Wednesday, August 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1993



Protected: সিলভার ডলার – Word count: 2822

0

This content is password protected. To view it please enter your password below:

Protected: টুকটুকির দিবারাত্রী

0

This content is password protected. To view it please enter your password below:

Protected: বাবার আত্মকথা

0

This content is password protected. To view it please enter your password below:

Protected: পাগল নাকি পুরুষ?

0

This content is password protected. To view it please enter your password below:

সম্পৃক্ততা পর্ব ১৩

0

সম্পৃক্ততা – ত্রয়োদশ পর্ব।

রিফাত হোসেন।

আসমা মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড় দিলো। দরজাটা শুধু ভেজানো ছিল। আসমা দরজা ধাক্কা দিয়ে চট করে ভিতরে ঢুকে গেল। আচমকা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সে। ভীমড়ি খেয়ে চোখ পাকিয়ে তাকালো।

ফাতেমা হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসল। বাঁকা চোখে একবার বিছানায় শুয়ে থাকা তুহিনের উপর চোখ রাখল, আবার সামনে তাজ্জব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আসমার দিকে চোখ রাখল। তুহিন এখনো ঘুমোচ্ছে। বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি মেরে নয়; একদম হাত-পা ছড়িয়ে। এটা তাঁর পুরোনো অভ্যাস। এর জন্য প্রায়ই ফাতেমাকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বিশেষ করে তুহিন ঘুমানোর পর যখন ফাতেমা একবার বিছানা ত্যাগ করে, তারপর ততক্ষণ পর্যন্ত বিছানায় ফাতেমার জায়গা হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত তুহিনের হুশ না ফিরে। এমনভাবে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে যে, তাকে সরিয়ে আবার নিজের জন্য একটু জায়গা করে নেওয়া মহা মুশকিল।

বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় ফাতেমার। অন্ধকারে সে অনুভব করে, নিজের অজান্তেই তুহিনের বুকের গভীরে চলে গেছে। যেখান থেকে চাইলেই তাঁর মতো ছোট্ট একটা মানুষ বের হতে পারবে না। বলতে গেলে সে তুহিনের বুকের নিচে চাপা পড়ে গেছে। সুঠাম দেহের অধিকারী তুহিন; চওড়া বুকের নিচ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারছে না ফাতেমা। তাঁর চোখ বেয়ে
অশ্রু ঝড়ছিল তখন। মানুষটা তাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে যে, হাত-পা নাড়াবার উপায় পর্যন্ত নেই। নিঃশ্বাস যেন আটকে আসছে। অন্ধকারে তুহিনের মুখের দিকে তাকায় ফাতেমা। জানালার পর্দা ভেদ করে জ্যোৎস্নার আলো ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। ফাতেমায় চোখ জ্যোৎস্নার আলোর সাথে মিলিয়ে যায়। সে আধো আলোয় তাকায় তুহিনের মুখের দিকে। কী সুন্দর দেখাচ্ছিল তুহিনকে! মুগ্ধ হয়ে জ্যোৎস্নার আবছায়া আলোয় তুহিনকে দেখছিল ফাতেমা। কত সুন্দরই-না দেখতে তুহিন! ফাতেমা ভাবে, ‘কে জানতো, ভবিষ্যতে এইরকম সুন্দর একটা মানুষ আমার স্বামী হবে; তাঁর জীবনসঙ্গী হবে!’ শেষ কবে যে এত মনোযোগ দিয়ে তুহিনকে দেখার সুযোগ ফাতেমা পেয়েছিল, তা মনে নেই। স্বামীর কাছে সে লজ্জা রাঙা একজন মেয়ে মানুষ। এখন হঠাৎ করে যদি তুহিন জেগে যায়, তাহলে অপ্রস্তুত হয়ে তাকে মুখ লুকোতে হবে ফাতেমাকে।
ফাতেমার দম বন্ধ হয়ে আসে। সে যখন নড়াচড়া করে নিজেকে ছাড়াতে পারল না, তখন মুচকি হেসেই তুহিনের গালে একটা কামড় বসিয়ে দিলো। তুহিন নড়েচড়ে উঠল। সেই সুযোগে তুহিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় ফাতেমা। বিছানা থেকেই ওঠে আসে। আস্তে আস্তে সুইচের কাছে গিয়ে বাতি জ্বালায়। স্পষ্ট দেখতে পায় তুহিনকে। মানুষটা একাই পুরো বিছানা দখল করে ফেলেছে। যেন এটা তাঁর একার সম্পত্তি! ফাতেমার জায়গা আর হয় না বিছানায়। সে মুখে ভেংচি কেটে মেঝেতে কাঁথা বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। মাথায় দেওয়ার জন্য একটা বালিশও নেয়। সেদিনের কামড়টা ছিল মাপছাড়া কামড়! অর্থাৎ ফাতেমা না বুঝে একটু জোরেই তুহিনের গালে কামড় বসিয়ে দেয়। ফলে দাঁতের ছাপ বসে যায় তুহিনের গালে। ফাতেমা এই ঘটনার সম্মুখীন হয় সকালে। সকালে তুহিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের গালে হাত বুলিয়ে দেখে, কারোর দাঁতের ছাপ বসে গেছে৷ ঘরে ফাতেমাকে বসে থাকতে দেখে তুহিন জিজ্ঞেস করে, ‘ ফাতেমা, তুমি কি ঘুমের ঘোরে আমাকে কামড়িয়েছ?’ ফাতেমা আতঙ্কে ওঠে আয়নায় থাকা তুহিনের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকায়। আসলেই কামড়টা একটু জোরেই মেরেছিল ফাতেমা। প্রথমবার তো; সেজন্য বুঝতে পারেনি। এরপর যতবার এইরকম ঘটনা ঘটেছে, ফাতেমা আস্তে করে তুহিনের গালে কামড় বসিয়ে দিয়েছে। কখনো তুহিন নড়েচড়ে উঠেছে, কখনো আবার তাঁর মধ্যে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া-ই দেখা যায়নি। ফাতেমা একবারই কামড় দিতো৷ তুহিন তাকে ছাড়লে সে ওঠে যেতো; না ছাড়লে সেভাবেই শুয়ে থাকতো। নিঃশ্বাস আটকে যাক; স্বামীর বুকে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা সৌভাগ্যের ব্যাপার। সবাই এইরকম সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায় না। ফাতেমা হয়তো জন্মেছিল। সেজন্য তুহিনের ওইরকম একটা ‘ভালো’ অভ্যাস তৈরি হয়েছিল। জেগে থাকতে না জোক, অন্তত ঘুমোনোর পর স্ত্রীকে বুকে টেনে নেয়।

ফাতেমা আজও আতঙ্কে উঠল। তবে তুহিনের গালে হালকা দাঁতের ছাপ দেখে নয়; আচমকা ঘরে আসমাকে দেখে। অবশ্য তুহিনের গালে এখন কোনো দাগ নেই৷ ওত আস্তে করে কামড়ে দিয়েছিল। দাগ বসার সুযোগই পায়নি।

আসমা জিজ্ঞেস করল, ” বড় আপু, তুমি নিচে কেন?”
” না মানে, উপরে জায়গা হচ্ছিল না।” ইতস্ততভাবে কথাটা বলে ‘হাই’ তুলল ফাতেমা। আবার বলল, “তুই হঠাৎ এ-ঘরে?”
আসমা চিন্তিত আর ভাবান্তর চাহনিতে তাকিয়ে বলল, ” না মানে, আমি ভুলে এ ঘরে এসে গেছি। আগে তো আমিই থাকতাম ; তাই হুটহাট করে ঢুকে যেতাম। তোমরা যে এখানে আছো, আমার মনে ছিল না।”
” ওহ্। ” ছোট করে বলল ফাতেমা।
আসমা আবার প্রশ্ন করল বোনকে, ” উপরে জায়গা হচ্ছিল না মানে? এতবড় একটা বিছানা; তবুও জায়গা হচ্ছে না? অথচ কালকেও আমরা তিনজন এই বিছানায় ঘুমিয়েছি।”
” দেখছিস না উনি কেমন নিজেকে ছড়িয়ে শুয়ে আছেন।”
” সে তো দেখতেই পাচ্ছি। সারারাত কী তুমি নিচেই শুয়েছিলে? ঠাণ্ডা মেঝেতে একটা কাঁথাতে কী হয়? আমাকে বললে একটা মাদুর বিছিয়ে দিতাম।”
” সারারাত বিছানাতেই ছিলাম। ভোরে নামাজের জন্য উঠেছি। সেজন্যই তো আর দরজায় খিল দেয়নি। নামাজ পড়ে দেখি, উনি হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছেন। তাই আর ধাক্কাধাক্কি করে ঘুম ভাঙাইনি। শরীর অসুস্থ; বিরক্ত করা ঠিক হবে না।”
মৃদু হেসে আসমা বলল, ” ওহ্ আচ্ছা। ঘুমোও তোমরা। আমি বাইরে দিয়ে একটু ঘুরে আসি। প্যান্ডেলে গিয়ে দেখে আসি, কাজ কতটা কী হলো।”
” আচ্ছা যা। কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে ডাক দিস।” মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ফাতেমা।
আসমাও মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, ” আচ্ছা।” কথাটা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ফাতেমা আবার শুয়ে পড়ল না। কাঁথাট গুছিয়ে রেখে, একটা টুল নিয়ে আয়নার সামনে বসে গেল। মেয়েদের সবচেয়ে পছন্দের স্থান যে শুধু স্বামীর বুকে, তা না। আয়নার সামনের স্থানটি-ও তাঁদের অতি পছন্দের একটি স্থান। এবং সেখানে বসা তাঁদের খুব পছন্দের একটি কাজ।

৩০.
প্রথম দিকের সিটের টিকিট কেটেছিল বলে, বাস ড্রাইভার এর কাছাকাছি বসেছিল তাহমিদ। সঠিক সময়ে বাস ছেড়েছিল। ঢাকা পাড় হতেই বাস চলছিল দ্রুত গতিতে। বাসের হেল্পারও ড্রাইভার এর পাশে বসেছিল। তাহমিদ চিন্তিত মুখ করে বসেছিল এক জায়গায়। বৃষ্টি পড়ছিল সেসময়। হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। মেঘ নেই, মেঘের গর্জন নেই, অথচ অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। অনেকটা বাধহীন চোখ দিয়ে অনবরত জল গাড়িয়ে পড়ার মতো! তাহমিদের বুক কাঁপছিল- মন কাঁপছিল; কাঁপছিল সারা শরীর। জানালা আটকানো ছিল। বাইরে থেকে কোনো বৃষ্টির ফোঁটা বা বাতাস ভিতরে প্রবেশ করছিল না। ছিল ভ্যাপসা গরম। তবুও কাঁপছিল তাহমিদ। ভয়ে; অজানা শঙ্কায়! মেয়েটাকে ওভাবে যেতে না দিলেই বোধহয় ভালো হতো। ফোন বন্ধ তাঁর। না জানি এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছে! নিশ্চয়ই কাঁদতে কাঁদতে পুরো বাসের লোকজনকে হয়রান করে দিয়েছে এতক্ষনে। খুব আবেগপ্রবণ মেয়ে তো; অল্পতেই কেঁদে দেওয়াটা স্বভাব ওর।
তাহমিদ হেসে উঠল। নিষ্প্রাণ হাসি! কোনো অনুভূতি নেই এই হাসিতে।

হঠাৎ বাসের হেল্পারের ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। বাজছে ‘পরাণ যায় জুড়িয়ে-রে’ গানটা। এখনো যে মানুষ এ ধরণের গানের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি, তা এই হেল্পারের ফোন রিংটোন শুনেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। সে ক্লান্ত চোখে ফোন স্ক্রিনে তাকালো। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকার পর রিসিভ করে কানে ধরল। কিছু বলল না। চুপচাপ শুনে গেল ওপাশের মানুষটার কথা। আদৌও ওপাশের মানুষটা কিছু বলছে কি-না, তা নিয়েও সন্দিহান আছে তাহমিদ। তাই চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে হেল্পারের দিকে। একজন হেল্পার ফোনে কাকে কী বলল, তা জানার জন্য তাহমিদের মনে কখনো কৌতূহলী তৈরি হয়নি। আজ হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে, তাকে জানতে হবে হেল্পারকে কে ফোন করেছে। হয়তো সন্ধ্যার আগের বরিশালের উদ্দেশ্যে যাওয়া সেই বাসটার ড্রাইভার, বা হেল্পার। এইরকম তো হয়-ই। একই মালিকের গাড়ি চালায় এরা। একে অপরের সাথে যোগাযোগ থাকাটা খুব স্বাভাবিক। হয়তো ফোন করে বলছে, ‘আমি অনেকটা পথ চলে এসেছি।’ বা সরাসরি বলছে, ‘আমরা প্রায় বরিশালে ঢুকে পড়েছি।’ যদিও তাহমিদ জানে না এতটুকু সময়ে বরিশাল বিভাগে চলে যাওয়া যায় কি-না। সে বহুদিন আগে একবার গিয়েছিল। তাঁর বড় ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি সেখানে। এখন মনে নেই কিছুই।

হেল্পারের কথায় তাহমিদের ভাবনায় ছেদ পড়ল। হেল্পার ফোনটা কান থেকে নামিয়ে কিছুটা আতঙ্কিত গলায় বলল, ” উস্তাদ, সর্বনাশ হয়ে গেছে!”

সর্বনাশের কথা শুনে তাহমিদের বুকটা ধুক্ করে উঠল। সেই অজানা শঙ্কাটা যেন হঠাৎ গাঢ় হয়ে তাকে ভয় পাইয়ে দিলো। কিছু না বলে তাকালো ড্রাইভার এর দিকে।।

ড্রাইভার কপাল কুঁচকে বলল, ” কী হইছে?”
” বাবলু ভাইয়ের গাড়িটা এক্সিডেন্ট করছে। বাস আর ট্রাকের মধ্যে সামনাসামনি সংঘর্ষ। বাবলু ভাইয়ের হেল্পার লাফ দিয়ে নেমে গেছে আগেই। ও ফোন করছিল।” হেল্পার হাঁপাতে হাঁপাতে একনাগাড়ে কথাগুলো বলল।
ড্রাইভার কথাগুলোর শুনেই গাড়ি একপাশ করে ব্রেক করে বসল। উৎকণ্ঠায় বলল, ” কসকি! বাবলু ভাই কই?”
” ও জানে না। ও নাকি ভয়ে পালায়া গেছে।”

তাহমিদের শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল। টানটান হয়ে বসে রইল। নিজের মনকে শক্ত করল। আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে নিজেকে বুঝালো, ” ধুর, বাবলু হয়তো অন্য কোনো ড্রাইভারের নাম। মানহা যে গাড়িতে গেছে, ওই গাড়ির ড্রাইভারের নাম হয়তো অন্যটা। হাবলু, ডাবলু, এই টাইপ কিছু।”
মনকে স্থির রাখতে পারছে না তাহমিদ। সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করছে৷ হেল্পারকে জিজ্ঞেস করতেই হবে, ‘ বাবলু কোন গাড়ির ড্রাইভারের নাম?’ ও যদি বলে, ‘ আগে যে গাড়িটা বরিশালের দিকে গেছে, ওই গাড়িটার ড্রাইভারের নাম।’
নাহ্, তাহমিদ আর ভাবতে পারছে না। শরীর ঘামছে তাঁর। গরম থেকেই বোধহয় শরীরটাও কাঁপছে; আগের থেকেও বেশি। মানহার কিছু হয়ে গেলে খুব বাজে হবে ব্যাপারটা। তাহমিদ যদি কড়া করে মানহাকে আটকানোর চেষ্টা করতো, তাহলে সফল হতো। সেই অধিকার তাকে মানহা নিজেই দিয়েছে। আজ না গিয়ে কাল যেতো; অথবা আরও কিছুদিন পর। কিংবা ও যে গাড়িতে যাচ্ছে, সেটায় করে যেতে পারতো, একসাথে। তাহমিদের আরও মনে হচ্ছে, সে-ও যদি মানহার সাথে ওই গাড়িতে চলে যেতো, তাহলে খুব ভালো হতো। উল্টো পাল্টা কিছু হয়ে গেলে একসাথে হতো। অন্তত এই অস্থিরতা তৈরি হতো না। অস্থিরতা সাধারণ দুই কারণে হয়। প্রথমত উত্তেজনা থেকে। দ্বিতীয়ত যন্ত্রণা থেকে। তাহমিদের যন্ত্রণা হচ্ছে খুব; বুকে, মনে। মাথাটা কেমন যেম ঝিম মেরে আছে। নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে। প্রকৃত পাগলরা নিজেকে পাগল ভাবতে পারে না। কিন্তু তাহমিদ পারছে; অর্থাৎ, সে প্রকৃত পাগল হয়নি এখনো। কিন্তু হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। মাথায় খুব আঘাত করছে একটা ভাবনা। দুশ্চিন্তার ভাবনা!

যাত্রীদের হৈচৈ-এ নড়েচড়ে বসল তাহমিদ। খুক করে একটু কেঁশে পিছনে তাকালো। সবাই কিছুটা হুংকার ছেড়ে জানতে চাইছে, ‘বাস কেন থামানো হলো?’
ড্রাইভার তাকালো পিছনে। হাত উঁচিয়ে ধমকের সুরে বলল, ” আরে থামেন। চিল্লাচিল্লি কম করেন। আগের বাসের এক্সিডেন্ট হইছে। অবস্থা খারাপ। বাসের কেউ বাঁইচা নাই।”

ড্রাইভার মিথ্যে বলছে। ‘বাসের কেউ বাঁইচা নাই’ এই কথাটা হেল্পার মুখ দিয়েও উচ্চারণ করেনি। তাছাড়া সবাই যদি মারা যেতো, তাহলে হেল্পার ফোনে দিলো কীভাবে? কেউ কেউ নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে মানহা একজন, এই বলে নিজেকে আশ্বস্ত করল তাহমিদ।

বাসের যাত্রীরা চুপসে যাওয়ার মতো করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ড্রাইভারের দিকে। এরপর শুরু করল নিজেদের মধ্যে কোলাহল। তাহমিদ দুই কান চেপে মাথাটা জানালার সাথে ঠেসে ধরেছে। রাস্তাটা সফট। ঝাঁকি লেগে মাথা ফাঁটার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া লোকদের মুখে ‘ কেউ বেঁচে নেই’ কথাটা শোনার চেয়ে ঝাঁকিতে মাথা ফাঁটানো অনেকটা সুখের। অচেতন হয়ে গেলে আরও ভালো হবে। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য জাগতিক চিন্তাভাবনা, মানহা, এক্সিডেন্ট, কেউ বেঁচে নেই, মানসিক যন্ত্রণা, এইসব থেকে দূরে থাকা যাবে। সারাজীবনের মতো অচেতন হলে তো আরও ভালো। এইরকম মর্মান্তিক যন্ত্রণার থেকে চিরনিদ্রায় থাকা ঢেড় ভালো।

ড্রাইভার বসেই কয়েকজনকে ফোন করলেন। এরপর আবার বাস স্টার্ট দিলেন৷

তাহমিদ দেখল, দু’টো ভাঙা গাড়ি মুখোমুখি হয়ে আছে। দু’টো গাড়িরই অর্ধেকটা একটার সাথে আরেকটার মিশে গেছে। মানহা যে কোন দিকটাতে বসে ছিল, তা মনে করতে পারল না তাহমিদ। মনে পড়ার সম্ভবনাও নেই। মানহা বাসে উঠার পর সে আর সামনে তাকায়নি। বেশ কয়েকটা এম্বুলেন্সও দেখা গেল। তাঁর থেকেও বেশি লোকজনের উপচে পড়া ভীড়। হুড়োহুড়ি করে সবাই যে আহত, নিহত, ব্যক্তিদের এম্বুলেন্সে তুলছে, তা না। অধিকাংশ লোকজনই ‘হা’ করে তাকিয়ে আছে, আর কপাল চাপড়াচ্ছে। তাহমিদ এগিয়ে গেল। পরপর থেতলে যাওয়া রক্তাক্ত কয়েকজনকে দেখে তাঁর মনে হলো, এদের মধ্যেই মানহা আছে। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আস্তে আস্তে এম্বুলেন্স সব উধাও হয়ে গেল। হৈচৈ কিছুটা কমল। পিছনে তাকিয়ে দেখল, অসংখ্য গাড়ি আটকে আছে। সামনেও আছে। তাহমিদ যে গাড়িটাতে আসছিল, সেটাও কোনো একদিকে আটকে আছে বোধহয়। খুঁজতে হবে। কিন্তু এ ঝামেলায় আর গেল না তাহমিদ। গাড়ি খোঁজাখুঁজি আপাতত অফ। তাকে হাসপাতালে যেতে হবে। একজনকে জিজ্ঞেস করে নিলো, হাসপাতালে ঠিকানা।
উনার থেকে ঠিকানা নিয়ে রাস্তায় ইউ টার্ন নিলো তাহমিদ। হেঁটে অন্য রাস্তায় এসে গাড়িতে উঠল।

হাসপাতালে গিয়ে অনেক খোঁজখবর নিয়ে অবশেষে দেখা পেলো মানহার। রক্তাক্ত শরীর। তবে মুখটা খুব বেশি ক্ষত হয়নি। স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে তাকে। ঠোঁটের কোণে অভিমানী একটা ভাব ফুটে উঠেছে। ঠিক যেমনটা ঢাকার বাসস্ট্যান্ডে থাকাকালীন সময়ে ছিল। অভিমানী মানহা চলে গেল সামনে থেকে। মানহার চোখমুখ ফুলে একাকার। নিশ্চয়ই এক্সিডেন্ট হওয়ার আগে পুরো রাস্তাটাই কেঁদেছে৷ মানহা মারা গেছে, ডাক্তার নিষ্ঠুরের মতো এই কথাটা বলে গেল। মানুষ নিজের মৃত্যুর খবর আগে থেকে জানলে একটা দিক দিয়ে বেশ সুবিধা হতো। মৃত্যুর আগে অন্তত একটু আনন্দ করতে পারতো। প্রিয়জনদের সাথে কিছু সময় কাটাতে পারতো। মানহা সেই সুযোগ পেলো না। উল্টো বুকভরা কষ্ট নিয়ে তাকে জীবন ত্যাগ করতে হলো। তাঁর শেষ নিঃশ্বাসের সময় তাহমিদ পাশে থাকতে পারলো না৷ অথচ প্রেমের শুরুতে এটাই মানহার খুব গভীর একটা স্বপ্ন ছিল। একটা আকাঙ্খা ছিল। ফিল্মি স্টাইলে তাহমিদ তাকে জড়িয়ে ধরবে। আর সে, তাহমিদের বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাসটা তাহমিদের বুকে ফেলবে। মানহার কোনো আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নই পূরণ হলো না। তাঁর আগেই চলে যেতে হলো তাকে।

মানহার ভাইকে তাহমিদ চিনতো। অনেকদিন আগে এক শুক্রবারে মানহা তাঁর ভাইয়ের সাথে তাহমিদকে বন্ধু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। লোকটা মোটামুটি ভালোই। সৎ ভাইদের অতটা ভালো হতে নেই, এটাই আগে মানহাকে বলতো তাহমিদ। কিন্তু মানহার ভাইকে দেখে মনে হয়েছিল, ভাই তো ভাই-ই হয়; আপন-পরের কথা তো পরের প্যারাতে আসবে।
তাহমিদের সাথে মানহার ভাইয়ের সাক্ষাৎকার বেশ জমে উঠেছিল। সেই সুবাধে তাহমিদ তাঁর নম্বরটাও নিয়ে নিয়েছিল। এতদিন সেটা কাজে লাগেনি। এবার লাগবে। সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে সেই নম্বরে ফোন দিলো। কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে মানহার মৃত্যু সংবাদটা জানালো।

সকালের আগেই ছুটে এলো মানহার ভাই, বাবা-মা। মানহা বলেছিল, তাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে তাঁর ভাই ক্লান্ত। কিন্তু তাহমিদের সেরকম মনে হয়নি সেসময়। ক্লান্ত মানুষ অত কাঁদতে পারে না! এখনো ভাবছে সৎ বোনের জন্য। মানহা বেঁচে থাকলে হয়তো সারাজীবন ভাবতো। মানহাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল নিশ্চয়ই জোর করে বিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। মাহনার শরীরে একটা অসুখ ছিল। যা কিছুতেই ঠিক হচ্ছিল না। ডাক্তাররা বলেছিল, যেকোনো সময় এর মৃত্যু হতে পারে। ট্রিটমেন্ট করে হয়তো কিছুদিন বেশি বাঁচিয়ে রাখা যাবে। হায়াত যদি না থাকে, তাহলে সেটাও সম্ভব হবে না। মানহা নিজের ইচ্ছেতেই ঢাকা এসেছিল পড়াশোনা করতে। তাঁর ভাই তাকে সাপোর্ট করেছিল। আপাতত এক্সাম শেষ। এবার তো সে চাইবেই নিজের বোনকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে। সেজন্যই তাড়া দিয়ে মানহাকে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিল।

হাসপাতালে মানহার ভাইকে সামলানো যাচ্ছিল না। তাই দ্রুত এম্বুলেন্স নিয়ে তাঁরা মানহার লাশ নিয়ে যায় গ্রামের বাড়িতে। সাথে যায় তাহমিদ। সেখানেই মানহার দাফনকাজ সম্পন্ন হয়।

সেই সেমিস্টারটা গ্যাপ যায় তাহমিদের। বড় ভাই রাগ করে, ভাবী রাগ করে, বন্ধুরা রাগ করে, কিন্তু কোনোকিছুতেই যায় আসে না তাহমিদের। তাঁর জীবনটা এলোমেলো হয়ে যায় একটা ঘটনার প্রভাবে। বন্ধুরা মানহার খোঁজখবর নেয় না রাগে। মানহার ক্লোজ যারা ছিল, তাঁদের সাথে আবার তাহমিদ বা ওর বন্ধুদের সম্পর্ক অতটা গাঢ় ছিল না। ফাইনাল এক্সামের পর আর সেভাবে যোগাযোগ হয়নি। মানহার বন্ধুরা হয়তো মানহার মৃত্যুর খবর পেয়েছিল; কিন্তু সেভাবে কাউকে জানায়নি। তাহমিদ নিজেও জানায়নি। অনেকেই ভেবেছে, মানহা তাহমিদের সাথে প্রতারণা করেছে। তাহমিদ কারোর ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় না। শুধু কেউ যখন মানহাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ কথা বলতো, তখন তাহমিদ রেগে গিয়ে বলতো, ‘যা হয়েছে আমার সাথে হয়েছে, তোরা একদম চুপ থাকবি।’ সবাই চুপ করে যেতো। ব্যাপারটা আস্তে আস্তে ধামাচাপা পড়ে যায়। তাহমিদ পরেরবার আবার এক্সাম দেয়। কিন্তু একটা লাল দাগ পড়ে যায়। সেজন্য ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে আর কিছু ভাবেনি। এর মধ্যে আবার আবির্ভাব হয় ‘009’ এর মতো অদ্ভুত কিছুর। ব্যাপারটা বেশ ইনজয় করতো তাহমিদ। তাঁর মনের সব প্রশ্ন বলার আগেই একজন জেনে যাচ্ছে, আবার উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। এতে মন্দ কিছু তো নেই। ব্যাপারটা আরও ভালো! ফ্রি তে একটা অপরিচিত মেয়ের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। মেয়েটা যেই হোক, কিছু প্রশ্নের দারুণ দারুণ উত্তর দিচ্ছে, ফ্রিতে অত সুন্দর কণ্ঠ শোনাচ্ছে, বেশ ভালোই। ফ্রিতে এইরকম সার্ভিস ক’জন দেয়! সে যে শুধুই একটা ভ্রান্তি, তা কখনো অনুভব করার চেষ্টাই করেনি তাহমিদ। চেষ্টা করলে হয়তো বুঝতে পারতো। অন্যের কাছে এটা পাগলামি হলেও তাঁর কাছে ছিল এটা প্রশ্নোত্তরের দারুণ একটা মাধ্যম। তাহমিদের পরামর্শ শুনে অনেকেই উপকৃত হয়েছে। কেউ কেউ তো তাকে নিজের আইডল ভেবে বসেছিল। এমনকি তাঁর বোন, তাঁর বন্ধুরা। এর জন্য তাহমিদ আরও বেশি করে ‘009’ এর মেয়েটির প্রতি দূর্বল ছিল। ব্যাস, আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছিল দিন।

৩১.
রাত প্রায় ১টা। তাহমিদ সহ সবাই আজ ঢাকায় ফিরে যাচ্ছে। গাড়িতে নয়, লঞ্চে করে। তিনটে কেবিন বুক করা হয়েছে। একটাতে আছে তানিশা আর তুলি। আর একটাতে আছে তুহিন আর ফাতেমা। অন্যটা তাহমিদের জন্য।

দু’তলায় কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। রেলিং-এ ঝুঁকে রাতের ধোঁয়াশা আকাশ দেখছে; আর অন্ধকারে আধচোখে তাকিয়ে নদীর কালো কুঁচকুচে জল দেখছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে লঞ্চ আর ট্রলারের হুইসেলের শব্দ। কিছুক্ষণ আগেও পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল লোকজন। কেউ বলছিল, ‘ঝাঁলমুড়ি, ‘কেউ আবার বলছিল ‘এই চানাচুর’। এইরকম নানান আওয়াজ আসছিল। এখনো হয়তো আছে। তবে চেচাচ্ছে না। কেবিনের দিকটা পুরোপুরি ফাঁকা। সবাই নিজ কেবিনে ঘুমোচ্ছে। তাহমিদ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দেখছে, হুইসেলের শব্দ শুনছে, আর উপভোগ করছে। এ যেন অন্যরকম এক জগৎ! এতোএতো মানুষ জড়োসড়ো হয়ে আছে একটা জায়গায়। লঞ্চের এই দিকটা বেশ ভালো লাগে তাহমিদের। এখানে সবাই নিজের মতো আছে। সবাই যেন নিজের একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছে এখানে। কেউ একটা চাদর বিছিয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে, কেউ আবার চেয়ারে বসে আছে; এদিক-ওদিক হাঁটছে। কেউ কেউ ঠিক বেডরুমের মতোই জায়গা নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। তাহমিদ দুই হাত রেলিঙের উপর রেখে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসল। বাতাসের তীব্রতায় চুলগুলো উড়ে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে কপালে।

” তাহমিদ, ঘুমোবি না?” তানিশা নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে তাহমিদকে দেখে কথাটা বলল।

হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনে পাশে তাকালো তাহমিদ। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে তানিশা। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে তাহমিদ বলল, ” ওহ্ তুই। দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এদিকে আয়।”

তানিশা ইতস্ততভাবে এগিয়ে গেল তাহমিদের দিকে। বাঁ হাতের তালু ঠেকালো কপালে। ঘামটুকু মুছে তাহমিদের পাশে এসে দাঁড়ালো। তাহমিদ জিজ্ঞেস করল, ” ব্যাপারটা কী? তুই ইদানীং আমার থেকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন?”
” কই?” চমকানো কণ্ঠে বলল তানিশা।
” আমার মনে হলো, তুই আমার থেকে দূরে দূরে থাকছিস।”
” আসলে, আমি নিজের মধ্যে অন্যরকম কিছু অনুভব করছি। কেমন যেন লজ্জা লাগছিল তোর সামনে আসতে।” কথাটা বলার পরই লজ্জায় তানিশার মুখের রং পাল্টে যেতে লাগল।

তাহমিদ শব্দ করে হেসে উঠল কথাটা শুনে। রাগে ফুঁসে উঠল তানিশা। তাহমিদকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ” হাসছিস কেন? হাসার মতো কী বললাম আমি?”
তাহমিদ হাসতে হাসতে বলল, ” কী বলিসনি সেটা আগে বল? ওহ্ মাই গড! তানিশা কি-না আমার সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে। এটাও কী আমায় বিশ্বাস করতে হবে?”
” বিশ্বাস না করার কী আছে? আমি কি নির্লজ্জ?” মুখ বাঁকিয়ে বলল তানিশা।
তাহমিদ আগের মতো হাসতে হাসতে বলল, ” অন্তত আমার সামনে আসলে তুই নির্লজ্জ হয়ে যাস। এটা তোরই কথা। ঠিক কি না বল?”
” আগে ঠিক ছিল। এটা এখন ঠিক নয়। কারণ, আগে আমি শুধুই তোর বন্ধু ছিলাম। এখন আমাদের মাঝে ভিন্ন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বললাম না, আমি নিজের মধ্যে অন্যরকম কিছু অনুভব করছি।”
” তাতে কী হয়েছে?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো তাহমিদ।
তানিশা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তরে বলল, ” অনেক কিছুই হয়েছে। আগে আমি যেমনতেমন ভাবে তোর সামনে চলে আসতাম। কিন্তু এখন পারছি না। কেমন যেন বিব্রত হয়ে যাচ্ছি বারবার। এই যে তোকে তুই করে বলছি, এখানেও কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে, তুমি করে বলা উচিত।” কথা বলতে বলতে উত্তেজনায় তাহমিদের হাত চেপে ধরল তানিশা।
তাহমিদ মৃদুস্বরে বলল, “এবার তুই ভেবে দেখ, প্রেম- ভালোবাসা বন্ধুত্বের মধ্যে কতটা ফাটল তৈরি করে দেয়।”
“সেই ফাটল জোরা লাগানোর মতো মনের জোর আমার মধ্যে আছে।” তানিশার কণ্ঠস্বর অত্যন্ত দৃঢ়।

তাহমিদ চুপ করে মুচকি হাসল শুধু। তানিশা ঘুরে রেলিং-এ হেলান দিয়ে বলল, ” তোকে একটা কথা বলব।”

কথা বলার আগে এভাবে কখনো অনুমতি নেয়নি তানিশা। আজ নিচ্ছে। তাহমিদ কপাল কুঁচকে তাকালো। তানিশা ঢিপঢিপ চোখে তাকিয়ে বলল, ” চল না এক্ষুনি আমরা বিয়ে করে ফেলি।”

আতঙ্কে উঠল তাহমিদ। এক্ষুনি বিয়ে; তানিশা পাগল হলো নাকি! তাহমিদ ‘হা’ করে তাকিয়ে রইল তানিশার দিকে। দমকা হাওয়া এসে তানিশা চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে গেল। চুলগুলো উড়ে এসে তানিশার মুখটা ঢেকে দিলো। নিজের লজ্জামাখা লাল মুখটা আড়াল করার জন্য এটার প্রয়োজন ছিল বোধহয়। প্রকৃতি নিজের অজান্তেই ওকে সাহায্য করল। তাহমিদের ইচ্ছে হলো, নিজের ডান হাতটা তানিশার মুখের দিকে বাড়িয়ে দিতে! ভালো কাজের জন্য ডান হাত ব্যবহার করতে হয়। তাই সে ডান হাত দিয়ে তানিশার মুখের সামনে থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিবে। তাঁর হাত স্পর্শ করবে তানিশার কপাল, গাল, নাক, আর ঠোঁট। শিউরে উঠবে তানিশা। স্পর্শটা প্রথম নয়। তবুও অনুভূতিটা একেবারেই ভিন্ন অনুভব করবে সে।
কাজটা করল না তাহমিদ। বিয়ের আগেই এতকিছু করা ঠিক না। একবার মানহাকে চুমু দিয়েছিল। পরে আর তাকে বিয়ে করতে পারেনি। এই নিয়ে এখনো মনে একটা অনুশোচনা কাজ করে। সেজন্য এই সত্যিটা এখন পর্যন্ত কাউকে বলতে পারেনি।

মানহা নিজেই, নিজের মুখের সামনে থাকা চুলগুলো সরালো। কিন্তু বাতাসে চুলগুলো আবার তাঁর মুখটা ঢেকে দিলো। আবারও বৃথা চেষ্টা করতে লাগল তানিশা। তাহমিদ বাধা দিলো না। মেয়েটা খুব সুন্দর করে এলোমেলো চুলগুলো কানের পিছন গিয়ে গুজে দিচ্ছে। প্রতিবারই বাতাসে আবার সেগুলো মুখের সামনে এসে ঝাপটা মারছে। সে আবার সরাচ্ছে, আবার আসছে। এই অবস্থায় তাকে বেশ সুন্দর দেখতে লাগছে।

আশেপাশে লোকজনের ভীড় নেই। রাত গভীর হচ্ছে। এবার কেবিনে যাওয়া উচিত মনে করে তাহমিদ বলল, ” কেবিনে যা তানিশা। রাত অনেক হয়েছে।”

তাহমিদের কথায় পাত্তা দিলো না তানিশা। এক হাতে চুলগুলো কানের কাছে নিয়ে ধরে রাখল। অন্যহাত তাহমিদের হাতের উপর রাখল। চোখ দু’টো বন্ধ করে মুখে অদ্ভুত একটা শব্দ করে বলল, ” জানিস, আগেও আমি বহুবার তোর হাত ধরেছি; কিন্তু এমন অনুভূতি কখনো হয়নি। সেদিন সন্ধ্যায় অনেককিছু হয়ে গেছিল। তুই যখন আমায় জড়িয়ে ধরেছিলি, আমি একদম জমে গেছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমার মধ্যে বজ্রপাত হচ্ছে। আর বজ্রপাতের আঘাতে আমি একদম স্ট্যাচু হয়ে গেছি। তুই তাকিয়ে দেখ, এখনো আমার হাত কাঁপছে। তোর হাত স্পর্শ করতেই আমার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা কেঁপে উঠেছে। শরীরে যেন কাঁটা বিধে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তুই নিজের হাত দিয়ে আমার শরীরের প্রতিটি অঙ্গে কাঁটা বিধিয়ে দিচ্ছিস। আমি নিশ্চিন্ত, এটাই ভালোবাসার অনুভূতি। তোর মনে হতে পারে, আমি একটু বেশিই আহ্লাদী হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তোর মনে হওয়াতে সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে না। বিশ্বাস কর, সত্যিই আমার হাত কাঁপছে। তাকিয়ে দেখ।”

তাহমিদ অবাক চোখে তানিশার হাতের দিকে তাকালো। নাহ্, হাত একটুও কাঁপছে না। এটা শুধুমাত্র তানিশার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। শুধুমাত্র ও নিজেই অনুভব করছে, ওর সারা শরীর কাঁপছে। বাইরে থেকে এই কম্পন দেখা যাবে না। তাহমিদ বলল, ” হুম। হাতটা খুব কাঁপছে।” মিথ্যে বলল তাহমিদ। এতে যদি তানিশা একটু বেশিই খুশি হয়, তাহলে অন্যায় কোথায়?

তানিশা উত্তেজনায় তাহমিদের হাতটা আরও চেপে ধরল। চেঁচিয়ে বলল, ” তোরও নিশ্চয়ই এইরকম হচ্ছে। ইয়েস।” উল্লাসে লাফ দিতে গিয়েও থেমে গেল তানিশা। নির্লজ্জের মতো বলল, ” ইচ্ছে করছে তোর সাথে চুটিয়ে প্রেম করতে।” একটু থেমে আগের কথাটা আবার বলল, “আমাদের উচিত, এক্ষুনি বিয়ে করা৷”

তাহমিদ নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে তানিশার গাল টেনে আদুরে গলায় বলল, ” পাগলামি বাদ দিয়ে নিজের কেবিনে যা। আমাকে আর লজ্জা দিস না। সবাইকে খুব বড় মুখ করে বলেছিলাম, এ জীবনে আমি আর প্রেম করব না। সেদিন রাতে তুই কেমন করে সবাইকে বলে দিলি। বিশ্বাস কর, লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম আমি। ভাবী মিটমিট করে হাসছিল আমায় দেখে। আর তুলি ক্ষেপাচ্ছিল। বড় ভাই-ও জেনে গেছে সবটা। মাফ চাই বোন। আমায় ছেড়ে দে।”
” বোন।” মলিন মুখে বলল তানিশা।
তাহমিদ বলল, ” তুই আমায় মামা বলতে পারলে আমি তোকে বোন বলতে পারব না?”
” আচ্ছা বল।” একটু চুপ থেকে তানিশা আবার বলল, ” কিন্তু আমায় আজকেই বিয়ে করতে হবে।”
” তুই কি ছোট থেকেই ভেবে রেখেছিলি লঞ্চে বিয়ে করবি?”
” না। ভাবনাটা হঠাৎ মাথায় এলো।”
” কিন্তু এটা সম্ভব না৷ এখানে কাজী নেই।”
” অবশ্যই আছে। এই লঞ্চে সব আছে। ঝাঁলমুড়িওয়ালা আছে, ফুচকাওয়ালা আছে, দোকানদার আছে, রুটি-বিস্কুটওয়ালা আছে, বিড়িওয়ালা আছে, সবাই আছে। কাজীও আছে নিশ্চয়ই।”
” নেই। এতসব-ওয়ালার সাথে কাজীর কোনো সম্পর্ক নেই৷ মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই মানুষ ওইসব নিয়ে এখানে ঘুরে বেড়ায়৷ কিন্তু কাজীর এখানে কোনো প্রয়োজন নেই।”
তানিশা ফুস করে হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “হয়তো সত্যি সত্যিই কাজী এখানে নেই। বাট থাকা উচিত ছিল। কখন কাদের প্রয়োজন হয়, তা কী আগে থেকে বলা যায়।”

রাশেদের ফোন পেয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো তুহিন। তাহমিদ আর তানিশাকে দেখেনি সে। ওদের পাশ দিয়ে ফোন কানে রেখে হেঁটে কোথায় যেন চলে গেল। তাহমিদ আর তানিশা তাকে দেখেছে। তানিশা বলল, ” জানিস তাহমিদ, তুহিন ভাইয়ার কিছু একটা হয়েছে। আমি শুনেছি, তিনি ফোনে কাকে যেন বলছে, ‘আমি এখনো নিজের অপরাধটা স্বীকার করতে পারিনি। আদৌ পারব কি-না, জানি না। রাশেদ, আমার খুব অনুশোচনা হচ্ছে। ফাতেমাকে আমি ক্রমাগত ঠকিয়ে যাচ্ছি।’

তাহমিদ কপাল ভাজ করে জানতে চাইলো, “কখন শুনেছিস এ-কথা?’
” গতকাল বিকেলে। আমি ঘরের সামনে দিয়েই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ তুহিন ভাইয়ের কণ্ঠ শুনতে পাই। ঘরে সেসময় উনি একাই ছিল। এই কথাটা শোনার পরই আমি ওখান থেকে চলে যাই।’
তাহমিদ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ” ঠিক আছে। তুই কেবিনে যা। ঘুমিয়ে পড়।’
” তুই ঘুমাবি না?”
” হ্যাঁ। তুই আগে যা।”

তানিশা মৃদু হেসে ‘গুড নাইট’ বলে চলে গেল। তাহমিদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে তাকালো উল্টো দিকে। নিজের মধ্যে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে হাঁটা দিলো তুহিন যেদিকে গেছে।

সম্পৃক্ততা পর্ব ১২

0

সম্পৃক্ততা – দ্বাদশ পর্ব।

রিফাত হোসেন।

২৮.
ফাতেমা রেগে আছে। সে খুব আশা করেছিল, তাঁর স্বামী অন্তত বিয়ের তিন-চারদিন আগে আসবে। নিজের দায়িত্বে সবদিক সামলাবে। কিন্তু তা করেনি তুহিন। এসেছে তো এসেছে; একেবারে হলুদের দিন এসেছে। তাও আবার সন্ধ্যার সময়। গত কয়েকদিন ফোনেও ঠিকমতো কথা বলে তুহিন। হু, হ্যাঁ ছাড়া আর কোনো শব্দ ব্যবহার করেনি। গত দু’দিন তো আরও কঠিন অবস্থা হয়েছিল। ফাতেমা তুহিনকে ফোন করেছিল বহুবার। কিন্তু সে রিসিভ করেনি। আরও একটা অপরাধ আছে তুহিনের; সে যে এক্সিডেন্ট করে মাথা ফাটিয়েছে, এটাও গোপন করেছে ফাতেমার কাছে। তুহিনকে শুনিয়ে শুনিয়ে আসমার কাছে ঠিক এই অভিযোগগুলোই করেছে ফাতেমা। কিন্তু তুহিনের কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ দেখেনি তাতে। এতে সে বেশ অপমানিতবোধ করেছে। রাগেরও একটা ধৈর্য আছে। সেটা অতিক্রম করলে আর নিজেকে সামলানো যায় না। ফাতেমার মনে হচ্ছে, তাঁর রাগ ধৈর্যের শেষ পর্যায়ে আছে। ভয়ঙ্কর এক ক্ষিপ্ততা গলা পর্যন্ত চলে এসেছে।

তুহিন এখন একটা ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। হলুদের ঝামেলা আজকের মতো প্রায় শেষ। বাড়িতে অতিথি বলতে তেমন কেউই নেই। তাই এখন সবকিছু নীরব। কুয়ো তলায় শুধু তাহমিদ, তৃষ্ণা, আসমা, তানিশা আর রাইশা আছে। ওরা রিল্যাক্স করে গল্প করছে সেখানে। বাড়ির বাইরে একটা প্যান্ডেল করা হয়েছে। কাল বর আসবে। রান্নাবান্নার জোগাড় সব ওখানেই হচ্ছে। তাই বাড়ির ভিতরটা অনেকটাই নীরব এখন। ফাতেমা এতক্ষণ মায়ের সাথে গোছানোর কাজ করছিল। কাজ ছিল বললে ভুল হবে; সে কাজ তেমন করছিলই না; মায়ের পাশে দাঁত কিড়মিড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হুমাইরা নিজেই কিছুক্ষণ পর মেয়েকে বলেছে, ” এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গিয়ে দেখ জামাইয়ের কিছু লাগবে কি-না।”

বাধ্য মেয়ের মতো, মায়ের কথা মেনে সে-ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য একটা ঘরের সামনে এলো ফাতেমা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো ভিতরে। তুহিন পা উঁচিয়ে বিছানায় বসে আছে। তাঁর তীক্ষ্ণ নজর বাইরের দিকে। জানালা দিয়ে সে বাইরের দৃশ্য দেখছে। দরজার কাছে যে আস্ত একজন মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে, এই নিয়ে তাঁর কোনো ভাবনাই নেই। তাকাচ্ছেও না। যেন বরফের মতো জমে গেছে।

ফাতেমা পায়ে শব্দ না করে ভিতরে ঢুকল। খুব সাবধানে গেল বিছানার কাছে। তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। কেউ কেউ বলে, ভালোবাসার মানুষ ১০০ গজ দূরে থাকলেও তা অনুভব করা যায়; অথচ সে স্বামীর এতটা কাছাকাছি থাকার পরও, স্বামী তা বুঝতে পারছে না। এমনভাবে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে, যেন বাইরে কোনো সুন্দরী নারী দাঁড়িয়ে আছে। পুরুষ মানুষ অস্বাভাবিক রমকের খারাপ। বিশেষ করে বিবাহিত পুরুষ। বিয়ের কয়েক বছর পরই স্ত্রীরা তাঁদের কাছে পুরোনো হয়ে যায়। যেন স্ত্রী একটা প্রোডাক্ট। মেয়াদ শেষ হলে তাঁর আর মূল্য নেই। এ-কথা শোনার পর কিছু কিছু স্বামী আবার ডায়লগ দেয়, স্ত্রী হলো অমূল্য রতন। এদের সাথে মেয়াদ
থাকা, না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। সারাজীবন এরা অমূল্য রতন হয়ে স্বামীর কাছে থাকবে।

তুহিন হঠাৎ পিছনে ঘুরে দেখল, ফাতেমা আনমনে কী যেন ভেবে যাচ্ছে। সে ফাতেমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কোনোকিছু বুঝতে না পেরে ডাকল ‘ ফাতেমা ‘ বলে। চমকে উঠল ফাতেমা। ভড়কে গিয়ে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল। তুহিন জিজ্ঞেস করল, ” কখন এসেছ?”
” একটু আগে। কেন আপনি দেখেননি আমায়? বাইরে কাকে দেখছিলেন?” কথাটা নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল ফাতেমা। মুখে সে কিছু বলতে পারছে না। এখনো ‘হা’ করে তাকিয়ে আছে। অনেকদিন পর হঠাৎ করেই সে অনুভব করল, তুহিন অনেকটা রোগা হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে গেছে। চুলগুলো পাগলদের মতো এলোমেলো হয়ে আছে। যেন কতকাল ধরে শ্যাম্পু করে না। অথচ আগে সে প্রতি সপ্তাহে অন্তত দু’বার চুলে শ্যাম্পু দিতো। তাঁর প্রিয় দু’টো কাজ আছে, যা করতে সে খুব ভালোবাসে। প্রথম কাজ হলো বইয়ের যত্ন নেওয়া। দ্বিতীয় কাজ হলো চুলের যত্ন নেওয়া। প্রতিটি মানুষের কিছু একটার প্রতি একটু বেশিই আকর্ষণ থাকে, বেশি যত্নশীল থাকে। এই যেমন তাহমিদ নিজের ঠোঁটের প্রতি যত্নশীল। ফাতেমা নিজের সংসারের প্রতি যত্নশীল৷ তুহিন আবার দু’টো দিকের প্রতি খুব যত্নশীল। একসময় তুহিনের একটা লাইব্রেরি ছিল। বাচ্চাদের খাতা-কলম, বই থেকে শুরু করে কলেজ ইউনিভার্সিটির বইপত্র তাঁর লাইব্রেরিতে ছিল। গল্পের বইও ছিল তাঁর লাইব্রেরীতে। বাংলা, ইংরেজি সব। কুরআন, সাহিদ সহ আরও অনেক ইসলামিক বইও ছিল। লাইব্রেরীর প্রতি তুহিনের ছোট থেকেই ঝোঁক ছিল। সে মনে করতো, এর থেকে স্বাধীন আর আরামের কাজ হয় না। রোজ কতশত মানুষের সাথে আলাপ-পরিচয়। কলেজ, ইউনিভার্সিটির কত ছেলে-মেয়েরা আসতো রোমান্টিক গল্পের বই, একাডেমিক বই, প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনতে। টুপি পড়া পুরুষ, পর্দাশীল নারী, সহ অনেক অভিভাবকও আসতো প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনতে। তিন মুখী দোকান ছিল ওটা৷ তিন দিকে তিন ধারার লোক ভিড় জমাতো। কর্মচারী ছিল দু’জন, আর তুহিন নিজে একজন। তিন জনে মিলে তিনমুখো ছোট লাইব্রেরীটা সামলাতো। বেশ পরিচিত লাইব্রেরী ছিল ওটা৷ এমন কিছু ছিল না, যা ওখানে পাওয়া যেতো না। দেখা গেল মাঝে মাঝে অন্য শহরের লোকজনও আসতো ওই দোকানে। বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে নিজেদের প্রয়োজনীয় সব পণ্য ক্রয় করতো। মালামাল শেষের দিকে চলে এলে সে একজন কর্মচারীকে দোকানে রেখে, অন্যজনকে নিয়েই চলে যেতো মালামাল কিনতে। হঠাৎ এক কর্মচারী জানায়, তাকে ইমিডিয়েট গ্রামে যেতে হবে। না গেলে হবেই না। তুহিন তাকে ছুটি দেয়। এদিকে মালামাল কেনার জন্য দু’জনকেই যেতে হবে। একরাত লাইব্রেরীতে কেউ না ঘুমালে কিছু হবে না, এই ভেবে রাতেই গাড়ি ভাড়া করে রওয়ানা দেয় তুহিন আর ছেলেটা৷ ভোরে ফিরে আসে। দেখে, তাঁর সাধের লাইব্রেরী আগুনে ধাউধাউ করে পুড়ে যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস আসে, কিন্তু লাভ হয় না। সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শুধু লাইব্রেরী না, সাথে তাঁর স্বপ্নও। অনেকেই বলেছিল, আবার শুরু করতে। সে সাহস পায়নি। গ্রামের জমিজমা, ভিটে বাড়ি, সব বিক্রি করে নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছিল। সেই স্বপ্ন যখন একবার পূড়ে ছাই হয়ে গেছে, তখন আবার একই স্বপ্ন দেখা ঠিক হবে না। তাছাড়া অত টাকা কোথায়? লাইব্রেরী থেকে যা ইনকাম হতো, তা দিয়ে সে আস্তে আস্তে লাইব্রেরী উন্নত করছিল। সঞ্চয় করার কথা তখনও ভাবেনি। ভেবেছিল, লাইব্রেরী বড় হলে একদিন লাখ লাখ টাকা সঞ্চয় করা যাবে। সেদিন রাতে যে বইগুলো এনেছিল, সেগুলো ঘরে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। ওগুলো ঘরেই থাক; স্বপ্নের লাইব্রেরী তো শেষ। বইগুলো নাহয় স্মৃতি হয়ে থাক। স্মৃতি কষ্ট দিবে তো? দিক। মাঝপথে স্বপ্ন ভাঙার আঘাতে হৃদয়ে যে ক্ষত হয়েছে, এক জীবনে সে ক্ষত স্থান ঠিক হবে না। সামান্য এই স্মৃতি আর হৃদয়কে কতটুকু পোড়াবে? কতটুকু ক্ষত করবে?
সেই থেকে প্রতিদিন একবার করে স্মৃতিগুলোকে যত্ন করে তুহিন। ধুলো জমার সুযোগ দেয় না। তাঁর আগেই সব পরিষ্কার করে ফেলে নিজের হাতে। বইয়ের সাথে সাথে চুলেরও খুব যত্ন নেয় তুহিন। পড়াশোনা জানা ছিল বলে চাকরি পেয়ে যায়। কিন্তু সুখ পায় না। তবুও চাকরি করেছে। তাঁর সাথে অনেকগুলো জীবন জড়িয়ে আছে। ভেবেছে, বাড়িঘর, জমিজমা সব নিজের হাতে খেয়েছে। ছোট দু’জন ভাই-বোন আছে, স্ত্রী আছে ঘরে। বাবা-মা নেই। ভাই-বোনদের তাকেই দেখতে হবে। হোক কষ্ট! স্বপ্ন ভাঙার কষ্টের কাছে এইসব কষ্ট অতি তুচ্ছ। দিনরাত পরিশ্রম করেছে। এমনও দিন গেছে, এক সকালে খাওয়ার পর আবার পরের সকালে খাওয়া হয়েছে। স্ত্রী ফাতেমা তাকে দেখতো, কাঁদতো। বলত, বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে দেবে। তুহিন ধমক দিতো ফাতেমাকে। বাপের বাড়ির সম্পদ বাপের বাড়ির। স্বামীর বাড়িতে ওইসব আনার দরকার নেই। যে আল্লাহ এমন অবস্থায় ফেলেছেন, সে-ই উদ্ধার করবেন। উদ্ধার করেছেন আল্লাহ। স্বপ্ন উদ্ধার না হোক, অন্তত ভাই-বোনের থেকে যেটুকু কেড়ে নিয়েছিল, সেটুকু পূরণ করার সামর্থ করে দিয়েছেন। একার খরচেই ভাইকে ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছে। বোনকে ভালো স্কুলে পড়িয়েছে; কলেজে পড়িয়েছে৷ এখন যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এর একজন ছাত্রী। মেধাবী ছাত্রী বলে তাঁর বেশ নামডাক আছে।

তুহিন, ফাতেমার কাধে হাত রাখল আলতো করে। আবারও চমকে উঠল ফাতেমা। বিষণ্ণ গলায় বলল, ” আপনার এই অবস্থা কেন?”
” কোন অবস্থা? বেশ ভালোই তো আছি আমি।” একটু হেসে জবাব দিলো তুহিন।

ফাতেমা সন্তুষ্ট হলো না। স্বামীর এই হাল সে বেশ কয়েকবছর পর দেখছে আজ। বিষণ্ণ মুখ করে আবার বলল, ” আপনার কি বড় ধরনের কোনো রোগ হয়েছে? হলে আমাকে বলুন।”
” আমার কিছু হয়নি ফাতেমা। হলে তোমাকে বলতাম না?” দ্রুত কণ্ঠে বলে দিলো তুহিন। এইরকম প্রশ্নের উত্তর দিতে দেরি করা উচিত নয়।
ফাতেমা অভিমানী কণ্ঠে বলল, “আপনি কী আর সব আমায় বলেন? আমরা একসাথে থাকি। একই বিছানায় ঘুমাই। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে সব স্বাভাবিক। তবুও যেন একটা অজানা দূরত্ব আমি অনুভব করি। দূরত্বটা ঠিক কোথায়, আমি বুঝতে পারি না। পারলে আমি সব লজ্জাসংকোচ ভুলে তা পূরণ করে দিতাম। এই যেমন গত কয়েকদিন আপনি আমার সাথে ঠিকভাবে কথা বলেননি। আমার খুব অভিমান হচ্ছিল। কিন্তু আপনার কাছে তা প্রকাশ করতে পারছিলাম না। কেন পারছিলাম না, সেটাই বুঝতে পারি না। অথচ আপনার উপর অভিমান করা আমার অধিকার।”
” কখনো জিজ্ঞেস করোনি বলেই বলতাম না সবকিছু। এই যেমন এখন জিজ্ঞেস করলে, আমার কী হয়েছে; তাই আমি উত্তর দিলাম। আমার কিচ্ছু হয়নি।” কথাটা হেসে বলল তুহিন। হাসিতে কোনো ভালোলাগা নেই। আছে মলিনতা। রাশেদ বলে দিয়েছে, আগে ফাতেমাকে শান্ত করতে হবে। হুটহাট করে কিছু বলে দেওয়া যাবে না। আর সব শোনার পর ফাতেমা যতই রিয়্যাক্ট করুক, তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব তুহিনের। কারণ ভুলটা তুহিনের। নারীরা সবকিছুর ভাগ অন্যকে দিতে পারে, কিন্তু স্বামী আর সংসারের ভাগ কাউকে দিতে পারে না। স্বামী তাঁদের অক্সিজেন, আর সংসার তাঁদের নিঃশ্বাস। সুতরাং স্বামীর মতো অক্সিজেন হারিয়ে তাঁরা নিজের নিঃশ্বাস বন্ধ করতে চায় না। দেরিতে হলেও সবকিছুই বলতে হবে ফাতেমাকে। হটকারিতা নয়, বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে হবে। আর আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, এখন থেকে স্ত্রীকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে ভালোবাসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আগের সব ভুলে যেতে হবে।

ফাতেমা, তুহিনের ব্যান্ডেজ করা কপালে আস্তে করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ” আপনি কী হাঁটার সময় চোখ দু’টো পকেটে ভরে রেখেছিলেন?” ফাতেমা রসিকতা করল একটু। স্বামীর পেট থেকে কথা বের করার জন্য মুহূর্তটাকে সহজ করতে হবে। তারপর কায়দা করে সব জানতে হবে। নাহলে সে কিছুই বলবে না। কতগুলো বছর ধরে এই মানুষটাকে সে চেনে; মতিগতি সব আয়ত্তে চলে এসেছে।

তুহিন ফিক করে হেসে বলল, ” কী যে বলো না! চোখ আবার পকেটে ভরে রাখা যায় নাকি?”
” না যায় না৷ যেহেতু যায় না, সেহেতু আপনার চোখ জোড়া কপালে নিচেই ছিল। আমার প্রশ্ন হলো, সামান্য একটা সিএনজি আস্ত একটা মানুষকে কীভাবে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল?”
” ফাতেমা, তুমি শহরের রাস্তাঘাটে হাঁটো না; তাই জানো না। শহরের সিএনজিগুলো মোটেও সামান্য নয়। এরা পারে তো মানুষের দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে চলে যায়। আর হকারদের কথা কী বলব; যাত্রীদের রাস্তার মাঝখানে এরা বসে যায়। তাই আমাদেরও নিচে আঁকাবাঁকা পথে হাঁটতে হয়। লোকজনের ভিড়ে সিএনজিগুলোও সোজা রাস্তা দিয়ে যেতে পারে না। ব্যাস, প্রতিনিয়ত যে বিপদের সম্মুখীন অন্যরা হয়, সেদিন আমিও হয়েছি।” কথাটা বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল তুহিন।

ফাতেমা ফট করে প্রতিবাদী কণ্ঠে বলে উঠল, ” এটা পুরোপুরি সত্যি না। দোষ আপনারই বেশি ছিল। তানিশা আমায় বলেছে, আপনিই উদাসীন হয়ে হাঁটছিলেন রাস্তা দিয়ে। এটা ঠিক না। আপনাকে আমি আগেও বহুবার বলেছি, রাস্তা দিয়ে সাবধানে হাঁটবেন। আর যতই ভিড় হোক, যাত্রীদের জন্য যে রাস্তাটা দেওয়া হয়েছে, সেটা দিয়ে হাঁটবেন। আমি রাস্তাঘাটে না হাঁটলেও বাসে বসে দেখেছি, পায়ে হাঁটা মানুষের জন্য দুই পাশে আলাদা দু’টো রাস্তা আছে। আপনি ওটা দিয়ে হাঁটবেন। ভিড় হোক, দেরি হোক, তবুও ওখান দিয়েই হাঁটবেন।” হুকুম করল ফাতেমা। স্বামীকে হুকুম করতে পেরে কিছুটা আনন্দিত হলো। সচরাচর এইরকম সুযোগ পায় না সে। কড়া করে কিছু বলতে গেলেই তুহিন তাড়াহুড়ো দেখাতো। যেন আগেই বুঝে যেতো, ফাতেমা তাকে কঠিন কিছু কথা বলার চেষ্টা করছে।

তুহিন পুরোপুরি ভাবে ঘুরে বসল ফাতেমার দিকে। ফাতেমার কাধ থেকে হাত সরিয়ে, ফাতেমার হাত দু’টো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ” আজ্ঞে ম্যাডাম। আপনার সব আদেশ আমি মেনে চলবো।”

লজ্জায় লাল হয়ে গেল ফাতেমা।। আজ একটু সাহস সঞ্চয় করে কিছু কথা বলবে ভেবেছিল। সেই সাহসটাও শেষ করে দিলো তুহিন। জড়তার কারণেই কিছু কিছু বিষয়ে এখনো তুহিনের সামনে লজ্জা পায় ফাতেমা। শুরুটা হয়েছিল বাসর রাতে। তুহিন সেদিন হঠাৎ করেই ফাতেমাকে ‘ম্যাডাম’ বলে সম্মোধন করেছিল। ফাতেমার সে-কি লজ্জা! ফাতেমার যেমন সাংঘাতিক রাগ, তেমনই মারাত্মক লজ্জা। রাগটা অন্যের জন্য প্রযোজ্য হলেও তুহিনকে রাগ দেখাতো না সে। তুহিনের জন্য শুধুমাত্র লজ্জাজনক ভাবটা বরাদ্দ করা ছিল। ফাতেমা সেদিনই বলতে চেয়েছিল, ঠিক এক বছর পর তাঁরা সন্তান নিবে। দেরি চলবে না। সন্তান ছাড়া সংসার পরিপূর্ণ হয় না। আর ফাতেমা শুধু স্বামী চায় না, একটা পরিপূর্ণ সংসারও চায়। কিন্তু তুহিন সেদিন এমন এমন কথা বলেছিল, যা শুনে লজ্জায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল ফাতেমার। বাসর রাতে যে স্বামীর কাছ থেকে ওই ধরনের কথা শুনতে হবে, আগে থেকে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সদ্য কৈশোরে পেরোনো ফাতেমা। সেসময় বয়স কম ছিল। সেই যে লজ্জা নামক একটা জড়তা ফাতেমার মধ্যে তৈরি হয়েছিল, তাঁর রেশ এখনো কাটেনি। এ-জীবনে আর কাটবে কি-না, তাও জানে না ফাতেমা। বিয়ের প্রায় ৭-৮ বছর হতে চলল। এখনো একটা সন্তান হলো না তাঁদের। এই নিয়ে সবার অভিযোগ। শুধু অভিযোগ নেই ফাতেমার। একেবারেই যে নেই, তা না। কিন্তু মুখ ফুটে তুহিনকে বলতে পারে না, ‘অনেক তো হলো, এবার সংসারে নতুন সদস্যের আগমন হওয়া চাই। চাই মানে চাই।’ আসমা আগে দিনরাত ফোন করে বলতো, আপু, ‘তোমাদের কী এ-জীবনে বাচ্চাকাচ্চা হবে না?’ দুলাভাইকে সেভাবে সামনাসামনি পেতো না তাঁরা। তাই রসিকতার নামে এইরকম কিছু বলার সুযোগও পেতো না। বাড়িতে শ্বাশুড়িও ছিল না, যে এইসব নিয়ে আলোচনা করবে। বাড়ির নিচতলার ভাবীও কতবার তুহিনকে বলেছে, এবার সন্তান নাও তুহিন। তুহিন পাত্তা দেয়নি। আড়চোখে শুধু ফাতেমার দিকে তাকিয়েছিল কয়েকবার। তুহিনের মধ্যেও ছিল স্ত্রীর প্রতি সাংঘাতিক জড়তা। সেজন্যই রাতে আধোআলোয় জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কণ্ঠে একটু জিজ্ঞেস করতো না, ‘ তোমারও কী মনে হচ্ছে, এবার আমাদের পরিবারে নতুন একজনের আসা উচিত?’ এই কথাটা বললেই ফাতেমা ‘হ্যাঁ’ ‘হ্যাঁ’ বলে লাফিয়ে উঠতো। অনেকবার ভেবেছিল, তুহিন যদি কোনো একদিন আচমকা এইরকম কিছু বলে, তাহলে ফাতেমা ‘হ্যাঁ’ ‘হ্যাঁ’ বলে লাফিয়ে উঠবে। কিন্তু আফসোস, তুহিন এতগুলো বছরে একবারের জন্যেও এই কথা বলেনি। রাতের আঁধারে পাশে শুয়ে ফাতেমার সাথে কতশত গল্প করতো। কিন্তু এই নতুন সদস্য প্রসঙ্গে কখনো কোনো শব্দ মুখ দিয়ে বের করেনি। পুরুষ মানুষের মধ্যে এত জড়তা থাকতে নেই, এই কথাটা যেন তুহিন বুঝতেই পারে না। ফাতেমা সরাসরি না বললেও আকারে-ইঙ্গিতে, হেয়ালি করে কিছুটা বইয়ের ভাষায় বুঝানোর চেষ্টা করেছিল তাকে। কিন্তু তুহিন বুঝতে পারেনি। মাঝে মাঝে ফাতেমা গল্পের বই পড়ার সময় হঠাৎ একটু জোরেই পড়তে শুরু করেছিল। তুহিনকে শুনিয়ে বলছিল, “বেশ কয়েকবছর আগে বিয়ে হয়েছে ফাতেমার। কয়েক বছর আগে আজকের এই দিনেই তাঁর সাথে অপরিচিত একজনের বিয়ে হয়েছিল। ফাতেমার বয়স তখন ছিল ১৮। লজ্জায় স্বামীকে কিছু বলতো পারতো না। বাসর রাতের দিন থেকেই সে মনেমনে ভেবে এসেছে, কোনো একদিন তাঁর কোল আলো করে একটা নতুন সদস্যের আবির্ভাব হবে। যে নিজের সবটুকু দিয়ে নতুন সদস্যকে আদর করবে। কিন্তু মেয়েটার এমন দুঃখী কপাল যে, বিয়ের এতগুলো বছর পরেও সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না। না পারছে নিজে থেকে স্বামীকে কিছু বলতে, আর না স্বামী তাকে কিছু বলছে। দু’জনেই যেন চাপা লজ্জার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। ফাতেমার এই কষ্ট দেখে আশেপাশের আপনজনেরা খুব আফসোস করে। তাঁদের আফসোস করতে দেখে ফাতেমার খুব কষ্ট। বেচারি ফাতেমা খুব অসহায়বোধ করে।”
এই লেখাগুলো বইয়ে নেই। নিজের বানানো কথাগুলো বই পড়ার নাম করে তাহমিদকে শোনায় সে। একেকদিন একেক গল্প বানায়। কিন্তু প্রতিটার প্রধান বিষয় একই থাকে। সেদিন হঠাৎ করেই নিজের নামটা বলতে শুরু করেছিল। যার জন্য তাকে আরও লজ্জায় পড়তে হয়েছিল। তুহিন হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে, “বইয়ে কী তোমার নামটাই লেখা আছে?” আচমকা দ্বিতীয় ব্যক্তির প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে ওঠে ফাতেমা। উৎকণ্ঠাযুক্ত গলায় বোকার মতো বলে ওঠে, ” না না; এখানে অন্য নাম আছে।” যখন বুঝতে পারে, সে খুব বড় ভুল করে ফেলেছে, তখনই বই দিয়ে মুখ আড়াল করে তৃষ্ণার ঘরের দিকে দৌড় দেয়।

তুহিন হঠাৎ ফাতেমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। নড়েচড়ে উঠল ফাতেমা। ভাবনা থেকে বেরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো, কেউ আছে কি-না। কাউকে না দেখে সে আবার তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ” করছেন কী? দরজা খোলা আছে। কেউ এসে পড়লে কী ভাববে বলুন তো।”
” কেউ দেখবে না। তোমার বাবা প্যান্ডেলের ওখানে আছে। আমি জানালা দিয়ে ওখানেই কাজ করতে দেখছিলাম। তোমার মা-ও ব্যস্ত। আর বাকিরা সবাই কুয়ো তলায় আছে। সুতরাং আমাদের এখানে উঁকি মারার মতো কেউ নেই।” আরও ভালো করে শুয়ে জবাব দিলো তুহিন।
” তবুও আপনি উঠুন। আমি বালিশ দিচ্ছি, আপনি বালিশে ঘুমান।”
” উঁহু। তুমি দরজাটা আটকে দিয়ে আসো। রাত তো অনেক হলো। আমার শরীরটা ক্লান্ত লাগছে”
” আপনি বিশ্রাম নিন। আমি ওদের কাছে যাচ্ছি। সবাইকে ঘুমোনোর জায়গা ঠিক করে না দিয়ে আমি ঘুমাবো কীভাবে?” কথাটা বলে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করল ফাতেমা। কিন্তু পারল না।
” তোমাকে এতকিছু ভাবতে হবে না। আসমা আছে তো ওখানে। চুপচাপ বসে থাকো।” ধমকে সুরে বলল তুহিন।
ফাতেমা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ” আচ্ছা ঠিক আছে। আমিও শুয়ে পড়ব। ওদের বলে আসছি আমি ঘুমোতে গেলাম। আর দরজাটা লাগিয়ে আসছি।”

তুহিম মাথা উঁচু করে ফাতেমাকে যেতে দিলো। আর ভাবতে লাগল, কীভাবে ফাতেমার কাছে ক্ষমা চাওয়া যায়।
কিছুক্ষণ পর ফাতেমা আবার ফিরে এলো। তুহিনের মতিগতি আজ সুবিধার লাগছে না তাঁর কাছে। অন্যদিনের তুলনায় আজ যেন একটু বেশিই আহ্লাদী করছে। এইরকম আহ্লাদী আগে করলে কবেই লজ্জাসরম ভুলে যেতো ফাতেমা। ফাতেমা দরজা লাগিয়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে এলো। বিছানায় বসতেই তুহিন আবার তাঁর কোলে মাথা রাখল। এক হাতে তুহিনের চুলে হাত বুলাতে লাগল। তুহিন চোখ বন্ধ করে বলল, ” ফাতেমা, তোমাকে একটা কথা বলব ভাবছিলাম।”
” এখনই বলবেন?”
” না, পরে বলব।”
” আমি জানতাম আপনি এখন বলবেন না।”
” কীভাবে জানতে?” চোখ মেলে তাকালো তুহিন।
” সেটাও পরে বলব।”

হেসে উঠল তুহিন। ফাতেমা-ও হেসে উঠল। একসময় হাসি থামিয়ে দিলো তুহিন। ঘুমোনোর চেষ্টা করল। ফাতেমা চুপচাপ বসে তুহিনের মাথায় হাত বুলাতে লাগল। তুহিন ঘুমোনোর পর ফাতেমা তুহিনের মাথার নিচে একটা বালিশ দিয়ে বিছানা থেকে নামল। তুহিনের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ” এতগুলো বছর যদি এভাবে নিজে থেকে আমার কাছে আসতেন, তাহলে হয়তো আমাদের মাঝে কোনোরকম দূরত্ব থাকতো না। আমাদের সম্পর্কটা হতো মধুর। আপনাকে আমি খুব ভালোবাসি। কৈশোর পেরিয়ে যখন যৌবনে পা দিয়েছি, তখন থেকেই আমি ভালোবাসতে শিখেছি। সেসময় অন্য কোনো ছেলে আমার জীবনে আসেনি। তাই আপনিই আমার প্রথম ভালোবাসা। এবং শেষ পর্যন্ত আমি আপনাকেই ভালোবাসতে চাই।”

ঘর থেকে বেরিয়ে কুয়ো তলায় এলো ফাতেমা। সবার সাথে গল্পগুজব করতে লাগল।

২৯.
হুমাইরা অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে, আসমা তাঁর ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। হুমাইরা তাকালেই আবার সে চলে যাচ্ছে। পরপর একই ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে।
এখন সকাল ৭ টা। মেয়েগুলো তাঁর সাথেই ঘুমিয়েছিল রাতে। হাফিজ উদ্দিন ছিল প্যান্ডেলে৷ কাজ করেছে, খবরদারি করেছে, আর গ্রামের সমবয়সীদের সাথে আজাইরা সব গল্প করেছে। যদিও হাফিজ উদ্দিনের কাছে ওগুলো আজাইর গল্প ছিল না। রাতটা সে ওভাবেই পাড় করেছে। হুমাইরা কত করে বলেছে, “তাহমিদ ওই ঘরে একাই আছে। তুমি গিয়ে ওর পাশে ঘুমিয়ে পড়। সকালে আবার খাটাখাটুনি করতে হবে।”
কিন্তু হাফিজ শোনেনি। বলেছে, ” আমি ঘুমিয়ে পড়লে এতকিছুর দেখাশোনা কে করবে? কোন কাজে কখন কী প্রয়োজন হয়, সব তো আমাকেই দেখতে হবে। জামাই অসুস্থ। তাকে তো আর এইসব কাজে হাত লাগাতে দিতে পারি না।”
হুমাইরা আর কিছু বলার সুযোগ পায়নি।

তানিশা বিছানা ছেড়েছে খুব সকালে। সারারাত তো সে ঘুমোতেই পারেনি। একেই নতুন জায়গা। তাঁর উপর গতকাল সন্ধ্যায় ওইরকম একটা ঘটনা ঘটল আচমকা। সন্ধ্যার পর আর তাহমিদের মুখোমুখি হয়নি সে। প্রথমবারের মতো তাহমিদকে দেখে লজ্জায় কথা বলতে পারছিল না। বন্ধু হোক আর যেই হোক, নারী লজ্জা পাবেই, এ কথাটা কাল সে বুঝে গেছে। আসমা, রাইশা, দু’জনেই ওঠে গেছে অনেকক্ষণ আগে। এখন বিছানায় তৃষ্ণা ঘুমোচ্ছে শুধু। আর হুমাইরা মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসে আছে। আসমা আবারও ঘরের সামনে আসতেই হুমাইরা ইশারায় ডাকলেন মেয়েকে। দুই-একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভিতরে এলো আসমা। মায়ের পাশে মাদুরে বসে পড়ল। ছটফট গলায় বলল, ” কী করছ মা”
” তুই কি এটা জিজ্ঞেস করার জন্য তখন থেকে আমার আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছিলি?” কড়া করে বললেন হুমাইরা।
আসমা মুখ কালো করে বলল, ” এভাবে বলছ কেন? আমি কী তোমার সাথে দু’টো কথাও বলতে পারব না?”
” তোর বয়সী মেয়েদের কী কথা থাকতে পারে, সে আমি জানি। বয়সটা আমিও পেরিয়ে এসেছি, বুঝেছিস?” বেশ অভিজ্ঞ গলায় বললেন হুমাইরা।
আসমা রাগ দেখি বলল, ” বলো দেখি আমি কী কথা বলতে এসেছি?”
হুমাইরা ফট করে বলে উঠল, ” সজল মাস্টারের কথা। ছোট বোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এবার তোরও ইচ্ছে করছে বিয়ে করতে। তাই তো?”

আসমা চমকে উঠল। সে বিয়ের কথা বলতে না এলেও সজল প্রসঙ্গে বলতে এসেছিল। তাঁর মা জানলো কীভাবে এটা? মানুষের মনের কথা পড়ার অদ্ভুত ক্ষমতা কী আল্লাহ তাকে দিয়ে দিয়েছেন? দিলে দিক, কিন্তু মায়ের ধারণাকে সঠিক হতে দেওয়া যাবে না। আসমা ভাবতে লাগল, ভিন্ন প্রসঙ্গে কী বলা যায় মা’কে।
হুমাইরা মেয়ের ভাবান্তর মুখটা দেখেই আবার বলে উঠলেন, ” নিশ্চয়ই কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছিস। আরে মা, এইসব আমি জানি। আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি না।”
” তাই নাকি? তা কয়খানা প্রেম করেছ শুনি? এত অভিজ্ঞতা তোমার হলো কোত্থেকে? ডজনখানেক প্রেম তো নিশ্চয়ই করেছ।” রসিক সুরে কথাটা বলে জোরে জোরে হেসে উঠল আসমা।

ঘুম ভেঙে গেল তৃষ্ণার। তবে এখনি ওঠে পড়ল না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে আসমা আর হুমাইরার কথোপকথন শোনার চেষ্টা করল। আড়ি পেতে অন্যের কথা শোনার মধ্যে একটা মজা আছে। হোক সেটা অপরাধ। এইরকম মজাদার একটা মুহূর্ত মিস করা বোকামি। ব্যাপারটা এইরকম যে, কেউ নিজের সব গোপন কথা বলে দিচ্ছে, আর তা আড়াল থেকে শুনছে অন্য একজন। অথচ সে বুঝতেই পারছে না। মানুষ বলে দেয়ালের কান আছে। অথচ সত্যি এটাই যে, দেয়ালের কোনো কান নেই। কান আছে দেয়ালের সাথে আষ্টেপৃষ্টে লেগে থাকা কিছু মানুষের। যারা নিজে অন্যের কথাগুলো গিলবে, আর ধরা খেলেই দেয়ালের দোষ দিয়ে পালিয়ে যাবে।

আসমা বলল, ” বলছিলাম কী মা, আমি ঢাকায় যাবো।”
” কেন কেন?” চমকে উঠলেন হুমাইরা।
” এমনিতেই। গ্রামে আর ভালো লাগছে না।”
” শহরে গিয়ে সজল মাস্টারের সাথে হাত মেলানোর ফন্দি করছিস নাকি?” রাগে গেটে পড়লেন হুমাইরা।
আসমা শান্ত কণ্ঠে বলল, ” না না।।সেরকম কিছু না।”
” তা এই ভূত মাথায় ঢুকালো কে?”
” কেউ ঢোকায়নি। আমি কাল রাতে বড় আপুকে বলেছিলাম, ‘আমার এখানে ভালো লাগছে না।’ বড় আপু বলল, ‘ আমার ওখানে চল। তৃষ্ণার সাথে থাকবি।’ মা, প্লিজ আমায় যেতে দাও।”

হুমাইরা কিছু বলার আগেই বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠল তৃষ্ণা। বলল, ” একদম ঠিক। তুমি আমাদের সাথে চলো আপু। তাছাড়া তুমি চাইলে ওখানে এর থেকেও ভালো চাকরি করতে পারবে। ওখানে তো স্কুল-কলেজের অভাব নেই।”
” তৃষ্ণা, তুই জেগেছিলি এতক্ষণ?” অবাক হয়ে আসমা জানতে চাইল।
তৃষ্ণা ইতস্ততভাবে বলল, ” না মানে, শেষের কথাটাই শুনেছি শুধু।”
– ” ওহ্। আচ্ছা, তাহলে বাকিটাও শোন। তাছাড়া রাতে তো সব শুনেছিসই। এখন আবার শোন।”

মৃদু হেসে ওঠে বসল তৃষ্ণা। আসমা আবার মায়ের দিকে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে বলল, ” ও মা, যাবো তো।”
” আমি জানি না। তোর বাবা যেতে দিলে যাবি।” হুমাইরার কণ্ঠে অভিমান জড়ানো।
” বাবাকে রাজি করানোর দায়িত্ব বড় আপুর। তোমাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। তুমি শুধু বলো, তুমি রাজি।”

হুমাইরা উত্তর দিলেন না। তাঁর বুক চিড়ে কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। চোখের কোণে অশ্রুর মেলা বসেছে। এ অশ্র রোধ করার কতো কেউ নেই। ছোট মেয়েটা কালকেই চলে যাবে। তারপর বড় মেয়েও চলে যাবে। এখন আবার মেজো মেয়েটাও চাচ্ছে, তাঁদের ছেড়ে চলে যেতে। সবাই চলে গেলে তাঁরা থাকবে কী করে?
আসমা তৃষ্ণার্ত প্রাণীর মতো চেয়ে আছে মায়ের দিকে। যেন মা রাজি হলেই তাঁর তৃষ্ণা মিটে যাবে। হুমাইরা কিছু বলছে না। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। তাঁর চাহনি নির্বাক, নিঃশ্বাস নির্বাক, সময় নির্বাক, সে নিজেও নির্বাক। সবকিছুই যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। কারোর কোনো কথা নেই, ভাষা নেই, ইশারা-ইঙ্গিত নেই। একসময় বলতো, মেয়েগুলো যে কবে বড় হবে, বড় হয়ে আমাদের দুঃখ ঘোচাবে। আর আজ বলতে হচ্ছে, মেয়েগুলো এত তাড়াতাড়ি বড় না হলেই ভালো হতো। অন্তত আরও কয়েকটা নিঃশ্বাস একসাথে নিতে পারতো, আরও কয়েকটা মুহূর্তে একসাথে কাটাতে পারতো, কয়েক দিন, সপ্তাহ, মাস, আর সবশেষে বছর। এক নয়, একাধিক বছর মেয়েদের সাথে থাকতে পারতো, যদি মেয়েগুলো এত তাড়াতাড়ি বড় না হয়ে যেতো। আজ বড্ড আফসোস হচ্ছে; কেন যে আল্লাহর কাছে দোয়া করতো, ‘ আল্লাহ, মেয়েগুলো যেন খুব বড় হয়।’ কে জানে, আল্লাহ কোন বড়’র কথা বুঝে কোন বড় বানিয়ে দিয়েছে। শুধুমাত্র বড় মনের মানুষ বানাতে পারতো। তা না করে সাথে শারিরীক বড়, চিন্তাভাবনার বড়, নারী সত্তার বড় এর মতো আরও হাজার খানেক ধারার বড় বানিয়ে দিয়েছে আল্লাহ।

আসমা মায়ের একটা হাত ঝাঁকিয়ে বলল, ” ও মা, প্লিজ রাজি হয়ে যাও না। যেতে দেও আমায়।”

হুমাইরা জোর করে আসমার হাতটা দূরে ঠেলে দিলেন। নাক-মুখ কুঁচকিয়ে বললেন, ” যা, চলে যা। আমাকে জিজ্ঞেস করার কী আছে শুনি? যাবি তো যাবিই। আর আসবি না আমাদের কাছে। এই বুড়ো-বুড়ি দু’জন মরে গেলে শুধু একবার কবরটা দেখে যাস। সময় না থাকলে তাও আসিস না। সবাই তো বড় হয়ে গেছিস৷ বাবা-মায়ের মতো ঝামেলা এখনো কী বয়ে বেড়ানোর বয়স আছে তোদের? সবাই চলে যা। আমরা একা বাঁচতে পারলে বাঁচবো, নাহলে গলায় দড়ি দেবো।” কান্নায় ভেঙে পড়লেন হুমাইরা।

স্তম্ভিত আসমা। ভড়কে গিয়ে নিষ্পলক চোখে শুধু তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। মায়ের এই রূপ তাঁর অচেনা। আগে কখনো দেখেনি। বড় আপার বিয়ের সময় শুধু একটু চোখের জল ফেলেছিলেন। এরপর আর কখনো কাঁদেনি। আজ খুব কাঁদছেন তিনি। আসমা দুই হাত বাড়িয়ে মায়ের গলায় জড়িয়ে ধরল। মা’কে শান্ত করার জন্য মায়ের গালে, কপালে, মাথায় অজস্র চুমুর বন্যা বইয়ে দিয়ে আতঙ্কিত গলায় বলতে লাগল, ” এ কেমন কথা মা! ছি ছি! আমি তোমাদের ছেড়ে কোত্থাও যাবো না। কখনোই যাবো না আমি। তুমি কষ্ট পেও না। আই অ্যাম সরি। আর কক্ষণো এ ধরণের কথা বলব না। বুদ্ধিটা বড় আপা দিয়েছে, ওকে আমি খুব বকব।” একনাগাড়ে কথাগুলো বলল মা’কে শান্ত করার জন্য।
তৃষ্ণা অদ্ভুত ভঙ্গিতে ‘হা’ করে তাকিয়ে ছিল। আসমা ওর দিকে তাকিয়ে এবার ক্ষিপ্ত গলায় বলল, ” এই মেয়ে, কূ-বুদ্ধি ছাড়া ভালো কিছু দিতে পারিস না? যা এখান থেকে। আমি এখানেই চাকরি করব।”
তৃষ্ণা এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলো। উঠোনে এসে আবার পিছনে তাকিয়ে দেখল, আসমা এখনো তাঁর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। উঠোন থেকে কুয়ো তলায় চলে এলো তৃষ্ণা। হাঁসফাঁস করে নিজের মনেমনে আসমালে গালাগাল দিয়ে বলল, ” তুমি খালি একবার বাইরে আসো। তারপর দেখো নেবো। কাল রাতে নিজেই আমাকে বললা, ‘ তৃষ্ণ শোন, মা যদি আমায় জিজ্ঞেস করে, ঢাকায় গিয়ে কী করবি? তখন আমার আগেই তুই বলবি, আমাদের ওদিকে অনেক স্কুল-কলেজ আছে। খুব সহজেই যেকোনো একটাতে চাকরি হয়ে যাবে।’ অথচ এখন আবার আমাকে ধমকিয়ে বলল, আমি নাকি কূ-বুদ্ধি দেই। বজ্জাত মেয়ে কোথাকার!

আসমা মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড় দিলো। দরজাটা শুধু ভেজানো ছিল। আসমা দরজা ধাক্কা দিয়ে চট করে ভিতরে ঢুকে গেল। আচমকা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। ভীমড়ি খেয়ে চোখ পাকিয়ে তাকালো।

সম্পৃক্ততা পর্ব ১১

0

সম্পৃক্ততা – একাদশ পর্ব।

রিফাত হোসেন।

২৬.
মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ অচেতন হয়ে যায় তাহমিদ। ডাক্তার এটাই জানিয়েছে। তবে এখন সে সুস্থ। তাকে পরদিন দুপুরের আগেই বাড়িতে আনা হয়েছে। তাহমিদের মানসিক যন্ত্রণা হওয়ার কারণ আসমা কাউকে বলেনি এখন পর্যন্ত। সবার প্রশ্ন এড়াতে সহজ ভাবে শুধু বলেছিল, ‘একটা শব্দ শুনে আসমা তাহমিদের ঘরে আসে। এসে দেখে, তাহমিদ মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছে।’ সবাই তাহমিদকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আসমাকে আর জেরা করেনি। দুপুরে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসার পর তাহমিদ নিজেও ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে। শুধু আসমার মুখোমুখি হওয়ার পর কিছুটা অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল তাকে। এছাড়া সব স্বাভাবিক ছিল। রাইশার হলুদ আজ ; তাই কোনোরকম ঝামেলা চাচ্ছে না তাহমিদ।

বেলা পড়ে গেছে। ডেকোরেশনের লোকজন এসেছে বাড়িতে। দূরের আত্মীয়স্বজন সেরকম কেউ ছিল না বলে আগে থেকে বাড়িতে কেউ আসেনি। গ্রামের কিছু লোকজন এসেছে কাজে সাহায্য করতে। রাইশার হবু শ্বশুর বাড়ি পাশের গ্রামে। তাঁরা সন্ধ্যার আগেই আসবে। রাইশাকে সাজানো হচ্ছে। সেখানে সবাই আছে। তাহমিদ কুয়ো তলায় একটা চেয়ারে বসে আছে। গালে হাত দিয়ে গম্ভীরমুখে বসে আড়চোখে ডেকোরেশনের কাজ দেখছে। দু’টো প্যান্ডেল করা হয়েছে। একটা বাড়ির ভিতরে, আরেকটা বাইরে। চারিদিকে লাইটিং করা হচ্ছে। সন্ধ্যায় নিশ্চয়ই পুরো বাড়ি আলোকসজ্জায় ভরে উঠবে। চারদিকে হৈচৈ। কতশত আনন্দ!

যে স্মৃতিগুলো মনে দাগ কেঁটে ছিল, সেগুলো এখন মনে করিয়ে দিচ্ছে। মনের ভিতর তো অনেক কিছুই গোপন থাকে, কিন্তু গচ্ছিত রাখা সেই স্মৃতিগুলো আর আড়ালে থাকতে চাচ্ছে না বোধহয়। সেই আহ্লাদী ঝগড়াগুলো থেকে বড় মাপের ঝগড়া পর্যন্ত, সব যেন আজ একসাথে তাকে আক্রমণ করছে।

সেদিনও শেষ বেলা ছিল। দূর্বল সূর্য এলিয়ে পড়েছিল পশ্চিমে। বাস স্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে অসহায় চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল মানহা। তাঁর ফাইনাল এক্সাম শেষ। আজকেই তাকে বরিশাল যেতে হবে। তাহমিদকে ফোন করেছে। কিন্তু জ্যামে আটকে পড়ায় তাঁর আসতে দেরি হচ্ছে। ওদিকে বাড়ি থেকে ক্রমাগত ফোন করেই যাচ্ছে। যেভাবেই হোক, তাকে আজকে রাতের মধ্যেই বাড়ি যেতে হবে। ব্যাপারটা সুবিধার লাগছে না মানহার কাছে। তাঁর বাবা-মা, বড় ভাই, সবাই তাঁর গ্রামে ফেরা নিয়ে যেন একটু বেশিই এক্সাইটেড।
তাহমিদ তখনই এলো, যখন গাড়ি ছাড়তে আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি। টিকিট আগেই কেটেছিল সে। মানহার মেজাজ বিগড়ে আছে। সকালেই তাহমিদকে জানিয়েছিল, সে চলে যাচ্ছে। কিন্তু তাহমিদ সকালে বের না হয়ে দুপুরে বের হয়েছে। এইজন্য রেগে আছে মানহা।
তাহমিদ এসে ওর সামনে দাঁড়ালো। তাকিয়ে দেখল, মানহার হাতে দু’টো ব্যাগ। অর্থাৎ সে আবার ঢাকা কবে আসবে, তাঁর কোনো নিশ্চয়তা নেই। । সকালে কেন, এইরকম কিছু আরও আগে জানানো উচিত ছিল, মনে মনে এটাই ভাবল তাহমিদ। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, – ‘ দেখে তো মনে হচ্ছে একেবারে চলে যাচ্ছো; আর আসবে না নাকি?’
– ‘ আসার উপায় কই? ক্যাম্পাসের হল তো আর আমার নিজের সম্পত্তি না, যে এক্সাম শেষ হওয়ার পরেও আমি আরামসে সেখানে থাকতে পারব।’
– ‘ তা এই চলে যাওয়ার খবরটা আমাকে আগে জানাতে পারলে না। তুমি জানো, আজ আমার এক্সাম ছিল? আমাকে এক্সাম দিয়ে এখানে আসতে হলো। কতটা প্রেশারে ফেলেছিলে আমায়, সেটা কী বুঝতে পারছ.’
– ‘ বুঝতে পারছি। কিন্তু কী করব বলো? বাবা তো সকালেই ফোন দিয়ে জানালো, আজকে আমাকে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে। সব গোছগাছ করতে আর তোমার জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে এতটা সময় পেরিয়ে গেল। শেষ রাতে আমি বাড়ি পৌঁছাবো। আবার ভাইয়াকে ফোন করে স্ট্যাণ্ডে আনতে হবে।’ কথাটা বলার সাথে সাথেই মানহার চোখ থেকে অশ্রু গাড়িয়ে পড়ল।

আহত হলো তাহমিদ। হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
দু’মিনিট পেরিয়ে গেছে। আর ৮ মিনিট পর ড্রাইভার শেষ হর্ণ দিবে। পরের বাস আবার সেই সন্ধ্যা ৬ টায়। প্রায় দেড় ঘন্টা পর। মানহাকে যে যেতে হবে, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। সুতরাং এই ৮ মিনিটে কিছু একটা করতে হবে। স্ট্যাণ্ডে লোকজন খুব বেশি। বাসের সংখ্যা কম।
মানহা একবার পিছনে তাকিয়ে বাস দেখে নিলো। লোকজন নিজেদের সিটে বসতে শুরু করছে। একটু পর তাকেও উঠতে হবে।

সে ঢোক গিলে অনুনয়ের স্বরে তাহমিদকে বলল,
– ‘ তুমি আমার সাথে চলো প্লিজ।’
– ‘ পাগল হয়েছ নাকি?’ ভড়কে উঠল তাহমিদ।
মানহা আগের থেকে আরও বেশি অসহায় আর অনুনয় করে বলল,
– ‘ প্লিজ চলো। দেখো, আমি জানি না বাবা-মা কেন আমায় এত তাগাদা দিয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার খুব ভয় হচ্ছে। আমার এক্সাম শেষ। আবার ঢাকায় আসতে দেরি হবে। এর মধ্যে যদি কিছু হয়ে যায়।’
– ‘ মরে যাওয়ার কথা আর বলবে না।’ জোর গলায় বলল তাহমিদ।
মানহা চোখের জল ফেলে আবার বলল,
– ‘ ঠিক আছে, বলব না। কিন্তু তবুও তুমি আমার সাথে চলো। দেখো, প্রতিমাসে ভাইয়া এসে আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। তুমি তো সব জানোই। ডাক্তার যা বলার, ভাইয়াকে বলেন। সুতরাং এই এই অসুখের অজুহাতে আমি তোমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি না। আমার মনে হচ্ছে, আমি বাড়িতে গেলে ওরা আমার বিয়ে দিয়ে দেবে।’
– ‘ এটা কীভাবে সম্ভব? তাঁরা তো জানেনই তোমার আয়ু বেশিদিন নেই। ইনফ্যাক্ট এটা সবাই জানে। তাছাড়া কোনো ছেলে জেনেশুনে তোমার সাথে বিয়ে করতে রাজি হবে না।’
– ‘ তুমি তাহলে রাজি হয়েছ কেন?’ নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করল মানহা।
তাহমিদ জবাবে বলল,
– ‘ কারণ আমি তোমায় ভালোবাসি। আমি চাই, তোমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার পাশে থাকতে। অন্য কোনো ছেলে তোমায় ভালোবাসে না। তাই সে সবটা জেনে তোমায় বিয়ে করবে না।’
মানহা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে এক হাত কোমরে রাখল। অন্য হাত দিয়ে ঠোঁট আর নাকের মাঝখানে থাকা ঘামটুকু মুছে ভারী কণ্ঠে বলল,
– ‘ আমার বাবা-মা হয়তো তাঁদের বিষয়টি জানাবেই না। এইরকম তো অহরহ হচ্ছে। তাছাড়া ভাইয়া তো আমার আপন ভাই না। সৎ ভাই আমার। বাবার প্রথম স্ত্রীর সন্তান। আমি বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। বাবা যে আমাকে খুব একটা পছন্দ করে না, তা আমি জানি। কারণ আমার অসুখের জন্য তাঁর পকেটের টাকা খরচ হচ্ছে। ভাইয়াও অনেকটা শান্ত হয়ে গেছে। সৎ বোনের জন্য আর কত করবে? তাই হয়তো চাচ্ছে, আমাকে অন্যের ঘাড়ে ঝুঁলিয়ে দিতে। দেখো আমি শুধু চাই মরার আগ পর্যন্ত তোমাকে পাশে পেতে। যেন তোমার কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি।’
তাহমিদ অসহায়ের মতো তাকিয়ে বলল,
– ‘ তোমার কিচ্ছু হবে না মানহা। আমার ফাইনাল ইয়ারের প্রজেক্টের কাজ চলছে। এক্সাম চলছে। এইসব ফেলে আমি এখন তোমার সাথে চলে গেলে, আমার একটা বছর নষ্ট হবে। আমার ভাইয়া কত কষ্ট করে আমাকে পড়াচ্ছে। আমাকে নিয়ে তাঁর কত স্বপ্ন। ১টা বছর নষ্ট হলে তাঁর সামনে দাঁড়াতে পারব না আমি।’
– ‘ আর আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি নিজের বিবেকের সামনে দাঁড়াতে পারবে তো?’ মানহার স্বরে হুমকি ভাব ফুটে উঠল।
তাহমিদ বলল,
– ‘ তুমি আমার বাড়িতে চলো। ভাবীকে আমি যা বলার বলব। আমার পরীক্ষাগুলি শেষ হোক, তারপর আমরা একসাথে তোমার বাড়িতে যাবো। তাঁরা আমাদের সম্পর্ক না মানলেও আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না।’
– ‘ সেটা সম্ভব না। যে আমাকে জন্ম দিয়েছে, যারা আমাকে খাইয়ে পড়িয়ে বড় করে তুলেছে, তাদের দেওয়া প্রতিজ্ঞা আমি ভঙ্গ করতে পারব না। আমাকে এই বাসে করেই যেতে হবে।’
– ‘ তারপর কী করবে? পরিবারের কথামতো বিয়ে করবে?’
– ‘ আমি তাঁদের বিরুদ্ধিতা করতে পারব না। সেই সাহস আমার নেই। কিন্তু তুমি পাশে থাকলে আমি অন্তত বলতে পারব, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই না।’ কোমর থেকে হাত নামিয়ে আবারও পিছনে তাকিয়ে বাস দেখে নিলো।

ড্রাইভার এখনো সিটে বসেনি। সে টিকিট কাউন্টারে কথা বলছে। হাতে আছে আর চার মিনিট। এক্ষুনি হয়তো ড্রাইভার বাসে উঠবে। এরপর বাস স্টার্ট দিবে।
তাহমিদ কিছু বলছে না দেখে মানহা আবারও বলল,
– ‘ প্লিজ আমার সাথে চলো। বাবা-মা আর ভাইয়ার কথাকে অমান্য করে আমি এখানে থাকতে পারব না। তাঁরা আমাকে আজকে এই জায়গায় আসতে সাহায্য করেছে। তাঁরা না চাইলে তো আমি ঢাকাতেই আসতে পারতাম না কখনো। তোমার সাথে পরিচয়ও হতো না। তাই তাঁদের অবাধ্যতা আমি করতে পারব না।’

তাহমিদের খুব রাগ হলো মানহার উপর। তাঁর পেট একদম ফাঁকা৷ টেনশনে গতরাতে কিছু খায়নি। আজ সকালে খাওয়ার সময়ই পায়নি। এক্সাম দিয়ে আবার এখানে আসতে হয়েছে। অর্থাৎ গতকাল রাত থেকে এখন পর্যন্ত সে ঠিকঠাকমতো পানিও খেতে পারেনি। এইসময় আবার নাকি তাকে বরিশাল যেতে হবে। এইসব এর কোনো মানে হয়? তাহমিদ ধকম দিয়ে বলল,
– ‘ তোমার কাছে তোমার পরিবারের যতটা গুরুত্ব আছে, আমার কাছে আমার পরিবারেরও ততটাই গুরুত্ব আছে। আমার বড় ভাই, আমার বইপত্রের খরচ দিতেই হিমশিম খায়। এখন যদি আমি একটা বছর নষ্ট করি, তাহলে কতটা ক্ষতি হবে বুঝতে পারছ?’
– ‘ তোমার জীবনে সবার গুরুত্ব আছে, শুধু আমার নেই, তাই তো?’ কিছুটা কড়া হলো মানহা।
তাহমিদ আগের মতো ধমকে বলল,
– ‘ আছে। অবশ্যই আছে। না থাকলে আমি ছুটে আসতাম না এখানে।’
– ‘ এসে লাভটা কী হলো শুনি? তুমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছ, আমি এখন গ্রামে গেলে তোমার থেকে হারিয়ে যাবো। বাবা-মা আমাকে এত তাড়া দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কেন, তা সঠিক ভাবে আমি না জানলেও আমার সিক্স সেন্স বলছে, হয় আমার অসুখটা গুরুতর হয়েছে, তাই তাঁরা আমায় ওখানে যেতে বলছে; আর নাহয় আমার দায় এড়াতে আমাকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে চাচ্ছে। যাতে আমার চিকিৎসার ভার আর তাঁদের না নিতে হয়। এই দু’টোর যেটাই হোক, আমি যে তোমায় হারিয়ে ফেলবো, সেটা নিশ্চিত।’ কথাগুলো একনাগাড়ে বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল মানহা। মুখ চেপে কোনোরকমে নিজেকে সামনে নিলো।
তাহমিদের মাথা সাংঘাতিক গরম হয়ে আছে। তাঁর শরীর দূর্বল এমনিতেই। তার উপর এইসব ঝামেলা। সহ্য করতে পারছে না। একটু চুপ থেকে বলল,
– ‘ তুমি যদি এখন বাড়িতে না যা-ও, তাহলেই সবদিক স্বাভাবিক থাকবে। দেখো, মৃত্যু আল্লাহর হাতে। তাই তুমি যেখানেই থাকো না কেন, তোমার মৃত্যু লিখা থাকলে অবশ্যই তা হবে। আর তোমার সাথে যদি আমার মিলন লিখা থাকে, তাহলে সেটাও হবে। আমার শরীরটা অসুস্থ লাগছে। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছি না। প্লিজ, আমার সাথে এসো তুমি। আমার বাড়িতে চলো। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তোমাকে হারাতে চাই না। তোমার অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। যারা তোমার জন্য এতকিছু করেছে, তাঁদের কষ্ট দিতে চাও না তুমি। অন্তত নিজের জীবনের শেষের দিনগুলোতে তাঁদের আঘাত করতে চাও না। কিন্তু কী করবে বলো, পরিস্থিতির স্বীকার আমরা।’

বাসের হেল্পার তাগাদা দিলো সবাইকে। বাসের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল আরও কয়েকজন। তাঁরা পরিবারের লোকদের সাথে কথা বলছিল। হেল্পারের তাগাদায় সবাই উঠে গেল বাসে। মানহা হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকালো। চোখের জল মুছে বলল,
– ‘ বেশ, তুমি তাহলে নিজের মতো ভালো থেকো। আমাকে ভুলে যাও।’
– ‘ এখানে ভুলে যাওয়ার প্রসঙ্গ আসছে কেন?’ ঢিপঢিপ চোখে তাকিয়ে বলল তাহমিদ।
– ‘ আর কিছু বলতে পারব না তাহমিদ। আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তুমিও জানো, আর আমিও জানি, এটাই আমাদের শেষ দেখা৷ প্রেম মানুষের জীবনে একবার হলেও আসে। আমাদের জীবনেও এসেছিল। আমার অসুখের কথা জেনেও তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে। এরজন্য আমি সারাজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো৷ আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি। একটা বিয়ে মানে অনেক কিছু। সুতরাং তুমি চাইলেও এখন আমাকে নিয়ে গ্রামে যেতে পারবে না। আমার বাবা-মাকে বলে আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হলে তুমি চাকরি করতে। তারপর হয়তো বিয়ের কথা ভাবতে। আমাকে বিয়ে করে তুমি বেশিদিন সুখে থাকতে পারবে না। অনেকটা দেরিতে হলেও এটা বুঝেছ তাহলে।’
– ‘ মানহা, আমায় ভুল বুঝছ তুমি। দেখো, আমি তোমাকে মন থেকেই ভালোবাসি।’
মানহা কঠিন করে বলল,
– ‘ প্রেম করে ভালোবাসা আর বিয়ে করে ভালোবাসা এক নয়। প্রেমিক হিসেবে তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো। কিন্তু আমাকে বিয়ে করা তোমার দ্বারা সম্ভব না। কারণ তুমি জানো, যেকোনো সময় আমি মরে যেতে পারি। এখানে আমি তোমাকে দোষারোপ করব না। দোষটা আমারই। আমারই উচিত হয়নি নিজের অনিশ্চিত জীবনে তোমাকে জড়ানো। আসলে তোমাকে দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিল। তাই তোমাকে ভালোবাসার লোভটা সামলাতে পারিনি।’
তাহমিদ, মানহার একটা হাত চেপে ধরল। অস্থির কণ্ঠে বলল,
– ‘ আমাকে একটু সময় দাও প্লিজ। আসলে আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুত না এইসবের জন্য। তুমি পরের বাসে যাও। ততক্ষণে আমাকে সময় নাও। আমি একটু ভাবী। তারপর সিদ্ধান্ত নেবো।’
– ‘ ভাবাভাবির কিছু নেই আর। তুমি যদি এখন আমার সাথে যা-ও, তাহলে সেখানে কোনো ভালোবাসা থাকবে না। ওটা হবে দয়া দেখানো। সহানুভূতি থেকেই আমার সাথে যেতে বাধ্য হবে তুমি। আমি সেটা চাই না। ভুলটা আমারই। ১টা বছর মানে অনেককিছু। গালফ্রেন্ড এর জন্য নিজের পড়াশোনা এতবড় ক্ষতি কেন করবে? তোমার এই ১ বছরের জন্য সারাজীবন তোমাকে পস্তাতে হবে। তোমার ভবিষ্যতে একটা লাল দাগ থেকে যাবে। এইসব আমি জানি। তবুও অন্ধ হয়ে বোকার মতো বলে ফেলেছি, আমার সাথে চলো। ক্ষমা করে দিও প্লিজ। তুমি এখন গাজীপুর যাও। ভালো করে প্রজেক্টের কাজ করবে। ভবিষ্যৎ জীবনে অনেক উন্নতি করবে।’ কথাটা বলে হ্যাচকা টানে তাহমিদের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলো মানহা।

আর কোনোদিকে না তাকিয়ে বাসের কাছে চলে গেল। এরপর বাসে উঠে গেল ব্যাগ নিয়ে। ওরা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। মানহা চলে আসার পর তাহমিদ কিছুটা এগিয়ে এলেও মানহার চোখে চোখ রাখতে পারল না আর। মাথা নিচু করে টিকিট কাউন্টারে থাকা ছাউনির ভিতরে একটা বেঞ্চে বসে পড়ল।
পকেটের ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ করে। তাহমিদ ফোন বের করে দেখল, রনি নাম৷ সে রিসিভ করল। রনি জিজ্ঞেস করল,
– ‘ কোথায় তুই? মানহা তো চলে গেছে হল থেকে।’

তাহমিদ এলোমেলো কণ্ঠে কী যেন বলল কিছুক্ষণ। রনি কিছুই বুঝতে পারল না। ফোনটা কেটে দিলো।
তাহমিদ চুপচাপ বসে রইল অনেকটা সময়। বাস ছেড়ে দেওয়ার পর আধঘন্টা পেরিয়ে গেল৷ কী করবে বুঝতে পারল না তাহমিদ। মানহাকে সে মন থেকেই ভালোবাসে। তাকে হারিয়ে বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করছে তাহমিদ। নিজের মনেমনে বলল,
– ‘ নাহ্, কাজটা ঠিক হয়নি। মানহা খুব কষ্ট পেয়েছে। আমার ১ বছরের থেকেও মানহা গুরুত্বপূর্ণ বেশি।’

৬ টার বাসে তাহমিদ নিজেও বরিশালের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলো।

২৭.
সন্ধ্যার আগে যখন বরের বাড়ির লোকজন এসে রাইশার মুখে হলুদ লাগাচ্ছিল ; সেসময় তাহমিদ নিজের সামনে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। সে একাই কুয়ো তলায় বসে ছিল। আসমার কাছে শুনেছিল, মানহাও এই কুয়ো তলায় বসে থাকতো। একটু পর পর টুপ করে গাছ থেকে পেয়ারা পাড়তো। আর খাওয়া শুরু করতো। আনন্দে নেচে উঠল। গাছটাও যেন মানহার নাচ দেখার লোভ সামলাতে পারেনি। যে দুই বছর মানহা এসে পেয়ারা খেয়েছে, অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় সেই দুই বছরই সবচেয়ে বেশি পেয়ারা হয়েছিল গাছে।

এই পর্যন্ত অনেকেই তাহমিদকে ডাকতে এসেছে। কিন্তু তাহমিদ কুয়ো তলা থেকে উঠেনি। মানহার বিরহে কাতর হয়ে যে সে কুয়ো তলায় বসে আছে, তা না। মানহার মৃত্যুর খবর তো আগেই পেয়েছিল। ইনফ্যাক্ট সে-ই প্রথম পেয়েছিল। জানাযা নামাজ পর্যন্ত পড়েছিল। উদাসীন যা হওয়ার, আগেই হয়েছিল। এখন শুধু বুকে কিছু দীর্ঘঃশ্বাস জমে আছে। যা থমকে গিয়ে মাঝে মাঝে কষ্ট দেয়। যেমন গতকাল দিয়েছিল। হৈহুল্লা ভালো লাগছিল না বলেই সে একজায়গায় চুপচাপ বসে ছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন একজনকে দৃষ্টির সীমানায় আবিষ্কার করল, সে নিজে থেকেই ওঠে দাঁড়াতে বাধ্য হলো।

তানিশা মুচকি হেসে একবার আশেপাশে তাকালো। সবাই কনে-কে নিয়ে ব্যস্ত। তাই সে এগিয়ে এলো তাহমিদের দিকে৷ কুয়োর উপরে বসল। কুয়োর গভীরতা না দেখেই পিছনে তাকাতেই মনে হলো পিছনে পড়ে যাচ্ছে। তাহমিদ চট করে তানিশার হাতটা ধরে ফেলল। উৎকণ্ঠাযুক্ত গলায় বলল,
– ‘ আরে এত ছটফট করছিস কেন? পড়ে গেলে তো তোকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

তানিশা, তাহমিদের হাতটা শক্ত করে ধরে আবারও নিচের দিকে তাকালো। চমকে ওঠে আবার বলল, – ‘ আরে বাপ্রে! ভেবেছিলাম মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। তাই লাফিয়ে বসে পড়েছি। তুই না ধরলে তো পড়েই যেতাম।’
– ‘ হুম। এবার ট্রিট দে। তোকে এত কষ্ট করে বাঁচালাম।’ রসিক সুরে বলল তাহমিদ।
– ‘তুই উল্টো আমায় ট্রিট দে। আমি এখানে এলাম বলেই না তুই আমাকে ধরার সুযোগ পেলি। মেয়েদের হাত ধরার জন্য কিন্তু অনেক সাধনা করতে হয়।’ খুব গৌরবের গলায় কথাটা বলল তানিশা।
হেসে উঠল তাহমিদ। জিজ্ঞেস করল,
– ‘ তুই যে এখানে আসবি, আমাকে জানাসনি তো? কখন এসেছিস?’
– ‘ অনেকক্ষণ আগে। এতক্ষণ বাকিদের সাথে গল্পগুজব করলাম। তোর সামনে দিয়েই গেলাম, অথচ আমাকে দেখলিও না।’
– ‘তাই নাকি?’ কপাল কুঁচকালো তাহমিদ। আবার বলল,
– ‘কালকেও তো সাথে কথা হলো। তখন অন্তত বলতে পারতি তুই এখানে আসছিস।’
তানিশা নিচে নামল। বলল,
– ‘ আরে মামা, তোর ফিট খাওয়ার কথা শুনেই তো সকালে আমি আর তুহিন ভাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আগে জানতাম নাকি আমি আসবো? তা কাহিনিটা কী? আমাকে খুব বেশি মিস করে কী শেষমেশ অজ্ঞান হয়ে গেলি?’ কথাটা বলে নিজেই হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো করতে লাগল তানিশা।
তাহমিদ দাঁত কিড়মিড় করে মনেমনে বলল,
– ‘যত্তসব পাগলের দল।’ কেঁশে মুখে বলল, – ‘ তোকে মিস করার কী আছে? তাছাড়া অজ্ঞান-টজ্ঞান কিছু না। আমি তো একটু ভং করছিলাম।’
হাসি থামিয়ে তানিশা বলে উঠল,
– ‘ ভং ধরছিলি! এটা কী সিনেমা? যে তুই অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করছিলি। আর তোর প্রিয়তমা সেই ঢাকায় বসে গান গেয়ে তোকে জাগিয়ে দিবে। এইরকমই ভাবছিলি বুঝি।’ কথাটা বলে আবারও হেসে উঠল তানিশা।

তাহমিদ রেগে দিয়ে তানিশার চুলগুলো টেনে দিলো। তানিশা হাসি থামিয়ে ‘উফ’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেই তাহমিদ ভয় পেয়ে চুল ছেড়ে দিলো। তানিশা আবার হাসতে হাসতে চেয়ারে বসল। বলল,
– ‘ তুই কি জানিস না মেয়ে জাতি চুলের প্রতি কতটা যত্নশীল? মেয়ে জাতি সব সহ্য করতে পারে, কিন্তু চুল টানা সহ্য করতে পারে না। কুয়োর ভিতরে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে তুই আমাকে বাঁচিয়েছিস। তাই এবারের মতো মাফ করে দিলাম। এবার বল তো তোর কী হইছে?’
– ‘ নতুন করে আমার আবার কী হবে? যা হওয়ার তা আগে হয়ে গেছে। তুই যে নির্লজ্জের মতো নিজের বাবা-মাকে বিয়েসাদী কথা বলেছিস, তোর কী লজ্জাসরম নেই?’
– ‘ আছে তো। বাবার সামনে তো আমি খুব লজ্জায় পড়ে গেছিলাম। মা বাবাকে বলেছে। আমি বলিনি।’ কথাটা বলেও কিছুটা লজ্জা পেলো তানিশা। খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আবার বলল, – ‘ভাবীর বোন, মানে আসমার সাথে একান্তে কিছু কথা বললাম। ও আমাকে সবটা বলেছে।’

চমকে উঠল তাহমিদ। চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল,
– ‘ সব বলেছে?’
– ‘ হ্যাঁ।’ স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলো তানিশা। পরক্ষণেই আবার বলল, – ‘ মানহার ব্যাপারেও সব বলেছে। তোর আর মানহার মধ্যে কী হয়েছিল, সেটা তো ও জানে না। কিন্তু মানহার মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল, সেটা জানে। আমি খুব কষ্ট পেয়েছি সব শুনে। সেসময় তোর উপর দিয়ে কী ঝড়টাই না বয়ে গেছিল!’
– ‘ আরে চুপ কর তো। আমার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাবে কেন?’ বিরক্ত হলো তাহমিদ।
তানিশা বলল,
– ‘ খুব যে কষ্ট পেয়েছিলি, তা তো অস্বীকার করতে পারবি না। তাছাড়া কাল যে তুই হঠাৎ অচেতন হয়ে গেলি, সেটাও তো মানসিক আঘাত পেয়ে।’
– ‘ এইসব গাজাখুরী কথাবার্তা। আমি কী এতই দূর্বল, যে সামান্য কিছু কথা শুনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবো? আসমা মেয়েটা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই যাচ্ছিল। ওকে এড়িয়ে যেতেই আমি অজ্ঞান হওয়ার ভান করছিলাম।’
– ‘ তাকি নাকি?’ কথাটা বলে চোখ পাকিয়ে তাকালো তানিশা। আবার বলল, – ‘ তা হাসপাতালে যাওয়াটাও কি তোর অভিনয় ছিল?’
– ‘ হ্যাঁ। ওরা সবাই বোকা। ভয় পেয়ে আমায় নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করছিল। আরে ভাই, চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিলেই তো আমি চোখ মেলে তাকাতাম।’
– ‘ ভাবী তো বলল, তোর মুখে পানি দিয়েছিল। কিন্তু তুই তাকাসনি। তাই তো একটা ভ্যান দিয়ে তোকে হাসপাতালে গিয়ে গেছিল। তুই কী এখন বলবি, ভাবী মিথ্যে বলেছে?
– ‘ না। ভাবী মিথ্যে বলবে কেন? পানি দিয়েছিল তো। তবে গরম একটু বেশি ছিল বলে ওইটুকু পানিতে কাজ হয়নি।’

তানিশা চেয়ার ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল৷ তাহমিদের বুকে ধাক্কা দিয়ে রাগী গলায় বলল,
– ‘ ধুর! ফাজলামি করিস না। তোর কথা বিশ্বাস করার কোনো মানেই হয় না। অভিনয় করে হাসপাতালে যাওয়া; ডাক্তারদের সেবা নেওয়া; এতকিছু সম্ভব না। আমি চোখ বন্ধ করে আছি; অথচ সবাই চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এখানে আমি হলে তো হেসেই লুটোপুটি খেতাম। তুইও খেতি। সুতরাং এটা অভিনয় ছিল না। তাছাড়া ডাক্তার তোকে দেখে কী বলেছে, সেটাও শুনেছি আমি।’

বিরক্তিতে আর কথা বলতে পারল না তাহমিদ। তানিশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
– ‘ চল হেঁটে আসি।’
– ‘সন্ধ্যা হয়ে আসছে।’ অনীহা দেখালো তাহমিদ।
তানিশা গম্ভীরমুখে প্রতিবাদী কণ্ঠে বলল,
– ‘ হোক, তবুও আমি যাবো।’

অগত্যা বাধ্য হলো তাহমিদ। দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। হাঁটতে হাঁটতে আচমকা তানিশা প্রশ্ন করল,
– ‘ তুই আমার বাবাকে কী বলেছিস শুনি?’
তাহমিদ ভেবে বলল, – ‘ কী বলেছি?’
– ‘ তুই জানিস না কী বলেছিস?’ কিছুটা রেগে গেল তানিশা। – ‘বাবা তোর নাম্বার চাইলো; আমি ভাবলাম হয়তো জরুরি কোনো কথা বলবে; তাই নম্বর দিলাম। সে ফোন করে জিজ্ঞেস করল, ‘ তুমি কী সত্যিই আমার মেয়েকে বিয়ে করবে?’ আর তুই উত্তরে কী বললি। বাবা তো রেগেমেগে ফায়ার। আমাকে শাসিয়ে বলল, ‘ যে ছেলে বিয়ের আগেই এত হেয়ালিপনা করে, তাঁর সাথে আর যাই হোক, বিয়েসাদী নিয়ে আলোচনা করা যায় না।’
তাহমিদ ফিক করে হেসে বলল,
– ‘ আর কী বলতাম বল। প্রথমবার জিজ্ঞেস করল; আমি বললাম, ‘আঙ্কেল, আমি ঢাকায় এসে নেই। তারপর ভাবীকে নিয়ে আপনাদের বাড়িতে গিয়ে যা বলার বলব।’ তাঁর এখানেই বুঝে যাওয়া উচিত ছিল আমি কী বলতে চাচ্ছি। তখন সে আবারও একই প্রশ্ন করল। আমি বললাম, ‘ আমাকে একটু ভাববার সময় দিন।’ সে দিলো না। আবার বলল, ‘তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে কি-না সেটা বলো?’ আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। রাগারাগি তো আর করতে পারি না। তাই সুন্দর করে বলে দিলাম, ‘ আমি বিয়ে করব না আপনার মেয়েকে।’ সে মনেহয় এই কথাটা শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিল। বলল, ‘ বেশ, তাহলে ফোন রাখছি।’ আজব মানুষ সবাই। এই পৃথিবীতে যে কত রকমের অদ্ভুত মানুষ আছে, তা তুই ভাবতেও পারবি না। হাসপাতালের ডাক্তার আমায় বলে, ‘ তোমার শরীরটা দূর্বল। আজকের দিনটা আমাদের এখানে থেকে যাও।’ তুই বল, পেসেন্টকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হাসপাতাল রাখা হয়, না জামাই-আদর করার জন্য? উনার কথা শুনে মনে হলো, উনি মেয়ের জামাইকে বলছে, ‘জামাইবাবাজি, আজকের দিনটা আমাদের সাথে থেকে যাও। আবার কবে আসবে না আসবে, তাঁর কী ঠিক আছে!’ আসলে এইসব ওদের টাকা কামানোর ধান্দা। আমাকে যতক্ষণ ওখানে রাখবে, বিল অটোমেটিক বাড়তে থাকবে। পারে তো ১০ দিনের জন্য আমাকে লাইফ সাপোর্টে রেখে দেয়। অথচ আমার কিছুই হয়নি। তোর বাবা-ও এইরকম আচরণ করছিল। আরে ভাই, আমাদের বিয়ে হলে আপনি হবেন আমার শ্বশুর। এইসব বিয়েসাদী নিয়ে আমি কী আপনার সাথে আলোচনা করব? আমার কী লজ্জাসংকোচ নেই?’

তাহমিদের কথা শুনে হাসতে লাগল তানিশা। হাসতে হাসতে তাহমিদের হাত জড়িয়ে ধরল । তাহমিদ হাতটা সরিয়ে দিলো না। মেয়েরা নিজের ইচ্ছায় স্পর্শ করলে সরিয়ে দিতে নেই। বরং এতে আলাদা একটা শিহরণ আছে। যা প্রকাশ করার মতো ভাষা বাংলা অভিধানে নেই।

তাহমিদ আর কিছু বলল না। তানিশা তাঁর হাত জড়িয়ে ধরে হাঁটছে। খোলা আকাশের নিচে দু’জনে। আকাশ আর তাঁদের মাঝে কোনো বাধা নেই। সন্ধ্যায় হয়ে আসছে। চারিদিকটা আস্তে আস্তে আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না তানিশার মুখটা। তবে অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে অনুভব করা যাচ্ছে। তানিশা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটছে। মনে কোনো জড়তা নেই। যেন সে খুব নিরাপদে আছে। তানিশাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে তাহমিদের ইচ্ছে করছে, ওকে একবার জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। এর আগেও একবার ভুল করে ফেলেছিল তাহমিদ। এরজন্য তাকে মহা বকাঝকা খেতে হয়েছিল। তবে এখন সেরকম কিছু হওয়ার ভয় নেই। আগের সময়টা ভিন্ন ছিল। এখনকার সময়টাই রোমান্স করার। সরু পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দু’জনে। পাশেই আছে শুকিয়ে যাওয়া নদী। চৈত্র মাসেই নদীটা কেমন শুকিয়ে গেছে! একটা ব্রিজ দেওয়া হয়েছে পাড়াপাড়ের জন্য। তানিশা আর তাহমিদ হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের উপরে গেল। দূর থেকে পাখির ডাক ভেসে আসছে। কোথায় যেন ঝিঁঝিঁপোকারা অদ্ভুত একটা শব্দ করে ডাকছে। মুহূর্তটা দেখে ওদের মনে হলো, ‘প্রকৃতি যেন ওদের কিছুটা স্পেশাল মুহূর্ত উপহার দিয়েছে।’ তাহমিদের ইচ্ছে করছে তানিশাকে একটু ভালোবাসতে। মেয়েটা তাকে এতই ভালোবাসে যে, তাঁর সামান্য অসুখের কথা শুনে সব কাজ ফেলে ঢাকা থেকে বরিশাল চলে এসেছে। মনের গহিনে সাংঘাতিক পরিমাণ ভালোবাসা না থাকলে হয়তো এতকিছু সম্ভব না। তাহমিদও ভালোবেসে ফেলেছে তানিশাকে। কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশ কীভাবে করবে, তা বুঝতে পারছে না। ব্রিজের মাঝে দাঁড়িয়ে চুপচাপ পশ্চিমের লালচে আকাশের দিকে তাকালো দু’জনে। মানহাকে ভালোবাসে যে কাজ তাহমিদ করেনি, তানিশাকে আচমকা ভালোবেসে সেটাই করল! তানিশার দুই কাধে হাত রেখে মুখোমুখি দাঁড়ালো। খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে হঠাৎ তানিশার কপালে যত্ন করে নিজের ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিলো। কেঁপে উঠল তানিশা। তাহমিদ এখানেই থেমে থাকলো না। তানিশাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল, ‘ আই লাভ ইউ তানিশা।’
তাহমিদের কথা কতটা শুনেছে, তা তানিশা নিজেও জানে না। তাঁর নিঃশ্বাস থমকে গেছে। হৃদপিণ্ড সোজা হয়ে গেছে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ গতিতে ঝাঁকি দিলো। প্রথম স্পর্শ! প্রথম অনুভূতি! প্রথম ভালোবাসা! সবকিছুর মিশ্রণে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো তানিশার। দুই হাত বাড়িয়ে যে তাহমিদকেও জড়িয়ে ধরবে, সেই অবস্থাতেও সে নেই। নিজের শরীরের সমস্তটুকু এলিয়ে দিয়ে চুপচাপ তাহমিদের বুকে আবদ্ধ হয়ে রইল। তাহমিদের বুকের ভিতর ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। তানিশার বুকেও হচ্ছে। তানিশার বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজ শুনতে না পেলেও তাহমিদ তা অনুভব করতে পারছে। বুক ধড়ফড় করছে তানিশার। তাহমিদের বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে আছে সে।

সম্পৃক্ততা পর্ব ১০

0

সম্পৃক্ততা – দশম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

তাহমিদ গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করল, – ‘ আপনি মানহাকে চেনেন?’

প্রশ্নটা শুনে ইতস্ততবোধ করতে লাগল আসমা। কী বলবে, ঠিক বুঝতে পারছে না। মানহাকে ও চেনে, এই কথাটা তাহমিদকে জানানো ঠিক হবে কি-না, সেটাও বুঝতে পারছে না। মাথা ব্যথা করছে তাঁর। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
তাহমিদ আবার জিজ্ঞেস করল, – ‘ কী হলো, বলুন আপনি মানহাকে চেনেন কি-না?’ তাহমিদের কণ্ঠে কিছুটা কড়া ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠল।
থতমত খেয়ে গেল আসমা; সাথে রাইশা। কিছুটা আড়ষ্টভাবে বলল,
– ‘ যদি বলি চিনি না, তাহলে আপনার জবাব কী হবে?’
তাহমিদ উগ্র কণ্ঠে বলল, – ‘ এটা বললে তো আপনি সক্কাল সক্কাল একটা মিথ্যা কথা বলবেন। আমি তো স্পষ্ট শুনেছি রাইশা বলল, ‘মানহা, মানে পেয়ারা আপা।’ দেখুন, এই পেয়ারা আপা কে তা আমি জানি না। কিন্তু মানহার নামটা যখন উচ্চারিত হয়েছে, তাহলে অবশ্যই আপনারা মানহাকে চেনেন। বলছিলাম কী, আপনাদের পরিচিত এই মানহার বাড়ি কি নদীর ওপাড়ের গ্রামে?’
আসমার শরীরটা ঝেঁকে উঠল তাহমিদের কথা শুনে। তাঁর কাছে সব পরিষ্কার। ফাতেমা বলেছিল, তাহমিদের সাথে একটা মেয়ের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটাকে ফাতেমা স্ব-চোখে না দেখলেও পরিচয়টুকু জানে। তাহমিদ নিজেই বলেছিল। সমবয়সী বন্ধুসুলভ ভাবীর কাছে অনেক কিছুই শেয়ার করেছিল তাহমিদ। মেয়েটার নাম মানহা। বাড়ি এই বরিশাল। ঢাকায় গিয়েছিল পড়াশোনা করতে। ইউনিভার্সিটির হলে থাকতো। দেখতে সুন্দরী। অল্পতেই শরীরে আধুনিকতার ছাপ ফুটে উঠেছিল। এছাড়া আর কোনো তথ্য তাহমিদের কাছ থেকে জানা যায়নি। আসমার খটকা লেগেছিল শুরু থেকেই। প্রায় সবদিক থেকেই তাঁর কলেজ লাইফের বন্ধুর সাথে মিলে যাচ্ছিল। তবুও বিভ্রান্তি ছিল মনের মধ্যেখানে। চারিদিকে ভিন্ন ভিন্ন গ্রাম আছে; তাহমিদ অন্যসব গ্রামের কথা না বলে; এমনকি এই গ্রামের কথা না বলে সরাসরি নদীর ওপাড়ের গ্রামের কথা বলেছে। অর্থাৎ তাঁর সেই প্রেমিকা পাশের গ্রামে থাকে; এবং আসমার বান্ধবী মানহাও পাশের গ্রামে থাকে। পুরো ব্যাপারটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে আসমার কাছে। কিন্তু মানহার কী হয়েছিল, সেটা কী তাহমিদ জানে? সে তো সবাইকে বলেছিল, মানহা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সবাই ভেবেছে মানহা প্রতারণা করেছে তাহমিদের সাথে। কিন্তু আসলেই কী সেরকম কিছু ঘটেছিল?

তাহমিদের যেন ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাচ্ছে ক্রমশ। তাঁর ইচ্ছে করছে আসমার দুই গালে ঠাসস করে দু’টো থাপ্পড় দিয়ে দিতে। তাহমিদ শেষবারের মতো দাঁত খিঁচিয়ে মুখে প্রশ্ন করল, – ‘ আপনাকে আমি একটা প্রশ্ন করেছি আসমা। আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।’
– ‘ আপনি যা অনুমান করেছেন, সেটা ঠিক। আপনার পরিচিত মানহা, আর আমার পরিচিত মানহা একজনই। আমার বান্ধবী মানহা ঢাকা গিয়েছিল পড়াশোনা করতে। ইন্টার পাস করে খুব সহজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। আমি ওখানে চেষ্টাই করিনি। আমার শহরের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলাম। কারণ ঢাকায় পড়াশোনা করা আমার দ্বারা সম্ভব ছিল না।’
তাহমিদ ভাঙা গলায় বলল, – ‘ আর আমি প্রতি সপ্তাহে দু’বার করে সেই গাজীপুর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম মানহার সাথে দেখা করতে। গাজীপুর-এ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তাম আমি তখন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বন্ধুরা ছিল। ওদের মাধ্যমেই মানহার সাথে পরিচয়। এরপর আমাদের মাঝে সম্পর্ক তৈরি হলো; প্রেমের সম্পর্ক।’
– ‘ আর সেটার পরিনতি যেন কী হয়েছিল? মানহার মৃত্যু!’ ক্ষিপ্ত গলায় কথাটা বলেই রাইশার হাত চেপে ধরল আসমা। তাঁর মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ বের হলো না।

তাহমিদ থমকে গেল কিছু মুহূর্তের জন্য। বুকটা ভারী হয়ে এলো; যেন কেউ বিশাল একটা পাথর বুকে চাপা দিয়েছে। হাত-পা ঝিম ধরে গেল। নিজের অনিচ্ছাতেই চোখ থেকে বেয়ে পড়ল অশ্রু। অশ্রুসিক্ত চোখ দু’টো নিয়ে আর সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। ঝাপসা চোখে ভেসে এলো একটা প্রতিচ্ছবি! একটা দৃশ্য! টিএসসির পাশে কোনো এক ফাঁকা স্থানে সাদা আর লাল রঙে মিশ্রিত শাড়ি পরে নাচছিল একটি মেয়ে। হাতে লাল রঙের চুড়ি। কপালে ছোট্ট টিপ; আর চোখে কাজল। ঘন ভুরুতে কাজল বেশ মানিয়েছিল। কমলার মতো ঠোঁট দু’টোয় ছিল লিপস্টিক। পায়ে ছিল ঘন আলতা। হাতে গাছের মেয়েদী। মেয়েটি নাচছিল। দিনটি ছিল পহেলা বৈশাখ। গোল হয়ে ১০-১২ জন্য ছেলে-মেয়ে বসেছিল। মেয়েদের পরণে শাড়ি, আর ছেলেদের পরণে পাঞ্জাবি। শুধু একজনের মধ্যে ভিন্নতা ছিল। সে হলো তাহমিদ। গাজীপুর থেকে যাতায়াত করে যেতে হয়েছিল বলে সে পাঞ্জাবি পরেনি। সাদামাটা শার্ট আর প্যান্ট পরেছিল। অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের মাঝেই বসেছিল সে। ওখানকার চার-পাঁচজনকে সে চিনলেও বাকিদের চিনতো না। সেদিনই প্রথম দেখেছিল। তবুও কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে সবার মাঝে আবদ্ধ থাকা মেয়েটিকে দেখছিল সে। সে অনেক আগে থেকেই মেয়েটা তাঁর পরিচিতি! ছোট্ট স্পিকারে চলছিল বাংলা গান। মেয়েটি গানের তালে তালে নাচছিল। একটু পরপর নিজের পরণের শাড়ি সামলাচ্ছিল। বন্ধুদের সাথে কথা বলে তাহমিদ জানতে পারল, মেয়েটি সেদিনই প্রথম শাড়ি পরিধান করেছিল। পহেলা বৈশাখের মতো অত আকর্ষণীয় একটা উৎসবে বাংলা গানের সাথে সেলোয়ার-কামিজ কিংবা জিন্স শার্ট বেমানান ছিল বলেই বাধ্য হয়েছিল শাড়ি পরতে। বন্ধুদের আবদারে নাচ করছিল। যতক্ষণ সে নাচ করছিল, তাহমিদ মুগ্ধ চোখে শুধু দেখছিল। নাচ শেষ করে হঠাৎ তাহমিদের সামনে ধপাস করে বসে পড়ল মেয়েটি। তাহমিদের বুকটা ধুক করে উঠেছিল সেসময়। হার্টবিট এলোপাথাড়ি ভাবে বেয়াদবি করছিল। তাহমিদ বুঝতে পারছিল না, সেসময় কী করবে। মেয়েটা তাঁর একদম মুখোমুখি বসেছিল। বাকিরা সবাই উঠে দাঁড়ালেও তাহমিদ আর মেয়েটা খানিকক্ষণ নীরবে বসেছিল। এরপর অন্য একটা মেয়ের তাগাদায় মেয়েটাও ওঠে দাঁড়ায়। কোমরে গুজে রাখা লাল-সাদা রঙের শাড়ির আঁচলটা হাতে তুলে নেয়। তাহমিদ বসে থেকেই মেয়েটার কোমরের দিকে তাকিয়েছিল। শুধুমাত্র এক মুহূর্তের জন্য দেখেছিল মেয়েটার মেদহীন মসৃণ কোমর। প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সাথে সাথেই। কোমর দেখে প্রেমে পড়েছিল; এ কথা কেউ জানতে পারলে তাকে লুচ্চা বলে সম্মোধন করতো নিশ্চয়ই। এটা ভেবে নিজের মনেমনে বেশ লজ্জাও পেয়েছিল তাহমিদ। সেও সবার সাথে উঠে দাঁড়ায়। তখন আবার মেয়েটার মুখোমুখি হয়।
মেয়েটা সামনে এসে রাগী কণ্ঠে বলে, – ‘ আপনার কী কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই? এইরকম একটা দিনে আপনি শার্ট-প্যান্ট পরে এসেছেন কেন? এখন যদি আমরা গ্রুপ ফটো তুলে ফেসবুক আপলোড দেই, তাহলে লোকে কমেন্ট এ বলবে, একঝাঁক বাঙালি মানুষের সাথে একটা হিন্দি মাল! আপনিই বলুন, এইরকম মন্তব্য দেখলে কি আমাদের ভালো লাগবে?’

তাহমিদ কোনো কথাই বলতে পারছিল না সেসময়। নির্বাক হয়ে শুধু তাকিয়েছিল মেয়েটার দিকে। মেয়েটা নিজের নরম ঠোঁট দু’টো নাড়িয়ে মুচকি হাসি দিয়েছিল। বলেছিল, – ‘ বাই দ্যা ওয়ে, আপনার ঠোঁট দু’টো কিন্তু খুব সুন্দর।’

তাহমিদের খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘আপনার ঠোঁট দু’টোও খুব সুন্দর। কমলার মতো। দেখতেই কামড়ে দিতে ইচ্ছে করে!’ কথাটা ইচ্ছে পর্যন্তই থেমেছিল। মুখ দিয়ে আর বলার সাহস পায়নি। মেয়েরা চট করে ছেলেদের অনেক কিছু বলে ফেলে ফেলতে পারে। মাল, শালা, এইসব বলে গালাগালও দিতে পারে। কিন্তু ছেলেরা তা পারে না। মেয়েদের সাথে কথা বলার সময় ছেলেদের অনেক ভাবনাচিন্তা করতে হয়। শালী বললে আবার সম্পর্কের দিকে চলে যায় ব্যাপারটা। আর মাল বললে তো কাম সারছে! মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না।
মেয়েটা আবার বলেছিল, – ‘ আচ্ছা, আপনি কি সিগারেট খান?’
তাহমিদ মাথা ঝাঁকিয়ে ‘না’ বলেছিল। মেয়েটা আবার বলেছিল, – ‘ কেন খান না?’
– ‘ আপনি বললে এখন থেকে খাওয়া শুরু করব।’ অনেকক্ষণ পর নিঃশ্বাস আটকিয়ে কথা বলেছিল তাহমিদ। এটা বলার পর আবার চুপ হয়ে গিয়েছিল।
কথাটা শুনে মেয়েটা কিছুক্ষণ ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে ছিল। এরপর হুকুম করে বলেছিল, – ‘ খবরদার খাবেন না। সিগারেট খেলে এত সুন্দর ঠোঁট জোড়া কালো হয়ে যাবে। আপনার ফরসা মুখে কালো ঠোঁট বিচ্ছিড়ি দেখাবে। শ্যামলা চেয়ারার সাথে কালো ঠোঁট মানায়; ফরসা চেহারার সাথে লাল ঠোঁট মানায়। সিগারেট খেতে ইচ্ছে করলে খাবেন; তবে এমনভাবে খাবেন যেন ঠোঁট জোড়া কালো না হয়।’
তাহমিদ মাথা নেড়েছিল। মেয়েটা আবার বলেছিল, – ‘ আর শুনুন, ঠোঁট জোড়া সাবধানে রাখবেন। এত আকর্ষণীয় ঠোঁট জোড়া দেখে কোনো কোনো মেয়ে আবার লোভ সামলাতে না পেরে চুমু দিয়ে বসবে। তখন হবে আরেক ঝামেলা। সবার চুমুতে তো একরকম ভিটামিন থাকে না। এই যেমন আমার চুমুতে মিষ্টি একটা ভিটামিন আছে। অন্যদেরটায় হয়তো অন্যকিছু আছে। সব ভিটামিন আবার আপনি সহ্য করতে পারবেন না। তাই সাবধান; নিজেও না বুঝে কাউকে চুমু দিয়েন না, আর কাউকে দিতেও দিয়েন না।’
তাহমিদ মাথা নেড়েছিল শুধু। প্রথম কেউ তাঁর ঠোঁটের প্রসংশা করছে। তাঁর ঠোঁট নিয়ে এত চিন্তা করছে। স্কুল, কলেজ, কত মেয়ের সাথেই তো দেখা হয়েছিল, কথা হয়েছিল, কিন্তু কেউ তাঁর ঠোঁট নিতে এতটা চিন্তা করেনি, যতটা চিন্তা ওই মেয়েটা করেছিল। অত প্রসংশাও করেনি। তাহমিদ সেদিনই ঠিক করেছিল, যাই হয়ে যাক, ঠোঁটের অযত্ন সে করবে না।
তাহমিদ ভেবেছিল, মেয়েটা চলে যাবে সেসময়। কিন্তু যায়নি; সে উচ্চস্বরে হেসে উঠে বলেছিল, – ‘ আপনাকে এবারের মতো মাফ করলাম। পরেরবার সবার সাথে মিলিয়ে জামা পরে আসতে হবে। আসুন, ওরা ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করছে।’

তাহমিদ ছবি তুলেছিল। মেয়েটা তাঁর পাশেই দাঁড়িয়েছিল। সে ক্যামেরার দিকে না তাকিয়ে আড়চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিল। ক্যামেরাম্যান আড়চোখা তাহমিদকে না দেখে সেভাবেই ছবি তুলেছিল। পরে তাহমিদ সে-সব ছবি দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেছিল।

ছবি তোলা পর্ব শেষ হওয়ার পর মেয়েটা একগাল হেসে বসেছিল, – ‘দুঃখিত। আমি অনেক কিছু বলে ফেললাম। যা বলেছি, বন্ধু হিসেবে বলেছি। আপনাকে আমি চিনি। আপনি রনির বন্ধু। সপ্তাহে একদিন এখানে আসেন ওদের সাথে আড্ডা দিতে। আমি প্রায়ই দেখি আপনাকে। তাই জড়তা ছাড়াই অনেক কথা বলেছি। ভুল হলে মাফ করবেন।’

মেয়েটার ব্যবহারে তাহমিদের প্রেম আঠালো হয় আরও। সে মনেমনে ঠিক করেই নিয়েছিল, যেভাবেই হোক, মেয়েটার সাথে প্রেম করতেই হবে। ভিটামিন-এ,বি,সি,ডি, অনেক নামই শুনেছে তাহমিদ। কিন্তু মিষ্টি ভিটামিনের নাম সে জীবনেও শুনেনি। তাকে এই নতুন সৃষ্টি ভিটামিন গ্রহণ করতেই হবে। সেজন্য সে সপ্তাহে একদিনের জায়গায় দু’দিন করে ঢাকায় আসতে থাকে। পড়াশোনার গোল্লায় যাক! সবার জীবনেই প্রেম একবার অন্তত আসে। তাঁর জীবনেও এসেছিল। এত সহজে হাতছাড়া করা যায় নাকি? মেয়েটার সাথে আলাপ-পরিচয় বেশ জমে উঠে তাহমিদের। ওদিক থেকেও কিছুটা ইচ্ছুক ছিল বোধহয়। তাই ব্যাপারটা সহজ হয়েছিল আরও। সেই প্রথম দেখার দিন শুধুমাত্র মেয়েটার ‘মানহা’ নামটুকু জেনেছিল। এরপর আস্তে আস্তে আরও অনেক কিছুই জানতে পারে।

এরপর পেরিয়ে গেল মাঝের দীর্ঘ একটা সময়। এতগুলো দিন পর আজকের তাহমিদ সম্পূর্ণ অন্যরকম। জীবনটাই অগোছালো। তবে সে এখনো ঠোঁটের যত্ন নেয়৷ আঘাত পেয়ে যখন একাকীত্ব তাকে টানতো, তখন সে একজনের কথা ভেবেই নিজেকে এক জায়গায় স্থির রাখতো। কোনোরকম নেশাদ্রব্য স্পর্শ করেনি কখনো। মাঝে মাঝে শুধু শখের বসে সিগারেট খায়; পান করে।

২৫.
হঠাৎ কারোর ডুকরে কেঁদে উঠার শব্দে শোয়া থেকে বসে গেল আসমা। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। গরম লাগছিল বলেই ঘুম আসছিল না আসমার। সামনের জানালা খোলা। ওখান দিয়ে বাতাস আসছে বটে, তবে শরীরকে ঠাণ্ডা করতে পারছে না। অনেকক্ষণ পায়চারি করেও চোখে ঘুম আনতে পারেনি আসমা। সেজন্য চোখ মেলে শুয়েছিল।
কান্নার আওয়াজটা পাশের ঘর থেকেই আসছে। পাশের ঘরে তাহমিদ আছে। সে একাই আছে পাশের ঘরে। আসমার ডানপাশে আছে ফাতেমা। তাঁর পাশে তৃষ্ণা। রাইশা বাবা-মায়ের ঘরে আছে। আর তাহমিদ একাই আছে পাশের ঘরে। ঘরটাতে তাহমিদ ছাড়া দ্বিতীয় কেউ থাকলে আসমা খুব একটা পাত্তা দিতো না। তাহমিদ নিশ্চয়ই কাঁদবে না এত রাতে! আসমা চুপচাপ শুয়ে রইল। কিন্তু মনকে স্বস্তি দিতে পারল না। মন যে পাশের ঘরে যাওয়ার জন্য উসখুস করছে।
মোবাইলে চার্জ নেই। ভেবেছিল সকালে ওঠে চার্জ দিবে। ক’টা বাজে, তাও অনুমান করা যাচ্ছে না। আসমা আবার উঠে বসল। বিছানা থেকে নেমে অন্ধকার হাতড়ে টেবিলের কাছে গেল। বিছানায় শোয়ার আগে এখানেই মোমবাতি রেখেছিল সে৷ মোমবাতি খুঁজে বের করল। দেশলাই দিয়ে আগুন জ্বালালো আস্তে আস্তে। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠনো এলো। সে উঠোনে দাঁড়িয়েই দেখল, তাহমিদের ঘরের জানালা খোলা। সে-ও নিশ্চয়ই একটু ঠাণ্ডা হাওয়া চাচ্ছে। আসমা একবার ভাবল দরজা ধাক্কিয়ে তাকে হাত পাখা দিয়ে আসবে৷ ‘ এমনও হতে পারে তাহমিদ ঘুমোচ্ছে’ এটা ভেবে দরজা ধাক্কানোর সিদ্ধান্ত মাথা থেকে ত্যাগ করল। ঢিপঢিপ পায়ে এগিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালো। হাতের মোমবাতিটা একটু উঁচু করতেই দেখল তাহমিদকে। মেঝেতে হাটু মুড়িয়ে বসে আছে। দুই পায়ের মাঝে মাথা নিচু করে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। তাহমিদকে এইরকম অবস্থায় দেখে আতঙ্কে উঠল আসমা। জানালার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল। তাহমিদের কোনো ভ্রু-ক্ষে নেই কোনোদিকে। দুই হাটুর মাঝে মাথা ডুবিয়ে দিয়ে বসে আছে নিশ্চিন্তে।
মাঝে মাঝে শুধু কেঁপে উঠছে, আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আসমা চোখ দু’টো বড় করে তাকিয়ে আছে ঘরের ভিতরে। মোমবাতির আলো আরও একটু উপরে তুলতেই তাহমিদ নড়েচড়ে উঠল। মুখ তুলে তাকালো জ্বানালার দিকে। আসমা খানিকটা চমকালেও চলে গেল না। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হলো, এখন যেন ভোর! অথচ চাঁদ মাথার উপর মাত্র। নিশ্চিত এখন মাঝরাত।
আসমা সটান দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
– ‘ তাহমিদ, কী হয়েছে আপনার?’

তাহমিদ কোনো উত্তর দিলো না। অবাক চোখে শুধু তাকিয়ে রইল আসমার দিকে। যেন আসমাকে সে এই প্রথম দেখছে। আসমা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দরজার কাছে গেল। দরজায় কড়া নাড়ার আগে একবার ধাক্কা দিলো শুধু। অদ্ভুতভাবে দরজাটাই খুলে গেল। বিস্মিত চাহনিতে সামনের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেল। মোমবাতিটা পাশে রেখে তাহমিদের পাশে বসল নিজেও। কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, – ‘ আপনার কী হয়েছে? এইরকম করছেন কেন?’
– ‘ আপনি এখানে এসেছেন কেন?’ আগুন গরম চোখে তাকিয়ে আসমাকে ধমক দিলো তাহমিদ।
আসমা থতমত খেয়ে গেল। মনে পড়ল ফাতেমার কথাগুলো। তাহমিদ মাঝরাতে কারোর সাথে কথা বলে। ‘হ্যালুসিনেশন’ রোগে আক্রান্ত সে। এই সময় তাকে ডিস্টার্ব করা ঠিক হলো না। মনে মনে নিজেকে কয়েকবার গালাগাল দিলো আসমা। – ‘কিন্তু তাহমিদ কাঁদছে কেন? উনার চোখমুখ এখনো ভিজে আছে।’ এই প্রশ্নগুলো নিয়ে নিজের মনে ভাবতে লাগল আসতা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাবধান গলায় বলল, – ‘ একটা বিশেষ কারণে এসেছি।’
ভ্রু জোড়া কুঁচকালো তাহমিদ। আসমার পরের কথার অপেক্ষায় রইল। এই মুহূর্তে কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই তাঁর। তবে শোনার ইচ্ছে আছে। মাঝরাতে আসমা কী বিশেষ কারণে এসেছে, তা জানা প্রয়োজন। তাহমিদ একটু নড়েচড়ে বসল। হাত দিয়ে মুখটা মুছল। কপালের ঘাম মুছল। সে শোনার জন্য প্রস্তুত ; নড়েচড়ে এটাই আসমাকে বুঝালো।

আসমা একটু নীরব থাকার পর বলল, – ‘আমার বাবা-মা আমাকে জোর করে অন্য একটা ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এখন আমার কী করা উচিত?’
– ‘ পালিয়ে যাওয়া উচিত। এইরকম বাবা-মায়ের থেকে যত দূরে থাকবেন, ততই ভালো।’ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জবাব দিলো তাহমিদ।
ওর কথা শুনে আসমার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নিজেকে সামলে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল,
– ‘একটু ভাবুন। ভেবে বলুন। আমার দিকে তাকান।’
তাহমিদ তাকালো আসমার দিকে। চোখের গভীরে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ নীরবতার দু’জনের মধ্যে। হঠাৎ নীরবতা কাটিয়ে তাহমিদ বলে উঠল, – ‘ কখনো দেখেছেন নিজের পায়ে নির্ভরশীল কোনো মেয়েকে তাঁর বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিচ্ছে?’
– ‘ না।’ অবাক হয়ে উত্তর দিলো আসমা।
তাহমিদ আসমার দিকে তাকিয়ে থেকেই মৃদু হেসে আবার বলল, – ‘ কারণ তাঁরা জানেন, তাঁদের মেয়ে যে খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেট বেশ শক্ত। অর্থাৎ মেয়েটা চাইলেই তাঁদের ছাড়াও নিজের মতো থাকতে পারে। তাই বাবা-মা এই বোকামিটা করে না। তাঁরা জোর করে তাকেই বিয়ে দেয়, যে দূর্বল। যে অন্যের খুঁটির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজস্ব কোনো খুঁটি নেই। শুধু আপনার ক্ষেত্রে না, যে মেয়ে নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে শিখেছে, কোনো বাবা-মা-ই তাঁদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। এরজন্য প্রতিটি মেয়েরই উচিত সারাজীবন অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজে কিছু করা। যে খুটিটার উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেটা নিজের এবং মজবুত করা। তাহলেই কোনো বাবা-মা তার সাথে জোরজবরদস্তি করতে পারবে না। তাকে গুরুত্ব দিবে। যা-ই করবে, আগে মেয়েটার সাথে আলোচনা করে নিবে। কারণ বাবা-মা তখন বিশ্বাস করেন, তাঁদের মেয়ে বড় হয়েছে। জোড়াজুড়ি করলে মেয়েকে হারাতে হবে। ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না। আপনি শিক্ষিকা মানুষ। বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেও ঢাকা গিয়ে কিছু একটা করতে পারবেন। সুতরাং আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনাকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টার মতো বোকামি তাঁরা করবে না।।’

আসমা অবাক হলো খুব। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তাহমিদের দিকে। এইরকম কিছু তাঁর ভাবনাতেও আসেনি। তাহমিদ আবার বলল, – ‘ উত্তর পেয়ে গেছেন নিশ্চয়ই। এবার যান প্লিজ।’
আসমা গেল না। চুপচাপ বসে রইল সেখানেই। তাহমিদও আর তাকে পাত্তা দিলো না। দু’জনে মধ্যে আবার নীরবতা নেমে এলো। ঘরে ঘড়ি নেই। থাকলে হয়তো এই নিস্তব্ধতায় ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ শোনা জেতো।

দীর্ঘক্ষণ পর আসমা আবার বলল, – ‘ আপনি মানহাকে খুব ভালোবাসতেন, তাই না?’
তাহমিদ মাথা নাড়ালো শুধু। এমন ভাব ধরল, যেন সে ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। আসমা আবার জিজ্ঞেস করতো, – ‘ আপনি এটাও জানতেন মানহা সেদিনই মারা গেছিল, তাই না?’
আগের মতো নিশ্চুপ থেকে মাথা নাড়ালো তাহমিদ৷
আসমা আবার বলল, – ‘ মানহাদের পারিবারিক কবরস্থানেই মানহাকে কবর দেওয়া হয়েছিল। পরিচয়ের জায়গায় সিরিয়াল নম্বর লেখা ছিল। সেই সিরিয়াল নম্বরটি ছিল ‘009’। আমি কী ঠিক বলছি?’
আগের মনোভাব বজায় রেখে মাথা ঝাঁকালো তাহমিদ।
আসমা একটু ভেবে আবার বলল,
– ‘মানহার একটা অসুখ ছিল ছোট থেকেই। ও সেটার জন্য সারাক্ষণ মৃত্যুর ভয়ে থাকতো। ভাবতো, এই বুঝি ও মরে গেল। ওদের পারিবারিক কবরস্থানে আগেই ৮টা কবর ছিল। ওদের বংশের ৮জন মারা গিয়েছিল আগেই। ও ধরেই নিয়েছিল, ৯ নম্বর সিরিয়ালে ওর কবর থাকবে। সবার সিরিয়ালে ’01 বা 02’ থাকলেও মানহা সবসময় বলতো, ওর সিরিয়াল নম্বর হবে ‘009’। ওর ক্ষেত্রে একটা শূন্য বেশি কেন, সেটা কী আপনি জানেন?’
মাথা ঝাঁকিয়ে না বলল তাহমিদ।
আসমা বলল, – ‘ আমিও জানি না। কলেজে পড়ার সময়ে ও আমাকে সব বললেও এটা বলেনি। ও সবসময় আমাকে বলতো, খুব শীঘ্রই ও মারা যাবে। কবরস্থানে ওর সিরিয়াল নম্বর হবে ‘009’। আমার বিশ্বাস, এই একই কথা ও আপনাকে হাজারবার বলেছে। শেষবার ও আপনার সাথে ঝগড়া করে গ্রামে আসছিল। সেদিনই মারা যায় ও। কিন্তু ও তো অসুখের জন্য মারা যায়নি। ওর মৃত্যুর কারণ ছিল অন্যটা।’

তাহমিদের পুরো শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে উঠল হঠাৎ। কাঁপতে কাঁপতে গাড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।
আসমা উৎকণ্ঠায় চেঁচিয়ে উঠল। বাড়ির সবাই জেগে গেল আসমার একটা চিৎকারের আওয়াজে। সবাই দৌড়ে তাহমিদের ঘরে এলো। তাহমিদকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। তৃষ্ণা ‘ভাইয়া’ বলে দৌড়ে তাহমিদের কাছে। ফাতেমাও দৌড়ে এসে বসে পড়ল তাহমিদের পাশে।

Protected: ডায়েরির পাতা থেকে

0

This content is password protected. To view it please enter your password below:

Protected: কন্যাসন্তান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অর্জন

0

This content is password protected. To view it please enter your password below: