দৃষ্টির আলাপন পর্ব-২৪+২৫

0
182

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৪(প্রথম অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

মোড়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁয়ে অলস সময় পাড় করছে রক্তিম। নিত্যদিন যে দোকানে বসে চায়ের আড্ডায় সময় চলে যেতো চোখের পলকে। আজ যেন সেখানেও মন টিকছেনা। একেতো পাশে মেহেদী নেই। দ্বিতীয়ত কতক্ষণ পরপর বোনটা ফোন করে কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে আবদার জানাচ্ছে ও বাড়ি যেতে।সব মিলিয়ে চারিদিকটা কেমন গুমোট মনে হচ্ছে।চারিদিক তখন ঘন কুয়াশার আস্তরণ সন্ধ্যার পূর্বেই আধার নামিয়ে দিয়েছে। চা শেষ করে সবে সিগারেট হাতে নিয়েছিল রক্তিম। এর মাঝেই পকেটে থাকা যান্ত্রিক বস্তুটা তারস্বরে বেজে ওঠে। সিগারেটটা ঠোঁটের ভাজে নিয়ে ধীরস্থির ভাবে আগুন ধরানোর কাজটুকু শেষ করে ফোন হাতে নেয়। স্ক্রিনে বোনের নাম্বার দেখে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। ক্ষণকাল কিছু একটা ভেবে রিসিভ করে কানে ঠেকায়। কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করে বলে,

“ইতু! কেন এমন পাগলামি করছিস? আমি বললাম তো ভাইয়া তোর বিয়েতে না থাকলেও দূর থেকেই সমস্ত দায়িত্ব পালন করে যাব। আমার বোনের সুখের জন্য যা যা করতে হয় সব করব।”

রেহানা বেগম ছেলের কথার পৃষ্ঠে তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারেনা। কতক্ষণ চুপ থেকে আমতা আমতা করে বলে,

“আমি ! আমি ফোন দিয়েছি। ইতু না।”

মায়ের কন্ঠ শুনে সাথে সাথে জমে যায় রক্তিম। বরফ শীতল চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। মুখ দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারণ হয়না। রক্তিমের অবাকের মাত্রা আরও একটু বাড়িয়ে দিতে রেহানা বেগম পূণরায় বলে,

“বোনের বিয়েতে ভাই উপস্থিত থাকবেনা এ কেমন কথা? মেয়েটা আমার সেই কাল থেকে কেঁদে যাচ্ছে।”

এটুকু বলতেই আবারও রেহানা বেগমকে জড়তা এসে আকরে ধরে। কতক্ষণ দ্বিধান্বিত হয়ে চুপ থাকে। পরপর আবারও ইতির উৎসুক মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে দ্বিধা-জরতা সমস্ত কিছু দূরে ফেলে বলে,

“সন্ধ্যার আগে বউমাকে নিয়ে এই বাড়িতে উপস্থিত হবে তুমি। আমার মেয়ের চোখ দিয়ে যেন আর এক ফোটা অশ্রুও না ঝরে। তোমরা না আসা পযর্ন্ত কোনো অনুষ্ঠান হবেনা।”

ব্যাস! দীর্ঘদিন পর মায়ের সাথে স্বাভাবিক আলাপচারিতা এটুকুই।সেটাও একপাক্ষিক। এই অল্প সময় আর মায়ের ঐ কথা গুলোই রক্তিম শিকদারকে অস্থিরতার অতলে ডুবিয়ে দিয়েছে। সর্বক্ষণ রুক্ষ হয়ে থাকা চোখ দুটো আচমকা জ্বালা ধরে ভিজে ওঠতে চাইছে। বুকের ভিতরটা অস্বাভাবিক মাত্রায় কাঁপছে। দুটো বছর যাবৎ যে মা বারবার তাকে ঐ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, আজ সেই মা নিজেই তাকে বাড়িতে যেতে বলছে। যে মায়ের মুখ থেকে কখনো খু নি ছাড়া অন্য কোনো সম্বোধন রক্তিমের জন্য উচ্চারিত হয়নি সেই মা আজ এতো শান্ত ভাবে তুমি বলে সম্বোধন করেছে। বাবার স্বাভাবিক একটা কথাতেও রক্তিম সবসময় ত্যাড়া জবাব দিলেও কখনো পারেনি মায়ের কোনো কথার বা মারের প্রতিবাদ করতে। চুপচাপ সকল অভিযোগ মাথা পেতে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিয়েছে। বিবর্ণ সেই অতীত রক্তিমকে যতটা না ক্ষতবীক্ষত করেছে, তার থেকেও বেশি হৃদয়ে আঘাত করেছে মায়ের এক একটা ধারালো কথা। পাষাণ হৃদয়টা মুখ ফোটে কারো কাছে না স্বীকার করলেও নিরবে প্রতিনিয়ত সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি জানিয়েছে, মা যেন তাকে একটাবার বুকে টেনে নেয়। একটাবার যেন ঐ মমতাময়ী তার স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেয় রক্তিমের মাথায়। তার কাছে বারবার মনে হতো মায়ের একটু পরশেই তার মনের ভিতর জ্বলতে থাকা আগুনটা নিভে যাবে। একটাবার যদি সে মায়ের কোলে মাথা রেখে চিৎকার করে কাঁদতে পারতো তবে হয়তো বুকের ভিতর জমে থাকা কষ্টটা লাঘব হতো। মা নামক জাদুর মানবীর স্পর্শে পাষাণ হৃদয়টা হয়তো নরম হতো। সৃষ্টিকর্তা বুঝি আজ অবশেষে তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে! আজ কি তবে শিকদার মঞ্জিলে পা রাখলে মা তার জাদুর পরশে রক্তিমের যন্ত্রণা গুলো ঘুচিয়ে দিবে! চোখের জ্বলন, বুকের ভিতরের যন্ত্রণা পুরো শরীরেও ছটফটানি সৃষ্টি করে দিয়েছে। দেহটা চলছেনা। কিন্তু মনটা এক মুহূর্তও দেরি করতে চাচ্ছেনা। পাষাণ হৃদয়টা মায়ের একটু নরম আচরণেই কেমন বাচ্চা হৃদয়ে পরিণত হয়েছে।
হঠাৎ রক্তিমের এমন অস্থিরতায় রাকিব, জাবির, শান্ত তিনজনই অভাব। চিন্তিত হয়ে শান্ত জানতে চায়,

“ভাই কি হলো আপনার! শরীর খারাপ লাগছে?”

কোনো জবাব দেয়না রক্তিম। তবে ইচ্ছে হচ্ছে বাচ্চাদের মতো চিৎকার করে সবাইকে জানিয়ে দিতে, “শুনো তোমরা। আমার মা আজকে আমাকে ডেকেছে। এই পাষাণ, খু নি, গুন্ডা রক্তিমকে বোধহয় মা এবার কাছে টেনে নিবে। তার মমতার পরশে আমার হৃদয়ের যন্ত্রণা নিঃশেষ করে দিব।” কিন্তু পারেনা রক্তিম। অনাকাঙ্ক্ষিত খুশি, আনন্দ বোবা বানিয়ে দেয় নিষ্ঠুর রক্তিমকে। অসাঢ় করে দেয় পুরো দেহ। অদ্ভূতভাবে ভেঙ্গে পরে ইস্পাত কঠিন রক্তিম। মুখে শুধু বলে,

“আমাকে একটু তাড়াতাড়ি শিকদার মঞ্জিলে দিয়ে আসবি?”

যে রক্তিম শিকদার সর্বদা নিজের ছেলেদের উপর হুকুম চালিয়েছে। আজ সেই রক্তিম শিকদার কেমন অনুরোধের স্বরে আকুতি জানাচ্ছে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। হঠাৎ রক্তিমের এমন আচরণ হজম হয়না কারো। অদ্ভূত চোখ করে তাকায় সকলেই রক্তিমের দিকে। মনের মাঝে হাজারটা প্রশ্ন থাকলেও মুখে কোনোটাই উচ্চারিত হয়না কারো। নিজেদের মতোই নিজেরা ভেবে নেয়, একটু আগের ফোনকলে হয়তো শিকদার বাড়িতে যাবার মতো কোনো জরুরী বার্তা পেয়েছে। বিয়ে বাড়িতে আবার কোন অঘটন না ঘটে গেছে! যে অঘটনের জন্য বোনের বিয়েতে থাকার জন্য ঘোর আপত্তি জানানো রক্তিম এখন এভাবে তার ছেলেদের আকুতি জানাচ্ছে তাকে ঐ বাড়ি দিয়ে আসতে। জাবির লক্ষ্য করে রক্তিমের শরীরটাও কেমন ভঙ্গুর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে নিস্তেজ হয়ে এখনই লুটিয়ে পরবে মাটিতে। আর এক মুহূর্ত দেরি করেনা জাবির। শান্তকে ইশারায় কিছু একটা বুঝিয়ে রক্তিমের বাইকে ওঠে বসে। বলে,

“আপনার শরীর খারাপ মনে হচ্ছে ভাই। এমন অবস্থায় বাইক চালাতে পারবেন না। পিছনে বসুন আমি দিয়ে আসছি।”

অস্থির রক্তিম কন্ঠে দ্বিগুণ অস্থিরতা ঢেলে বলে ওঠে,

“আমি একা গেলে হবেনা। তোরা একটা কাজ কর। দ্রুত একটা সিএনজি নিয়ে আমার বাড়ি থেকে ঐ মেয়েটাকে নিয়ে আয়। ততক্ষণ আমি এখানে থাকি।”

“কোন মেয়ে ভাই?”

যদিও দলের সকলেই এতোদিনে জেনে গেছে রক্তিমের বিয়ের খবর। রক্তিমের কথায় এটাও আন্দাজ করে নিয়েছে সে তার স্ত্রীকেই নিয়ে আসতে বলছে। কিন্তু তবুও রাকিবের কৌতূহলী মন ফট করেই প্রশ্নটা করে ফেলে। একেতো অপেক্ষা আর সহ্য হচ্ছেনা রক্তিমের। ইচ্ছে হচ্ছে একছুটে মায়ের কাছে চলে যেতে। এদিকে অনুভূতির জাতাকলে পৃষ্ঠ হয়ে মন, শরীর দুটোই অবশ হয়ে আছে। এর মাঝে আবার রাকিবের প্রশ্নটা যেন সহ্য হয়না রক্তিমের। মনে হয় প্রশ্নটা করে তার অপেক্ষার প্রহর আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সাথে সাথেই ব্যকুল চোখ দুটোতে কাঠিন্যতা ঢেলে শক্ত কন্ঠে বলে,

“আর একটা প্রশ্ন করলে তোর জ্বিভ টেনে ছিড়ে ফেলব। আমার ঘরে কয়টা মেয়ে মানুষের বসবাস? যেটাকে পাবি ঐটাকেই নিয়ে আসবি। দ্রুত যা।”

পরিস্থিতি অনুকূলে বুঝতে পেরে রাকিব আর একটুও দেরি করেনা। তৎক্ষণাৎ ছুটে যায় মেইন রোডের কাছে। একটা সিএনজি ঠিক করে পাঁচ মিনিটের মাথায় উপস্থিত হয় রক্তিমের পরিত্যক্ত প্রায় বাড়িতে। দ্রুত পদে সিএনজি থেকে নেমে দরজায় কড়াঘাত করে। টুকটাক কাজ সেড়ে দৃষ্টি মাত্রই একটা বই নিয়ে বসেছিল। সাত কলেজের পরীক্ষার আর বেশি দিন নেই। পাবলিক ভার্সিটি হারিয়েছে। বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে রক্তিমের বউ হয়ে এসেছে। মেয়ের থেকে একের পর এক আঘাত পেয়ে মা-বাবা নিশ্চয়ই বড্ড রুষ্ঠ তার প্রতি। এই পরিস্থিতিতে তাদের মন জয় করার একটাই উপায়। বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত যেকোন একটা কলেজে নিজের জন্য স্থান করে নিতেই হবে। এতে অন্তত একটু হলেও তার প্রতি সন্তুষ্ট হবে বাবা-মা। সেই চিন্তা মাথায় রেখেই রক্তিমের মন জয় করার পাশাপাশি নিজেকে সম্পূর্ণ রুপে প্রস্তুত করে নিচ্ছে সাত কলেজের ভর্তি যুদ্ধের জন্য।

বইয়ের মাঝে ডুবে থাকা দৃষ্টি হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত পড়ায় চমকে ওঠে। সাথে একটু চিন্তিত হয়। এই সময় তো রক্তিম বাড়িতে ফেরার কথা না। সেই রাত বারোটা-একটার আগে এভাবে দুয়ারে কে হানা দিতে পারে! কিছুটা চিন্তিত হয়েই ওঠে দাড়ায় দৃষ্টি। গলার স্বর উঁচু করে জানতে চায়,

“কে?” সাথে সাথে অধৈর্য রাকিব জবাব দেয়।

“ভাইয়ের লোক আমি রাকিব। দরজা খুলেন ভাবি। ভাই বলেছে দ্রুত আপনি নিয়ে যেতে।”

রাকিবের গলার স্বরেই তাকে চিনে নেয় দৃষ্টি। অসময়ে চামচাটার আগমনে মেজাজটাও খিঁচিয়ে ওঠে। তপ্ত মেজাজে লাফিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। তৎপরতার সাথে খিল খুলে বলে,

“ঐ চামচার বাচ্চা চামচা। এখানে কি চায় হ্যাঁ?”

