Thursday, August 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1995



সম্পৃক্ততা পর্ব ৪

0

সম্পৃক্ততা – চতুর্থ পর্ব।

রিফাত হোসেন।

৯.
অফিসে তাহমিদের খুব একটা কাজ নেই; সে শুধু পত্রিকার রিপোর্ট লিখে। তবুও যখন এই রিপোর্টের কাজটা করে, তখন খুব মনোযোগ দিয়ে করে। ১ মাস আগে নির্বাচিত হওয়া এমপি সাহেবের মেয়ের বিয়ে আজ। মহাকালের রিপোর্টার তাহমিদ-এর সহযোগী কিছুক্ষণ আগেই এমপি সাহেবের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছে। কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে এমপির সাথে কথা বলে। তাঁর বর্ণনানুযায়ী সেখানকার উজ্জ্বল দৃশ্য এবং ঝমকালো আয়োজনের উপর একটা রিপোর্ট লিখতে হবে তাহমিদকে। সে লিখছে মনোযোগ দিয়ে।
এমনসময় হঠাৎ ডেস্কের পাশে এসে দাঁড়ালো এক ভদ্রলোক। তাহমিদ বাঁকা চোখে দেখল তাকে। সাজ-বেশ ভদ্রলোকের মতো বটে; কিন্তু আসলে সে একটা পাক্কা হারামজাদা। অবশ্য প্রতিটি অফিসেই এইরকম দুই একটা থাকেন। এটা খারাপের কিছু না। লোকটার চেহারা ছিপছিপে বর্ণের। গালভরতি আধপাকা দাড়ি। ঠোঁটটা কালচে। দেখেই মনে হচ্ছে, দিনরাত এক করে শুধু সিগারেটের ধোঁয়া টানে। অবশ্য অন্য কারণেও ঠোঁট কালো হতে পারে।

– তাহমিদ সাহেব, কী করছেন আপনি?

লোকটার কথায় তাহমিদ এর ভাবান্তরে ছেদ পড়ল। এইমাত্র তাকে দেখল, এইরকম একটা ভাব ধরে তাহমিদ ওঠে দাঁড়াল। সালাম দিলো তাকে।
– আসসালামু আলাইকুম স্যার।

লোকটা তাহমিদের সিনিয়র রিপোর্টার। তাই সৌজন্যের খাতিরে একটু ভদ্রতা দেখালো।
লোকটা নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে উত্তর দিলো।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। কী অবস্থা ?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো স্যার।

– আমি আপনার অবস্থা জানতে চাইনি, আমি রিপোর্টের অবস্থা জানতে চেয়েছি।

তাহমিদ নাক ফুলিয়ে তাকালো। মেনশন করে জিজ্ঞেস করলেই হতো। তাহমিদের প্রতি যে লোকটার সাংঘাতিক রাগ, তা সে ভালো করেই জানে। প্রায় কয়েক বছর হতে চলল দু’জনে এখানে আছে। অনেক সময় অনেক কারণেই লোকটা রেগেছে ওর উপর।
লোকটা আবার বলল,
– ম্যাডাম আপনাকে ডাকছে। রিপোর্টটা দেখতে চেয়েছে।

তাহমিদ লেখায় মনোযোগ দিয়ে বলল,
– কোন ম্যাডাম?

– বড় ম্যাডাম।

– নাম বলুন?

– আমি তো আর আপনার মতো বেয়াদব না; যে অফিসের বসদের নাম ধরে ডাকবো। সম্পাদক ম্যাডাম আপনাকে ডাকছে। এবার হয়েছে?

লোকটার ধমক শুনে হকচকিয়ে উঠল তাহমিদ। কেঁশে চারদিকে চোখ বুলালো একবার। এই বদমেজাজি লোকের উশৃংখল কণ্ঠ শুধু তাহমিদকে না, অন্যদেরও বিরক্ত করেছে। তাহমিদ আর কথা বাড়ালো না। ইচ্ছে করছে লোকটাকেও একটা ধমক দিয়ে দিতে। কিন্তু দিলো না। মানুষকে কষ্ট দেওয়ায় তাঁর অনীহা আছে। রিপোর্টটা হাতে তুলে নিয়ে গম্ভীর মুখ করে সামনে থেকে সরে গেল। এখন সে যাচ্ছে সহকারী সম্পাদকের রুমে। সে সম্পর্কে বান্ধবী হয়। নাম তানিশা। দেখতে আহামরি সুন্দরী না হলেও মোটামুটি প্রেমে পড়ার মতো চেহারা আছে তানিশার। এছাড়াও দেশের বিখ্যাত পত্রিকা ‘মহাকালের’ সহকারী সম্পাদক সে। হাজারখানেক ছেলেপেলে তাঁর জন্য মরিয়া হয়ে আছে।
উপরতলার দক্ষিণ দিকে তানিশার রুম। তাহমিদ দরজায় টোকা দিলো। বলল,
– তানিশা আসবো?

তানিশা ল্যাপটপ স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
– তাহমিদ, আয়, ভিতরে আয়। রিপোর্টটা আমাকে মেইল করিসনি কেন?

তাহমিদ ভিতরে গেল। চেয়ারে বসে হাতে থাকা কাগজটা এগিয়ে দিলো তানিশার দিকে। তানিশা কাগজের লেখা রিপোর্টটা দেখেই রাগে ফেটে পড়ল। রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
– ওই হারামি, তোকে না কতবার বলেছি রিপোর্ট কম্পিউটারে লিখবি। সবার ডেস্কেই তো একটা করে কম্পিউটার আছে। সবাই যদি কম্পিউটারে রিপোর্ট লিখতে পারে, তাহলে তুই কেন পারবি না?

তাহমিদ হাত নাড়িয়ে বলল,
– কম্পিউটারে লিখলে আমার ঠিক ইমোশনটা আসে না।

– রিপোর্টের সাথে ইমোশনের কী সম্পর্ক?

– আহ্! আমি যেটা লিখবো, সেটা যথাযথভাবে লেখার জন্য ইমোশন থাকাটা প্রয়োজনীয়। কম্পিউটার একটা যন্ত্র মাত্র। ওর সামনে আমি নিজের ইমোশনকে প্রকাশ করতে পারি না। রিপোর্ট লেখাটা ক্রিয়েটিভ ব্যাপার। এটা যেমন সবাই পারে না, তেমনি সবাই সবভাবে পারে না। অন্যদের রিপোর্ট দেখ; আর আমার রিপোর্ট দেখ। ওরা শুধুমাত্র তা-ই লিখে, যে তথ্যগুলো অন্যজন জোগাড় পরে দেয়। আমি যখন একটা বিখ্যাত লেখককে নিয়ে রিপোর্ট লিখতে যাবো, তখন সেটা এমনভাবে লিখবো, যাতে সবাই পড়ে মুগ্ধ হয়। সুতরাং বাকিদের সাথে আমার তুলনা চলে না।

তানিশা চোখ-মুখ আগুন গরম করে বলল,
– তোকে কী আমি বলেছি; তুই রিপোর্টে কাব্যিক সব কথাবার্তা, বা মুগ্ধ হওয়ার মতো কিছু লেখ? তোকে সে বিষয়টা দেওয়া হয়েছে, তুই শুধু সেটার উপর সংক্ষিপ্ত একটা বক্তব্য লিখবি। এখন এটা আবার টাইপ করতে হবে। ধুর বাল! একই কাজ দু’বার করার কোনো মানে আছে? তোর হাতে লেখা তো আর আমি ছাপানোর জন্য দিতে পারব না। ইচ্ছে করছে তোকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে। সবসময় এই একই কাজ করিস তুই। আচ্ছা, নিজস্ব ফোন বা ল্যাপটপ, কিছু কিনেছিস?

তাহমিদ হেসে উঠল তানিশা কথা শুনে। পকেট থেকে নিজের বাটন মোবাইলটা বের করে বলল,
– এটা এখনো অক্ষত আছে। এটা পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত ফোন কেন কিনবো? আর ল্যাপটপ; ওরে আল্লাহ! এগুলো কিনে আমি টাকা অপচয় করতে পারব না।

তানিশা মাথায় হাত দিয়ে বিরক্তির গলায় বলল,
– আরে ইয়ার, এটা না। তোকে না বলেছিলাম একটা স্মার্ট ফোন কিনতে। আর তুই খবরের কাগজে কাজ করিস। তোর কাজটাই লেখালেখি। অর্থাৎ যখনতখন লেখালেখির জন্য একটা মাধ্যম তোর প্রয়োজন। অন্তত ল্যাপটপটা তোর প্রয়োজন। ধর, যেকোনো কাজে কোথাও গিয়েছিস। বা কোথাও আটকে পড়েছিস। এবার তোর জন্য তো আর অফিসে একটা প্রজেক্টের কাজ অফ থাকবে না। দূরে থাকলেও ল্যাপটপ এর সাহায্যে তুই রিপোর্ট লিখে আমাকে মেইল করতে পারবি।

– ঠিক এই কারণেই আমি ওইসব কিনছি না। ওইসব কিনে আমি টাকার সাথে সাথে নিজের ঘুমটা নষ্ট করতে পারব না। আমার বাড়ি কাছেই। সুতরাং কোথাও আটকে পড়ার সুযোগ নেই। পাশের ডেস্কের সুমন ভাই তো প্রায়ই আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে। এই চাকরি নাকি তাকে ঘুমাতেও দেয় না।

তানিশা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
– কেন কেন?

– কারণ, ওর সিনিয়র নাকি ওকে মাঝরাতেও ফোন দিয়ে বলে, একটা প্রতিবেদন তৈরি করে সকালের আগে আমাকে দেখাও। এবার তুই বল, আমি যদি ল্যাপটপ কিনি, তাহলে ওই আধবুড়ো দিনরাত এভাবেই আমাকে জ্বালাবে।

তাহমিদের কথা শুনে তানিশা খিলখিল করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে বলল,
– আচ্ছা শোন, তুই যদি রিপোর্টটা টাইপ করে লিখে দিস, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, আগামী মাসে তোর বেতন আমি ১৫ হাজার করে দেবো। মানে পাঁচ হাজার বাড়িয়ে দিবো।

তাহমিদ চমকে ওঠে বলল,
– ৫ হাজার টাকা! মানে আমার বেতনের প্রায় অর্ধেক বাড়িয়ে দিবি।

– হ্যাঁ, দিবো; কথা দিচ্ছি।

– যেই এই টাইপ করার কাজটা করবে, তাকেই কী বেতনের অর্ধেক বাড়িয়ে দিবি? ধর, কাজটা তুই করলি, তাহলে কী অফিসের মালিক তোমার বেতনের অর্ধেক টাকা বাড়িয়ে দিবে? তোর বেতন যদি ৫০ হাজার টাকা হয়, তাহলে তখন ৭৫ হাজার টাকা হয়ে যাবে। যদি ১ লাখ টাকা বেতন হয়, তাহলে দেড় লাখ টাকা হয়ে যাবে। ওয়াও!

তানিশা হাসল তাহমিদের কথা শুনে। বলল,
– আরে বোকা, তা আবার হয় নাকি! আমি শুধু তোরটাই বাড়িয়ে দিবো। তোর রিপোর্ট সবসময় ভালো হয় সবার থেকে। যদি সেটা কাগজে না লিখে, বা কাগজে লেখার পর আবার কম্পিউটারে টাইপ করে দিস, তাহলে আমি তোর বেতন ৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিবো।

তাহমিদ ঠোঁট বাঁকা করে বলল,
– তুই দিবি?

– হ্যাঁ, আমি দিবো। কেন, সেই ক্ষমতা কী আমার নেই? অবশ্যই আছে।

– তাহলে বরঞ্চ আগামী ১০০ বছরের বেতন আমাকে অগ্রীম দিয়ে দে। যদি বেঁচে থাকি, তাহলে কথা দিচ্ছি, মহাকাল ছাড়বো না কখনো। ১০০ বছর তোদের এখানেই চাকরি করব।

তানিশা চোখ বড় করে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
– বলিস কী! এত টাকা দিয়ে তুই কী করবি? ১০০ বছরের বেতন কতগুলো টাকা তুই জানিস? কী করবি এত টাকা দিয়ে?

– আমার একটা গোপন কাজ আছে। সেখানে ইনভেস্ট করব।

– আরে বাহ্! বিজনেস করার প্ল্যান করছিস নাকি।

– না। আমার জন্য না। একটা ইচ্ছা আছে আমার। সেটাই পূরণ করব। যদিও এত টাকার প্রয়োজন নেই। ঠিক আছে, ৫০ বছরের বেতন দিলেই হবে।

– তোর ইচ্ছেটা আমায় বল। দেখি, পূরণ করতে পারি কি না। বন্ধু হিসেবে তো আমার দায়িত্ব এটা।

– বন্ধু হিসেবে আমার ইচ্ছা পূরণ করবি?

– কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না? ঠিক আছে, ভেবে নে আমি তোর বউ। এবার নিশ্চয়ই বিশ্বাস হচ্ছে। বউ তো স্বামীর ইচ্ছে পূরণ করতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু না।

তাহমিদ চমকানো কণ্ঠে বলল,
– বউ!

– হ্যাঁ, বউ। পড়াশোনা, চাকরিবাকরি অনেক করেছি। আর ভালো লাগছে না। বাকি জীবনটা সংসার করে কাটাবো ভাবছি। বিয়ের পর তোকে আমার চাকরিটা দিয়ে দিবো। তুই বাইরে চাকরি করবি, আমি সংসার করব।

তাহমিদ হেসে উঠল। তানিশা সিরিয়াস ভঙ্গিতে অনুনয়ের কণ্ঠে বলল,
– সত্যি বলছি। তোকে আমার খুব ভালোলাগে। সহজ-সরল মানুষ তুই। যদিও একটু উদ্ভট টাইপের, অগোছালো। বাট তোর মন ভালো। তুই মানুষ হিসেবে খুব ভালো। সম্পর্কে একে অপরকে বুঝতে পারাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তোকে বুঝতে আমার একটু সময় লাগলেও আমাকে বুঝতে তোর একটুও সময় লাগবে না। তোর মধ্যে এমন একটা গুণ আছে, যার দ্বারা সহজেই অন্যকে বুঝতে পারিস। আনন্দে রাখতে পারিস। আমার মনে হয়, আমি তোর কাছেই ভালো থাকবো। বিয়ে করবি আমায়, প্লিজ।

তাহমিদ আবার হাসতে চাচ্ছিল। কিন্তু তানিশার চোখ-মুখ দেখে মনে হলো, তানিশা খুব সিরিয়াস। তাই সেও কিছুটা সিরিয়াস হওয়ার ভান ধরল। একটু চুপ থেকে বলল,
– তোকে তো আমি সবসময় বোনের নজরে দেখে এসেছি।

তানিশা রেগেমেগে বলল,
– মাইর খাবি কিন্তু। এটা কেম্নে সম্ভব? আমি কোনোকালেই তোর বোন ছিলাম না; এবং থাকবোও না। আমি আগে তোর বন্ধু ছিলাম। এখন তোর বউ হবো। তুই বন্ধু বলেই বলছি, অন্য কেউ হলে বেহায়ার মতো এভাবে অন্তত বলতে পারতাম না।

– দেখ, আমার বাবা ‘টি’ অক্ষরটাকে চিরকাল নিজের সন্তানের নামকরণের ব্যবহার করেছে। আমার ভাইয়ার নাম তুহিন, আমার নাম তাহমিদ, আর আমার বোনের নাম তৃষ্ণা। আমি তুলি ডাকি। এটাও ‘টি’ অক্ষরের। তোর নাম তানিশা। সুতরাং ‘টি’ অক্ষর দিয়ে শুরু এমন সব নামের মানুষকে আমি নিজের ভাই-বোন মনে করি।

তানিশার মাথা গরম হয়ে গেল। এখানে যে তাঁর নামটা ভিলেন হয়ে দাঁড়াবে, তা আগে কল্পনাও করেনি। আগে এইরকম কিছু ভাবলে, নামটা চেঞ্জ করে ফেলতো৷
তানিশা হাতের সামনে থাকা কাগজটা মুড়িয়ে তাহমিদের দিকে ছুড়ে মারল। চেঁচিয়ে বলল,
– হোক বোন। রক্তের তো আর না। তবুও আমি তোকে বিয়ে করব। বিকেলে আমি তোর বাড়িতে যাবো। এরপর ভাবীকে অনুরোধ করে বলব, আমাদের বাড়িতে তোর আর আমার বিয়ের পস্তাব পাঠাতে।

তাহমিদ তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। মনেমনে কী যেন বিড়বিড় করে মোড়ানো কাগজটা আবার তানিশার দিকে এগিয়ে দিলো। তানিশা সেটা হাতে নিয়ে রাগে গজগজ করতে লাগল। তাহমিদ কিছু না বলে বেরিয়ে এলো।

১০.
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও নুপুরের মনে হচ্ছে, চোখ দু’টো মনমতো হচ্ছে না। সেই চার-পাঁচ বছর আগের সজলের চোখে যে মাদকতা ছিল, কাগজে আঁকা ছবিটির চোখে সেই মাদকতা নেই। কিছু একটা যেন মিসিং আছে। কী জানি, মানুষটার চোখ দু’টো এখন কেমন হয়েছে!
নুপুর ছবি আঁকছে, আর কতকিছু ভাবছে! চোখের সামনে সজলের মুখটা ভেসে উঠছে। কিন্তু চোখ দু’টো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না; ঝাঁপসা লাগছে। কিছুটা ভয় পাচ্ছে নুপুর। যে মানুষটাকে এতগুলো বছর নিজের অন্তরে গেঁথে রেখেছিল, এক মুহূর্তের জন্যও যার মুখটা আড়াল হতে দেয়নি, আজ হঠাৎ তাঁর চোখ দু’টো সে আঁকতে পারছে না। ঘরে সজলের অসংখ্য ছবি লুকিয়ে রেখেছে নুপুর। চাইলেই ওখান থেকে একটা ছবি নিয়ে আসতে পারে; তারপর সেই ছবি দেখে চোখটা এঁকে ফেলতে পারে। কিন্তু সে তা করবে না। আগেও অন্তরে গেঁথে রাখা সজলকে সে ভালোবেসে এঁকেছে; আজও আঁকবে।

নুপুর নিজের মনে বলল,
– সমস্যাটা হলো, আজ আমার মন প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন; তাই মন স্থির রেখে সজলকে আঁকতে পারছি না।

কলিংবেলটা বেজে উঠল হঠাৎ। নুপুরের সময় যেন থমকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সে উৎসুক হয়ে নিচতলায় উঁকি দিলো। রহিম চাচা দরজা খুলে দিতে গেল। নিচে নুপুরের বাবা আফজাল হোসেনও বসে আছেন। তিনি ওঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। রহিম চাচা দরজা খুলে দিলেন। একগাল হেসে বললেন,
– আহেন ভাইজান। বড়সাব আপনি লিগা বইয়া আছে।

সজল রহিম চাচাকে সামাল দিয়ে ভিতরে ঢুকল। রহিম চাচা সালামের উত্তর নিয়ে সজলের হাত থেকে ব্যাগটা নিজের হাতে নিলো। সজল ব্যাগটা তাঁর হাতে দিয়ে আফজাল হোসেনের সামনে এলো। বলল,
– আসসালামু আলাইকুম মামা। কেমন আছেন?

– ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?

– আমিও ভালো আছি।

– সেই যে মাস্টার্স শেষ করে ঢাকা ছাড়লে, আর তো আসার কথা ভাবলেও না। অনেক কষ্টে তোমাকে আবার ঢাকায় আনতে পারলাম।

সজল হাসল কিছুটা। আফজাল হোসেন আবার বললেন,
– যা-ও, ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। তোমার মামি নিজের হাতে রান্না করছে তোমার জন্য। দুপুরের খাবার সবাই একসাথে খাবো; এরপর আমি বাইরে বের হবো। তা ঘরটা কোনদিকে মনে আছে তো; নাকি ভুলে গেছ?

সজল হেসে বলল,
– মনে আছে মামা। আমি অতটাও ভুলো মনের না।

– ঠিক আছে যাও। উপরে নুপুর আছে। ছবি আঁকছে।

নুপুরের কথা শুনেই সজলের আত্মা শুকিয়ে এলো। কয়েকবছর আগে যখন সজল এই বাড়ি থেকে পড়াশোনা করতো; তখনই নুপুর ওর দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। সবসময় সজলের সাথে ইউনিভার্সিটি যেতো। দু’জনের ইউনিভার্সিটি একই হওয়ায়, সজল কখনো ‘না’ করতে পারতো না। মাস্টার্স পরিক্ষা শেষ হলো। সজল বারান্দায় বসে গুনগুন গান গাইছিল। নুপুর সেসময় পাশে এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ আমতাআমতা করে বলে,
– সজল, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। অনেকদিন আগে থেকেই। কিন্তু বলতে পারছিলাম না। তোমার তো পরিক্ষা শেষ। এবার বাড়িতে যাবে। আবার কবে আসবে, তাঁর ঠিক নেই। তাই একপ্রকার লাজলজ্জা ভুলে গিয়ে তোমার কাছে এলাম।

সজল চমকে উঠেছিল। বাকরুদ্ধ হয়ে শুধু কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল নুপুরের দিকে। এরপর আর এক মুহূর্তও ওই বাড়িতে দাঁড়ায়নি। ব্যাগপত্র গুছিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিল। আর ফিরে যায়নি ঢাকায়। কারণ, তাঁর মনে আগে থেকেই আসমার স্থান ছিল। আসমাকে ছাড়া সে অন্য কাউকে কল্পনা করতে পারতো না। বাড়িতে গিয়ে বাবা-মায়ের অনেক প্রশ্নের মুখে পড়ে সজল। কেন হঠাৎ চলে এলো? নুপুরের সাথে কী হয়েছে? নুপুর বাড়িতে কাঁদছে কেন?
সজল সোজাসাপটা উত্তর দিয়ে সব বলে দিয়েছিল। সেটা শুনে ওর বাবা বলেছিল, বেশ তো, যদি তোমরা রাজি থাকো, তাহলে আমি আফজালের সাথে কথা বলব বিয়ের ব্যাপারে।
সজল তখন আরও রাগ করে বাবা-মায়ের কাছ থেকে চলে গেছিল। আসমাকে ফোন করে দেখা করতে বলে। আসমার সাথে দেখা হয়। কিন্তু নুপুরের কথা, বাবার কথা সে এড়িয়ে যায়।

সজলকে দেখেই নুপুর চোখ আঁকতে শুরু করেছিল। সজল তাঁর পাশ দিয়েই নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল। সেসময় নুপুরকে দেখল। সাদা কাগজের মাঝখানে নিজের মুখটা দেখে থেমে যেতে বাধ্য হয়েছে সে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,
– ওয়াও।

নুপুর হকচকিয়ে উঠল। সজল যে কখন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তা বুঝতেই পারেনি। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সজলের দিকে তাকিয়ে রইল। সজল বলল,
– তুমি বেশ সুন্দর ছবি আঁকতে পারো। আমি তো ভাবতেই পারছি না তুমি এইরকম বিশাল মাপের আর্টিস্ট হয়ে গেছ।

নুপুর আপাদমস্তক ভঙ্গিতে হাসল। বলল,
– থ্যাঙ্কিউ সো মাচ৷ তুমি কি ঘরের দিকে যাচ্ছো?

– হ্যাঁ।

– চলো আমি দেখিয়ে দেই।

– আমি একাই যেতে পারব। তুমি যে কাজটা করছিলে, সেটা করো।

নুপুরের মুখটা নিরোৎসাহিত হয়ে গেল। উল্টো দিকে ঘুরে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সজল আর দাঁড়ালো না। নিঃশব্দে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগল।

১১.
তাহমিদের ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। তাহমিদ পকেট থেকে ফোন বের করে দেখ, তানিশা নাম। পাশেই রনি বসে ছিল। মোবাইলের ছোট্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠা তানিশা নামটা তাঁর চোখ এড়ালো না। তাঁরা চার বন্ধু আর এক বান্ধবী চায়ের দোকানে বসে আছে। রনি সবাইকে উদ্দেশ্য করেই রসিকতা করে বলে উঠল,
– সবাই শোন, হবু বরের মোবাইল কল এসেছে হবু বউয়ের।

রনির কথা শুনে হেসে উঠল সবাই। দোকানী চাচা-ও না হেসে পারল না। এতক্ষণ তাঁদের মধ্যে তানিশাকে নিয়েই কথা হচ্ছিল। তানিশাকে সবাই চেনে। যদিও এদের মতো তানিশা অফিস শেষ করে এখানে এসে আড্ডা মারে না। তবে ফোনে এবং শুক্রবারে যোগাযোগ হয় সবার সাথে।

তাহমিদ সবাইকে ধমক দিয়ে বলল,
– আহ্! ফাজলামি বন্ধ কর। তোদের কী মনে হয় আমি ওকে বিয়ে করব?

– করবি না কেন? রাজকন্যার সাথে রাজ্য ফ্রি পাবি। বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। গাড়ি দিয়ে চলাফেরা করে। এছাড়া ও নিজেও ভালো চাকরি করে। তোর ভবিষ্যৎ তো আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আহ্! তুই টাকার বিছানায় শুয়ে আছিস।

রনি উচ্চবাক্যে কথাটা বলল। ওর কথা শুনে আবারও উচ্চস্বরে হেসে উঠল সবাই। তাহমিদ বলে উঠল,
– ওই শালা, তোর কী মনে হয় আমি ঘরজামাই থাকবো? তাছাড়া তোদের কে বলল, আমি ওকে বিয়ে করব. দেখ, বিয়ে একটা পবিত্র কাজ। আমি যদিও করি, তাহলে শেষ বয়সে করব। বউকে বলব, আমার যৌবন এক প্রেমিকাকে দিয়েছিলাম। সে চলে গেছিল। তাঁর বিরহে আমি এতই কাতর ছিলাম যে, উদাসীন থাকতে থাকতে যৌবন পেরিয়ে বুড়ো বয়সে চলে এসেছি। এবার যদি এই বুড়োটাকে নিতে চাও, তাহলে নাও; অন্যথায় উল্টো রাস্তা দেখো।

তাহমিদ রসিক সুরে বললেও ওর কথাগুলো সিরিয়াস শোনালো। ফোনের রিংটোন প্রথমবার কেটে গিয়ে দ্বিতীয়বার বাজতে শুরু করছে। তাহমিদ সংকোচবোধ করছে। নিজের মনে ভাবছে,
তানিশা বলেছিল ও আমার বাড়িতে যাবে। মনে হচ্ছে ও এখন আমার বাড়িতেই আছে। হায় আল্লাহ!

চতুর্থ পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

সম্পৃক্ততা পর্ব ৩

0

সম্পৃক্ততা — তৃতীয় পর্ব।

রিফাত হোসেন।

৭.
খাবার টেবিলে তুহিনকে দেখেই তাহমিদের হাসিমাখা মুখটা মুহূর্তের মধ্যে মলিন হয়ে গেল। উজ্জীবিত মুখটাতে আঁধার নেমে এলো। তুহিনের পাশে বসে আছে ফাতেমা আর তৃষ্ণা। তাহমিদ কপাল কুঁচকিয়ে সবাইকে একনজর দেখে চেয়ারে বসল। প্লেটে ভাত নিলো নিজেই। হঠাৎ তুহিন বলে উঠল,
– তুই কি ঠিক করেই নিয়েছিস এ জীবনে আর শুধরোবি না?

তাহমিদ মাথা তুলে তাকালো তুহিনের দিকে। তুহিনের চোখে-মুখে ক্ষিপ্ত ভাব। তাহমিদ আড়চোখে তৃষ্ণার দিকেও তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বড় ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– জাস্ট একবার গাল টেনেছিলাম। সেভাবে তো মারিওনি। এই সামান্য কারণে ও আবার তোমার কাছে অভিযোগ জানিয়েছে।

তাহমিদের কথা শুনে যেন আকাশ থেকে মাটিতে আঁছড়ে পড়ল তুহিন। খাওয়া বন্ধ করে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
– এইসব কী বলছিস? মানে তুই আবার আমার বোনটাকে মেরেছিস। এত সাহস তোকে কে দিয়েছে শুনি?

তাহমিদ থতমত খেয়ে গেল। সে ভেবেছিল, তৃষ্ণা তাঁর নামে বিচার দিয়েছে বড় ভাইয়ের কাছে। অথচ এখন মনে হচ্ছে, গাল টানার ব্যাপারটা বড় ভাই আগে জানতোই না; সে নিজেই এখন বলে দিলো।
তাহমিদ আর কিছু বলতে পারল না। আমতাআমতা করতে লাগল। ফাতেমা আর তৃষ্ণা খিলখিল করে হাসছে। তুহিন কয়েক মিনিট চুপ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে গিলে নিলো। এরপর প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে কিছুটা কটজ বলল,
– শোন তাহমিদ, আমার অফিসে একজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেওয়া হবে। আমি কথা বলেছি স্যারদের সাথে। পরশু ইন্টারভিউ। বেতম মোটামুটি বেশ ভালো। আমার বেতনের থেকেও বেশি বেতন।

তাহমিদ বিরক্তির স্বরে বলল,
– ভাইয়া, আমি পত্রিকার চাকরিতেই ভালো আছি। অন্য চাকরির কোনো প্রয়োজন নেই আমার।

– দশ হাজার টাকার বেতনের চাকরি করে কী সারাজীবন পাড় করবি তুই?

– হ্যাঁ।

– ইঞ্জিনিয়ারিং করেও মাত্র দশ হাজার টাকার বেতনের চাকরি করছিস। এটা কিন্তু লজ্জার বিষয়। তাছাড়া আজকাল মাত্র দশ হাজার টাকায় কিচ্ছু হয় না। সংসার হলে বুঝবি।

তাহমিদ হেসে উঠল। মলিন হাসি। মনে মনে ভাবতে লাগল, ভাইয়া কবে বুঝবে সংসারের প্রতি আমার কোনো ঝোঁক নেই। আমি স্বাধীন। সংসারে আবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা নষ্ট করার মতো বোকামি আমি করব না কখনোই।
তুহিনের আক্রোশ আরও বেড়ে গেল। সে রাগে কটমট করে উঠল। কঠিন মুখ করে বলল,
– হাসছিস কেন?

তাহমিদ হেসেই বলল,
– তুমি কত টাকা বেতন পাও?

নড়েচড়ে বসে উত্তর দিলো তুহিন।
– তেইশ হাজার টাকা।

– বাড়িভাড়া দাও কত?

– আট হাজার।

– বাজারসংশ্লিষ্ট যাবতীয় খরচ; গ্যাস, বিদ্যুৎবিল, এইসব মিলিয়ে কত টাকা চলে যায় প্রতি মাসে?

তুহিন বিস্মিত চাহনিতে সবার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো।
– পাঁচ-সাত হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে যায়। মাছ-মাংসের যা দাম, প্রতি শুক্রবারে বাজারে গেলে একেবারে ছাটাই করে দেয়।

তাহমিদ মুচকি হেসে বলল,
– বাড়িভাড়া আট হাজার, আর অন্যান্য খরচের ছয় হাজার ধরলাম। সুতরাং এখানে অলরেডি ১৪ হাজার টাকা শেষ। তাই তো?

তুহিনের বিস্ময়ের শেষ নেই। তাহমিদ এইসব কেন জিজ্ঞেস করছে, তা বুঝতে পারছে না সে। শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা করল। তাহমিদ আবারও মুচকি হেসে বলতে লাগল,
– বাকি আছে ৯ হাজার টাকা। তোমার যাতায়াত খরচ, তৃষ্ণার প্রতিদিনের হাতখরচ, ভাবীর খরচ, এইসব মিলিয়ে প্রতি মাসে ২-৩ তিন হাজার টাকা খরচ হয়। আরও বেশি হয়। এছাড়া বেতন পেলে সবার জন্য কিছু না কিছু কিনে আনো তুমি; এখানে আরও ১ হাজার টাকা খরচ হয়। অর্থাৎ ৯ থেকে আমি ৩ হাজার টাকা বাদ দিলাম। থাকে মাত্র ৬ হাজার টাকা। এই টাকা তুমি সঞ্চয় করো৷ কখনো আবার খরচও হয়ে যায় নানান কারণে। তবুও আমি ধরলাম প্রতি মাসে তোমার কাছে সবশেষে থাকে ৬ হাজার টাকা।

এইটুকু বলে থামল তাহমিদ। দেখল, উপস্থিত সবাই মুখটা ‘হা’ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সবার চাহনিতেই আছে মারাত্মক কৌতূহল। তুহিন মাথা ঝাঁকালো এবারও। তাহমিদ আবার বলল,
– আমার বেতন ১০ হাজার টাকা। আমার অফিস কাছেই। বাস ভাড়া মাত্র ১০ টাকা। সুতরাং যাতায়াত মাত্র ২০ টাকা। এছাড়াও সন্ধ্যায় একটু আড্ডা দেই বন্ধুদের সাথে। চায়ের দোকানে বসি শুধু। খুব বেশি হলেও ১ হাজার টাকা আমার প্রতি মাসে খরচ হয় সবমিলিয়ে। জামা-কাপড় তো তেমন কিনিই না। অর্থাৎ, বাকি ৯ হাজার টাকা প্রতিমাসে আমার কাছে থাকে। এবার তুমিই বলো ভাইয়া, কার চাকরিতে টাকা বেশি?

তুহিন দাঁত খিঁচিয়ে বলল,
– ফাজলামি করছিস। সবকিছু সামলানোর পর আমার কাছে ৬ হাজার টাকা থাকে। তুই তো সংসার এক টাকাও দিস না; তোর কাছে ৯ হাজার টাকা থাকবেই।

তাহমিদ অভিজ্ঞদের মতো আঙ্গুল উঁচু করে বলতে লাগল,
– সঞ্চয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাইয়া। আসল কথা এটাই যে, সারামাস খেটে তোমার কাছে থাকে মাত্র ৬ হাজার টাকা। মাত্র ৬ হাজার টাকা সঞ্চয় করেও তুমি বেশ আনন্দে চাকরি করছ। আর আমার কাছে থাকে ৯ হাজার এটা। এই ৯ হাজার টাকা আমার জন্য অনেক। তুমি যদি ৬ হাজার নিয়ে আনন্দে থাকতে পারো, তাহলে আমি ৯ হাজার টাকা নিয়ে কেন লজ্জা পাবো? আমার তো তোমার থেকেও খুশি থাকা উচিত। প্রতিটি মানুষের উচিত, যা প্রয়োজন, তা নিয়েই খুশি থাকা। আমি তো অফিসে গিয়ে বলব, আমার বেতন আরও কমিয়ে দিন। এত টাকা দিয়ে আমি করবটা কী শুনি? ৯ হাজার টাকা; বাপ্রে! এগ্লা আমি খরচ করব কীভাবে? কে খাবে আমার এত টাকা?

তাহমিদের কথা শুনে হো হো শব্দ করে হেসে উঠল ফাতেমা আর তৃষ্ণা। তাঁদের হাসির শব্দে যেন পুরো পাড়া কেঁপে উঠল। বাড়ির সামনের বটগাছে থাকা কাক উড়ে চলে গেল। এইরকম সাংঘাতিক হাসির শব্দে সে আর ওখানে বসে থাকার মতো দুঃসাহস দেখালো না। তাহমিদ নিজেও মিটমিট করে হাসল। সাথে চোখ-মুখে এমন একটা ভাব আনলো, যেন সে আমেরিকার কোনো সমাবেশে বক্তিতা দিয়ে অনেক মানুষের হাততালি এবং প্রেসিডেন্টের প্রসংশা পেয়ে গেছে।
তুহিন ধমক দিলো সবাইকে।
– চুপ করো সবাই।

হাসি থামিয়ে দিলো সবাই। চমকানো চোখে তুহিনের দিকে তাকালো। তুহিনের খাওয়া প্রায় শেষ। সে ওঠে দাঁড়াল। তাহমিদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাইকোলজিস্ট এর কাছে যা।

কথাটা বলে হাসল তুহিন। তাহমিদ হেসে বলল,
– আমি যে রোগে আক্রান্ত হয়েছি, সেই রোগ সারানোর ক্ষমতা কোনো সাইকোলজিস্ট এর নেই।

তুহিন মুখে কিছুই বলল না আর। মনে মনে বলল, এর সাথে কথা বলা মানেই সময় নষ্ট করা। ধুত!
হাত ধুঁয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল তুহিন। তাহমিদ নিজের খাবার শেষ করতে লাগল। এ সময় ফাতেমা হঠাৎ বলে উঠল,
– সত্যি বলছি ভাই, আজকের মতো আগে কখনোই হাসি পাইনি। কী দারুণ যুক্তি দিলা তুমি। একটা কোমায় থাকা রোগীকেও এইসব কথা বলে জাগিয়ে তুলতে পারবে তুমি।

কথাটা বলে ফাতেমা প্রসংশা করল, না টিপ্পনী কাটল, তা বুঝতে পারল না তাহমিদ। কিছু বললও না এ প্রসংগে।
খাওয়াদাওয়া শেষ করল তাহমিদ ফাতেমাকে বলে বাড়ি থেকে বের হলো। তাঁর বন্ধু ফোন দিয়েছে। কী যেন কথা আছে বলল। সে এখন ওখানেই যাচ্ছে।

৮.
এমনও হয়, প্রিয় মানুষটা কাছাকাছি আছে; খুব কাছাকাছি, অথচ তাঁর মুখটা দেখা যাচ্ছে না! একেবারে চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তবুও তাঁর মুখ দেখার উপায় নেই। আবছায়া চারিদিকটা। দূর থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক। মৃদু বাতাস বইছে। মাঝে মাঝে কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দ শোনা যাচ্ছে। সবকিছু একটা নির্দিষ্ট গতিতে চলছে। কিন্তু বুকের ধুকপুকানি অনির্দিষ্ট গতিতে বেড়ে যাওয়ায় বিরক্ত আসমা। কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। চোখ দু’টো অন্ধকারে হাতড়ে মরছে। একবার ডানে তাকালো, একবার বামে, কখনো আবার সামনে-পিছনে। মুহূর্ত এমন এক যন্ত্রণার, আসমার মনে হচ্ছে ও মরে যাবে। এভাবে বাঁচা যায় নাকি? হৃদপিণ্ডটা যেন দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। কেন যে এখানে আসতে গেল; কে জানে!

সজল মৃদু হেসে বলল,
– অনেকদিন পর তোমাদের বাড়ির কাছে এলাম। প্রায় কয়েক বছর পর।

আসমা অস্থির কণ্ঠে বলল,
– বাড়ির কাছে না, আপনি একেবারে বাড়িতেই এসেছেন। এই কুয়োতলা আমাদের বাড়িরই একটি অংশ।

– তা অবশ্য ঠিক। তবুও ঘরে না যাওয়া পর্যন্ত বলতে পারছি না, তোমাদের বাড়িতে এলাম।

– আপনি কী চাচ্ছেন আমাদের ঘরে যেতে?

– এইরকম কিছু চেয়ে তোমাকে অন্তত বিপদে ফেলতে চাই না।

সজলের কথা শুনে হাসল আসমা। চিন্তিত মুখে এই হাসি খুব বেমানান। তাঁর থেকেও বেমানান হতো, যদি সে একটু না হাসতো। আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। তাঁর পরণে এখন বাদামি রঙের একটা শাড়ি। সাথে লাল রঙের ব্লাউজ। চুলগুলো খোলা। যদিও তাঁর এই শাড়ি, ব্লাউজ কিংবা খোলা চুল সজল দেখতে পাচ্ছে না। দু’জনেই অন্ধকারে চোখ হাতড়াচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলো যা-ও আসার কথা ছিল; মাথার উপরে থাকা পেয়ারা গাছটা তা-ও আসতে দিচ্ছে না। যেন সে দু’জনের প্রতি খুব রেগে আছে। তাই কাউকেই, অন্যের মুখটা দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে না। রাত প্রায় ১০ টা বাজতে চলল। বাড়ির সবাই ঘুমে বিভোর। কুয়ো তলায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সজল আর আসমা।
কিছুক্ষণ আগেই আসমা ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মোবাইলটা বালিশের নিচে রেখে শুয়েছিল। পাশে ছিল ছোট বোন, রাইশা। ঠিক সেসময় হঠাৎ টুন করে একটা শব্দ হয় মোবাইলে। থমথমে ঘরে শব্দটা যেন আসমার বুকে এসে আঘাত করেছিল। রাইশা একটু নড়েচড়ে উঠলেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। আসমা আস্তে আস্তে বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে। কাঁথার ভিতরে মাথায় ঢুকিয়ে মোবাইলের পাওয়ার বাটনে চাপ দেয়। স্ক্রিনে তাকাতেই দেখে সজলের ম্যাসেজ। সজল লিখেছে, ‘তোমাদের কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি এসো।
আসমার সেসময় কান্না পাচ্ছিল। যদি কেউ দেখে ফেলে, তাহলে তো বাতাসের সাথে বদনাম ছড়িয়ে যাবে। ফোনে ম্যাসেজ কিংবা ব্যালেন্স, কিচ্ছু ছিল না। না পারছিল যেতে, আর না পারছিল সজলকে ‘চলে যান’ কথা বলতে। অনেকক্ষণ বিভ্রান্তিতে থাকার পর সে ঢিপঢিপ পায়ে বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। কুয়ো তলায় এসে থেমে যায়। সজলকে চোখের দেখা না দেখতে পেলেও বুঝতে পারে, মানুষ তাঁর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।

সজল কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আবার বলল,
– আসমা, তুমি কী খুব ভয় পাচ্ছ?

আসমা মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
– খুব, খুব বেশিই ভয় পাচ্ছি আজ। রাতেরবেলা আপনি যে কেন আসতে গেলেন।

সজল হাসল। তাঁরও কিছুটা চিন্তা হচ্ছে বটে। তবে প্রকাশ করল না। প্রেমিকার কাছে সবকিছু প্রকাশ করতে নেই। সে যদি আবার হুট করে ভীতু প্রেমিক বলে ওঠে, তখন লজ্জায় আর দাঁড়ানো যাবে না। সজল হঠাৎ আসমাকে একটা প্রস্তাব দিলো। বলল,
– আসমা, তোমার হাতটা একটু ধরব?

প্রস্তাবটা পেয়ে চমকে উঠল আসমা। সজলের চোখ দু’টো অন্ধকারে সয়ে গেছে। সে আসমার শ্যামলা চেহারার চমকানো মুখটা দেখতে পাচ্ছে। কিছুটা আবছায়া বটে; কিন্তু আবছায়াটুকু অনুভূতি দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। ভালোবাসার মানুষকে অনুভব করতে পারার থেকে বড় কিছু আর হয় নাকি!
আসমা মাথা নিচু করে বিড়বিড় করতে লাগল। সজল বুঝল, আসমা খুবই ভয় পাচ্ছে। তাই হাত ধরার অনুমতি দেওয়ার মতো দুঃসাহস দেখাচ্ছে না। সজল মনেমনে ফন্দি এঁটে বসল। রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
– আসমা, তুমি কী জানো, আমাদের মাঝে এখন দূরত্ব কতটা?

– জানবো কীভাবে? আমি তো দেখতেই পাচ্ছি না আপনি কতটা দূরে আছেন। জাস্ট কথা শুনছি। আসলে কিছুক্ষণ আগে দুই বোন মিলে মোবাইলে একটা মুভি দেখছিলাম। তাই চোখটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেছে। ঠিক হতে সময় লাগবে একটু।

– অনুমান করে বলো। আমার কণ্ঠ শুনছ, আমার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছ। এতকিছু শুনেও বুঝতে পারছ না, আমাদের মাঝে এখন কতটা দূরত্ব আছে।

আসমা মাথা চুলকিয়ে উত্তর দিলো।
– পারছি তো। উমম, চার-পাঁচ ফুট দূরত্ব তো হবেই।

এ-কথা বলে একটা হাত সোজাসুজি সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলো আসমা। হাতটা গিয়ে ঠেকল সজলের বুকের মাঝখানে। সে আরও চমকে উঠল। হাতটা সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল; কিন্তু এর আগেই সজল হাতটা খপ করে ধরে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,
– প্রথমে তুমি আমাকে স্পর্শ করেছ; এরপর আমি। সুতরাং বলতে পারবে না, আমি অন্যায় ভাবে তোমাকে স্পর্শ করেছি।

হাতটা সরিয়ে নেওয়ার জন্য জোড়াজুড়ি করল না আসমা। ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে উৎকণ্ঠিত গলায় শুধু বলল,
– আসতে কথা বলুন। বাবা জেগে যাবে। তখন স্পর্শ করার শখ ঘুচিয়ে দিবে।

সজল নিঃশব্দে হাসল। আসমা শান্ত হয়ে হেলান নিলো অচল কুয়োর দেয়ালে। সজল জিজ্ঞেস করল,
– কুয়োটা কী এখনো ব্যবহার করো?

আসমা জবাব দিলো।
– না। পানি শুকিয়ে গেছে। এখন তো কল আছে।

সজল মিটমিট হেসে বলল,
– জানো, এই কুয়ো দেখে বারবার একটা দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

আসমা কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল,
– কোন দৃশ্য?

– ছোটবেলায় যখন ক্রিকেট খেলতে এখান দিয়ে মাঠে যেতাম; তখন দেখতাম তোমার বাবা কুয়ো থেকে পানি তুলে, তোমাকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে৷ তখন বোধহয় তুমি ক্লাস ওয়ানে পড়তে। আমি সিক্সে পড়তাম। তোমার পরণে সেসময় ছোট একটা প্যান্ট ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

আসমা হতভম্ব হয়ে গেল সজলের কথা শুনে। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে, দুই হাত দিয়ে নিজের মুখটা চেপে ধরল। কপট রাগী গলায় বলল,
– ছি: ছি:! এইসব কেমন কথা, হুহ্!আপনি কী আমাকে লজ্জা দেওয়ার জন্যই এসেছেন?

– না। এখন তোমাকে লজ্জা দিয়েও কোনো লাভ নেই। তোমার লজ্জায় লাল হওয়া মুখটা তো আমি দেখতে পারব না। যা সত্যি, তাই বললাম।

– বাবা ঠিকই বলেন, আপনি মাস্টার আসলেই সুবিধার না। আপনার মতলবের কোনো ঠিক নেই। মতলব ঠিক থাকলে কী আর একটা মেয়ের গোসল দেখার মতো অন্যায় কাজ করতেন।

– ধুর! ক্লাস ওয়ানে পড়া বাচ্চা আবার মেয়ে হয় কীকরে? ওইসময় তো তুমি একটা খুকি।

আসমা মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল,
– সে যাই হোক। খুকি বা মেয়ে, সবই তো এক। আপনার উচিত হয়নি ওভাবে উঁকিঝুঁকি মারা।

– উঁকিঝুঁকি মারিনি তো। সোজা হাঁটতাম, নিজের অজান্তেই চোখ চলে যেতো। আর অদ্ভুত ভাবে প্রতিদিন আমি যখন যেতাম, তখনই তুমি গোসল করতে।

– আসলে বাবা প্রতিদিন বেলা করে বাড়িতে ফিরতো। মা তো সন্ধ্যায় সব কাজ সেড়ে গোসল করতো। আমি আবার ছোট ছিলাম বলে পানি তুলতে পারতাম না। তাই বাবার সাথে গোসল করতাম। আচ্ছা, আপনি কী এইসব বলার জন্য এসেছেন?

– না।

– তাহলে?

– আসলে মায়ের সাথে আজ ঝগড়া হয়েছে। ভালো লাগছিল না বলে তাই এখানে এলাম।

আসমা অবাক হয়ে বলল,
– ঝগড়া করেছেন কেন? বাবা-মায়ের সাথে ঝগড়া করা ঠিক না। এইরকম মানুষকে আমি পছন্দ করি না।

– আরে আগে কথাটা শোন। ঝগড়া করার একটা কারণ আছে। স্কুল থেকে যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন মা হঠাৎ একটা টিকিট ধরিয়ে দিলো হাতে। কাল ভোর সকালের ট্রেনের টিকিট। ঢাকা যাওয়ার। ঢাকা আমার এক মামা থাকে; একটা বড় পোস্ট এ চাকরি করে। তিনি নাকি আমাকে দ্রুত ঢাকায় যেতে বলেছেন। একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করেছে। যদিও মা আগেই এইসব নিয়ে বকবক করতো আমার সাথে। কিন্তু আজ কোনো আলোচনা ছাড়াই বাবাকে দিয়ে টিকিট কাটিয়ে নিয়েছে। মেজাজটা এই কারণেই বিগড়ে গেছে।

আসমা কিছুটা ধাক্কা খেলেও নিজেকে সামলে নিলো। বলল,
– বাহ্, বেশ ভালো তো। শুনুন, ঢাকায় যান। এতে বরং ভালোই হবে। আপনি যদি একটু শক্তভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, তাহলে নিজের বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবেন, আমাকে বিয়ে করতে চান। আপনি তখন ভালো অবস্থায় থাকবেন; আপনার বাবা-মা আপনাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে না।

– সে নাহয় ঠিক আছে। কিন্তু আরও একটা সমস্যা আছে।

– কী সমস্যা?

সমস্যার কথাটা বলতে সংকোচবোধ করছে সজলের। নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
– আমি তো আর শিওর না। অযথা আসমাকে চিন্তিত করা কী ঠিক হবে? বাবা হয়তো মজা করে বলেছিল কথাটা।

সজল গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
– না, আসলে তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।

– সবসময় তো আর নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা ভাবলে চলবে না। বাবা-মা’কে খুশি রাখা আপনার দায়িত্ব। এটা এড়িয়ে যেতে পারেন না আপনি।

সজল হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিল ; কিন্তু তাঁর আগেই কোত্থেকে যেন রাইশার কণ্ঠ শোনা গেল। রাইশা ফিসফিস করে বলল,
– মেজোপু, কোথায় তুমি?

আসমা চমকে ওঠে বলল,
– রাইশা তুই এখানে!

রাইশা হেসে বলল,
– হ্যাঁ আমি। তুমি যে উনার ম্যাসেজ পেয়ে ঘর থেকে চলে এসেছ, তা আমি জানি। আমি তখন জেগেই ছিলাম। তুমি ফোনটা রেখে এসেছিলে। ম্যাসেজটা দেখেই তো আমি বুঝলাম, তুমি কুয়ো তলায় আছো।

রাইশা সজলের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
– তা মাস্টার মশাই, রাত তো অনেক হলো। আর কত জ্বালাবেন আমাকে বোনটাকে?

সজল বলল,
– তোমাকে না বলেছিলাম আমাকে মাস্টার মশাই বলবে না। এটা শুনলে নিজেকে বুড়ো বুড়ো মনে হয়।

রাইশা হেসে উঠল। আসমা ওকে সাবধান করে দিয়ে বলল,
– আস্তে।

রাইশা আবার ফিসফিস করে বলল,
– ঠিক আছে।

সজল রাইশাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– রাইশা, তা তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে?

– হ্যাঁ। তবে তারিখটা এখনো ঠিক হয়নি। দুই একদিনের মধ্যে তারিখ ঠিক হবে।

– তা হবু বরকে কেমন দেখতে? তোমার পছন্দ হয়েছে তো? সম্মন্ধ করে বিয়ে হচ্ছে; ভেবেচিন্তে রাজি হয়েছ তো?

– পছন্দ হবে না কেন? উনি বেশ ভালো মানুষ। তাছাড়া আমি রাজপুত্র চাই না। ওরা এক জীবন চার-পাঁচটা করে বিয়ে করে। আগে তো আরও বেশি করতো। নিজের সংসারের ভাগ অন্য কাউকে দেওয়ার মতো মেয়ে আমি না। স্বামী হিসেবে ভালো একজন মানুষ চেয়েছি; আল্লাহ চাওয়া পূরণ করেছেন। রাজপুত্রদের থেকে আমি দূরে থাকি।

– যাক, শুনে খুশি হলাম।

– শুধু খুশি হলে তো হবে না; এবার আমার আপাটাকে যেতে দিন। একটা মুভি দেখছিলাম। অর্ধেক দেখা হয়েছে। সকালে বাকিটুকু দেখতে হবে। এখন না ঘুমালে খুব সকালে উঠতে পারবে না। বেলা হলেই আবার স্কুলে চলে যাবে।

আসমা বলল,
– আসলে উনি কাল ভোরের ট্রেনে ঢাকায় চলে যাচ্ছে। তাই এইসময় দেখা করতে এসেছেন।

রাইশা মুখটা ‘হা’ করে বলল,
– তাই নাকি? তা ঢাকার মেয়েদের দেখে আমার আপুটাকে আবার ভুলে যাবেন না তো।

রাইশার কথা শুনে আসমার হৃদস্পন্দন কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। মুখ গিয়ে কোনো কথা বলতে পারলো না।
সজল, রাইশার প্রশ্নের প্রতিউত্তরে বলল,
– আসলে আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। ইনফ্যাক্ট আমি এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি। মা হুমকি দিচ্ছে; বলছে, আমি ঢাকায় না গেলে তিনি নিজের ক্ষতি করবেন। এইসব এর কোনো মানে হয়? সবার মা ছেলেকে নিজের কাছে রাখতে চান; আর আমার মা আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চান।

আসমা নিঃশ্বাস আটকিয়ে বলল,
– সন্তানের ভালোর জন্য কিছু কিছু মা নিজের ইমোশনকে সেক্রিফাইজ করে থাকেন। যারা পারেন না, তাঁরা সন্তানকে আটকে রাখেন৷ এর দ্বারা এটা প্রমাণ হয় না, সেসব মায়ের মতো আপনার মা, আপনাকে ভালোবাসে না। আপনি ঢাকা যান। মায়ের কথা শুনুন। যে মা আপনাকে জন্ম দিয়েছে, তাঁর একটা ইচ্ছা আপনি পূরণ করবেন না? আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব; বিশ্বাস করুন।

এইটুকু বলে আসমা থেমে গেল। অন্ধকারে কয়েক ফোঁটা চোখের জলও ফেলল সাথে। সজল ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল। রাইশা বলল,
– আপনারা কথা বলুন। আমি ঘরের দিকে যাচ্ছি। বাবা জেগে গেলে আমি খবর দিয়ে যাবো।

রাইশা চলে গেল। ও চলে যাওয়ার পর সজল বলল,
– আসমা, একটু সামনের দিকে যাবে প্লিজ। যাওয়ার আগে চাঁদের আলোয় তোমার মুখটা একবার প্রাণভরে দেখতে চাই।

আসমা সম্মতি দিলো। হাত বাড়িয়ে সজলের একটা হাত ধরল। এরপর পেয়ারা গাছের নিচ থেকে খোলামেলা জায়গায় গেল। জ্যোৎস্নার আলোয় সজল মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগল আসমাকে। আসমার ম্লান মুখটা দেখে তাঁর চোখের পাতা ভিজে এলো।

এ সময় নিশ্চয়ই তৃতীয় কেউ থাকলে সেই পরিচিত গানের একটা লাইন বলল,
‘ হতেও পারে, এই দেখা শেষ দেখা।’

সম্পৃক্ততা পর্ব ২

0

সম্পৃক্ততা — দ্বিতীয় পর্ব।

রিফাত হোসেন।

৪.
ফাতেমা ভেবেছিল, তাহমিদ খাবার টেবিলে দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। তাই সে রান্নাঘরের ভিতরেই বেশ তোড়জোড় করে রান্না শেষ করছিল। কিন্তু রান্না শেষ করে যখন খাবার টেবিলের কাছে এলো, তখন তাঁর মেজাজ বিগড়ে গেল। ৮ টা বেজে গেছে। ছেলেটা খাবেই-বা কখন, আর অফিসেই-বা যাবে কখন?
মনেমনে এ-কথা বলে বিড়বিড় করে সে এগিয়ে গেল তাহমিদের ঘরের দিকে। দরজাটা ভিতর থেকে আটকানো। ফাতেমা জোরে ধাক্কা মারল দরজায়। তাহমিদের কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। রাগে আর ক্ষোভে সে ধুম করে দরজায় একটা লাত্থি মারল। মুখে চেঁচিয়ে বলল,
– ওই তাহমিদের বাচ্চা!

তাহমিদ সবেমাত্র গোসল করে বের হয়েছে। ফাতেমা সম্পর্কে তাঁর ভাবী হয়। বয়সে তাঁর থেকে বড় বা ছোট নয়। অনেকটা সেইম বয়সী দু’জনে। তবুও সে যথেষ্ট সম্মান করে ভাবীকে। ফাতেমা মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে তুমি থেকে তুই বলে সম্মোধন করলেও তাহমিদ সবসময় ভাবীকে তুমি বলে সম্মোধন করেছে। হোক সে সমবয়সী; সম্পর্কে সে একজন শ্রদ্ধাশীল মানুষ।
তাহমিদের সাড়া না পেয়ে ফাতেমা বোধহয় আরও জোরে চেঁচানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিংবা বড় সাইজের কিছু দিয়ে দরজা ভাঙার মতো প্ল্যান করছিল। কিন্তু তাঁর আগেই তাহমিদ ভিতর থেকে বলে উঠল,
– ভাবী, আমি রেডি হচ্ছি। তুমি খাবার রেডি করো।

তাহমিদের কণ্ঠ শুনে শান্ত হলো ফাতেমা। বলল,
– ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি এসো।

– আচ্ছা।

স্বল্প সময়ের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল তাহমিদ। টেবিলের উপর থাকা পুরোনো সময়ের নতুন মডেলের বাটন মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। খাবার টেবিলের কাছে গিয়ে দেখল, কেউ নেই। অর্থাৎ বড় ভাই, ছোট বোন, কেউই নেই ওখানে। শুধু ফাতেমা একটা চেয়ারে বসে ফোন টিপছে। তাকে দেখে ফাতেমা ফোন রেখে প্লেট রাখল একটা চেয়ারের সামনে। পানির গ্লাস দিলো। তাহমিদ চেয়ারে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল,
– ভাইয়া কোথায় ভাবী?

– সে তো অনেকক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে। আজ কী যেন একটা জরুরি কাজ আছে বলল; তাই খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছে। খেয়ে পর্যন্ত যায়নি। আমাকে রাতে কিছু বলেওনি। আগে থেকে জানা থাকলে আমি আরও আগে ঘুম থেকে ওঠে রান্না করতাম।

তাহমিদ হাসল। আজ আর তাকে কেউ বলবে না, ‘এই পত্রিকার চাকরি ছেড়ে একটা ভালো চাকরি খোঁজ।।আজকাল দশ হাজার টাকার বেতনে চাকরি করা ছেলেদের হাতে কেউ নিজের মেয়েকে দিতে চায় না। বয়স তো হচ্ছে। দু’দিন পর সবাই কাকু ডাকতে শুরু করবে।’ এই একই কথা তাঁর ভাই, তুহিন তাকে প্রতিদিন সকাল-বিকাল নিয়ম করে বলে৷ বড় ভাইকে আবার সে কিছু বলতে পারে না। মানুষকে কষ্ট দিতে তাঁর রুচিতে বাধে। সে নিজেও একজন মানুষ। একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে কষ্ট দেওয়াটা তাঁর কাছে ঠিক বোধগম্য না। তাই যখন বুঝে, তাঁর কথাতে বা তাঁর কাজে কেউ মনে আঘাত পাচ্ছে, সে চুপ করে যায়।
তাহমিদ গ্লাস থেকে পানি ঢালল প্লেটে। প্লেটটাসহ হাতটা ধুঁয়ে ভাবীর দিকে প্লেট এগিয়ে দিলো। মুখে বলল,
– ভাবী, ভাইয়া না খেয়ে গেছে বলে কী তোমার খুব আফসোস হচ্ছে?

ফাতেমা অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলো,
– এখানে আফসোসের কী আছে শুনি? একটা মানুষ না খেয়ে চলে গেল; জরুরি কাজ শেষ করে আবার কখন খাওয়ার সুযোগ পাবে, তাঁর কী ঠিক আছে? শেষে না শরীর খারাপ হয়ে যায়। উনার জন্য তৃষ্ণাটাও খেতে পারল না। সে তো আবার বড় ভাইয়ের সাথে ইউনিভার্সিটিতে যায়। বড় ভাই যেহেতু আজ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছে, তাই তাকেও না খেয়ে বড় ভাইয়ের সাথে যেতে হয়েছে।

এ-কথা বলে প্লেটে ভাত দিতে লাগল ফাতেমা। তাহমিদ বলল,
– সাভার থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দূরত্ব মাত্র ১০ মিনিট। ভাইয়া অফিসে যায় ঢাকার পথে। অর্থাৎ তুলিকে ইউনিভার্সিটি গেইটে নামিয়ে দিয়ে তাকে আবার উল্টো দিকে ছুটতে হয়৷ এটা ঠিক না। তাছাড়া তুলি যথেষ্ট বড় হয়েছে। এই দশ মিনিটের পথ যদি ও একা যেতে না পারে, তাহলে তো সমস্যা।

– কী আর করার বলো; অভ্যাসটা তো তোমরাই তৈরি করেছ। ও একা একা কোথাও যেতে চায় না। তুমিও তো দেরি করে ঘুম থেকে উঠো। তাই বড় ভাইয়ের সাথেই যায়।

তাহমিদ খাওয়া শুরু করল। ফাতেমা তাকে তাগাদা দিয়ে বলল,
– তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো। কয়টা বাজে দেখেছে একবার? আজ এত দেরি করে উঠলে কেন?

– এর একটা বিশেষ কারণ আছে। রাতে অনেক দেরি হয়েছিল ঘুমাতে।

– শুধু তো আজ বা কাল না। তুমি প্রায়ই দেরি করে ঘুম থেকে উঠো। আমি নিশ্চিত, এইরকম ঘন ঘন করতে থাকলে তুমি শীঘ্রই চাকরিটা হারাবে। যদিও এতে আমরা খুশিই হবো। বাট ব্যক্তিগত ভাবে আমি চাই না তোমাকে কেউ বকাঝকা করে অফিস থেকে বের করে দিক। তুমি নিজে থেকে চাকরি ছেড়ে দিলে আমি বেশি খুশি হবো।

– আমি নিজে থেকে এই চাকরি ছাড়ব না ভাবী। আর আমার চাকরি নট করার মতো সাহস মহাকালের কারোর নেই। কারণ যে ওই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক, সে আমার খুব কাছের বান্ধবী। একসময় আমরা খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলাম। এখনো আছি। সুতরাং আমি জানি, আর যাই হোক আমার চাকরি চলে যাবে না।

ফাতেমা হেসে বলল,
– ওহ্ আচ্ছা। তা তোমার চারিদিকে এত এত মেয়ে কেন? তোমার জীবনের সাথে এত মেয়ে জড়িয়ে আছে কেন?

তাহমিদ স্বাভাবিক ভাবে বলল,
– ভাবী, মেয়েদের আমি নিজের জীবনে জড়াই না। কীভাবে যেন মেয়েরাই আমার জীবনে জড়িয়ে যায়। এই যেমন, অফিসের মেয়েটা; ওর সাথে কিন্তু আমি সেই কলেজে একসাথে পড়েছিলাম। এরপর ও অনার্স করার সিদ্ধান্ত নিলো। আমি বিএসসি করতে অন্য জায়গায় গেলাম। এরপর আর যোগাযোগ ছিল না। মহাকালে চাকরি করার সময় হঠাৎ মেয়েটা এসে হাজির হয়। পুরো ম্যানেজমেন্ট টিম ওদের নিজেদের লোক। মহাকাল তো প্রায় ওদেরই। এবার তুমিই বলো, এখানে আমার দোষ কোথায়? আমি মহাকালে আসার পর ও এসেছে। ও আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে। আমি তো নিজে থেকে জড়াইনি।

– আর ওই রাতের মেয়েটা। যে তোমার স্বপ্নে আসে। যদিও এখানে আমার একটা খটকা আছে শুরু থেকেই।

তাহমিদ খাওয়া বন্ধ করে তাকালো ফাতেমার দিকে। বলল,
– আহ্, ভাবী! ভুল বললে। ও আমার স্বপ্নে আসে না। আমি জেগে থাকাতেই ও ফোন করে।

‘০০৯’ যে কোনো ফোন নম্বর না, ফাতেমা তা ভালো করেই জানে। সে যেদিন প্রথম তাহমিদের মুখে শুনেছিল, গভীর রাতে একটা মেয়ে তাহমিদকে ফোন দেয়, নানান বিষয়ে আলোচনা করে, সেদিনই অবাক হয়েছিল ফাতেমা। সে নিজের ফোনে ডালায় করেছিল ০০৯ নম্বরটা। কোনো লাভ হয়নি। এইরকম কোনো নম্বর নেই। প্রথমে ভেবেছিল কেউ অফিসিয়াল নম্বর দিয়ে তাহমিদের সাথে মজা করছে। কিন্তু পরে যখন দেখেছে বিষয়টি দিনদিন সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে, তখন তাহমিদের ফোন থেকে সিম কোম্পানিতে ফোন দিয়েছিল সে। সেখান থেকে জেনেছে, ০০৯ সংখ্যার কোনো নম্বর থেকে তাহমিদের সিমে কখনোই কোনো ফোনকল আসেনি। বিষয়টি নিয়ে নিজের স্বামীর সাথেও আলোচনা করেছে ফাতেমা। তুহিম বলেছে, হয় তাহমিদ নিজেই মজা করছে। নাহয় ওর মধ্যে মানসিক কোনো সমস্যা তৈরি হয়েছে।
ফাতেমা বলল,
– তাহমিদ, তোমাকে কতবার না বলেছি রাতে মোবাইল বন্ধ করে ঘুমাবে। শোনো, কাল থেকে ঘুমানোর আগে মোবাইল আমার কাছে দিবে। তোমার তো এখন আর গালফ্রেন্ড নেই। বাড়িতে এসে সেভাবে কারোর সাথে ফোনে কথাও বলো না। সুতরাং রাতে ফোনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না আমার।

– আছে ভাবী; খুব প্রয়োজন আছে। তুমি জানো, ওই মেয়েটা আমাকে কত সাহায্য করেছে। আমি জীবনের সব জটিল সমস্যার সমাধান করে দেয় ওই মেয়েটা। শুধু তো আমার না, আমাকে দিয়ে ও অনেকেরই সাহায্য করায়।

ফাতেমা অনুনয়ের কণ্ঠে বলল,
– প্লিজ ভাই, চুপ করো। এগুলো তোমার ভুল ধারণা। আসলে তুমি একটা মেয়েকে ভালোবাসতে একসময়। একটু বেশিই ভালোবাসতে। ও যখন তোমাকে ছেড়ে চলে যায়, তখন থেকেই তুমি মানসিক ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হও। তুমি সবসময় চাইতে, একজন মেয়ে তোমার জীবনে আসুক। তোমার জীবনটা আলোকিত করে দিক। তোমার জীবনে যত সমস্যা আছে, তা সমাধান করে দিক। দিনরাত এইসব ভাবতে তুমি। মনে মনে কল্পনা করতে, একটা খুব সুন্দর মেয়ে তোমার জীবনে এসেছে। তোমাকে জীবনের জটিলতা দূর করছে। মানুষের কল্পনার সাথে তাঁর মস্তিষ্কের একটা কানেকশন আছে। তুমি যা ভাবো, তোমার মস্তিষ্ক তা তোমার চোখের সামনে দৃশ্যমান করে তুলে। সারাদিন তুমি নানান কাজে ব্যস্ত থাকো। তাই সেভাবে মগ্ন হয়ে সেই মেয়েকে নিয়ে ভাবতে পারো না। কিন্তু রাতে তো তুমি চার দেয়ালের আবদ্ধঘরে একা থাকো। তখন গভীর ভাবে কল্পনা করো, তোমার জীবনে একটা মেয়ে এসেছে। যে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, তোমাকে আনন্দ দিচ্ছে, তোমার জটিলতা দূর করছে। তোমার এই ভাবনাগুলোই তোমার মস্তিষ্ক দৃশ্যমান করছে। তুমি যখন গভীরভাবে কোনোকিছুতে মগ্ন হয়ে পড়ো, তখন তোমার মস্তিষ্কে অন্য দিকে সঞ্চালিত হতে শুরু করে। একদম বাস্তবের মতো কিছু ঘটনা তোমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তুমি নিজের মস্তিষ্ককেই তখন প্রশ্ন করো। আর তোমার মস্তিষ্ক অটোমেটিক উত্তর দিয়ে দেয়। একটা চরিত্র তোমার সামনে তুলে ধরে। যাতে তুমি উত্তরগুলো বিশ্বাস করো। এইরকমটা অনেকের সাথেই হয় ভাই। আমরা একে বলি, হ্যালুসিনেশন।

তাহমিদ এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ফাতেমার কথা শুনছিল। ফাতেমা থেমে যেতেই সে বলে উঠল,
– আর ওই নম্বরটা; ফোন নম্বর ‘009’!

– এটা কোনো ফোন নম্বর না ভাই। তুমি হয়তো এই তিনতে সংখ্যা কোথাও দেখেছ। বা এই সংখ্যা তিনতে নিয়ে কিছু ভেবেছ মনেমনে। তাই তোমার মস্তিষ্ক এই তিনতে সংখ্যাকে কাজে লাগিয়েছে।

তাহমিদ হাসল। রসিক সুরে বলল,
– ভাবী, আমি অতটাও বোকা নই, যে সবকিছু বিশ্বাস করব। অনেক মানুষই হ্যালুসিনেশনে ভুগে। এটা আমি জানি। বাট তুমি যেভাবে বলছ, এই মস্তিষ্ক জিনিসটা যেন আস্ত একটা ক্ষমতাবান লোক। সে নিজের ইচ্ছেমতো আমাকে যা-তা দেখিয়ে দিচ্ছে।

– মস্তিষ্ক তো তোমার মধ্যে আছে। তুমি যা ভাববে, মনে মনে যা কল্পনা করবে, ও তো সেগুলোই তোমাকে বারবার মনে করিয়ে দিবে। আমি বলি কী, তুমি কিছুদিন বিশ্রাম নাও। আমাদের সময় দাও। তৃষ্ণাকেও বলব, কিছুদিন ইউনিভার্সিটি না যেতে। প্রয়োজনে তোমার ভাইয়াকে বলব, কিছুদিনের জন্য অফিস ছুটি নিতে। ওই মেয়েটা চলে যাওয়ায় তুমি যে মানসিক আঘাত পেয়েছ, সেখান থেকে বের হতে আমরা তোমাকে সাহায্য করব। এইসময় তোমার পরিবার তোমাকে সাপোর্ট করবে।

তাহমিদ স্তব্ধ হয়ে গেল। কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– ভাবী, তোমরা কি ভাবছ আমি মানসিক ভাবে অসুস্থ? মানে, আমি।পাগল।

– ওমা ছি:! এ কেমন কথা। মানসিক চাপে থাকা আর মানসিক অসুস্থতা কী এক?

তাহমিদ কিছু বলল না। তাঁর ভীষণ রাগ হচ্ছে। শরীরটা হিড়হিড় করছে। মস্তিষ্ক মানুষকে ভাবায়, কিন্তু ওইরকম স্পষ্ট এবং বাস্তব ভাবে ফোনে যোগাযোগ করতে পারে না। সে ভাবল, ভাবী বোকা বোকা কথা বলছে। মস্তিষ্ক একটা ভ্রান্তিমাত্র। আর যে ফোনে কথা বলে, সে একজন মানুষ। এটা ঠিক, প্রথম ভালোবাসা থেকে প্রতারিত হয়ে আমি হতাশ হয়েছি। খুব কষ্টও পেয়েছি। কিন্তু পাগল কিংবা নির্বোধ হয়ে যাইনি।

আর এক লোকমা ভাতও মুখে দিলো না তাহমিদ। সে হাত ধুঁয়ে ফেলল। বাইরে যাওয়ার আগে বলল,
– তুলি আসলে বইলো, ওর প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়েছি।

– কোন প্রশ্নের উত্তর?

ফাতেমা জিজ্ঞেস করল। কিন্তু তাহমিদ কোনো উত্তর দিলো না। হঠাৎ করেই তাঁর মনটা খারাপ হয়ে গেল। দু’টো কারণে তাঁর মুখটা হঠাৎ মলিন হয়ে গেছে। প্রথম কারণ তাঁর ভাবী ভাবছে, সে মানসিক ভাবে অসুস্থ। ভাবী মুখে স্বীকার না করলেও সে বুঝতে পারছে, ভাবী এইরকম কিছুই ভাবছে। আর দ্বিতীয় কারণ, হঠাৎ করেই এমন একজনের প্রসঙ্গ টেনে আনা হলো, যে আস্ত একটা যন্ত্রণার পাহাড়। মুহূর্তের মধ্যেই বুকে যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। আল্লাহ সৃষ্টি করে মানুষ, আর মানুষ সৃষ্টি করে যন্ত্রণা। কী অদ্ভুত সবকিছু!

৫.
সজল গোলগোল চোখ করে দেখছে আসমাকে। শুকিয়ে যাওয়া খালের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দু’জনে। সজল এখন পর্যন্ত বারকয়েক আসমাকে বলেছে, আজ তোমাকে খুব সুন্দর দেখতে লাগছে। প্রতিবারই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলেছে আসমা। ছোটবেলা থেকে তাঁর ধারণা ছিল, গ্রামের মেয়েরা অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির হয়। সে এই মনোভাব নিজের মধ্যে বজায় রেখেছে সবসময়। আসমার লাজুকতা সজলের সবচেয়ে বেশি পছন্দের। স্কুল বেশ কিছুটা দূরে। ভ্যান বা রিকশা দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। কিন্তু তাঁরা দু’জন ভ্যান বা রিকশা দিয়ে স্কুলে যায় না। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে দু’জনে হেঁটে যায় দু’জনে।
টাকা-পয়সার দিক দিয়ে উচ্চ পরিবারের ছেলে সজল। ঢাকায় পড়াশোনা করলেও চাকরিবাকরি করে সেখানে স্থায়িত্ব হওয়ার কোনো ইচ্ছে তাঁর মধ্যে ছিল না। আসমা আর সে একই গ্রামের বাসিন্দা। ছোট থেকেই একে অপরকে দেখে বড় হয়েছে তাঁরা। যদিও সেভাবে কখনো কথা বলেনি আগে। হঠাৎ হঠাৎ কখনো মুখোমুখি হয়ে গেলে, সামান্য কুশল বিনিময় হতো দু’জনের মধ্যে। আসমা আগে সজলকে ভাই বলে ডাকলেও সজলের অনুরোধে এখন নাম ধরেই ডাকে। তবে আপনি বলে সম্মোধন করা থেকে সরে আসতে পারেনি। অনার্স শেষ করেই আসমা একটা স্কুলে চাকরি নেয়। সজলের মনে অনেক আগেই থেকেই আসমার প্রতি একটা অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করতো। তাই সে নিজেও আর ঢাকা না গিয়ে আসমার সাথে একই স্কুলে চাকরি নেয়। এরজন্য অবশ্য তাকে পারিবারিক বেশ কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মোটামুটি কিছুটা বাধা কাটিয়ে উঠতে পারলেও পুরোপুরি ভাবে সবাইকে মানিয়ে নিতে পারেনি। শিক্ষকতার চাকরি যে খারাপ, তা না। কিন্তু পরিবারের এমন কিছু মানুষ থাকে, যারা চায় তাঁদের সন্তান শহরে গিয়ে একটা বড় পোস্টের চাকরি করুক। ভালো বেতনের চাকরি করে উঁচু পর্যায়ে যাক। গ্রাম-গঞ্জে এইরকম স্বপ্ন দেখা বাবা-মা অসংখ্য আছেন। সজলের বাবা-মা ও চেয়েছিল, ছেলে শহরে গিয়ে একটা বড় চাকরি করুক। ঢাকার অত ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে এখন গ্রামে পড়ে থাকাটা তাঁদের কাছে ভালো লাগেনি। এছাড়াও আসমার সাথে মেলামেশার ব্যাপারটা তাঁর পরিবার সহ গ্রামের অনেকেরই জানা। এটা নিয়েও তাঁর বাবা-মায়ের সাথে, তাঁর মত-দ্বিমতের একটা ঝামেলা হয়েছে। সে বাড়িতে বলেছিল, আসমাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু বাড়ির কেউ রাজি হয়নি। গ্রামের প্রভাবশালী মানুষ তাঁরা। তাঁর দাদা আগে গ্রামের চেয়ারম্যান ছিল। এইরকম সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষের সাথে, আসমার পরিবারের মতো সাধারণ একটা পরিবারের সম্পর্ক হয় না। এটা খুবই বেমানান। তবে সজল হাল ছাড়েনি। আসমাকে সে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। তাঁর মাথায় দু’টো বিষয় সবসময় ঘুরপাক খায়; প্রথমত তাঁর প্রতি আসমার দৃঢ় বিশ্বাস। যা সে কোনোমূল্যেই হারাতে চায় না। দ্বিতীয়ত নিজের পরিবারের সম্মান। কেউ যাতে তাঁর পরিবারের দিকে আঙ্গুল না তুলে, সেদিকটাও ভাবে। দু’টো বিষয়ের পাড় দুই প্রান্তে। পরিস্থিতি এমন যে, একটাকে পুরোপুরি নিজের আয়ত্তে নিতে হলে অন্যটাকে হারাতে হবে। তবুও সে চেষ্টা করে যাচ্ছে, একসাথে দু’টোকে নিজের আয়ত্তে নিতে। দু’টোর সাথে তাঁর সম্পৃক্ততা এমন যে, একটা ছাড়া অন্যটা কল্পনা করতে পারে না।

সপ্তাহে তিনদিন আসমার টিউশনি থাকলেও সে বাড়িতে মা’কে বলেছে, তাঁর সপ্তাহে ৬দিনই টিউশনি আছে। মাঝে মাঝে এটাও বলে, শুক্রবারেও পড়াতে যেতে হয় তাকে। তিনদিন ব্যতীত অন্যান্য যে সময়টুকু তাঁর হাতে থাকে, সে প্রিয় মানুষটার সাথে সেই সময়টা কাঁটায়। কখনো পাশাপাশি হাঁটে। কখনো আবার একজায়গায় বসে খোশগল্প শুরু করে দেয়।
আসমার পরণে একটা সবুজ রঙের শাড়ি। সুতি কাপড়ের এই শাড়িটা তাঁর খুব পছন্দের। কিছুদিন আগে স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছিল সে। সজল মাস্টারও একই দিনে স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছিল। এরপর দু’জনে মিলে একসাথে শহরে গিয়েছিল। মাস্টার তাকে এই সবুজ পাতা রঙের শাড়িটা পছন্দ করে কিনে দিয়েছিল। সেদিন থেকেই তাঁর প্রিয় জিনিসের লিস্টে এটাও যোগ হয়ে গিয়েছিল। সজলের পরণে সাদা রঙের শার্ট আর কালো রঙের প্যান্ট। তাঁরা যে পথটা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তা বেশ সরু। দু’জনের মাঝে দূরত্ব স্বল্প। তবে দু’জনেই যথাসম্ভব চেষ্টা করছে, যাতে একে অপরের সাথে, শরীরের স্পর্শ না লাগে।
সজল অনেকক্ষণ চুপচাপ পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আসমাও নিজে থেকে কিছু বলেনি এতক্ষণ। নীরবতা ভেঙে সজল নিজেই এবার মুখ খুলে বলল,
– আসমা, তুমি যে সপ্তাহে তিনদিন বাড়িতে মিথ্যে বলে আমার সাথে দেখা করতে আসো, তোমার কী ভয় করে না? মানে গ্রামের লোকজন তো আমাদের একসাথে অনেকসময়ই দেখে। তাঁরা যদি তোমার বাড়িতে কিছু বলে দেয়?

আসমা মাথা তুলে বলল,
– বললে বলবে। আমরা তো খারাপ কিছু করছি না। তাছাড়া এখনো কী সেই যুগ আছে, যে একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেই বদনাম করতে শুরু করে দেবে লোকজন?

– না। আসলে অনেকেই তো আছেন, যারা এখনো এইসব দিকগুলোকে অন্য নজরে দেখে। তাছাড়া আমরা দু’জন একটা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা। তাঁরা হয়তো আমাদের অন্যভাবে দেখতে চাইবে।

– দেখুন, আমরা এমন কিছু করছি না, যা তাঁদের দেখা-চাওয়ার বাইরে। এমন কোনো নিয়ম নেই যে, একজন শিক্ষিকা বা একজন শিক্ষক, কাউকে পছন্দ করতে পারবে না। আপনি অযথাই এভাবে ভাবছেন। তাছাড়া লোকে কী বলল, বা ভাবল, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আপনি এবং আমি, আমরা দু’জনেই জানি, আমরা কেন এভাবে মিশছি। জানি না?

আসমার কণ্ঠে দৃঢ়তা প্রকাশ পেলো। সে সচরাচর সজলের সামনে এভাবে কথা বলে না। কিন্তু এখন যেহেতু প্রসঙ্গ এসেছে, তাই বলতে বাধ্য হচ্ছে। সজল বলল,
– হুম জানি তো। আমরা একে অপরকে পছন্দ করি। বিয়েও করব আমরা। তবুও ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছে আমার কাছে। আমাদের স্কুলের কেউ যদি এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করে, তাহলে বেশ বড়সড় একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতি তৈরি হবে।

– আপনি কী চাচ্ছেন আমি এভাবে আপনার সাথে আর কখনো দেখা করতে না আসি?

সজল চমকে ওঠে বলল,
– না না। এইসব কী বলছ আসমা?

আসমা করুণ কণ্ঠে বলল,
– ঠিক কথাই তো বলছি। আপনি লোকের ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছেন। পরিবারের ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছেন। অথচ যখন আমরা একে অপরকে ভিন্ন ভাবে বুঝতে শুরু করেছিলাম, তখন এই প্রসঙ্গগুলো হাজার মাইল দূরে ছিল। আমরা তো জানতাম, আমাদের সম্পর্কটা লোকজন কটূ নজরে দেখবে। কারণ আমাদের পরিবারের লেভেল খুব ভিন্ন। এছাড়াও আমরা দু’জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। এই শব্দদুটি খুবই সম্মানিত। কিন্তু কাউকে পছন্দ করা তো অপরাধের কিছু না। যে কেউ, যাকে ইচ্ছে পছন্দ করতে পারে। আমরা তো আর খারাপ কোনো সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছি না, যে মানুষ বদনাম দিবে। আমি এবং আপনি, আমরা কেউই চাই না আমাদের ভুল কোনো কর্মের ফল আমাদের পরিবার ভোগ করুক। আমার কাছে আমার পরিবার যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ আপনি এবং আপনার পরিবার। যদি কখনো আমাদের বিয়ে হয়, তাহলে আমাকে ওই পরিবারে যেতে হবে। আর আমি চাই না, আমার জন্য ওই পরিবারের কোনো বদনাম হোক।

সজল তীক্ষ্ণ চোখে দেখল আসমাকে। আসমা এইরকম কথা নিয়মিত না বললেও তাঁর সব কথা শুনেই চমকে ওঠে সজল। তাঁর কাছে আসমা মেয়েটা খুব বিচক্ষণ একজন। সে আসমাকে সম্মান করে। সাধারণ দু’জন ছেলে-মেয়েদের ভালোবাসার সম্পর্ক এই হাফ-আধুনিক জগত মেনে নিলেও একজন শিক্ষক এবং একজন শিক্ষিকার প্রেমের ব্যাপারটা কেউই সহজভাবে নিবে না। অনেকেই টিটকারি মারবে। কটূ কথা বলবে। তবুও তাঁরা এখন পর্যন্ত একে অপরের পাশে আছে।
আসমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলতে লাগল,
– আপনাকে আমি আগেও বলেছি, আজ আবারও বলছি, আপনি প্লিজ নিজের বাবা-মায়ের ইচ্ছেটাকে গুরুত্ব দিন এখন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। যতদিন সম্ভব হবে, ততদিন আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। আপনি বাবা-মায়ের কথা শুনে ঢাকা যান। ভালো একটা চাকরি নিন। এরপর নিজের বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলবেন আমার কথা।

সজল অসহায় কণ্ঠে বলল,
– আমি তাঁদের বুঝিয়েছি। এটাও বলেছি, তোমার সাথে বিয়ের পর আমি ঢাকায় যাবো। কিন্তু তাঁরা বলেছেন, আমি বিয়ে করতে চাইলে বিয়ে করতে পারি। তবে এমন একটা পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে, যে তাঁদের পছন্দ। অর্থাৎ তাঁদের পছন্দ করা কোনো ধনী পরিবারের মেয়ে।

কথাটা বলে সজল নিজেও যেন শূন্যতা অনুভব করল বুকের ভিতরে। একটা হাহাকার বুকে যন্ত্রণা দিতে লাগল। শুরুর আগে জীবন যতটা সহজ মনে হয়েছিল, আদৌতেও ততটা সহজ না। এই মাঝপথে এসে মনে হচ্ছে, জীবনের থেকে কঠিন কিছু এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। সম্পর্ক গড়া যতটা সহজ হয়েছিল, সেই সম্পর্ক রক্ষা করা তাঁর থেকে হাজারগুন কঠিন মনে হচ্ছে।

আসমা আর কোনো কথা বলল না। দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে মলিন মুখে হাঁটতে লাগল। যেখানেসেখানে কাঁদতে নেই; এই ভেবে সে চোখের জল কোনোরকমে আটকে রেখেছে। অথচ সেই কখন তাঁর মন কেঁদে চলেছে; নিঃশব্দে, নির্বিকারে! মনের কান্না তো আর সজল দেখতে পাচ্ছে না। তাই সে নিশ্চিন্ত।

৬.
সন্ধ্যার পর তাহমিদ বাড়িতে ফিরল। দরজা খুলে দিলো তৃষ্ণা। তৃষ্ণা দরজা খুলে ভাইকে দেখেই আনন্দে আত্মাহারা হয়ে উঠল। উল্লাসে ভাইয়ের হাত ধরে টেনে ভিতরে নিয়ে এলো। তাহমিদ ক্লান্ত খুব। এ সময় টানাটানি তাঁর সহ্য হলো না। এদিকে বোনের উজ্জ্বল মুখটা দেখে আর রাগটাও প্রকাশ করতে পারল না। শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো,
– আস্তে তুলি; এইরকম করছিস কেন?

তৃষ্ণা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
– কেন করছি বুঝতে পারছ না। কাল যে তোমায় একটা প্রশ্ন করেছিলাম, তাঁর উত্তর কই?

– উত্তর আছে। মনের ভিতর যত্ন করে নোট করে রেখেছি। ঘরে চল।

– ওকে।

ঘরে এসে গতদিনের মতো দু’জন বসল। তৃষ্ণা আগ্রহী চোখে তাকিয়ে রইল তাহমিদের মুখের দিকে। তাহমিদ কেঁশে নিলো কিছুক্ষণ। এরপর বলল,
– তাঁর আগে বল, হঠাৎ তোর মনে এইরকম একটা প্রশ্ন কেন এলো?

তৃষ্ণা থতমত খেয়ে গেল। তাঁর ভাই যে এইরকম একটা প্রশ্ন করতে পারে, তা ভেবে দেখেনি আগে। এই প্রশ্নের উত্তরটা চট করে দেওয়া যাবে না। উল্টো পাল্টা বলে ফেললেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই সে অতি সাবধানে প্রশ্নটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বলল,
– ভাইয়া, আমাকে পড়তে বসতে হবে। তুমি চটপট আমাকে উত্তরটা বলো।

তাহমিদ হেসে বলল,
– আমি জানতাম আমার প্রশ্নটা তুই এড়িয়ে যাবি?

তৃষ্ণা অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– কীকরে জানতে?

– একজন বলেছে আমায়। তোকে বলেছিলাম না, রোজ রাতে একটা মেয়ে আমাকে ফোন দেয়।

তৃষ্ণা মাথা চুলকিয়ে কী যেন মনে করার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ পর ব্যর্থ হয়ে বলল,
– কই, এইরকম কিছু তো আমায় আগে কখনো বলোনি।

তাহমিদের মনে পড়ল; সেই 009 সংখ্যার নম্বর এবং মেয়েটার ব্যাপারে সে শুধুমাত্র ভাবীর সাথে আলোচনা করেছিল। তাঁর ভাবী, তাঁর ভাইকে হয়তো বলেছে। তবে বোন কিছু জানে না।
তাহমিদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
– আচ্ছা বাদ দে। উত্তরটা তাহলে শোন।

– বলো।

তৃষ্ণা নড়েচড়ে বসল। তাহমিদ-ও নড়েচড়ে বসল। এরপর বলতে শুরু করল,
– তুই দু’টো অপশন দিয়েছিলি। তাঁর মধ্যে একটাও পুরোপুরি ভাবে জড়িত না; একটা মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়ার পিছনে। বাট পরিবার এর সাথে সরাসরি জড়িয়ে আছে। ছোট থেকে যখন একটা মানুষ বেড়ে ওঠে, তখন সে পরিবারের ছায়ার মধ্যে থেকেই বেড়ে ওঠে। সমাজ কিংবা তাঁর নিজস্বতা, জীবনে সেসময় প্রভাব ফেলে না। মুসলিম সন্তান হলে পরিবারের ক্ষেত্রে আরও সুবিধা হয়৷ পরিবারের লোকজন যদি চায়, তাহলে নিজেদের সন্তানকে শুরু থেকেই একটা সঠিক পথ ধরিয়ে দিতে পারে। বাট অনেক বাবা-মা সেটা করে না। সেজন্য একটা সন্তান যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখন তাঁর মধ্যে একটা অন্যরকম অস্তিত্ব চলে আসে। সে নিজেকে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করে। এর মধ্যে আবার সমাজের খারাপ কিছু মানুষ এসে যায় তাঁর জীবনে। তখন ছেলেটা চাইলেও এইসব থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে না। কারণ সে খারাপ কিছুর মধ্যেই নিজের ভালোটা দেখতে পাচ্ছে। ছোট থেকে যদি পরিবারের লোকজন তাকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে, একটা সুন্দর পথে চলার অনুশীলনের ব্যবস্থা করে দিতো, তাহলে বড় হয়েও সে নিজেকে সেই পথেই রাখতো। সুতরাং এখান থেকে স্পষ্ট, একজন মানুষের মন বিকৃত হয় পরিবারের কারণে।

এইটুকু বলে তাহমিদ থামলো। তৃষ্ণা বলল,
– কিন্তু ভাইয়া; অনেক বাবা-মা আছেন, যারা সবসময় মনেপ্রাণে সন্তানের একটা সুন্দর জীবন চেয়ে এসেছে। কিন্তু একটা সময় দেখে, তাঁরা যা চাচ্ছে, তাঁর ঠিক উল্টোটা হচ্ছে। ফলে তাঁরা হতাশ হয়, অসহায় হয়ে পড়ে। সারাদিন চেষ্টা করেও সন্তানকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে না।

তাহমিদ হাসল। হেসে বলল,
– সেই চেষ্টাটা সঠিক সময় করলে সন্তানের জীবন দেখে আর তাঁদের হতাশ হতে হতো না৷ অসহায় হতো না। কিছু বাবা-মা আছে, যারা সারাজীবন শুধু চেয়েই এসেছে, তাঁর সন্তান যেন একজন ভালো মানুষ হয়। কিন্তু নিজেরা আসলে সন্তানকে সেই পথ তৈরি করে দেয়নি। একটা সময় অসহায় তাঁরাই হয়। একটা ছোট বাচ্চার ব্রেইন খুব মসৃণ হয়। মসৃণ বলতে খুব পরিষ্কার বুঝাচ্ছি। খেয়াল করে দেখবি ছোট বাচ্চারা যা দেখে, তা খুব সহজেই নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নিতে পারে। আগেই বলেছি, মুসলিম হলে এই কাজটা আরও সহজ হয়। অন্য কোনো ধর্মের ব্যাপারে আমি জানি না। বাট আমি নিজের ধর্ম থেকে যেটুকু জেনেছি, তাতে স্পষ্ট যে, আমাদের ধর্মে সকল খারাপ কাজে নিষেধাজ্ঞা আছে। সব খারাপ কাজ আল্লাহ নিজে হারাম করে দিয়েছে। ধর, তোর একটা সন্তান হলো। তুই নিজে একজন খুব ধার্মিক মানুষ। তুই নিশ্চয়ই চাইবি সন্তানকেও তোর মতো বা তোর থেকেও ধার্মিক একজন মানুষ হিসেবে তৈরি করতে। এরজন্য তোকে প্রথমে কী করতে হবে?

তৃষ্ণা অবাক চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
– অবশ্যই তাকে প্রথমে ইসলাম এবং ধর্ম কী, তা বুঝাতে হবে।

তাহমিদ মাথা নেড়ে বলল,
– একদম ঠিক। ইসলাম সম্পর্কে তাকে জানাতে হলে, তোকে অবশ্যই কুরআন-হাদিস এর সাহায্য নিতে হবে। আর কুরআনে, হাদিসে এমন কিছু আছে, যা জানতে পারলে একজন মানুষ খুব সহজেই ঠিক-ভুলের পার্থক্য বুঝতে পারবে। তুই যদি ছোট থেকেই নিজের সন্তানকে এই শিক্ষাগুলো দিতে পারিস, তাহলে সে এগুলো সহজেই নিজের আয়ত্তে নিতে পারবে। আমার বিশ্বাস, এগুলোর মধ্যে দিয়ে যে মানুষ বেড়ে ওঠে, সে সারাজীবন নিজের ভালোমন্দ, নিজে বুঝতে পারে। সমাজের খারাপ মানুষ কিংবা তাঁর নিজস্ব খারাপ সত্তা তাকে কাবু করতে পারবে না। কারণ যে খুব ভালো ভাবেই জানে, তাঁর ধর্মে কোনটাকে ঠিক বলা হয়েছে, আর কোনটাকে ভুল বলা হয়েছে। এবার বল, তোর কী মনে হয় না, একটা মানুষের ভালো-খারাপ হওয়ার পিছনে তাঁর পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি? বাবা-মা অসহায় হয় তখনই, যখন সন্তান তাঁর অবাধ্যতা করে। কোনো মানুষই ছোট বয়সে বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে খারাপ পথে যায় না। কারণ সেই ছোট বয়সে ভালো এবং খারাপ, দুই পথটাই তাঁর অজানা থাকে। বাবা-মা যদি নিজ দায়িত্বে তাঁর সন্তানকে একটা সুস্থ এবং সুন্দর পথ দেখিয়ে দিতো, তাহলে প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়ার কোনো সম্ভবনাই ছিল না।

তৃষ্ণা মুগ্ধ হয়ে তাহমিদের কথাগুলো শুনছে। কথাগুলো তাঁর বেশ ভালো লাগছে। আফসোসও হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আগে কেন এভাবে ভাবলাম না? তাঁর মনে আরও একটা খটকা আছে। সে আমতাআমতা করে বলল,
– যাদের বাবা-মা তথা পরিবার নেই, তাঁদের কী হবে? পথশিশুদের কথা বলছি আরকি।

– তাঁদের জন্য আল্লাহ এমন একটা বিবেক দিয়েছেন, যার সাহায্যে সে নিজেই নিজের পথ বেছে নিতে পারবে। কোনো পথশিশু যখন বড় হয়ে একটা মাস্তান তৈরি হয়। তখন সে মাঝে মাঝে আল্লাহকে দোষারোপ করতে শুরু করে। যে কেন তাকে পরিবার দেওয়া হলো না? একটা পরিবার পেলে সে অবশ্যই একটা সুস্থ জীবন পেতো। ভালো মানুষ হতো। অথচ সে এটা ভাবে না, এই যে সে ভালো হওয়ার কথা বলছে, এটা নিজের বিবেক থেকেই। অর্থাৎ, সে যদি চায় ভালো হতে, তাহলে নিজের বিবেকের সাহায্যে ভালো হতে পারবে। পরিবার নেই বলে আফসোস করে সারাজীবন কাঁদলেও লাভ হবে না।

তৃষ্ণা পরম তৃপ্তিতে দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ল। তাঁর মনের সব খটকা দূর হয়ে গেছে। প্রশ্নের উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট সে। তবে একটা বিভ্রান্তিতে আছে এখনো। কেঁশে আবার বলল,
– ভাইয়া আরও একটা প্রশ্ন আছে আমার।

তাহমিদের মুখটা মলিন হয়ে গেল। এ প্রসঙ্গে অনেক তথ্য সে গতকাল রাতেই পেয়েছিল। তাই উত্তর দিতে পেরেছে। এখন যদি আবার তৃষ্ণা তাকে ভিন্ন কোনো প্রশ্ন করে, তাহলে তাঁর পক্ষে তৃষ্ণাকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হবে না। তাই আপাতত নিশ্চুপ থাকল।
তৃষ্ণা আবার বলল,
– কী হলো ভাইয়া? প্রশ্নটা কী করব?

তাহমিদ ভীত কণ্ঠে বলল,
– কী প্রশ্ন? আমার কিন্তু ক্ষিধে পেয়েছে।

– ছোট্ট একটা প্রশ্ন। মানে তোমার মতো একটা অদ্ভুত প্রাণী এতসব জানলো কীভাবে? মানে, কালকে তোমাকে প্রশ্ন করার পর তোমার যে অবস্থা হয়েছিল, তাতে মনে হয়েছে ওইরকম ফাঁদে তুমি খুব কমই পড়েছ। অথচ এক রাতের মধ্যে এতসব জেনে গেছ তুমি। কীভাবে সম্ভব?

তাহমিদ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকালো তৃষ্ণার দিকে। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে, জোরে তৃষ্ণার গাল টেনে দিলো। তৃষ্ণা ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল। বাইরে থেকে ফাতেমা এসে আতঙ্কিত গলায় তাহমিদকে বলল,
– ওমা, বাচ্চা মেয়েটাকে মারছ কেন? তোমায় ভূতে ধরেছে নাকি?

তাহমিদ রাগী রাগী ভাব করে একবার তৃষ্ণার দিকে, আরেকবার ফাতেমার দিকে তাকালো। এরপর তৃষ্ণার গাল ছেড়ে দিয়ে তোয়ালে হাতে চলে গেল ওয়াশরুমে। তৃষ্ণা দাঁড়িয়ে গেল। গালে হাত বুলিয়ে দরজার দিকে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে ফাতেমাকে বলল,
– বড় ভাইয়া কী এসছে ভাবী?

– হ্যাঁ। এসেছে তো।

তৃষ্ণা কপট রাগী মুখ করে নিজের মনে বলল,
– দাঁড়াও, এর শোধ আমি নিচ্ছি।

ফাতেমা কিছু বুঝল না। সে আর প্রশ্নও করল না। তৃষ্ণার হাত ধরে বলল,
– এসো আমার সাথে।

তৃষ্ণা গালে হাত বুলাতে বুলাতে চলে গেল ফাতেমার সাথে।

Protected: আত্নহত্যার আত্নকাহিনী!

0

This content is password protected. To view it please enter your password below:

সম্পৃক্ততা পর্ব ১

0

১.
– আচ্ছা ভাইয়া, মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হয় তাঁর নিজের জন্য, নাকি সমাজের জন্য?

ছোট বোন হঠাৎ প্রশ্নটা করে বসল। তাহমিদ আড়চোখে একবার তাকালো ওর দিকে। প্রশ্নটা সহজ হলেও উত্তরটা সহজ হবে না বোধহয়। বিশেষ করে তাহমিদের ক্ষেত্রে! বিশেষত্ব তাঁর ক্ষেত্রে কারণ; সে মানুষটা খুব সহজ-সরল প্রকৃতির। সহজ-সরল মানুষ আবার চট করে কোনো কঠিন উত্তর দিতে পারে না৷ এটা একান্তই তাঁর মত। সে ব্যতীত, অন্য সবাই এর ভিন্নমত। কিন্তু লোকের ভিন্নমত দেখে তো আর সে নিজেকে ভিন্নভাবে ভাবতে পারে না; তাই সে সবসময় নিজের মতকে গুরুত্ব দিয়ে, নিজেকে সহজ-সরল দাবী করে।

– ভাইয়া, চুপ করে আছো কেন?

ছোট বোনের কথা শুনে তাহমিদ এবার নড়েচড়ে বসল একটু। সামনে থাকা কাঁচের গ্লাসে কিছুটা পানি আছে। গ্লাস হাতে তুলে ঢকঢক করে গিলে ফেলল সেটুকু। তাঁর অভিজ্ঞতা বলে, পানি নষ্ট করা যাবে না। এই অভিজ্ঞতা সে নিজে অর্জন করেছে; বই থেকে। কোনো এক বইয়ে পড়েছিল, ‘অপচয় করা ঠিক না’। এরপর থেকে সে অপচয় করে না। পুরোপুরি ভাবে বিসর্জন দিয়েছে অপচয়ের মতো বাজে একটা অভ্যাসকে। গ্লাসটা আবার আগের জায়গায় রেখে তাহমিদ বোনের দিকে তাকাল। ওর নাম তুলি। এটা ওর আসল নাম নয়। ওর আসল নাম তৃষ্ণা। তাহমিদের বাবা সেসময় সরকারি স্কুলের বাংলা শিক্ষক ছিলেন। ‘বাংলার মাস্টার’ নামে তাঁর বেশ খ্যাতি ছিল গ্রামে। তিনি গ্রাম থেকে ট্রান্সফার হয়ে ঢাকার একটা স্কুলে চাকরি করতেন। ঠিক সেসময় তাহমিদ এর মায়ের কোল আলো করে একটা ফুটফুটে বাচ্চার আগমন হলো। বাবা ছুটি নিয়ে গ্রামে গেলেন। মেয়েকে দেখেই ঝলমলে চোখ করে বললেন,
– আহ্! আমার সোনামণি কী সুন্দর দেখতে হয়েছে! এই ফুটফুটে মুখটা দেখলে যে কারোরই মন জুড়িয়ে যাবে। মনের সব তৃষ্ণা মিটে যাবে।

সেদিনই তাহমিদের বাবা নিজে সবাইকে আদেশ করলেন, ফুটফুটে মেয়েটাকে তৃষ্ণা বলে ডাকতে হবে। সেদিনের সেই ছোট্ট ফুটফুটে তৃষ্ণা আজ বড় হয়ে গেছে। ইন্টার পেরিয়ে অনার্স পড়ছে এখন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী সে। তৃষ্ণা নামে একটু ঝামেলা আছে। এই নাম উচ্চারণ করতে তাহমিদের কেমন যেন লাগে। তাই সে বাবার অবাধ্যতা করে, ওকে তৃষ্ণা থেকে তুলি বানিয়ে দিয়েছিল। বাবা রাগ করেছিলেন। তবে কিছু বলেননি। তিনি ট্রান্সফার হয়ে গ্রাম থেকে ঢাকা যেতে পারবেন; আর মেয়ের তৃষ্ণা নামটাকে তুলি নামে ট্রান্সফার করতে পারবে না, এ হয় নাকি! তাহমিদের বাবা-মা অনেক বছর আগেই মারা গেছে। তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর। বাবা মারা যাওয়ার পরপরই সে শহরে এসেছে। তাঁর বড় ভাই বিয়ে করে, স্ত্রীকে নিয়ে শহরে থাকতো আগে থেকেই। সে ভাইয়ের এখানে চলে এলো। মা মারা যাওয়ার পর ছোট বোনও ঢাকায় চলে এসেছে। এখন সাভারের একটা ফ্লাটে ভাড়া থাকে। ‘মহাকাল’ পত্রিকার রিপোর্টার তাহমিদ। একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের পত্রিকায় চাকরি করাটা বাড়ি অন্য সদস্যদের কাছে বোধগম্য না হলেও সে নিজে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করছে। ওখানে চাকরি করার পিছনে একটা রহস্য আছে। রহস্যটা এখন পর্যন্ত পরিবারের সব সদস্যদের কাছে গোপনীয়। বড় ভাই মাঝে মাঝে রাগারাগি করলেও সে খুব একটা পাত্তা দেয় না। মনেমনে বলে, বাবা নেই, সুযোগ পেয়ে বড় ভাই তো খিটমিট করবেই; করুক না, আমার কী!

তাহমিদ দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার পর সরাসরি তাকালো তুলির দিকে। তুলির চোখে বিন্দুমাত্র বিরক্তির ছাপ নেই। এই বয়সী মেয়েরা খুব কৌতূহলপ্রবন হয়। এই সহজ প্রশ্নের কঠিন উত্তর জানার জন্য ওর মনে যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে, তা সাংঘাতিক। ইচ্ছে করেই প্রশ্নের উত্তর দিতে দেরি করছে তাহমিদ। এইরকম একটা প্রশ্নের উত্তর তাঁর জানা নেই। উল্টো পাল্টা বলে তুলিকে অন্তত দমিয়ে দেওয়া যাবে না। বাড়িতে মেধাবী লোকজন থাকলে এই এক ঝামেলা। তুলি নিশ্চয়ই ভাবছে, ভাইয়া উত্তরটা সুন্দর করে সাজিয়ে নিচ্ছে। যাতে সহজ করে ওকে বলতে পারে। সেজন্যই ও উৎসুক জতনার মতো ফ্যালফ্যাল চোখ করে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে। কিন্তু তাহমিদ জানে, সে কেন চুপ করে আছে।
তাহমিদ অনেকক্ষণ চুপচাপ আকাশকুসুম ভাবলেও আর সাতপাঁচ না ভেবে গৌরবের গলায় বলল,
– এটা তো সহজ প্রশ্ন। প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হয় তাঁর নিজের জন্য। কথায় আছে না, নিজে ঠিক থাকলে দুনিয়া ঠিক।

তাহমিদের উত্তরে সন্তুষ্ট হলো না তুলি। তা ওর অসন্তুষ্ট মুখখানা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তাহমিদ চিন্তায় পড়ে গেল এবার। না জানি আবার কোন প্রশ্ন করে বসে!
তুলি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আবার বলল,
– কিন্তু ভাইয়া, মানুষ তো অন্যের কারণেও খারাপ হয়ে যায়। ব্যাপারটা এইরকম যে, অনেকগুলো অসুস্থ
প্রাণীর মাঝে একটা ভালো প্রাণী এলে, তা বেশিদিন ভালো থাকে না।

– হুম, তাও ঠিক।

মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ করে তাহমিদ গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলল। মিনিট দুয়েক চুপ থেকে আবার বলল,
– তাহলে নিশ্চিত, একজন মানুষ খারাপ হয় সমাজের জন্য। কারণ অসুস্থ সমাজে বসবাস করে একজন সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যায়। এর বাস্তব প্রমাণ আমাদের এলাকাতেই আছে। ওই যে ‘ছোট ভাই’ নামে পরিচিত যে ছেলেটা আছে না, ও তো আগে খুব ভালো ছিল। মেধাবী ছিল। প্রথম প্রথম আমাকে দেখলে সালাম দিয়ে কুশলাদি করতো। এরপর এলাকার বখাটে ‘বড় ভাই’ নামে পরিচিত ছেলেটা সহ ওর দলবলের সাথে মিশে, খারাপ হয়ে গেছে। এখন আমাকে দেখলে বাঁকা চোখে তাকায়। আগে নাম ছিল শিহাব। এখন ‘বড় ভাইয়ের’ ঘনিষ্ঠতা পেয়ে হয়ে গেছে ‘ছোট ভাই’।

এতেও সন্তুষ্ট হলো না তুলি। আগের মনোভাব বজায় রেখে বলল,
– কিন্তু ভাইয়া, অনেকেই আছে, যারা সুস্থ প্রাণীদের সাথে বসবাস করলেও নিজে সুস্থ হয় না, বা হতে চায় না। বরঞ্চ আশেপাশের মানুষজন, অর্থাৎ সমাজের অন্যান্য মানুষদের খারাপ পথে নিয়ে যায়। নানান ধরনের লোভ-লালসা দেখিয়ে ভালো ছেলেদের মন বিষিয়ে দেয়। ওদের মস্তিষ্ক বিকৃত করে দেয়। সুতরাং একজন মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়ার পিছনে শুধুমাত্র সমাজের দোষ কিংবা ব্যক্তির নিজের দোষ নেই। তৃতীয় কারোর হাত আছে।

তুলির চোখ-মুখে বিশাল চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তাহমিদ ফট করে বলে উঠল,
– নিশ্চয়ই এইসব আল্লাহর কারসাজি। তিনি উপর থেকে এইসব করছেন।

তাহমিদের কথা শুনে রেগে গেল তুলি। কিছুটা ধমকে সুরে বলল,
– আরে ধুর! মনে করো, আল্লাহ একটা স্থানে কিছু ভুট্টা ছিটিয়ে দিলেন। ভূট্টাগুলোর মধ্যে কিছু ভালো আছে, এবং কিছু খারাপ আছে। এবার সেখানে কিছু কবুতর ছেড়ে দিলেন। এবার কোন কবুতর ভালো ভুট্টা খাবে, আর কোন কবুতর খারাপ ভুট্টা খাবে, সেটা কবুতরের ব্যপার। এরজন্য আল্লাহকে দোষারোপ করলে তো চলবে না, তাই না? আবার দেখা গেল, অনেকগুলো কবুতর যেখানে জড়ো হয়ে খাবার খাচ্ছে, একটা কবুতরও তীব্র আকাঙ্ক্ষার তাড়নায় পড়ে ওই অনেকগুলো কবুতরের সাথে যোগ দিচ্ছে৷ একটা কবুতর হলো একজন মানুষ, আর অনেকগুলো কবুতর হলো সমাজ। সুতরাং একজন মানুষের মন বিকৃত হয় আড়ালের কারোর ভুল গুটি চালার কারণে।

তাহমিদ আগেই বুঝেছিল, প্রশ্নটা সহজ হলেও উত্তরে ঝামেলা আছে। তাঁর প্রচণ্ড রাগ হলো। আজব মেয়ে! অপশন দিলো দু’টো ; অথচ বলছে আসল অপরাধী এরা না, তৃতীয় কেউ। তাহমিদ বলল,
– তৃতীয় অপশনটা বললেই হতো। আমি দু’টো অপশন পেয়েছি, তাঁর মধ্যে দু’টোরই কিছুটা প্রভাব আছে। তৃতীয় কোনো অপশন থাকলে বল।

তুলি তাড়াহুড়ো কণ্ঠে বলল,
– আপাতত আর নেই। তুমি সঠিক উত্তর দিতে পারবে কি-না বলো।

– এইরকম ঝামেলাময় উত্তর আমি দিতে পারব না এখন। কাল সকালে দিলো। এখন যা।

তুলি মুখ বাঁকা করে ভাইকে টিপ্পনী কেটে বলল,
– তুমি তো ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্টুডেন্ট ছিলে। শুনেছি, ইঞ্জিনিয়ারদের সবরকম দক্ষতা থাকে। অথচ তুমি এই সাধারণ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে না। আরে বাবা, সবকিছু কী আর অপশনের উপর নির্ভর করে? ধরো আমি কোনো অপশনই দিলাম না। তাহলেও এই প্রশ্নের উত্তর তোমার জানা উচিত। কারণ তুমি একজন ইঞ্জিনিয়ার। একাধারে সবকিছু জানা বাধ্যতামূলক তোমার জন্য।

এ-কথা বলে তুলি হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তাহমিদকে আর কিছু বলার সুযোগও দিলো না। ব্যাপারটা তাহমিদের খুব গায়ে লাগল। তুলি শুধু তাকে নয়, গোটা একটা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো ভূতের বাক্সকে অপমান করলো।

তুলি বেরিয়ে যাওয়ার পর তাহমিদ দরজাটা খপ করে আটকে দিল। জানালা আগে থেকে লাগানো ছিল। এখন বাজে রাত ৯টা। ডিনার শেষ হয়েছে আরও ঘন্টাখানিক আগে। ডিনারের পর যখন তাহমিদ ঘরে এসেছিল, তখনই তুলি হাজির হয়েছিল। এখন চলে গেছে। একটু শান্তি অনুভব করছে তাহমিদ। তাকে আবার একটা কাজ বসতে হবে। মনের কিছু খটকা দূর করতে হবে। তাছাড়াও তুলির প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে। এরজন্য একটা নারী চাই। সব সমস্যার সমাধান পুরুষ দিতে পারে না। পুরুষদের জীবনে এমন কিছু সমস্যা থাকে, যার সমাধান নারী ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না; পারলেও তা একজন পুরুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। তাহমিদের সমস্যার সমাধান করার জন্য একজন নারী আছে। গভীর রাতে সেই নারীর উপস্থিতি ঘটে। উপস্থিতি ঘটে বলতে, সরাসরি রাতবিরেত ঘরে চলে আসে না; সে তাহমিদকে ফোন দেয় তিন সংখ্যার এক অদ্ভুত নম্বর থেকে! সংখ্যাটা হলো, ‘009’। এই নম্বর থেকে শুধুমাত্র রাতেই ফোন আসে। তাও আবার বিশেষ মুহূর্তে; যখন গভীর রাতে তাহমিদ একা জেগে থাকে। সকালে আর নম্বরটা ফোনে থাকে না। প্রথমবার তাহমিদ ডালায় করে ফোন দিতে গিয়েছিল। কিন্তু রাতের সেই নারীর অসাধারণ কণ্ঠের জায়গায় একটা কর্কশ কণ্ঠের মহিলা বলে, নম্বরটা ঠিক নয়। অর্থাৎ ঝামেলা আছে। সে আবার ঝামেলা পছন্দ করে না। সেজন্য সেই একবারের পর আর কখনো এই নম্বরে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করেনি।

২.
সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল তাহমিদের। সিনেমাতে দেখেছে, স্বামী ঘুম থেকে উঠছে না দেখে বউ ডাকাডাকি করছে। একটু পর চিল্লাচিল্লি। তবুও যখন স্বামীর কোনো পাত্তা পাওয়া যায় না, তখন জানালা খুলে দেয়। স্বামীর মুখে এসে পড়ে সূর্যের একফালি রোদ। ঘুমের ১৩টা বেজে যায় তাঁর। চোখ ডলতে ডলতে শোয়া থেকে ওঠে বসে। সামনে তাকিয়ে দেখে, বউ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে। কখনো আবার চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে দেখে। শ্যাম্পু করা চুল থেকে অসাধারণ একটা ঘ্রাণ আসে৷ সূর্যের আলো কিছুটা বউয়ের মুখেও এসে পড়ে। তাঁর ফরসা টসটসে গাল দু’টো আলোকসজ্জিত হয়ে কেমন চকচক করতে থাকে। কী অপরূপা মায়াবী দেখায় তাকে! মুড ভালো থাকলে স্বামী বিছানা থেকে নেমে বউকে কাছে টেনে নেয়। এরপর রোমান্স করে কিছুক্ষণ। আর মুড খারাপ থাকলে হয় উল্টোটা। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বউকে ঝাড়ি দেয়। এরপর তাঁর হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে।
তাহমিদের ক্ষেত্রে অবশ্য এইরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ সে এখনো পিউর সিঙ্গেল। গালফ্রেন্ড ছিল একসময়; এখন নেই। সে এখনো বিয়েসাদী করেনি। হাত দু’টো ছাড়া শরীরে অন্য সব অঙ্গ তাঁর খাটি। কয়েকবার শুধু গালফ্রেন্ড এর হাত ধরেছিল। তাঁর দুই হাত সে নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনেকটা সময় মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। এতে অবশ্য তাহমিদের চোখে কিছুটা ভেজাল ঢুকেছে। তাই চোখ দু’টোও পুরোপুরি খাটি নয়। আরও একটা ঘটনা ঘটিয়েছিল তাহমিদ। একবার সে আর তাঁর গালফ্রেন্ড, বাসের পাশাপাশি সিটে বসেছিল। তখন সন্ধ্যা। মেয়েটা অনেকটা ক্লান্ত ছিল বলে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বাসে কিছুটা আলো থাকলেও সেভাবে কেউ তাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিল না। প্রায় সবাই নিজেদের সিটে বসেছিল। বাসে থাকা লাল-নীল রঙের লাইটের আলোয় পাশের জনকে দেখছিল সে। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের যেমন আকর্ষণ থাকে, তেমন পাশের জনের কমলার মতো ঠোঁট দু’টোর প্রতি তাহমিদের আকর্ষণ হয়েছিল। সুযোগ বুঝে একটা চুমু দিয়ে দিয়েছিল সে। মেয়েটা সেসময় বুঝতে পারেনি। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল বোধহয়। ওইরকম একটা জঘন্য অপরাধ তাহমিদ ইচ্ছাকৃতভাবে করেছিল। সেজন্যই পরে ভীষণ অনুশোচনা হচ্ছিল। তবুও মনকে সান্ত্বনা দিয়েছে। নিজেকে খাটি বলে দাবি করেছে। তবে নিজের মনকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। মন মাঝে মাঝেই তাকে টিপ্পনী কেটে বলে, শালা, তোর যে শুধু হাতে বা চোখে ভেজাল আছে, তা না। তোর ঠোঁটেও ভেজাল আছে! তুই পর-নারীর ঠোঁটে চুমু দিয়েছিস। হোক সে তোর গালফ্রেন্ড। বিয়ে হওয়ার আগে তো তুই তাকে নিজের বলে দাবি করতে পারিস না।

আড়মোড়া হয়ে বিছানা থেকে নেমে গেল তাহমিদ। দেয়ালে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, ৭টা ১০ বাজে। হাই তুলতে তুলতে প্রথমেই এলো জানালার কাছে। জানালাটা খোলা। রাতে শুধু পর্দাটা টেনে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। শীত চলে গেছে। এখন আর সকালে কুয়াশা পড়ে না। তাই খুব সকালেই সূর্য উঁকি দেয় এই ঘরের জানালা দিয়ে৷ হালকা বাতাসে পর্দাটা সরে গেছিল বিধায় সহজেই সূর্যের আলো ভিতরে প্রবেশ করেছে। তাহমিদ দাঁড়িয়ে থেকে ভোর সকালে উদয় হওয়া সূর্যের মিষ্টি তাপ অনুভব করল। ‘হা’ করে কিছু খেয়েও নিলো। কিন্তু এই খাওয়াতে পেট ভরবে না। সুতরাং তাকে পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে থাকা টেবিলের ওখানে যেতে হবে। আরও একটা কারণে ওখানে যেতে হবে তাকে। তুলির করা প্রশ্নের উত্তর সে পেয়ে গেছে। খুব কঠিন একটা উত্তর এখন তাঁর আয়ত্তে। এই উত্তরে কোনো ঝামেলা নেই।

৩.
বরিশালের ছোট্ট একটা গ্রামে হাফিজ উদ্দিনের বসবাস। পেশায় তিনি একজন কৃষক। নিজের বেশ কিছু জায়গাজমি আছে। সেগুলোতেই চাষবাস করেন। দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের জন্য এই কাজ করেন না; কিছু সঞ্চয়ের জন্য তিনি এ কাজ করেন। একসময় তিন মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে এই গ্রামে বেশ সুখে সাচ্ছন্দ্যে বাস করতেন। বড় মেয়ে বিয়ে করে এখন স্বামীর সাথে ঢাকায় থাকছে। মেঝো মেয়ে স্কুল শিক্ষিকা। সে আপাতত বিয়েটিয়ের ঝামেলায় যেতে চায় না। তবে ছোট মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। দু’দিন আগেই পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল। মেয়েকে তাঁদের পছন্দ হয়েছে। অচিরেই বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে যাবে।

এখন সকাল। হাফিজ উদ্দিন পান মুখে দিয়ে মেঝো মেয়ের দিকে তাকালেন। উঠোনে একটা পাটি বিছিয়ে বসেছেন তিনি। সামনে, পান রাখা থেকে শুরু করে পান বানাতে যা যা সরঞ্জাম প্রয়োজন হয়, সে-সব আছে। তিনি আড়চোখে মেয়েকে দেখে সবকিছু আড়াল করলেন। মেঝো মেয়ের নাম আসমা। বয়স আনুমানিক ২৪ অথবা ২৬ হবে। ২৫ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ গত পরশু তাঁর স্ত্রী বলেছিলেন, আমাদের বাড়িতে ২৫ বছরের মেয়ে নেই। থাকলে বড্ড ভালো হতো। হাফিজ উদ্দিনের বয়স হয়েছে; অন্যের বয়স তো দূরে থাক, নিজের বয়সও মনে নেই। তবে তিনি নিশ্চিত, এ বাড়িতে ২৫ বছরের কোনো মানুষ নেই। থাকলে তাঁর স্ত্রী হুমাইরা, অবশ্যই জানতো।

পান চিবিয়ে তিনি আরাম করে বসার জন্য পা দু’টো মেলে দিলেন। ভেবেছেন, মেয়ে তাকে পান চিবোতে দেখেনি। এক্ষুনি তো স্কুলে চলে যাবে; আর পিছনে ফিরে দেখবে না, বাবা কী করছে! তাই আপাতত নিশ্চিন্ত। চোখ দু’টো বন্ধ করে পিছনে থাকা তিনটে উঁচু বালিশে হেলান দিলেন। কিছুটা সময় এভাবেই রইলেন। এরপর হঠাৎ ঝুমঝুম করে কিছু আঁছড়ে পড়ার শব্দ হলো। চমকে উঠলেন তিনি। পা দু’টো গুটিয়ে চোখ মেলে তাকালেন। দেখলেন, মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে, কেউ গরম তেলে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। আর সে ছ্যাদ করে ফুঁসছে। কিছুক্ষণ পরেই তিনি আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করলেন। তাঁর আড়াল করে রাখা পান খাওয়ার সরঞ্জামাদি পাশে নেই; ওগুলো আছে দুয়ারে। তিনি মনেমনে আহত হলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে বললেন,
– এটার কী কোনো দরকার ছিল?

আসমা আরও রেগে গেল। হাতে থাকা পরিক্ষার খাতা আর নিজের লাল কলমটা স্ব-যত্নে পাটির উপর রাখল। বাবার পাশে বসে ধমক সুরে বলল,
– অবশ্যই দরকার ছিল। আমার আদেশ না শুনলে একশবার এটাই করব।

আসমার সব আদেশ হাফিজ উদ্দিন পালন করলেও একটামাত্র আদেশ কখনোই পালন করেন না। কয়েক বছর আগে ঠিক এভাবেই হাফিজ উদ্দিন পান চিবোচ্ছিলেন। তবে সেসময় ঘরে বিছানার উপর বসেছিলেন। হঠাৎ ঝড়েরবেগে ছুটে এলো আসমা। বাবাকে পান চিবোতে আগেও দেখেছে সে। কোনোদিন কিছু বলেনি। সেদিন কী যেন হয়েছিল তাঁর। নিজের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক এক সত্তার উপস্থিতি টের পেয়েছিল। রাগে চোখ-মুখ লাল করে বাবাকে বলেছিল,
– মুখ থেকে এই বাজে জিনিসটা ফেলে দাও বাবা।

হাফিজ উদ্দিন ফেলেনি। হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল মেয়ের কথা। এতে আসমা আরও রেগে গিয়েছিল। রাগে ফেটে পড়ে, পান খাওয়ার সরঞ্জামাদি সহ ভিতরের সবকিছুই বাইরের দিকে ছুড়ে মেরেছিল। হাফিজ উদ্দিন তো চমকে উঠেছিল মেয়ের কাণ্ড দেখে। কিন্তু কিছু বলার সাহস পায়নি। আসমা আদেশের সুরে বলেছিল, আজকের পর থেকে যেন আর পান স্পর্শ করতে না দেখি তোমায়। এই মুখের পানটাই শেষ। আর জীবনেও যদি পান হাতে নাও, বা এর ঘ্রাণও শুকো, তাহলে তোমার একদিন কী আমার একদিন!
মেয়ে হয়ে বাবাকে আদেশ করছে; ব্যাপারটা হুমাইরার কাছে ভালো না লাগলেও হাফিজ উদ্দিনের কাছে বেশ ভালো লেগেছিল। তাঁর অভিজ্ঞতা বলে, বাবা-মায়েরা বুড়ো হলে শিশু হয়ে যায়। সন্তানের, সন্তান হয়ে যায়। তখন সন্তান বড় হয়ে শিশু বাবা-মাকে আদেশ করে। ভালো ভালো উপদেশ দেয়। উপদেশ না মানলে আদেশ করে। এতে তো খারাপের কিছু নেই।

ঝনঝন শব্দ শুনে আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল হুমাইরা। শুরুতে কিছু বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। এখন দু’জনের সামান্য কথোপকথন শুনে আর দুয়ারের দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝে গেলেন, আসলে ঘটনাটা কী ঘটেছে। দরজার কাছ থেকে বেরিয়ে উঠোনে পা রাখলেন তিনি। মেয়েকে বললেন,
– এইসব কী হচ্ছে? রোজ রোজ তোর বাবা পান কিনে আনছে, আর তুই সেগুলো নষ্ট করছিস। এর দ্বারা টাকা নষ্ট হওয়া ছাড়া আর কোনো ফায়দা হচ্ছে না।

আসমা বাবার দিক থেকে চোখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
– তুমি চুপ করো মা। বাবা যখন এইসব কিনে, টাকা তখনই নষ্ট হয়। এরপর যখন সেগুলো গিলে, তখন বাবার জীবন নষ্ট হয়। আমি এইসব ফেলে দিয়ে বাবার জীবন নষ্ট হওয়া রোধ করছি। এগুলো খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। মেয়ে হিসেবে তো আমি একটা দায়িত্ব পালন করছিই। এবার তোমার উচিত একটা দায়িত্ব পালন করা।

হুমাইরা অবাক হয়ে বলল,
– ওমা! আমি আবার কীসের দায়িত্ব পালন করব? এমনিতেই তো কতশত দায়িত্ব আমার উপর।

আসমা আঙ্গুল তুলে মাকেও আদেশের সুরে বললেন,
– সে হোক। তোমাকে আরও একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে।

– কী?

– এখন থেকে, বাবার হাতে একটা টাকাও দেবে না।

হুমাইরা মাথার ঘোমটাটা টেনে নিলেন কিছুটা। বললেন,
– সে খ্যাতে থেকেই সবজি বিক্রি করে। সেই টাকা থেকেই নিজের জন্য পান কিনে। টাকা আমার হাতে টাকা দেওয়া তো দূরে থাক, আমাকে দেখায় না পর্যন্ত।

– শোনো, তোমাকে একটা বুদ্ধি দেই; তুমি তো ওই দোকানদারদের চেনোই। তুমি তাঁদের বলে দিবে, এখন থেকে সবজির দাম যেন বাবার হাতে না দিয়ে তোমার হাতে দেয়। এটাও বলবে, বাবা বয়স্ক মানুষ। ভুলোমন নিয়ে চলতে গিয়ে টাকা হারিয়ে ফেলে। সে হয়তো আবার টাকা চাইবে। কিন্ত আপনারা ভুল করেও তাঁর হাতে টাকা দেবেন না; আমাকে দেবেন।

মেয়ের এইরকম কূ-বুদ্ধি শুনে হাফিজ উদ্দিন নাক ফুলিয়ে তাকালেন। মনে মনে নিজেও কিছু ফন্দি আঁটলেন।
হুমাইরা বেশ খুশিই হলো। এই কাজটা করাই যায়। তিনি মেয়েকে ‘ধন্যবাদ’ দিলেন।
আসমা বলল,
– আমি এখন যাচ্ছি মা। দু’টো টিউশনি আছে আজ। ওদের পাড়িয়ে তাঁরপর স্কুলে যেতে হবে।

হাফিজ উদ্দিন হঠাৎ সোজা হয়ে বসল। গলা খাঁকারি দিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
– তা আজকাল ওই মাস্টারের সাথে একটু বেশিই মেলামেশা হচ্ছে শুনছি। শোনো, মাস্টারটা সুবিধাজনক না। তুমিই বলো, এই সময়ে এসে ওইরকম একটা তরতাজা যুবক শহরে বড়সড় চাকরি না করে এই গ্রামের একটা সাধারণ স্কুলে মাস্টারগিরি করছে কেন? এর পিছনে একটা কারণ আছে অবশ্যই। ব্যাটার মতলব ভালা না। ওই যুবক মাস্টার গ্রামের স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের প্রতি দূর্বল। তাই শহরে না গিয়ে এখানে এই কম পয়সার চাকরি করছে।

আসমা থতমত খেয়ে গেল। বসা থেকে উঠে খাতা আর কলম হাতে নিয়ে হাঁটা দিলো। বাবার আজেবাজে কথা তাঁর সহ্য হচ্ছে না। অত সুন্দর একজন মানুষের মন অসুন্দর হতেই পারে না। কী ভালো করেই না বাচ্চাদের পড়ায়! আসমা সবসময় ছেলে-মেয়েদের মুখে ওই মানুষটার প্রসংশা শুনে এসেছে। মানুষ খারাপ হলে একটা ছেলে বা মেয়ে অন্তত অভিযোগ করতো। কেউ মানুষটার সম্মন্ধে খারাপ কথা বলল না, অথচ তাঁর বাবা মানুষটাকে নিয়ে কীসব বলছে! এগুলো কী সহ্য করা যায়?

আসমা বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছে। সরু পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সে। কিছুদূর যাওয়ার পরই দেখল, তাঁর প্রিয় মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ একেক জনের কাছে একেকরকম ভাবে পরিচিত। তাঁর বাবা মানুষটাকে যুবক মাস্টার বলে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে সে প্রিয় শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। আর আসমার কাছে মানুষটা, প্রিয় মানুষ হিসেবে পরিচিত। সে মাস্টারের কাছে গেল লাজুক ভঙ্গিতে। বাকি সবার কাছে আসমা মানুষটা অত্যন্ত কঠিন হলেও, এই একটামাত্র মানুষের কাছে সে লাজুক এক নারী। মানুষটা বলে; আসমা, তোমার লাজুক মুখখানা দেখলে আমার বুকে কম্পনের সৃষ্টি হয়৷ আমি চাই, এই কম্পন যেন বারবার হয় আমার বুকে। সেদিন থেকে মানুষটার সামনে গেলে আসমা আরও লাজুক হয়ে পড়ে। ঠোঁটের কোণে সেসময় হাসির রেখা লেগেই থাকে। চোখ মেলে তাকাতে পারে না; লজ্জায়!
আসমা প্রতিদিনের মতোই মাথা নিচু করে মাস্টারের সামনে দিয়ে দাঁড়াল।

Protected: বায়স্কোপ

0

This content is password protected. To view it please enter your password below:

Protected: গোপন রহস্য

0

This content is password protected. To view it please enter your password below:

Protected: সম্পূর্নার অসম্পূর্ণ সংসার

0

This content is password protected. To view it please enter your password below:

Protected: রূপকথার আয়না

0

This content is password protected. To view it please enter your password below:

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_২৯ (শেষপর্ব)

1

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_২৯ (শেষপর্ব)
লেখনিতে: চৈত্র রায়

৪৯
,
,
,
রাতে ওনি বাসায় ফেরার পর বেশ খাতিরদারি শুরু করে দিলাম…. ব্যাপার টা ওনার কাছে যদিও অস্বাভাবিক ঠেকছিল…. বারবার তো জিজ্ঞেস ই করছিলো কিছু হয়েছে কি না…. বা কিছু ভুল করেছি কি না!! কিন্তু সেরকম তো কোন কিছুই ছিলো না…… আমি উত্তরে হেসে আহ্লাদী করে ওনাকে জড়িয়ে ধরে না করলাম….আমার না শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন ———
,
,
,
——— এতোক্ষণ কনফিউজড ছিলাম কিছু হয়েছে কি না!! তুমি জড়িয়ে ধরে একেবারে কনফার্ম করলে ব্যাপারটা…..
,
,
,
লোকটা এমন কেন…. কেমন করে যেন সব বুঝে যায়….. সেদিনের পর টানা আটদিন তৈলমর্দন করেও কোনভাবেই তাকে রাজি করানো গেলো না….. সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও তার নাকি কি সব কাজ থাকে …. ছুটি একেবারে পসিবল না…. না মানে না…. কিন্তু আমিতো ছাড়ার পাত্রী না….. শুধু মোক্ষম সময়ের অপেক্ষা করছি মাত্র….এবং আমি খুব ভালো করেই জানতাম সেই সময় টা আমার খুব বেশি দূরে নয়….. তাই সুযোগের সদব্যাবহার করেও ফেললাম……
,
,
,
——— আচ্ছা তুলি আমাদের এই ঘনিষ্ঠ মূহুর্তেই কি তোমার এই কথা সেই কথা নানা হাবিজাবি মনে পড়ে…..?? মানে আমি যখন তোমাকে একটু আদর করতে যাবো ঠিক তখনি তোমার এটা ওটা চাই?
,
,
——— এমন করছেন কেনো!!।।। একদিনের ছুটিই তো….
,
,
——— আমি কিন্তু এইবার খুব রেগে যাচ্ছি….. কান্নাকাটি করেও কিন্তু কোন লাভ হবে না তখন বলে দিলাম….
,
,
ওনার কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো….. তাই কিছুটা সরে এসেই একপাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম….. ওনিও আর কথা বাড়ালেন না…..
,
,
——— আমি কাল মায়ের কাছে গিয়ে কয়টা দিন থেকে আসবো….. আপনাকে আর কষ্ট করে ছুটি নিতে হবে না…..
,
,
,
জবাবে ওনি কিছুই বললেন না…. কিন্তু নিরবতায় ওনার পর পর ফেলা দুটো দীর্ঘশ্বাস আমি বেশ স্পষ্ট শুনলাম….. আজকাল এতোই কাজপাগল হয়েছেন যে বাসায় ও লেট করে ফিরে….. বেশী সময় আর মন খারাপ করে থাকতে হলো না……
,
,
——— কোথাও যাওয়া চলবে না কাল…. আগামীকাল ছুটির এপ্লিকেশন করবো দেখি কি হয়…. বেশ গম্ভীর ভাবেই কথাটা বললেন…..
,
,
,
আমি তো খুশিতে বাকবাকম করতে করতে ওনার বুকের উপর চেপে বসে জড়িয়ে ধরলাম…. কিন্তু ওনি ধরলেন না আমায়….
,
,
,
———রাগ করেছেন??? ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে
,
,
——— না ভাবছি… দিনকে দিন আমার সংস্পর্শে থেকে থেকে তুমি কতটা চালাক হচ্ছো…. বেছে বেছে আমার ওয়িক টাইমে…
,
,
——— আপনার এতোদিনের কোলেপিঠে করে মানুষ করার ফলই তো…. আপনার নাক কাটতে দেই কি করে বলেন তো….
,
,
——— ওরেব্বাস।।।।
,
,
,
খুনশুটি আর ছোট ছোট ভালাওবাসাবাসিতেই কেটে গেলো সে রাত…. পরদিন ঘুম থেকে উঠেই ওনাকে বারবার ছুটির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম…..প্রথমত এতো সকালে আমাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে খানিকটা অবাকই হলেন…..সকাল থেকেই কি হলো জানি না তার একটু সুযোগ পেলেই জড়িয়ে ধরছে…. লুকিয়ে চুমু খেয়ে নিচ্ছে আবার বেশি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ গলায় বুকে কালসিটে দাগ ফেলে দিচ্ছে…. সকালে আম্মু আর ফুলি খালা মিলে ওনার প্রিয় ভূনা খিচুড়ি আর আলুভাজি করেছিলেন….. দেখে তার সেকি খুশি…. বেশ আয়েশি করেই সকালের নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ আল্লাদ করলেন…… বের হবার সময় ফের রুটিন মোতাবেক পানি চেয়ে নিয়ে শেষ চুমুটা কপালে তুলে দিয়ে বেরিয়ে পরলেন….. আর বলে গেলেন সাবধানে থেকো…..আম্মুকে দেখো…. আমি মিস্টি হেসে তাকে ফের ছুটির কথা মনে করিয়ে দিলাম….. ওনি আচ্ছা আচ্ছা করতে করতে মাথা দুলিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন…….
,
,
,
সারাদিনের একাজ সেকাজ করে সেদিন আর ঘুমুতে ইচ্ছে হলো না….. একটা উত্তেজনা কাজ করছে ভেতরে….. আল্লাকে ডেকে মনে মনে মানত করে নিলাম আজ যেনো ছুটি নিয়েই ফেরে…..হাবিযাবি ভাবতে ভাবতেই আলমিরার কাপড় চোপড় ঘেটে পিকনিকের জন্য ড্রেস পছন্দ করছিলাম…… এর মধ্যেই আম্মু খানিকটা হন্তদন্ত হয়ে রুমে এলেন…..
,
,
,
——— টুকি মা চলতো একটু…
,
,
——— কি হয়েছে আম্মু… কোথায় যাবো…. একটু পর তো সন্ধ্যে হয়ে যাবে….
,
,
——— আহ… এতো কথা…
,
,
,
আম্মু কথা শেষ করার আগেই ফোন বেজে উঠলো ওনার হাতের….. আমাকে কিছু না বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন…. হাতের কাপড় বিছানার উপর রেখে আমিও আম্মুর পেছন পেছন গেলাম….. কি হয়েছে…. কোথায় যাবো বারবার বলার পর ও কিছুই বলছিলেন না…. তবে খুব টেনশনে আছেন তা আমি ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম…… প্রায় ঘন্টা খানেক পর বাড়ির গেইটের দিকটায় হবে এম্বুলেন্স এর আওয়াজ….. আমার সাথে আম্মুর চোখাচোখি হতেই ওনি একপ্রকার ছুটে বেড়িয়ে গেলেন…. আমি কিছু না বুঝেই ওনার পেছনে দৌড় দিলাম….. নিচে নামতেই দেখি সাফি ভাই আর রফিক ভাই ওনার বন্ধু পেছনের দরজার দিকে ওয়ার্ডবয় দের সাথে স্ট্রেচার বের করছে…. খুব আগ্রহ থাকা স্বত্তেও আমি সামনে এগুলাম না…. আম্মু ওনাদের চিল্লিয়ে যেনো কি বলছেন….. রফিক ভাই আম্মুকে এক হাতে ধরে আরেক হাতে নিজের চোখের জল মুছেই আমার দিকে তাকালেন…. আমার দৃষ্টি স্ট্রেচারের সাদা কাপড়ে মোড়ানো মানুষটার উপর ই নিবদ্ধ……. আমার সামনে দিয়েই সবাই মিলে স্ট্রেচার সহ সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলেন…. মুখ ঢাকার কারণে চেহারা দেখতে পেলাম না….. ওনাদের পেছন পেছন উপরে চলে এলাম….. আম্মু ও এলেন…. রফিক ভাইকে ছেড়ে স্ট্রেচারের রাখা মানুষ টার উপর থেকে কাপড় সরিয়ে ওখানেই লুটিয়ে পড়লেন কান্নায়…. আম্মুর জন্য আমি তখনো মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম না….. সামনে এগুতেই মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি…. কোনভাবেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না…… সকালে ও তো মানুষ টাকে দিব্যি প্রাণোচ্ছল দেখেছিলাম….. পড়নের শার্ট নেই….. সারা শরীর জুড়ে শুধু ব্যান্ডেজ….. মাথায়….. হাতে…. এখানে সেখানে সারাশরীরে…. কপালের ব্যান্ডেজের জন্য চোখ দুটো ও কিছুটা ঢাকা পড়ে গেছে….. হাতটা দেখে মনে হচ্ছে ভেঙেই গেছে।।।।আচ্ছা আম্মু এভাবে মানুষ টার উপর শুয়ে আছে কেনো…. ব্যাথা পাচ্ছে তো….আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই আম্মুকে ডাকলাম…
,
,
,
——— আম্মু উঠো….. ওনি ব্যাথা পাবেন….
,
,
আম্মুর কি হলো জানিনা ওনি আমাকে জড়িয়ে ধরেই হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন….. দেখতে দেখতে ফাকা ঘরটা মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো….. আম্মু আর কাদতে পারছিলেন না…. ওনার বুকের সাথে মিশে ছিলেন একেবারে….. আমি আম্মুকে ডাকি….কেনো কাদছে জিজ্ঞেস করি….. কিন্তু আম্মু তাও কান্না থামায় না….আমি একপ্রকার বিরক্ত হয়েই আম্মুর কাছ থেকে উঠে এলাম…….. সাফি ভাইয়ের কাছে যেতে নিয়েও গেলাম না… ওনিও দেখি সোফায় বসে ডুকরে কেঁদে যাচ্ছেন…. অগত্যা আমাকে রফিক ভায়ের কাছেই যেতে হলো…..
,
,
,
——— রফিক ভাই ওনাকে একটু রুমে দিয়ে আসুন না…. এতো মানুষের মাঝে মানুষটার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে…… আপনারা মিলে ওনাকে বিছানায় শুইয়ে দিন….ঘুম খুব পাতলা ওনার….. একটু আওয়াজ হলেই উঠে যায়….
,
,
——— আল্লারে বলেন ভাবি তাই যেনো হয়….. ওর ঘুমটা ভেঙে যাক….. ওরে ফিরায়ে দিক….. ভাবি এই দিন আসবে জানলে কোনদিন ও আল্লার কাছে সকাল দেখার ফরিয়াদ করতাম না……..
,
,
,
রফিক ভাই আমার দুহাতের মাঝে নিজের কপাল রেখে কথা গুলো বলছিলেন আর ফুফাচ্ছিলেন….. ছেলে মানুষের কান্না টা দেখতে বড়ই অস্বস্তি হয়…. রফিক ভাইকে বসিয়ে দিয়ে আমি ফের ওনার কাছে চলে এলাম…. ইশ মুখটা মলিন হয়ে আছে একেবারে….. চেহার সেই জৌলুশ টাই যেনো নেই…. অথচ মানুষ টা হাসলে আমি নির্দিধায় একশো বছর তাকিয়ে থাকতে পারবো…. কথাগুলো ভেবেই শাড়ির আঁচল দিয়ে ওনার মুখটা মুছিয়ে দিলাম….. ততক্ষণে মা-বাবা চলে এলেন…. কান্নায় কান্নায় ঘড়ের পরিবেশ টাই যেন পালটে যাচ্ছিলো….. আমি তখন মেনে নিতে পারি নি মানুষ টা আর নাই….. চলে গেছে না ফেরার দেশে….. কর্মস্থল থেকে ছুটি আনার ওছিলায় একেবারে জীবন থেকেই ছুটি নিয়ে নিলেন চিরকালের জন্য …. আমি তখনও ভাবতে পারি নাই যে আমার দুই বছর দশ মাস সতেরো দিনের সংসার তার নিশ্বাসের সাথেই শেষ হয়ে গিয়েছে….. আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বসে ছিলাম সবাইকে দেখছিলাম….. আস্তে আস্তে বড় আপু, মেজো ভাইয়া ভাবিও চলে এলেন…. কান্নার রোল যেনো তাদের আগমনে আরো নতুন করে ভারি হলো…..
,
,
,
ওনাকে গোছলের জন্য নিতে চাইলে আমি বাধ সাধলাম…. সবার সাথে খুনোখুনি ঝগড়া করলাম….
,
,
,
——— আপনারা পাগল হয়ে গেছেন কিসের গোছল…. মানুষটার সারা গায়ে ব্যান্ডেজ….. এই অবস্থায় ওনাকে গোছল করাবেন!!! আম্মু তুমি চুপ করে আছো কেন???
,
,
কেউ আমার কথা শুনলো না…. ফুলি খালা… মেজোভাবি আর মা মিলে আমাকে আটকে রাখলেন…..
,
,
,
——— টুকিরে….. বাবু আর নাইরে মা…… ছেলে আমার শেষ হয়ে গেছেরে মা…… বাবু আর নাই….. আমারে এতিম কইরা রাইখা গেছেরে মা….. আমারে কে জড়ায়ে ধরবে বল….. আম্মু ডেকে এটা সেটা বলে কে আল্লাদ করবে….. আমার সব শেষ হয়ে গেছে….. আল্লাহ আমারে কেন দেখে না….. আমার কলিজা ছিড়ে নিছে আল্লাহ….. তোমার গায়ে যেনো এই আহাজারি সয়……আল্লাহ….. আমার সোনার টুকরা ছেলেটারে তুমি এতো কষ্ট দিলা…৷ কি পাপ করছিলাম আমি…… এই মেয়ের মুখের দিকে তাকাইয়াও তোমার আত্মা কাপে নাই……..
,
,
,
আম্মুর কথায় আমি খুব রেগে গেলাম…..আবল তাবল বকতে শুরু করে দিলাম…. নেই মানে কি…. ওনাকে গোছল করানোর পর মা আমাকে টেনে ওনার সামনে নিয়ে গেলেন।।।।।
,
,
——— তুলি শেষ দেখা দেখে নে মা….. ছেলেটাকে শেষ বারের মতোন দেখে দে….
,
,
,
মায়ের কথা শুনে বেশ জুড়েই।একটা ধমক দিলাম…. তারপর মায়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওনার কাছে চলে এলাম…. কপালে আর ব্যান্ডেজ নাই…. সেলাই দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট….. খুব চুপটি করে ওনার বুকে মাথা রেখে বেশ জোরে জড়িয়ে ধরলাম …. রোজ রাতেই তো ওনি এভাবে জড়িয়ে ধরে…… ওনার বুকের ধুকপুকানির আওয়াজ টা আমার খুব পছন্দের কিন্তু আজ একেবারে শান্ত…. কোন আওয়াজ পাচ্ছি না…..আমাকে জড়িয়ে ও ধরছে না…..
,
,
——— মা একটু দেখবা…. ওনার বুকে কোন আওয়াজ পাচ্ছি না…. কি হয়েছে আপনার…. আমাকে শক্ত করে একটু জড়িয়ে ধরেন না….আমি ভয় পাচ্ছিতো…. আচ্ছা আমরা না পিকনিকে যাবো….. ছুটি এনেছেন আপনি???আপনি সুস্থ হলেই যাবো কিন্তু ….
,
,
,
কেমন যেনো কথার খেই হারিয়ে ফেলছিলাম…… আমাকে ফের কয়েক জন ছাড়িয়ে নিতে এলেন…. আমি ওদের বকে ধমকে সরিয়ে দিলাম….. তখন আম্মুকে ধরে আমার পাশে বসানো হলো…. আম্মুর ওনার বুকের উপর হামলে পড়লেন…. কেমন যেনো ফ্যাচফ্যাচ করে কাদছিলেন…. গলা বসে গেছে হয়তো….. ওনার কপালে খুব সসন্তর্পণে চুমু খেলেন….. সারা মুখে বুকে চুমু খেয়ে যাচ্ছেন অনবরত …..
,
,
,
——— আল্লাহ তরে কেন কেরে নিলো বাপ….. আমারে একবার আম্মু বলে ডাকনা বাবু…. একবার ডাক….. আর বকবো না…. তুই ভুল করলেও না….একবার ডাক….. আল্লাহ তুমি আমারেও নিয়া নাও…. আমি আর কিসের জন্য বাচবো আল্লাহ……
,
,
,
আমাকে আম্মুকে সরিয়ে মেজো ভাইয়া, বাবা, বড় আপুর হাসবেন্ড, রাফি ভাইয়া ওনার খাটিয়া নিয়ে বেরোনোর জন্য রেডি হয়ে নিলেন…. দরজা দিয়ে বেরোনোর আগেই আমি দৌড়ে গিয়ে একগ্লাস পানি নিয়ে বাবার সামনে গেলাম…..
,
,
,
——— বাবা ওনাকে পানিটা খাইয়ে নিয়ে যাও…. ওনি কোথাও গেলে আমার হাতে পানি না খেয়ে বের হন না….
,
,
,
আমার কথা শুনে বাবা আমার মাথায় হাত রাখলেন…… তারপর ছলছল চোখেই বেড়িয়ে পড়লেন….. বড় আপু আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেদেছিলো সেদিন…. আমি তখন ওনার খাটিয়া দেখে যাচ্ছিলাম যতদুর দেখা যায়….. মানুষ টা চলে গেলেন….. আমাকে আর আম্মুকে একলা করে দিয়ে চলে গেলেন……
,
,
,
মেজো ভাবি আর বড় আপু মিলে আমাকে রুমে নিয়ে এলো…. আমি তখন ভাবলেশহীন….. রুমের আবওহায় যেনো নিশ্বাস নেওয়া দায় হয়ে পড়েছে আমার…. আমাকে গোসলে দিয়ে ওনারা দরজায় দ্বাড়িয়ে রইলেন কাফনের মতো সাদা কাপড় হাতে….. ঘাড়ে বুকে তখনও ওনার ভালোবাসার চিহ্ন গুলো জীবন্ত….. অথচ মানুষ টাই নাকি নাই….. আমাকে শাড়ি পড়ানোর সময় মেজোভাবি আর আপু নিজেকে সামলাতে পারলেন না…..হয়তো কখনো ভাবেননি আমাকে এইবেশে দেখবে…… দুজনেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেদে যাচ্ছেন….. অথচ আমার কান্না পাচ্ছে না….. হয়তো আমিই কাদতে পারছিলাম না…..
,
,
,
বাবা সাফি ভাইয়ারা বৃষ্টি ভিজে বাড়ি ফিরলেন…… সারারাত বৃষ্টি হয়েছিলো সেদিন….আম্মু ওনাদের আসতে দেখেই বাবার দিকে ছুটে গেলেন…..
,
,
,
——— আমার বাবুরে ঠামায় আসছেন ভাইজান…… এই বৃষ্টিতে ওরে একলা রাইখা আসছেন…… আমার ছেলেটা একদম বৃষ্টি সহ্য করতে পারে না ভাইজান……. ও কেমনে থাকবে….. ও রফিক…. আমার বাবু আমারে কেমনে একলা রাইখা চলে গেলো রফিক….
,
,
,
তখনো ঘরভর্তি মানুষ….. কিছু মহিলা আমার দিকে এগিয়ে এসে বলতে লাগলেন গায়ের গয়না এক এক করে সব খুলে ফেলার জন্য…. আমি দিলাম না….. তখন শুরু হলো নানা কথার গুঞ্জন……
,
,
——— আম্মু….. ওনি আমাকে কখনো এগুলো খুলতে বারণ করেছেন….. ওনার কথার খেলাফ করলে ওনি খুব রেগে যায় আম্মু…. তুমি চেনো না তুমার ছেলেকে…..
,
,
,
আমার কথা শুনে আম্মু আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বললেন যেনো আমাকে কোন কিছু নিয়ে জোড় না করা হয়…. আর ইসলামে স্বামী চিহ্ন বলে কোন রীতি নেই…. যা নেই তা নিয়ে আম্মুর কোন মাথা ব্যাথা নেই…. আম্মুর এই কথায় কেউ কিছু বললো না…..আস্তে এক এক করে পাড়া প্রতিবেশী শান্তনা দিয়ে চলে গেলেন…… শুধু রয়ে গেলেন কাছের মানুষ গুলো…… কেমন যেনো একটা নিরোবতা…. কান ধাধিয়ে যাচ্ছে….. বারবার মানুষ টার কথা মনে পড়ছে….. ইশ বাইরে কিভাবে বৃষ্টি হচ্ছে…. এইভাবে ভিজে নাজানি ফের জ্বর বাধায়…..
,
,
,
ওনার মৃত্যুর তিন দিনেও আমি স্বাভাবিক সত্যটা মানতে নারাজ…… সেদিন হসপিটালের এক ওয়ার্ড বয় এসে ওনার অফিস ব্যাগ…. ফোন… রক্তে ভেজা আকাশি রংা শার্ট আর হাত ঘড়িটা দিয়ে গেলেন…. বাসায় তখন সবাই রয়ে গেছে…. আমি একে একে ওনার জিনিস গুলো ছুয়ে দেখিছিলাম বুকের সাথে মিশিয়ে ধরছিলাম….
,
,
,
আম্মু নিজেকে খুব শক্ত করে নিলেন…… সাফি ভাইয়া আর রফিক ভাইয়াকে ডাকালেন বিস্তারিত সব শুনার জন্য….. ওনার তাদের সাথে সন্ধ্যায় দেখা করার কথা ছিলো…. অফিস থেকে নাকি কিছুটা এগিয়ে বের হয়েছিলেন….. শেষ বিকাল পাচটায় ফোনে কথা হয়েছিলো…. কোথায় তোরা থাক…. আমি আসছি এই ধরনের…. কিন্তু ঘন্টা পার হয়ে গেলো….. আসার খবর নেই দেখে সাফি ভাইয়া ফোন ধরতেই হসপিটালের একজন নার্স ধরলেন এবং তাদের ঠিকানা দিলেন….. ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে দেখেন ওনার ট্রিটমেন্ট চলছে…. দুই তিন জন লোক ওনাকে নাকি ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেছেন….. এক্সিডেন্ট কেইস বলে ভর্তি নিচ্ছিলো না…. এর মধ্যে তাদের একজন নাকি থানায় ফোন করিয়ে ব্যাপার টা সামলে নেয়…. কিন্তু সাফি ভাইয়ারা তাদের কাউকেই পেলেন না….. ডাক্তার বাড়ির লোকজন খবর দিতে বললে তারা আম্মুকে ফোন দেয়…. ডাক্তার জানায় সারা গায়ে জখম…. আর মাথায় অনেক ছোট ছোট আলপিন ধরনের পেরেক পাওয়া গেছে…. যা মস্তিষ্কেও আঘাত করেছে…. সাফি ভাইয়াদের দেখা করার অনুমতি দিলে ওনারা ভেতরে যান…. আবছা ভাবে আমার আর আম্মুর নাম নিতে নিতেই নাকি তিন শ্বাসে শেষ নিশ্বাস ছাড়েন…… আম্মু খুব সাধারণ ভাবেই চশমা খুলে চোখের জল মুছলেন….. আমি তখনও ওনার জিনিস পত্র ঘেটে যাচ্ছি…..
,
,
,
৫০
,
,
,
দিন চলছে তার নিজস্ব গতিতে আর তার সাথে যোগ হচ্ছে মানুষ টাকে হারিয়েছি তার দিনের হিসেব….. আম্মু এখন আর কাদেন না….. আপু আর মেজোভাবিরা সপ্তাহ খানেক থেকে ফিরে গেলেন….. মা-বাবা আমাদের সাথেই আছেন….. এখান থেকেই মা রোজ অফিস করছেন…. রাতে আম্মু আর মা আমাকে মাজখানে রেখে ঘুমোয়….. রোজ রাতে তাদের কাছে আবদার করি জড়িয়ে ধরার…. কিন্তু তাদের জড়িয়ে ধরাটা ওনার মতো হয় না…. আমি চোখ বুঝি…. ঘুমানোর চেষ্টা করি….. আর ভাবি সকালেই হয়তো ওনি চলে আসবেন…. তারপর আমাকে ঠিক আগের মতো জড়িয়ে ধরবেন….. রাতের পর সকাল আসেন ঠিকই কিন্তু ওনি আর আসেন না…. মাঝেমধ্যে অকারণেই দরজা খুলে অপেক্ষা করি…. সিড়িতে পায়ের আওয়াজ পেলেই ছুটে দরজায় কান পাতি আর ভাবি দরজা খুলে মুখটা বের করলে নিশ্চিত ওনি দুষ্টুমির ছলে চুমু খেয়ে বসবেন….. নিজে নিজেই ভাবি আর একা একা হাসি……কখনো মনেই হয় নাই ওনি নেই…. সব সময় মনে হতো আশেপাশে আছেন….. নাহয় মনে হতো অফিসে গেছেন….. একদিন দুপুরে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম আমার হাতে অফিসের ব্যাগটা দিয়ে বলছেন…. জলদি একগ্লাস পানি আনোতো তুলি….. ওমনিই আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো……
,
,
,
সেদিন সন্ধ্যায় ফুলি খালা রয়ে গেলেন…. আম্মু এখন প্রায়ই ফুলি খালাকে রাতে রেখে দেন…..বাবা ছাড়া সবাই আমার রুমে….. ওনারা নিজেদের মতন করে কথা বলছেন….. আমি শুনছি…. হুট কিরেই স্বপ্নটার কথা মনে হতেই আমি আলমিরা থেকে ব্যাগটা বের করে আনলাম….. আম্মুরা আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন তখন….. ওনার কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্রের মাঝে দুটো খাম পেলাম…. একটাতে দুই দিনের ছুটি গ্রান্ট করা এপ্লিকেশন আরেকটা খাম খুলে আমার ভেতর ওলট পালট হয়ে গেলো….. ওটাতে আমার পজিটিভ প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট….. লাস্ট চেকাপে গিয়েছিলাম মাস তিনেক হয়ে গেছে….. তখনকারই রিপোর্ট এটা….. ভেতর টা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছিলো যেনো….. এই সময়টার কতো অপেক্ষা করেছি দুজনে মিলে….. কতো কিছু সাজিয়েছি প্লেন করেছি….. আল্লাহ আমাকে যে এইভাবে অপূর্ণতার মাঝে পূর্ণতা দিবে আমি কখনো ভাবতে পারি নাই….. আমার কাঙ্কিত সুখ অথচ যাকে ঘিরে আমার সব কিছু সেই মানুষটাই নেই…… বারবার ওনার হাসিমাখা মুখটা চোখে ভাসছিলো….. হুট করেই শেষ দেখা মলিন মুখটা মানষপটে ভেসে উঠলো…… মা-আম্মু আমার কাছে আসতেই আমি বিছানায় লুটিয়ে গেলাম…..
,
,
,
——— আমার এতো বড় সর্বনাশ কে করলো আম্মু….. আল্লাহ আমার সব কেড়ে নিলো আম্মু….. আমার এই সুখ চাই না….. ওনাকে ফিরিয়ে দাও তোমরা….. আমার এতো কষ্ট সহ্য হচ্ছেনা….. ও মা…. তুমি ওনাকে ফিরিয়ে দাও না মা….. আমাদের সন্তান আসবে….. তুমিই বলো সে তার বাবার আদর পাবে না….. তার কোলে উঠবে না….. ওনি…..
,
,
,
এতো চাপ নিতে না পেড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম…… তখন থেকে আমার কাঠখোট্টা চোখ দুটো সজল হতে শুরু করলো….. ওনাকে ডাকি…. এখানে সেখানে খুজি……কিন্তু পাই না…. আমি আদৌ জানি না মানুষ টা জেনেছিলো কিনা সে যে বাবা হতে চলেছে….. আল্লাহ তাকে বাবা ডাক শুনার সৌভাগ্য টা দিলো না…… আম্মু সেদিন ঠিকই বলেছিলেন ওনি যে কি আমি একদিন ঠিকই বুঝবো…. আসলেই আমি বুঝছি…. কিন্তু এভাবে ওনাকে হারিয়ে সত্যিই আমি ওনার মূল্য বুঝতে চাই নি….. মাঝেমধ্যে আর নিজেকে আটকাতে পারি না…. খুব কষ্ট হয়…..ওনাকে খুব বকি…. এতো ভালোবাসার কি দরকার ছিলো…. এখন তো সেসব আমাকে প্রতিনিয়ত পুড়ায়…..
,
,
,
‌মা-বাবা আমাকে ওনাদের সাথে নিতে চেয়েছিলেন….. আমি যাই নি করেই বা যাবো….. আমাদের প্রথম মিলনের রাতে ওনাকে জড়িয়ে ধরে আমি কথা দিয়েছিলাম এ বাড়ি এঘড় আর আম্মুকে একা ফেলে আমি কোথাও যাবো না…. ওনি নাহয় আমার সাথে সারাজীবন কাটানোর কথা রাখতে পারলেন না কিন্তু আমি রাখবো….. সে তো স্বার্থপর মানুষের মতো আমার উপর সব শর্ত জারি করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে…..ওনার আমাকে বলা শেষ কথাটা এখনো কানে বাজে আম্মুকে দেখো…… মানুষ টা তো মা বলতে অন্ধ ছিলো….. তার এতো প্রিয় জিনিসটার অবহেলা কি করে করি আমি….
,
,
,
সাতমাসের আল্টাসনোতে ধরা পড়লো আমি জমজ বাচ্চার জন্ম দিতে চলেছি…..ডাক্তারের মুখে কথাখানা শুনে আমি প্রথম চোখ বুঝে মনে মনে ওনাকে ডাকলাম…..
,
,
,
———শুনছেন….. আপনি টুয়িনদের বাবা হতে যাচ্ছেন….
,
,
ফের নিজে হেসেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি…..সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো মানুষ টা আমার পাশের চেয়ারে বসে আমার হাতটা চেপে ধরতো…..জমজ বাচ্চা বলে ডাক্তার আর রিস্ক নিলেন না…. সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমেই আমাদের ছেলে মেয়েকে সুস্থ ভাবেই পৃথিবীতে নিয়ে এলেন….ওনার খুব মেয়ের শখ ছিলো…. যখন যখন আমি ওসামার মতন একটা ছেলে লাগবে বলতাম তখন তখন ওনি বলতেন ———
,
,
,
——— আমার মেয়েই লাগবে….. মেয়েরা মা-বাবার জন্য আশীর্বাদ বুঝলে…. ওরা কখনো কষ্ট দেয় না…. ছেলেরা পাজি বুঝলে…. ওরা অলওয়েজ সবকিছুতেই উদাসীন…..
,
,
,
আমি হাসতাম আর একেকটা যুক্তি টেনে এনে ওনার সাথে ঝগড়া করতাম….. ছেলে -মেয়ে দুটো একেবারে বাবাকে কপি করে এসেছে…. কিন্তু আমি পোড়াকপালি তাদের জন্মের ১৫ দিন পরেই মেয়েটাকে হারিয়ে ফেললাম….. হঠাৎ করে শ্বাস কষ্টের মতন হয়ে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলো…. মেয়াটাও বাবার মতোন ই স্বার্থপর….. বাপ মেয়ে একসাথে ফন্দি এটে করেছে এসব…. তারপর থেকে ছেলেকে বুকে আগলে আর আম্মুকে পাশে নিয়ে নিজের পথ চলেছি…. পড়াশোনা শেষ করে…. দুবছর একটা স্কুলে চাকরি করেছি…. ছেলেকে সময় দিতে পারছিলাম না বলে চাকরি ছেড়ে দিলাম….. তার বাবার রেখে যাওয়া নামেই দুই ভাইবোনের নাম রেখেছিলাম সাদাত আর তুস্মি….মেয়েটাতো বাবার কাছে চলে গেলো সেই কবে….. সাদাত কে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাম….. সেই নাক সেই হাসি সেই রাগ….. একটু চুপচাপ স্বভাবের….. আম্মুকে দেখতাম প্রাই লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল মুছতেন….. আর আমি তা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম…… এখনো তার কথাগুলো কানে বাজে…. ডায়নিং টেবিল থেকে এখনো পানি খেয়ে হাতে করে রুমে নিয়ে যাই…. সে পানি চাইছে বলে…. বছরের পর বছর যোগ হয় মানুষ টা চলে গেছে খাতায়…. কিন্তু সে আমার কাছে ঝাপসা হয় না…. ঠিক আগের মতোই অমলিন…..
,
,
,
সাদাত যখন ক্লাস ফাইবে পড়েন একদিন বাবা ফোন দিয়ে জানালেন চাচা নাকি আমাকে দেখতে চাইছেন….. খুবই অসুস্থ…. ব্লাড কেন্সারের সাথে লিভার ক্যান্সার আর তার সাথে হার্টের ব্লক তো আছেই…. চাচার সাথে আমার বিয়ের পর থেকেই কোন যোগাযোগ নেই…. বলা যায় তিনিই রাখতে দেন নি….. আম্মু কে নিয়ে সাদাত কে কুলে করেই চাচাকে দেখতে গেলাম…. সেখানে যে আমার জন্য এতো বড় চমক অপেক্ষা করছিলো জানা ছিলো না…..
,
,
,
সাদাফ কোন এক্সিডেন্ট করে নি তাকে প্লান করে খুন করা হয়েছে…. আর তার সবই হয়েছে আমার চাচার ইচ্ছে অনুসারে….. কারণ হচ্ছে বাবার ভাগের সম্পত্তি…. যা তিনি তার ছেলেকে আমার সাথে বিয়ে দিয়ে হাতিয়ে নিতে চেয়েছিলেন…… আমার বিয়ের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীর কিছুদিন পর বাবা নাকি ওনাকে একপ্রকার জোর করেই সব সম্পত্তি ট্রান্সফার করে দিয়েছিলেন ওনার ভবিষ্যৎ নাতি নাতনির জন্য….সেই ক্ষোভের থেকেই এতো কিছু….. চাচা আমাকে সব খুলে বলে হাত জোর করে মাফ চাইলেন….. আমি উল্টো ওনার পা জড়িয়ে ধরে বললাম ———
,
,
,
——— আপনার প্রতি আমার কোন অভিযোগ থাকবে না চাচা…. প্রতি মোনাজাতে আল্লাহর দরবারে আমি আপনার সুস্থতা কামনা করবো…. ওনি আমার আয়ু ও আপনাকে দিয়ে দিক…. আপনি শুধু আমার ছেলের বাবাকে ফিরিয়ে দিন…. বেশি না একদিনের জন্য….. তাকে বাবা ডাক শুনার সুযোগ করে দিন…..
,
,
,
আমি জানি আমার এই চাওয়া মূল্যহীন…… যার কোন অস্তিত্ব নেই….এই মানুষ টাকে আমি কি করে কি ভেবে ক্ষমা করবো তা আজ ও ভেবে পাই না…. তবে সত্যি এই যে আমি আমার আপনজন দ্বারাই অতিপ্রিয়জনকে হারিয়েছি…..এরকিছুদিনের মধ্যেই একদিন খবর পেলাম চাচা মারা গেছেন…..
,
,
,
আম্মু এই শেষ শোকটা আর মেনে নিতে পারলেন না….. খুব ভেঙে পড়েছেন….. সাদাত যখন সবেমাত্র ক্লাস ফাইবে তখনকার এক সকালে আম্মুকে ডাকতে গিয়ে বুঝতে পারলাম ওনিও আমায় ফাকি দিলেন…… তারপর থেকে মা-বাবাই আগলে রেখেছেন আমাদের….. ভাসুর দুজনি বিনা বাক্যে ঢাকার বাড়িটা আমার নামে লিখে দিলেন….. সাদাতের কলেজ পড়া কালিন সমিয়ে বাবা আর তার বছর দুয়েক পর মা …… চলে গেলেন সবাই এক এক করে…… এর মধ্যে কতো মানুষ এসেছে তার জায়গা নিতে….. অমন একটা মানুষের জায়গা কি কাউকে দেওয়া যায়!!! যায় না….
,
,
,
অবশ্য এখানে আমি একা না…. আমার মতো আরো অনেক মানুষ আছেন এখানে….. আসার সময় ওনার সব জিনিসপত্র আর পুরাতন এলবাম টা নিয়ে এসেছি…. এখকার সঙ্গী তো এগুলোই….রোজ রাতে মানুষটাকে স্বপ্নে দেখি….. সে সবার খোজ খবর নেয়…. এমনকি সাদাতের দুবছ্রের ছেলেটার ও….. বাচ্চাটার কথা খুব মনে পড়ে…. আধো আধো বুলিতে কি সুন্দর করে দিদুই ডাকতো…..
,
,
,
——— জানেন আপনার ছেলেকে মনে হয় আমি আপনার মতো করে মানুষ করতে পারি নি….. আর একা ভালো লাগে না….. একটা কাধের খুব প্রয়োজন….. আমাকে আপনার খুব প্রয়োজন……
,
,
জবাবে ওনি যেনো ফিসফিসিয়ে কি বলে…. তা শুনে আমি হাসি….. ঘুম ভেঙে যায় কিন্তু মুখের হাসিটা ঠিক বজায় থাকে….. ব্যাগ থেকে পুরানো এলবাম টা বের করে আমাদের খুব প্রিয় ছবিটা দেখি….. ওইযে শিমুল ভাইয়ের তুলা…. আম্মু যেদিন আঙটি পড়িয়ে দিলেন….. ওনার পাশে বসে কাদছি আর মানুষ টা অবাক হয়ে দেখছে আমায়….. হাত বুলিয়ে ছবিটাতে বুকে চেপে ধরে বসে থাকি….. বাইরে মেঘ ডাকছে…. বৃষ্টি হবে হয়তো…… কেনো যেনো আজকাল বৃষ্টি বড্ড ভয় করে….. আগে করতো না…. জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রিয় মানুষ গুলো তো এই বৃষ্টি সাথেই জীবনে এসেছিলেন….. কিন্তু তারা ছিলেন এক পশলা বৃষ্টির মতোন ক্ষনিকের …… দমকা হাওয়ায় সব ধুয়ে মুছে শেষ……. আজকাল বৃষ্টি দেখলে ছেলেটার জন্য মন কাদে……এমন কতো বৃষ্টিতে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেদেছি……. যতই হোক নাড়ি ছেড়া ধন তো…. শত ভুলের পর ও মায়া কাটাতে পারি না……এসব কথা ভাবতে ভাবতেই বারান্দার আবছা আলোতে এসে বেঞ্চে বসে ঝাপসা দৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখতে লাগলাম….. বৃষ্টির জলে পা ভেজালাম তার পরিয়ে দেওয়া নূপুর এখনো আমার পায়ে…… এই নূপুর আর বাজে না…..সুতোয় ক্ষ্য়ে যাওয়া অংশ জোড়ে দিয়েছি খানে খানে…….. মানুষ টা আমায় বড্ড পুড়ায়…….বারবার কষ্টের জ্বালা সইতে না পেরে শুরু থেকে ভাবি…… বারংবার ভাবি…… আমার জীবনের এক পশলা বৃষ্টি…. হ্যাঁ….. এক পশলা বৃষ্টি আর সে❤

,
,
,
‌,

~~~~~~~~~~~~♥সমাপ্ত ♥~~~~~~~~~