Friday, August 15, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 235



ফ্লুজি পর্ব-০৪

0

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ৪]

” কোন শর্ত আমি মানতে পারবো না আরশাদ।”

” না মানলে কী করার এখানে থাকো তবে।”

” দম থাকলে আপনি আমার শর্ত মেনে দেখান।”

আরশাদ ভ্রু কুচকালো শ্লেষ হেসে এগিয়ে এলো তার ফ্লুজির কাছে।

” তুমি কি শর্ত দেবে আমায় প্রিটি গার্ল?”

” আপনার শর্তে কোথাও আমার মতামত আছে?বললাম আমি ফ্লুজি নয় তারপরেও…

আচমকা আরশাদ ধমক দিল।তার ধমকে কেঁপে উঠলো খুশবু।কথা বলার নিস্বন যেন তার ফুরিয়ে গেছে।

” নাটকটা দয়া করে বন্ধ করো।আমাকে আর শাস্তি দিও না।আমাদের কি সম্পর্ক আজ কিসে পরিনত হলো বুঝতে পারছো তুমি?”

” আপনি আমার জীবনটা যে পাটায় ফেলে পিষে দিচ্ছেন সেটা কি বুঝতে পারছেন না?”

” যদি সুন্দর জীবন চাও আমার হাত ধরে উঠে এসো সব পাবে সব।আর যদি আমাকে ঠেলে দু’কদম এগিয়ে যেতে চাও আই সোয়্যার ধ্বংস তোমার অনিবার্য।”

খুশবু হাসলো তার এখন আর এই আরশাদ লোকটাকে ভয় লাগছে না।না একটুও না।ভালোবাসার মরিচিকায় ছুটে লোকটা সদূর ইতালি থেকে বাংলাদেশে এসেছে।কত্ত বড় বোকা এই লোকটা, তোর জন্য কি মেয়ের অভাব হয়েছে?তুই সুন্দর হ্যান্ডসাম ক্রাশ বয়, তুই যাবি আমেরিকা কানাডা লন্ডন যেখানে খুশি যা তুই কেন বাংলাদেশে এসে আমাকে শূলে চড়াবি।

” আমার জান কি ভাবছো?”

আরশাদের কথায় চমকে উঠে খুশবু।ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে বসলো বিছানায়।

” আমরা চিরকুট গেম খেলবো।আপনার চারটে শর্ত চিরকুটে লেখা থাকবে।আমার চারটা শর্ত চিরকুটে লেখা থাকবে।সেই শর্তনামা আটটা চিরকুটের সাথে চারটা খালি কাগজের চিরকুট থাকবে।টোটাল বারোটা চিরকুট।খেলার নিয়ম চিরকুট গুলো এলোমেলো করে দেওয়া হবে সেখান থেকে প্রথম চয়েজ আপনি করবেন।আমরা দুইবার করে মোট চারটা কাগজ তুলবো।
যদি আপনার একটা শর্ত উঠে যায় তবে সেটা আমি মানতে বাধ্য।আমার শর্ত উঠলে আপনি মানতে বাধ্য।”

” যদি সাদা কাগজ উঠে?”

” তাহলে আপনি প্রথম বারে হেরে গেছেন।না শর্ত মানতে পারবেন, না শর্ত দিতে পারবেন।”

আরশাদ দেরি করলো না সে সম্মতি জানালো খুশবুর কথায়।নিজ হাতে সবটা চিরকুট লিখলো খুশবু।একটা বাটিতে রেখে সব চিরকুট এলোমেলো করে ধরলো আরশাদের কাছে।আরশাদ ভয় নিয়ে তুললো একটি চিরকুট।চিরকুট খুলতেই একগাল হাসে সে।

” খুচবুকে টিন চাপ্তা চময় দিওয়া হপে।এরপর…. ”

আরশাদ তার ভাঙা বাংলায় সম্পূর্ণ কথা উচ্চারণ করার আগে কাগজটা ছিনিয়ে নিল খুশবু।চিরকুটের লেখা পড়ে মেয়েটার বেহাল দশা।প্রথম দানে কি না আরশাদের শর্ত! সে বিড়বিড় করে আবার পড়লো,

” খুশবুকে তিন সাপ্তাহ সময় দেওয়া হবে এরপর আরশাদের যে কোন শর্ত সে মানতে বাধ্য।”

” মাই প্রিটি গার্ল মানবে তো সব শর্ত?”

খুশবু আরশাদের হাতের দিকে তাকালো ছেলেটা সব ভিডিও করে রাখছে বলা তো যায় না খুশবু যদি তার শর্ত ভাঙে।

এবার পালা খুশবুর মেয়েটা অনেক ভেবে চিনতে চিরকুট তুলতে চিরকুটটা খুলে যেন সে আশাহত হলো।চিরকুটে লেখা ছিল, “পরিবারকে মানিয়ে খুশবু আরশাদকে বিয়ে করবে।”

আরশাদ পুনরায় হাসলো দুদিক থেকেই সে জিতে গেছে।তৃতীয় বার চিরকুট তুললো আরশাদ সেখানে কিছুই লেখা নেই অর্থাৎ সাদা কাগজ।চতুর্থবার চিরকুট তুললো খুশবু।চিরকুটের লেখা দেখে চকচক করে উঠে মেয়েটার দু’চোখ।
” আজ খুশবুকে তার বাবার কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।”

আরশাদের কোন হেলদোল হলো না।কারন আরশাদের বড় শর্ত ছিল খুশবুকে পাওয়া যা ইতিমধ্যে সে পেয়ে গেছে।
.
নতুন জামা পড়ে নিজেকে আয়নায় দেখছে খুশবু।আজ তার খুশির দিন শুধু খুশির দিন নয় মহা খুশির দিন।ঝটপট তৈরি হয়ে চুলগুলো উপরে তুলে বাঁধতে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে সে।তার গলায় থাকা কালসিটে দাগ বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে।আনজুমের সাথে চোখাচোখি হয়ে ভীষণ লজ্জায় পড়ে খুশবু।আনজুম এসেছিল তাকে সাহায্য করতে।
দরজায় এসে উপস্থিত হয় আরশাদ।আরশাদকে দেখে আনজুম দ্রুত বেরিয়ে যায় কক্ষ ছেড়ে।

” আমার জান তোমাকে এত প্রাণবন্ত লাগছে কেন?নিশ্চয়ই আমাদের বিয়ের শর্ত দেখে।”

” আর কিছু বলবেন?”

” ইয়েস।এখানে একটা সই চাই জান।”

” কিসের সই?কোন মতলবে এসেছেন এখানে?”

খুশবুর সন্দিহান দৃষ্টির অগোচরে ফিচেল হাসলো আরশাদ।হাতে থাকা কাগজটা বাড়িয়ে দিল তার দিকে।খুশবু বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়লো কাগজটা।

এখানে লেখা এতদিন সে আরশাদ ইহসানের বাড়িতে ছিল এবং এই সম্পর্কে বৃত্তান্ত।অহেতুক একটা কাগজে সই করতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল খুশবু।

” এটার জন্যেও আবার স্ট্যাম্প লাগে অদ্ভুত লোক আপনি।আরেকটা স্ট্যাম্প আনুন আমি যে আপনার মাথা ফাটিয়েছি নির্দ্বিধায় সই করে দেব।”

” এত স্ট্যাম্প দিয়ে কি হবে জান?একদম বিয়ের স্ট্যাম্প এনে দি।”

” যত্তসব..”

মনে মনে যত রকম গা লি জানে সবটা গা লি আরশাদের জন্য উজার করে ঢেলে দিল খুশবু।আরশাদের চোখ যায় খুশবুর গলায়।তার অতি ভালোবাসা যখন রাগে রূপ নেয় তখনি তার ফ্লুজিকে আঘাত দিয়ে বসে।আরশাদ তার ফ্লুজিকে কাছে আনলো।কালসিটে দাগটায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বাঁকা হেসে বলে,

” তোমার হবু বর রোহানকে এই দাগটা দেখাবে আশা করি তোমাকে বিয়ে করার স্বাদ এক নিমিষে তার মাথা থেকে চলে যাবে।”

” অসভ্য লোক।”

” আমি আরো অসভ্যতা করতে চাই।কিন্তু সুযোগের অপেক্ষা।”

.
খুশবু তৈরি হয়ে যখন কক্ষ থেকে বের হলো আশেপাশের পরিবেশ দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।টানা কয়েকদিন একটা কক্ষে ছিল সে।এই বাড়ির কোন কিছুই সে যানে না।রাজ প্রাসাদের ন্যায় সাজানো একটি বাড়ি।দেয়ালে বড় করে দুটো ছবি টাঙানো আছে।একজন হাস্যজ্বল বাঙালি নারীর ছবি তার পাশের জন দেখতে ঠিক আরশাদের মতো।বলা চলে হুবহু আরশাদ শুধু ছবির মানুষটা বয়সের ভারে চামড়া কুচকেছে অন্যজন তাগড়া যুবক।খুশবুর অবাক চাহনি দেখে আরশাদ বলে,

” তোমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি🔥।”

” বাজে বকবেন না।”

” আর তো তিন সাপ্তাহ এরপর তুমি আর আমি মিলে সুইটহানি হয়ে যাব ফ্লুজি।”

খুশবু বিরক্ত নিয়ে ছুটে চললো সামনের দিকে।আনজুম দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে তাকে দেখে মিষ্টি হাসলো খুশবু।

” এই বাড়িটা আমার বাবা আমার মাকে গিফট করেছে।বাংলাদেশে আমাদের থাকা না হলেও এই বাড়িটার দেখাশোনার জন্য আলাদা লোক রাখা আছে।তোমাকেও একটা বাড়ি গিফট করবো ফ্লুজি।”

” প্রয়োজন নেই আমার।এর থেকে ভালো আমাকে নিস্তার দিন।”

” কি বললে বুঝলাম না।”

আরশাদ ভ্রু কুচকালো সে নিস্তারের অর্থ বুঝলো না।
.
বাহারুল হকের শারিরীক অবস্থা কিছুটা উন্নতির পথে।অসুস্থ স্বামিকে নিয়ে বেশ বেগ পোহাতে হলো না আনিমার। তার ভাইয়েরা অর্থাৎ খুশবুর মামারা যথা সাধ্য সময় দিচ্ছেন তাদের।যেকোন প্রয়োজনে না চাইতে তারা এসে হাজির।বাহারুল হকের হঠাৎ অসুস্থতার মূল কারণ আকস্মিক তিনি উত্তেজিত হয়ে যান।

শুক্রবার বিয়ের দিন দুপুরে বর যাত্রী বের হওয়ার আগে রোহানদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় রোহানের প্রেমিকা।মেয়েটা অতিথি ভরা বাড়িতে বেশ সিনক্রিয়েট করছিল।মেয়েটা শেষ পর্যায়ে বারবার হুমকি দিয়েছে যে করে এই বিয়ে সে ভাঙবে।

রোহানের বাবা মা সেদিন সবার সামনে ছেলেটাকে নির্দোষ প্রমাণ করলেও প্রকৃত পক্ষে তারাও জানতো এই মেয়ের সাথে রোনার সম্পর্ক আছে।

এসব কথা যখনি বাহারুল হক খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তখনি তিনি ভীষণ রেগে যান।কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে বুকের ব্যথায় তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

রোহান আজ আবার বাহারুল হককে দেখতে এসেছে।কেভিনের সামনে রোহানকে দেখে ভীষণ রেগে যান অনিমা।

” এখানে কেন এসেছো?আর কী ক্ষতি করতে চাও আমাদের?”

” আন্টি প্লিজ মানুষ মাত্র ভুল হয়।আমিও ভুল করেছি।

“আমার মেয়েটার ক্ষতি তোমার মাধ্যমেই হয়েছে রোহান।আমার মেয়ে নিখোঁজ আজ এতটা দিন,তুমি তার খোঁজ এনে দিতে পেরেছো?তোমার সেই প্রেমিকা কোথায়?তাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

” আপনারা পুলিশকে তার কাজ চালিয়ে যেতে দিন।”

” চুপ থাকো।দূর হও আমার সামনে থেকে।আমার মেয়ের গায়ে যে কালি মাখালে মানসম্মান সবটাই ডুবলো আমাদের।”

” খুশবু এই মুহূর্তে এসে যদি দাঁড়ায় আমি তাকে এক্ষুনি বিয়ে করবো।আমার পরিবারের বাইরে গিয়ে হলেও আমি তাকে বিয়ে করবো।”

” কিন্তু আমি আমার মেয়েকে তোমার কাছে বিয়ে দেব না।কখনোই না।প্রয়োজনে ওর বিয়ে না হলে না হবে তবুও তোমার কাছে মেয়ে দেব না।এখান থেকে যাও রোহান।সিকিউরিটিকে ডেকে বের করতে চাইছি না।”

রোহান দাঁড়ালো না।এতটা অপমানের ভার নেওয়ার সহ্য ক্ষমতা তার নেই।
.
আরশাদের গাড়ি এসে থামলো হসপিটালের সামনে।সারাটা সময় আরশাদ গম্ভীর হয়ে ছিল অথচ খুশবু চাতকপাখির ন্যায় ছটফট করেছে কখন ফিরবে তার নীড়ে।খুশবু গাড়ি থেকে দ্রুত নামতে নিলে আরশাদ তার হাত ধরে ফেলে।ছেলেটার চোখে মুখে বিষন্নতার বর্ষণ।

” চলে যাচ্ছ যাও।দেখা আবার হবে হতেই হবে।”

” যদি না হয়।”

” তুমি এমনটা করবে না ফ্লুজি।তুমি আমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে এতটা দূর এসেছো।আমি বোকা কারন আমি তোমার প্রতি দূর্বল।যারা ভালোবেসে পিচলে যায় তারাই হয়তো সবচেয়ে বড় বোকা তাই না ফ্লুজি?”

” আমি কি করে জানবো আমি তো কাউকে ভালোবাসিনি।যে তিন সাপ্তাহ সময় আমি পেয়েছি সেই তিন সাপ্তাহের মাঝে আপনার সত্যিকারের ফ্লুজিকে আমি খুঁজে দেব।”

খুশবুর বোকা বোকা কথায় শ্লেষ হাসলো আরশাদ।কোলে থাকা প্যাকেটটি খুশবুর হাতে দিয়ে বলে,

” এখানে একটা নতুন ফোন আছে তোমার আগে সিম আছে।তোমার আগের ফোনটা ভেঙে গেছিলো তাই নতুন ফোন দিলাম।”

” লাগবে না ধন্যবাদ।”

“যেহেতু ফোনটা আমার কারনে ভেঙেছে সেহেতু লাগবেই।যাও বের হও আমার গাড়ি থেকে।”

শেষ কথাটা ধমকের সুরে বললো আরশাদ।খুশবু ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো তার পানে।কি অদ্ভুত লোক রে বাবা।যেখানে সারাক্ষণ তার কাছ ঘেষে থাকে সেখানে এখন তাকে বের করে দিচ্ছে।খুশবু গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেল হসপিটালের দিকে হঠাৎ পেছন থেকে ছুটে আসে আরশাদ।ছেলেটা পুনরায় গাড়ির কাছে টেনে আনে খুশবুকে।একটি স্ট্যাম্প এনে ধরলো খুশবুর সামনে।

” এখানে সই করো জান।”

” এটা কিসের কাগজ?”

” তোমাকে যে সেফলি পৌঁছে দিলাম তার প্রমান কি?নাও সই করো।”

খুশবু বিরক্ত হলো।বাবা মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য তার ভেতরটা কতটা যে ছটফট করছে এই আরশাদ বুঝবে কী?কাগজটা ভাজ করে আরশাদ গাড়ির ডেকিতে ধরলো।কাগজটাতে খুশবু দ্রুত সই করে প্রস্থান করলো।
.
বাহারুল হকের কেভিন খুঁজতে মোটেও দেরি হলো না খুশবুর।আরশাদ তাকে বলেই দিয়েছে কত তলার কয় নাম্বার কেভিনে আছে তার বাবা।খুশবুকে দেখে অনিমা খুব বেশি অবাক হলেন না কারণ তিনি আগেই জানতেন খুশবু আসছে।মেয়েকে জড়িয়ে অনিমার আহাজারি বাড়লো।এলোমেলো চুমু খেল মেয়ের কপালে।অনিমা দরজার দিকে চোখে বুলিয়ে বলে,

” আরশাদ আসেনি তোর সাথে?”

খুশবু যখন কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলছিল তখনি অনিমার একটি প্রশ্নে তার দম যেন বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলো।মা কি করে জানলেন আরশাদের কথা?
চলবে____

ফ্লুজি পর্ব-০৩

0

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ৩]

” তোমার আঙুলের রিংটা কোথায় ফ্লুজি?”

চট করে আরশাদের চোখ মুখের পরিস্থিতি পালটে গেল।অস্থিরতা থেকে মোড় নিয়েছে তীব্র রাগের দিকে।

” কি হলো কথা বলছো না কেন জান?আমার দেওয়া রিংটা কোথায়?”

খুশবু ঠোঁট বাঁকালো।কে দিয়েছে তাকে রিং!এই আরশাদ ব্যাটাকে সে এবার প্রথম দেখেছে।

” ফ্লুজি তুমি জাননা ওই রিংটা কতটা এক্সপেন্সিভ ছিল আমি নিজের পছন্দে অর্ডার করেছিলাম।ডায়মন্ডের রিংটা তুমি এক মুহূর্তের জন্য হাত থেকে খুলতে না তাহলে এখন কোথায় সেই রিং?”

শেষ কথাটা প্রবল ক্রোধ নিয়ে ধমকের সুরে বললো আরশাদ।খুশবু ভয় পেল নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইলে আরশাদ আরো বেশি রেগে গেল।খুশবুর গত বছর জন্মদিনে তার বাবা তাকে একটি ডায়মন্ডের রিং গিফট করেছিল কই আর তো কেউ তাকে ডায়মন্ডের কোন কিছু গিফট করেনি।খুশবুর হাতে একটি বেশ বড় স্বর্ণের রিং আছে সেটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশাদ।

“জান এই রিংটি কে দিয়েছে?”

“র..বা..মানে”

ভয়ে খুশবুর মুখ থেকে কথা বের হলো না।ওই শ্বেত চামড়ার যুবকটির রাগে রক্তিম মুখ দেখে সব কিছু যেন তার হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।বাদামি মনির চোখ জোড়া তার চোখ রেখেছে স্থিরতায় ।কিন্তু এটাতো স্থিরতা নয় সে কথা জানে খুশবু। কাল বৈশাখীর প্রবল ঝড় শুরুর আগের গুমুট পরিস্থিতিটাই যে আরশাদের চোখে মুখে।

” রোহান দিয়েছে তাই না জান?তোমার সো কল্ড হবু বর।”

চমকে গেল খুশবু।এই লোকটা কি করে জানে রোহানের কথা?রোহানের কথা মাথায় আসতে খুশবুর এবার ভীষণ কান্না পেল।এই মানুষটা তাকে কত্তটা ভালোবাসে তা বলে বোঝানো যাবে না,কিন্তু পরিস্থিতির স্রোত তাকে উল্টো দিকে নিয়ে যাচ্ছে রোহানের ভালোবাসার প্রাপ্য মর্যাদা সে দিতেও পারলো না।

পিনপিনে নিরবতা ছেঁয়ে থাকা কক্ষে আচমকা হা হা শব্দে হেসে উঠে আরশাদ।তার হাসিতে গায়ে কাঁটা দিল খুশবুর।আরশাদ খুশবুর বাম হাতের ভাজে নিজের হাত মেলালো, ডান হাতের ভাজে হাত মিলিয়ে প্যাঁচিয়ে ধরলো মেয়েটাকে।খুশবুর দু’হাত এখন আরশাদের নিকট বন্দি।আরশাদ বাঁকা হাসলো সে সাথে হাসলো তার বাদামি চোখ জোড়া।সে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিল মেয়েটার মুখে পড়ে থাকা চুল।সকল কার্যক্রম ভীতু চোখে পরখ করছে খুশবু মনে মনে একটা কথাই ভাবছে কী করে মুক্তি পাবে এই বদ্ধ উন্মাদের হাত থেকে!
আরশাদ তার ফ্লুজির গলায় নাক ঘেষে পুণরায় মুখ তুললো।

” ফ্লুজি আমার জান তোমার এই ভীতু মুখটা আমায় ভীষণ টানে।তুমি কি জানো না,গোটা তুমিটা আমার।তোমার অধিপত্যি বিস্তারকারী একমাত্র আমি।”

আরশাদ মুখ ডুবালো খুশবুর গলায়।একেকটা উত্তপ্ত ছোঁয়ায় কেঁপে উঠছিল খুশবু।আদরের ছোঁয়া ক্রমশ যেন রাগে ক্ষোভে পরিনত হচ্ছিল।আরশাদ তার ফ্লুজির চামড়া পিষে দিল দাঁতে চেপে।ব্যথা কেঁদে উঠলো তার ফ্লুজি।নিজেকে ছাড়াতে চেয়েও শক্ত দেহের আদলে থেকে সে কিছুই করতে পারলো না।খুশবুর ছটফটানো দেখে মুখ তুলে তাকালো আরশাদ।চোখাচোখি হলো দুজনের।বাদামি চোখ জোড়া কেমন নেশাতুর দৃষ্টি তাকিয়ে আছে এই চোখের ভাষা বুঝতে পারে না খুশবু।আচমকা খুশবুর শুষ্ক ঠোঁটে চুমু খেল আরশাদ একে একে ছড়িয়ে গেল বিস্তার গালে।বাম হাতের সাহায্যে খুশবুর হাত থেকে রোহানের দেওয়া রিংটি বের করলো আরশাদ।দু’আঙুলের সাহায্যে রিংটা চেপে বাঁকা করে ছুড়ে ফেলে উদ্দেশ্যেহীন।

” এই আঙুলি একমাত্র আমার রিং থাকবে।যদি না থাকে এই আঙুল আর তোমার সঙ্গে থাকবে না ফ্লুজি।”

নিজের উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে আরশাদকে সরিয়ে দিল খুশবু।রাগে রিরি করছে তার শরীর।

” কী ভাবেন নিজেকে?আর কতবার বলবো আমি ফ্লুজি নই।সেই মেয়ে আমি নই।আমার নাম খুশবু শুনতে পারছেন আমার নাম খুশবু।”

” খুচবু!”

বড্ড কষ্টে উচ্চারণ করলো আরশাদ।নিজের নামের এমন বিকৃতি উচ্চারণ দেখে পুনরায় দাঁতে দাঁত চাপলো খুশবু।

“খুচবু নয় খুশবু।”

” হোয়াট এভার।নামে কি আসে যায়?পরিচয় হওয়ার পর থেকে কম নামে নিজের পরিচয় দাওনি জান।একবার বললে টুবা,লাস্ট বার বললে টাচনোভা।”

” টুবা মানে!টাচনোভা মানে?এগুলা কারো নাম হয়?”

” নামে কি আসে যায়?তুমি আমার ফ্লুজি আমার শখের ফ্লুজি তুমি।”

” এই শুনুন আমি ফ্লুজি নই।আপনার গার্লফ্রেন্ডকে আপনি খুঁজে নিন প্রয়োজনে আমি খুঁজে দিব।”

আরশাদ হা হা শব্দে হেসে উঠলো।তার ওয়ালেট খুলে একটি মেয়ের ছবি দেখালো যাকে দেখতে হুবহু খুশবুর মতো।মেয়েটার গলা অবধি ছবি তোলা।ছবিটি দেখার পর ভয়ে দু’কদম পিছিয়ে পড়লো সে।যোজন বিয়োজন করে কোন কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।

” এই মেয়েটা আমার মতো দেখতে কিন্তু এই মেয়েটা আমি নই বিশ্বাস করুন।”

” আর কোন কথা নয় জান।তুমি রেস্ট করো।”

খুশবু রেগে গেল।সোফার সামনে থাকা টেবিল থেকে একটি ফুলদানি নিয়ে মাথায় ছুড়লো আরশাদের।

” কে তোর জান?তোর অত্যাচার অনেক সহ্য করেছি আর নয়।”

” ফ্লুজি ক্লাম ডাউন।”

” ফ্লুজি মাই ফুট।”

খুশবু ধাক্কা দিল আরশাদকে ছেলেটার মাথা ফে টে গলগল র ক্ত ধরছে।খুশবু পালিয়ে যেতে দরজা খুলতে চাইলো কিন্তু তার আর দরজা খোলা হলো না।বাইরে থেকে কেউ দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।অনেকবার করাঘাত করলো সে কিন্তু ফলাফল শূন্য।আরশাদ রক্তাক্ত স্থানে হাত রেখে চাপা হাসলো।ক্রমশ এগিয়ে গেল তার ফ্লুজির কাছে।

” মাই গার্ল এক ভুল আমি আর করবো না।তোমার উষ্কানিতে ঝামেলা করে ব্রেকাপ করেছি তোমার সব চিহ্ন নিজের থেকে মুছিয়ে নিয়েছি।কিন্তু সবশেষে আমি অনুভব করছি তোমায় ছাড়া আমি ভালো নেই,ভালো থাকবো না।আমার তোমাকে চাই ফ্লুজি।তোমাকে সামনা সামনি দেখে আরো গলে গেছি।প্লিজ জান সামলে যাও।”

” ফ্লুজি ফ্লুজি ফ্লুজি।বললাম তো আমি ফ্লুজি নই।খু ন করে ফেলবো ছেড়ে দিন আমাকে।”

খুশবু মেঝে থেকে একটি ভাঙা ফুলদানির টুকরো নিলো আর তা দেখে আরশাদ বাঁকা হাসলো।ক্রমশ এগিয়ে আসতে আসতে সে বলে,

” কিল মি জান।”

আরশাদের অভয়ে বড্ড বেশি ঘাবড়ে গেল মেয়েটা।আচমকা ফোন বেজে উঠলো আরশাদের।পকেট থেকে ফোন বের করতে ফোন ছিনিয়ে নিলো খুশবু।RONI নামে সেভ করা নাম্বার থেকে ফোন আসছে আরশাদ দ্রুত খুশবুর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো।দুজনের টানাহ্যাঁচড়ায় ফোনটা কেটে গেল।খুশবু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল আরশাদকে বার বার ফোন আনলক করার চেষ্টা করলো সে।তখনি ফোনে একটি মেসেজ আসে সেই মেসেজটি পাঠিয়েছে রনি।

” গুরুত্বপূর্ণ খবর দেওয়ার আছে স্যার।আপনার ফ্লুজি অর্থাৎ ম্যাডামের বাবা বাহারুল হক উনাকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে।মেয়ের শোকে উনার অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।আমার মনে হলো এই কথাটা আপনাকে জানানো উচিত।”

হাতের ফোনটি আরশাদের দিকে ছুড়ে মারলো খুশবু।তীব্র ক্রোধ নিয়ে আরশাদের শার্টের কলার চেপে বলে,

” আমার বাবা আমার বাবা….”

খুশবুর দম ফুরিয়ে এলো সাথে ফুরিয়ে এলো তার নিস্বান।দেয়ালে পিঠ ঠেকে চুপ চাপ বসে রইলো গুটিয়ে।

মেয়েটার আচরনে আরশাদ অবাক হলো দ্রুত মেসেজটি পড়ে বুঝতে পারলো তার ফ্লুজির কি হয়েছে।

” বাবার কাছে যাবে জান?”

” যাবো যাবো।আমি ছাড়া আমার বাবার কেউ নেই বিশ্বাস করুন কেউ না।প্লিজ আরশাদ আমাকে মুক্তিদিন।”

আরশাদ কিঞ্চিৎ হাসলো।খুশবুর চোখের জল মুছে দিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো কপালে।

” যাবে তো জান।তার আগে আমার শর্ত মানতে হবে কিছু কথা শুনতে হবে।”

” আপনার সব শর্ত আমি মানবো।”

” তবে এখন গুডগার্লের মতো বসে থাকো।এই যে মাথা ফাটিয়েছো আগে চিকিৎসা করিয়ে আসি।”

খুশবু সত্যি নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো সে একটুও নড়লো না।
.
আরশাদের কপালে তিনটে সেলাই লেগেছে।বাংলাদেশে তার পরিচিত গুটি কয়েকজন মানুষ আছে।নানার বাড়িতে নানা নানু নেই তারা মা রা গেছেন বহু আগে।নানার বাড়িতে দুই মামার বসবাস।বাংলাদেশে আসার পর থেকে তারা বারবার ফোন করে যাচ্ছে কবে যাবে আরশাদ।আরশাদ ফ্লুজির ঝামেলা না মিটিয়ে একদমি নড়বে না।ব্যথার ওষুধ খেয়ে কফি হাতে বারান্দায় বসে আরশাদ।ছোট ভাই ‘আরিব’কে বারবার ফোন করছে অথচ ছেলেটা ফোন তুলছে না।দীর্ঘ সময় পেরিয়ে আরিব ফোন তুলে আরশাদের মেজাজ তখন বেজায় গরম।

” আরিব হোয়াট ইজ দিস?”

” সরি ব্রো ঘুমে ছিলাম।”

আরশাদ ইতালিয়ান ভাষায় গা লি দিল আরিবকে।তা শুনে হাসলো আরিব
বদমেজাজি ভাইয়ের গা লি শোনা নতুন কিছু নয়।

” তোমার ফ্লুজি কোথায়?”

” আছে।”

” সে কি সব স্বীকার করেছে?নাকি এখনো না চেনার ভান করে আছে।”

” সে আমাকে চেনে না।ফ্লুজির এমন নাটক করার মানে কি আরিব।”

” ফ্লুজি তোমাকে ভালোবেসেছিল কিন্তু তোমার রাগারাগি গা/লা/গা/লি শুনে মেয়েটা ব্রেকাপ করলো।তুমিও জেদ করে তার সমস্ত ছবি,মেসেজ,জমানো স্মৃতি মুছে দিলে।দুজনের মাঝে দুরত্ব তৈরি হলো হয়তো বা ব্রেকাপের সময়টাতে ফ্লুজি মুভ অন করেছে।সে নতুন জীবন সঙ্গী এনেছে জীবনে,তাই তো তোমাকে ইগ্নোর করছে ব্রো।”

” আমি ছাড়া ফ্লুজির জীবনে আর কোন অপশন থাকবে না।আমি তার জীবনের সব!সব মানে সব।আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা কোট ম্যারেজ করবো ফ্লুজির দুরত্ব আমি আর মানতে পারছি না।”

” গ্রেড নিউজ ব্রো।এটাই ভালো হবে।”

” তোমরা সবাই বাংলাদেশে আসতে পারবে?”

” আমার আর মায়ের কাগজ পত্র সব রেডি যাস্ট টিকেট কাটবো।তবে বাবা গ্র‍্যানি আসতে পারবে না বাবা এলে গ্র‍্যানি একা হয়ে পড়বেন।”

“ওকে নো প্রবলেম।তোমরা দুজন আসো যত দ্রুত সম্ভব।”
.

আরশাদ খুশবুকে যেভাবে রেখে গেছে ঠিক সেভাবেই বসে আছে খুশবু।কোন সন্দেহ নেই মেয়েটা এক চুলো নড়েছে।থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সে।অশ্রুপাতে দু’গাল ভিজে টইটম্বুর।

” ফ্লুজি আমার জান।”

ফ্লুজি মাথা তুলে তাকালো।আরশাদের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে মন থেকে একটুও খারাপ লাগা কাজ করলো না তার।আরশাদ তার ফ্লুজির নরম গালে হাত ছোঁয়ালো অশ্রু মুছে টেনে আনলো তার কাছে।

” এতটা ভেঙে পড়ে না জান।”

” আমি বাবার কাছে কখন যাব?”

” তোমার কাছে তিনটা শর্ত রাখলাম।এই তিনটা শর্ত তোমার আগামী কয়েক ঘন্টা এবং ভবিষ্যৎ এ প্রভাব ফেলবে।এমকি পালটে যাবে তোমার জীবন।”

” কী শর্ত?”

” শর্ত ১: তোমার জীবনে তোমার পরিবার থাকবে তোমার প্রিয় মানুষরা থাকবে সাথে আমিও থাকবো তোমার প্রাণেশ্বর হিসেবে।
শর্ত ২: তোমার জীবনে আমি থাকবো না..

আরশাদ কথা শেষ করার আগে খুশবু সানন্দে বলে,

” শর্ত ২,হ্যা শর্ত ২ মানবো আমি।”

খুশবুর বোকামিতে আরশাদ হেসে ফেললো।

” আগে পুরো কথা শুনো আমার জান।
শর্ত ২: তোমার জীবনে আমি থাকবো না, তোমার পরিবারের কেউ থাকবে না কেউ না।তোমার কোন প্রিয় মানুষের অস্তিত্ব তোমার জীবনে থাকবে না।তোমার সাথে কি ঘটবে আমি আসলেই জানিনা।”

শর্ত ৩: তুমি তোমার হবু বর রোহানকে এখন ফোন করবে এবং বলবে তুমি তোমার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছো।বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সে তোমার সাথে ইন্টিমেট হয়েছে কিন্তু এখন তোমার প্রেমিক তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে।এই মুহূর্তে এসে তুমি রোহানকে বিয়ে করতে চাও।এসব বলার পর রোহান যদি তোমাকে সত্যি বিয়ে করতে চায় তবে আমি তোমার জীবন থেকে সরে যাব ফ্লুজি।আর যদি রোহান তোমায় না মেনে নেয় তবে তুমি আমার হয়ে থাকবে।
আমি যা বলবো তাই তোমাকে শুনতে হবে করতে হবে।আমি মানে আমি তোমার জীবনে শুধুই আমি।

এক নিষ্ঠুর প্রহেলিকায় বেঁধে গেছে মেয়েটার জীবন।আরশাদ উঠে দাঁড়ালো আয়নায় নিজেকে দেখে তার ফ্লুজির উদ্দেশ্যে বলে,

” প্রিটি গার্ল সিদ্ধান্ত তোমার কাছে কী করবে তুমি?”

__চলবে…..

ফ্লুজি পর্ব-০২

0

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২]

” ফ্লুজি আমার জান শুনতে পাচ্ছো?”

আরশাদের ভারী নিশ্বাসের পতন ঘটছে খুশবুর চোখে মুখে।মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে।দু’চোখ ফুলে যাচ্ছে তাই অবস্থা।আরশাদ মায়াভরা দৃষ্টিতে দেখলো তার ফ্লুজিকে।এলোমেলো চুল জড়িয়ে দিলো কানের পেছনে।অদৃশ্য এক অধিকার নিয়ে কপালে চুমু খেল বারংবার।এই মেয়েটা তার ধৈর্যের সীমা ভেঙে দেয় তার প্রেমে ডুবে থাকতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে আরশাদের।

আরশাদের কাছে এসব এখন আশ্চর্য বিষয়।একটা সময় ফ্লুজি তার পিছু ছাড়তো না।অনলাইনে সারাটা সময় মেয়েটা তাকে বিরক্ত করেছে একটা সময় এসে আরশাদ নিজেও মেয়েটার প্রেমে ডুবেছে অথচ এই প্রেম শেষে কি না অচেনা গল্পে রূপ নিলো!তার ফ্লুজি কি সত্যি তাকে চিনতে পারছে না?নাকি চিনতে চাইছে?

এসব টালবাহানায় খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না ফ্লুজি।এই আরশাদ ইহসান একবার যখন তোমার প্রেমে মজেছে তখন তোমার সব কৌশল এখানেই ব্যর্থ।আরশাদের চাওয়া পাওয়া ভীষণ অল্প স্বল্প কিন্তু সে যা চেয়েছে তা আদায় করে ছেড়েছে।তার গ্র‍্যানি মানে দাদিমা বলেন সে হয়েছে তার দাদার মত।মানুষটা ছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পূর্ণ মানব, শিকার ধরতে তিনি যে বেশ পটু।

” আমার জান শুনতে পাচ্ছো?”

আরশাদ আদর নিয়ে ডাকলো খুশবুকে।মেয়েটার সাড়া শব্দ না পেয়ে ফোলা ফোলা দু’গালে চুমু খেল বেশ কয়েকবার।
উষ্ণতায় আরো গুটিয়ে গেল খুশবু তা দেখে হাসলো আরশাদ।কিন্তু খুশবুর অবচেতন মন যে অন্যকিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে অচেনা আতঙ্কে ঝট করে চোখ মেলে তাকায় সে।তার দেহখানি জড়িয়ে থাকা আরশাদকে দেখে ছিটকে দূরে সরে যায়।কিন্তু পারলো কই?আরশাদ তাকে শক্ত বন্ধনীতে চেপে আছে।

“ক্লাম ডাউন ফ্লুজি মাই ডল।”

খুশবু শুনলো না আরশাদের কথা সে, চোখ রাঙিয়ে তাকালো মুহূর্তে,

” ছাড়তে বললাম তো।”

” এই রাগি চাহনিতে অনেক দিন পর তোমায় দেখলাম ফ্লুজি।”

খুশবুর এবার কান্না পেল কি এক মহা ঝামেলায় পড়লো সে।আচ্ছা এই লোকটার মাথায় কি সমস্যা আছে?নাকি সেচ্ছায় এমন করছেন তিনি।মুখভরে গা লি এলো খুশবুর তবুও নিজেকে সংযত করে বলে,

” নির্লজ্জ লোক।”

” লিলাযা মানে?”

ভাঙা ভাঙা শব্দে উচ্চারণ করলো আরশাদ।সে বাংলা কথায় পটু নয়।যতটুকু যা শিখেছে সবটাই মায়ের মুখে শুনে।যার জীবনের গোড়াপত্তন ইতালিতে সে তো ইতালীয় ভাষায় দক্ষ হবে।
আরশাদের ভ্যাবাচেকা ভাবটার সুযোগ নিয়ে ছিটকে দূরে সরলো খুশবু।

” আপনি এখান এখানে কি করছেন?”

” ডাক্তার এসেছে ফ্লুজি।তোমার শরীর ভালো নেই উনি চেকাপ করবেন।”

আবার সেই ভাঙা ভাঙা বাংলা এবার ভীষণ বিরক্ত লাগলো খুশবুর।মায়ের মুখের বাংলা ভাষাটাকে উনি যাচ্ছে তাই করে ছেড়েছেন।

” আমি ঠিক আছি।কোন ডাক্তার ফাক্তারের প্রয়োজন নেই।”

” আমার থেকেও বেশি বুঝতে যেয়েও না তুমি।”

” আপনি সত্যি চান আমি ভালো থাকি?”

” ইয়েস।”

” আমাকে বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিন।সন্তান নিখোঁজে মা বাবা কত চিন্তায় থাকে আপনি জানেন?”

” সরি এই টপিক বাদ।”

আরশাদ উঠে গেলো ক্লোজেট থেকে জামা নিয়ে এগিয়ে দিল খুশবুর কাছে।

” ফ্রেশ হয়ে আসো জান।ডাক্তার অনেকক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করছেন।”

খুশবু উঠার চেষ্টা করলো কিন্তু মুহূর্তে ‘আহ’ শব্দে থমকে পড়লো সে।দুই পায়ে ভীষণ ব্যথা হচ্ছে,গতরাতে আরশাদের আঘাতে ঘাড়ের ছিলে যাওয়া অংশে কেমন টান টান ব্যথা লাগছে।সবচেয়ে বেশি জ খ ম পেয়েছে পিঠে।তাকে যখন জোর জবরদস্তি করা হচ্ছিল তখন কোন কিছুর কোনার সাথে তার পিঠে বেশ আঘাত পেয়েছে।

খুশবুর চাপা আর্তনাদে আরশাদ দরজার কাছে গিয়ে ফিরে আসলো দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো তার ফ্লুজিকে।

” কি হয়েছে?আমায় বলো জান।”

” গতকাল থেকে কম অ ত্যা চার করছেন না, অ স ভ্য ব র্ব র লোক।আমার দু’পা শেষ।”

” আমায় বলো কি হয়েছে।”

খুশবু দু’চোখ ভেসেছে অশ্রুপাতে।ব্যথায় টনটন করছে সারা শরীর।মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে কেমন রক্তিম হয়েছে।আরশাদ আনজুমকে ডাকলো।মেয়েটা বসলো খুশবুর কাছে।আরশাদ ছুটলো ডাক্তার ডাকতে।মেয়েটার অবস্থা দেখে আনজুমের বেশ মায়া লাগলো,

” ম্যাডাম কি হয়েছে আপনার?আমাকে বলুন আমি সাহায্য করবো।”

” আমার সারা শরীর ব্যথায় টনটন করছে।জানেন কতটা জায়গা ছিলে আছে। এই লোকটা এমন পাষাণ কেন?কি ক্ষতি করেছিলাম আমি তার?জানেন এতটা কষ্ট আমি কখনো পাইনি এতটা আঘাত আমি কখনো পাইনি।

বড্ড যন্ত্রণা নিয়ে বললো খুশবু।ততক্ষণে আরশাদ চলে এসেছে সঙ্গে এসেছেন গম্ভীর মুখ করা একজন ডাক্তার।খুশবুর কাছে সকল সমস্যার কথা জানতে চান তিনি মেয়েটা নিজের সুস্থতা কামনায় ডাক্তারের কাছে সকল সমস্যার কথা জানায়।

ডাক্তার কিছু ওষুধ মলম লিখে দেন এবং জানান একটা ইঞ্জেকশন দিতে হবে।মনের সকল সাহস এক নিমিষে ফুস হয়ে গেল খুশবুর।সে চোখ বড় করে তাকালো ডাক্তারের পানে আরশাদ আশ্বস্ত করলো তাকে কিছুই হবে।কিন্তু কে শুনে কার কথা খুশবু নিজেকে বাঁচাতে পালিয়ে যেতে চাইলো আরশাদ তাকে চেপে বসালো বিছানায় এবং জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।

বিয়ে উপলক্ষ্যে নেইল এক্সটেনশন করিয়েছিল খুশবু সেই বড়বড় নখ দিয়ে চেপে ধরলো আরশাদের হাত।নখ দেবে আরশাদের হাতে রক্তে দেখা মিলছে কিন্তু টু’শব্দ করলো না সে।তার ফ্লুজির দেওয়া সকল ব্যথা সে এক নিমিষে হজম করতে পারে শুধু পারে না ফ্লুজির দূরত্বের কষ্ট মেনে নিতে।
.
একটা রাত পেরিয়ে গেল অথচ খুশবুর কোন খোঁজ এনে দিতে পারলো না কেউ।পুলিশ তার কাজ করছে কিন্তু এখনো তারা কোন পজেটিভ খবর এনে দিতে পারলো না।

খুশবুর শোকে তার বাবা বাহারুল হক চেতনা হারিয়েছিলেন তারপর থেকে তিনি বিছানায় লেগে আছেন।
বর্তমানে এই পরিবারের কাছের মানুষগুলো নানান কথা ছড়াচ্ছেন কেউ বলছেন মেয়ে পালিয়ে, কেউ বা বলছে নষ্টা মেয়ে।এসব কথা আর কানে সয়না খুশবুর মা অনিমার।তিনি কাঁদতে কাঁদতে বারবার বেহুশ হচ্ছেন।

ছেলের বাড়ির লোকেরা প্রথমে পরিস্থিতিটাকে বিপদ ভাবলেও এখন তারা শাসিয়ে চলছেন।কম টাকা খরচ হয়নি এই বিয়ে জুড়ে,আত্মীয় স্বজন সহ শত মানুষের কাছে তাদের সম্মানহানি হয়েছে।

এই ভাঙাচোরা পরিবারটার পাশে আছে খুশবুর হবু বর রোহান।ছেলেটা খুশবু বলতে অস্থির ছিল।নিজের পছন্দ করে বাবা-মায়ের সম্মতিতে বিয়ে করছে সে।মোদ্দা কথা সবটাই পারিবারিক ভাবে কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল।

রোহান এতক্ষণ ড্রয়িং রুমে বসে সবার থেকে আপডেট খবর নিচ্ছিলো।কাজ শেষে সে প্রবেশ করলো বাহারুল হকের কক্ষে।একদিনে এই মানুষটার সে কি বেহাল দশা।

” আঙ্কেল এখন কেমন ফিল করছেন?”

” ভালো।বাবা তুমি আমার মেয়েটার কোন খোঁজ পেয়েছো?”

” পুলিশ এখনো কোন খোঁজ দিতে পারলো না আঙ্কেল।”

” আমার মেয়ের কোথাও কোন রিলেশন নেই সে বরাবরি ভীতু প্রকৃতির।তার পৃথিবী জুড়ে আমি আর তার মা ছিলাম।এই মেয়ের তেমন কোন বন্ধুও নেই।”

” আমি সেসব জানি আঙ্কেল।সবার থেকে ভিন্নতা দেখে আমি খুশবুকে আমার জন্য পছন্দ করেছিলাম।জীবন সঙ্গী হিসেবে চেয়েছি।আঙ্কেল আপনার কোন আড়ালে থাকা শত্রু আছে?”

” শত্রু!বাবা আমি একজন ব্যবসায়ী মানুষ বন্ধু নামের কত শত্রুই তো আছে।আমি কীভাবে যে বুঝবো কে আমার জীবনের অভিশাপ নামালো।”
.
আরশাদ নিজের কক্ষে এসে চুপচাপ বসে আছে।তার ঠোঁটের কোনে দেখা মিলছে হাসির আভাস।খুশবুর দেওয়া আঁচড়ের স্থানে সে বেশ কয়েকবার চুমু খেয়েছে।

দূর থেকে যতটা না ভালোবেসেছিল তার ফ্লুজিকে, কাছে আসার পর ফ্লুজির প্রতি আলাদা টান জন্মেছে।এককথায় উন্মাদ হয়ে পড়েছে ফ্লুজির প্রেমে।আরশাদের ফোন এলো তার বাবা ফোন করেছে হাসি মুখে রিসিভ করলো আরশাদ।তার বাবার সাথে তার বাক্যালাপ ছিল ইতলীয় ভাষায়।

” বাবা কেমন আছো?”

” খুব ভালো।তুমি কেমন আছো?ফ্লুজি কেমন আছে?”

” সে ভালো নয় আমার কারনে অনেক চোট পেয়েছে।ডাক্তার দেখিয়েছি একটু আগে।আশা করি দ্রুত সেরে যাবে।মা কোথায়?”

” তোমার মা তোমার জন্য অস্থির হয়ে আছে বাবা।তুমি ফ্লুজিকে নিয়ে কবে ফিরে আসবে সেই অপেক্ষায় আছি আমরা।”

” ফ্লুজি আমাকে চিনতে পারছেনা নাকি চিনতে চাইছে না বাবা।আমি তাকে আমার কাছে কিছুতেই বশে রাখতে পারছি না।অথচ যতদিন যাচ্ছে আমি ততটাই তার প্রতি দূর্বল হচ্ছি।”

পুত্রের কথা শুনে কিঞ্চিৎ শব্দ করে হাসলেন পিতা।তিনি যতবার পুত্রের প্রেম কাহিনী শুনেন ততবার তিনি তার প্রেমকাহিনীতে ডুবে যান।

” এক বাঙালি হরিণাক্ষী মেয়ের প্রেমে পড়ে জাত কূল সবটাই আমি জলে ভাসিয়েছিলাম বাবা।আমি আশা রাখছি তোমার চেষ্টায় সফলতা আসবে।”

আরশাদ আরো কিছু কথা বলে ফোন রাখলো।তার বাদামি চোখের মনি কেমন ঝকমক করছে।চুলে দু’হাত বুলিয়ে পুনরায় গেল খুশবুর কক্ষে।মেয়েটা তখন বালিশ চাপা দিয়ে কাঁদছিল।
আরশাদের মন ভাঙলো,তীব্র ক্রোধে রিরি করছে তার শরীর।ঝটকায় খুশবুকে টেনে বসালো সে।দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” কাঁদছো কেন?”

খুশবু ভয় পেল তার ফোলা ফোলা চোখের আতঙ্ক নিয়ে বলে,

” আমাকে বাড়ি দিয়ে আসেন প্লিজ।”

” নো ফ্লুজি।”

” বাবার সাথে একবার কথা বলতে দিন একবার প্লিজ একবার।”

আরশাদ প্রত্যুত্তর করলো না বরং চেপে ধরলো ফ্লুজির থুতনি।চোখের জলে ভেসে গেছে ফ্লুজির দু’গাল।আরশাদ চুমু খেল তার ফ্লুজির চোখের পাতায় তৎক্ষনাৎ কেঁপে উঠলো খুশবু।মেয়েটা নিজেকে সরাতে চাইলো কিন্তু আরো সন্নিকর্ষে আসলো আরশাদ।থুতনি থেকে আরশাদের আঙুল বিচরণ করলো তার ফ্লুজির কোমল লাগে।মুগ্ধতায় ব্যাকুল হয়ে আরশাদ বলে,

” ইউ আর সো ড্যাম প্রিটি মাই গার্ল।”

” প্লিজ আরশাদ আমার বাবার সাথে যোগাযোগ করতে দিন।”

আরশাদ থমকে গেল।চোয়াল শক্ত করে বড় বড় শ্বাস ছাড়লো।চোখের পর্দা ফেলে প্রশ্ন করে,

” কি বললে?”

খুশবু ভয় পেল মানুষটার অদ্ভুত আচরণ তাকে ভয়ে ডুবিয়ে মা রে।

” ব..বলেছি ব..বাবার সাথে…”

” না তা নয় এর আগে কি বলেছিলে?”

” প্লিজ আরশাদ।”

” আরেকবার বলো।”

” প্লিজ আরশাদ।”

আরশাদ চোখের পাতা খুলে তাকালো তার ফ্লুজির পানে।ঠোঁট কামড়ে মিষ্টি হেসে আচমকা কোলে তুললো খুশবুকে।

” এই যে আমাকে চিনতে না পারার নাটক করলে আসলেই আমাকে তুমি চেন না জান?”

” সত্যি চিনি না।”

” তাহলে জানলে কিভাবে আমার নাম আরশাদ।”

” আমাকে তো আনজুম মেয়েটা বলেছে।”

” চুপ।আর কোন বাহানা নয় জান।”

“নামান আমাকে নির্লজ্জ লোক।”

আরশাদ নামালো না বরং খুশবুকে জড়িয়ে বসালো সোফায়।মেয়েটাকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে রাখলো ঠিক আদুরে বিড়ালছানার মত।

” ইউয়ু আর সো ফ্লাফি মাই গার্ল।”
চলবে_____

ফ্লুজি পর্ব-০১

0

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা মেহেরিন
[পর্ব ১]
__________

” আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে বিয়ে করে নেবে আর আমি কিচ্ছু জানতে পারবো না?খুব সহজ বুঝি?দেখলে তো সময় মতো এসে কিভাবে বিয়েটা ভেস্তে দিলাম।”

গায়ের ভারি লেহেঙ্গা নিয়ে ঘরের এক কোণে বিধস্ত অবস্থায় বসে আছে খুশবু।তার সামনে থাকা মানুষটি কেমন ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলে যাচ্ছে।এই পুরুষটি যে দেশি নয় তা এক পলকেই বুঝতে পারলো সে।মেয়েটার শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম থেকে রক্ত বেরিয়েছে সেই রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধেছে দীর্ঘক্ষণ।কৌতুহল নিয়ে খুশবু প্রশ্ন করে,

” আপনি কে?”

” তোমার জম।”

চমকে গেল খুশবু।আজ তার বিয়ে।বাবা মায়ের পছন্দ করা পাত্রের সহিত তার বিয়ে হচ্ছে এই বিয়ে নিয়ে কম স্বপ্ন বুনেনি সে।বাবা মাও একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কোন কার্পণ্য করেনি।মেহেদী,হলুদ,অনুষ্ঠান শেষে আজ তার স্বপ্নের দিন অর্থাৎ বিয়ের দিন অথচ পার্লার থেকে ফেরার পথে তাকে তুলে আনা হয়েছে।
খুশবুর গলা শুকিয়ে চৌচির তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে ঘন্টার পর ঘন্টা।এখন বিকাল না সন্ধ্যা নাকি রাত এসেছে ধরণিতে সে তাও জানে না।অদ্ভুত এক প্রহেলিকায় ফেঁসেছে সে।

” পা…পানি দিন দয়া করে।”

বদ্ধ ঘরে থাকা পুরুষটি কুটিল হাসলো।উঠে গিয়ে অন্য কক্ষ থেকে একটি গ্লাস এনে খুশবুর মুখে ধরলো।পানি ভেবে ঢকঢক করে গিলে নিলো মেয়েটা।কিন্তু এই পানি যে পেটে যায় না অদ্ভুত এক স্বাদে মুখ থেকে সবটা উগড়ে দিল খুশবু।

” টেস্টলেস?”

” এটা কি ছিল?”

” এমন কিছুই ছিল যেটা তুমি পান করতে পারবে না।”

” আপনি কে?কেন করছেন আমার সাথে এমন।”

” তোমার সাথে এতক্ষণ যাবৎ যা যা করছি সবটাই ভালো করছি।এই মেয়ে তোমার সাথে তো আরো খারাপ কিছু করার দরকার ছিল।”

সম্মুখে থাকা লোকটির নাম আরশাদ।শেষোক্ত বাক্যটি বলে আরশাদ উত্তেজিত হয়ে পড়লো।পাশে থাকা চেয়ারটি পদাঘাতে সরিয়ে হাটু গেড়ে বসলো খুশবুর সামনে।

” বেইমান কোথাকার বেইমান নারী।”

” আমি কি করেছি? আপনি আমার সাথে এমনটা কেন করছেন?”

” এই এই আওয়াজ নিচে।”

খুশবুর মুখ চেপে ধরলো আরশাদ।তার চোখে যেন আগুনের ফুল্কি ধরছে দাঁতে দাঁত চেপে হিংস্রতা অবয়ে তাকিয়ে আছে খুশবুর পানে।এতক্ষণে আরশাদের চোখে চোখ রাখলো খুশবু।সুপুরুষটির বাদামি চোখের মনিতে ধরা দিয়েছে হিংস্রতা।চামড়ায় যেন এক কৌটা শ্বেত রঙ ঢেলে দিয়েছে কেউ।বাদামি চুলগুলোতে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে দু’একটা কালো চুল।

” কি এমন আছে তোমার মাঝে?যার জন্য আমাকে ছুটে আসতে হয়েছে এতদূর!চাইলে কি সবটা বোঝাপড়ায় ভালো হতো না।”

খুশবু ধাক্কা দিল আরশাদকে।প্রচন্ড ভয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেল সে।

” ক..কে আপনি?কিসব বলছেন?কি বোঝাপড়া করবেন আপনি?আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসুন আমার বাবা মা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

খুশবু ভারী লেহেঙ্গা সামলে উঠে দাঁড়ালো।আরশাদকে ধাক্কা দিয়ে ছুটে পালাতে চাইলে, পেছন থেকে তার দোপাট্টা টেনে ধরে আরশাদ যার দরুনে হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে খুশবু।বেফাঁসে পড়ায় মারাত্মক ব্যথা পায় সে নিরবতা ছিন্ন করে হুহু শব্দে কেঁদে উঠলো মেয়েটা।তার কান্নায় হাসলো আরশাদ।দোপাট্টা ছেড়ে এগিয়ে বসলো খুশবুর কাছাকাছি।

“আটাশ দিন তল্লাশি চালিয়ে তোমাকে খুঁজে বের করেছি আর এক নিমিষে পালিয়ে যাবে!এত সহজ?জানো কয় চোখের পাহারায় আছো তুমি?মেয়ে তোমার কল্পনার বাইরে।”

” আমি করেছি কি?উন্মাদের মতো ব্যবহার করছেন আপনি।”

” উন্মাদ?হোয়াট?”

ভ্রু জোড়া সংকুচিত হলো আরশাদের।উন্মাদ শব্দের অর্থবহ’টা তার হয়তো জানা নেই।এমনিতে আরশাদের ভাঙা ভাঙা এলোমেলো উচ্চারণের বাংলা কথা শুনলে যে কারো মাথা ধরে যাবে।খুশবু ঘন ঘন শ্বাস নিলো যে করে হোক লোকটার সাথে তার বোঝাপড়া করতে হবে।

” আপনি কি চাইছেন?প্লিজ আমাকে বলুন।”

” আমি চাই তুমি বিয়ে করতে পারবে না ফ্লুজি।”

” ফ্লুজি!ফ্লুজি মানে।”

” এমন একটা অভিনয় চলছে যেন ফ্লুজি নামে তোমায় কেউ আগে ডাকেনি।”

” আমি বিয়ে করতে পারবো না কেন আগে সেটা বলুন।”

” এখন ওসব কথা বলতে চাই না।তোমার জন্য এতটাও সময় আমি বরাদ্ধ রাখিনি।যাই হোক আমি লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি ড্রেস চেঞ্জ করে নেবে।কাটা ছেড়া আঘাতপ্রাপ্ত স্থানের যত্ন নেবে।যা যা বলেছি ঠিক তাই তাই করবে এর বাইরে যদি নড়চড় হয় তবে তোমার কপালে দুঃখ আছে ফ্লুজি।”

হতভম্ব নয়নে আরশাদের পানে তাকিয়ে আছে খুশবু।কি এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আটকে আছে সে।কে এই লোকটা?একবার বলছে ফ্লুজি,আবার বলছে বিয়ে করতে পারবে না।কেন ভাই কে তুই?কেন এলি আমার জীবনের সর্বনাশ হয়ে?এই অপ্রত্যাশিত আগমন আমার জীবনে যে ঝড় তুলে দিয়ে গেল এর শেষ কোথায়?

আরশাদ বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আগমন ঘটে একজন নারীর।মহিলাটির পরনে সাদা শাড়ি।উনার পরিপাটি সাজগোজ কথার বচন ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে এই মানুষটা প্রফেশনাল।খুশবু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালো মানুষটার পানে।

” ম্যাডাম আপনার ড্রেস চেঞ্জ করতে হবে।আমার হাত ধরে উঠে আসুন।”

” আপনি কে?”

” আমি আনজুম এখানকার একজন কর্মচারী।যতদিন আপনি এখানে আছেন আপনার দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত করেছেন আরশাদ স্যার।”

” আরশাদ!আরশাদ কে?”

” একটু আগে যিনি এই ঘর থেকে বের হলেন উনি আরশাদ স্যার।আপনার জন্য জামা কাপড়ের ব্যবস্থা আছে উঠে আসুন ম্যাডাম।”

” আগে বলুন এখন কয়টা বাজে?”

” এসব ইনফরমেশন আপনাকে দেওয়া বারণ।আপনার কক্ষের জানলাও খোলা বারণ স্যারের নিষেধ আছে।”

খুশবু ভারী লেহেঙ্গা জড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো।শরীরের বিভিন্ন স্থানে তার জখমের চিহ্ন।পোশাক পালটে মেকাপ তুলে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা চালালো সে।পেটের ভেতর ইদুর ঘুরছে সেই সকালে খেয়েছে আর তো তার খাওয়া হয়নি।আচ্ছা বাবা মা এখন কী করছে?বর যাত্রীরা কি তাদের খুব বেশি কথা শুনিয়েছে?এসব কথা ভাবতেও কেঁদে ফেললো খুশবু।বাবা মা তাকে যতটা ভালোবাসা দিয়েছে এই পৃথিবীর কেউ আর তাকে কখনো এতটা প্রায়োরিটি ভালোবাসা দেয়নি।স্বভাব সুলভ খুশবু ইন্ট্রোভার্ট মেয়ে তাই খুব বেশি মানুষের সাথে তার সখ্যতা নেই।তার পৃথিবীতে এই দুটো মানুষের বিচরণ সবচেয়ে বেশি।

আনজুম খুশবুর জখম স্থানগুলো পরিষ্কার করে মলম লাগালো।সাথে নিয়ে আসা খাবার সম্পূর্ণটা শেষ করতে তাকে বাধ্য করলো।যদিও খুব বেশি খেতে চাইলো না সে কিন্তু এই কতক্ষণে খুশবু বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারলো আনজুম নামের ব্যক্তিটি নাছোড়বান্দা স্বাভাবের।
কাজ শেষে আনজুম প্রস্তান করলো।খুশবুর ভয় যেন আরো বাড়লো।সম্পূর্ণ কক্ষটা সে জহুরি চোখে পর্যবেক্ষণ করলো। আলিশান একটি কক্ষ প্রতিটি আসবাবপত্র কেমন যেন চকচক করছে।আরশাদ নামের মানুষটাকি এই বাড়ির মালিক!তবে তো তিনি বেশ ধনী।আচ্ছা উনি তো বাঙালি না উনার মাঝে বাঙালির ছিটে ফোটাও নেই সম্পূর্ণ ভিনদেশী।তবুও আরশাদ যেন বেশ কষ্টেই বাংলা বলে।তার এই বাংলা বলার ধরণ দেখে ভীষণ হাসি পাবে যে কারো কিন্তু খুশবু তো এখন হাসতে পারবে না তার যে ভীষণ কান্না পাচ্ছে।মায়ের কথা মনে পড়ছে।একাকিত্ব,ভয়,সংশয় ঘিরে ধরেছে তাকে।আগামী দিনে কি হবে?কেন হবে?সবটাই ঘুরঘুর করছে তার মাথায়।দরজা খোলার শব্দে চমকে গেল খুশবু।আরশাদ এসেছে গায়ের টিশার্ট’টা কেমন আঁটসাঁট ভাবে বেঁধে আছে ছেলেটার গায়ে।

” হেই কেমন লাগছে তোমার ফ্লুজি? ”

এই মুহূর্তে আরশাদকে ভীষণ ভয় লাগলো খুশবুর।কেমন করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

” ভ..ভালো।তবে কাজের কথায় আসুন, আমাকে এখানে আটকে রেখেছেন কেন?”

সাহস নিয়ে প্রশ্ন করলো খুশবু।আরশাদ ভ্রু নাচিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলো।

” সিরিয়াসলি আমাকে তুমি চিনতে পারছো না?”

” কে আপনি?আপনাকে আমি কেন চিনবো?আপনি কোন হিরো?”

” প্রয়োজনের বাইরে বেশি কথা বলা আমি পছন্দ করি না ফ্লুজি।যাই হোক তোমাকে এখানে আনার একটাই উদ্দেশ্য তোমার বিয়ে ভেঙে দেওয়া।আমার কষ্ট দিয়ে যে ভুল তুমি করেছো এর শাস্তি তোমায় পেতেই হবে।”

” আমি আবার কাকে কষ্ট দিলাম?”

আরশাদ এবার বেজায় রেগে গেল।সামনে থাকা কাচের টেবিলটি পদাঘাতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল মেঝেতে।কাচ ভেঙে সারা মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

” গ্র‍্যানি ঠিকি বলে বাঙালি নারীরা অভিনয়ে পটু।এরা এমন ভাবে বশ করতে জানে একটা পুরুষের হৃদয়টাকে অবশ করে ছেড়ে দেয়।”

” এই গ্র‍্যানিটা আবার কে?”

নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছিল আরশাদ।কিন্তু তার ফ্লুজির বুঝেও না বোঝার ভান করার স্বভাবটা তার মোটেও সহ্য হলো না।মেঝে থেকে ভাঙা বড় একটি কাচের টুকরো হাতে তুলে অগ্রসর হলো খুশবুর পানে।ভয়ে দু’কদম পেছাতে গিয়ে বিছানাত হুমড়ি খেয়ে পড়লো সে।আরশাদ বাঁকা হাসলো।ধীরে ধীরে খুশবুকে আড়াল করলো তার চওড়া শরীরের আদলে।খুশবুর ছোট্ট শরীরটা চাপা পড়লো আরশাদ নামক পাথর মানবের নিম্নে।কাচের খন্ডটা খুশবুর গ্রীবায় চেপে ধরলো আরশাদ,তৎক্ষনাৎ চামড়া কেটে রক্তের দেখা মিললো।তীব্র ব্যথায় চাপা আর্তনাদ করলো খুশবু তাতে আরশাদের হেলদোল হলো না।সে উঠে গিয়ে তুলা এবং ব্যান্ডেজ এনে লাগিয়ে দিল খুশবুর কাঁদে।

” তোমার এই ঘাড় ত্যারামো স্বভাবটা বদলালে আমরা সুখি হতাম ফ্লুজি।”

” কিসব বলছেন আমরা কেন সুখী হবো?কে আপনি?”

” তোমার হেমলোক।”

_চলবে?

কাছের মানুষ দূরে থুইয়া পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0

#কাছের_মানুষ_দূরে_থুইয়া
#পর্ব১১ অন্তিম পর্ব
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ কিরে তুই একা এসেছিস নাকি?তাসফি আসে নি?

মেয়েকে ব্যাগ সমেত একলা বাসার মধ্যে ঢুকতে দেখে কথাটা বলে উঠে লায়লা বেগম। তটিনী ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে ল্যাগেজ টা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সোফায় বসে পড়ে।
-“ নাহ আসে নি। আমি একাই এসেছি।
-“ একা এলি! অবাক হয়ে বলল লায়লা বেগম।
-“ হুমম।
-“ সব ঠিকঠাক আছে তো? সন্দেহান গলায় জিজ্ঞেস করলো।
-“ হ্যাঁ সব ঠিকঠাক আছে।
-“ সত্যি?
-“ বিশ্বাস না হলে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করো উনা কে।
-“ না থাক। ও বাড়ি যাবি আবার?
-“ হ্যাঁ কাল যাব। আজ এ বাসায় থাকবো।
-“ ও বাড়ির সবাই জানে তোর আসার কথা?
-“ নাহ।
-“ তাহলে?
-“ কি তাহলে? আসার পর থেকেই শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন করে যাচ্ছ। বিয়ের পর যে মেয়েদের নিজ বাড়িতে আসলেও এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় আগে তো জানা ছিলো না।
-“ আশ্চর্য রেগে যাচ্ছিস কেনো? আমি এমনি জিজ্ঞেস করলাম। অনেক টা পথ জার্নি করে এসেছিস রোজা নিশ্চয়ই?
-“ হুমম।
-“ রুমে গিয়ে রেস্ট নে।
-“ হুমম। আব্বা কই?
-“ দোকানে গেছে।
তটিনী নিজ রুমে চলে আসলো। লায়লা বেগম রান্না ঘরে গিয়ে বুট সিদ্ধ বসালো। তটিনী রুমে এসে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গোসল সেরে নেয়। আসরের আজান কানে আসতেই নামাজ পড়ে নেয়। তারপর রান্না ঘরের দিকে যায় মাকে হেল্প করতে।

লায়লা বেগম মেয়ে কে বারন করে। কিন্তু তটিনী শুনে না। সে কাজ করতে করতে আলেয়ার কথা বলে। যার কাছে সে এই কয়েকদিনে বেশ অনেক কিছু রান্না শিখেছে। লায়লা বেগম চুপচাপ মেয়ের কথা শুনলো। গল্পগুজবের মধ্যেই ইফতারের জন্য সব রান্না শেষ হয়। লায়লা বেগম খাবার গুলো টেবিলে সাজাতে সাজাতে তটিনী কে বলে ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে শরবত বানাতে। তটিনী ফ্রিজ থেকে পানির বোতল করে টেবিলের কাছে আনতেই কলিংবেল বেজে উঠে। লায়লা বেগম বলেন- তোর বাবা এসেছে হয়তো। দরজা টা খুলে দিয়ে আয়।

তটিনী বোতল টা টেবিলের উপর রেখে হাস্যজ্বল মুখ নিয়ে দরজা খুলে দেয়। সাথে সাথে তার বাবার চেহারা স্পষ্ট হয়। কিন্তু পাশে আরো একজন পুরুষালি দেহ দেখে চোখ তুলে সেদিকে তাকাতেই হাসি গায়েব হয়ে যায়। তার বাবার পাশে তাসফি ও দাঁড়িয়ে আছে। তারেক মেয়ের জামাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তটিনী এখনও তাকিয়ে আছে তাসফির দিকে। তাসফি যে আসবে তা ভেবেই দেখে নি তটিনী। তাসফি একবার তাকিয়েছিল তটিনীর দিকে এরপর আর তাকায় নি। তারেক তাসফিকে নিয়ে সোফায় বসে। লায়লা বেগম মেয়ের জামাইকে দেখে অবাক হয়। এদিকে ইফতারের ও টাইম হয়ে যাচ্ছে তাই মেয়ের জামাই আর তারেকের উদ্দেশ্যে বলে-
-“ হাত মুখ ধুয়ে আসো ইফতারের সময় হয়ে আসছে।
তারেক নিজের রুমে চলে গেলো। আর তটিনী কে লায়লা বেগম বলল তাসফি কে নিজের রুমে নিয়ে যেতে। তটিনী একবার তাসফির দিকে তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরলো আর পেছন পেছন তাসফিও।
রুমের ভেতর আসতেই তটিনী তাসফির দিকে তাকিয়ে বলে- আপনি এসেছেন কেনো?
তাসফি শার্টের বোতাম দুটো খুলতে খুলতে বলে- শ্বশুর বাড়ি আসা মানা ছিলো নাকি?
-“ আমি খুব ভালো করে জানি কেনো এসেছেন।
-“ তাহলে শুধু শুধু প্রশ্ন করলে কেনো? যাইহোক ইফতারের সময় হচ্ছে হাত মুখ ধুয়ে আসছি।

তাসফি হাতমুখ ধুয়ে আসলে তটিনী ও হাত মুখ ধুয়ে আসে। তারপর ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে। তাসফি তটিনীর পাশের চেয়ারেই বসেছে। আজান কানে আসতেই সবাই দোয়া পড়ে পানি মুখে দেয়। ইফতর করা শেষে তারেক তাসফি কে নিয়ে মসজিদে চলে যায় নামাজ পড়তে। লায়লা বেগম আর তটিনী নিজ নিজ রুমে নামজ পড়ে।

-“ কয়েক দিন থাকবে তো এখানে?
তারেকের প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় তাসফি। তটিনী সেই মুহূর্তে তাকায় তাসফির দিকে। ফলে চোখাচোখি হয়। তাসফি তো এসেছে তটিনীর জন্য। অফিসে গিয়েছিল কিন্তু মন বসে নি কাজে। সেজন্য সোজা এখানে চলে আসে তটিনী কে দেখতে। আসার পথেই রাস্তায় দেখা হয় তারেকের সাথে। তাসফি কে কিছু বলতে না দেখে তারেক ফের বলে উঠে –
-“ থাকবে তো?
-“ না আসলে বাবা কালই ফিরতে হবে। আপনার মেয়ে আসতে চাচ্ছিল বলে আসা।

তটিনী রাগী চোখে তাকায়। তাসফি পাত্তা দেয় না।
-“ তটিনী ও কি যাবে?
তাসফির ইচ্ছে করলো হ্যাঁ বলতে কিন্তু হ্যাঁ বলতে পারলো না।
-“ আমি কয়েক দিন থাকবো আব্বু।
ব্যাস কথাটা তড়িৎ গতিতে সে কানে বিঁধল তাসফির। মুহূর্তে মুখটা চুপসে গেলো। রাতে খাবার খেয়ে যে যার রুমে চলে গেলো।

তাসফি বিছানায় বসে আছে অপেক্ষা তটিনীর। তটিনী ওয়াশরুম থেকে আসতেই তাসফি বলে-
-“ না থাকলে হয় না? আমার সাথে কাল ফিরে চলো।
-“ আমি বলেছি কি আপনাকে আসতে?
-“ একা থাকা সম্ভব নয় আমার। প্লিজ চলো অফিস বন্ধ দিলে তখন আবার নিয়ে আসবো।
-“ আমি ও বাসায় যাবো কাল।

বিছানায় বসতে বসতে বলে তটিনী।
-“ আচ্ছা ও বাসায় থেকে বিকেলের দিকে রওনা হই?
-“ পাগল নাকি? রোজার মধ্যে আমি বিকেলে বের হবো! আমি কাল ও রাজশাহী ব্যাক করছি না।
-“ তাহলে কবে? উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে তাসফি।
-“ জানি না কবে। কিন্তু আপনি অফিস বাদ দিয়ে কেনো চলে এসেছেন? বউ পাগল এটা দেখাচ্ছেন?
-“ আমি সত্যি বউ পাগল। এটা দেখানো লাগবে কেনো।
– “ আবার গর্ব করে বলছেন!
-“ সত্যি বললাম।
-“ আপনাকে দেখলেই তো আমার রাগ লাগছে।
-“ একটু মানিয়ে নাও না। একটা ভুল না হয় করছি। তারজন্য তো ক্ষমা চাইছি রোজ। একটু ক্ষমা করে দেখোই না আর কখনও কোনো ভুল অন্যায় করবো না।
-“ মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি বলেই এখনও আপনার সাথে কথা বলছি। তা না হলে কখনই আপনার সাথে কথা বলা তো দূর আপনার মুখ ও দর্শন করতাম না।
তাসফির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে।
-“ ক্ষমা পাচ্ছি তাহলে?
-“ জানি না। তবে আপনাকে বিশ্বাস খুব সহজে করতেও পারবো না।
-“ সময় নাও সেক্ষেত্রে, আমি অপেক্ষা করবো তোমার বিশ্বাস অর্জনের। তবে প্লিজ দুরত্ব তৈরি করো না আমাদের মাঝে,দূরত্ব বড্ড পোড়ায়।
-“ রোজা রোমজানের মাস আপাতত দূরত্ব বজায় রাখুন তাতেই খুশি আমি।
তাসফি মাথা ঝাকালো। তটিনী পাশে শুয়ে পড়তেই তাসফি তটিনী কে টেনে তার মাথা টা নিজের বক্ষপটে নিয়ে বলে-
-“ সব দূরত্ব সইতে পারবো কিন্তু আমার থেকে তোমার দূরত্ব সইতে পারবো না। এই যে তোমার মাথাটা যেই না আমার বক্ষপটে রাখলাম কেমন শীতল হয়ে গেলো। অথচ কিয়ৎ ক্ষন আগেও এই বক্ষপটে কালবৈশাখী ঝড় বইছিলো। আমি যেই ভুল করেছি তোমার ভাষ্যমতে সেই ভুলের জন্য মৃত্যুর আগ অব্দি আমৃত্যু ক্ষমা চেয়ে যাব প্রয়োজন হলে ক্ষমা করো না কিন্তু আমাকে ছেড়েও দিয়ো না। বড্ড ভালোবাসি।
তটিনী চুপচাপ তাসফির কথা শুনলো। এমনি তে লোকটা মন্দ না। সবাই চায় তার ভালোবাসার মানুষ তাকে মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসুক। তটিনী ও এর উর্ধ্বে নয়। কিন্তু তাসফির সামনে তা স্বীকার করলো না বরং মুখ বাঁকিয়ে বলল। -“ হুহ ভালোবাসি!

তাসফি হাসলো। -“ অনেক ভালোবাসি।
-“ আমি বাসি না ভালো বুঝছেন?
-“ হুমম বুঝলাম। ম্যাডামের জন্য কি করলে আমার মতো অবলাজাতির জন্য তার মনে একটু ভালোবাসা উদয় হবে?
-“ তপস্যা।
-“ কত বছরের?
-“ মৃত্যুর আগ অব্দি।
-“ বেশ সেটাই করবো।

পরের দিন সকাল হলে তাসফি তটিনী কে নিয়ে নিজেদের বাসায় যায়। তানু ড্রয়িং রুমে বসে দাদির সাথে গল্প করছিল। তটিনী তর তাসফি কে দেখে অবাক + খুশি হয়। তটিনীর দিকে এগিয়ে এসে অবাক কন্ঠে বলে-
-“ তোরা!
-“ হু আমরা।
তটিনী গিয়ে সোফায় বসে। জাহানারা বেগম তটিনীর দিকে তাকিয়ে বলে- এই মাইয়া রোজা রাখছো?
তটিনী হ্যাঁ বলে। তাসফি বসে আছে পাশেই।
-“ তরা আইবি জানাই লি না ক্যা?
-“ জানালে সারপ্রাইজড হতে কি করে?
তটিনীর কথায় জাহানারা চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে।
-“ এই রোজার মধ্যে আইছো অতদূর থিকা রুমে গিয়া রেস্ট লও।
মেঘলা হোসেন হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
-“ আসসালামু আলাইকুম মা,কেমন আছেন?
-“ ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো?
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
-“ আসতে অসুবিধা হয় নি তো?
তটিনী ডানে বামে মাথা নাড়ালো। তানু বিস্ময় নিয়ে বলল-
-“ আম্মা আপনি জানতেন ওরা আসবে?
-“ হুমম। ওরা তো রাজশাহী থেকে গতকাল এসেছে ও বাড়ি।
তাসফি নিজেও অবাক হলো। তারমানে তটিনী যে রাজশাহী থেকে ফিরেছে সেটা মেঘলা হোসেন জানতো।
তানু অভিমান নিয়ে বোনের দিকে তাকালো।
-“ এসেছিস বললি ও না।
তটিনী বোন কে জড়িয়ে ধরে বলে-
-“ আম্মাই তো আসতে বলল। সেজন্য এসেছি।
তাসফি ভ্রু কুঁচকালো।
-“ আম্মা আসতে বলছে মানে?
তটিনী ইশারায় চুপ থাকতে বলল। রুমে গিয় বলবে। মেঘলা হোসেন তাসফির দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ সিমির বিয়ের প্রস্তাব এসেছে তুহিনের সাথে। তোকে তো বলেছিলাম।
তাসফি মনে করলো। তিনদিন আগেই জেনেছে তুহিন প্রস্তাব পাঠিয়েছি বিয়ের। তাসফি তুহিনের হাবভাবে বুঝেছিল ও সিমি কে পছন্দ করে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি বিয়ের প্রস্তাব রাখবে ভাবতে পারে নি। রাজশাহী চলে যাওয়ার দরুন সময়ের অভাবে তেমন যোগাযোগ হয় না।
-“ তোমরা কি বললে?
-“ সিমির ও আপত্তি নেই। ওর বাবা মা ও রাজি। আজ পাকা কথা বলতে আসবে।
-“ এই রোজা রোমজানে!
-“ তাতে কি? এরজন্য তটিনী আর তোকে আসতে বলেছিলাম। তুই ব্যাস্ততা দেখালি সেজন্য তটিনী কে বললাম একাই চলে আসতে।

তাসফি এবার তটিনীর হঠাৎ বাসায় আসার কারন বুঝলো। তাসফি তো ভেবেছিল তটিনী তার উপর রেগে চলে এসেছে। এখন জানতে পারলো আসল কারন।

সন্ধ্যার ইফতারের পর তুহিন আসলো তার বাবা মা কে নিয়ে। সিমি দের বাসা পাশেই হওয়ায় তারাও ইফতারের পর চলে আসলো তাসফিদের বাসায়।

দুই পরিবার মিলে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করলো। ঈদের দু’দিন পর বিয়ে। রিমি খুব একটা খুশি না এই বিয়েতে কিন্তু সিমির খুশি দেখে মেনে নিলো। সে কেনো যেনো তুহিন কে দেখতে পারে না।

ছাঁদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সিমি তুহিন। দু’জনেই নিশ্চুপ। পন করে এসেছে দুজনে হয়তো কথা বলবে না। কিন্তু কথা না বললেও তো হবে না। নীরবতা কে সাইডে রেখে তুহিন বলল-
-“ ফাইনালি তোমাকে পাচ্ছি।
সিমি হাসলো। অমায়িক সেই হাসির দিকে চেয়ে রইলো তুহিন। সিমি হাসি থামিয়ে বলল-
-“ খুব সহজে ধরা দিয়েছি অবহেলা করবেন না এই আমিটার। শুনেছি সহজে পেয়ে গেলে মানুষ কদর করে না তার আপনার ক্ষেত্রে সেটা হলে কিন্তু খবর আছে।
তুহিন চোখ বন্ধ করলো। পরপর দুটো শ্বাস নিয়ে বলল-
-“ আমার কাছে মোটেও তোমার মূল্য কখনও কমবে না সিমি এই ওয়াদা টা আমি করতে পারি। বিশ্বাস আছে নিজের উপর তোমার অমূল্য কখনই করবো না।
সিমি আবার হাসলো। এবার কিছুটা শব্দ হলো তার হাসিতে। সেই হাসির দিকে তুহিন চেয়ে বলল-
-“ তোমার হাসিটা ভীষণ সুন্দর।
সিমি হেসেই জবাব দিলো-
-“ শুধুই সুন্দর?
প্রতিত্তোরে তুহিন কিছু বললো না হাসলো কেবল।

পরের দিন দুপুর হতে তাসফি তটিনী চলে আসে রাজশাহী। আবার নিয়ম করে দুজনে বন্দী হয় তাদের রোজকার নিয়মে। তাসফি অফিসে চলে গেলে তটিনী হয় আলেয়ার সাথে গল্পগুজব করে আর তা না হলে রুমে বসে কিছুক্ষণ কুরআন শরীফ পড়ে, বেলকনিতে বসে ব্যাস্ত শহর দেখে।

বিকেল হলে ইফতারের সব রান্নাবান্না করে। আর সন্ধ্যার আগ দিয়ে তাসফি ফিরে। তারপর দু’জনে মিলে ইফতার করে। তারপর নামাজ পড়ে দুজনে বেলকনি বসে। আজও তাসফির এক হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। তাসফি এক হাতে তটিনী কে জড়িয়ে ধরে আছে। দৃষ্টি দু’জনেরই ঐ দূর আকাশে ভাসমান কালো মেঘ গুলোর দিকে। হাল্কা শীতল বাতাস পুরো শরীর টাকে শীতল করে দিচ্ছে। থেকে থেকে আকাশ থেকে ভেসে আসছে মেঘের গুমুরগুমুর আওয়াজ। দৃশ্য টা বেশ ভালো লাগছে তটিনীর।

-“ আজ বৃষ্টি হবে তাই না?
তটিনীর কথায় হু বলে তাসফি।
-“ আমি ভিজবো আজ।
তাসফি তটিনীর মাথায় আলতো করে হাত রাখে।
-“ জ্বর আসবে ভিজলে।
তটিনীর পছন্দ হলো না তাসফির কথাটা। তাসফির কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে বলল-
-“ মেডিসিন আছে কি করতে? জ্বর আসলে মেডিসিন খাবো। তবুও ভিজবো বৃষ্টি তে।
-“ জ্বর হলে তুমি নিজের মধ্যে থাকো না তটু। একদম নেতিয়ে যাও। তখন কে সামলাবে তোমায়? কয়েক দিন আগের কথা ভুলে গেছো? জ্বরে কি হয়েছিল তোমার? আমি অফিস সামলাবো নাকি তোমায় সামলাবো?
তটিনীর মনে পড়ে যায়,দু সপ্তাহ আগে বৃষ্টি তে ভেজার ফলে টানা তিনদিন বিছানায় পড়ে ছিল। শরীরে মাত্রাতিরিক্ত জ্বর ছিলো। তাসফি তো দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। এক দিকে অফিস আরেক দিকে অসুস্থ বউ। না পারছিল বউ কে রেখে নিশ্চিন্তে কাজে যেতে আর না পারছিল ছুটি নিতে। মাঝখানে পরিস্থিতির চাপে পড়ে বেহাল দশা। আলেয়া কে রেখে যেত তটিনীর কাছে একটু পর পর ফোন দিয়ে খবর নিতো তটিনীর। আবার বাসায় এসে রান্না করে তটিনী কে খাওয়ানো।
তিনটা দিন পাগলের মতো কেটেছে তাসফির। চতুর্থ দিনে একটু সুস্থ হয় তটিনী।

কথাটা মনে পড়তেই তটিনীর ওষ্ঠদ্বয়ে হাসি ফুটে। সেই সাথে আকাশ চিঁড়ে আবির্ভাব হয় বৃষ্টির। সেই বৃষ্টির দিকে কিয়ৎ ক্ষন চেয়ে থেকে হুট করে তটিনী রুম থেকে দৌড়ে ছাঁদে চলে যায়।

তাসফি পেছন থেকে তটিনী কে ডেকে বৃষ্টি তে ভিজতে বারন করে। কিন্তু তটিনী শুনলো না ছাঁদের দরজা খুলে বৃষ্টি তে ভিজলো।

তাসফি দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। ছাঁদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তটিনীর বৃষ্টি বিলাস দেখলো। আবার মেয়েটা জ্বরে ভুগবে। আবার তাকে সারা রাত জ্বালাবে। হুটহাট মাঝ রাতে এটা ওটা খেতে চাইবে বলে ঘুম থেকে তুলবে। আবার ও মেয়েটার চোখ মুখ শুকিয়ে যাবে জ্বরের কারনে।

বেশ অনেকক্ষণ পরও যখন তটিনী কে বৃষ্টির মধ্যে থেকে আসতে না দেখলো তখন তাসফি নিজেই বৃষ্টি তে ভিজে তটিনীর কাছে গেলো। তটিনী দু হাত মিলে চোখ বন্ধ করে আছে। তাসফি কাছে গিয়ে তটিনীর হাত ধরতেই চমকে উঠল। ইতিমধ্যে শরীর আগুনের মতো গরম হয়ে আছে। তটিনী বাহুতে টান পেতেই চোখ মেলে তাকায়। হাসি মুখে তাসফির দিকে তাকিয়ে বলে -“ বৃষ্টি টা বুঝি আমাকে খুশি করার জন্য ই এসেছে আজ! দেখুন না এই বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা আমার সর্বাঙ্গ দেহকে শীতল করে দিচ্ছে। আমি আজ বৃষ্টি বিলাসী।

কথাটা বলে নেতিয়ে পড়ে তাসফির উপর। তাসফি ধরে ফেলে তটিনী কে। তপ্ত শ্বাস ফেলে তটিনী কে পাঁজা কোলে নিয়ে রুমে ঢুকে। এখন মেয়েটা সারা রাত তাকে জ্বালিয়ে মারবে অথচ বিরক্তি নিয়ে একটা টু শব্দ ও করবে না তাসফি। তটিনীর ভেজা শরীর পাল্টে দিয়ে নিজেও কাপড় পাল্টে নিলো। তারপর চুলায় গরম স্যুপ বানিয়ে তটিনী কে ডেকে একটু একটু করে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলো। তারপর ভারী কম্বল টা তটিনীর উপর দিতেই তটিনী সেটা ভালো করে শরীরে জড়িয়ে নিয়ে আধশোয়া হয়ে তাসফির বুকে মাথা রাখে। মুহূর্তে মনে হলো আগ্নেয়গিরি লাভা তার বক্ষপটে রাখা হয়েছে। পুড়ে উঠলো বক্ষটা। অথচ মেয়েটা গুটিশুটি হয়ে কি দারুন জাপ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। তাসফি চুমু খেলো এলোমেলো ভেজা চুলে। আজকের রাতে আর তার ঘুম হবে না।

সমাপ্ত

কাছের মানুষ দূরে থুইয়া পর্ব-১০

0

#কাছের_মানুষ_দূরে_থুইয়া
#পর্ব১০
#Raiha_Zubair_Ripti

রাজশাহীর ব্যাস্ত শহরে রিকশায় বসে বিরক্তিকর চাহনি নিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে তটিনী। পুরো রাস্তা জ্যামে আঁটকে আছে। বেশকিছুক্ষন বসে থাকার পর ও যখন জ্যাম ছাড়ার কোনো সম্ভাবনা দেখলো না তখন বিরক্তি নিয়ে রিকশা থেকে নেমে রিকশাওয়ালা কে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে হাঁটা ধরলো।

একে তো গরম তার উপর রিকশায় জ্যাম ছাড়ার জন্য বসে থাকলে রাগ তরতর করে আরো বেড়ে যেত। এরচেয়ে হেঁটে বাসায় গিয়ে বৈদ্যুতিক ঠান্ডা বাতাসের নিচে বসে থাকা ঢের ভালো।

তার উপর কাল থেকে রোজা। আজ একটু বেরিয়েছিল কেনাকাটা করার জন্য রোজার। বাসায় ফিরে শরীরের বোরকা টা খুলে ওয়াশরুমে ঢুকে আগে গোসল সেরে নেয়। তারপর ফ্রিজ থেকে নরমাল পানি বের করে এক গ্লাস পাতি লেবুর শরবত তৈরি করে ঢকঢক করে খেয়ে নেয়।

জোহরের আজান কানে আসতেই নামাজ পড়ে আলেয়া দের ফ্ল্যাটে চলে যায়।

আলেয়া ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছিল। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে তটিনী কে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে। দরজা থেকে সরে তটিনী কে ভেতরে আসার জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়। তটিনী ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে-
-“ ভুল টাইমে এসে পড়েছি কি?
আলেয়া দরজা লাগাতে লাগাতে জবাব দেয় –
-“ আরে না। আমি একটু পরই তোমার কাছে যেতে চাচ্ছিলাম। তুমি এসে ভালোই করেছো।

তটিনী সোফায় বসলো। আলেয়া কে রান্না ঘরের দিকে যেতে দেখে তটিনী বলে উঠে –
-“ কোথায় যাচ্ছ আপু?
-“ কফি নিয়ে আসি বসো।
-“ আমি খাবো না কফি। একটু আগেই ঠান্ডা শরবত খেয়ে আসছি। এখন কফি খাওয়ার মুড নেই।
-“ তাহলে কি খাবে?
-“ কিছুই না। তুমি বসো,আমি অতিথি নই যে এতো আপ্যায়ন করতে হবে।

আলেয়া মুখ ভার করে তটিনীর পাশে বসলো।
-“ কাল থেকে তো রোজা। উঠতে পারবে তো রাতে? নাকি ডেকে দিব?
-“ তুমি তো আপু রান্না করার জন্য উঠবে তাই না?
-“ হ্যাঁ,,রাতে তরকারি রান্না করে রাখবো সেহরির সময় শুধু ভাত রান্না করবো।
-“ ওহ্ আচ্ছা তখন তাহলে ডেকে দিয়ো।
-“ আচ্ছা। বাজার করা হয়েছে?
-“ সব করা হয় নি। আমি ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে কিছু নিয়ে এসেছি। উনি আসার পথে নিয়ে আসবে বাকিসব।
-“ ওহ্ আচ্ছা। তা তোমার ভার্সিটি বন্ধ দিবে কবে?
-“ জানি না,,আমি আর যাচ্ছি না এই রমজানের মধ্যে ভার্সিটি।

আলেয়া আর তটিনী বেশকিছুক্ষন গল্পগুজব করে। আছরের আজান কানে আসতেই নিজের ফ্ল্যাটে চলে যায় তটিনী।

সন্ধ্যা সাতটার দিকে তাসফি ফিরে অফিস থেকে। হাতে তার রোজার বাজার। বাজার গুলো ফ্লোরে রেখে দরজায় কলিং বেল বাজায়। তটিনী দরজা খুলে দেয়। তাসফি একবার তটিনীর দিকে তাকিয়ে ফ্লোর থেকে বাজার গুলো হাতে নিয়ে ভেতরে ঢুকে। বাজার গুলো রান্না ঘরে রাখতে রাখতে বলে-
-“ এখনও রেগে আছো?
তটিনী কথা বললো না। পাশ কাটিয়ে রুমে চলে গেলো। তাসফি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রুমে ঢুকে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়।

রাতের খাবার খাওয়ার সময় তটিনী চুপচাপ নিজের মত খেয়ে দেয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়ে। তাসফি নিরবে দেখে যায় তটিনীর কার্যকলাপ।

তটিনী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, ঘুমায় নি। তাসফি পাশে এসে শুতেই তটিনী উল্টোদিকে ফিরে যায়। তাসফি শোয়া থেকে উঠে বসে। তটিনীর দিকে তাকিয়ে তটিনীর বাহুতে হাত দিয়ে বলে-
-“ কথাও বলবে না? যা শাস্তি দিবে মাথা পেতে নিবো। কিন্তু তোমার এই নীরবতা সহ্য হচ্ছে না। একই সাথে দুজনে থাকছি,খাচ্ছি অথচ কথা হচ্ছে না। এটা কি মানা যায় তুমিই বলো?

তটিনী তাসফির হাতটা সরিয়ে দেয়।
-“ সেহরির সময় উঠতে হবে রান্না করারর জন্য। এখন এসব কথা বলে ঘুম নষ্ট করার কোনো মানেই দেখছি না।
-“ তোমার রান্না করা লাগবে না। আমি রাঁধবো নি। তবুও এর একটা মীমাংসা হোক।

তটিনী শোয়া থেকে উঠে বসলো। -“ কিসের মীমাংসা? পারবেন আদৌও মীমাংসা করতে? আমি এখনও স্বস্তি তে শ্বাস নিতে পারছি না। আপনারা দু’জন আমার সাথে এতো নিচু কাজ করবেন কল্পনাও করতে পারি নি।
-“ এরজন্য তো ক্ষমা চাচ্ছি রোজ।
-“ ধরুন আমি জেনেশুনে অন্যায় করলাম আর অন্যায় করার পর ক্ষমা চাইলাম আর পেয়ে গেলাম? আপনাকে আমার ক্ষমা করতে ইচ্ছে করছে না।
-“ আমি কি খুব বেশি অন্যায় করে ফেলছি? এর ক্ষমা কি পাবো না? তোমাকে পাওয়ার জন্য ই তো সব করেছি। একটু আমার ভালোবাসা টার গভীরতা টাও মেপে দেখো।
গলার স্বর নিচু করে বলে কথাটা তাসফি।

-“ এটাকে ভালোবাসা বলে না। ভালোবাসলে এমন নিম্ন কাজ করতে পারতেন না। বিয়ের আগে আমাকে বলে দিতেন।
-“ তুমি বুঝি বিয়ে করতে আমায়?
তটিনী এদিক ওদিক তাকায়। বিয়ের আগে জানলে সে কখনই বিয়ে করতো না।
-“ কি হলো চুপ কেনো? করতে আমায় বিয়ে?
-“ ব…বলেই দেখতেন।
-“ করতে না তো বিয়ে।
-“ আপনার সাথে প্যাঁচাল পারার ইচ্ছে নেই। নিজেও ঘুমান আর আমাকেও ঘুমাতে দিন।

কথাটা বলে তটিনী কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। তাসফি তপ্ত শ্বাস ফেলে বেলকনি তে চলে যায়।

ঘন্টা খানেক বেলকনিতে একাকী কাটিয়ে তারপর নিশ্চুপে তটিণী-র পাশে এসে শুয়ে পড়ে।

রাত আড়াইটার দিকে তটিণী-র ঘুম ভেঙে যায়। মসজিদে ডাক দিচ্ছে সেহরির রান্নার জন্য। তটিনী বিছানা থেকে উঠে চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে নেয়। তারপর ভাত হলে রাতে রান্না করে রাখা তরকারি গরম করে তাসফিকে ডাকতে যায়। তাসফি তটিনীর উঠার সময়ই জেগে গিয়েছিল কিন্তু চোখ মেলে তাকায় নি। তটিনী কাছে এসে ডাকতেই নড়েচড়ে উঠে।
-“ রোজা রাখবেন না? উঠুন।
তাসফি শোয়া থেকে উঠে বসলো। ওয়াশরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে গিয়ে বসলো। তটিনী খাবার বেড়ে দিলো। তাসফও চুপচাপ খাবার খেয়ে নিলো। তটিনী নিজেও খাবার খেয়ে নিলো।

খাবার খাওয়া শেষে তটিনী এঁটো প্লেট গুলো বেসিনে নিয়ে যেতে যেতে বলল-
-“ আমি কাল বাসায় যাব। চাবি নিয়ে যাইয়েন অফিসে যাওয়ার সময়।

চকিতে ফিরে তাকায় তাসফি। বিরস মুখে বলে-
-“ আসবে না আর?
তটিনী জবাব দেয় না। আজান কানে আসতেই তাসফি মসজিদে চলে যায়।

তটিনী থালাবাসন মেজে নামাজ পড়ে নেয়।

তাসফি মসজিদ থেকে ফিরে দেখে তটিনী জানালার ধারে বসে আছে। তাসফি মাথার টুপি টা টেবিলের উপর রেখে তটিনীর সামনে দাঁড়ায়। তটিনী একবার তাকিয়ে ফের দৃষ্টি আগের জায়গায় স্থীর করে। তাসফি হাসফাস করে কিছু বলার জন্য। তটিনীর একই ভঙ্গির নীরবতা দেখে তাসফি ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলে-
-“ কখন যাবে? আমি কি ট্রেন অব্দি পৌঁছে দিয়ে আসবো?
-“ তার দরকার নেই।
তটিনী তাসফির দিকে না তাকিয়েই বলে।
-“ রোজা থেকে না গেলেই কি চলে না?
-“ না।
তটিনী কাটখোট্টা জবাব।
-“ ফিরবে কবে?
-“ জানি না।
-“ কি জানো তাহলে?
তটিনী রাগান্বিত হয়ে তাকালো। তাসফি সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলল-
-“ খুব কি আঘাত দিয়ে ফেলছি? কথা বলছো না ওকে ফাইন বলো না। প্লিজ দূরে গিয়ে থেকো না। ঘুম আসবে না রাতে আমার।
-“ আপনার ঘুম আসবে না তাতে আমার কি? আমার ঘুম আসলেই হলো।
-“ একটু আমার দিকটাও বুঝো।
-“ আমার এতো দিক বুঝার সময় নেই।
-“ তাহলে সত্যি যাবে?
-“ আপনার কি আমার কথা মিথ্যা মনে হচ্ছে?
তাসফি আর কথা বাড়ালো না।

তটিনী বসা থেকে উঠে কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিলো। তাসফি সেদিকে চেয়ে রইলো।

#চলবে?

কাছের মানুষ দূরে থুইয়া পর্ব-০৯

0

#কাছের_মানুষ_দূরে_থুইয়া
#পর্ব৯
#Raiha_Zubair_Ripti

সন্ধ্যায় ছেয়ে গেছে চারিপাশ,আকাশের সুর্য ডুবে আবছা চাঁদের আলো ছড়িয়ে গেছে ধরণীতে। হালকা গুমোট পরিবেশ৷ পাশে রাস্তার থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ ভেসে পরিবেশ টাকে অদ্ভুত করে তুলছে। বাসায় ফিরেই থম মেরে বসে আছে তটিনী। তার নিজের দিকবিদিকশুন্য ঠেকছে সব কিছু। কি করে পারলো দু’জন মানুষ তাকে দু ভাবে ঠকাতে? কান্না করার ফলে চোখ দুটো ফুলে উঠেছে। নাকের পানি চোখের পানি মিলে একাকার।

এভাবেই বসে থাকতে থাকতে রাত সাত টা বেজে গেলো। রান্না বান্না কিচ্ছু করে নি তটিনী। যেখানে নিজেকেই সামলাতে পারছে না সেখানে রান্না বান্না করা তো দুরস্ত।

হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ শুনতেই নড়েচড়ে উঠল তটিনী। ওড়না দিয়ে চোখ মুখ মুছে বসা থেকে দাঁড়ালো। তারপর এলোমেলো পায়ে দরজা খুলে দিলো। তাসফির দিকে ভুলেও একবারের জন্য তাকালো না। বিনাবাক্য রুমে চলে আসলো।

তাসফি তটিনী কে এমন চুপচাপ চলে যেতে দেখে অবাক হলো। দরজা লক করে কাঁধের ব্যাগ টা নামিয়ে রুমে ঢুকলো। তটিনী ততক্ষণে বেলকনিতে গিয়ে দাড়িয়েছে। তাসফি ফ্রেশ না হয়েই শার্টের দুটে বোতাম খুলতে খুলতে তটিনীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে-
-“ মন খারাপ?
তটিনী নিশ্চুপ। তাসফি তটিনীর মুখের দিকে তাকায়।
-“ শরীর ঠিক আছে?
এবার নিশ্চুপ তটিনী। তাসফি তটিনীর বাহুতে হাত দিতে নিলে তটিনী ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। একই ভঙ্গিতে থেকে ধরা গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়-
-“ কেনো করলেন এমন টা?
তাসফি সরল চোখে তাকায়।
-“ কি করেছি?
-“ জানেন না কি করেছেন?
তাসফি সত্যিই বুঝলো না তটিনীর কথার মানে।
-“ না।
-“ আদিল কে চিনেন?
তাসফি এবার কিছুটা আঁচ করতে পারলো। কোনো ভনিতা ছাড়াই বলল-
-“ হুমম চিনি।
-“ কিভাবে চিনেন?
-“ তোমার মাধ্যমেই চিনি।
তটিনী এবার নড়েচড়ে উঠলো। জোরে শ্বাস নিয়ে বলল-
-“ আপনারা দু’জন কাজ টা কি আমার সাথে ঠিক করেছেন? আমাকে জাস্ট গুটির মতো উইজ করে গেলেন।
তাসফি দৃঢ় কন্ঠে বলল-
-“ আমি মোটেও তোমায় ইউজ করি নি। ইউজ করলে বিয়ে করতাম নয়।
-“ এটাকে ইউজ বলে না তো কি বলে? আপনি জানতেন না আমি আদিল কে ভালোবসতাম? তবুও কেনো এমন করলেন?
কিছুটা জোরে শব্দ করে কথা গুলো বলে তটিনী। তাসফি তপ্ত শ্বাস ফেলে।
-“ আদিল তোমাকে ভালোবাসে নি। ভালোবাসলে সে নিশ্চয়ই তার এক্সকে বিয়ে করতো না? আমি জাস্ট থ্রেট দিতেই সে এক্স কে বিয়ে করে নিলো! সে যদি দৃঢ়ভাবে বলতো সে তোমাকে ভালোবাসে ট্রাস্ট মি আমি জীবনেও তোমাকে তার থেকে আলাদা করতাম না। কিন্তু ও তো তোমাকে সেভাবে চায়ই নি কোনোদিন। আর আমি যখন সুযোগ পেয়েই গেছি তোমাকে পাবার তাহলে কেনো আমি সেই সুযোগ ছাড়বো? আমি দেবদাস বা সন্যাসী ও নই। আমার তোমাকে লাগতো বেঁচে থাকার জন্য হলেও। তাই আমি জাস্ট পথ অবলম্বন করেছি তোমাকে পাবার।

-“ আপনার কি মনে হয় আমি এসব জানার পর আপনার সাথে সংসার করবো?
-“ ডিভোর্স পাবে না ইহজন্মে ও এটা শিউর থাকো। চাইলে রাগ করে বাবার বাড়ি যেতে পারো সমস্যা নেই। দিন কয়েক পর মানিয়ে নিয়ে আসবো।
-“ আমি যদি আপনার সাথে সংসার করতে না চাই আপনি কি জোর করে করাতে পারবেন সংসার?

-“ জোর করে সংসার করাতে পারবো না,কিন্তু ডিভোর্স ও তো দিতে পারবে না। ভুলে গেছো তেমার বাবা কে? বয়ফ্রেন্ডের জন্য বাসা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলে৷ তোমার বাবা সেটার ব্যাপারে এখনও কিছু জানে না। আর সেখানে তুমি যদি ডিভোর্সের কথা তুলো তাহলে কি হবে ভেবে দেখেছো?

তটিনী চোখমুখ শক্ত করে বলল- ভয় দেখাচ্ছেন?
-“ না পরিস্থিতি দেখিয়ে দিলাম। রান্না করো নি বোধহয় তাই না? আচ্ছা সে যাক আমি খাবার অর্ডার করে দিচ্ছি। তুমি বরং ফ্রেশ হও। শুধু শুধু কান্না কাটি করে এমন হাল করলে শরীরের। বুদ্ধি দিয়ে ভাবতে শুরু করো সব। সব জায়গায় হৃদয় কে খাটাতে যেয়ো না।

-“ আপনাদের মতো খেলোয়াড় নই আমি,,যে যারতার সাথে খেলা শুরু করবো তাদের হৃদয় নিয়ে।
-“ এ জন্য ই তো বললাম বুদ্ধি দিয়ে ভাবতে। সিম্পল বিষয় আদিল তোমাকে ভালোইবাসে নি,আর যে ভালোবেসেছে তার দিকে ঘুরেই তাকাও নি। কাছের মানুষ দূরে থুইয়া,তুমি গেছো রাজশাহীর এক ছেলের সাথে প্রেম করতে। কতবড় সাহস ভাবা যায়!

তটিনী তাসফির দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বেলকনি থেকে চলে রুমে আসলো। তাসফি তপ্ত শ্বাস ফেলে রুমে ঢুকে দেখে তটিনী ফের বিছানায় বসে আছে।
তাসফি ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। এরমধ্যে ডেলিভার বয় এসে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাসার নিচে।
তাসফি ফোন পেয়েই নিচপ নেমে খাবার টা কালেক্ট করে বিল পে করে আবার চলে আসে।
ডাইনিং টেবিলের প্লেটে খাবার সাজিয়ে তটিণী-র কাছে গিয়ে বলে-
-“ খাবার খাবে না?
-“ ক্ষিধে নেই।
তটিনীর কাটকাট গলায় বলা কথাটা শুনে তাসফি ঠোঁট কামড়ে কিয়ৎ ক্ষন চুপ থাকে। তারপর মাথর চুল গুলো পেছনে ঠেলে দিতে দিতে বলে-
-“ ক্ষিধে লেগেছে আমার ভীষণ।
-“ তো?
-“ খাবার খাওয়া লাগবে তো।
-“ আমি কি খাবার কোলে নিয়ে বসে আছি?
-“ তুমি না গেলে খাই কি করে!
-“ খাবো না আমি।
-“ কতদিন?
-“ মানে?
-“ বলছি কতদিন না খেয়ে থাকবে? কতদিন তোমার রাগ ভাঙাবো বলে দাও। আমি সেভাবে প্রিপারেশন নিবো তাহলে।

তটিনী রাগান্বিত হয়ে তাকায়।
-“ মশকরা করছেন আমার সাথে? আপনার খারাপ লাগছে না? আমার সাথে এমন টা করাতে?
-“ আগে লেগেছে। এখন লাগছ না।
-“ দূর হন আমার চোখের সামনে থেকে। আপনাকে দেখলে আমার রাগ তরতর করে বাড়ছে।
-“ কিছু একটা করো আর রাগ টা ঝেড়ে ফেলে দাও।
-“ খু’ন করতে ইচ্ছে করছে আপনাদের।
-“ ধারালো ছু’রি তো নেই,কি দিয়ে করবে তাহলে খু’ন।
তটিনী জোরে জোরে শ্বাস ফেলে রাগ কমানোর চেষ্টা চালায়। তটিনী খুব একটা রাগ করে থাকতে পারে না। কিন্তু যখন রেগে যায় তখন ঐ অল্প সময়েই হুলুস্থুল করে বসে। এখন রাগ টাকে কন্ট্রোল করার জন্য তটিনী নিজের হাত কচলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তাসফি খাবার প্লেট টা নিয়ে তটিনীর পাশে বসে। মাংস দিয়ে ভাতের লোকমা তুলে ধরে তটিনীর মুখের সামনে। তটিনী সাপের মতো ফোঁস করে উঠে।

-“ ভাত খাও রাগ কমে যাবে। তারপর ভালো করে বুদ্ধি খাটিয়ো আমাকে শাস্তি দেওয়ার।
তটিনী মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাসফি পূনরায় ভাতের লোকমা তুলে ধরে।
-“ খাবারের সাথে রাগ করতে নেই তটু।
তটিনী মুখ ঘুরায়। পেটে ও ক্ষুধা লেগেছে প্রচুর৷ চুপচাপ মুখে খাবার তুলে নেয়। তাসফি তটিনী কে খাওয়ার মাঝে মাঝে নিজেও খেয়ে নেয়।

খাওয়া শেষ হতেই তটিনী নিরবে খাটের এক পাশে গিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ে।

তাসফি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে লাইট লিভিয়ে বসার ঘরে গিয়ে ল্যাপটপে কাজ করে।

কাজ করতে কারতে শেষ প্রহরে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় তটিনীর। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠতেই চট করে মাথায় ব্যাথা পায়। মূহুর্তে মনে পড়ে যায় গতকাল কের ঘটনা গুলো৷ তটিনী আশেপাশে তাকায়। রুমে সে ব্যাতিত কেউ নেই। বিছানার পাশ থেকে ফোন তুলে সময় দেখে নেয়৷ নয় টা বেজে চল্লিশ । তাসফি চলে গেছে তাহলে অফিসে। তটিনী বিছানা থেকে নামতেই চোখ যায় টেবিলের উপর থাকা এক ছোট্ট কাগজের টুকরোর দিকে। তটিনী কাগজের টুকরো টা তুলে ভাজ খুলে।

-“ খাবার রান্না করে রেখে গেছি। খেয়ে নিয়ো,রাগ করে বাবার বাড়ি চলে যেয়ো না কেমন?

লেখাটা পড়ে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলো। তারপর খোলা চুল গুলে হাত খোঁপা করে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।

টেবিলের উপর খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। তটিনী একটা একটা করে ঢাকনা উঁচু করে দেখে,ডাল আর পাঙ্গাশ মাছ রান্না করা। পাঙ্গাশ মাছ ভীষণ প্রিয় তটিনীর৷ রাগ গুলো কে একপাশে রেখে আগে খাবার খেয়ে পেট মস্তিষ্ক ঠান্ডা করে নিলো। তারপর ফোন টা নিয়ে বেলকনিতে গিয়ে তানুর নম্বরে কল দিলো।
-“ কেমন আছিস তটু?
তটিনী জবাব দিলো- “ তুই জানতিস আপু সব?
-“ কি জানতাম? অবাক হয়ে বলে তানু।
-“ এই যে উনি আদিল কে থ্রেট দিয়ে আমায় বিয়ে করেছে এটা।
তানু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল- ওহ এটা৷ হ্যাঁ জানি তো। কেনো কি হয়েছে?
-“ সিরিয়াসলি তুই জানতিস আপু? অবিশ্বাসের সাথে বলে উঠে তটিনী। তুই জানা সত্ত্বেও আমায় বলিস নি! তুই নিজের বোন হয়েও আমায় ঠকালি এভাবি?
-“ কোথায় ঠকেছিস তুই? আদিলের সাথে বিয়ে হতো তোর? তুই জানতিস না বাবা রিলেশন টিলেশন করে বিয়ে এসব পছন্দ করে না? আর আদিল কি তোকে ভালোবাসতো? নিজের বিবেক কে প্রশ্ন কর।
-“ না বাসুক ভালো। আমি তো বেসেছিলাম ভালো।
-“ হারাম অলওয়েজ রং হয়৷ তোর আর আদিলের রিলেশন টা ছিলো হারাম। কোনো দিক দিয়েই তো তোদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতো না। তাহলে এখন পুরোনো কাসন্দি ঘেঁটে কি লাভ?
-“ এতো লাভ লোকসান খুঁজো কেনো তোমরা? ভালোবসা অপরাধ না আপু।
-“ ভালোবাসা অপরাধ সেটা আমিও বলি নি। কিন্তু ভুল মানুষকে ভালোবাসা কখনই ভালো কিছু বয়ে আনে না তটু। আবেগে না ভেসে বিবেক দিয়ে ভাবো। সামান্য একটা থ্রেটেই যে ছেলে তোর হাত ছেড়ে প্রাক্তনের কাছে চলে যায় সে ছেলে কতটা সুবিধার হতো তোর জন্য?
-“ আমাকে তাসফির সাথেই সংসার করতে হবে এখন তাহলে?
-“ সেটা তোর ইচ্ছে। বাবা কে কথা দিয়েছিলি তার অসম্মান হবে এমন কাজ কখনই করবি না। বাবা কিন্তু জানে না তোর রিলেশনের কথা। এসব নিয়ে ঘাঁটতে গেলে গর্ত থেকে কেঁচো বেরিয়ে আসবে। তখন কোন দিক সামাল দিবি?
-“ আমার কষ্ট, খারাপ,রাগ লাগছে আপু। আমার দিকটাও বুঝো একটু।
-“ বুঝি বলেই বলছি,,কিছুদিন নিজেকে সময় দাও। তাসফির সাথে ঝামেলা না করে চুপচাপ থাকো। তাসফি যে খুব মহান কাজ করেছে সেটাও বলবো না। সে তোমায় ভালোবেসে ফেলছে যার দরুন এমন কার্যকলাপ করে ফেলছে। তার ভালোবসার পরিমাপ টা দেখো সে কতটা ভালোবাসে তোমায়৷ তোমার মন খারাপে তার হৃদয় ব্যাকুল হয় নাকি সেটা দেখো। সম্পর্কের বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে গেছো এখন তো চাইলেই হুটহাট বেরিয়ে আসতে পারবে না।
-“ আচ্ছা রাখি।

তটিনী ফোন কেটে দিলো। অসহ্য লাগছে সব কিছু। জীবন টা কি বিশ্রী ঠেকছে।

#চলবে?

কাছের মানুষ দূরে থুইয়া পর্ব-০৮

0

#কাছের_মানুষ_দূরে_থুইয়া
#পর্ব৮
#Raiha_Zubair_Ripti

রাস্তার পাশ ঘেঁষে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে পাশাপাশি হেঁটে চলছে তটিনী আর তাসফি। উদ্দেশ্য ভার্সিটি। তাসফি আজ দিয়ে আসবে ভার্সিটি, এরপর থেকে তটিনী একাই যাবে। আকাশ টা আজ মেঘলাময়। হয়তো আজ কোনো একসময় আকাশ চিঁড়ে এই ধরণীতে আগমন ঘটবে ঝোড়ো বৃষ্টির।

হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পাসের মোড়ে আসতেই তাসফি তটিনী কে ডেকে উঠে। তটিনী দাঁড়িয়ে যায়। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে কি?
তাসফি হাত ঘড়ি টার দিকে একবার তাকায়। -“ আমার অফিস যদি চারটার আগে ছুটি হয়ে যায় তাহলে আমি তোমাকে নিতে আসবো। অপেক্ষা করো?
তটিনী মাথা নাড়ায়। -“ ফোন করে জানিয়ে দিয়েন।
-“ অবশ্যই। আসি এখন। লেট হবে দেরি করলে।
তটিনী সামনে ঘুরে ভার্সিটিতে ঢুকে পড়ে।
ক্লাস রুমে আসতেই তটিনীর দেখা মেলে হলরুমে একসঙ্গে থাকা মায়রা নামের মেয়েটার সাথে।
মেয়েটা ভীষণ কিউট,নাদুস-নুদুস গাল। ইচ্ছে করে তটিনীর টিপে দিতে। তটিনী কে দেখামাত্রই মেয়েটা দৌড়ে কাছে আসে। তটিনী কাঁধের ব্যাগ টা বেঞ্চে রেখে বলে- আস্তে আয়। হারিয়ে বা পালিয়ে যাচ্ছি না আমি।
মায়রা তটিনী কে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে বলে- “ খুব মিস করছি তোকে। হলে গিয়েছিলি?
তটিনী মায়রার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে- না হলে যাই নি। আমি আর হলে থাকবো না।
-“ কেনো? মায়রা অবাক হয়ে বলে।
-“ আমি হাসবেন্ড নিয়ে এসেছি।
-“ কিহ! বিস্ময়ের সাথে বলে কথাটা মায়রা। ‘ তুই কি বিয়ে করছিস? কাকে করছিস? আদিল ভাই তো বিয়ে করে ফেলছে।
-“ তোর কাছে একটা ফোন থাকলে এতোটা অবাক হতিস না। আগেই জানাতে পারতাম আমার বিয়ের খবর টা। সে যাই হোক ঐ আদিল ফাদিলের নাম আর আমার সামনে নিবি না। আমার আপুর দেবরের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। নাম তাসফি।
-“ ওহ্ পিক দেখা দুলাভাইয়ের।

উৎফুল্ল নিয়ে চায় তটিনীর দিকে। তটিনী ফোন বের করে তার আর তাসফির বিয়ের পিক দেখায়। মায়রা পিক গুলো দেখে বলে- ‘দুলাভাই তো দেখতে সেই জোশ। আদিল ভাইয়ের থেকে কম না..ওপ্স সরি.. কথাটা বলে জিহ্বায় কামড় দেয় মায়রা।

তটিনী ফোন টা নিয়ে ব্যাগে ঢুকায়। ক্লাসে টিচার আসতেই তারা ক্লাসে মনোযোগ দেয়।

ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে গাছের তলায় থাকা ছাউনিতে বসে আছে তটিনী আর মায়রা। তাসফি ফোন করে জানিয়েছে তার ছুটি হয় নি। তটিনী যেনো সাবধানে বাসায় ফিরে। তটিনী তাকিয়ে আছে আকাশের কালো মেঘগুলোর দিকে। আর মায়রা তটিনীর মুখের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর তটিনী বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে বলে-
-“ আজ আসি রে,দেরি করলে বৃষ্টির কবলে পড়তে হবে।
-“ আচ্ছা যা। মায়রাও হলের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলে।
তটিনী ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে। রিকশাওয়ালা কে গন্তব্যের ঠিকানা বলে আশেপাশে তাকাতে থাকে। রাজশাহীর শহর সন্ধ্যার পর এক আস্ত অনুভূতিতে পরিপূর্ণ হয়ে আসে। চোখ জুড়িয়ে যায় আশেপাশে তাকালে৷ সেই অনুভূতি টা এই বিকেল বেলায় হচ্ছে না তটিনীর কাছে।
তটিনী তপ্ত শ্বাস ফেলে চোখ ফিরাতে নিলেই সামনে রাস্তার ওপর পাশে আদিল কে দেখতে পায়। আদিল তার হবু বউ আইরিন শপিং মল থেকে বের হচ্ছে। মুহূর্তে মুখে কালো আধার নেমে এলো। প্রথম দিনেই দেখা হতে হলো? মন টা বিষিয়ে গেলো। চলতি রিকশা থাকায় বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারলো না তটিনী। শো শো করে রিকশা চলে গেলো। তটিনী ভুলক্রমে ও পিছু ফিরে তাকায় নি। পেছু ফিরে তাকানোর অভ্যাস তটিনীর নেই।
বাসার কাছে এসে রিকশাওয়ালা কে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে লিফট বেয়ে উপরে উঠে। অলস শরীর নিয়ে রুমের দরজা টা কোনো রকমে খুলে ওমনি বিছানায় শুয়ে পড়ে।

সেই শোয়া থেকে উঠতে উঠতে তটিনী মাগরিবের আজানের আগ দিয়ে উঠে। আজান কানে আসতেই ওজু করে আসরের ক্বাযা নামাজ সহ মাগরিবের নামাজ পড়ে নেয়। তারপর রান্না ঘরে গিয়ে রুটি আলু ভাজি আর ডিম ভাজি করে। এর চাইতে বেশি কিছু এই মুহূর্তে করা পসিবল না তটিনীর পক্ষে। ফ্রিজে থাকা ভাত আর মাংসের তরকারি টুকু গরম করে টেবিলে সাজিয়ে রাখে।

তারপর পড়ার টেবিলে গিয়ে এক্সামের পড়ার প্রিপারেশন নেয়।

রাত নয়টার দিকে দরজায় কলিং বেল বাজার শব্দ কানে আসলে তটিনী বুঝে ফেলে কে এসেছে। ওড়না টা বিছানা থেকে নিয়ে মাথায় দিয়ে দরজা খুলে দেয়। তাসফি আরেকবার কলিং বেল বাজাতে যাচ্ছিল, এরমধ্যে তটিনী কে দরজা খুলতে দেখে হাত গুটিয়ে নেয়। তটিনী দরজা থেকে সরে দাঁড়াতেই তাসফি ভেতরে ঢুকে। তটিনী দরজা আটকে দেয়।
তাসফি সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে আগে ফ্রেশ হয়ে আসে। বাহিরের তীব্র বাতাসে ধুলোবালি সব উড়ে শরীরে এসেছে।

তাসফি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতে কারেন্ট চলে যায়। তীব্র ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে আগে ভাগেই কারেন্ট চলে গেলো। তটিনী ফোনের টর্চ অন করলো। আইপিএস টাও জ্বলছে না। তটিনী ফোনের টর্চ টা টেবিলে রেখে চটপট করে সব জানালা বন্ধ করে দেয়।
এখন বাহিরে বাতাসের সাথে জোরে জোরে বিদ্যুৎ ও চমকাচ্ছে।
সেই সকালে নামার বৃষ্টি ঝড় এই শেষ বেলায় এসে নামলো।
-“ খাবার বেড়েছি আসুন।
তটিনী রুম থেকে বের হতে হতে বলে যায়। তাসফি তটিনীর পেছন পেছন ডাইনিং টেবিলের কাছে যায়। তটিনী দু প্লেটে রুটি আর ভাত এগিয়ে দেয়। তাসফি রুটির দিকে তাকিয়ে বলে- ভাত খাবো না। দুটো রুটি দাও।
তটিনী তাই দিলো। দুজনে চুপচাপ খেয়ে দেয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়লো।

————————–
পরের দিন,,

ভার্সিটি তে আজ একাউন্টিং এক্সাম থাকায় তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে তটিনী। তাসফি পৌঁছে দিতে চেয়েছিল কিন্তু তটিনী মানা করে দিছে। তাসফিও আর জোর করে নি। একটা রিকশা ডেকে তটিনী কে উঠিয়ে দিয়ে সেও অফিসের জন্য বেরিয়ে যায়।

তটিনী ভার্সিটি এসে একাউন্ট সাবজেক্টের একটা অঙ্ক নিয়ে মায়রার সাথে ডিসকাশন করে। অঙ্ক টা কোনোমতেই মিলছিলো না। মায়রা আর তটিনী অনেক সাধনার পর মিলাতে পারলো। ঘন্টার বেল বাজার শব্দ কানে আসতেই দু’জনে চলে যায় পরীক্ষার হলে।

প্রায় আড়াই ঘন্টায় পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে তটিনী আর মায়রা। ভার্সিটির পাশে থাকা ভেলপুরির দোকান থেকে দু’জনে দু প্লেট ভেলপুরি খায়। তারপর যে যার বাসার দিকে হাঁটা ধরে।

তটিনী আজ আর ফেরার পথে রিকশা নেয় নি। রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটছে।

হাঁটতে হাঁটতে কখন যে আদিল দের বাড়ি ক্রস করে ফেলছে আজ আর খেয়াল করতে পারে নি। আদিল দের বাড়ির মোড় শেষ করতেই পেছন থেকে চিরচেনা কন্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকায়। আদিল দৌড়ে আসছে তার দিকে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে- “ কখন থেকে ডেকে চলছি ডাক শুনো নি কেনো?
তটিনী আশেপাশে তাকালো। তারপর পাশ ঘেঁষে চলে যেতে নিলে আদিল রাস্তা আঁটকায়।

-“ এড়িয়ে চলছো কেনো?
-“ আপনি কি কোনো মহামূল্যবান ব্যাক্তি যে আপনাকে এড়িয়ে চলা যাবে না? শক্ত মুখে কথাটা বলল তটিনী। আদিল স্মিত হেঁসে বলল-
-“ কবে আসলে রাজশাহী?
-“ তার কৈফিয়ত আপনাকে দেওয়া লাগবে?
-“ না তা না দিলেও চলবে। হাসবেন্ড কোথায় সাথে?
-“ আপনার বউ কোথায় সাথে?
-“ বাসায়।
-“ অফিসে। আসি।
-“ আরে যাচ্ছ কেনো? কথা আছে তোমার সাথে।
তটিনী চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলে আদিল আবার রাস্তা আঁটকায়।
-“ তুমি কি এখনও আমার উপর রেগে আছো?
-“ কিসের জন্য আপনার উপর রেগে থাকবো?
ভ্রু কুঁচকে বলে তটিনী।
-“ আমি বিয়ে করে ফেলছি সেটা নিয়ে।
-“ এই বিষয় নিয়ে আমি আপনার সাথে কোনো কথা বলতে ইন্টারেস্ট নই।
-“ বাট আ’ম ইন্টারেস্ট।
-“ হোয়াই?
-“ তুমি কি জানো? তাসফি ভাই তোমায় আগে থেকে পছন্দ করতো?

তটিনী বিরক্তি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। আদিলের কথা শুনে বিরক্তি ভাব টা মুখ থেকে সরে গিয়ে অবাকের ন্যায় হয়।
-“ মাথা খারপ নাকি আপনার?
-“ না আমার মাথা ঠিকই আছে। আমি ট্রাস্ট মি তোমাকে সেভাবে ভালোইবাসি নি। ভালোবাসলে কখনই তাসফি ভাইয়ের সামান্য থ্রেটে তোমায় ছাড়তাম না।
-“ মানে!
-“ তাসফি ভাই আমার আগে থেকেই তোমাকে ভালোবাসতো। তোমার সাথে রিলেশনে যাওয়াতে সে ভীষণ রেগে ছিলো। তাই তো তোমার আমার রিলেশনের তিম মাসের মাথায় তাসফি ভাই রাজশাহী এসেছিল আমাকে থ্রেট দিতে।
-“ কি নিয়ে থ্রেট দিছে?
-“ সেদিন তুমি বাড়ি গিয়েছিল। তাসফি ভাই কি করে যেনো আমার ঠিকানা পেয়েছিল সাথে ফোন নম্বর। আমাকে ক্যাম্পাসে আসতে বলল। আমি চিনতাম না তাকে। তখন তিনি পরিচয় দিলো উনি তোমার বোনের দেবর। তোমাকে নিয়ে কিছু কথা বলতে চায়৷ তো আমিও চলে যাই ক্যাম্পাসে। পরে গিয়ে দেখি তাসফি ভাই টঙের দোকানে বসে আছে। আমি চিনি নাই,উনিই আমাকে দেখে আমার দিকে এগিয়ে এসেছি। কোনোরকম কুশলাদি না করেই বলে উঠে-“ ভালোবাসো তটিনী কে?
আমি ভরকে গিয়েছিলাম। এমন ভাবে জিজ্ঞেস করেছিল মনে হচ্ছিল না সে হ্যাঁ তে খুশি হবে নাকি না তে খুশি হবে।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে সে ফের জিজ্ঞেস করলো- ভালোবাসো তটিনী কে?
আমি আমতা আমতা করে জবাব দিয়েছিলাম- হ্যাঁ বাসি।
উনি মনে হয় আমার উত্তরে খুশি হন নি। চুল গুলো টেনে রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করছিল। তারপর সোজা কথায় আসে।
-“ ভালোবাসা অপরাধ নয়। তুমি ভালোবেসেছো তটিনী কে, ওকে ফাইন। আজকের পর থেকে তটিনী কে আর ভালোবাসবে না।
-“ মানে?
-“ মানে সিম্পল। তটিনী কে তোমার আগে থেকে ভালোবাসি আমি। আর আমি চাই না আমার ভালোবাসায় কেউ ভাগ বসাক। তোমায় ভালোভাবে বলছি তটিনী কে ভুলে যাবা। আর শীগ্রই বিয়ে করবা। বিয়ের বয়স হয়েছে তোমার।
-“ মগের মুল্লুক নাকি? আপনি বললেই আমার বিয়ে করতে হবে? আর আপনি বললেই আমায় তটিনী কে ছাড়তে হবে?
-“ জানের মায়া আছে? খু’ন হতে চাও আমার হাতে?বলছি না তটিনী আমার? ওর উপর অধিকার কেবল আমারই।
-“ ভয় দেখাচ্ছেন?
-“ ধরে নাও সেটাই। আর তাছাড়া তোমার তো গার্লফ্রেন্ডের অভাব নেই। তোমার মতো চিট কে তটিনী পাত্তা দিলো কি করে?

-“ আমার সাথে রিলেশন চলা কালিন আপনার গার্লফ্রেন্ড ছিলো আমি বাদেও?
তটিনী সন্দেহান নিয়ে জিজ্ঞেস করলো আদিল কে। আদিল এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল-
-“ আইরিনের সাথে আগে থেকেই আমার রিলেশন ছিল। ওর সাথে ব্রেকআপ হওয়ার পরই ওকে জেলাস করানোর জন্য তোমার সাথে রিলেশন শুরু করি।

তটিনী কাঁধের ব্যাগ টা হাতে নিয়ে সোজা আদিলের বাহুতে বারি মেরে রাগান্বিত হয়ে বলে-
-“ এই তুই আমার চোখের সামনে থেকে যা। তোর আমাকে ফেলনা মনে হয়? তর গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ হলো বলে আমার সাথে রিলেশনে গেলি। আবার তোর গফের সাথে সব ঠিকঠাক হয়ে গেলো বলে আমায় ছেড়ে বিয়ে করে নিলি?

-“ তাসফি ভাই ই তো ঠিকঠাক করে দিলো আমার আর আইরিনের মধ্যকার দূরত্ব।

তটিনী কটমট চাহনি নিয়ে তাকালো আদিলের দিকে।
-“ উনি সব ঠিকঠাক করে দিছে তোর…সরি আপনার বিয়ের?
-“ হুমম।
-“ আমাকে আগে বলিস কেনো?
তটিনী আশেপাশে তাকিয়ে রাগ থামানোর চেষ্টা করে বলে।
-“ তাসফি ভাই নিজেই তো তোমায় বলবে জানিয়েছিল।
-“ আপনি জানাতে পারলেন না? যে যার মতো করে ইউজ করলেন আমায়!
-“ সরি।
-“ সরি বললেই সব সমাধান হয়ে যাবে?
-“ সেটা হবে না। কিন্তু আমরা তো কেউ অখুশি নেই তাই না? আমিও বিয়ে করে হ্যাপি,তুমিও বিয়ে করে হ্যাপি। তাসফি ভাই তো খারাপ না।
-“ আমার অনুভূতি গুলো ফাস্টে কাকে ঘিরে ছিলো? আপনি না উনি? আর উনি ও চিট করেছে আমার সাথে। ঠকিয়েছে আমায়। আমি এতোদিন ভেবেছি আমিই অন্যায় করেছি। এখন দেখছি আপনারা তো আমার থেকেও বেশি। দু’জন পুরুষ মিলে একটা মেয়ে কে জাস্ট ইউজ করলেন নিজেদের মতো করে ছিঃ।
-“ ভুল বুঝছো।
তটিনী আর কথা বাড়ালো না। তার রাগে শরীর কাঁপছে। রাগের জন্য ঠোঁট অনবরত কাঁপছে চোখে পানিও টলমল করছে। পাশ থেকে খালি রিকশা ডেকে সেটায় উঠে পড়লো।

#চলবে?

কাছের মানুষ দূরে খুইয়া পর্ব-০৭

0

#কাছের_মানুষ_দূরে_থুইয়া
#পর্ব৭
#Raiha_Zubair_Ripti

বসার ঘরে সোফায় বসে আছে তটিনী তার পাশে তাসফি। সকালের নাস্তা টা সেরেই রওনা দিবে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। জাহানারা বেগম জহুরি চোখে তাকিয়ে দেখছে তটিনী কে। তটিনী জাহানারা বেগমের চাহনি তে অস্বস্তিবোধ করে। মেঘলা হোসেন টেবিলে খাবার বেড়ে ডাক দেয় তাসফি আর তটিনী কে। তাসফি তটিনীর হাত ধরে বসা থেকে উঠতে উঠতে জাহানারা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে-
-“ এমন চাহনি নিয়ে আমার বউয়ের দিকে তাকিয়ো না দাদি। ওর থেকে আমার বেশি অস্বস্তি লাগে।

জাহানারা বেগম লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হতাশার সুরে বলে- হ এহন তো আমার চাহনি তে তর অস্বস্তি লাগবো। বউ পাইছস সুন্দর এহন কি আর আমার মতো বুড়ির চোখের নিচে কালি পড়া চামড়া কুচকানো চাহনি ভালো লাগবো?

তাসফি কিছু বললো না। তটিনীর জন্য চেয়ার টেনে দিয়ে নিজেও চেয়ারে বসে পড়লো। তানু টিফিন বক্সে তটিনী আর তাসফির জন্য খাবার প্যাক করছে। ওখানে গিয়ে গোছগাছ করতে করতে অনেক টা সময় লেগে যাবে সাথে রান্নার প্যারাতেও ভুগতে হতে পারে। সেজন্য খাবার দিয়ে দিচ্ছে।

তটিনী আর তাসফির খাওয়া শেষ হলে মেঘলা হোসেন তটিনী কে নিজের রুমে আসতে বলে। তটিনী শ্বাশুড়ির কথা মতো তার রুমে যায়। বিছানায় চার থেকে পাঁচ টা গয়নার লাল বক্স সাজানো। তটিনী কে দরজার কাছে দাঁড়ানো দেখে মেঘলা হোসেন ইশারায় ভেতরে আসতে বলে। তটিনী কাচুমাচু হয়ে ভেতরে ঢুকে।
-“ বসো আমার পাশে।
তটিনী মেঘলা হোসেনের পাশে বসে।
-“ এই গয়না গুলোর মধ্যে কোনটা পছন্দ হয় তোমার দেখো তো।
তটিনী গয়না গুলোর দিকে একবার চোখ বুলায়। গয়না গুলোর কারুকাজ ভীষণ সুন্দর। গয়না গুলোর মধ্যে থাকা ছোট্ট একটা চিকন হাড় ধরে উল্টেপাল্টে দেখে।
-“ এটা পছন্দ হয়েছে?
তটিনী উপর নিচ মাথা নাড়ায়। মেঘলা হোসেন স্মিত হেঁসে বলে- আর কিছু পছন্দ হয় নি?
-“ উঁহু।
মেঘলা হোসেন তটিনীর হাত থেকে হাড় টা নিয়ে তটিনীর গলায় পড়িয়ে দেয়। আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলে- বাহ বেশ সুন্দর লাগছে তো তোমায়। পছন্দ আছে বলতে হবে তোমার।

তটিনী মুচকি হাসে।
-“ এবার চটপট রেডি হয়ে নাও। বেরোতে হবে তো।
তটিনী গলা থেকে হাড় টা খুলতে নিলে মেঘলা হোসেন বলে উঠে – আরে হাড় খুলছো কেনো? এটা তোমারই প্রাপ্য। তোমাকে বিয়ের পর কিছু দেওয়া হয় নি এখনও। সেজন্য এটা তোমার উপহার।
তটিনী ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষন চুপ থেকে হাড় টা নিয়ে রুম থেকে বের হয়।

তাসফি রেডি হয়ে বসে আছে রুমে। তটিনী কে দেখামাত্রই তাড়া দিয়ে বলে- রেডি হও তাড়াতাড়ি, যেতে হবে তো নাকি।
তটিনী হাড় টা তাসফির সামনে মেলে ধরে বলে- মা এটা দিলো।
তাসফি তাকায় হাড় টার দিকে। -“ ওহ্।
-“ হুমম।
তাসফি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মানিব্যাগ প্যান্টের পকেটে ভরে বলে- বোরকা পড়ে রেডি হইয়ো।
তটিনী চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তাসফির দিকে।
-“ আমার তো বোরকা নেই।
-“ আলমারি তে আছে।
তটিনী আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। পিংক কালারের একটা বোরখা সাথে হিজাব ও।

তটিনী পড়নে থাকা থ্রিপিস টার উপর দিয়েই বোরকা টা পড়ে রেডি হয়। তাসফি বিছানায় বসে বসে তটিনীর হিজাব বাঁধা দেখে নিলো। তটিনী পুরোপুরি রেডি হতেই তাসফি ল্যাগেজ হাতে করে তটিনী কে সাথে নিয়ে নিচে নামে।

তাজদিদ আর জাহাঙ্গীর হোসেন অফিসে গেছেন। তটিনী আর তাসফি মেঘলা হোসেন, তানু আর জাহানারা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।

রাজশাহী তে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে গেছে তটিনী আর তাসফির। তাসফি তার অফিস আর তটিনীর ভার্সিটির মাঝামাঝি একটা জায়গায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। দুজনের জন্য যাতায়াত সহজ। তাসফির ফ্রেন্ডে রোমানের সাহায্য আগেই রুম টা গুছিয়ে নিয়েছিল তাসফি। খাট,আলমারি, পড়ার টেবিল,ছোট্ট ফ্রিজ, ডাইনিং টেবিল প্রায় সবই আছে।

তাসফিদের ফ্ল্যাটের পাশের ফ্ল্যাটেই রুমান থাকে বউ নিয়ে।

তাসফি রা আসবে শুনেই রান্নাবান্না করে রেখেছে রুমানের বউ আলেয়া। তাসফি বলেছে খাবার সাথে করে নিয়ে এসেছে কিন্তু আলেয়া শুনেনি। খাবার রেখে গেছে রুমে। অগ্যত শেষ মেষ বাড়ি থেকে আনা খাবার গুলো ফ্রিজে রেখে দেয়।

তটিনী ওয়াশরুমে গেছে ফ্রেচ হতে। এই যানজটে এতদূর ট্রাভেল করার দরুন এখন ফ্রেশ না হলেই নয়।

তাসফি বসে আছে খাটে। তটিনী বের হলে সেও ঢুকবে ওয়াশরুমে। প্রায় বিশ মিনিট পর তটিনী ওয়াশরুম থেকে বের হলে তাসফি ওয়াশরুমে ঢুকে।
ওয়াশরুমে ঢোকার আগে তাসফি তটিনী কে বলে যায় খাবার সাজাতে।

তটিনী ভেজা টাওয়াল বেলকনিতে মেলে বসার ঘরে আসে। তাদের ফ্ল্যাটে দুটো রুম একটা কিচেন রুম আর ড্রয়িং রুম। তবে ড্রয়িং রুম টা খুব একটা বড় নয়।
টেবিলের কাছে এসে তটিনী ঢেকে রাখা খাবারের প্লেট টা উঁচু করে। প্লেটে পোলাও,গরুর মাংস আর মুরগীর মাংস দিয়ে বুটের ঘন ডাউল রান্না।

তটিনী নিজের প্লেটে খাবার বেড়ে তাসফির জন্য ও খাবার বেড়ে অপেক্ষা করে। তাসফি ভেজা টাওয়াল দিয়ে চুল মুছে সেন্টু গেঞ্জি পড়ে খাবার টেবিলে আসে। তটিনীর পাশে বসে বলে-
-“ অপেক্ষা করতে গেলে কেনো আমার জন্য।
তটিনী প্লেট টা এগিয়ে দিতে দিতে বলে-
-“ আপনাকে ফেলে একা একা খাবো নাকি?
-“ কেনো আমাকে একা রেখে খাওয়া বারন নাকি?
-“ আম্মু কে কখনও দেখি নি আব্বুকে রেখে একা খেতে।
-“ বাহ! ভালো কিছু শিখেছো তাহলে। নট ব্যাড। মুখে খাবার তুলে নিতে নিতে বলে কথাটা তাসফি।
তটিনী ও ততক্ষণে খাবার মুখে তুলে। কয়েক লোকমা খাওয়ার পর তটিনী বেশ ঝাল অনুভব করলো। আলেয়া রা খাবারে প্রায় ভালোই ঝাল খায়। কিন্তু তটিনী ঝাল খেতে পারে না। কয়েক লোকমা খাওয়ার পরই ঝালে কেশে উঠলো। তাসফি তড়িঘড়ি করে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। তটিনী কোনোরকমে পানি টা খেয়ে নিলো। ঝালে চোখ লাল হয়ে গেছে।
-“ খুব ঝাল লাগছে?
তটিনী উপর নিচ মাথা নাড়ালো। খাবারের কালার দেখে বোঝার উপায় নেই এই খাবারে এই মাত্রায় ঝাল থাকতে পারে।
তাসফি চেয়ার ছেড়ে উঠে রান্না ঘর থেকে আসার পথে কফির জন্য বয়ে আনা চিনির কৌটা টা নিয়ে তটিনীর সামনে ধরে বলে-
-“ একটু চিনি খাও ঠিক হয়ে যাবে।
তটিনী তাই করলো। চিনির কৌটা থেকে বেশ অনেক টাই চিনি খেয়ে নিলো। চিনি খাওয়ার পর ঝাল কমলে তাসফি জিজ্ঞেস করে – খাবে?
তটিনী এঁটো খাবারের দিকে তাকিয়ে বলে- অনেক ঝাল, খেতে পারবো না। কিন্তু না খেলে তো খাবার গুলো নষ্ট হবে।
-“ খেতে ইচ্ছে না করলে খেতে হবে না। বাসা থেকে আনা খাবার খাবে?
-“ না।
-“ আচ্ছা তাহলে হাত ধুয়ে ফেলো। খাবার টা আমি খেয়ে নিব।
-“ আপনি আমার এঁটো খাবার খাবেন? অবাক হয়ে বলে তটিনী।
-“ হুমম। তাসফির স্বাভাবিক হয়ে বলা কথাটায় কুঁচকে ফেলা ভ্রু সটান হয়। তারপর আর কোনো শব্দ ব্যায় না করে হাত ধুয়ে রুমে চলে আসে।

তাসফি খাবার খেয়ে প্লেট ধুয়েমুছে উল্টো করে রেখে দেয়। আর বাটিতে বেঁচে থাকা খাবার গুলো ফ্রিজে তুলে রাখে।

—————————

পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়েছে অনেক আগেই। ফ্ল্যাটের বড় বেলকনি টায় কয়েল জ্বালিয়ে চেয়ারে বসে আছে তটিনী আর তাসফি। আজকাল মশার উপদ্রব বেড়েছে প্রচুর। কয়েল ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব। এই ছয় তলার উপর থেকে সন্ধ্যার ব্যাস্ত শহর দেখছে তাসফি তটিনী। দিনের আলো বুজে যাওয়ায় রাস্তার পাশে থাকা সব কৃত্রিম আলো গুলো জ্বলে উঠেছে।
-“ কাল থেকে ভার্সিটি যাব?
তটিনীর কথায় নীরবতা ভাঙে। তাসফি ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়।
-“ কাল থেকে যাবে?
-“ হুমম,আপনি বললে।
-“ আচ্ছা। পৌঁছে দিয়ে আসবো?
-“ না না তার দরকার পরবে না। আমি তো চিনি এই শহর টা। কত ঘুরেছি। সব রাস্তা চেনা আমার।

উৎফুল্লতার সহিতে কথাটা বলল তটিনী।
-“ তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে? মুহূর্তে মুখের উৎফুল্লতা সরে গিয়ে গুমোট হয়। তটিনীর নীরবতা দেখে তাসফি ব’লে উঠে- এখনও ভালোবাসো তাকে? আই মিন মনে পড়ে?
তটিনী তড়িৎ গতিতে তাকালো তাসফির দিকে। কিয়ৎ ক্ষন চুপ থেকে বলে- আমি এখন বিবাহিত। প্রাক্তন কে মনে রেখে নিজ সংসারে অশান্তি বয়ে আনবো এমন মেয়ে আমি নই। আমি বর্তমান নিয়ে ভাবি। আর বর্তমান কেই ভালোবাসি।

তাসফি চুপচাপ শুনলো তটিনীর কথা। সন্ধ্যার আগ দিয়ে খাওয়ার দরুন তাসফির ক্ষিদে লাগছে না। কিন্তু তটিনী অল্প পরিমান খাওয়ায় তার এখন হাল্কা কিছু খেতে ইচ্ছে করছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাবে তাসফি কে কি করে বলবে তার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে সেটা।
-“ তুমি একটু থাকো,আমি আলেয়া ভাবি কে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আসলে আমার একটু বাহিরে যেতে হবে।

কথাটা বলে উঠে দাঁড়ালো তাসফি। তটিনী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। পকেট থেকে ফোন বের করে রোমান কে টেক্সট করলো আলেয়া কে তটিনীর কাছে কিছুক্ষণের জন্য এসে থাকতে সে না আসা অব্দি।
তাসফি চলে যেতেই আলেয়া আসে তটিনীর কাছে। তটিনী তখন বসে ছিল বেলকনিতে। আলেয়া কে দেখে মুচকি হাসি উপহার দিলো। বিনিময়ে আলেয়া ও হাসি উপহার দিয়ে তটিনীর পাশে বসলো।
-“ খুব ঝাল লেগেছে খাবার? ইশ আমি জানতামই না তুমি ঝাল খেতে পারো না। খুব সরি। প্রথম দিনেই এমন বাজে পরিস্থিতি ফেলার জন্য।
তটিনীর বুঝতে বাকি রইলো না। কথাটা কি করে আলেয়ার কান অব্দি গেছে।
-“ সরি বলছেন কেনো আপু। ঝাল ছিল কিন্তু খাবার টা অনেক টেস্ট ছিলো। ঝালের জন্য খেতে পারি নি বলে আফসোস হচ্ছে।
-“ আমি কালই আবার রান্না করে দিব ঝাল কম করে। আফসোস করতেই দিব না। আচ্ছা রান্না বান্না পারো তুমি?
তটিনী মিনমিন সুরে বলল- খুব একটা ভালো পারি না। ভাত, ডাল,ডিম,ভাজি এসব পারি।
-“ সমস্যা নেই আমি তোমাকে শিখিয়ে দিব।
তটিনীর মুখ খুশিতে জ্বলে উঠলো- সত্যি!
-“ হুমম। আমাকে আপনি করে বলবে না তুমি করে বলবে কেমন?
-“ আচ্ছা।
আলেয়ার সাথে গল্পগুজব করতে করতে বেশ ফ্রী হয়ে যায় তটিনী। রাত আটটার দিকে তাসফি বাসায় আসে। হাতে কিছু ঠোঙা নিয়ে৷ ঠোঙা গুলো দেখেই তটিনী বুঝে ঠোঙায় ভাজাপোড়া কিছু আছে। ঠোঙা টা তটিণী-র হাতে ধরিয়ে দিতেই তটিনী দেখে ঠোঙার ভেতর পেঁয়াজু, বেগুনি আছে। তটিনী খাবার গুলো প্লেটে ঢেলে আলেয়ার সামনে এগিয়ে দেয়। আলেয়া স্মিত হেঁসে একটা বেগুনি উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়।

তটিনী এবার প্লেট টা তাসফির দিকে এগিয়ে দিলে তাসফি বলে- আমি খাবো না৷ তুমি খাও। তোমার জন্য এনেছি।
তটিনী আর জোর করলো না। দু একটা পেঁয়াজু খেয়ে রেখে দিলো বাকিটা।

ঘুমানোর আগ দিয়ে তটিনী শ্বাশুড়ি, বোন আর মায়ের সাথে কথা বলেছে। তটিনীর মা পইপই করে বলে দিয়েছে তাসফির কথা মতো চলতে। তটিনী চুপচাপ শুনেছে তার মায়ের কথা। বোন ও সেম কথা কথা বলেছে। শ্বাশুড়ি একটু ব্যাতিক্রম কথা বলেছে। সেটা হলো তাসফি কে দেখে রাখার। তাসফির সুবিধা অসুবিধা বুঝে নেওয়ার। ঝুটঝামেলা বিহীন সংসার তটিনীর। বেশ ভালোই লাগছে। তাসফিকে অতোটা খারাপ ও লাগছে না।

তাসফির পাশে শুয়ে শুয়ে আকাশকুসুম ভেবে চলছে তটিনী। কাল থেকে ভার্সিটি যাবে। ভার্সিটি তে যাওয়ার পথে আদিল দের বাসা সামে পড়ে। তখন যদি আদিলের সাথে বাই এনি চান্স দেখা হয় তখন কি তটিনী এড়িয়ে যাবে? এড়িয়েই তো যাওয়া উচিত।

এদিকে তাসফি কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। তটিনীর সাথে যে আদিলের দেখা হবে কোনো না কোনো এক সময় এটা নিয়ে সন্দেহ নেই। আদিল যে তটিনী কে সব বলবে এটা তাসফি খুব ভালো করেই জানে। তাসফিও চায় আদিল বলুক তাকে সব নিজের মুখে৷ আর তটিনী এসে তাকে জিগ্যেস করুক,অভিযোগ করুক।

#চলবে?

কাছের মানুষ দূরে থুইয়া পর্ব-০৬

0

#কাছের_মানুষ_দূরে_থুইয়া
#পর্ব৬
#Raiha_Zubair_Ripti

সন্ধ্যার দিকে তরিকুল ইসলাম মেয়ে ও মেয়ের জামাই দের নিয়ে আসেন তার নিজ বাড়িতে। লায়লা বেগম বাসায় এসেই রান্নার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। লায়লা বেগম কে সাহায্য করছে লাবন্য আর তানিয়া বেগম। চার পাঁচ রকমের পিঠে বানিয়েছে সাথে সুস্বাদু খাবার, ভাত,ডাল,দু রকমের ভাজি,মাংস,পোলাও,ডিম। আর শেষ পাতে সেমাই।

তটিনী ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে লাবন্যর বাচ্চাকে কোলে নিয়ে গল্প করছে ঐশী আর তানুর সাথে। আজ তানিয়া বেগমের মেয়ে তাসলিমা ও এসেছে। সে এবার অনার্স ১ম বর্ষে পড়ে। পরীক্ষা থাকায় আসতে পারে নি আগে। পরীক্ষা শেষ হতেই আজ এসেছে।

তটিনীর রুমে বসে আছে তাজদিদ আর তাসফি। তাসফি নতুন জামাই কিন্তু তাজদিদ তো নতুন জামাই নয়। সেও এসে ঘাপটি মেরে বসে আছে তাসফির সাথে। এতে বরং তাসফির সুবিধাই হলো। বোরিং নেস টা কিঞ্চিৎ কম লাগলো। তটিনী এসে থেকে তার সামনে ভুলেও আসে নি। এ নিয়ে কিছুটা খারাপ লাগছে তাসফির। তবে বাহিরে প্রকাশ করলো না।

তাজদিদ তাসফির পাশে বসে থাকতে থাকতে বোরিং ফিল করলো সেজন্য তানু কে ডাক দিয়ে দু মগ কফি চেয়ে নিলো। তানু রান্না ঘরে গিয়ে দু মগ কফি বানিয়ে তটিণী-র সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ তোর ভাইয়া আর তাসফি কে কফি টা দিয়ে আয়।
তটিনী তাসলিমার সাথে কথা বলছিল,তানুর কথায় কথার মাঝে বাঁধা পায়। কফির মগটার দিকে তাকিয়ে লাবন্যর বাচ্চা টাকে তাসলিমার কোলে দিয়ে কফির মগ নিয়ে রুমে দিকে হাঁটা ধরে। দরজার কাছে আসতেই দেখে তাজদিদ বের হচ্ছে রুম থেকে। তটিনী সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দিতেই তাজদিদ হাসি মুখে তটিণী-র হাত থেকে কফির একটা মগ হাতে নিয়ে বলে-
-“ তাসফি রুমেই আছে। তাকে গিয়ে দিয়ে আসো।
তটিনী মাথা নাড়ায়। তাজদিদ প্রস্থান করলেই তটিনী রুমের ভেতর ঢুকে। তাসফি তখন আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছে। তটিনী কে দেখে শোয়া থেকে উঠে ভালো হয়ে বসে। তটিনী তাসফির দিকে কফির মগ টা এগিয়ে দেয়। তাসফি নীরবে কফির মগ টা নিয়ে কফিতে চুমুক বসিয়ে দেয়। তটিনী কিয়ৎ ক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ঘর থেকে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলে তাসফি ডেকে উঠে। তটিনী পেছন ফিরে তাকায়। তাসফি কফির মগ হাতে নিয়ে তটিণী-র সামনে দাঁড়ায়।
-“ তোমার পড়াশোনা করার ইচ্ছে আছে আর?
তটিনী তাকায় তাসফির পানে। মাথা নাড়িয়ে মৃদু সুরে বলে- হ্যাঁ আছে।
-“ রাজশাহী তেই?
-“ হুমম।
তাসফি কফির মগে চুমুক বসিয়ে বলে-“ কবে থেকে? আই মিন রাজশাহী যেতে চাচ্ছো কবে?
-“ আপনার অনুমতি পেলেই যাব।
-“ যদি না দেই?
তটিনী তাসফির দিকে তড়িৎ গতিতে তাকায়। তাসফি আগের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে।
-“ আপনি কি অনুমতি দিবেন না তাহলে যাওয়ার?
-“ না না তেমন কিছু না। বাট হলে থাকা টা তো বাসা থেকে এলাও করবে না।
-“ আগেও তো ছিলাম হলে।
তাসফি ভ্রু কুঁচকে বলে- আগে কি ছিলে আর এখন কি তুমি? এখন তুমি কারো মেয়ের সাথে সাথে কারো বাড়ির পুত্র বধূ।
-“ তাহলে কি করবো?
-“ সপ্তাহ খানেক ভাবার জন্য সময় হবে?
-“ দশ দিন পর আমার এক্সাম।
-“ ওহ্। আচ্ছা তাহলে দু তিন দিন ভাবার জন্য সময় দাও। আমি ম্যানেজ করে ফেলবো।
-“ আচ্ছা।
তটিনী চলে যায়। রাতে মেয়ে জামাই দের এক সাথে নিয়ে খাবার খায় তরিকুল ইসলাম। খাওয়া দাওয়া শেষে মেয়ের জামাই দের সাথে গল্প গুজব করে রুমে যায় ঘুমাতে। লাবন্য আর তানিয়া বেগম এক সাথে এক রুমে থাকে আর ঐশী তাসলিমা অন্য রুমে। তাজদিদ আর তানু দাঁড়িয়ে আছে তাদের রুমের বেলকনিতে। চারিদিকে শীতল ঠান্ডা বাতাস বইছে। তানুর শরীর কেঁপে উঠলো বাতাসে। তাজদিদ নির্দ্বিধায় বেলকনিতে পাশে বউ রেখে সিগারেটে টান দিচ্ছে আর ধোঁয়া গুলো বাতাসের সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে। তানু ফোনে সময় দেখে নিলো। তারপর হাই তুলতে তুলতে বলল- শেষ হচ্ছে না কেনো তোমার সিগারেট খাওয়া? আর কতক্ষণ থাকবো দাঁড়িয়ে এই ঠান্ডায়?
তাজদিদ আড়চোখে তাকালো। আধ খাওয়া সিগারেট টা ফেলে দিলো। নিত্যকার অভ্যাস রাতে তানু কে পাশে রেখে সিগারেট খাওয়া।
-“ চলো রুমে যাই।
তানু আধ খাওয়া সিগারেটের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ফেলে দিলে কেনো?
-“ এমনি, খাওয়া মুড নেই সেজন্য।
-“ আচ্ছা রুমে গেলাম আমি আসো।
তানু রুমে যায় পেছন পেছন তাজদিদ ও।

মাথার উপর সিলিং ফ্যান টা ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরে চলছে। তাসফি আর তটিনী সেই ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘর জুড়ে চলছে পিনপিনে নিরবতা। আর নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ। তটিনীর চোখে সকল রাজ্যের ঘুম এসে হানা দিচ্ছে। কিন্তু তাসফি নির্ঘুমে। বউ পাশে অথচ বউকে ছুঁতে পারছে না। নীরবতা কে সাইডে ফেলে তাসফি তটিনী কে ডাকে- ঘুমিয়ে গেছো তটিনী?
তটিনী ঘুমঘুম চোখে বলে-“ না কেনো?
-“ একটু কাছে আসবে?
বন্ধ করে রাখা চোখ ফট করে মেলে ফেলে তটিনী। তাসফির দিকে ঘুরে বলে-“ আমি তো সময় চেয়েছি।
তাসফি স্মিত হেঁসে বলে- আমি ওসবের জন্য কাছে আসতে বলি নি। আমার বুকে মাথা রাখবে এসো।
নিজের বোকামির জন্য লজ্জা পেলো তটিনী।
-“ বুকে মাথা রেখে কি হবে?
-“ বুকের মধ্যে থাকা হৃদপিণ্ডটা শীতল হবে এই আর কি।
তটিনী ঠোঁট কামড়ে কিছু ভেবে তাসফির কাছে গেলো। তাসফি তটিনী মাথাটা নিজের বুকের উপর নিয়ে বলে- কিছু শুনতে পারছো?
তটিনী তাসফির শার্ট খামচে ধরে। -“ হুমম।
-“ কি?
-“ কেমন ধুকধুক শব্দ হচ্ছে।
-“ হুমম। আস্তে আস্তে শীতল হয়ে থেমে যাবে।
কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যি আওয়াজ টা থেমে গেলো।
তাসফি তটিনীর চুলের ভাজে হাত রেখে হাত নাড়াতে থাকে। এতে যেনো আরাম বোধ করলো তটিনী। ঘুমের দিকে ঝুঁকে পড়লো। তাসফি কপালে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলে- সরি ফর এভরিথিং তটু।

পরের দিন দুপুরের খাবার খেয়েই তটিনী কে নিয়ে রওনা হয় তাসফি। আগামী কাল থেকে অফিসেও জয়েন হতে হবে।

তাজদিদ তানু কে নিয়ে বিকেলের দিকে আসে বাসায়। ড্রয়িং রুমে সিমির সাথে বসে আছে তটিনী। মেঘলা হোসেন আর তানু রান্না ঘরে রান্না করছে। রিমি চলে গেছে বাসায়। তাসফি বাসায় ফিরেই ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে আছে। প্রচুর কাজ বাকি আছে তার।

সিমি তার ভার্সিটির গল্প বলছে তটিনী কে। আর তটিনী চুপচাপ শুনছে সেসব। জাহানারা বেগম তটিনী কে ডেকে বলে- নাত বউ আমার কাছে আসো তো।

তটিনী এক ঢোক গিলে তার কাছে যায়। জাহানারা বেগম আশেপাশে একবার তাকিয়ে নেয়।- তোমাগোর মধ্যে এহনও কিছু হয় নাই?
তটিনী চোখ মুখ খিঁচে ফেলে। এই মহিলাটাও না যাচ্ছে তাই।
-“ কি হবে আমাদের মাঝে দাদি?
তটিনীর পাল্টা প্রশ্নে জাহানারা বেগম ভ্রু কুঁচকায়।
-“ জানো না কি হইবো? ক্লাস ফোর ফাইভের মাইয়া রাও তো জানে। আর তুমি জানো না?
তটিনী জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলার জন্য উদ্যত হলে,পেছন থেকে ভেসে আসে- দাদি এটা নিয়ে তোমার এতো চিন্তা হচ্ছে কেনো? আমার তো হচ্ছে না চিন্তা। একটু সময় নিক, পালিয়ে যাচ্ছে না ও। সময় পরে আছে অনেক ওসবের জন্য। প্লিজ এসব বলে আমার বউকে লজ্জায় ফেলো না।

জাহানারা বেগম তাসফির দিকে তাকায়। তাসফি গ্লাস হাতে করে পানি খাচ্ছে। কথাটা বলে তাসফি তটিনী কে একটু রুমে আসতে বলে চলে যায়। জাহানারা বেগম তটিনী উঠে যেতে নিলে হাত টেনে ধরে। পাশে আবার ফের বসিয়ে বলে- এই ছ্যামড়ি আর কত সময় নিবার চাও? বিয়ের তিনদিন হয়ে যাচ্ছে এখনও সময় লাগে? আমার নাতি রে খুশি করতে পারো না? তুমি কি পিচ্চি যে তোমার সময় লাগবো? আমার নাতি ভালা মানুষ দেইখা তোমারে সময় দিতাছে। অন্যরা হইলে তো এতক্ষণে পুরো বাড়ি মাথায় করে ফেলতো।

তটিনী কি বলবে বুঝতে পারছে না। তাসফির সমস্যা না কিন্তু এই মহিলার সমস্যার শেষ নেই। নিশ্চুপে উঠে রুমে চলে গেলো।

তাসফি শার্ট পড়ে রেডি হচ্ছে। এই অবেলায় তাসফি কে রেডি হতে দেখে তটিনী জিজ্ঞেস করে – কোথাও যাবেন?
-“ হুম। একটু কাজ আছে।
-“ ওহ্ ফিরবেন কখন?
-“ একটু লেট হবে। তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ো কেমন?
তটিনী এর বিপরীতে কিছু বললো না। তাসফি পকেটে মানিব্যাগ ভরে হাতে ঘড়ি পড়ে তটিনীর সামনে দাঁড়িয়ে কপালে চুমে খেয়ে বেড়িয়ে যায়।

রাতে খুব একটা ফিরতে লেট করে নি তাসফি,রাতের ডিনারের আগেই ফিরেছে। হাতে ছিল কয়েকটা শপিং ব্যাগ। সেগুলো তটিনীর হাতে ধরিয়ে ফ্রেশ হতে যায়। তটিনী প্যাকেট গুলো উল্টেপাল্টে দেখে। কয়েকটা শাড়ি আর থ্রিপিস। তাসফি ওয়াশরুম থেকে বের হলে তটিনী জিজ্ঞেস করে – এগুলো কার জন্য?
তাসফি তটিনীর দিকে তাকিয়ে বলে- তোমার জন্য।
-“ এতোগুলা কেনো?
-“ এমনি। পছন্দ হলো তাই নিয়ে আসলাম।
এরমধ্যে তানু ডেকে যায় খাবার খাওয়ার জন্য। তাসফি তটিনী কে নিয়ে খাবার খাওয়ার জন্য নিচে নামে।
খাবার টেবিলে জাহাঙ্গীর হোসেন,মেঘলা হোসেন, তাজদিদ আর তানু রয়েছে। জাহানারা বেগম আর সিমি আগেই খেয়ে রুমে চলে গেছে।
তাসফি তটিনী কে নিয়ে বসতেই মেঘলা হোসেন খাবার বেড়ে দেয় প্লেটে। তাসফি খাবার প্লেটে হাত দিয়ে ভাত মুখে তুলতে তুলতে বলে- বাবা আমি রাজশাহী তে ট্রান্সফার হচ্ছি। তটিনী কে নিয়ে রাজশাহী থাকবো।
জাহাঙ্গীর হোসেন অবাক হয়। -“ রাজশাহী!
-“ হুমম। ট্রান্সফারের জন্য আগে সিলেট এসেছিল,তো অফিসের আরেক জনের এসেছিল রাজশাহী। তো আমি তাকে সিলেট পাঠিয়ে রাজশাহী যাচ্ছি। আর তটিনীর ভার্সিটিও রাজশাহী।
মেঘলা হোসেন চেয়ার টেনে বসে বলে,- তা যাচ্ছো কবে?
-“ এই তো ট্রান্সফারের কাজকর্ম শেষ হলেই। তিন চারদিনের মধ্যে।
-“ ওহ্। ওখানে গিয়ে ফ্ল্যাট নিতে হবে তো।
-“ হুমম।
-“ আচ্ছা যেটা ভালো হয় সেটা করো।

তটিনী চুপচাপ শুনলো। খাওয়া দাওয়া শেষে শ্বাশুড়ির হাতে হাতে এঁটো প্লেট ধুয়ে দিলো। মেঘলা হোসেন প্লেট গুলো উপর করে রাখতে রাখতে বলে- তুমি তো তাসফির পছন্দ অপছন্দ জানো না তাই না?
তটিনী ছোট্ট করে জবাব দিলো- না।
-“ ওর তেমন অপছন্দ নেই৷ খাবার প্রায় সবই খায়। তুমি যা রাঁধবে সেটাই খাবে। এটা নিয়ে প্যারা নিতে হবে না। তবে ওর অবাধ্য হয়ে কোনো কাজ করো না। মানে ও যা নিষেধ করবে সেসব করবে না কেমন? তা না হলে ভীষণ রেগে যায়।
-“ আচ্ছা।

——————————–

সিমি চলে গেছে দু দিন হয়েছে। বাড়িতে তানু,জাহানারা বেগম,মেঘলা হোসেন আর তটিনী থাকে দিনে। আর রাত হলে বাড়ির পুরুষ গুলো বাড়ি ফিরে। কাল তটিনী আর তাসফিও চলে যাবে। তানু জামাকাপড় গুছিয়ে দিচ্ছে তটিনীর আর তাসফির। আর তটিনী বিছানায় বসে বসে ভাবছে। তটিনী কে ভাবনায় মগ্ন থাকতে দেখে তানু বলে- কি ভাবছিস এতো?
তটিনীর বিঘ্নিত হয় ভাবনায়। -“ আচ্ছা আপু উনার কি রং পছন্দ?
-“ কার?
-“ উনার।
-“ তাসফির?
-“ হুমম।
-“ হোয়াইট।
-“ আমার কাছে তো সাদা কালারের কোনো শাড়ি নেই। তোমার কাছে কি আছে?
-“ হুমম আছে কেনো?
-“ আমি পড়বো।
-“ এই রাত করে শাড়ি পড়বি কেনো?
-“ এমনি তুমি দিবে শাড়ি?
-“ হুমম দিব।
-“ একটু সাজিয়ে দিয়ো সাথে?
তানু সন্দেহান চোখে তাকায়। কাপড় গোছানো বাদ দিয়ে তটিনীর পাশে বসে বলে- ব্যাপার কি?
-“ কিসের ব্যাপার? চোখ ছোট ছোট করে বলে তটিনী।
-“ হঠাৎ সাদা রঙের শাড়ি পড়তে চাইছিস সাথে সাজতেও।
-“ এমনি আমি কি সাজতে পারি না?
-“ হ্যাঁ পারিস তবে…
-“ তবে কি? তুমি বেশি ভাবছো।
-“ তুই বুঝলি কি করে আমি কিছু ভাবছি?
তটিনী আমতা আমতা করে বলে-
-“ ঐ আ…আরকি
-“ যাক সুবুদ্ধি উদয় হয়েছে তাহলে।
তটিনী মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে হাসে।
-“ বয়ফ্রেন্ড কে মন থেকে ভুলে গেছিস?
তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে তাকায়।
-“ না মানে,মনে পড়ে ওর কথা?
তটিনী চোখ মুখ শক্ত করে বলে- না।
তানু অবাক হওয়ার ভান করে বলে- “ তুই না ভালোবাসতিস?
-“ হুমম তাতে কি?
-“ তাহলে মনে পড়বে না কেনো?
-“ জানি না। বাটপার দের কথা মনে পড়ুক আমি চাই না। ফর্ট ছেলে একটা।
-“ আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে। আমি শাড়ি এনে দিচ্ছি।
কথাটা বলে তানু নিজের রুমে চলে যায়।

তাসফির অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে রাত আট টা বেজে যায়। এমনি সময় বসার ঘরেই দেখে তটিনী কে। আজ দেখতে না পেয়ে তানুকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে- তটিনী কোথায়?
তানু হেঁসে বলে- রুমে গিয়ে দেখো।
তাসফির তানুর অযৌক্তিক হাসির মানে বুঝলো না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে। রুমের দরজা চাপানো। সেটা আস্তে করে খুলতেই দেখে সাদা রঙের শাড়ি পরিহিত রমণী ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল বাঁধছে। তাসফি অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো। সাদা রঙের শাড়িতে একদম শুভ্র পরীর মতো লাগছে তটিনী কে। তটিনী দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে তাকায় পেছনে। তাসফি কে দেখে ভরকে যায়। তাসফি নীরবে রুমে ঢুকে দরজাটা চাপিয়ে কাঁধের ব্যাগ টা সোফায় রাখে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলতে খুলতে বলে-
-“ আজ হঠাৎ সেজেছো যে?
তটিনী মিনমিনে সুরে জবাব দিলো- এমনি। আপনার পছন্দ হয়েছে?
-“ তোমাকে সাজ ছাড়াই সুন্দর লাগে। বাট এখনও লাগছে সুন্দর।
তটিনী তাসফির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে- ধুয়ে আসবো মুখ?
-“ ধুয়ে ফেলবে কেনো? সুন্দর ই লাগছে।
-“ সত্যি?
-“ মিথ্যা বলি না আমি।
-“ আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।
তাসফি মাথা নাড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। তটিনী ফোনে মেসেজ দেয় তানু কে খাবার টা রুমে দিয়ে যাওয়ার জন্য। তানু মেসেজেরই অপেক্ষায় ছিলো। খাবারের প্লেট টা তটিনীর রুমে এনে দিয়ে যায়। তটিনী খাবার টা নিয়ে টেবিলের উপর রাখে। তানু চোখ টিপ দিয়ে বলে- এনজয়।
তটিনী লজ্জা মাখা মুখ করে তানুর দিকে তাকায়৷ তানু তটিনীর থুতনিতে হাত দিয়ে বলে- এখনই লজ্জায় লাল নীল হচ্ছিস,পরে কোন রঙে নিজেকে রাঙাবি তাহলে?
-“ উফ যাবে তুমি?
তানু হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর তাসফি বের হয় ওয়াশরুম থেকে। তাসফি বের হতেই তটিনী তাসফি কে বলে- খাবার টা খেয়ে নিন। ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চয়ই?
তাসফি ভ্রু কুঁচকে বলে- খাবার হঠাৎ রুমে কেনো?
-“ আপু দিয়ে গেছে।
-“ ওহ্ আচ্ছা। তুমি খেয়েছো?
-“ হুমম।
তাসফি খেতে বসে আর তটিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত কচলাতে থাকে। তাসফি খাওয়ার মাঝে তটিনী কে বলে উঠে – কিছু হয়েছে তোমার?
তটিনী আকস্মিক তাসফির গলার আওয়াজে চমকে উঠে। -“ ক…কই না তো।
তাসফি চুপচাপ খাবার টা খেয়ে শেষ করে। তারপর বিছানায় গিয়ে শুতে নিলে তটিনী বলে উঠে -“ আপনার জন্য এত সুন্দর করে সাজলাম আপনি ঘুমাতে যাচ্ছেন কেনো?

তাসফি পেছন ফিরে। -“ আমার জন্য সেজেছো?
-“ তা না হলে আর কার জন্য সাজবো?
-“ আজ কি আমার জন্য বিশেষ কেনো দিন?
-“ হতেও তো পারে বিশেষ দিন।
-“ ওহ্।
-“ আবার ওহ্ কি?
-“ নাহ কিছু না। শুয়ে পড়ো।
তটিনী বিছানার কাছে আসলো। -“ আপনি না আমায় সময় দিয়েছিলেন। আপনার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য।
-“ হুমম।
-“ আমার আর সময় লাগবে না।
তাসফি সবেই চেখ বন্ধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তটিনীর কথা শুনে চোখ আর বন্ধ করলো না। শোয়া থেকে উঠে বিস্ময় হয়ে বলে- সময় লাগবে না আর শিউর?
-“ না লাগবে না।
-“ সত্যি?
-“ হুমম।
তাসফি তড়িৎ গতিতে তটিনী কে টেনে কোলে বসায়।
-“ তাহলে আর আমার ধৈর্য্য ধরে রেখে কি লাভ? অনুমতি তো পেয়েই গেছি।
তটিনী চোখ বন্ধ করে ফেলে। তাসফি তটিনীর গলায় মুখ গুঁজে দিতেই শিউরে উঠে। আস্তে আস্তে হাতের ছোঁয়া গাঢ় হতে থাকে। সেই সাথে তটিণী-র নিঃশ্বাস ভারী হতে থাকে।

#চলবে?