দৃষ্টির কথা রাকিবের কর্ণগোচর হবার সুযোগ পায়না। তার আগেই দৃষ্টিকে দেখে অত্যধিক বিস্ময়ে হা হয়ে যায় রাকিবের মুখ। চোখ দুটো বড় বড় মার্বেল আকৃতি ধারণ করে কুঠোর ছেড়ে বেড়িয়ে আসার উপক্রম হয়। ভাই বিয়ে করেছে জানত। কিন্তু শেষ মেষ এই মেয়েকে! যাকে কি না প্রথম দিনই গলা চেপে ধরে দুনিয়া থেকে টাটা বাই বাই করে দিতে চেয়েছিল সেই মেয়েকে কিভাবে ভাই বিয়ে করে ঘরে তুলল? এ তো অন্যায়। ছোটখাট কোনো অন্যায় না। মহা অন্যায়। মেয়েটার প্রতি ভাইয়ের বিতৃষ্ণা দেখেই তো রাকিব মনে মনে ভেবে রেখেছিল একে তার চৌদ্দ নাম্বার গার্লফ্রেন্ড বানাবে। সেই চিন্তা বাস্তবায়ন করার জন্যই তো ঐদিন সমাবেশে আড়ালে ডেকে দৃষ্টিকে পটানোর চেষ্টাও করেছিল। আর আজ কি না ভাই তার বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দেবার মতো এতো বড় অন্যায়টা করল! এ অন্যায় কিভাবে মেনে নিবে রাকিব?

চলবে…….

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৪ (শেষ অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

রাকিবকে দুঃখি দুঃখি ভাব নিয়ে তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে চটে যায় দৃষ্টি। চোখ পাকিয়ে মেজাজ দেখিয়ে বলে,

“সাহস কত! রক্তিম শিকদারের বউয়ের দিকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে ! চোখ সরান বলছি এক্ষুণি। নইলে কিন্তু ঐ চোখ তুলে কুতকুত খেলব আমি।”

তৎক্ষণাৎ রাকিবের ফাঁকা ঠোঁট দুটো একটা আরেকটার সাথে চেপে যায়। ঘনঘন পলক ঝাপটে অসহায় কন্ঠে বলে,

“এইটা কিছু হইলো সুন্দরী? তুমি এইভাবে আমারে ছ্যাকা না দিলেও পারতা।”

তার এহেন সাহস দেখে ভড়কে যায় দৃষ্টি। সে বর্তমানে রক্তিম শিকদারের বউ। এটা জানার পরও কিভাবে এই চামচা তাকে সুন্দরী ডাকে? এর একটা বিহিত আজকে করতেই হবে। দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“চামচার বাচ্চা চামচা! পিঁপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে, কথাটা শুনেছেন তো! যদি বিয়েশাদী করার আগেই মরার শখ না জাগে তবে আজকের পর যেন কখনো আমাকে ঐ নামে ডাকা না হয়। সুন্দর ভাবে, ভদ্রভাবে ভাবি ডাকবেন আমাকে। না না, শুধু ভাবি ডাকলে হবেনা। ভাবির সাথে মা যোগ করে ভাবিমা ডাকতে হবে। এখনই একবার ভাবিমা ডাকুন। দ্রুত।”

মুখ বাঁকায় রাকিব। তাচ্ছিল্যতার সাথে বলে,

“অ্যাহ্! আসছে ভাবিমা! শখের তুলা আশি টাকা না?এই রাকিব মরতে স্বীকার তবুও তোমার মতো সুন্দরীরে ভাবি ডাকতে স্বীকার না। সেখানে কি না ভাবিমা! নাউজুবিল্লাহ, আস্তাগফেরুল্লাহ।”

তার এহেন কথায় রাগে যেন এবার দিশাহারা দৃষ্টি। গরম চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে জানতে চায়,

“ডাকবেন না ভাবিমা?”

“কখনোই না।”

“এই শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, ডাকবেন না ভাবিমা?”

এবারও অস্বীকার যায় রাকিব। দৃষ্টি সাথে সাথে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে বারান্দায় যে পাশে রান্নার সামগ্রী সাজিয়ে রেখেছে সেখানে চলে যায়। কাটাকুটির জন্য মাঝারি সাইজের একটা বটি এনেছিল ঐদিন বাজার থেকে। সেটা হাতে নিয়ে খ্যাপা বাঘিনীর মতো তড়িৎ বেগে ছুটে আসে রাকিবের কাছে। চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

“তবে মর আজকে এই সুন্দরীর হাতে। ভালোই ভালোই বলছিলাম কথা কানে নিলিনা। এবার জান দিয়ে কর্মফল ভোগ কর।”

হতভম্ব রাকিব দৃষ্টির আচানক আক্রমণাত্মক রূপ দেখে ঘাবড়ে যায়। লাফিয়ে সোজা ঘরের সীমানা ছেড়ে বেরিয়ে যায়। দৌড়ের সাথে তুতলিয়ে বলে,

“এ কেমন সর্বনাশা কান্ড। সুন্দ.. থুক্কু ভাবিমা! মেহেরবানী করিয়া হাত থেকে ঐটা রাখেন। আপনি খুন করে জেলে গেলে আমার ভাইকে সন্নাস জীবন পাড় করতে হবে। শুধু আপনি কেন? আজ থেকে পৃথিবীর সকল সুন্দরী আমার মা। কালো গুলোর থেকে যেকোন একটা আমার বউ। এবার হাত থেকে ঐটা সরান।”

রাকিবের কথা শেষ হবার আগেই পকেটে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে। খ্যাপা বাঘিনীর সামনে দাঁড়িয়ে ফোন রিসিভ করে কথা বলার সাহস হয়না তার। বাড়ির ছোট্ট উঠোন পেরিয়ে গেটের বাইরে গিয়ে সিএনজিতে বসে বুকে হাত দিয়ে কতক্ষণ বিরবির করে বলে,

“এ কেমন বউ রে ভাই! যেমন খ্যাপা গুন্ডা শিকদার তেমন তার খ্যাপা বাঘিনী। একেবারে খাপে খাপ, মর্জিনার বাপ।”

মুখ গোল করে কতক্ষণ লম্বা শ্বাস টানে। মস্তিষ্ক শান্ত হতেই তৎপর হয়ে পকেট থেকে ফোন হাতে নেয়। রিসিভ করে কানে ধরতেই ঐপাশ থেকে ভেসে আসে রক্তিমের গালির বর্ষণ। চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে ধেয়ে আসা একের পর এক গালি হজম করে নেয় রাকিব। দ্বিতীয়বার ঐ বাঘিনীর সামনে যাবার সাহস না থাকাই রক্তিমকেই সাহস যুগিয়ে বলে,

“কি একটা মাইয়ারে বিয়া কইরা ঘরে তুলছেন ভাই! মাইয়া তো না পুরাই বোম্বাই মরিচ। আপনার ঐ বোম্বাই মরিচ আপনি আইসা নিয়া যান। আমার দ্বারা সম্ভব না। মাফ করেন।”

কথাটুকু শেষ করে তৎক্ষণাৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে একেবারে ফোন অফ করে রাখে রাকিব। সিএনজি ড্রাইভারকে নিজের বাসার ঠিকানা দিয়ে শরীর ছেড়ে সিটে বসে চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এক দিকে বউ বটি হাতে জান নিতে তাড়া করছে। অপরদিকে স্বামী বাংলা গালিতে কান পচিঁয়েছে। কি ভয়ানক পরিস্থিতি! বাপের জন্মে মনে হয় আগে কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়নি।গোল্লায় যাক সব কিছু। আজকের ঘটনা যতদিন পর্যন্ত রাকিবের মন-মস্তিষ্কে থেকে যাবে ততদিন পযর্ন্ত এই বাঘ, বাঘিনীর সামনে পরবেনা সে। প্রয়োজনে হাতে চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকবে। তবুও এদের সামনে পরবেনা। কি সাংঘাতিক বাবা রে বাবা! একটুর জন্য তার জানটা বেঁচে গেল।

****
রাকিব বিদায় নেবার কতক্ষণ পরই উদ্ভ্রান্তের মতো বাড়ি এসে উপস্থিত হয় রক্তিম। তার এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় দৃষ্টি। উৎসুক হয়ে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় দৃষ্টির কোমল হাতটা আকড়ে ধরে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যায় বাড়ির সীমানা ছেড়ে। হতবম্ভ দৃষ্টি মনের প্রশ্ন মনেই চেপে রাখে। রক্তিমের এমন বেহাল অবস্থা দেখে চিন্তার পাশাপাশি তার আচমকা অধিকার খাটানো স্পর্শে দৃষ্টির মন জমিনে সৃষ্টি হয় অনুভূতির আন্দোলন। একদিকে হঠাৎ স্পর্শে হৃদয়ের উচাটন, অন্যদিকে চিন্তা। দুইয়ে মিলে স্তব্ধ দৃষ্টি।

বাহারি রঙের ঝলমলে আলোয় সজ্জিত শিকদার বাড়ি। চারিদিকে উৎসব মুখোর আমেজ। বিয়ের পর এই প্রথম স্বামীর হাত ধরে শশুড়ালয়ে পা রাখল দৃষ্টি। এ যেন সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে এক অন্যরকম অনুভূতি। যে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা দৃষ্টির ক্ষেত্রে কষ্টসাধ্য। দৃষ্টির হাত নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় বন্দি রেখেই লম্বা কদমে সদর দরজা ডিঙিয়ে হলরুমে উপস্থিত হয় রক্তিম। চারিদিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেসব কিছুই যেন ঢুকছেনা তার মস্তিষ্কে। মমতাময়ী মায়ের সন্ধানে ছটফট করছে তৃষ্ণার্ত চোখ দুটোর কুচকুচে কালো মণি। কাঠিন্যতার খোলস ভেঙ্গে বাচ্চাসুলভ হৃদয়টা ব্যকুল হয়ে আছে মায়ের ভালোবাসার ছোট্ট একটা স্পর্শে স্বর্গীয় সুখ পাবার লোভে। রক্তিমের আকুল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একসময় চোখের সামনে স্পষ্ট হয় মায়ের আদল। এক পলক মা’কে দেখেই তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে মাথা ঝুঁকিয়ে নেয় রক্তিম। আলগা হয় হাতের বাঁধন। নিজের শক্ত হাতের মুঠো থেকে মুক্তি দেয় দৃষ্টির নরম হাতটা। অবাক হয় দৃষ্টি। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের নত মুখের দিকে। রক্তিম আসার খবর পেয়ে এতোক্ষনে শিকদার বাড়ির সকল আত্মীয়-স্বজন ভীড় জমিয়েছে ড্রয়িং রুমে। যে রক্তিম শিকদার সর্বদা বুক ফুরিয়ে কঠোর চিত্তে মাথা উচিঁয়ে ঘুরে বেড়ায়। আজ সেই রক্তিম শিকদার মায়ের সামনে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কোনো এক বাচ্চা বড়সড় কোনো ভুল করে মায়ের সামনে অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে। এমন এক অকল্পনীয় দৃশ্য দেখার পর কারো চোখ স্বাভাবিক থাকতে পারে? অত্যধিক আশ্চর্যিত ভঙ্গিতে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ দৃষ্টিতে অঘাত বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে মা-ছেলের দিকে।

কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে বিয়ে বাড়ি একদম নিশ্চুপ। দুরু দুরু বুকে মায়ের দিকে এগিয়ে যায় ইতি। কাধে হাত রেখে চাপা স্বরে বলে,

“তোমার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে মা। শুধুমাত্র তোমার একটা ডাকের অপেক্ষায়। আর দূরে সরিয়ে দিয়োনা। সমস্ত মান-অভিমান ভুলে কাছে টেনে নাও প্লিজ!”

রেহানা বেগম নিরব মূর্তিমান দাঁড়িয়ে। মৌনতা ভেঙ্গে কন্ঠলানী দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারিত হয়না। অপলক তাকিয়ে শুধু দেখে যায় নত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা সন্তানকে। যে সন্তান তাকে প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ বুঝিয়েছে। আদো আদো কন্ঠে মা ডেকে মন, প্রাণ জুড়িয়েছে। স্বার্থক করেছে নারীসত্তাকে। সেই প্রথম সন্তান যে সন্তান নিজের ছোঁয়ায় পূর্ণ করেছে নারীসত্তাকে,সেই আদরের টুকরোটাকে এতোদিন পযর্ন্ত বাড়ি ছাড়া রেখেছে রেহানা বেগম। একটা ভুলের শাস্তিস্বরুপ মায়ের কোল থেকে তাড়িয়ে বানিয়ে দিয়েছে এক ছন্নছাড়া পথিক। মা হয়ে সে কিভাবে পেরেছিল প্রথম সন্তানের প্রতি এতো কঠোর হতে?পথভ্রষ্ট করে এলাকার গুন্ডা, মাস্তানে পরিণতি করেছে আদরের সন্তানকে। এ যন্ত্রণা যে এতোদিন পর বড্ড পুড়াচ্ছে রেহানা বেগমকে। সন্তান শত অন্যায় কাজ করলেও কি কখনো কোনো মা পারে এভাবে দূরে সরিয়ে দিতে? রেহানা বেগমের মাতৃহৃদয় তো এতো কঠোর ছিলনা। তবে কিভাবে এতো বড় অন্যায় করে বসল নিজের সন্তানের প্রতি! ছেলেকে এভাবে অবহেলায় পথভ্রষ্ট করে সে নিজেও তো বর্তমানে এক অপরাধী নিজের বিবেকের কাছে। এ বিবেক কেন আগে জাগ্রত হয়নি? নির্দ্ধিধায় এতো বড় অন্যায় করার পরই কেন আজ এতোদিন পর উপলব্ধি হচ্ছে তা? নিজের বিবেকের কাছে নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ আজ রেহানা বেগম। সাহস হচ্ছেনা মায়ের দাবী নিয়ে রক্তিমের সামনে দাঁড়াতে। তবে না দাঁড়িয়েও যে উপায় নেই। বিবেক জাগ্রত হবার পরও কিভাবে পারবে ছেলেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। মায়ের মনটাও যে আর বাঁধা মানছেনা। সমস্ত দ্বিধা,জড়তা কাটিয়ে ইচ্ছে করছে সন্তানকে কাছে টানতে। রেহানা বেগমের কোমল মাতৃহৃদয় যখন দ্বিধা, জড়তা, অপরাধবোধে পৃষ্ঠ হয়ে ব্যর্থ সন্তানকে বুকে টেনে নিতে। তখনই উন্মোচন হয় অভিমানী মাতৃসত্তা। কান্নার ঢোক গিলে অভিমানে ঠাসা দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“আমি না হয় পাগল-মাথা নষ্ট, বিবেকহীন হয়ে মায়া মমতা সব ভুলে গিয়েছিলাম। তাই বলে তুই ও সব ভুলে যাবি? এই শিক্ষা দিয়ে তিলে তিলে বড় করেছি তোকে? আমার জানা মতে কোনো সন্তানকেই তো আমি কঠোর হবার শিক্ষা দেইনি। সন্তান যাতে কোমল হৃদয়ের অধিকারী হয় সেজন্য নিজের সমস্ত মায়া, মমতা ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে বড় করেছি। তবে কেন আমার একটু কঠোরতা দেখে তুই তার দ্বিগুণ ফিরিয়ে দিয়েছিস? কেন আমি বকলেই দূরে সরে যেতে হবে তোকে? কেন পারিস নি মায়া দেখিয়ে আমাকে মানিয়ে নিতে? একবার আমাকে জড়িয়ে ধরে মা বলে ডাকলে কি পারতাম এতোটা পাষাণ হতে? এতো বড় হবার পরও মা’কে কিভাবে মানাতে হয় সেটা জানলিনা। জানলি শুধু মা’কে কিভাবে সমাজের চোখে অপরাধী বানিয়ে রাখতে হয়। অপদার্থ কোথাকার!”

প্রতিবারের মতো এবারও মায়ের অভিযোগের তীরে বিদ্ধ রক্তিম। তবে এবারের অভিযোগ গুলো হৃদয়ে একটুও রক্তক্ষরণ ঘটায়নি। বরং মনে হচ্ছে হঠাৎ যেন লিলুয়া বাতাস মাতাল হাওয়ায় রূপবদল করেছে। সেই এক দলা মাতাল হাওয়া হৃদয় ছুঁয়ে ধীকধীক জ্বলতে থাকা অগ্নিশিখা ধপ করেই নিভিয়ে দিয়ে গেছে। স্বস্তির অনুভূতিতে জুড়িয়ে গেছে খরাপ্রবণ মন জমিন। এবার শুধু মায়ের মমতার পরশে সেই খরা প্রবণ মন জমিনে ঝুমঝুমিয়ে শীতল বর্ষণ নামার পালা। যে বর্ষণে হৃদয় কুটিতে জমে থাকা দগদগে ক্ষত পরিষ্কার হয়ে নতুন উদ্যোমে নেমে আসবে একরাশ স্নিগ্ধতা।

রক্তিমকে আগের মতো নত মস্তকে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাহস করে দৃষ্টি রক্তিমের একটা হাত আকড়ে ধরে। উদ্যোমী স্বরে বলে,

“সময় এসেছে ভুল-ভ্রান্তি সুধরে নিয়ে নতুন করে পথ চলার। নিজেকে এবার অন্ধকার থেকে বের করে আনুন। মা-বাবার কাছে সন্তান কখনো বড় হয়না। এগিয়ে যান মায়ের কাছে। মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন। উগলে দিন ভিতরে জমে থাকা সবটুকু কষ্ট। মাথা তুলে তাকান। দেখুন ঐ মানুষটা চোখে-মুখে কত আকুতি নিয়ে তাকিয়ে আছে। একটাবার মা বলে ডেকে দেখুন। সব ভুলে আপনাকে নিজের কোলে ঠাই দিবে। মায়ের কাছে সন্তান কখনো খারাপ হয়না। মায়েরা উদার হয়। তারা কখনো সন্তানের ভুল মনে রেখে আজীবন সন্তানের থেকে দূরে থাকতে পারেনা।”

থমথমে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে সকলের মাঝে। উপস্থিত প্রত্যেকে মৌনতা বজায় রেখে মুখিয়ে আছে মা-ছেলের মিলন মুহূর্ত দেখার অপেক্ষায়। একটু একটু করে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারাচ্ছে রক্তিম। শরীরটা একেবারে ভেঙ্গে আসছে। বন্ধ চোখ জোড়া কেমন জ্বারাপোড়া করছে। মনে হচ্ছে চোখ মেলে তাকালেই ফেঁটে রক্ত গড়িয়ে পরবে। মাথাটাও ঝিমিয়ে আছে। দাঁতে দাঁত পিষে টলতে টলতে মায়ের দিকে এগিয়ে যায় রক্তিম। কান্না গুলো জমাট বেঁধে লাল হয়ে ওঠা চোখ দুটো মেলে তাকায় মায়ের দিকে। সাথে সাথে টুপটাপ দুচোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পরে দু-ফোঁটা নোনাজল। পাষাণ রক্তিমের চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে! বিষয়টা দৃষ্টিগোচর হতেই এক প্রকার হোচট খায় উপস্থিত সকলেই। সেদিকে রক্তিমের কোনো ধ্যান নেই। হাঁটু মুড়িয়ে ধপ করে বসে পরে মায়ের সামনে। নিজের দুহাতের মাঝে মায়ের হাত দুটো যত্ন করে তুলে নিয়ে কপালে ঠেকায়। কাঁপা স্বরে বলে,

“জানি আমি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। তবুও পারলে এই পাপী সন্তানকে ক্ষমা করে দিও। সন্তান ভেবে বুকে টেনে নিতে হবেনা। শুধু একটু দয়া দেখিয়ে ক্ষমা করে আমাকে স্বস্থির নিঃশ্বাস নিতে দাও। আর কোনো অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিওনা আমার উপর। হাজারটা অপরাধের ভারে এখন আমি ম্রিয়মাণ। হাঁপিয়ে গেছি। হারিয়ে ফেলেছি সহ্যক্ষমতা। এতোদিনের কঠোরতার খোলসে আবৃত আমিটা আজ খোলস ছেড়ে বড্ড নাজুক। একটু করুনা করো আমাকে। বাঁচতে দাও অপরাধবোধ থেকে। মুক্তি দাও আত্মগ্লানি থেকে। যদি ক্ষমা না পাই, প্রতিটা প্রহর বেঁচে থেকেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে আমায়। জীবন্ত লাশ হয়ে আর বাঁচার ক্ষমতা নেই আমার। হয় সুস্থ্যভাবে বাঁচতে দাও। না হয় একেবারে গলা টিপে মেরে ফেলো। তবুও মুক্তি দাও।”

ছেলের করুন আহাজারি আর চোখের অশ্রু এলোমেলো করে দেয় রেহানা বেগমকে। বক্ষদেশে সৃষ্টি হয় তোলপাড়। বিমূঢ় দৃষ্টিতে কতক্ষণ পায়ের কাছে লুটিয়ে থাকা ভঙ্গুর রক্তিমের দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকায় নিজেও বসে পরে মেঝেতে। পাগলপ্রায় হয়ে জাপ্টে ধরে রক্তিমের মাথাটা বুকে টেনে। সহসা পুরো বাড়ি কেঁপে ওঠে এক মায়ের করুন চিৎকারে। মায়ের কান্নায় পাথর হৃদয়ের রক্তিম নিজেও বাচ্চাদের মতো মা’কে ঝাপটে ধরে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ওঠে। এক তৃষ্ণার্ত মা-ছেলের মহামিলনের সাক্ষী উপস্থিত প্রতিটা মানুষের চোখের কোণেও জল জমে। শান্তিপ্রিয় আজীজ শিকদারের চোখের কোণেও আজ অশ্রু। তবে তা ব্যর্থতার নয়। অদম্য খুশি গুলো আজ যেন সকলের চোখ বেয়ে কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। রেহানা বেগমের গগনবিদারী চিৎকার যেন পুরো পৃথিবীকে জানান দিতে চাইছে, তোমরা দেখো। আমার ছেলে আজ আমার বুকে ফিরে এসেছে। শেষ হয়েছে মা-ছেলের নিরব যুদ্ধ, মান-অভিমানের পালা। মমতাময়ী মায়ের পরশে পাষাণতুল্য রক্তিমের চোখ দুটোও আজ সিক্ত। মায়ের আদুরে পরশে তৃপ্ত মৃতপ্রায় হৃদয় জমিন।

চলবে…..

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৫
#আদওয়া_ইবশার

নিকশ কালো অন্ধকারের বলয় কেটে প্রকৃতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে মিঠা রোদ্দুর। শীতের প্রকট আজ ক্ষীণ। সকাল হতেই হইচই শুরু হয়ে গেছে শিকদার বাড়িতে। বহুদিন পর মৃতপ্রায় বাড়িটা যেন আজ প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আনন্দধারা উপচে পরছে চারিপাশে। দিন শেষে রাত পাড় হলেই বাড়ির ছোট মেয়ের বিয়ে। মায়ের জাদুর পরশে ছন্নছাড়া রক্তিম আজ নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। আদরের ছোট বোনের বিয়ের দায়িত্ব মহানন্দে তুলে নিয়েছে নিজ কাধে। মেহমান থেকে শুরু করে বাড়ির প্রতিটা মানুষের নাস্তা করা শেষ। বাকী শুধু রক্তিম আর দৃষ্টি। ঘুম থেকে ওঠার পর এখন পযর্ন্ত দৃষ্টি তার পাষাণ পুরুষের দেখা পায়নি। মহারাজ আজ মনে হচ্ছে একদিনেই নিজের দায়িত্ব সব পালন করে ফেলবে। ঘরে যে তার নতুন বউ একা সেদিকে একটুও খেয়াল নেই। তার খেয়াল ছিলই বা কবে? সেই তো প্রথম দিন থেকেই পাষান্ডটা দৃষ্টির প্রতি উদাসীন। তবুও দৃষ্টির অবচেতন লোভী মন ভেবেছিল গত রাতের ঘটনার পর রক্তিম বুঝি মা-বাবা, বোনদের পাশাপাশি বউকেও আপন করে নিবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। দৃষ্টিকে আরও একবার হতাশার সাগরে ডুবিয়ে রক্তিম দেদারসে নিজের বোনের বিয়ের কাজকর্মে মশগুল। এদিকে বাড়ি ভর্তি মেহমানদের সামনে দৃষ্টি যেন এক ঘরে তোলা নতুন শো-পিস। যার বিয়ে তার দিকে নজর না দিয়ে মানুষজন সকলেই তাকে নিয়ে পরেছে। বউ কালো না সুন্দর, খাটো না লম্বা, চুল কেমন, হাত-পায়ের নখ কেমন এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেউ নতুন বউয়ের রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আবার কেউ কেউ রক্তিমের প্রথম স্ত্রী জেরিনের সাথে তুলনা করে দৃষ্টিকে নাকাল বানাতে উদগ্রীব। অনেকেই আবার যা ঘটেছিল তার সাথে আরও রংচং মাখিয়ে অতি উৎসাহের সাথে বউকে জানাচ্ছে তার স্বামী প্রথম স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসতো। জেরিন নামক মেয়েটার প্রেমে কতটা পাগল ছিল রক্তিম। দৃষ্টির অবুঝ মনটাকে জেরিন সম্পর্কিত এক একটা কথা যে কতটা ক্ষতবীক্ষত করছে তা যদি কেউ দেখত তবে হয়তো ঐসব পুরোনো কাসুন্দি ঘাটার সাহস করতনা। সে মুখে যতই বলোক রক্তিমের অতীত নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই তার। দিন শেষে আজ সেই অতীতের গল্প শুনে তবুও ভালোবাসার কাঙ্গাল হৃদয়টাতে অসহনীয় ব্যথার সৃষ্টি হচ্ছে। না পারছে নিজের স্বামী কেন্দ্রিক ঐসব রসালো প্রেমগাথা অতীত কথন সহ্য করতে। আর না পারছে কারো মুখের উপর কিছু বলতে।

দৃষ্টিকে এই অসহনীয় পীড়া থেকে রক্ষা করতেই বোধহয় একসময় রেহানা বেগম উপস্থিত হয়। কারো দিকে না তাকিয়ে দৃষ্টির বাহু আকড়ে ধরে বসা থেকে উঠিয়ে তাড়া দিয়ে বলে,

“গল্প করার সময় অনেক পাবে। সকাল পেরিয়ে দুপুর হচ্ছে। এখনো না খেয়ে আছো। নিচে চলো। রক্তিম এসেছে, তার সাথে নাস্তাটা করে নাও।”

শাশুড়ির আগমনে দৃষ্টি যেন হাপ ছেড়ে বাঁচে। দ্রুত পা চালিয়ে শাশুড়ির পিছন পিছন বেরিয়ে যায়। ডাইনিং টেবিলে একমনে নিচে তাকিয়ে রক্তিম খেতে ব্যস্ত। তার ঠিক পাশের চেয়ারটাতেই দৃষ্টিকে বসিয়ে দেয় রেহানা বেগম। একটা প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলে,

“একদম লজ্জা করবেনা। পেট ভরে খেয়ে ওঠবে। সাথে আমার ছেলের যা লাগে তাও এগিয়ে দিবে। কে কি বলল না বলল এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমার ছেলেকে নিয়ে আর নিজেকে নিয়ে ভাবো শুধু। মনে করো তোমরা দুজন ছাড়া তোমার আশেপাশের সব অদৃশ্য। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের কাজই হলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তিলকে তাল বানিয়ে এটা সেটা বলে সংসারে আগুন লাগানো। ওদের কথায় কান দিবেনা একদম।”

মায়ের কথায় খাওয়া থামিয়ে চিন্তিত মুখে মাথা তুলে তাকায় রক্তিম। ভরাট কন্ঠে জানতে চায়,

“কি হয়েছে মা?”

“কি আর হবে? বিয়ে করে বউ ঘরে তোলে দায়িত্বজ্ঞান হীনের পরিচয় দিচ্ছিস যে, তাই পাড়া-প্রতিবেশী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।”

কথা কাটিয়ে রেহানা বেগম তাড়াহুড়ো করে এটুকু বলেই প্রস্থান করে সেখান থেকে। নিজ থেকে এসে রক্তিমের কাধে বসা দৃষ্টি নামক আস্ত এক মাথা ব্যথা কেন্দ্রিক কথায় বিরক্ত হয় রক্তিম। তবে প্রকাশ করেনা তা। মায়ের স্বাভাবিক আচরণে বিরক্তি ভাবটাও খুব দ্রুতই কেটে যায়। আবারও পুরো মনযোগ দেয় খাবারে। দৃষ্টি সেদিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। শাশুড়ির বোঝপূর্ণ কথায় মনটা যতটা হালকা হয়েছিল তার থেকেও দ্বিগুণ বিষাদ হানা দেয় রক্তিমের নির্লিপ্ততায়। চোখ দুটো সিক্ত হয় অশ্রুজলে। কথা বলতে গিয়ে টের পায় কাঁপন ধরেছে কন্ঠনালীতে। ঠোঁট কামড়ে ঢোক গিলে গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকা কান্নাটাকে গিলে নেয় দৃষ্টি। কন্ঠে অসহায়ত্ব নিয়ে জানতে চায়,

“আমার কি আপনার স্ত্রী হবার একটুও যোগ্যতা নেই? আপনার প্রথম স্ত্রী জেরিন, সে কি আমার থেকেও অত্যধিক সুন্দরী ছিল? রূপে, গুণে সব দিক থেকেই কি আমি তার থেকে পিছিয়ে?”

রুটি ছিঁড়তে গিয়ে তৎক্ষণাৎ রক্তিমের হাত দুটো থেমে যায়। মুখে থাকা অবশিষ্ট খাবারটুকুও আর গলা দিয়ে নামেনা। শান্ত চোখে তাকায় দৃষ্টির দিকে। স্বভাবজাত গম্ভীর কন্ঠে বলে,

“আজ প্রথমবার শুনেছি তাই কিছু বললাম না। দ্বিতীয়বার যদি আমার অতীত নিয়ে কোনো প্রশ্ন করার সাহস করেছিস তোর জ্বিভ টেনে ছিঁড়ে কুকুরের খোরাক বানাবো।”

অত্যধিক শীতল কন্ঠের এমন ঠান্ডা হুমকিতে কিছুটা কেঁপে ওঠে দৃষ্টি। রক্তিমের থেকে নজর সরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। নিজেকে সামলাতে গিয়েও হিমশিম খায় রক্তিম। দৃষ্টির মুখে হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে পায়ের রক্ত যেন মাথায় ওঠে যায়। রাগে কিড়মিড়িয়ে শতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে ডাইনিং একদম ফাঁকা বুঝতে পেরে খাঁমচে ধরে দৃষ্টির বাহু। তড়িৎ ভয়ে চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নেয় দৃষ্টি। ক্রোধান্বিত হয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে রক্তিম,

“কেন এসেছিস আমার জীবনে? যেটুকু সুখে আছি সেটাও কেড়ে নিতে? আমি তো এমনিতেই মৃতপ্রায়। আর কি মারবি আমাকে? কি সুখ কেড়ে নিঃস্ব করবি আমাকে? বিশ্বাস কর, আমি এমনিতেই নিঃস্ব। তোকে দেওয়ার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই আমার। টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ কিছুই নেই। যে ভালোবাসার দোহাই দিয়ে জুড়েছিস আমার জীবনে। সেই ভালোবাসা বোঝার জন্য যে একটা মন লাগে সেই মনটাও নেই। তবে কেন শুধু শুধু আমার জীবনে এসেছিস? সব জেনে বুঝে এসেছিস যখন, তো কেন আজ ঐসব অতীত নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস? এখনো সময় আছে, চলে যা আমার জীবন থেকে। বিশ্বাস কর বেঁচে যাবি। আমার থেকেও হাজার গুণ ভালো ছেলে পাবি। যে তোকে ভালোবাসা দিতে পারবে, বিলাসীতা দিতে পারবে সর্বোপুরি সুখে রাখতে পারবে। আমার জীবনে থাকলে দুঃখ ছাড়া কিছুই পাবিনা। আমার মাথা একদম ঠিক নেই। আমি পাগল। বদ্ধ উন্মাদ আমি। মাথা বিগড়ে গেলে তোকে মেরেও ফেলতে পারি। জীবনের মায়া থাকলে চলে যা। বেঁচে যাবি। সুখেও থাকবি।”

বেপরোয়া ভঙ্গিতে কথা গুলো বলে ঝড়ের গতিতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় রক্তিম। দুঃখের সাগরে ডুবিয়ে রেখে যায় দৃষ্টিকে। ভালোবাসায় টইটুম্বর এক অষ্টাদশীর হৃদয়ে সৃষ্টি করে যায় কাল বৈশাখী ঝড়। যে ঝড়ে নড়বড়ে হয় দৃষ্টির বুকে জমে থাকা স্বপ্ন। রক্তিম নামক এক পাষাণ পুরুষের সাথে সুখের সংসার গড়ার স্বপ্ন।

****
রক্তিমের বুকে সৃষ্ট দগদগে ঘায়ে সবে অল্প প্রলেপ পরেছিল। মুহূর্ত ব্যবধানে সেই ঘা অজান্তেই দৃষ্টি আবার খুঁচিয়ে তাজা করে দিল। জীবনটাকে অল্প-স্বল্প গোছানোর প্রস্তুতি নেওয়া রক্তিমকে আবারও পথভ্রষ্ট করে দিল। এলোমেলো করে দিল মন-মস্তিষ্ক। বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিরিবিলি এক কাঁঠাল বাগের ভিতরে গিয়ে গাছের গুড়ায় বসে পরে রক্তিম। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সর্বশক্তি দিয়ে টেনে ধরে নিজের চুল। বুকের ভিতরে সদ্য তাজা হওয়া ঘায়ের জ্বলনে অশান্ত হয় বক্ষ পিঞ্জর। ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাওয়া হৃদয়টা সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ জানায়, কেন তার জীবনটা এমন এক কালো আধারে ডুবে গেল? কি এমন জঘণ্য অন্যায় করেছিল সে, যে অন্যায়ের শাস্তি স্বরুপ পুরো জীবনটা এলোমেলো হলো তার! অন্যায় কথাটা স্বরণ হতেই থমকে যায় রক্তিম। শরীর ছেড়ে গাছের সাথে হেলান দিয়ে ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,

“অন্যায় তো করেছিই আমি। ভালোবাসার মতো মস্ত বড় অন্যায়। এ অন্যায়ের শাস্তি তো এখন ভোগ করতেই হবে। যে হৃদয় ভালোবেসে মহা পাপ করেছে সে হৃদয় তো পুড়বেই। মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত তাকে পুড়তে হবেই।”

অসাঢ় মস্তিষ্ক। নিস্তেজ শরীর। ক্লান্ত হয়ে গেছে ভাবনারাও। বুঝে গেছে রক্তিম সুখ তার জন্য না। এক বিন্দু সুখের পরিবর্তে যার জীবনে মুহূর্তেই নেমে আসে ঘুট্ঘুটে অন্ধকার তার সুখের সন্ধান করা অনুচিত। ভাবনা-চিন্তা, সুখ-দুঃখের হিসাব রেখে ক্লান্ত দেহ টেনে ওঠে দাড়ায় রক্তিম। ভঙ্গুর হৃদয়টাকে কাঠিন্যতার খোলসে ভরে এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে। জাগতিক সমস্ত কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ইচ্ছে হলেও উপায় নেই এই মুহূর্তে। যে দায়িত্ব কাধে নিয়েছে তা তো পালন করতেই হবে তাকে।

শিকদার মঞ্জিলের কাছাকাছি আসতেই পকেটে থাকা যান্ত্রিক বস্তুটা ভাইব্রেশন থাকায় বিপ বিপ শব্দ তুলে কেঁপে ওঠে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতেই পকেট হাতরে ফোন বের করে রিসিভ করে কানে ঠেকায় রক্তিম। জলদগম্ভীর কন্ঠে বলে,

“কে?”

“দৃষ্টির বাবা বলছিলাম।”

তৎক্ষণাৎ থেমে যায় রক্তিম। চোখ দুটো বন্ধ গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। ভাবে আজ কি এসব উটকো ঝামেলা তার পিছু ছাড়বেনা? কতক্ষণ আগেই মেয়েটা অতীত নাড়িয়ে বুকের ঘা তাজা করেছে। সেই যন্ত্রণা সামলে উঠতে না উঠতেই এখন আবার বাপ হাজির। বিতৃষ্ণায় তেতু হয়ে ওঠে রক্তিমের গলা অব্দি। নিরবতার জাল ছিঁড়ে ফোনের অপর পাশ থেকে সাদেক সাহেব দ্বিধান্বিত কন্ঠে বলে ওঠেন,

“তোমার বাবা এসেছিল বিয়ের দাওয়াত নিয়ে। একটু ঝামেলায় পরে গেছি তাই যেতে পারলাম না। তাছাড়া তোমাদের বিয়েটা যে পরিস্থিতিতে হয়েছে এখন পযর্ন্ত দৃষ্টির মা মেয়ের উপর রেগে আছে। সে কিছুতেই যাবেনা। তোমার বাবাকে বলে দিও কোনো কষ্ট না পায় যাতে। আত্মীয়তা যখন হয়েছেই, তখন আজ হোক কাল। সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে আসা-যাওয়া হবেই।”

আগুনে ঘি ঢেলে দিলে আগুন যে রূপে গর্জে ওঠে,রক্তিমের অবস্থাও ঠিক সেরকম। সাদেক সাহেবের কথা গুলো যেন রক্তিমের রাগে ঘি ঢালার কাজটাই করে দিয়েছে। অত্যধিক রাগে কপালের দুপাশের শিরা ধপ ধপ করছে। কপাল কুঁচকে কিছু যেই ফোনটা কান থেকে নিঃশব্দে নামিয়ে লাইন কাটতে যাবে ওমনি ভেসে আসে সাদেক সাহেবের কিছু কথা,

“দেখো বাবা! বিয়েটা যেভাবেই হোক আমার মেয়ে এখন তোমার দায়িত্বে। তাকে ভালো রাখার দায়িত্বটাও সম্পূর্ণ তোমার। তুমি কেমন তা আমার জানার প্রয়োজন নেই। তোমার কি আছে কি নেই, সেটাও কখনো জানতে চাইবনা আমি। আমি যা চাইব তা শুধু আমার মেয়ের সুখ। বলতে পারো এক অসহায় বাবা তোমার কাছে হাত জোর করে অনুরোধ করছে তার মেয়েটার খেয়াল রাখার জন্য। আমার মেয়েটা বড্ড সরল। ওর চাহিদা গুলোও খুব স্বস্তা, আবার বলা চলে খুব দামিও। কারণ আমার মেয়েকে সুখে রাখার জন্য দামি দামি পোশাক, কসমেটিকস এর প্রয়োজন হয়না। একটু ভালোবাসা আর অল্প যত্ন পেলেই আমার মেয়ে সুখী। এর বেশি কিছুই চায়না তার। তুমি যদি তাকে এক বিন্দু ভালোবাসা উপহার দাও। বিনিময়ে তোমাকে সে তার পুরো হৃদয়টা দিয়ে দিবে।”

কথার মাঝে একটু থামে সাদেক সাহেব। এই প্রথম মেয়ের জামাইয়ের সাথে কথা হচ্ছে। সেটাও তিনি নিজেই যা বলার বলে যাচ্ছে। শশুর হিসেবে যে সাদেক সাহেব অন্ততপক্ষে একটা সালামপ্রাপ্য এটাও হয়তো রক্তিমের জানা নেই। জানা থাকলেও হয়তো ছেলেটা ইচ্ছে করেই সাদেক সাহেবকে অসম্মান করছে। কথা গুলো ভাবতেই মেয়ের প্রতি রাগটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মেয়েটা তার এই ছেলের মাঝে কি দেখে পাগল হয়েছে? যে ছেলের মাঝে সামান্য সহবত নেই সেই ছেলে কি আদও ভালোবাসা বুঝে? বুঝলেও কিছু করার নেই না বুঝলেও কিছু করার নেই। যেখানে নিজের মেয়েই কথায় নেই সেখানে পরের ছেলের সম্মান দিয়ে কি হবে! ফোনের মাঝেও রক্তিম ঠিক টের পায় সাদেক সাহেবের দীর্ঘশ্বাস। মৌনতা ভেঙ্গে অনুরোধের স্বরে সাদেক আবারও বলে ওঠে,

“দৃষ্টির সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষা আর চার‍দিন পর। জানিনা মেয়েটা পড়ছে কি না। ওকে পরীক্ষাটা দেওয়ার সুযোগ দিও। আমার মেয়েটা পড়াশোনায় খুব ভালো। ওকে নিয়ে ওর মা-বাবার অনেক স্বপ্ন। মেয়েটাকে তো কেড়ে নিলে। তাকে ঘিরে দেখা আমাদের স্বপ্ন গুলোকে কেড়ে নিওনা। দয়া করে হলেও ওকে পড়ালেখার সুযোগ দিও। আমার বিশ্বাস সাত কলেজের যেকোন একটাতে ওর চান্স হবেই।”

যে ছেলে নিজের দায়িত্বটাও নিজে পালন করতে পারেনা, সে ছেলের কাছে কি না এক বাবা তার মেয়ের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করছে! শ্লেষাত্বক হাসে রক্তিম। তবে কেন যেন মুখের উপর না করে দিতে পারেনা। না শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়েই টের পায় গলার কাছে কিছু একটা চেপে ধরে রেখেছে। বলবেনা বলবেনা করেও জ্বিভের ডগায় শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলে,

“পরীক্ষা দিবে। চিন্তা করবেন না।”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে