Wednesday, August 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1992



সতীনকাঁটা পর্ব ৪

0

#সতীনকাঁটা পর্ব-৪
লেখায়ঃ(Nosrat Monisha)

হেঁচকা টানে তানজিনাকে নিজের দিকে টেনে তাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় আজুয়াদ।

দরজা খোলা থাকায় পুরো দৃশ্যটা দেখতে পায় রাফিয়া।
রাফিয়ার মনে হচ্ছিল কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে তার কলিজাটা কুচি কুচি করে কাটছে।
রাফিয়া মনে মনে বলে,
-খোদা, বেবাকতা (সব) জাইন্ন্যা-হুইন্ন্যা (জেনে-শুনে) ইত্তো হত্তীনের ঘর করবার আইছি তয় পরাণডা অত পুরাইতাছে কিয়ের লাইগ্যা?

আজুয়াদ একবার বাইরে দরজার তাকিয়ে দেখতে পেল রাফিয়া কাঁদছে।দৃশ্যটা দেখে তার গা জ্বলে ওঠে।তাই সে দেরী না করে তানজিনাকে ছাড়িয়ে রাফিয়ার মুখের উপর ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল।


রেহানা বেগম স্বামীকে পান সাজিয়ে দিচ্ছিলো।

-কামডা কি ঠিক অইলো, আবরারের মা?
-কুন কাম?
-ছোড বউমারে কুনদিন মন থেইক্যা আমরা কেউ মাইন্যা নিবার পারি নাই, আইজ নাটক কইরা কাম আদাই করতাছি। নাহ আমার পরানে মানতাছে না।

-আবাইত্তার(ফালতুর) মতো কতা কইয়ো না।ছোড বউয়ের কতা থুইয়্যা নিজের বইনজির (ভাগ্নী) কতা বাবো(ভাবো) । ছুডো মাইয়া এই বয়সে হত্তীনের ঘর কেমনে করবো।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আজম খান বলে,
-কতা হাছা কইছো। কি পোড়া কপাল লইয়্যা জন্মাইলো, বাপ মরা মাইয়্যাডার জীবনডা তোমার পোলার লাইগ্যা নষ্ট হইয়্যা গেলো।

মুখে আরো একটা পান গুঁজে দিয়ে, একটু রেগে রেহানা বেগম বলে,
-হুদাই(শুধু) হুদাই আমার আজুরে দোষ দিয়ো না। বেডা(পুরুষ) মাইনসের এড্ডু আড্ডু ছুকছুক স্বভাব থাহেই। ঘরের বউ বালা না হেয় তো অইলে বাইরে মুক দিবঐ। আর তোমার বইনজি পানিত পইরা যায় নাই। আমার আজুর খালি আগের একখান বউ আছে এইডা ছাড়া আর কুনো সমিস্যা নাই। হুন বেডা মানু অইলো সন্নের আংটি, ব্যাঁহ্যা (বাঁকা) অইলেও দর কমে না।

আমজাদ খান তার স্ত্রীর যুক্তি শুনে চুপ হয়ে যায়, কারণ তিনিও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে পুরুষ মানুষ স্বর্ণের আংটি।


এদিকে দরজা বন্ধ করে আবার তানজিনাকে কাছে টেনে নেয় আজুয়াদ ।

তানজিনা এবার চুপচাপ না থেকে নিজেকে আজুয়াদের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
-দাঁড়াও আজুয়াদ। আগে বোঝাপড়াটা শেষ হোক। এসবের জন্য সারারাত পড়ে আছে।

-তানু, কি বলছো তুমি কিসের বোঝাপড়া?

-তুমি খুব ভাল করেই জানো আমি কিসের বোঝাপড়ার কথা বলছি।এখন বলো।

-তানু, আজকে না। আমার এই অনুরোধটা রাখো।

-ঠিক আছে আমি জোর করবো না। কিন্তু সবকিছু না জেনে তোমার কাছাকাছি গেলে আমার নিজের উপর ঘৃণা চলে আসবে। তাই এখন চলে যাচ্ছি।
-না আমি তোমাকে যেতে দেব না।
ভ্রূ কুঁচকে তানজিনা বলে,
-জোর করবে?
-যদি বলি তাই।

তানজিনা গলাস্বর ভারী করে বলে,
-হ্যাঁ, সেটা তুমি করতেই পারো। সারাদিন পেছনে পড়ে থেকে প্রেম করতে পারো, আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে পালাতে বাধ্য করতে পারো, যখন ইচ্ছা গায়ে হাত তুলতে পারো আবার নতুন করে বিয়েও করতে পারো। এসব যদি তুমি করতে পারো তবে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার সাথে জোরও খাটাতে পারবে।

আজুয়াদের জানা ছিল না তানজিনা তার মনে এত অভিমান লুকিয়ে রখেছে। অবাক হয়ে আজুয়াদ বলে,
-তানু!

-অবাক হওয়ার কি আছে। আমি কি মিথ্যে বলেছি।
-না তানু, তুমি সত্যিটা বলেছো। আমি তোমাকে সম্মান দিতে পারি নি।

-তাহলে কি আমি চলে যাবো?

আজুয়াদ তানজিনার মনোভাব বুঝতে পারলো, তানজিনা সত্যিটা না জেনে আর কোনমতেই তাকে মানতে পারবে না।
তাই মনে মনে ভাবলো,
যে সত্যিটা এক না এক দিন তানজিনা জানতে পারবে তা আজকে বললে ক্ষতি কি?বরং অন্য কারো মুখে শোনার চেয়ে আমার মুখে শোনা ভালো ।
আজুয়াদ বলে,
-না, আমি এখনই সব বলবো।তুমি থাকো কিন্তু কথা দিতে হবে তুমি সবটা শুনবে।

-আচ্ছা শুনবো। তবে আমারও একটা কথা আছে, তোমাকে আল্লাহর কসম দিলাম একটা শব্দ মিথ্যা বলবে না আর লুকাবে না।

আজুয়াদের শেষ আশার আলোটা নিভে গেল সে ভেবেছিলো, কিছু সত্য কিছু মিথ্যা আর কিছু কথা গোপন করে তানজিনাকে বুঝিয়ে নিবে। কিন্তুু কসমের কারণে আর সেই উপায় রইলো না।

অবশেষে আজুয়াদ আর তানজিনা মুখোমুখি বসে। আজুয়াদ বলা শুরু করলো।

-তানু তুমি তো জানো, চাকরি হওয়ার পর আমি ঢাকায় গেলাম। ঢাকা আমার কাছে নতুন ছিলো না। আমার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সব ঢাকাতেই ছিল।
তবু বিয়ের পর তোমার সঙ্গ ছাড়া থাকতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, চিরচেনা ঢাকা শহরে আমি অনেক একা।

এর মাঝে একদিন ফুফুর ফোন আসে।

-আসসালামু আলাইকুম ফুআম্মা(ফুফুআম্মা)
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।আজু বালা আছোছ নি।
-জ্বি,আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনারা?
-আমরাও বালা। তয় একখান মুশকিলো পইরা ফোন দিছি৷
-কি বিপদ?
-তর বইনে হের ফুআম্মার লগে ঢাহা গেছিন। অহন তো এলহা(একা) এলহা আইবার পারে না। তুই যুদি হেরে এড্ডু দিয়া যাইতি।

-আমার তো অফিস আছে।
-তর না শুক্কুর শনি বদ্দ।
-জ্বি,আচ্ছা আমি শুক্রবার রাফিয়াকে বাড়ি পৌঁছে দিবো।

-না শুক্কুরবার না। মাইয়াডা খুব আউস(আশা) কইরা গেছিল, ঢাহা গুরবো। তুই এক কাম করিস শুক্কুরবারে হেরে এড্ডু গুরাইয়া শনিবার লইয়া আসিস। পরে তুই রোরবারে যাইছগা।

-আচ্ছা তাহলে রাফিয়ারে বলবেন শুক্রবার বিকেলে তৈরি হয়ে থাকতে।

-বিহালে কেন সহালে বাইর অইলে তো বেশি গুরন যাইবো।
-ফুআম্মা ঢাকায় কেউ সকালে ঘুরে না সবাই বিকেলেই ঘুরে।
-অ..

এরপর দিন চলে যায়। শুক্রবার বিকেল চলে আসে।
আমি রাফিয়ার ফুপুর বাড়ির বসার ঘরে তার ফুপুর সাথে গল্প করছিলাম আর তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
তখন রাফিয়া আসে। আমি রাফিয়াকে প্রথম এত খেয়াল করে দেখলাম। কেননা এর আগে আমি তাকে বাচ্চা ভাবতাম।
সেদিন রাফিয়াকে লাল থ্রি-পিসে অন্যরকম লাগছিলো। খেয়াল করলাম চোখে গাঢ় কাজল আর লিপস্টিক ছাড়া গোলাপি ঠোঁটে তার চেহারায় অদ্ভুত আভা ফুটে উঠেছে। বুঝতে পারলাম কৈশোর শেষে নব্য যৌবনে পা রাখার সৌন্দর্য এটা।

রাফিয়াকে নিয়ে বের হলাম। অনেক ঘুরলাম, রাতে বাইরে খেলাম তুমি তো এগুলো সবই জানো।
সন্ধ্যার পর তাকে নিয়ে তার ফুপুর বাড়ি দিয়ে আসলাম।
পরদিন সকালে ঢাকা থেকে রাফিয়াকে নিয়ে ফুপুর বাড়ি গেলাম।

তুমিতো জানো ফুপুর বাড়িতে এখনো বিদ্যুৎ যায় নি। তাই খুব গরম লাগছিলো। তার উপর রাতে হারিকেনের উত্তাপ গরমটা বাড়িয়ে দিয়েছিলো।
ঘুম আসছিলো না। তাই আমি দরজাটা খোলা রেখেই শুয়েছিলাম।

মাঝরাতে বুঝতে পরলাম কেউ ধীর পায়ে আমার ঘরে প্রবেশ করেছে।

দেখি রাফিয়া একটা নীল রঙের পাতলা জর্জেট শাড়ি পরে আমার বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি ধড়ফড় করে বিছানা থেকে উঠে রাফিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

-কিরে এত রাতে তুই এই ঘরে কি করিস। কেউ দেখলে ঝামেলা হবে যা।
-কেউ তো এইডা দেহে না আমি আপনেরে কত ভালাবাসি। তয় এইডা কেমনে দেকবো আমি এইহানে আইছি।

-কি বললি তুই? তোর মাথা ঠিক আছে তো?

-না, আমার মাতা ঠিক নাই, আমি পাগল অইয়্যা গেছি। যহনেত্তে ভালবাসা কি বুজজি, আপনেরে ভালবাসছি। আর আপনে তানজিনা ভাবীর লগে ভাগাইয়্যা বিয়া কইরালাছেন। আমার কতা ইট্টু(একটু) চিন্তা করলেন না।
বলে রাফিয়া কাঁদতে লাগলো।

কথাটা বলে আজুয়াদ থামলো হয়তো ভেবেছিলো তানজিনা কিছু বলবে কিন্তু তাজিনার পাথরের মতো স্থির দৃষ্টি নিয়ে বসেছিল।

তাই সে আবার বলতে লাগলো।
আমার কি হয়েছিলো জানি না।
কিন্তু এক সাড়ে সতেরো বছর বয়সী নব্য যুবতীর পাতলা শাড়ির আড়ালে থাকা যৌবন এক মুহূর্তের জন্য আমাকে বাধ্য করলো তোমার কথা ভুলে যেতে।

রাফিয়ার চোখের পানিতে সেইরাতে আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস ধুয়ে গেলো৷

আমি দুহাতে রাফিয়ার ধবধবে ফর্সা কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে কাছে টেনে নিলাম।
তারপর ওর ওষ্ঠদ্বয়কে গভীর চুম্বনে বার বার সিক্ত করে দিচ্ছিলাম।
তখনই রাফিয়ার দাদী চলে আসে।
উনি পানি খাওয়ার জন্য উঠেছিলো। আমাকে আর রাফিয়াকে ঐ অবস্থায় দেখে চিৎকার করে উঠে।
বাড়ির সবাই চলে আসে।আমার ঘোর কাটলে, নিজের ভুল বুঝতে পারি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
সবাই নানান কথা বললো, রাফিয়াকে মারধর করলো।

পরদিন ভোরে আমি পালিয়ে বাঁচলাম।

ঘটনার অনেক দিন কেটে গেলো।মা-বাবা বা অন্যকেউ আমাকে কিছু না বলায় আমি সবটা ভুলে গিয়েছিলাম।
তারপর বাবা গতকাল হঠাৎ ফুপু বাড়ি দাওয়াত নিয়ে উনার সাথে যেতে বলে।

আমি ভাবলাম সবার কাছ থেকে মাফ চাওয়ার এর চাইতে ভাল সুযোগ আর পাবো না তাই সাথে গেলাম।

ঐ বাড়ি গিয়ে দেখি রাফিয়ার হলুদ। খুব খুশি হলাম এই ভেবে রাফিয়ার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু আজ সকালে আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো, যখন বাবা বললেন রাফিয়ার বিয়ে আমার সাথে হচ্ছে।

-বাবা এসব কি বলছেন। আমি রাফিয়াকে বিয়ে কেন করবো আমি বিবাহিত ৷
-হেই জওয়াবডা(জবাবটা) আমি দেই আজু।
-ফুআম্মা,আপনি!
-হেইদিন রাইতে তর ঐ কান্ডের পর আমি মাইয়্যার বিয়া ঠিক করছিলাম। কিন্তু মাইয়্যা বিষ খাইলো।
-কি, বিষ! কিন্তু কেন?

মুখ বিকৃত করে তিনি বললেন,
-বেবাকতা জাইনা ঢঙ করিস না আজু। রাফিয়া আমারে সব কইছে। তুই হের লগে দিনের পর দিন পেরেম করছোস। ঢাকা নিয়া হের লগে ছি!ছি!ছি!

-ঢাকাতে আমি ওর সাথে কি করবো। আপনিইতো বলেছিলেন রাফিয়াকে নিয়ে ঘুরতে যেতে।

-আমি বাইরে গুবার কতা কইছিলাম আমার মাইয়্যারে লইয়া তর বাসাত গিয়া লীলা খেলা করনের লাইগ্যা কই নাই।

-ছি ফুআম্মা কি বলছেন এসব। আমি রাফিয়াকে নিয়ে আামার বাসায় কেন যাবো।

বাবা বললো,
-আমারে যহন বইনে কইল তর লাইগ্যা রাফিয়া বিয়া ভাইঙ্গা বিষ খাইছে, আমি এই বাইত আইলাম। ইতা(এসব) কতা মানতে আমি রাজি আছলাম না। কিন্তুক যহন মাঐমা(বোন/ভাইয়ের শ্বাশুড়ি) কইলো হেইলা কি দেখছে,শরমে আমার মাতা কাঠা গেল।
আমি কতা দিলাম কলঙ্ক যহন তুই দিছোছ তুইঐ ঘুচাবি। রাফিয়ারে তুই বিয়া করবি৷

আমি মাথা নিচু করে রইলাম।

ফুপু কেঁদে বলেছিল,
-দেখ আজু, তোরে জোর করমু না। তয় একখান কতা মনে রাহিস এই বিয়া না অইলে আমি আর আমার মাইয়্যা গলায় কলসি বাইন্দা ডুইব্যা মরুম।

-না বইনে(বোন) এই বিয়া অইবো। না অইলে খান বাড়িত আইজ আমজাদ খানের লাশ যাইবো। আজু ফয়সালা অহন তর বিয়া করবি কিনা।

এসব বলা শেষে আজুয়াদ থেমে তানজিনার হাত ধরে বলে,

-আমি কাউকে বুঝাতে পারলাম না যে রাফিয়ার সাথে আমার কিছু হয় নি,সে মিথ্যা বলেছে । তাই বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে হলো । বিশ্বাস করো তানু আমি শুধু তোমাকে ভালবাসি।

তানজিনা নিজের হাতটা ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়।

তারপর কিটমিট করে বলে,
-আমার এই মুহূর্তে কি ইচ্ছে করছে জানো, আজুয়াদ? বাইরে থেকে জুতা এনে ঠাস ঠাস করে তোমার দুই গালে মারতে। একজন তার মাথায় হাত দিয়ে কসম কাটিয়েছিল যে, শ্বশুর বাড়িতে যাই হোক আমি যেন বাবার বাড়ি ফিরে না যাই। তাই এখনো আছি, তা-না হলে অনেক আগেই তোমার সংসারের কপালে লাত্থি মেরে এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতাম।

অস্ফুটস্বরে আজুয়াদ বলে,
-তানু!!

-কি তানু? কিসের তানু? আমি ভাবছিলাম বাবা জোর করে তোমাকে বিয়ে করিয়েছে। আমি তো রাফিয়াকে আমার শত্রু ভাবছিলাম কিন্তু আমার প্রধান শত্রু তো তুমি। এখন ভালবাসার কথা বলছো, যখন সতের বছরের এক মেয়ের যৌবন দেখে সব ভুলে গিয়েছিলে, তখন কোথায় ছিলো এই ভালবাসা।

অনুরোধ করে আজুয়াদ,
-তানু, আমাকে মাফ করে দাও।ভুল হয়ে গেছে।কিন্তু এভাবে আমাকে অপমান করো না।

চেঁচিয়ে তানজিনা বলে,
-অপমান!মান-আপমান বোধ থাকলে রাফিয়ার সাথে এমন করতে?মেয়েটার এখানে কোন দোষ নেই, সে যাকে ভালবেসেছে তাকে সব উজাড় করে দিতে চেয়েছে। সেদিন ওর দাদী ঐ ঘটনা না দেখলে তুমি মেয়টার সাথে ছি! কি ভেবে এমন করেছিলে গাছের খাবে আবার তলারও কুড়াবে এমন কিছু?
আচ্ছা একটা কথা বলো, একই ভুল আমি করলে মাফ করতে তুমি। যাকগে তোমার সাথে কথা বলতে আমার গা ঘিনঘিন করছে।

আজুয়াদ রেগে গেল।এবার গলারস্বর উঁচু করে বলে,
-অনেক হয়েছে তানু। কখন থেকে মাফ চাইছি, বলছি ভুল হয়ে গেছে।তাছাড়া তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি রাফিয়ার কাছে যাই নি, সে নিজেকে সঁপে দিতে আমার কাছে এসেছিল। তাই দোষটা কিন্তু তার।আমার ভুল এটুকুই যে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি, একটু পিছলে গিয়েছিলাম। আর তুমি এই ছোট একটা ভুলের জন্য যা মুখে আসছে তা বলে অপমান করছো । ভুলে যেও না আমি তোমার স্বামী, আমাকে সম্মান করতে শেখো।

-এই হল তোমার আসল চেহারা। আসলে তুমি আমাকে ভাল-টাল কিচ্ছু বাস না যদি বাসতে তাহলে এটাকে ছোট ভুল মনে হতো না।তোমার মতো চরিত্রহীন কাপুরুষকে স্বামী বলতে আমার আত্মসম্মানে লাগে।

আজুয়াদ রাগ দেখিয়ে বলে,
-তানু আমার ধৈর্য্যের একটা সীমা আছে। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছ; যেন আমি চুরি,ডাকাতি বা খুনের মত জঘন্য কোন অপরাধ করেছি। আমি কালেমা পড়ে বিয়ে করেছি। তাছাড়া অনেকেই দুই বিয়ে করে, আর আমাকে তো বাধ্য করা হয়েছে বিয়েটা করতে।
এই যে, আমার ভালবাসা নিয়ে তুমি প্রশ্ন করছো, এখন আমি যদি প্রশ্ন করি তুমি আমাকে কেমন ভালবাস? যে সামান্য একটা ভুল মাফ করে রাফিয়াকে মেনে নিতে পারছো না।

তাচ্ছিল্য করে হাসলো তানজিনা,
-এতক্ষণে তোমার মনের কথা বুঝতে পারলাম। তোমার রাফিয়াকে বিয়ে করার জন্য কোন আফসোস হচ্ছে না। এত নাটক শুধু আমি যাতে রাফিয়াকে মেনে নিই তাই।

কথাগুলো বলে আজুয়াদ বুঝতে পারলো এইগুলো বলা তার উচিত হয় নি।
-তানু, তুমি আবার আমাকে ভুল বুঝছো।

-আমার যা বুঝার আমি বুঝে গেছি।

এই কথা বলে তানজিনা দরজা খুলে দেখলো রাফিয়া কান্নাভেজা চোখে দাঁড়িয়ে আছে।

তানজিনা রাফিয়ার দিকে এগিয়ে রাগী গলায় বলে বলে,
-এই লোকটা আমার কেউ হয় না, তুমি ভেতরে যাও। আমার ভালবাসাতো সেদিনই মরে গেছে যেদিন বিবাহিত হয়েও সে তোমাকে ছুঁয়েছিলো।

তাজিনা আর দাঁড়ায় না। দৌড়ে ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দেয়।

আজুয়াদ রাফিয়াকে বাহিরে রেখেই দরজা বন্ধ করে।

বাইরে রাফিয়া দরজা ধরে বসে পড়ে।
আর কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-আমি আপনেগো মইদ্দ্যে কুনদিন আইমু না। আমারে খালি হেই(সেই) রাইতের(রাতের) লাহান(মতো) এড্ডু কাছে টাইন্যা লইন।

আজুয়াদ কথাটা শুনতে পেলো, ওর বুকের ভিতরটা একটু মোচড় দিয়ে উঠলো । সে বুঝতে পারলো না তার রাফিয়ার জন্য খারাপ লাগলো কি-না।


মধ্যে রাত। কাল বৈশাখী ঝড় উঠেছে।

রাফিয়া দরজা ধরে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে গেছে।

কিন্তু তানজিনার চোখে ঘুম নেই। বাতাসে জানালা খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে সেজন্য জোরে জোর আওয়াজ হচ্ছে।
তানজিনা মনে মনে ভাবছে,
-বাহিরের ঝড়তো থেমে যাবে কিন্তু যে ঝড় আমার জীবনে উঠেছে সেটা থামবে কিভাবে। কি করে মুক্তি পাবো এমন একটা বিয়ে থেকে যেখানে সতীনকাঁটা ফুটে আছে।

বাইরে প্রচন্ড বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সেই আলোর ঝলকানিতে মাথার উপর স্থির ঝুলানো বৈদ্যুতিক পাখাটার উপর তানজিনার নজর পড়ে ।

ঝড়ে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল।

ফজরের পর আকাশটা বেশ পরিষ্কার দেখা গেলো।ভোরের আলো কেবল ফুটছে।

এমন সময় সানজিদার চিৎকারে সবার ঘুম ভেঙে গেলো।
-ও মা গো! কি সব্বনাশ অইলো গো।

-চলবে?

সতীনকাঁটা পর্ব ৩

0

#সতীনকাঁটা পর্ব-৩
লেখায়ঃ(Nosrat Monisha)

-ফহিন্নির মত কাফর(কাপড়) পিইন্দা আছো যে ছোড বউমা। এক্ষণ পাড়াত্তে বেবাকতে(সবাই) আইয়া পড়বো। হেরা তুমারে এমুন কাফরে দেকলে বাড়ির মান-ইজ্জত থাকবো?।
এসব বলে তানজিনাকে ঝাড়ছিল রেহেনা খাতুন।

তানজিনার অপরাধ সে রান্না-বান্না শেষ করে এখনো ভালো কাপড় পরে তৈরি হতে পারে নি।

-পাড়ার মানুষ তো আর আমাকে দেখতে আসবে না। আপনি চিন্তা করবেন না মা,আমি ঘর থেকে বের হবো না ।

-তুমি চাইতাছোডা কি হাছা কইরা কও দেহি। বেবাকতের সামনে খান বাড়ির ইজ্জত ডুবাইতে? নাইলে ঘররেত্তন বাইর অইবা না কেরে?

-এখানে ইজ্জত ডুবানোর কথা কেন আসছে মা? পাড়ার মানুষ নতুন বৌ দেখতে আসবে, আমি ঘরের ভিতরে থাকলাম না বাইরে থাকলাম তাতে কি যায় আসে?

-শিক্ষিত অইয়্যা মুরুখ্যের লাহান কতা কইয়ো না।
তুমি ঘরে খিলি দিয়া বইয়্যা থাকলে বেবাকতে কইবো আগের বউরে বেজার(অখুশি) কইরা খান বাড়ির পোলায় নতুন বউ আনছে।

-এটাই তো সত্যি মা।আমি তো আপনার ছেলের এই বিয়েতে খুশি নই।

-তুমার খুশি-বেজারে আমার কিছু আইয়্যে যায় না। তয় পাড়ার লোহের(মানুষের) কতায় বহুত কিছু আইয়্যে যায়। গেরামে আমরা(আমাদের) বাড়ির একটা ইজ্জত আছে। তুমি ঘরে বইয়্যা থাকলে মাইনসে কইবো খান বাড়ির মানু(মানুষ) বালা না, বউরে দুক(দুঃখ) দেয়।

নতুন বৌকে সাজিয়ে নিজের ঘরে যাচ্ছিলো সানজিদা। তখনই তার চোখ শ্বাশুড়ি-বউয়ের তর্ক চোখে পড়ে।

তাই সানজিদা সেখানে গিয়ে ফোঁড়ন কাটে,
-কারে কি বুজাঈন আম্মা। তানজিনা আফা যুদি বাড়ির মান-ইজ্জতের কতা চিন্তা করতো তয় কি ভাইগ্যা বিয়া বইত? আগে বাফের(বাবার) বাড়ির ইজ্জত ডুবাইছে অহন হঊর বাড়িরটা ডুবানের লাইগ্যা চেস্টা-চরিত্তি করতাছে।

-তা যা কইছো বড় বউমা। তয় তুমিও কান খুইল্যা হুন ছোড বউমা এইডা তুমার বাফের বাড়ি না হঊর বাড়ি। হেই বাইত যা করছো তা এই বাইত করন যাইবো না।অহন যাও তুমার মামা হঊরে যেই লাল শাড়ি কাফরডা দিছিন হেইডা পিইন্দা আহ। লগে এড্ডু সন্নও(স্বর্ণ) পিইন্দ। এমুন বিধবার লাহান আইয়ো না।

তানজিনা আর সেখানে দাঁড়ালো না কারণ এ বাড়িতে যখনই সানজিদা আর রেহানা খাতুন একসাথে হয়েছে তাকে অপমান করেছে। কখনো পড়াশোনা, কখনো তার ঘরের কাজ না পারা নিয়ে, কখনোবা তার শ্যামলা রঙ নিয়ে।
এমন না তানজিনা প্রতিবাদ করে নি।

কিন্তু সব প্রতিবাদের মন্তব্য এসে দাঁড়াতো,
যে মেয়ে নিজের মা-বাবাকে আঘাত দিয়ে দুই দিনের পরিচয়ে, একটা ছেলের সাথে পালাতে পারে, সে কিছুতেই ভালো হতে পারে না।

তানজিনা ঘরে এসে শাড়ি বদলাচ্ছে। আর ভাবছে,
আমার কি দোষ? এই পালিয়ে বিয়ে করেছি।
এই একটা ভুলের জন্য সবসময় সবাই কথা শুনায়। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা মা-বাবা তোলে গালি-গালাজ করে।
প্রতিবাদ করে কি পেয়েছি মাঝপথে পড়াশোনা থামিয়ে দিয়েছে তারা।
অথচ এই আজুয়াদের বাবাই আমার আব্বুর হাতে ধরে ওয়াদা করেছিল আমি যতদিন পড়তে চাই তারা পড়াবে।
আমার পড়া বন্ধ করে দেওয়ার পর যখন বাবা আর চাচা এসেছিল আমার শ্বশুরকে বোঝাতে তখন উনি বলেছিল,
বেয়াই বউ মানু ঢেঙ ঢেঙ কইরা রাস্তা দিয়া কলেজ যাইবো বালা দেহায় না। আর আমনের(আপনার) মাইয়্যারে তো কোনো কিছুর অবাবঅ(আভাবে) দেই না। অত পইরা কি অইব। এছাড়া হের মন তো ঘরের কামে কম কিতাবো বেশি থাহে।
আমার বাড়ির বউ ঘরে থাকবো কাম করবো, খাইবো, আইবোদ(বাচ্চা) পালবো। হেয় আর কলেজ যাইবো না, এইডা শেষ কতা।

না সেদিন আমার বাবা-চাচা প্রতিবাদ করতে পারে নি। মাথা নিচু করে এ বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো।
একবারও বলে নি চল তানজিনা, শুধু রান্না করা আর বাচ্চা মানুষ করার জন্য এ বাড়িতে তোর থাকতে হবে না।
তুই আমাদের বাড়ির মেয়ে কোন কাজের লোক বা বাচ্চা জন্ম দিয়ে লালন-পালনের যন্ত্র না।
আচ্ছা আমি যদি পালিয়ে বিয়ে না করতাম, যদি বাবার পছন্দে বিয়ে করতাম তাহলেও কি তারা আমাকে না নিয়ে এভাবে চলে যেতে পারতো?

