁচানোর কোনো শখ নাই। দ্রুত হাটা দে। বাসায় যাব।”

ফুসে ওঠে দৃষ্টি। নাক-মুখ কুঁচকে বলে,

“তোর কথা শুনতে যাব কেন আমি? তোকে জিজ্ঞেস করেছি? ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছি। ভাইয়া যা বলবে তাই শুনব আমি। তুই একদম চুপ থাক।”

পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে বুঝতে পারে সাইফুল। তার একমাত্র খালা শাশুড়ির একমাত্র মেয়েটা যে একটু পাগলাটে আর খ্যাপাটে স্বভাবের এটাও জানে। এই রাস্তায় দুজনের মাঝে কোনো ঝামেলা যাতে না হয় এজন্য পরিস্থিতি সামাল দিতে সায় জানায় দৃষ্টির কথায়,

“তুমি গান জানো এটা আগে বলবেনা! দ্রুত একটা গান গেয়ে ফেলো তো। এই সুন্দর ওয়েদারে একটা গান হলে মন্দ হয় না।”

সম্মতি পেয়ে সন্তুষ্টচিত্তে দু-পা এগিয়ে আসে দৃষ্টি। তুসীর দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে আবারও দৃষ্টি ফেলে রক্তিমের দিকে। ঠোঁটের কোণে সেই দুষ্টু হাসির রেখা ধরে রেখেই গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে,

প্রাণ দিতে চাই, মন দিতে চাই
সবটুকু ধ্যান সারাক্ষণ দিতে চাই
তোমাকে, ও তোমাকে
স্বপ্ন সাজাই, নিজেকে হারাই
দু’টি নয়নে রোজ নিয়ে শুতে যাই
তোমাকে, ও তোমাকে

নিরব পরিবেশ চাপিয়ে হঠাৎ বেসুরা মেয়ে কন্ঠের গান শুনে দলের ছেলেগুলো সব মাথা তুলে তাকায় রাস্তার অপর পাশে। দেখতে পায় এক সপ্তদশী কন্যা তার চিকন গোলাপী ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে সুর ছাড়াই গানের চরণ গুলো আওড়াচ্ছে। বিরক্ত হয় সকলেই। রক্তিমের একদম কাছ ঘেষে দাড়ানো সিয়াম বিরক্তি ভঙ্গিতেই বলে,

“এ ভাই! এই টয়লেট সিঙ্গার কই থেকে আমদানি হলো? কাকের কন্ঠে কোকিলের কুহু কুহু গান গেয়ে পরিবেশ নষ্ট করার জন্য রাস্তায় নেমেছে।”

পাশ থেকে রাকিব হালকা রাগের সাথে বলে ওঠে,

“তুই শুধু কাকের কন্ঠই শুনলি! বড় ভাইদের সামনে কেমন বেয়াদবের মতো গান গায়ছে এইটা দেখছিস না? আমাদের কথা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু সয়ং রক্তিম শিকদার উপস্থিত যেখানে, সেখানে এই মেয়ে এমন আবালের মতো গলা ছেড়ে গান গাওয়ার সাহস পায় কিভাবে? ভাবতে পারছিস দেড় ইঞ্চি মেয়ের কলিজা কত বড়?”

হাতে থাকা সিগারেটে শেষ টান দিয়ে উচ্ছিষ্ট অংশ টুকু পায়ের কাছে ফেলে পিষে দেয় রক্তিম। কাজটা সম্পূর্ণ করে নাক মুখ দিয়ে ধোয়া উড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে রাকিবের দিকে তাকিয়ে বলে,

“এসব ফালতু বিষয়ে মাথা ঘামানোর জন্য রেখেছি তোদের? এই মেয়ের কলিজা কত বড় আমার সেটা দেখার থেকেও জরুরী মাসুম বিল্লার কলিজা কত বড় সেটা দেখা। যে কাজ দিয়েছি মন দিয়ে সেটা কর।”

মুহূর্তেই তৎপর হয়ে ওঠে দলের সকলেই। মেহেদী রাগত স্বরে দাপটের সাথে বলে ওঠে,

“নিশ্চিন্তে থাকেন ভাই। পাতালের নিচ থেকে হলেও খোঁজে এনে ঐ শা’লা’রে আপনার পায়ের কাছে হাজির করব। সাহস আসলেই বেড়ে গেছে মা***।”

চোয়ালদ্বয় শক্ত রক্তিমের। পিচঢালা রাস্তায় দৃষ্টি স্থির রেখে হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“দুদিন হলো বাপ ক্ষমতায় এসেছে। এখনই এলাকায় রাজ করা শুরু করে দিয়েছে!দুপুরের আগে আমার সামনে এনে হাজির করবি ঐ জা’নো’য়া’র’কে। যে হাত দিয়ে চাদাবাজি করে বেড়ায়, মেয়েদের ওড়না নিয়ে টানাটানি করে। সেই হাত চিরতরে পঙ্গু না করা পযর্ন্ত আমার শান্তি হবেনা।”

****

বিকেলের শেষ প্রহরে ড্রয়িং রুমে লুডু খেলার আয়োজন করেছে তূর্ণা। দুই দলে খেলা হবে। এক দলে তূর্ণা আর তার হাসবেন্ড সাইফুল। আরেক দলে দৃষ্টি, তুসী। কিন্তু বেঁকে বসে তুসী। সে কিছুতেই দৃষ্টির সাথে দল মিলিয়ে খেলবেনা। সকালের সেই ঘটনার জেড় ধরে সারাদিন দৃষ্টির থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে তুসী। মনে মনে পণ করেছে যে পযর্ন্ত এই মেয়ের মাথা থেকে রক্তিম নামক ভূত না নামবে সে পযর্ন্ত কোনো কথা বলবেনা তার সাথে। অনেকবার চেষ্টা করেছে দৃষ্টি তুসীর রাগ ভাঙানোর। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় তুসী। হেরে গিয়ে একসময় বেঁকে বসে দৃষ্টি নিজেও। সেও আর আগ বাড়িয়ে তুসীর সাথে কথা বলতে যায় নি। দুজনের এই মনোমালিন্য চলাকালিন একসাথে জোড়া বেঁধে খেলার কোনো প্রশ্নই আসেনা। দুটোকে মানাতে গিয়ে হাঁপিয়ে যায় তূর্ণা নিজেই। এক পর্যায় হতাশ ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

“তোরা দুটো কি আজীবন এমন সতীনের মতো ঝগড়ায় করে যাবি? কখনো কি একটুও মিল-মিশাদ হবেনা তোদের মাঝে? বড় হচ্ছিস না দিন দিন ছোট হচ্ছিস দুটো!”

বোনের এতো গুলো কথা শুনে গাল ফুলায় তুসী। আড় নজরে তাকিয়ে ভার কন্ঠে বলে ওঠে,

“আমরা না হয় অবুঝ। কিন্তু তুমি তো খুব বুঝদার! তাহলে তুমি এমন করছো কেন? তোমাদের দুজনের দল ভেঙ্গে ভাইয়া আর তোমার সাথে আমাদের ভাগ করে নিলেই তো হয়। একটু তো খেলবোই। তোমার জামাইকে তো আর একেবারে তোমার থেকে নিয়ে যাচ্ছিনা।”

এমন কথায় কিটকিটিয়ে হেসে ওঠে সাইফুল। স্বামীর দিকে চোখ গরম করে তাকায় তূর্ণা। বোনের রাগটা ঝেড়ে দেয় স্বামীর উপর। বাঁজখায় কন্ঠে খ্যাঁকিয়ে ওঠে,

“এমন বিটলারি হাসি হাসবেনা আর কত বলতে হবে তোমাকে? তোমার এই কুৎসিত হাসির থেকে শয়তানের হাসিও বেশি সুন্দর।”

সাথে সাথে চুপসে যায় সাইফুল। মুখ কাচুমাচু করে বসে থাকে এক কোণায়। বউয়ের প্রতি অভিমান জন্মায় অল্প পরিমাণে। দুই শালীর এভাবে না বললেও হতো। বউ নামক দিল্লীকা লাড্ডু দেড় বছরেই তার জীবনটা একেবারে তুলাধুনা করে ফেলেছে। কেন যে মানুষ সুখ ধ্বংস করে দুঃখের সাগরে ডোবার জন্য বিয়ে করতে লাফায়! তার যদি সাধ্যি থাকত তবে বিয়ের পরপরই বউয়ের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে ব্যাচেলার লাইফে ফিরে যেতো। সেই সাথে বাংলাদেশের সংবিধানে নতুন এক আইন প্রণয়ণ করতো। সকল বাঙ্গালী অবিবাহিত ছেলেদের সন্নাসী হয়ে জীবন কাটানোর আইন। কিন্তু বেচারা বউয়ের ঝাঝালো কথার ফাঁকে ফাঁকে দুই-একটা মিষ্টি কথার জালে ফেঁসে গেছে। বউকে ভালোবেসে এতোটাই মাথায় তুলে ফেলেছে এখন না পারে এসব অত্যাচার সহ্য করতে। আর না পারে কিছু বলতে।

খেলতে গিয়ে এমন ছোটখাট ঝামেলার মাঝ দিয়েই কেটে যায় সময়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। চারিদিকের মসজিদ থেকে একে একে ভেসে আসে আজানের মিষ্টি সুর। সন্ধ্যার পর খেলা বাদ দিয়ে ঠিক করা হয় কমেডি মুভি দেখবে। মুভি প্রায় শেষের দিকে। ঠিক তখনই বাসায় আসে তূর্ণার বাবা নিয়াজ উদ্দিন। শশুর আসার আভাস পেয়ে তৎক্ষণাৎ সাইফুল টিভি বন্ধ করে ভদ্র জামাইয়ের মতো বসে থাকে চুপচাপ।শিউলী বেগম স্বামীর নিকট এগিয়ে এসে জানতে চায়,

“আজ আসতে এতো দেরী হলো যে! রাস্তায় জ্যাম ছিল না কি?”

“আর বলো না! মেয়রের ছেলেটা দিন দিন যা অশান্তির সৃষ্টি করছে। রাস্তা-ঘাটে বেড়োনোও এখন রিস্ক হয়ে পরছে। দুপুরে না কি এমপির ছেলে মাসুম বিল্লাকে মারতে মারতে আধমরা বানিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। এমপির ছেলেকে মেরে সে পাড় পেয়ে যাবে না কি? লেগেছে এখন দুই দলে হাঙ্গামা। যে হাড়ে ছুরি, লাঠি নিয়ে ছেলেপেরা রাস্তায় নেমেছে। আজ একটা রক্তারক্তি কান্ড ঘটবেই দেখে নিয়ো।”

কথাটা শোনা মাত্রই দৃষ্টির বুকের ভিতর অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এক দিনের চোখের দেখা যুবকের প্রেমে পরে মন দিশেহারা হয় তার চিন্তায়। চোখাচোখি হয় তুসীর সাথে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়েই জানিয়ে দেয় তুসী,

“বলেছিলাম এই ছেলে ডেন্জারাস। আগুনের দিকে নজর দিস না। এখন বুঝেছিস তো কতটা ভয়াবহ! এসব শুনেও ঐ গুন্ডা ছেলের প্রতি আগ্রহ থাকবে তোর?”

নজর সরিয়ে নেয় দৃষ্টি। নিজেকে কেমন অসহায় লাগছে তার। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেনা একদিনের পরিচয়ে একটা মানুষের বিপদের অশঙ্কায় তার মন এতোটা উতলা কেন হচ্ছে। তবে কি ভালো লাগাটা অচিরেই ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গেল!

চলবে……

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩
#আদওয়া_ইবশার

সাভার থানার সামনে জনসাধারণের উপচে পড়া ভীড়। দাবি তাদের একটাই ‘রক্তিম শিকদারের মুক্তি”। রাস্তাঘাটে ইতিমধ্যে মানুষের জটলায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। পুলিশ কিছুতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেনা। সাধারণ জনতা একবার ক্ষেপে রাজপথে নামলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর শক্তিও হার মেনে যায় তাদের কাছে। গতকাল দুপুরের দিকে এমপি লিয়াকত বিল্লার ছোট ছেলে মাসুম বিল্লাকে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে আধমরা অবস্থায় নিজ দায়িত্বে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন রক্তিম শিকদার। ছেলের গায়ে হাত তোলায় হিংস্র হয়ে ওঠে লিয়াকত বিল্লা। প্রতিশোধের নেশায় মত্ত হয়ে নিজের অবস্থান ভুলে গিয়ে পার্টির ছেলেদের লেলিয়ে দেয় রক্তিম শিকদারকে মারতে। দুই দলের পাল্টা আক্রমনে আহত হয় অনেকেই। হাঙ্গামার এক পর্যায়ে পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যায় রক্তিম শিকদারকে। এটেম টু মার্ডার এর অভিযোগ দায়ের করা হয় তার নামে।

সাভার উপজেলার বর্তমান সাংসদ লিয়াকত বিল্লা গত চার বছর যাবৎ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। লিয়াকত বিল্লা কেমন মানুষ, বা তার ছেলের দিকে নজর দেবার বিন্দু মাত্র আগ্রহ রক্তিমের ছিলনা। রাজনৈতিক বিষয় থেকে সবসময় রক্তিম নিজেকে দূরে রেখেছে। নিজের বাবা আজীজ শিকদার মেয়র হবার পরও কখনো কোনো প্রয়োজনেও পার্টির সাথে তার সখ্যতা হয় নি। সে শুধু নিঃস্বার্থ ভাবে যেখানে অন্যায় দেখেছে সেখানেই প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। তার এই প্রতিবাদী মনোভাবের কারণেই একটা সময় জনগণ তার প্রতি আস্থা রেখে নানা বিষয়ে সাহায্যের জন্য ছুটে আসে। লিয়াকত বিল্লার ছোট ছেলে দেড় মাস হয়েছে জাপানে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে নিজ এলাকায় এসেছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষিত হলেও মনুষ্যত্ব বোধের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই তার মাঝে। দেশের মাটিতে পা রাখার পর থেকে নিজের বাবার নাম ভাঙ্গিয়ে চাদাবাজি থেকে শুরু করে, ইভটিজিং, মারামারি সহ বিভিন্ন নেশা দ্রব্যের চালান শুরু করে। শান্তিপূর্ণ সাভারে অরাজকতার ছায়া নামে। সর্বক্ষণ প্রতিটা মা-বাবা আতঙ্কে থাকে নিজের ছেলে-মেয়ে নিয়ে। নেশার পথে ধাবিত করে তরুণ সমাজ ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে এই মাসুম বিল্লা। রক্তিম শিকদারের কাছে একের পর এক এমন অভিযোগ আসায় প্রথম প্রথম শান্তভাবে এসব বন্ধ করার জন্য বোঝায় মাসুম বিল্লাকে। কিন্তু নিজের বাবার দাপট আর টগবগে রক্তের গরমে রক্তিমের কথার তোয়াক্কা করেনা সে। দিনকে দিন তার অরাজকতা বাড়তেই থাকে। শেষ পযর্ন্ত ধৈর্য্যচ্যুৎ হয়ে রক্তিম এই পথ বেছে নেই। পুরো ঘটনা জনগণের খুব ভালো করেই জানা। রক্তিমকে গ্রেফতার করার পর থেকে এজন্যই জনগণ মরিয়া হয়ে তার মুক্তির দাবিতে রাস্তায় নেমেছে।

নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এই মুহূর্তে জনগণকে ক্ষেপিয়ে নিজের ক্ষতি ছাড়া কিছুই সম্ভব না বুঝতে পারে লিয়াকত বিল্লা। রক্তিমের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে সেটা তোলার আগ পযর্ন্ত জনগণ শান্ত হবেনা। অশান্তি আরও বাড়বে। ভোটার হারাবে সব। এই মুহুর্তে নিজের আহত ছেলের প্রতিই প্রচুর রাগ হচ্ছে তার। ছেলেকে বারবার বুঝিয়েছেন যায় করুক সাবধানতা অবলম্বন করে যেন করে। এতোবার সাবধান করার পরও আজ ছেলের কুকীর্তির জন্য তার এতো বছরের সাধনা, সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবার উপক্রম। সাধারণ একটা মেয়রের ছেলের কাছে মাথা নত করতে হবে। জনগণকে শান্ত রাখার এর থেকে ভালো উপায় এই মুহূর্তে আর কিছুই নেই। ছেলেকে হাসপাতালে রেখেই থানায় ছুটে আসে লিয়াকত বিল্লা। অভিযোগ তুলে নেয় রক্তিমের বিরুদ্ধে। উচ্ছাসে ফেঁটে পরে জনগণ। লকআপ থেকে বের হয়ে রক্তিম মুখোমুখি হয় লিয়াকত বিল্লার। শ্লেষাত্বক হেসে ঠাট্টার স্বরে বলে,

“আমাকে বারো ঘন্টাও জেলে আটকে রাখার মুরোদ নেই। বুঝতে পারছেন তো কেমন অযোগ্য এমপি আপনি! সাধারণ জনগণের কাছে এক ক্ষমতাধারী এমপির পরাজয়। বিষয়টা খুবই হাস্যকর।”

লিয়াকত বিল্লার ধরেবেঁধে আটকে রাখা তিরিক্ষি মেজাজটা রক্তিমের ঠেসমারা কথায় লাগামছাড়া হতে চাইছে বারবার। দাঁতে দাঁত পিষে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে রক্তিমের কাধে হাত রেখে বলে,

“সিংহের গুহায় ডুকে ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে তুলে নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনো না বাবা। আজ পর্যন্ত তোমার বাপ’ও আমার সাথে টেক্কা দেবার সাহস পায়নি। সেখানে একটা বাচ্চা হয়ে আমার সাথে পাল্লা দিতে আসাটা তোমার নেহাত বোকামি ছাড়া কিছুই না।”

নিচের ঠোঁট কামড়ে অল্প হাসে রক্তিম। নিজের কাধ থেকে লিয়াকত বিল্লার হাতটা সরিয়ে নিচু হয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ছোট সাপের বিষ বেশি এটা বুঝি ভুলে গেছেন? আপনার বা আপনার ছেলের সাথে লাগতে যাবার কোনো রুচিই আমার ছিলনা। কিন্তু বাপ-ছেলে মিলে যে কান্ড শুরু করেছেনএতে মনে হয় খুব বেশিদিন নিজের রুচি ধরে রাখতে পারবনা।”

কথার মাঝে একটু থামে রক্তিম। সোজা হয়ে বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে তেজস্ক্রিয় চোখে তাকায় লিয়াকত বিল্লার দিকে। চোয়াল শক্ত করে বলে,

