ফুলের সজ্জিত রুমে গুটিশুটি হয়ে বিছানায় বসে আছে তটিনী। একটু আগেই সব নিয়মিত কানুন শেষ করে তানু আর সিমি তাসফির রুমে বসিয়ে দিয়ে গেছে। পুরো রুম মৌ মৌ করছে গোলাপ আর রজনীগন্ধা ফুলে। হঠাৎ পায়ের শব্দ কানে আসতেই আরো জড়োসড়ো হয়ে বসে তটিনী। নিশ্চয়ই তাসফি আসছে,কারন রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তানু বলেছে তাসফি কে পাঠিয়ে দিবে। হঠাৎ পায়ের শব্দ বন্ধ হয়ে গেলো। তটিনী ঘোমটা ভেতর থেকে চেয়ে দেখলো তাসফি দরজার সিটকানি লাগাচ্ছে। তারপর এগিয়ে আসলো তটিনীর কাছে। তটিনী শাড়ি খামচে ধরলো। তাসফি আলতো হাতে তটিনীর ঘোমটা সরালো,তটিনী চোখ বন্ধ করে ফেললো। কেমন অস্বস্তি লাগছে। দম বন্ধ লাগছে। তাসফি তটিনীর চোখ বন্ধ করা দেখে আলতো হাসে। তারপর থুতনিতে হাত দিয়ে বলে- মাশা-আল্লাহ।
তারপর কপালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয়। এতে যেনো পুরো শরীর বরফের ন্যায় জমে যায় তটিনীর। চোখ খোলার সাহস পাচ্ছে না।
তাসফি তটিনী কে ছেড়ে দিয়ে পকেট থেকে একটা ছোট্ট বক্স বের করে। তটিনীর বা হাত টা টেনে অনামিকা আঙুলে একটা ডায়মন্ডের আংটি পরিয়ে দেয়। আকস্মিক হাতে কিছু পড়ানোর অনুভব হতেই চোখ মেলে তাকায় তটিনী। মুহূর্তে হাতে দেখতে পায় আংটি। তাসফির হাতের মধ্যে এখনও তার হাত। হাতটা উঁচু করে আঙুলে চুমু খেয়ে বলে-
-“ আমার তরফ থেকে ছোট্ট একটা গিফট তোমার জন্য।
তটিনী হাত টা টেনে আংটি টা ভালো করে দেখে বলে-
-“ দেখে তো মনে হচ্ছে ডায়মন্ডের।
-“ হুমম।
-“ দাম তো অনেক।
-“ নিশ্চয়ই তোমার চেয়ে বেশি নয় এটার দাম।
তটিনী ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তাসফি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। -“ এই শাড়ি পড়ে থাকতে নিশ্চয়ই অসুবিধে হচ্ছে?
তটিনী হ্যাঁ জানালো। -“ তাহলে শাড়ি টা পাল্টে আসো।
-“ আমার ল্যাগেজ টা মনে হয় আনা হয় নি এ ঘরে। আপনি কি একটু এনে দিবেন?
তাসফি আলমারির কাছে এগিয়ে গেলো। নীল রঙের একটা সুতি কাপড় বের করে বলে- আপাতত এখানে যেটা আছে ওটা পড়েই ফ্রেশ হও। সকালে এনে দিব ল্যাগেজ।
তটিনী তাই করলো। বসা থেকে উঠে নীল রঙের কাপড় টা নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ততক্ষণে তাসফি রুমের মধ্যেই শেরওয়ানি পাল্টে ব্লু কালারের টি-শার্ট পড়ে নিলো।
মিনিট বিশেক পর তটিনী বের হলো হাতে বেনারসি শাড়ি টা নিয়ে। -“ শাড়ি টা কোথায় রাখবো?
তটিনীর কথায় ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় তাসফি,মূহুর্তে সারা শরীরে অদ্ভুদ এক অনুভূতি বয়ে যায় মেরুদণ্ড দিয়ে। ভেজা চুলে খুব আকর্ষণীয় লাগছে তটিনী কে।
-“ সোফায় রেখে দাও।
তটিনী শাড়ি টা নিয়ে সোফায় রাখলো। তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো ভালো করে মুছে নিলো। ভেজা টাওয়াল টা বেলকনিতে মেলে দিয়ে রুমে আসতেই তাসফি লাল খামে মোড়ানো একটা প্যাকেট তটিনীর দিকে এগিয়ে দেয়। তটিনী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে -কি এটায়?
তাসফি প্যাকেট টা ইশারায় নিতে বলে। তটিনী প্যাকেট টা তাসফির হাত থেকে নিজের হাতে নেয়।
-“ এটায় তোমার দেনমোহরের টাকা টা আছে৷ ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী টাকা টা তোমার প্রাপ্য তাই তোমাকে দিলাম।
-“ কিন্তু এই টাকা দিয়ে আমি কি করবো?
-“ সেটা তুমি জানো কি করবে না করবে টাকা টা দিয়ে।
তটিনী কিয়ৎ ক্ষন চুপ থেকে বলে- আপাতত আলমারি তে তুলি রাখি?
-“ তোমার ইচ্ছে।
তটিনী টাকাগুলো আলমারি তে তুলে রাখলো। তাসফি ঠোঁট কামড়ে কিছু ভেবে তটিনী কে ডেকে উঠলো। তটিনী পেছন ফিরলো। তাসফি ইশারায় কাছে আসতে বলল। তটিনি আলমারি টা লাগিয়ে গুটিগুটি পায়ে তাসফির সামনে আসলো। তাসফি পাশে বসতে বলল। তটিনী চুপচাপ পাশে বসলো। তাসফি তটিনীর বাম হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে-
-“ আমরা এখন স্বামী স্ত্রী রাইট? তটিনী মাথা ঝাকায়। “ আই থিংক তুমি জানো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হয়। আমি তোমাকে ফোর্স করবো না। তুমি জানো পুরুষ মানুষের ধৈর্য্য একটু কম থাকে তবে তোমার যত সময় লাগে নাও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে এই সংসার জীবনে আমাকে ইজিলি মেনে নিতে। আমি অপেক্ষা করবো।
তটিনী এদিক ওদিক চোখ ঘুরালো। মিনমিন সুরে বলল- আমার সময় লাগবে।
-“ হুমম। অপেক্ষায় থাকবো।
তারপর পুরো রুম জুড়ে চলল পিনপিনে নিরবতা। কয়েক মূহুর্ত এভাবে নিরবতা কেটে যেতেই তাসফি বলে-“ শুয়ে পড়ো,আমি লাইট নিভিয়ে দিচ্ছি।
তটিনী বিছানার একপাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। তাসফি লাইট নিভিয়ে তটিনী পাশে দূরত্ব রেখে শুয়ে পড়ে। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাজার ও দুশ্চিন্তা। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বিয়েটা তো করে নিলো,ভবিষ্যৎ কিছুটা এখনও অনিশ্চিত তো বটেই।
সকালের ফজরের আজান কানে আসতেই ঘুম ভেঙে যায় তটিনীর। তটিনী আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই অনুভব করে কেউ তাকে জাপ্টে ধরে আছে। তটিনী সামনে তাকিয়ে দেখে সে তাসফির বুকের সাথে লেগে আছে আর তাসফি এক হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। মুহূর্তে কেমন লজ্জা পেলো তটিনী। আস্তে করে তাসফির হাত সরিয়ে উঠে পড়লো। তটিনী ভালো করেই জানে এই কাজ টা হয়তো তটিনী ঘুমের তালেই করে ফেলছে। কারন তটিনীর ঘুমানো ভালো না। বাবার বাসায় থাকতে পুরো খাটে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাতো আর তানু আসলে তানুর উপর ধুপধাপ করে হাত পা উঠিয়ে দিত। এরজন্য বকাও খেতে হয়েছে।
বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে ওজু করে বের হয়। গতকাল রাতে দেখেছে আলমারি তে জায়নামাজ। সেটা বের করে ফজরের নামাজ আদায় করে নেয়। তারপর তাসফির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আলতো সুরে ডেকে বলে-
-“ এই যে শুনছেন?
তাসফি নড়েচড়ে উঠে কিন্তু চোখ মেলে তাকায় না। তটিনী আরো দু বার ডাক দিতেই তাসফি চোখ মেলে তাকায়।
-“ আজান দিয়েছে নামাজ পড়তে যাবেন না মসজিদে?
তাসফি চোখ ডলতে ডলতে শোয়া থেকে উঠে বসে। চোখ তার অসম্ভব লাল। সারা রাত না ঘুমালে যেমন চোখ লাল হয়ে যায় ঠিক তেমন। তাসফি কোনো কথা না বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে করে বের হয়। ওজু টা মসজিদে গিয়ে করবে। তারপর টাওয়াল দিতে হাত মুখ মুছতে মুছতে তটিনী কে উদ্দেশ্য করে বলে-
-“ আলমারি থেকে পাঞ্জাবি টা বের করে দাও তো।
তটিনী আলমারির কাছে এগিয়ে গিয়ে সাদা একটা পাঞ্জাবি বের করে তাসফির দিকে এগিয়ে দিলো। তাসফি তটিনীর সামনেই টি-শার্ট খুলে পাঞ্জাবি টা পড়ে নিলো। টি-শার্ট খুলার সময় তটিনী চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। কেমন অস্বস্তি ব্যাপার ছিল৷
তাসফি ড্রেসিং টেবিল থেকে টুপি নিয়ে সেটা মাথায় পড়ে নেয়। তারপর তটিনীর সামনে দাঁড়ায়। হঠাৎ মসজিদে না গিয়ে নিজের সামনে তাসফিকে দাঁড়াতে দেখে তটিনী ভরকে যায়। তাসফি চোখ ঝাপ্টা দিয়ে তটিনীর গালে হাত দিয়ে কপালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয়।
-“ এটায় অভ্যস্ত হয়ে নিবে। রোজ নিয়ম করে এটা হবে আমি বাসা থেকে বের হবার সময়। আপত্তি থাকবে?
তটিনী মাথা নত করে মাথা দুদিকে নাড়িয়ে না জানায়। তাসফি তপ্ত শ্বাস ফেলে রুম থেকে বের হয়।
তটিনী তাসফির যাওয়ার পানে তাকিয়ে দরজাটা চাপিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। বাড়ির সদস্য গুলো হয়তো এখনও উঠে নি। উঠলে নিশ্চয়ই কথার শব্দ ভেসে আসতো।
শুয়ে পড়তেই আবার ঘুমে তলিয়ে যায় তটিনী। বোনের গলার আওয়াজে ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে তার বোন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তটিনী উঠে বসে। ফোনে টাইম দেখে নেয়,৯ টা ২০ বাজে। তানু তটিনীর পাশে বসে বলে-
-“ তাসফি কোথায়?
তটিনী এদিক ওদিক তাকায়। ঘুমের রেশ এখনও কাটে নি। অবাক হয়ে বলে- “ উনি ফিরে নি এখনও?
-“ কোথায় গেছে?
-“ মসজিদে নামাজ পড়তে।
-“ ওহ্ আচ্ছা। গোসল করছিস সকালে?
তটিনী বিরক্ত হয়ে বলে-“ এখনই গোসল করবো কেনো?
তানু তটিনীর মাথার চুলে হাত দেয়।-“ তোদের মধ্যে কিছু হয় নি?
তটিনী একই চাহনি নিয়ে বলে-“ কি হবে?
-“ যা হয়।
তটিনীর বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো। বিষয় টা বোঝার পর লজ্জা অস্বস্তিতে ইচ্ছে করলো মাটি ফাঁক করে ভেতরে চলে যেতে। ছোট্ট করে জবাব দিলো- না সেসব কিছু হয় নি। সময় চেয়েছি।
-“ ওহ্ আচ্ছা। বেশি সময় লাগাস না। ছেলেরা বেশি সময় নেওয়া পছন্দ করে না।
-“ হুমম।
-“ আচ্ছা এবার বাহিরে চল। আশেপাশের লোকজন এসেছে তোকে দেখতে।
-“ দেখেনি এর আগে আমাকে?
-“ দেখেছে। তখন তো তুই আমার বোন হয়ে এসেছিলি আর এখন এ বাড়ির ছেলের বউ। বিষয় টা তো আলাদা।
তটিনী উঠে দাঁড়ালো। শাড়ির কুঁচি গুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। তানু সেটা ঠিক করে দিয়ে আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দেয়।
চার থেকে পাঁচ জন মহিলা বসে আছে ড্রয়িং রুমে। তাদের পাশেই বসে আছে মেঘলা হোসেন আর জাহানারা বেগম। তটিনী কে দেখা মাত্রই মেঘলা হোসেন মুচকি হেঁসে বলেন-
-“ ঐ তো এসে গেছে তটিনী।
সবাই তটিনীর দিকে তাকায়। তানু তটিনী কে জাহানারা বেগমের পাশে বসায়৷ সবাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তটিনী কে। তাদের মধ্যে রহিমা নামের এক মহিলা বলে উঠে –
-“ ভালোই করলে দু বোন কে দু ছেলের জন্য নিয়ে এসে। মেয়ে দুটো দেখতে মাশা-আল্লাহ।
-“ তা যা বলেছেন। আমাদের বাড়ির দুই লক্ষী।
জাহানারা বেগম তটিনীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে- ঐ মাইয়া তর চুল ভিজা না ক্যা?
তটিনী এটারই ভয়ে ছিলো। ইয়া বড় ঘোমটা দেওয়ার পর ও মহিলার নজর থেকে বাঁচলো না। এখন এটার জবাব কি দিয়ে দিবে?
এরমধ্যে তাসফি বাড়িতে প্রবেশ করে। ক্লান্ত শরীর। একপলক ড্রয়িং রুমে বসে থাকা সকলের দিকে তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলে যায়। যাওয়ার আগে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি চেয়েছে। তানু তটিনী কে উদ্দেশ্য করে বলে-
-“ পানি টা দিয়ে আয় তাসফি কে।
তটিনী হাফ ছেড়ে বাঁচলো। বসা থেকে উঠে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে চলে গেলো উপরে।
বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে তাসফি। তটিনী পানির গ্লাস টা তাসফির দিকে এগিয়ে দেয়। তাসফি গ্লাস টা সাইডে রেখে তটিনী কে পাশে বসতে বলে। তটিনী পাশে বসে।-“ দাদি কিছু বলেছে তোমায়?
তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারলো না তটিনী।
-“ বলেছে কিছু?
-“ হুমম।
-“ কান দিয়ো না দাদির কথায়। বয়স হয়েছে তো। হুটহাট বলে ফেলে যা বলা উচিত না সেসব ও।
তটিনী মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা জানায়।
মেঘলা হোসেন তানু কে দিয়ে সকালের খাবার টা পাঠিয়ে দেয় তাসফির রুমে। তাসফি আর তটিনী খাবার টা খেয়ে নেয়। দুপুরের আগ দিয়ে পার্লারের লোক এসে সাজিয়ে যায় তটিনী কে। তাসফি তখন বাহিরে খাবারের বৈঠক খানায় দেখভাল করছিল।
পার্পল কালারের লেহেঙ্গা পড়ানো হয়েছে তটিনী কে। রিমি সিমি তটিনী কে নিয়ে স্টেজে বসায়। তাজদিদ তাসফি কে স্টেজে তটিনীর পাশে গিয়ে বসতে বলে। সে এদিক টা সামলে নিবে। তাসফি স্টেজের দিকে এগিয়ে যায়। ব্লেজারের নিচে থাকা সাদা শার্ট টা ভিজে গেছে ঘামে। তটিনীর পাশে বসতেই পাশে থাকা ফ্যান থেকে শীতল ঠান্ডা বাতাস শরীর টাকে আরাম দায়ক করে তুললো তাসফির। এক-এক করে সবাই তাসফি আর তটিনী কে শুভেচ্ছা আর গিফট দিয়ে গেলো। তটিনী চাতক পাখির মতো বসে আছে। বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছে তার বাবা মা কে দেখার জন্য।
তাসফি বিষয় টা বুঝতে পারে। -“ আঙ্কেল আন্টি গাড়িতে আছে। এসে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে।
তটিনী গেটের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিনিট কয়েক পর আগমন হলো তার বাবা মায়ের। মুখে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি। সেই হাসির দিকে কিয়ৎ ক্ষন চেয়ে রইলো তাসফি। তটিনীর মা এগিয়ে এলেন মেয়ের দিকে পেছন পেছন তরিকুল ইসলাম। আর সাথে রয়েছে লাবণ্য, তানিয়া বেগম আর ঐশি।
তটিনী বসা থেকে উঠে মা’কে জড়িয়ে ধরে। খুশিতে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
-“ কেমন আছিস?
তটিনী মাকে ছেড়ে দিয়ে বলে- ভালো আছি তোমরা?
-“ হুমম ভালো আছি।
তটিনী তরিকুল ইসলামের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ তুমি কেমন আছো আব্বু?
তরিকুল ইসলাম মেয়ের পানে এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে রয়। ছোট্ট করে জবাব দেয় -“ ভালো আছি তুমি?
-“ হুম ভালো আছি।
তরিকুল ইসলাম কে দেখতে পেয়ে জাহাঙ্গীর হোসেন এগিয়ে আসেন। তরিকুল ইসলাম কে নিয়ে সাইডে যান। লায়লা বেগম মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলে-
-“ কাল রাতে মানুষ টা ভীষণ ভেঙে পড়েছিল তুই চলে আসার পর। বড্ড ভালোবাসে তোকে।
তটিনী চুপ হয়ে থাকে।
তানিয়া বেগম আশেপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। এমন একটা বাড়ির ছেলের সাথে তার মেয়ে কে বিয়ে দিতে পারলে কপাল খুলে যেত। লাবন্যর কোল থেকে বাচ্চা টাকে তটিনী কোলে নেয়। আর তখনই সিমি আসে। তটিনীর থেকে বাচ্চা টাকে কোলে নিয়ে বলে- আপু ওহ্ সরি ভাবি ওকে আমি নিচ্ছি। তুমি আর ভাইয়া খেয়ে এসো।
তাসফি তটিনী কে নিয়ে খেতে যায়। সিমি বাচ্চা টাকে কোলে নিয়ে ঘুরে। তুহিন হাঁপিয়ে গেছে বন্ধুর বিয়েতে কাজ করতে করতে। তাই একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য চেয়ারে বসেছিল। সিমিকে বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরতে দেখে সিমি কে ডেকে বলে-
-“ হেই বাচ্চা নিয়ে ঘুরছো কেনো?
সিমি হাঁটা থামিয়ে দেয়। তুহিনের দিকে এগিয়ে এসে বলে- ভাবি আর ওর মা খেতে বসেছে সেজন্য।
-“ ওহ্ আচ্ছা। কথাটা বলে তুহিন দাঁড়ায়৷ তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে বলে-“ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকো একটা সেলফি তুলি।
কথাটা বলে ফটাফট একটার জায়গায় দু তিনটে সেলফি তুলল। সিমি ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ সেলফি তুললেন কেনো?
তুহিন সেলফি টা জুম করে দেখতে দেখতে বলল-
-“ আমার ভবিষ্যত ক্যামেরায় মুঠোবন্দি করে রাখলাম।
-“ মানে?
-“ মানে টানে কিছু না। খেয়েছো?
-“ হ্যাঁ।
-“ আমি খাই নি।
-“ কেনো?
-“ কাজ করেই তো সারতে পারছি না। তুমি এখানে বসো তো আমি খাবো।
কথাটা বলে একটা ওয়েটার কে এক প্লেট খাবার দিতে বলে তুহিন।
ওয়েটার এক প্লেট খাবার এনে তুহিনের হাতে দেয়। তুহিন খাবার টা খেতে আরম্ভ করে। সিমি পাশেই চেয়ার টেনে বসে রয়। তুহিনের খাওয়া শেষ হতেই সিমি বলে-“ খাওয়া শেষ এবার উঠি?
-“ হুমম।
সিমি চলে যায়। দূর থেকে রিমি ফোনে কথা বলতে বলতে এদিক টায় আসছিলো। সিমি আর তুহিন কে এক সাথে দেখতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকায়। ফোন টা কেটে দিয়ে সিমির সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ তুহিনের সাথে তোর কিছু চলছে?
সিমি ভ্রু কুঁচকে বলে- কি চলবে?
-“ কোনো সম্পর্ক টম্পর্ক?
-“ পাগল নাকি তুমি? কিসব বলছো।
-“ সত্যি করে বল।
-“ তেমন কিছুই না। উনি ভীষণ ভালো।
-“ সেজন্যই সন্দেহ টা হচ্ছে।
-“ তবে কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে মন্দ হবে না। বিকজ আই লাইক হিম।
-“ কি দেখে এমন মুচকি হাসছিস তুই?
তুহিনের কথায় হাসির আভা সরে গিয়ে মুখে জুড়ে বসে গম্ভীরতা। তুহিন ঘাড় এগিয়ে দেখে ফোনের স্কিনে তটিনীর গায়ে হলুদের ছবি জ্বলজ্বল করছে।
-“ ও এই ব্যাপার। আচ্ছা তাসফি ভেবে দেখেছিস আদিল যদি তটিনী কে বলে দেয় তুই থ্রেট দিছিস ডাই ও তটিনী কে ছেড়ে দিছে, তখন ও তো তোকে ভুল বুঝবে।
তাসফি এবার বিরক্ত বোধ করলো।
-“ তুই কি আমার ফ্রেন্ড? নেগেটিভ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে কেনো তোর মাথায়? আদিল এসব বললে তোর কি মনে হয় তটিনী আদিল কে ছেড়ে দিবে? শুনেছি আদিল চড় মেরেছে গতকাল তটিনী। এবার অন্য কিছু দিয়ে পিটাবে। যে অন্য কারো সামান্য ভয়ে সে তাকে ছেড়েছে বলে। আর আমার ভুল বুঝবে হ্যাঁ এটা আমিও জানি। কথা বলবে না রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যাবে,ডিভোর্স ও হয়তো দিতে চাইবে। বাট এটা হতে হতে তটিনী আমার উপর দূর্বল হয়ে পড়বে। সে মুখে মুখে আমার উপর রেগে থাকলেও মনে একটু হলেও ততদিনে আমি জায়গা করে নিব। এটা আমার বিশ্বাস।
-“ এতো ঝামেলা না পাকিয়ে মেয়েটাকে আদিলের আগে প্রপোজ করলেই তো পারতি।
-“ তোর মাথায় বুদ্ধি নেই? তুই জানিস না তটিনীর ফ্যামিলি কেমন? ওদের কানে যদি যেত আমি তটিনী রিলেশন টিলেশন হারাম কিছু করছি তাহলে আমার ইমেজ টা থাকতো? কথাটা বলে তাসফি উঠে দাঁড়ালো, গায়ে হলুদের সময় হয়ে গেছে।
-“ এসব সবাই জানার পর কি তোর ইমেজ থাকবে তাদের সামনে?
-“ বিয়ের পর সব উচ্ছন্নে চলে যাক আমি কেয়ার করি শুধু তটিনী আমার পাশে আমার সাথে পার্মানেন্ট থাকলেই চলবে।
তুহিন আর কথা বাড়ালো না। তাসফির পেছন পেছন চলে গেলো। তাসফিকে স্টেজে বসাতেই তাসফির বাবা,মা,ভাই,কাজিন সার্কেল,দাদি,মামা,মামি এসে এক এক করে হলুদ ছোঁয়াল। তারপর কাজিন মহলের থাকা রিমি আর সিমি,সম্পর্কে তাসফির মামা তো বোন, যারা জমজ দু বোন। ওরা হলুদের অনুষ্ঠান টাকে আরো মোহনীয় করে তোলার জন্য ডান্স দিলো।
তুহিন আড় চোখে তাকিয়ে দেখলো দু বোনের নাচ। এই নিয়ে দু বার সাক্ষাৎ হয়েছে এই দু বোনের সাথে। সিমি মেয়েটা কে কেনো যেনো রিমির থেকে একটু আলাদা লাগে। আর আলাদা লাগবেই না কেনো। মেয়েটা রিমির থেকে বেশ গোছগাছ পরিপাটি। দেখা হলে সালাম দিবে কুশলাদি করবে। আর রিমি মেয়েটা কেমন যেনো উশৃংখল টাইপের।
নাচ শেষ হতেই সিমি হাঁপিয়ে যায়। পানি খাওয়ার জন্য নিচে চলে যায়। আর তখনই রিমি এগিয়ে আসে তুহিনের দিকে। তুহিন ভ্রু কুঁচকায়।
-“ আপনি হা করে সিমি কে দেখছিলেন কেনো?
তুহিন ভরকে গেলো। -“ আমি হা করে তাকিয়ে দেখছিলাম?
-“ তা নয়তো কি? আমি বেশ খেয়াল করেছি।
-“ তার মানে আপনিও আমার দিকে নাচের মধ্যে থেকে লক্ষ রেখেছেন!
বিস্ময়ের সাথে পিঞ্চ মেরে কথাটা বলল তুহিন।
-“ আমার বোনের দিকে নজর দিচ্ছেন আর আমি খেয়াল করবো না?
-“ কোথায় নজর দিলাম? এখনও তো দেওয়া শুরু করি নি। লাস্টের কথাটা বিরবির করে বলল তুহিন। যা রিমির কান অব্দি পৌঁছালো না।
-“ দূরে দূরে থাকবেন আমার বোনের থেকে।
-“ কবেই বা কাছাকাছি ছিলাম আপনার বোনের?তবে আপনি একটু হেল্প করলে আপনার বোনের কাছাকাছি থাকতে পারি।
-“ মানে?
-“ মানে টানে কিছু না। থাকুন আপনি আমি গেলাম।
তুহিন কথাটা বলে নিচে নামতে গেলে রিমি বলে উঠে – আরে নিচে যাচ্ছেন কেনো? নিচে তো সিমি।
-“ আমার বাসায় যেতে হবে না? আমি কি পাখির মত উড়ে উড়ে যাব আকাশ দিয়ে?
পেছনে ফিরে কথাটা বলে আবার সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটা ধরে। সিমি পানি খেয়ে ছাঁদে আসার পথে সিঁড়িতে দেখা হয় তুহিনের সাথে। তুহিন আলতো হাসে।
-“ চলে যাচ্ছেন?
তুহিন ছোট্ট করে জবাব দেয় -হুমম।
-“ আচ্ছা।
কথাটা বলে সিমি সাইড দিয়ে উপরে উঠে যেতে নিলে তুহিন দৃষ্টি সামনে রেখেই বলে- আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে সিমি?
সিমি দাঁড়িয়ে যায়। পেছন ফিরে ভ্রু কুঁচকে বলে- কেনো?
-“ না এমনি জেনে রাখা ভালো তো সেজন্য।
-“ না নেই।
-“ না থাকাই ভালো তা না হলে তাসফির মত আমাকেও সেম কাজ করতে হতো। কথাটা বিরবির করে বলে চলে যায় তুহিন। সিমি তুহিনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছাঁদে চলে আসে।
গায়ে হলুদ লাগানোর পরপর ই তাসফি নিজের রুমে চলে আসে। ওয়াশরুমে ঢুকে গোসল সেরে নেয় হলুদ পরিষ্কার করার জন্য। তারপর বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের সকল ঘুম এসে হানা দেয় চোখে।
সকালে সূর্যের আলো চোখে পড়তেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে তটিনী। মুখের সামনে হাত দিয়ে আলো টাকে আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করে। বিরক্তি নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। পড়নে থাকা হলুদ শাড়ি দেখতেই মনে পড়ে যায় গতকাল তার হলুদ হয়েছে। ফ্রেশ না হয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বসা থেকে এবার উঠে দাঁড়ালো। তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো। লাল রঙের থ্রিপিস পড়ে বের হলো ওয়াশরুম থেকে।
এরমধ্যে খাবার নিয়ে রুমে ঢুকলো লায়লা বেগম। খাবার টা টি-টেবিলের উপর রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলল- খাবার টা তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। পার্লার থেকে লোক আসবে একটু পরই।
তটিনী হাতে থাকা ভেজা টাওয়াল টা বিছানায় রেখে পেছন থেকে লায়লা বেগম কে জড়িয়ে ধরে- এখনও রেগে থাকবা মা? আমি অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। একটু তো ক্ষমা করে দেখো। জীবনেও তোমাদের কথার অবাধ্য হব না। তোমাদের কথা মেনে তো বিয়ে টা করে নিচ্ছি । প্লিজ ক্ষমা করো। এই দেখো পায়ে পড়ছি প্লিজ ক্ষমা করো।
কথাটা বলে পা ধরতে গেলে তড়িৎ গতিতে মেয়েকে টেনে তুলে লায়লা বেগম- পাগল হয়েছিস? পা ধরছিস কেনো?
-“ ক্ষমা করছো না কেনো? ধরা গলায় বলে তটিনী।
লায়লা বেগম বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে ভেজা টাওয়াল বিছানার মধ্যে পড়ে আছে। মেয়ের মাথায় গাট্টা মেরে বলে-
-“ বড় হবি কবে? ভেজা টাওয়াল টা কেউ এভাবে বিছানায় ফেলে রাখে?
ভেজা টাওয়াল টা বিছানা থেকে তুলে নিয়ে বেলকনিতে মেলে দিয়ে আসে লায়লা বেগম। তারপর মেয়ের গায়ে আলতো ভাবে হাত রেখে বলে-
-“ এমন ভুল জীবনে করো না তটু। তোমার বাবা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তোমায় আর তানু কে বড় করেছে শেষ বয়সে এসে এসব দেখার জন্য না। আমরা তোমার খারাপ চাই না৷ সুপাত্রের হাতেই তোমার বাবা তোমাকে তুলে দিচ্ছে। তাসফি তোমার পড়াশোনায় কখনও বাঁধা দিবে না। তোমার যত ইচ্ছে পড়াশোনা করবে৷ যারা বাবা মাকে কষ্ট দেয় তাদের জীবনে সুখ ধরা দেয় না মা। আল্লাহ নারাজ থাকে তাদের উপর। এমনি এমনি তো বলা হয়নি মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত ।
তটিনী ডুকরে কেঁদে উঠলো। সে মস্ত বড় অপরাধ করে ফেলছে কাছের মানুষ দের সাথে ঐ আদিলের জন্য। ইচ্ছে করছে আদিল কে পঁচা পানিতে চুবাতে। লায়লা বেগমের হাত দুটো আঁকড়ে ধরে বলল- আমি আর তোমাদের বিরুদ্ধে কখনও যাব না মা। তোমাদের সব কথা মেনে চলবো।
-“ সেটা হলেই ভালো। এবার খেয়ে নাও,বেলা অনেক হয়েছে।
লায়লা বেগম প্রস্থান করতেই তানু রুমে ঢুকে।
-“ কি বলল মা তোকে? আবার রাগ করেছে?
-“না। তটিনী ছোট্ট করে জবাব দিলো।
-“ আচ্ছা খেয়ে নে তাহলে তাড়াতাড়ি।
-“ আচ্ছা আপু একটা কথা বলতো।
-“ কি কথা? ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো তানু।
-“ তুমি জানতে আমি ফিরে আসবো বাসায়?
তানু কিছুটা ভরকে গেলো। তবে সেটা তটিনীর সামনে প্রকাশ করলো না।
-“ আ..আমি কি করে জানবো?
-“ না মনে হলো তুমি জানতে আমি ফিরবো।
-“ আচ্ছা বাদ দে সেসব কথা।
————————–
এগারো টার দিকে পার্লার থেকে লোকজন এসেছিল তটিনী কে সাজাতে। ডার্ক রেড কালারে বেনারসি পড়ানো হয়েছে। সাথে স্বর্ণের কিছু গহনা। খুব বেশি গর্জিয়াছ সাজ না। সাদামাটাই সাজ। লাবন্য বেগম তটিনীর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। তটিনী থুতনি ধরে বলে- মাশা-আল্লাহ অনেক সুন্দর লাগছে তোকে। তাসফি চোখই সরাতে পারবে না।
তটিনী প্রথম কথাটার জন্য হাসলো তবে পরক্ষনে দ্বিতীয় কথাটা শুনে মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো।
লোকটার কাছে তার ইমেজ কতটা নিচে চলে গেছে তার ধারনা বুঝার বাকি নেই। অন্য কোনো লোক থাকলে জেনেশুনে নিশ্চয়ই এমন মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে না। কিন্তু লোকটা কেনো করছে বিয়ে?
এসব ভাবনার মাঝ তানু লাবন্য কে ডেকে বলল- খালামুনি আম্মা ডাকছে তোমায় তাসফিরা চলে এসেছে।
লাবন্য চলে গেলো। তানুও পেছন পেছন যেতে নিলে তটিনী ডেকে উঠে। তানু পেছন ফিরে বলে- কিছু বলবি?
তটিনী কিছু বলার জন্যই ডেকেছিল কিন্তু পরমুহূর্তে মাথা দুদিকে নাড়িয়ে না বলে। তানু কিয়ৎ ক্ষন তটিনী কে দেখে চলে যায়।
কাজি সাহেব বসে আছে তাসফির সামনে। কবুল বলার পালা। তাসফি কে কবুল বলতে বললে তাসফি ফটাফট কবুল বলে দেয়। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে।
তানু চলে যেতেই কিছুক্ষণ পর দুটো মেয়ে হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে তটিনীর। তটিনী মাথা তুলে তাকায়। জমজম মেয়ে দুটো এসেছে রিমি সিমি। সিমি তটিনীর পাশে বসে বলে-
-“ কেমন আছো আপু?
তটিনী স্মিত হেঁসে বলে- ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো?
-“ এই তো তোমাকে দেখে আগের থেকেও বেশি ভালো হয়ে গেলাম। বাই দ্যা ওয়ে তোমাকে কিন্তু দারুন লাগছে আপু। রিমি তটিনীর পাশে বসতে বসতে কথাটা বলে।
এরমধ্যে তাসফির দাদি জাহানারা বেগম লাঠি ঠক্ ঠক্ করে ভেতরে ঢুকে। রিমি সিমি কে উদ্দেশ্য করে বলে- তরা এহনও গল্প করতাছোস? ওদিকে যে আমার নাতি ডা অধৈর্য্য হইয়া বইসা আছে হের বউ রে একপলক দেখার লাইগা। তরা নিয়া যাস না ক্যা? বিয়ের সময় হইয়া গেছে কাজি আইসা বইসা আছে সেদিকে তগো হুঁশ নাই?
-“ তুমি কাজি কে পাঠাও দাদি। ভাবি তো রেডিই।
জাহানারা বেগম রুম থেকে বের হয়ে কাজি কে পাঠিয়ে দেয়। কাজির সাথে রুমে ঢুকে তানু,লাবন্য, তানিয়া বেগম,লায়লা বেগম।
তটিনীর মুখের সামনে ইয়া বড় ঘুমটা টানানো। কাজি তটিনীর সামনে বসে বলে- জাহাঙ্গীর হোসেনের ও মেঘলা হোসেনের ছেলে তাসফি হোসেন তিন লক্ষ এক টাকার দেনমোহর ধার্য্য করিয়াছে। তাসফি হোসেনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজি থাকলে বলো মা কবুল।
তটিনী অসহায় চোখে বোনের দিকে তাকালো। তানু তটিনীর পাশে বসলো। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো- ভয় পাচ্ছিস?
তটিনী মাথা ঝাকালো। তানু স্মিত হেঁসে বলল- ধূর পাগলি ভয় পাচ্ছিস কেনো। নির্দ্বিধায় কবুল বলে দেয়। তাসফি অপেক্ষা করছে তো দেখার জন্য।
তটিনী ধরা গলায় বলল-“ আব্বুকে একটু আনো না আমার সামনে। একু বসতে বলো না আমার পাশে।
তানু বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রুম থেকে বের হয়ে তরিকুল ইসলাম কে খুঁজতে লাগলো। তরিকুল ইসলাম হাসি মুখে কথা বলছে বেয়াই জাহাঙ্গীর হোসেনের সাথে।
-“ বাবা একটু সাইডে আসবে?
তানুর কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তরিকুল ইসলাম। সাইডে এসে বলে-
-“ কিছু হয়েছে?
-“ তটিনী কবুল বলছে না। তোমাকে পাশে চাইছে। একটু যাওনা ওর কাছে। আর কত রেগে থাকবে। ভীষন অনুতপ্ত ও।
তরিকুল ইসলাম দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলেন রুমে। জাহাঙ্গীর হোসেন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল- সব ঠিকঠাক তো তানু?
তানু স্মিত হেঁসে বলল- জ্বি বাবা সব ঠিকই আছে।
তরিকুল ইসলাম রুমে ঢুকে মেয়ের পাশে বসে। তটিনীর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। তরিকুল ইসলাম মেয়ের বাম হাত খানা চেপে বলে-
-“ এখনও কবুল বলতে আপত্তি আছে?
তটিনী মাথা নাড়িয়ে না জানালো। সুপ্ত হাসি ঠোঁটে কোনে ফুটিয়ে কবুল বলল।
সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো। তরিকুল ইসলাম চলে গেলো রুম থেকে। তটিনীর মন আবার বিষাদে ভরে গেলো। তরিকুল ইসলামের চোখ জলে টইটম্বুর করছে। আর একটু থাকলে গড়িয়ে পড়তো মেয়ের সামনে। সন্তপর্ণে জল টুকু মুছে নিচে গেলো।
তটিনী কে নিয়ে বসানো হয়েছে তাসফির পাশে। তটিনীর দমবন্ধ লাগছে। তটিনীর মুখে এখন ঘোমটা নেই। তাসফি বারংবার আড়চোখে দেখছে তটিনী কে। তটিনীর নজরে এসেছে বিষয় টা সেজন্য আরো লজ্জার প্রখরতা বাড়ছে। তুহিন তাসফির কানের কাছে ফিসফিস করে বলে- একটু কন্ট্রোল কর নজর টা ভাই। পরেও দেখতে পারবি।
তাসফি রাগী চোখে তাকালো।
রাত আটটার দিকে বিদায়ের পালা ঘনিয়ে এলো। তটিনীর মোটেও যেতে ইচ্ছে করছে না। লায়লা বেগম কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে চলছে। লায়লা বেগমের চোখেও পানি। মাকে ছেড়ে দিয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলে-
-“ এখনও রেগে থাকবে আব্বু আমার উপর? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তোমার এই কঠোরতায়। একটু জড়িয়ে বুকে আগলে নাও না ছোট বেলায় ব্যাথা পেলে যেভাবে জড়িয়ে ধরতে সেভাবে।
তরিকুল ইসলাম মেয়েকে বুকে জাপ্টে ধরলো। শব্দ করে কেঁদে উঠল তটিনী। নোনা জল গড়ালো তরিকুল আলমের গাল বেয়ে। মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে তাসফির হাতে মেয়ের হাত দিয়ে বলে-
-“ অনেক মূল্যবান জিনিস তোমার কাছে দিয়েছি বাবা। এর অমর্যাদা কখনও করো না। মারি বকি যাই করি না কেনো অন্য কেউ মেয়ে দুটো কিছু বললে ভীষণ কষ্ট হয়। আমার মেয়ে ভুল করলে একটু বুঝিয়ে বলো। কিন্তু কষ্ট দিয়ো না। বাবা হিসেবে সইতে পারবো না মেয়ের কষ্ট। অনেক ভরসা করে আমার মেয়েকে তোমায় দিয়েছি। আমি জানি আমার মেয়ের কষ্ট হবে এমন কিছু তুমি করবে না। তবুও ভবিষ্যতের কথা বলা তো যায় না।
তাসফি তটিনীর হাত শক্ত করে ধরে বলল-
-“ এই যে আপনার মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরেছি। মৃত্যুর অগ অব্দি ছাড়ছি না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
তরিকুল ইসলাম স্বস্তি পেলো। তানু তটিনী কে ধরে গাড়িতে বসালো। তারপর তাসফির কাছে গিয়ে বলল- তোমার কথাতে সব হলো তাসফি। আমি জানি তুমি তটিনী কে ভালোবাসো। আদিল যদি তটিনীর হাত না ছাড়তো তাহলে হয়তো আমি কখনই এসবে তোমার সঙ্গ দিতাম না৷ আশা করছি ওকে কষ্ট দিবা না। এখন যেভাবে ভালোবাসো ভবিষ্যতে ও ভালোবাসবে।
তাসফি স্মিত হেঁসে বলল- ধন্যবাদ ভাবি আমাকে হেল্প করার জন্য।
-“ আমি কি করতাম? তোমরা আমাকে বলার সুযোগ দিছো? আমি যে এক ছেলেকে পছন্দ করতাম সেটা বলার? যখনই বলতে চাইছি তুমি আমার মুখের কথা নিয়ে নিছো আর তা না হলে আব্বার সামনে থেকে সরায় দিছো।
রেগে বলে উঠে কথাটা তটিনী। তানু ভ্রু কুঁচকায়।
-“ তোর ভালোর জন্যই তো করছি সব। তুই জানিস না বাবা এসব প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক মানে না? তুই যদি বলে দিতি তোর কি মনে হয় বাবা তোকে ঐ ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিত?
-“ এর জন্যই তো ভাগ্যে নেই ঐ ছেলে। খোদাও বুঝে গেছিল পাবো না ঐ ফ্রট টাকে।
-“ মানে? অবাক হয়ে কথাটা বলল তানু। তটিনী তপ্ত শ্বাস ফেলে সব বলল। তানু মনে মনে হেসে নিলো প্রচুর।
-“ দেখছিস বাবা মায়ের কথা না শোনার ফল? আরো করবি প্রেম? এখন আব্বা যে তোর উপর রেগে আছে রাগ ভাঙাবি কি করে?
-“ বিয়ে ভাঙবে না?
তানু চোখ রাঙিয়ে তাকায়। তটিনী মিইয়ে যায়।
-“ আব্বা আমার সাথে কথা বলবে না আপু তাই না?
-“ তোর সাথে কথা বলার জন্য আব্বা বসে আছে গিয়ে কথা বলে আয়।
-“ সত্যি! বিস্ময় হয়ে কথাটা বলে তটিনী। তানু তটিনীর মাথায় গাট্টা মেরে বলে-
-“ বুদ্ধি হবে কবে তোর? খারাপ লাগছে না এমন টা করার জন্য? আব্বা ভীষণ হার্ট হয়েছে তটু৷ বারবার আশঙ্কায় মিইয়ে যাচ্ছিল আব্বা অপমান হওয়ার ভয়ে। জানিস তো আব্বার কাছে মানসম্মান টা আগে। এটা জেনেও কি করে এমন ভুল করলি?
তটিনীর গিল্টি ফিল হচ্ছে। তখন মাথায় এসব কাজ করছিল না তার। শুধু মাথায় এসেছিল পালাতে হবে। একজন কে ভালোবেসে অন্যজনকে বিয়ে করা যায় নাকি? মানুষ টা সঠিক হলে এই গিল্টি ফিল টা কখনই করতো না তটিনী। কিন্তু এখন হচ্ছে। ভুল মানুষের জন্য বাবা মা,বোনকে এতো টা কষ্ট দিয়ে।
-“ ভুল করছি আপু। ট্রাস্ট মি এমন ভুল আর কখনও করবো না। শিক্ষা হয়ে গেছে আমার। ভুল থেকেই তো শিক্ষা নেয় সবাই। আমিও নিলাম। তোমাদের কথার বাহিরে কিচ্ছু করবো না। আব্বুকে একটু বলো না রাগ কমাতে। আমি কথা বলবো। আব্বুর পা ধরে ক্ষমা চাইবো।
-“ ক্ষমা চাইলেই ক্ষমা পাবি মনে হয়?
-“ পাবো পাবো। জানি আমি আব্বু রাগ করে থাকতেই পারবে না আমার উপর।
-“ এতই যখন জানতে তাহলে গেলে কেনো পালিয়ে?
-“ রিজন টা তো বললাম আপু। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল তটিনী।
তানু তপ্ত শ্বাস ফেললো। -“ বিয়েতে আপত্তি আছে এখনও?
-“ আপত্তি থাকলেও তো দিবে তোমরা বিয়ে। আর বিয়ে না করতে চাইলে আবার আব্বু আমার উপর ক্ষেপে যাবে। আমি মোটেও আর ঝামেলা পাকাতে চাই না। তোমাদের ডিসিশন আমি মেনে নিব।
-“ চল তাহলে। কথাটা বলে তানু তটিনীর হাত ধরে। সোজা বাবার রুমে যায়। তরিকুল ইসলাম কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। তার মেয়ে আজ ভীষণ বাড়াবাড়ি করেছে। সামান্য পড়ালেখার জন্য সে বিয়ে করতে চায় নি! সে তো বাঁধা দেয় নি। যখন জিজ্ঞেস করলো বিয়ে নিয়ে আপত্তি আছে কি না তখন একটু মুখ ফুটে বলতো। তাহলে তো আর এই বিয়ে নিয়ে এগোতো না।
-“ বাবা আসবো?
বড় মেয়ের কথায় ঘোর ভাঙে তরিকুলের।
-“ ওকে আমার সামনে এনো না তানু। আমি ওর মুখ দেখতে চাই না। একই ভঙ্গিতে থেকে কথাটা বলে তরিকুল ইসলাম। সে জানে তানু একা আসে নি। ছোট টাকেও সাথে করে নিয়ে এসেছে।
তটিনী অসহায় হয়ে বোনের দিকে তাকালো।
-“ বাবা ও ভুল করে ফেলছে তাই বলে তুমিও রাগ পুষে রাখবা?
-“ এটাকে ভুল বলে না তানু। আমরা ওকে ফোর্স করি নি বিয়ের জন্য।
তানু ইশারায় তটিনী কে রুমের ভেতর বাবার কাছে যেতে বলে। তটিনী ভয়ে ভয়ে গুটিগুটি পায়ে বাবার কাছে হেঁটে যায়। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে অপরাধীর ন্যায় বলে-
-“ সরি আব্বু আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি বিয়েটা করবো। প্লিজ তুমি আমায় শেষ বারের মতো ক্ষমা করে দাও। আমি জীবনেও তোমার কথার অবাধ্য হবো না।
তরিকুল ইসলাম চুপ রইলো। তটিনী বাবার দিকে একবার তাকায়৷ একটু রাগ ভাঙেনি। সহাসা পা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে।
-“ বাবা প্লিজ এবারের মত ক্ষমা করো। কথা দিচ্ছি আমি আর জীবনেও তোমার কথার অবাধ্য হবো না।
তরিকুল ইসলাম সহসা উঠে বসলেন। তটিনীর থেকে পা ছাড়িয়ে তানির দিকে তাকিয়ে শক্ত মুখে বলে-
-“ ওকে আমি নিয়ে যেতে বলছি তানু। নিয়ে যাও।
তানু এবার রুমে ঢুকলো। তার বাবার মন এতো সহজে গলবে না। তটিনী কে ধরে রুম থেকে বের হয়।
-“ বললাম না গলবে না আব্বা। অনেক হার্ট করছিস।
-“ কি করবো এখন?
-“ আব্বা কে আব্বার মত থাকতে দে।
——————————-
সকাল থেকেই আত্মীয় এক এক করে আসছে তটিনী দের বাসায়। আজ গায়ে হলুদ। তরিকুল ইসলামের বোন তানিয়া বেগম পানের বাটা নিয়ে বসে আছে ড্রয়িং রুমে। লায়লা বেগম রান্না ঘরে শরবত বানাচ্ছে।
-“ তানুর মা শরবত টা হইলো নি?
-“ হ্যাঁ হয়ে গেছে আপা। শরবতের গ্লাস নিয়ে আসতে আসতে বলেন। তানিয়া বেগম শরবত টা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে বলে-
-“ যা গরম পরছে আজকে এক্কেরে মাথার চান্দি গরম তাওয়ার মতো হয়ে আছে। একটুকরো বরফ ফ্রিজে থাকলে দেও তো।
লায়লা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এই মহিলা আসলেই তার ফরমায়েশ খাটতে খাটতে জীবন শেষ হয়ে যায় । ফ্রিজ থেকে এক বাটিতে কয়েক টুকরা বরফ এনে দেয়৷ তানিয়া বেগম টকটকে লাল দাত গুলে বের হেঁসে বলে-
-“ বরফ টা চান্দিতে মাখিয়ে দাও৷ একটু আরাম পাই।
লায়লা বেগম বরফ ডলতে শুরু করলেন।
তটিনী ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে ড্রয়িং রুমে আসে। তানিয়া বেগম সেদিকে চেয়ে বলে-
-“ ঐ ছ্যামড়ি তোর না আজকে গায়ে হলুদ পার্লারে যাস নাই ক্যা?
তটিনী ফোনে টাইম দেখলো। -“ এখন বাজে কেবল ৯ টা ফুপি।
-“ তাতে কি? পার্লারে কত ভীড় হয় জানস তুই?
-“ তুমি জানো?
-“ হ তাসলিমা কয়েক দিন পর পর পার্লারে যায়। চার পাঁচ ঘন্টা পরে আসে বাড়িতে। সামান্য ব্রু ফ্লাক করতেই নাকি চার ঘন্টা লাগে।
তানু নিচে নামতে নামতে কথাটা শুনলো। তটিনীর পাশে বসে ফিসফিস করে বলল-
-“ ফুপি যদি শুনে তার মেয়ে পার্লারের নাম করে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যায় তাহলে কি হবে ধারনা করেছিস?
-“ মাইর একটাও মাটিতে পরবে না।
-“ হুমম। মেয়েটাকে বুঝাতে হবে। ভালোবাসা টা অপরাধ না। তবে প্রেম হারাম। এই হারাম প্রেম আমাদের ফ্যামিলির মেম্বার দের জন্য না।
তটিনী চুপ রইলো। আর তখনই সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো তটিনীর খালা লাবন্য। কোলে দু বছরের মেয়ে। তটিনী এগিয়ে গেলো। বাচ্চা টাকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলে- কেমন আছো খালামুনি?
লাবন্য তটিনীর গাল টেনে বলে- ভালো আছি। তুই?
-“ আমিও ভালো আছি।
তানু লাবন্যর ল্যাগেজ টা নিলো। লাবন্য সোফায় গিয়ে বসলো।-“ কেমন আছেন আপা?
তানিয়া বেগম মুচকি হেঁসে বলল- “ ভালোই আছি। তোমার জামাই আইলো না যে?
-“ ও কাল আসবে। আসলে অফিস থেকে ছুটি দেয় নি তো।
-“ ওহ্ আচ্ছা। এই তটু মাইয়া টারে আমার কোলে দে। দেহি একটু।
তটিনী বাচ্চা টাকে তানিয়া বেগমের কোল দিলো।
-“ যা মুখ ধুইয়া আয়। সেই কতক্ষণ ধইরা ব্রাশ করতাছোস।
তটিনি বেসিনে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিলো। খাবার টেবিলে বসে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ মা ক্ষুধা পাইছে।
লায়লা মেয়ের পানে চেয়ে বলল-
-“ তো আমি কি করবো?
-“ খাবার দাও।
-“ খাবার কি আমি ধরে নিয়ে বসে আছি? টেবিলে নেই খাবার?
তটিনীর মুখ চুপসে যায়। তটিনী চাচ্ছে স্বাভাবিক হতে কিন্তু তার মা বাবা হতে দিচ্ছে না। একটা ভুলের মাশুল তাকে অনেক দিন বয়ে যেতে হবে।
তটিনী খাবার বাড়ার জন্য চামিচে হাত দিতেই সেটা তানু হাতে নিয়ে খাবার বেড়ে দেয়।
-“ ক্ষিদে লেগেছে,ক্ষুধা পেটে জমিয়ে রেখে কি হবে? আম্মু বেড়ে দিতে হবে কেনো?
-“ আম্মুর রাগ এখন ও তো কমলো না আপু।
-“ কমবে কমবে এখন চুপচাপ খা।
তটিনী চুপচাপ খেলো। খাবার গুলো বারবার গলায় আঁটকে যাচ্ছিল। একটা ছোট্ট ভুল তাকে বেশ দূরে নিয়ে গেলো কাছের মানুষ গুলোর থেকে।
———————————-
পার্লার থেকে সেজে এসেছে তটিনী তানুর সাথে। শরীর গাঢ় হলুদের লাল পাড় দেওয়া শাড়ি। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তটিনী। আর তখনই হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে তটিনীর মামা তো বোন ঐশি। এবার একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে।
-“ আপু হয়েছে?
-“ হুম। ছোট্ট করে জবাবা দিলো তটিনী।
-“ চলো সবাই অপেক্ষা করছে।
ঐশি তটিনী কে নিয়ে ছাঁদে যায়। ছাঁদে আসতেই তানু এগিয়ে যায় বোন কে নিতে। স্টেজে বসিয়ে কয়েক টা ছবি তুলে। তানুর হাজবেন্ড তাজদিদ কে ফোন দিয়ে তটিনীর সাথে ডুয়েট পিক তুলে। তাজদিদ এসেছে সন্ধ্যায়। সাথে তাজদিদের কিছু কাজিন আর তাসফির ফ্রেন্ড।
তানু গিয়ে তার বাবা আর মা কে ডেকে আনে হলুদ ছুঁইয়ে দেওয়ার জন্য। তরিকুল ইসলাম আর লায়লা বেগম একত্রে আসে। তটিনী তাকায়,অনুশোচনায় দগ্ধ সে। কালই তো চলে যাবে ঐ বাড়ি। তার বাবা মা এখনও রেগে থাকবে! তরিকুল ইসলাম হলুদ ছোঁয়াতেই তটিনী ছলছল নয়নে বলে উঠে –
-“ এখনও রেগে আছো আব্বু? একটু কি ক্ষমা করা যায় না? কাল তো চলেই যাবো। করে দাও না ক্ষমা। ইচ্ছে হলে হাজার টা থাপ্পড় মারো। তবুও ক্ষমা করে দাও। ভুল করেছি স্বীকার করছি৷ প্লিজ ক্ষমা করো।
তরিকুল ইসলাম গালে হলুদ ছুঁইয়ে চলে আসলো। আর থাকলো না সেখান টায়। তটিনী অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকালো। লায়লা বেগম শীতল কন্ঠে বলল-
-“ সময় দে ঠিক হয়ে যাবে।
তটিনী মায়ের হাত জড়িয়ে ধরলো।
-“ মা আমি আর জীবনেও তোমাদের কথার অবাধ্য হবো না।
লায়লা বেগম কিছু বললো না। একএক করে সবাই হলুদ ছোঁয়ালো।
ওদিকে তাসফি বসে আছে রুমে। শরীরে তার সাদা পাঞ্জাবি। ফোন স্ক্রোল করছে। তাজদিদ তটিনীদের ওখানে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলেই বাসায় ব্যাক করে। তাসফির ফ্রেন্ড তুহিন রুমে ঢুক তাসফির পিঠে থাপ্পড় মেরে বলে-
-“ কাজ টা কি ঠিক করলি ভাই? মাইয়া টা আদিল রে ভালোবেসে ফেলছিল।
তাসফি ভ্রু কুঁচকালো। -“ দরদ লাগছে তোর আদিল তটিনীর জন্য? আমার জন্য হচ্ছে না?
-“ আরে ব্যাটা হবে না কেনো দরদ। আদিল ও তো তটিনী রে ভালোবাসতো।
তাসফি তাচ্ছিল্যের সুরে বলে-
-“ সিরিয়াসলি ও ভালোবাসতো তটিনী কে? যদি ভালোই বাসতো তাহলে আমার কথার জন্য সে তটিনীর হাত ছাড়তো না। বুক ফুলিয়ে বলতো সে তটিনী কে ছাড়বে না।
-“ তুই যেই থ্রেট দিছিস সেখনে কোনো ছেলের সাধ্যি ছিল না তার প্রেমিকা কে ধরে রাখার।
-“ আমাকে কেউ থ্রেট দিয়ে দেখুক তটিনী কে ছেড়ে দেওয়ার তার অবস্থা বারো টা বাজিয়ে দিব। এক বছর ধরে মেয়েটাকে মন কুটিরেতে জায়গা দিয়ে রেখেছি ছয় মাসের পরিচিত হওয়া এ ছেলেকে দিয়ে দেওয়ার জন্য নাকি?
-“ তটিনী বিয়ের ওর জানলে কি হবে?
-“ যা হওয়ার তাই হবে। বিয়ে হয়ে যাবে ডিভোর্স হবে না। সো সে আমারই থাকবে।
তাসফি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে কথাটা বলে উঠল। সাথে সাথে মেসেজ আসলো। তাসফি ওপেন করো। মুহুর্তে ভেসে উঠলো তটিনীর গায়ে হলুদের ছবি। এক চিলতে হাসি ফুটলো গম্ভীর মুখটায়। বিরবির করে বলল মাশা-আল্লাহ।
রাজশাহী এক্সপ্রেসে ট্রেনে রাত ৮:১৫ তে উঠে রাত ১০ টায় এসে পৌঁছায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ রেলস্টেশনে । স্টেশন থেকে ভোলাহাট যেতে আরো দু ঘন্টা লাগবে। কিন্তু স্টেশনে বেঞ্চে বসে আছে তটিনী।
ট্রেন থেকে নামতেই আকাশের বুক চিঁড়ে আবির্ভাব হয়েছিল ঝুম বৃষ্টির। যার থামার নাম নেই। যার জন্য বসে অপেক্ষা করছে বৃষ্টি বন্ধ হবার। স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা কিছু সংখ্যক লোক দৌড়ে স্টেশনের ভেতর দিকটায় আসলো। এক বৃদ্ধ মহিলা লাঠি ঠক্ ঠক্ করে তটিনীর পাশে বেঞ্চ টাতে বসলো। তটিনীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে বাহিরে পড়া ঝুম বৃষ্টির দিকে। কোনো বর্জপাতের শব্দ নেই। কল ছাড়লে যেমন একাধারে পানি পড়ে তেমনি মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। তটিনী বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। হেঁটে সামনের দিক টায় এসে দাঁড়ালো। শরীরে মেজেন্টা কালারের সেলোয়ার-কামিজ,চুল গুলো হাত খোঁপা করা। স্টেশনের ছাওনি থেকে বা হাত টা বাড়িয়ে দিলো। সাথে সাথে বৃষ্টির পানি তটিণী-র হাত ভিজিয়ে দিলো। পানির ছিটায় পড়নের জামাকাপড় ভিজে গেলো কিছুটা। সেই সাথে মুখেও আসলো পানির ছিটা। দূর থেকে বৃদ্ধ মহিলা গলা ছেড়ে ডাক দিলো তটিনী কে-“ এই মাইয়া বৃষ্টি তে ভিজো ক্যান,জ্বর আইবো তো।
তটিণী পেছন ফিরে। সত্তরে পা দেওয়া বৃদ্ধ মহিলা হয়তো উনি। তটিনীর মুখে হাসি ফুটলো বৃদ্ধ মহিলা কে দেখে । এতক্ষণ খেয়াল করে নি এই বৃদ্ধ মহিলা কে সে। দৌড়ে কাছে গেলো বৃদ্ধ মহিলার। পাশে বসে বলল-“ দাদি আপনি এখানে যে? কোথাও গিয়েছিলেন?
বৃদ্ধ মহিলা তটিনী কে পর্যবেক্ষণ করলেন। পাশে ল্যাগেজ দেখতে পেয়ে বলে উঠে -“ কই আর যামু,,তোমারেই লইতে আইছি। বিয়ের আগের দিন কেউ এমনে পালায় বাসায় থিকা?
তটিনী চুপসে গেলো। খেয়ালেই ছিলো না এই প্রশ্নের যে সম্মুখীন সে হবে। চুপ রইলো,বিপরীতে কোনো উত্তর দিলো না। সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো মাথার চুল হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে আসছে তাসফি। মুখে লেগে আছে বিরক্ত। আচ্ছা লোকটা কে নিশ্চয়ই আপু খবর দিয়ে পাঠিয়েছে তাই না? হ্যাঁ বেশ কিছুক্ষণ আগে তো আপুর সাথেই কথা হলো তটিনীর। আপুকেই তো বলেছে তটিনী সে স্টেশনে বসে আছে ট্রেনের জন্য। লোকটা এগিয়ে এলো তটিনী আর বৃদ্ধ মহিলার দিকে। তাসফি বাসা থেকে বের হতেই তাসফির দাদি জাহানারা বেগম নাতি কে পেছন থেকে ডেকে উঠেছিলেন। কারন সে ড্রয়িং রুমেই বসে ছিলেন,টিভি দেখছিলেন। নিত্যকার অভ্যাস রাত অব্দি টিভি দেখা। তাসফি দাদির ডাক শুনে পেছনে তাকায়।
-“ কই যাইতাছোস এতো রাতে তাসফি?
-“ তোমাদের বাড়ির হবু বউ কে তাদের বাসায় দিয়ে আসতে যাচ্ছি।
তাসফির সোজাসাপটা কথায় ভ্রু কুঁচকে আসে জাহানারা বেগমের। লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ বাড়ির হবু বউ রে তাদের বাসায় দিয়া আসতে যাইতাছোস মানে কি?
তাসফি হাত ঘড়ি টায় সময় দেখে বলে-
-“ স্টেশনে বসে আছে তটিনী।
-“ এতো রাইতে স্টেশনে ক্যান হেই মাইয়া?
-“ বাসা থেকে পালিয়েছে।
-“ কিহ! কিছুটা জোরে বিস্ময়ের সাথে কথাটা বলেন জাহানারা বেগম। তাসফি এগিয়ে গেলো।
-“ আস্তে কথা বলো দাদি। আর ঘুমাও নি কেনো। রাত অনেক হয়েছে ঘুমাও গিয়ে। আমি যাচ্ছি।
-“ আমিও যামু তর লগে। তাসফি যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই জাহানারা বেগম কথাটা ফট করে বলে বসেন। তাসফি তপ্ত শ্বাস ফেলে।
-“ বাহিরের আবহাওয়া ভালো না দাদি। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে।
-“ নামুক তাতে তর আমার কি? আমরা তো গাড়ির মধ্যে থাকমু। আমারও নাইট লং ডেরাইভ হইবো তর লগে।
-“ ডেরাইভ না দাদি ড্রাইভ ওটা।
জাহানারা বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বলল- ঐ হইলো একটা। খালি ভুল ধরস ক্যা আমার। আমারে লইয়া যা,মাইয়ার সাহস কত আমার নাতি রে বিয়ে না কইরা পালাইয়া যায়।
-“ আচ্ছা চলো।
তারপর দাদিকে নিয়েই স্টেশনে রওনা হয় তাসফি।
-“ দাদি তটিনী কে নিয়ে গাড়িতে বসো। বৃষ্টির মাত্রা কিছুটা কমেছে। ট্রেন আসতে আরো লেট হবে।
জাহানারা বেগম তটিনীর হাত ধরে বলে- চলো গাড়িতে। মাইয়া মানুষ বিয়ের কথা উঠলেই বাসা থিকা পালাইবার চাও ক্যান? আমার নাতি কি সুন্দর না নাকি? এই তাসফি তটিনীর দিকে তাকাতো। এই মাইয়া আমার নাতির দিকে তাকাও। দেহো তো কোনো খুঁত পাও কি না।
তটিনী তাকালো তাসফির দিকে। তাসফি অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শরীরে ব্লাক হুডি। গায়ের রং ফর্সা। আদিলের থেকেও কম সুন্দর না এই লোক।।
-“ পাইছো কোনো খুঁত?
তটিনী দু দিকে মাথা নাড়ালো।
-“ তাইলে পালাইছো ক্যান? সুখে থাকতে ভূতে কিলায়?
তটিনী অসহায় হয়ে রইলো। আসলেই সুখে থাকতে মনে হয় তাকে ভূতে কিলাচ্ছিলো। এই একটা ভুলের জন্য যে তাকে কত কথা শুনতে হবে তার হিসেব নেই। আল্লাহ আল্লাহ করে বিয়ে টা ভেঙে যাক।
-“ দাদি গাড়িতে উঠতে বলছি আমি।
তাসফির শক্ত মুখের কথায় জাহানারা বেগম তটিনী কে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। মুহূর্তে পকেটে আবার ফোন বেজে উঠে। তাসফি ফোন কল টা রিসিভ করে।
-“ ভাই পাইছেন তটিনী কে?
-“ হুমম পেয়েছি।
-“ আপনার জন্য চড় খেতে হয়েছে।
-“ ভুল করছো চড় খেয়েছো,,এখন ফুলশয্যা এনজয় করো। বেস্ট অফ লাক।
কথাটা বলে তাসফি ফোন কে’টে দেয়। বড় বড় পা ফেলে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। পেছনের সিটে তটিনী আর জাহানারা বেগম বসেছে। তাসফি ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
প্রায় দু’ঘন্টা পর এসে পৌঁছায় তটিনীর গন্তব্যে। গাড়িতে থাকাকালীন কেউ টু শব্দ টাও করে নি। গাড়ি টা বাসার সামনে এসে থামতেই তটিনীর বুক টা ধক করে উঠে। না জানি বাসায় কি অপেক্ষা করছে তার জন্য। জাহানারা বেগম গাড়ি থেকে নেমে তটিনী কে গাড়ি থেকে নামতে বলে। তাসফি লুকিং গ্লাসের আয়না দিয়ে পেছনে আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকা রমণীর দিকে দৃষ্টি রেখে বলে-
-“ দাদি তুমি যাও৷ তটিনী আসতেছে। চুপ থাকবা ভেতরে গিয়ে।
জাহানারা বেগম চলে গেলেন। তাসফি গাড়ি থেকে নেমে সোজা পেছনের সিটের দরজা খুলে তটিনীর পাশে বসে গাড়ির দরজা টা বন্ধ করে দেয়। ঠোঁট কামড়ে কিয়ৎ ক্ষণ চুপ থাকে রাগ নিবারন করার জন্য।
-“ বয়ফ্রেন্ড গ্রহণ করে নি?
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা টা বলে। তটিনী মাথা নিচু করে বসে থাকে। লোকটার শরীর থেকে কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ ভেসে আসতেছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তটিনী কে চুপ থাকতে দেখে তাসফি বিরক্তি নিয়ে বলে-
-“ অ্যান্সার মি। বয়ফ্রেন্ড গ্রহন করে নি?
-“ ওর বিয়ে হয়ে গেছে। মিনমিনে সুরে কথাটা বলে উঠে তটিনী।
-“ বেশ করেছে। বিরবির করে কথাট বলে তাসফি। তটিনীর কর্ণকুহরে গিয়ে পৌঁছায় না কথাটা৷
-“ গাড়ি থেকে নামো।
-“ চড় থাপ্পড় খাওয়ার জন্য?
তাসফি ভ্রু কুঁচকালো। -“ চড় থাপ্পড় খাওয়ার জন্য মানে?
-“ আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম। আবার বাসায় ফিরছি। সবাই আমাকে চড় থাপ্পড় না মেরে খ্যান্ত হবে নাকি? কয়েক টা থাপ্পড় চড় পরবে আমার গালে তার ধারনা নেই আপনার।
-“ আচ্ছা তোমাকে কেউ মারবে না। চলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে কথাটা বলে তাসফি।
-“ সত্যি?
-“ হুমম।
তটিনী খুশি মনে গাড়ি থেকে নামলো ল্যাগেজ নিয়ে। তাসফি নিজেও গাড়ি থেকে নামলো।
-“ আপনি আগে আগে হাঁটা ধরুন। তাসফি তাই করলো। তাসফির পেছন পেছন হাঁটা ধরলো তটিনী।
পুরো বাড়ি থমথমে। বসার ঘরে বসে আছে তটিনীর বাবা তারেক,মা লায়লা,আর বোন তানু,জাহানারা বেগম। পুরো বাড়ি রংবেরঙের আলোয় সজ্জিত। কোথায় আজ বিয়ে উপলক্ষে গান বাজনা বাজার কথা ছিল তা না হয়ে তটিনীর চিন্তায় সবাই কপোকাত। তটিনী এক বুক ভয় নিয়ে আল্লাহর নাম জপতে জপতে ভেতরে ঢুকে। তটিনী কে দেখামাত্রই তানু দৌড়ে আসে। তটিনী দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। তানু ভ্রু কুঁচকায়। তটিনী গালে এখনও চড় পড়তে না দেখে আঙুলের ফাঁকা দিয়ে দেখে তানু দাঁড়িয়ে আছে।
-“ রাগ করে চলে গিয়েছিলি কেনো? তোকে কি আমরা জোর করে বিয়ে দিচ্ছিলাম? রাজি না সেটাই বললেই পারতি।
তাসফি তানুর দিকে তাকালো। তানু এক ঢোক গিলল।
-“ কি হলো কথা বলছিস না কেনো? বিয়ে না করার জন্য ই তো বাড়ি থেকে পালালি তাহলে আবার চলে আসলি কেনো? মত বদলেছে? বিয়েতে রাজি তুই?
তাসফি প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বলে-
-“ রাজি না হলে নিশ্চয়ই বাসায় ব্যাক করতো না ভাবি আপনার বোন।
-“ সেটাও ঠিক। বাবা দেখছো তোমার ছোট মেয়ের কারসাজি?
তরিকুল ইসলাম বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। শক্ত মুখে বলল- “ যেই মেয়ে বাবা মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে পালিয়ে যায়৷ সেই মেয়ে কখনই ভালো হতে পারে না। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলো রুমে। তটিনী এসব কথা শোনার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো।
লায়লা বেগম তাসফির দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ওকে নিয়ে আসলে কেনো। পড়ে থাকতো রাজশাহীর মাটিতে। ওর কি পড়াশোনা বন্ধ করে দিব এসব বলেছি? চিঠিতে এসব লিখে যাওয়ার মানে কি?
তাসফি তার দাদি কে উঠে দাঁড়াতে ইশারা করলো। -“ সন্তান একটা ভুল করতেই পারে আন্টি সেজন্য আপনারা তাকে কটাক্ষ না করে বুঝিয়ে বলবেন। তাহলে আর এমন ভুল করবে না। তটিনী ভুল করেছে আপনারা সুন্দর করে বুঝিয়ে বলবেন। তটিনী অবুঝ নয় বুঝবে আপনাদের বুঝ।
লায়লা বেগম ভস্ম চাহনি নিয়ে একবার তটিনীর দিকে তাকায়। তটিনী তাদের কথার কোনো আগামাথা বুঝতে পারছে না। ও তো চিঠিতে এসব লিখে নি। তটিনীর মনে আছে সে চিঠিতে লিখেছিল সে পালিয়ে যাচ্ছে তার ছাতার ভালেবাসার জন্য। তাহলে এসব বলছে?
-“ তোমাদের বাসায় হয়তো এতক্ষণে সবার কানে চলে গেছে বাবা তটিণী-র পালিয়ে যাওয়ার কথাটা। তোমরা নিশ্চয়ই এবার বিয়ে টা ভেঙে দিবে। তটিনীর জন্য কি তানুর সংসারেও এর রেশ পড়বে?
তাসফি লায়লা বেগমের দিকে তাকালো।
-“ আন্টি আমার বাসার কেউ জানে না এখনও। আর আপনি চিন্তা করবেন না বিয়ে টা হবে। আর ভাবির সংসারে এসবের রেশ পড়বে না। আপনি তটিনী কে ভেতরে নিয়ে যান।
লায়লা বেগম স্বস্তি পেলো। তটিনীর দিকে তাকিয়ে বলল- রুমে চল।
তটিনী বাধ্য মেয়ের মতো মায়ের পেছন পেছন রুমে গেলো।
-“ ওর গায়ে যেনো হাত না তুলা হয় ভাবি। বিষয় টা খেয়ালে রাখবেন।
তানু মাথা নাড়িয়ে জানায় খেয়াল রাখবে।
তাসফি জাহানারা বেগম কে নিয়ে চলে যায়।
লায়লা বেগম রুমে ঢুকেই মেয়ে কে ইচ্ছে মত বকা শুরু করে। তটিনী বিছানায় অপরাধীর ন্যায় হয়ে সব হজম করে। এ ছাড়া উপায় নেই। লায়লা বেগম মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে রাগী কন্ঠে বলে-
-“চলে গিয়েছিলি আসলিই বা কেনো? তাসফি না থাকলে আজ তোর গাল চড়িয়ে লাল করে দিতাম ফাজিল মেয়ে। পরশু তার বিয়ে আর আজ সে সিনেমার মত চিঠি লিখে পালিয়েছে। জীবন টা কি সিনেমা?
তটিনী মাথা তুলে তাকালো। -“ চিঠি টা কোথায়?
লায়লা বেগম বিরক্তি নিয়ে বলে- তোর বাবার কাছে। চিঠি দিয়ে কি করবি? হুবহু কি সেটা লিখে আবার বাসা থেকে পালাবি? শুনে রাখ বিয়ের আগ অব্দি তোর বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ পড়াশোনা শ্বশুর বাড়ি গিয়ে করবি।
তটিনী বিরক্ত হলো। সেই কখন থেকে এই এক প্যাচাল করে যাচ্ছে একটু তো জিজ্ঞেস করতে পারে আসতে সমস্যা হয়েছে কি না। বা আদরে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে যে মা তুই এসেছিস৷ কেনো চলে গেছিলি তুই। মা বাবা তোর সব কথা শুনবে। দিবে না বিয়ে। তা না করে এই ছাতার প্যাচাল।
আজকের দিন টা স্মরনীয় করে রাখবে তটিনী যতদিন বেঁচে রবে। সব খারাপ ঘটনা আজই হচ্ছে। একটাও মনের মত ভালো সুন্দর হচ্ছে না।
লায়লা বেগম ল্যাগেজের জামাকাপড় গুলো আলমারি তে রেখে বলে- “ এ্যাহ আবার আলমারির সব নতুন নতুন জামাকাপড় গুলো নিয়েই পালিয়েছে। আর এত কাপড় কেনো নিয়েছিল? বছর চারেকের মধ্যে কি বাসায় না আসার প্ল্যান করেছিলি?
তটিনী চোখ ছোটো ছোট করে বলে- কোথায় সব কাপড় নিয়েছি। মাত্র তো দশ সেটই নিয়েছি।
-“ এটা মাত্র?
কথাটা বলে ঝাটা নিয়ে আগাতে আসলে তানু আঁটকে দেয়।
-“ উফ মা কি শুরু করলা। মেয়েটা বাসায় এসেছে এটাই তো অনেক। কাল থেকে মেহমান আসবে। কি হতো ও না ফিরলে ভেবে দেখেছো?
লায়লা বেগম ঝাটা টা ফেলে দিয়ে বলে-
-“ না ভাবি নি সেজন্য ই এখনও চলা ভাঙি নি ওর পিঠে।
তানু তপ্ত শ্বাস ফেলে। লায়লা বেগম রাগতে রাগতে রুম থেকে চলে যায়। তানু এগিয়ে এসে তটিনীর সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ তুই কি গাধা? ভালোমন্দ কিছু বুঝিস না? বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে যাবি সেটা চিঠিতে লিখে চলে গেলি! বাবা ঐ চিঠিটা দেখলে কি ধারনা পেত তোকে নিয়ে আন্দাজ করেছিস কখন? ভাগ্যিস চিঠিটা সরিয়ে ফেলেছিলাম বাবার হাতে পড়ার আগেই।
ভালোবাসার মানুষটির খোঁজে তার বাসায় এসে যে তারই বিয়ে দেখবে তা কল্পনাতেও ভাবতে পারি নি তটিনী । গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছে এই সুদূর রাজশাহীর শহরে যার ভরসায়, আজ সেই মানুষটির বিয়ে হয়ে গেছে অন্য এক মেয়ের সাথে!
বিয়ে বাড়ির এক পাশে নিস্তেজ বিধ্বস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে অনবরত গড়িয়ে পড়ছে জল। সবাই আড়ঁচোখে দেখে চলছে তটিনী কে। এই বিয়ে বাড়িতে হঠাৎ ল্যাগেজ সহকারে এমন সাদামাটা একটা মেয়েকে দেখে। আর সামনেই স্টেজে বসে ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আদিলের৷ এই মুহূর্তে তটিনী কে সে তার বাড়িতে আশা করে নি। তটিনী এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো আদিলের দিকে। আদিল বারবার ঢোক গিললো। তটিনী যদি সবার সামনে সিনক্রিয়েট করে তাহলে মানসম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে। অপমানিত হবে লোকজনের সামনে। তটিনী আদিলের সামনে আসতেই আদিল বসা থেকে উঠে তটিনীর হাত ধরে সাইডে নিরব জায়গায় নিয়ে যায়।
এতেই যেনো লোকজন কানাঘুঁষা শুরু করে দেয়। লোকজন বলাবলি শুরু করে দিয়েছে আদিল ওভাবে মেয়েটার হাত ধরে নিয়ে গেলো কেনো? আর ঐ মেয়েটাই বা কে? মেয়েটা কাঁদছিল ই বা কেনো? মেয়েটা আর আাদিলের মধ্যে কিসের সম্পর্ক?
আদিল তটিনীর হাত ছেড়ে দিতেই তটিনী আদিলের শেরওয়ানির কলার চেপে ধরে। এতোক্ষণ আঁটকে রাখা কান্নার দলা এবার হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসলো। রাগে শরীর কিলবিল করছে।
-“ তুমি বিয়ে করে নিলে! এই তুমি না আমাকে ভালোবাসতে? তাহলে অন্য মেয়েকে বিয়ে করলে কি করে?
আদিল তটিনীর থেকে শেরওয়ানির কলার ছাড়িয়ে বলে-“ তুমি এখানে কেনো? আর আসবে জানাও নি কেনো?
তটিনী দাঁতে দাঁত চেপে বলে- তোমাকে বলি নি বাসা থেকে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলছে বাবা? বলিনি আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না? বলিনি আমি পালিয়ে চলে আসবো?
আদিল ভ্রু কুঁচকালো। -“ আর ইউ ক্রেজি? বাসা থেকে কেনো পালিয়ে এসেছো? আমি কখনও তোমায় বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি? তুমি এখনই তোমার বাসায় ব্যাক করো।
তটিনি অবাকের শীর্ষে চলে গেলো।-“ ম..মানে ক..কি বললে এটা তুমি? তুমি আমায় ভালোবাসতে না?
আদিল এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল-“ হ্যাঁ ভালোবাসতাম তাই বলে কি বিয়ে করবো এমন কিছু বলছি? আর তোমাকে কেনো আমি বিয়ে করবো? জাস্ট টাইম পাস ছিলো তোমার সাথে। আর আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছে জানো সে কে? এই শহরের ধনীদের কাতারে পড়ে তারা।সেখানে তাকে রেখে আমি তোমায় বিয়ে করবো! কখনও দেখেছো কেউ বিরিয়ানি সামনে রেখে পান্তা ভাত খায়? তুমি প্লিজ তোমার বাসায় চলে যাও। তোমার বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করো। আমার বিয়েতে অশান্তি করো না।
সহসা তটিনী কোষে এক চ’ড় বসিয়ে দেয় আদিলের গালে। চোখ মুখ জুড়ে ভাসমান রাগ ঘৃণা। আদিল গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকায় তটিনীর দিকে। -“ তুমি আমাকে থাপ্পড় দিলে!
-“ এই থাপ্পড় টা সেদিন মা’রা উচিত ছিলো যেদিন তুই আমায় প্রপোজ করেছিলি। তোর মত লোভী গিরগিটি কে যে আমি তটিনী ভালোবাসছি সেজন্য নিজের উপর উপহাস হচ্ছে। তুই কি ভেবেছিস তুই বিয়ে করে সুখে শান্তিতে থাকতে পারবি? অন্যের সুখ হারাম করে থাকতে পারবি সুখে?
-“ একে তো আমায় থাপ্পড় দিয়েছো আবার আমার চিন্তা করছো। আমার চিন্তা তোমার না করলেও চলবে। তুমি প্লিজ সিনক্রিয়েট করো না,হাত জোড় করে রিকুয়েষ্ট করছি । চলে যাও।
তটিনী রাগী রাগী চোখে একবার আদিলের দিকে তাকিয়ে হনহন করে ল্যাগেজ নিয়ে বেড়িয়ে গেলো বিয়ে বাড়ি থেকে। আদিল দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। স্টেজের কাছে আসতেই আদিলের বউ আইরিন জিজ্ঞেস করলো- কে ছিল মেয়েটা? হুট করে এসে আবার হুট করে চলে গেলো?
আদিল হাসার চেষ্টা করে বলে- ও ঐ মেয়েটা আমার ফ্রেন্ড ছিল। আসলে বিয়ে করেছি এতো তাড়াহুড়ো করে ওকে বলিনি সেজন্য রাগ করে চলে গেছে।
আইরিন ওহ্ বলে নিশ্চুপ হয়ে গেলো।
বিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটতে থাকে তটিনী। এদিকে রাত ও ঘনিয়ে এসেছে। আকাশ টাও মেঘলা মেঘলা করছে। বৃষ্টি আসবে হয়তো। একদিনেই এত মসিবত না আসলেই কি হতো না? বাসা থেকে যে পালিয়েছে এটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বাসার সবাই জেনে গেছে। আর বাবার কানে তো গেছেই কথাটা৷ কোন মুখ নিয়ে এখন বাসায় ফিরবে? পরশু বিয়ে। ছেলের বাড়ির কানে কি চলে গেছে পাত্রী বাসা থেকে পালিয়েছে? বাসায় গেলে চড় থাপ্পড় গালে কয়টা পড়বে হাতের কড় গুনে দেখছে তটিনী। সবার প্রথম তার মা দিবে, তারপর বড় আপু,তারপর বাবা। আর বাবার একটা থাপ্পড় মানে গাল দশ দিনের জন্য লাল হয়ে থাকা। আর ব্যাথার কথা নাই বলা হলো।
পরপর থাপ্পড়ের কথা গুলো মনে পড়ে তটিনীর ইচ্ছে করলো এই রাস্তায় হাত পা ছুঁড়ে কান্না কাটি করতে। লোকজন ঠিকই বলে,,বাবা মায়ের উপর মাতব্বরি করলে কপালে দুর্দশা ছাড়া আর কিছুই জুটে না। কি দরকার ছিল বাসা থেকে এই ফালতু ছেলের জন্য পালানোর? এখন বাসায় গিয়ে তো মা’র তটিনী কেই খেতে হবে।
কথাগুলো ভেবে একটা রিকশায় উঠে পড়লো তটিনী । স্টেশনে যেতে হবে তারপর ট্রেন ধরে বাসায় ব্যাক করতে হবে। এ ছাড়া তো উপায় নেই।
আদিল ছেলেটার সাথে ছয় মাসের রিলেশন ছিলো তটিনীর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো দু’জনেই। তটিনী বাসা ছেড়ে হলে থাকতো। ছয়মাস আগে আদিল প্রপোজ করে তটিনী কে। তটিনীর ও ভালো লাগতো আদিল কে। কেননা ছেলেটা পুরোই চকলেট বয় ছিল। কিন্তু তটিনী ভুলেই গিয়েছিল চকলেট বয় রা আসলে প্লেবয় হয়।
এই তো সপ্তাহখানেক হয়েছে তটিনী ভার্সিটি থেকে বাসায় চলে গেছে৷ বাড়ি থেকে জরুরি তলব জানিয়েছিল তার মা। তটিনী ইমার্জেন্সি ভেবেই এসেছিল। কিন্তু বাসায় এসেই জানতে পারে তার বাবা তার বিয়ে ঠিক করে ফেলছে তটিনীর বড় বোন তানুর দেবরের সাথে। যার সাথে জীবনে সে কথা বলে দেখে নি। শুধু চোখেই দেখেছে। সবসময় গম্ভীর ভাব নিয়ে থাকে। মনে হয় হাসি তার ডিকশিনারিতে নেই। এমন এক রোবট কে সে বিয়ে করবে! কথাটা ভেবেই নতুন করে কান্না পাচ্ছে তটিনীর।
স্টেশনে এসে টিকেট কিনে অপেক্ষায় বসে রইলো স্টেশনে ট্রেনের জন্য। না জানি বাসায় কি অপেক্ষা করছে তারজন্য।
———————————
নিকষ কালো আঁধারে ঢেকে আছে পুরো আকাশ। থেকে থেকে আকাশের চাঁদ টা কালো মেঘের মধ্যে ঢুকে পড়ছে আবার মেঘ সরে যেতেই তার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। বেলকনিতে গিটার হাতে নিয়ে বসে আছে এব যুবক। গিটারে সুর তুলতে ব্যার্থ। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। ইচ্ছে করলো গিটার টা এই দুতলা থেকে নিচে ফেলে দিতে। এরমধ্যে পকেটে থাকা ফোন বেজে উঠে। যুবক টি গিটার টা সাইডে রেখে ফোন টা রিসিভ করে। ফোনের ওপাশ থেকে কিছু কথা অস্থির কন্ঠ ভেসে আসলো। যুবকটি ঠোঁট কামড়ে ধরলো। কিয়ৎ ক্ষন চুপ থেকে বলল-
-“ ও এখন কোন স্টেশনে?
ওপাশ থেকে হয়তো স্টেশনের নাম ভেসে আসলো। যুবক টি শক্ত মুখ করে বলল-
-“ আমি দেখছি।
কথাটা বল ফোন কেটে দিলো ফোনের ওপাশে থাকা ব্যাক্তির মুখের উপর। তারপর সাইড থেকে গিটার টা নিয়ে সুর ধরলো। সুরের তালে গেয়ে উঠলো-
ওরে নীল দরিয়া
আমায় দেরে, দে ছাড়িয়া
বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি, হায়রে
কান্দে রইয়া রইয়া ।।
কাছের মানুষ দূরে থুইয়া,
মরি আমি ধড়-ফড়াইয়া রে ।।
দারুণ জ্বালা দিবানিশি, ।।
অন্তরে অন্তরে
আমার এত সাধের মন বধূয়া হায়রে
কি জানি কি করে…
গান টা গেয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে গায়ে হুডি জড়িয়ে বের হলো বাসা থেকে এই মধ্য রাতে। গন্তব্য স্টেশনে।
সুখের দিন গুলো অতি দ্রুত কেটে যায়।মনে হয় মিনিট পাড় হয় সেকেন্ডের গতিতে। দিন পাড় হয় ঘন্টার গতিতে। আফসোস হয়,সুখ সুখ স্বপ্নীল মুহূর্ত গুলো আর একটু দীর্ঘ হলো না কেন?আর দুঃখের দিন গুলো হয় সুদীর্ঘ। এক একটা সেকেন্ড ও যেন মনে হয় পুরো একটা দিনের সমান। যদিও এটা আমাদের মনের ধারণা।বাস্তবিক অর্থে প্রতিটা দিনই সমান। কিন্তু সুখ-দুঃখের দিনের দীর্ঘতায় বিস্তর তফাৎ অনুভূত হয় আমাদের লোভী মানব মনের কারণে। মন যে সর্বদা সুখ সন্ধানী!তার অল্প সুখে হয়না। পেয়েও আরো পেতে চায়। আর না পাওয়ায় তো আফসোসের কোনো অন্তই থাকেনা। আশা ভঙ্গের যন্ত্রণায় দীর্ঘ মনে হয় দিবস-রজনী। ঠিক এমন কিছু মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার কারণেই সুখের সময় মনে হয় দ্রুত শেষ হয়ে যায় আর দুঃখের সময় দীর্ঘ।
স্বপ্নময় তিনটা দিন কুয়াকাটায় কাটিয়ে ব্যস্ত নগরীতে ফিরে এসে আবারও যে যার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। দিন যায় পূর্বের রুটিনে। সুখ-দুঃখের রঙিন দোলনায় দোলে দোলে বিদায় নেয় দিন,মাস। স্মৃতির পাতায় যুক্ত হয় সাগর কন্যার তীরে কাটানো স্বর্ণালী সেই দিন গুলো। অলস- বিষন্ন বিকেলের অবসর সময়ে এক কাপ চা হাতে জানালার পাটাতনে বসে দৃষ্টি ডুব দেয় সেই স্মৃতির মাঝে। ইচ্ছে হয় টাইম ট্রাভেলে চরে আবারও চলে যাক সেই সুখময় অতীতের তিনটা দিনে। যে তিনটা দিন ছিল শুধুই রক্তিম-দৃষ্টির। নব নির্বাচিত পাষাণ এমপি সাহেবের ছিলনা কোনো ব্যস্ততা, ছিলনা ভালোবাসা প্রকাশে লুকোচুরি,কপটতা। কিছু স্নিগ্ধ,শীতল অনুভূতিতে দুজনারই মন ছিল ভরপুর।
“ভাবি! তুমি এই সময় এভাবে মন ম’রা হয়ে একা একা দাঁড়িয়ে আছো কেন? জানোনা তোমার মন খারাপ হলে আমাদের পুচকেটারও মন খারাপ হবে!”
ছোট ননদের কথায় স্মিত হাসে দৃষ্টি। বাইরের থেকে নজর সরিয়ে হাত রাখে পেটে। সেদিকে তাকিয়েই বোকার মতো প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা আপু! এই ছোট পেটে ও কিভাবে থাকছে? কষ্ট হচ্ছেনা বুঝি! তোমার সময় তো দেখেছিলাম তোমার পেট কত উঁচু হয়েছিল। কিন্তু আমার দেখো। এখনো পেট-পিঠ এক জায়গায় হয়ে আছে।”
হু হু করে হেসে ওঠে ইতি। এগিয়ে এসে দৃষ্টির গালে হাত ছুঁয়ে বলে,
“এতো অধৈর্য হচ্ছো কেন? একটু সবুর করো। সবে তো দেড় মাস পরলো। আর এক-দুই মাস যাক। তখন দেখবে পেট ফুলে একদম ফুটবল হয়ে গেছে।”
আজ দুদিন হলো দৃষ্টি জানতে পেরেছে তার মাঝে বেড়ে উঠছে ছোট্ট একটা প্রাণ। তাদের ভালোবাসার সেতু বন্ধন দৃঢ় করতে খুব শিগ্রই কোল জুড়ে আসবে পবিত্র সেই প্রাণ। খবরটা জানাজানি হবার পর শিকদার মঞ্জিলে যেন আবারও ছড়িয়ে পরে খুশির আমেজ। সুখের সামিয়ানায় ডেকে যায় সমস্ত অতীত বিষাদ। দৃষ্টি নতুন করে আবিষ্কার করে এক পাগল রক্তিমের। যার মাঝে হঠাৎ বাবা হবার খবর শুনেই ভর করেছে অদ্ভূত বাচ্চামো স্বভাব। কাজ পাগল যে রক্তিম দিন-রাত বেমালুম ভুলে পরে থাকতো বাইরে, সেই রক্তিমকে এখন দৃষ্টি ঠেলেও বাইরে পাঠাতে পারেনা।ভোটে জেতার পর থেকে তার মাঝে জনসেবার যে টানটান উত্তেজনা টুকু ছিল, সেটা যেন মলিন হয়ে গেছে বাবা হবার আনন্দের কাছে। ইচ্ছে করে সমস্ত দায়বদ্ধতা এড়িয়ে সারাদিন অপলক বসে দেখুক তার সন্তান কিভাবে ঐটুকু একটা মেয়ের মাঝে একটু একটু করে বেড়ে উঠে। রক্তিমের এমন বাচ্চামো স্বভাব দেখে ক্ষণেক্ষণে অবাক হয় দৃষ্টি। অঘাত বিস্ময় নিয়ে দেখে যায় আমূল পরিবর্তন হওয়া মানুষটাকে। আজকেও সকাল থেকে পার্টি অফিস থেকে দলীয় কাজের জন্য একের পর এক বার্তা আসছিল। কিন্তু রক্তিমের মাঝে কোনো ভাবাবেগ ছিলনা। একের পর এক ফোনকলে টিকতে না পেরে অবশেষে কতক্ষণ আগে রাজ্যের বিরক্তি আর দ্বিধা নিয়ে বাড়ি ছাড়ে। যাবার সময় বারবার করে বলে যায়, কোনোরকম খারাপ লাগলেই যেন দৃষ্টি সাথে সাথে তাকে ফোন করে। তার এমন উচাটন দশা দেখে মুখ টিপে অগোচরে হাসে দৃষ্টি। সম্মতি জানিয়ে বিদায় দেয় তাকে। রক্তিমের কথা স্বরণ হতেই আবারও আনমনে হাসে দৃষ্টি। ইতির সাথে পা বাড়ায় রুমের ভিতর। ঠিক তখনই ঝড়ের গতিতে ছুটে আসে কাকলির মা। দৌড়ে আসায় হাঁপাতে হাঁপাতে জানায়,
“ভাবি জান! জলদি নিচে যান। গিয়া দেখুন কারা আইছে।”
“কারা এসেছে?”
কাকলির মায়ের অস্থিরতা দেখে উৎসুক হয়ে জানতে চায় ইতি।
“নতুন কুটুম আইছে গো আপা নতুন কুটুম আইছে। জলদি জলদি ভাবিরে নিয়া নিচে আসেন। আমি গেলাম। মেলা কাম আছে আমার।”
আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে যেমন ঝড়ের গতিতে এসেছিল,তেমনই ছুটে যায় কাকলির মা। পিছন পিছন উৎসুক ভঙ্গিতে দৃষ্টি, ইতিও হলরুমের দিকে পা বাড়ায়। সিঁড়ি ডিঙিয়ে কিছুটা নেমে আসতেই হলরুমের সবটা স্পষ্ট দেখা যায়। যেখানে দাঁড়িয়ে বর্তমানে থমকে আছে দৃষ্টি। কাকলির মায়ের বলা নতুন অথিতি আর কেউ নয়। সয়ং দৃষ্টির বাবা মা সাদেক সাহেব, দিলশান আরা আর ছোট ভাই দিহান। এতোদিন পর ওরা আবার কেন এসেছে! আবারও কি তাকে নিয়ে যাবার জন্য চাপ সৃষ্টি করবে! বাবা-মায়ের সাথে লড়ার মানসিকতা যে এই মুহূর্তে দৃষ্টির নেই। সন্তান আসার সুখের সংবাদটুকু দৃষ্টি চায়না পারিবারিক ঝামেলায় মলিন হয়ে যাক।দৃষ্টির মনের ভয় বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হয়না ইতির। কাধে হাত রেখে আশ্বস্ত করে বলে,
“ভয় পাচ্ছো! বোকা মেয়ে,একদম ভয় পাবেনা। এমনও তো হতে পারে ওনারা তোমার মাতৃত্বের খবর শুনে এসেছে। কোনো মা-বাবা নিজের মেয়ের মা হবার সংবাদ শুনে রাগ পোষে দূরে থাকতে পারেনা। হয়তো ওরাও পারেনি। তাই ছুটে এসেছে। এবার দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ননদের কথায় ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে পা বাড়ায় দৃষ্টি। তবে মনের ভয় এখনো দূর হয়নি। বুক কাঁপছে অজানা সংশয়ে। রক্তিমও বাড়ি নেই। আজ যদি বাবা-মা জোর করে হলেও তাকে নিয়ে যায়, তবে কে আটকাবে তাদের! দুরু দুরু মনে বাবা-মায়ের সামনে উপস্থিত হয় দৃষ্টি। দেখতে পায় বাবা-মায়ের সাথে ছোট ভাইটাও কেমন অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দিলশান আরা’র কঠিন চোখ দুটো নোনা জলে সিক্ত। ধীর গতিতে মেয়ের সামনে এসে দু হাতের আজলায় মলিন মুখটা তুলে ধরে কান্নায় রোধ হয়ে আসা কন্ঠে বলে ওঠে,
“কবে এতোটা বড় হয়ে গেলে! আমার তো এখনো মনে হয়,মাত্র কিছুদিন আগে আমার মেয়েটা আমার কোলে এসেছিল। সে মেয়েটা আজ এতো বড় হয়ে গেছে,যে কি না নিজের ভালোবাসার জন্য বাবা-মায়ের সাথে লড়তে শিখেছে। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ভালোবাসাকে জয় করে সুখের সংসার গড়েছে। দুদিন পর আবার সেই মেয়েটাই মা হবে। সত্যিই এতো বড় কবে হলে?”
বহুদিন পর মায়ের আদুরে স্পর্শে নিজেকে সংযত রাখতে ব্যর্থ হয় দৃষ্টি। কেঁদে উঠে শব্দ করে। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“আজ অন্তত আমাকে ক্ষমা করে দাও মা। বিশ্বাস করো, তোমাদের থেকে দূরে থাকতে খুব কষ্ট হয় আমার। হাজার সুখের মাঝে থেকেও মনে হয় কি যেন একটা হারিয়ে ফেলেছি। প্রাপ্তির ঝুলিটা এখনো পরিপূর্ণ হয়নি আমার।”
মেয়ের কান্না আজ আর নিরবে সহ্য করতে পারেনা দিলশান আরা। মান-অভিমানের খেলাই ওনার কঠিন সত্তাটাও আজ হার মেনে নিয়েছে। বুকে জড়িয়ে নিয়েছে মেয়েকে। দূর্বল হয়ে গিয়েও নিজেকে দৃঢ় কঠিন রাখার প্রয়াস চালিয়ে কাঠিন্য স্বরে বলে,
“তোমার মাঝে যে প্রাণটা বেড়ে উঠছে সে তো নিষ্পাপ। আমার নাতি-নাতনি। শুধুমাত্র ওর জন্যই আজ তুমি ক্ষমা পেলে। আমি আমার সন্তানদের কাছে কঠোর মা হলেও নাতি-নাতনির কাছে মিষ্টি নানি হতে চাই। বন্ধু হতে চাই তাদের। নেহাত নাতি-নাতনির সাথে খেলার লোভ সামলাতে পারিনি দেখেই খবরটা শুনে সব রাগ ঝেড়ে ছুটি এসেছি।”
দিলশান আরা’র কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে প্রত্যেকে। নতুন করে খুশির জোয়ার আসে সবার মাঝে। মুহুর্ত ব্যবধানে সৃষ্টি হয় উৎসব মুখর পরিবেশ। কাকলির মা,ইতির সাথে রেহানা বেগম অসুস্থ শরীর নিয়েও লেগে যায় রান্নার কাজে। এতোদিন পর বাড়িতে নতুন কুটুম এসেছে। তাদের আদর-যত্নে কমতি থাকলে কি হয়! ফাঁকে ইতি ভাইকে ফোন করে ঘটনা সংক্ষেপে জানিয়ে দেয়। শশুর শাশুড়ি এসেছে, এটুকু শুনেই রক্তিম গুরুত্বপূর্ণ মিনিং মাঝ পথে ভেস্তে দিয়ে বাড়ি মুখি হয়। অস্থিরতা-চিন্তায় রাস্তাও যেন আজ শেষ হয়না। বুকের ভিতর অজানা এক ভয় বাসা বাঁধে। কোনো ক্রমে যদি তার সুখের পাইরাটাকে ওনারা তার থেকে কেড়ে নেয়! দ্বিতীয়বার নিঃস হয়ে রক্তিম বাঁচবে কিভাবে?
বুকে সুখের পাইরা হারানোর তীব্র ব্যথা নিয়ে বাড়ি ফিরে মেহমানদারির এলাহি কান্ড দেখে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয় রক্তিম। রুদ্ধশ্বাসে ডেকে ওঠে এই প্রথম দৃষ্টির নাম ধরে। তার ডাকে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে ইতি। দৃষ্টিকে কোথাও না দেখে রক্তিম চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করে,
“ও কোথায়?”
ভাইয়ের অস্থিরতা দেখে মিটমিটি হাসে ইতি। বলে,
“উপরে গিয়ে দেখো। রুমে আছে।”
আর কোনো জবাবের আশায় না থেকে দুতলায় ছুট লাগায় রক্তিম। নিজেদের রুমের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। মায়ের কোলে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো শুয়ে আছে দৃষ্টি।পাশেই বাবা ভাই বসে তার একের পর এক সুখের গল্প শুনে যাচ্ছে সন্তুষ্ট চিত্তে। নিমিষেই যেন রক্তিমের বুক থেকে ভারী ওজনের কিছু একটা সড়ে যায়। স্বস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে চলে যেতে নিলেই সাদেক সাহেব গম্ভীর স্বরে ডেকে ওঠে,
“চোরের মতো পালাচ্ছো কেন? ভিতরে আসো। কথা আছে।”
সহসা থমকে দাঁড়ায় রক্তিম। শশুরের মুখ থেকে চোরের মতো পালানোর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়। হতবাক হয়ে ভাবে, শেষ পযর্ন্ত কি না শশুর তাকে চোরের সাথে তুলনা দিল! দেশের গণ্যমান্য একজন এমপি সে। এটা কি শশুর ভুলে গেছে? না কি জানেনা সে যে বিপুল ভোটে এমপি পদে জয় লাভ করেছে! ভাবনায় দাঁড়ি টেনে অসন্তুষ্ট বদনে রুমের ভিতর পা বাড়ায় রক্তিম। ভার মুখে সালাম জানায় শশুর,শাশুড়িকে। সাদেক সাহেব শব্দ করে সালামের জবাব দিলেও দিলশান আরা মেকি রাগের ভাব নিয়ে বিমুখ হয়ে মনে মনে জবাব দেয়। শাশুড়ির দাম্ভিকতা দেখে রক্তিম কোণা চোখে দেখে নেয়। মনে মনে ভাবে,
“এমন আগুনের গোলার পেট থেকে তার বউয়ের মতো ঠান্ডা পানির কলস কিভাবে জন্ম নিলো!”
দৃষ্টি মা আর স্বামীর নিরব প্রতিদন্দ্বীতা দেখে অসহায় মুখে বাবার দিকে তাকায়। সাদেক সাহেব ইশারায় মেয়েকে আশ্বস্ত করে জামাইকে বসতে বলে।
“বসো।”
“এভাবেই ঠিক আছি। বলুন আপনি।”
ভার মুখে জবাব দেয় রক্তিম। সাদেক সাহেব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করেন,
“দেখো যা হয়েছে তা তো হয়েই গেছে। এখন এসব ধরে রেখে আর কোনো লাভ নেই। বরং ক্ষতি হবে আমাদের অনাগত নাতা-নাতনির। ছোট বাচ্চাটা পৃথিবীতে এসেই দেখবে তার নানার বাড়ির সাথে বাবার বাড়ির দন্দ। এটা আমরা চাইনা। তোমরা হয়তো ভাবছো আমি বা আমার স্ত্রী খুব কঠিন মনের মানুষ। তোমাদের প্রতি অনেক অন্যায় করেছি আমরা। কিন্তু একজন বাবা-মায়ের স্থান থেকে আমরা ঠিক ছিলাম। এটা হয়তো এখন বুঝতে পারবেনা। বাবা হচ্ছো তো। আল্লাহর রহমতে আমার নাতি বা নাতনি যায় হোক পৃথিবীতে আসুক। একটু একটু করে আদর যত্নে বড় হোক। তখন বুঝতে পারবে বাবা-মায়ের কাছে সন্তান কি রত্ন। আমরা বাবা-মায়েরা সন্তান নিয়ে কত স্বপ্ন দেখি। হাজারো স্বপ্ন দেখা সেই সন্তানই যখন সমস্ত স্বপ্ন ভঙ্গ করে দেয়, তখন কতটা কষ্ট লাগে তা একজন বাবা-মা ছাড়া কেউ বুঝতে পারবেনা। যায় হোক। সব মন থেকে বাদ দিয়ে মেয়ের মা হবার খবর শুনেই ছুটে এসেছি আমরা। পারলাম না রাগ ধরে রাখতে। চিন্তায় অস্থির হয়েছি,মেয়েটা এমন অবস্থায় কেমন আছে, কি করছে,শশুর বাড়িতে যত্ন কেমন পাচ্ছে। আমি যেমন নানা হবো তেমন তুমিও বাবা হবে। এতোদিন আমার মেয়েকে কিভাবে রেখেছো কতটা সুখে রেখেছো সেসবের হিসাব আমি চাইবনা। আমি শুধু এখন তোমার কাছে একটা জিনিসই চাইব। সেটা হলো,আমার মতো তুমিও একজন যোগ্য বাবা হবে। ছন্নছাড়া জীবন রেখে যেভাবে সংসারমুখি হয়েছো, আশা করি সেভাবেই বাবার দায়িত্বটাও যথাযথ পালন করবে। সন্তানের সবথেকে কাছের বন্ধু হবে।”
শশুর কথায় কতক্ষণ নিরব থেকে ক্ষীণ স্বরে জবাব দেয় রক্তিম,
“আপনাদের মেয়েকে কতটা সুখে রাখতে পেরেছি তা না হয় নিজেদের মেয়ের মুখ থেকেই শুনে নিবেন। আর আমার সন্তানের সবথেকে কাছের বন্ধু আমিই হব। শ্রেষ্ঠ বাবা হব আমি তার ইন শা আল্লাহ। আমার যে অপূর্ণতা গুলো ছিল তার সবটুকু পূর্ণতা আমার সন্তানকে দিব। আপনারা শুধু দোয়া করবেন আল্লাহ যেন সুস্থ্যভাবে আমার সন্তানকে এই পৃথিবীর আলো দেখায়।”
“আমার মেয়ের বেলায় আমি কাউকে ভরসা করিনা। এই সময় মেয়েদের মেন্টালি সাপোর্ট প্রয়োজন পরে অধিক। যত্নে রাখতে হয়। এখানে কে কতটুকু যত্ন করবে তা নিয়ে আমি দ্বিধায় আছি। আমি আমার মেয়েকে সাথে নিয়ে যাব। বাচ্চা হবার আগ পযর্ন্ত ও আমার সাথেই ময়মনসিংহ থাকবে।”
“কখনোই না। বাচ্চা হবার আগ পযর্ন্ত ও এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেনা। আমি আমার বাচ্চার বেড়ে উঠা কাছ থেকে দেখব। অনুভব করব দশ মাস ও কিভাবে একটু একটু করে বড় হয়। ওর প্রতিটা মুভমেন্ট খুব কাছ থেকে ফিল করার অধিকার আমার আছে। কারণ আমি ওর বাবা।”
রক্তিমের পাগলামিতে দৃষ্টি চোখ বড় বড় করে তাকায়। বাবা-মায়ের সামনে অকপটে কিভাবে এসব বলে দিল এই লোক! একটুও লজ্জা সরম নেই। নিজে নির্লজ্জ হয়ে দৃষ্টিকে লজ্জার সাগরে ডুবাচ্ছে। রক্তিমের সরাসরি নাকোচ করাই খ্যাপে যায় দিলশান আরা। শক্ত কন্ঠে বলে,
“আমিও ওর নানি। আমারও অধিকার আছে কাছ থেকে ওর বেড়ে ওঠা দেখা।”
“তাহলে আপনিই থেকে যাক আমাদের এখানে।”
নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দেয় রক্তিম। তার এহেন জবাবে চিরবিরিয়ে উঠে দিলশান আরা,
“আমি কেন তোমার বাড়িতে থাকব? তোমার যদি এতোই বাচ্চার বেড়ে উঠা দেখার শখ থাকে, তুমি আমার বাড়িতে গিয়ে থাকবে। আমি না।”
“একদম বেয়াদবের মতো তর্ক করবেনা। আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাব।”
“আচ্ছা! আমিও দেখি, কার দৌড় কতদূর।”
হেয়ালি স্বরে জবাব দিয়ে অলস ভঙ্গিতে রুম থেকে বেড়িয়ে যায় রক্তিম। মেয়ে জামাইয়ের সাথে তর্কে না পেরে মেয়ের দিকে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দিলশান আরা। ঝাঝালো স্বরে বলে,
“দেখেছো! দেখেছো তো কেমন বেয়াদব ছেলের জন্য আমাদের ছেড়ে এসেছো! গুন্ডা-মাস্তান আজীবন গুন্ডা-মাস্তানই থাকে। যে ছেলে শাশুড়িকে নূন্যতম সম্মান দিতে জানেনা সেই ছেলেকে আমি কিভাবে মেয়ের জামাই হিসেবে মানব?”
জামাই-শাশুড়ির যুদ্ধ দেখে বোকার মতো শুধু তাকিয়ে থাকে প্রত্যেকে। অসহায় দৃষ্টি মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ জানায়,
“ইয়া মাবুদ! এ কোন মসিবতে ফেললে আমায়? দুজনের যু’দ্ধে আমি কার পক্ষে যাব?”
জনম ত্যাড়া রক্তিমের কাছে অবশেষে দিলশান আরা’কে হার মেনে মেয়ের শশুর বাড়ির আপ্যয়নে সন্তুষ্ট হয়ে বিদায় নিতে হয় সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে। তবে ছেলের বিরুদ্ধে গিয়ে রেহানা বেগম কথা দিয়েছেন দিলশান আরা’কে কিছুদিন পর দৃষ্টিকে পাঠাবে তাদের কাছে থেকে আসার জন্য। সেই আশ্বাস নিয়েই মেয়ের ভরা সংসার, সুখ দেখে আরও সুখের অধিকারী হবার দোয়া দিয়ে বিদায় নেয় তারা। পারিবারিক ঝামেলার সমাপ্তি ঘটায় বহুদিন পর যেন প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে দৃষ্টি। চঞ্চলতা ফিরে আসে আবার তার মাঝে। মুখ থেকে যেন হাসি সড়ছেই না।
****
নিস্তব্ধ রাতের আকাশ জুড়ে তারার মেলা। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় থৈ থৈ করছে চারপাশ। দূর আকাশের ঐ রূপালী চাঁদটা মিটিমিটি হেসে বারান্দায় নিবিড় আলিঙ্গনে বসে থাকা দুজন সুখী মনব-মানবীর গায়ে লেপ্টে দিচ্ছে তার আলো। রক্তিম ঘোর লাগা চোখে অপলক দেখে যাচ্ছে তার অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে। যার সৌন্দর্য্য মনে হচ্ছে দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে। মা হবার সংবাদ শোনার পর থেকে মনে হয় সৌন্দর্য্য আরও দ্বিগুণ হয়েছে। এই যে,এই মুহুর্তে চাঁদের আলোয় স্নিগ্ধ মুখটা কেমন দ্যুতি ছড়াচ্ছে! অমোঘ মায়ায় বাঁধছে রক্তিমকে। ভালো লাগার আবেশে শিহরিত হয়ে রক্তিম আরও নিবিড়ভাবে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় দৃষ্টিকে। ফিসফিসিয়ে ডেকে ওঠে,
“দৃষ্টি!”
প্রণয় পুরুষের মুখে এই নিয়ে দুইবার নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনেছে দৃষ্টি। সামান্য এইটুকু বিষয়েই বেহায়া লজ্জা এসে ঝেকে ধরেছে তাকে। কেমন যেন নতুন নতুন লাগছে সব কিছু । সেই প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভূতি। এক ছাদের নিচে এতো গুলো দিন কাটানোর পর আজ মনে হচ্ছে তারা নব্য প্রেমের জোয়ারে গা ভাসিয়েছে। আনমনে দৃষ্টি অতীতের সেই মিষ্টি প্রেমের যন্ত্রণাময় দিন গুলোর বর্ণনা দিতে থাকে রক্তিমকে। চোখে এক রাশ মুগ্ধতা নিয়ে রক্তিম দেখে যায় তার মায়ার রাজ্যকে। নিরবে শুনে যায় দৃষ্টির আলাপন। মন বলে,তুমি বলে যাও। আমি দিবস-রজনী বিভোর হয়ে শুনে যাব তোমার আলাপন।
****
পরিশিষ্ট
হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে প্যারালাইজড মা’কে হুইলচেয়ারে বসিয়ে নিয়ে ডাক্তারের সিরিয়ালের অপেক্ষায় জেরিন। চোখে-মুখে তার বয়সের ছাপ, রাত জাগা ক্লান্তি। বিষন্নতায় ছেয়ে আছে সর্বাঙ্গ। যে অঙ্গের সৌন্দর্য্য ছিল এক সময় তার অহংকার, আজ ঝং ধরেছে সে অঙ্গে। যে রূপের আগুনে এক সময় ছাড়খাড় করেছিল দুই পুরুষকে,আজ সেই রূপ ঢাকা পরেছে চোখের নিচের কালো দাগে। দেশে ফেরার পর মামার বাড়িতে ঠাই না হওয়ায় দুদিন এক বান্ধবীর বাসায় থেকে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে জীবন যুদ্ধে হার মেনে চাকরি নিতে হয় একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। মাস জুড়ে হাড় ভাঙা খাটুনির পর যে টাকা গুলো হাতে আসতো তা দিয়ে মূল্য বৃদ্ধির বাজারে ঠিকঠাক তিন বেলা খাবারও জুটতোনা। সেখানে সামলাতে হয়েছে তাকে সংগ্রামের বিরুদ্ধে লড়া কেস, মায়ের চিকিৎসার খরচ, বাড়ি ভাড়া সমস্ত কিছু। নিজের সাথে নিজেই হেরে গিয়ে বারবার চেষ্টা করেছে আ ত্ম হ ত্যা র।কিন্তু পরোক্ষনে মনে হয়েছে সৌন্দর্যের অহংকার আর লোভের বশবর্তী হয়ে যে পাপ সে করেছে, সেই পাপের শাস্তিই তো দুনিয়ায়তেই শুরু হয়ে গেছে। আ ত্ম হ ত্যা র মতো পাপ কাজ আবার বেছে নিয়ে জাহান্নামের আগুনে অনন্তকাল কিভাবে পুড়বে সে!তার থেকে বরং দুনিয়াতেই কিছুটা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে যাক। যে অ মানু ষে র জন্য নিজের এই পরিণতি তার শাস্তিও দেখে যাক। জেরিন দেখেছে সংগ্রামের শাস্তি। উচ্চ আদালত তাকে দশ বছরের কারাদণ্ডে দন্ডিত করেছে। দূর থেকে সেই সংবাদ শুনেছে রক্তিমও। আড়ালে নিজ চোখে দেখেছে জেরিনের করুণ পরিণতি। স্বস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে হৃদয় শীতল করেছে বেঈমান গুলোর পরিণতি দেখে।
ওয়েটিং রুমের একপাশে মা’কে রেখে তাদের সিরিয়াল কখন আসবে জানার জন্য রিসিপশনের দিকে এগিয়ে যায় জেরিন। কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে রিসিপশনিস্ট মেয়েটাকে কিছু জিজ্ঞেস
করতে যাবে ওমনি দৃষ্টিগোচর হয় একটু দূরেই এক সুখী দম্পতি। থমকে যায় জেরিন সেখানেই। জমে যায় বরফের মতো। অতীতে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া রক্তিম শিকদার আজ কতটা সুখী!কি সুন্দর হাসি মুখে নিজের অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে আগলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। হয়তো ডাক্তার দেখাতে এসেছিল।এই সুন্দর চোখ শীতল করা দৃশ্যটাতো জেরিনের বেলাতেও হতে পারতো। দৃষ্টির জায়গায় থাকতে পারতো সেও। ভাগ্য ফেরে আজ সব হারালো। নিঃস করতে গিয়ে পরিপূর্ণতা দিল রক্তিমকে। নিজে ডুবে মরল দুঃখের সাগরে। নিজ কর্মে হারিয়ে ফেলা যক্ষের ধনটাকে আজ অন্য একটা মেয়ের সাথে এতো সুখী দেখে পুড়ে যাচ্ছে অন্তর। তবুও কিছুই করার নেই। পাপের বোঝা ভারী করতে চায়না আর। তাই পাপী নজরটা সড়িয়ে এনে বহু কষ্টে সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি জানায়,”হে খোদা! ভালো রেখো ওদের।”
শেষ রাতের নিঃশব্দতাকে চূর্ণ করে হাইওয়ে রোড ধরে স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে একটা ষোল সিটের মাইক্রো বাস।গাড়ির ভিতরে নিশাচর পাখির মতো চার জোড়া দম্পতি কিচিরমিচির করে ঘুরতে যাওয়ার আনন্দে মেতে উঠেছে। সবার মাঝেই টানটান উত্তেজনা।খুশিতে বুকের ভিতরটা অল্প অল্প কাঁপছে। তবে সবার থেকে ব্যতিক্রম শুধু দৃষ্টি। মুখের আদলে তার কোথাও একটু আনন্দের লেশমাত্র নেই। মনে হচ্ছে তাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে কোনো বন্দিশালায় পাঠানো হচ্ছে। এর পিছনে অবশ্য কারণও আছে।দুদিন আগে থেকেই রক্তিমের তাগিদে ট্যুরে যাবার গোছগাছ শুরু করে দৃষ্টি। এর মাঝে কতবার যে রক্তিমকে জিজ্ঞেস করেছে,তারা কোথায় যাচ্ছে, কবে যাচ্ছে?তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তবে রক্তিম বরাবরই “গেলেই দেখতে পাবে।আগেই এতো জানার কি আছে?”এই এক জবাবে দৃষ্টির উৎফুল্লতায় জল ঢেলে দিয়েছে। এমন এক জবাবে কৌতূহলী মন কি আর চুপ করে থাকে! রক্তিমের থেকে একই জবাব পাবে জানার পরও দৃষ্টি বারবার জানার চেষ্টা করেছে। তবে ফলাফল প্রতিবারের মতোই শূণ্য। আজ সন্ধ্যা মুহূর্তেও এই নিয়ে এক দন্ড বাকবিতন্ডতা চালিয়ে অভিমানে চুপচাপ শুয়ে পরে দৃষ্টি। রক্তিমও বউয়ের অভিমানী মুখটা দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যায়। দুঃখ বিলাস করতে গিয়ে কখন যে দৃষ্টির দুই চোখের পাতা এক হয়ে যায় বুঝতেই পারেনি। রাত বারোটা নাগাদ হঠাৎ রক্তিমের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে দৃষ্টির। কাঁচা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
“হয়েছে কি? এমন মাঝ রাতে ডাকাডাকি শুরু করেছেন কেন?”
দৃষ্টির মেকি রাগ আর বিরক্তি ভাব দেখে অল্প হাসে রক্তিম। হাসি মুখেই জানতে চায়,
“সমুদ্রের গান শুনবে?”
ভ্রু কুঁচকে নেয় দৃষ্টি। রক্তিমের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে পায়ের কাছে পরে থাকা চাদরটা গায়ে ভালো ভাবে জড়িয়ে নিতে নিতে বলে,
“সরকার বুঝি আপনার কাজে খুশি হয়ে বাড়ির সামনে একটা সমুদ্র উপহার দিয়েছে? এখন সেখানেই গান শুনতে যাবেন?”
“উঁহু। সাগর কন্যার দর্শনে গিয়ে খুব কাছ থেকে তার গান শুনব। হাতে সময় নেই। আধা ঘন্টার মাঝে পুরো রেডি হবে। ওঠে পরো, কুইক।”
রক্তিমের কথাতেই স্পষ্ট বোঝা যায় কিছুক্ষণের মাঝেই তারা রওনা দিবে এতোদিন পযর্ন্ত লুকিয়ে-চুরিয়ে প্ল্যান করা সেই কাঙ্ক্ষিত স্থানে। শোয়া থেকে ঝট করেই উঠে বসে দৃষ্টি। চোখ দুটোতে বিস্ময় নিয়ে বলে,
“ঘুম থেকে এভাবে হুট করে ডেকে তুলে কেউ বেড়াতে যাবার কথা বলে কাউকে? পূর্ব প্রস্তুতি বলেও তো কিছু থাকে!”
দৃষ্টিকে তাড়া দিয়ে রক্তিম গুছিয়ে রাখা লাগেজটা চেক করে দেখে নিচ্ছিল সব ঠিকঠাক আছে কি না। নিজের কাজে ব্যস্ত থেকেই রক্তিম জবাব দেয়,
“গত এক সপ্তাহ যাবৎ গোছগাছ করেও এখন বলছো পূর্ব প্রস্তুতি নেই!তোমরা মেয়েরা আসলেই জিনিয়াস।একদম বাধিয়ে রাখার মতো জিনিয়াস। কোথাও যাবার হলেই বোঝা যায় তোমাদের কাছে সময় কতটা মূল্যহীন।”
এমন ঠেসপূর্ণ কথায় দৃষ্টি কিছু বলতে যাবে,তার আগেই রক্তিম হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয় তাকে।
“যত অভিযোগ আর যত যা বলার সব ট্যুর থেকে এসে বলো। আমি সব নিরবে মাথা পেতে নিব। তবুও এখন আর অহেতুক কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করোনা। সবাই চলে আসবে এখনই।”
কিছু বলার আগেই মুখের উপর এমন নিষেধাজ্ঞায় কিছুটা থমথম খেয়ে বিরস মুখে উঠে যায় দৃষ্টি। চুপচাপ নিজের মতো করে রেডি হয়ে অপেক্ষায় থাকে সবাই আসার। দুজন রেডি হয়ে বসতে না বসতেই নিচ থেকে ভেসে আসে গাড়ির হর্ন। ঝটপট দৃষ্টি পা বাড়াই শাশুড়ি মায়ের রুমের দিকে। উদ্দেশ্য শাশুড়ির থেকে বিদায় নেওয়া। দৃষ্টি ভেবেছিল হয়তো রেহানা বেগম ঘুমিয়ে থাকবে। কিন্তু রুমের সামনে যেতেই দেখতে পায় রেহানা বেগম গাড়ির হর্ন শুনেই বেরিয়ে এসেছে নিজের রুম থেকে। সাথে আছে ইতি। ইতিকে এতো রাতে এ বাড়িতে দেখে যারপরনাই অবাক দৃষ্টি। কন্ঠে অঘাত বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,
“আপু! আপনি কখন এসেছেন?”
“যখন তুমি আমার ভাইয়ের সাথে রাগ করে গাল ফুলিয়ে ঘুমাচ্ছিলে তখন।”
হেসে ঠাট্টার স্বরে জবাব দেয় ইতি। শাশুড়ির সামনে এ নিয়ে আর কোনো কথা বাড়ায়না দৃষ্টি। রেহানা বেগম না থাকলে নির্ঘাত তার গুণধর ভাই কেমন ধাচের মানুষ তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতো দৃষ্টি। বুঝাতো ঠিক কেন তার ভাইয়ের সাথে রাগ করে গাল ফোলাতে হয়। শাশুড়ির উপস্থিতিতে সেটা সম্ভব না হওয়াই কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে দৃষ্টি,
“আপনি তাহলে সত্যিই যাবেন না আপু?”
“না ভাবি। মাইতা আর একটু বড় হোক, তখন আবার সবাই মিলে যাব।”
সেদিন সবাই মিলে ফ্যামিলি ট্যুরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেও সেখান থেকে বাদ পরে যায় ইতি। সে নিজেই সাত মাসের ছোট মেয়ের কথা ভেবেই যেতে নারাজ। এতো ছোট বাচ্চা যদি ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন আবহাওয়ায় অসুস্থ হয়ে পরে, তখন শশুর বাড়ির লোকজন তাকে কথা শুনাতে ভুলবেনা। তাছাড়া একটু আনন্দের জন্য ভোগতে হবে বাচ্চা মেয়েটাকে। বাচ্চার কথা ভেবেই ইতি যাচ্ছেনা। আর কাপলদের মাঝে মেহেদী একা যেতেও রাজি না। যে চার জোড়া দম্পতি যাচ্ছে তারা হলো, রক্তিম-দৃষ্টি, জাবির- নাবিলা, রাকিব-বর্ণা,শান্ত-ঐশী। তাদের সাথে ফাইয়াজ-স্মৃতিরও যাবার কথা উঠলেও তারাও যাচ্ছেনা তাদের বিচ্ছু ছেলে-মেয়ে দুটোর কথা ভেবে। বাচ্চা দুটোর স্কুল পরীক্ষা শুরু হয়েছে।
রাত তখন প্রায় দুইটা। পুরো এলাকা যখন ঘুমিয়ে,ঠিক তখনই শিকদার মঞ্জিলের সামনে থেকে বিশালাকৃতির বাইক্রো বাসটা বেরিয়ে যায় মূল গন্তব্যে। গাড়িতে উঠার পর কিছুক্ষণ দৃষ্টি চুপচাপ বসে থাকলেও গল্প রসিক তিন মেয়ে নাবিলা,ঐশী,বর্ণার সাথে পরে খুব বেশিক্ষণ মুখ ভাড় করে থাকতে পারেনি। বিভিন্ন হাসি-ঠাট্টা, কথা-গল্পে শেষ হয় লম্বা এক জার্নি। সকাল সাড়ে নয়টায় গাড়ি যখন কোয়াকাটা জিরো পয়েন্টে এসে থামে ঠিক তখনও দৃষ্টি জানেনা, তারা কোথায় ঘুরতে এসেছে। সেখানে দুই মিনিটের জন্য গাড়ি থামিয়ে রক্তিম কোথাও একটা গিয়ে আবারও ফিরে এসে ড্রাইভারকে নির্দেশনা দিয়ে এক টানে পৌঁছে যায় হোটেল খান প্যালেসে। সারা রাত জার্নি করার ফলে ক্লান্ত প্রত্যেকেই। সিরিপশনের ফর্মালিটিস পূরণ করে যে যার রুমের দিকে চলে যায়। রুমে ঢুকে দৃষ্টি কোনো দিকে না তাকিয়ে মাঝ বরাবর রাখা কিং সাইজ বিছানায় হাত-পা ছেড়ে শুয়ে পরে। তার এমন কান্ডে ভ্রু কুঁচকে নেয় রক্তিম। অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“সাত সাগর-তেরো নদী পাড়ি দিয়ে আসোনি নিশ্চয়ই! শরীরে ধুলোবালি নিয়ে এভাবে ব্যাঙের মতো মটকা মেরে শুয়ে না থেকে গোসলটা সেড়ে নাও। হালকা কিছু খেয়ে পরে ঘুম দিও। কেউ নিষেধ করবেনা।”
ঝগড়া করার মতো শরীরে বর্তমানে এক বিন্দু ক্যালোরি না থাকলেও ছ্যাৎ করে উঠে দৃষ্টি। তড়িৎ শোয়া থেকে উঠে বসে কটমট করে তাকায় রক্তিমের দিকে।কিছুটা উঁচু গলায় বলে,
“কি পেয়েছেন টা কি আমাকে? সবসময় কেন আমার পিছনে এভাবে লেগে থাকুন? অন্য সময় যা করেন, বেশি কিছু বলিনা। কিন্তু আজকে! সরাসরি আমাকে ব্যাঙের সাথে তুলনা করলেন! এভাবে অপমান করার জন্যই কি এতো পথ পাড়ি দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন?”
রক্তিম শান্ত গলায় বলে,
“ঝগড়া করার জন্য হলেও শরীরে শক্তির প্রয়োজন। না খেলে শরীরে শক্তি পাবেনা।সুতরাং ঝগড়া করতে হলে খেয়ে শক্তি বাড়াতে হবে, শক্তি বাড়াতে হলে খেতে হবে, আর খেতে হলে ফ্রেশ হতে হবে। আরও কিছু বলতে হবে?”
অসহ্য,অত্যাচারী-পাষাণ,বর্বর এই শিকদার দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।বছরে যদি একটা দিন দুটো ভালো ভালো কথা বলে, তো অন্য সব গুলো মাস এইরকম তিতা তিতা কথা বলে অসহ্য করে তুলে দৃষ্টিকে। এসব আর কত নেওয়া যায়! ধুপধাপ পা ফেলে রক্তিমের দিকে এগিয়ে আসে দৃষ্টি। হাত থেকে লাগেজটা ছিনিয়ে নিয়ে প্রয়োজনীয় কাপড় বের করে পূণরায় ঘুরে তাকায় রক্তিমের দিকে। রাগ রাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শাসায়,
দৃষ্টির অদ্ভূত শাসানো বাক্যে হু হা করে হেসে ওঠে রক্তিম। ফের কটমট চোখে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে দৃষ্টি।
একে একে সকলে গোসল সেড়ে হোটেল খান প্যালেসের ক্যান্টিন থেকেই নাস্তা করে পূণরায় সকলের বরাদ্ধকৃত রুমে গিয়ে শুয়ে পরে। দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে রাত জাগা লম্বা পথ পাড়ি দেওয়া শরীরের ক্লান্তি দূর করে। পুরো দুপুর একটানা ঘুমিয়ে বিকেলের দিকে ঘুম ভাঙ্গে দৃষ্টির। পাশে তাকিয়ে দেখতে পায় রক্তিম এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসে আশপাশ তাকিয়ে দেখতেই চোখ যায় রুমের এক পাশ পুরোটা থাই গ্লাসে ঘেরা। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে রুমের সাথে লাগোয়া সুন্দর এক বারান্দা। বিছানা থেকে নেমে পা বাড়ায় দৃষ্টি সেদিকে। কাচের দরজাটা হাত দিয়ে ঠেলে বারান্দায় পা রাখতেই বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়। অবাক নেত্রে শুধু তাকিয়ে দেখে যায় দু-চোখের আঙ্গিনায় ভেসে ওঠা সমুদ্রের ফেনীল ঢেউ। মাথার উপর দিগন্তজোড়া নীল আকাশ। সেই আকাশের নিচে অনিন্দ্য সুন্দর সমুদ্র সৈকত। এর থেকে সুন্দর, চোখ জোড়ানো দৃশ্য আর কি হতে পারে! দৃষ্টির এখনো স্পষ্ট মনে আছে, তার এসএসসি পরীক্ষার পর স্কুল থেকে তাদের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের কোয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল। দৃষ্টির খুব ইচ্ছে ছিল তাদের সাথে যাবার। কিন্তু বাবা-মা তখন মেয়েকে এতো দূর সমুদ্র দেখতে দেওয়ার জন্য একা ছাড়তে নারাজ ছিল। ঐ সময় কিশোরী দৃষ্টির বাবা-মায়ের প্রতি সে কি অভিমান! এরপর তো আবার বন্ধুরা যখন ট্যুর থেকে এসে এই অনিন্দ্য সুন্দর সাগর কন্যার রূপের বর্ণনা দিয়েছিল,তখন থেকেই দৃষ্টির আফসোসের অন্ত ছিলনা এখানে আসার জন্য। সেই ইচ্ছেটা যে এভাবে পূর্ণতা পাবে, কল্পনাতেও বোধহয় ভাবেনি দৃষ্টি। রক্তিম যে তাকে এতো বড় একটা সারপ্রাইজ দিবে এটা জানলে কি আর শুধু শুধু বেচারার সাথে ঝগড়া করতো! অবাক, বিস্ময়,ভালোলাগা আর রক্তিমের প্রতি ভালোবাসার খুশিতে আঁখিদ্বয় সজল হয় দৃষ্টির। বিস্তৃত হয় চিকন দুই ঠোঁটের কোণে মনোহরী হাসি। অশ্রুজলে সিক্ত হওয়া চোখ দুটোতে সীমাহীন মুগ্ধতা নিয়ে অবলোকন করে সাগর কন্যার রুপ।
“কি ম্যাডাম! এখনো কোনো অভিযোগ আছে আমার উপর?”
পিছন থেকে হঠাৎ চির পরিচিত কন্ঠ শুনে ঘুরে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় রক্তিম ঘুম জড়ানো চোখে অমায়িক হেসে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার দরজার মুখে। কাল বিলম্ব না করে ছুটে গিয়ে রক্তিমের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে।দৃষ্টির হঠাৎ আক্রমণে পিছিয়ে পিছিয়ে যায় রক্তিম। দেয়ালে হেলান দিয়ে নিজেকে সামলে বিস্তর হেসে জিনেও দুই হাতে ঝাপটে ধরে দৃষ্টিকে। ঠাট্টার স্বরে বলে,
“এবার অন্তত দয়া করে আমার নামে কোনো বউ নির্যাতনের কেস দিবেন না ম্যাডাম। জেলে গিয়ে সংসদীয় আসন হারাতে চাইনা আমি। বহু কষ্টে মানুষকে ভুলভাল আশ্বাস দিয়ে এই আসন জয় করেছি।”
লাজুক হেসে আরও নিবিড় ভাবে রক্তিমের বুকের সাথে মিশে যায় দৃষ্টি। মন্থর কন্ঠে উচ্চারণ করে,
“ভালোবাসি পাষাণ শিকদার।”
রক্তিম নিজেও হেসে শক্ত করে হাতের বাঁধন। মাথার এক পাশে ওষ্ঠ চেপে বলে,
মুহূর্তেই দৃষ্টির সুন্দর,শান্ত মেজাজটা ঘেটে যায়। বিরক্তি ভঙ্গিতে ভ্রু কুঁচকে নিজেকে রক্তিমের বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলে,
“অসহ্য অসহ্য অসহ্য।”
শব্দ করে হেসে ওঠে রক্তিম। দৃষ্টিকে কাছে টেনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
“ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।”
চলবে….
#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৪৬
#আদওয়া_ইবশার
গোধূলি লগ্ন। সাগরের তীর ঘেষে হাতে হাত ধরে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে দুজন নর-নারী। বিশাল সমুদ্রের জলরাশি হুটহাট এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তাদের পা। যতবার ঢেউ গুলো দোলনার মতো দোলে দোলে এসে দৃষ্টিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, ঠিক ততবার ভালো লাগার শিহরণে কেঁপে উঠছে দৃষ্টির শরীর। পরোক্ষণে আবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে আনন্দে। সমুদ্রের গর্জন সাথে প্রিয় নারীর হাসি, দুটো মিলেমিশে রক্তিমের কানে বাজছে অপার্থিব এক খুশির গান। গোধূলির আলোয় মুগ্ধ চোখে দেখে যাচ্ছে প্রিয়তমার মায়া,মায়া,প্রাণোচ্ছল কায়া। চোখের মুগ্ধতা,হৃদয়ের ভালো লাগার আবেশটুকু কন্ঠে ফুটিয়ে রক্তিম অস্ফুট স্বরে বলে,
“অন্য দিনের থেকে তোমাকে আজ অনেক স্নিগ্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে মায়াবতীর মুখের মায়া অনেকাংশে বেড়ে গেছে। আমাকে নতুন করে নিজের মায়ার জাদুতে ফাঁসানোর জন্য এখানে এসে নতুন কোনো পন্থা অবলম্বন করেছো না কি?”
সামনের দিকে বাড়ন্ত পা জোড়া সহসা থেমে যায় দৃষ্টির। গোধূলির রঙে রাঙা মুখটা আরও একটু রঙিন হয় লাজ রঙে। ঠোঁটের কোণে উঁকি দেয় লাজুক হাসি। দৃষ্টির লাজুক মুখের রূপ দেখে রক্তিম যেন আরও এক দফা চমকায়। ভালো লাগার শিরশিরে অনুভূতি ছেয়ে যায় হৃদ প্রাঙ্গন। আশেপাশে সূর্যাস্ত দেখার জন্য মানুষের পদচারনা বাড়ছে। দৃষ্টি লোক সমাগম থেকে চোখ ফিরিয়ে উত্তাল সমুদ্রের বুকে তাকাতেই দেখতে পায় জেলেদের বাড়ি ফেরার তাড়া। সেদিকে নজর রেখেই ঠোঁট চেপে হেসে বলে,
“হ্যাঁ। নতুন পন্থা তো অবলম্বন করছিই। এই যে, পাশে প্রিয় পুরুষ। গোধূলি আমার দেহে আবির ছড়াচ্ছে।সমুদ্র তরঙ্গ আমার হৃদয়ে আনন্দের বীণা বাজাচ্ছে। আকাশের নিচ দিয়ে উড়ে যাওয়া গাংচিলের দল ভালোবাসার গান শুনাচ্ছে। দমকা প্রেমের হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার সর্বত্র। এই সবই তো আমাকে নতুন রূপ দিয়েছে। ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধেছে মন-প্রাণ।”
মুচকি হাসে রক্তিম। একটু নির্জন জায়গা দেখে হাঁটার গতি থামিয়ে দেয়। দৃষ্টির পিছনে দাঁড়িয়ে আঙুল উঁচিয়ে ইশারা করে পশ্চিম আকাশের বুকে রক্তাব সূর্যের দিকে। যে আপাতত ব্যস্ত ধরণী কূলের মানুষদের ফাঁকি দিয়ে নীলাভ সমুদ্রের জলে গোধূলির আবির মিশিয়ে হারিয়ে যেতে। সময়ের গতিতে মনে হচ্ছে সূর্যটা যেন সুনীল আকাশের বুকে না,বরং তলিয়ে যাচ্ছে নীল সমুদ্রের জলের নিচে। জীবনের প্রথম খুব কাছ থেকে সূর্যাস্তের মতো অপার্থিব সৌন্দর্য দেখে বাকহারা হয় দৃষ্টি। অবাক-বিস্ময়ে আঁখি মেলে তাকিয়ে দেখে যায় অপরূপ দৃশ্যটুকু। ভালো লাগার আবেশে শরীর ছেড়ে মিশে যায় রক্তিমের বুক পাঁজরে। রক্তিম নিজেও যত্ন সহকারে আগলে নেয় তার হৃদমোহিনীকে। সূর্যাস্তের সাথে দুটো প্রেমিক যুগলের সুখপূর্ণ মুহূর্তটা দূরে দাঁড়িয়ে ফ্রেম বন্দি করে নেয় জাবির। আকাশের বুকে সূর্যটা যখন পুরোপুরি বিলীন হয়ে সমুদ্রে আবছায়া অন্ধকার নেমে আসে, ঠিক সেই মুহূর্তেও ঘোর কাটেনা দৃষ্টির। আগের মতোই অপলক আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে আবেগঘন স্বরে বলে,
“পাষাণ সাহেব! এই মুহূর্তে আমার কি করতে ইচ্ছে করছে জানেন?”
কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে জানতে চায় রক্তিম। রিনিরিন চাপা শব্দ তুলে একটু হাসে দৃষ্টি। মিটমিট হাসি ঠোঁটে ধরে রেখে প্রফুল্লচিত্তে জবাব দেয়,
” এই ইচ্ছেটা আমার আজকের ইচ্ছে না। বহুদিন ধরে যত্ন করে পোষে রেখেছি ইচ্ছেটাকে। কিন্তু এখন বলা যাবেনা, কারণ ইচ্ছেটা একটু বেহায়া টাইপ। বললে আমি শিওর, আপনি আমাকে চরম বেহায়া ভাববেন আর মনে মনে বলবেন,এতো অল্প বয়সে এই মেয়ে এতো পেকে গিয়েছিল!”
এক ইচ্ছের এতো বিশদ বর্ণনা শুনে রক্তিমের মন উদগ্রীব হয় সেটা জানার জন্য। তবে দৃষ্টি অনঢ়। কিছুতেই বলবেনা তার ইচ্ছের কথা। রক্তিমও কম যায়না। নাছোড়বান্দা যেভাবেই হোক বউয়েদের যত্ন করে পোষে রাখা ইচ্ছের কথা জানবেই। অবশেষে দৃষ্টি রক্তিমের জোরের কাছে হার মেনে বলে,
“আচ্ছা আচ্ছা বলব। আগে আমাকে একটু ছাড়ুন। অপেক্ষণ ধরে একভাবে থাকতে থাকতে শরীর ব্যাথা করছে।”
অসল ভঙ্গিতে হাতের বাঁধন ঢিলে করে রক্তিম। দৃষ্টি তার বহুল আরাধ্য পুরুষের সান্নিধ্য থেকে দূরে গিয়ে জানান দেয় সেই ইচ্ছের কথা,
“এসএসসি পরীক্ষার পর যখন স্কুল থেকে কুয়াকাটা ঘুরতে নিয়ে আসার সময় আমি আসতে পারিনি,তখন মনে মনে একটা অদ্ভূত আর বেহায়া ভাবনা ভেবেছিলাম।ভাবনাটা হলো, বিয়ের পর স্বামীকে নিয়েই প্রথম কুয়াকাটা আসব। তারপর এই সাগর কন্যার তীরে দাঁড়িয়ে স্বামীর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে সাগর কন্যাকে হিংসের আগুনে পুড়াবো।”
শেষের কথাটুকু লাজুক ভঙ্গিতে বলেই তাদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জাবিরদের দিকে ছুট লাগায় দৃষ্টি। এমন বাচ্চাসুলভ ইচ্ছের কথা শুনে ভড়কে যায় রক্তিম। অদ্ভূত নজরে দৃষ্টির যাবার পানে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়িয়ে হেসে ওঠে। বিরবির করে বলে,
“পাগল একটা।”
আলো আধারির সময় টুকু সাগর পাড়ে নিজেদের মতো ঘুরেফিরে কাটিয়ে সবাই মিলে একত্রিত হয়ে চলে যায় ফিশ ফ্রাই মার্কেটে। সেখান থেকে মেয়েদের পছন্দমতো সামুদ্রিক মাছ কিনে বারবিকিউ করে খেয়ে কতক্ষণ সময় কাটিয়ে চলে আসে রিসোর্টে। ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে আবারও বেরিয়ে পরে রাতের সমুদ্রের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে। আকাশের বুকে থালার মতো গোলাকার রুপালি চাঁদ। তাকে ঘিরে সহশ্র তারার মেলা। চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে সমুদ্রের জলরাশি। সন্ধ্যায় মানুষের যতটা ভীড় ছিল বর্তমানে তার আংশিকও নেই। টুকটাক যুগল আনমনে হেঁটে যাচ্ছে। কিছুটা দূরে এক ঝাক উচ্ছল তরুণ-তরুণী গিটার হাতে গানের আসর জমিয়েছে। হিম হিম বাতাসের সাথে ভেসে আসা গিটারের সুরে মন অন্যরকম এক ভালো লাগায় ছেয়ে যাচ্ছে। নিঃশব্দে মুহূর্তটাকে উপভোগ করে হাঁটতে হাঁটতে দৃষ্টির হঠাৎ মনে পরে অন্যদের কথা। থেমে গিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে জানতে চায়,
“ওরা কোথায়? হারিয়ে গেল না কি?”
“ওরা সবাই কাপল ঘুরতে এসেছে। সবারই একটু প্রাইভেসির প্রয়োজন। নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে ওরা। তাছাড়া ওরা কি বাচ্চা, যে হারিয়ে যাবে!”
নিরবে প্রশ্নটা শুনে হেয়ালি করে জবাব দিয়ে পূণরায় দৃষ্টির হাত টেনে হাঁটা ধরে রক্তিম। দৃষ্টি প্রসঙ্গ পাল্টে টুকটাক গল্প জোরে দেয়। গল্পে গল্পে কখন যে ঝাউবনের ভিতর চলে যায় খেয়ালই করেনি দৃষ্টি। হঠাৎ চোখের সামনে সব ঘুটঘুটে অন্ধকার উপলব্ধি করে অৎকে উঠে থেমে যায় দৃষ্টি। ভয়ে আকড়ে ধরে রক্তিমের বাহু। দৃষ্টির ভীতিগ্রস্থ মনোভাব বুঝতে পেরে আশ্বাস দেয় রক্তিম,
“এখানে কেমন অন্ধকার! কখন জঙ্গলে চলে এসেছি একটুও টের পেলাম না। চলুন ফিরে যায়। জঙ্গল থেকে যদি কোনো আগ্রাসী প্রাণী বেড়িয়ে আসে!”
“এটা নিরাপদ জায়গা। কোনো ভয়ংকর প্রাণী নেই। থাকলে কি তোমাকে নিয়ে আসতাম?”
তবুও মন মানেনা দৃষ্টির।কেমন যেন একটা ভয় কাজ করছে। ভূতুড়ে অন্ধকার পরিবেশ দেখে শরীর কাটা দিয়ে উঠছে। রক্তিমের কাছাকাছি আসতে আসতে একদম মিশে গেছে তার সাথে। তা দেখে নিম্নোষ্ঠে দাঁত কামড়ে হাসে রক্তিম। মিনিট দুই-এক পাড় হতেই হুট করে আলোকিত হয়ে উঠে চারপাশ।হঠাৎ আলোর ছটায়
অন্ধকার সয়ে যাওয়া দৃষ্টির চোখ ঝলসে যেতে চায়। পিটপিট পলক ঝাপটে পূর্ণ নজরে তাকাতেই ভিষণ ভাবে চমকায় দৃষ্টি। চোখের সামনে সব কিছুই ফকফকা। সামান্য কিছুটা জায়গা নিয়ে ঝাউগাছ গুলো বাহারি রঙের লাইটিং করা। সমুদ্র তীর ঘেষে ছোট্ট একটা টেবিল। তার উপরে নেট কাপড়ের ছাউনি দেওয়া। সেখান থেকেই টেবিলের মাঝ বরাবর ঝুলছে হারিকেলের মতো স্ট্রিং লাইট। টেবিলের চারপাশ লাভ সেইপ বেলুন আর নেট কাপড় দিয়ে ডেকোরেট করা। সাদা কাভারে ঢাকা টেবিলের উপর সুভা পাচ্ছে তরতাজা এক গুচ্ছ বেলি ফুল। পাশেই বেলি ফুলের ডিজাইন দিয়ে ডেকোরেট করা একটা কেক। হতবিল্বত নজরে চারপাশ দেখতে দেখতে এক সময় চোখ দুটো বিদ্ধ হয় রক্তিমের দিকে। যে আপাতত দৃষ্টিতে শীতল অনুভূতি লেপ্টে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ফাঁকা ঢোক গিলে দৃষ্টি কিছু বলতে যায়, তার আগেই রক্তিম বলে ওঠে,
” এক বছর আগের ঠিক আজকের এই দিনটাতে একটা হাঁটুর বয়সী মেয়েকে নিজের বিরোদ্ধে গিয়ে আমার কবুল বলে বউ করতে হয়েছিল। ধুরন্ধর সেই মেয়েটা সময়ের সাথে সাথে আমাকে এতোটাই মায়ার জাদুতে ফাঁসিয়েছে যে, সেই এক বছর আগের সহ্য করতে না পারা মেয়েটার মায়ায় আজ খুব বাজে ভাবে ফেঁসে গেছি আমি। উপলব্ধি করতে পেরেছি,সেই মেয়েটাকে ছাড়া আমি রক্তিম অর্থহীন। কারণ সেই মায়াবতীর মায়ার ছোঁয়াতেই আমি রক্তিম নতুন এক জীবন পেয়েছি। মাঝখানে হয়তো অনেক মূল্যবান সম্পদ বাবাকে হারিয়েছি। তবে সব শোক কাটিয়ে, ছন্নছাড়া জীবন বিসর্জন দিয়ে বাঁচতে শিখেছি। হাসতে শিখেছি, নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। সাথে আরও একটা জিনিস উপলব্ধি করতে পেরেছি, পৃথিবীতে সবথেকে কঠিন জিনিস হলো মায়া। যদি কেউ একবার কারো মায়ায় আটকে যায়,তবে আমৃত্যু সেই মায়ার জালে আটকে থাকে। একটু একটু করে সেই মায়া থেকে জন্ম নেই ভালোবাসার। যে আমি একটা সময় ভালোবেসে জঘণ্যভাবে ঠকে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর কখনো কাউকে ভালোবাসি বলবনা। সেই আমি এক মায়াবতীর মায়ায় পরে সেই মায়ার জালে তৈরী ভালোবাসায় ডুবে গিয়ে বাধ্য হয়েছি ভালোবাসি বলতে। দ্বিতীয়বার ভালোবেসে সর্বত্র হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া আমি আজ আত্মসমর্পণ করলাম আমার মায়াবতীর কাছে, আমার হৃদমোহিনীর কাছে, আমার মনোহরির কাছে, আমার হৃদয়ের উঠোন জুড়ে যে আছে তার কাছে। ভালোবাসি মায়ার রাণী। আমাকে আমার থেকেও বেশি ভালোবেসে আগলে রাখবে একটু? বার্ধক্যে তোমার কাধে মাথা রেখে যৌবনের রঙিন স্মৃতির পাতায় হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিবে আমাকে?”
ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয়। প্রবাদ বাক্যটা বোধহয় খাঁটি সত্য। না হয় আজ কি দৃষ্টির জীবনে এমন দিন আসতো! যার একটু ভালো কথার জন্য, একটু মনযোগ পাবার জন্য দিনের পর দিন মুখ বুঝে সহ্য করেছে হাজার কথার বাণ। যার মুখ থেকে ভালোবাসি,শব্দটা শোনায় ছিল এক প্রকার ধু ধু মরুপ্রান্তে জলের সন্ধান পাবার মতো, সেই মানুষটাই সময়ের ব্যবধানে আজ নিয়ে দুবার তার কাছে এতো বিশদ ভাবে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি দিয়েছে। কাছে টেনে নিয়েছে তাকে যত্ন করে। আগলে রেখেছে পবিত্র এক ফুলের মতোই। প্রতিটা মুহূর্তে নিরবে অনুভব করিয়ে যাচ্ছে ভালোবাসার গভীরতা। এই এতো এতো প্রাপ্তির পর আর কিছু চাওয়ার থাকে দৃষ্টির? মাত্র একটা বছরেই নিজের চাওয়ার থেকেও অধিক পেয়ে দৃষ্টি আজ অনুভূতির জোয়ারে পৃষ্ঠ হয়ে বাকহারা। তির তির করে কাঁপন তুলেছে বুকের ভিতরটা। অনেক কিছু বলতে চেয়েও পারছেনা একটা শব্দও উচ্চারণ করতে। রোধ হয়ে আছে কন্ঠস্বর। উত্তাল সমুদ্রের ফেনিল ঢেউয়ের মতোই হৃদয়ে শুরু হয়েছে খুশির জলোচ্ছাস। সেই জলোচ্ছাসের জলধারা কখন যে উপচে এসে দুই চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরেছে খুশির বহিঃপ্রকাশ জানাতে দৃষ্টি বুঝতেই পারেনি। বহু চেষ্টার পর কাঁপা স্বরে বলতে সক্ষম হয়,
“আপনি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন তো!”
জবাব দেয়না রক্তিম। মন্থর গতিতে এগিয়ে আসে দৃষ্টির সন্নিকটে। হেচকা টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আগে হাঁটুর বয়সী বউয়ের বাচ্চা কালের বেহায়া টাইপ ইচ্ছেটাকে পূর্ণতা দিয়ে নেই! পরে বলব, মিথ্যে ভালোবাসি না কি সত্যি।”
কথার সমাপ্তি টেনে দৃষ্টিকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওষ্ঠ যুগল বন্দি করে নেয়। উষ্ণ আবেশে বিবশ হয় দুটো হৃদয়। তৃষ্ণার্ত দুটো হৃদয়ের সন্ধিক্ষণে দূর আকাশের চাঁদ-তারা গুলোও মিটিমিটি হাসে। তরঙ্গায়িত সমুদ্র কন্যা হিংসের আগুনে না পুড়ে গান শোনায় তার কলকল শব্দে। সুখী দুটো মানুষের সুখের পরিণয় দেখে ঝাউবনে লুকিয়ে থাকা নাম না জানা কিছু পাখি মনের সুখে ডানা ঝাপটে উড়ে যায়। কিচিরমিচির সুর তুলে বহিঃপ্রকাশ ঘটায় আনন্দের।
হাতে গুণা চারজন মানুষের পদচারনায় সর্বদা নিশ্চুপ থাকা শিকদার মঞ্জিল আজ নতুন করে আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে। নাস্তার পর পরই স্মৃতি,ইতি ভাইয়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে ছুটে এসেছে। স্মৃতির দুই ছেলে-মেয়ে সামিরা-সাদি ইতির সাত মাসের ছোট্ট কন্যা মাইতা কে নিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে রেখেছে। ছোট ছোট তিন বাচ্চার মধুর কলরবে মুখরিত শিকদার বাড়ি। ড্রয়িং রুমে মেহেদী,শান্ত,জাবির, রাকিব,স্মৃতির স্বামী ফাইয়াজ,রক্তিমের সাথে বসে খুশগল্পে মেতেছে।রেহানা বেগম নাতি-নাতনিদের নিয়ে নিজের রুমে খেলতে ব্যস্ত।রান্না ঘরে ব্যস্ত দৃষ্টি। দুই ননদ হাতে হাতে সাহায্য করছে তাকে। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে তিন রমণী ড্রয়িং রুম থেকে হঠাৎ হঠাৎ উচ্চ হাসির শব্দ শুনে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে,কি নিয়ে এতো হাসাহাসি করছে তারা। দৃষ্টি দ্রুত হাতে কাজ করতে করতে রক্তিমের প্রতি বিরক্ত হয়ে বিরবির করে বকে যাচ্ছে,
“বেশরম লোক একটা। ছোট বোন জামাই গুলোর সাথে বসে আল্লাহ জানে কি নিয়ে এভাবে হাসাহাসি করছে। সে সম্মন্ধি,ছোট বোনের জামাই গুলোর সামনে তো সে একটু রাখঢাক রাখবে! এমনিতে বোম ফাটালেও মুখ থেকে হাসি বের হয় না। আর আজ! দিন দিন আক্কেল, জ্ঞান সব মনে হয় হাঁটুর নিচে যাচ্ছে।”
“ভাবি! আমার ভাইয়ের বোন জামাই হবার আগেই ওরা একে অপরের প্রাণের বন্ধু। বন্ধুত্বে কোনো বাধা,দ্বিধা থাকেনা। এটা কি ভুলে গেছো?”
কড়াইয়ে ভাজি করার জন্য একটা একটা মাছ ছাড়তে ছাড়তে দৃষ্টি কপাল কুঁচকে জবাব দেয়,
“মেহেদী ভাই না হয় তার বন্ধু, তাই তার সাথে এমন দাঁত কেলিয়ে হি হি হা হা করে হাসে। কিন্তু ফাইয়াজ ভাই! ওনি তো আর তার বন্ধু না। ওনার সামনে তো অন্তত একটু সম্পর্ক বিবেচনা করে কথাবার্তা বলবে না কি?”
এবার জবাবটা স্মৃতিই দিয়ে দেয়,
“ফাইয়াজ নিজেই তো লাগামছাড়া মানুষ। ভাইয়া ওর সামনে কথাবার্তা মেপে মেপে বললেও ও ঠিকই বেফাঁস কথা বলতে দ্বিধা করবেনা। এমন এমন কথা বলবে,না হাসিয়ে ছাড়বেনা। লজ্জা-শরম আমার ভাইয়ের ঠিকই আছে। কিন্তু আমার আহাম্মক জামাইয়ের নাই।”
ওদের কথার মাঝ পথেই হুট করে ইতির মেয়ে মাইতার গগণ ফাটানো চিৎকারে চমকে ওঠে সকলেই।হাতের কাজ ফেলেই দৌড় লাগায় কি হয়েছে দেখার জন্য। ড্রয়িং রুমে বসে থাকা ছেলেরাও ছুটে যায় তৎক্ষণাৎ। রেহানা বেগমের রুমে মেঝেতে বসে স্মৃতির ছেলে-মেয়ে দুটো একটা আরেকটার চুল ধরে টানছে। এইটুকু বাচ্চা দুটোর শক্তির কাছে রেহানা বেগম একদম পেরে উঠছেনা। কোনোভাবেই ছাড়াতে পারছেনা একজনকে আরেকজনের থেকে। উল্টো ছাড়াতে গেলেই দুটোই দাঁত খিঁচিয়ে অধিক বল প্রয়োগ করে আকড়ে ধরছে একজন আরেক জনের চুল। তা দেখেই বিছানায় খেলনা গাড়ি নিয়ে বসে থাকা মাইতা ভয় পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে। বাচ্চাদের এমন পরিস্থিতি দেখে ভড়কে যায় প্রত্যেকেই। মেহেদী ছুটে এসে নিজের মেয়েকে কোলে তুলে শান্ত করার জন্য বাইরে চলে যায়। ফাইয়াজ,রাকিব সামিরা-সাদিকে টেনে আলাদা করে। দৃষ্টি বড় বড় চোখ করে দরজার সামনে দাঁড়িয়েই বাচ্চা দুটোর রুষপূর্ণ মনোভাব দেখে যাচ্ছে। রাকিব সামিরাকে জোর করে কোলে নিতে গেলেই তার হাতে দাঁত বসিয়ে দেয় সামিরা। তৎক্ষণাৎ তীব্র ব্যাথায় কোঁকিয়ে উঠে সামিরাকে ছেড়ে দেয় রাকিব। তড়িৎ রুম থেকে ছুটে পালায় সামিরা। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় উপস্থিত প্রত্যেকে। হাত ঝারতে ঝারতে রাকিব চোখ-মুখ কুঁচকে বলে,
” এতোটুকু একটা বাচ্চা মেয়ের দাঁতের কি শক্তি রে ভাই! বিচ্ছুর দল!”
নিজের ছেলে-মেয়েকে নিয়ে এমন বাক্য শুনে কিছুটা থমথম খেয়ে যায় স্মৃতি। কটমট দৃষ্টিতে ফাইয়াজের দিকে তাকিয়ে রুষ্ট ভাবে বলে,
“শুধু তোমার জন্য আজ আমার বাচ্চা দুটোর এমন পরিণতি। ওদের আদরে আদরে এরকম বাঁদর বানানোর জন্য দায়ী একমাত্র তুমিই। এখন তো খুব আনন্দ লাগে বাচ্চাদের এরকম আচরণে। বড় হবার পরও যখন এমন করবে আর বাইরে থেকেও মানুষ ঘরে বিচার নিয়ে আসবে, তখন দেখব তোমার হাসি হাসি মুখ কোথায় যায়।”
বলেই হনহন পায়ে মেয়েকে খোঁজতে চলে যায় স্মৃতি। ইতি ছুটে গিয়ে বরফ এনে দেয় রাকিবের হাতে লাগানোর জন্য। দাঁত বসে যাওয়া জায়গা টুকু থেকে অল্প অল্প রক্তের ফোটা পরতে দেখে রক্তিম কিছুটা চিন্তিত স্বরে বলে,
“ডাক্তারের কাছে যা। রক্ত পরছে। ইনফেকশন হতে পারে।”
“আরেহ! কিছুই হবেনা।”
রাকিবের নিষেধ কেউ মান্য করেনা। বর্তমান সময়ে এমনিতেই রোগের অভাব নেই। ছোট্ট একটা আঘাতেও বড় ধরনের রোগ বেধে যায়। সব জানার পরও রিক্স নেওয়ার কোনো কথায় আসেনা। জোর করেই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় রক্তিম।এমনিতে ঘরে বাচ্চা থাকলে সবসময় একটা সুন্দর অনুভূতি কাজ করে। তাদের দুষ্টু দুষ্টু কান্ড দেখলে শত মন খারাপও ভালো হয়ে যায়।কিন্তু বাচ্চা গুলো যদি হয় একরোখা,জেদি আর ইতর প্রকৃতির, তবে অশান্তির শেষ থাকেনা। তাদের পিছনে দৌড়ে, তাদের সামলাতে গিয়ে ঘরের অন্যান্য সদস্যদেরও মাঝে মাঝে আঘাতপ্রাপ্ত হতে হয়। দৃষ্টির ছোট থেকেই বাচ্চাদের প্রতি অন্যরকম একটা টান কাজ করে। দুষ্টু বাচ্চাদের সাথে অনেক সময় সে নিজেও বাচ্চাদের মতোই দুষ্টুমিতে মেতেছে। কিন্তু অতিরিক্ত দুষ্টুমিপণা বাচ্চা গুলো দৃষ্টির অপছন্দের তালিকায়। বড় ননদের কিউট কিউট ছেলে-মেয়ে দুটোকে প্রথম প্রথম তার খুব ভালো লাগলেও, তাদের সাথে মিশতে গেলেও আস্তে আস্তে তাদের এসব বাঁদরামি দেখে এখন সে নিজেই দূরত্ব বজায় রেখে চলে। সামিরা, সাদি দুজনেরই অন্তত বাজে একটা স্বভাব হলো, কারো সাথে নিজেদের মতের মিল না হলেও তারা হুট করে তাদের কামড়ে দিয়ে দৌড় লাগাবে। মূলত এই স্বভাবটা জানার পর থেকেই দৃষ্টি তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের ঔদ্ধত্য দেখে মনে মনে বড় ননদকেও দোষারোপ করতে ভুলেনা। বাচ্চারা শিখে তো বড়দের থেকেই। তারা হয় কাঁদা মাটির মতো। বাবা-মা, আশেপাশের পরিবেশ তাদের যা শিখাবে তারা সেটাই শিখবে। স্মৃতি আপু কি একটুও ভদ্রতা শিখাতে পারেনা বাচ্চা দুটোকে?বয়স তো তাদের খুব কমও না। দুটোই ক্লাস টু তে পড়ছে। পিঠাপিঠি হওয়াই দুজনকে একই সাথে এক ক্লাসে ভর্তি করানো হয়েছে। এখনই তো সহবত শিখানোর সঠিক সময়। এই সময় চলে গেলে কি আর বাচ্চারা আচার-আচরণ পরিবর্তন করবে? অসন্তুষ্ট চিত্তে দৃষ্টি মাথা নেড়ে শাশুড়ির কাছে যায়। নম্র স্বরৈ জানতে চায়,
“আপনি কোনো ব্যাথা পাননি তো মা?”
নাতি-নাতনিকে সামলাতে গিয়ে ব্যাথা পেলেও কি আর পুত্রবধূর কাছে সেই কথা বলে নাতি-নাতনিদের বদনাম হতে দেওয়া যায়? তড়িৎ মাথা ঝাকিয়ে না জানায় রেহানা বেগম,
“আমি ঠিক আছি। তুমি যাও, কাজ গুলো গুছিয়ে নাও। দুপুর হয়ে আসছে। খেতে দিতে হবে তো ছেলে গুলোকে।”
উপর নিচ মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানিয়ে আড়চোখে একবার ফাইয়াজের কোলে থাকা সাদির দিকে তাকিয়ে রুম ত্যাগ করে দৃষ্টি। নিচে গিয়ে দেখতে পায় ইতি, মেহেদী দুজন মেয়ের কান্না থামিয়ে খেলছে মেয়ের সাথে। ছোট্ট মাইতাও কি সুন্দর বাবা-মায়ের কথার তালে দন্তহীন মাড়ি বের করে মন শীতল করা হাসি হাসছে!ছোট্ট,পবিত্র প্রাণের ঠোঁটে এমন পবিত্র হাসি দেখলে কারো মন খারাপ কি অবশিষ্ট থাকতে পারে? বাচ্চা মেয়েটার খিলখিল হাসির শব্দে দৃষ্টির ঠোঁটের কোণেও এক চিলতে হাসির রেখে দেখা দেয়। প্রফুল্লচিত্তে পা বাড়ায় রান্না ঘরের দিকে।
***
দুপুরের খাওয়া শেষে ছেলেদের সাথে মেয়েরাও ড্রয়িং রুমে আড্ডায় বসেছে। রক্তিম এই অর্ধদিনেই বহুবার দলীয় কাজে বাইরে যাওয়ার পাইতারা করলেও বোন,বন্ধুদের নিষেধাজ্ঞা আর বউয়ের শাণিত দৃষ্টির কাছে হার মেনে আজকের পুরো দিনটা সব কাজ-কর্ম একপাশে রেখে পরিবারের সাথেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। গল্পগুজবের এক ফাঁকে হঠাৎ রক্তিম বলে উঠে,
“ভাবছি কোথাও থেকে ঘুরে আসব। মেহেদী সব ঠিকঠাক করিস তো।”
আকস্মিক রক্তিমের এমন কথায় অত্যধিক আশ্চর্য হয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেয় প্রত্যেকে। ভূত দেখার মতো করে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের দিকে। উপস্থিত প্রত্যেকের এমন হতবাক দৃষ্টি তার দিকে পরতে দেখে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খায় রক্তিম। একটু নড়েচড়ে বসে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে জানতে চায়,
“হোয়াট?তোরা এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন আমার দিকে?”
গালে হাত রেখে রক্তিমের দিকে অপলক তাকিয়ে রাকিব জবাব দেয়,
“দেখছি আপনার পা দুটো উল্টো ঘুরে আছে কি না। না মানে, যদি আপনার পা উল্টো ঘুরে থাকে তাহলে ভেবে নিব এটা আপনি না, আপনার বেশ ধরে আসা কোনো এক জ্বিন। দাদুর মুখে শুনেছি জ্বিনদের পা না কি উল্টো হয়ে থাকে। আর যদি আপনার পা ঠিকঠাক থাকে, তবে ভেবে নিব জ্বরে আপনার মাথা গেছে পুরোপুরি।”
রাকিব কথা শেষ করতেই মেহেদী রক্তিমের পায়ের দিকে সন্দিহান নজরে তাকিয়ে কিছু একটা পরখ করে ভাবুক স্বরে বলে,
“পা তো একদম ঠিকঠাক। কোনো জ্বিন-টিন না রে রাকিব। এটা ঠিকই আমাদের রক্তিম। তোর দ্বিতীয় কথায় মনে হয় ঠিক। একদিনের জ্বরেই একেবারে মাথা গেছে।”
মেহেদীর কথার প্রেক্ষিতে ফাইয়াজ বলে উঠে,
“আরে ভাইরা সাহেব, বিয়ে করেও এখনো আসল কাহিনী বুঝেন নি না কি? বিয়ের আগে ছেলেরা যেমন-তেমক থাকুক না কেন। বিয়ের পর ঠিকই নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে অনেক কিছুই করতে হয় তাদের। এই যেমন আমাদের ভাইজানের ইচ্ছে করছে বউকে নিয়ে হানিমুনে যেতে। কিন্তু ভাইজান তো আবার সরাসরি হানিমুনের কথা বলতে পারেনা পরিবারের কাছে। তাই আর কি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আমাদের কাছেই বলছে।”
কথা শেষ হতেই এক সুরে হেসে উঠে প্রত্যেকেই। দৃষ্টিও হাসে আড়ালে মুখ লুকিয়ে। সবার এমন কান্ডে রক্তিম মহা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,
“ফ্যামিলি ট্রিপের কথা বলেছি আমি।”
মেহেদী টিপ্পনী কেটে জবাব দেয়,
“ঐ একই হলো। ফ্যামিলি ট্রিপের উছিলায় হানিমুনটাও সেড়ে ফেলা যাবে। কোনো টেনশন নিবেন না এমপি সাহেব।সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনি শুধু নিজের মহা মূল্যবান সময়ের থেকে হানিমুনের জন্য কিছুটা সময় বের করে নিন।”
কি বেহায়া এক একটা! ভাই-বোন, বন্ধু,বউ সব একসাথে বসে এ কেমন মজা শুরু করেছে? দৃষ্টি আগে ভাবতো,আর যায় হোক,মেহেদী অন্তত একটু লাজুক প্রকৃতির হবে। তাকে সবসময় যেভাবে ছোট বোনের মতো ট্রিট করে, সেই বোন সমতুল্য বন্ধুর বউকে নিয়ে সে অন্তত কোনোদিন ঠাট্টা-মশকরা করবেনা।কিন্তু আজ যে স্বরুপ দেখালো!নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ জপতে জপতে দৃষ্টি তড়িৎ উঠে যায় সবার মাঝ থেকে। আড় চোখে তাকিয়ে দৃষ্টিকে লজ্জারাঙা মুখে প্রস্থান করতে দেখে অস্পষ্ট হাসে রক্তিম।
বৃষ্টির বেগ কমার বদলে এখন পযর্ন্ত বেড়েই যাচ্ছে। পুরো শহর অন্ধকারে নিমজ্জিত। মোমবাতির অল্প আলোয় খাবার পর্ব চুকিয়ে ডাইনিং, রান্নাঘর সব গুছিয়ে রুমে এসেছে দৃষ্টি। রক্তিম অনেক আগে এসেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে নাক-মুখ ডেকে শুয়ে পরেছে। এইটুকু সময়ের মাঝেই জ্বরের কবলে শরীর উত্তপ্ত। পাতলা এক কাঁথায় শীত নিবারণ করা দুস্কর হয়ে পরেছে। রুমে দৃষ্টির আভাস পেয়ে আদেশ ছুড়ে দেয়,
“আলমারি থেকে পাতলা কম্বলটা বের করে দাও।”
হাতে চিরুনি নিয়ে সবেই চুল গুলো আচড়ে বিনুনি করতে নিয়েছিল দৃষ্টি। এর মাঝেই রক্তিমের আদেশ পেয়ে ভ্রু কাঁচকে নেয়। মুখের আদলে ফুটে ওঠে বিরক্তির রেশ।
“এখন কম্বল লাগে কেন? বীর পুরুষ না! বীরত্ব দেখিয়ে তো খুব চলে এসেছিল ভিজেপুড়ে। দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা কিভাবে আমাকে জ্বালিয়ে মারবে সেই ফন্দি। আল্লাহ মনে হয় আমার কপাল থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার রেখা মুছে দিছে।”
চাপা স্বরে বকতে বকতে কম্বল বের করে শীতে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা রক্তিমের গায়ে জড়িয়ে দেয় দৃষ্টি। বউয়ের শাসন পূর্ণ মনোভাবের কথায় চোখ বন্ধ রেখেই মিটি মিটি হাসে রক্তিম। এতোটুকু একটা বাচ্চা বউ!পরে থাকে সর্বদা রক্তিমের হাঁটুর নিচে।অথচ সাহস কত বেড়েছে দেখো! রক্তিমকে বকতে আসে!মুখে বিরক্তি প্রকাশ করলেও দৃষ্টির মন ঠিকই স্বামীর সামান্য জ্বরে চিন্তায় অস্থির। ভালো ভাবে গায়ের সাথে কাঁথা, কম্বল দুটোই জড়িয়ে দিয়ে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“জলপট্টি দিয়ে দিব।”
” এতোটাও গুরুতর হয়নি এখনো।”
চোখ বন্ধ রেখেই মিহি স্বরে জবাব দেয় রক্তিম। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দৃষ্টি হতাশ স্বরে বলে,
“মেডিসিন’ও নেননি। আগেভাগেই একটা নাপা বা প্যারাসিটামল খেয়ে নিলে ভালো হতো না।”
“জ্বরই তো এখনো আসেনি। বহুদিন পর বৃষ্টিতে ভিজায় একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। সকাল হতে হতেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এতো চিন্তার কিছুই হয়নি। শুয়ে পরো।”
বিরক্তি ভাবটা আবার এসে হানা দেয় দৃষ্টির মুখে। হাত বাড়িয়ে রক্তিমের কপাল ছুঁয়ে কোমল স্বরটা কিছুটা গম্ভীর করে বলে,
“কপালে যদি একটা চাল রেখে দেই ফুটে ভাত হয়ে যাবে। তবুও বলছে জ্বর নেই।থাকগে। আমার কি! বাচ্চা না কেউ। নিজের ভালো নিজে না বুঝলে আমারও এতো ঠেকা পরেনি শুধু শুধু চেঁচিয়ে গলা ব্যথা করার।”
মুহূর্তেই বন্ধ চোখের পাপড়ি খুলে দৃষ্টির দিকে তাকায় রক্তিম। ভাবুক সুরে বলে,
“দিন দিন পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করা টিপিক্যাল বউদের মতো হয়ে যাচ্ছো না! এমন খোঁচা মেরে কথা বলার স্টাইল কোথা থেকে রপ্ত করেছো? আমার বাড়িতে তো কেউ এভাবে খোঁচাখুঁচি করেনা!”
একেতো বিরক্তিতে মন-মেজাজ ঘেটে আছে, তার উপর আবার এমন গা জ্বালানো কথায় মুহূর্তেই তেতো ওঠে দৃষ্টি। মেজাজ দেখিয়ে বলে,
“পুরোনো হচ্ছি না! এখন তো সব কিছুই আমার বস্তির মেয়েদের মতো লাগবে।ভালো কথাও খোঁচা মারা কথা মনে হবে। আমিও বা পাগলের মতো কি বলছি! ভালো ছিলামই বা কবে? সেই শুরু থেকেই তো ঘাড়ের উপর মস্ত বড় এক বোঝা। সমস্ত বিরক্তির কারণ। যে সর্বদা বিরক্তির কারণ তার ভালো কথা,ভালো আচরণ সবই খারাপ মনে হবে। খুবই স্বাভাবিক।”
দৃষ্টির আচরণে অন্যদিনের মতো আজ কেন যেন রক্তিমের একটুও বিরক্তবোধ হচ্ছেনা। উল্টো কেমন যেন এক ভালো লাগা কাজ করছে। মনে হচ্ছে স্বাভাবিক কোনো দুষ্টু-মিষ্টি দম্পতির মতোই মধুর এক সম্পর্ক তাদের। অবশ্য দৃষ্টির দিক থেকে তো সেই প্রথম থেকেই সম্পর্কটা সুন্দর। শুধু রক্তিমই নিজের গম্ভীরর্যতার খোলস ছেড়ে বের হতে পারছিলনা। জৈবিক তাড়নায় অর্ধাঙ্গীকে কাছে টেনে নিলেও,তাকে ঘিরে মায়ার জাল তৈরী হলেও কেমন যেন সুতো ছেড়া ভাব ছিল। সেই ভাবনায় বোধহয় এবার পরিহার করার সময় এসেছে। মুহূর্ত এসেছে খুব কাছ থেকে দুটো মন একে অপরকে অনুভব করার। ঠোঁটের কোণে মিটি মিটি হাসি ধরে রেখেই আবারও চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় রক্তিম।জেগে ওঠে এতোদিন দমিয়ে রাখা ভিতরের দুষ্টু সত্তাটা। ফাজলামি স্বরে বলে,
“আমার কপালে একটা চাল রেখে ভাত ফোটানোর ভাবনা রেখে নিজের মাথায় এক হাড়ি চাল রেখে দাও। দেখবে ঘরের সবার এক বেলা খাবারের ভাত হয়ে যাবে। কিছুটা গ্যাস বিল’ও কমে যাবে।”
কথা শেষ করে অসল ভঙ্গিতে অর্ধ শোয়া হয়ে বসে আবারও রগর করে বলে ওঠে,
“এতো ঘন ঘন মুড সুয়িং হচ্ছে কেন তোমার বলো তো!কোনো খুশির খবর-টবর আছে না কি? না মানে, নাটক সিনেমায় তো এমনটাই দেখায়, বউরা প্রেগনেন্ট হলে এভাবে হুটহাট মুড সুয়িং হয় তাদের।”
হুট করে এমন একটা অপ্রত্যাশিত কথায় দৃষ্টি চমকায়। ভড়কে যাওয়া ভাবে চোখ দুটো বড় বড় করে অবাক নেত্রে তাকায় রক্তিমের দিকে। বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে অপলক তাকিয়েই থাকে চোখে-মুখে চাপা দুষ্টুমির আভাস নিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে থাকা রক্তিমের দিকে। পরিচিত মানুষটার একদম অপরিচিত আচরণে মুখের ভাষা হারায়। নিরেট মস্তিষ্কে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে যায় অতি পরিচিত চির গম্ভীর স্বভাবের মানুষটার বদলে যাওয়া রূপ। অবচেতন মন ভেবে পায়না,এটা কি তার স্বপ্ন না বাস্তব! সকালেও তো মানুষটা তার চিরায়ত স্বভাব অনুযায়ী গম্ভীরর্যতার খোলসে আবৃত ছিল। হঠাৎ এই আমুল পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব! উঁহু, এটা সত্য হতে পারেনা। এ নিশ্চয়ই দৃষ্টির দেখার ভুল, শোনার ভুল। দৃষ্টিকে এমন বিহ্বল হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসে রক্তিম। ফিচেল স্বরে ভ্রু নাচিয়ে আবারও বলে ওঠে,
” এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? রাত কয়টা বাজে খেয়াল আছে? ঘুমাতে আসো।”
পাল্টা কোনো জবাব দিতে পারেনা দৃষ্টি। পিছন ঘুরে ফাঁকা মস্তিষ্কে এগিয়ে যায় ড্রেসিং টেবিলের কাছে। সম্পূর্ণ চুলে বিনুনি করে শেষ প্রান্ত বাঁধার জন্য রাবার ব্যান্ড নিতে গিয়ে আবিষ্কার করে টেবিলের এক পাশে ছোট্ট এক প্যাকেট পরে আছে। যার পুরোটা ভিজে নাজেহাল অবস্থা। ভাবুক নয়নে সেদিকে তাকিয়ে চুল বেঁধে হাতে তুলে নেয় প্যাকেটটা। ভাবে, এখানে তো বৃষ্টির ছটা আসার কথা না। তবে এটা ভিজল কিভাবে? আর এটা রাখলোই বা কে? সে তো কিছু কিনে আনেনি।সমস্ত ভাবনা চিন্তা একপাশে রেখে প্যাকেট খুলে ভিতরের জিনিসটা বের করতেই আরও এক দফা চমকায় দৃষ্টি। বিমূড় হয়ে তাকিয়ে থাকে প্যাকেট থেকে বেরিয়ে আসা তাজা বেলি ফুলের মালার দিকে। অত্যধিক বিস্ময়ে পূণরায় মায়াবী চোখ দুটো বৃহদাকৃতি ধারণ করে। অল্প অল্প করে ঠোঁটের কোণে উঁকি দেয় মুক্ত ঝরা হাসি। অপ্রত্যাশিত এই ক্ষুদ্র অথচ অতিশয় সুখ সুখ অনুভূতির জোগান দেওয়া উপহারে হুট করেই যেন দমকা হাওয়া এসে ছুঁয়ে দেয় মন জমিন। ভালো লাগার আবেশে ছেয়ে যায় অন্তঃকোণ। ঠোঁটে প্রাপ্তির হাসি ধরে রেখেই দৃষ্টি ঘুরে তাকায় রক্তিমের দিকে। মনের আনন্দ টুকু বহুকষ্টে দমিয়ে রেখে বারান্দার দরজার কাছে এগিয়ে যায়। ঘুট্ঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত আকাশ পানে তাকিয়ে মিছেমিছি কিছু একটা খোঁজার প্রয়াস চালায়। সেদিকে তাকিয়ে রক্তিম ভ্রু দ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে জানতে চায়,
“এই অন্ধকারে ঐদিকে কি দেখো?”
“দেখছি আর বোঝার চেষ্টা করছি চাঁদ আজকে কোন দিক দিয়ে উঠেছে।”
ঠোঁট কামড়ে হাসি সংবরণ করে ভাবুক স্বরে জবাব দেয় দৃষ্টি। এমন জবাবে হালকা কুঁচকে রাখা ভ্রু দ্বয় এবার বাজে ভাবে কুঁচকে নেয় রক্তিম। কিছু বলতে উদ্যত হয়,ঠিক তখনই দেখতে পায় দৃষ্টির হাতে থাকা বেলি ফুলের মালাটা। সাথে সাথে জ্বিভের ডগায় থাকা কথাটা হজম করে নেয়। চোরা হেসে জবাব দেয়,
“চাঁদের অস্তিত্ব আজ মেঘের আড়ালে ডেকে গেছে দেখতে পাচ্ছোনা। তাছাড়া প্রতিদিন যেদিক দিয়ে উঠে আজকেও তো সেদিকেই উঠবে।”
তড়িৎ ছুটে এসে রক্তিমের পাশে বসে পরে দৃষ্টি। উৎফুল্ল হেসে বলে ওঠে,
“এমনটা হলে তো আপনার স্বভাবের এতো পরিবর্তন হবার কথা না। চাঁদ যদি তার নিয়ম অনুযায়ী একই দিক থেকে উদিত হয়, তবে আপনি কিভাবে নিজের স্বরূপ পরিবর্তন করলেন?”
দৃষ্টির এমন প্রশ্নে রক্তিম নিজেও হেসে ওঠে। জবাব দেয়,
“চাঁদ একটি উপগ্রহ, আর আমি হলাম সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষের সাথে চাঁদের তুলনা চলে না কি! মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল। কিন্তু গ্রহ,উপগ্রহ তো তাদের নিয়মের বাইরে চলবেনা।”
“তাহলে কবি-সাহিত্যিক বা প্রেমিকরা তাদের ব্যক্তিগত নারীদের চাঁদের সাথে তুলনা করে কেন?”
অপ্রসন্ন ভঙ্গিতে জানতে চায় দৃষ্টি। রক্তিম আবারও হাসে। যা দেখে দৃষ্টি অপ্রসন্নতা ভুলে ফের চমকায়। হলো কি আজকে পাষাণটার? কারণে অকারণে এমন হাসছে কেন? বিষয়টা একদম হজম হচ্ছেনা দৃষ্টির। কেমন যেন খটকা লাগছে। সন্দিঘ্ন নজরে তাকিয়ে যেই এই ব্যাপারে প্রশ্ন করতে যাবে ওমনি রক্তিম প্রফুল্লচিত্তে প্রত্যুত্তর করে দৃষ্টির প্রশ্নের,
“সেটা তো একটা উপমা মাত্র।পুরুষেরা তার ব্যক্তিগত নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় চাঁদের সাথে তুলনা করে। কিন্তু আমার কি মনে হয় জানো! ব্যক্তিগত নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ঐসব চাঁদ তারার সাথে তুলনা করে পুরুষ নিজেদের নির্বোধ পরিচয় দেয়। প্রকৃত পক্ষে বোধজ্ঞান সম্পন্ন পুরুষ কখনো ঐসব অযাচিত ভাবনা ভাবতে পারেনা। কারণ কারো সৌন্দর্য কখনো অন্য কারো সাথে তুলনা করা যায়না। আল্লাহ তার প্রতিটা সৃষ্টিকে নিজ নিজ জায়গা থেকে ভিন্ন ভিন্ন সৌন্দর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছে। তোমার মাঝে যেটুকু সৌন্দর্য আল্লাহ দান করেছে তা কি ঐ চাঁদকে দিয়েছে? অথবা ঐ চাঁদের মাঝে যেটুকু সৌন্দর্য আছে সেটুকু তোমার মাঝে নেই। সত্যিকার অর্থে তো চাঁদের কোনো আলোয় নেই। সূর্য তাকে যেটুকু আলো ধার দেয় সেটুকুতেই সে নিজেকে সুন্দর হিসেবে প্রকাশ করে। তার মাঝে ধারকৃত ঐ আলোটুকু না থাকলে তো আমরা তাকে মস্ত বড় আকাশের বুকে খোঁজেই পেতাম না। তবে কেন শুধু শুধু আমি আমার ব্যক্তিগত নারীর সৌন্দর্য ঐ পরনির্ভরশীল চাঁদের সাথে তুলনা করব?যে আমার ভুবনোহিনী, তার সাথে অন্য কারো তুলনা হবে কিভাবে? আমার ব্যক্তিগত নারীর মাঝে আমি যেটুকু সৌন্দর্য খোঁজে পেয়েছি,সেটুকু অন্য কোনো মানব,প্রাণী বা বস্তুর মাঝে খোঁজে পাইনি দেখেই শুধু তাকে দেখেই আমার চোখ মুগ্ধ হয়। মনে প্রশান্তি বয়ে যায়। নশ্বর পৃথিবীটাকে মনে হয় এক স্বর্গরাজ্য। তার সাথে অন্য কিছুর তুলনা করে আমি তাকে কখনো ছোট করবনা।”
মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিকে তাকিয়ে থেকে রক্তিমের প্রতিটা কথা শুনে যায় দৃষ্টি।শেষোক্ত কথা গুলো তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে কি না, সেটা বুঝতে না পারলেও কেমন যেন এক শিরশিরে অনুভূতি বয়ে শরীর জুড়ে। এক মুঠো লজ্জা এসে রাঙিয়ে দেয় মুখাবয়ব। পলকেই প্রিয় পুরুষের জন্য মনে নতুন উদ্যমে ভালোবাসার জন্ম নেয়। আড় চোখে চেয়ে দেখতে পায় রক্তিম নিবিড় নয়নে অপলকে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। যে দৃষ্টির কবলে পরে হঠাৎ করেই মুচড়ে ওঠে বুকের ভিতর। অজানা এক ভয়ংকর শিহরণে হৃৎপিন্ড ধুকপুক শব্দ তুলে। অসহনীয় সুখ সুখ অনুভূতির পীড়ায় পৃষ্ঠ হয়ে তড়িৎ উঠে যায় দৃষ্টি। পিছন ঘুরে বুকে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে হৃৎপিন্ডের অবাধ গতিবিধি। বড় বড় দুটো নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালিয়ে নিভু নিভু জ্বলা মোমবাতিটা নিভিয়ে ক্রস্থ পায়ে পূণরায় বিছানায় এসে শোয়ার জন্য বালিশ ঠিক করতে করতে ব্যাঙ্গ করে বলে,
“পুরো দুনিয়ায় একমাত্র আপনিই বোধজ্ঞান সম্পন্ন পুরুষ। আর বাকী সবাই নির্বোধ।”
নিজের মতো করে জবাব দিয়েই অশান্ত মনে পাশ ফিরে শুয়ে পরে দৃষ্টি। তার ছটফটানি অনুভূতির দোদুল্যতা বুঝতে পেরে মাথা ঝুঁকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে রক্তিম। পরপর মাথা তুলে এক নজর দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তার দিকে ঝুঁকে শ্লথ কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আমি কি সরাসরি বলেছি আমি বাদে বাকী সব পুরুষ নির্বোধ? তোমরা নারীরা যে এক অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছো,তা কি জানো? স্ত্রীর সৌন্দর্যের কাছে পরাজিত হয়ে পৃথিবীর সকল পুরুষ কোনো না কোনো এক সময় নির্বোধে পরিণত হয়। ঠিক সেই সময়টাতেই পুরুষ বোধ-জ্ঞান শক্তি হারিয়ে স্ত্রীর সৌন্দর্যের তুলনা করে অন্য কিছুর সাথে। যেমনটা এই মুহূর্তে আমার করতে ইচ্ছে করছে।”
রুদ্ধশ্বাসে দৃষ্টি দাঁতে দাঁত চেপে শুয়ে থাকে সেভাবেই। বহুল আরাধ্য পুরুষের মুখ থেকে যে স্বীকারোক্তি শোনার আশায় এতোদিন তৃষ্ণার্ত ছিল শ্রবণেন্দ্রিয়, আজ সেই পুরুষের থেকে এতোটুকু শুনেই বেসামাল মন নিজের সাথে বিদ্রোহ শুরু করেছে। বাকীটা শোনার পর না জানি তার সুখের মরন হয়! দৃষ্টি শুনতে চায়না আর কোনো স্বীকারোক্তি। পাষাণ পুরুষের প্রগাঢ় অনুভূতি সহ্য করার মতো আর এক বিন্দু শক্তি অবশিষ্ট নেই তার মাঝে। দৃষ্টির এমন নাজুক অবস্থা দেখে যেন রক্তিম আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে নিজের অনুভূতির জানান দিতে। প্রণয়ানুভূতির ভার যেন আজ হৃদয়ে নতুন করে চাপ দৃষ্টি করেছে। যে চাপ সড়াতে না পারলে শ্বাসরোধ হয়ে মারা পরবে সে। দৃষ্টিকে এক টানে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে গালে গাল ঘষে নিবিড় আলিঙ্গনে মিশে গিয়ে আবারও বলতে শুরু করে,
“যে আমার অন্ধকার পৃথিবীর মাঝে এক টুকরো আলো হয়ে জীবনে এসেছে, ঘুচিয়ে দিয়েছে জীবন থেকে সমস্ত অন্ধকার। যার ছোঁয়ায় জীবন্ত লাশে পরিণত হওয়া আমার মাঝে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে,যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া হৃদয়ে প্রশান্তির বর্ষণ নেমেছে, তাকে আজ এক গুচ্ছ শুভ্র বেলি ফুলের সাথে তুলনা করে নিজেকে নির্বোধ হিসেবে পরিচয় দিতেও কোনো দ্বিধা নেই আমার। ভালোবাসি শুভ্র ফুল। আমার নিজের কাছেই নিজেকে পরাজিত হতে বাধ্য করেছো তুমি। মায়ার বাঁধনে বেঁধে সেই বাঁধনটাকে ছিন্ন করে নবউদ্যমে ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধেছো আমাকে। অপ্রিয় থেকে প্রিয় হওয়া ব্যক্তিগত ফুল, শুনে রাখো আজ তুমি,এই পাষাণ হৃদয়ের পুরুষ তোমার সান্নিধ্যে নতুন করে ভালোবাসতে শিখেছে। শক্ত,পাথুরে হৃদয়ে ভালোবাসার ফুল ফুটেছে। এবার সেই ফুলটাকে সতেজ রাখার দায়িত্ব তোমার। যতদিন নিঃশ্বাস চলে, ততদিন যেন ঝরে না পরে এই ফুল।”
চলবে….
#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৪৩
#আদওয়া_ইবশার
সারা রাতের ঘন বর্ষণ শেষে সূচনা হয়েছে স্নিগ্ধ এক ভোরের।গাছের পাতা থেকে এখনো বৃষ্টির মতো টুপটাপ পানি ঝরে পরছে। সবুজ ঘাসের ডগায় লেপ্টে আছে সেগুলো শিশির বিন্দুর মতো। প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপিয়ে দিচ্ছে শরীর। তবুও ইচ্ছে জাগছে খালি পায়ে ভেজা ঘাসের গালিচা মারিয়ে হেঁটে যেতে বহুদূর। দীর্ঘ প্রশ্বাসের সাথে গ্রহণ করতে ভেজা মাটির পাগল করা সোঁদা গন্ধ। যে গন্ধে নাম না জানা এক ভালো লাগার আবেশে ছেয়ে যায় মন। ইচ্ছে করে বারবার প্রলম্বিত প্রশ্বাসের সাথে সবটুকু ঘ্রাণ শুষে নিতে। গায়ের পাতলা চাদরটা আরও একটু শরীরের সাথে মিশিয়ে নিয়ে কাঁদা মাটিতে খালি পায়ের ছাপ ফেলে দৃষ্টি এগিয়ে যায় শিকদার মঞ্জিলের পিছনের দিকে। চোখ জুড়ে তার নিদারূণ মুগ্ধতা। ঠোঁটের কোণে প্রাপ্তির এক নির্মল হাসি। প্রকৃতির লিলুয়া বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে মনের মাঝেও বয়ে যাচ্ছে এক অদম্য খুশির শিরশিরে মাতাল হাওয়া। বর্ষণমুখর রাত শেষ হলেও শেষ হয়নি এখনো সে রাতের রেশ।অদৃশ্যভাবে এখনো কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে হৃদয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করা রক্তিমের প্রতিটা প্রেমময় বাক্য।সেই বাক্য গুলোতেই বিবশ এখনো সর্ব সত্তা। সে কি এক ঘোরলাগা মুহুর্ত!ভালো লাগার,ভালোবাসার এক বর্ষণের রাত!যে রাতের প্রতিটা মুহূর্ত মানসপটে ভেসে উঠতেই পুলকিত হচ্ছে অন্তঃকোণ। ভাবনার অতলে ডুবে থাকা দৃষ্টির ঘোর কাটে হঠাৎ কাকলির মায়ের ডাক কর্ণগোচর হওয়ায়। পেছন থেকে কিছুটা উত্তেজিত স্বরে চেঁচিয়ে ডেকে যাচ্ছে,
“ও ভাবি! ভাইজান বমি করতাছে। তাড়াতাড়ি আসেন।”
মুহূর্ত পল স্থির থেকে কথাটা শুনেই ঘরের দিকে ছুট লাগায় দৃষ্টি। মধুর স্মৃতিচারণের সাথে স্নিগ্ধ সকালটাকে উপভোগ করতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিল রক্তিমের কথা। রাতে রক্তিম মুখে অস্বীকার গেলেও দৃষ্টি ঠিক তার গায়ের উষ্ণতায় জ্বরের পরিমাপটা বুঝতে পেরেছিল।কিন্তু মন পুরুষের উষ্ণ আলিঙ্গন আর বশীভুত করা মন্ত্রের ন্যায় এক একটা বাক্যে হারিয়ে ফেলেছিল নিজের বোধ শক্তি। রক্তিমের সাথে নিজেও জাগতিক সমস্ত কিছু ভুলে পাড়ি জমিয়েছিল ভালো লাগার ভিন্ন এক রাজ্যে।একদম ভুলে গিয়েছিল রক্তিমের শারীরিক অবস্থার কথা। যে পুরুষটা তার প্রাণ, সেই পুরুষটার প্রতিই কিভাবে বেখেয়ালি হয়ে গিয়েছিল সে?ভাবতেই এখন নিজের প্রতি নিজেরই প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে।দায়িত্ব জ্ঞানহীন মনে হচ্ছে তার নিজেকেই।কর্দমাক্ত পায়ে নিজেদের রুমে ঢুকেই কাকলির মায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ওয়াশরুমে ছুটে যায় দৃষ্টি। ক্লান্ত ভঙ্গিতে রক্তিম সিন্কের সামনে পানির ট্যাব ছেড়ে ঝুঁকে কুলকুচি করছে। ছেলেকে পেছন থেকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে রেহানা বেগম।কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে অপরাধি মুখ করে দৃষ্টি বলে,
“কষ্ট হচ্ছে বেশি?”
পানির ট্যাব বন্ধ করে দৃষ্টির দিকে ঘুরে তাকায় রক্তিম। শরীরটা কেমন দূর্বল হয়ে আসছে! মনে হচ্ছে এখনই বুঝি ব্যালেন্স হারিয়ে পরে যাবে। দূর্বল স্বরে দৃষ্টিকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রেহানা বেগম পুত্রবধূকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন,
“রাতে ওকে ঔষধ দাওনি? আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম না,ওর জ্বর খুব খারাপ! অন্য কোনো অসুখ কাবু করতে না পারলেও এই জ্বর একদিনেই কাবু করে ফেলে। জন্মের পর থেকে যতবার জ্বর এলো প্রতিবার এভাবে বমি-টমি করে একাকার করেছে। দশ-পনেরো দিন না ভোগে কখনও সুস্থ্য হয়না।”
দৃষ্টি শাশুড়িকে কি জবাব দিবে এখন? বলবে যে তার গুনধর পুত্র জনম ত্যারা পন্ডিতি করে ঔষধ খায়নি,উল্টো মাছি তাড়ানোর মতো করে জ্বরটাকে উপেক্ষা করে প্রেমকথনে ব্যস্ত ছিল! না কি এটা বলবে,শরীরের দিকে নিজেও পাত্তা দেয়নি, সাথে দৃষ্টিকেও ভুলিয়ে-ভালিয়ে চিন্তাধারা ঘুরিয়ে রেখেছিল অন্য দিকে! রক্তিমের ক্লান্ত মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে নিরবে সবটা দোষ নিজের ঘাড়ে তুলে নেয় দৃষ্টি। মিনমিনে স্বরে শাশুড়িকে জানায়,
“আমার ভুল হয়ে গেছে মা। আসলে আমি বুঝতে পারিনি এক রাতেই এতোটা নাজুক হয়ে যাবে। ভেবেছিলাম সকালে জ্বর না সাড়লে তখন একটা টেবলেট খাইয়ে দিব।”
বলাবাহুল্য দৃষ্টির প্রতি রেহানা বেগমের অল্পস্বল্প অভিমান সৃষ্টি হয়েছে। এতোদিনের দেখে আসা সংসারের প্রতি দৃষ্টির দায়িত্ব পালনের পরিধি দেখে ভেবেছিল ছেলের সামান্য অসুখেও সে যথেষ্ট যত্নশীল হবে। সেই ভাবনাতেই রাত থেকে নিজেও আর ছেলের ঘরমুখো হয়নি। কিন্তু সকাল হতেই ছেলের এমন বেহাল দশা দেখে না চাইতেও দৃষ্টির প্রতি চাপা একটা রাগের আভাস পাচ্ছে নিজের মাঝে। তবুও আর কোনো প্রত্যুত্তর করেনি। মায়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে রক্তিম মুখ খুলে,
“আমি ঠিক আছি মা। বমিটা হয়ে এখন আরও ভালো লাগছে। এতোক্ষন ভিতরে পাক খাচ্ছিল। তাছাড়া রাতে সে টেবলেট বের করে দিলেও আমিই খাইনি।”
আড়চোখে একবার শাশুড়ির রুষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নজর লুটিয়ে নেয় দৃষ্টি। শাশুড়ির এমন কাট কাট ভাবটা যেন তার অপরাধবোধের মাত্রাটা আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। স্বামীর প্রতি অবহেলা,অযত্নের দায়ে হীনমন্যতায় ভুগছে নিজ মনেই। দৃষ্টির যেখানে কিছুটা হেয়ালীপনা ছিল,সেখানে শাশুড়ির হঠাৎ এমন কঠোর রূপ দেখাটা স্বাভাবিক। কথাটা ভেবে সে নিজেও আর কোনো প্রত্যুত্তর না করে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। পরিস্থিতি সামলাতে রক্তিম নিজেই আবারও বলে উঠে,
“খিদে পেয়েছে আমার। কিছু খেতে দাও।”
রক্তিমের কথায় সচকিত হয় দৃষ্টি। রক্তিমকে কিছুটা সাপোর্ট দিয়ে রুমে নিয়ে এসে বিছানার দিকে তাকাতেই নজরে পরে চাদরটা নষ্ট হয়ে গেছে। বমির বেগ সামলাতে না পেরে বিছানা কিছুটা নষ্ট করে ফেলেছে রক্তিম। মেঝেও নোংরা হয়ে আছে। এক পলক রক্তিমের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ঝটপট চাদর পাল্টে নতুন এক চাদর বিছিয়ে দিয়ে পূণরায় বাথরুমে ছুটে যায়। বালতি ভরে পানি এনে তড়িৎ মেঝে পরিষ্কার করে ছুটে রান্নাঘরের দিকে। কয়েক মিনিটের মাথায় এক বাটি স্যুপ নিয়ে চঞ্চল পায়ে রুমে ঢুকে আবারও। রক্তিমের পাশে বসা রেহানা বেগম কিছুটা গম্ভীর সুরেই হুশিয়ার জানিয়ে দেয়,
“আস্তে দৌড়াও।পরে-টরে গিয়ে কোমর ভেঙে বিছানায় পরে থাকলে কিন্তু তোমাদের দুজনকে টানার শক্তি আমার নেই।”
সাথে সাথেই চলার গতি কমিয়ে দেয় দৃষ্টি। ধিমি পায়ে রক্তিমের কাছে এগিয়ে আসে। রেহানা বেগম ছেলের পাশ থেকে উঠে রুম ছেড়ে যেতে যেতে আবারও বলে যান,
“পুরোটা খাইয়ে মেডিসিন দিয়ে দিও।”
উপর-নিচ মাথা ঝাকিয়ে শাশুড়ির কথায় সম্মতি দিয়ে রক্তিমের থেকে অল্প দূরত্বে বসে চামচ দিয়ে ধোয়া উঠা গরম স্যুপটা নাড়াচাড়া করতে থাকে দৃষ্টি।রেহানা বেগম রুম ছাড়তেই রক্তিম বলে ওঠে,
“মায়ের কথায় কষ্ট পেয়েছো?”
তৎক্ষণাৎ দৃষ্টির হাত থেকে যায়। মাথা উঁচিয়ে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে ভ্রুক কুঁচকে বলে,
“কষ্ট পাব কেন?মা কি আমাকে বকেছে? আর যদি বকেও থাকে,সেটা আপনার জন্যই বকেছে। মা তো আর জানেনা কার দোষ কার গুণ।”
স্মিত হেসে দৃষ্টির বাড়িয়ে দেওয়া এক চামচ স্যুপ মুখে তুলে নেয় রক্তিম। ফের বলে,
“রাতে জ্বর ছিলনা তো অযথা ঔষধ খাব কেন?”
কোনো কথা বাড়ায়না দৃষ্টি।জনম ত্যারা লোকটার সাথে অহেতুক কথা বলে সুন্দর,ফুরফুরে মেজাজটা নষ্ট করতে চায়না।রক্তিমও কোনো প্রকার উচ্চবাচ্য ছাড়াই পুরোটা স্যুপ খেয়ে ঔষধ খেয়ে নেয়। নিরবে খাওয়ানোর কাজ সম্পন্ন করে নোংরা হয়ে যাওয়া চাদর নিয়ে দৃষ্টি এগিয়ে যায় ওয়াশরুমের দিকে। ঠিক তখনই বাধ সাজে রক্তিম,
“এটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”
“নোংরা হয়ে গেছে। ধুয়ে দিব।”
“আমার বমি পরিষ্কার করবে!ঘেন্না লাগবেনা তোমার?”
চলন্ত পা স্থির করে চোখ দুটো ছোট ছোট করে রক্তিমের দিকে ঘুরে তাকায় দৃষ্টি। কোমরে এক হাত রেখে মহা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“যখন প্যারালাইজড হয়ে পরে ছিলেন, তখন কে পরিষ্কার করেছে আপনাকে?ঐ সময় যদি কোনো ঘেন্না ছাড়াই আপনার প’টি পরিষ্কার করতে পারি, তো এখন কেন ব মি পরিষ্কার করতে পারবনা? আমি বলেছি একবারও যে আমার ঘেন্না হয়? না কি আমার চেহারায় এমন কোনো ছাপ পেয়েছেন? আজাইরা কথা বলে আমার সুন্দর মেজাজটা নষ্ট করবেন না একদম।”
বিভীষিকাময় পঙ্গুত্ব বরণ করে রাত-দিন বিছানায় পরে থাকা সেই দিন গুলোর কথা মনে হতেই নিশ্চুপ বনে যায় রক্তিম। অপলক তাকিয়ে দেখে যায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তমান ধৈর্য্যমানবীকে। নতুন করে অনুভব করে তার ভালোবাসার প্রগাঢ়তা। এমন আষ্টাদশী একটা মেয়ের মাঝেও সৃষ্টিকর্তা এতোটা ভালোবাসা, মায়া দিতে পারে? কত শত নারীই তো আছে,যারা সুস্থ্য স্বামীর সাথে বছরের পর বছর এক ছাঁদের নিচে থেকেও সেই স্বামী বিকলাঙ্গ হবার পর অন্য পুরুষের হাত ধরে তাকে ছেড়েছে। আর এই মেয়ে কি না শুধু ভালোবাসার টানে নিজের জীবনের সমস্ত কিছু তুচ্ছ করে কাধে তুলে নিয়েছিল পঙ্গু স্বামীর দায়িত্ব। তাও সেই স্বামী, যে কি না বারবার তাকে অবহেলা আর অপমানের সাগরে ডুবিয়ে রেখেছে। সেই দিন গুলোর কথা মনে হলে রক্তিম আজ নিজের বিবেকের কাছে লজ্জিত হয় বারবার। অপরাধবোধে ভারী হয় বুক।
রক্তিমকে আনমনে তার দিকে তাকিয়ে ভাবনায় বিলীন হতে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয় দৃষ্টি। মৃদু স্বরে জানতে চায়,
শীতের রুক্ষতা শেষে যেমন বসন্তের ছোঁয়ায় প্রকৃতি সেজে ওঠে নতুন সাজে। পাতা ঝরা গাছে গজিয়ে ওঠে নতুন পাতা,ফুল,কলি। মানুষের জীবনেও তেমন বিষাদ ঘেরা দিন শেষে অন্ধকার রাতের পর উঁকি দেয় ঝলমলে সূর্য। যার আলোয় নিবারণ হয় রাতের নিকশ অন্ধকার। সূচনা হয় নতুন এক দিনের। আগের দিনটা তলিয়ে যায় অতীত গহ্বরে। কিছু বিষাদীত দিন স্থান নেয় স্মৃতির পাতায়। যা মাঝে সাজে স্বরণে এসে চিনচিনে ব্যাথার সৃষ্টি করে মন গহীনে। একে একে দিন ফুরিয়ে কেটে যায় যেমন প্রতিটা ঋতু, তেমন করেই চলে যায় মানুষের জীবন অন্তিম মুহূর্তের দোরগোড়ায়। কারো মৃত্যু বা বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় জীবন থেমে থাকেনা। একদিন, দুইদিন, তিনদিন, জীবদ্দশায় আমরা যতই ভাবি এই আপন মানুষটার প্রাণ পাখি উড়ে গেলে তার সাথে আমার প্রাণ পাখিটাও উড়ে যাবে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাব তৎক্ষণাৎ, সেই আপন মানুষটার মৃত্যুর দিন আমাদের যতটা যন্ত্রণা অনুভব হয়, মনে হয় যে জীবন এখানেই থেমে গেছে, মৃত্যু আমাকেও হাত ছানি দিয়ে ডাকছে। কিসের জীবন কিসের জিন্দিগী! যেখানে আপন মানুষটা নেই, সেখানে আমিও থাকবনা। এই যন্ত্রণাটুকু,এই উপলব্ধিটুকু সময়ের সাথে সাথে ঠিকই ক্ষীণ হয়ে যায়। বেঁচে থাকি দিব্যি তার শূণ্যতাটুকু অন্য কারো পূর্ণতায় ভুলে গিয়ে, অথবা জীবনের তাগিদে। কথায় আছে মৃত্যুর তিন দিনের মাথায় না কি সৃষ্টিকর্তা স্বজনদের বুকে পাথর চাপা দিয়ে দেয়। ভুলিয়ে দেয় অতি আপন মানুষ হারানোর যন্ত্রণা। হয়তো সেই কথাটাই ঠিক।না হয় কিভাবে আমরা হারানোর মৃত্যসম যন্ত্রণা ভুলে জীবনে অগ্রসর হই! কেন থেমে থাকেনা আমাদের জীবন! চোখের জল ফুরিয়ে গিয়ে আবার কিভাবে দেখা দেয় ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা! আমাদের মানব জীবনে দুটো জিনিস বিরাট পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হয়। একটা জন্ম আর একটা মৃত্যু। এই দুটো শব্দ অসাধ্যকে সাধন করে। এক নব জীবনের সূচনায় অনেক সময় আমরা অতীতের হিংসে-বিদ্ধেষ ভুলে এক হই। তেমন করেই কারো মৃত্যুতে মান-অভিমান সব ভুলে এক হই আবারও। সবার জীবনটাকে নতুন করে আরও একটা সুযোগ দেবার চেষ্টা করি। দুই দিনের দুনিয়ায় প্রতিটা প্রাণিই তো ক্ষণিকের অতিথি। তবে কেন এই অস্থায়ী জীবন কেন্দ্র করে এতো এতো অহংকার, এতো গরিমা আর এতো অভিমান! যতদিন নিঃশ্বাস নিতে পারি থাকিনা মনের কালি দূরে রেখে সব ভুলে এক সাথে। ছোট্ট এক জীবনের প্রাপ্তির ঝুলিটা কেন শুধু শুধু আফসোস দিয়েই পূর্ণ করব! বাবার মৃত্যুর পর ঠিক তেমনটা ভেবেই শিকদার বাড়িতে থেকে গেছে রক্তিম-দৃষ্টি। সব ভুলে কাধে তুলে নিয়েছে নিজেদের দায়িত্ব। যে মানুষটা চলে গেছে তার শূণ্যতা পূরণ না হলেও তাকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা সহজ হয়েছে সবারই। রক্তিম সাংসদের দায়িত্ব, একজন সন্তানের দায়িত্ব, একজন ভাইয়ের দায়িত্ব, একজন স্বামীর দায়িত্ব ছোট বড় প্রতিটা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে জীবন বাজি রেখে। এই এতো এতো দায়িত্বের ভীড়ে পরে এখন আর বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ না করার অনুতাপ খুব একটা পুড়াতে পারেনা। দৃষ্টি নিজ হাতে তুলে নিয়েছে প্রায় ধ্বসে পরা শিকদার গৃহের দায়িত্ব। সেও নিজের জায়গা থেকে একজন স্ত্রী, একজন পুত্রবধূ ,ভাবীর দায়িত্ব নিরলসভাবে পালন করে যাচ্ছে। স্বার্থহীন ভালোবাসা দুহাতে উজাড় করে দিয়ে ক্ষয়ে পরা সংসারটাকে জোড়া লাগাচ্ছে অল্প অল্প করে। তাকে দেখে এখন আর মনে হয়না সে কোনো অষ্টাদশী কন্যা। মনে হয় পাক্কা এক গৃহিণী। যার গৃহ সামলানোর অভিজ্ঞতা অনেক গুলো বছরের। যে সুনিপুণ হাতে সামলে নিতে পারে গোটা এক পরিবারকে। রক্তিমের মাঝে মাঝে বড্ড আফসোস হয় তার অষ্টাদশী বধূটাকে হারিয়ে ফেলায়। ইচ্ছে হয় কড়াভাবে শাসন করে বলোক,
“এই মেয়ে! কি সব হাবিজাবি রান্না-বান্না আর মশলা-পাতি নিয়ে সারাদিন হেঁশেলে পরে থাকো? সর্বক্ষণ শুধু সাংসারিক প্রয়োজনীয় জিনিসের কথায় বলে যাও। কেন! মাঝে মাঝে সেই আগের মতো একটু আধটু প্রেমময় কথা বলতে পারোনা! দুই-একটা প্রণয় বাক্য আমার দিকে ছুড়ে দিলে কি তোমার সংসারের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?”
মনের মাধুরী মিশিয়ে অভিযোগ গুলো প্রস্তুত করে ঠোঁটের কাছে নিয়ে যখন পা বাড়ায় দৃষ্টির কাছে গিয়ে ছুড়ে দিতে, ঠিক তখনই একজন পূর্ণ বধূর রুপ দেখে থমকায়। চমকায় তার হাতের জাদুতে প্রাণহীন বাড়িটাকে একটু একটু করে প্রাণ ফিরে পেতে দেখে। মন বলে,এই সাংসারিক কর্তব্যপরায়ণ বধূটাও বন্দ না। তার হাতের ছোঁয়া পেয়েই তো রক্তিম নতুন এক জীবন পেয়েছে, শিকদার মঞ্জিল হয়েছে অল্প-স্বল্প প্রানোচ্ছল, মা পেয়েছে নিঃসঙ্গ জীবনে সময় কাটানোর সঙ্গী, বোন গুলো পেয়েছে দুঃখ-কষ্ট ভাগাভাগি করে নেওয়ার মতো বান্ধবী রূপী ভাবি। সর্বপোরি সে পেয়েছে একজন যোগ্য জীবন সঙ্গীনি। এই নারীর প্রতি সে কিভাবে অভিযোগ রাখবে! যে নারী সর্বক্ষণ ভালোবাসা বিলানোতে ব্যস্ত,কখনো বিনিময় হিসেবে একটু সঙ্গ ছাড়া অঘাত ভালোবাসার আবদার করেনি। সে নারীর প্রতি অভিযোগ রাখা একদম শোভা পায়না।
এমনভাবেই দৃষ্টির মনেও মাঝে মাঝে কিছু অভিযোগ হানা দেয় রক্তিমের প্রতি। মানুষটা সর্বক্ষণ ব্যস্ত শুধু তার দায়িত্ব পালনে। এই দায়িত্ব গুলো একপাশে সরিয়ে এক-আধবার দৃষ্টির দিকে তাকাতে পারেনা!এই যে,শুধু তাকে ভলোবেসে দৃষ্টি নিজের শখ-আহ্লাদ সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে হাতে তুলে নিয়েছে পুরো সংসারের দায়িত্ব, এর বিনিময়েও কি মানুষটা পারেনা ভুল করেই একদিন মিথ্যে মিথ্যেই ভালোবাসি বলতে? কিন্তু পরোক্ষনেই অভিযোগ গুলো হাওয়ায় ভেসে যায় এই ভেবে,ছন্নছাড়া এক পথিক যে সংসারের প্রতি ঝোঁক ফিরিয়ে এনেছে,তাকে ঠাই দিয়েছে নিজের ঘরে নিজের পাশে, গোটা সংসারের দায়িত্ব তুলে দিয়েছে বিশ্বাস করে তার হাতে,এই তো অনেক। তবে কেন অবুঝ মন মাঝে মাঝে এতো উচাটন করে?ভালোবাসার বিনিময়ে যে ভালোবাসা পেতে হবে এমন কি কোনো কথা আছে!রক্তিম মুখে ভালোবাসি না বললেও তো শত ব্যস্ততার মাঝেও তার খোঁজ ঠিক সময় বের করে নেয়। ছোট্ট ছোট্ট কিছু আদুরে যত্নের মাঝে বুঝিয়ে দেয় পাষাণ হৃদয়ে মায়া ছাড়িয়ে ভালোবাসার বিজ বপন হয়েছে। মানুষটা ভালো আছে,পরিবার নিয়ে সুখে আছে, নিজের দায়িত্ব গুলো নিজ তাগিদে পালন করতে শিখেছে এই অনেক। আর কিছুই চাওয়ার নেই দৃষ্টির।
বর্তমানটাকে অতীতে ফেলে আসার পর একে একে প্রতিটা মানুষের জীবনে বিশদ পরিবর্তন এসেছে। ইতি-মেহেদীর কোল জুড়ে তাদের ভালোবাসার সেতু বন্ধন দৃঢ় করতে এসেছে এক পুতুল কন্যা। যার পুতুল পুতুল চেহারার দিকে তাকিয়ে ভুলে যায় তারা এই পার্থিব দুনিয়ার নিষ্ঠুরতা। পবিত্র কোমল এই প্রাণের আগমনে কিছুটা প্রানোদ্দীপনা ফিরে পেয়েছে শিকদার মঞ্জিল। শশুর বাড়ির সবার সাথে সম্পর্ক সহজ হয়েছে ইতির। বিয়ে করেছে রাকিব,শান্ত। জাবিরের সানাই ও বেজে গেছে। আগামী শুক্রবার তার বিয়ে। যে বিয়েতে স্ব-পরিবারে আমন্ত্রিত শিকদার মঞ্জিল। রক্তিম,মেহেদী, জাবির, রাকিব, শান্তর স্বপ্নের ব্যবসারও প্রসার ঘটেছে। নিজ প্রতিষ্ঠানে গুটিকয়েক বেকারের কর্মসংস্থান গড়ে দেওয়ার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে রক্তিমের। পাঁচজন মিলে একটু একটু করে দাঁড় করিয়েছে ইলেকট্রিক ডিলারশিপ ব্যবসা। যেটাতে বর্তমানে তাদের পাঁচজনের পাশাপাশি আরও গুটিকয়েক বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে। রক্তিম রাজনৈতিক কাজে জড়িয়ে বর্তমানে শুধু নাম মাত্র সেই ব্যবসার মালিক। পুরোটাই দেখাশোনা করছে বাকী চারজন। কালেভদ্রে যদি জনগণের সেবা করে সময় বের করতে পারে তবে শো-রুমে তার পদধূলি পরে। তার ব্যস্ততার অযুহাত দেখিয়ে সে নিজেই বহুবার চেয়েছিল ব্যবসা থেকে সড়ে আসতে। কিন্তু দেয়নি আত্মার আত্মীয় সেই দুঃসময়ের সঙ্গী গুলো। তাদের এক কথা, রক্তিমের প্রয়োজন নেই ব্যবসার দিকে তাকানোর। সে শুধু দূর থেকে তাদের বুদ্ধি দিলেই হবে। তারা তার সেই মেধাশ্রম আর নিজেদের কায়িক শ্রমের মাধ্যমেই সফলতার শীর্ষে পদচারনা করবে একদিন।
****
শুক্রবার দিনটা সমস্ত চাকরিজীবি মানুষের ছুটির দিন হলেও ব্যবসায়ী আর রাজধানীর সাথে জড়িত মানুষদের প্রতিদিনের মতোই ব্যস্ততম দিন। সেই সকালে শুধু এক কাপ চা পেটে চালান করে বেরিয়েছিল রক্তিম, এখন সকাল গড়িয়ে দুপুর। কিন্তু তার আসার কোনো লক্ষণ নেই। এদিকে মা-বউকে বলে গিয়েছে সময় মতো তৈরী হয়ে থাকার জন্য, সে বারোটার দিকে এসেই তাদের নিয়ে রওনা দিবে জাবিরের বিয়েতে। দৃষ্টিও ভেবেছিল হয়তো অন্যান্য দিন কথা দিয়ে সময় মতো আসতে না পারলেও আজ প্রাণপ্রিয় ছোট ভাই সমতুল্য বন্ধুর বিয়ের উছিলায় ঠিক আসবে। কিন্তু দৃষ্টিকে পুরো হতাশার সাগরে ডুবিয়ে ব্যস্ত এমপি সাহেব লাপাত্তা। মোবাইল ফোন নামক যন্ত্রমানবটাও তার কোনো সন্ধান দিতে পারছেনা। খুশি মনে সকাল সকাল সমস্ত কাজ সেড়ে শাশুড়ি-বউ মিলে তৈরী হয়েছিল বহুদিন পর কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানে সামিল হবে বলে। দৃষ্টি সংসারের কাজ থেকে বিরতি নিয়ে নিজেকে সাজিয়েছিল মনের মাধুরী মিশিয়ে। ভারী শাড়ি-গয়না আর প্রসাধনীর অল্প-স্বল্প ছোঁয়ায় নিজেকে ভিন্ন রূপে সাজিয়ে আয়নায় প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে লাজুক হেসেছিল। ভাবছিল এই প্রথম রক্তিম দৃষ্টিকে এমন সাজে দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে! একটু কি নিজের গন্ডি পেরিয়ে এসে প্রশংসা করবে! না কি এক নজর দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিবে! না কি শুধু চোখে মুগ্ধতা মিশিয়ে অপলক তাকিয়েই থাকবে! নিজের মনগড়া এমন শত শত ভাবনায় নিজেই লজ্জার সাগরে ডুবে তৈরী করে ফেলেছিল এক কল্পনার জগত। যে জগতে বিলীন হয়ে ভুলে গিয়েছিল সময়ের কথা। শাশুড়ি মা যখন চিন্তিত বদনে রুমে এসে জানিয়ে যায় সময়ের হিসাব আর ছেলের অপরাগতার কথা, তখনই কল্পনার জগতে বিশাল এক তালা ঝুলিয়ে বাস্তবে ফিরে আসে দৃষ্টি। সেই থেকে অপ্রসন্ন মনে একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে রক্তিমের নাম্বারে। কিন্তু সাহেব এতোই ব্যস্ত যে বারবার রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে কল। কিন্তু একবারও রিসিভ করার সময় পাচ্ছেনা।ঘড়ির কাঁটা যখন জানান দেয় দুপুর তিনটা বেজে গেছে, তখন এক দলা বিষাদ অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পরে দৃষ্টির কাজল কালো চোখের কোণ বেয়ে। রাগ-অভিমানের মিশেলে অসহনীয় বুকে চিনচিনে ব্যাথা ধরা এক পরিস্থিতির মুখে পরে মুছে ফেলে সমস্ত সাজ-সজ্জা। শাড়ি খুলে গায়ে জড়িয়ে নেয় সুতির থ্রি-পিস। নিজেকে স্বাভাবিক করে ছুটে শাশুড়ি মায়ের রুমে। মলিন মুখটাকে হাসি খুশী করার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলে,
“মা! আপনার ছেলে হয়তো কোনো জরুরী কাজ আটকে গেছে। বিয়েতে যাওয়া বোধহয় আর হবেনা। আসুন আমরা খেয়ে নেই। এমনিতেই আপনার দুপুরের ঔষধ খাওয়ার সময় চলে যাচ্ছে।”
পুত্রবধূর মেকি হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা অভিমানটুকু চোখে বিধে রেহানা বেগমের। বোকা মেয়ে ভেবেছে ঠোঁটে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে রাখলেই বুঝি পাক্কা অভিনেত্রীদের মতো অভিনয় করে সত্য লোকানো যাবে। মেয়েটা হয়তো এটা জানেনা, রেহানা বেগম নিজেও বহু বছর আগের অতীতে এমন শত শত দিন ফেলে এসেছে। প্রিয় অর্ধাঙ্গের থেকে সময় না পাবার যন্ত্রণাটাও উপলব্ধি করে এসেছে। কথা দিয়ে কথা না রাখলে যে কষ্টটা হয় তা বুঝে রেহানা বেগম। আজীজ শিকদার নিজেও তো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ছেলের মতোই ওনিও এমন কত শত আশা দেখিয়ে নিরাশা করতেন রেহানা বেগমকে! অতীত স্বরণ হতেই সাথে জড়িত মানুষটার কথাও স্বরণ হয়। অতীতের সেই তাগড়া মানুষটা আজ আর নেই। একটা বছর পাড় হয়ে গেছে এই পৃথিবীর বুক থেকে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে। কিন্তু এখনো মানুষটার কথা মনে হলে চিৎকার করে কেঁদে বুক ফাঁটাতে ইচ্ছে হয় সেই হারিয়ে ফেলার দিনটার মতোই। মনে হয় বেঁচে থাকাই বৃথা। তবে সন্তান গুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে নতুন করে বাঁচার সম্বল পেয়ে সামলে নেয় নিজেকে পূণরায়। প্রলম্বিত একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায় রেহানা বেগম। দৃষ্টির কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আর একটু দেখি মা! রক্তিম হয়তো জরুরী কাজে আটকে সময় মতো আসতে পারেনি। কিন্তু আসবে ঠিক। আমার ছেলে কথা দিয়ে কখনো কথা রাখেনা এমন হতেই পারেনা।”
শুকনো হাসে দৃষ্টি। তাড়া দিয়ে বলে,
“সে আসলে দেখা যাবে। যখন আসবে তখন না হয় যেতে পারলে যাব। কিন্তু এখন আপনার খেয়ে নেওয়াটা জরুরী। সময় মতো ঔষধ না খেলে কাজ হবে কোনো?”
পুত্রবধূর যত্নে সন্তুষ্ট রেহানা বেগম। মাঝে মাঝে এই অল্প বয়সী মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেই মনে হয় সৃষ্টিকর্তা হয়তো এই মেয়েটাকে তার ছেলের বউ হিসেবে ঠিক করে রেখেছিল দেখেই অতীতে সেই ভয়াবহ ঘটনাটা ঘটেছিল। মাঝে মাঝে কিছু খারাপের পিছনেও কিছু ভালো লুকিয়ে থাকে। সেই সময় যদি জেরিন সংগ্রামের এমন ঘটনা সামনে না আসতো তবে কি রক্তিম কখনো জেরিনকে ছাড়তো? আর দৃষ্টিই কি আসতে পারতো এই বাড়িতে বউ হয়ে!
দুজন মিলে খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁয়ে গল্পগুজবে পাড় করে দেয় পুরো বিকেল। দিনের তেজস্ক্রিয় সূর্যটা তেজ হারিয়ে একটু একটু করে ঢলে পরে পশ্চিমাকাশে। গোধূলির রং ছড়িয়ে পরে সজীব প্রকৃতিতে। অস্তে আস্তে অন্ধকারে তলিয়ে যায় প্রকৃতি। দৃষ্টি গল্পের আসর ছেড়ে ওঠে যায়। বৈদ্যুতিক আলোয় পুরো বাড়িটাকে আলোকিত করে শাশুড়ির নামাজ আদায় করে চুপচাপ নিজ রুমে চলে আসে। বাতি নিভিয়ে রুমটাকে অন্ধকার করে পা বাড়ায় বারান্দার দিকে। বিশাল আকাশটাতে রূপালী থালার মতো চাঁদকে ঘিরে হাজারো নক্ষত্রের মেলা বসেছে। মাঝে মাঝেই শুভ্র মেঘমালা এসে ঢেকে দিচ্ছে নিটোল চাঁদটাকে। এ যেন চাঁদ-মেঘের খুনসুটি। দূর আকাশে নির্নিমেশ তাকিয়ে সেসব দেখে যাচ্ছে দৃষ্টি।ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাসে ভারী হচ্ছে আশপাশ। অতর্কিতে পিছন থেকে ভেসে আসে পরিচিত এক কন্ঠস্বর,
“এখনো রেডি হওনি? দেরী হয়ে যাবে তো আমাদের। দ্রুত আসো।”
আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা দৃষ্টি হঠাৎ ডাকে ক্ষাণিক চমকায়। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখতে পায় কৃত্রিম আলোয় ঝলমল করছে রুম। যে আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একজন সু-পুরুষ শুভ্র পাঞ্জাবীর উপর থেকে মুজিব কোট খুলতে ব্যস্ত। সেই দুপুর থেকে রেডি হয়ে যার জন্য অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ধৈর্য্যহারা হয়ে একের পর এক ফোনকলেও কোনো হদিশ পেলনা, সেই এখন বাড়ি এসে জানতে চাচ্ছে এখনো কেন রেডি হয়নি!এই মানুষটা কি আদও নিজের ছন্নছাড়া ভাব টুকু পুরোপুরি দূর করতে পেরেছে! যদি পারতোই তবে এতো গুলো ফোন কল পেয়েও এভাবে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারতনা। নিশ্চয়ই বাড়িতে কোনো অঘটন ঘটেছে কি না এমন চিন্তা একটু হলেও হতো। বারান্দায় থেকেই দৃষ্টি শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“আপনার মাঝে কি সিরিয়াসনেস বলতে কিছুই নেই? না কি শুধু আমার বেলাতেই এমন!”
এক টানে গা থেকে পাঞ্জাবীটা খুলে দৃষ্টির হাতে ধরিয়ে দেয়। গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলে,
“বিনে রেখে দাও। বিয়ে থেকে এসে সময় করে ধুয়ে দিও।”
দৃষ্টি বুঝতে পারে রক্তিম আবারও তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেছে।আঁখি যুগল উষ্ণ জলে সিক্ত হয়। গাল বেয়ে তা গড়িয়ে পরার আগেই মুছে নেয় ঝটপট।পাঞ্জাবীটা যথাস্থানে রেখে বেরিয়ে যায় রুম ছেড়ে। রক্তিম গোসল সেড়ে রুমে এসে দৃষ্টিকে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাক ছাড়ে। সাড়া দেয়না দৃষ্টি। তবে মিনিট সময়ের ব্যবধানে উপস্থিত হয় রুমে। কিছুটা রাগী ভাব ধরে রেখেই জানতে চায়,
“হয়েছে কি?”
“রেডি হচ্ছোনা কেন?”
“যখন রেডি হয়ে অপেক্ষায় বসে ছিলাম তখন কোথায় ছিলেন? আর বিয়ে দিনে হবার কথা, তো এই রাতে গিয়ে কি করব? ডেকোরেশনের কাজ গোছাতে যাব?”
“কে বলেছে বিয়ে দুপুরে?”
“আপনি নিজেই তো বলেছেন?”
“কখন বললাম?”
“সকালে যাবার সময় কি বলেছিলেন?”
ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে হতাশ ভঙ্গিতে দৃষ্টির দিকে তাকায় রক্তিম। ক্লান্ত কন্ঠে বলে,
“সকালে বলেছিলাম রেডি হয়ে থাকতে। আমি সময় মতো এসে নিয়ে যাব। একবারও এটা উল্লেখ করিনি বিয়ে দুপুরে। আর ঘরে ইনভাইটেশন কার্ড নেই? তুমি কি অন্ধ না কি অক্ষরজ্ঞানহীন?”
থমথমে মুখে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে দৃষ্টি। আসলেই তো!এখানে তো রক্তিমের পাশাপাশি নিজের নির্বুদ্ধিতার দোষটাও সমান। সে যদি একবার কার্ড হাতে নিয়ে পড়ে দেখতো তাহলে এতো কাহিনী হতনা। তবে এটাও ঠিক, রক্তিমকে যে এতো গুলো কল দেওয়া হলো সে কেন ধরলনা!এতে কি আবারও তার ছন্নছাড়া পরিচয় পাওয়া গেলনা! আজ যদি কল গুলো কোনো বিপদে পরে দেওয়া হতো আর রক্তিম এমন করতো তখন কি হতো?ভেবে নিজেও কিছুটা ব্যাঙ্গাত্বক ভাবে বলে,
“আমি না হয় অন্ধ,অক্ষরজ্ঞানহীন। কিন্তু আপনি তো হাই এডোকেটেড,প্রচুর ব্রিলিয়ান্ট,দায়িত্ববাম মানুষ। আপনার ফোনে যে একটা মানুষ লাগাতার এতো গুলো কল দিল আপনি কি সেটা চোখে দেখেন নি? মানুষ তো প্রয়োজনেই ফোন করে। প্রয়োজনের সময় যখন ফোন কাজে লাগবেনা, তখন সেই ফোন সাথে রাখার কি প্রয়োজন!”
“ফোন আমার কাছে থাকলে তো রিসিভ করব! মিটিংয়ে ছিলাম আমি।”
ভাবলেশহীন জবাব রক্তিমের। দৃষ্টি পূণরায় প্রশ্ন করে ওঠে,
“তো মিটিং শেষে ফোন হাতে নেননি? তখন দেখেন নি এতো গুলো কল দিয়েছি?”
রক্তিম এবার যারপরনাই বিরক্ত। আসার পর থেকে কেমন আসামিদের মতো জেরা শুরু করেছে!
“তখন তো বাড়িতে আসার জন্যই বের হয়ে পরেছি। আধা ঘন্টার ব্যবধানে বাড়িতে চলেও এসেছি। যায় হোক,মানছি আমার ভুল হয়ে গেছে। পরবর্তীতে আপনার কল এড়িয়ে যাওয়ার মতো এতো বড় ভুল আর করবনা। এবার দয়া করে রেডি হবেন?”
“কোথাও যাচ্ছিনা আমি।”
অভিমানে ঠাসা উত্তর টুকু ছুড়ে আবারও রুম ছাড়তে উদ্যত হয় দৃষ্টি। তৎক্ষণাৎ হাত ধরে আটকে দেয় রক্তিম। বোঝানোর স্বরে বলে,
“বললাম তো আর এমন হবেনা। যাও, দ্রুত রেডি হও।”
ঝাড়ি মেরে রক্তিমের হাত ছাড়িয়ে চেঁচিয়ে ওঠে দৃষ্টি,
“পারবনা। একবার রেডি হয়ে সব ধুয়ে-মুছে একটু পর আবার রেডি হবার মতো এতো সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই। মা’কে নিয়ে আপনি চলে যান।”
রক্তিম নিম্নোষ্ঠ কামড়ে কিছু একটা ভাবে। পর মুহূর্তে মুচকি হেসে বলে,
“আসো, আমি রেডি করিয়ে দিচ্ছি। তোমার এতো কষ্ট করতে হবেনা। শাড়ি কোনটা পরবে বলো।”
বলতে বলতে রক্তিম কাবার্ডের সামনে গিয়ে দৃষ্টির শাড়ি গুলো হাতিয়ে দেখতে থাকে। ভাবনায় পরে যায় দৃষ্টি। বলে কি এই লোক! সত্যিই সে দৃষ্টিকে রেডি করিয়ে দিবে! দৃষ্টির ভাবনার মাঝেই রক্তিম নিজের পছন্দমতো একটা শাড়ি নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। একবার শাড়ির দিকে আর একবার দৃষ্টির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বলে ওঠে,
“এটাই পারফেক্ট মানাবে। চলো জামা খুলে ব্লাউজ-পেটিকোট পরে নাও।”
লক্ষণ খুব একটা ভালো ঠেকছেনা বুঝতে পেরে দৃষ্টি এক টানে শাড়িটা নিয়ে নেয় রক্তিমের হাত থেকে। ক্রস্থ পায়ে চলে যায় ওয়াশরুমে। রক্তিম ফিচেল হেসে নিজের কাজে মন দেয়। বউয়ের ত্যারা ঘাড়ের রগ কিভাবে সোজা করতে হয়, এসব টেকনিক খুব ভালো জানা আছে তার।
****
ডিভোর্স পেপার হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জেরিন।ছলনার সম্পর্কটা যে শেষ পযর্ন্ত বিচ্ছেদে রূপ নিবে কে ভেবেছিল তা! দেশপ্রেমি, সৈনিক প্রেমিকের হাত ছেড়ে সুখের আশায় আকড়ে ধরেছিল তারই ভাইয়ের হাত। মনে ছিল ভালোবাসার থেকেও বেশি আয়েশি জীবনের লোভ। লোভ! হ্যাঁ লোভই তো। সংগ্রাম তাকে প্রথম থেকেই গল্প শুনিয়েছিল বিদেশে সেটেল হবার। গরিব-দুঃখি দেশের ধূলোবালি আর অভাবের জীবন পাড় করা জেরিনও সংগ্রামের গল্প শুনে স্বপ্ন দেখতো এক আয়েশি জীবনের। যে জীবনে কোনো অভাব-অনাটন থাকবেনা। আজীবন পায়ের উপর পা তুলে খাবে। যখন যা খুশি তাই করবে। যেটা রক্তিমের মতো সাধারণ একজন সৈনিকের সাথে থেকে পাবেনা। একজন ডিফেন্সের মাসিক বেতনই বা কত হয়! তাদের তো বিয়ের বাজারে মূল্য শুধু সরকারি চাকরিজীবির খেতাবের জন্য আর রিটায়ার্ডের পর যে মোটা অঙ্কের ভাতাটা পায় তার জন্যই।এটুকু দিয়ে কি আর রাণীর হালে বসে খাওয়া যাবে! তাছাড়া জেরিনেরও ইচ্ছে ছিল তার স্বামী সর্বক্ষণ তার পাশে থাকবে।শুধু তাকে কেন্দ্র করেই নতুন এক পৃথিবী গড়বে।কিন্তু রক্তিমের সাথে থাকলে তা কখনোই হতনা।প্রথমত স্বপ্নের পেশা কখনো ছাড়তনা রক্তিম।বছরে একবার কি দুইবার বাড়ি এসে স্ত্রীর প্রতি হয়তো একটু ভালোবাসা দেখাতো। চার-পাঁচদিন কি এক সপ্তাহ থেকে আবার চলে যেতো।দ্বিতীয়ত বাবা-মা ভক্ত রক্তিম বাবা-মা’কে একা বাড়িতে রেখে স্ত্রীকে নিজের সাথেও নিতনা।সব কিছু ভেবেই রক্তিমের অল্প মায়াটুকু নিঃশেষ করে ঝুকেছিল সংগ্রামের প্রতি। প্রথম প্রথম চাওয়া অনুযায়ী ভেসেছিল সুখের সাগরে। এরপর যে জীবনের গল্পটা এভাবে বদলে যাবে ভাবেনি কল্পনাতেও।
অশ্রু সিক্ত নয়ন মেলে সোফায় আয়েশি ভঙ্গিতে বসে থাকা সংগ্রামের দিকে তাকায় জেরিন। কাঁপা স্বরে বলে,
“মাঝ পথে এভাবে আমাকে ছেড়ে দিতে পারোনা তুমি। এই ভিনদেশে আমি তোমার ভরসাতেই এসেছি। সেই তুমিই আমাকে ছুড়ে ফেলে দিলে কি হবে আমার?এতো নিষ্ঠুর আচরণ কিভাবে করতে পারছো তুমি?”
“দুধের শিশু না তুমি। আমার থেকেও ভালো বুঝো সব কিছু। কয়েক বছর আগে যেমন ভাইয়ের হাত ছেড়ে আমার হাত ধরতে পেরেছো,এখনো ঠিক আমার হাত হারিয়ে গেলে অন্য কারো হাত পেয়ে যাবে। তোমাদের মতো মেয়েদের জন্য শুভাকাঙ্খীর অভাব আছে না কি? রাস্তায় নামো, দেখবে খদ্দেরের অভাব নেই।”
টলমলে চোখের অশ্রু কণা এবার গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে অনায়াসে। মৃদ্যু কাঁপন ধরে পুরো শরীরে। রাগে-দুঃখে চেঁচিয়ে ওঠে জেরিন,
“মুখ সামলে কথা বলো।আমি যদি খারাপ হই তবে খারাপের গুরু তুমি। আজ থেকে তিন বছর আগে আমাকে কিভাবে নিজের বশে এনেছো ভুলে যেওনা সেই কথা।”
রগড় করে হাসে সংগ্রাম। বসা থেকে ওঠে এসে জেরিনের দিকে ঝুকে ফিচেল স্বরে বলে,
“কিছুই ভুলিনি ডার্লিং। কিভাবে তুমি আমেরিকা আসার লোভে পরে নিজের শরীর দেখিয়ে আমাকে বশ করেছিলে সব মনে আছে। তোমারও মনে আছে নিশ্চয়ই!শরীর তো এখনো ফিটফাট। আমার উপর এপ্লাই করা একই পন্থা কোনো আমেরিকানের উপর করতে পারো। সাদা চামড়ার শা লা গুলোর এমনিতেই বাঙ্গালী ললনাদের প্রতি ঝোক বেশি। দেখবে তোমার নাগরের অভাব হবেনা। আমার মতো ভাগ্য ভালো থাকলে সাথে ফ্রি গ্রিনকার্ড’ও পেয়ে যেতে পারো।”
শারীরিক আঘাতের থেকেও কথার আঘাত একটা মানুষকে সবথেকে বেশি কষ্ট দিতে পারে। আজ তা আবারও প্রমাণ পেল জেরিন। সংগ্রামের এক একটা কথা শরীরে মনে হচ্ছে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।এই কথার আঘাতে বেঁচে থেকে বারবার মৃত্যুসম যন্ত্রণা সহ্য করার থেকে মনে হয় মরে যাওয়া ঢের সহজ।আর তর্কে জড়ানোর সাহস হয়না জেরিনের।ঘোলা চোখে ডিভোর্স পেপারের দিকে তাকিয়ে কাঁপা হাতে সই করে দেয়। ছোট্ট একটা কলমের খোঁচায় শেষ করে দেয় পাপের রাজ্যে গড়া সম্পর্কের বন্ধন। কাগজটা সংগ্রামের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
“মুক্তি দিলাম। তবে মনে রেখো এটাই তোমার শেষ মুক্তি না।পাপের রাজ্য যেমন আমাকে সুখী করতে পারেনি তেমন তোমাকেও পারবেনা।যতটা দোষ আমি করেছি তার সমান দোষী তুমিও। আমার প্রায়শ্চিত্ত প্রায় শেষের পথে,এখান থেকেই শুরু হবে তোমার পালা।”
আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করেনা জেরিন। শূণ্য হাতে বেরিয়ে যায় সুখের আশায় তৈরী পাপের রাজ্য থেকে। তার চলে যাওয়ায় কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সংগ্রামের। মাথা থেকে যেন মস্ত এক বোঝা নেমেছে। হাফ ছেড়ে ফুরফুরে মনে নিজেও বেরিয়ে পরে এপার্টমেন্ট ছেড়ে। মেইন রোডে যেতেই দেখতে পায় স্থানীয় পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে রেড এলার্ট জারি করেছে। ঘটনা কি ঘটেছে জানার জন্য কিছুটা সামনে এগিয়ে যেতেই স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া এক রক্তাক্ত পরিচিত মুখের আদল দেখে থমকে যায়। বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
চলবে…..
#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৪১
#আদওয়া_ইবশার
দলীয় মিটিং শেষে নিজের জন্য বরাদ্ধকৃত রুমে এসে বসেছে রক্তিম। সেক্রেটারী তৌফিকের এগিয়ে দেওয়া ঠান্ডা পানির গ্লাস এক নিঃশ্বাসে শেষ করে তাড়া দেয় আরও এক গ্লাস পানির জন্য। পরপর দুই গ্লাস পানি পান করে গরমে অতিষ্ঠ হওয়া তৃষ্ণার্ত প্রাণটাকে শীতল করে চেয়ারে গা এলিয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এক মুহূর্তের জন্য চোখ দুটো বন্ধ করতেই বিপ বিপ শব্দ তুলে নিজের গুরুত্ব জানান দেয় ফোন নামক যান্ত্রিক বস্তুটা। কিঞ্চিৎ বিরক্ত বোধে কপাল কুঁচকায় রক্তিম। রাজনীতিতে আসার পর থেকে দু-দন্ড শান্তিতে নিঃশ্বাস নেওয়ারও জো নেই এই ফোনের জন্য। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে টেবিলে অবহেলায় পরে থাকা ফোনটা হাতে নিতেই দেখতে পায় মরহুম বাবার পার্সোনাল এসিস্টেন্ড রহমত উল্লাহ নামটা স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে। এক মুহূর্ত সময় ব্যয় না করে ফোন রিসিভ করে সালাম জানায়,
“আসসালামু আলাইকুম।”
ফোনের অপর পাশ থেকে বিনয়ী স্বরে সালামের জবাব দেয় রহমত উল্লাহ নামক ব্যক্তি। পরপর রক্তিম বলে ওঠে,
“হ্যাঁ চাচা,বলুন। অসময়ে হঠাৎ ফোন দিলেন! কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
কতক্ষণ মৌন থেকে রহমত উল্লাহ জবাব,
” আসলে বাবা, একটু আগেই সাভার থানার থেকে ফোন এসেছিল।”
রক্তিমের কপালে চিন্তার বলিরেখা দেখা দেয়। উৎকন্ঠা নিয়ে জানতে চায়,
“থানা থেকে! কিন্তু কেন? কি বলল তারা? বাবার কোনো আইনি ঝামেলা ছিল না কি?”
আসল ঘটনা বলতে গিয়ে অল্প দ্বিধান্বিত হয় রহমত উল্লাহ। সেই সাথে মনে কাজ করে কিছুটা ভীতি। তবুও না বলে উপায় নেই। তার কাজ যেটা সেটা করতেই হবে। গত দশটা বছর একটানা তিনি আজীজ শিকদারের পাশে ছায়ার মতো থেকেছেন। যত ব্যবসায়ীক, রাজনৈতিক আর পারিবারিক ঝামেলাপূর্ণ কাজ-কর্ম সব কিছুতেই আজীজ শিকদার চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে দায়িত্ব দিয়েছেন তাকে। বাবার চলে যাওয়ার পর রক্তিম সেই দায়িত্ব গুলো ওনার থেকে কেড়ে না নিয়ে উল্টো সম্পূর্ণ ভাড় ছেড়ে দিয়েছে তার কাধে। এমন বিশ্বাসের স্থানে থেকে ওনি পারেননা বিষয়টা গোপন করে যেতে। তাই মনে কিছুটা ভীতি কাজ করলেও সাহস সঞ্চার করে বলেন,
“স্যারকে নিয়ে কোনো ঝামেলা না। আমি সম্পূর্ণটা বলছি বাবা। তুমি সবটা শুনে এরপর যা বলার বলো। আগেই উত্তেজিত হয়ে যেওনা। এটা তোমার কাছে আমার অনুরোধ।”
কুঁচকে থাকা কপাল এবার আরও খানিক বাজে ভাবে কুঁচকে নেয় রক্তিম।গভীর চিন্তায় বোধ হয় স্নায়ুতন্ত্রের উত্তেজনক্ষম কোষ। এতোক্ষনের শান্ত-স্বাভাবিক স্বরটাও পাল্টে গিয়ে শুনায় রাশভারী। ভরাট গলায় বলে,
“আচ্ছা বলুন। শুনছি আমি।”
ফোনের অপর প্রান্তের রহমত উল্লাহ এখনো কিছুটা দ্বিধায় এই ভেবে, কথা গুলো ফোনে বলার থেকে সামনাসামনি বলা ভালো হবে কি না! আজীজ শিকদার নিরব-শান্ত, সরল মনের মানুষ হলেও ছেলে রক্তিম শিকদার যে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। আজীজ শিকদারের সাথে যেকোন বিষয়ে নির্দ্ধিধায় আলোচনা করতে পারলেও ওনার ছেলের সাথে সামনাসামনি বসে স্বাভাবিক ভাবে আলোচনা করার সাহস এখনো হয়ে ওঠেনি। সেখানে এই ভয়াবহ বিষয়টা নিয়ে সামনে বসে আলোচনা করার সাহস কিভাবে হবে? তাই যতটুকু সম্ভব ফোনের মাধ্যমে বলেই ক্রোধের স্বীকার হতে বাঁচার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবুও এখন ফোনে বলতে গিয়েও কেমন জড়তা কাজ করছে। একেবারে কাল ঘাম ছুটে যাবার দশা। নিজের ভিতরের অস্থিরতা আর উত্তেজনা টুকু কোনোমতে দমিয়ে বলতে শুরু করেন রহমত উল্লাহ,
“গত পনেরো দিন আগে জেরিন রোড এক্সিডেন্ট করে। আলাঙ্কার স্থানীয় পুলিশ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরদিন কিছুটা সুস্থ্য হলে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের সময় জেরিন স্বীকারোক্তি দেয় ওর এক্সিডেন্ট পূর্বপরিকল্পিত। সেদিনই না কি সংগ্রামের সাথে ওর ডিভোর্স হয়। ভারতীয় এক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে সংগ্রাম জেরিনকে ডিভোর্স দেয়। সেটা জেরিন মানতে না পেরে আত্মহত্যার প্রচেষ্টা করেছিল। এর আগেও না কি ঐ ভারতীয় মেয়েটার সাথে পরিচয় হবার পর থেকে সংগ্রাম বহুবার চেষ্টা করেছে জেরিনকে মেরে ফেলার। প্রতিনিয়ত শারীরিক-মানসিক অত্যাচারের স্বীকার হয়েছে। জেরিনের এক্সিডেন্টের পর থেকে সংগ্রামও তাদের এপার্টমেন্ট থেকে পালিয়ে যায়। শহরের আনাচে-কানাচেও তাকে খোঁজে পাওয়া যায়না। জেরিনের স্বীকারোক্তি আর সংগ্রামের পালিয়ে বেড়ানো, সব মিলিয়ে বাজে ভাবেই ফেঁসে যায় সংগ্রাম। পশ্চিমা দেশের আইন কতটা কঠোর জানোই তো। তাদের একদিনও সময় লাগেনি সংগ্রামকে ধরতে। ওখানকার স্থানীয় জেলে পনেরো দিন রেখে বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ করে গতকালই সংগ্রামকে সাভার থানার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে জেরিনকেও দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কারণ ঐ দেশে তার কোনো গার্ডিয়ান নেই।তাছাড়া দুজনই বাংলাদেশের নাগরিক। তাদের কেসটা বাংলাদেশ পুলিশকেই হেন্ডেল করতে হবে। সংগ্রাম আমেরিকা যাবার পর তার কোনো প্রয়োজন পরলে সরাসরি আমার কাছেই ফোন করত। আজীজ স্যার’ই তাকে নিষেধ করেছিল সরাসরি ওনার সাথে যোগাযোগ করার জন্য। সেজন্যই বোধহয় পুলিশের কাছেও অভিভাবক হিসেবে আমার কথা বলেছে সে। সংগ্রামের সাথে কথা হয়েছে আমার এক মিনিটের মতো। শুধু বলেছে যে করেই হোক স্যারকে যেন বলি ওর জামিনের ব্যবস্থা করতে।”
অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে পুরো ঘটনা শুনে যায় রক্তিম। এতো বড় একটা ঘটনা তাও সেই বেইমান দুজন মানুষকে ঘিরে। ভিতরে ভিতরে রক্তিম এলোমেলো হলেও বাইরে তা একবিন্দু প্রকাশ করেনা। অপর দিকে রক্তিমের ক্রোধের স্বীকার হওয়ার ভয়ে রহমত উল্লাহ’র অবস্থা সূচনীয়। ধরাস ধরাস শব্দ হচ্ছে বুকের ভিতর। ভয়ের চোটে গলা শুকিয়ে কাঠ। রক্তিম ওনাকে সম্পূর্ণ ভড়কে দিয়ে হিম শীতল কন্ঠে বলে,
“বাবা যে মারা গেছে সেই খবর সে জানেনা এখনো?”
যেখানে রহমত উল্লাহ ভেবে রেখেছিল সংগ্রাম, জেরিনকে নিয়ে কথা বলায় রক্তিম বোধহয় তার বুক ফেরে এক টানে কলিজা বের করে নেওয়ার মতো তান্ডব চালাবে, সেখানে রক্তিমের এমন বিকারহীন হিমশীতল কন্ঠ শুনে চমকায়, থমকায়। ছোট ছোট চোখ দুটো বৃহদাকৃতি ধারণ করে। ভড়কে গিয়ে কয়েক পল নিশ্চুপ থেকে বিমূঢ় স্বরে বলে,
“না বোধহয়। আমি ছাড়া তো আর কারো সাথে যোগাযোগ নেই তার। আমিও বলার সুযোগ পাইনি। তাই বোধহয় জানেনা। জানলে তো আর তার জামিনের জন্য স্যারকে বলার জন্য বলতনা।”
মুখ ভরে তৃপ্তির হাসি হাসে রক্তিম। হঠাৎ করে তার এতো আনন্দ লাগছে! মনে হচ্ছে যেন, বুকের ভিতর চেপে থাকা পাথরটা হুট করেই সড়ে গেছে। বহুদিন পর নিজেকে হালকা অনুভব হচ্ছে। বুক ভরে স্বস্থির নিঃশ্বাস নিতে পারছে। কিছু একটা ভেবে মুহূর্তেই আনন্দ উল্লাস টুকু গিলে নেই শক্ত চোয়ালে জানতে চায়,
” ঐ কালনাগিনী এখন কোথায়? খোঁজ জানেন কিছু?”
রূপক অর্থে ব্যবহৃত শব্দটা দ্বারা রক্তিম যে জেরিনকে বুঝিয়েছে চট করে ধরতে না পারলেও একটুক্ষন ভেবেই বুঝে যায় রহমত উল্লাহ। সাথে সাথে জবাব দেয়,
“আমি খোঁজ নিয়েছি বাবা। ওর মামার বাড়ি ছাড়া তো আর যাবার কোনো জায়গা নেই। তাই মামার বাড়িতেই গিয়েছিল। কিন্তু যেখানে বোনের কোনো জায়গা নেই, সেখানে ভাগ্নির জায়গা হবে কিভাবে? জেরিনের মা অনেক আগে থেকেই না কি প্যারালাইজড হয়ে ঘরে পরে ছিল। পরে ওনাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসে ভাইয়ের ছেলেরা। জেরিন ঐ বাড়িতে যাবার পর দরজার সামনে থেকেই তাড়িয়ে দেয় তাকে। আপাতত এক বান্ধবীর বাসায় আছে। চাকরির খোঁজ করছে। একটা চাকরি পেলেই না কি মা’কে নিয়ে আসবে বৃদ্ধাশ্রম থেকে।”
“পাপ কখনো বাপকেও ছাড়েনা। আমি অপাত্রে ভালোবাসা দান করে যেটুকু শাস্তি পাবার পেয়েছি। আমার বাবাও নিজের ভুলের মাসুল দিয়েছে শেষ বয়সে একাকিত্বের মর্মবেদনা সহ্য করে। তো ওরা কিভাবে পাড় পাবে? পাপের প্রায়শ্চিত্ত যেখানে শেষ,পাপির বিনাশ সেখানেই শুরু। মানসিক কষ্টে জর্জরিত হয়েও আমার অবচেতন মন কখনো সৃষ্টিকর্তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়নি। আজ হয়তো আল্লাহ আমাকে সেই প্রতিদানই দিচ্ছেন। পুরোপুরি সন্তুষ্ট করেছেন আমাকে।পাপিষ্ঠ গুলোর পরিণতি শুনিয়ে আমার যে কতটা উপকার করেছেন আপনি, ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা। আমার এতোদিনের ধিকধিক করে জ্বলা তুষের আগুন শীতল হয়েছে। ভাটা পরেছে হৃদয় চরের সর্বগ্রাসীর জোয়ারে। পাপিষ্ঠের পরিণতি জানিয়ে আমার বুকের ভিতরটা শীতল করায় আপনার প্রতি আমি রক্তিম আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।”
হতবিহ্বল রহমত উল্লাহ। যে উন্মাদের উন্মাদনার ভয়ে বুকে তার এতো কাঁপাকাঁপি, সেই উন্মাদ আজ এতো সাধু! বিষয়টা এমন হয়ে গেলনা, যে হুট করেই ধাউ ধাউ করে জ্বলা আগুন পানিতে রূপ নিয়েছে! এ কি আদও সম্ভব? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে রহমত উল্লাহ’র। সাথে এও ভাবছেন, অযথায় এতোক্ষন এতো কাঁপাকাঁপি করে হার্টের বারোটা বাজালো। যে বাঘের ভয়ে জঙ্গল ছেড়ে বাড়ি এসে লুকানো, সেই বাঘই বাড়ি বয়ে এসে বলে, “আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া মামা। আমাকে দেখে ভয় পেয়োনা বাছা।” কথাটা হাস্যকর হলেও কিছুটা এমনই ঘটে গেছে।
“থানা থেকে আবার যদি কেউ ফোন করে কিছু জানতে চায়, বলে দিবেন সংগ্রাম নামের কাওকে চিনেন না। আর হ্যাঁ, ঘটনাটা যেন ভুলেও শিকদার মঞ্জিলের আর কারো কানে না যায়। বিশেষ করে আমার মা। আমি চাইনা আর কোনো কালো ছায়া আমার পরিবারের উপর পরুক। বাবা যেমন আপনাকে বিশ্বাস করতো। আমিও তেমন আপনাকে বিশ্বাস করে দায়িত্বটা দিলাম। আশা করি আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা হবেনা।”
রক্তিমের কথায় হুট করেই রহমত উল্লাহ’র ভাবনার সুতোই টান পরে। সম্পূর্ণ কথা শুনে সাথে সাথে মাথা ঝাকিয়ে উত্তর দেয়,
“এক কালে তোমার বাবা আমার মালিক ছিল। এখন ওনার অনুপস্থিতিতে তুমি আমার মালিক। জীবদ্দশায় তিনি যেমন আমাকে ভরসা করে কখনো ঠকেনি, তুমিও ঠকবেনা। যার নুন খাব তার পিঠে-পিছে ছুরি চালানোর আগে আজরাইল যেন আমার জান কবজ করে নেয়।”
***
সারাটা দিন আবহাওয়া গুমোট ছিল।ভ্যাবসা গরমে উষ্টাগত মানব প্রাণ। সন্ধ্যার পর ঝড়ো হাওয়ায় শীতল হয়েছে প্রকৃতি। ঘন্টা খানিক তুমুল বাতাসের পর শুরু হয়েছে টুপটাপ বৃষ্টি। রাত বাড়ার সাথে বাড়ছে বৃষ্টির বেগ। সদর দরজা হাট করে খুলে রেখে হল রুমে চিন্তিত ভাবে পাইচারি করে যাচ্ছে দৃষ্টি। পাশেই সোফায় বসে আছেন রেহানা বেগম। তিনিও ছেলেকে নিয়ে অল্প চিন্তিত। এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে না জানি কিভাবে বাড়ি আসে! সামান্য ঝড়ো বাতাসেই শহরের বুকে রাস্তার পাশে হুটহাট চোখে পরা দানবাকৃতির গাছ গুলোর ডালপালা যেভাবে ভেঙ্গে পরে, প্রতি বছরই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা শোনা যায়। এসব দেখে-শুনে কি আর নিশ্চিন্তে ঘরে খিল এটে বসে থাকা যায়? দৃষ্টির চঞ্চল চোখ জোড়া একবার সদর দরজার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার দেয়ালে টানানো ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বৃষ্টির গতি এতোটাই যে,দরজার বাইরের এক হাত দূরেও সব ঝাপসা। হাতে থাকা ফোনটাও চার্জের অভাবে মরার মতো নিশ্চুপ হয়ে আছে। কলেজ থেকে এসে ঘরের কাজ করতে গিয়ে আর ফোনের দিকে নজর দেওয়ার সময় হয়নি। যখন নজর যায়, তখন আবার পুরো শহর ঝড়ের জন্য বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন।এদিকে নিষ্ঠুর ঘড়িটাও টিংটিং শব্দ তুলে জানিয়ে দিচ্ছে রাত গভীর হবার বার্তা।পাষাণ শিকদার বোধহয় এই এক জীবনে দৃষ্টিকে কখনো টেনশন ছাড়া অন্য কিছুই দিতে পারবেনা। এই টেনশনে টেনশনে দৃষ্টি যেদিন দুনিয়া ছাড়বে, পাষাণ সেদিন বুঝবে তার জীবনে দৃষ্টি কি অমূল্য রত্ন ছিল। চিন্তার ফাঁকে শাশুড়ির দিকে নজর যায় দৃষ্টির।মানুষটা স্বামী শোকে বয়সের আগেই যেন একদম বুড়িয়ে গেছে। অসুখে জর্জরিত দেহ-মন। এই মানুষটা ছেলের চিন্তায় এতো রাত অবধি জেগে আছে! নিজের থেকেও শাশুড়ির জন্য বেশি মায়া হয় দৃষ্টির। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবে, সে না হয় পরের মেয়ে বউ হয়ে ঘাড়ে ঝুলেছে। তাই তাকে টেনশনে রাখতে পাষাণটার ভালো লাগে। কিন্তু এই বয়স্ক রোগা মানুষটা তো তার নিজের মা। দৃষ্টির কথা না ভাবলেও এই অসুস্থ মানুষটার কথা ভেবেও তো একটু সময়মতো বাসায় ফিরতে পারে! গরু-ছাগল যেমন কখনো মানুষ হয়না, তেমন এই জনম ত্যারা তেদড়টাও বোধহয় কখনো ভালো হবেনা। আজীবন এমনই নিষ্ঠুর, নির্দয় থেকে যাবে। দৃষ্টির ভাবনার আমুল পরিবর্তন হয় হঠাৎ এক ছায়ামানবকে দরজার দিকে দৌড়ে আসতে দেখে। আবছায়া মানুষটাকে দেখে প্রথম দফায় অত্যধিক ভয়ে হৃৎপিন্ড লাফিয়ে উঠলেও, কাছাকাছি আসতেই পরিচিত মুখের সন্ধান পেয়ে শান্ত হয়। একেবারে কাক ভেজা হয়ে ঘরে ঢুকেছে রক্তিম। রেহানা বেগম ছেলের এই অবস্থা দেখেই হাই হাই করে ওঠেন,
“এ কি অবস্থা? গাড়ি থাকতে তুই ভিজে আসলি কেন? এই বৈরী আবহাওয়ায় জ্বর বাঁধানোর শখ হয়েছে তোর?”
“গ্যারেজে গাড়ি রেখে এইটুকু আসতে আসতেই ভিজে গেছি।পুরো পথ ভিজে আসলে আমার অস্তিত্ব খোঁজে পেতে না কি!”
সহসা কপট রাগি ভঙ্গিতে বিরবিরিয়ে ওঠে দৃষ্টি,
“পুরো পথ ভিজে না এসে মহারাজ খুব উপকার করেছেন আমাদের।আসুক আজ জ্বর, একদম ঘর থেকে বেরিয়ে যাব আমি। দেখি কে সেবা করে!”
বিরবিরিয়ে কথা গুলো বললেও রক্তিমের মনযোগ দৃষ্টির রাগি মুখটার দিকে থাকায় ওর ঠোঁট নাড়ানোর ভঙ্গিতেই বুঝে যায় সব কথা। দাঁতে নিম্নষ্ঠ চেপে নিঃশব্দে হেসে ওঠে রক্তিম। সেই দুপুর থেকে তার কি যে এক রোগ হলো! কারণে অকারণে ঠোঁটের কোণে আপনাতেই হাসি চলে আসছে। অতি বিরক্তিকর কোনো কিছু চোখের সামনে আসলেও মন থেকে খুশি ভাব বিলীন হচ্ছেনা। তার পাগল বউটা যদি তার হঠাৎ পরিবর্তিত এই রূপ দেখে, ঠিক থাকতে পারবে তো তখন? না কি অতি আশ্চর্যান্বিত হয়ে অ্যাটাক-ফ্যাটাক করে বসবে! ভেবে তোয়ালে দিয়ে মুখ ঢেকে আরও এক দফা হেসে নিল রক্তিম। পরপর দৃষ্টির দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে জানতে চায়,
“কিছু বললে আমাকে?”
ত্যাড়ছা চাহনিতে রক্তিমের দিকে তাকায় দৃষ্টি। মোমবাতির হলদে অগ্নিশিখায় গম্ভীরমুখোর মুখটা কতটা স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে! মোহাবিষ্ট হয় দৃষ্টি। নিজের একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষটার দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে অপলক। দৃষ্টির এমন চাহনির তোপে পরে রক্তিম আড়চোখে তাকায় মায়ের দিকে। যে আপাতত দরজা আটকাতে ব্যস্ত। এদিকে ঘুরেই ছেলের দিকে পুত্রবধূকে এভাবে মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখলে সর্বনাশ! জুড়ে জুড়ে কেশে ওঠে রক্তিম। গলা খাঁকারি দিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বলে,
“দ্রুত খাবার দাও। আমি চেইঞ্জ করে আসছি।”
হুশ ফিরে দৃষ্টির। একটু আগের কথা স্বরণ হতেই লজ্জায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পরে গাল জুড়ে। ঝুকে যায় শিরদ্বারা। যেন লজ্জাবতী কোনো মানবের ছোঁয়ায় লজ্জায় মিশে গেছে মাটির সাথে।