Monday, June 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 238



খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৬১+৬২+৬৩

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৬১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সময়কে বিষন্নতা গ্রাস করে ফেলছে। সময় তার বিষাদ দিয়ে হৃদয়কে তিক্ত করে তুলেছে। দুঃখ আছে বলেই সুখের এত মূল্য! সুখ মানুষের জীবনে ক্ষণিকের জন্য আসে আর দুঃখ মানুষকে মৃত্যু পর্যন্ত তাড়া করে বেড়ায়। সুখ যদি ভাগ্যে না-ই বা থাকবে তবে ক্ষণিকের জন্য এসে কেন মায়া ধরিয়েছিল? মস্তিষ্কে এত প্রশ্ন কিন্তু উত্তর দেওয়ার মানুষ নেই। উত্তর দেওয়ার জন্য মানুষের প্রয়োজন আছে। কিন্তু যে মানুষটা উত্তর দিবে সেই মানুষটাই যে আর নেই। সে দুঃখের কাছে হার মেনে পালিয়েছে। মানুষের ভালোবাসা গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখার পাশাপাশি মানুষের ঘৃণা সহ্য করার ক্ষমতাও অর্জন করতে হয়। না হলে রিয়াদ চৌধুরীর মতো বৃদ্ধ বয়সে এসেও ঝরে যেতে হয়। রিয়াদ চৌধুরী নেই দুই মাস হয়ে গিয়েছে। চৌধুরী বাড়ি আগের ন্যায় আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে না। মুনতাসিম আগের মতো রাগ করে না৷ প্রত্যেকটি মানুষ কেমন জানি নিরব হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিম নিজের কক্ষে গম্ভীর হয়ে বসেছিল। তখনই সাহেলা চৌধুরী আসেন৷ সে মুনতাসিমের পাশে বসে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–এমন দুর্বল মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে আমার ভালো লাগে না। আমার শত্রুপক্ষ যদি শক্তিশালী না হয়। তবে তার সাথে লড়াই করে আমার কোনো লাভ নেই। সাহেলা চৌধুরী প্রতিটি বাক্য হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করল। মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত মস্তিষ্ক জ্বলে উঠল। সে রক্তিম দৃষ্টিতে সাহেলা চৌধুরীকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। সে কণ্ঠে তেজ তুলে বলল,

–আমাকে কোন দিক দিয়ে আপনার দুর্বল মনে হয়? এত সহজের ভেঙে পড়ার মতো ছেলে আমি না। আমাকে ভাঙতে আসলে আমি আপনাকেই গুঁড়িয়ে দিব। মুনতাসিমের কথায় মুনতাসিমের আড়ালেই সাহেলা চৌধুরী মলিন হাসলো। সে খুব সংগোপনে হাসি গম্ভীরতার শক্ত আবরণে ঢেকে দিল। আগের ন্যায় গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আমার সতীনের ছেলে ভেঙে পড়েছে। সেটা আমি বহুদিন ধরেই দেখতে পাচ্ছি। এমন ভাঙা মানুষের সাথে যুদ্ধ করে শান্তি পাওয়া যায় না। আমার একটা শক্তপোক্ত মানুষ চাই। এই ডায়েরিটা তোমার বাবা তোমাকে দিতে বলেছিল। তুই এই ডায়েরিটা মেহেভীনের সাথে পড়বে। তোমার বাবার শেষ ইচ্ছে ছিল। এই ডায়েরিটা নিজে তোমাদের পড়ে শোনাবে। তিনি শোনাতে পারেনি। তাই যাবার আগে আমাকে বলে গিয়েছিল। আমি যেন দু’জনের হাতে ডায়েরিটা বুঝিয়ে দেই। মেহেভীনের সাথে সবকিছু ঠিকঠাক করে নাও। সবাই এভাবে ভেঙে পড়লে জীবন তার সৌন্দর্যতা হারাবে। একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে। তার জন্য কি আমাদের জীবন থেকে থাকবে। বাক্য গুলো শেষ করে দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করল সাহেলা চৌধুরী। মুনতাসিম দেখল একটা কঠিন নারী কিভাবে নিজের অশ্রু লুকিয়ে সংসার টাকে আগের ন্যায় প্রাণখোলা করার প্রচেষ্টা করছে। মুনতাসিমের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করে দিয়েছে। সময় অদ্ভুত একটা জিনিস স্রোতের ন্যায় টান ধরে চলে গেল। বাবা যাবার পর প্রথম কারো থেকে ভরসা পেল মুনতাসিম। এই ভরসাটাই তাকে সতেজ হতে সাহায্য করবে। মেহেভীনের মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বুক কেঁপে ওঠে। মেয়েটা আছে বলেই বাঁচার ইচ্ছে আছে নয়তো বা এ জীবন কবেই রবের কাছে চলে যেত। মুনতাসিমকে মন্ত্রী সভায় যেতে হবে। সে বিলম্ব করল না দ্রুত প্রস্তুত হয়ে নিল। এখন থেকে সে নতুন ভাবে জীবন শুরু করবে। চৌধুরী গৃহে আবার আনন্দ উল্লাস হবে। শুধু কিছু মানুষ সেই আনন্দ উল্লাসের ভাগিদার হবে না। মুনতাসিম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কক্ষ থেকে বেড়িয়ে গেল।

মেহেভীন জানালার পাশে বসে চিন্তা মগ্ন ছিল। তখনই মুঠোফোনটা শব্দ করে বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনের নানু নামটা ভেসে উঠতেই দ্রুত ফোনটা কর্ণে ধরলো। ওপাশ থেকে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে কিছু ভেসে এলো। মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এলো। সে দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বের হতেই সুফিয়া চৌধুরী এবং তাহিয়ার সামনে পড়লো। তাদের মুখশ্রীতে হাসির রেখা বিদ্যমান। সুফিয়া চৌধুরী ব্যঙ্গ করে বলল,

–অবশেষে মহারানী রাজ্য ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তোমার অনেক দিন আগেই চলে যাবার কথা ছিল। আমার ভাই টা মরে মুনতাসিমের পাশে থাকার নাম করে কয়টাদিন বেশি থেকে গেলে। মুনতাসিম আমার হিরার টুকরো ছেলে বলেই তোমার মতো মেয়েকে এতদিন এই বাসায় রেখেছে। অন্য কোনো পুরুষ হলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিত।

–আপনাকে আপনার স্বামী ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে ফুপি। তাই বাংলাদেশে এসে একদম গেড়ে বসেছেন?

–তোমার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি! বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা আমার বাবা মা তোমাকে শেখায়নি?

–আমাকে আমার বাবা-মা শিখিয়েছে। কিন্তু আপনাকে আপনার বাবা-মা শেখায়নি বাড়ির বউদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়?

–তোমার তেজ আমি বের করছি। আমার ভাবির নাকফুল আমার ভাইয়ের দেওয়া চুড়ি, গলার চেইন, কর্ণের অলঙ্কার সবকিছু খুলে দিয়ে তারপর এ বাড়ি থেকে যাবে। তার আগে এ বাড়ি ছেড়ে এক পা-ও যেতে দিব না। আমিও দেখতে চাই তোমার তেজ কোথায় যায়?

–সে আমি আপনাকে খুলে দিয়ে দিচ্ছি। আমিও দেখব আপনি কতক্ষণ এগুলো নিজের কাছে রাখতে পারেন। আমার স্বামী আমাকে এগুলো দিয়ে আবার নতুন ভাবে নতুন রুপে এ বাড়িতে নিয়ে আসবে। সেটা আপনার চোখের সামনে আপনি বসে বসে দেখবেন আর মজা আমি নিব। বাক্য গুলো শেষ হতেই মেহেভীন অলঙ্কার গুলো সুফিয়া চৌধুরীর হাতে তুলে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে গৃহ ত্যাগ করল।

রুগ্ন অবস্থায় আস্তরণে শায়িত আছে মেহেভীনের নানি। রজনীর মধ্য প্রহর থেকে ভিষণ রুগ্ন হয়ে গিয়েছে। মেহেভীনের নানা অর্ধাঙ্গিনীর মস্তকের কাছে বসে আছে। মেহেভীনকে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

–নানু ভাই তুমি এসেছ? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তোমার নানু একদম রুগ্ন হয়ে গিয়েছে। আমাদের পাকঘরে যাবার মতো কেউ নেই। কাল থেকে পাকঘরে আগুন জ্বলেনি। তোমাকে খানা তৈরি করার জন্য ডেকেছি। নানার কথায় মেহেভীন কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

–নানি এত অসুস্থ আমাকে আগে জানাবে না। তোমাদের কাজ করতে কে বলেছে? আমি কতবার বলেছিলাম কাজের লোক রাখি! কিন্তু তোমরা আমার কথা শুনোই না। আমি এখন রান্না করতে যাচ্ছি। কালকে থেকে কাজের লোক আসবে। আমি আসার সময় কাজের লোক ঠিক করে রেখে এসেছি। বাক্য গুলো শেষ হতে মেহেভীন কক্ষ ত্যাগ করল।

ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা ছুঁই ছুঁই। ক্লান্ত কায়া নিয়ে গৃহে প্রবেশ করল মুনতাসিম ও তাইয়ান। পথে আসার সময় থেকে তাইয়ান ভিষণ উসখুস করছে। সে মুনতাসিমকে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু জড়তার জন্য বলতে পারছে না। মুনতাসিম তাইয়ানকে সময় দিচ্ছে কিন্তু তাইয়ান বলতে পারছে না৷ এই কয়দিনে মুনতাসিমের নিস্তেজ মুখশ্রী তাইয়ানকে ভেতর থেকে কাবু করে ফেলছে। সে তুলিকে বিয়ে করতে পারেনি৷ তবে আজ তার মন গহীন ডেকে বলছে। যে মানুষটা সবার ভালো চাইল সেই মানুষটারও ভালো থাকার অধিকার আছে। তার জন্য যদি মুনতাসিম ভালো থাকে তাহলে সে না হয় মুনতাসিমের জন্য নতুন জীবন শুরু করল। তার বিনিময়ে কিনে নিল মুনতাসিমের জন্য এক টুকরো সুখ। তাইয়ান মস্তক নুইয়ে বলল,

–আমি তুলিকে বিয়ে করব স্যার। আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলুন। আমি সাত দিনের মধ্যে বিবাহ সম্পূর্ণ করতে চাই৷ আপনি যদি আমাকে মায়া করতেন। তাহলে আমি খুব উপকৃত হতাম। তাইয়ানের বাক্য গুলো কর্ণকুহরে আসতেই মুনতাসিম বিস্ময় নয়নে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাইয়ানের মুখশ্রীতে লজ্জার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। তাইয়ানের আর মুনতাসিমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস হলো না। সে দ্রুত পালিয়ে গেল। তাইয়ানের কর্মে মুনতাসিমের মুখশ্রীতে হাসি ফুটে উঠল। কক্ষে এসেই মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে গেল মুনতাসিমের। মাশরাফি সকালের সব ঘটনা মুনতাসিমকে বলে দিয়েছে। মুনতাসিম উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় সুফিয়া চৌধুরীর কক্ষ এলো। মুনতাসিমকে দেখে সুফিয়া চৌধুরী কিছু বলতে যাবে। তার আগেই মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে বলল,

–মেহেভীনের থেকে সকালে যা যা নিয়েছেন। এখন এই মুহুর্তে সবকিছু আমাকে দিবেন। আমি অযথা কোনো বাক্য অপচয় করা পছন্দ করি না। সুফিয়া চৌধুরী কোনো বাক্য উচ্চারন করার সাহস পেল না। সে দ্রুত অলঙ্কার গুলো মুনতাসিমের হাতে বুঝিয়ে দিল। তাহিয়া ক্রোধিত দৃষ্টি মেলে মাশরাফির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মাশরাফির অধরের কোণে তৃপ্তির হাসি বিদ্যমান।

রজনীর শীতল হাওয়া মুনতাসিমকে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। দূর গাছের ডাল থেকে নিশাচর পাখি ডাকছে। ঝিঁঝি পোকা রজনীর আঁধারে শব্দ তুলে ডাকতে ব্যস্ত। পথটাও যেন দীর্ঘ হয়ে গিয়েছে। কিছুতেই স্রোতের ন্যায় গড়িয়ে যাচ্ছে না। মুনতাসিম মুঠোফোনটা হাতে নিল। মেহেভীনের নানির নাম্বারে ফোন দিল। মেহেভীন খেয়ে সবে মাত্র কক্ষে এসে জানালার কাছে দাঁড়িয়েছিল। তখনই নানির ফোনটা শব্দ করে বেজে ওঠে। মেহেভীনের নানি ফোনটা তুলতেই মুনতাসিম রসিকতা করে বলল,

–কেমন আছ ডার্লিং? আমি তোমার কাছে খুব তাড়াতাড়ি চলে আসছি সুইটহার্ট। রাতে দরজা খোলা রেখো।

–তুমি কোন ডার্লিংয়ের লাইগা আইতাছ, হেইডা মুই ভালা কইরাই জানি। আমারে আর কইতে হইবো না। দু’জনের কি মান-অভিমান হইছে। যার লাইগা তুমি তারে কল না দিয়া আমারে দিছো।

–আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তোমাকে বিয়ে না করা। তোমাকে বিয়ে করলে জীবনে স্বর্গসুখ পেতাম আমি। আমার এখন খুব আফসোস হচ্ছে ডার্লিং।

–হইছে আমারে আর পাম পট্টি দেওন লাগবো না। তুমি তাত্তাড়ি আইয়া পড়ো। তোমার নানা বুঝে নাই অকারণের মাইয়াডারে ডাইকা লইয়া আইছে। এখন রাখছি। মেহেভীনের নানির বাক্য গুলো শেষ হতেই কলিং বেল বেজে উঠল। মেহেভীন অবাক হলো এতরাতে কে এলো? সে উঠে আসার আগেই মেহেভীনের নানা-নানি কণ্ঠ স্বর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। মুনতাসিমকে বসার ঘরে দেখতেই মেহেভীনের মস্তক নুইয়ে গেল। মুনতাসিম চোয়াল শক্ত করে বলল,

–দুই মিনিট সময় দিলাম। কক্ষ গিয়ে ব্যাগ নিয়ে আসুন৷

–আমার নানি অসুস্থ আমি কয়টা দিন থাকব।

–আমি বলেছি আমার সাথে আপনাকে যেতে হবে।

–এই মাইয়া জেদ করছোস ক্যান? স্বামী যা কয় তাই শুনুন লাগে। আমি এখন সুস্থ আছি৷ তোর নানা বুঝে নাই। তোরে ফাউ কাজে ডাইকা লইয়া আইছে। স্বামীর সব কথা শুনুন লাগে তবেই না স্বামী সোহাগ বেশি পাবি। নানির কথায় মেহেভীনের মস্তিষ্ক গরম হয়ে গেল। মুনতাসিম নানির কথায় মিটমিট করে হাসছে। মেহেভীন দ্রুত সেখানে থেকে চলে যায়। মুনতাসিম ফোনটা বের করে একটা মেসেজ করে দিল, “ভদ্র মেয়ের মতো বের হবেন নাকি কোলে তুলে নিয়ে আসব৷” মেসেজটা পড়ে মেহেভীনের আঁখিযুগল বড় হয়ে গেল। মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এলো, অসভ্য লোক একটা। মেহেভীন ব্যাগ হাতে নিয়ে বসার ঘরে এলো। নানি মুনতাসিমকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। দু’জনের ভালোবাসা দেখে মেহেভীনের আঁখিযুগল শীতল হয়ে গেল। তারা কিছুক্ষণ বসে বাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো। মেহেভীন হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে মুনতাসিম মেহেভীনের পিছু পিছু হাঁটছে।

–আমি আজকের রাতটা থাকতে চেয়েছিলাম।

–আমি আপনাকে ছাড়া এক রাতও থাকতে পারবো না।

–মুখে লাগাম টানুন।

–বিয়ের পর থেকেই টেনে আছি আর কত টানব? মুনতাসিমের কথার উত্তরে কোনো উত্তর করল না মেহেভীন। মানুষটার সাথে কথা বলা মানে নিজেকে লজ্জায় ফেলা৷ সে চুপচাপ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। মুনতাসিম এগিয়ে এসে মেহেভীনের হাতে ভাজে নিজের হাত রেখে পথ চলতে শুরু করে দিল।

–আমি তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম না তুলি। আমি মুনতাসিম স্যারকে ভিষণ ভালোবাসি। স্যারের পরিবারের করুন অবস্থা ভেতরটা রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। যে বাড়িতে সারাক্ষণ আনন্দরা রাজত্ব করতো। সেই বাড়িটা দুঃখের সমু্দ্রে তলিয়ে গিয়েছে। এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমার মধ্য দিয়ে যদি এ বাড়িতে সুখ ফিরে আসে, তবে আমার নিজেকে স্বার্থক বলে মনে হবে। তুমি আমাকে একটু সময় দিও। আমি সবকিছু মানিয়ে নিব। ভালোবাসা নামটাই আমার কাছে বিষাক্ত আমি ঘৃণা করি নারীকে। আমার অস্তিত্ব জুড়ে শুধু নারীর প্রতি ঘৃনা বসবাস করছে। যদি কখনো সুযোগ পাই তবে তোমায় ভালোবাসবো।

–ভালোবাসার আগে এটা বলুন আপনার সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? আমার আপনাকে নিয়ে সন্দেহ হয়৷ আপনি বিয়ে কেন করতে চান না? ভালোবাসাবাসি পরে হবে আগে বিয়ে করুন। আপনাকে আমায় ভালোবাসতে হবে না। আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে আপনাকে জিতে নিব। তুলির কথায় তাইয়ান শব্দ করে কেশে উঠল। তাইয়ানের রক্তিম আঁখিযুগলের দিকে দৃষ্টিপাত করে তুলি বলল,

–ভেবেছিলাম নিকোটিনে জ্বলে যাওয়া কালো কুচকুচে ঠোঁট দিয়ে আমাকে চুমু খাবে কোনো এক বুড়ো। আপনার সাথে বিয়ে ঠিক হবার আগ পর্যন্ত আমার এটাই মনে হয়েছিল, জানেন বাবুর আব্বু।” তুলির কথায় বিস্ময় নয়নে তুলির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে তাইয়ান। তুলি পানশে মুখশ্রী করে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাইয়ানের আঁখিযুগলে তুলির প্রতি কতটা ক্ষোভ জমেছে। সেটা তাইয়ানের আঁখিযুল বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। তাইয়ান বিরক্ত হয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। তবে মেয়েটা যখন তাকে বাবুর আব্বু বলে সম্মোধন করে তখনই ভয়ংকর ভাবে তাইয়ানের বুকটা কেঁপে উঠে।

তাইয়ানের বিয়ের মধ্য দিয়ে সবাই আগের মতো হতে শুরু করে দিয়েছে। চৌধুরী গৃহের চারপাশে মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। সমস্ত গৃহ আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। গৃহ ভর্তি মেহমান এসে গিজগিজ করছে। মেহেভীন হলুদের অনুষ্ঠানে বসেছিল। তখনই চিকন গড়নের ফর্সা যুবক এসে তার পাশে বসে। সে খুব আগ্রহী হয়ে মেহেভীনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–তুমি কোন পক্ষের হয়ে এসেছ? আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পারি না। আমার তোমাকে অনেক ভালো লেগেছে৷ আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই৷ তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? যুবকের কথায় মেহেভীন আড়দৃষ্টিতে যুবককে পর্যবেক্ষক করে নিল। তৎক্ষনাৎ শব্দ করে হেসে উঠল। মেহেভীনের হাসির শব্দের প্রতিধ্বনিতে কারো হৃদয়ে আগুন জ্বলে উঠল। মেহেভীনের অকারণে হাসির অর্থ বোধগম্য হলো না যুবকের। সে মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে নিয়ে এসে বলল,

–তুমি হাসছ কেন?

–এই ছেলে তুমি জানো আমি তোমার কতবড়। এতটুকু ছেলে হয়ে বিয়ে করতে চাও লজ্জা করে না। তাছাড়া আমি বিবাহিত আমার স্বামী জানলে তোমাকে খু’ন করে ফেলবে।

–আমি বিশ্বাস করি না। বিবাহিত মেয়েদের হাতে চুড়ি থাকে নাকে নাকফুল থাকে তোমার তো কিছুই নেই। তাহলে আমি কিভাবে বিশ্বাস করব? তুমি বিবাহিত! মেহেভীন শুধু হাসলো কোনো উত্তর দিল না। মুনতাসিম রক্তিম আঁখিযুগলে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাহিয়া মুনতাসিমের সামনে দিয়ে ফল নিয়ে যাচ্ছিল। মুনতাসিম তাহিয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

–ছেলেটা কে রে তাহিয়া?

–আমার দাদির বাড়ি থেকে এসেছে ভাইয়া। আমাকে কেমন লাগছে দেখে বলো তো। মুনতাসিম ফল খেতে খেতে তাহিয়াকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। একটা ফল নিয়ে তাহিয়ার হাতে দিয়ে বলল,

–এটা খেয়ে দেখ অনেক মিষ্টি ফল। মুনতাসিমের কর্ম দেখে মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রীতে আষাঢ়ের কালো মেঘ ঘিরে ধরলো। সে রাগান্বিত হয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম ইচ্ছে করে মেহেভীনকে দেখেও না দেখান ভান করে তাহিয়ার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। মেহেভীন জ্বলতে জ্বলতে ছাদে চলে গেল।

সমস্ত আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছে। রাতে বোধহয় বৃষ্টি নামবে। মেহেভীনের হঠাৎ করে মায়ের কথা স্মরন হলো। বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠল। তার জীবনে এত সুখ এলো কিন্তু তার মা এলো না। আঁখিযুগলে এসে অশ্রু জমা হলো। তখনই একজোড়া শীতল হাত মেহেভীনকে আলিঙ্গন করল। মুনতাসিম মেহেভীনের কাঁধে চিবুক রেখে বলল,

–রাগ করেছেন ম্যাডাম। মেহেভীন উত্তর দেয় না। তার মস্তক গরম হয়ে গিয়েছে। আচমকা বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। দু’জনের একে অন্যের কাছে আসার উষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। মেহেভীন মুনতাসিমকে যত দূরে সরিয়ে দিচ্ছে মুনতাসিম ততই মেহেভীনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিচ্ছে।

“ভালোবাসা গুলো বৃষ্টি হয়ে নামুক।
দুঃখ গুলো ঝরে যাক।
দ্বিধাদ্বন্দের দেওয়াল ভেঙে যাক।
প্রণয়নের হাওয়া এসে কায়াতে লাগুক।
প্রেয়সীর উষ্ণতা আমায় আলিঙ্গণ করুক।
শ্রাবনের ধারাতে ভালোবাসাবাসি হয়ে যাক।”

মুনতাসিমের বলা প্রতিটি বাক্য মেহেভীনের হৃদয় স্পর্শ করে গেল। শ্রাবনের ধারার গতিবেগ বাড়তে শুরু করেছে। কায়াতে ধীর গতিতে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে নিজের দিকে ঘোরালো। মুনতাসিমের অধরের উষ্ণতা দিয়ে মেহেভীনের ললাট উত্তপ্ত করে দিল। মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রীতে অধর ছোঁয়াল মুনতাসিম। মেহেভীনের সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। সে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে৷ ধারার সাথে উষ্ণতাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। মেহেভীন আঁখিযুগল বন্ধ করে আছে। মুনতাসিম নিজের অধরযুগলের সাথে মেহেভীনের অধর যুগল এক করে দিল। ধারা যেমন জমিনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ঠিক তেমনই একটি তৃষ্ণার্থ হৃদয় তার প্রেয়সী মাঝে উষ্ণতা ছড়াতে ছড়াতে নিজেও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বর্ষনের প্রতিটি ফোঁটা দেখলো দু’টি প্রেমিক যুগল তাদের মতো ধারার ন্যায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। দু’জন দু’জনকে উষ্ণ করার খেলায় মেতে উঠেছে। তাদের ভালোবাসা দেখে চন্দ্রও লজ্জা মুখশ্রী আড়াল করে নিল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৬২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সুখানুভূতিতে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে চারপাশ। যেদিকেই আঁখিযুগল যায়। সেদিকেই যেন সুখ দুঃখকে গ্রাস করে ফেলছে। গানের তালে তালে রমনীরা নৃত্য করছে। চৌধুরী বাড়িতে আনন্দের মেলা বসেছে। অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠেছে। সমস্ত মস্তিষ্ক জুড়ে অদ্ভুত ভাবে শীতলতা অনুভব করছে। হৃদয়ে শান্তি এসেছে ভেতরটা পরিতৃপ্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তুলি এবং তাইয়ানের বিবাহ সম্পূর্ণ হয়েছে। শেহনাজ অশ্রুসিক্ত নয়নে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। ভেতরটা তার হাহাকার করে উঠছে। সে তাইয়ানকে ভালোবাসলে এই সুখ তার হতো। সে তুলির জায়গায় থাকতো ভাগ্য তার সহায়ক হলো না। দিনশেষে একটা নরপিশাচকে মন দিয়ে দুঃখের সমু্দ্রের অতল গভীরতে তলিয়ে গিয়েছে। শেহনাজ ভেতর থেকে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। তুলিকে করে তার ভিষণ ঈর্ষা হচ্ছে। তুলিকে খু’ন করে তাইয়ানকে গ্রাস করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। তাহিয়া অসহায়ত্ব মুখশ্রী করে মুনতাসিম এবং মেহেভীনের হাসোজ্জল মুখশ্রী দেখছে। মুনতাসিম তাকে ভালোবাসলে মেহেভীনের সমস্ত সুখ তার হতো। তাহিয়া বুক ভারি করা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে নিজের কক্ষে চলে গেল। এখানে থাকলে যন্ত্রনার মাত্রা প্রকোপ পাবে।

–তাইয়ান এবং তুলির কক্ষের সাথে মুনতাসিম এবং মেহেভীনের কক্ষটাও ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিও। সাহেলা চৌধুরী কথায় কয়েকজনের রমনী মস্তক নাড়াল। তারা মুনতাসিমের কক্ষটা পুষ্প দিয়ে সাজিয়ে দিল। সমস্ত কক্ষ জুড়ে গোলাপ আর রজনীগন্ধার গন্ধ নাসারন্ধ্রে এসে ঠেকছে। রমনীরা সিলিং ফ্যানের সাথে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিল। মেহেভীন আর মুনতাসিম কক্ষে প্রবেশ করলেই ফ্যান ছেড়ে দিবে। পুষ্পের বর্ষণে দু’জনকে পুষ্পময় করে তুলবে। কিন্তু তাদের আশায় পানি ঢেলে দিল বৃষ্টি। আকাশটা জানান দিচ্ছে বর্ষন ধেয়ে আসছে। তাদের ভাবনার মাঝেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সমস্ত বাড়ি অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। মেহমানরা সব বাড়ি যেতে শুরু করেছে। কিছু মেহমান দুপুরে খেয়ে চলে গিয়েছে। দূরের মেহমান গুলো থেকে গিয়েছে প্রভাতের আলো ফুটতেই তারা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবে।

মেহেভীন কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখল কক্ষে মোমবাতি জ্বালানো। সমস্ত কক্ষ জুড়ে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। মেহেভীন বেলকনিতে চলে গেল। বর্ষণের ধারা এসে মেহেভীনের মুখশ্রী স্পর্শ করে যাচ্ছে। মেহেভীন হাত বাড়ির বৃষ্টির ফোটা গুলো হাতের তালুতে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠেছে। তার পরনে লাল টুকটুকে রঙের একটা শাড়ি। কায়াতে সামান্য কিছু অলঙ্কার জড়ানো। মুনতাসিম কৃত্রিম সাজসজ্জা পছন্দ করে না বলেই মেয়েটা সাজেনি৷ অধর যুগলটা শুধু লাল রঙে রাঙিয়েছে। এতেই যেন মেয়েটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই মুনতাসিম এসে মেহেভীনকে আলিঙ্গন করল। মুনতাসিমের শীতল স্পর্শে মেহেভীনের সমস্ত কায়া কেঁপে উঠল। মুনতাসিম মেহেভীনের কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে বলল,

–আমার মহারানী কি ভাবছে?

–ভাবছি আমাদের তুলি ভাগ্যটা ভিষণ ভালো। শুনেছি যে মেয়ের বিয়ের দিন বৃষ্টি হয়। সেই নারী নাকি বিয়ের পরে সুখী হয়।

–আপনি আমায় পেয়ে সুখী না ম্যাডাম?

–আপনার মতো মানুষ পেয়ে যে বলবে সে সুখী না। তার মতো অভাগা কেউ নেই। কতটা ভাগ্য নিয়ে জন্মালে আপনার মতো স্বামী ভাগ্যে থাকে। আপনি ভাবতেও পারবেন না। আপনি যতটা জানেন তার থেকে-ও বেশি সুখী আমি আপনাকে পেয়ে। এই আপনা-আপনি আর কতদিন চলবে মন্ত্রী সাহেব? আমরা কি আপনি থেকে তুমিতে আসতে পারি না?

–এই তুমির যুগে আমার একটা আপনি হোক। যে আপনিটা হাজারো তুমির মাঝে হারাবে না। আমার বুকের বা পাশে যার ঠাঁই হবে। সে আমার ভিষণ প্রিয় হবে। তুমি শব্দটাতে ভালোবাসা এবং অধিকার মেশালো থাকলে-ও শ্রদ্ধা এবং সন্মান টা আমি খুঁজে পাই না। আমি তো আপানাকে একের ভেতর সবকিছু দিতে চাই। আমরা তাকেই আপনি বলি যাকে আমরা ভিষণ ভালোবাসি, সন্মান করি, শ্রদ্ধা করি। যাদের আমরা মহামূলবান ভাবি, তাদেরকেই আপনি বলি। আপনি আমার কাছে মহামূল্যবানের থেকে-ও অনেক কিছু। তাই আমি আপনাকে তুমির মাঝে হারাতে দিতে চাইছি না। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন হাসলো। মানুষটার প্রতিটি বাক্যে মুগ্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। মানুষটা একবার মুখ খুললে দ্বিতীয়বার কথা বলার শক্তি থাকে না। মেহেভীন হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–ইচ্ছে ছিল একদিন আপনার খুব প্রিয় হব। আপনার বুকের বা পাশে আমার ঠাঁই হবে। আপনার হৃদপিণ্ডে আমি নামক এক অসুখ বাসা বাঁধবে। নিয়ম করে আমাকে আঁকড়ে ধরার ইচ্ছে জাগবে। আমার ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়ে গিয়েছে মন্ত্রী সাহেব। আমি ভিষণ খুশি। আমি খুব ভাগ্যবতী যে আমি আপনার মতো স্বামী পেয়েছি। আমার মা মানুষ চিনতে ভুল করেনি। আপনি আমার মায়ের দেখা আমার জন্য আমার জীবনে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ পুরুষ। মেহেভীনের কথার উত্তরে মুনতাসিম নিরব রইল। মুনতাসিমের নিরবতা মেহেভীনের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ বাড়িয়ে তুলেছে। মুনতাসিমে মাদকাসক্ত কণ্ঠে বলল,

–আমি আপনাকে বলেছিলাম। যেদিন আপনার সামনে আমি আমার অধিকার নিয়ে হাজির হব৷ সেদিন কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না৷ আজকে যদি আমি প্রয়োজনের থেকে একটু বেশি করে ফেলি, তবে কি আমায় শাস্তি পেতে হবে ম্যাডাম?

–আমি আপনাকে ভিষণ কড়া শাস্তি দিব। একদম অসভ্যতামি করতে আসবেন না। আমার থেকে দূরে থাকুন। খু’ন করে ফেলব একদম।

–আমি শাস্তি পাবার জন্য প্রস্তুত ম্যাডাম। আপনি শাস্তির ব্যবস্থা করুন। খু’ন তো আমি সে কবে থেকেই হয়ে আছি ম্যাডাম। বাক্য গুলো শেষ করেই মুনতাসিম মেহেভীনকে কোলে তুলে নিল। আচমকা কোলে তুলে নেওয়াতে মেহেভীন ভয় পেয়ে মুনতাসিমের গলা জড়িয়ে ধরলো। মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রীতে অন্যরকম নেশা ছড়িয়ে পড়েছে। মেহেভীনের ভেতরটা কেমন জানি লজ্জায় কুঁকড়ে আসছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে কক্ষে নিয়ে এসে আস্তরণে শায়িত হলো। সে খুব সংগোপনে মেহেভীনের আঁখিযুগলের পাতায় অধর ছোঁয়াল। মেহেভীন আঁখিযুগল বন্ধ করে রেখেছে। ভেতরে অস্থিরতার ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার৷ তখনই বিদ্যুৎ আসলো সিলিং ফ্যান চলতে শুরু করল। উপর থেকে পুষ্পের বর্ষণ হতে শুরু করল। মুনতাসিম মেহেভীনের হাতের ভাজে হাত রেখে মেহেভীনে গলদেশে মুখশ্রী ডুবালো। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষ। তাদের প্রণয়ের পরিনতি দেখে মোমবাতি গুলো লজ্জা নিভে গেল। হাওয়া এসে দু’জনকে আরো উন্মাদ করে তুললো। তাদের ভালোবাসা দেখে চন্দ্র বহু আগেই লজ্জায় মেঘের লুকিয়ে পড়েছে। চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে দু’টি প্রেমিক যুগলের প্রেমের মহাপ্রলয় ঘটে গেল।

তুলি তাইয়ানের জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। তাইয়ানের আসার নামে কোনো খোঁজ নেই। তার ভেতরে দারুন অস্থিরতা কাজ করছে। এতদিন মুখে শত কথা বললেও আজ ভয় লাগছে। তার চিন্তার মাঝেই তাইয়ান এসে উপস্থিত হয়। তাইয়ান গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,

–এভাবে বসে আছ কেন তুমি? তোমাকে অপেক্ষা না করে ঘুমোতে বলেছিলাম।

–সবাই আপনার জন্য জাগতে বলেছিল।

–তোমাকে বলেছি আমাকে সময় দিতে হবে। তুমি বিয়ের রাতেই অর্ধাঙ্গিনীর অধিকার ফলাতে আসলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে!

–আমি কখন আপনাকে অর্ধাঙ্গিনীর অধিকার দেখালাম?

–অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও এবার। তুলি আর কোনো কথা বলল না। সে আস্তরণের এক কোণে শায়িত হলো। তাইয়ান অসহায় দৃষ্টিতে তুলির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে কোথাও এই মেয়েটার প্রতি অন্যায় করে ফেলতে না তো আবার! সে মেয়েটার সাথে সহজ হতেই চাইছে। কিন্তু মেয়েটার সামনে আসলেই মস্তিস্ক উত্তপ্ত হয়ে যায়। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

চারিদিকে প্রভাতের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। মেহেভীন আঁখিযুগল মেলে তাকাতেই মুনতাসিমের স্নিগ্ধ মুখশ্রীটা সামনে ভেসে উঠল। মানুষটার দিকে দৃষ্টি যেতেই সমস্ত মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করল। অথচ মানুষটা তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মেহেভীন সাবধানতা অবলম্বন করে উঠে বসলো। এলোমেলো বস্ত্র কোনোরকম কায়াতে পেঁচিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। একটু পরে গোসল করে এসে মাথায় চিরনি করতে লাগলো। তার অধরের কোণে প্রশান্তির হাসি বিদ্যমান। হঠাৎ করে গলার দিকে নজর যেতেই যে লজ্জায় মিইয়ে গেল। দ্রুত ওড়না দিয়ে গলাটা ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিল।

–স্বামীর ভালোবাসা পেলে বুঝি মেয়েরা এভাবে হাসে? মুনতাসিমের প্রশ্নে চমকে উঠল মেহেভীন! সে কোনো বাক্য উচ্চারন না করে উঠে দাঁড়ালো। মেহেভীনের লাজুক মুখশ্রী মুনতাসিমের ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলছে। সে মেহেভীনের কাছে এসে কর্ণে ফিসফিস করে বলল,

–অল্প বয়সে বউহারা হতে চাই না৷ গলায় এত ওড়না পেঁচিয়ে আ’ত্ন’হ’ত্যা করবেন না আবার। কেউ কিছু বললে বলবেন। আমার স্বামী আমাকে ভালোবেসে দিয়েছে।

–গলায় কি করেছেন আপনি!

–কি করেছি? মুনতাসিমের প্রশ্নে মেহেভীন লজ্জায় মুনতাসিমের বুকে মুখ লুকালো। মুনতাসিম মেহেভীনের লজ্জা বাড়িয়ে দিতে বলল,

–যাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছেন। তার বুকেই মুখ লুকাচ্ছেন! সে যদি লজ্জার পরিমান বাড়িয়ে দেয়। তাহলে আপনার কি হবে? আপনার ভয় নেই ম্যাডাম? কি সাংঘাতিক নারী আপনি!

–আমি আপনাকে খু’ন করে ফেলব।

–আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।

–অসভ্য পুরুষ একটা যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন।

–আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আপনার খবর আছে। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম ওয়াশরুমে চলে গেল। মস্তকে কাপড় জড়িয়ে নিচে চলে গেল মেহেভীন। সবাই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে। মুনতাসিম গোসল করে এসে মেহেভীনকে দেখতে না পেয়ে নিচে এলো। মেহেভীন চায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। তার মাথাটা ভিষণ ধরেছে। তখনই মুনতাসিমে এসে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল,

–আপনাকে না আমি বলেছি। আমি যতক্ষণ বাসায় থাকব। ততক্ষণ আপনি এক মুহুর্তের জন্য আমার চোখের সামনে থেকে সরবেন না। তবুও কেন নিচে এসেছেন? এখনই আমার সাথে কক্ষে যাবেন চলুন।

–আমি এখন কক্ষে যাব না কি করবেন আপনি? মুনতাসিম বেশ বুঝতে পারছে। মেয়েটা তার থেকে দূরে দূরে থাকতে চাইছে। তাই তো পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া লাগানোর চেষ্টা করছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহেভীনকে কোলে তুলে নিল।

–আরে কি করছেন কেউ দেখে ফেলবে!

–ভালো কথায় কাজ হয়নি আঙুল বাঁকিয়েছি।

–আপনি বেশি অধিকার দেখাচ্ছেন কিন্তু!

–বউ আমার অধিকারও আমার। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে বউ শব্দটা যেন মেহেভীন সমস্ত বাক্য কেঁড়ে নিল। মেহেভীনের নিস্তব্ধতা দেখে মুনতাসিম হেসে দিল। সে কোনো বাক্য উচ্চারন না করেই নিজের কক্ষে চলে গেল।

সময় স্রোতের ন্যায় গড়িয়ে চলেছে। তাইয়ান এবং তুলির বিয়ের দু’মাস হয়ে গেল। তবুও দু’জন স্বাভাবিক হতে পারলো না। শেহনাজ আজকে সবার জন্য রান্না করেছে। মেহেভীন আজকাল কিছুই খেতে পারে না৷ সারাক্ষণ মস্তক ঘোরাতেই থাকে। মেহেভীনের চিন্তায় মুনতাসিমের রজনীর নিদ্রা পালিয়েছে। ডক্টর দেখে বলে সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। কিন্তু মেহেভীনের অসুস্থতা যেন কমছে না৷ আজকে শেহনাজকে মেহেভীন কালো জিরা ভর্তা এবং ভাত রান্না করতে বলেছিল। তার নাকি কালো জিরা ভর্তা দিয়ে ভিষণ ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। টেবিলে বসে সবাই খাবার খাচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ করে মেহেভীন দৌড়ে উঠে চলে যায়। মেহেভীনের পেছনে পেছনে মুনতাসিমও উঠে চলে যায়। মেয়েটা বমি করছে৷ কাল রাত থেকে বমি করতে করতে মেয়েটার অর্ধেক জীবন শেষ! মুনতাসিমের ভাবনার মাঝে মেহেভীন পড়ে যেতে নিলে মুনতাসিম মেহেভীনকে ধরে ফেলল। মেহেভীনকে জ্ঞান হারাতে দেখে মুনতাসিমের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। ভেতর টা অদ্ভুত ভাবে হুঁ হুঁ করে উঠল। সে হুংকার ছেড়ে গাড়ি বের করতে বলল। তাইয়ান, তুলি, শেহনাজ সহ সবাই সেখানে এসে উপস্থিত হলো। মুনতাসিম শেহনাজের দিকে তাকিয়ে বলল,

–আমি আগেই জানতাম কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না। ঠিক তেমনই তোমার স্বভাব কোনোদিন ভালো হবে না। আমি তোমার করা রান্না মেহেভীনকে কিছুতেই খেতে দিতে চাইনি। আজ যদি মেহেভীনের কিছু হয়ে যায়। তাহলে আল্লাহর কসম তোমাকে আমি খু’ন করে ফেলব। বাক্য গুলো শেষ হতেই মুনতাসিম মেহেভীনকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল। শেহনাজ তাইয়ানের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে করুন কণ্ঠে বলল,

–তুমি অন্তত আমাকে বিশ্বাস করো তাইয়ান। আমি ভাবির খাবারে কিছু দেইনি। তাইয়ান কিছু বলার আগেই তুলি এগিয়ে এসে বলল,

–আপনি কি করেছেন না করেছেন সেটা আমার স্বামীকে কেন বলছেন? আপনি আমার স্বামীর সাথে কথা বলবেন না। আপনি আমার স্বামীর সাথে কথা বলুন এটা আমি চাইনা। তাইয়ানের মস্তিষ্ক এমনিতেই উত্তপ্ত ছিল। তুলির কথায় তাইয়ান রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমার সব বিষয়ে তোমাকে কথা বলতে বলেছি। আমি স্যারের জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমাকে ভালোবেসে না। তুমি আমার বিষয়ে একটা কথাও বলবে না। তুমি কিসের আশায় এখানে পড়ে আছ? আমি তাইয়ান দেহের লোভী না এটা তুমি এতদিনে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছ। টাকার জন্য আমার কাছে এসেছিলে তাই না। তুমি চাইলে নিষিদ্ধ পল্লীর গলিতেও যেতে পারো। সেখানে ভালো টাকা ইনকাম করতে পারবে। আজকের পর তোমার মুখ দেখতে চাই না। আমি বাসায় এসে যেন দেখি তুমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছ। বাক্য গুলো শেষ করেই তাইয়ান বেড়িয়ে গেল। তুলির আঁখিযুগল বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। আঁখিযুগল ভয়ংকর ভাবে রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। তুলি কক্ষের দিকে যাবে এমন সময় গুলির বিকট শব্দে কেঁপে উঠল চৌধুরী বাড়ি। কালো বস্ত্র পরিধান করা বলিষ্ঠ দেহের কিছু লোক প্রবেশ করল চৌধুরী বাড়িতে। কিছু গার্ডদের লা’শ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। এসব দেখে শেহনাজ ভয় পেয়ে গেল। সে পালাতে চাইলে তাকে খপ করে ধরে ফেলল। তুলি স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। নিজের প্রতি তার নিজের ঘৃণা হচ্ছে। তাইয়ান আজকে তার আসল জায়গা দেখিয়ে দিয়েছে। বাঁচতে ইচ্ছে করছে না তার। তুলির মুখে রুপাল চেপে অবচেতন করা হলো। তুলি তাদের এতটুকুও বাঁধা দিল না। বাড়িতে তাহিয়া, তুলি, শেহনাজ ছিল। তিনজনকেই তারা নিয়ে চলে গেল। বেশিভাগ গার্ড মুনতাসিমের সাথে গিয়েছে। এই সুযোগটাই শত্রুরা লুফে নিয়েছে। প্রেয়সীকে আঘাত করে নিজেই দ্বিগুণ জ্বলে পুড়ে যাওয়া তাইয়ান জানতেও পারল না। তার বিধস্ত প্রেয়সীকে হায়নারা নিয়ে গিয়েছে। সে বাসায় এসে যার অভিমান ভাঙানোর কথা ভাবছে। হায়নারা তাকে ছিঁড়ে খেয়ে খু’ন করার কথা ভাবছে। তাইয়ান কি পারবে তার প্রেয়সীকে বাঁচাতে?

হসপিটালে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে মুনতাসিম৷ সে একটু পর পর ডক্টরের চেম্বারে গিয়ে ডক্টরকে বিরক্ত করে তুলেছে। তাইয়ান মুনতাসিমের পাশে বসে আছে। সে জাফর ইকবালের কথা মুনতাসিমকে বলবে সেটাও বলতে পারছে না। একটু পরে ডক্টর মুনতাসিমকে ডাকল। ডক্টরের অধরের কোণে প্রশান্তির হাসি। সে হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–কংগ্রাচুলেশনস স্যার আপনি বাবা হতে চলেছেন। কি মধুর শোনালো বাক্যটা মুনতাসিমের কাছে। কিছু সময়ের জন্য মুনতাসিমের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ স্থির হয়ে গেল। মেহেভীনের জ্ঞান ফিরেছে। মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রী চকচক করে উঠল৷ তার সমস্ত মুখশ্রীতে পূর্ণতার হাসি। মুনতাসিম ডক্টরের থেকে সবকিছু জেনে মেহেভীন নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। এত সুখ এত আনন্দ দুঃখের কালো ছায়া এসে ধংস করে না দেয় আবার!

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৬৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সুখানুভূতিতে তিক্ততা এসে ধরা দিয়েছে। মস্তিষ্ক টগবগ করছে উঠছে। ক্রোধ যেন শিরা-উপশিরায় ভ্রমন করছে। মুনতাসিমের ললাটের রগ গুলো ফুলে উঠছে। সমস্ত মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। তাইয়ান নিস্তব্ধ হয়ে মুনতাসিমের পাশে বসে আছে। কণ্ঠলানি দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারন হচ্ছে না। তুলির কথা স্মরন হতেই ভেতরটা হাহাকার করে উঠল৷ মেয়েকে সে একটু বেশিই আঘাত করে ফেলছে। মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে সে নিজেকে কিভাবে ক্ষমা করবে? প্রতিদিন যার মুখ থেকে বাড়ি থেকে বের হয়। আবার যে মানুষটার মুখ দেখেই বাড়িতে প্রবেশ করে সেই মানুষটা হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেলে যে ভেতর পুড়ে! তাইয়ানের ভেতরটা ভিষণ বাজে ভাবে পুড়ছে। তার জীবনে তুলির গুরুত্ব ঠিক কতটা, তা তাইয়ানের ভেতরটা কঠিন ভাবে স্মরন করিয়ে দিচ্ছে। বাড়িতে প্রবেশ করেই মেয়েটার মুখ না দেখে ভেতরটা কেমন ছটফট করছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে কক্ষে রেখে এসে ড্রয়িং রুমে বসেছে৷ সে খুব শান্ত মস্তিষ্কে তাইয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–তোমাকে আমি জাফর ইকবালের সমস্ত খবর আমাকে দিতে বলেছিলাম তাইয়ান৷ তুমি আমাকে পুরোপুরি তথ্য দাওনি। বুড়ো বয়সে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করার ভিষণ সাধ জেগেছে তার। আমি তার ছেলের মতো হয়েও সেই সাধ পূরণ না করে থাকতে পারি বলো? তার গোপনে কুকর্ম করার ঠিকানা বলো ওর কতবড় কলিজা হয়েছে, সেটা আমিও দেখতে চাই। আমার বাড়ি এসে আমার বাড়ির মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া!

–তুলি তো তাদের কোনো ক্ষতি করেনি স্যার। তাহলে ওরা তুলিকে নিয়ে চলে গেল কেন? তুলির কিছু হয়ে গেলে আমি কিভাবে বাঁচব? আমার জন্য সবকিছু হয়েছে আমি মেয়েটাকে বেশি আঘাত করে ফেলছি। আমাকে শাস্তি দিন স্যার।

–তাইয়ান শান্ত হও। কিছু আঘাত দুরত্ব বাড়ায় না কিছু আঘাত গুরুত্ব বাড়ায়, কিছু আঘাত দুরত্ব কমায়, কিছু আঘাত দূর থেকে কাছে নিয়ে আসে বুঝেছ। তুমি চিন্তা করো না আমি আছি। আমি সবকিছু ঠিক করে দিব। আমি তুলিকে বোন ডেকেছি। আমি থাকতে আমার বোনের কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। তুমি আমাকে সকল তথ্য গুলো দাও।

–শহর থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে একটা নদী আছে। সেখানে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর আছে। সেই ঘরটার পাশেই বিশাল একটা বটগাছ আছে। বটগাছের সাথেই নৌকা বাঁধা নৌকা করে নদীর ওপাশে যেতে হয়। নদীর ওপাশে গভীর অরণ্য আছে ভেবে সবাই ভুল করতে পারে। কিন্তু সেই গভীর অরণ্যের মধ্যে জাফর ইকবালের পাপের রাজত্ব আছে। সেখানে তিনি মেয়েদের আঁটকে রাখেন। ঐ এলাকায় ঘনবসতি কম হওয়ায় সেখানে কেউ যায় না। আমাদের ওখানে একা যাওয়া রিস্ক হয়ে যাবে স্যার।

–তুমি চিন্তা করো না তাইয়া কিছু হবে না। আমরা সেখানে যাওয়ার দশ মিনিট আগে পুলিশকে ইনফর্ম করবে। পরে যা হবে বাকিটা আমি দেখে নিব৷ সময় নষ্ট না করে চলো। আমাদের বাড়ির চারপাশে গার্ডের পরিমান বাড়িয়ে দাও। কোনো শত্রুর নিঃশ্বাস ও যেন আমার বাড়িতে না পড়ে। যদি কোনো ভুল হয়েছে আমি সবকিছু ধংস করে দিব । কথা গুলো শেষ করেই মুনতাসিম বেড়িয়ে পড়লো। তাইয়ান আরিয়ানকে ডেকে সবকিছু বলে সে-ও মুনতাসিমের সাথে চলে গেল।

চারিদিক আঁধারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। দূর থেকে নিশাচর পাখির ডাক কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাচ্ছে। তাইয়ান মুনতাসিমের কথা না শুনে পুলিশকে আগেই ইনফর্ম করে দিয়েছে। ছোট্ট কুঁড়েঘরটায় মোমবাতি জ্বলছে। নদীর আশেপাশে গার্ড দিয়ে ভরা। মুনতাসিম তার গার্ডদের নিস্তব্ধ হয়ে যেতে বলল। সবাই ফোনের আলো অফ করেই সামনের দিকে এগোতে লাগলো। সবার হাতে একটা করে রুমাল। রজনীর আঁধারের সুযোগ লুফে নিতেই এই পদ্ধতির ব্যবহার। দশ-বারো জনকে তারা অচেতন করে ফেলছে। কারো পদধ্বনির শব্দ কর্ণকুহরে আসতেই কিছু গার্ড গু’লি করতে শুরু করল। নিজেদের রক্ষা করতে মুনতাসিমের গার্ড গুলো গু’লি করতে শুরু করে দিল। মুহুর্তে মধ্যে শত্রু পক্ষের সাতজন রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। মুনতাসিমের তিনজন গার্ড আহত হলো। নদীর এপাশে ফাঁকা হতেই মুনতাসিম সহ আরো কয়েকজন গার্ড নৌকায় চড়ে বসলো। সবাই মিলে গভীর অরণ্যের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে। কিছু পথ অতিবাহিত হবার পর একটি আলোকিত বাড়ির দেখা মিললো। বাড়ির চারপাশে আলো ঝলমল করছে। গার্ডরা খুব সতর্কতার সাথে বাড়িটা ঘিরে রেখেছে।

তাহিয়া, শেহনাজ এবং তুলির জ্ঞান এসেছে। শেহনাজের পাশে তুলিকে দেখে উত্তপ্ত হয়ে গেল শেহনাজ। সে রক্তিম আঁখিযুগলে তুলির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। জাফর ইকবাল নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়তে ব্যস্ত। তিনজনের জ্ঞান ফিরতে দেখে সে লোভাতুর দৃষ্টিতে তুলির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। জ্বলন্ত সিগারেটে শেষ টান দিয়ে হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–তোমাদের মধ্যে কে আগে আমার সাথে শুতে চাও? জাফর ইকবালের কথায় ঘৃণায় মন মস্তিষ্ক রি রি করে উঠল। তুলি রাগান্বিত হয়ে জাফর ইকবালের মুখশ্রীতে থুতু ফেললো। এতেই জাফর ইকবাল হিংস্র হয়ে উঠল। উঠে এসে তুলির কেশগুলো মুঠোয় পুরে নিল। তুলি ব্যথায় কুঁকড়িয়ে উঠল কিন্তু হাল ছাড়লো না। সে জাফর ইকবালের পুরুষাঙ্গ বরাবর লাথি মারল। জাফর ইকবাল হৃদয়বিদারক চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সে তুলিকে বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করল। সে চেচিয়ে বলল,

–তোরা কে কোথায় আছিস? এই শালীকে ধরে বেঁধে ফেল। এই শালীর কত তেজ হয়েছে সব তেজ আমি কমাব। জাফর ইকবালের কথায় তুলি তেজী কণ্ঠে বলল,

–কেউ আমার কাছে আসার চেষ্টা করবি না৷ তোকে এক লাথি দিয়েছি বেঁচে গিয়েছিস৷ কিন্তু পরের বার লাথি দিলে বাঁচবি না। তুলির কথা শেষ হতেই গার্ড গুলো এসে তুলিকে ধরে ফেললো। তুলির হাত-পা শক্ত করে চেয়ারে বেঁধে ফেললো। জাফর ইকবাল এসে পর পর দু’টো থাপ্পড় তুলির গালে বসিয়ে দিল। তুলির ফর্সা মুখশ্রী মুহুর্তের মধ্যে রক্তিম বর্ন ধারণ করল। জাফর ইকবাল তুলির চুলের মুঠি ধরে বলল,

–আমি তোরেই আজ রাতে ভোগ করব। তুই আমারে আটকাতে পারলে আটকা।

–আমার মুনতাসিম ভাই থাকতে তুই আমার কিছু করতে পারবি না। তুই নিজের মৃত্যুর সময় গুনতে থাক মুনতাসিম ভাই তোকে ধংস করতে আসছে। তুলির কথায় শব্দ করে হেসে উঠল জাফর ইকবাল। তাহিয়া থরথর করে কাঁপছে। শেহনাজ পালানোর ফন্দি আঁটছে। তখনই বাহির থেকে গু’লা’গু’লি’র শব্দ কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাচ্ছে। জাফর ইকবাল জানালা দিয়ে মুনতাসিমকে দেখতে পেল৷ মুনতাসিমকে দেখে জাফর ইকবালের মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়লো। মুনতাসিম এবং তাইয়ান দু’জনেই দক্ষ হাতে গু’লি করছে। একটা গু’লিও যে মাটিতে পড়ছে না। তাহিয়া দৌড়ে এসে তুলির হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল। এই সুযোগে তিনজনই ঘরের বাহিরে গেল। ভাগ্য সেদিন খারাপ হয় সেদিন সবকিছুই খারাপ হয়৷ দৌড়াতে গিয়ে তুলি পড়ে গেল। তুলিকে ধরতে এসে তাহিয়াও ধরা পড়ে গেল। তারা মুনতাসিমদের অতি সন্নিকটে চলে এসেছে। তুলি উঠে মুনতাসিমের কাছে আসতে যাবে। তখনই পেছনে থেকে কেউ ভারি কিছু দিয়ে তুলির মস্তকে আঘাত করল। তুলি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তুলির করুন অবস্থা দেখে তাইয়ানের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল৷ সে ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়লো। তার হাত যেন আর চলছে না। কিন্তু মস্তিষ্ক স্মরন করিয়ে দিচ্ছে প্রেয়সীকে বাঁচানোর জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যেতে হবে। তুলিকে আরেকটা আঘাত করতে যাবে তখনই তাইয়ান গার্ডটাকে গু’লি করে দিল। সে দ্রুত তুলির কাছে গেল। তুলিকে বুকে নিয়ে শেহনাজকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। তুলিকে বুকে নেওয়াতে শেহনাজের ভিষণ ঈর্ষা হলো। তাইয়ান শেহনাজকে চেচিয়ে বলল,

–শেহনাজ তুমি উঠো না তুমি উঠলে ওরা গু’লি করে দিবে। আমি না বলা পর্যন্ত উঠবে না। তুমি গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ো। কিন্তু কথায় থাকে না হিংসা মানুষের মন মস্তিষ্ককে নষ্ট করে দেয়। হিংসা মানুষকে ধংস করে দেয়। যে মানুষের মনে হিংসা যত বেশি তার ধংস হওয়ার সম্ভবনাটাও ততই বেশি। শেহনাজ ঈর্ষায় বশিভূত হয়ে বলল,

–তুলি তোমার কাছে লুকাতে পারলে আমি কেন পারব না? আমিও তোমার আড়ালে লুকোতে চাই। তুমি ওখানে থাকো আমি আসছি। কথা গুলো বলেই শেহনাজ উঠে দাঁড়ালো। তাইয়ান তাকে বসার জন্য অনবরত অনুরোধ করছে। তবুও তাইয়ানের অনুরোধ তার মস্তিষ্ক গ্রহণ করছে না। সে কিছুদূর এগিয়ে আসতেই পরপর চারটে গু’লি এসে শেহনাজের বুকটা ছিদ্র করে দিয়ে গেল। শেহনাজ গলা কাটা মুরগীর ন্যায় ছটফট করতে করতে মাটিতে লুকিয়ে পড়লো। এসব রক্ত এবং গু’লা’গু’লি দেখে তাহিয়া গাছের আড়ালেই জ্ঞান হারালো। তুলি মস্তকে আঘাত পেয়েই জ্ঞান হারিয়েছে। তুলির মস্তক বেয়ে স্রোতের ন্যায় রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তুলির রক্তাক্ত মুখশ্রী তাইয়ানের ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। তাইয়ানের ভাবনার মাঝেই পুলিশ এসে উপস্থিত হয়। মুনতাসিম জাফর ইকবালের বুক বারবার গু’লি করেই শেহনাজের কাছে আসলো। পুলিশ তদন্ত করে অরণ্যের ভেতর থেকে তুলি, শেহনাজ এবং তাহিয়াসহ ৮১ টা মেয়ে উদ্ধার করল। আহতদের হসপিটালের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হলো। মুনতাসিমের প্রথম শেহনাজের জন্য খারাপ লাগছে। সে শেহনাজকে কথা বলতে বলছে কিন্তু শেহনাজ ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়েছে। তুলিকে তাইয়ান বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছে। দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে তারা হসপিটালের আসলো। তাহিয়া ঠিক আছে ভয়ের জন্য অচেতন হয়ে গিয়েছে। তুলির মোটামুটি আহত হয়েছে। তবে শেহনাজের অবস্থা ভালো না। ডক্টররা জরুরি বিভাগের নিয়ে গিয়েছে। তাইয়ান তুলির চিন্তায় এতটাই মগ্ন আছে যে পুরো দুনিয়ায় দারী ভুলে গিয়েছে সে। মুনতাসিম গম্ভীর মুখশ্রী করে জরুরি বিভাগের সামনে পায়চারি করছিল। তার শুভ্র পাঞ্জাবিটা রক্তে ভিজের রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। তখনই মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে নিয়ে এসে ডক্টর আসে। ডক্টরের মুখশ্রী দেখে মুনতাসিমের বুকটা কেঁপে উঠল। দুই সন্তান হারিয়ে সাহেলা চৌধুরী কিভাবে বাঁচবেন? ভাবতেই মুনতাসিমের অন্তরটা হুঁ হুঁ করে উঠছে। ডক্টর এগিয়ে এসে মস্তক নুইয়ে বলল,

–স্যরি স্যার আমরা আপনার বোনের চিকিৎসা করতে পারিনি। আপনার বোন তো পথে আসার সময় দশ মিনিট আগেই মারা গিয়েছে। আমরা চেষ্টা করার সুযোগ পাইনি। ডক্টরের কথায় মুনতাসিম কিছু বলল না৷ সে একদম নিরব হয়ে গিয়েছে। মেয়েটা জীবনে ভালোবাসা খুঁজতে গিয়ে ভালো থাকাটাই হারিয়ে ফেললো। মুনতাসিম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাহিয়ার কেবিনে গেল। তাহিয়া ভালো আছে। মুনতাসিম জড়তা নিয়ে তুলির কেবিনে গেল। তাইয়ান বিধস্ত অবস্থায় তুলির হাত ধরে বসে আছে। ওদের তিনজনকে ৮১ টা মেয়ের সাথে পাওয়া যাওয়াতে পুলিশের অনুমতি ছাড়া নিয়ে যাওয়া যাবে না। মহিলা পুলিশ এসে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। মুনতাসিম সবকিছু ঠিকঠাক করার বন্দোবস্ত করে ফেললো।

রজনীর আঁধার কেটে গিয়েছে। চারিদিকে প্রভাতের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। মুনতাসিমের কথাতেই তাহিয়া এবং শেহনাজকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। তুলিকে দু’টো দিন ডক্টর হসপিটালে থাকতে বলেছে। শেহনাজের মৃত্যুর খবর তাইয়ান পেয়েছে। এতেই সে আরো শক্ত করে তুলিকে আঁকড়ে ধরেছে। তুলিকে ছেড়ে দিলে তুলি পালিয়ে যাবে। মুনতাসিম অবাক হলো ঘৃণা জিনিসটা কি মারাত্মক তাই না! একটা সময় যে মানুষটাকে ভালোবাসত আজ সেই মানুষটার মৃত্যুর খবরেও কিছু যায় আসে না। ঘৃণা এমনই হওয়া উচিৎ নয়তো নিকৃষ্ট মানুষের মিছে ভালোবাসার একটা মানুষকে বাঁচতে দেয় না। তাইয়ানের নিজেকে সামলে নেওয়াটা মুনতাসিমের ভিষণ পছন্দ হলো। তাইয়ান শেহনাজের জানাজায় অংশ নিয়েছিল। সে বেশিক্ষণ দেরি করেনি। শেহনাজের মৃত্যু যে তার ভেতরে নাড়া দেয়নি এমনটা না৷ শেহনাজ যে এখন তার কাছে পরনারী আর একটা পরনারীকে নিয়ে ভাবাও যে পাপ তার ঘরে বউ আছে৷ তার বউয়ের করুন অবস্থা দেখে অন্য নারীর জন্য কষ্ট পাবে। এতটা নিকৃষ্ট এখনো তাইয়ান হয়নি। শেহনাজের জন্য খারাপ লাগছে কিন্তু তুলির জন্য ভেতর পুড়ছে। যে মেয়েটা তাকে এতটা ভালোবাসা দিল আর সে ছোট একটা ভুলের জন্য মেয়েটাকে এতটা শাস্তি দিল!

চৌধুরী বাড়ি জুড়ে আবার শোকের ছায়া নেমে এলো। মুনেম এবং শেহনাজকে হারিয়ে সাহেলা চৌধুরী সর্বহারা প্রায়। তাকে কেউ কিছুতেই স্থির করতে পারছে না। মেহেভীন সবকিছু শুনে কেমন জানি নির্বাক হয়ে গিয়েছে। তাদের জীবনেই কেন এত দুঃখ এত কষ্ট একটু সুখ কি তাদের জীবনে আসতে পারতো না! মুনতাসিমকে সে কিভাবে সামলাবে? সমস্ত মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে গিয়েছে মেহেভীনের। এত কোলাহলের মধ্যে সে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাইয়ান তুলির মস্তকের পাশে বসেছিল। তুলির জ্ঞান ফিরেছে। তুলি পাশ ফিরে তাইয়ানকে দেখে মুখশ্রী ঘুরিয়ে দিল। সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে যেতে লাগলে হাতে ব্যথা অনুভব করল। তুলি ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। তাইয়ান আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারল না। সে শক্ত বন্ধনে তুলিকে নিজের বুকের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলল। সে খুব শক্ত হাতে তুলিকে আলিঙ্গন করে রেখেছে। তুলি এতটুকু নড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তুলি কেমন হাসফাস করে লাগলো। তাইয়ান তুলির ললাটে চুমু খেয়ে বলল,

–আমাকে তুমি মাফ করে দাও তুলি। আমি তোমাকে অনেক আঘাত করে ফেলছি। তুমি আমাকে শাস্তি দাও তবুও আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি তোমার এবং স্যারের চুক্তির কথা শুনে ফেলছিলাম। সেদিনের পর তোমার প্রতি আমার মনে ক্ষোভ তৈরি হয়। আমার মস্তিষ্ক শুধু একটা কথাই বলতো যে তুমি আমাকে শুধু টাকার জন্য বিয়ে করেছ। আচ্ছা আমি যদি তোমাকে টাকার জন্য বিয়ে করতাম, তাহলে তুমি আমাকে কিভাবে গ্রহণ করতে? তুমি তো আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করোনি তুলি। তুুমি তোমার মায়ের সুস্থতার জন্য টাকাকে বিয়ে করেছ। আমার হৃদয়ের কান পেতে শুনো হৃদয়টা আমার জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছে। তুমি কি আমার হৃদয়ের হাহাকার শুনতে পাচ্ছো তুলি? আমাকে তোমার এতটা বাজে ছেলে মনে হয়? তোমার একটা অসুস্থ মাকে আমি দেখতাম না তুলি! আমি এতটাও খারাপ না তুলি। তাইয়ানের কথায় তুলির বুদ্ধিরা সজাগ হলো। সে তাইয়ানের হৃদয়ের আঘাতের গভীরতা অনুভব করতে লাগলো। সে তো আসলেই মানুষটাকে ভালোবেসে বিয়ে করেনি। তবে যে মানুষটার সাথে থাকতে থাকতে মনের অজান্তেই মানুষটাকে মন দিয়ে বসেছে। সে খবর কি মানুষটা পাইনি? যদি পেয়ে থাকতো তাহলে এত গুলো অভিযোগ করতো না। তুলি তাইয়ানকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠল। সে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল,

–আমি আসলেই আপনার যোগ্য না তাইয়ান। আমি সত্যিই আমার মা ভালো থাকবে বলে আপনাকে বিয়ে করেছি৷ কিন্তু আপনার সাথে থাকতে থাকতে কখন যে মন দিয়ে বসেছি৷ তার খবর আমি নিজেও জানি না। আপনাকে বিরক্ত করে আমার দিন শুরু হয়। আপনাকে বিরক্ত করে আমার রাত শেষ হয়। আপনি আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছেন। আপনাকে ছাড়া আমার দম বন্ধ লাগে তাইয়ান। আপনি তো বলেই দিয়েছেন আপনি আমার মুখ দেখবেন না৷ কিন্তু আপনি তো এটা বলে দেননি ,আপনাকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকব? আপনি আমাকে বলে দেন তাইয়ান আপনাকে ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচব? আমাদের শুরুটা ভালোবাসা দিয়ে না হলে-ও শেষটা যে ভালোবাসা দিয়ে শেষ হতে যাচ্ছে। আমি আপনাকে ছাড়া কিভাবে থাকব বলে দিন তাইয়ান। তুলির প্রতিটি বাক্য তাইয়ানের হৃদয় স্পর্শ করে গেল। সে তুলিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি কোথাও যাবে না। তুমি সারাজীবন আমার সাথে থাকবে। তোমাকে আমি কোথাও যেতে দিব না। আমার হৃদয়ের গুপ্ত কুঠুরিতে তোমাকে লুকিয়ে রাখব। আমার বুকের মধ্যে ফুলের মতো যত্নে তুমি থাকবে তুলি। তোমাকে আর কখনো কষ্ট পেতে দিব না। তুমি আমাকে মায়া ধরিয়ে দিয়েছ। আমি মায়াকে কিভাবে পিছু ছাড়াব? আমিও যে তোমাকে ভিষণ ভালোবেসে ফেলছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও তুলি। তোমাকে আমি আঘাত করে কথা বলেছি।” তাইয়ানের কথা শেষ হতেই তুলি তাইয়ানকে আঁকড়ে ধরল। তাইয়ান উন্মাদ প্রেমিকের ন্যায় তুলির সমস্ত মুখশ্রীতে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলতে লাগলো।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৫৮+৫৯+৬০

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

রজনীর আঁধার বিলুপ্ত হয়ে ধরনীর বুকে প্রভাতের আলো উপচে পড়েছে। বিষাদকে গ্রাস করে নিয়েছে এক টুকরো সুপ্ত অনুভূতি। তিক্ততা যখন হৃদয়কে বিষিয়ে তুলে ব্যস্ত, তখনই সুখানুভূতি তিক্ততাকে গুষে নেওয়ার কর্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। অনুভূতি গুলো সুখ-দুঃখের সংমিশ্রণে দোল খেলে যাচ্ছে। একদিকে যেমন সুখ বিষাদকে পাকড়াও করে ফেলছে। অপর দিকে প্রকৃতি তার দায়িত্ব পালন করেছে। সে অন্যের ক্ষতি চাইল সৃষ্টিকর্তা তাকে নরক যন্ত্রণা মিলিয়ে দিল। বিধাতার বিচার ভয়ংকরের রকমের সুন্দর। মানুষ তার কর্ম দ্বারা ফল পেয়ে যায়। তাইয়ান অষ্টাদশী কন্যাকে কোলে নিয়ে হসপিটালের মধ্যে প্রবেশ করল। অষ্টাদশীর মস্তক বেয়ে স্রোতের ন্যায় রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তাইয়ানের কোলে কোনো নারীকে দেখে মুনতাসিমের আঁখিযুগলে বিস্ময় ধরা দিল! তার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা বলছে। তাইয়ানের আঁখিযুগলে শেহনাজের জন্য অদ্ভুত লুকানো প্রণয় সে দেখেছে। তবে এই রমনীর দেখা সে পেল কোথায়? মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–এই মেয়েটা কে তাইয়ান?

–আমি আপনাকে সব বলছি স্যার, আগে মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে। তাইয়ান বাক্য গুলো শেষ করেই দ্রুত জরুরি বিভাগের দিকে ছুটে গেল। মুনতাসিম আড়দৃষ্টিতে তাইয়ানকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। মেয়েটার মস্তকে আঘাত লেগেছে। ডক্টররা তাকে সর্বোচ্চ ভালো চিকিৎসা দিয়েছে। তাইয়ান মুনতাসিমের কাছে আসতেই মুনতাসিম তাইয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–তুমি আবার বাড়ি যাও তাইয়ান। আমাদের বাড়ির প্রতিটি সিসি ক্যামেরা চেক করে দেখো। যদিও আমি জানি কাজটা কার, তবে আব্বার সামনে মানুষটাকে উপস্থাপন করাটা জরুরি। তাইয়ান নির্লিপ্ত চোখে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাইয়ানের দৃষ্টিতে মুনতাসিম ঘৃণা দেখতে পেল। তাইয়ানের আঁখিযুগলে কতটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ তাইয়ানের কি হয়ে গেল! তাইয়ান তো ভেজালযুক্ত প্রণয় গড়ে তুলে না। তাইয়ানের দৃষ্টিতে সে কয়েকমাস হলো প্রণয় দেখে না। তবে কি দু’জনের বিচ্ছেদ তার আড়ালেই হয়ে গেল? মুনতাসিমের মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে আছে। শূন্য মস্তিষ্ক দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে অক্ষম হলো। প্রেয়সীর চিন্তা মন মস্তিষ্ককে গ্রাস করে নিয়েছে।

তাইয়ান পথের ধারে রিয়াদ চৌধুরীর জন্য অপেক্ষা করছিল। মুনতাসিম কালকে রাতে সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। তাইয়ান তথ্য সংগ্রহ করে নিয়েই বের হচ্ছিল, এমন সময় রিয়াদ চৌধুরীর তাকে থামিয়ে দেয়। সে-ও তাইয়ানের সাথে যাবে বলে জানায়। তাইয়ান চৌধুরী গৃহের দিকে দৃষ্টিপাত করে ছিল। তখনই একটা কালো গাড়ির ভেতর থেকে একটা বস্তা রাস্তার মাঝে ফেলে দেওয়া হয়। কিছু ফেলার শব্দ কর্ণকুহরে আসতেই তাইয়ানের দৃষ্টি রাস্তার মাঝে যায়। বস্তার মুখ খুলে নারীর কেশগুলো দেখা যাচ্ছে। তাইয়ান তড়িৎ গতিতে বস্তার কাছে ছুটে যায়। বস্তার কাছে আসতেই তাইয়ানের দৃষ্টি অন্যদিকে চলে যায়। ততক্ষণে রিয়াদ চৌধুরীও চলে এসেছে। তাইয়ানকে দেখে তাইয়ানের কাছে আসতেই তার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। হঠাৎ করে ভেতরটা উথাল-পাতাল শুরু করে দিল। মুখশ্রী দিয়ে আপনা-আপনি বিশ্রী গালি চলে আসলো। তাইয়ান চিৎকার করে বলল কালো গাড়িটাকে ধরতে। রিয়াদ চৌধুরীর গায়ের চাদরটা মেয়ের কায়াতে জড়িয়ে দিল। চিৎকার দিয়ে অর্ধাঙ্গিনীকে ডাকল। আশেপাশে লোক জড়ো হয়ে গেল। চারিদিকে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল। মেয়ের করুন অবস্থা দেখে সাহেলা চৌধুরী জ্ঞান হারালো। শেহনাজকে দ্রুত হসপিটালে নেওয়া হলো। ভাগ্যের পরিহাসে যার মৃত্যুর খবরে আনন্দ উল্লাস করতে চেয়েছিল। বাস্তবতার নির্মম সত্যে আজ তার সাথেই একই হসপিটালের ভর্তি হতে হলো শেহনাজের। শেহনাজের নির্মম অবস্থা দেখে বুক কাঁপল না মুনতািসমের। সে নিরব ভূমিকা পালন করছে। তখনই কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল কিছু সুখময় বাক্য, সাদা এপ্রন পড়া নার্সে এসে জানালো মেহেভীনের জ্ঞান ফিরেছে। মুনতাসিম দ্রুত গতিতে মেহেভীনের কেবিনের দিকে ছুটে গেল। মেহেভীন নিষ্পলক চাহনিতে চেয়ে আছে। সমস্ত মুখশ্রী মলিনতায় ছেয়ে গিয়েছে। মুনতাসিমকে দেখে বুকের মধ্যে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। মানুষটা ঠিক আছে দেখে মানসিক ভাবে সুস্থ অনুভব করল মেহেভীন। মুনতাসিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে মেহেভীনের কাছে এসে মেহেভীনকে তুলে বসালো। মুনতাসিম রক্তিম আঁখিযুগল নিয়ে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–এত জেদ কিসের আপনার? আমি আপনাকে চলে যেতে বলেছি। মরে যেতে বলিনি! শুকনো পাতার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলাম৷ আপনি এসে কুড়িয়ে নিলেন। তা-ও আবার পোড়ানোর জন্য। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন মুনতািসমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিমের একটা বাক্যও তার বোধগম্য হয়নি। সে বোঝার চেষ্টা করছে। মুনতাসিম তাকে কি বলতে চাইছে? মেহেভীনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি উপলব্ধি করতে পেরে মুনতাসিম চোয়াল শক্ত করে বলল,

–আপনি বি’ষ খেয়েছেন কেন? মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমের মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীন গলায় ভিষণ ব্যথা অনুভব করল। তবুও সে সময় নিয়ে একটু একটু করে বাক্য উচ্চারন করে বলল,

–আপনাকে ছুঁয়ে বলছি। আমি বি’ষ খাইনি। আমি বি’ষ খাওয়ার মতো মেয়েই না৷ যে জীবন আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। সে জীবন নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। এত অল্পতে ভেঙে পড়ার মতো মেয়ে, আমি না৷ আমি জীবনে কম কঠিন পরিস্থিতির স্বীকার হইনি। যেখানে আমার আ’ত্ন’হ’ত্যা করার কথা ছিল। আমি সেখানে পাথরের ন্যায় শক্ত হয়েছি। সেখানে আপনার সামান্য মুখের কথায় আ’ত্নহত্যা’র মতো পাপ কাজ করে বসব! আর যদি আমি বি’ষ খেয়েও থাকি, তাহলে আপমার কি? আপনার জন্য তো আরো ভালো হবে। আপনার জীবনের অশান্তির মূল উৎস হলাম আমি। না থাকব আমি আর না থাকবে অশান্তি। আমার জন্য আপনাকে আর এতটুকু কষ্ট পেতে দিব না। যে মানুষটা ধরনীর নিয়মের উর্ধ্বে গিয়ে আমার ভালো চাইলো। আমি আমার জীবনের বিনিময়ে মানুষটার ভালো থাকা দিয়ে যাব। মেহেভীন আর কোনো বাক্য উচ্চারন করতে পারল না৷ মুনতাসিম নিজের অধরযুগলের সাথে মেহেভীনের অধরযুগল এক করে দিল। হৃদয়ের দহনে পুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে গিয়েছে সে। তার প্রেয়সী তাকে দ্বিগুন পোড়ানোর গল্প শোনাচ্ছে! সে পোড়াতে জানলে মুনতাসিম ভালোবাসা দিয়ে সেই আগুন নিভাতে জানে। মেহেভীন আঁখিযুগল বন্ধ করে ফেলছে। বুকের মধ্যের ধকধকানির শব্দ কর্ণকুহরে এসে বাড়ি খাচ্ছে। নিস্তেজ কায়াটা আরো নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। অনুভূতিরা চারপাশে রাজত্ব করছে। বিষাদ গুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। বাতাসে বাতাসে প্রনয়ের আদান-প্রদান ঘটছে। মুনতাসিম মেহেভীনের মস্তকটা নিজের বুকে চেপে ধরে বলল,

–হৃদয়টা পুড়তে পুড়তে একদম ছাই হয়ে গিয়েছে। ভেতরটা পোড়ার মতো এতটুকু অংশ অবশিষ্ট নেই। আপনি কি সেটা উপলব্ধি করতে পারছেন ম্যাডাম? যে আপনার মুখশ্রী দেখে বাহিরের সমস্ত ক্লান্তি মেটায়, আপনাকে দেখার ক্লান্তি সে কাকে দেখে মিটাবে? আপনি বললে আমি সেচ্ছায় মরে যাই। তবুও এত দুঃখ দেওয়ার কি আছে? আপনি সব বুঝেন শুধু আমায় বুঝেন না। মুনতাসিমের প্রতিটি বাক্য মেহেভীনের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। সে নিস্তেজ কায়ার শক্তি প্রয়োগ করে মুনতািসমকে শক্ত হাতে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করার চেষ্টা করল। কিন্তু শক্তি তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে। মানুষটাকে আঁকড়ে ধরার মতো শক্তি ক্ষয় হয়েছে। সে কোনো বাক্য উচ্চারন করল না। মানুষটাকে একটু কাছ থেকে অনুভব করার চেষ্টা করল। এই মানুষটা তার মানসিক শান্তি। যাকে ছাড়া তার দম বন্ধ হয়ে আসে। রজনীর নিদ্রা দূরে দেশে পাড়ি জামায়। মানুষটার অভিমান তার বুকে পাহাড় সমান অশান্তি সৃষ্টি করে। মেহেভীনের গলা ব্যথা হওয়ায় সে কোনো বাক্য উচ্চারন করতে পারছে না। বাক্য গুলো কণ্ঠনালিতে আসার আগেই গলায় টান ধরছে। চুপচাপ সেই যন্ত্রনা টাকে উপভোগ করতে হচ্ছে। মুনতাসিম দূরে সরতে চাইলে মেহেভীন মুনতাসিমের এক হাত আঁকড়ে ধরল। মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–ভালো করে কথা বলেছি। তারমানে এটা ভাববেন না। আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আপনার কোনো ক্ষমা নেই। খাবার এসেছে খাবার গুলো খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবেন৷ আপনাকে হসপিটালে থাকতে হবে না। আমি আজই আপনাকে বাসায় নিয়ে যাব। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীনের কোনো ভাবান্তর হলো না৷ সে মুনতাসিমের হাত ধরে রাখল।

শেহনাজের চিকিৎসা শুরু হয়ে গিয়েছে। অবস্থা খুব একটা ভালো না। রিয়াদ চৌধুরীর সমস্ত মুখশ্রী আঁধারে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। ভেতরটা অসহনীয় যন্ত্রনায় জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছে। তখনই মুনতাসিম আসে সেখানে বাবার পাশে না বসে তাইয়ানের কাছে গিয়ে বলল,

–কিছু খবর বাতাসের সাথে ছড়িয়ে পড়ে তাইয়ান। কিন্তু খেয়াল রাখবে খবরের সাথে যেন আমার নাম না জড়ায়। যার মেয়ে তার নাম উল্লেখ করেই যেন খবর প্রচার করে। আমার নাম কোনো টিভি চ্যানেল প্রচার করলে সেই টিভি চ্যানেলকে আমি বিলুপ্ত করে দিব। এটা প্রতিটি টিভি চ্যানেলের মালিককে বলে দিও। রিয়াদ চৌধুরী ছেলের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিম জীবনের প্রথম বাবার দৃষ্টি উপেক্ষা করল। তখনই পাশের কেবিন থেকে কারো উচ্চ স্বর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। তাইয়ান মুনতাসিম দু’জনেই গেল। তাইয়ানকে দেখেই রমনী তাইয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

–বাবুর আব্বু তুমি এসেছ? আমি তোমার জন্য কখন থেকে অপেক্ষা করছি। তুমি আমাকে রেখে কোথায় হারিয়েছিলে? আমি শহরের অলিতে-গলিতে তোমাকে খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও তোমাকে পাইনি। তুমি এতটা স্বার্থপর কিভাবে হয়ে গেলে! নিজের সন্তানের কথা ভেবে তোমার বুক কাঁপেনি? রমনীর কথায় তাইয়ান বিস্ময় নয়নে রমনীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে দ্রুত রমনীকে দূরে সরিয়ে দিল। মুহুর্তের মধ্যে মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠল। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–এই মেয়ে তোমার মস্তকে সমস্যা আছে? এসব তুমি কি বলছ? তুমি জানো আমি কে? আমি চাইলে তোমার কি করতে পারি, সেটা তোমার ধারনাতেও নেই। একটা থাপ্পড় দিব বাবার নাম ভুলিয়ে দিব। তুমি নিজেই একটা বাচ্চা আবার পরপুরুষকে বাবুর আব্বু ডাকতে তোমার লজ্জা করছে না!

–ঠিক টাইমে বিয়ে করলে তোমার বাবু আজ ধরনীর বুকে তোমার চুল টানত। আব্বা দেখছেন আপনার সামনে আপনার ছেলে আমাকে অপমান করছে। আপনার কি নাতির মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না। আপনি দাদা হতে চান না আব্বা। আপনার ছেলে আমার সাথে এমনটা কিভাবে করতে পারল? রমনীর কথায় তাইয়ান শব্দ করে কেশে উঠল৷ মুনতাসিমের মুখশ্রীর কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ সে গম্ভীর মুখশ্রী করে দাঁড়িয়ে আছে। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আমি তো তাইয়ানের আব্বা না। মুনতাসিমের কথায় রমনীর মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। সে চুপসে যাওয়া কণ্ঠে বলল,

–আপনি তাইয়ানের বাবা না!

–না।

–আমি তো আপনার সাথে মজা করছিলাম। আপনি নিশ্চয়ই তাইয়ানের বড় ভাই। তাইয়ানের সাথে গাড়িতে যে ছিল সেটা আপনাদের বাবা। আমি আপনার বোনের মতো মামা হয়ে আপনার অনাগত ভাগনের প্রতি অবিচার হতে দিবেন? রমনী মিথ্যার বলছে তা মুনতািসমের বিচক্ষণ আঁখিযুগল স্পষ্ট বলে দিচ্ছে। সে রমনীর কথায় তাল মিলিয়ে বলল,

–এটা তো ঘোর অন্যায়! আমি মামা হয়ে এত বড় অন্যায় ভাগনের প্রতি হতে দিতে পারি না। তোমার কি চাই বোন? তুমি ভাইকে বলো তোমার ভাই সকল সমস্যার সমাধান করে দিবে। মুনতাসিমের কথায় রমনীর সমস্ত মুখশ্রী চকচক করে উঠল। আঁখিযুগলে আশার আলো দেখতে পেল সে। তার অভিনয় এত সুন্দর সেটা আগে জানা ছিল না। কি সুন্দর মানুষ টাকে বোকা বানিয়ে ফেলল। মানুষটা তা ঘুনাক্ষরেও টের পেল না! সে খুশিতে আহ্লাদ করে বলল,

–আমার বেশি কিছু চাই না। আমি আমার স্বামীর সাথে আপনার বাড়িতে থাকতে চাই। বাচ্চাটা হয়ে গেলেই চলে যাব। আমি জানি আমার স্বামী আমাকে আর ভালোবাসে না। সে পর নারীতে আসক্ত হয়ে গিয়েছে। রমনীর কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল তাইয়ান। সে রমনীর দিকে দু’কদম এগিয়ে গিয়ে বলল,

–আমার নামে যদি আর একটা বাজে কথা বলেছ। তাহলে এখানেই খু’ন করে ফেলব। আমি তোমাকে চিনি না। পথের মাঝে গাড়ির সামনে এসে পড়েছিলে, তাই তোমাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছি। তোমার ধান্দা আমি বুঝেছি। তোমার কত টাকা চাই বলো? আমি তোমাকে তোমার ক্ষতি পূরন দিয়ে দিচ্ছি।

–আমার ভালোবাসাকে তুমি টাকার সাথে পরিমাপ করছ বাবুর আব্বু? আমার ভালোবাসায় তো কোনো কমতি ছিল না। তাহলে কেন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে? তাইয়ান মুনতাসিমের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করল। সে নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,

–আমি এই মেয়েটাকে চিনি না স্যার। ও মিথ্যা কথা বলছে। হসপিটালে আসার সময় গাড়ির সামনে পড়েছিল। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি৷ মুনতাসিম কোনো কথা না বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। তাইয়ানের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। বিধাতা তাকে কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন করল! কোনো দিকেই সে স্থির হতে পারছে না। কিছু সময়ের জন্য শেহনাজের কথা মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ঘৃণায় জর্জরিত হৃদয়টাও শেহনাজের করুন অবস্থা দেখে কাঁপছে না। সে শেহনাজকে শতবার নিষিধ করেছে। সর্তক করেছে তবুও শেহনাজ উন্মাদের মতো কাজ করেছে। দীর্ঘ কয়েক মাস তাদের কথা হয় না। বিচ্ছেদের যন্ত্রনায় কত রজনী তাইয়ান কাতরেছে। হাহাকারের রাত চিৎকার করে প্রেয়ীকে কাছে চেয়েছে। প্রেয়সী আসেনি। যার চিন্তায় সে বুকটা ভরা যন্ত্রনায় দিন পার করেছে। সে অন্যের বুকে সুখ খুঁজে নিয়েছে। মানুষটার প্রতি আগের ন্যায় ভালোবাসা নেই। কিন্তু অনুভূতি গুলো মাঝে মাঝে ভেতরটা নাড়িয়ে দেয়।

রজনীর মধ্য প্রহর চলছে। বিকট শব্দে নিদ্রা ভাঙে সবার। সবাই দ্রুত শেহনাজের কেবিনে যায়। সে পাগলের মতো চিৎকার করছে। শেহনাজের এমন অবস্থা দেখে মেহেভীন অবাক হলো! শেহনাজ যে হসপিটালে ভর্তি সে কথা মুনতাসিম তাকে বলেনি। শেহনাজ চিৎকার করে বলছে। আমার কাছে তোমরা এসো না। আমি একটা নোংরা মেয়ে। আমি পাপী। আমি পাপ করেছি। আমাকে বিধাতা শাস্তি দিয়েছে। আমি তো এমন শাস্তি চাইনি। আমাকে এতটা শাস্তি বিধাতা কেন দিল? ও বাবা আমাকে জন্মের পর বি’ষ দিয়ে মারলে না কেন? সমস্ত কায়া জুড়ে অসহনীয় যন্ত্রনা করছে। আমাকে তোমরা মেরে ফেলো। আমার মতো মেয়ের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। ও ভাই আমি না তোমার অনেক ক্ষতি করেছি। আমাকে তুমি শাস্তি দাও ভাই। তোমার সাথে বেইমানি করার শাস্তি যদি হয় মৃত্যুদণ্ড। তাহলে আমি কেন এখনো বেঁচে আছি? তোমরা চলে যাও। আমার সাথে কথা বললে তোমরাও নোংরা হয়ে যাবে। আল্লাহ তুমি আমায় কি শাস্তি দিলে। আমি কিভাবে বাঁচব। আমাকে মৃত্যু কেন দিলে না? আমাকে তোমরা বাঁচিয়েছ কেন? আমাকে শাস্তি দাও মুনতাসিম ভাই। চিৎকার চেচামেচি শুনে রমনীও এসে উপস্থিত হয় সেখানে। আশেপাশে লোক জড়ো হয়েছে। ডক্টর নার্সরা শেহনাজকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। শেহনাজ কাউকে তার আশেপাশে ঠেকতে দিচ্ছে না৷ তখনই মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “তোমার শাস্তি হলো বেঁচে থাকা।” মুনতাসিমের কথায় সকলের মুখশ্রীতে বিষণ্ণ ধরা দিল। উপস্থিত সকলের আঁখিযুগল মুনতাসিমের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছে।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

বিষন্ন আঁখিযুগল মুনতািসমের দিকে স্থির হয়ে আছে। নিস্তব্ধতায় পরিপূর্ণ পরিবেশ। মুনতাসিমের মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠল। ভেতরটা ঝনঝন করে শব্দ তুলে বলছে। এটাই সঠিক সময় হৃদয়ের গহীনে লুকানো তিক্ত বাক্য গুলো উপচে বের করে দাও। মস্তিষ্ক বাঁধা সাধলেও মন সেটার তোয়াক্কা করল না৷ বজ্রকণ্ঠে বের হতে শুরু করল কয়েক বছরের জমানো বিষাদ গুলো। মুনতাসিমের প্রতিটি বাক্য কেবিনের প্রতিটি মানুষের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের কণ্ঠে বাবার প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্যে ফুটে উঠল। সে তাচ্ছিল্য করে বলল,

–আপনি শেহনাজের অবস্থার জন্য মেহেভীনকে দোষ কিভাবে দিতে পারেন আব্বা? আপনি অতি সন্তান ভক্ত হতে গিয়ে অন্ধ হয়ে গিয়েছেন! আপনাকে আমি এতটাই ভালোবাসি। যতটা ভালোবাসলে আপনার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলার কথা স্মরন হতেই আমার হৃদয় কাঁপে। অনুভূতিরা শূন্য হয়ে পড়ে। বাবার দিক ধরতে গেলে আপনি আপনার জায়গায় ঠিক আছেন। কিন্তু অন্যায়ের দিকে গেলে আপনি ভুল পথে হাঁটছেন আব্বা। আমাকে উত্তপ্ত হতে বাঁধ্য করবেন না। আমি আমার কথার আঘাতে আপনাকে আঘাতপ্রাপ্ত করতে চাই না৷ আপনার মেয়েকে আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষমা করব না৷ মুনতাসিমের কথায় জ্বলে উঠল রিয়াদ চৌধুরী। নিজের ক্ষমতা আছে বলে সব জায়গায় ক্ষমতার প্রয়োগ দেখাতে নেই। নয়তো নিজের ক্ষমতার দাপটে নিজেকেই ঝলসে যেতে হয়। রিয়াদ চৌধুরীর অপ্রত্যাশিত ক্রোধই যেন তার কাল হয়ে দাঁড়ালো। সে উচ্চ বাক্যে বলল,

–তোমার অর্ধাঙ্গিনীর জন্যই আমার মেয়েটার ক্ষতি হয়েছে। তোমার অর্ধাঙ্গিনী যদি বি’ষ না খেত, তাহলে আমার শেহনাজের জীবনে এমন কালো অধ্যায় নেমে আসত না। তোমার অর্ধাঙ্গিনীর জন্য আমার মেয়ের পুরো জীবনটাই আঁধারে তলিয়ে গেল। বাবার প্রতিটি বাক্য ভেতরটা জ্বালিয়ে দিল। সে বাবার ন্যায় উচ্চস্বরে বলল,

–আপনি নিজের মেয়ের দোষ না দেখে আমার বউয়ের দোষ কেন দেখছেন? আমার বউ তো বি’ষ খাইনি। আমার বউকে বি’ষ খাওয়ানো হয়েছে। সেটা কে খাইয়েছে আপনি ভালো মতোই জানেন আব্বা। আপনি সবকিছু জেনেও নিজের মেয়ের জঘন্যতম অপরাধ গুলো আষাঢ়ের কালো মেঘের ন্যায় আড়াল করে দিয়েছেন। মাশরাফি বলতে চেয়েছিল। আপনি তাকে-ও বাঁধা দিয়েছেন। আপনি এখনো আমাকে চিনেন নাই আব্বা। ধরণীর বুকে আমার পরিবারের খবর আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। আমার পাশের বাসার মানুষ কখন কোথায় যায়, কি করে, তাদের অর্থ কতটুকু হালাল কতটুকু হারাম সব বলে দিতে পারব আমি। আর নিজের পরিবারের মানুষের তথ্য আমার কাছে থাকবে না। আমাকে আপনি এতটাই নির্বোধ ভাবেন আব্বা? আমি আসলে নির্বোধ না আব্বা। আমি আপনাদের সাথে কঠিন হতে চাই না বলেই আপনাদের সামনে নির্বোধ সেজে থাকি। আপনার মেয়ের করুন পরিস্থিতির জন্য আপনার মেয়ে নিজেই দায়ী। আপনি তাকে জিগ্যেস করে দেখুন। আমি তাকে শতবার নিষেধ করেছি৷ সহস্রবার সর্তক করেছি। তুমি যার সাথে মিশছ সে ভালো না। তোমাকে যেন পরবর্তী থেকে ঐ ছেলের সাথে মিশতে না দেখি। আপনার মেয়ে বাহিক্য ভাবে যেমন আলাভোলা দেখায় ভেতরটা তার ভয়ংকর রকমের বিষাক্ত। সে যদি আমার কথা শুনত তাহলে তাকে আঁধারের সমুদ্রে আঁচড়ে পড়তে হতো না৷ আপনার মেয়ে আমার বউকে বি’ষ খাইয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেল। তার বয়ফ্রেন্ড তাকে কলঙ্কিত করে তাকে ছেড়ে দিল। এখন সব দোষ আমার বউয়ের! সে চাইলে বড় ভাইয়ের কথা শুনতে পারত না। সে আমাকে কোনোদিনই নিজের ভাই মনে করেনি। তার নিজের ভাই আছে। আমি তার নিজের ভাইয়ের ভালোবাসা কেঁড়ে নিয়েছি। তার ভাইকে জোর করে বিয়ে দিয়েছি। তাই তার ভাই আমাকে খু’ন করার জন্য যা যা করতে বলছে। আপনার মেয়ে তাই তাই করেছে। আপনাকে আমি এতটাই সন্মান করি আব্বা। আপনার জন্য মুনেমের মতো অমানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছি। আপনার দুই ছেলে মেয়ে মিলে আমাকে প্রতি নিয়ত হ’ত্যা করার চেষ্টা করে গিয়েছে। আমি আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে সবকিছু সহ্য করে গিয়েছি। আমি যতদিন আপনার কথা মতো চলেছি। আমি ততদিন আপনার প্রিয় ছিলাম আব্বা। যেদিন থেকে আমি আমার সুখ আপনার থেকে চেয়েছি। সেদিন থেকে আমি আপনার কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠেছি। আমি কখনো ভাবিনি আব্বা আপনার প্রিয় সন্তান থেকে এতটা অপ্রিয় সন্তান হয়ে উঠব। আপনি মেহেভীনকে দেখতে পারেন না কেন সেটাও আমি আপনাকে বলছি। আপনি ভেবেছেন আপনার সব কথা মেহেভীন আমায় বলেছে। না আব্বা, মেহেভীন আমায় কিছু বলেনি। মেয়েটা এতটাও খাবার নয়। জানি মেয়েটা আমায় অনেক কষ্ট দেয়। কিন্তু নিজে কষ্ট পাবে তবুও আমাকে দেওয়া প্রতিজ্ঞার অমর্যাদা সে করবে না। আমার তার প্রতি বিশ্বাস আছে। একটা কথা জমিনে ফেলতে না দেওয়া মেয়েটা আপনার কথার আঘাতে শতবার মরেছে। তবুও আপনার নামে আমার কাছে একটা অভিযোগও করেনি। কিন্তু সেদিন থেকে মেহেভীন মুনেমের কথা জেনেছে। আপনি তাকে কিভাবে প্রতিনিয়ত আমার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। সেটা জেনেছে। শেহনাজের বিপথে চলে যাবার কথা জেনেছে। সেদিনের পর থেকে মেহেভীন আপনার চোখের বি’ষ হয়ে গিয়েছে। আপনি সব সময় ভয় পেতেন। এই বুঝি মেহেভীন আমার সব বলে দিল। আমি রাগলেও আপনি ভাবতেন মেহেভীন আমার কান ভারি করেছে। আমি বাহিরের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করে করে মানুষ চিনেছি আব্বা। প্রথমে আমার মানতে কষ্ট হলে-ও আমি পরে মানিয়ে নিয়েছি। সংসারের শান্তি চেয়েছিলাম মেয়েটার কাছে, এইদিকে মেয়েটা আমাকে শান্তি দিয়েছে। না বলেছে আপনার বেঈমানির কথা, না বলেছে মুনেমের কথা, আর না বলেছে শেনাজের উচ্ছন্নে যাবার কথা। সে শেহনাজের ভালো চাইল আর শেহনাজ তার মৃত্যু চাইল। এতে আপনি কি বুঝলেন আব্বা? পর মানুষের ভালো চাইতে নেই। পর যদি পরের মতো আচরণ না করে তাহলে তার স্বার্থকতা আসে না। পর যদি আপনের মতো আচরণ করে তাহলে এভাবেই কথার আঘাতে মরতে হয়। আপনার ছেলে আর মেয়ে আমাকে মারতে চেয়েছে। তারা জাফর ইকবালের মতো ক্রিমিনালের সাথে হাত মিলেছে। আমার এক্সিডেন্টও তারা মিলে করিয়েছে। আমার বউকে বি’ষ আপনার মেয়ে খাইয়েছে। আর আপনি আপনার ছেলেমেয়ের দোষ রেখে আমার বউয়ের দোষ খুঁজছেন। কথায় থাকে না দূরে গেলে দুরত্ব বাড়ে আর কাছে থাকলে প্রণয় বাড়ে। এই কথাটার স্বার্থকতা আমি নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছি। আমার মা যতদিন বেঁচে ছিল। আমার প্রতি আপনার ভালোবাসাও ঠিক ততদিনই ছিল। আমার মা নেই। আমার কেউ নেই। আমার একটাই পরিচয় আমি এতিম, অনাথ। আমার সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ নেই। তিনিই আমার একমাত্র গার্ডিয়ান। মুনতাসিমের প্রতিটি বাক্য হৃদয়ের গভীরে স্পর্শ করে গেল। অদ্ভুত ভাবে পরিবেশ শীতল হয়ে উঠল। কেবিনে উপস্থিত প্রত্যেকের আঁখিযুগলে অশ্রু এসে জমা হয়েছে। তাইয়ান অপরাধীর ন্যায় মস্তক নুইয়ে আছে। ভেতরটা ভয়ে কাবু হয়ে আসছে। মুনতাসিম কখন জানি তাকে নিয়ে বলতে শুরু করে। রিয়াদ চৌধুরীর অনুভূতি নাড়া দিয়ে উঠল। সে জানত না মুনতাসিমকে শেহনাজ আর মুনেম মারতে চায়। যদি জানত তাহলে কখনো দু’জনকে সাহায্য করত না। সে প্রতিটি সন্তানকে জীবিত দেখতে চেয়েছিল। নিজের ভালোটা দিয়ে সবাইকে মিলেমিশে এক করতে চেয়েছিল। নিয়তি যে তার সাথে এভাবে ছলনা করবে। সেটা সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। সে অসহায় মাখা দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। অসহায়ত্ব যেন রিয়াদ চৌধুরীর সমস্ত মুখশ্রীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। সন্তানদের ভালো চাইতে গিয়ে সন্তানদের খারাপটা যে কখন করে ফেলল, সেটা টেরই পাননি তিনি। রিয়াদ চৌধুরী বিধস্ত শেহনাজের গালে পরপর কয়েকটা প্রহার করল। ঘুমের ঔষধ দেওয়ার কারনে তার সমস্ত কায়া নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। রিয়াদ চৌধুরী অশ্রুমাখা কণ্ঠে বলল,

–ম’রে যা তুই। তোর মতো মেয়ের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তুই এতদিন আমায় কেন মিথ্যা বলেছিস? আমাকে কেন বলেছিস মুনেম মুনতাসিমের কাছে ক্ষমা চাইবে। অতীতের কালো অধ্যায়কে ভালোবাসার শক্ত আবরণে ঢেকে দিবে। আমাকে কেন বলেছিস মেহেভীন মুনেম আর তোর নামে মুনতাসিমের কাছে বি’ষ ঢালে? আমি তোদের ভালোবেসেছিলাম। আমি তোদের বিশ্বাস করেছিলাম। তোরা আমাকে এভাবে নিঃস্ব করে দিলি শেহনাজ। প্রতিটি টিভি চ্যানেলে তোর খবর দেখাচ্ছে। সবাই আড়দৃষ্টিতে দেখছে। আজ যদি একজন মন্ত্রীর ছেলে না হতাম। তাহলে আমার বেঁচে থাকা দুর্বিষহ হয়ে যেত। আমি নিজে মুনেমকে শাস্তি দিব। এতদিন মুনেমকে বাঁচিয়েছি। আমি ভুল করেছি। এসব দিন দেখার আগে আমার মৃত্যু হলো না কেন? অর্ধবুজা আঁখিযুগলে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করল শেহনাজ। মুখশ্রীতে তার তাচ্ছিল্য ফুটে উঠেছে। ভেতর থেকে ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে। শেহনাজ নেতিয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,

–আমার এখন আফসোস হচ্ছে ভিষণ আফসোস। আমি কেন তোমার ছেলেকে মারতে পারলাম না। আমি তোমার ছেলেকে মারিনি বলে, তোমার ছেলেও আমাকে মারছে না। আবার আমাকে বলছে। আমার শাস্তি নাকি বেঁচে থাকা। আমি কি করতাম আমি আমার ভাইকে হাহাকার করতে দেখেছি৷ প্রেয়সীকে না পাওয়ার যন্ত্রনায় ছটফট করতে দেখেছি৷ জ্বরের ঘোরে প্রেয়সীর কাছে যাওয়ার জন্য আর্তনাদ করতে শুনেছি। মুনতাসিম ভাই পেয়েছে একটা সুন্দর পরিবার কিন্তু আমার ভাই কি পেয়েছে আব্বু? আমার ভাইয়ের পরিবার থেকেও কেউ ছিল না। মুনতাসিম ভাই আমার সৎ ভাই হয়েও সুস্থ একটা পরিবার পেল। আর মুনেম আমার নিজের ভাই হয়েও সুস্থ পরিবার পেল না। মুনতাসিম ভাই তাকে গৃহত্যাগ করালো। তার ভালোবাসার মানুষের থেকে আলাদা করল৷ তাকে চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে বন্দী করে রেখে দিনের পর দিন মানসিক এবং শারিরীক ভাবে অচ্যাচার করল। এমনকি মুনেম ভাইয়ের বউ বাচ্চাকেও মুনতাসিম ভাই খু’ন করেছে। শেহনাজের শেষোক্ত বাক্যটি কর্ণকুহরে আসতেই মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–পরী আমার বোন ছিল। তুমি আমার কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলে, পরীও ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি তোমাকে প্রমাণ দেখাতে পারব শেহনাজ। আমি পরীকে খু’ন করেনি। তুমি তোমার বিকেক বুদ্ধি কাজে লাগাও। তোমার ভাই অপরাধ করেছে। সে অষ্টাদশীর মনে প্রণয় জাগিয়েছে। সেই প্রণয়ের সুযোগ লুফে নিয়ছে। বিবাহের আগেই অষ্টাদশীকে করেছে কলঙ্কিত। অষ্টাদশী যখন অন্তঃসত্ত্বা হলো তোমার ভাই তাকে অস্বীকার করল। তাদের পাপের ফল কেন একটা অবুঝ শিশু পাবে! আমি শুধুমাত্র তাদের অনাগত সন্তানের কথা ভেবেই দু’জনের বিবাহ দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার ভাই ছিল উন্মান আর চরিত্রহীন। নারীদের হৃদয়ের গভীরে গিয়ে তাদের আহত করাই ছিল তার প্রধান কাজ। সে কাউকে ভালোবাসত না। যদি ভালোবাসত তাহলে অন্য নারীর কাছে যাবার কথা দ্বিতীয় বার ভাবত না৷ সে নিজেই বিয়ের দুই মাস পরে পরীকে শ্বাসরোধ করে খু’ন করে। তারপর পলাতক হয়ে যায়। আমি তাকে খুঁজি পেয়েও যাই৷ কিন্তু তুমি আর আব্বা মিলে তাকে পলাতক হতে সাহায্য করো। আমি জেনেও চুপ থাকি৷ পরীর লা’শ খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু পাইনি৷ শেষবার যখন পেয়েছিলাম। তখন পরীকে দেখে আমার ভেতরটা হাহাকার করে উঠেছিল। জীবনে প্রথমবার নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছিল। কিন্তু আমি যে নিরুপমা ছিলাম। পরীর সাথে মুনেমের বিয়ে না দিলে সমাজ পরীকে বাঁচতে দিত না। আমি চেয়েও পারিনি পরীকে বাঁচাতে। পরীকে না বাঁচানোর অপরাধে আমি আজ-ও অপরাধী। এতদিন তোমরা সবাই মিলে আমাকে আঘাত করার চেষ্টা করেছ। আমি জেনেও নিরব থেকেছি। কিন্তু তোমরা আমাকে রেখে আমার হৃদয়ে আঘাত করলে। আমার ভালোর থাকার ভেতরে রক্তক্ষরণ ঘটালে। আমার ভালোবাসার মানুষকে খু’ন করার চেষ্টা করেছ। আমি তোমাদের কখনো ক্ষমা করব না৷ ভুল করেও যদি কারো হাত মেহেভীনের দিকে এগিয়ে আসে আমি সেই হাত ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিব। অদ্ভুত ভাবে শেহনাজের সমস্ত কায়া ঘৃণায় রি রি করে উঠল। সে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে শুরু করল। ঔষধের প্রভাব কাজ শুরু করে দিয়েছে। মুনতাসিম এবার তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করল৷ তাইয়ান কাঁপছে। সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। মুনতাসিম শীতল হেসে বলল, “পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বেইমানের নাম হলো তাইয়ান।” মুনতাসিমের শেষোক্ত বাক্যটি তাইয়ানকে ভয়ংকর ভাবে কাঁপিয়ে তুলল। উপস্থিত সবাই কেমন জানি স্তব্ধ হয়ে গেল। এত জড়ালো ঘটনা কারো মস্তিষ্কে প্রবেশ না করলে-ও তাইয়ান এবং রিয়াদ চৌধুরীর মস্তিষ্কে গভীর ভাবে প্রবেশ করেছে। সুখানুভূতিতে মেতে ওঠা জীবনটা মুহুর্তের মধ্যে বিষাদে রুপ নিল। চারদিকে খালি বিষাদ আর বিষাদ। বিষাদময় জীবনে হৃদয়টাও বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৬০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

অনুভূতিতে অভিমান গুলো খেলা করছে। বিষণ্ণতা হৃদয়কে গ্রাস করে ফেলছে। অতীতের কালো অধ্যায় গুলো মস্তিষ্কে এসে স্মৃতিচারণ করছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা তার নিরব চাদর দিয়ে পরিবেশকে মুড়িয়ে নিয়েছে। হৃদয়ের গহীনে হাহাকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেহনাজ নিদ্রা চলে গিয়েছে। পুরো কেবিন ধীর গতিতে জনশূন্য হয়ে গেল। মেহেভীন মুনতাসিমের পাশে বসে আছে। মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রীতে গম্ভীরতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। স্তব্ধ সময়কে শব্দ তুলে পরিবেশের নিস্তব্ধতা ভাঙলো মুনতাসিম। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আপনি মুনেমের কথা কিভাবে জেনে ছিলেন? মুনতাসিমের কথায় মলিন হাসলো মেহেভীন। ধরনীর সমস্ত মলিনতা যেন মেহেভীনের মুখশ্রীতে এসে রাজত্ব করছে। মেহেভীন তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে মলিন কণ্ঠে বলল,

–আপনার যে আরেকটা ভাই ছিল। সে কথা আমাকে তো আগে বলেন নি!

–কিছু জিনিস আড়ালেই সুন্দর। আড়াল কৃত কর্ম গুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটলে তিক্ততা এসে মন মস্তিষ্ককে গ্রাস করে ফেলে।

–আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার কথা শুনতে চাই।

–আমার মা মারা যাবার পর আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। সে কথা তো জানেন। শেহনাজের মা যখন বধু সাজে এসে আমাকে পেল। সেদিন উনার আঁখিযুগলে আমি আমার প্রতি একরাশ ক্ষোভ এবং ক্রোধ দেখেছিলাম। আমি উনাকে প্রথমে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনি আমার ভালোবাসর অনুমতি দেননি। বাবার সামনে আমার সাথে সব সময় ভালো ব্যবহার করতো। কিন্তু বাবা না থাকলে শারীরিক ভাবে অনেক অত্যাচার করতো। আমাকে ভয় দেখাতো আমি যদি বাবাকে বলে দেই। তাহলে উনি আমাকে খু’ন করে ফেলবে। আমার জেদ সম্পর্কে উনার ধারনা খুবই কম ছিল। উনি আমাকে যত মারতেন। আমার বিচার দেওয়া ততই প্রখর হতে শুরু করল। যেদিন থেকে বুঝলেন আমায় মে’রে কাজ হবে না। সেদিন থেকে আমাকে মারা বন্ধ করে দিল। আমাকে একাকীত্বের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিল। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কত রজনী বাবাকে কাছে চেয়েছি। কিন্তু ঐ মহিলার জন্য আমি আমার বাবাকে কাছে পাইনি৷ আমি রাতের আঁধারকে খুব ভয় পেতাম। মা মারা যাবার পর আমার ভয় পাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গেল। আজ আমি আপনাকে সব বলব। আমি কেন পাহাড় হতে গিয়ে পাথর হলাম। উত্তাল সমুদ্রের মতো একজন মানুষ ঠিক কি হারালে শান্ত হয়ে যায়। বড় হবার চক্করে কিভাবে বিসর্জন দিলাম আমার কৈশোর, কোন জাদুতে আমার আঁখিযুগল ভিজে না। আমি আপনাকে সব বলব। সৎ মায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে, আমি বড় হতে চেয়েছি। কোমলের ন্যায় কুসুম মনটাকে পাথরের ন্যায় শক্ত করেছি। ভালোবাসাহীনতায় ভুগতে ভুগতে আমার আঁখিযুগল অশ্রু ফেলে না। যার সমস্ত কৈশোর জীবনটা কেটেছে প্রিয় মানুষদের অবহেলায় এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্যে সেই মানুষটা কিভাবে নরম থাকতে পারে বলতে পারেন? আমার সৎ মাকে বুদ্ধি দেওয়া হয়। সে যদি দ্রুত বাচ্চা নিয়ে ফেলে তাহলে আমার বাবা তার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আর একটা সুন্দর বিষয় কি জানেন? আমার সৎ মাকে বুদ্ধিটা দিয়েছিল আমার নিজের ফুপি। আমি অবহেলা এবং অত্যাচার সহ্য করতে করতে নিরব হয়েছি৷ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ইচ্ছে ছিল। আমি বড় হয়ে আগে আমার সৎ মাকে খু’ন করব। আমি যখন বড় হলাম তখন বুঝে গেলাম। মা ছাড়া একটি সন্তানের জীবন মূল্যহীন। বাবা-মা দু’জনের মধ্যে যদি একজনের কমতি থাকে, তাহলে সবার আগে সেই সন্তান ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। বাবার বিয়ের দু’মাসের মাথায় মুনেম পেটে আসে। কি সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা হয়েছিল। তখন কেউ কি ভেবেছিল? সেই ছোট্ট বাচ্চাটা বড় হয়ে আস্ত একটা অমানুষ তৈরি হবে! তাকে গৃহ ত্যাগ করাতে হবে। তার অল্প বয়স থেকেই নারীর প্রতি ভিষণ ঝোঁক ছিল। পরী বাবা-মা মরা অনাথা মেয়ে ছিল। তার চাচা চাচি তাকে ভিষণ অত্যাচার করতো। মুনেমের কথা যখন তার চাচা চাচি জেনে যায়। মেয়েটার জীবনে অমাবস্যার আঁধার ঘনিয়ে আসে। আমি পারিনি একটা অনাথ মেয়ের জীবন দুঃখের সমু্দ্রে ভাসিয়ে দিতে। আমি তাকে সচ্ছ কাঁচের ন্যায় ঝকঝকে সুন্দর জীবন উপহার দিতে চেয়েছিলাম। লোকে বলে বিয়ের পরে অনেক পুরুষ বদলে যায়। কেউ বখাটে থেকে দারুন সংসারী হয়ে উঠে। কিন্তু লোকে তো এটা বলেনি যে বিয়ের পর একটা মেয়ের জীবন নরক হয়ে যায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভাগ্যবান সেই নারী, যে নারীর স্বামী ভালো। আর পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা নারী কে জানেন? যে নারীর স্বামী ভিষণ রকমের পাষাণ হৃদয়ের নিকৃষ্ট একজন মানুষ। যে নারীর স্বামী ভালো সে নারী ধরনীর বুকেই জান্নাতের শান্তি অনুভব করে। আর যে নারীর স্বামী খারাপ সেই নারীর সারাজীবনটাই জাহান্নামে পরিনত হয়ে যায়। আমার বোন পরীও সেই দলে ছিল। আমি আজ-ও তার কাছে অপরাধী। বাক্য গুলো শেষ করে স্তব্ধ হয়ে গেল মুনতাসিম। সমস্ত মুখশ্রীতে ক্লান্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেহেভীনের ভিষণ মায়া হলো। সে চুপচাপ সবকিছু শুনে ধীর কণ্ঠে বলল,

–আপনার ভাই তো আমারও ছোট এত অল্প বয়সে এতকিছু করে ফেলল! এত ক্ষোভ কিসের আপনার প্রতি? সে যার সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়েছিল। আপনি তো তার সাথেই তাকে বিবাহ দিয়েছিলেন।

–মুনেম আপনার ছোট ঠিকই ধরেছেন। তাকে এক নারীর মায়া কখনো বিমোহিত করেনি। সে সহস্র নারীর মোহে বিমোহিত ছিল। যে বারো নারীর স্বাদ গ্রহণ করেছে। সে কিভাবে বুঝবে এক নারীর স্বাদ কতটা ভয়ংকর! এক নারীর মায়াতে আঁটকে থাকা পুরুষ গুলো ভিষণ দুঃখী হয়। এরা আঘাতপ্রাপ্ত হতে হতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এদের ভেতরটা রক্তাক্ত করে দিতে তাদের প্রেয়সীরা দ্বিধাবোধ করে না। তাদের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে প্রেয়সীরা তৃপ্তি পায়। যারা শত নারীতে আসক্ত থাকে দিনশেষে ভালো থাকে কিন্তু মনে শান্তি থাকে না। কিন্তু যারা এক নারীতে আসক্ত থাকে এরা দুঃখ পায়। আবার এটা ভেবে শান্তি পায় যে মানুষ টা যতই দুঃখ দিক, তার প্রিয় মানুষটা একান্তই তার। প্রিয় মানুষ যেমনটা তার। ঠিক তেমনই প্রিয় মানুষটার দেওয়া দুঃখ গুলোও তার। এটা গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারলেই জীবনটা ভিষণ রকমের সুন্দর। দু’জনের কথোপকথনের মাঝে তুলি এসে সেখানে উপস্থিত হয়। তুলিকে দেখেই মুনতাসিম মলিন হাসলো। সে তুলিকে বলল,

–তুমি এখন থেকে আমাদের সাথে থাকবে। আমার কথা মতো কাজ করবে। তাইয়ানের মনে তোমাকে জায়গা করে নিতে হবে। তোমাকে ভরসা করে বিশাল দায়িত্ব দিয়েছি। তাইয়ানকে কাবু করার দায়িত্ব আমার। শেহনাজ যদি আমার বউয়ের মতো ঘাড় ত্যাড়া হতো কিন্তু এক পুরুষের মোহে বিমোহিত থাকতো। তাহলে আমি তাইয়ানের সাথে শেহনাজের বিয়ে দিয়ে দিতাম। শেহনাজ যে তাইয়ানের বিপরীত চরিত্র আমি ভাই হয়ে তাইয়ানের দুঃখ বাড়িয়ে দিতে পারব না। এতে আমি লোকচক্ষুর বিষ হয়ে যেতে পারি। তাতেও আমার কোনো আফসোস নেই। তাইয়ানের সংসারটা গুছিয়ে দিতে পারলে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পূর্ণতা পূর্ণ হবে। আমি তোমাকে সবকিছু বলে নিয়েছি বোন। তুমি পরে অভিযোগ করতে পারবে না। তাইয়ানকে মানিয়ে নেওয়ার সময় দিবে।

–আমি আমার মতো করে চেষ্টা করব। আমার অসুস্থ মাকে দেখলেই হবে। আমার আর কিছু চাই না মা ছাড়া আমার কেউ নেই। আপনি আমাকে লোভী মেয়ে ভাবতে পারেন। মায়ের ভালো চিকিৎসা করাতে পারব বলেই আপনার শর্ত রাজি হয়েছি। আপনার ভাইকে কতটা ভালো রাখতে পারব জানিনা। তবে আমি আমার ভালোটা দিয়ে তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করব। আমি আজ আসছি। কালকে আপনাদের বাসায় সঠিক সময়ে পৌঁছে যাব। কথা গুলো বলেই তুলি স্থান ত্যাগ করল। মেহেভীনের দু’জনের কথপোকথন শুনে কিছুই বোধগম্য হয়নি। সে নির্বাক ছিল। তুলি চলে যেতেই মেহেভীন ধীর কণ্ঠে বলল,

–মুনেমের ভাস্যমতে তার প্রিয় মানুষ ছিল অন্য কেউ তাই তো? আপনি পরীর সাথে বিবাহ দেওয়াতে সে ক্ষোভে পরীকে খু’ন করে আর আপনাকে খু’ন করার চেষ্টা করে। এতে শেহনাজ মুনেমকে সাহায্য করে। আর আব্বা তার ছেলেকে আপনার হাতে থেকে বাঁচিয়েছে তাই তো?

–হুম। মনটা ভিষণ জ্বলছে মেহেভীন।

–কেনো জ্বলছে?

–কারন আপন মানুষ গুলোই মনে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। মন জ্বলবে না তো কি করবে?

–আমাকে একটা বার মাফ করা যায় না? কথা দিলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অর্ধাঙ্গিনী হয়ে দেখাবো।

–আমার যে ভেতর পুড়ছে। জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আমার উত্তপ্ত হৃদয়কে আগে শীতল করুন। তারপরে না হয় মাফ চাইবেন। আপনাকে ক্ষমা করার মতো কোনো রাস্তা যে আমি দেখছি না। আপনি ডিভোর্স চেয়েছিলেন না খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিব। মুনতাসিমে প্রতিটি বাক্য সমস্ত ভেতরটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দগ্ধ করে দিচ্ছে। সমস্ত কায়া ঝলসে যেতে শুরু করেছে। ডিভোর্স শব্দটা কি বিষাক্ত শোনালো! ছোট একটা বাক্য তবুও ভেতরটাকে কিভাবে যন্ত্রনায় কাবু করে দিচ্ছে! মেহেভীন মুনতাসিমের মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তার মলিনতায় ছোঁয়া মুখশ্রী বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। একটা ভালো বাক্য শোনার জন্য বাহিরটা এমন নিকৃষ্ট বাক্য উচ্চারন করেছে। মেহেভীন শীতল মস্তিস্কে জবাব দিল,

–আমাকে দিয়ে না পোষালে আরেকটা বিয়ে করুন। প্রয়োজন চারটা বিয়ে করুন। বিয়ের করার আগে অবশ্যই আমাকে খু’ন করুন। প্রাণের মায়া থাকলে আমি জীবিত থাকা অবস্থায় করতে যাবেন না। আপনার জন্য শুধু শুধু চারটা নারীর প্রাণ যাবে। আপনি একাকিত্ব খুঁজছেন। আমি আপনাকে একাকিত্ব দিয়ে যাব। যদি কখনো একাকিত্ব ঘুচিয়ে ভালোবাসার চাদরে মোড়াতে ইচ্ছে করে, তবে আমায় ডাকবেন। আপনার জন্য আমার হৃদয়ের দরজা সর্বদা খোলা থাকবে। আপনি আমার হৃদয় গুপ্ত কুঠুরিতে প্রবেশ করতেই চাইলে তারা আপনাকে খুব সংগোপনে আলিঙ্গন করে নিবে। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিমের ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল। এমন কিছুই সে শুনতে চেয়েছিল। তবে কি তার তিক্ত বাক্য গুলো সার্থক হলো! তিক্ততায়ও এত তৃপ্তি পাওয়া যায়? কই আগে তো জানা ছিল না! যদি জানা থাকতো। তবে আগেই তিক্ত বাক্য গুলোকে সে আহবান জানাত। মুনতাসিম কিছু বলার আগেই তাইয়ান আসলো। তাইয়ানের আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। সমস্ত মস্তক নুইয়ে মুনতাসিমের চরণের কাছে অবস্থান করল। মুনতাসিম গম্ভীর মুখশ্রী করে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। তাইয়ান দু-হাত জোর করে বলল,

–আমাকে ক্ষমা করে দিন স্যার। আপনি আমার থেকে মুখশ্রী ফিরিয়ে নিলে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাই। আমি জানি আমি অপরাধ করেছি। আমি অপরাধী। আমাকে আপনি শাস্তি দিন। আমি বেঁচে থাকতে আপনার ঘৃণা দেখতে পারব না। আপনার আঁখিযুগলে ঘৃণা দেখার আগেই যেন আমার মৃত্যু হয়। আমি একটা সময় শেহনাজকে ভালোবেসেছি। আমার ভালোবাসা থেকেই শেহনাজকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু যেদিন থেকে জেনেছি শেহনাজ আপনাকে খু’ন করতে চায়। আল্লাহর কসম করে বলছি সেদিন থেকে শেহনাজকে ভালোবাসা ছেড়ে দিতে শুরু করেছি। ভালোবাসা যদি একদিনে ভোলা যেত তাহলে আমি শেহনাজের মায়া থেকে বের হতে এতদিন সময় নিতাম না। সে আমাকে কখনো ভালোইবাসেনি। আমি বোকার মতো ভালোবেসে গিয়েছি। সে অন্য কাউকে ভালোবাসে জানার পর আমি তাকে আমার জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছি। আমি এখন অনেক ভালো আছি। আমার পুরোনো ভুলের জন্য আমাকে এত বড় শাস্তি দিবেন না স্যার। আমি একদম নিঃস্ব হয়ে যাব।

–তুমি এমন ভাবে কথা বলছ যেন আমি তোমার প্রেয়সী। তোমার সাথে প্রণয় শেষ করে ধোঁকা দিয়েছি। এখন তুমি আমাকে ছাড়া বাঁচবে না। আমাকে কি তোমার গে মনে হয় তাইয়ান? তুমি যে অন্যায় করেছ তার কোনো ক্ষমা নেই। তুমি আমাকেও বাঁচিয়েছ। আবার আমার শত্রু শনাক্ত করার পর তাকে আমার হাতে তুলে না দিয়ে তাকে-ও বাঁচিয়েছ। এর থেকে জঘন্যতম অপরাধ কি হতে পারে তাইয়ান? তোমার মতো বড় বেইমান কেউ হতে পারে না। আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করব না। তুমি আমার আঁখিযুগলের সামনে থেকে চলে যাও। তোমার মুখশ্রী আমি দর্শন করতে চাই না। মুনতাসিমের বলা প্রথম বাক্যে ভিষণ লজ্জা পেল তাইয়ান। এই মানুষটা তার ভিষণ দুর্বলতা। এই মানুষটার সামনে তার সমস্ত আবেগ উপচে পড়ে। ভেতরের আবেগপ্রবণ বাক্যগুলো অনায়াসে বের হয়ে আসে। কিন্তু শেষোক্ত বাক্যগুলো ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলে। কথায় থাকে না মানুষ প্রেমে অন্ধ হয়। তাইয়ানও হয়েছিল। তবে সে সঠিক সময় ভুলটা উপলব্ধি করতে পেরেছিল বলেই এখনো নিঃশ্বাস ছাড়তে পারছে। কিন্তু অনুভূতি গুলো কেন যে মাঝে মধ্যে নাড়া দিয়ে উঠে! কেউ কি চাইলে পারে না। এই বিশ্রী অনুভূতি গুলোকে তার স্নিগ্ধ ভালোবাসার দিয়ে ঢেকে দিতে। পরক্ষনেই তাইয়ান নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানালো। ধরনীর বুকে ভালোবাসা বলতে কিছু নেই। যা আছে তা কিছুটা অভিনয় আর বাকিটা দীর্ঘশ্বাস।

–আপনি আমার শক্তি স্যার। আপনি আমার থেকে দূরে সরলে আমি নিস্তেজ হয়ে যাই। ভেতরটা দুর্বল হয়ে পড়ে। আমাকে শেষ বারের মতো ক্ষমা করে দিন। আমি আপনাকে দ্বিতীয় বার অভিযোগ করার সুযোগ দিব না।

–আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।

–আপনার জন্য আমি সবকিছু করতে পারব।

–তোমার জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার সময় হয়েছে। এবার তোমার সংসারী হওয়া উচিৎ। আমি তুলির সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি৷ তোমার মতামত ছাড়া কিছুই হবে না। তুমি যদি চাও আমি শেহনাজের সাথেও তোমার বিয়ে দিব। কিন্তু যার মনে তুমি নেই। তার মনে কি ভালোবাসা পাবে? সে তোমাকে ব্যবহার করে গিয়েছে। সে কখনো তোমাকে ভালোবাসেনি। আমি তোমাকে সময় দিলাম। আমার প্রস্তাবে রাজি হলে তবে আমার সামনে আসবে। এর আগে যেন আমি তোমাকে না দেখি। মুনতাসিমের কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল তাইয়ান। উঠে দু’কদম পিছিয়ে গেল সে। মুনতাসিম তার কাছে এ কি ধরনের আর্জি করে বসলো! তাইয়ান দোটানায় ভুগছে। ভালোবাসা নামক শব্দটাই এখন তার কাছে বিষাক্ত। সে কিভাবে অন্য এক নারীকে বধু হিসেবে গ্রহণ করবে? সবে মাত্র মনটাকে শান্ত করেছিল। মুনতাসিম যে তাকে অশান্তির সাগরে ডুবিয়ে দিল। তাইয়ানের মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে মুনতাসিম মনে মনে বলল, “আজ যেমন তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে অশান্তির সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছি। ঠিক তেমনই কোনো এক চন্দ্রের আলোতে আচ্ছাদিত রজনীর মধ্য প্রহরে তুমি আমায় বলবে। আমার জীবনের সবচেয়ে ভালোটা আপনি করেছেন স্যার। সেদিন তোমার জীবনের সমস্ত বিষণ্ণতা কে’টে গিয়ে হৃদয় জুড়ে ভালোবাসার বিচরন ঘটবে। এটা তুমি মিলিয়ে নিও তাইয়ান।”

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৫৫+৫৬+৫৭

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫৫
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সুখ গুলোকে গ্রাস নিয়েছে বিষাদের কালো মেঘের দল। নিস্তব্ধ রজনী মুহুর্তের মধ্যে হাহাকার করে উঠল। শহরের আনাচ-কানাচে দুঃখরা রাজত্ব করছে। অনুভূতিরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বাক্যরা ছন্দ হারিয়েছে। কণ্ঠনালি আওয়াজ তুলতে ভুলে গিয়েছে। বুকের মধ্যে ব্যথাটা জানান দিচ্ছে সে চলে এসেছে। তার ব্যথায় ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে। কোলাহল বিহীন হসপিটালটা মুহুর্তের মধ্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। ডক্টর, নার্স যে যেদিকে পারছে ছুটে চলেছে। মুনতাসিমকে জুরুরি বিভাগে নেওয়া হয়েছে। মুনতাসিমের অবস্থা খুব একটা ভালো না। যেকোনো সময় দেহ থেকে প্রাণ পাখিটা উড়াল দিতে পারে। তাইয়ান পাথরের ন্যায় বসে আছে। এখন তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। তাকে শক্ত থাকতে হবে। তার দেহে প্রাণ থাকা অবস্থায় মুনতািসমের জন্য লড়তে হবে। মুনতাসিমের করুন দৃশ্যটা মুখশ্রীর সামনে ভেসে উঠতেই তাইয়ানের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। সে চৌধুরী বাড়িতে খবর দিবে কি না সেটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভূগছে। মেহেভীন তাইয়ানকে আটত্রিশ বার ফোন করেছে। মুনতাসিমকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ফোনটা তুলতে পারেনি তাইয়ান। তাইয়ানের ভাবনার মাঝেই মুঠোফোন ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠল। তাইয়ান ফোনের স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই মেহেভীনের নামটা ভেসে উঠল। তাইয়ানের সমস্ত কায়া ধীর গতিতে কাঁপছে। সে শক্ত হাতে ফোনটা রিসিভ করল। অপর প্রান্ত থেকে মেহেভীনের রাগান্বিত কণ্ঠ স্বর ভেসে এল।

–আপনি আমার মেসেজের রিপ্লাই করছেন না কেন? আপনি যে শেষে বললেন, মুনতাসিম আপনাকে গাড়ি থেকে নামতে বলেছে। তারপর থেকে আপনার খোঁজ খবর পাচ্ছি না। আপনারা এখন কোথায় আছেন? উনাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসুন। আপনি যদি বাড়ি নিয়ে আসতে না পারেন। তাহলে উনার কাছে ফোনটা দিন। আমার যা বলার বলছি। মেহেভীনের কড়া বাক্য গুলো তাইয়ানের মস্তিষ্ক স্পর্শ করতে পারল না। তার কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো বাক্যই আসছে না৷ তার বাবা মরেও নিজেকে এতটা অসহায় লাগেনি। যতটা অসহায় মুনতাসিমকে রক্তাক্ত হতে দেখে লাগছে। তাইয়ানের নিরবতা মেহেভীনের হৃদস্পন্দনের গতিতে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভেতরটা অদ্ভুত ভাবে হুঁ হুঁ করে উঠছে। কায়ার সমস্ত শক্তি শুষে নিচ্ছে একদল চিন্তা। তাইয়ান নিজের মনকে শক্ত করে নিল। সে মলিন কণ্ঠে বলল,

–স্যার এক্সিডেন্ট করেছে ম্যাডাম। আমরা স্যারকে হসপিটালে নিয়ে আসছি। স্যারের অবস্থা খুব একটা ভালো না। ডক্টররা বলছে যেকোনো সময় স্যার মারা যেতে পারে। স্যারের কায়া থেকে প্রচুর রক্ত বেড়িয়েছে। আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত সংগ্রহ করতে পারছি না। আমি একা একা ভেঙে পড়ছি। আমার নিজেকে ভিষণ ক্লান্ত লাগছে। আপনারা সবাই আসুন না। আপনি বড় স্যারকে খবরটা দিন। বড় স্যার জানলে কিছুতেই ঘরের কোণে বসে থাকতে পারবে না। ধরনীর বুকে হুলস্থুল লাগিয়ে দিবে। তাইয়ানের বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই মেহেভীন হৃদয়বিদারক চিৎকার দিয়ে উঠল। মেহেভীনের চিৎকারে চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল কাঁপে উঠল। গার্ডরা দৌড়ে মেহেভীনের কক্ষে এল। চারদিকে কোলাহল সৃষ্টি হলো। ততক্ষণে সকলের নিদ্রা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। সবাই বিরক্তি মাখা মুখশ্রী করে মেহেভীনের কক্ষ এল। ফজরের আজান কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাচ্ছে। মেহেভীন দৌড়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। মেহেভীনের এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে সবাই বিরক্ত হলো। তখনই রিয়াদ চৌধুরীর মুঠোফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা কর্ণে ধরতেই কিছু বিষাক্ত বাক্য এসে ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। চৌধুরী বাড়িতে প্রতিটি আঙ্গিনা তিক্ততায় রুপ নিল। রিয়াদ চৌধুরীর মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। বুদ্ধিরা অকেজো হয়ে গিয়েছে। সে অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়েছে। তারা বিলম্ব না করে দ্রুত হসপিটালের উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়ল।

রজনীর শীতল হাওয়া এসে মেহেভীনকে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ রজনী কায়াকে শীতল করতে পারলেও উত্তপ্ত হৃদয়কে শীতল করতে পারছে না। ভেতরটা প্রিয়জন হারানোর ভয়ে হাহাকার করে উঠছে। সময় যে আজ ভিষণ পাষাণ হয়ে গিয়েছে। এতটুকু পথ তবুও যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। বিপদের পথ গুলো এত দীর্ঘ হয় কেন? দুঃখ গুলো এত অপেক্ষা করায় কেন? খারাপ সময়টা কিছুতেই সামনের দিকে দ্রুত এগিয়ে যায় না। ধীরে ধীরে সামনের দিকে আগায় তবুও পোড়াতে পোড়াতে নিয়ে যায়! হসপিটালের মধ্যে প্রবেশ করতেই তাইয়ান সহ আরো কিছু গার্ডদের দেখা গেল। তারা এতটুকু সময়ের জন্য আইসিইউর সামনে থেকে সরেনি। রিয়াদ চৌধুরীকে দেখেই তাইয়ান এগিয়ে আসলো। তাইয়ান উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

–আরো দুই ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন স্যার। আমরা রাতে দু’ব্যাগ জোগাড় করেছি। আর কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আপনার পরিচিত কেউ থাকলে ফোন দিয়ে আসতে বলুন। রিয়াদ চৌধুরীর মুখভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে না। সে কতটা আঘাত হয়েছে। সমস্ত মুখশ্রীতে গম্ভীরতা বিদ্যমান। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–তুমি চিন্তা করো না। আমি দু’জনকে বলেছি। তারা আসছে। তারা দু’জন সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ। রিয়াদ চৌধুরীর কথায় শান্ত হলো তাইয়ান। মুনতাসিমকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। একটু পর পর মুনতাসিমের অবস্থা এক একেক রকম হচ্ছে। তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে। শব্দ যেন প্রতিটি মানুষের মুখশ্রী থেকে হারিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ করে মেহেভীনের হৃদয়টা বলে উঠল, “ধৈর্য কি জানেন? হৃদয়টা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ার পরও আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল করে কষ্টের বিনিময়ে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা। মেহেভীনের হৃদয়টা কড়া করে বলছে। রবের কাছে গিয়ে হাত তুলো। সবাই তোমাকে নিরাশ করলে-ও তোমার রব তোমাকে নিরাশ করবে না। তোমার রব খুব শীঘ্রই তোমার সকল দুঃখ মোচন করে দিবে। মেহেভীনে আশেপাশে নার্সদের খুঁজতে শুরু করল। কিছু সময় যাবার পরেই সাদা এপ্রন পড়া একটা নার্স ইনজেকশন হাতে আইসিইউর দিকে এগিয়ে আসছে। মেহেভীন তাকে দেখে আহত কণ্ঠে বলল,

–আপনাদের হসপিটালের নামাজের ঘর আছে?

–জি ম্যাডাম আছে। আপনি নামাজ পড়বেন। চলুন আমি আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি। মেহেভীনকে ম্যাডাম সম্মোধন করায় মেহেভীনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মলিন মুখশ্রী নিয়ে নার্সকে একবার পর্যবেক্ষণ করে নিল। মেহেভীন অজু করে এসে নামাজ আদায় করে নিল। মোনাজাতে এসে মেহেভীনের দমিয়ে রাখা অশ্রুকণা গুলো বাঁধ ভেঙে বেড়িয়ে আসলো। ভেতরটা ভিষণ জ্বলছে। অসহনীয় যন্ত্রনায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে সে। মুনতাসিমের সর্বোচ্চ ভালো সে বিধাতার কাছে চাইল। মানুষটাকে ছাড়া যে সে একদম নিঃস্ব! ধরনীর বুকে আপন বলতে এই মানুষটাই আছে তার। এই মানুষটা থাকবে না ভাবতেই বুকটা খালি খালি লাগছে। মেহেভীনের আঁখিযুগল ফুলে গিয়েছে। মেহেভীনের রক্তিম আঁখিযুগলের দিকে দৃষ্টি যেতেই তাইয়ানের ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে গেল। দু’জন মানুষ দু’জনকে কতটা ভালোবাসে, কিন্তু পরিস্থিতি কিছুতেই দু’জনকে সুখী থাকতে দিচ্ছে না। তাইয়ানের পরিস্থিতির ওপর ভিষণ রাগ হচ্ছে। তার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে সে পরিস্থিতিকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিত।

কক্ষের সমস্ত আসবাবপত্র চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলছে জাফর ইকবাল। হেরে যাওয়ার ক্রোধ সমস্ত কায়াকে উত্তপ্ত করে তুলছে। সে পরপর কয়েকবার ভয়ংকর রকমের গর্জন করে উঠল। তার গর্জনে প্রতিটি গার্ডের হৃদয় কেঁপে উঠল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণের আনা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। হাত কে’টে রক্ত স্রোতের ন্যায় গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–কু’ত্তা’র বাচ্চাকে ডেকে নিয়ে আয়। আজকে আমার হাতেই খু’ন হবে। সে এতবড় দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। তাহলে তাকে দায়িত্ব নিতে কে বলেছিল? তোদের স্পষ্ট ভাবে বলেছিলাম। মুনতাসিম যেন হসপিটাল পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে। এক্সিডেন্ট হবার সাথে সাথে যেন দেহ থেকে প্রাণ পাখিটা দেহ থেকে উড়াল দেয়। তবুও মুনতাসিম কিভাবে বেঁচে গেল? জা’নো’য়া’রে’র বাচ্চা গুলো আমার মুখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা। ঐ তিন কু’ত্তা’র বাচ্চাকে আমার সামনে এখন এই মুহূর্তে হাজির কর। জাফর ইকবালের গর্জনে গার্ড গুলো থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। সায়ান আঁখিযুগল দিয়ে ইশারা করতেই সবাই কক্ষ ত্যাগ করল। তারা যেতেই তিন ট্রাক ড্রাইভারদের কক্ষে নিয়ে আসা হলো। জাফর ইকবাল শান্ত কণ্ঠে বলল,

–তোদের আমি এমনি এমনি টাকা দিয়েছিলাম। কাজ করতে পারিস না। তাহলে আমার কাজ করতে এসেছিলি কেন? তোদের জন্য এত দিনের সব পরিকল্পনা মুহূর্তের মধ্যে তচনচ হয়ে গেল। তোদের কে’টে পি’স পি’স করে কুকুরকে দিয়ে খাওয়াব আমি। কথা বলছিস না কেন জা’নো’য়া’রের বাচ্চা গুলো। কথা বল না হলে তোদের জ্যান্ত পুঁ’তে ফেলব। জাফর ইকবালের প্রতিটি বাক্য তিন জনকে ভয়ে কাবু করে ফেলল। একজন কম্পন মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

–আমরা উনাকে মেরেই ফেলতাম। আমরা উনার কাছে পৌঁছানোর আগেই উনার গার্ড এসে তাকে ঘিরে ফেলে। সেখানে থেকে যদি আমরা না পালাতাম। তাহলে ওরা আমাদের ধরে ফেলত। ড্রাইভারের কথায় জাফর ইকবালের কোনো ভাবান্তর হলো না। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–মুনতাসিম বেঁচে গেল কিভাবে?

–আসলে উনি গাড়ি থেকে লাফ দিতে চেয়েছিলেন। আমরা দ্রুত সামনে চলে আসায় আর পারেনি। উনি লাফ দিতে যাবে। তখনই উনি সিটকে এসে আমাদের ট্রাকের সাথে বাড়ি খায় এবং মাটিতে পড়ে যায়। উনি আবার উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমরা তাকে আবার ধাক্কা দিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলি। তিনি যেভাবে পড়ছিলেন। আমরা ভেবেছি উনি মারা গিয়েছে। উনার যে অবস্থা আমরা দেখেছি বাঁচার কোনো সম্ভবনাই ছিল না।

–আগে যদি জানতাম তোরা এতটা কাঁচা খেলোয়াড়। তাহলে কখনোই তোদের এড বড় দায়িত্ব দিতাম না৷ আমাকে পুতুল খেলার গল্প শোনাচ্ছিস? যেভাবে ধাক্কা দিয়েছিস। সেই ধাক্কায় একটা মুরগীও মরবে না। আমি তোদের শেখাচ্ছি কিভাবে মা’র’তে হয়। বাক্য গুলো শেষ করেই সায়ানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল জাফর ইকবাল। সায়ান বন্দুক এগিয়ে দিতেই পরপর ছয়টা গুলি তিনজনের বুক ছিদ্র করে দিল। তিনজন গলা কাটা মুরগীর ন্যায় ছটফট করছে। রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে জাফর ইকবালের কক্ষ জুড়ে।

সূর্যের রশ্মি ধরনীর বুকে আঁচড়ে পড়ছে। সোনালি আলোয় মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। রজনীর নিস্তব্ধ হসপিটাল কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়েছে। মুনতাসিমের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। ডক্টর বলেছে আটচল্লিশ ঘন্টা না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছে না। সবাইকে মলিনতা গ্রাস করে ফেলছে। একটি ভালো বার্তার আশায় সবাই চাতক পাখির ন্যায় বসে আছে। রিয়াদ চৌধুরীর মেহেভীনের দিকে দৃষ্টি যেতেই মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠল। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–এবার তোমার শান্তি হয়েছে মেহেভীন? একদিন রাগ করে বলেছিলাম। আমার ছেলেকে খেয়ে তোমার শান্তি হবে। তুমি সত্যি সত্যি আমার রাগটাকে প্রতিশোধ হিসেবে ধরে নিলে? তুমি আমার ছেলের জীবনে না আসলে আমার ছেলের এই অবস্থা হত না। ধৈর্য যখন বাঁধ ভেঙে যায় মস্তিষ্ক তখন ভদ্রতা ভুলে যায়। হঠাৎ করেই মেহেভীনের মুখভঙ্গি ক্রোধে রুপ নিল। তার সহ্য সীমা পরে হয়ে গিয়েছে। একটু সুখের আশায় কত কিছুই সহ্য করে নিল। দিনশেষে তার বুকেই ছুরি চালানো হলো! সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমি যদি বলি আপনার ছেলের অবস্থার জন্য আপনি দায়ী। তখন আপনি কি করবেন আব্বা? কাল রাতে আপনি আমাদের কক্ষে না আসলে মুনতাসিমকে আমি কিছুতেই কক্ষের বাহিরে যেতে দিতাম না। আমি তার ক্রোধ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি কি করলেন উত্তপ্ত আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন। কালকে আপনার পা ধরা বাকি ছিল আব্বা। কতবার করে বলেছিলাম। উনাকে যেতে দিয়েন না। উনি ভয়ংকর রকমের রেগে আছে। আমি হয়তো আপনার থেকে আপনার ছেলেকে কম চিনি। কিন্তু তার মনে কি চলছে। এই কয়দিনে সেটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার হয়েছে। আপনি আমায় ভালোবাসেন না কেন আব্বা? আমার ভালোবাসলে কি আমার ভালোবাসায় ঘাটতি পড়ে যাবে। আপনাদের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য কত তিক্ত কথাই না সহ্য করলাম। তবু্ও আপনাদের মন পেলাম না। আপনার মেয়ে রাত করে বাড়ি ফিরে বলাতে আমি খারাপ হয়ে গেলাম। আপনার ছেলের এক্সিডেন্ট হলো এতেও আমার দোষ! আপনি বাবা হয়ে কেন ছেলেকে আঁটকে রাখলেন না। আপনার এক ছেলে আরেক ছেলেকে প্রতিনিয়ত খু’ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এতেও আমার দোষ! আপনি নিজের সন্তানদের কোনো দোষই দেখছেন না। তাদের সব রাগ আমার উপর ঝারছেন। কেন আমি পরের মেয়ে বলে তাই? মুনতাসিম আপনার প্রাণ প্রিয় ছেলেকে মে’রে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। তাই আপনার হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। আর আপনি বাবা হয়ে ছেলের সংসার ভাঙতে বলেছেন। আপনার ছেলের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বাড়বে না। আপনি আমার আব্বা না বলেই আপনি আমার সব কাজে দোষ দেখতে পান। আব্বা জানেন আমার বাবাও আমার ভুলগুলো আপনার মতো করে আড়াল করে দিত। আপনি মুনতাসিমকে রক্তাক্ত করে না দিয়ে নিজের মেয়েকে শাসন করলে আপনাকে এই দিন দেখতে হত না। আপনার ভালোবাসায় আমি খাদ দেখতে পাচ্ছি আব্বা। আমার মনে হয় আপনার চোখের বি’ষ আমি নয়, মুনতাসিম। আমার মাধ্যমে মুনতাসিমকে আঘাত না করে একবারে মেরে ফেলুন। মেহেভীনের কথায় রিয়াদ চৌধুরীর অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। সে বিস্ময় নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে! মেহেভীন এতকিছু কিভাবে জানল? হঠাৎ করে দুশ্চিন্তা মস্তিষ্ককে গ্রাস করে ফেলল। সাহেলা চৌধুরী তাচ্ছিল্য করে বলল,

–কি চৌধুরী সাহেব খুব কষ্ট হচ্ছে? এই মেয়েটার মতো করে যদি আমিও বলতে পারতাম। তাহলে আমার সন্তান গুলো সমান সামান বাবার ভালোবাসা পেত। আপনাদের পরের ছেলের এই একটা অভ্যাস সব দোষ হচ্ছে পরের বাড়ির মেয়ের। কাল রাতে আপনাকে যেতে নিষেধ করেছিলাম। তবুও আপনি গিয়েছিলেন। ছেলেটাকে রাগালেন। ছেলেটা গৃহ ত্যাগ করল। তার ক্ষতি হলো। এখন সব দোষ বাড়ির বউয়ের! আপনার নয় কেন চৌধুরী সাহেব? রিয়াদ চৌধুরীর মস্তক নুইয়ে গেল। বুকের মধ্যে চিনচিন করে ব্যথা করছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যথাটা তীব্র হতে শুরু করেছে। তখনই মুনতাসিমের আইসিইউর ওয়ার্নিং বেলটা বেজে উঠল। তার শব্দে হসপিটাল মুখরিত হয়ে গেল। সে উচ্চ শব্দে জানান দিচ্ছে রোগীর দেহ থেকে প্রাণ পাখিটা বের আসার সময় চলে এসেছে। ওয়ার্নিং বেল বাজতেই ডক্টর, নার্স প্রাণপণে আইসিইউর দিকে ছুটে চলেছে। কারো হাতে ইলেকট্রনিক শক, কারো হাতে আরো একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার, কারো হাতে ইনজেকশন নিয়ে ঝড়ের গতিতে আইসিইউর দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। ওয়ার্নিং বেল অনবরত বেজেই চলেছে। ডক্টর নার্সকে দ্রুত ইলেকট্রনিক শকটা এগিয়ে দিতে বলল। সে ইলেকট্রনিকস শক হাতে নিয়েই মুনতািসমের বুকে চেপে উঠল। কয়েকবার দেওয়ার পরই মুনতাসিম রেসপন্স করা ছেড়ে দিল। মুহুর্তের মধ্যে আইসিইউ জুড়ে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সময়! তবে কি ভালোবাসার বিপরীতে গিয়ে সময়ের স্রোত বাধাগ্রস্ত হলো? প্রনয়ণের হাওয়া সময়কে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছে। প্রিয়জনকে তার মায়াবিনীর ফিরিয়ে দিতেই হবে, তবেই তার মুক্তি। বাহির পুড়লে মানুষ দেখতে পায় ভেতর পুড়লে দেখতে পায় না কেন? প্রতিটি মুহুর্তে দম আঁটকে আসছে মেহেভীনের। এই বুঝি দেহ থেকে প্রাণ পাখিটা উড়াল দিবে। সমস্ত কায়া নিস্তেজ হয়ে আসতে শুরু করেছে। কায়ার সমস্ত হাড় গুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবার মতো ব্যথা অনুভব করছে সে। ডক্টররা হাল ছেড়েই দিয়েছে। আইসিইউর প্রতিটি মানুষের মুখশ্রীতে অমাবস্যার আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। ডক্টর শেষ বারের মতো মুনতাসিমের বুকে তাপ দিতেই মুনতাসিমের জোরে শ্বাস দেওয়ার শব্দে খুশির আলোড়ন ছড়িয়ে পড়লো। তারা আবার ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পরে ডক্টরের মুখশ্রী দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এল, “আলহামদুলিল্লাহ।”

প্রভাত যেমন জমিনের বুকে ছড়িয়ে পড়েছে। সূর্য তার কিরণ দিয়ে ধরনীকে করেছে আলোকিত। ঠিক তেমনই প্রভাতের নতুন আলোর সাথে নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছে মুনতাসিম। চারদিন পর জ্ঞান আসলো তার। আঁখিযুগল মেলে তাকাতেই চারপাশ ঝাপসা লাগছে। কিছু সময়ের ব্যবধানে স্পষ্ট হতে শুরু করল চারপাশ। সমস্ত কায়া ব্যথায় জর্জরিত হয়ে আছে। বাহির থেকে কোলাহলে কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাচ্ছে। মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রীতে মলিনতা এসে ধরা দিয়েছে। সে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো স্মরন করতে লাগল। হঠাৎ করেই সমস্ত চিন্তাধারা থমকে গেল। মনের গহীনে থেকে কিছু বাক্য মস্তিষ্কে এসে বাজছে। আমার কেউ ছিল না। আমার কেউ নেই। আমি একান্তই আমার নিজের আমি কারো না। কিন্তু পাষাণ মন প্রেয়সীকে দেখার জন্য অশান্ত সমুদ্রের ন্যায় উথাল-পাতাল করছে। নিজেকে দমানো গেলেও অবাধ্য মনকে দমানো যাচ্ছে না। মস্তিষ্ক অদ্ভুত ভাবে বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। মুনতাসিম কাউকে ডাকল না। সে নিষ্পলক চাহনিতে স্থির হয়ে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে।

–স্যার আপনার জ্ঞান ফিরেছে? সাদা এপ্রন পড়া নার্সের বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই মুনতাসিম আঁখিযুগল বন্ধ করে ফেলল। মুনতাসিমের নিস্তব্ধতার কারণ খুঁজে পেল না নার্সটি। অন্যান্য রোগীদের তুলনায় মুনতাসিমকে বেশ অদ্ভুত লাগল! যেখানে মানুষ সুস্থ হয়ে প্রিয়জনদের দেখায় তৃষ্ণায় কাতর থাকে, সেখানে মুনতাসিম কিভাবে এতটা নির্বাক হয়ে আছে? নার্স দ্রুত কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। চাকত পাখি যেমন বৃষ্টি পেলে প্রানবন্ত হয়ে উঠে, ঠিক তেমনই মুনতাসিমের জ্ঞান ফেরার খবর কর্ণকুহরে আসতেই সকলের মুখশ্রীতে প্রাণবন্ত হাসির রেখার দেখা মিলল। রিয়াদ চৌধুরী দ্রুত ছেলের কেবিনে গেল। বাবাকে দেখেই মুখশ্রী ঘুরিয়ে নিল মুনতাসিম। রিয়াদ চৌধুরী কোমল কণ্ঠে বলল,

–কেমন আছিস বাবা? বাবার প্রতিটি বাক্য বিষাক্ত শোনালো মুনতাসিমের কাছে। সে নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,

–কেন এসেছেন? আপনাকে না বলেছি। আমি মরে গেলে-ও আমার লা’শে’র কাছে আপনি আসবেন না। উচ্চ স্বরে কথা গুলো বলতে গিয়ে মস্তিষ্কে কঠিন ভাবে চাপ লাগল। চারপাশে আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করল। মুনতাসিম ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টি যেতেই ডক্টর রিয়াদ চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–আপনি এখনই কেবিন থেকে বের হয়ে যান স্যার। উনার মস্তকে ভিষণ বাজে ভাবে আঘাত লেগেছে। এখন যদি উনার মস্তকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাহলে মস্তিষ্কে হঠাৎ করে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা রক্তক্ষরণ দেখা দিতে পারে। এতে রোগীর প্রতিটি মস্তিষ্কের কোষগুলি কাজ করা বন্ধ করতে বা মারা যেতে পারে। যখন মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষগুলি মারা যায়, তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা শরীরের অঙ্গগুলির কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা হারিয়ে যায়। এতে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। আপনাকে আমি কি বোঝাতে পেরেছি চৌধুরী সাহেব? রিয়াদ চৌধুরী কোনো বাক্য উচ্চারণ না করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। ছেলের বিধস্ত মুখশ্রী ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দগ্ধ করে দিচ্ছে। মুনতাসিমের কাছে শুধু তাইয়ানকে আসার অনুমতি দিল মুনতাসিম। তাইয়ান ব্যতিত অন্য কেউ প্রবেশ করলে ফলাফল ভয়ংকর রকমের হবে। মুনতাসিমের কথা মতো ডক্টর সবাইকে তার কেবিনে যেতে নিষেধ করেছে। তাইয়ান শুকনো মুখশ্রী করে মুনতাসিমে পাশে বসল। মুনতাসিমকে দেখে তার উত্তপ্ত হৃদয় মুহুর্তের মধ্যে শীতল হয়ে গেল। তাইয়ানের দিকে দৃষ্টি যেতেই মুনতাসিম মলিন হাসলো। তাইয়ান অভিমানের সুরে বলল,

–আপনি ভিষন স্বার্থপর স্যার। আমি আপনাকে বলেছিলাম। আপনার সাথে আমার জীবন জড়িয়ে আছে। তাই বাঁচতে হলে আপনার সাথে বাঁচব। আর ধরনীর মায়া ত্যাগ করতে হলে দু’জন একসাথে করব। তবে কেন আমার সাথে বেইমানি করলেন স্যার?

–তাইয়ান তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী বা প্রেমিকা নও! এভাবে কথা বলছ কেন? আমি তোমার সাথে প্রেম করে ধোঁকা দিয়েছি নাকি! পুরুষ মানুষের মতো কথা বলো। আমাকে দেখে তোমার লেসবিয়ান মনে হয়? মুনতাসিমের কথায় লজ্জা পেল তাইয়ান। ধরনীর বুকে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে এই মানুষটাকে বোঝা। কণ্ঠনালিতে এসে বাক্য গুলো বেঁধে যাচ্ছে। তবুও তার রসিকতার শেষ নেই। এই মানুষ টাই তার অনুপ্রেরণা। মৃত্যুর সন্নিকটে গিয়ে ফিরে এসেও নিজেকে কিভাবে শক্ত রাখতে হয়। সেটা এই মানুষটাকে দেখে শেখা উচিৎ। তাইয়ানের মনটা ভালো হয়ে গেল। হঠাৎ করেই মস্তিষ্ক ফুরফুরে হয়ে উঠল। অনুভূতিরা আনন্দে মিছিল করছে। তাইয়ান নিম্ন কণ্ঠে বলল,

–আপনি অনুমতি দিলে ম্যাডামকে নিয়ে আসি স্যার? আপনি বোধহয় ম্যাডামের অপেক্ষায় আছেন। তাইয়ানের বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই মুনতাসিমের মুখশ্রীতে শত জনমের আকুলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। আঁখিযুগলে প্রেয়সীকে দেখার তৃষ্ণা কণ্ঠে একরাশ ক্রোধ নিয়ে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিমের শীতল দৃষ্টি তাইয়ানের মস্তক নুইয়ে ফেলল। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমার জীবনের বারবার মৃত্যু আসুক তাইয়ান। তবু আর কখনো ভালোবাসা না আসুক। কোনো স্বার্থপর নারীর মুখ আমি দেখতে চাই না। আমাকে দেখার অনুমতি যদি হারাতে না চাও। তবে এ বাক্য আমার সামনে দ্বিতীয় বার উচ্চারন করবে না। এবার তুমি চলে যাও। আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছে। তাইয়ান বিলম্ব করল না। দ্রুত কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। তাইয়ান একটা রাগান্বিত মানুষকে দেখে গেল। কিন্তু একটা পিপাসিত হৃদয় প্রেয়সীকে দেখার তৃষ্ণায় শতবার মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করছে। সেটা তাইয়ান দেখল না। দেখলে কখনো এভাবে চলে যেত না। মানুষটাকে রক্তাক্ত হওয়া থেকে বাঁচাতে তার প্রেয়সীকে মানুষটার সামনে হাজির করত।

অভিমান অভিযোগের খেলা খেলতে খেলতে কে’টে গিয়েছে দেড় মাস। মস্তিষ্কে অভিমান হৃদয়ে এক গুচ্ছ ভালোবাসা। এই নিয়েই চলছে দু’জনের প্রণয়ের খেলা। যে মানুষটার মুখ দেখতেও নারাজ সেই মানুষটাকে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার অনুভূতিটা ভয়ংকর রকমের সুন্দর। আবার যে মানুষটা মুখ দেখবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। রজনীর মধ্য প্রহরের নিদ্রায় বিভোর থাকা সেই মানুষটাকে দেখার অনুভূতিটা পরম শান্তির। মান-অভিমানের আড়ালে লুকোচুরির ভালোবাসা গুলো একটু বেশিই সুন্দর। মুনতাসিম পাঁচ দিন হলো বাড়ি ফিরেছে। ডক্টর তাকে দু’মাস থাকতে বলেছিল। কিন্তু মুনতাসিম বলেছে সে থাকবে না। তাকে ধরে রাখার সধ্যি কার আছে? মেহেভীনের মুখ দেখতে চায় না বিধায় মেহেভীনকে অন্য কক্ষে থাকতে হচ্ছে। রজনী মধ্য প্রহর চলছে। সবাই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে। ঘুম নেই শুধু মেহেভীনের আঁখিযুগলে। কারন রজনীর মধ্য প্রহরেই তার প্রিয় মানুষটিকে দেখার সুযোগ মিলে। তাকে কারো কড়া বাক্য শুনতে হয় না। শখের মানুষের পাশে কিছু সময় শান্তিতে বসে থাকতে পারে। কি অদ্ভুত তাই না মেহেভীন রোজ রজনীর মধ্য প্রহরের মুনতাসিমে দেখতে যায়। গিয়ে মুনতাসিমের কবাট খোলা পায়। মায়াময়ী কি জানে না তার আগ্রহে কেউ নিদ্রাহীন রজনী পার করে। সে আসবে বলেই কবাট খোলা থাকে। সে কি চাইলে পারে না নিজের অধিকার টুকু ছিনিয়ে নিতে! তার অধিকার আজ-ও তারই আছে। সে চাইলেই নিজের অধিকারটুকু ফলাতে পারে। তার অধিকার একটা মানুষের মন গলিয়ে দিতে পারে। অভিমানের শক্ত আবরণ ভালোবাসার শক্তি দিয়ে ভেঙে ফেলতে পারে। কিন্তু পাষাণী মন বুঝে না। সে শুধু জানে ভুল বুঝতে আর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বাড়াতে।

মেহেভীনে মুনতাসিমের অবাধ্য কেশগুলোতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঘুমন্ত মুনতাসিমকে ভিষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। মনটা ভিষণ অসভ্য হয়ে উঠেছে। এই মাঝ রাতে প্রিয়তমকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নিজের ইচ্ছেটাকে দমালো না মেহেভীন। খুব সাবধানতা অবলম্বন করে মুনতাসিমের ললাটে অধর ছোঁয়াল মেহেভীন। মেহেভীনের উষ্ণ ছোঁয়াতে মুনতাসিমের ভেতরে উথাল-পাতাল শুরু করে দিল। অন্যদিন মেহেভীন আসে চুপচাপ বসে থাকে কিছুক্ষণ চলে যায়। কিন্তু আজ যে এমন অকল্পনীয় কিছু করে ফেলবে। তা মুনতাসিমের চিন্তাধারার বাহিয়ে ছিল। আচমকা মুনতাসিম আঁখিযুগল মেলে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করল। হঠাৎ মুনতসিম সজাগ হওয়ায় মেহেভীনের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ বেড়ে গেল। হৃদয়টা অশান্ত হয়ে কেমন ধড়ফড় করছে। চোর যেমন ধরা পড়লে বুদ্ধি কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসে ঠিক তেমনই মেহেভীনের সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসতে শুরু করেছে। লজ্জায় সমস্ত মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। মুনতাসিমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত কক্ষ থেকে বেড়িয়ে গেল। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে।

চারিদকে প্রভাতের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। মুনতাসিমের অসুস্থতার খবর পেয়ে রাজনৈতিক দলের বহু নেতা এসে মুনতাসিমের সাথে সাক্ষাৎ করে গিয়েছে। প্রভাতের আলো ফুটতেই কয়েকজন নেতা এসে হাজির হয়েছে। মুনতাসিম তাদের সাথে ভালোমন্দ কথা বলে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিল। তখনই তাহিয়া আর সুফিয়া চৌধুরী গৃহে প্রবেশ করে। তাদের দেখে মুনতাসিমের গম্ভীর মুখশ্রী আরো গম্ভীর হয়ে যায়। মুনতাসিম তাদের সাথে সংক্ষেপে আলোচনা শেষ করে তাদের বিদায় জানালো। তাহিয়া দৌড়ে মুনতাসিমের কাছে আসতে চাইলে মুনতাসিম বিরক্ত হয়ে নিজের কক্ষ চলে গেল। তাহিয়ার সমস্ত মুখশ্রীতে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। তাহিয়া অশ্রুসিক্ত নয়নে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সুফিয়া চৌধুরী মেয়েকে আশ্বাস দিয়ে বলল,

–মুনতাসিম আর মেহেভীনের দুরত্ব আমি ডিভোর্স পর্যন্ত নিয়ে যাব। তুই হবি মুনতাসিমের অর্ধাঙ্গিনী। তুই মায়ের ওপরে ভরসা রাখ ভাগ্যিস দু’জনের দুরত্বের কথা জেনেছিলাম। তাহিয়া কোনো বাক্য উচ্চারন করল না। নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল।

মুনতাসিম নিজের ক্ষত স্থানে মেডিসিন দিচ্ছিল। এক হাতে ব্যথা থাকায় সেই হাত প্রয়োগ করে মেডিসিন দিতে পারছে না। কবাটের আড়াল থেকে মেহেভীন বলল,

–আমি লাগিয়ে দেই?

–না।

–হিজাব মেরে এসেছি মুখ দেখা যাচ্ছে না তো। মেহেভীনের দিকে দৃষ্টি যেতেই মুনতাসিম হতভম্ব হয়ে গেল। সেটা বাহিরে প্রকাশ না করে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–খু’ন করে ফেলব কিন্তু। আমার কক্ষের সামনে থেকে চলে যান।

–খু’ন হতে এসেছি গো মন্ত্রী সাহেব। আমাকে একটু খু’ন করবেন। জীবনে কোনোদিন খু’ন হইনি। একবার খু’ন হয়ে দেখতাম খু’ন হতে কেমন লাগে? বিরক্ততে মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রী কুঁচকে এল। সে কবাট বন্ধ করতে যাবে তখনই মেহেভীন মুনতাসিমের হাত থেকে মেডিসিনটা নিয়ে মুনতাসিমকে দিয়ে দিতে লাগল। মুনতাসিম সরে যেতে চাইলে মেহেভীনের কিছু বাক্য কর্ণে আসতেই স্থির হয়ে গেল সে। মেহেভীন খুব শান্ত কণ্ঠে বলল,

–ভয় নেই খু’ন করতে আসিনি। আপনি আমার মুখ দেখতে চান না। আমিও আমার মুখ আপনাকে দেখাতে চাই না। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি। আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হলেই আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। এতটা দূরে চলে যাব। যতটা দূরে গেলে আমার কথা আপনার আর মনে পড়বে না। কি বিষাক্ত শোনালো কথা গুলো! ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। একরাশ ক্ষোভ তৈরি হলো মেহেভীনের প্রতি। সে মেহেভীনের হাত থেকে মেডিসিনটা নিয়ে ছুরে ফ্লোরে ফেলে দিল। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–যার তার হাতে মেডিসিন নেই না। এখনই আমার কক্ষ থেকে বের না হয়ে গেলে, আমি নিজেই কক্ষ থেকে বের হয়ে যাব। আপনাকে আমার বিষাক্ত লাগে এটা আপনি বুঝেন না। আমি আপনাকে ইগনোর করে চলছি। সেটা আপনি দেখতে পাচ্ছে না। আপনি কিসের আশায় এখানে পড়ে আছেন? আপনি ভাববেন না। আপনার সাথে কথা বলছি মানেই আপনার সব ভুলগুলো ক্ষমা করে দিয়েছি। যেখানে আমি আপনাকে চাইছি না। সেখানে এ বাড়িতে থাকা আপনার মূল্যহীন। চলে কেন যাচ্ছেন না? আপনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যান। আমাকে মুক্তি দিয়ে যান। এবার আপনার শান্তি হয়েছে। এ কথা গুলোই শুনতে চেয়েছিলেন। আপনি সর্বদা নির্দোষ থাকতে চেয়েছিলেন। আমাকে দোষী সাবস্ত করতে চেয়েছিলেন। আমি আপনার মনে ইচ্ছে পূর্ণ করে দিলাম। সব গল্পে আপনিই শ্রেষ্ঠ চরিত্র হিসেবে থাকুন। গল্পের মূল্যহীন আর নিকৃষ্ট চরিত্রটা না হয় আমি হলাম। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম বেলকনিতে চলে গেল। মেহেভীন কেমন দম বন্ধ লাগছে। বুকের মধ্যে ব্যথা করছে। মস্তক থেকে হিজাব খুলে ফেলল সে। মুনতাসিমের আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। নিজের বলা বাক্য গুলো এখন নিজেকেই ভিষণ পোড়াচ্ছে। কাউকে কড়া বাক্য শুনিয়েও শান্তি নেই। কাউকে বলার পরে কড়া বাক্য গুলো পরক্ষনে নিজেকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। মুনতাসিমের ভাবনার মাঝেই এক জোড়া কোমল হাত মুনতাসিমকে পেছনে থেকে আলিঙ্গন করল। সে সক্ষম হয়েছে। মেয়েটাকে কাঁদাতে চেয়েছিল মেয়েটাকে কাঁদছে। কি অদ্ভুত যে মানুষটা তাকে আঘাত দিল! সে মানুষটাকেই আলিঙ্গন করে কষ্ট মোচন করার প্রয়াস চালাচ্ছে। মেহেভীন কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

–আপনি মানিয়ে নিবেন বলেই আমি রাগ করি। আপনি শুধরে দিবেন বলেই ভুল করি। আপনি সহ্য করবেন বলেই আঘাত করে ফেলি। আপনি গুছিয়ে দিবেন বলেই আমি বারবার এলোমেলো হয়ে যাই। আপনি ছেড়ে যাবেন না বলেই আপনাকে এত বিরক্ত করি। আমাকে আঘাত করবেন না বলেই আপনার অপছন্দের কাজ করি। তবুও দিনশেষে এটাই ভাবি আপনি শুধুই আমার। সেই আপনি টাই যদি আমার না থাকেন। তাহলে এখানে থাকাটা আমার মূল্যহীন। আপনি তো আমায় অনেক সহ্য করলেন। আর কয়টা দিন করুন। আমি খুব বেশিদিন আপনার বিরক্তির কারন হব না। আপনি সুস্থ হলেই আমি চলে যাব। আমার ছায়াও আপনার আশেপাশে পড়তে দিব না। মেহেভীনের প্রতিটি বাক্য মুনতাসিমের মস্তিস্ক উত্তপ্ত করে দিল। সে তাচ্ছিল্য করে বলল, “ধুর বোকা মেয়ে খু’ন করার পর খু’নি’রা কি লা’শে’র জন্য কাঁদে নাকি!” মুনতািসমের কথায় কিছু সময়ের মেহেভীনের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ থেমে গেল। পরিবেশ জুড়ে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরলো। প্রকৃতি দেখল একজনের বাহির পুড়ছে আরেকজনের ভেতর পুড়ছে। প্রকৃতির যদি বলার ক্ষমতা থাকতো। তাহলে সে মেহেভীনকে চেঁচিয়ে বলত। ও নিষ্ঠুর রমনী পাষান মনের অধিকারীনি ভালোবাসার কাঙ্গাল ছেলে টার থেকে ভালোবাসা কেঁড়ে নিয়ে তাকে নিঃস্ব করে দিও না।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫৭
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সময় ধারার সাথে সন্ধি করে তাল মিলিয়ে গড়িয়ে যায়। চারদিক আমের মুকুলে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। শিমুল তার সৌন্দর্য দিয়ে ধরনীরকে করেছে মনোমুগ্ধকর। শিমুলের মুগ্ধতায় হৃদয়ের গহীনে প্রণয়ের হাওয়া বইছে। শিমুন ফুল যেমন তার সৌন্দর্য দিয়ে অন্যকে আকর্ষিত করছে। ঠিক তেমনই মুনতাসিমের সুস্থতা মেহেভীনকে গৃহ ত্যাগ করার আহবান জানাচ্ছে। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত রৌদ্রের মতো হৃদয়টা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গ্রীষ্মের রৌদ্রের তেজ যেমন জমিন ফাটিয়ে দেয়। ঠিক তেমনই কারো হৃদয়টাও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় । সহ্য সীমা আগের ন্যায় বেড়ে গিয়েছে মেহেভীনের। সে কথায় কথায় বিষন্ন হয়ে উঠে না। মলিনতা এসে তার মুখশ্রীতে ধরা দেয় না। আঁখিযুগলে অশ্রু এসে জমা হয় না। আঘাত মানুষকে শক্ত করে, শক্ত করে মানুষের কোমল হৃদয়টাকে। মাঝে মাঝে শখের পুরুষকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ভেতরটা হাহাকার করে উঠে। দম বন্ধ হয়ে আসে। চুপচাপ হৃদয়ের দহনে পুড়তে হয়। কি বিশ্রী এক অনুভূতি, না বাঁচতে দেয় না মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে দেয়!

কারো চরণের পদধ্বনি কর্ণকুহরে এসে বাড়ি খেতেই মুনতাসিমের থেকে দুরত্বে এসে অবস্থান করল মেহেভীন। আঁখিযুগলে শুকিয়ে আসা শেষ অশ্রুটুকু আদুরে হাতে মুছে নিল। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। চেহারায় বিষন্নতা ফুটে উঠেছে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটছে। তখনই গম্ভীর মুখশ্রী করে রিয়াদ চৌধুরী কক্ষে প্রবেশ করে। মেহেভীনকে উদ্দেশ্য করে কোমল কণ্ঠে বলল,

–তুমি কি চাও মেহেভীন আমি তোমার সাথে কঠিন আচরণ করি? তোমাকে কতবার বলেছি! মুনতাসিমের মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। সে তোমার সঙ্গ এখন চাইছে না৷ তবুও কেন বারবার ওকে উত্তেজিত করতে আসো? দেখো মা তুমি যেমন আমার মেয়ে, মুনতাসিমও আমার ছেলে। তোমার একার ভালো চাইলে তো হবে না। আমার ছেলেটার দিকেও দৃষ্টি দিবে হবে। আমি তোমাকে অনুরোধ করে বলছি। তুমি আর মুনতাসিমের কক্ষে এসো না।

–আর আসব না আব্বা।

–এই নিয়ে কতবার বললে যে আর আসবে না? তুমি প্রতিবারই বলো আসবে না। কিন্তু নিজের শপথ রক্ষা করতে ব্যর্থ তুমি।

–এবার সত্যি বলছি আব্বা। আপনি মিলিয়ে নিয়েন। আমি আর আসব না। কথা গুলো বলেই মেহেভীন সেদিন কক্ষ ত্যাগ করেছিল। আর পিছু ফিরে তাকাইনি। মুনতাসিম সেদিন নির্বাক ছিল। ভুল করেও যদি প্রেয়সীকে একটা ডাক দিত। তাহলে একটা রক্তাক্ত হৃদয় সুস্থ হয়ে উঠত। সব বিষাদকে গ্রাস করে নিয়ে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে দিত মানুষটাকে৷ কিন্তু মানুষটা তাকে ডাকেনি। এই বাড়িতে সে ছাড়া তার অনেক মানুষ আছে। কিন্তু মেহেভীন! মেহেভীনের সে ছাড়া আর কে আছে? মানুষটা তাকে বুঝল না। উল্টো তার জন্য মানুষটা দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে! নিজের আঁখিযুগলে শখের মানুষটার শেষ হয়ে যাওয়া সে কিভাবে দেখবে? দুরত্বের গল্প আপনাকে ছুঁয়ে দেখা হলো না। প্রার্থনা করি এতটা সুখে থাকেন, যতটা সুখে থাকলে আমাকে আর মনে পড়বে না। হঠাৎ হঠাৎ বুকের বা পাশে ব্যথা করে, দম বন্ধ হয়ে আসে, কাউকে বলতে পারি না আমার ভেতরটা মানুষ হারাতে হারাতে শূন্যতার হাহাকারে ডুবে মরে, নিজের ভাগ্যের প্রতি কিছুটা ক্রোধ এবং আক্ষেপ জমা হয়ে রয়েছে। চিন্তাধারা গুলো মস্তিষ্কে বাসা বাঁধতেই বুক ভারি হওয়া একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে গেল। এই মাঝে কেটে গেল কতগুলো দিন, কতগুলো প্রহর, কতগুলো হাহাকারে রাত, প্রভাতের দুঃখ মেশালো শীতল হওয়া। কালকে মেহেভীন চলে যাবে। মনটা বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। মাশরাফি এসে কতবার ডেকে গেল। মেহেভীন এক বাক্য বলে দিল খেতে ইচ্ছে করছে না। সে খাবে না। মেহেভীন আসবে না জেনে মুনতাসিম দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিল। ক্রোধে সমস্ত কায়া জ্বলে উঠল। এত জেদ কিসের মেয়েটার! অশান্ত আঁখিযুগল প্রেয়সীকে দেখার তৃষ্ণায় কাতরে মরছে। আর মানুষটা তাকে পোড়াতে ব্যস্ত! কাছে এসে ভালোবেসে কি বুকে জড়িয়ে নেওয়া যায় না। শুধু পারে রাগ করতে আর ভুল বুঝতে। মুনতাসিম উঠে চলে গেল। সবাই নিস্তব্ধ হয়ে আহার আহরন করতে শুরু করল।

মেহেভীন নিজের প্রয়োজনীয় বস্ত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। তখনই শেহনাজ আসে কক্ষে। শেহনাজের হাতের খাবারের প্লেট। শেহনাজ মেহেভীনের পাশে বসল৷ মুখশ্রীতে মলিনতা ঘিরে ধরেছে। শেহনাজ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,

–তুমি চলে যেও না ভাবি। তুমি থেকে যাও। তুমি যদি ভাইয়ের ক্রোধের ভাষা না বুঝো তাহলে কে বুঝবে? আমি চাই তুমি থেকে যাও। বড় বোনের মতো সেদিন যেমন প্রতিবাদ করেছিলে, সারাজীবন এই ভালোবাসাটা আমি পেতে চাই। যে ভালোবাসা আমাকে সঠিক পথে চালনা করবে।

–তুমি আমার ননদ আর ননদ কখনো বোন হতে পারে না। তুমি রাগ করলেও বলব। সেদিনের পর থেকে তোমাকে আমি ননদ ছাড়া আর কিছুই ভাবি না৷

–তারমানে তুমি চলে যাবে?

–হ্যাঁ।

–তাহলে আমার শেষ একটা ইচ্ছে পূর্ণ করে দাও। আজকে তুমি খাবার টেবিলে আসোনি। তুমি না খেয়ে চলে যাবে। এটা আমার সহ্য হবে না। আজকে আমি তোমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেই। প্লিজ, তুমি না করো না।

–আমার ইচ্ছে নেই। তুমি খাবার নিয়ে যাও। আমি খাব না।

–তুমি না খেলে ভাইও খাবে না। আমি ভাইকে কথা দিয়েছি। তোমাকে খাইয়ে তারপর ভাইয়ের কক্ষে খাবার নিয়ে যাব। ভাইকে কতগুলো ঔষধ খেতে হয় জানো তো। সেগুলো যদি একদিন না খায় ভাইয়ের যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায়। তখন কি করবে ভাবি?

–তুমি খাবার রেখে যাও। আমি খেয়ে নিব। উনাকে গিয়ে বলবে, আমি খেয়েছি।

–না তুমি আমার সামনে খাও। শেহনাজের কথায় মেহেভীন কোনো বাক্য উচ্চারন করল না। সে হাত ধুয়ে এসে খেতে শুরু করল। তখনই মাশরাফি কক্ষে প্রবেশ করল। মেহেভীন কাল চলে যাবে। সেটা মাশরাফি জানে না। সে মেহেভীনের পাশে বসে বলল,

–আমার সামনে পরীক্ষা ভাবি। তুমি তো ম্যাথে ভিষণ দক্ষ। এই কয়টা দিন তুমি আমাকে একটু ম্যাথ দেখিয়ে দিবে। তুমি খেয়ে নাও। আমি খাতা আর বই নিয়ে আসছি। মাশরাফি কথা শেষ করেই উঠে চলে গেল। মেহেভীন কিছু বলার সুযোগ পেল না। শেহনাজ হাসোজ্জল মুখশ্রী করে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীনের খাওয়া শেষ হতে শেহনাজ এক প্রকার প্লেট কেঁড়ে নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করল। শেহনাজ যাওয়ার কিছু সময় পর মেহেভীন অনুভব করল ভেতরটা ভিষণ জ্বালা করছে। সময়ের সাথে যন্ত্রনা প্রকোপ পেতে শুরু করেছে। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। সে কি অসহনীয় যন্ত্রনা! মেহেভীন মৃদুস্বরে মাশরাফি কে ডাকল। কিন্তু তার নিম্ন কণ্ঠে বলা একটা বাক্যও মাশরাফি পর্যন্ত পৌঁছাল না। মেহেভীন উঠে কক্ষের বাহিরে আসার চেষ্টা করল। ততক্ষণে ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কায়াকে কাবু করে ফেলছে। মেহেভীনের মুখশ্রী দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এল, মা। আর কিছু বলার সুযোগ পাইনি মেহেভীন মুহুর্তে মধ্যে জ্ঞান হারালো সে। মাশরাফি বই খাতা নিয়ে এসে মেহেভীন অবচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে আর্তনাদ করতে উঠল। মেহেভীনের মুখশ্রী দিয়ে সাদা বর্ণের কিছু একটা বের হচ্ছে, তা দেখে মাশরাফি চমকে উঠল। সে অস্ফুট স্বরে বলল, বি’ষ! ভাবিকে কে বি’ষ দিল? মাশরাফির আর্তনাদে রিয়াদ চৌধুরী মেহেভীনের কক্ষে এল। মেহেভীনকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে আঁতকে উঠল রিয়াদ চৌধুরী। সে উত্তেজিত হয়ে বলল,

–দ্রুত মুনতাসিমকে ডেকে নিয়ে আসো। আমি গাড়ি বের করতে বলছি। রিয়াদ চৌধুরী হুলস্থুল লাগিয়ে দিল। চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল আতঙ্কে কেঁপে উঠল। মুনতাসিম ল্যাপটপে কিছু একটা করছিল। তখনই মাশরাফি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

–ভাই তাড়াতাড়ি নিচে চলুন। ভাবি বি’ষ খেয়েছে। মাশরাফির বাক্য গুলো কর্ণকুহরে আসতেই হৃদয়টা ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠল মুনতাসিমের। সে ল্যাপটপ ফেলে দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। দৌড়াতে গিয়ে পায়ে ভিষণ ব্যথা অনুভব করল। কায়ার ক্ষত গুলো এখনো পুরোপুরি ভাবে সারেনি। প্রেয়সীর নির্মমতার খবরের কাছে এই ব্যথা অতি নগন্য। মেহেভীনের কক্ষ এসে মেহেভীনের নির্মম অবস্থা দেখে ভেতরটা ব্যথায় কাতরিয়ে উঠল মুনতাসিমের। সে অস্থির হয়ে মেহেভীনের কাছে গেল। মেহেভীনে মস্তক নিজের কোলে তুলে নিয়ে কাতর স্বরে বলল,

–আমি সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে আপনাকে চেয়েছি। আপনি কিছুতেই হারাতে পারেন না। আমি এত সহজে আপনাকে হারাতে দিব না। আমি থাকতে আপনার কিছু হবে না। আব্বা তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করতে বলেন। মেহেভীনের কিছু হয়ে গেলে আমি কিভাবে বাঁচব? কথা গুলো বলতে বলতে নিজের শুভ্র পাঞ্জাবি দিয়ে মেহেভীনের মুখশ্রী মুছে দিল। দ্রুত মেহেভীনকে কোলে তুলে নিয়ে বের হয়ে গেল। মাশরাফিও ভাইয়ের সাথে গেল। যদি কোনো তথ্যের প্রয়োজন হয় তবে সে দিতে পারবে। রিয়াদ চৌধুরী, মুনতাসিম, মাশরাফি চলে যেতেই শেহনাজ ছাঁদে চলে গেল। মুঠোফোনটা বের করে প্রিয়তমকে ফোন নিল। ফোনটা রিসিভ হতেই উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,

–আব্বা আর ভাই দু’জনেই বাসায় নেই। তাইয়ান ঘুমিয়ে আছে। এটাই সুযোগ আমি কি পালাব? অপর পাশে থেকে প্রশান্তির নিঃশ্বাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো। এতদিনের পরিকল্পনা সফল হতে যাচ্ছে। বোকা মেয়েটা জানেও না নিজের অজান্তে নিজের কত বড় ক্ষতি করে ফেলল।

–এটা আবার বলতে হবে জান। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো পাখি। তোমার জন্য হৃদয়টা কতদিন ধরে পুড়ছে। আমরা আজকেই বিয়ে করে ফেলব। আমাদের বিয়ে হয়ে গেলেই তুমি পুরোপুরি ভাবে একান্তই আমার। আমাদের অনেক ভালোবাসা বাকি। দু’জনের উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হওয়া বাকি। একসাথে চন্দ্র বিলাস করা বাকি। আমার অশান্ত হৃদয়টাকে শান্ত কর বাকি। সময় অপচয় না করে দ্রুত চলে এসো সুইটহার্ট। প্রিয়তমের কথায় সমস্ত মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছাড়িয়ে পড়লো। শেজনাজ বিলম্ব করল না। দ্রুত বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে বের হয়ে গেল। মুনতাসিমের ফলের বাগানের মধ্যে দিয়ে একটা গুপ্ত দরজা আছে। সেটা মুনতাসিম আর তাইয়ান ছাড়া কেউ জানে না। শেহনাজ কৌশলে জেনে নিয়েছে। আজ সে সুযোগে সৎ ব্যবহার টা করে নিল। সবাই মেহেভীনকে নিয়ে চিন্তিত আছে।

–উনি শেষ কি খাবার খেয়েছিল? ডক্টরের প্রশ্নে মাশরাফি তড়িৎ গতিতে জবাব দেয়,

–ভাত।

–আমাদের সন্দেহই ঠিক। উনার খাবারের সাথে বি’ষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা দ্রুত বি’ষ বের করার ব্যবস্থা করছি। ডক্টর আর দাঁড়াল না। দ্রুত জরুরি বিভাগের দিকে ছুটে গেল। চিন্তায় সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। ধরনীর এই মানুষটার কাছে তার সকল শক্তি তুচ্ছ! মানুষটার কিছু হলেই ধরনীর সব অসহায়ত্ব তার বুকে এসে বাসা বাঁধে। ছেলের চিন্তিত মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টি যেতেই রিয়াদ চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–মেয়েটাকে যখন এতটাই ভালোবাসো, তাহলে এভাবে মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছ কেন? মেয়েটা তোমার জন্য বি’ষ খেয়ে বসেছে। এখন যদি মেয়েটার কিছু হয়ে যায়। তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে তো? মুনতাসিম নিস্তব্ধ রইলো। মাশরাফি কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হতেই রিয়াদ চৌধুরী থামিয়ে দিল। মাশরাফি বাবার মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে, কোনো বাক্য উচ্চারন করার সাহস পেল না।

শহরের সুনশান নিস্তব্ধ নিষিদ্ধ কক্ষে শেহনাজকে নিয়ে এসেছে স্বাধীন। কক্ষে প্রবেশ করতেই ছয়জন যুবককে দেখতে পেল শেহনাজ। তাদের প্রতিটি মুখশ্রী শেহনাজের পূর্ব পরিচিত। সে কক্ষে প্রবেশ করে আস্তরণে গিয়ে বসল। স্বাধীন আচমকা কবাট লাগিয়ে দিল। কবাট লাগানোর শব্দ চমকে উঠল শেহনাজ! সে বিস্ময় নয়নে স্বাধীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। স্বাধীনের মুখশ্রীতে পৈশাচিক হাসি বিদ্যমান। মুহুর্তের মধ্যে শেহনাজে ছোট্ট হৃদয়টাকে ভয় গ্রাস করে ফেলল।

–তুমি কবাট বন্ধ করলে কেন স্বাধীন? আমাদের বিয়ে হবে না, কাজী কোথায়? শেহনাজের প্রশ্নে কক্ষ জুড়ে হাসির প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল। শেহনাজ অসহায় দৃষ্টিতে সবার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। স্বাধীন তাচ্ছিল্য করে বলল,

–তুই তো পাঁচ হাজার টাকার মেয়ে। তুই ভাবলি কি করে তোকে আমি বিয়ে করব। তোর মতো মেয়েকে টেস্ট করা যায়। কিন্তু সারাজীবন সংসার করা যায় না। তোকে বিয়ে করলে আমার বউ তোকে মেনে নিবে? স্বাধীনের কথায় অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে শেহনাজের। মস্তকের উপরে থাকা বিশাল আকাশটা তার কায়ার ওপরে এসে পড়লো। মুহুর্তের মধ্যে ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। সে দৌড়ে পালাতে চাইলে স্বাধীন খপ করে শেহনাজকে ধরে ফেলে। শেহনাজ হাত মোচড়াতে মোচড়াতে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমাকে ছেড়ে দে বেইমান। তুই আমার সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করবি। সেটা যদি আমি আগে জানতাম কখনোই তোর কাছে আসতাম না। আমাকে এভাবে ঠকালি কেন? আমি কি অপরাধ ছিল? আমার একটাই অপরাধ আমি তোকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি। স্বাধীন আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি বলো না সবকিছু মিথ্যা তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে স্বাধীন। আমাকে এভাবে না মানসিক মৃত্যুদন্ড দিও না। আমি সবাইকে ছেড়ে তোমার কাছে এলাম। এ তুমি কেমন হয়ে গেলে? তুমি তো এমন পাষাণ ছিলে না! এতটা পাষাণ কিভাবে হলে স্বাধীন? তুমি না আমাকে ভালোবাসো। তুমি তো আমাকে কষ্ট দিতে পারো না। আল্লাহর দোহাই লাগে তোমার আমাকে কলঙ্কিত করো না। আমি নিজ ইচ্ছেয় আমাকে তোমার নামে লিখে দিয়েছি। কবুল বললেই আমি তোমার দলিল করা সম্পদ হয়ে যাব। শেহনাজের কথায় পাষাণ প্রেমিকের হৃদয় পুড়ল না। সে শেহনাজের বুক থেকে একটা টানে ওড়না সরিয়ে ফেলল। শেহনাজ সাথে সাথে হৃদয়বিদারক চিৎকার দিয়ে বলেই উঠল, ”তাইয়ান।”

গভীর নিদ্রায় তলিয়ে ছিল তাইয়ান। আচমকা নিদ্রা ভেঙে গেল তার। ললাট বেয়ে তরতর করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। ভেতরটা অদ্ভুত ভাবে অস্থির হয়ে উঠছে। এত ভয় লাগছে কেন তার! হৃদয়টা এতটা বিষণ্ণ হয়ে উঠছে। সে পানি খেয়ে আবার নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। নিদ্রায় বিভোর থাকা তাইয়ান জানতেও পারল না। তার হৃদয়ের কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখা পাষাণ রমণীর জীবনের সবচেয়ে বড় অনর্থটা হয়ে গেল। রমণী বুঝল কে তার প্রিয়জন এবং কে তার প্রয়োজন। কিন্তু বুঝতে যে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। সময় আজ তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছে। পাপ ডেকে বলছে। কিছু মনে পড়ছে। প্রকৃতি ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৫২+৫৩+৫৪

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

বাতাসে বিরহ বইছে। অনুভূতিরা শূন্য হয়ে গিয়েছে। মস্তিষ্কের একাংশ ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। মনের আনাচে কানাচে দুঃখরা আনন্দ করছে। এখন যে তাদের সময়! সব সময় যদি সুখই রাজত্ব করে, তাহলে তারা রাজত্ব করবে কখন? এখনই যে সুবর্ণ সুযোগ এই সুযোগটা বুঝি হাতছাড়া করা যায়! বিরহরা চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি আঙ্গিনা দখল করে নিয়েছে। পাখিরা আর সুর তুলে না। ফুল গাছে ফুল ফুটে না। গাছ গুলো কেমন ঝিমতে শুরু করে দিয়েছে। অযত্নে রাখলে তো লাহায়ও মরিচা ধরে যায়। সেখানে ফুল গাছে সকালে পানি না দিলে বিকেলেই মিইয়ে যায়। একমাস ধরে পানি না দিলে তার অস্তিত্ব তো মুছে যাবেই। রাইমা বেগম চলে গিয়েছে একমাস হয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মে সবার জীবন আগের ন্যায় ছুটে চলেছে। সময় তো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের তো কোনো দুঃখ নেই। যদি থাকতো তাহলে এভাবে বিরতিহীন ভাবে ছুটতে পারত! কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকেনি। শুধু থেমে গিয়েছে মেহেভীনের মন৷ হাসোজ্জল মেয়েটা মুহুর্তের মধ্যে নিরব হয়ে গিয়েছে। সেই সাথে কেঁড়ে নিয়েছে কিছু মানুষের ভালো থাকা। সে কি জানে না! তার ভালো থাকার ওপরে একটা মানুষের ভালো থাকা নির্ভর করে। তবে কেন এত নিরবতা? মেহেভীন আস্তরণের বসে চিন্তায় মগ্ন ছিল। তখনই রিয়াদ চৌধুরী আসে। মেহেভীন রিয়াদ চৌধুরীকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। ভদ্রতা বজায় রেখে বলল,

–কিছু বলবেন আব্বা?

–তোমার সমস্যা কি বলতে পারো? তুমি এমন ভাব করছ যেন পৃথিবীতে শুধু তোমার মা-ই মারা গিয়েছে। আমার ছেলেটার মা ছোট বেলায় মারা গিয়েছে। তুমি অর্ধেক জীবন তোমার বাবা-মাকে পাশে পেয়েছ। কিন্তু আমার ছেলে সেটাও পাইনি। মুনতাসিম বুক ভরা হাহাকার নিয়ে বড় হয়েছে। তোমার চিন্তায় ছেলেটা আমার আধমরা হয়ে গিয়েছে। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে তোমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করছে। আর তুমি তাকে দুঃখ দিয়ে মুড়িয়ে ফেলছ! সব সময় নিজের কথা ভাবলেই হয় না। বিপরীত পক্ষের মানুষটার কথাও ভাবতে হয়। তোমরা দু’জন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো না। আগের মতো হাসো না। এগুলো কি মেহেভীন? আমার পরিবারকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমি তোমাকে দিয়েছিলাম। আর তুমি পরিবারটাকে বিষাদে পরিপূর্ণ করে দিলে। আজ থেকে যদি তুমি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা না করেছ। তবে আমাকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস সুখ দেখে ছাড়তে চাই, দুঃখ দেখে নয়। তোমরা যখন ঠিকই করে নিয়েছ। তোমরা সুখে নয় দুঃখেই সুখী। তাহলে আমিও না হয় সুখের সন্ধানে গৃহ ত্যাগ করব।

–আর হবে না আব্বা। আমি সবকিছু আবার আগের মতো করে দেওয়ার চেষ্টা করব। রিয়াদ চৌধুরী কোনো বাক্য উচ্চারন না করেই কক্ষ ত্যাগ করল। মেহেভীনের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করেছে। কথা গুলো সত্য হলে-ও ধারালো অস্ত্রের মতো মেহেভীনের হৃদয় এসে বিঁধল। যে মানুষটার জন্য তার বাঁচতে ইচ্ছে করে। যে মানুষটা না থাকলে তার জীবন মূল্যহীন হয়ে যেত। ধরনীর সকল মানুষের কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য পেত। যে মানুষটা তাকে তার সাম্রাজ্যের রাণী বানিয়েছে। তাকে দিয়েছে পাহাড় সমান সন্মান। সেই মানুষটাকে সে প্রতিনিয়ত আঘাত করে যাচ্ছে। মানুষটা তো আমার দেওয়া যন্ত্রনা সহ্য করে নিচ্ছে। সে আমাকে যেমন ভাবে সহ্য করছে। অন্য কেউ সহ্য করবে না এটাই স্বাভাবিক। এই যে তার মা মারা যেতে না যেতেই সবাই তাকে ভুলে গেল। সে মা’রা গেলেও বুঝি মানুষ তাকে ভুলে যাবে। আজকাল অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তাধারা এসে মস্তিষ্কে বাসা বাঁধে। আজকাল মুনতাসিমকে হারিয়ে ফেলার ভিষণ ভয় হয়। এই যে সে মুনতাসিমকে অবহেলা করছে। মুনতাসিম সেটা অমৃতের ন্যায় সদরে গ্রহণ করে নিচ্ছে। আচ্ছা মুনতাসিম না থাকলে তার কি হবে? কথাটা মস্তিস্কে হানা দিতেই অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। সে বুকে পাথর চাপা রাখবে। দুঃখ গুলো মাটি চাপা দিবে। আর মুনতাসিমকে দুঃখ দিবে না। মুনতািসমের ও ভালো থাকার অধিকার আছে। যে মানুষটা সবার ভালো চাইল। দিনশেষে সেই মানুষটার ভালো থাকাই সে কেঁড়ে নিল। আজ থেকে সে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করবে। তবে কি চাইলেই স্বাভাবিক হওয়া যায়?

–আপনি কি মানুষ! আপনি মেয়েটার সাথে এমন ব্যবহার না করলেও পারতেন। সারাদিন খালি নিজের ছেলের ভালো থাকার কথা ভাবেন। মেয়েটার ভেতর দিয়ে কি যাচ্ছে। সেটা আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। আপনাদের পুরুষ মানুষের এই একটা সমস্যা আপনারা নারীদের কিছুতেই বুঝতে চান না। আপনারা এতটা স্বার্থপর কেন বলেন তো? সাহেলা চৌধুরীর কথায় আড়দৃষ্টিতে অর্ধাঙ্গিনীর দিকে দৃষ্টিপাত করল রিয়াদ চৌধুরী। কণ্ঠে গম্ভীরতা এনে বললেন,

–মানুষ বেশি আদর পেলে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা হারায়। এই মুনতাসিম তাকে এতটা ভালোবাসা দিচ্ছে, আগলে রাখছে। মেয়েটা কি স্বাভাবিক হতে পেরেছে? সে ভেতরটা আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দু’জনই শেষ হয়ে যাবে। একটা মানুষকে শক্ত করার জন্য কিছু বিষাক্ত বাক্যই যথেষ্ট। পর মানুষ পরের মতো আচরণ করেছি। আমারটা আমাকে বুঝতে দাও। আমি কেন এমন আচরন করেছি। সেটা সময় হলেই বুঝতে পারবে। মেয়েটাকে ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে মে’রে ফেলতে পারব না। বাক্য গুলো শেষ করে স্থান ত্যাগ করল রিয়াদ চৌধুরী।

ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। সারাদিনের ক্লান্তি কায়াতে নিয়ে বাড়িতে ফিরল মুনতাসিম। সমস্ত মুখশ্রী বিষন্নতায় আচ্ছন্ন। মনটা বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। প্রেয়সীর ভালো থাকাটা যখন আঁধারে রুপ নেয়। তখন নিজের ভালো থাকাটা আমাবস্যার রজনীর ন্যায় হয়ে যায়। বুকভরা হতাশা নিয়ে নিজের কক্ষে প্রবেশ করল মুনতাসিম। চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষ জুড়ে অন্ধকারের রাজত্ব। এটা নতুন কিছু নয় অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সে ফ্রেশ হতে চলে গেল। আজ কতগুলো দিন হয়ে গেল আনন্দ করে আহার করা হয় না। আনন্দ গুলো যেন বিলীন হয়ে গিয়েছে। সে ফ্রেশ হয়ে এসে নিঃশব্দে মেহেভীনের পাশে শুয়ে পড়লো। তখনই কর্ণকুহরে কারো গম্ভীর কণ্ঠ স্বর ভেসে এল,

–না খেয়ে শুয়ে পড়ছেন কেন?

–আপনি ঘুমাননি?

–আমাকে প্রতিদিন ঘুমের ঔষধ খাওয়ান কেন?

–আপনি যেন শান্তিতে রজনী পার করতে পারেন, তাই।

–আর নিজে অশান্তিতে থাকেন। নিদ্রাহীন রজনী পার করেন। এই যে আমার পেছনে এত ছুটেন ক্লান্ত হন না।

–মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হব না।

–খাবার উপরে নিয়ে আসব নাকি নিচে গিয়ে খাবেন?

–আপনি না খেয়ে ঘুমাবেন। আর আমি খেতে যাব!

–আমার সাথে আপনার সাথ?

–অবশ্যই।

–আমি দুই হাঁড়ি ভাত খাব। আপনি খাবেন?

–চলুন। কথা গুলো শেষ করেই মুনতাসিম আস্তরণ ত্যাগ করল। মেহেভীন উঠে কেশগুলো ঠিক করতে করতে কক্ষের আলো জ্বলিয়ে বাহিরে চলে গেল। মেহেভীনের পেছনে পেছনে মুনতাসিমও গেল। মেহেভীনের স্বাভাবিক আচরণে মুনতাসিম একটু অবাক হলো! তবুও মেহেভীনকে বুঝতে না দিয়ে সে মেহেভীনের সাথে ডাইনিং টেবিলে বসল। মুনতাসিমে সমস্ত মুখশ্রী কেমন চকচক করছে। মেহেভীনের স্বাভাবিক আচরণ ক্ষণিকের জন্য হলে-ও মুনতাসিমের বিষন্নতা দূর করে দিয়েছে। মেহেভীনের হাসোজ্জল মুখশ্রী মুনতাসিমের সারাদিনের ক্লান্তি এক নিমিষেই শেষ করে দিল। মেহেভীন খাবার বেড়ে মুনতাসিমের সামনে দিল। নিজেও কিছুটা খাবার বেড়ে নিল। খাবার সামনে নিয়ে মলিন মুখশ্রী করে বসে আছে। কণ্ঠ স্বর স্বাভাবিক থাকলে-ও মুখশ্রীতে বিষন্নতা বিদ্যনাম। মেহেভীনের দিকে দৃষ্টি যেতেই মুনতাসিম মেহেভীনের সামনে এক লোকমা ভাত তুলে ধরল। মেহেভীন কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই ভাত টুকু মুখে পুরে নিল। মেহেভীনের আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন হতে শুরু করেছে। অশ্রুকণা এসে চোখের কার্ণিশে এসে জমা হয়েছে। মুনতাসিম যত্নসহকারে অশ্রু ঝড়ার আগেই মুছে দিল। আদুরে ভাবে মেহেভীনকে নিজের বুকের মধ্যে আগলে নিল। মেহেভীনকে বুকের মধ্যে রেখে খাইয়ে দিতে থাকলো। মেহেভীন অসহায়ত্ব মাখা কণ্ঠে বলল,

–আপনি না থাকলে আমার কি হতো? আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব কিভাবে? আপনি কখনো আমাকে ছেড়ে যাইয়েন না। আমি আপনাকে আর কখনো কষ্ট দিব না। আপনি আমাকে একটু সময় দিন। আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলব।

–আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি। আপনি ততক্ষণ রানীর মতো বাঁচবেন। আপনি এমন এক রাজার রানী, যে রাজার রাণীকে আঘাত করার কথা স্মরন হতেই প্রতিটি মানুষের হৃদয় কাঁপে। এই রাজ্য আপনার আপনি আপনার রাজ্যে যেভাবে খুশি থাকবেন। আপনার দুঃখ হলে কাঁদবেন। আপনি সুখ অনুভব করলে, চারিদক হাসির প্রতিধ্বনিতে মুখরিত করে রাখবেন। আপানাকে কেউ গোপনে আঘাত করলে আপনি আমাকে গোপনে স্মরন করবেন। বাকিটা বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব আমার। এই মানুষটা মন খুলে কথা বলে এটা মেহেভীনের ভিষণ ভালো লাগে। হৃদয় শীতল করা তার প্রতিটি বাক্য। দুঃখ গুলো কিছু সময়ের জন্য চাপা পড়ে যায়। মেহেভীন দু’হাতে মুনতাসিমের আঁকড়ে ধরল। তা দেখে মুনতাসিমের অধরের কোণে হাসির রেখার দেখা মিলল। দু’জনের প্রণয় দেখে রিয়াদ চৌধুরী বুকটা প্রশান্ত হলো। সে চা খাবার জন্য আসছিল। দু’জনকে খাবার টেবিলে দেখে দু’টি চরন স্থির হয়ে যায়। সাহেলা চৌধুরী রাগান্বিত হয়ে বলল,

–এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন? লজ্জা করছে না আপনার! আজকে আপনাকে চা খেতে হবে না। কক্ষে ফিরে চলুন। রিয়াদ চৌধুরী অর্ধাঙ্গিনীর কথায় লজ্জিত বোধ করল। সে কোনো বাক্য উচ্চারন না করেই হনহন করে চলে গেল। সাহেলা চৌধুরী এবার বুঝলেন। রিয়াদ চৌধুরী কেন মেহেভীনকে কড়া বাক্য শুনিয়েছিল। কিছু আঘাত ভালোবাসা দিয়ে নয় আঘাতপ্রাপ্ত মানুষটাকে আঘাত দিয়েই শক্ত করতে হয়।

চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। শেহনাজ খুব সাবধানতা অবলম্বন করে বাড়ি ফিরল। কতগুলো প্রহর কাটিয়ে দু’টি মানুষ মন খুলে কথা বলার মুহূর্তটা ভিষণ সুন্দর। কিন্তু কিছু সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী হতে গিয়ে কিছু সত্যের মুখোমুখি হবার যে ব্যাপারটা! সেটা ভিষণই অদ্ভুত। শেহনাজ সাবধানতা অবলম্বন করে-ও শেষ রক্ষা পেল না। অন্ধকারের মধ্যেই কারো সাথে ধাক্কা খেল সে। মেহেভীন চিৎকার করার আগেই শেহনাজ মেহেভীনের মুখ চেপে বলল,

–ভাবি আমি শেহনাজ চিৎকার করো না। কথা গুলো বলেই মেহেভীনের মুখ থেকে হাত সরিয়ে দিল। মেহেভীন বিস্ময় নয়নে শেহনাজের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। শেহনাজের মুখশ্রীতে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। মেহেভীন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–তুমি এতরাত পর্যন্ত বাহিরে ছিলে শেহনাজ? তুমি এটা জানো না। চৌধুরী বাড়ির মেয়ে-বউরা সন্ধ্যার পর বাড়ির বাহিরে থাকে না। তোমার ভাই জানলে কি অবস্থা হবে, এটা কখনো ভেবে দেখেছ?

–আমার ভুল হয়ে গিয়েছে ভাবি। আমি আর কখনো এমন রাত করে বাড়ি ফিরব না৷ আমি মাকে জানিয়েছিলাম। আজকে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্মদিন ছিল। ওর কথা ফেলতে পারিনি বলেই এত রাত হয়ে গিয়েছে।

–শেহনাজ তুমি কি ম’দ খেয়েছ? তোমার শরীর থেকে ম’দে’র গন্ধ আসছে।

–তুমি এভাবে আমাকে জেরা করছ কেন? আমি কেমন মেয়ে তুমি জানো না ভাবি? আমার ফ্রেন্ডরা খেয়েছে কসম করে বলছি ভাবি। আমি এসব খাইনি। তুমি ভাইকে কিছু বলো না ভাবি। ভাই জানলে আমাকে শেষ করে ফেলবে। আমাকে একটা সুযোগ দাও।

–তুমি নিজের কক্ষে যাও। আর কখনো এমন করো না। মেহেভীনের থেকে অনুমতি পেতেই শেহনাজ দ্রুত নিজের কক্ষে চলে গেল। মেহেভীনের মস্তিষ্ক বলছে। শেহনাজ মিথ্যা বলেছে। শেহনাজ কথা বলার সময় শেহনাজের মুখশ্রী দিয়ে মদের বিশ্রী গন্ধ নাসারন্ধ্রে এসে ঠেকছিল। মেহেভীন অশান্তি চায় না বলেই বিষয়টা চেপে গেল।

লা’শে’র ফ্রিজিং ড্রয়ারটা খুলতেই রক্তবিহীন সাদা বর্ণের দেহটা বের করল যুবক। সে খুব দ্রুত লা’শ’টা বের করতে চাইছে। যেকোনো মুহূর্তে এই লা’শ’টার খোঁজ মুনতাসিম পেয়ে যেতে পারে। এই লা’শে’র সন্ধান তো মুনতাসিমকে পেতে দেওয়া যাবে না। মুনতাসিম লা’শ পর্যন্ত পৌঁছে যাবার আগেই লা’শ’টা’কে সরাতে হবে। যুবকের সমস্ত কায়া ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। যুবকে তাড়াহুড়ো করতে দেখে লা’শ পাহাড়া দেওয়া গার্ডটা বলল,

–লা’শ নিয়ে কোথায় যাবেন?

–আমার রেখে যাওয়া লা’শ আমি যেখানে খুশি সেখানে রাখব। আপনাকে এত কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। আমার সামনে থেকে সরে যান না হলে খু’ন করে ফেলব। যুবকের কথায় সরে দাঁড়াল মানুষটা। বরফের ন্যায় শীতল দেহটা নিয়ে ছুটে চলেছে যুবক। কিছু পথ যেতেই কালো পোশাক পড়া ভারি সুঠাম দেহের লোক এসে যুবককে ধরে ফেলল। যুবক বজ্রকণ্ঠে হুংকার দিয়ে উঠল।

–আমাদের আশিটা মেয়ে দেওয়ার কথা ছিল স্যার। আমরা ঊনআশি মেয়ে জোগাড় করতে পেরেছি। আর একটা মেয়ে খুঁজে পাচ্ছি না। এত দ্রুত এত মেয়ে তোলা অসম্ভব ব্যাপার ছিল স্যার। জিহানের কথায় জাফর ইকবাল গা-ছাড়া ভাব নিয়ে আস্তরণে শায়িত হলেন।

–তোমরা এত চিন্তা কেন করছ? মুনতাসিমের অর্ধাঙ্গিনী আছে না। তাকে দিয়েই আমরা আশিটা পূর্ণ করে দিব। এবার সময় এসে গিয়েছে। তোমরা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকবে। সুযোগ পেলেই মুনতাসিমের অর্ধাঙ্গিনীকে তুলে নিয়ে আসবে। জাফর ইকবালের কথায় জিহান সম্মতি জানিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

বিষন্ন হৃদয়টা মেনে নিতে শিখে গিয়েছে। হাসি দিয়ে বুকের মধ্যে জমে থাকা চাপা কষ্ট গুলো কিভাবে আড়াল করতে হয়। সেটা পরিস্থিতি অবুঝ মনকে বুঝিয়ে দিয়েছে। দুঃখরা অভিমানে দূর দেশে পাড়ি জমিয়েছে। হতাশারা দুঃখ পেয়ে বিলীন হতে শুরু করেছে। সুখ গুলো একটু একটু করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এসে জমা হচ্ছে। অনুভূতিরা ফিরতে শুরু করেছে আপন নীড়ে। আঘাতপ্রাপ্ত মানুষকে আঘাত করলে যে আর দুঃখ লাগে না। সেটা কি মানুষ জানে না? তারা যদি জানতো তাহলে কখনোই এমন বোকামি করতো না। আঘাত প্রাপ্ত মানুষটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করার জন্য নতুন পথ খুঁজত। মেহেভীন মলিন মুখশ্রী করে কক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখনই কারো হাসির প্রতিধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠল। কিছু সময়ের ব্যবধানে চাপের কাপটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। কিছু ভাঙার শব্দ কর্ণকুহরে আসতেই মেহেভীনের দৃষ্টি সোফার দিকে গেল। রিনি এসেছে। রিনির সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে সুফিয়া চৌধুরী। তার পাশেই বসে আছে তাহিয়া। মেহেভীনকে দেখেই সুফিয়া চৌধুরী মেহেভীনকে ডাকলেন। মেহেভীন ভদ্রতা বজায় রাখতেই নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। সুফিয়া চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–তোমার কি কোনো কাজ আছে মেহেভীন?

–না।

–তাহলে তুমি একটা কাজ করো। এই বাড়ির বউ হয়ে আসোনি তো এসেছ রাজরানী হয়ে, সংসারের কোনো কাজে হাত দাও না। তোমার আর কি দোষ দিব বলো। আমাদের মুনতাসিম হয়েছে একটা বউ পাগল। বউয়ের একটা ফুলের টোকা লাগলেই যেন সে রক্তাক্ত হয়ে যায়। একটা রাজার মেয়েও তো এভাবে বসে খায় না। রাজার মেয়েও তো শখ আছে। সে সংসারের কাজ করবে। ভালোমন্দ রান্না করে শশুর বাড়ির লোকজনকে খাওয়াবে। তোমার কি কোনো শখ আহ্লাদ নেই? এমন শুয়ে-বসে খেতে পেলে কে-ই বা কাজ করতে চায় বলো। এই জায়গা টুকু পরিষ্কার করে দাও। সুফিয়া চৌধুরীর কথায় মেহেভীনের সমস্ত কায়া জ্বলে উঠল।তার প্রতিটি বাক্য মেহেভীনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছে। মেহেভীন কাঁচের টুকরো গুলো তুলতে তুলতে বলল,

–আমি একটা সময় চাকরি করতাম ফুপি। সেখানে থেকে কিছু টাকা জমিয়েছি। আমার বাপ ফকিরের সন্তান ছিল না। আমার বাপের যা আছে। তা আপনি আপনার মেয়ে সহ আরো দশটা পরিবার সুন্দর মতো বসে খেতে পারবে। শুধু তাই নয় সারাজীবন বসে খেলেও ফুরাবে না। নিজের প্রশংসা নিজের করতে হয় না। তবে আমি মেয়েটা ভিষণ পরিশ্রমী জানেন। ধরনীর বুকে খুব কাজ কাজই আছে যেগুলো আমি পারি না। তাই খাওয়ার খোঁটা অন্তত আমাকে দিয়েন না। আমি নিজের হাত খরচের টাকা পর্যন্ত মুনতাসিমের থেকে নেই না৷ কিন্তু সে প্রতি মাসে যত্ন সহকারে আমার হাতে তুলে দেয়। সেগুলো আমার কোনো কাজেই আসে না। আমি সেগুলো তুলে রাখি। আপনি যাকে বউ পাগলা বলছেন। ইসলাম তাকে শ্রেষ্ঠ স্বামী বলে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক একজন ব্যথা পেলে তো আরেকজন আঘাত প্রাপ্ত হবেই। এটাই স্বাভাবিক। যে স্ত্রী তার স্বামীর মন মতো চলে না। আল্লাহ তায়ালা সেই স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট হন। আমার স্বামী আমাকে কাজ করতে বললে আমি অবশ্যই করব। মেহেভীনের কথায় অপমানে সমস্ত মুখশ্রী চুপসে খেল সুফিয়া চৌধুরীর। মেয়েটাকে রিনির সামনে ছোট করতে গিয়ে নিজেই অপমানিত হবে। সেটা তার চিন্তাধারার বাহিরে ছিল। সুফিয়া চৌধুরী রিনিকে আঁখিযুগল দিয়ে ইশারা করতেই রিনি মেহেভীনের হাতে পা রাখলো। মেহেভীনের মুখশ্রী থেকে বিষণ্ণতাকে গ্রাস করে নিয়েছে একরাশ ক্রোধ। মেহেভীনের জ্বলে ওঠা আঁখিযুগলে দৃষ্টিপাত করেও রিনির ভাবান্তর হলো না। রিনিকে অবাক করে দিয়ে মেহেভীন রিনির পা মুচড়ে ধরল। রিনি ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল। মুনতাসিম বাহিরে থেকে গৃহে প্রবেশ করতেই মেহেভীনকে এমন অবস্থায় দেখে নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গেল। মুনতাসিমকে দেখে রিনির কলিজা শুকিয়ে গেল। রিনিকে কাঁপতে দেখে মেহেভীন পেছনের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিমকে দেখেই হাতটা আলগা করে নিল। মেহেভীনের হাত আলগা হতেই সে দৌড়ে রিয়াদ চৌধুরীর কক্ষে চলে গেল। মুনতাসিম এসে মেহেভীনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। মেহেভীন মুনতাসিমের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল।

–নিচে বসে কি করছিলেন?

–মেহমান চায়ের কাপ ভেঙে ফেলেছে। সেটাই পরিষ্কার করছিলাম।

–আমার বাসায় কি গার্ডের এতই সংকট পড়লো! আমি কি নতুন গার্ড নিয়োগ দিব? চৌধুরী বাড়িতে এত এত মানুষ থাকতে আপনি কেন অন্যের ভেঙে ফেলা জিনিস পরিষ্কার করবেন? মুনতাসিমের হুংকারে কেঁপে উঠল চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল। মুনতাসিমের উত্তপ্ত মেজাজ দেখে সুফিয়া চৌধুরী রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমি মেহেভীনকে পরিষ্কার করতে বলেছি। নিজের সংসারের কাজ করলে কি তোর বউয়ের হাত খসে যাবে?

–তোমার মেয়েও তো তোমার পাশে বসে আছে ফুপি। তোমার মেয়েকে না বলে আমার বউকে কেন বললে? আমি বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছি কোনো চাকরানি না। তোমার সব সময় এটা মস্তকে রাখতে হবে। মেহেভীন এ বাড়ির বউ কাজের লোক না। এই বাড়িতে কাজের মানুষের অভাব নেই। আপনি কাঁচের টুকরো গুলো হাত থেকে এখনই ফেলবেন। এখনই মানে এখনই। আমার কথার অবাধ্য হবার চেষ্টা করলে সবকিছু তচনচ করে দিব। তাহিয়া তুই উঠে আয়৷ এখনই এই জায়গাটা পরিষ্কার করে দিবি। আমার একটা বাক্য যেন দ্বিতীয় বার উচ্চারন করা না লাগে। যদি লেগেছে আজ চৌধুরী বাড়িতে লা’শ পরবে। মুনতাসিমের বলার প্রতিটি বাক্য তাহিয়ার হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। ভয়ে সমস্ত কায়া অবশ হতে শুরু করেছে। সে আড়দৃষ্টিতে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করল। সে মায়ের কথার অপেক্ষা না করেই কাঁচ গুলো তুলতে শুরু করল। নিজের ওড়না দিয়ে খুব দ্রুততার সঙ্গে জায়গাটা আগের ন্যায় পরিষ্কার করে দিল। সুফিয়া চৌধুরী যেন নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গেল। সে রাগান্বিত হয়ে চেচিয়ে বলল,

–একটা খু’নি’র মেয়ের জন্য এত আদিখ্যেতা কিসের? যে মেয়ের জন্য সারা পৃথিবীর সাথে লড়াই করছিস। একদিন সেই মেয়ের স্বার্থে আঘাত লাগলে, মেয়েটা তোর বুকে আঘাত করবে। এটা সব সময় মনে রাখিস। এই খু’নি’র মেয়ের জন্য সমাজে মুখ দেখাতে পারি না৷ পথে বের হলেই লোকজন জনসম্মুখে অপমান করে। এই মেয়ের জন্য তুই আমার মেয়েকে দিয়ে কাজ করালি!

–তোমাকে সমাজে মুখ দেখাতে কে বলেছে ফুপি? তুমি তো এই সমাজে থাকো না। দু’দিনের অতিথি হয়ে এসেছ। আবার দু’দিনের অতিথি হয়ে চলে যাবে। সমাজ কি বলল সেটা দেখার বিষয় তোমার না। সমাজ আমাকে আর আমার বউকে অন্ন-বস্ত্র দিয়ে আমাদের ভরনপোষণ করে না। আমার বউকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করবে কার এত সাহস? আমিও দেখতে চাই। কার কলিজা এত বড় হয়েছে? তার বড় কলিজা তো আমাকে মেপে দেখতেই হবে। মুনতাসিমের কথায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সুফিয়া চৌধুরী। ততক্ষণে রিয়াদ চৌধুরীকে নিয়ে রিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছে। রিয়াদ চৌধুরীকে দেখে সুফিয়া চৌধুরী অশ্রুভেজা কণ্ঠে বলল,

–আপনি দেখলেন ভাই। মুনতাসিম সামান্য একটা বিষয় নিয়ে আমাকে থাকার খোঁটা দিল। আমি আর কখনো আপনাদের বাড়িতে আসব না। আজই তাহিয়ার দাদির বাড়ি চলে যাব। যে মেয়েকে নিয়ে এত অহংকার করছে। সেই মেয়েই একদিন সব অহংকার ভেঙে দিবে। সুফিয়া চৌধুরী রিয়াদ চৌধুরীর থেকে কিছু কড়া বাক্য আশা করেছিলেন৷ কিন্তু সুফিয়া চৌধুরীকে বিস্ময় করে দিয়ে রিয়াদ চৌধুরী নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে। বাক্য গুলো আজ রিয়াদ চৌধুরীর মুখশ্রীর আশেপাশে নেই। শব্দরা ক্ষণিকের জন্য ছুটি নিয়েছে। মুনতাসিম রিনির দিকে রক্তিম চোখে দৃষ্টিপাত করে বলল,

–তোকে আমি সাবধান করেছিলাম। তুই আমার কলিজাতে হাত দিয়েছিস। সেদিন তোকে আমি ক্ষমা করেছি। আজ তোর পা আমি ভাঙব-ই। মুনতাসিমের কথায় রিনির সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। মেহেভীনের মলিন মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টি যেতে মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আপনার সাথে আমার কথা আছে। দ্রুত কক্ষ আসবেন। আপনাকে আমি বলেছি না। আমি যতক্ষণ বাসায় থাকব। আপনার ততক্ষণ কোনো কাজ নেই। আপনার শুধু একটাই কাজ আমার সামনে বসে থাকা। কতবার বলেছি কক্ষে প্রবেশ করেই যেন আপনার মুখশ্রী আমি দেখতে পাই। বাক্য গুলো শেষ করেই মুনতাসিম গম্ভীর মুখশ্রী করে নিজের কক্ষে চলে গেল। রিয়াদ চৌধুরী ইশারা দিয়ে মেহেভীনকে যেতে বলল। মেহেভীন বিলম্ব করল না দ্রুত স্থান ত্যাগ করল।

চারদিকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। রজনীর মধ্য প্রহর চলছে। সবাই নিদ্রা দেশে তলিয়ে গিয়েছে। আজকাল মেহেভীন প্রতি রজনীতে ভিষণ বাজে স্বপ্ন দেখে। কিছু স্বপ্ন ভেতরটায় সারাক্ষণ যন্ত্রনা দেয়। মাঝেমাঝে মায়ের কথা স্মরন হতেই নিরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে মেহেভীন। মস্তিষ্ক এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। মস্তিষ্ক সচল হতেই পানির অভাববোধ করল সে। পাশেই মুনতাসিম গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। সুফিয়া চৌধুরী চলে গিয়েছে সাতদিন হয়েছে। রিয়াদ চৌধুরী ফোন করে আসতে বলেছে। তবুও তিনি আসেননি। তার এক কথা মুনতাসিম ক্ষমা না চাইলে আসবে না। মেহেভীন নিঃশব্দে উঠে নিচে আসলো। পানি খেয়ে কক্ষের আসার সময় কারো কালো অবয়ব দেখতে পেল সে। মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রী কুঁচকে এল। সে অস্ফুট স্বরে বলল,

–কে ওখানে? মেহেভীনের বাক্য শেষ হতেই উচ্চ স্বরে কিছু পড়ার শব্দ হলো। রজনীর মধ্য প্রহর চলায় শব্দটা খুব স্পষ্ট ভাবেই কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। মেহেভীন ড্রয়িং রুমের আলো জ্বালাতেই শেহনাজকে দেখতে পেল। শেহনাজের মুখশ্রীতে বিরক্তির ছড়াছড়ি। শেহনাজ কোনো বাক্য উচ্চারন না করে নিজের কক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। তা দেখে মেহেভীন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–এত রাত পর্যন্ত তুমি কোথায় ছিলে শেহনাজ? আজকাল দেখছি রাত করে বাড়ি ফিরো। তোমাকে নিষেধ করার পরও কথা শুনো না কেন? তোমার ভাই জানলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে ভেবে দেখেছ কখনো?

–সব কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে! দু’দিন ধরে এসেই বাড়ির সবার ওপরে কর্তৃত্ব ফলাতে চাইছ। ভাই জানলে কি হবে আবার কিছুই হবে না। সে আমার সৎ ভাই নিজের ভাই না। সে জানলেই কি আর না জানলেই কি আমার কোনো যায় আসে না। আমাকে ধরার জন্য এভাবে প্রতিদিন চোরের মতো বসে থাকো। মানুষের সংসারে বউ আসে শান্তি নিয়ে আর আমাদের সংসার বউ এসেছে অশান্তি নিয়ে। যেদিন থেকে এসেছ সংসারের সুখ-শান্তি একদম কেঁড়ে নিয়েছ। যাও গিয়ে ভাইয়ের কাছে আমার নামে বি’ষ ঢালো।

–এভাবে কথা বলছ কেন শেহনাজ? তুমি আমার বোনের মতো। তোমার ভালো খারাপ দিক গুলো লক্ষ্য করা আমার দায়িত্ব।

–তুমি পরের মেয়ে পরের মেয়ের মতো থাকবে। একদম আমার জীবন নিয়ে তদারকি করতে আসবে না। তোমার সাহস হয় কি করে? একটা বাহিরের মেয়ে হয়ে আমার থেকে কৈফিয়ত চাওয়ার! শেহনাজের চিৎকারে মুনতাসিম, রিয়াদ চৌধুরী, সাহেলা চৌধুরী উঠে আসে। দু’জনকে তর্ক করতে দেখে সবাই স্থির হয়ে যায়। শেহনাজের শেষ বাক্যটা সহ্য করতে পারল না মুনতািসমের টগবগে মস্তিষ্ক। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–থাপ্পড় দিয়ে তোমাকে ভদ্রতা শিখিয়ে দিব বেয়াদব মেয়ে। সে তোমার বড় ভাবি হয়। তাকে সন্মান দিয়ে কথা বলবে। দীর্ঘ দিন যাবত তোমার অসভ্যতামি দেখছি। আমি তোমাকে বারবার সতর্ক করেছি। তুমি শুধরে যাওয়ার বদলে দিন দিন মাত্রা ছাড়া বিগড়ে যাচ্ছো। আমাকে রাগিও না মেয়ে। আমি রাগলে তোমাকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। এই যে তুমি প্রায় প্রায় মধ্যরাতে বাড়ি ফিরো। সেটা মেহেভীন দেখেও চুপ থাকে। সে চুপ থাকে কেন জানো? আমি তাকে বলেছিলাম। এই পরিবারের শান্তি রক্ষা করার দায়িত্ব তার। সে পরের মেয়ে হয়ে মেনে নিতে শিখে গেল। আর তুমি এই বাড়ির মেয়ে হয়ে কি করলে?

–আপনি শুধু নিজের বউয়ের হয়ে কথা বলেন ভাই। আপনার বউ সত্যি বলছে নাকি মিথ্যা বলছে সেটা কেন যাচাই করেন না? আপনার বউ মধ্য রাতে খাবার ঘরে এসে কি করে? আগে নিজের ঘরের বউকে সামলান। তারপর না হয় অন্যের মেয়েকে সামলাতে আসবেন। শেহনাজের বাক্য গুলো শেষ হবার আগেই শেহনাজের লাগে সজোরে থাপ্পড় বসলো মুনতাসিম। মুনতাসিমের রাগান্বিত মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে প্রতিবাদ করার সাহস পেল না শেহনাজ। সে অসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। রিয়াদ চৌধুরীর সহ্য সীমা পার হয়ে গিয়েছে। জীবনে প্রথম ছেলের উপরে চেচিয়ে বললেন,

–আমার মেয়ের গায়ে হাত দেওয়ার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে? আমি তোমাকে বলেছি আমার মেয়েকে শাসন করো। নিজের বউয়ের প্রতি অন্ধ হয়ে গিয়েছ? আজকাল বোনের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করছ না। এই মেয়েটা যেদিন থেকে সংসারে এসেছে। সেদিন থেকে সংসারের সুখ-শান্তি বিলীন হতে শুরু করেছে। আজ যদি আমার কথা মতো রিনিকে বিয়ে করতে। তাহলে আজ আমাকে এই দিন দেখতে হতো না। সেদিন আমার বোনের সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাকে বাড়ি ছাড়া করলে। এই মেয়ের জন্য আমাদের খু’ন করতেও দ্বিধাবোধ করবে না। আজকে এই মেয়ের একটা বিহিত করেই ছাড়ব। হয় এই মেয়েকে ডিভোর্স দিবে নয়তো আমাকে ত্যাগ করবে। রিয়াদ চৌধুরীর কথায় মেহেভীন যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। বাবার প্রতিটি বাক্য মুনতাসিমের বুকে ধারালো অস্ত্রের ন্যায় আঘাত করল। সে-ও দ্বিগুন উচ্চ স্বরে চেচিয়ে বলল,

–করলাম না আপনার মেয়েকে শাসন। আপনি কতটুকু জানেন আপনার মেয়ের সম্পর্কে? আপনার মেয়ের সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি শুনলে এতদিন বেঁচে থাকতে পারতেন না। এমন মেয়ের ভাই আমিও হতে চাই না। মুনতাসিম ফুয়াদ চৌধুরীর বোন হাতেও যোগ্যতা লাগে। সেই যোগ্যতা আপনার মেয়ের নেই। আর আমি কাকেই বোন বলছি। সে তো আমার জন্মদাত্রী জননীর সন্তান নয়। সে যদি আমায় খু’ন ও করে ফেলে আপনি আমাকে দেখতে আসবেন না। আপনার মতো বাবা আমারও চাই না৷ আপনি থাকুক আপনার মেয়েকে নিয়ে আমি ম’রে গেলে আমার লা’শে’র পাশেও যেন আপনাকে কেউ আসতে না দেয়। যদি দেয় আমি তাকে অভিশাপ দিয়ে যাব। ক্রোধে মুনতাসিমের সমস্ত কায়া থরথর করে কাঁপছে। সে ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। রিয়াদ চৌধুরী আগের ন্যায় বলল,

–তোমার মতো ছেলেরও আমার দরকার নেই। যে বউ পেয়ে পরিবারের মানুষকে আঘাত করতে দ্বিধাবোধ করে না। আজকের পর থেকে তুমি আমার সাথে কথা বলবে না। যে মেয়েটা তোমাকে অসম্মান করতে দ্বিধাদ্বন্দে ভূগে না৷ তোমাকে দুঃখ দিয়ো যার মন কাঁপে না। সেই মেয়েটা তোমাকে কতটা ভালোবাসে সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে। এই মেয়েকে আমার আগে থেকেই পছন্দ ছিল না। তোমার পাগলামির জন্য এ বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছিলাম। কে জানতো যে এই মেয়েটাই ভেতরে কালসাপ বের হবে!

–আমি আপনাকে অনেকটা সন্মান করি আব্বা। আপনি এমন কোনো বাক্য মুখশ্রী দিয়ে উচ্চারন করবেন না। যাতে আপনার প্রতি আমার সন্মান টুকু নষ্ট হয়ে যায়। আপনার সাথে কথা বললাম না। আমার কি হবে। এমনিতেই মা মারা যাবার পর থেকে কোনোদিন মন খুলে আমার সাথে আপনি কথা বলেননি। কথায় থাকেনা দুরত্ব বাড়লে গুরুত্ব কমে যায়। আমার মা যখন ছিল। তখন আমার গুরুত্বের অভাব ছিল না। মা চলে গিয়েছে সাথে নিয়ে গিয়েছে আমার ভালোবাসা, গুরুত্ব, হাসি, ভালো থাকা সবকিছু। যখনই একটু ভালো থাকা কুড়িয়ে নিয়ে আসলাম৷ তখনই সেটা কেঁড়ে নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন! আপনার মেয়ে ম’রে যাক আমার দেখার বিষয় নেই। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম বিলম্ব করল না। দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। মেহেভীন অপরাধীর ন্যায় সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে গেল। কারো ভালো চাইলে যে এতটা কষ্ট পেতে হয়। সেটা তো তার জানা ছিল না। যদি জানা থাকতো। তাহলে এমন জঘন্যতম অপরাধ কখনোই সে করত না।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫৪
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সুখ গুলোকে শুষে নিয়ে তিক্ততায় পরিপূর্ণ হয়েছে মন। এই যে লোকে বলে মেয়েদের নিজেস্ব কোনো বাড়ি হয় না। কিন্তু মেয়েদের ছাড়া কোনো বাড়িই সম্পূর্ণ হয় না। যে বাড়িতে নারী নেই। সেই বাড়িটা মরুভূমির মতোই মূল্যহীন। নারীই বাড়ির সৌন্দর্য। নারী ছাড়া বাড়ি তার সৌন্দর্য হারায়। সেই নারীকে কতই না তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়। নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেও সবার কাছে অবহেলিত হওয়ার নামই নারী। এই যে মেহেভীন নিজের বোনের মতো শেহনাজের ভালো চাইল। কিন্তু দোষটা তার হয়ে গেল! মুহুর্তের মধ্যে তার হৃদয়টা রক্তাক্ত করে দিল। বাবার বাড়িতে একটা কথা মাটিতে ফেলতে না দেওয়া মেয়েটাও আজ শশুর বাড়িতে এসে বিষাক্ত বাক্য গুলো চুপচাপ হজম করে, নিরব থাকে! মায়ের মুখে মুখে তর্ক করা মেয়েটা আজ কথা আঘাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। তবুও মুখশ্রী দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারন করে না। নিজের মেয়ের ভুল, ভুল। কিন্তু পরের মেয়ের ভুল অন্যায়! এই সমাজের নিয়ম এতটা জঘন্য কেন? পরের মেয়েকে যদি একাংশ নিজের মতো করে একাংশ ভালো দিত। তাহলে এই সমাজ থেকে অশান্তি নামক বাক্যটা বিলীন হয়ে যেত। মেহেভীন পাথর ন্যায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিয়াদ চৌধুরী রাগান্বিত হয়ে বলল,

–এবার তোমার শান্তি হয়েছে? এটাই তো চেয়েছিলে, তুমি! তোমাকে নিজের মেয়ের মতো করে রাখতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু তুমি প্রমাণ করে দিলে সবাই মেয়ে হবার যোগ্যতা রাখে না। তুমি আমাদের অশান্তি ছাড়া কিছুই দিতে পারোনি। আমাদের আলার করে তোমার হৃদয় শীতল হয়নি। এখনো কিসের জন্য এখানে দাঁড়িয়ে আছ? রিয়াদ চৌধুরীর কথায় মেহেভীনের ভিষণ করে বলতে ইচ্ছে করল, “আপনি আমাকে মেয়ে ভাবলে শেহনাজের মতোই আমার বলা সত্যি কথাটা যাচাই না করেই গ্রহণ করে নিতেন। আপনি আমার দোষ গুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। আমার ভুল গুলো খুঁজে খুঁজে বের করে দিলেন। আপনি যেমন আজ শেহনাজের দোষটা আপনার ছায়া দিয়ে আড়াল করে দিলেন। আপনার জায়গায় আমার বাবা থাকলে-ও একই কাজ করত। কিন্তু বাড়ির বউদের যে বলতে মানা। নারী মেনে নিতে আর মানিয়ে নিতে পারলেই সেই নারীর জীবন সুন্দর। আপনি নিজের মেয়ের দোষটা দেখলেন না। আমার ভুলগুলো দেখিয়ে দিলেন। তাহলে আপনি আমার বাবা হলেন কোথায় আব্বা?” কিছু বাক্য ধারালো অস্ত্রের মতো হৃদয়ে আঘাত করতেই থাকে। তবুও তা প্রকাশ করার নিয়ম নেই। প্রকাশ করলেই যে হৃদয়টা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। মেহেভীনের বাক্য গুলো কণ্ঠনালিতে এসে বেঁধে গেল। সে নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করল।

দখিনা বাতাস এসে মুনতাসিমের সমস্ত কায়া আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। বিষাদের ছোঁয়ায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে, মুনতাসিমের মন। ভেতরটা অদ্ভুত ভাবে যন্ত্রনা করছে। বাবার থেকে এমন অপ্রত্যাশিত আচরণ একদম আশা করেনি সে। বাবারা তো সংসার ভাঙার কথা বলে না। বাবারা তো সংসার টিকিয়ে রাখে। তাহলে আমার বাবা সংসার ভাঙার কথা কেন বলল? আমার ভেতরটা যে বাবার ছোট্ট কথায় রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে। সেটা কি বাবা দেখতে পেল না? যদি দেখতে পেত, তাহলে বাক্য গুলো কণ্ঠনালিতে আসার আগেই বাবার বুক কেঁপে উঠত। মেহেভীনের আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। সে নিঃশব্দে আস্তরণের এসে বসলো। বাক্য গুলো আজ শব্দ হারিয়েছে। অনুভূতিরা শূন্য হয়ে গিয়েছে। মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে পড়েছে। সমস্ত কায়া নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। তখনই মুনতাসিম মেহেভীনের পাশে অবস্থান করল। মেহেভীন মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মানুষ টার মুশ্রীর দিকে দৃষ্টি পড়তে-ই মেহেভীনের ভেতরটা অদ্ভুত ভাবে শীতল হয়ে গেল। একবার নয়, দুই বার নয়, অসংখ্যবার এই চোখের মায়ায় পড়েছে মেহেভীন। কিন্তু আজ তার জন্য মুনতাসিম তার বাবার থেকে আলাদা হয়ে গেল। ভাবতেই ভেতরটা যন্ত্রনায় কাবু হয়ে আসছে। বুকটা হাহাকার করছে। সমস্ত কায়া অস্থিরতায় ছটফট করছে। মেহেভীন শান্ত কণ্ঠে বলল,

–আপনার বাবা সঠিক কথাই বলেছে। আমি আপনার যোগ্য না। আমি যেদিন থেকে আপনার জীবনে এসেছি। সেদিন থেকে আপনাকে আমি দুঃখ ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি। আপনি আমায় ডিভোর্স দিয়ে দিন। আপনি বাবার পছন্দ মতো বিয়ে করে নিন। দেখবেন জীবনে সবশেষে সুখী মানুষটি হবেন আপনি। আমি জানতাম না আব্বা আমাকে এতটা অপছন্দ করে। মেহেভীনের প্রতিটি বাক্য আগুনে ঘি ঢালার জন্য যথেষ্ট ছিল। ডিভোর্স শব্দটা মুনতাসিমের ভেতরটা বিষাক্ত করে দিল। সে অন্য দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আমার মতো মানুষ পেয়েও যে বিচ্ছেদ চাইল! সে জীবনে আরো ভালো কিছু পাক। আপনি আপনার মন মতো জীবন সঙ্গী খুঁজে নিয়েন। আমার মতো নিকৃষ্ট মানুষের সাথে আপনার যায় না।

–আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি আপনার ভালো জন্য… মেহেভীনের প্রতিটি বাক্য বিষাক্ত করে তুলেছে মুনতাসিমকে। আজ যেন তার ক্রোধ শিরায়-উপশিরায় চলাচল করছে৷ মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠছে। উত্তপ্ত মেজাজে দৃষ্টি অন্য দিকে রেখেই হাত দিয়ে মেহেভীনকে থামিয়ে দিল। অদ্ভুত ভাবে মুনতাসিমকে মেহেভীনের ভয় লাগছে! নিরবতার থেকে ভয়ংকর প্রতিশোধ ধরনীর বুকে দু’টো নেই। মেহেভীন মুনতাসিমের হাতে হাত ছুঁতে গেলে মুনতাসিম গর্জন করে উঠল।

–একদম আমাকে ছোঁবেন না। আমাকে ছোঁয়ার অধিকার আপনি হারিয়েছেন। খুব সহজে পেয়ে গেলে মানুষ মানুষের কাছে সস্তা হয়ে যায়। আমি আপনাকে বলেছিলাম ধরনীর বুকে মহাপ্রলয় আসলেও আমার ওপরে ভরসা রাইখেন। আমি সবকিছু ঠিক করে দিব। কিন্তু আপনি ধরণীর অশান্তিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আপনার জীবনে আমার মূল্য কোথায়? আপনি আমার ভালোবাসা দেখেছেন। কিন্তু আমার নিষ্ঠুরতা দেখেন নাই। আমি যে কতটা জঘন্যতম মানুষ সেটা আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন। আমি আপনাকে অনুরোধ করে বলেছিলাম। আমার প্রতি অভিযোগ থাকলে বলবেন। আমি পুষিয়ে নিব। কিন্তু কখনো বিচ্ছেদের কথা মুখশ্রীতে উচ্চারন করবেন না। আমি বিষাক্ত হয়ে গেলে, আপনি জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবেন৷ তবুও আপনার প্রতি আমার এতটুকু মায়া কাজ করবে না। ভালোবাসা শেষ পরিনতি বুঝি মানসিক মৃত্যুদন্ড হয়? তাহলে সেই মানসিক মৃত্যুদন্ড নিয়ে জীবন পার করে দিব। তবুও যার কাছে আমার থেকে অন্যের মূল্যায়ন বেশি সেই মানুষের মুখ আমি দেখব না। আমি আর আপনার মুখ দেখতে চাই না। আপনি আর কখনো আমার সামনে আসবেন না। আমি আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিব। শেষের বাক্যটা উচ্চারন করার সময় কণ্ঠনালি কাঁপছিল। যেখানে ছেড়ে দেওয়ার কথা উচ্চারন করতেই ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। সেখানে মানুষটাকে ছাড়া সে থাকবে কি ভাবে? ভাবনা গুলো আজ শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির তৈরি করে দিয়েছে। ভেতরটা কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এই যে অসহায় লাগার ব্যাপারটা বিধাতা ছাড়া বোঝার ক্ষমতা কারো নেই। চারদিকে এত মানুষ এত কোলাহল তবুও মুনতাসিমের নিজেকে ভিষণ একা লাগছে। তার পাশে বসে ভরসা দেওয়ার কেউ নেই। সে কেবল যন্ত্রনা সহ্য করার জন্যই জন্ম নিয়েছে! তার ভাগ্য এমন কেন? একদিন ভালো কাটলে এক যুগ কাটে আপন মানুষের দেওয়া আঘাতে! মুনতাসিমের মলিন মুখশ্রী মেহেভীনের মস্তিষ্ক সচল করে দিল। পারিবারিক অশান্তিটা খুব সিক্রেট একটা কষ্ট, না কাউকে বলা যায় আর না সহ্য করা যায়। প্রতিদিন এত এত অশান্তি হলে তো মাথা খারাপ হবেই। তার যেমন মুনতাসিম ছাড়া ভালোবাসার কেউ নেই। মুনতাসিমেরও তো সে ছাড়া ভালোবাসার কেউ নেই। সে যদি সবকিছু ঊর্ধ্বে গিয়ে মেহেভীনের পাশে থাকতে পারে। তাহলে সে কেন অল্পতেই ভেঙে পড়ে! সে তো আগে এমন ছিল না। বেশি ভালোবাসা পেলে মানুষ দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা হারায়। তবে কি মুনতাসিমের অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা মেহেভীনের দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা শুষে নিল। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে উঠে চলে যাচ্ছিল। ভেতরটা অসহনীয় যন্ত্রনায় ছটফট করছে। জীবনে প্রথম মেহেভীনের ওপরে রাগ করল মুনতাসিম। সেই রাগ কতটা ভয়ংকর রুপ নিতে পারে৷ তার আভাস মেহেভীন পাচ্ছে। ভেতরটা কেমন জানি কু গাইছে! অদ্ভুত এক অনুভূতি! মন বলছে মুনতাসিমকে যেতে দিলে মস্ত বড়ো ভুল হবে। মেহেভীন মুনতাসিমের সামনে গিয়ে পথরোধ করে দাঁড়াল। মুনতাসিম রক্তিম আঁখিযুগলে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের আঁখিযুগলে প্রেয়সীকে নিয়ে কত-শত রাগ আর অভিযোগ দেখতে পাচ্ছে মেহেভীন। যে আঁখিযুগল ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকতো। কিছু সময়ের ব্যবধানে সেই আঁখিযুগল বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। মুনতাসিমের আঁখিযুগলে ভালোবাসা ছাড়া অন্য কেউ দেখতেই ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। মেহেভীন মুনতাসিমকে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,

–আপনি আমাকে খু’ন করে ফেললেও বাহিরে যেতে দিব না। আমার ভিষণ ভয় করছে। বুকের মধ্যে অসহনীয় যন্ত্রনা করছে। আপনি একটু শান্ত হন। আমি আপনাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি।

–আমাকে ছাড়ুন বলছি। আজ আপনাকে আঘাত করার কথা দ্বিতীয় বার ভাববো না। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েন না৷ দরকার পড়লে আপনাকে খু’ন করেই কক্ষ ত্যাগ করব। মুনতাসিমের হুংকারে কেঁপে উঠল মেহেভীনের সর্বাঙ্গ। তবুও শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে মুনতাসিমকে। আজকে সে কিছুতেই মানুষ টাকে ছাড়বে না৷ মানুষটার যে রাগ বেশি। যাকে দেখলে মানুষটার রাগ বিলীন হয়ে যেত। আজ সেই মানুষটার ওপরেই মুনতাসিম রেগে গিয়েছে। সেই রাগের পরিনতি কতটা ভয়ংকর হতে পারে? ভাবতেই মেহেভীনের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। দু’জন ধস্তাধস্তি করতে করতে মেহেভীন কায়া নিস্তেজ হয়ে আসতে শুরু করল। তার হাতের বাঁধন আলগা হতে শুরু করেছে। সে মুনতাসিমের ক্রোধ নিবারণ করতে অনেকটা সক্ষম হয়েছে। কিন্তু কথায় থাকে না যার ভাগ্য সহায় হয় না তার থেকে দুঃখী আর কেউ নেই। দু’জনের চেচামেচিতে রিয়াদ চৌধুরী উপরে আসলো। তাকে দেখেই মেহেভীন দুরত্বে সরে আসে। রিয়াদ চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–এটা ভদ্র লোকের বাড়ি! রজনীর শেষ প্রহরে এসে এমন অসভ্যের মতো চিৎকার চেচামেচি করছ কেন? দু’দিন পরে বাড়ি না গোরুর গোয়াল হয়ে যাবে। এত বছরের সব নিয়ম কানুন কয়েক দিনেই মাটির সাথে মিশে গিয়েছে। এমন অসভ্যের মতো আচরণ করা বন্ধ করবে নাকি আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব। এতকিছু করে শান্তি হয়নি তোমাদের? এমন মানসিক ভাবে অত্যাচার করছ কেন তোমরা? রিয়াদ চৌধুরীর কথায় কোনো উত্তর করল না মুনতাসিম। দ্রুত কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। মেহেভীন মুনতাসিমকে স্পর্শ করার আগেই মুনতাসিম ধরা ছোঁয়ার বাহিরে চলে গেল। মেহেভীন দ্রুত কক্ষের বাহিরে যেতে চাইলে রিয়াদ চৌধুরী থামিয়ে দিয়ে বলল,

–তুমি কোথায় যাচ্ছো?

–উনি অনেক রেগে আছে আব্বা। উনাকে বাহিরে যেতে দিবেন না। আপনি অনুমতি দিলে উনাকে গিয়ে নিয়ে আসি?

–আমার ছেলের মস্তক খেয়ে শান্তি হচ্ছে না? এবার কি তার জীবন খাবে! তাকে একটু তার মতো থাকতে দাও। তার রাগ পড়লে একাই বাড়ি ফিরে আসবে। তার পেছনে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।

–আপনি যতটা সহজ ভাবে বলছেন। ব্যাপারটা এতটা সহজ হলে এতটা যন্ত্রনা সহ্য করতাম না। যাকে দেখে মানুষটার রাগ শীতল হয়। তার ওপরে রাগলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হয়। সেটা আপনাকে কে বোঝাবে আব্বা? মানুষটা যে ভিষণ রাগী। রাগ হলে নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। মানুষটার কিছু হলে আমি একদম নিঃস্ব হয়ে যাব। মেহেভীনের কথা গুলো রিয়াদ চৌধুরীর কর্ণকুহরে পৌঁছাল কি না কে জানে? তিনি নিজের কথা শেষ করেই মেহেভীনের থেকে অনেকটা দুরত্বে চলে গিয়েছে। রিয়াদ চৌধুরীর সামনে থাকায় মুনতাসিমের কাছে যেতেও পারছে না। এটা নিয়েও যদি অশান্তি হয়। এই যে অসহায় লাগার মতো বাজে অনুভূতি দু’টো নেই। মেহেভীন তাইয়ানকে ফোন দিয়ে বলল সে যেন মুনতাসিমের সাথে যায়। তাইয়ান বাহিরেই ছিল। সে মেহেভীনের কথা মতো মুনতাসিমের গাড়িতে গিয়ে উঠে বসল। মুনতাসিমের রাগ হলে সে নিরিবিলি প্রাকৃতিক স্থানে গিয়ে বসে থাকতে স্বাচ্ছন্ন বোধ করে। তাই তাইয়ান স্বাভাবিক রাগ ভেবেই অন্য কাউকে ডেকে তুলল না। রজনীর আঁধারে কি আর কেউ ক্ষতি করার জন্য বসে থাকবে? তাইয়ান কি জানে না। বাহিরের লোক বসে না থাকলে-ও ঘরের লোক বসে ঠিকই থাকে। মুনতািসমের কোনো দিকে হুস নেই। এই অশান্তি নামক শব্দটা জীবনটাকে একদম মূল্যহীন করে তুলেছে। সে গাড়িতে উঠেই চলে গেল। সেই দৃশ্যটা ছাদের কার্নিশ থেকে কেউ একজন দেখে তৃপ্তির হাসি হাসল। মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে আনন্দ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

–মুনতাসিম তাইয়ানকে নিয়ে একা বেড়িয়ে গিয়েছে। মুনতাসিমের সাথে আজ কোনো গার্ড যাইনি। এটাই সুযোগ এই সুযোগটা যদি লুফে নিতে না পারো। তাহলে জীবনে মুনতাসিমকে ধংস করতে পারবে না। মুনতাসিম আজকে ভিষণ রেগে আছে। ও রেগে থাকলে নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তুমি দ্রুত জাফর ইকবালকে খবরটা পৌঁছে দাও। আমরা নিজে আর কিছুই করব না। তুমি বাহিরে বের হয়ো না। তাহলে মুনতাসিম কিন্তু আবার তোমাকে ধরে ফেলবে।

রজনীর মধ্য প্রহর হওয়াতে পথে তেমন গাড়ি নেই। কেউ গভীর নিদ্রায় ব্যস্ত কেউ বা রাত জেগে নিজের লক্ষ্য পূর্ণ করতে ব্যস্ত। এত ব্যস্ততার মধ্যে একটি অশান্ত হৃদয় গন্তব্যহীন ভাবে ছুটে চলেছে। মুনতাসিমকে এমন বেখেয়ালি ভাবে কোনোদিন গাড়ি চালাতে দেখেনি তাইয়ান। মুনতাসিম খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছে। যেন এ শহর ছেড়ে পালাতে পারলেই সে বাঁচে। তাইয়ানের ভেতরটা ভয়ে কাঁপছে। সে ভীত কণ্ঠে বলল,

–স্যার গাড়ি আস্তে চালান। যেকোনো সময় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

–আমি তোমাকে আমার সাথে আসতে বলিনি। তবুও তুমি কেন এসেছ? আর যখন এসেছ তখন ভয় কেন পাচ্ছ? আমি ম’রে গেলে আমার সাথে তুমিও ম’রেও যাবে। আমি বেঁচে থাকলে তুমিও বেঁচে থাকবে। তুমি কি মরতে ভয় পাচ্ছ তাইয়ান?

–আপনার জন্য আমি সর্বদা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে প্রস্তুত। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিম শীতল দৃষ্টিতে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করল। তাইয়ান নির্ভয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাইয়ানের আঁখিযুগলে মুনতাসিমের জন্য কত ভালোবাসা! এই ভালোবাসার ক্ষতি মুনতাসিম জেনে-বুঝে করবে? সেটা কখনোই না। তাইয়ানের সামনে নিজেকে স্বাভাবিক করতে হবে।

জাফর ইকবাল গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন। মুনতাসিমের খবরটা কর্ণকুহরে আসতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। সে দ্রুত নিজেদের লোকদের হুলস্থুল করে ডেকে তুলল। মুনতাসিম যে এরিয়ার মধ্যে আছে। সেই এরিয়ার মধ্যে দ্রুত তিনটা ট্রাকের ব্যবস্থা করতে বলল। প্রতিটি সেকেন্ড যেন ঘন্টার সমান হয়ে গিয়েছে। জাফর ইকবালের সমস্ত কায়া থরথর করে কাঁপছে। পনেরো মিনিট হয়ে গেল। তবুও এখনো সবকিছু রেডি করতে পারল না! জাফর ইকবালের সবকিছু চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে ইচ্ছে করছে। কক্ষের সব আসবাবপত্র তচনচ করে দিতে শুরু করেছে। তখনই মুঠোফোনটা বার্তা নিয়ে আসলো। মুনতাসিম মাঝ পথে গাড়িয়ে থামিয়েছে। এই সুযোগে তারা কায়দা কৌশল সঠিক ভাবে প্রস্তুত করে ফেলল। জাফর ইকবালের হৃদয়টা আজ শীতলতা অনুভব করছে। মুখশ্রীতে তার তৃপ্তির হাসি।

–গাড়ি দাঁড় করালেন কেন স্যার?

–বুঝতে পারছি না তাইয়ান। একটু বাহিরে গিয়ে দেখবে কি সমস্যা হয়েছে? তাইয়ান একটু অবাক হলো মুনতাসিম এতটা স্বাভাবিক হয়ে গেল কি করে? সে অদ্ভুত চাহনিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে বলল,

–তোমাকে যেতে হবে না থাক আমি যাচ্ছি। মুনতাসিমের কথায় তাইয়ান দ্রুত গাড়ি থেকে নামল। তাইয়ান গাড়ি থেকে নামতেই মুনতাসিম গাড়ি টান দিয়ে সামনের দিকে ছুটে চললো। তাইয়ান নিজেই নিজের ললাটে প্রহার করল। সে কেন মুনতািসমের ফাঁদে পা দিল? তাইয়ান দৌড়াতে শুরু করল। সে গার্ডদের কল করে দিয়েছে। তারা যেন গাড়ি নিয়ে দ্রুত উপস্থিত হয়। তারা অর্ধেক পথ চলে এসেছে। কিন্তু এখন সে মুনতাসিকে কিভাবে ধরবে? তাইয়ান আবার দৌড়াতে শুরু করে দিল। মুনতাসিম গাড়ির স্প্রিড সর্বোচ্চ বাড়িয়ে দিল। তাইয়ান যেন তাকে ধরতে না পারে। কিছুদূর যেতেই মুনতাসিমের দৃষ্টিতে তিনটা ট্রাকের দেখা মিললো। ট্রাকগুলো দ্রুত গতিতে তার দিকে ধেয়ে আসছে। মুনতাসিমের ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল। তারা ভুল পথ দিয়ে গাড়ি নিয়ে আসছে। মুনতাসিম গাড়ি পেছাবে তার কোনো সুযোগ নেই। তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাবে এমন অবশিষ্ট জায়গা নেই। মুনতাসিমের বিচক্ষণ মস্তিস্ক যা বোঝার বুঝে ফেলছে। সে এটা ভেবে শান্তি পেয়েছে। যে তাইয়ানকে সে নিরাপদে রেখে আসতে পেরেছে। মুনতাসিম নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করার আগেই ট্রাক গুলো মুনতাসিমের গাড়িটা গুঁড়িয়ে দিল। কালো পিচ ঢালাই করা রাস্তাটা রক্তে ভেসে যেতে শুরু করল। মাটি খুব যত্ন সহকারে মুনতাসিমের দেহ থেকে বেড়িয়ে আসা রক্ত গুলো শুষে নিচ্ছে। রাস্তায় রক্তের ছাড়াছাড়ি দেখে তাইয়ানের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। পাশেই মুনতাসিমের রক্তাক্ত নিথর দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। শুভ্র পাঞ্জাবিটি রক্তে ভিজে নতুন রুপ নিয়েছে। তাইয়ানের সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। আশেপাশেই দু-একজন মানুষ আসতে শুরু করেছে। মুনতাসিমের কোনো জ্ঞান নেই। দুই গাড়ির সংঘর্ষ হবার পর সাথে সাথেই কি সে জ্ঞান হারিয়েছে? মুনতাসিমের এমন ভয়ংকর অবস্থা দেখে তাইয়ানের ভেতর হাহাকার করে বলে উঠল, “মানুষটা বেঁচে আছে তো?”

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৪৯+৫০+৫১

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি কোণায় নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে। পরিবেশ জুড়ে পিনপতন নিরবতা। মুনতাসিমের শীতল চাওনি প্রলয়ের ভেতরে ঝড় তুলে দিয়েছে। সমস্ত মন মস্তিষ্ক ভয়ে কাবু হয়ে আসছে। মানুষটা তার সাথে কোনো কড়া বাক্যে কথা বলেনি। তবুও সে ভয় পাচ্ছে ভিষণ ভয়। বাক্য গুলো কণ্ঠ নালিতে এসে আঁটকে যাচ্ছে। প্রলয়ের ভেতরে দারুন জড়তা কাজ করছে। মুনতাসিমের গম্ভীর আঁখিযুগল প্রলয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের শীতল দৃষ্টি প্রলয়ের ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলছে। যাকে দেখলে অন্যরা ভয় পায়। আজ সে কাউকে দেখে ভয় পাচ্ছে! ভয় তো পাবারই কথা একজন মন্ত্রীকে তো আর বলা যায় না। স্যার আপনার বউয়ের সাথে অন্য একটা পুরুষ একান্তে কথা বলতে চায়। আপনি কথা বলার অনুমতি দিন। বিরক্তিতে মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রী কুঁচকে এল। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আপনার সময়ের মূল্য না থাকতে পারে প্রলয়। কিন্তু আমার সময়ের মূল্য আছে। আপনি দশ মিনিট ধরে এখানে চুপচাপ বসে আছেন। আপনাকে দেখার জন্য নিশ্চয়ই আমাকে বসিয়ে রাখেন নি। আপনার যা কথা বলার আছে। আপনি কোনো জড়তা ছাড়াই বলতে পারেন। মুনতাসিমের বাক্যগুলো কর্ণকুহরে আসতেই প্রলয় এলোমেলো হয়ে গেল। মস্তিষ্ক শূন্য হতে শুরু করল। বুদ্ধিরা কাজ না করার পণ করেছে। প্রলয় কোথায় থেকে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে গাঢ় শ্বাস ছেড়ে বলল,

–সাতদিন ধরে আপনার বাসায় আসছি। আপনার দেখা না পেয়ে আমাকে বারবার ঘুরে যেতে হচ্ছে। আমি একটা অনুমতি চাইতে আপনার কাছে এসেছি। আমি জানি আবদারটা আমার জন্য কতটা ভয়ংকর। তবুও আমি নিরুপায় স্যার। আপনি আমাকে সাহায্য করুন।

–আমি জানি আপনি আমার অর্ধাঙ্গিনীর সাথে জারিফকে শেষ বারের মতো কথা বলিয়ে দিতে চাইছেন। আমি ইচ্ছে করেই সাতদিন আপনার সাথে দেখা করিনি। আপনি নিশ্চই চাইবেন না। আপনার অর্ধাঙ্গিনীকে পরপুরুষের কাছে কথা বলতে পাঠাতে। এমন কোনো কথা বলবেন না। যেটা আমি রাখতে পারব না। আপনার সততাকে আমি সন্মান করি। আশা রাখছি। আপনি আমার সন্মানের মূল্য দিবেন। মুনতাসিমের কথায় প্রলয়ের মুখশ্রীতে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। তবে কি জারিফকে দেওয়া কথা রাখতে পারবে না সে? জারিফ যে তার অস্তিত্ব বিলীন করে দিবে ধরনীর বুকে থেকে। প্রলয় কাতর কণ্ঠে বলল,

–জারিফকে কথা দিয়েছিলাম। লা’শ দু’টোর সন্ধান দিলে তাকে মেহেভীনের সাথে কথা বলিয়ে দিব। সে তার কথা রেখেছে। আমি তাকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি বলে, সে আমার অর্ধাঙ্গিনী আর সন্তানকে আঁটকে রেখেছে। আপনি যদি সদয় না হোন। তাহলে আমার জন্য আমার প্রিয় মানুষ গুলো ধরনী থেকে বিলীন হয়ে যাবে। আমি যে জীবিত লা’শ হয়ে যাব স্যার। আমাকে একটু দয়া করুন।

–আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার অর্ধাঙ্গিনী আর সন্তানকে পেয়ে যাবেন। তাদের আপনার হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। আপনি এবার আসতে পারেন। আমাকে বের হতে হবে। আর পরের বার মেহেভীন নয় ম্যাডাম বলে ডাকবেন। মনে থাকে যেন। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম নিজের কক্ষে চলে গেল। প্রলয় আহত হৃদয় নিয়ে চৌধুরী বাড়ির বাহিরে আসলো। জারিফ আগ্রহ নিয়ে প্রলয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। প্রলয়ের মলিন মুখশ্রী দেখে জারিফের যা বোঝার বুঝে গেল। সে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে চৌধুরী বাড়ির দিকে দৌড় দিল। প্রলয় সহ আরো চারজন পুলিশ জারিফের পেছনে দৌড়ে দিল। একজন গার্ড জারিফকে গুলি করল। সেটা জারিফের কায়া স্পর্শ না করেই অন্য দিকে চলে গেল। প্রলয় গার্ডদের গুলি করতে নিষেধ করল। জারিফকে তারা ধরবে। গার্ডরা শুনলো না। সবাই মিলে জারিফকে ধরার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলো। জারিফ দৌড়ে মুনতাসিম এবং মেহেভীনের থেকে দশ হাত দুরত্বে এসে স্থির হয়ে গেল। সে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। হাতে তার হ্যান্ডকাফ লাগানো। সমস্ত কায়া শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। আঁখিযুগলের নিচে কালো দাগ পড়েছে। রমণীদের আর্কষণ করা সুদর্শন পুরুষটা আজ তার সৌন্দর্য হারিয়েছে। জারিফকে দেখেই মেহেভীন শক্ত হাতে মুনতাসিমের হাত আঁকড়ে ধরল। গার্ডরা এসে জারিফকে টানতে চাইলে এক চুল নড়াডে পারছে না। জারিফ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

–আমি দশটা মিনিট মেহেভীনের সাথে কথা বলব স্যার। আমার মৃত্যুর আগে শেষ চাওয়া আপনার কাছে। আপনি তো সারাটাজীবন আমার শখের মানুষটার সাথে কাটাবেন। সেখানে থেকে আমাকে দশটা মিনিট সময় দেওয়া যায় না স্যার? আমি আপনার পায়ে পড়ি। আমাকে আপনি এখানেই রক্তাক্ত করে দিন। আজ যদি মেহেভীনের সাথে কথা বলতে না পারি। তবে আমাকে এক চুল পরিমাণ সরাতে পারবেন না। আমাকে খু’ন করুন না হলে মেহেভীনের সাথে কয়টা কথা বলতে দিন। মেহেভীন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মেহেভীনের মুখশ্রীতে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। মুনতাসিম আঁখিযুগল দিয়ে মেহেভীনকে ভরসা দিল। মেহেভীনের হৃৎপিণ্ডের গতিবেগ তড়িৎ গতিতে ছুটে চলেছে। গার্ডরা জারিফকে টানাটানি করতে লাগলে মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–ছাড়ো ওকে। এখন সাতটা দশ বাজে সাতটা বিশে তোমার সময় শেষ। যা বলার আমার সামনেই বলতে হবে। বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা করলে দেহ থেকে মাথা আলাদা করে দিব। মুনতাসিমের অনুমতি পেয়ে জারিফের হৃদয় শীতল হয়ে গেল। আঁখিযুগলে অশ্রু এসে ভরে গেল। অদ্ভুত ভাবে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। জারিফের দৃষ্টিতে প্রিয় মানুষকে দেখার জন্য কত দিনের তৃষ্ণা জমে আছে। এত দিনের জমিয়ে রাখা তৃষ্ণা আজ সব উসুল করে নিচ্ছে। পিপাসিত হৃদয়টা আজ প্রেয়সীকে দেখে শীতল হয়ে গেল। তিন মিনিট সে মেহেভীনকে মন ভরে দেখে নিয়েছে। বাকি সাত মিনিটে কথা গুলো বলে শেষ করতে হবে। জারিফ আহত দৃষ্টিতে মেহেভীনকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। প্রিয় মানুষটাকে অন্যের পাশে দেখে বুকটা ভারি হয়ে আসছে। ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। মনটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। জীবনে মৃত্যু আসুক তবু্ও প্রিয় মানুষকে অন্যের পাশে দেখার মতো পরিস্থিতি কারো না আসুক। জারিফ কাতর কণ্ঠে বলল,

–আমার মনের রাণী কি সুন্দর একটা ভরসার হাত পেয়েছে। ধরনীর বুকে কত-শত পুরুষ আছে। কিন্তু আমার মহারাণী কাউকে ভয় পায় না। শুধু আমাকে ভয় পায় । আর পাবেই না কেন? মানুষ তো মানুষকে ভয় পায় না। ভয় পায় মানুষরুপী জা’নো’য়া’র’কে আমি তো মানুষ না। আমি একটা মানুষ রুপী জা’নো’য়া’র। কতটা ভাগ্য নিয়ে জন্মালে আমার শখের মানুষটাকে অন্য কেউ না চাইতেই পেয়ে যায়। আর আমি এত চেয়েও পাইলাম না। আমার মুনতাসিমকে ভিষণ করে ঈর্ষা হয় জানিস। আমি কেন মুনতাসিম হতে পারলাম না বল তো? পরপারে যদি আমাদের দেখা হয়। তাহলে আল্লাহকে বলব। আল্লাহ যেন আমাকে মুনতাসিম বানিয়ে দেয়। আজ আমার জায়গায় মুনতাসিম আছে। সেদিন মুনতাসিমের জায়গায় আমি থাকব। আমাকে কেন ভালোবাসলি না মেহেভীন? আমার মধ্যে কিসের কমতি ছিল? এতটা ভালোবাসা দিয়েও আমি কেন তোকে পেলাম না? আমাকে এরা ফাঁসি দিচ্ছে না কেন বল তো? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। আমার মতো নষ্ট পুরুষের সাথে তোর যায় না। মুনতাসিমের মতো অসাধারণ পুরুষের পাশেই তোকে মানায়। তোকে না পাওয়ার আক্ষেপ আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থেকে যাবে। জারিফের কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মেহেভীন। প্রতিটি মানুষের জীবনে যেমন খারাপ কিছু মুহূর্তে থাকে। ঠিক তেমনই ভালো মুহূর্তও থাকে। আজ মেহেভীনের ভালো মুহূর্তের কথা স্মরন হলো। সে কঠিন বাক্যে বলল,

–তুই আমাকে ভালোবেসে ছিলি এটা ঠিক। কিন্তু তোর ভালোবাসার কৌশল সঠিক ছিল না। ভালোবাসা পেলে শত্রুরাও গলে যায়। যেখানে আমি একজন মানুষ মাত্র তা-ও তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলি। ভালোবাসার মতো ভালোবাসলে তোকে ভালোবাসতে বাধ্য ছিলাম আমি। কিন্তু তুই সবকিছু নিজের মন মতো চেয়েছিস। তোর যা লাগবে তুই পেলেই হবে। অন্য কারো যে মন আছে। তার-ও যে মতামত আছে। সেটা তুই ভাবসি নি। তুই আমাকে কলঙ্কিত করতে চেয়েছিলি। আমার সাথে পৈশাচিক আরচণ করেছিস। জোর করে চাহিদা মেটানো যায়। কিন্তু ভালোবাসা পাওয়া যায় না। তুই সব সময় নিজের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়েছিস। তোর ভাষায় যেটা ভালোবাসা। আমার ভাষায় সেটা শরীরের কামনা। যদিই ভালোই বাসতি। তাহলে আমাকে অসুস্থ করে দিতি না। সেদিনের কথা স্মরন হলে আজও আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেঁপে ওঠে। আজ-ও আমি তোকে ভয় পাই। ভালোবাসায় তো ভয় থাকে না। ভালোবাসায় থাকে শুধু বিশ্বাস আর ভরসা। যেটা তোর মধ্যে আমি কোনোদিন পাইনি। আর কি বললি মুনতাসিম আমাকে না চাইতেই পেয়ে গেছে। মুনতাসিম একটাই এক পিস। সে আমাকে পাবার জন্য যা কিছু করেছে। তা তোর মানসিকতায়ও আসেনি। তোকে তোর কামনা মিটাতে দেইনি বলে তুই আমাকে প্রহর করতে দু’বার ভাবিসনি। আর মুনতাসিম আমাকে প্রহার করবে না বলে সে নিজেই নিজেকে প্রহার করে। আমি তোর হতে চাইনি বলে তুই আমায় সন্মান নষ্ট করতে চেয়েছিস। আর আমি মুনতাসিমের হতে চাইনি বলে, সে আমায় ভালোবাসতে বাধ্য করেছে। আমি তাকে কশ-শত অসম্মান, অবহেলা, দুঃখ দেওয়ার পরও মানুষটা শুধু আমায় চেয়েছে। মুনতাসিম এমন একটা মানুষ যাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না। এখানেই তোর আর মুনতািসমের পার্থক্য। মুনতাসিম সব সময় আমার চাওয়া পাওয়ার মূল্য দিয়েছে। আমাকে গুরুত্ব দিয়েছে। আমার স্বামী আমার কাছে সুপার হিরো। আমার চোখে দেখা শ্রেষ্ঠ পুরুষটি হচ্ছে আমার স্বামী। আমার স্বামীর সাথে নিজের তুলনা দিয়ে আমার স্বামীকে অসম্মান করিস না। তোর মতো অমানুষের সাথে আমার স্বামীর মতো অসাধারণ মানুষের তুলনা দিলে-ও পাপ হবে। পরিশেষে একটা কথাই বলব। আমি তোকে ঘৃণা করি। মনের গভীর থেকে ভিষণ ভাবে ঘৃণা করি। তোর মুখশ্রী দেখে আমার সমস্ত কায়া ঘৃণায় রি রি করে ওঠে। আমার জন্য দু’টো খু’ন করলেই তোর পাপ সব ছাপ হয়ে যাবে না। আমি তোমার স্বামীকে ভিষণ রকমের ভালোবাসি। আমি আমার স্বামীকে নিয়ে সুখ আছি। আর কখনো আমার স্বামীর সাথে নিজের তুলনা দিয়ে নিজেকে নিচু মন মানসিকতার পরিচয় দিস না। আমি আর তোর সাথে কথা বলতে চাইছি না। তুই আমার সামনে থেকে চলে যা। তোর মতো বড়লোক ঘরের ছেলেদের আমার চেনা আছে। বাবার টাকা দিয়ে দু’দিন পর ঠিকই জেল থেকে বের হয়ে আসবি। মেহেভীনের কথায় জারিফ মলিন হাসল। হাসিটা যে কারো হৃদয় কাঁপিয়ে তুলবে। কিন্তু হৃদয় কাঁপল না মেহেভীনের। সে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরে নিল। মুনতাসিম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আর এক মিনিট সময় আছে। জারিফের ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। শেষ বারের মতো মেহেভীনকে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে করল। পূর্ণতার জীবনে সবকিছু পূর্ণতা পায় না। কিন্তু অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হয়। জারিফ নিজ থেকেই সামনের দিকে এগোতে লাগলো। আঁখিযুগল বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। আঁখিযুগল অসম্ভব ভাবে লাল হয়ে গিয়েছে। অধরের কোণে মলিনতার হাসি। সমস্ত কায়া দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। শেষ বারের মতো মেহেভীনকে এক নজর দেখে নিল। পুরুষ মানুষের আঁখিযুগলে অশ্রু বড্ড বেমানান। এতদিন তেজে হুংকার করা মানুষটা হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল। চরণ দু’টি যেন আর এগোচ্ছে না। প্রলয় গভীর ভাবে জারিফকে পর্যন্ত করল। মনের অজান্তেই জারিফের জন্য বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠল। জারিফ বাহিরে এসে চিৎকার করে বলল,

–আমার সবকিছু মিথ্যা ছিল মেহেভীন। কিন্তু আমি যে তোকে ভালোবাসি। তোর প্রতি আমার ভালোবাসাটা এতটুকুও মিথ্যা ছিল না। আমার সব মিথ্যার মধ্যে আমি যে তোকে ভালোবাসি, এই কথাটা মৃত্যুর মতো সত্য ছিল। তোকে না পাওয়ার আক্ষেপ আমাকে প্রতিটি মুহুর্তে পোড়াবে। তুই দেখে নিস। জারিফ আর তোর পিছু নিবে না। এই অমানুষটা ম’রে গেলে লা’শটা দেখতে আসিস না। আমার মৃত মুখটা তোর দুঃখ বাড়িয়ে দিবে। বেঁচে থাকতে যত দুঃখ দিয়েছি। সেগুলো পুষিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তবে তোর পিছু ছেড়ে শান্তিতে থাকতে দেওয়ার পথ আমার জানা আছে। তুই ভালো থাকিস। আমাদের আর দেখা হবে না। পৃথিবীকে জানিয়ে গেলাম। তোমরা প্রেমে পড়ো না প্রেম মানুষকে বাঁচতে দেয় না। যদি প্রেম তোমার কাছে চলে আসে। তবে প্রিয় মানুষটাকে নিজের করে নিও। নিজের শখের মানুষটাকে অন্যের পাশে দেখার মতো ভয়ংকর যন্ত্রনা পৃথিবীতে দুটো নেই। মৃত্যু আসুক তবুও প্রেম না আসুক। কথা গুলো বলেই জারিফ গাড়িতে গিয়ে উঠে বসল।

প্রাপ্তির মা চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে ছিল। মেহেভীন আর মুনতাসিম ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই প্রাপ্তি মা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

–তুমি কেমন মেয়ে রে মেহেভীন? তোর মাকে পুলিশ ধরে গিয়েছে আর তুই নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! এই তোর মায়ের প্রতি ভালোবাসা! তোর মতো স্বার্থপর মেয়ে আমি দু’টো দেখিনি। যেই মন্ত্রীর বউ হয়েছিস। ওমনি মায়ের কথা ভুলে গিয়েছিস!

–আপনি কি সংসারে অশান্তি লাগানোর জন্য এসেছেন চাচি? আমি প্রতিদিন মায়ের সাথে কথা বলি। কাল রাতেও বলেছি। এসব মিথ্যা কথা আমার কাছে বলে লাভ নেই।

–তোকে মিথ্যা কথা বলে আমার লাভ আছে। তোর স্বামীও জানে তোর মাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। সে কি তোরে বলে নাই। আরো নতুন নতুন খবর শুনলাম। তোর মা নাকি তোর বাপকে খু’ন করেছে। মুনতাসিম নাকি তোর মাকে সাহায্য করেছে। তুই একজন খু’নি’র সাথে সংসার করেছিস মেহেভীন? মেহেভীনে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। সে মায়া ভরা দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে তাকালো। মুনতাসিম অপরাধীর ন্যায় মস্তক নুইয়ে নিল। মেহেভীন শান্ত কণ্ঠে বলল,

–চাচি যা বলছে সব সত্যি কথা বলছে মুনতাসিম? মেহেভীন সহজে মুনতাসিমের নাম ধরে ডাকে না। আর যখন ডাকে তখন মুনতাসিমের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলে। মুনতাসিম অনুভূতি শূন্য হয়ে গেল। উপস্থিত বুদ্ধি আজ কাজ করছে না। মুনতাসিম কেন জানি মিথ্যা কথা বলতে পারে না। তবে আজ সত্য মিথ্যার সংমিশ্রণ সে করবে। সে মেহেভীনের দিকে না তাকিয়েই বলল,

–সব সত্যি। আমি আপনার বাবাকে খু’ন করেছি। আপনার মা আমাকে বাঁচানোর জন্য নিজে পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছে। আপনি আপনার মাকে বোঝান। সে যেন ফিরে আসে। আপনি আপনার মাকে ভুল বুঝবেন না। আপনার যা শাস্তি দেওয়ার আমাকে দিন। বাক্য গুলো কর্ণকুহরে আসতেই মেহেভীনের সমস্ত কায়া নিস্তেজ হয়ে গেল। মনটা বিশ্বাস করতে চাইছে না। তবুও মস্তিস্ক অচল হয়ে পড়তে শুরু করেছে। মেহেভীন আহত দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। সামনে ভয়ংকর রকমের কিছুর আভাস পাচ্ছে মেহেভীন। তবে কি সে ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হতে চলেছে। ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত ভাবে শ্বাস আঁটকে আসছে তার। মেহেভীন দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে গেল। মুনতাসিম শত ডেকে ও মেহভীনের থেকে সাড়া পেল না। তবে কি দুঃখ এসে সুখে ভাঙ্গন ধরে গেল!

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বেড়েছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বুদ্ধিরা আজ শূন্য হয়ে গিয়েছে। বুকের ভেতরটা অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করছে। আঁখিযুগলে অশ্রুকণা এসে জমা হয়েছে। মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রীতে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। রাইমা বেগম মেয়েকে দেখে প্রশান্তির হাসি হাসলেন। তার মুখশ্রীতে নেই কোনো ভয়! আতঙ্ক মেহেভীনকে স্পর্শ করতে পারলেও রাইমা বেগমকে স্পর্শ করতে পারেনি৷ মেহেভীনের মন, মস্তিষ্ক চিন্তায় অকেজো হয়ে গিয়েছে। রাইমা বেগম জেলের অন্ধ কুঠুরি থেকে মেয়ে দিকে এগিয়ে আসলেন। মেহেভীনের মুখশ্রীতে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর শোনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। রাইমা বেগম শীতল কণ্ঠে বলল,

–কেমন আছিস মা?

–তুমি এখানে কিভাবে আসলে আম্মু? তোমার সাথে আমার রোজ কথা হয়। তুমি কেন আমাকে জানাওনি? যে তোমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছে! আমি আজকেই তোমার জামিনের ব্যবস্থা করছি। তারা কিসের ভিত্তিতে তোমাকে এখানে নিয়ে আসলো? তুমি তাদের বাঁধা প্রয়োগ করলে না কেন? মুনতাসিম কি সব বাজে কথা বলছে। চাচি এসে তোমার নামে বাজে কথা বলে যাচ্ছে। এবার কিন্তু তার স্বামীর সাথে তাকে-ও জেলে ভরে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিব আম্মু।

–মুনতাসিম তোকে কি বলেছে?

–সে বলেছে সে নাকি আমার বাবাকে খু’ন করেছে। আবার চাচি বলছে তুমি নাকি বাবাকে খু’ন করেছ।

–মুনতাসিম তোকে মিথ্যা বলেছে। আর তোর চাচি তোকে সত্যি কথা বলেছে। আমি-ই তোর বাবাকে খু’ন করেছি। আমি অনেক আগেই ধরা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মুনতাসিমের জন্য পারিনি। ছেলেটা তোকে বড্ড বেশি ভালোবাসে। তোকে হারানোর ভয়ে প্রতিটি মুহুর্তে তার হৃদয় কাঁপে। আমার জন্য ছেলেটাকে ভুল বুঝিস না মা। মুনতাসিমের মতো জীবনসঙ্গী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার এমন ভাগ্য সবার থাকে না। তুই ভাগ্য করে পেয়েছিস। হৃদয়ের গুপ্ত কুঠুরিতে আগলে রাখিস। রাইমা বেগমের বাক্য গুলো শেষ হতেই মুনতাসিম এসে উপস্থিত হয়। মুনতাসিমকে দেখেও রাইমা বেগমের মুখশ্রীতে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল। মুনতাসিম কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হতেই রাইমা বেগম বললেন,

–আজ তুমি কিছুই বলবে না মুনতাসিম। আজ আমি বলব। তোমরা শুনবে।

–আমার দোষ কেন শুধু শুধু নিজের কাঁধে নিচ্ছেন আন্টি?

–তুমি মিথ্যা বলায় ভিষণ কাঁচা মুনতাসিম। মিথ্যা কথা বলতে গিয়ে তোমার কণ্ঠনালি কাঁপছে। আমাকে তো অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখলে আর কতদিন বাঁচাবে? একজন খু’নিকে একদিন না একদিন মরতেই হবে। শুধু শুধু আমাকে বাঁচিয়ে রেখে কি লাভ? তুমি যে যন্ত্রনাটা মেহেভীনের থেকে আড়াল করতে চাইছ। সেটা মেহেভীন নিজ থেকে জানতে পারলে দ্বিগুন কষ্ট পাবে। তার থেকে ভালো আমি বলে দিয়ে কষ্টটা কমিয়ে দেই। সত্যটা যত তাড়াতাড়ি মেহেভীন মেনে নিতে পারবে। তত তাড়াতাড়ি মেহেভীনের জন্য মঙ্গল। তুমি আমাকে আন্টি না ডেকে মা ডাকবে। আন্টি ডাকে ভালোবাসা খুঁজে পাই না।

–আপনি মা হয়ে ছেলের কথা রাখলেন না কেন মা? আমাকে আর একটু সময় দিলে আপনার খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? মুনতাসিমের মুখশ্রীতে মা ডাকটা খুব মধুর শোনালো রাইমা বেগমের কাছে। সে বুক ভারি করা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

–আমি তোর বাবাকে খু’ন করেছি। তাকে ছয় টুকরো করে ছয় জেলায় লুকিয়ে রেখেছিলাম। আমি অনেক আগেই আত্নসমর্পণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মুনতাসিমের জন্য পারিনি। তখন তোর সদ্য চাকরি চলে গিয়েছে। তোর বাবার তোর ছোট্ট হৃদয়টা রক্তাক্ত করে দিয়েছিল৷ তুই যখন আমাকে বললি তোর চাকরিটা আর নেই। তখন আমি ভিষণ ভয় পেয়েছিলাম। তুই বাড়ি আসলে আবার সবকিছু বুঝে না ফেলিস। তোর বাবার মৃত্যুর খবরটা তোকে একদম ভেতর থেকে শেষ করে দিয়েছিল মেহেভীন। তুই ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতি না। চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে নিজেকে বন্দী করে ফেলছিলি৷ তোর মুখের হাসিটা যেন কোথায় বিলীন হয়ে গেল। তোর চেহারার দিকে তাকানো যেত না। দিন দিন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিলি। মা হয়ে মেয়ের এমন করুন অবস্থা কিভাবে সহ্য করতাম বল? তাই নিজের যন্ত্রনাকে মাটি চাপা দিয়ে তোকে সুখী দেখতে চেয়েছি। মুনতাসিমের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। আমি মুনতাসিমকে বলেছিলাম তিন মাস আমি তোমাকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য সময় দিলাম। কিন্তু বিশ্বাস কর প্রতিটি সেকেন্ড আমি শতবার করে মরে যাই। যে মানুষটাকে ঘৃণা করতে করতে তার পবিত্র ভালোবাসায় জড়িয়ে গিয়েছি। যার মায়ায় আমি নিজেকে হারিয়েছি। তাকে হারিয়ে আমি কিভাবে বাঁচব বল? বলতে পারিস বুড়ো বয়সে এসে মা এসব কি কথা বলছে! ভালোবাসায় কোনো বয়স মানে না। মানে না কোনো জাত। ভালোবাসার মতো ভালোবাসলে আশি বছরেও ভালোবাসার গভীরতা ব্যাখ্যা করা যায়। তোর বাবাকে আমি প্রথমে প্রচুর ঘৃণা করতাম। সে আমার সাথে ছলনা করে আমাকে বিয়ে করেছে। আমি মন থেকে ভালোবাসতাম মাহতাবকে। মাহতাব অনেক ভালো মনের মানুষ ছিল জানিস মেহেভীন। এই তো দুপুরেও আমরা দু’জন মিলে যুক্তি পরামর্শ করেছি। রজনীর মধ্য প্রহরে দু’জন পালিয়ে যাব। আমাদের প্রণয়নের সম্পর্কটা বাড়ি থেকে মেনে নিচ্ছিল না। তোর বাবা আর মাহতাব দু’জন বেস্ট ছিল। ওদের বন্ধুত্ব দেখে লোকে হিংসা করত। ওদের একটা বাজে স্বভাব ছিল। ওরা দু’জন জু’য়া খেলতো। তাদের কাছে জুয়ার নেশা একদিকে ধরনীর মানুষ আরেক দিকে। যেদিন রাতে আমাদের পালানোর কথা ছিল। সেদিন রাতে তোর বাবা আর মাহতাব জুয়া খেলে। তোর বাবা মাহতাবকে শর্ত দিয়েছিল। যে মাহতাব হারলে ফরিদ যা বলবে মাহতাব তাই মেনে নিবে। ফরিদের শর্তে মাহতাব রাজি হয়ে যায়। এই সুযোগ টাই ফরিদ লুফে নেয়। ফরিদ আমাকে মনে মনে ভালোবাসত। কিন্তু প্রাণ প্রিয় বন্ধুর প্রেয়সীকে তো আর সরাসরি চেয়ে নাওয়া যায় না। তাই সে অসৎ পথ অবলম্বন করে। সেদিন ফরিদ আমার বাড়ি এসেছিল। সে আমাকে বলল তাকে মাহতাব পাঠিয়েছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে। আমি তৈরি হবার জন্য প্রস্তুত হতেই পেছনে থেকে ফরিদ আমার মুখ চেপে ধরল। তারপরে আমার আর কিছুই মনে ছিল না। পরের দিন সকালে লোকজনের কোলাহলে আমার নিদ্রা ভাঙে। তোকে একটা মেয়ের গল্পটা শুনিয়ে ছিলাম না মেহেভীন। সেই মেয়েটাই আমি। বিয়ের পরে আমি মাহতাবের কাছে গিয়েছিলাম। সে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমাকে বলে আমি যদি ফরিদকে ডিভোর্স দিয়ে তার কাছে আসি। তাহলে এই সমাজ আমাদের সুখে সংসার করতে দিবে না। একটা মেয়ের জীবনে বিয়ে কতবার হয়? একবার যখন বিয়েটা হয়ে গিয়েছে। তখন তুমি ফরিদের সামনে মানিয়ে নাও। সেদিন আমি মাহতাবের পা পর্যন্ত ধরেছি। তবুও সে আমায় গ্রহন করেনি। আমার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। আমি প্রতিটি মুহূর্ত মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করেছি। কতবার যে আ’ত্ন’হ’ত্যা করার চেষ্টা করেছি। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমার অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই তোর বাবা আমাকে ভালোবাসার চাদরে মোড়ানোর চেষ্টা করল। একজনকে মনে রেখে আরেকজনের সাথে সংসার করা এতটাই সহজ বল! আমি কতটা যতটা সহজ ভাবে বলছি। কিন্তু আমার পরিস্থিতি এতটা সহজ ছিল না। আমি প্রতিটা মুহূর্ত পুড়েছি। তোর বাবাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না। আমি খুব করে চাইতাম তোর বাবাকে মেনে নিতে। কিন্তু আমার মন তোর বাবাকে গ্রহণ করত না। সবাই আমাকে পরামর্শ দিল। আমি যেন একটা বাচ্চা নেই। তাহলে তোর বাবার প্রতি ভালোবাসাটা আমার মনে আসবে। এরপর তুই হলি তবুও আমার মনে তার জন্য কোনো মায়া কাজ করে না। তোকেও আমার বিরক্ত লাগত। তোর বাবা রাত জেগে তোকে দেখাশোনা করত। দিনে আমাকে রান্না করে খাওয়াত। আমি বাড়ির কাজ করতাম না। তোর বাবার এত কেয়ার এত ভালোবাসা দেখে মনের অন্তরালে তার জন্য সুপ্ত অনুভূতি কাজ করতে লাগলো। তাকে আমি শর্ত দিলাম আমার সাথে থাকতে হলে জুয়া খেলতে পারবে না। সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাহিরে থাকতে পারবে না। মানুষটাকে আমার আর দ্বিতীয়বার এসব কথা বলতে হয়নি। আমার এক কথায় ফরিদ সবকিছু ছেড়ে দিল। আমি ভালো থাকব কিসে সারাক্ষণ এটা নিয়ে চিন্তা করত। আমি কষ্ট পাব এমন কাজ থেকে বিরত থাকত। আমি অসুস্থ থাকলে রাত জেগে আমার সেবা করত। সে আমাকে এমন ভাবে ভালোবেসেছে তাকে আমি খু’ন করে ফেললেও মুখশ্রী দিয়ে একটা শব্দ বের করত না। এমন মানুষের মায়ায় না বেঁধে আমি যেতাম কই? আমাকে ভালোবাসতে হয়নি ভালোবাসা গুলো ফরিদকে ভালোবেসেছে। ফরিদকে মেনে নিতে আমার কয়েকটি বসন্ত কে’টে গিয়েছে। আমার পরে গিয়ে মনে হয়েছিল। আমি ফরিদকে ভালো না বেসে মাহতাবকে কেন ভালোবেসে ছিলাম? আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা ফরিদেরই হওয়া উচিৎ ছিল। আমার মৃত্যুর পরে যদি বলা হয়। আমি কাকে চাই? তাহলে আমি তোর বাবাকে চাইব। তোর বাবা আমাকে অনেকটা যত্ন আর অনেকটা ভালোবাসা দিয়েছে। সেই ভালোবাসা ছেড়ে আমি কেন যে আমায় গ্রহণ করেনি। তাকে চাইব! মাহতাব ভালো মানুষ ছিল। কিন্তু ভালোবাসার মানুষ হিসেবে সে শূন্য। কিন্তু তোর বাবা মানুষ হিসেবে একটু খারাপ ছিল। কিন্তু ভালোবাসার মানুষ হিসেবে সে ছিল পরিপূর্ণ। তোর বাবার ভালোবাসা এতটা ছিল যে নিজেকে কোনো রাজ্যের রাণী ছাড়া অন্য কিছু মনে হত না। নিজের বউকে সেই রাণীর মতো করে রাখে। যার মনটা রাজার মতো। পরপারে যদি তোর বাবার সাথে আমার দেখা হয়। তবে আল্লাহকে বলব শুদ্ধ আর পবিত্র হয়ে যেন আমাদের দেখা হয়। তোর বাবা ভালোই ছিল। শেষ বয়সে এসে হঠাৎ করে কি যে হয়ে গেল। মানুষের নজরে আমি খুব একটা বিশ্বাস করতাম না। তবে আজ গভীর ভাবে বিশ্বাস করি। ভালো জিনিসে মানুষের নজর লাগে। তাই ভালো জিনিস গুলো লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে হয়। তোর বাবা তোকে আমার সামনে কটু বাক্য শোনাল। তবুও আমি তোর বাবাকে কিছু বলিনি। সে মাহতাবকে সন্দেহ করল। তবুও আমি তাকে কিছু বলিনি। সে আরিয়ানের বাবার সাথে জুয়া গেলে হেরে গেল। সে তোকে নিয়ে বাজি ধরেছিল। ফরিদ হারলে তোকে আরিয়ানের সাথে বিয়ে দিতে হবে। তোর সাথে মাহতাবের যোগাযোগ আছে। সেটা আমি জানতাম না। তবে তোর বাবা কিভাবে জানি খবর পায়। আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে মাহতাবকে খু’ন করে বসে। এতকিছুর পরে-ও আমি তোর বাবাকে ক্ষমা করেছি জানিস। কারন আমি মানুষটাকে অত্যন্ত ভালোবেসে ফেলছি। নিজের ভালোবাসার মানুষ যতই বড় অন্যায় করুক না কেন, সেটা তার ভালোবাসার মানুষের কাছে অন্যায় মনে হবে না। আমিও চেয়েছি তোর বাবা বাঁচুক। কিন্তু তোর বাবা দিন দিন অমানুষ হয়ে উঠছিল। জুয়ার নেশা তোর বাবাকে ধংস করে দিয়েছিল। সে ভালোমন্দ বিচার করা ভুল গিয়েছিল। ধীরে ধীরে সে মাদকদ্রব্য সেবন করা শুরু করে দেয়। আমাকে বাজি ধরে একদিন রাতে জুয়া খেলেছিল। ফরিদ হেরে গেলে একজন পর পুরুষ এক রাত আমার সাথে থাকবে। এমন শর্ত দেয় বিপরীত পক্ষের মানুষটা। তোর বাবাও রাজি হয়ে যায়। তোর বাবা সেদিন হেরে যায়। রজনীর মধ্য প্রহরে তোর বাবা একটা শ্যাম পুরুষকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। আমি ভেবেছিলাম। তোর বাবার কোনো বন্ধু হবে হয়তো। পরে যখন কথা গুলো শুনলাম। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল। আমার সব ধৈর্যর বাঁধ ভেঙে মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠেছিল। সেদিন আমি নিজের নিয়ন্ত্রণ ছিলাম না। তোর বাবার সাথে আসা মানুষটা তার কুৎসিত চাহনি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। ভয়ে আমার সমস্ত কায়া অবশ হয়ে গিয়েছিল। উপস্থিত বুদ্ধি কাজ করছিল না৷ হঠাৎ করে মনে পড়ে তোর বাবা তোকে অজ্ঞান করে আরিয়ানের সাথে বিয়ে দাওয়ার জন্য ঔষধ এনে রাখছিল। আমি সেটার ব্যবহার করি। তার জন্য আমাকে অনেক কাট কয়লা পোড়াতে হয়। আমাদের এলাকায় একটা পুকুর আছে না। সেখানে খুব একটা মানুষ আসে না। আমি সেখানে দু’জনকে নিয়ে যাই। রজনীর মধ্য প্রহর চলায় মানুষ খুব কম ছিল। রাতের আঁধারের সুযোগ নিয়ে দু’জনকেই ছয় পিস করি। জীবনে দ্বিতীয় বার তৃতীয় খু’ন করে প্রচুর শান্তি পেয়েছিলাম। আমার ইন্দ্রিয় খুব সজাগ ছিল। আমি অনুভব করলাম আমাকে খু’ন করতে কেউ দেখে ফেলছে। আমি টুকরো গুলো বস্তায় পুরে পানিতে ডুবিয়ে রেখেছিলাম। কচুরি পানা দিয়ে সেগুলো খুব সাবধানে আড়াল করে রাখি। পরে সময় সুযোগ পেলে সরিয়ে ফেলব। বাড়ি ফিরে সমস্ত মন মস্তিষ্ক শীতল হতে শুরু করল। বুঝলাম রাগে বশীভূত হয়ে কি করে ফেলেছি। রাগ মানুষকে ধংস করে দেয়। যখন বুঝলাম তখন অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। পরবর্তীতে মনে হয়েছে। যা হয়ে ভালো হয়েছে। যে সম্পর্কে সন্দেহ আর বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে যায়। সেই সম্পর্ক কোনোদিন আগের মতো জোড়া লাগে না। তোর বাবা আজ একজনকে আমার বিছানায় পাঠাতে চেয়েছে। কাল দশজনকে পাঠাতে চাইবে। যে পাপে জর্জরিত হয়ে গিয়েছে। তাকে কিভাবে ঠিক করতাম বল? আমার কথার অবাধ্য না মানুষটা আমার কথার অবাধ্য হয়েছে। আমার সাথে উচ্চস্বরে কথা না বলা মানুষটা কথায় কথায় আমাকে ধমকেছে। আমার ভাগ কাউকে দিবে না বলে ছলনা করে আমাকে বিয়ে করল। সেই মানুষটা পর পুরুষকে আমার বিছানাতে পাঠাতে চাইল। এটা তো আমি মেনে নিব না। একটা নারীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে তার সন্মান। যে নারীর সন্মানে আঘাত করার চেষ্টা করবে। তার মৃত্যু অনিবার্য। যে স্বামী তার স্ত্রীর সন্মান নষ্ট করতে চায়। আমি মনে করি তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। কথা গুলো একদমে বলে থামলো রাইমা বেগম। শীতল চাহনিতে মেহেভীনের দিকে চেয়ে আছে। কথা গুলো বলার সময় রাইমা বেগমের কণ্ঠনালি কাঁপেনি। আঁখিযুগলে এসে অশ্রুকণা জমা হয়নি। কিন্তু তার ভেতরটা যে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। সেটা কি মেহেভীন দেখতে পেয়েছে। মেহেভীন অদ্ভুত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবেশ শীতল হয়ে উঠল। চারিদিকে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। এই মুহূর্তের নিস্তব্ধতা প্রতিটি মানুষের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলছে।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সুখের শক্ত আবরণকে দুঃখের দমকা হাওয়া এসে মুহুর্তের মধ্যে সুখ গুলোকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে গেল। ধরনীর বুক জুড়ে হাহাকার নেমে গিয়েছে। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অশ্রুকণা গুলো যেন আজ অভিমান জমিয়েছে। সেজন্য বোধহয় আঁখিযুগলে এসে ভিড় জমাচ্ছে না। মনের আনাচেকানাচে দুঃখরা রাজত্ব করছে। মেহেভীন বাসায় আসার পর থেকেই পাথরের ন্যায় বসে আছে। মুখশ্রী দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারন করছে না। প্রেয়সীর রক্তিম আঁখিযুগলের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই মুনতাসিমের বক্ষথলে মোচড় দিয়ে উঠল।

–এভাবে নিজেকে কষ্ট কেন দিচ্ছেন? আপনার রাগ হলে আমাকে ঘৃণা করুন। আমাকে কথার আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিন। তবুও আপনি নিরব হয়ে যাইয়েন না। নিরবতা যে ভিষণ ভয়ংকর! প্রতিশোধের নেওয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে নিরবতা। আমি আপনাকে ভালো রাখার লোভী ভিষণ লোভী হয়ে উঠেছিলাম। আমি আঘাত পেলে আপনার যেমন ব্যথা লাগে। ঠিক তেমনই আপনার ব্যথা হলে আমি তার থেকে দ্বিগুন পুড়ি। আপনার মলিন মুখশ্রী দেখে আমি ভেতর থেকে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি। সেটা কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন না! আমি থাকতেও আপনি এভাবে পুড়বেন? আর সেটা বসে বসে আমাকে দেখতে হবে! আমাকে আপনি শাস্তি দিন। তবুও নিজেকে শেষ করে দিয়েন না। মুনতাসিমের প্রতিটি বাক্য মেহেভীনের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। মুখশ্রীতে ঢাকা শক্ত আবরণটা খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু কষ্ট গুলো যেন আজ ভেতর থেকে বের হতে চাইছে না। মেহেভীন মলিন কণ্ঠে বলল,

–ভালো থাকা আর ভালোবাসা দু’টোই আমার জন্য অভিশপ্ত। জীবনে কঠিন এক সময় পার করছি। তবে এখন যে সময় পার করছি। সেটা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। যে জীবন আমার প্রতি এতটা নিষ্ঠুর হবে। মাঝে মাঝে আমার ভাগ্যটাকে নিয়ে ভিষণ আফসোস হয়। আমার জীবন টা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না! আমার জীবনটা আর একটু সুন্দর হলে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত?

–আপনি যতটুকু ভেবেছেন। তার থেকে দ্বিগুন সুন্দর জীবন আপনাকে উপহার দিব। কথা দিলাম।

–সেই সুন্দর জীবনে যদি আমার বাবা-মা-ই না থাকে, তাহলে সেই জীবন নিয়ে আমি কি করব? মেহেভীনের কথায় মুনতাসিম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মনের অজান্তেই বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। জীবনের কঠিন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে মেহেভীন। যাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা এখনো তৈরি হয়নি। তবে পাশে থেকে ভরসা দেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। সেই ভরসা টুকু দিয়ে না হয় মেহেভীনকে আগলে নিবে। মুনতাসিমকে নিরব দেখে মেহেভীন নিজেই বলল,

–মাসের ফাঁ’সি কবে?

–উনি সব তথ্য আগেই পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে। পুলিশ তদন্ত করে সব সঠিক প্রমাণ পেয়েছে। কোর্ট থেকে রায় হলেই উনার ফাঁ’সি হয়ে যাবে। মেহেভীনের ভেতরটা কেঁপে উঠল। অদ্ভুত ভাবে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। খুব শান্ত ভাবে বলল,

–একজন খুনির মেয়ের সাথে সংসার করবেন! আপনার সমস্যা হবে না? সবকিছু জানাজানি হয়ে গেলে, আপনার ওপরে অনেক চাপ আসবে।

–নিজের জিনিসকে কিভাবে আগলে রাখতে হয়। সেটা মুনতাসিমের ভালো ভাবে জানা আছে। মুনতাসিমকে কিছু বলতে হলে দশবার ভাবতে হয়। আমি মায়ের এতবড় সত্য সবার কাছে আড়াল করে গিয়েছি। শুধু মাত্র আপনাকে হারানোর ভয়ে। আপনার সুখ নষ্ট হবে ভেবে দিনের পর দিন মিথ্যা না বলা মানুষটাও মিথ্যা বলেছে। আর আপনি বলছেন আপনার সাথে থাকতে আমার সমস্যা হবে!

–আমার মা এমন করতে পারে না। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমাকে আপনি বলুন না এটা সত্যি নয়। আমি স্বপ্ন দেখছি। আমার নিদ্রা ভাঙলেই সবকিছু মিথ্যা হয়ে যায়। আমার না ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি মাকে ছাড়া কিভাবে থাকব? ভেতরটা আমার দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। আমার মা আমার কথা কেন ভাবল না! যাকে দেখলে আমার মনের জোড় বেড়ে যায়। সেই জোড়ই যদি শেষ হয়ে যায়। তাহলে আমি কিভাবে সোজা থাকব? আমি যে ভেঙেচুরে একদম গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাব।

–সমস্ত পৃথিবীর সামনে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকি। পাথরের মতো শক্ত হতে গিয়ে হৃদয়ের খুব কাছে এসেও ভেঙে যাই খুব সংগোপনে। কাউকে বোঝানো যায় না। আমাদের ম্যাচিউরিটির শক্ত আবরণের ভেতরে আসলে কতটা কাঁদা মাটি থাকে! সেটা প্রকাশ করলে আপনাকে অচিরেই বিলীন হতে হবে। আর প্রকাশ না করে ধৈর্য ধরলে মনের জোর এনে রাজ্য চালানোর ক্ষমতা আপনার হবে। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ করেই মেয়েটা একদম চুপ হয়ে গেল। মেয়েটার চুপ থাকাটা যে অপর প্রান্তের মানুষটাকে কঠিন ভাবে পোড়াচ্ছে। সেটা কি মেয়েটা দেখতে পাচ্ছে না! হৃদয় পোড়া যন্ত্রনা গুলো এমন হয় কেন? ভেতরটা পুড়ছে অথচ কেউ দেখতে পাচ্ছে না। যে পুড়ছে সে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ে জ্বলে ওঠা আগুনটা যদি কেউ দেখতে পেত, তাহলে নিশ্চয়ই আগুন নেভানোর চেষ্টা করত। হৃদয়ের যন্ত্রনা শীতল করার ঔষধ নেই বলেই, শরীরের আঘাতের যন্ত্রণার চেয়ে হৃদয় পোড়ার যন্ত্রনা অনেক বেশি!

দুঃখ আছে বলে জীবন সুন্দর। দুঃখ না থাকলে আমরা আক্ষেপ করতাম কি নিয়ে? এই যে আমরা সুখে থাকলেও বিষাদ অনুভব করি। দুঃখ আছে বলেই সুখের এত মূল্য। নয়তো সুখ গুলোও কিছু মানুষের ন্যায় গুরুত্বহীন ভাবে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত! দুঃখীনির দুঃখ ঘুচবে কি করে? দুঃখ যে বেড়ে যাওবার সময় এসে গিয়েছে! সেটা কি দুঃখীনি অনুভব করতে পেরেছে? সেজনই বোধহয় দুঃখীনি ভেতরটা পুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে আবার জ্বলে উঠছে। মেহেভীনের মাকে আজ ফাঁ’সি দেওয়া হবে। জেলের অন্ধকার কুঠুরি থেকে রাইমা বেগমকে বাহিরে নিয়ে আসা হলো। এই কয়দিনে চেহারায় মলিনতা এসে গিয়েছে। আঁখিযুগলের নিচে কালো দাগ পড়ে গিয়েছে। সমস্ত মুখশ্রী বলে দিচ্ছে মানুষটা ভালো নেই। প্রতিটি মুহুর্ত মানুষটা যন্ত্রনায় ছটফট করছে। মেহেভীনকে দেখে রাইমা বেগম মলিন হাসলেন। মেয়ের মস্তকে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

–মাকে ক্ষমা করে দিস। তোর মা তোর সুখটা কেঁড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। মুনতাসিমের ওপরে ভরসা করে চলে যাচ্ছি। আমি তোকে যতটা দুঃখ দিয়েছি। তার থেকে দ্বিগুন সুখ সে তোকে উপহার দিবে। আমার মেয়েকে কষ্ট দিলে তার হিসাব কিন্তু আমি নিব। মা তোকে ভিষণ ভালোবাসে মেহেভীন। এই অভাগী মাকে ভুল বুঝিস না। আমাকে ক্ষমা করে দিস। তোর বাবা ভুল পথে না গেলে আজ আমরা সবাই বেঁচে থাকতাম। আমাদের একটা সুন্দর সংসার হতো। সেখানে সুখ শান্তি দিয়ে পরিপূর্ণ থাকতো। বিধাতা হয়তো আমাদের জীবনটা এভাবেই সাজিয়েছিলেন। তাই আমাদের জীবনের সমাপ্তি এভাবেই হলো। আমার জীবনের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। তবে মুনতাসিম তোকে আঘাত করলে আমার অভিযোগ তৈরি হবে। মৃত্যুর পরবর্তী জীবন কেমন হবে জানি না। যে পাপ করেছি। সেই পাপের শাস্তি পেতে শুরু করলে দুনিয়াদারী ভুলে যাব। তোকে একটা কথাই বলব। মায়ের জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করিস। আমার কবর টা যেন তোর বাবার পাশেই দাফন করা হয়। এটা আমার শেষ ইচ্ছে বলতে পারিস। আমাকে যেতে হবে মা। নিজের খেয়াল রাখিস। মুনতাসিমকে কখনো দুঃখ দিস না। স্বামীর মন মতো হয়ে চলিস। মায়ের কথায় নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না মেহেভীন। শক্ত আলিঙ্গনে মাকে বুকের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলল। কান্নার শব্দে চারিদিক মুখরিত হয়ে গেল। মেহেভীনের হৃদয় ভাঙা চিৎকার দেখে মুনতাসিমের ভেতরটা উথাল-পাতাল শুরু করে দিল। মেহেভীন কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

–আমায় ছেড়ে যেও না মা। আমি তোমায় ছাড়া কিভাবে বাঁচব। আমি কথা না শুনলে কে আমাকে বকবে? তোমাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব হয়ে যাব মা। আমার প্রতি এতটা নিষ্ঠুর তুমি হয়ো না। তুমি এতটা পাষাণ কিভাবে হয়ে গেলে? আমার মা তো এমন ছিল না! আমার আঁখিযুগলে অশ্রু আসার আগেই যার হৃদয় কোমল হয়ে যায়। আজ আমার হৃদয় ভাঙা চিৎকারে তার মন কেন নরম হচ্ছে না? আমার এই আর্তনাদ কি তোমার রুহু কাঁপাচ্ছে না মা। আমাকে এভাবে এতিম বানিয়ে দিও না। এতিমদের যে বড্ড জ্বালা। এত জ্বালা আমি কিভাবে সহ্য করব? তুমি আমাকে বি’ষ দিয়ে মে’রে দাও মা। আমি এত যন্ত্রনা কিভাবে সহ্য করব। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আল্লাহ আমার আর কত ধৈর্যের পরীক্ষা নিবে? তুমি আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও। আমি আর বাঁচতে চাই না। যে পৃথিবীতে আমার বাবা-মা থাকবে না। সেই পৃথিবীতে আমিও থাকতে চাই না। মেহেভীনের আর্তনাদের প্রতিটি মানুষের আঁখিযুগলে অশ্রুকণা এসে জমা হয়েছে। রাইমা বেগমও আজ শক্ত খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসলো। মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মেয়ের মুখশ্রীতে শত-শত আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে। পৃথিবীতে সবকিছু কেনা গেলেও সময় কেনা যায় না। সময় দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। মেহেভীন মাকে শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরে আছে। মাকে ছেড়ে দিলেই যে মা হারিয়ে যাবে। এত ভালোবাসা বুঝি এভাবে হারাতে দেওয়া যায়। মেহেভীনকে দু’জন মহিলা পুলিশ সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ মেহেভীনের শক্তি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গিয়েছে। দু’জন ব্যর্থ হয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। একজন পুলিশ অনুরোধ করে বলল, তাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সে যেন মেহেভীনকে দূরে সরিয়ে নেয়। মুনতাসিম মেহেভীনের এক হাতে টেনে বলল,

–মা কে ছেড়ে দিন। ওদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। মুনতাসিমের কথায় রাইমা বেগম তাল দিয়ে বলল,

–আমাকে ছেড়ে দে মা। আমাকে যেতে হবে। মেয়ে হয়ে যদি মায়ের দুঃখ না বুঝিস৷ তাহলে আমি কোথায় যাব বল?

–ও মা আমার কাছে থেকে যাও না। আমার নিজের জীবনের বিনিময়ে তোমাকে সুখে রাখব। তোমার এত কিসের জেদ? আমার ভালো চাও না তুমি! তুমি কি আমার নিজের মা না। তুমি এতটা স্বার্থপরের মতো কাজ কিভাবে করতে পারলে! আমি তোমার পায়ের নিচে পড়ে থাকব। আমাকে এভাবে দুঃখী করে দিও না। আমার ভেতরটা যে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছ না কেন তুমি? আমাকে একটু ভালো থাকা ভিক্ষা দাও মা। আমারও ভালো থাকার অধিকার আছে। মেহেভীনের হৃদয় ভাঙা চিৎকার রাইমা বেগমের বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাইমা বেগম মুনতাসিমকে ইশারা করতেই মুনতাসিম মেহেভীনকে নিজের কাছে টেনে নিল। মেহেভীন এক হাতে মায়ের হাত ধরে আছে। ভয়ে মেহেভীনের সমস্ত কায়া থরথর করে কাঁপছে। আঁখিযুগল ভয়ংকর ভাবে রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। মেহেভীন মায়ের হাতটা শক্ত ভাবে ধরে আছে। দু’জন মহিলা পুলিশ রাইমা বেগমকে টান দিতেই দু-হাত আলগা হয়ে গেল। মেহেভীনের সামনে দিয়ে রাইমা বেগমকে গাড়িতে তোলা হলো। মেহেভীন দৌড়ে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে উলটো দিকে ঘুরিয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। মেহেভীন পাগলের ন্যায় ছটফট করছে। মেহেভীনের করুন অবস্থা মুনতাসিমকে ভেতর থেকে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। মেহেভীন ক্ষিপ্ত হয়ে মুনতাসিমের ওপরে চেচামেচি করতে শুরু করে দিল। আশেপাশে ভিড় জমে গেল। জীবনে প্রথম মুনতাসিম মেহেভীনকে এতটা চিৎকার করতে দেখল। মেহেভীনের সমস্ত কায়া নিস্তেজ হয়ে আসতে শুরু করল। কণ্ঠনালি দিয়ে শব্দ আসা বন্ধ হয়ে গেল। কায়ার সমস্ত ভর মুনতাসিমের উপরে ছেড়ে দিল মেহেভীন। মুনতাসিম তাকিয়ে দেখল জ্ঞান হারিয়েছে মেহেভীন। বুকটা ভারি হয়ে আসছে মুনতাসিমের। দুঃখের পাহাড় এতটা ভারি হয়ে গেলে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কষ্টকর। মুনতাসিম মেহেভীনকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়ির দিকে অগ্রসর হলো। পথের প্রতিটি মানুষ একজন দুঃখীর হৃদয় ভাঙা চিৎকার দেখল। প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রনা যে কতটা যার হারায় সেই তো অনুভব করতে পারে! সুখের ভাগ নেওয়ার মানুষ অভাব নেই। তবে দুঃখ ভাগের সময় এত অভাব হয় কেন? সুখ যেমন মানুষকে ভালো রাখে, ঠিক তেমনই দুঃখ জীবনকে পরিপূর্ণ করে। সে পরিপূর্ণতা গ্রহণ করতে এত কিসের অনিহা!

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

চারিদিকে সুখানুভূতিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সুখ যেন তার অনুভূতির রাজত্বে শাসন কার্য শুরু করে দিয়েছে। মনের শহরের অলিতে-গলিতে আনন্দ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। এত সুখ, এত আনন্দ সইবে তো! আজকে মুনতাসিমকে জনসভায় যেতে হবে। মুনতাসমি তৈরি হয়ে গিয়েছে। মেহেভীন মুনতাসিমের শুভ্র পাঞ্জাবীর ওপরে পড়া কটির বোতাম গুলো যত্ন সহকারে লাগিয়ে দিচ্ছে। মুনতাসিম মুগ্ধ নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীন বোতাম লাগানো শেষ করে মুনতাসিমের কেশ গুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলল,

–মেয়ে ভক্তদের থেকে দশ হাত দুরত্ব বজায় রেখে চলবেন। যদি কোনো মেয়ের গা ঘেঁষে ছবি তুলতে দেখেছি। পরের দিন প্রভাত বেলা ব্রেকিং নিউজ হবে। মন্ত্রী মুনতাসিম ফুয়াদকে কে’টে পিস পিস করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার ভাবতেই আনন্দ লাগছে। আপনার কেমন লাগছে মন্ত্রী সাহেব? মেহেভীনের কথায় মুনতাসিম সহজ সরল মুখভঙ্গি করে ফেলল। আঁখিযুগলে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট! সে শুকনো ঢোক গিলে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আপনি আমাকে হু’ম’কি দিচ্ছেন?

–না আপনার ঘরে যে একটা বউ আছে। সেটা মনে করিয়ে দিলাম। আমি কি ছুরিতে ধার দিয়ে রাখব মন্ত্রী সাহেব? বলা তো যায় না কখন কোন কাজে গেলে যায়।

–হ্যাঁ দিয়ে রাখুন বলা তো যায় না। ওটা দিয়ে আমি আপনার গ’লা’ও কাটতে পারি। আমার যে বউ আছে৷ সেটা যেমন মনে রাখা আমার দায়িত্ব। ঠিক তেমনই আপনারও যে স্বামী আছে। সেটা মনে রাখাও আপনার কর্তব্য।

–লোকে বলে তুমি তার মাঝে কি দেখেছ? আমি বলি তাকে দেখার পর আর কিছু দেখিনি। আপনার মায়ায় আমি এমন ভাবে আঁটকে গিয়েছি। যে আপনার থেকে যতই সুদর্শন পুরুষ আসুক না কেন? আমার কাছে আপনার থেকে সেরা কেউ হবে না। আপনার মতো সুন্দর পুরুষ আমি দু’টো দেখিনি। আপনাকে দেখার পর আমার আর কাউকে ভালোই লাগে নি। আমার মহারাজা ছাড়া ধরনীর বুকে সকল পুরুষ আমার কাছে বিষাক্ত। আমার স্বামী আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ। আপনার যত রকম অস্ত্র আছে। আপনি সব গুলো মেরামত করে রাখুন। আমি আপনাকে একশো পারসেন্ট গ্যারান্টি গিয়ে বলতে পারি। সেগুলো আপনার কোনো কাজেই আসবে না। আমাদের যদি কোনোদিন বিচ্ছেদও হয়ে যায়। তবে আমি মেহেভীন আজকে আপনাকে কথা দিলাম। আপনি ব্যতিত কোনো পুরুষ আমার জীবনে প্রবেশ করবে না। মেহেভীনের বাক্য গুলো শেষ হবার সাথে সাথে মুনতাসিম মেহেভীন মুখ চেপে ধরলো। মেহেভীনের মুখশ্রীতে বিচ্ছেদের কথা কর্ণকুহরে আসতেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। আনন্দ উল্লাস করা হৃদয়টা মুহূর্তের মধ্যে রক্তাক্ত হয়ে গেল। সে কাতর স্বরে বলল,

–আপনি আমায় সবকিছু বলবেন। আমি মেনে নিব। কিন্তু আর কোনোদিন বিচ্ছেদের কথা মুখে আনবেন না। বিচ্ছেদ নামটাও বিষাক্ত। নামটা কর্ণে প্রবেশ করার সাথে সাথে ভেতরটা ভিষণ বাজে ভাবে পুড়তে শুরু করেছে। আপনি বিচ্ছেদ চাইলে আমার মৃত্যু অনিবার্য। আপনি যতটুকু জানেন তার থেকেও বেশি আপনার সাথে বাঁচার ইচ্ছে আছে আমার। আপনি আমাকে রক্তাক্ত করে দিয়েন। তবুও আমার সাথে থাইকা যাইয়েন। আমি আপনায় ছাড়া আর বুঝি না৷ আমি সকাল সন্ধ্যায় প্রতিনিয়ত আপনারেই খুঁজি। বিচ্ছেদ শব্দটা উচ্চারিত হলেই বুকটা ভিষণ ব্যথা করে আমার। মুনতাসিমের কাতর কণ্ঠ স্বর আর অসহায়ত্ব মাখা মুখশ্রী মেহেভীনকে আহত করল৷ সে মলিন মুখশ্রী করে মুনতাসিমে দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীনের বিষন্ন মন দেখে মুনতাসিম পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,

–আপনি দিন দিন কালো হয়ে যাচ্ছেন।

–কালো হয়ে যাচ্ছি বলে, আমাকে আর ভালো লাগছে না?

–আমি চাইলে আপনার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিতে পারি।

–কিভাবে?

–স্ত্রীকে স্বামী বেশি বেশি চুমু দিলে, স্ত্রীর সৌন্দর্য বেড়ে যায়। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে দূরে সরে গেল। রক্তিম আঁখিযুগল মুনতাসিমকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। মুনতাসিমের অধরের কোণে স্নিগ্ধ হাসি। মেয়েটাকে রাগানো খুব সহজ। তার অপছন্দের একটা কথা বললেই দুনিয়াদারী ভুলে যায় সে। মুনতাসিমের এটা ভেবে ভালো লাগছে। মেহেভীনের বিষন্নতাকে সে দূর সরাতে পেরেছে। মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–দূরে না গিয়ে কাছে এসে ভালোবেসে দিন। যাকে অবহেলা করে দূর সরিয়ে দিচ্ছেন। তাকে আদর করার জন্য বাহিরে অনেক তরুনী অপেক্ষা করছে। আপনি কাছে আসবেন নাকি আমি বাহিরে যাব?

–সাহস থাকলে যান। কথা গুলো বলেই সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার নিয়ে এসে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরালো মেহেভীন। মুনতাসিম নিজেই মেহেভীনের অতি সন্নিকটে এগিয়ে আসলো। মেহেভীন দূরে সরতে চাইলে মুনতাসিম মেহেভীনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিল। মেহেভীন মুহুর্তের মধ্যে আদুরে বেড়ালের মতো গুটিসুটি মেরে মুনতাসিমের বুকের মধ্যে লেপ্টে থাকলো। মানুষটা তার সামনে আসলেই মেহেভীনের সমস্ত ক্রোধ ছুটি নেয়। মুনতাসিম মেহেভীনের কর্ণের কাছে গিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল,

–শুনুন মেয়ে আপনাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে আমার নেই।

–আমাকে ছুঁয়েই কথা গুলো বললেন। ছাড়ুন আমাকে পাপী বান্দা। আমাকে ম’রা’র শখ জেগেছে বুঝি। যে ধরণীর বুকে আমি থাকতে পারব না৷ সেখানে আপনিও থাকতে পারবেন না। আপনাকে খু’ন করে তবেই ধরনীর মায়া ত্যাগ করব। এত সহজ নয়। আমাকে আপনার থেকে আলাদা করা। আপনি আমার না তো কারো না।

–কেন আমি আপনার হলে, আপনি আমাকে সবার মাঝে বিলিয়ে দিতেন? মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মেহেভীনের আঁখিযুগলের দিকে দৃষ্টিপাত করে আঁতকে উঠল মুনতাসিম। মেয়েটার আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন হয়ে গিয়েছে। সমস্ত মুখশ্রীতে প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলার ভয়। মুনতাসিম অস্থির হয়ে বলল,

–আপনি আমার কথায় দুঃখ পেয়েছেন? আমি আপনার মন ভালো করার জন্য মজা করছিলাম। আপনি দুঃখ পেলে আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। আমি ভুল করে ফেলছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি আর কখনো এমন করব না৷ মুনতাসিমের কথায় হেসে ফেলল মেহেভীন। সে হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–আপনি অস্থির হবেন না। আপনি অন্য কারো হবার কথা বলছেন। এতেই আমার খারাপ লেগেছে। আর কখনো বলবেন না। কারন সব মজা, মজা লাগে না আমার কাছে। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিমের হৃদয়ে অস্থিরতার ঝড় বয়ে যেতে শুরু করল। সে তার প্রিয় অর্ধাঙ্গিনীকে আঘাতপ্রাপ্ত করতে চায়নি। মুনতাসিম মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রীতে আদরে আদরে ভরিতে তুলতে লাগল। মুহুর্তের মধ্যে মলিনতাকে গ্রাস করে ফেলল এক টুকরো লজ্জা। বিষন্নতা কেটে গিয়েছে প্রয়নের হাওয়ায়। অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করছে মনে গহীনে। মুনতাসিম মেহেভীনের ললাটে চুমু খেয়ে বলল,

–আমি বের হচ্ছি। যেতে সময় লাগবে। আপনি দেখে শুনে থাকবেন। কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন করবেন। আপনার ফোনটা আজ আমার কাছে থাক। আমি আমার দ্বিতীয় ফোনটা আপনার কাছে রেখে গেলাম।

–আপনি সাবধানে যাবেন। আপনাকে নিয়ে আমার ভিষণ চিন্তা হয়। ড্রাইভারকে বলবেন গাড়ি আস্তে চালাতে।

–আমার ম্যাডাম যা বলবে। আমি সবকিছু শুনতে বাধ্য। আসছি। বলেই কক্ষ ত্যাগ করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফিরে এসে মেহেভীন আলিঙ্গন করল। যাবার সময় বলে বলে গেল, “বাহিরে যাবার আগে বউকে জড়িয়ে ধরলে বিপদ কম হয়।” মুনতাসিমের এমন অদ্ভুত কথায় মনের অজান্তেই মেহেভীনের অধরের কোণে হাসির রেখার দেখা মিলল।

মুনতাসিম গাড়ি থেকে নামতেই মানুষেই হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা তার দৃষ্টিতে এসে আঁটকে গেল। তার সামনে পেছনে পুলিশ প্রটেকশন দিয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে প্রিয় নেতার স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছে। প্রিয় নেতাকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে জেগেছে মুনতাসিম ভক্তদের। সবাই হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। মুনতাসিম নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে সবার সাথে হাত মেলানোর চেষ্টা করছে। মুনতাসিম মঞ্চ উঠতেই সবাই গর্জন করে উঠল। মুনতাসিম হাত উঁচু করে সবাইকে ভালোবাসা নিবেদন করল। আশেপাশে আরো নেতারা রয়েছে। মুনতাসিমের জন্য রাখা নিধারিত চেয়ারে গিয়ে সে বসল। মুনতাসিমকে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আহবান করা হলো। মুনতাসিম সালাম দিয়ে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করল। বাঘের ন্যায় গর্জন করে বক্তৃতা দিচ্ছে মুনতাসিম। তার গর্জন করে বলার বাক্য গুলো কারো কারো কলিজা কাঁপিয়ে তুলছে। বক্তৃতা দেওয়ার সময় একটু সময়ের জন্য তার কথা গুলো বেঁধে যায় না। সেজন্য মুনতাসিমের বক্তৃতা দেওয়া সবার কাছে ভিষণ প্রিয়। দীর্ঘ আটচল্লিশ মিনিট বক্তৃতা দেওয়ার পর মঞ ত্যাগ করল মুনতাসিম। সমস্ত জনতা তাকে ঘিরে ধরতে ব্যস্ত, তখনই গু’লি’র শব্দে সেই স্থান নিরব হলো। তাইয়ানের দৃষ্টি সেদিকে যেতেই তাইয়ান মুনতাসিমকে নিয়ে মস্তক নিচু করে ধরল। গু’লি’টা গিয়ে লাগলো একটা গার্ডের কায়াতে। গার্ডটা যন্ত্রনায় ছটফট করতে লাগল। তখনই ভয়াবহ ভাবে মঞ্চের দিকটায় বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো। আনন্দ আয়োজনের স্থানটা মুহুর্তের মধ্যো ভয়ানক রুপ নিল। জনগণ নিজেদের প্রাণ রক্ষার্থে প্রাণপণে এদিক সেদিক ছুটে চলেছে। পুলিশ প্রশাসন তাদের টিম, ফারার সার্ভিস সহ আরো নিরাপত্তার দলকে দ্রুত সেখানে আসতে বলল। দেড়শো জনের মতো মানুষ গুরুতর ভাবে আহত হলো। টাইম বো’ম’টা মাঝারি ধরনের হওয়ায় মঞ্চের আশেপাশে থাকা মানুষ গুলোর বেশ ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। পরপর আরো চারটা গু’লি এসে মুনতাসিনের কর্ণ ভেদ করে চলে গেল। পুলিশ সদস্য কোনদিকে গুলি করবে বুঝে উঠতে পারল না৷ হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কে গুলি করছে। তারা সেটা কিভাবে বের করবে? ভূল বসত যদি নিরীহ মানুষের কায়াতে গিয়ে লাগে। মুনতাসিমের বিচক্ষণ দৃষ্টি সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,

–কালো চাদর মুড়িয়ে থাকা মানুষটাকে মারুন গুলিটা সে-ই করছে। দেরি করবেন না, তাইয়ান সুট করো। পুলিশ সদস্য তাক করার আগেই ব্যক্তিটা পুলিশ সদস্যের বুকটা গু’লি দিয়ে ছিদ্র করে দিল। পুলিশ সদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তারা তাকে সুট করতে যাবে। তখনই সে মস্তক নুইয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। এত ভিড় ঢেলে সামনের দিকে আগানোও যাচ্ছে না। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে ভিড় ঠেলে সামনের দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই একজন সিনিয়র নেতা এসে মুনতািসমের হাত ধরে ফেলে। সে খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

–তুমি প্রটেকশনের বাহিরে যেও না। তোমার ক্ষতি হবে।

–জা’নো’য়া’রে’র বা’চ্চা’কে তো আমি দেখে নিব। ও আমার হাতে পড়লে আমি ওকে জ্যা’ন্ত পুঁ’তে ফেলব। আপনি আমার হাত ছাড়ুন স্যার। আমার ভালোবাসার মানুষদের আঘাতপ্রাপ্ত করেছে। তার চামড়া ছি’লে লবন মরচি লাগাব আমি। তার ভয়াবহ শরীরটা জনগণের সামনে আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মা’র’ব।

–মুনতাসিম এটা ক্রোধের সময় নয়। তুমি নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গিয়েছ। তুমি দ্রুত স্থান ত্যাগ করো। আমার অভিজ্ঞতা বলছে। ওরা তোমাকেই মারতে এসেছে। তুমি যতক্ষণ এখানে থাকবে। ততক্ষণ তারা আক্রমণ করতেই থাকবে। তুমি এখানে থাকলে হিতে বিপরীত হবে। তোমাকে আঘাত করতে গিয়ে ক্ষত হবে সাধারণ জনতা। এই ভিড়ের মধ্যে কেউ তোমাকে খু’ন করে দিয়ে গেলে-ও আমরা টের পাব না কে তোমাকে খু’ন করে গেল? তার থেকে ভালো তুমি স্থান ত্যাগ করো।

–আমি মরলে মরব। মরার আগে কু’ত্তা’র বাচ্চাকে খু’ন করে তবেই মরব। মুনতাসিম সামনের দিকে এগোনোর প্রস্তুত হতেই দেড়শোর মতো গাড়ি নিয়ে নিরাপত্তা দল এসে হাজির হলো। একজন পুলিশ এসে বলল,

–স্যার আপনি স্থান ত্যাগ করুন। আপনি থাকলে পরিস্থিতি আমাদের হাতের বাহিরে চলে যাবে। আপনি দূরে অবস্থান করলে, আমরা খুব সহজে পরিস্থিতি হাতের নাগালে নিয়ে আসতে পারব। মুনতাসিম আজ নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গিয়েছে। চারদিকে হাহাকার লেগে গিয়েছে। মুনতাসিম সবার কথার অর্থ উপলব্ধি করতে পেরে নিজ থেকেই স্থান ত্যাগ করল। চারিদকে আতঙ্কের ছাপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। পরে আরো পঞ্চাশটা গাড়ি এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সক্ষম হয়েছে। সন্দেহ জনক উনিশ জনকে আটক করা হয়েছে। আহতদের হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। খবরটা মুহুর্তের মধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। হামলার কথা কর্ণকুহরে আসতেই রিয়াদ চৌধুরী অস্থির হয়ে উঠলেন। সে অনবরত তাইয়ানকে ফোন করে যাচ্ছে। কিন্তু তাইয়ানকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। সময়ের সাথে চিন্তার মাত্রা প্রকোপ পেতে শুরু করল। সে তার পরিচিত পুলিশকে ফোন করেছিল। সেই পুলিশটা বলেছে। মুনতাসিম সমাবেশ থেকে এক ঘন্টা আগে বের হয়ে গিয়েছে। ভয়ে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল রিয়াদ চৌধুরী। রাজনীতিতে শত্রু বেশি প্রাণ হাতে নিয়ে ঘুরতে হয়। সেজন্য সে রাজনীতি জিনিসটা পছন্দ করে না। ছেলেকে কত করে নিষেধ করেছিল। রাজনীতিতে যাস না। মুনতাসিমের জেদের কাছে হেরে গিয়েছিল সে। ভয়ে ভেতরটা কাবু হয়ে আসছে তার। মুনতাসিমের খবরটা পেয়ে মেহেভীনও যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। বরাবরের মতোই ফলাফল শূন্য। অদ্ভুত ভাবে হাত পা কাঁপছে তার। সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। সে যদি বেরই হয়ে থাকে তাহলে গৃহে আসছে না কেন! তখনই বাহিরে থেকে অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। অ্যাম্বুলেন্স থেকে সাদা কাপড়ে ঢাকা লা’শ বের করে নিচে নামানো হলো। সাদা কাপড়টা রক্তে ভিজে যাচ্ছে। একদম তাজা রক্ত। যেন সবে মাত্র আহত হতেই দেহ থেকে প্রাণপাখিটা বিদায় নিয়েছে। তখনই শেহনাজ এসে বলল,

–ভাবি তাড়াতাড়ি নিচে এসো। নিচে অ্যাম্বুলেন্সে করে কার জানি লা’শ নিয়ে আসা হয়েছে। কিছু সময়ের জন্য মেহেভীনের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ স্থির হয়ে গেল। রিয়াদ চৌধুরী কক্ষে থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বের হয়ে এল। মেহেভীন দৌড়ে বাহিরে চলে আসলো। রিয়াদ চৌধুরী সামনের লা’শে’র দিকে তাকিয়ে জ্ঞান হারালো। মেহেভীন রক্তে মাখা সামনে শুয়ে থাকা লা’শ’টা দেখে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। সমস্ত কায়া নিস্তেজ হয়ে আসতে শুরু করেছে। সে মাটিতে ধপ করে বসে পড়লো।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪৭
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

চারদিকে হাহাকারে ভরে গিয়েছে। কান্নার প্রতিধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠেছে। লা’শে’র পাশে বসে দু’টো বাচ্চা আর একজন অর্ধবয়স্ক মহিলা লা’শ’কে জড়িয়ে ধরে অনবরত অশ্রুবিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। মুহুর্তের মধ্যে পরিবেশটা বিষাদময় হয়ে উঠল। মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে গেল। বুদ্ধিরা জোট বেঁধে বিলীন হয়ে গিয়েছে। ভেতরটা কেমন জানি ফাঁকা লাগছে। চৌধুরী গৃহের সদর কবাটে হাহাকারের মেলা বসেছে। বাচ্চা দু’টোর হৃদয়বিদারক চিৎকার দেখে মেহেভীনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মেহেভীন আঁখিযুগল দিয়ে ইশারা করতেই একজন গার্ড বলল,

–এটা শরিফুলের লা’শ স্যারের সাথে জনসভায় ছিল। যেখানে গু’লা’গু’লি হবার সময় সে, সেখানে উপস্থিত ছিল। আমারা বেঁচে ফিরতে পারলেও ভাগ্য তার সহায় হলো না। যারা অশ্রুবিসর্জন দিচ্ছে। তারা শরিফুলের অর্ধাঙ্গিনী আর সন্তান। কিছু ব্যথার কোনো ঔষধ হয় না৷ কিছু দুঃখের কোনো শান্তনা হয় না। শরিফুলের পরিবারকে মেহেভীন কোন ভাষায় শান্তনা প্রয়োগ করবে, তা জান নেই মেহেভীনের। বাচ্চা দু’টো বাবার চরণ দু’টি আলিঙ্গন করে উন্মাদের মতো চিৎকার করে যাচ্ছে। আঁখিযুগল দিয়ে অশ্রুর বন্যা বয়ে যাচ্ছে। মহিলাটি কেমন অস্থির হয়ে হয়ে উঠছে। সমস্ত কায়া নিস্তেজ হয়ে আসছে। কিছু সময়ের ব্যবধানে মহিলাটি জ্ঞান হারালো। ভালোবাসা কি অদ্ভুত জিনিস! যাকে ছাড়া দম বন্ধ হয়ে আসে। মৃত্যুর কাছে সেই ভালোবাসা হার মেনে যায়। এত মায়া, এত ভালোবাসা, এত এত পূর্ণতা অপূর্ণ করে দিয়ে চলে যায় মানুষটা। মহিলাটির অবস্থা দেখে মেহেভীনের বুকের মধ্যে চিনচিন করে ব্যথা করছে। একটু পরে একটা গাড়ি আসলো। সেই গাড়ি করে শরিফুলকে দেশের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। শরিফুলের শেষ ইচ্ছে ছিল। তার লা’শ’টা যেন তার দেশের বাড়িতে দাফন করা হয়। মুনতাসিম শরিফুলকে দেওয়া কথা রেখেছে। শরিফুলের লা’শ দেশের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সমস্ত বন্দোবস্ত করে দিয়েছে মুনতাসিম। তাইয়ান ফোন করে জানিয়েছে তারা হসপিটালে আছে। সবাই শান্ত হলে-ও তিক্ততা হৃদয়কে গ্রাস করে ফেলছে। এত এত হাহাকার প্রিয় মানুষ হারানোর যন্ত্রনা ভেতর টাকে কাবু করে তুলছে।

রজনীর শেষ প্রহর চলছে। সবাই নিদ্রা দেশে তলিয়ে গিয়েছে। মেহেভীন কায়াতে শীতের বস্ত্র পরিধান করে আস্তরণে বসে আছে। মুনতাসিমের চিন্তায় সারারাত আঁখিযুগল এক করেনি সে। মানুষটাকে দেখার জন্য ভেতরটা ছটফট করছে। মস্তিষ্ক ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে। অনুভূতিরা আজ অভিমানে দূর দেশে পাড়ি জমিয়েছে। অশান্ত আঁখিযুগল বারবার কবাটের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। এই বুঝি মানুষটা এসে তার সামনে দাঁড়াবে। কিন্তু মেহেভীনকে হতাশ করে দিয়ে মানুষটা আসছে না। অসহ্য যন্ত্রনায় ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। যাকে কোনোদিন কল্পনা করত না৷ আজ তার জন্যই ভেতরটা কতই না পুড়ছে! তাকে না জানিয়েছিল আমন্ত্রণ না দিয়েছিল অনুমতি। তবুও সে এসেছিল। তার ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে তাকে ভালোবাসতে বাধ্য করল। সে তো বলেনি ভালোবাসলে এভাবে পুড়তে হয়! নিজের জন্য সে কোনোদিন এতটা যন্ত্রনা অনুভব করেনি। আজ মুনতাসিমকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাকে যতটা যন্ত্রনা দিচ্ছে। নাকের ডগা রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে মেহেভীনের। আঁখিযুগল ফুলে গিয়েছে। সমস্ত মুখশ্রীতে কেমন বিষন্নতা ছড়িয়ে পড়েছে। মেহেভীনের ভেতরের হাহাকার গুলো যেন তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে।

শুভ্র পাঞ্জাবীটা রক্তে ভিজে রক্তলাল বর্ণ রুপ নিয়েছে। শীতে সমস্ত কায়া থরথর করে কাঁপছে। হাত-পা সহ কায়ার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বরফের ন্যায় জমে আছে। মুনতাসিম আর তাইয়ান সবে মাত্র গৃহে ফিরেছে। মুনতাসিম নিজের কক্ষের দিকে অগ্রসর হতেই কারো গম্ভীর কণ্ঠ স্বর ভেসে এল। মানুষটা মুখশ্রীতে আঁধার নিয়ে এসে বলল,

–তোমার আব্বা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। নিজের কক্ষে যাবার আগে তার সাথে দেখা করে যাও। সাহেলা চৌধুরীর কথায় মুনতাসিম বিলম্ব করে না। দ্রুত রিয়াদ চৌধুরীর কক্ষে ছুটে যায়। রিয়াদ চৌধুরীর হাতে এখনো স্যালাইন বিদ্যমান। আঁখিযুগলে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে তার। ছেলেকে দেখে হৃদয় শীতল হলো। হাত বাড়িয়ে মুনতাসিমকে নিজের নিকটে ডাকল। মুনতাসিম দূরে থেকেই বলল,

–আপনি এত বেশি চিন্তা করেন কেন আব্বা? আমার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি৷ আপনার কিছু হলে আমার কতটা কষ্ট হয়৷ সেটা আপনি কবে বুঝবেন? যদি বুঝতেন তাহলে নিজের যত্ন নিতেন। আমি বাহিরে থেকে এসেছি। দেখুন সমস্ত কায়াতে রক্তের ছড়াছড়ি। এভাবে আপনার কাছে যাব না। আপনি বিশ্রাম নিন। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আপনার শরীর এখন কেমন আছে?

–তোমাকে দেখে উত্তপ্ত হৃদয়টা শীতল হয়ে গেল। তুমি আমার কাছে এসো। ছোট বেলায় কত ধূলাবালি নিয়ে খেলেছ। সেই কায়াতে আমার কোলেও এসেছ। তখন কিছু হয়নি৷ আর এখন কি হবে? সন্তান যেমনই হোক না কেন বাবা-মায়ের কাছে তারা সব সময় রাজকুমার। তুমি আমার জন্য কি সেটা তুমি বুঝবে না। যেদিন বাবা হবে সেদিন বুঝবে। কেন তোমার আব্বা তোমাকে নিয়ে এত বেশি ভাবত? তুমি তোমার কক্ষে যাও। ফ্রেশ হয়ে আসার দরকার নেই বিশ্রাম নিবে। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে সকালে কথা হবে। মুনতাসিম বিলম্ব করল না। দ্রুত কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সমস্ত কায়াতে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। সাথে মেহেভীনের জন্য ভিষণ মন পুড়ছে৷ মেয়েটা নিশ্চয়ই তার জন্য অস্থির হয়ে আছে। কবাটের কাছে আসতেই মেহেভীনকে দেওয়ালের সাথে মস্তক ঠেকিয়ে চিন্তিত হয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুনতাসিমের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। এই গৃহে তো আরো মানুষ আছে৷ তার বাবা আর মেহেভীন ছাড়া তার জন্য কেউ এতটা যন্ত্রনা নিয়ে ছটফট করতে করতে রজনী পার করেনি। মুনতাসিম কক্ষে প্রবেশ করল। মেহেভীন মুনতাসিম দেখে উঠে দাঁড়াল। মেহেভীনের মুখশ্রী কাছ থেকে দেখতেই ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল। মেয়েটার সমস্ত মুখশ্রীতে কেমন বিষন্নতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেহেভীন কোনো বাক্য উচ্চারন না করে আলমারি থেকে মুনতাসিমের টি-শার্ট, প্যান্ট আর তোয়ালে বের করে আস্তরণে রাখল। মুনতাসিম চোরা দৃষ্টি মেহেভীনকে দেখছে। মেহেভীন নিজেই মলিন কণ্ঠে বলল,

–আপনি বস্ত্র বদলে আসুন। এভাবে আপনাকে দেখতে খারাপ লাগছে।

–আপনি রাগ করে আছেন? কথা গুলো বলতে বলতে মেহেভীনের দিকে এগিয়ে আসলো। মেহেভীন আগের ন্যায় আস্তরণে গিয়ে বসল। মুনতাসিম কাঁধে হাত রাখতে চাইলে মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,

–একদম ছোঁবেন না আমাকে। মুনতাসিম বুঝল মহারাণীর রাগটা বেশ গভীর ভাবেই হয়েছে। আগে নিজেকে বাঁচাতে হবে। তারপর মহারনীর ক্রোধকে দমন করা যাবে। সে কোনো বাক্য উচ্চারন করল না। বস্ত্র নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। মেহেভীন অশ্রুসিক্ত নয়নে মুনতাসিমের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। অভিমানী আঁখিযুগল নিরবে শতশত অভিযোগ করে যাচ্ছে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই মুনতাসিম গোসল করে বের হলো। সামনের চুল বেয়ে টুপ টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে৷ শীতে থরথর করে কাঁপছে মুনতাসিম। মেহেভীন উঠে এসে মুনতাসিমের হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে মস্তক মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

–আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন? এই ভোর রাতে গোসল করতে গিয়েছেন কেন? সকালে উঠে গোসল করলেই পারতেন! হায় আল্লাহ সমস্ত কায়া বরফের ন্যায় জমে গিয়েছে। আপনি আস্তরণে গিয়ে বসুন। আমি আসছি। কথা গুলো বলেই মেহেভীন কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। একটু পরে সরিষার তেল নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল। মুনতাসিমের মস্তক আরো একবার ভালোভাবে মুছে দিল। মুনতাসিমের দুই হাত নিজের হাতের মধ্যে নিতেই সমস্ত কায়া কেঁপে উঠল। মেহেভীন বিলম্ব না করে দ্রুত সরিষার তেল মুনতাসিমের দুই হাতের তালুকে ঘষতে লাগল। মুনতাসিম চুপচাপ মেহেভীনের কর্ম পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। মেহেভীন মুনতাসিমের হাত ছেড়ে চরণের কাছে গেল। এবার মুনতাসিম বাঁধা সাধলে মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমাকে বেশি জ্ঞান দিতে আসলে আপনার সাথে আমার তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ লেগে যাবে।

–সে যাক, কিন্তু পা ছুঁতে দিব না।

–কেন আপনার পা ছুঁলে আমার হাত নষ্ট হয়ে যাবে? এসব কেমন ধরনের পাগলামি! কথা গুলো বলেই মেহেভীন দ্রুত মুনতাসিমের দু’টি চরণ নিজের কোলে তুলে নিয়ে তেল দিয়ে ঘষতে শুরু করে দিল। অদ্ভুত ভাবে কয়েক মিনিটের মধ্যে মুনতাসিমের হাত-পা গরম হয়ে আসতে শুরু করল। মুনতাসিম বিস্ময় নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। কায়ার কম্পন কমে গিয়েছে৷ সে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।

–আপনি অপেক্ষা করুন খাবার নিয়ে আসছি।

–বেশি করে নিয়ে আসবেন। দু’জন একসাথে খাব। ভুলেও রান্না ঘরে ঢুকবেন না। খাবার গরম করার কোনো ব্যাপার থাকলে গার্ডকে ডেকে নিবেন। মেহেভীন কোনো উত্তর করল না। দ্রুত কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। একটু পরে খাবার গরম করে নিয়ে এসে মুনতাসিমের মুখের সামনে ধরল। মুনতাসিম মুখশ্রী অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল,

–আগে আপনি খাবেন।

–আমি খেয়েছি।

–মিথ্যা কথা বলছেন কেন?

–আমাকে নিয়ে আপনার এত ভাবতে হবে না। যার কেউ নেই। তাকে নিয়ে ভাবার জন্য আল্লাহ তায়ালা আছেন।

–আসলে…মুনতাসিমকে সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করতে না দিয়ে মেহেভীন এক লোকমা ভাত মুনতাসিমের মুখে পুরে দিল। মুনতাসিম রক্তিম আঁখিযুগল নিয়ে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমকে দেখতে পেয়ে মেহেভীন যেন নিজের জান ফিরে পেয়েছে। অভুক্ত পেটটা জানান দিচ্ছে তার প্রচন্ড ক্ষুদা পেয়েছে। রাগ আছে মুনতাসিমের সাথে আছে। খাবারের সাথে কোনো রাগ নেই। মেহেভীন নিজেও মুনতাসিমের সাথে খেতে শুরু করল। তা দেখে মুনতাসিম মুচকি হাসল। সবকিছু গুছিয়ে মেহেভীন শায়িত হবার জন্য প্রস্তুত হতে মুনতাসিম মেহেভীনের হাত ধরে ফেলল।

–আপনাকে ছুঁতে নিষেধ করেছি।

–কি একটা বউ পেয়েছি। এতবড় বিপদের মধ্যে থেকে বেঁচে ফিরলাম। অন্য কোনো বউ হলে এতক্ষণে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দিত। স্বামীর সমস্ত মুখশ্রীতে হাজার খানেক চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিত। আর আমি হতভাগা বাহিরেও যুদ্ধ করব। ঘরে এসেও বউয়ের রাগে ধংস হব। ভালোবাসা আমার ভাগ্য নেই। নিরামিষ কোথাকার। এত রাগে আসে কোথায় থেকে আপনার?

–তাহলে সেই সব বউদের কাছে যান। কথা গুলো বলেই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল মেহেভীন। মুনতাসিমের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। শীতল কণ্ঠে বলা বাক্য গুলো ভিষণ ভয়ংকর রকমের হয়। পাথরের ন্যায় শক্ত মানুষটার হৃদয় টাও কাঁপিয়ে তুলে। মেহেভীন বেলকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত শক্তি ক্ষয় হতে শুরু করেছে। শক্ত আবরণের খোলস টা বরফের ন্যায় গলতে শুরু করেছে। চাইলেই সব সময় স্ট্রং থাকা যায় না। ভেতরের চাপা আর্তনাদ লুকিয়ে রাখা যায় না৷ জমে থাকা ব্যথা গুলো হঠাৎ করেই বলে ওঠে, আমি আর পারছি না। মেহেভীনের আঁখিযুগলের কার্নিশ অশ্রুকণা এসে জমতে শুরু করেছে৷ ভেতরে অসহনীয় যন্ত্রনার মাত্রা প্রকোপ পেয়েছে। ছুটে গিয়ে মানুষ টাকে আলিঙ্গন করে হাজারো অভিযোগ করতে ইচ্ছে করছে। তবুও নিজের মনকে দমিয়ে নিল মেহেভীন। শান্ত নদীর ন্যায় স্থীর হয়ে গেল সে। যে মানুষের জীবনে তার কোনো মূল্য নেই । সে চাইলেই তো আর জোর করে মূল্য আদায় করে নিতে পারবে না৷ সে তার মতো ভালো থাকুক। সে ভালো থাকলেই ধরনীর সমস্ত সুখ মেহেভীনের হৃদয়ে এসে ধরা দিবে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই মুনতাসিম মেহেভীনকে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরল। মেহেভীনের কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে অপরাধীর ন্যায় বলল,

–আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন। আমার ফোনটা নিজের কাছে ছিল না৷ সেজন্য আপনাকে দিকে জানাতে পারিনি৷ এত এত মানুষ আহত হয়েছে। চারিদিকে প্রিয়জনদের এত এত হাহাকার আমাকে দিশেহারা করে দিয়েছিল। আমার জন্য এত গুলো মানুষ আহত হলো। শরিফুল পরপারে গমন করল। তার বউ স্বামী হারা হয়ে গেল। তার সন্তানরা বাবা হারা হলো। আমি উন্মাদের এদিক সেদিক ছুটেছি। আমি আপনার কথা ভুলিনি। তাইয়ানকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছি। নিজে খবর দিতে পারিনি বলে, আপনি যে আমার কাছে মূল্যহীন এমনটা কোনোদিন ভাববেন না। আমার নিজের থেকে-ও বেশি আপনি আমার কাছে মূল্যবান। আপনার অভিমান হওয়াটা স্বাভাবিক। আমি আপনাকে আমার পরিবারকে যেমন ভালোবাসি। ঠিক তেমনই জনগণকেও আমি ভিষণ ভালোবাসি। তাদের ভালো রাখার শপথ গ্রহন করেছি। তাদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্বটাও আমার। আমি সবাইকে নিরাপদ চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে দিয়ে কিভাবে গৃহে আসতাম বলেন? আমি যদি নিজের কথা ভেবে চলে আসতাম। তাহলে আমার ভালোবাসার মানুষদের সাথে অন্যায় করা তো। আপনি রাগ করুন। আমাকে শত-শত কথা শোনান৷ আপনার সমস্ত শাস্তি আমি মস্তক পেতে নিব। তবুও আপনি এভাবে কষ্ট পাবেন না। আপনার ব্যথা আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। আমার ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে যায়। মেহেভীন নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। মুনতাসিমকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মুনতাসিমের ভেতরটা অশান্ত নদীর ন্যায় উথাল-পাতাল করতে শুরু করে দিয়েছে। সে শক্ত বন্ধনে নিজের প্রেয়সীকে বুকের মধ্যে আবদ্ধ নিল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

চারদিক বিষাদে পরিপূর্ণ। তবুও কোথাও জানি এক টুকরো সুখ এসে মনের আনাচেকানাচে ঘুরঘুর করছে! মুনতাসিমকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে মেহেভীনের কাবু হয়ে আসা মুখশ্রী মুনতাসিমকে ভিষণ আনন্দ দিচ্ছে। ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে উঠছে। এমন একটা দিনের জন্য কতগুলো দিন তাকে পুড়তে হয়েছে। প্রেয়সীর অশ্রুসিক্ত আঁখিযুগল ভেতরটা অশান্ত সমুদ্রের ন্যায় উথাল-পাতাল করছে। মুনতাসিম মেহেভীনের অশ্রুকণা গুলো নিজ দায়িত্ব মুছে দিল। মেহেভীনের দু’গাল দু’হাতের তালু দ্বারা আবদ্ধ করে ফেলল। কণ্ঠে কমলতা নিয়ে এসে বলল,

–কি হয়েছে, এভাবে কাঁদছেন কেন?

–আপনি এত নিষ্ঠুর কেন বলেন তো? আমি কি আপনার কাছে এতটাই তুচ্ছতাচ্ছিল্যে করা মানুষ নাকি সহজেই পেয়ে গিয়েছেন বলে সস্তা মনে হচ্ছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি পাগলের মতো এদিক সেদিক ছুটেছি৷ আপনি কেবল মুখেই ভালোবাসা দেখান। কাজের বেলায় আপনি একদম শূন্য। আর একটু হলেই আমার দেহ থেকে প্রাণপাখিটা বের হয়ে যেতো। আপনি সারাদিন আপনার জনগণের কাছে থাকুন। তাদের সেবা করুন। আমার কোনো সমস্যা নেই। আপনি একটা বার আমাকে ফোন দিয়ে জানাতে পারতেন। আপনি ঠিক আছেন। সুস্থ আছেন। তাহলে এই অশান্ত মনটাকে শান্ত করতে পারতাম। আপনার কি একবারও আমার কথা মনে হয়নি? ভয়ে বুক কাঁপেনি আপনি হীনা আমার কি হবে সে কথা ভেবে? আমার প্রতি এত অবহেলা, এত অনীহা!

–আপনার প্রতি যদি আমার অনীহা থাকতো। তাহলে রজনীর শেষ প্রহরে গৃহে ফিরে আসতাম না। আমার কোনো পিছুটান ছিল না। আমি যদি সারারাত গৃহে না ফিরতাম। আমার খোঁজ নেওয়ার কেউ ছিল না। শুধু আব্বা ফোন দিয়ে খোঁজ নিতো সুস্থ আছি কি না। আমার এত কিসের টান ছিল গৃহে ফেরার? আমি চাইলেই আজ রাতটা হসপিটালের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে বসে কাটিয়ে দিতে পারতাম। এত হাহাকার, এত বিষাদ, এত তিক্ততার মধ্যে থেকে-ও তাইয়ানকে দিয়ে খবর পাঠাতাম না। যেখানে মানুষ রেগে গেলে মানুষের ফোন পর্যন্ত রিসিভ করে না। সেখানে আমি কঠিনতম পরিস্থিতির মধ্যে থেকে-ও আপনার কথা ভেবেছি। আপনাকে আর সবাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে সবাই নিজের কথা ভাবতেই ভুলে গিয়েছি আমি। আমি শেষ কবে নিজের কথা ভেবে তা আমার জানা নেই। তবে আজ থেকে জানলাম। আমার নিজের কথা ভাবার দরকার নেই। আমার কথা ভাবার জন্য একটা পূর্ণিমার চাঁদ আছে। এত সুন্দর চাঁদ যদি আমার কথা ভাবে, এরপরেও যদি নিজের কথা নিজে ভাবি। তাহলে এ জীবন আমার বৃথা যাবে।

–আপনাকে বারবার করে বলেছি। আপনি কোনোকিছু করার আগে আমার কথাটা একটু ভাববেন। আপনার কিছু হয়ে গেলে আমি কিভাবে থাকব? আপনায় ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগে না। আমি সুখ দুঃখ বলতে আপনাকেই বুঝি।

–কেন?

–কারন আমি আপনাকে… বাক্যটা কণ্ঠ নালিতে এসে আঁটকে গেল। হৃদস্পন্দনের ক্রিয়া দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করল। বক্ষথলে ধড়ফড় করতে লাগলো। সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসতে শুরু করেছে। মুনতাসিমের আঁখিযুগলে তীব্র আগ্রহ। বাক্যটা শোনার জন্য ভেতরটা ছটফট করছে। মুনতাসিমের তীব্রতা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে মেহেভীন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শান্ত নদীর ন্যায় স্থির হয়ে গেল। আঁখিযুগল নিচের দিকে বিদ্যমান। মুনতাসিম মেহেভীনের নিরবতা দেখে নিজেই বলতে শুরু করল,

–যাকে হারানোর ভয়ে আপনার বুক কেঁপে ওঠে। যাকে হারানোর ভয়ে চেতনায়, অচেতনায় আপনার আঁখিযুগলে অশ্রুকণা এসে জমা হয়। আপনি তাকে ভালোবাসেন।

–মিথ্যা কথা।

–আমাকে তো আপনি ভালোবাসেন না। তাহলে হারাতে ভয় পাচ্ছেন কেন? আমি কখনো চাইনি আমাদের মাঝে প্রেম হোক। কারন প্রেমে বিচ্ছেদ হয়। আমি সব সময় চেয়েছি আমাদের মাঝে ভালোবাসা তৈরি হোক। কারন ভালোবাসায় বিচ্ছেদ নেই। হাত ধরলে মানুষ হাত ছেড়ে চলে যায়। সেজন্য আমি আপনার মনে ধরেছি। মন তো আর ছেড়ে চলে যেতে পারবে না। আমার মন বলেছে। আপনি আমায় মায়ায় পড়ুন। ছায়া কখনো ছেড়ে যায় না। আর মায়া কখনো পিছু ছাড়ে না৷ ধরনীর বুকে সব নেশা কাটানোর ঔষধ আছে। কিন্তু মায়ার নেশা কাটানোর কোনো ঔষধ নেই। মায়ার নেশায় যে পড়েছে। সে মরেছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই নেশা বয়ে বেড়াতে হয়। জানেন ম্যাডাম আপনার মতো কেউ আমারে এত মায়া করেনি। আমার জন্য নির্ঘুম রজনী পার করেনি। আমায় ভালোবেসে খাইয়ে দেইনি। আমারে হারানোর ভয়ে ছটফট করেনি। আপনার মতো আমার জন্য কারো আঁখিযুগলে অস্থিরতা দেখিনি। আমার অসুস্থ কায়াকে দ্রুত সুস্থ করার চেষ্টা করেনি। আপনি আমায় এত মায়ায় কেন বাঁধছেন? এত সুখ, এত আনন্দ, এত ভালোবাসা আমার জীবন সহ্য করতে পারবে তো! আমাকে এতটা মায়ায় বাঁধবেন না। আপনায় ছাড়া চলতে ভিষণ কষ্ট হয়৷ আগে বাহিরে গেলে ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করেনি। আর এখন বাহিরে গেলে দ্রুত কাজ শেষ করে ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে। কোন জাদুবলে আমায় গ্রাস করে নিলেন আপনি? আমি ভুল করলে অভিযোগ করবেন। তবুও যেন বিচ্ছেদ শব্দটা আমাদের সম্পর্কের মধ্যে না আসে। যদি আসে তাহলে আমার আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। মেহেভীন মনযোগ দিয়ে প্রতিটি বাক্য মস্তিষ্কে গেঁথে নিল। মানুষটাকে দুঃখ দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। নিশ্চুপ হয়ে গেল মেহেভীন। অধীর আগ্রহ নিয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে সে। এই বুঝি মুনতাসিম আজ তাকে ভালোবাসি বলে দিবে। মেহেভীনকে হতাশ করে দিয়ে মুনতাসিম নিদ্রা যাবার জন্য প্রস্তুত হলো। মেহেভীনের কুঁচকে যাওয়া মুখশ্রী আড়দৃষ্টিতে দেখে মুনতাসিমের ভিষণ আনন্দ লাগছে। সে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। মেহেভীন বেলকনির গ্রিল ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।

চারদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। শীতল পরিবেশে নিস্তব্ধতার মেলা বসেছে। পাখিরা যেন আজ সুর তুলতে ভুলে গিয়েছে। মানুষ যেখানে কম্বলের উষ্ণ আলিঙ্গনের নিদ্রায় আচ্ছন্ন। সেখানে নিদ্রা ত্যাগ করে শহর থেকে দুইশো আটান্ন কিলোমিটার দূরে আসতে হয়েছে জারিফকে। জারিফের হাতে হ্যান্ডকাফ পড়ানো আছে। প্রলয় জারিফের কলার চেপে ধরে বলল,

–এতদিন অনেক জ্বালিয়েছিস। আজকে যদি একটুও ফাজলামি করার চেষ্টা করেছিস। তবে তোর বোনকে একদম শেষ করে ফেলব। তাড়াতাড়ি বল লা’শ কোথায় রেখেছিস? প্রলয়ের কথায় জারিফের মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠল। রক্তিম আঁখিযুগল দিয়ে প্রলয়কে ভস্ম করে দিতে ইচ্ছে করছে। ক্রোধ যেন শিরায় শিরায় চলাচল করছে। জারিফ পুলিশকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে পুলিশ সদস্যরা সেদিকেই যাচ্ছে। পথ চলতে চলতে একটা নিস্তব্ধ শ্মশানের কাছে এসে জারিফ স্থির হলো। শ্মশানের পাশ দিয়ে আঁকাবাকা নদী বয়ে গিয়েছে। শীতল বাতাস এসে সমস্ত মন মস্তিষ্ককে কাঁপিয়ে তুলছে। নদীর পাশেই বিশাল একটা বটগাছ। জারিফ বটগাছটা দেখিয়ে বলল,

–এখানে মিরাজুলের লা’শ পুঁ’তে’ছি। প্রলয় গভীর ভাবে চারদিক পর্যবেক্ষণ করে নিল। চারদিকে গাছপালায় ঘেরা। জনবসতি নেই বললেই চলে। ছেলেটা দারুন বুদ্ধিমান না হলে লা’শ গায়েব করার জন্য এত সুন্দর স্থান নির্ধারণ করে। এই পর্যন্ত আসতে তাদের অনেকটা সময় ব্যয় হয়ে যেতো। চারদিক কেমন সুনশান একটা মানুষকে খু’ন করে রেখে গেলে-ও কেউ দেখার নেই। প্রলয় গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আর আরিয়ানের লা’শ কোথায় পুঁ’তে’ছ?

–নদীর ওপারে জঙ্গলের মধ্যে গেলে দেখাতে পারব। প্রলয় লা’শ উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে দিতে বলল। মিরাজুলের লা’শটা বের করার জন্য মাটি খুঁড়তে শুরু করে দিল। প্রলয় জারিফকে নিয়ে সাঁকো দিয়ে জঙ্গলের ভেতরে গেল। জঙ্গলটা বেশ ভয়াবহ। জঙ্গলের যত গভীরে যাচ্ছে ভেতরটা ততই কেঁপে উঠছে। একজন পুলিশ সদস্য বলল,

–আমাদের সামনের দিকে না আগানোই ভালো হবে স্যার। আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে জঙ্গলের গভীরে যেতে হবে। এভাবে জঙ্গলের ভেতর গেলে আমাদের ক্ষতি হতে পারে। বলা তো যায় না জঙ্গলের কোনো হিংস্র পশু এসে আক্রমণ করল! তখন আমরা কি করব স্যার? পুলিশ সদস্যের কথায় জারিফ শব্দ করে হেসে উঠল। তাচ্ছিল্য করে বলল,

–এই জান নিয়ে পুলিশ হয়েছিস! এই তোকে পুলিশের চাকরি দিয়েছিল কে? আমি যদি তোদের থানায় কাজ করতাম। তাহলে আগে তোকে লা’থি দিয়ে থানা থেকে বের করতাম। তোরা আটজন মানুষ এসেছিস। তা-ও ভয় পাচ্ছিস! আর আমি একা এসেছি তা-ও লাশ কাঁধে নিয়ে। আমার তোকেও আরিয়ানের মতো বুঝাইতে ইচ্ছে করছে। জারিফের কথায় প্রলয় রাগান্বিত হয়ে বলল,

–তুমি কিন্তু আমার কথা ভুলে যাচ্ছো জারিফ। আমার এক ফোনে তোমার বোনের জীবন শেষ। মুহুর্তের মধ্যে জারিফের মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। সে মুখশ্রী গম্ভীর করে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। গভীর অরণ্যের মাঝখানে এসে জারিফ থামলো। চারিদিক থেকে বিশ্রী গন্ধ এসে নাসারন্ধ্রে ঠেকছে। জারিফ সামনের দিকে ইশারা করতেই সবার দৃষ্টি সামনের দিকে গেল। গাছের সাথে রশি দিয়ে আরিয়ানকে ঝুলানো আছে। দু’চরণের মাংস হাঁটুর অবধি নেই। হয়তো কোনো হিংস্র পশুর খাবার হয়েছে। মস্তকের সমস্ত কেশগুলো ঝরে পড়েছে। দেহ থেকে মাংস গুলো খসে পড়তে শুরু করেছে। আঁখিযুগল দু’টি বেড়িয়ে পড়ে গিয়েছে। লা’শে’র দেহ জুড়ে শতশত মাছি ভনভন করছে। কিছু বিষাক্ত পোকা লা’শ টাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কায়ার হাড্ডি গুলো বের হতে শুরু করেছে। হাতের আঙুল থেকে নখ খসে পড়েছে। পেটের অর্ধেক নাড়িভুড়ি হয়ে আসছে। লা’শে’র বিশ্রী গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকা দুষ্কর হয়ে গিয়েছে। প্রলয় সবাইকে নিয়ে একটু দূরে অবস্থান করল। আরিয়ানের এমন ভয়াবহ রুপ দেখে একজন পুলিশ সদস্যের মস্তক ঘুরতে শুরু করল। সে শীতের মধ্যেও তরতর করে ঘামছে। প্রলয় কাউকে ফোন দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে কিছু লোক পাঠাতে বলল। ত্রিশ মিনিট পর কিছু লোক এসে আরিয়ানের লা’শ নামিয়ে নিয়ে শ্মশানের দিকে অগ্রসর হলো। তারা প্রায় সাত ফিটের মতো মাটি খুঁড়ে ফেলেছে। তবুও লা’শে’র দেখা মিলছে না। প্রলয় জারিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–লা’শ কোথায়?

–সবে তো শুরু আরো নিচে যাও ওসি সাহেব।

–আনুমানিক কত ফিট নিতে পুঁ’তে’ছ?

–বিশ থেকে পঁচিশ ফিট হবে। মেপে দেখেনি।

–তোর কলিজা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।

–অবাক হবার কিছু নেই। তুমি আমাকে কথা দিয়েছ। ফাঁসির আগে মেহেভীনের সাথে কথা বলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। তুমি তোমার কথার বরখেলাপ করলে আমার পরবর্তী টার্গেট তোমার অর্ধাঙ্গিনী আর সন্তান। মৃত্যুর আগে নিষ্ঠুর মনটাকে বুঝিয়ে যেতে পারব। মেহেভীনের সাক্ষাৎ পাইনি তো কি হয়েছে। যে কথা দিয়ে কথা রাখেনি। তার সমস্ত সুখ কেঁড়ে নিতে পেরেছি। আর জারিফ যেটা বলে সেটা করেই ছাড়ে বাকিটা তোমাকে বলে দিতে হবে না।

–প্রলয় কথা দিলে কথা রাখে। প্রলয়ের কথায় জারিফ মৃদু হাসল। কুয়াশাকে গ্রাস করে নিয়েছে একফালি রৌদ্র। আশেপাশেই দু’একজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। কিছু সময়ের ব্যবধানের শ্মশানটা মানুষ দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। লা’শ দেখতে ভিড় জমিয়েছে শত মানুষ। এক কান দু’কান করতে করতে আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে গেল খু’নের কথা। বেলা গড়িয়ে দুপুরে হয়ে আসতে শুরু করেছে। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হবার পর লা’শের’ দেখা মিলল। লা’শে’র নাড়িভুড়ি বের হয়ে গিয়েছে। লা’শ পঁচে মাটির সাথে মিশতে শুরু করেছে। লা’শ পঁচা গন্ধে নিচে থাকা দুষ্কর হয়ে গিয়েছে। ওপর থেকে কেরোসিন ফেলা হলো। লা’শে’র ওপরে কয়েক কেজি কেরোসিন ঢেলেও গন্ধ দূর করা গেল না। কয়েকজন তো বমি করে দিল। বাচ্চারা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। একজন কিশোরী লা’শ দেখা মাত্রই জ্ঞান হারালো। এমন ভয়াবহ লা’শ তারা জীবনে দেখেনি। প্রলয় সবাইকে ধমকে দূরে সরতে বলল। সময়ের সাথে মানুষের ভিড় বাড়ছে। কড়া বাক্য গুলো যেন মানুষের কর্ণে যাচ্ছে না। উদ্ধার কর্মীদের মধ্যে একজন সহ্য করতে না পেরে অনবরত বমি করতে শুরু করল। মস্তক রীতিমতো ঘুরছে। সমস্ত কায়া তরতর করে ঘামছে। লা’শ ধরে তুলতে গেলেই গলে গলে খসে পড়ছে। লা’শ তোলার জন্য ওপর থেকে বস্তা ফেলা হলো। সেটার ওপর লা’শ তুলে রশি দিয়ে লা’শ টাকে মুড়িয়ে ফেলল। ওপর থেকে রশি ফেলতেই লা’শটা বেঁধে টেনে ওপরে তোলা হলো। চারদিকে পুলিশ ঘিরে রেখেছে। লা’শে’র আশেপাশে কাউকে আসতে দিচ্ছে না। সবাই শোরগোল শুরু করে দিল। লা’শ দু’টো গাড়িতে তুলে জারিফকে নিয়ে দ্রুত স্থান করল প্রলয়।

বিষাদে ভরপুর মুহুর্ত গুলো ভিষণ দীর্ঘ হয়। কিন্তু সুখ! সুখ জিনিস টা এমন কেন? দমকা হাওয়ার মতো আসে আবার সুখের স্থানটাতে দুঃখ পুষিয়ে দিয়ে সুখ কেঁড়ে নিয়ে চলে যায়! সুখ শব্দটা যেমন সুন্দর তার স্থায়িত্ব তেমনই ক্ষণিকের জন্য হয়। কিন্তু দুঃখ শব্দটা যেমন বিষাক্ত তার স্থায়িত্ব তার থেকে-ও দীর্ঘ হয়। এই যে মানুষ বলে আমাকে হয়তো সুখে মানায় না। আমি দুঃখ নিয়েই আছি বেশ। তবে দুঃখ গুলো কি মানুষের চাওয়া-পাওয়া গুলোকে আদরে গ্রহণ করে নিল। দুঃখের চেয়ে সুখের পরিমাণ বেশি হলেই যে, দুঃখ আমাদের জীবনে পোড়াতে চলে আসে। মুনতাসিম রাজনৈতিক আলোচনায় মশগুল ছিল। তখনই মুঠোফোনেটা অনবরত বেজেই যাচ্ছে। মুনতাসিম বিরক্ত হয়ে ফোনটা তুলতেই ওপর পাশ থেকে কিছু বিষাক্ত বাক্য মস্তিস্কে এসে বাসা বাঁধল।

–আমি আজকে আত্নসমর্পণ করে ফেলব। আমি আর পারছি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এভাবে থাকলে আমি নিজের ক্ষতি নিজে করে ফেলব। আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও। তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না।

–আপনি এমনটা করতে পারেন না। আপনি আমায় কথা দিয়েছিলেন। আপনাকে তো আমি বলেছি। আপনি আমাকে তিনমাস সময় দিন। আমি সবকিছু ঠিক করে দিব।

–আমি তিনটা সেকেন্ডে তিনবার করে মরছি। তিনটা মাস কিভাবে বাঁচব বলো? আমায় তুমি মাফ করে দিও। আমার ফুল টাকে দেখে রেখো। আমার খুব যত্নে তৈরি করে ফুল সে। তাকে আঘাত করলে পরকালে হিসাব নিব। ভালো থাকবে এবং তার খেয়াল রাখবে। কথা গুলো বলেই ফোনটা রেখে দিল। মুনতাসিম অনবরত ফোন করেই যাচ্ছে। কিছু সময়ের ব্যবধানের ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। জীবনে কোনোদিন সে এমন ভাবে দিশেহারা হয়নি। আজ যেভাবে সে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। মুনতাসিম চিৎকার করে বলল,“আপনি বেইমান। আপনি আমায় কথা দিয়ে কথা রাখলেন না। আপনি আমায় কোনোদিন ভালোই বাসেননি। যদি ভালোবাতেন। তাহলে আমার সুখ কেঁড়ে নেওয়ার আগে আপনার বুক কাঁপত। আপনি কিভাবে পারলেন এতটা স্বার্থপর হতে? আপনি তো এমন ছিলেন না! আমাকে গুছিয়ে ওঠার সময়টা দিয়েও কেঁড়ে নিলেন? আপনি যেমন আমার কাছে হিসাব চাইবেন। পরপারে আমাদের দেখা হলে আমার সুখ কেঁড়ে নেওয়ার হিসাবটাও আমি আপনার থেকে চেয়ে নিব।”

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৪৩+৪৪+৪৫

0

#খোলা জানালার দক্ষিণে
#পর্ব_৪৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

অর্ধবুজা আঁখিযুগল নিয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে মেহেভীন। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিম কক্ষে এসে টাকা গুনছে। দু’জনের মাঝে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। মেহেভীন নিদ্রায় তলিয়ে যেতে চাইলেই, মেহেভীনের হাত ধরে তুলে বসিয়ে দিচ্ছে মুনতাসিম। বিরক্ততে ললাটে কয়েক জোড়া ভাজ পড়লো মেহেভীনের। মেহেভীন দেওয়ালের সাথে মস্তক ঠেকিয়ে আঁখিযুগল বন্ধ করল। তখনই কর্ণকুহরে এসে মুনতাসিনের কণ্ঠ স্বর পৌঁছাল। মেহেভীন আঁখিযুগল মেলে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল।

–এই নিন দেনমোহরের টাকা। এগুলো আমার কালকেই বুঝিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল। আমি সময় মতো দিতে পারিনি। তার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। এগুলো গ্রহণ করুন আর আমার পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে, মনের অন্তরালে কোনো অভিযোগ রাখবেন না।

–এগুলো কি আমি চেয়েছি? এগুলো তো পরে-ও দিতে পারতেন। আজ কয়েকটা দিন হলো আমার ঘুম হয়নি ভালো করে। আমাকে ঘুমোতে দিলেই পারতেন।

–এগুলো চাইতে হবে কেন? এগুলো আপনার প্রাপ্য অধিকার। সেটা যথাযথ ভাবে আপনার হাতে তুলে দেওয়া আমার দায়িত্ব। এবার টাকা গুলো সব গুনে নিন দেখুন তো সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না?

–গুনতে হবে না রেখে দিন আপনি।

–টাকা-পয়সার ব্যাপার টা ভিষণ খারাপ ম্যাডাম। আপনার যতই কাছের মানুষ হোক না কেন? আপনি সর্বদা টাকা-পয়সা লেনদেন করার সময় গুনে নিবেন।

–এখন নিজের জীবন বাঁচানো বাদ দিয়ে টাকা গুনতে শুরু করব! পরে দেখা গেল টাকা গুনতে গুনতে আমি ক’ব’রে চলে গিয়েছি। মেহেভীনের একটা বাক্য মুনতাসিমের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। অজানা যন্ত্রনায় ভেতরটা ছটফট করছে। বিষণ্ণ আঁখিযুগল মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের বিষন্ন মাখা মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টি পড়তেই মেহেভীনের নিদ্রা উবে গেল। সে আন্দাজ করতে পারছে মুনতাসিম রেগে গিয়েছে। মানুষটা তার সাথে রেগে গেলে একদম নিশ্চুপ হয়ে যায়। মেহেভীন মনে কিছুটা ভয় আর বাহিরে স্বাভাবিক মুখভঙ্গি করে মুনতাসিমের হাত থেকে দ্রুত টাকা গুলো নিয়ে নিল। সেগুলো নিজের ব্যাগে রেখে এসে বলল,

–আমি সকালে টাকা গুলো গুনে নিব। আজকে ঘুমাই টাকা কম পেলে জানাব। কথা গুলো বলেই মেহেভীনের আস্তরণের এক কোণে গিয়ে শুয়ে পড়লো। কাল রাতে নতুন জায়গায় তার ঘুম আসছিল না। আজ হঠাৎ মুনতাসিমকে দেখে রাজ্যের সমস্ত নিদ্রা এসে তার আঁখিযুগলে ধরা দিয়েছে। কিন্তু মুনতাসিমের বিষণ্ণ মুখশ্রী ভিষণ পোড়াচ্ছ তাকে। মুনতাসিম কক্ষের আলো নিভিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো। সে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। মৃত্যুর মতো চিরন্তন সুন্দর সত্য ধরনীর বুকে দু’টো নেই। মৃত্যু হবে জেনেও আমরা ভালোবাসি। মৃত্যুর কাছে ভালোবাসার হার নিশ্চিত জেনেও, আমরা প্রিয়জনকে হারাতে ভয় পাই। প্রিয়জনকে আঁকড়ে ধরে রাখার বিথা চেষ্টা করি। প্রিয়জনের মৃত্যুর কথা কর্ণপাত হতেই আমাদের সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে। চিরন্তন সত্যটা মেনে নিতে বুকের ভেতরটায় অসহনীয় জ্বালা পোড়া করে। মনের গহীনে হাহাকার করে ওঠে। প্রিয়জন হারানোর ভয় মানুষকে নিরব করে তোলে। মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল মুনতাসিমের। আগে যে মানুষটা মৃত্যুর পরোয়া কোনোদিন করেনি। বিপদ হবে জেনেও সেই সকল স্থানে গিয়েছে। যার না ছিল কোনো পিছুটান। আজ সেই মানুষটা কাউকে হারানোর ভয়ে কাবু হয়ে গিয়েছে। মেহেভীনের বলা বাক্য গুলো স্মরন হতেই ভেতরটা ভিষণ জ্বালাপোড়া করছে। মেহেভীনকে দু’টো কড়া কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। এত সুন্দর মুহূর্তটাকে বিষিয়ে না তুললেই হতো না। ক্রোধে চোয়াল শক্ত হয়ে এল তার। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করছে। মুনতাসিমের জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার শব্দ মেহেভীন অনুভব করতে পারছে। জড়তার কারণে মুখশ্রী দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারন হচ্ছে না। দু’জন দুই দ্বিপের ন্যায় উল্টো দিকে শায়িত আছে। পিনপতন নিরবতার দেওয়াল ভেঙে মেহেভীন বলল,

–আপনি আমার কথায় রাগ করেছেন?

–না।

–আমি আসলে মজা করে বলেছি। আপনি সিরিয়ালি নিয়ে নিবেন ভাবতে পারিনি! তাছাড়া সবাইকেই তো একদিন চলে যেতে হবে। এটা বললে রাগ করার কি আছে?

–আপনার ঘুম পেয়েছে, আপনি ঘুমান। মেহেভীন কোনো বাক্য উচ্চারন করল না। কয়েকদিন ধরে কায়ার ওপর দিয়ে ভিষণ ধকল গিয়েছে। কিছু সময়ের ব্যবধানে মেহেভীন নিদ্রা দেশে তলিয়ে গেল। মেহেভীন নিদ্রা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মুনতাসিম ও নিদ্রা চলে গেল।

প্রভাতের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। গাছের মগড়াল থেকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ কর্ণকুহরে ভেসে আসছে। সেই শব্দে নিদ্রা ভেঙে যায় মেহেভীনের। এত পাখি এল কোথায় থেকে? কর্ণ একদম ঝালাপালা করে দিল। মেহেভীন আঁখিযুগল মেলতেই মুনতাসিমের স্নিগ্ধ মুখশ্রী খুব কাছ থেকে দেখতে পেল। সে অনুভব করল কারো শক্ত হাতের বাঁধনে সে আবদ্ধ রয়েছে। মুনতাসিম তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মুনতাসিমকে এত কাছে থেকে দেখে, মেহেভীনের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেল। অদ্ভুত এক ভালো লাগার সংমিশ্রণের ভেতরটা সুখানুভূতিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মুনতাসিমের অবাধ্য কেশ গুলো ললাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেহেভীন এক হাত বের করে সেগুলো যত্ন সহকারে সরিয়ে দিল। আচমকা মুনতাসিম আঁখিযুগল মেলে তাকালো। আকষ্মিক ঘটনায় মেহেভীন থতমত খেয়ে গেল। সে বিলম্ব না করে দ্রুত আঁখিযুগল বন্ধ করে নিল। মুনতাসিম ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,

–আপনার অভ্যাসটা ভিষণ খারাপ! এভাবে আঁখিযুগল দিয়ে ঘুমন্ত মানুষের সর্বনাশ করছেন৷ আপনি জানেন না। আমার বউ আছে। এখন আমি আমার বউয়ের সামনে মুখ দেখাব কি করে? আর অভিনয় করে লাভ নেই। আমি দেখেছি আপনি সজাগ হয়েছেন। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন গম্ভীর দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। সে কণ্ঠে গম্ভীরতা বজায় রেখে বলল,

–আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছেন কেন? আমাকে জড়িয়ে ধরার আগে বউয়ের কথা মনে পড়েনি? আমাকে ছাড়ুন বলছি!

–কে বলেছে আমি জড়িয়ে ধরেছি? আমার মতো মানুষ কোনো নারীকে জড়িয়ে ধরতেই পারে না! আপনি রাতে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন।

–মিথ্যা কথা, আমার কাউকে জড়িয়ে ধরার অভ্যাস নেই।

–কিন্তু আমার আছে। কোলবালিশ ভেবে ধরে ফেলেছি। এত ভাব নেওয়ার কিছু নেই। এমনিতেই আপনাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে আমার নেই।

–অথচ আমাকে ছুঁয়ে আছেন! হাত সরান আমি বাড়ি যাব। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিমের আঁখিযুগল বিস্ময় হয়ে গেল। সে সহজ-সরল মুখভঙ্গি করে জবাব দিল,

–আমার রাগিনীর রাগ আমার ভিষণ প্রিয়। রাগিনীকে রাগাতে আমি ভিষণ আনন্দ পাই। রাগিনী রাগ করলে সমস্ত মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করে, তখন আমার রাগিনীকে এত্ত গুলো ভালোবেসে দিতে ইচ্ছে করে। আপনি রাগ করছেন কেন? আমি তো আপনার সাথে মজা করছিলাম৷ তাই বলে আপনি আমাকে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার হুমকি দেখাবেন!

–আমি আপনাকে হুমকি দেখাচ্ছি না। আপনি কালকে মাকে কি বলেছিলেন? সেটা আপনার মনে নেই! মুনতাসিম নিষ্পলক চাহনিতে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের আঁখিযুগল জুড়ে আজ শুধুই মুগ্ধতা। সুখ গুলো আর মুনতাসিমের হৃদয়ে ধরা দিয়েছে। আজ বিষাদ সুখকে নয় সুখে বিষাদকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে ফেলছে। ধরনীর বুকে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে হচ্ছে মুনতাসিমের। সে প্রসন্ন মন নিয়ে মেহেভীনকে বলল,

–পাশ ফিরলেই আপনাকে দেখতে পাব। এমন একটা দিনের জন্য আমি কতগুলো প্রহর অপেক্ষা করেছি। আমার অপেক্ষার ফল সার্থক হয়েছে। ধমনীর বুকে সবচেয়ে সুখী মানুষটা হচ্ছে আমি। আপনাকে দেখলে আমার ভেতরের দুঃখ গুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই যে আপনি আমায় সুখ এনে গুলো দিলেন। এই সুখ কোনো কেঁড়ে নিয়েন না। যদি কখনো আমার প্রতি কোনো অভিযোগ আসে মনে, তবে নির্দ্বিধায় বলে দিবেন। আমি অভিযোগ করার সুযোগ রাখতে দিব না। আপনি আমার পাশে থাকলে, আমি আপনাকে হৃদয়ের গুপ্ত কুঠুরিতে আগলে রাখব। আমি কখনোই চাইনি আমাদের মাঝে প্রেম হোক। কারন প্রেমে বিচ্ছেদ হয়। আমি সব সময় চেয়েছি আপনি আমায় ভালোবাসুন। আমার মায়ায় জড়িয়ে যান। ভালোবাসায় কখনো বিচ্ছেদ হয় না। আর মায়া কখনো কাটানো যায় না। আমি আপনাকে হালাল ভাবে চেয়েছি বলেই আপনার থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলেছি, কারন হারামে আরাম নেই। সেজন্য বোধহয় আমাদের মাঝে মনমালিন্য হতো। আমি একদম বিয়ের দিন আপনার সামনে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনার বিপদের কথা শুনে স্থির থাকতে পারিনি। বিয়ের মতো সুন্দর আর পবিত্র জিনিস দু’টো নেই। যখন থেকে কবুল বলেছেন। আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তখন থেকেই আপনার আঁখিযুগলে আমার জন্য মুগ্ধতা দেখেছি। আগে আমি রাগ করলে কষ্ট পেলে আপনাকে দ্বিগুন যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখিনি। কিন্তু কালকে আমি আপনাকে আমার জন্য ভয়ংকর ভাবে পুড়তে দেখেছি৷ এরপরেও আপনার প্রতি আমার রাগ জমে থাকতে পারবে? আপনাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার ইচ্ছেটা যে আরো দ্বিগুন ভাবে বেড়ে গেল ম্যাডাম। এতক্ষণ মুনতাসিমের কথা গুলো মনযোগ দিয়ে শুনছিল মেহেভীন। আজকাল মুনতাসিমের সবকিছুই তার ভালো লাগে। কবুল বলার পর থেকে আলাদা একটা টান তৈরি হয়েছে মুনতাসিমের প্রতি। যেটা আগে তার কখনোই ছিল না। হালাল জিনিস হোক বা সম্পর্ক সেটা সব সময় সুন্দর হয়। তা মেহেভীন বিয়ের পর থেকেই উপলব্ধি করতে পারছে। মেহেভীনের মুখশ্রীতে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে। মেহেভীন নরম কণ্ঠে বলল,

–আপনি অনেক সুন্দর কথা বলতে পারেন। এভাবে সবার সাথে কথা বললে, প্রতিটি মানুষ আপনার ওপর দুর্বল হয়ে পড়বে। সত্যি করে বলুন কতজনকে এভাবে গিলিয়েছেন? আল্লাহ তায়ালা আপনাকে দারুন একটা ক্ষমতা দিয়েছে। আপনি খুব সহজে মানুষের মনের গভীরে চলে যেতে পারেন।

–আপনার মনের গভীরে কতটা গিয়েছি ম্যাডাম?

–মনের গভীরে তো দূর মনের ধারে কাছেও আসতে পারেন নি স্যার। এবার উঠে তৈরি হয়ে নিন৷ সবাই বলবে নতুন বউয়ের লজ্জা নেই। কত বেলা হয়ে গিয়েছে এখনো ঘুমোচ্ছে। মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য মনটা ভিষণ ছটফট করছে।

–আমার কাছে থাকতে ভালো লাগছে না? মেহেভীন উত্তর দিল না৷ মুহুর্তের মধ্যে মেহেভীনের মুখশ্রী মলিনতায় ছেয়ে গেল। মেহেভীনের মলিন মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে মুনতাসিম বলল,

–আমি নিয়ে যাব। তবে আমার একটা শর্ত আছে।

–কি শর্ত?

–আপনি দু’দিনের বেশি থাকতে পারবেন না।

–কেন? আমি তো ভাবছি সাতদিন থাকব। আমাদের দু’জনের গৃহের দুরত্ব তো খুব একটা বেশি না!

–তাহলে যেতেই দিব না। আমি বউ ছাড়া থাকতে পারব না।

–এতদিন কিভাবে থেকেছেন?

–এতদিন বউ ছিল না। এখন বউ হয়েছে। আগেকার ব্যাপার আর এখনকার ব্যাপারের অনেক তফাৎ আছে।

–বিয়ে করার সাথে সাথে আপনার মস্তকটাও গিয়েছে। কেমন ছোট বাচ্চাদের মতো আরচণ করছেন! কথা গুলো বলেই মেহেভীন উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল। মুনতাসিম কম্বল মুড়ি দিয়ে মুখশ্রী ঢেকে ফেলল। আজকে তার কিছুতেই আস্তরণ ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। দীর্ঘদিন পরে সে প্রশান্তিতে ঘুমিয়েছি। ভেতরটা আজ আনন্দে মনের শহরের অলিতে-গলিতে মিছিল করছে।

আজ চারদিন হলো মেহেভীন মায়ের কাছে এসেছে। মাকে একা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। এদিকে মুনতাসিম ও রাগ করে আছে। রাইমা বেগম বুঝিয়ে বলাতে মেহেভীন আজকে চলে যাবে। মায়ের কোলে মস্তক রেখে মেহেভীন শায়িত আছে। রাইমা বেগম মেহেভীনের মস্তকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

–আব্বু থাকলে দু’দিন আগেই চলে যেতাম। আব্বু নেই সেজন্য তোমাকে একা রেখে যেতে ভয় লাগছে আমার৷ এদিকে উনিও রাগ করে আছেন। আজকাল উনি রাগ করলে, কষ্ট পেলে আমার ভেতরটা ভিষণ পুড়ে জানো আম্মু। আমি সহ্য করতে পারি না৷ উনি ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকি। উনার রাগের কাছে হার মেনেই যেতে রাজি হয়েছি। আরো তিনটা দিন থাকার ইচ্ছে ছিল। রাইমা বেগম মেয়ের কথায় মুচকি হাসলেন৷

–স্বামী জিনিস হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। তাকে ভালোবাসতে জানলেই তার ভালো থাকা, খারাপ থাকার ওপরে নির্ভর করে স্ত্রীর ভালো থাকা, খারাপ থাকা। সেখানে ভালোবাসা আছে। সেখানে কষ্ট থাকবে স্বাভাবিক। ভালোবাসলেই পুড়তে হবে। ভালোবাসার পরে-ও যদি কেউ না পুড়ে। তাহলে সেখানে কখনোই ভালোবাসা ছিল না। মুনতাসিম ছেলেটা ভিষণ ভালো।ছেলেটাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখিস৷ নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখিস৷ ধরনীর সবচেয়ে সুখী আর ভাগবতী নারীটি হবি তুমি। মুনতাসিমের মনটা রাজার মতো। আমি জানি সে তোকে রানীর মতো করে রাখবে। বিয়ের মতো পবিত্র জিনিসটা এমনই হয়। যার প্রতি কোনোদিন কোনো টান ছিল না৷ সে ভালো থাকলেই কি বা খারাপ থাকলেই কি? তাতে আমাদের কোনো যায় আসত না। বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবার পরে, মানুষটার প্রতি টান আপনা-আপনি চলে আসে। মানুষটার সবকিছু অদ্ভুত ভাবে ভালো লাগতে শুরু করে। মানুষটাকে আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত জানতে ইচ্ছে করে। রাইমা বেগমের কথা শেষ হবার সাথে সাথে কলিং বেল বেজে উঠল। মেহেভীন উঠে বসলো। মুনতাসিম চলে এসেছে। মেহেভীন ব্যাগ নিয়ে কক্ষ থেকে বের হলো। সারাদিন সে কাজে ব্যস্ত থাকে বলেই রাতে মেহেভীনকে নিতে এসেছে। মুনতাসিম রাইমা বেগমের সাথে কুশল বিনিময় করল। মুনতাসিম আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখনই রাইমা বেগম আঁখিযুগল দিয়ে ইশারা করতেই দু’জন বিদায় নিয়ে চলে গেল।

ঘড়ির কাঁটায় রাত একটা ছুঁই ছুঁই। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবে মাত্র মাত্র কক্ষে এসেছিল মুনতাসিম। তখনই মুঠোফোনটা টুং করে বেজে উঠল। সে ফোনটা নিয়ে দেখল অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। ইনবক্সে একটা ভিডিও পাঠিয়েছে কেউ। ভিডিওটা ওপেন করতেই মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। চিন্তায় মস্তক ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। ভয়ংকর কিছুর আভাস পাচ্ছে সে। এই ঝাড়ের সাথে সে কিভাবে মোকাবেলা করবে? নিজেকে ভিষণ দুর্বল লাগছে তার। অদ্ভুত ভাবে হাত কাঁপছে। শীতের মধ্যেও কর্ণ বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। তবে কি সত্যি টা সামনে চলে আসার সময় এসে গিয়েছে। কথা টা ভাবতেই রুহু কেঁপে উঠল তার। সে চারিদিকে হাহাকার দেখতে পাচ্ছে। কিছু তিক্ত সত্য আনন্দ শুষতে শুরু করে দিয়েছে। মুনতাসিমের ভাবনার মাঝের মেহেভীন কক্ষে প্রবেশ করল। মেহেভীনকে দেখেই মুনতাসিম দ্রুত ফোনটা লুকিয়ে ফেলল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪৪
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

মেহেভীন আড়দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম মনোমুগ্ধকর হাসি হেসে বেলকনিতে চলে গেল৷ মুনতাসিমের এমন ব্যবহারে মেহেভীনের ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল। মেহেভীন সন্দিহান দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে চেয়ে আছে। মুনতাসিমের হাত অদ্ভুত ভাবে কাঁপছে। নিজের প্রতি নিজেরই ভিষণ বিরক্ত লাগছে। জীবনে এত কঠিন কঠিন কাজ সে করেছে। কিন্তু কোনোদিন এতটা ভয় পাইনি। যতটা ভয় সে মেহেভীনের সামনে পায়!

–আপনার ফোনটা দিন তো।

–আমার ফোন নিয়ে, আপনি কি করবেন?

–আমি কি আপনার ফোন দেখতে পারি না?

–অবশ্যই পারেন। কথা গুলো বলেই ফোনটা এগিয়ে দিল। মনের মধ্যে অস্থিরতার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে ভীরু দৃষ্টিতে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীন কিছু একটা দেখে ফোনটা এগিয়ে দিল। মেহেভীনের মুখশ্রী দেখে বোঝা যাচ্ছে না। সে কোনো কিছু দেখেছে কি না। সে অপেক্ষা করতে পারল না৷ সে নিজেই গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–একে তো আমার কথা রাখেননি। তার ওপরে আজকে এসেই আমার ফোন নিয়ে টানাটানি করছেন! আপনার সমস্যা কি হ্যাঁ?

–আপনি রাগ দেখাবেন, ভালো ভাবে দেখান। এভাবে তোতলানোর কি আছে? অন্যদের সাথে তো ঠিকি গর্জন করে উঠেন। কথা গুলো বলেই মেহেভীন কক্ষে চলে গেল। মুনতাসিম দ্রুত ফোন চেক করল। ভিডিওটা ডিলিট করে দেওয়ার হয়েছে। এটা দেখেই মুনতাসিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।

রজনীর শেষ প্রহর চলছে। সবাই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে। মুনতাসিম আঁখিযুগল মেলে তাকালো। পাশে তাকিয়ে দেখলো। মেহেভীন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সে ফোনের আলো জ্বালিয়ে উঠে বসলো। গায়ে কালো রঙের চাদর মুড়িয়ে কবাটের কাছে আসতেই মেহেভীনের নিদ্রা মিশ্রিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল,

–এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন? মেহেভীনের বাক্য গুলো কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই থেমে যায় দু’টি চরণ। মুহুর্তের মধ্যে মুনতাসিমের মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে গেল। বুদ্ধিরা জোট বেঁধে পালাতে শুরু করেছে। ভেতরটা ধীরে ধীরে শূন্য হয়ে আসতে শুরু করেছে। মুনতাসিম নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। কণ্ঠে গম্ভীরতা এনে বলল,

–আপনি ঘুমান নি?

–ঘুমিয়ে ছিলাম। আমার কথায় পরে আসুন। আগে আপনি বলুন। এতরাতে আমাকে না জানিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন?

–আমার প্রয়োজন পড়েছে, তাই যেবে হবে। আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন। তাই জানাতে পারিনি। সব কথা কিছুর কৈফিয়ত আপনাকে দিতে হবে!

–হ্যাঁ হবে একে তো মাঝরাতে উঠে বাহিরে বের হয়ে যাচ্ছিলেন। আবার আমাকেই উল্টো রাগ দেখাচ্ছেন! আপনি আর এখন একা নন। আপনার জীবনের সাথে আমার জীবনটা জড়িয়ে গিয়েছে। আপনার কিছু হলে আপনার থেকে আঘাতটা আমার বেশি লাগবে। এখন থেকে কোথাও গেলে আমাকে কৈফিয়ত দিয়েই যেতে হবে। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। এখন সে কি করবে? মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম কথা বাড়ালো না। সে দ্রুত আস্তরণে এসে শুয়ে পড়লো। মেহেভীন বিরক্ত মাখা মুখশ্রী করে মুনতাসিমের দিকে চেয়ে থাকলো। মাঝেমধ্যেই মুনতাসিম এমন আচরন করে, কিছু বললেই চুপ হয়ে যায়। মেহেভীন হতাশ হয়ে আঁখিযুগল বন্ধ করল।

চারিদিকে প্রভাতের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে মেহেভীনের নিদ্রা ভেঙে যায়। সে উঠে বেলকনিতে আসে। আজকে সে দেখেই ছাড়বে। এত পাখির ডাক কোথায় থেকে আসে? সে বেলকনিতে আসতেই দৃষ্টি যায় গৃহের পেছনের দিকে বিশাল ফলের বাগানের দিকে। যেখানে নানারকমের ফলের গাছ লাগানো রয়েছে। সেখানে কিছু কিছু গাছে লোভনীয় ভাবে ফলে পেকে আছে৷ মেহেভীন ফ্রেশ হয়ে নিচে আসলো। এই গৃহটা দূরে থেকেই দেখেছে সে। তার কোনোদিন কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আজকে সে গৃহের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখবে।

–এত সকালে কোথায় যাবে ভাবি? শেহনাজের কথায় মেহেভীন হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–আমাদের কক্ষের পেছনে ফলের বাগান দেখলাম। সেখানে অনেক রকমের ফল পেকে আছে। আমার দেখে ভিষণ লোভ লাগছে। আমি গিয়ে পেরে নিয়ে আসি।

–সর্বনাশ! ওটা তো ভাইয়ের বাগান। আমাদের কাউকে যেতে দেয় না। কেউ যদি ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া বাগানে প্রবেশ করে, তাহলে ভাইয়া গৃহে তান্ডব চালানো শুরু করে দেয়। ভাইয়া বাগান টা খুব শখ করে তৈরি করেছে। ভাইয়ার চিন্তাধারা অনুয়ায়ী বাগানের ফল গুলো নাকি পাখি খাবে। ভাই পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে ভিষণ পছন্দ করে। রোজ প্রভাত বেলায় পাখির কিচিরমিচির শব্দে ভাইয়ের নিদ্রা ভাঙে। আমাদের কাউকে ফল খেতে দেয় না ভাইয়া। ঐ বাগান নাকি শুধু পাখিদের জন্য বরাদ্দ আমাদের জন্য না। কথা গুলো বলতে বলতে শেহনাজের মুখশ্রী মলিনতায় ছেয়ে গেল। শেহনাজের কথায় বিস্ময় হলো মেহেভীন। সে বিস্ময় কণ্ঠে বলল,

–তোমাদের ফল পেরে খেতে ইচ্ছে করে না?

–আমি যে পরিমাণ ফল খেতে ভালোবাসি। বাগানে যাবার অনুমতি থাকলে, এই লোভনীয় ফল গুলো এতদিন বাগানে থাকতো!

–উনি কোনোদিন একটা ফলও বাসার কাউকে দেয় না?

–দেয়, তবে বছরে একবার। ভাইয়ের মন চাইলে তবেই দেয়।

–আমার সাথে চলো। আজকে তোমার ভাইয়ের বাগানে দু’টো নতুন পাখির আগমন ঘটবে।

–আমি যাব না ভাবি। আমার এত সাহস নেই। তুমি গিয়ে নিয়ে এসো। আমার জন্য কয়টা লাল পেয়ারা পেরে নিয়ে এসো। আমার অনেক দিন ধরে খেতে ইচ্ছে করেছে। আমি ভয়ে যেতে পারি না। শেহনাজের কথায় মেহেভীন হাসলো৷ সে বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে বাগানের দিকে চলে গেল। কাঁচা-পাকা ফল দেখে মেহেভীনের ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে গেল৷ মহান আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি অপরুপ সুন্দর। দেখলই সমস্ত মন মস্তিষ্ক শীতল হয়ে যায়। ভেতরে স্নিগ্ধ অনুভূতি কাজ করে।

অন্ধকারে আচ্ছন্ন কক্ষে মুনতাসিমের অপেক্ষায় বসে আছে যুকব। মুখশ্রীতের তার প্রশান্তির হাসি বিদ্যমান। আজকে নিজেকে ভিষণ করে সার্থক বলে মনে হচ্ছে তার। জীবনে প্রথম সে মুনতাসিমের ভেতরে ভয় প্রবেশ করাতে পেরেছে। আনন্দে তার ভেতরটা শান্তি অনুভব করছে। সে আয়েশি ভঙ্গিতে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত। তখনই মুনতাসিম হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। যুবককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কলার চেপে ধরলো। মুহূর্তের মধ্যে সে নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গেল। যুবককে প্রহার করতে করতে যুবকের নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করল। তবুও আজ যুবক রাগলো না। সে আজ মুনতাসিমের ব্যর্থতা দেখতে পাচ্ছে। আঁখিযুগলে প্রেয়সীকে হারানোর ভয় দেখতে পাচ্ছে সে। এই দিন টা দেখার জন্য সে কত গুলো প্রহর অপেক্ষা করেছে। সে তাচ্ছিল্য করে বলল,

–তুই আমাকে মে’রে ফেললেও সত্যিটা আড়াল করতে পারবি না মুনতাসিম। আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সাথে সাথে ভিডিওটা সোশ্যাল মিডিয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে। জনগণ দেখবে আর ধিক্কার জানাবে। আর তোর মেহেভীন! তুই তোর মেহেভীনকে কিভাবে সামলাবি? এতকিছুর পরে-ও মেহেভীন বাঁচতে পারবে তো। তোর সামনে তোর প্রেয়সীর প্রাণহীন দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকবে। তখন তোর কেমন লাগবে? ব্যাপারটা অনেক জোস হবে তাই না। প্রকৃতি ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না। আমি যেভাবে প্রতিনিয়ত পুড়েছি। তার থেকে দ্বিগুন ভাবে তুই পুড়বি। তোর বিধস্ত রুপ আমাকে তৃপ্তি দিবে। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে যুবকের মস্তকে বন্দুক ধরলো। বজ্রকণ্ঠে বলল,

–মুনতাসিম কোনোদিন হারতে শিখেনি। তুই কি ভেবেছিস? তোর দেওয়া সামান্য একটা ভিডিও দেখে মুনতাসিম ভয়ে কাবু হয়ে যাবে। তোর মতো কত-শত চুনোপুঁটিকে আমি শায়েস্তা করেছি। তুই আমার কাছে কিছু না। আব্বার দয়ায় বেঁচে আছিস৷ তুই না হয় আমাকে আর মেহেভীনকে আলাদা করবি। আমি পুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে যাব। আমার কয়ার সমস্ত হাড় গুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। আমার এমন করুন অবস্থা দেখে, তোর প্রতিশোধের জ্বলন্ত আগুন শীতল হয়ে গেল। কিন্তু তোর যে বোন তোকে সাহায্য করছে। তার ছোট্ট দেহটা যদি কেউ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে চলে যায়। একদল নরপশু তার নরম দেহটা শেয়াল কুকুরের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়ে নদীতে ফেলে দেয়। তোর বোন নামক অস্তিত্ব ধরনীর বুকে গায়েব হয়ে গেল। তখন তোর কেমন লাগবে? নাকি খ’ন্ড খ’ন্ড করে তোর কাছে পাঠাব বল? আচ্ছা আগের সব পরিকল্পনা বাতিল। তুই আমাকে যতটুকু ভাঙবি। আমি তোর বোনকে সেই কয় পি’স করব। যখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না৷ তুই ক্ষুদার জ্বালায় কাতরাবি। তখন আমি তোর বোনের পি’স করা অংশ গুলো তোর খাদ্য হিসেবে পাঠাব। ব্যাপার টা অনেক জোস তাই না বল ভাই! মুনতাসিমের কথায় সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল যুবকের। সমস্ত কায়া থরথর করে কাঁপছে। হাসোজ্জল মুখশ্রীটা মুহুর্তের মাঝে বিষাদগ্রস্ত হয়ে উঠল। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। সে কেন বারবার মুনতাসিমের কাছে হেরে যায়। মুনতাসিমের বলা প্রতিটি বাক্য যুবকের রুহু কাঁপিয়ে তুলেছে। ভয়ে সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসতে শুরু করেছে। কালকে সঞ্চয় করা সমস্ত শক্তি নেতিয়ে পড়েছে। সে নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,

–অমানুষ একটা! এসব কথা বলতে তোর বুক কাঁপল না? তোর মতো জা’নো’য়া’রে’র বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তুই ম’রে যেতে পারিস না। তুই ম’রে গেলে আমি একটা সুস্থ জীবন কাটাতে পারতাম। তোর জন্য আমার সবকিছু ধংস হয়ে গিয়েছে। তোকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না। আমার বোনের কায়াতে একটা ফুলের টোকা পড়লে, তোকে আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলব।

–কালকে রাতে আমাকে ভিডিও দেওয়ার সময় তোর বুক কাঁপেনি? তোর বুদ্ধি কি হাঁটুতে থাকে? আমাকে ভিডিও টা দেওয়ার আগে তোর মনে হয়নি। আমি কাকে মিছে ভয় দেওয়ানোর চেষ্টা করছি৷ মুনতাসিম কাউকে ভয় পায় না। যে মুনতাসিমকে কাবু করতে আসবে। সে নিজেই ধরনীর বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তোর বোনের বুক কাঁপে না। আমাকে প্রতিনিয়ত মা’রা’র প্রচেষ্টা করেই যাচ্ছে। আমি সবকিছু জেনেও তাকে ক্ষমা করছি। যেদিন আমার হৃদয়ে আঘাত পড়বে আল্লাহর কসম বাঁচতে পারবে না। নিজের বোনকে সাবধানে থাকতে বলিস। কথা গুলো বলেই যুবকের বুকে লা’থি মা’র’ল মুনতাসিম। যুবক আহত দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম গর্জন করে বলল,

–এই কু’লা’ঙ্গা’রে’র বোন আসলে এবার আর ছেড়ে দিবি না। রক্তাক্ত করে আমাকে ফোন দিবি। বারবার এই ঝামেলার কাছে আসতে আমার ভালো লাগে না। আমার কাজের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়। আমাকে মন্ত্রী সভায় যেতে হবে। আমার সাথে প্রতারণা করার চেষ্টা করলে, কাজে প্রামাণ দেখিয়ে দিব কি হয়। এই জা’নো’য়া’র’কে দু’দিন খেতে দিবি না। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম স্থান ত্যাগ করল। যুবক ব্যর্থ হয়ে নিজেই নিজেকে প্রহার করতে লাগলো। এ জীবনের সে মুনতাসিমের হার দেখতে পাবে না। পরের জন্ম বলে যদি কিছু হয়। তাহলে সে পরের জন্মে মুনতাসিমের থেকে শক্তিশালী হয়ে জন্মামে।

ধরনীর বুকে আঁধার নামতে শুরু করেছে। চৌধুরী গৃহের সবাই নাশতা করার জন্য ড্রয়িং রুমে আসর জমিয়েছে। মেহেভীন মুনতাসিমের বাগানের ফল গুলো সাহেলা চৌধুরীর হাতে দিয়েছিল। তিনি গম্ভীর দৃষ্টিতে একপলক মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করেছিল। সে কিছুটা কড়া কণ্ঠে বলেছিল, “মুনতাসিম তার বাগানে যাওয়া পছন্দ করে না। তুমি আর ওর বাগানে যেও না।” সাহেলা চৌধুরীর কথায় মেহেভীন মস্তক নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। সেই ফল গুলো কেটে সবাইকে দেওয়া হয়েছে। শেজনাজ আর মেহেভীন দু’জন আগেই পেট ভরে পেয়ারা খেয়ে নিয়েছে। দু’জন চোরের মতো এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই যেভাবে মেহেভীনকে ভয় দেখিয়েছে। প্রথমে মেহেভীনের ভয় না লাগলে-ও এখন ভিষণ ভয় লাগছে। মেহেভীনের ফোন আসায় মেহেভীন নিজের কক্ষে চলে গেল। মেহেভীন চলে যেতেই মুনতাসিম গম্ভীর মুখশ্রী করে গৃহে প্রবেশ করল। সবার হাতে তার গাছের পেয়ারা দেখে ধপ করে জ্বলে উঠল। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–তোমাদের কি খাবারের অভাব পড়েছে? তোমরা কি তিনবেলা খেতে পাও না। আমি সবাইকে কড়া গলায় বলে দিয়েছি। কেউ আমার ফলের বাগানে প্রবেশ করবে না। আমি বাগানটা পাখিদের জন্য তৈরি করেছি। ফলের বাগানে ফল না থাকলে পাখিরা আসবে! কার এত বড় সাহস আমার বাগানের ফল পেরে নিয়ে আসছে? তার কত বড় কলিজা হয়েছে। আমি আজকে তার কলিজা মেপে দেখব। আমি বছরে একবার করে আমার বাগানের ফল সবাইকে খাওয়াই। তবুও কে চুরি করেছে আমার বাগানে? আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না তাড়াতাড়ি স্বীকার করো। মুনতাসিমের রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে সবাই ভয়ে চুপসে গেল। কারো কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না। উপস্থিত সবার মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। মুনতাসিমের চিৎকার চেচামেচি শুনে মেহেভীন নিচে নেমে আসলো। তার জন্য এভাবে সবাইকে কথা শুনতে হচ্ছে। বিষয়টা মেহেভীনের কাছে ভিষণ খারাপ লাগলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–এভাবে সবার সাথে চিৎকার চেচামেচি করছেন কেন?

–আমার বাগানের ফল চুরি করা হয়েছে। আমি সেই ফল চোরকে খুঁজছি। ধরতে পেলে আগে হাত কাটব। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীনের মুখশ্রী মলিন হয়ে আসলো। দু’টো ফল পারার জন্য সোজাসাপ্টা তাকে চোর বলে সম্মোধন করবে! সে কোনো বাক্য উচ্চারন না করে হাত দু’টো এগিয়ে দিয়ে বলল,

–আমি আপনার গাছের ফল চুরি করেছি। এই নিন আমার হাত কা’টু’ন। মুনতাসিম উত্তপ্ত হতে গিয়েও শান্ত হয়ে গেল৷ বাঘের মতো গর্জন করা ছেলেটা বিড়ালের মতো ম্যাও ম্যাও করে বলল,

–আপনি পেরেছেন আগে বলবেন না। আমি তো সবার সাথে মজা করছিলাম। আপনি এত সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছেন কেন? মুনতাসিমের রুপ বদল দেখে বসে থাকা প্রতিটি মানুষের মুখশ্রীতে বিস্ময় এসে ধরা দিয়েছে। নিজের আঁখিযুগলকে বিশ্বাস করতে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। রিয়াদ চৌধুরী ঘটনা এড়াতে খবরের কাগজ নিয়ে মুখশ্রী আড়াল করলেন। হয়তো নিজের অজান্তে আসা হাসি টুকু আড়াল করতে। মেহেভীনের এবার ভিষণ রাগ হলো সবার সামনে উচ্চ স্বরে কথাও বলতে পারছে না। রক্তিম চোখে মুনতাসিমের দিকে তাকিয়ে বলল,

–সিরিয়াস ভাবে মজা করলে সিরিয়াস ভাবে নিব না। আপনি তো সবাইকে আপনার বাগানে যেতে নিষেধ করেছেন। আমিও দেখব আপনি আমার হাত কিভাবে কা’টে’ন। আমি এখন থেকে নিয়মিত আপনার বাগানের ফল পেরে খাব। আমার মতো এত সুন্দর পাখিকে আপনার পছন্দ হচ্ছে না! আমাকে দেখে একটা পাখিরও মায়া হবে। আপনার আমার প্রতি মায়া হচ্ছে না! মেহেভীনের কথায় মুনতাসিম লজ্জা পেয়ে গেল। আড়দৃষ্টিতে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। লজ্জায় দাঁড়াতে পারল না মুনতাসিম। সে দ্রুত কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো। মুনতাসিম চলে যেতেই সবাই শব্দ করে হেসে দিল। সাহেলা চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–যাকে দেখলে বনের সকল পশুরা ও ভয়ে কাঁপে। আজ সে-ও কাউকে দেখে ভয়ে কাঁপছে! সব জায়গায় গর্জন চলে না। দিনশেষে ভিষণ খারাপ মানুষটাও কারো কাছে ভয়ে কাবু হয়ে যায়। এতদিন সবাইকে নাচিয়েছে। এবার তার নাচার সময় এসে গিয়েছে। এবার সে নিজে নেচে দেখুক নাচতে কেমন লাগে। সাহেলা চৌধুরীর কথায় সবাই আবার হাসতে শুরু করল। সুখ যেন তাদের মুখশ্রীতে এসে ধরা দিয়েছে। এই একটা সুখের মুহূর্তে উপভোগ করার জন্য জীবনে কতই না দুঃখ কষ্ট উপভোগ করতে হয়!

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪৫
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে বিধস্ত অবস্থা মস্তক নুইয়ে আছে জারিফ। সমস্ত কায়া জুড়ে শত-শত প্রহারের চিহ্ন। গত সাতদিন ধরে রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। তবুও মুখ দিকে একটা বর্ণ ও বের করছে না। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। তাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আঁখিযুগলের কালো দাগ প্রকাশ করে দিচ্ছে। সে কত নির্ঘুম রাত না ঘুমিয়ে পার করেছে। জারিফের সামনে বসে আছে ওসি প্রলয়। সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখনই প্রলয়ের কাজ শুরু হয়ে যায়। প্রলয় চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–আমি তোকে ভালো ভাবে বলছি। সত্যি করে বল লা’শ দু’টো কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস? তুই যদি আমাকে সত্যি কথা বলে দিস। তাহলে আমি তোর শাস্তি কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। প্রলয়ের কথায় শব্দ করে হেসে উঠল জারিফ। প্রলয় চোয়াল শক্ত করে জারিফের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। জারিফ তাচ্ছিল্য করে বলল,

–আমি কেন বলব? আপনার এত ক্ষমতা আপনি খুঁজে বের করে নিন। এমনিতেও আমার বাঁচার ইচ্ছে নেই স্যার। আমি মৃত্যুকে কাছে চেয়েছি বলেই দু’টো জা’নো’য়া’র’কে খু’ন করেছি। জারিফের সহজ সরল স্বীকারোক্তি প্রলয়ের ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলল। ছেলেটার মুখশ্রী জুড়ে অসম্ভব মায়া লেগে আছে। যেন তার মুখশ্রীতে দৃষ্টি পড়লেই সবাই তার মায়াতে আঁটকে যেতে বাধ্য। প্রলয় কণ্ঠে কোমলত্ব নিয়ে এসে বলল,

–তোমার মুখশ্রীতে ভিষণ মায়া ছাড়ানো আছে। এত সুন্দর একটা ছেলে হয়ে ধংসের পথে আসলে কেন?

–ভালোবেসে ভালো আর মহৎ সবাই হতে পারে স্যার। কিন্তু ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষের ভালোর জন্য খারাপ সবাই হতে পারে না৷ আমার জীবনটা ছন্দহীন গানের মতো সুর আছে। কিন্তু কোনো তাল নেই। ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে, সেই ভালোবাসাকে কলঙ্কিত করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা কুলাঙ্গার আমি। জারিফের বাক্য গুলো কর্ণকুহরে আসতেই প্রলয় আগ্রহ প্রবল হয়ে উঠল। সে উৎসুক দৃষ্টিতে জারিফের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। জারিফ শান্ত নদীর ন্যায় স্থির হয়ে গেল। প্রলয় স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

–কার বিরহে এগুলো করলে?

–প্রেয়সীর জন্য।

–পেয়েছিলে তাকে?

–না পাইনি।

–কেন?

–কারন সে মানুষকে ভালোবাসতে পছন্দ করে। কিন্তু আমি তো মানুষ রুপি জা’নো’য়া’র!

–সবকিছু আমায় খুলে বলা যাবে? প্রলয়ের কথায় জারিফ সোজা হয়ে বসলো। শান্ত দৃষ্টিতে প্রলয়কে পরখ করে নিল। প্রলয়ের আঁখিযুগলে আগের মতো রাগ নেই। সে আগ্রহ নিয়ে জারিফের কথা শুনছে। এই জন্যই তাকে সবাই জাদুকর বলে সম্মোধন করে। খুব সহজ মনের ভেতরে গিয়ে কথা বের করে নিয়ে আসতে পারে। জারিফ বুক ভারি করা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। সে অপরাধীর ন্যায় মস্তক নুইয়ে বলতে শুরু করল,

–আমি আর মেহেভীন একসাথে পড়াশোনা করতাম। সে শুধু আমাকে বেস্ট ফ্রেন্ড মনে করতো। আর আমি তাকে মন দিয়ে বসেছিলাম। তাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে দীর্ঘ দিন মনের কথা গুলোকে নিজের মনের মধ্যে গোপন করে রেখেছিলাম৷ আমার মনের কথা গুলো তাকে বলতে না পারার আগুনে দাউদাউ করে জ্বলেছি। মানুষকে তো দমিয়ে রাখা যায়৷ কিন্তু মন! মনকে কিভাবে দমিয়ে রাখবো বলেন স্যার? আমি নিজেকে দমাতে পারলেও মনকে দামাতে পারিনি। তাকে হারিয়ে ফেলার ভিষণ ভয় ছিল আমার। তাকে মন গহীনে যত্ন করে রাখতে চেয়েছিলাম। সে আমার ভালোবাসার মূল্য দেয়নি স্যার। সে আমায় বলেছি সে আমাকে বন্ধু ছাড়া আর কিছুই ভাবে না। আমি নাকি তার কাছে তার ভাইয়ের মতো। আপনিই বলুন স্যার কোনো প্রেমিক পুরুষ তার প্রেয়সীর জামাই থেকে মায়ের পেটের ভাই হতে চাইবে? সেদিন আমাদের ভার্সিটিতে কনসার্ট চলছিল। শহরে নামী-দামী শিল্পীরা এসে তাদের মধুর সুর তুলে সবাইকে মাতোয়ারা করে দিচ্ছিল। মেহেভীন সেদিন লাল টকটকে রঙের একটা শাড়ি পড়েছিল। তার দিকে আমার দৃষ্টি যেতেই আমার হৃদস্পন্দনের গতিবেগ থেমে গিয়েছিল। আমার আঁখিযুগল পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছিল। আমার অনুভূতিরা নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গিয়েছিল। মনকে কড়া বাক্য প্রয়োগ করে-ও সেদিন মনকে দমাতে পারিনি। সমস্ত কার্যক্রম ছেড়ে তার পেছনে ছুটতে শুরু করলাম। সে কয়েকদিন ধরে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। তার অবহেলা আমাকে পোড়াতে পোড়াতে দগ্ধ করে দিচ্ছিল। আমি তাকে ডাকলাম সে আমাকে উপেক্ষা করে চলে গেল। তখন আমার ভিষণ রাগ হয়। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। ছুটে যাই তার পেছনে পেছনে। সেখানে গিয়ে দেখি তার চাচাতো বোন শাড়ি বদল করছে। আরো একদল মেয়ে ছিল। সবাই তৈরি হয়ে বের হয়ে গেল। প্রাপ্তির ফোন আসে প্রাপ্তি ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর এই সুযোগটাই আমি নেই। সেই কক্ষের মধ্যে মেহেভীন একাই ছিল। তার বোনের জিনিস গুলো ব্যাগে তুলছিল। হয়তো সে বাসায় চলে যাবে তার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমি মেহেভীনের হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসি। মেহেভীন নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আমাকে থা’প্প’ড় দিয়ে বসে। এতে আমি আরো ক্ষিপ্ত হয়ে যাই। মেহেভীন আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করে কাউকে দেখতে না পেয়ে কবাটের দিকে অগ্রসর হয়। তখনই আমি তার শাড়ির আঁচল টেনে ধরি। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য খুব চেষ্টা করছিল। ভয়ে তার আঁখিযুগল ছোট ছোট হয়ে আসছিল। আঁখিযুগল বেয়ে অনবরত অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছিল। ওর মুখশ্রীতের ভয় দেখে ভিষণ আনন্দ পাচ্ছিলাম আমি। ভেবেছিলাম ওকে একবার কলঙ্কিত করতে পারলে, কেউ আমাকে আর ওকে আলাদা করতে পারবে না। মেহেভীনকে বিয়ে করতে হলে আমাকেই করতে হবে। আমার ভেতরে শুধু মেহেভীনকে পাবার নেশা জাগছিল। আমি নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে মেহেভীনের শাড়ি খুলে ফেলি। মেহেভীন ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করে আর চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে থাকে। প্রাপ্তি কাছে থাকায় টের পেয়ে যায়। কিন্তু কবাট ভেতর থেকে লাগানো দেখে ভেতরে আসতে পারছিল না। এই সুযোগ টাই আমি কাজে লাগানোর চেষ্টা করলাম। সেদিন মেহেভীন হৃদয়বিদায় চিৎকার দিয়ে বলছিল। আমার সাথে এমন করিস না ভাই আমি মরে যাব। সেদিন মেহেভীনের কোনো বাক্যই আমার কর্ণকুহরে আসছিল না। আমি মেহেভীনকে নিজের মুঠোয় বন্দী করে ফেলি। সে আমাকে অনবরত প্রহার করতেই থাকে। একটা সময় বিরক্ত হয়ে ক’ষে থাপ্পড় বসিয়ে দেই তাকে। এতে মেহেভীন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমিও পৈশাচিক হাসি হেসে মেহেভীনের পাশে বসে পড়ি। মেহেভীন একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছিল। আমি একটু একটু করে মেহেভীনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। মেহেভীন দেওয়ালের সাথে গিয়ে ঠেকে। আমি ওর গালে হাত রাখতেই আমার হাতে ও কামড় দিয়ে বসে। আমি রেগে ওর গাল দু’টো চেপে ধরে। শার্টের বোতাম খুলে ওর ওপরে ঝাপিয়ে পড়ার চেষ্টা করতেই ওর আমার গোপনাঙ্গে প্রহার করে। আমি ব্যর্থায় কুঁকড়িয়ে উঠি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমার হিংস্রতা প্রকোপ পায়। এতক্ষণ আদরে বোঝানোর চেষ্টা করে-ও যখন পাখি পোষ মানেনি৷ তখন আদেরর দরকার নেই। ওর দুই হাতের ভাজে আমার হাত রেখে যখনই ওর ওপরে ঝাপিয়ে পড়তে যাব। তখনই প্রাপ্তি ছেলেমেয়ে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ছেলেরা আমাকে তুলে প্রচুর মারধর করে। প্রাপ্তি এসে মেহেভীনকে আগলে নেয়। জীবনের প্রথম মেহেভীনকে সেদিন জ্ঞান হারাতে দেখছিলাম। আমার হিতাহিত জ্ঞান আসতেই বুঝলাম। কি করে ফেলছি আমি। পরিস্থিতি আমার হাতের বাহিরে চলে গিয়েছে। মেহেভীনকে নিয়ে সবাই চলে গেল। সিনিয়ররা আমাকে উল্টো ঝুলিয়ে মেরেছিল। আমাকে ভার্সিটি থেকেও বের করে দেওয়া হয়েছে। অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতো। কিন্তু বিবেক কাজ করতো না। আমি এসব ঘটনা পর আরো দু’বার মেহেভীনকে তুলে চেয়েছি। কিন্তু পারিনি। মেহেভীনের মা একটা জিনিস। মেয়েকে দশ দিক থেকে প্রটেকশন দিয়ে রাখছিল। তারপর বাবার অপ্রিয় সন্তান হলাম। গৃহ হারা হলাম। মেহেভীনের মতো ভালো বন্ধু হারা হলাম। সমাজের চোখ নষ্ট পুরুষ হিসেবে বিবেচিত হলাম। এতকিছুর পরে-ও প্রিয় মানুষটাকে পেলাম না। জারিফের কথা শেষ হবার সাথে কথা প্রলয়ের সমস্ত কায়াতে কাটা দিয়ে উঠল। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–ছি এভাবে ভালোবাসা পাওয়া যায়! তুমি তো ভালোবাসা শব্দটাকেই কলুষিত করে ফেলছ। তুমি ভালোবাসার মানুষকে পাবার যোগ্যতা রাখো না বলেই বিধাতা তোমায় ভালোবাসার মানুষ মিলিয়ে দেয়নি। তুমি ভালোবাসার মানুষের ভালোর জন্য দু’টো খুন করেছ বলে তোমার সব অপরাধ মাফ? একটা কথা সব সময় মনে রাখবে। পাপ কখনো তার বাপ কেও ছাড় দেয় না। ভালোবাসা আগলে নেওয়ার জিনিস কলুষিত করে নষ্ট করার নয়। তুমি কথা গুলো কতটা সহজে বলে দিলে! কিন্তু মেহেভীনের পরিস্থিতিটা এতটা সহজ ছিল না। যে মেয়েটা এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে৷ সেই মেয়েটা জানে মৃত্যু কতটা কাছে। তোমাকে ধিক্কার জানাতে বাধ্য হলাম। জারিফ মলিন হাসলো। হাসতে হাসতে বলল,

–জানি স্যার আপনিও সবার মতো আমাকে ঘৃণা করবেন। আমি ঘৃণা করার জন্যই কথা গুলো বলেছি। কারন মানুষ ভালো জিনিসের কদর কম দেয়। আমাদের ভালো মুহূর্তের কথা গুলো বললে আপনি-ও আমায় ভালোবেসে ফেলবেন। আমি তো মেহেভীনের ক্ষতি করারই চেষ্টা করেছি সেদিনের পর। তারপর যখন জানলাম সে অন্য পুরুষে আসক্ত হয়ে গিয়েছে৷ সেদিন আমার কায়ার সমস্ত হাড় গুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়ে ছিল। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছিল না। মৃত্যুর আগে মেহেভীনের জন্য ভালো কিছু করতে চাইছিলাম। তখনই আরিয়ান আর মিরাজুলের তথ্য আমি পাই। মেহেভীনের বিয়ের দিন আমিই ওদের সরিয়েছি। ভালোবাসার মানুষের ভালো থাকা দেখতেও শান্তি লাগে। এটা আমি এতদিনে বুঝেছি৷ সেদিন বুঝলে মেহেভীন আমার হয়ে যেতো। পরপারে আল্লাহকে বলব। আল্লাহ তুমি আমাকে মুনতাসিম বানিয়ে দাও। তাহলে মেহেভীন আমাকে ভালোবাসবে। এই জীবনে পাইনি তো কি হয়েছে। পরপারে আল্লাহর কাছে ঠিক চেয়ে নিব। আপনি ভিষণ গভীর জলের মাছ স্যার। কি সুন্দর আমার পেট থেকে কথা গুলো বের করে নিলেন। আপনি এখন এখানে থেকে চলে যান। আমি আর একটা বাক্যও উচ্চারন করব না। প্রলয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জেলের মধ্যে থেকে বের হয়ে গেল। সে সময় মতো এসে জারিফের থেকে তথ্য বের করে নিবে।

চারদিকে প্রভাতের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। মেহেভীন ঘুম থেকে উঠেই মুনতাসিমের বাগানে ফল চুরি করতে এসেছে। আজকে এই বাগানে আসার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না তার। কিন্তু বড়ই গাছের হলদে রঙের বড়ই গুলো মেহেভীনের আঁখিযুগলকে আকর্ষণ করে টানছে। এমন লোভনীয় বড়ই আঁখিযুগলের সামনে থাকলে নিজেকে দমিয়ে রাখা যায়। জিভে পানি চলে আসলো মেহেভীনের। সে গাছের নিচে এসে হতাশ হলো গাছটা অতিরিক্ত উঁচু যার ফলে সে বড়ই গুলো পারতে পারছে না। আশেপাশে কোনো কিছুই পাচ্ছে না। যেটা দিয়ে বড়ই গুলো পারবে না। বিরক্ততে মুখশ্রী কুঁচকে এল তার৷ সে বিরক্ত হয়ে লাফাতে শুরু করল। হাত বড়ই ছুঁই ছুঁই হয়েও ধরতে পারল না। তখনই মেহেভীন অনুভব করল সে হওয়াতে ভাসছে। সে দ্রুত নিচের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিমকে দেখে দ্রুত হাত বাড়ির বড়ই গুলো পেরে ওড়নার মধ্যে নিচ্ছে। মেহেভীনের বড়ই পারা হলে মুনতাসিম মেহেভীনকে নিচে নামিয়ে দিল।

–বেলকনি থেকে দেখছিলাম। একটা পাখি বড়ই খাওয়ার জন্য কতটা ছটফট করছে। পাখিটা ভিষণ ছোট গাছের নাগাল পাচ্ছে না। আমি এই বাগানটা পাখিদের জন্যই তৈরি করেছি। আমি থাকতে একটা নিরীহ পাখি ফল খেতে পারবে না। তাই কখনো হয়! নিজ দায়িত্বে আসলাম পাখিকে ফল পেরে খাওয়াতে। আপনার ফল পারা হয়েছে পাখি আর কোনো ফল লাগবে?

–আর লাগবে না এতেই আমার হয়ে যাবে।

–ইশশ, আমার বাগানে কত সুন্দর পাখি প্রবেশ করেছে। এত সুন্দর পাখি দেখলে মন স্থির থাকে! এমন পাখি দেখলেই আমার আদর করে দিতে ইচ্ছে করে। আপনাকে একটু আদর করে দেই পাখি? মুনতাসিমের কথায় মেহেভীনের মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো। সে লজ্জা মিশ্রিত মুখশ্রী আড়াল করে গৃহে দিকে যেতে যেতে বলল,

–অসভ্য একটা।

–ভালো মানুষের দাম নেই। এত বড় উপকার করলাম। কই আমাকে পারিশ্রমিক দিবেন। তা না করে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে চলে যাচ্ছেন!

–কক্ষে আসুন পারিশ্রমিক দিচ্ছি। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিম মেহেভীনের পেছনে পেছনে গেল। মুনতাসিম কক্ষে প্রবেশ করে দেখল। মেহেভীন খুব আয়েশ করে লবন দিয়ে বড়ই মাখিয়ে খাচ্ছে। মেহেভীনের খাওয়া দেখে মুনতাসিমের ইচ্ছে জাগল খাওয়ার জন্য। মেহেভীন একটা বড়ই এগিয়ে দিয়ে বলল,

–এই নিন আপনার পারিশ্রমিক। মুনতাসিম বিলম্ব না করে দ্রুড বড়ইটা হাতে নিল। মুখে দিতেই সমস্ত মুখশ্রী কুঁচকে এল তার। সে বিরক্তি মাখা মুখশ্রী কর বলল,

–কি টক, এগুলো মানুষ খায়!

–একদম বাজে কথা বলবেন না। আপনারা ছেলেরা শুধু মিষ্টি খেতে পছন্দ করেন। আর আমরা মেয়েরা সেই মিষ্টিকে জাস্ট ইগনোর করি। আমার টক পছন্দ সেটা যেমন আপনার পছন্দ না। ঠিক তেমনই আপনার মিষ্টি পছন্দ আমার পছন্দ না।

–আপনি একটু হাসুন তো। আপনি হাসলে হালকা করে আপনার গালে টোল পড়ে। আপনি হাসলেই আপনাকে মিষ্টি লাগে। আমি আপনার টোলের মধ্যে লবন রেখে বড়ই খাব। তাহলে আর টক লাগবে না। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন আঁখিযুগল বড় বড় করে, মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিম বলাতে সে কৃত্রিম হাসলে মুনতাসিম সত্যি সত্যি তার গালে লবন রেখে বড়ই খেল। মেহেভীন হতভম্ব হয়ে মুনতাসিমের দিকে তাকিয়ে আছে। মুনতাসিম মেহেভীনের গালে চুমু খেয়ে বলল,“এবার মিষ্টি লাগছে।” কথা গুলো বলেই মুনতাসিম কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। মেহেভীন গম্ভীর দৃষ্টিতে মুনতাসিমের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তখনই মেহেভীনের ফোনটা টুং করে বেজে উঠল। মেহেভীন ফোনটা হাতে নেওয়ার আগেই মুনতাসিম এসে খপ করে ফোনটা কেঁড়ে নিল।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৪০+৪১+৪২

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

গীতের প্রতিধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠেছে। মেহেভীনকে গোসল করিয়ে দেওয়ার জন্য বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বজনরা গীত গাইছে আর মেহেভীনের মস্তকে পানি ঢালছে। সমস্ত কায়াতে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে মেহেভীনরে। হলুদের কার্যক্রম শেষ হতেই মেহেভীনকে কক্ষে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। মেহেভীন কক্ষে এসে গোসল করে মেরুন রঙের শাড়ি পরিধান করে নিল। কক্ষের কবাট খুলে বাহিরে যাবে, এমন সময় মুঠোফোনটা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে মুনতাসিমের নামটা জ্বলজ্বল করছে। ফোনটা কর্ণে ধরতেই মিষ্টি কণ্ঠস্বর ভেসে এল,

–কালকে কিন্তু শাড়ি পড়তে হবে।

–যদি না পড়ি তাহলে কি করবেন?

–আমি গিয়ে পড়িয়ে দিয়ে আসব। আমার বউকে আমার মনের মতো করে সাজিয়ে নিয়ে আসব।

–আর যদি না সাজি?

–বললাম তো আমি গিয়ে সাজিয়ে দিব।

–সাহস আছে?

–আমার সাহস দেখতে চান?

–হুম চাই।

–আমি জানি আপনি আমার মনের মতো করেই সাজবেন৷ কাল কেও বলেছিলেন কাঁচা ফুল দিয়ে সাজবেন না। তাহলে আজ সেজে ছিলেন কেন?

–আমার মন চেয়েছিল তাই।

–মিথ্যা কথা বলছেন?

–আমি আপনাকে ভয় পাই? যে মিথ্যা কথা বলব!

–আমি তো দেখতে পাচ্ছি। আপনি আমাকে ভয় পান।

–কালকে আমি লেহেঙ্গা পড়ব।

–না শাড়ি পড়বেন। মেহেভীন আর কিছু বলার সুযোগ পেল না৷ তখনই কেউ কবাটে কড়া নাড়ে খেতে যাবার জন্য। মেহেভীন মুনতাসিমের থেকে বিদায় নিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল।

আরিয়ান আর মিরাজুল তৈরি হয়ে নিয়েছে। আরিয়ান আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ হয়ে গিয়েছে। নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো ব্যাগে তুলে নিল। দু’জনেই কালো পোশাক পরিধান করেছে। খুব কাছে থেকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে, কেউ বুঝতে পারবে না তারা দু’জন আরিয়ান আর মিরাজুল। আরিয়ান চরণে জুতা পড়তে পড়তে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আমাদের লোকরা কোথায়?

–ছয়টা গাড়ি নিয়ে তারা আগে বেড়িয়ে পড়েছে। আমরা তো তাদের থেকে অনেকটা দুরত্বে আছি। আমাদের সেখানে পৌঁছে যেতে গোটা একটা দিন লাগবে।

–আমরা সেখানে গিয়ে কার কাছে থাকব? আরিয়ানের কথায় মিরাজুলের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে রাগান্বিত হয়ে কক্ষ ত্যাগ করল। আরিয়ান বিরক্তি মাখা মুখশ্রী করে তার যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মিরাজুলের এমন গা-ছাড়া ভাব আরিয়ানকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মেহেভীনের আগেই না আবার মিরাজুলকে সে খু’ন করে বসে। মিরাজুল হাতের ব’ন্দু’ক’টা নিজের মধ্যে আড়াল করে নিয়ে, তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

–এই জন্যই তোমাকে মেহেভীন বিয়ে করেনি। মস্তক ভর্তি শুধু ক্রোধ আর গোবর আছে। আরিয়ান রাগান্বিত হয়ে মিরাজুলের শার্টের কলার পাকড়ে ধরল। তাকে হালকা ঝাঁকিয়ে বলল,

–নিজেকে তুমি কি মনে করো? তুমি ভুলে যেও না এই যে এতদূর পর্যন্ত আসতে পেরেছো। সেটা কার জন্য? অবশ্যই আমার জন্য। আমি চাইলে তোমার যাত্রা এখানেই থামিয়ে দিতে পারি। আরিয়ানের কথায় মিরাজুলের মুখশ্রীতে বিরক্তি ফুটে উঠল। ক্রোধে সমস্ত কায়া কেঁপে কেঁপে উঠছে। মিরাজুল ঝাড়ি দিয়ে আরিয়ানের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,

–এই শক্তির প্রয়োগ আমার কাছে না করে, যদি মেহেভীনের সাথে করতে! তাহলে আজ তুমি মেহেভীনের অর্ধাঙ্গ হয়ে যেতে। মস্তক তো একদমই ফাঁকা তাই তোমার ফলাফল গুলোও ফাঁকা। এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করবে নাকি আমার সাথে যাবে? মিরাজুলের কথায় হুস আসলো আরিয়ানের এই কয়দিনে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে দু’জনের। তবে মিরাজুল আরিয়ানের চেয়ে অধিক বুদ্ধিমান হওয়ায় আরিয়ান তার সাথে পেরে ওঠে না। দু’জন আর বিলম্ব করল না নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিল।

অন্ধকার কক্ষে নিস্তেজ অবস্থায় বাঁধা ছিল যুবকটি। তখনই কক্ষের মধ্যে এক রমণী প্রবেশ করে। রমনী দেখে গার্ড গুলো বিস্ময় নয়নে দৃষ্টিপাত করে আছে। প্রাণ প্রিয় ভাইয়ের এমন করুন অবস্থা দেখে, রমনীর বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠল। সে অস্থির হয়ে ভাইয়ের কাছে এসে অবস্থান করল। নিজের কোমল হাতের ছোঁয়ায় ভাইয়ের গাল স্পর্শ করল। কারো আদুরে স্পর্শ কায়াতে পড়তেই অসহায়ত্ব আঁখিযুগল দৃষ্টি মেতে তাকালো। সামনে অবস্থান করা মানুষ টিকে দেখে অধরের কোণে হাসি ফুটে উঠল। মলিনতার ছোঁয়ায় মাখা হাসিটা বেশ দারুন দেখালো রমনীর কাছে। সে হুংকার ছেড়ে বলল,

–তোমাদের সাহস কি করে হয়? আমার ভাইকে আহত করে এই অবস্থায় ফেলে রাখার! দ্রুত আমার ভাইয়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হোক৷ রমনীর কথায় গার্ডদের মধ্যে একজন বলল,

–আপনার সাহস কি করে হয় এখানে আসার! স্যার জানতে পারলে, তার সাথে আপনার মস্তকটাও কাটা যাবে। রমনী বস্ত্রের ভেতর থেকে ব’ন্দু’ক বের করে গার্ড হাত বরাবর মা’র’ল। গার্ডটা হৃদয়বিদারক চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তখনই কেউ রমনীর মুখশ্রী পেছনে থেকে চেপে ধরলো। রমণীকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছ। তা দেখে বিধস্ত যুবকটি বজ্র কণ্ঠে বলল,

–আমার বোনকে ছেড়ে দে জা’নো’য়া’র। আমি মুক্ত হলে তোকে আর তোর মুনতাসিমকে কে’টে টুকরো টুকরো করে কুকুরের খাদ্য বানাব। আমার বোনের কায়াতে একটা ফুলের টোকা পড়লে। আমি তোকে শেয়াল শকুনের মতো ছিঁ’ড়ে ছিঁ’ড়ে খাব। যুবকের কথায় পরিবর্তন আসলো না সামনে থাকা মানুষটার। সে আগের ন্যায় রমণীকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। বিধস্ত যুবকটি নিরুপায় হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখলো। তার জন্য তার বোনের করুন অবস্থাটা। ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। মন বজ্রকণ্ঠে হুংকার ছেড়ে বলছে। প্রতিটি কাজের হিসাব দিতে হবে মুনতাসিম ফুয়াদ।

আনন্দ উল্লাস করে কে’টে দিল রজনী কে’টে গেল আস্ত একটা দিন। বিবাহের অনুষ্ঠান সন্ধ্যায় শুরু হবে। সূর্য মামা বিদায় জানিয়ে আঁধারকে আমন্ত্রণ করল ধরনীর বুকে আসার জন্য। সূর্য মামা বিলুপ্ত হবার সাথে সাথে, আঁধার ধরনীর বুকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। রাইমা বেগম বরযাত্রীর জন্য খাবার সাজাচ্ছিলেন। তখনই কর্ণকুহরে এসে পৌঁছল।

–কি রে রাইমা বিয়ের সময় তো হয়ে এল। কিন্তু ফরিদ তো এখনো এসে পৌঁছাল না। তুই ফরিদের নাম্বারটা আমাকে দে। আমি ফরিদকে ফোন দিয়ে দেখি সে কোথায় আসতে কতক্ষণ দেরি হবে?

–সে আসবে না আম্মা। আমার মায়ের অবস্থা ভালো না হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। সেখানে কেউ নেই যার ফলে মেহেভীনের বাবাকে আবার ঘুরে যেতে হয়েছে। মেহেভীনের বিয়ে হয়ে গেলে আমিও চলে যাব। মেহেভীনকে এ কথা বলবেন না। সে চিন্তা করবে। বৃদ্ধার বয়স্ক দৃষ্টি রাইমা বেগমের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে। সে এক কান দুই কান করতে করতে পাঁচ কান পর্যন্ত পৌঁছে দিল তথ্যটা। সবাই কানাঘুষা করছে তবে সামনে বলার সাহস কেউ পাচ্ছে না। এরমধ্যেই হৈচৈ শোনা গেল বর চলে এসেছে। সবাই বরকে বরন করার জন্য চলে গেল। এলাকার বাচ্চারা বরের গেট ধরেছে। তারা অনেক কষ্ট করে বরের গেট সাজিয়েছে। ফুল সংগ্রহ করে নিয়ে এসে বরের জন্য মালা বানিয়েছে৷ এত কষ্ট কিছুতেই বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। তার মধ্যে একটা ফর্সা বাচ্চা ছেলেকে দেখে শেহনাজ বলল,

–আমরা তোদের টাকা দিতে পারি। কিন্তু আমার একটা শর্তে আছে। তোদের সাথে কালো শার্ট পড়া ছেলে টাকে আমার ভিষণ পছন্দ হয়েছে। তোরা যদি এই কালো শার্ট পড়া ছেলেটার সাথে আমার বিয়ে দিস। তাহলে আমি তোদের এক হাজার টাকার বদলে পুরো পাঁচ হাজার টাকা দিব৷ শিশু মস্তিষ্ক শেহনাজের এমন কথায় লজ্জায় মস্তক নুইয়ে নিল। অন্যান্য বাচ্চারা তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে শুরু করল। আনন্দ উচ্ছাসে বর বরন হয়ে গেল। এবার খাওয়া দাওয়ার পালা সবাইকে খেতে বসানো হয়েছে। তখনই মুনতাসিমের দিকে ব’ন্দু’ক তাক করা হয়। যখন শু’ট করতে যাবে তখনই পেছনে থেকে মিরাজুলের মুখশ্রী চেপে ধরা হয়৷ মিরাজুল যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে। ছাড়া পাবার জন্য শত রকমের কৌশল ব্যবহার করে-ও মানুষটার হাত থেকে ছাড়া পেতে সে ব্যর্থ হয়৷ দু’জন ধস্তাধস্তি করতে করতে মিরাজুল নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তখনই মানুষটা মিরাজুলকে অজ্ঞান করে ফেলে। মিরাজুলের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,

–আমার ভালোবাসার মানুষের ভালো থাকা কেঁড়ে নেওয়ার অধিকার আমি তোদের দেইনি। যেখানে আমি নিজেই নিজের মনকে বুঝিয়েছি মানিয়েছি। সেখানে তোদের সাহস হয় কি করে! তাদের সুখের দিকে নজর দেওয়ার? তোদের এতটা দূরে পাঠাব যতটা দূরে গেলে ফিরে আসতে পারবি না। কথা গুলো বলেই উন্মাদের মতো উচ্চ হাসিতে মেতে উঠল।

মেহেভীনকে লাল টকটকে রঙের শাড়ি পড়ানো হয়েছে। সমস্ত কায়া জুড়ে সোনার অলঙ্কার পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই মুগ্ধ হয়ে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেয়েটার ভেতরে এতটা সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। তা মেয়েটার বিয়ে না হলে জানতেই পারতো না। সবাই মনে মনে আফসোস করতে শুরু করল। কেউ কেউ ঈর্ষা করছে। মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রী মলিনতায় ছেয়ে গিয়েছে। এত ভীড় এত কোলাহল আঁখিযুগল মাকে খুঁজতে ব্যস্ত। এর মধ্যেই কাজী সাহেব চলে আসলো বিয়ে পড়ানোর জন্য। মুহূর্তের মধ্যে পুরো কক্ষ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কিছু মেয়ে মেহেভীনের মস্তকে বড় করে ঘোমটা টেনে দিল। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিল। অদ্ভুত ভাবে মেহেভীনের ভেতরে ভয় কাজ করছে। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না। নিজেকে যতই স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। মানসিক ভাবে সে ততই অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। অনবরত অশ্রু বিবর্জন দিয়েই যাচ্ছে। তবুও মুখশ্রী দিয়ে কবুল শব্দটা উচ্চারিত হচ্ছে না। দীর্ঘ সময় নিয়ে কবুল বলতে সক্ষম হলো মেহভীন। সবাই মোনাজাত ধরল। বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ হতেই সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করা হলো। মেহেভীনকে বিদায়ের জন্য বাহিরে নিয়ে আসা হলো। মুনতাসিমের দৃষ্টি মেহেভীনের দিকে যেতে ডান হাতটা আপনা-আপনি বুকের পা পাশে চলে গেল।

–আমি শেষ এই মেয়ে আমাকে একদম শেষ করে দিয়েছে। নিজের অস্তিত্ব বলতে যতটুকু ছিল আজ সবটুকু নিজের মধ্যে গ্রাস করে নিয়েছে। বেহায়া আঁখিযুগল চোখের পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে। আজ আঁখিযুগল তাকিয়ে থাকতেও দ্বিধাবোধ করছে না। আজ থেকে এই মানুষটা একান্তই তার নিজের, এই মানুষটার প্রতি একান্তই তার অধিকার থাকবে। তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে শুধু সে বিচরণ করবে। তাইয়ান নিজের আবেগকে দমিয়ে রাখতে পারল না। উৎসুক কণ্ঠে বলল,

–এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবেন না স্যার। এখানো পুষ্প শয্যার রাত বাকি। একবার বিয়ে না করে-ও সন্তানের বাপ হতে হতে বেঁচে গিয়েছেন। এখন বিয়ে করে বাপ না হতেই পটল তুলবেন? কথা গুলো বলেই তাইয়ান মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। সাথে সাথে তার জান উড়ে যাবার জোগাড়। সে শুকনো ঢোক গিলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। ভয়ে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। সে মলিন গলায় বলল,

–স্যরি স্যার সবাই কত আনন্দ করছে। আপনাদের নিয়ে কত মজার মজার কথা বলছে। আমিও বলে ফেলছি ছোট ভাই মনে করে মাফ করে দেন। মুনতাসিম কিছু বলল না। সে সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাইয়ানের মুখশ্রীতে হাসি ফুটে উঠল। সে জানে সে ঠিক কতটা প্রিয় মুনতাসিমের। মুনতাসিম মুখে যাই বলুক না কেন, সে কোনোদিন তাইয়ানের কিছুই করবে না। মুনতাসিমের রক্তিম দৃষ্টিকে ভয় পাওয়া যেন তার প্রতিদিনের অভ্যাস। সে ভয়কে দূরে সরিয়ে দিয়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠল।

–আজকালকার যুগে বিয়ের দিন মেয়েরা কাঁদতেই ভুলে গিয়েছে। নিজের বিয়েতে নিজেই নাইচা গাইয়া উল্টায়া দেয়। আমাদের মেহেভীন সোনার টুকরো একটা মেয়ে। ছোট বেলা থেকে কোনো বাজে রিপোর্ট নাই। এমন মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। দোয়া করি মা স্বামীর সংসারে তুমি সুখী হও। হাতের মেহেদীর রঙও দেখি ভিষণ গাঢ় হয়েছে। শুনেছি যার হাতের মেহেদীর রঙ যত বেশি গাঢ় হয়। সে স্বামীর সোহাগ তত বেশি পায়। মহিলাটির কথা গুলো কর্ণকুহরে আসতেই সবাই উচ্চ শব্দে হেসে উঠল। মেহেভীন শক্ত করে মায়ের হাত ধরে আছে। মুনতাসিমকে মেহেভীনের পাশে নিয়ে এসে দাঁড় করানো হলো। মাশরাফি শেহনাজকে বলল,

–বিয়ে করার সাথে সাথে ভাইয়ার ক্ষমতা কি আরো বেড়ে গেল নাকি আপু? কবুল বলার সময় এত দ্রুত বলল যেন ভাবি পালিয়ে যাচ্ছে। এখন ভাবির পাশে এসে দাঁড়াতে বলতে না বলতেই ঝড়ের গতিতে এসে দাঁড়াল।

–ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দই আলাদা। যেদিন বড় হবি সেদিন বুঝতে পারবি। কথা গুলো বলেই শেহনাজ মুনতাসিমের পাশে এসে দাঁড়াল।
মুনতাসিম দুধ কলা খাইয়ে দেওয়া হলো৷ সেটার আংশিক অবশিষ্ট ছিল। বাকিটা মেহেভীনকে খাইয়ে দিল রাইমা বেগম। মেহেভীনের হাত মুনতাসিমের হাতে তুলে দিয়ে বলল,

–নিজের জান তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি। আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় যদি কখনো মনে হয়। সে তোমার সাথে সংসার করার যোগ্য না। নিজ দায়িত্বে আমার কাছে দিয়ে যাবে। আমার বুকের জিনিস আমি আবার বুকে আগলে নিব৷ আমি তোমাকে ভরসা করেছি। তাই এই ভরসার হাতে আমার কলিজার টুকরাকে তুলে দিলাম। কখনো কষ্ট পেতে দিও না। তার অশ্রু গুলো মাটিতে পড়ার আগেই তুলে আমার মেয়েসহ সেটা দিয়ে যেও। আমি আমার মেয়ের ভালো থাকার আশায় তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। যেদিন আমার মেয়ের ভালো থাকাটা হারিয়ে যাবে। সেদিন আমার মেয়েকে দুঃখ দেওয়া মানুষটাও আর ধরনীর বুকে থাকবে না। এই মেয়ের জন্য আমি সমস্ত ধরনীর মানুষের সাথে যুদ্ধ করেছি। তাকে দুঃখ দিলে আঘাতটা আমার কলিজাতে লাগবে। আমি তোমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছি। আমার ভরসার মূল্য দিও। আমার বিশ্বাস বিফলে যেতে দিও না বাবা। মুনতাসিম মেহেভীনের হাত শক্ত করে ধরে জবাব দিল,

–আজ থেকে তার সব দুঃখ আর বিপদ আমার। যেদিন আপনার ভরসার মূল্য ভেঙে যাবে। সেদিনই হবে আমার জীবনের শেষ দিন। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করব। আমাকে ভরসা করেই দেখুন না আন্টি। সময়ের সাথে প্রমাণ আপনি নিজেই পেয়ে যাবেন। মুনতাসিম কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। মুনতাসিমের কথা শুনে রাইমা বেগমের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। মেহেভীন মাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। নিঃশব্দে কান্না করে যাচ্ছে। সবাই শক্তি প্রয়োগ করেও মেহেভীনকে ছাড়াতে পারছে না। মাকে না ছাড়ার পণ করেছে সে। রাইমা বেগম সবাইকে দূরে যেতে বলল। সে মেহেভীনের মস্তক তুলে বলল,

–বাচ্চাদের মতো আচরন করছিস কেন মেহেভীন?

–তুমি আমার সাথে চলো।

–লোক হাসাতে চাস। আমি এতটাও দুর্বল নই। নিজেকে রক্ষা করার মতো ক্ষমতা আমার আছে। আমাকে কঠিন হতে বাধ্য করিস না। চুপচাপ গিয়ে গাড়িতে বসবি। মেহেভীনের অবস্থা দেখে মুনতাসিমের ভিষণ খারাপ লাগছে। সে রাইমা বেগমকে বলল,

–আন্টি আপনি আমাদের সাথে চলুন।

–এটা দৃষ্টিকটু দেখায় বাবা। তোমরা সামনের দিকে এগোনোর প্রস্তুতি নাও। আমি মেহেভীনকে নিয়ে আসছি। তখনই সবাই হৈহৈ করে উঠল নতুন বউ কেন হেঁটে যাবে? আশেপাশে তেমন কেউ নেই যে তাকে বলবে। মেহেভীনকে সে গাড়ি পর্যন্ত কোলে তুলে নিয়ে যাক। তখনই নজরে আসে আয়মান সবাই আয়মানকে ধরল। আয়মান রাজিও হয়ে গেল তবে মেহেভীনের মাঝে একরাশ অস্বস্তি ঘিরে ধরল। যাকে বিয়ে করবে না বলে পালিয়েছে! তার কোলে সে কিভাবে উঠবে?মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই কারো গম্ভীর কণ্ঠ স্বর ভেসে এল।

–আমার কি হাত নেই? নাকি আমি প্রতিবন্ধী যে, আমি থাকার পরেও আমার বউকে অন্য কেউ কোলে নিবে! আমার বউকে কোলে তুলে নিয়ে যেতে হলে, আমিই নিয়ে যাব। তবুও কোনো পরপুরুষকে আমার বউয়ের কাছে আসতে দিব না। যারা অন্যকের বউকে কোলে নিতে বলে আর যারা অন্যের বউকে কোলে তুলে নিতে আসে। তাদের মতো মেরুদণ্ডহীন মানুষ ধরনীর বুকে দুটো নেই। কথা গুলো বলেই মেহেভীনকে কোলে তুলে নিল মুনতাসিম। আকষ্মিক ঘটনায় মেহেভীন বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমকে দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের কান্ড দেখে সবাই মিটমিট করে হাসছে। মুনতাসিমের সাথে তাল মিলিয়ে সবাই গাড়ির কাছে চলে গেল। মেহেভীনকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে সে-ও মেহেভীনের পাশে বসে ফিসফিস করে বলল,”আজকে যতখুশি পারুন কান্না করে নিন। আজকের পর থেকে আর কোনোদিন কান্না করতে দিব না। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত ভাবে আঁখিযুগল দিয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। মনের অজান্তেই ভেতরটা খালি খালি লাগছে।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

গাছের আড়ালে মস্তক লুকিয়ে দক্ষ ভাবে মেহেভীনের দিকে ব’ন্দু’ক তাক করা হলো। ক্রোধ সমস্ত কায়া কেঁপে কেঁপে উঠছে আরিয়ানের। মিরাজুল মুখে অনেক বড় বড় কথা বলেছিল। কিন্তু কাজের বেলায় শূন্য! এই যে বিয়ে হয়ে গেল। এখন মেহেভীনের বিদায়ের পালা চলে আসলো। তবুও তার দেখা মিলছে না! ক্রোধের মাত্রা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রকোপ হতে লাগলো। সমস্ত কায়া থরথর করে কাঁপছে। সে বিলম্ব করল না। দ্রুত গু’লি করার জন্য প্রস্তুত হতেই মিরাজুলের মতো কেউ তাকে পেছনে থেকে চেপে ধরলো। দু’জন মানুষের হাতাহাতির মাঝেই আরিয়ান জ্ঞান হারালো। সেই সাথে অন্ধকার আচ্ছন্নে ঢেকে গেল কারো চূর্ণবিচূর্ণ হৃদয়ে। ভেতরটা ভিষণ বাজে ভাবে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। মানুষটা অশ্রুসিক্ত নয়নে শেষ বারের মতো প্রেয়সীকে দেখে নিল। ভেতর জুড়ে আজ শুধুই হাহাকারের বসবাস। তারে এত করে চাইলো। তবুও মানুষটারে নিজের করে পেল না। বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করেছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ভেতরে থেকে দুমড়ে মুচড়ে যাবে। নিজের প্রেয়সীকে অন্য কারো হতে দেখার সহ্য ক্ষমতা সবার থাকে না। তবে বিধাতা তাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে। তবে ক্ষমতাটা বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব পেল না। মনের সাথে সাথে কায়ার সমস্ত শক্তি ক্ষয় হতে শুরু করল। সে মলিনতায় ছোঁয়ায় মাখা কণ্ঠে বলল, “ভালো থেকো আমার না হওয়া প্রিয় মানুষ। পরের বার জন্ম বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে আমি অবশ্যই মুনতাসিম হয়ে জন্মাম। খুব সংগোপনে তোমার ভালোবাসা লুফে নিব। আমার মতো নিকৃষ্ট মানুষের সাথে তোমার যায় না। মুনতাসিমের মতো অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষই তোমার যোগ্য, আমার মতো অমানুষ কখনোই তোমার ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা রাখে না৷ পরপরে দেখা হলে একজন ভালো মানুষ হয়ে, আল্লাহর কাছে তোমারে চাইব। তখন আমায় ফিরিয়ে দিও না। আমার না হওয়া প্রিয় মানুষ। তুমি ভালো থেকো সুখে থেকো। তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা রইল গুড বাই ডার্লিং। ” বাক্য গুলো শেষ করেই আঁধারের সাথে মিলিয়ে গেল মানুষটা।

রাজপ্রাসাদের মতো বিশাল গৃহের সামনে এসে দাঁড়াল গাড়িটা৷ মুনতাসিম আগে নেমে মেহেভীনের হাত ধরে মেহেভীনকে নামালো। সে মেহেভীনের হাত শক্ত করে ধরে প্রবেশ দারে এসে স্থির হলো। সাহেলা চৌধুরী দু’জনকে বরন করে নিল। দূরের স্বজনরা বউ দেখতে ভিড় জমিয়েছে। এত এত ভিড়ের মাঝে হঠাৎ মুনতাসিমের আঁখিযুগল অস্থির হয়ে যায়। বিদায়ের মুহুর্ত থেকে তাইয়ানের উপস্থিতি সে অনুভব করছে না। ছেলেটা তো তাকে ছাড়া এক মুহূর্ত কোথাও যায় না। তবে আজ তার কি হলো? যে মুনতাসিমের আশেপাশে ও তাকে দেখা যাচ্ছে না! মুনতাসিমের ললাটে চিন্তার ভাজ পড়লো। তাইয়ানের জন্য ভিষণ চিন্তা হচ্ছে তার। সবাই মেহেভীনকে ঘিরে ধরে বসে আছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে বলল,

–আপনি এখানে সবার সাথে বসে গল্প করেন। আমি পাঁচ মিনিটে আসছি। মেহেভীন কোনো উত্তর দিল না। নতুন মানুষদের ভিড়ে ভিষণ অস্বস্তি লাগছে তার। মুখ ফুটে সে কথা বলতেও পারছে না সে। সবাই তাকে প্রশ্ন করছে সে হ্যাঁ না উত্তর দিচ্ছে। সবাই অনেক প্রশংসা করল মেহেভীনের। এত ভিড়ের মধ্যে সে তাইয়ানকে কোথায় পাবে? চিন্তায় মস্তক ঝনঝন করে উঠল। মুনতাসিম সমস্ত গৃহ হন্যে হয়ে খুঁজে চলছে। অবশেষে গৃহের পেছনে মুনতাসিমের ফলের বাগানে তাইয়ানের দেখা মিলল। তাইয়ানের কাঁধে স্পর্শ করতেই তাইয়ান চমকে উঠল! তড়িঘড়ি করে আঁখিযুগলের অশ্রুকণা গুলো মুছে নিল। মুনতাসিম গম্ভীর দৃষ্টিতে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাইয়ানের সমস্ত মুখশ্রীতে মলিনতা ছেয়ে গিয়েছে। আঁখিযুগল ভয়ংকর ভাবে রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। তাইয়ান অপরাধীর ন্যায় বলল,

–স্যরি স্যার আমি আসলে ভেবেছিলাম। এত মানুষ আছে সমস্যা হবে না। তাই আপনার থেকে কিছুটা দূরত্বে চলে এসেছি। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে কোনো পরিবর্তন এল না৷ সে আগের ন্যায় গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,

–সত্যি কথা বলো।

–কিসের সত্যি কথা স্যার?

–এক কথা দু’বার বলা পছন্দ করি না।

–কিছু হয়নি স্যার চলুন ভেতর যাই। সবাই আপনাকে খুঁজবে।

–কাঁদছিলে কেন?

–আপনার আজ কত বড় সুখের দিন স্যার। আপনাকে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হতে দেখেছি। কিন্তু আপনার আনন্দ কোনোদিন দেখিনি। আজ আপনার আনন্দ দেখে আমার এতটা আনন্দ হচ্ছে, যে আঁখিযুগলের কার্ণিশে অশ্রুকণা এসে জমা হচ্ছে।

–অভিনয়ে তুমি ভিষণ কাঁচা তাইয়ান। পাকাপোক্ত হয়ে তারপর আমার সাথে অভিনয়ের খেলা খেলতে আসবে। আমি তোমাকে জাস্ট দশ সেকেন্ড সময় দিলাম। সত্যি কথা ছাড়া একটা অযথা বাক্য যেন মুখ দিয়ে উচ্চারিত না হয়। আমার কথা গুলো মস্তকে রেখে বলা শুরু করো।

–স্যার আমার বাবা মারা গিয়েছে। কথা গুলো বলতে গিয়েও তাইয়ানের কণ্ঠনালি কাঁপছিল। ভেতরটা অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করছে। মানুষটাকে এতদিন অবহেলা করে এসেছে সে। যে মানুষ টাকে এতদিন ঘৃণা করতো আজ সেই মানুষটার জন্য ভেতরটা হাহাকার করছে। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিম বিস্ময় নয়নে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে কিছুটা বিস্ময় কণ্ঠে বলল,

–তুমি না বলেছিলে তোমার কেউ নেই!

–মিথ্যা কথা বলেছিলাম স্যার। আমি আসলে আমার বাবাকে ঘৃণা করতাম। যদি-ও ঘৃণার মাত্রা এতটাও প্রকোপ ছিল না। আমার মা কালো ছিল বলে আমার বাবা আমার মাকে ছেড়ে সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করে নেন। তারপর আর আমাদের কোনো খোঁজ খবর তিনি রাখনেনি। মা আমাকে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করিয়েছে। আমি নিজেও মায়ের সাথে কাজ করেছি। আমার মা রাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতো। মায়ের কান্না আমার বুকে ভিষণ ব্যথা দিতো। আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম। আমার মাকে সুখে রাখার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না৷ তবে মনে মনে শপথ করে ছিলাম। মাকে আমি রাজরানীর মতো করে সাজাব। তখন আমার মা ছিল কিন্তু ক্ষমতা ছিল না। এখন আমার ক্ষমতা আছে কিন্তু মা নেই। যে মানুষটার জন্য আমার মা তিলে তিলে শেষ হয়ে গেল। সেই মানুষকে কিভাবে ভালোবাসব বলেন স্যার। আমার মা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। বাবা তার দ্বিতীয় বিয়ের কয়েক বছর পর ফিরে আসেন। মাকে বলেন মায়ের মতো করে কেউ তাকে ভালোবাসতে পারবে না। বাবার কান্নায় মায়ের নরম মন গলে গিয়েছিল। মা বাবাকে ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু আমি মানুষটাকে ক্ষমা করতে পারিনি৷ সেদিন মায়ের ওপরে ভিষণ অভিমান হয়েছিল। পকেটে এক হাজার চারশো টাকা নিয়ে গৃহে ত্যাগ করেছিলাম। শহরে আসি কাজ করি। তখন আমি নতুন কলেজে উঠেছি। দীর্ঘ তিন মাস বাসায় যোগাযোগ রাখিনি। বাবা আমাকে অনেক মানানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ঘৃণা নামক জিনিস আমার বাবার প্রতি এসে গিয়েছিল। তারপর একদিন যোগাযোগ করলাম। মা আমাকে প্রতি মাসে পড়াশোনার খবর পাঠানো শুরু করল। জীবনটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। আমি খুব আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। আমি বাসায় ফিরে আমার মায়ের জীবিত মুখটা দেখতে পারিনি স্যার। বাবা নামক মানুষ টার ওপরে যতটুকু ভালোবাসা এসেছিল। সেদিনের পর সেটুকুও মুছে গেল। আমার মনে হলো মায়ের মৃত্যুর জন্য সে দায়ী। সে তিলে তিলে আমার মাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু আমার ধারোনাটা ভুল ছিল তাই না বলেন স্যার? আমি কোনোভাবেই সন্তান হবার যোগ্যতা রাখি না। না পারলাম মায়ের স্বপ্ন পূর্ণ করতে। আর না পারলাম বাবার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে। আপনিই বলুন স্যার আপনি আমার জায়গায় থাকলে কি করতেন? যে বয়সে এসে আমার বাবার ভালোবাসা পাবার কথা ছিল। সে বয়সে এসে বাবার ভালোবাসা কি তা কেমন হয়? সেটাই আমি জানতাম না। তিনি ঠিকিই তার ভুল বুঝতে পেরে আমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করছে। তাহলে আমি কেন তার সাথে মানিয়ে নিতে পারলাম না?

–তোমাকে কিছু কথা বলি তাইয়ান। আমরা হচ্ছে মানুষ আর প্রতিটি মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। চলার পথে আমরা না চাইতেও ভুল করে বসি। তোমার বাবাও একটা ভুল করে ফেলছে। ভুল বললে ভুল হবে জঘন্যতম অপরাধ করেছে। একজন অপরাধী যখন অপরাধ করার পর অনুতপ্ত হয়। তখন তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিৎ। ক্ষমা হচ্ছে মানুষের মহৎ গুন। যে ক্ষমা করতে জানে সে অনেক সুখে থাকে জানো। ক্ষমা করার মধ্যেও আলাদা একটা শান্তি আছে। যা রাগ আর ঘৃণার মধ্যে নেই। রাগ আর ঘৃণা মানুষের মস্তিষ্কে বিকৃত করে দেয়। একটা সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে তোলে। ধীরে ধীরে ধংসের দিকে ঠেলে দেয়। তোমার দোষ আমি দিব না তাইয়ান। তোমার হৃদয়ের ব্যথাটা আংশিক হলে-ও অনুভব করতে পারছি। আমাদের জীবনটা অনেক ছোট তাইয়ান। তুমি চাইলে কয়টা দিন তোমার বাবা-মায়ের সাথে সুন্দর কিছু মুহূর্ত উপভোগ করতে পারতে। কিন্তু তুমি জীবন টাকে উপভোগ করতে ব্যর্থ হয়েছ। আমি যদি আগে জানতাম তোমার বাবা বেঁচে ছিল। তাহলে অবশ্যই আমার কাছে নিয়ে এসে রাখতাম। যে মানুষটা প্রতি মাসে তোমাকে দেখতে আসতো, তিনিই তোমার বাবা? আর এতদিন যে টাকা গুলো তুমি পাঠাতে সেগুলো তোমার বাবার কাছে?

–জি স্যার বাবা অনেক অসুস্থ ছিল। প্রতিদিন অনেক টাকার ঔষধ লাগতো। আমি সেগুলো বাবার চিকিৎসার জন্য পাঠাতাম। আমাদের এলাকার একজনকে বাবার দেখাশোনার জন্যও রেখেছিলাম।

–তোমার বাবা জানতো তুমি টাকা পাঠাতে?

–জানতো স্যার।

–তিনজন মানুষ তিনজনকে এতটা ভালোবাসলে অথচ প্রকাশ করতে ব্যর্থ হলে তাইয়ান! তোমাদের জেদের কাছে হেরে গেল ভালোবাসা। তা কি ঠিক করলে বাবাকে দেখতে যাবে না।

–যাব না স্যার।

–কেন?

–না সে বাবার মতো বাবা হতে পেরেছে। আর না আমি সন্তানের মতো সন্তান হতে পেরেছি। আমাদের জীবনের ছন্দ বহু আগেই হারিয়ে গিয়েছে। আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।

–এই যে এখানে এসে বসেছিলে?

–কাছেই তো ছিলাম স্যার।

–যার তৈরি হয়ে নাও।

–আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না৷

–বেশ তবে আমিও যাব তোমার সাথে চলো।

–আজকে আপনার জীবনের একটা বিশেষ দিন স্যার! আমার মতো নিকৃষ্ট মানুষের জন্য এত সুন্দর মুহুর্ত নষ্ট করবেন না। কিছু সময় জীবনে বারবার আসে না।

–আমি আর মেহেভীন বেঁচে থাকলে এমন হাজারটা মুহুর্ত কাটাতে পারব। কিন্তু তোমার বাবা পরপারে গমন করেছে! আজকের পর তুমি চাইলেও আর তোমার বাবাকে দেখতে পারবে না৷ আমি থাকতে তোমাকে এই আক্ষেপ নিয়ে বাঁচতে দিব না। তুমি তৈরি হয়ে না আমি গাড়ি বের করতে বলছি।

–আমি কোথাও যাব না স্যার।

–তোমার থেকে অনুমতি চাইছি না তাইয়ান।

–এখন গেলে কখন ফিরব?

–তোমার বাবা কখন মা-রা গিয়েছে?

–আপনাদের বিদায়ের সময় ফোন দিয়ে জানিয়েছে বাবা আর নেই।

–তাহলে কাল সকালে আসব।

–আপনি আজ আমার সাথে গেলে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হবে। তাইয়ানের আরো কিছু বলার ছিল। কিন্তু কথাগুলো কণ্ঠনালিতে এসে আঁটকে গেল।
মুনতাসিমের রাগান্বিত দৃষ্টি উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার নেই। মুনতাসিম মেহেভীন আর রিয়াদ চৌধুরীকে জানিয়ে তাইয়ানকে নিয়ে চলে গেল। মেহেভীনকে মুনতাসিমের কক্ষে রেখে গেল শেহনাজ। সবকিছু দেখিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বলল। তাইয়ানের বাবার জন্য ভিষণ খারাপ লাগছে মেহভীনের। তাইয়ান বড় ভাইয়ের মতো সব সময় মেহেভীনকে সাপোর্ট করে গিয়েছে। অদ্ভুত ভাবে তাইয়ানের জন্য মনের গহীনে সফট কর্ণার কাজ করছে। মেহেভীন পুরো কক্ষে চোখ বুলিয়ে নিল। সমস্ত কক্ষ জুড়ে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। গোলাপ আর রজনীগন্ধার সুবাস মস্তিষ্ককে মাতাল করে তুলছে। মেহেভীন আস্তরনের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ ফুলের সুবাস নিল। ব্যাগ থেকে বস্ত্র বের করে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

কোলাহলের মাত্রা সময়ের সাথে প্রকোপ হতে শুরু করেছে। সারাদিন গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। তবুও তাইয়ান আর মুনতাসিমের দেখা মিলেনি চৌধুরী গৃহে। দু’জনকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। কাল থেকে মেহেভীনের মনটা স্বাভাবিক থাকলে-ও সময়ের সাথে মনের মধ্যে ভয় জেঁকে বসছে। মনের সুখ গুলোকে আঁধারে ঢেকে নিয়েছে আতঙ্কের কালো ছায়া। মানুষটাকে এক নজর দেখার জন্য ভেতরটা ছটফট করছে৷ মানুষটাকে ছাড়া আজকাল নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে মেহেভীনের। বিষাদের ভরপুর হয়ে উঠল মন, মস্তিষ্ক। কারো সাথে সুসম্পর্ক না থাকায় মুখ ফুটে বলতেও পারছে না। তখনই মেহেভীনের কর্ণকুহরে এসে কিছু বাক্য পৌঁছল।

–মুনতাসিম কি এই বিয়েতে রাজি ছিল না? রিয়াদ কি তার ছেলেকে জোর করে বিয়ে দিল? যার কারনে বিয়ের রাতে বউ রেখে কাউকে কিছু না জানিয়ে উধাও হয়ে গেল! আজকাল কার বাবা-মা গুলোও হয়েছে। ছেলে-মেয়েদের বিয়েতে মত থাকে না। জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় আর ছেলে মেয়েরা বিয়ের পরে প্রেমিক, প্রেমিকার লগে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়ায়। কথা গুলো মাটিতে পড়ার আগেই জ্বলে ওঠা কণ্ঠ স্বর ভেসে এল।

–আমি নিশ্চয়ই আপনার মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতে গিয়েছিলাম। তা না হলে আপনি কিভাবে জানলেন? আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না! আবার আমার প্রেমিকা ও আছে! কাইন্ড ইওর ইনফরমেশন বিয়েটা আমার পছন্দেই হয়েছে। আমাকে জোর করে কোনো কিছু করানোর ক্ষমতা কারো নেই। কারো সম্পর্কে কোনো কিছু মন্তব্য করার আগে, সবকিছু জেনে তারপর মন্তব্য করবেন৷ যারা না জেনে শুনে অন্যের নামে কটু কথা রটায়। আমি তাদেরকে ভয়ংকর রকমের ঘৃণা করি। আপনি বিয়ের দাওয়াত খেতে এসেছেন। আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার জন্য আসেন নি। যে কাজে এসেছেন সে কাজ করুন। মুনতাসিম ব্যক্তিগত জিনিস ব্যক্তিগত রাখতে পছন্দ করে। আপনি যদি আমার বিষয়ে আর একটা বাজে কথা বলেছেন। তাহলে আমি ভুলে যাব আপনি আমার গুরুজন। এই সময়ে মুনতাসিমের উপস্থিতি একদমই আশা করেনি মহিলাটি৷ সে মেহেভীনকে আঘাত করার জন্য সুযোগ বুঝে কথা গুলো বলেছে। মুনতাসিমকে দেখে ভয়ে চুপসে গেল সে। ভীরু দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের উত্তপ্ত মস্তিষ্ক নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যস্ত। মুহুর্তের মধ্যে আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে করে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে সে। মুনতাসিমকে দেখে মেহেভীনের জানে পানি আসলো। সে খুব সংগোপনের স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। সমুদ্রের ঢেউয়ের ন্যায় উথাল পাথাল করা হৃদয়টা মুহুর্তের মধ্যে শান্ত নদী হয়ে গেল। মুনতাসিমের পাশেই বিধস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তাইয়ান। ছেলেটার সমস্ত মুখশ্রীতে মলিনতা ছেয়ে গিয়েছে। খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে, যে কারো বুক কেঁপে উঠবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মহিলাটি বলল,

–আমার ভুল হয়ে গিয়েছে বাবা। তুমি আমাকে মাফ করে দাও। আমি না বুঝেই তোমার মন্তব্য করে ফেলছি। সবকিছু না জেনেশুনে আমার এভাবে মন্তব্য করা উচিৎ হয়নি।

–এরপর থেকে কারো সম্পর্কে কোনো কিছু বলার আগে বুঝে শুনে বলবেন। কথা গুলো বলেই তাইয়ানের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে আসলো মুনতাসিম। মহিলাটি আড়দৃষ্টিতে মেহেভীনকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। মুনতাসিম তাইয়ানের হাত ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন তাইয়ান। তুমি কক্ষ গিয়ে ঘুমিয়ে নাও। আমি সবাইকে বলে দিব৷ তোমার কক্ষের কাছে কেউ যেন কোলাহল না করে।

–আমি ঠিক আছি স্যার, সমস্যা নেই।

–তোমার থেকে কোনো কথা শুনতে চেয়েছি। আমার চোখের সামনে থেকে যাও। মুনতাসিমের কড়া কণ্ঠে বলা কথা গুলো তাইয়ানের হৃদয় স্পর্শ করে গেল। সেই সাথে অভিমান এসে ভিড় জমালো মনে। মনের গহীনে থেকে ভিষণ করে বলতে ইচ্ছে করছে, “আপনি এত পাষাণ কেন স্যার? সব সময় কঠিন কঠিন কথা বলেন। আজকে অন্তত একটু নরম হতে পারতেন। আপনি আমার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন। মৃত্যু আগ পর্যন্ত আপনার পাশে ছায়ার মতো লেগে থাকব৷ আপনার রাগের মধ্যে, গম্ভীর কণ্ঠ স্বরের মধ্যে এক সমুদ্র সমান ভালোবাসা খুঁজে পাই। এত ভালোবাসা পাবার পরে কিভাবে আপনার সাথে বেইমানি করব স্যার? আপনি আমার সব পথ বন্ধ করে দিলেন। আপনার মতো মানুষের সাথে বেইমানি করার আগেই আমার মৃত্যু আসুক। তবুও বেইমানি না আসুক। তাইয়ান বিলম্ব করল না দ্রুত পায়ের কক্ষে চলে গেল।

পার্লারের মেয়েরা চলে এসেছে। সন্ধ্যায় আজকে চৌধুরী গৃহে অনুষ্ঠান করবে। শেহনাজ মেহেভীনকে নিয়ে সাজতে যাচ্ছিল। তখনই মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–মেহেভীনকে আমার কক্ষে আসতে বল।

–কিন্তু ভাই পার্লারের মেয়েরা চলে এসেছে। সাজাতে সময় লাগবে। সন্ধ্যা থেকে অনুষ্ঠান শুরু হবে। আপনি ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নিন। মুনতাসিম কোনো উত্তর করল না। ক্লান্ত মস্তিষ্ক নিয়ে কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো।

চারিদিক আঁধারে আচ্ছন্ন হতে শুরু করেছে। রাইমা বেগমের সাথে কয়েকজন স্বজন এসেছে মেহেভীনকে নিয়ে যেতে। মেহেভীনকে মেরুন রঙের লেহেঙ্গা পড়ানো হয়েছে। সমস্ত কায়া ভর্তি বাহারি রকমের অলঙ্কার পড়ানো হয়েছে। মেহেভীনের এমন রাজরানীর মতো রুপ দেখে মায়ের চক্ষু শীতল হয়ে গেল। অজানা অনুভূতিতে ভেতরটা আনন্দে নেচে উঠছে। রাইমা বেগম মেয়ের পাশে বসলেন। আজ খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে। তার মেয়েটা কেমন আছে? নিজের ইচ্ছে টাকে দমিয়ে রাখতে পারল না। হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–কেমন আছিস মা?

–আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি মা। তুমি ভরসা করে আমায় পাঠিয়েছ। আমি কি খারাপ থাকতে পারি? তোমার রাতে একা থাকতে কোনো সমস্যা হয়নি তো আবার? প্রাপ্তি আপুর আম্মু তোমাকে কোনো কথা শুনিয়েছে? আমার কাছে কিছু লুকাবে না বলে দিলাম।

–আমার গৃহ ভর্তি এত মানুষ ছিল। ক্ষতি করার সাহস কার আছে শুনি? তা আমাকে দেখে কাঁদছিস না যে!

–তুমি তো কালকে বললে আমি বাচ্চাদের মতো আচরণ করছি।

–তাই এক রাতে বড় হয়ে গেলি?

–হয়তো!

–মায়ের ওপরে অভিমান হয়েছে?

–না।

–তোর ভালোর জন্যই আমাকে শক্ত হতে হয়েছে মা। আমার কথা মনে রেখে কষ্ট পাস না। তোর সাথে যদি আমিও কান্না করতাম। তাহলে পরিস্থিতি খারাপ দিকে চলে যেতো। কালকে সারারাত ঘুমাতে পারিনি। কালকে জীবনের প্রথম আমি এত কেঁদেছি জানিস! তুই চলে আসার পর আমার বুকটা খালি খালি লাগছিল। আমার ইচ্ছে করছিল ছুটে চলে আসি তোর কাছে। মায়ের নরম কণ্ঠে বলা কথা গুলো মুহূর্তের মধ্যে মেহেভীনের মন গলিয়ে ফেলল। মেহেভীন কোনো বাক্য উচ্চারন না করেই মাকে জড়িয়ে ধরল। মেহেভীনের মা পরম যত্নে মেয়ের ললাটে চুমু খেল। তখনই মুনতাসিম এসে সেখানে উপস্থিত হলো। মুনতাসিম রাইমা বেগমের সাথে কুশল বিনিময় করে সেখানে বসলো। রাইমা বেগম বললেন,

–আজকে মেহেভীনকে নিয়ে যেতে দিবে না বাবা?

–না, আমি কালকে গিয়ে আপনার কাছে রেখে আসব।

–তাহলে দেরি না করি চলে যাব।

–আপনাকেও যেতে দিব না। আপনি যদি আজ চলে যান। তাহলে আমি ভিষণ রাগ করব।

–মেহেভীনের নানির বাড়ি থেকে অনেক স্বজন এসেছে। আমি তাদের রেখে কিভাবে থাকি বলো বাবা? আমাকে আজ যেতে হবে। পরে না হয় মেহেভীনের সাথে এসে থাকব।

–কথা দিন।

–কথা দিলাম। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে হাসি ফুটে উঠল। রাইমা বেগম অদ্ভুত ভাবে দু’জনকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। মায়ের দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পারছে না মেহেভীন। তার মা তো কোনোদিন তাকে এভাবে দেখেনি। তবে আজ এভাবে দেখছে কেন? অদ্ভুত ভাবে মেহেভীনের ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে। কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো শব্দও উচ্চারিত হচ্ছে না। ভেতর অনেক কথা কিন্তু তা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হচ্ছে মেহেভীন।

আস্তে আস্তে সমস্ত গৃহ ফাঁকা হতে শুরু করেছে। রাত যত গভীর হচ্ছে কোলাহল ততই কমছে। অর্ধেক বাসা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। কালকের ন্যায় আজ-ও মুনতাসিমের কক্ষটা সাজানো হয়েছে। মেহেভীন আস্তরণে বসে ছিল। তখনই মুনতাসিম আসে। মুনতাসিমের রাগ সম্পর্কে সবাই অবগত রয়েছে। সেজন্য কবাটে টাকার নেওয়ার ঝামেলা কেউ করেনি। মুনতাসিম এসে মেহেভীনের পাশে বসলো।

–আপনি কি রাগ করেছেন? আমি কালকে ওভাবে তাইয়ানের সাথে চলে যাওয়াতে?

–আমি হচ্ছে একজন মানুষ। আর একজন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে যেটা বেশি থাকা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে মনুষ্যত্ব যা আমার আছে। আমি এতটা বিবেকহীন হয়ে যাইনি যে, এমন হৃদয়ভাঙা খবর শুনেও রাগ করব! আপনাকে প্রচুর ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।

–আপনাকেও ভিষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। এসব ভারি অলঙ্কার আর লেহেঙ্গা বদলে রেগুলার ইউজ করার বস্ত্র পরিধান করুন। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন শান্তি অনুভব করল। সে দ্রুত উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল। কালো রঙের সালোয়ার কামিজ পরিধান করে বের হলো মেহেভীন। মেহেভীন বের হতেই মুনতাসিম ফ্রেশ হতে চলে গেল। মেহেভীনের ভেতরে ভিষণ অস্বস্তি কাজ করছে। অদ্ভুত ভাবে সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। এতক্ষণ তো স্বাভাবিকই ছিল সবকিছু। কিন্তু এখন অস্বাভাবিক ভাবে ভয় লাগছে কেন তার! ওয়াশরুমের কবাট খুলার শব্দে চমকে উঠল মেহেভীন। দু’জনের মাঝে পিনপতন নীরবতা চলছে।

–আপনি কি ভয় পাচ্ছেন ম্যাডাম?

–না।

–আমি তো দেখতে পাচ্ছি। আপনি ভয় পাচ্ছেন৷ আপনি ভয় পাবেন না ম্যাডাম। আপনার আঁখিযুগলে আমার প্রতি ভয় নয় ভরসা দেখতে চাই। আপনার অনুমতি ছাড়া আপনার ছায়ার ওপর দিয়েও আমি হাঁটব না। মুনতাসিমের পুরোটাই ভালোবাসাময় চাই। সেখানে এতটুকু ভালোবাসার কমতি থাকবে, সেটা আমার চাই না।

–আমি কি আপনাকে সে কথা একবারও বলেছি?

–তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ঘুমিয়ে পড়ুন। কি অদ্ভুত! মেহেভীনের বাক্য গুলো কণ্ঠনালিতে এসে আঁটকে যাচ্ছে। সে দৃষ্টি লুকিয়ে আস্তরণে গিয়ে উঠে বসলো। ভয়ে সমস্ত কায়া অবশ বয়ে আসছে। এই ভয়ের সমীকরন মিলছে না মেহেভীনের। এর আগেও সে কত সুন্দর সময় মুনতাসিমের সাথে কাটিয়েছে। তখন তো ভয় লাগেনি। তবে আজ কেন ভয় লাগছে? মুনতাসিম একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। হয়তো মেহেভীনের ভয় আর অস্থিরতা তার মনটাকে পোড়াচ্ছে। মেহেভীন মুনতাসিমের সরে যাওয়ার কারন উপলব্ধি করতে পেরে আড়দৃষ্টিতে তাকালো৷ সে তো স্বাভাবিক হতেই চাইছে। কিন্তু তার অনুভূতিরা তার সাথে ছলনা করছে। কিছুতেই স্নিগ্ধ অনুভূতিতে এসে ধরা দিচ্ছে না৷ মেহেভীন উঠে মুনতাসিমের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। মুনতাসিম আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল,

–না ঘুমিয়ে উঠে আসলেন যে?

–আপনি এখানে আসলেন কেন? আপনাকে অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আপনি দু’টো রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। এভাবে রাতে ঘুম না হলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

–আমার অভ্যাস আছে। একটু আগে কি বলেছি শুনতে পাননি। আমাকে দেখে আপনার ভেতর ভয় বা জড়তা কাজ করুক এটা আমি চাই না। আমার জন্য আপনার মধ্যে ভয় দেখলে ভেতরটা আমার পুড়বে। মেহেভীন নিশ্চুপ হয়ে গেল। সে তার অনুভূতিটা কিভাবে মুনতাসিমকে বোঝাবে। অনুভূতি এমন একটা জিনিস যা সহ্য করা যায়৷ আর না কাউকে বোঝানো যায়।

–আসলে প্রথবার বিয়ে করেছি। তাই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে গিয়েও অনুভূতির কাছে ব্যর্থ হয়ে, অস্বাভাবিক হয়ে উঠছি।

–আর আমার এটা চার নাম্বার বিয়ে তো তাই আমি স্বাভাবিক আছি। মুহুর্তের মাঝে মেহেভীনের মন মস্তিষ্ক জ্বলে উঠল। সাথে নিজের বলা বোকা বোকা কথা গুলোর জন্য নিজের ওপরেই বিরক্ত হলো মেহেভীন। সে রক্তিম চোখে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিম আড়দৃষ্টিতে মেহেভীনকে পর্যবেক্ষণ করছে। মেহেভীনের মুখশ্রী দেখে ভিষণ হাসি পাচ্ছে তার৷ মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,

–কি বললেন আরেকবার বলেন?

–আজকে আপনাকে ভিষণ সুন্দর লাগছিল৷ আপনার রুপের সৌন্দর্যকে ভেদ করে, আপনার ভেতরে বিলীন হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার। আপনার মতো সুন্দর নারী আমি আমার জীবনে দু’টো দেখিনি। আমার অস্তিত্ব বলতে যতটুকু ছিল। আপনাকে দেখার পরে আপনি তা গ্রাস করে ফেলছেন।

–এসব মন গলানো কথা বলে লাভ নেই। বাজে লোক একটা! খুব শখ তাই না চার টা বিয়ে করার?

–এটা প্রতিটি পুরুষের স্বপ্ন আমি ছাড়া। কারন আমার বউ আছে। মেহেভীন রেগে মুনতাসিমের হাত ধরে কক্ষ নিয়ে আসতে যাবে। তখনই মুনতাসিম হাত সরিয়ে মেহেভীনের দিকে ঘুরবে, এমন সময় মেহেভীনের হাত মুনতাসিমের হাত স্পর্শ করতে পারে না। মেহেভীন শান্ত গলায় বলল,

–আমাকে স্পর্শ করবেন না। আপনার হাত নোংরা হয়ে যাবেন। কথা গুলো বলেই কক্ষের দিকে অগ্রসর হতেই মুনতাসিম মেহেভীনের হাত ধরে ফেলল।

–এটা আপনি কেমন কথা বললেন ম্যাডাম? কখনও কখনও আপনার স্পর্শ পাবার তৃষ্ণা এতটা প্রকট হয় যে, মনে হয় আপনি যে পথ দিয়ে হেঁটে যান। সেই পথের ধুলাবালি হয়ে যাই।

–তাহলে হাত সরিয়ে নিলেন কেন?

–হাত সরিয়ে নেইনি। আপনার দিকে ঘুরতে যাচ্ছিলাম। তখনই আপনি হাত বাড়িয়েছেন৷ সেজন্য আপনার হাত আমাকে ছুঁতে পারেনি। যেদিন আমার অধিকার নিয়ে আপনার সামনে দাঁড়াব। সেদিন আপনি আমাকে আটকাতে পারবেন না। মুনতাসিমের শীতল কণ্ঠে বলা কথা গুলো মেহেভীনের মুখের ভাষা কেঁড়ে নিল। সে ধীর কণ্ঠে বলল,

–আপনার কায়াতে শীতের বস্ত্র নেই। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ঠান্ডা লাগবে। কক্ষ চলুন ঘুমাব। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে মুনতাসিম মেহেভীনকে জড়িয়ে ধরল। আচমকা জড়িয়ে ধরাতে কেঁপে উঠল মেহেভীনের সর্বাঙ্গ। মুনতাসিম মেহেভীনের কর্ণের কাছে গিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল, শীতল কায়াকে উত্তপ্ত করে নিতে জানি ম্যাডাম। উস্কে দেওয়া মূলক কথা কম বলবেন। কথা গুলো বলেই মেহেভীনের ললাটে চুমু খেল। মেহেভীনের সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। ধীর গতিতে কাঁপছে সে। শক্তি গুলো ক্ষয় হতে শুরু করেছে। সে আদুরে বিড়ালের মতো মুনতাসিমের বুকে লেপ্টে আছে।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩৭
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষ। কক্ষের মধ্যে জীর্ণশীর্ণ দেহটা নিয়ে মিরাজুলের সামনে শুয়ে আছে আরিয়ান। মিরাজুল গম্ভীর দৃষ্টি মেলে আরিয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মনের একাংশে প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। মেহেভীন আরিয়ান আর রহমানের নামে নারী নির্যাতনের মামলা করেছে। সে খবর কর্ণকুহরে আসতেই পালিয়েছে সে। শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তবুও প্রতিশোধের নেশা মস্তিষ্ককে নাড়া দিচ্ছে। রহমানের হাত ভেঙে গিয়েছে। সে পুলিশ হেফাজতে আছে। মিরাজুল নিজেই আরিয়ানকে পালাতে সাহায্য করেছে।

–পালালেন কেন? মিরাজুলের কথায় জ্বলে উঠল আরিয়ান। কর্ণ দিয়ে উত্তপ্ত হাওয়া বের হচ্ছে। হিম শীতের মধ্যেও ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা তৈরি হয়েছে। আরিয়ান রাগান্বিত হয়ে বলল,

–শা’লী পুলিশ কেস করে দিয়েছে। পুলিশ আমায় খুঁজছে আমি না পালালে শা’লী’কে কি মারতে পারব! তোমার মেহেভীনের ওপরে এত কিসের রাগ ক্ষতি করতে চাও কেন?

–আমার মেহেভীনের প্রতি কোনো রাগ নেই। আমি মেহেভীনকে ভালোবাসি। হাজারটা বসন্ত আমি মেহেভীনের সাথে পার করতে চাই। কিন্তু আমার সুখানুভূতিতে মুনতাসিম বিষাদ ঢেলে দিয়েছে। আমি মুনতাসিমকে মা’র’তে চাইছি। আমার অধরযুগলের দিকে তাকিয়ে দেখো এখনো ক্ষত রয়ে গিয়েছে। এই ক্ষতের দিকে যতবার দৃষ্টিপাত করি মন মস্তিষ্ক নাড়া দিয়ে বলে মুনতাসিমকে নিঃস্ব করে দে। আমি বহু কষ্ট মেহেভীনের গৃহ পর্যন্ত এসেছি। তোমার জন্য শুধু মাত্র মেহেভীনকে তুলতে পারলাম না। মিরাজুলের বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই আষাঢ়ের আঁধার আরিয়ানের মুখশ্রীতে ঘনিয়ে এল। সে নেতিয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,

–মেহেভীনের সাথে আমার বিয়ে হবার কথা ছিল। কিন্তু আমাকে মেহেভীনের মায়ের পছন্দ না। মেহেভীনও আমাকে পছন্দ করে না। সেজন্য আমাকে সে বিয়ে করেনি। শুনেছি মন্ত্রী সাহেব মেহেভীনকে ভিষণ ভালোবাসে। মেহেভীনের মনের অন্তরালে মন্ত্রী সাহেবের জন্য সুপ্ত অনুভূতি কাজ করে। তুমি ভেবেছো এত ভালো কিছু রেখে আমাদের মতো পঁচা আলুর দিকে নজর দিবে মেহেভীন!

–পঁচা আলু আপনি হতে পারেন আমি না। যে ভাবেই হোক মেহেভীনকে আমার চাই। মেহেভীন আমার না হলে মেহেভীনকে ধরনীর বুক থেকে মুছে দিব।

–তাহলে তোমাকে একটা সুখবর দেই। মেহেভীনের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে মন্ত্রী সাহেবের সাথে, মা এখনই মেসেজ করে জানালো। এবার বলো দু’জনকে পৃথিবী থেকে সরাতে আমাকে সাহায্য করবে কি না?

–যদি ধরা পড়ে যাই?

–তাহলে বিয়ের দিনটাই আমরা বেছে নেই। সেদিন এতএত মানুষের কোলাহল থাকবে। চারদিকে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন হবে। বাহারী রঙের মানুষের আনাগোনা হবে। এত এত মানুষের ভিড়ে কে তাদের মা’র’ল সেটার হদিস কেউ খুঁজে পাবে না। মিরাজুল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। যার জন্য মন গহীনে একটা সময় সুপ্ত অনুভূতি কাজ করেছিল। নিয়তির বিরুদ্ধে গিয়ে তাকেই মা’র’তে হবে।

–আপনি এই কয়টা দিন সুস্থ হয়ে নিন। আমি প্রস্তুতি নেই অনেক শ্রম দিতে হবে। কথা গুলো বলেই মিরাজুল কক্ষ ত্যাগ করল।

ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই বিষন্ন মন নিয়ে মুনতাসিম কক্ষ প্রবেশ করল। কক্ষে প্রবেশ করে বাবা উপস্থিত টের পেয়েও আগের ন্যায় নিজের কর্মে ব্যস্ত থাকলো। রিয়াদ চৌধুরী কিছু বলতে যাবে তখনই মুনতাসিম ফ্রেশ হতে চলে গেল। মুনতাসিম ফ্রেশ হয়ে আসতেই রিয়াদ চৌধুরী এক বিবাদিনীর বিষাদ মাখা মুখশ্রী মুনতাসিমের সামনে উপস্থাপন করল। মুনতাসিম আগের ন্যায় গম্ভীর মুখশ্রী করে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। প্রেয়সীর এমন মলিনতায় ছোঁয়া মুখখানা ভেতরে অস্থিরতার ঝড় তুলে দিয়েছে। মুনতাসিম নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল।

–কিছু দেখতে পাচ্ছ?

–হ্যাঁ পাচ্ছি মেয়েটা ভিষণ অসুস্থ!

–আর কিছু দেখতে পাচ্ছ না?

–সুন্দর ফুলের পাপড়ি যদি পোকা খেয়ে ফেলে, তাহলে মানুষের দৃষ্টি আগে সেই পোকা খাওয়া পাপড়িতে গিয়ে পড়ে। ফুলের সৌন্দর্য ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য পোকা খাওয়া পাপড়িটা ছেঁটে দেওয়া উচিৎ। তবেই ফুলের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে।

–খুশি হওনি?

–আমার খুশির সাথে কি যায় আসে?

–রাগ করে আছ?

–আমার রাগ আছে?

–ধরনীর বুকে সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা মুনতাসিমের রাগ নেই! বিয়ে ঠিক করে এসেছি। আমি তো ভিষণ খারাপ বাবা। তাই ছেলের ছোট বেলার ইচ্ছেটা পূর্ণ করে আসলাম। কারো অনেক শখ ছিল মায়ের নাক ফুল দিয়ে লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসবে। কেউ সেটা ভুলে যেতে পারে কিন্তু তার মা ভুলে যায়নি। তার মা আমার কাছে ছেলের বউয়ের আমানত রেখে গিয়ে ছিল। এত গুলো বছরে সেই জিনিসটার সংস্পর্শে কাউকে আসতে দেইনি। যে জিনিসটার আসল মালিক সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আসলাম। আগামী সপ্তাহে বিয়ে ঠিক করে এসেছি।

–দয়া দেখানোর দরকার ছিল না।

–আমি তোমায় পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। তোমার ভালোবাসা ঠিক কতটা গভীর।

–তার জন্য মেয়ের প্রয়োজন ছিল না। সেই পথেই হাঁটলেন মাঝখানে কিছুটা জল ঘোলাটে করলেন।

–মেহেভীনের বাবা বাসায় নেই। সেজন্য তার সাথে কথা বলতে পারিনি। তোমার কাছে নাম্বার থাকলে দিও তো আমি কথা বলব। কথা গুলো বলেই রিয়াদ চৌধুরী কক্ষ ত্যাগ করছিলেন। তখনই মুনতাসিম ধীর কণ্ঠে ডাকল, আব্বা। রিয়াদ চৌধুরী থমকালেন। উৎসুক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে।

–আপনাকে বিশ্বাস করে একটা কথা বলব। আপনি যদি বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেন। তবেই বলব কথা না দিলে বলব না।

–তোমার বিষয়ে আমি কতটা সিরিয়াস তুমি জানো না। তুমি যতটুকু জানো তার থেকে-ও অনেক বেশি আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার ক্ষতি হবে তুমি আঘাত পাবে এমন কাজ করার আগে আমার মৃ’ত্যু হোক।

–বাজে কথা বলা বন্ধ করুন। কথাটা আপনার আর আমার মধ্যেই থাকে যেন। আর সবকিছু জানার পরে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দায়িত্ব আপনার। রিয়াদ চৌধুরী চিন্তিত হলেন। তার ভেতরে দারুণ অস্থিরতা কাজ করছে। মুনতাসিম আগে কখনো তাকে এমন কথা বলেনি। তবে কি ভয়ংকর কিছুর সম্মুখীন হতে চলেছে? রিয়াদ চৌধুরী ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।

–মেহেভীনের বাবা বেঁচে নেই আব্বা। মেহেভীনের বাবা খু’ন হয়েছে। আমাদের বিয়ের আগ পর্যন্ত কথা গুলো নিজের মধ্যে রাখবেন। মেহেভীনের মা আমার থেকে কিছু আড়াল করতে চান না। তাই সমস্ত সত্যি কথা আমাকে বলেছে। আপনি সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে আনন্দ করতে ভালোবাসেন। হয়তো প্রচন্ড রকমের বাড়াবাড়ি করতেন। তাই আপনাকে বলতে বাধ্য হলাম আন্টির সামনে এসব কথা বলে আমটিকে বিব্রত করার করবেন না। মেহেভীনকে ভালোবাসার চেষ্টা করবেন। তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তিটি হব আমি। রিয়াদ চৌধুরী বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরানো। অদ্ভুত ভাবে আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে।

–মেহেভীন অসুস্থ জানলে কিভাবে?

–সব জানি আমি গিয়েছিলাম। আন্টি বললেন রাত করে দু’টো মেয়ে মানুষ বাসায় থাকে। মানুষজন দেখলে বদনাম রটাবে। তাদের মানসন্মানের কথা চিন্তা করে চলে এসেছি। প্রাপ্তির শশুর আর ভাই মিলে দু’জনকে মেরেছে। কথা গুলো কর্ণকুহরে আসতেই কলিজা কেঁপে উঠল রিয়াদ চৌধুরীর। বাক্য গুলো আজ শব্দ হারিয়েছে। অনুভূতিরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। ভেতরে ভেতরে ভিষণ অনুশোচনা কাজ করছে। এই সময়ে কেন মুনতাসিমকে দূরে সরতে বলল। ছেলেটা তার আল্লাহর তৈরি শ্রেষ্ঠ নেয়ামত সবাইকে কিভাবে মিলেমিশে ভালোবাসতে হয়। সেটা তার ছেলের থেকে শেখা উচিৎ।

–আপনি যে বিয়ের কথা পাকা করে এসেছেন। এটা জানেন তো মেয়ে টার চাকরিটা আর নেই। বিয়ের পরে শোনার থেকে বিয়ের আগেই শোনা ভালো। বিয়ের পরে যেন মেয়ে টাকে কখনো কোনো কড়া বাক্যের সম্মুখীন হতে না হয়। আপনাকে আমি ভিষণ সন্মান করি। আমার মনে হলো কথা গুলো আপনাকে জানানো প্রয়োজন। বিয়ের পরে আপনার তরফ থেকে মেহেভীনের প্রতি অসম্মান আসলে, আমি সেটা সহ্য করতে পারব না। তাই মনের কথা কোনো কিছু থাকলে সরাসরি বলে দিন।

–আমার মেহেভীনের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। তবে সে তোমায় কষ্ট দিয়েছে। সেজন্য মনের গহীনে রাগ ছিল। কিন্তু যখন দেখলাম আমার ছেলের অধিকাংশ পরিবর্তনের কারণ মেয়েটা। তখন আমার ভুল ধারণা ভাঙলো। আমার ছেলের সুখের উর্ধে গিয়ে কিছুই হবে না। তোমার মতো করে মেয়েটাকে আগলে রাখতে পারব কি না জানি না। তবে তোমাকে সাহায্য করব যেন মেয়ে টাকে প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই আগলে রাখা যায়। কথা গুলো বলেই কক্ষ ত্যাগ করল রিয়াদ চৌধুরী। ভেতরটা ছিন্ন ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তবুও যেন আরিয়ানের দেখা মিলছে না। যে হাতে মেহেভীনকে প্রহার করেছে। সে হাত দু’টো সে আগে কা’ট’বে তবেই রক্তাক্ত হৃদয়টা শুকাতে শুরু করবে। তাইয়ান মস্তক নুইয়ে বলল,

–এলাকার কোথাও নেই আরিয়ান। সিসি ক্যামেরাতে দেখা গিয়েছে মিরাজুল ভাই আরিয়ানকে নিয়ে পালিয়েছে। যেদিকে গিয়েছে সেদিকের এলাকা গুলোতেও খোঁজা নেওয়া হয়েছে পাওয়া যায়নি। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিমের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এল। ক্রোধে চোয়াল শক্ত করে ফেলল। মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠল। মিরাজুলের প্রতি ক্রোধের মাত্রা দ্বিগুন ভাবে প্রকোপ পেল। মুনতাসিমে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–আমি একটা ঠিকানা দিচ্ছি তোমাকে সেখানে খোঁজ করো। তাইয়ান ঠিকানা নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করল। মুনতাসিম আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের ক্রোধ সংবরন করার চেষ্টা করছে। কিছু স্নিগ্ধ অনুভূতির মধ্যে তিক্ত অনুভূতি এসে অনুভূতি নাম টাকেই বিষাক্ত করে তুলেছে। সেই বি’ষ বাতাসের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে মনটাকে ভিষণ পীড়া দিচ্ছে।

প্রভাতের আলো ফুটে গিয়েছে। গাছের মগডালে বসে পাখিরা সুর তুলতে ব্যস্ত। রোদের সোনালী আলোয় কুয়াশা বিলীন হতে শুরু করেছে। সময় স্রোতের ন্যায় ছুটে চলেছে। জীবন বদলায়, বাদলায় জীবনের গতিবেগ বদলায় না শুধু কিছু মানুষ মন। নির্ঘুম রজনী কাটিয়ে মেহেভীনদের বাসায় এসেছে মুনতাসিম। রাইমা বেগমকে বেশ সুস্থ দেখাচ্ছে। মুনতাসিমকে দেখে রাইমা বেগম মিষ্টি হেসে বললেন,

–তুমি এসেছ? কালকে রাস্তা থেকে চলে যেতে বললাম রাগ করোনি তো আবার। আসলে কালকে এতবড় ঘটনা হয়ে গিয়েছে। আশেপাশের মানুষ কেমন নজরে দেখছিল। আমি চাইনি আমাদের নিয়ে কেউ কোনো বাজে কথা বলুক।

–আমাকে এতটা কৈফিয়ত দিতে হবে না। ভালো-মন্দ বোঝার বুদ্ধি বিবেক দু’টোই আমার আছে। আপনার শরীর এখন কেমন আছে?

–আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছে। তুমি কালকে যে নার্সকে রেখে গিয়েছিলে মেয়েটা ভিষণ মিষ্টি। ডক্টর এসে কি যে ঔষধ দিয়ে গেল সকালে উঠে দেখি মস্তকের ব্যথা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত দু’টো ডক্টরের ঔষধ খেলাম। কিন্তু পার্থক্য কতটা আলাদা! মুনতাসিম হালকা হাসলো কিছু বলল না।

–তুমি এখন মেহেভীনের সাথে দেখা করতে পারো। তুমি মেহেভীনের কক্ষে গিয়ে বসো। আমি রান্না ঘর থেকে আসছি। মুনতাসিম কোনো বাক্য উচ্চারন না করেই মেহেভীনের কক্ষের সামনে আসলো। মেহেভীন বিছানায় শুয়ে ফোনে স্ক্রোল করলছিল।

–আসব? মুনতাসিমকে দেখে মেহেভীন ফোন রেখে উঠে বসলো। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–দয়া দেখাতে এসেছেন? আপনাকে কে বলেছিল আমাদের নার্স লাগবে? আপনি কেন কাল আমাদের বাসায় নার্স নিয়ে এসেছিলেন?

–এই প্রশ্নের উত্তর আমি সেদিন দিব। যেদিন আমি অসুস্থ হব আপনি ডক্টর ডাকবেন। অনুভূতি তো বলে প্রকাশ করা যায় না। তবে অনুভূতি পরিস্থিতি দিয়ে অনুভব করানো যায়।

–আপনি ভেতরে এসে বসুন। মা দেখলে আমাকে কথা শোনাবে।

–তার দরকার নেই দেখতে এসেছিলাম। এই যে দেখলাম এখন চলে যাব।

–চলে যাবেন কেন?

–যাব না বলছেন?

–একটা মেয়ে যখন রাগ করে বলবে কথা বলবেন না। তখন বুঝতে হবে এখন মেয়েটার সাথে জোর করে কথা বলতে হবে। একটা মেয়ে যখন বলবে আমার কারো ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। তখন বুঝবেন মেয়েটাকে প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই ভালোবাসা দিতে হবে।

–থেকে ভালোবাসতে বলছেন?

–অদ্ভুত মানুষ তো আপনি!

–আপনার চিন্তা ভাবনা গুলো অদ্ভুত। তাই আমাকেও আপনার কাছে অদ্ভুত লাগছে।

–আপনার বাবাকে বলুন বিয়েটা ভেঙে দিতে।

–আপনার মাকে বলুন আপনাকে তুলে আ’ছা’র দিতে।

–আপনি ঝগড়া করতে এসেছেন?

–আমার মতো মানুষ ঝগড়া করতে পারে?

–আমি আপনাকে বিয়ে করব না।

–করবেন না সমস্যা কি সারাজীবন দেবদাস হয়ে থাকবেন।

–আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব।

–তাহলে আমার হাতে খু’ন হওয়া প্রথম নারীটি আপনিই হবেন। আমি নিজেও বিয়ে করব না। আপনাকেও বিয়ে করতে দিব না। আর বিয়ে করতে মন চাইলে আমাকেই করতে হবে।

–স্যার আপনি দাঁড়িয়ে না থেকে কক্ষে এসে বসুন। আপনার সাথে আমার কয়টা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। সেগুলো শুনে আমাকে বাধিত করুন। মুনতাসিম বিলম্ব করল না গম্ভীর মুখশ্রী করে বসলো। মেহেভীন শান্ত কণ্ঠে বলল,

–আপনার বাবাকে বিয়েটা পেছাতে বলুন। আমার একটু সময়ের প্রয়োজন। আপনি তো সবকিছুই জানেন। সবকিছু জানার পরে-ও মায়ের সাথে তাল কেন মেলাচ্ছেন?

–বাচ্চাদের পড়াশোনার দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই। মেহেভীন হতভম্ব হয়ে গেল। মুহুর্তের মধ্যে মেজাজ উত্তপ্ত হয়ে গেল। সে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। আর মানুষটা তাকে নিয়ে মজা লুটছে! মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই কিছু বাক্য কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল।

“আমারে হারাইতে দিয়েন না ম্যাডাম। আমার মতো মায়া করে কেউ আপানারে চাইবে না। কথা গুলোর মধ্যে কত-শত আকুলতা দেখতে পেল মেহেভীন। মায়ায় জড়ানো কণ্ঠস্বর মেহেভীনের ভেতরে নাড়া দিয়ে উঠল। মেহেভীনের আঁখিযুগল মুনতাসিমের দিকে স্থির হয়ে আছে। কতদিন পরে মুনতাসিম তাকে আদুরে মাখা কণ্ঠে ম্যাডাম বলে ডাকলো!

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

উত্তপ্ত মেজাজ টগবগে মস্তিষ্ক রাগান্বিত চেহারার সামনে ঘৃণিত মুখশ্রী দেখে সমস্ত শরীর জ্বলে উঠল। ক্রোধের চোয়াল শক্ত হয়ে এল মুনতাসিমের। পিনপতন নিরবতা ভেঙে, সে সামনে থাকা নিকৃষ্ট মানুষটার দু’গাল চেপে ধরে হুংকার ছেড়ে বলল,

–তোর সাহস কি করে হয় আমার গার্ডদের খু’ন করার! তোকে আমার জ্যা’ন্ত পুঁ’তে ফেলতে ইচ্ছে করছে। শুধু মাত্র আব্বার জন্য তোর মতো জা’নো’য়া’র’কে বাঁচিয়ে রেখেছি। এতদিন আমাকে খু’ন করতে চেয়েছিস সবকিছু জানেও চুপ থেকেছি৷ কিন্তু এখন তুই মেহেভীনের দিকে নজর দিয়েছিস। আমি তোকে শেষ বারের মতো সাবধান করছি। মেহেভীনের ছায়ার পাশেও যেন তোর ছায়া না দেখি। যদি আমার কথার অবাধ্য হয়েছিস। আল্লাহর কসম করে বলছি তোকে খু’ন করতে দু’বার ভাবব না। মুনতাসিমের কথায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠল ব্যক্তিটি। একদলা থুতু মুনতাসিমের মুখে ফেলতে যাবে। তখনই মুনতাসিম তার মুখটা মাটির দিকে বাঁকিয়ে ধরলো। থুতু গুলো গিয়ে ব্যক্তিটির পায়ে ওপরে পড়লো। প্রতিশোধের নেশা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে দ্বিগুন ভাবে প্রকোপ হচ্ছে। কাল বৈশাখী ঝড়ের ন্যায় নিজের শক্তি প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বরাবরের ন্যায় সে ব্যর্থ হচ্ছে, সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–তুই আমার ভালোবাসার মানুষের থেকে আমাকে আলাদা করেছিস। আমি তোকে তোর ভালোবাসার মানুষের সাথে সুখ থাকতে দিব। আমি যেভাবে না পাওয়ার দহনে পুড়ছি তোকেও সেভাবে পোড়াব। তবেই আমার শান্তি মিলবে। যখন তুই হারাবি তখন বুঝবি হারানোর যন্ত্রনা ঠিক কতটা। আমার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোকে অভিশাপ দিতেই থাকবে। তুই কোনোদিন সুখী হতে পারবি না।

–আমি যদি অন্যায় করে থাকি, তাহলে আমার বিধাতা আমাকে শাস্তি দিবেন। আমার বিধাতা যদি আমায় দুঃখ দিয়ে খুশি হন। তার খুশিতেই আমার খুশি তোর মতো জা’নো’য়া’রে’র কথা আমার ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। আমি তোর মতো কাপুরষ নই যে একজনকে ভালোবেসে আরেকজনকে ব্যাবহার করব। তারপর ব্যবহার শেষে ছুঁড়ে ফেলে দিব। তুই তো বাবা নামের কলঙ্ক তোর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তুই যেমন নষ্ট পুরুষ তেমনই নিকৃষ্ট বাবা। তুই বাবা শব্দ টাকেও কলঙ্কিত করে দিয়েছিস। তোর আসল চেহারা সবার সামনে প্রকাশ পেলে সবাই তোকে ইট-পাথর নিক্ষেপ করে মা’র’বে। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না। যেদিন আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবে। সেদিন আব্বা ও তোকে বাঁচাতে পারব না।

–কাপুরুষের মতো আমাকে ধরে রেখেছিস কেন? তোর বুকে সৎ সাহস থাকলে আমাকে ছেড়ে দিয়ে দেখা। ব্যক্তিটির কথায় মুনতাসিম তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল ফ্লোরে। ব্যক্তিটি ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে অদ্ভুত ভাবে হাসতে লাগলো। আঁখিযুগল দিয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। ভেতর টা হাহাকারে ভরে গিয়েছে। সমস্ত শরীর জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। সে উঠে দাঁড়াল রক্তিম আঁখিযুগল গুলো স্থির হয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে বলল,

–কি করবি কর? মুনতাসিমের কথায় ব্যক্তিটির মুখশ্রীতে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল। সে মলিনতার ছোঁয়ায় মাখা কণ্ঠে বলল,

–তোকে পোড়ালে শান্তি পাব না। যাকে পোড়ালে তোকে রক্তাক্ত করে দিতে পারব। আমি তাকেই পোড়াব পেয়েও হারানোর যন্ত্রনা কতটা সেটা তোকে প্রতিটি মুহুর্তে অনুভব করাব। মৃত মানুষ হারানোর চেয়ে জীবিত মানুষ হারানোর যন্ত্রনা কতটা পোড়ায় যেটা তোকে উপলব্ধি করাব। তোদের বিয়ের দিন কবুল বলার পর, মেহেভীন তোর গৃহ পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারল না। তার আগেই মেহেভীন শরীর টা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় কালো পিচ ঢালাই করা পথে লুটিয়ে পড়ে থাকলো। তখন তোর অনুভূতি কেমন হবে?ভয়ংকর ভাবে মুনতাসিমের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। ললাটে চিন্তার ভাজ পড়লো। মুনতাসিম শান্ত দৃষ্টিতে ব্যক্তিটির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের শান্ত দৃষ্টি ব্যক্তিটিকে আরো উত্তপ্ত করে দিল।

–আমাকে নষ্ট বলেছিস না। এই নষ্টামি যদি তোর মেহেভীনের সাথে করি। কথা গুলো বলার সাথে সাথে ব্যক্তিটির গ’লা ছু’টি দিয়ে কে’টে দিল মুনতাসিম। এতক্ষণ ধরে ছু’টি আসার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। গলায় আঘাত পেতেই গ’লা মুরগীর মতো ছটফট করতে লাগলো ব্যক্তিটি। মুনতাসিম তার পাশে বসে দারুন হেসে বলল,

–আপনার যাত্রা শুভ হোক মুনতাসিম কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। এরপর থেকে কোনো কিছু বলার আগে ভেবেচিন্তে বলবেন। আপনি আমার বাবার ভালোবাসার মানুষ তাই মৃত্যুর আগে একটু সন্মান করে দিলাম। প্রসঙ্গ যখন মুনতাসিমের ভালোবাসা মানুষ। তখন মুনতাসিম ভয়ংকর রকমের পাষাণ। আমার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে কেউ কিছু বললে আমি অমানুষ হয়ে উঠি। আর একটা অমানুষ কি কি করতে পারে। সেই সম্পর্কে তোকে ধারণা দিতে হবে না। আমাকে উত্তপ্ত করার উপহার তোকে দিয়ে গেলাম। উত্তপ্ততা বেশি প্রকোপ হতে দিস না। তাহলে মাটির ওপরে না থেকে মাটির নিচে থাকবি। ব্যক্তিটি কিছু বলতে চাইল হাত বাড়িয়ে মুনতাসিমকে স্পর্শ করতে চাইল। কিন্তু তার শক্তি ধরা ছোঁয়ার বাহিরে গেল গেল। চারদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। আঁখিযুগল ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। হৃদয়স্পন্দনের গতিবেগ কমতে শুরু করেছে। অশ্রুসিক্ত আঁখিযুগল বন্ধ হয়ে গেল। নিথর দেহটা মাটিতে পড়ে থাকলো। তাইয়ান গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–এভাবে থাকলে উনি মারা যাবেন স্যার। আমাদের দ্রুত উনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আপনার বাবা জানলে গভীর ভাবে আহত হবেন। আপনি এতটা নিষ্ঠুর হইয়েন স্যার। আপনার এমন পাষাণ রুপই না আবার মেহেভীন ম্যাডামকে আপনার বাবার চোখে বি’ষ বানিয়ে দেয়।

–তোমাকে এসব নিয়ে এত ভাবতে হবে না তাইয়ান। আমি এখন কি করব না করব সেটা তোমার থেকে অনুমতি নিয়ে করতে হবে!

–স্যরি স্যার।

–আমি এতটাও গুরুতর ভাবে আঘাত করেনি। সাময়িক ভাবে জ্ঞান হারিয়েছে। ডক্টর ডেকে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ না হওয়া অবধি তাকে চেয়ারের সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখবে। বেশি বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা করলে উল্টা করে ঝুলিয়ে রাখবে। আর একে কে সাহায্য করছে খুঁজে বের করো। সে যদি একবার আমার হাতে পড়েছে জীবিত বাঁচতে পারবে না। মুনতাসিমের কথা গুলো কর্ণকুহরে আসতেই তাইয়ানের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। সুপ্ত অনুভূতি গুলো বিষাদের কালো মেঘে ঢাকা পড়ে গেল। তাইয়ানের সমস্ত মুখশ্রীতের আঁধার ঘনিয়ে এল। তা মুনতাসিমের দৃষ্টি এড়ালো না। মুনতাসিমের তাইয়ানের দৃষ্টির আড়ালেই রহস্যময় হাসিতে মেতে উঠল। সে দেখত চায় তাইয়ান কতদিন লুকোচুরির খেলা খেলতে পারে। তাইয়ান দোটানায় প্রতিটি মুহুর্ত পুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে যাচ্ছে। তাইয়ানের অসহায় মাখা মুখশ্রী মুনতাসিমকে শান্তি দেয়। সে দেখতে চায় তাইয়ানের ভালোবাসা তার প্রতি কতটা প্রখর। সে কতদিন দু’দিক এভাবে সামলাতে পারে। কথা গুলো ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মুনতাসিম।

রাইমা বেগম কক্ষে এসেই ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। সমস্ত মুখশ্রীতে রক্তিম বর্ন ছড়িয়ে পড়েছে। হাসোজ্জল মুখশ্রী টা মুহুর্তের মধ্যে ক্রোধে ছেয়ে গিয়েছে। মেহেভীন বিস্ময় নয়নে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মায়ের ক্রোধের কারন সে খুঁজে পাচ্ছে না। ভ্রু যুগল কুঁচকে মায়ের রক্তিম মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করছে। মায়ের নিরবতা মেহেভীনকে ভিষণ বিরক্ত করে তুলেছে। নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না মেহেভীন। বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলল,

–কি হয়েছে, আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?

–মুনতাসিমকে তুই কি বলেছিস? যে এতটা তাড়াহুড়ো করে চলে গেল কেন?

–আমি তাকে কিছুই বলিনি। তার একটা ফোন আসলো আর সে চলে গেল।

–মিথ্যা কথা বলছিস?

–তুমি ভালো করেই জানো মা। আমি মিথ্যা কথা বলি না। তোমার বিশ্বাস না হলে তুমি তাকে ফোন দিয়ে বলো। আমি তার সাথে কোনো রুপ বাজে আচরণ করেছি কি না।

–মুনতাসিম তোকে কি বলে গেল?

–আমি তাকে কয়টা দিন বিয়ে পেছাতে বললাম। সে আমাকে বলল সেটা সম্ভব নয়। আমাদের আড়ালে কিছু গোপন তিক্ততা আছে। সেগুলো সামনে আসলে পরিস্থিতি ভয়ংকর রুপ নিবে। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির সাথে আমি একা লড়াই করতে পারব না। আমি নাকি সামনে বড় ধরনের ধাক্কা খাব। সেই ধাক্কা খেয়ে যেন পড়ে না যাই সেজন্য সে আমার শক্তি হয়ে আমার পেছনে দাঁড়াতে চায়।

–আমার ছেলে টাকে ভিষণ ভালো লাগে। কি সুন্দর করে কথা বলে কেউ তার সাথে পাঁচ মিনিট ভালো করে কথা বললে, তার কথার মাথায় মায়ায় আঁটকে যাবে।

–তুমি আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য এত তাড়াহুড়ো কেন করছ আম্মু? কোনোভাবে আব্বুকে তুমি খু’ন করোনি তো আম্মু? রাইমা বেগম বিস্ময় নয়নে মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মায়ের চোখের ভাষা উপলব্ধি করতে পেরে মেহেভীন মস্তক নুইয়ে নিল। রাইমা বেগম কণ্ঠে গম্ভীরতা এনে বলল,

–আমি তোর মা তোর ক্লায়েন্ট না। বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে তুই আমাকে একটার পর একটা জেরা করেই যাচ্ছিস। একজন মা তার সন্তানের কখনো খারাপ চাইবে না। আমিও তার ব্যতিক্রম নয়। যেদিন আমি থাকব না সেদিন বুঝতে পারবি মা কি জিনিস ছিল।

–আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি মা।

–তুই মুনতাসিমকে খানিকটা অবহেলা আর অনেকটা অসম্মান দিয়েছিস। বিয়ের পরে এমন কোনো কাজ করিস না। যে ব্যবহারের জন্য আমাদের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে স্বামীকে সন্মান করার চেষ্টা করবি। একটা মেয়ের পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন কে জানিস? তার স্বামী! অবাক হচ্ছিস অবাক হবার কিছু নেই। তুই জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারবি। তোর জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যতগুলো মানুষ আসবে। তারা সবাই একটা সময়ের পরে জীবন থেকে চলে যাবে। কিন্তু স্বামী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোর সাথে থেকে যাবে। সেই স্বামীকে দুঃখ দেওয়ার মতো দুঃসাহস আর করিস না মেহেভীন। মুনতাসিমের মতো ছেলে সবার ভাগ্যে জুটে না। আমি যতদূর চিনেছি মুনতাসিম খাঁটি সোনা। অনেক সময় মানুষের দেখায় ভুল থাকে। যদি কখনো মুনতাসিম পরিবর্তন হয়ে যায়। তোকে প্রতিনিয়ত আঘাত করতেই থাকে। তখন যদি আমি পৃথিবীতে না থাকি, তবে তুই কেয়ামতের আগ পর্যন্ত আমাকে অভিশাপ করতেই থাকবি। একজন সন্তানের দোয়া আল্লাহ তায়ালা দ্রুত কবুল করে নেন। তোকে বিয়ে করতে আমি বাধ্য করছি। হঠাৎ করে যদি তোর জীবনটা নষ্ট হয়ে যায়। তাহলে তার দায় সম্পূর্ণ আমার। তুই যতটুকু দুঃখ পাবি তার থেকে দ্বিগুন দুঃখ পাবার যোগ্য হব আমি। তোর বদদোয়ায় শাস্তির মাত্রা প্রকোপ পাবে। আমি জানিনা মৃত্যুর পরবর্তী জীবন কেমন হবে। তবে জীবনে যে পাপ গুলো করেছি। আমার জন্য অধিকতর ভয়াবহ হবে। আর যদি মনে করিস মা আমাকে সবচেয়ে ভালো কিছু দিয়ে গিয়েছে। তাহলে আমার জন্য দোয়া করিস। তোর দোয়ায় অন্তত কিছুটা হলে-ও শান্তি পাব। জীবনের এপর্যায়ে এসে মনে হবে মা আমার জন্য ভালো করেছে। নয়তো বা মনে হবে মা আমার জন্য খারাপ করেছে। যার সমাধান একটাই হবে বদদোয়া নয়তো বা ভালোবাসার দোয়া। তোর জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তোকে সামনের দিকে এগিয়ে দিলাম। ভবিষ্যতে খারাপ কিছু হলে কি করবি সেটার সমাধান ও বলে গেলাম। তোমার জীবন সুন্দর ও সুখময় হোক। মায়ের কথায় বাকরূদ্ধ হয়ে গেল মেহভীন। শব্দরা ভেতর থেকে না আসার পণ করেছে। অনুভূতিরা জোট বেঁধে পালিয়েছে। এই কথা গুলোর উত্তর দেওয়ার ভাষা জানা নেই মেহেভীনের। সে নিশ্চুপ রইল। রাইমা বেগম খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। তখনই মেহেভীনের নজরে পরিচিত মানুষের মুখশ্রী ভেসে উঠল। মেহেভীন খপ করে মায়ের হাত থেকে খবরের কাগজটা কেঁড়ে দিল। তা দেখে রাইমা বেগম কিছুটা আঁতকে উঠল। মেহেভীন গভীর মনোযোগ দিয়ে লেখা গুলো পড়তে শুরু করল। লেখাগুলো পড়ার সময় মেহেভীনের শিরা-উপশিরা কেঁপে কেঁপে উঠছে। হাত-পা শীতল হয়ে আসছে। মনের অজান্তেই মানুষটার জন্য ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। অনুভূতিরা আজ শূন্য হয়ে গিয়েছে। আহত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ছবিটির দিকে দৃষ্টিপাত করে রাখালো মেহেভীন।

–মাহতাব আংকেল খু’ন হয়েছে! তার মতো সহজ সরল লোককে কে মারলো?

–কে সে? তুই কি তাকে চিনিস?

–আমি চিনব না আংকেল খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমাকে অনেকটা ভালোবাসা দিয়েছে। এই মানুষটার সম্পূর্ণ জীবন মানুষের প্রতারণা আর অবহেলা পেতে পেতে শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার না ভিষণ কষ্ট হচ্ছে আম্মু মানুষ এতটা খারাপ কিভাবে হয়!

–তার পরিবার কেস করেনি?

–আংকেল তো বিয়ে করেনি। শুনেছি আংকেল একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। কিন্তু আতংকেলের বেস্ট ফ্রেন্ড আংকেলের ভালোবাসার মানুষকে কলঙ্কিত করে বিয়ে করেছে। আংকেল মেয়েটাকে এতটাই ভালোবাসতো যে আর দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। আংকেলের কাছে তার ভালোবাসার মানুষটা ছাড়া নাকি সব নারী বিষাক্ত লাগে।

–তারপর সেই মেয়ে তোর আংকেলের কাছে ফিরতে চায়নি?

–চেয়েছিল কিন্তু আংকেল গ্রহণ করেনি। আংকেলের বেস্ট ফ্রেন্ড তার ভালোবাসার মানুষকে ঘুমিয়ে ঔষধ খাইয়ে ছিল ।তারপর সেই মেয়ের সাথে রাত্রী যাপন করে। পরের দিন সকাল বেলা পরিকল্পনা মাফিক সেই মেয়ের ঘর থেকে আংকেলের বেস্ট ফ্রেন্ড বের হয়। সমস্ত এলাকাবাসী তাদের দিকে জু’তা ছুড়ে মারে। আশ্রাব্য ভাষায় গা’লা’গা’লি করতে থাকে এলাকায় মিটিং বসে, সেখানে সিদ্ধান্ত হয়। তাদের দু’জনকে বিয়ে দেওয়া হবে। মেয়েটা নাকি সকলের পা জড়িয়ে ধরে কান্না করেছিল। সে এসব বিষয়ে কিছুই জানতো না সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। কিন্তু এলাকাবাসী তার কথা শুনেনি জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়।

–তারপর কি হলো?

–বিয়ের পরে মেয়েটা আংকেলের কাছে ফিরে এসেছিল। কিন্তু আংকেল তাকে ফিরিয়ে দেয়। তাকে বলে মানুষের জীবনে বিয়ে একবারই হয়। এমনিতেই মানুষ তাকে কটু কথা শোনাতে দ্বিধাবোধ করছে না। বিয়ের পরে সংসার ছাড়লে লোকে তাকে বাঁচতে দিবে না। একটা সুস্থ পরিবেশে তার সাথে সংসার করতে দিবে না। বিধাতা তার সাথে হয়তো তার জোড়া লিখেনি তাই তাদের মিলন হলো না। আংকেলের শেষ কথা ছিল, তুমি ভালো থেকো সুস্নিগ্ধা। ভালোবাসলেই যে পেতে হবে এর কোনো মানে নেই। ভালোবাসার মানুষের ভালো দেখেও ভালো থাকা যায়। আমার বন্ধু তোমাকে ভিষণ ভালোবাসে। সে তোমাকে অনেক ভালো রাখবে। সে তোমাকে ভালোবাসে বলেই এত ছলনা করল। আমি তাকে কোনোদিন ক্ষমা করব না। তবে তোমার খারাপ আমি চাইব না। পৃথিবীর সমস্ত সুখ তোমার হোক মায়াময়ী। তোমার ঐ সুখের মধ্যে আমি শান্তিতে বসবাস করব। যেদিন তোমার জীবনে সুখ ফুরাবে। তোমার জীবনে দুঃখের আবির্ভাব ঘটবে। তোমার হারানোর সুখের সাথে সাথে আমিও বিলীন হয়ে যাব। যে সংসার তৈরি হয়ে গিয়েছে। সে সংসার তুমি নষ্ট করো না। আমি পরপারে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। এই জনমে পাইনি তো কি হয়েছে। মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে তোমাকে আমার করে নেওয়ার জন্য বিধাতার কাছে আর্জি করব। এতটুকু বলেই আংকেল চলে যায়। তারপর আর দু’জনের দেখা মেলেনি। জীবন কি অদ্ভুত তাই না মা একজন বিয়ের করে সংসার করছে। আর একজন তাকে না পাওয়ার বিরহে আস্ত একটা জীবন গোটা একা কাটিয়ে দিল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সুখানুভূতিকে ঢেকে নিয়েছে বিষাদের কালো মেঘের দল। একটু টুকরো সুখকে দুঃখ তার চাদরে মুড়িয়ে নিয়েছে। আনন্দিত হৃদয়ের ভেতর থেকে আনন্দ শুষে নিয়ে একরাশ তিক্ততা বিরাজ করছে। মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ পরিবেশটা মুহুর্তের মাঝে কালো মেঘের ন্যায় আঁধারে রুপ নিল। চারদিকে নিস্তব্ধতার মেলা বসেছে। অনুভূতিরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। শব্দ গুলো আজ ছন্দ হারিয়েছে। কিছু তিক্ত সত্য বুকের ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। ভেতরটা যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে প্রতিটি মুহুর্তে ম’র’ছে। মনের শহরের অলিতে-গলিতে হাহাকার ছড়িয়ে পড়েছে। পিনপতন নিরবতা ভেঙে রাইমা বেগম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,

–তোর আংকেলের সাথে তো ভিষণ খারাপ হয়েছে। একটা সত্যি কথা কি জানিস মেহেভীন? ভালো মানুষের সাথেই সব সময় খারাপ হয়। আর ভালো মানুষ গুলোও বেশিদিন বাঁচে না। বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই মেহেভীনের মুখশ্রীতে মলিনতার ছায়া দেখা গেল। বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠল। আজকাল ভেতরটা ভিষণ খালি খালি লাগে। বাবার শূন্যতায় ভেতরটা জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যায়।

–তাহলে আমার বাবাও কি ভালো মানুষ ছিল মা?

–হয়তো ছিল, কে জানে শেষ বয়সে এসে এমন হয়ে গেল কেন? সে না বদলালে আমরা জীবনে আরো কয়টা সুন্দর বসন্ত পার করতে পারতাম। এসব কথা ভেবে নিজেকে দুর্বল করে তুলিস না। এই কয়টা দিন নিজের যত্ন নিবি না হলে পরের ঘরে গেলে সবাই বলবে, আমরা মেয়েকে ঠিকমতো খেতে দেইনি। কথা গুলো বলেই রাইমা বেগম স্থান ত্যাগ করল। মেহেভীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার কাছে চলে গেল। এক ফালি রৌদ্রের আলো এসে মেহেভীনের মুখশ্রীতে আঁচড়ে পড়লো। মেহেভীন পরম আবেশে আঁখিযুগল বন্ধ করে রাখল। সমস্ত মুগ্ধতা যেন মেহেভীনের মুখশ্রীতে এসে ধরা দিয়েছে। মনে পড়ে গেল সেই খোলা জানালার দক্ষিণের কথা, পাশে দৃষ্টিপাত করতেই হতাশ হলো মেহেভীন। কিন্তু সুন্দর স্মৃতি মুখশ্রীর সামনে ভেসে উঠল। কত-শত স্নিগ্ধ অনুভূতির সাক্ষী সেই বাড়ির জানালাটা। সেই জানালা পাশ থেকেই দেখা মিলেছিল একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষের। যার আগা থেকে মাথা পর্যন্ত দুষ্টিতে ভরা। যার প্রধান কাজই ছিল তাকে বিরক্ত করা। সেই মুহুর্ত গুলো যেন চোখের পলকে হাওয়ার সাথে মিলিয়ে গেল। প্রতিদিন প্রভাতের আলো ফুটতেই দেখা হবে না, খোলা জানালার দক্ষিণের পাশে অবস্থান করা মানুষটা এসেছে কি না। চন্দ্রা আলোকিত রজনীতে মানুষটার সাথে সুখানুভূতি আদান-প্রদান করা হবে না। মানুষটার অপেক্ষায় চাতক পাখি ন্যায় প্রতীক্ষা করতে হবে না৷ কথা গুলো ভাবতেই তিক্ত অনুভূতি এসে মনে হানা দিল।

জাফর ইকবাল সুন্দরী রমনীর বুকে আস্তরণে শয়িত ছিলেন। তার সুন্দর মুহুর্ত বিষাদ করে দিয়ে কবাটে কেউ কড়া নাড়ে। জাফর ইকবালের মুখশ্রীতে বিরক্তির ছাপ ফুঠে উঠল। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। সে কড়া ভাবে গৃহের প্রতিটি মানুষের কর্ণ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। তার ব্যক্তিগত মুহুর্তে কেউ যেন তাকে বাধাগ্রস্ত না করে। গায়ে বস্ত্র পরিধান করে কবাট খুলে দিতেই পরিচিত মুখশ্রী ভেসে উঠল। সে অধরের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল,

–সায়ান যে, কি তথ্য নিয়ে এসেছ তুমি?

–আপনার জন্য একটা গরম খবর আছে স্যার। সেজন্য আপনার অন্তরঙ্গ মুহুর্তে বাঁধা প্রদান করতে বাধ্য হলাম। আমার ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন। মন্ত্রী সাহেব বিয়ে করছেন আমাদের হাতে একটা দারুন সুযোগ এসেছে। এই সুযোগটা যদি লুফে নিতে না পারি। তাহলে সারাজীবন আমাদের মুনতাসিমের পেছনে পড়ে থাকতে হবে। বিয়ের অনুষ্ঠানে শতশত মানুষ থাকবে। এত এত মানুষের মধ্যে যদি মুনতাসিমের সমস্ত কায়া ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেওয়া যায়। কারো বাবার ক্ষমতা হবে না আমাদের ধরার। সায়ানের কথায় জাফর ইকবালের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল। সে হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–মানুষের দুর্বলতা তৈরি হতে দেওয়ার জন্য আমাদের সময় নেওয়া উচিৎ। শক্ত মানুষকে এত সহজে ভাঙা যাবে না। আমাদের মেইন পয়েন্ট ধরে দুর্বল জায়গায় আঘাত করতে হবে। যেন ভাঙলে এমন ভাবে ভাঙে কায়ার সমস্ত হাড়গুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। সেই ভাঙা কায়া নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করার ক্ষমতা সারাজীবনের জন্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রেম মানুষকে বাঁচতে শেখায় আবার প্রেমই মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর করে। অতিরিক্ত ভালোবাসার পরে ,মানুষটা হুট করে জীবন থেকে মর্মান্তিক ভাবে হারিয়ে গেলে বিপরীতে পক্ষের মানুষটা আঘাত ছাড়াই রক্তাক্ত হয়ে যায়। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ক্ষয় হয়ে যায়। সবার প্রিয় মুনতাসিম আরো একটু গভীর প্রেমে মজুক। সুযোগ বুঝে আমরাও তার প্রেয়সীকে লুটে নিব। মুনতাসিম এমনিতেই ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। কথা গুলো কর্ণপাত হতেই সায়ান মৃদু হেসে চলে গেল। জাফর ইকবাল গানের সুর তুলতে তুলতে আস্তরনে এসে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে মেতে উঠলেন।

চারদিক সুখ সুখ অনুভূতিতে মেতে উঠেছে। মুনতাসিম আর মেহেভীনের বিয়ের বার্তা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গিয়েছে। সবাই মেহেভীনকে দেখতে আসছে। মেহেভীনের ভিষণ বিরক্ত লাগছে। একই এলাকার মানুষ ছোট থেকেই দেখে আসছে। সেই মানুষকে নতুন করে দেখার কি আছে? নাকি তার রুপ নতুন করে রুপ বদল করেছে। যার জন্য সবাই তাকে দলে দলে দেখতে আসছে। মেহেভীনের বাবার খোঁজ পড়লে সবাইকে জানানো হয়েছে। মেহেভীনের নানি ভিষণ অসুস্থ সেজন্য তাকে সেখানে থাকতে হচ্ছে, বিয়ের দিন এসে উপস্থিত হবেন। সবাই বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে। কারন ফরিদ রহমান এর আগেও বহু বার মেহেভীনের নানা-নানির দেখা শোনা করেছে। গৃহ ভর্তি মেহমান গিজগিজ করছে। কালকে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে হবে। সমস্ত গৃহে ফুল আর মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। মেহেভীন আর মুনতাসিমের মতো নতুন ভাবে সেজেছে দু’টো গৃহ। রিয়াদ চৌধুরী ছেলের বিয়ের কোনো ত্রুটি রাখেনি। রাজকীয় ভাবে বিয়ের আয়োজন করেছেন। চৌধুরী গৃহের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই মুগ্ধতা এসে আঁখিযুগলে ধরা দিচ্ছে। যে কেউ দেখলে বলবে, কোনো এক রাজ্যের রাজার বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। রাজপ্রাসাদের ন্যায় গৃহটা রঙবেরঙের ফুল আলো দিয়ে সেজে উঠেছে। তার সৌন্দর্য দিয়ে মানুষের হৃদয়কে আকৃষ্ট করতে বাধ্য করছে। বিবাহের দু’দিন আগেই এত মানুষের আনাগোনা এত এত কোলাহল! বিয়ের দিন কি অবস্থা হবে? গোলাপ আর রজনীগন্ধার সুবাস সবাইকে মাতাল করে তুলছে। চারিদিকে কাজের তোরজোর চলছে। মেহেভীন নিজের কক্ষে বসেছিল। একদল মহিলা তাকে ঘিরে রেখেছে। ভালোমন্দ আলোচনা করছে। সে মন্ত্রীর বউ হবে এটা তাদের কাছে বিশাল ব্যাপার। সবার এত বাড়াবাড়ি মেহেভীনের মেজাজ উত্তপ্ত করে দিচ্ছে। সে একটু নির্জন স্থান খোঁজয় ব্যস্ত তবে আজ নির্জনতা পথ হারিয়েছে। কিছুতেই সে মেহেভীনের সামনে ধরা দিচ্ছে না। তখনই মুঠোফোনটা জানান দেয়। সে কারো বার্তা নিয়ে এসেছে। ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো মুনতাসিম মেসেজ করেছে।

–কি করছেন ম্যাডাম?

–আপাতত একটু নির্জন জায়গায় খুঁজছি। এত কোলাহল এত মানুষজন মস্তকে ব্যথা তুলে দিয়েছে।

–আমি আসব? আমি আসলেই নির্জনতা চলে আসবে।

–তার আগে বলুন, সেদিন ভূতের মতো গায়েব হয়ে গেলেন আর খোঁজ নিলেন না কেন? সেদিন কোথায় গিয়ে গিলেন?

–কারো মধ্যে বউ বউ ভাব পাচ্ছি।

–কেন বউ হবার মতো ভাব আমার নেই?

–এত সুন্দর একটা মেয়ে! আপনি কেন সব সময় রেগে রেগে কথা বলবেন? আপনি সব সময় হেসে হেসে কথা বলবেন। আপনার মুখশ্রীতে ক্রোধ মানায় না ম্যাডাম। আপনি হাসলে আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে।

–ফ্লাট করছেন আমার সাথে?

–না বউকে বোঝাচ্ছি। তাকে হাসলে ভিষণ সুন্দর লাগে, তার মুখের এক টুকরো হাসি আমার অশান্ত হৃদয়ের প্রশান্তির হাওয়া। মুনতাসিমের কথায় অদ্ভুত ভাবে মেহেভীনের সমস্ত কায়া কেঁপে উঠল। হৃদয়স্পন্দনের ক্রিয়া অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেল। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি! সেই অনুভূতির সাথে পরিচিত নয় মেহেভীন। নতুন এক অনুভূতির সন্ধান পেল মেহেভীন। সে কণ্ঠে স্নিগ্ধতা নিয়ে এসে বলল,

–আপনি ঘুমাবেন না? সকালে যখন আপনাকে হলুদ মাখাবে একটা ছবি দিয়েন। আমি দেখব আপনাকে কেমন দেখায়?

–ভালো না দেখালে বিয়ে করবেন না?

–আমি বলেছি সে কথা! আমি কি আপনাকে দেখতে চাইতে পারি না।

–বহু আগেই চোখ দিয়ে আমার সর্বনাশ করে রেখেছেন। যতটুকু সন্মান আছে বাকিটুকু সর্বনাশ করার ধান্দা। মুনতাসিমের কথায় মনের অজান্তেই লজ্জা পেল মেহেভীন। সেটা প্রকাশ না করে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আচ্ছা অসভ্য লোক তো আপনি! আপনার মেসেজেই রিপ্লাই-ই আর করব না। মেসেজটা পাঠিয়েই মুঠোফোনটা বালিশের নিচে রেখে দিল। মেহেভীনের কান্ড দেখে সবাই মিটমিট করে হাসছে। কেউ কেউ রসিকতা শুরু করে দিয়েছে। এত আনন্দ এত সুখ সইবে তো? কথা গুলো ভাবতেই মেহেভীনের বুকটা ভারি হয়ে আসলো। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ বসে থেকে সবাই কথা শুনতে লাগলো।

চারিদিকে প্রভাতের আলো ফুটতে গিয়েছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকের দিনটা একটু অন্য রকম। রজনীর শেষ প্রহর থেকে রান্নার কার্যক্রম শুরু হয়ে গিয়েছে। রান্নার টুংটাং ধ্বনি কর্ণকুহরে এসে বাড়ি খাচ্ছে। বাচ্চারা হৈ হুল্লোড় করছে খেলাধূলা করে সমস্ত গৃহ মাতিয়ে রেখেছে। আগের তুলনায় দ্বিগুন মেহমান এসে বাড়ি ভরে গিয়েছে। মুনতাসিমকে শুভ্র লুঙ্গি আর সেন্ডো গেঞ্জি পরিধান করিয়ে কাঁধের ওপরে লাল গামছা পড়িয়ে ছাদে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হলুদের আয়োজন ছাদেই করা হয়েছে। নিচে করার মতো অবস্থা নেই। তাই রিয়াদ চৌধুরী ছাদ টাকেই বেছে নিয়েছে। মাশরাফি, শেহনাজ, তাহিয়া, রিনি, আরো কিছু বয়স্ক মহিলারা যাচ্ছে মুনতাসিমের সাথে। শেহনাজ গান গাইছে শেহনাজের সাথে সুর মেলাচ্ছে মাশরাফি। তাহিয়া চুপচাপ তাদের সঙ্গ দিচ্ছে। বৃদ্ধারা বলছে,

–আজকালকার পোলা মাইয়ারা গানের তালে তালে হলুদ লাগায়। আর আমাগো সময় কত আনন্দ কইরা গীত গাওয়া হইতো। সে-সব আজকাল উইঠা গেছে। তোরা গান বাজনা যা করার করবি। আমরা গীত গাইয়া আগে হলুদ লাগামু। তারপর বাচ্চারা হলুদ দিবি কি কইছি বুঝছোস তোরা? শেহনাজ একটা বৃদ্ধার গাল টেনে বলল,

–সমস্যা নেই দাদি যতরকমের গীত আছে সব গাইবে। তোমাদের হলুদ লাগনো শেষ হলে, আমরা নাচ গান করে হলুদ অনুষ্ঠান শুরু করব। মুনতাসিমকে ছাদে নিয়ে এসে বসানো হলো। বৃদ্ধারা গীত গাইছে আর হলুন দিচ্ছে অদ্ভুত ভাবে মুনতাসিমের ভিষণ লজ্জা লাগছে। সমস্ত মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। বৃদ্ধাদের পালা শেষ হলে সবাই আস্তে আস্তে হলুদ মাখিয়ে দিল। মুনতাসিমের সাথে সবাই হলুদ মাখায় মেতে উঠল। শেহনাজ আর মাশরাফি গানের তালে তালে নাচছে। তাদের সাথে একদল ছেলেমেয়ে এসে যোগদান করল।শীতের সকালের ঠান্ডা পানি কায়াতে পড়তেই সমস্ত কায়া কেঁপে উঠল। কলসি দিয়ে মুনতাসিমের মস্তকে পানি ঢালা হচ্ছে। হলুদের কাজ সম্পূর্ণ হলেই মুনতাসিম নিজে নেমে আসলো। কক্ষের এসে ভালোভাবে গোসল করে বস্ত্র পরিধান করে নিল। তার ছোঁয়ানো হলুদ নিয়ে সবাই মেহেভীনের গৃহের উদ্দেশ্য বের হবে। মেহেভীনকে হলুন শাড়ি পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সমস্ত কায়াতে তাজা সতেজ গাঁদা ফুলের অলঙ্কার বানিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই মেহেভীনকে দেখে দোয়া করে দিচ্ছে। রাইমা বেগম মেয়ের দিকে মুগ্ধ নয়নে দৃষ্টিপাত করে আছেন। তার মেয়েকে পরীর থেকে কোনো অংশে কম লাগছে না। মেয়ের হাতে কামড়ে দিতে ইচ্ছে করছে, যেন তার মেয়ের সৌন্দর্যে কারো নজর না লাগে। মেহেভীনকে হলুদের আয়োজনের মাঝখানে বসিয়ে দেওয়া হলো। সেখানে নানা রকমের মিষ্টি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রঙবেরঙের ফল কে’টে সুন্দর সুন্দর ডিজাইন করে সাজিয়ে রেখেছে। সবাই আসছে মেহেভীনকে মিষ্টি খাইয়ে দিয়ে দোয়া করে টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছে। মেহেভীন অসহায় দৃষ্টিতে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। এতএত মানুষের আনাগোনা তবুও তার ভেতরটা খালি খালি লাগছে। ভিষণ করে বাবার করে মনে পড়ছে। বাবার কথা স্মরণ হতেই ভেতরটা ভিষণ জ্বালা পোড়া করছে। আঁখিযুগলের কার্ণিশে অশ্রুকণা এসে জমাট বাঁধল। এর মধ্যেই হৈচৈ শোনা গেল হলুদ এসে গিয়েছে। শেহনাজ এসেই মেহেভীনের পাশে বসলো। মেহেভীনের ডান হাত ধরে বলল,

–আমি ভাবির ডান হাতে মেহেদী দিয়ে দিব। তোরা কে বাম হাতে দিয়ে দিবি ঠিক কর। একদম আমাদের সাথে ঝামেলা করতে আসবি না। তাহলে ভাইকে বলে সবার অবস্থা খারাপ করে ফেলব। মুহুর্তের মধ্যে মেহেদী দেওয়া নিয়ে ঝামেলা বেঁধে গেল। হলুদ বড়দের হাতে দেওয়া হয়ে গিয়েছে। তাদের ঝামেলার মাঝেই একজন বলল,

–অবিবাহিত মেয়ে গুলো সইরা যাও। আমরা হলুদ দিয়া চইলা যাই। তারপর তোমরা সবাই মিইলা মেন্দি পড়াইয়া দিও। মহিলাটির কথায় কয়েকজন সরে গেল। মেহেভীনকে হলুদ পড়িয়ে দিয়ে সবাই সরে যেতেই সবাই মেহেভীনের হাত নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেল। অবশেষে চারজন মিলে ঠিক করল তারাই মেহেদী পড়াবে। শেহনাজ খুব সুন্দর করে মেহেদী পড়াতে পারে। সবাই মেহেভীনকে মেহেদী পড়িয়ে দিচ্ছে। মেহেভীন চুপচাপ বসে বসে দেখছে, মুখ দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারন করছে না। রাইমা বেগম মেয়েকে ভরসা দিতে একটু পর পর এসে দেখে যাচ্ছে। মেহেভীনের দু’হাতের মাঝখানে মুনতাসিমের নাম লিখে দেওয়া হয়েছে। মেহেদী পড়ানো শেষ করে, সবাই নিজদের মতো করে আড্ডায় মেতে উঠেছে। এত সুখ এত আনন্দ তবুও কোথাও জানি, মেহেভীনের ভেতরটা শূন্যতা অনুভব করছে। অদ্ভুত ভাবে আঁখিযুগল দিয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। এমন অনুভূতি সে আগে কখনো অনুভব করেনি। তবে আজ কেনো তার এত কষ্ট হচ্ছে? প্রশ্নের গভীরে গিয়েও উত্তর পাইনি সে। মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩৪
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

খুলবে না জানালা ফিরবে না রমনী। হবে না খোলা জানালার দক্ষিণে প্রনয়নের আদান-প্রদান। পড়ে থাকবে বাড়ি বন্ধ হবে জানালা। ফিরবে না সেই মধুর কিছু মুহূর্ত। ধুলাবালির মতো শহরে বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে কিছু স্মৃতি। এত স্নিগ্ধ অনুভূতি রেখে যাওয়া এই বাড়িটা যে ভিষণ পোড়াবে। কাউকে দেখার জন্য আঁখিযুগল খোলা জানালার দক্ষিণে দৃষ্টিপাত করবে না। কেউ দুষ্টু হেসে বলবে না এভাবে তাকাবেন না ম্যাডাম প্রেমে পড়ে যাবেন। শহরের ধুলাবালির সাথেও প্রনয়নের আদান-প্রদান হয়েছে। সেজন্য এই শহরের প্রতি এত টান এত মোহ এতা মায়া! যেতে মন সায় দেয় না তবুও কিছু তিক্ত অনুভূতি নিয়ে যেতে হয়৷ বুক ভরা চাপা কষ্ট নিয়ে মেহেভীন গৃহ ত্যাগ করল। অনুভূতিরা আজ শূন্যহীন হয়ে গিয়েছে। শব্দগুলো যেন আজ বাক হারা। বিষন্ন রজনীর সাথে বিষাদের ছেয়ে গিয়েছে মন। বিষাদিনী কি জানে তার বিষাদগ্রস্ত মন কারো হৃদয়ে অস্থিরতার ঝড় তুলে দেয়। অশান্ত সমুদ্রের মতো ভেতরটা উথাল পাথাল করতে থাকে মন গহীনে। কিছু তিক্ত অনুভূতি আর বুকভরা বিষাদ নিয়ে শহর ত্যাগ করল মেহেভীন।

তাহিয়া ড্রয়িং রুমে বসেছিল তখনই নজর কারা রমনী প্রবেশ করে চৌধুরী বাড়িতে। তাহিয়া ভ্রুযুগল কুঁচকে রমনীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। দুধে আলতা গায়ের রঙের সাথে কালো রঙের শাড়ি যেন নিজ দায়িত্ব রমনীর সৌন্দর্যের বর্ণনা দিচ্ছে। রিনি তাহিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–এটা রিয়াদ আংকেলের বাড়ি? তাহিয়া উৎসুক হয়ে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল,

–জি।

–আমি রিনি আমি আমার বাবা আংকেলের বন্ধু। আংকেল আমাকে এখানে আসতে বলেছে। আপনি একটু আংকেলকে ডেকে দিবেন। তখনই রিয়াদ চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ দাঁড়ে এসে হাজির হন। মুখশ্রীতে চিৎকার হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,

–মামনি তুমি এসে গিয়েছ? আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। একটু বাগানের দিকে গিয়েছিলাম। সেজন্য তোমার সাথে দেখা হয়নি। তোমার আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো মামনি?

–আমার আসতে কোনো সমস্যা হয়নি আংকেল। আমি প্রচুর ক্লান্ত আমাকে আমার কক্ষটা দেখিয়ে দিন। আমি একটু বিশ্রাম করতে চাই। রিয়াদ চৌধুরী গার্ডকে ডেকে রিনিকে নিয়ে যেতে বলল। রিনি নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে কক্ষের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে হালকা খাবার খাওয়ার জন্য আসলো। তখনও তাহিয়া বসে বসে নখ ঘষছিল। রিনিকে আড়চোখে পরখ করে নিল। রিনি এসে তাহিয়ার পাশে বসলো। কিছুটা অহংকার নিয়েই বলল,

–বাড়িতে এত সুন্দর সুন্দর মেয়ে থাকতেও বাহির থেকে মেয়ে নিয়ে আসা হয়, চৌধুরীর ছেলের মন জয় করার জন্য! রিনির কথায় জ্বলে উঠল তাহিয়া। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–তুমি কি কথা গুলো আমাকে বললে রিনি আপু?

–তোমাকেই তো বললাম। জাল পেপার বানিয়েও তো মুনতাসিমকে নিজের আয়ত্ত করতে পারলে না। এই রুপ দিয়ে কি করবে? বিদেশে গিয়ে সাদা বিলাতী ধরে নাও।

–তুমি মনে হয় খুব পারবে মুনতাসিম ভাইয়াকে বশ করতে?

–আমার কাছে এটা কোনো বিষয়ই না। আমি যে পথ ধরে হেঁটে যাই। সেই পথের ধুলাবালি গুলোও আমার প্রেম পড়তে বাধ্য হয়। আর মুনতাসিম তো সাধারণ একজন মানুষ মাত্র। রিনির কথায় তাহিয়ার অধরের কোণে হাসি ফুটে উঠল। দীর্ঘ দিন পর তার প্রাণ খুলে হাসতে ইচ্ছে করছে। তবুও সে নিজেকে দমিয়ে নিল। মনে মনে তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘একবার যাও মুনতাসিম ভাইয়ের কাছে তারপরে বুঝবে। মুনতাসিম ভাই কি জিনিস। মুনতাসিম ভাইকে ভালোবাসার মতো অপরাধ করেছিলাম। ভালোবাসার উপহার স্বরুপ পেয়েছি যন্ত্রনা আর আঘাত। দীর্ঘ দেড় মাস আমাকে হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকতে হয়েছে। ভাইয়াকে ভোলোর জন্য কত নির্ঘুম রজনী আমি পার করেছি। চাইলেই কি এত বছর ধরে মনের মধ্যে রাখা মানুষটাকে ভোলা যায়! আঁখিযুগলের কোণে অশ্রুকণা এসে হানা দিল। মুখশ্রীতে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,

–তুমি মুনতাসিম ভাইয়াকে বশ করতে পারলে, আমি তোমার কথা মতো বিদেশি বিলাতী ধরে বিয়ে করে নিব। আমার থেকে তোমার রুপ কমই আছে। যেখানে আমার মতো মেয়েকে মুনতাসিম ভাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। সেখানে তুমি কোন কালনাগিনী। কথা গুলো বলেই শব্দ করে হেসে উঠল। রিনি রক্তিম চোখে তাহিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে।

–তোমার যোগ্যতা যেখানে মুনতাসিম তোমাকে সেখানেই বসিয়ে দিয়েছে। আমি আমার যোগ্যতা তোমাকে দেখিয়ে দিব। এই যে আমি এখন তোমার পাশে বসে আছি। একটু পরে আমার স্থান হবে মুনতাসিমের কক্ষে। মুনতাসিম নিজে আমায় আপন করে নিবে। আমাকে ছাড়া সে এক মুহূর্তে চলতে পারবে না। তুমি শুধু অপেক্ষা করো আর আমার কেরামতি দেখো। তাহিয়া বুঝল রিয়াদ চৌধুরী রিনিকে সবকিছু বুঝিয়েই নিয়ে এসেছে। তাহিয়া মলিন গলায় বলল,

–মুনতাসিম ভাইয়া এক নারীরে আসক্ত। এক নারীতে আসক্ত পুরুষ গুলো ভিষণ ভয়ংকর রকমের সুন্দর হয় জানো তো। যেমন তাদের ভালোবাসার প্রখরতা বেশি হয়। তেমনই নিজের প্রিয় মানুষকে আপন করে পাবার আকুলতা টাও দৃঢ় হয়। তোমার মতো রাস্তার মেয়েকে মুনতাসিম ভাই তার জুতা পরিষ্কার করার জন্যও রাখবে না। রিনি নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। রাগান্বিত হয়ে তাহিয়ার গালে প্রহার করতে যাবে। তখনই তাহিয়া হাত ধরে ফেলে। দু’জনকে এমন অবস্থায় দেখে চমকে উঠল রিয়াদ চৌধুরী! রিনির পছন্দের খাবার কেনার জন্য বাহিরে গিয়েছিল তিনি। রিনি রিয়াদ চৌধুরীকে দেখে কৃত্রিম কান্না দেখিয়ে বলল,

–আংকেল জানেন এই মেয়েটা আমাকে রাস্তার মেয়ে বলছে। রিয়াদ চৌধুরী গম্ভীর দৃষ্টিতে তাহিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাহিয়ার মুখশ্রীতে কোনো অনুশোচনার ছাপ নেই। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিনির বলা শেষ হলে তাহিয়া চিৎকার করে বলল,

–আপনার বন্ধু মেয়ে যদি আমাকে বিদেশি বিলাতী ধরে বিয়ে করতে বলে, তাহলে আমি কেন তাকে রাস্তার মেয়ে বলতে পারব না? একমাত্র রাস্তার মেয়ের মুখেই এমন বিশ্রী বাক্য উচ্চারিত হতে পারে। আমি নিজের প্রিয়তমকে পাবার জন্য জালিয়াতি করেছি। কিন্তু কাউকে এমন বিশ্রী ভাষা প্রয়োগ করিনি মামা। এবার তার হয়ে যদি আপনি আমাকে কথা শোনাতে আসেন। তাহলে আমি মাকে বলব কালই যেন এ বাড়ি ছাড়েন তিনি। কথা গুলো বলে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল তাহিয়া। রিয়াদ চৌধুরী রিনিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–তুমি তাহিয়াকে সত্যি এসব বলেছ?

–আপনার কি মনে হয় আংকেল? আমি এসব বিশ্রী ভাষা ব্যবহার করতে পারি!

–আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পেরেছি। তুমি কষ্ট পেও না আমি কালকে তাহিয়াকে বুঝিয়ে বলব। সে যেন আর তোমার সাথে বাজে ব্যবহার না করে, তাকে দিয়ে তোমার কাছে মাফ চাইয়ে নিব। কথা গুলো বলেই রিনিকে খাবার জন্য টেবিলে নিয়ে গেল। অদ্ভুত বিষয় রিনি গৃহে প্রবেশ করেছে অনেকক্ষণ যাবৎ। কেউ তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলো না। এতে অপমানে রিনির মুখশ্রী চুপসে গেল।

মুনতাসিমের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল। ধমনীর বুকে মানসিক শান্তির ওপরে কিছু নেই। মানসিক শান্তি থাকলে পুরো দুনিয়ায় শান্তি থাকে। মুনতাসিমের সমস্ত শরীরে অনুভূতিরা আনন্দে মিছিল করছে। মনের শহরের অলিতে-গলিতে গর্জন করে বলছে। এবার নিজের প্রেয়সীকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে ফেলার সময় এসে গিয়েছে। যে চাদর সরানো ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো নেই। কিন্তু কিছু তিক্ততা খারাপ লাগলেও ভয়ংকর রকমের সত্যি। রজনী কি মুনতাসিমকে বলেনি? এই হাসি এই আনন্দ তোমার জন্য নয়। তোমাকে কেবল দুঃখ দেওয়ার জন্য আপন মানুষরা ভালোবেসেছে। সে আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরেছিল। সে কি জেনেছিল তা মুহুর্তে মধ্যে বিষাদে রুপ নিবে। নিজের কক্ষে প্রবেশ করতেই চারদিকে আঁধারে আচ্ছন্ন দেখে মস্তিস্ক টগবগ করে উঠল। তার বিনা অনুমতিতে কে তার কক্ষ প্রবেশ করেছে? কার এত বড় স্পর্ধা মুনতাসিমের কক্ষে প্রবেশ করার দুঃসাহস দেখিয়েছে! তার বাবা আসলে তো কখনো আলো নেভায় না। কক্ষে প্রবেশ করতেই একজোড়া কোমল হাত মুনতাসিমের গলা জড়িয়ে ধরল। মুনতাসিম বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। তার কক্ষে কোনো নারী প্রবেশ করেছে। কে সে যে তার কক্ষে আসার অনুমতি পেল? মুনতাসিমের ভাবনার মানেই রমনীকে ভয়ংকর রকমের কাজ করে বসলো। সে মুনতাসিমের গালে চুমু খেয়েছে। মুনতাসিম যেন এবার নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গেল। সে দ্রুত ফোনের আলো জ্বালিয়ে কক্ষের আলো জ্বালালো। নববধূর মতো রুপ নিয়েছে রিনি। মুনতাসিমের জায়গান অন্য কোনো পুরুষ থাকলে, রিনিতেই আঁটকে যেত। রিনির প্রেম পড়েনি এমন পুরুষ খুব কমই আছে। রিনির মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। মুনতাসিনের আঁখিযুগলে দৃষ্টিপাত করার সাহস হচ্ছে না। লজ্জা মস্তক নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুনতাসিম শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে রিনির গালে ক’ষে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল। সাথে সাথে রিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। রিনির কর্ন দিয়ে উত্তপ্ত ধোঁয়া বের হচ্ছে। সমস্ত ধরনী অন্ধকার হয়ে আসছে তার কাছে। মুনতাসিমের রক্তাক্ত আঁখিযুগলের দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়তেই অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল তার। ভয়ে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। মুনতাসিম হুংকার ছেড়ে সবাইকে ডাকলো। এতক্ষণ কারো সাড়াশব্দ ছিল না। মুনতাসিমের এক ডাকেই নিস্তব্ধ বাড়িটা মুহূর্তের জাগ্রত হয়ে গেল। কাল বৈশাখী ঝড়ের গতিতে সবাই মুনতাসিমের কক্ষে এসে হাজির হলো। সবাইকে দেখে মুনতাসিম বজ্র কণ্ঠে বলল,

–এই মেয়ে কে? এই মেয়ের এত সাহস হলো কি করে আমার বাড়িতে এসে আমার কক্ষে প্রবেশ করে, আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার! এই মেয়েকে এত সাহস কে দিয়েছে আমি জানতে চাই? মুনতাসিমের হুংকারে কেঁপে উঠল চৌধুরী বাড়ির প্রতি দেওয়াল। ভয়ে সবাই জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাহিয়া মুখ চেপে হাসছে এই মুহূর্তটার জন্যই সে অপেক্ষা করছিল। সবার মুখশ্রীতে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। মেয়ে টাকে মেরে না ফেলে আবার মুনতাসিম। রিনি লজ্জায় মাটির সাথে মিশে থাকলো। সে মুনতাসিমকে যতটা সহজ ভেবেছিল মুনতাসিম যে তার বিপরীত চিত্র হবে। সেটা রিনির ভাবনার বাহিরে ছিল। রিনিকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে, রিয়াদ চৌধুরী অস্থির হয়ে তাকে তুলে দাঁড় করালো। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–তুমি কোন সাহসে ওর গায়ে হাত তুললে?

–ও কোন সাহস আমার কক্ষে এল? ওর এত বড় কলিজা কে দিয়েছে? আমার কক্ষে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে চুমুর খাওয়ার! আজকে আমি ওর কলিজা টেনে বের করে দেখব। তার কলিজা ছিঁ’ড়ে এনে ভেজে কু’কু’র’কে দিয়ে খাওয়াব।

–মুনতাসিম সাবধানে কথা বলো। আমি তোমার বাবা সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কন্ঠস্বর নিম্ন করে কথা বলো!

–যেখানে আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সেখানে আমি চুপ থাকব। আপনি এই কথা বলছেন। এই মেয়েকে এখানো খু’ন না করে বাঁচিয়ে রেখেছি। এটাই তো তার ভাগ্য ভালো। আমার সামনে থেকে একে নিয়ে যান না হলে আপনার সামনেই খু’ন করে ফেলব।

–দু’দিন পরে যে মেয়ে তোমার অর্ধাঙ্গিনী হবে। তাকে সন্মান দিয়ে কথা বলো। রিনিকে নিয়ে আর একটা বাজে মন্তব্য করলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। এত সুন্দর একটা মেয়ে কিসের কমতি আছে তার কাছে!

–আমার মনের রাণী ছাড়া সব নারী আমার কাছে বিষাক্ত। আমি মেহেভীনকে ভালোবাসি। আমি বিয়ে করলে মেহেভীন কেই করব৷ আমি মেহেভীনের না তো কারো না। মুনতাসিমের একটা বাক্যে পুরো পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। যে ছেলে বিয়ের কথা বললেই লজ্জা পেত। সেই ছেলে বিয়ে ভালোবাসার কথা বলছে! তবে আঘাতটা কি একটু বেশিই করা হয়ে গেল? রিয়াদ চৌধুরী নিজেকে দমিয়ে রাখলেন না। মুনতাসিমের থেকে দ্বিগুন গর্জন করে বলল,

–আমার বাড়ির বউ হিসেবে আমি রিনি কেই মেনে নিব। রিনি ছাড়া অন্য কাউকে আমার বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিব না। আর মেহেভীনকে তো একদমই নয়। কারন আমি মেহেভীনকে পছন্দ করি না।

–কেন মেহেভীনকে পছন্দ করেন না? কিসের কমতি আছে মেহেভীনের মধ্যে।

–তাকে অপছন্দ করার কোনো কারন নেই। তাকে একটা কারনেই পছন্দ করি না। কারন সে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে। নিজের বুকে পাথর চাপা রেখেছি। তবু ও তোমায় কষ্ট পেতে দেয়নি। সেই ছেলেকে দু’দিনের একটা মেয়ে এসে এক টার পর একটা আঘাত করে যাবে। আমি সেটা বাবা হয়ে সহ্য করব। তোমার চরিত্র নিয়ে এত ভয় সে-ও তো তোমায় চরিত্রহীন প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। তাহিয়া, রিনি যদি ছাড়া না পায় তবে সে পেল কি করে?

–আপনি আমার কষ্টের কথা বলছেন আব্বা। সেটা তো আপনি নিজেও দ্বিতীয় বিয়ে করে আমাকে দিয়েছেন৷ চরিত্রহীন প্রমাণ করার চেষ্টা আপনিও করলেন। আপনি ছাড়া পেলে সে কেন পাবে না? সবাই আমার এত ভালো চাইলো। ভালো চাইতে চাইতে আমার ভালো থাকাই কেড়ে নিল। রিয়াদ চৌধুরী নিস্তব্ধ হয়ে গেল মুখশ্রী থেকে বাক্য গুলো হারিয়ে গিয়েছে। মস্তিষ্ক ঝিম মেরে গিয়েছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি ক্ষয় হচ্ছে এক মুহুর্তে বিলম্ব করল না। দ্রুত রিনিকে নিয়ে কোনো রকমে কক্ষ ত্যাগ করল। ধীরে ধীরে কক্ষ একদম ফাঁকা হয়ে গেল। মুনতাসিম দেওয়ালে হাত ঠেকিয়ে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। শরীরের মধ্যে ভিষণ খারাপ লাগছে। আঁখিযুগল অস্বাভাবিক ভাবে রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। নির্ঘুম রজনী আর নিস্তব্ধ কক্ষ মুনতাসিমের হাহাকারের সাক্ষী হয়ে রইল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩৫
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

মনের সাড়া মস্তিষ্কের পিছুটান এ কেমন লড়াই! জীর্ণ ক্ষত হৃদে বাস্তবতার যুদ্ধে আমি ভিষণ অসহায়। বিষাদে ছেয়ে গিয়েছে মনের আনাচে-কানাচেতে। রিয়াদ চৌধুরী রজনীর মধ্যে প্রহরে ভিষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে খবর কর্ণকুহরে আসতেই সমস্ত মন মস্তিষ্ক তিক্ত হয়ে উঠল। অপরাধবোধ ভেতর টা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সে বাবার কাছে মুখশ্রী দেখাবে কি করে? কালকের কথা স্মরন করতেই বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠল। সে বাবাকে কখনোই আঘাত করতে চায়নি। বাবার অসহায়ত্ব মাখা মুখশ্রী আঁখিযুগলের সামনে বারবার ভেসে উঠছে। ভেতরে অসহনীয় জ্বালাপোড়া করছে। সে মনস্থির করে নিল বাবাকে কষ্ট নিয়ে নিজের সুখ চাইবে না। সবাই তো পূর্ণতা খোঁজে সে না হাহাকার খুঁজে নিবে। মুনতাসিম নিজেকে শক্ত করে নিল। এতটা শক্ত হয়ে নিল যেন বাহির থেকে বোঝা না যায়। এই মানুষ টাই ভেতর থেকে একদম চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিম তার বাবার কক্ষে এসে বসলো। রিয়াদ চৌধুরী হাতে তখনও স্যালাইন চলছে। বাবাকে এমন অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখে যন্ত্রনা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। অস্বাভাবিক ভাবে ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মুনতাসিম গম্ভীর দৃষ্টিতে সাহেলা চৌধুরীর দিকে দৃষ্টিপাত করল। সাহেলা চৌধুরী বিলম্ব করল না মুখশ্রীতে আঁধার নিয়ে এসে কক্ষ ত্যাগ করল। রিয়াদ চৌধুরী ললাটের ওপরে এক হাতে রেখে স্থির হয়ে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। মুনতাসিম মলিন গলায় বলল,

–স্যরি আব্বা আমি আপনাকে আঘাত করতে চাইনি। আপনি তো জানেন রাগের মাথায় আমি নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকি না। আপনি ছোট বেলা থেকে আমার কত-শত ভুল মাফ করে দিয়েছেন। শেষ বারের মতো আমাকে মাফ করা যায় না আব্বা। আপনাকে দুঃখ দিয়ে যে আমি শান্তি পাচ্ছি না। প্রতিটি মুহুর্তে জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। আপনি চিন্তা করে নিজের ক্ষতি করবেন না। এই ধরনীর বুকে আপন বলতে আমার আপনিই আছেন। আপনার কিছু হয়ে গেলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাব আব্বা। আমাকে শাস্তি দিন মা’রু’ন তবুও নিজেকে কষ্ট দিবেন না। আপনার কষ্ট আমাকে ভিষণ বাজে ভাবে পোড়ায়। আপনাকে কষ্ট দিয়ে সুখ কিনতে চাইনা আব্বা। আমি শুধু চাই আপনি ভালো থাকেন সুস্থ থাকেন। আপনার ভালো থাকার জন্য যা করতে বলবেন। আমি সবকিছু কিছু করতে রাজি আছি। আপনি শুধু আমাকে ক্ষমা করে দিন। রিয়াদ চৌধুরী আগের ন্যায় স্থির হয়ে আছেন। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–মেহেভীনকে ভুলে যেতে হবে। যদি পারো তবেই আমায় আব্বা ডেকো, না হলে তোমার মুখে যেন আব্বা ডাক না শুনি।

–ভুলে যাব আব্বা খুব শীঘ্রই ভুলে যাব। আর কখনো আপনার কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়াব না। তবুও আপনি চিন্তা করে নিজেকে অসুস্থ করে ফেলবেন না৷ কথা গুলো বলার সময় মুনতাসিমের মনে হলো কেউ তার ভেতরটা রক্তাক্ত করে দিয়ে যাচ্ছে । ভালোবাসায় এতটা যন্ত্রনা কেন? ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যেতে হবে কথা গুলো বলতেও যে দম বন্ধ হয়ে আসছে। বুকের বা পাশে চিনচিন করে ব্যথা করছে। হাহাকার বয়ে যাচ্ছে মনের শহরের অলিতে-গলিতে। ভাগ্যে যদি না-ই বা থাকবে তবে দেখা হয়েছিল কেন তার সাথে! মৃত মানুষ হারানোর চেয়ে জীবিত মানুষ হারানোর যন্ত্রণা বেশি। সে যে বলল মেহেভীনকে ভুলে যাবে। মেহেভীনকে কি ভোলা তার জন্য এতটাই সহজ হবে? তার অস্তিত্বের সাথে মিশে গিয়েছে মেহেভীন। নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যাওয়া যায়! বুকভাঙা আর্তনাদ নিয়ে বাবার কক্ষ ত্যাগ করল মুনতাসিম। যে বাবা সারাজীবন দুঃখ কিনে তাকে সুখ দিয়েছে। সেই বাবাকে কষ্ট দিয়ে সে সারাজীবন কিভাবে সুখী হবে? এক জীবনে সব পেয়ে গেলে আক্ষেপ করবে কি নিয়ে? সে না হয় প্রিয় মানুষকে না পাওয়ার আক্ষেপ করে জীবন পার করে দিবে।

মুনতাসিম চলে যেতেই সাহেলা চৌধুরী রাগান্বিত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করল। মুখশ্রীতে তার বিরক্তি ফুটে উঠেছে। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–এটা আপনি কি করলেন? আপনি ছেলেটার ভালো চাইতে গিয়ে খারাপ করে ফেলছেন। আপনি শুধু নিজের ভালোর কথাই ভেবে গেলেন। বাবা হয়েও ছেলের মনের খবর টা রাখলেন না। এভাবে নিজ হাতে ছেলেকে শেষ করে দিচ্ছেন। দু’দিন পরে ছেলের লা’শ সামনে দিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতে হবে। সাহেলার কথায় অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল রিয়াদ চৌধুরী। ক্রোধে চোয়াল শক্ত হয়ে এল তার। সে রাগান্বিত হয়ে সাহেলা বলে হুংকার ছাড়ল। সাহেলা তেজী কন্ঠে বলল,

–আপনার ছেলের এক কথায় আপনার সব মুখের কথা হারিয়ে গেল। আল্লাহ তায়ালা দারুন একটা জিনিস তৈরি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কথায় থাকে না আমরা থাকতে মূল্য বুঝি না। কিন্তু হারিয়ে গেলে সেটা খুঁজি তখন বুঝে ও লাভ হয় না। কারন ততক্ষণে মানুষটা চিরতরে আমাদের জীবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আমি তার সৎ মা হয়ে বলছি মুনতাসিম একটা জিনিয়াস। যাকে আল্লাহ নিখুঁত ভাবে তৈরি করেছে। যার মনে না আছে হিংসা আর আছে প্রতিশোধের নেশা। সে এমনটা একটা মানুষ যাকে দেখলে রাস্তার ধুলাবালি গুলোও তাকে ভালোবেসে ফেলে। তার ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতিও তাকে সন্মান জানায়। সে আপনাকে দ্বিতীয় বিয়ের খোঁটা দিয়েছে। এতেই আপনার বাবার ভালোবাসা উবে গেল। একটা বার ভাবলেন না যে ছেলের মা মারা গিয়েছে। সেই ছেলেকে সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার জন্য কিছু সময় দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। ছেলে বড় হচ্ছিল নিজেই সংসারে মায়ের অভাবটা বুঝে যেত। কিন্তু আপনি তাকে সময় দেননি। তার মা মারা যাবার পরপরই আমাকে করেছেন বিয়ে! একটা বার ভাবলেন না আমি আপনার সন্তানকে আদৌও ভালোবাসব কি না। যে মেয়ের নিজের সন্তান হয়নি। সেই মেয়ে কিভাবে অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তান মনে করে ভালোবাসবে? মুনতাসিমই বা নতুন মানুষকে কিভাবে গ্রহণ করবে। মেহেভীনের কথা বলছেন। প্রাচীন কাল থেকে মেয়েদের বদনাম একটু বেশিই। যে মেয়েটা আপনার ছেলের জন্য নিজের জন্মদাতা পিতার কাছে র’ক্ষি’তা উপাধি পেল। জেনেশুনে বিবাহিত পুরুষের ঘর ভাঙে আরো কত-শত আঘাত পেল তার বাবার কাছে থেকে। দোষ না করে-ও দোষী হয়েছে মেয়েটা। কিন্তু যার জন্য আপনার ছেলেকে মেয়েটা এতটা কষ্ট দিল। সেই তাহিয়ার কোনো বিচার আপনি করলেন না! পারিবারিক সমস্যাটা না খুব গোপন একটা অসুখ। সেই অসুখে যারা পড়েছে তারা জানে মৃত্যু কতটা সহজ তাদের কাছে। একদিকে পারিবারিক সমস্যা আরেক দিকে প্রিয় মানুষের প্রতারণা। মেয়েটা ভেতর থেকে ভেঙেচুরে গিয়েছিল। সহ্য ক্ষমতা কমে গিয়েছিল দু’টো পরিস্থিতি একসাথে নিতে পারেনি। যার ফল স্বরূপ জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলল। সে ছেলে হলে সাতগুন মাফ হয়ে যেত কিন্তু সে মেয়ে তার ক্ষমা নেই মানে কোনো ক্ষমা নেই। ভাববেন না আমি মুনতাসিমকে ভালোবেসে কথা গুলো বলেছি। আমি একজন মা আর মেয়ে হয়ে কথা গুলো বললাম। আজ মুনতাসিমের জায়গায় আমার ছেলে-মেয়ে থাকলে আমি যুদ্ধ করে শুরু করে দিতাম। সে আমার ছেলে নয় বলেই মুখে কথা গুলো বললাম। আর একটা মেয়ে সমাজের কাছে কতটা বিষাক্ত সেটা তুলে ধরলাম। আপনার ছেলেকে কষ্ট দিয়ে মেয়েটা যে ভালো আছে। এমনটা কিন্তু নয় আপনার ছেলের থেকে দশগুন মেয়েটা পুড়ছে। আপনার হাতে যদি সময় থাকে খোঁজ নিয়ে দেখবেন। কথা গুলো বলে থামলেন সাহেলা চৌধুরী। রিয়াদ চৌধুরী তখনো নিরুত্তর রইল। সাহেলা চৌধুরী কথা গুলো যেন কর্ণগোচর করেননি। সাহেলা চৌধুরী বিরক্ত হয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলন। রিয়াদ চৌধুরী বুক ভারি করা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

শব্দরা আজ বাক্য হারিয়েছে। সুখরা হারিয়ে দুঃখে পরিনত হয়েছে। কথা বলার মেয়েটা চুপ থাকা শিখে গিয়েছে। হাসি গুলো আজ মলিনতায় ঢেকে গিয়েছে। ছন্দরা আজ সুর হারিয়েছে। চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে বসে আছে মেহেভীন। এই প্রথম বাড়ি আসলো কিন্তু বাড়িতে বাবা নেই। বাবা ছাড়া পুরো বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার জীবন টা তো এমন হবার কথা ছিল না। তবে জীবন কেন তাকে বিষাদের মোড়ে নিয়ে এসে দাঁড়া করালো! মেয়ের নিরবতা রাইমা বেগমকে ভিষণ কষ্ট দিচ্ছে। সে মেহেভীনের মাথায় তেল দিয়ে খাবার নিয়ে আসতে গিয়েছে। শান্ত নদীর ন্যায় মেয়েটা তার শান্ত হয়ে গিয়েছে। কথায় কথায় আর ঝগড়া করছে না। মুখে মুখে তর্ক করছে না কথা বলা মানুষ যখন চুপ হয়ে যায়। তখন সহ্য ক্ষমতা ভেতর থেকে ক্ষয় হয়ে আসে। মেহেভীনের অবস্থা দেখে রাইমা বেগম ভেতর থেকে শক্তি হারাচ্ছে। মেহেভীনের সামনে এক লোকমা খাবার মুখের সামনে ধরে বলল,

–মুনতাসিম এসেছিল। এবার মেহেভীন মলিন দৃষ্টিতে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করল। রাইমা বেগম শান্ত কণ্ঠে বলল,

–তোকে বিয়ে করতে চায়। আমি বলেছি তাকে আমার পছন্দ সে পরিবার নিয়ে আসলে তবেই বিয়ে দিব। আমি কি ভুল কিছু বলে ফেলছি মেহেভীন?

–আমি এখন বিয়ে করতে চাই না মা। আমার একটু সময়ের প্রয়োজন। দিন দিন তুমি এতটা পাষাণ হয়ে যাচ্ছে কিভাবে? এই সময়ে বিয়ের কথা চিন্তা করলে!

–সবাই যদি ভেঙে পড়ে শক্তি যোগাবে কে? মায়েদের নিজের কথা ভাবার সময় নেই। তারা শুধু চায় তাদের সন্তান কিভাবে ভালো থাকবে। আজ তোর বাবা চলে গিয়েছে। কাল যদি আমি চলে যাই তখন তোর কি হবে? আমি কার ভরসায় তোকে রেখে যাব? এই দুনিয়া ভিষণ নিষ্ঠুর রে মেহেভীন। একজন শক্ত পুরুষ ছাড়া মেয়েরা বরাবরই অসহায় কথাটা তিক্ত হলে-ও বাস্তব সত্য।

–বাবার খু’নি কে সামনে না আসা পর্যন্ত বিয়ে করব না। আমাকে এতটুকু সময় দাও। তোমাকে ছাড়া নিঃস্ব হয়ে যাব। পাষাণের মতো কথা বলা বন্ধ করো মা। তোমার মেয়ে এতটাও দুর্বল নয় সে নিজের টা নিজে ঠিক করে খেতে পারবে। রাইমা বেগম কিছু বলার আগেই রহমান আর আরিয়ান প্রবেশ করল কক্ষের মধ্যে। মেহেভীনকে দেখে চমৎকার হাসি উপহার দিলেন। রহমান হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–খাওয়ার সময় এসে বিরক্ত করলাম?

–আপনারা নিজের মানুষ খাওয়ার সময় কি আর অসময়েই কি যখন ইচ্ছে তখন আসবেন। রাইমা বেগমের কথায় হাসলেন রহমান। সে কোমল কণ্ঠে বলল,

–মেহেভীন রাতে এসেছে?

–জি, থানা থেকে কোনো খবর পেলেন ভাই?

–না কোনো খবর পাইনি। তারা একটা খন্ড ও উদ্ধার করতে পারেনি। কথা গুলো কর্ণকুহরে আসতেই মা-মেয়ের মুখশ্রী মলিন হয়ে আসলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রহমান বলল,

–যে কথা বলতে আসলাম। ফরিদের শেষ ইচ্ছে ছিল মেহেভীনের সাথে আরিয়ানের বিয়ে দিবে। এখন তোমাদের বাসায় একটা ছেলের প্রয়োজন আছে। নিজের বাসায় ছেলে রেখে বাহিরে যাওয়ার চিন্তা করছ না নিশ্চই। তুমি অনুমতি দিলে ঘরোয়া ভাবে বিয়ের কাজটা শেষ করে রাখতে পারি। কেসের তদন্ত শেষ হলে তুলে নেওয়ার অনুষ্ঠান করব। রাইমা বেগম জ্বলে উঠলেন। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আপনার ছেলে আমার মেয়েকে বেচে দিতে চেয়েছিল। জেনেশুনে এমন ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে কখনোই দিব না। আপনার ছেলে স্বার্থের জন্য বিয়ের পরে আমার মেয়েকে বেচে দিতে দু’বারও ভাববে না। এমন নিকৃষ্ট ছেলের হাতে আমি আমার মেয়ে দিব না। আপনি না ভালো মানুষ ভিষণ ধর্ম ভিরু মানুষ। আপনি কোন বিবেকে এমন কথা বলতে পারলেন!

–আমি ভালো মানুষ জন্যই তোমাদের এখানে রেখেছি। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তোমাদের উচ্ছেদ করে দিতো। মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আপনারা এমন ভাবে কথা বলছেন। যেন আমাদের উচ্ছেদ করে দেওয়া খুব সহজ কাজ! আপনি বলবেন আর আমরা আপনাদের ভয়ে পালিয়ে যাব!

–বেশি কথা বলিস না মেহেভীন ফলাফল খারাপ হয়ে যাবে।

–আপনি কি ফলাফল খারাপ করবেন। আপনার ভালো মানুষির মুখোশ টেনে ছিঁড়ব আমি। আরিয়ান রাগান্বিত হয়ে মেহেভীনকে থা’প্প’ড় দিতে যাবে। তখনই মেহেভীন আরিয়ানের পু’রু’ষা’ঙ্গে লাথি মারে। এই জা’নো’য়া’রটা এই অঙ্গের জন্যই নিজেকে শক্তিশালী মনে করে। সেই শক্তি টাই যদি না থাকে, তাহলে কিভাবে শক্তির অপর প্রয়োগ করবে। আরিয়াম ব্যথায় কুঁকড়িয়ে উঠল। আগের থেকে দ্বিগুন ভয়ংকর হয়ে এগিয়ে আসতে চাইলে, রহমান ছেলেকে থামিয়ে দেয়। রাগান্বিত হয়ে বলে,

–ভালো কথায় সমাধানে আসতে চেয়েছিলাম। আরিয়ানের গায়ে হাত তুলে কাজটা ঠিক করলি না। আমি তোদের ছাড় দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন ব্যাপার টা তোরা ঘোলাটে করে ফেলছিস। আমার জমির সম্পূর্ণ ভাগ আমি নিব। তোদের মা-মেয়েকে ভাতের সাথে বি’ষ দিয়ে মে’রে দিব। কেউ টেরও পাবে না। সাধারণ মৃত্যু বলে চালিয়ে দিব জানিস তো সমাজের মানুষ আমায় কতটা ভালোবাসে। রাইমা বেগম রহমানের মুখশ্রীতে এক দলা থুতু নিক্ষেপ করল। ঘৃণায় পুরো শরীর রি রি করছে। রহমান রাগান্বিত হয়ে রাইমা বেগমের চুলে মুঠি শক্ত করে ধরলেন। রাইমা বেগম ব্যথায় কুঁকড়িয়ে উঠলেন। মেহেভীনের ভেতরে অদ্ভুত ভাবে শক্তি কাজ করতে শুরু করল৷ সে ঘরের কোণে রাখা বাঁশটা নিয়ে এসে রহমানের হাতে পরপর চারটা বাড়ি মা’র’লো। রহমান ব্যথায় হাত সরিয়ে নিল। মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,

–তোরা যাবি নাকি তোদের দু’টোকে এখানেই পুঁ’তে ফেলব। মানুষ ডাকব ডেকে তোদের ভালো মানুষের মুখোশ খুলব। বাবা নেই বলে যা ইচ্ছে খুশি করবি? আর আমরা অসহায় নারীর মতো সবকিছু মুখ বুঁজে সহ্য করে নিব। আমাদের এতটা দুর্বল ভাবার কিছু নেই। আমাদের জমি আমরা কত ফকিরকে দান করেছি। তোর মতো ফকিরকেও না কিছুটা জমি দান করব। এতে আমার জমি কবে যাবে না আমাদের আয়য়ের বরকত আল্লাহ তায়ালা নিজে বাড়িয়ে দিবেন। আরিয়ান রাগান্বিত হয়ে মেহেভীন গলা চেপে ধরলো। রাইমা বেগম আরিযানকে প্রহার করতে যাবে। তখনই রহমান রাইমা বেগমের মুখ চেপে ধরলো।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

পুরুষালি শক্তির সাথে পেরে ওঠা এতটাই সহজ! মেহেভীনকে খুব শক্ত করে ধরা হয়েছে। মেহেভীনের সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসতে শুরু করেছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। মেহেভীন পা দিয়ে আরিয়ানের পায়ে শত-শত প্রহার করেই যাচ্ছে। আরিয়ান আগের থেকে দ্বিগুন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। মেহেভীনের করুন অবস্থা দেখে রাইমা বেগম কনুই দিয়ে রহমানের পেটে প্রহার করল। সাময়িক সময়ের জন্য হাতের বাঁধন আগলা হতেই রাইমা বেগম রহমানকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। মাটি থেকে বাঁশটা তুলে আরিয়ানের মাথায় চার-পাঁচটা বাড়ি বসিয়ে দিল। ছয় বারের বেলায় আরিয়ান বাঁশটা ধরে ফেলল। সে মেহেভীনকে ছেড়ে রাইমা বেগমকে ধরতে যাবে তখনই মেহেভীন আরিয়ানকে পা বাঁধিয়ে ফেলে দিল। মেহেভীন ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়লো। রাইমা বেগমের হাত থেকে বাঁশ নিয়ে উন্মাদের মতো আরিয়ানকে প্রহার করতে লাগলো। আরিয়ানের মস্তক বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সমস্ত শরীর নিস্তেজ হয়ে আসতে শুরু করেছে। আঁখিযুগল ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এভাবে মারতে থাকলে ছেলেটা মা’রা যাবে রাইমা বেগম মেহেভীনকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে মেয়েটা আজ তার দ্বিগুন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। মেহেভীন আরিয়ানকে ফেলে রহমানের দিকে এগিয়ে গেল। বজ্রকণ্ঠে বলল,

–এই নোংরা হাত দিয়ে আমার মাকে স্পর্শ করেছিস। তোর এই নোংরা হাতের অবস্থা আমি কি করি দেখ। কথা গুলো বলেই নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে রহমানের হাতে প্রহার করল। সাথে সাথে রহমাম হৃদয়বিদারক চিৎকার দিয়ে উঠল। আরিয়ান জ্ঞান হারিয়েছে। রহমানের চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে এল। আরিয়ান আর রহমানকে এই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে সবাই কানাঘুষা শুরু করে দিল। প্রাপ্তি মা প্রানপ্রিয় স্বামী আর ছেলের করুন অবস্থা দেখে উচ্চ স্বরে কান্না করতে লাগলো। মেহেভীন আর রাইমা বেগমকে অকথ্য ভাষায় গা’লা’গা’লি করতে লাগলো। কয়েকজন প্রতিবেশীর সাহায্য নিয়ে আরিয়ান আর রহমানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। এতক্ষণে দমিয়ে রাখা সব দুর্বলতা সামনে চলে আসলো। বাড়ি ফাঁকা হতেই মেহেভীন ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো। মেহেভীনের নাক দিয়ে গ’ল’গ’ল করে রক্ত পড়ছে। তা দেখে রাইমা বেগমের বুকটা কেঁপে উঠল। ছোট বেলা থেকেই মেহেভীনের এই অসুখটা আছে। অতিরক্তি রৌদ্রে গেলে বা মাথায় বেশি চাপ লাগলেই অস্বাভাবিক ভাবে মেহেভীনের নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। আশেপাশে কেউ নেই, যে তার সাহায্য নিয়ে মেহেভীনকে নিয়ে হাসপাতালে যাবে। রাইমা বেগম ফরিদের বন্ধুকে ফোন করল কিন্তু ফরিদের বন্ধু ফোন তুলছে না। সে হয়তো রুগী দেখায় ব্যস্ত আছে। রাইমা বেগম দিশেহারা হয়ে পড়লেন। সে মেহেভীন বিছানায় শুয়ে দিয়ে বাসায় তালা লাগিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য বের হয়ে গেল। বাসা থেকে দশ মিনিট লাগে হাসপাতালে যেতে। রাইমা বেগম চল্লিশ মিনিট পর ফরিদের বন্ধুকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরল। সে মেহেভীনের অসুখ সম্পর্কে অবগত আছে। তাই এসেই চিকিৎসা শুরু করে দিলেন।

–ভাবি মেহেভীনের শরীর তো ভিষণ দুর্বল। বেশ কিছু দিন ধরে খাওয়ার অনিয়ম করছে। আপনার মেয়ে এত কিসের চিন্তা করে? এতটুকু মেয়ে চিন্তা করে করে নিজেকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে। আমি কয়টা ঔষধ লিখে দিয়েছি। আপনি ঔষধ গুলো আনিয়ে নিবেন। আর পারলে মেহেভীন কে স্যালাইন করিয়ে নিবেন। তাহলে যদি মেয়েটার দুর্বলতা একটু কমে খাবারের অনিয়ম একদম চলবে না। আর মেহেভীনের মাথায় আঘাত লাগতে দিবেন না। এভাবে শরীর থেকে রক্ত ক্ষয় হলে যেকোনো সময় মৃত্যু হতে পারে। কথা গুলো বলেই ফরিদের বন্ধু চলে গেল। রাইমা বেগম নেতিয়ে যাওয়া শরীরে মেয়ের পাশে বসলো। রবিন নামের এক ছেলেকে ফোন দিয়ে জানালো। সে যেন এসে মেহেভীনকে স্যালাইন লাগিয়ে দিয়ে যায়।

এমন ভাবে আপনাকে চাইলাম! নিয়তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, আমার সমস্ত পার্থনার উর্ধে গিয়ে যেন আপনাকে চাওয়া মৃত্যুর মতোই সুন্দর। থাকুক না কিছু ভালোবাসার অপূর্ণতা! সব ভালোবাসা পূর্ণতা পেলে জীবনের সকল স্বাদ ফুরিয়ে যাবে, ইচ্ছেদের মৃত্যু হবে। কথা গুলো ভাবতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিল মুনতাসিমের। স্নিগ্ধ আঁখিযুগল মেহেভীনের ছবির দিকে বিদ্যমান। কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই ফোনটা অফ করে দিল। সে জানে এই স্পর্শটা কার ছোট ছেলে থেকে এই স্পর্শটা তাকে আদর ভালোবাসা দিয়ে এসেছে। মুনতাসিম বাহিরের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল,

–কিছু বলবেন আব্বা?

–তুমি আমার এক কথায় নিজের ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যেতে রাজি হলে!

–আল্লাহ তায়ালা মুখ দিয়েছে বলার জন্য মুখ কি আর চুপ থাকবে আব্বা। মুখ চুপ থাকবে না তবে মন থেমে যেতে পারে। মাঝেমধ্যে হাহাকার করে উঠবে। মানুষ তো ভেতরের খবর জানবে না। ভেতরটা বোঝার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো নেই। আমি আপনাকে বলেছি মেহেভীনকে ভুলে যাব। আমি তো একবারও বলিনি আপনার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করব। আপনাকে কষ্ট দিয়ে চাইলেই আমি মেহেভীনকে বিয়ে করে সুখে সংসার করতে পারব৷ কিন্তু পরপারে যখন আপনি আমার কাছে হিসাব চাইবেন। তখন আমি কি জবাব দিব? দীর্ঘশ্বাস বলেও একটা ব্যাপার আছে। আমি চাই না আমার প্রতিটি সুখ আপনার দীর্ঘশ্বাসের কারন হোক। আমি এই জীবনে বিয়ে করব না। আপনি আমায় অনুগ্রহ করে বিয়ের কথা বলবেন না। আমি আপনার সিদ্ধান্তকে সন্মান জানিয়েছি। আমি আশা রাখছি আপনিও আমার সিদ্ধান্তকে সন্মান জানাবেন। অপূর্ণতার জীবনে পূর্ণতার ক্ষুধা মানুষকে বাঁচতে শেখায়। আমি না হয় পরিবারের পূর্ণতা দেখেই বাকি জীবন পার করে দিব। ছেলের অভিমানের ভাষা বুঝতে সময় নিল না রিয়াদ চৌধুরী। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আর আক্ষেপ?

–আমার আক্ষেপ থাকবে কেন? আমি তো স্ট্রং। আমি আবার মানুষ নাকি! আমি তো রোবট, আমার আবার কিসের ফিলিংস? কথা গুলো বলে বিলম্ব করল না। কক্ষ ছেড়ে বের হয়ে গেল। রিয়াদ চৌধুরী হতাশ হয়ে বেলকনির গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো।

রজনীর আঁধার নিজ নিয়মে ধরনীকে গ্রাস করে ফেলছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। মেহেভীনের সাথে যেন পরিবেশও মন খারাপ করেছে। কেমন বিষাদের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে আছে। শরীরের সমস্ত শক্তি ক্ষয় হয়ে কখন যে নিদ্রা দেশে তলিয়ে গিয়েছিল। সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। মেহেভীন দশ মিনিট হলো সজাগ হয়েছে। মায়ের ক্লান্ত মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আর ডাকতে ইচ্ছে করেনি। আঁখিযুগল স্থীর হয়ে আছে উপরের দিকে অশ্রুগুলো শুকিয়ে গিয়েছে। রাইমা বেগম সজাগ হয়ে মেয়েকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,

–তুই উঠে পড়েছিস?

–জা’নো’য়া’র গুলো কোথায় মা? এখনো বাহিরে আছে নাকি পুলিশ আদর করতে করতে নিয়ে গিয়েছে?

–হাসপাতালে আছে ওদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। আমি চিন্তা করছি ওরা সুস্থ হলে আমাদের কি অবস্থা হবে? এই জন্যই তোকে বলেছি তুই বিয়ে কর। তুই বিয়ে করলে আমাদের মাথার ওপরে বিশাল ছাদ তৈরি হয়ে। আমাদের পায়ের তলার মাটি শক্ত হবে। কেউ আমাদের ক্ষতি করতে আসার আগে দশবার ভাববে।

–এখনো ম’রে’নি ওরা?

–আমি তোকে কিছু বলছি শুনতে পারসনি? তোকে ঔষধ খেতে হবে। আমি খাবার তৈরি করে নিয়ে আসছি।

–তুমি নিজেও অসুস্থ মা ডক্টর দেখিয়েছো?

–তোর আলিম আংকেল এসেছিল। ঔষধ দিয়ে গিয়েছে খেয়েছি।

–মিথ্যা কেন বলছ? রাইমা বেগম উত্তর দিলেন না। উঠে রান্না ঘরে চলে গেলন। মেহেভীন হালকা করে উঠে বসলো। আশেপাশে দৃষ্টিপাত করে ফোনটা খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু কোথাও ফোনের দেখা মিলছে না। সে বুঝল তার মা সরিয়েছে। হাতের স্যালাইন প্রায় শেষ হয়েই আসছে। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মেহেভীন।

সাহেলা চৌধুরী মাশরাফিের পাশে বসেছিল। তখনই রিয়াদ চৌধুরী আছেন। রিয়াদ চৌধুরীকে দেখে মুখশ্রী কুঁচকে ফেলে সাহেলা চৌধুরী। রিয়াদ চৌধুরী দরজার কাছে থেকেই বলল,

–আমার সাথে একটু আসো তো।

–কোথায় যাবেন?

–আমার সাথে গেলেই দেখবে পাবে। কথা গুলো বলেই সাহেলা চৌধুরী নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। স্বামীর এহেন কর্মে বিস্ময় হয়ে গেলেন সাহেলা চৌধুরী। মেহেভীনের মা মেহেভীনকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে নিল। অদ্ভুত ভাবে ভেতরে ভয় কাজ করছে তার। সে নিজের জীবনের পরোয়া করে না। কিন্তু মেহেভীন তার কিছু হয়ে গেলে মেহেভীনের কি হবে? রাইমা বেগমের ভাবনার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠল। মেহেভীন মলিন কণ্ঠে বলল,

–দরজা খুলো না মা আর কাউকে বিশ্বাস করি না। এরা আসবে আর আমাদের অবস্থা দেখে মজা নিবে। রাইমা বেগম মেয়ের কথায় সম্মতি জানালো। কিন্তু তাদের বিরক্ত করতে কলিং বেল বেজেই চলেছে। রাইমা বেগম মনে সাহস নিয়ে দরজা খুলতে গেল। দরজা খুলে ভিষণ অবাক হয়ে গেল! রিয়াদ চৌধুরী হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–ভেতরে আসতে বলবেন না। রাইমা বেগম লজ্জায় পড়ে গেল। সে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল,

–ভেতরে আসুন অসময়ে আপনাদের উপস্থিতি আশা করিনি। তাই একটু অবাক হয়েছিলাম।

–মেহেভীন কোথায়? রিয়াদ চৌধুরীর কথায় রাইমা বেগমের মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। রাইমা বেগমকে নিস্তব্ধ থাকতে দেখে, রিয়াদ চৌধুরী উৎসুক দৃষ্টিতে রাইমা বেগমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তখনই মেহেভীন ধীর কণ্ঠে বলল, কে এসেছে মা? রিয়াদ চৌধুরী নিজের সাথে নিয়ে আসা জিনিস গুলো রাইমা বেগমের দিকে এগিয়ে দিল। রাইমা বেগম ভদ্রতা সুলভ সেগুলো হাতে নিল। রিয়াদ চৌধুরী মেহেভীনের কক্ষে দিকে অগ্রসর হলো। মেহেভীনের কক্ষে এসে মেহেভীন কে এমন অবস্থায় দেখে মনের অজান্তেই বুকটা হুঁ হুঁ উঠল। রিয়াদ চৌধুরীকে দেখে মেহেভীন সালাম দিল। সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। তাড়াহুড়ো করে উঠে বসতে গিয়ে হাতে টান লাগলেই মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠল। রিয়াদ চৌধুরী নরম কণ্ঠে বলল,

–এতটা ব্যস্ত হতে হবে না মা। তুমি কি অসুস্থ? মেহেভীনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাইমা বেগম বলল,

–জি, মেয়েটা আমার একটু অসুস্থ আপনারা দাঁড়িয়ে থাকবেন না বসুন। রিয়াদ চৌধুরী আর সাহেলা চৌধুরী সোফায় গিয়ে বসলো। রাইমা বেগম নাশতা নিয়ে আসতে চলে গেল। একটু পরে নাশতা হাতে ফিরল। রিয়াদ চৌধুরী হেয়ালি না করে বলল,

–আপনার বাড়ি আলা কোথায়?

–নেই ঢাকায় গিয়েছে আসতে দেরি হবে। আসলে ভিষণ আমার মা অনেক অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। সেখানে তাকে দেখার মতো কেউ নেই। তাই মেহেভীনের বাবা একমাস থাকবে। মায়ের মুখে প্রথম মিথ্যা কথা শুনে মেহেভীনের আঁখিযুগল বড় বড় হয়ে গেল।

–আমি একটা প্রস্তাব নিয়ে আসছিলাম। মেহেভীনকে আমার বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে চাই। আপনাদের অনুমতি থাকলে তবেই সামনের দিকে আগাব। এমন কথায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো মেহেভীন। বিষন্ন মুখশ্রীতে লজ্জার আভাস দেখা গেল। রাইমা বেগম বললেন,

–আপনি তো হীরার জন্য আমার মেয়েকে চেয়েছেন। আমাদের নাকচ করার কোনো ক্ষমতা আছে?

–আমরা একই এলাকায় থাকি আলাদা করে খোঁজ খবর নেওয়ার বিষয়টি থাকছে না। তবে কি আমরা বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে পারি?

–অবশ্যই পারেন।

–মেহেভীনের বাবা না থাকলে কিভাবে আগাব? রিয়াদ চৌধুরীর কথায় কথা গুলো গলায় আটকে আসছে রাইমা বেগমের। এক মুখে এত মিথ্যা করা বলা যায়! তবে মেয়ের ভালোর জন্য এতটুকু মিথ্যা তো বলাই লাগবে।

–আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনাকে নাকচ করার ক্ষমতা মেহেভীনের বাবার হবে না। আমি মেহেভীনের বাবাকে সবকিছু বলব।

–আমি নিজেও মেহেভীনের বাবার সাথে কথা বলে নিব। সামনের সপ্তাহে বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ করতে চাইছি। আমার ছেলের বিয়ে তো আর যেমন-তেমন ভাবে দেওয়া যায় না। এই সপ্তাহ সবকিছু আয়োজন করার জন্য নিলাম। আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না তো আবার? মেহেভীন কিছু বলতে যাবে। তখনই রাইমা বেগম আঁখিযুলের ইশারায় বোঝায় ভুলভাল কিছু বললে সে মায়ের ম’রা মুখ দেখবে। মেহেভীন গম্ভীর মুখশ্রী করে বসে রইল। রিয়াদ চৌধুরী মেহেভীনের কাছে এসে বলল,

–দেখি মা তোমার হাতটা এগিয়ে দাও তো। মেহেভীন ভদ্রতা বজায় রাখতেই হাত এগিয়ে দিল। রিয়াদ চৌধুরী ডায়মন্ডের একটা আংটি মেহেভীনের হাতে পড়িয়ে দিল। পকেট থেকে নাকফুল বের করে সাহেলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

–এটা তুমি পড়িয়ে দাও। সাহেলার মুখভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে না। সে বিরক্ত হয়ে কাজটা করছে নাকি খুশি হয়ে। মেহেভীনের নাকের ফুলটা খুলে নতুন নাক ফুলটা পড়িয়ে দিল। রিয়াদ চৌধুরী ধীর কণ্ঠে বলল,

–এই নাক ফুলটা মুনতাসিমের মায়ের মুনতাসিম ছোট বেলায় বলেছিল, মা তুমি আমার বউকে তোমার এই নাক ফুলটা দিয়ে দিবে। সে ছোট ছিল না বুঝে কথাটা বলেছিল, বলার কিছু দিনের মাথায় হয়তো ভুলেও গিয়েছিল। কিন্তু মুনতাসিমের মা ছেলের কথা হৃদয়ে গেঁথে রেখেছিল। মৃত্যুর আগে বলেছিল তার ছেলের বউকে যেন এই নাক ফুল দিয়েই চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এই নাক ফুলের মধ্যে অনেক দোয়া আর ভালোবাসা জড়িয়ে আছে মা। আশা রাখছি আমার ছেলেকে আঘাত করার মতো কোনো কাজ তুমি করবে না। আমার ছেলেটা আমার হৃদয়ের মণি তার এক বিন্দু কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না। মেহেভীন কি বলবে বা তার কি বলা উচিৎ বুঝতে পারল না। সে নিরুত্তর রইল।

চলবে…..