কাছের মানুষ দূরে থুইয়া পর্ব-০৯

0
158

#কাছের_মানুষ_দূরে_থুইয়া
#পর্ব৯
#Raiha_Zubair_Ripti

সন্ধ্যায় ছেয়ে গেছে চারিপাশ,আকাশের সুর্য ডুবে আবছা চাঁদের আলো ছড়িয়ে গেছে ধরণীতে। হালকা গুমোট পরিবেশ৷ পাশে রাস্তার থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ ভেসে পরিবেশ টাকে অদ্ভুত করে তুলছে। বাসায় ফিরেই থম মেরে বসে আছে তটিনী। তার নিজের দিকবিদিকশুন্য ঠেকছে সব কিছু। কি করে পারলো দু’জন মানুষ তাকে দু ভাবে ঠকাতে? কান্না করার ফলে চোখ দুটো ফুলে উঠেছে। নাকের পানি চোখের পানি মিলে একাকার।

এভাবেই বসে থাকতে থাকতে রাত সাত টা বেজে গেলো। রান্না বান্না কিচ্ছু করে নি তটিনী। যেখানে নিজেকেই সামলাতে পারছে না সেখানে রান্না বান্না করা তো দুরস্ত।

হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ শুনতেই নড়েচড়ে উঠল তটিনী। ওড়না দিয়ে চোখ মুখ মুছে বসা থেকে দাঁড়ালো। তারপর এলোমেলো পায়ে দরজা খুলে দিলো। তাসফির দিকে ভুলেও একবারের জন্য তাকালো না। বিনাবাক্য রুমে চলে আসলো।

তাসফি তটিনী কে এমন চুপচাপ চলে যেতে দেখে অবাক হলো। দরজা লক করে কাঁধের ব্যাগ টা নামিয়ে রুমে ঢুকলো। তটিনী ততক্ষণে বেলকনিতে গিয়ে দাড়িয়েছে। তাসফি ফ্রেশ না হয়েই শার্টের দুটে বোতাম খুলতে খুলতে তটিনীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে-
-“ মন খারাপ?
তটিনী নিশ্চুপ। তাসফি তটিনীর মুখের দিকে তাকায়।
-“ শরীর ঠিক আছে?
এবার নিশ্চুপ তটিনী। তাসফি তটিনীর বাহুতে হাত দিতে নিলে তটিনী ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। একই ভঙ্গিতে থেকে ধরা গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়-
-“ কেনো করলেন এমন টা?
তাসফি সরল চোখে তাকায়।
-“ কি করেছি?
-“ জানেন না কি করেছেন?
তাসফি সত্যিই বুঝলো না তটিনীর কথার মানে।
-“ না।
-“ আদিল কে চিনেন?
তাসফি এবার কিছুটা আঁচ করতে পারলো। কোনো ভনিতা ছাড়াই বলল-
-“ হুমম চিনি।
-“ কিভাবে চিনেন?
-“ তোমার মাধ্যমেই চিনি।
তটিনী এবার নড়েচড়ে উঠলো। জোরে শ্বাস নিয়ে বলল-
-“ আপনারা দু’জন কাজ টা কি আমার সাথে ঠিক করেছেন? আমাকে জাস্ট গুটির মতো উইজ করে গেলেন।
তাসফি দৃঢ় কন্ঠে বলল-
-“ আমি মোটেও তোমায় ইউজ করি নি। ইউজ করলে বিয়ে করতাম নয়।
-“ এটাকে ইউজ বলে না তো কি বলে? আপনি জানতেন না আমি আদিল কে ভালোবসতাম? তবুও কেনো এমন করলেন?
কিছুটা জোরে শব্দ করে কথা গুলো বলে তটিনী। তাসফি তপ্ত শ্বাস ফেলে।
-“ আদিল তোমাকে ভালোবাসে নি। ভালোবাসলে সে নিশ্চয়ই তার এক্সকে বিয়ে করতো না? আমি জাস্ট থ্রেট দিতেই সে এক্স কে বিয়ে করে নিলো! সে যদি দৃঢ়ভাবে বলতো সে তোমাকে ভালোবাসে ট্রাস্ট মি আমি জীবনেও তোমাকে তার থেকে আলাদা করতাম না। কিন্তু ও তো তোমাকে সেভাবে চায়ই নি কোনোদিন। আর আমি যখন সুযোগ পেয়েই গেছি তোমাকে পাবার তাহলে কেনো আমি সেই সুযোগ ছাড়বো? আমি দেবদাস বা সন্যাসী ও নই। আমার তোমাকে লাগতো বেঁচে থাকার জন্য হলেও। তাই আমি জাস্ট পথ অবলম্বন করেছি তোমাকে পাবার।

-“ আপনার কি মনে হয় আমি এসব জানার পর আপনার সাথে সংসার করবো?
-“ ডিভোর্স পাবে না ইহজন্মে ও এটা শিউর থাকো। চাইলে রাগ করে বাবার বাড়ি যেতে পারো সমস্যা নেই। দিন কয়েক পর মানিয়ে নিয়ে আসবো।
-“ আমি যদি আপনার সাথে সংসার করতে না চাই আপনি কি জোর করে করাতে পারবেন সংসার?

-“ জোর করে সংসার করাতে পারবো না,কিন্তু ডিভোর্স ও তো দিতে পারবে না। ভুলে গেছো তেমার বাবা কে? বয়ফ্রেন্ডের জন্য বাসা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলে৷ তোমার বাবা সেটার ব্যাপারে এখনও কিছু জানে না। আর সেখানে তুমি যদি ডিভোর্সের কথা তুলো তাহলে কি হবে ভেবে দেখেছো?

তটিনী চোখমুখ শক্ত করে বলল- ভয় দেখাচ্ছেন?
-“ না পরিস্থিতি দেখিয়ে দিলাম। রান্না করো নি বোধহয় তাই না? আচ্ছা সে যাক আমি খাবার অর্ডার করে দিচ্ছি। তুমি বরং ফ্রেশ হও। শুধু শুধু কান্না কাটি করে এমন হাল করলে শরীরের। বুদ্ধি দিয়ে ভাবতে শুরু করো সব। সব জায়গায় হৃদয় কে খাটাতে যেয়ো না।

-“ আপনাদের মতো খেলোয়াড় নই আমি,,যে যারতার সাথে খেলা শুরু করবো তাদের হৃদয় নিয়ে।
-“ এ জন্য ই তো বললাম বুদ্ধি দিয়ে ভাবতে। সিম্পল বিষয় আদিল তোমাকে ভালোইবাসে নি,আর যে ভালোবেসেছে তার দিকে ঘুরেই তাকাও নি। কাছের মানুষ দূরে থুইয়া,তুমি গেছো রাজশাহীর এক ছেলের সাথে প্রেম করতে। কতবড় সাহস ভাবা যায়!

তটিনী তাসফির দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বেলকনি থেকে চলে রুমে আসলো। তাসফি তপ্ত শ্বাস ফেলে রুমে ঢুকে দেখে তটিনী ফের বিছানায় বসে আছে।
তাসফি ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। এরমধ্যে ডেলিভার বয় এসে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাসার নিচে।
তাসফি ফোন পেয়েই নিচপ নেমে খাবার টা কালেক্ট করে বিল পে করে আবার চলে আসে।
ডাইনিং টেবিলের প্লেটে খাবার সাজিয়ে তটিণী-র কাছে গিয়ে বলে-
-“ খাবার খাবে না?
-“ ক্ষিধে নেই।
তটিনীর কাটকাট গলায় বলা কথাটা শুনে তাসফি ঠোঁট কামড়ে কিয়ৎ ক্ষন চুপ থাকে। তারপর মাথর চুল গুলো পেছনে ঠেলে দিতে দিতে বলে-
-“ ক্ষিধে লেগেছে আমার ভীষণ।
-“ তো?
-“ খাবার খাওয়া লাগবে তো।
-“ আমি কি খাবার কোলে নিয়ে বসে আছি?
-“ তুমি না গেলে খাই কি করে!
-“ খাবো না আমি।
-“ কতদিন?
-“ মানে?
-“ বলছি কতদিন না খেয়ে থাকবে? কতদিন তোমার রাগ ভাঙাবো বলে দাও। আমি সেভাবে প্রিপারেশন নিবো তাহলে।

তটিনী রাগান্বিত হয়ে তাকায়।
-“ মশকরা করছেন আমার সাথে? আপনার খারাপ লাগছে না? আমার সাথে এমন টা করাতে?
-“ আগে লেগেছে। এখন লাগছ না।
-“ দূর হন আমার চোখের সামনে থেকে। আপনাকে দেখলে আমার রাগ তরতর করে বাড়ছে।
-“ কিছু একটা করো আর রাগ টা ঝেড়ে ফেলে দাও।
-“ খু’ন করতে ইচ্ছে করছে আপনাদের।
-“ ধারালো ছু’রি তো নেই,কি দিয়ে করবে তাহলে খু’ন।
তটিনী জোরে জোরে শ্বাস ফেলে রাগ কমানোর চেষ্টা চালায়। তটিনী খুব একটা রাগ করে থাকতে পারে না। কিন্তু যখন রেগে যায় তখন ঐ অল্প সময়েই হুলুস্থুল করে বসে। এখন রাগ টাকে কন্ট্রোল করার জন্য তটিনী নিজের হাত কচলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তাসফি খাবার প্লেট টা নিয়ে তটিনীর পাশে বসে। মাংস দিয়ে ভাতের লোকমা তুলে ধরে তটিনীর মুখের সামনে। তটিনী সাপের মতো ফোঁস করে উঠে।

-“ ভাত খাও রাগ কমে যাবে। তারপর ভালো করে বুদ্ধি খাটিয়ো আমাকে শাস্তি দেওয়ার।
তটিনী মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাসফি পূনরায় ভাতের লোকমা তুলে ধরে।
-“ খাবারের সাথে রাগ করতে নেই তটু।
তটিনী মুখ ঘুরায়। পেটে ও ক্ষুধা লেগেছে প্রচুর৷ চুপচাপ মুখে খাবার তুলে নেয়। তাসফি তটিনী কে খাওয়ার মাঝে মাঝে নিজেও খেয়ে নেয়।

খাওয়া শেষ হতেই তটিনী নিরবে খাটের এক পাশে গিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ে।

তাসফি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে লাইট লিভিয়ে বসার ঘরে গিয়ে ল্যাপটপে কাজ করে।

কাজ করতে কারতে শেষ প্রহরে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় তটিনীর। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠতেই চট করে মাথায় ব্যাথা পায়। মূহুর্তে মনে পড়ে যায় গতকাল কের ঘটনা গুলো৷ তটিনী আশেপাশে তাকায়। রুমে সে ব্যাতিত কেউ নেই। বিছানার পাশ থেকে ফোন তুলে সময় দেখে নেয়৷ নয় টা বেজে চল্লিশ । তাসফি চলে গেছে তাহলে অফিসে। তটিনী বিছানা থেকে নামতেই চোখ যায় টেবিলের উপর থাকা এক ছোট্ট কাগজের টুকরোর দিকে। তটিনী কাগজের টুকরো টা তুলে ভাজ খুলে।

-“ খাবার রান্না করে রেখে গেছি। খেয়ে নিয়ো,রাগ করে বাবার বাড়ি চলে যেয়ো না কেমন?

লেখাটা পড়ে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলো। তারপর খোলা চুল গুলে হাত খোঁপা করে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।

টেবিলের উপর খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। তটিনী একটা একটা করে ঢাকনা উঁচু করে দেখে,ডাল আর পাঙ্গাশ মাছ রান্না করা। পাঙ্গাশ মাছ ভীষণ প্রিয় তটিনীর৷ রাগ গুলো কে একপাশে রেখে আগে খাবার খেয়ে পেট মস্তিষ্ক ঠান্ডা করে নিলো। তারপর ফোন টা নিয়ে বেলকনিতে গিয়ে তানুর নম্বরে কল দিলো।
-“ কেমন আছিস তটু?
তটিনী জবাব দিলো- “ তুই জানতিস আপু সব?
-“ কি জানতাম? অবাক হয়ে বলে তানু।
-“ এই যে উনি আদিল কে থ্রেট দিয়ে আমায় বিয়ে করেছে এটা।
তানু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল- ওহ এটা৷ হ্যাঁ জানি তো। কেনো কি হয়েছে?
-“ সিরিয়াসলি তুই জানতিস আপু? অবিশ্বাসের সাথে বলে উঠে তটিনী। তুই জানা সত্ত্বেও আমায় বলিস নি! তুই নিজের বোন হয়েও আমায় ঠকালি এভাবি?
-“ কোথায় ঠকেছিস তুই? আদিলের সাথে বিয়ে হতো তোর? তুই জানতিস না বাবা রিলেশন টিলেশন করে বিয়ে এসব পছন্দ করে না? আর আদিল কি তোকে ভালোবাসতো? নিজের বিবেক কে প্রশ্ন কর।
-“ না বাসুক ভালো। আমি তো বেসেছিলাম ভালো।
-“ হারাম অলওয়েজ রং হয়৷ তোর আর আদিলের রিলেশন টা ছিলো হারাম। কোনো দিক দিয়েই তো তোদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতো না। তাহলে এখন পুরোনো কাসন্দি ঘেঁটে কি লাভ?
-“ এতো লাভ লোকসান খুঁজো কেনো তোমরা? ভালোবসা অপরাধ না আপু।
-“ ভালোবাসা অপরাধ সেটা আমিও বলি নি। কিন্তু ভুল মানুষকে ভালোবাসা কখনই ভালো কিছু বয়ে আনে না তটু। আবেগে না ভেসে বিবেক দিয়ে ভাবো। সামান্য একটা থ্রেটেই যে ছেলে তোর হাত ছেড়ে প্রাক্তনের কাছে চলে যায় সে ছেলে কতটা সুবিধার হতো তোর জন্য?
-“ আমাকে তাসফির সাথেই সংসার করতে হবে এখন তাহলে?
-“ সেটা তোর ইচ্ছে। বাবা কে কথা দিয়েছিলি তার অসম্মান হবে এমন কাজ কখনই করবি না। বাবা কিন্তু জানে না তোর রিলেশনের কথা। এসব নিয়ে ঘাঁটতে গেলে গর্ত থেকে কেঁচো বেরিয়ে আসবে। তখন কোন দিক সামাল দিবি?
-“ আমার কষ্ট, খারাপ,রাগ লাগছে আপু। আমার দিকটাও বুঝো একটু।
-“ বুঝি বলেই বলছি,,কিছুদিন নিজেকে সময় দাও। তাসফির সাথে ঝামেলা না করে চুপচাপ থাকো। তাসফি যে খুব মহান কাজ করেছে সেটাও বলবো না। সে তোমায় ভালোবেসে ফেলছে যার দরুন এমন কার্যকলাপ করে ফেলছে। তার ভালোবসার পরিমাপ টা দেখো সে কতটা ভালোবাসে তোমায়৷ তোমার মন খারাপে তার হৃদয় ব্যাকুল হয় নাকি সেটা দেখো। সম্পর্কের বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে গেছো এখন তো চাইলেই হুটহাট বেরিয়ে আসতে পারবে না।
-“ আচ্ছা রাখি।

তটিনী ফোন কেটে দিলো। অসহ্য লাগছে সব কিছু। জীবন টা কি বিশ্রী ঠেকছে।

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে