উত্তরাধিকার (৫ম পর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************
সকালের একরাশ সোনালী রোদ চোখের উপর পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো নাযিয়াতের।চোখ কুঁচকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘড়ি দেখে আঁতকে উঠলো সে।
সাড়ে আটটা! ইস্,একদমই টের পায়নি!
দ্রুত ধাক্কা দিয়ে জাগালো রাফিজকে।
রাফিজ ঘুম ঘুম গলায় বললো-
–“দশটা বাজতে এখনো অনেক দেরী……!”
-“এখুনি না উঠলে পরে কিন্তু দেরী হয়ে যাবে….!”
–“একদিন দেরী হলে কিছু হয়না!”
-“কে বলেছে কিছু হয়না?এভাবেই অভ্যেস খারাপ হওয়া শুরু করে!উঠুননা… প্লিজ।”
-“প্রতিদিনতো আমিই তোমাকে ডেকে তুলি,আজ একেবারে……!”
বলেই থেমে গেলো রাফিজ।চোখ মেলে তাকালো নাযিয়াতের দিকে ওর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।আসলে প্রিয়ন্তী ভেবে কথাগুলো মুখে চলে এসেছে ওর।
নাযিয়াত মুচকি হেসে বললো-“যম্মিন দেশ যদাচার” বলে একটা কথা আছে।আমার দেশে আলসেমীর কোনো স্থান নেই!এবার উঠে ফ্রেশ হয়ে নিন!আপনার না কি যেন কাজ আছে বললেন…!”
-“ওহ্…একদম মনেই ছিলোনা!”
রাফিজ আড়মোড়া ভাঙ্গতে গিয়ে নাযিয়াতকে ফের টান দিতে গেলে নাযিয়াত দ্রুত বিছানা থেকে নেমে পড়লো!
-“আজ ঠিক দেরী হয়ে যাবে!”
রাফিজ হতাশ গলায় বলরো-“আমি সবসময় ঠেলাগাড়ীতে চলে অভ্যস্ত।তুমি এভাবে জেট প্লেন ছোটালে তো মুশকিল!”
-“ঠেলাগাড়ীতে বসে থাকলে বুড়ো হবেন তাড়াতাড়ী!”
-“উঁহুঁ….একটুও না! বরং নিজেকে বেশ ইয়াং মনে হচ্ছে সকাল থেকে।”
নাযিয়াত কড়া চোখে তাকিয়ে অপরূপ ভ্রূ ভঙ্গিতে শাসনের চেষ্টা করলে রাফিজ চোখ টিপে প্রত্যুত্তর দিলো!
*
নাযিয়াত চটপটে হাতে চারপাশটা গুছিয়ে ফেললো!
মোটামুটি চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে সব কাজ গুছিয়ে রাফিজকে অফিসের জন্য তৈরী করে ফেললো!
রাফিজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জানতে চাইলো নাযিয়াতের মাদ্রাসা বন্ধ কবে!
নাযিয়াত জানালো, আপাতত কোনো বন্ধ নেই!
-“তাহলে দুতিনদিনের ছুটি নাও!”
-“ছুটি দিয়ে কি করবো?”
-“দিনগুলো আমাকে দেবে!আমরা বেড়াতে যাবো!”
নাযিয়াত বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো রাফিজের দিকে।
রাফিজ পেপার রেখে উঠে যেতে যেতে নাযিয়াতের মাথায় আলতো টোকা মেরে বললো-“কক্সবাজার যাবো!”
*
রাফিজকে অফিসে বিদায় দিয়েই নাযিয়াত মাদ্রাসায় ছুটলো।ফিরতে সেই বিকেল চারটা!বিয়ের আগে সকাল সাতটার দিকে মাদ্রাসায় চলে যেতো,বিয়ের পরপর রাফিজের অফিসের সাথে টাইম মিলিয়ে দুঘন্টা পিছিয়ে নিয়েছে।
রাফিজ পৌণে দশটার দিকে অফিসের জন্য বেরোয়।ও বেরুনোর ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে নাযিয়াত মাদ্রাসায় চলে যায়!
*
ইদানীং রাফিজের অভ্যেস হয়েছে রাত জেগে গল্প করার।প্রত্যেক দিনই বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোচনা করে ওরা।বেশীরভাগই নাযিয়াত বলে আর রাফিজ শোনে!
ওদিকে রাত সাড়ে এগারোটার পরপরই নাযিয়াত হাই তুলতে থাকে কিন্তু রাফিজ ওর কাছ থেকে প্রতিদিনই কিছু না কিছু শুনবে বলে ওকে আটকে রাখে !
নাযিয়াত কখনো বই থেকে পড়ে শোনায় কখনো নিজের জানা থেকে বলে।
রাফিজ খুব মনোযোগ দিয়ে সেসব শোনে।ওর আগ্রহ দেখে নাযিয়াতের ভালো লাগে কারন ইসলামের প্রতি আগ্রহ থাকাটা হেদায়েতের একটা লক্ষণ।
নাযিয়াত ওকে বিভিন্ন নবীদের সাহাবীদের তাবেয়ীদের জীবনীগুলো শোনায়।এ পর্যন্ত রাফিজের বেশ কিছু কাহিনী শোনা হয়ে গেছে।
একদিন রাফিজ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলো-“আচ্ছা,একটা সত্যি কথা বলবে?”
-“আমি সবসময় সত্যি কথা বলারই চেষ্টা করি!সজ্ঞানে কখনো মিথ্যা বলেছি বলে মনে পড়েনা! আপনি জিজ্ঞেস করুন!”
-“আজকালকার মেয়েরা তো স্বামীর সেবা করাকে দাসত্ব বলে মনে করে,কিন্তু লক্ষ্য করে দেখেছি তুমি খুব আগ্রহ নিয়ে গুরুত্বের সাথে কাজটা করো,কেন বলো তো?”
নাযিয়াত হেসে ওঠে-“আমরা মেয়েরা সবচে বেশী দাসত্ব কার করি, জানেন?”
রাফিজ উত্তর না দিয়ে চুপ করে তাকিয়ে থাকে!
নাযিয়াত বলে চললো-”
-“নিজেদের সন্তানের।আমরা মেয়েরা স্বামীর চেয়ে বেশী সন্তানের খেদমতে অনেক বেশী শ্রম দিয়ে থাকি এবং এটা করতে গিয়ে নিজেদের আরামকে হারাম করতে এতটুকু দ্বিধা করিনা।দেখবেন যেসব স্ত্রী তার নিজে স্বামীকে ঠিকমতো রেধেবেড়ে খাওয়ায় না সেই স্ত্রী’টিও তার প্রিয় ছেলেমেয়ের বেলায় স্নেহময়ী মা হয়ে তাদের পছন্দের খাবারটা নিজ হাতেই রাঁধে!
সন্তানের কোন্ খাবারে রুচি বেশী,সে কোন্ খাবারটা পছন্দ করে, না পেলে আব্দার করে, পেলে খুশী হয়ে একটু বেশী খায় এসব কিছু মায়েদের নখদর্পনে! আর এসব করতে গিয়ে খেদমতের পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের ঝাড়িঝাপটা মায়েদের জন্য ফ্রি থাকে! তবু দেখবান কোনো মা’ই এই কাজটাকে দাসত্ব মনে করেনা!কেন জানেন?কারন সন্তানকে মা ভালোবাসেন,সে যে তার নাড়ীছেঁড়া ধন।
কিন্তু যার ঔরসের বদৌলতে সে এই নাড়ী ছেঁড়া ধনের গর্বিতা মা হলো তাকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে আজকের একদল তথাকথিত শিক্ষিতারা নারাজ!সত্যি বলতে,একজন নারীর কাছে স্বামী অনেক বড় ব্যপার!কারন একজন নারীর জান্নাত যাবার চারটি শর্তের একটি হলো স্বামীর সন্তষ্টি! স্বামীকে মান্য করা একজন আদর্শ নারীর বৈশিষ্ট্য!এর কারনটাও পরিস্কার!আমরা মেয়েরা বাবার বাড়ী কতদিন থাকি বলুন তো!আঠারো বিশ কি বাইশ বছর!কিন্তু বিয়ের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চল্লিশ পঞ্চাশ কি ষাট বছর পর্যন্ত আমাদের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব থাকে সেই পুরুষটির ঘাড়ে যার নাম স্বামী! বিয়ে নামক বন্ধনের কারনে সে নারীর উপর দায়িত্বপ্রাপ্ত!সে রোজগার করে বউকে খাওয়াতে বাধ্য ,সাধ্যমতো সে তার প্রয়োজন পুরো করবে,তার আব্দার আহ্লাদ সব মেটাবে,ভরনপোষণ করা সহ তাকে দেখেশুনে রাখার সকল দায়িত্ব সে পালন করবে কেবল একজন স্বামী হবার কারনে!সেখানে স্ত্রী হিসেবে তার আনুগত্য করাকে দাসত্ব মনে করা হবে কেন?ওই কাজটুকু কি স্ত্রী’র দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা?
বরং স্বামীর প্রোটেকশন মেনে সংসারকে সাজিয়ে রাখাই তো নারীর কাজ।স্বামীর সমকক্ষ হবার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে?আল্লাহপাক যাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তার সেটাই করা উচিত!আকাশের কাজ আকাশের,পাতালের কাজ পাতালের।পাতাল যদি আকাশ হয়ে ভেসে বেড়াতে চায় তবে সমস্ত সৃষ্টিকূল পা রাখবে কোন্ জমিনে?স্বাভাবিক ভাবেই সব ধ্বংস হয়ে যাবে!তেমনি নারীও যদি পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে ঘর ছেড়ে পথে নামে তখন সন্তান বেড়ে উঠবে কার ছত্রছায়ায়?আজকের প্রজন্মের বিকৃত উন্মাদনার সবচে বড় কারন প্রপার ম্যাটারনিটির অভাব কারন আজকের সন্তানরা মায়ের ছত্রছায়ায় কম আর ডে কেয়ার ও বুয়ার তত্ত্বাবধানেই বেড়ে উঠছে বেশী।
এর ফলাফল হিসেবে হিসেবে আমরা এই প্রজন্মকে পেয়েছি ড্রাগ,পর্ণ,অবৈধ রিলেশন,হাজারটা গফ,লক্ষটা বফ,অবৈধ সন্তান জন্মদান,আত্মহত্যা,জরায়ু ক্যানসারের পাকচক্রে।
কই,আগে তো এসব কখনো শোনা যায়নি?কারন তখন মায়েরা সন্তানের দেখাশোনা করতেন!দেখুন,নারী পুরুষ যিনি বানালেন
তাঁর চেয়ে বেশী কে জানবে এই দুই প্রজাতির ভালো মন্দ কিসে ?”
রাফিজ হেসে বললো-“সত্যি, এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি তো! সবাই এভাবে ভাবলে আজকে পৃথিবীতে এতো বড় সমস্যার জন্মই হতো না!”
★
রাতে খাবার টেবিলে রাফিজ মা’কে জানালো সে নাযিয়াতকে নিয়ে তিনচার দিনের জন্য কক্সবাজার যেতে চায়।
বেলা চৌধূরী
নাযিয়াতের দিকে তাকালেন-“কই,তুমি তো আমাকে কিছু বলো নি!”
নাযিয়াত কিছু বলার আগেই রাফিজ বলে উঠলো-“কথাটা ওকে এখনো জানাইনি আমি।তোমাকে বলেই ওকে জানাবো ভেবেছি,তুমি কি বলো?”
বেলা আমতা আমতা করতে লাগলেন-“না,মানে বলছিলাম,এদিকে আবার কি না কি কাজ বেরিয়ে আসে।আমি একা ক’দিক সামলাবো!”
নাযিয়াত স্মিত হেসে বললো-“এখন নাহয় এসব থাক্,আম্মা বাড়ীতে একা পড়ে যাবে!আপনি….!”
-“আমি টিকিট কনফার্ম করে ফেলেছি যে,কারন জানি আম্মা বারন করবেনা।আর বাড়ীতে এত লোক্,আম্মার একা হবার প্রশ্ন আসেনা!কাজ তো সবসময় থাকবেই তাই বলে তো আর সব ফেলে ঘরে বসে থাকা যাবেনা!”
বেলা হাসতে চেষ্টা করে বললেন-“তুই নাকি প্রিয়ন্তীর সাথে ঠিকমতো যোগাযোগ করিসনা?”
-“কে বললো,একথা!প্রায়ই তো নাযিয়াতের সাথে ওর কথাবার্তা হচ্ছে!”
-“নাযিয়াত আর তুই এক হলি!”
-“আচ্ছা,কাল বলে নেবো!কিন্তু আমি কথা বলিনা’ এমনতরো অভিযোগ করার মেয়ে তো প্রিয়ন্তী নয়! কারন আমার যোগাযোগ করা না করাতে তার কিছু এসে যায় না।তুমি নিজেও ভালো করে জানো সে কতটা আত্মকেন্দ্রিক!”
-“ও তো চিরকালই অমন তাই বলে তুই ওকে এভাবে ভুলে থাকবি এটা কেমন কথা?”
-“আমি ভুলে থাকি কোথায়?আমি তো নিয়মিতই যোগাযোগ করছি,ও কয়বার ফোন দিয়েছে তুমিই বলো?আমার দিকটা তুমি বুঝবেনা?”
নাযিয়াত নিরবে সেখান থেকে সরে গেলো!
মা ছেলের আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা চললো।
*
খানিক বাদে নাযিয়াত কাপড় ভাজ করছিলো তখন রাফিজ এসে ওর পাশ ঘেষে বসলো!
-“কি,মন খারাপ?”
-“নাহ্,মন খারাপ হবে কেন?”
-“না,আমি ভাবলাম,মায়ের কথা শুনে…..!”
-“না না..মা এমন কিছু খারাপ তো বলেন নি!উনি দুজনের দিকই দেখার চেষ্টা করছেন!এটা তো বরং ভালো।”
-“আসলে বাবা মারা যাবার পর থেকে আমি মায়ের সাথে কখনো কোনো বিষয়ে তর্ক করিনা।তাঁকে অমান্যও করিনা।আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজে আর বিয়ে করেন নি,আমিই তার একমাত্র সম্বল!তাই আমি কষ্ট না দিয়ে সবসময় খুশি রেখেই চলার চেষ্টা করি!”
-“খুবই ভালো করেন! আর এটাই তো উচিত।মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত।বরং এটা জেনে ভালো লাগছে যে,আপনি তাঁকে মান্য করেন!আপনাকে শুধু মা’ই না,আমাদের দুজনের মধ্যেও সমতা বজায় রেখে চলতে হবে!রাসুল সাঃ মৃত্যুর পূর্বে নয়জন স্ত্রী রেখে মারা যান,কোনো একজন স্ত্রী কখনো তাঁর দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলতে পারেন নি!কারন তিনি স্ত্রীদের মধ্যে সবসময় সমতা রক্ষা করে চলতেন।প্রত্যেক স্ত্রী’র ঘরে একই সময়কাল অবস্থান করতেন!”
-“সব বুঝলাম,তিনি হচ্ছেন আমাদের আদর্শ!সব বিষয় তিনিই আমাদের অনুসরনীয়।কিন্তু মন?
মনের উপর তো কারো হাত নেই!আমার যদি তোমাকে বেশী ভালো লাগে সে দোষ কি আমার?আমি যদি তোমার মাঝে আমার জীবনের ভালোলাগাগুলো খুঁজে পাই তো আমি কি করবো?”
নাযিয়াতের হাত কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেলো!
তারপর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো-“রাসুল সাঃ মা আঈষাকে অত্যাধিক ভালোবাসতেন,কিন্তু কেনোদিন তাঁর ঘরে অন্য স্ত্রীদের তুলনায় পাঁচমিনিট সময় বেশী কাটাননি।মা আঈষি রাঃ বর্ণিত আছে–
-“হযরত সাওদা রাঃ যখন বেশী বৃদ্ধ হয়ে পড়েন তখন বলেন-“ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার কাছে আমার প্রাপ্য পালা আমি আঈষাকে দিলাম।তখন রাসুল সাঃ দুই পালা নির্ধারন করতেন-তাঁর নিজের পালা ও বিবি সওদার পালা(বুখারী/মুসলিম)!
এমনকি তাঁর মৃত্যুর পূর্বে রাসুল সাঃ জিজ্ঞেস করছিলেন-“আগামীকাল আমি কার ঘরে থাকবো?তিনি ইচ্ছা করেছিলেন, আঈষা রাঃ দিনের পালার কথা!সকল স্ত্রীগণ তখন তাঁকে অনুমতি দিলেন, যে ঘরে তাঁর ইচ্ছা তিনি থাকতে পারেন!অতঃপর তিনি আঈষা রাঃ ঘরেই ছিলেন।এমন কি তিনি সেখানেই ইন্তেকাল করেন!(বুখারী)উনি যদি কোথাও সফরে যেতে ইচ্ছে করতেন তখন স্ত্রীদের নামের লটারী করতেন,তাতে যার নাম উঠতো তাকেই সাথে নিয়ে যেতেন(বুখারী/মুসলিম)!
-“আসলে ন্যায়বিচার জিনিসটা সবাই করতে পারেনা।উনি খুব ভালোভাবেই সেটা করতে পেরেছিলেন।কারন উনি আল্লাহর নবী! ইনশাআল্লাহ, আমি ওনার সুন্নত প্রাণপন মেনে চলার চেষ্টা করবো!কিন্তু যে অবহেলা আমি প্রিয়ণ্তীর কাছ থেকে পেয়েছি তার কি?”
-“সেটা তার অংশের হিসাব যা সে আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করবে।আপনি আপনার দিক থেকে নিষ্কলুস থাকুন! কারন আবু হুরায়রা রাঃ এর বর্ণনায় আছে-” যখন কোনো ব্যক্তির কাছে দুই স্ত্রী থাকে,সে তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার না করে, কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি এক অঙ্গহীন অবস্থায় উঠবে!”(তিরমিযী,আবু দাউদ,নাসায়ী)! তাই আপনি নিজেকে গুনাহমুক্ত রাখুন!”
*
রাফিজ নাযিয়াতের হাত ধরে কাছে টেনে বললো-“সর্বান্তকরনে আমি চেষ্টা করবো!তবু কখনো ভুল হলে ধরিয়ে দিও! আল্লাহর অশেষ রহমত,যে তোমাকে পেয়েছি!তোমাকে পেয়ে আমি এমন এক জীবন লাভ করেছি যার প্রতিটা ক্ষণ অর্থবহ আর বরকতময়!
-“আমরা রক্তমাংসের মানুষ,ভুল তো হতেই পারে!ভুল হলেও সংশোধন করতে দেরী করবো না!মানুষের সবচে প্রিয় তার সন্তান,অধিক সন্তান থাকলে তাদের ভালোবাসতে কোনো বাবা মায়ের কখনো সমস্যা হয়না,ভালোবাসা ভাগ হয়ে যায়না কিন্তু স্বামী স্ত্রীর বেলায় এই প্রশ্নটা তৈরী করা হয়েছে কারন স্ত্রী তার স্বামীর উপর একচ্ছত্র রাজত্ব করতে চায়।স্বামীকে একার করে রাখতে চায়।কিন্তু এটা করতে গিয়ে জিনিসটা কতটা ঘোলাটে হয়ে গেছে দেখুন,স্বামী তার কর্তব্যকর্ম যেমন পিতামাতার হক আদায়,ভাইবোনের হক আদায়, নিজ ঘনিষ্ট আত্মীয়দের হক আদায় করতে গিয়েও স্ত্রীর দিকে তাকায় যে সে রাজী কিনা!
আল্লাহর ভয় তার মন থেকে চলে গিয়ে স্ত্রী’র ভয় তার মনে গেঁথে যায়!
আল্লাহর বান্দা তার হুকুম মেনে চলবে এটাই ঠিক !কিন্তু দেখা যায় ঐ স্বামী তার স্ত্রীর মন রাখতে গিয়ে, স্ত্রীর পরিবারের ঘানি টানে যা তার উপর ফরয নয় অথচ
এদিকে নিজ হকদারদের বঞ্চিত করে ফেলে ! এতে সে মারাত্মক গুনাহগার হয়!সে নিজের ভাইবোনকে হক না দিয়ে শালাশালিকে গিফট দেয়,বাবা-মা’র হক বঞ্চিত করে শ্বশুড় শ্বাশুড়ীকে খুশী করে।এটাই মুল কারন,স্বামীকে ভাগ করতে না পারার!
কারন স্বামী তো তাহলে তাকে একা এটেনশন দিতে পারবেনা!
আপনিই বলুন,এসব করে কয়টা স্বামী স্ত্রী জীবনে সুখী হতে পেরেছে?স্বামীর গুনাহ তাকে মনে মনে অসুখী রাখে আর স্ত্রী নিজেকে সুখী ভাবলেও সারাক্ষণ স্বামী হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে,স্বামীর সাথে ঝগড়া করে!মোটকথা তার গুনাহের অনলে সে জ্বলতেই থাকে!সুখ বা আত্মতৃপ্তি জিনিসটা তার ভাগ্যেই জোটেনা!
-“হমম,ঠিকই বলেছো! আচ্ছা,তাহলে তুমি মাদ্রাসা থেকে ছুটি নিয়ে নিও।আমরা বুধবার রাতে রওনা দেবো আর একেবারে আগামী সোমবারে
ফিরবো!”রাফিজ প্রসঙ্গান্তরে বলে উঠলো!
নাযিয়াত মাথা নাড়তেই ওর ফোন বেজে উঠলো!নাযিয়াত ফোনের দিকে তাকিয়ে রাফিজের দিকে তাকালো!
রাফিজ জিজ্ঞেস করলো –“কি?”
নাযিয়াত ফোন দেখিয়ে হাসলো-“প্রিয়ন্ত
ী!”
রাফিজ হতাশ ভঙ্গিতে উঠে যেতে নিলে নাযিয়াত ওর কাঁধ ধরে বসিয়ে ফোন রিসিভ করলো!
নাযিয়াতের প্রানোবন্ত আচরনের কারনে হোক বা যে কারনেই হোক,প্রিয়ন্তী ওর সাথে সহজ
ভঙ্গিতেই কথাবার্তা বলে!
নাযিয়াত নিজেই ফোনটা রাফিজের হাতে গুঁজে দিলো!তারপর উঠে ভাঁজ করা কাপড়গুলো নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো!
অগত্যা রাফিজ ফোনটা কানে ঠেকালো-“আসসালামুআলাইকুম!”
-“বাব্বাহ্,নাযিয়াত দেখি তোমাকে ভালোই শিক্ষা দিয়েছে!”
-“এটা তো সালামের জবাব হলোনা!”
-“ওয়ালাইকুমুসসালাম!”
-“তা দেশে কবে ফিরছো?”
-“আমার ফেরা না ফেরাতে তোমার কি আর কিছু যায় আসে?তুমি তো তোমার মনমতো হুকুমের গোলাম পেয়েই গেছো!যে সকাল বিকাল তোমার মুখের সামনে চায়ের কাপ ধরবো আর এ্যাসট্রে হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে!চাওয়ার আগেই তোমার মনোবাসনা পূরন করে দেবে তোমাকে……!”
-“তুমি কি এসব বলতেই ফোন করেছো?”
-“ফোন তো তোমাকে করিনি,নাযিয়াত কে করেছি!ও বেশী ভালোমানুষী দেখিয়ে তোমাকে দিতে গেছে কেন?”
-“তুমিই বলে দিতে যে,তুমি আমার সাথে কথা বলতে চাও না!তুমি তো আর কারো হুকুমের গোলাম না!আর পাশাপাশি এও জেনে রাখো, নাযিয়াত আমার হুকুমের গোলাম নয়।ও আমার বউ,আমার অর্ধাঙ্গিনী,আমার সসহধর্মিনী!যার মর্ম তুমি এ জীবনেও বুঝলেনা!”
-“আমার অতো বুঝে কাজ নেই,আমি এতটুকু বুঝি!আমি একজন মানুষ।আমার একটা নিজস্বতা আছে।কারো দাসী হয়ে তার পায়ের সামনে পড়ে থাকার জন্য আমার জন্ম হয়নি।এখানে এসে বরং আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।আমার আঁকার হাত ভালো আমি জানতাম কিন্তু এখানে সেটা ব্যপক সাড়া ফেলেছে।আজ সন্ধ্যায় আমার এক্সিজিবিশন!তোমার ওখানে থাকলে নিজের এই প্রতিভার কথা আমার অজানাই থেকে যেতো।আমি সুখী রাফিজ।খুব সুখী!”
-“যে নিজেকে যেভাবে দেখতে চায় সে সেভাবে থাকাকেই ‘সুখে থাকা’ মনে করে।থাকো,সুখে থাকো!আমার কিছু বলার নেই!”
-“তোমার বলার থাকলেই বা শুনছে কে?কাগজে কলমে তোমার বউ আছি বলে তোমার হুকুম ছাড়া চলতে পারবোনা ভেবেছো?”
-“এটা ভাবার মতো বোকা আমি কোনোকালেই ছিলাম না!”
-“নাযিয়াত কোথায়,ওকে দাও।কয়েকটা কথা বলে ফোনটা রাখি!”
-“ও আমাকে তোমার সাথে নির্বিঘ্নে কথা বলতে দিয়ে বাইরে গেছে।যদি বলো,তো ডেকে দেই?”
-“না থাক্,আমি নাহয় পরে ফোন করবো!এখন তাহলে ছাড়ি…..বাই !”
রাফিজ ফোন রেখে চুপ করে বসে রইলো।মনটাই খারাপ হয়ে গেছে।মা যদি ওকে বিয়েই করালো তো এই যন্ত্রনাটাকে ওর সাথে বেঁধে রাখলো কেন!ডিভোর্স করিয়ে দিলো না কেন!এক জ্বলন্ত অশান্তি নিত্য পোড়াচ্ছে ওকে।কোনদিন যে এসে ওর সুখের ঘরে হানা দিবে কে জানে!
রাফিজের মাঝে আজকাল নাযিয়াতকে হারানোর ভয়টা প্রকট হয়ে উঠছে।ওকে ছাড়া যে রাফিজ অসম্পূর্ণ!
★
রাত আটটার মধ্যেই খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়েছে ওরা।নয়টার দিকে বেরিয়ে পড়বে!নাযিয়াত নিজের হাতেই সবকিছু গুছিয়ে রেখেছে।যাবার আগ দিয়ে মা’কে বলেই ওরা বেরিয়ে পড়বে।
এমন সময় বেলা ঘরে ঢুকে ওদের প্রস্তুতি দেখলেন।রাফিজ ফোনে কথা সেরে মায়ের দিকে ফিরলো-“মা,আমরা এখন বেরুব!ওখানে পৌঁছে তোমাকে ফোন দিবো!”
বেলা বললেন-“তোরা ফিরবি কবে?”
-“ইনশাআল্লাহ্।সব ঠিক থাকলে সোমবার!”
-“দেরী করিসনা যেন।মঙ্গলবারে প্রিয়ন্তী আসবে! কেন,তোকে প্রিয়ন্তী কিছু বলেনি?”
রাফিজ একটা হার্টবিট মিস করলো যেন!
-“কবে বলেছে একথা?”
-“দুপুরে ফোন করে বলেছে।ওর বাবা-মায়ের ম্যারেজ ডে উপলক্ষে ও আর ওর ভাই আসবে বলেছে!ওর ভাইয়ের জন্য পাত্রীও নাকি ঠিক করা হয়েছে!দেখে পছন্দ হলে বিয়ে করিয়ে দেবে!সেজন্যেই আসছে ওরা!”
রাফিজ আর কথা না বাড়িয়ে হাতের জিনিসগুলো গোছাতে লাগলো!মনে মনে ভাবছে,প্রিয়ন্তী এসে কোন্ ঝামেলা লাগায় কে জানে!ওর কপালে যেন সুখ জিনিসটাও বেশিদিন সয় না!”
…..
চলবে…..
উত্তরাধিকার (৫ম পর্ব)
উত্তরাধিকার (৪র্থ পর্ব)
উত্তরাধিকার (৪র্থ পর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
************************
ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না!মেয়েটা কি ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি!
খানিক অপেক্ষা করে রাফিজ উঠে পড়লো!মনে মনে ভাবছে, পানি খাবার ছল করে ঘরে গিয়ে দেখা যেতে পারে!এভাবে একা বসে থাকতে বিরক্ত লাগছে!
ঘরের ভেতর ঢোকার মুহুর্তে দরোজার কাছে মৃদু সংঘর্ষ হয়ে গেলো!নাযিয়াত বারান্দার দিকেই আসছিলো!রাফিজও ঘরে ঢুকছিলো! সেই মুহূর্তেই ধাক্কা!
রাফিজ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে সরে আসলো!
নাযিয়াত মৃদু স্বরে বললো-“দুঃখিত।খেয়াল করিনি!”
-“কি ব্যপার?”রাফিজের কন্ঠটা একটু কঠিন শোনালো!
-“ঘরে মাথাব্যথার কোনো ঔষধ আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে এসছিলাম!”
রাফিজ লক্ষ্য করলো মেয়েটি এরই মধ্যে পোষাক বদলে ঘরোয়া হয়ে গেছে।ও মেয়েটির পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে ড্রয়ার হাতড়ে একটা ছোট্ট কৌটা নাযিয়াতের হাতে দিলো।
নাযিয়াত মৃদু স্বরে বললো-“যাজাকাল্লাহ!”
রাফিজ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বিছানার একপাশে গিয়ে বসলো!হাত বাড়িয়ে একটা বই টেনে নিলো!
নাযিয়াত মাথায় ঔষধ মেখে রাফিজের দিকে তাকালো-“অনুমতি দিলে আমি শুয়ে পড়ি?”
রাফিজ অবাক হয়ে বললো-“তুমি শোবে এতে আমার অনুমতি লাগবে কেন?”
নাযিয়াত মুচকি হাসলো-“আমি যদি এখন কোনো নফল নামাজও পড়তাম তবু আপনার অনুমতি লাগতো কারন নফল নামাজ রোজা করতে স্বামীর অনুমতি নিতে হয়”!
রাফিজ বেশ অবাক হলো।সে মুসলিম হলেও ইসলাম সম্পর্কে তার জানাশোনা খুব কম।পাঁচওয়াক্ত নামাজ আর ত্রিশ দিনের রোজার বাইরে সে খুব কমই জানে!তাই আগ্রহ নিয়ে বললো-“তাই নাকি?এমন কেন?”
নাযিয়াত বিছানায় পা তুলে নামাজের ভঙ্গিতে বসলো-“কারন,স্ত্রী যদি নফল নামাজ রোজায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে তাহলে স্বামীর ডাকে সে যখন তখন সাড়া দিতে পারবেনা!যেহেতু নফলের পরিসর অবারিত আর ব্যক্তিভেদে স্বামীর চাহিদাও ভিন্ন!তাই শরীয়তের এই হুকুম।স্বামীর নিজের জন্য যে কোনো সময় তার স্ত্রীকে প্রয়োজন হতে পারে!তখন সে স্ত্রীকে তার ব্যক্তিগত আমলের জন্য কাছে পাবেনা।এটা মহান আল্লাহ চান না,কারন স্ত্রী হচ্ছে স্বামীর জন্য শস্যক্ষেত্র সেখানে স্বামী অবাধে বিচরণ করতে পারবে!আর স্বামীর ষড়ঋপুর হেফাজত করবে তার স্ত্রী!নিজস্ব স্ত্রী ছাড়া বাকীদের দিকে তাই স্বামী তাকাবেনা,লোভ করবেনা!সেই স্ত্রী যদি ব্যক্তিগত আমলে ব্যস্ত থাকে তাহলে সেটা স্বামীর জন্য কষ্টকর হয়ে পড়বে! সে তখন নিজের প্রয়োজন মেটাতে বাইরের দিকে আগ্রহী হবে!এতে সমাজে বিশৃঙ্খলা বাড়বে!এই যেমন এখনকার দিনে হচ্ছে!
মহান আল্লাহ প্রত্যেক স্ত্রীকে তার স্বামীর জন্য মনোরঞ্জনের বস্তু করে দিয়েছেন।স্ত্রী হলো স্বামীর বেগাম!বেগাম মানে হলো যার কাছে গেলে মনের সব গাম(কষ্ট)দুর হয়ে যাবে!তাই নফল ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ পাক এমন নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন।
তবে,ফরয ইবাদতের ক্ষেত্রে এ নিয়ম খাটবেনা তখন আল্লাহর আদেশ আগে,স্বামীর আদেশ পরে!”
-“হমম…খুব,সুন্দর নিয়ম!আচ্ছা,এতে কি স্বামীকে স্ত্রী’র উপর খবরদারী করার প্রাধান্য দেয়া হয়ে গেলো না?সব স্বামী তো এক না!কোনো স্বামী যদি স্ত্রী’র প্রতি এই অধিকারের অপপ্রয়োগ করে তাহলে স্ত্রী কি করবে?”
-“প্রথমতঃ স্ত্রীকে স্বামীর নেতুত্ব মেনে নিতে হবে!স্বামী হলেন গৃহকর্তা!যে নেতৃত্ব দেয় তার উচিত তার দলের সকল সদস্যের সুখ সুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখা।আবার দলের বাকী সদস্যদের উচিত নেতার আদেশ সর্বান্তকরনে মান্য করা।তাহলেই একটি দল সুন্দরভাবে পরিচালিত হবে।সংসারও তেমনি একটি দল যা পুরুষের নেতৃত্বে চলবে আর পুরুষটির দুর্বলতা হলো তার বেগম যার কাছে গিয়ে সে রিচার্জড হয়!এভাবেই সংসার চলে!এতো সুন্দর সিষ্টেম আপনি আর কোথাও পাবেন না!স্বামী স্ত্রী একে অন্যের পরিপূরক।বাকী থাকলো স্বামীর অনাচারের বিষয়টা, সেটা স্ত্রীর দিক থেকেও হতে পারে!তবে যেহেতু স্বামী পুরুষ,সমস্যা তার দিক থেকেই বেশী আসে!সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে,শেষ বিচারের দিনে স্বামীকে ঐ অন্যায় কাজের জন্য কঠিন জবাবদিহী করতে হবে!আমাদের দেশে ইসলামের বিধিবিধান সবটা না জানার কারনে স্বামীরা স্ত্রীদের উপর একচেটিয়া রাজত্ব করে যাচ্ছে!কিন্তু ব্যপারটা আসলে অন্যরকম।কেয়ামতের মাঠে স্বামীর চরিত্রের সনদ দেবে তার স্ত্রী!কোনো স্ত্রী যদি স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে তো ঐ স্বামীর জান্নাত পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে তা সে যত বড় পরহেজগার ব্যক্তিই হোক না কেন! আমাদের রাসুল সাঃ বলেছেন–
-“তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে ভালো!আসলে ইসলাম নারীকে যতটা সম্মানের দরোজা দিয়েছে অন্য কেউ ততটা দেয়নি!”
-“হমম,সবসময় তো স্বামীর অধিকারের গল্প শুনি!স্ত্রী’র অধিকারের গল্প তো কাউকে করতে শুনিনা!”
রাফিজ স্বগোতক্তির সুরে বললো।বলতে গিয়ে লক্ষ্য করলো যে,নাযিয়াতের সাথে এভাবে গল্প করতে ওর বেশ ভালো লাগছে!
নাযিয়াতকে বলতে শুনল-“স্ত্রী’র আরো অনেক অধিকার আছে সময় করে একদিন শোনাবো আপনাকে!”
বলেই নাযিয়াত হেসে ফেললো আর হঠাৎই রাফিজের মনে হলো নাযিয়াতের হাসিটা বড় মিষ্টি!
মেয়েটা প্রিয়ন্তীর মতো পুতুল সুন্দরী নয় তবে তার চেহারায় একটা টান আছে যেটা অন্যকে আকর্ষণ করে।একেই বোধহয় বলে মায়া!রাফিজ চোখ সরিয়ে নিলো!
আরেকটা প্রশ্ন করার জন্য মুখ খুলেছিলো সে কিন্তু তাকিয়ে দেখলো নাযিয়াত বিছানায় শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।মিহি নাক ডাকার শব্দ আসছে ওর দিক থেকে।রাফিজ বই খোলা রেখেই ওর দিকে তাকিয়ে রইলো!
★
সকালে ঘুম ভাঙ্গার পরই রাফিজ দেখলো ঘরে কেউ নেই! উঠে বসতেই পায়ের কাছে চপ্পল জোড়া ঠেকলো!প্রতিদিন চপ্পল জোড়া খুঁজতে খাটের নিচে উঁকি মারতে হয় আজ যেন মনে হলো কেউ জায়গামতো সাজিয়ে রেখেছে।
ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখলো নাযিয়াত ওর জন্য নাস্তা সাজিয়ে অপেক্ষা করছে!
রাফিজ অবাক হয়ে বললো-“নাস্তা এখানে কেন?”
-“জ্বী,আন্ট…মানে আম্মাই ঘরে দিতে বললেন!আপনি দেরী করে উঠেন বলে ডাকিনি!নিন্,খেয়ে নিন!
রাফিজ কথা না বাড়িয়ে চেয়ার টেনে বসলো!
নাযিয়াত পানি ঢেলে সামনে রেখে বললো-“চায়ে চিনি ক’চামচ দেবো?”
-“চায়ে চিনি খাইনা!”
-“তাই?আমি ও খাইনা !বাহ্,আপনার সাথে আমার মিলে গেলো দেখছি!”
রাফিজ কোনো উত্তর করলোনা।নিরবে নাস্তা শেষ করলো!
অমনি ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাজির!রাফিজ হাত বাড়িয়ে সেটা নিতেই নাযিয়াত ট্রে নিয়ে বেরিয়ে গেলো!
রাফিজের কাছে পুরো ব্যপারটা স্বপ্ন মনে হতে লাগলো!বউ সামনে দাঁড়িয়ে যত্ন করে নাস্তা খাওয়াবে এটা ওর চিরদেখা স্বপ্ন ছিলো যা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিলো!প্রিয়ন্তীকে যখন বলতো,তুমি একটু বসো না আমার সামনে, খেতে খেতে গল্প করি।প্রিয়ন্তী নানান বাহানা দেখিয়ে সটকে পড়তো।পরে দেখা যেতো সে কোনো না কোনো ম্যাগাজিনে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে।
একদিন রাফিজ রাগ করলে সে সমান তেজে উত্তর দিয়েছিলো,স্যরি,তোমার সঙ্গে এসব লুতুপুতু প্রেম খেলা আমাকে দিয়ে হবেনা,খাওয়া সামনে আছে নিয়ে খাও,যা লাগবে ময়নাকে বলো।আমি পারবোনা তোমার অত ফাইফরমাশ খাটতে!”
রাফিজ আহত স্বরে বলেছিলো-“এটাকে ফাই-ফরমাশ খাটা বলছো কেন!আমি কি তোমাকে আমার সামনে চাইতে পারিনা?”
-“অবশ্যই পারো,তবে কারনে অকারনে এসব আলগা পিরীত আমার ভালো লাগেনা!খুব বিরক্ত লাগে!এতো চাহিদা কেন তোমার?”
এমন কথার পর আর কথার উত্তর দিতে রাফিজের রুচি হয়নি।’এতো চাহিদা কেন’ কথাটা ওর পৌরষে লেগেছিলো!
তারপর থেকে সে নিজেই নিজের কাজগুলো করে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো।
প্রিয়ন্তীকে আর যখন তখন ডাকতো না,হঠাৎ করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতো না,আচমকা বিশেষ কিছু চাইতো না….ফলে ওদের সম্পর্কটা একটা যান্ত্রিক সম্পর্কে পরিণত হয়েছে।
আজ অনে..ক দিন পর রাফিজের মনে হলো ও একজন পুরুষ যার চাওয়াপাওয়ার বেলাভূমি তার স্ত্রী আর সেটা হতে পারে নাযিয়াত।
চায়ের কাপ রাখার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলো নাযিয়াত হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।রাফিজ আনমনেই ওর দিকে তাকালো,নাযিয়াত নিজের তর্জনী থুতনীতে ঠেকিয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত করলো!রাফিজ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুঝলো নাযিয়াত ওর মুখে কিছু লেগে থাকার কথা মিন করছে।রাফিজ নিজের হাতটা থুতনীতে বুলালো!নাযিয়াত তর্জনী তুলে রেখেছে আর দেখাচ্ছে, শেষে নিজেই ওড়নার প্রান্ত দিয়ে ওর থুতনীটা মুছে দিয়ে আর দাড়ালো না,সম্ভবত ঝোঁকের বশে কাজটা করে লজ্জা পেয়েছে।
রাফিজ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো!
বড় অসময়ে এসে স্বপ্নেরা সব হানা দিচ্ছে !
★
বেলা চৌধুরীর সামনে ঔষধ আর পানির গ্লাসটা রেখে নাযিয়াত বসলো!বেলা ফোনে কথা বলছিলেন।কথার ধরনে ও বুঝতে পারলো বেলা প্রিয়ন্তীর সাথে কথা বলছে।নাযিয়াত ইশারা করলো, ও কথা বলবে।বেলা দ্বিরুক্তি না করে নাযিয়াতকে ফোনটা ধরিয়ে দিলেন।নাযিয়াত হেসে হেসে এমন ভাবে কথা বলতে লাগলো যেন কত পুরোনো বন্ধুত্ব ওদের!বেলা একটু অবাকই হলেন নাযিয়াতের প্রাণশক্তি দেখে।তারপর ঔষধ টা খেয়ে নিলেন।সবসময় ময়নাকে দিয়েই চেয়ে নেন ঔষধটা।গত ক’দিন ধরে নাযিয়াত সামনে এনে দিচ্ছে।মেয়েটার মধ্যে সাংসারিক গুণ আছে!মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন বেলা।
★
রাফিজ নিয়মিতই অফিস করছে!বিয়ে উপলক্ষে কোনো ছুটিই সে নেয়নি!বরং ঘণিষ্ট দু একজন ছাড়া অফিসের অনেকে জানেই না যে,ও বিয়ে করেছে!
তবে জীবনটা যেন আচমকা বদলে গেছে ওর!
অফিস থেকে ফিরে প্রতিদিনের মতো লুঙ্গি খুঁজে হয়রান হতে হয়না।
সকালে অফিসে যাবার সময় আবার অফিস থেকে ফেরার পর প্রয়োজনীয় প্রতিটা জিনিস হাতের কাছে সাজানো থাকে!
এসবের বাইরেও যে স্ত্রী’র কিছু বাড়তি যত্ন থাকে তা রাফিজ এতোদিন জানতো না!
নাযিয়াত আজকাল নিজের পছন্দের রঙটাও পরিয়ে দেয় ওকে।এইতো আজ সকালেই জলপাই রঙা একটা টিশার্ট বিছানার ওপর বের করে রেখেছে।
রাফিজ হাতে নিয়ে অবাক হয়ে তাকালে নাযিয়াত মিনতিমাখা কন্ঠে বললো-“আম্মা মার্কেটে গিয়েছিলো,ওনাকে কালারটা বলে দিয়েছিলাম!মনে হলো আপনাকে ভালো লাগবে!এটা একটু পরেননা আজ!”
রাফিজ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না,কেবল নির্বিকার চিত্তে টিশার্টটা গায়ে দিয়ে অফিস চলে গেলো!অফিসে কাজ করতে গিয়ে মনে হলো,প্রিয়ন্তীর সাথে থাকতে থাকতে প্রিয়ন্তীর নির্লিপ্ততা ওর ওপরও ভর করেছে।নতুবা সকালে এই সুন্দর শার্টটার জন্য একটা থ্যাংকস কি নাযিয়াতের পাওনা ছিলো না?
কি ভেবে ফেরার পথে এক তোড়া রজনী গন্ধা কিনলো!তারপর সেটা ব্যাগের ভেতর লুকিয়ে রাখলো।আসলে মায়ের হাতে এমন নগ্নভাবে প্রকাশিত হতে চায়না ও!তাছাড়া এটা কোনো প্রেমপূর্ণ আবেগ না কেবল থ্যাংকসের একটা বহিঃপ্রকাশ মাত্র,রাফিজ নিজেকে বোঝালো!
★
বিকেলে স্ন্যাক্সের ফাঁকে রজনীগন্ধার তোড়াটা ক্যাজুয়ালী নাযিয়াতের হাতে তুলে দিয়ে চায়ে চুমুক দিলো রাফিজ।একমনে পেপার দেখতে লাগলো যেন এটা কোনো ব্যপারই না!দৃষ্টি পেপারে থাকলেও নাযিয়াতের মুখের ছড়িয়ে পড়া হাসি চিনতে একটুও ভুল হলোনা রাফিজের।
প্রতিদিনই ওর মনে আশঙ্কা দানা বাঁধে এই ভেবে যে,আজ থেকে বুঝি সব আগের মতো নিরব নিস্পৃহ হয়ে যাবে।নাযিয়াত বোধহয় নব বিবাহিতার আবেগ কাটিয়ে যান্ত্রিক হয়ে উঠবে।কিন্তু না,প্রতিদিনই বরং নাযিয়াত একটু একটু করে নিজেকে নিত্য নতুন রূপে প্রকাশ করে যাচ্ছে!
সাপ্তাহিক ছুটির দিন একটু দেরী করে ওঠার অভ্যাস রাফিজের।
নাযিয়াত এগারোটা থেকে ঠেলতে লাগলো গোসলের জন্য!আজ জুম’আ বার।তাড়াতাড়ি গোসল করে নামাজে যান।জুমআ’র দিন গোসল করতে হয়!যারা জুমআ’র নামাজ ছাড়ে তারা অভিশপ্ত!জুম’আ না পড়লে সে ব্যক্তি মুনাফিক!জুম’আ একটি বিশেষ দিন।এই দিনে দু’আ কবুল হয়!এই দিনে একটি বিশেষ মুহূর্ত আছে যখন দু’আ কবুল হয়।
এসব বলে বলে রাফিজকে অস্থির করে তুললো!বিবাহিত জীবনের পাঁচ বছরের মধ্যে আজই প্রথম রাফিজ শুভ্র সফেদ পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে নামাজের একঘন্টা আগে মসজিদে চলে গেছে।
যাবার আগে নাযিয়াত হাঁটু গেড়ে বসে ওর পাজামা তুলে দিয়েছে টাখনুর ওপর!
রাফিজ একটু তাড়াতাড়িই মসজিদে চলে গেছে!
এটিও রাফিজ করেছে এক দীর্ঘ হাদিস শুনে!হাদীসটি শোনার পর ও আর থাকতে পারেনি–
-“আবু হুরায়রা রাঃ এর বর্ণনা-‘রাসুল সাঃ বলেছেন-“যখন জুম’আর দিন আসে,ফেরেস্তাগণ মসজিদের দরোজায় এসে দাঁড়ায় এবং যার পূর্বে যে আসে তা লিখতে থাকেন!যে ব্যক্তি খুব সকালে আসে তার উদাহরণ হচ্ছে,যে মক্কায় কুরবানী করার জন্য উট পাঠায়!তারপরে যে আসে তার উদাহরণ,যে একটি গরু পাঠায়!তারপরের আগমনকারী একটি দুম্বা,তারপরের আগমনকারী একটি মুরগী,তারপরের আগমনকারী যেমন একটি ডিম পাঠালো!যখন ইমাম খুতবার জন্য বের হন,ফেরেস্তাগণ তাদের কাগজ ভাঁজ করে লন এবং খুতবা শুনতে আরম্ভ করেন!”(হাদিসটি বুখারী ও মুসলিম শরীফ এর)!
{note:আশাকরি,এই সহীহ হাদীসটি শোনার পর আর কোনো ভাইজান জুম’আ মিস করবেন না এবং নামাজে দেরী করে যাবেন না!দেখুন টাকা দিয়ে উট কিনে কুরবানীর সামর্থ্য সবার থাকেনা অথচ প্রতি শুক্রবার এই সুযোগটি হেলায় হারাচ্ছেন!বিষয়ট
ি গভীরভাবে ভেবে দেখার বিনীত অনুরোধ রইল}
★
জুম’আ থেকে ফিরে দেখলো নাযিয়াত নিজেও সুন্দর একটি পোষাক পড়ে সামান্য সেজেছে।রাফিজ প্রশ্ন না করে পারলোনা,’জুম’আর দিনে কি মেয়েদের সাজতে হয় নাকি?”
নাযিয়াত লজ্জায় বেগুনী হয়ে বলেছে-‘না..না,এটা তো আমাদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন।তাছাড়া জামাটা নতুন না!এটা আমার বিয়ের আগের বানানো!আপনি বললে নাহয় বদলে ফেলি?”
-“আরে না,আমি তো শুধু জানতে চাইলাম।আচ্ছা,তুমি যে সকালে বললে আজকের দিনে দু’আ কবুল হয়!সেই কবুলের সময়টা কখন, জানো?”
নাযিয়াত মৃদু স্বরে বলল -“দুটো বর্ণনা আছে,একটি হলো ইমামের বসা থেকে নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত আরেক বর্ণনা আসর থেকে সুর্যাস্তের আগের সময়টার মধ্যে খুঁজতে বলা হয়েছে।তবে জুমার দিনে যে দু’আ কবুল হবে এটি সহীহ সনদে বর্ণিত আছে।”
-“যাক্,তাহলে সারাদিনই চাইতে থাকবো…!”
বলে নাযিয়াতের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালে নাযিয়াত চোখ নামিয়ে ফেললো!ওর লজ্জা দেখে রাফিজ মুচকি হাসল।
★
রাতে ঘুমুবার আয়োজন করছিলো নাযিয়াত।রাফিজ বললো-“একটু বারান্দায় আসবে?”বলার সময় মনে হলো প্রিয়ন্তী হলে উত্তর দিতো….’কিইই?পারবোনা এখন!”
কিন্তু নাযিয়াত যে এটা বলবেনা,এই ক’ দিনে জেনে ফেলেছে রাফিজ।সত্যিই নাযিয়াত হাতের কাজ রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো!রাফিজ চেয়ার দেখিয়ে বললো-“বসো!”
নাযিয়াত বসলে রাফিজ নিজেও ওর পাশে বসলো!তারপর দীর্ঘক্ষণ দুজনেই চুপ।
কিছুক্ষণ পরে রাফিজ বললো-“তুমি আসার পর আমার জীবনটা বদলে গেছে,নাযিয়াত! জীবনে যে এতো আনন্দ আছে আগে জানতাম না।আসলে আমি একটু সেকেলে ধরনের।বঊ যত্ন করবে,খোঁজখবর রাখবে,আদর করে কথা বলবে এগুলো আমার আকৈশোর লালিত স্বপ্ন।প্রিয়ন্তীকে বিয়ের পর…..”!
-“একটু থামুন…,প্লিজ!”নাযিয়াত ওকে থামিয়ে দিলো!রাফিজ তাকালে নাযিয়াত বললো-
-“প্রিয়ন্তীর নামে কোনো দোষ বলবেন না যেন,তাহলে সেটা গীবত হয়ে যাবে!”
-“সেটা যদি দোষের হয় তবুও?”রাফিজ অবাক হলো!নাযিয়াত মাথা নাড়লো!
-“একবার রাসুল সাঃ সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন,তোমরা কি জানো,গীবত কি?তাঁরা উত্তর দিলেন,আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলই অধিক জানেন!তিনি বললেন-‘গীবত হলো তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা যা সে অপছন্দ করে।জিজ্ঞেস করা হলো-“আমি যা বলছি যদি তার মাঝে ঐ দোষ বিদ্যমান থাকে তখন আপনার মতামত কি?রাসুল সাঃ বললেন-‘তুমি যা বলো যদি তার মাঝে তা থাকে তবে তুমি তার গীবত করলে আর যদি তার মাঝে ঐ দোষ না থাকে তবে তুমি তার নামে মিথ্যা অপবাদ রটালে!(মুসলিম)
রাফিজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“তাহলে ওর কথা থাক্ কারন যা’ই বলবো,তা হয়তো গীবতই হয়ে যাবে!”
নাযিয়াত নিরবে বসে রইলো!
রাফিজ ওর দিকে তাকিয়ে মুদু স্বরে বললো-“তোমার কথা বলো,আমার মতো পূর্ব বিবাহিত পুরুষকে বিয়ে করে তোমার স্বপ্ন হোঁচট খেয়েছে নিশ্চয়ই!”
নাযিয়াত বাতাসের শব্দে হাসলো-“কেন,এমন হবার তো কোনো কারন নেই,বিয়ে হয়ে গেলে কি কেউ ভালোবাসার অযোগ্য হয়ে যায়?আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিটা বড় বিদঘুটে!ছেলেরা/মেয়েরা একশটা বফ আর গফ রাখলে দোষ হয়না কারন তখনো তাদের কাছে সে অবিবাহিত আর পূত পবিত্রই রয়ে যায় অথচ একজন বিবাহিত পূরুষ কিংবা তালাকপ্রাপ্তা মহিলার গায়ে কেবল বিয়ের সিল পড়ে যাবার কারনে তারা অচ্ছ্যুৎ হয়ে যায়।তাদের বিয়ে করা যাবেনা!পুরো ব্যপারটার মধ্যে একটা শয়তানী প্ররোচনা কাজ করছে!মুলতঃ নারী পুরুষের সম্পর্কের চুড়ান্ত ও পবিত্র পরিণতি হলে বিয়ে!এটাকে মন্দভাবে দেখার কোনো উপায় নেই!আসলে আমার চাওয়াটা অন্যখানে!”
রাফিজ কৌতুহল নিয়ে তাকালো-“কি সেটা…?”
-“আমার খুব ইচ্ছা আমার স্বামী নামাজী হবে,তাকওয়া অবলম্বন করবে,দাঁড়ী রাখবে,ইসলামের হুকুম আহকামগুলো মেনে চলবে,আমাকে সেভাবে চলতে উৎসাহিত করবে,দুজনে মিলে একটি সাহাবীওয়ালা ঘর রচনা করবো যে ঘরের যাত্রা হবে জান্নাতের পথে….এইতো! যেদিন থেকে দ্বীন আর দুনিয়ার পার্থক্য বুঝতে শিখেছি সেদিন থেকে এমনটিই চেয়ে এসেছি!”
-“পেয়েছো?”রাফিজের স্বরে কৌতুক না কি ঠিক বোঝা গেলোনা!নাযিয়াত স্থির কন্ঠে বললো!
-“পাইনি…এমনটাও তো বলতে পারছিনা!কার কখন হেদায়েত হয়ে যায় কে বলতে পারে!”
-“হমম…গত একটা সপ্তাহ ধরে তোমার মুখে সাহাবীদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা শুনতে শুনতে নিজেকে তাদের একজন ভাবতে মন চাওয়া শুরু হয়েছে!”
-“সত্যিই…?”নাযিয়াতের কন্ঠে উচ্ছাস!
রাফিজ হাসল!বললো-“প্রথম দিন কি বলেছিলে মনে পড়ে?”
-“কি বলেছিলাম?”
-“স্বামীর কাছে স্ত্রী’র অধিকার সম্পর্কে পরে বলবে বলেছিলে!সেটা কিন্তু এখনো বলোনি!”
-“ওহ্…..! এমনিতে তো অনেক অধিকার রয়েছে!”
-“সেসব কি তুমি আমার কাছে আশা করো না?”
-“জ্বী,তা তো করিই!”
-“আমিও চাই,আমার অধিকার খর্ব না করে তোমাকে তোমার হক দিয়ে দিতে!”
নাযিয়াত মুখ নিচু করে রাখলো!কোনো জবাব দিলোনা!বাইরে বাতাসের বেগ বাড়ছে!নাযিয়াতের মনে হলো ও সেই ঠান্ডা বাতাসে একটু একটু কাঁপছে! রাফিজ হঠাৎ ঝুঁকে ওর বেতের চেয়ারটা ধরে টান দিয়ে একেবারে নিজের কাছে নিয়ে এলো!
নাযিয়াত একটু চমকে উঠলো।রাফিজ ওর হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো!
-“আমার দিকে তাকাও…!”
নাযিয়াত একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে ফেললো!রাফিজ তাকিয়ে আছে।বাইরে বাতাসের বেগ ক্রমাগত বাড়ছে।সেই ঝড়ের দাপট ওদের ভেতরটাকে একেবারে ভেঙ্গেচুরে দিতে চাইছে যেন!
…..
চলবে…..
উত্তরাধিকার (৩য় পর্ব)
উত্তরাধিকার (৩য় পর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
**************************
গত তিনদিন ধরে নাযিয়াত পড়াতে আসছেনা প্রিয়ন্তীকে।এ নিয়ে বেলা চৌধুরী খানিকটা চিন্তিত।
কি ব্যপার?
তার মনের খবর টের পেয়ে যায়নি তো?নাহ্,এটা অসম্ভব।
তার মনের খবর নাযিয়াত কিভাবে টের পাবে?তার বংশের ওয়ারিশের জন্য তিনি যে কোন মেয়েকেই ছেলের বৌ হিসেবে চাইতে পারেন।এটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়!
তাহলে সেদিনের পর থেকে মেয়েটা পড়াতে আসা বন্ধ করে দিলো কেন?
নাকি সে দ্বিতীয়া হতে রাজী নয়?
কিন্তু,কেন রাজী হবেনা?
এমন রাজকীয় প্রস্তাব সে কোথায় পাবে?
*
এমনতর নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতে প্রিয়ন্তীর রুমে গেলেন! সে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে!ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন!সে কম্বলের তলা থেকেই ঘুম ঘুম গলায় উত্তর দিলো-“জানিনা,কেন আসেনা!”
-“তোমাকে ফোনে জানিয়েছে কিছু?”
-“মমম…না!”
-“তুমি ফোন করে জিজ্ঞেস করো, কেন আসছেনা!”
-“দুউর…!”বলে প্রিয়ন্তী চোখ বুঁজে পড়ে রইল।
বেলা মনে মনে কষে একটা বিশ্রী গালি দিলেন প্রিয়ন্তীকে।তার ছেলে যে বলেনা অকম্মার ধাঁড়ি..!
ঠিকই বলে।বাপের টাকার জোরে বিয়ে দিতে পেরেছে নইলে এরকম মাকাল ফল কারো উপকারে আসার না।
নাহ্,তার নিজেকেই যোগাযোগ করতে হবে।
মেয়েটা হঠাৎ আসা বন্ধ করলো কেন?তার প্রস্তাবটা নাকচ করে দিবে নাকি?এই বাজারে অমন লোভনীয় প্রস্তাব পাগল ছাড়া কেউ না করবে?
বেলা মোবাইলে নাযিয়াতের নাম্বার বের করতে করতে ড্রইংরূমে এলেন।ঠিক তখনই ডোরবেল বাজলো।ময়না দরজা খুলে দিতেই নাযিয়াত প্রবেশ করতে দেখে বেলা চাপা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন!
নাযিয়াত বেলাকে দেখে সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সালাম দিলো!
বেলা ওকে দেখে খুশি হয়ে এগিয়ে গেলেন-“আরে,তুমি এসেছো?আমি ভাবলাম,অসুখ করলো কিনা!তুমি ভালো আছো তো মা?”
-“জ্বী,আলহামদুলিল্লাহ্।”
-“তুমি বসো, আমি প্রিয়ন্তীকে ডেকে নিয়ে আসি!”
-“আন্টি…এক মিনিট!”
নাযিয়াত বাধা দিয়ে বললো!বেলা থামলেন।নাযিয়াত কিছুটা সংকোচ করে ইতস্তত কন্ঠে বললো-“তার আগে আপনার সাথে আমার একটু কথা ছিলো!”
-“হ্যাঁ…হ্যাঁ…বলো!”বেলা আগ্রহের সাথে তাকালেন।নাযিয়াত মৃদু স্বরে বললো-
-“আমি এ মাসের পর আর পড়াবোনা আন্টি!”
বেলা হাসিমুখে বললেন-“তা তো ঠিকই আছে!তুমি তো এ বাড়ীর বউ হয়ে যাবে।তখন তো আর এ বাড়ীর টিউশনি না করাটাই ঠিক হবে!”
-“ন্..না তা না!আমি…আপনার প্রস্তাবটা মেনে নিতে পারছিনা আন্টি!আমাকে ক্ষমা করবেন!”
বেলার মুখের হাসি দপ করে নিভে গেলো!
-“কেন?কেন মেনে নিতে পারছোনা?”
নাযিয়াত নিরব রইলো!
বেলা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো-
“আমার কষ্টটা তুমি বুঝতে পারছোনা বলেই এভাবে বলতে পারলে!আজ আমার জায়গায় হলে তুমি বুঝতে আমি কতটা নিরুপায়!আমার বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আর এটা আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে!আমি জানি,তোমার উপর সংসারের অনেক দায়িত্ব,ঠিক সেকারনেই আমি তোমার সব দায়িত্ব নিজের মাথা পেতে নিতে রাজী আছি।তোমাদের বাড়ীটা….!”
-“আমার আপত্তিটা ওখানেই,আন্টি!”ব
েলাকে থামিয়ে দিলো নাযিয়াত!
বেলা চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
নাযিয়াত বলে চলল-
-“বিয়েটা মানুষের ভাগ্য।আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক।কিন্তু বিয়ের বিনিময়ে ওসব আমি কেন নেবো আপনার কাছ থেকে?এটা তো কোনো নিয়মের আওতায়ই পড়েনা।”
-“হোহো….এই কথা…?”বেলা হেসে শুরু করতে যাচ্ছিলেন।
নাযিয়াত আবার থামালো তাকে-“আরেকটা কথাও আছে।প্রিয়ন্তীকে সরিয়ে ওর জায়গা দখল করবো আমি,এটা কেন মনে হলো আপনার?আমি সবিনয়ে আপনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছি আন্টি।আমাকে ক্ষমা করবেন!তাছাড়া আমার অনুপস্থিতিতে আমার পরিবার সমস্যার মুখে পড়বে!ওদের দেখাশোনা আমাকেই করতে হবে!আমি এ মুহূর্তে বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই!”
বেলা দ্রুত নাযিয়াতের হাত চেপে ধরলেন-“এজন্যেই তো বলেছি মা,তোমার পরিবারের দেখাশোনার ভার আমার!আচ্ছা,তুমি দান নিতে চাচ্ছোনা ভালো কথা,ধার হিসেবে নিতে পারো!তোমার বাবা যে দেনা রেখে গেছেন তা তুমি নিজের টাকাথেকেই শোধ দিতে পারবে! বিয়ের পর তুমি অন্তত কয়েক লক্ষ টাকার মালিক হবে!ধার শুধতে তোমার একটুও আটকাবেনা!তাছাড়া প্রিয়ন্তীকে তো সরিয়ে দিচ্ছি না মা।তোমরা দুজনই থাকবে!আর তোমার মতো সচ্চরিত্র মেয়ের পক্ষেই এটা সম্ভব।আমাদের ধর্মে একসাথে চার স্ত্রী রাখার অনুমতি আছে।এটা মানো তো!আমি তো অন্যায় কিছু করছিনা!আর আমি তোমাকেই ছেলে বৌ হিসেবে চাইছি কারন তুমি মানুষ হিসেবে সৎ।কে না চায় একজন আদর্শ বৌমা?আর তুমি আমার দান নিতে চাইছোনা…..নিওনা।বরং তোমার এই সিদ্ধান্ত আমাকে তোমার প্রতি আরো শ্রদ্ধাশীল করে তুলেছে! এ কথা শোনার পর তো আমি আরও তোমাকে ছাড়তে পারবো না মা।যে করেই হোক,এ বিয়ে হবেই!তুমি না করোনা মা।আমার দান তুমি নিওনা,কিন্তু আমার প্রস্তাবটা তুমি ফিরিয়ে দিওনা মা….প্লিজ ! জানো তো,কারো উপকার করাটাও অনেক বড় সওয়াবের কাজ! ”
*
নাযিয়াত বিপর্যস্ত বোধ করলো।বেলা দুহাতে ওর হাত চেপে ধরেছেন।সে মানা করে চলে যেতে এসেছিলো।কিন্তু এভাবে ফেঁসে যাবে ভাবেনি!কাঁপা কন্ঠে ফের বলতে চেষ্টা করলো-“কিন্তু….প্রি..প্রিয়ন্ত
ী….!”
-“ও এসব ব্যাপারে খুবই উদার। তুমি চাইলে ওর সাথে কথা বলতে পারো।”
নাযিয়াত মাথা নাড়লো-“জ্বী!”
বেলা উঠে প্রিয়ন্তীকে ডাকতে গেলেন।
প্রিয়ন্তীকে ঘুমাতে দেখে ফিরে এলেন-“ও তো ঘুমিয়ে আছে তাই ডাকিনি!তুমি বললে ডেকে তুলি?”
-“,আচ্ছা,থাক্।আজ আমি নাহয় উঠি আন্টি!”
বেলা তবু ওকে বসিয়ে জোর করে মিষ্টি খাইয়ে দিলেন।
বাড়ী ফেরার পথে নাযিয়াত চিন্তায় পড়ে গেলো!ওর বিয়ে হয়ে গেলে ওদের সংসার চলবে কি করে!মা’ও একই কথা বলছিলেন।কেবল নাদিয়া বলেছে’ নিজেদের ভবিষ্যত ঠিক রাখতে আমরা বড়াপুর ভবিষ্যত নষ্ট হতে দিতে পারিনা!এতো ভালো একটা প্রস্তাব।না করা উচিত হবেনা!সেই মা’কে ক্রমাগত বোঝাচ্ছে বিয়ের ব্যপারে রাজী হবার জন্য!
সময় এবং পরিস্থিতি সবসময় সবার অনুকূলে থাকেনা!বড়াপু’র জন্য যে প্রস্তাবটা এসেছে এটা কোনোদিক দিয়ে ফেলনা নয় তাই রাজী হওয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ!
★
★ ★
রাতে রাফিজ ফিরলে বেলা ওর সাথে কথা বললেন!রাফিজ প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলো তারপর বললো-“এসব তুমি কি বলছো মা?”
-“যা বলছি,ঠিকই বলছি ,একদম প্রাকটিকাল কথা বলছি।পাঁচ বছর হয়েছে তোর বিয়ে হয়েছে, আজ পর্যন্ত একটা নাতি নাতনীর মুখ দেখলাম না!তোর বাবা ডাক শুনতে ইচ্ছে না করলেও আমার তো ‘দাদু’ ডাক শুনতে ইচ্ছে করে!
তুই আমার পরিবার আর বংশের স্বার্থে রাজী হয়ে যা বাপ।কেনোকিছুই বদলাবে না,সব যেমন আছে তেমনি থাকবে,কেবল নাযিয়াত এ বাড়ীতে একজন সদস্য হয়ে আসবে!
রাফিজ নিরব রইলো!আর কেউ না জানুক,ও নিজে জানে, পিতৃত্বের আকাঙ্খা ওর ভেতরটা কতখানি পোড়ায়! কিন্তু প্রিয়ন্তীকে কষ্ট দেয়া হবে ভেবে ও সবসময় চুপ থেকেছে।
আজ মায়ের এ কথাগুলো ওর মনের বন্ধ দরজায় আঘাত করলো যেন!
তবু বললো-“আমি প্রিয়ন্তীর সাথে একটু কথা বলতে চাই,মা !”
-“ওর অনুমতি নিতে?শরীয়ত অনুযায়ী স্বামীর ২য় বারের বিয়েতে ১ম স্ত্রী’র কোনো অনুমতি লাগেনা তবে আমাদের মুসলিম আইনে আবার অনুমতি লাগে তাই আমি প্রিয়ন্তীর সাথে কথা বলেছি!ওর তো কোনো বিকার নেই!,এ কেমন মেয়ে রে বাবা!হুঁ…হাঁ…টু..টা নেই!যেন ওর কিছু যায় আস। না!তোদের কেনো ঝগড়া হয়েছে নাকি?”
রাফিজ একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল!সে কি করে বলবে মা’কে যে প্রিয়ন্তী এক অদ্ভুত মেয়ে।কোনো বিষয়েই তার কোনো আগ্রহ নেই!নির্লিপ্ততা,নির্বিকারত্ব তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য!অত্যন্ত শীতল প্রকৃতির মেয়ে সে।তার সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্কটা রাফিজের কাছে একটা বোঝার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।যে বোঝাটা সে বয়ে বেড়াচ্ছে কেবল।চিরকালের মায়ের গুডি বয় হিসেবে খ্যাত রাফিজ তার নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পারছে যে,দৃশ্যত বিয়ে করলেও বাস্তবিক সে কোনো সংসার পায়নি!প্রিয়ন্তীর মধ্যে কোনো উষ্ণতা নেই,রাগ নেই,জেদ নেই,খুনসুটি নেই!সত্যি বলতে প্রিয়ন্তীর সাথে কোনোরকম মানসিক বন্ধনই তার গড়ে ওঠেনি।চারিদিকে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী’র প্রতি অত্যাচারের অনেক ঘটনা সে শুনেছে কিন্তু স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর প্রতি এমন নিরব অত্যাচারের গল্প কেউ কি শুনেছে?যার ভুক্তোভোগী রাফিজ নিজে।অথচ বাইরে থেকে যে কেউ দেখলে বলবে পুতুলের মতো বউ পেয়েও স্বামীর মন উঠেনা! প্রিয়ন্তীকে কখনো কোনভাবেই সে উদ্দীপিত করতে পারেনি!ব্যর্থতাটা কার তা আজো রাফিজ বুঝে উঠতে পারেনা!
ছেলেকে নিরব দেখে বেলা বললেন-“শোন্,যা করছি,তা তোর ভালোর জন্যই করছি!
রাফিজ কিছু বলতে যাবার আগেই ডোরবেল বাজলো!রাফিজ উঠে নিজের রুমে চলে গেলো!ময়না এসে জানালো,প্রিয়ন্তীর বাবা মা দুজনই এসেছে!
বেলা ওদেরকে ভেতরে নিয়ে আসতে বললেন।তিনি জানতেন,এমনটা ঘটবে।তাই পূর্ব থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন!
প্রিয়ন্তীর বাবা-মা আর বেলা চোধুরী প্রায় একঘন্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেন।
পরিশেষে সিদ্ধান্ত হলো,রাফিজ তার নতুন বৌ কে ঘরে আনুক,সংসার করুক,ততদিন প্রিয়ন্তী তার মামার কাছে অষ্ট্রেলিয়া থাকবে!প্রিয়ন্তীর বাবা তার মেয়ের মনের ওপর কোনোরকম চাপ পড়তে দিতে চাননা!তার ইচ্ছা,পরবর্তীতে পরিস্থিতি বুঝে প্রিয়ন্তীকে বাংলাদেশে আনিয়ে নেয়া যাবে!তার আগ পর্যন্ত প্রিয়ন্তী ওর মামার কাছেই থাকবে!
বেলা তাদের মনের উষ্মা টের পেলেও মুখে কিছু বললেন না!কেবল প্রিয়ন্তীর বাবাকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে,তার নাতি পৃথিবীতে আসার পরেই প্রিয়ন্তীর পথ পরিস্কার করার কাজ শুরু করবেন তিনি!এটা তার দায়িত্ব হয়ে থাকলো!প্রিয়ন্তীর সংসার প্রিয়ন্তীরই থাকবে!এটা অন্য কারো হতে দেবেন না তিনি!
প্রিয়ন্তীর বাবা-মা নির্ভার হয়ে মেয়ের সাথে দেখা করে চলে গেলেন!
*
রাফিজ ঘরে ঢুকে দেখলো প্রিয়ন্তী শুয়ে শুয়ে একটা ম্যাগাজিন পড়ছে।রাফিজকে দেখে সে ফিরেও তাকালোনা।ব্যপারটা প্রথম দিকে রাফিজের খুব খারাপ লাগতো কিন্তু এখন গা সওয়া হয়ে গেছে!সে নিজে থেকেই ডাকলো-“প্রিয়ন্তী…?”
-“(জবাব নেই)”
-“প্রিয়….তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছো ?”
-“মমম?কিছু বললে?”
রাফিজ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“আমি যে ঘরে ঢুকেছি তা কি তুমি দেখেছো?”
-“উফ্…বিরক্ত করোনা তো,আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ নিউজ পড়ছি।অজয় আর কাজলের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে!”
রাফিজ বুকের ভেতর থেকে জেগে ওঠা রাগটাকে দমন করে বললো-“তোমার নিজের জীবনে কি ঘটতে চলছে সে বিষয়ে তোমার কোনো হুঁশ নেই,তুমি এসেছো আরেকজনের দাম্পত্য নিয়ে গসীপ করতে!”
প্রিয়ন্তী ‘ধ্যুৎ’ বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ম্যাগাজিনে মন দিলো!রাফিজ পেছন দিক থেকে ওর দিকে চেয়ে রইলো!তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়লো!বারান্দায় এসে সিগারেট ধরালো।মাথার ভেতর বিক্ষিপ্ত চিন্তা এলোমেলো জট পাকাচ্ছে!কি ঘটতে যাচ্ছে তার জীবনে!না জানি কোন্ নতুন অশান্তি আবার এসে জুটবে!এক অশান্তি তো রোজকার চলছেই!এরপর যে কি নতুন অশান্তি হবে!
লম্বা করে সিগারেটে টান দিয়ে নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়ার সাথে সমস্ত চিন্তা উদ্বেগগুলোকে যেন বের করে দিতে চাইলো রাফিজ !
★
পরের সপ্তাহেই প্রিয়ন্তী হাসিমুখে অষ্ট্রেলিয়া চলে গেলো।যাবার আগের দিন রাতে রাফিজ প্রিয়ন্তীকে জড়িয়ে ধরে ওর মনের খবর নিতে চেষ্টা করেছিলো!প্রিয়ন্
তী ছটফটিয়ে নিজেকে মুক্ত করে সরিয়ে নিয়ে বলল-“আরে তুমি এমন করছো কেন,আমাদের তো আর বিচ্ছেদ হচ্ছে না,এসব সিলি বিষয়,হরহামেশাই হচ্ছে!তাছাড়া আমাদের সম্পর্ক তো থাকছেই!কেন তুমি দিব্যাভারতীর ঐ ছবিটা দেখনি..?”
-“শাটআপ…জাষ্ট শাটআপ!”(প্রচন্ড ধমকে প্রিয়ন্তীকে থামিয়ে দিয়েছিলো রাফিজ)সবসময় খালি,ঐ নায়ক এই নায়িকা,অমুক সিনেমা তমুক সিরিয়াল।এসবের বাইরে কিছু ভাবতে শেখোনি?”
-“আগামীকাল আমি অষ্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি আর তুমি আমাকে ধমকাচ্ছো?যাকগে ,আমার ওসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই!আমি তোমার মতো এসব সিলি সেন্টিমেন্টে ভুগি না!এসব আমাদের জীবনেরই অংশ,বুঝলে?একটু প্রাকটিক্যাল হতে শেখো!”
রাফিজ আর কথা বাড়ায়নি!প্রিয়ন্তী খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিদায় নিয়ে চলে গেলো!সারাটা দিন এক অস্থিরতার মধ্যে কাটলো রাফিজের।এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কা পেয়ে বসেছে ওকে।আর কতবার ওকে মায়ের স্বেচ্ছাচারীতার বলি হতে হবে!
★
এর দিন দুয়েক পরেই এক ঘরোয়া পরিবেশে,খুব ঘনিষ্ট দু একজন আত্মীয়ের উপস্থিতিতে রাফিজের সাথে নাযিয়াতের বিয়েটা হয়ে গেলো!
বেলা চৌধুরী তেমন কাউকেই জানাননি এ বিয়ের কথা!ঘনিষ্ট দুচারজনকে নিয়ে ঘরোয়াভাবে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারলেন তিনি!নাদিয়া,নাঈ
মা,নিকিতা,রেশমা চোখের জলে ভাসতে ভাসতে নাযিয়াতকে বিদায় দিলো!বিয়েতে নাযিয়াতের বড় মামা উপস্থিত ছিলেন।ওর বাবার অনুপস্থিতিতে তিনিই ওদের একমাত্র অভিভাবক!নাযিয়াতের বিয়ের স্বপক্ষে তার ভূমিকাটাই ছিলো সবচে বেশী জোরালো!
★
নিরবে চোখের পানি ফেলছিলো নাযিয়াত।কয়েকবার চারিদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো,আরেকজনের সাজানো সংসারে ঢুকে পড়েছে সে!নাযিয়াত জানে,এখনো দ্বিতীয় বিয়ে বা ২য় স্ত্রী’র মানসিকতা মুসলিম সমাজে এতটা সমৃদ্ধি লাভ করেনি!এখনো এটাকে মন্দ চোখেই দেখা হয়।পুরুষ মানুষ একসাথে দশটা গার্লফ্রেন্ড পুষলেও তাকে কেউ ততটা খারাপ বলেনা যতটা খারাপ বলে অধিক বিয়ে করলে।অথচ সম্মাণিত সাহাবায়ে কেরামগণের প্রায় অনেকেরই একাধিক স্ত্রী ছিলো।তারা সুখে সংসার কাল কাটিয়ে গেছেন।অথচ এখন তো একক সংসারগুলোতেও কেবল স্বামী স্ত্রী’র মাঝেই সে সুখের ছিটেফোঁটাও নেই!অধিক স্ত্রী’গণের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের নজির স্বয়ং রাসুল সাঃ স্থাপন করে গেছেন।তবু মুসলিম সমাজে কত দুর্বাক্য বলা হয় এই বিষয়টাকে নিয়ে!বর্তমান সময়ে যে পরিস্থিতি এসেছে,একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রী গ্রহন না করলে হাজার হাজার মহিলাকে অবিবাহিতা কুমারী জীবন কাটাতে হবে!কারন বর্তমান জরিপে দেখা গেছে,পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে।ইসলাম সবসময়ই মানবতার সমাধান দিয়ে আসছে।এমন সমস্যা হবে জানে বলেই স্রষ্টা অধিক স্ত্রী’র সুন্নত আমাদের সামনে রেখেছেন।
এখন কেবল কিছু মানুষের বোঝার বাকি!
*
নাযিয়াত নিজ ধর্মের প্রতিটি বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই সে এটাকে অন্য অর্থে গ্রহন করেনি বরং খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে!তবে প্রিয়ন্তী এটাকে কিভাবে নিয়েছে সেটাই ওর জানার ইচ্ছে ছিলো!
প্রিয়ন্তীর সাথে দেখা করে ওর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো নাযিয়াত।কিন্তু সেটাও আর হয়ে উঠলো না!
দুহাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে নাযিয়াত!ওর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফুলের পাপড়ী!
সম্ভবত বসে থাকতে গিয়ে ওর চোখটা লেগে এসেছিলো!আচমকা খাটের উপর কারো বসার শব্দে নাযিয়াত তটস্থ হলো!মুখ তুলে তাকিয়ে রাফিজকে দেখে ঘোমটাটা আরেকটু টানলো!
রাফিজের দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ স্পষ্ট।
কিছুক্ষণ নিরবতার পর নাযিয়াত বিশুদ্ধ উচ্চারণে সালাম দিলো।
রাফিজ কিছুটা চমকে তাকিয়ে তারপর সালামের উত্তর দিলো!তারপর উঠে বারান্দায় চলে গেলো!
*
নাযিয়াত খানিকক্ষণ বসে থেকে খাট থেকে নামলো!ধীর পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো!
-“একটা কথা ছিলো যে…!”
রাফিজ একবার তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলো!
নাযিয়াত কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসতে নিলে রাফিজ বললো-“কথা ছিলো বলে চলে যাচ্ছো কেন!কথা শেষ করে যাও!”
নাযিয়াত চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“বিয়েটা কি আপনার স্বইচ্ছায় হয়েছে?”
রাফিজ ঘাড় ফেরালো-“মানে?”
-“মানে,বিয়েটা কি আপনি নিজের ইচ্ছেতে করেছেন নাকি মায়ের চাপে…”!
-“আমাকে কি বাচ্চা ছেলে মনে হয়?”
-“না…তা না !মিনিমাম পঞ্চাশের ওপরে তো হবেনই!”বিড়বিড় করে বললো নাযিয়াত।
রাফিজ ঘুরে দাঁড়ালো-“কি?”
-“,আরো বেশী?”
-“তুমি কি আমার সাথে ফাজলামী করার চেষ্টা করছো?”
নাযিয়াত ভীরু চাহনীতে তাকিয়ে মাথা নাড়লো!
রাগে রাফিজেরর মুখে কথা আটকে গেলো-”
-“তুমি ইচ্ছে করেই এটা বলেছো যেন আমি রেগে যাই!আমার এখনো চল্লিশ পেরোয়নি আর….!”
-“স্যরি,বুঝতে ভুল করেছি!”
-“না,বুঝতে কেন ভুল করবে,আমাকে কি এতো বয়স্ক দেখায়?”
-“স্যরি,আমার ধারনার মেশিনটা একদমই অকেজো!”
-“স্বীকার করার জন্য ধন্যবাদ!এখন কি বলবে বলে বিদায় হও!”
-“কোথায় বিদায় হবো?”
-“উফ্….মানে ঘরে যাও!”
-“ও…..আমি,বাসর ঘরের কিছু নিয়ম সম্পর্কে আপনাকে জানাতে এসেছিলাম!”
-“কিসের নিয়ম?”ভ্রু সামান্য কুঁচকে জানতে চাইলো রাফিজ!”
নাযিয়াত হেসে ফেললো!-“কেন,আপনার প্রথম বাসর রাতে নিয়মগুলো পালন করেননি?”
রাফিজের মুখ শক্ত হয়ে গেলো!মনে পড়ে গেলো প্রথম বাসর রাতের কথা!তার সাথে প্রিয়ন্তীর কথাও!এরকম শীতল প্রকৃতির মেয়ে রাফিজ তার জীবনে আরেকটা দেখেছে কিনা বলতে পারবেনা!
রাফিজ সেরাতে কত কথা বলে যে প্রিয়ন্তীকে হাসাতে চেষ্টা করেছিলো কিন্তু প্রিয়ন্তী যেন মুখে ছিপি এঁটে বসেছিলো।একদম এক্সপ্রেশন লেস একটা মানুষ।প্রথমে রাফিজ ভেবেছিলো বাড়ীর জন্য হয়তো মনখারাপ কিন্তু পরে জেনেছে সে মানুষটাই এমন।কোনো উত্তেজনা নেই,উদ্দীপনা নেই!
রাফিজকে চিন্তায় ডুবতে দেখে নাযিয়াত বললো-“বিয়ের রাতে স্ত্রী’র কপালে হাত রেখে দু’আ পড়তে হয় আর দুজন দুরাকাত নামাজ পড়বো,ব্যস্।তারপর আপনাকে আর বিরক্ত করবোনা!
-“কেন?’রাফিজের মুখ ফসকে স্বভাবজাত দুষ্টুমিটা বেরিয়ে এলো! অবচেতন মনটা যেন জানতে চাচ্ছে সব মেয়েই কি প্রিয়ন্তীর মতো আবেগহীন ?
নাযিয়াত মুখ নামিয়ে বললো-“কেন মানে?”
-“মানে ঐ যে বললে,আমাকে আর বিরক্ত করবেনা?”
নাযিয়াত আরক্ত মুখে চুপ করে রইলো।
রাফিজ এগিয়ে এসে বললো-“চলো দেখি,কি কি করতে হবে… শিখিয়ে দাও!”
নাযিয়াত ওর পাশে পাশে চললো!
তারপর
ঘরে এসে বললো-“বসুন!”
রাফিজ বসলে নাযিয়াত ওর হাতে এক টুকরো কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললো-“এটা পড়তে হবে!”
-“কপালে হাত রেখে?”
-“জ্বী!”
রাফিজ তাই করলো!
নাযিয়াত কাগজটা হাতে নিয়ে বললো-“এবার,অযু করে আসুন!”
-“আবার অযু করতে হবে?”
-“কেন,করা আছে?”
-“ও…না করে নিচ্ছি!”
কিছুক্ষণ পর দুজনে নামাজে দাঁড়ালো।
নামাজ পড়তে গিয়ে রাফিজের মনে হলো সে এই প্রথম কোনো মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছে যে তার স্ত্রী!পরক্ষণেই চিন্তাটাকে উড়িয়ে দিলো!এভাবে প্রিয়ন্তীকে ছোট করার কোনো মানে হয়না!নামাজ শেষে পূর্ব মুডে ফিরে গেলো সে!পুনরায় বারান্দায় চলে গেলো!এবার আর নাযিয়াত তাকে ডাকলো না কিন্তু রাফিজের ইচ্ছে হচ্ছিলো মেয়েটি তাকে ডাকুক,কথা বলুক।কারন তার কথা শোনার মতো এতদিন যে কেউ ছিলোনা!
……
চলবে……
উত্তরাধিকার (২য় পর্ব)
উত্তরাধিকার (২য় পর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
*************************
বোরকাটা সযত্নে গেটের পেছনে একটা হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখলো নাযিয়াত।ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে পড়তে চাইছে।কিন্তু এখনো বিশ্রাম নেবার সময় হয়নি ওর।
মাগরিবের নামাজের পরপরই আরো দুটো মেয়ে পড়তে আসবে।ওরা দুই বোন!একজন ক্লাস এইটে অপরজন ক্লাস নাইনে পড়ে!ওদের পড়ানো শেষ হলে আজকের মতো ছুটি।আবার আগামীকাল সকাল থেকে শুরু হবে!
মাদ্রাসার সময়টুকু বাদে প্রতিদিন গুণে গুণে চারটা টিউশনি করতে হয় নাযিয়াতকে।
একটা সময় যখন ওর বাবা বেঁচে ছিলো তখন নাযিয়াতকে পরিবার নিয়ে এতো ভাবতে হয়নি।
স্কুল পেরিয়ে তখন কলেজে উঠেছিল সে।এখনকার মতো পূর্ণ হিজাব নিকাব না করলেও সবসময় শালীনভাবে চলাফেরা করতেই পছন্দ করতো সে!
কোনোদিনই সে ওড়নাকে মাফলার ষ্টাইলে গলায় ফেলে রাখেনি।সবসময় তার সদ্ব্যবহার করেছে।আড়াই গজের ওড়নাকে দুপাশে সেফটিপিন দিয়ে আটকে কিছুটা পেঁচিয়ে অর্ধেক শরীর ঢেকে পড়তো সে!তারপরেও কিছু কৌতুহলী দৃষ্টির ছোবল থেকে নিজেকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়তো!বয়স বাড়ার সাথে সাথে আশেপাশের মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে যেতে দেখেছে নাযিয়াত।পর্দা আর শালীনতার পার্থক্য বুঝতে খুব বেশী বেগ পেতে হয়নি নাযিয়াতকে!
শালীনতা আর পর্দার সংজ্ঞা সম্পূর্ণ ভিন্ন।কারন একটা হাফহাতা জামা একটা স্লিভলেস জামার চেয়ে শালীন!আবার স্লিভলেস জামা একটা বিকিনির চেয়ে শালীন।কারো কাছে হাঁটু পর্যন্ত পোষাক হাঁটুর উপরের জামার চেয়ে শালীন!শালীনতা জিনিসটা সবসময়ই তুলনামূলক ভাবে বিচার্য এবং এটা ব্যক্তিভেদে সবসময়ই বিভিন্ন!দেশকালের বিচারে শালীনতার সংজ্ঞাও বদলে যায়!আমেরিকায় যেটা শালীন বাংলাদেশে সেটা অশালীন!
কিন্তু পর্দা একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
এটি একটি ফরয ইবাদত।
এটি শুধু পোষাকের সাথে সম্পর্কিত নয়,এর আরো আনুষঙ্গিক শর্ত আছে!
কেবল কব্জি আর মুখমন্ডল বাদে সমস্ত শরীর ঢেকে রাখার নামই পর্দা নয়!
পোষাক যথেষ্ট ঢিলেঢালা হওয়া,রঙচঙে চাকচিক্যবিহীন হওয়া এর অন্যতম শর্ত।পাশাপাশি অকারনে গায়ের মাহরামের সামনে না যাওয়া,তাদের সাথে মিষ্টি স্বরে কথা না বলা,আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে তাদের সামনে চলাফেরা না করা,কন্ঠের মিষ্টতা পরপুরুষ পর্যন্ত না পৌঁছানো….পর্দ
ার অনেকগুলো শর্তের মধ্যে অন্যতম।পর্দার বিধান সারাবিশ্বে সকল দেশের সকল ভিন্ন গোষ্ঠির মানুষের জন্য একই।
একজন বাঙালী মুসলিমের জন্য পর্দার যে নিয়ম একজন আমেরিকান মুসলিমের জন্য ঐ একই নিয়ম।
এগুলো নাযিয়াত জানতো না।
কলেজে পড়ার সময় এক ইমাম সাহেবের মেয়ের সাথে ওর খুব বন্ধুত্ব হয়েছিলো!মেয়েটি পূর্ণ পর্দা করে কলেজে আসতো,ওর আপাদমস্তক কারো আচ্ছাদান দেখে কলেজের মেয়েরা ওকে বলতো ‘কাকতাড়ুয়া’!ও একথায় একদম গা করতো না!কোনোরকমে চোখ টুকু বের করে ক্লাসে বসতো।কলেজ শেষ হবার দিন নাযিয়াত ওকে অনুরোধ করেছিলো ওর পুরো মুখটা দেখাতে।
ও অনুরোধ রেখেছিলো তবে পর্দার আরেকটি শর্ত বেধে দিয়ে বলেছিলো কারো কাছে যেন ওর চেহারার বর্ণনা না করে!নাযিয়াত ওর কথা রেখেছিলো,কাউকে বলেনি যে ও ছিলো দম বন্ধ করা সুন্দরী!
কলেজে পড়াবস্থাতেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়!তারপর আর যোগাযোগ হয়নি ওর সাথে!
নাযিয়াত ওর সংষ্পর্ষে থেকেই পর্দা করা শিখেছে।দ্বীন সম্পর্কে জেনেছে।ও’ই নাযিয়াতকে বলেছে যে কুরআন বিশুদ্ধভাবে না পড়লে তার অর্থ বদলে যায় এবং নামাজও শুদ্ধ হয়না।ওরই পরামর্শ ছিলো নাযিয়াত যেন একটা মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে কুরআন পড়াটা বিশুদ্ধভাবে শিখে নেয়।
সে বছরই নাযিয়াত একটা মাদ্রাসায় ঢুকে কুরআন পড়া শিখতে শুরু করেছিলো!
মাত্র এক বছরের মধ্যেই নাযিয়াত বিশুদ্ধ কুরআন পাঠে দারুন পারদর্শীতা অর্জন করে ফেললো।পাশাপাশি মাদ্রাসার নুরানী সোহবতে বদলে গিয়েছিলো ওর জীবনধারা!
কলেজের পাশাপাশি মাদ্রাসাতে ছোট বাচ্চাদের পড়া শেখানোর দায়িত্বটা তখনই স্বেচ্ছায় নিয়ে নেয় ও!
এদিকে পাশ করে বেরুবার পরপরই ওর বাবা আচমকা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে কলেজের খরচ জোটানো দুরূহ হয়ে পড়েছিলো ওর জন্য!
উপরন্তু সংসারের খরচ, ছোটবোনদের পড়াশোনা ওকে দিশেহারা করে ফেলছিলো প্রায়!তখন মাদ্রাসাতে পড়ার সময়ই জেনেছিলো যে, আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের পছন্দ করেন,তিনি সর্বদা ধৈর্য্যশীলদের সাথে আছেন।
তখন থেকেই নাযিয়াত ধৈর্য্যকে নিজের বর্ম বানিয়ে নিয়ে জীবনযুদ্ধে নামলো!
নিজের পড়াশোনা বাদ দিয়ে অর্ধেক বেলা মাদ্রাসা আর বাকীবেলা চারটা টিউশনি জুটিয়ে নিয়েছিলো সে!এতেই আল্লাহ বরকত দিয়েছেন।আর সেই বরকতের জোরে মসৃন গতিতে চলছে ওদের সংসার নামক ঠেলাগাড়ীটা!
★
★★
মাগরিবের নামাজ পড়ে উঠতেই সবচে ছোট বোন রেশমা ওকে এককাপ ধোঁয়া ওঠা চা ধরিয়ে দিয়ে বললো-“বড়াপু,চা টা খেয়ে নাও,তোমার সাথে জরুরী কথা আছে!”
-“চা খেতে খেতেই শুনি, কি তোর জরুরী কথা!”
রেশমা ওর জামার কোনা খুঁটছে।
নাযিয়াত বুঝলো, সে কিছু চাইতে এসেছে।নাযিয়াত ওর চায়ের কাপটা রেখে ওর হাত ধরে বললো-
-“তোর কিছু লাগবে তাইনা?কিন্তু বলতে দ্বিধা হচ্ছে!”
রেশমা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বললো-
-“না বললেও কিভাবে বুঝে ফেললে বড়াপু?”
নাযিয়াত সামান্য হাসলো-“এবার বল্,কি চাই?”
রেশমা মৃদুস্বরে তার ব্যাগের কখা জানালো যেটা ছিঁড়ে গেছে!নাযিয়াত চায়ে চুমুক দিয়ে বললো-“কই নিয়ে আয় দেখি সেটা!”
কথার মাঝেই নাযিয়াতের ইমিডিয়েট ছোটো বোন নাদিয়া এলো!ও নিজেও ছোটখাট দুটো টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়!ও এসেই ওর সমস্যা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো!নাযিয়াত ধৈর্য্য ধরে ওর কথাটাও শুনলো!
ওর কথাটা শেষ হতে না হতেই মা এসে বসলেন ওর পাশে-“হ্যাঁরে,তোর সাথে একটা জরুরী কথা ছিলো,তুই ফী হবি কখন?”
-“পুরোপুরি ফ্রি হতে গেলে রাত বারোটা বাজবে মা, তারচে এখনি বলে ফেলো!”
-“তোর ছোট খালামনি এসেছিলো আজ।তার কথায় যা বুঝলাম,সে নাদিয়ার সাথে তার ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।”
নাযিয়াত নিরবে কথাটা শুনে বললো-“উনি কি পরিস্কার করে বলেছেন কথাটা?”
-“না,ঠিক,সরাসরি বলেননি তবে আমার মনে হলো!”
-“বিয়েশাদীর ব্যপারে কথাবার্তা খোলাখুলি হলে ভালো পরে মনকষাকষি হয়না!আচ্ছা,প্রয়োজনে খালামনির সাথে আমি নিজেই কথা বলে নেবো,যদি সত্যিই উনি চান যে নাদিয়া তার ছেলের বৌ হবে তাহলে আমাদের রাজী না হবার কোনো কারন নেই মা!বরং এটাতো আল্লাহর রহমত!”
-“সব বুঝলাম কিন্তু বিয়ের খরচ জোটাবি কোত্থেকে?ন্যুনতম ঘর সাজিয়ে দিতে গেলে….”!
-“মা..!আমি আগে খালামনির সাথে কথা বলে নেই!উনি তো আমাদের সবই জানেন!তারপর যা হয় দেখা যাবে,তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ!”
-“আমি আরেকটা কথা ভাবছি!”
-“বলো!”ক্লান্ত চোখে তাকালো নাযিয়াত।ওর ভীষণ ঘুম পাচ্ছে!
-“তুই আমার বড় মেয়ে,তোকে রেখে মেজটাকে বিয়ে দিতে দাঁড়ালে লোকে কি বলবে?তাছাড়া তোর কি হবে?”
নাযিয়াত হেসে ফেলল-“লোকে তো কত কথাই বলে মা,সমস্যার সময়ই কেবল তাদের কাউকে পাশে পাওয়া যায়না।আমাদের ধর্মে বড়র আগে ছোটকে দেয়া যাবেনা এমন কোনো বিধিনিষেধ নেই!আমার ভাগ্যে যা আছে তা’ই হবে!আমাকে নিয়ে ভাবতে গেলে তোমার বাকী চার মেয়েকে সিরিয়াল ধরে বসে থাকতে হবে মা!এখন এসব ভাবনা ছাড়ো!তুমি বিশ্রাম নাও গে!”
-“ঘরে কিন্তু একদম বাজার নেই!”
নাযিয়াত একটু থমকে গেলো!ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো-“রাতটা কোনোরকম চালাও,কাল সকালে দেখি কি পাওয়া যায়!এতো রাতে আবার বোরকা গায়ে দিতে ইচ্ছে করছেনা মা!ঘরে ডিম আছে না?ঐটা দিয়ে চালিয়ে নাও!”
পেছন থেকে সেজো বোন নাঈমা বলে উঠলো-“আমাদের বাসার সামনেই সব্জির ভ্যান বসেছে বড়াপু!আমি মাথায় কাপড় দিয়ে যেয়ে নিয়ে আসি?”
নাযিয়াত জ্বলে উঠলো-“নিয়ে আসি মানে?তোর ঠ্যাঙ আমি ভেঙ্গে ফেলবো!”(মায়ের দিকে তাকিয়ে)ও বুঝি ফটাফট রাস্তায় বেরোয়?তুমি কিছু বলো না?”
মা আমতা আমতা করতে লাগলো!মুলতঃ নাযিয়াতের ভয়েই তারা একটু আধটু রেষ্ট্রিকশন মানতে চেষ্টা করে,নইলে সুযোগ পেলেই নিয়মের বেড়া ডিঙ্গোতে চায়!নাযিয়াত বরাবরের মতোই পর্দার আদেশ সম্পর্কে ওদের নসীহত করলো!ওরা চুপচাপ শুনলো।ওদের চারবোনের একটাই বড় গুণ আর তা হলো ওরা কখনোই নাযিয়াতের সাথে তর্ক করেনা!কিন্তু নাযিয়াতের চোখের আড়াল হলেই ওরা যে যার মতো স্বাধীন হয়ে যায়।
পিতার অনুপস্থিতিতে একটি পরিবার লাগামবিহীন ঘোড়া আর পালবিহীন নৌকার মতোই!নাযিয়াত সাধ্যমতো সেই হাল ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে কই!
★
প্রিয়ন্তী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হিজাবটা মাথায় চাপালো!যে কোনো মুহূর্তে নাযিয়াত এসে পড়বে।
পেছন থেকে রাফিজের ব্যস্ত কন্ঠে তটস্থ হলো সে-“কোথায় যাচ্ছো?”
-“পড়তে বসবো!নাযিয়াত আপু আসবে এখন!”
-“আমার নীল ফাইলটা গতরাতে এখানে রেখেছিলাম।এখন পাচ্ছিনা!কোথায় দেখেছো?”
-“না,তো….!”বলে প্রিয়ন্তী ফের হিজাব বাঁধতে লাগলো!রাফিজ বাঁজখাই স্বরে ধমক লাগালো-“না তো’.. বলে যে দায় সারছো,খুঁজে বের করতে পারোনা?খালি আছো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।একটা জিনিস যদি গুছাতে দেখি!গতরাতেই এখানে ফাইলটা রেখেছি আর এখন গায়েব হয়ে গেলো?”
প্রিয়ন্তী মুখ ভার করে সোফার নিচে উঁকি দিয়ে বললো-“এখানে নেই!”
রাফিজ রাগে ফেটে পড়লো-“ওখানে যে নেই ওটাতো আমিই প্রথমে বললাম।তোমার কোমড় কি বাঁকা হতে চায়না?খুঁজে দেখতে পারোনা?নাকি সারাদিন খালি সেজেগুজে পুতুল হয়েই থাকতে পারো?অকম্মার ঢেঁকি কোথাকার!যাও,সরো এখান থেকে!যত্তসব আহ্লাদী মার্কা ঢং..!”
প্রিয়ন্তী মুখ কালো করে চলে এলো সেখান থেকে।রাফিজ নিজেই সোফার ফোমগুলো তুলে,তোষকের নিচে,খাটের নিচে দেখতে লাগলো।কোথাও নেই!রাতারাতি একটা ফাইল হাওয়া হয়ে যেতে পারেনা!গেলো কোথায়? খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফাইল।
আজকের মিটিং এ এটার উপরই আলোচনা চলবে!রাফিজ প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করছে। প্রিয়ন্তীর ওপর রাগটা ক্রমাগত বাড়ছে।খাওয়া,ঘুমানো আর সাজগোজ করা ছাড়াও যে দুনিয়াতে আরো কাজ আছে সেটা যেন এই মেয়ে জানেইনা!মা যে কোত্থেকে একটা পুতুল যোগাড় করে ওর ঘাড়ে গছিয়ে দিয়েছে আল্লাহই জানেন!
পুতুলটা খালি পটের বিবি সেজে ঘুরে,কোনো উপকারেই আসেনা!মনটাই তেতো হয়ে গেলো ওর!হতাশ হয়ে বসে সিগারেট ধরালো! সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়েই আলমারীর ডালা খুললো শার্ট বের করবার জন্য আর তখনই একগাদা কাপড় হুড়মুড় করে রাফিজের গায়ের উপর দিয়ে মাটিতে পড়লো!সবশেষে পড়লো রাফিজের নীল ফাইলটা।
রাফিজের মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেলো!গলা চড়িয়ে ডাক দিলো-“প্রিয়ন্তী….!”
প্রায় সাথে সাথেই বেলা চৌধুরী ঘরে ঢুকলেন-“কি রে, সাত সকালে এতো চ্যাঁচাচ্ছিস কেন?প্রিয়ন্তীর এ্যারাবিক টিচার এসছে,ও পড়তে বসেছে।কি বলবি আমাকে বল!”
-“এই দেখো তোমার পুতুল বৌমার কাজ।গতরাতে তাকে কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখতে বলেছিলাম,সময়মতো কেনো কিছুই হাতে কাছে পাইনা।সে সব কাপড় দুহাতে ধরে এটার ভেতর ঠেলে ঢুকিয়ে রেখেছে।একটাও ভাঁজ করা নেই,কি অবস্থা দেখো !এতো বছর ধরে সংসার করছে অথচ এখনো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘোরে।সে কাপড়ের সাথে আমার ফাইলটাকে শুদ্ধ পোটলা বানিয়ে আলমারীতে ঢুকিয়েছে,অথচ সে নিজেই জানেনা।সেই তখন থেকেই এই ফাইলটা খুঁজছি।তার কোনো খবর নেই!এভাবে কতদিন,মা?কিছু শেখাতে পারোনা ওকে?”
-“আরে বাবা!বড়লোকের মেয়ে কাজকর্ম করে তো আর অভ্যেস নেই!তাছাড়া আদরে আদরে বড় হয়েছে।আমি ময়নাকে বলে দেবো, ও সব গুছিয়ে দেবে!”
-“নিজেদের ব্যক্তিগত জিনিসও কি ময়না গুছিয়ে দেবে?এসব বলে তুমিই ওকে মাথায় তুলেছো!ওকেই শেখাও না কেন?সংসার তো আর ময়না করবে না ও’ই করবে…তো ওকেই এসব বিষয়ে যত্নবান হতে বলো!যত্তসব !”
রাফিজ গজরাতে গজরাতে কাপড়ের পাহাড় টপকে বাইরে চলে গেলো!বেলা চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাপড়গুলোর দিকে তাকালেন।প্রিয়ন্তীটা আসলেই বড় উদাসীন।স্বামীর প্রয়োজন অপ্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখা যে ওর কর্তব্য, এই জিনিসটাই ওকে বোঝানো যায়না!
★
★ ★
প্রিয়ন্তীকে পড়াতে নাযিয়াতের বেশ পরিশ্রম হয় কারন মেয়েটার মধ্যে পরিশ্রম করার মানসিকতা একেবারেই নেই!সে সব কিছু সহজে আয়ত্ত্ব করতে চায়।ওকে একটা শব্দ কয়েকবার পড়তে বললেই সে বিরক্ত হয়ে যায়।নাযিয়াতের মাথা ভোঁ ভোঁ করে ওকে পড়াতে বসলে।তারপরেও হাল ছাড়েনা।গত দুটো মাস ধরে ওকে কায়দাই পড়িয়ে যাচ্ছে, আর কোনো অগ্রগতি হচ্ছেনা!
নাযিয়াত চলে আসতে নিলে বেলা চৌধুরীর ডাকে থেমে গেলো!
-“তোমার মোবাইল নম্বরটা দেয়া যাবে?”
-“জ্বী..?”অবাক হয়ে তাকালো নাযিয়াত!
-“তোমার সাথে আমার পার্সোনাল কিছু কথা আছে!”
-“জ্বী,বলুন!”
-“উঁহুঁ…এখন নয়।পরে। সেকারনেই তোমার মোবাইল নম্বর চাচ্ছি যেন যে কোনো সময় তোমার সাথে কন্ট্যাক্ট করতে পারি!”
নাযিয়াত কিছুটা ভেবে নম্বর বললো!বেলা চটপটে হাতে তা সেভ করে নিলেন।নাযিয়াত সালাম দিয়ে চলে গেলো!
বেলা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন,নাহ্,ব্যপারটাকে এভাবে ফেলে রাখার কোনো মানে হয়না!যা করার তাকেই করতে হবে।তাহলে অযথা দেরী কেন!
তিনি প্রিয়ন্তীর মা’কে ফোন দিলেন।এবং তারপর পরই গাড়ী বের করতে বললেন!
*
আধাঘন্টার মধ্যেই তিনি প্রিয়ন্তীর মায়ের মুখোমুখি হলেন।প্রিয়ন্তীর মা শাজিয়া হামিদ একটু অবাক হয়েই তাকালেন!
বেলা চৌধুরী এতো জরুরী ভিত্তিতে একেবারে বাড়ী বয়ে কি বলতে এসেছেন!
তারপরেও তিনি স্বাভাবিক সুরে বলার চেষ্টা করলেন-“আপা, একেবারে হঠাৎ, এসময়ে?বিশেষ কিছু দরকার নাকি?”
বেলা স্বগোতক্তি করলেন-“বিশেষ তো বটেই!আপনার সাথে কথা বলা দরকার তারপর বাকী কাজ।গেটটা একটু লাগিয়ে দিন”!
শাজিয়ার বিস্ময়ের মাত্রা বাড়লো!তিনি উঠে গিয়ে দরজা চাপিয়ে এসে বসলেন-“জ্বী,বলুন।প্রিয়ন্তী ঠিক আছে তো!জামাই…?”
-“আপাত দৃষ্টিতে ওরা ঠিকই আছে ,তবে কতদিন ঠিক থাকবে সেটাই প্রশ্ন!”
-“কেন,এমন কেন বলছেন?”
-“দেখুন,একটা সংসারের ভিত্তি হলো স্বামী স্ত্রী’র পারষ্পরিক ভালোবাসা বিশ্বাস।আমি প্রিয়ন্তীর কোনো বদনাম গাইতে আসিনি।সে যেমন আছে সেটাকেই ভাগ্য বলে মেনে নিতে আমার অসুবিধে নেই !
সে আগাগোড়াই সংসারের প্রতি উদাসীন কিন্তু এখন যে সমস্যাটা প্রকট হয় দেখা দিয়েছে সেটা হলো আমার বংশ তাকে দিয়ে রক্ষা হচ্ছেনা!সেটা হলেও নাহয় তার অন্যান্য দোষ মাটিচাপা পড়ে যেতো,কিন্তু….!”
-“কি বলতে চান সেটা পরিস্কার করে বলুন!”শাজিয়া থমথমে মুখে বললেন!বেলা আর ভণিতা না করে সরাসরি বললেন-“আমি আমার রাফিজকে আবার বিয়ে করাতে চাই!”
শাজিয়া বোকার মতো তাকিয়ে রইলেন-“,মানে?”
-“মানে যা শুনেছেন সেটাই!এর আবার মানে কি?আমার উত্তরাধিকার দরকার,ব্যস্!”
শাজিয়া সোজা হয়ে বসলেন-“আপনি কি আমার মেয়েকে ডিভোর্সের কথা বলতে এসেছেন?”
-“এই তো বেশী বুঝে ফেললেন!আপনার মেয়েকে তো বলেও বোঝানো যায়না,আর আপনাকে না বলতেই সব বুঝে ফেলেন!”
-“তাহলে?আমার মেয়ের সতীন আনবেন যে বললেন ?”
-“জ্বী,আর সেটা আপনার মেয়ের ভালোর জন্যই!যা বলি ভালো করে শুনুন,তারপর মতামত দেবেন!”
শাজিয়া তাকিয়ে রইলেন।বেলা যথাসম্ভব গুছিয়ে তার পরিকল্পনা বললেন।
শাজিয়ার মুখ পর্যায়ক্রমে গম্ভীর হয়ে উঠলো-
-“এভাবে জেনেশুনে আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট করা কি ঠিক হবে?”
-“নষ্ট হবে কেন?এর বিনিময়ে তার সমস্ত দায়ভার যে আমি নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছি তার কি?এজন্যেই তো গরীব ঘরের মেয়ে বেছে নিচ্ছি।এমনিতে তো এদের ভালো বিয়েই হতোনা,সেখানে বিয়ে হবে,সংসার পাবে,স্বামী টাকায় বাপের বাড়ীর জঞ্জাল সাফ করবে!মন্দ কি?”
-“কিন্তু তার সন্তানটাকে রেখে তাকে যে পরে ঘরছাড়া করবেন,এতে পাপ হবেনা?”
-“আরে,এতো ভাবলে দুনিয়া চলবেনা।তাহলে ঠিক আছে,আমি ঐ গরীব মেয়েটাকে রেখে দেবো আপনি আপনার মেয়েকে নিজের ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন,কেমন…. রাজি তো?”
শাজিয়া থমকে গেলেন।
বেলা সবজান্তার হাসি হেসে বললেন-“শোনেন,ওসব তত্ত্ববাক্য যে আমি জানি না,এমন না।কিন্তু এসব আপ্তবাক্যে আমার পোষাবে না,আমার একজন উত্তরাধিকারী চাই,ব্যস ! তার জন্য যা যা করা দরকার তা আমি করতে প্রস্তুত।নাযিয়া
তকে ঠকাবো না,ওর চারটে বোনকে পার করার দায়িত্ব নিচ্ছি,বাড়ীটা ওর মা’র নামে কিনে দিচ্ছি,ক্যাশ পাঁচলাখ টাকা দিচ্ছি আর কি চাই?”
-“নাযিয়াতটা কে?”
-“আপনার মেয়ের আরবী টিচার!”
-“ওকে বলেছেন,এসব কথা?”
-“আরে পাগল নাকি?ওকে সবই বলবো! কেবল নাতি হবার পর যে ওকে আমার আর লাগবেনা একথাটা বাদ দিয়ে।এটা বললে রাজী হবে নাকি?আরে উন্নত বিশ্বে পেট ভাড়া দেয়া হয়,কিন্তু এটা মুসলিম কান্ট্রি এখানে ওসব চলবেনা!তাছাড়া ওদের বৈধ অবৈধ নেই!আমি পাকাপোক্তভাবে আমার একজন ওয়ারিশ চাই!নইলে তো দত্তকই নিতাম! কিন্তু সে তো আর আমার রক্ত হবেনা! তাই রাফিজকে বিয়ে করানো ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই!আপনাকে জানালাম যেন আপনি আবার অন্য কিছু ভেবে না বসেন।বেয়াই সাহেবকে একথা বোঝানোর দায়িত্ব আপনার। আমি জনে জনে এতো বোঝাবুঝিতে নেই।সামনে আমাকে আরো কঠিন কিছু দায়িত্ব পালন করতে হবে তাই আপনাকে জানালাম।বেয়াই সাহেব রাজী না হলেও আমাকে ভিন্ন পথ দেখতে হবে তাই ওনাকে ভালোভাবেই বোঝাবেন।আমি এখন তাহলে উঠি!”
-“সে কি চা….ঠান্ডা…!”
-“নো,থ্যাংকস।আমাকে এখন এক জায়গায় যেতে হবে!”
★
★ ★
আজ শুক্রবার।আজ নাযিয়াতের বাইরে কোনো কাজ নেই!দিনটাকে সে বড় উপোভোগ করে সে!সারা সপ্তাহের জমানো কাপড় কাচা,ইস্ত্রি করা,ঘরদোর পরিস্কার করা,ভালো মন্দ রান্না করে মা আর ছোটবোনদের নিয়ে খাওয়া দাওয়া করেই কাটিয়ে দেয়!
আজও সমস্ত কাজ সেরে দুপুরের খাওয়া সেরে বিছানায় গা টা এলিয়েছে মাত্র।
অমনি ডোর বেল বাজলো!
নাযিয়াত অলস সুরে নাঈমাকে বললো-“দ্যাখতো এসময় কে এলো?”
মিনিট দুয়েক পরে বেলা চৌধুরীকে ওর রুমে প্রবেশ করতে দেখে নাযিয়াতের মুখের ভাষা হারিয়ে গেলো যেন।অপ্রস্তুত হয়ে অভ্যেসবশত সালাম দিয়ে বেতের সোফাটা ইঙ্গিত করলো সে!
বেলা অত্যন্ত অমায়িক হাসি হেসে বললেন-“বাহ্,তোমাকে দেখে তো আজ আরো দশ বছর কম মনে হচ্ছে!সবসময় তো তোমায় বোরকায় দেখি,বেশ ম্যাচিওরড মনে হয়!আজ তোমাকে এমন ঘরোয়া পরিবেশে একদম পিচ্চি পিচ্চি লাগছে।তোমার আসল বয়সটা আসলে কত বলো তো?”
নাযিয়াত আমতা আমতা করে বলল-“বয়স লুকোনো আমার স্বভাব নয়।আমার এখন সাতাশ চলছে!”
-“কিন্তু দেখতে তোমাকে বাইশ কি তেইশ লাছে,বিশ্বাস করো!”
-“আ…আপনি হঠাত এখানে?”প্রসঙ্গ বদলাতে চাইল নাযিয়াত।বেলা শান্ত হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে পাশে বসালেন!
-“তোমার কাছে কিছু চাইতে এসেছি,প্লিজ মামনি,আমাকে ফিরিয়ে দিওনা,সোনা মা!”
-“ক্কি..কি চাইছেন বুঝলাম না।আমার এমন কি আছে যা আমি আপনাকে দিতে পারি…?”
-“আগে বলো তুমি আমাকে ফেরাবে না?তোমার দোহাই লাগে।তোমার আম্মা কোথায় ওনাকে ডাকো,ওনার সামনেই কথাগুলো বলতে চাই আমি!”
বিভ্রান্ত নাঈসা মা’কে ডেকে দিলো।
নাযিয়াত নিঃশ্বাস বন্ধ করে ওনার কথাগুলো শুনতে লাগলো!মহিলা ওর মায়ের হাত ধরে অনুনয়ের সুরে ওকে চাইছেন তাঁর নিজের ছেলের জন্য!
ও ভুল শুনছে না তো?”
….
চলবে…..
উত্তরাধিকার (১ম পর্ব)
উত্তরাধিকার (১ম পর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
*************************
গতরাতেও ঠিকমতো ঘুম হয়নি বেলা চৌধূরীর।গাইনী ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার পর থেকে মনটা ভার হয়ে আছে তার!
ডাক্তার কোনো আশ্বাসই এবার দিতে পারেন নি।
এর আগে ছেলেকে দিয়ে বৌকে চেন্নাই ও পাঠিয়েছিলেন দু’বার।
সেখান থেকে তারাও এসিওর করেছে যে তার একমাত্র ছেলে রাফিজ আর বৌমা প্রিয়ন্তী দুজনই ফিজিক্যালি ফিট।
তাদের কোন সমস্যা নেই!
আল্লাহ চাহেতো যে কোনো দিন সুসংবাদ শোনাবে তার বড় বৌমা প্রিয়ন্তী!
কিন্তু বেলা চৌধুরীর মন তাতে ভেজেনি কারন এই স্তোকবাক্য তিনি গত পাঁচবছর ধরে শুনে আসছেন যে প্রিয়ন্তীর মা হতে কোনো বাধা নেই!
গাইনোকলজিষ্ট রেহানা শিকদার তার একজীবনের ক্লাসমেট ছিলো!সে প্রতিনিয়তই সান্তনা দিয়ে আসছে তাঁর ছেলে রাফিজ যে কোনো দিনই বাবা হবার সৌভাগ্য অর্জন করবে!
কিন্তু সেই সৌভাগ্য আজো ধরা দেয়নি বেলা চৌধুরীর কাছে!
স্বামী মারা যাবার পর থেকে বিগত পঁচিশ বছর ধরে স্বামীর রেখে যাওয়া বিশাল সম্পত্তি পাহাড়া দিয়ে আসছেন বেলা চৌধুরী একা।
এক হাতে সামলেছেন ব্যবসা আর একমাত্র ছেলে রাফিজকে !তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, মানুষ করেছেন।ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছেন এক শিল্পপতির সুন্দরী মেয়ের সাথে।বাবার ব্যবসা সে’ই এখন দেখাশোনা করছে।সপ্তাহে দুদিন দেশে থাকলে বাকী পাঁচদিন দেশের বাইরে দৌড়ায় সে!
কিন্তু সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললেও আসল জায়গাতে এসেই আটকে গেছেন তিনি।
তার বংশের একটি প্রদীপ নেই যে তার ভবিষ্যত জীবনকে আলোকিত করবে!তাঁর একটি ওয়ারিশ দরকার যা প্রিয়ন্তী তাকে দিতে পারছেনা।কাউকে দত্তক নেয়াও চলবেনা কারন সেটি তো আর তার বংশের কেউ হবেনা! আবার তিনি যে,প্রিয়ন্তীকে রেখে কিংবা বাদ দিয়ে ছেলেকে আরেকটি বিয়ে করাবেন! সেটিও সম্ভব নয়।
কারন প্রিয়ন্তী ধনী বাবার আদরের মেয়ে। প্রিয়ন্তীর বাবা পান থেকে চুন খসলে বেলা চৌধুরীকে ছেড়ে কথা কইবেন না এটা বেলা চৌধুরী ভালোই বোঝেন !
এদিকে তার এতবড় সম্পত্তির উত্তরাধিকারীর অভাবে নষ্ট হয়ে যাবে, বারো ভুতে এটাকে লুটে পুটে খাবে এটাও তিনি মেনে নেবেন না!তিনি কোনোভাবেই এটা হতে দিতে পারেন না!
*
তাঁকে কিছু একটা করতেই হবে।যে করেই হোক তাঁর একজন উত্তরাধিকারী লাগবেই। তাঁর জীবদ্দশায় যদি তিনি এ সমস্যার সমাধান না করে যান তবে এটি সমস্যাই থেকে যাবে,সমাধানের মুখ আর দেখবেনা!
নানান চিন্তায় রাতে পাগলের মতো লেগেছিলো বেলার।
সকালের দিকে চোখটা লেগে এসেছিলো !
কিন্তু হতচ্ছাড়া বেলের শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো তাঁর !
কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে ঘুম না আসায় উঠে পড়লেন তিনি!
বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানির ছিটা দিলেন !তারপর বাইরে এসে ড্রইংরুমের দিকে যেতেই সুললিত কন্ঠের ক্বুরআনের তেলাওয়াৎ শুনে থমকে গেলেন।
★
মনে পড়লো,প্রিয়ন্তী এসময় কুরআন পড়তে বসে এক মহিলার কাছে!মাসখানেক ধরেই শিখছে সে।
ও নাকি একদমই ক্বুরআন পড়তে জানেনা তাই নিজেই কোন এক বান্ধবীর মাধ্যমে এক মাদ্রাসা শিক্ষিকাকে খুঁজে বের করেছে যে তাকে প্রতিদিন বাড়ী এসে ক্বুরআন পড়তে শিখিয়ে দিয়ে যাবে!নিঃসন্দেহে খুবই ভালো উদ্যোগ।বেলাও সায় দিয়েছেন এতে!
★
বেলা চৌধুরী ঘরে চলে আসতে গিয়েও কি ভেবে ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়ালেন।ভাবছেন,যে মেয়েটা পড়াতে আসে ওকে একবার বলে দেখবে নাকি যে,সন্তান ধারনের কোনো আমল বা তাবিজ কবজের কথা ওর জানা আছে কিনা!
মাদ্রাসায় যখন পড়ায় এ ব্যপারে কিছু জানলেও জানতে পারে!
এসব ভেবে মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি!
বেলা চৌধুরীকে প্রবেশ করতে দেখে মেয়েটি তার পড়া থামালো!
সালাম দিলো বেলা চৌধুরীকে!
বেলা চৌধুরী মাথা নাড়লেন।
মেয়েটি সামান্য হেসে বললো-“আন্টি সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব।ওভাবে মাথা নাড়াটা কিন্তু সুন্নত সম্মত নয়!”
বেলা চৌধুরী মেয়েটার দিকে কৌতুহলী চোখে তাকালেন!বাহ্,বেশ স্মার্ট মেয়ে তো! ওর দিক থেকে চোখ না সরিয়ে সালামের জবাব দিলেন তিনি!
তারপর প্রশ্ন করলেন-“বাড়ীতে কে কে আছেন তোমার?”
মেয়েটি স্মিতহাস্যে জানালো ওরা পাঁচবোন।মেয়েটি সবার বড়ো!বাবা নেই!মা আর চার বোনকে নিয়েই তাদের সংসার।বোনেরা সবাই লেখাপড়া করে! দুজন মাদ্রাসায় আর ছোটো দুজন স্কুলে!
বেলা চৌধুরী সরাসরিই প্রশ্ন করলেন-‘তোমাদের সংসার চলে কি করে?”
মেয়েটি মৃদু হেসে বললো-“আল্লাহতা’লাই চালান!”
-“তা তো বুঝলাম।কিন্তু আল্লাহ তো আর আসমান থেকে টাকাপয়সা ফেলেননা। মানুষকে তো কিছু না কিছু করে খেতে হয়।না করলে সে খাবে কি?তুমি মাদ্রাসায় আর ক’টাকাই বা বেতন পাও?এতগুলো বোন আর মা’কে নিয়ে সংসার চলে?”
মেয়েটার হাসি কিছুটা মলিন হলো!সে নম্র অথচ দৃঢ় কন্ঠে বললো-“আল্লাহপাক সাত আসমানের উপর আরশে আছেন।তিনি সেখান থেকেই তাঁর রহমতের বৃষ্টি জমিনে বর্ষণ করেন।আল্লাহ আসমান থেকে না ফেললে জমিনে কেবল হাত পা নেড়েই অনেকে অনেক কিছু করে ফেলতে পারতো!শুধু হাত পা নাড়লে আর চেষ্টা তদবীর করলেই যদি চলতো তাহলে মানুষ আল্লাহর কাছে সাহায্য ভিক্ষা চাইতো না!আমি হাত পা নেড়ে যে টাকা আয় করি তা দিয়ে আমাদের সংসার চলা মুশকিল হতো যদিনা আল্লাহ আসমান থেকে তাঁর রহমতের বারিধারা বর্ষণ না করতেন।আল্লাহর ঐ অশেষ রহমতের কারনেই আমরা অন্য অনেকের চেয়ে ভালো আছি !”
-“হমম….!”
বলে বেলা মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকালেন।মেয়েটির বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর শুনে তিনি মনে মনে কিছুটা চমকে গেলেন।
তবে মেয়েটির মনের উষ্মা কিছুটা টের পাওয়া গেলো!মেয়েটি তার কথা শুনে হয়তো কিছুটা রেগে গিয়ে থাকতে পারে।ওকে আরেকটু বাজিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো বেলার।
প্রিয়ন্তী ওদের কথা বলতে দেখে উঠে ঘরে গেলো!বেলা অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়েটার দিকে।কমদামী একটা কালো বোরকা পড়ে আছে মেয়েটা।চেহারাটা সাদামাটা তবে মায়াকাড়া।
কথাবার্তায় যথেষ্ট ;বুদ্ধিমত্তার ছাপ রয়েছে!বেলা বললেন-
-“তাহলে তুমি বলতে চাও,আল্লাহ আসমান থেকে রহমত ফেলেন বলেই তোমরা কম উপার্জনেও ভালো আছো?”
মেয়েটা মৃদু হেসে বললো-
-“জ্বী,আলহামদুলিল্লাহ!”
-“তা,আল্লাহর রহমত না থাকলে হাত পা নেড়েও কেউ ভালো থাকবেনা বলতে চাচ্ছো?”
-“জ্বী,অবশ্যই!কিছু যদি মনে না করেন আর অভয় দেন তো একটা কথা বলি?”
বেলা মাথা নাড়লেন-“বলো!”
-“উদাহরন হিসেবে আমি আপনার পরিবারকেই দেখাতে পারি!কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালছেন,ডাক্তার কবিরাজ এক করে ফেলছেন,বাংলাদেশ ইন্ডিয়া চষে ফেলেছেন একটি শিশুর মুখে দাদু ডাক শোনার জন্য!অথচ আপনার তো মাশাআল্লাহ টাকার অভাব নেই!আপনি কি ভালো আছেন,আন্টি?”
বেলা পুরো ফ্লপ মেরে গেলেন।মুখের হাসি মুছে গেলো!সত্যিইতো,মেয়েটিতো মিথ্যে বলেনি!সব কিছু থাকার পরেও তিনি আজ কাঙালীনি।তার বংশ নিবু নিবু প্রায় একটা প্রদীপের অভাবে।রাফিজের পরে তার বংশ আর কোনো উত্তরাধিকার পাবেনা।
মাথাটা আবার ধরে এলো!সেই পুরোনো চিন্তা আবার জেঁকে ধরলো তাকে।তিনি মেয়েটিকে বাচ্চা হবার তদবীর সম্পর্কেই জিজ্ঞেস করতে এসে অন্য কথায় পড়ে গেছেন।মেয়েটাকে সেই কথাটাই জিজ্ঞেস করতে হবে।মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতী চৌকস মনে হচ্ছে!
বেলা ওকে বললেন-“আচ্ছা,আমার বৌমার সন্তান হবার ব্যপারে কোনো ভালো তদবীর তুমি বলতে পারবে বা কোনো তাবিজ কবজ?যদিও আমি এসব মানিনা!”
মেয়েটা সহজ কন্ঠে বললো-
-“আলহামদুলিল্লাহ, যে আপনি তাবীজ মানেন না!তাবীজ ষ্পষ্ট শির্ক।আমাদের রাসুল সাঃ বলেছেন-“যে তাবীজ পড়লো সে শির্ক করলো!”তাই তাবীজ থেকে বেঁচে থাকা জরুরী।আর তদবীর বলতে সবচে বড় কথা হলো,প্রচুর ইস্তেগফার করুন আর রাতের নামাজ অর্থাৎ তাহাজ্জুদে কাঁদুন।তাহাজ্জু
দ হচ্ছে বান্দার সাথে আল্লাহর মোলাকাতের সবচে উত্তম সময়।আল্লাহ চাহে তো আপনার ঘর আলোকিত হবে ইনশাআল্লাহ। ঐ যে বললেন না,আল্লাহ আসমান থেকে ফেলে কিনা।জ্বী,আল্লাহর রহমত আসমান থেকে জমিনে বর্ষিত হয় ঠিকই কিন্তু দুহাত না পাতার কারনে সেই রহমত অনেক সময় আমাদের হস্তগত হয়না!আমরা নিজ গাফিলতিতে রবের রহমত বঞ্চিত হই।যে চায় সে পায়।
কেউ না পেলেও হতাশ হওয়া চলবেনা।সবর করতে হবে।এটাই একজন ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য।পেলে শোকর না পেলে সবর!”
,-“হমম….বুঝলাম।তা তোমার নাম কি?”
-“জ্বী,আমার নাম “নাজিয়াত!”
বেলা তীক্ষ চোখে তাকিয়ে বললো-“নাজিয়াত,তুমি খুব ভালো কথা বলতে পারো!হয়তো শিক্ষকতা করো বলে! ”
-“জ্বীনা,আন্টি!আসলে আমি শিক্ষকতার পাশাপাশি একজন দাঈ।অর্থাৎ মাদ্রাসার শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন ঘরোয়া মজলিশে আমি দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে থাকি।আর একজন দাঈ কে অকপট এবং প্রাঞ্জল কথা বলায় পারদর্শী হতে হয়।হয়ত সে কারনেই আপনার কাছে আমার কথাগুলো অন্যরকম মনে হচ্ছে!”
-“হমমম…তোমার কথাগুলো আমার ভালো লেগেছে।তা আমাদের বৌমা কেমন পড়ছে?”
-“জ্বী,ওনাকে আমি একেবারে গোড়া থেকে শুরু করেছি।যেন মাখরাজটা ঠিক করে নেয়া যায়!কারন উনি আগে যে মাখরাজে পড়া শিখেছেন সেটা ভুল।তাই নতুন করে ধরতে হচ্ছে!”
কথাবার্তার এ পর্যায়ে প্রিয়ন্তী এসে পড়ায় বেলা আর কথা বাড়ালেন না! উঠে পড়তে গিয়ে হঠাৎ ওনার মনে একটা চিন্তা বিদ্যুৎ গতিতে খেলে গেলো! বারান্দা পেরিয়ে ঘর পর্যন্ত আসতে গিয়ে চিন্তাটা উনাকে একেবারে আচ্ছন্ন
করে ফেললো!
অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি,প্রথমে প্রিয়ন্তীর সাথে তাকে কথা বলতে হবে তারপর রাফিজের সাথে।রাফিজ অবশ্য কোনো ফ্যাক্ট না!তিনি যা বলবেন রাফিজ সেটাই মানতে বাধ্য।তবে মেয়েটির সাথে খুব কৌশলে কথা বলতে হবে!মেয়েটা এমনিতেও খুব বুদ্ধিমতী।তার মনের খবর টের পেয়ে গেলে রাজী নাও হতে পারে।এজন্য আগে ওর সব খবর জানতে হবে,তারপর ওকে লোভ দেখাতে হবে।তারপর কার্যসিদ্ধি করতে হবে!
সব যদি ঠিক মতো চলে তাহলে তিনি হয়তো পেতে পারেন একজন উত্তরাধিকার!
যে তার বংশে প্রদীপ জ্বালাবে!
আর তার সেই অন্ধের ষষ্ঠীর বুদ্ধিটাও মনে হয় ভালোই হবে,প্রিয়ন্তীর মতো গবেট যে সে হবেনা তা ভালোই বোঝা যায় কারন যেমন মা তেমন ছা।
কারন নাজিয়াত আসলেই বড় বুদ্ধিমতী মেয়ে।
…..
চলবে…..
blind love পর্ব ৬
#Blind_Love পর্ব-৬
#লেখায়ঃপ্রজাপতি(নুসরাত মনিষা)
১৫ বছর আগে।।
–“সাত মাসের গর্ভবতী স্ত্রীকে একা একা ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে আবার অনুরোধ করছো সবার কাছে মিথ্যা বলতে?লজ্জা করে না তোমার?আমি পারব না।”ফোনে পলি এতটা চেঁচিয়ে কথাটা বললো যে আশেপাশে সবাই ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো।
–পলি,প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো।তুমি একা ডাক্তার দেখাতে গিয়েছো আম্মু-আব্বু জানতে পারলে আমাকে আস্ত রাখবে না।একটা জরুরি কাজে আটকে গেছি।(তালহা ফোনের ওপাশ থেকে অনুরোধের সুরে বলছিলো)
–ও আচ্ছা!!কাজটা জরুরি আর আমি ফেলনা?
–তুমি সবচেয়ে বেশি জরুরি। আচ্ছা আমার ভুল হয়ে গেছে।ঠিক আছে? আজকে যে কেসের জন্য এসেছি তা অনেক বেশি হাইপ্রোফাইল।তুমি যদি আমাকে বাঁচিয়ে দাও তবে তোমাকে এর ডিটেইলস রিপোর্ট দিব কাভারের জন্য।
–সে তো তুমি সব চ্যানেলকেই দিবে।
–আরে না।বললাম না কেসটা হাইপ্রোফাইল।তাই লিক হওয়া নিষেধ।
–তাহলে আমাকে কেন দিবে? নিয়ম বিরোধী কোন কাজ তো তুমি করো না।কেমন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।
–আরে রহস্য-টহস্য কিছু না।এই অপরাধটা ছোট ছোট বাচ্চাদের অর্গানট্রেফিকিং এর।আর ঘটনাটা ঘটেছে শহরের বড় একটা হাসপাতালে।তাই আমি চাই জনগণ সবটা জানুক। মানুষরূপি জানোয়ারগুলোকে চিনে রাখুক।প্লিজ টিম নিয়ে চলে এসো।
–ব্যাপারটা বাচ্চাদের তাই মাফ করলাম।ঠিকানা পাঠিয়ে দাও। এই অবস্থায় আমি তো আর প্রেজেন্ট করতে পারবো না, দেখি কাউকে মেনেজ করে নিয়ে আসছি। রাখি এখন।
বলে ফোন কেটে দিলো পলি।
–প্রথম বাচ্চা?(পলির পাশে বসা মহিলাটি জিজ্ঞেস করলো)
–হ্যাঁ। আপনার?
–আমার দ্বিতীয় এর আগে একটা ছেলে। আমার স্বামীর খুব মেয়ের শখ।ও নাকি মেয়ে হলে সবচেয়ে খুশি হবে।
–কোথায় উনি?(পলি)
–আপনার উনার মতো কাজে আটকে গেছে।
–These Husband and their work.এদের কাজ কখনো শেষ হয় না।
–কিন্তু কাজটাও তো আমাদের জন্যই করে।তাই আমারা সাপোর্ট করি।
–তা যা বলেছেন ভালোবাসার কাছে সব হেরে যায়।(পলি)
–হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়।ভালোবাসার শিকলে আমরা বন্দি।এই শিকলটাও আবার ভালো লাগে।
–Sacrifice,Craziness,Blindly trust..Things we do for love..
— কথাটা ভালো লাগলো।
কম্পাউন্ডার পলির নাম ডাকতেই ও ভিতরে গেলো।বেরিয়ে ওই মহিলাকে আর দেখতে পেল না।
হাসপাতাল থেকে অফিসে গিয়ে টিম তৈরি করে নিউজ রিপোর্ট করতে গেলো।
কেসের বিস্তারিত তালহার কাছ থেকে ফোন করে জেনে নিয়েছে।
রাতে খাবার খেয়ে পরিবারের সাথে সেই নিউজটাই দেখছিলো তালহা৷
নিউজ বাংলা
সিটি হাসপাতালের বড়ো ডাক্তার আশফাকের মুখোশ খুলে গেলো।ফ্রি চেকআপের নামে সাকসমিথোনিয়াম ক্লোরাইড ড্রাগ ব্যবহার করে বস্তির গরীব বাচ্চাদের অসুস্থ করতেন তিনি। তারপর চিকিৎসার নামে করে তাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বের করে দেশে-বিদেশে পাচারের মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়ে তোলে আশফাক। এরমধ্যেই বেশ কয়েকটি বাচ্চা মারা গেলে পুলিশের নজরে আসে এই হাসপাতাল। তারপর তদন্তের মাধ্যমে এ.সি.পি. তালহা ও তার সদস্যরা ডাক্তার আশফাক ও তার সহযোগীদের হাতে নাতে গ্রেফতার করেন।
–আমি তিন মাস ধরে ফাঁদ পেতে পুরো রেকেটটাকে ধরলাম আর তুমি পাঁচ মিনিটে সব বলে দিলে।
–তুমি লেট লতিফ হলে আমি কি করব?
–তা যা বলেছো বউমা। আমার পুরো বংশে এমন আলস কেউ নেই। শুনেছি ছেলেরা মায়ের মত হয়।(হাসতে হাসতে কথাটা বললো পলির শ্বশুর)
–একদম আমাকে এর মধ্যে টানবে না ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। (রেগে গিয়ে বললো পলির শ্বাশুড়ি।
তখনই তালহার ফোন রিং হলো।ফোন রিসিভ করে কথা বলতেই ওর মুখটা কালো হয়ে যায়।
–কি হয়েছে?(পলি)
–ডাক্তার আশফাক আত্মহত্যা করেছে।
–কি বলো এতো লোক থাকতে কিভাবে?
–জানি না। তবে আমার মনে হয় কোন ড্রাগের ওভার ডোজে। ডাক্তার হিসেবে সে জানত কতটা কিভাবে নিলে মরে যাবে।
–হুম। নিজের পাপের শাস্তি সে পেয়েছে। তুমি মন খারাপ করো না।
এভাবেই কেটে যায় আরও কিছু দিন। সাড়ে আট মাসে আবার চেক-আপে যায় পলি।
ফিরে এসে দেখে দরজা খোলা।তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির কেউ গলা কেটে দিয়েছে। তারা সদ্য জবাই করা মুরগির মতো ছটফট করছিলো। হতভম্ব হয়ে পরে পলি। দৌড়ে ভেতরে আসতেই কেউ তার পিঠে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। পলি দেখে এটা আর কেউ নয় সেইদিনের সেই মহিলা যার সাথে তার ডাক্তারের চেম্বারে আলাপ হয়েছিল ।পলি ছুরির আঘাত সহ্য করতে পারলো না। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো।
কারও ক্ষতি করলে নিজেরও ভালো হয় না। ওই মহিলা বাড়ি থেকে বের হবার সময় রক্তের উপর পিছলে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। টেবিলের ভাঙা কাঁচ পেটে ঢুকে যায়।
বতর্মান
–এরপর কি হয়েছিলো তালহা?
–বাড়ি ফিরে আমি সবাইকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখি। মহিলাটিকে চিনতে পারি যে তিনি ডাক্তার আশফাকের স্ত্রী আইরিন।সেদিন মানবতার খাতিরে আমার মা-বাবার খুনিকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার বাচ্চাকে বাঁচাতে পারি নি। আর আমি হারিয়েছিলাম আমার মা-বাবাকে।
–উনি জেল থেকে ছাড়া পেলেন কিভাবে?
–না ছাড়া পায় নি।সুস্থ হওয়ার পর সে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল।এরপর ছেলেকে নিয়ে উধাও হয়ে যায়।
–হুম বুঝতে পারলাম উনার এমন হওয়ার কারন।
–কি?
–ভালোবাসা।।
–মানে? ঠিক বুঝতে পারলাম না।
–তালহা, আমরা ভালবাসি, বিশ্বাস করি।কিন্তু সবসময়ই ঐ মানুষটা ভালো না খারাপ তা বিচার করি।যদি ঐ মানুষটার মধ্যে অমানবিক বা খারাপ কিছু পাই তবে তা বদলাতে চেষ্টা করি,সে না বদলালে তাকে ছেড়ে চলে যাই।একজন ব্যক্তি নিজে যতই খারাপ হোক না কেন অন্য একজন খারাপ মানুষকে ভালোবাসতে পারে না। পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ জন্মায় যারা ভালো কিংবা খারাপ বিবেচনা না করে ভালোবাসার মানুষকে অন্ধের মতো ভালোবাসে।যেমন আইরিন তার স্বামীকে ভালবাসে।কার ভাগ্য খারাপ আমি জানিনা, তবে আইরিনের স্বামী অপরাধী না হলে আইরিনের এই ভয়ংকর রূপ প্রকাশ পেতো না।কিন্তু তার স্বামীর মৃত্যুর পর তার হিংস্রতা প্রকাশ পায়।ওর গর্ভের সন্তানের মৃত্যুর পর সে সম্পূর্ণভাবে অপ্রকৃতস্থ হয়ে যায়। তাই তার স্বামী যত বড় অপরাধীই হোক না কেন তার চোখে সে নিরপরাধ। আর আপনি যত ভালো মানুষই হোন না কেন আইরিনের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম জীব আপনি।কারণ আপনার জন্য সে তার ভালবাসা হারিয়েছে। তার স্বামী যে সন্তানকে সবচেয়ে বেশি চেয়েছিলো তাকে হারিয়েছে।
–এটা কি কোন রোগ?
–হ্যাঁ।এটার সাইকোলজির ভাষায় একটা নাম আছে Love Disorder।এই রোগের অনেক ধরন আছে,তার মধ্যে একটা ধরন হলো”Blind Love”। এই রোগে যারা আক্রান্ত তারা যতক্ষণ ভালোবাসার মানুষের কাছে থাকে ততক্ষণ স্বাভাবিক থাকে কিন্তু দূরে গেলেই ভয়ংকর হয়ে উঠে।
–চিকিৎসা কি এর?
–পৃথিবীতে অনেক প্রকার মানসিক রোগ আছে যার কোন চিকিৎসা নেই।এই রোগটা তেমনই।
–চিকিৎসা নেই কিন্তু শাস্তি আছে (বিড়বিড় করে বললো তালহা)
–কি বললেন?
–কিছু না। কিন্তু ফারাবির তো এই রোগ নেই। তাহলে সে এতো হিংস্র কেন?
–আইরিনের মতো মানসিক বিকারগ্রস্ত মায়ের কাছে সে একা বেড়ে ওঠেছে । তার মা তাকে কারও সাথে মিশতে দেয় নি। তাই নৃশংসতা তার মন-মস্তিষ্ক বলতে পারেন রক্তবিন্দুতে মিশে গেছ। সোজা বাংলায় ফারাবি ছোটবেলা থেকেই একটা বদ্ধ উন্মাদ তৈরি হয়েছে।আর দিন দিন তার উন্মাদনা বৃদ্ধি পেয়েছ।সত্যি কথা বলতে,এটা ওর মায়ের অন্ধ ভালোবাসার ফল।
–সে কি তার ছেলেকে ভালোবাসে না?
–আইরিনের মতো মানুষ শুধু একজনকেই ভালোবাসে। তার ছেলেকে স্বামীর অংশ হিসেবে আগলে রেখেছে মা হিসেবে ভালোবাসে নি।তবে তার সেই অনাগত সন্তান জীবিত থাকলে হয়তো স্বামীর পর কাউকে ভালবাসাতো।
–ভালোবাসা এমনো হয়?
–হয়। হাজার প্রকারের ভালোবাসা হয় তার মধ্যে এটা একটা ধরন।চোখ বন্ধ করে অন্ধের মতো ভালোবাসা।
–এবার সময় এসেছে। আইরিনের নিজের অন্ধ ভালোবাসার ফল ভোগ করার।যে অন্যায় সে করছে তার শাস্তি সে পাবেই। (তালহা দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বললো)
সিফাত দৌড়ে দৌড়ে করিডোরে এলো।হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
–স্যার ডাক্তার ডাকছে। ম্যাডামের জ্ঞান ফিরেছে আর তোয়া’রও কিন্তু…
–কিন্তু কি ওদের জ্ঞান ফিরে এসেছে আমার আর কি চাই বলো?চলো এক্ষুনি।
–স্যার,আপনি যান আমি ম্যাডামকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসছি৷
–ঠিক আছে। সাবধানে,যেও। (বলে তালহা আই.সি.ইউ’র দিকে গেলো)
তালহা চলে গেলো।
–তোয়া এখন কেমন?(ফাতিমা)
–বেশি ভালো না ডাক্তার বলেছে সম্ভাবনা কম। কিন্তু মেয়েটার অসম্ভব মনের শক্তি তাই লড়ছে। দেখুন জ্ঞানও ফিরেছে। কিন্তু কতক্ষণ থাকবে জানি না।
–হুম। চলুন যাওয়া যাক।
চলবে—-?
বিঃদ্রঃ গল্পের কাহিনির মতো রোগটাও সম্পূর্ণ কাল্পনিক। তাই এটা সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করবেন না।
blind love পর্ব ৫
#Blind_Love পর্ব-৫
#লেখায়ঃপ্রজাপতি(Nosrat Monisha)
পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারি হয়।সেই ভার যাতে বহন করতে না হয় তার জন্য অপারেশন থিয়েটারের বাহিরের করিডোরে জায়নামাজে বসে কান্না করছে তালহা।
সব কিছু হারিয়ে যাদের জন্য বেঁচে আছে আজ তারাই মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।আপনজনের লাশ বার বার কেন তাকেই বইতে হবে?এমন হাজারো প্রশ্ন নিয়ে আল্লাহর কাছে নিজর স্ত্রী-সন্তানের সুস্থতা চাইছে।
——-।।।——–।।।——।।।——–
দেয়ালে ঘুষি দিয়ে হাত থেকে রক্ত বের করে ফেললো সিফাত। মা-ছেলেকে সে ছুঁতেও পারছে না । সব আইন কেন শুধু যারা আইন মানে তাদের জন্য প্রযোজ্য ? আইরিন আর ফারাবির মতো শয়তানদের জন্য কেন কোন আইন নেই?
আলমারির পেছনের যে দরজা তখন সিফাতের টিমের নজর এড়িয়ে গিয়ছিল;সেই দরজা ভেঙ উদ্ধার করা হয়েছিল তোয়া আর পলিকে। সিফাতরা ভেতরে গিয়ে যা দেখেছিলো তার চেয়ে ভয়ংকর কিছু হয়তো পৃথিবীতে কেউ কখনো দেখে নি।আধমরা তোয়া’র হাতে হাতুড়ি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছে ফারাবি। পুলিশের দরজা ভাঙার শব্দ শুনে আইরিন পলির গলায় ছুরি চালিয়ে দেয়।
আশ্চার্যের বিষয় হলো,গ্রেফতারের সময় ওরা কেউই কোন প্রকার বাধাই দেয় নি,বরং নিজেরা গিয়ে পুলিশের গাড়িতে বসেছে।সিফাত পলি আর তোয়াকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছিলো।
সিফাতের ইচ্ছে করছিল মা-ছেলেকে এমন শাস্তি দিতে যাতে, কেউ এমন কিছু করার আগে মরে যাওয়া ভালো মনে করে।কিন্তু অপরাধী নিজের অপরাধ স্বীকার করছে এমনকি বাকি লাশগুলোর সন্ধানও দিয়েছে তাই তাদের গায়ে হাত তোলার অধিকার আইন দিচ্ছে না।
সিফাত যখন খুন করার কারণ জিজ্ঞেস করেছে তখন দুজনেই অদ্ভুত উত্তর দিয়েছে তাই আইনানুসারেই সাইক্রিয়াটিস্টকে ডেকেছে সে।
–দেয়ালে ঘুষি দিয়ে হাত ভাঙাও মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। (সিফাত পিছন ফিরে দেখলো চল্লিশোর্ধ ছিপছিপে গড়নের এক ভদ্র মহিলা কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে।ইনিই হলেন সাইক্রিয়াটিস্ট রাবাব ফাতিমা)
–ম্যাম,আমার রোগ পরে ভালো করবেন। যাদের জন্য এসেছেন আগে তাদের থেকে অপরাধের কারন বের করুন।
–এতো রাতে ডেকেছেন তার উপর আপনার রাগ দেখে বুঝতে পারছি যে, ঘটনা সিরিয়াস।তাই ওদের অপরাধের বণর্না করুন।
সিফাত ততটুকু বললো যতটুকু সে জানে।তোয়া আর পলির অবস্থার কথাও বললো।
–ছেলেটা খুনের কারণ হিসেবে বলেছে,সে আনন্দ পেয়েছে। আর তার মা বলেছে ছেলেকে ভালো করার জন্য মেয়েদের এনে দিয়েছে আর পলি ম্যামকে নিজের মনের আনন্দের জন্য মেরেছে।(সিফাত)
–আমি আমার পুরো ক্যারিয়ারে এ ধরনের কেস দেখবো ভাবিনি।ছাত্রজীবনে এরকম কেস পড়েছিলাম কিন্তু ঘটনাগুলো ঘটে ছিলো বাহিরের দেশে।(চিন্তিত হয়ে ফাতিমা বললো)
–আপনি এদেশের সেরা দশ সাইক্রিয়েটিস্টদের একজন।তাই আপনাকে ডেকে পাঠানো। আমার মনে হচ্ছে মা ছেলে পাগলের অভিনয় করে শাস্তি থেকে বাঁচতে চাইছে।
–হুম চলুন আগে ছেলেটার কাছে যাই।
—–।।।—–।।।——।।।—
অপারেশন থিয়েটার থেকে পলিকে বের করে আই.সি.ইউ তে দেওয়া হয়েছে।তালহা অস্থির হয়ে ডক্টরকে জিজ্ঞেস করলো,
–আমার স্ত্রী ঠিক হয়ে যাবে তো ডক্টর?
–দেখুন আপাদত বিপদ কেটে গেছে।তবুও উনাকে আমরা ২৪ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখছি।তবে একটা কথা জানিয়ে দেওয়া ভালো।
–কি কথা ডক্টর?
–আপনার স্ত্রী প্রাণে বেঁচে গেছে।কিন্তু উনার শরীরে যে ড্রাগ ইনজেক্ট করা হয়েছে তার থেকে উনার রিকভারি করা মুশকিল। প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে রিকভারি চান্স মাত্র ৪থেকে৫ পার্সেন্ট। উনার ফুল বডি প্যারালাইজড হয়ে গেছে।তাছাড়া
–আর কি?
–জিহ্বা কাটার ফলে উনি আর কোনোদিন কথা বলতে পারবেন না।
–লাগবে না।কিচ্ছু লাগবে না।আমি শুধু চাই মানুষটা বেঁচে থাকুক।
——-।।——-।।।——।।—-
সেল -২।
মুখোমুখি বসে আছে ফারাবি আর রাবাব ফাতিমা।
–একুশটা খুন করেছো তুমি?
–হিসাবে ভুল করছেন আপনি।সংখ্যাটা বাইশ হবে।আজকের মেয়েটা মরলে তেইশ।(এত স্বাভাবিকভাবে কথাটা বললো ফারাবি যেন খুন করা পানি খাওয়ার চেয়ে সহজ)
–সেই মেয়েটা কে ছিলো তার লাশ কোথায়?
–সে মরে যাবার পর মা তার লাশ কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল।সে ছিলো আমার একমাত্র ভালোবাসা ছিলো রাফিদা।
–ভালোবাসার মানুষের গায়ে আঁচড় লাগলে কান্না আসে আর তুমি তাকে মেরে ফেললে?
–প্রথম রাগের ঘটনা আমি মনে করতে পারি, যখন রাগ করে ফুলের গাছ নষ্ট করে ছিলাম। আম্মু পরদিন নতুন একটা গাছ এনেছিলো হুবহু একই।আদরের বিড়াল মেরে ফেলার পরও একইরকম বিড়াল এনেছিলো।
–তাই তুমি ভেবেছো আরেকটা রাফিদাও নিয়ে আসবে?
–এনেছে তো আজকের মেয়েটা অবিকল রাফিদার মতো।কি নিষ্পাপ চেহারা।ভেবেছিলাম মারব না কিন্তু সে নিজের বাড়ি যেতে চাইছিলো।
–কেনো মেরেছিলে রাফিদাকে?
–বড্ড খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল সে।আম্মু আমাকে সবসময় একটা জিনিস শিখিয়েছে কোন প্রশ্ন নয় আর যদি কেউ উত্তর না দিতে চায় ভুলেও ২য় বার প্রশ্ন নয়।কিন্তু রাফিদা সেই কাজটাই বারবার করত। একদিন সব ঝগড়া থামলো তাও সে আবার প্রশ্ন করলো।রাগের মাথায় থাপ্পড় দিলাম।তাতেই বলে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।তাই তাকে রড দিয়ে মারলাম। খুব মজা লাগছিলো ওর রক্ত দেখে।কিন্তু কখন যে মরে গেল বুঝতে পারি নি।
–আর বাকিদের?
–তাদের দেখলে আমার গা জ্বলে ওঠতো। কেউ রাফিদার মতো ছিলো না।কিন্তু ওদের যন্ত্রণামাখা চিৎকারে আমার ভালো লাগত।
–তোমার কখনো খারাপ লাগে নি?
–আমার শুধু রাগ হয়।খারাপ লাগা কি তা আমি বুঝি না।
–তোমার যদি ফাসি হয়।
–আমার মা আমাকে বাচিয়ে আনবে।
–সেই মায়ের যদি ফাসি হয়?
–তো?তাতে কি? মা মরে গেলে ভালো হবে।
–কেন?
–মা আমাকে কখনো কারো সাথে কথা বলতে দিতো না।কথা বললে শাস্তি দিতো।এখন মা মরে গেলে সবার সাথে কথা বলবো। (বলে ফারাবি হাসতে লাগলো আর হাততালি দিতে লাগলো)
–হুম। আচ্ছা মা তোমাকে মারতো?
–না। শুধু কথা বলত না আর খাবার দিতো না।
–আচ্ছা আজ আমি যাই।
–ঠিক আছে।
সেল থেকে বের হলেন রাবার ফাতিমা।
–ছেলেটা অভিনয় করছে, তাইতো ম্যাম?(সিফাত)
–কিছু বলা যাচ্ছে না।কোন সিদ্ধান্তের নেওয়ার আগে আমি ওর মায়ের সাথে কথা বলবো।
–চলুন ওইদিকে।
—।।—–।।।——।।—–
তোয়া’র অপারেশন চলছে পাঁচ ঘন্টা ধরে।যে-ই ভেতর থেকে বের হচ্ছে তাকেই তালহা জিজ্ঞেস করছে আমার মেয়ে কেমন আছে।সবার একই উত্তর এত জঘন্য অত্যাচার হয়েছে ওর উপর যে কিছু বলা যাচ্ছে না।
ডক্টর বের হলো অপারেশন শেষে।
–স্যার আমার মেয়ে?
–এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। ওকে এখনকার মতো আই.সি.ইউ তে ৭২ঘন্টা অবজারভেশনে রাখছি।জীবনের মালিক আল্লাহ, দোয়া করুন।
——-।।—–।।।——-।।—–
সেল-১
–আমি কতবার বলবো আমি যা করেছি আমার ছেলেটাকে ভালো করার জন্য করেছি।(চিৎকার করে বলে উঠলো আইরিন)
–আইরিন চিৎকার করলে মিথ্যেটা সত্যিতে পরিণত হয়ে যায় না।আমি কোন পাঁচ বছরের বাচ্চা নই যে আপনার মিথ্যেগুলো বিশ্বাস করব। দুনিয়ার কোন সাইক্রিয়াটিস্ট বলবে না বাচ্চা কোন কিছু নষ্ট করলে আরেকটা এনে দিতে।ভুল করলে সে ভুল না শোধরে,তাকে আরও ভুল করার উৎসাহ দিতে।সত্যিটা বলুন।
–আজ অবধি সবাই বিশ্বাস করেছে।এমনকি ঐ মেয়েটাও। তাহলে তোর সমস্যা কি?
–আমার সমস্যা আমি একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। আপনার মিথ্যেগুলো আমার কাছে ধরা পরে গেছে।
–হ্যাঁ।।হ্যাঁ।।।হ্যাঁ, আমি কোন দিন ছেলের জন্য কোন মানসিক ডাক্তারের কাছে যাই নি।আমার ছেলের যখন যা প্রয়োজন সব দিয়েছি।কোন কিছু নষ্ট করে মন খারাপ করলে আবার এনে দিয়েছি। মেয়েগুলোও সে জন্যই।তাছাড়া ওরা পতিতা আর আমি টাকা দিয়েছি।
–জীবন টাকা দিয়ে কেনা যায় না,আইরিন।সেটা আপনি বুঝবেন কি-না বলতে পারছি না।কিন্তু তোয়া আর পলির উপর আপনি আপনার ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটিয়েছেন তাই-না?
–যে জীবনটা আমার হবার কথা ছিলো সেই জীবন তালহা পলির সাথে উপভোগ করছিলো।সেদিন স্কুলের বাইরে ওদের তিনজনকে হাসতে দেখে আমার পুরোনো ঘা তাজা হয়ে ওঠে।তাই আমি তালহার মেয়েটাকে ফলো করি।মেয়েটা খুব হেল্পফুল।তাই অসুস্থ হবার ভান করি ওকে বাসায় পৌঁছে দিতে বলি। কিন্তু একটা বাচ্চা পিছনে ডাকায় রিকশায় বসে তোয়াকে অজ্ঞান করে ফেলি আর বাসায় নিয়ে আসি।তারপর আমার ছেলের হাতে তুলে দেই।
–কি আছে আপনার আর ওদের দুজনের অতীতে?
আইরিন দাঁত বের করে বিদঘুটে হাসি দিয়ে বললো,
–সেটা আপনাকে ওদের মুখ থেকে শুনতে হবে।ওহ!! পলি তো নিজের মুখে আর কিছু বলতেই পারবে না।তালহাকে জিজ্ঞেস করুন ও যদি নিজের কালো অতীত আপনাকে বলে।
ফাতিমা বুঝতে পারল এখানে আর কথা বলে লাভ নেই। তাই বেরিয়ে এলো।
–তালহা সাহেব কি হাসপাতালে?
–বউ বাচ্চার এমন অবস্থায় মানুষটা আর কোথায় থাকবে?কেন?
–চলুন হাসপাতালে যাই।
–এই মাঝরাতে?তাছাড়া এই পরিস্থিতিতে কি স্যারের সাথে কথা বলাটা কি ঠিক হব?
–দেখুন ঐ বাচ্চার সাথে কেন এমন হল তা আমাকে আজকেই জানতেই হবে।সেজন্যই আমাকে আাগে ওদের অতীত জানতে হবে।
–কিন্তু?
–কোন কিন্তু নয়। আপনি সাথে না গেলে আমি একাই যাবো।
–না আমিও যাচ্ছি চলুন।
—-।।——।।।——।।—–
আই.সি.ইউ ‘র বাইরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে তালহা।ভাবছে সেদিন যে কথা পলিকে দিয়েছিলো তা সে রাখতে পারেনি।পলিকে বলেছিল ওর আর কোন ক্ষতি সে হতে দিবে না কিন্তু আজ সে ব্যর্থ।
ওর উচিত ছিলো আইরিনকে শাস্তি দেওয়া । তাহলে হয়তো তোয়ার সাথে এমন কিছু ঘটতো না।
–স্যার…..(সিফাতের ডাকে তালহার ভাবনায় ছেদ পড়লো)
–আপনি।একি মিসেস রাবাব ফাতিমা আপনি এতো রাতে এখানে?
–স্যার আসলে আমি উনাকে আটকাতে চেয়েছিলাম কিন্তু একপ্রকার জোর করেই চলে এসেছেন।
–আচ্ছা।এখন আমাকে বলতে দিন।আপনার স্ত্রী আর তোয়া কেমন আছে?(ফাতিমা)
–অপারেশন শেষ।পলি বিপদমুক্ত কিন্তু তোয়া’র কথা বলা যাচ্ছে না।
–তালহা সাহেব আমি অতীতটা জানতে চাই এক্ষুনি।নাহলে খুনিদের শাস্তি দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।(ফাতিমা)
–চলুন করিডরে।সিফাত আপনি একটু থাকুন কখন কি লাগে।
–স্যার আপনি ভাবেবন না আমি আছি। কোন কিছু হলেই খবর দিবো।
তালহা আর ফাতিমা হাসপাতালের করিডোরের দিকে যাচ্ছে ;পলি, তালহা আর আইরিনের অতীতের দরজা খুলতে।
চলবে–?
মায়া ৪র্থ পর্ব এবং শেষ পর্ব
গল্প :- মায়া
পর্ব :- ০৪ এবং অন্তিম
লেখিকা :- তাসনিম রাইসা
.
.
.
-: এই তো প্রায় ৭ লাখের মতো।
– এতো টাকা! ডাক্তার সাব আমি যেভাবেই হোক টাকা জোগাড় করবো। আমার রাইসাকে যে বাঁচতেই হবে। কথা হসপিটাল থেকে বের হয়ে ভাবছে এতোগুলো টাকা কি করে সংগ্রহ করবে। বাবার অবস্থাও ভালো না।
-এদিকে কথা বাসায় এসে দেখে রাইসা সেন্সলেন্স হয়ে আছে।
– কথাকে দেখেই তা মা বললো’ কথা তুই কোথায় ছিলি রাইসা বললো তার পেট ব্যথা করছে প্রচন্ড। তার পর সেন্সলেন্স হয়ে গেল। রাইসাকে নিয়ে হসপিটালে আবারো রওয়ানা দেয়। ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিলে রাইসা মোটামুটি সুস্থ হয়ে যায়।
– ডাক্তার আড়ালে নিয়ে বলে দিল, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব রাইসার চিকিৎসা শুরু করে দিতে।
– ডাক্তারের কথা শুনে বাসায় এসে সারারাত আর ঘুমাতে পারিনি। সারা রাত রাইসাকে বুকে জড়িয়ে কেদেছি। আমার বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন ছিল রাইসা আজ সেও হারিয়ে যাচ্ছে।
– মাঝরাতে রাইসা উঠে দেখে তার মা কাঁদছে।
” মা তুমি কাঁদছো কেন?”
– কথা চোখের পানি মুছে বললো ‘ কই মা কাঁদছি না তো?”
– মা জানো আমার না খুব কস্ট হয়। প্রতিদিন রাতে ঘুমালে কে যেন আমাকে ডাকে। তার কাছে নিতে চায়।
– রাইসার কথা শুনে কথার বুকটা কেঁপে ওঠে।
– রাইসাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে মারে তুর কিছু হবে না। আমি যেভাবেই হোক তোর কিছু হতে দিব না।
– তারপর কথা সে রাতেই সিদ্ধান্ত নেয় নিজের জীবনের বিনিময়ে তার মেয়েকে বাঁচাবে। তাই পরের দিন আনোয়ারের বাসায় গিয়ে বলে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই তবে শর্ত হচ্ছে বিয়ের আগে আমাকে আট লাখ টাকা দিতে হবে।
– আনোয়ার মৃদু হেসে বললো’ জানতাম তোদের মতো মেয়ে টাকা পেলে সব করতে রাজি। ‘ আচ্ছা কালই টাকা পেয়ে যাবে। আর পরশুই বিয়ে করতে চাই আমরা।
– কথা কিছু না বলে মাথা নাড়িযে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়।
– এদিকে কথা বাসায় এসে সারারাত রাজের ছবিটা বুকে নিয়ে কান্না করে আর বলতে থাকে ‘ রাজ পারলাম না তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে। আজ আমি নিয়তীর কাছে পরাজিত। আজ সমস্ত মায়া বির্সজন দিয়ে আমি অন্যের হয়ে যাচ্ছি। তবে মনে রেখ দেহটা অন্যকেও পেলেও এ মনের রাজ্যে তুমিই থাকবে।
– এর পর কথার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পরের ঘটনা তো আপনারা জানেনই।
– এদিকে আজ কথা আবারো চলে যাবে আনোয়ারের সাথে। আনোয়ারকে বললো ‘ যাওয়ার সময় রাইসাকে সাথে করে নিয়ে যাবে। ‘ কিন্তু আনোয়ারের এক কথাই বেজাল সাথে নিবে না। এই বলে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
– আনোয়ার চলে যাওয়ার পর রাইসা কাঁদতে কাঁদতে রুমে ঢুকে। কথাকে দেখেই রাইসা জড়িয়ে ধরে বলতে লাগে’ মম তোমার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে?’ রিফাত বললো তুমি নাকি পতা। তুমি আর আমাকে বুকে নিবা না। তুমি আমাকে রেখে চলে গেছো। কাল রাতে কতো কান্না করছি বুকে নেওনি।
– রাইসা মা আমার কাঁদে না। আমার বুকে আয় তকে আদর করে দেয়।
– না না না! তুমি আমাকে ডাকবে না। তুমি পতা। তুমি পতা লোকটাকে বিয়ে করেছে। তুমি চলে যাও। কথাটা বলে রাইসা চলে গেল।
– বিকেল বেলা যখন কথা তার জামাই বাড়ি চলে যাবে এমন সময় কোথাও রাইসাকে খুঁজে পেল না। কথা বুঝে ফেলছে তার মেয়েটা তার বাবার মতোই অভিমানী। নিশ্চয়ই মন খারাপ করে কাঁদছে। তাই আনোয়ারকে রেখে তার মায়ের রুমে গিয়ে দেখে রাইসা উপুড় হয়ে কাঁদছে।
-কথা পিছন থেকে গিয়ে, রাইসার মাথায় হাত রাখতেই রাইসা কান্না জড়ানো কন্ঠে বললো কে? আপনি চলে যান।
– রাইসা চলো আমার সাথে।
-না আমি আপনার সাথে যাবো না। আপনি আমাকে ছুঁবেন না। আমার কেউ নেই। আমার মা-বাবা কেউ নেই। কাঁদতে কাঁদতে অন্যরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল।
– এদিকে মাস খানেক পর রাইসার অপারেশন হয়। রাইসা এখন পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু রাইসা সুস্থ হলেও সে হাসতে ভুলে গেছে। তার মাকে ঘৃণা করে বড্ডবেশি ঘৃণা করে। তার বিশ্বাস তার মা নিজের জন্য তাকে ছেড়ে গেছে। এখনো কথা আসলে রাইসা মুখ ফিরিয়ে নেয়। কথা পারেনা তার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিতে।
– দেখতে দেখতে অনেক গুলো বছর কেটে যায়।
কথা মারা গেছে। মারা যাওয়ার আগে একটা ডাইরি রেখে গেছে। হ্যাঁ কথা কাঁদছে। তার মায়ের জন্য কাঁদছে কারণ এখন তার মা নেই। তার মায়ের মায়া জড়িত কথাগুলো ডাইরি বন্ধ হয়ে আছে।
.
.
সমাপ্ত…….
.
মায়া পর্ব ৩
গল্প :- মায়া
পর্ব :- ০২
লেখিকা :- তাসনিম রাইসা
.
.
.
-: যখন রান্না ঘরে প্রবেশ করবে তখন, তার বড় ভাবি কাকে যেন বলছে’ আনোয়ার এটা একটা কাজ করলো? মেয়ে সহ বিয়ে করা মেয়েকে বিয়ে করলো।
– কথাকে রুমে ডুকতে দেখে চুপচাপ হয়ে গেল।
– পরের দিন কথা তাদের বাসায় যেতেই ‘ রাইসা দৌড়ে এসে কথাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল ‘ মম তুমি কোথায় ছিলে? আর আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?
– রাইসার এই কথার কোন উওর নেই কথার কাছে। রাইসাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে নিরবে চোখের অশ্রু জড়াচ্ছে। কখনো ভাবেনি এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে সে। রাইসাকে কুলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে আসে।
-বাড়ির সবাই হাসিখুশি। নতুন জামাইয়ের জন্য কথার মা রান্না করতে ব্যস্ত। বাড়িতে খুশির আমেজ চলছে। রাইসার কথার কুলে বসে আছি আর একেক সময় একেক প্রশ্ন করছে। দিনটা ভালোভাবে কাটলেও বিপত্তি লাগলো রাতে।
রাতে সাতবছর বয়সি রাইসা কথার বুকে শুয়ে আছে। রাত প্রায় দশটা বাজে। কথা রাইসার মাথাই হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রাইসা ঘুমাচ্ছে। রাইসার ঘুমন্ত চেহারাটা আজ কেন জানি বড্ডবেশি সুন্দর লাগছে। হঠাৎ রুমে আনোয়ার প্রবেশ করলো। আনোয়ার এসেই রাইসাকে দেখে বললো’ রাইসা এখানে কেন? রাইসাকে তার নানুর কাছে দিয়ে আসো।
– কথা মাথাটা নিচু করে বললো’ থাক না কাল তো চলেই যাবো। ‘
– তুমি থাকো মেয়ে নিয়ে আমি থাকব না এই রুমে।
– কি তুমি রাগ করছেন কেন?
– রাগ কেন করবো? তুমি মেয়ে নিয়ে শুয়ে থাকো ।
– তুমি না বলেছিলে রাইসা তোমারো মেয়ে?
– বিয়ের আগে ওসব বলাই যায়। তাই বলে অন্যজনের জন্ম দেয়া মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনবো?
– কথা কিছু না বলে, রাইসাকে তার মায়ের রুমে রেখে আসল।
– কথা রুমে আসতেই আনোয়ার দরজা লাগিয়ে দেয়। দরজা বন্ধ করে কথাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলতে লাগল ‘ জানো কথা এই দিনটির অপেক্ষা দীর্ঘ দশবছর ধরে করছি।
– মানে কি বলছো এসব?
– হুম ঠিক বলছি, কলেজে প্রথম যেদিন দেখি সেদিনই তোমার প্রেমে পড়ে যায়। প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু তুমি আমার মুখের উপর চিঠি ছুড়ে মারো। সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বিয়ে যদি করতে হয় তোমাকেই করবো। কিন্তু তুমি কি করলা রাজকে বিয়ে করে নিলা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস রাজ ঢাকা থেকে ফেরার পথে লঞ্চ ডুবে মারা যায়। তার লাশটাও খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষ দেখাও দেখতে পেলে না।
– আনোয়ার প্লিজ চুপ করো এসব বলো না।
– কি খুব কস্ট হচ্ছে? কস্ট পেয়ো না বেবী। তোমাকে আজ আদরে আদরে ভরিয়ে দিবো।
– আজ না ভালো লাগছে না। এখন তো তোমার বউ আজ না কাল হবেই তো।
– এই মা—!* চুপ কর। তোকে বিয়ে কি তোর রুপ দেখার জন্য করেছি?
– কথা কিছু বলতে পারছে না। আনোয়ার তার পুরুষত্ব প্রমাণ করছে।
– হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে আদো আদো কান্না জনিত কন্ঠে ভেসে আসছে ‘ মা মা দরজা খুলো। আমি তোমার কাছে যাবো। দরজার ওপাশ থেকে কথার মা বলছে নানা ভাই এখন ঘুমাও সকালে তোমার মার কাছে যেয়ো। তোমার মা এখন ঘুমাচ্ছে।
– না না আমি যাবো না আমি মা’র বুকে ঘুমাবো। মা মা দরজা খুলো মা। দরজা খুলো তুমি কালকেও আমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাওনি। মা আমার কি কস্ট হয় না? তুমি জানো না মা আমি তোমার বুক ছাড়া ঘুমাতে পারি না। নানু তুমি যাবে এখান থেকে? দেখো আমার মা ঠিক আমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাবে।
– কথার বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু কথা উঠতে পারছে না। কথার মুখটা চেপে ধরে আছে। আনোয়ার তার শরীরের চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত। বারবার রাজের চেহারাটা চোখে ভাসছে।
– এদিকে রাইসা দরজার ওপাশ থেকে ডেকেই যাচ্ছে। মা রাইসাকে একটা থাপ্পর দিয়ে রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
– এদিকে আনোয়ার তার চাহিদা মিটিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে রইল।
– কথার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আল্লাহ এ কোন পরীক্ষায় ফেললো তাকে। বার বার রাজের কথা মনে পড়ছে। রাইসাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিল। জন্মের আগেই নাম ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু আল্লাহ তাকে নিয়ে নিলো। কথার বিবাহিত জীবনে একটি রাতও রাজের বুক ছাড়া ঘুমায়নি কথা। তার বালিশটা ছিল রাজের বুক। কিন্তু আজ বিবাহিত হয়েও সে ধর্ষিত হচ্ছে।
– এখনো মনে পড়ে যেদিন ওকে প্রথম বললাম জানো রাজ’ আমাদের চার পা থেকে ছয় পা হতে যাচ্ছে। রাজ কিছু না বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমি ক্ষানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। ভাবলাম খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাবে। কিন্তু তারমাঝে কিছুই দেখতে পেলাম না।
– আমি মন খারাপ করে শুয়ে আছি, হঠাৎ দেখলাম পাশের রুম থেকে ফিসফিস আওয়াজ হচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দেখি, রাজ নামায শেষ করে মোনাজাতে আল্লাহর কাছে কাঁদছে।
– মোনাজাত শেষ করে রাজ আমার কপালে চুমু দিয়ে বললো’ জানো কথা আজ আমি অনেক খুশি। তাই দু’রাকাত নফল নামায পড়ে নিলাম।
– রাজের আল্লাহর প্রতি আনুগত্য দেখে দু’চোখ বেয়ে জল নেমে আসল। সত্যিই আমি পেয়েছি ঝিনুকে থাকা মুক্তা।
– দিনগুলি ভালোই কাটতেছিল। হঠাৎ একদিন জরুরি কাজে ঢাকা যায়। পরের দিন ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে লঞ্চ ডুবে যায়। আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। সবসময় ভাবতাম সে মরিনি। কিন্তু নদী আমার সব কেড়ে নিছে। তখন রাইসা চার মাসের পেটে। মা বলছিল সন্তানটা নস্ট করে ফেলতে।
– দেখতে দেখতে রাইসার জন্ম হয়। পরিবারের অবস্থা ভালো ছিল না। তাই নিজে একটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পড়িয়ে নিজের খরচ চালাতাম। কিন্তু রাস্তা ঘাটে অনেকে অনেক বাজে কথা বলতো।
-কেউ কেউ বলতো ‘ স্বামী ছাড়া আর কতদিন? আমাকে দিয়ে দেখতে পারো। ‘ খুব কস্ট হতো তাদের কথা শুনে। বাড়িতে বিয়ের অনেক প্রপোজাল আসতো। দেখতে সুন্দর ছিলাম বলে। কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর রাজের শুদ্ধতম ভালোবাসা আমাকে নতুন করে বাঁচতে শেখালো। কিন্তু হঠাৎ একদিন রাইসার পেটের বাম সাইন্ডে প্রচন্ড ব্যাথা উঠে ””’
.
.
চলবে……….
মায়া পর্ব ২
গল্প :- মায়া
পর্ব :- ০২
লেখিকা :- তাসনিম রাইসা
.
.
.
-: যখন রান্না ঘরে প্রবেশ করবে তখন, তার বড় ভাবি কাকে যেন বলছে’ আনোয়ার এটা একটা কাজ করলো? মেয়ে সহ বিয়ে করা মেয়েকে বিয়ে করলো।
– কথাকে রুমে ডুকতে দেখে চুপচাপ হয়ে গেল।
– পরের দিন কথা তাদের বাসায় যেতেই ‘ রাইসা দৌড়ে এসে কথাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল ‘ মম তুমি কোথায় ছিলে? আর আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?
– রাইসার এই কথার কোন উওর নেই কথার কাছে। রাইসাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে নিরবে চোখের অশ্রু জড়াচ্ছে। কখনো ভাবেনি এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে সে। রাইসাকে কুলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে আসে।
-বাড়ির সবাই হাসিখুশি। নতুন জামাইয়ের জন্য কথার মা রান্না করতে ব্যস্ত। বাড়িতে খুশির আমেজ চলছে। রাইসার কথার কুলে বসে আছি আর একেক সময় একেক প্রশ্ন করছে। দিনটা ভালোভাবে কাটলেও বিপত্তি লাগলো রাতে।
রাতে সাতবছর বয়সি রাইসা কথার বুকে শুয়ে আছে। রাত প্রায় দশটা বাজে। কথা রাইসার মাথাই হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রাইসা ঘুমাচ্ছে। রাইসার ঘুমন্ত চেহারাটা আজ কেন জানি বড্ডবেশি সুন্দর লাগছে। হঠাৎ রুমে আনোয়ার প্রবেশ করলো। আনোয়ার এসেই রাইসাকে দেখে বললো’ রাইসা এখানে কেন? রাইসাকে তার নানুর কাছে দিয়ে আসো।
– কথা মাথাটা নিচু করে বললো’ থাক না কাল তো চলেই যাবো। ‘
– তুমি থাকো মেয়ে নিয়ে আমি থাকব না এই রুমে।
– কি তুমি রাগ করছেন কেন?
– রাগ কেন করবো? তুমি মেয়ে নিয়ে শুয়ে থাকো ।
– তুমি না বলেছিলে রাইসা তোমারো মেয়ে?
– বিয়ের আগে ওসব বলাই যায়। তাই বলে অন্যজনের জন্ম দেয়া মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনবো?
– কথা কিছু না বলে, রাইসাকে তার মায়ের রুমে রেখে আসল।
– কথা রুমে আসতেই আনোয়ার দরজা লাগিয়ে দেয়। দরজা বন্ধ করে কথাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলতে লাগল ‘ জানো কথা এই দিনটির অপেক্ষা দীর্ঘ দশবছর ধরে করছি।
– মানে কি বলছো এসব?
– হুম ঠিক বলছি, কলেজে প্রথম যেদিন দেখি সেদিনই তোমার প্রেমে পড়ে যায়। প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু তুমি আমার মুখের উপর চিঠি ছুড়ে মারো। সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বিয়ে যদি করতে হয় তোমাকেই করবো। কিন্তু তুমি কি করলা রাজকে বিয়ে করে নিলা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস রাজ ঢাকা থেকে ফেরার পথে লঞ্চ ডুবে মারা যায়। তার লাশটাও খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষ দেখাও দেখতে পেলে না।
– আনোয়ার প্লিজ চুপ করো এসব বলো না।
– কি খুব কস্ট হচ্ছে? কস্ট পেয়ো না বেবী। তোমাকে আজ আদরে আদরে ভরিয়ে দিবো।
– আজ না ভালো লাগছে না। এখন তো তোমার বউ আজ না কাল হবেই তো।
– এই মা—!* চুপ কর। তোকে বিয়ে কি তোর রুপ দেখার জন্য করেছি?
– কথা কিছু বলতে পারছে না। আনোয়ার তার পুরুষত্ব প্রমাণ করছে।
– হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে আদো আদো কান্না জনিত কন্ঠে ভেসে আসছে ‘ মা মা দরজা খুলো। আমি তোমার কাছে যাবো। দরজার ওপাশ থেকে কথার মা বলছে নানা ভাই এখন ঘুমাও সকালে তোমার মার কাছে যেয়ো। তোমার মা এখন ঘুমাচ্ছে।
– না না আমি যাবো না আমি মা’র বুকে ঘুমাবো। মা মা দরজা খুলো মা। দরজা খুলো তুমি কালকেও আমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাওনি। মা আমার কি কস্ট হয় না? তুমি জানো না মা আমি তোমার বুক ছাড়া ঘুমাতে পারি না। নানু তুমি যাবে এখান থেকে? দেখো আমার মা ঠিক আমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাবে।
– কথার বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু কথা উঠতে পারছে না। কথার মুখটা চেপে ধরে আছে। আনোয়ার তার শরীরের চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত। বারবার রাজের চেহারাটা চোখে ভাসছে।
– এদিকে রাইসা দরজার ওপাশ থেকে ডেকেই যাচ্ছে। মা রাইসাকে একটা থাপ্পর দিয়ে রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
– এদিকে আনোয়ার তার চাহিদা মিটিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে রইল।
– কথার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আল্লাহ এ কোন পরীক্ষায় ফেললো তাকে। বার বার রাজের কথা মনে পড়ছে। রাইসাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিল। জন্মের আগেই নাম ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু আল্লাহ তাকে নিয়ে নিলো। কথার বিবাহিত জীবনে একটি রাতও রাজের বুক ছাড়া ঘুমায়নি কথা। তার বালিশটা ছিল রাজের বুক। কিন্তু আজ বিবাহিত হয়েও সে ধর্ষিত হচ্ছে।
– এখনো মনে পড়ে যেদিন ওকে প্রথম বললাম জানো রাজ’ আমাদের চার পা থেকে ছয় পা হতে যাচ্ছে। রাজ কিছু না বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমি ক্ষানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। ভাবলাম খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাবে। কিন্তু তারমাঝে কিছুই দেখতে পেলাম না।
– আমি মন খারাপ করে শুয়ে আছি, হঠাৎ দেখলাম পাশের রুম থেকে ফিসফিস আওয়াজ হচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দেখি, রাজ নামায শেষ করে মোনাজাতে আল্লাহর কাছে কাঁদছে।
– মোনাজাত শেষ করে রাজ আমার কপালে চুমু দিয়ে বললো’ জানো কথা আজ আমি অনেক খুশি। তাই দু’রাকাত নফল নামায পড়ে নিলাম।
– রাজের আল্লাহর প্রতি আনুগত্য দেখে দু’চোখ বেয়ে জল নেমে আসল। সত্যিই আমি পেয়েছি ঝিনুকে থাকা মুক্তা।
– দিনগুলি ভালোই কাটতেছিল। হঠাৎ একদিন জরুরি কাজে ঢাকা যায়। পরের দিন ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে লঞ্চ ডুবে যায়। আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। সবসময় ভাবতাম সে মরিনি। কিন্তু নদী আমার সব কেড়ে নিছে। তখন রাইসা চার মাসের পেটে। মা বলছিল সন্তানটা নস্ট করে ফেলতে।
– দেখতে দেখতে রাইসার জন্ম হয়। পরিবারের অবস্থা ভালো ছিল না। তাই নিজে একটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পড়িয়ে নিজের খরচ চালাতাম। কিন্তু রাস্তা ঘাটে অনেকে অনেক বাজে কথা বলতো।
-কেউ কেউ বলতো ‘ স্বামী ছাড়া আর কতদিন? আমাকে দিয়ে দেখতে পারো। ‘ খুব কস্ট হতো তাদের কথা শুনে। বাড়িতে বিয়ের অনেক প্রপোজাল আসতো। দেখতে সুন্দর ছিলাম বলে। কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর রাজের শুদ্ধতম ভালোবাসা আমাকে নতুন করে বাঁচতে শেখালো। কিন্তু হঠাৎ একদিন রাইসার পেটের বাম সাইন্ডে প্রচন্ড ব্যাথা উঠে ””’
.
.
চলবে……….