এসব ভাবতে ভাবতে গয়না পড়তে লাগলো তানজিনা।
যখন হাতে চুড়ি পরবে তখন সেদিনের কথা মনে পড়লো যেদিন শ্বাশুড়ি এই চুড়ি নিয়েও তাকে কথা শুনিয়েছিলো।

একটু দেরি করে ঘুম ভাঙায় চুড়ি আর গলার চেইন না পরেই কাজ করছিল তানজিনা।
হঠাৎ আজুয়াদ এসে পানি খেতে চায়।সে স্বর্ণ পরে ঘুমাতে পারে না অস্বস্তি হয়।
তানজিনা পানি এগিয়ে দিলে তার শ্বাশুড়ি হাত থেকে গ্লাস ফেলে দেয়।
-বলি আমার পোলাডারে অসুকে(রোগে) ভুগাইতে চাও?
-মা আমি এমন কেন চাইবো? আর আপনি গ্লাসটা কেন ফেলে দিলেন?
-অ তুমি বুজ নাই ফিডার খাও। তোমার মায় কি শিহাইয়্যা (শিখিয়ে) হঊর বাইত পাডাইছে? এহেনিও(এতটুকু) জানো না খাইল্যা আত আর খাইল্যা গলায় সোয়ামীরে দানা-পানি দিতে নাই। হের অসুক অয়।

সামান্য একটা কারণে মা তুলে কথা তানজিনার ভাল লাগে নি।
তাই সে জবাব দেয়,
-মা এগুলো কুসংস্কার। কোন হাদিসে কিন্তু এসব লেখা নেই।
-অ-মায়া-মায়া-গো (বিশেষ বিলাপ) দুই দিনের মাইয়্যা আমারে কুরান-আদিস শিহায়। ও আজুরে, তুই কইত্তে আনছোস এইডারে?

সেদিন আজুয়াদ কিছু বলেনি তার মা’কে।

রাতে যখন তানজিনা তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিল ;তখন আজুয়াদ জবাবে বলেছিলো,
-তুমি এসব ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে ঝামেলা না করলেই পারো। মা’তো অনেক বড়ো কিছু করতে বলে নি, শুধু গহনা পরে থাকতে বলেছে। তাছাড়া গহনাতে তোমাকে বেশ সুন্দর লাগে।

অসাবধানতা বশত একটা কাঁচের চুড়ি ভেঙে তানজিনার হাত কেটে যায়। আর সে বর্তমানে ফিরে আসে।
তারপর রক্তটা মুছে একবার আয়নার দিকে তাকায়। তানজিনার মনে হয় নিজের প্রতিচ্ছবিটাও আজ তাকে দেখে হাসছে৷

বাজারে বাবুর্চি ঠিক করে বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরছে আমজাদ খান আর আজুয়াদ।

অনেকক্ষণ যাবত সাহস সঞ্চার করে আজুয়াদ কথাটা বলেই ফেলে,
-আব্বা আমি রাফিয়াকে তালাক দিবো৷

আমজাদ খান খুব বিজ্ঞ লোক। ছেলের মনোভাবটা সহজেই ধরে ফেললেন। তাই মাথা খাটিয়ে বলেন,
-তর বউ তুই তালাক দিবার পারস। তয় তালাক দিলে দুনো বউরে দেওন লাগবো।

-আব্বা এ কেমন কথা। তানজিনার কি দোষ? সে কেন সতীনের সংসার করবে?

-দুশ তো রাফিয়ারও নাই। যা দুশ সব তর। বউয়ের লাইগ্যা এত পীরিত আগে কই আছিন?

আজুয়াদ কোন জবাব দিতে পারলো না।

আমজাদ খান আবার বলে,
-খান বাড়ির পুরুষ মাইনসে দরহার অইলে চাইড্যা(চারটা) বিয়া করে, কিন্তুক তালাক দেয় না। আর তুই বউ খেদাবি (তাড়াবি) আমি বাইচ্যা থাকতে হেইডা অইবো না। দুই বউয়ের লগে বালা ব্যবার(ব্যবহার) কর দেকবি সব ঠিক অইব। সবতে(সবাই) সব মাইন্যা নিবো।

আজুয়াদ কোন কথা বলতে পারলো না,কোনদিনই পারেনি।
তাছাড়া বাবার সামনে কথা বলতে পারলে আজ তার অবস্থা এত করুণ হতো না।


এদিকে খান বাড়ির বসার ঘরে পাড়ার সব মহিলারা ভিড় জমিয়েছে।
নতুন বউ তার উপর ছেলের আগে একটা বউ আছে তাই ভিড়টা একটু বেশিই।সবাই আসলে নতুন বৌ দেখতে না পুরাতন বউয়ের কষ্ট দেখে মজা নিতে এসেছে।

-কিগো আবরারের মা আগের বউ পছন অয় নাই দেইখ্যা পোলারে আবার বিয়া করাইয়্যা দিলা?

-কি যে কন সালেহা ভাবী আমার পোলারে তো চিনেন। হেয় হের মজ্জি(মর্জি)মত বিয়া করছে। আগেরডাও অহেনরডাও।

-তা তুমার ছোডু বউ রাজি আছিন নি সোয়ামীর বিয়াত।

রেহানা খাতুন জানতো এই প্রশ্নটা উঠবে তাই তিনি এর উত্তর আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন।
-সোয়ামীর খুশিতেই ইস্তিরীর খুশি। আমার ছোড বউমা উচ্চ শিক্ষিত এইসব ভালা জানে বুজে। দেহেন না নতুন বউয়ের লগে কি সৌন্দর বইনের লাহান বইয়্যা রইছে। আইজকার বেবাক রান্নাও হেয়ই করছে।

সালেহা মুখ পানসে করে বলে,
-বালা অইলেই বালা।

এতক্ষণে রেহানা খাতুনের চাল বুঝতে পারলো তানজিনা। তাকে দিয়ে রান্না করানো, সাজিয়ে নতুন বউয়ের সাথে বসানো এসব করেছে তার শ্বাশুড়ি শুধু সবাইকে এটা বুঝাতে যে আজুয়াদ প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে বিয়ে করেছে।

তানজিনার ইচ্ছে করছিল চিৎকার দিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে আমি এ বিয়ে মানি না। কিন্তু বলে কি হবে কয়েকজন মজা পাবে, কয়েকজন দুঃখ প্রকাশ করবে। একসময় সবাই এক হয়ে তাকে নিয়ে গল্প করবে।

সবশেষে প্রমাণ হবে, নিশ্চয়ই তানজিনার মধ্যে তার স্বামী খারাপ কিছু পেয়েছে তা না হলে তার স্বামী কেন দ্বিতীয়বার বিয়ে করবে।এটাই সমাজের বাস্তব চিত্র।
একসময় সবাই চলে গেলো।

তানজিনা ঘরে চলে গেলো।
সন্ধ্যার পর আফিয়া এসে বলে তাকে রেহানা খাতুন ডাকছে।

ঘরে যেতেই তার শ্বাশুড়ি বলে,
-আইছো, এদিকে আহো। আমার কাছে বহো।
শ্বাশুড়ির এমন ভাল ব্যবহারের কোন কারণ খুঁজে পেল না তানজিনা। তাও গিয়ে পাশে বসলো।

তানজিনার শ্বাশুড়ি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে,
-মায়াআ(মা) আমি বুজি তর খারাফ লাগতাছে। কি করবি ক। যা অওনের তা তো অইয়্যাই গেছে।
এড্ডু মানাইয়া ল। তোরে একখান কতা কই হুনবি?

মাথা নেড়ে সায় দেয় তানজিনা। বিয়ের পর আজ প্রথম তার শ্বাশুড়ি তার সাথে ভাল ব্যবহার করছে,স্নেহ করছে। কিছু সময়ের জন্য তো সে সব দুঃখই ভুলে গেলো।

-তুই আজুরে এড্ডু বুজা, ছোট্টু মাইয়্যাডারে ঘরেত্তন বাইর কইরা দিছে৷ নতুন বউয়ের লগে কেউ এমুন করে? তুই ওর ঘরে যা গিয়া কবি তোর এই বিয়ায় কুনো আপত্তি নাই।

আবার ধোঁকা পেল তানজিনা। বুঝলো এ স্নেহ তার জন্য না রাফিয়ার জন্য।
কিছু না বলে চোখের পানি নিয়ে শ্বাশুড়ির ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

তানজিনা দেখতে পেলো রাফিয়া সেজেগুজে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পানিতে তার কাজল মুছে যাচ্ছে।

তানজিনা যেন নিজেকেই অন্যরূপে দেখতে পেলো। কারণ একইভাবে একদিন সেও দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। এ বাড়ির কেউ তাকে মেনে নিতে পারে নি বলে।

আজ রাফিয়ার সাথে বাড়ির সবাই তাও সে ঘরে যেতে পারছে না কিন্তু কেন? তাকে যদি এমন কষ্টই দিবে তাহলে বিয়ে কেন করেছে আজুয়াদ?

শ্বাশুড়ির কথায় গলে গিয়ে নয় এইসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আজুয়াদের দরজার কড়া নাড়লো তানজিনা।

ভেতর থেকে আজুয়াদের চিৎকার করা গলা শুনা গেলো,
-আবার যদি কেউ আমাকে ডাকে তাহলে আমি গলায়দড়ি দিবো।
তানজিনা একটু জোরেই বলে,
-আমি তানজিনা।

একটু পর খট করে আওয়াজ হলো এবং দরজা খুলে গেলো।

-চলবে?

সতীনকাঁটা পর্ব ২

0

#সতীনকাঁটা
পর্ব-২
লেখায়ঃNosrat Monisha

-একদম ঢং করবি না আমার সামনে। আমাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করার সময় মনে ছিলো না?তোরে তো আমার খুন করতে ইচ্ছে করতেছে।
আজুয়াদ এতটা চেঁচিয়ে কথাগুলো বলছিলো যে পাশের ঘর থেকে আমজাদ খান চলে এলো।

-হইতাছেটা কি এহানে? আজু, নতুন বউয়ের উপর কেউ এমনে চিল্লায়?
ধমকের সুরে কথাটা বলে আমজাদ খান।

-আমি তো কাল থেকে চুপই ছিলাম,আব্বা।এই কালনাগিনীর সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিলেেন। তাও চুপ ছিলাম। কিন্তু সে এই ঘরে থাকবে না বলে দিলাম।

-এগুলাইন কি কতা? মুহে মধু নাই? আর ভুইল্যা যাইস না যা হইছে এতে তোরও বরাবর দোষ আছিলো।তোর পছন না হইলে রাফিয়া এই ঘরে থাকবো না। কিন্তু হেইডা অইবো ফিরউল্ডার পর।

একথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে আজুয়াদ,
-কিসের ফিরউল্ডা আব্বা? বিয়েটাই যখন আমি মানি না।

দাঁত কিটিমিটি করে চিৎকার করে আমজাদ খান বলে,
-এহন না মানলে কি অইবো? ঘরে বউ রাইখ্যা পিরীত করবার সময় মনে আছিলো না?তিনদিন বাদে শুক্কুরবার তোগো বৌভাতের অনুষ্ঠান। তোর লাইগ্যা বইনের কাছে হের হউর(শ্বশুর) বাড়ির মাইনসের কাছে আমারে অনেক ছোড হউন লাগছো। এহন চুপচাপ এই অনুষ্ঠানগুলা কইরা আমারে উদ্ধার কর।

একটু নরম হয়ে আজুয়াদ বলে,
-আব্বা আমি কালও বলেছি, আজকেও বলতেছি রাফিয়া যা বলেছে তার অর্ধেকই মিথ্যা কথা।

-বাকি আধা তো হাছা এইডাই অনেক।

“ঘরে বউ রাইখ্যা পিরীত করার সময় মনে আছিল না?” শ্বশুরের এই কথাটা তানজিনার কানে বিষের মত বাজতে ছিলো, আর কোন কথা তার কানে পৌঁছাতেই পারলো না। সে বুঝতে পারলো আজুয়াদের সম্মতিতেই এ বিয়েটা হয়েছে ।

নিজেকে সর্বশক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে একটু জোরে কঠিন গলায় বলে,
-বাবা, এত ঝামেলা কেন হচ্ছে তাইতো বুঝতে পারছি না।শুধু শুধু একটা ঘর আগলে থেকে আমি কি করবো?যেখানে মানুষটাকেই আগলে রাখতে পারলাম না। আমি ঐ ঘরে চলে যাচ্ছি।

তানজিনা বের হয়ে গেলো।

আজুয়াদ এবার আর তাকে আটকাতে চেষ্টা করলো না। কারণ তানজিনা যেভাবে আর যে কথা বলেছে তাতে আজুয়াদের সাহস হলো না তাকে আটকানোর।

-দেখছো নি তেজ কমে না,মাইয়্যার। কতা-বারতার লাগাম নাই। বেত্তমিজ কোনহানকার।
রেহানা বেগম এত চেঁচিয়ে কথাগুলো বলেছে যে ঘর থেকে বের হয়ে উঠানে গিয়েও সব শুনতে পাচ্ছে তানজিনা।

-মা তানুরে কিছু কইলে বাড়িতে কিন্তু আগুন লাগাইয়া দিমু।

গলার স্বর উঁচুিয়ে আমজাদ খান বলে,
-আরে আবার কি অইলো? আর আবরারের মা তুমি এত কতা কিয়ের লাইগ্যা কইতাছো? বুইড়া বয়সে কেচা(মাইর)খাইবার মন চাইছে নি?

আমজাদ খানের কথায় রেহানা খাতুনের মুখটা চুন হয়ে গেল।

-আজু, তুই খারাইয়্যা আছোছ কেন?জলদি যা গতর ধুইয়্যা ল বাজারো যাওন লাগবো। আবরাররে ফোন করছি হের আইতে আইতে বুইধবারে অইবো।তাই আমার লগে সব বাজার-আট তোরই করন লাগবো।

আজুয়াদ পুকুরে ডুব দিতে চলে গেল। আর আমজাদ খান নিজের ঘর।

ইচ্ছেমত তানজিনাকে কথা শুনাতে না পারায় গা জ্বলতে ছিলো রেহানা খাতুনের।
-শত্তুরের ঘরে তো শত্তুরইতো জন্ম নিবো। যেমুন বাপ তেমুন পোলা। আমার লগে হেরা ভালা ব্যবহার করতেই পারে না।
নাকি কান্না কেঁদে কথাগুলো বলছিলো তিনি।

তখন আফিয়া বলে,
-আম্মা ছোট ভায়ের আর আব্বার কি দোষ? সব তো হইছে ভাবীর লাইগ্যা।

মুখ বাঁকিয়ে রেহানা খাতুন বলে,
-হের কতা আর কি কমু? যবেত্তোন (যেদিন থেকে)এ বাইত আইছে আমার হাড্ডী-গোশত জ্বালাইয়্যা খাইতাছে।

এতক্ষণ রাফিয়া চোখের পানি ফেলছিলো।
-থাহুক না মাইমা(মামীমা)। তানজিনা ভাবীরে আর বইক্যেন না। দোষতো আমার আমিই তো হের সংসার ভাঙবার আইছি।
বলে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল।

সানজিদা মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-অ্যাঁ..তুমি কান্দ কিয়ের লাইগ্যা? তানজিনা আফারে আমি ছোডোত্তে চিনি। হের পেডে পেডে যে কত্ত বড় শয়তান লুকাইয়্যা আছে হেইডা আমি জানি। হের আর হের মা’র কামই অইলো ছলাকলা কইরা বাড়ির পুরুষ মাইনসেরে বশ করা।

রেহানা খাতুন সানজিদার কথায় তাল মিলায়,
-বড় বৌমা উচিত কতা কইছে। তুই কানবি না। নিজের সোয়ামীর মন জয় কর। কিরে পারবি না।

-আফনেরও যেমুন কতা আম্মা কেন পারবো না? আমাগো রাফিয়ার যে রূপ! হেই রূপ দেইখাইতো আজুয়াদ ভাই সব ভুইল্যা যাইবো।
বলে রাফিয়ার গায়ের সাথে নিজের গা দিয়ে একটা ধাক্কা দিলো সানজিদা।

সানজিদার এমন টিটকারির বিপরীতে রাফিয়া কিছু বলতে পারলো না । শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

-অক্করে হাছা কতা কইছেন বড় ভাবী কই ছোড ভাবী আর কই আমাগো রাফিয়া। কথাটা আছিয়া বলে। তার রাজপুত্রের মতো ভাইয়ের বৌ তানজিনার মত বয়সী কালো মেয়ে এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি।

ভারাক্রান্ত গলায় রাফিয়া বলে,
-না,গো আফিয়া আফা। তানজিনা ভাবী অনেক গুণবতী।হেইলার তুলুনায় আমি কিচ্ছু না।

মুখ বাঁকায় সানজিদা,
-ভাবী কি গো রাফিয়া আফা ডাহো। হেয় অহন তোমার হত্তীন। আর তুমি অতো নরম অইয়ো না। হেরে অহনো তুমি চিনো নাই। ছুডুবেলাত্তন আমারে জ্বালাইছে। হেয় নাহি ফাশ কইরা জজ-বেরিস্টার অইবো।আমি পড়া-লেহায় এড্ডু খারাপ আছিলাম তাই কত কতা হুনতে অইছে। আমার আব্বাতো আমার চাইতে তানজিনা আফারে আদর করে।কিয়ের লাইগ্যা না হেয় গুনবতী। ভাইগ্যা বিয়া বওনের সময় কই আছিলো গুণ?পুরা বংশের মুহে চুনকালি মাহাইছিলো। এরপরেও আমার বাপে তানজিনা তানজিনা করে। পুরুষ মাইনসেরে হেরা মা-বেডী খুব বাইন্দা রাখবার পারে। সময় থাকতে নিজের সোয়ামীরে সামলাও গো রাফিয়া। নাইলে তোমার হত্তীন তোমারে এই বাড়ির বাত(ভাত) খাইবার দিবো না।

-বড় বৌ ঠিকই কইছে তোর মন পরিষ্কার তাই ঐ মাইয়্যার ছলা-কলা তুই বুঝবি না। নিজের সোয়ামীরে আঁচলের সাথে বাইন্ধা রাখবি বুঝবার পারছস নি?

এভাবেই তিনজন মিলে রাফিয়ার কানে বিষ ঢালতে থাকে তানজিনার বিরুদ্ধে।

-কি-রে আজু হুনলাম তুই নাহি আবার বিয়া করছোস?
শান বঁধানো পুকুর ঘাটে বসে দাঁতে খিলাল করতে করতে প্রশ্নটা করেছে আজুয়াদের পাশের বাড়ির মুরব্বি করিম মুন্সি। সাধারণত ই সময় খান বাড়ির পুকুরে তিনি ছাড়া আর কেউ আসে না।

আজুয়াদ কিছু বলতে পারলো না। শুধু মাথা নিচু করে সায় দিলো।

-তগো এহনকার পোলাপাইনের মতিগতি বুঝা মুশকিল। অত কিছু কইরা তো পাশের গেরামের ভুঁইয়াগো মাইয়াডারে বিয়া করছোস, অহন বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার নয়া বউ ঘরে তুলছোস? তয় কি সবাই রূপের পুজারি।একখান কতা কই, আগের বউডারে অনাদর করিস না। তরে ভরসা কইরা ঘর-দোর ছাড়ছিলো অহন হত্তীনের বাত খাওন লাগবে।ডর লাগতাছে, মাইয়াডা না আবার তগো বাড়ির মাইনসের অত্যাচার আর তর অনাদরে হারায়িয়্যা যায়।
ওজু করে করিম মুন্সি চলে গেলো। তিনি এখন খান বাড়ির মসজিদে বসে কুরআন তিলাওয়াত করবেন। তারপর একবারে জোহরের নামায পড়ে বাড়ি যাবেন। এটাই তার রোজকার নিয়ম।

পুকুরে ডুব দিতে দিতে আজুয়াদ মনে মনে ভাবতে লাগলো,
-রূপে আমি ভুলে যাবো? আমি অনাদর করবো তাও তানুকে? কখনোই না। সারাজীবন ওকে আগলে রাখবো আমি। একটা ছোট ভুলের জন্য আমি তানুকে হারাতে পারবে না। দরকার হলে রাফিয়াকে তালাক দিবো। আব্বার সাথে আজই কথা বলবো।

আজুয়াদ উঠানে পা রাখতেই আমজাদ খান বলে,
-আজু, তুই তৈয়ার হইয়া ল।হাটে যামু। বাবুর্চি ঠিক করুন লাগবো৷ কিছু সদাইও করুন লাগবো।

-আচ্ছা।
বলে আজুয়াদ ঘরে গেলো।

আজুয়াদ আলমারি খুলে দেখে তানজিনার কাপড়ের জায়গায় রাফিয়ার কাপড়। এটা দেখে তার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেলো।

এমন সময় রাফিয়া গোসল করে ঘরে এলো।

রাফিয়াকে দেখে নিজের রাগ ঝাড়তে আজুয়াদ রাফিয়ার গালে স্ব জোরে চড় দিলো। রাফিয়া মেঝেতে পড়ে গেল।

-ও মাগো। বলে রাফিয়া চিৎকার করে উঠে।

– আমার লগে ন্যাকামি করবি না তোর জিনিস যাতে আমার আলমারিতে না থাকে।
বলে রাফিয়ার সব কাপড় ছুঁড়ে তার মুখের উপর ফেলতে লাগলো।
রাফিয়ার চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে আজুয়াদের ঘরে এলো৷

ঘরের এলোমেলো অবস্থা আর রাফিয়ার ফর্সা গালে পাঁচ আঙুলের দাগ দেখে সবাই বুঝতে পারলো কি ঘটেছে।

আমজাদ খান হুংকার দিয়ে ওঠে,
-আমার মা’য়ের গায়ে হাত তোলার তোর সাহস কেমনে হয়?

আজুয়াদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। কারণ যাই হোক সে একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলে অন্যায় করেছে।

অবশ্য এই অন্যায়টা এর আগেও সে একদিন করেছিলো তানজিনার সাথে। আর এই মানুষগুলোই তার কাজের জন্য সেদিন তাকে বাহবা দিয়েছিলো।

কিন্তু আজ রাফিয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বদলে যায়।

আজুয়াদের চোখের সামনে সেই দিনটা ভেসে উঠে,
-আজুরে, কই গেলি রে? দেইখা যা তোর বউ কি করছে। আমার কি সব্বনাশ অইলো গো।

-কি হয়েছে আম্মা চিল্লাচ্ছো কেনো?

-হ আমি তো খালি চিল্লাই আর তোর বউ আমার লগে কাইজ্জা করে তার বেলা?

তানজিনার বিয়ের তখন তিনমাসও হয় নি।শ্বশুড় বাড়ির সবাই তার সব কাজে ভুল ধরতো।বিশেষ করে তার শ্বাশুড়ি।

তানজিনা সহ্য করতো।কিন্তু আজ এত সামান্য একটা ব্যাপারে তিনি এত হুলস্থুল বাঁধিয়েছে যে
তানজিনা জবাব দিয়ে ফেলে,
-মা আপনি শুধু শুধু ব্যাপারটা নিয়ে ঝামেলা করতেছেন। আমি হাতের কাজটা করেই আসছিলাম।

মুখ বাঁকিয়ে রেহানা খাতুন বলে,
– তোমার কাম মানে তো সারা দিন তো কিতাবের মাইধ্যে থাহা। সংসারের কামে মন নাই কিছু না।

আজুয়াদ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-হইছেটা কি বলবা তো?
-কি আর অইবো? তোর আব্বায় এতগুলান বাজার আনছে। তোর বউরে কছিলাম গুছাইয়া রাখতে হেয় কইলো হাতের কাম সাইরা পরে আইবো। একঘন্টা হইয়া গেলো হেয় কিচ্ছু করে নাই। যাইয়া দেহি নবাবের ছেড়ি টেবিলে বইয়্যা পড়ে । মাছগুলাইন পঁইচা গেলো। এতক্ষণ কেরে আইলো না জিগাইতেই কয় এতো জরুরি হইলে আফিয়ারে কেন ডাকলাম না।

প্রতিবাদ করে তানজিনা বলে,
-মা আপনি কেন শুধু শুধু মিথ্যা বলছেন। আপনি আমাকে ডেকেছেন দশ মিনিটও হয় নাই তার মধ্যেই আমি চলে আসছি। আর আফিয়ার কথাতো আমি এমনি….

