Monday, June 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 236



দৃষ্টির আলাপন পর্ব-৩৪+৩৫

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩৪
#আদওয়া_ইবশার

ঋতু পাল্টেছে। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন এসেছে প্রতিটা জিনিসে। নতুনত্বের ছোঁয়া লেগেছে প্রকৃতিতে। জরাজীর্ণ গাছপালা ছেয়ে গেছে কচি পাতায়। শিমুল,পলাশের আগুন রাঙা রূপের বাহার, কোকিলের কুহুতান, বুনোফুলের মাতাল ঘ্রাণ জনমানবের মনে প্রেমের গুঞ্জন ছড়াচ্ছে। প্রকৃতির নতুনত্ব যেন মানব মনেও নতুনত্বের ছোঁয়া দিয়েছে। কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী সময়ে অসময়ে ভালো লাগার আবেশে গুনগুনিয়ে গেয়ে যাচ্ছে, “বসন্ত এসে গেছে”। প্রিয় ঋতুর মন ভুলানো রূপ, সাথে ভালোবাসার মাস। দুইয়ে মিলে শহর জুড়ে সে কি আনন্দোচ্ছ্বাস!

প্রকৃতির সাথে বিস্তর পরিবর্তন আসে মানব জীবনেও। কিঞ্চিৎ পরিবর্তন এসেছে দৃষ্টি-রক্তিমের জীবনেও। দৃষ্টির চান্স হয়েছে কবি নজরুল সরকারি কলেজে। রক্তিমের নির্দেশেই মেহেদীর সাথে গিয়ে যথাসময়ে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করে এসেছে। আগের থেকেও উন্নতি হয়েছে রক্তিমের শারীরিক অবস্থার। একটু একটু করে সচল হচ্ছে অচল পেশী। সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদ আর দৃষ্টির ভালোবাসার জুড়ে নিজের পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারছে। হাটা-চলা এখনো অন্যের নির্ভরতায় করতে হয়। ডাক্তার জানিয়েছে একুটুও খুব শিঘ্রই সম্ভব হবে। রেহানা বেগম এক প্রকার বাধ্য হয়েছে শিকদার মঞ্জিলে ফিরে যেতে। কিছুদিন আগেই কাকলির মা এসে জানিয়ে যায় আজীজ শিকদার ভিষণ অসুস্থ। হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে। দুই-একটা কথা বলতেই হাপিয়ে যায়। শ্বাস কষ্ট শুরু হয়। খাওয়া-দাওয়ার ভিষণ অনিয়ম। সব মিলিয়ে সজ্জাশায়ী। এমতাবস্থায় একজন এমপির দায়িত্ব পালন করা বড্ড দুরহ। দুদিন আগেই পদত্যাগ করেছে নিজ ইচ্ছায়। যে মানুষের নিজের পরিবারকে আগলে রাখার ক্ষমতা নেই, সেই মানুষ কিভাবে গোটা একটা উপজেলার মানুষদের সুখে-দুঃখে আগলে রাখবে?তাছাড়া যে সন্তানকে বেঁধে রাখতেই নিজের পূর্ব পরিকল্পনা না থাকা সত্বেও নিজেকে বসিয়েছিল এমপি আসনে। সেই সন্তানেই যখন থাকলনা, তখন কেন এই আসনে বসবে?

রেহানা বেগম যে মানুষটার সাথে এতো গুলো বছর এক ছাঁদের নিচে সংসার নামক মায়ার জালে আটকা পরে কাটিয়ে দিয়েছে অনায়াসে। সেই মানুষটার এমন দুর্দিনের সংবাদ শুনে মনটা হুহু করে কেঁদে ওঠে। বাবা নামক বট বৃক্ষটা যতই আঘাত দিক। এমন একটা খবর শুনে তাকে হারানোর ভয়ে তবুও বুক কাঁপে রক্তিমের। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত বুকের ভিতরটা দিন শেষে নিজের সাথে বেঈমানি করে সেই বাবা নামক বট বৃক্ষের দুর্দশা শুনে উচাটন শুরু করে। রক্তিম চেয়েও পারেনা জন্মদাতার প্রতি মন থেকে পুরোপুরি ঘৃণার সৃষ্টি করতে। কোথাও যেন ফাঁকফোকরে অল্প টান থেকেই যায়। রক্তের টান! সে টান কি আর মৃত্যুর আগে নিঃশেষ হতে পারে! দুঃখ-কষ্ট, অভিমানের পাহাড় পুরোপুরি না ভাঙলেও দুটানায় ভুগতে থাকা মা’কে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠিয়ে দেয় শিকদার মঞ্জিলে। এতো গুলো বছর যে মানুষটার ছত্রছায়ায় থেকেছে, সেই মানুষটাকে শেষ বয়সে একটা ভুলের জন্য নিঃসঙ্গতার মতো এতো বড় শাস্তি দিতে না পারলেও পুরোপুরি সঙ্গও দিতে নারাজ রেহানা বেগমের মন। শিকদার মঞ্জিলে ফিরে গেলেও খুব একটা কাছঘেষেনা আজীজ শিকদারের। অপরের মতো দূর থেকে প্রয়োজন-অপ্রয়োজন দেখে যায়। কাকলির মায়ের হাতেই সময় মতো পাঠিয়ে দেয় খাবার,ঔষধ। রাত হলেও আগের মতো আর স্বামীর পাশে ঘুমানোর জন্য আসেনা। আলাদা হয়েছে বিছানা। আজীজ শিকদার’ও কোনো অভিযোগ করেনা। মেনে নেয় সকলের নিরব প্রতিশোধ। ভেবে নেয় এটাই তার ভবিতব্য। সন্তানদের ভালো করতে গিয়ে মস্ত বড় যে ভুল করেছে, সেই ভুলের কাছে এই নিরব প্রতিশোধ তেমন কিছুই না। এর থেকেও জঘন্য শাস্তি দিলেও হয়তো কম হয়ে যাবে। আবার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় স্ত্রী-সন্তানকে বলতে,এমন নিঃসঙ্গতার মতো অসহনীয় শাস্তির থেকে মেরে ফেলুক একেবারে। কিন্তু পারেনা।ভয় হয়। এটুকু বলতে গিয়েও যদি আবার কোনো ভুল হয়ে যায়! যে মানুষ ভালো করতে গিয়েও অজান্তেই সন্তানের খারাপ করতে পারে, সে মানুষ আর কি’ই বা ভালো করতে পারে! যে ভালো সুন্দর, সুস্থ্য একটা পরিবারকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পারে। যে ভালো সন্তানকে আলোর পথ থেকে টেনে অন্ধকার নিয়ে যেতে পারে, সে ভালো করার থেকে না করাই শ্রেয়। আয়ুষ্কাল আছেই বা আর কতদিন! যেটুকু সময় অবশিষ্ট আছে, সেটুকু না হয় এভাবেই প্রতিশোধ প্রতিশোধ খেলাই কাটিয়ে দিল। শেষ বয়সে এসে আত্মগ্লানিতে জ্বলে,পুড়ে ছাই হোক অন্তর। তবুও ভালো থাকুক সন্তান।

বাবা অন্তঃপ্রাণ ইতিটাও এখন আর বাবার সাথে মন খুলে কথাও বলতে চায়না। ইচ্ছে হলে শশুর বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে এসে এক নজর বাবাকে দেখে যায়। অথচ ভাইকে ঠিকই রোজ একবার হলেও এসে দেখে যায়।ভাইয়ের করুণ পরিণতির দায় বাবার ঘাড়ে চাপিয়ে কোমল হৃদয়টা বাবার প্রতি পাষাণ বানাতে গিয়ে পুরোপুরি সফল হতে না পারলেও যেটুকু পেরেছে ইতি মনে করে সেটুকুই বাবার জন্য বিরাট বড় শাস্তি। দূরহ যন্ত্রণা সইতে না পেরে আজীজ শিকদার একদিন ইতিকে বলেছিল,

“মা!এখন আর এই পাপী বাবাকে বাবা বলে ডাকতেও ইচ্ছে করেনা?”

প্রত্যুত্তরে নির্বাক দৃষ্টিতে ইতি ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাওয়া বাবা নামক এক পরাজিত সৈনিকের দিকে তাকিয়েছিল কতক্ষণ। পরপর অসহায় কন্ঠে জানতে চেয়েছিল,

“এটুকু মিথ্যের আশ্রয় না নিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো? মিথ্যে যে কখনো সুফল বয়ে আনেনা পেলে তো তার প্রমাণ! তাছাড়া যে ছেলেকে বাঁচাতে এতো বড় মিথ্যের আশ্রয় নিলে সেই ছেলে আজ কোথায়? বাবার এমন অসুস্থতার সময় পাশে নেই কেন সে? কেন আমার অসুস্থ ভাইটা আজ বিছানায় পরে ছটফটায় বাবা নামক ধ্বংস কারিগরের দুর্দিনের খবর পেয়ে! আমার ভাইটাকে এতো বড় শাস্তি না দিলেও পারতে। পাপ ঢেকে যে পাপের রাজ্য গড়েছো সেই পাপের রাজ্যের অভিশাপ তো এখন নিজের উপরেই আসবে। এটুকু তোমার প্রাপ্য।”

****
রক্তিমকে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরছে দৃষ্টি, মেহেদী। সকলের মনটা আজ বড্ড ফুরফুরে। ডাক্তারের কথায় অন্যরকম এক প্রশান্তি কাজ করছে মনে। রক্তিম পুরোপুরি সুস্থ্য। এখন নিয়মিত প্রেশারের ঔষধ গুলো খেয়ে গেলেই হবে। এর থেকে বড় খুশির সংবাদ তাদের জীবনে আর কি হতে পারে! হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে কিছু পথ আসতেই জ্যামে পরেছে। গাড়ির বিশাল লম্বা লাইন। মনে হয়না আধা ঘন্টার আগে জ্যাম ছুটবে। গাড়ির ভিতরে থেকেই মনের সুখে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে থাকে দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে বিজয়ের হাসি। হঠাৎ চোখ যায় ফুটপাতের পাশে সাড়ি সাড়ি ফুলের দোকানে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে সেদিকেই। অপলকে দেখে যায় কিছু জোড়া শালিকের খুনশুটি। মনে ইচ্ছে জাগে, সেও রক্তিমের হাত ধরে হারিয়ে যাবে ঐ ফুলের রাজ্যে। হাজার ফুলের ভিতর থেকে রক্তিম ভালোবেসে একটা ফুল ছিনিয়ে নিবে তার জন্য। যত্ন নিয়ে গুজে দিবে খোপা করা রেশম, কালো চুলের ভাজে। কিন্তু মনে হয়না দৃষ্টির এই ইচ্ছেটাকেও কখনো পূর্ণতা দিবে গম্ভীরমুখো পাষাণ শিকদার। এই পাষাণটাকে ভালোবেসে তার সাথে থাকতে হলে হয়তো মনের সকল ইচ্ছেকেই এভাবে অচিরেই মনের গহীনে দাফন করতে হবে। তবুও চেষ্টা তো একটু করতেই পারে! ভেবেই রক্তিমের দিকে ঘুরে তাকায়। রক্তিম অপজিটে বাইরের দিকে তাকিয়ে নিজ ভাবনায় ধ্যানমগ্ন। দৃষ্টি ভেবে পায়না সারাক্ষণ এতো কি ভাবে মানুষটা! তাকে যে এতো ভাবে চিন্তা করার জন্য বারণ করা হচ্ছে, সে গায়েই লাগাচ্ছেনা কারো কথা। চিন্তায় চিন্তায় আবারও স্ট্রোক করে একদম সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে চিরনিদ্রিত হয়ে তবেই হয়তো এই চিন্তা ছাড়বে।

গলা খাঁকারি দিয়ে রক্তিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় দৃষ্টি।ধ্যান ভঙ্গ হয়ে ভ্রু কুঁচকে দৃষ্টির দিকে তাকায় রক্তিম। ইশারায় জানতে চায়, “হয়েছে কি?”
একটু নড়েচড়ে বসে দৃষ্টি। সময় নিয়ে জানতে চায়,

“খারাপ লাগছে আপনার?”

শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে না জানিয়ে দেয় রক্তিম। পরমুহূর্তে দৃষ্টি আবারও জানতে চায়,

“কিছু খাবেন?”

আগে শুধু ভ্রু দ্বয় কুঁচকে থাকলেও এই প্রশ্নে চোখ-মুখ’ও কুঁচকে নেয় রক্তিম। বিরক্তি ভঙ্গিতে বলে,

“বাচ্চা মনে হচ্ছে আমাকে?”

“শুধু কি বাচ্চাদেরই খিদে লাগে? বড়দের খিদে লাগেনা?”

“তিন বেলার বদল ছয় বেলা খাওয়ার মানুষ আমি না।”

জবাব দিয়ে আবারও মুখ ঘুরিয়ে বাইরে দৃষ্টিপাত করে রক্তিম। দৃষ্টি রক্তিম যাতে শুনতে পারে এমন ভাবেই বিরবিরিয়ে উচ্চারণ করে,

“খাবে কিভাবে ছয় বেলা! জনম কিপ্টা একটা। তিন বেলা যে খায় এটাও বোধহয় না খেয়ে বেঁচে থাকার পলিসি থাকলে খেতনা। বাপ জন্মে এমন কিপ্টা লোক দেখিনি আমি।”

কথা গুলো স্পষ্ট শুনতে পেয়ে খ্যাপে যায় রক্তিম। চোখ পাকিয়ে তাকায় দৃষ্টির দিকে। জানতে চায়,

“কয় বেলা না খাইয়ে রেখেছি? কোন চাওয়াটা অপূর্ণ রেখেছি, যার জন্য এমন কথা মুখে আসছে?”

এই একটা কথা শোনার জন্যই তো এতোক্ষনের এতো প্যাচাল! অবশেষে সুযোগ পেয়ে চোরা হাসে দৃষ্টি। পরোক্ষনে হাসিটা বিলীন করে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

“বিয়ের পর থেকে এখন পযর্ন্ত যে স্বামী দশ টাকার একটা বকুল ফুলের মালাও এনে দিলনা, সে আবার জানতে চায় কোন চাওয়া অপূর্ণ রেখেছে! একেই বলে চোখ থাকিতেও অন্ধ।”

ফুলের দোকানে নজর যেতেই রক্তিম ঠিকই টের পায় দৃষ্টির হা-হুতাশের কারণ। তবুও কিছু বলেনা। শান্ত দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। হতাশ হয় দৃষ্টি। সামান্য দশ টাকার একটা বকুলের মালা কিনে দিলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেতো! বউয়ের ইচ্ছে জানার পরও কিভাবে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে! দৃষ্টিরই ভুল। বেহায়া মন জানে, পাষাণতুল্য মানুষটা সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকে, তার ইচ্ছে গুলোকে গলা টিপে হত্যা করে পৈশাচিক আনন্দ পাবার জন্য। তবুও কেন মন অযথা আশা রাখে! জ্যাম ছুটে গেছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে আপন গতিতে। বাকিটা পথ দৃষ্টির অভিমানী মন মুখ ফিরিয়ে রেখেছে রক্তিমের থেকে। কিন্তু বাড়ি পৌঁছে ঠিকই আবার স্বামীর সেবায় বোধ হয়ে থেকেছে। ব্যস্ত পায়ে ছুটাছুটি করে যা যা লাগবে নখদর্পণে রেখেছে।

****
দিনের আলো একটু একটু করে ম্লান হচ্ছে। শহরের অলিতে গলিতে জ্বলে উঠেছে নিয়ন বাতি। ব্যস্ত শহর জুড়ে শুরু হয়ে গেছে আলোর মেলা।স্বাভাবিক হাটা-চলার শক্তি ফিরে পেতেই রক্তিম নিজ মর্জিতে চলা শুরু করে দিয়েছে। সাহেব এখন বোধহয় আবার ভুলে গেছে ঘরে তার বউ আছে। তাকেও একটু আধটু সময় দিতে হয়।ইচ্ছে হয় তারও স্বামীর সাথে বসে দু-দন্ড গল্প করতে। মহা ব্যস্ত মানুষের এসব ভাবার সময় কি আর আছে!মন খারাপের পসরা সাজিয়ে বহুদিন পর বই খুলে বসেছে দৃষ্টি। নতুন বইয়ের পাতা না উল্টানো হলেও সময় তো আর থেমে থাকছেনা। সে নিজ গতিতে ঠিকই এক একটা নতুন দিনকে পুরোনো করে আরও নতুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই হুট করে হয়তো কোনো দিন এয়ার ফাইনাল দোরগোড়ায় কড়া নাড়বে। নিরুপায় দৃষ্টি তখন বইয়ের অভিশাপে ফেল্টুস দৃষ্টির উপাধি পেয়ে যাবে। সমস্ত চিন্তা একপাশে রেখে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে পড়াই মনযোগ দেয় দৃষ্টি। টানা দুই ঘন্টা পড়েই হাপিয়ে যায়। বইয়ের সাথে এতোদিনের বিচ্ছেদে মস্তিষ্কে ঝং ধরেছে। আস্তে আস্তে সে ঝং সাড়াতে হবে আবার। নইলে সর্বনাশ। এটুকু সময় পড়েই গলাটা মনে হচ্ছে শুকিয়ে গেছে। বড্ড চায়ের পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে যে এক কাপ চা করে আনবে সেই সাহস টুকুও নেই। বাড়িটা এমন এক জায়গায়, চারপাশ মনে হয় একেবারে জনমানবশূন্য। এমন ভুতুড়ে পরিবেশে কোনো মেয়েরই সাহস হবেনা সন্ধ্যার পর একা ঘর থেকে বের হতে। রাত বিরাতে চায়ের পিপাসা মিটানোর জন্য হলেও মনে হচ্ছে ঘরের ভিতর একটা চুলার ব্যবস্থা করতে হবে।

আরও ঘন্টা দুয়েক পর বাড়ি ফিরে রক্তিম। ক্লান্তশ্রান্ত চেহারা। গায়ের সাদা শার্টটা ঘামে ভিজে চুপচুপে। এমন হাল দেখে অবাক হয় দৃষ্টি। কন্ঠে অঘাৎ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,

“এমন অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে কোথায় মাটি কাটতে গিয়েছিলেন। কি পরিমাণে ঘাম ঝরছে শরীর থেকে!”

কোনো উচ্চবাচ্য ছাড়াই শরীর থেকে শার্ট খুলতে খুলতে জবাব দেয় রক্তিম,

“দোকান পরিষ্কার করে এসেছি। কালকে মাল আসবে।”

বিস্ময়ের মাত্রা এবার যেন আকাশ ছোঁয়া দৃষ্টির। জানতে চায়,

“কিসের দোকান?”

এবার একটু বিরক্ত হয় রক্তিম। নিচু ধমকের সাথে বলে,

“একসাথে এতো জবাব দিতে পারবনা।অবস্থা কি চোখে দেখাই যাচ্ছে। একটু দম ফেলতে দাও।”

থমথম খেয়ে চুপ হয়ে যায় দৃষ্টি। দৌড়ে গিয়ে আলনা থেকে কাপড় এগিয়ে দেয়। মিনমিন করে জানতে চায়,

“গোসল করবেন?”

“হ্যাঁ।” ছোট্ট করে জবাব দেয় রক্তিম। তৎক্ষণাৎ এতোক্ষনের একা বাইরে যাবার ভয়টাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ছুটে যায় কলবারে। চাপকল চেপে বালতি অর্ধ ভর্তি করতেই পৌঁছায় রক্তিম।

“আমি তুলছি। সরো।”

সাথে সাথে দ্বিমত পোষণ করে দৃষ্টি। মাথা ঝাকিয়ে বলে ওঠে,

“একদম না। মাত্র কয়েক দিন হলো সুস্থ্য হয়েছেন। এখনই এই হাতে এতো চাপ সৃষ্টি করা ঠিক হবেনা। তবুও কিসের কি দোকান পরিষ্কারের নাম করে না জানি কতটুকু বল খাটিয়েছেন।”

আর কোনো প্রত্যুত্তর করেনা রক্তিম। চুপচাপ সাইডে দাঁড়িয়ে শান্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকে দায়িত্বশীল এক বধূকে। যে বধূ স্বামীর শত তাচ্ছিল্যতা মুখ বুজে সহ্য করেও অটুট নিজ দায়িত্বে। কখনো এক বিন্দু কার্পন্যতা করছেনা। না আছে চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। গোসল শেষে দুজনে একসাথে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সেড়ে রক্তিম বারান্দায় বিছিয়ে রাখা শীতল পাটিতেই শরীর ছেড়ে কাত হয়ে শুয়ে পরে। বারান্দার গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে লিলুয়া বাতাসের সাথে থৈ থৈ জোৎস্নার আলো লুটিয়ে পরছে। পূর্ণ চন্দ্রিমার আলোয় এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য ভর করেছে চারপাশে। হৃদয় শীতল করা বাতাস, আর এক ফালি চাঁদের আলো, এর থেকেও সুন্দরতম মুহূর্ত আর কি হতে পারে! দুজন কপোত-কপোতির এক মায়াময় স্মৃতি তৈরির জন্য এমন একটা পরিবেশের থেকে উত্তম দ্বিতীয়টা নেই।

ঝটপট চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে দেয় দৃষ্টি। অভিজ্ঞ হাতে দু-কাপ চা করে নিজেও বসে পরে রক্তিমের পাশে। একটা কাপ নিজের কাছে রেখে অন্যটা বাড়িয়ে দেয় রক্তিমের দিকে। চায়ের কাপে ঠোঁট ভিজিয়ে নিরবে অনিন্দ সুন্দর মুহূর্তটাকে উপভোগ করতে ব্যস্ত দুজন। কিছু পল অতিবাহিত হবার পর নিরবতার জাল ছিড়ে রক্তিম। শান্ত কন্ঠে চাঁদের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলতে শুরু করে,

“আমি আর মেহেদী মিলে অনেক আগে থেকেই একটা বিজনেস প্ল্যান করেছিলাম। মাঝে এতো কিছু ঘটে যাওয়ায় তখন সেটা সম্ভব না হলেও ইচ্ছেটা জীবিত ছিল। আপাতত বাজারের একটু ভিতরে স্বল্প ভাড়ায় দুটো দোকান রেখেছি। স্টক মালের ব্যবসা শুরু করছি। ইচ্ছে আছে বড় কিছু করার। আমার মতো হাজারটা না হলেও দুই-একটা ছন্নছাড়া রক্তিমের কর্মসংস্থান গড়ার।স্বপ্ন দেখবনা বলেও আবার একটু স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হলো আর কি। ভাগ্যকে না হয় শেষ একটা সুযোগ দিয়েই দেখলাম।”

“আর আমাকে?” নিরবে রক্তিমের কথা গুলো শুনে আচমকা প্রশ্নটা করে বসে দৃষ্টি। হঠাৎ এমন একটা প্রশ্নে একটু চমকায় রক্তিম। মুহূর্ত ব্যবধানেই দুজনের দৃষ্টির মিলন ঘটে। ভরাট স্বরে রক্তিম বলে,

“আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া অতীতের গল্পটা একজনের কাছে বলার ইচ্ছে ছিল। হবে সেই একজন?শুনবে আমার সেই বিষাক্ত অতীত?”

“কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছেন?”

“উঁহু। গল্পছলে উত্তর দেবার চেষ্টা করছি।”

“অতীতের সবটা তো জেনেই গেছি। তবে কোন গল্পে উত্তর দিবেন?”

স্মিত হাসে রক্তিম। বলে,

“কিছু কিছু জানার মাঝেও হাজার অজানা লুকিয়ে থাকে। আমি সেই অজানাটাই জানাতে চাই। হালকা করতে চাই বুকের ভিতরটা।”

রক্তিমের থেকে নজর সরিয়ে অন্যদিকে তাকায় দৃষ্টি। কিঞ্চিৎ ভয়ের সঞ্চার হয় মনে। ভাবে ভালোবাসার মানুষের লুকানো অতীত জানার পর মন জমিনে আবার না জানি কোন বিষ ফোড়া সৃষ্টি হয়!দ্বিধান্বিত মন নিয়েই পূণরায় তাকায় রক্তিমের দিকে। কাঁপা স্বরে বলে,

“আপনার যদি মনে হয় আপনার সেই লুকানো অতীত শোনার যোগ্য আমি, তবে বলতে পারেন। যে অতীত জানালে আপনার মন হালকা হবে, সেই অতীত শুধু একবার না, বারবার জানতে রাজি আমি।”

আবারও নিরবতায় ছেয়ে যায় চারপাশ। পিছনে দু-হাত ভর করে দূর আকাশের মুক্ত ঝরা আলো ছড়ানো সেই নিটোল চাঁদের দিকে তাকিয়ে রক্তিম বলতে শুরু করে সেই অতীত। হৃদয় পুড়ে ছাই হওনা সত্বেও যে অতীত যত্ন করে মনের ভিতর লুকিয়ে রেখেছিল এতোদিন।,

“আমি তখন সদ্য ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমাদের কলেজের অপজিটেই আরেকটা কলেজ ছিল। সেখানেই একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে দেখা হয় এক রূপবতীর সাথে। যার রূপের ঝলকে প্রথম দেখাতেই খুব বাজে ভাবে আটকে গেছিলাম আমি। প্রতিদিন এক নজর দেখার জন্য হলেও ছুটে যেতাম সেই কলেজে। একদিন লক্ষ্য করলাম মেয়েটা আমাদের কলেজ গেটের সামনে দিয়েই যাতায়াত করে। সেই থেকে সকাল বিকেল নিয়ম করে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মুগ্ধ নয়নে দেখতাম সাদা ইউনিফর্ম পড়নে এক শুভ্রপরীকে। মেয়েটাকে কখনো আমি সাজতে দেখিনি। ঠোঁটে স্বাভাবিক কৃত্রিম রং লাগানোও কখনো দেখিনি। সেই অতি সাধারণ মেয়েটার সৌন্দর্যের মায়াতেই দিনের পর দিন বোধ হচ্ছিলাম আমি। একটা সময় বুঝতে পেরেছিলাম মন ভালোবেসেছে মেয়েটাকে। তাকে পাবনা ভাবলেই দম বন্ধকর পরিস্থিতি অনুভব করতাম। কেমন যেন পাগল পাগল লাগত নিজেকে। কিন্তু সাহস হতনা কখনো মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলার। অবচেতন মন ভাবতো যদি মেয়েটা ভুল বুঝে! সময় এভাবেই যাচ্ছিলাম। এক পাক্ষিক ভালোবাসা বুকে নিয়ে তাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম আমি। প্রতিদিনের মতো সেদিনও আমি কলেজের গেইটের সামনে অপেক্ষায় ছিলাম তাকে এক নজর দেখব বলে। সেও এসেছিল ঠিক সময়ে। আমাকে পাশ কাটিয়ে চলেও গিয়েছিল। এরপর হুট করে আবার পিছু ফিরে এগিয়ে আসে আমার দিকে। সামনে দাঁড়িয়ে অবলীলায় জানতে চেয়েছিল, “আপনি কি প্রতিদিন এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখুন?” সেই মুহুর্তে যে কতটা ভয় পেয়েছিলাম আমি তা আমি ছাড়া কেউ জানেনা। কতক্ষণ মেয়েটার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে সত্যটাই বলে দিয়েছিলাম। পরপর মেয়েটা আবারও প্রশ্ন করেছিল, “কিন্তু কেন?” বুকে কাঁপন নিয়েই সেদিন সাহস করে বলে দিয়েছিলাম ভালোবাসি আমি তাকে। প্রত্যুত্তরে মেয়েটা আমার দিকে চুপচাপ কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গিয়েছিল। হতাশ হয়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম হয়তো তার আমাকে পছন্দ নই। যদি পছন্দ হতো তবে নিশ্চয়ই এভাবে উপেক্ষা করতে পারতনা। এই ঘটনার পর আরও মাস খানেক কেটে যায়। মেয়েটার কোনো জবাব না পেয়ে হতাশ হয়েও রোজকার নিয়ম আমি বদলাতে পারিনি। না পেরেছিলাম তার প্রতি সৃষ্টি হওয়া ভালোবাসা মুছে ফেলতে। নিয়ম করে সেই সকাল দুপুর গেটের সামনে অপেক্ষায় থাকতাম এক নজর দেখার। মাস খানেক পর এক সন্ধ্যায় হুট করে আমার হোস্টেলের দারোয়ান রুমে খবর নিয়ে যায় কেউ একজন আমার জন্য রাস্তায় অপেক্ষায় আছে। কিছুটা অবাক হয়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম এই সময় তো আমার সাথে কারো দেখা করতে আসার কথা না। বাবা আসলে ফোন করে আগেই বলে দিত। ভাবতে ভাবতেই নিচে যায়। সেখানেই অপেক্ষা করে ছিল আমার জন্য সবথেকে বড় একটা চমক। তখন বোকা মন বুঝতে পারেনি সেই চমকটাই ছিল আমার জীবন ধ্বংসের এক টুকরো আলামত। আলো-আধারির সন্ধ্যায় সেই মেয়েটা বধূ বেশে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার পাশে। কৃত্রিম সাজের ছোঁয়া লাগা মুখটাই ছিল রাজ্যের ভয়। বারবার এদিক সেদিক দেখছিল। আর আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নয়নে দেখছিলাম সেই ভিতু নব বধূ সাজে অপরূপা মোহিনীকে। অঘাৎ বিস্ময় জন্মেছিল মনে। সে এভাবে বধূ বেশে আমার হোস্টেলের সামনে কেন আসবে? তার সামনে দাঁড়ানোর পর সেই জবাব পেয়েছিলাম আমি। ছোট বেলায় তার বাবা মারা যায়। তখন না কি তার বয়স ছিল দেড় কি দুই বছর। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান সেই ছিল। ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে যুবতী বয়সে তার মা একা টিকতে পারেনি স্বামীর বাড়ি। বিধবা মেয়ে মানুষ একা থাকাটা এই সমাজে মুখের কথা না। কিছু চরিত্রহীন শকুনের নজরে টিকতে না পেরে আশ্রয় নেয় বাপের বাড়ি। ভাই-ভাবি প্রথম প্রথম একটু ভালো ভাবে দেখলেই মেয়ে যত বড় হচ্ছিলো, খরচ বাড়ছিল আবার সবার চোখের কাটা হচ্ছিলো। একাদশ শ্রেণি পযর্ন্ত মা এক প্রকার যুদ্ধ করেই পড়িয়েছিল তাকে। এরপর আর পারছিলনা ভাই-ভাবির সাথে। জোর করে মেয়ের মতামত ছাড়াই অর্থের লোভে এক বিবাহিত বয়স্ক লোকের সাথে বিয়ে ঠিক করে। সেটা মানতে না পেরেছি সেদিন সে ছুটে এসেছিল আমার কাছে। জানতে চেয়েছিল আমি তাকে সত্যিই ভালোবাসি কি না। যদি ভালোবাসি, তবে যেন সেদিন সেই মুহূর্তে তাকে বিয়ে করে তার দায়িত্ব নেই আমি। না হয় আজীবনের জন্য হারাতে হবে। হারিয়ে ফেলার কথা শুনে আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। তখনই ফোন করি বাবার কাছে। কোনো আবদার রাখি প্রথম বারের মতো। আমার ভালোবাসার পূর্ণতা চাই তার কাছে। বাবা সেদিন আমার একটা কল পেয়েই ছুটে গিয়েছিল। আমাকে আর তাকেও অনেক ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছিল। সেই মুহূর্তে বিয়েটা করলে আমার ডিফেন্স হবার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। কখনো তা পূর্ণতা পাবেনা। ভালোবাসার কাছে সেদিন আমার স্বপ্নের মূল্য ফিকে হয়ে গিয়েছিল। জানিয়ে দিয়েছিলাম যেকোন মূল্যে আমি তাকে চাই। নিরুপায় হয়ে বাবা ওনার ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধুর সহযোগীতায় লুকিয়ে আমাদের বিয়েটা সম্পন্ন করে। তাও শুধু ইসলামিক শরীয়ত মোতাবেক। প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল যতদিন পযর্ন্ত আমার চাকরি না হচ্ছে আর যতদিন পযর্ন্ত চাকরির পর আমি বিয়ের অনুমতি না পাচ্ছি ততদিন আমরা একসাথে থাকতে পারবনা। সে আমাদের বাড়িতেই আমার আত্মীয় হিসেবে থাকবে। আর আমি থাকব হোস্টেলে। মেনে নিয়েছিলাম দুজনেই সেই কথা।
সময় গুলো খুব ভালোই যাচ্ছিল আমাদের। বাবা আবার তাকে সাভারে নতুন করে কলেজ ভর্তি করিয়ে দেয়। সে বাড়িতে আর আমি হোস্টেলে। ফোনালাপে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হতো আমাদের। শিক্ষা জীবন শেষে চাকরি পাবার পর আমাদের দূরত্ব বাড়ল আরও। আগে যাও কিছুদিন পর পর ছুটিতে বাড়ি গেলে দেখা হতো, সেটাও হচ্ছিলনা। ট্রেনিং অবস্থায় চট্টগ্রাম ক্যান্টলম্যান্ট থাকতে হয় আমাকে। সেই সময় বুঝতে পারি সেও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এভাবে সময় যেতে যেতে চাকরি জীবনে কেটে যায় আরও দুই বছর। এরপর ক্যাপ্টেন থেকে পদোন্নতি হয় আমার। একজন আর্মি মেজর হিসেবে পরিচয় পাই নিজের। ওহ হ্যাঁ! এর মাঝেই বিয়ের অনুমতিও পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন সে রাজি ছিলনা। পরীক্ষার অযুহাতে আরও কিছুটা সময় চেয়েছিল। তবে সে যে আমার স্ত্রী তা আর গোপন থাকেনা। ছড়িয়ে পরে পুরো এলাকায়। এরপরই এক সময় আমি নিজেই ধৈর্য্যহারা হয়ে তাকে চাপ দেই আবার বিয়ের। ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রী হলেও আইনত স্বামী-স্ত্রী ছিলাম না। দূরত্বটা আমার আর সহ্য হচ্ছিলনা। কি আর করব! রক্তে-মাংসে গড়া পুরুষ মানুষ বলে কথা। হরমোনাল কারিশমার কাছে বারবার পরাজিত হচ্ছিলাম। একসময় সেও রাজি হয়। আনন্দের আমার অন্ত থাকেনা। লম্বা একটা ছুটি নিয়ে রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ি যেতে যেতে মাঝ রাত হয়। বাবাকে জানিয়ে দেই আগেই আমি আসছি। আর কাওকে জানাইনি। ভালোবাসাকে সারপ্রাইজ দিব ভেবেছিলাম। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে থেকেই তার সাথে থেকে সমস্ত চাওয়া পূরণ করব। কিন্তু সেদিন তাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আমি নিজেই যে মস্ত বড় এক সারপ্রাইজ পেয়ে যাব ভাবিনি কখনো। চুপিচুপি মধ্য রাতে বাবার সহযোগীতায় ঘরে ঢুকে নিজের রুমের দিকে যাবার সময় হঠাৎ একটা রুমের সামনে থমকে যায়। একের পর এক শিৎকারের শব্দে কান গরম হয় আমার। আমার জানা মনে বাড়িতে তখন মা-বাবা, সংগ্রাম, ইতি আর সে ছাড়া অন্য কেউ নেই। সেখানে এমন একটা ঘটনা কিভাবে ঘটতে পারে! বোধশক্তি হারিয়ে দরজায় অল্প আঘাত করতেই খুলে যায়। দুজন মানুষ খেলায় এতোটাই মত্ত ছিল দরজা লাগানোর চিন্তাটাও মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। চোখের সামনে নিজের ছোট ভাই আর প্রাণপ্রিয় নারীটাকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে এক মুহুর্তের জন্য সব ভুলে গিয়েছিলাম আমি। মনে হচ্ছিলো পায়ের নিচ থেকে সমস্ত কিছু সড়ে গেছে। ডুবে যাচ্ছি আমি কোনো এক অতলে। তখনও ওদের কোনো হুশ নেই। নিজেদের মতো ব্যস্ত তারা। যখন আমি নিজের বোধ ফিরে পায় তখন অনুভব করে পায়ের রক্ত আমার সব মাথায় উঠে গেছে। আমি পাগল হয়ে গেছি। মগজে কোনো এক রাক্ষুসে পোকা তান্ডব চালাচ্ছিল। সেই তান্ডবে স্থির থাকতে পারিনি। ছুটে যায় রান্নাঘরে। চোখের সামনে ধারালো বটি দেখে সেটা নিয়েই আবার ফিরে আসি। হিতাহিত জ্ঞান ভুলে এক এলোমেলো কয়েকটা কুপ দিয়েই চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাই আমি। পরদিন নিজেকে আবিস্কার করি হাসপাতালে। হাতে-পায়ে শিকল পরানো। মাথার কাছে পুলিশ দাঁড়িয়ে। জ্ঞান ফিরতেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। সেখানেই খবর পায় বিশ্বাসঘাতক দুটো মারা গেছে। খবরটা আমার বাবা নিজেই দেয়। সেই বাবা যে এতো বড় একটা মাইন্ড গেইম খেলতে পারে আমার সাথে ভাবিনি কখনো। যাক নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছিলাম। স্বপ্ন দেখেছিলাম সুখের সংসার গড়ার। নিজের ভবিষ্যতের চিন্তা বাদ দিয়ে যাকে সেইফ রাখতে রিস্ক নিয়ে বিয়ে করেছিলাম ছাত্র কালে। সেই ভালোবাসার মানুষটাকেই যখন নিজের ভাইয়ের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেছিলাম তখন আমি ভেবেছিলাম হয়তো মরেই গেছি। কিন্তু বিধাতা বাঁচিয়ে রেখেছিল ভাগ্যে আরও যে কষ্ট গুলো ছিল সেগুলো সহ্য করার জন্য।”

চলবে….

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩৫
#আদওয়া_ইবশার

কিছু অতীত থাকে, যার আবছায়া দিন গুলো মানব মন স্বরণ করে খুশির জোয়ারে গা ভাসায়। আবার কিছু অতীত থাকে, যে অতীতের ক্ষুদ্র থেকেও ক্ষুদ্রাংশ স্বরণ হলেই নিভৃতে পুড়ে ছাই হয় অন্তর। নতুন করে তাজা হয় পুরোনো ক্ষত। বহুদিন পর মনের মাঝে চাপা রাখা সত্য গুলো ভরসার কাওকে পেয়ে উন্মোচন করে নির্বিকার বসে আসে রক্তিম। তার মাঝে এমন কোনো ভাবাবেগ নেই যা দেখে পাশের জন বুঝতে পারবে বিবর্ণ অতীত নতুন করে তার হৃদয়ে দগদগে ঘা সৃষ্টি করেছে। অথচ অন্তর জানে, মানুষটা উপর থেকে নির্লিপ্ত থাকলেও ভিতরটা তার পুড়ে ছাই হচ্ছে। টুপটাপ বৃষ্টির ফোটার মতো এক একটা অশ্রুকণা অবলীলায় ঝরে পরছে দৃষ্টির আক্ষিকোণে। যতই কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে ততই যেন কান্নার বেগ বাড়ছে। অবুঝ মন বারবার প্রশ্ন তুলছে, কেন তার ভালোবাসার মানুষটাই ভুল মানুষকে ভালোবাসলো? এক জীবনে একটা মানুষের ভাগ্যে কি বিধাতা এতোটাই দুঃখ লিখে রাখে? না কি একমাত্র তার ভালোবাসার মানুষটার ভাগ্যই এমন! বুকটা যেমন জ্বলছে রক্তিমের কষ্টে, তেমন করেই জ্বলছে এই ভেবে,অতীতে একজনকে রক্তিম পাগলের মতো ভালোবাসতো। যাকে পাবার আশায় নিজের শখ, স্বপ্ন ধুলিসাৎ করতেও প্রস্তুত ছিল সে। আর আজ দৃষ্টির হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার এক বিন্দু পরিমাণ মূল্যটুকুও নেই তার কাছে। এজন্যই হয়তো বলে, আমি যাকে চাই সে আমাকে চায়না, আবার সে যাকে চায়, সেও তাকে পায়না। নিয়তির নিষ্ঠুর খেলাই ভালোবাসা আজীবন অধরা। বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় ভাড়ী গোটা পৃথিবীর বিশুদ্ধ বাতাস। প্রলম্বিত একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রক্তিম দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,

“এবার বলো, হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে আগলে রাখার প্রতিদানে যে মানুষটার মন আজ একের পর এক আঘাতে জর্জরিত, সে মানুষটা কিভাবে নতুন করে ভালোবাসতে পারবে? দ্বিতীয়বার ভালোবাসার মতো সাহস,শক্তি কোনোটাই আমার নেই।”

কোলের উপরে রাখা হাত দুটোর দিকে নজর রেখে দৃষ্টি কান্নার ঢোক গিলে বলে,

“আপনাকে ভালোবাসতে হবেনা। শুধু আমার প্রতি এক বিন্দু দয়া দেখিয়ে আপনার পাশে থাকতে দিন। আমাদের দুজনের জন্য আমার একার ভালোবাসাই যথেষ্ট।”

কথাটুকু শেষ করে ক্ষণকাল বিরতি নিয়ে স্মিত হেসে আবারও বলে ওঠে দৃষ্টি,

“এই ভালোবাসার খেলাই আমার আর আপনার মাঝে অদ্ভূত একটা মিল খোঁজে পাচ্ছি আমি।বলুন তো কি?”

উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় রক্তিম। ক্ষীণ স্বরে জানতে চায়,

“কি?”

দৃষ্টি আবারও বলে ওঠে,

“অতীতে আপনি যেমন একটা মানুষকে পাগলের মতো ভালোবাসতেন, ঠিক সেভাবেই বর্তমানে আমিও আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসি। জেরিনের কাছে আপনার ভালোবাসার কোনো মূল্য ছিলনা। যার কারণেই সে আপনাকে ছেড়ে যেতে পেরেছে। বর্তমানে আপনার কাছেও আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। এতে কি অনুমান করা যাচ্ছে? এই ভালোবাসার খেলাই যদি আবারও কারো ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে থাকে তবে সেটা আমি। কারণটা আপনার হয়তো খুব ভালো করেই জানা। যে মানুষ ভালোবাসতে পারে, সে কখনো ঠকাতে পারেনা। ভালোবাসা না থাকলেই ঠকানোর প্রশ্নটা আসে। আমার হৃদয়ে তৈরি হওয়া আপনার প্রতি অনুভূতির প্রগাঢ়তা কতটুকু,তা আমি হয়তো ভাষায় বলে বোঝাতে পারবনা। তবে এতটুকু বলতে পারি,এই প্রগাঢ় অনুভূতিদের হৃদয় থেকে উপরে ফেলার সাধ্যি আমার নেই। সেখানে ঠকানোর প্রশ্ন আসে কিভাবে!”

প্রত্যুত্তরে কিছুই বলেনা রক্তিম। কতক্ষণ নিরব থেকে আবারও একটা দির্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“আমি জীবনটাকে সব দিক থেকেই একটা সুযোগ দিতে চাই। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে ঠকতে ঠকতে এই পর্যায়ে এসে হয়তো ঠকে যাওয়ার ভীতিটা মন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পারবনা।আর না পারব ভালোবাসতে। তবে এটুকু কথা দিতে পারি। শেষ নিঃশ্বাস অব্দি আগলে রাখব।যা চাইবে সব পাবে। শুধু ভালোবাসা ছাড়া।পারবে আমার সাথে ভালোবাসাহীন সম্পর্ক গড়তে?”

এক একটা দির্ঘশ্বাসের সাথে একটা মানুষের ভিতরে দলা পাকিয়ে থাকা কষ্ট গুলো যদি বাষ্পের মতো না বেরোতে পারত,তবে হয়তো বুকে কষ্টের পাহাড় সৃষ্টি হয়ে বেঁচে থাকা দুরহ হয়ে যেত। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে দৃষ্টি নিজেকে শান্ত করে রক্তিমের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। মুচকি হেসে বলে,

“এই পৃথিবীতে সব মানুষের সংসার ভালোবাসা দিয়ে হয়না। একশোর মাঝে যদি বিশজন দম্পতির সংসারে ভালোবাসা খোঁজে পান, তবে বাকী আশিজন দম্পতির সংসারই দেখবেন ভালোবাসাহীন। তবুও তারা দিব্যি হাসি মুখে সংসার নামক যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকে। কিসের জুড়ে জানেন!মায়ার জুড়ে।আমার জানামতে সংসার দুই ধরনের হয়। একটা ভালোবাসার সংসার, আর একটা হলো মায়ার সংসার। আমি আপনাকে সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বিশ্বাস সবই দিব। বিনিময়ে আপনি শুধু আমাকে একটু মায়া দিবেন। ঐ মায়ার জালে আটকা পরেই আমি থেকে যাব আমৃত্যু। আমাদের দুজনের সংসারটাকে সুখ দিয়ে মুড়িয়ে রাখার জন্য আমার ভালোবাসা আর আপনার একটু মায়াই যথেষ্ট।”

কথারা বোধহয় এবার পালিয়েছে দুজনের থেকেই। আবারও নিরবতায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। কিন্তু মন তার ভাবনাঘরে তালা দিতে সক্ষম হয়নি। পাশাপাশি বসে থাকা দুজন মানুষের মনের মাঝে চলছে এলোমেলো অন্তহীন কিছু ভাবনা। এই অসম সম্পর্কটা কি আদও তারা শেষ অব্দি টিকিয়ে রাখতে পারবে? আজকাল রক্তিম মনের ঘরে মেয়েটার জন্য ভালোবাসা খোঁজে না পেলেও অদ্ভূত একটা টান অনুভব করে। এই টান কিসের ভেবে পায়না সে। “কায়া দেখলে মায়া বাড়ে”কথাটাই হয়তো ঠিক। ভালোবাসা সৃষ্টি না হলেও মায়ার সৃষ্টি ঠিকই হয়ে গেছে। দৃষ্টিও হয়তো এটাই চেয়েছিল। মানতে হবে মেয়েটা বড্ড চালাক। সে হয়তো জানত এই পাষাণ শিকদারের পাথর মনে ভালোবাসা তৈরী না হলেও, ঠিক একদিন মায়া তৈরী হবে। সেই মায়ার টানেই পাষাণ মন ঘর বাঁধতে চাইবে।না হলে কি আর মুখ বুজে শত অপমান সহ্য করে দাঁত খিঁচিয়ে পরে থাকত মেয়েটা!

“আমার মস্তিষ্কে একটা দুষ্টু পোকা বাস করে। পোকাটা অধিকাংশ সময় ঘুমিয়ে থাকলেও হুটহাট জাগ্রত হয়ে তান্ডব শুরু করে। যে তান্ডবের মুখে তুমি নিজেও এর আগে দুই-একবার পরেছো। ভবিষ্যতে আরও পরবে। পারবে তো শেষ পযর্ন্ত এই খিটখিটে, বদমেজাজী মানুষটার পাগল পাগল অত্যাচার গুলো সহ্য করে থেকে যেতে?”

রক্তিমের কথা গুলো দৃষ্টির এবার একটু অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে লোকটা তাকে ভয় দেখানোর পাইতারা করছে। যেমন দেখায় ছোট বাচ্চাদের ভূত-পেত্নির ভয়। বাঁকা চোখে তাকায় দৃষ্টি রক্তিমের দিকে। বলে,

“কালকে আমাকে একটা রেঞ্জ এনে দিয়েন তো।”

কিসের মাঝে কি? ভালোবাসা না পাবার শোকে পাগলটাগল হয়ে গেল না কি মেয়েটা!

“রেঞ্জ দিয়ে কি করবে?”

গা ঝাড়া দিয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায় দৃষ্টি। চায়ের কাপ দুটো যথাস্থানে রাখতে রাখতে বলে,

“ঐযে বললেন না! আপনার মাথায় না কি একটা পোকা বাস করে। ভাবছি রেঞ্জ দিয়ে আপনার মাথার চান্দি খুলে পোকাটাকে বের করে আবার মাথা ঠিকঠাক সেট করে নাট-বল্টু টাইট দিয়ে ফেলব।”

এমন একটা অদ্ভূত কথায় রক্তিম বিরক্ত হতে গিয়েও অল্প শব্দ করে হেসে ফেলে। হঠাৎ পুরুষালী ক্ষীণ হাসির শব্দে দৃষ্টি তৎক্ষণাৎ পিছন ঘুরে তাকায়। কিন্তু তার তাকানোর আগেই রক্তিম ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি বিলীন করে গম্ভীরমুখো রূপ ধারণ করে। দৃষ্টি সাবক হরিণের ন্যায় চোখ দুটো বড় বড় করে হতবাক চাহনি নিক্ষেপ করে রক্তিমের দিকে। কন্ঠে অঘাত বিস্ময় নিয়ে জানতে চায়,

“একটু আগে কে হাসল?”

“ফালতু কথা রেখে ঘুমাও গিয়ে।”

চোরা হাসে দৃষ্টি। শ্রাগ করে বলে,

“হাসল কে বলুন আগে। কি বিশ্রী হাসির শব্দ! আমি শিওর ঐটা কোনো মানুষের হাসি ছিলনা। নির্ঘাত কোনো শয়তান হেসেছিল। বাপরে বাপ! একটুর জন্য আমার হার্ট ফেল হয়নি।”

দৃষ্টি যে সবটা বুঝেও এমন ফাজলামি জুড়েছে ঠিক ধরে ফেলেছে রক্তিম।ঘাড় বাঁকা করে তাকায় রক্তিম। মুখের ভঙ্গিমাতে গম্ভীরতা এটে বলে,

“যাবে না কি কানের নিচে একটা লাগাবো?”

কোথায় ভেবেছিল ফাজলামি করার একটা সুযোগ পেয়ে সেটা কাজে লাগিয়ে মন খারাপিটাকে বিদায় করবে। উল্টো এখন মনে হয় এই গুরুগম্ভীর লোকটার সাথে ফাজলামি করে মন ভালো করার বৃথা চেষ্টার থেকে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে থাকা অতি উত্তম হবে। কথাটা ভেবে মুখ ঝামটে ঘরের ভিতর পা বাড়ায় রক্তিম। কন্ঠে অল্প অভিমানের আভাস নিয়ে বলে,

“গেলাম আমি ঘুমাতে। কারো যদি ইচ্ছে হয় তবে সারা রাত না ঘুমিয়ে বাড়ি পাহারা দিক। এবার অসুস্থ হলে আমিও আর ধারেকাছে ঘেঁষবনা। দেখব কিভাবে কি করে।”

কপট রাগি ভঙ্গিমায় রুমে এসে বিছানায় পা তুলে ওঠে বসে দৃষ্টি। তখনই চোখ যায় টেবিলে বইয়ের উপর রাখা তাজা বেলি ফুলের মালা। নিমিষেই চোখ দুটো বৃহদাকৃতির হয়ে যায়। কতক্ষণ ফ্যালফ্যাল নয়নে সেদিকে তাকিয়ে থেকে লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে পরে। মালাটা হাতে নিয়ে বিস্মিত নয়নে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তুলে চমৎকার হাসি। গলা উঁচিয়ে রক্তিমকে শুনিয়ে বলে ওঠে,

“কি গো! কোথায় আপনি? দেখে যান কি সর্বনাশা কান্ড ঘটে গেছে। শয়তান তার বিটলামি হাসি উপর দেওয়ার পাশাপাশি আমাকে বেলি ফুলের একটা মালাও উপহার দিয়েছে।”

স্মিত হাস্যে রক্তিম শীতল পাটি থেকে ওঠে দাঁড়ায়। আড়মোড়া ভেঙ্গে অল্প হাসির রেখাটুকু ঠোঁটের কোণে ধরে রেখেই ঘরের ভিতর পা বাড়ায়। দৃষ্টির পিছনে দাঁড়িয়ে ট্রাউজারের পকেটে দুই হাত রেখে রগর করে বলে,

“শয়তানের মনে হয় তোমাকে ভালো লেগে গেছে। প্রেম করতে চায়। তাই ফুল দিয়ে ইমপ্রেস করতে চাইছে।”

তড়িৎ পিছন ঘুরে তাকায় দৃষ্টি। ভ্রু নাচিয়ে বলে,

“ইনডাইরেক্টলি আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে না কি?ইশ! একদিনে এতো চমক! এবার বোধহয় সত্যি সত্যি অতি খুশিতে হার্ট এটার্ক হয়েই যাবে।”

দৃষ্টির হাতে থাকা মালাটা লক্ষ্য করতে গিয়ে রক্তিমের চোখে পরে তার হাতের চিকন দুটো চুড়ির দিকে। মনে পরে দৃষ্টিই একদিন বলেছিল এই চুড়ি দুটো সে প্রথম যেদিন বউ হয়ে শিকদার মঞ্জিলে পা রেখেছিল সেদিন রেহানা বেগম নিজ হাতে পারিয়ে দিয়েছিল। হাস্যোজ্জ্বল মুখটা আবারও গম্ভীর্যতায় ছেয়ে যায়। কাটকাট ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে দৃষ্টির দিকে। হাতে থাকা মালাটা নিজের হাতে নিয়ে রেখে দেয় টেবিলে। পরপর যত্ন করে চুড়ি গুলো খুলে দিতে দিতে বলে,

“ঐ বাড়ির আর কি কি আছে তোমার কাছে?”

রক্তিমের হঠাৎ এমন আচরণে প্রথমে একটু অবাক হলেও পরমুহূর্তে দৃষ্টি বুঝে যায় আসল ঘটনা। প্রশ্নের উত্তরে বলে,

“আপনি?”

চোখ পাকিয়ে তাকায় রক্তিম। কপট রাগি ভাবে বলে,

“সবসময় ফাজলামি ভালো না।”

“আরেহ! ফাজলামি কোথায় করলাম? আপনি তো ঐ বাড়ির ছেলেই। এই চুড়ি গুলো আপনার মা প্রথম দিন পরিয়ে দিয়ে বলেছিল হাত থেকে যেন কখনো না খুলি। মুরুব্বিরা বলে বউয়ের হাতে চুড়ি না থাকলে স্বামীর অমঙ্গল হয়। শাশুড়ির কথা রাখতে গিয়ে আর খুলিনি হাত থেকে। এরপর ইতির বিয়ের সময় যে গয়না গুলো দিয়েছিল সেগুলো তো ঐ বাড়িতেই আলমারিতে খুলে রেখে দিয়েছিলাম। এখন আমার কাছে ঐ বাড়ির জিনিস চুড়ি আর মানুষ আপনি এই দুটো ছাড়া আর কিছুই নেই। তাহলে বলব কি?”

শীতল দৃষ্টিতে রক্তিম কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,

“যদি জন্ম পরিচয়টা সত্যি সত্যি মুছে ফেলা যেতো, তবে সেটা অনেক আগেই করে ফেলতাম। আজকে শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি, আমার অতীত বা একমাত্র ইতি ব্যতিত ঐ বাড়ির কোনো সদস্য নিয়ে আমি যেন তোমার মাঝে কোনো কৌতূহল না দেখি। ঐ বাড়ির মানুষ, জিনিস সব থেকেই দূরে থাকবে।”

কিছু কিছু জিনিস নিয়ে কখনো মজা করা খাটেনা। কথাটা না ভেবেই মজা করা ঠিক হয়নি দৃষ্টির। অথবা মানুষটার ভালো মেজাজটা বিগড়ে দিয়েছে। ভেবে মাথা নিচু করে নেয় দৃষ্টি। অস্ফুটে বলে,

“স্যরি।”

চোখ দুটো বন্ধ করে লম্বা দুটো নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে রক্তিম। মাথা থেকে অতীতের ভাবনা চিন্তা গুলো ঝেড়ে ফেলে। চুড়ি দুটো টেবিলের এক কোণে রেখে বেলি ফুলের মালাটা হাতে তুলে নেয়। দৃষ্টির একটা হাত টেনে নিয়ে মালাটা পড়িয়ে দিতে দিতে বলে,

“হাত খালি থাকলে স্বামীর অমঙ্গল হয়, এমন কুসংস্কার তোমার মতো শিক্ষিত মেয়ে কিভাবে কানে নেয়? এসব কুসংস্কার যেন আর কখনো মানতে না দেখি।”

অল্প মন খারাপ যেটুকু উঁকি দিয়েছিল, রক্তিমের আলতো পরশে সেটুকু যেন হুট করেই লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেছে। মন জমিন ছেয়ে গেছে সুখ সুখ আবেশে। অধর কোণে আবারও উন্মোচিত হয় প্রাপ্তির হাসি। একদিনে সত্যিই না চাইতেও একটু বেশিই সুখ পেয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি। রক্তিম যে সেই দুপুরের ইচ্ছেটুকু স্বরণে রেখে রাতে চুপিচুপি ফুল নিয়ে হাজির হবে কল্পনাও করেনি দৃষ্টি। এখন আবার সে নিজেই যত্ন হাতে পেচিয়ে দিচ্ছে! এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। কল্পনাতীত সুখটা যখন হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেয়, মন তখন ঠিক কতটা আনন্দিত হয় তা একমাত্র ঐ কল্পনাতীত সুখ পাওয়া মানুষটা ছাড়া আর কেউ জানেনা। সৃষ্টিকর্তা এবার বোধহয় সত্যিই দৃষ্টির দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে! দৃষ্টি-রক্তিম দুজনের জীবন থেকে এবার হয়তো সমস্ত অন্ধকার এভাবেই দূর হবে। উজ্জীবিত হবে এক সুখময় আলোকিত দিন। খরাপ্রবণ মন জমিনে ঝুমঝুমিয়ে বর্ষণ নেমে আসবে।

চলবে….

(রি-চেইক দেইনি। অনেক ভুল থাকতে পারে। একটু মানিয়ে নিবেন )

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-৩২+৩৩

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩২
#আদওয়া_ইবশার

দুপুর থেকেই রক্তিমের অপেক্ষায় সদর দরজা খুলে পথ চেয়ে রেহানা বেগম। এখন মধ্য রাত। তবুও অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ছেলে আসছেনা। মনটা বারবার কেন জানি কু ডাকছে। না চাইতেও আজেবাজে চিন্তারা মন-মস্তিষ্ক ঘিরে ধরেছে। মায়ের সাথে ইতিও ভাইয়ের অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। এতো রাত হবার পরও বাবা, ভাই, ভাবি কাওকে বাড়ি আসতে না দেখে তার মনটাও অস্থির হয়ে আছে। দুশ্চিন্তায় শীতের মাঝেও ঘাম ছুটে যাচ্ছে। একে একে প্রতিটা মানুষের নাম্বারে লাগাতার কল করার পরও কেউ ফোন তুলছেনা। মেহেদীটাও কেমন দায়িত্বহীনের পরিচয় দিচ্ছে! সকালে তারা যখন কোর্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছিল তখন রেহানা বেগম, ইতি তারাও যেতে চেয়েছিল।মেহেদী নিতে রাজি থাকলেও আজীজ শিকদার বাঁধা দেয়। তারা দুজন আদালতে উপস্থিত থাকলে তাদেরকেও সাক্ষী হিসেবে জেরা করতে পারে। মহিলা মানুষ যদি কোনো কথার প্যাঁচে পরে যায়! তখন সব শেষ হবে। তাছাড়া রক্তিম তো নির্দোষ প্রমাণ হবেই। আজ কেউ পারবেনা রক্তিমকে জেলে আটকে রাখতে। এমন হাজারটা যৌক্তিক, অযৌক্তিক কথার জালে ফাঁসিয়ে দুজনকেই বাড়িতে রেখে যায় আজীজ শিকদার। রেহানা বেগমও বাধ্য স্ত্রীর মতো স্বামীর কথা মেনে নেয় তখন। যার কারণে এখন আফসোস হচ্ছে। মনে হচ্ছে তখন অবাধ্যতা করে সাথে গেলেই হয়তো ভালো হতো। কি ঘটেছে, ছেলেটা কোথায় আছে আর তারাই বা কোথায় আছে অন্তত এগুলো জানতে পারত।

হাট করে খুলে রাখা সদর দরজা দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে আজীজ শিকদারকে প্রবেশ করতে দেখে মা-মেয়ে দুজনেই বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায়। ক্রস্ত পায়ে এগিয়ে যায়। আজীজ শিকদারকে একা দেখে উৎসুক হয়ে রেহানা বেগম জানতে চায়,

“কি ব্যাপার! আপনি একা কেন? রক্তিম, বউমা, মেহেদী ওরা কোথায়?”

প্রশ্নটা করে কতক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভাবে। পরমুহূর্তে আৎকে ওঠা কন্ঠে বলে,

“রক্তিম ছাড়া পায়নি? আপনি না বলেছেন ওকে নিয়েই বাড়ি ফিরবেন! এখন একা এসেছেন কেন?”

দুই সন্তানের ভালোর কথা ভেবে আড়াই বছর আগের এক মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে যে ভুল আজীজ শিকদার করেছে,সেই ভুলের মাসুলই মনে হয় মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত দিতে হবে। এখন নতুন করে আবার কিছু গোপন রেখে পাপের বোঝা আর ভাড়ী চায়না। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে অসহায় কন্ঠে জানিয়ে দেয় রক্তিমের অসুস্থতার কথা। অবাক নেত্রে রেহানা বেগম কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে স্বামীর মুখের দিকে। পর পরই চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। মা-মেয়ে দুজন সেই মাঝ রাতেই ছুটে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। রাস্তা ফাঁকা থাকায় আজীজ শিকদারের ব্যক্তিগত গাড়িটা পনেরো মিনিটের মাথায় দুজনকে হাসপাতালের সামনে রেখে যায়। অশান্ত মনে মা-মেয়ে উদভ্রান্তের ন্যায় ছুটে যায় চতুর্থ ফ্লোরে রক্তিমকে রাখা ৪০৪ নাম্বার কেবিনের সামনে। দৃষ্টি, মেহেদী,রাকিব, জাবির চারজনেই কেবিনের সামনে বসেছিল। দুজনকে পাগলের মতো ছুটে আসতে দেখে সকলেই ওঠে দাঁড়ায়। মেহেদী ছুটে যায় ইতির কাছে। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ইতি কান্নারত অবস্থায় বলে,

“ভাইয়া কোথায়?”

উপস্থিত প্রত্যেকে বোঝার বুঝে যায়। নিশ্চয়ই আজীজ শিকদার বাড়ি গিয়ে খবরটা জানিয়ে দিয়েছে। ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেহেদী বলে,

“ঘুমাচ্ছে এখন। একটু আগে অস্থির হয়ে গেছিল। অবস্থা খারাপ দেখে ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে। কেবিনে কাওকে যাবার অনুমতি দেয়নি।”

মেহেদীর কথায় রেহানা বেগম বিলাপ জুড়ে দেয়। বলতে থাকে,

“আমি একটু দেখব। দূর থেকে শুধু একটু দেখে চলে আসব। আমাকে কেবিনে ঢুকতে দিতে বলো। শুধু এক নজর ছেলেটাকে আমি দেখব।”

ডাক্তার কোনোক্রমেই ভিতরে যাবার অনুমতি দিচ্ছেনা। সাফ সাফ জানিয়ে দেয় বারো ঘন্টা পার হবার আগে কেউ যদি এক নজর দেখার আফসোস নিয়ে মরেও যায় তবুও আর অনুমতি দিবেনা। তাদের কাছে গার্ডিয়ানের দুঃখ-কষ্ট, আবেগের থেকেও পেশেন্টকে সেইফ রাখা অতিব জরুরি। অনুমতি ব্যতিত তবুও যদি কেউ ভিতরে যায় তবে এই মাঝ রাতেই হাসপাতাল থেকে রোগী নিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। এমন কঠোর নিষেধাজ্ঞার পর আর কারো সাহস হয়নি ভিতরে পা বাড়ানোর। একজন মায়ের হাহাকার দেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন নার্সের হয়তো একটু মায়া হয়। চুপিচুপি দরজা অর্ধ ফাক করে দূর থেকে দেখতে দেয় এক নজর। নিস্তেজ হয়ে সাদা বেডে পরে থাকা ছেলেকে এক পলক দেখে শান্ত হবার পরিবর্তে আরও অশান্ত হয় মায়ের মন। ছটফট করে ছেলেকে একটু ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু পারেনা। পরিস্থিতির কাছে হার মেনে মুখে আঁচল গুজে শুধু কাঁদে গুণগুণ করে। দূরে দাঁড়িয়ে নিরবে সব দেখে যায় দৃষ্টি। আজীজ শিকদারের মতো একজন মানুষের এতো বড় জালিয়াতির কথা শোনার পর ঐ বাড়ির আর কোনো সদস্যকে বিশ্বাস হয়না। যেখানে আজীজ শিকদার দৃষ্টিসম্মুখে ছেলেকে ভালো রাখার প্রচেষ্টা করে একজন ভালো বাবার পরিচয় দিয়ে সেই লোকটাই ভিতরে ভিতরে এতো বড় একটা চাল চালতে পারল, সেখানে রেহানা বেগম তো এমনিতেই ছোট ছেলের শোকে পাগল হয়ে বড় ছেলেকে শারীরিক, মানসিক সব দিক থেকে আঘাত করেছে সর্বক্ষণ। তবে এই মানুষটার কান্না দেখে আজ কিভাবে মায়া হবে দৃষ্টির? কিভাবে বিশ্বাস করবে সে, রক্তিমের জন্য মায়ের সত্যিই দুঃখ হচ্ছে? একজন মানুষের কর্মে ঐ বাড়ির প্রতিটা মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস ওঠে গেছে। মা’কে একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখে ইতি এগিয়ে যায় মেহেদীর কাছে। সম্মুখে দাঁড়িয়ে কঠোর স্বরে বলে,

“তোমাকে বিশ্বাস করে চুপচাপ বসে থাকাটাই আমার সবথেকে বড় ভুল হয়েছে। বিশ্বাসের যোগ্য তুমি না, এটা আমার বোঝা উচিৎ ছিল। যদি যোগ্যই হতে তবে এতো বড় একটা ঘটনা এভাবে লুকিয়ে রাখতে না। আমার ভাইটা সেই সকালে স্ট্রোক করে প্যারাইলজড হয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছে। আর আমরা জানতে পারলাম এই মাঝ রাতে। এতো বড় একটা ঘটনা আমাদের থেকে গোপন রাখার অধিকার কে দিয়েছে তোমাকে?”

গত একটা সপ্তাহ যাবৎ রক্তিমকে ছাড়ানোর চিন্তায় অস্থির থেকেছে। নাওখা, খাওয়া ভুলে আজীজ শিকদার যখন যেখানে যেতে বলেছে কুত্তার মতো সেখানেই ছুটেছে। এরপর আজ কোর্টে যা হলো তা তো একেবারে বাধিয়ে রাখার মতো। একের পর এক ধকল সইতে সইতে মেহেদীর মন-মেজাজ ও বিক্ষিপ্ত। ইতির এটুকু কথাতেই চটে যায়। এই প্রথম চোখ পাকিয়ে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,

“একদম চিৎকার করবেনা। আমি বিশ্বাসের যোগ্য না, তাই না! আর তোমার বাপ খুব বিশ্বাসী! একদম পীর আউলিয়া। এতোটাই সৎ আর বিশ্বাস যোগ্য যে বিশ্বাসের প্রতিদান হিসেবে নিজের ছেলেকেই আজ পঙ্গু বানিয়ে রেখেছে।”

মেহেদীর এমন রূঢ় আচরণে অবাক হয় ইতি। কিছোটা ব্যথিত হয়ে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থেকে জানতে চায়,

“কি করেছে বাবা?”

শ্রেষাত্মক হেসে মেহেদী বলে,

“চোখে দেখতে পাওনা? কি করেছে চোখের সামনে তার জলন্ত প্রমাণ হিসেবে প্যারালাইজড ভাইকে দেখার পরও আমার মুখ থেকে জানতে চাও!”

এমন ঠেসপূর্ণ কথার কিছুই বুঝতে পারেনা ইতি। তিতি-বিরক্ত হয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে,

“ওফ! ঘুরিয়ে-প্যাচিয়ে মাথা নষ্ট না করে সরাসরি বলবে কি হয়েছে?”

ইতির বিরক্ত মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে হাত টেনে রেহানা বেগমের সামনে নিয়ে দাড় করায়। দুজনকে উদ্দেশ্য করেই ফরফর করে বলে দেয় শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত যা যা ঘেটেছে সমস্তটা। বিস্ময়ে মাথা ঘুরে ওঠে মা-মেয়ে দুজনেরই। চোখ দুটো বৃহৎ আকৃতি ধারণ করে। অসাঢ় মস্তিষ্ক ব্যর্থ হয় কোনো প্রকার অনুভূতির যোগান দিতে। নির্বাক দৃষ্টিতে এক ধ্যানে তাকিয়ে কতক্ষণ পর রেহানা বেগম শুধু এটুকুই বলে,

“সংগ্রাম বেঁচে আছে!”

****
রক্তিমের অচল হাতটা বুকে জড়িয়ে ধরে অবিরাম ধারায় অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে রেহানা বেগম। অস্ফুট স্বরে বারবার বলছে, “ক্ষমা করিস না আমাকে। কখনো ক্ষমা করিস না। আমি ক্ষমার যোগ্য না। কোনো অপরাধ ছাড়াই মা হয়েও অপরাধী বানিয়ে এতো গুলো বছর একের পর এক আঘাত করেছি। চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে থেকেছি। মা হবার কোনো যোগ্যতা নেই আমার। কোনো যোগ্যতা নেই।”

রক্তিম নির্বাক। মায়ের আহাজারি কিছুই যেন তার কান পযর্ন্ত পৌঁছাতে পারছেনা। এক ধ্যানে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে নিজ ভাবনায় মজে আছে। ভাইয়ের পায়ের কাছে বসে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে ইতি। মা-বোন কারো কান্নায় রক্তিমের মাঝে উদ্যেগ সৃষ্টি করতে পারছেনা। সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই কেমন নির্জীব হয়ে পরে আছে বিছানায়। এক বিন্দু পানিও খাওয়াতে পারেনি কেউ এখনো। না পেরেছে মুখ দিয়ে কোনো কথা বের করাতে। নিজ ভাবনায় বিভোর থেকে হয়তো জীবনের হিসাব মিলাতে ব্যস্ত। যতবার হিসেবে ব্যর্থ হচ্ছে ততবারই বুক চিরে শুধু দীর্ঘশ্বাসের ক্ষীণ আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। শেষ পযর্ন্ত হিসাব মিলাতে ব্যর্থ হয়ে অস্ফুট শব্দ করে আরও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের দিকে তাকায় রক্তিম। ক্ষীণ স্বরে বলে,

“কেঁদো না।”

পর পর দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,

“কোন কোন মেডিসিন খেতে হবে?”

একটু সময় নিয়ে রক্তিমের দিকে এগিয়ে যায় দৃষ্টি। রেহানা বেগমের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলে,

“খালি পেটে খাওয়াতে ডাক্তার নিষেধ করে দিয়ে গেছে। একটু স্যুপ দেই?”

কোনো দ্বিরূক্তি করেনা রক্তিম। জবাবের আশায় কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে হতাশ হয়ে দৃষ্টি নিজ উদ্যোগেই উষ্ণ গরম স্যুপের বাটিটা হাতে নিয়ে এক চামচ বাড়িয়ে দেয় রক্তিমের মুখের দিকে। জ্বিভের ডগায় শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজানোর চেষ্টা করে রক্তিম। কিন্তু মুখ বেকে যাওয়ায় খুব একটা সুবিধা করতে পারেনা। জ্বিভটাও কেমন ভাড়ী ভাঢ়ী মনে হয়। হতাশ হয়ে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে বলে,

“একটু ধর। বসব।”

তড়িৎ মেহেদী, রাকিব দুজনেই এগিয়ে আসে। দুইপাশ থেকে দুজন ধরে আধশোয়া করে পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে বসিয়ে দেয়। রক্তিম নিরবে দৃষ্টিকে চোখের ইশারায় খাইয়ে দিতে বলে। বহুক্ষণ কাঠফাটা রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার পর হুট করেই যেন কোথা থেকে অল্প শীতল হাওয়া এসে দৃষ্টির গাঁ ছুঁয়ে গেল। তৎপর এগিয়ে এসে স্ব-যত্নে খাইয়ে দিতে থাকে। ভালোবাসার কাঙ্গাল স্বার্থপর মনটা বলে, “সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আজ যদি রক্তিম অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে না থাকতো, নিজ হাতে খাওয়ার শক্তি যদি থাকত, তবে হয়তো কখনো তাকে খাইয়ে দেবার ভাগ্য দৃষ্টির হতনা।

অল্প একটু খেয়েই মুখ ফিরিয়ে নেয় রক্তিম। মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় আর খাবেনা। দৃষ্টিও কোনো প্রকার জোর করেনা। এটুকুই যে খেয়েছে এতেই শুকরিয়া। একে একে মেডিসিন খাইয়ে সোজা করে শুইয়ে দেয়। হাপিয়ে যাবার ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস ছেড়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রক্তিম বলে,

“যা হয়েছে সব আমার ভাগ্য দোষে হয়েছে। আমি কখনো এসবের জন্য তোমাকে দায়ী করিনি আর করবোও না। তুমি আমার মা। পৃথিবী উল্টে গেলেও তোমার থেকে আমি মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবনা। তুমি চাইলে তোমার ছোট ছেলের সাথেও যোগাযোগ রাখতে পারো। আমি কোনো অভিযোগ করবনা। ইচ্ছে হলে নিজ বাড়িতে এনেও রাখতে পারো। আমি আর ঐ বাড়ি ফিরবনা। শেষবারের মতো সবার কাছে আমার শুধু একটাই অনুরোধ, আমি মরলেও যেন আমার লাশটাকেও কখনো ঐ বাড়ির আঙ্গিনায় না নেওয়া হয়। শিকদার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থান ব্যতিত অন্য কোথাও যদি আমাকে কবর দেবার মতো কোনো জায়গা না পাওয়া যায়, তবে আমাকে নদীতে ভাসিয়ে দিও। তবুও আমাকে ঐ মাটিতে কবর দিয়ে আমার মৃত আত্মাকে অভিশপ্ত করে রেখোনা। আর শিকদার সাহেবের আগেই যদি আমার মরন হয়,তবে ওনি যেন আমার মৃত মুখটাও দেখতে না পারে। মসজিদের মাইকে যেন শিকদার সাহেবের ছেলে হিসেবে আমার মৃত্যু খবর ঘোষণা না হয়। আর কারো দয়া-করুনা চাইনা আমার। তোমরা যে আমাকে জন্ম দিয়েছো, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আলো দেখিয়েছো এই ঋণ’ই তো শোধ করতে পারবনা। নতুন করে আর কারো দয়া নিয়ে নিজেকে যেমন ঋণী করতে চাইনা। তেমন কিছু বিশ্বাস ঘাতকের কারণে নিজের জীবনটাও আর শেষ করতে চাইনা। অর্ধেক জীবন মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিশ্বাস ঘাতকদের চিনতে চিনতেই শেষ। বাকী যে অর্ধেক জীবনটা আছে, এই জীবনটা এখন একটু শান্তিতে কাটাতে চাই। চরিত্রহীনদের যদি এই পৃথিবীর বুকে বুক ফুলিয়ে সংসার করার অধিকার থাকে, তবে সেটা আমারও আছে। কোনো দোষ না করেও কেন পুরোটা জীবন দোষের বোঝা নিয়ে কাটিয়ে দিব? আট-দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো আমিও নিজের স্ত্রীকে নিয়ে সুখে থাকব। টিনের চালার যে ঘরটাতে আমার এক একটা অভিশপ্ত রাত কেটেছে, সেই ঘরেই এক বিন্দু সুখের সন্ধান করে শান্তিপূর্ণ রাত কাটাতে চাই। তুমি তোমার সংসারে ফিরে যাও। স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালো থাকো। কখনো যদি এই পাপি, অযোগ্য সন্তানকে দেখতে ইচ্ছে হয়, নির্দ্ধিধায় আমার শান্তির ঠিকানায় চলে যেয়ো।”

উপস্থিত প্রতিটা মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে প্রতিটা কথা শুনে গেছে। কথা গুলো শোনার পর প্রতিটা মানুষের মনের কোণে উদিত হয় একটাই ভাবনা, একটা মানুষ ঠিক কতটা আঘাত পাওয়ার পর এমন ভাবনা-চিন্তা করতে পারে! রেহানা বেগম আঁচলে মুখ লুকিয়ে কান্নাবিজড়িত কন্ঠে ছেলের কথায় সাই জানিয়ে বলে,

“আমিও চাইনা তুই ঐ বাড়ি যা। এতোদিন চাইতাম না তোর প্রতি সৃষ্টি হওয়া ক্ষোভের কারণে। সর্বক্ষণ চেয়েছি আপন মানুষদের থেকে দূরে থেকে উপলব্ধি কর প্রিয় মানুষ হারানোর যন্ত্রণা কতটা প্রগাঢ়। কিন্তু এখন চাই ঐ অভিশপ্ত বাড়ির ছায়া থেকে দূরে গিয়ে বেঁচে থাক। কাল সাপের সাথে এক ছাঁদের নিচে থেকে কখনো ভালো থাকবিনা। ঐ অভিশাপে ঘেরা অভিশপ্ত বাড়ি শুধু তোর মৃত্যুই ডেকে আনবে। কখনো এক বিন্দু স্বস্তি দিবেনা। আমিও পারবনা। ঐ বাড়িতে ঐ মানুষটার সাথে এক ছাদের নিচে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাব। আমি জানি আমি অনেক বড় অন্যায় করেছি। তোর জীবনটাকে এলোমেলো করে দেওয়াই আমি মা হয়েও অনেক বড় অবদান রেখেছি। তবুও তোকে জন্ম দেওয়ার প্রতিদান হিসেবেই চাইছি, তুই যেখানেই থাকিস ঘরের এক কোণে না পারলেও বাইরে হলেও এই অভাগী মা’কে একটু জায়গা দিস। তোর এক বিন্দু সুখ নিজের চোখে দেখতে না পারলে যে মরে গিয়েও শান্তি পাবনা। তোকে জন্মের পর একটু একটু করে বড় হতে দেখে চোখ জুড়িয়েছি। আবার একটু একটু করে নিঃশেষ হতে দেখে রাক্ষসী মনের জ্বালা মিটিয়েছি। এখন আবার তোর জীবনটাকে নতুন রূপে সাজতে দেখে অপরাধ বোধের ভারটা হালকা করতে দিস।”

চলবে……

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩৩
#আদওয়া_ইবশার

দীর্ঘ পনেরো দিন অবজার্বেশনে রেখে দুদিন আগে হাসপাতাল থেকে রক্তিমকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। সেই টিনের চালার কুড়ে ঘরটাতেই ঠাই নিয়েছে দৃষ্টি-রক্তিম। ছোট্ট ঘরটাতে সদস্য বেড়েছে আরও একজন। রেহানা বেগম হাজার বারণ সত্বেও ছেলের পিছু ছাড়েনি। রক্তিম যখন মা’কে প্রাসাদ তুল্য শিকদার মঞ্জিল রেখে নিজের কুড়েঘরে রাখতে একেবারেই দ্বিমত পোষণ করে, তখন রেহানা বেগম পরাজিত এক সৈনিকের মতো ছেলের পায়ের কাছে বসে নত মস্তকে বলেছিল,

“আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য যদি তোর পায়ে ধরতে হয়, তাতেও আমি রাজি আছি। তবুও তুই আমাকে আর শাস্তি দিসনা। একটু দয়া করে তোর ঘরের এক কোণে ঠাই দে আমাকে। না খেয়ে থাকতে রাজি আছি আমি। তবুও আমাকে একটু ঠাই দে।”

এভাবে সন্তানের পায়ের কাছে পরে মা যদি কোনো আবদার রাখে তবে হয়তো কোনো সন্তানেই পারেনা ফিরিয়ে দিতে। অতীতে মা যত যায় বলে থাকুক, যতই আঘাত দিয়ে থাকুক। তবুও তো মা! পুরো পৃথিবী ধ্বংস হলেও কখনো এই সত্যটা মিথ্যে হবেনা। যে মায়ের রক্ত, মাংস খেয়ে একটু একটু করে বেড়ে ওঠেছে তার পেটের ভিতর। পৃথিবীতে আসতে গিয়ে সহ্য করিয়েছে মৃত্যু সম যন্ত্রণা, সেই মা যতই আঘাত করুক কিভাবে পারবে কোনো সন্তান তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে! রক্তিমও পারেনি। নিজের কাছে নিজেই আরও একবার পরাজিত হয়ে জয়ী বানিয়ে দেয় গর্ভধারিনী মা’কে। রক্তিমের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে দৃষ্টি মনে মনে রুষ্ট হলেও মুখে কিছু বলেনি। রেহানা বেগমের সাথেও এখন পযর্ন্ত স্বাভাবিক কোনো কথা-বার্তাও বলেনি। যখনই যায় একটু স্বাভাবিক ভাবে মিশতে তখনই মনে পরে যায় এই মানুষটাও তার স্বামীকে কম কষ্ট দেয়নি। রক্তিমের আজকের এই পরিস্থিতির জন্য আজীজ শিকদারের পাশাপাশি রেহানা বেগমের অবদানও কোনো অংশে কম না।

আজ-কাল দৃষ্টির দিন গুলো ভিষণ ব্যস্ততায় কাটছে। মনে হচ্ছে রাত নামতে না নামতেই চোখের পলকেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঝলমলে প্রতিটা সকাল শুরু হওয়ার সাথে সাথে শুরু হচ্ছে দৃষ্টির যুদ্ধ। যে যুদ্ধের একমাত্র লক্ষ্যই হলো স্বামীকে সুস্থ্য করে তোলা। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিদিন নিয়ম করে শারীরিক ব্যায়াম, ম্যাসাজ, খাবার খাওয়ানো,মেডিসিন খাওয়ানো। কখন কি লাগবে না লাগবে এসব ভেবে সর্বক্ষণ কাছাকাছি থাকা। আবার নিয়ম করে ফিজিওথেরাপির জন্য ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া। এর মাঝে নিজের জন্য এক বিন্দু সময় অবশিষ্ট থাকেনা। সকালের নাস্তা খেতে হয় দুপুরে, দুপুরের খাবার খেতে হয় রাতে। আবার কোনো কোনো দিন তিন বেলার খাবার এক বেলাতেই খেতে হয়। তবুও একটুও আফসোস নেই দৃষ্টির। নেই চোখে-মুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ। হাসি মুখে পালন করে যাচ্ছে নিজের সবটা দায়িত্ব। সেবা-যত্নের পাশাপাশি বিভিন্ন কথায় ভুলিয়ে রাখতে চাচ্ছে অসুস্থ মস্তিষ্কটাকে। কখনো বলে চলে নিজের ছোট্ট বেলার গল্প, কখনো বা স্কুল-কলেজের কাহিনী। রক্তিম দৃষ্টির মন ভুলানো গল্প গুলো এড়িয়ে যেতে চেয়েও পারেনা। কিভাবে কিভাবে যেন মাঝে মাঝে ডুবে যায় দৃষ্টির আলাপনে। অপলক তাকিয়ে দেখতে থাকে স্বহাস্যে গল্প বলে যাওয়া অষ্টাদশীকে। এর মাঝে আবার রক্তিমের এমন দুর্দশার খবর শুনে দৃষ্টির মা-বাবা বুকে অল্প আশা নিয়ে রাগ-ক্ষোব ভুলে ছুটে এসেছিল। ভেবেছিল এবার অন্তত মেয়েটাকে নির্মম বাস্তবতা দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু প্রতিবারের মতোই দৃষ্টি বাবা-মা’কে ব্যর্থতায় ডুবিয়ে দেয়। রক্তিমকে ছেড়ে যাবার জন্য মায়ের দেখানো হাজারটা যুক্তি ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি ঝুলিয়ে স্বাভাবিক কথা দিয়েই হারিয়ে দেয় প্রতিবার,

“আমি ভালো আছি মা। তোমরা আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করোনা তো। যে মানুষটাকে আমি ভালোবাসি তার অসুস্থতাকেও আমি ভালোবাসি। তার ভালো-খারাপ সমস্তটা ভালোবাসি বলেই আমি তাকে ভালোবাসি। আর কাওকে ভালোবাসলে কখনো তার খারাপ দিন দেখে তাকে ফেলে চলে যাওয়া যায় না। আমি যদি শুধু তার মোহে অন্ধ হয়ে তার কাছে ছুটে আসতাম বা তার বাঃহিক দিক দেখে ভালো লাগার অনুভূতি জন্ম হলে সেটাকে ভালোবাসা হিসেবে দাবী করতাম, তবে হয়তো ছেড়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমি তো শুধু তার বাহিরটাকেই ভালোবাসিনি মা। হ্যাঁ এটা ঠিক, প্রথম তাকে দেখেই আমার ভালো লাগার সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর একটু একটু করে যতই তার মনটাকে চিনতে পেরেছি, ততই তার প্রতি আমার ভালোবাসা উপলব্ধি করেছি। বুঝে গিয়েছি শুধু মন বা শরীর আলাদা ভাবে এসব কোনো এক দিক না, পুরো মানুষটাকেই আমি ভালোবাসি। তার ভালোটাকেও ভালোবাসি তার খারাপটাকেও ভালোবাসি। সে যদি সত্যি সত্যিই কোনো খুনি হতো, সেদিন কোর্টে যদি তার ফাঁসি,বা যাবৎজীবন কারাদণ্ডও হতো তবুও আমি এই মানুষটার স্মৃতির ছায়া সঙ্গী করে তার নামেই বেঁচে থাকতাম। তার নামে কবুল পড়েছি, তাকে স্বামী হিসেবে মেনেছি আজীবনের জন্য। সাময়িক সময়ের জন্য না। আশা করি বাবা-মা হিসেবে আমার অনুভূতি গুলোকে তোমরা একটু হলেও সম্মান দিবে। তোমাদের মেয়ে বিপথে গিয়ে কারো সাথে অবৈধ কোনো সম্পর্ক স্থাপন করেনি। আল্লাহর কালাম সাক্ষী রেখে ভালোবাসাকে পবিত্রতা দিয়েই বরণ করেছে। এতে তোমাদের লজ্জাবোধ বা আফসোস করার তো কোনো কারণ দেখছিনা। তবে কেন এতো আমাদের আলাদা করার ব্যস্ততা তোমাদের? কি লাভ আমাকে জীবন্ত মেরে ফেলে?”

দৃষ্টির বাবা-মা আসার খবর শুনেই মেহেদী ছুটে এসেছিল, আবার কোনো অঘটন যদি ঘটে যায় এই শঙ্কায়। ভাইকে দেখতে ইতি সেই সকালেই চলে এসেছিল। বলা চলে মোটামুটি পরিচিত রক্তিমের আপনজন সকলেই উপস্থিত। উঠোন
ভরা মানুষের সামনে দৃষ্টির এতো গুলো কথার পৃষ্ঠে কোনো জবাব দিতে পারেনা দিলশান আরা। অবাক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে। ভাবে, সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ বুঝি সত্যিই বড় হয়ে গেল! মা-বাবার কাছে নিজের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতে শিখে গেছে। ভালোবাসার জন্য বাবা-মায়ের সাথে লড়তেও পিছুপা হচ্ছেনা। আজ থেকে ঊনিশ বছর আগে ভালোবাসা যেমন ওনাকে অন্ধ বানিয়ে দিয়েছিল, নিজের পরিবারের কথা না ভেবে সাদেক সাহেবের হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছিল। আজ সেভাবেই নিজের মেয়েটাও ভালোবাসার কাছে অন্ধ হয়ে গেছে। তবে তার আর তার মেয়ের পরিস্থিতি তো সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাদেক সাহেবের হাত ধরে বেরিয়ে আসার পর থেকে তো কখনো কোনো অভাব-অনটন বুঝতে পারেনি দিলশান আরা। সাদেক সাহেব সবসময় স্ত্রী-সন্তানের প্রতিটা চাওয়া-পাওয়া পূরণ করেছে। স্বামী ঘরে সুখে থেকে দিলশান আরা কখনো সেইভাবে বাবা-মায়ের থেকে আলাদা হয়ে দুঃখ অনুভব করতে পারেনি। কিন্তু মেয়েটার কপাল তো সম্পূর্ণ ভিন্ন। চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে মেয়ের করুণ পরিস্থিতি। কতক্ষণ বিমূঢ় হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে দিলশান আরা একসময় বলে ওঠি,

“যার স্বামী পঙ্গুত্ব বরণ করে বিছানায় পরে আছে, সে কিভাবে সুখে থাকে সেটা আমারও দেখার আছে। মা হয়ে আমি চাইনি আমার মেয়ের জীবনটা শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে যাক। সবসময় চেয়েছিলাম আমার মতোই স্বামী, সংসারে সুখে থাকবে আমার মেয়ে। রানীর হালে জীবন পাড় করবে। কিন্তু আফসোস! ভালোবাসা তোমাকে এতোটাই অন্ধ করে দিয়েছে যে চোখের সামনে নিজের করুক পরিণতিটাও দেখতে পাচ্ছোনা। তবে ভেবোনা। খুব শিগ্রই সব কিছুই দেখতেও পারবে বুঝতেও পারবে। একদিন, দুইদিন মনে আনন্দ নিয়ে ঠিকই পতিভক্ত স্ত্রী হয়ে স্বামীর সেবা করে যাবে। কিন্তু তিনদিনের মাথায় ঠিক মনে মনে হলেও ভাববে যে, আমার মতো একটা মেয়ে কি আসলেই এমন জীবন ডিজার্ভ করে! নিজের চাহিদা আর অভাবের কাছে যেদিন ভালোবাসা হেরে যাবে সেদিন কপাল চাপড়িওনা আবার। আফসোস করোনা জীবন নিয়ে।”

“তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি মা। আমি এখন নিয়মিত নামাজ আদায় করার পুরো চেষ্টা করি। নির্ঘুম প্রতিটা রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে সিজদায় আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে দুটো জিনিস চাই। একটা হলো আমার স্বামীর সুস্থ্যতা, দ্বিতীয়টা হলো কখনো যদি আমার স্বামীর প্রতি আমার মাঝে বিরক্ত বা অনিহা আসার প্রবনতা থেকে থাকে,তবে যেন তার আগেই আমার মৃত্যু হয়। শুনেছি আল্লাহর কাছে মন থেকে কিছু চাইলে না কি আল্লাহ কখনো তার বান্দাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়না। আমি বিশ্বাস করি, আমার আল্লাহ’ও আমাকে খালি হাতে ফিরাবেনা। দুটো চাওয়া থেকে যেকোন একটা হলেও পূরণ করবেন ইন শ আল্লাহ। তুমিও একটু দোয়া করো, আমার দুটো চাওয়া থেকে একটা হলেও যেন খুব শিগ্রই পূর্ণতা পায়। সন্তানের জন্য বাবা-মা দোয়া করলে সেই দোয়া তো সবথেকে বেশি কাজে লাগে।”

ঘরের বাইরে মা-মেয়ের তর্ক চললেও টিনের ঘর হওয়াই ভিতরে শুয়ে থেকেও রক্তিম প্রতিটা কথা শুনতে পায়।দিলশান আরার মুখে নিজেকে নিয়ে বারবার পঙ্গু ,অক্ষম এমন হাজারটা তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথা শুনে যতটা হীনমন্যতা কাজ করছিল,মনে তার থেকেও বেশি মুগ্ধতা ছড়িয়েছে দৃষ্টির বলা এক একটা কথা। খরাপ্রবণ উত্তপ্ত হৃদয়ে ছেয়ে যায় শীতলতা। বিষাদীত অনুভূতির জোয়ারে ভাসতে ভাসতে হুট করে এক টুকরো শান্তির খোঁজ পেয়ে আবেশে দু-চোখ বুজে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। মন বলে, আরও একবার না হয় ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস এনে দেখ। “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু” কথাটা স্বরণে রেখে মেয়েটাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখো। হতে এই একটা সুযোগ তোমাকে এই নশ্বর পৃথিবীতেই স্বর্গ সুখ উপলব্ধি করাতে পারে। বুক ফুলিয়ে গলা ছেড়ে তুমিও বলতে পারো, আমি সুখী। সুখ আমার জীবনে ধরা দিয়েছে।, তোমার একটু উষ্ণ ছোঁয়ায় মেয়েটাও পেতে পারে তার ভালোবাসার পূর্ণতা। ঠকতে ঠকতেই মানুষ জিতে যায়। তুমিও জিতবে। আর সময় নষ্ট করোনা। আকড়ে ধরো মেয়েটার হাত।

মা-বাবা’কে বাইরে থেকেই বিদায় দিয়ে বিক্ষিপ্ত মনে দৃষ্টি ঘরে এসে দেখে রক্তিম চোখ বুজে শুয়ে আছে। মনে করে হয়তো ঘুমাচ্ছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে এই ভেবে, রক্তিম বোধহয় ঘুমিয়ে থাকাই তাদের কথা কিছুই শুনেনি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে যাচ্ছে। একের পর এক ঝামেলায় মজে এখনো গোসল করা হয়নি। এদিকে গোসল না করেও থাকতে পারবেনা। শরীর এখনই কেমন চুলকাচ্ছে। রক্তিম ঘুম থেকে ওঠার আগেই গোসলটা সেড়ে নেওয়া যাক।ভেবেই আলনা থেকে প্রয়োজনীয় কাপড় নিয়ে দরজার সামনে যেতেই শুনতে পায় রক্তিমের কথা,

“ওনাদের সাথে চলে গেলেই পারতে।”

সহসা থমকে যায় দৃষ্টি। লোকটা ঘুমায়নি তবে! সব শুনেছে তাদের কথা।ফিরে তাকায় রক্তিমের দিকে দৃষ্টি । ফোস একটা ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

“চলে যাবার জন্য আসিনি। মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত আপনার পিছু ছাড়ছিনা। তাই বলছি, এসব বাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।”

মাথা কাত করে দৃষ্টির দিকে ঘুরে তাকায় রক্তিম। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কতক্ষণ চুপ থেকে বলে,

“একটা গুন্ডা-মাস্তানের কি দেখে ভালোবাসলে? আমার জানা মতে মেয়েরা সবসময় ছেলেদের চেহারা, টাকা-পয়সা, চাকরি এসব দেখেই প্রেমে পরে। এসবের একটাও তো আমার নেই। তবে কেন ভালোবাসলে?”

একটু আগেই বাবা-মায়ের সাথে একই টপিকে কথা বলে মাথা ব্যথা করে ফেলেছে। এখন আবার এই বান্দা একই টপিক নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেছে। বিষয়টা একদম ভালো লাগেনা দৃষ্টির। ত্যাড়া ভাবে জবাব দেয়,

“আপনার সুন্দর মুখ নিঃসৃত তিতা তিতা কথার প্রেমে বাজে ভাবে পিছলে পরেছিলাম। করলার থেকেও তিতা কথার প্রেমে এতোটাই মজে গেছিলাম যে, লোভ সামলাতে না পেরে আজীবন শোনার আশায় আপনার ঘাড়ে ঝুলেছি।”

এমন ত্যাছড়া জবাবে চোখ পাকিয়ে তাকায় রক্তিম। কন্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে ধমকের সুরে বলে,

“খুব বেশি সাহস হয়ে গেছে না!নিজের ইচ্ছে স্বাধীন মনে যা আসছে তাই বলতে পারছো। আপাতত কিছু করতে অক্ষম দেখে ভেবোনা চোখের মাথা খেয়েছি। সব কিছুই দেখছি। একটু সুস্থ্য হয়ে নেই। একে একে সব হিসাব চুকাবো।থাপড়িয়ে যখন চাপার দাঁত সব পেটে চালান করব, তখন দেখব মুখ দিয়ে কথার খই কিভাবে ফোটে।”

স্মিত হাস্যে বিছানার দিকে এগিয়ে যায় দৃষ্টি। রক্তিমের মাথার কাছে বসে হাত দিয়ে গাল স্পর্শ করে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে। নিয়মিত থেরাপি আর ব্যায়ামের ফলে ক্রেনিয়াল নার্ভ অনেকটাই সচল হয়েছে। মুখের বাকা ভাবনা এখন আর কাছ থেকে ধ্যান ধরে না দেখতে বোঝা যায়না। কথাও আগের মতো এতো জড়িয়ে যায়না। যথেষ্ট স্পষ্ট হয়েছে আগের তুলনায়। মন দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে একটা সময় বলে,

“প্রথম যেদিন এই মুখটা দেখেছিলাম সেদিনই মায়ায় পরেছিলাম। রাতের পর রাত নিজের প্রতি নিজেই অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, ঐ রাগের পারদে ভাড়ী হওয়া মুখের আদলটা এতো টানছে কিভাবে আমাকে! যে মুখের সর্বত্রই মায়ার বদলে কাঠিন্যতায় ঘেরা সেই মুখ দেখে কিভাবে মায়ার সৃষ্টি হতে পারে! দ্বিতীয়বার অনেকটা চমকে গিয়ে এই কঠোর মুখটাতে অল্পস্বল্প মায়া দেখেছিলাম। সেটাও ছোট্ট এক কুকুর ছানার জন্য। বকুল মিয়ার স্টলের সামনে একটা কুকুরের ছানাকে রুটি খেতে দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। আপনি হয়তো নিজেও জানেন না, সেই মুহুর্তে আপনার চোখে-মুখে ঠিক কতটা মায়া ভর করেছিল। যে মায়া সর্বনাশ ডেকে এনেছিল আমার। বুঝে গিয়েছিলাম কাঠিন্যতার মুখোশের আড়ালে ঐ মুখে যে মায়া লেপ্টে আছে সেটা আমার মনের চোখ প্রথম দিনই দেখে নিয়েছিল। তাইতো এক দেখাতেই এমন ছটফট করছিল। মনের চোখ যে মুখের মায়া দেখে নিজেও মায়ায় পরেছে, সে কিভাবে এই মায়ার মানুষটাকে ছেড়ে যেতে পারে! পৃথিবী ধ্বংস হোক। তবুও কখনো আমাদের বিচ্ছেদ না হোক।ক্ষনস্থায়ী দুনিয়ায় সৃষ্টি হওয়া বন্ধন আখিরাতেও অটুট থাকুক।”

চোখে মুগ্ধতা নিয়ে অপলকে দৃষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে রক্তিম। পাষাণ পুরুষের তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আজ কোনো কঠোরতা দেখতে না পেয়ে নির্মল হাসে দৃষ্টি। মন বলে, অবশেষে পাষাণ বোধহয় একটু একটু করে গলছে। একই ভাবে দৃষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টিকে একটু বাজিয়ে দেখার জন্য রক্তিম ধীরকন্ঠে বলে ওঠে,

“তার মানে আমার চেহারা দেখে প্রথম মায়ার সৃষ্টি, এরপর ভালোবাসা! তাহলে তো বলাই যায় ঐ ভালোবাসা শুধু শরীরের প্রতি। বয়সের সাথে সাথে চেহারা ম্লান হয়ে গেলে ভালোবাসাও ফুরিয়ে যাবে।”

জনম ত্যারা, এক রোখা, বদ মানুষ কি কখনো এতো সহজে ভালো হবে! আদা মরলেও আদার ঝাঝ যায়নি। আর এ তো দৃষ্টির পাষাণ শিকদার। এর তিতা তিতা কথায় এতো সহজে কিভাবে মধুরতার সৃষ্টি হবে! এখনই মধু মিশ্রিত কথা আশা করলেও দৃষ্টির বোকামি হবে। শরীরটাই শুধু ঠুসঠাস গাল চেপে ধরে কান গরম করা থাপ্পড় দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে সাময়িক সময়ের জন্য। কিন্তু মুখটা তো ঠিকই আছে। তাই এর মুখের কথা এতো সহজে পরিবর্তন হবার আশা বৃথা। চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি কতক্ষণ রক্তিমের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসে। অল্প ঝুকে প্রথমবারের মতো সাহস করে প্রণয় পুরুষের কপালে এঁকে দেয় ভালোবাসার শুন্ধতম পরশ। মেয়েলি চিকন ওষ্ঠদ্বয় কয়েক সেকেন্ড স্থির থাকে রক্তিমের কপালের মধ্যিখানে। হুট করে এমন ছোঁয়ায় জমে যায় রক্তিম। বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকে খ্যায় হারিয়ে। কপালে ঠোঁট ঠেকিয়েই দৃষ্টি ফিসফিসিয়ে বলে,

“ভালোবাসা শরীর থেকেই মন ছুঁয়ে যা, আবার মন থেকেই শরীর। ভালোবাসতে শরীর, মন দুটোই লাগে। নারী-পুরুষ যেমন একে অপরকে ছাড়া অসম্পূর্ণ, তেমন শরীর, মন দুইয়ের যেকোন একটা ছাড়াই ভালোবাসা অসম্পূর্ণ। এই চিরন্তন সত্যটা সবাই মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে ঠিকই জানে।”

চলবে….

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-৩০+৩১

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩০
#আদওয়া_ইবশার

অশান্ত মস্তিষ্ককে কোনোমতে শান্ত করে একটানা তিন ঘন্টার পরীক্ষা শেষে হল থেকে বেরিয়েছে দৃষ্টি। আদালতে কি হয়েছে ভাবনা, চিন্তায় বুকের ভিতরটা অবিরাম কাঁপছে। রাস্তায় শিক্ষার্থী সহ অভিভাবকদের উপচে পরা ভীড়। ভয়ার্ত চোখে আশেপাশে তাকিয়ে পরিচিত কোনো মুখ খুজতে ব্যস্ত দৃষ্টি। মিনিট দুইয়েক পাড় হতেই দেখতে পায় ব্যস্ত ভঙ্গিতে রাকিব এগিয়ে আসছে তার দিকে। দ্রুত পা চালিয়ে দৃষ্টি নিজেও এগিয়ে যায় সেদিকে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রথমেই জানতে চায়,

“কি হয়েছে কোর্টে? ওনার জামিন হয়েছে তো?”

দৃষ্টির প্রশ্ন রাকিবের কানে গেল কি না কে জানে! প্রশ্ন দুটো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রাকিব ভাঙা স্বরে বলে,

“ভাই হাসপাতালে। জ্ঞান নাই। অবস্থা খুব একটা ভালো না। তাড়াতাড়ি আসেন।”

বলতে বলতেই রাকিবের চোখে জমে থাকা অশ্রুজল টুপটাপ ঝরে পরে কার্নিশ বেয়ে। অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে থাকে দৃষ্টি। এতোক্ষনের বুকের ভিতরের অস্থিরতাটা এবার যেন শ্বাস রোধ করে নেয়। মনে হয় পৃথিবীতে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের বড্ড অভাব। হাঁসফাঁস করে দৃষ্টি। পাগলের মতো হাটু গেড়ে বসে পরে সেখানেই। সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে বেজে ওঠে বিধ্বস্ত এক কিশোরীর আর্তনাদ। বুকে জমে থাকা কষ্ট গুলো একে একে বেরিয়ে আসে প্রতিটা চিৎকারের সাথে। ছোট্ট হৃদয়ে কষ্টের বোঝাটা হয়তো একটু বেশিই হয়ে গেছিলো। সেই ভার সহ্য করতে না পেরে জনসম্মুখেই হিতাহিত জ্ঞান ভুলে দুঃখ বিলাসে মেতে উঠেছে। মাঝ রাস্তায় এক কিশোরী মেয়ের বুক ফাঁটা আর্তনাদে জনগণ বিমূঢ়। অবাক নেত্রে শুধু তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে বিধ্বস্ত দৃষ্টিকে। রাকিব বুঝতে পারে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে খুব বড় এক ভুল করে বসেছে। এখন এই ভঙ্গুর হৃদয়ের মানবীকে কিভাবে সামলাবে সে? ইতিমধ্যে দৃষ্টিকে ঘিরে জটলা বেঁধে গেছে। কেউ কেউ এগিয়ে এসে জানতে চাইছে, কি হয়েছে? আবার কেউ কেউ দূর থেকেই মায়া মায়া দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে দুঃখবিলাসিনীকে। কয়েকজন মহিলার সহযোগীতায় একটা সিএনজি ঠিক করে দৃষ্টিকে তুলতে সক্ষম হয় রাকিব। হাসপাতালে যাবার পুরোটা সময় চিৎকার করে কেঁদে গেছে দৃষ্টি। অস্পষ্ট স্বরে কি যেন বারবার বলেছে। বুঝতে পারেনি রাকিব। বিষাদের প্রলেপ ঘেরা মুখটা দেখে কি যে মায়া হয় রাকিবের! এতোদিন এই মেয়েটাকে দেখলেই তার রাগ হতো। ইচ্ছে হতো পায়ে পা মিলিয়ে ঝগড়া করার। তবে আজ খুব করে চাইছে কোনো এক জাদুবলে ঘুচে যাক বিষাদিনীর সমস্ত বিষাদ।

হাসপাতালের সামনে সিএনজি থামতেই পাগলের মতো ছুটে যায় দৃষ্টি। জ্ঞানশূণ্য হয়ে যেদিকে দুচোখ যাচ্ছে সেদিকেই ছুটছে। রাকিব কোনোমতে সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত বেগে এসে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েই দৃষ্টির একটা হাত শক্ত করে ধরে নেয়। বলে,

“এমন পাগলামি করবেন না। মানুষ খারাপ বলছে।আমার সাথে আসুন। ভাই চতুর্থ ফ্লোরে। এখানে না।”

রুদ্ধশ্বাসে রাকিবের সাথে লিফটের ভিতর দাঁড়িয়ে যায় দৃষ্টি। এতোক্ষন যাবৎ এক সুরে চিৎকার করে কান্নার ফলে নেতিয়ে গেছে। গলা চিরে এখন আর চিৎকারের শব্দ আসছেনা। তবে ফোঁপানোর শব্দটা রয়ে গেছে। লিফট চতুর্থ ফ্লোরে থামতেই দুজন সমান গতিতে কয়েক লাফে আইসিইউ এর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চারিদিকে নজর ঘুরিয়ে দৃষ্টি দেখে নেয় শক্ত খোলসে আবৃত প্রতিটা পুরুষের চোখে আজ অশ্রু। মেহেদী, জাবির, শান্ত সহ আরও কিছু পরিচিত-অপরিচিত মুখ দাঁড়িয়ে। পাশেই চেয়ারে শরীর ছেড়ে বসে আজীজ শিকদার। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে নিঃশব্দে। আজীজ শিকদারের দেখা পেয়ে দৃষ্টি যেন এবার একটু ভরসা খোঁজে পায়। ছুটে গিয়ে জানতে চায়,

“বাবা!ওনি কোথায়? কি হয়েছে ওনার? আমি দেখব। একটাবার দেখব শুধু।”

কান্নায় এইটুকু সময়েই গলা বসে গেছে দৃষ্টির। কন্ঠস্বর কেমন রুক্ষ শুনাচ্ছে। কোনো জবাব দেয়না আজীজ শিকদার। কতক্ষণ জবাবের আশায় তাকিয়ে থেকে ধৈর্য্যহারা হয়ে মেহেদীর কাছে ছুটে যায় দৃষ্টি। অনুরোধের স্বরে বলে,

“ভাইয়া! আপনিও চুপ করে থাকবেন না প্লিজ। বলুন ওনি কোথায়? আমি শুধু একবার দেখব। আমার নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে আর টেনশন দিবেন না। নিতে পারছিনা আমি আর এসব। মরে যাব। একদম মরে যাব।”

কথা গুলো বলতে বলতেই নিস্তেজ হয়ে ঢলে পরে দৃষ্টি। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসে সমস্ত কিছু। মেঝেতে লুটিয়ে পরার আগেই ধরে নেয় মেহেদী। তড়িৎ দুজন নার্স ডেকে ধরাধরি করে একটা কেবিনে নিয়ে যায়। ডাক্তার দেখে জানায় অত্যন্ত দুর্বল শরীর। স্ট্রেস বেশি হয়ে গেছিল। এতো ধকল সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছে। মাঝ সাগরে ডুবতে গিয়েও যেন ডুবছেনা কেউ। কেমন একটা দম বন্ধকর পরিস্থিতি। যেদিকেই তাকায় সেদিকেই যেন বিপদ। একটু একটু করে ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গছে প্রত্যেকের। ক্ষীণ হচ্ছে আশার আলো। রক্তিম-দৃষ্টির গল্পের শেষ পরিণতি কি এটাই? হঠাৎ আসা এই ঝড়েই কি নিঃশেষ হবে তাদের অসমাপ্ত গল্প। দুচোখ জুড়ে হাজার স্বপ্ন বুক ভরা আশা নিয়ে ছন্নছাড়া রক্তিমকে ভালোবেসেছিল যে মেয়েটা, সৃষ্টিকর্তা কি তার ভাগ্যে বিয়ে পরবর্তী দিন গুলোতে এক বিন্দু সুখ রাখেনি? এ কেমন নিষ্ঠুর বিচার তার?

বুক চিরে হতাশার নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে মেহেদীর। দুহাতে মুখ ঢেকে কতক্ষণ চুপ থেকে অন্যদের উদ্দেশ্যে বলে,

“রক্তিমের কথা আপাতত বাড়িতে যেন আর কেউ না জানে। দুজনকে সামলাতেই জান বেরিয়ে যাচ্ছে। বাকীদের সামলানোর ধৈর্য্য আমার আর নেই।”

দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ডাক্তার বেরিয়ে আসে আইসিইউ থেকে। উদগ্রীব হয়ে ছুটে যায় সকলেই। ঘিরে ধরে চারপাশ থেকে ডাক্তারকে। অধৈর্য হয়ে মেহেদী জানতে চায়,

“কি অবস্থা ওর? ভালো আছে তো! জ্ঞান ফিরেছে? রিপোর্ট কি এসেছে?”

আস্তেধিরে মুখ থেকে সার্জিক্যাল মাস্ক খুলে প্রতিটা উৎসুক মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে ডাক্তার। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে জানায়,

“সিচুয়েশন ক্রিটিক্যাল। স্ট্রোক হয়েছে। ডান পাশ প্যারালাইজড।আর ঘন্টা খানেক অবজারবেশনে রাখব। এরপর কেবিনে শিফট করব।”

হঠাৎ যেন প্রতিটা মানুষের মাথায় মস্ত বড় আকাশটা ভেঙ্গে পরেছে। শরীর ছেড়ে দেয় প্রত্যেকে। দুহাতে মুখ ঢেকে চোখের জল ছেড়ে দেয় মেহেদী। অশান্ত মন গুলো শান্ত হবার বদলে নতুন করে চোরাঝড়ের সম্মুখিন হয়ে আরও অশান্ত রূপ নিয়েছে। নিভু নিভু জ্বলা আশার প্রদিপটা ঝুপ করেই নিভে গেছে।এটুকুই কি বাকী ছিল? একটা মানুষের জীবনে আর কতভাবে দুর্দশা দিবেন সৃষ্টিকর্তা? একের পর এক আঘাতে মৃতপ্রায় জীবনটা এমন নির্জীবের মতো পরে থাকার থেকে না হয় মরেই যেতো। মৃত্যু অন্তত রেহাই দিত এই অভিশপ্ত জীবন থেকে। কিন্তু হায়! মৃত্যও যেন রক্তিমকে উপহাস করছে। সেও দেখতে চাচ্ছে একটা মানুষ এক জীবনে ঠিক কতটা দুঃখ সইতে পারে।

মুখ থেকে হাত সরিয়ে পাগলের মতো মাথার চুল খামচে ধরে মেহেদী। শরীর কাঁপিয়ে হাটু মুড়ে নিঃশ্বের কান্নায় ভেঙ্গে পরে। হাতের উল্টো পিঠে সিক্ত চোখ মুছে এগিয়ে আসে জাবির। এক হাত মেহেদীর কাধে রেখে ধরা গলায় বলে,

“ভাই! আপনি এভাবে ভেঙ্গে পরলে আমরা কি করব? রক্তিম ভাইয়ের পর তো আপনিই আমাদের একমাত্র ভরসা। আর ভাবি! ভালোবাসার কাঙ্গাল ঐ মেয়েটাকে কে সামলাবে? আপনার কাধে যে এখন অনেক বড় দায়িত্ব। একজন ভাই হয়ে ভাবির পাশে ছায়ার মতো থাকতে হবে। ভাইকে সঠিক চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ্য করে তুলতে হবে। আমরা ভাইকে খুব বেশিদিন বিছানায় পরে থাকতে দেখতে পারবনা। সবাই মিলে খুব তাড়াতাড়ি ভাইকে সুস্থ্য করে তুলব। আমাদের এতো গুলো মানুষের মনের জোর মিথ্যে হতে পারেনা। ভাই সুস্থ্য হবে। আবার আগের মতো পুরো সাভার জোরে রাজ করে বেড়াবে।”

ক্ষনকাল পর নিজেকে শান্ত করে ঝট করে সোজা হয়ে দাঁড়ায় মেহেদী। শীতল চোখে তাকায় নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা আজীজ শিকদারের দিকে। নিস্তেজ ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়ে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,

“এটাই তো চেয়েছিলেন আপনি তাইনা! এবার শান্তি পেয়েছেন তো? মনের জ্বালা মিটেছে? নিজের সন্তানকে তিলে তিলে নিজ হাতে মেরেছেন। দেহের মৃত্যু না দিয়ে মনের মৃত্যু দিয়েছেন। এক কুলাঙ্গারের জন্য এক স্বপ্নবাজ ছেলের স্বপ্ন গুলো গলা টিপে হত্যা করেছেন। এখন তো আপনার খুশির অন্ত থাকবেনা। আর কোনো লুকোচুরির ও প্রয়োজন পরবেনা। আদরের কলিজার টুকরা চরিত্রহীন ছেলে আর পুত্রবধূ নিয়ে নিশ্চিন্তে নিজ গৃহে শান্তিতে থাকতে পারবেন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন এখনো এখানে? যান না! দ্রুত যান। রক্তিম নামের গলার কাটা আজ নিথর দেহে পরে আছে হাসপাতালের বেডে। এই খুশিতে পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা অতিব জরুরি।”

কথা গুলো শোনা মাত্রই অত্যাধিক রাগে কিড়মিড়িয়ে সর্বসম্মুখে আজীজ শিকদার থাপ্পড় বসিয়ে মেহেদীর গালে। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলে,

“একদম চুপ! বেয়াদব! একজন বাবাকে বিচার করার ক্ষমতা কবে হয়েছে তোমার? সংগ্রাম যেমন আমার সন্তান তেমন রক্তিম ও আমার সন্তান। বরং সংগ্রামের থেকেও রক্তিমের প্রতি আমার টান একটু হলেও বেশি। কারণ সে আমার বড় সন্তান। তার জন্যই আমি প্রথম বাবা হবার অনুভূতি চিনেছি। প্রথম বাবা ডাক শুনেছি ওর মুখ থেকে। সবাই শুধু একপাক্ষিক ভাবে ওর দিকটাই দেখছো। কারণ ওর দুঃখ গুলো দৃশ্যমান। আর আমার! আমি তো বাবা। বাবাদের কোনো দুঃখ,কষ্ট প্রকাশ করতে নেই। আজ কেউ আমাকে বুঝবেনা। আমার ছেলেও না। বুঝবে সেদিন। যেদিন নিজেরা বাবা হবে। একজন বাবা ছাড়া কখনও অন্য কেউ একজন বাবার দুঃখ বুঝতে পারেনা। সব কিছু ছাপিয়ে আজ সত্যিই আমি অপরাধি। সন্তানদের ভালো করতে গিয়ে, একটা শান্তিপূর্ণ, সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে গিয়ে আজ আমি একজন আদর্শ বাবা থেকে নিকৃষ্ট বাবাতে পরিণত হয়েছি।”

নিরব কান্নার সাক্ষী বহন করছে আজীজ শিকদারের রক্তিম, ফোলা দুটো চোখ। কাঁপছে পুরো শরীর। জোর গলায় এতো গুলো কথা বলায় হাঁপিয়ে গেছে। বুকে চাপ অনুভব হচ্ছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। কিছুই বলতে পারেনা আর। ক্লান্ত ভঙ্গিতে ধপ করে বসে পরে চেয়ারে। দুহাতে মুখ ঢেকে ছোট বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কেঁদে ওঠে। ভালো করতে গিয়ে ছোট্ট একটা ভুলের কারণে আজ এতো গুলো মানুষের জীবন বিপন্ন। যে ছেলের আঙুল ধরে টুকটুক করে হাঁটা শিখিয়েছিল ছোট্ট কালে। আজ সেই ছেলে পঙ্গুত্ব বরণ করে বিছানায় নিথর হয়ে পরে আছে। শুধুমাত্র নিজের ভুলের কারণে। একটা সময় যে ছেলের গোপন কথার সিন্ধুক ছিল, আজ সেই ছেলের দুঃখের সিন্ধুক হয়ে গেল। তালাবদ্ধ সিন্ধুক খুলে ছেলেকে ভাসিয়ে দিল দুঃখের সাগরে। বাবা-ছেলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বদলে নিঃশেষ করে দিল একেবারে। বাবা হয়ে নিজে হেঁটে বেড়াবে, আর ছেলে পরে থাকবে বিছানায়! কিভাবে সহ্য করতে এই দৃশ্য? ছেলের অচল দেহ দেখার আগে আল্লাহ মৃত্যু দিক এই পাপি বাবাকে। উঠিয়ে নিক পৃথিবী থেকে বাবা নামক ঘৃন্য মানুষটাকে।

****

রক্তিমকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে।আপাতত কড়া ডোজের ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ার ফলে ঘুমাচ্ছে। ডাক্তার স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছে একদম চিন্তামুক্ত রাখতে হবে। দ্বিতীয়বার কোনো কিছু নিয়ে হাইপার হলে ধুকধুক নিঃশ্বাসটাও হয়তো চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আবার এমনও হতে পারে হৃৎপিন্ডটা সচল থাকলেও ডান সাইডের পাশাপাশি পুরো শরীরটাই অকেজো হয়ে যেতে পারে। বিপদ এখনো উত পেতে আছে। যত সাবধানতা অবলম্বন করা যায় ততই ভালো। আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করার সময় দূর থেকে একবার রক্তিমের নিথর দেহটা দেখার সুযোগ হয়েছে একবার। ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করে দ্বিতীয়বার কেবিনে গিয়ে দেখার সাহস কেউ করেনি।

রক্তিমকে কেবিনে শিফট করার কতক্ষণ পরই দৃষ্টির জ্ঞান ফিরে। পিটপিট দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখে মাথার উপর সাদা ছাঁদ। আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কোথায় আছে। মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করতেই মনে পরে যায় একে একে সমস্ত ঘটনা। সাথে সাথে ধরফরিয়ে ওঠে বসে। তখনই বা-হাতে ব্যথা অনুভব হয়। চোখ কুঁচকে হাতের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় ক্যানুলায় স্যালাইন চলছে। দাঁত চেপে এক টানে ক্যানুলা খুলে ওঠে বসে। ক্যানুলায় বেকায়দায় টান লাগায় গলগলিয়ে রক্ত গড়িয়ে পরে। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই দৃষ্টির। দৌড়ে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন নার্স আটকে দেয় তাকে। বলে ওঠে,

“ম্যাম প্লিজ এভাবে ছুটবেন না। আপনার শরীর দুর্বল। আবারও মাথা ঘুরিয়ে পরে যেতে পারেন।”

দৃষ্টি শুনেনা কারো কথা। দুর্বল শরীরেই কিভাবে যেন শক্তি এসে ভর করে। এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নেয় নিজেদের। ছুটে গিয়ে থামে মেহেদীর সামনে। হাপিয়ে যাওয়া স্বরে বলে,

“কোথায় ওনি?”

ফ্যালফ্যাল নয়নে দৃষ্টির মুখের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে মেহেদী। কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ দুটো বন্ধ করে কি যেন ভাবে। পরোক্ষনে চোখ খুলে দৃষ্টির হাত দুটো স্ব-স্নেহে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নরম সুরে বলে,

“দৃষ্টি! বোন তুমি তো অনেক স্ট্রং একটা মেয়ে তাইনা? আমি ভাই হয়ে তোমার কাছে একটা আবদার রাখি! আমার আবদারটা ফেলে দিওনা প্লিজ। নিজেকে শক্ত করো। একমাত্র তুমি ছাড়া ঐ অভাগাটার আর কেউ নেই। তোমাকেই সবটা সামলাতে হবে। আমি জানি তুমি পারবে। তুমিতো রক্তিমকে ভালোবাসো। এখন তুমিও যদি এমন ভেঙ্গে পরো অসুস্থ হয়ে যাও তবে রক্তিমকে কে দেখবে? বোন প্লিজ! শক্ত করো নিজেকে।”

একদম শান্ত দৃষ্টি।শীতল চোখে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে থমকে যাওয়া কন্ঠে জানতে চায়,

“বেঁচে আছো তো!”

আৎকে ওঠে মেহেদী। তড়িৎ মাথা ঝাকিয়ে বলে,

“কিসব আজেবাজে ভাবছো! এমন কিছুই হয়নি। স্ট্রোক হয়েছে। এখন ভালো আছে। ডাক্তার বলেছে আর কোনো টেনশন নেই। ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে তো। তাই ঘুমাচ্ছে। তুমি যাও। দেখে আসো। তবে ডেকো না। নিজে থেকে উঠলে তখনই কথা বলো।”

হঠাৎ দৃষ্টির এমন অস্বভাবিক শান্ত কন্ঠের এমন ভয়াবহ একটা কথায় মেহেদী বাকিটুকু বলার সাহস পায়না। কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের থেকে অনুমতি নিয়ে দৃষ্টিকে দেখার সুযোগ করে দেয়। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই বুকটা মুচড়ে ওঠে দৃষ্টির। বলিষ্ঠ সুদেহী শরীরটা বিছানার সাথে মিশে আছে। দাড়ি ভর্তি মুখটা কেমন ফ্যাকাশে! ধূসর ঠোঁট দুটো কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। বুকের ভিতরের অশান্ত ঝড়টা আবারও টের পায় দৃষ্টি। উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকায়। শরীরটা আবারও দুর্বল হচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন শ্বাস নেয়। অপলক তাকিয়ে থাকে ফ্যাকাশে মুখটার দিকে। বুকের ভিতর কান্না আটকে রাখা দায় হয়ে পরছে। সব ভেঙ্গেচূরে তোলপাড় হচ্ছে। কিছুতেই পারছেনা নিজেকে সামলাতে। মুখে ওড়না গুজে ব্যর্থ হয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। অশান্ত মন সৃষ্টিকর্তাকে শুধু বলে, হে আল্লাহ! ধৈর্য্য দাও আমাকে। বাড়িয়ে দাও সহ্যক্ষমতা।

চলবে……

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৩১
#আদওয়া_ইবশার

দুচোখ বন্ধ করে নিস্তেজ ভঙ্গিতে বিছানায় পরে আছে রক্তিম। ঘন্টা খানেক আগে ঘুম ভাঙ্গে তার। ভারী চোখ খুলে এক পলকের জন্য শুধু দেখেছিল সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় দৃষ্টিকে। এরপর সেই যে চোখ বন্ধ করেছে, ডাক্তারের ডাকেও কোনো সাড়া দেয়নি। একবার শুধু অস্ফুট স্বরে বলেছিল, তাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে। মুখের ডান পাশটাও অল্প একটু বেঁকে গেছে রক্তিমের। কথা কেমন জড়িয়ে আসে। ডাক্তারের মুখ থেকেই দৃষ্টি জানতে পারে রক্তিমের প্যারালাইজড এর বিষয়টা। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। না ফেলেছে এক ফোঁটা চোখের জল। অতি শোকে পাথর, কথাটাই যেন ফলেছে দৃষ্টির ক্ষেত্রে।শান্ত কন্ঠে শুধু ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিল,

“পুরোপুরি সুস্থ্য হবার সম্ভাবনা কতটুকু?”

ডাক্তার যখন জানতে পারে পেশেন্ট রক্তিম শিকদারের স্ত্রী এই অল্প বয়সী দৃষ্টি মেয়েটা,তখন কিছু সময়ের জন্য থমকায়। সহানুভূতির নজরে তাকায় কিশোরী মেয়েটার দিকে। ভাবে এটুকু একটা মেয়ে! এই বয়সে তো তার বই, বন্ধু-বান্ধব নিয়েই মেতে থাকার কথা। অথচ সেই মেয়েটাই কি না ভাগ্যের ফেরে আজ প্যারালাইজড স্বামীর সবথেকে কাছের অভিভাবক! নিশ্চয়ই সুস্থ্য স্বাভাবিক স্বামীর ঘরে দু-চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল। হাতে হাত রেখে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটবে দুজন। স্বামীর কাধে মাথা রেখে চোখ বুজে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিবে। ছোট, বড় সমস্ত আবদার, আহ্লাদ পূরণ করবে স্বামী। কিন্তু আজ! স্বামী নামক মানুষটা তার নির্ভরতার স্থান হবার বদলে উল্টো সেই আজ স্বামীর নির্ভরতার স্থান। অল্প বয়সেই স্বামী সুখ থেকে বঞ্চিত হলো মেয়েটা। কাধে তুলে নিতে হবে পঙ্গু স্বামীর সকল দায়িত্ব। কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল ডাক্তার আসলাম হাজারী। স্মিত হেসে ভরসা দিয়ে বলেছিল,

” আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলোনা মা। চিকিৎসা এক ধারা আর মনের জোর আরেক ধারা। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখো। নেগেটিভ কোনো কিছু মাথায় না এনে সবসময় পজেটিভ ভাবো। তোমার স্বামীর যা সিচুয়েশন এর থেকেও আরও ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনের পেশেন্ট ও সুস্থ্য হয়েছে। পুরো শরীর প্যারালাইজড পেশেন্টদের ও আমি সঠিক চিকিৎসায় রেগুলার ফিজিওথেরাপি আর সঠিক যত্নে হাঁটতে দেখেছি। সেখানে তোমার স্বামীর কন্ডিশন এতোটাও খারাপ হয়নি। ডান পাশ একেবারেই অকেজো না। অল্প নড়চড় হয়তো করতে পারবে।তোমার স্বামীও সুস্থ্য হবে ইন শা আল্লাহ। হয়তো একটু সময় লাগবে। কিন্তু আল্লাহ চাইলে অবশ্যই সুস্থ্য হবে।”

মলিন মুখে ডাক্তারের কথা গুলো মন দিয়ে শুনে দৃষ্টি। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। চুপচাপ চেম্বার থেকে বেরিয়ে রক্তিমকে রাখা কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। নিশ্চুপে দরজার নব ঘুরিয়ে ভিতরে ঢুকে একটা টুল টেনে নিরবে বসে পরে রক্তিমের মাথার কাছে। কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দেয় রক্তিমের অবশ ডান হাতটা। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকে,

“জেগে আছেন?”

দৃষ্টির ডাকে সময় নিয়ে চোখ খুলে তাকায় রক্তিম। অষ্টাদশীর লাবন্যময় মুখে আজ কোনো লাবন্যতা খোঁজে পায়না রক্তিম। চুপচাপ খুটিয়ে খুটিয়ে অপলক চোখে দেখে যায় দৃষ্টির মলিন মুখটা। বিয়ের এতোদিন পর এই প্রথম রক্তিম হয়তো পূর্ণ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়েছে। আজ তো দৃষ্টির চেহারায় এক রাশ মলিনতা ছাড়া কিছুই নেই। তবে এই বিষাদ ঘেরা মুখে অপলকে কি দেখছে রক্তিম? ম্লান হাসে দৃষ্টি। আদুরে পরশে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

“ঘুম পাচ্ছে আরও?”

দৃষ্টির ডাকে হুশ ফিরে রক্তিমের। তড়িৎ মুখ ফিরিয়ে কাত হয়ে শুতে চায়। ঠিক তখনই অনুভব করে ডান পাশটা ঠিকভাবে নাড়াতে পারছেনা। বল প্রয়োগ করতে গেলেই কেমন ঝিমঝিম করছে। অসহনীয় এক পীড়া দিচ্ছে। বারকয়েক চেষ্টার পরও যখন ব্যর্থ রক্তিম, তখনই বিমূঢ় চিত্তে দৃষ্টির দিকে তাকায়। অস্পষ্ট ভাবে বলে,

“আমার হাতে-পায়ে কি হয়েছে?”

মুখ বেকে যাওয়ার ফলে কথা জোরালো শুনালেও বুঝতে পারে দৃষ্টি। তৎক্ষণাৎ চঞ্চলতায় ছেয়ে যায় দৃষ্টির চোখ দুটো। শুকনো খড়খড়ে ঠোঁট দুটো জ্বিভের ডগায় ভিজিয়ে স্মিত হেসে বলে,

“তেমন কিছুনা। তখন না কি কোর্টে মাথা ঘুরিয়ে পরে গেছিলেন! ঐ সময় একটু ব্যথা পেয়েছেন। ডাক্তার বলেছে ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। আপনি এতো অস্থির হবেন না প্লিজ!”

কথাটা বিশ্বাস হয়না রক্তিমের। পরে গিয়ে ব্যথা পেলে এমন অবশ অবশ লাগবে কেন হাত-পা? তাও শুধু এক পাশ। নড়তে না পেরে ছটফট করে রক্তিম। তার এমন ছটফটানি দেখে দৃষ্টি ব্যর্থ হয় চোখের জল আটকে রাখতে। ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে ওঠে ফুপিয়ে। দিশেহারা হয়ে ছুটে যায় বাইরে। মেহেদীর সামনে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে অনুনয় করে বলে,

“ভাইয়া প্লিজ ওনাকে সামলান। আমি পারছিনা। আমি, আমি কি বলব? কোন মুখে বলব যে আপনি হাঁটা-চলার শক্তি হারিয়েছেন? আমি আর পারছিনা। আমার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনি যান। গিয়ে কিছু একটা বলুন। আপনার কথা ঠিক শুনবে।”

মেহেদীর পিছন পিছন আজীজ শিকদার ছুটে যায়। বাইরে দৃষ্টির কাছে ঝাপসা চোখে দাঁড়িয়ে থাকে জাবির, শান্ত। রাকিব দরজার কাছে আড়াল থেকে দেখার চেষ্টা করে ভিতরের পরিস্থিতি। মেহেদীর সাথে আজীজ শিকদারকে দেখা মাত্রই একদম শান্ত হয়ে যায় রক্তিম। থেমে যায় এতোক্ষনের সকল ছটফটানি। শরীরের ব্যথা ছাপিয়ে অনুভূত হয় বুকের ভিতর জ্বলছে। শারীরিক যন্ত্রণার থেকেও বেশি পীড়া দিতে শুরু করে মনের যন্ত্রণা। চোখের পাতায় একে একে ভেসে ওঠে আদালতের প্রতিটা ঘটনা। অসহনীয় ব্যথার উদ্বেগ হয় মাথায়।ঘন ঘন নিশ্বাস নিয়ে সামলানোর চেষ্টা করে নিজেকে। যেই আজীজ শিকদার পা বাড়ায় তার কাছাকাছি আসতে, ওমনি সচল বা-হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয় রক্তিম। হাপিয়ে যাওয়া কন্ঠে কাঠিন্যতা মিশিয়ে চোখ খিঁচিয়ে বলে মেহেদীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ওনাকে চলে যেতে বল। সহ্য হচ্ছেনা আমার ঐ চেহারা।”

এমন একটা আচরণেই বোধহয় আশা করেছিল আজীজ শিকদার। এতো বড় একটা ঘটনার পর আর কি ই বা আশা করা যায়। তবুও দমেনা আজীজ শিকদার। ভুল যখন করেছে সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তো করতেই হবে। ফোঁস করে একটা দম ছেড়ে নিষেধ সত্বেও এগিয়ে যায় আজীজ শিকদার। বোঝানোর সুরে বলে,

“বাবা আমার কথাটা শুন। আমাকে একটা সুযোগ দে।”

“সুযোগ! কিসের জন্য? যেটুকু বেঁচে আছি সহ্য হচ্ছেনা? একেবারে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে পুতে রাখতে চাচ্ছেন? কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি একটুও মরতে চাইনা। আগে চাইলেও এখন আর চাইনা। বাঁচতে চাই। বেঁচে থেকে নিজ চোখে দেখতে চাই আমার আশেপাশে থাকা মানুষ গুলো আর কতভাবে আমাকে আঘাত করতে পারে। আর আমিও কতটুকু সহ্য করতে পারি। একসময় জীবনের প্রতি অনিহা ছিল। আর এখন জীবনের প্রতি জেদ ছাড়া কোনো অনিহা নেই।”

এটুকু বলেই হাপিয়ে যায় রক্তিম। শরীর ছেড়ে শুয়ে থেকে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে কতক্ষণ। তড়িৎ বেগে মেহেদী এগিয়ে যায় তার দিকে। একটা হাত নিজের দু-হাতে মুঠোয় নিয়ে অনুরোধের স্বরে বলে,

“ভাই প্লিজ চুপ থাক। তোর শরীর ভালো না। আর কথা বলিস না। যা বলার সুস্থ্য হয়ে বলিস। ওনাকে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। চলে যাবে ওনি। তুই একটু শান্ত হো।”

আবারও অশান্ত ভঙ্গিতে মাথা কাত করে বা-হাত ঝাড়ি দিয়ে মেহেদীর থেকে ছাড়িয়ে নেয় রক্তিম। ঠেলে একটু দূরে সড়াতে চায়। মেহেদীও কোনো জোর ছাড়াই ঝটপট সড়ে দাঁড়ায়। এভাবে বল প্রয়োগ করলে যদি আবার কোনো ক্ষতি হয়! অস্পষ্ট স্বরেই রক্তিম চিৎকার করে বলতে থাকে,

“আপনার জন্য। একমাত্র আপনার জন্য আমার তিলে তিলে গড়ে তোলা ক্যারিয়ার নষ্ট হয়েছে। ছোটবেলা থেকে ডিফেন্সের যে স্বপ্ন দেখে কিশোর বয়স থেকে যুবক হয়েও দিন-রাত এক করে নিজেকে মিলিটারী হিসেবে গড়ে তুলেছিলাম। সেই স্বপ্ন এক লহমায় ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন আপনি। খুনি না হয়েও গায়ে খুনের তকমা লাগিয়েছি।যে মুহূর্তে সামরিক বাহিনী আমাকে বহিঃষ্কার করেছিল,ঠিক সেই মুহূর্তে আমার ভিতরে কি চলছিল আপনি কোনোদিন জানবেন না।আমার শরীর থেকে যখন একে একে কঠোর সাধনার ফল হিসেবে পাওয়া প্রতিটা ব্যাজ খুলে নিয়েছিল সেই মুহূর্তেই আমি রক্তিম বেঈমান স্ত্রী আর ভাইয়ের বিশ্বাস ঘাতকতায় যে আঘাত পেয়েছিলাম তা ভুলে গিয়েছিলাম।নিজের স্বপ্ন গুলোকে দাফন করে প্রাণহীন দেহটা নিয়ে যখন বাড়ি ফেরেছিলাম, চেয়েছিলাম মায়ের কোলে মাথা রেখে মনে জমে থাকা দুঃখ গুলো একটু লাঘব করতে। কিন্তু এতোটাই কপাল পোড়া ছিলাম আমি যে, নিজের মায়েই মৃতপ্রায় হৃদয়টা নতুন করে কথার আঘাতে ক্ষতবীক্ষত করেছিল। জীবন্ত লাশে পরিণত হয়েছিলাম তখন। একজন মিলিটারী মেজর থেকে গুন্ডাতে পরিণত করেছেন আপনি আমাকে। আমার আজকের এই ছন্নছাড়া জীবনের জন্য একমাত্র দায়ী আপনি। বাবা হয়ে পুরো সমাজের কাছে আমাকে খুনি বানিয়েছেন আপনি। শুধু আপনার জন্য যে মা আমাকে দশ মাস গর্ভে ধারণ করল সেই মা দুটো বছর মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। যে সমাজের মানুষ গুলো একসময় আমাকে দেশ রক্ষক ভেবে সম্মান জানাতো,আজ সেই সমাজের মানুষ গুলোই আমাকে দেশের আবর্জনা ভেবে উপরে ফেলতে চায়। কেন করলেন এমনটা? দিনশেষে সমস্ত ধারণা মিথ্যে প্রমাণ করে দিলেন?আমার জীবনটা নষ্ট করার জন্য এই সব কিছু আপনি আর আপনার ছেলে মিলে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ঘটিয়েছেন তাই না!আপনাদের পরিকল্পনা সফল। এখন আর কিছুই নেই আমার। নিঃস একেবারে। এবার অন্তত রেহাই দিন আমাকে। ভুলেও আর কখনো মুখ দিয়ে আমাকে নিজের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিবেন না। আপনার মতো মানুষকে বাবা হিসেবে পরিচয় দেওয়ার থেকে নিজেকে জা র জ হিসেবে পরিচয় দেওয়া আমার জন্য অধিক সহজ।”

সমস্ত কথা ছাপিয়ে শেষের কথাটাই বারবার প্রতিধ্বনিত হয় আজীজ শিকদারের কানে। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু ছেলের ব্যথাতুর মুখের দিকে। সত্যিই কি আজীজ শিকদার এতোটাই দোষী হয়ে গেল! যে দোষের কারণে আজ নিজেকে জা র জ বলতেও রক্তিমের বুক কাঁপলনা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে রক্তিমের। মাথার অসহ্য যন্ত্রণায় চোখ-মুখ বিকৃত করে মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের হচ্ছে। দিকবিক না পেয়ে মেহেদী দৌড়ে ডাক্তারকে নিয়ে আসে। কেবিন থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে নিজের মতো করে চিকিৎসা চালিয়ে যায় ডাক্তার।

রক্তিমের চিৎকার শুনে তখনই ছুটে যায় দৃষ্টি। কিন্তু দরজা পেরিয়ে ভিতরে যাবার শক্তি পায়না। রক্তিমের মুখ নিঃসৃত এক একটা কথা অসাঢ় করে দেয় দৃষ্টিকে। স্তব্ধতার রেশ এতোটাই ভারী ছিল যে এখনো বিমূঢ় হয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। উত্তেজিত হয়ে রক্তিম আবার অসুস্থ হয়ে পরেছে সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। কানে এখনো বেজে যাচ্ছে রক্তিমের অস্পষ্ট এক একটা কথা। আজীজ শিকদার বুকে পাহাড়সম দুঃখ চেপে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যায় হাসপাতাল থেকে। ছেলের সামনে থেকে এভাবে উত্তেজিত করে শারীরিক অবস্থার অবনতি করে আর দোষী হতে চায়না। চোখের আড়াল হলে ছেলে যদি ভালো থাকে তবে তাই হোক। এই পাপি মুখ আর কখনো না দেখুক ছেলে।

ডাক্তারের কথায় স্তব্ধতার রেশ কাটে দৃষ্টির। মস্তিষ্ক সচল হয়। ডাক্তার হাজারী কেবিন থেকে বেরিয়ে রাগত স্বরে বলে ওঠে,

“আগেই বলেছিলাম আপনাদের,পেশেন্ট যাতে কিছুতেই হাইপার না হয়। কি একটা কন্ডিশন হয়েছিল এখন ধারণা আছে আপনাদের? আবারও ঘুমের ইনজেকশন পুস করে শান্ত করতে হয়েছে। আমার অনুমতি ব্যতিত আর কেউ যদি কেবিনে ঢুকেন তবে এই রোগীর দায়িত্ব আমি আর নিবনা। এটা হাসপাতাল। পারিবারিক ঝামেলা মিটানোর জায়গা না। আর পেশেন্ট ও রক্তে, মাংসে গড়া মানুষ।কোনো রোবট না। আশা করি এই দিকটা মাথায় রেখে এখন থেকে যা করার করবেন।”

কথা গুলো বলে ডাক্তার হাজারী দুজন নার্সকে কেবিনের সামনে কড়া নজরদারির দায়িত্ব দিয়ে চলে যায়। সাথে সাথেই দৃষ্টি মেহেদীর দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,

“কি হয়েছিল কোর্টে? ওনি কেন বাবার সাথে এমন আচরণ করছে?”

বুক ফুলিয়ে একটা দম নেয় মেহেদী। প্রস্তুত হয় একে একে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে। সংক্ষেপে পুরো ঘটনা খুলে বলতেই অবাকতার চরম পর্যায় পৌঁছে যায় দৃষ্টি। ফ্যালফ্যাল নয়নে শুধু তাকিয়ে থাকে মেহেদীর মুখের দিকে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আজীজ শিকদারের মতো একজন মানুষ নিজের ছেলের সাথে এতো বড় মিথ্যাচার করতে পারে।

চলবে…..

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-২৮+২৯

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৮
#আদওয়া_ইবশার

পুরো দেশ জুড়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিষয়বস্তু একটাই। সাভারের নব নির্বাচিত এমপি আজীজ শিকদারের বড় ছেলে একজন খুনি। নিজের ছোট ভাই এবং সহধর্মিণীকে নিজ হাতে নিষ্ঠুর ভাবে খুন করেছিল আড়াই বছর আগে। সেই খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সয়ং এমপি আজীজ শিকদার। সবটা জানার পরও মেয়র থাকা কালীন সময়েই ক্ষমতা আর টাকার জোড়ে সত্যকে মিথ্যে প্রমাণ করে খুনি ছেলের দোষ ঢেকেছে। একজন খুনিকে ইন্ধন দিয়ে সে নিজেও সমান অপরাধী। এমন একজন মানুষ কিছুতেই এমপি হতে পারেনা। যে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় সে কিভাবে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করবে? ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন থেকে নোটিশ চলে এসেছে,ঘটনা যদি সত্য প্রমাণিত হয় এবং ছেলের বিরুদ্ধে যদি আজীজ শিকদার সাক্ষী না দেয়, তবে এমপি পদ থেকে বাতিল করা হবে। চারদিক থেকে সকল চাপ একসাথে আসতে শুরু করেছে। আর প্রেস মিডিয়া তো আছেই। মিডিয়ার লোকজন যেন শিকদার বাড়ির আশেপাশে প্রতি মুহূর্ত উত পেতে থাকে। এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখে পরে আজীজ শিকদার হতাশায় জর্জরিত। ছেলেকে বাঁচাবে না নিজে বাঁচবে না কি মিডিয়ার সামনে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে জনগণের মুখ বন্ধ করবে? সর্বদা নিরব, শান্ত থেকে নিজের বুদ্ধিমত্বা কাজে লাগিয়ে যেকোনো অনুকূল পরিস্থিতি সামলে নেওয়া আজীজ শিকদার আজ কোনো কূল খোঁজে পাচ্ছেনা। একের পর এক ঘটনায় মস্তিষ্ক জট পাকিয়ে নিস্তেজ হয়ে আছে। শুধু আজীজ শিকদার একা না। রক্তিমের সাথে চলা প্রতিটা ছেলে বর্তমান পরিস্থিতির জাতাকলে বুদ্ধিহীন। তবুও কেউ থেমে নেয়। মেহেদী, রাকিব, জাবির, শান্ত প্রত্যেকে নিজেদের মতো সমাধান খোজার চেষ্টায় মত্ত।ভাইয়ের খবর শোনার সাথে সাথেই ইতি নিজের নতুন সংসার ছেড়ে ছুটে আসে শিকদার বাড়ি। এখন পযর্ন্ত মেহেদী নিজেও শিকদার বাড়িতে পরে আছে। প্রাণ প্রিয় বন্ধুর এমন একটা অবস্থায় কিছুতেই স্থির থাকতে পারেনি।

নিস্তেজ হয়ে স্টাডি রুমে বসে আছে আজীজ শিকদার। উত্তরে জানালার থাই গ্লাস সড়ানো। পৌষের সকালের হীম হাওয়া এসে শরীর কাঁপিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে কোনো হুঁশ নেই আজীজ শিকদারের। এক ধ্যানে জানালা গলিয়ে দৃষ্টি যতদূর যাচ্ছে স্থির তাকিয়ে নিজ ভাবনায় মত্ত।শান্ত রুমটাতে অশান্ত হাওয়া নিয়ে একসময় হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পরে মেহেদী। সাথে জাবির। ব্যস্ত ভঙ্গিতে ডেকে ওঠে আজীজ শিকদারকে,

“বাবা!” ভাবনাচ্যুৎ হয় আজীজ শিকদার। নির্বাক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় মেহেদীর দিকে। শীতল স্বরে জানতে চায়,

“কিছু জানতে পেরেছো?”

মেহেদীর চোখের দৃষ্টি চঞ্চল। অত্যধিক উত্তেজনায় বুকের ভিতরটাও ধরফর করছে। বার কয়েক ঢোক গিলে শুকনো গলাটা ভিজানোর প্রয়াস চালিয়ে বলে,

“যা ভেবেছিলাম তাই।”

কথাটা শুনে কিছুটা ধাতস্থ হয় আজীজ শিকদার। বসা থেকে ওঠে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে জানতে চায়,

“কিভাবে বুঝলে? সন্দেহজনক কিছু পেয়েছো?”

“থানায় যে কনস্টেবলটাকে টাকা খাইয়ে হাত করেছিলাম! খবরটা ওনিই জানিয়েছে। কাল রাতে লিয়াকত বিল্লা থানায় গিয়েছিল। তাছাড়া রাকিবকে যে পাঠিয়েছিলাম জেরিনের মামার বাড়ির দিকে লক্ষ রাখতে। রাকিব নিজেও আজ সকালে লিয়াকত বিল্লাকে জেরিনের মামার সাথে দেখেছে।”

চিন্তায় ভাজ হয়ে থাকা কপালদ্বয় মসৃণ হয় আজীজ শিকদারের। ঠোঁটের কোণে ভেসে ওঠে বক্র হাসির রেখা। মাথা ঝাকিয়ে বললেন,

“জানতাম। সাবেক এমপি সাহেব ছাড়া এতো ধূর্ত বুদ্ধি আর কার হবে!”

“আজকে রক্তিমের সাথে একবার দেখা করতে চাচ্ছিলাম বাবা। এখন মনে হচ্ছে থানায় যাওয়াটা অতি আবশ্যক। শু য়ো র টা না জানি কাল রাতে কোন কু-মতলবে থানায় গিয়েছিল।”

মেহেদীর মুখে গালি শুনে যথেষ্ট বিরক্ত হয় আজীজ শিকদার। মুখে ‘চ’ বর্গীয় উচ্চারণ করে বিরক্তিভাব প্রকাশ করে বলে,

“আহ্! যাবে ভালো কথা। কিন্তু মুখ খারাপ করো কেন? আর কার সামনে কি বলতে হয় সব খেয়ে বসে আছো না কি? আমি তোমার শশুর কথাটা মনে হয় ভুলে গেছো!”

অত্যাধিক উত্তেজনায় মেহেদী সত্যিই ভুলে গিয়েছিল তার সামনে অন্য কেউ না,সয়ং নিজের শশুর দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণ একটা গালির বিপরীতে এমন মুখে ঝামা ঘষে দেওয়ার মতো অপমানে কাঁচুমাচু মুখ লজ্জায় মাথা নত করে রাখে মেহেদী। তখনই শুনতে পায় আজীজ শিকদারের আদেশ,

“বউমাকে সাথে নিয়ে যেয়ো। দুদিন থেকে মেয়েটা বারবার অনুরোধ করছে একবার তাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। একবার দেখা করতে পারলে হয়তো একটু সামলাতে পারবে নিজেকে।”

তৎক্ষণাৎ মুখ উঁচিয়ে বিরোধীতা করে ওঠে মেহেদী,

“অসম্ভব বাবা। ভাবিকে সাথে নিয়ে গেলে আপনার খ্যাঁপা ছেলে লকআপের ভিতর থেকেই আমার গলা টিপে ধরবে।”

“কিছুই করবেনা। সবসময় সবার মন-মানসিকতা এক রকম থাকেনা। তাছাড়া মেয়েটার কথাও একবার আমাদের ভেবে দেখা উচিৎ।খাওয়া,ঘুম সব ভুলে ঘরবন্দি করে রেখেছে নিজেকে। এভাবে চলতে থাকলে অসুস্থ হয়ে পরবে।”

শশুরের সাথে কথায় না পেরে হার মেনে নেয় মেহেদী। রাজি হয় দৃষ্টিকে সাথে নিতে। নিয়ে তো যাবে। তবে আদও রক্তিমের সাথে দেখা করাতে পারবে কি না কে জানে!

****
আধ ঘন্টার মাঝেই মেহেদীর সাথে থানায় উপস্থিত হয় দৃষ্টি। চোখ দুটো তার তৃষ্ণার্ত। বুকের ভিতরটা অস্থিরতায় ভরপুর। যখন থেকে শুনেছে রক্তিমের সাথে দেখা করার সুযোগ পাবে তখন থেকেই প্রচণ্ড অস্থিরতা, ছটফটানিতে মনের অবস্থা বেগতিক।সাভার মডেল থানার সামনে গাড়ি থামতেই দৃষ্টি মেহেদীকে রেখেই এক প্রকার দৌড়ে ভিতরে ঢুকে পরে। পিছন পিছন ছুটে যায় মেহেদী।কয়েক জায়গায় ঘুষ আবার কয়েক জায়গায় বিভিন্ন ফরমালিটিস পূরণ করতে করতে আরও আধ ঘন্টা সময় চলে যায়। দৃষ্টির যেন এবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। এতোটুকু দেরীও তার সহ্য হচ্ছেনা। অত্যধিক উত্তেজনায় শ্বাস-প্রশ্বাস এলোমেলো। অনুমতি পেতেই মেহেদীকে পিছনে ফেলে দৌড় লাগায় দৃষ্টি। দৃষ্টির এমন পাগলপ্রায় অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় মেহেদী। কোনোমতে বুঝিয়ে কিছুটা শান্ত করে ধীরস্থির ভাবে এগিয়ে যায় রক্তিমকে রাখা সেলের দিকে। নির্দিষ্ট সেলের সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরের চিত্র দেখে থমকে যায় দুজনেই। দৃষ্টির এতোক্ষনের এলোমেলো শ্বাস-প্রশ্বাস টুকু এবার বন্ধ হবার জোগাড়। অস্থিরতা কাটিয়ে বুকের ভিতর শুরু হয় ঝড়ের তান্ডব। নির্বাক মেহেদীও একই ভাবে অত্যধিক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে সেলের ভিতর এক হাঁটু ভাজ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে থাকা রক্তিমের দিকে। মাত্র ছয়দিন হয়েছে রক্তিম জেলে। এই ছয় দিনেই নিষ্ঠুর গুলো কিভাবে অত্যাচার চালিয়েছে তার উপর! ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রক্তের দাগটা দূর থেকে দেখেও মনে হচ্ছে এখনো তাজা হয়ে আছে। কেমন নিস্তেজ শক্তিহীনের মতো চোখ দুটো বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে প্রাণহীন এক শরীর। মেহেদীর নির্বাক দৃষ্টি ওক সময় ঝাপসা হয়। মানতে কষ্ট হয় বন্ধুর এমন পরিণতি। কতটা নির্দয়ের মতো অত্যাচার চালিয়েছে অমানুষ গুলো! ভাবতেই ভিতরটা কেঁপে ওঠে। দৃষ্টির ফোঁপানোর শব্দে মেহেদীর ঘোর কাটে। তটস্থ ভঙ্গিতে একবার আশেপাশে তাকিয়ে মৃদু স্বরে ডেকে ওঠে রক্তিমকে। কে ডাকছে কন্ঠটা ধরতে পারেনা রক্তিমের বেদনায় পৃষ্ঠ মস্তিষ্ক। শরীরের পীড়ার কাছে সব কিছুই ঝাপসা আজ। বহু কষ্টে বন্ধ চোখের পাপড়ি দ্বয় আলগা করে মাথা অল্প সোজা করে রক্তিম।নিভু নিভু দৃষ্টিতে ভাসে দুজন মানুষের প্রতিবিম্ব। কিন্তু মানুষ দুজন কে, তা ঝাপসা দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়না। রক্তিমের এমন বেহাল দশায় মেহেদীর চোখে অশ্রু বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পরে। সাথে সাথেই আবার শার্টের হাতায় চোখ দুটো মুছে নেয়। একবার কান্নারত দৃষ্টিকে দেখে নিয়ে আবারও ডাকে রক্তিমকে। এতোক্ষন পর এবার রক্তিমের অসাঢ় মস্তিষ্ক মেহেদীর কন্ঠ চিনতে পারে। চোখের দৃষ্টিও অল্প পরিষ্কার হয়। ভেসে ওঠে পরিচিত দুটো মুখ। দৃষ্টিকে এখানে দেখে খানিক উত্তেজিত হয় রক্তিম। বসা থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে কোনোমতে টলতে টলতে এগিয়ে আসে লোহার শিকল দিয়ে তৈরি দেয়ালের নিকট। ডান হাতে একটা শিক ধরে নিজের ব্যালেন্স টুকু বজায় রাখার চেষ্টা করে ব্যথাতুর কন্ঠে নিচু স্বরে বলে ওঠে,

“ওকে কেন নিয়ে এনেছিস?”

রক্তিমের এমন ব্যথাতুর নিস্তেজ কন্ঠ এবার যেন দৃষ্টিকে একেবারে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। নিঃশব্দের কান্নাটা রূপ নেয় উচ্চ রুলে। তৎক্ষণাৎ পাশে থাকা কনস্টেবল হালকা ধমকের সাথে বলে ওঠে,

“এটা জেলখানা। আপনাদের রঙ্গতামাশা করার জায়গা না। আলগা পিরিতি দেখাইতে আসলে ঐটার সাথে সব কয়টারে ভরে রাখব।”

কনস্টেবলের কথা সবার কানে গেলেও কোনো প্রত্যুত্তর করেনি কেউ। কারণ পরিস্থিতি এখন তাদের অনুকূলে। এমন শত অপমান মুখ বুজেই সহ্য করতে হবে। দৃষ্টি ঠোঁট কামড়ে কান্নার শব্দ আটকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সেলের ফাঁক গলিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে রক্তিমের ঠোঁটের কোণের রক্ত টুকু ছুঁয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ হালকা ব্যথা সেই সাথে দৃষ্টির হঠাৎ এমন একটা কাজে বিস্ময়ে কেঁপে ওঠে রক্তিম। চোখ তুলে কান্নারত দৃষ্টির মুখের দিকে তাকায়। রক্তিমের ঠোঁটের কোণের রক্ত টুকু হাতের কনিষ্ঠ আঙুলে লাগিয়ে আবারও হাতটা বাইরে নিয়ে আসে দৃষ্টি। টকটকে লাল রক্ত কতক্ষণ অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে দেখে জানতে চায়,

“এতোটা নির্দয়ের মতো কিভাবে মেরেছে ওরা আপনাকে? খুব কষ্ট হয়েছে আপনার, তাইনা!”

শরীরের যন্ত্রণা থেকেও মনের যন্ত্রণা তীব্র রক্তিমের। দৃষ্টির এমন প্রশ্নে নির্বাক তাকিয়ে থাকে কতক্ষণ। রক্তাক্ত ঠোঁটের কোণে যন্ত্রণামিশ্রীত হাসি ফুটিয়ে বিরবিরিয়ে বলে,

“এক নারী জাতি আর কত রূপ দেখাবে? একজন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে আনন্দ পায়। আরেকজন শরীরে অল্প আঘাতের সন্ধান পেয়ে তীব্র বেদনায় ছটফটানি প্রকাশ করে।”

বুকের ভিতরে থাকা যন্ত্রণাটা যেন এবার শরীরের যন্ত্রণা ম্লান করে দিয়েছে। তীব্র এক দহনে বুকের ভিতরটা চৌচির। জ্বিভের ডগায় রক্তাক্ত ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে বেদনার ঢোক গিলে রক্তিম। কন্ঠে দৃঢ়তা আনার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে বলে,

“আর কখনো এখানে আসবেনা। আমার চিন্তা তোমাকে করতে হবেনা। আমি ভালো আছি। বাড়ি যাও। পড়াই মন দাও। মাত্র দুদিন পর এডমিশন টেস্ট। এবার যদি চান্স হারিয়ে নিজের মা-বাবার কাছে আমাকে দোষী করেছো তবে খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি। আমি যেন জেলের ভিতর থেকেও শুনতে পায় চান্স হয়ে গেছে।”

এই প্রথম! বিয়ের এতোদিনে এই প্রথম রক্তিম কন্ঠে অধিকার খাটিয়ে দৃষ্টিকে শাসনের সুরে কিছু বলেছে। তাও এমন একটা মুহূর্তে এসে, যে মুহূর্তে দৃষ্টি পারছেনা রক্তিমের এমন আচরণে খুশী হতে, পারছেনা চোখের সামনে দেখা রক্তিমের করুণ পরিণতি ঘুচিয়ে দিতে। বুকের ভিতরটা যে কি অসহ্য যন্ত্রণায় নিঃশেষ হচ্ছে!মনে হচ্ছে বিষাক্ত কোনো এক পোকার বাস এই বুকে। যে পোকা কামড়ে ধরে বুকের মাঝে নিজের সমস্ত বিষ উগলে দিচ্ছে। সেই বিষে নীল হচ্ছে হৃৎপিন্ড। চোখের সামনে শখের পুরুষের এমন নির্মম পরিণতি সহ্য হচ্ছেনা কিছুতেই। ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে পুরো বিশ্বকে জানান দিতে, তার ভালোবাসার মানুষের শরীরের প্রতিটা আঘাত তার হৃদয়ে এক একটা অগ্নিপাতের সৃষ্টি করছে। যে অগ্নিপাতে দগ্ধ হচ্ছে মন জমিন। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া এ মন জমিনে কি আর কখনো বসন্তের কোকিল উড়বে? ভালোবাসার গান গাইবে? না কি সারাজীবন ডাহুকের আর্তনাদ ভেসে আসবে!

জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে বহু কষ্টে সামলায় দৃষ্টি। তবে কান্নারা কি আর এতো সহজে বিদায় নিতে চায়! দৃষ্টি পারেনা কান্না আটকাতে। সেভাবেই কান্নায় রোধ হয়ে আসা কন্ঠে বলে,

“এবার আমি ঠিক চান্স পেয়ে যাব। আমার স্বামী এই প্রথম আমার থেকে কিছু একটা আশা করছে। আমি কিভাবে সেটা অপূর্ণ রাখি! বাড়ি গিয়ে সব ভুলে মন দিয়ে পড়ব। তবে আমি চাই আমার এই খুশির সংবাদটা আপনি জেলের ভিতরে থেকে না, মুক্ত আকাশের নিচে থেকে শুনবেন। রেজাল্ট পাবলিশড হবার আগে আপনার জামিন না হলে লাগবেনা আমার চান্স। কিসের পড়ালেখা কিসের কি? যে জীবনে আপনি নেই সেই জীবনের থেকে আমার মৃত্যু শ্রেয়। আচ্ছা! একটা কথা বলুন তো। মানুষ বলে মন থেকে কাওকে ভালোবাসলে না কি তাকে পাওয়া যায়। আমিও পেয়েছি আপনাকে। মন থেকে ভালোবেসেছি দেখেই পেয়েছি। কিন্তু যে পাওয়ায় বারবার হারানোর ভয় তাড়া করে বেড়ায়, সেই পাওয়ার কি কোনো মূল্য আছে! আমি কেন আপনাকে পেয়েও পেলাম না এখনো? আল্লাহ কিসের শাস্তি দিচ্ছে আমাকে? আমার যে আর সহ্য হচ্ছেনা এই যন্ত্রণা। যখনই মনে হয় আপনাকে আমি পেয়েও হারিয়ে ফেলছি তখনই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে আমার। মনে হয় পুরো পৃথিবীটা থমকে গেছে। ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেন?”

কথা গুলো বলতে বলতেই মুখ ঢেকে আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পরে দৃষ্টি। রক্তিম নির্বিকার। শরীরে অজস্র আঘাতের চিহ্ন নিয়েও নির্বাক তাকিয়ে সামনের দিকে। একদিকে বন্ধুর নির্মম পরিণতি অপরদিকে দৃষ্টির পাগলপ্রায় দশা। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মেহেদীর। এই এক দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া বর্তমানে হয়তো তাদের আর কিচ্ছু নেই। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে দৃষ্টিকে বুঝিয়ে থানার বাইরে গাড়িতে রেখে মেহেদী আবারও রক্তিমের কাছে আসে। দেখা করার জন্য যি সময় টুকু পেয়েছিল তার মধ্যে হাতে আরও পাঁচ মিনিন অবশিষ্ট আছে। এর মাঝেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা সেড়ে ফেলতে হবে। দ্রুত কদমে আবারও রক্তিমকে রাখা সেলের কাছে এসে নিচু স্বরে রক্তিমকে উদ্দেশ্য করে জানতে চায়,

“ঐ স্কাউন্ড্রেলটা কাল রাতে না কি থানায় এসেছিল!”

“হু” ছোট্ট করে জবাব দেয় রক্তিম। রাগে চিড়বিড়িয়ে ওঠে মেহেদী। চোয়াল শক্ত করে জানতে চায়,

“শু য়ো র টা আসার পরই কি তোর উপর এভাবে অত্যাচার চালিয়েছে? কোনো রিমান্ড ছাড়া কিভাবে এমন টর্চার করে তারা? সালার সব কয়টা বা*** দালাল। একবার শুধু তোকে বের করে নেই। প্রত্যেককে দেখে নিব। একটাকেও ছাড়বনা।”

শ্লেষাত্মক হাসে রক্তিম। নিজের প্রতি নিজেই বিদ্রোপ করে বলে,

“দুটো খুনের আসামি হয়েও দীর্ঘ আড়াই বছর আরামছে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরেছি। তোর কি মনে হয় ওরা উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কেস রি-ওপেন করেছে? আলরেডি এমপি সাহেবের উপর চাপ আসতে শুরু করে দিয়েছে। এই খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সয়ং এমপি সাহেব। বাতাসের গতিতে এটা সবার কাছেই পৌঁছে গেছে। তাছাড়া লিয়াকত বিল্লার মতো ক্রিমিনাল যেখানে হাত লাগিয়েছে সেখানে আমার মুক্তির আশা কিভাবে করিস? ছেড়ে দে আমার আশা। শুধু শুধু মরিচিকার পিছনে ঘুরে নিজেদের জীবনটা নষ্ট করিস না। মৃত্যুর ভয় আমার নেই। যদি থাকতোই তবে হয়তো এতো সহজে এই হাতে দুটো শরীর থেকে প্রাণ আলাদা করতে পারতাম না। আমার মৃত্যুতেই আমার মুক্তি। আমিও এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি চাই। শান্তির ঘুম ঘুমাতে চাই।”

রক্তিমের নির্লিপ্ত কন্ঠের এমন ভয়াবহ কথায় বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে মেহেদীর। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দিনের মতোই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়। বুকের ভিতর সৃষ্টি হয় নাম না জানা এক তোলপাড়। শিক ধরে রাখা রক্তিমের হাতটা এক হাতে শক্ত করে ধরে মেহেদী। শক্ত মনোবলে দৃঢ় কন্ঠে বলে,

“একদম ঘাবড়াবিনা। ভুলে যাবিনা তুই আজীজ শিকদারের ছেলে রক্তিম শিকদার। এতো সহজে তোর পতন হতে পারেনা। আরও অনেক বছর বাঁচতে হবে তোকে। তোর মনে নেই, আমরা দুজন যে প্ল্যান করেছি ব্যবসা শুরু করব! ছন্নছাড়া জীবনটাকে বিদায় দিয়ে আট-দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচব আমরা। নিজেদের পাশাপাশি এলাকার প্রতিটা বেকার ছেলের কর্মসংস্থান গড়ব। তুই ছাড়া এগুলো কিভাবে হবে? আমাকে প্লিজ মাঝ পথে ফেলে চলে যাস না। তোকে বাঁচতে হবে। আমাদের দুজনের একসাথে দেখা এখনো কত কত স্বপ্ন অপূর্ণ! সেগুলোর পূর্ণতা দিতে হবে। দৃষ্টি মেয়েটা শুধু তোকে ভালোবেসে নিজের পরিবার ছেড়েছে। তোকে যেদিন পুলিশ ধরে নিয়ে আসে, ঐদিনই দৃষ্টির মা-বাবা এসেছিল তাকে নিয়ে যেতে। মেয়েটা যায়নি। কি বলেছিল জানিস! তুই নাকি ওর মানসিক শান্তি। ছন্নছাড়া,গুন্ডা রক্তিম শিকদারকে ভালোবেসে সে নিজের পরিবার ছাড়তে পেরেছে যেহেতু।এখন খুনি রক্তিম শিকদারকেও ভালোবেসে দুঃখ গুলোকেই সুখ ভেবে একটা জীবন পাড় করে দিতে পারবে। একবার ঐ মেয়েটার কথা ভাব। পৃথিবীতে সব মেয়ে খারাপ হয় না। সবাই ছলনা করেনা। যদি কতরোই, তবে তোর আমার মা-বাবা এখনো একসাথে এক ছাঁদের নিচে থাকতনা। তাদের সংসারটা এমন সুন্দর পরিপূর্ণ হতনা। পৃথিবীতে দৃষ্টির মতো মেয়েরা আছে বলেই ভালোবাসা এখনো বেঁচে আছে।ঐ খাঁটি হিরেকে আর কাঁচ ভেবে পায়ে ঠেলে দিস না। ঐ মেয়েটার ভালোবাসার মূল্য চুকানোর জন্য হলেও তোকে এই চৌদ্দশিকের ভিতর থেকে বের হতে হবে। আর তোর বাবা-মা! তাদের একমাত্র ছেলে এখন তুই। তুই ছাড়া ওদের আর কেউ নেই। ঐ দুটো মানুষের বুড়ো বয়সের হাতের লাঠি তুই। নিজের পরিবারের কথা ভেবে হলেও হার মেনে নিস না। মনে বিশ্বাস রাখ। ইন শা আল্লাহ তোর মুক্তি হবেই।”

চলবে…….

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৯
#আদওয়া_ইবশার

জেলা জজ আদালতে আজ দশটায় রক্তিমের
কেস উঠবে। কাকতলীয় ভাবে আজকেই দৃষ্টির এডমিশন এক্সাম। কি করবে দৃষ্টি? পরীক্ষা দিতে যাবে! না কি আদালতে কি রাই ঘোষণা হয় তা শুনতে যাবে? স্রোতের টানে দৃষ্টি যেন খেয় হারিয়ে মাঝ সাগরে ডুবতে যাচ্ছে। সারাটা রাত ছটফট করেছে একই ভাবনায়। আদালতে কি হচ্ছে না হচ্ছে এসব চিন্তায় না পারবে ভালো করে পরীক্ষা দিতে আর না পারবে পরীক্ষা না দিয়ে স্ব-শরীরে আদালতে উপস্থিত থাকতে। এই এক এডমিশন এক্সামকে কেন্দ্র করে এখন শুধু মা-বাবার স্বপ্ন পুরণ না। সাথে যুক্ত স্বামীর প্রথম চাওয়া। দৃষ্টি কিভাবে পারবে তার প্রিয় মানুষের প্রথম চাওয়া টুকু অপূর্ণ রাখতে! হাজার দ্বিধা-দন্দ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত স্থির করে পরীক্ষা সে দিবে। আজীজ শিকদার তাকে আশ্বস্ত করেছে রক্তিম মুক্তি পাবেই। দেশে এমন কোনো আদালত এখনো তৈরি হয়নি যে রক্তিম শিকদারকে সাজা দিবে। দৃষ্টি জানে আজীজ শিকদার শুধুমাত্র তাকে আশ্বস্ত করার জন্যই মনগড়া কথা গুলো বলেছে। যেখানে বিপক্ষ দল রক্তিমের বিরুদ্ধে খুনের সমস্ত প্রমাণ ইতিমধ্যে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে সেখানে কিভাবে রক্তিম নির্দোষ প্রমাণিত হবে? তাছাড়া রক্তিম নিজেও না কি কোনো ভনিতা ছাড়াই স্বীকারোক্তি দিয়েছে খুন দুটো সে করেছে। এর পরও কি আর কোনো আশা থাকে রক্তিম নির্দোষ প্রমাণ হবার?

বেদনায় পৃষ্ঠ মন, মস্তিষ্ক নিয়েই যথাসময়ে মেহেদীর সাথে পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হয় দৃষ্টি। মানসিক অশান্তিকে সঙ্গী করেই পা বাড়াই একটু ভালো কিছুর আশায়। এতো এতো অনিশ্চয়তার মাঝেও মন বলে কিছু একটা মিরাক্যাল হবে। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের পর নতুন সূর্য কিরণ ছড়াবে। একটা খারাপ দিনের পরই একটা ভালো দিনের সূচনা হয়। সেই ভালো দিনটা দৃষ্টির জীবনে খুব শিগ্রই আসবে। সৃষ্টিকর্তা একজন মানুষের ভাগ্যে সবসময় দুঃখ রাখেনা। বিভিন্ন অনুকূল পরিস্থিতির মাধ্যমে বান্দার ধৈর্যের পরীক্ষা নেই। সেই ধৈর্যের পরীক্ষায় দাঁত খিঁচিয়ে সফল হতে পারলেই সুখের দিনের সন্ধান পায় মানব জাতি। পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই দৃষ্টি মেহেদীকে তাড়া দেয়,

“ভাইয়া! আপনি এবার কোর্টে চলে যান। বাকিটা আমি সামলে নিতে পারব।”

দৃষ্টিকে বোঝানোর সুরে মেহেদী বলে,

“তুমি এতো হাইপার হয়ে যেওনা। ওখানে বাবার সাথে রাকিব, জাবির, শান্ত সবাই আছে। বাবা যখন একবার বলেছে রাই আমাদের পক্ষেই আসবে তখন একদম নিশ্চিত থাকো তুমি। ভালো করে মন দিয়ে পরীক্ষাটা দাও বোন প্লিজ। মনে করো এটাই রক্তিমের মন জয় করার তোমার শেষ চান্স। ধরে নাও কেন্দ্র থেকে বের হয়েই শুনতে পারবে রক্তিম মুক্তি পেয়ে গেছে। মাথা থেকে সমস্ত বাজে চিন্তা ঝেড়ে ফেলো।”

ম্লান হাসে দৃষ্টি। তাকে সবাই কেমন বাচ্চাদের মতো ট্রিট করছে! ছোট বাচ্চাদের যেমন খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখে, তেমন করেই প্রতিটা মানুষ তাকে শান্তনার বাণী শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখছে। পরিস্থিতি যে এতোটাও ভালো না সেটা বোঝার মতো বয়স দৃষ্টির হয়েছে। এটা হয়তো সবাই ভুলে গেছে। তবুও দৃষ্টি মনের ছটফটানি মুখে প্রকাশ করে মানুষ গুলোকে হতাশ করেনা। চুপচাপ শুধু শুনে যায় এক একটা শান্তনার বাণী। পা বাড়াই হলের ভিতর। অস্থির মনে বাইরে অপেক্ষমাণ মেহেদী। আদালতে কি হচ্ছে সেই চিন্তায় স্থির থাকতে পারেনা। দৃষ্টিকে বুঝিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে চলে যায় জেলা আদালতের দিকে। ভাবে দৃষ্টির পরীক্ষা শেষ হবার আগে পরিস্থিতি বিবেচনা করে আবারও চলে আসবে। মেয়েটা এই মিথ্যেটুকুই জানোক, মেহেদী তার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

*****
দুই পক্ষের উকিলের একের পর এক যুক্তিপূর্ণ বয়ান, সাক্ষীদের সত্য-মিথ্যা সাক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতে তর্ক-বিতর্কে আদালত ভবনে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিরোধী দলের উকিল সবশেষে প্রধান সাক্ষী হিসেবে খুনের প্রত্যক্ষদর্শী আজীজ শিকদারকে জেরা করার অনুমতি চায় বিচারকের কাছে। অনুমতি প্রধান করা হলে আজীজ শিকদারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। বিপরীত পাশের কাঠগড়ায় রক্তিম নির্বাক মাথা তুলে এক ধ্যানে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলের দিকে এক নজর তাকিয়ে আজীজ শিকার ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে সত্য শপথ করেন। সাথে সাথে বিপক্ষ দলের উকিল একের পর এক যুক্তি দেখিয়ে আজীজ শিকদারের মুখ থেকে, খুন দুটো রক্তিম করেছে কথাটা বের করার প্রয়াস চালাই। মাথা উঁচিয়ে আজীজ শিকদার বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলে ওঠে,

“রক্তিম শিকদার খুন করেনি।”

“তবে খুন গুলো কে করেছে? একজন এমপি হয়ে নিজের ছেলের দোষ ঢাকার জন্য এভাবে জনসম্মুখে মিথ্যে বলতে একবারও আপনার ভয়ে বুক কাঁপছেনা? তাছাড়া খুনি রক্তিম শিকদার যেমন আপনার ছেলে, তেমনই তো সে যাদের খুন করেছে তাদের মধ্যে একজন সংগ্রাম শিকদার সেও আপনার ছেলে। এক ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক ছেলের হত্যাকারীকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছেন না! বাবা হয়ে কিভাবে পারছেন নিজের ছেলের খুনিকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য মিথ্যা বয়ান পেশ করতে? আজ না হয় ভরা আদালতে মিথ্যা বলে ছেলেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এরপর!বিবেকের ধ্বংসনে বাঁচতে পারবেন তো?”

বিরোধী দলের উকিলের যুক্তিপূর্ণ কথায় একটুও টলেনি আজীজ শিকদার। বরং আগের চেয়েও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ স্বরে বলে,

“যদি মিথ্যে বলতাম তবে অবশ্যই বুক কাঁপতো। মিথ্যে বলিনি দেখেই বুক কাঁপেনি। আর না কখনো বিবেকের ধ্বংসনের স্বীকার হব।”

“আপনি যে মিথ্যে বলছেন না তার কি প্রমাণ? আসামি নিজেও তো স্বীকার করছে সে খুন করেছে। তবে!”

“সবসময় আমাদের জানা আর দেখা সঠিক হয়না। চোখের দেখাও অনেক সময় মিথ্যে হয়। আর মনের বিশ্বাস ও।”

“এতোক্ষনে একটা সত্য কথা বলেছেন। আসলেই অনেক সময় চোখের, দেখা-মনের দৃঢ় বিশ্বাসও মিথ্যে হয়। যেমন আপনি এই মুহুর্তে নিজের চোখে দেখেছেন আপনার ছেলে খুন করেছে তবুও বলছেন সে খুন করেনি। সেটাও আবার অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে জোর গলায় বলছেন। কিন্তু শেষ পযর্ন্ত কি হবে? সেই আপনার প্রখর আত্মবিশ্বাস মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে রক্তিম শিকদারের ফাঁসি না হয় যাবৎজীবন কারাদণ্ড হবে।”

“আর যদি উল্টো রক্তিম শিকদার নির্দোষ প্রমাণিত হয়?”

ঠাট্টার ছলে হাসে বিরোধী দলের উকিল। রগড় করে বলে,

“চোরের মায়ের বড় গলা, কথাটা আবারও সত্য প্রমাণিত করতে চাইছেন এমপি সাহেব। কি লাভ শুধু শুধু কোর্টের মূল্যবান সময় নষ্ট করে? সত্যিটা বলে দিন। অযথা আর সময় নষ্ট করবেন না।”

উকিলের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবারও এক নজর নির্বাক রক্তিমের দিকে তাকায় আজীজ শিকদার। পরমুহূর্তে বিচারকের দিচ্ছে তাকিয়ে জোর গলায় বলে ওঠে,

“মহামান্য আদালত! আমার ছেলে রক্তিম শিকদারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যে। আমার ছেলে কাওকে খুন করেনি। আমার ছোট ছেলে সংগ্রাম শিকদার এবং বড় ছেলের স্ত্রী জেরিন দুজনের কেউ খুন হয়নি। ওরা দুজনেই বেঁচে আছে।”

ভরা আদালতে হুট করেই যেন বড়সড় এক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে আজীজ শিকদার। কথাটা শোনা মাত্রই রক্তিম চমকে বাবার মুখের দিকে তাকায়। উপস্থিত প্রতিটা মানুষের দৃষ্টি অবিশ্বাস্য। এমন একটা মনগড়া কথার কি আদও কোনো ভিত্তি আছে? কিসব পাগলের প্রলাপ বকছে আজীজ শিকদার! উপস্থিত প্রতিটা মানুষকে আশ্চর্যের চরম শিকড়ে পৌঁছে দিয়ে আজীজ শিকদার আবারও বলে ওঠে,

“মানুষের কাজেই হলো তিলকে তাল বানিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া। যেমনটা ঘটেছে আমার পরিবারের সাথে। আমার বড় ছেলের স্ত্রী জেরিন আর আমার ছোট ছেলে সংগ্রাম শিকদারের মাঝে দেবর-ভাবির সম্পর্ক ছাপিয়ে এক সময় অবৈধ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। রক্তিম তখন সামরিক বাহিনীতে যুক্ত ছিল। তার বছরে হাতে গুণা কয়েকটা দিন সুযোগ হতো নিজের পরিবারের সাথে কাটানোর। বাকী পুরোটা বছর কাটাতে হতো সামরিক বাহিনীর ঘাটিতে। এমন অবস্থায় রক্তিমের স্ত্রী জেরিন রক্তিমের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে সংগ্রামের দিকে ঝুকে যায়। দুজনেই দুজনের সম্মতিতে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করে। নিজের আপন ভাইয়ের সাথে স্ত্রী অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত। কথাটা জেনেও হয়তো কোনো পুরুষ পারবেনা সহজে মেনে নিতে। যেমনটা পারেনি রক্তিম শিকদার। রাগে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে আক্রমণাত্মক হয়ে আঘাত করেছিল স্ত্রী এবং ভাইয়ের উপর। তবে সেই আঘাতে দুই-একদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকা ছাড়া তেমন কোনো ক্ষতিই হয়নি। রক্তিম হয়তো দ্বিতীয়বার প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওদের উপর আক্রমণ করতে পারে। এটা ভেবেই আমি পরবর্তীতে তাদের দুজনকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেই। এদিকে সবাই জানে সংগ্রাম শিকদার এবং জেরিন দুজনেই মৃত। এটা ছাড়া আমার কিছুই করার ছিলনা মহামান্য আদালত। নিজের ছেলেদের বাচানোর জন্য আর পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য আমি নিরুপায় হয়ে মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছিলাম। তবে মিথ্যে যে খুব বেশিদিন গোপন থাকেনা তা আজ আবারও প্রমাণ পেলাম। যে ছেলেদের বিপদের ভয়ে এতো বড় একটা সত্যকে মিথ্যে দিয়ে ঢেকেছিলাম। আজ সেই ছেলের বিপদের জন্যই সত্যটাকে সকলের সামনে তুলে ধরতে হয়েছে। আমার এই মিথ্যের জন্য আজ যদি আমার কোনো শাস্তি হয় সেটাও আমি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত। নির্দ্বিধায় আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। সাথে এও জানাচ্ছি পরিবারের প্রতিটা সদস্যকে বিপদ মুক্ত রাখার জন্যই আমি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি। আমার ছেলে রক্তিম শিকদার নির্দোষ। দোষী যদি কেউ হয়ে থাকে তবে সেটা আমি। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আমি দোষী। আমার দোষ আমি মাথা পেতে নিচ্ছি।”

কথা গুলো শেষ করেই দলের একজন ছেলেকে ইশারায় কিছু একটা বলেন আজীজ শিকার। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে আদালতে স্ব-শরীরে উপস্থিত হয় সংগ্রাম শিকদার এবং রক্তিমের প্রথম স্ত্রী জেরিন। উপস্থিত প্রতিটা মানুষ বাকহারা। এতোদিনের ভুল ধারণাটা হঠাৎ সবার সামনে মিথ্যে বলে প্রমাণ হওয়াই স্তব্ধ প্রত্যেকে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এতোক্ষনের কোলাহলপূর্ণ ভবন এক লহমায় নিস্তব্ধ। রক্তিম পলকহীন তাকিয়ে আছে আজীজ শিকদারের দিকে। মস্তিষ্ক অসাঢ় হয়ে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আদালতে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ সংগ্রাম, জেরিনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও সে তাকায়নি একবারের জন্যও। ছেলের এমন শীতল দৃষ্টির কাছে আজীজ শিকদার নতজানু। কিছুতেই পারছেনা আজ ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। না পারছে মাথা তুলতে।

এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে মিনিট পাঁচেক পার হবার পর আবারও আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। যাদের খুনের দায়ে আসামিকে দোষী সাভ্যস্ত করা হচ্ছিলো সেই তাদের স্বীকারোক্তিতেই রক্তিম নির্দোষ প্রমাণিত হয়। সংগ্রাম, জেরিন দুজনেই নত মস্তকে স্বীকার করে নেয় তাদের ভুল। জানিয়ে দেয় রক্তিম নির্দোষ। জেরিন অকপটে স্বীকার করে, রক্তিমের সাথে তার ভালোবেসে বিয়ে হলেও বিয়ের পর এক সময় উপলব্ধি করে রক্তিম আসলে তার ভালোবাসা ছিলনা। স্রেফ মোহ ছিল। মামার সংসারে বোঝা হয়ে থাকাই শেষ পযর্ন্ত কোনো কূল না পেয়ে রক্তিমকেই ভালোবাসা ভেবে বিয়ে করে নেয়। কিন্তু বিয়ের পর ধীরে ধীরে বুঝতে পারে রক্তিম আসলে তার ভালোবাসা না। তার মোহ। আর সংগ্রাম হলো তার সত্যিকারের ভালোবাসা। যে ভালোবাসার জেড় ধরেই সমাজের প্রতিটা মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে আজও তারা একসাথে ভিনদেশে সংসার পেতে ভালো আছে।

আদালতে পুরোটা সময় রক্তিম একমাত্র আজীজ শিকদারের দিকেই তাকিয়ে ছিল। কান দুটো তার খোলা থাকলেও আকস্মিক এমন একটা ধাক্কায় অসাঢ় মস্তিষ্ক হয়তো জেরিন বা সংগ্রাম কারো কথায় ধরতে পারেনি। আর না পেরেছে নিশ্চল মস্তিষ্ক শরীরে কোনো উত্তেজনা সৃষ্টি করতে। বিচারকের মুখে রক্তিম নির্দোষ কথাটা শোনার পরও কারো মুখে এক বিন্দু হাসি ফুটেনি। সকলের মস্তিষ্কে একটাই ভাবনা, এরপর কি হবে? রক্তিম আর কতক্ষণ এমন নির্বাক থাকবে? আবার কোনো বিপদ আসতে চলেছে সামনে?

বিচার কার্য শেষ হতেই একে একে সকলেই বিদায় নেয়। আজীজ শিকদারের আদেশে যে লোক জেরিন, সংগ্রামকে কোর্টে হাজির করেছিল সেই লোকের সাথেই তারা আবারও চলে যায়। যাবার সময় দুজনেই এক পলক শুধু তাকিয়ে দেখে যায় নির্বাক রক্তিমকে। রক্তিম একই ভাবে নিশ্চল কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। ইন্সপেক্টর এসে তাড়া দেয় কেস নিষ্পত্তির কিছু ফর্মালিটিস পূরণ করার জন্য।রক্তিমের কোনো হেলদুল হয়না।মেহেদী চিন্তিত মুখেই বসা থেকে ওঠে এগিয়ে যায় রক্তিমের দিকে। ভয় জড়ানো মনেই শুকনো ঢোক গিলে রক্তিমের হাত ধরে বাইরে নিয়ে যায়। রক্তিম যেন এক কলের পুতুল। মেহেদী তাকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে সে প্রাণহীন এক পুতুলের মতোই সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। তার এমন অস্বভাবিক নির্লিপ্ততায় ভয় হয় উপস্থিত প্রতিটা মানুষের। এভাবে আর কতক্ষণ থাকবে ছেলেটা?এক বিপদ শেষ হবার সাথে সাথেই আবার না কোনো অঘটন ঘটে যায়।

কোর্টের সমস্ত কার্যক্রম সমাপন করে আজীজ শিকদারকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় মেহেদী। জানায় রক্তিমকে নিয়ে কিছুক্ষণ অন্য কোথাও থেকে স্বাভাবিক করার প্রয়াস চালিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবে তারা। আজীজ শিকদার অপরাধী চোখে ছেলের দিকে একপলক তাকিয়ে প্রলম্বিত একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বিদায় নেয় আদালত প্রাঙ্গন থেকে। মেহেদী রক্তিমের হাত ধরে এগিয়ে যায় অন্য একটা গাড়ির দিকে। গাড়ির কাছাকাছি যেতেই হুট করে শরীরের শক্তি হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে রক্তিমের বলিষ্ঠ দেহটা। তৎক্ষণাৎ অজানা এক ভয়ে, আতঙ্কে নীল হয়ে ওঠে মেহেদীর মুখ। জাবির, শান্ত, রাকিব দৌড়ে এসে মাটিতে লুটিয়ে থাকা রক্তিমের দেহটা আগলে নেয়। জড়বুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেহেদীকে তাড়া দিয়ে বলে,

“দ্রুত গাড়িতে ওঠেন। ভাইকে এক্ষুণি হাসপাতালে নিতে হবে। দেরী হলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।”

চলবে….

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-২৬+২৭

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৬
#আদওয়া_ইবশার

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে এসেছে। এবার শুধু কিছু মুহূর্তের অপেক্ষা। এরপরই দুজন ভালোবাসার মানুষ বাঁধা পরবে পবিত্র বন্ধনে। দুটানা অনুভূতিতে ঠাসা দুরু দুরু বুকে লাল টুকটুকে বউ সেজে প্রণয় পুরুষের অপেক্ষায় ইতি। ভালোবাসার মানুষটাকে চিরসঙ্গী হিসেবে আপন করে পাবে ভেবে যেমন আনন্দের বন্যা বইছে মনে, ঠিক তেমনই ভবিষ্যৎ চিন্তায় বক্ষমাঝে অজানা কিছু ভয় দানা বেঁধেছে আনন্দের পাশাপাশি। কতক্ষণ পরেই বাইরে শোরগোল শোনা যায় ‘বর এসেছে’। কথাটা শোনা মাত্রই অস্থিরতা বেড়ে যায় ইতির। বুকের ধুকপুক শব্দটা দ্বিগুণ হয়। হাজার অনুভূতির মিশেলে পৃষ্ট হৃদয়ে স্বাদ জাগে প্রিয় মানুষটাকে বর বেসে এক নজর দেখে চোখের তৃষ্ণা মিটাতে। নব বধূর লজ্জার আস্তরণে হৃদয়ের চাওয়া টুকু হেরে যায়। চুপচাপ অশান্ত হৃদয়ে প্রহর গুণে যায়, কখন দুজনার তীব্র অপেক্ষার অবসান ঘটবে? কখন দুজন দুজনকে সকলের সম্মতিতে কবুল পড়ে আপন করে নিবে। পরক্ষনে আবার ভাবনারা বদলে গিয়ে বুকে জমে বিষাদ। জন্ম থেকে পাওয়া আপন মানুষ,আপন ভিটে সমস্ত কিছু পর করে চলে যেতে হবে এ বাড়ির মায়া ছেড়ে। এমন ভাবনায় খুশী গুলো মলিন হয়ে তীব্র কষ্টে ছেয়ে যায় নব বধূর মন।

নতুন বরকে দেখার আশায় ইতির পাশে বসে থাকা সকলেই ছুটে যায়। থেকে যায় শুধু দৃষ্টি। চারিদিকে সকলের মনের মাঝে বিয়ে উপলক্ষে আনন্দ উচ্ছ্বাসের ছড়াছড়ি থাকলেও মনের কোণে মেঘ জমেছে দৃষ্টির। সকলের আনন্দ উল্লাস যেন তার কাছে বিষের মতো ঠেকছে। রক্তিমের কথায় দেহে আঘাতের চিহ্ন না হলেও মনে বিশাল আচড় কেটেছে। আঘাতে জর্জরিত মন ভিষণ বাজে ভাবে অসুখে ভোগছে। এমন অসুস্থ মন নিয়ে কি আর আনন্দে মেতে থাকা যায়? তবুও মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে মুখ বোঝে সমস্ত কিছু সহ্য করে যাচ্ছে দৃষ্টি। তবে ভুল করেও গতকালের পর আর রক্তিমের চোখের সামনে পরেনি। পাষাণ পুরুষের প্রেমে পাগল প্রায় দৃষ্টি এবার দাঁতে দাঁত চেপে মনকে শাসিয়েছে। প্রতিজ্ঞা করেছে আর অপমানিত হতে যাবেনা ঐ মানুষটার সামনে। যতদিন পযর্ন্ত পাষাণটা নিজে থেকে দৃষ্টিকে কাছে না ডাকবে ঠিক ততদিন পযর্ন্ত প্রয়োজনে বেহায়া মনকে শিকল পরিয়ে হলেও ঐ পাষান্ডটার থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। এমন একটা শক্ত প্রতিজ্ঞা করার মাঝেও দৃষ্টির বেলাজ,বেহায়া মনটা লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে প্রশ্ন করে বসে, “ঐ পাষাণ শিকদার যদি কখনো তোকে নিজ থেকে কাছে না ডাকে! তবে কি তাকে ছেড়ে যাবি?” বিপরীতে দৃষ্টি নিজেই নিজেকে শাসিয়ে মনের ভাবনা গুলোকে পাত্তা না দেওয়ার প্রয়াস চালিয়ে বিরবিরিয়ে বলে,
“যদি ঐ পাষাণটা তাকে কখনো না ডাকে,তবে সে বুঝে নিবে ঐ মানুষটা সত্যিকার অর্থেই হৃদয়হীন। হৃদয় নেই দেখেই দৃষ্টি নামক আস্ত এক ভালোবাসার খনিকে সে উপেক্ষা করতে পেরেছে। দৃষ্টিও মস্ত বড় পাপ করেছে এমন হৃদয়হীন পুরুষকে নিজের কোমল মন দিয়ে। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবেই ধরে নিবে ভালোবাসার মানুষের অবহেলা।সবাই ভালোবেসে সুখ পায়। সে না হয় দুঃখই পেল। এক জনম হাসি মুখে বুকে দুঃখ লুকিয়ে পাড় করে দিল ভালোবাসা নামক পাপের শাস্তি ভোগ করে।”

বর বেশে মেহেদী শিকদার মঞ্জিলে পা রাখার পর কিছু নিয়ম পালন শেষেই ধুম পরে যায় খাওয়া-দাওয়ার। বাড়ির সবথেকে ছোট সদস্যের বিয়ে। এই বিয়েতে কি কোনো আয়োজনের কমতি রাখা যায়? একপ্রকার বলা চলে এটাই শিকদার বাড়ির শেষ বিয়ে। নিজের ছেলের প্রতি আজীজ শিকদারের খুব একটা ভরসা নেই। ঐ অনুভূতিহীন রোবট মানব আদও কখনো বাবা ডাক শুনবে কি না কে জানে। সেখানে তার ভবিষ্যৎ ছানাপোনার বিয়ের খাবার আশা করাটা একপ্রকার বিলাশীতা। সেই চিন্তা করেই মনের সবটুকু শখ-আহ্লাদ ঢেলে পুরো শহর জানিয়ে ধুমধাম আয়োজন করেছে ছোট মেয়ের বিয়েতে। ঐ পাথুরে মনের রোবট মানব ছেলেটা যা কির্তী শুরু করেছে, নাতি-নাতনির বিয়ে দূরের কথা, দাদা ডাক শোনার আশায় মনে হয় বাদ দিতে হবে খুব শিগ্রই। মাঝে মাঝে আজীজ শিকদার নিজেকে অপরাধী ভাবতে বাধ্য হয় এই ভেবে, দৃষ্টি নামক মিষ্টি ফুলটাকে তার অনুভূতিহীন ছেলের সাথে জড়িয়ে দিয়ে মেয়েটার জীবনটাই না নষ্ট করে দিল। কিন্তু ওনারই বা আর কি করার আছে? দৃষ্টির বাবা-মায়ের সাথে সৈন্যসমেত একপ্রকার যুদ্ধ করে ছেলেটাকে বিয়ে করিয়ে এনেছিল। ভেবেছিল মেয়েটার সাথে থাকতে থাকতে নিশ্চয়ই ঐ পাষাণের মন গলবে। কিন্তু হচ্ছে তার বিপরীত। তবুও কিছুই করার নেই। বাবা হয়ে তো আর ছেলের বৈবাহিক জীবনে নাক গলাতে পারেনা সর্বক্ষণ।

খাওয়া-দাওয়া শেষে কতক্ষণ খোশগল্পে বিয়ে বাড়ি মাতিয়ে রাখে মুরুব্বিরা। কথায় কথায় জানা যায় আগেভাগে আজীজ শিকদার দেনমোহরের বিষয়টা পরিষ্কার করেননি। বিয়ের মুহূর্তে এসে তিনি বলছেন ছেলে খুশি হয়ে যা দিবেন তাই তারা মেনে নিবে। পরক্ষনেই মেহেদীর বাবা-বড় ভাই জানায় দশ লক্ষ টাকা দেনমোহর দিবেন তারা। কথাটা রক্তিমের কানে পৌঁছাতেই প্রতিবাদ করে ওঠে। সরাসরি মেহেদীর সামনে গিয়ে জানতে চায়,

” স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করা স্বামীর ফরজ কাজ। তোর যত টাকা পরিশোধ করার সামর্থ্য আছে তত টাকায় দেনমোহর ধার্য করবি। এর বেশি এক টাকাও না।”

রক্তিমের কথাটা উপস্থিত অধিকাংশ মানুষের পছন্দ হয়নি। প্রায় অর্ধেকেই ভাবছে ছেলের বাবা-ভাই যখন চাচ্ছে তখন মেয়ের ভাই হিসেবে সে কেন বিরোধীতা করবে? মেয়ের ভাই হিসেবে তো তার আরও মোটামুটি বড় একটা অংকের দেনমোহর দাবী করে বোনের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার কথা। সেখানে কি না উল্টো সে আরও বাগরা দিচ্ছে। বিষয়টা মেহেদীর বাবা নিয়াজ সাহেবের পছন্দ হয়নি। মনে মনে ভাবেন সারা বছর গুন্ডা মাস্তানি করে নিজের সাথে ওনার ছেলেটার ভবিষ্যৎ ও নষ্ট করেছে। এখন আজ আবার সে নিজেই সামর্থ্য খোঁজতে আসছে। সে কি জানেনা মেহেদী বেকার! নিজেই এখনো বাপের-ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খায়।সেখানে বউয়ের দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করবে কিভাবে? রক্তিমের এটা ভাবা উচিৎ ছিল মেহেদীর বাবা-ভাই যখন বলছেন তখন তারাই পরিশোধ করবে দেনমোহরের টাকা। মনে মনে রুষ্ট হলেও মুখে প্রকাশ করেননা নিয়াজ সাহেব। মুখে মেঁকি হাসি ফুটিয়ে বললেন,

“দেখো বাবা! তুমি তো জানোই আমার ছেলে বেকার। সব জেনেই তোমরা আমার ছেলের সাথে তোমার বোনের বিয়ে দিতে চাইছো। আমার ছেলে বেকার হলেও কখনো তোমার বোনের কোনো চাহিদা অপূর্ণ থাকবেনা। আল্লাহ আমাকে যথেষ্ট অর্থবিত্ত দান করেছেন। আমার ছেলে সারাজীবন পায়ের উপর পা তুলে খেলেও তা কমবেনা। তেমন দেনমোহরের টাকাও দশ লক্ষ কেন বিশ লক্ষ হলেও অপরিশোধ্য থাকবেনা। পুত্রবধূর ভরন-পোষনের দায়িত্ব যেমন আমি নিব। তেমন তার দেনমোহরের টাকাও আমি পরিশোধ করব।”

এমন একটা জবাবে মুহূর্তেই চটে যায় রক্তিম। তবে বোনের বিয়েতে কোনো ঝামেলা হোক চায়না বিধায় শান্ত ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টায় বলে,

“কিন্তু আমি চাই আমার বোনের দেনমোহর তত টাকায় হবে যত টাকা তার স্বামী নিজে পরিশোধ করতে পারবে। ছেলেটা আপনার হলেও তার সম্পর্কে জানার মাঝে অল্প ভুল করেছেন। আমার সাথে থেকে গুন্ডামি করেও ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারটা খুব ভালো করেই আয়ত্ব করে নিয়েছে আপনার ছেলে। যা আপনার অজানা। সুতরাং আমার মনে হয় স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করার মতো সামর্থ্য তার আছে। তাই আমি তার মুখ থেকেই শুনতে চাচ্ছি কত টাকা দিলে সে পরিশোধ করতে পারবে। আর একটা কথা। আমার বোনের ভরন-পোষনের দায়িত্বটাও আপনাকে নিতে হবেনা। এটাও আপনার ছেলে নিতে পারবে। বন্ধু হিসেবে এতোটুকু বিশ্বাস আমার তার উপর আছে।”

ছেলের যুক্তিতে সন্তুষ্ট হাসেন আজীজ শিকদার। নিয়াজ সাহেবকে মানাতে বিনয়ী স্বরে বলে,

“বিয়াই সাহেব!লোক দেখানো অল্প সু-নামের জন্য লাখ লাখ টাকা দেনমোহর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক না। হাদীসেও এটাই বর্নিত। স্বামীর যতটা সামর্থ্য আছে সেই হিসেবেই দেনমোহর ধার্য্য করা। আপনার ছেলের যদি এক টাকা দেওয়ার সামর্থ্য হয় আমি তাতেও খুশী। ঐসব দেনমোহর বড় বিষয় না। বড় বিষয় হলো আমার মেয়ের সুখ। আপনার ছেলের সাথে আমার মেয়ে সুখে থাকলেই হবে। আর কিছুই চাইনা।”

এক কথা, দুই কথায় কখন না জানি বড় কোনো ঝামেলা বেঁধে যায়। সেই ঝামেলার জের ধরে না আবার পেয়ে গিয়েও প্রেয়সীকে হারিয়ে ফেলতে হয় ভয় হয় মেহেদীর। পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত বলে ওঠে,

“দেড় লাখ টাকা দিতে পারব আমি। আব্বা প্লিজ! আর কোনো অমত করবেন না। আমিও চাই আমার স্ত্রীর দেনমোহর আমার নিজের টাকায় পরিশোধ করব।”

ছেলের সোজা জবাবে আধার ছেয়ে আসে নিয়াজ সাহেবের মুখে। ভাবে লোক-সমাজে কতটা অসম্মান হবে তার। পাড়া-প্রতিবেশী সবাই বলবে লাখ লাখ টাকার মালিক হয়েও ফকিরের মতো সামান্য কয়টা টাকা দেনমোহর দিয়ে ছেলের বউ ঘরে তুলেছে। তবে এই মুহূর্তে কিছু বলাও যাবেনা। ছেলেই যেখানে ভরা মজলিসে সম্মতি দিয়ে দিয়েছে। সেখানে নিয়াজ সাহেব অমত পোষণ করলে বিষয়টা বিচ্ছিরি হয়ে যাবে। সেই ভেবেই সম্মতি দিয়ে দেয়।

বিয়ের আসল কার্যক্রম শুরু হয়। ইতিকে নিচে নিয়ে আসার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়। বিয়ের ভারী ল্যাহেঙ্গার কিছুটা ভার একপাশে উঁচিয়ে ধরে ননদিনীকে সার্পোট দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নিয়ে আসে দৃষ্টি। শিকদার বাড়ির ছোট রাজকন্যার নব রূপে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে উপস্থিত সকলেই।শিকদার বাড়ির মেয়ের পাশাপাশি তার পাশে থাকা বউয়ের রূপের প্রশংসার গুঞ্জন সৃষ্টি হয় গুটিকয়েক আত্মীয়র মাঝে। শত মানুষের ভীরের মাঝেও প্রয়সীর বধূ রূপে থমকায় মেহেদী। তাকে এভাবে মুগ্ধ হয়ে এক নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঠাট্টা-হাসির রোল পরে যায় মুহূর্তে। মেহেদীর সেদিকে কোনো ধ্যান জ্ঞান নেই। পাত্তা দেয়না কারো হাসি ঠাট্টা।তার এতো বছরের প্রেম সাধনা আজ পূর্ণতা পেতে চলেছে। তার প্রেয়সী তার জন্যই আজ নিজের সমস্ত রূপ উজাড় করে সেজেছে। তবে সে দেখবেনা তো কে দেখবে? মেহেদীর এমন নির্লজ্জ চাহনী চোখ তুলে একবার তাকিয়ে দেখেই লজ্জায় নতজানু হয় ইতি।নিচে নেমে রক্তিমকে দেখতে পেয়ে বর কনে দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে দূরে সরে যায় দৃষ্টি। মুহূর্তেই শান্ত হয়ে ওঠে পরিবেশ। সকলের মনযোগ কাজীর কথায়।বিয়ের কার্যক্রম শুরু করে কাজী। মেহেদীর উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বলে ওঠেন,

” দেড় লক্ষ টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া আপনি নিয়াজ উদ্দিন সাহেবের ছোট পুত্র মেহেদী হাসান, এমপি আজীজ শিকদারের ছোট কন্যা ইসরাত ইতিকে বিবাহ করিতে রাজি থাকলে বলুন ‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল’।

নিরব পরিবেশে উপস্থিত সকলেই উৎসুক দৃষ্টিতে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে। অপেক্ষায় তার মুখ থেকে কবুল শব্দটা শোনার। কারো দিকে না তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে এক পলক রক্তিমের দিকে তাকায় মেহেদী। রক্তিম নির্বাক। কাটকাট ভঙ্গিতে বুকে হাত গুজে বোনের পাশে দাঁড়িয়ে। মেহেদীকে তার দিকে তাকাতে দেখেও কোনো নড়চড় হয়না। বরং আগের থেকেও শাণিত হয় চোখের দৃষ্টি। মেহেদী নিজে থেকেই ভেবে নেয় রক্তিমের ঐ কঠোর দৃষ্টির মানে। চোখের চাহনীতেই গুন্ডা শিকদার তাকে জানিয়ে দিচ্ছে,

“আমার বোনের মুখে আজীবন হাসি ফোটানোর দায়িত্ব নিতে পারলেই কবুল বলবি। নইলে না। বিয়ের পর যদি কোনোদিন বোনকে কাঁদতে দেখি তবে সেদিনই হবে তোর শেষ দিন।”

রক্তিমের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে নড়েচড়ে বসে মেহেদী নিজেও আত্মবিশ্বাসের সাথে তাকায় তার চোখে। বুক ফুলিয়ে একটা দম নিয়ে সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বলে ওঠে,

“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

সাথে সাথে কেঁপে ওঠে ইতি। ভালো লাগার এক শীতল শিহরণ বয়ে যায় পুরো শরীরে। পরপর তিনবার মেহেদীর কবুল পড়া শেষে সকলেই উৎসুক নজরে তাকায় ইতির দিকে। সুখ-দুঃখের অদ্ভূত এক সংমিশ্রনে একটু সময় নিয়ে ইতি নিজেও তিনবার কবুল বলে প্রণয় পুরুষকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। হাসি ফোটে ওঠে সকলের মুখে। বিদাইয়ের সুর বাজতেই কান্নার রুল পরে শিকদার বাড়িতে। বাবার আদরের রাজকন্যা, মায়ের আদরের দস্যি মেয়ে, ভাইয়ের আদরের ছোট্ট বোনটা সমস্ত সম্পর্ক পিছনে ফেলে স্বামীর হাত ধরে পা বাড়ায় নতুন সংসারে। নিজের বাড়ি নিজের মানুষ গুলোকে ছেড়ে যেতে ফুট ফাঁটে ইতির। কান্নায় মুর্ছা যায়। তবুও সব বন্ধন ছিন্ন করে যেতে হয় নতুন জীবন সাজাতে।

****
বর যাত্রী বিদায় নিতেই খুব কাছের দুই-একজন আত্মীয় ছাড়া অন্যরাও একে একে বিদায় নেয়। মানুষে গমগম করা শিকদার মঞ্জিল আবারও নির্জীব হয়ে ওঠে। চারিদিকে অদ্ভূত নিরবতা গ্রাস করে নেয়। শিকদার বাড়ির প্রতিটা মানুষের জীবনে নেমে আসে মন খারাপের রাত্রি। খেয়েদেয়ে নিজের মতো করে নিশ্চুপ হয়ে ইতির রুমে শুয়ে পরে দৃষ্টি। মাত্র তিনদিনের পরিচয়েও আজ ইতির বিদায়ে অদ্ভূতভাবে মন খারাপ অনুভব করে দৃষ্টি। চোখের তারাই ভেসে ওঠে তার সেই বিদায় মুহূর্তের দৃশ্য। আজ যেভাবে ইতি বিদায় নিল বাড়ি ছেড়ে সেভাবেই তো তার বিদায় হয়েছিল। পরমুহূর্তে মনে পরে, উঁহু এভাবে না। ইতি বধূ বেসে সকলের সম্মতিতে ধুমধাম অনুষ্টানের মধ্য দিয়ে স্বামীর হাত ধরে বিদায় নিয়েছে। আর সে তো মা-বাবা’কে কষ্ট দিয়ে সাধারণ ঘরে পরা থ্রি-পিস পরে শশুরের হাত ধরে বিদায় নিয়েছিল। বউ সাজে স্বামীর হাত ধরে যেমন বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি আসার ভাগ্য হয়নি তার। তেমনই এখনো স্বামীর ভালোবাসা পাবার ভাগ্যটাও হয়নি। আদও হবে কি না সেটাও জানা নেই। অলস মস্তিষ্ক এমন হাজারটা ভাবনা চিন্তার উৎপাত ঘটিয়ে মন খারাপের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় দৃষ্টির। অর্ধরাত পর্যন্ত নির্ঘুম কাটে। আজানের আগ মুহূর্তে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে ভাবনা ঘর বন্ধ করে। ঘুম নামে দুই চোখে। মনে হয় সবেই চোখ দুটো লেগেছে। এর মাঝেই কানে ভাসে নিচে থেকে শোরগোল এর আওয়াজ আসছে। কিছুটা বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে দেয়ালে ঝুলানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা দশটা। হুড়মুড়িয়ে ওঠে বসে দৃষ্টি। শশুর বাড়িতে নতুন বউ হয়ে এতো বেলা অব্দি ঘুমাচ্ছে সে! না জানি উপস্থিত গুটিকয়েক আত্মীয় কত মন্দা রটাচ্ছে। কথাটা ভেবেই ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে উদ্যত হয়। সময় গড়ানোর সাথে সাথে নিচে থেকে আসা আওয়াজ তীব্র হয়। সাথে বাড়ে দৃষ্টির পায়ের গতি। সিঁড়ির কাছে গিয়ে নিচের দৃশ্য দৃষ্টিকোণ হতেই থমকে যায় দৃষ্টি। তিন-চারজন পুলিশ ঘিরে ধরেছে রক্তিমকে। নিশ্চল মস্তিষ্কে কতক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থেকে আচমকায় ক্রস্ত পায়ে নিচে নামতে নামতে চেঁচিয়ে ওঠে,

“কি হয়েছে এখানে? পুলিশ কেন বাড়িতে?”

দৃষ্টির উপস্থিতি টের পেয়ে শিকদার মঞ্জিলের সকলেই তটস্থ হয়। রেহানা বেগম দ্রুত দৃষ্টির কাছে এসে তাকে ফের উপরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে বলে,

“কিছুই হয়নি। বাড়ির নতুন বউ তুমি। এসব ঝামেলা দেখতে হবেনা। তোমার শশুর আছেন, ওনি সবটা সামলে নিবে। আমার সাথে রুমে চলো তুমি।”

শাশুড়িকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে জোর খাটিয়ে নিচে নেমে আসে দৃষ্টি। রক্তিমের সামনে দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করে,

“কি হয়েছে বলুন আমাকে। পুলিশ কেন এসেছে? আর আপনাকেই বা এভাবে ঘেরাও করে রেখেছে কেন? কি করেছেন আপনি? আবার কোথাও মারামারি করেছেন?”

দৃষ্টির অস্থিরতা দেখে একজন পুলিশ অফিসার আজীজ শিকদারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “ওনি কে?” উত্তরে চিন্তিত আজীজ শিকদার গম্ভীর স্বরে জানায়,

“আমার ছেলের স্ত্রী।”

একটু থেমে আবারও উদগ্রীব হয়ে বলে,

“দেখুন অফিসার, কেইস রি-ওপেন হয়েছে এর কোনো নোটিশ আমরা পাইনি। এভাবে হুট করে এসে সেই মান্দাতার আমলের ডিসমিস হয়ে যাওয়া কেসের সূত্র ধরে আমার ছেলেকে নিয়ে যেতে পারেন না। কেস যদি রি-ওপেন হয়েও থাকে তবে আমরা কেন নোটিশ পাইনি? এর জবাব আগে দিন আমাদের।”

“তা তো আমরা জানিনা স্যার। উপর মহল থেকে আমরা অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট পেয়েই এসেছি। আমাদের কাজ আমাদের করতে হবে। আপনি যদি বাঁধা দিতে আসেন তবে হয়তো বিষয়টা আরও জটিল হবে। বুঝতেই পারছেন আপনার ছেলে মার্ডার কেসের আসামি। এই মুহূর্তে আপনি বাঁধা দিয়ে কিছুই করতে পারবেন না। উল্টো আপনি নিজেও একজন খুনিকে সাপোর্ট করার অপরাধে এমপি পদ হারাতে পারেন।”

অফিসারের কথা গুলো শোনা মাত্রই যেন দৃষ্টির মাথায় মস্ত বড় আকাশটা ভেঙ্গে পরে। অনুভূতি শূণ্য নিস্তেজ কন্ঠে জানতে চায়,

“কিসের মার্ডার কেস?”

“প্রায় আড়াই বছর আগে আপনার স্বামী ওনার প্রথম স্ত্রী জেরিন এবং ভাই সংগ্রাম শিকদারকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। সেই কেসে তখন আপনার শশুর মিথ্যে প্রমাণ দিয়ে ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণ করে ছাড়িয়ে এনেছিল। কিন্তু সেটা জেরিনের পরিবার মেনে নেয়নি। ওনারা আবার নতুন করে কেস ওপেন করেছে।”

চলবে…..

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৭
#আদওয়া_ইবশার

মানুষের জীবন কখন কোন দিকে মোড় নেয় কেউ বলতে পারেনা। সুখ, দুঃখ এই দুটো জিনিস মনে হয় একে অপরের পরিপূরক। না হয় কি সুখের মুহূর্ত গুলো শেষ হতে না হতেই মানব জীবনে দুঃখ এসে হাজির হতো? শিকদার মঞ্জিলের বিয়ের সাজ এখনো মুছেনি। চারিদিকে এখনো উৎসবমোখর আমেজ। সেই আনন্দঘন মুহূর্ত শেষ হবার আগেই ঝুমঝুমিয়ে ঝরে পরল দুঃখের বর্ষণ। যেই কালো অতীত মা-ছেলের মাঝে দূরত্বের দেয়াল সৃষ্টি করেছিল। আজ সেই দেয়াল ভাঙ্গতে না ভাঙ্গতেই সেই কালো অতীত আবারও হানা দিল। সুখের সানাই শেষ হবার আগেই বেজে ওঠল দুঃখের সানাই।

আজীজ শিকদার কোনো যুক্তি, তর্ক দেখিয়েও ছেলেকে আটকে রাখতে পারেননি। বিভীষিকাময় ঘুমিয়ে থাকা সেই অতীত জাগ্রত হয়ে নিয়ে গেল চৌদ্দ শাকের ভিতর। বিবশ চোখে চেয়ে দৃষ্টি শুধু দেখে গেল তার প্রণয় পুরুষ, যে পুরুষের প্রেমে মজে পরিবার ছেড়ে এতোদূর এসেছে, হাজার লাঞ্চনা সহ্য করছে সেই পুরুষের হাতে হায়কড়া পরিয়ে পুলিশ খুনের আসামী হিসেবে নিয়ে গেল। রেহানা বেগম ছেলের এমন বিপদে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। ছেলের শোকে কান্নায় মূর্ছা যাবার অবস্থা। একদিকে পুরোনো কেসের সূত্র ধরে ছেলেকে নিয়ে গেল পুলিশ, অন্যদিকে পুত্রবধূর থমকানো চেহারা, স্ত্রীর কান্না, সব মিলে আজীজ শিকদার দিশাহারা। কি রেখে কি করবে, কাকে সামলাবে মস্তিষ্ক ঘেটে গিয়ে কিছুই ঠাহর করতে পারছেনা। প্রায় আড়াই বছর পর কেনই বা শেষ হয়ে যাওয়া কেস আবার শুরু হলো সেটাও ভেবে পাচ্ছেনা। জেরিনের বাবার বাড়ির লোক বলতে তো একমাত্র জেরিনের মা, মামারা আছেন। ওনারা যদি আড়াই বছর আগের রায়ে সন্তুষ্ট না থাকতেন তবে কি আরও আগেই এই কেস নতুন করে শুরু করার কথা ছিলনা?বছরের পর বছর চলে যাবার পর তারা কেন এটা নিয়ে পরবে? এর পিছনে কি অন্য কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে?পেছন থেকে কি অন্য কেউ কলকাঠি নাড়ছে?একের পর এক ভাবনায় মস্তিষ্ক অসাঢ় আজীজ শিকদারের। তবুও কোনো সুরাহা করতে পারছেনা।

“বাবা! ওনি কি সত্যিই খুন করেছিল?”

ভাবনার অতলে ডুবে থাকা আজীজ শিকদার হুট করে পুত্রবধূর মুখে এমন একটা প্রশ্নে থমকে যায়। শীতল চোখে কতক্ষণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করে মেয়েটার মনে কি চলছে। কিন্তু ব্যর্থ হয় আজীজ শিকদার। কেমন যেন প্রাণহীন হয়ে গেছে মেয়েটা। চোখের সামনে স্বামীকে এভাবে ধরে নিয়ে যেতে দেখেও কান্না দূরের কথা, কোনো নড়চড় পযর্ন্ত করেনি। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে আজীজ শিকদার প্রবল আত্মবিশ্বাসী স্বরে বললেন,

“যে হাত দেশের জন্য অস্ত্র ধরেছে, অসহায় মানুষের দুঃখ মুছে দিয়েছে,অনাহারীর মুখে খাবার তুলে দিয়েছে,সেই হাত কখনো খুন করতে পারেনা। আমার ছেলে খুনি না।”

“তবে কেন সবাই বলে নিজের স্ত্রী,ভাইকে খুন করেছে রক্তিম শিকদার? কেন খুনি বলে মানুষজন তাকে?খুনের দায়ে আজ কেনই বা পুলিশ ধরে নিয়ে গেল? এতো ধোয়াশার মাঝে আমাকে কেন রাখছেন আপনারা? আমার স্বামীর সম্পর্কে জানার অধিকার কি আমার নেই? কি সেই অতীত, যে অতীতের সূত্র ধরে আজ আমার স্বামী খুনি? সে যদি খুন না করেই থাকে তবে আপনার ছেলে সংগ্রাম কিভাবে মারা গেছে? আর আপনার বড় ছেলের প্রথম স্ত্রী! ওনিই বা কিভাবে মারা গেছে? দয়া করে আমাকে আর ধোয়াশার মাঝে রাখবেন না। আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।”

নিস্তেজ কন্ঠস্বর একসময় চওড়া হয় দৃষ্টির। প্রতিটা কথায় তার অতীত জানার প্রবল জেদ। যে অতীতের জন্য রক্তিম শিকদারকে স্বামী হিসেবে পেয়েও পেলনা সেই অতীত আজ যেকোন মূল্যে সে জানবেই। পুত্রবধূর এমন দৃঢ় স্বরের প্রশ্নে একটাও ঘাবড়ায়না আজীজ শিকদার। কন্ঠস্বর আগের থেকেও নরম করে বলে,

“ঠিক সময়ে সব জানতে পারবে মা। একটু ভরসা রাখো এই বাবার উপর। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে, খুব বেশিদিন আমার ছেলেকে আমি জেল খাটতে দিবনা। সঠিক সময়ে সবার সামনেই সব সত্য প্রকাশ পাবে।”

“কোন সত্য?” জানতে চায় দৃষ্টি। আজীজ শিকদার দৃষ্টির মেঝের দিকে রেখে গম্ভীরভাবে বলে ওঠে,

“যে সত্য এতোদিন নিজের মাঝে চেপে রেখেছি। সেই সত্য।”

****
কোনো ঘটনা ঘটতে দেরি হলেও রটতে দেরি হয়না। ঝড়ের গতিতে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পরেছে পুরোনো কেসের দায়ে রক্তিম শিকদারকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কথাটা পুরো এলাকায় জানাননি হতে হতে একসময় পৌঁছে দৃষ্টির খালা শিউলি বেগমের কানে। সেখান থেকে ময়মনসিংহ খবর পৌঁছাতে খুব একটা সময় লাগেনা। সাদেক সাহেব, দিলশান আরা দুজনেই এমন একটা খবর শুনে স্থির থাকতে পারেনি। সেদিনই ছুটে আসে সাভার মেয়ের কাছে। বাবা-মায়ের দেখা পেয়ে এবার যেন দৃষ্টির ভিতরে চলা ভাংচুর প্রকাশ পায় চোখের জলে। মায়ের পায়ের কাছে বসে করুণ আর্তনাদের সাথে বলতে থাকে,

“তোমার অমতে সেদিন ওনাকে বিয়ে করাই তুমি আমাকে অভিশাপ দিয়েছিলে মা? তোমাকে কাঁদিয়ে আমি একটুও ভালো নেই মা। বিয়ের পর থেকে একটা রাতও আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারিনি। তুমি তো মা! আমি না হয় একটা ভুল করেই ফেললাম। ক্ষমা করে দাওনা আমাকে! আমি আর নিতে পারছিনা এসব। এই অভিশপ্ত জীবনের বোঝা আর বইতে পারবনা। ঐ মানুষটাকে আমি আমার জীবনের থেকেও বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। কখন কিভাবে এতোটা ভালোবাসলাম জানিনা আমি। শুধু এটুকুই জানি ঐ মানুষটা ছাড়া আমি নিজেকে কল্পনা করতে পারিনা। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। আমার স্বামী খুনের দায়ে জেলে। কথাটা ভাবতেই আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মা। ভিতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।মেনে নাও না মা! ক্ষমা করে দাও আমাদের। তুমি ক্ষমা না করলে আমি কখনো শান্তিতে সংসার করতে পারবনা।”

মেয়ের করুণ আর্তনাদে দিলশান আরা’র কঠোর হৃদয় কেঁপে ওঠে। কেঁদে ওঠে মাতৃমন। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় কান্নারত মেয়ের মুখের দিকে।মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানেই মেয়েটা শুকিয়ে কি অবস্থা হয়েছে! চোখের নিচের কালো দাগেই প্রমাণ করছে নির্ঘুম রাত কাটানোর। চেহারায় সেই আগের লাবন্যতা আর নেই। আঠারো বছর বয়সেই মনে হয় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের কোনো এক সংসার সামলানো ক্লান্ত নারী। যার দিন শুরু হয় সংসার নামক জাতাকলে পৃষ্ঠ হতে। একমাত্র আদরের মেয়ের এমন করুণ পরিণতি মানতে পারেনা দিলশান আরা। বিয়ে থেকে শুরু করে এখন পযর্ন্ত জমে থাকা সমস্ত রাগ, ক্ষুব বেরিয়ে আসে ঝাঝালো কথার তোরে। দৃষ্টিকে মেঝে থেকে টেনে তুলে দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে বললেন,

“ভালোবাসার মানুষের কাছে সুখে থাকতে এসে এখন কেন এমন দশা তোমার? স্বাস্থ্যের অবনতি, চোখের নিচে কালি, চেহারায় বয়সের ছাপ এসব কেন? কেন চেহারা থেকে সুখ উপচে পরার বদলে দুঃখ ঝড়ছে অশ্রু হয়ে? কিসের কমতি রেখেছিলাম তোমার? টাকা-পয়সা, খাবার-পোশাক, ভালোবাসা কিসের অভাব ছিল আমার ঘরে তোমার? কোন সুখের আশায় এই জীবন বেছে নিয়েছো?একটু খুনির কাছ থেকে কি সুখ আশা করো তুমি যা আমরা দিতে ব্যর্থ! উত্তর দাও। উত্তর দাও আমার প্রশ্নের।”

কোনো প্রতিত্তোর করতে পারেনা দৃষ্টি। চুপচাপ মাথা নত করে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। কান্না ছাড়া যেন এই মুহূর্তে তার মাঝে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মেয়ের নিরবতায় ক্ষেপে যায় দিলশান আরা। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে দৃষ্টির বাহুতে চাপ প্রয়োগ করে আবারও চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

“কথা বলছোনা কেন? উত্তর দাও আমার প্রশ্নের। আর যদি উত্তর না থাকে তোমার কাছে, তবে আজ এই মুহূর্তে ঐ খুনির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমার সাথে যেতে হবে তোমার। হয় আমাকে তোমার সুখ দেখাও না হয় সম্পর্ক চুকিয়ে নাও।”

সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা শুনে দৃষ্টি সহ আজীজ শিকদার, রেহানা বেগম সকলেই চমকে ওঠে। প্রতিবাদ করে ওঠে আজীজ শিকদার,

“এসব কি ধরনের কথা আপা! সম্পর্ক ছিন্ন করবে মানে কি? বিয়ে কি কোনো ছেলে খেলা, যে ইচ্ছে হলো খেলল আবার ইচ্ছে হলো খেলা শেষ করে দিল? সেই প্রথম দিন থেকে আপনি বারবার আপনার কথায় নিজেকে ভুল প্রমাণ করে আসছেন। একজন সম্মানিত কলেজের প্রভাষক হিসেবে এমন কথা-কাজ আপনার মানায়না।”

“সাধারণ জনতা ভেবে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে পরিবারের অমতে একটা মেয়েকে জোর করে নিজের খুনি ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়াটা কি একজন এমপি হিসেবে আপনার মানায়? অন্য কারো দিকে আঙুল তোলার আগে নিজের দিকটা ভেবে নিবেন। না হয় নিজের জালে নিজেই ফাঁসবেন। ভাববেন না আমার সাথে অন্যায় করে পাড় পেয়ে গেছেন দেখে সব জায়গায় পাড় পেয়ে যাবেন।”

চোখ বুজে সবটা হজম করে নেয় আজীজ শিকদার। ভুল সত্যিই আজীজ শিকদার নিজেও করেছে। আসলেই দিলশান আরা’কে প্রশ্নবিদ্ধ করার আগে নিজের দিকে তাকানো উচিৎ ছিল। খুব বড় মুখ করে তো দাপট দেখিয়ে মেয়েটাকে ছেলের বউ করে এনেছিল। কিন্তু দুঃখ ছাড়া কিছুই দিতে পারলনা আজ পযর্ন্ত মেয়েটাকে। অথচ জীবনে প্রথম ক্ষমতার অপব্যবহার করে দাপট দেখিয়ে মেয়েটার ভালোবাসার পূর্ণতা দেবার জন্যই নিজের ছেলের সাথে জড়িয়েছিল। ভেবেছিল মেয়েটাও সুখী হবে পাশাপাশি ছেলেটাও হয়তো এবার বদলে যাবে।

“মনের সুখ সবথেকে বড় সুখ মা। আমার রূপ লাবন্যতা দিয়ে কি হবে, যদি আমার মনেই শান্তি না থাকে? ঐ মানুষটার সাথে আমি সুখে আছি। ভালো আছি। মনের দিক থেকে আমি তৃপ্ত। আত্মতৃপ্তি ছাড়া আমি আর কিছুই চাইনা মা। তুমি দয়া করে আর কখনো এসব কথা বলবেনা। খুনি হোক আর যায় হোক। ঐ খুনি রক্তিম শিকদারটাকেই আমি ভালোবাসি। যেখানে পুরো মানুষটাকেই আমি ভালোবাসি, সেখানে তার খুনের অপবাদে কিভাবে আমার ভালোবাসা বদলে যাবে? একমাত্র মৃত্যু ছাড়া ঐ মানুষটার জীবন থেকে আমি কখনো সরবনা মা। তুমিও দয়া করে আমাদের আলাদা করার বৃথা চেষ্টা করোনা। আমাকে ক্ষমা করতে না পারো, সুখী হবার দোয়া করতে না পারো, কোনো অভিযোগ তলবনা তোমার প্রতি। তবুও দয়া করে দুজনকে আলাদা করার বৃথা চেষ্টা করোনা।”

চলবে…..

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-২৪+২৫

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৪(প্রথম অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

মোড়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁয়ে অলস সময় পাড় করছে রক্তিম। নিত্যদিন যে দোকানে বসে চায়ের আড্ডায় সময় চলে যেতো চোখের পলকে। আজ যেন সেখানেও মন টিকছেনা। একেতো পাশে মেহেদী নেই। দ্বিতীয়ত কতক্ষণ পরপর বোনটা ফোন করে কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে আবদার জানাচ্ছে ও বাড়ি যেতে।সব মিলিয়ে চারিদিকটা কেমন গুমোট মনে হচ্ছে।চারিদিক তখন ঘন কুয়াশার আস্তরণ সন্ধ্যার পূর্বেই আধার নামিয়ে দিয়েছে। চা শেষ করে সবে সিগারেট হাতে নিয়েছিল রক্তিম। এর মাঝেই পকেটে থাকা যান্ত্রিক বস্তুটা তারস্বরে বেজে ওঠে। সিগারেটটা ঠোঁটের ভাজে নিয়ে ধীরস্থির ভাবে আগুন ধরানোর কাজটুকু শেষ করে ফোন হাতে নেয়। স্ক্রিনে বোনের নাম্বার দেখে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। ক্ষণকাল কিছু একটা ভেবে রিসিভ করে কানে ঠেকায়। কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করে বলে,

“ইতু! কেন এমন পাগলামি করছিস? আমি বললাম তো ভাইয়া তোর বিয়েতে না থাকলেও দূর থেকেই সমস্ত দায়িত্ব পালন করে যাব। আমার বোনের সুখের জন্য যা যা করতে হয় সব করব।”

রেহানা বেগম ছেলের কথার পৃষ্ঠে তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারেনা। কতক্ষণ চুপ থেকে আমতা আমতা করে বলে,

“আমি ! আমি ফোন দিয়েছি। ইতু না।”

মায়ের কন্ঠ শুনে সাথে সাথে জমে যায় রক্তিম। বরফ শীতল চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। মুখ দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারণ হয়না। রক্তিমের অবাকের মাত্রা আরও একটু বাড়িয়ে দিতে রেহানা বেগম পূণরায় বলে,

“বোনের বিয়েতে ভাই উপস্থিত থাকবেনা এ কেমন কথা? মেয়েটা আমার সেই কাল থেকে কেঁদে যাচ্ছে।”

এটুকু বলতেই আবারও রেহানা বেগমকে জড়তা এসে আকরে ধরে। কতক্ষণ দ্বিধান্বিত হয়ে চুপ থাকে। পরপর আবারও ইতির উৎসুক মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে দ্বিধা-জরতা সমস্ত কিছু দূরে ফেলে বলে,

“সন্ধ্যার আগে বউমাকে নিয়ে এই বাড়িতে উপস্থিত হবে তুমি। আমার মেয়ের চোখ দিয়ে যেন আর এক ফোটা অশ্রুও না ঝরে। তোমরা না আসা পযর্ন্ত কোনো অনুষ্ঠান হবেনা।”

ব্যাস! দীর্ঘদিন পর মায়ের সাথে স্বাভাবিক আলাপচারিতা এটুকুই।সেটাও একপাক্ষিক। এই অল্প সময় আর মায়ের ঐ কথা গুলোই রক্তিম শিকদারকে অস্থিরতার অতলে ডুবিয়ে দিয়েছে। সর্বক্ষণ রুক্ষ হয়ে থাকা চোখ দুটো আচমকা জ্বালা ধরে ভিজে ওঠতে চাইছে। বুকের ভিতরটা অস্বাভাবিক মাত্রায় কাঁপছে। দুটো বছর যাবৎ যে মা বারবার তাকে ঐ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, আজ সেই মা নিজেই তাকে বাড়িতে যেতে বলছে। যে মায়ের মুখ থেকে কখনো খু নি ছাড়া অন্য কোনো সম্বোধন রক্তিমের জন্য উচ্চারিত হয়নি সেই মা আজ এতো শান্ত ভাবে তুমি বলে সম্বোধন করেছে। বাবার স্বাভাবিক একটা কথাতেও রক্তিম সবসময় ত্যাড়া জবাব দিলেও কখনো পারেনি মায়ের কোনো কথার বা মারের প্রতিবাদ করতে। চুপচাপ সকল অভিযোগ মাথা পেতে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিয়েছে। বিবর্ণ সেই অতীত রক্তিমকে যতটা না ক্ষতবীক্ষত করেছে, তার থেকেও বেশি হৃদয়ে আঘাত করেছে মায়ের এক একটা ধারালো কথা। পাষাণ হৃদয়টা মুখ ফোটে কারো কাছে না স্বীকার করলেও নিরবে প্রতিনিয়ত সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি জানিয়েছে, মা যেন তাকে একটাবার বুকে টেনে নেয়। একটাবার যেন ঐ মমতাময়ী তার স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেয় রক্তিমের মাথায়। তার কাছে বারবার মনে হতো মায়ের একটু পরশেই তার মনের ভিতর জ্বলতে থাকা আগুনটা নিভে যাবে। একটাবার যদি সে মায়ের কোলে মাথা রেখে চিৎকার করে কাঁদতে পারতো তবে হয়তো বুকের ভিতর জমে থাকা কষ্টটা লাঘব হতো। মা নামক জাদুর মানবীর স্পর্শে পাষাণ হৃদয়টা হয়তো নরম হতো। সৃষ্টিকর্তা বুঝি আজ অবশেষে তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে! আজ কি তবে শিকদার মঞ্জিলে পা রাখলে মা তার জাদুর পরশে রক্তিমের যন্ত্রণা গুলো ঘুচিয়ে দিবে! চোখের জ্বলন, বুকের ভিতরের যন্ত্রণা পুরো শরীরেও ছটফটানি সৃষ্টি করে দিয়েছে। দেহটা চলছেনা। কিন্তু মনটা এক মুহূর্তও দেরি করতে চাচ্ছেনা। পাষাণ হৃদয়টা মায়ের একটু নরম আচরণেই কেমন বাচ্চা হৃদয়ে পরিণত হয়েছে।
হঠাৎ রক্তিমের এমন অস্থিরতায় রাকিব, জাবির, শান্ত তিনজনই অভাব। চিন্তিত হয়ে শান্ত জানতে চায়,

“ভাই কি হলো আপনার! শরীর খারাপ লাগছে?”

কোনো জবাব দেয়না রক্তিম। তবে ইচ্ছে হচ্ছে বাচ্চাদের মতো চিৎকার করে সবাইকে জানিয়ে দিতে, “শুনো তোমরা। আমার মা আজকে আমাকে ডেকেছে। এই পাষাণ, খু নি, গুন্ডা রক্তিমকে বোধহয় মা এবার কাছে টেনে নিবে। তার মমতার পরশে আমার হৃদয়ের যন্ত্রণা নিঃশেষ করে দিব।” কিন্তু পারেনা রক্তিম। অনাকাঙ্ক্ষিত খুশি, আনন্দ বোবা বানিয়ে দেয় নিষ্ঠুর রক্তিমকে। অসাঢ় করে দেয় পুরো দেহ। অদ্ভূতভাবে ভেঙ্গে পরে ইস্পাত কঠিন রক্তিম। মুখে শুধু বলে,

“আমাকে একটু তাড়াতাড়ি শিকদার মঞ্জিলে দিয়ে আসবি?”

যে রক্তিম শিকদার সর্বদা নিজের ছেলেদের উপর হুকুম চালিয়েছে। আজ সেই রক্তিম শিকদার কেমন অনুরোধের স্বরে আকুতি জানাচ্ছে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। হঠাৎ রক্তিমের এমন আচরণ হজম হয়না কারো। অদ্ভূত চোখ করে তাকায় সকলেই রক্তিমের দিকে। মনের মাঝে হাজারটা প্রশ্ন থাকলেও মুখে কোনোটাই উচ্চারিত হয়না কারো। নিজেদের মতোই নিজেরা ভেবে নেয়, একটু আগের ফোনকলে হয়তো শিকদার বাড়িতে যাবার মতো কোনো জরুরী বার্তা পেয়েছে। বিয়ে বাড়িতে আবার কোন অঘটন না ঘটে গেছে! যে অঘটনের জন্য বোনের বিয়েতে থাকার জন্য ঘোর আপত্তি জানানো রক্তিম এখন এভাবে তার ছেলেদের আকুতি জানাচ্ছে তাকে ঐ বাড়ি দিয়ে আসতে। জাবির লক্ষ্য করে রক্তিমের শরীরটাও কেমন ভঙ্গুর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে নিস্তেজ হয়ে এখনই লুটিয়ে পরবে মাটিতে। আর এক মুহূর্ত দেরি করেনা জাবির। শান্তকে ইশারায় কিছু একটা বুঝিয়ে রক্তিমের বাইকে ওঠে বসে। বলে,

“আপনার শরীর খারাপ মনে হচ্ছে ভাই। এমন অবস্থায় বাইক চালাতে পারবেন না। পিছনে বসুন আমি দিয়ে আসছি।”

অস্থির রক্তিম কন্ঠে দ্বিগুণ অস্থিরতা ঢেলে বলে ওঠে,

“আমি একা গেলে হবেনা। তোরা একটা কাজ কর। দ্রুত একটা সিএনজি নিয়ে আমার বাড়ি থেকে ঐ মেয়েটাকে নিয়ে আয়। ততক্ষণ আমি এখানে থাকি।”

“কোন মেয়ে ভাই?”

যদিও দলের সকলেই এতোদিনে জেনে গেছে রক্তিমের বিয়ের খবর। রক্তিমের কথায় এটাও আন্দাজ করে নিয়েছে সে তার স্ত্রীকেই নিয়ে আসতে বলছে। কিন্তু তবুও রাকিবের কৌতূহলী মন ফট করেই প্রশ্নটা করে ফেলে। একেতো অপেক্ষা আর সহ্য হচ্ছেনা রক্তিমের। ইচ্ছে হচ্ছে একছুটে মায়ের কাছে চলে যেতে। এদিকে অনুভূতির জাতাকলে পৃষ্ঠ হয়ে মন, শরীর দুটোই অবশ হয়ে আছে। এর মাঝে আবার রাকিবের প্রশ্নটা যেন সহ্য হয়না রক্তিমের। মনে হয় প্রশ্নটা করে তার অপেক্ষার প্রহর আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সাথে সাথেই ব্যকুল চোখ দুটোতে কাঠিন্যতা ঢেলে শক্ত কন্ঠে বলে,

“আর একটা প্রশ্ন করলে তোর জ্বিভ টেনে ছিড়ে ফেলব। আমার ঘরে কয়টা মেয়ে মানুষের বসবাস? যেটাকে পাবি ঐটাকেই নিয়ে আসবি। দ্রুত যা।”

পরিস্থিতি অনুকূলে বুঝতে পেরে রাকিব আর একটুও দেরি করেনা। তৎক্ষণাৎ ছুটে যায় মেইন রোডের কাছে। একটা সিএনজি ঠিক করে পাঁচ মিনিটের মাথায় উপস্থিত হয় রক্তিমের পরিত্যক্ত প্রায় বাড়িতে। দ্রুত পদে সিএনজি থেকে নেমে দরজায় কড়াঘাত করে। টুকটাক কাজ সেড়ে দৃষ্টি মাত্রই একটা বই নিয়ে বসেছিল। সাত কলেজের পরীক্ষার আর বেশি দিন নেই। পাবলিক ভার্সিটি হারিয়েছে। বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে রক্তিমের বউ হয়ে এসেছে। মেয়ের থেকে একের পর এক আঘাত পেয়ে মা-বাবা নিশ্চয়ই বড্ড রুষ্ঠ তার প্রতি। এই পরিস্থিতিতে তাদের মন জয় করার একটাই উপায়। বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত যেকোন একটা কলেজে নিজের জন্য স্থান করে নিতেই হবে। এতে অন্তত একটু হলেও তার প্রতি সন্তুষ্ট হবে বাবা-মা। সেই চিন্তা মাথায় রেখেই রক্তিমের মন জয় করার পাশাপাশি নিজেকে সম্পূর্ণ রুপে প্রস্তুত করে নিচ্ছে সাত কলেজের ভর্তি যুদ্ধের জন্য।

বইয়ের মাঝে ডুবে থাকা দৃষ্টি হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত পড়ায় চমকে ওঠে। সাথে একটু চিন্তিত হয়। এই সময় তো রক্তিম বাড়িতে ফেরার কথা না। সেই রাত বারোটা-একটার আগে এভাবে দুয়ারে কে হানা দিতে পারে! কিছুটা চিন্তিত হয়েই ওঠে দাড়ায় দৃষ্টি। গলার স্বর উঁচু করে জানতে চায়,

“কে?” সাথে সাথে অধৈর্য রাকিব জবাব দেয়।

“ভাইয়ের লোক আমি রাকিব। দরজা খুলেন ভাবি। ভাই বলেছে দ্রুত আপনি নিয়ে যেতে।”

রাকিবের গলার স্বরেই তাকে চিনে নেয় দৃষ্টি। অসময়ে চামচাটার আগমনে মেজাজটাও খিঁচিয়ে ওঠে। তপ্ত মেজাজে লাফিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। তৎপরতার সাথে খিল খুলে বলে,

“ঐ চামচার বাচ্চা চামচা। এখানে কি চায় হ্যাঁ?”

দৃষ্টির কথা রাকিবের কর্ণগোচর হবার সুযোগ পায়না। তার আগেই দৃষ্টিকে দেখে অত্যধিক বিস্ময়ে হা হয়ে যায় রাকিবের মুখ। চোখ দুটো বড় বড় মার্বেল আকৃতি ধারণ করে কুঠোর ছেড়ে বেড়িয়ে আসার উপক্রম হয়। ভাই বিয়ে করেছে জানত। কিন্তু শেষ মেষ এই মেয়েকে! যাকে কি না প্রথম দিনই গলা চেপে ধরে দুনিয়া থেকে টাটা বাই বাই করে দিতে চেয়েছিল সেই মেয়েকে কিভাবে ভাই বিয়ে করে ঘরে তুলল? এ তো অন্যায়। ছোটখাট কোনো অন্যায় না। মহা অন্যায়। মেয়েটার প্রতি ভাইয়ের বিতৃষ্ণা দেখেই তো রাকিব মনে মনে ভেবে রেখেছিল একে তার চৌদ্দ নাম্বার গার্লফ্রেন্ড বানাবে। সেই চিন্তা বাস্তবায়ন করার জন্যই তো ঐদিন সমাবেশে আড়ালে ডেকে দৃষ্টিকে পটানোর চেষ্টাও করেছিল। আর আজ কি না ভাই তার বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দেবার মতো এতো বড় অন্যায়টা করল! এ অন্যায় কিভাবে মেনে নিবে রাকিব?

চলবে…….

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৪ (শেষ অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

রাকিবকে দুঃখি দুঃখি ভাব নিয়ে তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে চটে যায় দৃষ্টি। চোখ পাকিয়ে মেজাজ দেখিয়ে বলে,

“সাহস কত! রক্তিম শিকদারের বউয়ের দিকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে ! চোখ সরান বলছি এক্ষুণি। নইলে কিন্তু ঐ চোখ তুলে কুতকুত খেলব আমি।”

তৎক্ষণাৎ রাকিবের ফাঁকা ঠোঁট দুটো একটা আরেকটার সাথে চেপে যায়। ঘনঘন পলক ঝাপটে অসহায় কন্ঠে বলে,

“এইটা কিছু হইলো সুন্দরী? তুমি এইভাবে আমারে ছ্যাকা না দিলেও পারতা।”

তার এহেন সাহস দেখে ভড়কে যায় দৃষ্টি। সে বর্তমানে রক্তিম শিকদারের বউ। এটা জানার পরও কিভাবে এই চামচা তাকে সুন্দরী ডাকে? এর একটা বিহিত আজকে করতেই হবে। দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“চামচার বাচ্চা চামচা! পিঁপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে, কথাটা শুনেছেন তো! যদি বিয়েশাদী করার আগেই মরার শখ না জাগে তবে আজকের পর যেন কখনো আমাকে ঐ নামে ডাকা না হয়। সুন্দর ভাবে, ভদ্রভাবে ভাবি ডাকবেন আমাকে। না না, শুধু ভাবি ডাকলে হবেনা। ভাবির সাথে মা যোগ করে ভাবিমা ডাকতে হবে। এখনই একবার ভাবিমা ডাকুন। দ্রুত।”

মুখ বাঁকায় রাকিব। তাচ্ছিল্যতার সাথে বলে,

“অ্যাহ্! আসছে ভাবিমা! শখের তুলা আশি টাকা না?এই রাকিব মরতে স্বীকার তবুও তোমার মতো সুন্দরীরে ভাবি ডাকতে স্বীকার না। সেখানে কি না ভাবিমা! নাউজুবিল্লাহ, আস্তাগফেরুল্লাহ।”

তার এহেন কথায় রাগে যেন এবার দিশাহারা দৃষ্টি। গরম চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে জানতে চায়,

“ডাকবেন না ভাবিমা?”

“কখনোই না।”

“এই শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, ডাকবেন না ভাবিমা?”

এবারও অস্বীকার যায় রাকিব। দৃষ্টি সাথে সাথে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে বারান্দায় যে পাশে রান্নার সামগ্রী সাজিয়ে রেখেছে সেখানে চলে যায়। কাটাকুটির জন্য মাঝারি সাইজের একটা বটি এনেছিল ঐদিন বাজার থেকে। সেটা হাতে নিয়ে খ্যাপা বাঘিনীর মতো তড়িৎ বেগে ছুটে আসে রাকিবের কাছে। চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

“তবে মর আজকে এই সুন্দরীর হাতে। ভালোই ভালোই বলছিলাম কথা কানে নিলিনা। এবার জান দিয়ে কর্মফল ভোগ কর।”

হতভম্ব রাকিব দৃষ্টির আচানক আক্রমণাত্মক রূপ দেখে ঘাবড়ে যায়। লাফিয়ে সোজা ঘরের সীমানা ছেড়ে বেরিয়ে যায়। দৌড়ের সাথে তুতলিয়ে বলে,

“এ কেমন সর্বনাশা কান্ড। সুন্দ.. থুক্কু ভাবিমা! মেহেরবানী করিয়া হাত থেকে ঐটা রাখেন। আপনি খুন করে জেলে গেলে আমার ভাইকে সন্নাস জীবন পাড় করতে হবে। শুধু আপনি কেন? আজ থেকে পৃথিবীর সকল সুন্দরী আমার মা। কালো গুলোর থেকে যেকোন একটা আমার বউ। এবার হাত থেকে ঐটা সরান।”

রাকিবের কথা শেষ হবার আগেই পকেটে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে। খ্যাপা বাঘিনীর সামনে দাঁড়িয়ে ফোন রিসিভ করে কথা বলার সাহস হয়না তার। বাড়ির ছোট্ট উঠোন পেরিয়ে গেটের বাইরে গিয়ে সিএনজিতে বসে বুকে হাত দিয়ে কতক্ষণ বিরবির করে বলে,

“এ কেমন বউ রে ভাই! যেমন খ্যাপা গুন্ডা শিকদার তেমন তার খ্যাপা বাঘিনী। একেবারে খাপে খাপ, মর্জিনার বাপ।”

মুখ গোল করে কতক্ষণ লম্বা শ্বাস টানে। মস্তিষ্ক শান্ত হতেই তৎপর হয়ে পকেট থেকে ফোন হাতে নেয়। রিসিভ করে কানে ধরতেই ঐপাশ থেকে ভেসে আসে রক্তিমের গালির বর্ষণ। চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে ধেয়ে আসা একের পর এক গালি হজম করে নেয় রাকিব। দ্বিতীয়বার ঐ বাঘিনীর সামনে যাবার সাহস না থাকাই রক্তিমকেই সাহস যুগিয়ে বলে,

“কি একটা মাইয়ারে বিয়া কইরা ঘরে তুলছেন ভাই! মাইয়া তো না পুরাই বোম্বাই মরিচ। আপনার ঐ বোম্বাই মরিচ আপনি আইসা নিয়া যান। আমার দ্বারা সম্ভব না। মাফ করেন।”

কথাটুকু শেষ করে তৎক্ষণাৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে একেবারে ফোন অফ করে রাখে রাকিব। সিএনজি ড্রাইভারকে নিজের বাসার ঠিকানা দিয়ে শরীর ছেড়ে সিটে বসে চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এক দিকে বউ বটি হাতে জান নিতে তাড়া করছে। অপরদিকে স্বামী বাংলা গালিতে কান পচিঁয়েছে। কি ভয়ানক পরিস্থিতি! বাপের জন্মে মনে হয় আগে কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়নি।গোল্লায় যাক সব কিছু। আজকের ঘটনা যতদিন পর্যন্ত রাকিবের মন-মস্তিষ্কে থেকে যাবে ততদিন পযর্ন্ত এই বাঘ, বাঘিনীর সামনে পরবেনা সে। প্রয়োজনে হাতে চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকবে। তবুও এদের সামনে পরবেনা। কি সাংঘাতিক বাবা রে বাবা! একটুর জন্য তার জানটা বেঁচে গেল।

****
রাকিব বিদায় নেবার কতক্ষণ পরই উদ্ভ্রান্তের মতো বাড়ি এসে উপস্থিত হয় রক্তিম। তার এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় দৃষ্টি। উৎসুক হয়ে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় দৃষ্টির কোমল হাতটা আকড়ে ধরে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যায় বাড়ির সীমানা ছেড়ে। হতবম্ভ দৃষ্টি মনের প্রশ্ন মনেই চেপে রাখে। রক্তিমের এমন বেহাল অবস্থা দেখে চিন্তার পাশাপাশি তার আচমকা অধিকার খাটানো স্পর্শে দৃষ্টির মন জমিনে সৃষ্টি হয় অনুভূতির আন্দোলন। একদিকে হঠাৎ স্পর্শে হৃদয়ের উচাটন, অন্যদিকে চিন্তা। দুইয়ে মিলে স্তব্ধ দৃষ্টি।

বাহারি রঙের ঝলমলে আলোয় সজ্জিত শিকদার বাড়ি। চারিদিকে উৎসব মুখোর আমেজ। বিয়ের পর এই প্রথম স্বামীর হাত ধরে শশুড়ালয়ে পা রাখল দৃষ্টি। এ যেন সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে এক অন্যরকম অনুভূতি। যে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা দৃষ্টির ক্ষেত্রে কষ্টসাধ্য। দৃষ্টির হাত নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় বন্দি রেখেই লম্বা কদমে সদর দরজা ডিঙিয়ে হলরুমে উপস্থিত হয় রক্তিম। চারিদিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেসব কিছুই যেন ঢুকছেনা তার মস্তিষ্কে। মমতাময়ী মায়ের সন্ধানে ছটফট করছে তৃষ্ণার্ত চোখ দুটোর কুচকুচে কালো মণি। কাঠিন্যতার খোলস ভেঙ্গে বাচ্চাসুলভ হৃদয়টা ব্যকুল হয়ে আছে মায়ের ভালোবাসার ছোট্ট একটা স্পর্শে স্বর্গীয় সুখ পাবার লোভে। রক্তিমের আকুল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একসময় চোখের সামনে স্পষ্ট হয় মায়ের আদল। এক পলক মা’কে দেখেই তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে মাথা ঝুঁকিয়ে নেয় রক্তিম। আলগা হয় হাতের বাঁধন। নিজের শক্ত হাতের মুঠো থেকে মুক্তি দেয় দৃষ্টির নরম হাতটা। অবাক হয় দৃষ্টি। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের নত মুখের দিকে। রক্তিম আসার খবর পেয়ে এতোক্ষনে শিকদার বাড়ির সকল আত্মীয়-স্বজন ভীড় জমিয়েছে ড্রয়িং রুমে। যে রক্তিম শিকদার সর্বদা বুক ফুরিয়ে কঠোর চিত্তে মাথা উচিঁয়ে ঘুরে বেড়ায়। আজ সেই রক্তিম শিকদার মায়ের সামনে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কোনো এক বাচ্চা বড়সড় কোনো ভুল করে মায়ের সামনে অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে। এমন এক অকল্পনীয় দৃশ্য দেখার পর কারো চোখ স্বাভাবিক থাকতে পারে? অত্যধিক আশ্চর্যিত ভঙ্গিতে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ দৃষ্টিতে অঘাত বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে মা-ছেলের দিকে।

কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে বিয়ে বাড়ি একদম নিশ্চুপ। দুরু দুরু বুকে মায়ের দিকে এগিয়ে যায় ইতি। কাধে হাত রেখে চাপা স্বরে বলে,

“তোমার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে মা। শুধুমাত্র তোমার একটা ডাকের অপেক্ষায়। আর দূরে সরিয়ে দিয়োনা। সমস্ত মান-অভিমান ভুলে কাছে টেনে নাও প্লিজ!”

রেহানা বেগম নিরব মূর্তিমান দাঁড়িয়ে। মৌনতা ভেঙ্গে কন্ঠলানী দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারিত হয়না। অপলক তাকিয়ে শুধু দেখে যায় নত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা সন্তানকে। যে সন্তান তাকে প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ বুঝিয়েছে। আদো আদো কন্ঠে মা ডেকে মন, প্রাণ জুড়িয়েছে। স্বার্থক করেছে নারীসত্তাকে। সেই প্রথম সন্তান যে সন্তান নিজের ছোঁয়ায় পূর্ণ করেছে নারীসত্তাকে,সেই আদরের টুকরোটাকে এতোদিন পযর্ন্ত বাড়ি ছাড়া রেখেছে রেহানা বেগম। একটা ভুলের শাস্তিস্বরুপ মায়ের কোল থেকে তাড়িয়ে বানিয়ে দিয়েছে এক ছন্নছাড়া পথিক। মা হয়ে সে কিভাবে পেরেছিল প্রথম সন্তানের প্রতি এতো কঠোর হতে?পথভ্রষ্ট করে এলাকার গুন্ডা, মাস্তানে পরিণতি করেছে আদরের সন্তানকে। এ যন্ত্রণা যে এতোদিন পর বড্ড পুড়াচ্ছে রেহানা বেগমকে। সন্তান শত অন্যায় কাজ করলেও কি কখনো কোনো মা পারে এভাবে দূরে সরিয়ে দিতে? রেহানা বেগমের মাতৃহৃদয় তো এতো কঠোর ছিলনা। তবে কিভাবে এতো বড় অন্যায় করে বসল নিজের সন্তানের প্রতি! ছেলেকে এভাবে অবহেলায় পথভ্রষ্ট করে সে নিজেও তো বর্তমানে এক অপরাধী নিজের বিবেকের কাছে। এ বিবেক কেন আগে জাগ্রত হয়নি? নির্দ্ধিধায় এতো বড় অন্যায় করার পরই কেন আজ এতোদিন পর উপলব্ধি হচ্ছে তা? নিজের বিবেকের কাছে নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ আজ রেহানা বেগম। সাহস হচ্ছেনা মায়ের দাবী নিয়ে রক্তিমের সামনে দাঁড়াতে। তবে না দাঁড়িয়েও যে উপায় নেই। বিবেক জাগ্রত হবার পরও কিভাবে পারবে ছেলেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। মায়ের মনটাও যে আর বাঁধা মানছেনা। সমস্ত দ্বিধা,জড়তা কাটিয়ে ইচ্ছে করছে সন্তানকে কাছে টানতে। রেহানা বেগমের কোমল মাতৃহৃদয় যখন দ্বিধা, জড়তা, অপরাধবোধে পৃষ্ঠ হয়ে ব্যর্থ সন্তানকে বুকে টেনে নিতে। তখনই উন্মোচন হয় অভিমানী মাতৃসত্তা। কান্নার ঢোক গিলে অভিমানে ঠাসা দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“আমি না হয় পাগল-মাথা নষ্ট, বিবেকহীন হয়ে মায়া মমতা সব ভুলে গিয়েছিলাম। তাই বলে তুই ও সব ভুলে যাবি? এই শিক্ষা দিয়ে তিলে তিলে বড় করেছি তোকে? আমার জানা মতে কোনো সন্তানকেই তো আমি কঠোর হবার শিক্ষা দেইনি। সন্তান যাতে কোমল হৃদয়ের অধিকারী হয় সেজন্য নিজের সমস্ত মায়া, মমতা ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে বড় করেছি। তবে কেন আমার একটু কঠোরতা দেখে তুই তার দ্বিগুণ ফিরিয়ে দিয়েছিস? কেন আমি বকলেই দূরে সরে যেতে হবে তোকে? কেন পারিস নি মায়া দেখিয়ে আমাকে মানিয়ে নিতে? একবার আমাকে জড়িয়ে ধরে মা বলে ডাকলে কি পারতাম এতোটা পাষাণ হতে? এতো বড় হবার পরও মা’কে কিভাবে মানাতে হয় সেটা জানলিনা। জানলি শুধু মা’কে কিভাবে সমাজের চোখে অপরাধী বানিয়ে রাখতে হয়। অপদার্থ কোথাকার!”

প্রতিবারের মতো এবারও মায়ের অভিযোগের তীরে বিদ্ধ রক্তিম। তবে এবারের অভিযোগ গুলো হৃদয়ে একটুও রক্তক্ষরণ ঘটায়নি। বরং মনে হচ্ছে হঠাৎ যেন লিলুয়া বাতাস মাতাল হাওয়ায় রূপবদল করেছে। সেই এক দলা মাতাল হাওয়া হৃদয় ছুঁয়ে ধীকধীক জ্বলতে থাকা অগ্নিশিখা ধপ করেই নিভিয়ে দিয়ে গেছে। স্বস্তির অনুভূতিতে জুড়িয়ে গেছে খরাপ্রবণ মন জমিন। এবার শুধু মায়ের মমতার পরশে সেই খরা প্রবণ মন জমিনে ঝুমঝুমিয়ে শীতল বর্ষণ নামার পালা। যে বর্ষণে হৃদয় কুটিতে জমে থাকা দগদগে ক্ষত পরিষ্কার হয়ে নতুন উদ্যোমে নেমে আসবে একরাশ স্নিগ্ধতা।

রক্তিমকে আগের মতো নত মস্তকে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাহস করে দৃষ্টি রক্তিমের একটা হাত আকড়ে ধরে। উদ্যোমী স্বরে বলে,

“সময় এসেছে ভুল-ভ্রান্তি সুধরে নিয়ে নতুন করে পথ চলার। নিজেকে এবার অন্ধকার থেকে বের করে আনুন। মা-বাবার কাছে সন্তান কখনো বড় হয়না। এগিয়ে যান মায়ের কাছে। মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন। উগলে দিন ভিতরে জমে থাকা সবটুকু কষ্ট। মাথা তুলে তাকান। দেখুন ঐ মানুষটা চোখে-মুখে কত আকুতি নিয়ে তাকিয়ে আছে। একটাবার মা বলে ডেকে দেখুন। সব ভুলে আপনাকে নিজের কোলে ঠাই দিবে। মায়ের কাছে সন্তান কখনো খারাপ হয়না। মায়েরা উদার হয়। তারা কখনো সন্তানের ভুল মনে রেখে আজীবন সন্তানের থেকে দূরে থাকতে পারেনা।”

থমথমে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে সকলের মাঝে। উপস্থিত প্রত্যেকে মৌনতা বজায় রেখে মুখিয়ে আছে মা-ছেলের মিলন মুহূর্ত দেখার অপেক্ষায়। একটু একটু করে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারাচ্ছে রক্তিম। শরীরটা একেবারে ভেঙ্গে আসছে। বন্ধ চোখ জোড়া কেমন জ্বারাপোড়া করছে। মনে হচ্ছে চোখ মেলে তাকালেই ফেঁটে রক্ত গড়িয়ে পরবে। মাথাটাও ঝিমিয়ে আছে। দাঁতে দাঁত পিষে টলতে টলতে মায়ের দিকে এগিয়ে যায় রক্তিম। কান্না গুলো জমাট বেঁধে লাল হয়ে ওঠা চোখ দুটো মেলে তাকায় মায়ের দিকে। সাথে সাথে টুপটাপ দুচোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পরে দু-ফোঁটা নোনাজল। পাষাণ রক্তিমের চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে! বিষয়টা দৃষ্টিগোচর হতেই এক প্রকার হোচট খায় উপস্থিত সকলেই। সেদিকে রক্তিমের কোনো ধ্যান নেই। হাঁটু মুড়িয়ে ধপ করে বসে পরে মায়ের সামনে। নিজের দুহাতের মাঝে মায়ের হাত দুটো যত্ন করে তুলে নিয়ে কপালে ঠেকায়। কাঁপা স্বরে বলে,

“জানি আমি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। তবুও পারলে এই পাপী সন্তানকে ক্ষমা করে দিও। সন্তান ভেবে বুকে টেনে নিতে হবেনা। শুধু একটু দয়া দেখিয়ে ক্ষমা করে আমাকে স্বস্থির নিঃশ্বাস নিতে দাও। আর কোনো অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিওনা আমার উপর। হাজারটা অপরাধের ভারে এখন আমি ম্রিয়মাণ। হাঁপিয়ে গেছি। হারিয়ে ফেলেছি সহ্যক্ষমতা। এতোদিনের কঠোরতার খোলসে আবৃত আমিটা আজ খোলস ছেড়ে বড্ড নাজুক। একটু করুনা করো আমাকে। বাঁচতে দাও অপরাধবোধ থেকে। মুক্তি দাও আত্মগ্লানি থেকে। যদি ক্ষমা না পাই, প্রতিটা প্রহর বেঁচে থেকেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে আমায়। জীবন্ত লাশ হয়ে আর বাঁচার ক্ষমতা নেই আমার। হয় সুস্থ্যভাবে বাঁচতে দাও। না হয় একেবারে গলা টিপে মেরে ফেলো। তবুও মুক্তি দাও।”

ছেলের করুন আহাজারি আর চোখের অশ্রু এলোমেলো করে দেয় রেহানা বেগমকে। বক্ষদেশে সৃষ্টি হয় তোলপাড়। বিমূঢ় দৃষ্টিতে কতক্ষণ পায়ের কাছে লুটিয়ে থাকা ভঙ্গুর রক্তিমের দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকায় নিজেও বসে পরে মেঝেতে। পাগলপ্রায় হয়ে জাপ্টে ধরে রক্তিমের মাথাটা বুকে টেনে। সহসা পুরো বাড়ি কেঁপে ওঠে এক মায়ের করুন চিৎকারে। মায়ের কান্নায় পাথর হৃদয়ের রক্তিম নিজেও বাচ্চাদের মতো মা’কে ঝাপটে ধরে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ওঠে। এক তৃষ্ণার্ত মা-ছেলের মহামিলনের সাক্ষী উপস্থিত প্রতিটা মানুষের চোখের কোণেও জল জমে। শান্তিপ্রিয় আজীজ শিকদারের চোখের কোণেও আজ অশ্রু। তবে তা ব্যর্থতার নয়। অদম্য খুশি গুলো আজ যেন সকলের চোখ বেয়ে কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। রেহানা বেগমের গগনবিদারী চিৎকার যেন পুরো পৃথিবীকে জানান দিতে চাইছে, তোমরা দেখো। আমার ছেলে আজ আমার বুকে ফিরে এসেছে। শেষ হয়েছে মা-ছেলের নিরব যুদ্ধ, মান-অভিমানের পালা। মমতাময়ী মায়ের পরশে পাষাণতুল্য রক্তিমের চোখ দুটোও আজ সিক্ত। মায়ের আদুরে পরশে তৃপ্ত মৃতপ্রায় হৃদয় জমিন।

চলবে…..

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৫
#আদওয়া_ইবশার

নিকশ কালো অন্ধকারের বলয় কেটে প্রকৃতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে মিঠা রোদ্দুর। শীতের প্রকট আজ ক্ষীণ। সকাল হতেই হইচই শুরু হয়ে গেছে শিকদার বাড়িতে। বহুদিন পর মৃতপ্রায় বাড়িটা যেন আজ প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আনন্দধারা উপচে পরছে চারিপাশে। দিন শেষে রাত পাড় হলেই বাড়ির ছোট মেয়ের বিয়ে। মায়ের জাদুর পরশে ছন্নছাড়া রক্তিম আজ নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। আদরের ছোট বোনের বিয়ের দায়িত্ব মহানন্দে তুলে নিয়েছে নিজ কাধে। মেহমান থেকে শুরু করে বাড়ির প্রতিটা মানুষের নাস্তা করা শেষ। বাকী শুধু রক্তিম আর দৃষ্টি। ঘুম থেকে ওঠার পর এখন পযর্ন্ত দৃষ্টি তার পাষাণ পুরুষের দেখা পায়নি। মহারাজ আজ মনে হচ্ছে একদিনেই নিজের দায়িত্ব সব পালন করে ফেলবে। ঘরে যে তার নতুন বউ একা সেদিকে একটুও খেয়াল নেই। তার খেয়াল ছিলই বা কবে? সেই তো প্রথম দিন থেকেই পাষান্ডটা দৃষ্টির প্রতি উদাসীন। তবুও দৃষ্টির অবচেতন লোভী মন ভেবেছিল গত রাতের ঘটনার পর রক্তিম বুঝি মা-বাবা, বোনদের পাশাপাশি বউকেও আপন করে নিবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। দৃষ্টিকে আরও একবার হতাশার সাগরে ডুবিয়ে রক্তিম দেদারসে নিজের বোনের বিয়ের কাজকর্মে মশগুল। এদিকে বাড়ি ভর্তি মেহমানদের সামনে দৃষ্টি যেন এক ঘরে তোলা নতুন শো-পিস। যার বিয়ে তার দিকে নজর না দিয়ে মানুষজন সকলেই তাকে নিয়ে পরেছে। বউ কালো না সুন্দর, খাটো না লম্বা, চুল কেমন, হাত-পায়ের নখ কেমন এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেউ নতুন বউয়ের রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আবার কেউ কেউ রক্তিমের প্রথম স্ত্রী জেরিনের সাথে তুলনা করে দৃষ্টিকে নাকাল বানাতে উদগ্রীব। অনেকেই আবার যা ঘটেছিল তার সাথে আরও রংচং মাখিয়ে অতি উৎসাহের সাথে বউকে জানাচ্ছে তার স্বামী প্রথম স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসতো। জেরিন নামক মেয়েটার প্রেমে কতটা পাগল ছিল রক্তিম। দৃষ্টির অবুঝ মনটাকে জেরিন সম্পর্কিত এক একটা কথা যে কতটা ক্ষতবীক্ষত করছে তা যদি কেউ দেখত তবে হয়তো ঐসব পুরোনো কাসুন্দি ঘাটার সাহস করতনা। সে মুখে যতই বলোক রক্তিমের অতীত নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই তার। দিন শেষে আজ সেই অতীতের গল্প শুনে তবুও ভালোবাসার কাঙ্গাল হৃদয়টাতে অসহনীয় ব্যথার সৃষ্টি হচ্ছে। না পারছে নিজের স্বামী কেন্দ্রিক ঐসব রসালো প্রেমগাথা অতীত কথন সহ্য করতে। আর না পারছে কারো মুখের উপর কিছু বলতে।

দৃষ্টিকে এই অসহনীয় পীড়া থেকে রক্ষা করতেই বোধহয় একসময় রেহানা বেগম উপস্থিত হয়। কারো দিকে না তাকিয়ে দৃষ্টির বাহু আকড়ে ধরে বসা থেকে উঠিয়ে তাড়া দিয়ে বলে,

“গল্প করার সময় অনেক পাবে। সকাল পেরিয়ে দুপুর হচ্ছে। এখনো না খেয়ে আছো। নিচে চলো। রক্তিম এসেছে, তার সাথে নাস্তাটা করে নাও।”

শাশুড়ির আগমনে দৃষ্টি যেন হাপ ছেড়ে বাঁচে। দ্রুত পা চালিয়ে শাশুড়ির পিছন পিছন বেরিয়ে যায়। ডাইনিং টেবিলে একমনে নিচে তাকিয়ে রক্তিম খেতে ব্যস্ত। তার ঠিক পাশের চেয়ারটাতেই দৃষ্টিকে বসিয়ে দেয় রেহানা বেগম। একটা প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলে,

“একদম লজ্জা করবেনা। পেট ভরে খেয়ে ওঠবে। সাথে আমার ছেলের যা লাগে তাও এগিয়ে দিবে। কে কি বলল না বলল এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমার ছেলেকে নিয়ে আর নিজেকে নিয়ে ভাবো শুধু। মনে করো তোমরা দুজন ছাড়া তোমার আশেপাশের সব অদৃশ্য। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের কাজই হলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তিলকে তাল বানিয়ে এটা সেটা বলে সংসারে আগুন লাগানো। ওদের কথায় কান দিবেনা একদম।”

মায়ের কথায় খাওয়া থামিয়ে চিন্তিত মুখে মাথা তুলে তাকায় রক্তিম। ভরাট কন্ঠে জানতে চায়,

“কি হয়েছে মা?”

“কি আর হবে? বিয়ে করে বউ ঘরে তোলে দায়িত্বজ্ঞান হীনের পরিচয় দিচ্ছিস যে, তাই পাড়া-প্রতিবেশী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।”

কথা কাটিয়ে রেহানা বেগম তাড়াহুড়ো করে এটুকু বলেই প্রস্থান করে সেখান থেকে। নিজ থেকে এসে রক্তিমের কাধে বসা দৃষ্টি নামক আস্ত এক মাথা ব্যথা কেন্দ্রিক কথায় বিরক্ত হয় রক্তিম। তবে প্রকাশ করেনা তা। মায়ের স্বাভাবিক আচরণে বিরক্তি ভাবটাও খুব দ্রুতই কেটে যায়। আবারও পুরো মনযোগ দেয় খাবারে। দৃষ্টি সেদিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। শাশুড়ির বোঝপূর্ণ কথায় মনটা যতটা হালকা হয়েছিল তার থেকেও দ্বিগুণ বিষাদ হানা দেয় রক্তিমের নির্লিপ্ততায়। চোখ দুটো সিক্ত হয় অশ্রুজলে। কথা বলতে গিয়ে টের পায় কাঁপন ধরেছে কন্ঠনালীতে। ঠোঁট কামড়ে ঢোক গিলে গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকা কান্নাটাকে গিলে নেয় দৃষ্টি। কন্ঠে অসহায়ত্ব নিয়ে জানতে চায়,

“আমার কি আপনার স্ত্রী হবার একটুও যোগ্যতা নেই? আপনার প্রথম স্ত্রী জেরিন, সে কি আমার থেকেও অত্যধিক সুন্দরী ছিল? রূপে, গুণে সব দিক থেকেই কি আমি তার থেকে পিছিয়ে?”

রুটি ছিঁড়তে গিয়ে তৎক্ষণাৎ রক্তিমের হাত দুটো থেমে যায়। মুখে থাকা অবশিষ্ট খাবারটুকুও আর গলা দিয়ে নামেনা। শান্ত চোখে তাকায় দৃষ্টির দিকে। স্বভাবজাত গম্ভীর কন্ঠে বলে,

“আজ প্রথমবার শুনেছি তাই কিছু বললাম না। দ্বিতীয়বার যদি আমার অতীত নিয়ে কোনো প্রশ্ন করার সাহস করেছিস তোর জ্বিভ টেনে ছিঁড়ে কুকুরের খোরাক বানাবো।”

অত্যধিক শীতল কন্ঠের এমন ঠান্ডা হুমকিতে কিছুটা কেঁপে ওঠে দৃষ্টি। রক্তিমের থেকে নজর সরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। নিজেকে সামলাতে গিয়েও হিমশিম খায় রক্তিম। দৃষ্টির মুখে হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে পায়ের রক্ত যেন মাথায় ওঠে যায়। রাগে কিড়মিড়িয়ে শতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে ডাইনিং একদম ফাঁকা বুঝতে পেরে খাঁমচে ধরে দৃষ্টির বাহু। তড়িৎ ভয়ে চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নেয় দৃষ্টি। ক্রোধান্বিত হয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে রক্তিম,

“কেন এসেছিস আমার জীবনে? যেটুকু সুখে আছি সেটাও কেড়ে নিতে? আমি তো এমনিতেই মৃতপ্রায়। আর কি মারবি আমাকে? কি সুখ কেড়ে নিঃস্ব করবি আমাকে? বিশ্বাস কর, আমি এমনিতেই নিঃস্ব। তোকে দেওয়ার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই আমার। টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ কিছুই নেই। যে ভালোবাসার দোহাই দিয়ে জুড়েছিস আমার জীবনে। সেই ভালোবাসা বোঝার জন্য যে একটা মন লাগে সেই মনটাও নেই। তবে কেন শুধু শুধু আমার জীবনে এসেছিস? সব জেনে বুঝে এসেছিস যখন, তো কেন আজ ঐসব অতীত নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস? এখনো সময় আছে, চলে যা আমার জীবন থেকে। বিশ্বাস কর বেঁচে যাবি। আমার থেকেও হাজার গুণ ভালো ছেলে পাবি। যে তোকে ভালোবাসা দিতে পারবে, বিলাসীতা দিতে পারবে সর্বোপুরি সুখে রাখতে পারবে। আমার জীবনে থাকলে দুঃখ ছাড়া কিছুই পাবিনা। আমার মাথা একদম ঠিক নেই। আমি পাগল। বদ্ধ উন্মাদ আমি। মাথা বিগড়ে গেলে তোকে মেরেও ফেলতে পারি। জীবনের মায়া থাকলে চলে যা। বেঁচে যাবি। সুখেও থাকবি।”

বেপরোয়া ভঙ্গিতে কথা গুলো বলে ঝড়ের গতিতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় রক্তিম। দুঃখের সাগরে ডুবিয়ে রেখে যায় দৃষ্টিকে। ভালোবাসায় টইটুম্বর এক অষ্টাদশীর হৃদয়ে সৃষ্টি করে যায় কাল বৈশাখী ঝড়। যে ঝড়ে নড়বড়ে হয় দৃষ্টির বুকে জমে থাকা স্বপ্ন। রক্তিম নামক এক পাষাণ পুরুষের সাথে সুখের সংসার গড়ার স্বপ্ন।

****
রক্তিমের বুকে সৃষ্ট দগদগে ঘায়ে সবে অল্প প্রলেপ পরেছিল। মুহূর্ত ব্যবধানে সেই ঘা অজান্তেই দৃষ্টি আবার খুঁচিয়ে তাজা করে দিল। জীবনটাকে অল্প-স্বল্প গোছানোর প্রস্তুতি নেওয়া রক্তিমকে আবারও পথভ্রষ্ট করে দিল। এলোমেলো করে দিল মন-মস্তিষ্ক। বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিরিবিলি এক কাঁঠাল বাগের ভিতরে গিয়ে গাছের গুড়ায় বসে পরে রক্তিম। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সর্বশক্তি দিয়ে টেনে ধরে নিজের চুল। বুকের ভিতরে সদ্য তাজা হওয়া ঘায়ের জ্বলনে অশান্ত হয় বক্ষ পিঞ্জর। ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাওয়া হৃদয়টা সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ জানায়, কেন তার জীবনটা এমন এক কালো আধারে ডুবে গেল? কি এমন জঘণ্য অন্যায় করেছিল সে, যে অন্যায়ের শাস্তি স্বরুপ পুরো জীবনটা এলোমেলো হলো তার! অন্যায় কথাটা স্বরণ হতেই থমকে যায় রক্তিম। শরীর ছেড়ে গাছের সাথে হেলান দিয়ে ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,

“অন্যায় তো করেছিই আমি। ভালোবাসার মতো মস্ত বড় অন্যায়। এ অন্যায়ের শাস্তি তো এখন ভোগ করতেই হবে। যে হৃদয় ভালোবেসে মহা পাপ করেছে সে হৃদয় তো পুড়বেই। মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত তাকে পুড়তে হবেই।”

অসাঢ় মস্তিষ্ক। নিস্তেজ শরীর। ক্লান্ত হয়ে গেছে ভাবনারাও। বুঝে গেছে রক্তিম সুখ তার জন্য না। এক বিন্দু সুখের পরিবর্তে যার জীবনে মুহূর্তেই নেমে আসে ঘুট্ঘুটে অন্ধকার তার সুখের সন্ধান করা অনুচিত। ভাবনা-চিন্তা, সুখ-দুঃখের হিসাব রেখে ক্লান্ত দেহ টেনে ওঠে দাড়ায় রক্তিম। ভঙ্গুর হৃদয়টাকে কাঠিন্যতার খোলসে ভরে এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে। জাগতিক সমস্ত কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ইচ্ছে হলেও উপায় নেই এই মুহূর্তে। যে দায়িত্ব কাধে নিয়েছে তা তো পালন করতেই হবে তাকে।

শিকদার মঞ্জিলের কাছাকাছি আসতেই পকেটে থাকা যান্ত্রিক বস্তুটা ভাইব্রেশন থাকায় বিপ বিপ শব্দ তুলে কেঁপে ওঠে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতেই পকেট হাতরে ফোন বের করে রিসিভ করে কানে ঠেকায় রক্তিম। জলদগম্ভীর কন্ঠে বলে,

“কে?”

“দৃষ্টির বাবা বলছিলাম।”

তৎক্ষণাৎ থেমে যায় রক্তিম। চোখ দুটো বন্ধ গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। ভাবে আজ কি এসব উটকো ঝামেলা তার পিছু ছাড়বেনা? কতক্ষণ আগেই মেয়েটা অতীত নাড়িয়ে বুকের ঘা তাজা করেছে। সেই যন্ত্রণা সামলে উঠতে না উঠতেই এখন আবার বাপ হাজির। বিতৃষ্ণায় তেতু হয়ে ওঠে রক্তিমের গলা অব্দি। নিরবতার জাল ছিঁড়ে ফোনের অপর পাশ থেকে সাদেক সাহেব দ্বিধান্বিত কন্ঠে বলে ওঠেন,

“তোমার বাবা এসেছিল বিয়ের দাওয়াত নিয়ে। একটু ঝামেলায় পরে গেছি তাই যেতে পারলাম না। তাছাড়া তোমাদের বিয়েটা যে পরিস্থিতিতে হয়েছে এখন পযর্ন্ত দৃষ্টির মা মেয়ের উপর রেগে আছে। সে কিছুতেই যাবেনা। তোমার বাবাকে বলে দিও কোনো কষ্ট না পায় যাতে। আত্মীয়তা যখন হয়েছেই, তখন আজ হোক কাল। সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে আসা-যাওয়া হবেই।”

আগুনে ঘি ঢেলে দিলে আগুন যে রূপে গর্জে ওঠে,রক্তিমের অবস্থাও ঠিক সেরকম। সাদেক সাহেবের কথা গুলো যেন রক্তিমের রাগে ঘি ঢালার কাজটাই করে দিয়েছে। অত্যধিক রাগে কপালের দুপাশের শিরা ধপ ধপ করছে। কপাল কুঁচকে কিছু যেই ফোনটা কান থেকে নিঃশব্দে নামিয়ে লাইন কাটতে যাবে ওমনি ভেসে আসে সাদেক সাহেবের কিছু কথা,

“দেখো বাবা! বিয়েটা যেভাবেই হোক আমার মেয়ে এখন তোমার দায়িত্বে। তাকে ভালো রাখার দায়িত্বটাও সম্পূর্ণ তোমার। তুমি কেমন তা আমার জানার প্রয়োজন নেই। তোমার কি আছে কি নেই, সেটাও কখনো জানতে চাইবনা আমি। আমি যা চাইব তা শুধু আমার মেয়ের সুখ। বলতে পারো এক অসহায় বাবা তোমার কাছে হাত জোর করে অনুরোধ করছে তার মেয়েটার খেয়াল রাখার জন্য। আমার মেয়েটা বড্ড সরল। ওর চাহিদা গুলোও খুব স্বস্তা, আবার বলা চলে খুব দামিও। কারণ আমার মেয়েকে সুখে রাখার জন্য দামি দামি পোশাক, কসমেটিকস এর প্রয়োজন হয়না। একটু ভালোবাসা আর অল্প যত্ন পেলেই আমার মেয়ে সুখী। এর বেশি কিছুই চায়না তার। তুমি যদি তাকে এক বিন্দু ভালোবাসা উপহার দাও। বিনিময়ে তোমাকে সে তার পুরো হৃদয়টা দিয়ে দিবে।”

কথার মাঝে একটু থামে সাদেক সাহেব। এই প্রথম মেয়ের জামাইয়ের সাথে কথা হচ্ছে। সেটাও তিনি নিজেই যা বলার বলে যাচ্ছে। শশুর হিসেবে যে সাদেক সাহেব অন্ততপক্ষে একটা সালামপ্রাপ্য এটাও হয়তো রক্তিমের জানা নেই। জানা থাকলেও হয়তো ছেলেটা ইচ্ছে করেই সাদেক সাহেবকে অসম্মান করছে। কথা গুলো ভাবতেই মেয়ের প্রতি রাগটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মেয়েটা তার এই ছেলের মাঝে কি দেখে পাগল হয়েছে? যে ছেলের মাঝে সামান্য সহবত নেই সেই ছেলে কি আদও ভালোবাসা বুঝে? বুঝলেও কিছু করার নেই না বুঝলেও কিছু করার নেই। যেখানে নিজের মেয়েই কথায় নেই সেখানে পরের ছেলের সম্মান দিয়ে কি হবে! ফোনের মাঝেও রক্তিম ঠিক টের পায় সাদেক সাহেবের দীর্ঘশ্বাস। মৌনতা ভেঙ্গে অনুরোধের স্বরে সাদেক আবারও বলে ওঠে,

“দৃষ্টির সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষা আর চার‍দিন পর। জানিনা মেয়েটা পড়ছে কি না। ওকে পরীক্ষাটা দেওয়ার সুযোগ দিও। আমার মেয়েটা পড়াশোনায় খুব ভালো। ওকে নিয়ে ওর মা-বাবার অনেক স্বপ্ন। মেয়েটাকে তো কেড়ে নিলে। তাকে ঘিরে দেখা আমাদের স্বপ্ন গুলোকে কেড়ে নিওনা। দয়া করে হলেও ওকে পড়ালেখার সুযোগ দিও। আমার বিশ্বাস সাত কলেজের যেকোন একটাতে ওর চান্স হবেই।”

যে ছেলে নিজের দায়িত্বটাও নিজে পালন করতে পারেনা, সে ছেলের কাছে কি না এক বাবা তার মেয়ের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করছে! শ্লেষাত্বক হাসে রক্তিম। তবে কেন যেন মুখের উপর না করে দিতে পারেনা। না শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়েই টের পায় গলার কাছে কিছু একটা চেপে ধরে রেখেছে। বলবেনা বলবেনা করেও জ্বিভের ডগায় শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলে,

“পরীক্ষা দিবে। চিন্তা করবেন না।”

চলবে….

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-২৩

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৩
#আদওয়া_ইবশার

টুকটাক বাজার করার কথা বললেও পুরো একটা ভ্যান পূর্ণ করে তবেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছে দৃষ্টি। হাড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে টুকিটাকি রান্নার সরঞ্জাম, একটা রেক, বিছানার জন্য নতুন বালিশ- তোশক, চাদর, আয়না, চিরুনি কিছুই বাদ রাখেনি। কেনাকাটার পুরোটা সময় রক্তিম শুধু গম্ভীর হয়ে শান্ত চোখে দৃষ্টিকে দেখে গেছে। ভিতরে ভিতরে রেগে দিশাহারা হলেও মুখে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। সকলের অতি পরিচিত মুখ রক্তিম শিকদারের সাথে হুট করে একটা মেয়েকে দেখে প্রত্যেক দোকানি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকলেও মুখ ফোটে কিছু বলার সাহস পায়নি। আড়ালে-আবডালে শুধু ফিসফিসিয়ে গেছে, কে হতে পারে মেয়েটা? রক্তিম শিকদার কি আবার বিয়ে করল! করলেই বা কখন? কেউ তো শুনেনি! এমন লুকিয়ে-চুরিয়ে হঠাৎ কেন এভাবে বিয়ে করল? মেয়ে ঘটিত কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়েছিল না কি? এমন হাজারটা প্রশ্ন বাজারের প্রতিটা মানুষের মনে থাকলেও মুখ ফোটে উচ্চারণ করার হিম্মত কারো নেই। সকল জিনিসপত্র ভ্যানে তুলে দিয়ে দৃষ্টিও ওঠে বসে রক্তিমের বাইকের পেছনে। মনের ভিতর তার আনন্দেরা নৃত্য করছে। মুখ থেকে হাসি সরছেই না। এতো আনন্দিত হবেই বা না কেন! সেই কবে থেকে ইচ্ছে ছিল রক্তিমের বাইকের পিছনে বসে সাভারের অলিগলি ঘুরে বেড়াবে। বিয়ের দুদিনের মাথায় পাষাণ শিকদারের মন জয় করার আগেই সেই সুযোগ পেয়ে হাতে যেন চাঁদ পেয়ে গেছে দৃষ্টি। মনের সুখে স্বামী যে তার আস্ত এক জল্লাদ তা বেমালুম ভুলে বাইকে বসেই রক্তিমের কাধে হাত রাখে দৃষ্টি। ঠিক তখনই কর্ণগোকোহরে পৌঁছায় রক্তিমের হিমশীতল কন্ঠ,

“কাধ থেকে হাত সড়া। নইলে ফুটবলের মতো লাথি মেরে বাইক থেকে মাঝ রাস্তায় ফেলব।”

কোনো আগামবার্তা ছাড়াই এমন একটা তরতজা অপমানে ফুস করে দৃষ্টির উৎফুল্ল মনটা নিভে যায়। সাথে একটু ভয়’ও হয়। না জানি আবার গুন্ডাটা মাঝ রাস্তায় তার গলা চেপে ধরে। এমনিতেই গতরাত থেকে যে পরিমাণে জ্বালাতন করছে দৃষ্টি! এরপরও সবসময় নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরা রক্তিম শিকদার শান্ত। আল্লাহর অশেষ রহমতে সে এখনো ঐ গুন্ডাটার ক্রোধের স্বীকার হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে জল্লাদটাকে না রাগানোই ভালো। কথাটা ভেবেই দৃষ্টি তড়িৎ কাধ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। মুখটা কাঁচুমাচু বিরস কন্ঠে বলে,

“আজকে নিজে থেকে ধরেছি তবুও এভাবে অপমান করছেন তো! দেখবেন, খুব শিগ্রই এমন একটা দিন আসবে। যেদিন আপনি নিজে থেকে বলবেন, বউ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসো। নইলে পরে যাবে।”

বিপরীতে রক্তিম কিছুই বলেনা। অত্যধিক রাগে মুখটা থমথমে করে সর্বোচ্চ গতিতে বাইক ছুটিয়ে এক টানে বাড়ি গিয়ে থামে।

দৃষ্টিকে রেখে আবারও সেই একই গতিতে বাইক ছুটিয়ে চোখের আড়াল হয় রক্তিম। রক্তিমের যাবার পানে তাকিয়ে হতভম্ব দৃষ্টি চেঁচিয়ে ওঠে,

“আরে! যাচ্ছেন কোথায়? ভ্যান থেকে জিনিস গুলো নামিয়ে ঘরে দিয়ে যাবেন তো!”

কিন্তু কে শুনে কার কথা! দৃষ্টির চেঁচানো রক্তিমের কান পযর্ন্ত পৌঁছালে তো! অগত্যা অসহায় দৃষ্টি নিজেই ভ্যান চালকের সাহায্য নিয়ে জিনিস গুলো ঘরে নেয়। সাথে বিরবিরিয়ে মনের ক্ষুবে পাষাণ শিকদারের গুষ্ঠি উদ্ধার করে। ভ্যান চালককে বিদায় দিয়ে রক্তিমের প্রতি রাগ-ক্ষুব ঝেড়ে ফেলে মনের মাধুরী মিশিয়ে স্বল্প জিনিসেই নিজের সংসারটাকে গোছাতে ব্যস্ত হয় দৃষ্টি। পুরো ঘর ঝাড়-মুছ করে জায়গা মতো প্রতিটা জিনিস রেখে এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। এবার ছোট্ট চৌকিটাতে নতুন তোশক-চাদর বিছানো হয়ে গেলেই ঘরটা টিপটপ হবে। বালিশ গুলো সড়িয়ে পুরোনো চাদরটা উঠাতেই চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে যায় দৃষ্টির। সাথে ভয়ে কেঁপে ওঠে শরীরের লোমকূপ। চৌকিতে পরপর সাজানো দুটো বালিশের নিচে চকচক করছে একটা ধারালো রাম-দা, একটা চা পা টি। এতো বড় দা বাস্তবে এর আগে কখনও দেখেনি দৃষ্টি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভালো কোনো কাজের জন্য এগুলো রাখেনি। নিশ্চয়ই খু না খু নি কান্ড ঘটানোর চিন্তাতেই এসব রাখা। দৃষ্টি নিজের চোখে দেখেছে রক্তিম খালি হাত আর হকিস্টিক দিয়েই আঘাত করে প্রতিপক্ষকে। তার ভালোবাসার মানুষটা নিজ এলাকার মানুষের কিছু ভালো করতে গিয়েই গুন্ডামি করে বেড়ায়। কিন্তু তার কাছে যে এমন অস্ত্র থাকতে পারে এটা দৃষ্টি একটুও ভাবেনি। অস্ত্র যেহেতু আছে তবে কি এই অস্ত্রের ব্যবহারও করতে জানে রক্তিম! তুসীর মুখ থেকে শোনা কথাটা কি তবে সত্যিই! আসলেই কি আততায়ীর হামলায় রক্তিমের ছোট ভাই আর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল! না কি রক্তিম নিজেই খু ন করেছিল তাদের! আর কিছুই ভাবতে পারেনা দৃষ্টি। অজানা এক ভয়ে চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। অবশ হয়ে আসে শরীর। ঐসব সর্বনাশা ভাবনা দৃষ্টি ভাবতেও চায়না। তার প্রণয় পুরুষ গুন্ডা হলেও কখনো খু নি হতে পারেনা। দুদিন যাবৎ দৃষ্টি মানুষটার ঘরে আছে। বিভিন্ন কথায়, কাজে কতভাবে জ্বালাচ্ছে তাকে। তার বিরুদ্ধে গিয়ে তার নিজের বাবাকে হাত করে তারই ঘরে বউ হয়ে এসেছে। শুধু একটু রাগচটা হওয়ায় এতো গুলো কান্ড ঘটানোর ফলে দুবার গায়ে হাত তুলেছে। এর বেশি তো কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি তার সাথে। যদি সত্যিই রক্তিম খু নি হতো তবে কি দৃষ্টিকে এতো সহজভাবে ছেড়ে দিতো!

****

বহুদিন পর শিকদার বাড়িতে আবারও বিয়ের ধুম পরেছে। বাড়ির সবথেকে ছোট সদস্যের বিয়ে। সেটাও ভালোবাসার। দুই পরিবারের সম্মতিতেই ধুমধাম আয়োজনের মাধ্যমে বিয়েটা হচ্ছে। এই বিয়েতে কি কোনো আয়োজনের কমতি থাকতে পারে! অন্দরমহলের বাইরে ঝাকঝমক পূর্ণ আয়োজনের চিত্র দেখা গেলেও ভিতরের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আদরের ছোট বোন আর প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে এক সুতোয় বাঁধার জন্য রক্তিম বাবার সকল আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেও বিয়েতে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কোনো কিছুর বিনিময়েও সে শিকদার বাড়ির এই ঝমকালো আয়োজনে থাকবেনা। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হবার পর থেকেই আজীজ শিকদার, ইতি, মেহেদী সকলেই রক্তিমকে বুঝানোর কাজে লেগে গেছে। কিন্তু সে কারো কথা শুনতে নারাজ। নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে ছন্নছাড়া জীবনের ছকবাধা নিয়মেই দিন পার করছে। প্রতিদিন মোড়ের চায়ের স্টলে ছেলেপেলে নিয়ে আড্ডা, কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে আসলে মেরেধরে হলেও সমাধান করা। এলাকার বখাটেদের হাত থেকে মেয়েদের নিরাপদে রাখা। এসব করেই দিব্যি চলে যাচ্ছে রক্তিমের দিন। সেদিন দৃষ্টি অস্ত্র গুলো নিয়ে কিছুই বলেনি রক্তিমকে। মনের মাঝে হাজারটা কৌতূহল আর ভয়ের উদ্দীপনা থাকলেও চুপচাপ অপেক্ষায় থাকছে সঠিক সময়ের। তার ধীর বিশ্বাস সঠিক সময়ে রক্তিম নিজেই অতীত থেকে শুরু করে বর্তমান সহ সব কিছুই দৃষ্টির কাছে খুলে বলবে। এই নিয়ে কিছু না বললেও দৃষ্টি কয়েকবার চেষ্টা করেছে বোনের বিয়েতে থাকার জন্য বুঝিয়ে বলার। বরাবরই রক্তিমের কঠোর চোখের চাহনির কাছে দমে গিয়েছে দৃষ্টি। ভেবে নিয়েছে এটা নিয়েও আর কিছুই বলবেনা। ইচ্ছে না হলে না যাক বিয়েতে। তাকে যে এখন পযর্ন্ত রক্তিম নিজের ঘরে ঠাই দিয়েছে,এটাই তো তার পরম ভাগ্য। তার থেকেও বড় কথা দৃষ্টি রক্তিমের নিরব ক্রোধের চাহনিতে ভস্মীভূত হলেও ইদানিং যথেষ্ট লাই পেয়েছে। সেই আগের মতো এখন আর কথায় কথায় তার দিকে মারতে তেড়ে আসেনা। তুই তুকারিটা যদিও এখনো পরিবর্তন হয়নি। রাগি রাগি কন্ঠে কথা বলার ধরনও পরিবর্তন হয়নি। সবথেকে বড় পরিবর্তন যেটা হয়েছে তা হলো, প্রথম দুদিন রক্তিম দৃষ্টির হাতের রান্না না খেলেও বহু খেসারতের পর তাকে খাওয়াতে সক্ষম হয়েছে। এখন প্রতিদিন তিন বেলা না খেলেও এক বেলা রাতে দৃষ্টির হাতের রান্নায় খাচ্ছে। এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে দৃষ্টির! পাষাণ শিকদার তাকে ভালো না বাসুক। নরম স্বরে দুটো কথা না বলোক, চোখে মায়া নিয়ে না তাকাক তার দিকে। তবুও তো তাকে ঠাই দিয়েছে নিজের জীবনে। নিরবে দায়িত্ব দিয়েছে তার এলোমেলো ঘরটাকে গোছানোর। দৃষ্টির বিশ্বাস। এভাবেই ঠিক একদিন রক্তিম শিকদার নিরবেই তার নিজের দায়িত্বটাও দৃষ্টির হাতে তুলে দিবে।

****
বিয়ের কনের সম্পূর্ণ সম্মতিতে, ভালোবাসা পূর্ণতা পাবার লক্ষ্যে বিয়ের আয়োজন শুরু হলেও হাসি নেই তার মুখে। মলিনতা ঘিরে রেখেছে পুরো মুখ জোরে। মায়াবী চোখ দুটো ফুলে-ফেপে লাল হয়ে আছে কান্নার তোপে। এমন দৃশ্য বিয়ের দিন হলেও মানা যেতো। সবাই ভেবে নিতো নিজের বাবার ঘর ছেড়ে যেতে হচ্ছে এই দুঃখে কাঁদছে কনে। কিন্তু বিয়ের বাকী আরও দুদিন। এখনই কেন কনের চোখে এতো কান্না? কেনই বা এতো মলিনতা! কারণটা বিয়েতে উপস্থিত কাছের কিছু আত্মীয়র কাছে পরিষ্কার থাকলেও বাইরের নতুন কিছু আত্মীয়র কাছে অস্পষ্ট। ভাইকে বিয়েতে থাকার জন্য রাজি করতে না পেরে পৃথিবীর যত বিষাদ আছে সব মনে হয় ইতির মুখে ভর করেছে। চোখ দিয়ে উপচে পরছে নোনাজল। হাতের কাছে এখনো ফোনটা নিয়ে নিজের ঘরে বসে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। বোনের বিয়ে উপলক্ষে প্রায় দেড় বছর পর বাবার বাড়িতে পা দিয়েছে স্মৃতি। এখানে আসার পরই সে জেনেছে ভাই আবারও বিয়ে করেছে। সেটাও বাবার জোরে। ভাইয়ের প্রতি ইতির যতটা টান স্মৃতির মনে তার কিঞ্চিৎ পরিমাণও নেই। উল্টো সে নিজেও তার বাবার সংসার এলোমেলো আর মায়ের মানসিক পরিণতির জন্য দায়ী করে ভাইকে। এই ভাইটার জন্যই তো তার শশুর বাড়িতেও কম কথা শুনতে হয়না এখনো তাকে। উঠতে বসতে শাশুড়ি, ননদ, জা সকলেই কথা শোনায় ভাই খু নি, মা পাগল এসব বলে। যে ভাইয়ের জন্য শশুর বাড়িতে রোজ রোজ তাকে কথা শুনতে হয় সেই ভাই কিভাবে প্রিয় হবে তার? বিয়ের আগে ইতির মতো তার কাছেও ভাই অধিক প্রিয় থাকলেও বিয়ের পর সেই প্রিয়র জায়গাটা অপ্রিয়তে স্থান বদল করেছে।

ঘরোয়াভাবে আজকে ইতির মেহেদী অনুষ্ঠান করা হবে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায় হয়ে এসেছে। মেহেদী অনুষ্ঠান রাতে হবে। এই অনুষ্ঠানের জন্যও পার্লার থেকে ব্রাইডাল লোকে সাজানো হবে ইতিতে। সেজন্যই তাড়া নিয়ে স্মৃতি এসেছিল বোনকে নিয়ে পার্লারের উদ্দেশ্যে যাবে বলে। কিন্তু রুমে দেখে দেখল বোন তার এখনো হাতে ফোন নিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। আসার পর থেকেই এই এক নাটক দেখতে দেখতে বিরক্ত স্মৃতি। কি এক জমিদার রক্তিম শিকদার! তার জন্য নিজের বিয়ের আনন্দ মাটি করে এভাবে কেঁদেকুটে দুনিয়া ভাসানোর কোনো মানে হয়? বরং এটা ভেবে খুশি হবার কথা যে গুন্ডাটা তার বিয়েতে উপস্থিত থেকে কোনো ঝামেলা বাধাবেনা। স্মৃতির বিরক্ত ভাবটা এবার রাগে পরিণত হয়। রুমে ঢুকে তিরিক্ষি মেজাজে বলে,

“কি শুরু করেছিস তুই? ঐ খু’নি’টার জন্য চোখের পানি নাকের পানি এক করে আত্মীয় স্বজনে ভর্তি বাড়িতে কোনো অঘটন না ঘটিয়ে তুই শান্ত হবিনা? কি এমন হবে সে বিয়েতে উপস্থিত না থাকলে? তোর বিয়ে আটকে থাকবে? না কি কোনো কাজ পরে থাকবে?”

বোনের কথায় ইতির নিজেরও রাগ হয় অত্যধিক। কেমন পাষাণ বোন তার! রক্তিম তো তারও ভাই। তবে কিভাবে পারছে সে এভাবে কথা গুলো বলতে? মানুষ যে বলে বিয়ের পর মেয়েরা পরিবর্তন হয়ে যায়, কথা কি আসলেই সত্যি? স্মৃতি তো এমনটাই প্রমাণ করছে। নিজের মায়ের পেটের ভাই রক্তিম। স্মিতি, ইতির মাঝে কখনো রক্তিম কোনো ব্যবধান করেনি। সবসময় দুই বোনকেই সমান ভালোবাসা দিয়েছে। সমান স্নেহে আগলে রেখেছে। তবে স্মৃতি আজ কিভাবে পারছে সেই ভাই নামক আস্ত এক ভালোবাসার খনিকে এভাবে তাচ্ছিল্য করতে? বড় বোনের আমূল পরিবর্তনে রাগের সাথে ব্যথিতও হয় ইতি। কন্ঠে কিছুটা রাগ, কিছুটা অসহায়ত্ব মিশিয়ে বলে,

“তুই পাষাণ হতে পারলেও আমি পারিনি আপু। তোর কাছে সূবর্ণ সেই অতীত গুলো সময়ের ব্যবধানে পানসে মনে হলেও আমার কাছে এখনো অতি মধুর। বড় ভাইয়ের ভালোবাসা, স্নেহ মায়া, মমতা কিছুই বদলায়নি আমার জন্য। আর বদলাবেও না। তাই আমিও বদলে যেতে পারছিনা। ভাইয়া আমার কাছে কি সেটা তুই জানিস না। দয়া করে আর আমার সামনে কখনো ভাইয়াকে নিয়ে কোনো উল্টাপাল্টা কথা বলবিনা। বিয়ে খেতে এসেছিস ভালো কথা। বিয়ে খেয়ে আবার চলে যাবি, চলে যা। দুদিনের জন্য এসে অযথা আমাদের মাঝে নাক গলাবিনা।”

“কোন ভাইয়ের জন্য মনের মাঝে টান থাকবে আমার? যে ভাইয়ের জন্য আমার মা আজ মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে? যে ভাইয়ের জন্য আমার বাবার সংসারটা পুরো ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। সেই ভাইয়ের জন্য কেন আমি মায়া দেখাবো?”

চেঁচিয়ে কথা গুলো বলে থামে স্মৃতি। বিপরীতে ইতি শান্ত অথচ অবিচল স্বরে বলে,

“তা আমার ভাই সংসার এলোমেলো করে দেবার পর কি সংসারটাকে তুই গুছিয়েছিস? না কি মা মানসিক রোগীতে পরিণত হবার পর তুই তার খেয়াল রেখেছিস! কোনোটাই তো না। বছরে একবার এসে চোখের দেখা দেখে যাবি দূরের কথা। সপ্তাহেও তো একদিন মায়ের সাথে ফোনেও কথা বলিস নি। একবাবরও খোঁজ নিয়ে জানতে চাসনি কিভাবে আছি আমরা, কি খাচ্ছে বাবা বা কিভাবে চলছি আমি। তবে আজ কেন এসব বলে অধিকার ফলাতে আসছিস? তুই নিজেই ভেবে দেখ তো, মাঝ পথে ছেড়ে গিয়ে ঘোর বিপদের সময় পাশে না থেকে হঠাৎ উড়ে এসে এই সংসার বা এই সংসারের মানুষ গুলো নিয়ে কথা বলা তোর শোভা পায় কি না!”

ইতির এই কথা গুলোই যথেষ্ট ছিল স্মৃতির মুখের সমস্ত কথা কেড়ে নিতে। সত্যিই এমন প্রশ্নের বিপরীতে স্মৃতির কাছে বলার মতো যুক্তিপূর্ণ কোনো উত্তর নেই। বলার মতো কিছু খোঁজে না পেয়ে অল্প রাগের আভাস নিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে যায় স্মৃতি। দরজার কাছে আসতেই দেখতে পায় রেহানা বেগম শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে এতোক্ষন পযর্ন্ত দুই মেয়ের সকল কথায় শুনেছেন। মা’কে দেখেও কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায় স্মৃতি। রেহানা বেগম নিজেও বড় মেয়েকে কিছু বলেনা। চুপচাপ রুমে ঢুকে ইতির সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,

“ফোন দে ওকে।”

মায়ের কথায় একটু অবাক হয় ইতি। বুঝতে পারেনা কাকে ফোন করার কথা বলছে। জানতে চায়,

“কাকে?”

উত্তর দিতে একটু সময় নেয় রেহানা বেগম। কতক্ষণ চুপ থেকে কন্ঠে অধিক জড়তা নিয়ে বলে,

“রক্তিমকে।”

মায়ের মুখে এতোদিন পর ভাইয়ের নাম শুনে থমকে যায় ইতি। কতক্ষণ ফ্যালফ্যাল নয়নে শুধু তাকিয়ে থাকে মায়ের মুখের দিকে। সে জানতো মায়ের নিয়মিত কাউন্সেলিং হচ্ছে। মানসিক সমস্যাটা সেড়ে গেলে মা অবশ্যই রক্তিমকে কাছে টেনে নিবে। কিন্তু এতো দ্রুত যে সেটা হবে তা তো জানতনা। অত্যধিক খুশিতে চোখ দুটো আবারও অশ্রুজলে সিক্ত হয় ইতির। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে ভাইয়ের নাম্বারে ডায়াল করে এগিয়ে দেয় মায়ের দিকে।

চলবে…..

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-২১+২২

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২১
#আদওয়া_ইবশার

দৃষ্টির কথার বিপরীতে কোনো কথা বলেনা রক্তিম। স্থির চিত্তে কতক্ষণ শুধু তাকিয়ে থাকে অষ্টাদশীর কান্নারত মায়াবী মুখপানে। অন্তঃকরণে জ্বলন ধরে রক্তিমের। তবে সেটা দৃষ্টির দুঃখে না। বিভীষিকাময় দুই বছর আগের ফেলে আসা সেই অতীত দুয়ারে এসে কড়া নাড়ায় অন্তরে জ্বলন অনুভূত হয়। মস্তিষ্ক হয় অসাঢ়। একটু একটু করে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারায় আবার। ইচ্ছে হয় চোখের সামনে থাকা সমস্ত কিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে। বিধ্বংসী তান্ডব লীলা চালিয়ে ভালোবাসা নামক যন্ত্রণা পোকাটাকে এই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে দিতে। নিজেকে বহুকষ্টে সামলায় রক্তিম। পুরোপুরি ভারসাম্য হারানোর আগেই টলতে টলতে বেরিয়ে পরে ঘর থেকে। অসহায় নয়নে তাকিয়ে দেখে দৃষ্টি রক্তিমের প্রস্থান। আবারও অশ্রুস্বজল হয় আঁখি যুগল। বুক চিরে বেরিয়ে আসে হাহাকার মিশ্রিত নিঃশ্বাস। এক দিনেই হাপিয়ে গেছে দৃষ্টি। কথার আঘাতে জর্জরিত ভালোবাসায় টইটম্বুর হৃদয়। ইচ্ছে করছে ভালোবাসা নামক যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিয়ে এই নশ্বর পৃথিবীর বুক থেকে পালিয়ে যেতে। তবে সেই ইচ্ছেটুকু পূর্ণতা পাবার নয়। সবার সব ইচ্ছে এক জীবনে পূর্ণতা পায়’ও না। এ যুদ্ধের আহ্বায়ক যে সে নিজেই। এখন যুদ্ধের ময়দানে নেমে সে নিজেই যদি পরাজয় মেনে পালিয়ে যায় তবে তো নিজের বিবেকই নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। হেরে যাবে নিজ স্বত্তার কাজেই ভালোবাসা। এমনটা হতে দেওয়া যাবেনা। কিছুতেই না। দাঁতে দাঁত পিষে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। হাজারটা তীরবিদ্ধ হয়ে হৃদয় ক্ষতবীক্ষত হলেও নিঃশ্বাস চলা অব্দি থামা যাবেনা। সেও দেখতে চায় শেষ পরিণতি কি হয়। ঐ নিষ্ঠুর মানবের পাষাণ হৃদয়ে তার জন্য কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভালোবাসার সৃষ্টি না হলেও মায়ার সৃষ্টি হয় কি না। কোনোদিন ঐ মানুষটার মনে শিশির বিন্দু পরিমাণ মায়ার খোঁজ’ও যদি পায় দৃষ্টি তবে সেটুকুই চলবে। তার একার ভালোবাসাটুকু উজাড় করে মানুষটার সাথে গুছিয়ে নিবে এক মায়ার সংসার। এই পৃথিবীতে কয়জন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালোবাসা দিয়ে সৃষ্টি হয়? হাজারে একশটা সম্পর্কে ভালোবাসা থাকলেও বাকী নয়শ সম্পর্কই খোঁজ নিলে দেখা যাবে ভালোবাসাহীন। তারা স্রেফ মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে দিব্যি কাটিয়ে দেয় পুরো একটা জীবন। তাদের মতো দৃষ্টিও পারবে ভালোবাসাহীন মায়ার সংসার গড়তে।

কেটে যায় আরও একটা নির্ঘুম রাত। বুকে চাপা যন্ত্রণা নিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগ পযর্ন্ত দৃষ্টি অপেক্ষায় থাকে রক্তিমের বাড়ি ফেরার। তিমিরাচ্ছন্ন রাত কেটে ভোরের নির্মল আভা ছড়ায় প্রকৃতির বুকে। তবুও রক্তিম ফিরেনা। হতাশ হয় দৃষ্টি। ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয় বিছানায়। অল্পক্ষণের মাঝে ঘুম নেমে আসে ফোলা চোখ দুটোতে। দুই-তিন ঘন্টার ব্যবধানে পেটের ক্ষিদে মাথা চারা দিয়ে উঠতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় আপনাতেই। বন্ধ চোখ জোড়া খুলে আবারও একবার খোঁজ করে পাষাণ পুরুষটা এলো কি না। কিন্তু না। আসেনি। মলিন মুখে বিছানা ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় দৃষ্টি। ছোট্ট উঠোনের একপাশে একটা চাপকল। ঠান্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে দুই হাতের আজলায় একটু পানি পান করতেই খালি পেটে পাক দিয়ে ওঠে। এবার যেন ক্ষিদেটাকে দমিয়ে দায়। উপায় না পেয়ে ঘরে এসে ফোন হাতে নেয়। খোঁজে খোঁজে বের করে প্রথম দিন রক্তিমের দেওয়া রাকিবের নাম্বার। ডায়াল করে কানে ধরতেই দুইবার রিং হবার পরই ঐপাশ থেকে ভেসে আসে রাকিবের উৎফুল্ল কন্ঠস্বর,

“ওও পরদেশী সুন্দরী! এতোদিন পর এই অচেনা পুরুষের কথা মনে পরল তোমার? তা সাত সকালে কি মনে করে ফোন দিলে? ঠিকানা দিতে না কি? তুমি তো দেখি ভারী অলস সুন্দরী। সেই কবে ঠিকানা চেয়ে ম্যাসেজ করেছিলাম! এতোদিন পর আজ মনে হলো?”

একেতো পেটের ক্ষিদে, কান্নার ফলে মাথা ব্যথা। হৃদয়ে অশান্তি। এই এতো এতো যন্ত্রণার মাঝে এখন আবার ঐ ছাগলটার এমন কথা। মেজাজ খিঁচে ওঠে দৃষ্টির। দাঁতে দাঁত পিষে ধমকে ওঠে দৃষ্টি,

“ঐ চামচার বাচ্চা চামচা! চুপ, একদম চুপ! আর একটা উল্টাপাল্টা কথা বললে মাথা ফাটিয়ে দিব।”

এতো সুন্দর সুন্দর কথার বিপরীতে এমন ধমকে ভড়কে যায় রাকিব। চোখ দুটো বড় বড় করে তৎক্ষণাৎ কান থেকে ফোন সরিয়ে নাম্বারে চোখ বুলায়। হ্যাঁ, এটাই তো নাম্বার। এই নাম্বার থেকেই তো ম্যাসেজ করে বলেছিল কেউ তার প্রেমে পরেছে। তবে আজকে কেন এমন ঝাড়ি! এটা প্রেমের কয় নাম্বার ধাপ? এই ধাপের কথা তো রাকিবের জানা নেই। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আবারও কানের কাছে ফোন নেয় রাকিব। ফের কিছু বলতে যাবে তার আগেই দৃষ্টি বলে ওঠে,

“রক্তিম শিকদার কোথায়? তাকে ফোন দিন।”

সাহস কত মেয়ের! তার ফোনে কল দিয়ে তাকেই উপেক্ষা করে রক্তিমকে চায়! এই মেয়েকে তো উচিৎ শিক্ষা দিতেই হয়। বড়সড় একটা ধমক দিয়ে চোখের পানি নাকের পানি এক করে বুঝিয়ে দিতে হবে রক্তিম আর রাকিবের মাঝে কোনো তফাৎ নেই। রক্তিম যদি হয় বারুদ তবে সে হলো আগুন।

“এই মেয়ে এই!”

“বললাম না উল্টাপাল্টা কিছু বললেই মাথা ফাটাবো। চামচা চামচার মতো থাকুন। রক্তিম শিকদারকে বলে দিন তার বউ গত দুপুর থেকে অভুক্ত। পাঁচ মিনিটের ভিতর যেন ঘরে খাবার আসে। নইলে কিন্তু আপনার মাথা চিবিয়ে খাব আমি।”

রাকিবের কথা কেড়ে নিয়ে বলে ওঠে দৃষ্টি। নিজের প্রয়োজনটুকু বলে সাথে সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ঐদিকে রক্তিম শিকদারের বউ শুনে রাকিবের মাথা ঘুরে ওঠে। ফোন কানে ঠেকিয়েই আশ্চর্যের চরম পর্যায় গিয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে তাকায় একটু দূরে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানা রক্তিমের দিকে। আকস্মিক এমন একটা কথা হজম করতে না পেরে মাথা ঘুরিয়ে ওঠে রাকিবের। নিশ্চল ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় রক্তিমের দিকে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন ফোনটাই এখনো কানে ঠেকানো। সেভাবেই অসহায় সুরে ডেকে ওঠে,

“ভাই!” ঠোঁটের ভাজে সিগারেট নিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে রক্তলাল চোখে রাকিবের দিকে তাকায় রক্তিম। একের পর এক দুশ্চিন্তায় বিগত দুই-তিনটা রাত পুরোপুরি নির্ঘুম কেটেছে রক্তিমের। যার প্রমাণ রক্তলাল চোখ দুটো। হিমশীতল ঐ লাল আঁখি জোড়া কি ভয়ংকর ঠেকাচ্ছে! মনে হচ্ছে কোনো এক হিংস্র পশু শিকারের আশায় ওত পেতে আছে জলন্ত চোখে। ঐ চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় হয় রাকিবের। পেটের ভিতর মুচড় দিয়ে ওঠে।কিছুদিন যাবৎ এমনিতেই তার ঘাড়ের উপর শনি নাচন করছে। প্রাণ প্রিয় ভাই হুট করেই মেজাজ হারিয়ে ক্ষণেক্ষণে তাকেই প্রহার করে যাচ্ছে। দুদিনে দুটো থাপ্পড় দিয়েই তার নাদুসনুদুস গাল দুটো কেমন চেপ্টা করে দিয়েছে। আজ না জানি আবার বউয়ের কথা শুনে তাকে এই দুনিয়া থেকেই এক থাপ্পড়ে বিদায় করে দেয়। কিন্তু কৌতূহলও তো দমার নয়। কেমন পেটের ভিতর সুরসুরি দিয়ে যাচ্ছে। কথাটা না বলেও শান্তি নেই। বা-হাতে এখনো ফোন কানে ঠেকিয়ে ডান হাতে গাল ঘষে বলে,

“ভাই আপনি ঘরে বউ এনেছেন?”

সাথে সাথেই হাসির রুল পরে যায় সেখানে। উপস্থিত প্রত্যেকে স্ব-শব্দে হেসে ওঠে রাকিবের এমন কথায়। ঘরে বউ এনেছে মানে কি? বউ কি মেলাই কিনতে পাওয়া যায় কাঠের ফার্নিচারের মতো! যে ইচ্ছে হলো ঘরের শোভাবর্ধনের জন্য একটা বউ কিনে এনে সাজিয়ে রাখল।এই রাকিবটাও যে কি বোকা বোকা কথা বলে! এতোদিন পযর্ন্ত রক্তিম শিকদারের আশেপাশে থেকেও একটু চালাক-চতুর হতে পারলনা। রাকিবের কথাটা ছেলেরা মজার ছলে নিলেও মেহেদী ঠিকই বুঝে যায় আসল মর্মার্থ। রক্তিমের কপালেও শুক্ষ ভাঁজ পরে। জোরালো ধমকে সবাইকে চুপ করিয়ে মেহেদী জানতে চায়,

“ফাও প্যাঁচাল রেখে আসল কথা বল।”

নিজের গাল দুটো শক্ত হাতের প্রহার থেকে বাঁচাতে মেহেদীর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায় রাকিব। ফটাফট বলে দেয়,

“একটা মেয়ে ফোন করে বলল ভাইকে যেন বলি তার বউ গত দুপুর থেকে অভুক্ত। ভাই যেন পাঁচ মিনিটের মধ্যে খাবার পাঠায়। নইলে আমার মাথা চিবিয়ে খাবে।”

কথাটা শুনে হা হয়ে যায় উপস্থিত প্রত্যেকে। অত্যধিক বিস্ময়ে ছানাবড়া সকলের চোখ। ব্যতিক্রম শুধু রক্তিম, মেহেদী। হতবাক দৃষ্টিতে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে দলের সব গুলো ছেলে এক সুরে বলে,

“ভাই! আপনি বিয়ে করেছেন?”

বিরক্ত হয় রক্তিম। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। মনে মনে রাগে ফুঁসে ওঠে দৃষ্টির প্রতি। কত বড় বেয়াদব মেয়ে। নিজে থেকে ছলনা করে তার বউ হয়ে ঘাড়ে চেপেছে। এখন আবার হুকুম জারি করে! বিয়ের আগে মনে ছিলনা এই গুন্ডার ঘরে এসে খাবে কি? গুন্ডাটার আদও তাকে খাওয়ানোর সামর্থ্য আছে কি না! কোনো খাবার ঘরে নিবেনা রক্তিম। পেটে খাবার না থাকলে দুদিন পর ভালোবাসা এমনিতেই পালাবে। ঐ আপদও তখন নিজে থেকেই ঘর ছাড়বে। এতো বড় সুযোগ একদম হাতছাড়া করবেনা রক্তিম। রক্তিমের হাবভাব দেখে ঠিক বুঝে যায় মেহেদী এই ছেলে জিন্দিগীতেও মেয়েটার জন্য খাবার পাঠাবেনা। ভালোবাসার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত মেহেদীর বড্ড মায়া হয় মেয়েটার জন্য। একটু হলেও অনুভব করতে পারে দৃষ্টির মনের ব্যথা। কারণ সে নিজেও তো একই নাইয়ের মাঝি। দৃষ্টির কষ্টে ব্যথিত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মেহেদী। কাওকে কিছু না বলে নিজেই চলে যায় সেখান থেকে। উদ্দেশ্য হোটেল থেকে খাবার কিনে দৃষ্টিকে দিয়ে আসা।

***
আজও অপেক্ষা করতে করতে রাত গভীর হয়। কিন্তু রক্তিমের ফেরার কোনো নাম নেই। তবে আজ আর ঘুমায়না দৃষ্টি। কোনো কাজ না থাকাই বলতে গেলে পুরো দিনটাই সে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। এখন আর চোখে ঘুম নেই। গত রাত একটা ঘোরের মাঝে থাকার কারণে একা থাকতেও কোনো ভয় করেনি। কিন্তু আজ ভয়টা যেন দৃষ্টির পিছুই ছাড়ছেনা। বারবার মনে হচ্ছে সে হাঁটলেও তার পিছন পিছন কেউ হাঁটছে। বসে থাকলেও মনে হয় কেউ তার পিছনে বসে আছে। কানের কাছে অদ্ভূত আওয়াজ হয়। অজানা ভয়ে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। সকালে খাবার দিয়ে যাবার সময় মেহেদী নিজের নাম্বার দিয়ে গিয়েছিল দৃষ্টিকে। বলেছিল যেকোন প্রয়োজনে নির্দ্ধিধায় ফোন দিয়ে বলতে। মেহেদীর ব্যবহার দৃষ্টির কাছে যথেষ্ট আন্তরিক মনে হয়। তবে এই মুহুর্তে মেহেদীকেও তার বন্ধুর মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে হচ্ছে। দৃষ্টি সেই কখন থেকে বারবার ফোন করে বলছে রক্তিমকে যেন একটু তাড়াতাড়ি চলে আসতে বলে।
একলা এমন এক ভূতুড়ে বাড়িতে থাকতে তার ভয় হচ্ছে। দৃষ্টি যতবার ফোন দিয়েছে ততবার মেহেদী বলেছে রক্তিমকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেই পাঠিয়ে দেওয়া অব্দিই সীমাবদ্ধ। পাষাণ পুরুষের এখনো আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। মনের ভয়টা এখন কান্নায় পরিণত হচ্ছে দৃষ্টির। চোখ গড়িয়ে পরেও যায় অশ্রুজল। বিছানায় বসে দৃষ্টি যখন অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই দরজায় কড়াঘাত পরে। তৎক্ষণাৎ ভয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায় দৃষ্টি। কাঁপা স্বরে জানতে চায়,

“ককে!” কয়েক সেকেন্ড নিরবতায় কেটে যায়। ক্ষণকাল পর ভরাট কন্ঠে রক্তিম নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়,

“আমি।” ছোট্ট একটা শব্দে রক্তিমকে প্রথমে চিনতে অসুবিধা হলেও কিছুক্ষণ পর বুঝে নেই এটা রক্তিমই। সিংহের গুহায় সিংহ ছাড়া আর কে আসবে! ঝটপট দুইহাতে চোখের অশ্রু মুছে দৌড়ে গিয়ে কপাট খুলে দেয় দৃষ্টি। গম্ভীর চিত্তে দৃষ্টিকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে রক্তিম। তাকে দেখার সাথে সাথেই অভিমানে ফুলে ওঠে দৃষ্টি। নাক ফুলিয়ে অভিযোগের স্বরে বলে,

“এই আপনার আসার সময় হলো! ঘরে একটা মেয়ে মানুষ রেখে কেউ এতোক্ষন বাইরে থাকে? নির্দয় পুরুষ একটা!”

ঘামে ভেজা শার্ট গা থেকে ছাড়াতে টপ বোতামে সবেই হাত রেখেছিল রক্তিম। এর মাঝেই দৃষ্টির কথায় বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে যায়। থেমে যায় হাতটাও। ইচ্ছে করে ঐসব ন্যাকা কথার বিপরীতে এক থাপ্পড়ে মেয়েটার মাথা ঘুরিয়ে দিতে। কিন্তু তা করেনা। একটা মানুষের গায়ে কতদিন হাত তোলা যায়! তবুও সে যদি কোনো ছেলে হতো তবে একটা কথা ছিল। মারতে মারতে মেরে ফেলতেও কোনো দ্বিধা ছিলনা রক্তিমের। কিন্তু যেখানে এই মেয়ে জাতির গায়ে হাত দেবার কথা ভাবতেও এখন ঘেন্না হয় রক্তিমের। সেখানে এই মেয়ের গায়ে আর কত হাত তুলবে! চোখে-মুখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়েই দৃষ্টির দিকে দু-পা এগিয়ে যায় রক্তিম। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে,

“আমি আসতে বলেছিলাম, না কি নিয়ে এসেছিলাম! দুটোর একটাও না। যেভাবে একা এসেছিস, সেভাবেই একা নিজের ভাবনা নিজ ভাব। দুনিয়া উল্টে গেলেও এই রক্তিম শিকদার কোনো মেয়েকে নিয়ে ভাববেনা।”

‘তুই’ শব্দটায় ক্ষেপে যায় দৃষ্টি। চোখ রাঙিয়ে বলে,

“একদম তুই-তুকারি করবেন না বলে দিচ্ছি। কাল রাগের মাথায় ডেকেছেন কিছু বলিনি। তাই বলে সবসময় ডাকবেন আর আমি হজম করে নিব এটা ভাববেন না।”

দৃষ্টির সাহসে রক্তিম হতবাক। অবাক চিত্তে কতক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে জোরালো ধমকে ওঠে। নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলে,

“চুপ! গলা নামিয়ে আর চোখ নিচে রেখে কথা বলবি। তুই কেন? বাংলা অভিধানে যদি তুই শব্দের থেকেও নিম্ন কোনো শব্দ থাকত তবে সেটাই উচ্চারণ করতাম তোর বেলায়। দ্বিতীয়বার আমার সাথে গলা উচিয়ে কথা বলতে আসলে গলা কে টে বস্তা ভরে নদীতে ভাসিয়ে দিব।”

এমন শুকনো হুমকিতে অল্প ভিতু হয় দৃষ্টি। তবে সেটা চেহারায় প্রকাশ করতে চায়না। মনের ভয় মনে রেখেই রক্তিমের মতোই গম্ভীর হবার ভাব ধরে বলে,

“মিস্টার রক্তিম শিকদার! আপনি নিজেও গলা নামিয়ে কথা বলবেন আমার সাথে। পুরো সাভারবাসীর কাছে আপনি সবার বড় ভাই হলেও ঘরের ভিতর আমি আপনার হোম মিনিস্টার। সো রেসপেক্ট মি। আমার সাথে বাহাদুরী করতে আসলে একেবারে নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে দিব। তখন দেখব চৌদ্দ সিকের ভিতর থেকে কিভাবে আমার উপর দাও ঘুরান।”

কথাটা বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায়না দৃষ্টি। দুরুদুরু মনে গালে থাপ্পড় পরার আগেই দৌড়ে বিছানায় গিয়ে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরে। মনে মনে আল্লাহকে জপে। বারবার আর্জি জানায় তাকে এবারের মতো বাঁচিয়ে দেবার আশায়। আজ যদি তার সুন্দর গাল দুটো ঐ রাক্ষসের হাত থেকে বাঁচে তো সকাল হতেই প্রথম চোখ খুলে যাকে দেখবে দৃষ্টি তাকেই একশো টাকা দান করবে। অন্যদিকে রক্তিম দৃষ্টির সাহসীকতায় বিস্ময়ে জড়িভূত হয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়গায়। দিন দিন মেয়েটার কার্যকলাপ যত দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে। এতো মার খাওয়ার পরও তার মুখের ওপর কথা বলার সাহস পায় কোথায় এই মেয়ে!

চলবে…..

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২২
#আদওয়া_ইবশার

কুয়াশাচ্ছন্ন নতুন আরও একটা সকাল। ভোরের দিকে শীত শীত ভাবটা একটু বেশি অনুভব হওয়াই আরামের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে দৃষ্টির। গায়ের উপর মোটা এক কম্বল সাথে একটা কাঁথা। দুইয়ে মিলেও শীত নিবারণ করতে পারছেনা। সে তো রাতে রক্তিমের থেকে বাঁচতে কাঁথা, কম্বল সব দখল করে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রক্তিম! সে কোথায়? মানুষটা কি আজকেও এই হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় বাইরে ছিল। ভাবতেই শীতের ভয় দূরে ফেলে ধরফরিয়ে ওঠে বসে দৃষ্টি। তখনই চোখ আটকে যায় তার পাশেই পাতলা এক চাদর গায়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা রক্তিমের দিকে। তৎক্ষণাৎ থমকে যায় দৃষ্টি। এই শীতে মানুষটা সারারাত পাতলা একটা চাদর গায়ে কাটিয়েছে! অন্তঃকরণে ব্যথারা এসে হানা দেয় দৃষ্টির। চোখ দুটো জ্বালা করে। ঝটপট একটা হাত বাড়িয়ে দাড়ি ভর্তি গালের একটা পাশ ছুঁয়ে দেয় আলতো স্পর্শে। সাথে সাথেই কেঁপে ওঠে শরীরের অত্যধিক শীতলতায়। আর একটুও দেরী না করে নিজের গায়ের কাঁথা, কম্বল দুটোই অতি সাবধানে জড়িয়ে দেয় রক্তিমের গায়ে। অপলক দৃষ্টিতে রক্তিমের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে, লোকটা এতো অদ্ভূত কেন? এই তীব্র শীতের মাঝে এমন ভাবে শুয়ে থেকে ঠান্ডায় ভোগার কোনো মানে হয়? কি এমন পাপ হয়ে যেতো দৃষ্টির গায়ে থাকা কম্বলের একটা অংশ নিজের গায়ের উপর মেলে দিলে? কত নিষ্পাপ দেখাচ্ছে ঘুমন্ত মুখটা! অথচ জেগে ওঠলেই জল্লাদের মুখোশ পরে সুন্দর এই মুখটা ঢেকে ফেলবে হিংস্রতার আড়ালে। মানুষ প্রেমে পরে বিপরীত লিঙ্গের কোমল হৃদয় দেখে, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটা মনের সন্ধান পেয়ে। আর সে কপাল পুড়ি আজীবন ক্রোধের অনলে পুড়তে প্রেমে পরল এক গুন্ডা, মাস্তানের হিংস্র রূপ দেখে।খাল কেটে কুমির আনা বোধহয় একেই বলে।

টিনের চালায় টুপটাপ ছন্দ তুলে বৃষ্টির ফোটার মতো ঝরে পরছে শিশির বিন্দু। মন্দ লাগছেনা শুনতে। বরং এতো এতো দুঃখের মাঝেও অন্যরকম একটা সুখ সুখ অনুভূতি জাগাচ্ছে মনে। সাথে ইচ্ছে জাগছে প্রিয় মানুষটাকে সঙ্গে নিয়ে এই কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে খালি পায়ে শিশির ভেজা ঘাসের উপর কিছু পথ হেঁটে আসতে। কিন্তু এই সিংহ মানবকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া ইচ্ছে গুলো কি আর পূর্ণতা পাবার হয়! সে তো মন জমিনে উকি দেয় শুধু আফসোস নামক শব্দটাকে ভারী করতে। না পাওয়ার ঝুলিটাকে পূর্ণতা দিতে। সাত সকালে ঘুম থেকেই ওঠেই সুন্দর, পবিত্র একটা ইচ্ছেকে মাটি চাপা দিতে হয় দৃষ্টির। বিছানা ছেড়ে দখিনের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ভারী কাঠের পাল্লা দুটো খুলে দিতেই এক দফা ঠান্ডা বাতাস এসে ছুঁয়ে দেয়। কনকনে শীতের তীব্রতায় ক্ষণেক্ষণে কেঁপে ওঠে দেহ। বাইরে যতদূর দৃষ্টি যাচ্ছে সবটুকু অন্ধকার। এক হাত দূরের কিছুও স্পষ্ট ন। হঠাৎ ঘরের লাইট জ্বলে ওঠায় জানালার বাইরে থেকে নজর সরিয়ে পিছন ফিরে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় রক্তিম থমথমে মুখে আলনা থেকে হুডি নিয়ে গায়ে জড়াচ্ছে। কাজটা সম্পূর্ণ করে একবারও দৃষ্টির দিকে না তাকিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সেদিকে তাকিয়ে হতাশামিশ্রিত একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে দৃষ্টি। ভাবে এইযে বেরিয়েছে এবার হয়তো একেবারে রাতের সেই বারোটা, একটা বাজে ফিরবে। কিন্তু দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে ঘন্টা খানেক এর মাথায় ফিরে আসে রক্তিম। হাতে খাবারের প্যাকেট। কোনোকিছু না বলে থমথমে মুখেই বিছানায় বসে থাকা দৃষ্টির দিকে ছুড়ে মারে প্যাকেটটা। পাষাণতুল্য পুরুষটা হুট করে দৃষ্টির জন্য খাবার নিয়ে এসেছে! চোখের দেখাটাও যেন বিশ্বাস হয়না দৃষ্টির। অবাক, বিস্ময়ে কতক্ষণ রক্তিমের দিকে তাকিয়ে থেকে কোলের কাছে পরে থাকা প্যাকেটটা হাতে নেয়। খুলতে খুলতে সন্দিহাত কন্ঠে বলে,

“বাব্বাহ্! এতো দর‍দ দেখিয়ে খাবার আনলেন। তাও কি না আমার জন্য! সূর্য আজকে কোন দিক দিয়ে ওঠল?”

কথাটা রক্তিমের কর্ণকোহরে পৌঁছালেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়না রক্তিম। গোসল করার জন্য চুপচাপ নিজের কাপড় খোঁজে নিতে ব্যস্ত সে। তার এমন নিরবতা যেন দৃষ্টির সহ্য হয়না। খ্যাঁপা বাঘকে একটু খ্যাঁপানোর আশায় ফের বলে ওঠে,

“এই! আপনি আবার খাবারে বিষটিষ মিশিয়ে আনেন নি তো! না বাবা! সাত দিন না খেয়ে থাকলেও আমি এই খাবার মুখে তুলবনা। আপনাকে বিশ্বাস নেই। আমাকে মারতে খাবারে বিষ মিশাতেও আপনার হাত কাঁপবেনা। দেখা গেল এই খাবার খেয়ে আজকে মরে গেলাম। আর কাল সকালেই স্যোসাল মিডিয়া সহ সকল সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরবে,”স্বামীর হাতে খাবার খেয়ে নববধূর মৃত্যু।” তখন আবার পুলিশ এসে আপনাকে জেলে ভরবে। স্ত্রি হয়ে আমি কিভাবে স্বামীকে জেলে পাঠানোর মতো কাজ করতে পারি!”

কাধে কাপড় নিয়ে দরজা পযর্ন্ত গিয়েও দৃষ্টির কথায় থমকে যায় রক্তিম। ঘাড় ঘুরিয়ে কটমট চোখে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,

“তোর মতো একটা পোনা মাছকে মারার জন্য আমার খাবারে বিষ মিশিয়ে ছলনার আশ্রয় নিতে হবেনা। মারলে বীর পুরুষের মতো সামনে থেকেই মারব। কাপুরুষের মতো আড়াল থেকে না। অমানুষ হতে গিয়েও এখনো পুরোপুরি অমানুষ হতে পারিনি। তার জন্যই চোখের সামনে জেনে-শুনে কাওকে অভুক্ত রাখতে মন সাই দিচ্ছিলনা। যতদিন কিঞ্চিৎ মনুষ্যত্ব বেঁচে থাকবে এই রক্তিমের মনে। ততদিন তুই’ও বাঁচতে পারবি। যেদিন একেবারে অমানুষে পরিণত হব সেদিনই হবে তোর শেষ দিন।”

তুই-তুকারি শুনে এবারও নারাজ হয় দৃষ্টি। তবে তা নিয়ে কিছু বলেনা। বর্তমান প্রসঙ্গটাকেই গুরুত্ব দিয়ে বলে,

“সেই সুযোগ দিলে তো! যেদিন,যে মুহুর্তে অনিচ্ছা স্বত্বেও আমাকে কবুল করেছেন। ঠিক সেই মুহুর্তেই পুরোপুরি অমানুষ হবার সুযোগ হারিয়েছেন।আপনার মনের ঐ কিঞ্চিৎ মনুষ্যত্বের খোঁজ পেয়েই তো এসেছি,ঐটুকু পুঁজি করে পুরো আপনিটাকে বদলে দিয়ে একজন সু-পুরুষে পরিণত করার জন্য। যে সু-পুরুষের হৃদয় থাকবে মায়া দিয়ে পরিপূর্ণ।”

কথাটা বলেই রক্তিমের থেকে নজর ফিরিয়ে খাওয়ায় মন দেয় দৃষ্টি। শান্ত চোখে কতক্ষণ দৃষ্টিকে দেখে নিয়ে কলপাড়ে চলে যায় রক্তিম। তাকে এভাবে কোনো প্রতিত্তোর না করে চলে যেতে দেখে মিটিমিটি হাসে দৃষ্টি। মনে মনে ভাবে, পাষাণ শিকদার সবে অল্প অল্প কথা হারানো শুরু করেছে। এর মানে আগুনের দিন খুব শিগ্রই শেষ হতে যাচ্ছে। শীতের পর যে বসন্ত ঋতু আসবে। সে ঋতুই হয়তো প্রকৃতির সাথে সাথে দৃষ্টির সংসারেও সুখের হাওয়া বইয়ে দিবে।
প্যাকেটে থাকা খাবার অর্ধেক রক্তিমের জন্য রেখে বাকী অর্ধেক খেয়ে টেবিলে থাকা জগটা নিয়ে করপাড়ে যায়। রক্তিম এখনো কল চেপে বালতিতে পানি ভরছে গোসলের জন্য। হাতে থাকা জগটা এগিয়ে দেয় দৃষ্টি রক্তিমের দিকে। মুখটা গম্ভীর করার যথাসাদ্ধ চেষ্টা করে বলে,

“দ্রুত পানি দিন। খাবার আটকে গেছে গলায়।”

কল চাপা বন্ধ করে কতক্ষণ গরম চোখে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে রক্তিম। পরক্ষনে দৃষ্টির মুখের হাবভাব দেখে ভাবে হয়তো সত্যিই খাবার আটকেছে গলায়। এক প্রকার ছু মেরে জগটা হাত থেকে নিয়ে পূর্ণ করে দেয় পানি দিয়ে। বিনিময়ে মুখ ভরে হাসে দৃষ্টি। বাচ্চাদের “থ্যাংকিউ” বলে ঝটপট ঘরে চলে যায়।

****
গোসল ছেড়ে রক্তিম ঘরে আসতেই দৃষ্টি মুখটা সিরিয়াস করে বলে,

“খাবারটা খেয়ে দ্রুত রেডি হয়ে নিন। বাইরে যাব। আমার কিছু কেনাকাটা করতে হবে।”

ভ্রু কুঁচকে দৃষ্টির দিকে তাকায় রক্তিম। চুল মুছতে ব্যস্ত থাকা হাতটা থামিয়ে শীতল কন্ঠে বলে,

“কিসের জন্য?”

“বাজার করতে হবে। হাড়ি-পাতিল কিনতে হবে। টুকটাক ঘরের কিছু জিনিস কিনতে হবে। আমার কয়েকটা ড্রেস কিনতে হবে। এভাবে কতদিন বাইরের খাবার খেয়ে এক পোশাকে থাকব? অনিচ্ছা স্বত্বেও তো বিয়েটা করেছেন। এবার স্বামীর দায়িত্বটুকুও যথাযথ ভাবে পালন করুন।”

এতোক্ষনের সামলে রাখা মেজাজটা এবার লাগামছাড়া হয় রক্তিমের। তেড়ে আসে দৃষ্টির দিকে। হাত উচিয়ে চড় দেবার ভঙ্গিতে এগিয়ে নিয়ে বলে,

“একদম বউগিরি ফলাতে আসবিনা বলে দিলাম। গলা কে টে বস্তায় ভরে ডাস্টবিনে ফেলে রাখতে খুব বেশি সময় লাগবেনা। যেভাবে আছিস সেভাবে থাকতে পারলে থাক না হয় নিজের রাস্তা মাপ।”

রক্তিমের এমন আক্রমণাত্মক মনোভাবে ভয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে পিছিয়ে যায় দৃষ্টি। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে মনে সাহস জুগিয়ে সমান তেজে বলে,

“একটা সোজা কথার সোজা উত্তর দিতে জানেন না? সবসময় এমন হম্বিতম্বি করেন কেন? যাবেন কি যাবেন না সেটা বলুন।”

“যাবনা। কি করবি তুই?”

“যাবেন না!”

হাত দুটো ভাজ করে শান্ত চোখে তাকিয়ে জানতে চায় দৃষ্টি। নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে শক্ত কন্ঠে আবারও না বলে রক্তিম। সাথে সাথেই দৃষ্টি ফোন হাতে নিয়ে আজীজ শিকদারের নাম্বারে ডায়াল করে। ফোন রিসিভ হতেই দৃষ্টি কন্ঠে অসহায়ত্ব ঢেলে বলে,

“শশুর বাবা! আজ দুইদিন হয়ে গেছে আপনার ছেলের সংসারে আছি আমি। দুটো দিনে পেটে একটা দানাও পরেনি আমার। বাপের ঘর থেকে যে পোশাকে বেরিয়েছিলাম সেই পোশাকেই এখনো আছি। একটা সুতা পযর্ন্ত কিনে দেয়নি আপনার ছেলে। না দিয়েছে খাবার জন্য এক ফোটা বিষ। আজকে বলেছি আমাকে নিয়ে একটু বাজারে যেতে। বলতেই আমার গায়ে হাত তুলেছে। আপনিই বলুন, আমি কি কোনো অন্যায় আবদার করেছি? কোন স্ত্রী তার স্বামীর কাছে নিজের প্রয়োজনের কথা বলেনা! সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার কথা বললে স্বামী বউয়ের গায় হাত তুলবে কেন? আপনি একজন সম্মানিত এমপি। আপনার কাছে আমি বিচার চাইছি। হয় আপনার ছেলেকে বলুন আমাকে বাজারে নিয়ে যেতে না হয় আপনার ছেলের বিচার করুন।”

একদমে কথা গুলো বলে থামে দৃষ্টি। ছেলের এমন আচরণের কথা শুনে আজীজ শিকদারের শান্ত মেজাজ অশান্ত হয়। গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

“কোথায় অপদার্থটা? ফোনটা দাও তুমি ওর কাছে।”

সাথে সাথে ফোন লাউডে রেখে রক্তিমের দিকে এগিয়ে ধরে দৃষ্টি। রক্তিমের কানে ভাসে বাবার শান্ত কন্ঠের হুমকি,

“আমি এই মুহূর্তে মেহেদীর বাসায় আছি। বিশ্বাস না হলে তোমার গুণধর বন্ধুকে ফোন দিয়ে জেনে নিতে পারো। বিয়ের কথাবার্তাও প্রায় এগিয়ে গেছে। এখন যদি তুমি চাও তো সব ক্যান্সেল করে দেই! আর সেটা যদি না চাও তবে দশ মিনিটের ভিতর বউমাকে নিয়ে মার্কেটে যাবে। বউমা যা যা চায় সব কিনে দিবে। টাকা না থাকলে আমি পাঠাচ্ছি। তবুও যে বউমা’র একটা আবদার’ও অপূর্ণ না থাকে। কথাটা মাথায় রেখো।”

পাষাণ হৃদয়ের রক্তিম শিকদারকে নাকানি-চুবানি খাওয়ানোর খুব ভালো এক পন্থা খোঁজে নিয়েছে আজীজ শিকদার। সে খুব ভালো করেই জানে, ছেলে তার যেকোন কিছুর বিনিময়ে হলেও প্রাণপ্রিয় বন্ধ আর বোনের ভালোবাসার পূর্ণতা চায়। প্রাণের থেকেও প্রিয় এই মানুষ দুটোর জন্য রক্তিম শিকদার শুধু বাবা আর বউ নামক বিনা নোটিশে ঘাড়ে চাপা মেয়েটার আবদার গুলোই না। নিজের জীবনটাও দিয়ে দিতে প্রস্তুত। রক্তিম খুব ভালো করেই জানে তার বাবা কেমন মানুষ। মানুষটাকে সবাই যতটা শান্ত আর সরল ভাবে চিনে। তার থেকেও ভিন্ন ভাবে জানে রক্তিম। সে খুব ভালো করেই জানে আজীজ শিকদার মুখে একবার যা বলে তা অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করবেই। এমন শান্ত স্বভাবের মানুষ গুলোর জেদ নামক জিনিসটা অত্যন্ত প্রখর হয়। এরা হুটহাট না রাগলেও শান্ত মস্তিষ্কে একবার রাগ চাপলে নিজের ক্ষতি করতেও দ্বিধা করেনা।

জলন্ত দৃষ্টিতে কতক্ষণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে নিরুপায় রক্তিম রেডি হয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। রক্তিমের নিরব প্রস্থানে দৃষ্টি হতাশ হয়ে ভাবে শশুরের হুমকি হয়তো কাজে দেয়নি। ঠিক তখনই বাইরে থেকে লাগাতার বাইকের হর্ন ভেসে আসে। দৃষ্টি বুঝে যায় রক্তিম তাকে যাবার জন্যই নিরবে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছে। সাথে সাথেই মনে অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে যেভাবে ছিল সেভাবেই ওড়নাটা মাথায় পেঁচিয়ে বেরিয়ে যায়।

চলবে……

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-১৯+২০

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৯
#আদওয়া_ইবশার

হেডলাইটের আলোয় মধ্যরাতের অন্ধকার চূর্ণ করে সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে যাচ্ছে আজীজ শিকদারের গাড়িটা। গাড়ির ভিতরের পরিবেশ একেবারে থমথমে। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। কতক্ষণ পরপর শুধু দৃষ্টির নাক টানার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ফিরতি পথেও ড্রাইভারের পাশের সিটটা সবার আগেভাগে দখল করে নিয়েছে রক্তিম। পেছনের সিটে একেবারে জানালার পাশ ঘেষে বসেছে দৃষ্টি। তার পাশেই আজীজ শিকদার। এরপর মেহেদী। কবুল বলার সেই মুহুর্তের পর থেকে রক্তিমের মুখ দিয়ে আর একটা শব্দও উচ্চারিত হয়নি। তার এই অস্বাভাবিক শান্ত আচরণ কারো হজম হচ্ছেনা। তিনজন মানুষের মনেই ভীতি সঞ্চার করছে। প্রকৃতি যেমন ঝড় আসার পূর্বে একদম নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ঠিক তেমন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে রক্তিমের মাঝে। এই নিরবতা বাদ বাকী তিনজন মানুষের মুখ থেকেও শব্দ কেড়ে নিয়েছে। দৃষ্টির যেমন বাবা-মায়ের কথা মনে হয়ে কষ্ট হচ্ছে। ঠিক তেমন তার এই পাষাণ প্রেমিক পুরুষের নিরবতাটুকু মনের কোণে প্রলয়ঙ্কারি ঝড় তুলছে। কান্নার বেগ কমে এলেও অজানা এক ভয়ে ছোট্ট আদুরে দেহটা বারবার কেঁপে কেঁপে ওঠছে। ঝোঁকের বসে শত পাগলামি করে তিন কবুল পড়ে ধর্মীয় মতে আপন তো করে নিল এই মানুষটাকে। কিন্তু মানুষটার মনের ঘরে কি কখনো তার ঠাই হবে?

ফজরের ঠিক আগ মুহূর্তে নিজ শহরে এসে পৌঁছায় আজীজ শিকদারের গাড়িটা। শিকদার মঞ্জিলে যাবার আগে রক্তিমের সেই ছোট্ট কুঠির পেরিয়ে যেতে হয়। গাড়িটা সেখানে আসতেই এতোক্ষনে মুখ খুলে শুধু ড্রাইভারকে থামতে বলে রক্তিম। আজীজ শিকদার বুঝে যায়, আজও ছেলেটা বউ নিয়ে নিজের বাড়ি যাবেনা। সেই ছোট্ট টিনের চালার পাখির বাসার মতো ঘরটাতেই ঠাই নিবে। এ নিয়ে আর কোনো কথা বাড়ায়না আজীজ শিকদার। এমনিতেই ছেলের মতের বিরুদ্ধে এতো বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। ঐ ঘটনার পর ঝড় কখন কোন দিক দিয়ে এসে কোনদিকে যায় এটা নিয়েই এখনো সংশয়ে। এর উপর আবার ঐ বাড়ি যাবার কথা বলে ঘুমন্ত বাঘকে জাগ্রত করার কোনো মানে হয়না। তবে দৃষ্টিকে নিয়ে মুখ খুলেন আজীজ শিকদার। যদিও তিনি জানেননা ছেলে আজও মেয়েটার দায়িত্ব নিবে কি না। তবুও বলেন,

“আজকের রাতটুকু দৃষ্টি শিকদার মঞ্জিলে থাকবে। তোমাদের ধর্মীয় ভাবে বিয়ে হলেও আইনত এখনো বিয়েটা হয়নি। কাল কোর্টের সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করে ওকে তোমার ঘরেই দিয়ে যাব।”

কথাটুকু শেষ হওয়া অব্দিও অপেক্ষা করেনা রক্তিম। গাড়ি থেকে নেমে বড় বড় পায়ে ছুটে যায় নিজের ঠিকানায়। পিছনে দৌড়ে যায় মেহেদী। তবে শশুরের কথায় এতোক্ষনের আটকে রাখা দমটা যেন ফিরে পায় দৃষ্টি। বহুক্ষণ পর একটু স্বস্থির নিঃশ্বাস নেয় এই ভেবে, অন্তত আজকের রাতটুকু হলেও জল্লাদ মুখো মানুষটার থেকে দূরে থাকতে পারবে। পাষান্ডটা যেভাবে প্রথম দিনই ভালোবাসার কথা শুনে দৃষ্টির গলা চেপে ধরেছিল! সেই ঘটনার পর একে আর সহজভাবে নেওয়া বোকামি। আজ এতো বড় একটা কান্ড ঘটানোর ফলে হয়তো হাতের নাগাল পেলে একেবারে কুচি কুচি করে নদীতে ভাসিয়ে দিতো। দৃষ্টি নামক অস্তিত্বটাই একেবারে মুছে দিত পৃথিবীর বুক থেকে। তবে এভাবে কতদিন লুকিয়ে থাকবে? সেই তো কাল থেকে তার সাথেই থাকতে হবে। তখন কি করবে দৃষ্টি? কিভাবে বাঁচবে ঐ জল্লাদের হাত থেকে! বিয়ের জন্য এতো বড় একটা কান্ড ঘটানোর আগে নিজের জীবনের প্রতি মায়া কেন হলনা তার! এক চিন্তার ভিতর আরেক চিন্তা ঢুকে ঢুকে একেবারে মাথাটা জট পেকে যাচ্ছে।

ভাবনার অথৈ সাগরে দোদুল্যমান দৃষ্টি টেরই পায়নি গাড়িটা কখন এসে শশুরালয়ে ভিড়েছে। ভাবনার সুতোই টান পরে আজীজ শিকদারের ডাকে।

“এসো মা। শশুর বাড়ির মাটিতে পা রাখো। কষ্ট করে বউ না সেজেও শশুর বাড়ি চলে আসতে পেরেছো। এমন ভাগ্য কয়জন মেয়ের হয়!”

শেষের কথা গুলো স্ব-শব্দে হেসে রসিকতার ছলে বলে আজীজ শিকদার। শশুরের কথায় দৃষ্টি নিজেও মুখাবয়বে বিষাদ নিয়েই একপেশে হেসে নেমে পরে গাড়ি থেকে। গুটি গুটি পায়ে আজীজ শিকদারের পিছন পিছন এসে দাঁড়ায় সদর দরজার সামনে। কলিং বেল বাজার সাথে সাথেই ভিতর থেকে খুলে যায় সিংহকপাট। দৃষ্টির চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক উচ্ছল কিশোরীর হাস্যোজ্জ্বল মুখবিবর। গাল ভর্তি হেসে মেয়েটা দারুন উৎসাহের সাথে বলে,

“অবশেষে তাহলে সত্যি সত্যি অসাধ্য সাধন হলো! ভাইয়া শেষ পযর্ন্ত বিয়েটা করল বাবা!”

ইতির কথায় আজীজ শিকদার প্রশান্তিময় হাসে। বুক ফুলিয়ে বলে,

“বাপ হয়ে যদি ছেলের এটুকু জেদ ভাঙ্গাতে না পারি তবে কিসের বাপটা হলাম! তাছাড়া একজন সংসদ সদস্য বলে কথা। আমার একটা পাওয়ার আছে না! তোমার ঐ পাতি মাস্তান ভাইয়ের নাকে দড়ি দেওয়া আমার বা-হাতের খেল।”

বাবার কথায় খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ইতি। তড়িৎ দৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“ওয়েলকাম টু ইওর ইন-ল’স হাউস ভাবি। এন্ড ওয়েলকাম টু মাই ব্রাদার’স মেসসি লাইফ। মন-প্রাণ ভরে দোয়া করি, তোমার ছোঁয়ায় আমার ভাইয়ের বিষাদপূর্ণ জীবনটা যেন আবারও রঙিন হয়ে ওঠে। তুমি জানোনা, কত অধীর আগ্রহে তোমার অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। প্রতিটা সেকেন্ড অপেক্ষা নামক অনলে পুড়েছি। ভেবেছি কবে আমার ভাইয়ের জীবনে এমন একটা মানুষের আগমন ঘটবে,যে আমার ভাইয়ের জীবনটা তার ভালোবাসা দিয়ে নতুন করে রাঙিয়ে দিবে। যেদিন থেকে তোমার কথা শুনেছি সেদিন থেকেই তোমাকে একনজর দেখার জন্য আমি অস্থির হয়ে ছিলাম।অবেশেষে আমার সেই অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে। আমার সিংহ ভাইকে ভালোবাসার মতো সেই দুঃসাহসিক বাঘিনীর দেখা পেলাম আমি। এবার সত্যি সত্যি খুশিতে আমি পাগল হয়ে যাব ভাবি।”

এক নজর চোখের দেখাই কেউ একজন যে তাকে এতোটা আপন করে নিবে ভাবেনি দৃষ্টি। কোনো অহংকার নেই, জড়তা নেই। এমন ভাবে মিশে গেল মনে হচ্ছে এর আগে আরও কতশত বার দেখা হয়েছে তার সাথে। শশুর বাড়িতে পা রেখেই নিজের বয়সী এমন বন্ধুসুলভ ননদ পেয়ে মন খারাপি ছাপিয়ে এক টুকরো খুশি ঝিলিক দেয় দৃষ্টির মনের কোণে। ইতির এতো গুলো কথার পৃষ্ঠে লাজুক হাসে সে। হাকডাক শুরু করে দেয় ইতি। তার চিৎকারে উপস্থিত হয় রেহানা বেগম। বরণ ঢালা হাতে পিছন পিছন দৌড়ে আসে কাকলির মা। নিয়মিত কাউন্সেলিং এর ফলে রেহানা বেগমের মানসিক অবস্থার আগের থেকে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। আগের মতো সেই পাগলামি এখন আর করেনা। আস্তেধীরে সংসারের কাজকর্মে মন লাগছে। কথাবার্তা এখনো মন খুলে না বললেও কাজের সময় টুকটাক কথা বলেন। মাঝে মাঝেই ইতিকে ডেকে নিয়ে চুলে তেল দেওয়ার নাম করে জড়তা কাটিয়ে মা-মেয়েতে গল্পের আসর জমানোর চেষ্টা করেন। ইতিও মায়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে নিজ থেকেই আগ বাড়িয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা তুলে মা’কে সহজ করতে চায়। সব কিছু একটু একটু করে ঠিক হতে থাকলেও রক্তিমকে নিয়ে এখন পযর্ন্ত রেহানা বেগম কিছুই বলেনি। তার মানসিক দিক চিন্তা করে আজীজ শিকদার, ইতি তারাও এখন আর নিজে থেকে রক্তিমের কথা তুলেনা। তবে আজ ময়মনসিংহ যাবার আগে আজীজ শিকদার এটুকু বলে গিয়েছিল, “তোমার ছেলের বউ নিয়ে বাড়ি ফিরব। রেডি থেকো তাকে বরণ করার জন্য।” প্রতিউত্তরে রেহানা বেগম তখন শুধু নিরবে স্বামীর দিকে কতক্ষণ তাকিয়েছিল। কিছুই বলেনি। তবে ঠিকই সন্ধ্যায় নিজ থেকেই কাকলির মা’কে নিয়ে সাজিয়েছে বরণ ঢালা। অপেক্ষায় থেকেছে নতুন বউয়ের আগমনের। মায়ের আমুল পরিবর্তনে ইতির খুশিটা যেন আরও দ্বিগুণ হয়। মনের কোণে শিকদার বাড়ির অতি সন্নিকটিত সুখের সানাই বাজে। চোখে ভাসে হাসিখুশি একটা পরিবারের বাস্তব চিত্র।

কোনো উচ্চবাচ্য ছাড়াই দৃষ্টিকে বরণ করে নিজের গলার সেই পুরোনো আমলের চেইনটা দিয়েই দৃষ্টিকে ঘরে তুলেন রেহানা বেগম। পাশে দাঁড়িয়ে তা মুগ্ধ চোখে দেখে প্রাণ জুড়ায় বাবা-মেয়ে। অত্যধিক খুশিতে আনন্দশ্রু ভীড় করে ইতির আক্ষিকোঠরে। বরণ শেষে রেহানা বেগম মেয়েকে আদেশ করেন,

“ওকে নিয়ে তোমার রুমে যাও।”

মাথা নাড়িয়ে মায়ের আদেশ মেনে দৃষ্টিকে এক হাতে জড়িয়ে সিড়ি ভেঙ্গে দুতলায় নিজের রুমে নিয়ে যায়। লম্বা জার্নি আর কান্নার ফলে শরীর অত্যধিক ক্লান্ত দৃষ্টির। ইতি সেটা বুঝতে পেরে দৃষ্টিকে ফ্রেস হয়ে অল্প কিছু খেয়ে বিশ্রাম নিতে বলে। তবে দৃষ্টি খেতে নারাজ। কোনোমতে ফ্রেস হয়ে দ্বিধা জড়তা দূরে ফেলে শরীরের অল্প আরামের আশায় শুয়ে পরে। ঠিক তখনই রুমে এসে উপস্থিত হয় রেহানা বেগম। নিখুঁত কারুকার্য খচিত চিকন দুটো চুড়ি এনে দৃষ্টির হাত টেনে পড়িয়ে দিয়ে বলে,

“বউ মানুষের হাত খালি থাকতে নেই। দেখতেও ভালো দেখায় না,মুরুব্বিরাও ভালো বলেনা। স্ত্রীর হাত খালি থাকলে স্বামীর অমঙ্গল হয়।আজ কালের যুগের ছেলে-মেয়েরা এসব নিয়ম না মানলেও আমরা এখনো মানি। এগুলো যেন কখনো হাত থেকে খোলা না হয়।”

নিজের কথার পৃষ্ঠেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন রেহানা বেগম ছেলের অমঙ্গল চায়না। অথচ এই মানুষটাই কিছুদিন আগেই মা হয়েও দিন-রাত মুখে ছেলের মৃত্যু কামনা করতো। মানসিক ব্যাধি মানুষকে ঠিক কতটা বদলে দিতে পারে! মায়ের আজকের এক একটা আচরণ এতোদিনে ইতির মনে তৈরি হওয়া অভিমান গুলোকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে। অশান্ত মনে প্রশান্তির হাওয়া বইছে। শাশুড়ির কথায় বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে সাই জানায় দৃষ্টি। এরপর ননদ শাশুড়ির জোরাজোরিতেই অল্প হলেও মুখে তুলে শশুর বাড়ির অন্ন। বউ সাজ বিহীন, স্বামী বিহীন কাটিয়ে দেয় শশুর বাড়ির প্রথম রাত।

****

পরদিন যথাসময়ে কোর্ট ম্যারেজ সম্পন্ন হয় দৃষ্টি রক্তিমের। সাদেক সাহেব ময়মনসিংহ থেকে সরাসরি কোর্টে গিয়ে উপস্থিত হয়। সাথে আসে তুসীর বাবা। সেখানের কার্যক্রম সম্পাদন শেষে শিকদার মঞ্জিলে যাবার ইচ্ছে না থাকলেও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে যেতে হয়। তবে এক ফোঁটা পানিও মুখে তুলেন না। শিকদার মঞ্জিলের প্রতিটা সদস্যের আন্তরিক ব্যবহারে এতোটুকু নিশ্চিত হয় মেয়ে তার এখানে সুখেই থাকবে। তবুও একমাত্র মেয়েকে এতো দূরে রেখে যেতে বাবার মন মানেনা। শিকদার মঞ্জিলে যতটা সময় থেকেছে পুরোটা সময় জুড়ে প্রতিটা মানুষকে হাত জোর করে অনুরোধ করেছে তার মেয়েটাকে যেন একটু দেখে রাখে। তবে মেয়ে জামাইয়ের সাথে আজও কোনো কথা হয়না। কোর্টের ব্যস্ত সময়টুকুতে রক্তিম শুধু এক ঝলক দেখা দিয়ে নিজের কাজ শেষ করে কারো দিকে না তাকিয়ে আবারও ফিরে যায়। তার এমন ব্যবহারে সাদেক সাহেবের মনে অল্প শংসয়ের দানা বাঁধে। আজীজ শিকদার তা বুঝতে পেরে কথা ঘুরিয়ে নেয়, শশুরের সামনাসামনি হতে ছেলে লজ্জা পাচ্ছে এটা বলে।

বাবা বিদায় নিতেই দৃষ্টি নিজেও প্রস্তুত হয় স্বামীর বর্তমান ঠিকানায় যাবার জন্য। ইতির সাথে টুকটাক কথার মাঝে এটুকু বুঝতে পেরেছে সেই ঘটনার পর থেকে রক্তিম নিজের বাড়ি ছাড়া হয়েছে। এরপর আর কখনো এক রাতের জন্যও সে এ বাড়িতে এসে থাকেনি। যেখানে স্বামী নেই,সেখানে দৃষ্টি কিভাবে থাকবে! একমাত্র রক্তিমের জন্যই তো এতোকিছু করে এ বাড়িতে বউ হয়ে আসা। বিয়ের পরও যদি ভালোবাসার মানুষের থেকে দূরে থাকতে হয় তবে এতো কিছু করার মানে হয়! তাছাড়া দূরে থেকে কখনো ঐ পাষাণতুল্য প্রেমিকের মনে নিজের জন্য ভালোবাসার ফুল ফোটাতে পারবেনা দৃষ্টি। যা করার কাছাকাছি থেকেই করতে হবে। কথায় আছে না, “কায়া দেখলে মায়া বাড়ে”! দৃষ্টিও দেখতে চায় দিন-রাত সর্বক্ষন চোখের সামনে থাকার পরও রক্তিম কিভাবে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।

****

চারিদিকে ইট-সিমেন্টের বেষ্টনী থাকলেও উপরে টিনের চালার তিন কামরার মুটামুটি ধরনের একটা ঘর। সামনের দিকে বারান্দা আছে। বারান্দার গ্রিলে মরিচা ধরেছে। একটা রুমের দরজা ব্যতিত বাকী দুটো রুমের দরজায় তালা ঝুলে আছে। বাড়ির প্রকৃত মালিক বউ-সন্তান নিয়ে বিদেশে থাকেন। বৃদ্ধা মা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন বাড়িটা ওনিই দেখাশোনা করেছে। সেই বৃদ্ধা মারা যাবার পর বাড়ির অবস্থা যাচ্ছেতাই হয়েছিল। এলাকার কিছু বখাটে বারান্দার তালা ভেঙ্গে সন্ধ্যার পর জোয়ার আসর বসাতো। একবার তো ঘরের তালা ভেঙ্গেও সব লুটপাট করে নিয়ে গিয়েছিল। বাড়িটা রাকিবের দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়র। রক্তিম যখন নিজের জন্য নিরিবিলি একটা বাসস্থান খোঁজ করছিল তখন রাকিব নিজ থেকেই তার সেই আত্মীয়র সাথে কথা বলে নামমাত্র ভাড়ায় বাড়িটা ঠিক করে দেয়। বাড়ির মালিক ভাড়ার চিন্তায় না গিয়ে বাড়িটা কারো তত্ত্বাবধানে ভালো থাকবে এটা ভেবেই দিয়ে দেয়। পুরো বাড়িটাই নিজের মতো করে ব্যবহার করার অনুমতি পেলেও রক্তিম নিজের প্রয়োজনে শুধুমাত্র একটা রুমের তালা খুলে সেটাই ব্যবহার করছে। অন্য দুটো রুমে কি আছে না আছে সেটাও দেখার প্রয়োজন মনে করেনি রক্তিম।

ইতির পিছন পিছন রক্তিমের ব্যবহার করা রুমটার ভিতরে ঢুকে দৃষ্টি। চারদিকে নজর ঘুরিয়ে দেখতে পায় যা-তা অবস্থা রুমের। আসবাবপত্র বলতে মাত্র একটা চৌকি, একটা টেবিল, আর একটা আলনা। পুরো আলনা জুড়ে এলোমেলো হয়ে আছে কিছু ছেলেদের পোশাক। মেঝেতে ফুলের মতো ছড়িয়ে আছে সিগারেটের ফিল্টার। বিছানার মাঝেও দেখা যাচ্ছে দুই-একটা পরে আছে। ঘরের এমন বেহাল অবস্থা দেখে হতাশ দৃষ্টি আনমনে কিছুটা জোরেই বলে ফেলে,

“নে দৃষ্টি। তোর জামাই তোর জন্য ফুলের বদলে সিগারেটের ফিল্টার দিয়ে বাসার সাজিয়েছে। তোর সিগারেটময় বাসর।”

দৃষ্টির কথায় হাসতে হাসতে নাজেহাল অবস্থা ইতির। কোনোমতে নিজের হাসিটা আটকে বলে,

“কষ্ট পেয়োনা ভাবি। একটু ধৈর্য্য ধরে আমার ভাইটাকে সঠিক পথে নিয়ে আসো। তখন দেখবে পায়ের উপর পা তুলে খাবে তুমি। কষ্টের ফল সর্বদা মিষ্টি হয়।”

ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে দৃষ্টি। হতাশ মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে বলে,

” মনে হচ্ছে তোমার ভাইকে বিয়ে করেছি ভালোবাসা পাবার জন্য। এক গাধা পিটিয়ে গরু বানানোর দায়িত্ব নিতে এতো ইতিহাস সাজিয়ে বিয়ে করলাম।”

দৃষ্টির কথায় ঠোঁট টিপে হাসে ইতি। মজার ছলে বলে,

“গাধা পিটিয়ে গরু করতে হবেনা। গরু পিটিয়ে মানুষ করতে পারলেই হবে।”

“তোমার কি মনে হয় তোমার ভাই এখনো গরু উপাধিতে আছে? সেই কবেই তো মানুষ থেকে গরু রেখে একেবারে গাধায় পরিণত হয়েছে। তা না হলে কি আর আমার মতো একটা সুন্দরী মেয়ের ভালোবাসা পাবার পরও পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়? একে মনে হয় আমার পক্ষে মানুষ করা সম্ভব হবেনা। গাধা থেকে গরুতে পরিণত করার মাঝেই না জানি আবার আমাকেই হাতে পরকালের টিকেট ধরিয়ে দেয়।”

ননদ ভাবি মিলে কতক্ষণ সময় কাটিয়ে না চাইতেও চলে যায় ইতি। পুরো দুপুর শেষে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার পথে। তবুও এখনো রক্তিম আসার কোনো খবর নেই। তিমিরাচ্ছন্ন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে আলোর মিছিল। ইতি বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর দৃষ্টি কতক্ষণ বাড়িটা টুকটুক করে ঘুরে দেখে আবারও রুমে ফিরে আসে। একা একা কিছুই ভালো লাগছেনা। কতক্ষণ বসে থেকে টুকটাক কাজে হাত লাগায়। প্রথমে আলনাটা গোছানোর জন্য কাছে যেতেই বিশ্রি ঘামের গন্ধ নাকে লাগে। নাক কুঁচকায় দৃষ্টি। একটা শার্ট হাতে নিয়ে অসহায়ের মতো ভাবে, এতোদিন গল্প উপন্যাসে পুরুষের গায়ের গন্ধ নিয়ে কত উপমা শুনেছে। প্রেমিক পুরুষের শরীর থেকে না কি মিষ্টি বুনোগন্ধ ছড়ায়। যে গন্ধে মাতাল হয় প্রেমিকার তনুমন। বক্ষজুড়ে সৃষ্টি হয় তুলপার। আর এখন বাস্তবতা তার নাকে এ কোন বুনোগন্ধ ঠেলে দিল! এ গন্ধে তো দৃষ্টি মাতাল হবার আগেই জ্ঞান হারাবে। হতাশ দৃষ্টি। স্বামীর ঘরে পা রেখেই মেয়েটা হতাশ। তবুও কি আর করা। নিজে থেকেই যখন এই অদ্ভূত মানুষটাকে আপন করেছে তখন তাকেই হয় এই মানুষটার বদ অভ্যাস গুলো পরিবর্তন করাতে হবে। না হয় তার সকল ভালো-খারাপ আপন করে নিতে হবে। ঐ উটকো ঘামের গন্ধেই নিজেকে খোঁজে নিতে হবে মাতালতা।

চলবে….

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২০
#আদওয়া_ইবশার

[আজকের পর্বে গল্পের প্রয়োজনে কিছু স্থানে অশালীন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি সেজন্য]

রাত তখন বারোটা। মেহেদীকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে রক্তিম। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই থমকে যায় দুজনে। দুজনেরই নজর বিদ্ধ হয় বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা দৃষ্টির দিকে। সাথে সাথে সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে নেয় মেহেদী। ঘরের আনাচে কানাচে তাকিয়ে দেখতে পায় একদম পরিপাটি। আলনায় স্তুপ হয়ে থাকা কাপড় গুলো সুন্দরভাবে ভাজ করা। বিছানাটা টানটান করে গোছানো। মেঝেতে এক বিন্দু ধুলো পযর্ন্ত মনে হচ্ছে নেই। মুচকি হাসে মেহেদী। চারিদিকে নজর বুলিয়ে ভাবে, অগোছালো রক্তিমের ঘর গোছানোর দায়িত্বটা প্রথম দিনই নিয়ে নিয়েছে তার ঘরণী। এবার নিজ থেকে দায়িত্ব নিয়ে অগোছালো রক্তিম শিকদারকে গোছাতে পারলেই হলো। রক্তিমের দিকে তাকিয়ে মেহেদী দেখতে পায় সে এখনো শান্ত দৃষ্টিতে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। রক্তিমের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য খুক খুক করে কাশে মেহেদী। মুখ ভরে হেসে বলে,

“আজ থেকে আপনার সাথে আমার থাকার মেয়াদ শেষ। এখন থেকে বন্ধু রেখে বউয়ের সাথেই বিছানা শেয়ার করুন। বেস্ট অফ লাক।”

কথাটা বলে আর দাঁড়ায়না মেহেদী। দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে একেবারে বাড়ির আঙ্গিনা থেকেই বিদায় নেয়। রক্তিম সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে আবারও দৃষ্টির দিকে তাকায়। এক পা দু-পা করে এগিয়ে একেবারে দৃষ্টির মুখের কাছাকাছি গিয়ে থামে। টেবিলের কাছে থাকা কাঠের চেয়ার টেনে বসে। ফের তীক্ষ্ম নজর স্থির করে দৃষ্টির দিকে। সেকেন্ড গড়িয়ে মিনিট পার হয়। রক্তিমের পলক পরেনা। কিছুক্ষণ পর নড়ে ওঠে দৃষ্টি। ঘুমটা এখনো তার জোরালো হয়নি। গতরাত নির্ঘুম কাটানোর ফলে খুব বেশিক্ষণ জেগে থাকতে না পেরে বিছানায় হেলান দিয়ে রক্তিমের জন্য অপেক্ষামান অবস্থাতেই ঘুমের জগতে তলিয়ে যায়। ঘুমের মাঝেই অনুভব হয় কেউ তার দিকে শাণিত নজরে তাকিয়ে আছে। সহজা পাতলা ঘুমটা ছুটে যায়। চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পায় রক্তিমের তিক্ষ্ম নজর। হুট করে ফাঁকা মস্তিষ্ক বিষয়টা ধরতে পারেনা। ফ্যালফ্যাল নয়নে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে পুরো বিষয়টা মস্তিষ্ক ধারণ করতেই লাফিয়ে ওঠে দৃষ্টি। গায়ের ওড়না ঠিক করে জড়োসড়ো হয়ে বসে। আমতা আমতা করে বলে,

“ইয়ে, কখন এসেছেন?”

জবাব দেয়না রক্তিম। সেই আগের মতোই তিক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে থাকে দৃষ্টির মুখের দিকে। ঐ নজরের তোপে পরে হাঁসফাঁস করে দৃষ্টি। অস্বস্তিতে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। নিজেকে আরও একটু গুটিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালায়। অজানা এক ভয়ে বুকের ভিতর উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই গর্জে ওঠে কিছু একটা। শুকনো ঢোক গিলে গলা ভেজায়। নিজেকে প্রস্তুত করে রক্তিমের ক্রোধের অনলে ভস্ম করতে। দৃষ্টিকে ভয় পেতে দেখেও দমেনা রক্তিম। বরং আরও একটু ঝুকে আসে দৃষ্টির মুখের দিকে। সাথে সাথে চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নেয় দৃষ্টি। কানে ভাসে রক্তিমের হিমশীতল কন্ঠ,

“খুব শখ ছিল রক্তিমের বউ হবার! ওফস! বউ না তো। বেড পার্টনার হবার। ঠিক বললাম তো!”

কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে দৃষ্টির। কেঁপে ওঠে বন্ধ চোখের পাপড়ি। দুহাতে আকড়ে ধরে বিছানার চাদর। কাঁপা কন্ঠে বলে,

“একদম উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার ভালোবাসার অপমান করবেন না।”

‘ভালোবাসা’ শব্দটা উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো নিজের কান দুটো চেপে ধরে রক্তিম। ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলে,

“এই মেয়ে চুপ! একদম চুপ। ঐ মুখ দিয়ে দ্বিতীয়বার ভালোবাসার কথা উচ্চারণ করলে একেবারে জ্বিভ টেনে ছিড়ে ফেলব।”

অশান্ত ভঙ্গিতে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায় রক্তিম। স্বজোরে চেয়ারে লাথি বসায়। কেঁপে ওঠে দৃষ্টি। বন্ধ চোখ দুটো আরও খিঁচিয়ে নেয়। দরজার সামনে গিয়ে ঘন ঘন শ্বাস নেয় রক্তিম। দুই হাতে টেনে ধরে মাথার চুল। পাগলের মতো কতক্ষণ ঘরময় পায়চারি করে আবারও এগিয়ে যায় দৃষ্টির দিকে। ঝুঁকে গিয়ে শক্ত হাতে চেপে ধরে দৃষ্টির নরম গাল দুটো। আৎকে ওঠে দৃষ্টি। বন্ধ চোখের পাপড়ি খুলে অসহায় চোখে তাকায় রক্তিমের দিকে। তার ঐ অসহায় নয়নের আকুতি একটুও টলাতে পারেনা পাষাণহৃদয়ের ক্রোধ। বরং হাতের চাপ আরও একটু জোরালো হয় দৃষ্টির কোমল গালে। দাঁতে দাঁত পিষে শক্ত চোয়ালে রক্তিম বলে ওঠে,

“কিভাবে পারিস? কিভাবে পারিস তোরা শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদার জন্য ভালোবাসার মতো পবিত্র নামটা ব্যবহার করে সেটা অপবিত্র করতে? কি বুঝিস তোরা ভালোবাসার? তোদের মতো ছলনাময়ীর ভালোবাসা মানেই তো শুধু শরীরের ক্ষিদা। এটা ছাড়া তোদের কাছে ভালোবাসার ভিন্ন কোনো সজ্ঞা আছে? কেন, কেন তোদের মতো পতিতার জন্ম কোনো পতিতালয়ে না হয়ে এই শুদ্ধ সমাজের শুদ্ধ পরিবারে হয়? শুধুমাত্র আমাদের মতো কিছু ছেলেদের বুকের বা-পাশে ছুরি বসানোর জন্য! একটা বাগানের মতো সুন্দর পরিবারকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবার জন্য! বিনিময়ে কি পাস তোরা? ঐ শরীরের ক্ষিদে মিটানোর পৈশাচিক আনন্দ! এটা তো পতিতাবৃত্তি করেই মিটাতে পারিস। তবে কেন একটা পুরুষকে ভালোবাসা নামক বিষাক্ত অনুভূতি দিয়ে জীবন্ত লাশে পরিণত করিস তোরা?”

সহ্য হয়না দৃষ্টির। একের পর এক বিষাক্ত কথার বাণ শ্বাস আটকে দেয় দৃষ্টির। কান চেপে ধরে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,

“চুপ করুন। চুপ করুন প্লিজ। আমার আর সহ্য হচ্ছেনা এসব। একটুও নিতে পারছিনা আপনার কথা গুলো। বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।”

কিশোরী হৃদয়ের অনুভূতি গুলো যেন এক মুহুর্তের জন্য ফিকে হয়ে যায় রক্তিমের অপবাদ গুলোর কাছে। ডুকরে কেঁদে ওঠে দৃষ্টি। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে গাল থেকে রক্তিমের হাত সড়ানোর চেষ্টা করে। এই মুহূর্তে রক্তিমের আঘাতের উদ্দেশ্যে করা স্পর্শটুকুও মনে হচ্ছে দৃষ্টির পুরো শরীরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। উন্মাদের মতো গাল থেকে হাত সড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তবুও থামেনা। আচড়ে খাঁমচে নিজের গাল নিজেই রক্তাক্ত করে। এক পর্যায় দৃষ্টির পাগলামি দেখে রক্তিম নিজেই দূরে সরে যায়। দু-পা পিছিয়ে চুপচাপ ভঙ্গিতে দেখে যায় বিধ্বংসী দৃষ্টিকে। হ্যাঁ বিধ্বংসী। এই মুহুর্তে যে কেউ দেখলে দৃষ্টিকে বিধ্বংসীই বলবে। উদ্ভ্রান্তের মতো রক্তিম দূরে সরে যাবার পরও এখনো কেমন নিজেই নিজের গাল নখের আঘাতে ক্ষতবীক্ষত করে যাচ্ছে! এক সময় বুঝতে পারে রক্তিম তার থেকে দূরে সরে গেছে। ক্ষণকাল একটু থামে দৃষ্টি। পূণরায় হাতের উল্টোপিঠ কামড়ে ধরে গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে। রাতের নিস্তব্ধতায় কি বীভৎস শোনায় দৃষ্টির সেই চিৎকার! কান্নারত অবস্থায় অস্পষ্ট স্বরে বলে,

“আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল আপনাকে ভালোবাসা। সবথেকে বড় পাপ আমি করেছি আপনাকে ভালোবেসে। আগে যদি জানতাম এই ভালোবাসায় এতো বেদনা তবে নিজেই নিজের জীবন শেষ করে দিতাম। তবুও ভালোবাসা নামক নরকে ঝাপ দিতাম না।”

একটু থামে দৃষ্টি। প্রাণপণ চেষ্টা করে কান্না আটকানোর। ঠোঁট কামড়ে ধরে চিৎকার করা কান্নাটা বন্ধ করতে পারলেও চোখের অশ্রু বন্ধ হয়না। বন্ধ হয়না বুকের ভিতরের জ্বলন। সৃষ্টিকর্তার এ কেমন বিচার? নিষ্পাপ হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দেওয়ার পরও কেন এমন অপবাদ পেতে হয়! তার অবুঝ হৃদয়ের ভালোবাসায় তো কোনো স্বার্থ ছিলনা। সেই শুরু থেকে একদম নিঃস্বার্থভাবে সবটুকু ভালোবাসা নিংড়ে দিয়েছে পাষাণ মানুষটাকে। বিনিময়ে কি অবহেলাটুকু যথেষ্ট ছিলনা? সাথে কেন আবার যোগ হলো কথার আঘাত। কিভাবে পারল মানুষটা তার পবিত্র ভালোবাসায় অপবিত্রতার কালিমা লেপ্টে দিতে?

মুখ হা করে বড় বড় দম ফেলে দৃষ্টি। সময় নিয়ে নিজেকে একটু শান্ত করে তাকায় রক্তিমের দিকে। ফের নিবরি অশ্রু গড়িয়ে পরে দৃষ্টির গাল বেয়ে। দুহাতে গালে লেপ্টে থাকা অশ্রুটুকু মুছে ঠোঁট কামড়ে বেদনামিশ্রিত হেসে বলে,

“আমি বেহায়া। বড্ড বেহায়া আমি। অবশ্য আপনার সাথে দেখা হবার আগে এতোটা বেহায়া ছিলাম না। যেই আপনার সাথে দেখা হলো,সেই আমি দৃষ্টি পুরোটাই বদলে গেলাম। আমার অস্তিত্ব আমার ব্যক্তিত্ব পুরোটাই ভালোবাসা নামক এক অদৃশ্য বলয় গ্রাস করে নিয়েছে। বানিয়ে দিয়েছে আমাকে আস্তো এক বেহায়া। যদি বেহায়া না হতাম, তবে কখনো আজ এখানে আপনার স্ত্রী হয়ে বসে থাকতাম না। আর না আপনার এতো গুলো অপবাদ সহ্য করতাম। আগে জানতাম ভালোবাসা মানুষকে ব্যক্তিত্ববান বানায়। কিন্তু যখন নিজে ভালোবাসলাম! তখন দেখলাম একটা মানুষের ব্যক্তিত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে পুরোপুরি বেহায়াতে পরিণত করার নামই হলো ভালোবাসা। একবার যখন বেহায়া হয়েই গেলাম। তবে আর কি! না হয় নিলাম সহ্য করে আপনার সমস্ত অপবাদ। যদি আরও কোনো অপবাদ দেবার থাকে দিতে পারেন। বিশ্বাস করুন!কোনো অভিযোগ তুলবনা আপনার প্রতি। শুধু আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে ধৈর্য্য চাইব। আর অপেক্ষায় থাকব সেই দিনের, যেদিন আপনি নিজে আমাকে আকড়ে ধরবেন। মুখ ফোটে বলতে না পারলেও অনুশোচনায় ভুগবেন আমাকে দেওয়া আজকের অপবাদ গুলোর জন্য। সেদিন আমি ঠিক ভালোবাসার জোরে বুঝে নিব আপনার বুকের ভিতরে জ্বলতে থাকা অনুশোচনার আগুন। তবে একটুও উপহাস করবনা। আর না দিব আপনাকে বেশিক্ষন সেই আগুনে পুড়তে। স্ব-যত্নে আমার ভালোবাসার শীতল পরশে নিভিয়ে দিব সেই আগুন। উত্তপ্ত হৃদয়ের প্রতিটা কোণায় কোণায় বিছিয়ে দিব ভালোবাসা নামক শীতল পাটি।

চলবে….

দৃষ্টির আলাপন পর্ব-১৭+১৮

0

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৭
#আদওয়া_ইবশার

সকাল হয়েছে অনেক্ষন। কিন্তু পাখিরা আজ ব্যর্থ তাদের কিচিরমিচির রব তুলে রক্তিমের ঘুম ভাঙ্গাতে। সারা রাত দৃষ্টি নামক উটকো ঝামেলাটা কিভাবে ঘাড় থেকে দূর করবে এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই নির্ঘুম কেটেছে। তবে কোনো হদিস মিলেনি। অবশেষে ব্যর্থতাকে বরণ করে ফজরের ঠিক আগ মুহূর্তে ঘুমের দেশে পাড়ি দেয় রক্তিম। যার দরুন আজ এতো বেলা হওয়ার পরও ঘুমাচ্ছে সে। অন্যথায় ঠিক ফজর ওয়াক্তেই চোখ থেকে ঘুম উড়ে যায়। তার এই অভ্যাসটা তৈরি হয়েছিল ক্যাডেট কলেজ থাকাকালিন সময়ে। এরপর মিলিটারী চাকরি সূত্রে কঠোর নিয়মের বেড়াজালে সেই অভ্যাসটা একেবারে পাকাপুক্ত ভাবে থেকে যায় রক্তিমের জীবনে। দীর্ঘ পাঁচ বছরের সৈনিক জীবনের এমন আরও কিছু অভ্যাস এখনো রয়ে গেছে রক্তিমের জীবনে। এই যেমন প্রতিদিন ফজর ওয়াক্তে ঘুম থেকে ওঠে কমপক্ষে এক ঘন্টা সময় নিয়ে মর্নিং ওয়াক করবে। নেই শুধু চাকরিটাই। রক্তিম ওঠেনি দেখে আজ মেহেদীরও ওঠার কোনো নাম গন্ধ নেই। সেও পরে পরে ঘুমাচ্ছে।হঠাৎ ফোনের তীব্র শব্দে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে রক্তিমের। ঘুম ঘুম চোখে কপাল কুঁচকে পাপড়িদ্বয় অল্প ফাঁক করে ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকায়। বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নেয় আবারও। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে,

‌”এতো সকাল সকাল ফোন করেছেন কেন?”

ছেলের এমন জবাবে ফোনের অপর পাশে থেকে কপাল কুঁচকায় আজীজ শিকদার। সাথে কিছুটা অবাক হয় এটা ভেবে যে ছেলেকে কখনো ছয়টা পযর্ন্ত বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখেনি সেই ছেলে আজ এতো বেলা অব্দি ঘুমাচ্ছে! তাও আবার এখন বলছে এতো বেলাকে সকাল! কিছুটা চিন্তিত হয় আজীজ শিকদার। জিজ্ঞেস করে,

“কয়টা বাজে দেখেছো? তোমার জন্য সকাল এখনো অপেক্ষা করে নেই। অনেক আগেই সে বিদায় নিয়েছে। তুমি হঠাৎ এতো বেলা অব্দি ঘুমাচ্ছো কেন? শরীর ঠিক আছে?”

বাবার কথায় এবার দু-চোখের পাতা পুরোপুরি আলগা হয় রক্তিমের। কান থেকে ফোন নামিয়ে সময় দেখে বিস্মিত হয় অনেকটাই। আশ্চর্য! সে এতো বেলা অব্দি ঘুমিয়েছে! বিষয়টা যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা। ঘাড় কাত করে পাশে তাকিয়ে দেখে মেহেদীও এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। শরীরটা কেমন মেচমেচ করছে রক্তিমের। এটা নিশ্চয়ই অনিয়ম করে এতো বেলা অব্দি ঘুমানোর ফল। অলসতা ঝেড়ে তৎক্ষণাৎ শোয়া থেকে ওঠে বসে। বাবাকে জবাব দেয়,

“আমার শরীরের আবার কি হবে?গন্ডারের চামড়ায় যেমন কখনও আঘাত লাগেনা। তেমন আমার শরীরেও কখনো অসুখ বাঁধেনা। রাতে একটু দেরীতে ঘুমিয়েছিলাম তাই ওঠতে বেলা হলো। তা আপনি বলুন কেন ফোন দিলেন? সব ঠিকঠাক! না কি কেউ আবার কোনো গন্ডগোল পাকিয়েছে?”

“সব ঠিকঠাক আছে। ফোন করেছি রেডি হতে বলার জন্য। দ্রুত ওঠে ঝটপট রেডি হয়ে নাও। আমরা আজই ময়মনসিংহ যাব দৃষ্টির বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।”

অচিরেই যেন রক্তিমের মাথায় ধুম করে মস্ত বড় আকাশটা ভেঙ্গে পরে। সদ্য জাগ্রত হওয়া শান্ত মস্তিষ্ক তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারেনা কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কতক্ষণ স্থবির হয়ে বসে থেকে স্থিমিত স্বরে প্রশ্ন করে,

“আজকে না মা’কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার কথা! তো ওখানে যাবেন কখন?”

“সকালটা এখন হয়নি বাবা। গুণে গুণে একেবারে সাড়ে চার ঘন্টা আগে সকাল হয়েছে। আর ডাক্তারেরাও আপনার মতো সারারাত রাজকার্য শেষ করে দশটায় ঘুম থেকে ওঠে দুটোই রোগী দেখতে বসেনা। ডাক্তার দেখিয়ে কতক্ষণ আগেই এসেছি।”

জবাবে শুধু ছোট্ট করে “ওহ্” বলে রক্তিম। পূনরায় কিছুক্ষণ চুপ থেকে জানতে চায়,

“ডাক্তার কি বলেছে?”

“হুট করে এতো বড় একটা আঘাত মস্তিষ্ক নিতে পারেনি। ভয়টা মন-মস্তিষ্ক দখল করে নিয়ে একেবারে মানসিক রোগীতে পরিণত করে রেখেছে। ধীরে ধীরে সঠিক কাউন্সেলিং আর চিকিৎসায় ঠিক হবে।”

বুক ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রক্তিম। হতাশাগ্রস্থ হয়ে ডান হাতে মুখের একপাশ ঘষতে থাকে বারবার। সুস্থ্য স্বাভাবিক মা’কে মানসিক রোগীতে পরিণত করার জন্য অজান্তেই মনটা নিজেকেই দায়ী করে। এক ভালোবাসা নামক অভিশপ জীবনটাকে নরক করে দিয়েছে একেবারে। পূণরায় আবার কিভাবে রক্তিম নিজেকে সেই নরকের মাঝে নিয়ে যাবে? কেন বুঝতে চাইছেনা বাবা, ঐসব প্রেম, ভালোবাসা, সংসার অন্যদের জীবনে সুখ এনে দিলেও তার জীবনে শুধু কষ্ট ছাড়া কিছুই দেয়না। গত দুটো বছরে এই ভবঘুরে ছন্নছাড়া জীবনটাতেই তো মানিয়ে নিয়েছে রক্তিম নিজেকে। সময়ের সাথে সাথে পুরনো সেই ক্ষতটাতেও হালকা প্রলেপ পরতে শুরু করেছে। সেই প্রলেপ ছুটিয়ে ক্ষতটাকে নতুন করে তাজা করতে কেন ওঠেপরে লেগেছে আজীজ শিকদার আর ঐ মেয়েটা?

“আমাকে শান্তিতে থাকতে দেখে কি সত্যিই আপনার ভালো লাগছেনা? কেন বাবা হয়েও বারবার ঐ বিভীষিকাময় জীবনের দিকে ঠেলছেন?”

অসহায় কন্ঠে জানতে চায় রক্তিম। গম্ভীর্যতার দেয়াল ডিঙিয়ে এতোদিন পর ছেলের এভাবে অসহায় স্বরের কথা শুনে আজীজ শিকদারের মনটা অশান্ত হয়। ভিতরে ভিতরে সন্তানের অসহায়ত্বে গুড়িয়ে যায় বাবা নামক সত্তাটা। বুকের ভিতর হাহাকার করে ছেলেটার একটু সুখ দেখতে। ভিতর থেকে গুড়িয়ে গেলেও মুখে তা প্রকাশ করেনা আজীজ শিকদার। কঠোর স্বরে উত্তর দেয়,

“যা খুশি ভাবতে পারো। তোমার ভাবনায় আমার চেষ্টা থেমে যাবেনা। সন্তানের ভালোর জন্য বাবা-মা’কে অনেক সময় তাদের বিরুদ্ধে যেতে হয়। যা এই মুহূর্তে আমি করছি। এই যাত্রায় শেষ। আমাকে এই শেষ চেষ্টাটুকু করতে দাও। কথা দিচ্ছি, এবার যদি আমি ভুল হই তবে আর কখনো তোমার সামনে কোনো আবদার নিয়ে যাবনা। তোমার যেভাবে খুশি সেভাবেই চলতে পারবে।”

কঠোর চিত্তে কথাগুলো বলতে চাইলেও শেষ পযর্ন্ত কঠোরতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় আজীজ শিকদার। শেষের কথাগুলোতে রক্তিম স্পষ্ট টের পায় বাবার ব্যকুলতা। যার দরুন সে নিজেও আর কোনো পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনা। এই দুটো বছর যাবৎ মানুষ গুলো তার থেকে তো আর কম কষ্ট পায়নি। কষ্টের আঘাত সহ্য করতে না পেরে বর্তমানে একজন মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে। আরেকজন এখনো সন্তানের মঙ্গল কামনায় তৎপর। একেই বুঝি বলে বাবা-মা! যারা সন্তানের থেকে শত কষ্ট পাবার পরও তাদের ভালোর কথা ভাবতে ভুলেনা। এই যাত্রায় কেন যেন বাবার মুখের উপর না শব্দটা ছুড়ে দিয়ে তাকে কষ্ট দিতে বিবেকে বাঁধে রক্তিমের। কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা ছাড়াই আস্তে করে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

এতোক্ষনে ঘুম ভেঙ্গে গেছে মেহেদীর। আড়মোড়া ভেঙ্গে ওঠে বসে। পরপর দুটো হাই তুলে তাকায় রক্তিমের দিকে। দেখতে পায় কেমন নির্জীবের মতো মাথাটা নত করে পা ঝুলিয়ে বসে আছে রক্তিম। তার এমন নির্জীবতায় খুব একটা অবাক হয়না মেহেদী। বৈশাখ থেকে চৈত্র বারো মাসেই তো এই ছেলে এমন নিঃস্পৃহ। এর এমন জড় বস্তুর মতো আচরণের জন্য নতুন করে কিছু ঘটতে বা ঘটাতে হয়না। কথাটা ভেবে অলস শরীরটা আবারও লুটিয়ে দেয় বিছানায়। ঠিক তখনই রক্তিম আগের অবস্থানে থেকেই শান্ত ভাবে বলে,

“ওঠে রেডি হো। বেড়োতে হবে আমাদের।”

একটু কপাল কুঁচকায় মেহেদী। তার জানা মতে আজকে তো কোনো কাজ থাকার কথা না। কাজের মাঝে শুধু একটাই অকাজ আছে। সেটা হলো মোড়ের দোকানে বসে কাপের পর কাপ চা শেষ করা আর সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে বায়ু দোষণ করা। সেটার জন্য নিশ্চয়ই এতো তাড়া দেওয়া না! তবে কেন? প্রশ্নটা মাথায় রেখে জানতে চায়,

“কেন? কোথাও যাবি না কি?”

বসা থেকে ধীরেসুস্থে ওঠে দাঁড়ায় রক্তিম।আলনায় এলোমেলো হয়ে থাকা কাপড়ের স্তুপ থেকে বেছে একটা শার্ট আর একটা প্যান্ট নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ময়মনসিংহ যেতে হবে। নব নির্বাচিত এমপি সাহেবের আদেশ দ্রুত বেড়িয়ে পরতে হবে।”

হঠাৎ ময়মনসিংহ কেন যেতে হবে ভেবে পায়না মেহেদী। কোথায় ভেবেছিল আজকে এতোদিন পর একটু মনের সুখে পরে পরে ঘুমাবে। কিন্তু এই বাপ-ছেলের যন্ত্রণায় সেটাও আজ হয়ে ওঠলনা। চোখে-মুখে বিরক্তি নিয়ে না চাইতেও ওঠে যায় মেহেদী। রক্তিমের পাশাপাশি নিজেও কিছুটা পরিপাটি হয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। রাস্তায় দাঁড়ানোর দুই মিনিটের মাথায় দেখতে পায় এমপি সাহেবের গাড়ি তাদের সামনে এসে উপস্থিত। ড্রাইভারের পাশের সিটটা ঝটপট দখল করে নেয় রক্তিম। মেহেদী কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে উপায় না পেয়ে পিছনের সিটে আজীজ শিকদারের পাশে গিয়ে বসে। ঠিক তখনই দেখতে পায় আজীজ শিকদার কেমন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। একটু অপ্রস্তুত হয় মেহেদী। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে কতক্ষণ উঁশখোঁশ করে অপ্রস্তুত হেসে সালাম জানায়। শব্দ করে সালামের জবাব দেয়না আজীজ শিকদার। মনে মনে জবাব দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় অন্যদিকে। এতে যেন মেহেদী আরও একটুর অপ্রস্তুত হয়। ভাবে এই মহান হৃদয়ের অধিকারী এমপির চোখে সে আবার কোন ভুল করে বসল?

***
ময়মনসিংহ শহরে স্বগৌরবে অবস্থানরত দৃষ্টিদের একতলা বাড়িটার বাহিরের সৌন্দর্যটায় যেন আশেপাশের উচু দালান গুলোকে হার মানাতে বাধ্য। বাড়ির নকশা, চারদিকের পরিবেশ এটুকু দেখেই যে কেউ বলে দিতে পারবে অত্যন্ত রুচিশীল কোনো মানুষের বসবাস এখানে। ভিতরের পরিবেশটাও ঠিক সেটাই বহন করে। সাদেক সাহেব মনের ইচ্ছে পুরোটা উজাড় করে মন মতো ডিজাইনে সুদক্ষ কারিগর দিয়ে তৈরী করেছেন নিজের ছোট্ট প্রাসাদটা। পূণরায় সেটা দিলশান আরা মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়েছেন। দুজনের যৌথ ইচ্ছেতে পরিপূর্ণ রূপ নিয়েছে এই স্বপ্ন নিবাস। যে নিবাসের একমাত্র স্বপ্নচারিনী দিলশান আরা। যার কাজই হলো নিজের স্বপ্ন গুলোকে পূর্ণতা দান করার জন্য নিজের পাশাপাশি স্বামী, সন্তানদেরকেউ সেই পথে পরিচালনা করা। সর্বদা নিজের বাড়িতে দাম্ভিকতার সাথে নিজের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দেওয়া দিলশান আরা হয়তো কখনো ভুল করেও ভাবেনি তার জীবনে এমন কোনো দিন আসতে পারে, যেদিন তার বাড়িতে দাঁড়িয়ে বাইরের কিছু মানুষ তার কথার বিরোধীতা করে জয় ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। ভাবনাতীত সেই দিনটাই বোধহয় আজ। দুপুরের একটু পরপর কলেজ ছুটির পর বাড়িতে এসেছিল দিলশান আরা। এসে প্রতিদিনের মতোই সবার আগে ছেলে-মেয়ে দুটোর খোঁজ নিয়ে চলে যায় নিজের রুমে। ফ্রেশ হয়ে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় লাগানোর সাথে সাথেই বেজে ওঠে ডোরবেল। দৃষ্টি-দিহান দুজনই তখন দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমাচ্ছিল। কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেও ওঠে যায় দিলশান আরা। সদর দরজা খুলে দিতেই বাড়িতে প্রবেশ করে একে একে এলাকার নবনির্বাচিত এমপি, সিটি কর্পোরেশনের মেয়ের সহ আরও কিছু গন্যমান্য রাজনৈতিক ব্যক্তি। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে দিলশান আরা। হুট করে কোনো কারণ ছাড়াই এতো এতো রাজনৈতিক দলের লোক তার বাড়িতে ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভূত লাগে। সেই সাথে মনের কোণে সঞ্চার হয় অল্প ভীতি। ভাবে নিজেদের অজান্তে আবার কোনোভাবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যায়নি তো!

“আমরা যদি ভুল না করি তবে এটাই তো সাদেক সাহেবের বাসা তাইনা!”

শুভ্র পাঞ্জাবী পরিহিত আজীজ শিকদার ঠোঁটের কোণে স্মতি হাসি নিয়ে সরল কন্ঠে জানতে চায়। একটু ধাতস্থ হয় দিলশান হয়। মনে মনে অল্প ঘাবড়ালেও মুখবিবরে তা প্রকাশ করেনা। স্বভাবজাত নিজের শিক্ষক জীবনের ব্যক্তিত্ব ধরে রেখেই বলে,

“জ্বি। এটাই সাদেক সাহেবের বাসা। আমি ওনার ওয়াইফ। তবে আপনারা হঠাৎ আমাদের বাসায় সঠিক কি কারণে বুঝতে পারলাম না। বিষয়টা একটু পরিষ্কার করে বললে ভালো হতো।”

“এসেছি যখন সব কিছুই বলব। তবে আমরা কি বসে কথা বলতে পারি? আর হ্যাঁ। সাদেক সাহেবকে ডাকলে একটু ভালো হয়। আপনাদের দুজনের সাথেই আমাদের কিছু কথা আছে।”

“নিশ্চয়ই। বসুন আপনারা। সাদেক সাহেব বাসায় নেই। অফিসে। আমি ওনাকে আসতে বলছি।”

“জ্বি ধন্যবাদ।”

মুচকি হেসে কথাটা বলে একে একে সাথে নিয়ে আসা রাজনৈতিক দলের প্রত্যেককে নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসেন আজীজ শিকদার। তবে রক্তিম মেহেদী এখনো সেই দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে। রক্তিমের চোখে-মুখে রাজ্যের বিরক্তি। সে এখানে আসতে রাজি হয়েছিল কারণ জানত তার বাবা কখনো এই প্রস্তাবে দৃষ্টির বাবা-মাকে রাজি করাতে পারবেনা। দৃষ্টি যেদিন প্রথম তার সাথে দেখা করে সেদিনই অতি সচেতন রক্তিম শিকদার তার সম্পর্কে সকল খোঁজ খবর নিয়ে রাখে। এটা ভেবে, মেয়েটাকে আবার নতুন কোনো চাল শিখিয়ে বিরোধী দল পাঠিয়েছে কি না। তখনই সাদেক সাহেব এবং দিলশান আরা’র যে ব্যক্তির সন্ধান রক্তিমে পেয়েছিল সেটা থেকেই নিশ্চিত ছিল সে এমন সচেতন দুজন বাবা-মা কখনো তাদের মেয়ের জন্য এই প্রস্তাব মানবেনা। হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হবে আজীজ শিকদারকে। কিন্তু কে জানত লোকটা যে নিজের রাজনৈতিক পাওয়া খাটিয়ে একেবারে দলবল নিয়ে এসে হাজির হবে? এখন নিশ্চয়ই এই মানুষ গুলোকে নিজেদের ক্ষমতার দাপটে হাত করে নিবে। কথাটা ভেবেই মনে মনে অস্থির হয় রক্তিম। অন্যদিকে মেহেদীর চোখে-মুখে হতবুদ্ধিতার লেশ। সে এখন পযর্ন্ত এটাই বুঝতে পারছেনা এখানে আসার উদ্দেশ্যটা কি। এমনকি এটাই যে তার গুন্ডা বন্ধুকে ভালোবাসার মতো দুঃসাহসী মেয়ে দৃষ্টির বাসা এটাও এখন পযর্ন্ত জানতে পারেনি।

চলবে……

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৮(প্রথম অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

ড্রয়িং রুম জুড়ে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। স্ত্রীর ফোন পেয়ে সাদেক সাহেব তৎক্ষণাৎ ছুটে আসে বাসায়। তবে ঘটনার বিস্তারিত বুঝতে পারেনা কিছুই। এখন পযর্ন্ত সৌজন্যমূলক আলাপচারিতা ছাড়া সঠিক উদ্দেশ্যের কথা কেউ জানায়নি। পরিচয় পর্বের মাঝেই সাদেক সাহেব জানতে পারে নিজের এলাকার মেয়র, এমপির সাথের অপরিচিত লোক গুলোর একজন সাভারের এমপি এবং এমপি পুত্র সাথে তার বন্ধু। হুট করে কোনো আগামবার্তা ছাড়া নিজের এলাকার রাজনৈতিক সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে অন্য এলাকার এমপিও উপস্থিত বিষয়টা ক্রমশই গভীর চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে দৃষ্টির মা-বাবা দুজনকেই। কিছুতেই কিছু ভেবে পাচ্ছেন না ঠিক কি কারণে ওনারা সরাসরি বাসায় এসে উপস্থিত হতে পারে। কোনো কূলকিনারা না পেয়ে ভাবনা-চিন্তা একপাশে রেখে সাদেক সাহেব সৌজন্য হেসে বলেন,

“আপনাদের মতো এতো সম্মানীয় ব্যক্তি আমার বাসায় এসেছে বিষয়টা সত্যিই আমার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু ঠিক কি কারণে হঠাৎ আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের বাসায় আসলেন বিষয়টা ক্লিয়ার করলে হয়তো আমাদের সবার ভালো হতো।”

সাদেক সাহেবের কথায় উপস্থিত সকলেই একটু নড়েচড়ে বসে। আজীজ শিকদার নিজের পাশে বসা ময়মনসিংহ আসনের এমপি মাজহারুল ইসলামকে ইশারায় কথা শুরু করতে বলেন। কৃত্রিম কাশির শব্দ তুলে মাজহারুল ইসলাম সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে শুরু করেন,

“দেখুন ভাই সাহেব হতে পারি আমরা বর্তমানে নিজেদের এলাকার এমপি পদে আছি। তবে আমি-আপনি আমরা সবাই তো সাধারণ মানুষেই তাই না! আপনারা যদি আমাদের ভোট না দিয়ে এলাকার ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব না দিতেন তবে তো আর আমরা এই দায়িত্ব পেতাম না। তাই বলছিলাম আমাদের স্বাভাবিক মেহমান হিসেবে গ্রহণ করলেই আমরা খুশি হবো। তাছাড়া আমাদের আজকে এখানে আসার উদ্দেশ্যটাই আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি করার জন্য।”

আত্মীয়তার জন্য ওনারা এই বাসায় বাসায় এসেছে! কিন্তু কিরকম আত্মীয়তা? সঠিক বুঝতে পারছেনা সাদেক সাহেব। দিলশান আরা, সাদেক সাহেব সন্দিহান চোখে একে অপরের দিকে তাকায়। মাজহারুল ইসলাম আবারও বলে ওঠেন,

” যাইহোক। বাকী কথা টুকু না হয় আজীজ ভাই আপনি নিজেই বলুন।”

মুচকি হেসে সম্মতি জানায় আজীজ শিকদার। সরাসরি সাদেক সাহেবের তাকিয়ে বলেন,

“আপনার মেয়ে দৃষ্টি মেহজাবিন কিছুদিন আগে সাভারে বেড়াতে গিয়েছিল আপনার বড় শ্যালিকার বাড়ি। সেখানেই ওর সাথে আমার দেখা হয়। প্রথম বার দেখেই আপনার মেয়েকে আমার ছেলের জন্য মনে ধরে। আমি সবসময় সব কথা সরাসরি বলতে পছন্দ করি ভাইজান। তাই ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে না বলে সরাসরিই বলে দিচ্ছি। আপনার বাসায় আমি আমার ছেলে রক্তিম শিকদারের জন্য আপনার মেয়ের হাত চাইতে এসেছি।”

দৃষ্টি নামটা শোনা মাত্রই লাফিয়ে ওঠে মেহেদী। হতবাক দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে থাকে রক্তিমের দিকে। এটা যে তার বন্ধুর প্রেমে দিওয়ানি হওয়া সেই মেয়েটার বাড়ি তা এতোক্ষনে মাত্র জানতে পারল মেহেদী। কিন্তু কিভাবে কি হলো? ঐ মেয়ের খোঁজ আজীজ শিকদার অব্দি কিভাবে পৌঁছালো? আর রক্তিমেই বা সব জেনেও কিভাবে রাজি হলো এখানে আসতে? তবে কি ভিতরে ভিতরে বন্ধু তার আবারও প্রেমে মজলো? কিন্তু কখন? দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা একসাথে থেকেও সে একটুও টের পেলনা কেন? আচ্ছা সে না হয় মেনে নিল রক্তিম মেয়েটার প্রেমে পরেনি। আজীজ শিকদার নিজ উদ্যোগে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। তারপরও তো এখানে একটা কিন্তু থেকে যায়। আজীজ শিকদার যদি নিজ উদ্যোগেই এই পর্যন্ত আসে তবে রক্তিম কিভাবে আসল? সে তো এতো সহজে বাবার কথায় রাজি হয়ে চলে আসার পাত্র না। তাছাড়া এই মুহুর্তে রক্তিমের চোখ-মুখ দেখেও মনে হচ্ছেনা সে আগে থেকে কিছু জানতনা বা তাকে জোর করে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে কি! আর কিছুই ভাবতে পারেনা মেহেদী। মাথা এখনই পুরো ফাঁকা মনে হচ্ছে তার। এতো বড় একটা ঘটনা বদ হজম হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বহু কষ্টে মেহেদী তা চেপে রাখছে। ঘটনা পুরোটা না জেনে মুখ খোলা ঠিক হবেনা।

এমন কিছু আবদার নিয়ে যে মানুষ গুলো ওনার বাসায় এসেছে সেটা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি তারা সাদেক সাহেব। দিলশান আরা কথাটা শোনা মাত্রই বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতেই ইশারায় থামিয়ে দেয় সাদেক সাহেব। স্ত্রীকে শান্ত হয়ে বসতে ইশারা করে ওনি নিজেই স্মিত হেসে বলেন,

“মেয়ের বাবা হয়েছি,বিবাহ যোগ্য মেয়ে ঘরে আছে এমতাবস্থায় প্রস্তাব আসাটাই স্বাভাবিক। তবে ভাইসাহেব, আমাদের মেয়েকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে আমরা প্রস্তুত নই। মেয়ে পড়ছে পড়োক। একটা মাত্র মেয়ে আমাদের। তাকে প্রতিষ্ঠিত করার আগেই বিয়ে নিয়ে ভাববনা আমরা।”

“প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে মেয়েরা তো বিয়ের পরেও হতে পারে। তাছাড়া আজকালের যুগে আমার মনে হয় মেয়েদের আঠারো হলেই যোগ্য পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই বাবা-মায়ের জন্য ভালো। কারণ ছেলে-মেয়েরা বড় হলে কলেজ-ভার্সিটিতে গিয়ে বাবা-মায়ের আড়ালে ভুল কোনো সম্পর্ক বা অন্য কিছুতে জড়িয়ে পরে কি না এই সম্পর্কে কিন্তু আমরা সবসময় অবগত থাকিনা। সেকারণেই…”

“মাজহারুল ইসলাম নিজের কথা শেষ করার আগেই দিলশান আরা বলে,

“বিয়ে দিয়ে দিলেই যে মেয়ে কোনো খারাপ কাজে বা সম্পর্কে জড়াবেনা এটার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? যে মেয়ের এমন সম্পর্কে জড়ানোর ইচ্ছে থাকে তাকে শুধু বিয়ে কেন সে যদি দুই-তিন বাচ্চার মা’ও হয়ে যায় তবুও সে অবৈধভাবেই সম্পর্ক রাখবে। ভুল পথে পা দিবে। আর যে মেয়ের এমন কোনো ইচ্ছে না থাকে সে মেয়ে বিয়ের আগেও কোনো সম্পর্কে জড়াবেনা বিয়ের পর তো কথায় নেই। তাছাড়া আমার মেয়েকে এখন বিয়ে দিলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে যাব এর মানে কি? আমার মেয়ে নিয়ে যদি আমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ থাকে তবে সেটা বিয়ে না দিলেও থাকবে বিয়ে দিলেও থাকবে। আর সবথেকে বড় কথা আমাদের মেয়ের কি করলে ভালো হবে কি করলে খারাপ হবে এটা বোঝার জন্য আমরা এখনো বেঁচে আছি। আপনাদের কষ্ট করে এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা। অনেক দূর থেকে এসেছেন আপনারা, নিজেদের অনেকটা মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন সেজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত সাথে অসংখ্য ধন্যবাদ। এবার আপনারা আসতে পারেন।”

মুখের উপর সরাসরি এমন একটা জবাব ছুড়ে দেওয়াই উপস্থিত সকলের মুখে অসন্তুষ্টির রেশ থাকলেও রক্তিম নির্বিকার। দিলশান আরা’র কথা গুলো অন্য সবার মতো তার কাছে কটূক্তি মনে না হয়ে অত্যন্ত শ্রুতিমধুর বাণী মনে হচ্ছে। সে আগে থেকেই এমন একটা ধারণা করেছিল। মেয়ের বাবা-মা এখনো ছেলে সম্পর্কে জানলোই না। তার আগেই এমন প্রতিক্রিয়া! আর ছেলে সম্পর্কে যখন সবটা জানবে তখন কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে? সেই প্রতিক্রিয়া দেখার পর আজীজ শিকদারের মুখটাই বা কেমন দেখাবে? আজীজ শিকদার কি খুব বেশি অপমানিত বোধ করবে না ঐসব কটূক্তি গায়ে মাখবেনা! ঠোঁটের কোণে ধূর্ত হাসির রেখা ঝুলিয়ে মাথা নত করে সেসব ভাবনায় মশগুল রক্তিম। ঠিক তখনই কর্ণগোচর হয় আজীজ শিকদারের কথা। দিলশান আরা’র কথায় একটুও অপমানিত হবার না হয়ে স্বহাস্যে আজীজ শিকদার বলেন,

“সে নাহয় বুঝলাম আপা। কিন্তু আপনার মেয়ে আর আমার ছেলে যে একে অপরকে ভালোবাসে! এখন আপনি কি বলবেন? এই মুহুর্তে কি আমাদের উচিৎ না তাদের নামহীন সম্পর্কটা মেনে নিয়ে বৈধতার সাথে নতুন একটা নাম দেওয়া! এখন যদি আমরা এটা না করি তবে হয়তো একদিন আগে হোক বা পরে, মানুষ ওদের মেলামেশা দেখে নানান কথা রটাবে। বাবা-মা তুলেও মন্তব্য করবে। বলবে কেমন বাবা-মা? ছেলে-মেয়েদের এভাবে ছেড়ে দিয়েছে। তখন কি সেসব শুনতে বা দেখতে ভালো লাগবে আপনাদের?”

কথাটা শোনা মাত্র সাদেক সাহেব, দিলশান আরা যতটা না অবাক হয়েছে তার থেকেও অধিক বিস্মিত রক্তিম। আজীজ শিকদার কি বলল এসব? তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে মানে? রক্তিম কখন ঐ মেয়েকে ভালোবাসতে গেল? সে পারেনা একেবারে মেয়েটার গলা চেপে ধরে শ্বাস রোধ করে মে রে ফেলেতে। সেখানে কি না বলল রক্তিম ঐ মেয়েকে ভালোবাসে! মুহূর্তেই শান্ত মেজাজ উত্তপ্ত হয় রক্তিমের। ছলাৎ করেই যেন পায়ের রক্ত সব মাথায় ওঠে যায়। মেজাজ খিঁচিয়ে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই বাঁধা পরে যায় আজীজ শিকদারের কঠিন দৃষ্টির কাছে। না চাইতেও শান্ত হয়ে যায় শরীরের উত্তপ্ত রক্ত কণিকা। সে যতই খারাপ হোক। আর যতই বাবার অবাধ্যতা করুক। সবটাই তো নিজের এলাকায় করেছে। এখন এরকম অন্য এক এলাকায় এমন সম্মানীয় মানুষ গুলোর সামনে বাবার কথার অবাধ্য হতে মন সাই দেয়না রক্তিমের। সবার অলক্ষ্যে আগোচরে চোয়াল শক্ত করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সামলে নেয় নিজেকে। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত কি হয় সেটা দেখার।

চলবে…..

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৮(শেষ অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

নিজের মেয়েকে ঘিরে এমন একটা কথা শুনে বুকের ভিতর মুচড়ে ওঠে দিলশান আরা’র। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আজীজ শিকদারের দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থাকে। পরক্ষনে নিজেকে সামলে জোর গলায় প্রতিবাদ জানিয়ে বলে,

“একদম ফালতু কথা বলবেন না আমার মেয়েকে ঘিরে।সেই তখন থেকে কিসব অযৌক্তিক কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন! আমি আগেই বুঝতে পারছিলাম আপনারা আমার বাড়িতে এসেছেন কিছু একটা অশান্তি করার জন্যই। আমার বাড়িতে বসে আমার মেয়ে সম্পর্কে এমন একটা কথা বলার পরও আমি যথেষ্ট আন্তরিক ব্যবহার করছি আপনাদের সাথে। সম্মানের সহিত বলছি, দয়া করে বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। অন্যথায় আপনাদের সাথে ঠিক কতক্ষণ আন্তরিকতা বজায় রাখতে পারব তা সঠিক বলতে পারছিনা।”

আজীজ শিকদার এখনো শান্ত। কথাগুলো একদম গায়ে লাগেনি, এমন একটা ভান করে বোঝানোর স্বরে বলে,

“আহা! এতো রেগে যাচ্ছেন কেন আপা? আমি তো খারাপ কিছু বলিনি। ভালোবাসা পবিত্র একটা শব্দ। এটাতে খারাপ কি পেলেন? তাছাড়া আমি যতটুকু জানি আপনাদেরও ভালোবাসার বিয়ে। ভালোবাসা খারাপ হলে তো নিশ্চয়ই আপনাদের মতো দুজন শিক্ষিত মানুষ ভালোবেসে সংসার গড়তেন না! তবে এখন কেন মেয়ের ভালোবাসার কথা শুনে এমন রিয়েক্ট করছেন?”

চমকের পালা যেন শেষই হচ্ছেনা সাদেক সাহেব, দিলশান আরা’র। লোক গুলো কেমন আসার পর থেকেই একের পর এক বুক কাঁপানো আওয়াজ দিয়ে যাচ্ছে! সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়, ওনারা এটা জানল কিভাবে যে তারা ভালোবেসে বিয়ে করেছে? সাদেক সাহেব, দিলশান আরা তো কখনো এই কথাটা নিজের ছেলে-মেয়ের কান পযর্ন্ত পৌঁছাতে দেয়নি। ওনাদের পৈত্রিক ভূমি ময়মনসিংহের তারাকান্দা গ্রামের হাতে গুণা কয়েকজন মানুষ ছাড়া তো এই কাহিনী শহরের কেউ জানেনা। বহু বছর আগেই সেই অতীত গ্রামে ফেলে জীবিকার তাগিদে আর অল্প আয়েশী জীবনের আশায় ছুটে এসেছিল এই শহরে। তাহলে এই গোপন তথ্য কিভাবে জানল লোকগুলো! তবে কি ওনারা এখানে আসার আগেই সব খবরাখবর জেনেই এসেছে! রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত মানুষ গুলো এমনিতেই ধূর্ত হয়। এরা সর্বদা নিজেদের পাওয়ার খাটিয়ে অসম্ভবপ্রায় কাজকেও সম্ভব করে নেয় এক চুটকিতেই। তবে কি এবার এই মানুষ গুলোর ক্ষমতার কাছে নত হতে হবে তাদের? মেয়ের জন্য যে প্রস্তাব এনেছে মেনে নিতে হবে তা! কথা গুলো যত ভাবছে ততই অস্থির হয়ে ওঠছে দিলশান আরা। একটা মাত্র মেয়ে তাদের। সেই মেয়েটাকে কিছুতেই তারা রাজনীতি নামক নোংরা শব্দের সাথে জড়িত মানুষ গুলোর হাতে দিবেনা। তাছাড়া কোথায় তাদের বসবাস ময়মনসিংহ আর ছেলের বসবাস ঢাকার সাভারে! তারা না জানে ছেলে সম্পর্কে, আর না জানে ছেলের পরিবার সম্পর্কে। হুট করে মস্তিষ্কে ছেলের কথা স্বরণ হতেই তড়িৎ শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তিমের দিকে তাকায় দিলশান আরা। মুখে দাড়ি-গোঁফ আর অপরিপাটি চুলের বেহাল অবস্থায় আপাত দৃষ্টিতে যে কেউ দেখলে প্রথমেই বলে দিবে,এলাকার বড় ভাই টাইপ ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ানো গুন্ডা ধাচের ছেলে। বয়সটাও তো কম মনে হচ্ছেনা। কিন্তু মুখ ভর্তি দাড়ি আর মাথা ভর্তি এলোমেলো চুলের ভীরে লুকিয়ে থাকা শ্যাম পুরুষের সুডৌল চেহারাটা নজরে পরলে যে কোনো মেয়ে মুগ্ধ হতে বাধ্য, এই কথাটা মানতে হবে। তবে যায় হোক, কিছুতেই এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য না। তাছাড়া এটাও বিশ্বাসযোগ্য না, দৃষ্টি নিজের থেকে এতো বড় একটা ছেলেকে ভালোবাসতে পারে।

দিলশান আরা’র ভাবনা গুলোকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে কিছুটা রাগত স্বরে সাদেক সাহেব বলে ওঠেন,

“ফাজলামি করতে এসেছেন আমার বাড়িতে? আমরা কি করব না করব, আমাদের সন্তানেরা কি করবে না করবে সেটা একান্তই আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনারা যতই ক্ষমতাশীল মানুষ হয়ে থাকুন না কেন, কারো ব্যক্তিজীবনে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কেউ দেয়নি আপনাদের। দেখুন, আপনাদের মতো মানুষের সাথে আমার ঝামেলা করার কোনো শখ নেই। আমি অতি সাধারণ মানুষ সাধারণ ভাবেই জীবন যাপন করতে পছন্দ করি। দয়া করে আমার পরিবারে জটিলতা সৃষ্টি করবেন না।”

“জটিলতা আমরা না আপনারা সৃষ্টি করছেন। একটা সহজ বিষয়কে সহজ ভাবে মেনে নিলেই তো সব মিটে যায়। কেন শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে বিষয়টাকে জটিল করছেন? তাছাড়া যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে দুজন দুজনকে ভালোবাসে সেখানে আপনারা কিন্তু কোনোভাবেই বাঁধা দিতে পারবেন না। কোনো ঝামেলা ছাড়া বিষয়টা মেনে না নিয়ে আইনি পদক্ষেপের দিকেও যদি যান তবে সেখানেও কিন্তু কোনো বাঁধা দিতে পারবেনা তারা। কারণ আপনাদের মেয়ে রাজি এই প্রস্তাবে। আর তার বয়স’ও বর্তমানে আঠারো ছাড়িয়েছে। এখন আর তার উপর নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারবেননা। কোট-কাচারি করেও যখন লাভের লাভ কিছুই হবেনা তাই বলছি, আত্মীয়তার আগেই দুই পরিবারে তিক্ততার সৃষ্টি না করে বিষয়টা মেনে নিন। এতে সম্মান, সম্পর্ক দুটোই ঠিক থাকবে।”

এমপি মাজহারুল ইসলামের কথার ধরনে দৃষ্টির বাবা-মা এবার স্পষ্ট বুঝে যায় এরা সহজে দমার পাত্র না। আঁটঘাঁট সব বেঁধেই এসেছে। এক একটা কথার পিঠেই সু-স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে আইন’ও তাদের আশ্রয় দিবেনা। এবার যেন দিশেহারা দুজনেই। সর্বদা নিজের কঠোর ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে মাথা উচিয়ে চলা দিলশান আরা’র চোখে-মুখে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। সেই অসহায়, উস্থির চিত্তে তাকায় স্বামীর দিকে। সাদেক সাহেব নিজেও ভেবে পায়নি কি বলে দমাবে এদের। স্ত্রীর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে আদেশ ছুড়ে,

“দৃষ্টিকে ডেকে নিয়ে আসো। যা শোনার ওর মুখ থেকেই শুনতে চাই। বাইরের কোনো মানুষের থেকে নিজের মেয়ে সম্পর্কে কিছু শুনে বিশ্বাস করে নিব,এতোটাও অপদার্থ বাবা আমি না।”

সাহেক সাহেবের কথায় মনে মনে হাসে আজীজ শিকদার। নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে শরীর নাড়িয়ে আরেকটু আয়েশ করে বসে। আমুদে কন্ঠে সম্মতি জানিয়ে বলে,

“হ্যাঁ তাই করুন। মেয়ের মুখ থেকে সবটা শোনার পর আশা করি আপনারা কোনো আপত্তি করবেন না।”

সন্দেহের পালাটা যেন ধীরে ধীরে সত্যি হবার সংকেত দিচ্ছে। দিলশনা আরা সাদেক সাহেব এই পর্যায়ে নিজের মেয়েকে নিয়েই সন্দিহান হয়। লোকটা যেভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে দৃষ্টির থেকে জানার কথা বলছে এতেই প্রমাণ হয়ে যায় ওনারা যা বলছে তা পুরোটাই সত্য। এই কথা শোনার পর রক্তিম নিজেও ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়। ঐ বেশরম মেয়ে যেভাবে রাস্তা-ঘাটে তাকে ভালোবাসার কথা জানান দেয় সেভাবে যদি এখানেও সবার সামনে বলে দেয়! তবে সব শেষ। আজীজ শিকদারকে কেউ আটকে রাখতে পারবেনা আর। ফের ঐ আগুনে ঝাপ দিতে হবে তাকে।

নিজের রুমের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রথম থেকে শেষ পযর্ন্ত সবটাই শুনছিল দৃষ্টি। দিলশান আরা মেয়েকে ডাকতে এসে তাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় মেয়ের দিকে। তবে ভিন্ন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে শান্ত ভাবে আহবান জানায় ড্রয়িং রুমে যাওয়ার জন্য। দুরুদুরু মনে চুপচাপ মায়ের পিছন পিছন ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয় দৃষ্টি। আগে থেকেই জানত সে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। তবে তখন এটা জানতনা সেই পরিস্থিতি যে তাকে এতোটা ভিতু করে দিবে। বুকটা কেমন ধরফর করছে। পুরো শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে। দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। মাথা পুরো ফাঁকা মনে হচ্ছে। দৃষ্টি উপস্থিত হতেই আজীজ শিকদার অভয় দিয়ে বলে,

“মা! কোনো ভয় পেয়োনা। তুমি সরাসরি নির্ভয়ে তোমার মনের কথা বলো। তুমি কি আমার ছেলেকে ভালোবাসো? বিয়ে করতে চাও ওকে! যদি চাও তবে তোমার মা-বাবার কাছে বলে দাও। বাকীটা আমি সামলে নিব।”

দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইস্পাত কঠিন মুখের মানুষটার দিকে এক পলক তাকায় দৃষ্টি। যে মানুষটাকে প্রথম দেখায় মন-প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছে অষ্টাদশী দৃষ্টি। এতো করে ভালোবেসেও পাষাণ মানুষটার মনে নিজের জন্য একটু মায়ার সৃষ্টি করতে পারেনি। তবুও তাকে পাওয়ার জন্যই কিশোরী প্রাণ ব্যাকুল আজও। সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে মা-বাবার দিকে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় তারাও উৎসাহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। উপস্থিত প্রতিটা মানুষ ব্যকুল হয়ে আছে দৃষ্টির মুখের একটা কথা শোনার জন্য। যে কথাটা এক পক্ষকে জিতিয়ে দিতে পারলেও হারিয়ে দিবে অপরপক্ষকে। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নেয় দৃষ্টি। বুকে অদম্য সাহস যুগিয়ে বলে দেয় মনের কথা। নিজেকে প্রমাণিত করে আরও একবার বেহায়া হিসেবে। একটু ভালোবাসার লোভে ভেঙ্গে চুড়মাড় করে দেয় মা-বাবার আশা ভরসা।

“হ্যাঁ। আমি রক্তিম শিকদারকে ভালোবাসি। দুই পরিবারের সম্মতিতে আমার ভালোবাসার সুন্দর একটা পরিণয় চাই আমি।”

নিজের কথাটুকু শেষ করার আগেই স্বপাটে চড় বসিয়ে দেয় দিলশান আরা। আকস্মিক এতো গুলো মানুষের সামনে মায়ের থেকে থাপ্পড় খেয়ে স্তব্দ হয়ে যায় দৃষ্টি। গালে হাত দিয়ে ছলছল নয়নে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। দিলশান আরার হঠাৎ এমন আক্রমণে রক্তিম সহ উপস্থিত প্রতিটা মানুষ বিস্মিত। বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় আজীজ শিকদার। গলা উচিয়ে বলে,

“এতো গুলো মানুষের সামনে কিভাবে আপনি এতো বড় একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলেন? এই আপনি একজন কলেজের সম্মানিত প্রভাষক? আপনার থেকে এমন কিছু আশা করা যায়না আপা।”

অত্যধিক রাগে-ক্রোধে অন্ধ দিলশান আরা। এতো দিনের তিলতিল করে গড়ে তোলা সম্মান অহংকার সবটাই মনে হয় মেয়ে নিজের ভালোবাসার কথা জাহির করে শেষ করে দিয়েছে। অধিক রাগে কাঁপছে দিলশান আরা। হাত উচিয়ে আজীজ শিকদারকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“একদম চুপ থাকবেন আপনি। আমার মেয়েকে আমি মা র ব না কে টে টু ক রো টু ক রো করে নদীতে ভাসিয়ে দিব সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার বাসা থেকে এক্ষুণি বেড়োবেন আপনারা। নইলে আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব।”

“ডাকুন পুলিশ। দেখি কোন আইন আপনার সাপোর্ট করে। ভুলে যাবেন না এখন আপনার মেয়ে সাবালিকা। তাকে শাসন করতে গিয়ে ভালোবাসা জাহির করার অপরাধে অপশাসন করতে পারেন না। ।জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের ভাষায় আঠারোই হলো অধিকার দাবি করে মাথা তোলার সময়। আপনার মেয়ে এখন নিজের যেকোন বিষয়ে নিজেই মতামত নিতে পারবে। হোক সেটা ভালোবাসা-বিয়ে কিংবা অন্য যেকোন ক্ষেত্রে। আইন অনুযায়ী তা বৈধ। বাবা-মা হিসেবে এখন আপনাদের সন্তানের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে। যদি না দিন তবে সেটাই হবে আইনবিরূদ্ধ। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে আশা করি এই ধারণা টুকু আপনাদের আছে।”

এক কথা দুই কথা হতে হতে কিছুক্ষণের মাঝেই দৃষ্টি হয়ে যায় বিড়াট এক ঝামেলা। যে ঝামেলার নিরব দর্শক দৃষ্টি, রক্তিম, মেহেদী। বহু কথা কাটাকাটির পর আজীজ শিকদার নিজ তাগিদে থানা-পুলিশ করতেও পিছুপা হয়না। অবশেষে আইন, নীতি আর মেয়ের মুখের একটা বয়ান হার মানতে বাধ্য করে সাদেক-সাহেব দিলশান আরা’কে। বাবা-মায়ের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে এক সময় দৃষ্টি বদলে ফেলতে চায় নিজের সিদ্ধান্ত। কিন্তু আজীজ শিকদার সেটা হতে দেয়না। দৃষ্টির হাবভাব দেখেই ধূর্ত মস্তিষ্ক বুঝে যায় তার মনোভাব। ঘটনা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে প্যাচিঁয়ে সিদ্ধান্ত নেয় সেই মুহূর্তেই কাজী ডেকে ইসলামি শরীয়ত মোতাবেক বিয়ের কার্যক্রম সমাপন করবে। ময়মনসিংহ থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার সহ রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে দৃষ্টির মা-বাবা সকলের উপস্থিততে অল্প সময়ের ব্যবধানেই ইসলামের দৃষ্টিতে এক হয়ে যায় দৃষ্টি -রক্তিম। মাঝখানে যদিও রক্তিম নিজেও ভেজাল করতে চেয়েছিল কিন্তু আজীজ শিকদার নিজের সুপ্ত মস্তিষ্কের ধূর্ত চালে সামলে নেয় সবটা। নিজের ছেলের নিশ্চিত একটা ভবিষ্যতের আশায় জীবনে প্রথম জয় ছিনিয়ে আনে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে। এতো গুলো মানুষের উপস্থিতি, তর্কবিতর্কে পুরোটা সময় একটা ঘোরের মাঝে ডুবে ছিল দৃষ্টি। কবুল বলার সময় টুকুতেও শুধু কাজির কথায় কলের পুতুলের মতোই মুখ ফুলে পরপর তিনবার শব্দটা উচ্চারণ করে আপন করে নেয় ভালোবাসার মানুষটাকে। পুরো ঝামেলা শেষ হতে হতে দিন পেরিয়ে রাত গভীর হয়। সে রাতেই পুত্রবধূ সমেত বিদায় নিতে প্রস্তুত হয় আজীজ শিকদার। বিদায় শব্দটাও কর্ণগোচর হবার পরও সচল হয়না দৃষ্টির মস্তিষ্ক। তবে শেষ সময়ে এসে মায়ের কথায় ঘোর কাটে দৃষ্টির। শক্ত চোয়ালে বুকে পাথর চেপে দিলশান আরা মেয়েকে বলেন,

“ভালোবাসার মানুষকে চেয়েছো। বাবা-মায়ের সম্মানের বলি দিয়ে সেটা ছিনিয়ে নিয়েছো। বাবা-মায়ের সম্মান, ভালোবাসার থেকেও যখন নিজের ভালোবাসা তোমার কাছে বেশি প্রিয় মনে হয়েছে, তবে জেনে রেখো। ঠিক যে মুহূর্তে মুখে কবুল শব্দ উচ্চারণ করে ঐ ছেলেকে স্বামী হিসেবে মেনেছো। সেই মুহুর্তেই আমি তোমাকে আমার মেয়ে হিসেবে মন থেকে বাদ দিয়েছি। ভুলে গিয়েছি আমার কোনো মেয়ে ছিল। আমরা যে তোমার বাবা-মা আশা করি তুমিও সেটা ভুলে যাবে। আজকের পর থেকে এই বাড়ির কারো সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক থাকবেনা।”

মায়ের কথা গুলো শেষ হতে না হতেই কান্নায় ভেঙে পরে দৃষ্টি। মেঝেতে লুটিয়ে মায়ের পা জড়িয়ে চিৎকার করে বলে,

“আমি না হয় তোমাদের চোখে একটা ভুল করেই ফেলেছি। তাই বলে তোমরা আমাকে এতো বড় শাস্তি দিবে? তুমি তো আমার মা! তুমি কিভাবে আমাকে এই কথা বলতে পারো? আমি তো শুধু আমার ভালোবাসাটুকুই চেয়েছি তোমাদের কাছে। এটা অন্যায়! আর কোনোদিন আমি তোমাদের কাছে কিছুই চাইবনা। তোমরা যেভাবে বলবে সেভাবেই চলব। তবুও আমাকে এতো বড় শাস্তি দিয়োনা প্লিজ।”

মেয়ের কান্নায় দিলশনার আরা না গললেও সাদেক সাহেব একটু নরম হয়। চোখে ভেসে ওঠে আজ থেকে তেইশ বছর আগে দিলশান আরাকে বিয়ে করে তিনি নিজেও ঠিক এভাবেই মায়ের পায়ের কাছে লুটিয়ে পরেছিল। বারবার আর্জি জানিয়েছিল ভালোবাসার মানুষটাকে মেনে নেওয়ার। কিন্তু সেদিন কেউ তাদের মেনে নেয়নি। নববধূকে নিয়ে খালি হাতে পারি দিতে হয়েছিল এই অচেনা শহরে। সেদিন সাদেক সাহেবের মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবথেকে পাষাণ মা-বাবা বুঝি তার নিজের মা-বাবা।প্রকৃতির কি অদ্ভূত নিয়ম! আজ সেই তেইশ বছর আগের একই ঘটনা মনে হচ্ছে নিজের চোখের সামনে ঘটছে। নিজের জায়গায় দেখতে পাচ্ছেন মেয়েকে আর বাবা-মায়েয জায়গায় নিজেকে। আচ্ছা! সেদিন যে সাদেক সাহেব ওনার বাবা-মাকে পৃথিবীর শ্রেষ্টা পাষাণ বাবা-মা বলে মেনে নিয়েছিল। আজ কি তবে তার মেয়েটাও তাকে সেই কাতারে ফেলল তাদের! ফেলে আসা সেই দিনটার কথা স্বরণ হয়েই যেন সাদেক সাহেব একটু নরম হয়। ভরসার একটা হাত বাড়িয়ে দেয় মেঝেতে বসে ডুকরে কাঁদতে থাকা মেয়ের মাথায়। তড়িৎ কান্নার বেগ কমে দৃষ্টির। মেঝে থেকে নজর সরিয়ে উপরে তাকায়। দেখতে পায় বাবা নামক বট বৃক্ষটা আজ এতো কিছুর পরও কি সহজে তার মাথার উপর ছায়া দিচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে আবারও ডুকরে ওঠে দৃষ্টি। অস্ফুট স্বরে ডাকে, “আব্বু!” বেদনা মিশ্রিত অল্প হাসেন সাদেক সাহেব। মেয়েকে টেনে মেঝে থেকে তুলে আগলে নেয় দুই-হাতে। বলে,

“যা চেয়েছো পেয়েছো। এবার বাবা হিসেবে আমার একটাই চাওয়া। সুখে থাকো। মায়ের কথায় কষ্ট পেয়োনা। একটু বেশি রাগ হয়েছে তো তাই এমন বলেছে। রাগ পরলে ঠিকই সবটা মেনে নিবে।”

বিভিন্ন কথায় মেয়েকে শান্ত করে এগিয়ে যায় আজীজ শিকদারের দিকে। বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই রক্তিম বন্ধুকে নিয়ে বেড়িয়ে গেছে। তাকে না পেয়ে আজীজ শিকদারের হাতেই তুলে দেয় আদরের একমাত্র মেয়েকে।

“ভাই সাহেব! যা হবার তা তো হয়েই গেছে। মানুষের জীবনে এরকম ছোট বড় কত ঘটনাই ঘটনা। ঐসব মনে রাখবেন না দয়া করে। সম্পর্ক যেহেতু একটা হয়েই গেছে তখন না হয় সব ভুলে নতুন করে সম্মানের সাথে মেনে নিলাম সবটা। আসলে আমারই ভুল হয়েছে। আগেই যদি মেয়ের কথা মেনে তার সুখেই সুখী হয়ে সবটা মেনে নিতাম তবে এতোটা ঝামেলা হতনা। সেইজন্য আমি লজ্জিত। ক্ষমা করবেন আমাকে। সেই সাথে একটাই অনুরোধ। আমি আপনার ছেলের ভরসায় না। আপনার ভরসায় আমার মেয়েকে আপনাদের সাথে দিচ্ছি। জানিনা আমার মেয়ের ভালোবাসা কতটা ঠিক বা ভুল। তবে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধন যে কখনো ভুল হয়না সেটা জানি। আমি আশা রাখব সেই পবিত্র সম্পর্কের জোরেই আমার মেয়ে আপনার ঘরে সুখে থাকবে। আপনি আমার মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো করেই আগলে রাখবেন। কখনো কোনো ভুল করলে বাবা হিসেবে শাসন করবেন। আর যদি কখনো বোঝা মনে হয় তবে কষ্ট করে আমাকে একটা খবর দিবেন। আমি আমার মেয়েকে অতি আদরে আপনার বাড়ি থেকে নিয়ে আসব।”

আজীজ শিকদারের মুখে জয়ের হাসি। তবে বিয়ে শেষ হতেই ছেলেটা এভাবে চলে যাওয়ায় একটু বিব্রতও হচ্ছেন। এতো ঝামেলার পর ছেলেটার এমন ব্যবহারে না জানি দৃষ্টির মা-বাবার মনে কেমন ধারণা তৈরী হয়েছে! কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন আর এসব ভেবে কিছু হবেনা। সেদিক থেকে ভাবনা সরিয়ে নিজেও সাদেক সাহেবের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় পুরো ঘটনার জন্য। এরপর আশ্বস্ত করেন দৃষ্টিকে তিনি সবসময় নিজের মেয়ের মতোই রাখবেন। কখনো কোনো কষ্ট পেতে দিবেননা। অবশেষে বাবার থেকেই অল্প শান্তনা আর অফুরন্ত দোয়া নিয়ে পা বাড়ায় দৃষ্টি নতুন জীবনে। সে জীবনে দৃষ্টির জন্য ঠিক কি অপেক্ষা করে আছে জানা নেই তার। রক্তিম আদও তাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে কি না তাও জানা নেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে শুধুমাত্র ভালোবাসা পুঁজি করেই অগ্রসর হয় দৃষ্টি।

চলবে….