Monday, June 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 239



খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সময় তার নিয়মে স্রোতের ন্যায় ভেসে চলে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে কিছু মানুষের হৃদয়। ভারাক্রান্ত মন ছন্নছাড়া মস্তিষ্ক নিয়ে কারো সাথে কথোপকথনে ব্যস্ত মুনতাসিম। তখনই দরজা জানান দেয় কেউ তাকে স্মরন করছে। বিরক্তিতে মুনতাসিমের মুখশ্রী কুঁচকে আসে। সে গম্ভীর কণ্ঠে ভেতরে আসার অনুমতি দিল। তাইয়ান কক্ষে এসে বিস্ময় কণ্ঠে বলল,

–আপনার সাথে দেখা করতে মেহেভীন ম্যাডামের আম্মু এসেছেন। দীর্ঘ এক ঘন্টা ধরে আপনার জন্য নিচে বসে অপেক্ষা করছেন। আপনি যদি একটু নিচে আসতেন। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিমের মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো। সে রাগান্বিত হয়ে বজ্রকণ্ঠে বলল,

–আমাকে এখন বলছ কেন? কথা গুলো বলেই মুনতাসিম হন্তদন্ত হয়ে কক্ষের বাহিরে চলে গেল। ড্রয়িং রুমে মেহেভীনের আম্মু বসে আছে। প্রাপ্তি এসে রাইমা বেগমের গা ঘেঁষে বসে আছে। প্রাপ্তির কর্মকাণ্ডে রাইমা বেগম ভিষণ বিরক্ত। তখনই মুনতাসিম নিচে আসে মুনতাসিমকে দেখে রাইমা বেগম সালাম দেয়। মুনতাসিম সালামের উত্তর নিয়ে নিজেও সালাম দিল। সে কুশল বিনিময় করে বলল,

–আপনি আমার কক্ষে এসে আপনার কথা গুলো বলতে পারেন আন্টি। এখানে বিরক্ত করার অনেক মানুষ আছে। আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটানো মানুষ গুলোকে আমি একদম পছন্দ করি না। মুনতাসিমের কথায় প্রাপ্তির মুখশ্রী অপমানে থুবড়ে গেল। ক্রোধে চোয়াল শক্ত হয়ে এল তার। মুনতাসিমের কথার ওপরে কথা বলার সাহস নেই বিধায় দাঁতে দাঁত চেপে কথা গুলো সহ্য করল। সে কোনো কথা না বলে হনহন করে উঠে চলে গেল। মুনতাসিম তাইয়ানকে নাস্তা বানানোর কথা বলে রাইমা বেগম কে উপরে যাওয়ার জন্য আহবান জানাল। মুনতাসিম আগে আগে হাঁটছে আর রাইমা বেগম পেছনে পেছনে হাঁটছে। মুনতাসিম নিজের কক্ষে এসে সোফায় রাখা ল্যাপটপ টা গুছিয়ে রাখল। রাইমা বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,

–আমি কি ভেতরে আসতে পারি স্যার? রাইমা বেগমের কথায় মুনতাসিম লজ্জায় পড়ে গেল। সে দ্রুত উত্তর করল,

–আমি আপনার ছেলের মতো এভাবে স্যার সম্মোধন করে আমাকে ছোট করবেন না আন্টি।

–আপনি কত বড় মাপের মানুষ আপনাকে অসম্মান করে কথা বলার ক্ষমতা আমার আছে। আপনি আপনার বাসায় আমার প্রবেশ করতে দিয়েছেন। আপনার কক্ষে বসতে দিয়েছেন। এটাই তো আমার ভাগ্য ভালো জিনিসের কদর সবাই করে সে বড়ো হোক বা ছোট। রাইমা বেগমের কথায় মুগ্ধ হলো মুনতাসিম। মানুষটা মুহুর্তের মধ্যে যে কারো মন কেঁড়ে নিতে পারে তার কথার মুগ্ধতা দিয়ে, মুনতাসিম একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলল, “আপনি ঠিকই আমার মূল্যটা বুঝলেন। কিন্তু আপনার মেয়ে বুঝল না। সে যদি আপনার মতো করে আমায় বুঝতো। তাহলে আমাদের জীবনটা আজ অন্য রকম সুন্দর হতো। কথা ভাবতেই বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। নিজেকে স্বাভাবিক করে কোমল কণ্ঠে রাইমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–আপনি আমায় তুমি করে বলতে পারেন। আপনি আমার বড় হয়ে আমাকে আপনি বলে সম্মোধন করছেন। এতে আমার ভিষণ খারাপ লাগছে। মুনতাসিমের কথা গুলো কর্ণপাত হতেই রাইমা বেগম হালকা হাসলো। ছেলেটা ভিষণ সুন্দর ভাবে কথা বলতে জানে। কথার মধ্যে কত সুন্দর ভদ্রতা বিরাজ করে। রাইমা বেগম মস্তক নুইয়ে মাটির দিকে দৃষ্টি স্থীর করল। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলতে শুরু করল,

–আমি খবর নিয়ে জেনেছি। যে মেহেভীনের কেসটা নিয়ে তদন্ত করছে। সে আপনার বন্ধু হয় মূলত আপনিই তাকে রেফার করেছেন। আমি চাই আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত পৌঁছে যেতে আপনি নেহাল স্যারকে সাহায্য করুন। আপনার অনেক ক্ষমতা যে কাজটা আমরা একমাসে করব৷ সেই কাজটা আপনার এক ফোনে সাতদিনেও হতে পারে আবার একদিনেও হতে পারে। আপনি যদি আমার মেয়ের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করতেন। তাহলে আমি সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। তার বিনিময়ে আপনি যা চাইবেন আমি আপনাকে সেটাই দিব কথা দিলাম। রাইমা বেগমের কথায় মুনতাসিম চমকে উঠল। রাইমা বেগম এত তথ্য পেল কোথায়! মুনতাসিম বিস্ময় নয়নে রাইমা বেগমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। রাইমা বেগমের শেষ কথাটা কর্ণকুহরে আসতেই মুনতাসিমের হৃদয়ে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল। সে আগের ন্যায় নরম কণ্ঠে জবাব দিল,

–আপনি সত্যি কথা বলছেন? আমি যা চাইব আপনি আমায় সেটাই দিবেন!

–একবার চেয়ে দেখুন। বলুন আপনার কি চাই?

–সময় মতো চেয়ে নিব। ততক্ষণ আপনার অপেক্ষা করতে হবে।

–বেশ তবে তাই হবে। আমি আপনার চাওয়ার অপেক্ষায় থাকব।

–আপনি চিন্তা করবেন না। আমার দেহে নিঃশ্বাস থাকা অবস্থায় আমি মেহেভীনের শরীরে কলঙ্কের হাওয়া পর্যন্ত বইতে দিব না। আপনি গৃহে ফিরে যান নিশ্চিন্তে নিদ্রায় তলিয়ে যান। মেহেভীনের সব দায়িত্ব আমার তার সব চিন্তা আমি নিলাম। আমাকে একবার ভরসা করে দেখুন ঠকে গেলে পরবর্তীতে আমার মুখ আপনায় দেখাব না। মেহেভীনের সব দায়িত্ব আমার কথাটা মধুর মতো শোনাল রাইমা বেগমের কাছে। সে কত পুরুষকে দেখেছে কই আগে কোনো পুরুষ এভাবে মেহেভীনের দায়িত্ব নেয়নি। বরঞ্চ মেহেভীনের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে। তবে কি রাইমা বেগম ভয়ংকর রকমের ভালো কিছুর আভাস পাচ্ছে। একটা মানুষকে বাহির থেকে যেমনটা মনে হয়। তার সাথে কথা না বললে তার সাথে না মিশলে বোঝা যায় না মানুষটা আসলে কেমন। এর মাঝের তাইয়ান একটা গার্ডকে সাথে নিয়ে নাস্তা নিয়ে আসলো। রাইমা বেগম খাবে না কিছুই মুনতাসিমের জোড়াজুড়িতে হালকা কিছু আহার করলেন। রাইমা বেগম চলে যাচ্ছিলেন। তখনই মুনতাসিম আদুরে কণ্ঠে ডাকল,

–আজকে থেকে যান আন্টি দুপুর ভাত খেয়ে যাবেন। রাইমা বেগম মুনতাসিমকে যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে! এত বড় মাপের মানুষের মন এতটা সহজ সরল হতে পারে সেটা রাইমা বেগমের ধারনার বাহিরে ছিল। সে ভেবেছিল মুমতাসিম হয়তো তাকে কয়টা কড়া বাক্য শুনিয়ে বিদায় করে দিবে। সে কি জানত না মুনতাসিম মানেই মুগ্ধতা। মুনতাসিম প্রতিশোধে নয় ক্ষমায় বিশ্বাসী। সে ঘৃণায় নয় ভালোবাসায় পারদর্শী। একটা মানুষের কাছে যত আসা যায়। ততই মানুষটার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। রাইমা বেগমের মুনতাসিমের গাল স্পর্শ করে আদর করে দিতে ইচ্ছে করল। এত মিষ্টি একটা ছেলে নিশ্চই কোনো এক ভাগ্যবতী মায়ের গর্ভের সন্তান। যেমন তার ব্যবহার তেমন তার শিক্ষা। রাইমা বেগম মিষ্টি হেসে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।

মুঠোফোনটা হাতে নিতেই দেখল, নেহাল পনেরো বার ফোন দিয়েছে। মুনতাসিম বিলম্ব করল না। দ্রুত ফোন ব্যাক করল। ওপর পাশ থেকে রাগান্বিত কণ্ঠ স্বর ভেসে এল। নেহাল চেচিয়ে বলল,

–এই শা’লা মন্ত্রী হয়েছিস বলে যা খুশি তাই করবি! গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিলাম! কথা শেষ না করেই কল কাটলি কেন? কল কাটলি তো কাটলি একদম ভূতের মতো গায়েব হয়ে গেলি! আমাকে উলটা রাগ দেখাতে আসিস না। তুই মন্ত্রী হবার আগে আমার বন্ধু এটা ভুলে যাস না।

–তুই রাগ করিস না আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলাম। সেজন্য না বলে কল কেটে দিতে হয়েছে। তোকে কতবার বলেছি। বন্ধুত্বের মধ্যে একদম নিজেদের পেশা টানবি না। আমি আগে যেমন তোর কাছে সাধারণ মুনতাসিম ছিলাম। আজও তেমনই আছি। এবার কাজের কথায় আসা যাক।

–আমার মনে হয় মেহেভীনের অফিসের কেউ এতটা গভীর ষড়যন্ত্র করেনি। দুই তিনটা তথ্য পেয়েছি। কিন্তু সেগুলো সব মেহেভীনের বিপরীত পক্ষে, এগুলো দিয়ে মেহেভীনকে নির্দোষ প্রমাণ করা সম্ভব নয়। আমাদের আসল মাথা খুঁজে বের করতে হবে। আমি শুধু মাথার খোঁজটা পাই গোড়া পর্যন্ত পৌঁছে যেতে দুই সেকেন্ড সময় লাগবে না। মুনতাসিমের বিচক্ষণ মস্তিষ্ক নাড়া দিয়ে উঠল। ক্রোধে নিজেই নিজের হাত দেওয়ালে বা’ড়ি মা’র’ল। মুনতাসিম ভেবেছিল কাজটা হয়তো অফিসের মধ্যে হয়েছে। সেজন্য নেহালকে অফিসের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত তল্লাসি চালাতে বলেছে। এদিকে রুপার কথা তার মাথা থেকেই বের হয়ে গিয়েছিল। এতবড় ভুল তার দ্বারা কিভাবে হলো ভাবতেই রাগে ললাটের রগ ফুলে ফুলে উঠেছে। মুনতাসিম ঘন গাঢ় শ্বাস নিয়ে বলল,

–আমার থেকে তুই অভিজ্ঞ বেশি তোকে আমি আগা দেখিয়ে দিচ্ছি। তুই গোড়া পর্যন্ত অনায়াসে চলে যেতে পারবি। মেহেভীনের কাজের মেয়েটা রুপা তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হস্তান্তর কর। আশা করছি তার সবকিছু সামনে আসলে বড়ো বড়ো মুখ গুলো সামনে চলে আসবে।

–আর কারো কথা তুই জানিস?

–জুনায়েদ খান নামের এক লোকের সাথে দেড় বছর ধরে ঝামেলা চলছিল মেহেভীনের। তুই চাইলে তাকে-ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিস। নেহালকে আর কিছু বলতে হলো না। নেহাল যথেষ্ট বুদ্ধিমান একটা ছেলে ছোট বেলায় থেকে সে বেশ মেধাবী। তাকে আঁটি ভেঙে শ্বাস দিতে হয় না। অল্প একটু বললেই সে খুব সহজে গভীরে চলে যেতে পারে।

দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে যাবার পরে আজ সেই কাঙ্খিত দিন চলে এসেছে। আজকে মেহেভীনের কেসের ফাইনাল রাই হবে। মেহেভীনের মা, মুনতাসিম, নেহাল, রুপা সবাই কোর্টে উপস্থিত। একটু পরেই জজ সাহেব কোর্টে উপস্থিত হতেই সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দিল। জজ সাহেব আসার সাথে সাথেই মেহেভীনকে উপস্থিত করা হলো। নেহাল জজের কাছে একটা ফুটেজ প্রদান করল। যেখানে মেহেভীন ইউএনও সাহেবকে হুমকি দিচ্ছে। সেটা শুনে মেহেভীনের মস্তক নত হয়ে গেল। ফুটেজ টা দেখা হলে মেহেভীনকে বলা হলো,

–আপনার কি নিজের সম্পর্কে কিছু বলার আছে?

–এখানে আমার হুমকি দেওয়ার ফুটেজ টা শুধু দেখানো হয়েছে। কিন্তু ইউএনও সাহেব আমার যে অশালীন আরচণ করেছেন। সেই অংশটুকু কেনো কেটে দেওয়া হয়েছে? নেহাল মেহেভীনকে শান্ত কণ্ঠে বলল,

–আপনার নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য কোনো প্রমাণ আপনার কাছে আছে? মুহুর্তের মধ্যে মেহেভীনের চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। আঁখিযুগলে অশ্রু এসে চকচক করছে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সেগুলো গড়িয়ে পড়লো। মেহেভীন মস্তক নুইয়ে ধীর কণ্ঠে জবাব দিল,

–না। তখনই নেহাল আরো কিছু ফুটেজ জজের কাছে প্রদান করল। সেগুলো দিয়ে নেহাল বলতে লাগলো।

–এখানে অনেক গুলো ফুটেজ আছে জজ সাহেব। আপনি একটা একটা করে দেখলে বুঝতে পারবেন। মেহেভীনের কাজের মেয়েটা কিভাবে দিনের পর দিন মেহেভীনের আড়ালে অনৈতিক কাজ করে গিয়েছে। সে বৈধ দলিলের মধ্যে অধৈর্য দলিল প্রবেশ করিয়ে কাগজ গুলো সাইন করিয়ে নিয়েছে। এভাবে তিনি মেহেভীনের বিভিন্ন ক্লায়েন্টের কাছে থেকে অবৈধ অর্থ দাবি করেন। শুধু তাই নয় জুনায়েদ খান নামক এক ক্লায়েন্টের কাছে থেকে সে পুরো এক কোটি টাকা অর্থ নিয়েছে। তারা মেহেভীনের আড়ালে মেহেভীনের বাসায় গোপন বৈঠক বসায়। আমাদের দেশের বেশিভাগ মানুষ নিজেদের বাসার কাজের লোককে একটু বেশি বিশ্বাস করে থাকে। মেহেভীনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মেহেভীনের কাজের লোক অর্থাৎ রুপা মেহেভীনের সরলতার সুযোগ টাকে কাজে লাগিয়ে দিনের পর দিন তাকে ঠকিয়ে এসেছে। অবৈধ কাজের বিনিময়ে টাকা ঠিকি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই টাকা গুলো মেহেভীন পর্যন্ত কোনোদিন আসেইনি। মেহেভীন এসব টাকার বিষয়ে কিছুই জানে না। বলতে গেলে মেহেভীনকে জানতে দেওয়া হয়নি। মেহেভীনের সাথে ইউএনও সাহেবের ঝামেলা চলছিল। মূলত সমস্যাটা এখানে থেকেই তৈরি হয়। ইউএনও সাহেব মেহেভীনের সাথে দিনের পর দিন অশালীন আরচণ করছিলেন, আপত্তিকর প্রস্তাব প্রদান করছিলেন। মেহেভীন তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিবে বলায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে যান। আর মেহেভীনকে ভয় দেখান সে মেহেভীনকে পদত্যাগ করাতে বাধ্য করবেন। তারপরে তিনি জুনায়েদ খান আর রুপাকে কাজে লাগিয়ে এতদূর আসেন। ইউএনও সাহেবের বাসায় যেদিন মেহেভীন যায়। সেদিনের ফুটেজও আছে। তারা এতটুকু করেই ক্ষান্ত হননি মেহেভীনকে মারার বুদ্ধিও তারা করেছেন। রুপা মেয়েটা তাদের এত সাহায্য করল। তারা সেই মেয়েটার উপকারের কথা ভাবেনি। রুপাকেও মারার পরিকল্পনা তারা করেছে। বোকা মেয়েটা বুঝল না কে তার আপন কে তার পর! অর্থের লোভ মানুষকে ধংস করে দেয়। রুপা কেও ধংস করে দিয়েছে। রুপার জালিয়াতি করে টাকা নেওয়া ইউএনও সাহেবের অশালীন আরচণ ও কথা রুপার মেহেভীনকে মারতে বলার কথা সবকিছু এই ফুটেজের মধ্যে আছে। আপনি সবকিছু দেখুন আর আপনার মতামত জাহির করুন জজ সাহেব। হিম শীতের মাঝে-ও পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। জজ সাহেব একটা একটা করে ফুটেজ দেখতে লাগলো। এগুলো মেহেভীনের ড্রয়িং রুমের ফুটেজ যেখানে মাহতাব উদ্দিনের কাগজের মধ্যে রুপা জুনায়েদ খানের কাগজ গুলো ঢুকিয়ে দিচ্ছে। জুনায়েদ খানের বাসায় রুপাকে যেতে আসতে দেখা হয়েছে। জুনায়েদ খানকে হুমকি দিতে দেখা যাচ্ছে। ইউএনও সাহেবের বাসায় মেহেভীনকে খু’ন করতে ও গা’লি দিতে দেখা যাচ্ছে। ইউএনও সাহেবের অশালীন আরচণ ও প্রস্তাবের কথা শোনা যাচ্ছে। দিনের পর দিন এত এত টাকা রুপাকে নিতে দেখা যাচ্ছে। সবকিছু দেখে ঘৃণায় মেহেভীনের সমস্ত শরীর রি রি করে উঠল। মেহেভীন ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে রুপার দিকে দৃষ্টিপাত করল। রুপা ভয়ে জমে গিয়েছে। মুখশ্রী বেয়ে তরতর করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। শক্তি গুলো যেন পালিয়েছে। পুরো শরীর অবশ হতে শুরু করেছে। পালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা সে হারিয়েছে। রুপার এক পাশে রাইমা বেগম অন্য পাশে মুনতাসিম। মুনতাসিমের অধরের কোণে স্নিগ্ধ হাসি বিরাজমান। রুপার পালিয়ে যাবার কোনো রাস্তাই খোলা নেই। সে মস্তক নুইয়ে কাঁপতে লাগলো।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

চারিদিক সুখানুভূতিতে মেতে উঠেছে। মেহেভীনকে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়েছে। রাইমা বেগমের আঁখিযুগলে অশ্রুকণা এসে হানা দিয়েছে। যেকোনো সময় ভারী বর্ষণের ন্যায় জমিনে গড়িয়ে পড়বে। আস্তে আস্তে কোর্ট ফাঁকা হতে শুরু করল। পুলিশ এসে রুপাকে আটক করল। জুনায়েদ খান ও ইউএনও সাহেবকে ধরার কার্যক্রম শুরু হয়ে গিয়েছে। জুনায়েদ খানকে ধরা গেলে-ও ইউএনও সাহেবের খোঁজ মিলেনি। রুপাকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছিল তখনই মেহেভীন রুপার সমানে গিয়ে উপস্থিত হয়। মেহেভীনকে দেখে রুপার মস্তক নুইয়ে যায়৷ তবুও নিজেকে বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল,

–আমি ছোট মানুষ অনেক বড় ভুল করে ফেলছি আপা। আমাকে আপনি বাঁচান। আমি আর কখনো এমন ভুল করব না। আপনি চাইলে আমাকে বাঁচাতে পারবেন। আমি জেলে যেতে চাইনা। আপনি না আমায় বলেছেন। আমি আপনার ছোট বোনের মতো বড় বোন হয়ে ছোট বোনের ভুলটা মাফ করা যায় না। আমি আপনার জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাব। তবুও আপনি আমায় জেলে যেতে দিয়েন না। রুপার কথায় মেহেভীনের মস্তক জ্বলে উঠল। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না৷ নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে রুপার গালে ক’ষে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–পায়ের জুতাকে কখনো মাথায় তুলতে নেই। আমি আপন ভেবে পায়ের জুতাকে মাথায় তুলেছিলাম। এতটুকু শাস্তি আমার প্রাপ্য ছিল। এবার তুই বুঝবি তোর অবস্থান টা ঠিক কোথায়। তুই পায়ের জুতা ছিলি তার সারাজীবন পায়ের জুতাই থাকবি। চাকরানী চাইলেই রাজরানী হতে পারে না। তুই অবৈধ অর্থ উপার্জন করে চাকরানী থেকে রাজরানী হতে চেয়েছিলি না। সৃষ্টিকর্তা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। তাই তোকে তোর অবস্থান দেখিয়ে দিল। আমার তোকে খু’ন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। দুধকলা দিয়ে এতদিন ঘরে কাল সাপ পুষেছিলাম। কথা গুলো বলতে বলতে মেহেভীন নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গেল। আচমকা রুপার গলা চেপে ধরলো। অদ্ভুত ভাবে মেহেভীনের শক্তি দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। রুপা বাঁচার জন্য ছটফট করছে। দু’জন মহিলা পুলিশ মেহেভীনকে দূরে সরিয়ে দেয়। একজন মহিলা পুলিশ বলল,

–আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না ম্যাম। আমাদের কাজ আমাদের করতে দিন।

–এই মেয়ে যেন এতটুকু শাস্তি ও কম না পায়। আপনাদের সর্বোচ্চ শাস্তি যেন এই মেয়ে পায়। মেহেভীনের কথায় মহিলা পুলিশ দু’টো রুপা নিয়ে চলে গেল। রুপা ছাড়া পাবার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু দু’জন মানুষের সাথে পেরে উঠছে না। পুরো কোর্ট ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। রাইমা বেগম, নেহাল আর মুনতাসিম রয়ে গিয়েছে। নেহাল হাসোজ্জল মুখশ্রী করে ভা উচ্চারন করতেই মুনতাসিম জোরে নেহালের পায়ের ওপরে পা রাখল। নেহাল ব্যথায় কুঁকড়িয়ে উঠল। নেহালের আর্তনাদ শুনে, মেহেভীনের দৃষ্টি নেহালের ওপরে পড়লো। মেহেভীন নেহালের কাছে এসে বলল,

–আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করার আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।

–আমার কাজই এটা আমাকে ধন্যবাদ দিতে হবে না। যদি দিতে হয় তাহলে মুনতাসিমকে দিবেন৷ সে আমাদের অনেক সাহায্য করেছে৷ আমি আপনার কাছে থেকে বেশি কিছু চাই না৷ আমাকে আপনাদের বি..উচ্চারণ করতেই মুনতাসিমের দিকে নজর যায়। মুনতাসিম অগ্নি দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। মেহেভীন এখানে না থাকলে তাকে এতক্ষণে ধংস করে দিত মুনতাসিম। আঁখিযুগল দিয়ে তাকে শতবার ভষ্ম করে দিচ্ছে। নেহালের কণ্ঠনালিতে শব্দ গুলো এসে আঁটকে গেল। আমার কাজ আছে বলেই সে দ্রুত কোর্ট থেকে বেড়িয়ে গেল। মুনতাসিম চলে যাচ্ছিল। তখনই মেহেভীন ডাকলো।

–স্যার। মেহেভীনের ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার কোনোদিনই ছিল না। আজ ও সে প্রেয়সীর ডাককে উপেক্ষা করতে পারল না৷ দৃষ্টি ঘুরালো পেছনের দিকে। মেহেভীন নরম কণ্ঠে বলল,

–আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ বিপদে পাশে থাকার জন্য।

–একজন বন্ধুর বিপদে পাশে দাঁড়ানোই প্রকৃত বন্ধুর কাজ। আমি কখনোই নির্দোষ ব্যক্তির শরীর কলঙ্ক লাগিয়ে আরামে বসে থাকতে পারি না। আমার শরীরে যদি কেউ কলঙ্ক লাগায় তাহলে আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে জানি৷ ঠিক তেমনই আমার বন্ধুর শরীরে যদি কেউ মিথ্যা বোঝা চাপিয়ে দেয়। আমার যতটুকু সাধ্য আছে। সেটা প্রয়োগ করে তাকে সাহায্য করতেও জানি। ধন্যবাদ দিয়ে আমাকে ছোট করতে হবে না। ভালো থাকবেন আসছি। আমি কাজ ফেলে রেখে এসেছি আমাকে যেতে হবে। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। মানুষটার অভিমান তার ভালোবাসার মতোই প্রখর। অভিমান ভাঙাতে যে প্রচুর কাঠ কয়লা পোড়াতে হবে। সেটা মেহেভীন গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। রাইমা বেগম দিন পর দিন ছেলেটার প্রতি মুগ্ধতা বেড়েই চলেছে। মুনতাসিমের মাকে রাইমা বেগমের ভিষণ দেখতে ইচ্ছে করে। গর্ব করে বলতে ইচ্ছে করে, মানুষের মতো মানুষ করেছেন ছেলেটাকে। এমন সোনার টুকরো ছেলে কয়জনের হয়? কথা গুলো ভাবতে ভাবতে মেয়েকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্য রওনা হলেন। মেয়ের বাসায় দু’টো দিন থেকে চলে যাবে। ফরিদ রহমান একটি বারের জন্য মেয়ের খোঁজ নেয়নি। রাইমা বেগম বাসায় ফিরছে না। সেটা নিয়েও প্রচুর অশান্তি করেছে। বাবা কি আসলেই এমন হয়? ভাবতেই মেহেভীনের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল।

অভাগী যেদিকে যায় কপাল পুড়তে পুড়তে যায়। কথাটার সঠিক মর্ম আজ মেহেভীন উপলব্ধি করতে পারছে। এত কষ্ট সাধ্য সাধনা সবকিছু অসৎ এর কাছে এসে হেরে গেল। তাতে কি যায় আসে নিজের সন্মান নিয়ে ফিরতে পেরেছে সে। এটাই তার কাছে বিশাল কিছু। নিজের সন্মান বিক্রি করে তো আর কাজে থাকতে পারবে না। এই জন্যই বোধহয় মানুষ বলে সৎ পথে কষ্ট বেশি আর অসৎ পথে বন্ধু বেশি৷ মেহেভীন তার মায়ের কাছে ফোন দিল। ত্রিশ সেকেন্ডের মতো চুপ ছিল মেহেভীন। রাইমা বেগম অস্থির হয়ে বলল,

–আমার কিন্তু ভিষণ চিন্তা হচ্ছে তোর কি হয়েছে বলবি?

–মা আমার চাকরিটা চলে গিয়েছে।

–কেন কি হয়েছে?

–সেই ঘটনার পরে কিছু মানুষ আমার সাথে খুব অশালীন আরচণ করতে লাগছিল। যা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। আমার নামে একে পর এক মামলা আসছিল। আমি কিছু নিয়ম ও ভঙ্গ করেছি মা৷ সেজন্য আমাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। মেহেভীনের কথায় রাইমা বেগম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কারো কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না। রাইমা বেগম দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছেন। সে মেহেভীনকে খবর টা দিবে কি না৷ রাইমা বেগম স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

–আমি জানি তোর মনের অবস্থা ঠিক কতটা খারাপ। এটাও জানি তোর ভেতরে ছোটখাটো একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সমস্যা যেন আমাদের সমস্যায় ফেলতে না পারে। বরঞ্চ আমরা চেষ্টা করব সমস্যাকে সমস্যায় ফেলতে। আমি তোকে কি বোঝাতে চেয়েছি আশা করি বুঝতে পেরেছিস? আল্লাহ তায়ালা আমাদের মাঝে মাঝে দুঃখ-কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করেন৷ ধৈর্য হারা হোস না আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।

–সব ভালো কেন আমার সাথেই করেন আম্মু। জীবনের পাপের বোঝা খুব বেশি হয়ে গিয়েছে। তাই তিনি এভাবে আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছেন।

–তুই রাগ করে এসব কথা বলছিস। আল্লাহ তায়ালা আমাদের থেকে যা কিছু কেঁড়ে নেন৷ তার থেকে দ্বিগুন ফিরিয়ে দেন৷ তুই নিরাশ হোস না তিনি যতটুকু কেঁড়ে নিয়েছেন। তার থেকে দ্বিগুন খুব তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দিবেন। মানুষের ওপরে ভরসা করলে নিরাশ হবি খালি হাতে ফিরে আসবি। কিন্তু আল্লাহ তায়ালাকে ভরসা করে দেখ তিনি তোকে নিরাশ ও করবে না৷ আবার খালি হাতেও ফিরিয়ে দিবেন না। পৃথিবীতে মানসিক শান্তির আরেক নাম মা। এই যে ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল। অসহ্য যন্ত্রনায় শরীরটা ছটফট করছিল। মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে গিয়েছিল। চিন্তায় মস্তক থম মেরে গিয়েছিল। এত অশান্তির মধ্যে অজানা আনন্দ অনুভূত হচ্ছে মেহেভীনের। চিন্তিত মস্তক নিজেকে বোঝাতে আর মানাতে নেমে পড়েছে।

উত্তপ্ত মস্তিষ্ক টগবগে মেজাজ রাগান্বিত চেহারা রক্তিম আঁখিযুগল নিয়ে বাবার সামনে বসে আছে মুনতাসিম। মুনতাসিমের বাবা গম্ভীর মুখশ্রী করে ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা-ছেলের মধ্যে কিছু মুহুর্ত তর্কাতর্কি হয়েছে। পরিবেশ শীতল করতে দু’জনই নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিমের বাবা শান্ত হয়ে কোমল কণ্ঠে বলল,

–তোমার বয়স তো আর কম হয়নি। আমি চাই তোমার বিয়ে দিতে তুমি আমার মতামতকে উপেক্ষা করতে পারো না। তুমি রীতিমতো আমার মতামতকে অসন্মান করছ মুনতাসিম।

–আমি আপনাকে কতবার বলব আব্বা। আমি বিয়ে করব না৷

–নিজের বয়সের দিকে নজর দিয়েছ! এই বয়সে বিয়ে করবে না। তাহলে কোন বয়সে বিয়ে করবে? আমার ও তো মন চায়। ছেলে-মেয়ে বিয়ে দিয়ে নাতি-নাতনীর মুখ দেখতে।

–এক ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দেখলেন না নাতি-নাতনীদের মুখ। আবারও একটা লা’শ বের হয়ে যাবে চৌধুরী বাড়ি থেকে যদি আমার সাথে ছলনা করার চেষ্টা করছেন।

–সে আজ আমার থেকে বহুদূর। আমি তোমার জন্য আমার না হওয়া নাতি-নাতনীর মুখ দেখতে পারিনি। তাই তোমাকেই আমার না দেখা স্বপ্নটা পূর্ণ করে দিতে হবে। বাবার কথায় মুনতাসিম লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। নিজের বিয়ে নিয়ে বাবার সাথে কথা বলতে সে ভিষণ লজ্জা পায়। লজ্জা আর জড়তার কারনেই নিজের মনের কথা বাবার কাছে প্রকাশ করতে পারছে না। বাক্য গুলো যেন ছুটি নিয়েছে। যে মানুষটার একটা কথায় সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়৷ আজ সেই মানুষটা কথা বলার শব্দ হারিয়েছে।

–আমি তোমাকে সাতদিন সময় দিলাম। তুমি সাত দিনের মধ্যে নিজের সিদ্ধান্ত জানাবে। আমি আমার বন্ধুর মেয়েকে আমাদের বাসায় নিমন্ত্রণ করেছি। সে চৌধুরী বাড়িতে আসবে। তুমি তার সাথে ঘুরবে ফিরবে মিশবে। তারপরে যদি তোমার তাকে ভালো লাগে তবে আমি সামনের দিকে আগাব বুঝেছ। মুহুর্তের মধ্যে মুনতাসিমের ভেতরটা জ্বলে উঠল। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে বাবার কথা গুলো সহ্য করে নিল। বাবার মতামতকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার ক্ষমতা তার নেই। সে রাগান্বিত হয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। রিয়াদ চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তার অজানা কারনে মেহেভীনকে পছন্দ নয়। দু’জনের দুরত্বের কথা জেনেই ছেলেকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে চায় সে। কিন্তু ছেলে তার নাছোড় বান্দা নিজের সিদ্ধান্তে অটুট থাকবে। মেহেভীনকে রাস্তা থেকে সরানোর জন্য একটা পথ অবলম্বন করবেন তিনি। সেই পথ যদি কাজে লেগে যায় তাহলে আলহামদুলিল্লাহ। আর না হলে মনের বিরুদ্ধেই ছেলের সুখ বেছে নিবে সে।

রাইমা বেগমের কণ্ঠ কেমন জানি শোনালো। মেহেভীন বুঝতে পারছে। তার মা তার থেকে কিছু আড়াল করার চেষ্টা করছে। মেহেভীন নিজের দুঃখ গুলো খুব যতনে মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখে বলল,

–তোমার কি হয়েছে আম্মু? আমাকে একদম মিথ্যা বলার চেষ্টা করবে না। আমার মা তো এত সহজে নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার মতো মানুষই না। মেহেভীন কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে কথা টা ভাবতেই চমকে উঠল রাইমা বেগম।

–পরে শুনিস।

–আমি এখনই শুনব৷ রাইমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। সে সত্য টা দু’দিন পরে সবার সামনে চলে আসবে৷ সেটা দু’দিন আগে আসলে ক্ষতি কি? তাই মেহেভীনের মা দম নিলেন৷ কিছু সময়ের ব্যবধানে বলার জন্য প্রস্তুত হলেন। শব্দ গুলো যেন কণ্ঠনালিতে এসেও হারিয়ে যাচ্ছে। নিজের অশ্রু গুলো সংবরণ করে বলল,

–তোর বাবা খু’ন হয়েছে মেহেভীন। সাতদিন ধরে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না৷ আজকে খবর পেয়েছি তাকে খু’ন করে ছয় টু’ক’রো করা হয়েছে। একটা ভিডিও ক্লিপ তারা সংগ্রহ করতে পেরেছে। কিন্তু তোর বাবার খন্ড গুলো তারা এখনো উদ্ধার করতে পারেনি। উদ্ধার করার কার্যক্রম চলছে। কথা গুলো কর্ণকুহরে আসতেই মেহেভীনের মনে হলো কেউ তার শরীরের সমস্ত হার গুলো গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিয়েছে। এক মুহুর্তের জন্য তার রুহু কেঁপে উঠল। পুরো শরীর অবশ হয়ে আসতে শুরু করেছে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য গয়ে পড়েছে বুকের মধ্যে ভিষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মানুষটা যতই খারাপ হোক মানুষটা তার বাবা ছিল। যার হাত ধরে সে হাঁটতে শিখেছে। যার উষ্ণ ভালোবাসায় সে বড় হয়েছে। কিছু দিনের করা খারাপ ব্যবহারের কাছে কি সারাজীবনের ভালোবাসা বৃথা যেতে পারে! মেহেভীনের মনে হচ্ছে জীবনের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে সে। আর একটা ধাক্কা দিলে দেহ থেকে প্রাণ পাখিটা খাঁচা ফেলে উড়াল দিবে। এক ধাক্কায় ভেঙে পড়ার মতো মানুষ মেহেভীন নয়। বারবার ধাক্কা দিলে পাহাড় ও ভেঙে পড়ে সেখানে মেহেভীন একজন মানুষ মাত্র।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

প্রতিটি মুহুর্ত যেন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। বাসতের সাথে তাল মিলিয়ে যেন বি’ষ উড়ে বেড়াচ্ছে। মেহেভীনের সমস্ত শরীর বিষাদে ছেয়ে গিয়েছে। ভেতর থেকে বুদ্ধি শূন্য হয়ে পড়েছে সে। মস্তিষ্ক না কাজ করার পণ করেছে। অশ্রুকণা গুলো যেন পালিয়েছে। কিছুতেই আঁখিযুগলের কোণে এসে ভির জমাচ্ছে না। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসছে। মেহেভীনকে নিস্তব্ধ হয়ে যেতে দেখে রাইমা বেগম মলিন কণ্ঠে বলল,

–এই জন্যই আমি তোকে বলতে চাইনি। কারন বাবা যতই খারাপ হোক না কেন একজন বাবা প্রতিটি মেয়ের দুর্বলতা। আমি যে ধাক্কা টা সহ্য করে নিয়েছি। তুই সেটা সহ্য করতে পারবি না৷

–আমি বাসায় আসছি মা।

–তোর বাবার নিখোঁজ হবার খবর পরিবারের লোক ছাড়া কেউ জানে না। তুই বাসায় এসে বিষয়টা ঘোলাটে করিস না৷ তোর চাকরি চলে গিয়েছে শুনলে মানুষ তোকে আর আমাকে ছিঁড়ে খাবে। এখনো সঠিক সময় আসেনি। সবাইকে সত্যিটা বলার তুই আর কয়টা দিন পরে আয়৷ বাবাহীন মেয়েটা জানে বাবা ছাড়া ধরনীর বুকে টিকে থাকা কতটা কঠিন। বাবাহীন প্রতিটি মেয়ে জানে তারা সমাজে কতটা অবহেলিত। যার বাবা নেই তার কেউ নেই। মানুষটা যতই খারাপ হোক মাথার ওপরে ছিল বিধায় কেউ মুখ দিয়ে কটু বাক্য উচ্চারন করতে পারেনি। তোর বাবার মৃত্যুর খবর পাঁচ কান হলে দেখবি সবাই তার খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছে।

–আমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না আম্মু। আমার পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে শরীরের শক্তি ক্ষয় হতে শুরু করেছে। তোমাকে এই অবস্থায় আমি কিছুতেই একা থাকতে দিব না। যতই রাত হোক না কেনো আমি আসছি। কথাগুলো বলেই কল কেটে দিল। রাইমা বেগম ক্রোধে দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিল৷ রহমান যদি আরিয়ানের সাথে মেহেভীনের বিয়ে চাপ দেয়। তখন সে কি করবে তার স্বামীও নেই। যে জোড় গলায় কথা বলবে। এখন তার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করবে না। এই পরিবারের প্রতিটি মানুষের রগ তার চেনা আছে।

রজনীর আঁধার ধরনীকে গ্রাস করে ফেলছে। আজকে শেহনাজের বাসায় ফরিতে দেরি হয়ে গিয়েছে। আজকে ড্রাইভার কেও বাসায় ফিরে যেতে বলছে। জীবনে প্রথম গাড়ির জন্য মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে সে। ভেতরে ভেতরে ভিষণ ভয় কাজ করছে তার। কেন যে বোকামি করে ড্রাইভারকে বাসায় যেতে বলল। শেহনাজ একটা চায়ের দোকানের পাশে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। সে একা থাকায় কেউ নিয়ে যেতে চাইছে না৷ তখনই কর্ণকুহরে কিছু অশালীন বাক্য এসে পৌঁছায়। বাক্য গুলো যত স্পষ্ট হচ্ছে শেহনাজের শরীর ততই ঘৃণায় রি রি করে উঠছে৷ তখনই শেহনাজের সামনে এসে তাইয়ান উপস্থিত হয়। তাইয়ানকে দেখে স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়ে শেহনাজ। দ্রুত গাড়িতে উঠে বসলো সে। তাইয়ান গাড়ি চালানো শুরু করল।

–আপনি গাড়ি কেন বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন? স্যার অনেক রাগ করেছে। আমি আপনার ভার্সিটি থেকে খুঁজতে খুঁজতে এতদূর এসেছি। আপনাকে বাসায় নিয়ে না ফিরতে পারলে স্যার আমার গরদান নিয়ে নিতো।

–জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা আজকে আমি করেছি জানো। আমার বোঝা উচিৎ ছিল আমি একটা মেয়ে। আর একটা মেয়ের জন্য রজনীর আঁধার কতটা ভয়ংকর হতে পারে। সেটা আমি আজ উপলব্ধি করতে পারলাম। শেহনাজের কথার উত্তরে তাইয়ান আর কিছুই বলতে পারল না৷ সে নিরুত্তর রইল। শেহনাজ যেতেই চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে আসলো শেহনাজের প্রিয়তম স্বাধীন। মুখশ্রীতে তার বিশ্রী হাসি বিদ্যমান। সে রফিককে উদ্দেশ্য করে বলল,

–শা’লি’কে আমরা কবে তুলছি। ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলছে। ওর তেজ না কমানো পর্যন্ত আমার ভেতরটা শীতল হবে না। শেয়াল কুকুরের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাব ওকে। তবেই আমার ভেতরটা শান্ত হবে। স্বাধীনের বলা বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই রফিক বলল,

–কিছু পেতে হলে কিছু কষ্ট সহ্য করতে হয়। তার মনে জায়গা করে নিতে পেরেছিস। তাকে ছিঁড়ে ও খেতে পারবি। একটা মন্ত্রীর বোনকে তুলে নেওয়া কি এতটাই সহজ! শেহনাজকে কৌশলে তুলতে হবে। কথা গুলো বলেই স্বাধীনের কর্ণের কাছে এসে কিছু একটা বলল৷ স্বাধীনের মুখশ্রীতে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল।

রাইমা বেগমের সামনে বসে আছে মুনতাসিম। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে যাবার পরও মুনতাসিম কিছু বলছে না দেখে, রাইমা বেগম নিজেই বিরক্ত হয়ে বলল,

–আপনি আমায় কিছু বলতে চান স্যার? রাইমা বেগমের মুখে আপনি আর স্যার ডাকে নিভে গেল মুনতাসিম। সে অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

–আমি আপনার ছেলের মতো। আপনি আমাকে স্যার না ডেকে তুমি বলে সম্মোধন করবেন। তাহলে আমি আপনার সাথে কথা বলতে সহজ হতে পারতাম। রাইমা বেগম বুঝলেন মুনতাসিমের অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা। তিনি ও নিজেকে স্বাভাবিক করে মুনতাসিমকে অভয় দিয়ে বলল,

–আমি তোমার মায়ের মতো মায়ের কাছে এত কিসের হেলাফেলা! তুমি নিশ্চিন্তে তোমার মনের কথা আমায় জানাতে পারো।

–আমি মেহেভীনকে বিয়ে করতে চাই আন্টি। কথাগুলো বলেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল মুনতাসিম৷ হৃদস্পন্দনের ক্রিয়া তড়িৎ গতিতে ছুটে চলেছে। মনের গহীনে অস্থিরতা কাজ করছে। মুনতাসিম উৎসুক দৃষ্টিতে রাইমা বেগমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। রাইমা বেগমের মুখশ্রী আগের ন্যায় গম্ভীর হয়ে আছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি মুনতাসিমের প্রস্তাবে বেশ চিন্তিত হয়েছেন। মুনতাসিমের ভেতরে অদ্ভুত ভাবে ভয় কাজ করছে। রাইমা বেগম যদি তাকে নাকচ করে দেয় কথা গুলো ভাবতেই মস্তিস্ক এলোমেলো হয়ে গেল।

–তোমার পরিবার জানে তুমি মেহেভীনকে বিয়ে করতে চাও। দেখো বাবা আমি তোমাকে পছন্দ করি না, এমন টা না।তোমাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। আমি খোলামেলা কথা বলতে পছন্দ করি। কিন্তু তোমার পরিবারের মতামত না থাকলে, আমি সামনের দিকে এগোতে পারব না। কারন তোমার পরিবার তোমাকে ছোট থেকে বড় করেছে। তোমাকে নিয়ে তাদেরও স্বপ্ন আছে। আমি কারো রঙিন স্বপ্ন ভেঙে আমার মেয়ের জীবন রঙিন ভাবে সাজাতে পারি না। তুমি তোমার পরিবারসহ আমার কাছে এসো। তখন না আমি ভেবে দেখব। আমি তোমাকে কড়া করে কথা গুলো বলতে বাধ্য হলাম। কারন এখানে আমার মেয়ের সারাজীবনের ব্যাপার জড়িয়ে আছে।

–আপনি রাজি হলে এখনই আমার পরিবারকে আসতে বলব। আমার খুশির জন্য কেউ রাজি না হোক। আমার বাবা রাজি হবে। নিজের সুখ বিক্রি করে হলে-ও আমার বাবা আমার জন্য সুখ কিনবে। বাবা ছাড়া দুনিয়ায় আপন বলতে আমার কেউ নেই। এই ধরনীর বুকে আমি বাবাকেই নিজের ধরনী মনে করি। আপনি অনুমতি দিলে আমার পরিবারকে আসতে বলব। রাইমা বেগম মুগ্ধ হয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। ছেলেটা এত ভালো কেনো? ছেলেটা এতটা ভালো না হলে-ও পারতো। ভালোবাসার মানুষ তো এমনই হওয়া উচিৎ। যেখানে অধিকারই থাকবে আলাদা যেটা মুনতাসিমের আঁখিযুগলে দেখেছে সে। রাইমা বেগম একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। মনস্থির করে নিলেন মেহেভীন আসলে মেহেভীনের সাথে কথা বলবে। জীবনে চলার পথে একটা শক্ত লা’ঠি’র ভিষণ প্রয়োজন আছে। রাইমা বেগম মুনতাসিমকে পরীক্ষা করার জন্য বলল,

–আমার মেয়ের কিন্তু চাকরি চলে গিয়েছে। তুমি আগে যে মেহেভীনকে দেখেছো। সে কিন্তু এখন আর আগের মতো নেই। তুমি আমার বেকার মেয়েকে মেনে নিতে পারবে তো? আমি অবাক হচ্ছি যে মেয়েটা তোমার সন্মান নষ্ট করল! তুমি কেন তাকেই বিয়ে করতে চাইছ?

–ভালোবাসা হচ্ছে স্নিগ্ধ পবিত্র জিনিস। প্রকৃত ভালোবাসায় না থাকে কোনো খাদ আর না থাকে প্রতিশোধের নেশা। ভালোবাসায় থাকে শুধু প্রিয় মানুষটাকে ভালোবাসার নেশা। আমি তো ঘৃণায় করতে শিখিনি আর না নিয়েছি প্রতিশোধ। আমি সবকিছুর বিনিময়ে ভালোবাসার মানুষটাকে একান্তই নিজের করে নিতে চেয়েছি। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে হৃদয়ের ছোট্ট কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছি। যার মুখ দেখে আমার নিদ্রা ভাঙবে। যার মুখ দেখে আমি শান্তিতে নিদ্রা যেতে পারব। যার মুখের হাসি আমার মানসিক শান্তির কারন। আমার উথাল পাথাল করা হৃদয় যাকে দেখে শান্ত হয়ে যায়। সেই মানুষ টাকে আমি ভিষণ ভালোবাসি। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনা করতেও আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। যাকে দুঃখ দিয়ে আমি নিজেই তার থেকে দ্বিগুন পুড়ি। তাকে আমি কিভাবে অবহেলা করব? শত্রুর সাথে লড়াই করা যায় আন্টি। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের সাথে লড়াই করা যায় না। ভালোবাসার কাছে আমরা চরম ভাবে বেহায়া হয়ে যাই। আমরা বাহির থেকে নিজেদের যতই শক্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করি না কেন? ভেতর থেকে আমরা কারো না কারো প্রতি গভীর ভাবে দুর্বল। একজন আত্মসম্মান সম্পূর্ণ মানুষ দিনশেষে কারো কাছে বেহায়া হয়ে যায়। চাইলেও তার সামনে শক্ত হওয়া যায় না। আর না করা যায় তার সাথে কঠিন ব্যবহার। আমাদের সমস্ত আত্মসম্মান শুষে নিয়ে চলে যায় আমাদের ভালোবাসার মানুষ গুলো। সেজন্য বোধহয় দিনশেষে আমরা বেহায়া উপাধি পেয়ে থাকি। আমি কি আপনাকে বোঝাতে পেরেছি। এতকিছুর পরে-ও কেন আমি মেহেভীনকে চাই। রাইমা বেগম যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। মনের শহরে আনন্দের মিছিল শুরু হয়ে গিয়েছে। অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠেছে। অশ্রুশিক্ত নয়নে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। আল্লাহ তায়ালার কাছে শতবার শুকরিয়া আদায় করলেন। তার ললাটে ভালোবাসা জুটেনি তো কি হয়েছে। আল্লাহ তার মেয়ের ললাটে অফুরন্ত ভালোবাসা জুটিয়ে দিয়েছে। রাইমা বেগমের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে। ভেতরে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন টা মুহুর্তের মধ্যে নিভে গেল। এবার সে শান্তিতে পরকালে গমন করতে পারবেন। একজন মায়ের কাছে মেয়ের সুখ দেখার মতো শান্তি ধরনীর বুকে নেই।

–আমি তোমার সাথে মেহেভীনের বিয়ে দিব। কিন্তু মেহেভীনের বাবা মা’রা গিয়েছে। মেহেভীনের বাবার লা’শ খোঁজার তদন্ত চলছে। তাকে না পাওয়া পর্যন্ত কিভাবে মেহেভীনের বিয়ে দেই বলো? রাইমা বেগমের কথায় চমকে উঠল মুনতাসিম! সে বিস্ময় কণ্ঠে বলল,

–আংকেল কবে মা’রা গেল আন্টি? আপনি আমাকে জানাননি কেন? আমি আপনাকে আমার সর্বোচ্চ দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করব। আংকেলের তদন্তে কোন থানার পুলিশ আছে। আপনি আমাকে নাম বলুন। আমি ব্যাপারটা দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা করছি।

–মেহেভীনের বাবাকে খু’ন করা হয়েছে। আমি চাই মেহেভীনের বাবা শাস্তি পাক। সে আমার মেয়েকে রক্তাক্ত করেছে। আমার মেয়ে কলঙ্ক না করে-ও সে আমার মেয়েকে কলঙ্কিত নারী বলে উপাধি দিয়েছে। নিজের মেয়ে বলে অস্বীকার করেছে। আমি চাই তার এতটুকু শাস্তি হোক। এবার মুনতাসিমের মস্তিস্ক নাড়া দিয়ে উঠল। বিচক্ষণ মস্তিষ্ক ভয়ংকর কিছুর আভাস পাচ্ছে। মেয়ে মানুষের মন তো কুসুমের ন্যায় কোমল হয়। তবে রাইমা বেগম কেন তার বিপরীত চিত্র! একটা নারী যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে। তা রাইমা বেগমকে না দেখলে উপলব্ধি করা যাবে না। এতটা পাষাণ মনের নারী কিভাবে হতে পারে? মুনতাসিমের মস্তক ঝনঝন করে উঠল। ভেতরটা আপন জন হারানোর পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছে। এই ঝড়ের সাথে না আবার মেহেভীন ভেসে চলে যায়। সে নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তার এক একটা দিন বেঁচে থাকা হবে মৃত্যুর সমান। সবকিছু সামনের আসার আগেই মেহেভীনকে নিজের আয়ত্ত করে নিতে হবে। মনের গোপন কুঠুরিতে ভালোবাসার চাদর দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। যেন কোনো বিপদ তার প্রেয়সীকে স্পর্শ করতে না পারে। এই প্রথম মুনতাসিম ভয় পাচ্ছে প্রিয়জন হারানোর ভয়। ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। রাইমা বেগম মুনতাসিমের দিকে শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। সেই শীতল চাহনি ভয়ংকর ভাবে মুনতাসিমের হৃদয় স্পর্শ করে গেল।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-২৮+২৯+৩০

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

শীতল হাওয়া এসে মুনতাসিমের শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে। শরীরে শীতের কাপড় না থাকায় কেঁপে কেঁপে উঠছে মুনতাসিম। চারদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। বুকের মধ্যে অশান্ত নদীর মতো উথাল-পাতাল করছে। মাঠের পাশে নদীটা কেমন থম মেরে গিয়েছে। মুনতাসিমের অবস্থা দেখে তাইয়ানের ভিষণ খারাপ লাগছে। তবুও প্রকাশ করতে পারছে না। মুনতাসিমকে কোনো কথা বলা মানে, নিজের ক্ষতি নিজে করা৷ মুনতাসিম রেগে যদি তাকে দূর সরিয়ে দেয়। তখন সে কিভাবে মুনতাসিমকে আগলে রাখবে। মানুষ টা সামনে বড় ধরনের একটা ধাক্কা খাবে। কথা গুলো ভাবতেই তাইয়ানের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। সে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মুনতাসিমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–আপনার কি ম্যাডামের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে স্যার? আপনি ম্যাডামকে ম্যাসেজ দিয়ে নিচে আসতে বলুন। আপনি মেসেজ করলে ম্যাডাম নিশ্চই আপনার কাছে আসবে।

–কথা বলতে ইচ্ছে করলে-ও মেসেজ দিতে ইচ্ছে করছে না। আত্মসম্মান বলেও একটা ব্যপার আছে।

–আপনি অনেক শক্ত মনের মানুষ স্যার। আমি হলে জীবনে ও পারতাম না।

–এই যে আমি নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে বিলীন হয়ে যাচ্ছি। সে কথা আমি কাকে বলবো? মুনতাসিমের কথায় তাইয়ান বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। মানুষটা কথা বলে না বলে না। আবার যখন বলতে শুরু করে। জবাব দেওয়ার এতটুকু জায়গা থাকে না। তাইয়ান নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মুনতাসিম তা দেখে মুচকি হেসে বলল,

–এত অল্পতে ভেঙে পড়লে চলবে। তুমি যাকে ভালোবাসো সে তো আরো গভীর জলের মাছ। তোমার দুর্বলতার কথা জানলে, তোমাকে এক নিমিষেই চূর্ণবিচূর্ণ করে দিবে। এমন দুর্বল মানুষ আমার চাই না তাইয়ান। আমার মনে হয় আমার থেকে তোমার দূরে যাওয়া উচিৎ। তুমি না পারবে ভালোবাসাকে আঘাত করতে আর না পারবে আমাকে আঘাত করতে। তোমার এখন একটা নিরপেক্ষ স্থানে যাওয়া দরকার। মুনতাসিমের কথায় তাইয়ানের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। সে বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তার মানে মুনতাসিম সবকিছুই জানে, আর সে ভেবেছে কিছুই জানে না। মুনতাসিম তাকে এমনি এমনি বোকা বলে না। সেই আসলেই বোকা। মুনতাসিম আসলেই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সেজন্যই মানুষ তাকে এতটা ভালোবাসে। সে মনকে পাথরের ন্যায় কঠিন করে নিল। কণ্ঠে কাঠিন্যতা বজায় রেখে বলল,

–আমি পৃথিবীর সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে আপনার পাশে থাকতে চাই স্যার। আমার ভালোবাসার থেকে আপনি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আপনার পাশে থেকে আমার লা’শ বের হয়ে যাবে। তবুও আমি জীবিত থাকা অবস্থায় আপনার থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও দূরত্ব তৈরি করব না। মুনতাসিমের অধরের কোণে আগের ন্যায় হাসি বিরাজ করছে। মুনতাসিম এভাবে হাসলে তাইয়ানের কেন জানি ভিষণ ভয় লাগে। সে খারাপ কিছুর আভাস উপলব্ধি করতে পারছে। কেউ যে হাসির মধ্যে দিয়েও কারো অন্তর আত্মা কাঁপিয়ে তুলতে পারে। সেটা মুনতাসিমকে না দেখলে সে জানতেই পারত না।

–আমার কক্ষটা পরিষ্কার করতে বলো তাইয়ান। আমি আজকে এখানেই থাকব। আর মেহেভীন যেন কোনো অবস্থাতেই আমার গৃহের সামনে আসতে না পারে। সে দিকে খেয়াল। সে আসতে চাইলে তাকে যেন দূরেই বিদায় করে দেওয়া হয়। একটু পুড়ে দেখুক পুড়তে কতটা আনন্দ লাগে। তাইয়ানের কথা বলার সাহস হলো না। সে কিছু গার্ডদের ডেকে বাড়িটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিতে বলল।

চন্দ্র তার আলো ধরনীর বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে। চারদিক করে তুলেছে মনোমুগ্ধকর। হিম শীতল হাওয়া বইছে। মেহেভীন জানালা লাগানোর জন্য, জানালার কাছে আসতেই কিছু সময়ের জন্য থমকে গেল। মানুষটা তবে ফিরল তার চেনা নীড়ে। কত গুলো দিন ধরে ফোন করেছে সে। তার কর্ণে একটি বাক্যই এসেছে। মেহেভীন কিছুক্ষণ নিষ্পলক চাহনিতে বাসার দিকে চেয়ে থাকলো। অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠল। এবার সে মানুষটার রাগ ভাঙিয়েই ছাড়বে। মনের শহরে আনন্দের মিছিল শুরু হয়ে গিয়েছে। মেহেভীন জানালা লাগিয়ে শরীর চাদর মুড়িয়ে বাসার বাহিরে আসলো। তাইয়ান জানালার কাছে মেহেভীনকে দেখেছিল। সে দ্রুত কক্ষ থেকে বের হয়ে মেহেভীনের গৃহের সামনে আসলো। তাইয়ানকে দেখে মেহেভীন অবাক হলো! মেহেভীন কিছু বলার আগেই তাইয়ান বলল,

–আপনি এখন স্যারের কাছে যাবেন না ম্যাডাম। স্যার আপনার ওপরে ভিষণ ভাবে রেগে আছে। স্যারের রাগটা পড়ুক। তারপর না হয় স্যারের সাথে দেখা করবেন।

–আমি বেশি সময় নিব না। তার সাথে কিছু কথা বলেই চলে আসব।

–স্যরি ম্যাডাম বেয়াদবি মাফ করবেন। স্যারের কড়া নির্দেশ আছে। আপনাকে যেন স্যারের গৃহের দরজা
তেও আসতে দেওয়া না হয়। আমরা আপনাকে ওদিকে যেতে এলাও করব না। মেহেভীন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। ভেতরটা জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে। মানুষ টাকে সে কতটা বাজে ভাবে পুড়িয়েছে। আজ যখন নিজের বেলা এসেছে। তখনই গভীর ভাবে যন্ত্রনাটা অনুভব করতে পারছে। অনুভূতি দিয়ে যন্ত্রনা গুলোকে খুব কাছ থেকে স্পর্শ করতে পারছে। কথা গুলো কণ্ঠলানিতে এসে আঁটকে গিয়েছে। তাইয়ানের সাহস হলো না মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করার৷ দু’জন মানুষ দু’জনকে এতটা ভালোবাসার পরে-ও তাদের মাঝে এক আকাশ সমান দূরত্ব। ভালো নেই কেউ। তবুও যেন হার না মানার খেলায় মেতে উঠেছে। ভালোবাসার ভিত হচ্ছে বিশ্বাস। সেটা যদি দুর্বল থাকে সেটা শক্ত করার জন্য হলে-ও পুড়তে হবে। তাইয়ান বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। মেহেভীন একবার দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করল। বুক ভরা হাহাকার নিয়ে নিজের গৃহে ফিরে গেল।

তাইয়ান চুপিসারে গৃহে প্রবেশ করল। মুনতাসিম যেন টের না সেজন্য সোজা নিজের কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো। কথায় থাকে না। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। মুনতাসিম তাইয়ানের বিছানায় বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে। তাইয়ানকে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–ঘরের কথা পরকে বলা আমি পছন্দ করি না। প্রথম বার ভুল করেছ। মাফ করে দিলাম। এমন ভুল যেন দ্বিতীয় বার না করা হয়। সমস্ত তথ্য প্রমাণ জোগাড় করেছ?

–জি স্যার।

–আর সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সমস্ত ভিডিও মুছে ফেলা হয়েছে তো? এক চুল পরিমাণ সেই ঘটনা নিয়ে কোনো বর্ণনা নেই তো।

–কোথাও নেই স্যার সব জায়গা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এখন যদি কারো ফোনে সেভ থাকে। তবে সেটা থাকলে থাকতে পারে। কিন্তু সে-সব ভিডিও যদি কেউ প্রচার করার চেষ্টা করে। তাহলে তার জেল হয়ে যাবে। কারো ফোনে কোনো ভিডিও থাকলে, সেটা প্রশাসনের চোখে পড়লে কঠিন শাস্তি পেতে হবে তাকে। তাই কাজেই এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।

–তোমাকে কে বলল আমি দুশ্চিন্তা করছি?

–স্যরি স্যার।

–কালকে যেন টপ নিউজে থাকে সেদিনের অধিকাংশ ঘটনাই সব মিথ্যা। আশা করি আমাকে বেশি কিছু বলতে হবে না। সকাল সকাল যেন খবরটা দেখতে পারি। ঘরের লোককে আমি বাসায় গিয়ে দেখে নিব। মুনতাসিমের কথায় তাইয়ানের মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। সে মলিন মুখশ্রী করে মুনতাসিমকে সম্মতি জানালো। মুনতাসিমের মন মতো কাজ হয়ে যাবে। আজকে মুনতাসিমের নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। বুকের মধ্যে বসে থাকা ভারি পাথরটা মুহুর্তের মধ্যে নেমে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাইয়ানের কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল সে।

রজনীর আঁধার কেটে গিয়ে প্রভাতের আলো ধরনীকে করেছে আলোকিত। চারদিক কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। শীত কাল মেহেভীনের ভিষণ প্রিয়। যেখানে মানুষ শীতের ভয়ে কম্বলের নিচে থেকে বের হতে ভয় পায়। সেখানে মেহেভীন রোজ সকালে ঘাসের ডগায় জমে থাকার শিশির বিন্দু গুলো ছুঁয়ে দেখে। মাঝেমধ্যে জুতা খুলে ভিজিয়ে নেয় দু’টি চরণ। আজকেও বের হয়েছিল মেহেভীন। কিছুদূর যেতেই রাস্তার মাঝখানে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। মানুষটা দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে। মানুষটাকে চিনতে এতটুকুও সময় নিল না মেহেভীন। ধীর গতিতে মুনতাসিমের কাছে এগিয়ে গেল। কোমল কণ্ঠে বলল,

–কেমন আছেন?

–মানুষ মনে আঘাত করে শরীরের খবর নেয়। এত সুন্দর অভিনয় মানুষের দ্বারাই সম্ভব।

–মুনতাসিম।

–ডোন্ট কল মি মুনতাসিম অ্যাট অল। জাস্ট কল মি স্যার। উইল রিমেম্বার। মুনতাসিমের কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল মেহেভীন। বুকের মধ্যখানে ভিষণ যন্ত্রনা হচ্ছে। মেহেভীনকে উপেক্ষা করে মুনতাসিম গৃহের দিকে চলে গেল। মেহেভীন পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। মানুষটা যে তার সাথে কথাই বলতে চাইছে না। সে কিভাবে মানুষ টার রাগ ভাঙাতে সক্ষম হবে।

মুনতাসিমের মনটা মুহুর্তের মধ্যে বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। প্রিয় মানুষ গুলো কি জানে না। তাদের আঘাত করার পরে ওপর প্রান্তের মানুষ আঘাত করা মানুষটার থেকে বেশি পুড়ে। তাহলে জেনে শুনে কেন সামনে আসে? এই যে সে মেহেভীন কে আঘাত করল। মেহেভীনকে পোড়াতে চাইল। এখন সে মেহেভীনের থেকে দশগুণ পুড়ছে। সে মানুষ টাকে যতটা আঘাত করল। সেই কথা মনে হতেই ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। মুনতাসিম গাছের কাছে থাকা বেঞ্চে বসলো।

“বুঝেছেন ম্যাডাম। আপনাকে ভালোবেসে আপনার কাছেই সস্তা হয়ে গেলাম। আপনাকে বেশি দাম দিতে গিয়ে নিজের দামই কমিয়ে ফেললাম। আমার মান অভিমান, রাগ কখনো আপনার হৃদয় স্পর্শ করেনি। তাই রাগ ভাঙাতে আসলেন না। আপনি হয়তো বুঝেই গিয়েছেন। আমি আপনাকে কোনোদিনই ছাড়ব না। আমি এতটা সস্তা আপনার কাছে হতে চাইনি। আমি চাইনি আপনার কাছে সহজলভ্য হয়ে যেতে। আমি আপনাকে একটু বেশিই ভালোবেসেছি। তাই এতটুকু শাস্তি আমার প্রাপ্য ছিল। আপনি তো আমায় কোনোদিনই ভালোবাসেননি। দোষ তো আমারই আমি আপনাকে ভালোবেসেছি। পুড়তে হলে আমি পুড়ব। জানেন ম্যাডাম বেশি ভালোবেসে ফেলার মতো বড়ো দোষ আর নেই। মুনতাসিমের ভাবনার মাঝেই তাইয়ান বলল,

–স্যার গাড়ি বের করেছি। আমাদের ফিরতে হবে। মুনতাসিম বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে গাড়িতে উঠে বসলো। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে বোধহয় নির্লজ্জ তার পরিচয় দিয়ে বসবে। ছুটে যাবে মেহেভীনের কাছে। নিজেকে এতটা সস্তা বানানো ঠিক হবে না। মেহেভীনের উপলব্ধি করা উচিৎ। সে মুনতাসিমকে কি ভাবে আর মুনতাসিম আসলে কি। কথা গুলো ভাবছিল মুনতাসিম। গাড়ি ছুটে চলেছে তার নিজ গন্তব্যে। শীতের সকাল হওয়ায় গাড়িঘোড়া তেমন নেই। সবাই নিদ্রা দেশে তলিয়ে আছে।

ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে আটটা বাজে রুপা কাজ শেষ করে সিরিয়াল দেখতে বসেছিল। তার পছন্দের সিরিয়াল শুরু হতে দেরি আছে। তাই সে গানের চ্যানেল খু্ঁজছিল তখনই খবরের চ্যানেলে এসে আঁটকে যায়। খবর দেখে রুপার আঁখিযুগল আপনা-আপনি বড়ো বড়ো হয়ে গেল। সে দ্রুত মেহেভীনকে ডেকে নিয়ে আসলো। মেহেভীন খবর শুনে মলিন হাসলো। এমনটা হবার কথাই ছিল। সে আগেই বুঝেছিল জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুলটা সে করেছে।

–রুপা তোর ফোনটা একটু দে তো। রুপা নিজের কক্ষ থেকে ফোনটা নিয়ে এসে মেহেভীনের হাতে দিল। মেহেভীন রুপার ফোনটা নিয়ে নিজের কক্ষে চলে গেল। মুনতাসিমের নাম্বার বের করে ফোল দিল। দু’বার ফোন বেজে কেটে গেল। তৃতীয় বারের বেলায় মুনতাসিম বিরক্ত হয়ে ফোন তুলল।

–অনুগ্রহ করে ফোন কাটবেন না স্যার। আমি আপনার সাথে কয়টা কথা বলেই রেখে দিব। কথা দিচ্ছি এতটুকু বিরক্ত করব না। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল। বুকের মধ্যে উথাল-পাতাল করেছে। এমন একটা মুহুর্তের জন্য কতই না ছটফট করেছে সে। অথচ আজ সে দিনটি চলে আসলো। কিন্তু মুনতাসিমের কথা বলার উপায় নেই। মুনতাসিম কঠিন গলায় বলল,

–আপনার মতো ভালো মেয়ের আমার মতো চরিত্রহীন পুরুষের সাথে কথা বলা মানায় না। তাছাড়া আমার এত সময় নেই অযথা সময় নষ্ট করার। আপনার কাছে নিজেকে বেশি সস্তা বানিয়ে ফেলছিলাম। সেজন্য এতদিন আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গিয়েছেন। আজ থেকে প্রতিটি মুহুর্তে আপনাকে বোঝাব। আমি আসলে কি ছিলাম। আমাকে ভাঙার মতো সাধ্য সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো নেই। যে আমাকে ভাঙবে। তার কাছে আমি স্বেচ্ছায় টুকরো হয়ে যাই। আমার মতো খারাপ মানুষ দূরত্ব যদি আপনায় ভালো রাখে, সুখে রাখে। তাহলে এই দূরত্ব আকাশ পাতাল সমান হোক। তবুও আমার আপনার সুখ হোক। এমনিতেই আপনার পেছনে অনেক সময় অপচয় করে ফেলছি। আমার সময় এত বেশি হয়নি। যে যার তার পেছনে অপচয় করব। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম কল কেটে দিল। মেহেভীন আবার ফোন দেওয়ার চেষ্টা করল। তবে এবার ফোন বন্ধ দেখালো। মানসিক আঘাতের চিহ্ন থাকে না বলেই দুই প্রান্তের মানুষ আঘাত লুকিয়ে হাসছে। কিন্তু ভেতরটা যে পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছে। মানুষ কি সে খবর রাখে?

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

শীতের মাঝে-ও পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। চারদিকে মেহেভীনের নামে কানাঘুষা শুরু হয়ে গিয়েছে। খবরের কাগজে বড় বড় করে মেহেভীনকে নিয়ে লিখা হয়েছে। মেহেভীনের নামে দুই কোটি টাকা ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অন্যান্য জায়গায় খবরটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলে-ও মেহেভীনদের এলাকা এখন গরম। কটু কথা শোনাতে এক চুল পরিমাণ ছাড়ছে না কেউ। রাইমা বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তার মেয়ে এমন জঘন্যতম কাজ করতেই পারে না৷ ফরিদ রহমান পাশেই বসে ছিল। রাইমা বেগমকে কথা শোনানোর দারুণ একটা রাস্তার সন্ধান মিলেছে। এই সুযোগ তো তিনি কিছুতেই হাত ছাড়া করবেন না। সে তাচ্ছিল্য করে বলল,

–তোমার মেয়ে এতদিন এই ঘুষের টাকায় গরম দেখাতো। রাইমা আমাকে আজ একটা সত্যি কথা বলো তো। এই মেয়ে আদৌও আমার মেয়ে তো নাকি অন্য কারো? আমার সন্দেহ হয় জানো।

–মুখ সামলে কথা বলবে। তুমি কিন্তু দিনদিন ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছ। আমার হাতেই তুমি খু’ন হবে বলে দিলাম।

–পুরোনো প্রেম বুঝি জেগে উঠেছে। মেয়ের কাছে পুরোনো প্রেমিক আসে। সে খবর পেয়ে মেয়েকে হাতে রাখছো। তুমি কি ভেবেছো। আমি এসব কথা বুঝি না। কে কোন মতলবে কোন পয়েন্টে হাঁটছে। সে-সব খবর আমার হাতে আছে। যার আশায় আমাকে ছাড়ার চিন্তা করছো। আমি তাকেই ধরনীর বুক থেকে গায়েব করে দিব। নিজে তো নষ্ট ছিলে মেয়ে টাকে ও নষ্ট বানিয়ে ফেলছো। নষ্ট মায়ের নষ্ট মেয়ে তৈরি হয়েছে। কথা গুলো বলেই দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। রাইমা বেগম শীতল দৃষ্টিতে ফরিদ রহমানের যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে। দৃষ্টি যেন মনের কথা বলে দিচ্ছে। সামনে ভয়ংকর কিছু হতে চলছে। শান্ত নদীর মতো স্থীর হয়ে গেল রাইমা বেগম। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে মেয়েকে ফোন দিলেন। মেহেভীন উত্তেজিত হয়ে বলছে,

–আমি এমন জঘন্যতম কাজ করিনি আম্মু। সবাই আমাকে অবিশ্বাস করছে। তুমি অন্তত আমাকে বিশ্বাস করো।

–আমি জানি আমার মেয়ে কেমন। তুমি উত্তেজিত হোস না। ঠান্ডা মাথায় ভাবতে থাক কে তোর নামে এমন অভিযোগ করতে পারে। আমার থেকে তোর শ্রবণ শক্তি প্রখর। তুই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুনরায় স্মরন কর। তাহলেই নিজের উত্তর পেয়ে যাবি।

–আমার একজনকে সন্দেহ হয় আম্মু। আমি অবশ্যই তার সাথে দেখা করব। কিন্তু আমার মান সন্মান যে সব নষ্ট হয়ে গেল। আল্লাহ সব সময় আমার সাথেই কেন এমন করেন। আমি কি খুব বেশি পাপ করে ফেলছি?

–এসব কথা বলতে হয় না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের দুঃখ কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করেন। কখনো আল্লাহ তায়ালার ওপরে নিরাশ হবি না। তার ওপরে ভরসা রাখ। সে তোর থেকে যতটুকু কেঁড়ে নিবে। তার থেকে দ্বিগুন ফিরিয়ে দিবে অপেক্ষা শুধু সময়ের। তোর বাবা ফোন দিলে একদম ধরবি না। নিজের কাজে মনযোগ দে। আমি তোর ওপরে আশা রাখছি। তুমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবি। রাইমা বেগম মেয়েকে ভরসা দিয়ে ফোন রেখে দিলেন। মেহেভীন গভীর চিন্তা মগ্ন হয়ে উঠল। কে তার সাথে এমন কাজ করতে পারে। সেটাই তার ভাবনাতে আসছে না। তখনই তার খেয়াল আসলো ইউএনও সাহেবের সাথে তার একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিল। সে বলেছিল মেহেভীনকে দেখে নিবে। মেহেভীনকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করবে। তবে সে-ই কি কিছু করল। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া তো এমনি এমনি অভিযোগ উঠবে না। সবকিছু মাথার ওপরে দিয়ে যাচ্ছে মেহেভীনের। সে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভাবতে হবে। এভাবে ঘাবড়ে গেলে চলবে না। সমস্যা যখন এসেছে সমস্যার সমাধান তাকেই করতে হবে। সে মনস্থির করে নিল বিকালে ইউএনও সাহেবের সাথে দেখা করতে যাবে।

গোধুলি আলোয় ধরনীর সৌন্দর্য দ্বিগুন বেড়ে গিয়েছে। এই মনোমুগ্ধকর কর পরিবেশ কেউ উপভোগ করতে ব্যস্ত। কেউ বা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য ছুটে চলেছে শহরের অলিতে-গলিতে। চারদিকে এত মানুষ তবুও মেহেভীনের নিজেকে ভিষণ একা মনে হচ্ছে। সবকিছু থেকে-ও সে আজ শূন্য। ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ভিষণ। এই মুহুর্তে কারো একটু সঙ্গ ভিষণ ভাবে প্রয়োজন তার। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ইউএনও সাহেবর গৃহের সামনে চলে আসলো। গাড়ি থেকে নেমে দরজায় কলিং বেলে চাল দিল। একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। মেয়েটি নরম কণ্ঠে বলল,

–কাকে চাই? মেহেভীন নিজের পরিচয় দিল। তারপর মেয়েটি মেহেভীনকে বসিয়ে রেখে উপরে চলে গেল। একটু পরেই রেহান আঁখিযুগল ডলতে ডলতে ড্রয়িং রুমে আসলো। সবে মাত্র বাসায় এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। তখনই কাজের মেয়ের ডাক শুনে বিরক্ত হয় সে। কিন্তু যখন মেহেভীনের নাম শুনে, তখনই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। শরীরে কাপড় পরিধান করেই নিচে আসলো। হাসোজ্জল মুখশ্রী করে মেহেভীনের সামনে বসলো।

–আকাশের চাঁদ টা আমার গৃহে তার চরণ ফেলল। আমার গৃহেটা পবিত্র হয়ে গেল। এত সুন্দর ফুল যদি সারাজীবন আমার গৃহে বাস করত। তাহলে আমার জীবনটা সার্থক হয়ে যেত। তা কি মনে করে সুন্দরী রমনী আমার গৃহে পদচারণ করল। মেহেভীন ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রেহানের দিকে। মেহেভীন শান্ত কণ্ঠে বলল,

–আপনি আমার সাথে এমনটা না করলে-ও পারতেন স্যার। মেহেভীনের কথায় রেহান বিস্ময় নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীনের বলা একটি বাক্যও তার বোধগম্য হলো না। সে চিন্তিত হয়ে মেহেভীনকে প্রশ্ন করল,

–আমি কি করেছি তোমার সাথে?

–ব্যক্তিগত সমস্যা ব্যক্তিগতই রাখা ভালো ছিল। হিংসা মানুষকে ধংস করে দেয়। সাথে নষ্ট করে দেয় মানুষের মনকে। আপনি আমার এত বড় ক্ষতি না করলেও পারতেন। এবার রেহান বুঝল মেহেভীন কিসের কথা বলছে। তার মুখশ্রীতে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল। সে বিরক্তিকর মুখশ্রী করে বলল,

–আগেই বলেছিলাম। আমার সাথে লাগতে এসো না৷ ফলাফল ভালো হবে না। কিন্তু তোমার কাছে মন্ত্রী সাহেবের টেস্ট বেশি ভালো লাগে। একটা বার আমায় টেস্ট করে দেখতে পারতে। মন্ত্রী সাহেবের থেকে আমার টেস্ট ভালো ছিল৷ হীরা ফেলে কয়লার পেছনে ছুটলে এমনই হয়। রেহানের কথায় মেহেভীনের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে ক্রোধে দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আছে। এর আগেও রেহান তাকে নোংরা নোংরা কথা বলেছে। মেহেভীন সেগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। রেহান দিন দিন তার সীমা অতিক্রম করে ফেলছে। মেহেভীন শীতল কণ্ঠে বলল,

–আপনি আমার বিরুদ্ধ করা অভিযোগ গুলো তুলে নিন।

–তুমি আমার হয়ে যাও। শুধু অভিযোগ কেন তোমাকেও তুলে নিয়ে আসব। মেহেভীনের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে উঠে দাঁড়াল। রাগান্বিত হয়ে চিৎকার করে বলল,

–আমি যদি ফেঁসে যাই স্যার। তাহলে আপনাকেও আমি ফাঁসিয়ে দিব। জেলের ভাত আমি একা কেনো আপনাকেও খাওয়াব। কথা গুলোই বলেই মেহেভীন বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে মেহেভীন গৃহ ত্যাগ করল। মেহেভীন চলে যেতেই দু’জন আগন্তুক বের হয়ে আসলো। তিনজনের মুখশ্রীতে রহস্যময় হাসি। রেহান দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–শান্ত মস্তিষ্কে মেয়েটা আমাকে হুমকি দিয়ে গেল। এখন মেয়ে টাকে আমার কি করা উচিৎ? একজন আগন্তুক বলল,

–মে’রে দিন শা’লী’কে বহুত জ্বালিয়েছে। এবার ওর ম’রা’র সময় এসে গিয়েছে। সামান্য একটা মেয়ের হুমকিতে ভয় পেয়ে গেলেন ইউএনও সাহেব।

–আমাকে জ্ঞান না দিয়ে তুমি তোমার চিন্তা করো। ধরা পড়ে গেলে বাঁচতে পারবে তো।

–আমাকে ধরা এত সহজ নয়। দ্বিতীয় আগন্তুক বলল,

–নিজেকে নিয়ে এতটা গর্ব করা উচিৎ নয়। আমার মনে হয় তোমার এখন যাওয়া উচিৎ। নয়তো তুমি ধরা পড়ে যাবে। দ্বিতীয় আগন্তুকের কথায় সায় মেলালো রেহান। প্রথম আগন্তুক বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে গৃহ ত্যাগ করল। প্রথম আগন্তুক চলে যেতেই দ্বিতীয় আগন্তুক বলল,

–ওকে সরিয়ে না দিলে আমরা ধরা পড়ে যাব। মেহেভীনের সাথে ওকে ও আমরা গায়েব করে দেই স্যার? রেহান কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলল,

–এখানো সময় হয়নি ওকে শেষ করে দেওয়ার। ওর থেকে এখনো আরো তথ্য নেওয়া বাকি আছে। তুমি এখন আসতে পারো। আমি তোমাদের আবার পরে ডেকে নিব। রেহানের কথায় দ্বিতীয় আগন্তুক গৃহ ত্যাগ করল।

বেলকনির গ্রীল ভেদ করে শীতল হাওয়া এসে মুনতাসিমের শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে। পরম আদুরে ভাবে শীতল আলিঙ্গনে কাঁপিয়ে তুলছে সমস্ত দেহ। নিজেকে এলোমেলো রাখতেই বেশি ভালোবাসে সে। তাইয়ান কফির মগ হাতে নিয়ে মুনতাসিমের কক্ষে আসলো। কক্ষে না পেয়ে বেলকনিতে আসলো মুনতাসিমের হাতে কফির মগটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,

–স্যার ম্যাডামের বিষয়ে কিছু শুনেছেন?

–এসব বিষয়ে খবর রাখা কি আমার কাজ তাইয়ান?

–স্যরি স্যার আসলে ম্যাডামের নামে ঘু’ষ খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

–তো আমি কি করব তাইয়ান?

–এই সময়টা আপনি ম্যাডামের পাশে থাকলে ম্যাডাম মনে জোড় পেতো।

–তোমার ম্যাডামের পাশে থাকাই কি আমার কাজ? আমার আর কোনো কাজ নেই? তুমি যাও আমি একা থাকতে চাই। বাসার সবাইকে ড্রয়িং রুমে আসতে বলো। আমার সবার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। মুনতাসিমের কথা শেষ হবার সাথে সাথে তাইয়ান অনুমতি নিয়ে বিদায় নিল। মুনতাসিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীনের সাথে বোধহয় আকাশ টারও মন খারাপ। কালো মেঘে ঢেকে আছে আকাশটা। অন্য দিন চন্দ্রের আলোয় আলোকিত করে আঁধারে ঘেরা ধরনীকে। মুনতাসিম কফি খাওয়া শেষ করে নিচে আসলো। সবাই মুনতাসিমের জন্য অপেক্ষা করছিল। মুনতাসিম আসতেই পুরো পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মুনতাসিম এসে সোফায় বসলো। তার ফুপিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–এবার বলুন ছেলে হিসেবে আমাকে আপনার কেমন লাগে? মুনতাসিমের কথায় সুফিয়া চৌধুরীর মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। সে মুখশ্রী কালো করে বলল,

–তুই হচ্ছিস চাঁদ। আর চাঁদ হয়ে বামুনে হাত দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। আমার ক্ষমা করে দে বাজান। আমি আর কখনো এমন জঘন্যতম অপরাধ করব না। কি করব বল। আমি তো একজন মা। আর একজন মা কখনো তার মেয়ের চোখের পানি সহ্য করতে পারবে না। আমিও মেয়ের জন্য নিকৃষ্ট মন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছি৷ আমার মেয়ে তোকে চাইলেই তো হবে না। তোকে ও আমার মেয়েকে চাইতে হবে। এটা আমি ভালো মতোই বুঝে গিয়েছি। তুই যদি না চাস আমরা এ বাড়িতে থাকি। তাহলে কালকেই এ বাড়ি ত্যাগ করব।

–আপনি আমার ফুপি জন্য এখনো কথা বলতে পারছেন। এমন ভুল দ্বিতীয় বার হলে ভুল যাব আপনি আমার ফুপি। জ্যা’ন্ত পুঁ’তে ফেলব একদম। আমার চরিত্রে দাগ লাগানোর অধিকার আমি আপনাদের দেইনি। আর আপনাদের পেছনে যে কলকাঠি নাড়ছে। আমি তাকে-ও সাবধান করে দিচ্ছি। মুনতাসিমকে যেন সে এতটা দুর্বল না ভাবে। কে কোথায় যাচ্ছে কার সাথে মিশে আমাকে মা’রা’র পরিকল্পনা করছে। সবকিছু মুনতাসিমের মস্তিস্কে নোট করা আছে। আমার রক্ত বলে সে পার পেয়ে যাবে। এমনটা ভাবার দরকার নেই। আজ আমি শান্ত আছি। আমাকে শান্ত থাকতে দিন। আমি যেদিন ধরব। সেদিন কেউ বাঁচতে পারবে না বলে দিলাম। কথায় আছে না। চোরের দশ দিন আর সাধুর একদিন। ভালোবাসি বলে আমাকে এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কারন নেই। ভালো যেমন বাসতে পারি। ঠিক তেমনই ঘৃণা করে রক্তাক্ত করে দিতে-ও জানি। ঠান্ডা মাথায় সাবধান করে গেলাম। আমার সাথে গেম খেলতে হলে পাকাপোক্ত খেলোয়াড় হতে হবে। গোবর ভরা মাথা নিয়ে মুনতাসিমকে শেষ করা যাবে না। কথা গুলো বলেই স্থান ত্যাগ করল। পুরো পরিবেশে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরলো। একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। মুনতাসিম কাকে হুমকি দিয়ে গেল। এখানে সবাই পরিবারের আপন জন। আপন মানুষ কি কখনো মুনতাসিমের ক্ষতি করতে পারে। হ্যাঁ পারে তাইয়ানের মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করলে, যে কেউ সহজেই ধরে ফেলতে পারবে। তাইয়ান মুনতাসিমের বলা কথা গুলো বুঝতে পেরেছে৷ সেজন্যই বোধহয় তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বেড়েছে। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। মনটা হাহাকার করে উঠছে।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

অন্ধকারের আচ্ছন্ন চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষ। ষড়যন্ত্রের শিকার যেন হচ্ছে ঘরের প্রতিটি দেওয়াল। না পারছে স্বৈরাচারী সব ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিতে আর না পারছে সহ্য করতে। তাদের নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র দেখে প্রকৃতিও তাদের থেকে ঘৃণায় দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়েছে। সেজন্য প্রভাতের আলোও তাদের স্পর্শ করছে না। অন্ধকার ঘরের মধ্যে নিজেদের আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত। থমকে রয়েছে ভোরের সকাল শরীর বিন্দু ঘাসের ডগায় জমতে ব্যস্ত। পাখিরা মগডালে বসে তার সুর তুলতে ব্যস্ত। কম্বলের উষ্ণতায় অলসতা ধরেছে বেশ। এই কনকনে ঠান্ডার মধ্যে ষড়যন্ত্রের বৈঠক বসেছে। পুরুষালী গম্ভীর কণ্ঠ স্বর ভেসে এল।

–এভাবে আর কতদিন মুখ লুকিয়ে থাকব? আমাকে হুকুম কেন দিচ্ছেন না! আমি আপনার কথা মতো বসে থাকতে পারব না৷ ঐ মুনতাসিম আমার পুরো জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। আমি তাকে ধংস করে দিয়ে ক্ষান্ত হব। যুবকের রক্তে রক্তে যেন প্রতিশোধের নেশা ঘুরে বেড়াচ্ছে। জমে যাওয়া হিম শীতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা তৈরি হয়েছে। ক্রোধে মস্তিষ্ক টগবগ করছে। দেহের সমস্ত রক্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ললাটের দু’টি রগ ফুলে উঠেছে। ভাইয়ের এমন চেহারার সাথে পরিচিত রমনী। সে আদুরে ভাবে ভাইয়ের কাধে হাত রাখল।

–তুমি তীরে এসে নৌকা ডুবিয়ে দিতে পারো না ভাইয়া। মুনতাসিম আমাকে ধরে ফেলছে। ঐ বাড়িতে থাকা আমার জন্য কতটা বিপদজনক সেটা তুমি আন্দাজ করতে পারছ? আমার এক একটা দিন আতঙ্ক নিয়ে বাঁচতে হয়। এই মনে হয় মুনতাসিম মৃত্যু নিয়ে আমার সামনে হাজির হবে৷ সে শান্ত মস্তিষ্কের মানুষ তোমার থেকে দ্বিগুন ক্রোধ তার৷ সে তোমার মতো কথায় কথায় জ্বলে উঠে না। মানুষকে কিভাবে কথার যন্ত্রনায় রক্তাক্ত করে দিতে হয়৷ সেটা মুনতাসিমের থেকে শিখতে পারো না। বোনের কথায় জ্বলে উঠল যুবক। দুই ভাই বোনের বিতর্ক দেখে বেশ বিরক্ত জাফর ইকবাল। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমি তোমাদের ফালতু ড্রামা দেখার জন্য কনকনে ঠান্ডার মধ্যে আয়শী নিদ্র থেকে বেড়িয়ে আসিনি। আমার এত বছরের সাধ্য সাধনার ফল সব মুনতাসিম নিয়ে গেছে। আমার ভেতরটায় কি হচ্ছে তোমরা একবার ভেবছ? প্রতিশোধ আগুনে আমি শতবার মৃ’ত্যু বরন করি। মুনতাসিম কে চাইলেই মা’রা যায়। তাকে মা’রা’র পরে যদি ধরা পড়ে যাই। সে হ’ত্যা’র কোনো মূল্য থাকবে না। তাকে মারতে হলে এমন ভাবে মারতে হবে। যেন সাপও না ম’রে আর লাঠিও না ভাঙে৷ জাফর ইকবালের কথায় রক্তিম চোখে জাফর ইকবালের দিকে দৃষ্টিপাত করল যুবক। সে বজ্র কণ্ঠে বলল,

–আমি ধরা পড়ে গেলে যাব। তবুও মুনতাসিমের মৃত্যু আমি দেখতে চাই। প্রতিটি সেকেন্ড আমি যেমন যন্ত্রনায় ছটফট করি। তার থেকে দ্বিগুন যন্ত্রণা দিয়ে আমি মুনতাসিমকে মারব। সে বাঁচার জন্য ছটফট করবে পাশে কাউকে চাইবে। পানির জন্য আহাজারি করবে৷ কিন্তু সে কিছু পাবে না কিছু না। আমার থেকে আমার ভালোবাসার মানুষকে করেছে আলাদা। একটা জঙ্গল আমার কাঁধে দিয়েছিল ঝুলিয়ে, আমি সেই জঙ্গলকে খু’ন করে লা’শে’র ফ্রিজিং ড্রয়ারে রেখে আসছি। আমার মন যখন থেমে যায়। তখন আমি গিয়ে তার কুৎসিত মুখশ্রী দেখে আসি ভেতরে দমে যাওয়া আগুন টা আবার দাউদাউ করে জ্বলে উঠে। ভাইয়ের কথায় রমনীর অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। তার চেনা ভাইটা কিভাবে অপরিচিত হয়ে গেল। সবকিছুর জন্য তার মুনতাসিমকে দায়ী মনে হয়। সে যদি তার ভাইয়ের ভুল গুলো মাফ করে দিয়ে, একটা সুখী পরিবার উপহার দিতে পারতো। তাহলে আজ চৌধুরী ভবন হয়ে উঠল আনন্দের রাজত্ব। সেখানে সুখ আর শান্তি বসবাস করতো। রমনীর ভাবনার মাঝেই জাফর ইকবাল বলল,

–তুমি তো চৌধুরী বাড়িতে থাকো তোমাকেই কাজটা করতে হবে। যদি-ও বাসার চারপাশে সিসি ক্যামেরার অভাব নেই। তবুও তোমাকে একটা রিস্ক নিতেই হবে। তুমি যেদিন কাজটা করবে সিসি ক্যামেরা গুলো অফ করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। মুনতাসিমের গাড়ির ব্রেক অকেজো করে দিবে। আর না হলে যেদিন মুনতাসিম কম গার্ড নিয়ে বের হবে। সেদিন আমাকে ইনফর্ম করবে বাকিটা আমি বুঝে নিব। জাফর ইকবালের কথা শেষ হবার সাথে সাথে যুবক বলল,

–তাহলে আমি কি করব?

–ভোটের আগে যেমন আড়াল থেকে মা’রা’র চেষ্টা করেছ। কিন্তু মা’র’তে ও পারোনি আবার তোমায় ধরতেও পারেনি। জাফর ইকবালের কথায় রমনী তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলল,

–এই জন্যই বোধহয় জনগণ আপনাকে ভোট প্রদান করা ছেড়ে দিয়েছে। মস্তক ভর্তি ক্রিমিনালি বুদ্ধি থাকলে-ও কাছের মানুষদের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা আপনার নেই। সে সবকিছু জানে জেনেও চুপ আছে। পরিবারের লোক বলে সুযোগ দিচ্ছে নিজেকে শুধরে নেওয়ার এখানেই আপনার আর তার মধ্যে পার্থক্য। এতটুকু বাচ্চা মেয়ে তাকে শান্ত মস্তিষ্কে অপমান করে দিল। এটা তার সহ্য হলো না সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমাকে একদম জ্ঞান দিতে আসবে না। তোমার বহুত আগে ধমনীর বুকে এসেছি৷ বুদ্ধি হওয়া বয়স থেকে মানুষ চিনতে শিখেছি। মুনতাসিমকে নিয়ে এতটা গলাবাজি করো না। কখন ছোবল দিয়ে বসবে তা গুনাক্ষরে ও টের পাবে না। দরকার পড়লে ভাতের সাথে বি’ষ মিশিয়ে দাও। এত সহজে কেউ ধরতে পারবে না। বাহিরের লোকের সাথে লড়াই করা যায়। কিন্তু ঘরের লোক শত্রুতা শুরু করলে মৃত্যু অনিবার্য। জাফর ইকবালের কথা কর্ণকুহরে আসতেই যুবক টি ক্রোধে কক্ষ ত্যাগ করল। সময় অতিক্রম হতে শুরু করেছে। সে-ও বিদায় জানিয়ে গৃহের উদ্দেশ্য রওনা দিল।

মেহেভীন এত বুদ্ধি খাটিয়ে ও সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারল না। মাথায় হাত দিয়ে নিজের কক্ষে বসে ছিল মেহেভীন। মস্তিষ্কের সাথে থেমে গিয়েছে সমস্ত শরীর বুদ্ধি গুলো সব লোপ পেয়েছে। চিন্তা গুলো অকেজো হয়ে গিয়েছে। মস্তক টা হালকা হতে চাইছে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠল। রুপা কাজের জন্য বাহিরে গিয়েছে। মেহেভীন উঠে এসে নিয়েই দরজা খুলে দিল। মেহেভীনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক টি নিজের পরিচয় মেহেভীনকে দিল। সে মেহেভীনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–আপনার কেসের তদন্তের দায়িত্ব যেহেতু আমি পেয়েছি। আশা রাখছি আপনি আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে আসবেন না। আমি আপনার পুরো বাড়ি তল্লাসি করতে চাই। নেহালের কথা শুনে মেহেভীন সরে দাঁড়াল। নেহাল পুরো বাড়ি তল্লাসি করল। সে বাড়ির মধ্যে সন্দেহজনক কিছুই পেল। সে মেহেভীনের সামনে আসলো। গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

–আপনি কি আসলেই অপরাধটা করেছেন?

–আমি করিনি।

–যদি করে থাকেন আমার কাছে স্বীকার করতে পারেন। আমি আপনার শাস্তি কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।

–যে কাজ আমি করিনি। আমি কেন সে কাজের মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিব?

–আপনি যা বলছেন বুঝে শুনে বলছেন তো?

–আমি মিথ্যা কথা বলি না।

–আপনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণও করতে পারেননি। এর জন্য আপনার কিন্তু জেল হবে।

–জেল হলে হবে। তবুও আমি মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিব না।

–আমার কাজ হয়ে গিয়েছে আমি আসছি। কথা গুলো বলেই নেহাল গৃহ ত্যাগ করল৷ মেহেভীন নেহালের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। ভেতরটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করেছে। মিথ্যার বোঝা এতটা ভারি হয় কেন? দম বন্ধ হয়ে আসছে তার এমন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সে আগে কখনো পড়েনি। বাবার কথা স্মরন করে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। এই সময় টাতে তার পাশে থেকে তাকে আগালে রাখতে পারতো। নিজের ভাবনাকে নিজেই ধিক্কার জানালো মেহেভীন। পরের দিনই মেহেভীনকে থানায় নিয়ে আসা হয়। অন্ধকার জেলের মধ্যে বসে অশ্রুকণা গুলো যেন বাঁধ মানছে না। সে নিঃশব্দে অশ্রু বিবর্জন দিচ্ছে। ভেতর থেকে একটা বাক্যই আসছে। আমার কেউ নেই। নিশ্চই নিঃশব্দে কান্না ভিষণ ভয়ংকর মানুষের দুঃখ কষ্ট গুলো যখন শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। দুঃখ গুলোর ভাগ নেওয়ার মতো কেউ থাকে না। পাশে এসে বসে বলে না এত চিন্তা কিসের আমি তো আছি। পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে নিজেকে সামলানো আর নিজেকে বোঝানো। যেটা মেহেভীনের নিজের সাথে করে যাচ্ছে। দুঃখের বোঝা ভারি হয়ে গেলেই মানুষ নিঃশব্দে কান্না করে। মেহেভীন সেটা হারে হারে উপলব্ধি করতে পারছে।

দু’টো দিন কে’টে গিয়েছে মেহেভীন জেলার অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দী হয়ে আছে। কেউ আসেনি মেহেভীনের খোঁজ নিতে। রুপা এসেছিল খাবার নিয়ে তাকে বেশিক্ষণ থাকতে দেওয়া হয়নি৷ মেহেভীনের মা মেয়ের জন্য পাগল প্রায় ফরিদ রহমান রাইমা বেগমকে দু’দিন ধরে ঘর বন্দী করে রেখেছে। সে চাইলেও আসতে পারছে না। ভেতরটা তার জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। ক্রোধে বশিভূত হয়ে গা’লি দিতেও দু’বার ভাবেনি। মায়ের দোয়া ধরনীর সমস্ত বিপদকে গ্রাস করে ফেলে। রাইমা মেয়ের জন্য অনবরত দোয়া করেই যাচ্ছেন।

দুই হাঁটু ভাজ করে মেহেভীন বসেছিল। তখনই পরিচিত কণ্ঠ স্বর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। মানুষটাকে দেখে ভেতরটা উথাল-পাতাল শুরু করে দিয়েছে। মুহুর্তের মধ্যে মনটা নিস্তেজ হয়ে গেল। সে ধীর গতিতে উঠে এসে মুনতাসিমের সামনে দাঁড়াল। মুনতাসিম সহজ সরল প্রশ্ন করল,

–কেমন আছেন? মেহেভীন মুনতাসিমের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,

–আমাকে এই অবস্থায় দেখে আনন্দ লাগছে না আপনার? কত অপবাদ, কত আপমান, কতই না দুঃখ দিয়েছি আপনাকে। আমি পাপ করেছিলাম আল্লাহ তায়ালা আমার পাপে শাস্তি দিচ্ছে। আমার করুন অবস্থা দেখে এই অধমের প্রতি দয়া জাগল বুঝি? মেহেভীনের কথায় মুনতাসিম হাসলো। সেই হাসিটা মেহভীনের হৃদয়টা রক্তাক্ত করে দিল। এই হাসি মুখটার হাসি সে কেঁড়ে নিয়েছে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই মুনতাসিম বলতে শুরু করল।

–আমি কখনোই আজ অব্দি আমার জন্য কাউকে নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিতে দেখিনি। কাউকে বলতে শুনিনি আপনি আমার চোখে সবচেয়ে সুন্দর একটা মানুষ। আপনার থেকে সুন্দর মানুষ আমি কাউকে দেখিনি। আমি আজীবন তিরস্কার নিয়েই বেড়ে উঠেছি। স্পেশাল হবার জন্য আমার মধ্যে কোনোকিছুই ছিল না। আমার যা কিছু আছে সেটুকু দিয়েই সবাইকে স্পেশাল বানানোর চেষ্টা করি। আমার জন্য কেন জানি এতটুকুও কেউ করে না। মুনতাসিমের কথায় বাকরূদ্ধ হয়ে গেল মেহেভীন। অপরাধীর ন্যায় মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেভীনের মলিন মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে মুনতাসিমের ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এই মায়াবী মুখশ্রীতে শুধু হাসি মানায় কান্না নয়। মেয়েটা কি জানে না তার এক একটি অশ্রুবিন্দু মুনতাসিমের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে তুলছে। দু’জনের মাঝে পিনপতন নীরবতা চলছে। মুনতাসিমকে দ্রুত কথা বলতে বলা হয়েছে। মেয়ে টার সামনে একদম দুর্বল হওয়া চলবে না। সে একটু গম্ভীর ভাব ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,

–ঘুষ খেয়েছেন ভালো কথা এত অল্প টাকা কেউ খায়! একটু বেশি করে খেতে পারতেন৷ একা একা ঘুষ খেলে এমনই হয়৷ আমাকে যদি ভাগ দিতেন তাহলে আজ আপনার এই দিন দেখতে হতো না। ভাববেন না আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি৷ আমার এক বন্ধুকে এখানে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। তার জামিন করাতেই এখানে এসেছি৷ আপনাকে কিন্তু এখানে বেশ মানাচ্ছে। কথা গুলো বলেই চলে গেল মুনতাসিম। পেছনে ফেলে গেল চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া মেহেভীনকে। মুনতাসিমের কাছে সে ভালো কিছু আশা করেছিল৷ কিন্তু মানুষটা তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে গেল। কণ্ঠ নালি দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল মেহেভীন। তাকে মানসিক ভাবে অসুস্থ করে দিয়ে চলে গেল মানুষটা। মানসিক ভাবে শান্তি না পেলে মানুষ দিন দিন পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে যায়। যে অসুস্থতার দুর্বলতা নিজে ছাড়া অন্য কেউ অনুভব করার ক্ষমতা রাখে না। মেহেভীন দেখল একজন হাসিখুশি মানুষ একটি ছেলের হাত ধরে বের হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষটা যে তার জান ফেলে রেখে যাচ্ছে। ভেতরটায় যে রক্তক্ষরণ বয়ে যাচ্ছে। হাহাকার করে উঠছে বুকটা, মানুষটা দিন-রাত যন্ত্রনায় ছটফট করছে। সেটা মেহেভীন দেখল না। তা কালো মেঘের ন্যায় আড়ালে ঢেকে গেল।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-২৫+২৬+২৭

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২৫
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

রজনীর আঁধার কেটে গিয়ে প্রভাতের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিটি মানুষ নিদ্রা দেশে তলিয়ে আছে। নির্ঘুম রজনী পার করেছে মুনতাসিম। অদ্ভুত ভাবে বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রনায় সারারাত ছটফট করেছে। তার মানতেই কষ্ট হচ্ছে মেহেভীন তাকে বিশ্বাস করে না। সে শক্ত মনের অধিকারী জন্যই হয়তো নিজেকে সামনে নিয়েছে। ভাগ্যিস ভেতরের খবর কেউ দেখতে পায় না। তাহলে সবাই এতক্ষণে মুনতাসিমের জন্য আকুল হয়ে উঠত। ভেতরটা রক্তাক্ত করে দিয়ে চলে গিয়েছে মেয়েটা। বেহায়া মন শুনেনি মেয়েটাকে বোঝানার জন্য আরো একবার চেষ্টা করেছিল। যার পরিনাম সে এখন প্রেয়সীর ব্লক লিস্টে। সারারাত না ঘুমানোর ফলে আঁখিযুগল রক্তিম ধারণ করেছে। প্রয়োজনের তুলনায় চোখ ফুলেছেও বেশ। বেলকনির গ্রীল ধরে আকাশ পাশে চেয়ে আছে মুনতাসিম। মুখ দিয়ে অস্ফুত স্বরে বেড়িয়ে আসলো,

–আপনি আমার মুখ দেখতে চান না। আমিও আপনার সামনে যাব না। ভালোবাসলেই যে তাকে পেতে হবে। তার কোনো মনে নেই। সব পেয়ে গেলে আক্ষেপ ফুরিয়ে যাবে। আক্ষেপ করার জন্য হলে-ও আমি আপনার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করব। নিজের সক্রিয়তা কতটুকু বজায় রাখতে পারব। তা আমি জানি না তবে আপনি আমার সামনে আসলে, আমি সবকিছু ভুলে আপনাতেই মিশে যাই। ভুলে যাই সব অভিমান অভিযোগ। আপনি মানুষটা আল্লাহ তৈরি নিখুঁত সুন্দর মানবী। আমার অভিমান গুলোও আপনার প্রেম পড়তে বাধ্য হয়৷ সেখানে আমি তো তুচ্ছ মানব। কথা গুলো আনমনে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো।

মাত্র দুই ঘন্টা ঘুমিয়েছিল মুনতাসিম। তখনই মুঠোফোনটা শব্দ করে বেজে উঠে। বিরক্তিতে মুখশ্রী কুঁচকে এল তার৷ সে নিদ্রা মিশ্রিত কণ্ঠে ফোন তুলল। ওপর পাশ থেকে তাইয়ানের চিন্তিত কণ্ঠ স্বর ভেসে এল। মুনতাসিম তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–কে সে? তাড়াতাড়ি আমাকে তার নাম বলো না হলে ফলাফল ভালো হবে না, বলে দিলাম।

–তাহিয়া ম্যাডাম এসব করেছেন। শুধু তাই নয় আপনাকে নিজের স্বামী বলে পরিচয় দিয়েছে। সে আরো বলেছে সে দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আপনি তাকে নিয়মিত মা’রধর করেন। সে মেহেভীন ম্যাডামকে আপনার জীবন থেকে দূরে সরে যেতে বলছে। তাছাড়া মেহেভীন ম্যাডাম… তাইয়ানের কথা শেষ হবার আগেই মুনতাসিম কল কেটে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে ফুরফুরে মেজাজে ড্রয়িং রুমে আসলো। সেখানে সকাল সকাল চায়ের আড্ডা জমেছে বেশ। মুনতাসিম আয়েশী ভঙ্গিতে সোফায় গিয়ে, তার ফুপির পাশে গিয়ে বসলো। কিছুটা লাজুক মুখশ্রী করে বলল,

–আমাকে তোমার কেমন লাগে ফুপি? মুনতাসিমকে কখনো পরিবারের আড্ডায় বসতে দেখা যায় না। মুনতাসিমকে দেখে সবাই বিস্ময় নয়নে তার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুহুর্তের মধ্যে পরিবেশ শীতল হয়ে উঠল। নিস্তব্ধতার রাজত্ব চলছে চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি কোণায়। এ যেন ঝড় আসার পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছে। সবাইকে শীতল হয়ে যেতে দেখে সুফিয়া চৌধুরীর মুখে ভাঁজ পড়ল। সে আনন্দিত হয়ে মুনতাসিমকে বলল,

–তোর মতো ছেলে যার ঘরে হবে। সে তো ভাগ্যবতী রে। তোর মতো হীরাকে অপছন্দ করার কোনো কারন আছে। এতদিন পর বুঝি ফুপির কথা মনে পড়ল। সে কবে এসেছি। সারাদিন বাসায় থাকিস না। রাতে কোনোরকম আসিস। ভোর হবার সাথে সাথে তোর খোঁজ পাওয়া যায় না। তুই আমাকে আগে কতটা ভালোবাসতি রে মুনতাসিম। এখন কি ফুপিকে আর ভালো লাগে না।

–আমি এত সহজে আমার ফুপিকে ভুলতে পারি। আমি আমার ফুপির শখের ফুলদানিটা ভেঙে ফেলে দিয়েছিলাম। শাস্তি স্বরুপ শীতের দিনে কনকনে ঠান্ডা পানিতে দুই ঘন্টাটা ডুবে থাকতে হয়েছিল। ছোট্ট মুনতাসিমের সহ্য ক্ষমতা কম ছিল। মা টাও ছিল না। এই সুযোগটা হাতিয়ে নিলেন। আমার মাকে আল্লাহ নিয়ে গিয়েছেন তার কাছে। এই সুযোগ হাত ছাড়া করা যায়। সেদিন আমি পানিতেই জ্ঞান হারালাম। ভাগ্য সহায়ক ছিল বলেই আব্বা আমায় খুঁজতে এসে পেয়ে যায়। তারপর দু’দিন আমার কোনো জ্ঞান ছিল না। পনেরো দিন হসপিটালের বেডে থাকতে হয়েছে। কত রাত যন্ত্রনায় ছটফট করেছি। মা মা করে ডেকেছি। ছোট্ট মুনতাসিমের পাশে কেউ ছিল না৷ আদরের সন্তানের জন্য সেদিন আব্বাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছি। সেদিনই উপলব্ধি করেছিলাম। যার মা নেই তার কেউ নেই কেউ না। একটু ভুল হলেই আপনার চড়,বিশ্রী ভাষায় গালি, আমার নামে সৎ মায়ের কাছে বি’ষ ঢালা সবকিছুই দেখেছি। এত ভালোবাসা কি এত সহজেই ভুলে যাওয়া যায় ফুপি। মনে নেই দুধের সাথে বি’ষ মিশিয়ে মা’র’তে চেয়েছিলেন। সেইদিনের ভালোবাসা আমি কখনোই ভুলব না। সেদিনের কথা মনে হলে আনন্দে আমার ভেতরটা ছটফট করে। মুনতাসিমের কথায় সুফিয়া চৌধুরীর সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। অতীতে করা পাপ গুনো যত্ন সহকারে মুনতাসিম তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটার মধ্যে দারুন প্রতিভা আছে। মিষ্টি কথায় কত সুন্দর করে অপমান দিল। সুফিয়া চৌধুরীর মুখটা দেখে মুনতাসিমের ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। পুরোনো ক্ষত যেন নতুন করে জাগ্রত হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত করে মুখশ্রীতে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,

–আমাকে জামাই হিসেবে কেমন লাগে আপনার? মুনতাসিমের কথায় রিয়াদ চৌধুরী বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। সবার দৃষ্টি মুনতাসিমের দিকে স্থীর। সমস্ত অপমান ভুলে সুফিয়া চৌধুরীর মুখশ্রী চিকচিক করে উঠল। সে কিছুটা আদুরে কণ্ঠে বলল,

–আমি জানতাম আমার বাবা আমার মনের কথা বুঝবে। আমি তোকে শক্ত করার জন্যই ছোট বেলার বারবার তোকে আঘাতপ্রাপ্ত করেছি। এই জন্য আজ তুই এতটা শক্ত হয়েছিস। কার জন্য হয়েছিস। আমার ওপরে রাগ করেই তো হয়েছিস। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল। সে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল,

–মুনতাসিম তার মায়ের মতো হয়েছে। তার মায়ের সহ্য ক্ষমতা ছিল বলেই, এই নিকৃষ্ট পরিবারে মানুষদের সাথে কতগুলো বছর সংসার করতে পারছে। আপনিই বলুন আপনাদের মানুষদের কাতারে ধরে?

–আমি তোমার ফুপি হই ভুলে যাচ্ছ!

–সামনে আপনি আমার শাশুড়ী হতে চলেছেন। আমি কি আমার শাশুড়ীর সাথে একটু মশকরা করতে পারি না। আচ্ছা আপনি রাগ করবেন না। এখন বলুন আপনার মেয়ে কোথায়? তাকে দেখার জন্য ভেতরটা ছটফট করছে। কবে থেকে তাকে দেখিনা। তার মায়াবী মুখশ্রী দেখে পরাণটা শীতল করতে চাই। মুনতাসিমের কথায় সবার আঁখিযুগল আপনা-আপনি বড় হয়ে গেল। কিন্তু সুফিয়া চৌধুরীর মুখশ্রীতে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। যে আশা নিয়ে এতদিন বুক বেঁধে ছিল। আজ সেই আশা পূর্ণতা পেতে চলেছে। সে আঙুল দিয়ে মাশরাফির পাশের কক্ষটা দেখিয়ে বলল,

–ওখানে তাহিয়া আছে। মুনতাসিম মুহুর্তের মধ্যে লাজুক মুখশ্রী করে ফেলল। লজ্জা মাখা কণ্ঠে বলল,

–আমি যাই আপনার মেয়ের সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে আসি। রিয়াদ চৌধুরী মুনতাসিমকে বাঁধা দিতে আসলে, মুনতাসিম রক্তিম দৃষ্টিতে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে। আঁখিযুগল দিয়ে তার আগুন ঝরছে। মুনতাসিম হাতের ইশারা করে দেখাল। সে তার কাজে বাঁধা সৃষ্টি করলে সে নিজেই নিজের শরীর গু’লি চালিয়ে দিবে। রিয়াদ চৌধুরী অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়লেন। একদিকে ছেলের জীবন অন্য দিকে তাহিয়ার জীবন। সে কাকে বাঁচাবে? অজানা ভয়ে বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ইতিমধ্যেই তাইয়ান রিয়াদ চৌধুরীকে সমস্ত কথা খুলে বলছে। ছেলেটা তার ভিষণ নিষ্ঠুর। মেয়েটা আবেগে বশিভূত হয়ে ভুল জায়গায় আঘাত করেছে। সে মুনতাসিমের ব্যক্তিত্বের আঘাত করেছে। মেয়েটাকে বাঁচতে দিবে না মুনতাসিম।

সূর্যের সোনালী রশ্মি মেহেভীনের মুখশ্রীতে আঁচড়ে পড়ছে। কালকে নিজেকে পাগল মনে হচ্ছিল মেহভীনের। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। অকেজো মস্তিষ্ক নিয়ে ছটফট করতে করতে নিদ্র দেশে তলিয়ে গিয়েছে। মাথাটা এখন বেশ হালকা লাগছে। ঘুম থেকে উঠলে অনুভব করা যায়। ঘুম হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। কালকে সমস্ত চিন্তায় একটা কাজও মস্তকে প্রবেশ করছিল না। মস্তিষ্ক গভীর ভাবে সজাগ হতেই কালকের সমস্ত ঘটনা মনে পড়ে গেল। নিজের অজান্তেই সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। ভেতরটা যন্ত্রনায় হুঁ হুঁ করছে। মানুষটার ব্যক্তিত্বে আঘাত করেছে সে। মানুষটা তাকে ক্ষমা করবে তো। মেহেভীন বিলম্ব করল না। দ্রুত ফোন বের করল। কোনোদিন কাউকে ফোন করার সময় তার হাত কাঁপেনি। তবে আজ কাঁপছে। অপরাধ বোধে ভেতরটা তচনচ হয়ে যাচ্ছে। দু’বার ফোন বেজে কেটে গেল। মেহেভীন চারবার ফোন করল। পাঁচ বারের বেলায় ফোনটা কেটে দিল। পরের বার ফোন করতেই মেহেভীন অনুভব করল নাম্বারটা ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। মেহেভীন সাথে সাথে মেসেজ করল। আমাকে একটা বার ক্ষমা করে সুযোগ দেওয়া যায় না৷ সত্যিটা সামনে নিয়ে আসার জন্য। মেসেজ ব্লকটাও মুহুর্তের মধ্যে হয়ে গেল। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে মেহেভীনের। এত বাজে ভাবে জ্বালা করছে মনটা। মেহেভীনকে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে, রুপা আসলো তার কক্ষে। কালকে মেহেভীন দরজা না লাগিয়েই ঘুমিয়েছিল। রুপাকে দেখে শান্ত দৃষ্টিতে একবার পরখ করে নিল মেহেভীন।

–আমি বোধহয় জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেই ফেললাম রুপা। সমস্ত শরীর যন্ত্রনায় জ্বলে যাচ্ছে আমার। মানুষটা আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না। আমার উচিত চিল৷ একটা বার ঐ মেয়েটাকে তার সামনে উপস্থিত করা। আমি নিজের কথা ভেবেছি। মানুষটাকে একটা বার বোঝার চেষ্টা করিনি। মানুষটা কালকে গ’লা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করছে, আমার সাথে একটু কথা বলার জন্য আমি স্বার্থপরের মতো তার নাম্বার ব্লক করে আরামে ঘুমিয়েছি। আল্লাহ ভালো জানেন কিভাবে মানুষটা রাত পার করেছেন। ফোন দিলাম আমার ফোনটা ধরল না রে রুপা। মানুষটা আমার জীবন থেকে চলে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচব। মেহেভীনের অসহায়ত্ব দেখে রুপার কোনো ভাবান্তর হলো না। তার মুখশ্রীতে বিরক্ত ফুটে উঠল।

–আপনি কার জন্য কষ্ট পাচ্ছেন আপা। যে মানুষটা আপনাকে ঠেকিয়েছে। আপনি যা করেছেন একদম ঠিক করেছেন। মানুষটাকে আমার একদম পছন্দ ছিল না। সেদিন ছাদে সে আমাকে অচেতন করে রেখে এসেছিল। আমি থাকলে তার সমস্যা হতো। আমাকে সরিয়ে আপনার থেকে সুযোগ নিতে চেয়েছিল। প্রথম থেকেই মানুষটার চরিত্রে সমস্যা ছিল। এমন চরিত্রহীন ছেলের জন্য এতটা কষ্ট পাবেন না। আপনার জন্য কত সুন্দর সুন্দর ছেলে পাগল। রুপার কথায় মেহেভীন মুহুর্তের জ্বলে উঠল। রক্তিম চোখে রুপার দিকে তাকিয়ে আছে। একবার রুপা বলে চেঁচিয়ে সাবধান করেছে। তবুও রুপা শুনছে না। মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে রুপার গালে থা’প্পড় বসিয়ে দিল।

–অন্যকে খারাপ বলার তুই কে? তুই নিজের যোগ্যতা ভুলে যাস না। তুই কি করে বেড়াস সেসব আমি জানিনা মনে করেছিস। আমার সামনে মুনতাসিমকে নিয়ে বাজে কথা বললে, তোর জিভ আমি টেনে ছিঁ’ড়ে ফেলব। আমার জিনিসে বলার অধিকার শুধু আমারই। আমার জিনিস নিয়ে কথা বলার অধিকার আমি তোকে দেইনি৷ তাকে খারাপ বললেও আমি বলব৷ ভালো বললেও আমি বলব। তুই যে মুনতাসিমকে আঁড়চোখে দেখিস৷ তোর মনের অন্তরালে কি চলে। সেটা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। আমার সামনে থেকে চলে যা। না হলে তোকে আমি খু’ন করে ফেলব। রুপা অশ্রুসিক্ত নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে৷ মেহেভীন রুপাকে উপেক্ষা করে ওয়াশরুমে চলে গেল।

তাহিয়া বই পড়ছিল। মুনতাসিম এসে দরজা লাগিয়ে দিল। মুখশ্রীতে তার স্বাভাবিক ভাব ফুটে উঠেছে। মুনতাসিমকে নিজের কক্ষ দেখে রহস্যময় হাসি হেসে উঠল তাহিয়া। তা মুনতাসিমের দৃষ্টি এড়ালো না। মুনতামিস আদুরে কণ্ঠে বলল,

–বই পড়ছিস? কি বই পড়ছিস জামাইকে কিভাবে আঁচলে বাঁধতে হয়।

–বাঁধতে আর পারলাম কই। বিয়েই তো করতে পারলাম না।

–এই তুই আমার সাথে মজা করছিস৷ তোর আঁখিযুগলের সামনে তোর অর্ধাঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বুঝি তোর পছন্দ হচ্ছে না। আমাকে কি আর তোর পছন্দ হবে৷ কোথায় তুই কোথায় আমি। বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে পারি বল৷ মুনতাসিমের কথায় তাহিয়া আঁখিযুগল বড় বড় করে তাকলো। মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত শরীর শীতল হয়ে উঠল। সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। মুনতাসিম তাহিয়ার কিছুটা কাছে গিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,

–বিয়ে করেছি বহুদিন হলো। কিন্তু বাসর করা হয়নি। তাই বউয়ের সাথে শুভ কাজটা সারতে আসলাম। তোর কোনো আপত্তি নেই তো আবার৷ মুনতামিসম লাজুক ভঙ্গিতে বলল। তাহিয়ার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। গলা শুকিয়ে কাট হয়ে আসছে। মুনতাসিম কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলল,

–আমি আমার বউকে কিছু করিনি জানিস। তবুও সে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। এটা কিভাবে সম্ভব জানিস কিছু। লজ্জায় তাহিয়ার মুখশ্রী নত হয়ে আসলো। মুনতাসিম ভালো মানুষির মুখোশ ছেড়ে বের হয়ে আসলো।

–আমার কাছে আমার চরিত্র শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ছোট থেকে বড় হয়েছি। কারো সাহস হয়নি আমার চরিত্রের দাগ লাগানোর। কিন্তু তুই তো আমার চরিত্রে সোজা কলঙ্ক লাগিয়ে দিলি। তোকে শাস্তি স্বরুপ কেমন মৃ’ত্যু দিলে ভালো হয় বল তো। তুই আমার বাবার রক্তের বোনের মেয়ে। আমি তোকে কষ্ট দিয়ে মা’রতে পারি না। কেমন মৃত্যু তোর পছন্দ। আর হ্যাঁ যে কাগজ গুলো মেহেভীন কে দেখিয়েছিস। সেগুলো তাড়াতাড়ি বের করে দে। তাহিয়া থরথর করে কাঁপছে। কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না। ভয়ে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। একদম দেওয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছে তাহিয়া। মুখশ্রীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে তার।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি সদস্যের মুখশ্রীতে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সবাই সুফিয়া চৌধুরীকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তিনি সবার সব কথা শোনার পরে, রাগান্বিত হয়ে বলছে। সবাই তাকে আর তার মেয়েকে ঈর্ষা করে। সেজন্য তার কানে বি’ষ ঢালছে। রিয়াদ চৌধুরী মাশরাফিকে অনবরত ফোন দিয়েই যাচ্ছে। মাশরাফির কক্ষের মধ্যে দিয়ে আরেকটা দরজা আছে। যেটা দিয়ে পাশের কক্ষে প্রবেশ করা যায়। মাশরাফির ফোন সাইলেন্ট থাকায় সে টের পাচ্ছে না। রিয়াদ চৌধুরীর ললাটে চিন্তার ভাজ পড়েছে কয়েকটা। তা দেখে সুফিয়া চৌধুরী বিরক্ততে নিজের মুখশ্রী কুঁচকে ফেলছে।

–তুই আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না। আমি তোকে কাগজ গুলো বের করে দিতে বলছি। এভাবে সঙ্গের মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমি তোর কাছে আসলে ফলাফল ভালো হবে না। আমার চরিত্রে কলঙ্ক লাগানোর কত গুলো সময় পেরিয়ে গেছে। তুই যে এখনো বেঁচে আছিস। এটাই তোর ভাগ্য ভালো। মুনতাসিমের কথায় তাহিয়ার রুহু পর্যন্ত কেঁপে উঠল। এত সহজে সে ধরা পড়ে যাবে। সেটা কল্পনা ও করতে পারেনি সে। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়েছে তার। সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তাহিয়াকে নিরব থাকতে দেখে মুনতাসিম দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–কাগজ গুলো দিবি কি না? হ্যাঁ অথবা না।

–না দিব না। কারন আমি তোমাকে ভালোবাসি ভাইয়া। আমার ভালোবাসার মানুষকে চোখের সামনে অন্য কেউ নিবে যাবে। সেটা আমি সহ্য করব না। যেটা আমার না সেটা কারো না।

–হুট করে ভালোবাসি বলাটা উপন্যাসের গল্পেই বেশি মানায়। কাউকে ভালোবাসি বলার আগে মানুষটার ভয় সম্পর্ক জানতে হয়। মানুষটার সীমাবদ্ধতা কতটুকু সেটা জানতে হয়। তার ঘৃণা, তার হতাশা, তার অপ্রাপ্তি, তার ভালো লাগা না লাগা, সবকিছু সম্পর্কে জানতে হয়। মানুষটাকে গভীর ভাবে চিনতে হয়। একটা মানুষের প্রচন্ড সুখের সময়ে ভালোবাসি বলাটা যতটা সহজ। তার দুর্দিনে তাকে ভালোবাসাটা ততটাই কঠিন। তাই ভালবাসাটা মূলত দায়িত্ববোধেরই একটা বহিঃপ্রকাশ। তোর মতো বিকৃত মন মানসিকতার মেয়ে সেটা বুঝবে না।

–তুমি ঠিকিই বলেছ ভাইয়া। আমি এত সাধ্য সাধনা করে-ও তোমার মন পেলাম না। আর বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মেয়েটা খুব সহজে পেয়ে গেল। তুমিও নির্লজ্জের মতো তার পেছনে ঘুর ঘুর করলে। আমি বেশ করেছি তাকে মিথ্যে কথা বলেছি। কোথায় গেল তার এত ভালোবাসা? নিজের প্রিয়তমকে এতটুকু ভরসা করতে পারলো না। তুমি দুই বাচ্চার বাপ হয়ে গেলে-ও আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি আছি।

–ঠিক এখানেই তার আর তোর পার্থক্য। তুই মেয়ে হয়েও একটা মেয়ের সংসার ভাঙার জন্য প্রস্তুত আছিস। কিন্তু সে একটা সুন্দর সাজানো সংসার নষ্ট করতে চাইনি বলেই, বুকে পাথর চাপা দিয়ে দূরে সরে গিয়েছে। এজন্য সে আমার চোখে প্রিয়জন আর তুই আমার চোখে কালনাগিনী। মুনতাসিমের কথায় মুহুর্তের মধ্যে তাহিয়ার ভয় হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ক্রোধে সমস্ত শরীর জ্বলে উঠল। সে চিৎকার করে বলে উঠল,

–তার মতো বা’জারের মেয়েদেরই তোমাদের মতো ছেলেরা পছন্দ করে। আমার মতো ভালো মেয়েদের তোমাদের চোখেই পড়েনা। আমার মতো মেয়েরা তাদের মতো জামা…কথা গুলো শেষ হবার আগেই মুনতাসিম সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে তাহিয়ার গ’লা চে’পে ধরলো। মুনতাসিমের রক্তাক্ত আঁখিযুগল খুব কাছ থেকে দেখে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল তার। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ছুটাছুটি পর্যন্ত করতে পারছে না সে, এতটা শক্ত করে মুনতাসিম তাকে ধরেছে। বলিষ্ঠ দেহের যুবকের সাথে এত ছোট একটা শরীর যুদ্ধ করতে পারে। একটু পরেই তাহিয়ার মুখ দিয়ে গলগল করে র’ক্ত বের হয়ে আসতে শুরু করল। এই মেয়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হলে তবেই সে এই মেয়েকে ছাড়বে। তাহিয়ার শরীরটা নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। বাঁচার জন্য যতটুকু শরীর নড়ছিল তার ধীর গতিতে নেমে আসছে। প্রচন্ড কাশি আসতে চাইছে। গলা চেপে ধরে রাখার জন্য ঠিকমতো কাশতেও পারছে না। মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দেওয়াতে মুনতাসিমের হাত খুবই দক্ষ। তা তাহিয়া মৃত্যু কাছাকাছি গিয়ে উপলব্ধি করতে পারছে। আঁখিযুগল ছোট হয়ে আসতে শুরু করেছে। তখনই কক্ষের মধ্যে রিয়াদ চৌধুরী আর আয়মান প্রবেশ করল। দ্রুত মুনতাসিমের হাত থেকে তাহিয়াকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। বাবাকে আঘাত করবে না বিধায় মুনতাসিমের হাতটা আলগা হয়ে আসলো। তখনই আয়মান তাহিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিল। সমস্ত শরীর নেতিয়ে গিয়েছে তাহিয়ার। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি বহু আগেই হারিয়েছে সে। শরীরের সমস্ত ভর আয়মানের ওপরে ছেড়ে দিয়েছে। মুনতাসিম শান্ত দৃষ্টিতে তাহিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। রিয়াদ চৌধুরীর থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে তাহিয়ার দুই গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

–এ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিস। পরের বার কিছু বলার আগে সাবধানে বলবি। আল্লাহর কসম এর পরের বার তোকে বাঁচতে দিব না। কথা গুলো বলেই ক’ষে একটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল। মুনতাসিমের ক্রোধে কাছে আয়মানও হার মেনে গেল। মুনতাসিমের শক্ত হাতের প্রহার সামলাতে না পেরে ফ্লোরে পড়ে গেল তাহিয়া। তবুও আয়মান তাহিয়াকে ধরল না। নিজের প্রাণ প্রিয় মেয়ের করুন অবস্থা দেখে শব্দ করে কেঁদে উঠলেন সুফিয়া চৌধুরী। দ্রুত তাহিয়াকে হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো।

সকালে ফোন হাতে নিতেই কালকের সব ঘটনা আঁখিযুগলের সামনে আসতেই মেহেভীনের চোখ গুলো আপনা-আপনি বড় বড় হয়ে গেল। ছোট একটা কাহিনিকে সবাই এত বড় করে ফেলল। আজকে মেহেভীন উপলব্ধি করছে পারছে। মানুষটা আসলেই অনেক বড় মাপের মানুষ। সে ভালোবাসার মানুষ ভেবে কতটাই না তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। এতকিছুর পরে যে মানুষটা তাকে ক্ষমা করবে না। মনের অজান্তেই ভেতরটা শূন্য হয়ে গিয়েছে। মানুষটার শূন্যতায় তাকে প্রতিটি প্রহর ছটফট করতে হবে। মানুষটা কি আর ফিরবে না চেনা নীরে। কথা গুলো ভাবতেই উঠে এসে জানালর কাছে দাঁড়াল। খোলা জানালার দক্ষিণের বাড়িটা আগের ন্যায় নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। মানুষটা আর বেলকনিতে এসে দাঁড়াবে না। কেউ তার জন্য পাগলামি করবে না। কথা জালে ফাঁসিয়ে রাগিয়ে দিবে না। ভেতরটা বড্ড খালি খালি লাগছে। অপরাধবোধ ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাসার দিকে নিষ্পলক চাহনিতে চেয়ে থাকলো মেহেভীন।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মাহতাব উদ্দিনের সামনে বসল রুপা। রুপাতে দেখে মনোমুগ্ধকর হাসি হাসলেন মাহতাব উদ্দিন। রুপা মাহতাব উদ্দিনের থেকে কাগজ গুলো নিজের হাতে নিল। এই মানুষটার ভিষণ উপকার মেহেভীন করেছে। সেজন্য কোনো সমস্যায় পড়লে, সে আঁখিযুগল বন্ধ করে মেহেভীন কাছে আসে। তার কাছে মেহেভীন ভরসার একটা বিশাল জায়গা। যেখানে অসৎ এর থেকে সৎ এর মূল্য বেশি। মাহতাব মিষ্টি হেসে বলল,

–এগুলো তুমি ম্যাডামের থেকে সাইন করিয়ে রাখবে মামনি। আমি বিকালে এসে নিয়ে যাব। আমি ম্যাডামের অফিসেই যেতাম। কিন্তু আমার বোনটা কাল রাতে স্ট্রোক করেছে। দেখতে যাব। কথা গুলো বলেই সে রুপার হাতে এক হাজার টাকা গুঁজে দিল। রুপা নিতে চাইল না। তবুও মাহতাব উদ্দিন জোর করে দিল। এটা নতুন কিছু নয়৷ এমন শতশত মানুষ তার হাতে হাজার হাজার টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বলে, মেহেভীন যেন তাদের কাজটা দ্রুত করে দেয়৷ প্রথমে রুপা এসবে না কারলেও এখন ঝটপট নিয়ে নেয়। মাহতাব উদ্দিন চলে যেতেই রুপা কাগজের দিকে দৃষ্টিপাত করে রাখল। তারপরে টাকাটা আঁচলে বেঁধে রান্না ঘরে চলে গেল।

সকাল সকাল এমন খবর দেখে ফরিদ রহমানের মুখশ্রীতে তাচ্ছিল্য ফুরে উঠল। রাইমা বেগম গম্ভীর মুখশ্রী করে বসে আছেন। ফরিদ রহমানের আজ ভিষণ আনন্দ হচ্ছে। যে মেয়ের জন্য তার প্রেয়সী তাকে প্রহার করল। সেই মেয়েই তার মুখে চুনকালি লাগিয়ে দিল। সে অজস্র বাজে ভাষায় মেয়েকে গালি দিয়ে হাসতে হাসতে বলল,

–একটা চরিত্রহীন মেয়ের জন্ম দিয়েছ। এত অবিবাহিত ছেলের থাকা সত্বেও বিবাহিত পুরুষের সাথে নষ্টামি করে। তুমি এই মেয়ের জন্য আমাকে প্রহার করেছিলে রাইমা!

–সব সময় চোখের দেখা সঠিক হয় না। খোঁজ নিয়ে জেনেছি মুনতাসিম বিবাহিত নয়। তাহিয়া মুনতাসিমের ফুফাতো বোন। মুনতাসিমকে সে ভালোবাসে কিন্তু মুনতাসিম মেহেভীনকে ভালোবাসে। মেহেভীনকে দূরে সরানোর জন্যই মেয়েটা মিথ্যা কথা বলেছে। তোমাকে আরো একটা খারাপ খবর দেই। মেহেভীনকে বাজে কথা বলার অপরাধে মেয়েটা এখন হসপিটালে। ভালোবাসতে হলে এভাবে ভাসতে হয় বুঝলে৷ আমার নির্বোধ মেয়েটা কেন যেন খাঁটি সোনা চিনল না। খুব তাড়াতাড়ি সঠিক তথ্য সামনে চলে আসবে। তখন তোমার এসব কথা থাকবে তো। অর্ধাঙ্গিনীর কথায় ফরিদ রহমানের আঁখিযুগল বড় হয়ে আসলো। সে বিস্ময় নয়নে অর্ধাঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার প্রান প্রিয় বউটা এতটা ধুরন্ধর আর পাষাণ হয়ে গেল কিভাবে? সেটাই তিনি বুঝতে পারছেন না!

হসপিটালের কোলাহলে তাহিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। আজ সাতদিন ধরে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে সে। কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো শব্দ বের হতে চায় না। গলাটা ভিষণ ব্যথা হয়ে আছে। জীবন বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে কিছু নরম খাবার অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে ও খেতে হয়। মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখেছে বলেই বাঁচার ইচ্ছেটা দ্বিগুণ ভাবো বেড়ে গিয়েছে। মুনতাসিম তাইয়ানকে বলে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সেদিনের ভিডিও মুছে দিয়েছে। কয়েকজন ত্যাড়ামি করেছিল। তাদের নামে সাইবার মামলা করেছিল। তারা সবাই এখন পুলিশ হেফাজতে আছে। তাহিয়ার কেবিনটা ফাঁকা হতেই মুনতাসিম আসলো তার কেবিনে। তাহিয়া খেয়ে সবেমাত্র শুয়েছিল মুনতাসিমকে দেখেই অস্থির হয়ে উঠল। তাহিয়ার নিঃশ্বাস নিতে ভিষণ কষ্ট হয়। সেজন্য অক্সিজেন মাক্স লাগিয়ে রাখা হয়েছে। মুনতাসিম এই কয়দিনে তন্ন তন্ন হয়ে খুঁজেছে কাগজ গুলো। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি। বাধ্য হয়ে তার কাছে আসতে হলো। মুনতাসিম গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,

–আমি শুধু আর একবার বলব। একবারের বেশি যদি বলতে হয়। তাহলেই আজকেই তোর জীবনের শেষ দিন। তাহিয়া কিছু বলল না৷ শুধু চুপচাপ নিজের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। তা দেখে মুনতাসিম তাহিয়ার মুখ থেকে অক্সিজেন মাক্সটা খুলে দিল। দ্রুত গতিতে তাহিয়া শ্বাস নিতে লাগলো। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যন্ত্রনা তীব্র হতে লাগলো। সে মুনতাসিমকে ইশারা করে বলল। যে কাগজ গুলো কোথায় আছে সে বলবে। তারপরে মুনতাসিম অক্সিজেন মাক্সটা আবার পড়িয়ে দিল। তাহিয়ার কণ্ঠনালি দিয়ে যেন শব্দ বের হচ্ছে না। ভিষণ কষ্ট করে এতটুকু উচ্চারন করল, “দাদুর বাড়িতে আমার রুমে আছে কাগজ গুলো। ” তাহিয়ার কথা শেষ হবার সাথে সাথে মুনতাসিম কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। তাহিয়ার তীব্র যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতেও এক টুকরো শান্তি অনুভব করল। তার বলা মিথ্যা কথা গুলো মুনতাসিম খুব সহজেই বিশ্বাস করে নিল।

নিজের কক্ষে গম্ভীর হয়ে বসে আছে মুনতাসিম। তাইয়ান খবর নিয়ে জেনেছে। সেখানে কোনো তথ্য পায়নি। ক্রোধের আগুনে ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। সবকিছু তচনচ করে দিতে ইচ্ছে করছে। তখনই দরজায় কেউ কড়া নাড়ে, মাশরাফিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুনতাসিম বিস্মিত হলো। কিন্তু সে বাহিরে তা প্রকাশ করল না। জীবনে প্রথম মাশরাফি তার কক্ষ এল। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–কি চাই তোমার?

–আপনার জন্য কিছু নিয়ে আসছিলাম।

–তোমার কিছু প্রয়োজন নেই আমার।

–এগুলো আপনার কাজে দিবে। ভয় পাবেন না মায়ের কথা শুনে ক্ষতি করতে আসিনি। কথা গুলো বলেই কিছু কাগজ মুনতাসিমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। মুনতাসিম কাগজ গুলোর দিকে বিস্ময় নয়নে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করল। ললাটের দু’টো রগ ফুলে উঠেছে। কর্ণের পাশ দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। মুনতাসিমকে এতটা উত্তপ্ত দেখে তাইয়ান দরজা কাছে এসে স্থির হয়ে গেল।

চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছে। তখনই উজ্জল শ্যাম বর্ণের এক রমনী কক্ষে প্রবেশ করে। সমস্ত কক্ষ জুড়ে নিস্তব্ধতা রাজত্ব করছে। কক্ষের ভেতর থেকে ম’দের বিশ্রী গন্ধ নাসারন্ধ্রে এসে ঠেকছে। রমনী বিরক্ত হয়ে বলল,

–আপনি কোথায়? আপনার কথা মতো দলিলে সাইন করে নিয়ে আসছি। তখনই মাঝ বয়সী একজন পুরুষ বের হয়ে আসেন। রক্তিম চোখে রমনীর দিকে দৃষ্টিপাত করেন। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমি চারটা দলিল সাইন করাতে বলেছি। এখানে মাত্র একটা দলিল আছে।

–আপনি যেভাবে বলছেন। যেন মেহেভীন ম্যাডামকে দিয়ে অবৈধ দলিল সাইন কারনোটা পানির মতো সহজ। যেটা আপনি দেড় বছরে করতে পারলেন না। সেটা আমি আট মাসে করে দেখিয়েছি। আমি কৌশল জেনে গিয়েছি। এখন শুধু সাইন করানোর পালা৷ ম্যাডাম দেখে দেখে কাগজে সাইন করেন। যে কাগজ গুলো আমার কাছে আসে, সেগুলো ম্যাডাম শেষ আর প্রথমের পেজ গুলো দেখে। এই সুযোগ টাকে কাজে লাগিয়ে মধ্যের পেজে কাগজটা ঢুকিয়ে সাইন করিয়ে নিয়েছি। আমি না থাকলে আপনার কি হবে ভাবুন। তাই অযথা মেজাজ দেখাবেন না। ফলাফল ভালো হবে না। কথা গুলো বলেই চলে গেল রমণী। যুবকের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে রক্তিম চোখে রমণীর যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২৭
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

কাঁধে কারো কোমল হাতের স্পর্শ পেতেই মেহেভীনের দৃষ্টি তার দিকে দৃষ্টিপাত করল। রুপা মলিন মুখশ্রীতে মেহভীনের দিকে চেয়ে আছে। মেয়েটার চোখ দু’টি ভিষণ সুন্দর। যে কেউ তার মায়াবী চোখের প্রেম পড়তে বাধ্য হবে। এতটা নিখুঁত ভাবে মহান আল্লাহ তায়ালা রুপার আঁখিযুগল তৈরি করেছেন। রুপার মলিন মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে মেহেভীনের ভিষণ মায়া হলো। মেয়েটা তার খারাপ সময়ে ছায়ার মতো পাশে থেকেছে। আর সে কি-না মেয়েটার সাথে জঘন্যতম ব্যবহার করল। মেহেভীন রুপার গালে আলতো ভাবে স্পর্শ করে বলল,

–আপার ওপরে রাগ করেছিস? মেহেভীনের কথায় রুপার আঁখিযুগল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। সে অশ্রুসিক্ত নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে, দুই পাশে মাথা ঘুরিয়ে বোঝাল না। সে মেহেভীনের ওপরে রাগ করেনি। মেহেভীন আদুরে হাতে রুপার চোখের অশ্রুকণা গুলো মুছিয়ে দিল। রুপা দৃষ্টি নত করে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেভীন রুপাকে উদ্দেশ্য করে কোমল কণ্ঠে বলল,

–তুই কাঁদিস না রুপা। তুই কাঁদলে আমি ভিষণ কষ্ট পাই। কতটা অসহায় অবস্থায় তোকে পেয়েছিলাম। এত গুলো দিন ধরে তোকে তিলে তিলে নিজের মন মতো গড়ে নিয়েছি। নিজের বোনের থেকে কম কিছু ভাবিনা তোকে। বোন হয়ে নিজের বোনাকে আঘাতপ্রাপ্ত করেছি। বল আমার কি শাস্তি হওয়া দরকার?

–আমি আপনার কথায় কষ্ট পাইনি আপা। আমি জানি আপনার মনের অবস্থা ভালো ছিল না। আপনার কোনো দোষ নেই। ভুলটা আমারই ছিল। আমি সবকিছু না জেনে শুনে আপনাকে আঘাত করেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন আপা। আপনি আমার সাথে কথা বলছেন না। আমার ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে আপা। আমি একটা কথাও বলব না। তবুও আপনি আমার সাথে আগের মতো কথা বলুন। রুপার কথায় মেহেভীনের বুকটা ভারি হয়ে আসতে লাগলো। সে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রুপায় মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

–এসব নিয়ে ভাবিস না। আমার কাজে যেতে হবে। টেবিলে খাবার তৈরি কর। আমি আসছি। কথা গুলো বলেই কক্ষে এসে জামা বের করতে লাগলো। রুপা কোনো কথা না বলে কক্ষ থেকে বের হয়ে চলে গেল।

মুনতাসিম গভীর ভাবে কাগজ গুলোকে পর্যবেক্ষণ করছে। তাইয়ান উৎসুক দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তখনই মুনতাসিম তাইয়ানের দিকে কাগজ গুলো এগিয়ে দিল। তাইয়ান কাগজ গুলো হাতে নিতেই মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–ভালো করে দেখে বলবে সাইন টা কার? তাইয়ান নিখুঁত ভাবে কাগজ গুলো পর্যবেক্ষণ করে নিল। আঁখিযুগল আপনা-আপনি বড় হয়ে গেল। সে বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

–স্যার আপনি বিয়ে করেছেন?

–তাইয়ান আমি তোমাকে সাইনটা দেখতে বলেছি। কে বিয়ে করেছে সেটা দেখতে বলিনি। তুমি যদি দেখতে না পারো। তাহলে আরিয়ানকে পাঠিয়ে দাও। আমি আরিয়ানকে দিয়ে দেখিয়ে নিচ্ছি।

–স্যরি স্যার আর কোনোদিন আপনার অপছন্দের কাজ করব না। সাইনটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সাইনটা আপনার। কিন্তু আপনি আমাকে আপনার সাইন দেখাচ্ছেন কেন?

–সাইনটা ভালো করে দেখ সাইনের গভীরতার মাঝে ডুবে যাও। তবুও এই সাইনের রহস্য তুমি উন্মোচন করো।

–স্যার আপনি নিজের সাইন চিনেন না?

–এতদিন আমার সাথে থেকে আমার সাইনই চিনলে না! তাহলে আমাকে কি ভালোবাসলে তাইয়ান?

–আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন স্যার। এটা আপনারই সাইন।

–তুমি শিওর?

–জি স্যার।

–এখন তুমি আসতে পারো। আমি তোমার সাথে পরে কথা বলব। তাইয়ান বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করল। মুনতাসিমও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা তার সাইন নয়। এতটা নির্ভুল ভাবে কে তার সাইন নকল করল। সেটাই মস্তিষ্কে আসছে না। মুনতাসিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পার্টি অফিসে যাওয়ার জন্য বেড়িয়ে পড়লো।

মেহেভীন খাবার খাচ্ছিল। এমন সময় রুপা মাহতাব উদ্দিনের দিয়ে যাওয়া কাগজটা মেহেভীনের সামনে রাখল। মেহেভীন পানি মুখের সামনে ধরে বলল,

–এটা কিসের কাগজ রুপা?

–আপনি পড়ে দেখেন আপা। ঐ যে মাহতাব উদ্দিন আছে না। যার জমির মিমাংসা আপনি করে দিয়ে ছিলেন৷ সে সকালে এসেছিল। তার বোন স্ট্রোক করেছেন। সেজন্য উনি অপেক্ষা করতে পারেননি। আপনাকে দেখে শুনে সাইন করতে বলেছেন। উনি বিকালে এসে কাগজ গুলো নিয়ে যাবেন৷ রুপার কথায় মেহেভীন কাগজ গুলো পড়তে লাগলো। তিনটা পেজ দেখেই বুঝতে পারল৷ এটা কোন জমির কাগজ সে রুপাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–এটা দিঘির পাশের জমি টার কাগজ জমিটা ভিষণ সুন্দর। তোর অনেক পছন্দের জমি ছিল তাই না রুপা। আল্লাহ যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। আমি একদিন কোনো এক দিঘির পাশে তোকে বাড়ি করে দিব। মেহেভীনের কথায় রুপা মনোমুগ্ধকর করে হাসি হাসলো। মেহেভীন কাগজ গুলোতে সাইন করে দিয়ে চলে গেল।

প্রভাতের আলো নিভে গিয়ে চারদিক আঁধারে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। এই কয়দিনে প্রানবন্ত চৌধুরী বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। আগের মতো আনন্দ করতে যেন সবাই ভুলে গিয়েছে। প্রতিটি মানুষের মধ্যে নিস্তব্ধতা রাজত্ব করছে। ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। তখনই মুনতাসিম বাসার মধ্যে প্রবেশ করে। ভেতরটা একদম চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। ভেতরটা জানে কতটা অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায়। তার শত্রুরা যদি তার মনের খবর জানতো। তাহলে দূর থেকে আঘাত না করে কথার আঘাতে ধরণীরর বুক থেকে তাকে মুছে ফেলত। কাগজ গুলো তদন্তের জন্য পাঠিয়েছে মুনতাসিম। আজ নিজের কক্ষে যেতে ইচ্ছে করল না। যখন সব দুঃখ কষ্ট সহ্য সমী পেরিয়ে যায়। তখনই সে বাবার কাছে চলে আসে। এই মানুষ টার মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই জীবনের অর্ধেক দুঃখ কমে যায়। আরো কয়টা দিন বেশি বাঁচতে ইচ্ছে করে। মুনতাসিমকে নিজের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, রিয়াদ চৌধুরী খবরের কাগজ রেখে ছেলের দিকে মনযোগ দিলেন। মুনতাসিম ক্লান্ত শরীরে বাবার পাশে এসে বসল। কোমল কণ্ঠে বলল,

–আজ রাতে আমি আপনার সাথে ঘুমোতে পারি?

–অনুমতি নেওয়ার কি আছে! তুমি চাইলে আমার সাথে প্রতিদিন ঘুমোতে পারো।

–আপনার বউয়ের কোনো সমস্যা হবে না?

–সে তোমার মা হয়।

–আমার মা ম’রে গিয়েছে। যাকে তাকে আমার মায়ের সাথে তুলনা দিবেন না৷ রিয়াদ চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ছেলেকে রাগানো উচিৎ হবে না। হঠাৎ কি এমন হলো যে ছেলেটার বুক এতটা ভারি হয়ে গেল। এত শক্ত একটা মানুষ যখন ভেঙে পড়ে। তখন রিয়াদ চৌধুরীর বুকটা হাহাকার করে উঠে। সে কোনো কথা না বলে, গম্ভীর হবার ভান ধরে চশমা খুলে শুয়ে পড়লেন। মুনতাসিম কোনো কথা না বলে বিছানায় উঠে বাবার এক হাতের ওপরে মাথা রেখে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আঁখিযুগল বন্ধ করে রাখল। মুনতাসিম ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে মানুষটার দম নিতে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। না চাইতেও রিয়াদ চৌধুরী আঁখিযুগলের কোণে অশ্রুকণা চলে আসলো। সে নরম কণ্ঠে বলল,

–তোমার কি হয়েছে? আমারে বলা যাবে?

–কিছু হয়নি আব্বু। বরাবরের মতোই হতাশ হলেন রিয়াদ চৌধুরী। ছেলের পেটে বো’মা মারলেও নিজের দুর্বলতার কথা কারো সাথে শেয়ার করবে না। ঠিক তার মায়ের মতো গুন পেয়েছে। তাকে ভেতর থেকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলা গেলে-ও তা বাহিরে প্রকাশ পায় না। সেজন্য লোকে ভাবে তার কোনো দুঃখ নেই। সে সর্বদা সুখী মানুষ। তার কখনো কষ্ট হয় না। লোকে কি জানে না। সে রোজ দুঃখ মেশানো হাসিতে মগ্ন থাকে। ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে আছে। ক্ষতটা শুকানোর বদলে দিন দিন তাজা হয়ে উঠছে। রিয়াদ চৌধুরী ছেলের চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তিনি কিছুটা হাত বাড়িয়ে ছেলেকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আসলেন। পরম যত্ন সহকারে ছেলের ললাটে চুমু দিলেন। বাবা ছেলের এমন আদুরে দৃশ্য দেখে মনের অজান্তেই সাহেলা চৌধুরীর মুখশ্রীতে হাসি ফুটে উঠল। ঘুমানোর জন্য নিজের কক্ষে আসতেই মুনতাসিমকে দেখে দরজা কাছে দাঁড়িয়ে যায়। সে বাবা ছেলেকে বিরক্ত না করেই দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। সারাদিন এই ছেলেটার সাথে সে যুদ্ধ করে। ছেলেটা যখন শান্ত হয়ে যায়। তখন না চাইতেও মুনতাসিমের জন্য তার বুকের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে উঠে।

শেহনাজ ফোন কথা বলছিল। তখন সাহেলা চৌধুরী আসে তার কক্ষে। মাকে দেখে মুখশ্রী কুঁচকে যায় তার। যখন সে শুনলো সাহেলা চৌধুরী তার সাথে ঘুমাবে। তখনই শেহনাজের মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। সে গম্ভীর মুখশ্রী করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।

রজনীর মধ্য প্রহরে ছাদ থেকে কারো বাক্য কর্ণকুহরে আসতেই তাইয়ান সেদিকে মনোযোগ প্রদান করল। সে স্পষ্ট ভাবে অনুভব করতে পারছে কণ্ঠটা কার। সে খুব নিখুঁত ভাবে মুনতাসিমের সব খবর পাচার করছে। কিভাবে মুনতাসিমকে ধরনীর বুক থেকে মুছে ফেলা যায়। সেই পরিকল্পনা চলছে। পর মানুষ শত্রুতা করলে সেখানে সাহস সঞ্চয় করে তাদের সাথে যুদ্ধ করা যায়। কিন্তু ঘরের মানুষ যখন শত্রুতা শুরু করে দেয়। তখন অর্ধেক জীবন আগেই ম’রে যায়। যতটুকু বেঁচে থাকে কাছের মানুষের আসল রুপ সামনে আসার পর সেটুকু ও ম’রে যায়। তার শরীরে নিঃশ্বাস থাকা অবস্থায় মুনতাসিমের কোনো ক্ষতি সে করতে দিবে না। সে বড় বড় পা ফেলে ছাদে প্রবেশ করল। তাইয়ানকে দেখেই মানুষটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে বিস্ময় কণ্ঠে বলল,

–তুমি এখানে কি করছ?

–একই প্রশ্ন আমিও তোমাকে করতে পারি।

–সামান্য একজন গার্ড হয়ে আমার মুখে মুখে কথা বলছ?

–যেখানে আমাকে স্যারকে রক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে স্যারের ক্ষতি দেখলে আমি কথা বলবই। তোমার কোনো অধিকার নেই। আমার সাথে এভাবে কথা বলার। তুমি নিজেও জানো না। আমি চাইলে তোমার কি কি করতে পারি। তাইয়ানের কথায় মানুষটা জ্বলে উঠল। সে বজ্রকণ্ঠে বলল,

–তোমাকে একদম জ্যা’ন্ত পু’তে ফেলবো। কেউ টের পাবে না। আমার সাথে লাগতে এসো না। ভালোবাসি বলেই তোমার বাড়াবাড়ি সহ্য করি। মানুষটার কথা শুনে তাইয়ান ভুবন ভুলানি হাসি হাসলো। তা দেখে মানুষটার মুখশ্রী বিরক্তিতে কুঁচকে এল। তাইয়ান মানুষটাকে ওয়ারনিং দিয়ে ছাদ থেকে চলে আসলো। সে মানুষটার সাথে কথা বলে দুর্বল হতে চায় না। পৃথিবীর সব মানুষ একদিকে আর মুনতাসিম তার কাছে একদিকে। মুনতাসিমের জন্য সে নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত।

প্রভাতের আলো ফুটতেই মুনতাসিমের ঘুম ভেঙে গেল। রিয়াদ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে সারারাত ঘুমিয়ে ছিল। রিয়াদ চৌধুরী পরম যত্নে ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছেন। কখন যে সে ঘুমিয়ে গিয়েছিল তা তার জানা নেই। মায়ের পর এই মানুষ টাই তাকে অসম্ভব রকমের ভালোবাসে। তার ভুল গুলো অন্যায় গুলো ক্ষমা করে দেয়। প্রচন্ড খারাপ ব্যবহার করার পরে-ও রিয়াদ চৌধুরী এসে ছেলের সাথে আগে কথা বলেন৷ বাবারা বুঝি এমনই হয়৷ সেজন্য বাবাকে বটগাছের ছায়া বলা বলা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নিরাপদ হচ্ছে বাবার বুক। তা মুনতাসিম যত দিন যাচ্ছে। ততই উপলব্ধি করতে পারছে। সময়ের সাথে বাবার নামে করা অভিযোগ গুলো মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। সে বদলে যাইনি পরিস্থিতি তাকে চুপ থাকতে শিখিয়ে দিয়েছে। সে তো আর একা তার সন্তান নয়। তার প্রতি যেমন রিয়াদ চৌধুরীর দায়িত্ব আছে। ঠিক তেমনই বাকি সন্তানদের প্রতিও তার দায়িত্ব আছে। মুনতাসিম কোনো কথা না বলে বিছানা ছাড়ল। তখনই রিয়াদ চৌধুরীর কিছু কথা কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। মুনতাসিম বুঝল সে আগেই উঠেছে। মুনতাসিমের জন্য শুয়ে ছিল।

–আপনি যেটা বলছেন সেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ আমার সন্মানে যে কলঙ্ক লাগাতে চেয়েছে। আমি তার সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করব। কথা গুলো বলেই চলে গেল মুনতাসিম। রিয়াদ চৌধুরী ছেলের কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

আজ শুক্রবার মুনতাসিমের আজকে ভিষণ করে বাড়ি ছাড়তে ইচ্ছে করছে। যেতে চেয়েছিল না সেই চেনা নীড়ে। কিন্তু অবাধ্য মনটা নিজের হয়েও অন্যের জন্য সব সময় মরিয়া হয়ে থাকে। সে কোনো কথা না বলে তাইয়ানকে গাড়ি বের করতে বলল৷ দীর্ঘ সময় পথ পাড়ি দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে এসে পৌঁছে গেল। মুনতাসিম বাসার দিকে না গিয়ে মাঠের দিকে যেতে লাগলো। তখনই তাইয়ান অস্থির হয়ে প্রশ্ন করল,

–আপনি ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন স্যার?

–টয়লেটে যাচ্ছি যাবে। তোমরা সব সময় চিনি জোঁকের মতো আমার সাথে লেগে থাকো কেন? আমার প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই! চলো গিয়ে দেখবে আমি টয়লেটের মধ্যে গিয়ে কি করি। তোমরাও আমার মতো সেই প্রসেস ব্যবহার করবে। কোন দুঃখে রাজনীতিতে এসেছিলাম আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন। জীবনে ঝামেলার কোনো শেষ নেই। বিরক্তিতে মুখশ্রী কুঁচকে ফেলল মুনতাসিম।

–আপনি হুকুম করলে আমরা আপনার সাথে টয়লেটে যেতেও রাজি স্যার। আমরা আমাদের দায়িত্ব অবহেলা করতে পারিনা। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিম রক্তিম চোখে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করল। বজ্রকণ্ঠে তাইয়ান বলে গর্জন করে উঠল। তাইয়া মাথা নুইয়ে ধীর কণ্ঠে বলল, “স্যরি স্যার।

চলবে……

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-২২+২৩+২৪

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

ভারাক্রান্ত হৃদয়, বিষন্ন মন, ছন্নছাড়া মস্তিষ্ক নিয়ে মেহেভীন নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। যে বাড়িতে তার মতামতের গুরুত্ব নেই। সেই বাড়ির গুরুত্বও তার কাছে নেই। কালকে সকালেই এই বাড়ি ছাড়বে সে। অশান্ত মস্তিষ্ককে শান্ত করার জন্য পরিবারের কাছে এসেছিল সে। কিন্তু ঘরের লোক যদি পরের মতো আচারের করে। তখন বেঁচে থাকা মুসকিল হয়ে যায়। মেহেভীনকে বিষাদগ্রস্ত হয়ে কিছু ভাবতে দেখে রাইমা বেগম মেয়ের পাশে বসলেন। মায়ের চোখের ভাষা বুঝতে বেগ পেতে হলো না মেহেভীনের।

–আমি তোকে এখন যা বলব একটা কথাও বলনি না। শুধু চুপচাপ শুনে যাবি। ভেতরটা যে বহু বছর ধরে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে আছে রে মা। শরীরের আঘাত মানুষ দেখতে পায়। কিন্তু হৃদয়ের আঘাত কেউ দেখতে পায় না। বহু আগেই আমার হৃদয়টা রক্তাক্ত করে দিয়েছে তোর বাবা। তুই তোর যে বাবাকে চিনিস। তার ভেতরের রুপ বাহিরে আসলে সহ্য করতে পারবি না৷ নিজের ভালো চাস তো এখানে আসিস না। মায়ের মন তো তাই মেয়ের জন্য বুকটা খাঁ খাঁ করে। তাই বারবার তোকে এখানে আসতে বলি। কিন্তু সময় যত সামনের দিকে আগাচ্ছে। তোর জন্য পরিস্থিতি ততই জটিল হচ্ছে। তুই বুদ্ধিমান মেয়ে আশা করি কি বোঝাতে চেয়েছি। সেটা তুই বুঝবি। আগের সময় আর এখানকার সময়ের অনেক তফাৎ। মেহেভীন হতবাক হয়ে বসে রইল। মায়ের এমন জটিল কথা তার মস্তিষ্কে ঢুকলো না। সে নিষ্পলক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেয়েকে ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে রাইমা বেগম চলে গেলেন।

সূর্যি মামা বিদায় নিয়েছে কিছুক্ষণ হলো। ধরনীর বুকে প্রাকৃতিক নিয়মে আঁধার নেমে এসেছে। নির্বাচনের সময় হওয়ায় পাড়ার মোড়ে আড্ডা নিত্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই বেড়েছে। কথায় আছে না অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না৷ আড্ডার মাঝেই দুই দলের ঝামেলা লেগে গেল। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ঝামেলা গুরুতর হয়ে উঠল। মুখের ঝামেলা মা’রা’মা’রিতে পরিনত হলো। এক দল আরেক দলকে বেদম পে’টা’চ্ছি’ল। আশেপাশের মানুষ ঝামেলা এড়াতে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। কেউ কেউ ভয়ে দোকান বন্ধ করে ভেতরের মধ্যে বসে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যে এক দলের এক লোকের র’ক্তা’ক্ত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। সেটা দেখে বিরোধী দল দিগুন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। কয়েকজনকে ফোন দিয়ে প্রয়োজনীয় অ’স্ত্র নিয়ে আসতে বলা হলো। মুহুর্তের মাঝে গু’লা’গু’লি’র শব্দ কর্ণকুহরে ভেসে আসলো। মানুষ ভয়ে জড়সড় হয়ে বাসার মধ্যে থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সবকিছু দেখছে। প্রাণের ভয়ে কেউ বাহিরে বের হচ্ছে না৷ এসব ঝামেলার কথা তাইয়ানের কর্ণে আসতেই তাইয়ান হন্তদন্ত হয়ে মুনতাসিমের কাছে গেল। উত্তেজিত হয়ে বলল,

–স্যার পাড়ার মোড়ে আমাদের লোক আর বিরোধী দলের লোকের মধ্যে বিশাল ঝামেলা হয়ে গিয়েছে। বিষয়টা গু’লা’গু’লিতে পরিনত হয়েছে। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা আসবে আসতে একটু সময় লাগবে। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিমের ক্রোধে মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠল। কোনো কথা না বলে সোজা কক্ষ থেকে হনহন করে বের হয়ে গেল। তাইয়ান হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে মুনতাসিমকে বলে দিয়েছে। এখন মুনতাসিম নিজের জীবনের পরোয়া না করে, ওদেরকে বাঁচাতে চলে যাবে। তাইয়ান চিন্তিত হয়ে বলল,

–স্যার আপনার ওখানে যাওয়া উচিৎ হবে না। পুলিশ আসলে আমরা পুলিশের সহায়তায় নিয়ে যাব। এভাবে নিজের বিপদ ডেকে নিয়ে আসবেন না। আপনাকে মা’রা’র জন্য সবাই পা’গ’লা কু’কু’র হয়ে আছে। হতেও পারে ওরা ইচ্ছে করে এমন করছে। আপনাকে বাহিরে বের করে আপনার ক্ষতি করে দিবে। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে গর্জন করে উঠল,

–তুমি আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখাচ্ছ তাইয়ান। নিজের লোকের বিপদ জেনেও ঘরে বসে থাকার মতো কাপুরষ আমি না। আমার দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ আমি সবাইকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করব। তুমি আমাকে এত দেরি করে খবরটা দিলে কেন? না জানি কতজনের ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। ওদের কাউকে আমি ছাড়ব না। মুনতাসিম ফুয়াদ মৃ’ত্যু’র ভয় করে না। মৃ’ত্যু হবে জেনেও আমি স্বেচ্ছায় মৃ’ত্যু’র দিকে অগ্রসর হই।

–আপনি কারো কথা না ভাবতে পারেন। আপনি আপনার পরিবারের কথা ভাবুন। আপনি আপনার পরিবারের ওপরে কতবড় ছাদ হয়ে আছেন। আপনি সরে গেলে আপনার পরিবারের ওপর কিরূপ ঝড় বয়ে আসবে৷ সেটা সম্পর্কে আপনি আমার চেয়েও অধিক অবগত আছেন।

–তুমি স্বার্থপরের মতো আমার কথা কেন ভাবছ! আমি যেমন কারো ছেলে কারো ভাই। তারাও কারো স্বামী, বাবা, ভাই। টাকা দিলেই কি তার জীবন ফিরে পাওয়া যাবে! আমার সামনে অন্তত এমন স্বার্থরের মতো কথা তুমি বলবে না। ফলাফল ভালো হবে না। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম বেড়িয়ে গেল। মুনতাসিমের সুরক্ষার জন্য কয়েকজন গার্ড তার পেছনে পেছনে ছুটলো।

কালো পিচ ঢালাই করা রাস্তা রক্তের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ছয় সাতজন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। মুনতাসিমকে দেখে কয়েকজন একটু দুর্বল হয়ে পড়লে বিরোধী দল এই সুযোগ টাই লুফে নিতে চাইলো। মুনতাসিম শান্ত মস্তিষ্কে কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা শুনতে চাইনি৷ মুনতাসিমকে রক্ষা করার জন্য কয়েকজন গার্ড মুনতাসীমের সামনে এসে দাড়ালো। প্রত্যেক জনের হাতে বন্দুক। মুনতাসিমকে আঘাত করার সাথে সাথে বিপরীত পক্ষের মানুষ গুলো ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে যাবে। তারাও কয়েকজন বন্দুক তাদের দিকে তাক করে আছে। তবে তাদের ভেতরে ভয় ঢুকে গিয়েছে। হালক করে হাত কাঁপছিল। তখনই পুলিশ এসে সবাইকে পেছনে থেকে ধরে ফেলে। মুনতাসিম যেন এই সময়ের জন্যই অপেক্ষা করছিল। কিছু সময়ের জন্য হয়তো মা’রা’মা’রি বন্ধ রাখতে পারলে, কয়টা প্রাণ বেঁচে যাবে। কিছু আঘাত কমে যাবে। পুলিশ এসে সবাইকে গাড়িতে তুলল। ঠিক এমন সময় মুনতাসিমের কর্ণের পাশ কাটিয়ে একটা গু’লি গিয়ে গার্ডের হাতে লাগলো। মুনতাসিম দ্রুত পেছনের দিকে ঘুরে তাকালো৷ গাছের আড়াল থেকে খুব সাবধানতার সাথে মুনতাসিমকে গু’লি করা হয়েছে। যে গার্ডের হাতে গুলি লাগছে। সেই গার্ড হৃদয়বিদারক চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। মুনতাসিম আগেই এম্বুলেন্সকে ফোন দিয়ে আসতে বলেছিল। নিজের প্রাণ সংশয়ের কথা চিন্তা না করে, দ্রুত সবাইকে হসপিটালে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। সে কে? যে এত যত্ন করে মুনতাসিমকে মারতে চাইলো। সেটা না হয় পরেই জানা যাবে। আগে তার কাছের মানুষ গুলোকে চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন।

সারাদিন খাওয়া হয়নি মেহেভীনের। তার চেনা বাবা কিভাবে এতটা অচেনা হয়ে গেল। সেটা মানতেই মেহেভীনের ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। সে প্রভাতের আলো ফুটতেই বাড়ি ছেড়েছে৷ ঐ বাড়িতে থাকলে হয়তো দম বন্ধ হয়ে মা’রা যেত। তার বাবা তাকে মুখের ওপরে বাসায় যেতে নিষেধ করেছে। মনে মনে শপথ গ্রহণ করল৷ সে কিছুতেই এই বাড়িতে আসবে না। যেদিন তার বাবা আবার আগের মতো হয়ে যাবে। সেদিন না হয় আবার ফিরবে সেই চিরচেনা গৃহে। মনটা কেমন হাহাকার করে উঠল। কাল রাতে মুনতাসিমের সাথে কথা হয়নি। কথা হলে বোধহয় একটু শান্ত পেত। কিন্তু মুনতাসিম তাকে কালকের সব ঘটনা জানিয়েছে। এতকিছু জানার পরে-ও মানুষটার সাথে কঠিন হতে পারেনি মেহেভীন। মানুষটাকে সামলে নেওয়ার সময় দিয়েছে। মাথাটা ভিষণ ঘুরছে মেহেভীনের। শরীর প্রচন্ড দুর্বল লাগছে৷ হয়তো না খাওয়ার কারনে শরীরটা নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। ড্রাইভারকে একটা দোকান দেখে দাঁড়াতে বলল মেহেভীন। কিছু খাবার কিনে আবার উঠে বসলো। পেটের আর কি দোষ রাগ করে শুধু শুধু নিজের রুহুকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। মনের দোষ পেটের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে কতদিন চলবে? তার থেকে ভালো খেয়ে শান্ত মস্তিষ্কে চুপ থাকা৷

ক্লান্ত শরীর নিয়ে মেহেভীন নিজের বাসায় ফিরলো। রুপা মেহেভীনের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। বাড়ি থেকে গেল এক হাসোজ্জল মুখশ্রী। আর বাসায় ফিরলো এক বিষাদগ্রস্ত মুখশ্রী। ব্যাপারটা রুপার মোটেও হজম হলো না। সে মেহেভীনকে কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হতেই মেহেভীন দ্রুত নিজের কক্ষে চলে গেল।

সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। জীবন আগের ন্যায় চলতে শুরু করেছে। মাঝেমধ্যে মনটা শুধু থেমে যায়। বাবা-মায়ের কথা ভিষণ মনে পড়ে। যার হাত ধরে হাঁটতে শিখেছে। যার মুখ থেকে শব্দ শিখেছে। সেই বাবা-মার থেকে দূরে থাকা কতটা কষ্টকর। তা একমাত্র পিতামাতাহীন সন্তানই অনুভব করতে পারে। কিন্তু মেহেভীনের বাবা-মা থেকে-ও মেহেভীন সেই অনুভূতি অনুভব করছে। সাতদিন ধরে মেহেভীনের বাবা মেহেভীনকে বাসায় যেতে বলছে। মেহেভীন মুখের ওপরে না করে দিয়েছে। তবুও শেষ বারের মতো তিনি কথা বলতে চান৷ মেহেভীন না করতে পারেনি। মুনতাসিমও মেহেভীনকে অনুরোধ করেছিল। ভোটের দিন সে যেন মুনতাসিমের পাশে থাকে। কিন্তু মেহেভীন ছুটি পাচ্ছিল না দেখে যেতে পারছিল না। বৃহস্পতিবার কাজ করে রাতে যাবে। অবশেষে কাঙ্খিত সময় চলে এসেছে। মেহেভীন আঁধারে আচ্ছন্ন বিষন্ন রাতের সাথে তাল মিলিয়ে বিষাদগ্রস্ত মন নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটে চলছে। মনটা ভিষণ কু ডাকছে বারবার ঘুরে যেতে ইচ্ছে করছে। তবুও মনের বিরুদ্ধে যেতে হচ্ছে। রাতের শেষ প্রহরে মেহেভীন বাসায় গিয়ে পৌঁছালো। মেয়ের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ের হৃদয় কেঁপে উঠল। মেহেভীন কোনো কথা না বলে ফ্রেশ হয়ে নিল। মেহেভীনের মা মেহেভীনের জন্য খাবার নিয়ে বসেছিল। মেহেভীন আসতেই মেহেভীনকে খাইয়ে দিল। মেহেভীন আবারও মাকে নতুন ভাবে জানলো। যে মা ধরণীর বুকে আঁধার নামার কিছুক্ষণ পরেই নিদ্রা চলে যায়। সেই মা সারারাত মেয়ের জন্য জেগে পার করে দিল। মনের অজান্তেই মেহেভীনের আঁখিযুগলে অশ্রুকণা এসে জমা হলো। তা দেখে রাইমা বেগম মেহেভীনের ললাটে চুমু খেয়ে মেয়েকে বুকে আগলে নিল। কিছুক্ষণ পরে মেহেভীন ঘুমিয়ে পড়লে রাইমা বেগম চলে গেল।

পরের দিন মেহেভীনের বারোটায় ঘুম ভেঙে গেল। তা দেখে মেহেভীনের চক্ষু চড়কগাছে উঠে গেল। সে দ্রুত উঠে ফ্রেশ হয়ে ফোন হাতে নিল। আজকের দিনটা মুনতাসিম তার পাশে থাকতে বলেছিল। তাকে ভরসা জোগাতে বলেছিল। কিন্তু অর্ধেক বেলা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল। ভেতরে ভেতরে ভিষণ অপরাধ বোধ কাজ করছিল তার। ফোন হাতে নিতেই দেখলো মুনতাসিম তাকে বিশ বারের মতো ফোন করেছে। পঞ্চাশ টার মতো মেসেজ দিয়েছে। সে বিলম্ব করল না দ্রুত মুনতাসিমকে ফোন দিল। মুনতাসিম ভোট কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছিল। সে দ্রুত মেহেভীনের কল কেটে দিয়ে মেসেজ দিল। ” ব্যস্ত আছি অবসর হয়ে ফোন করছি। মেসেজটা দেখে মেহেভীনের মুখশ্রীতে বিষাদ এসে ধরা দিল। কেন পারলো না মানুষটাকে একটু শান্তি দিতে, প্রিয় মানুষকে শান্তি না দিতে পারলে ভেতরটা বুঝি এভাবে পোড়ায়। মেহেভীন ভিষণ করে বুঝতে পারছে। অজানা কারনে ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠছে। মেহেভীন দুই ঘন্টা ধরে ফোনের কাছে বসে আছে। মেহেভীনের বাবা ভোট দিতে গিয়েছে সেই সকালে এখনো বাড়ি ফিরেনি। যাবার সময় মেহেভীনকে বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করেছে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মুনতাসিমের ফোন আসলো। ফোন কর্ণে ধরতেই গম্ভীর কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল।

–আপনি সারাদিন কোথায় ছিলেন? একটা দিন আপনাকে আমার পাশে থাকতে বলেছিলাম। সেটাও পারলেন না। এখন কেন ফোন করেছেন? আপনার আমার সাথে কথা বলতে হবে না। আপনি যেখানে ছিলেন। সেখানে যান৷

–আপনার জন্য সারারাত জার্নি করে বাসায় আসলাম। ভোরের দিকে ঘুমিয়েছি। বুঝতে পারিনি এতটা বেলা হয়ে যাবে। আপনি অনুগ্রহ করে রাগ করবেন না। আমি আপনার কথা রাখতে পারিনি। তার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আপনার মতো শক্তপোক্ত মানুষের এমন দুর্বল হলে চলবে।

–আমার ভিষণ ভয় করছে মেহেভীন।

–জনগণ কি জানে তারা একটা ভীতু ছেলেকে তাদের নিতা হিসবে গ্রহণ করছে। আপনি আমাকে শিখিয়েছেন। কিভাবে দুঃসময়ে শান্ত মস্তিষ্কে থাকতে হয়। তাহলে আপনি কেন এতটা অস্থির হচ্ছেন। চিন্তা করে লাভ নেই। আল্লাহ ভাগ্যে যা রাখছে তাই হবে। ভাগ্যের লিখন কেউ খন্ডাতে পারবে না৷ এভাবে দুশ্চিন্তা করে নিজের মনকে দুর্বল করবেন না। আমি জানি এমন সময় চিন্তা করতে হয় না। তারা নিজ দায়িত্বে এসে হাজির হয়ে যায়। আমাদের উচিৎ যথাসম্ভব চিন্তাকে উপেক্ষা করা। জনগণ আপনাকে ভিষণ ভালোবাসে। আর জনগণ যাকে ভালোবাসে সেই মানুষটা কিছুতেই হেরে যেতে পারে না। এভাবে আপনি অস্থির হবেন না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। তিনি উত্তম পরিকল্পনা কারী। আপনি যতটুকু ভেবে রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা তার থেকে দশগুন আপনার জন্য ভেবে রেখেছে। এবার একটু শান্ত হোন মন্ত্রী সাহেব। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিমের উথাল-পাতাল করা হৃদয়টা শান্ত নদী হয়ে গেল। এই জন্যই বুঝি প্রিয় মানুষটাকে মন ভালো করার ঔষধ বলে উপাধি দেওয়া হয়েছিল। এক নিমিষেই মেয়েটা কেমন তার অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করে দিল। ক্ষণিকের জন্য সমস্ত দুশ্চিন্তা দূরে পালিয়ে গেল। মস্তিস্ক সচল হয়ে গেল এই মুহুর্তে মেহেভীনকে সে কি বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। সেই ভাষা জানা নেই মুনতাসিমের। মনটা ডেকে বলছে। আপনাকে আমার লাগবেই লাগবে।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে রৌদ্রের প্রখরতা বেড়ে চলেছে। মেহেভীন ফ্রেশ এসে খেতে বসেছিল। রাইমা বেগম গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। মেহেভীন মাকে প্রশ্ন করলে উত্তর আসে না। মুখের সামনে খাবার রেখে বসে থাকা যায় না। মেহেভীন বিলম্ব করল না। দ্রুত খাবার খেতে শুরু করল। খাবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে রাইমা বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–তোর লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই। এতটা নির্লজ্জ হয়ে গেলি কি করে! নাকি সরকার তোকে চলার মতো অর্থ প্রদান করে না। কাল রাতে দূর থেকে জার্নি করে এসেছিস। তাই রাতে কথা গুলো বলতে আমার বিবেকে বাঁধা দিয়েছে। না হলে কালকে দরজা থেকে বিদায় করতাম৷ তোর মতো আত্মসম্মান বিহীন আমার মেয়ে ভাবতেই বিরক্ত লাগছে। যে চাকরি করে খেতে পাস না। সেই চাকরি ছেড়ে দে। চাকরি করেও যদি খাওয়ার জন্য বাবার বাসায় আসতে হয়। তাহলে এখানেই পড়ে থেকে মেরুদণ্ডহীনতার পরিচয় দে। বেহায়া মেয়ে মানুষ কোথাকার। মায়ের কথা মেহেভীন বিস্ময় নয়নে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। পৃথিবীতে কথার আঘাত বড়ো মারাত্মক জিনিস। ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে যায়। মায়ের কথা গুলো মেনে নিতে পারল না মেহেভীন।

–তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন আম্মু? কতটুকু খেয়েছি তোমাদের? আমাকে একটা টাকার হিসাব দিও। আমি তোমাদের সব টাকা ফিরিয়ে দিব। তবুও খাবারের খোঁটা দিও না। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়। মেহেভীনের কথায় জ্বলে উঠল রাইমা বেগম। আগের চেয়ে দিগুন ক্রোধ নিয়ে বলল,

–তোকে আমি এখানে আসতে কতবার নিষেধ করেছিলাম। তবুও বাবা ডাকলো আর বেহায়ার মতো চলে আসলি। তোর কি ভেতর লজ্জা টুকুও নেই। মায়ের আদেশ পালন করতে পারিস না। তোর মতো মেয়ে থাকার থেকে না থাকা অনেক ভালো। তুই আমাকে টাকার গরম দেখাস। ভুলে যাস না প্রাপ্তির কথা শুনে পালিয়েছিলি। তোর এই মা তোকে সব বিপদ থেকে আগলে রেখেছে। এই যে চাকরি করে খাচ্ছিস। এর পেছনে আমার একটা বড় অবদান আছে। আমি চেয়েছিলাম। তুই যেন অনেক বড় হোস। তোর যেন কারো পায়ের কাছে আসতে না হয়। তুই নিজের সুন্দর ব্যক্তিত্ব নিয়ে বাঁচতে পারিস। সেজন্য আমি তোকে সব রকম সাহায্য করেছি। আর তুই মুর্খতার পরিচয় দিয়ে দিলি। এখানে কেন এসেছিস তুই?

–আমি আসতে চাইনি আম্মু। আব্বু আমাকে অনেক বার ফোন দিয়েছে। তুমি জানো বাবা-মা মেয়েদের একটা আবেগের জায়গা। যেখানে তারা কঠিন অপরাধ করার পরে একটু ভালোবেসে দিলেই মেয়েরা সব ভুলে যায়। বাবার আদুরে ডাক আমি অপেক্ষা করতে পারিনি। যে বাবা জন্ম দিয়েছে তার সাথে কিভাবে বেয়াদবি করতে পারি বলো?

–আমি ঠান্ডা মাথায় তোকে কিছু কথা বলি। আমার কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবি। বাবা নামটা ছোট হলে-ও এর দায়িত্ব অনেক বড়। বাবা আমাদের আবেগের জায়গা। বাবা নামটা শুনলেই প্রতিটি মেয়ের হৃদয়ে একটা স্নিগ্ধ অনুভূতি কাজ করে। কিন্তু তোর বাবা সেই আবেগের জায়গা নয়। সেটা তুই আজই ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারবি। তোর বাবা সাপের চেয়েও বেশি বিষাক্ত। তার স্বার্থে আঘাত লাগলে রঙ বদলাতে এক সেকেন্ড সময় নিবে না। এখনো সময় আছে যদি নিজের ভালো চাস। তাহলে এখনই এই বাসা থেকে বেড়িয়ে যা। আমি চাইনা তুই একটা তিক্ত সত্যের মুখোমুখি হোস।

–সত্য কোনোদিন চাপা থাকে না আম্মু। তোমাকে আজ বলতেই হবে। তুমি আমার সাথে এত ধোঁয়াশা রেখে কেন কথা বলো। আমি সবকিছু জানতে চাই। আমার আব্বু কি করেছে। নিজের বাবা হয়ে কেউ কখনো নিজের মেয়ের ক্ষতি করে। ধরনীর বুকে মেয়েরা সবচেয়ে নিরাপদ তার বাবার কাছে। সেই বাবা কি করে কারো ক্ষতির কারন হতে পারে!

–তোর বাবা আরিয়ানের সাথে তোর বিয়ে দেওয়ার জন্য তোকে এখানে নিয়ে এসেছে। আরিয়ানকে বিয়ে করে সংসার করার এজন্য এখানে এসেছিস তুই! আমার কোনো আপত্তি নেই। তুই যদি আরিয়ানের সাথে সংসার করে খেতে পারিস। তাহলে আমার নিশ্চুপ থাকাই ভালো।

–তুমি চিন্তা করো না আম্মু। আব্বু এত সহজে আমাকে আরিয়ান ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিতে পারবে না। এসব কথা তুমি আমাকে আগে জানালে, আমি কখনো এখানে আসতাম না৷ এসে যখন পড়েছি আব্বুর সাথে লড়াই করেই বের হয়ে যাব।

–তুই যতটা সহজ ভাবে তোর আব্বুকে নিচ্ছিস। তার ভেতরের রুপ বেড়িয়ে আসলে, তোর রুহু পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। মেহেভীন চিন্তায় পড়ে গেল। শত্রুর সাথে লড়াই করে জেতা যায়। কিন্তু ঘরের লোকের সাথে লড়াই করে, ঘরের লোককে সে কিভাবে আহত করবে!

–তুমি আমাকে এতদিন ফোন দিয়ে জানাওনি কেন?

–সুযোগ পেলে অবশ্যই জানাতাম। মেহেভীন কিছু ভাবতে শুরু করল। তখনই তাহিয়ার আগমন। তাহিয়াকে দেখেই বিরক্তিতে মুখশ্রী কুঁচকে এল। তাহিয়া রাইমা বেগমকে সালাম দিয়ে মেহেভীনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। রাইমা বেগম তাহিয়াকে দেখে গম্ভীর মুখশ্রী করে নিজের কক্ষ চলে গেলেন। এই কয়দিনে মেয়েটাকে হারে হারে চিনেছে। সে-ই মেহেভীনের বাবার মাথা খেয়েছে। নিজের মেয়ে এমনিতেই চোখের বি’ষ হয়েছিল। সময়ের সাথে আরো একটু বি’ষ যোগ করে ভয়ংকর রকমের বিষাক্ত করে তুলছে। তাহিয়া হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–আপনি আমার কাছে প্রমাণ চেয়েছিলেন না৷ আমি সব প্রমাণ জোগাড় করেছি। সেই কবে থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আপনার আব্বু আম্মু জানে কতদিন আপনাদের বাসায় এসেছি। কথা গুলো বলেই কিছু কাগজ মেহেভীনের হাতে ধরিয়ে দিল। মেহেভীন কাগজ গুলো পর্যবেক্ষণ করল। এগুলো দেখার পরে যে কারো বিশ্বাস হবে না। যে তাহিয়া মিথ্যা কথা বলছে। নিপুণ দক্ষ হাতে মুনতাসিমের সাইন দেখেই বুঝতে পারলো। তাহিয়া সত্যি কথা বলছে। সে জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়লো। বিশাল আকাশটা যেন তার মস্তকে এসে পড়েছে। তাহিয়া তৃপ্তির হাসি হেসে বলল,

–এরপরেও বলবেন আমি মিথ্যা কথা বলছি।

–আমার ওপরে ভরসা রাখুন। আমি আজকের পর থেকে আপনার স্বামীর সাথে কথা বলব না। তাহিয়া কাগজ গুলো মেহেভীনের হাত নিয়ে চলে গেল। মেহেভীনের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। তাহিয়ার হাতের সব কাগজ দেখে সর্ব শান্ত হয়ে গেল। দৌড়ে নিজের কক্ষে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। সারারাত আর দরজা খুলেনি। তাকে সবাই ডাকতে গেলে বলছে সবার সাথে সকালে কথা বলবে। সবাই মেহেভীনের কথা মেনে নিয়েছে। এখন মেহেভীনকে রাগানো উচিৎ হবে না। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছে মেহেভীন। মুনতাসিম বিপুল পরিমাণ ভোট পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। চারদিকে ঈদ ঈদ আমেজ লেগে গিয়েছে। সমস্ত এলাকা জুড়ে মুনতাসিমের স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে। রাতভর আনন্দ উল্লাস মেতে উঠেছিল এলাকাবাসী। এত আনন্দের মাঝে নিজের প্রেয়সীর জন্য ভেতরটা ছটফট করেছে। শতবার ফোন দিয়েও মেহেভীনকে পাওয়া যায়নি। অজানা কষ্টে বুকটা হাহাকার করে উঠছে। হঠাৎ মেয়েটার কি হলো ভাবতে ভাবতে রজনী পার করল মুনতাসিম৷ সকালে হলেই মেহেভীনের বাসায় চলে আসবে। মেয়েটাকে ছাড়া একটা মুহুর্ত সে শান্তিতে থাকতে পারে না। সবকিছু জেনেও মেয়েটা কেন তাকে এভাবে পোড়াচ্ছে। সেসব ভেবে পায় না মুনতাসিম।

ভোরের আজান কর্ণকুহরে আসতেই মেহেভীন উঠে বসলো। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। আঁখিযুগল দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকণা গুলো পরম যত্নে মুছে নিল। অজু করে এসে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। এতদিনের জমিয়ে রাখা সব শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। আঁখিযুগল দিয়ে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে যাচ্ছে। নিজের প্রিয় মানুষদের নতুন নতুন রুপ সে সহ্য করতে পারছে না। সব সময় তার জীবন থেকেই সবকিছু হারিয়ে যায় কেন? সে কি কারো ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা রাখে না। তবে কেন বারবার সবার ছলনার স্বীকার হয়। দীর্ঘ সময় কান্না করার ফলে মনটা হালকা লাগছে বেশ৷ নিজের কষ্ট হলে নিজেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অনুভূতিটা ভিষণ সুন্দর। মেহেভীনের চেহারায় মলিনতা এসে ধরা দিয়েছে। মেয়ের এহেন বিধ্বস্ত চেহারা দেখলে যেকোনো বাবার রুহু কেঁপে উঠবে। কিন্তু ফরিদ রহমান মেয়ের মনের অবস্থা বুঝবে? মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। মেহেভীন দরজা খুলে ফরিদ রহমানকে দেখে চমকে গেলে। তার বাবা সচরাচর এত সকালে তার কাছে আসে না। তবে আজ হঠাৎ কি মনে করে আসলেন? মেয়ের বিধস্ত অবস্থা দেখে রাইমা বেগমের ভেতরটা হুঁ হুঁ করে উঠল। ফরিদ রহমান মিষ্টি হেসে মেয়ের হাত ধরে ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসলো। মেহেভীন বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

–এত সকালে ডেকে নিয়ে আসার কারন কি আব্বু?

–আমি তোর সাথে আরিয়ানের বিয়ে দিব। রাতে দরজা খুলিসনি। কাজী সাহেব রাগ করে চলে গিয়েছে। তাই ভোরের আজান শেষ হবার সাথে সাথে নামাজ শেষ করে, সবাই মিলে তোর জন্য অপেক্ষা করছি। এবার আর আমাকে হতাশ করিস না মা। তুই আরিয়ানকে বিয়ে করে ফেল৷ তাহলে জীবনে তুইও সুখী হবি। আর আমিও তোর সুখ দেখে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করতে পারব। মেহেভীনের বিষণ্ণতা মুহুর্তের মাঝে কেটে গেল। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–তুমি আবার সেই এক গান গাইছো কেন আব্বু । তোমাকে আর কিভাবে বোঝালে বুঝবে। আমি আরিয়ান ভাইকে বিয়ে করব না। তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে, তার কি অবস্থা আমি করতাম। সেটা আমি নিজেও জানিনা৷ আমারই ভুল হয়েছে। কেন যে আম্মুর কথা শুনলাম না। তুমি শুধু নিজের কথাই ভাবছ। প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস পড়লে দেখা যায়। পৃথিবীর সমস্ত শক্তিশালী মানুষ গুলো শত্রু দ্বারা নিহত হয়নি। হয়েছে আপন মানুষের বেইমানি কারনে। যেমন তোমার কথার মায়ায় পড়ে ছুটে আসলাম তোমার কাছে। আর তুমি আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে পাঠাচ্ছ। এবার যদি আমি এই বাড়ি থেকে বের হই। তাহলে আমার লা’শ আসবে এই বাড়িতে, তবুও আমি জীবিত থাকতে এই বাড়িতে আসব না।

–আরিয়ানকে বিয়ে করবি না কাকে বিয়ে করবি। ঐ মুনতাসিম ফুয়াদকে যে কি-না বিবাহিত সন্তানের বাবা হতে চলেছে। একটা কথা ভালো করে শুনে রাখ। যাকে তুই স্বামী বানানোর চেষ্টা করছিস। সে তোকে রক্ষিতা বানানোর চেষ্টা করছে। এসব এমপি মন্ত্রীরা ভালো হয় নাকি। এরা কখনো এক নারীতে আসক্ত থাকে না। এরা প্রতিদিন কাপড় বদলের মতো একটা করে মেয়ে বদল করে। প্রতি রাতে নতুন নতুন মেয়ে লাগে। সেখানে তোর মতো মেয়েকে বিয়ে করে ঘরের বউ করবে। এত মহান আশা নিয়ে বাঁচিস না। মুনতাসিম ফুয়াদের রক্ষিতা হয়ে থাকবি তুই। ফরিদ রহমানের কথায় মেহেভীনের মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে গেল। ঘৃণায় পুরো শরীর রি রি করছে। ক্রোধে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পরিবেশ গরম করে তুলল রাইমা বেগম। স্বামীর মুখশ্রীতে একদলা থুতু ফেলে পায়ের জুতা খুলে পর পর চারটা বাড়ি মা’র’লে’ন মুখে। স্বামীর গলা চেপে ধরে বললেন,

–জা’নো’য়া’রে’র বাচ্চা বহু বছর ধরে তোর নাটক আমি সহ্য করছি৷ তোর কলিজা কে’টে আমি সিদ্ধ করে পা’গ’লা কু’ত্তা’কে খাওয়াব। তুই নিজে একটা নষ্ট হয়ে, আমার ফুলের মতো পবিত্র মেয়ের দিকে নোংরামির কাঁদা ছুঁড়ে দিস। আমি বেঁচে থাকতে এসব সহ্য করে চুপ থাকতে হবে। তোকে আমি বাঁচতে দিব না। তোর মতো অমানুষের না আছে বাবা হবার যোগ্যতা আর না আছে স্বামী হবার যোগ্যতা। তোর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তুই ম’রে গেলে আমি দুধ দিয়ে গোসল দিব। আমার মেয়েকে নোংরা কথা বলার আগে তুই ম’র’তে পারলি না। প্রাণ প্রিয় প্রেয়সীর এমন রুপ দেখে হৃদয় থমকে গেল ফরিদ রহমানের। তার শান্ত শিষ্ট অর্ধাঙ্গিনীর ভেতরে এমন ভয়ংকর রুপ আছে। সেটা সে কোনোদিন কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত সে তবুও অর্ধাঙ্গিনীকে আঘাত করবে না। কারন মানুষটা তার ভিষণ শখের। রাইমা বেগম মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে বজ্র কণ্ঠে বলল,

–কি রে হতভাগা এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? নাকি আরো কিছু শোনার বাকি আছে। জেদ ধরে এখানে থেকে গিয়েছিলি না। এখন নিজের প্রাণ প্রিয় বাবার আসল রুপ দেখ। তোর মতো মেয়ে আমার পেটে হলো কিভাবে তাই ভাবছি। বে’য়া’দ’বে’র মতো দাঁড়িয়ে না থেকে এখনই এই বাসা থেকে বের হয়ে যা। এই বাড়ির আশেপাশে যেন তোকে না দেখি।

–আমি তোমাকে রেখে যাব না আম্মু। তুমিও আমার সাথে যাবে। এই লোকটা যদি আমার বাবা না হতো। তাহলে একদলা থুতু তার মুখে ছুঁ’ড়ে ফেলতাম। ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে এত ভালো মানুষির পেছনে জঘন্যতম রুপ লুকিয়ে আছে। তোমাকে আমি এই মানুষটার সাথে সংসার করতে দিব না। তোমাকে শেষ করে দিবে এই মানুষটা। এতটা যন্ত্রনা বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। আমাকে একটা বার জানালে কি হতো।

–আমি তোর মতো দুর্বল নই। নিজেকে রক্ষা করার মতো ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দিয়েছে। তাছাড়া এই জা’নো’য়া’র টা আমার শরীরে একটা ফুলের টোকাও দিবে না। বড্ড শখের মানুষ বলে কথা। তুই আমার চোখের সামনে থেকে যাবি নাকি তোর চোখের সামনেই একে রক্তাক্ত করে ফেলব। মেহেভীন মায়ের এমন রুপে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার সহজ সরল মায়ের মধ্যে এমন ভয়ংকর রুপ লুকিয়ে আছে। সেটা গুন অক্ষেরও টের পায়নি। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। ফল কাটা ছুরিটা হাতে নিয়ে ফরিদ রহমানের গলায় ধরে আছে রাইমা বেগম। একটু নড়লে ফরিদ রহমানের মৃত্যু যেন নিশ্চিত। তা দেখে মেহেভীনের শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২৪
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

হিম শীতল করা হওয়া মেহেভীনের শরীর কাঁপিয়ে তুলছে। ধরণীতে বাবা নামক বটগাছটা এত জঘন্যতম হতে পারে, তা মেহেভীনের কল্পনার বাহিরে ছিল। সে তো বাবার ভালোবাসা চেয়েছিল। কিন্তু তার বাবা তার মৃত্যু চাইল! এমন বাবাও ধরনীর বুকে আছে। মেহেভীনের মা দিব্বি দিয়ে, মেহেভীনকে বাসার বাহিরে বের করে দিয়েছে। না চাইতেও তাকে আসতে হয়েছে। গুটি গুটি পায়ের মেহেভীন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তখনই মুনতাসিম হন্তদন্ত হয়ে মেহেভীনের সামনে উপস্থিত হয়৷ চেহারায় বিধ্বস্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সে রাগান্বিত হয়ে উচ্চ স্বরে বলল,

–আপনার সমস্যাটা কি? আপনি সব সময় আমার সাথে এমন করেন কেন? আমাকে কি মানুষ মনে হয় না। আমি কি এতটাই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের জিনিস। প্রতিনিয়ত আমাকে ভেঙে চূড়ে চুরমার করে দিচ্ছেন। আপনার জ্বালিয়ে দেওয়া আগুনে জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাই। তবুও আপনাকে আহত করার চেষ্টা কখনোই করি নি। মানুষ এতটা স্বার্থপর হয় কিভাবে কাল থেকে শতশতবার আপনাকে ফোন দিয়েছি। আপনি কেন আমার ফোন তুলেনি। মেহেভীন নিষ্পলক চাহনিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সমস্ত মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে। মেহেভীনের শান্ত চাহনি মুনতাসিমের উথাল-পাতাল করা হৃদয়টা শান্ত করে দিল। মনটা কু ডেকে বলছে। ভালো কিছু হবে না অনর্থ হয়ে যাবে। নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করো মুনতাসিম ফুয়াদ। মেহেভীন শান্ত কণ্ঠে বলল,

–মানুষ এতটা সুন্দর ভাবে ঠকাতে পারে৷ সেটা আপনাকে না দেখলে জানতেই পারতাম না। সুযোগের সৎ ব্যবহার করলেন। আর কতজনকে ঠকিয়েছেন আপনি? একটা কথা সব সময় মনে রাখবেন। আল্লাহ তায়ালা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না৷ আপনি যেভাবে আমাকে ঠকিয়েছেন৷ একদিন আপনি-ও ঠিক একই ভাবে ঠকবেন। আমার অনুভূতিরা কবেই ম’রে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে একটু সতেজ হয়ে উঠেছিল। জেগে উঠার আগেই অনুভূতি গুলোকে দাফন করে দিলেন আপনি। আমার মধ্যে অনেক ভুল আছে। সবকিছু জানার পরে-ও কেন আমার ভেতরে এসে, অনুভূতি তৈরি করে সেগুলোকে দাফন করে দিলেন৷ মেহেভীনের কথায় নিস্তব্ধ হয়ে গেল মুনতাসিম। অজানা ভয়ে বুকটা হাহাকার করে উঠছে৷ মেহেভীন এসব কি বলছে! সে কি কোনো কারনে আবার তাকে ভুল বুঝল। মুনতাসিন শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল,

–আপনি এসব কি বলছেন। আমার যদি কোনো ভুল পান। তাহলে সেটা আমাকে বলুন। আমি সেই ভুলটা শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করব। আমি চাইনা আমার কোনো কাজে আপনি আঘাতপ্রাপ্ত হন। যদি হয়ে থাকেন। তাহলে সেটা আমাকে জানান। আমি ধরনীর বুক থেকে তাকে গায়েব করে দিব। তবুও আপনার এক বিন্দু কষ্ট আমি সহ্য করব না।

–আপনি আমার সামনে থেকে সরে যান। আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই না। আপনার সাথে কথা বলতে আমার রুচিতে বাঁধে। পুরুষ জাতিকে বিশ্বাস করাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। এরা নিজের স্বার্থের জন্য সবকিছু করতে পারে। অথচ আপনার জন্য নিজ জন্মদাতা পিতার কাছে কি জঘন্যতম অপবাদ টাই না পেলাম।

–আমার অপরাধ?

–আপনি একজন বিবাহিত পুরুষ দু’দিন পরে বাচ্চার বাবা হবেন। ঘরে অর্ধাঙ্গিনী থাকা সত্বেও পর নারীর পেছনে কেন ঘুরেন। কেন তাকে প্রেমালাপ কথা বার্তা শোনান। দুর্বলতার সুযোগ নিলেন। এতটা বাজে ভাবে আঘাত না করলে-ও পারতেন।

–আপনার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। আপনাকে কতবার বলব আমি বিবাহিত না। আপনাকে কিভাবে বোঝালে বুঝবেন। আমি শুধু… কথা গুলো বলতে গিয়েও থেমে গেল। মেহেভীনের দমিয়ে রাখা ক্রোধ গুলো বের হয়ে আসলো। চারিদিকের এত এত মানসিক চাপ তাকে দিশেহারা করে দিয়েছে। জীবনটা তার কাছে মূল্যহীন লাগছে৷ সে বজ্রকণ্ঠে বলল,

–চরিত্রহীন পুরুষ কোথাকার! ঘরে বউ রেখে পরনারীর পেছনে ঘুরতে আপনার লজ্জা করে না৷ আপনার মতো পুরুষকে মৃত্যু দন্ড দেওয়া উচিৎ। এলাকার লোক কি জানে, তাদের মহৎ নেতা কতবড় চরিত্রহীন। ভালো মানুষির মুখোশ পরে থাকেন। আসলেই এমপি মন্ত্রীরা এক নারীতে আসক্ত থাকে না। এদের কোনো শখের নারী হয় না। সকল নারীই এদের শখের নারী। আপনি যদি আমার সামনে থেকে না গিয়েছেন। আমি লোক জড় করে আপনার অবস্থা খারাপ করে ফেলব। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিমের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ফর্সা মুখশ্রী ভয়ংকর ভাবে রক্তিম বর্ন ধারণ করল৷ বজ্র কণ্ঠে বলল,

–ডাকেন কাকে ডাকবেন। কার এত ক্ষমতা মুনতাসিম ফুয়াদের বিচার করবে। আমি অপেক্ষা করছি। নিজেকে আপনি কি মনে করেন। আমার চরিত্রের সার্টিফিকেট দেওয়ার আপনি কে? বেশি মূল্য পেয়েছেন তাই নিজেকে মহান কিছু ভাবতে শুরু করেছেন। আমি যদি বিবাহিত হয়েও থাকি। তাহলে আপনার সমস্যা কোথায়? আপনি কেন আমার সাথে এমন ব্যবহার করছেন। আমি কি এমন ব্যবহার করার মতো কোনো কাজ করেছি। না আমি আপনাকে বলেছি আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনার সাথে আমার প্রণয়ের সম্পর্ক থাকলে, এসব কথা বললে সহ্য করা যেত। কিন্তু আপনার সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আপনি কেন এমন আচরণ করছেন! মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কথা বলার শক্তি যেন সে হারিয়েছে। আসলেই তো মুনতাসিম তাকে কখনোই ভালোবাসার কথা বলেনি। তবে ভালোবাসার দিক গুলো প্রকাশ পেয়েছে বলেই সে কথা গুলো বলেছে। মেহেভীনকে নিরুত্তর দেখে মুনতাসিম দু’হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। ক্রোধে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। মেহেভীন চেঁচিয়ে বলল,

–মিথ্যেবাদী, ঠক, জালিয়াত, ভন্ড, প্রতারক আমাকে ভালোবাসেননি। তাহলে আমার কাছে কেনো এসেছিলেন? আমার অনুভূতি নিয়ে কেনো খেললেন? আপনার মতো চরিত্রহীন লোকের মুখ আমি দেখতে চাই না৷ যে মেয়ের স্বামী এমন চরিত্রহীন যে মেয়ের সারাজীবনই বরবাদ। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিম ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। শীতের মাঝে-ও তরতর করে ঘামছে। ক্রোধের মস্তকে প্রেয়সী আঘাত পাবে। এমন কথা স্মরণ রাখতে যেন ভুলল না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে, ঘুষি মা’র’লো। মুহুর্তের মধ্যে হাতটা রক্তাক্ত হয়ে গেল। মুনতাসিমের এমন কান্ডে চমকে গেল মেহেভীন। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। আশেপাশে ভিড় জমা হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিমের ভয়ে কারো মুখ দিয়ে টু ও শব্দ বের হচ্ছে না। কয়েকজন কানাঘুষো শুরু করে দিয়েছে। একজন বৃদ্ধ মেহেভীনের দিকে এগিয়ে এসে ধীর কণ্ঠে বলল,

–কি হয়েছে মা রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে দু’জন চিৎকার চেঁচামেচি করছ কেন?

–আমি চিৎকার চেঁচামেচি করতে চেয়েছিলাম। আপনাদের ভালোবাসার নেতা আমার পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। সে একজন বিবাহিত পুরুষ হয়ে পরনারীর পেছনে ঘুরে। তার বউ এসে আমাকে সবকিছু জানায়। একটা মেয়ে হয়ে আমার উচিৎ এই চরিত্রহীন পুরুষকে প্রশ্রয় না দেওয়া। যদি আবেগ বশত দিয়ে ফেলি। তখন আমার নামের সাথে কলঙ্ক লেগে যাবে। একটা নারী কখনোই শরীরে কলঙ্ক নিয়ে ঘুরে বেড়াতে চাইবে না। আমি মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সংসার কিছুতেই ভাঙতে পারব না। দু’দিন পরে এই লোক বাবা হবে। তিনি তার বউকে সময় না দিয়ে, পরনারীর পেছনে ছুটছে। তার অর্ধাঙ্গিনীর ভেতরে কি হচ্ছে একটা বার ভাবুন। আমি নিজেও সরে যাচ্ছি। আর প্রতিটি নারীকে উদ্দেশ্য করে বলে যাচ্ছি। এই চরিত্রহীন পুরুষকে যেন কেউ প্রশ্রয় না দেয়। কথা গুলো বলেই মেহেভীন বিলম্ব করল না। দ্রুত ভিড় ঠেলে বের হয়ে গেল। মুনতাসিম গাছের সাথে এক হাত ধরে মেহেভীনের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। রক্তাক্ত আঁখিযুগল, চেহারায় অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তাইয়ান অসহায় দৃষ্টিতে মুনতাসিমের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। গার্ডদের ইশারা করতেই ভিড় কমিয়ে ফেলা হলো। কেউ কেউ মেহেভীনের কথা বিশ্বাস করল। কেউ কেউ মানতে নারাজ মুনতাসিম এমন কাজ করতে পারে না। মুনতাসিমের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। সে তাচ্ছিল্য করে বলল,

–আপনার কাছে নিজেকে বড্ড সস্তা বানিয়ে ফেলছিলাম। যার পরিনাম এমনটা হবার কথাই ছিল। সস্তা জিনিসের দাম বরাবরের মতোই কম থাকে। আপনি না আমায় ভালোবাসতেন। তাহলে আমাকে বিশ্বাস কেন করলেন না। ভালোবাসার আগে বিশ্বাস আর ভরসা করাটা জরুরি। ওহে আমার শখের নারী সর্বকালের সর্ব সুখ আপনার হোক। তবুও আপনি ক্ষমার অযোগ্য। আপনি ছেড়ে যাওয়ার বাহানা খুঁজ ছিলেন। আর আমি রাগ করে তা সহজ করে দিলাম। কাউকে ভালোবাসলে এক সমুদ্র সমান বিশ্বাস আর ভরসা নিয়ে বাসবেন। তাহলে আপনার করা আঘাতে কারো ছোট্ট হৃদয়টা চূর্ণবিচূর্ণ হবে না। এতদিন ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। আপনি আমায় সস্তা ভেবে উড়িয়ে দিলেন। এবার আপনি আমার অবহেলা দেখবেন। একটা মুহূর্ত বাঁচার মতো বাঁচতে দিব না। আমাকে বিনা দোষে ভুল বোঝার কারনে জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাবেন। ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলবে আপনার। আগুন নেভানোর জন্য আমি আসব না। আমার ভালোবাসা যতটা তীব্র ছিল। আমার অবহেলা ভয়ংকর রকমের সুন্দর। আপনি আমার মুখ দেখতে চান না। আমার এই মুখ আপনি কোনোদিন দেখতে পাবেন না। একদিন আপনি নিজে ছুটে আসবেন আমার কাছে। ভালোবাসা ভিক্ষা চাইবেন। সেদিন আমি ভয়ংকর রকমের পাষাণ হব। আপনার ভেতরটা পোড়াতে পোড়াতে কয়লা করে ফেলব। কথা গুলো বলেই বাসার দিকে অগ্রসর হলো।

চৌধুরী বাড়িতে আনন্দ যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। কিন্তু যার জন্য এত আনন্দ এত উল্লাস। তার ভেতরটা পুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে গিয়েছে। মুখের হাসি পরিস্থিতি শুষে নিয়েছে। ছেলের বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে, রিয়াদ চৌধুরীর অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। মুনতাসিমের আঁখিযুগলের দিকে তাকিয়ে রক্তাক্ত হয়ে গেল বাবার হৃদয়। ভয়ংকর ভাবে মুনতাসিমের আঁখিযুগল রক্তিম হয়ে আছে। ছেলের এমন বিভর্স চেহারা আগে কখনো দেখেননি তিনি। রিয়াদ চৌধুরী মুনতাসিমের কাছে এগিয়ে আসতে চাইলে। মুনতাসিম তাকে উপেক্ষা করে চলে গেল। ভেতরটা এতটা দুর্বল হয়ে গেল কেন তার? মেয়েটা আসলেই জাদুকরী নিমিষেই মনটা বিষাদে ভরিয়ে দেয়। আবার মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত সুখ তার মুখশ্রীতে এনে দেয়। পরিস্থিতির কাছে সে হেরে গেল। আর দেখতে পাবে না চাঁদ মুখটা। শুনতে পারবে না মায়াবী কণ্ঠ স্বরটা। করতে পারবে না পাগলামি। হতে চাইবে না ছোট বাচ্চা। হয়ে যাবে আগের ন্যায় কঠিন। তার আগে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা টা অত্যন্ত জরুরী। মুনতাসিম তাইয়াকে ফোন দিয়ে নিজের কক্ষে নিয়ে আসে। তাইয়ানের উপস্থিতি অনুভব করতেই মুনতাসিম বলল,

–আমার নামে মেহেভীনকে কে কি বলেছে তাইয়ান। তাড়াতাড়ি খোঁজ নিয়ে জানাও। ইলেকশন নিয়ে এতটা ব্যস্ত ছিলাম যে এদিকে খেয়াল করিনি। কে সে যে এত বড় জঘন্যতম অপরাধ করেছে। তাকে সামনে পেলে আমি জ্যা’ন্ত পুঁ’তে ফেলব।

–আপনি ম্যাডামকে ভুল বুঝবেন না স্যার। ম্যাডাম অনেক ভালো। সে আপনাকে অনেক ভালোবাসে। আমার মনে হয় কারো প্রচারনায় এমন কাজ করে ফেলছে। আপনাকে নিয়ে কটুক্তি করার সময় ম্যাডামের কণ্ঠ স্বর কাঁপছিল। আমি ম্যাডামের আঁখিযুগলে আপনার জন্য তীব্র ভালোবাসা আর অভিমান দেখেছি। তাইয়ানের কথা শেষ হবার আগেই মুনতাসিম বালিশের পাশে রাখা নিজের ব’ন্দু’ক টা তাইয়ানের বুক বরাবর তাক করল। তাইয়ান ভীত দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই তিরস্কার করল তাইয়ান। ভুল সময়ে ভুল কথা বলে ফেলছে। মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাইয়ান। ধীর কণ্ঠে বলল,

–স্যরি স্যার আমি আপনাকে আঘাত করতে চাইনি৷ আমার ভুল হয়েছে। আমি এমন অন্যায় আচরন কখনো করব না।

–গেট আউট ফর্ম হেয়ার। কালকের মধ্যে সব তথ্য চাই। তাইয়ানের কণ্ঠনালি দিয়ে আর একটা বাক্য উচ্চারিত হলো না। সে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল।

পরের দিন সকাল বেলা মুনতাসিমের নামে টিভি চ্যানেলে প্রচার করা হচ্ছে। বিবাহিত হয়েও নিজেকে অবিবাহিত দাবি করে পরনারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছেন মন্ত্রী মুনতাসিম ফুয়াদ। বিবাহের খবর এতদিন আড়ালে রাখলেও। মুনতাসিম ফুয়াদের স্ত্রী সঠিক তথ্য ফাঁস করে দেন। পরকীয়া প্রেমিকার সাথে রাস্তায় ঝামেলা করছিলেন তিনি। এমন সময় সঠিক সত্যটা সকলের সামনে বেড়িয়ে আসে। কেউ কেউ বলছে মেয়েটি মিথ্যা কথা বলছে। আবার কেউ কেউ বলছে সত্য বলছে। সবকিছু এখনো ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। সঠিক তথ্য নিয়ে হাজির হব আমি আনিকা তাসনিম।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-১৯+২০+২১

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_১৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

লা’শে’র ফ্রিজিং ড্রয়ার খুলতেই এক সুন্দর রমণীর মুখশ্রী ভেসে উঠল। সমস্ত মুখশ্রী ফ্যাকাশে হয়ে আছে। পুরো শরীর রক্ত বিহীন সাদা বর্ণের হয়ে গিয়েছে। সমস্ত শরীর পাথরের ন্যায় ঠান্ডায় জমে আছে। রক্তিম আঁখিযুগল রমণীর মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। যখনই প্রতিশোধের নেশা দমে যায়। তখনই এই মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করলে, প্রতিশোধের নেশা দাউদাউ করে জ্বলে উঠে। চোয়াল শক্ত হয়ে এল যুবকের। সে ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে লা’শে’র গালে স্পর্শ করল। তাচ্ছিল্যের করে বলে উঠল,

–আমার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে বেঁচে থাকার তোর খুব শখ ছিল তাই না। তোর শখকে আমি সারাজীবনের জন্য নিশ্চুপ করিয়ে দিলাম। আর আসবি না অর্ধাঙ্গিনীর অধিকার নিয়ে বাসবি না ভালো আমায়। তোর জন্য আমি নিজের প্রেয়সীকে নিজের করে পাইনি। তোকেও আমি বাঁচতে দেইনি। এখন তোর কেমন অনুভূতি হচ্ছে। আমি ভিষণ শান্তিতে আছি জানিস। তোর মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করলে ঘৃণায় আমার পুরো শরীর রি রি করে। তোর জন্য আজ আমি ত্যাজ্য পুত্র হয়েছি। শরীরটা নেতিয়ে গিয়েছিল। তোর বিশ্রী মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করলে প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠে। তুই যতদিন বাঁচবি তোকে এভাবে জমে থাকতে হবে। এতটুকু মাটির ছোঁয়াও তোকে পেতে দিব না। আমার প্রেয়সী আমাকে না পাবার আক্ষেপে ধরণীর মায়া ত্যাগ করে বিদায় নিয়েছে। যার জন্য আজ আমাদের করুন অবস্থা হয়েছে। সেই মুনতাসিম
কে ধরণীর বুক থেকে বিতাড়িত করে, নিজেও বি’ষ পানে জীনের মায়া ত্যাগ করে ধরণী ছাড়ব। কথাগুলো বলেই শব্দ করে হাসতে শুরু করল যুবক। সে কি ভয়ংকর হাসি। যে কেউ দেখলে তার রুহু কেঁপে উঠবে। এই মায়াবী মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে যে কারো মায়া হবে। কিন্তু পাষাণ যুবকের মায়া হলো না।

সময় যেন স্রোতের বিপরীত চিহ্ন স্রোত যেমন কারো জন্য থেমে থাকে না। ঠিক তেমনই সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। প্রাকৃতিক নিয়মে নিজ গতিতে ছুটে চলে যায়। দেখতে নির্বাচনের সময় চলে আসলো। মুনতাসিম নিবার্চন নিয়ে ভিষণ ব্যস্ত। সেজন্য মেহেভীনের সাথে দেখা হয় না বহুদিন। প্রেয়সীকে না দেখায় তৃষ্ণায় মনটা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাকে দেখার অসুখ মুনতাসিমের কোনোদিনই সারবে না। তার শূন্যতায় ভেতরটা ছটফট করে। দৌড়ে গিয়ে প্রেয়সীকে বুকে আগলে নিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে নিরূপায় ইচ্ছে থাকলে-ও উপায় নেই। গোধুলি আলোয় চারদিক চকচক করছে। প্রাকৃতিক সুন্দর্য যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। মেহেভীনের বাবা কালকে স্ট্রোক করেছেন। সে খবর পেয়ে মেহেভীন ছুটে আসছে নিজ মাতৃভূমিতে। নিজের মাতৃভূমিতে চরণ রাখতেই কিছু মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। চারদিকে পোস্টারের ছড়াছড়ি ভোট আসলে এ নতুন কিছু নয় স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু মেহেভীনের আঁখিযুগল থমকে গেল পোস্টারের দিকে। এই মানুষটাকে সে চিনে খুব ভালো করে। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো পোস্টটারের দিকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাড়ির দিকে চলতে শুরু করল। শত-শত মোটর সাইকেল নিয়ে মিছিল যাচ্ছে। এলাকার অলিতে-গলিতে শত-শত মানুষ তার আপনজনের জন্য ভোট চাওয়া ব্যস্ত। চারদিকে মাইকিং হচ্ছে ভোট চাই ভোটারের দোয়া চাই সকালের। আরো কিছু রেকর্ড করা বক্তব্য কর্ণে এসে পৌঁছাচ্ছে। কর্ণ একদম ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। মেহভীন সেগুলো মানুষকে উপেক্ষা করে বাসার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। একটু দূরে যেতেই নির্দিষ্ট মানুষের দেখা মিলল। কিছু মানুষ দলবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসছে। মুখশ্রীতে নিজের পছন্দের নেতার প্রতীকের প্রতিধ্বনি। সামনে থাকা মানুষটাকে চিনতে খুব একটা সময় লাগলো না। মুনতাসিম মেহেভীনকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেল। মুহুর্তের মাঝে অদৃশ্য মন খারাপ এসে তাকে আলিঙ্গন করল। এতদিন পর দেখা মানুষটা তার দিকে ফিরেও চাইল না। ভিষণ অভিমান হলো মেহেভীনের। বাবার কথা স্মরন হতেই সে বাসার মধ্যে চলে গেল। কলিং বেলে চাপ দিতেই মেহেভীনের মা এসে দরজা খুলে দিল। মেহেভীন কোনো বাক্য উচ্চারণ না করে দ্রুত বাবার কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো। দীর্ঘদিন পর মেয়েকে দেখে জানে পানি আসলো। হাত বাড়িয়ে মেয়েকে ডাকলেন। বাবার আদুরে ভাবে ডাকটা মেহেভীন উপেক্ষা করতে পারল না। দৌড়ে গিয়ে বাবার বুকের মধ্যে গিয়ে মুখ লুকালো। কিছু সময় অতিবাহিত হবার পরে মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,

–তোমাকে কতবার বলেছি আব্বু তুমি একদম চিন্তা করবে না। তোমার কিসের এত চিন্তা আমি তো আছি। তোমার মেয়ে কি ম’রে গিয়েছে। তোমাকে আর কোনো কাজ করতে হবে না৷ আমি প্রতি মাসে যে টাকা পাঠাই তার পরিমান আরো বাড়িয়ে দিব। তবুও তোমাকে আর কাজ করতে দিব না। তুমি যদি আমার কথা না শুনেছ। তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না আব্বু।

–আমার একটা কথা রাখবি মেহেভীন?

–তোমার একটা কথা কেনো আব্বু। আমি তোমার সব কথা রাখতে রাজি আছি।

–আমি মনে হয় বেশিদিন বাঁচব না। আমি মা’রা যাবার আগে তোকে একটা দায়িত্ববান পুরুষের হাতে তুলে দিয়ে যেতে চাই। আমার মতো তো সবাই হতে পারবে না। তবে আমার মতো করে তোকে যে ভালো রাখার চেষ্টা করবে। আমি তার হাতে তোকে তুলে দিতে চাই। পড়াশোনা করতে চেয়েছিস। আমি তোকে নিষেধ করিনি। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে চাকরি করেছিস। তবুও আমি তোকে কিছু বলিনি। তোর ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়েছি। আজ যদি আমার কথা না শুনিস। তাহলে আমি ম’রা’র পরে যেন আবার না পস্তাস। সামনে ভয়ংকর রকমের ঝড় আসতে চলেছে। আমি চাইনা আমার করা পা’পে’র ঝড়ের প্রভাব তোর জীবনে এসে পড়ুক। তোর জীবনে ঝাড় আসলেও সে আগলে নিবে। এমন একটা মানুষ তোর জীবনে এনে দিতে পারলেই আমার শান্তি।

–একদম বাজে কথা বলবে না আব্বু। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কিভাবে বাঁচব। তুমি আমাকে বিয়ে দিতে চাইছ মানছি। তাই বলে আমাকে দুর্বল করার জন্য আঘাতপ্রাপ্ত করবে আব্বু। আমাকে কয়টা দিন সময় দাও আব্বু। আমি বিয়ে করব।

–তুই আমার অবস্থা বুঝতে পারছিস না মেহেভীন। আমার শরীরের অবস্থা ভালো না। বেলা যেকোনো সময় ফুরিয়ে যেতে পারে। তার আগেই তোকে বিয়ে দিয়ে যেতে চাই। কেউ তোর ক্ষতি করার চেষ্টা করলে, সে যেন ছাদ হয়ে তোকে আগলে নেয়। আমি জানতাম তুই আসবি। সেজন্য আমি হসপিটালে থাকি নাই। সব সময় শরীরের ঔষধে মানুষ সুস্থ হয় না৷ কিছু কিছু সময় মনের ঔষধে মানুষ সুস্থ হয়ে যায়। আর আমার মনের ঔষধটা কে জানসি? আমার মনের ঔষধ হচ্ছিস তুই। তোকে দেখেই আমি অর্ধেক সুস্থ হয়ে গিয়েছি।

–কাজটা তুমি একদম ঠিক করনি আব্বু। তুমি হাসপাতালে থাকলে যে সেবা গুলো পেতে, বাসায় কি সেই সেবা গুলো পাবে। তোমাকে কালকেই হসপিটালে রেখে আসব।

–শোন মানুষ মাত্রই ভুল করে আরিয়ানও করেছে। তার জন্য আরিয়ান ভিষণ কষ্ট পাচ্ছে। ছেলেটা আমার কাছে তোকে চাইছে। আমিও ভেবে দেখলাম ছেলেটা সত্যিই অনুতপ্ত। মানুষ একবার ভুল করলে তাকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিৎ। আমি আরিয়ানের সাথে তোর বিবাহ দিতে চাইছি। এতে তুই সবসময় আমার চোখের সামনে থাকবি৷ আমিও শান্তিতে থাকতে পারব। একবার আমাকে অসম্মানিত করেছিস। দ্বিতীয়বার এমন করার চেষ্টা করিস না। যদি করিস আমি দম বন্ধ হয়ে বোধহয় মা’রা’ই যাব। আমি এই বিষয়ে তোর বড় আব্বুর সাথে কোনো কথা বলিনি। তুই মতামত দিলেই সামনের দিকে আগাব। তোর পছন্দ থাকলে বলতে পারিস। আমি তোর পছন্দের মানুষের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে দেখব। তাকে যদি আমার যোগ্য মনে হয় তাহলে তার হাতে তোকে তুলে দিব। মুনতাসিম ছাড়া অন্য কারো হয়ে যাবে কথাটা ভাবতেই ভেতরটা হুঁ হুঁ করে উঠল। বুকের ভেতরটায় কেমন মোচড় দিচ্ছে। অসহনীয় যন্ত্রনায় সমস্ত শরীর কাতর হয়ে আসছে। কথা বলার শক্তি যেন সে হারাচ্ছে। সে বাবার মুখের ওপরে বলতে পারছে না। বাবা আমি একজনকে পছন্দ করি। কিন্তু বিপরীতে পক্ষের মানুষটা আমাকে পছন্দ করে কি না সেটা আমি জানিনা। সে কথা বললে তার বাবা মানবে কি? নিশ্চই দু’টো কড়া বাক্য শুনিয়ে দিবে। মেহেভীন কিছু বলতে পারল না। সে মলিন মুখশ্রী করে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল।

নিস্তব্ধ রজনী, বিষন্ন মন, বিষাদগ্রস্ত শরীর দিয়ে নিজের কক্ষে শুয়ে ছিল মেহেভীন। মুনতাসিম ছাড়া অন্য কারো ছায়াকেও তার অসহ্য লাগে। সে সহ্য করতে পারে না। সেখানে আরিয়ানকে সে কিভাবে নিজের অর্ধাঙ্গ হিসেবে মেনে নিবে। তার বাবা কি জানে না। আরিয়ান তাকে কি করতে চেয়েছিল। সবকিছু জানার পরেও কেন তার মতো নিকৃষ্ট মানুষের সাথে বিবাহ দিতে চাইছে। ভাবতেই পুরো শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠছে। অদ্ভুত ভাবে পুরুষ জাতির প্রতি ঘৃণা চলে আসছে। সবার মতো মুনতাসিমকেও নোংরা মনে হচ্ছে। মনের আড়াল থেকে ডেকে বলছে। সে-ও সব পুরুষের মতো হবে। তুই তাকে ভুলে যা নিজেকে গুছিয়ে নে। কিন্তু মেহেভীন মানতে নারাজ তার মহারাজ এমন হতেই পারে না। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই মুঠোফোনটা জানান দিল মেসেজ আসছে। মেহেভীন বিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিল। অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ আসছে।

“কালকে পুকুর পাড়ে দেখা করতে পারবেন ম্যাডাম। আপনার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। ” মেসেজটা কার বুঝতে বেগ পেতে হলো না মেহেভীনের। সে কিছুক্ষণ নিরুত্তর রইল। কিছুক্ষণ পরে ফোনটা আবার বেজে উঠল। আবার মেসেজ এসেছে। “আপনি কি আমার ওপরে রাগ করেছেন? মেহেভীন বিষন্ন মন নিয়ে জবাব দিল, ” রাগ করব কেন? আপনি কি রাগ করার মতো কোনো কাজ করেছেন? এবার আর দ্রুত মেসেজ এল না। মানুষটা হয়তো হাজারও ব্যস্ততা নিয়ে তাকে মেসেজ করেছিল। কথাটা ভাবতেই অজানা অনুভূতিতে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। দশ মিনিট পরে মেসেজ এল। “রাগ করবেন না ম্যাডাম। বাজে ভাবে মানসিক চাপে আছি। আমি কথা বলার মতো অবস্থাতে নেই। কালকে সকালে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। আমার বিশ্বাস আপনি আসবেন। এই অবেলায় অবহেলা শুরু করবেন না। আমি শেষ হয়ে যাব। শুভ রাত্রী। ” মেহেভীন মেসেজটা দেখেই ফোনটা রেখে দিল। যাবে কি যাবে না সেটা ভেবেই দোটানায় ভুগছে। অদ্ভুত এক অনুভূতি রাতে আর ঘুম হলো মেহেভীনের। ভোরের মধুর স্বরে আজানের প্রতিধ্বনি কর্ণকুহরে আসতেই উঠে বসলো মেহেভীন। নামাজ আদায় করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। রাজ্যের নিদ্রা এসে মেহেভীনের আঁখিযুগলে ধরা দিবে। তখনই মেসেজ আসলো, “একদম ঘুমাবেন না ম্যাডাম। আমি জানি আপনি-ও আমার মতোই নির্ঘুম রজনীর পার করেছেন। একটা রজনী না হয় আমার জন্য নষ্ট করলেন। প্রভাতের আলো ছড়াতে আর কিছুক্ষণ বাকি। উঠে গিয়ে কফি বানিয়ে খান। সকল নিদ্রা মামা বাড়ি পালিয়ে যাবে। মেহেভীন বিস্ময় নয়নে ফোনের স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মানুষটা কিভাবে বুঝল একেই বুঝি বলে হৃদয়ের টান৷ মেহেভীন ছোট করে উত্তর দিল, “ঘুমাব না। বিপরীত পক্ষ থেকে কোনো উত্তর আসলো না। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নির্দিষ্ট সময় চলে এল। মুনতাসিম পুকুরের ধারে এসে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে চারপাশে গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। এই পুকুর পাড়ের দিকটা বেশ নিরিবিলি। এখানে সচরাচর মানুষ খুব কমই আছে। সেজন্য মুনতাসিম ভোরে মেহেভীনের সাথে দেখা করতে চাইছে। সে এই মুহুর্তে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে মেহেভীনের ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসতে পারে না। কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেভীন সেখানে এসে উপস্থিত হলো। মেহেভীনের পেছনে পেছনে আরিয়ান আসছিল। সেটা মেহেভীন টের পাইনি। সে তার নির্দিষ্ট মানুষটার কাছে পৌঁছানোর জন্য আকুল হয়েছিল। প্রভাতেরই আলো ফুটতেই ছুটে এসেছে। আরিয়ানকে দেখেই মুনতাসিমের মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আপনি মেহেভীনের পেছনে পেছনে আসলেন কি কাজে? আমি কি আপনাকে ডেকেছি! মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন হতভম্ব হয়ে গেল। পেছনে দৃষ্টিপাত করতেই বিস্মিত হয়ে গেল মেহেভীন। আরিয়ান কখন আসলো। অস্থিরতায় কোনোকিছু না দেখেই চলে আসছে। তখনই আরিয়ানের গম্ভীর কণ্ঠ স্বর শোনা গেল,

–আমার বউকে আমি একা একা কোনো পর পুরুষের সাথে দেখা করতে দিতে পারিনা। তাই নিজের সাথে করে নিয়ে আসছি। এত নামী দামি মানুষ হয়ে এত ভোরে একটা মেয়েকে ডাকতে আপনার লজ্জা করল না। যা বলার আমার সামনেই বলুন। আরিয়ানের কথায় মুনতাসিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। মুহুর্তের মধ্যে আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করল। তার যদি ক্ষমতা থাকতো। তাহলে আঁখিযুগল দিয়েই আরিয়ানকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতো।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

ভোরের শীতল হওয়া মন,মস্তিষ্ক, শরীর সবকিছু শীতল করে তুলছে। হৃদয়ের অস্থিরতা দিগুণ ভাবে বেড়ে গিয়েছে। আরিয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম শান্ত মস্তিষ্কের মানুষ। সে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আপনার বোন নিশ্চই ছোট বাচ্চা নয়। যে কেউ তাকে ডাকবে সে অবুঝের মতো চলে আসবে। আমি তাকে প্রয়োজনে ডেকেছি। সে জেনে-বুঝেই এসেছে। কারো অনুমতি ছাড়া তার পিছু করা দণ্ডনীয় অপরাধ। সেটা কি আপনি জানেন? ভয় পাবেন না ঘু’ষ দিয়ে জমি কিনে নেওয়া গেলে-ও মানুষের মন কিনে নেওয়া যায় না। আমি আপনার বোনকে খেয়ে ফেলছি না। আমি তার সাথে কিছু জরুরি কথা বলব। সেজন্য এখানে ডেকেছি। আপনি এখন এখানে থেকে আসতে পারেন। কাইন্ড ইওর ইনফরমেশন আমার মনে যদি পাপ থাকতো। তাহলে এতগুলো গার্ড নিয়ে এই খোলামেলা পুকুর পাড়ে দেখা করতে আসতাম না। আমি চাইলে আপনার বোনকে তুলে নিয়ে নিজের কাছে রাখতে পারতাম। কিন্তু আমি সেসব কিছুই করি নাই। মাথার মধ্যে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে বুঝে নিব। আপনি বুদ্ধিমান আর না বুঝলে নির্বোধ। এখন এখানে আমি আপনাকে পছন্দ করছি না। ভালোই ভালোই যাবেন নাকি তুলে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। মুনতাসিমের কথায় অপমানে মুখটা চুপসে গেল আরিয়ানের। মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। ক্রোধে সমস্ত শরীরে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। তবুও মুনতাসিমের মুখের ওপরে কথা বলার সাহস হলো না। ঘন গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। আরিয়ান চলে যেতেই পুরো পরিবেশ নিস্তব্ধতায় ভরে উঠল। মুনতাসিম মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। আঁখিযুগলে শত বছরের তৃষ্ণা। সারাজীবন মেহেভীনকে দেখলেও তার দেখার তৃষ্ণা মিটবে না। নিরবতা ভেঙে মেহেভীন বলল,

–কেনো ডেকেছে আমায়?

–আপনি আমার ওপরে রাগ করছেন? আপনার অভিমানের আঁখিযুগল আমাকে সারারাত নিদ্রা যেতে দেয়নি। আপনাকে দেখার কঠিন অসুখে আমি খুব বাজে ভাবে অসুস্থ হয়েছি। আমার অসুখ আপনি দ্রুত সুস্থ করে দিন। আপনার কি এতটুকুও রাগ হয় না। এই যে আমি মাসের পরে মাস আপনার খোঁজ রাখি না। আপনার সাথে কথা বলি না। তবুও আমি ডাকার সাথে সাথে আপনি অস্থির হয়ে, কেন আমার কাছে ছুটে আসলেন? কেন আমার ডাককে উপেক্ষা করতে পারলেন না৷ আমি কি আদৌও বন্ধু হবার যোগ্যতা রাখি। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপরে শান্ত কণ্ঠে বলল,

–ভালোবাসি বলার চেয়ে মানুষের কাজে ভালোবাসা প্রকাশ পাবার ব্যাপার টা একটু বেশিই সুন্দর। আমাকে আপনি একটু বেশিই বোকা ভাবেন। এই যে আপনি রোজ নিয়ম করে আমার খোঁজ খবর রাখেন। আমি কোথায় যাই, কি করি, কে আমার দিকে তাকালো, কে আমার খারাপ চাইলো, কিসে আমার ভালো হবে। আপনি সব দিকেই খেয়াল রাখেন৷ এগুলো কি একটা মানুষকে মুগ্ধ করার জন্য যথেষ্ট নয়। ভালোবাসি বললেই ভালোবাসার মানুষ হওয়া হয় না। ভালোবাসার আগে ভালো রাখার দায়িত্ব নিতে শিখতে হয়৷ সেটা আপনি ভালো করেই জানেন। কে বলেছে ভালোবাসলেই রোজ নিয়ম করে কথা বলতে হবে। নিয়ম করে প্রতিদিন দেখা করতে হবে। ঘুরাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, হৈ-হুল্লোড় করলেই মানুষের মধ্যে ভালোবাসা প্রকাশ পায়! ভালোবাসার জন্য একটা সুন্দর পবিত্র মনের প্রয়োজন আছে৷ সেই পবিত্র মনটা আপনার কাছে আছে। ভালোবাসা দূর থেকেই সুন্দর কাছে আসলে তা পানসে হয়ে যায়। সম্পর্কটা তিক্ততায় ভরে উঠে গুরুত্ব বোঝার জন্য দুরত্বের প্রয়োজন আছে। অল্পতে পেয়ে গেলে সেই জিনিসের মূল্য থাকে না। আপনি আমার সাথে কথা না বলেও আমার খোঁজ খবর রেখেছেন। আপনি জানেন আমি ছোট বাচ্চা নয়। আমি একটা ভালো মানের কাজের সাথে যুক্ত আছি। আমাকে রক্ষা করার জন্য সরকার অনেক সুযোগ সুবিধা দিয়েছে। কাজেই আমার ক্ষতি করা এতটা সহজ নয়। এই যে আজ আমায় ডাকলেন। আমি অস্থির হয়ে ছুটে আসলাম। আমাদের নিয়ম করে দেখা হলে, এতটা অস্থিরতা এত গভীর টান হৃদয়ের গহীনে থেকে আসতো। মেহেভীন পুকুরের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলছিল। মুনতাসিম মেহেভীনের প্রতি আরো গভীর ভাবে মুগ্ধ হলো। সে নিষ্পলক চাহনিতে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেয়েটার মুখশ্রীতে অসম্ভব ভাবে মায়া জড়ানো আছে। এই মায়াতেই সে শত-শত বার আঁটকে গিয়েছে। তার শান্ত হৃদয়টা এই মুখশ্রী উথাল পাথাল করে দিয়েছে। মৃত অনুভূতি গুলো করেছে জাগ্রত। দিয়েছে স্বচ্ছ এক পবিত্র ভালোবাসার ছোঁয়া।

–আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে। সেগুলো আমি আপনাকে নির্বাচনের পরে বলব। তার আগে বলুন আপনি আমায় চিনেও কেন না চেনার ভান ধরে ছিলেন।

–আপনি গিরগিটি হলে আমি হয়েছি প্রজাতি। রং বদলের খেলা দু’জন মিলে খেলেছি। মন্ত্রীর এলাকায় মানুষ হয়ে যদি মন্ত্রীকেই না চিনি৷ তাহলে এই এলাকায় থাকা আমার জন্য বৃথা। যদিও আপনাকে সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার কখনো হয়নি। আমি জন্মের পরে আমার মা ভিষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন আমরা পরিবার সহ ঢাকাতে চলে যাই। সেখানে থেকেই আমার পড়াশোনা। আমি পাঁচ বছর বয়স থেকে নানির বাসায় থাকি। মাঝেমধ্যে আব্বু আম্মুর কাছে বেড়াতে আসতাম। আমার একা একা ভালো লাগতো না দেখে, বড় আব্বু প্রাপ্তি আপুকে আমার জন্য ঢাকা পাঠিয়ে দিলেন। দু’বোন মিলে সেখানে পড়াশোনা শেষ করেছি। মাঝেমধ্যে গ্রামে এসে আপনার ছবি দেখতাম। চারদিকে পোস্টটারের ছড়াছড়ি। একদিন আপনার ছবির দিকে তাকিয়ে কি বলেছিলাম জানেন? মুনতাসিম উৎসুক দৃষ্টিতে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। আঁখিযুগলে তার কত-শত আকুলতা। মুনতাসিম নরম কণ্ঠে বলল,

–কি বলেছিলেন?

–আজকে বলব না সময় হোক শুনতে পাবেন। আজকে কিসের জন্য ডেকেছেন সেটা বলুন?

–এই কয়টা দিনে উপলব্ধি করলাম। আপনার সাথে কথা না বলে থাক অসম্ভব ব্যাপার। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। আমি প্রহর গুনতে থাকি কখন আপনার কণ্ঠ স্বর শুনতে পাব। আমার অস্থির হৃদয়কে শীতল করব৷ অনেক তো হলো গুরুত্ব বোঝাবুঝির খেলা। এই কয়টা দিন আমি ভিষণ ব্যস্ত থাকব। হয়তো আপনার চেনা মানুষটাও অচেনা হয়ে উঠবে। আমার জীবনটা ভিষণ অশান্তির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। শান্তি হিসবে আপনার কাছে কিছু চাইব দিবেন?

–কি চাই আপনার?

–রাতে আমাকে একটু করে সময় দিবেন। বেশি পাঁচ দশ মিনিট করে আমার সাথে কথা বলবেন। যেন বুক ভরা শ্বাস নিয়ে রাতে ঘুমোতে পারি। দীর্ঘ রজনী আমি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় নিদ্রা গিয়েছি। এবার আমাকে ক্ষমা করুন মহারাণী দয়া করে ফোন দিলে একটু ফোন ধরবেন। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন মলিন হাসলো। সে আহত কণ্ঠে বলল,

–আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে মন্ত্রী সাহেব। একা একা ঘুমোতে শিখুন। দু’দিন শশুর বাড়ি চলে গেলে, আমার স্বামী নিশ্চয়ই আপনাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য আমাকে আপনার কাছে পাঠাবে না। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিমের শান্ত হৃদয়টা মুহুর্তের মধ্যে রক্তাক্ত হয়ে গেল। অনুভূতিরা বিষাদে ছেয়ে গেল। ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। মেহেভীন অন্য কারো হয়ে যাবে। কথা টা মস্তিষ্কে বাজতেই রুহু কেঁপে উঠছে। বুকের মধ্যে চিনচিন করে ব্যথা করছে। মনের গহীনে সে কি অসহনীয় যন্ত্রণা। মুনতাসিমের আহত মুখশ্রী মেহেভীনের ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। হাওয়ার সাথে মিশে থাকা কোনো অজানা দেওয়াল মেহেভীনের দাঁড়িয়ে থাকার সমস্ত শক্তি শুষে নিচ্ছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরলো। মুনতাসিম আহত কণ্ঠে বলল,

–এই যে আমাদের দেখা হয়না কথা হয় না। তবুও আপনি আমার সাথেই থাকেন অসহনীয় যন্ত্রনায়, মন খারাপ করা গানের লাইনে, মাঝ রাতে বুকের ব্যথায় আপনি আমার সাথে থাকেন। আপনি আমার মনের অন্তরালে ছিলেন। আছেন আর সব সময় থাকবেন৷ আমি কিছু বলব না সময় কথা বলবে। আমি কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। সূর্য তার কিরণ চারদিকে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে। এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়। আপনি বাসায় ফিরে যান। মেহেভীনের বিয়ের কথায় মুনতাসিমের কোনো ভাবান্তর হলো না। তা দেখে মেহেভীনের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। মানুষটা কি তবে তার নয়। মানুষটা তো কোনো যন্ত্রণা পাচ্ছে না। তাহলে তার ভেতরটা যন্ত্রণায় কেন ছটফট করছে। কেন সারাক্ষণ মানুষটার কাছে থাকতে ইচ্ছে করছে। মেহেভীন একবার পেছন ফিরে তাকালো। মুনতাসিম অদ্ভুত দৃষ্টিতে মেহেভীনের দিকে চেয়ে আছে। মুনতাসিমের এমন চাহনিতে মেহেভীন আরো ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। মানুষটার মনে কি চলে বোঝা বড় দায়৷ বুকভরা অজানা যন্ত্রণা নিয়ে মেহেভীন বাসায় দিকে যাচ্ছে।

মুনতাসিম আর মেহেভীনের ছবি আঁখিযুগলের সামনে স্পষ্ট হতেই সমস্ত শরীর জ্বলে উঠল তাহিয়ার। সে দাদুর বাসায় ফুফাতো ভাইয়ের বিয়ের কাজে ব্যস্ত ছিল। সেজন্য বাবা মায়ের সাথে চৌধুরী বাড়িতে আসেনি। অন্য নারীর পাশে মুনতাসিমকে দেখে মনের অজান্তেই আঁখিযুগল দিয়ে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়ল। মনটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। যে মানুষটা শুধুই তার সেই মানুষটার পাশে অন্য নারী কি করে! তার জবাব সে চাইবে। খুব তাড়াতাড়ি সে চৌধুরী বাড়িতে যাবে। কেন যে বাবা মায়ের সাথে না গিয়ে এখানে আসলো। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে তাহিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে কিভাবে অন্য কারো সাথে মুনতাসিমকে সহ্য করবে। সে রাগান্বিত হয়ে তার মাকে ফোন করল। দ্রুত গাড়ি পাঠাতে বলল সে আজই চৌধুরী বাড়িতে যাবে।

ঘড়ির কাঁটায় রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই। তখনই দরজায় অনবরত কলিং বেল বেজেই যাচ্ছে। মেহেভীনের বাবা অসুস্থ থাকার কারনে ঘুমের ঔষধ খেয়ে দ্রুত নিদ্র গিয়েছেন। রাইমা বেগম বেশি রাত জাগতে পারেন না৷ সে-ও অনেক আগেই নিদ্রা গিয়েছেন। মেহেভীনের রাত জাগার অভ্যাস আছে। সে কিছুটা অবাক হলো। বিরক্ততে মুখশ্রী কুঁচকে এল। সে হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলে একটা রমণীকে দেখে বিস্মিত হয়ে গেল। নেভি ব্লু জিন্স আর কলাপাতা রঙের ছোট টপসে মেয়েটিকে দারুন আকর্ষণীয় লাগছে। দুধে-আলতা গায়ের রঙ রাতের আঁধারেও চমক দিচ্ছে। মেহেভীন থমথমে মুখশ্রী করে বলল,

–কে আপনি?

–আপনি মেহেভীন তাই না৷

–জি, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না আপু।

–আমি মুনতামিসের বউ। কথাটা কর্ণকুহরে আসতেই ভেতরটা ধক করে উঠল মেহেভীনের। অজানা ভয়ে ভেতরটা কাবু হয়ে আসতে শুরু করল। তবে কি সে আবার মানুষ চিনতে ভুল করল। ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। মনের শহরে তাচ্ছিল্যের মিছিল শুরু হয়ে গিয়েছে। মেহেভীন ধরে আসা কণ্ঠে জবাব দিল,

–আপনি আমার সাথে ফাজলামি করছেন? চেনা নেই জানা নেই হুট করে এসে বলছেন। আপনি মুনতাসিমের বউ আমি কিভাবে বিশ্বাস করব?

–কি করলে আপনি বিশ্বাস করবেন? আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। আপনি শুধু মুনতাসিমের জীবনে থেকে সরে যান। আমি মুনতাসিমকে ভিষণ ভালোবাসি। এভাবে আমার স্বামীকে আমার থেকে কেঁড়ে নিবেন না আপু। মুনতাসিম আমার থেকে দূরে সরে গেলে আমি দম বন্ধ হয়ে মা’রা যাব। এভাবে আমার স্বামীর ভালোবাসা থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না। পৃথিবীতে এত পুরুষ থাকতে আমার স্বামীর দিকে কেন নজর দিলেন। আমি দুই মাসের অন্তসত্ত্বা এই অবস্থায় মুনতাসিম আমাকে ডিভোর্স ও দিতে পারবে না। আমার অনাগত সন্তান পৃথিবীতে আসার পরে, মুনতাসিম যদি আমাকে ডিভোর্স দেয়। তখন আমি আমার সন্তানকে নিয়ে কথায় যাব। আমাকে এতটুকু দয়া করুন আপু। এভাবে আমার সংসারটা ভাঙবেন না৷ এই যে মুনতাসিম আপনার কাছে যায়। আবার মাসের পর মাস তার খোঁজ থাকে না৷ সে কোথায় থাকে কার কাছে থাকে। সেটা কখনো ভাবেননি আপু। আজ আপনাকে দেখে সে আমাকে অবহেলা করছে। আমার শরীরে প্রহার পর্যন্ত করেছে। আমি যেন সবকিছু আপনাকে না বলি। কথা গুলো বলেই অশ্রুবিসর্জন দিতে লাগলো তাহিয়া। মেহেভীন কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়েছে। বুদ্ধি গুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। যে মেয়েটার গলায় এতটা জোর সে কিছুতেই মিথ্যা কথা বলতে পারে না। মেহেভীনের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। তাহিয়া যদি তার সামনে না থাকতো। তাহলে এখনই ছটফট করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়তো। তার মস্তিষ্ক একটা কথায় বলছে। এত সুন্দর নিষ্পাপ চেহারা কিভাবে প্রতারণা করতে পারে। অসহনীয় যন্ত্রনায় ভেতরটা জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

আঁখিযুগল ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করল। মনের গহীনে থেকে ডেকে বলছে। এত সহজে বিশ্বাস করিস না মেহেভীন। ধোঁকার জগতে সহজ-সরল হতে নেই। মেহেভীনের মস্তিষ্কে সন্দেহের দানা এসে বাসা বাঁধলো। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাহিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। আচমকা মেহেভীনের মুখশ্রী বিরক্তিতে ভরে উঠল। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আপনার স্বামী আপনাকে এতরাতে একা ছাড়লো? আপনি বাসায় গেলে আপনার স্বামী আপনাকে মা’রবে না। চলুন আমি আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। আর আপনার স্বামীর সাথে আমার কিছু বোঝাপড়া আছে। আজকে সেগুলো মিটিয়ে তারপরে আমি বাড়ি আসব। মেহেভীনের কথায় তাহিয়া থতমত খেয়ে গেল। সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীন এমন কিছু বলতে পারে, তা তাহিয়ার কল্পনার বাহিরে ছিল। প্রাপ্তি যে তাকে বলল মেহেভীন খুব সহজ সরল মেয়ে। তাহিয়াকে নিশ্চুপ হতে দেখে মেহেভীনের সন্দেহ দৃঢ় হলো। সে আরেকটু নিশ্চিত হতে বলল,

–আপনাদের বিয়ের ছবি আছে। থাকলে একটু দেখাবেন? মেহেভীনের কথায় তাহিয়া আশার আলো খুঁজে পেল। সে বিলম্ব করল না। দ্রুত ফোন থেকে একটা ছবি বের করে দেখালো। সেখানে তাহিয়া লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে আছে। শরীরে বাহারী রকমের অলঙ্কার। দু-হাত ভর্তি মেহেদী পুতুলে মতো লাগছে তাহিয়াকে। যে কেউ দেখলে বলবে নতুন বউ। তার পাশেই শুভ্র পাঞ্জাবি পড়া মুনতাসিম দাঁড়িয়ে আছে। ছবিটা দেখে মেহেভীনের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। হৃদয় টা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। শরীর পুড়লে দেখা যায়। কিন্তু মন পুড়লে দেখা যায় না কেন? তাহলে মানুষ মানুষকে পোড়ানোর আগে দশবার ভেবে নিতো।

–হতেও পারে আপনি কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে বউ সেজে গিয়েছিলেন। আমি আপনাকে এভাবে কিভাবে বিশ্বাস করতে পারি। আপনি মুনতাসিমকে আমার সামনে নিয়ে এসে প্রমাণ করুন যে সে আপনার স্বামী। তাহিয়া নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না৷ সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–একটা মেয়ে কখনো তার স্বামী সন্তান নিয়ে মিথ্যা কথা বলতে পারে! আজকাল মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু একটা বিবাহিত ছেলের সাথে রঙ্গলীলা করতে খুব মজা লাগে তাই না। আমি বলছি আমি তার অর্ধাঙ্গিনী তার অনাগত সন্তানের মাতা। আমার কথা বিশ্বাস না করে আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন?

–আমাকে খোঁচাতে এসে আপনার খুব ভালো লাগছে তাই না। ভেবেছিলেন মেহেভীন কতটা বোকা তাকে যা বোঝানো যায়। সে তাই বুঝবে আমাকে ছোট বাচ্চা মনে হয় আপনার। প্রমাণ ছাড়া একটা কথাও মেহেভীন বিশ্বাস করবে না। আপনি বিয়ের ছবি দেখিয়েছেন। বিয়ের কাবিন দেখাবেন। মুনতাসিমকে আমার সামনে নিয়ে এসে তার মুখে স্বীকার করাবেন। তারপরেই আমি বিশ্বাস করব সে আপনার অর্ধাঙ্গ। ক্রোধে চোয়াল শক্ত হয়ে এল তাহিয়ার। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। আঁখির জলন্ত আগুন মেহেভীনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিতে ইচ্ছে করছে। মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে টগবগ করছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–আপনি কয়টা দিন অপেক্ষা করুন। আমাদের বিয়ের কাগজ আমেরিকাতে আছে। সে তো আর আজকাল ধরে আমার স্বামী নয়। সে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আমার অর্ধাঙ্গ। তাহিয়ার কথায় মেহেভীনের মুখশ্রীতে তাচ্ছিল্যের ফুটে উঠল। তাহিয়া কোনো কথা বলার সুযোগ পেল না। যাবার সময় মেহেভীনকে হুমকি দিয়ে গেল। সে মেহেভীনকে দেখে নিবে। মেহেভীন তাচ্ছিল্যের সুরে জবাব দিল, “অপেক্ষায় থাকলাম।

তাহিয়া চলে যেতেই অজানা ভয়ে ভেতরটা কাবু হয়ে আসছে মেহেভীনের। তাহিয়া যদি সত্যি কথা বলে থাকে আর সেটা যদি প্রমাণ হয়ে যায়। তখন সে কি করবে? ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। অনুভূতি শূন্য হয়ে যাচ্ছে মেহেভীন। মনের গহীন অশান্ত হয়ে উথাল পাথাল করছে। মেহেভীনের হৃদয় শীতল করার জন্য মুনতাসিমের একটা কলই যথেষ্ট ছিল। সে কক্ষে এসে দেখলো মুনতাসিম ফোন দিয়েছে। কেন জানি মেহেভীনের ভিষণ রাগ হলো। সে নিজের মধ্যে কথা দমিয়ে না রেখে বলল,

–আপনি কি বিবাহিত মন্ত্রী সাহেব?

–এটা আপনি আজ জানলেন ম্যাডাম। আমি শুধু বিবাহিতই না চার সন্তানের বাপ আমি। ভিডিও কল দিব? দেখবেন আমার বউ বাচ্চাকে ভিষণ সুন্দর। একটা বাচ্চাকে আপনার ঘাড়ে তুলে দিব। আরেকটাকে আপনার মাথায়। তৃতীয় জনকে কোলে তুলে দিব। চতুর্থজনকে পায়ের সাথে গড়াগড়ি করতে লাগিয়ে দিব। আপনি চাইলে আমি আরো কয়টা বাচ্চা নিয়ে আপনার গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারব। মেহেভীন মুনতাসিমকে অবাক করে দিয়ে বলল,

–ভিডিও কল দিন দেখব আমি। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিম হতভম্ব হয়ে গেল। বিস্ময় কণ্ঠে আবার প্রশ্ন করল৷ মেহেভীনের উত্তর একই রইল। মুনতাসিম উঠে বসলো তারপর কিছুটা ব্যঙ্গ করে বলল,

–এভাবে নিজের ভূতের মতো রুপ দেখিয়ে আমাকে ভয় দেখাতে চান ম্যাডাম। যান গিয়ে ভালো করে আগে মেকআপ করে আসুন। তারপর না হয় ভিডিও কলে আসবেন।

–আমি কোনো বিশ্ব সুন্দরী নই বা নায়িকাও নই। কাজেই আমার মেকআপ করার প্রয়োজন নেই। আপনি দিতে পারবেন না বললেই হয়। কথা গুলো বলেই মেহেভীন কল কেটে দিল। সাথে সাথে মুনতাসিম ভিডিও কল দিল মেহেভীন কেটে দিল। কেটে দিতেই আবার কল আসলো। মেহেভীন ধরল মুনতাসিমের মুখের দিকে তাকাতেই মেহেভীনের সমস্ত রাগ হাওয়ার সাথে মিলিয়ে গেল। আচমকা অধরের কোণে হাসির রেখা দেখা গেল। অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠল। মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–বলুন মহারাণী আপনার কি জানার আছে। আমাকে আর কি কি করতে হবে? মেহেভীন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। অকারণে প্রচুর হাসি পাচ্ছে তার। সে নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। তবে হাসি আজ তার সাথে বেইমানী করছে। এমন সিরিয়াস মুহুর্তে হাসি আসার বাজে ব্যাপারটা মেহেভীনকে অসহ্য করে দিচ্ছে। সে হাসি চেপে না রাখতে পেরে সমস্ত মুখশ্রী এক হাতে আড়াল করে নিল। বুকের মধ্যে তার ধুকপুক করছে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া অস্বাভাবিক ভাবে বাড়তে শুরু করছে। মেহেভীনের কান্ড দেখে মুনতাসিম শব্দ করে হেসে উঠল। মুনতাসিনের হাসোজ্জল মুখশ্রী হৃদয়ের গহীনে প্রশান্তির দোল খেলে গেল। মেহেভীন ভেতর থেকে অদ্ভুত এক শান্তি অনুভব করছে। মানুষটার সাথে কথা বললে মনেই হয় না। মানুষটা তাকে ঠকাতে পারে। মৃত্যুর মতো যেন সত্যি হয় মেহেভীনের মনের কথা। সারাজীবন বেঁচে থাকব। এমন আশা নিয়ে বলা কথা গুলো মিথ্যা হয়ে যাক তাহিয়ার কথা। মানুষটা তার একান্তই ব্যক্তিগত। সে তার ব্যক্তিগত চাঁদের পাশে অন্য একটা তারা কেও সহ্য করতে পারবে না। মুনতাসিম মেহেভীনের সাথে কথা বলে রেখে দিল। তখনই তাইয়ান আসলো মুনতাসিমের কক্ষে। তাইয়ানকে ভিষণ বিধস্ত দেখাচ্ছে। মুনতাসিম তাইয়ানের মুখ দেখলেই তার মন পড়ে ফেলতে পারে। মুনতাসিব সবকিছু বুঝে-ও নিশ্চুপ রইল। তাইয়ান মলিন কণ্ঠে বলল,

–আপনি সাবধানে থাকবেন স্যার। আপনার বিরুদ্ধে গভীর ভাবে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আপনার পরিবারের ওপরেও আঘাত আসতে পারে। আপনি বাড়ির চারপাশে গার্ডের পরিমাণ বাড়িয়ে দিন। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিম হালকা হাসলো। সে কি ভয়ংকর হাসি। তাইয়ান এই হাসির মানে জানে। মুনতাসিম শীতল মস্তিষ্কের লোক। সে ঠান্ডা মাথায় তাইয়ানের মনের কথা বুঝে গেল। তাইয়ানের ভেতরটা যন্ত্রনায় ছটফট করছে। তার ভেতরটা তীর দিয়ে কেউ ছিদ্র করে দিয়েছে। সেই মৃ’ত্যু যন্ত্রনা বুকে নিয়ে সে মুনতাসিমের থেকে সত্য কথাটা আড়াল করে গেল। মুনতাসিম তাচ্ছিল্য করে বলল,

–তুমি আমাকে ছোট বাচ্চা মনে করেছ তাইয়ান? আমি তোমার বোকা বোকা করে শুনে ভিষণ অবাক হচ্ছি! তোমার মতো সহজ সরল ছেলে আমার ব্যক্তিগত বডিগার্ড হলো কিভাবে সেটাই চিন্তা করছি? শত্রু, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ,এসব পুরোনো হয়ে গিয়েছে। নতুন কিছু থাকলে বলতে পারো। আমার যদি শত্রু না থাকে, তাহলে আমার মন্ত্রী হওয়া টাই বৃথা।

–জাফর সাহেব খুব শক্ত হাতে মাঠে নেমেছে। আপনার কাছের লোকই আপনার আড়ালে গভীর ষড়যন্ত্র করছে। আপনি কাছের মানুষদের থেকে দুরত্ব বজায় রাখবেন।

–সেই মানুষ টাকে তুমি চিনো তাইয়ান? মুনতাসিমের শান্ত কণ্ঠে বলা কথা গুলো তাইয়ানে কলিজা কেঁপে উঠল। সে জানে মনুতাসিম না জেনে কোনো কথা বলে না। তবে কি সে তার কথা জেনে গেল। সে যে মানুষটা কে ভিষণ ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষের শত অপরাধ সে ক্ষমা করতে প্রস্তুত। কিন্তু মুনতাসিমের ক্ষতি সে সহ্য করতে পারবে না। সে তার প্রেয়সীকে বলবে সে যেন এমনটা না করে। বুকের মধ্যে অশান্ত নদীর মতো উথাল পাথাল করছে। সে মুনতাসিমের সামনে আর কিছুক্ষণ থাকলে ধরা পড়ে যাবে। সে ভয়ার্ত কণ্ঠে মুনতাসিমের থেকে অনুমতি নিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। মুনতাসিম তাইয়ানের দিকে তাকিয়ে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

প্রভাতের আলোয় চারদিক ঝলমল করছে। রৌদ্রের মিষ্টি কিরণ এসে মেহেভীনের মুখশ্রীতে আঁচড়ে পড়ছে। চারদিক সোনালী আলোয় মুখরিত হয়ে উঠেছে। সবুজ বর্ণের ধানের গাছ গুলো ধানসহ সোনালী বর্ণের রুপ নিয়েছে। মেহেভীন হালকা করে ধান গুলোকে ছুঁয়ে দিল। তাদের এলাকাটা তার ভিষণ ভালো লাগে। না শহর না গ্রাম দু’টোর মাঝামাঝি মনে হয় তার তাছে। শহরের মতো যানবাহন চলাচল করে। দোকানপাটের অভাব নেই। আবার থেকে থেকে একটু করে ফাঁকা জায়গায় আবাদ করা৷ এই জমির মালিক গুলো ভবিষ্যতে এখানে বাড়ি তুলবে। সেজন্য জমি কিনে রেখে দিয়েছেন। ফাঁকা থাকলে কাজে লাগবে না। সেজন্য আবাদ করে প্রতিবছর। সাথে পরিবেশকে করে তুলেছে মনোমুগ্ধকর কর। মেহেভীনের বাবা হাতে ডিম আর সয়াবিন তেল নিয়ে আসছিল। মেয়েকে ধানের জমির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনোমুগ্ধকর হাসি উপহার দিলেন তিনি। মেয়ের কাছে এসে মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বাসার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। মেহেভীন বাবার আদুরে হাতকে উপেক্ষা করতে পারল না। সে-ও প্রাকৃতিক সুন্দর্যকে উপভোগ করাকে বিদায় জানিয়ে বাবার সাথে ছুটলো।

–মেহেভীন বিয়ের সম্পর্কে কিছু ভাবলি?

–আমি আরিয়ান ভাইকে বিয়ে করতে পারব না আব্বু।

–কেন?

–তুমি এত তাড়াতাড়ি সবকিছু ভুলে গেলে! তুমি কিভাবে এমন নিকৃষ্ট মানুষের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করতে পারো? আমি তোমার বিবেকের তারিফ করছি।

–আমি জানি আরিয়ান জঘন্যতম অপরাধ করেছে। তার জন্য সে অনুতপ্ত। আমার কাছে প্রতিদিন মাফ চায়। আমাদের বিপদে এগিয়ে আসে। আমাকে কেউ কিছু বললে আরিয়ান আমার ঢাল হয়ে দাঁড়ায়।

–আর তোমার মেয়েকে অজ্ঞান করে বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। তার বেলায় কিছু না। একটু সেবাযত্ন করেছে তার সাত গুন মাফ! তুমি একজন বাবা হয়ে কিভাবে পারলে আরিয়ান ভাইয়ের মতো মানুষের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করতে! আমাকে এতটা মানসিক চাপ দিও না আব্বু। প্রাপ্তি আপুর কথা মতো সত্যিই তোমাদের মুখ দেখতে চাইব না। তোমার ভাইয়ের ছেলের তোমার মায়া লাগতে পারে। সে আমার কেউ না। আমার তার প্রতি কোনো মায়া কাজ করে না। আমি তাকে ঘৃণা করি। যে ছেলে সামান্য টাকার লোভে আমাকে বিক্রি করে দিতে পারে। সেই ছেলে বিয়ের পরে নিজের বউকে টাকার বিনিময়ে অন্য পুরুষের ঘরে পাঠাবে না। তার কোনো নিশ্চয়তা আছে আব্বু।

–মুখ সামলে কথা বল মেহেভীন। আমি তোর বাবা ভুলে যাচ্ছিস তুই। আরিয়ান একটা অপরাধ করে ফেলছে। সে অপরাধবোধে ভুগছে। আমাদের উচিৎ তাকে ক্ষমা করে দেওয়া৷ আমার বিশ্বাস আরিয়ান এমন কিছুই করবে না।

–তোমার নিজের ছেলে নেই। তাই ভাইয়ের ছেলের প্রতি তুমি অন্ধ বিশ্বাসে ডুবে গিয়েছ। তোমার ভুলের মাশুল আমি আমার জীবন দিয়ে দিতে পারব না৷ একবার বিয়ে ঠিক করেছিলে কাপুরুষের সাথে। আরেকবার ঠিক করলে লোভী ছেলের সাথে। যে টাকা পেলে নিজের বউয়ের অন্য পুরুষের ঘরে পাঠাতে দু’বার ভাববে না। কথা গুলো শেষ হবার সাথে সাথে ফরিদ রহমান মেয়ের গালে ক’ষে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিলেন। মেহেভীন বিস্ময় নয়নে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করছে আছে। মনের অজান্তেই বাবা নামক মানুষটার জন্য মনের মধ্যে ঘৃণা তৈরি হলো। সব সময় তার সিদ্ধান্তই কেন তাকে মেনে নিতে হবে। তার কি নিজস্ব কোনো মতামত নেই। মেহেভীন অশ্রুসিক্ত নয়নে বাবার দিকে তাকিয়ে নিজের কক্ষে চলে গেল। যাবার আগে ঘৃণা ভরা দৃষ্টি দিতে ভুলল না।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-১৬+১৭+১৮

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_১৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

চৌধুরী বাড়িতে আনন্দের মেলা বসেছে। রিয়াদ চৌধুরীর একমাত্র বোন আজ আমেরিকা থেকে আসবে। বিয়ের দুই বছর পর সুফিয়া চৌধুরী স্বামী-সন্তান নিয়ে প্রবাসে পাড়ি জমান। দীর্ঘ কয়েক বছর তিনি দেশে আসেনি। বহু বছর পরে নিজের প্রাণ প্রিয় বোন বাসায় আসবে শুনে, চৌধুরী বাড়িতে ঈদ লেগে গেছে। সকাল থেকে রান্নার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। সমস্ত বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। পরিবারের প্রতিটি মানুষের মুখশ্রীতে সুখ এসে ধরা দিলে-ও ধরা দেয়নি একটি মানুষের মুখশ্রীতে সে হলো মুনতাসিম। সে নিজের কক্ষে বসে ছিল। ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনটা তার বাবা কি করে ভুলে গেল! নিজেকে এতটা অসহায় বোধহয় কোনোদিন লাগেনি। আঁখিযুগল অসম্ভব ভাবে রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। তখনই নিজের কক্ষে কারো উপস্থিতি অনুভব করল মুনতাসিম। সে জানে কে এসেছে তার কক্ষে। সে ছাড়া কারো সাহস হবে না। তার কক্ষে অনুমতি না নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার। রিয়াদ চৌধুরী ছেলের মাথায় হাত রাখতেই মুনতাসিম দ্রুত হাত সরিয়ে দিল। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–ছোঁবেন না আপনি আমাকে। আপনার মতো নিকৃষ্ট মানুষ আমি দু’টো দেখিনি। কিভাবে পারলেন আজকের দিনটা ভুলে যেতে! সবাই ঠিকি বলে মা মা’রা গেলে বাপ হয়ে যায় তাওই। একটা মানুষ মা’রা গিয়েছে। সেই সাথে মানুষটার প্রতি গুরুত্ব, ভালোবাসা, মায়া, টান সবকিছুও কি উঠে গিয়েছে। মানুষটাকে আপনি ভুলেই গিয়েছেন। আপনার মতো বাবার আমার দরকার নেই। আপনি থাকুন আপনার পরিবার নিয়ে, আমি আর আসব না আপনার পরিবারের আনন্দ নষ্ট করতে। আমি আসি আমার পেশার জন্য, জনগণকে ভালো রাখার শপথ গ্রহণ করেছি। তাদের ভালো রাখার দায়িত্ব আমার। আমি নিজের দায়িত্ব থেকে সরে আসতে পারছি না বলেই বারবার এখানে আসছি।

–মুনতাসিম আমার বাবা তুমি নিজেকে শান্ত কর। তুমি ভাবছ আমি সব ভুলে গিয়েছি। আমি বদলায়নি বাবা সময় আমাকে চুপ থাকতে শিখিয়ে দিয়েছে। আমি আমার ব্যথার কথা ভেবে যদি সবার আনন্দ নষ্ট করে দেই। তাহলে মানুষ আমাকে স্বার্থপর বলে উপাধি দিবে। আমি স্বার্থপর হতে চাই না বাবা। সেজন্য নিজের ব্যক্তিগত দুঃখ গুলোকে নিজের কাছেই রাখতে চাই। সেগুলো বাহিরে প্রকাশ করে হাসি ঠাট্টার পাত্র হতে চাই না। আমি যাব তোমার মায়ের কবরের কাছে, তুমিও আমার সাথে যাবে।

–আপনার মতো মানুষের আমার মায়ের কবরের কাছে যেতে হবে না। আপনি বরঞ্চ আপনার পরিবারকে সময় দিন। যে সময়টা আমার মায়ের কবরের কাছে গিয়ে অপচয় করবেন। সেই সময়টুকু আপনার পরিবার ছেলে-মেয়েকে দিন। তাদের কাছে আপনি অনেক মহান মানুষ হয়ে উঠবেন। আমি কে আমার কাছে মহান হতে হবে। আমার মতো মা নেই। আমাকে এত প্রাধান্য দিতে হবে কেন? যার মা নেই তার কেউ নেই। আপনি একদম আমার সাথে কথা বলবেন না। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। রিয়াদ চৌধুরী অশ্রুসিক্ত নয়নে ছেলের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। নিজেকে আজকাল ভিষণ অপরাধী বলে মনে হয়। ছেলের ভালো চাইতে গিয়ে, ছেলের জীবনটা বিষাদময় করে তুলল। বুকটা হাহাকারে ভরে উঠছে। ভেতরটা তীব্র যন্ত্রনা ছটফট করছে। দ্বিতীয় বিয়ে করা টাই যেন জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলে মনে হচ্ছে। সাহেলা প্রতিটি মুহূর্তে মুনতাসিমকে বুঝিয়ে দিয়েছে। সৎ মা কখনো আপন মা হতে পারে না। ভাই-বোনকে করেছে আলাদা। মুনতাসিমকে দিয়েছে বুক ভরা যন্ত্রনা। সেই যন্ত্রনায় মুনতাসিম প্রতিটি মুহূর্তে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।

রিয়াদ চৌধুরী মলিন মুখশ্রী করে সোফায় গিয়ে বসলো। আমান চৌধুরী এসে ভাইয়ের পাশে বসে বুকে আগলে নিলেন। ভাইটা তার ভিষণ আবেগী। সে ছোট হয়ে যতটুকু বুদ্ধি অর্জন করেছে। তার বড় ভাই হয়ে সেটুকুও অর্জন করতে পারেননি। সে কোমল কণ্ঠে বলল,

–মুনতাসিম রাগ করে বের হয়ে গেল। আজ তার ফুপি আসবে। সে কি জানে না। ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য হলে-ও তার বাসায় থাকা উচিত ছিল।

–আজকের দিনে ছেলেটা আমার মা হারা হয়েছিল। সারাবছর তার মায়ের কবরের কাছে সময় দেই না। আজকের দিনটাই ও আশা করে। তার সাথে তার মায়ের কবরের পাশে বসে সারাদিন সময় দিব। ছেলেটাকে বোঝাতে পারিনা। ভেতরটার খবর শুধু আল্লাহই ভালো জানেন। রিয়াদ চৌধুরীর কথা স্তব্ধ হয়ে গেল আমান চৌধুরী। তার তো মনেই ছিল না। মুহুর্তের মধ্যে মনটা বিষাদে ভরে গেল। প্রতি বছর এই দিনটায় বাবা ছেলের ভিষণ মনমালিন্য তৈরি হয়। সময়ের সাথে আবার সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। এসব দেখতে দেখতে অভস্ত্য হয়ে গিয়েছে সবাই। সাহেলাও নিজের স্বামীকে সতীনের কাছে যেতে দিবে না বলে, নানান রকমের অশান্তি তৈরি করেন। পরিবেশটা কেমন বিষাদের ছেয়ে গেল।

মায়ের কবর জিয়ারত করে মুনতাসিম নিজের বৃদ্ধাশ্রমের দিকে অগ্রসর হলো। বাসা থেকে দশ মিনিটের দুরত্বে অবস্থান করছে বৃদ্ধাশ্রমটি। সে মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর দিন এই আশ্রমে এসে সময় কাঁটায়। ছোট ছোট বাচ্চারাও এই আশ্রমে থাকে। তারা প্রতি বছর এই দিনের জন্য অপেক্ষা করে। আজকে মুনতাসিম তাদের সময় দিবে। মুনতাসিম তাদের ভিষণ ভালোবাসার মানুষ। মুনতাসিম আসতেই আশ্রমে হৈচৈ পড়ে গেল। প্রতিটি মানুষের মুখশ্রীতে সে কি মনোমুগ্ধকর কর হাসি। এই হাসিতেই মুনতাসিমের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠে। বাচ্চারা মুনতাসিমকে ঘিরে ধরেছে। হৈ-হুল্লোড় করে পুরো আশ্রম মাতিয়ে তুলেছে। কিছু মুহূর্তের জন্য মুনতাসিমের সমস্ত দুঃখ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বাচ্চাদের সাথে সে মিশে গেল। বাচ্চারা তাদের প্রতিভা তুলে ধরছে। মুনতাসিম সবাইকে চকলেট দিল। আজকের দিনে আশ্রমটা অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশিই মেতে থাকে। মুনতাসিম অদ্ভুত ভাবে অনুভব করছে। তার যখন দুঃখ হয়। তখন তার মেহেভীনের কাছে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে। প্রেয়সীর সাথে একান্তে কিছু সময় উপভোগ করতে ইচ্ছে করে। এত আনন্দের মাঝে মেয়েটার শূন্যতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে। সে শুধু অবসর সময়ে মেহেভীনে কাছে যায়। কাজের ব্যস্ততা থাকলে কখনো ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়নি। সে কি মেহেভীনকে প্রয়োজনে ব্যবহার করছে। কথা গুলো ভাবতেই অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। সে তো দেখতে চেয়েছিল। তার অনুপস্থিতিতে মেহেভীন অস্থিরতা অনুভব করে কি-না। তাকে দেখার তৃষ্ণায় মেহেভীনের আঁখিযুগল ছটফট করে কি-না। তার শূন্যতা মেহেভীনকে কাবু করে কি-না। এসব পরীক্ষা করতে গিয়ে মেয়ে টাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলছে না তো আবার! কথা গুলো ভাবতেই ভেতরটা অস্থিরতায় ছটফট করতে লাগলো। আজকে ভিষণ করে পাখি হতে ইচ্ছে করছে। দু’টো ডানা মেলে মেহেভীনের কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। মুনতাসিম আজ বেশি দেরি করল না। গাড়িতে উঠতে যাবে তখনই একজন বৃদ্ধা মহিলা আসলো। মুনতাসিমের দিকে চেয়ে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল,

–আপনি মুনতাসিম বাবা না। আপনার জন্য আমি মেলা দিন ধরে অপেক্ষা করছি। আমাগো এলাকার মেয়ররে কতবার যে কইছি। আমার বাড়িত একটা ভালো টয়লেট নাই। আমার বাড়িত একটা ভালো টয়লেট দিয়া দেন। তিনি আমার কথা শুনে না। বলে দিব বলেও দেয় না। সবাইরে দেয় শুধু আমারে দেয় না। কেন বাবা আমি মানুষ না। আমি কি তারে ভোট দেইনি। আপনার তো মেলা ক্ষমতা বাবা। আপনি একটু হেরে বইলেন তো। যাতে আমার বাড়িত একখানা টয়লেট বসায় দিয়া যায়। আপনি কইলে ঠিক শুনবে। বৃদ্ধা মায়ের কথায় মুনতাসিমের হৃদয় স্পর্শ করে গেল। মানুষ কতটা অসহায় হলে এভাবে বলে। মুনতাসিমের ভিষণ রাগও হলো। সে বৃদ্ধার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

–আপনার বাসায় কল আছে আম্মা। মুনতাসিমের মুখে আম্মা ডাক শুনে, বৃদ্ধা মহিলাটি অদ্ভুত ভাবে হাসতে শুরু করল। সে কি সুন্দর হাসি। মুনতাসিম মুগ্ধ হলো সে উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলো। বৃদ্ধা মহিলা মুনতাসিমের গালে হাত স্পর্শ করে নিজের হাতে চুমু খেল। কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

–কল নাই তো বাজান। পাশের বাড়ি থেকে পানি আইনা খাই। কল দিয়ে দিলে আমার মেলা উপকার হবে। কিন্তু মেয়ের সাহেব কি আমারে এতকিছু দিবো?

–আপনি চিন্তা করবেন না আম্মা। আপনি সময় মতো সবকিছু পেয়ে যাবেন। তাইয়ান তুমি কালকের মধ্যে সবকিছু ব্যবস্থা করে দিবে। কথা গুলো বলেই বৃদ্ধার হাতে দুই হাজার দিয়ে বলল,

–এই টাকা দিয়ে আপনি ঔষধ কিনে খাবেন। আর কোনো দরকার হলে আমাকে বলবেন। আমি আমার সাধ্যমতো আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করব। কথা গুলো বলেই চলে গেল। বৃদ্ধা নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে অশ্রুকণা গুলো মুছে মুনতাসিমের জন্য দোয়া করতে করতে বাড়ির দিকে চলে গেল।

পশ্চিম আকাশ জানান দিচ্ছে সূর্য মামার বিদায়ের সময় হয়ে এসেছে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে মাত্র মুনতাসিম গাড়ি থেকে নামল। বাসায় না গিয়ে সোজা মাঠের দিকে চলে গেল। সে জানে প্রতিদিনের মতো আজ-ও মেহেভীন এখানে আসবে। আজকে এসে যখন তাকে দেখবে। তখন মেহেভীন কি করবে? অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে। নাকি অস্থির হয়ে জানতে চাইবে। আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন? আজকে মেহেভীন রাগ করলে, সে মেহেভীনের রাগ ভাঙাতে ভিষণ বাজে ভাবে ব্যর্থ হবে। আজকে তার হৃদয়টা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে আছে। মুনতাসিমের ভাবনার মাঝে এক মায়াবী মুখশ্রী তার সামনে এসে স্থির হয়ে গেল। দু’জন দু’জনের দিকে নিষ্পলক চাহনিতে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীনকে দেখা মাত্রই তার নিজেকে গভীর ভাবে অসহায় মনে হচ্ছে। একটা অসহায় মানুষ যেমন খাবার পেলে আনন্দিত হয়। মেহেভীনকে পেয়ে মুনতাসিম আবেগে উৎফুল্ল হয়ে গেল। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে উঠে এসে মেহেভীনকে আলিঙ্গন করল। প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ পেয়ে বুকটা কেঁপে উঠল মেহেভীনের। অভিমানের পাল্লাকে গ্রাস করে নিল একদল ক্রোধ। সে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে মুনতাসিম সরিয়ে দিল। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আপনারা সব পুরুষ এমন কেন? একটু সুযোগ পেলেই ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। পুরুষ জাতির রক্তে কি লিখা আছে। নারীকে একা পেলেই ছুঁয়ে দিতে হবে। নারীকে ভালোবাসা কি আপনার মা আপনাকে শেখায় নাই। আপনার মা ও তো একজন নারী। পারবেন এভাবে আপনার মাকে ছুঁয়ে দিতে? মেহেভীনের কথায় মুনতাসিমের মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠল। পরক্ষণেই মনে হলো সে আবেগের বসে কতবড় ভুল করে ফেলছে। মেহেভীন কি তাকে ভুল বুঝল। সে তো এমনটা করতে চায়নি। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন হয়ে আসছে। মেহেভীন বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে বাসার দিকে অগ্রসর হলো। মেহেভীন যে তাকে বুঝতে পারল না। সেটা ভেবেই মুনতাসিমেট আঁখিযুগলের পাতা ভিজে আসছে। এই মেয়েটার কাছে আসলেই সে অসহায় হয়ে পড়ে। হারিয়ে যায় তার ভেতরের আত্মসম্মানবোধ বেহায়া হয়ে যায় সে। মুনতাসিম নিজের দুঃখ কষ্ট গুলোকে দূরে ঠেলে দিয়ে মেহেভীনের পেছনে ছুটল।

–আপনি আমায় ভুল বুঝছেন। আমি আসলে এমনটা করতে চাইনি। আপনি হঠাৎ করে আমার সামনে চলে আসলেন। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। আপনি অনুগ্রহ করে চলে যাবেন না। আপনি একটু বসুন আপনার সাথে আমার কথা আছে।

–আমি এই রাত্রীকালে আপনার পাশে বসে আপনার খাবার হতে চাই না। আমি একটা মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলাম। কোনো নরপিশাচের সাথে না। একটা নরপিশাচের খাদ্য হবার থেকে আ’ত্ম’হ’ত্যা করা ঢের ভালো। মেহেভীনের কথা গুলো মুনতাসিমের বুকে ধা’রা’ল অস্ত্রের মতো গিয়ে বিঁধল। মুহুর্তের মধ্যে ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে গেল। এতটুকু ভুলের জন্য মেয়েটা তাকে এতটা জঘন্য ভাবলো। মেহেভীন ঠিকই বলেছে দোষ তার। সে কেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। কেন সে আবেগে উৎফুল্ল হয়ে গেল। এটাই তার প্রাপ্য ছিল। সে সব দোষ নিজের কাঁধে তুলে নিবে। তবুও নিজের প্রেয়সীর এতটুকু দোষ কারো সামনে তুলে ধরবে না। করুন চোখ মেহেভীনের দিকে চেয়ে আছে মুনতাসিম। মেহেভীন মুনতাসিমকে উপেক্ষা করে চলে গেল। মুনতাসিম বুকের মধ্যে অসহনীয় যন্ত্রনা নিয়ে মেহেভীনের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। হয়তো কেউ তার আড়ালে তার জন্য অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। কিন্তু মুনতাসিম জানতেই পারল না।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_১৭
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

নিজের কক্ষে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন জাফর ইকবাল। মুখশ্রীতে তার বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। পাঁচটা বছর ধরে হেরে যাবার আগুনে জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছেন তিনি। এবারের নির্বাচনে যে করেই হোক তাকে উত্তীর্ণ হতেই হবে। সময় হাতে বেশি নেই। সামনে নিবার্চন এবার সে কিছুতেই বাচ্চা ছেলেটার কাছে হেরে যাবে না৷ তার তিলে তিলে গড়ে তোলা সাম্রাজ্য এইটুকু বাচ্চা ছেলের হাতে চলে গেল। জনগণ তার মাঝে কি পেল? বিশ বছর ধরে সে রাজনীতির সাথে যুক্ত আছে। আর দু’দিন ধরে রাজনীতিতে এসেই ছেলেটা সবার ভিষণ প্রিয় হয়ে উঠল। একবার মনোনয়ন পেয়েই সে উত্তীর্ণ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে মুনতাসিমের প্রতি তার ভিষণ ঈর্ষা হয়। এবার তাকে শক্ত হাতে মাঠে নামতে হবে৷ দরকার পড়লে সকলের প্রিয় মুনতাসিকে ধরণীর বুক থেকে মুছে ফেলবে। কাজটা কি এতোই সহজ হবে!

মুনতাসিমের মুখশ্রীতে বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট। ধরণীর সকল মানুষের প্রতি ভিষণ অভিযোগ জমেছে। কেন ভালোবাসে না তাকে? সে একটু অসহায়ত্ব দেখিয়েছে বলে, সবাই তাকে অসহায় মনে করবে। এক তরফা কোনো কিছুই হয় না। একটা মানুষকে সে মূল্য দিয়ে যাবে। আর বিপরীত পক্ষের মানুষটা তাকে অবহেলা করে চলে যাবে। ভালো না বাসুক মানুষ হিসেবে সন্মান টুকু তো দিতে পারে। একটা দিন সময় পেয়ে এক পলক দেখার জন্য এসেছিল সে। কাল সকালেই চলে যাবে আর আসবে না। কিন্তু মন তো আর মানে না তাই ছুটে চলে আসে। মুনতাসিম তাইয়ানকে ডেকে বলল,

–যাও আমার জন্য ঘুমের ঔষধ নিয়ে আসো।

–স্যার আপনাকে ডক্টর ঘুমের ঔষধ খেতে নিষেধ করেছে।

–আমি তোমাকে ঔষধ নিয়ে আসতে বলেছি নাকি কে কি বলে বলেছে সটা জানতে চাইছি। তাইয়ানের মস্তক নত হয়ে গেল। কণ্ঠনালি দিয়ে আর কোনো বাক্য উচ্চারিত হলো না। সে নিঃশব্দে কক্ষ ত্যাগ করে ঔষধ আনতে চলে গেল। এটা কি তার নিজের এলাকা যে গিয়ে চাইলেই ঔষধ দিয়ে দিবে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে যাচ্ছিল তাইয়ান। তখনই মেহেভীনের সাথে দেখা। মেহেভীন নিম্ন কণ্ঠে বলল,

–কোথায় যাচ্ছেন ভাইয়া?

–স্যারের জন্য ঔষধ নিয়ে আসতে।

–বন্ধু থেকে স্যার হয়ে গেল! আপনার স্যার ভাত না খেয়ে ঔষধ খাবে। মেহেভীনের কথায় নিশ্চুপ হয়ে গেল তাইয়ান। মিথ্যা কথা বলতে তার ভিষণ খারাপ লাগে। সে মাঝে মাঝে অবাক হয়। একই এলাকার মানুষ হয়ে সে কেন মুনতাসিনকে চিনে না। সবাই মুনতাসিমকে এক নামে চিনে। পথেঘাটে তার পোস্টারের ছড়াছড়ি। এই মেয়েটা সবকিছু জেনেশুনে অভিনয় করে নাকি। তবে মেয়েটা যাই করুক না কেনো মেয়েটার জন্য তার স্যার ভালো থাকে। এই কথাটা ভাবতেই বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল। অদ্ভুত ভাবে তাইয়ান হেসে মেহেভীনকে বলল,

–স্যার সারাদিন কিছু খাইনি। এখানে এসে আপনার জন্য অপেক্ষা করছিল। আপনি খারাপ ব্যবহার করার কারণে স্যার ভিষণ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। ডক্টর স্যারকে ঘুমের ঔষধ খেতে নিষেধ করছে। স্যার যখনই গভীর ভাবে আঘাত হয়। তখনই ঘুমের ঔষধ সেবন করে গভীর নিদ্রায় চলে যায়। মেহেভীনের ভিষণ খারাপ লাগলো তাইয়ানের কথা শুনে। বাসায় এসে সে গভীর ভাবে অনুতপ্ত হয়েছে। মানুষটা এতদিন পর এল তা-ও বিধস্ত অবস্থা। তার উচিৎ ছিল আগে সবকিছু জানা। কিন্তু সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কোনো পুরুষ স্পর্শ করলেই অতীতে কালো ছায়া তাকে কাবু করে ফেলে। মনের শহরে মিছিল করে বলে সব পুরুষ জাতি এক। সুযোগ পেলেই নারীকে লুফে নেওয়ার চেষ্টা করে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেহেভীন বলল,

–ঘুমের ঔষধ নিয়ে আসতে যেতে হবে না। আপনাদের বাসায় রান্না হয়েছে।

–না এসেছি সন্ধ্যা বেলায় রান্না কখন করব।

–আপনি আমার সাথে আসুন। আমি রুপাকে বলছি আপনাকে খেতে দিতে। আমি উনার জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছি।

–কিন্তু স্যার যদি রাগ করে।

–সেটা আমি বুঝে নিব। আপনার এত ভাবতে হবে না। কথা গুলো বলেই মেহেভীন নিজের বাসায় গেল। একটা প্লেটে করে খাবার নিয়ে মুনতাসিমের বাসায় গেল। মুনতাসিম বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছিল। মেহেভীন কম্পন মিশ্রিত হাতে মুনতাসিমের কাঁধে হাত রাখলো। মুনতাসিম হাত বাড়িয়ে বলল,

–আমার ঔষধ দাও আর এক গ্লাস পানি দেও। মেহেভীন মুনতাসিমের হাতে খাবারের প্লেটটা এগিয়ে দিতেই মুনতাসিম ভার সামলাতে না পেরে ফেলে দিতে চাইলে, মেহেভীন সাথে সাথে ধরে ফেলল। উলটো দিক হয়ে খাবারের প্লেট ধরা যায়। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে উঠে বসলো। মেহেভীনকে দেখে মুনতাসিম হতভম্ব হয়ে গেল। মুহুর্তের মাঝে মুখটা গম্ভীর করে ফেলল। সে কঠিন গলায় বলল,

–আপনি এখানে কেনো এসেছেন? আপনি আপনার বাসায় ফিরে যান। বলা তো যায় না কখন কোন নরপিশাচের খাদ্য হয়ে যাবেন। একা একা একটা পুরুষের গৃহে আসতে আপনার ভয় করল না।

–খোঁচা দিচ্ছেন। তখন আমি রাগ করে ফেলছি। দু’টো মাস আপনাকে কোথায় কোথায় আমি খুঁজেছি। আমি কি মানুষ না। আমার কি কোনো মূল্য নেই। আপনি এখানে দু’দিনের জন্য আসবেন। আবার না বলে মাসের পর মাস উধাও হয়ে যাবেন। আমার চিন্তা হয় না। আমি ঠিকমতো খেতে পারি না। ঘুমোতে পারি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। এখন এই মুহূর্তে সবগুলো খাবার শেষ করবেন। আমার না শুনলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। আমি আপনার থেকে কোনো কথা শুনতে চাইছি না। চুপচাপ হাত ধুয়ে খেতে বসুন।মেহেভীনের ওপরে যতটুকু রাগ ছিল। তা মেহেভীনের আদুরে শাসনের মধ্যে দিয়ে সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সে এই মেয়েটার ওপরে কিছুতেই রেগে থাকতে পারে না। এই মেয়েটা তার জন্য এতটা অস্থির হয়েছে। তাকে খুঁজেছে ভাবেই বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠছে। সে মেহেভীনের হৃদয়ে শক্ত ভাবে স্থান দখল করতে পারছে। এটা ভেবেই মুনতাসিমের বুক থেকে পাথর নেমে গেল। কতদিন পর তাকে কেউ কড়া করে শাসন করল। ভালোবাসার শাসন। যা পাবার জন্য মুনতাসিম প্রতিনিয়ত আকুল হয়ে থাকে। সে মেহেভীনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,

–আর কখনো এমন করব না৷ আমি কিন্তু কালেই চলে যাব। আমার অনেক কাজ আছে। আজ আমার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। আব্বুর সাথে সকালে ঝগড়া করে বের হয়ে ছিলাম। কিছু সময় মায়ের কবর স্থানে আর কিছু সময় আশ্রমে পার করেছি। যতটুকু সময় ছিল নিজের কথা ভাবিনি। আপনার জন্য ভেতরটা ভিষণ পুড়ছিল। তাই ছুটে এলাম আপনার কাছে। আমার মায়ের পরে পৃথিবীতে আপনি-ই একমাত্র নারী যার কাছে আমার শান্তি মিলে। মুনতাসিম হাত ধুয়ে এসে বিনাবাক্যে খেতে বসলো। সারাদিন পেটে কিছু পরেনি। চুপচাপ খেতে লাগলো। মেহেভীন মুনতাসিমের পাশে বসে আছে। মেহেভীনের অভিমানী মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে মুনতাসিমের ভিষণ মায়া হলো। ভেতরে অসহনীয় যন্ত্রনা করছে। আজকের পর থেকে এই মেয়ে টাকে সে কিছুতেই কষ্ট দিবে না৷ খাওয়া শেষ হয়ে গেল মেহেভীন প্লেট গুলো নিয়ে যেতে যেতে বলল,

–তৈরি হয়ে নিচে আসুন আপনার জন্য শাস্তি অপেক্ষা করছে। কথা গুলো বলেই মেহেভীন চলে গেল। মুনতাসিমের শরীর ভিষণ ক্লান্ত লাগছে। সে আরাম করতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রেয়সীর আবদারে সব আরাম চুকে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে নিচে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। মেহেভীন কালো রঙের সালোয়ার কামিজ পড়েছে। আচমকা কাজল দিয়ে আঁখিযুগল রাঙাতে ইচ্ছে করল। কাজল প্রতিটি মেয়ের আঁখির সুন্দর্য অদ্ভুত ভাবে বাড়িয়ে তুলে। কাজল কালো আঁখিযুগলের মায়ায় মেহেভীন নিজেই মুগ্ধ হয়েছে শতবার। সে সাজতে খুব একটা পছন্দ করে না। কালো রঙের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ছুটল নিচে। মেহেভীন গাড়ি বের করতে বলেছিল। বাহিরে এসে দেখল মুনতাসিম আগেই গাড়িতে উঠে বসে আছে। মেহেভীন গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি চলার সাথে সাথে আগে পিছে আরো কতগুলো গাড়ি তাদের গাড়িটাকে আড়াল করে রাখলো। মেহেভীন সেগুলোকে দেখেও আড়াল করে গেল। মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল,

–আজকে আমাকে আপনি পুরো শহর ঘুরাবেন। ফুল কিনে দিবেন। কাঁচের চুড়ি কিনে দিবেন। পাশে বসে ফুচকা খাওয়াবেন। ফুটপাতের রাস্তা ধরে আমার সাথে কিছুক্ষণ হাঁটবেন। আমার কথা মতো না চললে কালকে আপনাকে যেতে দিব না। মুনতাসিম মুগ্ধ হলো মেহেভীনের প্রতি, মেয়েটা ভিষণ রাগী। কিন্তু তার চাহিদা খুবই স্বল্প। এমন মন মানসিকতার মেয়ে সে খুব কমই দেখেছে। কাজল কালো আঁখিযুগলের দিকে তাকিয়ে হৃদয়ের ঘরে উথাল পাথাল শুরু হয়ে গিয়েছে। বিষন্নতাকে গ্রাস করে নিয়েছে এক টুকরো সুখ। অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠেছে। চারদিকে সুখ সুখ আমেজ লেগে গিয়েছে। না চাইতেও বেহায়া আঁখিযুগল আঁড়চোখে প্রেয়সীকে দেখে যাচ্ছে। গাড়ি এসে থামলো নিজ গন্তব্যে মেহেভীন গাড়ি থেকে নামলো। মুক্ত পাখি ন্যায় এদিক-সেদিক ছুটছে। মেহেভীন ফুলের দোকানের সামনে গেল। মেহেভীন বলার আগেই মুনতাসিম বলল,

–একটা মাথার ক্রাউন দিবেন। একটা গাজরা দিবেন। আর চারটা গোলাপ ফুল আর দু’টো রজনীগন্ধা ফুল দিবেন। ফুল মানেই নারীর ভালোবাসা। একটা নারী নিজেকে যতটা ভালোবাসে ঠিক ততটাই ফুলকে ভালোবাসে। ফুলের দোকানে আসতেই মেহেভীনের আঁখিযুগল চকমক করছে। তা চোখ এড়ায়নি মুনতাসিমের এত অশান্তির মাঝে-ও সে ভিষণ শান্তি অনুভব করছে। মন বারবার বলছে যে করেই হোক এই মেয়েকে তার লাগবে। মুনতাসিম গাজরা হাতে নিয়ে মেহেভীনের দিকে এগিয়ে দিল। মেহেভীন সেটা না নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। গাজরাটা সে মুনতাসিমের হাতে পড়তে চায়। সন্ধ্যার কথা স্মরন হতেই মুনতাসিমের ভেতরে জড়তা কাজ করছে। মুনতাসিমকে চিন্তিত দেখে সে অভয় দিল। মুনতাসিম জড়তা নিয়েই মেহেভীনকে গাজরা পড়িয়ে দিল। একটু পরে ক্রাউন তৈরি হয়ে গেলে সেটাও মুনতাসিমের হাতেই পড়লো৷ মুনতাসিম গোলাপ আর রজনীগন্ধা মেহেভীনের হাতে দিয়ে টাকা পরিশোধ করে দিল। এই সুন্দর মুহুর্তকে তাইয়ান আড়াল থেকে ক্যামেরা বন্দী করে নিল। দু’জনের কেউ টেরই পেল না।

দু’জন পাশপাশি হাঁটছে সামনেই চুড়ির দোকান। চুড়ির দোকানে গিয়ে দু’জনের ঝগড়া লেগে গেল। মেহেভীনের প্রিয় রঙ কালো। আর মুনতাসিমের প্রিয় রঙ শুভ্র। সে কালো রঙের চুড়ি নিতে চায়। আর মুনতাসিম তাকে শুভ্র রঙের চুড়ি কিনে দিতে চায়। মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আপনার প্রিয় রঙ কি?

–শুভ্র।

–সেজন্য সব সময় সাদা গরুর মতো শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পড়ে থাকেন।

–আপনার প্রিয় রঙ কি?

–কালো।

–সেজন্য সব সময় কালো কালো কথা বলেন। আমি বলেছি আপনি শুভ্র রঙের চুড়ি পড়বেন। তারমানে শুভ্র রঙের চুড়ি আপনাকে পড়তেই হবে।

–আমার কালো পছন্দ আমি কালোই পড়ব। অবশেষে দু’জনের পছন্দ মতো সাদা-কালো মিশিয়ে চুড়ি পড়লো মেহেভীন। দু’জনের মুখশ্রীতে স্নিগ্ধ হাসি পাশাপাশি হাঁটছে দু’জন। সামনে ফুচকার দোকান নজরে আসতেই মুনতাসিম মেহেভীনকে নিয়ে সেখানে গেল। মুনতাসিমের গুরুত্বপূর্ণ ফোন আসায় মেহেভীনকে বসিয়ে দিয়ে একটু দূর গেল মুনতাসিম। ফোনের ওপাশে থেকে বিপদের সংকেত দিয়ে গেল। যে করেই হোক পরিবারকে রক্ষা করতে হবে। সে থাকতে কারো সাহস হবে না তার পরিবারের দিকে নজর দেওয়ার। তবুও সাবধানের মা’র নেই। সে ফোন রেখে মেহেভীনের কাছে আসলো। মনটা মুহুর্তের মধ্যে বিষাদে পরিণত হয়ে গেল। মলিন মুখশ্রী করে চুপ করে মেহেভীনের পাশে বসলো। মেহেভীন একটা ফুচকা মুনতাসিমের দিকে এগিয়ে দিল।

–এসব আমি খাই না আপনি খান। আমাকে বাসায় ফিরতে হবে। আপনাকে বাসায় দিয়ে আমি চলে যাব। মুনতাসিমের যাওয়ার কথা শুনেই মেহেভীনের মন খারাপ হয়ে গেল। ভেতরটা শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে উঠল। গলা দিয়ে খাবার নামচে চাইছে না। সে খাবে না বলে ফুচকা রেখে উঠে দাঁড়ালো। মেহেভীনের মন খারাপ হয়ে যেতে দেখে, ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে মেহেভীনকে বসতে বলল। একটা ফুচকা নিয়ে খেল সে। তবুও মেহেভীনের মন ঠিল হলো না। বাধ্য হয়ে মেহেভীনের সাথে হাঁটা ধরলো। হঠাৎ করে মেহেভীনের চরণ দু’টি থেমে গেল। আশেপাশে এত মানুষ থাকা সত্বেও সে ভয়ে কাবু হয়ে আসছে। শরীর থরথর করে কাঁপছে। সে ভয় পেতে চাইছে না। মনে সাহস নিয়ে আসতে চাইছে। তবুও ভেতরটা তার সাথে বেইমানি করছে। ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়ালো সে। পুরোনো কালো অতীতকে সে আঁখিযুগলের সামনে দেখতে পাচ্ছে। মেহেভীনকে ভয় পেতে দেখে মনতাসিম বলল,

–কি হয়েছে আপনার এমন করছেন কেন?

–ও আমাকে মেরে ফেলবে। চলুন এখানে থেকে সে দেখার আগেই আড়ালে চলে যাই। মেহেভীনের বোকা বোকা কথায় হতভম্ব হয়ে গেল মুনতাসিম। যে মেয়েটা বুকে এতটা সাহস নিয়ে চলাফেরা করে। সেই মেয়েটা ভয় পাচ্ছে! কিসের জন্য সে এতটা ভয় পাচ্ছে। প্রতিটি কঠিন মানুষেরও একটি করে দুর্বল জায়গা থাকে। তবে কি মেহেভীনেরও কোনো গল্প লুকিয়ে আছে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করল মুনতাসিম। মেয়েটা ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছে। মেহেভীনের এমন অবস্থা দেখে ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠেছে মুনতাসিমের। সে মেহেভীনকে নিয়ে বাসার দিকে অগ্রসর হলো।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_১৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

মন্ত্রীসভা থেকে বের হতেই কনফারেন্স রুমের অন্য জেলার এক নেতা মুনতাসিমের দিকে এগিয়ে এল। মুখশ্রীতে তার বিশ্রী হাসি মুনতাসিম তাকে ভালোভাবেই চিনে। জাফর ইকবালের সাথে তার বেশ সখ্যতা রয়েছে। মাহতাব উদ্দিন তাকে খোঁচা মা’রা’র জন্য আসছে। সে সেটা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে। বিরক্ততে মুখশ্রী কুঁচকে এল মুনতাসিমের। সে মাহতাব উদ্দিনকে দেখেও না দেখার ভান করে, সামনের দিকে অগ্রসর হলে, মাহতাব উদ্দিন রসালো কণ্ঠে বলল,

–ভালো আছো মুনতাসিম।

–আমার ভালো থাকা বুঝি আপনার সহ্য হচ্ছে না।

–একদম ত্যাড়া কথা বলবে না। বেশি বাড় বেড়ো না অকালে ঝরে যাবে। আমি তোমাকে ভালোর জন্য একটা পরামর্শ দিচ্ছি। ছোট মানুষ না বুঝেই রাজনীতিতে চলে আসছো। হুজুগে বাঙালি না বুঝেই তোমাকে আপন করে নিল। জাফর সাহেব দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সাথে যুক্ত আছেন। তুমি তার ক্ষমতার সাথে পেরে উঠবে না। তাই বলছি আগেই রাজনীতি থেকে সরে যাও। চোয়াল শক্ত হয়ে এল মুনতাসিমের আশেপাশে নানান মানুষের আনাগোনা। শান্ত মস্তিষ্কের ছেলে সে। মুনতাসিম মাহতাব উদ্দিনের কানে কানে ফিসফিস করে বলল,

–অন্যের দালালি কম করে করবেন। পরে দেখা গেল আপনার দালালি আছে। কিন্তু যে কাজ করে দালানকোঠা গড়েছেন। সেটাই নেই। আপনার মতো ফ্রীতে চা’ম’চা আর কোথায় পাওয়া যায়। আমার জন্য একটা জোগাড় করে দিবেন। আমি জাফর ইকবালের থেকে বেশি বকশিস দিব। মুনতাসিমের কথায় জ্বলে উঠল মাহতাব উদ্দিন। রক্ত চক্ষু নিয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। চোয়াল শক্ত করে বলল,

–তুমি কি আমাকে অপমান করছ মুনতাসিম।

–আপনার আবার অপমানবোধ আছে! আমি তো জানি আপনি মেরুদন্ডহীন প্রাণী।

–নিজের সীমা লঙ্ঘন কর না মুনতাসিম।

–আপনি-ও নিজের অবস্থান ভুলে যাবেন না। আপনি কার সাথে কথা বলছেন৷ একটা কথা সব সময় মস্তকে রাখবেন। আপনার মতো ফ্রী তে পাওয়া দালালের কথার ধার আমি মুনতাসিম ধারিনা। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম বিলম্ব করল না দ্রত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। মাহতাব উদ্দিন অপমানে চুপসে গেলেন। থমথমে মুখশ্রী করে জাফর ইকবালকে ফোন দিলেন। দু’জনের কথোপকথন শেষ করে রহস্যময় হাসি হাসলেন।

নিজের কক্ষে এসে ফ্রেশ হতে গিয়েছিল মুনতাসিম। কাল থেকে দু’টো চোখের পাতা এক হয়নি। আজকে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাবে। ফ্রেশ হয়ে এসে লাইট অফ করে দিল। পুরো কক্ষ জুড়ে মুহুর্তের মধ্যে আঁধারে ছেয়ে গেল। ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই দরজায় টোকা পড়লো। মুনতাসিম বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে নিজের বাবাকে দেখতে পেল।

–আমি তোমার বাবা এটা নিশ্চই ভুলে যাবে না। আমি তোমার জন্য নিজের হাতে তোমার পছন্দের খাবার রান্না করে নিয়েছি। একদম গরম গরম সাদা ভাত আর গরুর মাংস। এত স্বাদ হয়েছে তোমাকে না দিয়েই সব খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। তুমি খাবে নাকি আমি নিয়ে চলে যাব। বাবার এই ভালোবাসার কাছেই সে কাবু হয়ে যায়। বাহিরে যতই কঠিন ভাব দেখাক ভেতরটা তার কুসুমের ন্যায় কোমল। সে মুখশ্রী গম্ভীর করে বিছানায় গিয়ে বসলো। মুনতাসিমের বাবা হেসে নিজ হাতে ছেলের সামনে খাবার ধরলো। নিজের পছন্দের খাবার সামনে থাকলে রাগ করে বসে থাকা যায়। মুনতাসিমও রাগ করে থাকতে পারলো না। টুপ করে খাওয়ার গুলো মুখে তুলে নিল। মা ম’রা ছেলে টাকে একটু বেশিই ভালোবাসেন তিনি। ছেলের রাগ, অভিমান, অভিযোগ সবকিছু সম্পর্কে সে অবগত। সে এটাও জানে ছেলে তার বাবার ওপরে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারবে না। জিতে যাবে বাবার ভালোবাসা। হেরে যাবে ছেলের রাগ কথা গুলো ভাবতেই রিয়াদ চৌধুরী হালকা হাসলেন।

জাফর ইকবাল অন্ধকার কক্ষে বসে প্রহর গুনছিলেন। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একটি মেয়ে আসলো তার কক্ষে। মেয়েটিকে দেখে বিস্ময়ে তার আঁখিযুগল বেড়িয়ে আসার উপক্রম। তার কল্পনার বাহিরে ছিল। এই রমণী তার কাছে আসতে পারে। সুন্দরী রমণী এসে জাফর ইকবালের সামনে বসে বলল,

–পয়তাল্লিশটা মেয়ে তুলেছেন পাচারের জন্য খবরটা কি মুনতাসিম পর্যন্ত পৌঁছে দিব। নাকি আমার কথা মতো কাজ করবেন?

–মুনতাসিমের সাথে রাজনীতি নিয়ে আমার শত্রুতা। কিন্তু মুনতাসিমের সাথে তোমার শত্রুতা কিসের!

–এত অবাক হবার কিছু নেই। আপনার থেকে সাহায্য চাইতে এসেছি। আমাকে সাহায্য না করলে আপনার খবর কালকে প্রতিটি টিভি চ্যানেলের হেড লাইন হবে। তিনবার জয়যুক্ত মন্ত্রী নারী পাচারকারীর সাথে যুক্ত আছেন। পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে তদন্তের পরে ফের জানা যাবে। তার সব অপকর্মের কথা। চারদিকে জনগন আপনাকে ছি ছি করবে। ঘৃণায় আপনার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিবে। একবারেই রাজনীতিতে মুনতাসিমের জায়গা শক্তপোক্ত হয়ে গিয়েছে। সবার নয়নের মনি মুনতাসিম। এসব ঘটনা বাহিরে লিক হলে, আপনাকে ভালোবাসার যে দু’চার জন ছিল। তারাও হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যাবে। জাফর ইকবাল রক্তিম চোখে রমণীর দিকে দৃষ্টিপাত করল। এতটুকু মেয়ের এতবড় সাহস তাকে হু’ম’কি দিচ্ছে! সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–তুমি জানো আমি কে? আমি চাইলে তোমার কি করতে পারি? এই কে কোথায় আছিস। এই মেয়ে টাকে মে’রে গুম করে দে। একটা পাখিও যেন টের না পায়।

–আপনি যা বলছেন ভেবে বলছেন তো জাফর সাহেব? আপনি এখানে আমাকে মারবেন। আর আমার লোক আপনাকে এত সহজে ছেড়ে দিবে। এত কাঁচা কাজ করার মতো মেয়ে আমি না। আপনি আপনার কর্ম ফলের জন্য প্রস্তুত হন। এবার আপনি আমাকে মা’র’তে পারেন। রমণীর কথায় ভয়ে কাবু হয়ে গেল জাফর ইকবাল। ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা তৈরি হলো। মেয়েটাকে সে যতটা সহজ ভেবেছিল। সে ততটা সহজ নয় আটঘাট বেঁধেই ময়দানে নেমেছে। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–কি চাই তোমার?

–মুনতাসিমের মৃ’ত্যু।

–সেটা আমিও চাই। তোমার কোনো ধারনা আছে। এই কয়েক বছরে আমি কম চেষ্টা করিনি। একজন মন্ত্রীকে খু’ন করা সহজ কথা না। তুমি তো তার কাছের লোক তুমি কেন মা’র’ছো না?

–যদি মা’র’তে পারতাম তাহলে আপনার মতো অপদার্থের কাছে আসতাম না। জাফর ইকবাল রাগান্বিত হয়ে রমণীর গালে প্রহার করতে যাবে। তখনই রমণী তার হাত ধরে ফেলে। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করে। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–সাবধান ভুলেও এই কাজ করবেন না। আপনার হাত কে’টে টু’ক’রো টু’ক’রো করে ফেলব। আপনার মুনতাসিমের সম্পর্কে যা যা তথ্য লাগবে। আমি আপনাকে সব রকম তথ্য দিব। আপনি শুধু মুনতাসিম কে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিন৷ কথা গুলো বলেই বের হয়ে গেল রমণী। জাফর ইকবাল ক্রোধিত দৃষ্টিতে রমণীর দিকে চেয়ে আছে। পুরোনো ঝামেলার শেষ নেই। আবার নতুন করে ঝামেলা এসে ললাটে জুটলো।

সারাদিন পরিশ্রম করে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বাসায় ফিরল মেহেভীন। এসেই খোলা জানালার দক্ষিণে দৃষ্টিপাত করল। হঠাৎ করে যদি মানুষটার দেখা পায়। সে জানে মানুষটার দেখা পাবে না। তবুও তার নিয়ম করে আসতে বিরক্ত লাগে না। মানুষটা তাকে বলেই গিয়েছে। তবুও মানুষটার শূন্যতা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কিছুক্ষণ নিরব আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে রাখলো। ফ্রেশ হয়ে ফোন নিয়ে বসেছিল। এমন সময় দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল। রুপা কফি তৈরি করছিল। বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে একটা সুদর্শন যুবককে দেখে কিন্তু বিস্মিত হলো। সে শান্ত কণ্ঠে বলল,

–কাকে চাই?

–মেহেভীন বাসায় আছে?

–জি আছে।

–একটু ডেকে দিবেন। বলবেন তার ছোট বেলার বন্ধু এসেছে। রুপা আর কথা বাড়ালো না। মেহেভীনের কক্ষে এসে মেহেভীনকে জানালো তার বন্ধু এসেছে। কথা শুনেই মেহেভীনের ভ্রুযুগল কুঁচকে এল। তার ছোট বেলার কোনো বন্ধু নেই। তবে কে এল? মেহেভীন উঠে ড্রয়িং রুমে আসতেই দুপা পিছিয়ে গেল। পুরো শরীর কাঁপছে। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। মেহেভীন রুপাকে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–রুপা তোকে কতবার নিষেধ করেছি। তুই আমাকে না বলে দরজা খুলবি না। যাকে তাকে বাসার মধ্যে প্রবেশ করতে দিয়েছিস কেন? তোকে আর কিভাবে বোঝালে বুঝবি। সব মানুষ আমাদের ভালোর জন্য আসে না৷ কিছু কিছু মানুষ বিকৃত মন মানসিকতা নিয়ে আসে। যার পরিচয় সে তার আচরনের মাধ্যমে প্রকাশ করে।

–আমার তোর সাথে কথা আছে মেহেভীন। জারিফের মুখশ্রীতে নিজের নাম উচ্চারিত হতেই মেহেভীনের পুরো শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠল। সে রক্তিম চোখে জারিফের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। বজ্র কণ্ঠে বলল,

–তুই এখনই আমার বাসা থেকে বেরে হয়ে যা। আমার সাথে অসভ্যতা করার চেষ্টা করলে ফলাফল ভালো হবে না। আমাকে তুই আগের বোকা মেহেভীন ভাবিস না। আগুন নিয়ে খেলতে আসিস না। সেই আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবি।

–তোর জ্বালিয়ে দেওয়া আগুনে আমি প্রতিটি মুহুর্ত জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছি। আমাকে গ্রহণ করে আমার পিপাসিত হৃদয়কে শীতল করে দে অনুগ্রহ করে। তোকে পাবার তৃষ্ণায় ক্ষ্যা’পা কুকুর হয়ে আছি। ভালোবেসে কাছে টানতেও জানি আবার ভালো না বাসলে জোর করে টেনে ছিঁ’ড়ে খেতেও জানি। ঘৃণায় মেহেভীনের সমস্ত শরীরে আগুন জ্বলে উঠল। সে নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে জারিফের গালে প্রহার করল। আকষ্মিক ঘটনায় জারিফ বিস্ময় নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। আজকে নতুন মেহেভীনের সাথে পরিচিত হলো সে। নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে আদুরে ভাবে মেহেভীনের দুই গাল স্পর্শ করল। জারিফের স্পর্শ মেহেভীনের কাছে বিষাক্ত লাগলো। সে ধৈর্যের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে জারিফের মুখশ্রীতে এক দোলা থু’থু ছু’ড়ে মা’র’লো। জারিফ একহাতে নিজের মুখশ্রী মুছে নিল। আরেক হাতে মেহেভীনের দুই গাল শক্ত করে চেপে ধরলো। মেহেভীন নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলো। পুরুষ মানুষের শক্তির সাথে পেরে ওঠা এতই সহজ! চোয়াল শক্ত করে বলল,

–ভালোবেসে বুকে আগলে নিতে চেয়েছিলাম। আমার ভালোবাসা মূল্য দিলি না। তোকে পাবার আশায় নিজেকে কতটা পরিবর্তন করেছি। সেটা তোর আঁখিযুগলে ধরা দিল না। কয়েকবছর আগে একটা ভুল করেছি। সেটা ঠিকই ধরে বসে আছিস। আমাকে এতটা অবহেলা করিস না মেহেভীন। আমার খারাপ রুপ সহ্য করতে পারবি না। বাঁচতে দিব না তোকে। তোকে খু’ন করার অপরাধে যদি আমার ফাঁ’সিও হয়। তবে আমি হাসি মুখে ফাঁ’সি’র দড়িতে ঝুলে যাব। যে ধরণীতে আমি থাকব না। সেই ধরণীর বুকে তুইও থাকতে পারবি না। তোর অস্তিত্ব শেষ করেই আমার অস্তিত্ব বিলীন হবে। এটা সব সময় মনে রাখিস। বি’ষে’র চেয়েও বেশি বিষাক্ত লাগছে জারিফের ছোঁয়া। সে সহ্য করতে পারছে না দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। আশেপাশে হাতরে কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। মেহেভীনকে অবাক করে দিয়ে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বসলো রুপা। একটা ভারি ফুলদানি দিয়ে জারিফের মাথায় প্রহার করল। জারিফ ব্যথায় কুঁকড়ে গেল। রুপা দৌড়ে এসে মেহেভীনকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। মেহেভীন রুপাকে শান্তনা দিতে বলল,

–কিছু হয়নি ভয় পাস না। ঠিক এভাবেই নিজেকে রক্ষা করবি। ফোনটা নিয়ে আয়। ওর মতো জা’নো’য়া’র’কে কিভাবে শায়েস্তা করতে হয়। সেটা আমার ভালো মতোই জানা আছে। কথা গুলো বলেই জারিফের বুক বরাবর লা’থি মা’র’ল। জারিফ ব্যথা কাতর দৃষ্টিতে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করল। সে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে সবকিছু ধংস করে দিতো। তা জারিফের রক্তাক্ত আঁখিযুগল বলে দিচ্ছে। একটু পরে মেহেভীনের গার্ড আসলে মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,

–এই জা’নো’য়া’র টার এমন অবস্থা করবে। যেন প্রতিটি মানুষের রুহু কেঁপে উঠে। কোনো পুরুষ নারী জাতিকে নোংরা ভাবে স্পর্শ করার আগে একবার অন্তত ভাবে। দরকার পড়লে ওর মতো জা’নো’য়া’র’কে কে’টে কু’টি কু’টি করে রাস্তার কুকুরকে খাওয়াবে। একে আমার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও। না হলে তাজাই পুঁ’তে ফেলব তাকে। ক্রোধে সমস্ত শরীর কাঁপছে মেহেভীনের। অদ্ভুত ভাবে সমস্ত শক্তি এসে তার শরীরে ভর করছে। সে নিজেকে দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। জারিফকে খু’কে মনের আগুন নেভাতে ইচ্ছে করছে।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-১৩+১৪+১৫

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_১৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

পরিবেশের সাথে থমকে গিয়েছে মেহেভীনের মস্তিষ্ক। ঘটে যাওয়া ঘটনা স্মরন করতেই আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। নতুন করে মানুষটাকে জানছে মেহেভীন। মানুষটার মধ্যে তার জন্য কতটা অধিকারবোধ! সে কি কোনো ভাবে মেহেভীনকে নিজের দখলে করে নিতে চাইছে! সমস্ত ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিয়ে মনের শহরে বিষাদ খেলা করতে লাগল। সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। মুনতাসিম তার সাথে এতটা রাগান্বিত হয়ে কথা বলবে। সে নিজেই তো মুনতাসিমের অন্য রুপের সাথে পরিচিত হতে চেয়েছিল। কিন্তু তা এত তাড়াতাড়ি বাস্তবায়িত হয়ে যাবে। তা মেহভীনের ভাবনার বাহিরে ছিল।

জারিফ নিজের কক্ষে বসে ছিল। একটু পরে অফিসে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। তখনই তার বোন আর্শিয়া আসে। ধরণীর বুকে এই মানুষটা নিয়ম করে তার খোঁজ খবর নেয়। মানুষটাকে যখন তার বাবা-মা বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল। তখন এই ছোট বোনটাই তার হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছিল। তার ভাই টা যেন কয়টা দিন ভালো থাকতে পারে। আর্শিয়া ভাইয়ের মুখশ্রীর দিকে নিষ্পলক চাহনিতে দৃষ্টিপাত করে আছে। মানুষটা একটা মেয়েকে ভালোবেসে, নিজের গোটা জীবনটাই বিসর্জন দিয়ে দিল। নিজের নাম খারাপ করল। নিজের শরীরে লাগিয়ে দিল ধ’র্ষ’ক উপাধি। তবুও মেয়েটাকে পাবার আশা ছাড়ল না। একটা মানুষ কতটা ভালোবাসলে, একটা মেয়েটা পাবার জন্য এতটা নিকৃষ্ট হতে পারে! সমাজের দৃষ্টিতে এই ছেলেটা ভিষণ খারাপ। কিন্তু আর্শিয়ার চোখে সে একজন উন্মাদ প্রেমিক। যে কি-না নিজের প্রেয়সীকে পাবার জন্য জঘন্যতম কাজ করে বসল। হয়তো নিজের ভাই বলেই সে ভাইয়ের অন্যায় টা চোখে দেখছে না। ভালোবাসা কি জোর করে পাওয়া যায়। ভালোবাসা অর্জন করে নিতে হয়। ভালোবাসা একটা স্নিগ্ধ পবিত্র জিনিস। জারিফ সেই পবিত্রতায় কলঙ্ক লাগাতে চেয়েছে। শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে। সে পেয়েছে শাস্তি। কয়েকবছর আগে না থাকার শূন্যতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। আজ সবকিছু থেকে-ও সে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। জারিফ তৈরি হয়ে মেহেভীনের ছবির সামনে গেল,

–দেখেছ মেহেভীন আমি প্রতিদিন নতুন ভাবে পুড়ছি। জানো আমার ভেতরটা পুড়তে পুড়তে ছারখার হয়ে গিয়েছে। আমার ভেতরটায় আমার অস্তিত্ব বলতে কিছু নেই। আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে শুধু তোমার বিচরণ। তুমি আমার শিরা-উপশিরায় বসবাস কর। তুমি এভাবে আমাকে জ্বালিয়ে না দিলেও পারতে। জ্বালতে তো সবাই পারে। কিন্তু প্রেম দিতে সবাই পারে না। আমাকে প্রেম দিলে কি তোমার খুব ক্ষতি হয়ে যেত। আমিও দেখতে চাই। আমি থাকতে তোমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করে। তোমার শরীরে কলঙ্ক লাগিয়ে হলে-ও আমি তোমাকে আমার করে নিব। একবার কলঙ্ক লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। এবার আর ব্যর্থ হবার কোনো সম্ভবনা রাখব না।

–ভালোবাসা একটি পবিত্র জিনিস ভাইয়া। তুমি যাকে জোর খাটিয়ে আঁকড়ে ধরতে যাবে। সে ততই তোমার থেকে দূরে সরে যাবে। তোমাদের মধ্যে তৈরি হবে গভীর দুরত্ব। আর তুমি যাকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে চাইবে। সে ততই আদুরে বিড়ালের মতো তোমার হৃদয়ের গহীনে লুকিয়ে পড়বে। শত চেষ্টা করে-ও কেউ তাকে বের করতে পারবে না। মেয়ে মানুষ অল্পতেই খুশি। তাদের বেশি কিছু লাগে না ভালোবাসা পেলে হয়ে যায় অবুঝ বাচ্চা। আর অবহেলা পেলে হয়ে যায় পাথরের ন্যায় কঠিন। একটা মেয়ের কাছে শ্রেষ্ঠ সম্পদ তার সন্মান। তুমি মেহেভীন আপুর সন্মানের দিকে নজর দিয়েছিলে ভাইয়া। যে পুরুষ একটা নারীকে কলঙ্কিত করতে চায়। সেই পুরুষ অন্তত অর্ধাঙ্গ হবার যোগ্যতা রাখে না। একটা নারী একটা পুরুষকে তখনই ভালোবাসে, যখন নারীটি সেই পুরুষের কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে করে। তুমি তো আগেই মেহেভীন আপুর সমস্ত বিশ্বাস চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছ। তারপরেও কোন বিবেকে আশা কর সে তোমার হবে।

–তাকে আমার হতেই হবে। জারিফ এতকিছু বুঝে না। মেহেভীনকে আমার ভালোবাসতে হবে না। আমি তো মেহেভীনকে ভালোবাসি। এর থেকে বড় পাওয়া মেহেভীনের কাছে কি হতে পারে। কয়েক বছর আগে আমার কিছু ছিল না। আজ আমার সব হয়েছে অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা। কি নেই আমার! সবকিছু আছে এবার আমি এবার মেহেভীনের সামনে যাব। জোর করে নিয়ে করব সংসার ও করব।

–ক্ষমতার অপব্যবহার করতে চাচ্ছ! তুমি তোমার অতীত ভুলে যেও না ভাইয়া। তার আশা তুমি ছেড়ে দাও। আমি বাবা-মাকে বুঝিয়েছি। তুমি বাসায় ফিরে চলো। আর এসব বাজে কার্ম ছেড়ে দাও। আমাদের জীবনটা ভিষণ সংলিপ্ত ভাইয়া। এসব রেষারেষি বাদ দিয়ে, এই ছোট্ট জীবনটাকে আমরা সুন্দর ভাবে উপভোগ করতে পারি না ভাইয়া।

–আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটা তুই। তোর জায়গায় অন্য করেই হলে, এতক্ষণে মাটির নিচে থাকত। ভাইয়াকে জ্বালাস না। বাসায় ফিরে যা আমার কাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। কথা গুলো বলেই জারিফ স্থান ত্যাগ করল। আর্শিয়া ভাইয়ের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই যুদ্ধের শেষ কোথায়? হতাশ হলো আর্শিয়া। বিষণ্ণ মন নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

প্রভাতের আলো ফুটতেই মুনতাসিমের নিদ্রা ভেঙে যায়। কাল রাতের কথা স্মরন করতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। ক্রোধের বশে মেহেভীনকে সে আঘাতপ্রাপ্ত করেছে। এই যন্ত্রনা সে সহ্য করবে কি করে। মুহুর্তের মধ্যে মন জুড়ে হাহাকার নেমে এল। হালকা শীতের মাঝে-ও সমস্ত শরীর ঘামছে। মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। চরিত্র মানুষের অমূল্য সম্পদ। সেই চরিত্রে আঘাত আসলে মুনতাসিম কেন জানি সহ্য করতে পারে না। এখানে মেহেভীনের কোনো দোষ নেই। দোষ তো তার নিজের সে নিজেই অন্য মেয়ের কথা মেহেভীনের সামনে বলছে। মেহেভীনের তাকে চরিত্রহীন ভাবাটা স্বাভাবিক নয় কি! অপরাধবোধ মুনতাসিম কে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। নিজের ওপরে ভিষণ রাগ হচ্ছে তার। সে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে নিজের হাতে প্রহার করল। আজকে উঠতেও দেরি হয়ে গিয়েছে। সে উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজ আদায় করে, না খেয়েই বাহিরে বের হলো। আজকেও মেহেভীনের বাসায় থাকার কথা। প্রতিদিন সকালে মেহেভীন হাঁটতে বের হয়। সে মেহেভীনের জন্য অপেক্ষা করছে। মেহেভীন মুনতাসিমকে দেখেই গৃহে চলে গেল। সে মনে মনে পণ করল। সে মুনতাসিমের সামনে যাবে না। মানুষটা তাকে বুঝিয়ে বললেই সে বুঝত। আচমকা এমন বিশ্রী ব্যবহার করার কি দরকার ছিল! মানুষটাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়ে গিয়েছে। সেজন্য মানুষটা মস্তকে উঠে গিয়েছে। তাকে কিভাবে মস্তক থেকে নামাতে হয়৷ সেটা আমার ভালো মতোই জানা আছে। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। সূর্যমামা তার কিরণ চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে রৌদ্রের প্রখরতা বেড়ে চলেছে। উত্তপ্ত হতে শুরু করে মস্তক। মুনতাসিম হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল নয়টা বাজে। সে ধরেই নিল মেহেভীন আজ আসবে না৷ হতাশ হয়ে ফিরে গেল নিজ গৃহে। মুনতাসিম বের হতেই মেহেভীন তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গেল। আজকে তার অফিসের অনেক কাজ আছে। প্রচুর দলিল এসে জমা হয়েছে। নিজের কাছেই নিজেকে বিরক্ত লাগছে মেহেভীনের৷ সে একটা পুরুষ মানুষের জন্য নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে, চোরের মতো গৃহ থেকে বের হচ্ছে। কেন করছে সে এসব? তার মন কি চায়। মানুষটা আবার আসুক। তার রাগ আবার ভাঙাক! মানুষটার কিসের এত দায় পড়েছে। যে সে রাগ করবে আর মানুষটা বেহায়ার মতো তার কাছে এসে আত্নসমর্পণ করবে। মানুষটার নিজস্ব অভিমান বলতে কিছু নেই। আমাকে নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই। এই আমি তার সম্পর্কে না জেনে, তাকে চরিত্রহীন উপাধি দিলাম। আমার জন্য কেন তার মনে ক্ষোভ জমল না। মানুষটার বন্ধুত্বের বন্ধন কি তার থেকে গাঢ়! সেজন্য মেহেভীন তার কাছে হেরে যাচ্ছে। মানুষটা তাকে একটু বেশিই মূল্য দেয়! এতটা মহামূল্যবান সে নয়। সে তার মনের কথা আমায় বলবে। না হয় সবকিছু এখানেই স্থগিত হয়ে যাবে। এভাবে দু-টানায় ভুগতে ভালো লাগে না।

মুনতাসিম রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুল হাতে নিয়ে আসছিল। তখনই আঁখিযুগল স্থির হয়ে গেল। মুখশ্রীতে ক্রোধের ছাপ স্পষ্ট। মিরাজুল মেহেভীনের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মুনতাসিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে গম্ভীর মুখশ্রী করে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। মনটা বিষাদে ভরপুর হয়ে গেল। সমস্ত ফুলগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল। কারো দিকে দৃষ্টিপাত না করেই চলে গেল। মিরাজুল ডাকলেও তাকে ইগনোর করে চলে গেল। মিরাজুল মেহেভীনের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে এসেছিল। তাই নিজের বাবার জমিকে নিজের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করল। মেহেভীনের সাথে কথা বলে ভিষণ আনন্দ লাগছে তার। মেহেভীন তাকে সাহায্য করবে বলছে। প্রয়োজনের বাহিরে একটা কথাও বলেনি মেহেভীন। মিরাজুল চলে যেতেই মেহেভীন ফুলগুলো হাতে তুলে নিয়ে বাসার মধ্যে চলে গেল। মুনতাসিমে ওভাবে যেতে দেখে, মেহেভীনের মনটা ভিষণ খারাপ হয়ে গেল। মানুষটা কি তাকে ভুল বুঝল!

হঠাৎ করে আকাশটা মেঘলা হয়ে আসলো। মেঘেরাও কি জেনে গিয়েছে। দুটি মানুষের মন ভিষণ খারাপ। তাদের সঙ্গ দিতেই সে চলে এসেছে। মেহেভীন বেলকনিতে এসেছেই খোলা জানালার দক্ষিণে দৃষ্টিপাত করল। তখনই আঁখিযুগলের সামনে ভেসে উঠল একটা জোড়া বিধস্ত আঁখিযুগল। মানুষটা কেমন ছন্নছাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো সে মেহেভীনের জন্যই অপেক্ষা করছিল। মেহেভীন দ্রুত নিজের কক্ষে যেতে চাইল। কিন্তু মুনতাসিম আঁটকে দিল।

–কালকের ব্যবহারের জন্য দুঃখিত ম্যাডাম। রাগের বশে আপনার সাথে বাজে ব্যবহার করে ফেলছি। আপনাকে আঘাত করে ফেলছি। আমি আপনাকে আঘাত করতে চাইনি। আপনাকে আঘাত করা মানে, নিজেকে আঘাত করা। কোনো মানুষ নিশ্চই নিজেকে আঘাত করতে চাইবে না। মেহেভীনের অভিমানের পাল্লা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। মেহেভীন গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। সে মানুষটার প্রতি ভিষণ ভাবে দুর্বল হয়ে গিয়েছে। মানুষটার নাম করে যে কেউ তাকে কাবু করতে পারবে। মেহেভীন নিরুত্তর রইল। এর মাঝেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। অসময়ে বৃষ্টি আসার কারন জানে না মুনতাসিম। তবে এই বৃষ্টিটা তার ভিষণ ভালো লাগছে। তার মনের গহীনে জমানো কষ্ট গুলো বৃষ্টির পানির সাথে ধুয়েমুছে যাক। প্রকৃতির মতো তার হৃদয়টাও ঝকঝকে হয়ে উঠুক। মেহেভীন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–নিজের কক্ষে যান। অসময়ে বৃষ্টির পানিতে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে। খুব সহজে শরীর সুস্থ হতে চাইবে না। প্রেয়সীর বিষাদে ভরা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আহত হলো মুনতাসিম। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রেয়সীকে বুকের মধ্যে নিয়ে গভীর ভাবে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে করছে। দু’জনে একাকার হয়ে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, আপনি কষ্ট পাবেন না ম্যাডাম। আপনি কষ্ট পেলে আমার পুরো দুনিয়ায় এলোমেলো হয়ে যায়। আমার ভেতরে অস্থিরতার ঝড় বয়ে যায়। আমার হৃদয়টা অশান্ত নদীর মতো উথাল-পাতাল ঢেউ খেলতে থাকে। বুকের মধ্যে অসহনীয় যন্ত্রনা করে। আমি মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকি। আপনার মন খারাপ থাকলে, আমার পুরো পৃথিবীর মন খারাপ হয়ে যায়। মন খারাপ করার আগে, একটা বার আমার কথা অন্তত ভাবুন মেহেভীন। মনের কথা গুলো আড়াল করে মুনতাসিম বলল,

–আপনি আমাকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না। হে আকাশ তুমি আল্লাহ তায়ালার হুমুকে সারারাত বৃষ্টি দাও। আমি তোমার ছোঁয়ায় ভিজে একাকার হতে চাই। তোমার এতটুকু উপকারে আমার প্রেয়সীর মন গলে যাক। তাহলে নিজের জান কুরবান করতেও রাজি আছি। হে আল্লাহ তুমি নারাজ হইও না৷ কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। নিজের জীবন অন্য কারো নষ্ট করতে হয় না। তবুও আমরা আবেগের বশে বলে ফেলি। আমি ছাড়া তোমার বান্দার অভাব নেই। কিন্তু তুমি ছাড়া আমার কোনো রব নেই। আমার ভুল গুলো তুমি ক্ষমা করে দিও। কথা গুলো বলেই বিলম্ব করল না। কক্ষ থেকে বের হয়ে বাহিরে এসে মেহেভীনের জানালার কাছে দাঁড়াল। তখন কথা গুলো ধীরে বলায় মেহেভীন শুনতে পাইনি। মুনতাসিম বলল,

–আমাকে ক্ষমা করবেন কি না ম্যাডাম। আপনার উত্তর যদি না আসে। তাহলে আমি আজ সারারাত এখানে দাঁড়িয়ে পার করে দিব। হাতে সময় বেশি নেই। উত্তর দিয়ে নিজের কক্ষে চলে যান। এই বৃষ্টির পানি আপনাকে গভীর ভাবে আলিঙ্গন করছে। আমার ভিষণ হিংসে হচ্ছে। একে তো মনটাকে ভিষণ বাজে ভাবে পোড়াচ্ছেন। এখন আবার হিংসের আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েন না। আমার অস্তিত্ব খুঁজে পাবেন না। বিরক্তিতে মুখশ্রী কুঁচকে এল মেহেভীনের। এত বড় মানুষের এমন পাগলামি শোভা পায়! সে বিরক্তি মাখা মুখশ্রী করে বলল, আপনি সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে পার করে দিন। তাতে আমার কোনো যায় আসে না। কথা গুলো বলেই মেহেভীন নিজের কক্ষে চলে গেল। মনের অজান্তেই ভেতরে অসহনীয় যন্ত্রনা অনুভব করল মুনতাসিম। সে মলিন মুখশ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জেদ যেন তার সবকিছুকে কাবু করে ফেলছে। সে দেখবে তার কষ্টে মেহেভীনের কষ্ট হয় নাকি। মুহুর্তের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল মুনতাসিমের।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_১৪
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

হালকা হাওয়ায় গাছের ডালপালা হেলেদুলে পড়ছে। শীতে সমস্ত শরীর জমে আসছে। মুনতাসিমের সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গিয়েছে। প্রায় দুই ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা বাজে। মেহেভীন জানালার কাছে আসতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষটার এত কিসের জেদ! মেহেভীনের ভিষণ খারাপ লাগতে লাগলো। সে ছাতা হাতে নিয়ে নিচে চলে গেল। মুনতাসিম আঁখিযুগল বন্ধ করে কাঁপছিল। তখনই অনুভব করল বৃষ্টি তাকে স্পর্শ করছে না। আহত দৃষ্টিতে আঁখিযুগল উপরে দৃষ্টিপাত করল। পাশে কারো উপস্থিতি অনুভব করল। মানুষটাকে চিনতে এক সেকেন্ড সময় নিল না মুনতাসিম। আঁখিযুগল অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে, গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল,

–এখানে কেন এসেছেন? বৃষ্টির পানি আপনার শরীরে সইবে না। ঠান্ডা লেগে যাবে।

–আপনি নিজ গৃহে ফিরে যান।

–আমি যাব না আপনার সমস্যা কোথায়?

–আমার সমস্যা আছে। একটা মানুষ আমার জন্য নিজেকে কষ্ট দিবে। সেটা আমি সহ্য করতে পারব না। আমার ভিষণ খারাপ লাগবে। আমার কথা শুনুন গৃহে ফিরে চলুন।

–আপনার কথা কেন শুনব!

মেহেভীন জবাব দিল না। মুহূর্তের মধ্যে শীতল পরিবেশটা উত্তপ্ত হয়ে গেল। মেহেভীন ছাতাটা নিজের হাত থেকে ফেলে দিল। বৃষ্টির পানিগুলো মেহেভীনকে ভিজিয়ে দিতে শুরু করছে। মুনতাসিম হতভম্ব হয়ে গেল! যেখানে রাগ দেখানোর কথা তার। সেখানে মেহেভীন ক্ষমা করে তার অভিমান ভাঙিয়ে দিবে। মেয়ে তা না করে উল্টো রাগ করে বসল! দু’টি প্রেমিক হৃদয় বৃষ্টির পানির সাথে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। হৃদয় বলছে কাছে টেনে নাও। শরীর যেন দু’টি প্রেমিক হৃদয়ের মাঝে বাঁধা সাধছে। দু’জনকে এক না করার শপথ গ্রহণ করেছে। মেহেভীন ঠান্ডায় কাবু হয়ে আসছে। পুরো শরীর পাথরের ন্যায় অবশ হয়ে আসছে। সে মলিন কণ্ঠে জবাব দিল,

–আমি আপনাকে ক্ষমা করেছি। এবার গৃহে ফিরে চলুন। ঠান্ডায় বোধহয় জমে মা’রা যাব। আমি আপনার জেদের কাছে হার মেনে নিয়েছি।

–এত অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে গেলেন ম্যাডাম? আপনার মনের জোড় এত স্বল্প! এভাবে কাউকে ধরে রাখতে পারবেন না। ভেতর থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠুন। না হলে সবাই আপনাকে ভিষণ বাজে ভাবে আঘাত করবে। এত সহজে আমি যাব না। ঠান্ডায় এতক্ষণ কষ্ট করলাম। এত পরিশ্রম করলাম। সেই পরিশ্রমের ফল না নিয়ে কিভাবে যাব বলুন? মুনতাসিমের কথায় মেহেভীনের হৃদয় ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল। বৃষ্টির জন্য একটা কাক পাখিও দেখা যাচ্ছে না। ফল স্বরুপ মুনতাসিম কি চাইছে তার কাছে? যদি কোনো নিষিদ্ধ কিছু চেয়ে বসে। ভয়ে শক্তিহীন হয়ে পড়ছে মেহেভীন। মেহেভীনের মনের কথা বুঝতে পেরে মুনতাসিম ইচ্ছে করে, মেহেভীনের কাছে এগিয়ে আসলো। মেহেভীন একটু দূরে সরে গেল। মুনতাসিমের ভিষণ হাসি পাচ্ছে। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে শীতল কণ্ঠে বলল,

–আপনি চুপ করে গেলেন যে ম্যাডাম। আমাকে আমার পরিশ্রমের ফল দিবেন না। মুনতাসিমের শীতল কণ্ঠে বলা কথা গুলো মেহেভীনের হৃদয় স্পর্শ করে গেল। ভেতরে অস্থিরতার ঝড় বইতে শুরু করল। মস্তিষ্কে এসে হানা দিয়েছে এক ঝাঁক ভয়। পানির শব্দ ছাড়া আশেপাশে কোনো শব্দ কর্ণকুহরে আসছে না। মেহেভীন মুখশ্রী মলিন করে বলল,

–কি চাই আপনার? কথা গুলো বলার সময় গলা ধরে আসছিল। শব্দগুলোও যেন আজ ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিমের ভিষণ ঠান্ডা লাগছিল। আর কিছুক্ষণ থাকলে বোধহয় সেন্সলেস হয়ে যাবে। সে আর বেশি কথা বলতে পারল না। হাসোজ্জল মুখশ্রী করে জবাব দিল,

–এই আমাকে এত শাস্তি দিলেন। তার বিনিময়ে আমাকে এখন খিচুড়ি আর গরুর মাংস রান্না করে খাওয়াবেন। এই বৃষ্টির সময় খিচুড়ি আর গরুর মাংস জমে যাবে। সাথে আপনি থাকলে কোনো কথাই নেই। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন আঁখিযুগল মেলে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মানুষটার প্রতি আরো একবার মুগ্ধ হলো সে। যতদিন যাচ্ছে মানুষটার প্রতি মুগ্ধতা ততই বেড়ে যাচ্ছে। একটা মানুষ এতটা অসাধারণ কিভাবে হতে পারে! মুনতাসিমের দৃষ্টি অন্য দিকে বিদ্যমান। বৃষ্টির পানিতে ভিজে মেহেভীনের জামা শরীরের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিমের জায়গায় অন্য কেউ হলে, নিশ্চই এত সুন্দর সুযোগ হাতছাড়া করত না।

–চোখ দিয়ে আমাকে পরে খাবেন। আগে আমাকে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ান। ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে যাচ্ছি। শুনেছি মেয়েদের আইসক্রিম নাকি খুব প্রিয়। আমাকে জমিয়ে বরফ বানিয়ে খাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি। যদি ইচ্ছে থাকে তাহলে সেই ইচ্ছে টাকে ঝেড়ে ফেলে দিন। আমাকে খিচুড়ি খাওয়ার সুযোগ করে দিন। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন ভিষণ লজ্জা পেল। মানুষটা কিভাবে বুঝল সে তার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে! সব সময় মানুষ টাকে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় সে । মেহেভীন বিলম্ব করল না। দ্রুত গৃহের মধ্যে চলে গেল। মুনতাসিম ও মেহেভীনের পেছনে পেছনে চলে আসলো। কক্ষে এসে ফ্রেশ হয়ে কম্বলের মধ্যে নিজেকে আড়াল করে নিল। তবুও শীত যেন কমতে চাইছে না। তখন জেদ করে হিরোগিরি দেখাতে গিয়ে, এখন শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। জ্বর ভালো মতোই আসবে মনে হচ্ছে। তাতে মুনতাসিমের কোনো যায় আসে না। নিজের প্রেয়সী রাগ ভাঙাতে সক্ষম হয়েছে। এখানেই তার সকল কষ্ট সার্থক হয়েছে। মুনতাসিম একটু পরে মেহেভীনের গৃহের কাছে এসে কলিং বেল দিল। মেহেভীন দরজা খুলে বলল,

–আমি খিচুড়ি রান্না করতে পারি না। আমার বাসায় গরুর মাংস ও নেই। কালকে আসার সময় আপনার জন্য খিচুড়ি নিয়ে আসব। এবার নিজের গৃহে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।

–আপনি কিন্তু আমাকে ঠকাচ্ছেন ম্যাডাম। আপনার সাথে আমার এমন কথা ছিল না। আপনি যদি আমাকে এখন খিচুড়ি রান্না করে না খাওয়ান। তাহলে আমি সারারাত আপনার দরজা বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকব। আপনার বাসায় মাংস নেই। সে কথা আপনি আমাকে আগে বলবেন না। আমার বাসায় গরুর মাংস আছে। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি এখনই নিয়ে আসছি। মেহেভীন আহত দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। সে এত রাতে রান্না করতে চাইছে না। সেজন্য মুনতাসিমকে মিথ্যা কথা বলল। কিন্তু মুনতাসিম তো নাছোড়বান্দা জোঁকের মতো আঁটকে ধরেছে। মেহেভীন ফিসফিস করে বলল,

–আস্তে কথা বলুন চিৎকার চেঁচামেচি করবেন না। মানুষ শুনলে কি বলবে। আমরা বাসায় দু’জন মেয়ে মানুষ থাকি। কেউ দেখে ফেললে আমাদের খারাপ ভাববে। আপনি কাল সকালে আসবেন। আমি আপনাকে রান্না করে খাওয়াব।

–আপনি সকালে অফিসে চলে যান। সারাদিনে আপনার দেখা মিলে না। আপনি দরজা খোলা রাখুন। আমি বেশি সময় নিব না। খেয়েই চলে যাব। আপনি প্লিজ রাগ করবেন না। আপনাকে কথা দিলাম। আজকের পর দীর্ঘসময় আপনাকে বিরক্ত করব না। তখন আপনি শান্তিতে থাকবেন। কথা গুলো কর্ণে আসতেই মেহেভীনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। হঠাৎ করে মানুষটা এমন কথা বলল কেন! মেহেভীন যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কোনো কথা না বলে মুনতাসিমকে ভেতরে প্রবেশ করতে বলল। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে বিশ্ব জয়ের হাসি। মেহেভীন রুপাকে ডেকে নিল। রুপা মেহেভীনের সাথে সাহায্য করছে। এই ছেলেটার সবকিছু রুপার অসহ্য লাগে। শুধু মাত্র মেহেভীনের জন্য কিছু বলতে পারছে না।

ঘড়ির কাঁটায় রাত তিনটা বেজে পনেরো মিনিট। মেহেভীন নিজ হাতে মুনতাসিমের প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। আজ রান্না করতে গিয়ে মেহেভীনের ভিষণ আনন্দ লাগছে। সে আগেও কত রান্না করেছে। কই আগে তো এমন আনন্দ অনুভব করেনি। বেশ যত্ন নিয়ে রান্নাটা করেছে সে। রান্না করে ভিষণ তৃপ্তিও পেয়েছে মেহেভীন। আচমকা মুনতাসিমের আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন হয়ে আসতে শুরু করেছে। কতদিন পরে এতটা যত্ন নিয়ে কেউ তাকে খাবার বেড়ে খাওয়াচ্ছে। তার মা চলে যাবার পরে, সে কবে এতটা যত্নে খাবার গ্রহণ করেছে। তা তার জানা নেই। মুনতাসিম আহত কণ্ঠে বলল,

–আপনি আমার পাশে একটু বসবেন ম্যাডাম। এতটুকুও বিরক্ত করব না। আপনি শুধু আমার পাশে বসে খাবেন। কথা গুলো মাদকের মতো শোনালো। মেহেভীন নাকচ করার সাহস পেল না। নিঃশব্দে মুনতাসিমের পাশে বসলো। রুপা গিয়ে মেহেভীনের পায়ে বসলো। মুনতাসিম খাবার মুখ দিল। মেহেভীন অধীর আগ্রহে মুনতাসিমের দিকে চেয়ে আছে। খাবার কেমন হয়েছে জানার জন্য উতলা হয়ে আছে। মুনতাসিম খেয়ে মুখশ্রী কুঁচকে নিল। তা দেখে মেহেভীনের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মুনতাসিম গভীর ভাবে মেহেভীনের দিকে তাকিয়ে বলল,

–সত্যি করে বলুন তো খাবারটা কি আপনি রান্না করেছেন? নাকি বাহিরে থেকে অর্ডার করে নিয়ে আসছেন। মুনতাসিমের কথায় বিরক্তিতে মুখশ্রী কুঁচকে এল মেহেভীনের। সে তার জন্য এত কষ্ট করে রান্না করল। আর মুনতাসিম তার রান্না নিয়ে মজা করছে। অভিমানে মুখশ্রী ঘুরিয়ে নিল। রাগান্বিত হয়ে জবাব দিল,

–আপনি রাত করে আমার সাথে মজা করছেন। এই মধ্যরাতে আমার জন্য কে দোকান খুলে বসে আছে? তার ওপরে হয়েছে বৃষ্টি। চারদিকে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। আপনি তাড়াতাড়ি খেয়ে নিজ গৃহে ফিরে যান।

–আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আপনার রান্না ভিষণ সুন্দর হয়েছে। সব খিচুড়ি আর মাংস আমি একাই খাব। আপনারা এতটুকুও খাবেন না। খাবার টেবিলে থেকে দূরে সরুন।

–আপনার পেটে কি দানব ধরেছে। এতগুলো খাবার সব একা খাবেন।

–আপনার চোখে কি দানব ধরেছে। এতবড় মানুষকে চোখ দিয়ে একা খিলে খান। মেহেভীন স্তব্ধ হয়ে গেল। বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টি করে আছে। রুপার সামনে তাকে ছোট না করলেই হতো না। মনটা বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। পরিবেশ জুড়ে নিস্তব্ধতা রাজত্ব করছে। মুনতাসিম দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

–আমার শেষ একটা কথা রাখবেন ম্যাডাম। আমি আপনাকে একবার নিজ হাতে খাইয়ে দিতে চাই। আপনি না করবেন না। দু’লোকমা খাবার আমার হাতে থেকে আহার করুন। আমি ভিষণ আনন্দিত হব। এক সেকেন্ডের জন্য বিরক্ত করব না।

–ভেতরে প্রবেশ করার আগে কি বলেছিলেন মনে আছে?

–বিড়াল যদি বলে আমি মাছ খাব না। আপনি বিশ্বাস করবেন?

–না।

–কেনো?

–কারন এটা বিশ্বাস করা কখনোই সম্ভব না।

–তাহলে আমি আপনাকে বললাম। আমি আপনাকে বিরক্ত করব না। এটা কেনো বিশ্বাস করলেন? মেহেভীন একরাশ হতাশা ভরা দৃষ্টি নিয়ে মুনতাসিমের দিকে তাকিয়ে আছে। রুপা দু’জনের কান্ড দেখে মুখ চেপে হাসছে। মুনতাসিম মেহেভীনের সামনে খাবার ধরল। মেহেভীন বিনাবাক্য খেয়ে নিল। কি অপরুপ সেই মুহূর্ত! যার পুরুষ যত যত্নশীল তার নারী ততই ভাগ্যবান। এই মুহূর্তে এই কথাটাই মেহেভীনের মস্তিষ্কে বিচরন করছে। মুনতাসিম খেয়ে চলে গেল। যাবার আগে মেহেভীনের সাথে ভালো করে কথাও বলল না। শুধু এতটুকু বলে গেল। ভালো থাকবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন। আপনি মানুষটা আমার ভিষণ শখের। আপনার কিছু হয়ে গেলে, আমি ভিষণ বাজে ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হব। কথা গুলো বলে বিলম্ব করেনি। দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করেছে। শেষের কথা গুলো মেহেভীনের হৃদয় ছিদ্র করে বের হয়ে যাচ্ছিল। অজানা কারনে ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। মনটা বিষাদে ছেয়ে যাচ্ছে। মন খারাপ গ্রাস করে ফেলছে তাকে। বুকটা ভারি হয়ে আসছিল। এই বুঝি মানুষটাকে আর দেখা হবে না। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কক্ষে চলে গেল মেহেভীন।

মুনতাসিম নেই আর পাঁচ দিন হলো। মানুষটাকে দেখার জন্য হৃদয়টা ভিষণ ভাবে অস্থির হয়ে আছে। সুযোগ পেলেই মানুষ টাকে সে খুঁজেছে। শহরের অলি-গলিও বাদ রাখেনি। মানুষটা বোধহয় এই শহরে নেই। প্রতিদিন দিনের মতো নিয়ম করে খোলা জানালার দক্ষিণের পাশে আঁখিযুগল স্থির হয়ে থাকে। এই বুঝে কেউ এসে বলবে। এভাবে চোখ দিয়ে আমার সর্বশান করবেন না ম্যাডাম। আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারব না। প্রতিদিন সকালে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে না। এতদিন যার জ্বালাতন সহ্য করতে না পেরে, তাকে দূরে যেতে বলতো। আজ সেই মানুষটা তার ছায়ার পাশেও আসে না। মানুষটাকে ছাড়া ভিষণ অসহায় বোধ করছে মেহেভীন। ভেতরটা শূন্যতায় ভরে উঠেছে। অশ্রুকণা গুলো চোখের কার্নিশে এসেও থেমে যাচ্ছে। আজকাল বুকের ব্যথাটা ভিষণ বেড়েছে। সে কি অসহনীয় যন্ত্রনা করে। বুকটা খাঁ খাঁ করছে। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে মানুষটার কাছে। গভীরভাবে আলিঙ্গন করে বলতে ইচ্ছে করছে। আমাকে এত মায়ায় বেঁধে কোথায় পালিয়েছিলেন। আপনাকে ছাড়া ভিষণ অসহায় আমি। আপনার শূন্যতা আমাকে ভিষণ ভাবে পোড়াচ্ছে। আপনি ফিরে আসুন আমার না হওয়া মহারাজ। আমাকে প্রতিটি প্রহরে প্রহরে বিরক্ত করুন। আমি আপনাকে কিছু বলব না। আমার আপনি হলেই হবে। আমার আর কিছু চাই না। আপনি ফিরে আসুন।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_১৫
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

দিন যায়, রাত যায়, প্রহের পর প্রহর চলে যায়। তবুও নির্দিষ্ট মানুষের দেখা মিলে না। কেটে গিয়েছে দু’টো মাস। মানুষটা যেন হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেল। সাথে তৈরি করে দিয়ে গেল একরাশ হতাশা। মনটা তীব্র ব্যথায় ছটফট করে। ভেতরটা শক্তিহীনতায় ভুগছে। এই যে সে মানুষটার জন্য যন্ত্রনায় ছটফট করছে। মানুষটার কি তার কথা একটি বারের জন্য স্মরন হচ্ছে না। মানুষ এতটা স্বার্থপর কিভাবে হতে পারে! মনটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আজকাল কিছুই ভালো লাগে না তার। সবকিছু বিষাদ গ্রাস করে ফেলছে। যত দিন যায় মেয়েটা তত ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে রাইমা বেগম মেয়ের বাসায় এসে সাতদিন থেকে গিয়েছে। তার প্রাণবন্ত মেয়েটা হঠাৎ করে শান্ত নদীর মতো থম মে’রে গেল কেন? সেটাই তার সরল মস্তিষ্কে ঢুকছে না। মানুষ একটা বয়সে এসে একাকিত্বে ভূগে, একাকিত্ব মানুষকে ভয়ংকর ভাবে ধংস করে দেয়। মেয়েটার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। মেয়েটাকে একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে। তাকে হাজার বার বলা হয়েছে। কাকে বিয়ে করেছিস। সে একটাই জবাব দেয় সে বিয়ে করেনি। সবকিছু দেখে সবাই মেনেই নিল মেহেভীন বিয়ে করেনি। শরীর অসুস্থ হলে শরীরে ডক্টর দেখালে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু হৃদয়ে যে হুটহাট রক্তক্ষরণ হয়। মনটা বাজে ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে, বিধাতা মনের ডক্টর কেন তৈরি করেনি। ভেতরটা যে যন্ত্রনায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। এই উত্তপ্ত হৃদয়কে কিভাবে সে শীতল করবে।

“রাতে সূর্য থাকে না। তবুও মানুষ কেনো দিনের চেয়ে রাতে বেশি পুড়ে! আকাশ পানে চেয়ে নির্বিকার প্রশ্ন মেহেভীনের। সে তো এমন ছিল না। একটা ছলনাময়ী পুরুষ তার হৃদয় হরণ করে পালিয়েছে। তাকে করে দিয়েছে উন্মাদ ছন্নছাড়া। তার গভীর আঁখিযুগলের মায়ায় করেছে আসক্ত। শুনেছি হাত ধরলে মানুষ ছেড়ে চলে যায়। তাই সে আমার মনে ধরেছিল। আমি তাকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না। কথাগুলো ভাবতেই বুকটা ভারি হয়ে আসলো। আজকাল অশ্রুকণা গুলো খুব সহজে চোখ ভেজাতে চায় না। নির্জন কোনো স্থানে গিয়ে ইচ্ছে মতো অশ্রু বির্সজন দিতে ইচ্ছে করে। কাউকে গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে বলতে ইচ্ছে করে। আমি ভালো নেই। সবাই তো ভালোবাসার দায়িত্ব নেয়। তুমি না হয় আমার ভালো থাকার দায়িত্বটা নাও। কথা গুলো ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মেহেভীন। সব কষ্টের সমাধান একটাই দীর্ঘশ্বাস। যার মধ্য দিয়ে হৃদয়ের সব দুঃখকষ্ট গুলো উঠিয়ে দেওয়া যায়।

প্রভাতের আলো চারদিক চকচক করছে। ভোরের মৃদু হাওয়া শরীর, মন, মস্তিষ্ক শীতল করে দিয়ে যাচ্ছে। ফরিদ রহমান শরীরে চাদর মুড়িয়ে দু-হাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাসায় ফিরছে। প্রতি সপ্তাহে হাটের দিন বাজার করেন তিনি। আরিয়ান বাবার সাথে আসছিল। ফরিদ রহমানকে এতগুলো বাজার নিয়ে হিমশিম খেতে দেখে ছুটে আসলো। খপ করে বাজারের ব্যাগ দু’টো নিজের হাতে নিল। ফরিদ রহমানের গম্ভীর আঁখিযুগল আরিয়ানকে একবার পর্যবেক্ষণ করে নিল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–এসব কেমন ধরনের ভদ্রতা আরিয়ান! আমার অনুমতি না নিয়ে, তুমি কেন আমার হাত থেকে ব্যাগ কেঁড়ে নিলে?

–আপনি আমাকে নিজের ছেলে মনে করতে না পারেন চাচা। আমি আপনাকে নিজের বাবা মনে করি। আমি যে অন্যায় করেছি। তার জন্য যদি আপনি আমাকে খু’ন করে ফেলেন। আমি মুখ দিয়ে দু’টো বাক্য উচ্চারণ করব না। আপনি মুখে যতই বলুন আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আসলে আপনি আমাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারেননি। এভাবে আমাকে পোড়াবেন না চাচা। আমার একটা ব্যবস্থা করে দিন না হয় আমাকে ভাতের সাথে বি’ষ দিয়ে মে’রে ফেলুন। আমি যে আর অপরাধের যন্ত্রনা সহ্য করতে পারছি না। তখনই পাশে থেকে কেউ একজন বলে উঠল,

–কি দরকার ভাই অন্যের জন্য অপেক্ষা করার। আমি আপনাকে বি’ষ এনে দিব। এখনই খেয়ে ম’রে যান৷ আপনাকে আর যন্ত্রনা সহ্য করতে হবে না। জারিফকে দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে এল আরিয়ানের। এতদিন পরে জারিফ কোথায় থেকে এল। শীতের মধ্যেও ঘামতে শুরু করল আরিয়ান। জারিফ আরিয়ানের থেকে বাজারের ব্যাগ গুলো নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কোমল কণ্ঠে ফরিদ রহমানকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার কথা জানাল জারিফ। জারিফকে ফরিদ রহমান মতো ভাবে চিনেন। বহুদিন পরে ছেলেটাকে দেখে ভিষণ আনন্দ লাগছে ফরিদ রহমানের। সে জারিফের সাথে পায়ে পা ফেলে চলতে লাগলো।

জারিফকে দেখকেই রাইমা বেগমের সমস্ত শরীরে ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। নিজের চরণের জুতা খুলে জারিফকে প্রহার করতে শুরু করল। ফরিদ রহমান কিছু বুঝতে পারল না। বিস্ময় নয়নে অর্ধাঙ্গিনীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। তার শীতল মস্তিষ্কের অর্ধাঙ্গিনী এমন রণচন্ডী রূপ ধারণ করল কেন! রাইমা বেগম সহজে রেগে যাওয়ার মানুষ নন। সে জারিফের থেকে রাইমা বেগমকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসলো। জারিফ নিয়ে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না৷ সে নিজের লুকায়িত অস্ত্র বের করতে যাবে। তখনই জারিফের মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠল। ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠছে। তীরে এসে নৌকা ডুবিয়ে দিস না জারিফ। অপেক্ষার প্রহর গুলো খুব দীর্ঘায়িত হয়। এত সহজে হেরে গেলে চলবে না। ঘন ঘন গাঢ় শ্বাস নিচ্ছে জারিফ। সে বিলম্ব করল না দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। রাইমা বেগম অস্থির হয়ে উঠেছে। ঝড়ের গতিতে শ্বাসকষ্ট এসে জানান দিচ্ছে সে চলে এসেছে। রাইমা বেগম কেমন ছটফট করতে লাগলো। আরিয়ান চিৎকার শুনে মেহেভীনদের বাসায় এসেছিল। রাইমা বেগমকে অসুস্থ হতে দেখে দ্রুত ঔষধ খাওয়ালেন। কোনো কিছুতেই যেন কাজ হচ্ছে না। অবশেষে হসপিটালে নেওয়া হলো রাইমা বেগমকে।

তাহিয়ার সামনে বসে আছে প্রাপ্তি। মুখশ্রীতে তার অন্য রকম আনন্দ প্রকাশ পাচ্ছে। অপেক্ষার প্রহর শেষ করে, কাঙ্খিত মানুষটার দেখা মিলেছে। সে যতগুলো আঘাত পেয়েছে। সবগুলো গুনে গুনে ফেরত দিবে। কালো জিন্স, টপ, সানগ্লাস পড়া মর্ডান মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে প্রাপ্তি। এত সুন্দর মেয়ে সে আগে কখনো দেখেনি। বিদেশের মাটিতে বড় হয়েছে বলে কথা, সুন্দর্য না থাকলে বিদেশে থাকাই তার জন্য বৃথা ছিল। তাহিয়া বিরক্তিতে মুখশ্রী কুঁচকে ফেলল। তেজী কণ্ঠে বলল,

–তোমাদের দেশে এতগুলো ধুলো বালি কেন? এজন্য বাংলাদেশ আসতে ইচ্ছে করে না। শুধুমাত্র মুনতাসিম ভাইয়ের জন্য আসি। আল্লাহ এত মানুষের মাথায় সুবুদ্ধি দিয়েছে। মুনতাসিম ভাইয়ার মাথায় কেন দেয়নি। তাকে কত করে বলি। দেশের মায়া ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমাও। তার এক কথা দেশে থাকবে। দেশের মানুষের সেবা করবে। জনগণের সেবা করে তার কি লাভ হচ্ছে। আমি তার ক্রোধের কাছে দমে যাই। সেজন্য কিছু বলতে পারি না। তুমি তো সে বাড়ির বউ তুমি মামাদের কিছু বলতে পার না।

–আমি চৌধুরী বাড়ির বউ হয়ে এসব কথা কিভাবে বলব বল। সেজন্য তোমাকে দেশে আসতে বলেছি। তোমার ভাই একজন মন্ত্রী মানুষ। তার ক্ষমতাই আলাদা। তাকে একটা বাক্য উচ্চ শব্দে বলা যায় না। আমার বিশ্বাস তুমি পারবে মুনতাসিম ভাইয়ের এলোমেলো জীবনটা গুছিয়ে দিতে। তোমাকে আমার বড় জা হিসেবে দেখতে চাই। মানুষটা প্রচুর অনিয়ম করে চলাফেরা করে। আমি তাই তুমি তাকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে চলে আসো। তোমাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। মুনতাসিম ভাইয়ের বউ হবার জন্য প্রস্তুত তো তাহিয়া। প্রাপ্তির কথায় লজ্জায় মুখশ্রী লাল হয়ে আসলো তাহিয়ার। সে মুখে অনেক বড় বড় কথা বললেও, মুনতাসিমের বউ হবার কথা শুনলেই ভিষণ লজ্জা পায়। মেয়েটা বাহির থেকে কঠিন হলে-ও ভেতর থেকে ভিষণ বোকা। কেউ তার প্রশংসা করলে সে গলে যায়। আর অপর পাশের মানুষটাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে শুরু করে।

–আমি তোমার জা-ই আমাদের বিয়ে অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। কথা গুলো বলেই লজ্জা লতা গাছের ন্যায় মিইয়ে গেল তাহিয়া। প্রাপ্তি বিস্ময় নয়নে তাহিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি মানুষের মধ্যে কেমন জানি রহস্য লুকিয়ে আছে। প্রাপ্তি চৌধুরী বাড়ির মানুষের হিসেবে মিলাতে পারে না। মাথা কেমন জানি ঘুরছে। সে সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাতে গিয়ে নিজেই নতুন সত্যের মুখোমুখি হয়ে গেল। মুনতাসিমকে আঘাত করার শেষ উপায় টাও জলে চলে গেল।

চারদিকে আঁধারে আচ্ছন্ন হতে শুরু করেছে। গ্রামের পরিবেশ নিস্তব্ধ হতে শুরু করেছে। বাচ্চারা নিদ্রা দেশে পাড়ি জমিয়েছে। রাত আটটা বাজার সাথে সাথে পুরো গ্রাম মরুভূমিতে পরিনত হলো। এই আঁধারের অপেক্ষায় ছিল মুনতাসিম। শহর থেকে একটু দূরে গ্রামের মধ্যে আঁকাবাকা নদীর তীরে বসে আছে সে। বিশাল নদীর সাথেই একটা বিশাল গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছটা তার মতো ভিষণ একা। সেজন্য এই গাছটাকে সে ভিষণ ভালোবাসে। মৃদু চিৎকার কর্ণকুহরে আসতেই মুনতাসিম অস্বাভাবিক ভাবে হেসে উঠল। পানিতে ভিজিয়ে রাখা চরণ দু’টো তুলে উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে গভীর অরণ্যের মাঝে প্রবেশ করতে লাগলো। দিনের বেলায় এই অরণ্যে আসলে মানুষের শরীর শীতল হয়ে আসে। কিন্তু মনুতাসিমের ভয়ডর বলতে কিছু নেই! সে নিশ্চিন্তে গভীর অরণ্যের মধ্যে চলে যাচ্ছে। ছোট একটা বাড়ির দেখা মিলল। সেখানে মিরাজুল কে উল্টো ভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। মিরাজুলকে দেখে মুনতাসিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে রাগান্বিত হয়ে চেয়ারে বসলো। হুংকার ছেড়ে বলল,

–এই দুই মাসে একশো ছাপ্পান্ন বার পিছু নিয়েছিস। বারোবার কুনজর দিয়েছিস। সাতবার খারাপ স্পর্শ করার চেষ্টা করেছিস। চারবার তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিস। তোকে নিষেধ করেছিলাম। তার পেছনে থেকে সরে যা। আমার কথা শুনিসনি। উল্টো আমার না থাকার সুযোগটা কাজে লাগাতে চেয়েছিস। তুই কি ভুলে গিয়েছিস। তুই কার সাথে লাগছিস। তোকে কি মনে করিয়ে দিতে হবে।

–তুই নিজেকে কি মনে করিস মুনতাসিম। মেহেভীন তোর সবকিছু জানার পরে তোকে পছন্দ করবে। তোর মুখে থু’তু ফেলবে। চৌধুরী পরিবারকে মেহেভীন ভিষণ ভাবে ঘৃণা করে। ঘৃণা করে মিথ্যা বলা পুরুষ জাতিকে। আমি মেহেভীনকে ভালোবাসি। মেহেভীনকে যেকোনো নজরে দেখার অধিকার আমার আছে। তুই চাইলেও আমাদের আলাদা করতে পারবি না। মুনতাসিম চেয়ার থেকে উঠে বসলো। হাত দিয়ে ইশারা করতেই একজন গার্ড এসে চা’কু, লবন, ম’রি’চ দিয়ে গেল। মুনতাসিমের কখন কি চাই গার্ডগুলোর যেন সবকিছু মুখস্থ করা। মুখ দেখলেই বুঝে যায় মানুষটার এখন কি লাগবে। মুনতাসিম মিরাজুলের দিকে এগিয়ে গেল। মুনতাসিম অদ্ভুত ভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। মুনতাসিমের এমন রুপ থেকে মিরাজুলের আত্মা গলায় উঠে আসছে। শান্ত মস্তিষ্কে মিরাজুলের কাছে গিয়ে অবস্থান করল মুনতাসিম। মিরাজুলের অধর যুগল মুহুর্তের মধ্যে ফালা ফালা করে দিল। চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে মিরাজুলের হৃদয়বিদারক চিৎকারের প্রতিধ্বনিতে পুরো কক্ষ কেঁপে উঠল। মুনতাসিম লবন আর ম’রি’চ ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দিল। সমস্ত যন্ত্রণা যেন শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। মিরাজুল জ্ঞান হারালো। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে প্রশান্তির হাসি।

–সে সজাগ হলে এক পা আর এক হাত ভেঙে দিবে। বাহিরে বের হয়ে অন্যের ফুলের দিকে কুনজর দেওয়ার সাহস যেন না পায়। সে যদি পালিয়ে যায়। তাহলে তোমাদের কে’টে কু’টি কু’টি করে লবন আর ম’রি’চ দিয়ে মাখিয়ে রোদে শুকোতে দিব। মুনতাসিমের কথার ব্যাখ্যা বুঝতে গিয়ে প্রতিটি গার্ডের হৃদয় কেঁপে উঠল। তারা ভয়ংকর কিছুর আভাস পাচ্ছে। সামনে ভিষণ রকমের খারাপ কিছু হতে চলছে। তাইয়ান ভয়ে জমে গিয়েছে। শরীর টা যেন টানছে না। এতগুলো বছর মানুষটার সাথে থেকেও মানুষটাকে বুঝতে পারল না সে। মুনতাসিমের এমন পাষণ্ড রুপ দেখলে তার কান্না করতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীতে সে-ই একমাত্র ছেলে। যে কি-না ভয় পেলেই মেয়েদের মতো কান্না করে দেয়। এতে মুনতাসিম তাইয়ানের প্রতি বেশ বিরক্ত। কেন যে তাইয়ানের মতো বোকা ছেলেকে তার ব্যক্তিগত গার্ড হিসেবে রাখা হয়েছে।

–স্যার আপনি আমার মাথাটা কবে কা’টবেন? মুনতাসিমের মেজাজ এমনিতেই প্রচন্ড খারাপ ছিল। তাইয়ানের কথায় সে বিলম্ব করল না। দ্রুত তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিমের আঁখিযুগলের দিকে তাকিয়েই তাইয়ান শেষ। মুনতাসিম এক পা ফেলার আগেই তাইয়ান হওয়ার মতো মিলিয়ে মুনতাসিমের পায়ের নিচে চলে আসলো।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-১০+১১+১২

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_১০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

প্রাকৃতিক শীতল বাতাস এসে মেহেভীনের শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে। মেহেভীন এক কাপ কফি নিয়ে বেলকনিতে আসলো। কিরণ ছড়িয়ে দেওয়া চাঁদটাকে গ্রাস করে নিয়েছে, এক টুকরো কালো মেঘের দল। মেহেভীন আঁখিযুগল বন্ধ করে বাসতের আলিঙ্গন অনুভব করছে। তখনই দক্ষিণ পাশে থেকে ডাক দেয়।

–একা একা কপি খাচ্ছেন ম্যাডাম।

–আমার মতো কফি খেতে চান।

–জি।

–তাহলে নিজের বাসায় বানিয়ে খান। কথা গুলো বলেই হাসোজ্জল মুখশ্রী খানা আড়াল করে নিল। মুনতাসিম হতভম্ব হয়ে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। আর মনে মনে বলছে আচ্ছা বজ্জাত মেয়ে তো। কোথায় সে ভাবল মেহেভীন তাকে কফির নিমন্ত্রণ করবে। তা-না করে উল্টো অপমান করে দিল। মুহুর্তের মধ্যে মুনতাসিমের মুখটা থমথমে হয়ে গেল। যেন রজনীর সব আঁধার তার মুখশ্রীতে ঘনিয়ে আসছে। মুনতাসিমকে নিরব হয়ে যেতে দেখে, মেহেভীন উৎসুক দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে আঁড়চোখে তাকাল। মুনতাসিমকে মুখটা গম্ভীর করে রাখতে দেখে, মেহেভীন বলল,

–আপনি রাগ করলেন?

–আমার আবার রাগ আছে।

–তাহলে চুপ হয়ে গেলেন যে!

–আপনাকে বলব কেন?

–সেটাই তো আমাকে বলবেন কেন। কথা গুলো বলেই মেহেভীন কক্ষের মধ্যে চলে আসলো। হঠাৎ মেহেভীনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। বিষাদ এসে ক্ষণে ক্ষণে রাজত্ব চালাতে লাগলো। একটু পরেই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। রুপা টিভি দেখছিল তার কাজে ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্ততে মুখশ্রী কুঁচকে গেল। দরজা খুলে মুনতাসিমকে দেখে মুখটা গম্ভীর করে ফেলল। কিছুটা থমথমে কণ্ঠে জবাব দিল,

–এত রাতে আপনার কি চাই? আজকে আবার আপনার কি ফুরিয়ে গিয়েছে। রুপার কথায় মুনতাসিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। মেয়েটার বেশি কথা বলাই মুনতাসিম সহ্য করতে পারে না। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টায় মেতে উঠেছে। বুকে ভরা হাহাকার আর অস্থিরতা নিয়ে বলল,

–তোমার আপাকে ডেকে নিয়ে আসো।

–এতরাতে আপাকে ডাকা যাবে না। আপা আমাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেছে।

–শুনো মেয়ে যা বলছি তাই কর। আমার কথা না শুনলে ফলাফল ভালো হবে না বলে দিলাম।

–আপনার কথা না শুনলে কি করবেন আপনি! রুপার এক একটা কথা মুনতাসিমের হৃদয়ে কাঁটার মতো বিঁধছে। প্রেয়সীর রাগ ভেতরটা ছারখার করে দিচ্ছে। প্রেয়সীর মলিন মুখ খানা মৃ’ত্যু যন্ত্রনার থেকে-ও বেশি যন্ত্রনা দেয়। মুনতাসিম নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে, নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে নিজের হাত দেওয়ালে সাথে বাড়ি মা’র’ল। মুনতাসিমের ফর্সা মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। মুনতাসিমের ভয়ংকর রুপের সাথে পরিচিত হয়ে, রুপার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো। থরথর করে কাঁপছে রুপা। শান্ত কণ্ঠে কথা বলা মানুষটার হঠাৎ করে কি হলো। মুনতাসিম পর পর আরো চারটে বা’ড়ি মা’র’ল। তা দেখে রুপা দৌড়ে মেহেভীনের কক্ষে গেল। মেহেভীনকে সবকিছু খুলে বললে, মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে ছুটে এল। ড্রয়িং রুমে এসে স্তব্ধ হয়ে গেল। মুনতাসিম শান্ত নদীর ন্যায় সোফায় বসে আছে। মেহেভীন রুপার দিকে দৃষ্টিপাত করল। রুপার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ এখনো স্পষ্ট। রুপার ভয়ার্ত চেহারা বলে দিচ্ছে রুপা মিথ্যা কথা বলেনি। কিন্তু মনুতাসিমের এমন শান্ত হয়ে থাকাটা অন্য কথা বলছে।

–আপনি নাকি নিজের হাতে প্রহার করছেন? মেহেভীনের কথায় বুকটা শীতল হলো। মস্তিষ্ক সজাগ হলো। মনের গহীনে থেকে কিছু শব্দ ভেসে এল। ভুল জায়গায় এসে ভুল কাজ করে ফেলছিস মুনতাসিম। একদিন তোর এই বিশ্রী রাগ আর রাগের মাথায় করা জঘন্য ব্যবহার কারনে তুই তোর সবকিছু হারিয়ে ফেলবি। কি এমন ক্ষতি হতো যদি নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করা শিখে নিতি। মুনতাসিম সত্য আড়াল করে গেল না। সহজ-সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে বলল,

–জি আমি নিজেকে প্রহার করেছি।

–কেন করেছেন?

–আপনার বোনকে আমি বললাম আপনাকে ডেকে দিতে, কিন্তু সে আমার মুখে মুখে তর্ক করছিল। সেটা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। কেউ আমাকে রাগিয়ে দিলে, আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। অন্যের ক্ষতি কখনোই আমার দ্বারা সম্ভব নয়। সেজন্য নিজের ক্ষতি করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করি। মেহেভীন বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মানুষটা কিন্তু অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষ। কি সুন্দর রুপাকে তার বোন বলে সম্মোধন করল! তার জায়গায় হলে অন্য কেউ ঠিক কাজের মেয়ে উল্লেখ করত। আমরা রাগে বশিভূত হয়ে অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা করি আর মুনতাসিম অন্যের ক্ষতি করবে না বলে, সে নিজের ক্ষতি নিজে করে। মানুষটাকে বাহবা না দিয়ে পারছে না মেহেভীন। সে মানুষটা রাগের মাথায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে৷ তার মতো অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষ দু’টো নেই। মুনতাসিমের ব্যবহারে মেহেভীন মুগ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তা বাহিরে প্রকাশ করল না। সে গম্ভীর মুখশ্রী করে জবাব দিল,

–এত রাতে আমাকে আপনার কিসের জন্য প্রয়োজন?

–আপনি কি আমার ওপরে রাগ করছেন?

–আপনি কি আমার ভালোবাসার মানুষ!

–মানে?

–মানুষ যাকে ভালোবাসে তার ওপরে রাগ করে। আপনি কি আমার ভালোবাসার মানুষ যে, আমি আপনার ওপরে রাগ করতে যাব৷ এভাবে যখন তখন আমাদের বাসায় আসবেন না। আমরা দু’জন মেয়ে একসাথে বাসায় থাকি। রাতের বেলায় একটা পুরুষ মানুষ আসাটা সবাই সহজ ভাবে নিবে না। আপনার কোনো প্রয়োজন থাকলে সকালে আসবেন।

–এভাবে কথা বলছেন কেন আমার সাথে? আপনি সত্যি আমার ওপরে রাগ করেছেন। আপনি অনুগ্রহ করে আমার ওপর রাগ করে থাকবেন না। আপনি রাগ করে থাকলে আমি ভেতর থেকে জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাব। এভাবে অপরাধের আগুনের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মা’র’বে’ন না। আপনার রাগ আমাকে ভিষণ ভাবে পোড়ায়। আমার বুকের কাছে এসে কান পেতে দেখুন। আপনার রাগ দেখে বুকটা কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে। ভিষণ যন্ত্রনা করছে। বুকের বা পাশে চিনচিন করে ব্যথা করছে। অদ্ভুত ভাবে মুনতাসিমের প্রতি মেহেভীনের মনের গহীনে মায়া কাজ করতে লাগলো। মানুষটার কথার মধ্যে জাদু আছে। প্রতিটি কথায় কেমন আসক্ত হয়ে পড়ছে মেহেভীন। নেশার থেকে-ও বেশি ভয়ংকর মানুষটার কথা। পাথরের ন্যায় কঠিন হৃদয়টা কোমল হতে শুরু করছে। মানুষটার কথা গুলো তাকে খুব করে টানছে। এই প্রথম কেউ মেহেভীন মেহেভীনের রাগকে এতটা প্রাধান্য দিল। সে তো সাধারণ একটা মানুষ। তার রাগকে এত অসাধারণ ভেবে কঠিন ভাবে নেওয়ার কি আছে।

–আশ্চর্য! আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন? আমার রাগ আপনাকে কেন পোড়াতে যাবে। আমি আপনার জীবনের তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই। মেহেভীনের কথায় হালকা হাসলো মুনতাসিম। মেহেভীন আরেক দফা মুগ্ধ হলো। পুরুষ মানুষের হাসি বুঝি এত সুন্দর হয়! কই আগে কখনো কাউকে গভীর ভাবে এতটা পর্যবেক্ষণ করেনি। তবে আজ তাহলে এই মানুষটাকে এতটা মুগ্ধ হয়ে কেন দেখছে সে। মানুষ টা হাসলে ভিষণ সুন্দর লাগে। মানুষটা হাসলে তার সাথে পুরো ধরনী হাসে। মানুষকে আগে কখনো হাসতে দেখেনি সে। অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে মেহেভীনের সমস্ত শরীরে। আনন্দ লাগছে ভিষণ মানুষটার বিরক্ত করা। সারাক্ষণ জ্বালানো তার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেহেভীনের এক টুকরো সুখের মাঝে মুহূর্তের মধ্যে বিষাদ নেমে এল।

–আসলে কেউ আমার ওপরে রাগ করে থাকলে, আমার ভেতরে খুব লাগা কাজ করে। আমি সেটা সহ্য করতে পারি না। আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে, আমি এই একই কাজ করতাম। তখন আমি মজা করেছি। আমার কথায় দুঃখ পেয়ে থাকলে, আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। মেহেভীনের মুখশ্রীতে দেখা গেল হতাশার ছায়া। সে কি ভেবেছিল আর কি হলো। মনটা মুহুর্তের মধ্যে খারাপ হয়ে গেল। এতক্ষণ সামান্য অভিমান হয়েছিল। এখন সত্যি সত্যি রাগ হয়ে গিয়েছে। মেহেভীন রাগ করিনি বলেই নিজের কক্ষ চলে গেল। মুনতাসিম আচমকা একা একা হাসতে হাসতে চলে গেল। রুপা বোকার মতো দু’জনের কান্ড দেখে ভাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ঘড়ির কাঁটায় রাত সাড়ে বারোটা ছুঁই ছুঁই। আয়মান আর প্রাপ্তি ড্রয়িং রুমে বসে আছে। হয়তো নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করছে। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। প্রাপ্তি কেমন ছটফট করছে। আয়মানও অস্থির হয়ে উঠেছে। দু’জন এখনো পুরোপুরি ভাবে সুস্থ হয়ে উঠেনি। সবকিছুর জন্য প্রাপ্তি মুনতাসিমকে দায়ী করেছে। কিন্তু আয়মান সহ পরিবারের সকলে মানতে নারাজ যে, মুনতাসিম এমন জঘন্যতম কাজ করতেই পারে না। বাড়ির ছেলে হয়ে নিজের বাড়ির ছেলে আর বউকে আহত করবে। এমন মন মানসিকতা মুনতাসিমের নেই। কিন্তু প্রাপ্তি কেন জানি মনে হয়। এই যে তারা ব্যথা পেয়েছে। সেটা মুনতাসিমই করিয়েছে। এই এলাকায় কার এত বড় সাহস যে, চৌধুরী বাড়ির ছেলের গায়ে হাত দিবে। সবকিছু মিলিয়ে এক করতে পারলেও প্রমাণের অভাবে মুনতাসিমকে দোষী প্রমাণ করতে পারছে না। রাতের শেষ প্রহর চলে এসেছে। তখনই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। প্রাপ্তি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। আয়মান ও সজাগ হলো। প্রাপ্তি গিয়ে দরজা খুলে নির্দিষ্ট মানুষকে চক্ষের সামনে দেখতে পেয়ে মানুষটাকে আলিঙ্গন করল। দু’জনের চোখেই অশ্রুকণা এ যেন শত বছরের ভালোবাসা জমে আছে। মানুষটাকে পেয়ে প্রাপ্তি খুশির শেষ নেই। আহ্লাদে আটখানা হয়ে গিয়েছে প্রাপ্তি। ভাই বোনের মিলন দৃশ্য দেখে আয়মানের বুকটাও প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। মেয়েটা যতই খারাপ হোক এ বাড়িতে আসার পর থেকে, মানুষের অবহেলা আর লাঞ্ছনা পেতে পেতেই দিন গিয়েছে বেশি। কথার আঘাতে হয়েছে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। নিজের প্রিয়তমার মুখশ্রীতে এক টুকরো হাসি তুলে দিতে পেরে, নিজেকে ধন্য মনে করছে আয়মান।

–তোমাকে কতদিন পর দেখলাম ভাইয়া। আমি তোমাকে আর বিদেশে যেতে দিব না৷ বাবা-মায়ের কাছে তোমাকে যেতে হবে না৷ তুমি সব সময় আমার কাছে থাকবে। তোমাকে আমি আমার চক্ষের সাথে সব সময় দেখতে চাই। তোমার মতো করে আমাকে কেউ বুঝে না ভাইয়া। আমাকে আর একা করে দিয়ে চলে যেও না। তুমি আমার শক্তি ভাইয়া। আমার একমাত্র ভরসা তুমি।

–কাঁদছিস কেন বোন। তোর ভাই তোর কাছে চলে আসছে। আমার এই দেহে রক্ত থাকা অবস্থায় তোকে আর কষ্ট পেতে দিব না। আমি জানি আব্বু আম্মু আমার ওপরে কি কারনে রাগ করে আছে। আমি মেহেভীনের সাথে যে কাজটা করেছি। তা সত্যি অত্যন্ত জঘন্যতম কাজ। জানিনা কোন মুখ নিয়ে মেহেভীনের সামনে যাব। তবুও মেহেভীনের থেকে আমার ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। চাচা চাঁচি আমাকে হয়তো আর আগের মতো ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু এবার আমি যোগ্য হয়ে এসেছি। আমি যে অন্যায় করেছি মেহেভীনকে বিয়ে করে, সেই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করব। ভাইয়ের কথায় জ্বলে উঠলো প্রাপ্তি। বিস্ময় নয়নে ভাইয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। বিদেশ থেকে এসে তার ভাইয়ার মাথা টা খারাপ হয়ে গিয়েছে। নাকি চাচা চাঁচি ফোন দিয়ে তার ভাইয়ের মস্তিষ্ক সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলছে। তার ভাই দেশে আসার পরেও ঠিক ছিল। হঠাৎ করে তার কি এমন হয়ে গেল৷ যে সে মেহেভীনের মতো মেয়েকে বিয়ে করবে। সে থাকতে এটা কখনোই হতে দিবে না। প্রাপ্তির সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। আয়মান ও মুখটা গম্ভীর করে ফেলল। মুহুর্তের মধ্যে পরিবেশটা শীতল হয়ে উঠলো। নিস্তব্ধতার রেশ চারিদিকে ঘিরে ধরেছে। পিনপতন নিরবতা চলছিল। এমন সময় খট করে আওয়াজ হলো।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_১১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

কোলাহলে পরিপূর্ণ পরিবেশ। সরকারি হাসপাতালে শতশত রোগীদের আনাগোনা। প্রতিটি মানুষই সুস্থভাবে শান্তিতে বাঁচতে চায়। অসুস্থ জীবন কাটাতে কে-ই বা পছন্দ করে। অসুস্থতা মানুষের মনকে করে বিষাদগ্রস্ত। বিষন্নতা নিয়ে পড়ে থাকতে হয় হাসপাতালের বেডে। আত্নীয় স্বজদের মাঝে বিষাদের আহাজারি। সব ভালোর মধ্যেই খারাপ লুকিয়ে থাকে। মানুষ অভাবের তাগিদেই সরকারি হাসপাতালে আসে।

–আমার মাকে কাল রাতে স্যালাইন করার কথা ছিল। আপনারা এখনো স্যালাইন করেন নাই কেন?

–আপনাকে কাল রাতেই বলেছি। আমাদের এখানে স্যালাইন শেষ হয়ে গিয়েছে। আপনি বাজার থেকে স্যালাইন কিনে নিয়ে আসুন।

–আপনি মিথ্যা কথা বলছেন কেন? সরকার তো ঠিকি ঔষধ, রোগীদের বেড, যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেয়। কালকেই গাড়ি এসে স্যালাইন দিয়ে গেল। এক রাতের মধ্যেই সবকিছু শেষ হয়ে গেল। মানুষের জীবন নিয়েও আপনাদের দুর্নীতি করতে হয়। আমি কিন্তু আপনাদের আপনাদের নামে বিচার দিব। তখন বুঝতে পারবেন। মাসে কয়দিন যায় আর দিনে কয়দিন যায়। টাকা দিয়ে স্যালাইন কেনার জন্য তো সরকারি হাসপাতালে আসি নাই।

–কাল রাত থেকে বেশি কথা বলছেন। আপনার গলায় এত জোড় আছে। আপনি আপনার মাকে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করালেই পারেন। স্যালাইন নাই মানে স্যালাইন নাই। বেশি সমস্যা সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে, আপনার মুখ বন্ধ করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। কথা গুলো বলেই নার্স চলে গেল। আরিফ তার অসুস্থ মাকে নিয়ে চিকিৎসা করাতে সরকারি হাসপাতালে এসেছিল। কালকে সে নিজের চক্ষে দেখেছে। ঔষধের গাড়ি এসে সবকিছু দিয়ে গিয়েছে। রোগীদের জন্য কতগুলো নতুন বেডও নিয়ে এসেছিল। এরা এক রাতের মধ্যে সবকিছু কোথায় গায়েব করে দিল! সরকার তো ঠিকি তার দায়িত্ব পালন করছে। রোগীদের জন্য যা যা প্রয়োজন সবকিছু পাঠিয়ে দিচ্ছে। আর এরা সরকারের দেওয়া জিনিস রোগীদের না দিয়ে নিজেরা আত্মসাত করে খাচ্ছে। নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না আরিফ। সে জীবনের মায়া করে না। আজ গরীব ঘরে জন্ম নিয়েছে বলেই, সরকার হাসপাতালে এসেছিল। বড়লোক হলে নিশ্চই মাকে বড় কোনো প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাত।

দু’দিন পরে ঝড়ের গতিতে মেহেভীন আসলো হাসপাতালের সামনে। সে বিলম্ব করল না দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে, হাসপাতালের সামনের বড় দোকানটায় চলে গেল। ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখেই ভেতরটা শুকিয়ে কাট হয়ে যায় ইবরাহীমের। ভয়ে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়েছে। বুদ্ধিরা জোট বেঁধে পালিয়েছে। শরীর রীতিমতো কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছে। মেহেভীন গাড়ি থেকে নেমে দোকানদার ইবরাহীমকে ঔষধ দেখাতে বলল। মেহেভীন ও তার সহযোগীকে একটা একটা করে ঔষধ বের করে দেখাতে লাগলো। আশেপাশে বাজারের মধ্যে কানাকানি হয়ে গেল। বাজারের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট প্রবেশ করছে। দুই একজন বাদে সবাই দোকান বন্ধ করে পালিয়ে চলে গেল।

–আমরা খবর পেয়েছি আপনারা বেআইনি ভাবে ঔষধ বিক্রি করেন। আপনার দোকানের সব ঔষধ আমাদের দেখাবেন। কোনো রকম চালাকি করার চেষ্টা করলে, ফলাফল ভালো হবে না। যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন। তাহলে আগেই স্বীকার করে নিন। আমরা আপনার বিষয়টা ভেবে দেখব। মেহেভীনের কথায় ভেতরটা ভয়ে কাবু হয়ে আসলো ইবরাহীমের। তবুও সে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে গা-ছাড়া জবাব দিল,

–আপনি আমার পুরো দোকান চেক করে দেখতে পারেন ম্যাডাম। আমি আপনাকে একশো পারসেন্ট নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি। আপনি আমার দোকানে ভেজাল মেশানো কোনো কিছুই পাবেন না।

–সেটা আপনি বললেও আপনার দোকান আমরা তল্লাসি নিব। না বললেও নিব। আপনি দোকানের প্রবেশ দরজা খুলে দিন। আমার লোক গিয়ে তল্লাসি করবে। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে অস্থির হয়ে উঠলো ইবরাহীম। ফ্যানের নিচে থেকে-ও তরতর করে ঘামছে। ইবরাহীমকে বিলম্ব করতে দেখে, মেহেভীন কঠিন কণ্ঠে দরজা খুলতে বলল। ইবরাহীম দ্রুত দরজা খুলে দিল। ভেতরে তল্লাসি চলছে। ইবরাহীম মেহেভীনকে ঔষধ দেখাচ্ছে। মেহেভীন কয়টা ঔষধের মধ্যে ভেজাল দেখতে পেল। বেশিরভাগ ঔষধের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। সেগুলো তারা নিজেদের মতো সিল বসিয়ে নতুন বলে বিক্রি করছে। তখনই মেহেভীনের সহযোগী বলল,

–ম্যাডাম ঔষধের দোকানের পেছনে গুপ্ত দরজার সন্ধান পেয়েছি। তালা লাগানো আছে। কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই ইবরাহীমের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পর্শ হয়ে উঠল। সে দ্রুত পালানোর চেষ্টা করতে চাইছে। কিন্তু তার পথ সবদিকে বন্ধ। মেহেভীন তাকে নিয়েই গুপ্ত দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। সেখানে বিভিন্ন রকমের ঔষধ দেখতে পেল। সেগুলো মূলত সরকারি হাসপাতালের। রোগীদের তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তারা বেআইনি ভাবে রোগীদের হোক বিক্রি করে খাচ্ছে। মেহেভীন হাতের কাছে কিছু পাতা দেখতে পেল। সেখানে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য দেখতে পেল। মেহেভীন গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,

–গাঁ’জা কে খায়?

–ম্যাডাম আমি জানিনা। হাসপাতাল থেকে তিনদিন আগে আমাকে যেসব ঔষধ দিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো এখানে রেখেছি। এসব মাদকদ্রব্য কোথায় থেকে আসলো জানিনা।

–আমাকে আপনার ছোট বাচ্চা মনে হয়। আপনারা রীতিমতো রোগীদের জীবন নিয়ে খেলা করছেন। সরকারেন নাম খারাপ করছেন। এভাবে জনগনকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়ার কোনো অধিকার আপনাদের নেই। আপনারা মেয়াদ উত্তীর্ণ ঔষধ কেন বিক্রি করছেন। আপনারা জানেন এসব ঔষধ সেবনের ফলে, রোগী মৃ’ত্যু ঘটতে পারে। আপনাদের কোনো ধারনা আছে। সামান্য কয়টা টাকার জন্য আপনার কতটা নিকৃষ্টতম কাজ করছেন। সত্যি করে বলুন এসব মাদক কে সেবন করে। সরকারি ঔষধ গুলো কে দিয়ে গিয়েছে আপনাকে। মুখ খুলুন বলছি। আমি রেগে গেলে আপনার এমন অবস্থা করব। সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে পারবেন না। মেহেভীনের কথায় কেঁপে উঠলো চারপাশ। শীতল হয়ে গেল পরিবেশ। আশেপাশে মানুষ জড় হয়ে গিয়েছে। দুই ঘন্টা ধরে তল্লাসি নিয়েছে তারা। ইবরাহীন আর বাকরুদ্ধ থাকতে পারল না। সবকিছু বলতে শুরু করল,

–আমার ভুল হয়ে গিয়েছে ম্যাডাম। আমাকে মাফ করে দিন। আমাকে একটা সুযোগ দিন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি। আমি আর কখনো বেআইনি ভাবে ঔষধ বিক্রি করব না। সব সময় সৎ পথে চলব। শেষ বারের মতো একটা সুযোগ দিন ম্যাডাম। মাদকদ্রব্য আমি সেবন করি। আমি নে’শা’য় আসক্ত ম্যাডাম। মেহেভীনের মুখশ্রীতে বিরক্তি ফুটে উঠেছে। রাগে পুরো শরীর কাঁপছে। আমরা মানুষই মানুষের শত্রু। মেহেভীন বের হয়ে আসতে চাইলে, ইবরাহীম মেহেভীনের পায়ের কাছে বসে যায়। সবাই তাকিয়ে দেখছে আর হাসছে। মেহেভীন বাহিরে বের হয়ে সহযোগীকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–তার দুই লক্ষ টাকা জরিমানা ধরুন আর ছয় মাসের জন্য দোকানটাকে সিল করে দিন। ছয় মাসের মধ্যে দোকানের আশেপাশে কেউ যেন না আসে। কথা গুলো শেষ হবার সাথে সাথে গাড়িতে গিয়ে বসল। ভেজাল মেশানো ঔষধ গুলো বাহিরে নিয়ে আসা হয়েছে। পুলিশ এসে ইবরাহীমকে ধরে নিয়ে চলে গেল। যে নার্সটা আরিফের সাথে বাজে ব্যবহার করেছিল। তাকেও মহিলা পুলিশের সাথে দেখা গেল। মেহেভীন অপেক্ষা না করে বাজারের মধ্যে দিয়ে চলে গেল।

মেহেভীনের রণচন্ডী মুখশ্রী কারো হৃদয়ে ঝড় তুলে দিয়েছে। এত ভিরের মাঝে আঁখিযুগল মেহেভীনেতে আঁটকে গিয়েছে। সে মেহেভীনকে চিনেনা। তার হৃদয় বলছে এই রমনীকে তার চাই। তার হৃদয়ের রাণী হিসেবে মেহেভীনকে চাই। সে মেহেভীনকে অনুসরণ করতে লাগল। খাঁ খাঁ রৌদ্রের মধ্যে মেহেভীন বেড়িয়েছিল। বাসার বাজার নেই বললেই চলে। বাজার করার জন্য নেমেছিল। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে। ফর্সা মুখশ্রী লাল হয়ে গিয়েছে। মেজাজ বিগড়ে আছে তার। তখনই মেহেভীনের পাশে এসে দাঁড়াল মুনতাসিম। মুনতাসিনকে দেখেই অদ্ভুত ভাবে মেহেভীনের উত্তপ্ত হৃদয়টা শীতল হয়ে গেল। সমস্ত বিরক্তি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মানুষটাকে বোধহয় আল্লাহ তায়ালা মুগ্ধতা দিয়ে তৈরি করেছে। মানুষটা তার কাছে আসলেই চারিদকে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠেছে। বিষাদগ্রস্ত মনটা মুহুর্তের মধ্যে ফুরফুরে হয়ে গেল। মেহেভীনকে বাজারের ব্যাগ হাতে নিতে দেখে বলল,

–আমি থাকতে আপনি এত কষ্ট করছেন কেন ম্যাডাম? এই কথাটার মধ্যে একটা অন্যরকম জাদু ছিল। কথাটা কর্ণকুহরে আসতেই হৃদয়ের গহীনে প্রশান্তি দোল খেলে গেল। কত সুন্দর বাক্য আমি থাকতে কষ্ট করছেন কেন ম্যাডাম! যত দিন যাচ্ছে মানুষটার প্রতি ততই মুগ্ধ হচ্ছে মেহেভীন। চাইলেও এই মানুষটার সামনে সে রাগ করতে পারে না। রাগ গুলো যেন আপস মেনে নিয়েছে। তারা কিছুতেই এই মানুষটাকে কষ্ট দিবে না। ললাট বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। মেহেভীন নিজের ওড়না দিয়ে মুখশ্রী মুছে হেসে জবাব দিল,

–সমস্যা নেই আমার লোক আছে।

–আপনি চাইলে আপনার সহযোগী হিসেবে, আমাকেও রাখতে পারেন। ছায়ার মতো আপনার সাথে থাকব।

–ফ্লার্ট করছেন।

–এটা যদি আপনার ফ্লার্ট মনে হয় তাহলে তাই। আপনি যা বলবেন তাই মঞ্জুর মহারাণী। মেহেভীন এবার শব্দ করে হেসে উঠলো। মেহেভীনের হাসির প্রতিধ্বনিতে চারপাশে মুখরিত হয়ে গেল। মেহেভীনের হাসির সাথে মুগ্ধতা ঝরে ঝরে পড়ছে। মুনতাসিম বুকে হাত রেখে মনে মনে বলল, এই মেয়েটা আমাকে আজকে একদম খু’ন করে ফেলবে। এভাবে কেউ হাসে! ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়েছে গিয়েছে আমার। ভেতরটা ছটফট করছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি আমি। এভাবে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিলে, নিজেকে আমি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করব। এত সহজে ধরা পড়তে চাই না আমি। মেয়েটা আমাকে একদম শেষ করে দিল। আজকে আমি শেষ।

–এভাবে হাসবেন না ম্যাডাম প্রেমে পড়ে যাব। আমি নিতান্তই ভালো ছেলে। এসব প্রেম পড়ার লোভ আমার নেই। এভাবে হেসে লাভ নেই। আমি আপনার প্রেমে পড়ব না।

–আমার প্রেমে পড়ার মানুষের কি অভাব আছে।

–প্রেমে পড়ার মানুষের অভাব নেই। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের অভাব আছে। দু’দিনের জন্য প্রেমে সবাই পড়তে জানে। কিন্তু ভালোবেসে আগলে রেখে, সারাজীবনের দায়িত্ব সবাই নিতে পারে না মেহেভীন। প্রেমে ফেলে প্রেমিকা বানানোর যোগ্যতা প্রতিটি পুরুষই রাখে। কিন্তু নারীকে ভালোবেসে নিজের প্রেমিকাকে বউ বানানোর যোগ্যতা সব পুরুষ রাখে না। এক দুই বছরের জন্য প্রেম করে দুই বছর পর তাকে ছেড়ে দিব। এমন প্রেম আমি করি না। ভালোবাসলে তাকে এমন ভাবে ভালোবাসবো। যেন সারাজীবন আমার কাছে আগলে রাখতে পারি। তার সাথে বসে তার কাঁধে মাথা রেখে শত-শত প্রহর জেগে, নির্ঘুম রজনী পার করে দিতে পারি। তার বুকে মাথা রেখে গভীর আলিঙ্গন করে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যেতে পারি। সে আর আমি যেন মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ হতে পারি। বৃদ্ধ বয়সে একে অন্যের লা’ঠি হতে চাই। একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই। তার সাথে অনন্ত কাল কাটাতে চাই। তার প্রতি আমার মুগ্ধতা কখনো হারাবে না। তাকে দেখার তৃষ্ণা আমাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়াবে। বিয়ের ষাট বছর পরে-ও যেন তাকে বলতে পারি। এভাবে কেউ হাসে ম্যাডাম আপনি হাসলে আমি পাগল হয়ে যাই। মুনতাসিনের কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল মেহেভীন। মুনতাসিমের মুখে প্রথম নিজের নাম শুনে হৃদয় কেঁপে উঠল। শান্ত হৃদয়টা হয়ে উঠলো অশান্ত। হৃদয়ের গহীনে উথাল-পাতাল ঢেউ খেলতে শুরু করে দিয়েছে। মানুষটার প্রতিটি দিন দিন সন্মান আর শ্রদ্ধা বেড়েই চলেছে। মানুষটার চিন্তা ধারা কতটা সুন্দর। সেজন্য বোধহয় মেহেভীন তাকে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষ বলে উপাধি দিয়েছে। মানুষটা তার কথার মধ্যে দিয়ে মেহেভীনের সব শক্তি শুষে নেয়। নিস্তেজ করে দেয় তেজী শরীর খানা। নিষ্পলক চাহনিতে মুনতাসিমের দিকে তাকিয়ে আছে। মুনতাসিম মেহেভীনের হাত থেকে ব্যাগ গুলো নিয়ে বলল,

–এভাবে তাকাবেন না ম্যাডাম প্রেমে পড়ে যাবেন। এভাবে একা একটা পুরুষকে পেয়ে আঁখিযুগল দিয়ে, গিলে খাচ্ছেন। আমার বুঝি সন্মান নেই। আমার কথাটা একটু ভাবুন ম্যাডাম। আমার বিয়ে-শাদি করতে হবে। এভাবে চোখ দিয়ে আমার সর্বনাশ করবেন না। আমি সমাজ মুখ দেখাতে পারব না। বলেই লজ্জা রাখা মুখশ্রী করে দুষ্টু হেসে সামনের দিকে অগ্রসর হলো৷ মেহেভীন হতভম্ব হয়ে গেল। মনে মনে বলল, কি পা’জি ছেলে রে বাবা। কিন্তু সুন্দর করে তাকে নির্লজ্জ বানিয়ে দিয়ে চলে গেল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_১২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

গোধুলী আলো মনোমুগ্ধকর পরিবেশ গড়ে তুলছে। চারদিকে শীতের আভাস জানান দিচ্ছে। আজ শুক্রবার মেহেভীন প্রতি শুক্রবারে নিজের বাসার পাশে, খোলা মাঠে গাছের নিচে থাকা বেঞ্চটায় বসে থাকে। মাঠের সাথেই আঁকাবাকা নদী। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে স্রোত ভেসে যায়। সে কি অপরূপ নদীর সেই দৃশ্য। গোধুলি আলো মেহেভীনের মুখশ্রীতে আঁচড়ে পড়ছে। মেহেভীন বসে বাচ্চাদের ফুটবল খেলা দেখছে। এই মাঠে রোজ বাচ্চারা খেলতে আসে। মেহেভীন গভীর ভাবে খেলা দেখছিল। তখনই নিজের পাশে কারো উপস্থিত অনুভব করে। পাশে তাকিয়ে দেখল মুনতাসিম। তার থেকে বেশ দুরত্ব বজায় রেখে বসেছে। মেহেভীন বাহিরে আসলে মানুষটা টের পায় কিভাবে? সেটাই মেহেভীনের মাথায় আসে না।

–আপনাকে আজকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে ম্যাডাম।

–কেন আমার রুপ কি আগের থেকে বেশি হয়ে গিয়েছে। যার কারনে আজকে আমাকে একটু বেশি সুন্দর লাগছে।

–আপনার রুপ বেশি হয়নি। এটা আমার দৃষ্টির দোষ আমার দৃষ্টি রোজ আপনাকে নতুন ভাবে দেখে, নতুন ভাবে জানে, নতুন করে বোঝার চেষ্টা করে। আপনিতে পুরাতন বলতে কিছুই নেই। মুগ্ধতার আরেক নাম আপনি। আপনি রোজ দেখি আর রোজ নতুন করে তৈরি করি। আমার দৃষ্টি যে আপনিতেই সীমাবদ্ধ। তাই আপনিতেই নতুনত্ব খোঁজার প্রচেষ্টায় থাকি সারাক্ষণ।

–একটা মানুষের পেছনে সারাক্ষণ আঠার মতো লেগে থাকেন। বিরক্ত হন না!

–বিরক্ত হব না। তবে হঠাৎ করে না জানিয়ে একদিন থেমে যাব। সেদিন চাইলেও আর বিরক্ত করা মানুষ টাকে খুঁজে পাবেন না। সে চলে যাবে আপনার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। মেহেভীনের বুকটা হঠাৎ করে মোচড় দিয়ে উঠল। ভেতরে অদ্ভুত এক শূন্যতা অনুভব করল। মস্তিষ্ক থম মে’রে গিয়েছে। কাজ না করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে সে। মেহেভীনকে স্থীর হয়ে যেতে দেখে মুনতাসিম শীতল কণ্ঠে বলল,

–চুপ করে গেলেন যে ম্যাডাম!

–আজকে আমাকে সত্যি করে একটা কথা বলবেন? আপনি সামনে থেকে যা দেখান, সেটাই আপনি নাকি আপনার ভেতরে অন্য কোনো রহস্যময় চরিত্র বসবাস করছে। আমি একটা জিনিস প্রায় খেয়াল করি। আপনার আশেপাশে কিছু লোক সব সময় আপনাকে ঘিরে রাখে। তারা যেন আপনাকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করছে। কে আপনি? তারা কেন আপনাকে ঘিরে রাখে?

–আমার প্রেমে পাগল হয়ে যাননি তো ম্যাডাম। ভর সন্ধ্যা বেলায় কি সব ভুলভাল বকছেন! আশেপাশে নানা রঙবেরঙের মানুষ চলাচল করে। কে আমার আশেপাশে আছে। সেটা তো আমি জানিনা। আপনি কাকে নাতে কাকে দেখে, আমাকে দোষারোপ করছেন। আমি নিত্যান্তই একজন সাধারণ মানুষ। আমাকে রক্ষা করার জন্য আমার আল্লাহ আছেন।

–আমাকে আপনি বোকা পেয়েছেন! তাই বলে একই মানুষ সারাক্ষণ আপনার আশেপাশে ঘুরঘুর করবে। নাকি আপনার মনে হচ্ছে আমি মিথ্যা কথা বলছি। আপনাকে আমার প্রচুর সন্দেহ হয়। পৃথিবীতে এত এত মানুষ থাকতে, আপনি কেন শুধু আমার পেছনেই পড়ে থাকেন বলেন তো। আশা করছি আজকের পর থেকে আপনার সাথে আমার আর কোনো কথা হবে না। মেহেভীনের কথায় বুকটা ব্যথায় চিনচিন করে উঠল। মনের অন্তরালে হাহাকার শুরু হয়ে গিয়েছে। মনের শহরের অলিতে-গলিতে বিষাদের মিছিল শুরু হয়ে গিয়েছে। মেহেভীন বিলম্ব করল না। মুহূর্তটাকে বিষাদে পরিপূর্ণ করে দিয়ে স্থান ত্যাগ করল। সে দোষও দিল আবার দুঃখও দিল! মুনতাসিমের কেন জানি ছুটতে ইচ্ছে করল না। তার পেছনে ছুটতে ছুটতে জীবন ফুরিয়ে যাবে। তবুও মেহেভীনের মনের গহীনে নিজের নামে এতটুকু স্থান দখল করতে পারবে না। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যাচ্ছে পরিবেশ। বাচ্চারা মাঠ থেকে চলে গিয়েছে। সূর্যকে বিদায় জানিয়ে চারদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। মশার জ্বালায় বসে থাকা দুষ্কর হয়ে গিয়েছে।

মেহেভীনের বাবা-মায়ের সামনে বসে আছে আরিয়ান। দৃষ্টি তার নত। মুখশ্রীতে অপরাধবোধের ছাপ স্পষ্ট। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। কথা বলার শক্তি হারাচ্ছে সে। ভেতরটা ভয়ে কাবু হয়ে আছে। কণ্ঠনালি দিয়ে শব্দ উচ্চারিত হবার আগেই, কণ্ঠনালি কেঁপে কেঁপে উঠছে। এত বড় জঘন্যতম কাজ করার পরে-ও সে নিজের মনের ভাব কিভাবে প্রকাশ করবে? মস্তিস্ক নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। সে আজ আরিয়ানের সঙ্গ দিতে চাইছে না। তবে সে যে ভুল করেছে। সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত নিশ্চই করবে। সে বিলম্ব করল না। মেহেভীনের বাবা-মায়ের চরণের কাছে বসে, কান্নায় ভেঙে পড়ল। অনবরত ক্ষমা চেয়েই যাচ্ছে সে। ক্ষমা না করা পর্যন্ত চরণ জড়িয়ে রাখার পণ করেছে সে। পানি দুইভাগ করলে যেমন আলাদা হয় না। ঠিক তেমনই রক্তের সম্পর্কের মানুষকে কখনো আলাদা করা যায় না। এতদিনের জমানো সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, অভিমান নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেল। বরফের ন্যায় গলতে শুরু করল দু’জন মানুষের মন। তারা কি এটা জানে না। জীবনে খুব সহজে সহজ-সরল হতে নেই। কারন এই পৃথিবীতে সহজ-সরল মানুষ গুলো ভিষণ বাজে ভাবে ঠকে যায়।

–চাচা আমি জানি আমি জঘন্যতম অপরাধ করেছি। তার ক্ষমা হয়তো কখনো হবে না। তবে একটা কথা কি চাচা জানেন? ক্ষমা মানুষের মহৎ গুন। ক্ষমাশীল ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ তায়ালা ভিষণ ভালোবাসেন। আপনারা চাইলে আমাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। আবার ক্ষমা করতে না চাইলে, আমাকে আমার উপযুক্ত শাস্তি দিন চাচা। আমি এই অপরাধের বোঝা বয়ে বেড়াতে পারছি না। রজনীর শেষ প্রহরে আমার নিদ্রা ভেঙে যায়। হৃদয়টা বড্ড ছটফট করে অতীতের অপরাধের কথা স্মরন করে, আমার ভেতরটা হাহাকারে কাঁদে। আমাকে শেষ একটা সুযোগ দিন চাচা। আপনারা চাইলে আমি মেহেভীনকে বিয়ে করতে রাজি আছি। তার জন্য আমাকে যা বলবেন আমি তাই করব। ফরিদ রহমান কিছুটা গম্ভীর গলায় বলল,

–তুমি আমাদের বংশের ছেলে। তাই হয়তো এ যাত্রায় ক্ষমা পেয়ে যাবে। তা না হলে তুমি এত জঘন্যতম অপরাধ করার পরে-ও কখনো ক্ষমা পেতে না। তোমার ভাগ্য হলো আমাদের মতো একটা পরিবার পেয়েছ। তোমার লজ্জা করল না মেহেভীনকে বিয়ে করার কথা বলতে! কোন মুখে বিয়ের কথা বললে তুমি? তোমার মতো ছেলেকে পায়ের তলায় ফেলে পিষে মা’রা উচিৎ। অপমানে আরিয়ানের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করছে। এখন বি’ষ খেয়েও সহ্য করে নিতে হবে। আরিয়ান খুব সহজে দমে যাবে না। সে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।

মুনতাসিম নিজের কক্ষে বসে কিছু একটা পকেটে তুলে নিল। তখন ক্ষনিকের জন্য প্রেয়সীর উপর অভিমান হয়েছিল। সেজন্য প্রেয়সীর রাগ ভাঙানোর জন্য ছুটেনি। বাসায় আসার পর থেকে ভিষণ অস্থিরতা কাজ করছে। যন্ত্রনায় ভেতরটা ছটফট করছে। আজকাল নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। মেয়েটা তার ভালো থাকার কারন হয়ে গিয়েছে। মেয়েটাকে ছাড়া তার দম বন্ধ হয়ে আসে। সমস্ত শরীর মন জুড়ে শুধু মেয়েটারই বিচরণ। মেয়েটা নিশ্চয়ই কোনো জাদুকরী। তা না হলে তার মতো পাষাণ মানুষের হৃদয়ে দুঃখ পুরে দিতে পারে! কি মায়ায় জড়াল মেয়েটা। মনটা নিজের হয়েও ভালো থাকটা তার ওপরে নির্ভর করে। তার সমস্ত আবেগ মেহেভীনের সামনে এসে কার্যক্রম শুরু করে দেয়। মাঝে মাঝে সে ভিষণ অবাক হয়। সে আগে কি ছিল আর এখন কি হয়ে গেল! মুনতাসিমের ভাবনার মাঝেই মুঠোফোনটা বেজে উঠল। নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের নামটা ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে। মুনতাসিম মুঠোফোনটা কর্ণে ধরতেই মিরাজুল বলল,

–মুনতাসিম জানিস কি হয়েছে? তোর বন্ধু প্রেমে পড়েছে! একজন রাজকুমারী তোর বন্ধুর হৃদয়হরন করে নিয়ে গিয়েছে। তাকে দেখার পর থেকে আমি খেতে পারছি না। রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারছি না। আমার মন মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু সেই রমনীর ভাবনা। সুন্দরী রমনী আমাকে গ্রাস করে ফেলছে। আমি তার মুগ্ধতা থেকে বের হয়ে আসতে পারছি না। তুমি মেয়েটাকে আমার কাছে এনে সে। তা না হলে আমি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পরকালে গমন করব। মেয়েটার সাথে কথা বলে না পারার যন্ত্রনায় বাকরুদ্ধ হয়ে যাব। মেয়েটাকে না পাবার শূন্যতায় পাগল হয়ে শহরের অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়াব। আমার জীবনের কোনো ইচ্ছে তুই অপূর্ণ রাখিসনি। অপূর্ণতার জীবনে আমার সবকিছু পরিপূর্ণ করে দিয়েছিস তুই। শেষ বারের মতো তুমি আমাকে আমার মুগ্ধতাকে আমার কাছে এনে দে। মিরাজুলের কথায় দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিল মুনতাসিম। সে মনে মনে যা আশঙ্কা করেছিল। সেটাই হলো। সেদিন মিরাজুলই মেহেভীনকে পিছু করতে করতে এসেছিল। মুনতাসিম নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করল। চোয়াল শক্ত করে বলল,

–তুই যেটা চাইছিস। সেটা আমার পক্ষে দেওয়া কখনোই সম্ভব না। তুই তার থেকে ভালো মেয়ে পাবি। চেনা নেই জানা নেই। হঠাৎ করে একটা মেয়েকে দেখলি আর প্রেমে পড়ে গেলি। মেয়েটার সম্পর্ক খোঁজ খবর নিবি না। মেয়েটা বিবাহিত নাকি অবিবাহিত। মেয়েটা ভালো নাকি খারাপ। কোনো কিছুই তুমি জানিস না। তুই সেই মেয়ের আশা বাদ দে। আর নিজের আশেপাশে দেখে ভালো মেয়ে খুঁজে নে।

–তুই বুঝতে পারছিস না। আমার ঐ মেয়েকেই চাই। ও মেয়ে যদি আমার না হয়। তাহলে আমি কারো হতে দিব না। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তাকে ভালোবেসে যাব। তার মুগ্ধতা আমার হৃদয়ের গহীনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। আমি সেই মুগ্ধতা কিভাবে কাটিয়ে উঠব ভাবছিস। আমি থাকতে ও মেয়ে অন্য কারো হতে পারবে না মিলিয়ে নিস।

–তাহলে তোকেই সরিয়ে দেই। কি দরকার শুধু শুধু ঝামেলা রেখে। মুনতাসিনেম কথায় ক্ষোভ দেখাল। নিজের প্রেয়সীর প্রতি অন্য কারো অধিকারবোধ সহ্য হচ্ছে না তার। হারিয়ে ফেলার ভয় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে। না পেয়ে হারানোর যন্ত্রনা সহ্য করা যায়। কিন্তু পেয়ে হারানোর যন্ত্রনা সহ্য করার চেয়ে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করা ঢের ভালো। মুনতাসিম কল কেটে দিয়ে দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

মেহেভীন বেলকনিতে বসে কিছু কাগজপত্র দেখছিল। তখনই পেছনে আরো উপস্থিতি টের পায়। আজকাল মানুষটাকে চিনতে তার বেশি সময় লাগে না। মানুষটা তার আশেপাশে থাকলে অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করে। মুনতাসিম কিছুটা নম্র কণ্ঠে বলল,

–আমি আপনার পাশে বসতে পারি ম্যাডাম?

–বিকেলে আপনাকে কি বলেছিলাম। আমার কথা আপনি বুঝেননি নাকি বুঝেও না বোঝার ভান ধরছেন।

–আপনি বললেই আপনার পিছু নেওয়া ছেড়ে দিব। এত ভালো ছেলে আমি না বুঝছেন।

–কেন এসেছেন এখানে?

“যদি পারতাম আপনাকে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতাম। যেন অন্য কারো দৃষ্টি আপনার উপরে না পরে। আপনাকে হারানোর ভয়ে হতাম পাষাণ। বেঁধে রাখতাম আমার ভালোবাসার শিকলে। যেন অভিমান হলে-ও আপনি আমায় ছেড়ে যেতে না পারেন।” হতভম্ব হয়ে গেল মেহেভীন। তবে একটু সুখানুভূতি হচ্ছে হৃদয়ের গহীনে। এই যে সে রাগ করে আর মানুষটা তার রাগ ভাঙাতে চলে আসে। এই জিনিসটা মেহেভীনের ভেতরটা বেশি করে কাবু করছে। মানুষটা সব সময় এমন থাকবে তো। পরে পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে দূরে সরে যাবে না তো আবার। আমার ভিষণ ভয় হারিয়ে ফেলার ভয়। আমি মানুষকে ভিষণ ভাবে ভয় করি। তারা নির্মম ভাবে আঘাত দিয়েও অপরাধ বোধে ভুগে না।

–ছন্দটা সুন্দর ছিল না ম্যাডাম। আমার একটা বান্ধবী আমাকে পাঠিয়েছে। আমার ভালো লেগেছে। তাই আমি আপনাকে শোনালাম। মুহুর্তের মাঝে মেহেভীনের মুখশ্রী গম্ভীর রুপ ধারন করল। সে উৎসুক দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আপনার আবার বান্ধবীও আছে। ছেলে মানুষ মানেই তো চরিত্রহীন। এজন্য ছেলে মানুষকে আমার একদম বিশ্বাস হয় না। কতগুলো মানুষের সাথে এভাবে ফ্লাট করে বেড়ান। চরিত্রহীন কথাটা কর্ণকুহরে আসতেই ক্রোধে সমস্ত শরীর হুংকার দিয়ে উঠল। একজন চরিত্রবান মানুষ সব সহ্য করতে পারে। কিন্তু তার চরিত্র নিয়ে কথা বললে, কলিজায় আঘাত লাগে। মুনতাসিমের হুংকারের মেহেভীনের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। মুহুর্তের মাঝে অন্য এক মুনতাসিমকে আবিষ্কার করল মেহেভীন। এই মুনতাসিমের সাথে সে পরিচিত না। মুনতাসিম মেহেভীনের কিছুটা কাছে এগিয়ে গেল। মুনতাসিমের উত্তপ্ত গাঢ় নিঃশ্বাস সে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারছে। মুনতাসিম কিছুটা শাসানোর ভঙ্গিতে বলল,

–আমাকে মেরে রক্তাক্ত করে দিন। তবুও কণ্ঠনালি দিয়ে একটা বাক্য বের হবে না। যদি কেউ আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলে, তাহলে আমার সমস্ত শরীর দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। সেই আগুনে সানের মানুষটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে ইচ্ছে করে। আপনি এমন কিছু করবেন না মেয়ে। আপনার জ্বালিয়ে দেওয়া আগুনে, আপনাকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দগ্ধ করে দিব। আজ প্রথম বলেছেন। তাই ক্ষমার যোগ্য মনে করে ক্ষমা করে দিলাম। দ্বিতীয় দিন এমন ভুল করলে আপনাকে ধংস করে দিব। সাথে নিজেও ধংস হয়ে যাব। আপনার দু’টি পা এগিয়ে দিন মেয়ে। মেহেভীন বাকরূদ্ধ হয়ে গেল। ক্ষণে ক্ষণে কথা বলার শক্তি হারাচ্ছে সে। মুনতাসিম আবার হুংকার ছাড়লে কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে পা দু’টি এগিয়ে দিল। মুনতাসিম মেহেভীনের দিকে না তাকিয়ে মেহেভীনের পায়ে নুপুর পড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল। এসেছিলাম ভালোবাসা নিয়ে, বিষাদ সাথে দিয়ে ফেরত পাঠালেন কাজটা আপনি ঠিক করলেন না ম্যাডাম।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৮+৯

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

নিস্তব্ধতার রেশ যখন সবাইকে ঘিরে ধরতে ব্যস্ত। তখনই প্রাপ্তি সুযোগ পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে চলে যাবার জন্য অগ্রসর হলো। সবাই মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তখনই মেহেভীনের নজর যায় প্রাপ্তির দিকে, প্রাপ্তি দৌড় দিতে চাইলে মেহেভীন খপ করে প্রাপ্তির হাত ধরে ফেলে। রক্তিম আঁখিযুগল প্রাপ্তির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। আল্লাহ তায়ালা যদি চোখ দিয়ে খু’ন করার শক্তি দিত। তাহলে প্রাপ্তি এতক্ষণে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতো।

–কোথায় পালাচ্ছ আপু? এত সহজে তোমাকে ছেড়ে দিব ভাবছ! আমার সবকিছুর হিসাব আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে, তারপরে এখানে থেকে পালাবে। এর আগে পালানোর চেষ্টা করলে পা ভে’ঙে রেখে দিব। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে প্রাপ্তি মেহেভীনের গালে প্রহার করতে চাইলে, মেহেভীন প্রাপ্তির হাত ধরে ফেলে। অদ্ভুত ভাবে মেহেভীন ভেতর থেকে দিগুণ শক্তি অনুভব করল। নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না৷ প্রাপ্তির গালে ক’ষে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। মেহেভীনের মতো মেয়ে এমন কাজ করতে পারে! তা সবার ধারণার বাহিরে ছিল। প্রাপ্তি মেহেভীনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল। মেহেভীন পড়ে যেতে চাইলে শেহনাজ এসে তাকে ধরে ফেলল। মেহেভীন নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গিয়েছে। সমস্ত শরীর ভূমিকম্পের ন্যায় কাঁপছে। রাগান্বিত হয়ে প্রাপ্তির দিকে ছুটে যেতে চাইছে। কিন্তু শেহনাজ তাকে ধরে রাখায় যেতে পারছে না। তাকে আঁটকে রাখার যুদ্ধে নেমে পড়ল নাকি শেহনাজ।

–তুই কাকে ক্ষমতার পাওয়ার দেখাচ্ছিস মেহেভীন? তুমি জানিস আমি চাইলে তোর কি করতে পারি৷ আজ তুমি সফল হয়েছিস কার জন্য শুধু মাত্র আমার জন্য। সেই তুই আমার গালে প্রহার করলি! এর ফলাফল কতটা ভয়ংকর হতে চলেছে। তা তোর ধারণার বাইরে তোর সবকিছু কেঁড়ে নিব আমি৷ অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে দেখে, আয়মান দৌড়ে প্রাপ্তি কাছে গেল। প্রাপ্তিকে টানতে টানতে নিজের কক্ষের দিকে এগিয়ে নিতে চাইলে, প্রাপ্তি হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে নেয়। কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হয় প্রাপ্তি। মেহেভীন ও শেহনাজকে ছাড়িয়ে দেয় নিজের থেকে। মেহেভীন সামনের দিকে অগ্রসর হতেই, একজোড়া হাত এসে মেহেভীনকে ধরে ফেলে। মেহেভীন তাকিয়ে দেখে ফরিদ রহমান তার হাত ধরে আছে। বাবাকে দেখে সমস্ত রাগ নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল৷ চুপসে এল রণচণ্ডী রুপ ধারণ করা মুখশ্রী।

–তুই এখানে কার অনুমতি নিয়ে এসেছিস?

–আব্বু আমি আম্মুর থেকে অনুমতি নিয়ে আসছি।

–চুপ কর বে’য়াদব মেয়ে! আবার গর্ব করে বলছে। দূরে গিয়ে অভদ্রতা শিখে এসেছিস। দোষ তো তোর তুই কেন আমাদের সাথে যোগাযোগ করিসনি। নিজের দোষ অন্যের ওপর চাপিয়ে বেঁচে যেতে চাইছিস? আজকে বাসায় চল আগে, তারপরে তোর একটা ব্যবস্থা করব আমি। বাবার কথায় লজ্জাবতী পাতার ন্যায় মাথা নুইয়ে গেল। বাবার প্রতি ভিষণ অভিমান জমলো মনের গহীনে। সে তো স্বীকার করছে। দোষ তার ও আছে। তাই বলে যে বেইমানি করেছে। তাকে তো আর ছাড় দেওয়া যায় না৷ সুযোগ পেয়ে সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে ভুললেন না সাহেলা চৌধুরী।

–দেখেছেন ভাই মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি। কেমন করে নিজের বড় বোনের গায়ে হাত তুলল। আবার বড় বড় কথা বলছে। আপনার মেয়ের কত টাকা চাই। আমাদের বললে আমরা দিয়ে দিতাম। এভাবে কোন সাহসে আমাদের বাড়ির বউয়ের শরীরে প্রহার করে।

–আপনি-ও আপনার বাড়ির বউকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি। তা-না হলে এভাবে ছোট বোনের টাকা চুরি করে নেয়। আমার মেয়েকে আমি কথা শোনাব৷ বাহিরের কাউকে কথা বলতে বলিনি আমি।

–এই পালিয়ে যাওয়া মেয়েকে নিয়ে এত অহংকার! না জানি কার সাথে কি করতে গিয়েছিল। আবার আপনাদের মুখ পোড়াতে আসছে।

–সাবধানে কথা বলবেন। আমার মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলার অধিকার আমি আপনাকে দেইনি। আপনি নিজের চরিত্র দেখুন। অতীতের কাহিনি বলব কেঁচো খুঁজতে গিয়ে কেউটো বের না হয়ে আসে আবার। আপনার বাড়ির বউকে বলেন। আমার মেয়ের টাকা গুলো যেন ফেরত দেয়৷ ফরিদ রহমানের কথায় সমস্ত মুখে আঁধার ঘনিয়ে আসে সাহেলা চৌধুরীর। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে না। বাকরুদ্ধতা যেন তাকে সম্পূর্ণ রুপে গ্রাস করে ফেলছে। প্রাপ্তি মুখটা ছোট করে নিজের কক্ষ থেকে টাকা গুলো বের করে নিয়ে আসলো। সবার সামনে মাফ চেয়ে টাকা গুলো ফেরত দিল। মেহেভীন ছাড় দিতে চাইনি। ফরিদ রহমান অজানা কারনে প্রাপ্তিতে শাস্তি দিতে নিষেধ করেছে। ভেতরটা তার ভয়ে কাবু হয়ে আসছে।

আঁধারকে বিদায় জানিয়ে প্রভাতের আলোয় আলোকিত হয়েছে সমস্ত ধরনী। কালকে মেহেভীন মলিন মুখশ্রী নিয়ে বাসায় ফিরেছে। ক্রোধে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। নিজের ওপরে ভিষণ রাগ হচ্ছে, কেনো সে এত বোকামি করল। কথায় থাকে না কঠিন মুহূর্তে বুদ্ধি কাজে আসে না। সেই মুহুর্ত চলে যাবার পর হাজার রকমের বুদ্ধি বের হয়৷ কিন্তু তা অকেজো হয়ে যায় কেনো কাজেই আসে না। মেহেভীনের সফলতার খবর পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গিয়েছে। সবাই প্রশংসা করছে। এমন সময় খবর আসলো। প্রাপ্ত ছাঁদ থেকে পড়ে গিয়েছে। অবস্থা খুব একটা ভালো না। আয়মানকে রাস্তার কিছু ছেলে ধরে মা’র’ছে। দু’জনের অবস্থা খুব একটা ভালো না৷ এক রাতের ব্যবধানে এতকিছু হয়ে গেল। সবকিছুই কি কাল্পনিক ভাবে হয়েছে! নাকি এর পেছনে কারো হাত আছে। কথা গুলো মেহেভীনকে ভিষণ করে ভাবাচ্ছে। প্রাপ্তির জন্য এতটুকু ও মায়া লাগছে না৷ মেহেভীনের বাবা প্রাপ্তির বাবার সাথে হসপিটালের চলে গিয়েছে। প্রাপ্তির মায়ের সাথে মেহেভীনের আম্মু হাসপাতালে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেহেভীনের সবকিছু বিষাদ লাগছে। সে বাসায় থেকে বের হয়ে গেল। প্রাপ্তি নামক অশান্তি তার জীবনের সব শান্তি কেঁড়ে নিয়েছে। এই মেয়েটা কেই সে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। অথচ মেয়েটা তার প্রতি কতটা অবিচার করল! কথা গুলো ভাবতে ভাবতে মেইন রোডে চলছে আসছে মেহেভীন।

মাশরাফি স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বাসার দিকে আসছিল। তখনই চায়ের দোকানের সামনে হিমেলের সাথে দেখা। হিমেল হাতে সি’গা’রে’ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাশরাফিকে দেখে সি’গা’রে’ট’টা মাশরাফির দিকে এগিয়ে দিল। মাশরাফি প্রথমে ভয়ে নাকচ করে দিল। সেদিনের মারের কথা মনে হলে এখনো দম বন্ধ হয়ে আসে। হিমেল অনেক করে বোঝানোর পরে, নিতে রাজি হলো। কাঁপা কাঁপা হাত বাড়ালো সিগারেট হাতে নেওয়ার জন্য। আশেপাশে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিল। অথচ রাস্তার ওপাশে একজোড়া রক্তিম আঁখিযুগল তার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে৷ সেদিকেই তার নজর পড়েনি। আচমকা সেদিকে নজর যেতেই কলিজা শুকিয়ে আসলো। মুনতাসিমের কিছু বলতে হলো না৷ চোখের গরমেই কাবু হয়ে গেল মাশরাফি। দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। মাশরাফি চলে যেতেই মুনতাসিম নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

চারিদিকে টুংটাং প্রতিধ্বনিত মুখরিত। এত কোলাহলের মধ্যে মেহেভীন একটু নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ খুঁজছে। মনের মধ্যে শান্তি নেই তার৷ অশান্ত হৃদয় নিয়ে ছুটে চলেছে অজানা গন্তব্যে। বাবা-মা বাসায় আসলে তবে তার শান্তি মিলবে। বাবা কথা বলছে না। কথাটা স্মরন হতেই বুকটা চিনচিন করে উঠলো। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে গিয়ে কখন যে রাস্তার মাঝে চলে আসছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই। শতশত গাড়ির চলাচল চারদিকে। একটা গাড়ি মেহেভীনের দিকে ধেয়ে আসছিল। তখনই কেউ একজন হাত ধরে সরিয়ে নিয়ে আসে। আকষ্মিক ঘটনায় মেহেভীন স্তব্ধ হয়ে গেল। পেছনে ফিরে চেনা মুখশ্রী দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো মেহেভীন।

–জামাই হারিয়ে গিয়েছে ম্যাডাম। এভাবে দেউলিয়া হয়ে রাস্তার মাঝে নেমে এসেছেন কেন? মনে খুব বেশি ব্যথা করছে? আমাকে বললেই পারতেন। আমি নিজ দায়িত্বে আপনার স্বামীকে আপনার হাতে তুলে দিতাম। মুনতাসিমের কথা রাগান্বিত হয়ে গেল মেহেভীন। এই মানুষটা এতটা বেশি কথা বলে কেন! বেশি কথা বলা মানুষ তার একদম পছন্দ না। সে তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছে বলে, তাকে যা খুশি তাই বলবে!

–আমাকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ। প্রাণে বাঁচিয়েছেন বলে, নিজেকে কি মনে করেন? আমাকে যা খুশি তাই বলা যায়৷ বেশি কথা বলা মানুষ একদম পছন্দ না আমার৷ এরপরে আমার সামনে বেশি কথা বলার চেষ্টা ও করবেন না।

–বেশি কথা বলা মানুষটা যখন চুপ হয়ে যাবে। সেই নিরবতা টা আপনি নিতে পারবেন না ম্যাডাম। নিরবতা বড্ড ভয়ংকর। আপনার মানতে কষ্ট হবে। দম বন্ধ হয়ে আসবে। আগের মানুষটাকে ফিরে পেতে চাইবেন৷ কিন্তু শত চেষ্টা করে আগের রুপে ফেরাতে পারবেন না। মানুষ একবার পরিবর্তন হয়ে গেলে, তার মনে জায়গা দখল করার মতো কঠিন কাজ ধরণীর বুকে নেই।

–আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?

–সব কথা যদি সবাই সহজে বুঝে যেত। তাহলে হৃদয়টা জ্বলে পুড়ে এতটা দগ্ধ হয়ে যেত না। বলতে না পারার আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে। হারিয়ে ফেলার ভয় সমস্ত শরীরকে কাবু করে ফেলছে৷ মেহেভীন তাকিয়ে দেখল মুনতাসিম অদ্ভুত ভাবে ঘামছে। শরীর জুড়ে অস্থিরতা কাজ করছে। শরীরের শিরা-উপশিরা ভয়ে কাঁপছে। মানুষটার এত অস্থিরতা, ভয় হয়ে কাবু হয়ে আসা, তার সামনে এত কথা বলা। মানুষটার এই একটাই রুপ নাকি আরো কোনো রুপ আছে। যে রুপের কথা মানুষটা তার সামনে বলতে চাইছে না৷

–আপনি এত ঘামছেন কেন?

–প্রচন্ড গরম পড়েছে তাই।

–আপনার বাসা এখানে? আপনি কোথায় থাকেন? এদিকে কি করতে আসছেন?

–আমি পালিয়ে যাচ্ছি না। চাইলে আমাকে কোলে নিয়ে আপনার বাসায় যেতে পারেন। আমি আপনার কোলে বসে খেতে খেতে উত্তর দিব। মেহেভীন নিজের ললাটে নিজেই প্রহার করল। একটা পাগলের সাথে কথা বলছে সে। এমন উল্টা পাল্টা কথা ছাড়া তার থেকে ভালো কিছুই আশা করা যাবে না। মেহেভীনকে নিরব দেখে মুনতাসিম আবার বলে উঠলো,

–যদি-ও আপনার বয়সটা বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর। কিন্তু আপনার তো বাচ্চা নেই। তাই আপনি চাইলে আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরবার চেষ্টা করতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না।

–আপনার মতো আস্ত একটা হাতিকে কোলে নিতে হলে, আমাকে আবার জন্ম নিতে হবে। আমার ভুল হয়েছে আপনার সাথে কথা বলা৷ কেন যে বারবার আপনার সাথে আমার দেখা হয়। বিরক্ততে মুখশ্রী কুঁচকে এল মেহেভীনের। তখনই মাতাল করা সুগন্ধি এসে ঠেকল মেহেভীনের নাকে। গন্ধটা তার পূর্ব পরিচিত সে এই ফুলটা ভিষণ ভালোবাসে। ছোট বেলায় এই ফুলের জন্য কতশত পাগলামি করত।
মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই মুনতাসিম শিউলি ফুলের মালা মেহেভীনের সামনে ধরে বলল,

–ফুলের জন্য ফুল নিয়ে এসেছি৷ আপনার শিউলি ফুল ভালো লাগে৷ মেহেভীন ফুল দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। আবেগে উৎফুল্ল হয়ে গেল। চট করে মুনতাসিমের হাত থেকে শিউলি ফুলের মালাটা হাতে তুলে নিল। মেহেভীনের হাসোজ্জল মুখশ্রী দেখে, মুনতাসিমের বুকটা প্রশান্তিতে ভয়ে গেল। তোলপাড় করা হৃদয়টা শান্ত নদীর ন্যায় স্থির হয়ে গেল। প্রেয়সীর মুখশ্রীতে এক টুকরো হাসি তুলে দিতে পেরেছে। এটাই তার কাছে সবথেকে বড় পাওয়া। মনটা নিজের হয়েও অন্যের ভালো থাকার উপরে নিজের ভালো থাকা নির্ভর করে। মেহেভীন মালাটা খোঁপায় পড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। মুনতাসিম মেহেভীনের হাত থেকে মালাটা নিয়ে পড়িয়ে দিল। মেয়েরা অল্পতেই খুশি মেয়েদের খুশি করার বেশি কিছু লাগে না। আর সবচেয়ে যেটা পেলে খুশি হয়। সেটা হচ্ছে ফুল। যে মেয়ে ফুল ভালোবাসে না৷ সে মেয়ে কোনো মেয়েই না। মুনতাসিম মনোমুগ্ধকর হয়ে বলল,

“ফুলের সুন্দর্য কেও হারিয়ে মানিয়ে দিবে। আমার ব্যক্তিগত ফুল। ফুলের চেয়েও বেশি সুন্দর। আমার ব্যক্তিগত ফুল। ”

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

অভিমান যেন শরীরের শিরায়-উপশিরায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। দিনের আলো বিদায় নিয়ে চারদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। মেহেভীন নিজের কক্ষে কিছু একটা করছিল। রাতে খাবে না বলে দিয়েছে সে। মেয়ের অভিমানের ভাষা বুঝতে বাবার মন এতটুকু সময় নিল না। পরিস্থিতি আমাদের এমন বানিয়ে দেয়। যে-সময় টাতে নিজের মেয়ের থেকে, অন্যের মেয়েকে বেশি প্রাধান্য দিতে হয়। কাল কেও সে নিরুপায় ছিল। মেয়ের ভালোর স্বার্থে মেয়েকে দমিয়ে রাখতে হয়েছে। বাবাদের অল্পতে মাথা গরম করতে নেই। তাদের প্রতিটি কথা বলার পেছনে একটি করে দায়িত্ব থাকে। তাই তাদের এক একটা কথা হিসাব করে বলতে হয়। বাবারা হুটহাট রাগ করতে জানে না। কিন্তু আগলে রাখার ব্যাপারে তাদের তুলনা হয় না৷ ফরিদ রহমান মেহেভীনের কক্ষে আসলো। মেয়ের পাশে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

–অভিমান তো আমার করার কথা! তুই আমার সম্মানের কথা না ভেবে পালিয়েছিস। আবার বিয়েও করেছিস। বাবা-মায়ের কথা একটা বার ভাবলি না। আমাদের সাথে যোগাযোগ না করে, তুই মস্ত বড়ো অন্যায় করেছিস। আমি প্রাপ্তিকে দোষ দিব না। আমি মনে করি দোষ টা তোর। তুই নিজের বাবা-মায়ের থেকে চাচাতো বোনকে বেশি বিশ্বাস করেছিস। আজ আমার সাথে এমন করছিস তো। একদিন ঠিক বুঝবি বাবা কি জিনিস। আমি যদি একবার চোখ বন্ধ করি। তাহলে এখানে একটা দিন টিকতে পারবি না। দেখতে পাবি চেনা মানুষের অচেনা রুপ। সেসব সহ্য করতে পারবি না। তোর পছন্দের চিংড়ি মাছ নিয়ে আসছি। তুই খাসনি বলে আমরা সবাই না খেয়ে বসে আছি। তুই কি চাস আমি না খেয়ে নিদ্রা চলে যাই। বাবার কথায় বুকটা ভারি হয়ে এল। বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। বাবা থাকবে না কথা ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাবা নামক বৃক্ষের ছায়া মাথার ওপরে থেকে সরে গেলে, মাথার ওপরের উত্তপ্ত সূর্য খানা সোজা মাথার মগজে এসে অবস্থা করবে। সে কি ব্যথা অসহনীয় যন্ত্রনা সহ্য করার মতো নয়। কথা গুলো কল্পনা করলেই সমস্ত শরীর কাটা দিয়ে উঠছে।

সময় স্রোতের ন্যায় গড়িয়ে চলে যায়। দেখতে সাতদিন হয়ে গিয়েছে। মেহেভীনকে নিতে গাড়ি আসছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে রৌদ্রের প্রখরতা দিগুণ ভাবে বেড়ে চলেছে। মেহেভীনের মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ফরিদ রহমান মেয়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে দিল। মেহেভীন মুগ্ধ নয়নে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সত্যি বাবা চরিত্র টা অতুলনীয়। বাবার ব্যাখ্যা করতে গেলে শুরু হবে। কিন্তু শেষ হবে না। এতটাই সুন্দর বাবা নামক বটগাছের ছায়া। মেহেভীন সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। রাইমা বেগম মেয়ের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। রুপা আগেই বাসায় চলে আসছে। সকাল থেকে পুরো বাসা পরিষ্কার-পরিছন্ন করেছে সে। মেহেভীন একটু খুঁত খুঁতে ধরনের মেয়ে। তার সবকিছু পরিষ্কার চাই। রুপা সবে মাত্র বসেছিল। তখনই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। রুপার অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠলো। এই বুঝি আপা চলে এসেছে। কতদিন পর সে আপাকে দেখবে। মেহেভীনকে না দেখলে রুপার মনের গহীনে অজানা বিষাদ এসে ধরা দেয়। দরজা খুলে মেহেভীনকে দেখে, আবেগে উৎফুল্ল হয়ে পরে রুপা। মেহেভীনকে শক্ত করে আলিঙ্গন করে। রুপার পাগলামি দেখে মেহেভীন হেসে দিল।

–রুপা এবার ছাড় বাহিরে থেকে এসেছি। রাস্তায় কত ধুলাবালির ছিল। আমাকে এখন স্পর্শ করিস না।

–আপা আমার এসবে অভ্যাস আছে। আমার আপনাকে ছাড়া একদম ভালো লাগে না। আমার আপনি ছাড়া কে আছে বলেন। আমার পুরো ধরণীটাই হচ্ছে আপনি। আমার এক টুকরো আবেগ আপনি। আমার সুখ, শান্তি, ভালো থাকা, আমার আহ্লাদ করা, আমার শখ পূরন করে দেওয়া, আমার সবকিছু শুধু আপনাকে ঘিরে। এত ভালোবাসা পাওয়ার পরে ভালোবাসার মানুষ টিকে ছাড়া থাকা ভিষণ দুষ্কর আপা। হাসোজ্জল মুখশ্রী খানা মুহুর্তের মধ্যে মলিনতায় ছেয়ে গেল। বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেল চঞ্চল হৃদয়। সমস্ত আঁধার ঘনিয়ে ধরলো মেতে ওঠা মস্তিষ্কের আনন্দ গুলোকে। মেহেভীন রুপার মলিন মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলল,

–এই যে বিষাদ রাণী! আপনি মাঝে মাঝে বিষাদের শহরে হারিয়ে যান। মনকে এত বিষাদগ্রস্ত করে তুলছেন কেন? আমি কি বিষাদিত হবার মতো কোনো কাজ করেছি। মা অনেক খাবার পাঠিয়েছে। সেগুলো বের কর আমি ফ্রেশ হয়ে এসে খাব। কথা গুলো বলেই চলে গেল মেহেভীন। মা শব্দটা অতি আবেগের মা শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে আছে অফুরন্ত ভালোবাসা। যে ভালোবাসার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। যার মা নেই সে বুঝে ধরনীর বুকে টিকে থাকার কতটা কঠিন। রুপা যেন মেহেভীনের মায়ের রান্না করা খাবারে, নিজের মায়ের ভালোবাসার স্বাদ খুঁজে পেল। এই রান্নার মধ্যে মেয়ের জন্য মায়ের কত ভালোবাসা আছে। ভাবতেই বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। আজ যদি তার মা বেঁচে থাকত তাহলে তাকে-ও এভাবে রান্না করে খাওয়াত। রুপার আঁখিযুগল অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই। তখনই একটা হাত তার মুখের সামনে এক লোকমা খাবার ধরল। রুপার তড়িঘড়ি করে অশ্রুকণা গুলো মুছে নিল। মেহেভীনকে দেখে কৃত্রিম হাসার চেষ্টা করল।

–তোর আপা আছে না। তোর আপা থাকতে তোকে একদম কষ্ট পেতে দিবে না। আমার ভুল হয়েছে। তোকে আমার সাথে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। আমি একটু ভয়ে ছিলাম। তাই তোকে রেখে গিয়েছিলাম। এরপরে যখন যাব। তখন তোকে নিয়ে যাব। জানি মায়ের কথা স্মরণ করে কষ্ট পাচ্ছিস। আর কয়দিন পরে আমার মা আমার কাছে আসবে। আমার মা অনেক ভালো জানিস। আমার মাকে নিজের মা মনে করবি। আমার অনেক কাজ আছে। কয়টা দিন অনেক ব্যস্ত থাকব। তোকে বলেছিলাম না। বেআইনি ভাবে জমি নিজের নামে নিতে চাইছে। শুধু মাত্র আমার একটা সাইনের জন্য পারছে না। সে আমার ওপরে খুব রাগান্বিত হয়ে আছে বুঝছিস। যেকোনো সময় ক্ষতি করে দিতে পারে। বাসা থেকে একা একা বের হবি না। কিছু লাগলে দারোয়ানকে বলবি। কাউকে না পেলে আমাকে কল দিবি। আমি আসার সময় নিয়ে আসব। আর বেশি কথা বলিস না। চুপচাপ খেয়ে নে আমার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে নিস্তব্ধ হয়ে গেল পরিবেশ। মেহেভীন নিজে একবার খাচ্ছে। আরেকটা রুপাকে খাইয়ে দিচ্ছে। এজন্য মেহেভীনকে রুপা এতটা ভালোবাসে। মেয়েটা এতটা দায়িত্ববান আর যত্নশীল যা দেখে রুপা প্রতিবারই মুগ্ধ হয়। মানুষটার প্রতি ভালোবাসা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এই মানুষটা যদি তার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। তাহলে কিভাবে সমাজের বুকে সাহস নিয়ে বেঁচে থাকবে। সবাই তাকে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য শেয়াল কুকুরের মতো অত পেতে থাকবে।

মেহেভীন ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল। তখনই রুপা এসে জানান দিল। জুনায়েদ খান এসেছেন। মুহূর্তের মধ্যে মেহেভীনের মুখশ্রী বিরক্তিতে কুঁচকে এল। এই লোকটা বাসা পর্যন্ত চলে আসছে। মেহেভীন ভদ্রতা সুলভ রুপাকে নাস্তা নিয়ে আসতে বলল। রুপা চা সহ আরো বিভিন্ন ধরনের নাস্তা নিয়ে এসে সামনে হাজির হলো। জুনায়েদ খান বিরক্তি মাখা হাসি দিয়ে বলল,

–আমার কথা কি ভুলে গিয়েছেন ম্যাডাম। কতদিন ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। এই সাতটা দিন পাগলের মতো অফিসে গিয়ে আপনাকে খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি এভাবে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলেন?

–আমি কোথায় যাব না যাব। সেটা আমার ব্যক্তিগত বিষয় এটা নিশ্চয়ই আপনাকে বলে যেতে হবে না। আপনি এখানে কি কাজে আসছেন। সেই আলোচনায় আসা যাক।

–আমার বেশি কিছু চাই না ম্যাডাম। আপনি শুধু দলিল টাই সাইন করে দিবেন। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার ম্যাডাম। আপনি সাইন করে দিলে, আপনিও মুক্ত আর আমিও খুশি।

–দেখুন জুনায়েদ আমি আপনাকে আগেও বলেছি। আজকে আবারও বলছি। আপনি যেটা চাইছেন। সেটা কখনোই সম্ভব নয়। আমি মেহেভীন কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করিনি। আর এই দেহে প্রাণ থাকা অবস্থায় করব ও না। এটা সব সময় মাথায় রাখবেন। আপনি এবার আমার সামনে থেকে চলে যেতে পারেন।

–আমি জানতাম সোজা কথা শোনার মতো মানুষ আপনি না। তাই আমি আপনাকে রাজি করানোর জন্য একটা জিনিস নিয়ে আসছি। যেটা দেখলেই আপনার মস্তিষ্ক সচল হয়ে যাবে। আর বুদ্ধিমানের মতো আপনি সাইন করে দিবেন। কথাগুলো বলে বিলম্ব করল না জুনায়েদ খান। সে একটা টাকার ব্যাগ রাখল মেহেভীনের সামনে। টাকা গুলো দেখে মেহেভীন ক্রোধের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। জুনায়েদ বিশ্রী হেসে জবাব দিল,

–এবার নিশ্চয়ই আপনার কোনো আপত্তি নেই। এখানে একদম পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আছে। আপনি যদি চান। তাহলে আপনাকে আরো টাকা দিতে রাজি আছি। আপনি শুধু সাইনটা করে দিন ম্যাডাম। আমি সারাজীবন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।

–খোঁজ নিয়ে জেনেছি। আপনার অর্থসম্পদের অভাব নেই। এত অর্থ সম্পদ থাকার পরেও অন্যের জিনিসের প্রতি এত লোভ লালসা কেন? আমাকে জবাব দিন জুনায়েদ খান। সুস্থ অবস্থায় যদি থাকতে চান। তাহলে এখনই আমার বাসা থেকে বের হয়ে যান। আপনি পঞ্চাশ লক্ষ কেন পঞ্চম কোটি টাকা দিলেও আমি সাইন করব না। এখনই যদি আমার সামনে থেকে চলে না যান। তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে জুনায়েদ খান মেহভীনের পা জড়িয়ে ধরল। সাইন করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। মন গলল না মেহেভীনের সে দারোয়ানকে ডেকে জুনায়েদকে বাসা থেকে বের করে দিল।

চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। জুনায়েদ অশ্রুসিক্ত নয়নে মেহেভীনের বাসার দিকে তাকিয়ে আছে। বুকটা তার খাঁ খাঁ করছে। মেহেভীনের প্রতি ক্ষোভ জমেছে মনে। সে মেহেভীনের শেষ দেখে ছাড়বে। কাউকে একটা কল দিয়ে কিছু একটা বলল জুনায়েদ। ওপর পাশ থেকে হাসির শব্দে মুখরিত হয়ে গেল চারপাশ।

মেহেভীনের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা যুবক। চোখে তার শত জনমের ব্যথা। বুকে জমে আছে টুকরো হয়ে যাওয়া হাজারো স্বপ্ন। এলোমেলো কেশগুলো বিরতিহীন ভাবে উড়ে চলেছে। ফুলের মতো চেহারাটা আজ নেশায় জর্জরিত হয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মুখশ্রীতে সব সময় হিংস্রতার প্রকাশ পায়। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন হয়ে আছে। মনটা ভালো নেই। যে মানুষ গুলো মনে থাকে, সেই মানুষ গুলোই মনে আঘাত করে। যুবকটি মেহেভীনের ছবির দিকে হিংস্র নয়নে তাকিয়ে আছে। চোয়াল শক্ত হয়ে এল যুবকের। সে ছবির দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল,

–তোমার জ্বালিয়ে দেওয়া আগুনে, আমি যেমন জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছে যাচ্ছি মেহেভীন। ঠিক এমন করেই তোমার জীবনটা আমি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিব মেহেভীন। আমার আঁখিযুগলের দিকে কখনো চেয়েছ? যদি চাইতে তাহলে দেখতে এই চোখ কতটা তৃষ্ণা জমে আছে। তোমাকে দেখার তৃষ্ণা। তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য আমি কতটা আকুল হয়ে থাকতাম। একটু দেখার জন্য কতটা ছটফট করতাম। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে ফেলতে চাইছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে বানিয়েছ চরিত্রহীন। আদরের ছেলেটাকে হতে হয়েছে বাড়ি ছাড়া। আমার প্রতিটি কষ্টের প্রতিশোধ আমি নিব মেহেভীন। তোমার জীবনটা নরক বানিয়ে ফেলব। তুমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হও। আমি আসছি।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৬+৭

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সোনালী আলোয় চারদিক মনোমুগ্ধকর করে হয়ে উঠেছে। মেয়েকে পেয়ে রাইমা বেগমের খুশির শেষ নেই। ধরণীর সমস্ত আনন্দ রাইমা বেগমের মুখশ্রীতে রাজত্ব করছে। মায়ের ভালোবাসা পেয়ে মেহেভীনের বুকটা শীতল হয়ে গেল। বাবার ভয়ে ভেতরটা কাবু হয়ে আছে। এখনো বাবার সাথে কথা হয়নি। মেহেভীন কথা বলতে চাইলে দূরে সরে গিয়েছে। মেহেভীন অপরাধীর ন্যায় বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেভীনের বাবা বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাজারে চলে গেল। মেহেভীন মায়ের দিকে তাকিয়ে মলিন কণ্ঠে বলল,

–আম্মু আব্বু আমার সাথে কথা বলবে না।

–সাময়িক ভাবে রেগে আছে। তোর বাবার হাটের দিন ছাড়া বাজারে যায় না। দেখলি না তোকে দেখে বাজার গেল। নিশ্চই তোর পছন্দের সব খাবার নিয়ে আসবে।

–আমার খাবার চাই না আম্মু। আমার আব্বুর ভালোবাসা চাই।

–তুই শুধু খাবার নিয়ে আসতে যেতে দেখলি। বাবার ভালোবাসি আর দায়িত্ব দেখলি না। এতগুলো দিন আমাদের ছেড়ে দূরে ছিলি। ক’জন তোকে দায়িত্ব নিয়ে খাইয়েছে? তুই চিন্তা করিস না। আমি তোর বাবাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলব। সারারাত জার্নি করে এসেছিস। এবার একটু ঘুমিয়ে নিবি চল।

–প্রাপ্তি আপুর কাছে থেকে একটু ঘুরে আসি।

–সে তো বাসায় নেই। তাকে গিয়ে বাসায় পাবি না। তাহলে কার কাছে যেতে চাইছিস।

–মানে?

–কেনো তোর প্রাণ প্রিয় বোন বলেনি সে বিয়ে করেছে। মায়ের কথায় বিস্ময় নয়নে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে মেহেভীন। মানুষ কতটা জঘন্য হলে, দিনের পরে দিন এতগুলো মিথ্যা কথা বলতে পারে। কথা গুলো ভাবতেই ঘৃণায় পুরো শরীর রি রি করছে। তবে ভেতর থেকে অদ্ভুত এক খারাপ লাগা কাজ করছে৷ তার ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না। বাস্তবতা তাকে শিখিয়ে দিল। চাচাতো বোনরা কখনো আপন বোন হতে পারে না। মেহেভীন গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,

–তা কার সাথে বিয়ে হয়েছে আপুর?

–আয়মানের সাথে বিয়ে হয়েছে। খবর পেয়েছি প্রাপ্তি আর আয়মানের আগে থেকেই প্রেমের সম্পর্ক ছিল। দু’জন দু’জনকে ভিষণ ভালোবাসত। কিন্তু পরিবারের ভয়ে কেউ তা প্রকাশ করতে পারেনি। মূলত আমাদের সন্মান নষ্ট করার জন্যই তারা এসব করেছে। প্রাপ্তির বাবার থেকে তোর দাদা তোর বাবাকে বেশি জমি দিয়েছে। সেজন্য প্রাপ্তির বাবার তোর বাবার ওপরে ভিষণ রাগ। মাঝেমধ্যে মনে হয় এই জমি জামার চক্করে তোর বাবাকে না হারিয়ে ফেলি।

–একদম বাজে কথা বলবে না আম্মু। ভুলে যেও না আম্মু তোমাদের মেয়ে আর আগের মতো বোকা নেই। আমি থাকতে আমার আব্বুর কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

–আম্মু তুমি আমার সফল হবার গল্প শুনবে না।

–না।

–কেনো?

–কারণ আমি প্রথম থেকেই সবকিছু জানি। তোর একটা বার মনে হলো না। হুট করে একজন মহিলা তোর কাছে এল। তোর পাশে দাঁড়াল। তোর দুঃসময়ে তোকে ভরসা দিল। টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করল। এগুলো কি সে এমনি এমনি করেছে। মায়ের কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মেহেভীন। তার মা এসব কিছু জানল কিভাবে! সে তো এসব কথা কারো সাথে গল্প করেনি। মেহেভীনের ছোট্ট হৃদয়ে সন্দেহের দানা বাঁধে। সে মায়ের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে জবাব দিল,

–এতকিছু তু্মি জানলে কিভাবে?

–প্রাপ্তি তোকে আগে পিছে কখনোই পছন্দ করত না। কিন্তু সেটা বাহিরে প্রকাশ করত না। তোকে পালিয়ে যেতে সে এ-কারণে সাহায্য করেছে। যেন রাস্তার কিছু নরপিশাচ তোকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। আমাদের সন্মান নষ্ট করে সে সুখী হতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি যে তোর মা৷ তোকে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেছি। তোর বেড়ে ওঠা, কথা বলা, হাঁটা চলা সবকিছু আমার হাত ধরে হয়েছে। সেই মেয়েকে আমি কিভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি৷ সেদিন তোর চিঠিটা আমি পেয়েছিলাম। তোর ফোনের লোকেশন ট্র্যাকিং করাই আমি। তুই যেখানে গিয়েছিলি সেখানে আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সামিরাকে পাঠাই। তোর যত টাকা পয়সা সব সামিরা দিয়েছে ভেবেছিস। সবকিছু আমি দিয়েছি। তোর নানা আমাকে যে জমিটুকু দিয়েছিল। সেটা বিক্রি করে তোকে টাকা দিয়েছি৷ যেন তুই ভালো থাকিস৷ সামিরার থেকে তোর খোঁজ খবর নিয়েছি। তাই নিশ্চিন্তে থাকতে পেরেছি। তোর বাবাকে ভরসা দিয়েছি। তোর বাসার কাজের মেয়েটাকে দিয়ে রোজ আমার খবর নিতি। সেটাও আমি জানতাম। কিন্তু কখনো বুঝতে দিতাম না৷ আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম। তুই কবে নিজ থেকে আমার সাথে কথা বলিস। সাফল্যের অর্জনের পরে যদি আমাদের ভুলে যেতি৷ তাহলে ভাবতাম একটা কুসন্তান জন্ম দিয়েছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোকে জন্ম দিয়ে ভুল করিনি। আমাদের মুখ তুই উজ্জ্বল করেছিস। ভাবিস না তোর টাকা পয়সা খেতে পারব জন্য এসব বলছি৷ বাবা-মা তার সন্তানের সাফল্য চায়। এতেই তাদের সুখ, শান্তি, তৃপ্তি। তোর টাকার আমার দরকার নেই মা। আমাদের যা আছে তা দিয়ে জীবন চলে যাবে। তুই আমাকে জিনিস কিনে খাওয়ার জন্য যে টাকা গুলো পাঠাতি। আমি সেগুলো জমিয়ে রাখতাম। তোর বাবার হাতের সমস্যা হলে সেগুলো দিতাম। তোর বাবাকে আজ-ও জানাতে পারিনি। তবে জানানোর সময় এসে গিয়েছে। এভাবেই জীবনে এগিয়ে যা আর সমাজের কিছু কটু লোকের মুখ বন্ধ করে দে। এখানেই আমার প্রাপ্তি। আমি জানতাম আমার মেয়েটা বড্ড বোকা আর সরল। সেজন্য আড়াল থেকে পাশে থেকেছি। তুই যেন শক্ত হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়াতে পারিস। লক্ষ্য অর্জনের পথে আপন মানুষের দেখা পেলে মানুষ শক্তিহীন হয়ে যায়। দুর্বল হয়ে পড়ে আমি তোকে দুর্বল করতে চাইনি। মায়ের কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মেহেভীন। কণ্ঠনালি দিয়ে এক বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না৷ সে আসলেই বোকা ভিষণ বোকা। স্বার্থের পৃথিবীতে কেউ এক পা লড়ে না। সেখানে একটা অচেনা মহিলা তাকে সাহায্য করল৷ সেটা সে বিশ্বাস করল। এর পেছনে মা নামক যোদ্ধার এতবড় অবদান রয়েছে। সেটা সে গুন অক্ষরেও টের পেল না। নিজের মাকে নিয়ে ভিষণ গর্ব হচ্ছে মেহেভীনের।

–সেজন্য সামিরা আন্টি আমার কাছে বেশিদিন থাকেনি। প্রয়োজন মতো থেকে ছিল। তুমি আমার জন্য এতকিছু করেছ। আমাকে জানাওনি কেন আম্মু? আমি আসলেই বোকা। প্রথমে তাকে নারী পাচারকারী ভেবেছিলাম। সব সময় ভয়ে থাকতাম। প্রাপ্তি আপু আমার সাথে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করল! আমি যে তার কাছে প্রতি মাসে তোমাদের জন্য টাকা পাঠাতাম। সে টাকা গুলো কি তোমাদের দেয়নি?

–তিন মাসের মতো আমাদের টাকা দিয়েছিল। কিসের টাকা বলেনি। রোজ বলতাম তোর সাথে কথা বলিয়ে দিতে। কিন্তু সে আজেবাজে কথা বলত। আমি যে তোর বিষয়ে সবকিছু জানি। এটা কাউকে বুঝতে দিতাম না৷ সবার সাথে অভিনয় করে যেতাম। তুই আমার নিজের মেয়ে। তোকে রেখে নিশ্চয়ই প্রাপ্তিকে বেশি বিশ্বাস করব না।

–মাঝেমধ্যে প্রাপ্তি আপুকে আমার সন্দেহ হতো। কিন্তু কাজের চাপে সেগুলোকে গুরুত্ব দিতাম না। এবার বাসায় এসেছি। প্রাপ্তি আপুকে সামনে বসিয়ে নিয়ে সবকিছু ফায়সালা হবে।

–সে এখন অনেক বড় বাড়ির বউ। তাকে কিছু বলার সাধ্য আমাদের আছে। এসব বিষয়কে ইস্যু করে তোকে হারাতে চাইনা। উপরে একজন আছে। সবকিছু দেখছেন বিচার করে দিবেন। কিন্তু তুই প্রাপ্তির কাছে টাকার হিসাব চাইবি। তোর পরিশ্রমে ফল সৎ মানুষকে খেতে দিস। অসৎ মানুষকে ভোগ করতে দিস না। কথা গুলো বলতে গিয়ে বুকটা ভারি হয়ে আসলে রাইমা বেগমের৷ তিনি আর কোনো কথা বলতে পারলেন না৷ মনের গহীনে বহু ব্যাথা লুকিয়ে আছে। দুঃখ কষ্ট দিয়ে ভেতরটা ভিষণ ভারি হয়ে আছে।

মুনতাসিম নিজের কাজে মনযোগ দিয়ে আছে। তখনই শেহনাজ মুনতাসিমের কক্ষে প্রবেশ করে। শেহনাজের উপস্তিতি টের পেয়ে মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–কারো কক্ষে প্রবেশ করার আগে অনুমতি নিতে হয়। এটা কি তুমি জানো না। তোমাকে আবার নতুন করে শিখাতে হবে।

–সেটা অন্য মানুষের কক্ষে প্রবেশ করার আগে অনুমতি নিতে হয়। নিজের ভাইয়ের কক্ষে না। সে তুমি আমাকে আপন বোন ভাবতে না-ই পারো। কিন্তু আমি তোমাকে মনে প্রাণে নিজের ভাই মনে করি।

–আজকাল ভার্সিটিতে একটা ছেলের সাথে তোমাকে বেশি দেখা যাচ্ছে। ছেলেটা কে শেহনাজ?

–ভাইয়া তুমি যেমনটা ভাবছ আসলে তেমনটা না। সে আসলে আমার জাস্ট ফ্রেন্ড।

–শেহনাজ তুমি ভুলে যাচ্ছ তুমি কার সাথে কথা বলছ? আমাকে তোমার বাচ্চা ছেলে মনে হয়। আমাকে দায়িত্বহীন ভাই বা ছেলে মনে করবে না। কে কোথায় যাচ্ছে কে কোন পয়েন্টে চলছে। সেটা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। আমি চুপ করে থাকি তার মানে এই না যে আমি কথা বলতে জানিনা। পরবর্তীতে ঐ ছেলের সাথে তোমাকে দেখলে ছেলের জান যাবেই। সাথে তোমার অবস্থাও আমি খারাপ করে দিব।

–আহির অনেক ভালো ছেলে ভাইয়া। আমি আহিরকে অনেক ভালোবাসি। আহিরকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মুনতাসিম রক্তিম চোখে শেহনাজের দিকে দৃষ্টিপাত করল। বোনকে সে ভিষণ ভালোবাসে শেহনাজের জায়গায় অন্য কেউ থাকলে, তাকে এখনই ধংস করে ফেলত। শেহনাজ ভীত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়ের সামনে গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস নেই। কথায় আছে মানুষ প্রেমে পড়লে তার সাহস দিগুন বেড়ে যায়। শেহনাজ তার জলজ্যান্ত প্রমান। মুনতাসিম চোয়াল শক্ত করে বলল,

–তুমি আমার থেকে মানুষ বেশি চিনো? তুমি যদি একজন সৎ রিকশাওয়ালাকে ভালোবাসতে, তাহলে আমি নিরদ্বিধায় তোমাকে তার হাতে তুলে দিতাম। কিন্তু তুমি এমন একজনকে ভালোবেসেছ। যার হাতে তোমাকে তুলে দেওয়া কখনোই আমার পক্ষে সম্ভব না। মস্তিষ্ক গরম হয়ে যাচ্ছে। আমি রেগে যাবার আগে আমার কক্ষ থেকে বের হয়ে যাও শেহনাজ। ভাইয়ের কথার ওপরে কথা বলার সাহস হয়ে উঠলো না শেহনাজের। সে নিঃশব্দে কক্ষ থেকে বেয় হয়ে গেল। তার ভাই কারন ছাড়া কোনো কথা বলে না। তাহলে কি আহিরের মধ্যে কোনো সমস্যা আছে। কিন্তু আহিরকে যে আমি ভিষণ ভালোবাসি। আমি আহিরকে ছাড়া থাকব কিভাবে। কথা গুলো ভাবতেই শেহনাজের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। ভেতরটা হাহাকারে ভরে উঠছে। মনটা ভিষণ করে জ্বলে উঠলো। তবে তাকে সারাজীবনের জন্য আহিরকে হারাতে হবে। কথা গুলো ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে শেহনাজের।

সূর্য বিদায় নিয়েছে। চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। দূর থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাচ্ছে। চারদিক মৃদু হাওয়া বইছে। শীতল হাওয়া এসে মেহেভীনের শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে। মেহেভীন মায়ের অনুমতি নিয়ে প্রাপ্তির সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। দীর্ঘসময় হাঁটার পরে অবশেষে চৌধুরী বাড়িতে এসে পৌঁছালো। রাজপ্রাসাদের মতো দেখতে বাড়িটা। বাড়ির চারপাশে বলিষ্ঠ দেহের কালো পোশাক পড়া লোক ঘিরে রেখেছে। বাড়ির চারপাশে এত গার্ড দেখে মেহেভীনের মুখশ্রী কুঁচকে এল। মেহেভীন পরিচয় দিয়ে চৌধুরী বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। প্রাপ্তি সবার জন্য চা নিয়ে আসছিল। হাত কাঁপছে প্রাপ্তির কাজের মেয়েটাকে একটা কাজে বাহিরের পাঠানো হয়েছে। এতগুলো চায়ের কাপ কেউ একসাথে নেয়। এখনই সব পড়ে যাবে। মেহেভীন বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে প্রাপ্তির দিকে অগ্রসর হলো। মুনতাসিম বাহিরে যাবার জন্য বের হয়েছিল। মেহেভীনকে দেখেই দেওয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। তার হৃদস্পন্দনের গতিবেগ বেড়ে গিয়েছে। মেহেভীন প্রাপ্তি হাত ধরতেই প্রাপ্তি মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করল। ভয়ে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। হাত-পা শীতল হতে শুরু করেছে। প্রাপ্তিকে ভয় পেতে দেখে মেহেভীনের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠছে। অজানা আনন্দে অনুভূতিরা মেতে উঠেছে।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৭
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

মানুষ যেখানে থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। বাস্তবতা তার সামনেই তাকে দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রাপ্তি এখন সেই বাস্তবতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হৃদস্পন্দনের গতিবেগ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে। ভেতরটা ভয়ে কাবু হয়ে আসছে। মস্তিস্ক শূন্য হয়ে পড়েছে। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও একটু আশার আলো দেখল প্রাপ্তি। চায়ের ট্রে টা টেবিলে রেখে মেহেভীনকে আলিঙ্গন করল। নিখুঁত দারুন অভিনয়ের সুরে বলল,

–মেহেভীন বোন আমার কেমন আছিস? তুই কবে এসেছিস? তুই যে এখানে আসবি আমাকে জানাসনি তো! আগে জানলে তোর জন্য ভালো মন্দ রান্না করে রাখতাম। চাচি নিশ্চয়ই তোকে সবকিছু বলেছে। আমি ইচ্ছে করে তোর থেকে সবকিছু আড়াল করে গিয়েছি। আমি কখনো চাইনি তুই এসব চিন্তা মাথায় নিয়ে, তোর লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়িস। তোর জন্য আমি আমার জীবনটা নষ্ট করেছি। তবুও তোকে এতটুকু চিন্তা মাথায় তুলতে দেইনি। আমাকে তুই ভুল বুঝিস না বোন।

–আমি তোমাকে কিছু বলেছি আপু! কথায় আছে না চোরের মন পুলিশ পুলিশ।

–তুই কি আমাকে অপমান করছিস?

–তোমার অপমান আছে আপু।

–তোকে কেউ দেখার আগে তুই এই বাসা থেকে বের হয়ে যা। তোকে কেউ দেখলে অনেক বড় সমস্যা হয়ে যাবে। তুই সেদিন পালিয়ে গিয়েছিলি। সেজন্য সবাই তোর ওপরে রেগে আছে।

–কোথায় ডাকো সবাইকে, আমি আজকে সবার রাগ দেখতে এসেছি। মেহেভীনের কথায় ক্রোধে ললাটের রগ গুলো ফুলে উঠছে প্রাপ্তির। এই মেয়ে এতটা ধুরন্ধর হলো কিভাবে! প্রাপ্তি শক্ত হাতে মেহেভীনকে ধরতে চাইলে, মেহেভীন দূরে সরে আসলো। কিছুটা গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,

–তুমি রান্না ঘর থেকে এসেছ। তোমার এই নোংরা হাত দিয়ে আমাকে একদম স্পর্শ করবে না। আগে হাতটা ভালো করে ক্লিন করে আসো। তারপরে না হয় আমাকে স্পর্শ করার মতো দুঃসাহস দেখাবে। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে আমান চৌধুরী সেখানে উপস্থিত হয়। মেহেভীনকে দেখে অদ্ভুত ভাবে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। মেয়েটা আগের থেকে দিগুণ সুন্দর্যের অধিকারীনি হয়ে গিয়েছে। মেয়েটার মুখশ্রীতে অদ্ভুত এক মায়া লেগে থাকে সব সময়। এই মায়াভরা মুখশ্রী দেখেই মেহেভীনকে পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু তার অপদার্থ ছেলে সেটা আয়ত্ত করতে পারল না। চাঁদের সাথে অমাবস্যার রাতের তুলনা দিল। মেহেভীন কিছুটা ভীরু দৃষ্টিতে আমান চৌধুরীর দিকে তাকালো। ভেতরে ধীর গতিতে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। পরিবেশটা শীতল হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে সবাই নিজ কক্ষ থেকে বের হয়ে, ড্রয়িং রুমে আসতে শুরু করেছে। মেহেভীন দমে গেল না। সে ধীর পায়ে আমান চৌধুরীর দিকে এগিয়ে গেল। কিছুটা ভাবলেশহীন ভাবে সালাম দিয়ে বলল,

–কেমন আছেন আংকেল? অনেক দিন পর আপনার সাথে দেখা। শরীর স্বাস্থ্য ভালো আছো তো। আপনাদের বাসার সবাই কোথায়? এবার সবাইকে ডাকুন। আপনাদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে এসেছি। একজন ও যেন বাদ না থাকে। আমার সবাইকে এক সাথে চাই মানে, সবাইকে একসাথে চাই। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে মাশরাফির মা সাহেলা চৌধুরী বললেন,

–এই তুমি সেই মেয়েটা না। যার সাথে আয়মানের বিয়ে হবার কথা ছিল। কিন্তু তুমি বিয়ে না করে পালিয়ে গিয়েছিল!

–একটা কা’পু’রু’ষ’কে বিয়ে করার থেকে, পালিয়ে যাওয়া ঢের ভালো।

–সাবধানে কথা বল মেয়ে! আমাদের বাসায় এসে, আবার আমার সাথেই বাজে ব্যবহার করা!

–আমি তো আপনার সাথে আগে কথা বলতে যাইনি আন্টি। আমি এখানে আপনার সাথেও কথা বলতে আসিনি। আপনি পুরোনো কথা টেনে আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছেন। কেউ আমাকে অপমান করার চেষ্টা করলে, তাকে আমি এক চুল পরিমাণ ছাড় দিব না। সে যদি হয় আমার নিজের মায়ের পেটের বোন সে-ও ছাড় পাবে না।

–আয়মান সঠিক কাজ করেছে। তোমার মতো বেয়াদব মেয়েকে বিয়ে করলে, আয়মানের জীবনটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যেত। সাহেলার ব্যবহার দেখে রিয়াদ চৌধুরী বজ্রকণ্ঠে সাহেলাকে ধমক দিল। স্বামীর ধমকে চুপসে যায় সাহেলা। রাগান্বিত হয়ে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীন সাহেলার দৃষ্টি উপেক্ষা করে, সামনের দিকে এগিয়ে গেল। মুনতাসিমের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তবুও গভীর আগ্রহ নিয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। তখনই তাইয়ান এসে মুনতাসিমের পাশে এসে নিজের স্থান দখল করল। মুনতাসিমের কর্ণের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,

–স্যার আপনার হৃদয় হরণ হয়ে গিয়েছে। মেহেভীন নামক রমনী আপনার হৃদয় হরণ করেছে। না হলে আপনার মতো নিষ্ঠুর মানুষের মনে, সাধারন এক রমনীকে দেখে, আপনার হৃদয়ের গহীনে এতটা ঝড় উঠে, আপনার ভেতরটা যে উথাল পাথাল হয়ে যাচ্ছে। আপনার অশান্ত বুকটাকে কে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলবে। এই মেয়েকে আমি চিনি। এই মেয়ের সাথে আয়মান স্যারের বিয়ে হবার কথা ছিল। আয়মান স্যার কি একটা ভুল করল। পূর্নিমার চাঁদকে ঘরে তুলে সমস্ত ঘর আলোকিত করা বাদ দিয়ে, অমাবশ্যার রাতকে ঘরে তুলে ঘরকে করেছে আঁধার। আয়মান স্যার একদিন বহু পস্তাবে। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিম রক্তিম চোখে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে। তাইয়ান তার ব্যক্তি বডিগার্ড সব সময় বেশি কথা বলে, আর উপহার স্বরূপ মনুতাসিমের ব’কা শুনতে হয়। ছেলেটা ভিষণ ভালো। সব সময় মুনতাসিমের সাথে আঠার মতো লেগে থাকে। মুনতাসিমের বিপদে সবার আগে সে এগিয়ে আসে। মুনতাসিম চোয়াল শক্ত করে বলল,

–তুমি এখানে থেকে যাবে নাকি মা’থাটা দেহ থেকে আলাদা করে দিব। মুনতাসিমকে দেখে সে ভিষণ ভয় পায়। মুনতাসিম একবার রেগে গেলে, তার সামনে কোনো বাক্য আসে না ভেতর থেকে। নিঃশব্দে তাইয়ান চলে গেল। তাইয়ান চলে যেতেই মুনতাসিন অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠলো। কি স্নিগ্ধ সেই হাসি! প্রতিটি নারীর হৃদয়ে ঝড় তোলার জন্য এমন এক মনোমুগ্ধকর হাসিই যথেষ্ট। ” আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। সেদিন আয়মান তোমাকে বিয়ে না করে, আমার অনেক বড় উপকার করেছে মেহেভীন। কারন তুমি যে অন্য কারো ভাগ্যে লিখা আছ। তুমি আয়মানের হও সেটা বিধাতাও চাইনি। তোমাকে আমার হতেই হবে। তোমাকে পাবার জন্য যদি আমাকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যেতে হয়। তাহলে আমি সেখানেই চলে যাব। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে, তোমাকে আমার নামে লিখিত ভাবে দলিল করে যাব। আমি ছাড়া যেন কেউ তোমায় স্পর্শ করতে না পারে। তোমার পাশে অন্য কেউ থাকবে। কথাটা কল্পনা করলেই, আমার হৃদয়ের গহীনে ভীষণ ব্যথা করে। তুমি কি সেটা উপলব্ধি করতে পারো। আমার অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করার জন্য হলে-ও তোমাকে আমার চাই মেহেভীন। কথা গুলো ভাবতেই বুকটা হাহাকারে ভরে গেল। ভালোবাসা মানুষকে এতটা ভালোবাসার পরেও, বলতে না পারার যে ব্যাপারটা। তার মতো বাজে অনুভূতি দু’টো নেই। বুকের ভেতরটায় অসহনীয় যন্ত্রনা করছে। মনটা ভিষণ ভাবে জ্বলছে। হারিয়ে ফেলার ভয় সব সময় কাবু করে রাখে। অনুভূতিরা নেতিয়ে যায়। আনন্দরা মেতে উঠতে ভুলে যায়। তুমি আমার হলে পৃথিবীর সমস্ত সুখ, আনন্দ, অনুভুতি, আবেগ সবাই আমার হবে মেহেভীন। আমি হয়ে উঠব ছোট বাচ্চা ন্যায় করব শিশুসুলভ আচরণ। কথা গুলো ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

চারদিকে পিনপতন নীরবতা সবাই গভীর আগ্রহে মেহেভীনে দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। প্রাপ্তির সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। এক ঝাঁক ভয় এসে মনের মধ্যে হানা দিয়েছে। ভয়ে জড়সড় হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। আয়মান এতক্ষণ ছিল না। সবে মাত্র বাসার মধ্যে প্রবেশ করেছে। মেহেভীনকে দেখে তার আঁখিযুগল স্থির হয়ে যায়। পুতুলের ন্যায় কি সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। সেদিন রাতের আলোয় ভালোভাবে দেখতে পাইনি সে। মেহেভীনদের বাসা তাদের বাসার থেকে তুলনামূলক ভাবে অনেক ছোট৷ তাদের বাসার মধ্যে চারদিকে রশ্মি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। মেহেভীনদের বাসায় তেমন আলো ছিল না। মুগ্ধ নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীন ভুল করেও আয়মানের দিকে নজর দেইনি। সে আমান চৌধুরীর কাছে গিয়ে বলল,

–এড বড় বাড়ি আপনাদের এলাকায় নাম ডাকও বেশ ভালো। তা বউয়ের হাত খরচ দিতে পারেন না নাকি। আপনার বাড়ির বউ যে অন্যের মেয়ের টাকা মেরে খায়। সে খবর কি রাখেন। মেহেভীনের কথায় আমান চৌধুরী বিস্মিত হয়ে যায়। সে বিস্ময় নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে কিছু কঠিন কণ্ঠে জবাব দিল,

–এসব তুমি কি বলছ! তোমার মাথা ঠিক আছে। আমাদেরকে তোমার কি মনে হয়! আমরা অন্যের টাকা মেরে খাই। আমাদের বাড়ির প্রতিটি ছেলে প্রতিষ্ঠিত। আমি আর আমার ভাই ব্যবসা করি। আমাদের কোনো দিকে কমতি নেই। তাহলে আমরা কেন তোমার টাকা মেরে খাব। তখনই আয়মান বলে উঠলো।

–এক হাতে কোনোদিন তালি বাজে না মেহেভীন। তুমি প্রাপ্তির কাছে টাকা পাঠিয়েছো কেন? প্রাপ্তি তোমার কাজের লোক নাকি যে তুমি প্রতি মাসে টাকা পাঠাবে। সেগুলো তোমার বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দিবে। তুমি কেমন মেয়ে নিজের বাবা-মায়ের হাতে টাকা তুলে না দিয়ে, নিজের চাচাতো বোনের হাতে তুলে দাও। তুমি শেয়ালের কাছে মুরগী বাগি দিবে। আর শেয়াল মুরগী টা খেয়ে ফেললেই দোষ। আয়মানের কথায় জ্বলে উঠলো মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,

–যার স্বভাব গিরগিটির মতো রঙ বদলানো। তার থেকে এসব ছাড়া বেশি কিছু আশা করা যায় না৷ আমি না হয় বাবা-মায়ের সুসন্তান হতে পারিনি। কিন্তু আপনি-ও একজন আদর্শ স্বামী হয়ে উঠতে পারেনি। আপনি তো একদম চোর স্বামী হয়েছেন। বউ অন্যের টাকা চুরি করে মেরে দিচ্ছে। আপনিও সেই টাকায় মজা লুটছেন। পরিস্থিতি আমাদের এমন জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়। অনেক সময় সহজ কিছুও কঠিন হয়ে যায়। আপনার মতো কাপুরুষের সাথে আমার বাবা বিয়ে ঠিক করেছিল। সেদিন আমি বাবা-মায়ের সন্মানের কথা চিন্তা না করে, আমার স্বপ্ন পূরন করতে চলে গিয়েছিলাম। একটা বার ভেবে দেখেছেন? আমি কোন মুখ নিয়ে বাবার সামনে আসতাম। আপনার বউ টাকা নিয়েই থেমে থাকেনি। আমার নামে বাবা-মায়ের কাছে নানারকমের মিথ্যা কথা বলেছে। আবার আমার কাছে বাবা-মায়ের নামে মিথ্যা বলেছে। আমি মানছি আমি খারাপ। আপনার বউ না হয় ভালো ছিল। সে চাইলই পারতো আমাকে আর বাবা-মাকে এক করে দিতে। সে দেয়নি। কেন দেয়নি জানেন সে আমার থেকে আর টাকা লুফে নিতে পারবে না। আপনি আর প্রাপ্তি আপু দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতেন। দু’জন বুদ্ধি করে বিয়ে করলেন। মাঝখানে থেকে আমার বাবা-মায়ের সন্মান আর আমার জীবনটা কেন নষ্ট করলেন। আমি বাসায় এসেছি একদিন হয়নি। মানুষ আমায় নিয়ে কটু কথা শোনাচ্ছে। আমাকে আঁড়চোখে দেখছে। আমার যে সন্মান নষ্ট হয়েছে। সেগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবেন। বউকে চুরি করার শিক্ষা দিচ্ছেন। সে তো আমার বোন ছিল৷ আমি তাকে ভিষণ ভালোবাসতাম। ভরসা আর বিশ্বাস থেকেই তাকে টাকা পাঠাতাম৷ এমনি এমনি পাঠালে আব্বু আম্মু টাকা গুলো ঠিক পাঠিয়ে দিত। সে এভাবে আমার সরলতার সুযোগ নিল! আজকে আপুকে জবাব দিতেই হবে। কেনো সে আমার সাথে এমন করল। আমার প্রশ্নের জবাব না দিলে, সবকিছু চূর্ণবিচূর্ণ করে দিব। জানের পরোয়া মেহেভীন করে না। আজকে আপনার বউকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। বেইমানি করার অপরাধে আপনার বউকে এমন শান্তি দেওয়া উচিৎ। তা দেখে যেন শহরের প্রতিটি অলিগলি কেঁপে ওঠে। মেহেভীনের কথায় পুরো পরিবেশ স্তব্ধ হয়ে গেল। এ যেন নিরতার মেলা বসেছে। প্রাপ্তি সুযোগ বুঝে পালাতে চাইল।

চলবে…..