Wednesday, August 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1994



Protected: মিঃ টুইস্ট

0

This content is password protected. To view it please enter your password below:

Protected: ‘তুমি আসবে বলে’ Word count: 7138

0

This content is password protected. To view it please enter your password below:

Protected: আলোর সন্ধানে

0

This content is password protected. To view it please enter your password below:

সম্পৃক্ততা পর্ব ৯

0

সম্পৃক্ততা – নবম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

২২.
তানিশা বিকেলে যখন ছাদের গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিল, তখন তাঁর বাবা-মায়ের একসাথে আগমন ঘটল। দু’জনকে একসাথে দেখেই হকচকিয়ে উঠল তানিশা। অতটাও চমকে উঠত না, যদি সে সকালে নিজের পছন্দের মানুষের কথা মায়ের কাছে না বলতো। এখন মায়ের সাথে বাবা এসেছে মানে, মা সব জানিয়ে দিয়েছে তাকে। তানিশা বুঝতে পারছে, শীঘ্রই তাকে বিরাট অস্বস্তিতে পড়তে হবে।
পানি দেওয়া থামিয়ে কৌতূহলী কণ্ঠে বলল, – ‘ কিছু হয়েছে?’
তানিশার মা মেয়েকে কী যেন ইশারা করলেন। মুখে বললেন, – ‘ তাহমিদের কথাটা তোর বাবাকে বলেছি দুপুরে। তুই তখন ঘুমোচ্ছিলি বলে আর ডাকাডাকি করিনি। ঘুম থেকে উঠেই তো ছাদে চলে এলি। তাই আমরা এখন ছাদে চলে এলাম।’
বাবার দিকে তাকাতে পারল না তানিশা। মায়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিম্নস্বরে বলল, – ‘ মা, এই বিষয়ে পরে কথা বলব।’

পাশ থেকে ধমকে সুরে তানিশার বাবা বললেন, – ‘ পরে কেন?’
তিনি এখনো পুরোপুরি ভাবে বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না। তাঁর মেয়ের জামাই কিনা সামান্য ১০ হাজার টাকার চাকরি করে! একজন সাধারণ রিপোর্টার। এটা কী সহজে মানা যায়? এছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে; ছেলেটা পুরোপুরি অন্যরকম। দেখা গেল বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি থেকে তাকে কিছু দেওয়া হলো; বা একটা ভালো বেতনের চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো; সে তা নেবে না। বলবে, ‘অত টাকার চাকরি করে কী করব আমি? যার টাকা আছে, টেনশন তাঁর আছে। আমি ঝামেলাহীন মানুষ; আগেপিছে কোনো টেনশন নেই। অযথা বড় চাকরিবাকরি করে টাকার ভার নিবো কেন?’ এখানেই খ্যান্ত থাকবে না; আরও বলবে, ‘ টাকা তো আর কবরে নিয়ে যেতে পারব না। আমি মরে গেলে সেগুলো খাবে অন্যমানুষে। সারাজীবন টাকার ভার বয়ে শেষ সময়ে সেগুলো অন্যকে কেন খেতে দিবো? এর থেকে যেভাবে আছি, সেভাবেই ভালো। টাকা নাই, ঝামেলা নাই।’ আজব কথা! ওইরকম মানসিকতা যদি সবার থাকতো, তাহলে পৃথিবীতে বড়লোক শব্দটার উৎপত্তি হতো না। তাহমিদের এই কথাগুলো শুনে মানুষ হিসেবে তানিশার বাবা মজা পেলেও, মেয়ের জামাইয়ের কাছ থেকে এইরকম কথাবার্তা তিনি আশা করেন না। কারণ ছেলেটার সাথে সেসময় তাঁর মেয়ে জড়িয়ে থাকবে।

তানিশা বলল, – ‘এখনই-বা কেন?’
– ‘ কারণ ব্যাপারটা যত দ্রুত সংশোধন করা যায়, ততই ভালো।’
– সংশোধন মানে?’ ভ্রু জোড়া উঁচু হয়ে গেল তানিশার।
তাঁর বাবা বললেন, – ‘ না মানে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া আরকি। তুই কি আসলেই তাহমিদকে বিয়ে করতে চাস?’
তানিশা একনজর মায়ের দিকে তাকিয়ে জবাবে বলল, – ‘ হ্যাঁ। কেন, তোমার মত নেই?’
– ‘ না মানে, একটু ভেবে দেখ। তোর উপর আমরা কখনো জোর খাটাইনি। কখনো খাটাবো-ও না।’ ইতস্ততবোধ করলেন তানিশার বাবা।
– ‘ জোর খাটানোর অধিকার তোমাদের আছে বাবা। তোমরা চাইলেই আমার ইচ্ছেকে অগ্রাহ্য করতে পারো। কিন্তু সেটার জন্য একটা যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে। তোমার যদি মনে হয় তাহমিদের সাথে আমার বিয়ে না হলে ভালো হবে, তাহলে এমন একটা কারণ দেখাও, যার জন্য আমি তোমাদের চাওয়াকে সম্মান করতে পারব।’ তানিশার কণ্ঠে দৃঢ়তা প্রকাশ পেলো স্পষ্ট।
তানিশার বাবা এবার আরও বিব্রত হলেন। তাড়াহুড়ো করে তাহমিদ সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু ভাবতে লাগলেন। কিন্তু সেরকম শক্তপোক্ত কোনো নেগেটিভ কিছু বের করতে পারলেন না। মাথা চুলকিয়ে বললেন, – ‘ না মানে, ছেলেটা তো সেভাবে কিছু করতে পারেনি জীবনে?’
– ‘ পারেনি তো কী হয়েছে শুনি? ও কী বুড়ো হয়ে গেছে? সুযোগ পেলে অবশ্যই কিছু একটা করবে। তাছাড়া ব্যাংকে আমার একাউন্টে তো বেশ মোটা অংকের টাকা আছে। আমি অত বিলাশীতা করি না যে, এক মাসে সব শেষ করে ফেলবো। ওই টাকা এবং এখন যা রোজগার করছি, তা দিয়ে আমাদের এক জীবন পার হয়ে যাবে।’
– ‘ জীবনে টাকার প্রয়োজন যে কতটা, সেটা বুঝতে আরও কিছুটা সময় লাগবে তোর। যাই হোক, ছেলেটা খুব ভালো, তা আমি জানি। যদিও একটু সমস্যা আছে। তবুও তোর কথা ভেবে আমি দ্বিমত করছি না।’
বাবার কথা শুনে উত্তেজনায় বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করল তানিশা। মা’কেও সালাম করল। ‘ইয়াহু’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল।
মেয়ের কাণ্ড দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলেন আফসানা বেগম এবং তানিশার বাবা। তানিশা কিছুক্ষণ পর আবার বলল, – ‘ যাক, অনুমতি তাহলে পেয়ে গেছি।’
– ‘আগেই লাফিও না। আগে ওদের সাথে কথা বলে নেই। আচ্ছা, তাহমিদ কী নিজেই তোকে বিয়ের কথা বলেছে?’ মেয়ের খুশি দেখে হঠাৎ আফসানা বেগম প্রশ্নটা করে বসলেন।
তানিশা ম্লান মুখে বলল, – ‘ আসলে মা, তাহমিদ জানেই না আমি বিয়েসাদী নিয়ে তোমাদের সাথে আলোচনা করছি।’
– ‘ কিহ্! মানে তুই একাই লাফাচ্ছিস; আর ওদিকে বর জানেই না তাঁর বিয়ে নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেছে।’
তানিশা হাসল। হেসে বলল,
– ‘ আসলে ও এইসব নিয়ে আলোচনা করতে চায় না। ও এখন বরিশাল আছে। ওর ভাবীর বোনের বিয়েতে। ফিরে এলে নাহয় ভাবীর সাথে তোমরা কথা বলো। আপাতত আমাকে যেতে দাও প্লিজ।’
তানিশার বাবার মুখটা ‘হা’ হয়ে গেলেন। নিজের মনেমনে বললেন, – ‘ হায় আল্লাহ! ও তাহলে বিয়ের কথা জানেই না। বিয়ের কথা শুনলে আবার না জানি কোন যুক্তি সামনে হাজির করে দেয়। হয়তো বলবে, জগতের সবাই যদি একটা সময় বিবাহিত হয়ে যায়, তাহলে চিরকুমার থাকবে কে? কাউকে না কাউকে তো এর দায়িত্ব নিতে হবে। নাহলে শব্দটাই অচল হয়ে যাবে।’ কথাটা বলে নিজেই নিঃশব্দে হেসে উঠলেন তানিশার বাবা। তিনি অনেক আগে থেকেই তাহমিদকে খুব পছন্দ করেন। এটাও বলেছিলেন, তাহমিদকে একটা বড় পোস্ট-এ চাকরি দিবেন। কিন্তু তাহমিদ রাজি হয়নি। ‘বড় পোস্টের চাকরি মানে বড় বড় কাজ। এটা খুব কষ্টকর!’ ; এইরকম একটা যুক্তি দেখিয়ে এড়িয়ে গেছিল। তখন তানিশার বাবা হেসেছিলেন খুব। কিন্তু এখন তিনি চিন্তিত। এইরকম ছেলের হাতে মেয়েকে দেওয়াটা খুব রিস্কি হয়ে যাবে। সেজন্য তানিশার বাবা একটু বিভ্রান্তিতে আছেন।

– ‘ হ্যাঁ-রে, তাহমিদের বড় ভাই যেন কী করে?’ আফসানা বেগম প্রশ্ন করলেন হঠাৎ।
তানিশা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল; মায়ের প্রশ্ন শুনে থেমে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, – ‘ চাকরি করে। উনি এখনো ঢাকাতেই আছে। অফিস থেকে ছুটি পায়নি। সকালেই তো আমার সাথে দেখা হলো।’
– ‘ তাই নাকি? কোথায় দেখা হয়েছিল?’
– ‘ বাড়ির সামনেই। আমি হঠাৎ করেই তাকে দেখেছি।’
– ‘ বাড়িতে নিয়ে এলি না কেন? তাহলে সকালেই আলাপকাল হয়ে যেতো।’
– ‘ আসলে মা, তুহিন ভাই তখন ওইরকম অবস্থায় ছিল না। সিএনজির সাথে ধাক্কা লেগে মাথা ফেটে গেছিল।’
তানিশার বাবা ফট করে বলে উঠলেন, – ‘ চোখে কম দেখে নাকি?’
আফসানা বেগম বললেন, – ‘ ওমা, এ আবার কেমন কথা? রাস্তাঘাটে চলার সময় একটু-আধটু এক্সিডেন্ট হয়-ই। সবাই তো আর তোমাদের মতো প্রাইভেট গাড়ি দিয়ে যাতায়াত করে না, যে রাস্তায় পা পড়বে না।’ আফসানা বেগমের কণ্ঠে প্রতিবাদীপক্ষ প্রকাশ পেলো। এতে আপ্লুত হলো তানিশা।
গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, – ‘ একদম ঠিক। বাবা, তুমি চুপ করো। আসলে তুহিন ভাই একটু অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলেন। তাকে দেখে তো আমি ঘাবড়ে গেছিলাম। দু’জন লোক ধরেছিল রেখেছিল তাকে। আরও একটা বিষয় খটকা লাগল আমার কাছে; ওই সময়টাতে তুহিন ভাইয় অফিসে থাকার কথা। অথচ তিনি উদভ্রান্তের মতো হাঁটছিলেন রাস্তা দিয়ে। তাঁর অফিস তো অনেকটা দূরে। সেই ঢাকায়। অথচ এলাকায়, মানে এই সাভারে হাঁটছিলেন। তাকে দেখেও কেমন যেন বিমর্ষ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, নিষ্প্রাণ একটা মানুষ। আমি তাকে নিয়ে ফার্মেসীতে গেলাম। ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে দিলো, মেডিসিন দিলো, অথচ সে একটা কথাও বলল না। এমনকি আমার সাথেও না। কিছু একটা বলা উচিত ছিল তাঁর।’
মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে তানিশার বাবা আবার বলে উঠলেন, – ‘ চাকরিটাকরি খেয়ে ফেলেছে বোধহয়। আজকাল তো এইসব অহরহ হচ্ছে; চাকরি হারিয়ে লোকজন মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ছে। উদাসীন হয়ে রাস্তাঘাটে হাঁটাচলা করে। ফলে এক্সিডেন্ট হয়।’
– ‘ বাবা, মানুষের সম্পর্কে নেগেটিভ মন্তব্য করাটা তোমার অভ্যাস হয়ে গেছে দেখছি।’ কথাটা বলে ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল তানিশা।
বাবার কথা শুনে আগ্নেয়গিরির মতো উত্তপ্ত হয়ে গেছে সে।
মেয়ের রাগ দেখে আফসানা বেগম স্বামীকে বললেন, – ‘ আহ্, তুমি যাও তো এখান থেকে। যেজন্য এসেছিলে, সেটা তো শেষ হয়ে গেছে, এবার যাও।’

তানিশার বাবা গেলেন না। এক চুল পরিমাণ জায়গাও পরিবর্তন করলেন না। সটান দাঁড়িয়ে থেকে একটু কেঁশে আবার বললেন, – ‘ ঠিক আছে। ভাইয়ের প্রসঙ্গ বাদ। আচ্ছা, তাহমিদ কী নেশাটেশা করে?’

– ‘না।’ মুখটা কঠিন করে জবাব দিলো তানিশা।
তাঁর বাবা আবার বললেন, – ‘ সিগারেট খায় নিশ্চয়ই।’
– ‘ না। সেটাও খায় না।’
– ‘ মিথ্যা কথা; আমি দেখেছি একদিন।’
কপাল কুঁচকালো তানিশা। তবে উত্তর দিলো না। তাঁর বাবা আবার বললেন, – ‘ বিয়েটা তো মেনে নিলামই। তাহলে আর মিথ্যাচার করছিস কেন? মিথ্যার আশ্রয় তো অন্যপক্ষ নেবে। তুই আমাদের পক্ষের মেয়ে হয়ে যদি ওদের হয়ে মিথ্যে বলিস, তাহলে তো আমাদের সাথে অন্যায় করা হবে।’
– ‘ যা সত্যি তাই বললাম বাবা। ও সিগারেট খায় না।’
– ‘ এটা তুই জানিস। কিন্তু আমি ভিন্ন কিছু জানি। তাহমিদ ভালো ছেলে, যার একটা প্রমাণ হলো, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ও মিথ্যে বলে না। যেমন আমি একদিন হঠাৎ জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাহমিদ, ‘তুমি কি ধুমপান করো?’ ও কিছুক্ষণ ইতস্ততবোধ করে আমাকে সত্যি বলেছিল, ‘ ধুমপান করি, তবে নিয়ম মেনে।’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ সেটা কীভাবে? মানে মানুষ নিয়ম মেনে আবার ধুমপান করে কীভাবে? আমি যতদূর দেখেছি, এটা খুব বাজে নেশা। একবার যাকে ধরে, নাজেহাল করে ছাড়ে। দিনে তাঁর বেশ কয়েকটা লাগবেই।’ ও বলেছিল, ‘ আমার ধুমপান করার নিয়মটা ব্যতিক্রম।’ আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। ও তাড়া দেখিয়ে চলে গেছিল।’
তানিশা ছোট করে ‘ওহ্’ বলল শুধু। তাঁর বাবা আবার জিজ্ঞেস করলেন,
– ‘তুই কী জানিস, ও এইরকম নিয়ম কেন করেছে?’
– ‘ হ্যাঁ। ঠোঁট কালো হয়ে যাওয়ার ভয়ে ও নিয়মিত সিগারেট খায় না। সপ্তাহে একটা৷ অথবা মাসে একটা।’
– ‘ একেবারে ছেড়ে দিলেই তো পারে।’
– ‘ ও চেয়েছিল সিগারেট খোর হতে। কিন্তু একসময় দেখা গেল, ওর মুখটা ফরসা হয়ে গেল। এখন তুমিই বলো, ফরসা মুখে কী কালো ঠোঁট মানায়? তাই ও সেভাবে ধুমপান করে না। একসাথে দুইদিন ব্যালেন্স করে চলে।’
– ‘ এতকিছু জানিস, অথচ আমাকে মিথ্যা বললি।’
– ‘ তো কী করব বলো? যখন আমাদের বিয়ে হবে, তখন তো ও সম্পর্কে তোমার মেয়ের জামাই হবে। আমি ওর স্ত্রী হয়ে কীভাবে তোমার সামনে ওর ইজ্জতভ্রষ্ট করি?’
আফসানা বেগম মুখ চেপে হাসলেন। তানিশার বাবা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
– ‘ শুধু কী সিগারেট খায়, না আরও কিছু ইরেগুলার অভ্যাস আছ?’
– ‘ ও কী আরও কিছু বলেছিল তোমায়?’
– ‘না।’
– ‘ তাহলে ধরে নাও আর কোনো খারাপ অভ্যাস ওর নেই। থাকলে সততার খাতিরে সেটাও বলতো। ও নিজের সুরক্ষার জন্যই উল্টো পাল্টা কিছু খায় না। অগোছালো হলেও নিজের শরীরের যত্ন নেয়।’
– ‘ হুহ্, পাগলের আবার রূপচর্চা।’ তানিশার বাবা হাস্যকর গলায় কথাটা বললেন।

তানিশা রেগেমেগে এবার ফেটে পড়ল। চেঁচিয়ে বলল, – ‘ তুমি আসলেই খুব খারাপ একটা লোক। আমার সাথে আর কথা বলবে না তুমি। বিয়ের পরে আর তোমার বাড়িতেও আসবো না।’
তানিশার বাবা হেসে উঠলেন উচ্চস্বরে। হাসতে হাসতে বললেন, – ‘ শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ছাগলের চুল আঁচড়াবে, তাই তো? ঠিক আছে। আমার পক্ষ থেকে শুভ কামনা রইল।’

তানিশা আর দাঁড়াল না ছাদে। পানির বালতি রেখেই হনহনিয়ে চলে গেল। আফসানা বেগম রাগী কণ্ঠে বললেন,
– ‘ তুমিও না! অযথাই মেয়েটাকে রাগিয়ে দিলে। ধুর!’ কথাটা বলে আফসানা বেগম নিজেও তাড়াহুড়ো করে ছাদ ত্যাগ করলেন।

২৩.
নুপুর, সজলকে আশ্বস্ত করে বলল, – ‘ অযথাই চিন্তা করছ তুমি। আমি বললাম তো, বাবা আর তোমাকে বিয়ের কথা বলবে না। এখন যদি তুমি চলে যাও, তাহলে বাবা-মা কষ্ট পাবে। ভাববে, তাঁদের কথায় কষ্ট পেয়ে তুমি অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছ।’
– ‘ আমি তোমার বাবা-মায়ের কথায় কষ্ট পেয়ে এখান থেকে যাচ্ছি না নুপুর। উনারা তখন জানতো না বিষয়টা, তাই তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমাকে বলেছে। বাট এখন তো সবাই জানে আমার সাথে অন্য একটা মেয়ের সম্পর্ক আছে। এটা তুমি তাঁদের বুঝিয়েছ। এর জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এখন আমি চাকরি করছি। তাই আমার মনে হয়, আমাকে একটা বাসা নিয়ে থাকতে হবে। দেখো, আসমাকে যে আমার পরিবার মানবে না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাই আমি চাচ্ছি, আমি একটা বাসা ভাড়া নিবো। যাতে আসমাকে বিয়ে করে আমরা সেখানে থাকতে পারি।’
– ‘ এখানে থাকতে অসুবিধে কী? আমাদের এতবড় বাড়ি। মানুষ মোটে তিনজন।’

সজল আবার কিছু বলার আগেই আফজাল হোসেন ঘরের ভিতরে এলেন। সজলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, – ‘ কী ব্যাপার সজল, শুনলাম তুমি নাকি অন্য জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে চাচ্ছো?’
মামাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল সজল। আমতাআমতা করে জবাবে বলল,
– ‘ আসলে মামা, ওখান থেকে আবার অফিসটা খুব কাছে। রোজ এত দূর থেকে যাতায়াত করতে কষ্ট হচ্ছে।’
– ‘ বাসা কী খুঁজে পেয়েছ?’
– ‘না।’ আস্তে করে জবাব দিলো সজল।
মামাতো বোনকে যতটা সহজে বিয়ের কথা বলতে পেরেছিল, মামাকে তা পারেনি৷ সেদিন সকালের ঘটনাটা জন্য নুপুরও অপ্রস্তুত ছিল। নুপুর যে সজলকে পছন্দ করে, সেটা তাঁরা জানতো। তাই হঠাৎ করেই বিয়ের কথা বলেছিল। পরে নুপুর তাঁদের বুঝিয়েছে। জোর করে বিয়ে দেওয়া যেতো হয়তো, কিন্তু পরিনতি ভালো হতো না। আফজাল হোসেনের অভিজ্ঞ চিন্তাধারা সহজেই বুঝে গেছে ব্যাপারটা। তাছাড়া যেখানে তাঁর মেয়ে নিজেই ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিয়েছে, সেখানে তাঁর মাথা ঘামানো ঠিক না।

আফজাল হোসেন কড়া গলায় বললেন, – ‘ তাহলে আগে থেকে কীভাবে বলছ, অফিসের কাছাকাছি কোথাও বাসা পেয়ে যাবে তুমি?’
সজল বিব্রত হলো।
আফজাল হোসেন আবার বললেন,
– ‘ ঢাকা শহরে ব্যাচেলর বাসা পাওয়া অনেক ঝামেলার ব্যাপার। দেখো, তুমি কেন এখান থেকে চলে যেতে চাচ্ছো, তা আমি জানি। আসলে ভুলটা আমাদেরই হয়েছিল। শুধু নুপুরের ইচ্ছেতে তো সব হবে না, তোমার মতামতও নেওয়া প্রয়োজন। আমি না বুঝেই তখন বিয়ের আলোচনা করেছিলাম।’
– ‘ মামা, এগুলো আগের কথা। এখন এগুলো বলে দয়া করে আমাকে লজ্জা দেবেন না।’ কথাটা বলে মাথা নিচু করে ফেলল সজল।
আফজাল হোসেন বললেন,
– ‘শোনো সজল, তুমি এখানেই থাকো। আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলব। তুমি যাকে পছন্দ করো, তাঁর সাথেই তোমার বিয়ে হবে।’
– ‘ বাবা আমাদের সম্পর্ক মানবে না মামা। আপনাকে তো আমি বলেছি।’
– ‘ সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও। এখন মন দিয়ে চাকরিটা করো। ওদিকটা আমি দেখছি।’ কথাটা বলেই হাঁটা দিলেন আফজাল হোসেন।
নুপুর যাওয়ার আগে বলল,
– তোমার আর ওর মধ্যে আমি আসবো না। অতটাও খারাপ আমি নই। এইটুকু বিশ্বাস করো প্লিজ।’

নুপুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দরজার বাইরে আসতেই তাঁর চোখ থেকে কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।

২৪.
– ‘ আচ্ছা রাইশা, মানহার কথা মনে আছে তোর?’
– ‘ কোন মানহা? পেয়ারা আপার কথা বলছ?’ কোনো ভাবনা ছাড়াই বলে দিলো রাইশা।
– ‘হ্যাঁ।’ সম্মতি জানালো আসমা।

মানহা পাশের গ্রামের মেয়ে। নদীর ওপাড়ে ওদের গ্রাম। আসমা আর মানহা একই কলেজে পড়তো। মানহা নদী পাড় হয়ে এই গ্রামে আসতো; তারপর কলেজে যেতো। আসমার সাথে হঠাৎ পরিচয় হয়েছিল একদিন। মানহা পেয়ারা খেতে পছন্দ করতো, তাই প্রায়ই আসমাদের বাড়িতে আসতো পেয়ারা খেতে। রাইশার সাথেও এভাবেই পরিচয়। রাইশা তাকে পেয়ারা আপা বলে ডাকতো। এতদিন পর আজ হঠাৎ মানহাকে নিয়ে ছোট বোনের কাছে জিজ্ঞেস করছে কেন, তা আসমা নিজেও জানে না। হঠাৎ করেই তাঁর মনে হলো, মানহার একটু খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন।
আসমা আবার জিজ্ঞেস করতে যাবে, তখনই দেখল দরজার বাইরে তাহমিদ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে ক্ষিপ্ততা। তাহমিদকে হঠাৎ দেখেই আতঙ্কে উঠল আসমা। তাহমিদ পা বাড়িয়ে ভিতরে এলো। চুপচাপ গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ।

সম্পৃক্ততা পর্ব ৯

0

সম্পৃক্ততা – নবম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

২২.
তানিশা বিকেলে যখন ছাদের গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিল, তখন তাঁর বাবা-মায়ের একসাথে আগমন ঘটল। দু’জনকে একসাথে দেখেই হকচকিয়ে উঠল তানিশা। অতটাও চমকে উঠত না, যদি সে সকালে নিজের পছন্দের মানুষের কথা মায়ের কাছে না বলতো। এখন মায়ের সাথে বাবা এসেছে মানে, মা সব জানিয়ে দিয়েছে তাকে। তানিশা বুঝতে পারছে, শীঘ্রই তাকে বিরাট অস্বস্তিতে পড়তে হবে।
পানি দেওয়া থামিয়ে কৌতূহলী কণ্ঠে বলল, – ‘ কিছু হয়েছে?’
তানিশার মা মেয়েকে কী যেন ইশারা করলেন। মুখে বললেন, – ‘ তাহমিদের কথাটা তোর বাবাকে বলেছি দুপুরে। তুই তখন ঘুমোচ্ছিলি বলে আর ডাকাডাকি করিনি। ঘুম থেকে উঠেই তো ছাদে চলে এলি। তাই আমরা এখন ছাদে চলে এলাম।’
বাবার দিকে তাকাতে পারল না তানিশা। মায়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিম্নস্বরে বলল, – ‘ মা, এই বিষয়ে পরে কথা বলব।’

পাশ থেকে ধমকে সুরে তানিশার বাবা বললেন, – ‘ পরে কেন?’
তিনি এখনো পুরোপুরি ভাবে বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না। তাঁর মেয়ের জামাই কিনা সামান্য ১০ হাজার টাকার চাকরি করে! একজন সাধারণ রিপোর্টার। এটা কী সহজে মানা যায়? এছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে; ছেলেটা পুরোপুরি অন্যরকম। দেখা গেল বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি থেকে তাকে কিছু দেওয়া হলো; বা একটা ভালো বেতনের চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো; সে তা নেবে না। বলবে, ‘অত টাকার চাকরি করে কী করব আমি? যার টাকা আছে, টেনশন তাঁর আছে। আমি ঝামেলাহীন মানুষ; আগেপিছে কোনো টেনশন নেই। অযথা বড় চাকরিবাকরি করে টাকার ভার নিবো কেন?’ এখানেই খ্যান্ত থাকবে না; আরও বলবে, ‘ টাকা তো আর কবরে নিয়ে যেতে পারব না। আমি মরে গেলে সেগুলো খাবে অন্যমানুষে। সারাজীবন টাকার ভার বয়ে শেষ সময়ে সেগুলো অন্যকে কেন খেতে দিবো? এর থেকে যেভাবে আছি, সেভাবেই ভালো। টাকা নাই, ঝামেলা নাই।’ আজব কথা! ওইরকম মানসিকতা যদি সবার থাকতো, তাহলে পৃথিবীতে বড়লোক শব্দটার উৎপত্তি হতো না। তাহমিদের এই কথাগুলো শুনে মানুষ হিসেবে তানিশার বাবা মজা পেলেও, মেয়ের জামাইয়ের কাছ থেকে এইরকম কথাবার্তা তিনি আশা করেন না। কারণ ছেলেটার সাথে সেসময় তাঁর মেয়ে জড়িয়ে থাকবে।

তানিশা বলল, – ‘এখনই-বা কেন?’
– ‘ কারণ ব্যাপারটা যত দ্রুত সংশোধন করা যায়, ততই ভালো।’
– সংশোধন মানে?’ ভ্রু জোড়া উঁচু হয়ে গেল তানিশার।
তাঁর বাবা বললেন, – ‘ না মানে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া আরকি। তুই কি আসলেই তাহমিদকে বিয়ে করতে চাস?’
তানিশা একনজর মায়ের দিকে তাকিয়ে জবাবে বলল, – ‘ হ্যাঁ। কেন, তোমার মত নেই?’
– ‘ না মানে, একটু ভেবে দেখ। তোর উপর আমরা কখনো জোর খাটাইনি। কখনো খাটাবো-ও না।’ ইতস্ততবোধ করলেন তানিশার বাবা।
– ‘ জোর খাটানোর অধিকার তোমাদের আছে বাবা। তোমরা চাইলেই আমার ইচ্ছেকে অগ্রাহ্য করতে পারো। কিন্তু সেটার জন্য একটা যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে। তোমার যদি মনে হয় তাহমিদের সাথে আমার বিয়ে না হলে ভালো হবে, তাহলে এমন একটা কারণ দেখাও, যার জন্য আমি তোমাদের চাওয়াকে সম্মান করতে পারব।’ তানিশার কণ্ঠে দৃঢ়তা প্রকাশ পেলো স্পষ্ট।
তানিশার বাবা এবার আরও বিব্রত হলেন। তাড়াহুড়ো করে তাহমিদ সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু ভাবতে লাগলেন। কিন্তু সেরকম শক্তপোক্ত কোনো নেগেটিভ কিছু বের করতে পারলেন না। মাথা চুলকিয়ে বললেন, – ‘ না মানে, ছেলেটা তো সেভাবে কিছু করতে পারেনি জীবনে?’
– ‘ পারেনি তো কী হয়েছে শুনি? ও কী বুড়ো হয়ে গেছে? সুযোগ পেলে অবশ্যই কিছু একটা করবে। তাছাড়া ব্যাংকে আমার একাউন্টে তো বেশ মোটা অংকের টাকা আছে। আমি অত বিলাশীতা করি না যে, এক মাসে সব শেষ করে ফেলবো। ওই টাকা এবং এখন যা রোজগার করছি, তা দিয়ে আমাদের এক জীবন পার হয়ে যাবে।’
– ‘ জীবনে টাকার প্রয়োজন যে কতটা, সেটা বুঝতে আরও কিছুটা সময় লাগবে তোর। যাই হোক, ছেলেটা খুব ভালো, তা আমি জানি। যদিও একটু সমস্যা আছে। তবুও তোর কথা ভেবে আমি দ্বিমত করছি না।’
বাবার কথা শুনে উত্তেজনায় বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করল তানিশা। মা’কেও সালাম করল। ‘ইয়াহু’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল।
মেয়ের কাণ্ড দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলেন আফসানা বেগম এবং তানিশার বাবা। তানিশা কিছুক্ষণ পর আবার বলল, – ‘ যাক, অনুমতি তাহলে পেয়ে গেছি।’
– ‘আগেই লাফিও না। আগে ওদের সাথে কথা বলে নেই। আচ্ছা, তাহমিদ কী নিজেই তোকে বিয়ের কথা বলেছে?’ মেয়ের খুশি দেখে হঠাৎ আফসানা বেগম প্রশ্নটা করে বসলেন।
তানিশা ম্লান মুখে বলল, – ‘ আসলে মা, তাহমিদ জানেই না আমি বিয়েসাদী নিয়ে তোমাদের সাথে আলোচনা করছি।’
– ‘ কিহ্! মানে তুই একাই লাফাচ্ছিস; আর ওদিকে বর জানেই না তাঁর বিয়ে নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেছে।’
তানিশা হাসল। হেসে বলল,
– ‘ আসলে ও এইসব নিয়ে আলোচনা করতে চায় না। ও এখন বরিশাল আছে। ওর ভাবীর বোনের বিয়েতে। ফিরে এলে নাহয় ভাবীর সাথে তোমরা কথা বলো। আপাতত আমাকে যেতে দাও প্লিজ।’
তানিশার বাবার মুখটা ‘হা’ হয়ে গেলেন। নিজের মনেমনে বললেন, – ‘ হায় আল্লাহ! ও তাহলে বিয়ের কথা জানেই না। বিয়ের কথা শুনলে আবার না জানি কোন যুক্তি সামনে হাজির করে দেয়। হয়তো বলবে, জগতের সবাই যদি একটা সময় বিবাহিত হয়ে যায়, তাহলে চিরকুমার থাকবে কে? কাউকে না কাউকে তো এর দায়িত্ব নিতে হবে। নাহলে শব্দটাই অচল হয়ে যাবে।’ কথাটা বলে নিজেই নিঃশব্দে হেসে উঠলেন তানিশার বাবা। তিনি অনেক আগে থেকেই তাহমিদকে খুব পছন্দ করেন। এটাও বলেছিলেন, তাহমিদকে একটা বড় পোস্ট-এ চাকরি দিবেন। কিন্তু তাহমিদ রাজি হয়নি। ‘বড় পোস্টের চাকরি মানে বড় বড় কাজ। এটা খুব কষ্টকর!’ ; এইরকম একটা যুক্তি দেখিয়ে এড়িয়ে গেছিল। তখন তানিশার বাবা হেসেছিলেন খুব। কিন্তু এখন তিনি চিন্তিত। এইরকম ছেলের হাতে মেয়েকে দেওয়াটা খুব রিস্কি হয়ে যাবে। সেজন্য তানিশার বাবা একটু বিভ্রান্তিতে আছেন।

– ‘ হ্যাঁ-রে, তাহমিদের বড় ভাই যেন কী করে?’ আফসানা বেগম প্রশ্ন করলেন হঠাৎ।
তানিশা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল; মায়ের প্রশ্ন শুনে থেমে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, – ‘ চাকরি করে। উনি এখনো ঢাকাতেই আছে। অফিস থেকে ছুটি পায়নি। সকালেই তো আমার সাথে দেখা হলো।’
– ‘ তাই নাকি? কোথায় দেখা হয়েছিল?’
– ‘ বাড়ির সামনেই। আমি হঠাৎ করেই তাকে দেখেছি।’
– ‘ বাড়িতে নিয়ে এলি না কেন? তাহলে সকালেই আলাপকাল হয়ে যেতো।’
– ‘ আসলে মা, তুহিন ভাই তখন ওইরকম অবস্থায় ছিল না। সিএনজির সাথে ধাক্কা লেগে মাথা ফেটে গেছিল।’
তানিশার বাবা ফট করে বলে উঠলেন, – ‘ চোখে কম দেখে নাকি?’
আফসানা বেগম বললেন, – ‘ ওমা, এ আবার কেমন কথা? রাস্তাঘাটে চলার সময় একটু-আধটু এক্সিডেন্ট হয়-ই। সবাই তো আর তোমাদের মতো প্রাইভেট গাড়ি দিয়ে যাতায়াত করে না, যে রাস্তায় পা পড়বে না।’ আফসানা বেগমের কণ্ঠে প্রতিবাদীপক্ষ প্রকাশ পেলো। এতে আপ্লুত হলো তানিশা।
গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, – ‘ একদম ঠিক। বাবা, তুমি চুপ করো। আসলে তুহিন ভাই একটু অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলেন। তাকে দেখে তো আমি ঘাবড়ে গেছিলাম। দু’জন লোক ধরেছিল রেখেছিল তাকে। আরও একটা বিষয় খটকা লাগল আমার কাছে; ওই সময়টাতে তুহিন ভাইয় অফিসে থাকার কথা। অথচ তিনি উদভ্রান্তের মতো হাঁটছিলেন রাস্তা দিয়ে। তাঁর অফিস তো অনেকটা দূরে। সেই ঢাকায়। অথচ এলাকায়, মানে এই সাভারে হাঁটছিলেন। তাকে দেখেও কেমন যেন বিমর্ষ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, নিষ্প্রাণ একটা মানুষ। আমি তাকে নিয়ে ফার্মেসীতে গেলাম। ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে দিলো, মেডিসিন দিলো, অথচ সে একটা কথাও বলল না। এমনকি আমার সাথেও না। কিছু একটা বলা উচিত ছিল তাঁর।’
মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে তানিশার বাবা আবার বলে উঠলেন, – ‘ চাকরিটাকরি খেয়ে ফেলেছে বোধহয়। আজকাল তো এইসব অহরহ হচ্ছে; চাকরি হারিয়ে লোকজন মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ছে। উদাসীন হয়ে রাস্তাঘাটে হাঁটাচলা করে। ফলে এক্সিডেন্ট হয়।’
– ‘ বাবা, মানুষের সম্পর্কে নেগেটিভ মন্তব্য করাটা তোমার অভ্যাস হয়ে গেছে দেখছি।’ কথাটা বলে ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল তানিশা।
বাবার কথা শুনে আগ্নেয়গিরির মতো উত্তপ্ত হয়ে গেছে সে।
মেয়ের রাগ দেখে আফসানা বেগম স্বামীকে বললেন, – ‘ আহ্, তুমি যাও তো এখান থেকে। যেজন্য এসেছিলে, সেটা তো শেষ হয়ে গেছে, এবার যাও।’

তানিশার বাবা গেলেন না। এক চুল পরিমাণ জায়গাও পরিবর্তন করলেন না। সটান দাঁড়িয়ে থেকে একটু কেঁশে আবার বললেন, – ‘ ঠিক আছে। ভাইয়ের প্রসঙ্গ বাদ। আচ্ছা, তাহমিদ কী নেশাটেশা করে?’

– ‘না।’ মুখটা কঠিন করে জবাব দিলো তানিশা।
তাঁর বাবা আবার বললেন, – ‘ সিগারেট খায় নিশ্চয়ই।’
– ‘ না। সেটাও খায় না।’
– ‘ মিথ্যা কথা; আমি দেখেছি একদিন।’
কপাল কুঁচকালো তানিশা। তবে উত্তর দিলো না। তাঁর বাবা আবার বললেন, – ‘ বিয়েটা তো মেনে নিলামই। তাহলে আর মিথ্যাচার করছিস কেন? মিথ্যার আশ্রয় তো অন্যপক্ষ নেবে। তুই আমাদের পক্ষের মেয়ে হয়ে যদি ওদের হয়ে মিথ্যে বলিস, তাহলে তো আমাদের সাথে অন্যায় করা হবে।’
– ‘ যা সত্যি তাই বললাম বাবা। ও সিগারেট খায় না।’
– ‘ এটা তুই জানিস। কিন্তু আমি ভিন্ন কিছু জানি। তাহমিদ ভালো ছেলে, যার একটা প্রমাণ হলো, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ও মিথ্যে বলে না। যেমন আমি একদিন হঠাৎ জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাহমিদ, ‘তুমি কি ধুমপান করো?’ ও কিছুক্ষণ ইতস্ততবোধ করে আমাকে সত্যি বলেছিল, ‘ ধুমপান করি, তবে নিয়ম মেনে।’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ সেটা কীভাবে? মানে মানুষ নিয়ম মেনে আবার ধুমপান করে কীভাবে? আমি যতদূর দেখেছি, এটা খুব বাজে নেশা। একবার যাকে ধরে, নাজেহাল করে ছাড়ে। দিনে তাঁর বেশ কয়েকটা লাগবেই।’ ও বলেছিল, ‘ আমার ধুমপান করার নিয়মটা ব্যতিক্রম।’ আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। ও তাড়া দেখিয়ে চলে গেছিল।’
তানিশা ছোট করে ‘ওহ্’ বলল শুধু। তাঁর বাবা আবার জিজ্ঞেস করলেন,
– ‘তুই কী জানিস, ও এইরকম নিয়ম কেন করেছে?’
– ‘ হ্যাঁ। ঠোঁট কালো হয়ে যাওয়ার ভয়ে ও নিয়মিত সিগারেট খায় না। সপ্তাহে একটা৷ অথবা মাসে একটা।’
– ‘ একেবারে ছেড়ে দিলেই তো পারে।’
– ‘ ও চেয়েছিল সিগারেট খোর হতে। কিন্তু একসময় দেখা গেল, ওর মুখটা ফরসা হয়ে গেল। এখন তুমিই বলো, ফরসা মুখে কী কালো ঠোঁট মানায়? তাই ও সেভাবে ধুমপান করে না। একসাথে দুইদিন ব্যালেন্স করে চলে।’
– ‘ এতকিছু জানিস, অথচ আমাকে মিথ্যা বললি।’
– ‘ তো কী করব বলো? যখন আমাদের বিয়ে হবে, তখন তো ও সম্পর্কে তোমার মেয়ের জামাই হবে। আমি ওর স্ত্রী হয়ে কীভাবে তোমার সামনে ওর ইজ্জতভ্রষ্ট করি?’
আফসানা বেগম মুখ চেপে হাসলেন। তানিশার বাবা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
– ‘ শুধু কী সিগারেট খায়, না আরও কিছু ইরেগুলার অভ্যাস আছ?’
– ‘ ও কী আরও কিছু বলেছিল তোমায়?’
– ‘না।’
– ‘ তাহলে ধরে নাও আর কোনো খারাপ অভ্যাস ওর নেই। থাকলে সততার খাতিরে সেটাও বলতো। ও নিজের সুরক্ষার জন্যই উল্টো পাল্টা কিছু খায় না। অগোছালো হলেও নিজের শরীরের যত্ন নেয়।’
– ‘ হুহ্, পাগলের আবার রূপচর্চা।’ তানিশার বাবা হাস্যকর গলায় কথাটা বললেন।

তানিশা রেগেমেগে এবার ফেটে পড়ল। চেঁচিয়ে বলল, – ‘ তুমি আসলেই খুব খারাপ একটা লোক। আমার সাথে আর কথা বলবে না তুমি। বিয়ের পরে আর তোমার বাড়িতেও আসবো না।’
তানিশার বাবা হেসে উঠলেন উচ্চস্বরে। হাসতে হাসতে বললেন, – ‘ শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ছাগলের চুল আঁচড়াবে, তাই তো? ঠিক আছে। আমার পক্ষ থেকে শুভ কামনা রইল।’

তানিশা আর দাঁড়াল না ছাদে। পানির বালতি রেখেই হনহনিয়ে চলে গেল। আফসানা বেগম রাগী কণ্ঠে বললেন,
– ‘ তুমিও না! অযথাই মেয়েটাকে রাগিয়ে দিলে। ধুর!’ কথাটা বলে আফসানা বেগম নিজেও তাড়াহুড়ো করে ছাদ ত্যাগ করলেন।

২৩.
নুপুর, সজলকে আশ্বস্ত করে বলল, – ‘ অযথাই চিন্তা করছ তুমি। আমি বললাম তো, বাবা আর তোমাকে বিয়ের কথা বলবে না। এখন যদি তুমি চলে যাও, তাহলে বাবা-মা কষ্ট পাবে। ভাববে, তাঁদের কথায় কষ্ট পেয়ে তুমি অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছ।’
– ‘ আমি তোমার বাবা-মায়ের কথায় কষ্ট পেয়ে এখান থেকে যাচ্ছি না নুপুর। উনারা তখন জানতো না বিষয়টা, তাই তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমাকে বলেছে। বাট এখন তো সবাই জানে আমার সাথে অন্য একটা মেয়ের সম্পর্ক আছে। এটা তুমি তাঁদের বুঝিয়েছ। এর জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এখন আমি চাকরি করছি। তাই আমার মনে হয়, আমাকে একটা বাসা নিয়ে থাকতে হবে। দেখো, আসমাকে যে আমার পরিবার মানবে না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাই আমি চাচ্ছি, আমি একটা বাসা ভাড়া নিবো। যাতে আসমাকে বিয়ে করে আমরা সেখানে থাকতে পারি।’
– ‘ এখানে থাকতে অসুবিধে কী? আমাদের এতবড় বাড়ি। মানুষ মোটে তিনজন।’

সজল আবার কিছু বলার আগেই আফজাল হোসেন ঘরের ভিতরে এলেন। সজলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, – ‘ কী ব্যাপার সজল, শুনলাম তুমি নাকি অন্য জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে চাচ্ছো?’
মামাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল সজল। আমতাআমতা করে জবাবে বলল,
– ‘ আসলে মামা, ওখান থেকে আবার অফিসটা খুব কাছে। রোজ এত দূর থেকে যাতায়াত করতে কষ্ট হচ্ছে।’
– ‘ বাসা কী খুঁজে পেয়েছ?’
– ‘না।’ আস্তে করে জবাব দিলো সজল।
মামাতো বোনকে যতটা সহজে বিয়ের কথা বলতে পেরেছিল, মামাকে তা পারেনি৷ সেদিন সকালের ঘটনাটা জন্য নুপুরও অপ্রস্তুত ছিল। নুপুর যে সজলকে পছন্দ করে, সেটা তাঁরা জানতো। তাই হঠাৎ করেই বিয়ের কথা বলেছিল। পরে নুপুর তাঁদের বুঝিয়েছে। জোর করে বিয়ে দেওয়া যেতো হয়তো, কিন্তু পরিনতি ভালো হতো না। আফজাল হোসেনের অভিজ্ঞ চিন্তাধারা সহজেই বুঝে গেছে ব্যাপারটা। তাছাড়া যেখানে তাঁর মেয়ে নিজেই ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিয়েছে, সেখানে তাঁর মাথা ঘামানো ঠিক না।

আফজাল হোসেন কড়া গলায় বললেন, – ‘ তাহলে আগে থেকে কীভাবে বলছ, অফিসের কাছাকাছি কোথাও বাসা পেয়ে যাবে তুমি?’
সজল বিব্রত হলো।
আফজাল হোসেন আবার বললেন,
– ‘ ঢাকা শহরে ব্যাচেলর বাসা পাওয়া অনেক ঝামেলার ব্যাপার। দেখো, তুমি কেন এখান থেকে চলে যেতে চাচ্ছো, তা আমি জানি। আসলে ভুলটা আমাদেরই হয়েছিল। শুধু নুপুরের ইচ্ছেতে তো সব হবে না, তোমার মতামতও নেওয়া প্রয়োজন। আমি না বুঝেই তখন বিয়ের আলোচনা করেছিলাম।’
– ‘ মামা, এগুলো আগের কথা। এখন এগুলো বলে দয়া করে আমাকে লজ্জা দেবেন না।’ কথাটা বলে মাথা নিচু করে ফেলল সজল।
আফজাল হোসেন বললেন,
– ‘শোনো সজল, তুমি এখানেই থাকো। আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলব। তুমি যাকে পছন্দ করো, তাঁর সাথেই তোমার বিয়ে হবে।’
– ‘ বাবা আমাদের সম্পর্ক মানবে না মামা। আপনাকে তো আমি বলেছি।’
– ‘ সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও। এখন মন দিয়ে চাকরিটা করো। ওদিকটা আমি দেখছি।’ কথাটা বলেই হাঁটা দিলেন আফজাল হোসেন।
নুপুর যাওয়ার আগে বলল,
– তোমার আর ওর মধ্যে আমি আসবো না। অতটাও খারাপ আমি নই। এইটুকু বিশ্বাস করো প্লিজ।’

নুপুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দরজার বাইরে আসতেই তাঁর চোখ থেকে কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।

২৪.
– ‘ আচ্ছা রাইশা, মানহার কথা মনে আছে তোর?’
– ‘ কোন মানহা? পেয়ারা আপার কথা বলছ?’ কোনো ভাবনা ছাড়াই বলে দিলো রাইশা।
– ‘হ্যাঁ।’ সম্মতি জানালো আসমা।

মানহা পাশের গ্রামের মেয়ে। নদীর ওপাড়ে ওদের গ্রাম। আসমা আর মানহা একই কলেজে পড়তো। মানহা নদী পাড় হয়ে এই গ্রামে আসতো; তারপর কলেজে যেতো। আসমার সাথে হঠাৎ পরিচয় হয়েছিল একদিন। মানহা পেয়ারা খেতে পছন্দ করতো, তাই প্রায়ই আসমাদের বাড়িতে আসতো পেয়ারা খেতে। রাইশার সাথেও এভাবেই পরিচয়। রাইশা তাকে পেয়ারা আপা বলে ডাকতো। এতদিন পর আজ হঠাৎ মানহাকে নিয়ে ছোট বোনের কাছে জিজ্ঞেস করছে কেন, তা আসমা নিজেও জানে না। হঠাৎ করেই তাঁর মনে হলো, মানহার একটু খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন।
আসমা আবার জিজ্ঞেস করতে যাবে, তখনই দেখল দরজার বাইরে তাহমিদ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে ক্ষিপ্ততা। তাহমিদকে হঠাৎ দেখেই আতঙ্কে উঠল আসমা। তাহমিদ পা বাড়িয়ে ভিতরে এলো। চুপচাপ গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ।

সম্পৃক্ততা পর্ব ৮

0

৮ম পর্ব

রিফাত হোসেন।

২০.
গনগনে রোদ কুয়োতলায়। পেয়ারা গাছের ফাঁকা দিয়ে শরীরে এসে আঘাত করছে তীব্র রোদের উত্তাপ। তৃষ্ণা এবং আসমা, দু’জনেই সবেমাত্র স্নান সেড়ে এখানে এসে বসেছে মাথার চুল শুকোতে। দু’জনের হাতে দু’টো আধভেজা গামছা৷ চুল মুছছে, আর শীতল শরীরে উষ্ণতার স্পর্শ উপভোগ করছে। তৃষ্ণা একবার কুয়োর দেয়ালের উপরে গিয়ে বসল। ভয় পেয়ে আবার নিচে নেমে এলো৷ আসমা আড়চোখে ওকে দেখছে, আর মিটমিট করে হাসছে।
হুমাইরা তাগাদা দিচ্ছে; দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় হয়েছে। আসমা, তৃষ্ণাকে কয়েকবার বলেছে এ-কথা। কিন্তু তৃষ্ণা পাত্তা দেয়নি। নিজের ছটফটানি পরিহার না করে, উল্টো আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

– ‘ তৃষ্ণা, খাবে না নাকি?’ আসমা নিচু স্বরে আবার জিজ্ঞেস করল।
তৃষ্ণা কোনো উত্তর দিলো না। আসমা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে আবার বলল,
– ‘আচ্ছা, তোমার কোন নামটা বেশি পছন্দের; তৃষ্ণা, না তুলি?’
তৃষ্ণা সোজাসাপটা বলল – ‘দু’টোই আমার পছন্দের।’
– ‘আমি কোন নামে তোমাকে ডাকলে, তুমি বেশি খুশি হবো।’
– ‘নাম ধরে না ডাকলেই আমি বেশি খুশি হবো।’
– সেকি! কেন?’ হকচকিয়ে উঠল আসমা।
– ‘নাম শুনতে আর ভালোলাগে না।’
আসমা আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, – ‘ তাহলে কী বলে ডাকবো?’

কথাটা বলে কপাল ভাজ করে তাকিয়ে রইল তৃষ্ণার দিকে।
তৃষ্ণা প্রথমে ভ্রুক্ষেপ দেখাল না৷ কিন্তু কী যেন ভেবে পরক্ষণেই আবার উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, – ‘ তুমি আমাকে আপু বলে ডাকবে। তৃষ্ণা আপু, বা তুলি আপু, এইরকম না। জাস্ট বলবে, আপু, শোনো। ঠিক আছে?’
ভীমড়ি খেলো আসমা। নিজের মনেমনে বিড়বিড়িয়ে বলল, বলে কি মেয়েটা! আমি ওর কতবড়। অথচ আমাকে বলছে, ওকে যেন আপু বলে ডাকি! এ তো দেখি ভাইয়ের মতো পাগল।
আসমা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, – ‘ তুমি যে আমার ছোট, সে কথা কী ভুলে গেছো?’
– ভুলব কেন? ভুলিনি আমি। তাছাড়া বড়রা কী ছোটদের আপু ডাকতে পারে না? তোমাদের এইসব নিয়ম আমার একদম সহ্য হয় না। বাড়ির সবাই বড় বলে আমাকে সারাক্ষণ তুলি অথবা তৃষ্ণা বলে ডাকে। অথচ আমাকে কখনো ভাবীকে ভাবী বলতে হয়, কখনো আবার ভাইয়াদের ভাইয়া। আমিও তো ওদের বোন। আমাকে কী আপু ডাকা যায় না? আমি আগে দু’টো বাচ্চাটাকে পড়াতাম। ওরা আমাকে সবসময় তুলিপু বলতো। আমার রাগ হতো খুব। আরে ভাই, আমি তোদের টিচার। আমাকে ম্যাডাম ডাকলে কী তোদের জাত চলে যাবে?’ তৃষ্ণা একনাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু নিঃশ্বাস নিলো।
আসমা শুধু মুখ চেপে হাসল একটু। কিছু বলল না এখন। তৃষ্ণা আবার বলতে লাগল,
– ‘তুমিই বলো, তোমার ছাত্রটা যখন তোমাকে ম্যাডাম বলে ডাকে, তখন কী তোমার ভালোলাগে না?’
আসমা মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। তৃষ্ণা আবার বলতে শুরু করর, – ‘ম্যাডাম শব্দটা খুব সম্মানের। কেউ যখন আমাকে ম্যাডাম ডাকে, তখন আনন্দে আমার চোখ ভিজে যায়। কিন্তু আফসোস, এখন পর্যন্ত সেই সৌভাগ্য আমার হয়নি। ওদের আপু ডাকে আমি ক্লান্ত। তাই চেঞ্জ করার প্রয়োজন ছিল। তোমাদের মুখে তৃষ্ণা নাম শুনে আমি ক্লান্ত, তাই এখন আমায় আপু ডাকবে।’
– ‘তুমি তো ওদের বললেই পারো, যে তোমরা আমাকে তুলিপু না ডেকে ম্যাডাম বলে ডাকবে।’ আসমা উচ্চস্বরে কথাটা বলল।
তৃষ্ণা নিরাশ গলায় বলল,
– ‘আরে ধুর! ওভাবে বলা যায় নাকি? ওরা যদি ওদের বাবা-মাকে বলে দেয়; তাহলে ব্যাপারটা আমার জন্য কত লজ্জার হবে একবার ভাবো! দেখো, আমি চাই, আমাকে ওরা ম্যাডাম বলে সম্মান করুক। তাই বলে কী আমি বেহায়ার মতো বলব, ‘ওই, তোরা আমায় ম্যাডাম বলে ডাক!’
আসমা হেসে বলল,
– ‘ওরা তো বাচ্চা মানুষ। অতকিছু বুঝবে কীভাবে? তাছাড়া তুমিও খুব বেশি বড় নও। আর সেভাবে প্রফেশনাল শিক্ষিকাও নও। সেজন্যই বোধহয় ওদের মা বলে দিয়েছে, তোমাকে যেন আপু বলে ডাকে। তাছাড়া অনেকেই আছে, যারা ম্যাডাম শুনতে পছন্দ করে না।’
– ‘অনেকের সাথে তো আর আমার তুলনা হয় না। তাছাড়া আমি ম্যাডাম শুনতেই পছন্দ করি। এই শব্দে খুব সম্মান আছে। যা ওই আপা-টাপা তে নেই।’
– ‘ তুমি কি ওদের এখনো পড়াও?’
– ‘ না। অনেকদিন আগেই বাদ দিয়ে দিয়েছি। যে কাজে তৃপ্তি নেই, তৃষ্ণা সেখানে কাজ করে না। তাছাড়া আমার তো টিউশনি করার প্রয়োজন নেই। ওদের মা কোত্থেকে যেন খবর পেয়েছিল, আমি খুব ভালো স্টুডেন্ট। তাই তাঁর মনে হয়েছে, উনার বাচ্চাদের আমি ভালোবাসে পড়াতে পারব। সেজন্য বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছিল। শিক্ষিকা হওয়ার প্রতি আমার একটা ঝোঁক আছে। তাই আমি সহজেই রাজি হয়ে গেছিলাম। আগে তো আর জানতাম না ওরা আমাকে ম্যাডাম বলে ডাকবে না। জানলে আগেই না করে দিতাম।’
– ‘ তোমার কী মনে হয়, ওরা ম্যাডাম ডাকলেই তুমি শিক্ষিকা হয়ে যেতে; আর আপু বলে ডাকলে তুমি শিক্ষিকা হতে পারতে না?’
– ‘অবশ্যই। কেউ যদি আমাকে ম্যাডাম না-ই ডাকে, তাহলে আমি শিক্ষিকা হলাম কীভাবে? একজন ইঞ্জিনিয়ারকে যখন মানুষ ইঞ্জিনিয়ার বলে ডাকে, তখনই সে নিজেকে একজন ইঞ্জিনিয়ার ভাবে। তাঁর আগে নিজেকে সেরকম কিছু ভানতে সংকোচবোধ করে। ডাক্তারকে মানুষ ডাক্তার বলে। সাংবাদিককে মানুষ সাংবাদিক বলে। লেখককে মানুষ লেখক বলে। কবিকে বলে কবি। সবাইকেই যদি ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, লেখক, কবি বলে ডাকা যায়, তাহলে একজন আমাকে কেন ম্যাডাম বলে ডাকা যাবে না? ছোট হোক কিংবা বড়, টিচার ইস টিচার৷ আমি তো অনেক জায়গায় দেখেছি স্কুলের শিক্ষিকাকেও দিদিমনি, আপামনি বলে ডাকে অনেকে। অথচ সেই দিদিমনি আর আপামনি স্টুডেন্টদের জন্য দোয়া করে বলে, ‘অনেক বড় হও মা/বাবা।’ একবার জাস্ট কল্পনা করো, যে মানুষটা একজন স্টুডেন্টকে সন্তানের মতো স্নেহ করে দোয়া করছে, সেই বাচ্চারাই আবার তাকে দিদিমনি, আপামনি বলে ডাকছে। এটা কিছু হলো? এরা তো সম্পর্কের ১২টা বাজিয়ে দিচ্ছে।’

আসমা খিলখিল করে হেসে উঠল এবার। তাঁর হাসির শব্দে হুমাইরা আর রাইশা ঘর থেকে উঠোনে এসে দাঁড়ালো। তাহমিদও বাঁকা চোখ করে জানালা দিয়ে তাকালো কুয়ো তলায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হুমাইরা আর রাইশা আবার চলে গেল ঘরের ভিতরে। তাহমিদও অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
আসমা হাসি থামিয়ে দিলো। সজল চলে যাওয়ার পর এই প্রথম সে মনখুলে হাসল। ঘটনাটা ঘটিয়ে সে সে নিজেও অবাক হলো খুব! সজলের সাথে ইদানীং তাঁর খুব ঘনঘন কথা হচ্ছে। ভিডিও কলে একে অপরকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে৷ তবুও যেন মনের তৃপ্তি মেটে না কারোরই। সেজন্য আসমা সারাক্ষণ মনখারাপ করে বসে থাকতো। আরও একটা কারণ আছে। সজল তাঁর কাছে কী যেন লুকোচ্ছে! ঘনঘন ফোন দিলেও খুব একটা কথা বলতে পারে না সজল। তাড়াহুড়ো দেখায় শুধু। আসমার সবসময় মনে হয়, সজল কী নিয়ে যেন দুশ্চিন্তা করছে খুব। সেরকম একটা কালো ছাপ সবসময় যেন সজলের মুখে ফুটে উঠে। মাঝে মাঝে লক্ষ্য করে, সজলের মুখ ফেঁকাশে হয়ে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যায়। এই নিয়ে গত কয়েকদিনে আসমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু আজ হঠাৎ করেই তৃষ্ণার কথা শুনে মনখুলে হাসতে বাধ্য হয়েছে। মনে হলো যেন, তৃষ্ণা তাকে আনন্দ দেওয়ার জন্যই এসেছে এখানে।
আসমা দীর্ঘক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল,
– ‘আচ্ছা, এইরকম কঠিন যুক্তিগুলো তুমি কীভাবে আবিষ্কার করলে?’
– ‘ আবিষ্কার করিনি তো; কপি করেছি। তাহমিদ ভাইয়ার থেকে।’
– ‘তাই নাকি।’ আসমা চমকালো কিছুটা।
তৃষ্ণা হেসে বলল,
– ‘ হ্যাঁ। তাহমিদ ভাইয়া সেই একটা জিনিস। ওর মতো মানুষই হয় না। আমি তো সবসময় চাই ওর মতো হতে। কোনো ঝামেলা নেই, কোনো পিছুটান নেই। জীবনটা নিজের মতো করে কাটাচ্ছে। আহ্ কী সুখ!’
তৃষ্ণার কথা শুনে তৃতীয় বারের মতো ভীমড়ি খাওয়ার উপক্রম হলো আসমার। কিছুটা রাগী কণ্ঠে বলল,
– ‘ কোনো মেয়ে মানুষ যে ওইরকম এলোমেলো জীবন প্রত্যাশা করতে পারে, তা আমার ভাবনার বাইরে ছিল।’
– ‘ হোক এলোমেলো। তাতে কী? ভাইয়া বলে, এলোমেলো জীবনের থেকে সুখের জীবন আর হয় না। যে ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন ভাবতে পারবে, সে দেশকে স্বাধীন ভাবতে পারবে। নিজে যদি পরাধীন হয়ে থাকে সারাজীবন, তাহলে দেশের স্বাধীনতা তাকে তৃপ্তি দিবে না।’
– ‘তা অবশ্য ঠিক। দেশ যতই স্বাধীন হোক, নিজে স্বাধীন না হলে শান্তি পাওয়া যায় না। মনের কথা শুনে কিছু করা যায় না, বলা যায় না। দেশের প্রতিটি মানুষ স্বাধীন হলে দেশ এমনিতেই স্বাধীন হবে।’
– ‘ তাহলে বলো, যে মানুষটা এতকিছু জানে, সে অবশ্যই অনেক জ্ঞানী একজন মানুষ। আমি কী তাহলে ওর মতো হতে চেয়ে অন্যায় করেছি?’
– ‘না করোনি।’ একটু চুপ থেকে আসমা আবার বলল, – ‘ আচ্ছা, আমি যদি উনাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি, তাহলে উনি কী সেটার উত্তর দিতে পারবেন?’
– ‘নিশ্চয়ই পারবে। শুধু একটু সময় দিতে হবে। যেমন, এখন যদি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করো, সে উল্টো পাল্টা বলবে। কাল আবার নিজেই তোমাকে উত্তর দেবে।’ তৃষ্ণা দৃঢ় কণ্ঠে আশ্বস্ত করল আসমাকে।
আসমা একটু ভেবে আবার বলল,
– ‘এইরকমটা কেন?’
– ‘জানি না। ভাইয়া বলে, রাতে সে একান্তে এই নিয়ে ভাববে। তাঁরপর সকালে উত্তর দিবে। আমি তো খুব কৌতূহলী মেয়ে; তাই বারবার যেকোনো বিষয়ের প্রশ্ন ভাইয়াকে করি। ওর থেকে পরামর্শ নেই। সবসময় একরাত সময় নেয়। এরপর আমাকে উত্তর দেয়।’
আসমা ফিক করে হেসে বলল,
– ‘ উনি কী রাতে গুগুল থেকে সেই প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে?’
– ‘না। ভাইয়ার তো ছোট মোবাইল।’ তৃষ্ণা গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো।
আসমা আবার ফিক করে হেসে বলল,
– ‘তাহলে নিশ্চয়ই কোনো বই ঘেটেঘুটে প্রশ্নের উত্তর বের করে।’
– ‘ এটাও করে না। ইনফ্যাক্ট ভাইয়ার ঘরে কোনো বই নেই। বই তো বড় ভাইয়ার ঘরে আছে। তবে একটা ব্যাপার আছে। ভাবীর কাছে শুনেছি, ভাইয়ার একটা সমস্যা আছে। ‘009’ নিয়ে কী যেন বলছিল। আমার মনে নেই।’

আসমা কোনো উত্তর দিলো না। সে অলরেডি ফাতেমার থেকে তাহমিদের সম্পর্কে অনেককিছু জেনেছে। সকালে বৃষ্টি নামার আগেই ঘরে ফিরে এসেছিল সে। তারপরই গিয়েছিল বড় আপার কাছে। ‘009’ নিয়ে আসমার মনে নানান চিন্তা বিরাজ করছে। এই সংখ্যাটা কোথায় যেন দেখেছে!

২১.
জানালা খুলে দিতেই দমকা হাওয়া প্রবেশ করল ঘরের ভিতরে। শরীরে শীতলতা ছুঁইয়ে দিয়ে গেল। সকাল ৮টা। বসন্তে প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়াবাড়ি রকমের বৃদ্ধি পেয়েছে। আশপাশ থেকে বাতাসের সাথে ভেসে আসছে তীব্র সুবাস। সূর্য উদয় হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। কিন্তু কার উপর দয়া করে যেন সেভাবে উত্তপ্ততা ছড়াচ্ছে না। নাহলে ভ্যাপসা গরম লাগল শরীরে। বাতাস গায়ে লাগতো না। আকাশপটা মেঘলা না হলেও খুব সুন্দর দেখাচ্ছে এ সময়।

জানালার কাছ থেকে সরে এলো তানিশা। গোল টুলটা আয়নার সামনে রাখল। চুলগুলো ভেজা। কিছুক্ষণ আগে গোসল করেছে। আজ অফ ডে। নাহলে তাকে আরও আগে ঘুম থেকে উঠতে হতো। অফ ডে তে তাকে অলসতায় আঁকড়ে ধরে। সেজন্য ফজরের নামাজও পড়তে পারে না। প্রতি শুক্রবারে তাঁর ঘুম ভাঙে ৮ টার একটু আগে। যেন কেউ একজন নিয়ম করে দিয়েছে! এরপর ওয়াশরুমে যায়। সকালেই গোসল করে সে। তারপর ঘরের জানালা খুলে আয়নার সামনে বসে। প্রতি শুক্রবারে সকালের রুটিন এটা। অন্যদিনে এত সময় থাকে না তাঁর হাতে। সারাক্ষণ দৌড়ের উপর থাকতে হয়।
তানিশা তোয়ালে দিয়ে চুল মুছল। কিছুটা শুকনো হওয়ার পর হাতে তুলে নিলো চিরুনি। বরিশাল থেকে ফাতেমা ফোন দিচ্ছে বারবার। ফাতেমার বোনের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে। তানিশা বারবার বলেছে, ‘ভাবী, এখানে কাজের খুব চাপ। আমি যদি যেতে পারতাম, তাহলে তোমাদের সাথেই যেতাম।’ বেশ কিছুদিন ধরে তাহমিদের সাথে তানিশার দেখা হয় না। শুধু ফোনে কথা হয়। কাল রাতেও কথা হচ্ছিল তাহমিদের সাথে। তানিশা জিজ্ঞেস করছিল,
– ‘ তাহমিদ, এখনও কী রাতে ওইরকম কোনো নম্বর থেকে ফোন আসে?’
– ‘ হ্যাঁ। গতকাল রাতেও ফোন এসেছিল।’
– ‘কী বলছিল?’গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল তানিশা।
তাহমিদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
– ‘ অনেক কিছুই তো বলছিল।’
– ‘ শুধু কি ও বলছিল? না তুইও কিছু বলেছিস।’
– ‘ আমার কিছু বলার সুযোগ নেই তো। প্রথম কয়েকদিন বলার চেষ্টা করেছি। তখনই ফোনটা কেটে যেতো।’ কথাটা বলার সময় তাহমিদ কিছুটা দুঃখী দুঃখী ভাব করল।
তানিশা আবার জিজ্ঞেস করল,
– ‘তাহলে তুই ওকে কোনো প্রশ্ন করতে পারিস না, তাই তো?’
– ‘না। ও আমাকে সেই সুযোগ দেয় না।’
– ‘তাহলে তুই যে বলিস, ও তোর সমস্যার সমাধান করে দেয়। তুই যদি ওকে তোর সমস্যার কথা না-ই বলিস, তাহলে ও সেসব সমস্যার কথা কীভাবে জানলো? আর সমাধানই বা কীভাবে দিলো?’
– ‘জানি না। বোধহয় ও আগে থেকেই আমার মনের সব প্রশ্ন বুঝে ফেলে। ফোন দিয়ে নিজেই কথা বলতে থাকে। আর কীভাবে যেন আমি নিজের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই। এখন আর ভয়ে প্রশ্ন করি না। কারণ প্রশ্ন করলেই ও চলে যায় খুব তাড়াতাড়ি।’
তানিশা অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
– ‘ এই কথাটা তো আমায় আগে বলিসনি।’
– ‘ সব কী আর তোকে বলতে হবে? কে তুই?’ কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করল তাহমিদ। তানিশা মেয়েটা ইদানীং তাকে একটু বেশিই জ্বালাচ্ছে।
তানিশা কাতর কণ্ঠে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। তাঁর গলা গিয়ে কথা বের হচ্ছে না। তাহমিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
– ‘ তানিশা, তোকে একটা কথা বলব।’
– ‘কী কথা?’ খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ছাড়া ছাড়া গলায় জিজ্ঞেস করল তানিশা।
তাহমিদ দৃঢ় গলায় বলল,
– ‘ আমার মনে হয়, মেয়েটা আমাকে ভালোবাসে।’
প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও পরক্ষণেই মৃদু হেসে দিলো তানিশা। নিম্নস্বরে বলল,
– ‘ওহ্।’
– ‘ আমিও বোধহয় ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।’ কথাটা বলার পর তাহমিদের কণ্ঠে ভয়ার্ত ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠল।
তানিশা আবারও স্বাভাবিক ভাবে বলল,
– ‘ ওহ্।’
– ‘ ওহ্ মানে? তোর খারাপ লাগছে না? আমি তো জানতাম মেয়ে মানুষ খুব হিংসুটে হয়। বিশেষ করে প্রেম-ভালোবাসার দিক দিয়ে৷ তুই বলিস, তুই আমাকে ভালোবাসি, অথচ আমি বলছি, আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি৷ এর জন্য কী তোর মধ্যে কোনোরকম ইর্ষা কাজ করছে না?’
– ‘ ওমা, কার সাথে হিংসে করব আমি? একটা অবান্তরের সাথে! যার কোনো অস্তিত্ব নেই। বরং আমার এটা ভেবে ভালোলাগছে যে, ওই ভ্রান্তিটা তোর মধ্যে ভালোবাসার সৃষ্টি করছে।’
তাহমিদ চমকানো কণ্ঠে জানতে চাইল,
– ‘কীভাবে?’
– ‘ তুই কী নিজের মধ্যে এখন ভিন্ন কিছু উপলব্ধি করিস? এই যেমন, কোনো মন মুগ্ধকর দৃশ্য’র প্রতি আকৃষ্ট হওয়া৷ বা আগে যে জিনিসটা অতি সাধারণ মনে হতো তোর কাছে, এখন তা অসাধারণ মনে হচ্ছে।’ কথাগুলো বলে তানিশা মৃদু হাসল আবারও।
তাহমিদ অবাক কণ্ঠে বলল,
– ‘ হ্যাঁ। ঠিক বলেছি তুই। এখানে আসার পর থেকে আমি নিজেকেই যেন অন্যভাবে ভাবতে শুরু করেছি। এই যেমন একটা মেয়ের হাসি। আগে এটাকে খুবই সাধারণ মনে হতো। কিন্তু সেদিন হঠাৎ করেই ভাবীর মেজো বোনের হাসিমাখা মুখটা আমার নজরে এলো। আমি মুগ্ধ চোখে দেখলাম ওর হাসি। শব্দ করে হাসছিল ও। তুইও তো এভাবেই হাসিস, তাই না? আমার মনে হঠাৎ তোর প্রতি মায়া জন্মালো। ভাবলাম, আমার উচিত ছিল তোর হাসিমাখা মুখটার দিকে একটিবারের জন্য অন্তত তাকানো। তোর হাসির শব্দ সেসময় আমার কানে ভাসছিল। আমার মধ্যে হঠাৎ আবেগ, অনুভূতি কাজ করতে লাগল।’
– ‘ওয়াও। তোর মস্তিষ্কের তৈরি ওই ভ্রান্তি মেয়েটাকে সামনে পেলে একটু চুমু দিয়ে দিতাম! ও তোর মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করছে, আবেগ, অনুভূতি সৃষ্টি করছে৷ একদিন চট করে সবার সামনে তোকে প্রপোজ করে বসব। তুই ‘না’ শব্দটা উচ্চারণই করতে পারবি না৷ তারপর তোর মাথা থেকেই ওই মেয়েকে কীভাবে তাড়াতে হয়, তা আমি জানি। আহ্! তোকে বরিশাল পাঠানো সার্থক হচ্ছে বোধহয়।’ তানিশার কণ্ঠে উত্তেজনা প্রকাশ পেলো।
তাহমিদ আর কিছু বলেনি। ফোন কেটে দিয়েছিল।

দরজার ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে। তানিশার ভাবনায় ছেদ পড়ল। আয়নার সামনে থেকে থেকে সরে দরজা খুলে দিলো। দরজার বাইরে মা’কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একগাল হাসল। দরজার সামনে থেকে সরে এসে বলল,
– ‘ এসো মা, ভিতরে এসো।’

আফসানা বেগম ভিতরে গেলেন। চুপচাপ বিছানায় বসলেন। তানিশা আবার টুলে বসল। এখন বাজে ৮ টা ৩০ মিনিট। তানিশা ঘুরে মায়ের দিকে তাকালো। আবারও একগাল হেসে বলল,
– ‘কী ব্যাপার মা, তুমি এখানে এলে। রান্নাবান্না শেষ বুঝি?’
আফসানা বেগম জবাব দিলেন,
– ‘ হ্যাঁ শেষ। তোকে ডাকতেই এলাম।’
– ‘ ঠিক আছে, চলো তাহলে। খাওয়াদাওয়া করে আবার আমাকে বের হতে হবে।’
– ‘কোথায় যাবি? ওই চায়ের দোকানে? কী লাভ ওখানে গিয়ে? আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে, বন্ধুদের বাড়িতে নিয়ে আয়।’
– ‘ ওখানে যে মজাটা হয়, এখানে তা হয় না। মা, তুমি একজন ইয়াং লেডি হয়ে এইরকম কথা বলতে পারো না। বন্ধুবান্ধবদের সাথে সবজায়গায় ইনজয় করা যায় না। তাছাড়া মাত্র একটা দিনই তো যাই। ওই দোকানদার কাকার বয়স কতো জানো তুমি? ৭০ এর উপরে। যুদ্ধের সময় ছিলেন একজন টগবগে যুবক। যুদ্ধ করেছেন তিনি। কিন্তু কপাল খারাপ ছিল বলে দেশের কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর সৃকৃতি মেলেনি। উনার সাথে গল্প করলে জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়। উনার দেওয়া কত ইনফরমেশন যে আমার কাজে লেগেছে, তা শুধু আমিই জানি। সাধেই কী আমরা শুধুমাত্র ওখানেই যাই? এখনো শক্তপোক্ত মানুষ উনি। শুধু চামড়াটা একটু ঝুলে গেছে।’
আফসানা বেগম হাসলেন শুধু। বললেন,
– ‘ এই একই বকবক আর কত পারবি মা? কিছু বললেই তুই এই বকবক শুরু করে দিস। ওই দোকানদারের কথা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।’ এ-কথা বলে আবারও হাসলেন আফসানা বেগম।
তানিশা আর কিছু বলল না।
আফসানা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেন,
– ‘ বলছিলাম কি, আজ একজন ঘটক এসেছিল। তোর বাবার পরিচিত সে। তোকে নাকি একটা ছেলে দেখেছে বাইরে কোথাও। দেখে পছন্দ করে ফেলেছে। পেশায় ডাক্তার। তোর বাবা বলছিল, একবার সামনাসামনি দেখা করতে। তুই যদি বলিস, তাহলে আমি ঘটককে বলে ওদের বাড়িতে আসতে বলব।’
তানিশা কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর বলল,
– ‘ মা, আমি তাহমিদকে পছন্দ করি।’
– কোন তাহমিদ? তোর বন্ধু তাহমিদ নাকি?’ চমকে ওঠে জানতে চাইলেন আফসানা বেগম।
তানিশা মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। আফসানা বেগম আবার বললেন,
– ‘ আগে তো কখনো এইরকম কিছু বলিসনি।’
– ‘ বিয়ের প্রসঙ্গ আসেনি বলেই আমি বলিনি।’ তানিশার সোজাসাপটা জবাব।
– ‘ তাহলে কী আমি ঘটককে চলে যেতে বলব?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘ তোর বাবা যদি কিছু বলে, তাহলে কী করব?’
– ‘ তাহমিদ তো আর খারাপ ছেলে নয়। তাছাড়া এমনও নয় বাবা তাহমিদকে অপছন্দ করে।’
– ‘ মানুষ হিসেবে পছন্দ করা আর মেয়ের জামাই হিসেবে পছন্দ করা তো আর এক নয়।’
– ‘ তোমার কী মনে হয়, তাহমিদ আমার স্বামী হিসেবে অযোগ্য?’
– ‘ না, আমি সেটা বলছি না। ছেলেটা খুব ভালো। অনেকদিন থেকেই তো চিনি ওকে। শুধু একটু অন্যরকম।’
– ‘প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিত্ব আলাদা হয় মা। তাহমিদ একটু নীরব প্রকৃতির মানুষ। অযৌক্তিক কথা বলে না। একটু অগোছালো। ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ভাবনাচিন্তা নেই। এটাই তো সমস্যা, তাই না?’
আফসানা মাথা নাড়ালো।
তানিশা আবার বলল,
– ‘ এগুলো বিয়ের আগের জীবন। বিয়ের পর মানুষ চেঞ্জ হয় মা। সংসারের প্রতি..।’ মায়ের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল তানিশা।
আফসানা বেগম হেসে বললেম,
– ‘ মা গো, আমি জানি আপনি এখন কী বলবেন। বয়সটা আমরা পাড় করে এসেছি তো। আপনার জ্ঞান এখন আমার হজম হবে না।

মায়ের মুখে ‘আপনি’ শব্দটা শুনে ফিক করে হেসে দিলো তানিশা। আফসানা নিজেও হাসলেন। আবার বললেন,
– ‘ এখন খাবার টেবিলে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করুন দয়া করে। ঘটককে আমি ‘না’ বলে দিবো।’

তানিশা মাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে আত্মাহারা হয়ে বলল,
– ‘ থ্যাঙ্কিউ সো মাচ মা। তুমি খুব ভালো মা।’
– ‘ হু, আবদার মেনে নিলে তো মা ভালোই। যদি বলতাম, না, এটা হবে না, তখনই বলতি, তোমার মতো খারাপ মা এই পৃথিবীতে নেই।’

তানিশা শব্দ করে হাসল মায়ের কথা শুনে৷ পরক্ষণেই হাসি থামিয়ে সতর্ক গলায় বলল,
– ‘ খবরদার, বাবাকে এইসব বলো না।’
– ‘ ওমা, তাকে না জানালে হবে কীভাবে? আমি একাই কি তোর অভিভাবক?’ আফসানা বেগম তাজ্জব গলায় বললেন কথাটা।
তানিশা লজ্জায় লাল হয়ে বলল,
– ‘ ইশ, বাবার সামনে আমি যাবো কীভাবে? খুব লজ্জা লাগবে আমার! বাবা যে মানুষ, আমাকে আরও লজ্জা দিবে।’
আফসানা বেগম হেসে উঠলেন উচ্চস্বরে।

খাওয়াদাওয়া করে বিশ্রাম নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো তানিশা। বাড়ির সামনে থেকে রিকশায় উঠতে যাবে, তখনই একজনকে দেখে তাঁর চোখ কপালে উঠে গেল!

৮ম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক- https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=555886145356090&id=100028041274793

ছবি: Umme Rokshana Akther

সম্পৃক্ততা পর্ব ৭

0

৭ম পর্ব

রিফাত হোসেন।

১৭.
উঠোনে বড় পাটিটা বিছানো হয়েছে। পড়ন্ত বিকেল। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। পাটিতে সবাই বসে আছে। পরপর তিনটে ঘর আছে এ বাড়িতে। সামনে আছে একটা বারান্দা, তাঁর সামনে বিশাল আকারের একটা দুয়ার। দুপুরে ফ্রেশ হয়ে সবার সাথে খাওয়াদাওয়া করেছে তাহমিদ। এখন সবার সাথেই বসে গল্প করছে।

হাফিজ উদ্দিন মেয়ে ফাতেমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– ফাতেমা, জামাই বাবাজি এলে খুব ভালো হতো।

ফাতেমা জবাবে বলল,
– বাবা, উনি কিছুদিন পর আসবেন। তাহমিদের অফিসের বসকে আমি চিনি। তাই ওকে বলে সহজেই তাহমিদের ছুটির ব্যবস্থা করতে পেরেছি। ওর ভাইয়ের অফিসে একটু বেশিই ঝামেলা। তাই হুটহাট করে ছুটি পাওয়া যায় না। উনি বলেছেন, বিয়ের আগে চলে আসবে।

– তা সে আছে কেমন?

ফাতেমা মৃদুস্বরে বলল,
– উনি ভালো আছে বাবা।

হাফিজ উদ্দিন কিছু বললেন না আর৷ ভাবতে লাগলেন নিজের সংসার জীবনের কথা। কত কষ্ট করে মেয়েদের বড় করে তুলেছেন। অথচ এখন মেয়েদের অন্যের ঘরে দিয়ে দিতে হচ্ছে। চাইলেও রোজ রোজ মেয়েদের মুখখানি দেখতে পারবেন না। কোনো উৎসব বা বছরে দুই একবার ঘুরতে আসা ছাড়া মেয়েদের একটু সঙ্গ দিতে পারবেন না। হঠাৎ করেই মেয়েগুলো এতবড় হয়ে গেল যে, তাঁদের পরের ঘরে দিয়ে দিতে হচ্ছে।

আসমা চুপচাপ বসে ছিল এক কোণায়। তাহমিদ আড়চোখে বারবার তাকে দেখছিল ; আর ভাবছিল, মেয়েটাকে কী বিয়েতে বাধ্য করা হচ্ছে? এইরকম কিছু হলে তো অন্যায় হবে। একজন মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে কিছু আছে। অন্য একজন মানুষ হয়ে, কারোর ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। আসমার যদি বিয়েতে মত না থাকে, তাহলে জোর করে বিয়ে দিয়ে ওর বাবা-মা অন্যায় করছেন।
তাহমিদ বেশ কয়েকবার ভেবেছে কিছু বলবে। কিন্তু কী দিয়ে শুরু করবে, তা ভেবে পাচ্ছিল না। এবার হঠাৎ করেই তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেল। সে একটু কেঁশে গলা পরিষ্কার করে নিলো। সবাই একসাথে তাকালো তাঁর দিকে। তুলি পাশ থেকে বলে উঠল,
– ভাইয়া কি গান গাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছ?

তুলির কথায় পাত্তা দিলো না তাহমিদ। সে আসমার দিকে তাকিয়ে প্রবল দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– আসমা, আপনি অত গম্ভীর হয়ে বসে আছেন কেন?

আসমা চমকে উঠল হঠাৎ তাহমিদের কথা শুনে। কপাল ভাজ করে তাকিয়ে রইল। তাহমিদ পরক্ষণেই আবার বলে উঠল,
– আপনি কী এই বিয়েতে রাজি নন? মানে আপনাকে কী জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে?

তাহমিদের কথা শুনে তুলি পাশ থেকে আবার বলল,
– ভাইয়া, কাকে কী বলছ? আসমা আপুকে জোর করে বিয়ে দিতে যাবে কেন?

তাহমিদ তুলির দিকে তাকিয়ে বলল,
– না মানে, উনি কেমন চুপচাপ বসে আছেন। নববধূরা তো এইরকম থাকে না সাধারণত। বিয়ের আগে তাঁদের বেশ হাসিখুশি এবং আনন্দে থাকতে হয়।

তুলি হো হো করে হেসে বলল,
– ভাইয়া, বিয়ে হচ্ছে রাইশার, আর তুমি বলছ আসমা আপুকে, হা হা হা।

তুলির কথা শুনে থমকে গেল তাহমিদ। লজ্জাও পেলো বেশ কিছুটা। হাফিজ উদ্দিন, হুমাইরা, ফাতেমা উচ্চস্বরে হেসে উঠল তুলির কথা শেষ হতেই। আসমাও মুখ টিপে হাসল। তাহমিদ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অবাক কণ্ঠে বলল,
– মেজো কে রেখেই সেজোর বিয়ে হচ্ছে নাকি?

আসমা অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো শুধু। তাহমিদ আবার বলল,
– এ কেমন কথা! ভাবী বলল, তাঁর বোনের বিয়ে। যেহেতু ভাবীর পর সিরিয়ালে আপনিই আছেন, তাই আর জিজ্ঞেস করিনি, কোন বোনের। দেখো কী কাণ্ড!

আসমা মুখ খুলে কিছু বলার আগেই হাফিজ উদ্দিন, তাহমিদের সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠল,
– এটাই ওকে বুঝায় কে? এই সামান্য একটা কারণে আমাকে কত মানুষের কথা শুনতে হচ্ছে। অথচ আজ যদি রাইশার আগে আসমা বিয়ে করতো, তাহলে লোকের বাঁকা কথাবার্তা শুনতে হতো না।

আসমা চোখ পাকিয়ে তাকালো বাবার দিকে। কিন্তু হাফিজ উদ্দিন মেয়ের চোখ রাঙানোকে অগ্রাহ্য করে আবার বললেন,
– তাহমিদ বাবা, তোমার মতো একটা ছেলে হাতের কাছে পেলে আমি আসমার বিয়েই আগে দিতাম। কিন্তু সে তো এমন একটা ছেলেকে পছন্দ করেছে, যে আমাদের ধরাছোঁয়ার অনেক বাইরে। ছেলেটার নাম সজল মাস্টার৷ ওর দাদা আগে চেয়ারম্যান ছিল। ছেলে যেমনি হোক, বংশের একটা ব্যাপারস্যাপার আছে। আসমার সাথে তো আর সম্পর্ক শুধুমাত্র মাস্টারের সাথে হবে না; ওদের পুরো পরিবারের সাথে হবে। আমি নিশ্চিত, আমার মেয়েটা ওখানে দু’দিনও টিকটে পারবে না। অত্যাচার করে মেরে ফেলবে ওরা। ছেলেটার দাদাকে গ্রামের লোকজন ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান করছিল গ্রামের উন্নয়ন করার জন্য। অথচ সে এমন হারামজাদা ছিল যে, সারাজীবন খালি নিজের সম্পত্তি বাড়াইছে। এখন এমন অবস্থা হইছে যে, গ্রামের সবার যত সম্পত্তি আছে, ওগো একাই তাঁর থেকে বেশি সম্পত্তি আছে। এছাড়াও ওদের যা ব্যবহার। আল্লাহ মাফ করুক, ওইরকম পরিবারের ছেলের সাথে আমি মরে গেলেও নিজের মেয়ের সম্মন্ধ করব না।

আসমা রাগে গজগজ করছে। একজায়গায় বসে থেকেও ছটফট করছে সে। তাহমিদ আড়চোখে একবার আসমার রাগী মুখ দেখে হাফিজ উদ্দিনকে বলল,
– এটাই কী সমস্যা? মানে এই সমস্যা সমাধান হলেই কি আপনি ওই মাস্টারের সাথে আসমার বিয়ে দেবেন?

– না। আরও একটা সমস্যা আছে।

– কী?

– ওরা অনেক বড়লোক। ওরা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের সাথে সম্মন্ধ করবে না।

তাহমিদ কী যেন ভেবে বলল,
– ওহ্। তাহলে এই দু’টোই সমস্যা।

ফাফিজ উদ্দিন বললেন,
– না। আরও একটা আছে। ওই মাস্টারও সুবিধার না। বাপ-দাদার মতো টাকার ক্ষিধে না থাকলেও চরিত্রে ঝামেলা আছে। দেখতে একেবারে বাংলা সিনেমার নায়কদের মতো। তাই এতদিন শহরে না গিয়া গ্রামে থেকে, গ্রামের মেয়েদের মাথা খাইছে।

এ-কথা শোনার পর আসমা আর বসে ছটফট করতে পারল না। বসা থেকে দাঁড়িয়ে, তেড়ে এলো বাবার সামনে। চেঁচিয়ে বলল,
– একদম চুপ বাবা। সবাই চুপ। আর কেউ যদি ওই মাস্টার বা মাস্টারের পরিবার নিয়ে কথা বলো, তাইলে সুই-সুতো দিয়ে সবার মুখ সেলাই করে দিবো। যত্তসব পাগলের কারখানা।

আসমা আর দাঁড়ালো না ওখানে। রেগেমেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। তাহমিদ হাসল; সাথে যোগ দিলো ফাতেমা, তুলি আর রাইশা। কিছুক্ষণ পর সবাই আবার কথা বলতে লাগল ভিন্ন প্রসঙ্গে। কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। আসমা ফিরে এলো না তখনো। তাহমিদ হঠাৎ বলল,
– আমি একটু গ্রামটা ঘুরে আসছি৷

তাহমিদ বেরিয়ে পড়ল।

১৮.
মানুষ একটা সময় নিজের ভুল বুঝতে পারে৷ কিন্তু ভুল শুধরে নিতে পারে না। কারণ ততক্ষণে আর সময় থাকে না। নদীর জল একজায়গায় আটকানোর জন্য যেমন বাধ দেওয়া হয়, তেমনি সম্পর্কে নিজেকে আবদ্ধ রাখার জন্য নিজেকে কন্ট্রোল করতে হয়। নিজেকে যেমন একজন সিদ্ধান্তকারী ভাবতে হয়, তেমনি একজন মতামতকারী ভাবতে হয়। অর্থাৎ সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করার জন্য নিজেকে একজন সঠিক সিদ্ধান্তকারী ভাবতে হবে। আবার যেকোনো বিষয়ে কাছের কারোর সাথে আলোচনা করতে হয়। শুরুতেই সিদ্ধান্ত নয়, মতামত জানাতে হয়।

বনানীর হাইওয়ে রোডের পাশে থাকা রেস্টুরেন্টে বসে আছে তুহিন এবং রাসেদ। রাসেদ পেশায় একজন উকিল। দু’জনের বন্ধুত্ব ইউনিভার্সিটি থেকেই। আজ অফিস যায়নি তুহিন। গতকালও যায়নি। যাওয়ার কোনোরকম ইচ্ছেও ছিল না। অবশ্য খুব শীঘ্রই এমন এক মুহূর্ত আসতে চলেছে, সে চাইলেও আর ওই অফিসে যেতে পারবে না। শুধু অফিস নয়, সে বাড়িতেও যেতে পারবে না। বাড়িতে যেতে তাঁর বিবেক বাধা দিবে। বিশেষ করে যখন ফাতেমা নামের নির্দোষ মেয়েটি বাড়িতে থাকবে। মেয়েটির সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস তুহিনের নেই। সে তাঁর সাথে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছে।

ফাতেমা বাড়িতে নেই আজ দু’দিন হতে চলল। গতকাল সকালে ফাতেমা থাকাকালীন সময়ে তুহিন বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। কিন্তু অফিসে যায়নি। ফাতেমা চলে যাওয়ার পরই সে আবার বাড়িতে ব্যাক করেছিল। সারাদিন বাড়িতে ছিল। সন্ধ্যায় হঠাৎ ডাক পড়ল তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকার। সে বিরক্ত হয়েছিল বটে, তবে না করতে পারেনি। গিয়েছিল এক রেস্টুরেন্টে। খাওয়াদাওয়া শেষে হঠাৎ মেয়েটা বলে উঠল, তাকে বিয়ে করতে হবে। অবাক কাণ্ড! এক বউ থাকতে নাকি আবার বিয়ে?
মেয়েটার সাথে তুহিনের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল বিয়ের আগে। এরপর মেয়েটার অন্য একজনের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। তুহিনও ফাতেমাকে বিয়ে করে সংসার করতে থাকে। শুরু থেকে ফাতেমার প্রতি একটা সংকোচবোধ ছিল বটে, তবে আস্তে আস্তে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। এর মাঝে হঠাৎ আবার চলে আসে মেয়েটা। সে জানায়, তাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়েতে বাধ্য করা হয়েছিল। তুহিন আবার মেয়েটার ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এরপর থেকে এভাবেই চলছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, সে নিজেই নিজের জীবনকে জটিল করে তুলছে।

রাশেদ চুপচাপ খাচ্ছিল এতক্ষণ। আর ভাবছিল বন্ধুর জীবনের জটিলতার কথা। অনেকক্ষণ পর এবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,
– দোস্ত, উকালতি করে কতোশত কেস ডিশমিশ করেছি। কিন্তু তোর এই কেসটা সত্যিই আমাকে বড্ড ভাবাচ্ছে।

তুহিন মাথা তুলে তাকালো রাশেদের দিকে। রাশেদের পরণে একটা সাদা রঙের শার্ট। সে কাজ থেকে সরাসরি এখানে এসেছে। হাতে কিছু ফাইলও আছে। এইসব অন্যায়মূলক কাজ নিয়ে একজনের উকিলের সাথে আলোচনা করার বোধগম্য তুহিনের হতো না, যদি রাশেদ তাঁর প্রিয় বন্ধু না হতো! তুহিন কোনো বাক্যকয় করল না। কফির কাপে চুমুক দিলো শুধু। রাশেদ বলল,
– একটা কথা বলতো, মেয়েটার সাথে কি তোর শারীরিক কোনো সম্পর্ক হয়েছে?

তুহিন চমকে উঠল রাশেদের কথা শুনে। ভীমড়ি খাওয়া কণ্ঠে উত্তর দিলো,
– আরে না না। ওইরকম কিছু হয়নি আমাদের মাঝে।

– তাহলে তুই মেয়েটার কথায় এত পাত্তা দিচ্ছিস কেন? সরাসরি বলে দে, তুই ওকে বিয়ে করতে পারবি না।

– বলেছি। তখন ও বলেছে, ওর কাছে আমাদের একসাথে যা ছবি আছে, সেসব ফাতেমাকে দেখিয়ে দেবে।

– তুই না বললি, ওর সাথে শারীরিক কোনো সম্পর্ক হয়নি৷ তাহলে ছবি কীসের?

– ওভাবে কোনো সম্পর্ক হয়নি। বাট যখন আমরা দেখা করেছি, তখন ও প্রায়ই আমাকে জড়িয়ে ধরতো, ছবি তুলতো৷ হাত ধরাধরি করে হেঁটেছি। সেসময়কার ছবিও তুলেছে। এখন সেসব ছবি দিয়েই হুংকি দিচ্ছে।

রাশেদ অবাক হলো। ব্যাপারটা আসলেই খুব জটিল। মেয়েটা যে খুব ধুরন্ধর, তা রাশেদ বুঝতে পারছে। সে বলল,
– তুই এখন কী করতে চাচ্ছিস?

– বুঝতে পারছি না। সেজন্যই তোর কাছে এলাম।

রাশেদ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
– ওকে কী তুই বিয়ে করতে চাচ্ছিস?

তুহিন নিঃশ্বাস আটকিয়ে বলল,
– না না। আমার বাড়িতে স্ত্রী, ভাই-বোন সবাই আছে। ওদের মুখ দেখাবো কীভাবে? তাছাড়া ফাতেমাকে ঠকাবো কীভাবে আমি?

– মেয়েটার সাথে সম্পর্ক করে তুই কী ফাতেমাকে ঠকাসনি? এখন ভালোমানুষি দেখালে তো চলবে না। বিয়ের আগে প্রেম করেছিস, সেটা আলাদা ব্যাপার। কিন্তু বিয়ের পরেও ওর সাথে সম্পর্ক করেছিস৷ এটাকে বলে পরকীয়া। তুই জানিস এটা কতবড় অন্যায়? ফাতেমা যদি তোর নামে মামলা করে, তাহলে তুই শেষ।

তুহিন উত্তর দিলো না। দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ল। রাশেদ আবার বলল,
– মেয়েটার কী পরিবার নেই?

– আছে। ওর স্বামী আছে। আমার সাথেই চাকরি করে। ওর মাধ্যমেই তো আবার মেয়েটার সাথে আমার দেখা হলো। ওর স্বামীর সাথে আমার সম্পর্কটা ভালো; বন্ধুত্বপূর্ণ। তাই আমি ওর সাথে একদিন বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখনই ওর স্ত্রীর সাথে দেখা হয়েছে।

রাশেদ হেসে দিলো এবার। খিলখিল করে হেসে বলল,
– আরে ইয়ার, তুই তো দেখি চারিদিক দিয়ে ফেঁসে গেছিস। তোদের এই প্রেমকাহিনী ফাঁস হলে বন্ধুত্ব, বিশ্বাস সব হারাবি। আবার এমনও হতে পারে, ছেলেটা অফিসের কারোর সাথে এটা শেয়ার করল। এভাবে অফিসে ছড়িয়ে যাবে। এইসব খবর তো চাপা থাকে না। তখন অফিসে তোর ইজ্জতভ্রষ্ট হবে। এরপর জানবে তোর বউ। তারপর তোর ভাই, বোন। সবাই জানবে। তুই মামা শেষ। তাঁর থেকে বলিকি, সব তো শেষ হয়েই যাবে, তুই আগেই মেয়েটাকে বিয়ে কর৷ রোমান্স কর। যা হওয়ার তা হবে।

রাশেদ রসিক সুরে গড়গড় করে কথাগুলো বলে আবার হাসতে লাগল। আশেপাশের দুই-একজন বাঁকা চোখে তাকালেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তুহিন হুংকার ছেড়ে বলল,
– ধুর শালা! আমি আছি বিপদে, আর তুই ফাজলামি করছিস। মজা কম নিয়ে আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার কর।

রাশেদ হাসি থামিয়ে বলল,
– তুই এই বিপদেই জড়াতি না, যদি স্ত্রীকে নিজের মনে জায়গা দিতি।

রাশেদকে সমর্থন করে বলল,
– এটা ঠিক বলেছিস। ফাতেমার সাথে আমার সম্পর্ক এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক না। ও আমাকে আপনি বলে ডাকে। আমিও খুব একটা কথা বলি না। দেখছিস না, বিয়ের পর এতবছর হয়ে গেল, অথচ আমাদের সন্তান নেই৷ আসলে সেরকম কোনো চিন্তাভাবনা আমি করিনি। ও নিজেও লজ্জায় কিছু বলেনি।

– তোরা কী সাংসারিক জীবনে অসুখী?

– না। ও আমায় খুব ভালোবাসে। মেয়ে মানুষ, একটু-আধটু লজ্জা তো পাবেই। আমি নিজেই ওর সাথে সহজ হতে পারিনি। ও মেয়ে হয়ে কীভাবে হবে বল? তবে আমাদের মধ্যে এই নিয়ে কখনো মনমালিন্যতা হয়নি। ও খুব ভালো একটা মেয়ে।

– এইরকম একটা মেয়েকেই তুই দিনেরপর দিন ঠকিয়ে যাচ্ছিলি। ভাবতে পারছিস, কতবড় অন্যায় করেছিস। বিয়ে হওয়ার পরেও পুরোনো প্রেমিকার সাথে সম্পর্ক রেখেছিস, এটা খুব বড় অন্যায়। দেখ, এইসব ফাঁস হলে ওই মেয়েটার কী ক্ষতি হবে জানি না, কিন্তু তোর আর ফাতেমার অনেক ক্ষতি হবে। স্ত্রীকে একটু গুরুত্ব দিতে শিখ। আবার সম্পর্কে জড়ানোর আগে তোর উচিত ছিল, ফাতেমার পরামর্শ নেওয়া।

– ধুর, ওর পরামর্শ নিলে আরও ঝামেলা হতো৷ ও কী আমায় বলতো, যাও, তুমি ওর সাথে প্রেমে করো! রাশেদ তুই খুব বোকা উকিল।

রাশেদ হাসল। হেসে বলল,
– এখন কী মনে হচ্ছে না, পুরোনো প্রেমিকার সাথে আবারও সম্পর্কে না জড়ালেই ভালো হতো?

তুহিন মাথা নাড়ল। রাশেদ আবারও বলল,
– এবার বল, আমি বোকা উকিল, না তুই বোকা স্বামী?

তুহিন নিজের মনে বলল,
– বোকা স্বামী!
রাশেদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
– সেসময় যদি তুই নিজের স্ত্রীর কাছে পরামর্শ নিতি, তাহলে আজ এইরকম একটা জটিলতায় জর্জরিত হতি না। আমার বাড়িতে স্ত্রী আছে। আমি জানি স্ত্রী কেমন হয়! দেখ, একটা স্ত্রী নিজের ভালো কতটা বুঝে তা আমি জানি না, কিন্তু একজন স্ত্রী তাঁর স্বামী এবং সন্তানের ভালো যেভাবে বুঝতে পারে, তা পৃথিবীর অন্য কেউ পারে না। তোর ওই গালফ্রেন্ডকে আমি স্ত্রী বা নারী বলেই ভাবি না। যে মেয়ে তাঁর স্বামীকে ঠকায়, সে আবার কেমন স্ত্রী! ও জাস্ট একটা মেয়ে। স্ত্রী অথবা নারী শব্দের গভীরতা খুব বেশি। তুই যদি ফাতেমার কাছে পরামর্শ চাইতি, তাহলে ফাতেমা সঠিক কাজটাই করতো৷ তোকে আগলে রাখতো। তোদের মধ্যে যে দূরত্বটা ছিল, ও নিজেই সেটা পূরণ করে দিতো। ফলে কোনো ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগই পেতি না তুই। ঠিক কি না বল?

তুহিন মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো। রাশেদ আবার বলল,
– তুই যে আবার কোনো ভুল না করে আমার কাছে সবটা শেয়ার করেছিস, এতে আমি খুশি হয়েছি৷ এটা করে তুই নিজেই নিজের উপকার করেছিস। শোন, মেয়েটা যদি তোকে সত্যিই ভালোবাসতো, বা একজন ভালো মানুষ হতো, তাহলে নিজের স্বামীকে ঠকিয়ে তোর জীবনটা ধ্বংস করতে আসতো না। আবার তোকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করতেও চাইতো না। তুই নিজে যে অপরাধ করেছিস, তাঁর জন্য আল্লাহ তোকে ক্ষমা করবেন কিনা জানি না। কিন্তু যদি আমার পরামর্শ শুনিস, তাহলে হয়তো স্ত্রীর কাছে ক্ষমা পেতে পারিস। শুনবি আমার পরামর্শ?

– শুনবো।

– বেশ। তাহলে শোন, তুই এখন সরাসরি বরিশাল যা। যেভাবেই পারিস, কালকের মধ্যেই ওখানে চলে যা। তারপর ফাতেমার কাছে সব স্বীকার কর।

তুহিন হকচকিয়ে বলল,
– বলিস কি! ফাতেমাকে বললে, ও তো চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে। ও খুব রাগী, আমি দেখেছি ওর রাগ।

রাশেদ হেসে আবার বললাম,
– বললাম না, নিজের স্বামীর ভালো একজন স্ত্রীর থেকে কেউ ভালো বুঝবে না। তুই যদি এখন নিজে থেকে ওর কাছে সব অন্যায় স্বীকার করিস, তাহলে ও ভাববে, তুই নিজের ভালো বুঝতে পেরে ওর কাছে ক্ষমা চাচ্ছিস। ফলে ও তোকে স্বামীর জায়গায় থেকে না সরিয়ে স্ত্রী হিসেবে তোকে সাপোর্ট দিবে। কিন্তু ও যদি নিজে থেকে কখনো এইরকম কঠিন সত্যি জানতে পারে, তাহলে ভাববে তুই ওকে স্ত্রীর জায়গাটা কখনো দিসই তো। ফলে ও রেগেমেগে উল্টো পাল্টা কিছু করবে। তুই যদি স্ত্রীর সাথে মিশতি, তাঁর সাথে মন খুলে কিছুক্ষণ কথা বলতি, তাহলে স্ত্রীর মর্ম বুঝতে পারতি। একজন স্ত্রী তাঁর স্বামীর জন্য কতটা কী করতে পারে, তা কখনো বুঝার চেষ্টা করিসনি তুই। সেজন্য আজ এই অবস্থা। শোন, যদি নিজের ভালো চাস, তাহলে আমার কথা শোন, ফাতেমার কাছে যা। দু’জনে একান্তে কিছুটা সময় কাটা। তোর মনে ওর প্রতি যে দূরত্ব আছে, সেটা পূরণ করে দে। আমার বিশ্বাস, ও নিজে থেকেই কিছুটা অনুমান করতে পারবে। নিজেই তোকে জিজ্ঞেস করবে, কী হয়েছে। বিপদের সময় স্ত্রী-সন্তানের থেকে বড় শক্তি পৃথিবীতে আর কিচ্ছু নেই।

– আমার চাকরি! আমি তো এখনো ছুটি পাইনি। ইনফ্যাক্ট এখনো আবেদন করিনি।

– এইসব জানাজানি হলে তুই এমনিতেও চাকরিটা করতে পারবি না। একবার ভাব, তোর সেই বন্ধুর কাছে তোর জায়গাটা ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। ওর সাথে কী একই জায়গায় কাজ করতে পারবি আর?

তুহিন নিশ্চুপ। রাশেদ আবার বলল,
– এদিকের ব্যাপারটা আমি দেখে নিবো। দেখ, সেরকম ভাবে কোনো অঘটন ঘটাসনি তুই, তাই মেয়েটা মামলা-টামলা করলেও খুব একটা সুবিধে করতে পারবে না। তবুও যদি কিছু করে, আমি দেখে নেবো। এইরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। সবাই তো আর আমার কাছে পরামর্শ চায়নি। তুই চেয়েছিস, তাই তোকেই বললাম। আমার বিশ্বাস, তোরা সুন্দর একটা জীবনে ফিরতে পারবি। এখন তুই শ্বশুর বাড়ি যা। সব স্বাভাবিক হলে আবার যখন ফিরে আসবি, তখন চাকরির ব্যবস্থা করা যাবে। আপাতত নিজের যা জমানো আছে, তা দিয়ে চলাফেরা কর।

তুহিন সমর্থন করল রাশেদের কথায়। দু’জনে আরও কিছুটা সময় কাটিয়ে নিজেদের গন্তব্যে যাওয়া শুরু করল।

১৯.
– ‘আচ্ছা, আপনি কাউকে ভালোবাসেন?’
আসমার প্রশ্নে ভ্রু-কুঁচকে তাকালো তাহমিদ। কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলো,
– ‘হ্যাঁ।’
আসমা অবাক হলো। যদিও অবাক হওয়ার মতো কিছু বলেনি তাহমিদ। তবুও সে অবাক হতে বাধ্য হলো। এইরকম এলোমেলো একটা মানুষের জীবনে ভালোবাসা থাকতে পারে, তা ভাবেনি সে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
– ‘কতটা ভালোবাসেন তাকে?’
– ‘অনেকটাই। পরিমাপ করার যন্ত্র এখনো আবিষ্কার হয়নি। আবিষ্কার হলে আমি তা দিয়ে ভালোবাসা পরিমাপ করে আপনাকে জানাবো।’
আসমা ফিক করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল,
– ‘ তবে এই যন্ত্রের আবিষ্কারককে অবশ্যই প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা হতে হবে। কোনো সাধারণ মানুষ এই যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারবে না। সারাজীবন চেষ্টা করবে, আর ভীমড়ি খাবে।’
এ-কথা বলে উচ্চস্বরে হেসে উঠল আসমা। তাহমিদ অবাক চোখে দেখল আসমাকে। কী স্নিগ্ধ হাসি মেয়েটার! তানিশাও মাঝে মাঝে জোরে জোরে হেসে ওঠে। তাহমিদ কখনো মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তানিশার হাসিমাখ মুখটা দেখেনি। অথচ তাঁর উচিত ছিল, একবার অন্তত দেখা। যে মেয়েটাকে তাকে এত ভালোবাসে, তাঁর হাসিমাখা মুখটা দেখল না, অথচ অন্য একটা মেয়ের দিকে সে ‘হা’ করে তাকিয়ে আছে। খুব আফসোস হচ্ছে তাহমিদের।

সকাল ৭ টা ৩০ মিনিট। আকাশ কিছুটা মেঘলা। তবে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আসমার একটা বাগান আছে। ফুলগাছ সহ আরো অনেক গাছই আছে সেখানে। রোজ সকালে বাগানের গাছগুলোতে পানি দেয় আসমা নিজেই। মাঝে মাঝে রাইশা সাথে আসে। তবে আজ এসেছে তাহমিদ। তাহমিদ যে এত ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, তা ভাবনার বাইরে ছিল আসমার।
ছোট গোলাপ গাছটাতে পানি দিচ্ছিল আসমা; সেসময় তাহমিদ আবার বলে উঠল,
– ‘আপনি সজল মাস্টারকে খুব ভালোবাসেন, তাই না?’
– ‘ হ্যাঁ, খুব।’ মুচকি হেসে জবাব দিলো আসমা।
তাহমিদ আবার জিজ্ঞেস করল,
– ‘সবাই দেখছি আপনাদের এই সম্পর্কের বিপক্ষে। মানে কেউ আপনাদের পক্ষে নেই।’
– ‘না থাক; তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না।’
– ‘আমার জীবনে যে ভালোবাসাটা আছে, তাঁর পক্ষেও কেউ নেই। সবাই আমার ভালোবাসার বিপক্ষে। এমনকি আপনি যদি আমার ভালোবাসার সম্পর্কে সবকিছু জানেন, তাহলে আপনিও বিপক্ষে চলে যাবেন।’
– ‘কক্ষনো না। আমি আপনার ভালোবাসার পক্ষে আছি, এবং থাকবো।’ বেশ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে কথাটা বলল আসমা।
তাহমিদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
– ‘আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর আপনি আমার বিপক্ষে চলে যাবেন। এমনকি আমাকে পাগল বলবেন।’
– ‘ ধুর! আপনি সুস্থ একজন মানুষ। আপনাকে আমি পাগল বলতে যাবো কোন দুঃখে. আপনি বলুন দেখি, আপনার সেই ভালোবাসার মানুষটির নাম কী?’
– ‘ ওর কোনো নাম নেই। তবে একটা সংখ্যা আছে।’
আসমা চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– ‘ সংখ্যা মানে; মানুষের নাম নেই, অথচ সংখ্যা আছে! এ আবার হয় নাকি।’
– ‘যা সত্যি তাই বললাম। সংখ্যাটি হলো, ‘009’। এটা অবশ্য মোবাইল নম্বর। যেহেতু ওর কোনো নাম নেই, তাই ওর পরিচয় হিসেবে আমি ‘009’ ব্যবহার করি।’
আসমা রাগে চোখ-মুখ লাল করে বলল,
– ‘আপনি কী পাগল? এইরকমটা হয় নকি। পাগল ছাড়া এই ধরনের কথা কেউ বলতে পারে।’
আসমার কথা শুনে জোরে হেসে উঠল তাহমিদ। আসমা কী যেন বুঝতে পেরে নিজের ভুল শুধরে নিয়ে বলল,
– ‘ না না, ঠিক পাগল না। আপনি একজন নির্বোধ মানুষ। সংখ্যা কারোর পরিচয় হতে পারে না। নিশ্চয়ই তাঁর একটা ভিন্ন পরিচয় আছে। আচ্ছা, সে থাকে কোথায়?’ কথা বলার সময় আসমার মুখ কপট বিব্রত দেখালো।
তাহমিদ দ্রুত বলল,
– ‘আমার মস্তিষ্কে ওর বসবাস।’
তাহমিদের কথা শুনে আসমার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। চোখ বড় করে বলল
– ‘ হোয়াট? আর ইউ ক্রেজি? দেখুন, সহজ বিষয়টিকে আপনি জটিল করছেন।’
তাহমিদ হাসল। হেসে বলল,
– আমি সহজ বিষয়টিকে জটিল করছি বা। এই ‘009’ একটি সংখ্যা। এই সংখ্যার নম্বর থেকে একটা মেয়ে ফোন দেয় আমাকে। সবাই এটাকে ‘হ্যালুসিনেশন’ বলে তাচ্ছিল্য করলেও আমি এর থেকে দূরে যেতে পারিনি৷ আপনি সজল মাস্টারের থেকে দূরে যেতে পারেননি, কারণ আপনি তাকে ভালোবাসেন। আমিও বোধহয় এই ‘009’ পরিচয়ের মেয়েটিকে ভালোবাসি বলেই তাঁর থেকে দূরে যেতে পারিনি। আপনি সজল মাস্টারকে ঠিক যতটা ভালোবাসেন, আমার মনে হয় আমিও ওই মেয়েটিকে ততটাই ভালোবাসি। কারণ আমরা কেউ নিজেদের ভালোবাসা থেকে দূরে যেতে পারেনি। ভালোবাসার জন্য সবার অবাধ্য হয়েছি।

চারিদিকে আঁধার নেমে আসছে। মেঘ গর্জন নিয়ে উঠেছে। আকাশের মেঘলা ভাবটা ঘন হয়ে এসেছে। আসমা তাগাদা দিয়ে বলল,
– ‘এক্ষুনি বৃষ্টি নেমে পড়বে। বাড়ি চলুন তাড়াতাড়ি।’

আসমা হাঁটা দিলো। ভেবেছে তাহমিদ তাঁর পিছনেই আসছে। কিন্তু তাহমিদ নড়ল না এক-পা ও। স্থির দাঁড়িয়ে থেকে আকাশের দিকে তাকালো।
মিনিট কয়েক পরেই ঝুমঝুম করে
বৃষ্টি নামল। তাহমিদ আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল।

৭ম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক কমেন্ট বক্সে দেওয়া আছে।

ছবি: Umme Rokshana Akther

সম্পৃক্ততা পর্ব ৭

0

সম্পৃক্ততা – সপ্তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

১৭.
উঠোনে বড় পাটিটা বিছানো হয়েছে। পড়ন্ত বিকেল। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। পাটিতে সবাই বসে আছে। পরপর তিনটে ঘর আছে এ বাড়িতে। সামনে আছে একটা বারান্দা, তাঁর সামনে বিশাল আকারের একটা দুয়ার। দুপুরে ফ্রেশ হয়ে সবার সাথে খাওয়াদাওয়া করেছে তাহমিদ। এখন সবার সাথেই বসে গল্প করছে।

হাফিজ উদ্দিন মেয়ে ফাতেমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– ফাতেমা, জামাই বাবাজি এলে খুব ভালো হতো।

ফাতেমা জবাবে বলল,
– বাবা, উনি কিছুদিন পর আসবেন। তাহমিদের অফিসের বসকে আমি চিনি। তাই ওকে বলে সহজেই তাহমিদের ছুটির ব্যবস্থা করতে পেরেছি। ওর ভাইয়ের অফিসে একটু বেশিই ঝামেলা। তাই হুটহাট করে ছুটি পাওয়া যায় না। উনি বলেছেন, বিয়ের আগে চলে আসবে।

– তা সে আছে কেমন?

ফাতেমা মৃদুস্বরে বলল,
– উনি ভালো আছে বাবা।

হাফিজ উদ্দিন কিছু বললেন না আর৷ ভাবতে লাগলেন নিজের সংসার জীবনের কথা। কত কষ্ট করে মেয়েদের বড় করে তুলেছেন। অথচ এখন মেয়েদের অন্যের ঘরে দিয়ে দিতে হচ্ছে। চাইলেও রোজ রোজ মেয়েদের মুখখানি দেখতে পারবেন না। কোনো উৎসব বা বছরে দুই একবার ঘুরতে আসা ছাড়া মেয়েদের একটু সঙ্গ দিতে পারবেন না। হঠাৎ করেই মেয়েগুলো এতবড় হয়ে গেল যে, তাঁদের পরের ঘরে দিয়ে দিতে হচ্ছে।

আসমা চুপচাপ বসে ছিল এক কোণায়। তাহমিদ আড়চোখে বারবার তাকে দেখছিল ; আর ভাবছিল, মেয়েটাকে কী বিয়েতে বাধ্য করা হচ্ছে? এইরকম কিছু হলে তো অন্যায় হবে। একজন মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে কিছু আছে। অন্য একজন মানুষ হয়ে, কারোর ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। আসমার যদি বিয়েতে মত না থাকে, তাহলে জোর করে বিয়ে দিয়ে ওর বাবা-মা অন্যায় করছেন।
তাহমিদ বেশ কয়েকবার ভেবেছে কিছু বলবে। কিন্তু কী দিয়ে শুরু করবে, তা ভেবে পাচ্ছিল না। এবার হঠাৎ করেই তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেল। সে একটু কেঁশে গলা পরিষ্কার করে নিলো। সবাই একসাথে তাকালো তাঁর দিকে। তুলি পাশ থেকে বলে উঠল,
– ভাইয়া কি গান গাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছ?

তুলির কথায় পাত্তা দিলো না তাহমিদ। সে আসমার দিকে তাকিয়ে প্রবল দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– আসমা, আপনি অত গম্ভীর হয়ে বসে আছেন কেন?

আসমা চমকে উঠল হঠাৎ তাহমিদের কথা শুনে। কপাল ভাজ করে তাকিয়ে রইল। তাহমিদ পরক্ষণেই আবার বলে উঠল,
– আপনি কী এই বিয়েতে রাজি নন? মানে আপনাকে কী জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে?

তাহমিদের কথা শুনে তুলি পাশ থেকে আবার বলল,
– ভাইয়া, কাকে কী বলছ? আসমা আপুকে জোর করে বিয়ে দিতে যাবে কেন?

তাহমিদ তুলির দিকে তাকিয়ে বলল,
– না মানে, উনি কেমন চুপচাপ বসে আছেন। নববধূরা তো এইরকম থাকে না সাধারণত। বিয়ের আগে তাঁদের বেশ হাসিখুশি এবং আনন্দে থাকতে হয়।

তুলি হো হো করে হেসে বলল,
– ভাইয়া, বিয়ে হচ্ছে রাইশার, আর তুমি বলছ আসমা আপুকে, হা হা হা।

তুলির কথা শুনে থমকে গেল তাহমিদ। লজ্জাও পেলো বেশ কিছুটা। হাফিজ উদ্দিন, হুমাইরা, ফাতেমা উচ্চস্বরে হেসে উঠল তুলির কথা শেষ হতেই। আসমাও মুখ টিপে হাসল। তাহমিদ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অবাক কণ্ঠে বলল,
– মেজো কে রেখেই সেজোর বিয়ে হচ্ছে নাকি?

আসমা অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো শুধু। তাহমিদ আবার বলল,
– এ কেমন কথা! ভাবী বলল, তাঁর বোনের বিয়ে। যেহেতু ভাবীর পর সিরিয়ালে আপনিই আছেন, তাই আর জিজ্ঞেস করিনি, কোন বোনের। দেখো কী কাণ্ড!

আসমা মুখ খুলে কিছু বলার আগেই হাফিজ উদ্দিন, তাহমিদের সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠল,
– এটাই ওকে বুঝায় কে? এই সামান্য একটা কারণে আমাকে কত মানুষের কথা শুনতে হচ্ছে। অথচ আজ যদি রাইশার আগে আসমা বিয়ে করতো, তাহলে লোকের বাঁকা কথাবার্তা শুনতে হতো না।

আসমা চোখ পাকিয়ে তাকালো বাবার দিকে। কিন্তু হাফিজ উদ্দিন মেয়ের চোখ রাঙানোকে অগ্রাহ্য করে আবার বললেন,
– তাহমিদ বাবা, তোমার মতো একটা ছেলে হাতের কাছে পেলে আমি আসমার বিয়েই আগে দিতাম। কিন্তু সে তো এমন একটা ছেলেকে পছন্দ করেছে, যে আমাদের ধরাছোঁয়ার অনেক বাইরে। ছেলেটার নাম সজল মাস্টার৷ ওর দাদা আগে চেয়ারম্যান ছিল। ছেলে যেমনি হোক, বংশের একটা ব্যাপারস্যাপার আছে। আসমার সাথে তো আর সম্পর্ক শুধুমাত্র মাস্টারের সাথে হবে না; ওদের পুরো পরিবারের সাথে হবে। আমি নিশ্চিত, আমার মেয়েটা ওখানে দু’দিনও টিকটে পারবে না। অত্যাচার করে মেরে ফেলবে ওরা। ছেলেটার দাদাকে গ্রামের লোকজন ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান করছিল গ্রামের উন্নয়ন করার জন্য। অথচ সে এমন হারামজাদা ছিল যে, সারাজীবন খালি নিজের সম্পত্তি বাড়াইছে। এখন এমন অবস্থা হইছে যে, গ্রামের সবার যত সম্পত্তি আছে, ওগো একাই তাঁর থেকে বেশি সম্পত্তি আছে। এছাড়াও ওদের যা ব্যবহার। আল্লাহ মাফ করুক, ওইরকম পরিবারের ছেলের সাথে আমি মরে গেলেও নিজের মেয়ের সম্মন্ধ করব না।

আসমা রাগে গজগজ করছে। একজায়গায় বসে থেকেও ছটফট করছে সে। তাহমিদ আড়চোখে একবার আসমার রাগী মুখ দেখে হাফিজ উদ্দিনকে বলল,
– এটাই কী সমস্যা? মানে এই সমস্যা সমাধান হলেই কি আপনি ওই মাস্টারের সাথে আসমার বিয়ে দেবেন?

– না। আরও একটা সমস্যা আছে।

– কী?

– ওরা অনেক বড়লোক। ওরা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের সাথে সম্মন্ধ করবে না।

তাহমিদ কী যেন ভেবে বলল,
– ওহ্। তাহলে এই দু’টোই সমস্যা।

ফাফিজ উদ্দিন বললেন,
– না। আরও একটা আছে। ওই মাস্টারও সুবিধার না। বাপ-দাদার মতো টাকার ক্ষিধে না থাকলেও চরিত্রে ঝামেলা আছে। দেখতে একেবারে বাংলা সিনেমার নায়কদের মতো। তাই এতদিন শহরে না গিয়া গ্রামে থেকে, গ্রামের মেয়েদের মাথা খাইছে।

এ-কথা শোনার পর আসমা আর বসে ছটফট করতে পারল না। বসা থেকে দাঁড়িয়ে, তেড়ে এলো বাবার সামনে। চেঁচিয়ে বলল,
– একদম চুপ বাবা। সবাই চুপ। আর কেউ যদি ওই মাস্টার বা মাস্টারের পরিবার নিয়ে কথা বলো, তাইলে সুই-সুতো দিয়ে সবার মুখ সেলাই করে দিবো। যত্তসব পাগলের কারখানা।

আসমা আর দাঁড়ালো না ওখানে। রেগেমেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। তাহমিদ হাসল; সাথে যোগ দিলো ফাতেমা, তুলি আর রাইশা। কিছুক্ষণ পর সবাই আবার কথা বলতে লাগল ভিন্ন প্রসঙ্গে। কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। আসমা ফিরে এলো না তখনো। তাহমিদ হঠাৎ বলল,
– আমি একটু গ্রামটা ঘুরে আসছি৷

তাহমিদ বেরিয়ে পড়ল।

১৮.
মানুষ একটা সময় নিজের ভুল বুঝতে পারে৷ কিন্তু ভুল শুধরে নিতে পারে না। কারণ ততক্ষণে আর সময় থাকে না। নদীর জল একজায়গায় আটকানোর জন্য যেমন বাধ দেওয়া হয়, তেমনি সম্পর্কে নিজেকে আবদ্ধ রাখার জন্য নিজেকে কন্ট্রোল করতে হয়। নিজেকে যেমন একজন সিদ্ধান্তকারী ভাবতে হয়, তেমনি একজন মতামতকারী ভাবতে হয়। অর্থাৎ সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করার জন্য নিজেকে একজন সঠিক সিদ্ধান্তকারী ভাবতে হবে। আবার যেকোনো বিষয়ে কাছের কারোর সাথে আলোচনা করতে হয়। শুরুতেই সিদ্ধান্ত নয়, মতামত জানাতে হয়।

বনানীর হাইওয়ে রোডের পাশে থাকা রেস্টুরেন্টে বসে আছে তুহিন এবং রাসেদ। রাসেদ পেশায় একজন উকিল। দু’জনের বন্ধুত্ব ইউনিভার্সিটি থেকেই। আজ অফিস যায়নি তুহিন। গতকালও যায়নি। যাওয়ার কোনোরকম ইচ্ছেও ছিল না। অবশ্য খুব শীঘ্রই এমন এক মুহূর্ত আসতে চলেছে, সে চাইলেও আর ওই অফিসে যেতে পারবে না। শুধু অফিস নয়, সে বাড়িতেও যেতে পারবে না। বাড়িতে যেতে তাঁর বিবেক বাধা দিবে। বিশেষ করে যখন ফাতেমা নামের নির্দোষ মেয়েটি বাড়িতে থাকবে। মেয়েটির সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস তুহিনের নেই। সে তাঁর সাথে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছে।

ফাতেমা বাড়িতে নেই আজ দু’দিন হতে চলল। গতকাল সকালে ফাতেমা থাকাকালীন সময়ে তুহিন বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। কিন্তু অফিসে যায়নি। ফাতেমা চলে যাওয়ার পরই সে আবার বাড়িতে ব্যাক করেছিল। সারাদিন বাড়িতে ছিল। সন্ধ্যায় হঠাৎ ডাক পড়ল তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকার। সে বিরক্ত হয়েছিল বটে, তবে না করতে পারেনি। গিয়েছিল এক রেস্টুরেন্টে। খাওয়াদাওয়া শেষে হঠাৎ মেয়েটা বলে উঠল, তাকে বিয়ে করতে হবে। অবাক কাণ্ড! এক বউ থাকতে নাকি আবার বিয়ে?
মেয়েটার সাথে তুহিনের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল বিয়ের আগে। এরপর মেয়েটার অন্য একজনের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। তুহিনও ফাতেমাকে বিয়ে করে সংসার করতে থাকে। শুরু থেকে ফাতেমার প্রতি একটা সংকোচবোধ ছিল বটে, তবে আস্তে আস্তে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। এর মাঝে হঠাৎ আবার চলে আসে মেয়েটা। সে জানায়, তাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়েতে বাধ্য করা হয়েছিল। তুহিন আবার মেয়েটার ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এরপর থেকে এভাবেই চলছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, সে নিজেই নিজের জীবনকে জটিল করে তুলছে।

রাশেদ চুপচাপ খাচ্ছিল এতক্ষণ। আর ভাবছিল বন্ধুর জীবনের জটিলতার কথা। অনেকক্ষণ পর এবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,
– দোস্ত, উকালতি করে কতোশত কেস ডিশমিশ করেছি। কিন্তু তোর এই কেসটা সত্যিই আমাকে বড্ড ভাবাচ্ছে।

তুহিন মাথা তুলে তাকালো রাশেদের দিকে। রাশেদের পরণে একটা সাদা রঙের শার্ট। সে কাজ থেকে সরাসরি এখানে এসেছে। হাতে কিছু ফাইলও আছে। এইসব অন্যায়মূলক কাজ নিয়ে একজনের উকিলের সাথে আলোচনা করার বোধগম্য তুহিনের হতো না, যদি রাশেদ তাঁর প্রিয় বন্ধু না হতো! তুহিন কোনো বাক্যকয় করল না। কফির কাপে চুমুক দিলো শুধু। রাশেদ বলল,
– একটা কথা বলতো, মেয়েটার সাথে কি তোর শারীরিক কোনো সম্পর্ক হয়েছে?

তুহিন চমকে উঠল রাশেদের কথা শুনে। ভীমড়ি খাওয়া কণ্ঠে উত্তর দিলো,
– আরে না না। ওইরকম কিছু হয়নি আমাদের মাঝে।

– তাহলে তুই মেয়েটার কথায় এত পাত্তা দিচ্ছিস কেন? সরাসরি বলে দে, তুই ওকে বিয়ে করতে পারবি না।

– বলেছি। তখন ও বলেছে, ওর কাছে আমাদের একসাথে যা ছবি আছে, সেসব ফাতেমাকে দেখিয়ে দেবে।

– তুই না বললি, ওর সাথে শারীরিক কোনো সম্পর্ক হয়নি৷ তাহলে ছবি কীসের?

– ওভাবে কোনো সম্পর্ক হয়নি। বাট যখন আমরা দেখা করেছি, তখন ও প্রায়ই আমাকে জড়িয়ে ধরতো, ছবি তুলতো৷ হাত ধরাধরি করে হেঁটেছি। সেসময়কার ছবিও তুলেছে। এখন সেসব ছবি দিয়েই হুংকি দিচ্ছে।

রাশেদ অবাক হলো। ব্যাপারটা আসলেই খুব জটিল। মেয়েটা যে খুব ধুরন্ধর, তা রাশেদ বুঝতে পারছে। সে বলল,
– তুই এখন কী করতে চাচ্ছিস?

– বুঝতে পারছি না। সেজন্যই তোর কাছে এলাম।

রাশেদ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
– ওকে কী তুই বিয়ে করতে চাচ্ছিস?

তুহিন নিঃশ্বাস আটকিয়ে বলল,
– না না। আমার বাড়িতে স্ত্রী, ভাই-বোন সবাই আছে। ওদের মুখ দেখাবো কীভাবে? তাছাড়া ফাতেমাকে ঠকাবো কীভাবে আমি?

– মেয়েটার সাথে সম্পর্ক করে তুই কী ফাতেমাকে ঠকাসনি? এখন ভালোমানুষি দেখালে তো চলবে না। বিয়ের আগে প্রেম করেছিস, সেটা আলাদা ব্যাপার। কিন্তু বিয়ের পরেও ওর সাথে সম্পর্ক করেছিস৷ এটাকে বলে পরকীয়া। তুই জানিস এটা কতবড় অন্যায়? ফাতেমা যদি তোর নামে মামলা করে, তাহলে তুই শেষ।

তুহিন উত্তর দিলো না। দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ল। রাশেদ আবার বলল,
– মেয়েটার কী পরিবার নেই?

– আছে। ওর স্বামী আছে। আমার সাথেই চাকরি করে। ওর মাধ্যমেই তো আবার মেয়েটার সাথে আমার দেখা হলো। ওর স্বামীর সাথে আমার সম্পর্কটা ভালো; বন্ধুত্বপূর্ণ। তাই আমি ওর সাথে একদিন বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখনই ওর স্ত্রীর সাথে দেখা হয়েছে।

রাশেদ হেসে দিলো এবার। খিলখিল করে হেসে বলল,
– আরে ইয়ার, তুই তো দেখি চারিদিক দিয়ে ফেঁসে গেছিস। তোদের এই প্রেমকাহিনী ফাঁস হলে বন্ধুত্ব, বিশ্বাস সব হারাবি। আবার এমনও হতে পারে, ছেলেটা অফিসের কারোর সাথে এটা শেয়ার করল। এভাবে অফিসে ছড়িয়ে যাবে। এইসব খবর তো চাপা থাকে না। তখন অফিসে তোর ইজ্জতভ্রষ্ট হবে। এরপর জানবে তোর বউ। তারপর তোর ভাই, বোন। সবাই জানবে। তুই মামা শেষ। তাঁর থেকে বলিকি, সব তো শেষ হয়েই যাবে, তুই আগেই মেয়েটাকে বিয়ে কর৷ রোমান্স কর। যা হওয়ার তা হবে।

রাশেদ রসিক সুরে গড়গড় করে কথাগুলো বলে আবার হাসতে লাগল। আশেপাশের দুই-একজন বাঁকা চোখে তাকালেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তুহিন হুংকার ছেড়ে বলল,
– ধুর শালা! আমি আছি বিপদে, আর তুই ফাজলামি করছিস। মজা কম নিয়ে আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার কর।

রাশেদ হাসি থামিয়ে বলল,
– তুই এই বিপদেই জড়াতি না, যদি স্ত্রীকে নিজের মনে জায়গা দিতি।

রাশেদকে সমর্থন করে বলল,
– এটা ঠিক বলেছিস। ফাতেমার সাথে আমার সম্পর্ক এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক না। ও আমাকে আপনি বলে ডাকে। আমিও খুব একটা কথা বলি না। দেখছিস না, বিয়ের পর এতবছর হয়ে গেল, অথচ আমাদের সন্তান নেই৷ আসলে সেরকম কোনো চিন্তাভাবনা আমি করিনি। ও নিজেও লজ্জায় কিছু বলেনি।

– তোরা কী সাংসারিক জীবনে অসুখী?

– না। ও আমায় খুব ভালোবাসে। মেয়ে মানুষ, একটু-আধটু লজ্জা তো পাবেই। আমি নিজেই ওর সাথে সহজ হতে পারিনি। ও মেয়ে হয়ে কীভাবে হবে বল? তবে আমাদের মধ্যে এই নিয়ে কখনো মনমালিন্যতা হয়নি। ও খুব ভালো একটা মেয়ে।

– এইরকম একটা মেয়েকেই তুই দিনেরপর দিন ঠকিয়ে যাচ্ছিলি। ভাবতে পারছিস, কতবড় অন্যায় করেছিস। বিয়ে হওয়ার পরেও পুরোনো প্রেমিকার সাথে সম্পর্ক রেখেছিস, এটা খুব বড় অন্যায়। দেখ, এইসব ফাঁস হলে ওই মেয়েটার কী ক্ষতি হবে জানি না, কিন্তু তোর আর ফাতেমার অনেক ক্ষতি হবে। স্ত্রীকে একটু গুরুত্ব দিতে শিখ। আবার সম্পর্কে জড়ানোর আগে তোর উচিত ছিল, ফাতেমার পরামর্শ নেওয়া।

– ধুর, ওর পরামর্শ নিলে আরও ঝামেলা হতো৷ ও কী আমায় বলতো, যাও, তুমি ওর সাথে প্রেমে করো! রাশেদ তুই খুব বোকা উকিল।

রাশেদ হাসল। হেসে বলল,
– এখন কী মনে হচ্ছে না, পুরোনো প্রেমিকার সাথে আবারও সম্পর্কে না জড়ালেই ভালো হতো?

তুহিন মাথা নাড়ল। রাশেদ আবারও বলল,
– এবার বল, আমি বোকা উকিল, না তুই বোকা স্বামী?

তুহিন নিজের মনে বলল,
– বোকা স্বামী!
রাশেদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
– সেসময় যদি তুই নিজের স্ত্রীর কাছে পরামর্শ নিতি, তাহলে আজ এইরকম একটা জটিলতায় জর্জরিত হতি না। আমার বাড়িতে স্ত্রী আছে। আমি জানি স্ত্রী কেমন হয়! দেখ, একটা স্ত্রী নিজের ভালো কতটা বুঝে তা আমি জানি না, কিন্তু একজন স্ত্রী তাঁর স্বামী এবং সন্তানের ভালো যেভাবে বুঝতে পারে, তা পৃথিবীর অন্য কেউ পারে না। তোর ওই গালফ্রেন্ডকে আমি স্ত্রী বা নারী বলেই ভাবি না। যে মেয়ে তাঁর স্বামীকে ঠকায়, সে আবার কেমন স্ত্রী! ও জাস্ট একটা মেয়ে। স্ত্রী অথবা নারী শব্দের গভীরতা খুব বেশি। তুই যদি ফাতেমার কাছে পরামর্শ চাইতি, তাহলে ফাতেমা সঠিক কাজটাই করতো৷ তোকে আগলে রাখতো। তোদের মধ্যে যে দূরত্বটা ছিল, ও নিজেই সেটা পূরণ করে দিতো। ফলে কোনো ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগই পেতি না তুই। ঠিক কি না বল?

তুহিন মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো। রাশেদ আবার বলল,
– তুই যে আবার কোনো ভুল না করে আমার কাছে সবটা শেয়ার করেছিস, এতে আমি খুশি হয়েছি৷ এটা করে তুই নিজেই নিজের উপকার করেছিস। শোন, মেয়েটা যদি তোকে সত্যিই ভালোবাসতো, বা একজন ভালো মানুষ হতো, তাহলে নিজের স্বামীকে ঠকিয়ে তোর জীবনটা ধ্বংস করতে আসতো না। আবার তোকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করতেও চাইতো না। তুই নিজে যে অপরাধ করেছিস, তাঁর জন্য আল্লাহ তোকে ক্ষমা করবেন কিনা জানি না। কিন্তু যদি আমার পরামর্শ শুনিস, তাহলে হয়তো স্ত্রীর কাছে ক্ষমা পেতে পারিস। শুনবি আমার পরামর্শ?

– শুনবো।

– বেশ। তাহলে শোন, তুই এখন সরাসরি বরিশাল যা। যেভাবেই পারিস, কালকের মধ্যেই ওখানে চলে যা। তারপর ফাতেমার কাছে সব স্বীকার কর।

তুহিন হকচকিয়ে বলল,
– বলিস কি! ফাতেমাকে বললে, ও তো চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে। ও খুব রাগী, আমি দেখেছি ওর রাগ।

রাশেদ হেসে আবার বললাম,
– বললাম না, নিজের স্বামীর ভালো একজন স্ত্রীর থেকে কেউ ভালো বুঝবে না। তুই যদি এখন নিজে থেকে ওর কাছে সব অন্যায় স্বীকার করিস, তাহলে ও ভাববে, তুই নিজের ভালো বুঝতে পেরে ওর কাছে ক্ষমা চাচ্ছিস। ফলে ও তোকে স্বামীর জায়গায় থেকে না সরিয়ে স্ত্রী হিসেবে তোকে সাপোর্ট দিবে। কিন্তু ও যদি নিজে থেকে কখনো এইরকম কঠিন সত্যি জানতে পারে, তাহলে ভাববে তুই ওকে স্ত্রীর জায়গাটা কখনো দিসই তো। ফলে ও রেগেমেগে উল্টো পাল্টা কিছু করবে। তুই যদি স্ত্রীর সাথে মিশতি, তাঁর সাথে মন খুলে কিছুক্ষণ কথা বলতি, তাহলে স্ত্রীর মর্ম বুঝতে পারতি। একজন স্ত্রী তাঁর স্বামীর জন্য কতটা কী করতে পারে, তা কখনো বুঝার চেষ্টা করিসনি তুই। সেজন্য আজ এই অবস্থা। শোন, যদি নিজের ভালো চাস, তাহলে আমার কথা শোন, ফাতেমার কাছে যা। দু’জনে একান্তে কিছুটা সময় কাটা। তোর মনে ওর প্রতি যে দূরত্ব আছে, সেটা পূরণ করে দে। আমার বিশ্বাস, ও নিজে থেকেই কিছুটা অনুমান করতে পারবে। নিজেই তোকে জিজ্ঞেস করবে, কী হয়েছে। বিপদের সময় স্ত্রী-সন্তানের থেকে বড় শক্তি পৃথিবীতে আর কিচ্ছু নেই।

– আমার চাকরি! আমি তো এখনো ছুটি পাইনি। ইনফ্যাক্ট এখনো আবেদন করিনি।

– এইসব জানাজানি হলে তুই এমনিতেও চাকরিটা করতে পারবি না। একবার ভাব, তোর সেই বন্ধুর কাছে তোর জায়গাটা ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। ওর সাথে কী একই জায়গায় কাজ করতে পারবি আর?

তুহিন নিশ্চুপ। রাশেদ আবার বলল,
– এদিকের ব্যাপারটা আমি দেখে নিবো। দেখ, সেরকম ভাবে কোনো অঘটন ঘটাসনি তুই, তাই মেয়েটা মামলা-টামলা করলেও খুব একটা সুবিধে করতে পারবে না। তবুও যদি কিছু করে, আমি দেখে নেবো। এইরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। সবাই তো আর আমার কাছে পরামর্শ চায়নি। তুই চেয়েছিস, তাই তোকেই বললাম। আমার বিশ্বাস, তোরা সুন্দর একটা জীবনে ফিরতে পারবি। এখন তুই শ্বশুর বাড়ি যা। সব স্বাভাবিক হলে আবার যখন ফিরে আসবি, তখন চাকরির ব্যবস্থা করা যাবে। আপাতত নিজের যা জমানো আছে, তা দিয়ে চলাফেরা কর।

তুহিন সমর্থন করল রাশেদের কথায়। দু’জনে আরও কিছুটা সময় কাটিয়ে নিজেদের গন্তব্যে যাওয়া শুরু করল।

১৯.
– ‘আচ্ছা, আপনি কাউকে ভালোবাসেন?’
আসমার প্রশ্নে ভ্রু-কুঁচকে তাকালো তাহমিদ। কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলো,
– ‘হ্যাঁ।’
আসমা অবাক হলো। যদিও অবাক হওয়ার মতো কিছু বলেনি তাহমিদ। তবুও সে অবাক হতে বাধ্য হলো। এইরকম এলোমেলো একটা মানুষের জীবনে ভালোবাসা থাকতে পারে, তা ভাবেনি সে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
– ‘কতটা ভালোবাসেন তাকে?’
– ‘অনেকটাই। পরিমাপ করার যন্ত্র এখনো আবিষ্কার হয়নি। আবিষ্কার হলে আমি তা দিয়ে ভালোবাসা পরিমাপ করে আপনাকে জানাবো।’
আসমা ফিক করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল,
– ‘ তবে এই যন্ত্রের আবিষ্কারককে অবশ্যই প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা হতে হবে। কোনো সাধারণ মানুষ এই যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারবে না। সারাজীবন চেষ্টা করবে, আর ভীমড়ি খাবে।’
এ-কথা বলে উচ্চস্বরে হেসে উঠল আসমা। তাহমিদ অবাক চোখে দেখল আসমাকে। কী স্নিগ্ধ হাসি মেয়েটার! তানিশাও মাঝে মাঝে জোরে জোরে হেসে ওঠে। তাহমিদ কখনো মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তানিশার হাসিমাখ মুখটা দেখেনি। অথচ তাঁর উচিত ছিল, একবার অন্তত দেখা। যে মেয়েটাকে তাকে এত ভালোবাসে, তাঁর হাসিমাখা মুখটা দেখল না, অথচ অন্য একটা মেয়ের দিকে সে ‘হা’ করে তাকিয়ে আছে। খুব আফসোস হচ্ছে তাহমিদের।

সকাল ৭ টা ৩০ মিনিট। আকাশ কিছুটা মেঘলা। তবে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আসমার একটা বাগান আছে। ফুলগাছ সহ আরো অনেক গাছই আছে সেখানে। রোজ সকালে বাগানের গাছগুলোতে পানি দেয় আসমা নিজেই। মাঝে মাঝে রাইশা সাথে আসে। তবে আজ এসেছে তাহমিদ। তাহমিদ যে এত ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, তা ভাবনার বাইরে ছিল আসমার।
ছোট গোলাপ গাছটাতে পানি দিচ্ছিল আসমা; সেসময় তাহমিদ আবার বলে উঠল,
– ‘আপনি সজল মাস্টারকে খুব ভালোবাসেন, তাই না?’
– ‘ হ্যাঁ, খুব।’ মুচকি হেসে জবাব দিলো আসমা।
তাহমিদ আবার জিজ্ঞেস করল,
– ‘সবাই দেখছি আপনাদের এই সম্পর্কের বিপক্ষে। মানে কেউ আপনাদের পক্ষে নেই।’
– ‘না থাক; তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না।’
– ‘আমার জীবনে যে ভালোবাসাটা আছে, তাঁর পক্ষেও কেউ নেই। সবাই আমার ভালোবাসার বিপক্ষে। এমনকি আপনি যদি আমার ভালোবাসার সম্পর্কে সবকিছু জানেন, তাহলে আপনিও বিপক্ষে চলে যাবেন।’
– ‘কক্ষনো না। আমি আপনার ভালোবাসার পক্ষে আছি, এবং থাকবো।’ বেশ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে কথাটা বলল আসমা।
তাহমিদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
– ‘আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর আপনি আমার বিপক্ষে চলে যাবেন। এমনকি আমাকে পাগল বলবেন।’
– ‘ ধুর! আপনি সুস্থ একজন মানুষ। আপনাকে আমি পাগল বলতে যাবো কোন দুঃখে. আপনি বলুন দেখি, আপনার সেই ভালোবাসার মানুষটির নাম কী?’
– ‘ ওর কোনো নাম নেই। তবে একটা সংখ্যা আছে।’
আসমা চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– ‘ সংখ্যা মানে; মানুষের নাম নেই, অথচ সংখ্যা আছে! এ আবার হয় নাকি।’
– ‘যা সত্যি তাই বললাম। সংখ্যাটি হলো, ‘009’। এটা অবশ্য মোবাইল নম্বর। যেহেতু ওর কোনো নাম নেই, তাই ওর পরিচয় হিসেবে আমি ‘009’ ব্যবহার করি।’
আসমা রাগে চোখ-মুখ লাল করে বলল,
– ‘আপনি কী পাগল? এইরকমটা হয় নকি। পাগল ছাড়া এই ধরনের কথা কেউ বলতে পারে।’
আসমার কথা শুনে জোরে হেসে উঠল তাহমিদ। আসমা কী যেন বুঝতে পেরে নিজের ভুল শুধরে নিয়ে বলল,
– ‘ না না, ঠিক পাগল না। আপনি একজন নির্বোধ মানুষ। সংখ্যা কারোর পরিচয় হতে পারে না। নিশ্চয়ই তাঁর একটা ভিন্ন পরিচয় আছে। আচ্ছা, সে থাকে কোথায়?’ কথা বলার সময় আসমার মুখ কপট বিব্রত দেখালো।
তাহমিদ দ্রুত বলল,
– ‘আমার মস্তিষ্কে ওর বসবাস।’
তাহমিদের কথা শুনে আসমার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। চোখ বড় করে বলল
– ‘ হোয়াট? আর ইউ ক্রেজি? দেখুন, সহজ বিষয়টিকে আপনি জটিল করছেন।’
তাহমিদ হাসল। হেসে বলল,
– আমি সহজ বিষয়টিকে জটিল করছি বা। এই ‘009’ একটি সংখ্যা। এই সংখ্যার নম্বর থেকে একটা মেয়ে ফোন দেয় আমাকে। সবাই এটাকে ‘হ্যালুসিনেশন’ বলে তাচ্ছিল্য করলেও আমি এর থেকে দূরে যেতে পারিনি৷ আপনি সজল মাস্টারের থেকে দূরে যেতে পারেননি, কারণ আপনি তাকে ভালোবাসেন। আমিও বোধহয় এই ‘009’ পরিচয়ের মেয়েটিকে ভালোবাসি বলেই তাঁর থেকে দূরে যেতে পারিনি। আপনি সজল মাস্টারকে ঠিক যতটা ভালোবাসেন, আমার মনে হয় আমিও ওই মেয়েটিকে ততটাই ভালোবাসি। কারণ আমরা কেউ নিজেদের ভালোবাসা থেকে দূরে যেতে পারেনি। ভালোবাসার জন্য সবার অবাধ্য হয়েছি।

চারিদিকে আঁধার নেমে আসছে। মেঘ গর্জন নিয়ে উঠেছে। আকাশের মেঘলা ভাবটা ঘন হয়ে এসেছে। আসমা তাগাদা দিয়ে বলল,
– ‘এক্ষুনি বৃষ্টি নেমে পড়বে। বাড়ি চলুন তাড়াতাড়ি।’

আসমা হাঁটা দিলো। ভেবেছে তাহমিদ তাঁর পিছনেই আসছে। কিন্তু তাহমিদ নড়ল না এক-পা ও। স্থির দাঁড়িয়ে থেকে আকাশের দিকে তাকালো।
মিনিট কয়েক পরেই ঝুমঝুম করে
বৃষ্টি নামল। তাহমিদ আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল।

সম্পৃক্ততা পর্ব ৬

0

সম্পৃক্ততা – ষষ্ঠ পর্ব।

রিফাত হোসেন।

১৪.
বাস্তবতার যদি মানুষের করুণ আকুতি বুঝার ক্ষমতা থাকতো, তাহলে আজ কারোর প্রেম হারিয়ে যেতো না। পৃথিবীতে যত প্রেম ছিল, সব পূর্ণতা পেতো। কিন্তু
প্রেমিক-প্রেমিকাদের দূর্ভাগ্য এটাই যে, তাঁদের প্রেম বারবার হেরে যায় বাস্তবতার কাছে। কারণ বাস্তবতা সবার প্রেম, তাঁদের ভেজা কণ্ঠের আকুতি বুঝতে পারে না।

আসমা বসে আছে কুয়ো তলায়। মাথার উপরে আছে পেয়ারা গাছ। গাছের একটা ডালে ছোট্ট চড়ুই পাখি বসে আছে। আসমা দীর্ঘক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে চড়ুই পাখির দিকে। তাঁর মনে হচ্ছে, এই চড়ুই পাখিটা ঠিক তাঁর প্রেমের মতো। দেখা যাচ্ছে, অনুভব করা যাচ্ছে, কিন্তু কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগেও সজলের সাথে কথা হয়েছে তাঁর। কিন্তু সে তৃপ্তি পায়নি। মানুষটা তাঁর থেকে খুব দূরে চলে গেছে। চাইলেই আর খপ করে তাঁর হাতটা ধরা যাচ্ছে না। চোখে চোখ রেখে ইশারায় স্পর্শ করা যাচ্ছে না! কাঠফাটা রোদের মতো খটখটে হয়ে আছে মন। শূন্যতায় দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে বুকের ভিতরটা। অদ্ভুত এক হাহাকার বয়ে যাচ্ছে শরীর জুড়ে, মন জুড়ে।

রাইশা মেজো আপাকে সারা বাড়ি খোঁজ করার পর অবশেষে কুয়ো তলায় পেলো। সে দৌড়ে কুয়ো তলায় এসে মেজো আপার পাশে দাঁড়ালো। বোনকে কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। মুখটা কালো হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কী নিয়ে যেন বড্ড দুশ্চিন্তায় আছে! রাইশার হাতে মোবাইল। ফোনের ওপাশে এখনো তাঁদের বড় আপা অপেক্ষা করছে।
রাইশা ডাকল,
– মেজো আপা, শুনছ।

আচমকা রাইশার কথা শুনে হকচকিয়ে উঠল আসমা। বিব্রত মুখে রাইশার দিকে তাকালো। রাইশা ঝটপট কী যেন বুঝে ফেলে মর্মান্তিক কণ্ঠে বলল,
– আপা, তুমি কী কাঁদছিলে?

আসমা আরও চমকে উঠল। সজলের কথা ভাবতে গিয়ে কখন যে চোখের কোণায় জল এসে গেছে, সে বুঝতেই পারেনি। দ্রুত চোখমুখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে বলল,
– কী হয়েছে রাইশা?

রাইশা চিন্তিত চাহনিতে আসমার দিকে তাকিয়ে ফোনটা বাড়িয়ে দিলো। বলল,
– ফাতেমা আপু ফোন দিয়েছে। আমি কথা বলেছি, এখন তুমি বলো।

আসমা ফোনটা হাতে নিলো। কানে ধরশেই ওপাশ থেকে ফাতেমা আহ্লাদী গলায় বলতে লাগল,
– কিরে পাগলি, কেমন আছিস? তোর ফোনে কতবার যে কল দিয়েছিলাম, তাঁর হিসেবে নেই। সারাদিন নাকি মনমরা হয়ে কুয়ো তলায় বসে থাকিস। কী হয়েছে?

– না আপু, তেমন কোনো ব্যাপার না। এমনিতেই কুয়ো তলায় বসে থাকি। আমি ভালো আছি; তুমি কেমন আছো?

– আমি তো ভালো আছি। তোকে একটা কথা বলব, যা শুনলে তুই খুব খুশি হবি।

– কী কথা?

– আমরা আজকেই আসছি।

কথাটা বোধহয় আসমার ভিতর পর্যন্ত পৌঁছালো না। সে খুবই স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো।
– ওহ্।

ফাতেমা অবাক হলো। বলল,
– ওহ্ মানে?

– কিছু না আপু।

– আসমা, তোর কণ্ঠটা ভারী শোনাচ্ছে। কী হয়েছে?

ফাতেমার কণ্ঠে গম্ভীর্যতা প্রকাশ পেলো। আসমা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– কিছু হয়নি আপু। তুমি এসো বরিশালে। আমি অপেক্ষায় থাকবো।

ফাতেমার হাসিমুখটা ইতোমধ্যেই মলিন হয়ে গেছে। বোনের মারাত্মক ভারী কণ্ঠস্বর শুনে তাঁর বুক কাঁপছে বারবার। যদিও সে জানে এর কারণ কী। তবুও আসমাকে কখনো এতটা ভেঙে পড়তে দেখেনি ফাতেমা। সে কিছুটা কড়া গলায় এবার বলল,
– আমাকে মিথ্যা বলছিস কেন? তোর যে কিছু একটা হয়েছে, সে আমি জানি। সজল মাস্টার ঢাকা চলে এসেছে, সেজন্য তুই এইরকম হয়ে আছিস, তাই না? আমি রাইশার কাছে শুনেছি মাস্টারের কথা।

আসমা বাক্যব্যয় করতে পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল শুধু। ওর কান্নার আওয়াজ শুনে ফাতেমা স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ ‘থ’ মেরে রইল।
দীর্ঘক্ষণ পর ফাতেমা নিজেকে সামলে নিয়ে, আসমাকে আশ্বস্ত করে বলল,
– চিন্তা করিস না। ও যদি তোকে সত্যিই ভালোবেসে থাকে, তাহলে তোকে ছাড়া দ্বিতীয় কারোর কাছে যাবে না।

আসমা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলল,
– আমি এই কারনে কষ্ট পাচ্ছি না আপু। উনি যে আমাকে কতটা ভালোবাসেন, তা আমি জানি। আমাকে কখনোই ঠকাবেন না উনি। আসলে উনার অনুপস্থিতি আমার মনকে কুঁকড়িয়ে দিচ্ছে বারবার। যাওয়ার জন্যও আমি জোর করেছিলাম। এখন এমন মুহূর্ত এসেছে যে, মনে হচ্ছে তাকে দেখার জন্য এক্ষুনি ঢাকা ছুটে যাই।

– আসমা, ধৈর্য ধারণ কর।

– আমি পারছি না আপু।

– তোকে পারতে হবে। তুই একটু অপেক্ষা কর, আমি দুপুরেই পৌঁছে যাবো।

– আচ্ছা আপু।

আসমা ফোনটা কেটে দিলো। কুয়োর দেয়ালে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আবার মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রাইশা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফোন হাতে নিয়ে চলে গেল।

১৫.
আফজাল হোসেন খাবার টবিলে বসে হঠাৎ বললেন,
– সজল, এবার তাহলে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাক। সঠিক সময় তো পেরিয়ে যাচ্ছে। আর কতো দেরি করবে?

সজল জানতে চাইল,
– কীসের সিদ্ধান্ত মামা? চাকরির সিদ্ধান্ত; আমি তো বলেছিই চাকরি আমি করব।

– আরে সেটা তো করবেই। কিন্তু এখানে তো শুধু চাকরির জন্য আসোনি তুমি।

– তাহলে?

আফজাল হোসেন হাসলেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
– দেখো নুপুরের মা, তোমার মেয়ের জামাই রসিকতা করছে আমার সাথে। এমন ভান ধরছে, যে কিছুই বুঝতে পারছে না।

সজল বুঝল। মনে মনে এই ভয়টাই পাচ্ছিল ও। এখানে এলে যে নুপুরের সাথে তাঁর বিয়ে নিয়ে সবাই জোড়াজুড়ি করবে, সেটাও সে অনুমান করেছিল। তবে নিজের প্রতি তাঁর বিশ্বাস আছে। সেজন্যই এখানে এসেছে।
সজল বলল,
– মামা, আপনারা যা ভাবছেন, সেরকম কোনো ব্যাপার আমাদের মধ্যে নেই। আপনি নুপুরকেই জিজ্ঞাসা করুন।

পাশেই নুপুর ছিল। সজলের কথা শুনে মাথা তুলে তাকালো সে। চুপ থেকে দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ল শুধু। সজলের কপাল কুঁচকে গেল। নুপুর কিছু বলবে; এইরকমটাই আশা করেছিল সে। আফজাল হোসেন নুপুরকে চুপ থাকতে দেখে নিজেই আবার বললেন,
– ও আবার কী বলবে? ও যে তোমাকে পছন্দ করে, সেটা তো আমরা আগে থেকেই জানি। তুমিও যে ওকে পছন্দ করো, সেটাও আমরা জানি।

– আপনারা ভুল জানেন মামা। সত্যিটা নুপুরকেই জিজ্ঞেস করেন।

আফজাল হোসেন নুপুরের দিকে তাকালেন। নুপুর নড়েচড়ে বসে দৃঢ় গলায় বলল,
– তোমরা আমার বাবা-মা; তোমরা যা ভালো বুঝো, তাই করো?

মেয়ের কথা শুনে আফজাল হোসেনের মুখটা ঝলমলে হয়ে উঠল। তিনি উল্লাসী মুখ করে বলে,
– বাহ্! তাহলে তো আর সমস্যাই রইল না। মেয়ে যখন রাজি, তখন আর দেরি করে কী লাভ?

সজল অবাক হলো নুপুরের কথা শুনে। নিজের মনেমনে বলতে লাগল,
কালকে ওর কথা শুনে মনে হয়েছিল, বোধহয় আমার প্রতি ভালোবাসার ঝোঁক থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসেছে। তাই সেভাবে জোর দেখাচ্ছে না। অথচ এখন বলছে, তোমরা যা ভালো বুঝো, তাই করো! আরে ভাই, তাঁরা তো সেই কবে থেকেই চাচ্ছে বিয়ে দিতে। তাই বলে কি আমরা বিয়ে করে নেবো?
সজল চোখ-মুখ গম্ভীর করে বসে রইল। মামার সাথে তর্ক জড়ানোর সাহস তাঁর নেই৷ যা বলার, সরাসরি নুপুরকে বলবে।

খাওয়াদাওয়া শেষে সজল চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল।

১৬.
– হেই লেডি, আপনাকে কী জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে? এভাবে মুখটা গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

আসমা গোসল করে আবার কুয়ো তলায় এসেছিল চুল শুকোতে। কুয়ো তলার সামনের দিকটা ফাঁকা। তাই খুব ভালোভাবেই ওখান দিয়ে বাড়ির ভিতরে বাতাস প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ পিছন থেকে একটা পুরুষালী কণ্ঠ শুনতে পেলো।
আসমা পিছনে তাকিয়ে দেখল লম্বাচওড়া দেখতে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। দুই গালে দুই ঝাক দাড়ি। হাতে দু’টো বই-ও আছে। চোখে চশমা নেই। থাকলে কবি হিসেবে বেশ মানাতো৷ আজকাল অবশ্য চশমা ছাড়াও অনেক কবিকে দেখা যায়। কিন্তু আসমার মনে হচ্ছে, সামনের লোকটার চোখে চশমা থাকলে কবি হিসেবে বেশ ভালো দেখাতো৷
লোকটাকে আসমা চেনে। তাঁর দুলাভাইয়ের ছোট ভাই। যদিও অনেকবছর আগে শেষ দেখেছিল। কিন্তু এখন চিনতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি।

আসমা একগাল হেসে বলল,
– আপনি, আপনাকে আমি চিনি। আপনার নাম তাহমিদ।

– আপনি, আপনাকেও আমি চিনি। আপনার নাম আসমা।

কথাটা বলে হাসল তাহমিদ। আসমাও হাসল।
তাহমিদ আবার বলল,
– আপনি চাইলে আমাকে অন্য নামে ডাকতে পারেন।

আসমা কপালে সুক্ষ্ম ভাজ করে বলল,
– অন্য নাম..।

– হ্যাঁ। সেক্ষেত্রে সৌজন্যের খাতিরে আমিও আপনাকে একটা অন্য নাম দিবো।

– তো এতে লাভটা কী হবে শুনি?

– লাভ তো অনেক হবে। তাঁর মধ্যে অন্যতম লাভ হলো, একই নাম শোনার এক ঘেয়েমি স্বভাবটা কেটে যাবে। আমি একদিন তুলিকে বলেছিলাম, তুলি, আমি তো তোকে তৃষ্ণা থেকে তুলি বানিয়ে দিয়েছি। তুই আমাকে তাহমিদ থেকে কিছু একটা বানা। এই নামটা আর ভালো লাগছে না। তুলি রাজি হলো। ভাবতে লাগল, কী নাম দেওয়া যায় আমাকে। শর্ত একটাই, সবগুলো নামের শুরুতে ‘টি’ অক্ষর থাকা চাই। তুলির সে কী চিন্তা! কিছুক্ষণ ভেবে শুরুতেই ও বলল, তুমি যেহেতু নিয়মিত চা পান করো, তাই তোমার নাম ‘টি’। বাংলাতে এর অর্থ যা-ই হোক, উচ্চারণ তো বাংলাতেও ‘টি’ আছে। তুলি নামের অর্থ তো বাংলাতে পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গলও হতে পারে। উচ্চারণে প্রথম অক্ষর টি থাকলেই হলো।
ওর কথা শুনে তো আমার মাথা গরম হয়ে গেল। অদ্ভুত তো; ‘টি’, ‘চা’ এইসব আবার নাম হয় নাকি! আমি ধমক দিয়ে বললাম, ভিন্ন কিছু ভাব। ও কিছুক্ষণ ভেবে আবার বলল, তুমি ভীষণ অদ্ভুত মানুষ ভাইয়া। তাই তোমার নাম আজ থেকে অদ্ভুত। যদিও এখানে প্রথম অক্ষর ইংরেজি ‘টি’ নেই; শেষে আছে। আচ্ছা ভাইয়া, অনেকেই তো ভুল করে সাবজেক্ট, অবজেক্ট-এ জগাখিচুরি পাকিয়ে ফেলে। সেভাবে কী অদ্ভুত নামের শেষ অক্ষরের ‘টি’ আগে আনা যায় না?
আসমা, একবার জাস্ট ভাবেন মেয়েটা কী পরিমাণ বোকা বোকা কথা বলছিল। একটা নামের অক্ষরগুলো নিয়ে কী শুরু করেছিল। আসল কথা হলো, ওর খুব খিধে পেয়েছিল। আমিও যেতে দিচ্ছিলাম না। তাই উল্টো পাল্টা বলছিল। এরপর আরও আধঘন্টা ভাবল। তারপর বলল, ভাইয়া, আমার না প্রচণ্ড খিধে পেয়েছে। পেট শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে৷ এখন না খেলে আমি আর বাঁচবো না। আমি পরে তোমাকে একটা নাম দেবো।
এরপরই ও চলে যায়।

তাহমিদ থামল। আসমা বড় করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
– এরপর কী আর নাম দিয়েছিল?

তাহমিদ হতাশ গলায় বলল,
– না।

খুশি হলো আসমা। কথাগুলো হাস্যকর হলেও তাঁর হাসার মতো মানসিকতা নেই এই মুহূর্তে। একগাল মলিন হাসি দিয়ে বলল,
– যাক, বাঁচলাম। আপনি যে এত কথা বলতে পারেন, তা আমার জানা ছিল না। আগে কিন্তু খুব চুপচাপ ছিলেন আপনি।

– গতকাল পর্যন্ত আমি নিজেও ভাবতাম, আমি চুপচাপ একজন মানুষ। চুপচাপ না ঠিক, কিন্তু অযৌক্তিক কিছু বলি না। কিন্তু আজ আপনার সামনে একটু বেশিই বকবক করে ফেললাম।

– সমস্যা নেই। মেয়েদের দেখলে ছেলেরা এমনিতেই একটু বেশি বকবক করে। এই স্বাভাব তো ছেলে জাতির ঐতিহ্য।

তাহমিদের রাগ হলো। সে নিজের অপমান সহ্য করতে পারে না। আর এই মেয়ে তো পুরো ছেলে জাতিকে টিপ্পনী কেটে অপমান করল। চোখমুখে রাগী একটা ভাব এনে তাহমিদ কঠিন গলায় বলল,
– আপনার ধারণা ভুল। যে মেয়েরা নিজেদের একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবে, তাঁরাই ছেলেদের এইরকম ভাবে। আপনাকে দেখে আমার বকবকানি শুরু হয়নি। গতকাল সন্ধ্যায় একজন খুব বকবক করছিল আমার সামনে। আমি তখন তাকে আড়ালে বাচাল বলে সম্মোধন করেছিলাম। এরপর থেকেই এই বাচালতা আমি নিজের মধ্যেও উপলব্ধি করতে পেরেছি। সারারাত শুধু বকবক করেছি। বাই দ্যা ওয়ে, ওই একজন কিন্তু একটা মেয়ে।

আসমা মৃদু হেসে বলল,
– ওহ্ আচ্ছা। তাঁর মানে আপনি বুঝাতে চাচ্ছেন, এই বকবকানি স্বভাবটা মেয়েদের থেকেই আপনি পেয়েছেন।

তাহমিদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
– আজ্ঞে হ্যাঁ।

আসমা এ প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ালো না। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,
– আচ্ছা, আপনি কখন এসেছেন?

– একটু আগে এলাম।

– তুহিন ভাই, বড় আপা, তুলি, ওরা কোথায়?

– ওরা ঘরে গেছে। আমি আপনাকে দেখে এখানে এলাম।
হাতে বইদুটি এগিয়ে দিয়ে তাহমিদ আবার বলল,
– ভাবীর কাছে শুনেছিলাম আপনি বই পড়তে খুব পছন্দ করেন। যেহেতু আমি খুব গরীব মানুষ। মূল্যবান কিছু কেনার সাধ্য নেই। তাই মহা মূল্যহীন বই দু’টো আপনার জন্য নিয়ে এলাম।

আসমা আপ্লুত হয়ে বইদুটি নিজের হাতে নিলো। হেসে বলল,
– দারুণ বলেছেন তো। বই তো মূল্য দিয়ে বিচার করা যায় না। তাই একে মহা মূল্যহীন বই বলাই উচিত।

– কোথায় যেন শুনেছিলাম জোড়া সংখ্যা খুব শুভ। যেহেতু বিয়েটা খুব শুভ একটা কাজ। তাই আপনার বিয়েতে দু’টোই বই দিলাম। নাহলে তিনটে দিতাম।

কথাটা বলে হাসল তাহমিদ। আসমা বলল,
– আমার বিয়ে?

– হ্যাঁ।

মুখ চেপে হাসি আটকিয়ে আসমা বলল,
– বেশ। চলুব এবার ভিতরে যাই।

– আচ্ছা।

দু’জনে কুয়ো তলা থেকে ভিতরে গেল।

সম্পৃক্ততা পর্ব ৫

0

সম্পৃক্ততা – পঞ্চম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

তাহমিদ ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে করুণ গলায় তানিশা বলে উঠল,
– তাহমিদ, আমি একটা সমস্যায় পড়ে গেছি।

সমস্যার কথা শুনে তাহমিদ আশেপাশে তাকালো। বন্ধুমহলের প্রায় সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। স্ক্রিনে তাকিয়ে সময়টাও দেখে নিলো একবার। এরপর ফোনটা কান থেকে সরিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
– তোরা তাহলে থাক, আমি বাড়ির দিকে যাচ্ছি।

সবার মুখটা কালো হয়ে গেল তাহমিদের কথা শুনে। বিয়ে এখনো ঠিকই হলো না, অথচ তাঁদের বন্ধু এখনই হবু বউয়ের ফোন পেয়ে আড়াল হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা হজম করতে পারল না কেউ। কিছু বলার সুযোগও পেলো না। তাহমিদ দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। ওদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে এসে আবার ফোনটা কানে ধরল। বলল,
– কী সমস্যায় পড়েছিস তুই?

তানিশা ইতস্ততভাবে বলল,
– না মানে, আমি তোদের বাড়িতে গিয়েছিলাম ঠিক, কিন্তু কিছু বলতে পারিনি।
একটু থেমে তানিশা আবার বলল,
– খুব লজ্জা করছিল। তাই আর বিয়ের কথাটা তুলতে পারিনি। ভাইয়া, ভাবী, তুলি সবার সাথে গল্পগুজব করে তোদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি।

কথাগুলো শুনে তাহমিদ শব্দ করে হাসতে লাগল। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকগুলোর মধ্যে কেউ কেউ ভ্রু-কুঁচকে দেখল তাহমিদকে। আবার পাত্তা না দিয়ে নিজেদের গন্তব্যে যেতে শুরু করল। তাহমিদ হাসতে হাসতে তানিশাকে বলল,
– তো এখানে সমস্যাটা কোথায় শুনি? ভালোই তো হয়েছে।

রাগে টগবগ করে তানিশা বলল,
– কিচ্ছু ভালো হয়নি। খুব আফসোস হচ্ছে আমার। ক্ষিধে পেয়েছে প্রচণ্ড। এখন খেতেও পারছি না। নিজের প্রতি খুব রাগ হচ্ছে। রাগের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। সাথে খুব কান্নাও পাচ্ছে।

– রাগ হলে কী তোর সবসময়ই কান্না পায়? নাকি আজই শুধু কান্না পাচ্ছে।

কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল তাহমিদ। যেন এটা জানা তাঁর ভীষণ প্রয়োজন। তানিশা গোমড়া মুখ করে উত্তর দিলো।
– রাগ মাত্রাতিরিক্ত হলে কান্না পায় আমার। আর রাগটা যদি হয় নিজের প্রতি, তাহলে কান্নার মাইরে বাপ; ওকে ঠেকায় কে!

তাহমিদ এবারও খুব জোরে জোরে হেসে উঠল। আশেপাশের লোকজন নিশ্চয়ই ওকে এবার পাগল ছাড়া অন্য কিছু ভাবছে না! ও কাউকেই পাত্তা দিলো না সেভাবে। নিজের মনোভাব বজায় রেখে হাস্যজ্বল মুখ করে বলল,
– তুই মামা আসলেই একটা সেই লেভেলের জিনিস। তোর মুখেই প্রথম শুনলাম রাগ হলে কেউ কেঁদে দেয়। রাগ হলে আমি তো গর্জন দিয়ে উঠি; আর তুই কান্না করিস। হা হা হা।

তাহমিদের হাসির শব্দ শুনে তানিশা খুব একটা না ক্ষেপলেও ওর কণ্ঠে ‘মামা’ শব্দটা শুনে মারাত্মক ক্ষেপে গেল তানিশা। করুণ মুখটা পরিবর্তন করে হুংকার ছেড়ে বলল,
– ওই, মামা কী হুহ্! এখবার বোন বানাচ্ছিস; আবার মামা বানাচ্ছিস। এগুলো কোন ধরনেই কথা শুনি? বোন বলেছিস তাও মনকে মানিয়ে নিয়েছি, কিন্তু মামা ডাকটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না।

তাহমিদ হাসি থামিয়ে বলল,
– এইজন্যই প্রেম-ভালোবাসা থেকে আমি নিজেকে দূরে রেখেছি এখন। মজা করে বন্ধুকে মামা ডেকেছি ; তবুও তোর মানা না মানার কথা ভাবতে হচ্ছে।

– তুই চুপ করবি প্লিজ। আমি আছি আমার টেনশনে। ইশ, কেন যে ভাবীকে বললাম না, ভাবী, তোমার ভাইটাকে আমার সাথে বিয়ে দিবা! সত্যি বলছি, তুহিন ভাইয়া না থাকলে আমি নির্ঘাত এতটুকু বেহায়া হতাম।

– আরও লজ্জায় পড়তি; যখন শুনতি আমিই বিয়েতে রাজি হচ্ছি না।

– রাজি হবি না কেন? আমার মধ্যে কী কম আছে শুনি?

তাহমিদ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
– তোর মধ্যে কোনোকিছুর কম নেই। তুই পরিপূর্ণ একজন নারী। কিন্তু আমার মধ্যে কিছু কম আছে।

তানিশা ফিক করে হাসল। কিছু সুরেলা কণ্ঠে বলল,
– তুমি কী এখনো বালক রয়ে গেছ? তা বালক, পরিপূর্ণ পুরুষ হতে তোমার আর কতদিন সময় লাগবে শুনি?

তাহমিদ ধমক দিয়ে বলল,
– চুপ। আমি ওই কথা বলিনি।

ধমক শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল তানিশা। একটু কেঁশে নিজের গলা ঠিক করে নিলো। কিছু বলতে যাবে, তাঁর আগেই তাহমিদ বলে উঠল,
– আচ্ছা শোন, তুই বারান্দায় এসে দাঁড়া, আমি এক্ষুনি আসছি।

এ-কথা বলে ফোন রেখে দিলো তাহমিদ। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটা দিলো। কিছুটা সামনে যাওয়ার পর রিকশা নিলো। রিকশাওয়ালাকে ঠিকানা বলে সে পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসল।

১২.
– নুপুর, তখন ওভাবে কথাটা বলে আমি ভুল করছি। সেজন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি এখন।

নুপুর ঘরে বসে বই পড়ছিল। সেসময় দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে সজল। দুপুরের পর আর নুপুরের সাথে কথা হয়নি তাঁর। সজল তখন একটু কড়া করে একটা কথা বলেছিল। তাই বোধহয় নুপুর সারাক্ষণ মুখটা গম্ভীর করে রেখেছিল। ব্যাপারটা সজলকেও ভাবাচ্ছিল। তাই অপরাধবোধ দূর করতে চলে এসেছে এখানে।

নুপুর সজলের কথা শুনে বই রেখে দরজার দিকে তাকালো। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,
– ওহ্ তুমি। এসো, ভিতরে এসো।

সজল ভিতরে এলো। বিছানার উপর বসে বইটা হাতে তুলে নিলো। বইটার নাম ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’। লেখক হুমায়ূন আহমেদ। বইটা সজল পড়েছে আগেও। এখানে একটা ব্যর্থ প্রেমের গল্প আছে। ছেলে-মেয়ে, দু’জনের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। তবে ভিলেন ছিল মেয়েটার বাবা। সে মেয়েকে কিছুটা জোর করেই খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়। বইটা পড়ে সজলের চোখের সামনে প্রথমে আসমার মুখটা ভেসে এসেছিল। মনে মনে ভীষণ দুঃখ পেয়েছিল সে। যদি তাঁর সাথেও এইরকম কিছু হয়, তাহলে সে বাঁচবে না।

কিছুক্ষণ পর নুপুর বড় করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
– ক্ষমা চাচ্ছো কেন? তুমি অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছ তখন। নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত ছিলে। তাই একটু কড়া করে বলেছিলে। তাছাড়া আমারও বুঝা উচিত ছিল; তুমি বেশ কয়েকটা বছর এ বাড়িতে ছিলে। প্রতিটি কোণা তোমার চেনা। আমি অযথা তোমাকে ঘরে পৌঁছে দিতে যাবো কেন?

সজল মৃদু হাসল। কিছু বলল না আর৷ নুপুরের সামনে এমনিতেই সংকোচবোধ করছে সে।
নুপুর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
– তোমার বাবা-মা কেমন আছেন?

– ভালো।

দু’জনের মধ্যে নীরবতা নেমে এলো আবার৷ সজল আড়চোখে বারকয়েক তাকালো নুপুরের দিকে। নুপুরের মুখটা বিব্রত হয়ে আছে। খুব লজ্জা পাচ্ছে বোধহয়। কিছু যেন বলতেও চাচ্ছে। সজল জিজ্ঞেস কলল,
– তুমি কী কিছু বলতে চাচ্ছ?

নুপুর আহত ভঙ্গিতে বলল,
– হ্যাঁ। তোমাকে আমি প্রায়ই ফোন দিতাম। কিন্তু তুমি রিসিভ করতে না। কেন করতে না?

– আসলে আমি অপরিচিত নম্বরের কোনো ফোনকল রিসিভ করি না। আমার নম্বর চেঞ্জ করার পর আর তোমার নম্বর সেভ করা হয়নি।

– কিন্তু তুমি তো জানতে ওটা আমার ফোন নম্বর। তোমার মা অসংখ্যবার তোমার ফোন দিয়ে আমার সাথে কথা বলেছে; বলেনি?

সজল মাথা নাড়ল শুধু। সে ইচ্ছে করেই নুপুরের সাথে কথা বলতো না। নুপুর ভালো মেয়ে; কিন্তু সে যে ভাবনা মনে পুষে রেখেছে, সেটা ঠিক না। সজল সোজাসাপটা বলল,
– নুপুর, তুমি যা চাচ্ছো, তা আসলে সম্ভব না।

– কেন সম্ভব না?

– কারণ আমি একজনকে ভালোবাসি। তুমি সেটা ভালো করেই জানো। আমার মা নিশ্চয়ই তোমায় বলেছে। আজ আমিও বলছি; আমি একজনকে ভালোবাসি।

নুপুরের চোখ দু’টো ছলছল করছে। অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সজলের দিকে। ভারী কণ্ঠে বলল,
– আমি তো বলছি না আমাকে বিয়ে করো, বা ভালোবাসো। ইনফ্যাক্ট আমি এ প্রসঙ্গে কোনো আলোচনাই করতে চাই না।

– কিন্তু আমি চাই। কারণ আমি জানি, তুমি আমার জন্যই এখনো বিয়ে করছ না। অপেক্ষা করে আছো আমার জন্য।

– তাতে তোমার কী? আমার অপেক্ষার মূল্য তো তোমার কাছে নেই। তুমি তো চিরকাল আমাকে অবহেলা করেছ; এখনো করছ। অথচ আমি দিনের পর দিন শুধুমাত্র তোমাকেই নিয়েই ভেবেছি। এই ঘরে অসংখ্য আসবাবপত্র আছে। তাঁর থেকেও বেশি আছে তোমার ছবি। ঘরের নানান জায়গায় তোমার ছবি আমি লুকিয়ে রেখেছি। আমি আর্টকে প্রফেশনালি নিলে এতদিনে বেশ উপরে পৌঁছে যেতাম। কিন্তু তা করিনি। কারণ আমি সব সময় শুধুমাত্র তোমার ছবি এঁকেছি। অন্য কারোর, বা অন্য কোনো দৃশ্যের ছবি আঁকার প্রতি আমার কোনো ইচ্ছাই ছিল না।

কথা বলতে বলতে নুপুরের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। সজল অপরাধী গলায় বলল,
– নুপুর, কেঁদো না। দেখো, তুমি চাইলে আমরা ফ্রেন্ড হয়ে থাকতে পারি।

তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো নুপুর। হাত দিয়ে চোখের জল মুছে বলল,
– এতগুলো বছর পর তোমার মনে হলো, তোমার বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা আমার হয়েছে।

– তুমি আমায় ভুল বুঝছ নুপুর।

– আমি তোমায় ভুল বুঝছি না সজল। আমি এখন এইসব নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। আমি তো বলছি না, তুমি ওই মেয়েটার সাথে সম্পর্ক ভেঙে আমাকে বিয়ে করো। তুমি থাকো ওর সাথে। আমি আমার মতো থাকছি। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আগেও ছিল, এখনো আছে। এটা কখনো কমবে না। কিন্তু আমি চাই না, তোমার মনে আমার জন্য কোনোরকম সহানুভূতি তৈরি হোক। তুমি এখন যেতে পারো। রাতের খাবার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।

– তুমি রাতের খাবার খাবে না?

– না। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি ঘুমাবো এখন। যাওয়ার আগে দরজাটা একটু ভিড়িয়ে দিয়ে যেও।

সজল কিছু বলার আগেই নুপুর ঘরের লাইটটা বন্ধ করে দিলো। টেবিলল্যাম্প এর স্বল্প আলোয় সজল একবার নুপুরকে দেখল; এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা একটু টেনে দিলো।

১৩.
– তুই পৃথিবীতে কোনো একটা জায়গায় ছোট একটা কাঠের ঘর তৈরি করলি; আমি সেখাই থাকতে পারব। আমার একটা সংসার চাই। সংসারের জন্য স্বল্প কিছু আসবাব চাই; আর..

তাহমিদ চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– আর কী চাস?

– আর তোকে চাই।

তাহমিদ রাগী কণ্ঠে ‘ নির্লজ্জ’ শব্দটা বলল শুধু। সেটা শুনে তানিশা পাশ থেকে সামনে এসে দাঁড়ালো। দুই হাত কমোরে রেখে গাল ফুলিয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে রইল।
ওরা দু’জনে এখন রাস্তায় পাশে থাকা খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে। বিকেলে এই ফাঁকা জায়গাটায় আশেপাশের বাড়ির সব বাচ্চারা খেলাধুলা করে। দু’টো বেঞ্চ আছে একপাশে। বাচ্চাদের দোলন খেলার ব্যবস্থাও আছে। দুই পাশে দু’টো ল্যাম্পপোস্ট আছে। এটাকে ঠিক পার্ক বলা যায় না বটে; ছোট মাঠ বলা যায়। মাঠের গা ঘেষেই আছে তানিশাদের এক তলা বড় বাড়িটা। বাড়ির পশ্চিমে মাঠ; তানিশার ঘরও পশ্চিমে। তাহমিদ এখান থেকে কিছুটা উঁচু গলায় ‘তানিশা’ বলে ডাক দিয়েছিল। তানিশা বারান্দাতেই ছিল; তাই সহজেই দেখতে পেয়েছিল তাহমিদকে। দৌড়ে বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে।

তানিশা বলল,
– আমাকে বিয়ে না করার একটা কারণ অন্তত দেখা?

– তোকে বিয়ে কেন করব, সেটা আগে বল।

– কারণ আমি তোকে ভালোবাসি। তোকে বিয়ে করতে চাই। তুই এখন সিঙ্গেল। অর্থাৎ কোনো বাধা নেই। তাই তোর উচিত আমাকে ভালোবাসা, এবং বিয়ে করা। করবি কি না বল?

– তুই এত বেহায়া কেন বলতো? কীভাবে একটা ছেলেকে বলছিস, বিয়ে করবি কি না বল! মেয়েদের একটু লাজুক হতে হয়, তুই জানিস না?

– জানি তো। সেজন্যই তো তোর বাড়িতে গিয়ে কিছু বলতে পারিনি।

– তাহলে আমাকে কেন বলছিস?

– কারণ তুই আমার বন্ধু। তোর কাছে আবার কীসের লজ্জা?

– বন্ধু তো বন্ধু হয়েই থাক না। অযথা বিয়েসাদীর কথা তুলছিস কেন?

তাহমিদকে কিছুটা সিরিয়াস দেখালো এ সময়। তানিশা অবাক হলো বটে, কিন্তু দমে গেল না। তাহমিদের আরও একটু কাছে এলো। করুণ কণ্ঠে বলল,
– আমি সত্যিই তোকে ভালোবেসে ফেলেছি।

– এই জিনিসটা ঠিক কবে উপলব্ধি করলি; আজকে?

– না। আরো অনেকদিন আগে। কিন্তু বলার ইচ্ছা ছিল না এতদিন। ভেবেছিলাম যেহেতু পারিবারিক কোনোরকম তাড়া নেই, তাহলে আমি এত তাড়াহুড়ো কেন করব? আজ হঠাৎ করেই বলে বসলাম।

– তুই তো জানিস আমি একজনকে ভালোবাসতাম। জানিস না?

তানিশা মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বলল,
– জানি।

– দেখ, ওকে যে এখনো ভালোবাসি, তা না। বা ওর জন্য যে আমি অপেক্ষা করছি, সেটাও না। বাট অন্য একটা কারণ আছে।

– কী কারণ শুনি?

– সেটা আমি বলতে পারব না। কেন পারব না, সেটাও বলব না। প্রত্যেকের জীবনে যেমন গোপনীয়তা আছে, তেমনি আমার জীবনেও আছে। সবকিছু অন্যের কাছে শেয়ার করা যায় না।

তানিশা, তাহমিদের পাশে এসে, তাহমিদের হাতের মুঠোয় নিজের একটা হাত রাখল। তাহমিদ নির্বিঘ্নে চেপে ধরল তানিশার হাত। তানিশা চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছে। কণ্ঠও ভারী হয়ে গেছে। সে নিঃশ্বাস আটকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– আমাকে কী তোর ভালোলাগে না? দেখ, তুই হয়তো আমাকে নিয়ে এইরকম ভাবে কখনো ভাবিসনি; কিন্তু আমি ভেবেছি। আমি সত্যিই তোকে খুব ভালোবাসি।

– তানিশা, তুই খুব সুন্দরী এবং খুব ভালো একটা মেয়ে। তোর মধ্যে কোনো অহংকার নেই৷ তুই বড়লোক বাবার মেয়ে হয়েও গরীবদের পাশে থাকিস। কত মানুষকে তুই কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিস। আমার মতো ১০ হাজার টাকার একজন কর্মচারীকে কত আপন করে নিয়েছিস। অথচ সেসময় আমাদের বন্ধুত্ব তেমন গাঢ় ছিল না। অফিসের মালিকদের একজন হয়েও তুই আমাকে বন্ধু বলে সম্মোধন করেছিস। এবং আমাকেও বলেছিস, তোকে যেন নাম ধরে, এবং তুই বলে সম্মোধন করি। তোর মতো মানুষ আমি আগে দেখিনি। অন্য কেউ হলে হয়তো বলতো, বাইরে আমাদের মাঝে যেই সম্পর্কই থাক না কেন, অফিসে আমি তোমার বস। ঠিক এইরকমটাই বলতো। অথচ তুই কত ভিন্ন। সত্যি বলতে তোর মতো মেয়ে আমি একসময় জীবনসঙ্গী হিসেবে চাইতাম। সেজন্য মানহা নামের ওই মেয়েটাকে ভালোবেসেছিলাম। শুরুতে আমাদের সম্পর্ক ভালোই ছিল। কিন্তু হঠাৎ ও চেঞ্জ হতে শুরু করল। আমি ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা পরে আর সম্ভব হয়নি।

তানিশা চোখের জল মুছে বলল,
– তোদের ব্রেকআপ কেন হয়েছিল, সেটা এখনো আমার কাছে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। আমি যতদূর শুনেছি, মেয়েটা রাগ করে চলে গেছিল কোথায় যেন। রনি বলেছিল, ও তোর সাথে প্রতারণা করেছে। সবাই তো এটাই বলেছে।

তাহমিদ হাসল। রহস্যময় হাসি। ওর হাসির কারণ বুঝতে পারল না তানিশা। জিজ্ঞেস করল,
– হাসছিস কেন?

তাহমিদ দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
– এমনি।

– সত্যি করে বল তো, তুই কি এখনো ওর জন্য অপেক্ষা করছি?

– না।

– ওকে কি এখনো ভালোবাসিস?

– না।

– তোর কাছে ওর স্থানটা ঠিক কোথায় এখন? একজন প্রতারক?

তাহমিদ সোজাসাপটা বলল,
– না। ও খুব ভালো একটা মেয়ে। ওর প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। প্রথম প্রথম ছিল অবশ্য। এখন নেই।

– কেন নেই? ওকে ভুলে গেছিস নাকি?

– হ্যাঁ।

– তাহলে আমাকে ভালোবাসতে অসুবিধে কী?

– অসুবিধে আছে। একটাই অসুবিধে আছে। যদি সম্ভব হতো, তাহলে আমি এক্ষুনি তোকে নিয়ে কাজী অফিসে চলে যেতাম। অবশ্য এখন কাজী অফিস বন্ধ। তবুও আমি কাজীকে এক্সট্রা টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতাম।

তানিশা খিলখিল করে হাসল। ওর ভেজা চোখ-মুখে হাসিটা খুব বেমানান লাগছে। তাহমিদ বলল,
– তুই নিশ্চয়ই ভাবছিস, তাহমিদ খুব নিষ্ঠুর। তোকে বুঝতে পারছে না। এইরকমটা ভাবলে ভুল ভাববি। কারণ আমি তোকে বুঝতে পারছি। আমি এটাও বুঝতে পারছি, তুই আমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিস। তোর এই ভালোবাসাকে আমি অগ্রাহ্য করছি না৷ করলে হয়তো এইসময় তোর এখানে আসতাম না। দেখ, আমার কথাবার্তা শুনে অনেকেই ভাবে, মানহার চলে যাওয়া নিয়ে আমি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত আছি। তাই আমি একটু অসুস্থ। সত্যি বলতে একসময় আমিও এমনটাই ভাবতাম। কিন্তু আমি পরে ঠিকই উপলব্ধি করেছি যে, আসল কারণ এটা না। একসময় আমিও অনেক স্বপ্ন দেখতাম। ভালোবাসা অনুভব করতে পারতাম। ভেবেছিলাম মানহাকে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসার করবো। ভাইয়া, ভাবী, বোন, সবাইকে নিয়ে আমরা আনন্দে থাকবো। কিন্তু মানহা আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর হঠাৎই যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। ভালোবাসা, সংসার, সুখ, এইসব কিছু পানশে হয়ে গেল আমার কাছে। তোরা কেউ আমার চোখের জল দেখিসনি। কিন্তু আমি কাঁদতাম, খুব কাঁদতাম। মানহার জন্য না; অন্য একটা কারণে আমার চোখ বেয়ে জল পড়তো৷ সবকিছু থেকে আমার মন ওঠে গেল। জীবনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে শুরু করলাম। তবে একটা স্বপ্ন আছে আমার। সেটার জন্য এখনো সবার সাথে আছি। স্বপ্নটা পূরণ হয়ে গেলে হয়তো আমিও এইসব ছেড়ে চলে যাবো।

তানিশা, তাহমিদকে থামিয়ে দিয়ে হঠাৎ বলে উঠল,
– কোথায় যাবি? হিমালয়ে; সাধনা করতে।

তাহমিদ হাসল। তানিশার হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের ভেজা চোখ মুছল। কাতর গলায় আবার বলতে শুরু করল,
– ধরে নে তাই। আমার সাথে থাকলে তুই ভালো থাকবি না। দেখছিসই তো আমার অবস্থা। আমার না আছে কোনো ভবিষ্যৎ, আর না আছে কোনো নিজস্ততা। এইরকম একটা মানুষকে বিয়ে করে তুই নিজের জীবনকে অনিশ্চিত কেন করবি?

– তুই তো আগে এমন ছিলি না। আমার বিশ্বাস, তুই কোনো একসময় আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবি। তোর মতো পাগলকে শায়েস্তা করার মন্ত্র আমার জানা আছে।

তাহমিদ চমকে ওঠে বলল,
– কী মন্ত্র?

– আছে। সেটা পরে নিজেই বুঝতে পারবি। আপাতত একটা কাজ কর। তুই বাড়িতে ফোন করে বল, আজকে রাতটা তুই আমার সাথে থাকবি।

তাহমিদের চোখ কপালে ওঠে গেল তানিশার কথা শুনে। থতমত মুখ করে বলল,
– নাউজুবিল্লাহ। এখনো বিয়েই হয়নি, তাঁর আগেই আমার সাথে রাত কাটাতে চাচ্ছিস। ছি ছি ছি!

তানিশা অবাক হয়ে নিজের মুখটা চেপে ধরল। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে তাহমিদের মাথায় গাট্টা মারল। আর বলল,
– আরে বোকা, আমি এটা বলিনি যে তুই আমার রুমে রাত কাটা। আমরা আজ ড্রয়িংরুমে বসে থাকবো সারারাত। আমার বাবা-মা, তুই আমি, চারজন মিলে ক্যারাম খেলবো। কোনোরকমে রাতটা শুধু পাড় করব আরকি। শর্ত এটাই যে, তোকে সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে থাকতে হবে।

তাহমিদ কৌতূহল আর ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– এইরকমটা কেন?

– কারণ, আমি দেখব তোকে কে মাঝরাতে “009” নাম্বার থেকে ফোন দেয়।

তাহমিদ ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,
– অসম্ভব। আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা উত্তর জানার আছে।

– সত্যিই যদি কেউ তোকে ফোন দেয়, তাহলে সেখানেও দিবে। সেটা তুই যেখানেই থাকিস না কেন।

– আসবে না। আমাকে একান্তে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে হবে।তাছাড়া আমার ঘর ছাড়া বাইরে কোথাও ও ফোন দেয় না।

তানিশা হাসল। হেসে বলল,
– আসলে এইসব ধোঁকা খাওয়া, অনুভূতি নাই, প্রেম নাই, এইসব গাজাখুরি কথাবার্তা। তোর মতো মানুষ আমি অনেক দেখেছি জীবনে। তোর প্রধান এবং অন্যতম দূর্বলতা হলো ‘হ্যালুসিনেশন’। তুই প্রথমে মানহার চলে যাওয়াটাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পেরেছিস খুব ভালোভাবেই; কিন্তু কিছুদিন পর নিজে হঠাৎ অন্যরকম হয়ে গেছিস। কারণ সেদিন থেকেই তোর ‘হ্যালুসিনেশন’ নামক অসুখটা হয়। হয়তো কোথাও একটা মানসিক চাপ ছিল তোর মস্তিষ্কে। তাই সেখান থেকেই তোর অবচেতনায় একটা চরিত্র আসতে শুরু করে। ভাবীর সাথে আমি কথা বলেছি। আমাদের দু’জনেরই ধারণা তোকে যদি এই ০০৯ থেকে কিছুদিনের জন্য দূরে রাখা যায়, তাহলে তুই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবি।

– এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। ওই মেয়েটার সাথে কথা না বললে আমি বাঁচবো না। আমি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ ওর সাথে পরামর্শ করে নেই। ওকে হারিয়ে ফেললে আমিও অচিরেই হারিয়ে যাবো।

– তাহমিদ, নিজের বর্তমান অবস্থার কথা চিন্তা করে একবার ভাব, তোর অসুখটা ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর। এর সাথে তুই নিজের জীবনকে জড়িয়ে ফেলেছিস। এটি এমন এক মানসিক অবস্থা যখন কেউ ভ্রান্তির ভেতর বসবাস করে অজান্তে। আসলে মিথ্যার জগতে বসবাস করে কেউ ভাবে সে সত্যজগতে বসবাস করছে। এটি একটি অস্বাভাবিক অনুভূতি। এ অনুভূতি স্বাভাবিক অনুভূতির মতোই ঘটে থাকে।
যেমন ধর, কেউ একজন হয়তো দাবী করে অদৃশ্য কেউ তার কানে কানে কথা বলে যায়। তার মানে ঐ ব্যাক্তির শ্রবণেন্দ্রিয়ের হ্যালুসিনেশন ঘটে থাকে। হ্যালুসিনেশন দেহের প্রতিটি ইন্দ্রিয়তে ঘটতে পারে। কেউ হয়তো দেখে তার আশেপাশে একটা কুকুর সব সময় হাঁটাহাঁটি করছে; কিন্তু আদতে কোনো কুকুর তার আশেপাশে থাকে না। এটা ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন। এমনও হতে পারে আক্রান্ত মানুষটি এক বা একের অধিক মানুষের সাথে কথা বলতে পারে। হতে পারে সে এখানে বসে দূরের কারো সাথে কথা বলছে। আসলে কেউ কেউ এটাকে অলৌকিক শক্তি ভাবলেও এটা একটা মানসিক রোগের উপসর্গ।
এটি সাধারণত মানসিক রোগের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তবে কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থেকেও হ্যালুসিনেশন হতে পারে। তোর যেহেতু মানসিক সমস্যা, তাই এর চিকিৎসা তোকেই করতে হবে। তুই যে বলছিলি না, তোর মধ্যে এখন আর কোনো ভালোবাসা নেই, কোনো আবেগ, অনুভূতি নেই। এটা তোর ভ্রান্তি ধারণা। ভালোবাসা না থাকলে তুই রোজ অফিস শেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় যেতি না। আড্ডা থেকে আবার বাড়িতে যেতি না। আবেগ, অনুভূতি, এইসব না থাকলে এই সময় আমাকে বুঝানোর জন্য, আমার কাছে ছুটে আসতি না। “009” জাস্ট একটা সংখ্যা। আর যে মেয়েটা আছে, ওটা তোর মস্তিষ্কের সৃষ্টি। মানুষ যখন সবকিছু অস্বাভাবিক ভাবে চিন্তা করতে শুরু করে, তখন তাঁর মস্তিষ্ক এইরকম একটা চরিত্র সৃষ্টি করে৷ তারপর সেই চরিত্রের দ্বারা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। যেমন তোকে করছে। তোর এমন এক অবস্থা হয়েছে যে, ওই মেয়ে চরিত্রটা যদি তোকে বলে, তাহমিদ, তুমি আত্মহত্যা করো, তাহলে তুই ঠিক-ভুল বিচার না করে আত্মহত্যার চেষ্টা শুরু করে দিবি। অর্থাৎ ও যা বলবে, তুই সেটাই করবি। এর কারণ, তুই ওর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তুই কাউকে ভালো কোনো উপদেশ দিলে ভাবিস, এটা ওই চরিত্রের দেওয়া উপদেশ। আসলে এমনটা না৷ সব প্রশ্নের উত্তর তুই দিস। কিন্তু ভাবিস, ওই মেয়ে চরিত্রটা দিচ্ছে। এটা অনেক বড় একটা সমস্যা। এখান থেকে বের হওয়ার একটাই উপায়, তা হলো নিজের মনকে শক্ত করা। মনের উপর আস্থাশীল হওয়া। সবসময় ভাববি, তোর দ্বারা যার উপকার হচ্ছে, তাঁর কৃতিত্ব আসলে তোর, অন্য কারোর না। আবার তোর দ্বারা যদি কারোর ক্ষতি হয়, তাহলে সেটাও ভাববি তোর জন্য হয়েছে। এরপর আর ওইরকম কাজ তুই করবি না। বুঝেছিস কী বলছি?

তাহমিদ ব্যাক্কলের মতো তাকিয়ে মাথা নাড়ল শুধু। তানিশা পাশ থেকে আবার ওর সামনে এলো। তাহমিদের দুই হাতে হাত রেখে মৃদু হেসে বলল,
– আল্লাহর কাছে দোয়া কর। তাঁর উপর ভরসা রাখ। নিজেকে বিশ্বাস কর। এভাবে তুই শেষ হয়ে যাচ্ছিস। এখান থেকে তোকেই বের হতে হবে। শোন, কাল তোর অফিসে যেতে হবে না।

তাহমিদ কপাল কুঁচকে বলল,
– কেন?

– কারণ কাল তুই বরিশাল যাবি। ভাবীর মায়ের বাড়িতে। ভাবী বোনের বিয়েতে।

– কিন্তু, সেটা তো আরও দেরি আছে।

– থাক দেরি। ভাবীর সাথে আমার কথা হয়েছে।

– আর চাকরি; মানে ওখানে তো আর একদিনের জন্য যাওয়া হবে না।

– যতদিন ইচ্ছে ওখানে থাক। তোর চাকরির চিন্তা করতে হবে না।

– সবকিছুর একটা নিয়ম তো আছে, তাই না। যদিও আমি সেরকম নিয়ম অনুসরণ করি না। বাট এই ছুটি দেওয়ার দায়িত্ব তোর। আমি এখন পর্যন্ত আবেদনই করিনি। যদি তোর সিনিয়র তোর কাছে জবাবদিহি চায়।

– চাইলে চাইবে। তোর চাকরির দায়িত্ব আমার। মাস শেষে আমি তোকে বেতন দেবো। এই চাকরি চলে গেলে আরেকটা ধরবি। দেশের প্রায় সব পত্রিকার সাথে আমার যোগাযোগ আছে। আমি এক দিনে তোর চাকরির ব্যবস্থা করব। তুই ওখানে যা। নতুন জায়গায় ঘুরে আয়। আর রাতে ফোন থেকে সাবধান।

– বরিশাল যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।

– কেন নেই?

– কারণ, ওখানে মানহার বাড়ি।

তানিশা হেসে বলল,
– বরিশাল কী আর ছোট্ট একটা অঞ্চল? ওটা একটা বিভাগ। ওখানে মানহাকে খুঁজতে গেলেও তোর জীবন তেজপাতা হয়ে যাবে। আর তুই যদি নিজেই ওর থেকে দূরে থাকিস, তাহলে ওর আশপাশ দিয়ে তোর যাওয়ার সুযোগই হবে না। তাছাড়া ও কী এখনো দেশে আছে? থাকলে তোর সাথে না হোক, অন্যান্য বন্ধুদের সাথে একবারের জন্য অন্তত যোগাযোগ করতো। বিয়েসাদী করো বোধহয় বরের সাথে বিদেশে চলে গেছে। তোরাই তো বলতি, ও শুধু বিদেশে যেতে চাইতো।

তাহমিদ নিজের মনেমনে বলল,
– সেই সুযোগ আর পেলো কোথায়!

তানিশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
– অনেক বকবক করে ফেলেছি। মুখ ব্যথা হয়ে গেছে। শোন, তুই কী ভালো হতে চাস? তোর মনের কথাটা আমি জানতে চাই।

তাহমিদ মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। তানিশা বলল,
– ওকে। তাহলে এখন বাড়িতে যা। ভয় পাস না। দাঁড়া, রিকশা করে যেতে হবে না। আমি ড্রাইভার কাকাকে বলে দিচ্ছি, উনি পৌঁছে দেবেন।

তানিশা ড্রাইভারকে ডাকতে গেল। তাহমিদ বড় করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
– বাপ্রে! কত কথা বলতে পারে মেয়েটা। একে বিয়ে করতে তো আমাকে সারাজীবন পস্তাতে হবে। বাচাল একটা।