Monday, August 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1991



ভালোবাসার রাত পর্ব ৪

0

# ভালোবাসার-রাত

#রোকসানা

পর্ব (৪)

সেই ছোটবেলার একি কান্ড কি আজকেও ঘটতে যাচ্ছে তার সাথে? তিল রিদের হাতের ব্লেডের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখগুলো কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে,মাথাটাও ভার ভার হয়ে আসছে। তিল রিদের দিকে তাকাতেই চারপাশে অন্ধকার হয়ে আসছে দেখতে পেলো। সবকিছু এমন অন্ধকার হয়ে আসছে কেন? বিদ্যুৎ চলে গেলো??? তিল আর কিছু ভাবতে পারলো না। কাপতে কাপতে রিদের বুকে ঢলে পড়লো

মাঝরাতেই তিল হালকা জাগনা পেলো। চোখ মেলতেই পুরো রুম অন্ধকার! চোখটা আবার বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলো কি হয়েছিলো তার সাথে। হঠাৎই মাথায় হাত চলে গেলো। দুহাত দিয়ে হাতরিয়ে নিজের মাথায় চুলের স্পর্শ নিয়ে নিজের মনটাকে শান্ত করার কাজে লেগে পড়লো। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে লাইটটা জ্বালিয়ে নিলো। আয়নার সামনে দাড়িয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে নিজের চুলগুলো দেখছে। চুল তো যেমন ছিলো তেমনি তাহলে কি আমি ঘুমের ঘোরে সব স্বপ্ন দেখছিলাম?? কিন্তু মন তো বলছে স্বপ্ন নয়। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো ৩ টা বেজে ৩৬। মধ্যরাত হয়ে গেছে। যদি সেরকম কিছুই হয়ে থাকে রিদ ভাইয়া যেমন রাগী মানুষ আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা না। তিল নিচের ঠোটটা কামড়াতে কামড়াতে পুরো রুমে চোখ বুলালো। হঠাৎই বিছানার কাছটাতে লাইটের আলোতে কিছু ঝিলিক দিতে দেখতে পেলো। তিল একটু এগিয়ে ওটা উঠাতেই বুঝতে পারলো সে কোনো স্বপ্ন দেখেনি। তাহলে উনি কিছু করলেননা কেন?? আর আমি বিছানায় কিভাবে গেলাম? আমার গায়ে তো চাদরটাও টানা ছিলো! তিলের মাথায় কিছুই ঢুকছেনা। বার বার ব্রেনে চাপ দিয়েও কি হয়েছিলো তা বের করতে পারলোনা। বিরক্ত নিয়ে বিছানায় পুনরায় শোয়ার ব্যবস্থা করতেই মনটা বলে উঠলো,তিল তোর রিদ ভাইয়া তো এখন গভীর ঘুমে,মন ভরে একটু দেখে নিবিনা? তুই কি তার ঘুমন্ত চেহারা দেখার সুযোগটাকে পায়ে মাড়িয়ে দিবি???

তিল রিদের দরজাটা শব্দহীনভাবেই খুলার চেষ্টা করলো। কিন্তু এই নির্জনতায় শব্দকে মেরে ফেলা অসম্ভব। তবুও যতটা পারলো নিঃশদেই রিদের রুমে ঢুকে পড়লো। এই জৈষ্ঠ্যমাসেও উনি এমন কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুৃাচ্ছেন কেন?? মুখটাও কেমন ঢেকে ঘুমাচ্ছেন! উনার কি নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছেনা? শরীরটা কি ঘেমে নেয়ে উঠছেনা? নাকি উনার নিশ্বাসের প্রয়োজন নেই?? ঠান্ডা গরমের কোনো অনুভূতি নেই? তিলের ইচ্ছে হলো রিদের হয়ে সে কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে দিক। ইশ! উনি হয় তো নিশ্বাস নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন তাই এখন নিশ্বাস ছাড়া কিভাবে থাকতে হয় সেই গবেষনায় ব্যস্ত!

তিলের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। জাগনা অবস্থায় তো আমাকে শাস্তি দিয়েই কুল পাননা একটু ঘুমের ঘোরে দেখতে চাইলাম সেটাও দিলেননা। আপনার শাস্তির ঝুড়ি কি কোনোদিন শেষ হবেনা? ওটা থেকে একমুঠো ভালোবাসা আমাকে দিবেননা? আমি যে আপনার ভালোবাসা না পেয়ে কাঙাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেননা??

তিল দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে উল্টো ঘুরে হাটা ধরতেই রিদ বলে উঠলো,

“” পা টা টিপে দেতো। তোর চুল মুঠো করে ধরতে গিয়ে আমার সব শক্তি খরচ হয়ে গেছে। আর পাটাও ব্যথা করছে।””

রিদের কন্ঠ শুনে তিল ঝপ করে আবার পিছনে ঘুরে দাড়ালো। কিন্তু উনিতো সেই আগের মতোই মুখ ঢেকে শুয়ে আছে তাহলে কথা বলছে কে? আমি কি ভুল শুনলাম?

তিলের ভাবনার মাঝে হামি পেয়ে গেলো। মুখটা হা করতেই রিদ আবার বলে উঠলো,

“” এতো বড় করে কেউ হামি দেয়? মনে তো হচ্ছে তুই আস্ত গরুর মাথা খাওয়ার জন্য হা করছিস এখনো হামি দেওয়াও শিখলিনা? আর এখনো ওখানেই দাড়িয়ে আছিস কেন? বললাম না পা টিপে দিতে?””

তিল মুখটা কালো করে রিদের পায়ের কাছে এগিয়ে যেতেই রিদ কম্বলের তলা থেকে একটা পা বের করে দিলো।

উজ্জ্বল শ্যামলা পায়ের মধ্যে ছোট ছোট কালো পশমগুলোকে তিলের কাছে পাতাহীন গাছের ছোট ছোট ঝোপ মনে হলো। যে ঝোপের মধ্যে কোনো পোকা মাকর নেই। কিন্তু কেন নেই? দু একটা পোকামাকড় থাকলেই বোধহয় আরো সুন্দর লাগতো!
রিদের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিলের পুনরায় হামি পেলো।

“” তুই একরাতে কয়বার ঘুৃমাবি বলতো? মাত্রই তো ঘুম থেকে উঠে এলি তাও এতো হামি আসছে কেন? আমার তো মনে হচ্ছে তোর জন্য ২৪ ঘন্টায় ১ দিন ২ রাত হওয়া দরকার ছিলো!””

তিল হাতদুটো নিজের জামায় হালকা করে মুছে নিয়ে রিদের পায়ে হাত দিতেই মনে হলো গরম পানির ছেকা খেয়েছে। হাত পুরে যাওয়ার ভয়ে হাতটা সরিয়ে নিতেই রিদ বলে উঠলো,

“” কিরে,তুই কি চাস না আমি ঘুমাই?””
“” আপনাল পা এতো গলম কেন?””
“” আমার পা গরম না ঠান্ডা সেটা তোকে ব্যখ্যা করে বুঝাতে হবে?? তোকে সামান্য পা টিপে দিতে বললাম বলে এখন আমার খাতা কলম নিয়ে লিখালিখি করতে হবে?””

রিদ যে আবার রেগে যাচ্ছে বুঝতে বাকি রইলোনা তিলের। ওতো চায়না তার রিদ ভাইয়া তার উপর রাগ করুক তাই চুপচাপ পা টিপায় মন দিলো।

“” আমার পায়ের নিচের চাদরটা তোল,দেখ নিচে একটা কাগজ ভাজ করা আছে। ওটা খুলে পড়তো!””

রিদের কথা মতো তিল কাগজটা বের করে মেলে ধরলো চোখের সামনে।

“” কি হলো পড়ছিস না কেন?””

তিল কাগজটাতে চোখ বুলিয়ে পড়লো,

“” প্রিয়,ঝলমলে কালাকেশী।””
“” কালা কেশী পড়ছিস নাকি মালাকেশি কিছুইতো বুঝতে পারছিনা। কাকা কাকি কি তোকে শাকসবজি খাওয়ায় না? তোর চেয়ে তো কাকরাও ভালো করে কা কা করতে পারে।এখন কি তোর কথা শুনার জন্য তোর মুখের সামনে মাইক ধরতে হবে? আমাকে তোর মাইকম্যান মনে হয়? তোর মাইক ম্যান হওয়ার জন্যই তো ইউকে তে বসে মোটা মোটা ইংলিশ বই পড়েছি তাইনা,তিল? আমার কানের কাছে এসে পড়।””

তিল রিদের পায়ের দিক থেকে এসে মুখের কাছটাতে আসতেই রিদ বলে উঠলো,

“” ওভাবে দাড়িয়ে আছিস কেন? পড়ে তো কাল আব্বুকে বলবি আমার জন্য দাড়িয়ে থাকতে থাকতে তোর কোমড় ব্যথা হয়ে গেছে,পিঠের মেরুদন্ড বাকা হয়ে গেছে। নালিশ দেওয়ার জন্য তো তুই দু পা তুলে দাড়িয়ে থাকিস।””

রিদ নিজের কথা শেষ করতে করতে তিলকে টান দিয়ে নিজের বালিশের পাশে বসিয়ে দিলো।

মুখের থেকে কম্বলটা সরিয়ে বললো,

“”নে এবার পড়।””

“” প্রিয় ঝলমলে কালাকেশী!

তুমি কেমন আছো? আমি কিন্তু ভালো নেই তোমার পেটে হাত দেওয়ায় তুমি যে চিৎকার দিয়েছিলে সেটা আমার কান ফুটো করে বের হয়ে গিয়েছে। ফলে আমি এখন তোমার সেই চিৎকার ছাড়া আমার এই কান আর কিছু শুনবেনা বলে ওয়াদাবদ্দ হয়েছে।
তোমার সাথে আমার পরপর দুবার দেখা হয়েছে কিন্তু একবারও তোমার নাম জানা হয়নি। রিদের কাছ থেকে শুনলাম তোমার নাম নাকি তিল। তোমার নাম শুনে আমি বেশ আশ্চর্য হয়েছিলাম। আরেকটু গবেষনা করতেই বুঝতে পারলাম তোমার শরীরে লেগে থাকা অসংখ্য কালো বৃত্তের চিন্হের প্রতীক হিসেবেই তোমাকে সবাই তিল বলে ডাকে। তোমার ভালো নাম তিয়ামতী। আমার এই দুটো নামই ভালো লেগেছে। তবে কেন জানি তোমার নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছে করেনা। কেন করেনা তাতো জানিনা। তুমি প্লিজ আমাকে জানিয়ে দিও।””

“” এতো মন দিয়ে পড়ছিস যেন এই প্রথম লাভলেটার পেলি। লাভলেটার বললে ভুল হবে যেন রাষ্ট্রপতির হাত থেকে শুভেচ্ছাবার্তা পেলি। কাগজটা উল্টিয়ে নিচের দিকে কয়েকটা লাইন আছে ঐটা পড়।””

রিদের কথামতো তিল অসংখ্য ক্ষুর ক্ষুদ্র লাইনকে অবহেলা করে পেজটা উল্টিয়ে নিচের প্যারা পড়তে লাগলো,

“” আমি কালই আমার বাবা মাকে নিয়ে তোমার বাবা,মায়ের সাথে দেখা করিয়ে সব পাকাপাকি করবো। তোমার মত থাকলে কালই কবুল বলে কাবিন করে ফেলবো। তোমার ঐ ঠোটের কোনের তিলটা ছুতে না পেরে আমার হাতটা অবশ হয়ে গেছে। আর সাথে সাথে আমার রিদয়টাও। এভাবে আর একদিন কাটালে আমার রিদকম্পন অফ হয়ে যাবে! আর আমি কম্পহীন রিদয় নিয়ে মারা যাবো।

তুমি কি আমার দ্বিতীয় জীবনটা দান করবে?

ইতি তোমার সিজজজজজ..””

তিল নামটা পড়ার আগেই রিদ কম্বলটাসহ তিলকে বিছানার সাথে চেপে ধরলো।

“” তোর ঠোটের দাগটা দেখি মিলিয়ে গেছে। দাগ ভেনিশ করার মলম লাগিয়েছিলি নাকি???””

তিল রিদের দিকে তাকাতে তাকাতে আবার সেই পুরোনো স্মৃতিতে চলে গেলো।

সেইদিন কাকিমার ঘরে ঘটে যাওয়া ঘটনায় পুরোবাড়ির মানুষের মাথা নাড়িয়ে দিয়েছিলো রিদ।

“” ভাইজান রিদ ছোট মানুষ,ভুল মানুষের পাল্লায় পড়ে হয়তো এমন করে ফেলেছে। কতই বা বয়স? ১৬ বছরের ছেলে এসবের কি বুঝে বলো? ওকে বুঝিয়ে বললে ও সব বুঝতে পারবে!””
“”রহমত,সব অন্যায় ছেড়ে দেওয়া যায় না। আজ হয়তো তিল ছোট। তাই রিদ ওর সাথে কি করতে চেয়েছে ও বুঝতে পারেনি। কিন্তু যখন ও বুঝবে? ওর সামনে আমি কি করে যাবো? আর তাছাড়া রিদ আমার ছেলে। ওকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় আমার জানা আছে।””
“”তাই বলে এইটুকু ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে দিবে? ভাইজান এতো বড় শাস্তি তুমি ওকে দিওনা। আমি নাহয় তিল আর ওর মাকে নিয়ে অন্য কোথাও…””

রহমত আলীর কথায় নিজেরই বড় ভাই গর্জে ওঠে।

“” এ বাড়িতে কে থাকবে কে থাকবেনা সেটা ঠিক করার দায়িত্ব বাবা আমাকে দিয়ে গেছেন। তুই যদি বাবার আদেশের অবাধ্য হতে চাস তাহলে যা চলে যা। বাবার ভিটেতে থাকার কোনো যোগ্যতাই নেই,তোর!””
“” ভাইজান,আমি রিদের ভা….””
“” যে নিজের কাকার মেয়ে তাও একটা বাচ্চা মেয়ের দিকে খারাপ নজরে তাকাতে পারে তার এর চেয়েও ভয়ানক শাস্তি পাওয়ার দরকার ছিলো!””

তিল নিজেদের দরজার আড়াল থেকে রিদের চলে যাওয়া দেখছিলো। রিদ কাধে ব্যাগ নিয়ে বাবার হাত ধরেই তিলের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। ভয়ে তিল দরজার আড়ালে চলে গেলো। কিন্তু হঠাৎই তুফানের গতিতে নিজের বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে তিলের কাছে দৌড়ে এসে ওর ঠোট কামড়ে ধরে।

“” তোর কি মনে হয়েছিলো আমার নামে নালিশ করেছিলি তাই তোকে কামড়ে দিয়েছিলাম?””

রিদের প্রশ্নে তিল অতীত থেকে ছুটে বের হয়ে রিদের দিকে তাকালো।

রিদ নিজের ডান হাতের বৃদ্ধা আংগুলটি দিয়ে তিলের ঠোটের বা পাশেই ঘেসে থাকা লাল তিলটাই ছুতে ছুতে বললো,

“” এইটা যাতে আমি ছাড়া কেউ দেখতে না পারে,কেউ ছুতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু…””

রিদের শীতলচোখদুটো আবার অগ্নিনালার মতো জেগে উঠলো,

তি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো,

“” আপনাকে খুব ভয়ংকল লাগছে লিদ ভাইয়া। আমি লুমে যাবো।””
“” কেন,আমার রুমে থাকতে তোর বুঝি কষ্ট হচ্ছে??””
“” লিদ ভাইয়া প্লিজজজজজ….””

তিলকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই রিদ ওর ঠোট কামড়ে ধরলো। ব্যথায় তিল ছটফট করতে লাগলো। তাতে রিদের প্রতিক্রিয়া আরো বেকে বসলো। তিলকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে,ওর ঠোট থেকে বের হওয়া রক্ত চুষে নিচ্ছে রিদ!

চলবে

ভালোবাসার রাত পর্ব ৩

0

#ভালোবাসার-রাত

#রোকসানা

পর্ব (৩)

ঘুমের ঘোরেই তিলের মনে হলো কেউ তার উপর উঠে আসছে। তার পড়নের জামাটায় কেউ হাত দিয়ে পেটের দিক থেকে জামাটা সরাচ্ছে। তিল ঝট করে চোখ খুলতেই মাথাভর্তি ঝাঝড়া চুল দেখতে পেলো। মাথাটা আসতে আসতে নিচের দিকে যাচ্ছে। তীলকে অবাক করে দিয়ে তিলের পেটের ডানপাশটাতে কামড় বসিয়ে দিলো৷ তীল চিৎকার করতে নিলেই ওর মুখটা চেপে ধরে এক জোড়া চোখ তার দিকে চেয়ে রইলো,

“” আমি শাড়ী পরাতে গেলেই তোর কান্না পায়,ব্যথা লাগে,সুড়সুড়ি লাগে। আর এখন নিজে পেট বের করে শাড়ী পড়ে ছেলেদের পাগল করে বেড়াচ্ছিস? তাও আমাদের বাড়িতে আমারি ফ্রেন্ডের? এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে তিল!””

ব্যথায় তিলের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে কানে গিয়ে ঠেকছে। মুখ থেকে হাতটা সরে যেতেই তিল চাপা স্বরে বলে উঠে,

“” লিদ ভাইয়া??””
“” তুই এখনো ‘র’ বলা শিখিসনি??””

রিদের প্রশ্নের শেষে প্রশ্নবোধক চিন্হ হিসেবে ওর চাহনি কাজ করলো। তিল সেই প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা।

“” নাকি ইচ্ছে করেই আমার নামকে অপমান করছিস?””

রিদের মুখের চোয়ালের সাথে সাথে হাতটাও শক্ত করে চেপে ধরলো তিলের গালদুটো।

“” গালে কি মেখেছিলি? বালুর মতো চিকচিক করছিলো! আর আর ঠোটে কি দিয়েছিলি? গোবর মেখেছিলি নাকি? তোর কি মনে হয় এইসব আবিজাবি মাখলেই ছেলেরা তোর জন্য পাগল হয়ে যাবে?? গাদার মতো তোর পিছে ঘুরঘুর করবে?””

রিদ এমনভাবেই গালদুটো চেপে ধরেছে যে তিল কথা বলার জন্য ঠোটদুটোও এক করতে পারছেনা। অনেক কষ্টে ঠোট না নাড়িয়ে বলতে চাইলো,

“” লিমা জোল কল….””
“” চুপ! তোর ঐ তুতলানো কন্ঠ নিয়ে একটা কথাও বলবিনা। এখন পর্যন্ত ‘র’ বলাই শিখলিনা,তোর সাথে কথা বলা মানেই আমার মেজাজ আরো খারাপ করা।””

রিদ তিলের উপর থেকে হালকা সরে আসতেই তিল উঠে বসে পড়ে। নিজের জামাটা ঠিক করতে নিলেই রিদ আবার ওর পেটটা খামচে ধরলো। রিদের কামড়ের জায়গায় পুনরায় খামচে ধরায় ব্যথায় হালকা কুকিয়ে উঠলো তিল। নিজের একটা হাত রিদের হাতের উপর চেপে ধরতেই রিদ বলে উঠলো,

“” সিগরেট খেয়েছিস কখনো?””

রিদের প্রশ্নে তিল মাথা নাড়িয়ে না বলতেই রিদ নিজের খামচিটা আরেকটু গভীর করে বললো,

“” এইবার তো দাত বসিয়েছি, নেক্সটটাইম এতো কষ্ট করবোনা। জ্বলন্ত সিগারেট লাগিয়ে দিবো!””

রিদ তার কথা শেষ করেই সেখান থেকে প্রস্থান করলো। তিল তার রিদ ভাইয়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। উফ! আপনি দেখতে কি সুন্দর হয়েছেন রিদ ভাইয়া! এইটুকুন দেখায় তো আমার চোখের জ্বালা বাড়িয়ে দিয়েছেন। আপনার কামড়ের ব্যথার থেকে শতগুন বেশি ব্যথা করছে চোখে। আপনাকে এতোবছর দেখতে না পারার ব্যথা! এভাবে চলে গেলেন কেন?

তিল সারারাত চোখ বন্ধ করে রিদের মুখটা বারবার মনে করার চেষ্টা করছে। কি সুন্দর মাথা ভর্তি চুল, গালভর্তি খোচা খোচা দাড়ি,আর নাকটাও কি সুন্দর লম্বা হয়েছে। ছোটবেলা তো এতো লম্বা ছিলোনা এখন এতো লম্বা কি করে হলো???

তিল ঘুম থেকে উঠেই আয়নার সামনে দাড়িয়ে পেটটা বের করে দেখছে। হালকা বেগুনি কালার দাতের আকার ধারন করে আছে। উনার দাতগুলোও নিশ্চয় অনেক সুন্দর নাহলে আমার পেটে এতো সুন্দর দাগ হলো কি করে???

“” তুই নাকি রিমার বৌভাতে যাবিনা?””

বড় আম্মুর কন্ঠ পেয়ে তিল তাড়াতাড়ী জামাটা নামিয়ে পেটটা ঢেকে ফেললো।

“” কে বললো?””
“” রিদ।””
“” রিদ ভাইয়াকে কে বললো?””
“” রিদ তো বললো তুই বলেছিস!””
“” আমি কখন…””

তিল কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। বড় আম্মুর কাছে এসে বললো,

“” বড় আম্মু,আমি এখনো ‘র’ বলা শিখিনি?””
“” মানে?””
“” এই যে আমি রিদ ভাইয়া বললাম তুমি কি রিদ শুনছো নাকি লিদ?””
“” আমি তো রিদই শুনছি তিল। তোর কি হয়েছে বলতো?””
“”আমার আবার কি হবে? কিছু হয়নি তো!””
“” তাহলে বৌভাতে যাবিনা কেন? রিমাকে আনতে যাবিনা?””

তিল ব্রাশে পেস্ট লাগাতে লাগাতে বললো,

“” তোমার ছেলে যখন বলেছে আমি যাবোনা তাহলে তোমার ছেলেকেই জিজ্ঞেস করো আমি কেন যাবোনা!””
“” তুই কি বলছিস আমি তো কিছুই বুঝছি না।””

তীল ব্রাশটা মুখে নিয়ে বললো,

“” আমিও বুঝতেছিনা,বড় আম্মু!””
“” তুই আবার কি বুঝছিস না?””
“” ঐটাই তো জানিনা!””

তিল ওয়াশরুমের দরজাটা আটকিয়ে মনের সুখে দাত ব্রাশ করতে লাগলো।

~~
নাস্তার টেবিলে বসতেই বড় আব্বুর প্রশ্নের মুখোমুখি হলো তিল,

“” তোর নাকি শরীর খারাপ? পেটে ব্যথা,মাথা ব্যথা?””
“” কে বললো,বড় আব্বু?””
“” রিদ বলেছে। কাল রাতে নাকি তুই ওর কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে খেয়েছিস??””

তিলের সামনা সামনি বসে রয়েছে রিদ। বড় আব্বুর থেকে চোখটা সরিয়ে রিদের দিকে নিলো। এমন একটা ভাব যেন সে কিছুই জানেনা। এতো বড় মিথ্যা উনি কিভাবে বললো? আমি কখন উনার থেকে ওষুধ চায়লাম? উল্টা উনিই তো,,,

“” কিরে,চুপ করে গেলি যে? তোর কি খুব বেশি শরীর খারাপ? রিমা তো তোর জন্য বসে অপেক্ষা করে আছে। ও জানালো তুই না গেলে ও আসবেইনা।””
“” এটাও কি রিদ ভাইয়া বলেছে?””
“” রিদ বলতে যাবে কেন? রিমা একটু আগে ফোন করে বললো।””
“” ওহ!””

রিদের মানা আর রিমার অভিমানের মাঝে পড়ে তিলের নাজেহাল হওয়ার অবস্থা। সে একটা মানুষ হয়ে দুজনের কথা কিভাবে রাখবে? আর রিদ ভাইয়ারই বা কি হলো হঠাৎ সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে কেন আমি যাবোনা? আমি তো উনাকে এ কথা বলিনি। তাহলে?? এদিকে বড় আব্বু,বড় আম্মু একটু পরপর তাড়া দিচ্ছে রেডি হওয়ার জন্য। আর আম্মু তো পারলে আমাকে এভাবেই কোলে নিয়ে চলে যায়।

“” আব্বু তুমিও পেছনে বসছো তাহলে সামনে কে বসবে?””
“” তিল,আসতেছে। ওকে বসাবি।””
“” তিলও যাবে নাকি?””

রিদের বাবার উত্তর দেওয়ার আগেই তিল গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসলো। রিদ তিলের দিকে না তাকিয়েই গাড়ীতে বসে পড়লো।

রিদের দিকে তাকিয়ে তিলের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসলো। এবার তো আমি পেট বের করে শাড়ী পড়িনি,ঠোটে লিপস্টিক দেইনি,গালে পাউডার মাখিনি,চোখে কাজল দেইনি তবুও কেন উনার মুখে রাগ দেখতে পাচ্ছি? শুধু উনার কথা শুনলেই হবে আমার তো এ বাসার সবার কথাই রাখতে হয়। উনি এমন কেন? আসার পর থেকে মুখটাকে এমন করে রেখেছে। মুখটাতে কি একটু হাসি আনা যায় না???

~~
“” কিরে,কি ভাবছিস?””

রিমার কথাই তিল নড়ে চড়ে উঠে,

“” ঐ আমি কি তোকে মাথায় করে নিয়ে যাবো যে আমি না আসলে তুই যাবিনা?””
“” নিতে পারলে তো ভালোই হতো। তোকে খুব মিস করছিলাম তো।””
“” তোর মিসের খেতা পুরি। বিয়ে করেও আমাকে শান্তি দিলিনা।””

তিলের কথার মাঝখানেই সিজাত তিলের খোলা চুলে একটি গোলাপ এনে গুজে দিলো।

“” আপনার এই খোলা চুলে যাতে কারো নজর না লাগে তাই গোলাপ দিয়ে নজর কাটা দিয়ে দিলাম,কেশবতী।””
“” গোলাপ দিয়ে নজর কাটা?””

সিজাত হালকা লজ্জা নিয়ে বললো,

“” জ্বী,আমিতো ভেবেছিলাম আপনি মেকাপ সুন্দরী। কিন্তু আজ আপনার নেচারাল লুক সেটা মিথ্যে প্রমান করে দিলো। আপনাকে যত দেখছি আমি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। কাল ওভাবে পালালেন কেন? আপনি কি জানেন আপনার সাথে সাথে সে রাতে আমার চোখের ঘুমও পালিয়েছে?””
“” ঘুম পালিয়েছে?””
“” জ্বী। আজকে আপনার দেখা পাওয়ায় দেখুন আমার চোখে ঘুমও চলে আসছে।””

সিজাত রিমার দিকে তাকিয়ে বললো,

“” রিমা আমাকে একটা রুমের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে? জাস্ট ১ ঘন্টার জন্য? আমার ভীষন ঘুম পাচ্ছে।””

রিমা আর তিল হা করে সিজাতের দিকে তাকিয়ে রইলো।

রিমা তিলকে টানতে টানতে নিজের রুম ছেড়ে বের হয়ে আসলো।

“” উফ! এতো জোরে হাত চেপে ধরে আছিস কেন? তোদের কি মনে হয় আমি লোহা দিয়ে বানানো?””
“” তোদের মানে? তোর হাত আমি ছাড়া আর কে চেপে ধরেছে?””

তিল কথার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললো,

“” রিমা দেখতো আমার ‘র টা ঠিক মতো উচ্চারন হয় নাকি?””
“” মানে?””
“” র,র,র,র,র,র,র,র,র,র,র,র,র””

তিল সমানে র বলে যাচ্ছে। যেভাবেই হোক তাকে ‘র’ টা ঠিক মতো উচ্চারন করতেই হবে রিদ ভাইয়াকে দেখিয়ে দিতে হবে সে লিদ না রিদ বলতে পারে। সে তার রিদ ভাইয়ার নামকে অপমাননা বরং ভালোবেসে উচ্চারন করে!

~~
রিমাকে নিয়ে ফেরার সময় রিদের পাশে বসার সাহস হলোনা তিলের। মনে হয়েছে এবার তার পাশে বসলে তাকে চোখ দিয়েই গিলে খাবে। উনার ঐ ছোট ছোট চোখগুলো যখন হা করবে তখন কত বড় হবে???

বাসায় এসেই তিল সবার আগে নিজের গায়ে সেটে যাওয়া গোল্ডেন কালারের জামাটা চেন্জ করায় লেগে গেলো। যেইনা জামাটা দুহাতে ধরে উপরে তুলেছে অমনি দরজা আটকানোর শব্দ পেলো তিল৷ জামাটা ছেড়ে দিয়ে অবাক হয়ে বললো,

“” আপনি?””

রিদ দরজা আটকিয়ে তিলের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,

“” আমি নিষেধ করার পরও তুই রিমার শ্বশুরবাড়ি গেলি কেন?””
“” বল আব্বু…””

তিল বুঝতে পারলো এই মুহুর্তে সে আবার ‘র’ বলা ভুলে গেছে। নিজের মুখটা নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরে অসহায়ভাবে রিদের দিকে তাকিয়ে রইলো।

“” খুব কথা শুনার মেয়ে হয়ে গিয়েছিস না? আমাকে মিথ্যা প্রমান করে দিয়ে ধেই ধেই করে আব্বুর কথা শুনে ভালো মেয়ে সাজছিস?””

তিল কি বলবে বুঝতে পারলোনা এই মুহুর্তে রিদের দিকে তাকিয়ে থাকাও তার জন্য কষ্টকর হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে মাটিতে তাকাতেই রিদের হাত এসে তিলের চুলগুলো মুঠোতে আটকে নিলো।

“” আমি এখন আপনি হয়ে গেছি? আমি তোর অপরিচিত কেউ, না?””
“” আহ! চুলে লাগছে লিদ ভাইয়া।””
“” তোর এই চুল আমি ছিড়ে ফেলবো। জানিস তো চুলের কেজি কত??””
“” লিদ ভাইয়া!””

রিদ পকেট থেকে একটা ব্লেড বের করে তিলের সামনে ধরতেই তিল ভয়ে নড়ে উঠে।

“” লিদ ভাইয়া আমি আল ঝুটি কলবোনা। আমাকে ছেলে দাও,লিদ ভাইয়া।””
“” তুই আমার কথার অবাধ্য হয়ে আজকেও ঝুটি করে স্কুলে গিয়েছিস। আর এটার শাস্তি তোকে পেতেই হবে,তিল।””
“” আল কলবোনা। ছেলে দাওনা,লিদ ভাইয়া!””

তিলের কান্না সেদিন রিদের রাগকে দমাতে পারেনি। শাস্তি স্বরুপ তিলের মাথার কালো ঝলমলে ছোট ছোট চুলগুলো হারিয়ে ফেলেছিলো।

সেই ছোটবেলার একি কান্ড কি আজকেও ঘটতে যাচ্ছে তার সাথে? তিল রিদের হাতের ব্লেডের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখগুলো কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে,মাথাটাও ভার ভার হয়ে আসছে। তিল রিদের দিকে তাকাতেই চারপাশে অন্ধকার হয়ে আসছে দেখতে পেলো। সবকিছু এমন অন্ধকার হয়ে আসছে কেন? বিদ্যুৎ চলে গেলো??? তিল আর কিছু ভাবতে পারলো না। কাপতে কাপতে রিদের বুকে ঢলে পড়লো

চলবে

ভালোবাসার রাত পর্ব ২

0

#ভালোবাসার-রাত

#রোকসানা

পর্ব (২)

ড্রয়িংরুমের সামনে যেতেই তিলের হাত পা কাপতে লাগলো। আল্লাহ এতগুলো ছেলে কোথা থেকে আসলো? এর মধ্যে রিদ ভাইয়া কোনটা? ছোটবেলা আর বড়বেলার চেহারা কি এক হবে?? আমি কি চিনতে পারবো?? ইশ! রিমা আমাকে কতবার উনার ছবি দেখাতে চাইলো আর আমি ফালতু রাগ দেখিয়ে মুখের উপর বলে দিয়েছিলাম,তোর ভাই কি ঘোড়ায়চড়া রাজকুমার যে আমি দেখতে যাবো? তোর ভাই গাদা চড়ার গরুকুমার। আর আমি গরুকুমারদের দেখিনা!

তিল ওড়নার নিচ দিয়ে সবাইকে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। কোনটা তার রিদ ভাইয়া! এদিকে পায়ের সাথে হাতটাও তাল মিলিয়ে কাপছে সাথে চায়ের কাপ টকটক করে শব্দ শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আজ কাপেরা মিলে যুদ্ধ বেধে যাচ্ছে কে আগে ফেটে গিয়ে চা নিচে গড়িয়ে ফেলতে পারে।

তীল কাপদের ঝাকানি নিয়ে এক সাইড থেকে চা বাড়িয়ে দিচ্ছে সবাইকে। হঠাৎই,,

“” এভাবে সঙ সেজে সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করছিস কেন? তোর কি মনে হয় আমি ইউকে থেকে এসেছি তোর মতো কুৎসিত সঙের সার্কাস দেখার জন্য?? আর আড়াইহাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে কি প্রমান করতে চাচ্ছিস,তুই খুব পর্দা করিস? ছেলেদের সামনে আসতে লজ্জা পাস? নাকি নিজেকে খুব রুপবতী ভাবিস যে আমরা দেখলে তোর রুপ খসে খসে নিচে পড়বে???””

রিদের এমন রিদয়ঘাত কথা শুনে তীলের হাত থেকে চায়ের ট্রেটা টুপ করে মেঝেতে পড়ে গেলো। চায়ের কাপগুলো এবার যেন যুদ্ধে জয়ী হয়ে নিজেদেরকে বিসর্জন দিলো। তিলের বুঝতে বাকি রইলোনা এমন ঝাঝালো কথা তাকে কে বলতে পারে। তিলের চোখ নোনা পানিতে তৈ তৈ করছে। কাপা কাপা পা নিয়ে ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে আসে। মাথাটা উচু করে তার রিদ ভাইয়াকে দেখার সাহস হলোনা। চুপচাপ নিজের রুমে চলে আসলো।

বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করছে। যার অনুপস্থিতে বুকের ভেতরে এতো ব্যথা অনুভব হতো তার উপস্থিতে তা যেন দ্বিগুন হারে বেড়ে গেলো। তিলের ইচ্ছে হলো ব্যথার হারটাকে হিসেব করে বের করতে। কি পরিমান ব্যথা হচ্ছে জানতে পারলে তো মন্দ হয়না। কিন্তু হারটা কি স্বাভাবিকভাবেই ধরবো নাকি চক্রবৃদ্ধীতে???? আর রিদ ভাইয়াকে প্রেজেন্ট ভেল্যু ধরবো নাকি ফিউচার ভেল্যু??

~~
“” তোর এতো দেমাক কিসের, তিল? তুই সামান্য শাড়ীর কাছে আমাকে হারিয়ে দিলি?””

তিল নিজের কাপড় গুছানো রেখে রিমার দিকে তাকালো। পুরো শরীরে হলুদের মাঝামাখি। কি অপরুপ লাগছে রিমাকে। কই আগে তো কখনো এতো সুন্দর লাগেনি তাহলে কি বিয়ের ছোয়া রিমাকে এক ঝটকায় সুন্দরী বানিয়ে দিলো? আমার গায়ে হলুদেও বুঝি আমাকে এমনি সুন্দর লাগবে?

“” কি হলো কথা বলছিস না কেন? কাল তো তোদের ছেড়ে চলেই যাবো। তাই বুঝি আজকেই পর করে দিলি? তুই এতো পাষান তিল?? আমার গায়ে হলুদের ছোয়া লাগাতে এলিনা?””
“” তুই তো বলেছিলি শাড়ী না পড়লে তোর সামনে যাওয়া নিষেধ!””
“” আমি রাগ করে বললাম দেখে তুই যাবিনা? এই তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড?? আর আমার জন্য একটু শাড়ী পড়লে কি এমন হতো শুনি?””

তিল কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিমা শাড়ী গুটিয়ে বেড়িয়ে গেলো। বেশ অভিমান করেছে খুব বুঝতে পারছে তিল। কিন্তু তাতে তিলের কষ্ট লাগেনি বরংচ ঠোটে হাসি ফুটে উঠেছে। মনে মনে বিড়বিড় করে বললো,

“” বাব্বাহ,এতো রাগ?””

সে রাতে তিলের ঘুম হলোনা। সে তো তার ব্যথার হার বের করায় বিজি ছিলো। যার উত্তরের ডিজিটগুলো একক,দশক,শতকে মিলিয়ে পড়তে পড়তে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেলো। ভোরের আযান কানে আসতেই তিল ওযু করে নামাজটা পরে নিলো। নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। কেন জানি আজ খোলা আকাশের নিচে মনভরে নিশ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে।

তিল দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে শব্দ করে লম্বা নিশ্বাস নিতেই হালকা কেশে উঠলো। ধুর ছাই! নিশ্বাসটাও ঠিকমতো নিতে শিখলাম না। কিছুটা মুখটা ভেংচি কেটে নিচে নামতেই মনে হলো রিদ ভাইয়ার রুমে একটু উকি দিতে। আচ্ছা উনি কি এখনো ঘুমাচ্ছে? কোন রুমে শুয়েছেন উনি? আবার এমন নয় তো উনার গরুর পাকবাহিনীকে সাথে নিয়ে ঘুমিয়েছে?

তিল এতো ভাবনা ছেড়ে ছোটবেলা রিদ যে রুমে ঘুমাতো সে রুমের কাছাকাছি এসে থেমে গেলো। দরজায় হালকা বল প্রয়োগে নড়ে উঠলো। তারমানে দরজা খুলেই ঘুমিয়েছে। কিন্তু কেন? উনিও কি আমার মতো দরজা আটকিয়ে ঘুমাতে ভয় পান নাকি ইচ্ছে করেই খুলে রেখেছেন?

তিল দরজাটা যেইনা আরেকটু খুলতে যাবে অমনি ভেতর থেকে রিদ বলে উঠে,

“” আমার রুমে রুপ খসিয়ে পড়া মেয়েদের ঢুকা নিষেধ। আর নিষেধ অবজ্ঞা করার শাস্তি কি হতে পারে সেটা জানতে চাইলে ভেতরে আসতে পারে!””

রিদের মুখে শাস্তির কথা শুনেই তিল ভয়ে চোখ বন্ধ করে,সেই ছোটবেলাতে চলে গেলো,

“” এ্যাা,এ্যাা,এ্যাা,আমাল হাতে লাগছে লিদ ভাইয়া। আম্মু! বলো আব্বু,লিদ ভাইয়া আমাকে মালছে। আমাল কষ্ট লাগছেতো,লিদ ভাইয়া!

রিদ বাশের সবুজ,চিকন কুন্চিটা আরোশক্ত করে চেপে ধরে তীলের হাতে লাগাতার বাড়ি মেরে যাচ্ছে,

“” তোকে মানা করেছিলাম রবিনের সাথে খেলবিনা? তোর এতো বড় সাহস আমার নিষেধ অবজ্ঞা করলি? ওর পুতুলের সাথে তোর পুতুলের বিয়ে?? আজ মেরে তোর হাত দিয়ে রক্ত বের করে ফেলবো আর সেই রক্ত দিয়ে তোর পুতুলকে রাঙিয়ে বউ সাজাবো। দেখি কত বিয়ে দিতে পারিস।””

তিল সাথে সাথে চোখ খুলে ফেললো,রিদের রুমের দরজাটা ঝট করে টেনে দিয়ে নিজের হাতটা সরিয়ে ফেলে। চোখের সামনে ডানহাতটা মেলে ধরতেই মনে হলো হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে! আজ এতো বছরও কি এই রক্ত পড়া বন্ধ হবেনা???

~~
“” রিমা,তুই নাকি আমাকে ডেকেছিস?””

রিমার চোখে মেকাপ আর্টিস্ট কাজল লাগিয়ে দিচ্ছে তাই তিলের দিকে তাকাতে পারলোনা। চোখদুটো বড়বড় করে একটু বাকিয়ে উপরের দিকে তাকিয়েই বললো,

“” তোর নাকি জামাই মরে গেছে?””
“” মানে??””

রিমা কাজল দেওয়া শেষ করে তিলের কাছে এগিয়ে এসে বললো,

“”আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে জামাইকে মেরে ফেললি?””
“” এসব কি উল্টাপাটা বলছিস রিমা?””

রিমা তিলকে টেনে নিজে যেখানে বসে বউ সাজছিলো সেখানে বসিয়ে দিলো। আয়নায় তিলের চোখে চোখ রেখে বললো,

“” তোকে দেখেতো সেরকমই লাগছে তিল! তোর বেস্টফ্রেন্ডের বিয়ে,কোথায় তুই সেজেগুজে বাড়ি মাতিয়ে রাখবি তা না বিধবা মেয়ের মতো ঘুরঘুর করছিস! আমি চলে গেলে আমার মায়ের মুখটাতে হাসি ধরে রাখার দায়িত্বটা তো তোরই। এমনভাবে মনমরা হয়ে আছিস,যেন সবার কষ্ট তুই একা ভোগ করার দায়িত্ব নিয়েছিস!””

রিমা মেকাপ আর্টিস্টদের চোখের ইশারা দিতেই সবাই এতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো তিলের উপর। গলার ওড়নাটায় হাত দিতেই চিৎকার করে উঠে,

“” আরে কি করছেন আপনারা?””

রিমা সবাইকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে নিজে তিলের সামনে এসে ওড়নাটা খুলতে খুলতে বললো,

“”তোর এই গোলাপি ঠোট,মায়া চোখ,গোলাপী গাল গুলোকে ঢাকলে তোকে কেমন দেখা যায় সেটা দেখবো। মনে কর এটা আমার তোর কাছে চাওয়া আমার বিয়ের সেরা গিফট।””

রিমা কি বুঝাতে চাচ্ছে বুঝার জন্য ফেলফেল করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তিল। যেন ওর মুখের দিকে এভাবে কিছুক্ষন তাকালেই সব বুঝতে পারবে!

“” যা,এই জামাটা ছেড়ে ব্লাউজ আর পেডিকোটটা পড়ে আয়।””

তিল কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিমা বলে উঠে,

“” মুখ দিয়ে আর একটা শব্দ বের হলে আমার মুখ দিয়ে কবুল বের হবেনা। আর তুই জানিস আমি যা বলি তা করেই ছাড়ি!””

তিল অসহায়ের মতো মুখ করে রিমার হাত থেকে ব্লাউজ আর পেডিকোটটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।

“” এই মেয়ে তোমাকে আমার তিল মায়ের মতো লাগছে! নাম কি গো তোমার?””

তাসমিয়া বেগমের এমন আচরনে তিলের ইচ্ছে হলো আবার যদি মায়ের পেটে ঢুকা যেতো! কি লজ্জা,কি লজ্জা!! নিজের মা, নিজের মেয়েকে চিনতে পারছেনা,আমি কি এমনি অভাগী মেয়ে??? আচ্ছা এটা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিলে কেমন হবে? নিশ্চয় হাজার হাজার হা হা রিয়েক্ট আসবে। এমন ও তো হতে পারে এই একটা পোস্ট আমাকে ভাইরাল করে দিলো???

শাড়ী পড়ে বের হওয়ার পর থেকে তিলের মনে হচ্ছে কেউ তাকে খুব কাছ থেকে দেখছে। এমনভাবেই দেখছে মনে হচ্ছে তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। তিল বার বার চারপাশে চোখ বুলিয়েও সেরকম চোখের দেখা পেলোনা। কিন্তু হঠাৎ এমন মনে হওয়ার কারন কী?? তিল পুরো বাড়ী ঘুরে চষে বেড়িয়েও রিদ ভাইয়ার দেখা পাচ্ছে না হঠাৎ এমন নাই হয়ে গেলো কিভাবে? গেলেন কোথায় উনি? রিদকে না পেয়ে চোখগুলো যেমন তাকে খোচাচ্ছে তার চেয়ে দ্বিগুন খোচাচ্ছে তার পড়নের শাড়ী। মাঝে মাঝেই কুচিতে পা লেগে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। এদিকে মনে হচ্ছে শাড়ীর নীচ দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। খুবই বাজে ফিল হচ্ছে। মাঝে মাঝে তো এমন লাগছে মনে হচ্ছে আমি কোনো জামাই পড়িনি। কি অদ্ভুত ফিলিং রে বাবা!

তীল এতোকিছুকে পা মাড়িয়ে রিদকেই খুজে যাচ্ছে। এতক্ষন পর্যন্ত তাকে যে দেখেছে সেই বলেছে তাকে খুবই সুন্দর লাগছে। আর এই সুন্দরটা তার রিদ ভাইয়া না দেখলেতো সব বৃথততততততা,

কিছু একটার সাথে পা লেগে ধপাস করে তিল পড়ে যেতে নিলে একটা ছেলে এসে ধরে ফেলে,

তিল চোখ,মুখ,কুচকিয়ে একদিকে হেলে আছে। ছেলেটার হাত বাধা হিসেবে কাজ করায় তিল মাঝ পথেই আটকে আছে এখনো মাটিতে পড়েনি।

“” ওয়াও,চোখ জুরিয়ে গেলো। হোয়াটস ইউর নেম প্রিটি গার্ল?””

তিল চোখ মেলে তাকাতেই ছেলেটি বলে উঠলো,

“” আমি সিজাত,ইউ কেন কল মি সিজ!””

তিল ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকাতেই মনে হলো তার পেটের ডানপাশটাতে কিছু একটা চেপে বসে আছে। তিল নিজের হাত দিয়ে ওখানটাই হাত দিতেই বুঝতে পারলো ওটা অন্য কিছুনা এই বেটা সিজারের হাত। তিল আবার চোখ মুখ কুচকিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে বললো,

“” সিজার,হাত সরান!””

~~
রিমাকে বিদায় দিয়ে বড় আব্বু,বড় আম্মুকে সামলিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে মাঝরাত হয়ে গেলো। তিল বড্ড ক্লান্ত হয়ে যাওয়া শরীরটা বিছানায় মেলে দিলো। রিমার জন্য মনটা বারবার কেদে উঠছে। ভাবতেই বুক ফেটে যাচ্ছে এখন থেকে তাকে একাই চলতে হবে,একা একাই সব কিছু করতে হবে। এই পুরো পরিবারটার খেয়ালও তাকে একাই রাখতে হবে। ভাবতেই বুকের ভেতর বড় পাথরের চাপ অনুভব হলো। এতোকিছুর ভেতরেও ক্লান্ত শরীরকে ঠান্ডা করতে চোখে ঘুম নেমে আসলো তিলের।

ঘুমের ঘোরেই তিলের মনে হলো কেউ তার উপর উঠে আসছে। তার পড়নের জামাটায় কেউ হাত দিয়ে পেটের দিক থেকে জামাটা সরাচ্ছে। তিল ঝট করে চোখ খুলতেই মাথাভর্তি ঝাঝড়া চুল দেখতে পেলো। মাথাটা আসতে আসতে নিচের দিকে যাচ্ছে। তিলকে অবাক করে দিয়ে তিলের পেটের ডানপাশটাতে কামড় বসিয়ে দিলো৷ তিল চিৎকার করতে নিলেই ওর মুখটা চেপে ধরে এক জোড়া চোখ তার দিকে চেয়ে রইলো,

“” আমি শাড়ী পরাতে গেলেই তোর কান্না পায়,ব্যথা লাগে,সুড়সুড়ি লাগে। আর এখন নিজে পেট বের করে শাড়ী পড়ে ছেলেদের পাগল করে বেড়াচ্ছিস? তাও আমাদের বাড়িতে আমারি ফ্রেন্ডের? এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে তিল!””

ব্যথায় তিলের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে কানে গিয়ে ঠেকছে। মুখ থেকে হাতটা সরে যেতেই তিল চাপা স্বরে বলে উঠে,

“” লিদ ভাইয়া??””
“” তুই এখনো ‘র’ বলা শিখিসনি??””

চলবে

ভালোবাসার রাত পর্ব ১

0

#ভালোবাসার-রাত

#রোকসানা

পর্ব (১)

তিলকে পাজাকোলে করে চোখের সামনেই কাকিমার রুমে ঢুকে পড়লো রিদ। অস্থিরতায় চারপাশটা চোখ বুলিয়ে দরজায় সিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে তিলের জামা টেনে খুলার চেষ্টা করছে। জামা খুলতে না পারায় এক পর্যায়ে টান দিয়ে ছিড়তে থাকে। রিদের হাতের আচরে ভ্যা ভ্যা করে কেদে উঠে তিল। চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছে আর নাকি নাকি কন্ঠে চিৎকার করে বলছে,

“” লিদ ভাইয়া,আমাল লাগছে। ছালো আমাকে। আমাল পুতুলের তো আজকে বিয়ে। ছালো আমাকে। আমার নতুন লাল জামাটা ছিলে ফেলছো কেন? আম্মু আমাকে মালবে,লিদ ভাইয়া,ছালো!””

তিলের কথা রিদের কানে যাচ্ছেইনা। সে তিলের দিকে তাকিয়ে আরো অস্থির হয়ে টান দিয়ে ছিড়ে পুরো জামাটা ফ্লোরে ছুড়ে ফেললো। নিজের গেন্জির ভেতরে প্যান্টের সাথে আটকে থাকা শাড়ীটা বের করে তিলের সামনে মেলে ধরলো। ওর লাল ফ্রকটার সাথে মেচিং করা লাল কুচি দেওয়া শর্ট প্যান্টের কোমড়ের রাবারটার ভেতর দিয়ে শাড়ী গুজতে গুজতে বললো,

“” ক্লাস ফ্লোরে পড়িস এখনো ‘ র’ উচ্চারন করতে পারিসনা? রিদ থেকে লিদ? আমার নামের অপমান করিস তুই? আর আমি তোর কাছে আসলেই তোর কান্না পায়?ব্যথা লাগে? আমাকে দেখলেই তোর চোখে সমুদ্র তৈরী হয়ে যায়? চুপ আর একবার চিৎকার করলে এই শাড়ীটা তোর কোমড়ে না পেচিয়ে গলায় পেচিয়ে ধরবো।””

তিলের কান্নার গতি কমার বদলে আরো বেড়ে গেলো। গলার শব্দ আরেকটু চিকন করে চিৎকার করে বলতে লাগলো,

“” আমাল নতুন জামা,আমাল পুতুল বউ। আমাল সুলসুলি লাগছে,লিদ ভাইয়া ছালো আমাকে!””

রিদ রক্তচক্ষুতে তাকালো তিলের দিকে। ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলো। নিমেষেই অসহায় ভঙ্গিতে শাড়ীর কুচিটা দিতে দিতে বললো,

“” এভাবে কাদিস না,তিল। আমি শুধু দেখতে চাই শাড়ী পড়লে তোকে কেমন লাগে। আমাকে একটু শাড়ীটা পড়াতে দে। তোর কান্না আমাকে খুব জ্বালাচ্ছে। শাড়িতে তোকে দেখতে কেমন দেখায়, এটা দেখেই চলে যাবো।””

রিদের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দরজায় বাড়ি পড়ছে। দরজার অপরপাশ থেকে বাবার কন্ঠ পেয়ে রিদ ভয় পেয়ে যায়। আর তিলও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে,

“” বলো আব্বু,বলো আব্বু। লিদ ভাইয়া আমাল জামা…””

তিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর মুখ চেপে ধরে রিদ। বাবা এবার প্রচন্ড শব্দ আর হুংকার দিয়ে রিদকে দরজা খুলতে বলছে। রিদের চোখটা আবার রক্তরঙে রাঙিয়ে তিলের শরীর থেকে শাড়ীটা খুলতে খুলতে বললো,

“” তোর এই কান্না আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। যেদিন তুই লিদের জায়গায় রিদ বলতে শিখবি সেদিন আমাকে খুজে পাবিনা। আফসোস করবি তুই,খুব আফসোস করবি!””

রিদ হেচকা টানে পুরো শাড়ীটা আবার নিজের গেন্জির ভেতরে ঢুকাতে ঢুকাতে জানালাটা খুলে লাফ দিয়ে পালিয়ে গেলো।
~~
“” তিল,তুই এখনো রেডি হোসনি? গায়ে হলুদ তো শুরু হয়ে গেছে!””

মায়ের ডাকে তিল ছোটবেলার স্মৃতি থেকে বের হয়ে আসলো। আয়নায় মায়ের চোখে চোখ রেখে বললো,

“”আমি এখনি রেডি হয়ে আসছি আম্মু, রিমাকে কিন্তু সবার আগে আমিই হলুদ লাগাবো। তুমি গিয়ে পাহারা দাও যেন আমার আগে কেউ লাগাতে না পারে।””

তাসমিয়া বেগম মেয়ের কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

“” এই হলুদ শাড়ীটাতে তোকে হলদে পাখির মতো সুন্দর লাগবে। কি এতো ভাবছিস? রিদের কথা?””
“” আমি নিজেকে ভেবেই কুল পাইনা আবার আরেকজনের কথা ভাববো। শাড়ীটা কোন স্টাইলে পড়বো সেটাই ভাবছিলাম। তুমি যাও তো,তুমি না গেলে আমি পড়বো কিভাবে?””

তাসমিয়া বেগম মুচকি হাসি দিয়ে বের হয়ে গেলেন।

তিল হাতের হলুদ শাড়ীটার দিকে তাকাতেই চোখটা ভিজে এলো। গলা বন্ধ হয়ে কান্না আসছে। আমি ‘র’ বলা শিখে গিয়েছি রিদ ভাইয়া। আপনি কি আজকেও আসবেননা? আমার আফসোসের পাহাড় ভেংগে গুড়িয়ে দিবেননা? এতো বড় পাহাড়টা আমি আর বয়ে বেড়াতে পারছিনা। আমার ঐ একটা নালিশ যে আপনাকে আমার থেকে এভাবে কেড়ে নিবে আমি বুঝতে পারিনি। আমার অবুঝের পাগলামীগুলো মনে পড়লেই সেগুলো তীর হয়ে বুকে বিদছে। ৮ টা বছর তো পেরোলো আর কত অভিমান করে থাকবেন? এবার অভিমানটা দিয়ে আমার আফসোসের পাহাড়টা ভেংগে গুড়িয়ে দিননা,প্লিজ!

তিল কাদতে কাদতে আয়নার সামনেই হাটু ভেংগে বসে পড়ে। খুব কষ্ট হচ্ছে খুব,এতো কষ্ট হচ্ছে কেন রিদ ভাইয়া??

তিল শাড়ীটা ঢিল মেরে ফেলে দিলো। পড়বোনা আমি শাড়ি! আপনার হাত যেদিন পড়াবে সেদিনই পড়বো। সেদিনি নিজের শরীরে শাড়ী জড়াবো।
~~
“” খবরদার তুই আমাকে হলুদ লাগাবিনা।””

রিমা তিলের হাতটা আটকে দিয়ে তিলের দিকে তাকিয়ে রইলো।

“” কেন?””
“” তুই তো আমাকে কথা দিয়েছিলি হলুদ শাড়ী পড়েই হলুদ লাগাবি। তুই কথার খেলাপ করেছিস। আমি তোর হাতে হলুদ লাগাবোনা। আমার সামনে থেকে যা!””

তিল অসহায়ভঙ্গিতে রিমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছে। একজনের পুতুলের সাথে আরেকজনের পুতুলের বিয়ে হয়েছে কতবার তা অগনিত। রিমা রিদানেরই ছোটবোন। রিদানের বাবা আর তিলের বাবা আপন দুইভাই। সে সুবাদেই তারা জয়েন ফ্যামিলির ন্যায় একসাথে থেকে আসছে। রিদানের বাবা বড় হওয়ায় তিল বড় আব্বু বলেই ডাকে। আর উনিও রিমার মতোই তিলকে মেয়ের মতোই দেখেন। সেভাবে দেখতে গেলে এ বাড়িতে সব থেকে আদরের মেয়ে হলো তিল। হবেইনা কেন? একটা ভদ্র,ভালো মেয়ের যা যা গুন থাকা সব তিলের মধ্যে বিদ্যমান। বরংচ অন্যদের মধ্যে যেগুলো নেই সেগুলোও আছে। এক কথায় ভদ্র,শান্ত,চুপচাপ মেয়েকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। যদি এই নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা হতো তাহলে বিচারক চোখ বন্ধ করে তিলকে ফার্স্ট প্রাইজটা খুশিমনে তুলে দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতো।

“” এমন করছিস কেন? শাড়ী দেখলেই আমার চুলকানি শুরু হয়ে যায়,আমার কি দোষ? আমি তো পড়তেই চাইলাম।””
“” তিল, আমার সাথে একদম মিথ্যা কথা বলবিনা। তুই যে মিথ্যে বলতে পারিস না সেটা আমার থেকে ভালো তুই নিজেও জানিস না। তুই যতক্ষননা শাড়ী পড়বি ততক্ষন আমার চোখের সামনে আসবিনা। আমাদের বন্ধুত্বের কসম।””

তিল মন খারাপ করে সেখান থেকে উঠে আসে। তোরা দুইভাইবোন এমন বিচ্ছিরী পোকা কেন রে? যখন তখন কামড়ে দিস। তোদের কি মনে হয়না তোদের বিষদাতগুলো আমার শরীরে কেমন জ্বলন ধরায়? ইচ্ছে তো করে তোদের বিষগুলো নিঙরিয়ে নিয়ে পুকুরের পচা পানির সাথে মিশিয়ে সরবত বানিয়ে তোদেরকে খায়িয়ে মেরে ফেলি। আমি তো শুনছি নিজের বিষ নিজে খেলে সাথে সাথে মারা যায়। সেটা তোদের উপর পরীক্ষা করে সিউর হতে হবে!

তিল বিড়বিড় করে হাটতে হাটতে বড়আম্মুর সাথে ধাক্কা খেলো।

“” উফ! শুভ কাজে বাধা দিলি কেন? একটু দেখে হাটতে পারিসনা?””
“” আবার কি শুভ হলো??””
“” আরে,আমার ছেলে এসেছে। আমার ছেলে আমার বুকে ফিরে এসেছে। আমি জানতাম নিজের আদরের ছোট বোনের বিয়ের কথা শুনে ও না এসে থাকতে পারবেনা। বাবার প্রতি রাগটা তাহলে এবার পড়লো।””
“” কার কথা বলছো,বড় আম্মু?””
“” কার কথা আবার আমার সোনার খনি,আমার রিদান এসেছে!””
“” রিদ ভাইয়া?””

তিলের মনে হলো তার শরীর বেয়ে বড়সড় একটা ঘুর্নিঝড় বয়ে গেলো। চারপাশের সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে। হঠাৎই রিমার সজোরে চিৎকার করে ভাইয়া ডাকটা তিলের নিশ্বাসটা আটকে দিলো।

~~
তিল ড্রয়ার থেকে একে একে সব জামাকাপড় খুলে বের করছে। একের পর একটা পড়ে যাচ্ছে,আর খুলছে। সে তার রিদ ভাইয়ার সামনে কি পড়ে যাবে?? কোনটা পড়লে সব থেকে বেশি সুন্দর লাগবে?? উফ! আমার তো আজকে বেস্ট জামাটা পড়তে হবে। রিদ ভাইয়া এতো বছর পর বিদেশ থেকে এলো। ইউকে থেকে পড়াশুনা করেছে মানে তার পছন্দগুলোও অমনই হবে। আর তার পছন্দসই নাহলে আমার দিকে তো ফিরেও তাকাবেনা। কি যে করি! উফ! টেনশনে মাথা ভার হয়ে আসছে। সাথে সাথে মাথা ফাটিয়ে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে।

তিলের মাথা ব্যথা আরো বাড়িয়ে দিলো তার বড় আম্মু!

“” একি তুই রুম এমন গোয়ালঘরের মতো করে রাখছিস কেন?””
“” এমনি,আমি কোন জামাটা পড়বো ঐটা…””
“” জামা কাপড় পরে খাচিস। রিদানের নাকি মাথা ধরেছে। আমার মাথা ধরলে তুই যে কি মশলা চা নাকি কি চা বানাস ঐটা বানিয়ে দেতো,মা।। যাতে চায়ে চুমুক দিতেই মাথা ব্যথা ফুরুৎ হয়ে যায়!””

বড় আম্মুর বিপরীতে কথা বলার সময়টাও পায়নি তিল। ওকে টানতে টানতে রান্নাঘরে নিয়ে গেলো।

তিল হাতে চায়ের ট্রেটা নিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার বেস্ট সাজের বারোটা বাজিয়ে দিলো বড় আম্মু। এতো জামাকাপড় থাকতে কিনা শেষে এই সাদামাটা হলুদ জামাটা পড়েই উনার সামনে যেতে হবে?? শাড়ী পড়বোনা দেখে কি একটা গর্জিয়াস জামাও পড়তে পারলাম না? আর আমি চা বানালাম দেখে আমাকেই দিয়ে আসতে হবে? এই বড় আম্মুটাও আমাকে বুঝলোনা। রিদ ভাইয়ার সামনে আমাকে চাকরানী বানিয়ে দিলো? তিল মাথায় ওড়নার ঘোমটাটা আরো টেনে নিলো যাতে রিদ চিনতে না পারে।
I
ড্রয়িংরুমের সামনে যেতেই তিলের হাত পা কাপতে লাগলো। আল্লাহ এতগুলো ছেলে কোথা থেকে আসলো? এর মধ্যে রিদ ভাইয়া কোনটা? ছোটবেলা আর বড়বেলার চেহারা কি এক হবে?? আমি কি চিনতে পারবো?? ইশ! রিমা আমাকে কতবার উনার ছবি দেখাতে চাইলো আর আমি ফালতু রাগ দেখিয়ে মুখের উপর বলে দিয়েছিলাম,তোর ভাই কি ঘোড়ায়চড়া রাজকুমার যে আমি দেখতে যাবো? তোর ভাই গাদা চড়ার গরুকুমার। আর আমি গরুকুমারদের দেখিনা!

তিল ওড়নার নিচ দিয়ে সবাইকে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। কোনটা তার রিদ ভাইয়া! এদিকে পায়ের সাথে হাতটাও তাল মিলিয়ে কাপছে সাথে চায়ের কাপ টকটক করে শব্দ শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আজ কাপেরা মিলে যুদ্ধ বেধে যাচ্ছে কে আগে ফেটে গিয়ে চা নিচে গড়িয়ে ফেলতে পারে।

চলবে

blind love পর্ব ৪

0

#Blind_Love পর্বঃ৪

–পলি….ভালোবাসার জন্য আমি কি করেছি দেখতে চাও?কথাটা বলে পলির সামনে থেকে সরে গেল আইরিন।
পলির মনে হচ্ছে কেউ তার কলিজাটা কুচি কুচি করে কেটে ফেলছে।যে মেয়ের গায়ে কোনদিন ফুলের টোকা দেয় নি সে আজ তার সামনে আধপোড়া আর রক্তাক্ত অবস্থায় পরে আছে।
এসব কিছু এই মহিলার জন্য হয়েছে।একে কিছুতেই ছাড়বে না।
পলি তার বাঁধন খুলতে চাইলো। ক্রোধে তার চোখ বের হয়ে আসতে চাইছে।হাত-পা নাড়াচাড়া করছে।
পলি অনুভব করলো তার গায়ে সুচ ফুটেছে।সে হাতে-পায়ে অসাড়তা অনুভব করছে।চাইলেও নড়তে পারছে না।
বেশ আয়েশ করে পলির সামনে বসল আইরিন। তারপর সামনে ঝুঁকে বললো
–সাকসমিথোনিয়াম ক্লোরাইড নামটা আশা করি তোমার মনে আছে?তোমার শরীররে এটা ২.৫মিলিগ্রাম ইঞ্জেক্ট করা হয়েছ।
–ওম…..ওমমম..ম…ম.. (পলি অনেক চেষ্টা করছে একটু নড়াচড়া করার জন্য কিন্তু পারছে না। )
–লাভ নেই। আর কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার ঘাড়ের নিচে সব প্যারালাইজড হয়ে যাবে।তোমার সাথে কেন এটা করছি জানো?শুধু তোমার যন্ত্রণা মাখা মুখ দেখবো বলে।কিছু বলতে চাও?
আইরিন পলির মুখের টেপটা খুলে দিলো।
— আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও ওর খুব কষ্ট হচ্ছ। তুমি আমকে মেরে ফেলো।
–ওফ!!তোমার কথা আমার কানে কাঁটার মতো বিঁধছে। (বলেই একটা ছুরি দিয়ে ঘ্যাঁচ করে পলির জিহ্বাটা কেটে ফেললো আইরিন)
কাটা জিহ্বাটা নিচে পড়ে দুবার লাফ দিলো। গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এল পলির মুখ থেকে।
–অ্যা… অ্যা…(আর কোন শব্দ রের হচ্ছে মা পলির মুখ থেকে)
–দেখি তোমার কিসে বেশি কষ্ট হয় নিজের ব্যাথাতে না মেয়ের যন্ত্রণায়?
–আপনি একটা মানুষিক রোগী।(ক্ষীণ একটা কণ্ঠ শুনে আইরিন পেছনে তাকিয়ে দেখে তোয়া’র জ্ঞান ফিরে এসেছে)
–তোমার মাও তাই বলতো।অবিকল মায়ের মতো হয়েছো।দেখো দুজনের গায়ে সামান্য গরম পানি ঢেলেছি তাতেই তোমাদের জ্ঞান ফিরে এসেছে।

–মা আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না হলো তোমার?(দরজা খুলে ফারাবি জিজ্ঞেস করলো)
–বাবা চলে এসো।
ফারাবি ভেতর এসে দরজা লাগিয়ে দিলো।সব দেখলো।কিন্তু কোন প্রশ্ন করলো না। কারণ প্রশ্ন করাটা সে শিখে নি।তাই নিজের কাজে মন দিলো।
আইরিন নিজের আর পলির চেয়ারগুলো এমনভাবে সাজালো যাতে সে পলিকে আর পলি তোয়া’কে দেখতে পায়।
এদিকে যখন লোহার আলপিনগুলো গরম হয়ে লাল হয়ে এলো।তখন ফারাবি তোয়া’কে উপুর করে শুইয়ে ওর পিঠে সেগুলো ঢেলে দিলো।
যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে তোয়া।ও দুর্বল হয়ে পড়েছে।গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।তবুও তার সমস্ত শক্তি সঞ্চার করে বললো
–আ…..আ…..আ…..আমাকে মেরে ফলো। আর পরছি না। আল্লাহর দোহাই লাগে।মেরে ফেলো আমাকে।
দাঁতে দাঁত চেপে ফারাবি বললো,
–এখনো তো তোমার মরার সময় হয় নি।সময় হলে আমি মেরে ফেলবো তোমাকে।
নিজে যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যাচ্ছে পলি, মুখ দিয়ে অনর্গল রক্ত পড়ছে।তবুও যেন ওর চোখজোড়া ওই পাষন্ড মা-ছেলের কাছে মিনতি করছে,
–তোমরা আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। ও বড্ড নিষ্পাপ।তোমরা আমাকে আরো কষ্ট দাও তবুও ওকে যেতে দাও।
ঠিক এই যন্ত্রণাটাই পলির মুখে দেখার জন্য এতো বছর অপেক্ষা করেছে আইরিন। পলির মুখের দিকে তাকিয়ে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে সে।আর মাঝে মাঝেই মধ্যে হো হো করে জোর হেসে উঠছে।
একটা হাতুড়ি দিয়ে তোয়া’র পিঠে বাড়ি দিচ্ছে ফারাবি, যাতে আলপিনগুলো ডেবে যায়। মেয়েটা শুধু গোঙাচ্ছে। চোখের পানিও শুকিয়ে গেছ। এরপর একটা চিমটা দিয়ে আলপিনগুলো তুলতে লাগলো সে।লোহাগুলো এতটা গরম ছিলো যে তোয়া’র জামার কাপড় আর চামড়া পুড়ে গিয়েছি। চিমটা দিয়ে টেনে তোলার সময় সব একসাথে মাংসের সাথে আলপিনে লেগে উঠে আসতে থাকে।
তোয়া’র গোঙানিও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।তার চোখ ধীরে ধীরে কষ্টে উল্টে যাচ্ছে।
পলির চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরে পরছে।সে মনে মনে বার বার শুধু আল্লাহর কাছে নিজের মেয়ের জীবন ভিক্ষা চাইছে।

আর ফারাবি মনে মনে ভাবতে থাকে
–এরপর এই মেয়েটার বাম হাতের আঙুলগুলো থেতলে একটা একটা করে কাটবো।

—।—-।—-।

স্কেচ চলে এসেছে। সিফাত আর তালহা মহিলার ছবি দেখে চমকে যায়।
–আপনার উপর ভরসা করা আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিলো।আজ যদি আমার মেয়ের কিছু হয় তবে আমি পলি সামনে কি করে দাঁড়াবো ।একটা বাড়ি সার্চ করতে পারেন না।সত্যি করে বলুন তো আপনি পুলিশে চাকরি কি করে পেয়েছেন?(ফোনে রেগে চেঁচিয়ে কথাগুলো সিফাতকে বলছে তালহা)
–স্যার প্লিজ। আমার ভুল হয়ে গেছে। বিশ্বাস করুন আমরা ভালোমতো খুঁজেছি কিন্তু কিছুই পাই নি।আর ওদের এতো ভালমানুষ মনে হয়েছে।
–ওই মহিলা কেমন ভালো সেটা আমি জানি। এবার ঐ বাড়ির প্রত্যেকটা দেয়াল ভেঙে দেখবেন।
–জ্বি স্যার। আমার আর পনের মিনিট লাগবে পৌঁছাতে।আমি এম্বুলেন্সও খবর দিয়েছি।
–ঠিক আছে।আমার ওইখানে যেতে ঘন্টা খানিকের উপর লাগবে।আমি শহরের দিকে যাচ্ছি। আপনি জানাবেন কোথায় যাবো।
–জ্বি স্যার।
–শুনুন পলিকে এখন কিছু জানানোর দরকার নেই।তোয়ামনিকে পেলে আমি নিজে ওকে ফোন করব।
পলি যে ওইদিকে অনেক আগে থেকে ফোন রিসিভ করছে না তা তালহাকে একরকম ঝাড়ি খাওয়ার ভয়েই বললো না সিফাত।
–আচ্ছা স্যার।(বলে ফোন রেখে দিলো)

এদিকে তালহা ভাবতে থাকলো পলি কি করবে যখন জানতে পারবে তোয়াকে ঐ মহিলা কিডন্যাপ করেছে। আইরিন নামের দুঃস্বপ্নটা যে তাদের জীবনে আবার কখনো ফিরে আসবে সেটা তালহার কল্পনারও বাইরে ছিলো।

—চলবে???

Blind love পর্ব ৩

0

#Blind_Love পর্বঃ৩

ডেডইন্ডে যে তালহা আর পলির জন্য এত বড় একটা ধাক্কা অপেক্ষা করছিল; তা তারা বুঝতে পারে নি।এতো। জঘন্য একটা ক্রাইম স্পট তালহা’র নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কেউ তৈরি করেছে তা সে নিজে মেনে নিতে পারছে না।
এদিকটা জঙ্গল তাই কেউ আসে না, মনে করে এখানে বেশি নজর দেয় নি।কিন্তু আজকে এই জঙ্গলের মাটি খুঁড়েই একে একে বের করা হলো আটটি পঁচা গলা লাশ।
পলি এরইমধ্যে দু’বার বমি করেছে।তারপরও বিকৃত লাশগুলো একে একে দেখছে আর নিজের মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।প্রতিটা লাশ দেখে শিউরে ওঠে পলি আর আল্লাহর কাছে দোয়া করে এটা যেন তার মেয়ে না হয়।
— লাশগুলো পুরানো।এদের মধ্যে আমাদের তোয়ামনি নেই। (তালহা)
–তুমি দেখছো কত নৃশংসভাবে মেয়ে গুলোকে মেরেছে? কতটা অমানুষ!!!এই খুনির হাতে যদি আমার তোয়ামনি পরে। আল্লাহ আমি আর ভাবতে পারছি না।(পলির কান্না থামছেই না)
–তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ো তাহলে মেয়েকে কি করে খুঁজবে?মায়ের ভালবাসায় অনেক শক্তি। ভরসা রাখো আল্লাহর উপর। (তালহা)
–স্যার……এদিকে আরও একটা লাশ। (কনস্টেবল চেঁচিয়ে ডাকলো ওদের)
সবাই সেখানে গেল।
–স্যার এটাও অনেক পুরন। মাংস পঁচে গেছে।
–হুম। তাই দেখছি। তুমি থানা থেকে আরও কয়েকজনকে আসতে বলো।জায়গাটা ভালোভাবে সার্চ করো। আর এই লাশগুলো পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠাও।
–জ্বি স্যার।
— আমি আর বাকি টিম নিয়ে আমি সামনে যাচ্ছি। আপডেট করবে।
–ওকে স্যার।
___________।__________

–পলি তুমি বাড়ি যাও।(তালহা)
–তোমার মাথা ঠিক আছে?আমার মেয়েটা কোথায় তার কোন হদিস নেই আর তুমি আমাকে বাড়ি যেতে বলছো?(পলি)
–বলছি কারণ তুমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছো।এখন তুমি অসুস্থ হলে বিপদ বাড়বে। তার চেয়ে তুমি বাড়ি যাও। নামাজ পড়ে দোয়া করো।
–তুমি বুঝতেছ না।
–তর্ক করো না। বাসায় যাও। আমি এদিকটা দেখছি।শোন তুমি সিফাতের টিম থেকে প্রতিটা বাড়ি চেকের পর ডিটেইলে আপডেট নিবে আর আমি অন্য টিম থেকে।কোন খটকা লাগলে জানাবে।আমি কোন ঝুঁকি নিবো না।
–স্কেচটার কি হলো?
–বাচ্চা মানুষ ঠিক মতো সব মনে নেই।তাই দেরি হচ্ছে। আরও ঘন্টা-দেড়েক লাগবে।
–হুম।তোমার কথা মেনে নিলাম, বাড়ি যাচ্ছি কিন্তু আমার মেয়েকে না নিয়ে তুমি বাড়ি ফিরো না।
–বাড়ি ফিরলে তোয়ামনিকে নিয়েই ফিরব।
তালহা চলে গেল।
আর পলি রিকশায় বসে সিফাতকে ফোন দিয়ে সব খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করছে। সে বাড়ি ফিরছে মেয়ে ছাড়া।
—।—-।—–।—
–কে এসেছে মা?
— রাজু। তুমি নাকি ফোন করে কিসব আনতে বলেছো।
–হ্যাঁ ওকে ভেতরে নিয়ে আসো।
আইরিন রাজুকে নিয়ে ভেতরে এলো দরজা খোলা রেখেই।
–সব এনেছিস?ফারাবি
–জ্বি ভাই।(রাজু)
–দাঁড়া তোর টাকাটা নিয়ে আসছি।(বলে ফারাবি ভেতরে গেলো)
বাহিরে এসে দেখলো ওর মা কয়েকজন পুলিশের সাথে তর্ক করছে।
–সরি মেডাম। বলছিতো দরজা খোলা পেয়ে ভেতরে চলে এসেছ। কিন্তু বোঝার চেষ্টা করুন আমাদের কোন খারাপ উদ্দেশ্য নেই।
–আমি কোন কথা শুনব না।বের হয়ে যান এক্ষুণি।
একটা কাগজ বের করে সিফাত আইরিনের হাতে দিল।
–আমাদের কাছে পুরো এলাকা সার্চের ওয়ারেন্ট আছে।একটা মেয়ের জীবন-মরন ব্যাপার।
আইরিন মুহূর্তে রঙ বদলায়।
–আগে বলবেন তো।আপনারা খুঁজে দেখুন কিন্তু এখানে সময় নষ্ট না করলেই ভালো হতো।
— সেটা আমরা বুঝব(সিফাত)
–মা কোন সমস্যা?
–না বাবা।তুমি প্যানিক হইয়ো না। ওদের কাজ করতে দাও।আর তুমি রাজুকে বিদায় করো।
–কেউ বাড়ি থেকে বের হতে পারবে না আগে সার্চ শেষ হোক।
— ও আমার বাসায় কিছু জিনিস দিতে এসেছে।ওকে চেক করে বিদায় করুন।(আইরিন)
–কি জিনিস?
–সেটা আপনার দরকারের নয়।(আইরিন)
–আহ মা!!এভাবে কথা বলছো কেন?একটা মেয়ের জীবন নিয়ে কথা।না জানি ওর মা-বাবা কত চিন্তা করছে।সার্চ করতে দাও।আর তুমি বলছো না কেন আমার ঘরে নতুন পেইন্টিং টানানোর জন্য রাজু লোহা এনেছ। এত ঝামেলার কি আছে?(ফারাবি)
আইরিন ছেলেকে সবসময় বাহিরের মানুষের সাথে নরম সুরে কথা বলা শিখিয়েছে।পরিস্থিতি যত খারাপই হোক ফারাবি সবার সামনে নিজেকে ভালো হিসেবে প্রদর্শন করতে পারে।
–সরি স্যার, ম্যাডামের রাগ করাটা স্বাভাবিক।আমাদের শুধু দশ-পনের মিনিট লাগব।আর ওই ছেলেটা যেতে পারে।(সিফাত)

রাজু চলে গেল।পুরো বাড়ি খুঁজা হলো কিন্তু কিছুই পেল না সিফাতের টিম।
–আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ।(সিফাত)
–এটা আমাদের কতর্ব্য। আমার মায়ের ব্যবহারের জন্য আমি মাফ চাইছি।কোন সহায়তা লাগলে বলবেন।
— নিশ্চয়ই। চললাম।
–আচ্ছা। আমি আশা করি মেয়েটা ভালো আছে।
পুলিশ চলে গেলো।

–মা আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও।এরপর মেয়েটার কাছে যাবো।(ফারাবি)
–চলো।
——-।——–।——–।——–।——-

সিফাত পলিকে ফোন দিলো।
–ম্যাম ২৩ নম্বর বাড়িও ক্লিন।
–আপনি কি কি দেখলেন তা বলুন।
তারপর সিফাত শুরু থেকে সব বলে ফোন রাখলো।

–মা মেয়েটা কি এইটুকুতেই মরে যাবে? (ফারাবি)
–নাহ।।ও শুধু জ্ঞান হারিয়েছ। এত সহজে মরবে না।(আইরিন)
–তার মানে লোহাগুলি দিয়ে ওর উপর এক্সপেরিমেন্ট করা যাবে।
—তোমার যা খুশি করো। আমি বাঁধা দিবো না কারণ তুমি কথা দিয়েছো এটাই শেষ।
–হ্যাঁ, মা কথা দিলাম এই মেয়েই শেষ।
তখন কলিংবেল বাজলো।কেউ অস্থির হয়ে বারবার বেল চাপছে ।
আইরিন দরজার ছিদ্র দিয়ে চেহারা দেখে ভেতরে গেলো।নিজের ঘর থেকে কিছু একটা আনলো। দরজা খুলেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির উপর স্প্রে করল এবং ব্যক্তিটি অজ্ঞান হয়ে যায়।

পানির ঝাপটাতে জ্ঞান ফিরলে নিজেকে চেয়ারে বাঁধা আবিষ্কার করলো পলি । ওর মুখও টেপ দিয়ে আটকানো। সামনে দাঁড়িয়ে একটা মহিলা ভীষণ বিচ্ছিরি রকম হাসছে। মহিলাকে ভীষণ চেনা লাগছে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না কোথায় দেখেছে ।
–পলি।।।চিনতে পেরছো আমাকে?(দাঁত বের করে হেসে পলির মুখের সামনে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো আইরিন)
–মাথা নাড়িয়ে না করে পলি।
—আমি সাহায্য করছি। Things we do for love…কিছু মনে পড়ছে?

—চলবে??

Blind love পর্ব ১

2

Blind love পর্ব ১

আমাকে প্লিজ ছেড়ে দিন।আমি কি করেছি কেন আমাকে তুলে এনেছেন?আমি বাড়ি যাব।” বলেই ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল চৌদ্দ বছর বয়েসী তোয়া।
‘”হিসসস…..চুপ চুপ….আরে কান্না থামাও …আমার কান্নাকাটি একেবারেই পছন্দ না।
এইতো আর একটু অপেক্ষা করো,আমার ছেলে এলো বলে। সে এসেই তোমাকে খুন করবে।” বলেই বিচ্ছিরিভাবে দাঁত বের করে হাসতে লাগলো তোয়া’র সামনে বসা মহিলাটি।
এই কথা শুনে তোয়া প্রচন্ড ভয় পয়।আর জোরে কেঁদে ওঠে।
ভাঙা ভাঙা গলায় কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করে,
–আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি কেন আমাকে মারবেন?
–না মামনি তুমি কিছু করো নি। এর আগের একুশটা মেয়েও কিছু করে নি কিন্তু তবুও তাদের মরতে হয়েছ।
-আপনি কে? কিসব আজে-বাজে কথা বলছেন? আমি বাড়ি যাবো।
-ও মরার আগে পরিচিত হতে চাও, ঠিক আছে। আমি আইরিন।আর আমি মোটেও বাজে বকছি না কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার খুন হবে। তাই তুমি বাড়িতে যেতে পারবে না।(আইরিন)
-আপনি কেন এমন করছে? প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।কি চাই আপনার।আপনার যদি টাকা লাগে বলুন আমি পাপাকে ফোন করছি পাপা দিয়ে দিবে। চিৎকার করে বললো তোয়া।
–না সোনা আমার টাকা লাগবে না।টাকা দিয়ে আমি কি করব? আমার তো শুধু তোমার প্রাণটা চাই। (আইরিন)
–কিন্তু কেন?আমাকে মারলে আপনার কি লাভ?
–আমার লাভ আছে বলেই তো তোমাকে মরতে হবে।তোমাকে মারলে হয়তো আমার ছেলে ভালো হয়ে যাবে।
–আন্টি প্লিজ আমাকে যেতে দেন। আর তাছাড়া কাউকে মারলে কেউ ভালো হয় না।বোঝার চেষ্টা করুন।(তোয়া খুব করুন সুরে অনুরোধ করতে লাগলো)
–তুমি বেশি জানো?ডাক্তার বলেছে এই কথা।(ধমকের সুরে বললো আইরিন)
–ডাক্তার খুন করতে বলেছ?(অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল তোয়া)
–হুম,কিছুটা এমন।
–মানে বুঝলাম না। দেখুন আমাকে তো খুন করে ফেলবেন কিন্তু মারার আগে বলুন কেন মারতে চান?
–দেখো সে অনেককথা।এত কিছু শুনে কি করবে তুমি?
–আমাকে তো মেরে ফেলবে। মরার আগে নিজের মৃত্যুর কারণ জানতে চাই। প্লিজ শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করুন।
–ঠিক আছে । এত করে বলছো যখন শুনো।
-।-।-।-।
আমি তখন সব হারিয়ে আমার ছেলে ফারাবিকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করি।
কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে ফারাবির কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দিল।তখন আমি ওকে সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে যাই।উনি ওক দেখে বলে সারাদিন একা থাকার ফলেই এমন।ওকে যেনকোন কিছুতে বাধা না দেই।ফারাবি একটা খেলনা নষ্ট করলে যেন আরেকটা এনে দেই।তাতেও বোর হয়েঐ কাজ করা ছেড়ে দিবে এভাবেই ভালো থাকবে,তারপর উনি পরবর্তী চিকিৎসা দিবেন। আর উনি আমাকে দুইমাস পর আবার যেতে বলেছিলেন কিন্তু তার প্রয়োজন হয় নি।কারণ ফারাবি খেলনা ভেঙে বোর হয়ে গেছিলো।সুস্থ হয়ে গেছিল ।

এভাবে অনেক বছর ভালো যায়। আমার ছেলে কলেজে ভর্তি হয়।পাশের বাসার নবম শ্রেণির এক মেয়ের সাথে তার প্রেম হয়। সব ঠিকঠাক চলছিল।ফারাবি অনেক খুশি ছিল ।

কিন্তু মেয়েটার সাথে মাঝেমধ্যে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া হতো।তখন ছেলেটা আমার খুব পাগলের মতো করতো,মন খারাপ করতো । আমি তখন মেয়েটাকে বাসায় ডেকে ঝগড়া মিটিয়ে দিতাম। এমনই একদিন ওদের ঝগড়া মিটিয়ে বাজার থেকে চিনি আনতে গিয়েছিলাম।

ফিরে এসে দেখি সারা বাড়ি রক্তে ভরা। মেয়েটা যন্ত্রণাতে কাতরাচ্ছে।ওর মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে।আমি দৌড়ে মেয়েটাকে ধরতে যাবো তখনই ফাবারি বলে উঠে,
–মা, একে পড়ে থাকতে দাও। আমার ওর যন্ত্রণা দেখতে ভালো লাগছে।ওর চিৎকারে শুনে আনন্দ পাচ্ছি।
আমি বুঝতেপারলাম খুন করতে পারলে আমার ছেলে ভাল থাকবে।তাই মেয়েটা মরার পর লাশ গুম করে ফেললাম। সেদিন রাতে ঠিকানা বদলে ফেলি।
এরপর ও যখনই পাগলামি করে আমি একটা করে চৌদ্দ-পনের বছর বয়েসী পতিতার ব্যবস্থা করি।ও তাদের মারে আমি গুম করি। যে দেশে ভালো মানুষের খুনের বিচার হয় না চাপা পড়ে যায়, সেখানে পতিতা-দের খুঁজ কে করবে?

–এতে কি আপনার ছেলে সুস্থ হয়ে গেছ? তোয়া কথাটা জিজ্ঞেস করল।
–না।আরও হিংস্র হয়ে গেছে। কিন্তু ও ভালো আছে।
–কিন্তু আমিতো পতিতা নই।স্কুলে পড়ি।
–জানি তো।আসলে কাল স্কুলের সামনে তোমাকে দেখে মনে হলো যে আমি যদি একটা ভালো মেয়েকে এনে ওর সামনে দেই ও ভালো হয়ে যাবে।
এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো।
–ওই তোমার আজরাইল এসে গেছে বলে দরজা খোলার জন্য গেল আইরিন।


অপরদিকে নিজের একমাত্র মেয়েকে পলি আর তালহা খুঁজেই চলছে। স্কুল ছুটির পর মেয়ে বাসায় ফিরে নি। তখন তারা খুঁজ নিয়ে জানতে পারে তোয়া আজ স্কুলেই যায় নি।পলি সাংবাদিক আর তালহা পুলিশের চাকরি করেও নিজের মেয়েকে খুঁজে বের করতে পারছে না।
–আমার মেয়েটা তো কোনদিন কারও কোন ক্ষতি করেনি তাহলে কেন এমন হলো।(কাঁদতে কাঁদতে কথাটা বললো পলি)
–আমাদের মেয়ের কিছু হবে না।ও ভালোয় ভলোয় ঘরে ফিরে আসব।(তালহা পলিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো)
–আচ্ছা আমরা কি চাকরিক্ষেত্রে অজান্তেই কোন শত্রু পুষে ফেলেছি যার জন্য এমন কিছু হলো । (পলি)
–আমরা কোনদিন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেই নি।কারও সাথে অন্যায় করি নি।সৎ থেকেছি।বিশ্বাস রাখো আল্লাহর উপর তিনি আমাদের কোন হতে দিবেন না।(তালহা)
–কিন্তু (পলি কিছু একটা বলবে এমন সময় তালহার ফোন রিং হলো)
–হ্যালো, অফিসার বলুন তোয়ামনির কোন খুঁজ পেলেন?
–না স্যার । কিন্তু একটা ক্লু পেয়েছি। আপনি এক্ষুনি একবার তোয়া’র স্কুলের সামনে চলে আসুন।(ওপাশ থেকে)
–আমি আসছি।
তালহা ফোন রেখে পলিকে বললো,
–আমি যাই ওরা একটা ক্লু পেয়েছ। তুমি থানায় বসবে না বাসায় যাবে?
–আমি তোমার সাথে যাবো।
–কিন্তু পলি…..
— প্লিজ তালহা আজ আমরা সাংবাদিক আর পুলিশ নই।আজ আমরা তোয়ামনির মা-বাবা হিসেবে ওকে দুজন মিলে খুঁজব।
–ঠিক আছে চলো।
দুজন মা-বাবা বেরিয়ে গেল নিজের সন্তানকে খুঁজতে।
চলবে?—–

সতীনকাঁটা ৭ম পর্ব এবং শেষ পর্ব

0

#সতীনকাঁটা পর্বঃ ৭এবং শেষ
লেখায়ঃ( Nosrat Monisha)

সদ্য জন্মানো একটা শিশু মারা গেলো।

আমজাদ খান বাকরূদ্ধ। নিজেকে বার বার সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গেছে।তবুও তার মনের এক কোণে একটা খটকা লাগছে তখন যদি দাইয়ের কথা শুনে তানজিনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতো তবে কি বাচ্চাটাকে বাঁচানো যেতো।

ভেতর থেকে বিলাপের স্বর ভেসে আসছে।
তানজিনা ঠুকরে ঠুকরে নিজের বাচ্চার লাশ ধরে কাঁদছে।
এত যন্ত্রণার পর জন্ম দেওয়া সন্তান, যখন আধ ঘন্টার মধ্যেই মারা যায় তখন একজন মায়ের কান্না ছাড়া আর কি-ই-বা করার থাকতে পারে?

আমজাদ খান নিজের মায়ের কবরের কাছে চলে গেলেন।
বড় কাঁঠাল গাছের নিচে বাঁধানো উঁচু কবরটা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় সবার চোখে পড়ে। জীবনে যেকোন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমজাদ খান একান্তে মায়ের কবরের পাশে কিছু সময় কাটান।
আজকেও সেজন্যই এসেছেন।
কিছুক্ষণ পর
আমজাদ খান ফিরে যায়।


পুরোনো খান বাড়ি।
আঁতুড় ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আমজাদ খান গলা ঝাড়া দেয়।

-আমি এড্ডু বিতরে আইতাম। বউমার গতরের(শরীরের) কাপড় ঠিক করো।

রেহানা বেগম, রাফিয়া, সানজিদা সবাই সেখানেই ছিলো। তারা বুঝলো আমজাদ খান বাচ্চার মৃত্যুতে কষ্ট পেয়ে তানজিনাকে তাড়ানোর জন্য আসছে।
তাই সব ঠিকঠাক করে আমজদ খানকে ভেতরে ডাকলো রেহানা বেগম।

ভেতরে গিয়ে তিনি দেখলেন তানজিনা মরা বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে আছে।

-বাইচ্চাডারে কব্বর দেওন লাগবো। সব কাম শেষে ছোড বউমা লও(চলো) বাইত যাওন লাগবো । বাড়িডা তুমারে ছাড়া খাঁ খাঁ করতাছে।

পাশ থেকে খেঁকিয়ে উঠে রেহানা খাতুন,
-তুমার মাতা ঠিক আছে নি?এই আলীক্কীরে(অলক্ষী) আবার ঘরে নিবা। আরে তুমার নাতি মইরা গেছে।
বংশের পত্থম বাত্তি নিইব্বা(নিভে) গেছে এইডার লাইগ্যা।

-কতা কম কও আবরারের মা। আমি যা কইছি তাই অইবো। আজু আইলে রাফিয়ার লগে হের তালাকের কামডা সাইরা ফালামু।

তানজিনা এতক্ষণে হুঁশ ফিরে পায়। সে আমজাদ খানের কথা শুনে চমকে উঠে।
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

-বাবা আমি তো আপনাকে নাতি দিতে পারি নি। সে তো জন্মের পরই চলে গেলো তাহলে?

শক্ত হয়ে আজম খান বলে,
-বৌমা আমারে তুমি নাতি দিতে পার নাই ঠিকঐ। তয় আমি যে অত দিন বাদে আমার মায়ের দেহা পাইছি।
-বাবা!

-বৌমা আমার মায় যহন মরে আমি খুব ছোড। বইনে অইতে গিয়া মায় মইরা গেল।মায়ের মুকখান ছাড়া অহন আর কিছু তেমুন দিশ(মনে) করবার পারি না।
তহন অত ডাক্তর বদ্যি আছিল না তাই আমার মায় বাঁচে নাই৷ আইজ সব থাইক্যাও আমার নাতি বাঁচে নাই।হের কারণ আমার জিদ। আমি পাপী তাই পাশ্চিতির করুম। হের আগে তুমি মাফ করো আমারে।

-বাবা এরকম বলে আমাকে আর কষ্ট দিবেন না।

-তয় আমার মায়রে লইয়া বাইত চলো যাই।
বলে তানজিনার পাশে ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে তুলে নেয় আমজাদ খান।

হ্যাঁ তানজিনার জমজ বাচ্চা হয়। ছেলেটি আঁতুড়েই মারা গেছে।

সবাই অবাক হয়। একটা মেয়েকে আমজাদ খান এভাবে আদর করে মেনে নিবে তা সবার কল্পনাতীত ছিলো।

-জানো ছোড বউমা। দাই যহন হেরে দেহাইতে আমার বারাত(কাছে) নিল আমি মনে মনে কইতাছিলাম মাইয়্যার মুক দেইকা কি করুম বংশের বাত্তিঐ যহন নিইব্বা গেলো।
কিন্তুক দাইয়ে কতায় একবার চাইয়া দেহি এইডা অক্করে তুমার মাইয়্যার মুক অক্করে আমার মায়ের মুহের(চেহারা) লাহান। তুমি আমার মায়েরে ফিরত দিছ। তুমি যা চাইবা তাই অইবো। চলো।

আমজাদ খানের মুখের উপর কথা বলার সাহস কারও নেই। তাই বাচ্চার দাফনের পর অগত্যা সবাই তানজিনাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো৷


দুদিন পর আজুয়াদ ফিরে এলো। সে মেয়েকে দেখে যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেল।আবার ছেলের জন্য দুঃখও পেলো।
আজুয়াদ যখন বাবার সিদ্ধান্ত জানলো খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো।


আজ আমজাদ খান তার শেষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলো যে কালকেই রাফিয়াকে তিনি বাপের বাড়ি রেখে আসবেন।
রাতে তানজিনা মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলো। হঠাৎ মেয়ে জেগে ওঠলে তারও ঘুম ভেঙে যায়৷ মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে খেয়াল করে আজুয়াদ ঘরে নেই।
শরীর খারাপ থাকা সত্ত্বেও আজুয়াদকে খুজতে বের হয়। সব কয়টা ঘরে খুঁজে। একবার নিজের মনের সন্দেহ দূর করার জন্য রাফিয়ার ঘরেও দেখে,কিন্তু পায় না। রাফিয়ার ঘর দেখে মনে হলো রাফিয়া কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে ।

পরক্ষণেই মনে হলো,হয়তো সিগারেট পান করতে বাড়ির পেছনে গেছে । তানজিনা মনে মনে খুশি হলো যে আজুয়াদ তার কথা শুনে এখনও ঘরে সিগারট খায় না আজুয়াদকে তার কিছু বলার ছিলো। তাই মেয়েকে খাইয়ে চারপাশে বালিশ দিয়ে দরজা লাগিয়ে বাড়ির পেছন দিকে যায়৷


খান বাড়ির পিছনদিকটা হাসনাহেনা ফুলের সৌরভে বিমোহিত হয়ে আছে।

তানজিনা গিয়ে দেখে রাফিয়া আজুয়াদের পায়ে ধরে কান্না করছে। তানজিনা বুঝতে পারে মেয়েটা আবার একটা তালগোল পাকাবে। তাই একটু জোরে হেঁটে কাছে যায়।

-সারা জেবন আপনেগো দুইজনের বান্দি গিরি খাটুম। তাও আমারে খেদাইবেন না।

তানজিনার খুব মেজাজ খারাপ হলো। সিদ্ধান্ত নিল এবার এই মেয়েকে উচিৎ শিক্ষা দিবে। চুলের মুঠি ধরে এ বাড়ি থেকে বের করবে। কিন্তু কিছু একটা শুনে থেমে যায়।

-আপনে যুদি অহন আমারে ছাইড়া দেন আমার পেডের বাইচ্চার কি অইবো।

তানজিনার পায়ের নিচের মাটি সরে যায়।
না আর কোন ভনিতা নয়।
সে সোজাসুজি গিয়ে আজুয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-এই মেয়েটার পেটে তোমার বাচ্চা? সত্যি কথা বলো।
আজুয়াদ নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করে বলে,
-হ্যাঁ।
-কেন করলে এটা।তুমি মিথ্যে বলছো না তো? তুমি তো এই মেয়েটাকে কখনো মেনে নিতে পারো নি।
-তানু এতে তোমারও দোষ আছে। এই কয়মাস আমাকে নিজের কাছে ঘেঁষতে দাও নি।তোমার কাছে গেলে দূর দূর করেছো। আমি ঢাকা থেকে এসে কতবার তোমার কাছে থাকতে চেয়েছিলাম প্রতিবার তুমি আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলে। তুমি কেন বুঝ না, আমারও তো একটা চাহিদা আছে।তুমি চিন্তা করো না আমি রাফিয়াকে…

না আর কোন কথা শুনলো না তানজিনা। ধীর পায়ে সেখান থেকে বাড়ির ভেতরে যাচ্ছে আর শরৎ বাবুর বলা দুটো লাইন ভাবছে,
-যাহার ভালবাসা পাইয়াছি বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছি, সেইখানে ভুল ভাঙিয়া যাওয়াটাই নিদারুণ।

আজ তানজিনার ভুল ভেঙেছে।

আমজাদ খানের দরজায় তানজিনা জোরে জোরে কড়া নেড়ে ডাকছে।
মাঝরাতে তানজিনার গলা শুনে আমজাদ খান ভয় পেয়ে যায়। মনের মধ্যে কুডাকে। একবার মনে হয় মেয়েটার আবার কিছু হলো না তো।

তারপর দরজা খুলতেই তানজিনা কাঁদতে কাঁদতে দরজা ধরে নিচে বসে পড়ে।


২৭ বছর পর।
সময়ের স্রোতে আমজাদ খান, তানজিনার মা,বাবা, চাচা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও বাকি সবাই রয়ে যায়।


খান বাড়ি।
খান বাড়ির এখন আর আগের মতো সমৃদ্ধশালী নেই ।

হাসনাহেনা গাছটা মরে গেছে।

বাড়ির দালানগুলোতে শেওলা জমেছে, ছাউনির টিনগুলোতে জং পড়েছে, কাঠের দরজা-জানালাগুলোতে ঘুন ধরেছে।

খান বাড়ির উঠোন।

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া রেহানা খাতুন ময়ালা আধা সেলাই করা একটা কাপড় পড়ে, ময়লা ফেটে যাওয়া একটা বাসন নিয়ে রান্না ঘরের সামনে বসে আছে।সে এখন লাঠি ভর দিয়ে হাঁটে।
রেহানা খাতুনের আগের তেজ এখন নেই।এখন তাকে দেখলে যে কারও অন্তর কেঁপে উঠবে।

একটা মলিন হাসি দিয়ে করুন সুরে আবদার করে,
-আমারে দুইলা(অল্প) বাত(ভাত) দিবা? সহালেত্তে(সকাল) কিচ্ছু খাইতে দেও নাই অহন বিহাল(বিকেল) অইয়্যা গেছে। পেডর(পেটে) ভুক(খুদা) লাগজে।

সামনে থাকা মহিলাটি দাঁত খিঁচিয়ে জবাব দেয়।
-বুড়ি খালি বাত কেরে? আমারেও খা। তর জামাই জমিদারি থুইয়্যা গেছে, এড্ডু পরে পরে খালি কয় পেডর ভুক লাগজে। অত খাছ যায় কই? কামের বেলা তো খুইজ্যা পাই না।

-রাফিয়া আম্মারে এমনে কইয়্যো না।
গরুকে খড় দিতে দিতে সানজিদা কথাটা বলে।

-এহ আইছে আরেক আলীক্কী(অলক্ষী) , বান্জা(বাঁজা) মাইয়া মানু। তর খাওনঢা তুই বুড়িরে দিলেই পারস। নিজের সোয়ামীরে খাইয়্যাঅতো পরান জুরায় নাই, অহনতো আমার সংসারে বইয়্যা বইয়্যা খাস।

ভেতর থেকে আজুয়াদদের গলা শুনা যায়,
-রাফিয়া মুখ বন্ধ করো। ওদের ওরকম করে বলো না। টাকাতো আমার খেতের ধান থেকেই আসে।

-ওরে গোলামের-গরের-গোলাম(গালি বিশেষ)। আমারে টেহার খুঁডা দেছ তুই।খেতে কাম করে কেডা? আমার পোলায়।ক্ষেমতা নাই উট্টা বইবার তক্ক করে। তর কপালো উঁস্টা মারি।
আর কতদূর (কতটুকু) খেত আছে তর? তর বাপে তো বেবাকতা তর বড় বউরে দিয়া গেছে। বাহি(বাকি) যদ্দূর(যতটুকু) আছিন তর বইনের বিয়ার সম বেইচ্যা হেরে দিছে। তাও যুদি তর বইনে বালামত ঘর সংসার করবার পারত,দুইদিন বাদে বাদে জামাইয়ের কেচ্যা(মাইর)খাইয়্যা আমার বাইত আইয়্যা উঢে। আমার মুক খুলাইবি না।
আর আমার লগে বাড়াবাড়ি করলে আইজ তর
গু-মুত সাফ করতাম না। এমনেঐ পইরা থাকবি।

আজুয়াদ চুপ হয়ে যায়। কারণ আজ সে এমন অবস্থানে পড়ে আছে যেখানে থেকে রাফিয়াকে কিছু বলা তার পক্ষে অসম্ভব।সে এটাও জানে রাফিয়া মিথ্যা বলছে কারণ আমজাদ খান তানজিনাকে পুরাতন ভিট আর ভিটের সামনের এক বিঘা জমি ছাড়া কিছুই লিখে দেয় নি।

দশ বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আবরার মারা যায় আর আজুয়াদের কোমড় ভেঙে যায়। তখনই আজুয়াদের চাকরিটা চলে যায়। চার বছর আগে আমজাদ খান মারা যায়। তখন থেকেই পুুরো পরিবারের কর্তী হয় রাফিয়া।

সানজিদা তার বাবার বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু সেখানে কেউ তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার আগ্রহ দেখায় নি। তাই বাধ্য হয়ে এখন খান বাড়িতে রাফিয়ার কাজের লোকের মতো থাকে।

-আম্মা।
বলে ডাক দেয় রাফিয়ার একমাত্র ছেলে রফিক।

-আব্বা আইছো?দেহো তুমার লাইগ্যা মুরোগ রাইন্দা কহনেত্তে বইয়্যা আছি।যাপ মুক-আত দুইয়্যা আইয়্যো।

হাত মুখ ধুয়ে রফিক খেতে বসে। সে মুরগীর রানের টুকরো দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে আর বাইরে থেকে রেহানা খাতুন আর সানজিদা খালি পেটে অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছে।
এতে তাদের দুজনের লজ্জা বা রাগ কিছুই হচ্ছে না।
দৃশ্যটা ঘরে শুয়ে থেকে দেখছে আজুয়াদ। আর নিরবে চোখের পানি ফেলছে।

এটা এ বাড়ির নিত্য ঘটনা। রাফিয়া নিজের খেয়াল খুশিমতো এদের দুজনকে খাবার দেয়।


খান বাড়ির পুরোনো ভিটায় এখন একটা পাকা দালান উঠছে।
সেই বাড়ি বাইরে বড় একটা মুরগির খামার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। খামারে পাশের পুকুরের কিছু মাছ লাফাচ্ছে।

এসব কিছুর মালকিনই তানজিনা।সেদিন রাতে আজুয়াদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে সে চিরদিনের মতো ঐ বাড়ি ছেড়ে এ বাড়িতে এসে ওঠে । আমজাদ খান সব জানতে পেরে দুইটি জায়গা তানজিনাকে লিখে দেয়।
সাবিহা বেগমের গয়না বিক্রির টাকা দিয়ে জামালের মাকে সাথে নিয়ে একটা ছোট মুরগির খামার শুরু করেছিলো। সেখান থেকে লাভের টাকা জমিয়ে এই ভিটায় পাকা দালান তুলেছে,খামারটা বড় করেছে, আবার এখন একটা পুকুরও কেটেছে।

সন্ধ্যার পর।
বাড়ির প্রধান ফটক ধরে এক যুবক বাজার হাতে ভেতরে যাচ্ছে।

উঠানে লেবু গাছটায় নতুন ফুল ফুটেছে।

সেখানে দাঁড়িয়েই সে আওয়াজ দেয়,
-খালাম্মা ও খালাম্মা। খাদিজা ।

তানজিনা বের হয়ে দেখে যুবকটি ব্যাগ ভর্তি বাজার আর চার-পাঁচ কেজি ওজনের একটা রুইমাছ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

-আরে জামাল কি হইছে?এতো বাজার দিয়ে কি হবে?তোর মাথা ঠিক আছে।

-হ আমার মাতা ঠিক আছে।এই যে আইজকার আন্ডা(ডিম) বেচার টেহা। আরে এই খাদিজা কই গেলা তুমি? বাইরে আহ।
বলে অনেকগুলো টাকা তানজিনার হাতে দেয়।

ভেতর থেকে ছয়-সাত মাসের গর্ভবতী এক মহিলা বের হয়ে বলে,
-আমি এহানেই। কও কি কইবা।

-এই বাজারগুলান ঘরে নেও। এই মাছডা কাইট্টা আগে ফিরিজ রাহো। বড় একটা দেশি মুরগও আছে। কাইল পোলাও, গোশত আর মাছর মাতা দিয়া মুরিঘন্ড রানবা। আর মাছের পেডিঢি কড়া কইরা ভাজবা।

-পুস্কুনিত অতো মাছ থাকতে বাজারত্তন মাছ কেরে আনলা যে।

-পুস্কুনির মাছ ছুডু। বইনের জন্মদিবসো ছুডো মাছ কেমনে খাওয়াই?এর লাইগ্যা মুন্সি বাড়ির পুস্কুনীত্তে জালোরে(জেলে) দিয়া বড় মাছ ধরাইয়্যা আনলাম। কাইল সহাল সহাল রাইন্দো।

খাদিজা হলো জামালের স্ত্রী। জামালের মা কখনোই তানজিনাকে ছেড়ে যায় নি। সেই সুবাদে মায়ের মৃত্যুর পরও জামাল তানজিনার কাছে থেকে যায়। খাদিজাকে তানজিনাই পছন্দ করে বিয়ে করায়৷

-যাক এ বাড়িতে কারও অন্তত মনে আছে কাল আমার জন্মদিন। নাহলে মানুষ (তানজিনাকে উদ্দেশ্য করে) জানতো আমার বিয়ে ভেঙে গেছে সেই নিয়ে চিন্তা করছে আর মরাকান্না কাঁদছে।
ভেতর থেকে বের হতে হতে কথাগুলো বললো তানজিনার মেয়ে তারিন।

-বইন এইড্ডা তুমি কি কতা কইলা? তুমার জম্মদিবস আমি ভুইল্যা যামু এইডা অয়।

তানজিনা একটু রেগে বলে,
-তাই বলে এতো বাজার। আর তুই ভুলে যাস কেন খাদিজা গর্ভবতী এত কাজ করা তার পক্ষে কষ্টের।

জামাল কিছু বলার আগেই খাদিজা বলে,
-খালাম্মা, আপনে এত চিন্তা করুইন না। আমিতো খালি রানদি। আর বেবাক ভারি কাম তো আপনে আর আপনের পোলায়ই করেন। ডাক্তরেও কইছে এড্ডু গতর খাঢাইতে এইডা পেডের বাইচ্চার লাইগ্যা বালা।আপনেরা তো কুনো কামঐ করবার দেন না।

-কিন্তু তোরা যার জন্য এত কাজ করবি, সে দেখ কেমন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।বলি সে আমাদের কোন কাজে কোনদিন সাহায্য করেছে?

জামাল একটু রেগে গিয়ে বলে,
-খালাম্মা এইতা কি কতা কইন। আমার বইনে অইল রাইজকইন্যা। খাদিজা কাম না করবার পারলে, বেবাক কাম আমি করুম। তাও আমার বইনেরে কুনো কাম করবার দিমু না।

-তুমি থামোতো। খালাম্মা, আমার লাহান এতিম এই বাইত আইয়া মা পাইছি, বইন পাইছি।বড় বইন বাইচ্যা থাকতে ছোড বইন কাম করবো এইডা অয়?

-তোরা দুইজন লাই দিয়েই তারিনকে মাথায় তুলেছিস। নাহলে পাত্র পক্ষের সামনে এভাবে কথা বলে।

-এনার সাথে কথা বলে লাভ নেই সারাদিন মাথায় বিয়ে ঘুরে। চলো ভাবী বাজারগুলো আমাকে দাও নিয়ে যাই। দুজনে তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিই। আজকে আমি আমার ভাতিজিকে শেক্সপিয়ার পড়ে শুনাবো।

তারিন ভেতরে যাচ্ছিলো তখন তানজিনা বলে,
-জন্মদিনে একবার বাবার সাথে দেখা করবে না?

এবার তারিন ক্ষেপে যায়।
-দাদা যেদিন মারা গেছে সেইদিন ঐ বাড়ির সাথে আমার সব সম্পর্ক মুছে গেছে। ঐ বাড়ির লোকের প্রতি তোমার দয়া থাকলেও আমার নেই।আমি তো এটাই বুঝতে পারি না এত বছরেও তুমি ঐ লোকটার কাছ থেকে তালাক কেন নাও নি।

তারিন খাদিজাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো।

তানজিনা মেয়েকে কিছু বলতে পারলো না। কিন্তু মনে মনে বললো,
-তুই বুঝবি নারে মা। কারণ তোকে আমি আর পাঁচটা মেয়ের চেয়ে আলাদা করে গড়ে তুলেছি।তোর বাবাকে তালাক দেওয়া মাত্রই আমার গায়ে তালাকপ্রাপ্ত মহিলা হওয়ার পোস্টার লেগে যেতো। তখন চারপাশ থেকে কিছু পুরুষ শকুনের মতো আমার উপর নজর দিতে। কিছু মহিলা আমার নামে কুৎসা রটনায় ব্যস্ত হয়ে পড়তো। তখন সমাজ আমাকে একঘরে করে দিতো। আর তোকে নিয়ে আমি এই সমাজে বাঁচতে পারতাম না। তারচেয়ে একজনের নাম সাথে জড়িয়ে যদি একটু ভালভাবে সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারি তাহলে ক্ষতি কি।

-খালাম্মা।
জামালের ডাকে ধ্যান ভাঙে তানজিনার।
-হ্যাঁ, বল।
একটু অভিযোগের স্বরে জামাল বলে,
-খালাম্মা আপনে বইনের উপরে রাগ করেন কেন? বইনে কত বড় চারহি করে। আমাগো গেরামে কলেজো ইংরাজি পড়ায়। যহন ডাক্তরে কইলো আমার মাইয়্যা অইবে তহন ঐ ঠিক করছি আমার মাতায় কুনোদিন লেহা-পড়া ঢুহে নাই তয় কি অইছে? আমার মাইয়্যারে বইনের মতো শিক্ষিত বানামু।

-তোরা বুঝতে পারবি না জামাল আমার কষ্টটা কোথায়৷ মেয়েতো আমার হীরের টুকরো কিন্তু জহুরি যে পাই না।এতো বয়স হয়ে গেছে এখনো বিয়ে হয় নি।নানান লোকে নানান কথা বলে। মরার আগে মেয়ের স্বামী -সংসার দেখে যেতে পারবো কি-না কে জানে।

-খালাম্মা আল্লায় যেদিন চাইবো হেইদিন সব অইবো।

-আর কবে? কতগুলো বিয়ে তো সব ঠিকঠাক হওয়ার পর ভেঙে গেলো।

-খালাম্মা হেইডাতো রফিক্যা করছে। হেই বাড়ির হেরা জ্বলে, আমনের বালা চায় না। এর লাইগ্যা ঐত্তো যত্তবার বইনের বিয়ার পাক্কা কতা অইছে রফিক্যা পোলার বাইত গিয়া উল্ডা-পাল্ডা কতা কইয়া বিয়া বাঙানি(ভেঙে) দিছে। আর বাকিগুলান তো বইনেই বাঙছে কারণ পোলারা টেহা(টাকা) চাইছে।

জামাল চলে গেলো।

রাফিয়ার কারণে আজও তানজিনার জীবনের সুখ বিঘ্নিত। নিজের ছেলেকে দিয়ে বার বার রাফিয়া তানজিনার ক্ষতি করেছে৷
কখনো পুকুরে বিষ দিয়েছে, কখনো ফসলের ক্ষেত আগুন লাগিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে বার বার তারিনের বিয়ে ভেঙে দিয়ে ।

সতীনকাঁটা এখনো তানজিনার জীবনে ফুটে আছে।

তানজিনা একটু বির বির করে বলে,
-মা তুমি বেঁচে থাকলে দেখতে এই সমাজটা আজও বদলায় নি। মেয়েরা যতই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাক না কেন, তাদের পাশে স্বামী নামের একটা সাইনবোর্ডের প্রয়োজন হয়।


রাতে তারিনের আওয়াজ শুনা যায়।
তানজিনা উঁকি দিয়ে দেখে। তারিন খাদিজাকে পড়ে শুনাচ্ছে,

Blow, blow the winter wind
Thou(you) are not so unkind
As man’s ingratitude

তানজিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে চলে যায়।
সে ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে,
অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত।

তানজিনা খেয়াল করে, বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকাগুলোর আওয়াজ অন্ধকারটা ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর করে তুলছে।


(সমাপ্ত)

বিঃদ্রঃ গল্পের সমাপ্তি কিংবা কাহিনি পছন্দ না-হলে আমাকে দোষ দিবেন না। এর জন্য শরৎ বাবু আর জহির রায়হান সাহেব দায়ী।
সমাজিক গল্প বলতে যা শিখেছি, প্রথম তাদের গল্প পড়েই শিখেছি।
তাদের দুইজনের গল্প পড়েই আমি শিখেছি গল্পের শুরুতে যা ভাবি শেষটা কখনো তেমন হয় না। সামাজিক গল্প তখনই সফল হয় যখন তাতে অপূর্ণতা আর আফসোস মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

সতীনকাঁটা পর্ব ৬

0

#সতীনকাঁটা পর্বঃ৬
লেখায়ঃ(Nosrat Monisha)

-আম্মু এই সিদ্ধান্তটা আমি নেই?
মেয়ের কথায় সাবিহা বেগম একটুও অবাক হয় না।
-জীবনটা তোমার তানু। তাই তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।তবে এইবার আর ভুল করো না।

তানজিনা মুচকি হেসে বলে,
-সেটা তো সময় বলে দিবে আম্মু। এইতো পাঁচ মিনিট আগেও আমি তোমার কথামত নতুন একটা জীবনের স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু নিয়তি আবার তার খেলা দেখালো।যখন আমি একা ছিলাম আমার সিদ্ধান্ত একরকম ছিল। কিন্তু এখন আমার সাথে আরেকটা জীবন জড়িয়ে আছে। তাই তাড়াহুড়ো করে আমি কিছু করতে চাই না।

-কি করতে চাও তুমি?

-বলছি তার আগে আমি আব্বুর সাথে কিছু কথা বলতে চাই। আম্মু তুমি খুব খেয়াল করে শুনবে কথাগুলো।

তারপর তানজিনা নিজের বাবাকে বলে,

-আব্বু আজুয়াদ আমাকে তালাক দিলে তুমি কি সারাজীবন আমাকে আর আমার বাচ্চাকে তোমার বাড়িতে থাকতে দিবে।দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের ব্যবস্থা না হয় আমি নিজেই করে নিবো।

তানজিনা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তাকে থামিয়ে পাশ থেকে আজুয়াদ বলে উঠে,
-আমার দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ তোমাকে আমি তালাক দিবো না।

-আমি আমার বাবার সাথে কথা বলছি। তুমি একটু চুপ থাকো না হয় বাইরে চলে যাও৷
বলে আজুয়াদকে ধমক দেয়। তানজিনার ধমক শুনে আজুয়াদ চুপ হয়ে যায়।

-যা বলছিলাম আব্বু তুমি বলো। তুমি কি আমাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে, আমাকে কেউ কোন দিন বাপের বাড়ি থাকার জন্য খোটা দিবে না বা সেখানে কখনো আমাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে বাধ্য করা হবে না। বাবা আবেগী হয়ে আমি আবার ভুল করতে চাই না। তাই তুমিও সত্যটা বলো কোন লুকোচুরি না।

জমির ভুঁইয়া নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো।তার সেই ছোট্ট অবুঝ কল্পনা বিলাসী মেয়েটা আজ কত বাস্তববাদী হয়ে গেছে।

-তুই সারা জেবন এলহা থাকতে চাছ?এমনে কি জেবন চলে?

-আব্বু কথা ঘুরিয়ো না। সরাসরি উত্তর দাও।

-না এইডা ত অয় না। এক বস্সর, দুই বস্সর না অয় মাইনা নিলাম। বাদে?বাদে কি অইব?মাইনসে কি কইবো?
-আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি।

বলে সে তার মায়ের কাছে যায়।

-আম্মু, তোমার মেয়েকে নিয়ে তুমি যতই স্বপ্ন দেখো না কেন আমাদের এই সমাজটা এখনো একটা মেয়েকে স্বপ্নপূরণের পুরোপুরি অধিকার দেয় নি।
আম্মু আমরা মেয়েরা যতই শিক্ষিত আর প্রতিষ্ঠিত হই না কেন আমাদের পাশে স্বামী নামক একটা সাইনবোর্ড লাগে। নাহলে এই সমাজ আমাদের একঘরে করে দেয়। এখন তোমার সাথে গেলে তাই হবে যা বাবা বললো। প্রথম প্রথম মানুষ সহানুভূতি দেখাবে পরে আবার তারাই আমার নামে কুৎসা রটনা করবে। আমার সন্তানকে বলবে তোর মা কলঙ্কিনী তাই স্বামীর ঘর করতে পারে নি।
আর আবার বিয়ে করলেই যে সেই বাড়িতে সম্মান পাবো তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? তারা যদি আমার সন্তানকে মেনে না নেয় তখন। মা আমি বলছি না সবাই খারাপ। কিন্তু আম্মু আমি ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘেও ভয় পাই। তাই আবার বিয়ে করে নতুন কাউকে নিয়ে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সাবিহা বেগম বলে,
-বুঝতে পারলাম তোমার কথা কিন্তু তুমি কি করতে চাও একটু খুলে বলো।

-মা আমি আজুয়াদকে ক্ষমা করবো কি-না সেটা আমার বাচ্চা জন্মের পর ঠিক করবো। আমিও দেখি ছেলে না মেয়ে? আল্লাহ কি চায়? আমি আজুয়াদের সাথে থাকি, না ওর থেকে আলাদা হই।তাছাড়া তুমিই তো বললে গর্ভে সন্তান থাকলে তালাক হয় না।তবে আম্মু একটা কথা মনে রেখো, সতীনের সাথে এক সংসারে তোমার মেয়ে থাকবে না। কিন্তু আজুয়াদের সাথে আমি থাকবো কি-না সেটা আল্লাহর হাতে।

সাবিহা বেগম কিছু বলবেন তার আগেই তানজিনা আবার বলে,
-আম্মু আর একটু বাকি আছে। বাবা আপনার সাথে কিছু কথা আছে।
আমজাদ খান একটু নড়েচড়ে বসে বলে,
-কি কইবা কও

-বাবা রাফিয়ার সাথে আমি এক বাড়িতে থাকবো না। কিন্তু আপনি তো বলে দিলেন যে, রাফিয়া এই বাড়িতেই থাকবে।

-তয় তুমি কি কয়ডা মাসের লাইগ্যা বাপের বাইত যাইবার চাও।

-না বাবা। সেখানে যাওয়ার হলে আব্বুকে বলতাম। আপনাকে না।

-তয় কই যাইবার চাও?

-আব্বা আমি এই কয় মাসের জন্য পুরাতন বাড়িতে গিয়ে থাকতে চাই আপনি ব্যবস্থা করুন।

আমজাদ খান চমকে গেল। কারণ কোন মেয়ে যে পাকা দালানের ঘর ছেড়ে জীর্ণ-শীর্ণ ভাঙা টিনের বাড়িতে থাকার কথা ভাবতে পারে সেটা তার জানা ছিলো না।

রেহানা খাতুন এ কথা শুনে গরম তেলে দেওয়া কই মাছের মতো টগবগ করে ফুটে উঠে।

-বলি আক্কেল জ্ঞিয়ান কিচ্ছু আছে নি তোমার। পেট লইয়া পুরান বিডাত(ভিট) যাইবার কিতা কও। মাইনসের লগে মুক দেহাইতে পারুম?

-মা আমি কথাটা বাবাকে বলেছি। আর মুখ না দেখাতে না পারার কি আছে? আপনার ছেলের বউ চলে যাচ্ছে না শুধু অন্য বাড়ি থাকছে তাও আবার আপনাদেরই৷কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবেন দুই সতীনের ঝগড়া হবে তাই আপনারাই পাঠিয়ে দিয়েছেন, মিটে গেলো।

আমজাদ খান স্ত্রীকে চোখ রাঙিয়ে বলে,
-হারামজাদি, বেত্তমিজ মাইয়্যা মানু কুমবালাত্তে (অনেকক্ষণ) কইতাছি চুপ কর। হুনে নি আমার কতা। এইবার মুক খুললে তরে পোলার হউর বাড়ির মাইনসের সামনে ছেঁছুম(মার দিবো)।

এবার রেহানা খাতুন ভয় পেয়ে চুপসে গেল ।

-ছোড বউমা তুমি কও। হেইহানে তুমারে দকবো কেডা?
-বাবা আজকে এক মুহূর্তের জন্য আমাকে নিজের মেয়ে ভেবে বলুন এই বাড়িতে আমাকে দেখার মত কে আছে?এত অন্যায় অবিচারের মধ্যে কি আমি ভালভাবে বাচ্চার জন্ম দিতে পারবো?আপনি বলুন আপনারা কখনো কি আমার সাথে দুটো ভালো কথা বলেছেন? সেখানে গেলে অন্তত এইসব মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো৷

আমজাদ খানের জীবনে প্রথমবার তানজিনার জন্য খারাপ লাগলো। সত্যিতো মেয়েটা এ বাড়িতে শুধু অত্যাচার সহ্য করে গেছে।সবার সব কাজ করেছে।
-ঠিক আছে। তয় এলহা এলহা পুরান বিডাত তুমারে দেই কেমনে কও দেহি?

আজুয়াদ বলে,
-আব্বা আমি সাথে যাবো।

-তুই কেমনে যাবি? পরের সাপ্তা থেইক্যা তোর অপিস যাওন লাগবো।তাই আমি কই কি ছোড বউমা তুমি বাপের বাড়িতে যুদি যাইতে চাও যাইতে পারো ।

-না বাবা, আমি পুরানো বাড়িতেই যেতে চাই। আমি জামালের মা’কে বলবো আমার সাথে থাকতে। সে এমনিতেও দুধের ছেলেটাকে নিয়ে খাবারের কষ্ট করে। জামালের বাবা মারা যাওয়ার পর দু’বেলা খাবারের আশায় দেবর -ভাসুরের সংসারে চাকরানীর মতো খাটে। আমার সাথে থাকলে তো সেটা করতে হবে না।

আমজাদ খান দেখলেন এটা সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি এতে মানসম্মান আর নিজের ভাগ্নীর সংসার দুটোই বেঁচে যায়।

-আইচ্চা তয় আমি বেবাক বাউ করি।

-বাবা, আরেকটা আবদার। আমার ঐ বাড়িতে সময় কাটবে না তাই যদি কিছু বই নিয়ে যেতে দিতেন।

-হ নিবা। পোয়াতি থাইক্যা বই পললে আমার নাতি বিদ্যা লইয়া জম্ম নিবো। তয় আমার রাইত লইয়া ডর, ভাঙ্গা টিনের ছাড়ফা (বেড়া)।

-বাবা আপনি শুধু শুধু ভাবছেন। জামালের মা থাকবে তো, আর আপনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় একবার ঘুরে আসবেন।
আর আপনি কি এত ভাবছেন বলুন তো, খান বাড়ির বউয়ের দিকে কে নজর দিবে? এমন সাহস কারও আছে।

-এইডা অক্করে খাঁডি কতা কইছো তুমি।


আবারো মা-মেয়ে একান্তে।
তানজিনা মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে,
-আমার উপর আবার তোমার অনেক রাগ হচ্ছে তাই না আম্মু?

মেয়েকে ছাড়িয়ে সাবিহা বেগম বলে,
-সত্যি বলতে, তোমার উপর একটু আগে অনেক রাগ হয়েছিলো। কিন্তু এখন ভেবে দেখছি তুমি ঠিক বলেছো।
তানু, তুমি তখন অনেক ছোট। তোমার বাবা আর আমার মধ্যে সামান্য একটা বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। তিনি আমাকে খুব মেরেছিলেন। আমার অনেক রাগ হয়েছিলো। আমি তোমাকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। প্রথম দুই তিন দিন সব ঠিক ছিলো।
এরপর থেকে শুরু হলো সবার কথা, তোর স্বামী কোথায়? কবে আসবে?
একদিন তোমার নানা ডেকে বলে ,
তিনি তোমার বাবাকে খবর পাঠিয়েছে আমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। আমি যেন তার সাথে ফিরে যাই, যদি তা-না করি তাহলে যেন আমি তোমার বাবাকে তালাক দিয়ে দেই৷ আর তোমাকে তোমার বাবার সাথে পাঠিয়ে দেই। কারণ তার কথা ছিলো তালাক প্রাপ্ত কালো মেয়েকে কেউ হয়তো বিয়ে করবে, কিন্তু বাচ্চা থাকলে তা প্রায় অসম্ভব ।

-এরপর?

-আমার পক্ষে তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারা সম্ভব ছিলো না বলে তোমার বাবার সাথে ফেরত চলে এলাম। তিনি সবার সামনে কথা দিয়েছিলেন আর কখনো আমার গায়ে হাত তুলবেন না।
কিন্তু কি বলোতো,কিছু পুরুষ মানুষ হয় কুকুরের লেজের মতো কখনো সোজা হয় না। তিনি আবার একই কাজ করেছিলেন।তবুও আমি বাবার বাড়ি যাই নি। কারণ বাবার বাড়ি গেলে আবার সেই এক ঘটনা ঘটতো।
তাই মার খেয়েও সংসার করে যাচ্ছি । তোমার বাবা আমাকে খুব বেশি মারতেন না কিন্তু একটা দুটো থাপ্পড়ই যথেষ্ট ছিলো আমার ভেতরটা ভেঙে দেওয়ার জন্য।এমনকি তোমাদের সামনেও কত মার খেয়েছি।সেই জন্য হয়তো তোমারও আমাকে কখনো সেভাবে মূল্য দাও নি।

-আম্মু

-জানোতো তোমার নানাকে প্রশ্ন করেছিলাম,
আমি তার মেয়ে আমার কি কোন হক নেই? কেন ঐ বাড়িতে আমি সারাজীবন থাকতে পারি না। তিনি জবাব দিয়েছিলো, হক ততক্ষণ পাবো যতক্ষণ সাথে স্বামী নিয়ে যাবো, অথবা সব অতীত মুছে দিয়ে ফেরত যাবো।
আমি বুঝতে পারছি, যে কথা আমি বাবার বাড়িতে দু’দিন থেকে বুঝেছিলাম সেটা তুমি এখন বুঝে গেছো।
তবে তোমাকে একটা কথা বলি, যা-ই হোক আমাকে লুকিয়ে যেও না। আমি হয়তো তোমাকে ঐ বাড়িতে সবসময়ের জন্য রাখতে পারবো না কিন্তু তোমার লড়াইয়ের সাথী হতে পারবো। নিজেকে কোনদিন একা মনে করবে না। মনে রাখবে তোমার মা তোমার মা তোমার সাথে সবসময় আছে।

ভুঁইয়া বাড়ির লোকজন চলে গেলো।

কিছুদিন পর রাফিয়া আর আজুয়াদের বৌভাত হয়।
এরপরই তানজিনা খানদের পুরানো বাড়িতে উঠে যায়।
আজুয়াদ ঢাকা চলে যায়।

একমাস পর পর শুক্রবারে আজুয়াদ আসে তানজিনার কাছে। তানজিনার সাথে তার শুধু কুশলাদি বিনিময় হয়।


তখন তানজিনার সাতমাস চলে। তার নানা কিছু খেতে মন চায়।
তানজিনার শ্বশুর প্রতিদিন একবার এসে খোঁজ নিয়ে পরদিন বাজার পাঠিয়ে দেয়। ইদানিং তিনি তানজিনাকে খুব সমীহ করে।

বাইরে চুলায় গরুর মাংস রান্না করছে জামালের মা। জামাল উঠানে আতাগাছটির নিচে মাটি নিয়ে খেলছে।
তানজিনার খুব মিষ্টি কুমড়া দিয়ে গরুর মাংস খেতে মন চাইছিলো। তাই এ রান্না।
মাংসের গন্ধ নাকে পৌঁছাতেই ঘর থেকে একটা বই নিয়ে এসে উঠানে বসে তানজিনা।
সে কপালকুণ্ডলা পড়ছিলো।

হঠাৎ আজুয়াদ এসে দাঁড়ায়।
তানজিনা কেবল বইয়ের এই লাইনটা পড়েছে,
যেখানে কপালকুণ্ডলা নবকুমারকে বলছে,
-পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?

আজুয়াদকে দেখে তানজিনার তাই মনে হলো সে পথ হারিয়েছ৷

জামালের মা ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷
-বাইজান আমনে বিতরে গিয়া বহেন।আমি শরবত কইরা আনি৷

তানজিনা ধীরে ধীরে উঠে ঘরে চলে যায়। আজুয়াদও যায়।

-তানু তুমি ভালো আছো?
-তোমার বাড়ি থেকে অনেক বেশি। তা হঠাৎ কি মনে করে?
-কেন আমিতো এখানে আসি।
-সেটা মাসের প্রথম শুক্রবারে আজ তো মঙ্গলবার আবার মাসের শুরুও নয় ।
-জমির একটা মামলা ছিলো। তার হাজিরা দিতে এসেছি ভাবলাম তোমাকে দেখে যাই।
-ভালো করেছো, খেয়ে যেও। কিন্তু তুমি তো মিষ্টি কুমড়া খাও না। আমি জামালের মাকে বলে আসি একটু তরকারি আলাদা করে রাখতে।
-থাক না। একদিন খেলে কিছু হবে না। তুমি বসো।

-যা অপছন্দ তার জন্য জীবনের একমুহূর্তও ব্যয় করা উচিত না। তাতে বিরক্তি বাড়ে।
বলে তানজিনা চলে যায়।

এই কয় মাস আজুয়াদ তানজিনাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করতে চেয়েছে, যদি মেয়ে হয় তবে সে কি করবে? কিন্তু আজকেও জিজ্ঞেস করতে পারে নি।

এভাবে আরও দুই মাস কেটে যায়।

একদিন ফজরের সময় জামালের মায়ের চিৎকার শুনা যায়।
-ওরে কেউ আছুননি? ছুড়াইয়া(জলদি) বাইর অইন নাইলে সব্বনাশ অইয়া যাইবো।

চিৎকার শুনে খান বাড়ির সবাই বের হয়ে উঠানে আসে।
রেহানা খাতুন বিরক্ত হয়ে বলে,
-কি লা? এমনে চিল্লাছ কেন জামাইল্যার মা? কেউ মরছে নি।

বিলাপ করে জামালের মা বলে,
-আল্লা বিবিসাব ইতা কিতা কইন? ভাবীর বেদনা উঠছে। ছুড়াইয়া কিছু করুইন।

রেহানা খাতুন মুখ বিকৃত করে,
-উঁহ! খুব এলহা থাহুনের সক উতলাইয়া উঠছিন অহন।

আমজাদ খান স্ত্রীকে উদ্দশ্য করে বলে,
-হারামজাদি তরে মনডায় চাইতাছে কিযে করাবার লাইগ্যা। কিন্তুক অহন সময় নাই৷ জামাইল্যার মা তুই যা দৌড়াইয়্যা গিয়া দাই আর ঐ বাড়ির করিম মুন্সির বউরে ডাইক্যা লইয়া আয়। আর তোমরা হগ্গলতে লও পুরান বাইত যাওন লাগবো।
জামালের মা চলে যায় দাই ডাকতে।

রেহানা খাতুন মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-হেন কি মেমানি নাহি? যে হগ্গলতের যাওন লাগবো।লও তুমার লগে আমি যাই আর হেরা বাইত থাহুক। আফিয়া তুই বেইল(দিন) উঠলে মুরগীডি ছাইড়া খাওন দেইছ।

সানজিদা বলে,
-কইছিলাম কি আম্মা এমুন সময় আমি না থাকলে মাইনসে নিন্দা করবো। লাক কতার এক কতা, হেয় তো আমার বইন।

-অঁহ! আইছে বইন। এই সাতমাসে একবার বইনের মুকও দেহ নাই। অহন ঢং কইরো না।

আমজাদ খান খেঁকিয়ে উঠে,
-তুমরা কি এহানে খারাইয়্যা তামশাই করবা নাকি, যাইবাও।

-আরে তুমার ছোড বউমা মইরা যাইতো না। আইবোদ আমারও অইছে লও যাই।

তারা তিনজন যাচ্ছিলো তখন রাফিয়া এসে বলে,
-আব্বা আমিও লগে যামু।দেহি আমার কপালো কি লেহা আছে।

কেউ কিছু বলতে পারলো না। কারণ আজ সত্যি সবাই দেখতে চায় ওদের কপালে কি লেখা আছে।

চারজন মিলে পুরনো বাড়ি গেলো।
আমজাদ খান বাইরে অস্থির পায়চারি করতে লাগলো।

ভেতর থেকে রেহনা খাতুন আর দাই বের হয়ে এলো।
একরাশ আশঙ্কা নিয়ে রেহানা খাতুন বলে,
-আবরারের আব্বা হুনেন, ছোড বউয়ের অবিস্তা তো বেশি বালা না।

আমজাদ খান তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
-কি কও এইগুলান তুমি।

দাই একটু বিলাপের সুরে বলে,
-হরে আমজাত। আইজ চল্লিশ বস্সর আমি দাইয়ের কাম করি এমুন দেহি নাই।যা খুশি অইবার পারে৷ তুই হেরে এড্ডা ডাক্তরের বারাত লইয়া যা।

আমজাদ খান কথাটা শুনে দমে যায়। তারপর গুরুগম্ভীর গলায় বলে,
-আপনের আতে গেরামের বেবাকতের আইবোদ অইছে আজুর বউয়েরটাও অইবো।
এই গেরামে বেবাক ডাক্তর বেডা। খান বাড়ির বউরে বেগানা(পর) পুরুষ মাইনসে আত লাগাইবো আমি আমজাদ খান বাঁইচ্যা থাকতে হেইডা অইবো না।

দাই যেন একটু রেগে যায়।
-তয় কেউ মরলে আমারে দুশ দিছ না।মাও মরতারে, বাইচ্চাও।
বলে দাই ভিতরে গেলো। পিছন পিছন রেহানা খাতুন।

রাফিয়া উঠানে আতাফল গাছটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ছে।

আর সানজিদা ভেতরে তানজিনার পাশে বসে মনে মনে দোয়া করছে যেন মেয়ে হয়, না হলে যেন বাচ্চাটা মারা হয়। কারণ খান বাড়ির প্রথম ছেলের জন্ম সে দিতে চায়।

পূর্বাকাশে নতুন সূর্য রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে।
তখন আমজাদ খান ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। কিন্তু আওয়াজটা একবারই হয় তারপর থেমে যায়।

রাফিয়ার বুকের ভিতরটা ধুকপুক শুরু করে।

আমজাদ খান দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ বেরিয়ে আসে না।
আমজাদ খানের মনে ভয় ঢুকে যায়।
তিনি মনে মনে বলে,
-তয় কি কুনো বদ(খারাপ) খব্বর(খবর)?

চলবে

সতীনকাঁটা পর্ব ৫

0

#সতীনকাঁটা পর্ব-৫
লেখায়ঃ(Nosrat Monisha)

-ও মা গো! কি সব্বনাশ অইলো গো।
সানজিদার চিৎকার শুনে সবাই বের হয়ে দেখে,
ঝড়ে উঠানের বড় জলপাই গাছটা উপড়ে গিয়ে গোয়াল ঘরের উপর পড়েছে। এতে সাত মাসের গর্ভবতী লাল গাভীটা জিহ্বা বের করে মরে পড়ে আছে।

সবার সাথে তানজিনা, রাফিয়া আর আজুয়াদও এলো।
সবার কষ্ট হচ্ছে। নিরীহ মৃত গরুর খোলা চোখ, পাষাণের চোখেও পানি এনে দিবে।

-এইগুলান হইতাছে তুমার লাইগ্যা ছোড বউমা।

তানজিনা অবাক হয়ে যায় শ্বাশুড়ির কথায়।

তানজিনার হয়ে জবাবটা আজুয়াদ দেয়,
-মা ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়েছে। এর মধ্যে তানু এলো কিভাবে?
-নতুন বৌ হের লাইগ্যা কেওয়ার(দরজা) দইরা(ধরে) ঘুমাইলো। বাইত বালা কিছু অইবো কেমনে। অালিক্কী(অলক্ষী) একটা ।

-আম্মা বন্ধ করো । আমি নতুন বৌকে বাইরে রাখছি এতে তানুর, কি দোষ ?

আফিয়া বলে,
-আপনের কানে এইসব মন্তর(মন্ত্র) তো ছোটভাবীই দিছে ছোড ভাই।

-তা যা কইছো আফিয়া। বলি তানজিনা আফা অত বড় সব্বনাশটা না করলে তুমার শান্তি লাগতাছিন না, তাই-না?

আজুয়াদ অনেক রেগে যায়,
-আফিয়া আর একটা কথা বললে তোর হাড়-গোড় সব ভেঙে দিবো আমি।এই যে ভাবি আপনারে সাবধান করতেছি, তানুর সাথে এমন করে যদি আর কোনদিন কথা বলেন আমি আপনাকে দেখে নিবো। আমি এতদিন অনেক সহ্য করেছি আর না।

অন্য সময় হলে তানজিনা খুশিতে গদগদ হয়ে যেত, কারণ আজুয়াদ তার পক্ষ নিয়ে বাড়ির সবার সাথে ঝগড়া করছে। কিন্তু আজকে আজুয়াদের এই আদিখ্যেতা দেখে তার মেজাজ খারাপ হলো।

তাছাড়া এই গাভীর নির্মম মৃত্যুটা সে মেনে নিতে পারছে না, এই বাড়িতে ঐ জীবটাইতো ছিলো যে নিরবে তার সব দুঃখের কথা শুনতো। তানজিনা গরুটার একটা নামও দিয়েছিলো সুখী। এটা নিয়ে এবাড়ির সবাই কত ঠাট্টা করেছে।

তানজিনার সবসময়ই মনে হতো খান বাড়ির মানুষগুলোর চেয়ে এখানকার হাঁস-মুরগি আর সুখী তাকে বেশি ভালবাসে। তাই এদের নিয়ে তানজিনার খান বাড়িতে একটা আলাদা সংসার তৈরি হয়েছিল। সেই সংসারের একজন আজ তাকে ছেড়ে চলে গেছে।
তানজিনার চোখ ভরে কান্না আসছে, কিন্তু এদের সামনে কাঁদলে এরা মজা পাবে। তাই ঘরে চলে গেল।

ঘরে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভাবতে লাগলো,
-আমি যাকেই ভালবাসি সেই কেন আামাকে ছেড়ে দূরে চলে যায়? গতকাল সকালেও তো সব ঠিক ছিলো।আমার জীবনটা সুন্দর সাজানো ছিল। এই ঝড়ে কেন সুখী মারা গেলো? গাছটা আমার উপর কেন পড়লো না?একবার তো ভেবেছিলাম মরে যাবো কিন্তু আমি এত ভীতু যে মরার জন্য যেটুকু সাহস লাগে তাও আমার নেই।

তারপর উপরের দিকে তাকিয়ে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে বলে,
-আল্লাহ আমার জীবনটা কেন এমন হলো? তুমি আর কত কষ্ট দিবে আমায়?


-না বেয়াইসাব এইডা অয়না। আমরা বাড়ির মাইয়্যা হত্তীনের ঘর করব না। আফনে জামাইয়ের নতুন বউ ছাড়ানির(তালাক) বাউ (ব্যবস্থা) করুইন।
কথাটা বলছে তানজিনার বাবা।

কাল রাতে সানজিদার কাছ থেকে সব শুনে আজ সকালেই তানজিনার বাপের বাড়ির লোকেরা খান বাড়িতে হাজির হয়েছে।
তানজিনার বাবা জমির ভুঁইয়া আর চাচা কবির ভুঁইয়া আমজাদ খানের সাথে এসব নিয়েই তর্ক-বিতর্ক করছে।

আর এদিকে তানজিনার মা সাবিহা বেগম তানজিনার ঘরে একান্তে বসে মেয়ের সাথে কথা বলছে।

তিনি মেয়ের উপর ভীষণ রেগে আছেন।
-কবে তুমি এত বড় হয়ে গেলে তানু যে, এত বড়ো একটা ঘটনা নিজের মাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করনি।

তানজিনা একটু গম্ভীর আর ভারাক্রান্ত স্বরে বল,
-সেইদিন আম্মু যেদিন তুমি আমাকে পর করে দিয়েছিলে। কসম দিয়েছিলে এ বাড়িতে যাই হোক না কেন, ঐ বাড়ি যেন ফিরে না যাই।

-পিটিয়ে তোমার পিঠের চামড়া তুলে নেবো আমি। এমনিতে তো মায়ের কোন কথা শুন না সেদিন রাগের মাথায় একটা কথা বলেছি আর সেটা ধরে বসে আছো তুমি? কবে বুঝবে, তোমার চেয়ে দামী আমার কাছে এই দুনিয়ায় আর কিছু নেই ।
তানজিনা মায়ের এই কথা শুনে আনন্দে কেঁদে দিলো।
-আম্মু!

সাবিহা বেগম মেয়েকে টেনে বুকে নিলেন।

একটু ধীর গলায় বলতে লাগলেন,
-যখন তুমি জন্মালে তখনই ঠিক করেছিলাম তোমার জীবনটা আমার মত হবে না। তুমি পড়বে, বড় চাকরি করবে,নিজের পায়ে দাঁড়বে । আর তুমি আজুয়াদের সাথে প্রেম করে সব নষ্ট করে দিলে।তোমার বাবা যখন তোমার বিয়ে ঠিক করে সেই বিয়ে ভাঙার জন্য আমি কি-না করেছি।

মায়ের এই কথা শুনে অবাক হলো তানজিনা।
মায়ের বুকে থেকে মুখ উঠিয়ে প্রশ্ন করে,
-আম্মু এইসব কথা তো তুমি আগে কখনো বলো নি।

সাবিহা বেগম একটু হাসলো।
-তুমি কখনো জানতে চেয়েছো?দোষ তোমার না। আসলে যে নারীর স্বামী তাকে সম্মান করে না সেই মেয়ে শ্বশুর বাড়ির মানুষ কিংবা তার সন্তানদের কাছ থেকে সম্মান পায় না।
তানজিনা অস্ফুটস্বরে বলে,
-আম্মু!

-কি হলো এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। তানু এমন না যে তোমার বাবা, আমি কালো বলে আমায় ভালবাসে না। তিনি আমাকে খুব ভালবাসে। কিন্তু ভালবাসা আর সম্মান এক নয়। আর সেই জন্যই হয়তো তুমি কিংবা তোমার ভাই কেউই কোনদিন আমাকে সেই সম্মানটা দিতে পারনি যেটা পাওয়ার যোগ্য আমি।

মুখভার করে তানজিনা বলে,
-আম্মু, আমাকে কি মাফ করা যায় না?

-পাগল মেয়ে এখানে মাফ চাওয়ার প্রশ্ন কোথা থেকে আসছে?তোমরা দুইজন ছোটবেলা থেকে যা দেখেছো তাই শিখেছ । তোমার বাবা যদি আমাকে সম্মান দিতো তবে কখনো কারও সাহস হতো না আমাকে অপমান আর অসম্মান করার। কিন্তু তানু এখন এই বয়সে এসে বুঝতে পেরেছি যে ভুলটা আমার ছিলো।
ততক্ষণ সংসারে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো যতক্ষণ সেখানে তোমার সম্মান বজায় থাকে। যদি নিজের সম্মান নষ্ট করে কিছু মেনে নিতে হয় তবে থেমে যাও।কারণ সম্মান এমন একটা জিনিস যে, কেউ তোমাকে যেচে দিবে না তোমার আাদায় করে নিতে হবে। আমার ভুলটা কোথায় ছিলো জানো?
আগ্রহ ভরে বাচ্চাদের মতো প্রশ্নটা করে,
-কোথায় আম্মু?

-তোমার নানার বাড়ির লোকের বরাবরই আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা ছিলো। কালো মেয়ের বিয়ে হবে কি করে? আমি ডাক্তারিতে ভর্তি হয়েছিলাম তখন তোমার দাদা আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ার কাছ থেকে আমার বাবার বাড়ির টাকা-পয়সার কথা শুনে আমাকে ঢাকায় দেখতে যায়। মোটা যৌতুকোর লোভে তোমার দাদা বিয়ে করাতে রাজি হয়ে যায়। আমার ডাক্তারি পড়া মাঝপথে থামিয়ে অজপাড়াগাঁয়ে আমাকে বিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হয়েছিল তোমার নানা। বাবার মুখে কন্যা বিদায়ের আনন্দ দেখে আমি নিজের স্বপ্নকে মেরে ফেলি। আর তোমার দাদার বাড়িতে প্রতি পদে পদে মানিয়ে নিতে নিতে একসময় নিজের আত্মসম্মানটা ভুলে যাই৷
কিন্তু তুমি জন্মানোর পর সেই স্বপ্নটা আবার দেখতে শুরু করি। তুমি পড়াশোনায় ভালো তাই আমার স্বপ্নটা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। আমি চেয়েছিলাম তোমাকে একটা ভাল জীবন দিতে। সেজন্য বাড়ির সবার বিরুদ্ধে লড়াই করে তোমাকে কলেজে পড়িয়েছি। কিন্তু আমার সব স্বপ্ন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় যখন তুমি আজুয়াদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পরো।
তারপর তাকে আবার বিয়েও করলে। তানু তুমি এমন একটা মানুষকে বিয়ে করেছো যে তোমার ভালবাসা আর ত্যাগের কোন মূল্যই দিতে জানে না।

অনেকক্ষণ মা-মেয়ে কোন কথা বলে নি। তারপর সাবিহা বেগম নিরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে,
-তুমি কি এখনো এই নরকে থাকবে?

-মা আমি। বলে তানজিনা হঠাৎ জ্ঞান হারায়।

এঘটনা আগেও কয়েক বার ঘটেছে এ নিয়ে সাবিহা বেগম তানজিনাকে ডাক্তারও দেখিয়েছিলো।তাই তিনি বুঝলেন মেয়ে হয়তো কাল থেকে কিছু খায় নি। তাই শরীরে গ্লুকোজ কমে জ্ঞান হারিয়েছে।

উনি জগ থেকে একটু পানি নিয়ে তানজিনার মুখে দিলেন। তানজিনার জ্ঞান ফিরলো।
তারপর একটু পানি খাইয়ে দিয়ে বলেন,
-কিছু না খেলে তো এমনই হবে।যে মানুষটা তোমাকে ঠকালো তার জন্য নিজেকে কেন শাস্তি দিচ্ছো তানু?

দুর্বল গলায় তানজিনা বলে,
-না,আম্মু খাবারের জন্য না। কিছুদিন হলো শরীরটা খুব দুর্বল আর খাবারগুলো গন্ধ লাগে। মাছ মাংস দেখলেই গা গোলায়।

একথা শুনে সাবিহা বেগম মেয়েকে আরও কিছু প্রশ্ন করলো। যেগুলোর জবাব দিতে তানজিনা সংকোচবোধ করছিলো।

তারপর বললো,
-চলো
-কোথায় আম্মু।
-তুমি প্রশ্ন শুধু আমাকেই করতে জানো। বাকি সবার বেলায় মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকো।

তানজিনা আর কিছু বললো না চুপচাপ মায়ের সাথে গেলো।

অন্যদিকে বসার ঘরে তুলকালাম চলছে। রেহানা খাতুন লম্বা ঘোমটার আড়ালে পায়ে-পা দিয়ে ঝগড়া করছে।

-সোয়ামীরে বাইন্দা রাখবার না পারলে আমরা কিতা করুম? আপনেগো মাইয়্যারে বিয়া কইরা আমার আজুর জেবনডা (জীবন) শেষ অইয়্যা গেছে।
-খোদারে এড্ডু ডরাইন বিয়াইন। আমার ভাইজির নামে অত বদনাম কইরেন না। আমনের (আপনার) ঘরেও একখান মাইয়্যা আছে।

-আমার মাইয়্যার লগে আপনেগো ভাইগ্যা বিয়া করা মাইয়্যার তুলনা দিবাইন না।

-আমার ভাইজিরে তো আপনের বাড়ির পোলায়ই ভাগাইছিলো।

জমির ভুঁইয়া ছোট ভাইকে থামিয়ে বলে,
-আহা! কবির থাম এলা। মাইয়্যা মাইনসের লগে তক্ক করস কিয়ের লাইগ্যা?

আমজাদ খানও রেহানা বেগমকে চোখ রাঙিয়ে চুপ করিয়ে দেয়।

-আমার মাইয়্যা হত্তীনের ঘর করবো না বেয়াইসাব এইডা পথমেত্তে(প্রথম থেকে) আমি কইতাছি অহন আবার কইলাম।

রেহানা বেগম স্বামীর চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে বলে উঠে,
-তয় নিজেগো মাইয়্যারে লইয়্যা যান গা।

তখনই সাবিহা বেগম দরজা দিয়ে তানজিনাকে নিয়ে ভেতরে আসতে আসতে বলে,
-নিশ্চয়ই নিয়ে যাবো। এই নরকে তো আর নিজের মেয়েকে রেখে যাবো না আমি।

এবার আমজাদ খান ক্ষেপে যায়।এতক্ষণ নিজের স্ত্রীর উপরতো রাগ হচ্ছিলোই তার উপর সাবিহা বেগমের কথা বলায় রাগ তার চরমে পৌঁছে গেল ।
পুরুষ মানুষের মধ্যে মেয়েদের কথা বলা আমজাদ খানের একদম পছন্দ না।

মেয়েরা থাকবে ঘরের ভিতরে।

-তাই নাহি আমরা বাড়ি নরহক। যান তাঅইলে অক্ষণ নিজের মাইয়্যা লইয়া বাইরোয়্যা যাইন।
বলে গর্জে উঠে আমজাদ খান।

-হ্যাঁ, নিয়ে যাচ্ছি।
বলে সাবিহা বেগম আজুয়াদের সামনে গিয়ে দাঁড়য়।

– তুমি তালাকের কাগজ পেয়ে যাবে কিন্তু বাচ্চাটা হওয়ার পর। কারণ গর্ভাবস্থায় তালাক হয় না।

এক মুহূর্তে পুরো ঘরে নিরবতা ছেয়ে যায়।

আজুয়াদ নিরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে,
-বাচ্চা মানে?
-তানজিনা সন্তান সম্ভাবা।

তানজিনা নিজের মায়ের মুখ হতে এই কথা শুনে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়। সে এখন ঐ প্রশ্নগুলোর মানে খুঁজে পায়।

-এইডা কি হাছানি আবরারের মা?
রাগী গলায় স্ত্রীকে ধমকে উঠে আমজাদ খান।

-আমি কেমনে কমু? তয় কয়দিন দইরা দেকতাছি ছোড বউমার পোয়াতি অওয়ার লক্কন।

আমজাদ খানসহ সবাই বুঝতে পারে তানজিনা মা হতে চলছে।

-তাঅইলে অহন ছোড বউমার আর কুনোহানে যাওন অইবো না।

-তাহলে বেয়াই সাহেব, আপনি আপনার ছেলে আর নতুন বউয়ের তালাকের ব্যবস্থা করুন।
সাবিহা বেগমের কথায় জমির আর কবির ভুঁইয়া সায় দেয়।

কোন মতেই তাদের মানাতে না পেরে নিরুপায় হয়ে আমজাদ খান বলে,
-ঠিক আছে। আজু রাফিয়ারে তালাক দিবো। তয় আমার একখান শত্ত আছে?
-কি শর্ত

-আপনের মাইয়্যার পোলা পয়দা করুন লাগবো।

একটু অবাক হয়ে সাবিহা বেগম প্রশ্ন করে,
-আর যদি মেয়ে হয়।

-তয় হের যা খুশি করবো। তয় আজু আর রাফিয়ার তালাক অইবো না।যদদিন ছোড বউমার আইবোদ(বাচ্চা) না অইব তদদিন রাফিয়া এ বাইত থাকবো। হের পর পোলা না মাইয়্যা হেইডা দেইক্যা তালাক অইবো।

ভুঁইয়া বাড়ির সবাই ভাবছে কি করবে।

তখনই তানজিনা বলে,
-আম্মু এই সিদ্ধান্তটা আমি নেই?

– চলবে?