“একবার যদি আমার রুচির দূর্বিক্ষ দেখা দেয় তবে তোদের বাপ-ছেলের ধ্বংস নিশ্চিত। সো বি কেয়ার ফুল। আমাকে ঘাটতে আসবিনা। তোর ছেলেকেও বলে দিবি বেশি বাড় যেন না বাড়ে। সুস্থ্য হবার পর চব্বিশ ঘন্টার ভিতর যেন এলাকা ছাড়ে। এবার হয়তো জানে বেঁচে গেছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার আমার চোখে তোর ছেলের কুকীর্তি ধরা পরলে একেবারে বাপ-ছেলে দুটোকেই সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে পুতে ফেলব। কথাটা ভালো ভাবে মাথায় ডুকিয়ে নিস।”

হিমশীতল স্বরে ভয়ংকর হুমকিটা ছুড়ে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়না রক্তিম। দাপটের সাথে হেঁটে বেরিয়ে যায় থানা থেকে। আগুন চোখে রক্তিমের যাবার দিকে তাকিয়ে ফুসতে থাকে লিয়াকত বিল্লা। রাগ সংবরণ করতে না পেরে সামনে থাকা চেয়ারে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে লাথি বসায়। দাঁত কিড়মিড় করে নিজ মনেই বলে ওঠে,

“এই লিয়াকত বিল্লার সাথে পাঙ্গা নিতে এসে বড় বড় রাঘব বোয়াল’ও একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আর তুই দুইদিনের ছেলে হয়ে ভেবেছিস বেঁচে যাবি!”

থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার লিয়াকত বিল্লার কথা শুনে ফিচেল হেসে বলে ওঠে,

“রক্তিম শিকদার কি জিনিস সেটা হয়তো আপনিও জানেন না স্যার। একে যত সহজ ভাবে নিবেন ততই আপনার পরাজয় নিশ্চিত হবে। ছোট সাপের বিষ বেশি, কথাটা কিন্তু ভুল বলেনি।”

কথাটা শোনা মাত্রই লিয়াকত বিল্লা হায়েনার মতো হিংস্র চোখ মেলে তাকায় অফিসারের দিকে। ঐ নজরের তোপে চুপসে যায় অফিসার। লিয়াকত বিল্লা এক ধ্যানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠোঁটের কোণে কূটিল হাসি ফুটিয়ে কিছু না বলেই বেরিয়ে যায় থানা থেকে।

সুস্থ্য শরীরে রক্তিমকে থানা থেকে বের হতে থেকে ক্ষিপ্ত জনগণ শান্ত হয়। রক্তিমের দলবল দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় তার দিকে। পায়ে পা মিলিয়ে হাটতে হাটতেই রাকিব বলতে থাকে,

“ভাই! আপনার খবর পেয়ে আপনার বাবা ঐ লিয়াকত বিল্লার কাছে গিয়েছিল অনুরোধ করতে যাতে, আপনার নামে কেইস উঠিয়ে নেয়। শা’লা’র বাচ্চা হাসপাতালে সবার সামনে আপনার বাবার কলার চেপে ধরে যা নয় তাই বলে অপমান করেছে। এর একটা বিহিত আপনাকে করতেই হবে।”

কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না রক্তিমের মাঝে। শান্ত স্বরে জানতে চায়,

“আমার বাইক কোথায়?”

“ঐযে মেহেদী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”

হাত উচিয়ে ইশারায় দেখিয়ে দেয় জাবির। সেদিকে এগিয়ে যায় রক্তিম। বাইকের কাছে গিয়ে একপলক জনগণের দিকে তাকিয়ে উঠে বসে মেহেদীর পিছনে। রাকিবের উদ্দেশ্যে বলে,

“সবাইকে এবার যে যার কাজে যেতে বল। আর ঐ হা’রা’ম’জা’দাটা হাসপাতালে মরে না বাঁচে প্রতি ঘন্টার আপডেট দিবি আমাকে।”

“কোথায় যাবি এখন?”

রক্তিমের কথা শেষ হতেই জানতে চায় মেহেদী।জবাবে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জানায়,

“শিকদার মঞ্জিলে চল।”

এতোদিন পর তার মুখে শিকদার মঞ্জিলের নাম শুনে অবাক হয় সকল ছেলেরা। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের দিকে। সবার মুখেই কিছুটা আতঙ্ক, কিছুটা খুশি। দুরকম অনুভূতি সকলের। প্রত্যেককে বিস্ময়ের সাগরে ডুবিয়ে রেখেই বাইক ছুটে যায় শিকদার মঞ্জিলের দিকে।

***

প্রায় এক বছর পর নিজের চিরচেনা সেই বাড়িতে পা রাখে রক্তিম। যে বাড়িতে তার জন্ম। যেখানে সে ছোট থেকে শৈশব, কৈশোর পুরোটা সময় পার করেছে হেসে-খেলে। যে বাড়ির প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে মিশে আছে তার হাজারটা স্মৃতি। এই বাড়িটাতেই জন্ম হয়েছিল মেয়র আজীজ শিকদারের সু-পুত্র আর্মি ক্যাপ্টেন রক্তিম শিকদারের। ঠিক এই বাড়িতেই নিজের শরীর থেকে আইনের পোশাক ফেলে গায়ে লাগিয়েছিল খুনির তকমা। হয়ে উঠেছিল একজন দেশ প্রেমী আদর্শ আর্মি অফিসার থেকে গুন্ডা রক্তিম শিকদার। বিভীষিকাময় সেই দিন সেই রাতের স্মৃতি এখনো রক্তিমকে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে দেয়না। নিকোটিনের ধোয়ায় বুকের ভিতরটা পুড়িয়ে নির্ঘুম রাত পার করে নিঃস্বঙ্গতাকে সঙ্গী করে।

সদর দরজা দিয়ে এতোদিন পর ছেলেকে বাড়িতে ডুকতে দেখে হল রুমে উপস্থিত প্রতিটা সদস্য দৃষ্টিতে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। রক্তিমের মা রেহানা বেগমের মনটা ছটফটিয়ে ওঠে দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে বুকের ভিতর টেনে নিতে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে পা দুটো আগায়না রেহানা বেগম। ঠাই দাঁড়িয়ে থেকে নিস্পলক চোখে অবলোকন করে ছেলেকে। শুনেছিল ছেলেটাকে আবার পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু এখন আবার এখানে ! তবে কি ছাড়া পেয়ে গেল! রেহানা বেগমের পাশে দাঁড়ানো রক্তিমের ছোট বোন ইতি ভাইকে দেখে ছুটে যায়। খুশিতে আত্মহারা হয়ে জড়িয়ে ভাইয়া বলে। প্রথমে একটু চমকায় রক্তিম। পরোক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বোনের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে জানতে চায়,

“কেমন আছে আমার ইতি মনি?”

“একটুও ভালো নেই ইতি মনি। তার ভাইয়াকে খুব মনে পরে তার। কিন্তু ভাইয়া একদম মনে করেনা তাকে। ভালোও বাসেনা।”

বোনের অভিযোগে ঠোঁট এলিয়ে হাসে রক্তিম। আদুরে কন্ঠে বলে,

“কে বলেছে ভাইয়ার তার ইতি মনিকে মনে পরেনা? ভাইয়া সবসময় মিস করে তার ছোট্ট পুতুল বোনটাকে।”

সাথে সাথে ভাইয়ের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে মুখ ভার করে জবাব দেয় ইতি,

“এতোই যদি মিস করো তবে কেন থাকোনা বাড়িতে? মাসের পর মাস চলে যায় একবার তো এসে দেখেও যাওনা। সেই আমাকে রাস্তা-ঘাটে গিয়ে তোমার সাথে দেখা করতে হয়।”

এই কথার কোনো জবাব নেই রক্তিমের কাছে। শান্ত চোখে বোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কথা পাল্টে জিজ্ঞেস করে,

“মেয়র সাহেব বাড়িতে আছে?”

আজীজ শিকদার বাড়িতেই ছিল। স্টাডি রুমের জানালা দিয়ে দেখেছে রক্তিমকে বাড়িতে আসার সময়। ছেলের সাথে সাক্ষাৎ করতেই নিচে নামছিল। ঠিক তখনই শুনতে পায় রক্তিমের এমন সম্বোধন। হতাশায় ছেয়ে যায় আজীজ শিকদারের মন। রক্তিমের এমন অধঃপতন মানতে না পেরে একদিন শাসন করতে গিয়ে বলেছিল, “এমন গুন্ডামি, মাস্তানি করলে তুমি আমাকে কখনও বাবা বলে ডাকবেনা। আমি কোনো গুন্ডা, মাস্তানের বাবা হতে চাইনা।”

জবাবে খুবই স্বাভাবিক চিত্তে নির্লিপ্ত স্বরে রক্তিম জবাব দিয়েছিল, “ঠিক আছে। ডাকবনা বাবা।”

সেদিনের পর থেকে ছেলের মুখে আর কখনো বাবা ডাক শুনতে পায়নি আজীজ শিকদার। সিড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতে নামতেই জানতে চায় আজীজ শিকদার,

“হঠাৎ এই অতি সাধারণ মেয়রের কথা মনে পরল কেন এলাকার গট ফাদার রক্তিম শিকদারের!”

রাশভারী গম্ভীর কন্ঠ কর্নে পৌঁছাতেই চোখ তুলে বাবার মুখের দিকে তাকায় রক্তিম। বাবার মতোই গম্ভীর স্বরে জানতে চায়,

“আমি তো খারাপ ছেলে। রাস্তা-ঘাটে গুন্ডামি করে বেড়ায়। আমার মতো এমন একটা গুন্ডা, মাস্তানের জন্য লিয়াকত বিল্লার কাছে মাথা নত করতে গিয়েছিলেন কেন?”

ছেলে তাহলে জেলে থেকেও এই খবর পেয়ে গেছে! বাবা-মা সন্তানের সুখের জন্য শুধু মাথা নত কেন? নিজের জীবনটাও হাসি মুখে দিয়ে দিতে পারে। এটা কি আর সন্তান বুঝবে? সন্তান যদি বি-পথে চলে যায় তবে বাবা-মা শাসন করতে গিয়ে তো মুখে কত কথায় বলে। তাই বলে কি সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের টান শেষ হয়ে যায়!

“পাপ করেছিলাম যে সন্তান জন্ম দিয়ে। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়েছিলাম।”

একজন বাবা ঠিক কতটা কষ্ট মনে নিয়ে এই কথাটা উচ্চারণ করতে পারে! বাবার বেদনাটা হয়তো একটু হলেও আচ করতে পেরেছে রক্তিম। তাই আর গলা উচিয়ে কিছু বলার সাহস পায়নি। কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করে ছোট্ট করে বলে,

“আর কখনো যাবেন না ঐ জা’নো’য়া’রে’র ধারেকাছে। আমি ম’র’লেও না।”

আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায়না রক্তিম। মায়ের দিকে একপলক শান্ত চোখে তাকিয়ে দ্রুত কদমে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।

****

সাদেক সাহেব মেয়েকে নিতে এসেছে। যখন থেকে দৃষ্টি শুনেছে বাবা তাকে নিতে আসবে তখন থেকেই মনটা বিষন্ন হয়ে আছে। এমনিতেই গতকাল থেকে ঐ রক্তিমের চিন্তায় অন্তঃকরণ বিষয়ে ছিল। এখন আবার এই শহর থেকে বিদায় নিতে হবে বলে মনটা আরও বিষিয়ে আছে। তার এখনই মনে হচ্ছে ঐ গুন্ডাটাকে একদিন না দেখলেই রাতে ঘুম আসবেনা। গতকাল সকালে একবার দেখার পর এখন পযর্ন্ত আর দেখা না পেয়ে এখনই মন উতলা হচ্ছে গুন্ডাটাকে একনজর দেখার জন্য। সেখানে প্রতিদিন না দেখে থাকবে সে। তাছাড়া এখন পযর্ন্ত তার মনের কথা মানুষটাকে বলায় হয়নি। তার অনুপস্থিতিতে যদি অন্য কোনো মেয়ে এসে তার হিরোর মন জয় করে নেয়! তখন কি হবে দৃষ্টির! এমন হলে ভালোবাসা পাওয়ার আগেই যে হেরে যাবে সে।কথাটা স্বরণ হতেই দৃষ্টির হাসফাস লাগতে শুরু করে। অস্থির চিত্তে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তার যাওয়া দেখে তুসীও ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে যায় পিছু পিছু। ড্রয়িং রুমে শিউলী বেগমের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত সাদেক সাহেব। দৃষ্টি এক দৌড়ে বাবার কাছে গিয়ে তাড়াহুড়ো নিয়ে বলে,

“আব্বু! তুমি একটু বসো। আমার জরুরী একটা কাজ আছে। কাজটা শেষ করেই এসে রেডি হয়ে যাব।”

মেয়ের কথায় একটু অবাক হয় সাদেক সাহেব। ভেবে পায়না এই অচেনা শহরে তার মেয়ের কি এমন জরুরী কাজ থাকতে পারে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায়,

“কি কাজ মামুনি! আমাকে বলো। যাবার সময় আমি করে দিয়ে যাব।”

“তুমি পারবেনা আব্বু। আমি যাব আর আসব।”

আর একটুও সময় নষ্ট করেনা দৃষ্টি। এক দৌড়ে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। পিছন পিছন তুসীও কিছু না বুঝেই দৌড় লাগায় দৃষ্টির দেখাদেখি।

চলবে……

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-০১

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#আদওয়া_ইবশার
#সূচনা_পর্ব

জনসম্মুখে এক যুবক চার-পাঁচটা ছেলেকে বেধড়ক পিটিয়ে যাচ্ছে। জটলা বেঁধে মানুষ জন শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে তামাশা দেখছে। কেউ এগিয়ে আসছেনা প্রতিবাদ করতে। ভীড়ের মাঝ থেকে হঠাৎ এক কিশোরী কন্ঠে উচ্ছাস নিয়ে প্রফুল্লচিত্তে বলে ওঠে,

“ওয়াও! একা একটা মানুষ কি সুন্দর এতো গুলো ছেলেকে পিটিয়ে যাচ্ছে! একেবারে সিনেমার হিরোর মতো। তুসু! তোদের এলাকায় এতো সুন্দর, সাহসী একটা হিরো আছে আগে বললি না কেন? আমি তো জাস্ট ফিদা হয়ে গেছি।”

খালাতো বোন দৃষ্টির মুখে এমন কথা শুনে নাক-মুখ কুঁচকে বিরক্ত নিয়ে তাকায় তুসী। কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে একেবারে দৃষ্টির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

“এভাবে নির্দয়ের মতো ছেলে গুলোকে মারছে সেটা দেখে কষ্ট না পেয়ে তুই মুগ্ধ হচ্ছিস? পাষাণ মেয়ে কোথাকার।কোনো অঘটন না চাইলে নজর সরা ঐ গুন্ডার থেকে। তুই জানিস এই ছেলে কতটা ভয়ংকর? যদি জানতি তাহলে ঐ সুন্দর চেহারা দেখে যতটা মুগ্ধ হয়েছিস তার থেকেও দ্বিগুণ আতঙ্কে নীল হয়ে যেতি।”

তুসীর কথায় যথাপরনায় অবাক দৃষ্টি। কন্ঠে বিস্ময় ভাব ধরে বলে,

“ওমা! চোখের সামনে জলজ্যান্ত একটা রিয়েল হিরো দেখে মুগ্ধ হব না! এমন ফাইটিং স্কিল কয়জনের থাকে? তোদের এলাকায় এরকম ছেলে আর এক পিস আছে না কি? আর এমন মারামারি সিনেমায় দেখে মুগ্ধ হতে পারলে রিয়েল লাইফে দেখে কেন মুগ্ধ হব না? শুধু সিনেমায় অভিনয় করে মারামারি করলে হিরো আর বাস্তবে করলে গুন্ডা! এটা তোর কেমন যুক্তি ভাই?”

দৃষ্টিকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয়না তুসী। হাত ধরে ঝড়ের গতিতে ভীড় ঠেলে বেরিয়ে আসে। দ্রুত পায়ে কিছুটা দূরে গিয়ে অনুনয়ের স্বরে বলে,

“বোইন!দুইদিনের জন্য বেড়াতে আসছিস ভদ্র মেয়ের মতো বেড়ানো শেষ করে চলে যা। দয়া করে কোনো ফালতু টপিক নিয়ে যুক্তি খাটিয়ে নিজের মাথার সাথে সাথে আমার মাথাটাও নষ্ট করিস না।”

ঝারি মেরে তুসীর হাতের বাঁধন থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় দৃষ্টি। চোখ পিট পিট করে বলে ওঠে,

“অদ্ভুত তো! আমি কখন তোর মাথা নষ্ট করতে গেলাম? জাস্ট বললাম ছেলেটাকে ভালো লেগেছে। সিম্পল! বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সব মানুষেরই আকর্ষণ থাকে। সেই আকর্ষণ থেকেই আমার ছেলেটাকে ভালো লেগে গেছে। বলতে পারিস লাভ এট ফার্স্ট সাইট। এতে তোর সমস্যা হচ্ছে কোথায়?”

“তুই জানিস এই ছেলে কে? কি তার পরিচয়, তার চরিত্র কেমন?”

তুসীর প্রশ্নে খুশি মনে দৃষ্টি বলে ওঠে,

“আমি তো সেই কখন থেকেই প্রশ্ন গুলো তোকে করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু তুই সেই সুযোগ দিলে তো! আচ্ছা এখন বল ছেলেটা কে?”

হতাশ হয় তুসী। বুঝতে পারে এই পাগল মেয়েকে যে পযর্ন্ত তার মুগ্ধ পুরুষের কুকীর্তি খুলে বলা না হবে সে পযর্ন্ত তার পাগলামি থামবেনা। ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

“সব বলব। কিন্তু এখানে না। আগে বাড়ি চল। তারপর যা যা জানতে চাইবি সব সব বলব। তবুও প্লিজ বোন রাস্তায় আর কোনো পাগলামি করিস না!”

মেনে নেয় দৃষ্টি। ভদ্র মেয়ের মতো মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে তুসীর হাত ধরে এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে। মনের ভিতর তার রঙিন প্রজাপতি গুলো ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছে। তার সতেরো বছরের জীবনে এই প্রথম কোনো পুরুষকে দেখে মন পায়রা গুলো বাকবাকুম করে ডাক পারছে। প্রেমহীন সতেরোটা বসন্তের পর তার জীবনে রঙিন বসন্তের কোকিল ডেকে উঠেছে। এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে!

সদ্য এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ায় গতকাল খালামনির বাড়িতে বেড়াতে এসেছে দৃষ্টি। নিজের চিরচেনা ময়মনসিংহ শহর ছেড়ে এতোদূর ঢাকা শহরের ব্যস্ত নগরী সাভারে খালামনির বাসায় খুব একটা আশা হয়নি তার। বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে হওয়াই সেই ছোট থেকেই একটু পাগলাটে স্বভাবের ছিল দৃষ্টি। যার কারণে মেয়েকে কাছ ছাড়া করতে বড্ড ভয় কাজ করে সাদেক সাহেব আর দিলশান আরা’র। এবারও তার ব্যতিক্রম হয় নি। দিনভর কান্নাকাটি করে বহু কষ্টে বাবা-মা’কে মানিয়ে তবেই খালামির বাড়িতে কিছুদিনের জন্য আসতে পেরেছে দৃষ্টি। আসার পর এই প্রথম খালাতো বোন তুসীর সাথে এলাকাটা ঘুরে দেখার জন্য বেড়িয়েছিল। আর সেখানেই দেখা পেয়ে গেল তার জীবনের বসন্তের কোকিলের।

সদর দরজা ডিঙিয়ে ড্রয়িং রুমে ডুকতেই শিউলী বেগমের প্রশ্নে সহসা থেমে যায় দুজন,

“কি রে! এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি যে? মাত্রই না বের হলি! এর মাঝে ঘুরাঘুরি শেষ?”

খালামনির প্রশ্নে অস্থিরচিত্তের দৃষ্টি কিছু বলতে নিলেই ফট করে তার মুখ চেপে ধরে তুসী। চোখ রাঙিয়ে দৃষ্টির দিকে এক পলক তাকায়। পরোক্ষণে মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখে মেঁকি হাসি ফুটিয়ে বলে,

“বাইরে প্রচুর গরম আম্মু। এমন ভর দুপুরে রোদের মাঝে কেউ হাঁটতে যায়? তোমার আহাম্মক বোন ঝি’র কথায় ঘুরতে গিয়ে গরমে আমার জান বেড়িয়ে আসছে। তাই চলে এসেছি। বিকেলে আবার যাব।”

মেয়ের কথায় পাত্তা দেয়না শিউলী বেগম। চোখ-মুখ কুঁচকে তুসীকে বলে ওঠে,

“তুই ওর মুখ চেপে ধরেছিস কেন? কি বলতে চাইছে বলতে দে। ওর মুখ থেকে হাত সরা বলছি।”

মায়ের কঠিন ধমকে ধপ করে নিভে যায় তুসী। সাথে সাথেই দৃষ্টির মুখ থেকে হাত সরিয়ে ইশারায় অনুরোধ করে, “প্লিজ বোন! দয়া করে আম্মুকে রাস্তার ঘটনা বলতে যাস না।” দৃষ্টি বোঝে নেয় তুসীর চোখের ভাষা। কথা ঘুরিয়ে বলে,

“তেমন কিছুনা খালামনি। আমি আর একটু ঘুরতে চাইছিলাম কিন্তু তোমার মেয়ে দিলনা। এটাই বলে চাচ্ছিলাম তোমাকে।”

শিউলী বেগমের কুঁচকানো ভ্রু-দ্বয় শিথিল হয়। মুখে চমৎকার হাসি ফুটিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,

“এই গরমে এভাবে ঘুরে বেড়ালে অসুস্থ হয়ে যাবি মা। বিকেলে রোদ পরলে না হয় আবার যাবি। এখন ঘরে গিয়ে দুজন হাত-মুখ ধুয়ে নে। সন্ধ্যায় তোর তূর্ণা আপু আসবে। জামাই আসবে সাথে। হাতে আমার প্রচুর কাজ। এই অল্প সময়ে কিভাবে কি করব বুঝতে পারছিনা। তোরা দ্রুত এসে খেয়ে নে। আমি পরে আর সময় পাবনা।”

বড় বোন আর বোন জামাই আসার খবর পেয়ে দৃষ্টি, তুসী দুজনেই খুশিতে আত্মহারা। আমুদে কন্ঠে দৃষ্টি চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

“সত্যি খালামনি ওরা আসবে? ইশ! কতদিন ধরে আপুর সাথে দেখা হয় না। আমি যখন আসি তখন আপু শশুর বাড়ি থাকে। আবার আমি চলে গেলে আপু আসে। ফাইনালি এবার দেখা হবে আমাদের।”

দৃষ্টির বাচ্চামো দেখে মুচকি হাসে শিউলী বেগম। মুখে কিছুই বলেনা। শুধু মনে মনে ভাবেন তার বোনের মেয়েটা আর কখনো বড় হবেনা।

****

অধীর আগ্রহ নিয়ে সেই কখন থেকে জ্বলজ্বল চোখে কিছু শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে তুসীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দৃষ্টি। গুন্ডা একটা ছেলের প্রতি তার এমন মাত্রাহীন আগ্রহ দেখে ক্ষণে ক্ষণে বিস্মিত হচ্ছে তুসী। গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে সন্তুর্পণে দরজার দিকে তাকিয়ে কেউ আছে কি না দেখে নিয়ে নিচু কন্ঠে বলতে শুরু করে,

” রক্তিম শিকদার। আমাদের মেয়ের আজীজ শিকদারের বড় ছেলে। পেশায় একজন আর্মি মিলিটারী অফিসার ছিল।”

“ছিল বলছিস কেন? তারমানে কি এখন আর নেই? আমার তো গুন্ডা+ ডিফেন্স অফিসার দুটোই পছন্দ। ইশ! ভাই দেখেছিস আমার কি ভাগ্য! প্রথম দর্শনে যাকে ভালো লাগল তার মাঝে আমার পছন্দ অনুযায়ী সব গুণ আছে। কি লাকি রে আমি! খুশিতে তো আমার নাচতে ইচ্ছে করছে।”

কথার মাঝে বাঁধা পরায় বিরক্ত হয় তুসী। বিরক্তি ভাবটা লুকিয়ে মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“থাম বোন! আগেই এতো নাচন-কুদনের দরকার নাই। আগে সবটা শুন। পরে যদি নাচার আগ্রহ থাকে তবে স্পিকারে পছন্দের গান ছেড়ে উড়াধুড়া নাচিস। তার আগে আমাকে সবটা বলতে দে। কথার মাঝে যদি আবার বাঁধা সৃষ্টি করিস তাহলে কিন্তু আমি আর বলবনা।”

একটু নড়েচড়ে বসে দৃষ্টি। চোখে-মুখে সিরিয়াস ভাব ফুটিয়ে বলে,

“আর বাঁধা দিবনা। বল তুই।”
কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলতে শুরু করে তুসী,

” ক্যাডেট কলেজে থাকতে একটা মেয়ের সাথে প্রেম হয় রক্তিম শিকদারের।” কথাটা শুনে উৎফুল্ল মুখটা চুপসে যায় দৃষ্টির। প্রেম শুরু হবার আগেই কি তবে বিরহ যন্ত্রণা সইতে হবে তার? তার হিরো প্রেম করে অন্য একটা মেয়ের সাথে! কথাটা শুনেই কেমন বুকের ভিতর হলকা ফুটছে। ইশ! কি যন্ত্রণা কি যন্ত্রণা! দৃষ্টির চুপসে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে অল্প হাসে তুসী। বেচারীর অন্য একটা মেয়ের সাথে প্রেম হয়েছে শুনেই এই দশা! পুরোটা শুনে কার্ডিয়াক অ্যাটাক না হলেই হয়। দৃষ্টির দুঃখি ভাবটা পাত্তা দেয়না তুসী। বরং তার এই অবস্থা দেখে আরও উৎফুল্লতার সাথে বাকী টুকু বলতে থাকে,

“দীর্ঘ পাঁচ বছর প্রেম করে আর্মিতে জয়েন করার পর মেয়েটাকে বিয়ে করে রক্তিম শিকদার। ওনার বাবা-মা, ছোট ভাই, বোন আর ওনার স্ত্রী জেরিন সাভারে তাদের বাড়িতেই থাকত। রক্তিম শিকদার তার কর্মসূত্রে চট্টগ্রাম ক্যান্টলমেন্ট থাকত। ছুটিতে অনেক দিন পর পর বাড়িতে আসত। এভাবেই দূরত্বের মাঝেও তাদের সুখের সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ কি জানি হলো। সুখে ভরপুর শিকদার বাড়িতে ছড়িয়ে পরে শোকের ছায়া। এক সকালে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পরে রক্তিম শিকদারের হাতে খুন হয় তার স্ত্রী। ছোট ভাই গুরুতর আঘাতে ছয় মাস কোমায় থেকে মারা যায়। দুটো খুনের দায়ে জেল হয় তার। চাকরি চলে যায়।পরবর্তীতে অবশ্য তদন্ত করে রক্তিম শিকদার নির্দোষ প্রমাণিত হয়। কিন্তু এলাকা বাসীর কাছে দিনকে দিন সে নিজেই নিজেকে একটা আতঙ্ক হিসেবে জানান দেয়। শান্ত, বিনয়ী, ধৈর্যশীল রক্তিম শিকদার হয়ে যায় অশান্ত, দূর্বার এক ত্রাস। যে ত্রাসের নাম শুনলেই ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে পুরো এলাকাবাসী। দুদিন পর পর এখানে ওখানে মারামারি, রক্তারক্তি এসব যেন ওনার নিত্য দিনের রুটিন হয়ে ওঠেছে। আজীজ শিকদার একজন মেয়র পরিচয়ের বাইরে সাধারণ ব্যক্তি হিসেবেও খুবই পরোপকারী। দোষ-গুণ নিয়েই মানুষ। তবে আজীজ শিকদারের নামে যদি একটা দোষ খোঁজে পাস তবে বিপরীতে একশোটা গুণ খোঁজে পাবি। এলাকাবাসীর চোখের মণি শ্রদ্ধাভাজন সেই আজীজ শিকদারের ছেলের এমন পরিণতি দেখেও জনগণ নির্লিপ্ত। কারণ সকলের চোখেই রক্তিম যা করে তা ভালোর জন্য করে। এই রক্তিম শিকদারের জন্য আজ দুই বছর যাবৎ এই এলাকায় কোনো ছেলে কোনো মেয়েকে ইভটিজিং করার সাহস পায়না। জনগণের কাছে রক্তিম শিকদারের এই কাজ গুলো ভালো হলেও আজীজ শিকদারের কাছে লজ্জার বিষয়। একজন সনামধন্য মেয়রের ছেলে এমন গুন্ডামি করে বেড়ায় রাস্তায় রাস্তায় এটা মানতে না পেরে ছেলেকে বোঝাতে অপরাগ হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যদি বলে। রক্তিম শিকদার ও কোনো উচ্চবাচ্য না করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। তবে গুন্ডামি বা এই এলাকা ছাড়েনা। নিজের পাওয়ার খাটিয়ে ঠিকই রাজ করে বেড়ায় পুরো এলাকায়।”

অবাক বিস্ময়ে বিহ্বল দৃষ্টি। অবাকতার রেশ ধরে রেখেই বিস্মিত বদনে প্রশ্ন করে,

“ওনার ভাই আর স্ত্রী’কে যদি রক্তিম শিকদার না মেরে থাকে তবে কে হত্যা করেছিল?”

” আততায়ীর হামলা। যে মেয়ের সাথে দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রণয়ের পর বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল সেই মেয়েকেই রক্তিম শিকদার মেরে ফেলবে বিষয়টা সবার কাছেই হাস্যকর। কারণ এলাকা বাসী কমবেশি সবাই জানে তাদের প্রেম কাহিনি সম্পর্কে। পুরো সাভারের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে তাদের প্রেমের স্মৃতি। মেয়েটাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসতো রক্তিম শিকদার। আর ওনার ছোট ভাই সেও ছিল তার প্রাণ। খুব কাছের দুজন মানুষকে হারিয়েই না কি রক্তিম শিকদারের এই পরিণতি। এলাকা বাসী এটাই মানে।”

নিজ মনে কতক্ষণ কিছু একটা ভাবে দৃষ্টি। এরপর ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,

“সে যায় হোক। আমার রাস্তা তো ক্লিয়ার। বউ ছিল। এখন তো আর নেই। সুতরাং আমার সাথে প্রেম করতে বা বিয়ে করতেও কোনো অসুবিধা থাকার কথা না।”

বিস্ময়ে তুসীর চোখ দুটো কুঠোর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। কি বলে এই মেয়ে! মাথা কি পুরোপুরি গেল না কি? এতো কাহিনি জানার পরও কিভাবে এমন একটা ছেলের সাথে নিজেকে জড়ানোর কথা ভাবতে পারে? এই মেয়ে কি আদও সুস্থ্য মস্তিষ্কে ভেবে কথা গুলো বলেছে?,

“পাগল হলি তুই? এতো কিছু জানার পরও কিভাবে এসব কথা বলিস তুই? শুন দৃষ্টি! জীবনটা কোনো নাটক সিনেমা না যে ফেন্টাসি জগতে বাস করে যা ইচ্ছে তাই ভেবে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে নিবি আর তুই সাকসেস হয়ে যাবি। এটা বাস্তব জীবন। এখানে কোনো সিনেমাটিক ঘটনা ঘটেনা। এমন কোনো ভুল করিস না যা তোর সহ তোর পুরো পরিবারের আজীবনের কান্না হয়ে দাঁড়ায়।”

কথা গুলো একটুও পছন্দ হয় না দৃষ্টির। চোখ-মুখ কুঁচকে বলে ওঠে,

“বড়দের মতো আচরণ বাদ দে। ভুলে যাস না আমি তোর থেকেও গুণে গুণে তিন মাসের বড়। সো এসব জ্ঞান তোর থেকে একটু হলেও বেশি আছে আমার। আর একটা কথা ভুল বললি তুই। জীবন কোনো সিনেমা না হলেও নাটক, সিনেমা কিন্তু জীবনের একটা অংশ থেকেই তৈরী হয়। মানুষের জীবনে যদি ঐসব নাটকীয় ঘটনা না ঘটত তাহলে কখনো এসব মানুষের ভাবনায় আসতনা। আর ভবিষ্যতে কি হবে না হবেএটা কেউ আগাম বলতে পারে? অযথা এসব ভেবে কেন ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাব! যুদ্ধের পরেই তো জয় আসে। আমিও না হয় যুদ্ধে নামলাম। প্রেমের যুদ্ধ। আমার বিশ্বাস এই যুদ্ধে জয় আমার হবেই। তুই শুধু একটু আমার পাশে থেকে আমাকে অনুপ্ররেণা দিস। সেটা যদি না পারিস তবে চুপ করে থাকিস। তবুও অহেতুক কথা বলে আমার মনটা আগেই ভেঙ্গে দিসনা প্লিজ।”

এমন কথার পর আর কিছু বলার থাকতে পারে তুসীর! অসহায়ের মতো শুধু তাকিয়ে থাকে দৃষ্টির মুখের দিকে। ক্ষণে ক্ষণে আতঙ্কে বুকটা ধরাস করে ওঠে আগাম বিপদের কথা ভেবে। শেষমেশ উপায় না পেয়ে বলে ওঠে,

“তুই কিন্তু আগুন নিয়ে খেলতে চাইছিস দৃষ্টি। যেটা আমি হতে দিবনা। আমার কথায় যদি এসব পাগলামি বন্ধ না করিস। তবে কিন্তু আমি আম্মু-আব্বু, খালামনি-খালুজান সবাইকে বলে দিব। তখন আজীবনের জন্য তোর সাভার আসা বন্ধ হবে। এটা ভালো হবে তোর জন্য?”

তুসীর কথার বিপরীতে জিদ্দি স্বরে অনঢ় হয়ে বলে ওঠে দৃষ্টি,

“পুরো ঘটনাটা আমি আর তুই ছাড়া তোর মুখ থেকে যদি অন্য কেউ জানতে পারে তবে কিন্তু তোর সাথে আমার আজীবনের জন্য সম্পর্ক নষ্ট হবে। ভুলে যাব আমি তুই একসময় আমার খালাতো বোন+ প্রাণের থেকেও প্রিয় বান্ধবী ছিলি।”

দৃষ্টির কথায় মর্মাহত হয় তুসী। অসহায় নয়নে তাকিয়ে থাকে শুধু তার দিকে। বলার মতো আর কিছুই খোঁজে পায়না।

চলবে….

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৬৪ এবং শেষ পর্ব

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৬৪(অন্তিম পর্ব)
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

পরিবেশ জুড়ে নিস্তব্ধতার মেলা বসেছে, ডাকছে না কভু কেউ৷ সাহেলা চৌধুরী নিজ থেকে এলো মেহেভীনের কক্ষে বাঁধা দিল না কেউ। অনুভূতিরা মলিনতায় ছেয়ে গিয়েছে। বিষাদ প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে আসক্ত করে ফেলছে। সুখ যেন হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে পালিয়েছে। ভারাক্রান্ত হৃদয়টা নিয়ে বিরতিহীন ভাবে ছুটে চলেছে জীবন। তখনই খোলা জানালার দক্ষিণের বাতাস গেয়ে উঠল,
খোলা জানালা দখিনের বাতাসে
ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে
তখন তুমি এসে হেসে বলে দাও,
আছি আমি তোমার পাশে
বহুদূর পথ ভীষণ আঁকাবাঁকা
চলতে ভীষণ ভয়
তুমি এসে বলে দাও,
আছি আমি পাশে
নিজের ফল বাগানের গাছের নিচে বসেছিল মুনতাসিম। ফেলা আসা শহরটা স্মরন করিয়ে দিচ্ছে। আমাকে তুমি কাঁদিয়ে চলে গিয়েছ। অথচ ভালোবাসাটা আমার শহরেই তুমি পেয়েছিলে। ভালোবাসা পেয়ে তুমি আমাকেই ত্যাগ করলে! তোমাকে আবার আসতে হবে সেই দখিনেরর বাতাস গ্রহণ করতে। যে বাতাসে শুধু প্রণয়নের হাওয়া বইবে। সেখানে দুঃখ নামক কোনো শব্দ আসবে না৷ সুখের রাজত্বের রাজা হবে তুমি। প্রচন্ড ভালোবাসার পর কিছু জিনিস ছেড়ে আসতে হয় না। যদি কাউকে প্রচন্ড ভালোবাসার পর ছেড়ে দাও। তাহলে মানুষটার দীর্ঘশ্বাস না লাগলেও প্রকৃতির অভিশাপ ঠিকি লেগে যায়। মুনতাসিমকে পিছু ডাকছে সেই শহর যে শহরে সে সুখের সন্ধান পেয়েছিল। সে মনো স্থির করে নিল নিজের জীবনে যতটুকু অশান্তি সে গ্রহণ করেছে। তার একাংশও তার সন্তানের জীবনে আসতে দিবে না। সে ফিরে যাবে খোলা জানালার দক্ষিণের বাতাসে ভালোবাসার স্বাদ গ্রহণ করতে। সে উঠে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।

মেহেভীনের সামনে প্রাপ্তি, তাহিয়া, সেহেলা চৌধুরী গম্ভীর মুখশ্রী করে বসে আছে। মেহেভীন সর্বক্ষণ প্রচেষ্টা করছে সকলের মন ভালো জন্য। মেহেভীন মুনতাসিমের টি-শার্ট এবং প্যান্ট পড়ে গলায় ওড়না ঝুলিয়ে মুনতাসিমের মতো করে সকলের সামনে পায়চারি করছে। মেহেভীন মুখশ্রীতে গম্ভীরতা এনে সাহেলা চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–এই মহিলাকে আমার সামনে কথা বলতে নিষেধ করবেন আব্বা। এই মহিলা যদি আমার সামনে কথা বলার চেষ্টা করেছে, তাহলে এই মহিলাকে আমি ধংস করে দিব। মেহেভীনের বলার ধরন দেখে সাহেলা চৌধুরী হেসে ফেলল৷ মেহেভীন প্রাপ্তির সামনে গিয়ে বলল,

–কি প্রাপ্তি দিনকাল ভালো যায় তো? আজ থেকে ভালোমন্দ খাবে সামনে অনেক ধাক্কা সামলাতে হবে তো। মেহেভীনের কথায় প্রাপ্তি মলিন হাসলো। মেহেভীন এবার তাহিয়ার কাছে গিয়ে মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে নিয়ে এসে বলল,

–বিয়ে করেছি দু’দিন পরে বাচ্চার বাপ হয়ে যাব৷ কিন্তু এখনো বউয়ের সাথে বাসর করতে পারলাম না। চলো বউ বাসরটা আজকেই সেরে ফেলি। মেহেভীনের কথা শেষ হতেই সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। তাহিয়া লজ্জায় মস্তক নুইয়ে ফেলল। মুনতাসিম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বুকে দু-হাত গুঁজে মেহেভীনের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। সাহেলা চৌধুরীর দৃষ্টি মুনতাসিমের দিকে পড়তেই তিনি আস্তে করে উঠে চলে গেলেন। সাহেলা চৌধুরীকে অনুসরণ করে প্রাপ্তি এবং তাহিয়াও চলে গেল। মুনতাসিম গম্ভীর মুখশ্রী করে মেহেভীনের কাছে এগিয়ে আসলো। মেহেভীন মুনতাসিমের পায়ের ওপরে পা রেখে মুনতাসিমের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

–আপনি কোথায় গিয়েছিলেন মন্ত্রী সাহেব? মুনতাসিম মেহেভীনকে এক হাতে আগলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

–আপনি আমার মনের সাথে জামাকাপড় গুলোও দখল করা শুরু করে দিয়েছেন?

–জামাইয়ের সব টি-শার্ট এবং প্যান্টের অর্ধেক মালিকানা হচ্ছে তার বউ। আপনার সব টি-শার্টের অর্ধেক ভাগ আমার বুঝেছেন মন্ত্রী সাহেব। আপনি চাইলে আমার সালোয়ার কামিজের ভাগ নিতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না। কথা গুলে বলেই মেহেভীন খিলখিল করে হেসে উঠল। মেহেভীনের স্নিগ্ধ হাসির প্রতিধ্বনিতে মুনতাসিমের হৃদয় শীতল হলো৷ সে মেহেভীনের অতি সন্নিকটে গিয়ে মেহেভীনের গালে চুমু খেল। মেহেভীন নিজ থেকে মুনতাসিমে ললাটে অধর ছোঁয়াল। এতে মুনতাসিম ভিষণ অবাক হলো! মুনতাসিমের ভাবনার মাঝেই সাহেলা চৌধুরী কক্ষে প্রবেশ করল। দু’জন দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো। সাহেলা চৌধুরী গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,

–শুনো মুনতাসিম আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই। তোমার জন্য দু’টি সন্তান এবং আমার স্বামীকে হারিয়ে আমি প্রায় সর্বহারা। আমি এদিকে বিরহে কাতরাবো আর তুমি সুখানুভূতিতে মেতে উঠবে। এটা আমার সহ্য হবে না। তুমি আমাদের থেকে দুরত্বে চলে যাও। আমি তোমাকে কোনোদিনই ভালোবাসিনি। আমি তোমার থেকে সবকিছু কেঁড়ে নিয়ে তোমাকে সর্ব শান্ত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিধাতা আমাকে একাকিত্বের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিল। ঐ যে কথায় থাকে না অন্যের অমঙ্গল কামনা করলে নিজের ধংস অনিবার্য আমার সবকিছু ধংস হয়ে গিয়েছে মুনতাসিম। আমি তোমাকে আর দুঃখ দিতে চাই না৷ কিন্তু মায়ের মন তো তোমাকে দেখলেই আমার মস্তিষ্ক জ্বলে উঠ। আমার ভেতরটা প্রতিশোধ নেওয়ার নেশায় আক্রান্ত হয়ে যায়। তোমাকে যতটুকু দুঃখ দিয়েছি। তার থেকে দ্বিগুন দুঃখ আমি পেয়েছি। যে কয়টা দিন বাঁচব মাশরাফিকে বুকে নিয়ে বাঁচতে চাই। তুমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাও সুখে থাকবে।

–আমি নিজেও ভেবেছি আমি এ বাড়ি ত্যাগ করব। আপনি চিন্তা করবেন না। আব্বা বেঁচে থাকতে এ বাড়ি যেমন আপনার দখলে ছিল। আমি বেঁচে থাকা অবস্থায়ও এ বাড়ি আপনার দখলে থাকবে। সাহেলা চৌধুরী কিছু বলল না দ্রুত কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। মুনতাসিম সব দুঃখ কষ্ট এ বাড়িতে দাফন করে রেখে যেতে চায়। তাই সে বাবার দেওয়া ডায়েরিটা মেহেভীনের সামনে খুলল। ডায়েরির প্রথমেই লিখা ছিল।

আমার প্রিয় মুনতাসিম,
আমি জানিনা কোন মুখে তোমার থেকে ক্ষমা চাইব। আমার ক্ষমা চাওয়ার কোনো বাক্য জানা নেই। আমি তোমার ভালো করতে গিয়ে তোমার সবচেয়ে খারাপটা আমি করে ফেলেছি। তোমাকে ভালো থাকার আশ্বাস দিয়ে তোমার ভালো থাকাটা কেঁড়ে নিয়েছি। আমি সব সময় চেয়েছি তুমি ভালো থাকো। কিন্তু মেহেভীন তোমার জীবনে আসায় তুমি মেহেভীনকে নিয়ে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করতে যা আমার একদম পছন্দ ছিল না। তুমি চাইলে আমার ছেলে-মেয়ে দু’টোকে ভালোবাসতে পারতে, কিন্তু তুমি ভালোবাসোনি। আমি জানি তুমি কেন তাদের ভালোবাসো না৷ একজন মানুষ নিশ্চই তার খুনির জন্য কাঁদবে না। আমি তো বাবা আমি সর্বদা চেয়েছিলাম। আমার ছেলে-মেয়ে গুলো একসাথে মিলেমিশে থাকুক। আমি সবাইকে এক করতে গিয়ে সবার খারাপ করে ফেলছি। মেহেভীন যখন মুনেমের কথা জেনে যায়৷ তারপর থেকে আমি মেহেভীনের সাথে ভিষণ অন্যায় করে ফেলছি। কখনো মেহেভীনের সাথে ভালো করে দু’টো কথা বলিনি। সব সময় সব দোষ মেহেভীনের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছি। মেহেভীন পরের বাড়ির মেয়ে তো তাই সুযোগটা লুফে নিয়েছি। তুমি মেহেভীনকে বলো তোমার এই অধম বাবাকে পারলে যেন ক্ষমা করে দেয়। যেদিন তোমার আঁখিযুগলে আমার জন্য ঘৃণা দেখলাম। সেদিন থেকে আমার বাঁচার ইচ্ছে হারিয়ে গিয়েছিল। আমি তোমাকে ভালোবেসে বাঁচতে চেয়েছি। কিন্তু তোমার ঘৃণা আমাকে ভেতর থেকে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল। আমি জানিনা এই চিঠিটা পড়ার সময় তুমি আমাকে পাবে কি না তবুও বলব এই নিকৃষ্ট বাবাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। তোমার বাবা তার শাস্তি পেয়েছে। ভালো থেকো মুনতাসিম।
ইতি, তোমার নিকৃষ্ট বাবা।

মিষ্টিমুধুর সময় নিয়ে এগিয়ে চলছে জীবন। সেদিন মুনতাসিম ডায়েরিটা বন্ধ করে সকল দুঃখ মাটি চাপা দিয়ে চৌধুরী বাড়ি ত্যাগ করেছিল। আর পিছু ফিরে আসেনি চেনা নীড়ে, জীবন তার নিয়মে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু সুন্দর সময় পাড়ি দিয়ে চিন্তিত মুহূর্তে পার করছে মুনতাসিম। এর মাঝেই কে’টে গিয়েছে কত গুলো মাস। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর তিনটা বাজে। সমস্ত মস্তিষ্ক কেমন জানি অকেজো হয়ে গিয়েছে। সে আহত কণ্ঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

–আমার মেহেভীনকে তুমি ঠিক রেখে আল্লাহ। আমার মেহেভীন ছাড়া আমার কেউ নেই। ওর কিছু হয়ে গেলে আমি কিভাবে বাঁচব? তুমি আমার থেকে আমার ভালো থাকাটুকু কেঁড়ে নিও না। মেহেভীন আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাব। আমাকে এভাবে সর্বশান্ত করে দিও না। আমি না আমার মেহেভীনকে ভিষণ ভালোবাসি। পৃথিবীতে এত গুলো মানুষের মধ্যে এই একটা মানুষের কাছে আমি ভিষণ দুর্বল। আমার এক কথায় কিছু মানুষের রুহু কাঁপে, কিন্তু তোমার কাছে আসলে আমার রুহু কাঁপে। আমি ছাড়া তোমাকে ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। কিন্তু ধরনীর বুকে মেহেভীন ছাড়া আমাকে ভালোবাসার কেউ নেই। আমাকে এতটুকু দয়া করো আল্লাহ। মুনতাসিমের কথা শেষ হবার সাথে সাথে বাচ্চার কান্নার প্রতিধ্বনি মুনতাসিমের কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। দু’জন নার্স দু’টি বাচ্চা নিয়ে এসে মুনতাসিমের সামনে ধরে বলল,

–কংগ্রাচুলেশন আপনার দু’টি বাচ্চা হয়েছে। আপনার একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে হয়েছে। মুনতাসিমের চিন্তিত মুখশ্রী প্রশস্ত হলো না৷ সে অস্থির হয়ে বলল,

–আমার অর্ধাঙ্গিনী কেমন আছে? মুনতাসিমের কথায় নার্সটা স্নিগ্ধ হেসে বলল,

–আপনার অর্ধাঙ্গিনী একদম ভালো আছে এবং সুস্থ আছে। তাকে একটু পরে কেবিনে দেওয়া হবে। আপনাকে একাই দেখছি আপনার বাড়ির কেউ আসেনি?

–আমার তো কেউ নেই। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম বাচ্চা দু’টোকে দু-হাতে কোলে নিয়ে অনবরত চুমু খেতে লাগলো। অদ্ভুত এক শান্তি অনুভব করছে মুনতাসিম। অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠেছে। সুখেরা শহরের অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মস্তিষ্ক ফুরফুরে মেজাজে আনন্দ করছে। সুখানুভূতিতে স্রোতের ন্যায় বয়ে চলছে সময়।

মেহেভীন খোলা জানালার দক্ষিনে দাঁড়িয়ে আছে। চন্দ্রের আলো এসে মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রীতে রাজত্ব করছে। কেটে গিয়েছে কত গুলো বসন্ত। সেদিনের পর আর দুঃখ মেহেভীন এবং মুনতাসিমকে গ্রাস করতে পারেনি৷ দু’টি সন্তান নিয়ে তারা বেশ সুখেই আছে। তার দু’টি ছেলে-মেয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে।

–আমি মেহবুবা চৌধুরী মেহেনুর কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করিনি আর কখনো করব না৷ আমি এখনই মাকে বলে দিব তুই চুরি করে দেখে লেখছিস। মেহেনুরের কথায় মেহেরাব জ্বলে উঠল। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমি মেহেরাব চৌধুরী সব সময় জিতেছি। আমি কখনো হারতে শিখিনি। তুই মাকে বলবি মা তোর কথা বিশ্বাস করে নিবে। এটা তো আমি পারি মুখস্থ আছে মাকে মুখস্থ বলে দিব৷ তখন তুই মার কাছে ছোট হয়ে যাবি। আর আমি সব সময় বড় থাকব।

–তোকে দেখাচ্ছি। কথা গুলো বলেই মেহেনুর মায়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। তার মায়ের শাড়ির আঁচল টেনে বলল,

–মা মেহেরাব চুরি করে লিখছে। তুমি এসে বিচার করে দাও। মেহেভীন কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

–তোদের দু’জন পড়তে বলেছি ঝগড়া করতে বলিনি। এসে দু’টোকেই পড়া ধরব৷ আজকে যদি পড়া না পাড়িস তাহলে তোদের বাবার নাম ভুলিয়ে দিব।

–তুমি আমার মা হয়ে শত্রুতা করছ। বুঝেছি তুমি আমার বিরোধী পক্ষ শত্রু পক্ষের কাছে বিচার দিয়ে লাভ নেই। আমি যাচ্ছি আব্বু কাছে আব্বুকে এর বিচার করতেই হবে। আমি কষ্ট করে পড়াশোনা করব আর তোমার ছেলে দেখে দেখে লিখবে। আমি থাকতে এটা কিছুতেই হতে দিব না। মেহেনুর কথা শেষ করে মুনতাসিমের কাছে গেল। সে আঙুল ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,

–আমি আমার শত্রু পক্ষের কাছে গিয়েছিলাম বিচার চাইতে, কিন্তু শত্রুপক্ষ আমাকে সঠিক বিচায় দেয়নি আব্বু। তুমি সঠিক বিচার করে দাও। তোমার ছেলে দেখে দেখে লিখেছে। এখন তুমি কি করবে করো না হলে আমি পড়তে বসব না। মুনতাসিম চিন্তিত হবার ভান ধরে বলল,

–মেহেরাব তো দারুন অন্যায় করেছে! তাকে একটা কঠিন শাস্তি দেওয়া উচিৎ মা৷ তুমি চিন্তা করো না আমার মা যখন আমাকে বলেছে। আমি এর একটা সঠিক বিচার করে দিব।

–এই জন্যই তোমাকে এত ভালোবাসি আব্বু। আমি আর কখনো বিরোধী দলের কাছে বিচার চাইতে যাব না। মা যে মেহেরাবকে বেশি ভালোবাসে এটা আমি বুঝেছি। মেহেনুরের কথায় মেহেভীন বিস্ময় নয়নে মেহেনুরের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমি বিরোধী পক্ষ! তুই আজকে আসিস খালি আমার কাছে তোকে আমি দেখে নিব। মেহেভীনের কথা শেষ হতেই মেহেরাব খিলখিল করে হেসে উঠল। সে হাসতে হাসতে বলল,

–তোমার মেয়ে আমাকে হিংসা করছে এটা তুমি বুঝতে পারছ মা আম্মু। এই হিংসুটে বুড়ীকে কয়টা লাগিয়ে দাও। তাহলে ওর মাথা থেকে সব হিংসে বের হয়ে যাবে। মেহেরাবের এই বাক্যটাই আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করল। মুহুর্তের মধ্যে মেহেনুর জ্বলে উঠল। মেহেনুর মেহেরাবের দিকে এগিয়ে এসে মেহেরাবকে শাসাতে শুরু করল। দু’জনের কান্ড দেখে মেহেভীন হেসে ফেলল। মুনতাসিম মেহেভীনের কাছে এসে কর্ণে ফিসফিস করে বলল,

–এভাবে কেউ হাসে ম্যাডাম? আপনি এভাবে হাসলে আমি পাগল হয়ে যাই!

–দু’দিন পরে নিজের মেয়ে বিয়ে দিবেন। তবুও আপনার ভালোবাসা ফুরায় না!

–আপনার জন্য আমার হৃদয় ভালোবাসা অনন্তকাল থাকবে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনাকে আমি প্রথম দিনের মতোই ভালোবেসে যাব। মেহেনুর এবং মেহেরাব দু’জন ঝগড়া করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। এই দুই ফাঁকিবাজ পড়াশোনা না করার ভয়ে রাতে ইচ্ছে করে ঝগড়া শুরু করে তারপর ঘুমিয়ে যায়। মুনতাসিম মেহেভীনকে সাথে নিয়ে খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো। খোলা জানালার দক্ষিণে বাতাস এসে দু’জনকে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। যে শীতল বাতাসে নেই দুঃখে ছোঁয়া পুরো বাতাসটাই যেন ভালোবাসায় মাখা। এমন একটু সুখই তো তারা চেয়েছিল। যে সুখ এই খোলা জানালার দক্ষিণের বাতাস তাদের দিয়েছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,

–আমি আপনাকে ভিষণ ভালোবাসি ম্যাডাম। আপনি যতটুকু জানেন তার থেকে-ও বেশি আমি আমার বাচ্চার মাকে ভালোবাসি। মেহেভীনের হৃদয় শীতল হলো সে মুনতাসিমের বুকে মাথা রেখে বলল,

–আমিও আমার মন্ত্রী সাহেবকে ভিষণ ভালোবাসি। আমার বাচ্চার বাবা যেমন আমাকে ভালোবাসে। ঠিক তেমনই আমিও আমার বাচ্চার বাবাকে ভালোবাসি। মুনতাসিম শক্ত বন্ধনে মেহেভীনকে আবদ্ধ করে ফেলল৷ সে পরম আবেশে মেহেভীনের ললাটে অধর ছোঁয়াল। মেহেভীন মুনতাসিমের কাঁধে মস্তক ঠেকিয়ে চন্দ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে এক হাতে আগলে রেখেছে। খোলা জানালা দিয়ে দক্ষিণের বাতাস বইছে। চারিদিক ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। অনুভূতিরা নতুন ছন্দে মেতে উঠল। মস্তিষ্ক ফুরফুরে হয়ে গেল। সুখ যেন সময়কে গ্রাস করে নিয়েছে। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ জীবন বয়ে যাবে সারাজীবন।

(সমাপ্ত)