কথাটা শেষ করার আগেই আজুয়াদ তানজিনার দুই গালে ঠাস ঠাস করে চড় মেরে বসে।

তারপর প্রবল আক্রোশে বলে,
-হারামজাদি আমার আম্মারে মিথ্যাবাদী বলিস? আমার মা-বোন তোরে কাজ করে খাওয়াবে? আর তুই নবাবের বেটী পায়ের উপর পা তুলে বসে খাবি? আজকে থেকে তোর পড়ালেখা বন্ধ। আবার যদি তোরে বইয়ের সামনে বসতে দেখি তবে আমি তোর বই খাতা আগুন দিয়া পুড়িয়ে ফেলবো।
এরপরে গটগট করে বের হয়ে গিয়েছিল।
ঘটনার আকষ্মিকতায় তানজিনা বুঝতে পারছিল না, কি হচ্ছে তার সাথে। এই কি সেই আজুয়াদ য়ার হাত ধরে সব সম্পর্ক ভুলে সে ঘর ছেড়ে এসেছিলো।

[অবশ্যই পেইজটি ফলো করে, নোটিফিকেশন ফাস্ট অপশন চালু করে রাখুন। তাহলে গল্প পোস্ট হওয়া মাত্রই জেনে যাবেন]

এতসবের পরেও ছেলের শাসনে খুশি হতে পারে নি রেহানা খাতুন। তাই আমজাদ খান বাড়ি এলে বিচার দেন।
আমজাদ খানও জরুরি তলব পাঠায় ছেলে আর ছেলের বউকে।

-তেমার মায়ের কাছ থেইক্কা সব হুনলাম। বউয়ের হইয়া তোমার কিছু বলার আছে আজু?

-আব্বা, তানু একটা ভুল করে ফেলেছে।

ধমক দিয়ে আমজাদ খান বলে,
-কিয়ের ভুল। নিজের হউরির(শ্বাশুড়ির) লগে তক্ক করে, হেরে মিথ্যাবাদী কয়,এইডা কোন ভুল? না, এইডা গুনা । তাই তুই যা শাস্তি ঠিক করছোস তাই অইব। আইজকার পর ছোট বউমা লেহাপড়া করবো না।

-কিন্তু বাবা আমি তো এমনি রাগের মাথায় কথাটা বলেছিলাম।

-হেইডা আমি বুইঝাই তোগোরে ডাকছি। এই বাড়ির বাত খাওনের হইলে তোর বউয়ের পড়া ছাড়ুন লাগবো।

তানজিনা শ্বশুরের পায়ে ধরে বসে কান্না করে দেয়।
-বাবা আমার ভুল হয়ে গেছে। আমারে আর একটা সুযোগ দেন। আমার পড়া বন্ধ করবেন না।একটু দয়া করেন।

আমজাদ খান তার সিদ্ধান্তে অনঢ় হয়ে বল,
-অহন সুযোগ দিলে তুমি আবার একই অন্যায় করবা।হেইডা আমি অইতে দিমু না। তাই কোন সুযোগ দেওন যাইবো না।

সেদিন তানজিনার পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শ্বশুর-শ্বাশুড়ির পায়ে ধরেও লাভ হয় নি।
সেদিন বাড়ির সবার কাছে অনেক প্রশংসা পেয়েছিল আজুয়াদ।

আজও একই কাজ করেছে শুধু মানুষটা বদলে যাওয়ার কারণে তিরস্কার পাচ্ছে !

আমজাদ খানের চিৎকারে হুঁশে আসে আজুয়াদ।
-কিরে কতা কছ না কেরে? এই শিক্ষা দিছি? ফুলের মতো মাইয়ার গায়ে হাত দেছ।

-ভুল হইছে আব্বা।
বলে বের হতে নিলে তাজিনার মুখোমুখি হয় আজুয়াদ।

চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সেও এসেছে। সব দেখে পুরোনো কথাগুলো মনে করছে। মাথা নিচু করে সরে গিয়ে আজুয়াদকে জায়গা দিলো।

আজুয়াদ দিকে তাকিয়ে দেখে এই কয়েক ঘন্টায় যেন ঝরে যাওয়া শুকনো ফুলের মত শুকিয়ে গেছে তানজিনা।

তানজিনার এ চেহারা সহ্য করতে পারছে না আজুয়াদের নিজেকে শেষ করে দিতে মন চাইছে তার। চোখ নামিয়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

-পোলার উপর চিল্লাও কেন? নষ্টের গেড়া তো অইলো তোমার ছোড বউমা । হেয়ই আড়ালে আজুর কান ভারী করছে। নাইলে এমুন পরীর লাহান বউরে আমার পোলায় মারে? রেহানা বেগম নিজের স্বামীকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে।

আমজাদ খান তানজিনার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
-তোমার জইন্য যুদি আমাট ভাগ্নীর কোন অসুবিদা অয় তাইলে কিন্তু তোমারে আমি ছাইড়া দিমু না।

আমজাদ খান রেগে বের হয়ে যায়।

রেহানা বেগম চেঁচিয়ে বলতে থাকে,
-সংয়ের মত খারাইয়া আছো কেন?যাও ভালা কিছু নাস্তা বানাও। দুফুরের পরেই নতুন বৌ দেখতে সবাই আইতে শুরু করবো, তাগো সামনে তো কিছু দেওন লাগবো। আফিয়া, যাতো দৌড়াইয়া ফিরিজত্তে বরফ লইয়া আয়। আহারে গালঢা লাল হইয়া রইছে। না জানি কত জ্বলতাছে।

তানজিনা এই আদিখ্যেতাগুলো আর নিতে পারছিলো না। তাই বের হয়ে রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছে।
আর মনে মনে ভাবছে,
-কি কপাল আমার স্বামী সতীন নিয়ে এলো।মন খুলে একটু কাঁদতেও পারলাম না। পাড়ার লোক সতীনকে দেখতে আসবে তাদের আপ্যায়নের জন্য রান্নাও আমাকেই করতে হবে। আজ আমি এতটাই অসহায় আর নিরুপায় যে বাপের বাড়িও যেতে পারছি না। কপালে সতীনকাঁটা ফুটে সব তছনছ হয়ে গেছে।

একটা করুণ দীর্ঘঃশ্বাস্ বের হয়ে এলো তানজিনার মুখ থেকে।

-চলবে?

সতীনকাঁটা পর্ব ১

2

সতীনকাঁটা পর্ব ১

তোর কপাল পুড়ছেরে তানজিনা আফা।তোর জামাই নতুন বউ লইয়া আইছে দুয়ার খুইল্যা বাইরে আইয়্যা দেখ।খুবতো তহন ভাইগ্যা বিয়া বইছিলি। এহনতো জামাই হত্তীন লইয়া আইছে।

এমন না আমি দেখেনি ঘটনাটা। সবকিছু দেখেই ঘরে খিল এঁটেছি। তবুও আমাকে বার বার ডেকে কথাগুলো বলে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে বড়জা সানজিদা।

সম্পর্কে আপন চাচাতো বোন আমরা। বয়সেও আমিই সানজিদার চেয়ে চার বছরের বড়। কিন্তু ছোট থেকেই সানজিদা আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না।
সানজিদা কখনো চায় নি আমি খান বাড়ির ছোট বউ হয়ে আসি। এমনকি আমার আর আজুয়াদের রিয়েতে দুই বাড়ির কেউ রাজি ছিলো না।
আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি তো একদমই না। কারণ প্রথমত তারা এখনি তাদের ছোট ছেলেকে বিয়ে করাতে চায় নি৷ দ্বিতীয়ত তারা চেয়েছিলো বড় ছেলের বউয়ের মতো স্বল্প শিক্ষিত আর কম বয়সী মেয়ের সাথে ছোটো ছেলের বিয়ে দিতে ।
সেদিকে থেকে আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ি।আবার বয়সেও আজুয়াদের থেকে মাত্র দু’বছর ছোট। আবার গায়ের রঙটাও হালকা চাপা।
দুই বাড়ির কাউকে আমাদের রাজি করাতে পারছিলাম না। এদিকে আমার মা-বাবা আজুয়াদের সাথে আমার সম্পর্কের কথা জানতে পেরে বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলেন।শত চেষ্টা করে যখন আমার বিয়েটা ভাঙছিল না তখন একরকম নিরুপায় হয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি আমি আর আজুয়াদ।
বাড়ির মানসম্মান রক্ষা করতে সবাই বাধ্য হয়ে আমাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছিলো।
শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়ি কিংবা সমাজের মানুষের দেওয়া অপমান-লাঞ্ছনা সব তখনি তুচ্ছ হয়ে গেছে যখন আজ নিজের স্বামী আজুয়াদকে বরের বেশে নতুন বউয়ের সাথে বাড়ির দরজায় দেখলাম।
বদ্ধ ঘরে বসে এসব কথাই ভাবছে তানজিনা ৷

এদিকে আমজাদ খান তার স্ত্রী রেহেনা খাতুনকে জোরে হাঁক দিয়ে বলে,
-আবরারের মা, এত দূর থিকা আইসা আর কতক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকমু? নতুন বৌ ঘরে তুলো।

পান চিবোতে চিবোতে রেহানা খাতুন বলে,
-বউ ঘরে কেমনে তুলুম? আজুয়াদের বউয়ের লাইগ্যা বানানি সব গয়না তো দিয়া দিছি। আর তোমাগো উচ্চ শিক্ষিত বউ তো ঘরে খিল দিছে।

আমজাদ খান বলে,
-আল্লা দিলে তোমারে তো কম গয়না দেই নাই। ঐখান থেকে একটা দিয়া নাহয়..
-তুমি চুপ থাকো শুভ অশুভের একটা ব্যাপার আছে ।ঐ খানদানি গয়নাগুলা আজুয়াদের বউয়ের লাইগ্যা ।হেইগুলাতে নতুন বৌয়ের হক আছে। ঐ গয়না ছাড়া আমি নতুন বৌ ঘরে তুলুম না।
আমজাদ খান বিরক্ত হয়ে তানজিনার ঘরের দিকে গেলেন।

অনেকবার ডাকার পর কোন সাড়া না পেয়ে। একসময় রেগে গিয়ে বলে,
-এবার যদি বাইর হইয়া না আসো তবে দরজাটা ভাইঙ্গা ফালামু ছোট বউমা।

তানজিনা ভেতরে থেকে শ্বশুরের গলা শুনতে পায়।
তানজিনা ধীর পায়ে খিল খুলে দেয়।

-ছোট বউমা ভালা কইরা হুনো(শুনো)। পুরুষ মাইনসের চাইরডা বিয়া জায়েজ। এহন বিয়া হইয়া গেছে নতুন বউয়ের সাথে বইনের মতো থাকবা। যাও দেহি অহন তোমার শ্বাশুড়ির দেওয়া খানদানি বালাজোড়া লইয়া নতুন বউরে বরণ করতে আসো।
চোখে পানি চলে আসে তানজিনার। অস্ফুটস্বরে শ্বশুরকে বলে,
-বাবা, আমি বরণ করবো!
-তুমি নাইলে আর কে করবো?এ বাড়ির বউ হিসাবে তোমার একটা দায়িত্ব আছে না?যাও অহন জলদি করো, আর কথা বাড়াইয়ো না। নতুন বৌ সারাদিন বাইরে দাড়াইয়্যা থাকবো নি?

তানজিনা চুপচাপ আলমারি থেকে গয়নার বাক্সটা বের করে। বালাজোড়া দেখে তার অতীত মনে পড়ে।
যেদিন তানজিনাকে তার শ্বাশুড়ি বালা পরাচ্ছিলো পাড়া-প্রতিবেশী সবাই ছিলো।

একসময় পাশের বাড়ির সালেহা বলে উঠে,
-কিছু মনে কইরো না আবরারের মা তোমার ছোট বউয়ের রঙটা একটু ময়লা। ধলা অইলে বালা জোড়া হাতে ফুইট্টা থাকতো।
-কপাল সবই কপাল গো আফা। নাইলে পোলা এমুন কাম করে? শত্তুর পেটে ধরছি।
-হুনছি তোমার ছোট বৌ আর আবরারের বউয়ের বইন লাগে?
-ঠিকই হুনছো। হেরা হুদ্দোর(আপন) চাচাতো বইন।
-তয় এগো রঙে এত ফারাক কেন?

এই কথা শুনে পাশ থেকে সানজিদা বলে উঠে,
-চাচী আমাগো পুরা বংশে সবাই ধলা। খালি জেঠী মানে তানজিনা আফার মায় কাইল্যা। আফা হের মা’র মতো হইছে।
-অ্যঁ, বলে মুখ বাঁকায় সালেহা বেগম।
-আর দুইন্যার বেবাক মাইয়া থুইয়্যা আমার পোলার ওরেই বিয়া করা লাগলো। না আছে রূপ, না আছে বয়সে তালগোল। এই মাইয়্যা লইয়া আমার আজু যে কেমনে ভাত খাইবো কে জানে?

– ছোট বউমা হলো তোমার।
আমজাদ খানের ডাকে বর্তমানে ফিরে আসে তানজিনা।
-আসছি বাবা, বলে গয়নার বাক্সটা আলমারিতে রেখে বালা জোড়া নিয়ে বের হয়।

তারপর মাথানিচু করে সেটা শ্বাশুড়ির হাতে দেয়।

রেহানা খাতুন নতুন বৌকে বালা জোড়া পরিয়ে বরণ করে।
-দেখছো নি আম্মা নতুন ভাবীর হাতে বালা জোড়া কি সুন্দর ফুটছে।, কথাটা বলে আজুয়াদের ছোট বোন আফিয়া।
-ফুটবো না? হাজারে এক নতুন বৌমা। গায়ের রং তো না যেনো কাঁচা অলদি(হলুদ) ।

আজুয়াদ এসব আর নিতে পারছিলো না তাই গটগট করে ভেতরে চলে গেল।

বাকিরা নতুন বৌকে ঘরে নিয়ে যাবে সেই সময় সানজিদা ফোঁড়ন কাটে,
-নতুন বউরে কোন ঘরে নিমু আম্মা?
-এ আবার কেমুন কথা বড়বৌমা? নতুন বৌ তার সোয়ামীর ঘরে যাইবো।
সানজিদা তানজিনাকে শুনানোর জন্য জোরেই বলে,
-তাইলে তানজিনা আফা কই থাকবো?
রেহানা খাতুনও উঁচু গলায় বলে,
-হেয় দরকার হইলে আইজ আফিয়ার ঘরে থাকবো। নিজের সোয়ামীরে আঁচলের বাইন্ধা রাখুনের লাইগ্যা রূপও লাগে হেইডা হের অহন বুঝোন লাগবো।

আফিয়া তানজিনাকে খুব একটা পছন্দ করে না। তাই মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-আমি কারো লগে এক ঘরে থাকবার পারুম না। তাছাড়া ছোট ভাবীরও তো একটা আলগা ঘর লাগবো নাকি?
আমজাদ খান ধমকের সুরে বলে,
-এই বাড়িত কি ঘর কম নাকি?দরকার হইলে ছোটবউ এহন থিইকা দক্ষিণের ঘরে থাকবো। যাও তোমারা, এই নিয়া আর কোন কতা না। নতুন বৌ লইয়া ঘরে যাও সে অনেকক্ষণ দাড়াইয়া আছে।হের কষ্ট হইতাছে।

শ্বশুরের এমন কথা দুঃখের মধ্যেও হাসি পেলো তানজিনার।
যেদিন বিয়ে করে এসেছিল টানা আট ঘন্টা খান বাড়ির প্রধান ফটকে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো সে।
যখন তার বাবা আর ছোট চাচা এসে মাফ চেয়েছিলো তখন তাকে ঘরে তোলা হয়েছিল ।

কিন্তু আজ সেই আমজাদ খান নতুন বউয়ের কষ্ট খুব সহজেই বুঝতে পারছে ।
বুঝবে নাই-বা কেন?
নতুন বৌ যে আর কেউ না তারই ছোট বোনের একমাত্র মেয়ে রাফিয়া।
নিজের ভাগ্নীকে কি করে কষ্ট দিবেন তিনি।

গতকাল হঠাৎ আজুয়াদকে নিয়ে তার বাবা আমজাদ খান তার ফুপুর বাড়ি গিয়েছিল। যাবার সময় বলেছিলো, আম-কাঁঠালের দাওয়াত নিয়ে যাচ্ছে ।সেখান থেকে আজ ফিরলো।সাথে রাফিয়াকে নিয়ে এলো খান বাড়ির বউ বানিয়ে।

-পাত্তরের মত খারাইয়্যা না থাইক্যা ঘরেত্তে জিনিস-পত্তর নিয়া আসেন।
আফিয়ার কথায় সম্বিত ফিরে পায় তানজিনা।
অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– আমাকে কিছু বলেছো আফিয়া?
-আপনেরে কমু না তয় কারে কমু? মা’য় কইছে আপনার জিনিসপাতি নিয়া দক্ষিণের ঘরে যাইতে। দেরী কইরেন না নতুন ভাবী জিনিস গুছাইয়া গোসল করবো। বৈকালে পাড়া-প্রতিবেশী আইবো বউ দেখতে। জলদি করেন।

আফিয়ার এমন ব্যবহারে তানজিনা মোটেও আবাক হয় নি। কারণ এবাড়িতে আসার পর কেউ তার সাথে ভাল ব্যবহার করে নি।
যার কাছ থেকে তানজিনা ভালবাসা আর সম্মান পেয়েছিলো সে ছিল তার স্বামী আজুয়াদ। কিন্তু আজ সেই স্বামীই তাকে জীবনের চরম আঘাত দিলো।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে জিনিসপত্র গুছাতে চলে গেলো।

ঘরে গিয়ে দেখে তার শ্বশুর আর আজুয়াদ ছাড়া সবাই আছে।সবার মধ্যমনি হয়ে খাটের উপর বসে আছে রাফিয়া।
তানজিনার মনে হচ্ছে কেউ তার বুকের ভিতরে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করছে। কষ্টে দু’ফোটা পানি বের হয়ে এলো। কারও নজরে আসার আগেই সেই পানি মুছে ফেলে সে।

তানজিনা চুপচাপ জিনিসপত্র গুছানো শুরু করে দিলো। সে তার কাপড়-চোপড় ব্যাগে ভরছিলো আর ফাঁকে ফাঁকে আঁড়চোখে নিজের ঘরটা দেখছিলো।

ঘরের প্রায় সব জিনিসই তানজিনার বাবার দেওয়া। গয়না থেকে শুরু করে সংসার সাজানোর সব জিনিসই দিয়েছিলো তানজিনার বাবা তারেক ভুঁইয়া। তিনি ভেবেছিলো এসব জিনিস দিয়ে মেয়ের অপরাধ ঢেকে দিবেন।
কিন্ত একবারও এটা ভাবেন নি যে ছেলেটা তার মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছিলো সেও সমান অপরাধী।না এটা সমাজের কেউ ভোবতেই পারে না। কারণ এসব ক্ষেত্রে ছেলেকে কখনোই অপরাধী সাব্যস্ত করা হয় না।

জিনিস গোছানোর সময় সবার কিছু ভাসা ভাসা টিপ্পনী তানজিনার কানে আসছিলো,
-রূপ না থাকলে খালি মিষ্টি কতায় কিছু হয় না।
-কই তানজিনা কই আমাগো রাফিয়া। মাশাল্লাহ দেখতে একদম আসমানের পরী। রঙটাও পাইছে অক্করে নানির লাহান ।

চোখের পানি আটকানোর অনেক চেষ্টা করছিলো তানজিনা। কিন্তু তানজিনার মনে হলো আজ নিজের চোখের পানিও তার শত্রু হয়ে গেছে। যতই বাধা দিচ্ছে আবার দ্বিগুন গতিতে দু’গাল দিয়ে বেয়ে পড়ছে।
রেহানা খাতুন তানজিনাকে তাড়া দিয়ে বলে,
–বলছি এখন যা লাগে খালি সেগুলান নিয়া ঘরটা খালি করো।বাকি জিনিস পরে নিও।এতো ভারী শাড়ী গয়না পইরা রাফিয়া আর কতক্ষণ থাকবো?
সানজিদা আগুনে ঘি ঢেলে বলে,
-ব্যাগ গুছাইতে এতো সময় লাগে না আম্মা। তানজিনা আফা এড্ডু বেশিই কানতাছে তাই সময় লাগতাছে।
হুংকার দিয়ে ওঠে রেহানা খাতুন,
-তোমার চক্ষের পানির কারণে যদি আমার আজু আর রাফিয়া সংসারে কোন অশান্তি হয় তোমার খবর আছে। আরে কেমুন ইস্ত্রিরী তুমি সোয়ামির ভালা বুঝো না।

তানজিনা কোনরকমে কিছু কাপড়-চোপড় গুছিয়ে ঘর হতে বের হয়ে যাচ্ছিলো, তখনই আজুয়াদ তার সামনে এসে দাঁড়ায়।

-তুমি কোথায় যাচ্ছো,তানু?

তানজিনা এই ঘটনার পর আজুয়াদের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেনি। আর তার ইচ্ছেও করছেনা তাকাতে তাই মাথা নিচু করে রইলো।

রেহানা খাতুন খাটে বসেই জবাব দিলো,
-রাফিয়া নতুন বৌ। তাই তোর আব্বা আর আমি ঠিক করছি ছোটবৌমা কয়েকদিনের জন্য দক্ষিণের ঘরে থাকবো।

এই কথা শুনে ক্ষোভে ফেটে পরলো আজুয়াদ। চিৎকার করে রাফিয়ার দিকে আঙুল তুলে বলে,
-আমার ঘরে থেকে কেউ বের হলে এই মেয়ে বের হবে তানু না।

কথাটা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল আর রাফিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো।

-চলবে?

#সতীনকাঁটা পর্ব -১
লেখিকাঃNosrat Monisha

বিঃদ্রঃএটা একটা সামাজিক গল্প।
আমার কাছে সামাজিক কাহিনি মানে পল্লীসমাজ, গৃহদাহ, বিষবৃক্ষ ইত্যাদি উপন্যাস। যা শিখেছি সমাজের সেসব কমতি নিয়ে লিখতে চেষ্টা করেছি।

সম্পৃক্ততা ১৮ পর্ব এবং শেষ পর্ব

0

সম্পৃক্ততা – ১৮তম পর্ব / শেষ পর্ব।

রিফাত হোসেন।

৩৯.
সজল দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে বলল, ” দেখেছ আসমা, আমি বলেছিলাম না খুব শীঘ্রই তোমাকে আমার কাছে আসতে হবে।”
আসমা দুই হাত বুকের নিচে জড়ো করে নড়েচড়ে দাঁড়ালো। হেসে বলল, ” হুম, বলেছিলেন তো।”
” আমি কিন্তু আগেই জানতাম তুমি নিজেই আমার কাছে আসবে। আসতে বাধ্য হবে। বাধ্য হয়েছ না?”
” হয়েছি।” মিটমিট করে হাসল আসমা।
দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে তাকালো মাথার উপরে থাকা চাঁদের দিকে। আশ্চর্য ; চাঁদও মিটমিট করে হাসছে! আসমা উৎকণ্ঠাযুক্ত গলায় কিছুটা চেঁচিয়ে বলল, “তাকিয়ে দেখুক, চাঁদ হাসছে; মিটমিট করে।”
সজল উপরের দিকে তাকালো না। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে পিছনে তাকালো একবার। আসমা আড়চোখে সজলের হাবভাব দেখল; তাঁর মনে হলো, আকাশের দিকে তাকানোর থেকেও পিছনের দিকে তাকানোটা সজলের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আসমা অস্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। বলল, ” প্লিজ, একবার উপরের দিকে তাকান।”
সজল তাকালো না এবারও। আসমা ক্ষিপ্ত গলায় চেঁচিয়ে বলল, “বিলিভ মি, দ্যা মুন ইস স্মাইলিং।”
সজল ভড়কে গেল। আসমার দিকে এগিয়ে এসে গা ঘেষে দাঁড়ালো। এরপর আসমার মতো করে মাথাটা সামান্য তুলে চোখ রাখল খোলা আকাশের দিকে; আকাশের গায়ে আষ্টেপৃষ্টে থাকা চাঁদের দিকে। চাঁদটা কী সুন্দর দেখতে! সাদা রঙের গোলাকার ফুটবলের মতো দেখতে চাঁদটাতে কালো দাগ আছে । তবুও কত সুন্দর তাঁর রূপ! মানুষের গায়েও কখনো কখনো কালো দাগ থাকে। কিন্তু তাকে কখনোই সুন্দর বলা হয় না। মুখে কালোর ছাপ আছে মানেই তাঁর রূপ নেই। অথচ তাঁরা বুঝে না, কালোতে কত মায়া আছে! কত মততা, কত সৌন্দর্য আছে!

অবাক কাণ্ড! সজল স্পষ্ট দেখলো, চাঁদ হাসছে! ঠিক যেভাবে বলল আসমা, সেভাবেই হাসছে; মিটমিট করে। যেন সে প্রেমে পড়েছে! সজল উত্তেজনায় আসমাকে চেপে ধরল। আসমা বাধা দিলো না। সে তাকিয়ে আছে মিটমিটিয়ে হাসতে থাকা চাঁদের দিকে। সজল, আসমার সাথে ঘেষে দাঁড়িয়ে, আসমার শরীর চেপে ধরে কানে কানে বলল, ” এই সময় আমাদের পাশে তৃতীয় ব্যক্তি থাকলে কী বলতো জানো?”
আসমা ঘোরলাগা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ” কী?”
” বলতো, এই দু’জন নির্ঘাত প্রেমের সমুদ্রে ডুব দিয়েছে। তাই গম্ভীর চাঁদকে বলছে, মিটমিট করে হাসছে।”
আসমা চোখ নামিয়ে পাশে থাকা সজলের দিকে তাকালো। দু’জনের মধ্যে দূরত্ব এক ইঞ্চি কিংবা আরো কম হবে। আসমা সেই সামান্য দূরত্বটুকু মাড়িয়ে সজলের একটা হাত ধরল। আবারও আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত উঁচু করে দেখালো, ” ওই দেখুন চাঁদ। শুধু যে মিটমিট করে হাসছে, তা না, মুচকি হাসিও দিচ্ছে।”
সজল নিজের হাত গুটিয়ে নিলো; সাথে আসমাও। কারোর মুখে খানিকক্ষণ কথা থাকলো না। সাহসা সজল একটা ভয়ঙ্কর প্রস্তাব দিয়ে বসল। বলল, ” আসমা, তোমার গালে একটা চুমু দিবো?”
আসমা হতভম্ব! সজলের মুখে এ ধরণের কথা শোভা পায় না। আসমার রাগ হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু অদ্ভুতভাবে সে লজ্জা মেয়ে গেল। সজলের চোখের দিকে আর সরাসরি তাকালো না। বলল, ” এটা যে পাপ, তা কী আপনি জানেন না?”
” জানি। কিন্তু খুব লোভ হচ্ছে।”
” সবাই তো কপালে অথবা ঠোঁটে চুমু দেয়। হাতেও দেয়। আপনি গালে দিতে চাচ্ছেন কেন?”
” জানি না। শুধু এটা জানি, আমাকে তোমার গালে একটা চুমু দিতেই হবে।” সজলের মধ্যে থেকে তীব্র অস্থিরতা বেরিয়ে এলো।
” আপনার চোখে আমি কামনা দেখতে পাচ্ছি সজল সাহেব। শান্ত হোন।”
” মিথ্যা কথা। তুমি এখনো আমার চোখের দিকে তাকাওনি ভালো করে। আমার চোখে কী আছে, তা তোমার জানার কথা না।”
” তবুও আমি বলব, আপনার মধ্যে কামুকতা প্রকাশ পাচ্ছে।”
” বিপরীত সত্তার দু’টো মানুষ এই রাতেরবেলা এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। কামুক যন্ত্রণা হবে না? এটা কী খুব অস্বাভাবিক কিছু?”
” নিজেকে সংযত করুন। যে ব্যক্তি সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজেকে সংযত রাখতে পারে; সেই ব্যক্তিই একজন প্রকৃত এবং আদর্শবান পুরুষ।”
” যে আদর্শতা আমাকে ভালোবাসার মানুষকে স্পর্শ করতে বাধা দেয়, সেই আদর্শতা আমি চাই না। আমি একজন সাধারণ পুরুষ। এটাই আমার পরিচয়। এবং একজন সাধারণ পুরুষ হয়ে বলছি, তোমাকে স্পর্শ করতেই হবে। একটা চুমু দিতেই হবে।”
“শুধুমাত্র একটা চুমু দিবেন?” মুখ টিপে হাসল আসমা।
সহজ হেসে বলল, ” খুব বেশি লোভ হলে দু’টোও দিতে পারি। আবার না-ও দিতে পারি।”
আসমা নিঃশ্বাস আটকিয়ে বলল, ” দিন।”
চোখ বন্ধ করল আসমা। সজল নিজের ঠোঁট জোড়া আস্তে আস্তে আসমার গালের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। আসমার বুক বিদ্যুৎ গতিতে ধুপধাপ করছে। দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে বুকের ভিতর। চিনচিন ব্যথা করছে। শরীর কাঁপছে। কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। আসমার মনে হচ্ছে, চাঁদও ওর মতো কাঁপছে; ঘামছে! চোখ মেলে চাঁদের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। এই বুঝি উষ্ণতা তাকে স্পর্শ করবে! প্রথম কোনো পুরুষ কামুকতা থেকে তাকে স্পর্শ করছে! অনুভূতিটা যেন অন্যরকম!

সজল অনেকটা সময় স্থির দাঁড়িয়ে থেকেও আসমার গালে ঠোঁট ছোঁয়াতে পারল না। শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে দ্রুতবেগে কয়েকপা পিছিয়ে গেল। এটা পাপ করা হচ্ছে। খুব বড় অন্যায় করা হচ্ছে। অন্যদিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, ” আসমা, চলো একটু হাঁটাহাঁটি করি। এই ছাঁদের কার্নিশ ঘেষে। যান্ত্রিক আলো দেখি, প্রাকৃতিক আলো দেখি। শরীর ভেজাই, মন ভেজাই, একে অপরকে ভিজিয়ে দিই।”
আসমা নিঃশ্বাস ছাড়ল বড় করে। চোখ মেলে দেখল, সজল তাঁর বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে; অন্যদিকে তাকিয়ে। ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নিলো আসমা। কেঁশে বলল, ” আচ্ছা।”
দু’জনে ছাদের কোণা ঘেষে হাঁটতে লাগল। মাঝের দূরত্ব খুব বেশি না হলেও আবার ভুল করার মতো না। নিজেদের কন্ট্রোল করার মতো দূরত্ব বজায় রেখেছে দু’জনে।

রাত আনুমানিক ১০ টা। ছাদের এপার-ওপার হাঁটছে দু’জন মানুষ; নির্ভয়ে। বাড়িটার দু’তলায় থাকে আসমার বড় বোন ফাতেমা; নিজের পরিবার নিয়ে। আজ তাহমিদের বিয়ের দাওয়াতে এসেছে আসমা। সজলও বিয়ের দাওয়াতে এসেছে। সব কিছু যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল আসমার কাছে। যেদিন তানিশা আসমাদের বাড়ির কুয়োতলায় বসে সবাইকে তাঁর আর তাহমিদের সম্পর্কের কথা বলেছিল, সেদিনই আসমা, তানিশা আর তাহমিদের গল্প করছিল সজলের কাছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সজল জোর গলায় বলেছিল, খুব শীঘ্রই আসমা তাঁর কাছে আসতে বাধ্য হবে। ঠিক তাই হয়েছে। তাহমিদের বিয়েতে দাওয়াত পেয়ে আসমা নিজের গোটা পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। সাথে আসে রাইশা এবং ওর স্বামী। আসমা তখনও বুঝতে পারেনি, ঢাকায় সজলের সাথে তাঁর দেখা হবে। সজল জানতো। সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিল আসমার জন্য। ফাতেমার সাথে সজলের যোগাযোগ আগে থেকেই ছিল। ফাতেমা যখন ঢাকায় স্বামীর বাসায় থেকে পড়াশোনা করতো, সজল তখন নিজের মামার বাসায় থেকে পড়াশোনা করতো। একই ইউনিভার্সিটিতে না হলে দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। মাঝে মাঝেই দেখা হয়ে যেতো, কথা হতো। এই ব্যাপারটা আসমা জানতো না। সময়টা অনেকদিন আগের ছিল। সেসময় আসমার আর সজলের সম্পর্কের শুরু হয়। ফাতেমা এটা জানতো না। তাই সজলের বিষয়ে কোনোরকম আলোচনা সে করেনি আসমার সাথে। ঢাকায় একই এলাকাতে বসবাস না অবশ্য; তবে খুব বেশি দূরে না। রাইশার বিয়ের পর আসমা ঢাকায় ফিরেই আবার যোগাযোগ করে সজলের সাথে। তাহমিদের বিয়েতে ইনভাইট করে সজলকে। আসমা সবাইকে নিয়ে বিয়ের তিনদিন আগে ঢাকায় আসে। সেদিনই দেখা হয়ে যায় দু’জনের। একান্ত কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ হয়। সজলের মামার বাড়িতে যায় আসমা। সবার সাথে আলাপ করে। নুপুরে বাবা, সজল আর আসমাকে আশ্বস্ত করে এই বলে, তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকেই ওদের বিয়েটা দেবেন। সেই থেকেই নিশ্চিন্ত দু’জনে। এরপর আস্তে আস্তে দু’টো দিন কেটে গিয়ে আজ তাহমিদের বিয়ের দিন চলে এলো। সজল পুরোপুরি ভাবে বিয়েতে যোগ দেয়। তাহমিদ আর ফাতেমা, সজলকে অনুরোধ করে, বিয়ের শুরু থেকে শেষ, সারাক্ষণ যেন সাথে থাকে। সজল থেকেছে, থাকছে। অন্তত আসমার জন্য থাকতেই হবে। এর মধ্যে আসমার বাবার সাথে কয়েকবার মুখোমুখি হয়েছে। তিনি কয়েকবার বাঁকা চোখে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেছেন। বিয়ের ঝামেলা আজকের মতো শেষ হতেই কিছুটা সময় কাটানোর জন্য সবার দৃষ্টির অগোচরে ছাদে আসে আসমা আর সজল।

৪০.
অনিক আর তৃষ্ণা ইউনিভার্সিটি থেকে একসাথে বাড়িতে ফিরছে। অনিকের বাড়ি আর তৃষ্ণার বাড়ি খুব কাছাকাছি না হলেও একই এলাকায়। দু’জনে সাভার স্ট্যাণ্ডে নেমে হাঁটতে লাগল। হঠাৎ তাহমিদের সামনে পড়ে গেল। আচমকা তাহমিদকে দেখে হতবাক হয়ে গেল তৃষ্ণা। মুখ দিয়ে কথা বেরুলো না। অনিক ঢোক গিলে ইতস্ততভাবে ভাবে তাহমিদকে সালাম দিলো, ” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”
” ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো অনিক?”
” ভাইয়া আপনি আমার নাম জানেন?” অনিকের চোখ জোড়া বড় গোলাকৃতি হয়ে গেল।
” জানবো না? যে আমার বাড়িতে গিয়ে, একতলা টপকিয়ে দু’তলায় গিয়ে চিঠি দিয়ে আসে, তাঁর নাম না জানলে যে অন্যায় হবে। তাছাড়া, ইদানীং আমার বোনটার সাথে তোমাকে অনেকটা বেশি সময়ই দেখা যাচ্ছে৷ তোমার ব্যাপারে সবরকম খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে আমার।”
অনিকের মনে হলো, সে তাহমিদকে যতটা সাদামাটা ভেবেছে, লোকটা আসলে ততটা সাদামাটা না। অনেকটাই বুদ্ধিমান মানুষ। এই মানুষটার সাথে ভেবেচিন্তে কথা বলাই শ্রেয়।
অনিক আড়চোখে তৃষ্ণার দিকে তাকালো একবার। দেখল, সে ভয়ে চুপসে আছে। ছটফট করছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে বারবার। দৌড়ানোর রাস্তা খুঁজতে কি-না, কে জানে! অনিক কী বলবে, খুঁজে পেলো না। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
তাহমিদ, দু’জনের দিকে একবার তাকিয়ে পরিবেশ সহজ করতে হেয়ালি গলায় বলল, ” অবশ্য, আমি চিঠিটা পড়তে পারিনি। পরে পড়ব বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু সকালে শার্টটা ধুয়ে দিয়েছি। চিঠিটা যে আমার শার্টের পকেটে ছিল, গোসল করার সময় সেটা স্মরণে ছিল না। থাকলে অবশ্যই আমি চিঠিটা সরিয়ে রাখতাম। নিজে না পড়লেও অন্যকে দিয়ে পড়াতাম। উল্টো পাল্টা কিছু শুনলে ভাবতাম, লোকজন তো মানুষকে নিয়ে নিন্দাসূচক কথা বলবেই। এইসবে কান দিলে তো চলবে না। নিজে পড়লে তো আর এই ভাবনাটা ভাবতে পারতাম না।”
তৃষ্ণার ফেকাসে মুখটা সাহসা উদ্ভাসিত হয়ে গেল। চমকে যাওয়ার মতো করে চোখদুটো গোল করে জিজ্ঞেস করল, ” তারমানে তুমি চিঠিটা পড়োনি? ওটা ছিঁড়ে গেছে। ওয়াও।”
তৃষ্ণার উত্তেজনা দেখে গম্ভীরমুখে তাকালো তাহমিদ। হাতের তালু কপালে ঠেকিয়ে ছোট ছোট চোখ করে আকাশের দিকে তাকালো। মধ্যদুপুরের উত্তপ্ত সূর্য শরীর যেন ঝলসে দিচ্ছে। সে তানিশাদের বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি যাচ্ছে। বিয়ের আজ তৃতীয়দিন। তানিশা নিজের বাড়িতে আছে এখনো। বিকেলে আবার ওই বাড়িতে যাবে তাহমিদ।

তাহমিদ খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল, ” তৃষ্ণা, এত খুশি হচ্ছিস কেন? চিঠিটা বেশ কয়েকদিন আগে দিয়েছিল। তুই তো আমাকে এই প্রসঙ্গে কিছুই জিজ্ঞেস করিসনি। তাই আমিও আগ-বাড়িয়ে কিছু বলিনি।”
” তুমি কিছু জিজ্ঞেস করোনি বলেই আমিও আর নিজের বিপদ ডেকে আনতে চাইন। আসলে ভাইয়া, ওটা কোনো চিঠিই ছিল না। জাস্ট একটা সাদা কাগজ। যার মধ্যে লেখা ছিল কয়েকটা নাম। আমরা তো ক্যাম্পাসে প্রায়ই অনুষ্ঠান করি। সেখানে আমরা গান গাই, নাচ করি। কে কে এইসব করবে, সেগুলোরই একটা লিস্ট ছিল ওখানে। আমরা যে বাড়িতে ছিলাম না, সেটা ও জানতো না। কারণ আমার নম্বর ওর কাছে ছিল না। ও এটাও জানতো না, আমার ঘর কোনটা। তাই তো দু’তলায় একটা ঘরের বারান্দায় লিস্টটা রেখে চলে গেছে।”
তাহমিদ হেসে বলল, ” তা, তোদের কোন বান্ধবীর নাম ‘প্রিয় রূপবতী’, শুনি একটু? আমি এই লেখাটাই শুধুমাত্র স্পষ্ট দেখেছিলাম।”
তৃষ্ণা কোনো উত্তর দিলো না। চুপসে গেল সে। অনিকেরও একই অবস্থা।

তাহমিদ কিছুক্ষণ পর গলা খাঁকারি দিয়ে অনিককে বলল, ” তোমার বাড়িটা কোন দিকে যেন?”
অনিক ঘুরে একটা মোড়ের রাস্তা দেখিয়ে বলল, ” এই রাস্তায় দিয়ে সামনে গেলেই আমার বাড়ি।”
” ওহ্ আচ্ছা। ঠিক আছে, তুমি আপাতত বাড়িতে যাও। আমি তৃষ্ণার সাথে যাচ্ছি।”
অনিক একবার তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে, আবার তাকালো তাহমিদের দিকে। সালাম দিয়ে উত্তরের অপেক্ষা না করেই দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। তাহমিদ হেসে, তৃষ্ণার কাধের উপর হাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ” ছেলেটা খুব একটা খারাপ না, তাই না? আমি খোঁজখবর নিয়েছি। বেশ ভদ্র ছেলে। পরিবারও খুব ভালো। আমাদের মতোই সাধারণ জীবনযাপন করে। এটাই তো সেই ছেলে, যে ভুল করে আমার ঘরে চিঠি দিয়েছিল।”
তৃষ্ণা উত্তর দিলো না। এড়িয়ে গেল, তাঁর ঘরেও একটা চিঠি দিয়েছিল। তাহমিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার জিজ্ঞেস করল, ” তুই কি ওকে পছন্দ করিস?”
উত্তর দিলো না তৃষ্ণা। হাসল একটু। তাহমিদ যেন এতেই বুঝে গেল। আবার প্রশ্ন করল, ” খুব বেশি ভালোবাসিস?”
লজ্জা পেলো তৃষ্ণা। হেসে তাহমিদের পেটে খোঁচা মেরে বলল, ” তুমি চুপ করো তো ভাইয়া। ক্ষিধে পেয়েছে, তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলো। আর দুপুরবেলা শ্বশুরবাড়ি থেকে এলে কেন? খেতে দেয়নি বুঝি?

তাহমিদ হাসল। তৃষ্ণার কাধের উপর হাত রেখে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগল।

পরিশেষঃ
আসমা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, গেইটের সামনে লোকজনের ভীড়। সজলকে দেখা যাচ্ছে না এই ভীরের মধ্যে। তবুও মন শান্ত রেখেছে সে। তাঁর কল্পনায় সজল উপস্থিত আছে। পরণে পাঞ্জাবি আর পাজামা। ঠোঁটের কোণে হাসি। উদ্ভাসিতমুখে এগিয়ে আসছে ভিতরের দিকে। আসমার পাশে আছে তানিশা আর তৃষ্ণা। ওরাও জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দেখছে বাইরের দৃশ্য।

রাইশা হঠাৎ দৌড়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। আসমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ” আপু, ওখান দিয়ে দেখছ কেন? উঠোনে এসো।”
রাইশার কথা শুনে তাজ্জব দৃষ্টিতে তাকালো আসমা। দরাজ কণ্ঠে বলল, ” পাগল হয়েছিস নাকি? মা মাইর দিবে না?”
রাইশা পাল্টা কঠিন মুখ করে জবাবে বলল, ” মা বকবে কেন? তোমার বরকে তুমি যেখান থেকে ইচ্ছে, সেখান থেকে দেখবে। এখানে মা বকবে কেন?”
“তুই চুপ করবি? যা এখান থেকে।” ধমকালো আসমা।
” না এলে মিস করবে কিন্তু। বাইরে এসে দেখো, সজল মাস্টারকে বর বেশে কী দারুণ লাগছে! মনে হচ্ছে ২২ বছরের তরতাজা যুবক। কে বলবে, এই মানুষটার বয়স ৩০ পেরিয়ে গেছে।” রাইশা খিলখিল করে হেসে উঠল কথাটা বলে৷
আসমা ভাবতে লাগল চুপচাপ। সজলকে দেখার খুব লোভ হচ্ছে তাঁর। কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পাবে; তবুও ইচ্ছে করছে এখন তাকে দেখতে।
আড়চোখে একবার তানিশা আর তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে রাইশার দিকে এগিয়ে গেল। রাইশাকে বাইরের দিকে ঘুরিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে পিছনে দাঁড়ালো আসমা। যেন রাইশা একটা দেয়াল! আর সে দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে হবু বরকে দেখার চেষ্টা করছে।

নুপুরের বাবা যে এত তাড়াতাড়ি চমকপ্রদ একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবেন, তা কেউ বুঝতে পারেনি আগে। বুদ্ধিটা নুপুর দিয়েছিল তাঁর বাবাকে। সে বুঝে গিয়েছিল, অন্যের ভালোবাসায় হস্তক্ষেপ করে নিজে সুখী হওয়া যায় না। এটাই বাস্তবতা। সেজন্য মনেপ্রাণে চাচ্ছিল, সজলের সাথে যেন আসমার বিয়ে হয়। নুপুরের বাবা অনেকটা সজলের বাবা-মায়ের অভিভাবক হিসেবে ছিলেন। তিনি বেশ সিনিয়র মানুষ। সেজন্য সজলের বাবা-মা তাঁর কথা আদেশের মতোই গ্রহণ করতেন। তিনি সজল আর আসমার বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে প্রথমে দ্বিমত পোষণ করলেও শেষমেশ সবদিক ভেবে রাজি হয়ে যায়। তাছাড়া যেখানে নুপুর, নুপুরের বাবা-মা, এবং সবাই চাচ্ছে সজল আর আসমার বিয়ে হোক, সেখানে শুধুমাত্র তাঁদের দ্বিমত করাটা বেমানান হয়ে যায়। তাঁরা অচিরেই আসমার বাবা-মায়ের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যায়। আসমার মা রাজি হলেও আসমার বাবা বেঁকে বসেন। ওইরকম পরিবারে তিনি মেয়েকে বিয়ে দেবেন না। বড়লোক হোক, বড় মনের মানুষ তো না৷ সবার মুখটা তখন মলিন হয়ে যায়। আসমার বাবাকে বাধ্য করার মতো কেউ নেই এই পৃথিবীতে। আসমা অন্যসব ব্যাপারে বাবার প্রতি জোর খাটাতে পারলেও নিজের বিয়ের ব্যাপারে কোনো শব্দ করতে পারছিল না। প্রথমত, আসমার বাবা খুব কষ্ট পাবেন। দ্বিতীয়ত, আসমার কাছে রুচিসম্মত লাগছিল না ব্যাপারটা। তাই চুপ করে যায়। এখানেও নুপুরের বাবা চলে আসেন। তাকে দেখে আসমার বাবা শান্ত হয়। ভাবে, মানুষটা ভদ্রলোক। সৎ মানুষ। শান্ত হয়ে তাকে বিশ্বাস করা যায়।
নুপুরের বাবার অনুরোধে, আসমার বাবা রাজি হয়। নুপুরের বাবা তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, আসমা আর সজলের সাথে সুখে থাকবে। সব মানুষের মধ্যেই দোষত্রুটি থাকে। এটা ভেবে ছেলে-মেয়েদের আলাদা করে দেওয়া ঠিক না।

এরপরই সবাই গ্রামে আসে। গ্রামেই পারিবারিক ভাবে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়।

সজল আর আসমার বিয়ে সম্পন্ন হয় সন্ধ্যায়। তাঁদের ভালোবাসা পূর্ণতা পায়, এই ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে দু’জনে।
সমাপ্ত

সম্পৃক্ততা পর্ব ১৭

0

সম্পৃক্ততা – ১৭তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

ফাতেমা অনুজ্জ্বল স্বরে জিজ্ঞেস করল, ” আপনি এত চুপসে গেলেন কেন?”
” তুমি কি আমাকে নিয়ে উপহাস করতে চাচ্ছ ফাতেমা? নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে গেছ কেন আমি চুপ করে আছি।”
তুহিন বিছানা থেকে নেমে যেতে চাইলে ফাতেমা সাহসা তাকে আটকে দিয়ে বলল, ” চলে যাচ্ছেন কেন? আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।”

তুহিন মাথা নাড়িয়ে বসে পড়ল। ফাতেমা মৃদু হেসে বিছানা থেকে নিজের মাথাটা সরিয়ে, তুহিনের পায়ের উপর মাথা রেখে শুলো। তুহিন বিস্মিত হলো; তবে কিছু বলল না।
ফাতেমা, মুখটা বৃথা উদ্ভাসিত করে বলল, ” আপনার কি মনে হয়, আমি আপনার থেকে দূরে চলে যাবো?”
তুহিনের একটা হাত টেনে এনে, হাতের উপর পাতায় চুমু দিলো। এরপর হাতটা বুকে ঠেকিয়ে রাখল। ম্লান হেসে আবার জিজ্ঞেস করল, ” আমার বুকের ভেতরটায় যে ধুকপুক শব্দ হচ্ছে, তা কি আপনি অনুভব করতে পারছেন? ভয় তো আমি পাচ্ছি। আপনি যদি আমার থেকে দূরে সরে যান; তাহলে আমার কী হবে? আমার এই সংসারটার কী হবে?”

তুহিনের চোখের পাতা নড়াতেই টপ করে দু’ফোঁটা জল পড়ল ফাতেমার মুখের উপর। ফাতেমা হতভম্ব হয়ে ওঠে বসল। নিজের হাতে তুহিনের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, ” আপনি কাঁদছেন কেন? আমার উপর কি কোনো ভরসা নেই আপনার? আমি এমন কিছু করব না, যার কারণে এই সংসা শেষ হয়ে যাবে। ফাটল আপনি ধরিয়েছেন, সেটা জোড়া লাগানোর দায়িত্ব আপনার। আপনিই যদি হাল ছেড়ে দেন, তাহলে সংসার টিকবে কীভাবে।”
” যে নিজের উপরই ভরসা করতে পারে না, সে অন্যের উপর কীভাবে ভরসা করবে?”
” নিজের উপর ভরসা করতে না পারলে কি অন্যের উপর ভরসা করা যায় না? আপনি আমার উপর একটু ভরসা রাখুন।”
তুহিন কিছু না বলে আবারও চোখের পলক ফেলল। ফাতেমা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ” উনার সাথে আরও একজন এসেছিল। উনার স্বামী।”
কপাল কুঁচকে তুহিন বলল, “কী বলো!”
” হ্যাঁ। উনারা দু’জনেই এসেছিল আমাদের সাথে কথা বলতে। দেখুন, যখন পুরো ব্যাপারটা আমি জেনেছি, তখন খুব রাগ হয়েছিল। আপনাকে সামনে পেলে আমি কুচিকুচি করে কাঁটতাম! কিন্তু পরে আমি ভাবলাম, সত্যি এটাই যে, প্রথম ভালোবাসা সহজে ভুলে যাওয়া যায় না৷ কখনো কখনো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রথম ভালোবাসা স্মরণে থাকে। এর মাঝে কত ঘটনা যে ঘটে যায়, তাঁর হিসেব নেই। আপনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন, তা আমি জানি না। কিন্তু আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। আপনি আমার প্রথম ভালোবাসা। তাই এর মর্ম আমি বুঝি। এই কঠিন সত্যির মুখোমুখি আরও কিছুদিন আগে হলে হয়তো আমি সহ্য করতে পারতাম না। উল্টো পাল্টা কিছু করে বসতাম। কিন্তু গত কয়েকদিনে আপনি আমায় যে ভালোবাসা দিয়েছেন, সেখান থেকে বঞ্চিত হতে চাই না আমি। সেজন্যই আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা একবারও কল্পনা করিনি আমি। আপনিই তো আমার সব। তবে, আপনার উচিত ছিল নিজে থেকে আমাকে এই সত্যিগুলো বলা। যে নিজেকে শুধরে নিয়েছে, আমি তাকে আরও আঘাত করতাম কীভাবে?”
তুহিন কাতর গলায় বলল, ” আমি বলতে চেয়েছিলাম ফাতেমা। কিন্তু এই কয়দিন তোমার সাথে এত সুন্দর সব মুহূর্ত কাটিয়েছি যে, আমি আর সাহস করে কিছু বলতে পারিনি। ভয় হচ্ছিল খুব। আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ।”
মুখে অস্বস্তিকর ভাব এনে বলল, ” ধুর! আপনি এইবার আমায় অপ্রস্তুত করে দিচ্ছেন।” তুহিনের হাতের মুঠোয় নিজের ছোট্ট হাত দু’টো ঢুকিয়ে দিলো ফাতেমা।
তুহিন হেসে বলল, ” সরি সরি।”
” হোয়াট সরি? শুনুন, মেয়েটি যদি হাজার অন্যায় করার পরও, তাঁর স্বামীর মেয়েটিকে সহজেই মেনে নিতে পারে, তাহলে আমি কেন পারব না? মেয়েটা আমার কাছে এসে সরি বলেছে। আমি এতে আপ্লুত হয়েছি। মেয়েটা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। এবার আপনি বলুন, আপনি কি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন?”
” পেরেছি।”
” থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।” তুহিনের গাল টেনে হেসে বলল ফাতেমা।
তুহিন বলল, ” আমার কাছে এই মুহূর্তটা স্বপ্নের মতো লাগছে ফাতেমা। সবকিছু এত সহজভাবে মিটে যাবে, তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল।”
” ভালোবাসার জন্য মানুষ কতকিছু করে। আর আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারব না? তবে খবরদার, পরবর্তীতে এইরকম কিছু হলে আপনাকে পুলিশে দেবো।” শাসিয়ে বলল ফাতেমা।
তুহিন একগাল হেসে ফাতেমাকে নিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। ফাতেমার কপালে, গালে, ঠোঁটে, ঘাড়ে, অজস্র চুমু এঁকে দিয়ে বলল, ” বুকের উপর থেকে যেন পাথর সরে গেল। এতদিন নিঃশ্বাস আটকিয়ে কোনোরকমে বেঁচে থেকেছি। আর অপেক্ষার প্রহর গুনেছি।”
তুহিনের মাথার চুলে হাতের আঙ্গুল গুজে দিয়ে ফাতেমা বলল, ” আরও একটা সত্যি গোপন করেছেন আপনি। আপনার যে চাকরিটা নেই, সেটা আমায় বলেননি। আমি এটাও জেনেছি।”

তুহিন চোখ নিচে নামিয়ে নিলো। আর কিছু বলল না। ফাতেমা চট করে উল্লাসী গলায় বলল, ” আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
” কী?
“এখন বলব না। সময় মতো বলব।”
তুহিন কিছুক্ষণ স্থির চোখে ফাতেমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আর হেসে বলল, ” আমাদের যদি একটা ছোট্ট বেবি হয়, তাহলে কেমন হবে ফাতেমা? আমাদের দূরত্ব পুরোপুরি কমে যাবে।”

ফাতেমা সাহসা লজ্জা পেয়ে তুহিনের বুকে মুখ লুকালো। তুহিনের শার্ট খামচে ধরে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলল তুহিনের বুকের ভিতরে। তুহিন হেসে শক্ত করে ফাতেমাকে জাপটে ধরল। আর মনে মনে বলতে লাগল, “কী থেকে কী হয়ে গেল হঠাৎ! কিছুক্ষণ আগেও যেই আমি ভয়ে কাঁপছিলাম, সেই আমিই এখন স্ত্রীকে স্বাচ্ছন্দ্যে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছি। যেন কিছুই হয়নি। সব স্বাভাবিক। ফাতেমার মনের জোর যে এতটা প্রখর, তা এই জগতের কেউই জানতো না। আজ নিজের চোখে দেখলাম আমি।”
তুহিন মুচকি হেসে ফাতেমাকে আবারও চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

সকালে তুহিন যে চমকটা পেলো, তা হজম করে স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। তাহমিদ যে তাকে এতবড় একটা চমক দিবে, তা কখনো কল্পনা করতে পারেনি। যে তাহমিদকে সে সবসময় উদ্ভট ভেবে অগ্রাহ্য করেছে, সেই তাহমিদই তাঁর স্বপ্ন পূরণ করে দিলো।

সকাল হতেই তাহমিদ বাড়ির সবাইকে রেডি হতে বলল। তুহিন প্রশ্ন করল, “কোথায় যাবো?”
তাহমিদ উত্তর দিলো না। ঘরের ভেতর ফাতেমা এসে বলল, ” এত প্রশ্ন করছেন কেন? বলেছিলাম না একটা সারপ্রাইজ আছে আপনার জন্য। চুপচাপ রেডি হয়ে নিন।”
তুহিন চিন্তিত ভাবে ঘরের ভিতরে গেল আবার। ফাতেমাও ওর পিছনে গেল। তাহমিদ, তৃষ্ণা, সবাই রেডি হয়ে নিলো চটপট।

আধঘণ্টার মধ্যেই ওরা একটা স্থানে পৌঁছে গেল। ওখানে গিয়ে তুহিনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এই জায়গাটা তুহিনের খুব পরিচিত। একসময় এখানেই তাঁর লাইব্রেরি ছিল। আজও এখানেই একটা লাইব্রেরি আছে। সেই একই নামের; তিন মুখী লাইব্রেরি। তুহিন বাকরুদ্ধ হয়ে শুধু সবকিছু দেখতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর নিঃশ্বাস আটকিয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ” এইসব কী হচ্ছে তাহমিদ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
তাহমিদ হেসে বলল, ” লাইব্রেরিটা পছন্দ হয়েছে ভাইয়া?”
” হ্যাঁ। কিন্তু এটা কার?” মুখটা বিস্মিত করে জিজ্ঞেস করল তুহিন।

পাশে থেকে ফাতেমা বলল, ” কার আবার? আপনার এটা। দেখছেন না নামটা।”
” ফাতেমা, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এই লাইব্রেরি আমার মানে কী?
ফাতেমা হেসে বলল, “আগের লাইব্রেরিটা পুড়ে যাওয়াতে আপনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন না, সেটাই এতদিন আপনার ভাই বুকে আকড়ে ধরেছিল। সবসময় বলতেন না, ও চাকরি করে বেতনের টাকা দিয়ে কী করছে? শুনুন তাহলে, তাহমিদকে আপনি যতটা বেখেয়ালি ভাবেন, ও ততটা বেখেয়ালি না। চাকরির শুরু থেকেই ও মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, একদিন আপনাকে একটা লাইব্রেরি করে দিবে। আপনার স্বপ্ন ও পূরণ করে দিবে। আপনি ওর জন্য এতকিছু করেছেন, আর ও আপনার জন্য এইটুকু করবে না! ও নিজের বেতনের সব টাকা জমিয়ে রাখতো। আমিও আপনার থেকে কিছু কিছু টাকা নিয়ে জমাতে শুরু করেছিলাম। সে সব এক করে, ঠিক এই জায়গাটাতে আমরা এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছি।”

তুহিন অবাক চোখে তাহমিদের দিকে তাকালো। সে হাসছে। মিটমিটিয়ে হাসছে। এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাহমিদকে। তুহিনের উজ্জ্বল মুখটা দেখে যেন ফাতেমার প্রাণ ফিরে এলো।

সেদিন লঞ্চে তাহমিদ, তুহিনকে জিজ্ঞেস করেছিল, ” ভাবীর কাছে কী লুকিয়েছ তুমি?”
তুহিন অনেক ইতস্তত করার পর বলেছিল, ওর চাকরি চলে গেছে; সেটাই ফাতেমাকে জানায়নি। তাহমিদ তখনই সিদ্ধান্ত নেয়, এবার বড় ভাইকে লাইব্রেরির দায়িত্ব দিবে। তাহমিদ নিজেই তুহিনের চাকরি চলে যাওয়ার ব্যাপারটা জানায় ফাতেমাকে। ফাতেমা নির্বাক হয়ে গেছিল। তাহমিদের অনুরোধেই সে তখনকার মতো চুপ করে যায়। ভেবেছিল, তুহিন নিজেই বলবে। অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে ফাতেমা। অপেক্ষা শেষ হয় বাড়িতে অপরিচিত দু’জন মানুষের আগমনে। ফাতেমা যখন জানতে পারল, মেয়েটা তাঁর স্বামীর প্রাক্তন প্রেমিকা; তখনই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। মেয়েটা নিজেই ফাতেমাকে আশ্বস্ত করে। নিজের দোষ স্বীকার করে। বিয়ের পর ও যদি তুহিনকে উৎসাহ না দেখিয়ে বরং দূরত্ব বজায় রাখতো, তাহলে সম্পর্কটা এতদূর চলে আসতো না। মেয়েটা আরও বলে, সে নিজের স্বার্থের জন্যই তুহিনকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু তুহিন রাজি হয়নি। তুহিনের বন্ধু রাশেদ, মেয়েটাকে অনুরোধ করে বলে, এই নিয়ে যেন আর সামনে না আগায়। এদিকে মেয়েটার স্বামীও জেনে যায় ব্যাপারটা। তাঁদের সংসারটা ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। মেয়েটা আস্তে আস্তে নিজের ভুল বুঝতে পারে। স্বামী-সংসার দূরে সরিয়ে পুরোনো সম্পর্কে ফিরে গিয়ে যে অন্যায় করেছে, সেখান থেকে বের হতে চায়। সেজন্য নিজের স্বামীর কাছে ক্ষমা চায়। তাঁদের কথা শুনে ফাতেমার মনেও তুহিনের জন্য মায়া তৈরি হয়। ঠাণ্ডা মাথা ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করে। অযথা হট্টগোল করে নিজের সংসারে আঘাত করার প্রশ্নই আসে না। মেয়েটা যেহেতু স্বাভাবিক, সেহেতু তুহিনকে আঘাত করা ঠিক হবে না। ব্যাপারটা যেখানে স্থগিত করে ফাতেমা। তাহমিদকে এইসব বলেনি। ভেবে রেখেছিল, রাতে শুধুমাত্র তুহিনকে এইসব বলবে। সংসার টিকিয়ে রাখতে হলে দু’জনের সাহায্য প্রয়োজন। একার পক্ষে এটা সম্ভব না। তুহিন, মনে যে কষ্ট নিয়ে ভারী মুখে দিন কাটাচ্ছে, সেখান থেকে তাকে মুক্ত করতে হবে।

তাহমিদ লাইব্রেরি খুলে দেয়। তুহিন আশ্চর্য চোখ করে ভিতরে ঢুকে চারিদিকে চোখ বুলাতে থাকে। প্রতিটি কোণায় তাকায়, আর মনে হয়, এটা যেন সেই কয়েক বছর আগের লাইব্রেরিটাই। এত অন্যায় করার পরও তাঁর স্ত্রী আর তাঁর ভাই এত যত্ন করে এটাকে তৈরি করেছে। তুহিনের চোখ ভিজে আসে। স্ত্রী, ভাই, বোন, সবাইকে বুকে আগলে চারিদিক দেখতে থাকে। সময় বদল হয়, কিন্তু মুহূর্তটা একই থাকে। তুহিনের বুকের ভিতর চিনচিন শিহরণ হতে থাকে। সে তাকায় ফাতেমার দিকে; তাহমিদের দিকে; আর তৃষ্ণার দিকে। এটা তাঁর পরিবার। এই পরিবার নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চায় সে।

৩৮.
তাহমিদ আর তানিশার বিয়ে সম্পন্ন হলো। বিয়ের অনুষ্ঠান খুব যে অলসভাবে হয়েছে, তা না। তুহিন নিজের সঞ্চয়ের সবটুকু দিয়ে বেশ চাঞ্চল্যকর ভাবে তাহমিদের বিয়েটা দিচ্ছে। কোনোদিকে কমতি রাখেনি। তাহমিদের পুরো বিল্ডিংটাই আলোর গজগজ করছে করছে। অনেকক্ষণ আগেই নিজের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে আসে তাহমিদ।

সাধারণত বাসররাতে বর ঘরে এসে দেখে, বউ বিছানার বসে আছে। ঠোঁটের কার্নিশে লজ্জাময়ী হাসি! কিন্তু তাহমিদ দেখল, তানিশা পুরো ঘর তন্নতন্ন করে কী যেন খুঁজছে।
সে শব্দহীন পায়ে হেঁটে ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। তানিশা পিছনে ঘুরতেই মুখোমুখি হলো তাহমিদের সাথে। বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, ” ধুর বাল! পুরো ঘর খুঁজে এমন জায়গা পেলাম না, যেখানে নিজের ব্যক্তিগত কিছু জিনিস লুকিয়ে রাখব।”
বাসর রাতে স্বামীর সামনে ‘বাল’ বলাটা বেমানান লাগল তাহমিদের কাছে। কিন্তু কিছু বলল না। এ প্রসঙ্গে কথা বলা মানেই অযথা সময় অপচয় করা! তাহমিদ ভিন্ন প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “আসলে আমার এইসব আসবাব প্রয়োজন হয় না। সেজন্য ঘরের বিছানা আর টেবিল আর একটা ছোটখাটো ওয়ারড্রব ছাড়া তেমন আসবাব নেই। আয়নাটা আগে ছিল না। বিয়ের কিছুদিন আগেই ভাবী কিনেছে। দম্পতির ঘরে নাকি আয়না থাকা বাধ্যতামূলক! তাছাড়া ওয়ারড্রব তো আছেই; তোর ব্যক্তিগত জিনিস সেখানেই রাখ।”
” রাখা যায় বটে। তবে কতটা নিরাপদ, আমি জানি না। আমি এমন জায়গা খুঁজছিলাম, যেখানটায় কারোর নজর যাবে না। এমনকি তোরও না।”
“কী সেটা?”
তানিশা ঠোঁট কামড়ে পেটের কাছ থেকে শাড়ির অংশটা সরালো। তাহমিদ ফ্যালফ্যাল চোখে দেখল তানিশার সাদা পেট। সেখানে আরো একটা জিনিস দেখা গেল, তা হলো একটা সিগারেটের প্যাকেট। কাপড়ের আড়ালে গুজে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা বের করল তানিশা। ওটা হাতে নিয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বলল, ” কী দেখছিস?”
” তুই কি এটা দেখিয়ে আমাকে লোভ দেখাচ্ছিস?” আগের মতোই ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থেকে বলল তাহমিদ।
” লোভ দেখানোর কী আছে? তুই-ই তো বলেছিলি, প্রতি সপ্তাহে একটা করে সিগারেট যেন তোকে দেই। দেখ, আমি এই বাড়ির বউ এখন। প্রতি সপ্তাহে তো আর দোকানে গিয়ে সিগারেট কিনে আনতে পারব না। মান-ইজ্জত সব যাবে তোর। তাই ওই বাড়ি থাকতেই এক ছোট ভাইকে দিয়ে আনিয়ে নিয়েছিলাম।”
তাহমিদ মুচকি হেসে তানিশার খুব কাছাকাছি এসে বলল, ” আমি সিগারেটের কথা বলিনি। তুই যে এত সুন্দর পেটটা উন্মুক্ত করে দিয়েছিস, আমি তো নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছি। এভাবে লোভ দেখানো উচিত না।”
তানিশা হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল। বিছানায় বসে গড়াগড়ি খেয়ে শব্দ করে হেসে বলল, ” আরে মামা, তুই তো সেই জিনিস একখান।”
” তুই এখনো আমাকে মামা বলছিস। সম্পর্কের ১২টা বাজিয়ে ছাড়বি দেখছি। বরকে কেউ মামা ডাকে?” তাহমিদ ফ্যাচফ্যাচে গলায় বলল কথাটা।
” আরে, যাকে তাকে মামা ডাকাটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই এখনো হুটহাট করে মুখ দিয়ে বেড়িয়ে যায়।” প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে আবার প্রশ্ন করল, ” আচ্ছা, মানহার সাথে উল্টো পাল্টা কূ-কাম করিসনি তো।”
তাহমিদ সোজাসাপটা বলল, ” আরে না।”
” সত্যি করে বল।” তানিশার কণ্ঠে দরাজ ভাব প্রকাশ পেলো।
তাহমিদ বিব্রত মুখ করে বলল, ” জাস্ট একটা চুমু খেয়েছিলাম।”
তানিশা বিছানায় নড়েচড়ে বসল। গম্ভীরমুখে কিছুক্ষণ নড়াচড়া করে আবার স্থির হয়ে বসে বলল, ” ঠিক আছে। প্রেম করার সময় আমাকেও তো চুমু দিয়েছিস। তাই মাফ করে দিলাম।”
” তোরটার থেকে ওরটার গভীরতা বেশি ছিল। তোকে দিয়েছি কপালে, আর ওকে দিয়েছিলাম ঠোঁটে। তবে ও ঘুমে ছিল। সেভাবে টের পায়নি।” আচমকা সাহস পেয়ে গোপন কথাটা বলে দিলো তাহমিদ।
তানিশা দাঁত খিটিরমিটির করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারও শান্ত গলায় বলল, ” তবুও মাফ করে দিলাম। ও তো আর বেঁচে নেই। এখন এই নিয়ে রাগারাগি করা ঠিক হবে না।”
তাহমিদ কিছু না বলে তানিশার সামনে হাটু গেড়ে বসল। নির্বিকার চাহনিতে তাকিয়ে তানিশার একটা হাত ধরে বলল, ” তোর জন্য একটা গিফট আনতে চেয়েছিলাম। ভাবী বলেছিল, তোর পছন্দের কিছু একটা কিনতে। আংটি বা ভিন্ন কিছু। আমি না আসলে ভুলে গেছি৷ কাল খুব সকালে দু’জনে একসাথে গিয়ে কিনে নেবো৷ আপাতত তোকে দেওয়ার মতো একটা জিনিসই আছে আমার কাছে।”
তানিশা হাসল। হেসে তাহমিদের মাথায় চুলগুলো আউলিয়ে দিলো এক হাতে। বলল, ” কী আছে শুনি?”
তাহমিদ ফিক করে হেসে বলল, ” একটা প্রসংশা আছে। চলবে?”
” চলবে।” তানিশাও হাসল খুব।
তানিশার হাত কচলিয়ে তাহমিদ বলল, ” তোর হাতে এই গাছের মেহেদী দারুণ লাগছে। আমি কাল একটা মেহেদী চারাগাছও কিনবো। টবে করে ছাদে লাগিয়ে দেবো। ভালো পাতা বের হতে একটু সময় লাগবে বটে; কিন্তু একসময় ঠিক গাছটা আরো বড় আর শক্তপোক্ত হবে। তখন তুই নিয়মিত হাতে মেহেদী লাগাবি। প্রয়োজনে আরও দুই তিনটে গাছ এক্সট্রা লাগিয়ে দেবো। তুই মেহেদী লাগাবি তো?”
” লাগাবো।” মুচকি হাসল তানিশা।

তাহমিদ কিছুক্ষণ পর আমতাআমতা করে বলল, ” আজ একটা সিগারেট খাবো।”
” এখন না। সিগারেট খাওয়ার জন্য গোটা একটা রাত পড়ে আছে। নে, এই সিগারেটের প্যাকেটটা কোথাও লুকিয়ে রাখ। কেউ যাতে দেখতে না পায়।”

তাহমিদ সিগারেটের প্যাকেটটা ওয়ারড্রবে লুকিয়ে রেখে আবার বিছানায় বসল। তানিশা বলল, ” এখন আমায় একটু মানহার সাথে কথা বলিয়ে দে। ফোন কোথায় তোর?”
তাহমিদ চোখ-মুখ শক্ত করে কর্কশ গলায় বলল, ” তামাশা করছিস?”
” তামাশা করব কেন? তুই না বলতি, ও রাতে ফোন দিতো।”
“ও দিতো; আমি তো দিতাম না।”
“এখন দেয় না?”
“না।”
“শেষ কবে দিয়েছিল?”
“মনে নেই।”
“বল বলছি।” ধমক দিলো তানিশা।
“বললাম তো মনে নেই।”
“বলবি না তো।” আগের থেকেও কঠিন করে বলল তানিশা।
তাহমিদ ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “যেদিন থেকে তোকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি; সেদিন থেকেই ও আর ফোন দেয় না। ও বলতে, ‘009’ আরকি।”

তানিশা বিছানা থেকে নেমে সাহসা অনুজ্জ্বল মুখ করে জিজ্ঞেস করল, “একটা কথা বলব।”
” কী?”
” আমার না কেন জানি মানহার উপর খুব রাগ হচ্ছে। সাধারণত একটা বিষয়। তবুও খুব রাগ হচ্ছে আমার। তুই যদি ওকে চুমুটা না দিতি, তাহলে খুব ভালো হতো। তোর উপরও খুব রাগ হচ্ছে।”

তাহমিদ নিশ্চুপ দৃষ্টিতে তানিশার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিছানা থেকে নেমে ঘরের লাইটটা অফ করে দিলো। মুহূর্তের মধ্যেই পুরো ঘরটা ঘুটঘুটে আঁধারে ছেয়ে গেল। শুকনো গলায় ঢোক গিলল তানিশা। কোনো শব্দ নেই। ঘরের সবকিছু একদম চুপচাপ। বাইরে থেকে ছেলে-মেয়ের হাসির শব্দ তানিশার কানে ভেসে এলো ; উচ্চ হাসির শব্দ। আবার থেমে গেল। অনেকটা সময় আলোর মধ্যে থাকার পর হঠাৎ অন্ধকারে কিচ্ছুটি দেখতে পেলো না তানিশা। জিব দিয়ে ঠোঁট দু’টো ভিজিয়ে নিলো। এক হাতে শক্ত করে শাড়ির আঁচল মুঠি করে ধরল। নিম্নস্বরে শুধু একবার বলল, ” তাহমিদ।”
কোনো শব্দ এলো না। ঘরের জানালা আটকানো; পর্দা টানা, বাতি বন্ধ। তানিশার চোখে পুরো জগৎটাই যেন অন্ধকারছন্ন হয়ে গেছে। হঠাৎ তাহমিদের শরীরের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে শিউরে উঠল তানিশা। শরীর জুরে কাঁটার মতো করে শিহরণ বয়ে গেল। তাহমিদের দুই হাত তাঁর কোমর জড়িয়ে আছে। ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে তাঁর চোখে-মুখে। অন্ধকারের মধ্যেও তানিশা চোখ দু’টো বন্ধ করে ফেলল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আবারও ‘ তাহমিদ’ বলে ডাকার আগেই তাহমিদ কঠোর উত্তপ্ততায় তাঁকে শব্দহীন করে দিলো!

৩৯.
সজল দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে বলল, ” দেখেছ আসমা, আমি বলেছিলাম না খুব শীঘ্রই তোমাকে আমার কাছে আসতে হবে।”
আসমা দুই হাত বুকের নিচে জড়ো করে নড়েচড়ে দাঁড়ালো। হেসে বলল, ” হুম, বলেছিলেন তো।”
” আমি কিন্তু আগেই জানতাম তুমি নিজেই আমার কাছে আসবে। আসতে বাধ্য হবে। বাধ্য হয়েছ না?”
” হয়েছি।” মিটমিট করে হাসল আসমা।
দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে তাকালো মাথার উপরে থাকা চাঁদের দিকে।

সম্পৃক্ততা পর্ব ১৬

0

– ১৬তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

৩৫.
তোমার প্রেমে আসক্ত হয়ে আমি আজ খোদার তৈরি রিহ্যাবে ভর্তি!

ডেস্কে বসে আকাশ-কুমুস ভাবছিল তাহমিদ। অনেকদিক পর আজ অফিসে এসেছে; নিজের ডেস্কে বসেছে। মনে হচ্ছে কয়ক যুগ অফিস থেকে দূরে ছিল! অফিস আর সে, আলাদা দু’টো প্রান্তে ছিল।

” স্যার, ম্যাডাম আপনাকে ডাকছেন।” সিনিয়র রিপোর্টার তাহমিদের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ এইরকম একটা বাক্য বলে উঠল।

ভড়কে গেল তাহমিদ! সিনিয়র রিপোর্টার তাকে ‘স্যার’ বলছেন, ব্যাপারটা যে মোটেও সুবিধাজনক না, তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারল তাহমিদ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। অবাম হওয়ার রেশটা কেটে গেলেও সে অবাক কণ্ঠে বলল, “স্যার, আপনি ভুল করে আমায় স্যার ডেকে ফেলেছেন। আমি আপনার জুনিয়র।”
” হ্যাঁ হ্যাঁ জানি।” সাংঘাতিক বিরক্তি প্রকাশ করল লোকটা। আবার বলল, ” সাথে এটাও জানি, খুব শীঘ্রই আপনি আমার সিনিয়র হতে যাচ্ছেন। তাছাড়া বসের খুব কাছের মানুষদের সাধারণত আমরা স্যার বলেই ডাকি।”

লোকটার কথা শুনে তাহমিদের মনে হলো, কথাগুলো উনি একেবারেই বলতে চাচ্ছেন না। কেউ যেন জোর করে বলাচ্ছে; কোমরে পিস্তল ঠেকিয়ে। তাহমিদ কিছুটা গম্ভীর গলায় বলল, ” স্যার, আপনি উল্টো পাল্টা বলছেন৷ জরুরি কিছু বলার হলে বলুন। আমার কাজ আছে।”
” বললাম না ম্যাডাম আপনাকে ডাকছে। সহকারী সম্পাদক ম্যাডাম। চিনতে পেরেছেন নিশ্চয়ই।” এবারও বিরক্তির স্বরে বলল কথাটা।

তাহমিদ আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ডেস্ক ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল। লোকটার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে সামনে থেকে চলে গেল।

তানিশার রুমে যেতেই তাহমিদ প্রথমে বলল, ” তুই কি ওই লোকটাকে কিছু বলেছিস? আমার সিনিয়র রিপোর্টারকে।”
” কেন, স্যার বলেছে নাকি?”
” হ্যাঁ। আচ্ছা তুই বল, উনি আমায় স্যার বলল কেন? আমি কোন এঙ্গেলে উনার স্যার?”
” আর বলিস না; আমি উনাকে বললাম তাহমিদকে ডাকতে। উনি বলল, ‘ওই ব্যাটা খুব ফাঁকিবাজ। এখন একটু কাঁজ করছে, করতে দিন ম্যাডাম।’ উনার কথা শুনেই আমার মাথা গরম হয়ে গেল৷ তাই বলেছি, তোকে যেন আজ থেকে স্যার বলে ডাকে। এটাও বলেছি, খুব শীঘ্রই আমাদের বিয়ে হতে চলেছে।”
” এত সহজে বলে দিলি তুই?”
” হ্যাঁ। এবার থেকে তোর সাথে ভালো ব্যবহার করবে সারাক্ষণ।”
” তাই বলে সরাসরি বিয়ে।”
” হ্যাঁ। যা সত্যি, তাই বলেছি।”
” আচ্ছা ঠিক আছে। আগে আমার একটা কথা শোন।” প্রসঙ্গ পাল্টাল তাহমিদ। বলল, ” শুনবি তো?”
” শুনবো। বল তুই।” অতি আগ্রহী হয়ে তাহমিদের দিকে তাকালো তানিশা।

তাহমিদ বলল, সবটা। তৃষ্ণার হাবভাব, আর ওই চিঠি প্রসংশে। । সবটা শোনার পর তানিশা আরও আগ্রহী হয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আরে বাহ্। কই, চিঠিটা দেখি তো আমি।”

তাহমিদ শার্টের পকেটে হাত দিলো। কিন্তু পেলো না সকালে রাখা সেই আধভেজা কাগজটা। মন খারাপ হলো৷ বিমর্ষ মুখ করে তাকালো তানিশার দিকে। তানিশা জিজ্ঞেস করল, ” চিঠিটা কি নেই?”
” না। বোধহয় গোসল করার সময় যে শার্টটা ধুয়ে দিছি, সেটার ভেতরে আছে।”
” একেই ভেজা ছিল। তাঁর উপর শার্টের পকেটে রেখে, শার্টের সাথে ওটাও ধুয়েছিস। বুঝতে পারছিদ, চিঠির অবস্থাটা কেমন হয়েছে?” হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ল তানিশা।
তাহমিদও আহত কণ্ঠে বলল, ” হুম। বুঝছে পারছি। আমিও পড়তে পারিনি ওটা।”
” একটুও পড়িসনি?”
” শুধু ‘ প্রিয় রূপবতী’ কথাটা পড়েছিলাম। যা পড়েই বুঝেছি, ওই চিঠিটা তৃষ্ণাকে পাঠিয়েছে কেউ। ভেবেছিলাম কিছুদিন পর ওকে দিয়ে ও দেবো। কিন্তু সেটা আর হলো না।”

তানিশা হঠাৎ মুহূর্তটা স্বাভাবিক কররে ভারী ভাব কাটিয়ে বলল, “এই কথা এখন বাদ দে। আমার কথা শোন। কাল বিকেলে আমাদের বাড়িতে তোদের সবাইকে দাওয়াত।”
” হঠাৎ দাওয়াত দিচ্ছিস যে? বিয়েশাদি করছিস নাকি? ছেলে কি কাল দেখতে আসছে?”
” জানি না। তুই সবাইকে নিয়ে আসবি কি-না বল। ভাবীকে আমি আগেই বলেছি। তোকেও বললাম। তোরা চারজনই আসবি। কাল শুক্রবার। সুতরাং কোনো অসুবিধে নেই।”
” আসতে পারি, যদি একটা সিগারেট খাওয়াস। তোর বেডরুমে গিয়ে খাবো। যাতে কেউ টের না পায়।” কিছুক্ষণ ভেবে এই শর্ত দিলো তাহমিদ।

তানিশার ভ্রু জোড়া উঁচু হয়ে গেল। হবু জামাই নাকি শ্বশুর বাড়ি গিয়ে সিগারট খাবে! যে হবু বউকে দেখতে যাবে, তাকেই বলছে, একটা সিগারেট খাওয়াতে হবে। এইরকম আবদার কেউ করে? এইরকম আবদার মেনে নেওয়া সম্ভব না।

কিছুক্ষণ ভাবার পর এই অসম্ভব টাকেই সম্ভব করল তানিশা। তাহমিদকে ভড়কে দেওয়ার জন্য এইরকম শর্তে রাজি হওয়াই যাই। কাল হঠাৎ চমকে দেবে তাহমিদকে। তাহমিদ অবাক হয়ে দেখবে তানিশাকে! এইরকম মুহূর্তটার জন্য সব করা যায়। আর এ তো সামান্য একটা সিগারেট। তানিশা হেসে বলল, ” বেশ। তুই আমার বেডরুমে বসেই সিগারেট খাস। আমি ব্যবস্থা করে দেবো।”
” বসে না। দাঁড়িয়ে খাবো। জানালা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ব। যে দেখবে, তাঁর সৌভাগ্য ভালো।”

তানিশা কিছু বলল না। এখন কথা না বাড়ানোই ভালো। শেষে দেখা গেল, আরও দুই একটা শর্ত হাজির করেছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ” যা নিজের ডেস্কে যা। কাজ কর।”

তানিশার ওখান থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কে গেল তাহমিদ। সিনিয়র রিপোর্টারের সাথে একবার চোখাচোখি হলেও কথা হলো না।

৩৬.
তাহমিদের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে। সেদিন সবাইকে নিয়ে তাহমিদ গিয়েছিল তানিশাদের বাড়ি। বেশ স্বাভাবিক সে। আগে থেকে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, আজ তাঁর বিয়ের তারিখ ঠিক করা হবে। খাওয়াদাওয়া শেষে যখন তুহিন আর ফাতেমা, তানিশার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলছিল, তখন তানিশা, তাহমিদের সাথে কথা বলতে বলতে নিজের ঘরের দিকে চলে গিয়েছিল। দরজা আটকিয়ে তাহমিদকে অবাক করে দিয়ে তানিশা একটা প্যাকেট থেকে, একটা সিগারেট বের করে তাহমিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাহমিদ ভীষণ অবাক! ওই প্রস্তাবটা যে তানিশা সিরিয়াস ভাবে নিবে, তা ভাবতে পারেনি সে। তানিশার হাত থেকে সিগারেট নিয়ে মুখে দিয়েছিল। এরপর দেশলাই দিয়ে সিগারেটে আগুন দিয়েছিল। বেশ আরাম করেই জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট টেনে যাচ্ছিল। হঠাৎ তানিশা তাঁর একটা হাত ধরে। তাহমিদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকায় তানিশার দিকে। তানিশা মৃদু হেসে বলে, ” আজকে আমাদের জীবনের স্মরণীয় একটি দিন?”
” কেন?” বেশ অবাক হয়ে জানতে চাইলো তাহমিদ।
তানিশা মুচকি হেসে বলল, ” কারণ আজ আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হচ্ছে।”
তাহমিদ ভ্রু জোড়া উঁচু করে জানতে চাইলো, ” আমাকে আগে বলিসনি কেন?”
” তোকে চমকে দিবো বলে।”
” তোর কী ধারণা, আমি এই কথা শুনে খুব চমকে গেছি?” মিটমিট করে হেসে কথাটা বলল তাহমিদ। আবারও আস্তে করে সিগারেটের ধোঁয়া নিজের মধ্যে নিয়ে নিলো।
তানিশা বোকাসোকা ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ” চমকে যাসনি তুই?”
” না।” মাথা ঝাঁকালো তাহমিদ। আবার বলল, ” আমি তো আগেই অনুমান করেছিলাম। এরপর তোর বাবাকে ফোন করেছিলাম। সে তো গড়গড় করে বলে দিলো আসল কাহিনী।”

বাবার কথা মনে করে দাঁত কিড়মিড় করল তানিশা। কিছুক্ষণ সেভাবে থেকে তাহমিদের বুকে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরল। তাহমিদ, তানিশাকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে কপালে চুমু দিয়ে বলল, ” কখনো ভাবিনি আমি এভাবে তোর সাথে জড়িয়ে যাবো। মানহাকে হারানোর পর তো আমার জীবনের সব স্বপ্ন, ইচ্ছা, আকাঙ্খা, সবকিছু ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আচমকা তোকে ভালোবেসে ফেললাম। নিজেকে এবং প্রিয়জনদের গুরুত্ব দিতে থাকলাম। যে ভালোবাসা নামক অনুভূতিটা হারিয়ে ফেলেছিলাম, সেটা আবার ফিরে পেলাম। তুই দেখিস, আমাদের সংসারটা খুব সুন্দর হবে। আমি, তুই, বড় ভাই, ভাবী, আর তুলি, আমরা সবাই একসাথে খুব ভালো থাকবো।”

তাহমিদের বুক থেকে মাথা তুলে, হাতটা শক্ত করে চেপে ওকে আশ্বস্ত করল তানিশা।
আরও কিছুটা সময় ওখানে কাটিয়ে নিচে চলে এলো।
খুব তাড়াতাড়িই দু’জনের বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। সব কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর সবাই চলে সে।

৩৭.
তাহমিদের বিয়ের খুব বেশি দেরি নেই। ফাতেমাকে এখনো সত্যিটা জানাতে পারল না তুহিন। চাকরির কথাটাও জানাতে পারেনি। সকালে বের হয়, এরপর এদিক-ওদিক ঘুরে, দুপুরে রাশেদের সাথে দেখা করে। আবার বিকেলেও ওরা দেখা করে। এরপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঠিক সময়ে বাড়িতে চলে আসে।

প্রতিদিনের মতো আজও বাড়িতে এলো তুহিন। রাতের খাবার শেষ করে ঘরে গেল। কিছুক্ষণ পর ফাতেমাও ঘরে এলো। দরজা আটকিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল তুহিনের পাশে৷ তুহিন চুপচাপ থাকল কিছুক্ষণ। হঠাৎ সে অনুভব করল, ফাতেমা কাঁদছে। কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তুহিন চমকে ওঠে ফাতেমার দিকে তাকালো। ফাতেমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে ফাতেমা? কাঁদছ কেন তুমি?”

ফাতেমা কান্না থামালো না। নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল সে। চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝড়তে লাগল। তুহিন হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিলো। কিন্তু আটকে রাখতে পারল না। বাধছাড়া হয়ে আবার ফাতেমার চোখ থেকে জল পড়তে লাগল। তুহিনের দৃষ্টিতে নির্বাকতা, ভয়, শঙ্কা। ফাতেমার মুখের উপর তুহিনের কৌতূহলী মুখটা। ফাতেমা ডুকরে কেঁদে উঠল। বলল, ” কেন করলেন এমনটা?”
হতভম্ব চোখে শুধু তাকিয়েই রইল তুহিন। বুঝতে পারল না, ফাতেমা কী বলতে চাচ্ছে। তবে ভীষণ ভয় পাচ্ছে তুহিন। আগের মতোই কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইল ফাতেমার দিকে।

তুহিনকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ফাতেমা আবার বলল, ” একটা কথা বলব?”
তুহিন মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলো।।গলা শুকিয়ে আসছে তাঁর। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কেউ যেন গলা টিপে ধরেছে। বুক ঢিপঢিপ করছে। শিরদাঁড়া সোজা করতে পারছে না।
ফাতেমা বলল, ” আজ বাড়িতে একটা মেয়ে এসেছিল; আপনার গালফ্রেন্ড। দেখতে খুব সুন্দর; আমার থেকে অনেক বেশি। অবশ্য আমি একটুও সুন্দরী নই। আমার সাথে উনার তুলনা হয় না।” ম্লান হাসল ফাতেমা।

তুহিনের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। যে শঙ্কা অনুমান করছিল, সেটাই হলো। শেষমেশ আর নিজে থেকে কিছু বলা হলো না। ফাতেমাকে অন্যরকম লাগছে আজ। খুব রহস্যমতী

সম্পৃক্ততা পর্ব ১৫

0

সম্পৃক্ততা – ১৫তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

তাহমিদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ” ভিতরে আয়। আজ তোর ক্লাস নেই?”
” আছে ভাইয়া।” ভিতরে আসতে আসতে মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো তৃষ্ণা।

মেঝেতে বসে পড়ল তৃষ্ণা। শেষ কবে যে বিছানায় বসেছিল, তা মনে পড়ছে না। তাহমিদও এখন মেঝেতে বসবে; তৃষ্ণার সামনে। অনেকটা ধ্যানে বসার মতো করে; গম্ভীরমুখে। হাতদুটো রাখবে দুই পায়ের উপর। এরপর অভিজ্ঞ গলায় জিজ্ঞেস করবে, ‘বল কী সমস্যা?’

তাহমিদ বিছানায় বসল। ভারী আশ্চর্য হলো তৃষ্ণা! সে ঘরে এসেছে, অথচ তাহমিদ বিছানাতে বসেছে; এইরকম কিছু দেখা আর রাজার মাটি কাটার দৃশ্য দেখা একই ব্যাপার! আরও একটা জিনিস উপলব্ধি করা গেল; তাহমিদ প্রতিদিনের মতো আজ গম্ভীরমুখে কিছু জিজ্ঞেস করল না। আজ সে বিছানার উপর বসে একগাল হেসে বলল, ” কী ব্যাপার তুলি? এত সকালে আমার ঘরে যে। কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?”

তাহমিদকে রহস্যময় দেখাচ্ছে আজ। তৃষ্ণাও কিছুটা রহস্যময় ভাব নিয়ে বলল, ” তোমার কী মনে হচ্ছে?”
” তোকে আজ মুমূর্ষু জাতির মতো লাগছে। মুখটা ভীষণ মলিন। শরীরে যেন প্রাণ নেই।” মৃদু হেসে জবাব দিলো তাহমিদ।

কথাটা একদম মিথ্যা। তৃষ্ণাকে আজ ভীষণ উল্লাসী দেখাচ্ছে। এত উজ্জীবিত মুখে তৃষ্ণাকে সচরাচর দেখা যায় না। যখন তাঁর পরিক্ষার রেজাল্ট খুব ভালো হয়, তখনও এতটা খুশি হয় না সে। আজ যেন শুধু হাসিখুশি না, আরও বিশেষ কিছু ফুটে উঠেছে তৃষ্ণার মধ্যে। তৃষ্ণার নাক লাল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। গাল দু’টোর রংও পরিবর্তন হচ্ছে আস্তে আস্তে। এর কারণ তাহমিদ জানে। মানহাকে যেদিন প্রথম সে প্রপোজ করেছিল, সেদিন মানহার অবস্থা ঠিক এমন হয়েছিল। মিটমিটিয়ে হাসি, ঠোঁটের কোণের হাসির সাথে যেন গাল দু’টোও হাসছে। খুব ছটফট করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। তানিশাকে প্রপোজ করার সময় এতকিছু দেখার সুযোগ হয়নি। তখন অন্ধকার ছিল চারিকটা। আজ তৃষ্ণাকে ঠিক সেরকম লাগছে। তাছাড়া, এ বাড়িতে রূপবতী বলতে তৃষ্ণা একাই আছে। সে ভীষণ সুন্দরী। সারাক্ষণ সাজুগুজু করে নিজেকে উজ্জীবিত করে রাখে। চিঠিটা নিশ্চয়ই তৃষ্ণাকে কেউ পাঠিয়েছে। ভুল করে এই ঘরের বারান্দায় দিয়ে গেছে। তাহমিদ ভাবল, ছেলেটা খুব বোকা। তবে খুব ভদ্র। আগে থেকে কোনোরকম খোঁজখবর নিয়ে আসেনি; এটা করে বোকার পরিচয় দিয়েছে ছেলেটা। আর বাড়িঘর সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য বখাটেদের মতো বাড়ির নিচে ঘুরঘুর করেনি; এতে ভদ্রতার পরিচয় দিয়েছে।
তাহমিদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ” তুলি, তোর কি বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে?”

তৃষ্ণা উত্তর দিলো না। তাহমিদ এইরকম অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা তাঁর সাথে বলে না। বিশেষ করে এই ঘরে। সে চুপচাপ মানুষ। প্রয়োজনীয় কথাগুলো শুধু যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেবে। এছাড়া সে অন্যদের ব্যাপারে নাক গলায় না খুব একটা। তৃষ্ণা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ” ভাইয়া, আজকের সকালটা কি তোমার কাছে অন্যরকম লাগছে?”
তাহমিদ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, ” হ্যাঁ, কারণ আজ বৃষ্টি নেমেছে। অনেকদিন পর আজ বৃষ্টি নামল।”
” আমি এই ভিন্নতার কথা বলিনি। মানে, অন্যরকম একটা ফিলিংস আরকি।”
বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলল, ” তোকেও আজ অন্যরকম লাগছে।”
” তাই নাকি? কেমন লাগছে আমায়?” তৃষ্ণাকে খুব আগ্রহী দেখালো।
তাহমিদ অসহায় গলায় বলল, ” খুব বিষণ্ণ লাগছে। মনে হচ্ছে খুব কষ্টে আছিস।”
তৃষ্ণা কপাল কুঁচকে রাগী কণ্ঠে বলল, ” এটা তোমার ভুল ধারণা। আমি আজকেই সবচেয়ে বেশি খুশি। এইরকম আনন্দ আমার আগে কখনোই হয়নি।”
” কখনোই না?”
” না।” তৃষ্ণার কণ্ঠে উত্তেজনার আভাস পাওয়া গেল।

তাহমিদ আর কিছু বলল না। সত্যিই আজ তৃষ্ণাকে খুব আনন্দিত দেখাচ্ছে। অনেকদিন অনাহারে থাকার পর যখন একটি প্রাণী তৃষ্ণা মেটানোর সুযোগ পায়, তখন তাঁর খুব আনন্দ হয়। ক্ষণিকের জন্য হলেও পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ভাবে নিজেকে। তৃষ্ণাকে এই মুহূর্তে ঠিক ওই প্রাণীটার মতো লাগছে। আচমকাই যেন ও প্রেমের স্পর্শ পেয়েছে, এই ভেবে হাসল তাহমিদ।

তৃষ্ণা বলল, ” ভাইয়া, একটা প্রশ্ন করব?
” কর।” আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল তাহমিদ।
“উত্তর কিন্তু এখনি দিতে হবে।”
” এখনি?”
” হ্যাঁ, এখুনি মানে এক্ষুনি।”
“উত্তরটা যদি তোর পছন্দ না হয়?”
” না হলে নাই। তবুও আমি এক্ষুনি উত্তর চাই।”
” ওকে। প্রশ্ন কর।”

একটু নড়েচড়ে বসে, এদিক-ওদিক উঁকি মারল তৃষ্ণা। এরপর তাহমিদের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগল, ” কেউ যদি হঠাৎ করে তোমায় রূপবতী বলে সম্মোধন করে, তাহলে তোমার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে?”
” এইরকম হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।” সোজাসাপটা উত্তর দিলো তাহমিদ।
” কেন নেই?” আবারও নড়েচড়ে বসল তৃষ্ণা।
” কারণ আমি রূপবতী নই। রূপবতী হয় সুন্দরী মেয়েরা। আর সুন্দর ছেলেরা হয় রূপবান।”
” ওহ্। আচ্ছা, তাহলে বলো; কেউ যদি আমায় হঠাৎ করে রূপবতী বলে বসে, তাহলে আমি কী ভেবে নিবো সে আমায় পছন্দ করে?”
তাহমিদ মনেমনে কী যেন ভাবল। এরপর জিজ্ঞেস করল, ” সে কি বড়লোক?”
” না।”
” তাহলে ভেবে নে, ছেলেটা তোকে পছন্দ করে; এবং ভালোবাসে। মধ্যবিত্তরা অকারণে কাউকে রূপবতী বলে না। অকারণে মেয়েদের রূপবতী বলা বড়লোকদের কাজ। এরা মেয়েদের শুধুমাত্র ইমপ্রেস করার জন্যই রূপবতী বলে। আরও অনেক কিছু বলে মেয়েদের প্রসংশা করে। কিন্তু মধ্যবিত্তরা এতকিছু করতে পারে না। এরা যাকে চট করে ভালোবেসে ফেলে, শুধুমাত্রই তাকেই খুশি করার জন্য এই ধরনের কথাবার্তা বলে।”

তৃষ্ণা কিছু না বলে মুচকি হাসি দিলো। এই হাসির অর্থ তাহমিদের জানা। সে অভিজ্ঞ লোক। দু’টো মেয়ের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক হয়ে গেছে৷ প্রেমে পড়লে মেয়েদের হাবভাব কেমন হয়, তা তাহমিদ জানে। তাহমিদ আবারও বলল, ” আরও একটা ব্যাপার আছে। বড়লোকরা কারোর প্রেমে পড়লে কখনো চিঠি দেয় না। তাঁদের আরও অনেক পদ্ধতি জানা আছে। মধ্যবিত্তরা চিঠির উপর খুব ভরসা করে।”

তাহমিদের কথা শুনে তৃষ্ণার গলা শুকিয়ে গেল। সে আবারও ঢোক গিলে তাহমিদের হাতের দিকে তাকালো। নিজের হাতের দিকেও তাকালো একবার। জামার দিকে তাকালো৷ চোখে-মুখেও হাত দিলো। ভুল করে যদি কোথাও চিঠিটা শরীরের সাথে এঁটে যায়, তাহলে ভ্যাজাল আছে!
তৃষ্ণা ওঠে চলে যেতে তাচ্ছিল; তাহমিদ নিচে নেমে খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেলল। তৃষ্ণা ভয়ে ভয়ে বলল, ” ও ভাইয়া, প্লিজ ছেড়ে দাও।”
তাহমিদ হেসে বলল, ” ছাড়ব, আগে বল কাহিনীটা কী?”
” কোনো কাহিনি নেই। আমার এক বান্ধবী এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছিল। ও তো জানে তুমি অনেক জ্ঞানী মানুষ। পৃথিবীতে এমন কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই, যা তোমার অজানা।”
” তারপর..।”
” তারপর আরকি? ওর প্রশ্নগুলোর উত্তর-ই আমি জেনে নিলাম তোমার থেকে। আর কিছু না।”
” এটা সত্যি না।”
” সত্যি এটা।” কাঁদোকাঁদো ভাবে বলল তৃষ্ণা। এই বুঝি ভাইয়া সব ধরে ফেলল, এই ভেবে ওর চোখ ভিজে আসছে। তাহমিদ কিছু বলার আগে ও আবার বলল, ” আমাকে ইউনিভার্সিটি যেতে হবে। ছাড়ো প্লিজ।”
” আজ তো বৃষ্টি হচ্ছে, আজ ইউনিভার্সিটি যাবি?” অবাক হয়ে জানতে চাইল তাহমিদ।
” হ্যাঁ যাবো। যেতে আমাকে হবেই। খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে আজ।” ঢিপঢিপ চোখ করে বলল তৃষ্ণা।
তাহমিদ বলল, ” শুধু কী ক্লাসই আছে?”
” হ্যাঁ। আর কী থাকবে? তাছাড়া ওকে তো উত্তরটা জানাতে হবে।”
” ও কি আসবে আজ?”
” হয়তো আসবে।” মুখটা ভাবান্তর করে জবাব দিলো তৃষ্ণা।

তাহমিদ হাতটা ছেড়ে দিতেই দৌড়ে ঘর থেকে চলে গেল সে। তাহমিদ পকেট থেকে ভেজা চিঠিটা বের করে সেই ‘প্রিয় রূপবতী’ লেখাটার দিকে তাকালো। হেসে বলল, ” আমার অভিজ্ঞতা বলছে, প্রেমে পড়লে মানুষ ঘূর্ণিঝড়কে অগ্রাহ্য করে; আর এ তো সাধারণ বৃষ্টি।” কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আবার বলল, ” আমার অভিজ্ঞতা আরও বলছে, প্রেমে পড়লে মানুষ সহজেই অনেক মিথ্যে কথা বলতে পারে। আবার সহজেই ধরা খেয়ে যায়।”

কাগজটা এখন আর খুলল না তাহমিদ। শার্টের পকেটে রেখে তোয়ালে হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে গেল।

৩৩.
ফাতেমার শরীর ভেজা। বৃষ্টিতে ভেজার লোভ সামলাতে পারেনি সে। তাই একদফা আকামটা করেই এসেছে। সাথে আরও একটা জিনিস নিয়ে এসেছে; বুকভরা ভয়! কী সুন্দর করেই না বৃষ্টিতে ভিজছিল! ছাদে জমে ছিল পানি। সেই পানির উপর আবারও বৃষ্টির টুপটাপ ফোঁটা পড়ছিল। অদ্ভুত এক শব্দ তৈরি হচ্ছিল। যে জায়গাটায় ফোঁটা পড়ছিল, ক্ষণিকের জন্য সেই জায়গাটায় অন্যরকম একটা দৃশ্য তৈরি হচ্ছিল। যেন কেউ হাত ডুবিয়ে জায়গাটুকু নিচু করে দিচ্ছে। ফাতেমা মুগ্ধ হয়ে দেখছিল, শুনছিল, আর উল্লাসে লাফিয়ে উঠছিল। অদ্ভুত ভাবে তাঁর লাফানো থেকেও একটা শব্দ তৈরি হচ্ছিল। সেটা শুনতে যেন আরও অদ্ভুত ছিল! ফাতেমা মনোযোগ দিয়ে নিজেকে আনন্দিত করছিল। ছাদের নিচের ঘরে যারা ছিল, তাঁরা নিশ্চয়ই খুব গালাগাল করেছে নিজেদের মনেমনে। ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারেনি। এর মধ্যে একটা অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ঘটে যায়! আচমকা বজ্রপাত হয়। বজ্রপাত যে সবসময় হঠাৎ করে হয়, তা না। মাঝে মাঝে জানান দেয় আগে; ঘুম ঘুম আওয়াজ করে। আজকে এই আওয়াজ করেনি মেঘ। ফলে সর্বনাশ হয়ে গেছে! বজ্রপাতের শব্দ শুধু ফাতেমার কানকেই আঘাত করেনি; তাঁর ঝলকানিতে ফাতেমার হৃদপিণ্ড সোজা হয়ে গেছিল। মনে হচ্ছিল, চোখের সামনে সবকিছুতে আগুন ধরে যাচ্ছে; শরীরেও। ফাতেমা ভয়ে দুই কান চেপে ধরেছিল। চিৎকার করে কেঁদে দিয়েছিল। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল। লাভ হয়নি; বৃষ্টির জলে সেই চোখের জল কারোর নজরে আসেনি। অবশ্য সেসময় কেউ ছিল না সেখানে। ফাতেমার মনে হচ্ছিল, ও জ্ঞান হারাবে। হাঁত-পা কাঁপছিল। দৌড়ে নিচে আসতে পারছিল না। সিড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের ঘরে এসেছে।

ভেজা শরীর নিয়ে ঘুরে ঢুকতেই ফাতেমা লক্ষ্য করল, তুহিন ঘুমোচ্ছে; হাত-পা ছড়িয়ে একেবারে মূর্তির মতো করে। ফাতেমা, তাকে একপলক দেখেই ওয়াশরুমে গেল।

তুহিন ঘুমিয়ে ছিল না। উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল শুধু। এখন সোজা হয়ে শুলো। তাঁর চোখে নিদ্রা নেই। চাকরিটা চলে গেছে। সেই অফিসের বন্ধু সব জেনে গেছে। সেদিন অফিসে হঠাৎ করেই সে বলে উঠেছিল, ‘আমার সংসারটা না ভাঙলেও পারতে।’ কথাটা শুনে তুহিনের বুকটা দ্রিম করে উঠেছিল। হতভম্ব তুহিন শুধু বেশ কিছুটা সময় তাকিয়েই ছিল বন্ধুর বিমর্ষ মুখখানার দিকে। কী অসহায়, কী শান্ত দেখাচ্ছিল তাকে! শুধু চোখের কোণে ছলছলে জল ছিল ; উঁহু, জল নয়, ওটা ছিল ঘৃণার উপস্থিতি!
ওখানে আর থাকতে পারেনি তুহিন। কাউকে কিছু না বলেই অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নেয়। পরেরদিনও অফিসে যায় না সে। অফিস থেকে তাকে মেইল করা হয়। সে জবাব দেয় না। ফোন করলে রিসিভ করে না। বরিশাল থেকে ফিরে যখন ঢাকার বাড়িতে এসেছে, তখনই দরজার বাইরে চিঠি দেখতে পায়। খামের উপর অফিসের লোগো দেখেই সে স্পষ্ট হয়ে যায়, কী লেখা থাকতে পারে এখানে। কায়দা করে চিঠিটা লুকিয়ে ফেলে সে। এরপর দরজা খুলে ভিতরে চলে যায়। সবাই ছিল খুব ক্লান্ত; তাই কিছু দেখেনি। তুহিন সেদিনই উপলব্ধি করতে পারে, তাঁর চাকরিটা আর নেই। ভালোই হয়েছে; সারাক্ষণ অপরাধীর মতো থেকে কাজ করা যায় না। কিন্তু ফাতেমা; সে বাড়িতে ফাতেমা আছে। তাকে কীভাবে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব? তুহিন তো অনেক চেষ্টা করেও ফাতেমাকে সবকিছু বলতে পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে, সংসারটা ভেঙে যাবে। তাঁর ছোট বোন তাকে যে সম্মান করতো, তা আর করবে না। ঘৃণার নজরে তাকাবে। ছোট ভাইয়ের কাছেই বা মুখ দেখাবে কীভাবে?

ফাতেমা ওয়াশরুম থেকে বের হলো। পরণে শুকনো কাপড়। ছাদে যাওয়ার আগেই কাপড়টা ওয়াশরুমে রেখে গিয়েছিল। তাঁর পুরো শরীর কাঁপছে এখন। খুব ভয় পেয়ে গেছে। সে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো। আস্তে আস্তে বিছানার উপর বসে ভারী কণ্ঠে বলল, “আপনি আজ এত দেরি করে উঠেছেন কেন? আগে তো নিজে থেকেই আমার রান্না শেষ হওয়ার আগে উঠে যেতেন।”
” আজ অফিস যাবো না, ফাতেমা।” দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ল তুহিন।
ফাতেমা অবাক কণ্ঠে বলল, ” কেন যাবেন না?”
” পরে বলব। আগে বলো, তুমি এত কাঁপছ কেন? শীত করছে নাকি?”

ফাতেমা ইতস্ততভাবে নিজের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা বলল তুহিনকে। যা শুনে হাসির রোল পড়ে গেল তুহিনের মধ্যে; যেন এর থেকে হাস্যকর ঘটনা সে জীবনেও শুনেনি। তাঁর জীবনে হাস্যকর সব ঘটনার মধ্যে ফাতেমার এই অভিজ্ঞতার ঘটনাটা অন্যতম।
ফাতেমা অভিমানী চোখ করে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ” আপনি জানেন, কেন একজন স্ত্রী তাঁর স্বামীর সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চায় না?”
” স্ত্রী, স্বামীর সাথে ভিজতে চায় না, এ-কথা তোমায় কে বলেছে?” তুহিন হাসি থামিয়ে দিলো।
” আমি বলছি। এবং এটাই সত্যি। আপনি, আপনার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করে দেখবেন, তাঁদের স্ত্রী, তাঁদের কখনো বলেছে কি-না, চলো আজ দু’জনে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজি।”
” অবশ্যই ভিজেছে। সবাই কী আমাকে বলে বেড়াবে? এইসব তাঁদের খুব একান্ত এবং স্পেশাল মুহূর্ত।”
” না, ভিজেনি। আমি নিশ্চিত ভিজেনি। কারণ এই দিক দিয়ে কোনো মেয়েই তাঁর স্বামীর উপর ভরসা করতে পারে না। আমি অন্তত একেবারেই পারি না।” ফাতেমা গাঢ় জোর দিয়ে কথাটা বলল।

তুহিন তো অবাক! একটা মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে; বৃষ্টির জলে তাঁর শরীরের প্রতিটি অঙ্গ স্পষ্ট ফুটে উঠবে; সেটা তাঁরই স্বামী দেখবে; এখানে ভরসা না করার কী আছে? বরং পরপুরুষ কিংবা মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড হলে আরও সমস্যা; উল্টো পাল্টা কিছু করে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। এই জায়গায় স্বামী থাকলে সমস্যা নেই। সে দেখুক, যা করার করুক, অসুবিধের তো কিছু নেই। কিন্তু বয়ফ্রেন্ড; ইন্না-লিল্লাহ!
তুহিন চোখ মুখ কুঁচকে বলল, ” তাহলে কার উপর ভরসা করা যায়?”
” বয়ফ্রেন্ড এর উপর!”
চোখ পাকিয়ে তাকালো তুহিন। কিছু বলল না। ফাতেমা আবার নিজেই বলল, ” আপনার জায়গায় আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড থাকলে কী করতো জানেন, আমার ভয় কাটানোর চেষ্টা করতো। যদিও আমি এইরকম ঘটনার সম্মুখীন আগে কখনো হইনি। এতটা কাছ থেকে কখনো বজ্রপাত হতে দেখিনি। তবুও বলছি, কোনো মেয়ে তাঁর স্বামীর সামনে, বৃষ্টিতে ভিজতে চায় না। কারণ সে জানে, তাকে ভয় পেতে দেখলে তাঁর স্বামী মজা নিবে। আরও ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো কাণ্ড নিজেও করবে। বয়ফ্রেন্ড থাকলে কিন্তু এই কাজটা করবে না; সে নিজের গালফ্রেন্ডকে আরও আগলে রাখলে। আহ্লাদী করবে, যাতে মেয়েটা ভয় না পায়, সেজন্য হাত ধরে থাকবে। আরও অনেক কিছু করবে। এবার আপনিই ভেবে দেখুন, স্বামী আর বয়ফ্রেন্ড এর মধ্যে কত পার্থক্য। বয়ফ্রেন্ড চাইবে, তাঁর ভালোবাসার মানুষটা যাতে ভয় না পায়; আর স্বামী চাইবে, তাঁর স্ত্রী যেন আরও ভয় পায়! যাতে সে মন খুলে হাসতে পারে। আমার ভয় পাওয়া দেখে আপনি আজ যে কাণ্ডটা করলেন, আপনি নিশ্চিত থাকুন, আগামী ১০০ বছর যদি বেঁচে থাকি আমরা, তাহলেও আমি আপনাকে বলব না, চলুন বৃষ্টিতে ভিজি।”
তুহিন কাচুমাচু মুখ করে জিজ্ঞেস করল, “বয়ফ্রেন্ড আর স্বামীর পার্থক্য নিয়ে তুমি কি পড়াশোনা করেছ? তোমার কাছে কি এই বিষয়ের ডিগ্রি আছে? মানে, এতকিছু কীভাবে জানো তুমি?”
” না নেই। আপনি তো এতদূর পড়তে দিলেন না আমায়। নিজের টাকায় অনার্স করিয়েছেন বলে দিনরাত হুমকি দিয়েছেন; বলেছেন, এত টাকা খরচ করে পড়াচ্ছি, ভালো রেজাল্ট না হলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবো। সব টাকা উশুল করব। বলেননি? অবশ্যই বলেছেন। স্কুলে পড়ার সময় আমার বাবা-ও আমায় এইরকম ভাবে বলেননি। আপনি যদি আমায় পিএইচডি পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ দিতেন, তাহলে আমি এই বিষয়েই পড়তাম।”

তুহিনের ফোনটা বেজে উঠল। তুহিন ফোন ধরার আগেই ফাতেমা ফোন নিয়ে নিলো। স্ক্রিনে রাশেদ নাম দেখে রিসিভ করে বলল, ” আসসালামু আলাইকুম রাশেদ ভাইয়া। কেমন আছেন?”
রাশেদ হেসে বলল, ” আমি ভালো আছি ভাবী৷ আপনি কেমন আছেন?”
” আমি ভালো আছি। আপনার স্ত্রী কী পাশে আছে?”
” হ্যাঁ আছে। কথা বলবে?”
” দিন।”

রাশেদের স্ত্রীর পাশেই ছিল। ফোনটা হাতে নিয়ে কানে ধরে বলল, “কী খবর ফাতেমা?”
” ভালো। ভাবী, একটা কথা বলুন; আপনি কী আজ ভাইয়ার সাথে বৃষ্টিতে ভিজেছেন?”
” না।”
” কেন ভিজেননি? আপনি না বলেছিলেন, বৃষ্টি আপনার খুব পছন্দ।” কথাটা বলে কলটা লাউড স্পিকার দিলো ফাতেমা।
” বলেছিলাম বটে। কিন্তু এখন আর সেই শখ নেই। আগে ছিল; যখন ক্যাম্পাসে পড়তাম। তোমার ভাইয়ার সাথে তো আমার বিয়ের আগেও সম্পর্ক ছিল। সে ছিল অন্য ইউনিভার্সিটির সিনিয়র। আমি তাকে ফোন দিয়ে আমার ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে আসতাম। সে বৃষ্টিতে ভিজে আসতো৷ আমরা হাত ধরে পুরো ইউনিভার্সিটি চক্কর দিতাম। বজ্রপাতের শব্দ হলে আমাকে জড়িয়ে ধরতো। ভয় পেলে আগলে রাখতো। জানো, বিয়ের আগের দিনই ও আমায় বলেছিল, ‘বিয়ের পর আমরা রাতভর জ্যোৎস্না দেখব। বৃষ্টিতে ভিজবো।’ অদ্ভুতভাবে বাসর রাতেই বৃষ্টি হলো। আমি ওকে বললাম, চলো ছাদে যাই। ও গেল না, বলে, লজ্জা করে। বেশ, আমি আর সেদিন কিছু বললাম না। এর কয়েকদিন পর আবার বৃষ্টি হলো; বিকেলবেলা। সেদিন ও বাড়িতেই ছিল। আমি আবার ওকে বললাম, চলো যাই। ও গেল বটে, তবে ছাদ পর্যন্ত না। সিড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি দুই হাত উড়িয়ে দিয়ে একাই ভিজছিলাম। আমি হঠাৎ পিচ্ছিল খেয়ে পড়ে গেলাম ছাদে। ভাবলাম, ও এদিকে এসে আমায় ধরবে। ওমা! দেখছি ও হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে আমার ছবি তুলল, ভিডিও করল। আমি যে পড়ে আছি, সেদিকে ওর খেয়াল নেই। এরপর তো ওই ছবি, ভিডিও দিয়ে আমাকে খুব ক্ষেপিয়েছে। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, বিয়ে না করলেই ভালো হতো। আর মাঝরাতে খোলা স্থানে বসে গল্প করার কথ বললে ও বলে, ঘুম পাচ্ছে।।”
ফাতেমা দ্রুত গলায় বলল, ” ভাবী, আমি একটু পরই আবার ফোন দিচ্ছি। এখন রাখছি।”

ফোন পাশে রেখে ফাতেমা, তুহিনের দিকে তাকিয়ে গৌরবের গলায় বলল, ” আমার কথা মিলল তো। এই দেশের প্রতিটি নারীর কাছে এই বাস্তব গল্পটা শুনতে পাবেন। দুই একজন ব্যতিক্রমী স্বামী পায়, তবে ক্ষণস্থায়ী ভাবে। বিয়ের রেশ যতদিন শরীরে থাকে আরকি। তারপর বলবে, বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবে। ঠাণ্ডা লাগবে। স্বামী জিনিসটা যে কী, তা আমার জানা হয়ে গেছে।”

তুহিন এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ফাতেমার কথা শুনছিল, ওর কাণ্ড দেখছিল। এবার বড় করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ” তুমি কী চাচ্ছ, এখন আমি তোমায় নিয়ে ছাদে যাই। তারপর তোমাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজি।”
” একেবারেই তা চাচ্ছি না।” খানিক লজ্জা পেলো ফাতেমা।
” তাহলে কী চাচ্ছ, আমি এখন তোমায় জড়িয়ে ধরি। তোমার এই কাঁপুনি থামিয়ে দেই।”
আবার লজ্জা পেলো ফাতেমা। কিছু বলার আগেই তুহিন তাঁর হাত ধরে টান দিয়ে। তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে, কাঁথাটা মাথায় উপর দিয়ে টেনে দিলো। কাঁথার ভেতরটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। দু’টো মুখ, মুখোমুখি হয়ে আবছায়া অন্ধকারে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল।
তুহিন, ফাতেমাকে জাপটে ধরে বলল, ” এবার ঠিক আছে তো। আমাকে নিয়ে তোমার কত অভিযোগ। এবার সব অভিযোগ, সব অপূর্ণতা পূরণ করব।”
ফাতেমা অবিশ্বাসের গলায় বলল, ” আপনাকে খুব অদ্ভুত লাগছে কিছুদিন ধরে। আপনি বরিশাল যাওয়ার পর থেকেই অদ্ভুত আচরণ করছেন। আগে আপনি কথা খুব কম বলতেন। আমাকে তো সময়ই দিতেন না। অথচ এখন সারাক্ষণ আমার সাথে কথা বলছেন। আপনার কাছে আসাতে আমার মধ্যে যত সংকোচ ছিল, এখন তা নেই। বিশ্বাস করুন, ইচ্ছে করছে সারাক্ষণ আপনার বুকের উপর শুয়ে থাকতে।”

তুহিন কোনো উত্তর দিতে পারল না। শুধু ফাতেমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সে নিজেও বুঝতে পারছে না, ফাতেমাকে ভালোবাসে এতটা কাছে টেনে নিচ্ছে, না নিজের দোষটাকে হালকা করার জন্য।

ফাতেমাও দীর্ঘক্ষণ পর বলল, ” অফিস যাবেন না?”
” না।” নিম্নস্বরে বলল তুহিন।
ফাতেমা জিজ্ঞেস করল, ” কেন?”
” কারণ, আমার চাকরিটা আর নেই।”
কথাটা শুনে ফাতেমার শরীর কেঁপে উঠল। বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করে উঠল। তুহিন কিছু বলল না। খানিকক্ষণ পর ফাতেমা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল” আবোলতাবোল কী বলছেন এইসব? উঠুন বলছি। ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি খারাব দিচ্ছি। তাহমিদ আর তৃষ্ণাকে ডাকতে হবে৷”

তুহিন ছেড়ে দিলো ফাতেমাকে। ফাতেমা বিছানা থেকে নেমে মৃদু হেসে বলল, ” এভাবে কেউ মজা করে। আমি তো হার্ট অ্যাটাক করব এটা সত্যি হলে। আমাদের এই সংসারটা চলে আপনার চাকরির বেতনে। হায় আল্লাহ! এইরকম কিছু যেন কখনোই না হয়।”

তুহিন তবুও কিছু বলল না। ফাতেমা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেও ওঠে দাঁড়াল।

৩৪.
সকাল ১০ টা। বৃষ্টি ভাব কেটে গিয়ে এখন খটখটে রোদে ঝলমল করছে চারিদিক। তৃষ্ণা আর অনিক পাশাপাশি হাঁটছে। অনেক খোঁজ করার পর অনিকের দেখা পেলো তৃষ্ণা। অনিকের সামনে গিয়ে বলল, ” তোমার দুঃসাহস দেখে তো আমি অবাক!”
অনিক মাথা নিচু করে হাঁটছিল। তৃষ্ণার কথা শুনে মাথা কিছুটা তুলে হেসে বলল, ” পছন্দ হয়েছে আমার দুঃসাহস? যাক, আমার একটা কিছু অন্তত তোমার পছন্দ হয়েছে। তুমি তো আমার সব কিছুকেই অপছন্দ করো।”
তৃষ্ণা রাগী গলায় বলল, ” এটাও অপছন্দ করি। এইরকম দুঃসাহস দেখাতে নেই।
” আমার গান শুনে সবাই প্রসংশা করে, আর তুমি বলো, ‘এইরকম প্যানপ্যানানি গায়ক আমাদের বাড়ির নিচে সারাক্ষণ দুই একটা পড়ে থাকে। তাই ভাবলাম, ওই দুই একটাকে সঙ্গ দিয়ে আসি। এখানে দুঃসাহস-এর কিছুই নেই।”
তৃষ্ণা হেসে উঠল খিলখিল করে। অনিক, তৃষ্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ” তোমার হাসিটা খুব সুন্দর। আমার মনের তৃষ্ণা মিটিয়ে দেয়।” কথাটা বলে হাসল অনিক।
তৃষ্ণা কপট উগ্র গলায় বলল, “আর তোমার হাসিটা খুব বিচ্ছিরি।”

অনিকের মুখটা মলিন হলো না। এইরকম কথা তাকে প্রায়ই শুনতে হয়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনিক জিজ্ঞেস করল, ” এতদিন আসোনি কেন?”
” ভাবীর বাবা-মায়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ভাবীর বোনের বিয়ে ছিল।”
” ওহ্। আমি তোমায় খুঁজছিলাম।”
” কেন খুঁজছিলে?”
” এমনি।” বিমর্ষ মুখ করে তাকালো অনিক।
” চিঠিতে ‘প্রিয় রূপবতী’ লিখেছিলে কেন?” অনেকক্ষণ পরে আসল কথাটা ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করল তৃষ্ণা। আড়চোখে একবার অনিকের প্রতিক্রিয়া দেখে মাথা নিচু করে ফেলল।
অনিক লাজুক ভঙ্গিতে বলল, ” যা সত্যি, তাই লিখেছি।”
“আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, একটা ছেলে কেন একটা মেয়েকে রূপবতী বলে? ভাইয়া বলেছে, ছেলেটা যদি মধ্যবিত্ত হয়, তাহলে বিশেষ কারণে, অর্থাৎ মেয়েটাকে পছন্দ করে এবং ভালোবেসে রূপবতী বলে। আর বড়লোকেরা কোনো কারণ ছাড়াই মেয়েদের রূপবতী বলে। কথাটা কি ঠিক?”
” হ্যাঁ।” লাজুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল অনিক।

তৃষ্ণার রাগ হলো। ‘ হ্যাঁ’ মানে কী? সরাসরি বললেই তো হয়। মচকানো পা নিয়ে রাত-বিরেতে একতলা টপকিয়ে দু’তলায় গিয়ে চিঠি দিয়ে আসতে পারে, অথচ সরাসরি কিছু বলতে পারে না। এইরকম ছেলের সাথে প্রেম করা খুব রিস্ক। দেখা গেল, বিয়ের সময় বাড়িতে বলতেও পারবে না।
তৃষ্ণা মুখটা কঠিন করে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, ” ভেবেছিলাম তুমি আজ আসবে না ক্যাম্পাসে।”
” তোমার জন্যই এলাম। নাহলে আসতাম না।”
” তুমি কি খুব লজ্জা পাচ্ছ?”
” খুব বেশি না; একটু একটু।”
” তাহলে মাথা নিচু করে হাঁটছ কেন? যারা খুব বেশি লজ্জা পায়, তাঁরাই লজ্জায় মেয়েদের দিকে তাকাতে পারে না।”
অনিক একবার পিছনে তাকালো। আবার সামনে তাকিয়ে হেসে বলল, ” আমার খুব বেশি লজ্জা নেই। আমি সাহসী ছেলে। তোমার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকার মতো সাহস আমার আছে।”
তৃষ্ণা মুখ চেপে হাসি আটকিয়ে বলল, ” যারা সারাক্ষণ মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাঁদের বেয়াহা বলা হয়।”
অনিক চুপসে গেল। কাতর কণ্ঠে বলল, ” আমি কি বেহায়া?”
” এটা তোমার আগামী মুহূর্তের কর্মকাণ্ডের উপর ডিপেন্ড করবে। তুমি যদি বেহায়ার মতো আমার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকো, তাহলে তো আমাকে প্রতিক্রিয়া দেখাতেই হবে।”
” তুমি কি জানো আমি নিচের দিকে তাকিয়ে আছি কেন?” প্রসঙ্গ পাল্টাল অনিক।
“না। তুমি যেহেতু খুব একটা লজ্জা পাচ্ছ না। তাহলে নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণ আছে।” দুই হাত কচলিয়ে হেসে জবাব দিলো তৃষ্ণা।
অনিক বলল, ” পায়ে এখনো ব্যথ আছে। তাই নিচের দিকে তাকিয়ে সাবধানে হাঁটছি। তুমি, আমার প্রতি এতটাই অমনোযোগী যে, আমার হাঁটার গতির দিকে লক্ষ্য করছ না। আমি যে খুব সাবধানে পা ফেলছি, সেটাও দেখছ না।”
তৃষ্ণা লজ্জা পেলো। লজ্জায় নিজেও মাথা নিচু করে কাঁচুমাচু মুখ করে হাঁটতে লাগল। অনিক, তৃষ্ণার লজ্জামাখা মুখটা দেখে সহজভাবে বলল, ” ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। ডাক্তার কী বলেছে শুনবে?”
” কী?” তৃষ্ণার কণ্ঠে জড়তা প্রকাশ পেলো। কিছুটা বিষণ্ণ মুখ করে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল।
অনিক বলল, ” ডাক্তার বলেছে, ক্যাম্পাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটার সাথে কিছুক্ষণ হাঁটলেই পা ঠিক হয়ে যাবে। তোমার চেয়ে সুন্দরী কেউ আমার নজরে আসেনি এখনো।”
নিজের প্রসংশা শুনে আপ্লুত হলো তৃষ্ণা। হেসে বলল, “তুমি কি আমায় পটানোর চেষ্টা করছ?”
মাথা তুলে অনিক বলল, ” তুমি কি একটুও পটেছ?”
“না।”
” তাহলে ভেবে নাও, আমি তোমায় পটানোর চেষ্টা করছি না। সেই চেষ্টা করলে এতক্ষণে তুমি পটে যেতে।”
খিলখিল করে হেসে উঠল তৃষ্ণা। অনিক আবারও মুগ্ধ চোখে তৃষ্ণার হাসির দিকে তাকিয়ে রইল।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লাসের কাছাকাছি চলে এলো দু’জনে।

একটা ক্লাস করে আবার বেরিয়ে এলো দু’জনে। হাঁটতে হাঁটতে স্ট্যাণ্ডের দিকে যেতে লাগল। হঠাৎ অনিক বলল, ” তৃষ্ণা, চিঠি দু’টোই পেয়েছ তো?”
তৃষ্ণা কপাল কুঁচকে বলল, ” দু’টো মানে? আমি তো একটাই পেয়েছি; যেটা আমার ঘরের বারান্দায় ছিল।”
” আমি দুই ঘরে দু’টো দিয়েছি। বারান্দায় রেখে চলে এসেছি।”
তৃষ্ণার বুকটা ধুক্ করে উঠল। ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ” কোন দু’টো ঘরে রেখে এসেছে?”
” আমি যতটুকু জেনেছি, দু’তায় তোমাদের তিনটে ঘর।”
” মাঝেরটাতে রেখেছ নাকি? ওটা কিন্তু বড় ভাইয়ার ঘর।”
অনিক একগাল হেসে বলল, ” আমি জানতাম ওটা তোমার বড় ভাইয়ের ঘর। অভিভাবকরা সবসময় মাঝে থাকে। তোমার বড় ভাই তো তোমাদের অভিভাবক। তাই সহজেই বুঝে গেছি। তোমার আরেক ভাই একটু অন্যরকম। আমি কয়েকবার দেখেছি তাকে। তাঁর বন্ধুরা সবাই খুব হাসাহাসি করে। কিন্তু তিনি চুপচাপ শুনে। প্রয়োজন হলে কথা বলে। বারান্দায় যায় হলো সৌখিন মানুষরা। তোমার ভাই হলো রোবটের মতো। ঘুম থেকে ওঠে অফিস যায়; অফিস শেষ একটু বন্ধুদের সাথে দেখা করে, এরপর বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে৷ দূর থেকে দেখে আমার অন্তত এইরকমই হয়েছে। তাই নিশ্চিন্তে দু’টো বারান্দায় চিঠি রেখেছি।
তৃষ্ণা মাথায় হাত দিয়ে বলল, ” হায় আল্লাহ! এতকিছু জেনেছ, অথচ এটা জানোনি আমি কোন ঘরে থাকি?”
” জানার প্রয়োজন হয়নি। অন্যের সাহায্যে শুধু জেনেছি, ওই বিল্ডিংয়ের দু’তলায় তোমরা থাকো। গতকাল তো কোনোরকম প্ল্যান ছাড়াই চলে গেছিলাম। তাই কারোর কাছে জিজ্ঞেসও করতে পারিনি।”
” তাহমিদ ভাই যদি চিঠিটা দেখে ফেলে, তাহলে কী হবে ভেবে দেখেছ একবার?”
অনিক অগ্রাহ্যের স্বরে বলল, ” আরে কিছুই হবে না। এইসব উনি বুঝবেনই না।”
অনিকের হাতে একটা থাপ্পড় মারল তৃষ্ণা। দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ” তুমি ভাইয়ার সম্পর্কে কিছুই জানো না। ও যে কী জিনিস, তা শুধু আমিই জানি। তুমি থাকো, আমি গেলাম। গিয়ে দেখি চিঠিটা আছে কি-না।” কথাটা বলে হাঁটা দিল তৃষ্ণা।
অনিক বলল, ” আরে থামো। এত তাড়াহুড়োর কী আছে? সে তো এখন অফিসে; সেই সন্ধ্যায় আসবে। এখনো দুপুরই হলো না ঠিকমতো। তোমার ভাবী কি ওই ঘরে যায়?”
” ভাইয়া থাকার সময় কিছু বলতে, বা কোনো কাজে যায়। এছাড়া অপ্রোয়জনে যায় না।”
” তাহলে রিল্যাক্সে বাড়িতে যাও।”

তৃষ্ণা রিল্যাক্স হতে পারল না। তবে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল। তাঁর মধ্যে ভয়ঙ্কর চিন্তার ছাপ ফুটে এসেছে। সকালে তাহমিদ খুব রহস্য করে কথা বলছিল। তাকে দেখে মনে হয়েছিল, অনেককিছু জানে। চিঠি প্রসঙ্গে কিছু একটা বলেছিল আবার।
তৃষ্ণার বুক কাঁপছে; মন কাঁপছে; হাত-পা, পুরো শরীরই কাঁপছে। মাথা যেন বনবন করে ঘুরছে।

সম্পৃক্ততা পর্ব ১৪

0

সম্পৃক্ততা – চতুর্দশ পর্ব।

রিফাত হোসেন।

৩২.
দেখা হবে মুগ্ধকর এক সকালে —
দেখা হবে তপ্ত দুপুরের সোনালী রোদ্দুরে।
দেখা হবে পশ্চিমে ডুব দেওয়া সূর্যের ক্লান্ত বিকেলে —
দেখা হবে গোধূলির আলোমাখা আকাশপটের নিচে।
দেখা হবে কাকভেজা জ্যোৎস্নার রাতে —
দেখা হবে নক্ষত্রভরা আকাশের ছায়াতলে; মধ্যরাতের উঠোনে।

“কবে আপনার সাথে আমার দেখা হবে মাস্টার সাহেব?” আসমা কাতর কণ্ঠে সজলকে বলল কথাটা।

সজল ঘুমোচ্ছিল। এখন ভীষণ ভোর! স্বভাবত এত ভোরে সজলের ঘুম ভাঙে না। আজ ভেঙেছে। সেটাও অপরিচিত একটা মানুষের জন্য। মানুষটা যে একটা মেয়ে, তা কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পেরেছে সজল। স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর! সুরেলা গলায় কিছু একটা বলেছে। আধঘুমো সজল কথাটা শুনতে পায়নি। বিচ্ছিরি কণ্ঠের কেউ হলে, এতক্ষণে ফোন কেটে দিতো। কিন্তু এই মেয়ের কণ্ঠে সুন্দর। গান গাইলে অল্পতেই বেশ নাম করতে পারবে। এর সাথে কথা বলাই যায়।
ঘুমন্ত কণ্ঠে সজল আস্তে করে মেয়েটির কণ্ঠের প্রসংশা করল, ” বাহ্! আপনার কণ্ঠস্বর খুব সুন্দর। এই ভোরবেলা মনকে শান্ত করে দিলো।”

অবাক হলো আসমা। সজল এভাবে কখনো তাঁর কণ্ঠের প্রসংশা করেনি। করেছে মুচকি হাসির প্রসংশা ; লজ্জামাখা মুখের প্রসংশা; বুকের ভিতরের অদৃশ্য কম্পনের প্রসংশা! এই প্রথম যেন সজল তাঁর কণ্ঠের প্রসংশা করল। সজল মাস্টার নিজের মধ্যে আছে তো, এটা ভেবেই আসমা আবার বলল, ” আপনি শুধুই আমার কণ্ঠ শুনেছেন, কথাটা শুনেননি নিশ্চয়ই?”
” না, শুনিনি। আগের কথাটা আর শোনার প্রয়োজনবোধ করছি না। যে মেয়ের কণ্ঠ এত সুন্দর, সে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু বলবে না।”

আসমা হাসল। সাথে এটাও বুঝল, সজল মাস্টারের ঘুম এখনো কাটেনি। এমনটা আগেও বেশ কয়েকবার হয়েছে। তবে প্রতিবারই ছিল আসমার পরিচিত নম্বরের ফোনকল। কিন্তু আজ সে অপরিচিত নম্বর দিয়ে সজলকে ফোন দিয়েছে। তাই সজল একেবারেই উল্টো পাল্টা বলছে। আসমা নিঃশব্দে ফিক করে হেসে বলল, ” শুধুই কি কণ্ঠ সুন্দর? না আরও কিছু সুন্দর আছে।”
” আপনিও খুব সুন্দর।”
” আমায় দেখেছেন আপনি?”
” না। অনুমান করলাম। আমার অনুমানশক্তি খুব প্রখর। যে মানুষটার সুর এত মধুর, সে দেখতেও নিশ্চয়ই মধুর হবে।”
” দেখবেন আমায়?” মুচকি হেসে জানতে চাইল আসমা।
সজল দ্রুত কণ্ঠে বলল, “অবশ্যই। আপনার মতো সুন্দরী একজন মানুষকে যে দেখতেই হবে। আপনার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অন্য কারোর মধ্যেই নেই।” কথাটা বলে ‘হাই’ তুলল সজল।
আসমা একটু কৌতূহলী কণ্ঠে বলল, ” তা কী আছে আমার মধ্যে?”
” স্পেশাল কিছু আছে। যা আমাকে প্রেমে পড়তে উৎসাহিত করছে।”
” কার প্রেমে? আমার!” কপালে সুক্ষ্ম ভাজ করল আসমা।
সজল চোখ মেলল না ভালো করে। উত্তরও দিলো না। আসমা আবার বলল, ” কণ্ঠস্বরের সাথে কি প্রেমের কোনো যোগসূত্র আছে?”
” আছে। একজন মানুষ এমনি এমনি কারোর প্রেমে পড়ে না। অন্তত একটা বিশেষ কারণ থাকে। এই যেমন আপনার কণ্ঠ শুনে আমি, আপনার প্রেমে পড়ে গেছি। এটাও কিন্তু বিশেষ একটা কারণ; আমার কাছে।”
” মাস্টার সাহেব, আমি আসমা।” কিছুটা দরাজ কণ্ঠে বলল আসমা। অপরিচিত একজনকে লোকটা এইরকম কথা বলতে পারলো? এত খারাপ! কান্না পেয়ে গেল আসমার। সজল কিছু বলার আগেই আবার বলল, ” আমি এখন কথা বলতে পারছি না। রাখছি।” ফোনটা কেটে দিলো আসমা।

সজল লাফ দিয়ে উঠল বিছানা থেকে। এক মুহূর্তের জন্য ফোন স্ক্রিনে তাকিয়ে ওয়াশরুমে দৌড় দিলো।

কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলো। হাতে তুলে নিলো একটা তোয়ালে। মন এখন কিছুটা ফ্রেশ লাগছে। খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনা হলো। আসমা নিশ্চয়ই খুব অভিমান করেছে। সজল জানালার পর্দা সরালো। জানালা খোলাই আছে। তাই পর্দাটা সরানোর সাথে সাথে চোখ দু’টো কেমন যেন ঝলমল করে উঠল। পূর্বদিকের সূর্য কুসুম রঙের হতে শুরু করেছে মাত্র। এখনো কিছুটা আড়ালে আছে। চারিদিকটা থমথমে; নিস্তব্ধ। সজল জানালার কাছ থেকে বিছানায় এসে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। আসমা অপরিচিত একটা নম্বর থেকে ফোন দিয়েছে৷ কারণটা জানা নেই সজলের। কিন্তু এটা জানে, সে নিজের অজান্তেই ভুল করে ফেলেছে। ঘুমের ঘোরে কাকে ভেবে কী বলেছে, তাও স্পষ্ট মনে নেই এখন। তবে আসমার হঠাৎ ফোন কেটে দেওয়া থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায়, সে খুব অভিমান করেছে।
সজল আসমার নম্বরে ফোন দিলো। রিং হতে থাকলো; কিন্তু রিসিভ করল না।

আসমা গাল ফুলিয়ে বসে রইল। চোখ দু’টো ছলছল করছে তাঁর। ফোনের রিংটোন বেজে যাচ্ছে ক্রমাগত। প্রেমে পড়লে মানুষের বয়সের বোধগম্য হারিয়ে যায়; তখন সে শুধু প্রেমটাই বুঝে। মান-অভিমান, রাগ, এইসব তো প্রেমের একেকটা অঙ্গ। তাই মানুষ প্রেমে পড়লে, বাচ্চাদের মতো রাগ করে, অবুঝের মতো অভিমান করে। আসমার ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে।

১৫ বারের মতো ফোনকল এলো সজলের নম্বর থেকে। আসমা গননা করেনি; অনুমান করে এটাই মনে হলো। প্রেমিক-প্রেমিকাদের অনুমান আবার মিলে যায় মাঝে মাঝে। আর থাকতে না পেরে ফোন রিসিভ করল আসমা। ফোন কানে ঠেসে ধরে, নিশ্চুপে বসে রইল।

সজল হঠাৎ হেসে বলল, ” আসমা একটা মজার গল্প শুনবে?”

আসমা কোনো উত্তর দিলো না। দাঁতে দাঁত চেপে আগের মতোই চুপচাপ বসে রইল। সজল কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেই বলতে শুরু করল, ” গতকাল বিকেলে আমি যখন অফিস থেকে ফিরেছি, তখন দেখি নুপুর আমার ঘরে এসে ছবি আঁকছে। তোমাকে তো বলেছিলাম ও সারাক্ষণ শুধু ছবিই আঁকে।”
” শুধুমাত্র আপনার ছবি।” হঠাৎ মুখ খুলে কথাটা বলল আসমা। এরপর আবার চুপ হয়ে গেল।
সজল আবার সহজ ভাবে বলতে লাগল, ” এখন অন্যান্য দৃশ্যের ছবিও আঁকে; আমার অনুরোধে। যাই হোক, আসল কাহিনিটা শোনো; আমি এসে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ভবিষ্যতে কী হতে চাও? আর্টিস্ট, না অন্যকিছু। ও ফট করে বলল, ‘আমি ভবিষ্যতে একজন প্রেমিকা হতে চাই। সবাই আমায় প্রেমিকা নামেই চিনবে। গোটা পৃথিবী। বেশ রোমাঞ্চকর হবে ব্যাপারটা। অপরিচিত নম্বর থেকে আমার কাছে ফোন আসবে। আমি প্রথমে তাঁদের কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করব। যদি খুব ভালোলেগে যায়, তাহলে কিছু রোমান্টিক কথাবার্তা বলে পটিয়ে ফেলব। এরপর প্রেম, দেখাসাক্ষাৎ যা হওয়ার হবে।”
গল্পের আগামাথা বুঝতে পারল না আসমা। সে রাগে গজগজ করে বলল, ” এটা কোনো গল্প হলো? এটা বলে আমায় কী বুঝাতে চাইলেন আপনি?”
” দেখো, ব্যাপারটা কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং। মানে, শুধুমাত্র কণ্ঠের উপর নির্ভর করবে, তাকে আমি পটাবো কি-না। আমি গতকাল থেকে এইগুলো ভেবে যাচ্ছি। বিশ্বাস করো, ভোরবেলা আমি এইরকমই একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। ভাবলাম, স্বপ্নে অপরিচিত কোনো নম্বর থেকে মেয়ে ফোন দিয়েছে। আমি ঠিক করলাম, তাঁর কণ্ঠস্বর ভালো হলে পটানো শুরু করব। ওই যে সারারাত যা ভেবেছি, তারই প্রভাব। আমি আধঘুমন্ত অবস্থায় হাত হাতড়িতে ফোন রিসিভ করলাম। ঠিক তাই হলো। একটা মেয়ে কণ্ঠ শোনা গেল। কণ্ঠটা এতই মধুর শুনতে যে, আমি প্রেমে পড়ে গেলাম। সেজন্যই তো স্বপ্ন ভেবে ফোন করা মেয়েটিকে পটানোর জন্য ওই কথাগুলো বলেছি। কে জানতো বলো, ওটা স্বপ্ন না, সত্যি। তুমি আমায় ফোন দিয়েছ। তাছাড়া আগেই তুমি পরিচয় দিলে আমি সতর্ক হয়ে যেতাম।”
“তবুও আমার কণ্ঠ শুনে আপনার চিনে ফেলা উচিত ছিল।”
” বললাম না স্বপ্ন দেখছিলাম। স্বপ্নে তো আমার মধ্যে অপরিচিত নম্বরটাই খেলা করছিল। তাই অতকিছু বুঝতে পারিনি। দোষটা আসলে আমার না।”
” তাহলে কার?”
” স্বপ্নের। নুপুরকেও দোষারোপ করা যায়।”

আসমা ফিক করে হেসে দিলো এবার। সজল শুনল আসমার হাসি৷ অনুভব করল। অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে একপলক দেখেও নিলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেও মুচকি হাসল। কিছুক্ষণ নীরব থাকলো দু’জনেই।
১ মিনিট পর হঠাৎ সজল নিজেই বলে উঠল, ” আরও একটা স্বপ্ন দেখেছি। তবে সেটা মাঝরাতে।”

আসমা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বলল, ” হি হি হি, এটাও সত্যি হবে না। শুনেছি ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে তা হয়নি। অপরিচিত নম্বর থেকে আপনি আমার ফোন পেয়েছেন। যেখানে ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়নি, সেখানে মাঝরাতের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।”
” হতেও পারে।”
” হবে না।” দৃঢ় কণ্ঠস্বর আসমার।
” আগে তো শোনো মাঝরাতের স্বপ্নটা কী? আমি দেখেছি, তুমি ঢাকায় এসেছ। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো। হাসছ; খিলখিল করে। আমি বললাম, ‘আসমা তোমার হাসিটা খুব সুন্দর।’ তুমি সাথে সাথে লজ্জায় আমার বুকে মুখ লুকালে।”

আসমার পিলে চমকে উঠল। থতমত চেহারা করে বলল, ” অসম্ভব। বাবা-মাকে ছেড়ে আমি ঢাকায় যাবো না। তাছাড়া ফাতেমা আপুরা চলে গেছে কাল রাতেই। এতক্ষণে ঢাকা পৌঁছে গেছে। বাবা আমাকে একা যেতেই দেবে না।”
” তবুও তুমি আসবে। খুব শীঘ্রই। আমার এই স্বপ্ন সত্যি হবেই।”
” আচ্ছা ঠিক আছে। সে পরে দেখা যাবে। এখন বলুন, আপনি কেমন আছেন?”
” আছি ভালোই। নিজেকে কেমন যেন খাটি প্রবাসী মনে হচ্ছে।
” খাটি প্রবাসী!” অবাক হলো আসমা।
” হ্যাঁ। যদিও এখানে আমার মামা-মামী আছে, মামাতো বোন আছে। এদের সাথে আমি অনেকটা সময় থেকেছি। তবুও নিজেকে প্রবাসী মনে হচ্ছে।

হেসে উঠল আসমা। কিছুক্ষণ আগেও এই মানুষটার উপর খুব রাগ ছিল, অভিমান ছিল। এখন তা ভালোবাসায় পরিনত হয়েছে। সম্পর্কগুলো এমনই। সবকিছুর মিশ্রণেই তো একটা পরিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আসমা জানতে চাইল, ” আপনার তো অফিস আছে। নিশ্চয়ই এত ভোরে জাগিয়ে দিয়ে ঠিক কাজ করিনি। আরও একটু পরে উঠতেন আপনি।”
” অবশ্যই ঠিক কাজ করেছ। খুব সকালে বিছানা ত্যাগ করার মধ্যে একটা আলাদা ব্যাপার আছে। আচ্ছা, আমায় এটা বলো, আজ হঠাৎ অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন দিলে কেন?”
” এমনি। মাঝে মাঝে অপরিচিত হয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে। একটা নতুনত্বের ব্যাপার থাকে।” কথাটা বলে বিছানা থেকে নেমে গেল আসমা।
সজল বলল, ” বাহ্, আজ মনে হচ্ছে একটু বেশিই খুশি।”
” তা অবশ্য ঠিক। সেজন্যই সক্কাল সক্কাল ফোন দিলাম। যদিও মাঝে একটু ব্যাঘাত ঘটেছিল। তবে এখন সব ঠিক। ইচ্ছে করছে পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে। পুরো আকাশ নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে।” কথাটা বলে দরজা খুলে দুয়ারে এসে দাঁড়ালো আসমা। বসন্তের প্রকৃতির সুবাস মনকে ভরিয়ে দিয়ে গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘঃশ্বাস নিলো।

উৎফুল্লতায় শব্দ করে হাসতে লাগল সজল। আবারও জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। বলল, ” ঠিক আছে। তুমি পাখির মতো উড়ে বেড়াও। আমি জানালা দিয়ে উঁকি মেরে তোমায় দেখি।”
” উড়ছি তো।” এক হাতে মোবাইলটা কানে ঠেসে ধরে, অন্যহাত মেলে দিলো পাখির ডানার মতো। আবার বলল, ” আপনি আমায় দেখছেন না? আমি তো আপনাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ওই যে আপনি দু’তলায় জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। উৎসুক চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। আপনার পরণে একটা ইয়োলো কালারের টি-শার্ট।”

সজল চমকে ওঠে নিজের দিকে তাকালো। আসমার কথা একদম সত্যি। সে এখন ইয়োলো কালারের টি-শার্ট পরে আছে। এবং জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরের দিকে উঁকি দিচ্ছে। সজল জিজ্ঞেস করল, ” এই দাঁড়াও, দাঁড়াও।”
সজলকে থামিয়ে দিয়ে আসমা বলল, ” দাঁড়াতে পারব না। আকাশ পথে দাঁড়ানো যায় না। আমি এখন শুধুই উড়বো। আর গান শুনবো। আপনিও গান শোনেন।”

..এমন যদি হতো,
আমি পাখির মতো;
উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ’…

সজল ধমকের সুরে বলল, ” চুপ। আগে আমার কথা শোনো। তুমি জানলে কীভাবে আমার শরীরে ইয়োলো কালারের টি-শার্ট? কাকতালীয় ভাবে মিলে গেল নাকি? আচ্ছা বলো তো, আমি কি প্যান্ট পরে আছি?”
” ট্রাউজার পরে আছেন। ইয়োলো কালার টি-শার্ট এর সাথে সাথে ছাই রঙের একটা ট্রাউজার। ঠিক কি না?” মুচকি হেসে উত্তর দিলো আসমা।
সজল তাজ্জব গলায় ‘ঠিক’ বলল।।কিছুক্ষণ ভেবে আবার বলল, ” তুমি জানলে কীভাবে?”
” পাখিরা সব জানে। আকাশে উড়ে বেরিয়ে সব দেখে নেয়। এখন রাখছি মাস্টার সাহেব।” দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে আবার বলল, “আমাকে স্কুলে যেতে হবে আজ। ছুটি শেষ।” কথাটা শেষ করেই টুট করে ফোন কেটে দিলো আসমা। মিটমিট করে হেসে, গতকাল সজলের দেওয়া ছবি দু’টো বের করল মোবাইলে। বলল, ” বোকা মাস্টার। গতকাল ঘুমোনোর আগেই তো আমায় ছবি তুলে দিলেন। এর মধ্যেই ভুলে গেছেন। অপরিচিত মেয়ের ফোনের আশায় এতই বিভোর ছিলেন যে, সব ভুলে গেছেন। হা হা হা।”

ফোনটা বুকে জড়িয়ে পিছনে ঘুরে তাকালো আসমা। দেখল, তাঁর বাবা উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁতের সাথে দাঁত খিঁচিয়ে তাকিয়ে আছেন শুধু। আসমা জিবে কামড় দিয়ে এক ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দিলো।

৩৩.
ঝুম বৃষ্টি নেমেছে তোমার শহরে —
অথচ আমি অনুভব করছি চোখের কার্ণিশে।

সকাল থেকেই ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। চিন্তিত আর উৎফুল্ল ফাতেমা রান্নাঘর আর বারান্দা ছুটে বেড়াচ্ছে। গতকাল সকালে তাঁরা ঢাকা এসেছে। কালকে দিনের প্রায় অর্ধেক সময়টাই ঘুমিয়েছে বাড়ির সবাই। ঢাকায় আসার পর আজ দ্বিতীয় দিন। বাড়ির দু’জন মানুষ অফিসে যাবে; একজন ইউনিভার্সিটি যাবে। তাঁদের জন্য রান্না করতে হবে। এদিকে আজ অনেকদিন পর বৃষ্টি নেমেছে। হঠাৎ করেই এমন কাণ্ড! মন চাচ্ছে এক ছুটে বাড়িটার ছাদে চলে যেতে। কোমরে আঁচল গুজে মেঘলা আকাশের দিকে চোখের পাতা ডুবিয়ে তাকাতে। টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়বে; টসটসে গালে, আদুরে ঠোঁটে, আর চকচকে ললাটে! ক্লান্ত হলেই হাত দু’টো কপালের উপর ছাউনির মতো রাখতে। শীতল আবেশে নিজেকে জড়িয়ে নিতে। চিলেকোঠার ঘরে থাকবে স্পিকার। সেখানে গান বাজবে, আর সে বৃষ্টিতে ভিজে নাচবে —..

” অসময়ি বৃষ্টিতে আমি;
অসময়ি বৃষ্টিতে তুমি!
কিছু না বলা কথা দিলাম ভাসিয়ে—
ধুয়ে যাক না এই মন অভিমানী..”

রান্নাটা আজ খুব ঝামেলার মনে হচ্ছে ফাতেমার কাছে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জন্যই বারবার যাচ্ছে বারান্দায়। তুহিন এখনো ঘুমোচ্ছে। তাই অসুবিধে হচ্ছে না। বারান্দা থেকে আবার ছুটে আসছে রান্নার কাছে। বৃষ্টির বেগ বেড়ে যাচ্ছে। রান্না এখনো মাঝের দিকে। ফাতেমা আবারও বারান্দায় গেল। এক হাতে গ্রীল ধরে অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিলো বাইরের দিলে। বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলো হাত। কিন্তু মন ভেজাতো পারল না। অভিমানী ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারও রান্নাঘরে চলে এলো।

আধভেজা চিঠির পাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তৃষ্ণা। হঠাৎ করেই ঘরের বারান্দায় চিঠিটার আবির্ভাব ঘটেছে। গতকাল সকালে তাঁরা বাড়িতে এসেছে। দিনটা প্রায় ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। তারপর রাত পেরিয়ে আবার সকাল হলো। মেঘের ঘুম ঘুম ডাকে তাঁর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দ্রুত বিছানা নেমে গেল বারান্দায় গেছে। তখনই দেখল, একটা ভাজ করা কাগজ পড়ে আছে। বৃষ্টি শুরু হলো হঠাৎ করেই। বাতাসের সাথে বৃষ্টি এসে ক্ষণিকের মধ্যেই কাগজটার কিছু অংশ ভিজিয়ে দিয়ে গেল। তৃষ্ণা ঝড়েরবেগে কাগজটা হাতে তুলে ঘরে চলে এলো। ভিতর থেকে উঁকি দিলো বাইরের দিকে। না, সামনের বাড়ির বারান্দায় কেউ নেই। রাস্তাটায় কেউ নেই। রাস্তায় পাশের দোকানটাও বন্ধ।

বিছানায় বসে কাগজটা পড়তে লাগল তৃষ্ণা..

প্রিয় রূপবতী,
তুমি হয়তো জানো আমার ক্ষিধে মাত্রাতিরিক্ত বেশি। যাকে বলে মারাত্মক। আমার অনেক কিছুর ক্ষিধে আছে; যার মধ্যে অন্যতম হলো জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না খেতে খুব ভালোবাসি আমি। মাঝরাতে ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাই। মনে হয় যেন এক টুকরো জ্যোৎস্না আমার মুখের সামনে চলে এসেছে। আমি খপ করে গিলে ফেলি। ক্ষিধে মিটে যায় আমার। প্রতিদিনের মতো আজকেও আমার ক্ষিধে পেয়েছিল। সেজন্য এক ছুটে বাড়িটার ছাদে গিয়েছিলাম। কত আশা যে ছিল মনে! ছাদে ওঠে দেখি, জ্যোৎস্না নেই। আকাশে চাঁদ-নক্ষত্র, কিছুই নেই। প্রথমে ভাবলাম কুয়াশায় জ্যোৎস্না ঢেকে গেছে। তৎক্ষনাৎ আবার ভাবলাম, শীতের সময় শেষ। এখন আর কুয়াশা আকাশকে ঘিরে ধরে না; মেঘ ধরে। এটা নিশ্চয়ই মেঘের কাজ! ভীষণ রাগ হলো আমার। চুপচাপ অন্ধকার আকাশের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। আচমকা যেন তোমার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল; বিদ্যুতের ঝলকানির মতো করে। মনে হলো, ওই আকাশ আমার সাথে স্বার্থপরতা করলেও তুমি করবে না। তোমার কাছে একটুকরো জ্যোৎস্না চাইলে তুমি অবশ্যই দিবে আমায়। তোমার চাঁদের মতো মুখ যেন স্বচ্ছ কাঁচের মতো ঝকঝকে। চাঁদে কালো দাগ আছে; তোমার মুখে নেই। তোমার হরিণী চোখের চাহনি, চিকোন ঠোঁট জোড়ার আড়ালে থাকা নিষ্পাপ হাসি; সবকিছুই বিদ্যুতের মতো চমকে ওঠে আমার চোখের সামনে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, তোমার কাছে গেলে একটুকরো জ্যোৎস্না পাবোই, পাবো। তোমার দেওয়া জ্যোৎস্না দিয়ে আমি ক্ষিধে মেটাবো। সেজন্য ছুটে আসতে চাচ্ছিলাম তোমার কাছে। সিড়ি দিয়ে নামার সময় হঠাৎ স্লিপ কেটে পড়ে গেলাম নিচে। ভয় পেয়ো না; গুরুতর কিছু হয়নি। সিড়ি থেকে পড়লে আজকাল খুব বেশি কিছু হয় না। বড়জোর হাত-পা ভাঙতো। ভাগ্যের জোরে তবুও বেঁচে গেলাম৷ শুধু পায়ে কিছুটা ব্যথা পেয়েছি। চমকে গেছে বোধহয়। আমি ব্যথায় কাতরে উঠলাম। কেউ শুনতে পায়নি। এদিকে ক্ষিধেতে আমার পেটও কাতরাচ্ছিল। আমি কষ্ট চেপে উঠে দাঁড়ালাম। এরপর পা ল্যাংড়িয়ে তোমার কাছে গেলাম। সরাসরি তোমার কাছে যাওয়ার ক্ষমতা বা সাহস, আমার মধ্যে নেই। ভেবেছিলাম মেঘলা আকাশ দেখার জন্য তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি দূর থেকে তোমার দেখবো। তোমার মুখ, তোমার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি, তোমার চাহনি, আমার কাছে এইসব কিছুই তো একেকটা জ্যোৎস্না। আমি দূর থেকে তোমার দেখতাম। তোমার অজান্তেই জ্যোৎস্না খেয়ে ফেলতাম। সবকিছুর জন্য অনুমতি নিতে নেই। কিন্তু তুমি নেই। আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আজ বোধহয় অনাহারেই থাকতে হবে! কী করি, কী করি ভেবে পকেটে হাত দিলাম। সন্ধ্যায় টিউশনিতে গিয়েছিলাম। পকেটে তখনও কলমটা ছিল। রাস্তাতেই সাদা ঠোংগা পেয়ে গেলাম। হাঁটুর উপর ঠোঙাটা রেখে লিখতে শুরু করলাম। লিখা যেন শেষই হচ্ছে না। কাগজে জায়গা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তাই আপাতত এখানেই থেমে যেতে হলো। আর শোনো, বড় ভাইকে বলবা, একতলায় বাড়ি ভাড়া নিতে। দু’তলায় ওঠে চিঠি দেওয়া বেশ মুশকিল। হয়তো পড়ে গিয়ে আবার পায়ে ব্যথা পাবো। ক্ষিধের কষ্ট যখন সহ্য করতে পারছি, তখন তোমার জন্য এইটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারব। তাই এভাবেই উঠব। ভালো থেকো।
ইতি,
ক্যাম্পাসের নবীন বরণে তোমার সঙ্গীতের সঙ্গী হওয়া ছেলেটি।

শ্বাস আটকিয়ে পুরো চিঠিটা পড়া শেষ করল তৃষ্ণা। কাগজের কোণায় কিছুটা ধুলো লেগে আছে। তৃষ্ণা ফু দিয়ে ধুলো উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু উড়ল না ধুলো। ” চিঠির সাথে সাথে নাহয় ধুলোটুকুও যত্ন করে রেখে দেবো।” এই বলে দ্রুত চিঠিটা বইয়ের ভাজে লুকিয়ে ফেলল। তাঁরপর বিছানা থেকে নেমে তাহমিদের ঘরের দিকে যেতে লাগল।

বৃষ্টির সকাল যে তাহমিদ এতটা ভড়কে যাবে, তা বারান্দায় যাওয়ার আগে বুঝতে পারেনি। নতুন করে প্রেমে পড়েছে সে। এ-সময় একটু-আধটু বৃষ্টি স্পর্শ করতে ইচ্ছে করে। হৃদয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে প্রেম তরতাজা হয়। কিন্তু বারান্দায় যেতেই হতভম্ব হওয়ার মতো কিছু একটা পেয়ে গেল। একটা সুন্দর ভাজ করা কাগজ। উত্তরমুখী ঘর হওয়ায় বাতাসের সাথে বৃষ্টি ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেলে এসে বারান্দা ভিজিয়ে দিচ্ছে। বারান্দার সাথে সাথে কাগজটা ভিজে যাচ্ছে। কাগজটা কীসের, তা দেখার জন্য সে হাতে তুলে নিলো। ভাজ খুলতে গিয়ে কিছুটা ছিড়েও গেল। তবে পুরোটা খোলার আগেই প্রথম লাইনটা স্পষ্ট দেখতে পেলো। প্রথম লাইনে লেখা, ‘প্রিয় রূপবতী’। পুরো ভাজ খোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাহমিদ। তাকে যে, কেউ রূপবতী বলবে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত। এখানে বেশ বড়সড় একটা রহস্য আছে। এ বাড়িতে আহামরি সুন্দরী একজনই আছে।

হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। কাগজের বাকি অংশটুকু না খুলে আবারও ভাজ করে পকেটে রেখে দিলো। এরপর দরজা খুলে দিলো। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তৃষ্ণা। তাহমিদ চোখ বড় করে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলল ‘ প্রিয় রূপবতী’।

হকচকিয়ে উঠল তৃষ্ণা। ঢোক গিলে তাহমিদের হাতের দিকে তাকালো। ‘না, কিছু নেই, এই ভেবে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারল না।

Protected: ধূসর সময়

0

This content is password protected. To view it please enter your password below: