দৃষ্টির আলাপন পর্ব-২৩

0
170

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৩
#আদওয়া_ইবশার

টুকটাক বাজার করার কথা বললেও পুরো একটা ভ্যান পূর্ণ করে তবেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছে দৃষ্টি। হাড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে টুকিটাকি রান্নার সরঞ্জাম, একটা রেক, বিছানার জন্য নতুন বালিশ- তোশক, চাদর, আয়না, চিরুনি কিছুই বাদ রাখেনি। কেনাকাটার পুরোটা সময় রক্তিম শুধু গম্ভীর হয়ে শান্ত চোখে দৃষ্টিকে দেখে গেছে। ভিতরে ভিতরে রেগে দিশাহারা হলেও মুখে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। সকলের অতি পরিচিত মুখ রক্তিম শিকদারের সাথে হুট করে একটা মেয়েকে দেখে প্রত্যেক দোকানি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকলেও মুখ ফোটে কিছু বলার সাহস পায়নি। আড়ালে-আবডালে শুধু ফিসফিসিয়ে গেছে, কে হতে পারে মেয়েটা? রক্তিম শিকদার কি আবার বিয়ে করল! করলেই বা কখন? কেউ তো শুনেনি! এমন লুকিয়ে-চুরিয়ে হঠাৎ কেন এভাবে বিয়ে করল? মেয়ে ঘটিত কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়েছিল না কি? এমন হাজারটা প্রশ্ন বাজারের প্রতিটা মানুষের মনে থাকলেও মুখ ফোটে উচ্চারণ করার হিম্মত কারো নেই। সকল জিনিসপত্র ভ্যানে তুলে দিয়ে দৃষ্টিও ওঠে বসে রক্তিমের বাইকের পেছনে। মনের ভিতর তার আনন্দেরা নৃত্য করছে। মুখ থেকে হাসি সরছেই না। এতো আনন্দিত হবেই বা না কেন! সেই কবে থেকে ইচ্ছে ছিল রক্তিমের বাইকের পিছনে বসে সাভারের অলিগলি ঘুরে বেড়াবে। বিয়ের দুদিনের মাথায় পাষাণ শিকদারের মন জয় করার আগেই সেই সুযোগ পেয়ে হাতে যেন চাঁদ পেয়ে গেছে দৃষ্টি। মনের সুখে স্বামী যে তার আস্ত এক জল্লাদ তা বেমালুম ভুলে বাইকে বসেই রক্তিমের কাধে হাত রাখে দৃষ্টি। ঠিক তখনই কর্ণগোকোহরে পৌঁছায় রক্তিমের হিমশীতল কন্ঠ,

“কাধ থেকে হাত সড়া। নইলে ফুটবলের মতো লাথি মেরে বাইক থেকে মাঝ রাস্তায় ফেলব।”

কোনো আগামবার্তা ছাড়াই এমন একটা তরতজা অপমানে ফুস করে দৃষ্টির উৎফুল্ল মনটা নিভে যায়। সাথে একটু ভয়’ও হয়। না জানি আবার গুন্ডাটা মাঝ রাস্তায় তার গলা চেপে ধরে। এমনিতেই গতরাত থেকে যে পরিমাণে জ্বালাতন করছে দৃষ্টি! এরপরও সবসময় নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরা রক্তিম শিকদার শান্ত। আল্লাহর অশেষ রহমতে সে এখনো ঐ গুন্ডাটার ক্রোধের স্বীকার হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে জল্লাদটাকে না রাগানোই ভালো। কথাটা ভেবেই দৃষ্টি তড়িৎ কাধ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। মুখটা কাঁচুমাচু বিরস কন্ঠে বলে,

“আজকে নিজে থেকে ধরেছি তবুও এভাবে অপমান করছেন তো! দেখবেন, খুব শিগ্রই এমন একটা দিন আসবে। যেদিন আপনি নিজে থেকে বলবেন, বউ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসো। নইলে পরে যাবে।”

বিপরীতে রক্তিম কিছুই বলেনা। অত্যধিক রাগে মুখটা থমথমে করে সর্বোচ্চ গতিতে বাইক ছুটিয়ে এক টানে বাড়ি গিয়ে থামে।

দৃষ্টিকে রেখে আবারও সেই একই গতিতে বাইক ছুটিয়ে চোখের আড়াল হয় রক্তিম। রক্তিমের যাবার পানে তাকিয়ে হতভম্ব দৃষ্টি চেঁচিয়ে ওঠে,

“আরে! যাচ্ছেন কোথায়? ভ্যান থেকে জিনিস গুলো নামিয়ে ঘরে দিয়ে যাবেন তো!”

কিন্তু কে শুনে কার কথা! দৃষ্টির চেঁচানো রক্তিমের কান পযর্ন্ত পৌঁছালে তো! অগত্যা অসহায় দৃষ্টি নিজেই ভ্যান চালকের সাহায্য নিয়ে জিনিস গুলো ঘরে নেয়। সাথে বিরবিরিয়ে মনের ক্ষুবে পাষাণ শিকদারের গুষ্ঠি উদ্ধার করে। ভ্যান চালককে বিদায় দিয়ে রক্তিমের প্রতি রাগ-ক্ষুব ঝেড়ে ফেলে মনের মাধুরী মিশিয়ে স্বল্প জিনিসেই নিজের সংসারটাকে গোছাতে ব্যস্ত হয় দৃষ্টি। পুরো ঘর ঝাড়-মুছ করে জায়গা মতো প্রতিটা জিনিস রেখে এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। এবার ছোট্ট চৌকিটাতে নতুন তোশক-চাদর বিছানো হয়ে গেলেই ঘরটা টিপটপ হবে। বালিশ গুলো সড়িয়ে পুরোনো চাদরটা উঠাতেই চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে যায় দৃষ্টির। সাথে ভয়ে কেঁপে ওঠে শরীরের লোমকূপ। চৌকিতে পরপর সাজানো দুটো বালিশের নিচে চকচক করছে একটা ধারালো রাম-দা, একটা চা পা টি। এতো বড় দা বাস্তবে এর আগে কখনও দেখেনি দৃষ্টি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভালো কোনো কাজের জন্য এগুলো রাখেনি। নিশ্চয়ই খু না খু নি কান্ড ঘটানোর চিন্তাতেই এসব রাখা। দৃষ্টি নিজের চোখে দেখেছে রক্তিম খালি হাত আর হকিস্টিক দিয়েই আঘাত করে প্রতিপক্ষকে। তার ভালোবাসার মানুষটা নিজ এলাকার মানুষের কিছু ভালো করতে গিয়েই গুন্ডামি করে বেড়ায়। কিন্তু তার কাছে যে এমন অস্ত্র থাকতে পারে এটা দৃষ্টি একটুও ভাবেনি। অস্ত্র যেহেতু আছে তবে কি এই অস্ত্রের ব্যবহারও করতে জানে রক্তিম! তুসীর মুখ থেকে শোনা কথাটা কি তবে সত্যিই! আসলেই কি আততায়ীর হামলায় রক্তিমের ছোট ভাই আর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল! না কি রক্তিম নিজেই খু ন করেছিল তাদের! আর কিছুই ভাবতে পারেনা দৃষ্টি। অজানা এক ভয়ে চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। অবশ হয়ে আসে শরীর। ঐসব সর্বনাশা ভাবনা দৃষ্টি ভাবতেও চায়না। তার প্রণয় পুরুষ গুন্ডা হলেও কখনো খু নি হতে পারেনা। দুদিন যাবৎ দৃষ্টি মানুষটার ঘরে আছে। বিভিন্ন কথায়, কাজে কতভাবে জ্বালাচ্ছে তাকে। তার বিরুদ্ধে গিয়ে তার নিজের বাবাকে হাত করে তারই ঘরে বউ হয়ে এসেছে। শুধু একটু রাগচটা হওয়ায় এতো গুলো কান্ড ঘটানোর ফলে দুবার গায়ে হাত তুলেছে। এর বেশি তো কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি তার সাথে। যদি সত্যিই রক্তিম খু নি হতো তবে কি দৃষ্টিকে এতো সহজভাবে ছেড়ে দিতো!

****

বহুদিন পর শিকদার বাড়িতে আবারও বিয়ের ধুম পরেছে। বাড়ির সবথেকে ছোট সদস্যের বিয়ে। সেটাও ভালোবাসার। দুই পরিবারের সম্মতিতেই ধুমধাম আয়োজনের মাধ্যমে বিয়েটা হচ্ছে। এই বিয়েতে কি কোনো আয়োজনের কমতি থাকতে পারে! অন্দরমহলের বাইরে ঝাকঝমক পূর্ণ আয়োজনের চিত্র দেখা গেলেও ভিতরের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আদরের ছোট বোন আর প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে এক সুতোয় বাঁধার জন্য রক্তিম বাবার সকল আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেও বিয়েতে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কোনো কিছুর বিনিময়েও সে শিকদার বাড়ির এই ঝমকালো আয়োজনে থাকবেনা। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হবার পর থেকেই আজীজ শিকদার, ইতি, মেহেদী সকলেই রক্তিমকে বুঝানোর কাজে লেগে গেছে। কিন্তু সে কারো কথা শুনতে নারাজ। নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে ছন্নছাড়া জীবনের ছকবাধা নিয়মেই দিন পার করছে। প্রতিদিন মোড়ের চায়ের স্টলে ছেলেপেলে নিয়ে আড্ডা, কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে আসলে মেরেধরে হলেও সমাধান করা। এলাকার বখাটেদের হাত থেকে মেয়েদের নিরাপদে রাখা। এসব করেই দিব্যি চলে যাচ্ছে রক্তিমের দিন। সেদিন দৃষ্টি অস্ত্র গুলো নিয়ে কিছুই বলেনি রক্তিমকে। মনের মাঝে হাজারটা কৌতূহল আর ভয়ের উদ্দীপনা থাকলেও চুপচাপ অপেক্ষায় থাকছে সঠিক সময়ের। তার ধীর বিশ্বাস সঠিক সময়ে রক্তিম নিজেই অতীত থেকে শুরু করে বর্তমান সহ সব কিছুই দৃষ্টির কাছে খুলে বলবে। এই নিয়ে কিছু না বললেও দৃষ্টি কয়েকবার চেষ্টা করেছে বোনের বিয়েতে থাকার জন্য বুঝিয়ে বলার। বরাবরই রক্তিমের কঠোর চোখের চাহনির কাছে দমে গিয়েছে দৃষ্টি। ভেবে নিয়েছে এটা নিয়েও আর কিছুই বলবেনা। ইচ্ছে না হলে না যাক বিয়েতে। তাকে যে এখন পযর্ন্ত রক্তিম নিজের ঘরে ঠাই দিয়েছে,এটাই তো তার পরম ভাগ্য। তার থেকেও বড় কথা দৃষ্টি রক্তিমের নিরব ক্রোধের চাহনিতে ভস্মীভূত হলেও ইদানিং যথেষ্ট লাই পেয়েছে। সেই আগের মতো এখন আর কথায় কথায় তার দিকে মারতে তেড়ে আসেনা। তুই তুকারিটা যদিও এখনো পরিবর্তন হয়নি। রাগি রাগি কন্ঠে কথা বলার ধরনও পরিবর্তন হয়নি। সবথেকে বড় পরিবর্তন যেটা হয়েছে তা হলো, প্রথম দুদিন রক্তিম দৃষ্টির হাতের রান্না না খেলেও বহু খেসারতের পর তাকে খাওয়াতে সক্ষম হয়েছে। এখন প্রতিদিন তিন বেলা না খেলেও এক বেলা রাতে দৃষ্টির হাতের রান্নায় খাচ্ছে। এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে দৃষ্টির! পাষাণ শিকদার তাকে ভালো না বাসুক। নরম স্বরে দুটো কথা না বলোক, চোখে মায়া নিয়ে না তাকাক তার দিকে। তবুও তো তাকে ঠাই দিয়েছে নিজের জীবনে। নিরবে দায়িত্ব দিয়েছে তার এলোমেলো ঘরটাকে গোছানোর। দৃষ্টির বিশ্বাস। এভাবেই ঠিক একদিন রক্তিম শিকদার নিরবেই তার নিজের দায়িত্বটাও দৃষ্টির হাতে তুলে দিবে।

****
বিয়ের কনের সম্পূর্ণ সম্মতিতে, ভালোবাসা পূর্ণতা পাবার লক্ষ্যে বিয়ের আয়োজন শুরু হলেও হাসি নেই তার মুখে। মলিনতা ঘিরে রেখেছে পুরো মুখ জোরে। মায়াবী চোখ দুটো ফুলে-ফেপে লাল হয়ে আছে কান্নার তোপে। এমন দৃশ্য বিয়ের দিন হলেও মানা যেতো। সবাই ভেবে নিতো নিজের বাবার ঘর ছেড়ে যেতে হচ্ছে এই দুঃখে কাঁদছে কনে। কিন্তু বিয়ের বাকী আরও দুদিন। এখনই কেন কনের চোখে এতো কান্না? কেনই বা এতো মলিনতা! কারণটা বিয়েতে উপস্থিত কাছের কিছু আত্মীয়র কাছে পরিষ্কার থাকলেও বাইরের নতুন কিছু আত্মীয়র কাছে অস্পষ্ট। ভাইকে বিয়েতে থাকার জন্য রাজি করতে না পেরে পৃথিবীর যত বিষাদ আছে সব মনে হয় ইতির মুখে ভর করেছে। চোখ দিয়ে উপচে পরছে নোনাজল। হাতের কাছে এখনো ফোনটা নিয়ে নিজের ঘরে বসে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। বোনের বিয়ে উপলক্ষে প্রায় দেড় বছর পর বাবার বাড়িতে পা দিয়েছে স্মৃতি। এখানে আসার পরই সে জেনেছে ভাই আবারও বিয়ে করেছে। সেটাও বাবার জোরে। ভাইয়ের প্রতি ইতির যতটা টান স্মৃতির মনে তার কিঞ্চিৎ পরিমাণও নেই। উল্টো সে নিজেও তার বাবার সংসার এলোমেলো আর মায়ের মানসিক পরিণতির জন্য দায়ী করে ভাইকে। এই ভাইটার জন্যই তো তার শশুর বাড়িতেও কম কথা শুনতে হয়না এখনো তাকে। উঠতে বসতে শাশুড়ি, ননদ, জা সকলেই কথা শোনায় ভাই খু নি, মা পাগল এসব বলে। যে ভাইয়ের জন্য শশুর বাড়িতে রোজ রোজ তাকে কথা শুনতে হয় সেই ভাই কিভাবে প্রিয় হবে তার? বিয়ের আগে ইতির মতো তার কাছেও ভাই অধিক প্রিয় থাকলেও বিয়ের পর সেই প্রিয়র জায়গাটা অপ্রিয়তে স্থান বদল করেছে।

ঘরোয়াভাবে আজকে ইতির মেহেদী অনুষ্ঠান করা হবে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায় হয়ে এসেছে। মেহেদী অনুষ্ঠান রাতে হবে। এই অনুষ্ঠানের জন্যও পার্লার থেকে ব্রাইডাল লোকে সাজানো হবে ইতিতে। সেজন্যই তাড়া নিয়ে স্মৃতি এসেছিল বোনকে নিয়ে পার্লারের উদ্দেশ্যে যাবে বলে। কিন্তু রুমে দেখে দেখল বোন তার এখনো হাতে ফোন নিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। আসার পর থেকেই এই এক নাটক দেখতে দেখতে বিরক্ত স্মৃতি। কি এক জমিদার রক্তিম শিকদার! তার জন্য নিজের বিয়ের আনন্দ মাটি করে এভাবে কেঁদেকুটে দুনিয়া ভাসানোর কোনো মানে হয়? বরং এটা ভেবে খুশি হবার কথা যে গুন্ডাটা তার বিয়েতে উপস্থিত থেকে কোনো ঝামেলা বাধাবেনা। স্মৃতির বিরক্ত ভাবটা এবার রাগে পরিণত হয়। রুমে ঢুকে তিরিক্ষি মেজাজে বলে,

“কি শুরু করেছিস তুই? ঐ খু’নি’টার জন্য চোখের পানি নাকের পানি এক করে আত্মীয় স্বজনে ভর্তি বাড়িতে কোনো অঘটন না ঘটিয়ে তুই শান্ত হবিনা? কি এমন হবে সে বিয়েতে উপস্থিত না থাকলে? তোর বিয়ে আটকে থাকবে? না কি কোনো কাজ পরে থাকবে?”

বোনের কথায় ইতির নিজেরও রাগ হয় অত্যধিক। কেমন পাষাণ বোন তার! রক্তিম তো তারও ভাই। তবে কিভাবে পারছে সে এভাবে কথা গুলো বলতে? মানুষ যে বলে বিয়ের পর মেয়েরা পরিবর্তন হয়ে যায়, কথা কি আসলেই সত্যি? স্মৃতি তো এমনটাই প্রমাণ করছে। নিজের মায়ের পেটের ভাই রক্তিম। স্মিতি, ইতির মাঝে কখনো রক্তিম কোনো ব্যবধান করেনি। সবসময় দুই বোনকেই সমান ভালোবাসা দিয়েছে। সমান স্নেহে আগলে রেখেছে। তবে স্মৃতি আজ কিভাবে পারছে সেই ভাই নামক আস্ত এক ভালোবাসার খনিকে এভাবে তাচ্ছিল্য করতে? বড় বোনের আমূল পরিবর্তনে রাগের সাথে ব্যথিতও হয় ইতি। কন্ঠে কিছুটা রাগ, কিছুটা অসহায়ত্ব মিশিয়ে বলে,

“তুই পাষাণ হতে পারলেও আমি পারিনি আপু। তোর কাছে সূবর্ণ সেই অতীত গুলো সময়ের ব্যবধানে পানসে মনে হলেও আমার কাছে এখনো অতি মধুর। বড় ভাইয়ের ভালোবাসা, স্নেহ মায়া, মমতা কিছুই বদলায়নি আমার জন্য। আর বদলাবেও না। তাই আমিও বদলে যেতে পারছিনা। ভাইয়া আমার কাছে কি সেটা তুই জানিস না। দয়া করে আর আমার সামনে কখনো ভাইয়াকে নিয়ে কোনো উল্টাপাল্টা কথা বলবিনা। বিয়ে খেতে এসেছিস ভালো কথা। বিয়ে খেয়ে আবার চলে যাবি, চলে যা। দুদিনের জন্য এসে অযথা আমাদের মাঝে নাক গলাবিনা।”

“কোন ভাইয়ের জন্য মনের মাঝে টান থাকবে আমার? যে ভাইয়ের জন্য আমার মা আজ মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে? যে ভাইয়ের জন্য আমার বাবার সংসারটা পুরো ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। সেই ভাইয়ের জন্য কেন আমি মায়া দেখাবো?”

চেঁচিয়ে কথা গুলো বলে থামে স্মৃতি। বিপরীতে ইতি শান্ত অথচ অবিচল স্বরে বলে,

“তা আমার ভাই সংসার এলোমেলো করে দেবার পর কি সংসারটাকে তুই গুছিয়েছিস? না কি মা মানসিক রোগীতে পরিণত হবার পর তুই তার খেয়াল রেখেছিস! কোনোটাই তো না। বছরে একবার এসে চোখের দেখা দেখে যাবি দূরের কথা। সপ্তাহেও তো একদিন মায়ের সাথে ফোনেও কথা বলিস নি। একবাবরও খোঁজ নিয়ে জানতে চাসনি কিভাবে আছি আমরা, কি খাচ্ছে বাবা বা কিভাবে চলছি আমি। তবে আজ কেন এসব বলে অধিকার ফলাতে আসছিস? তুই নিজেই ভেবে দেখ তো, মাঝ পথে ছেড়ে গিয়ে ঘোর বিপদের সময় পাশে না থেকে হঠাৎ উড়ে এসে এই সংসার বা এই সংসারের মানুষ গুলো নিয়ে কথা বলা তোর শোভা পায় কি না!”

ইতির এই কথা গুলোই যথেষ্ট ছিল স্মৃতির মুখের সমস্ত কথা কেড়ে নিতে। সত্যিই এমন প্রশ্নের বিপরীতে স্মৃতির কাছে বলার মতো যুক্তিপূর্ণ কোনো উত্তর নেই। বলার মতো কিছু খোঁজে না পেয়ে অল্প রাগের আভাস নিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে যায় স্মৃতি। দরজার কাছে আসতেই দেখতে পায় রেহানা বেগম শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে এতোক্ষন পযর্ন্ত দুই মেয়ের সকল কথায় শুনেছেন। মা’কে দেখেও কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায় স্মৃতি। রেহানা বেগম নিজেও বড় মেয়েকে কিছু বলেনা। চুপচাপ রুমে ঢুকে ইতির সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,

“ফোন দে ওকে।”

মায়ের কথায় একটু অবাক হয় ইতি। বুঝতে পারেনা কাকে ফোন করার কথা বলছে। জানতে চায়,

“কাকে?”

উত্তর দিতে একটু সময় নেয় রেহানা বেগম। কতক্ষণ চুপ থেকে কন্ঠে অধিক জড়তা নিয়ে বলে,

“রক্তিমকে।”

মায়ের মুখে এতোদিন পর ভাইয়ের নাম শুনে থমকে যায় ইতি। কতক্ষণ ফ্যালফ্যাল নয়নে শুধু তাকিয়ে থাকে মায়ের মুখের দিকে। সে জানতো মায়ের নিয়মিত কাউন্সেলিং হচ্ছে। মানসিক সমস্যাটা সেড়ে গেলে মা অবশ্যই রক্তিমকে কাছে টেনে নিবে। কিন্তু এতো দ্রুত যে সেটা হবে তা তো জানতনা। অত্যধিক খুশিতে চোখ দুটো আবারও অশ্রুজলে সিক্ত হয় ইতির। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে ভাইয়ের নাম্বারে ডায়াল করে এগিয়ে দেয় মায়ের দিকে।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে