Sunday, August 17, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1987



উত্তরাধিকার (পর্বঃ-১৫)

0

উত্তরাধিকার (পর্বঃ-১৫)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************
এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনা এ মন…
হমহমহমহহমহ………
বধূ তোমার নিমন্ত্রণ….!”
খালিগায়ে একটা ওশন ব্লু কালারের ট্রাউজার পড়ে গুনগুন করে গানের কলি ভাজছে রাফিজ।সে স্কুলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বেলা চৌধুরী বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে ছেলের ঘরে ঢুকলেন।
-“কি রে?গান ? তাও তোর মুখে? আমি হেমন্ত শুনি দেখে সেদিনই না বললি গান শুনলে কানে গরম সীসা ঢেলে দেয়া হবে?”
রাফিজ হকচকিয়ে গেলো-“ওহ্,স্যরি মা! কখন গুনগুনিয়ে ফেলেছি খেয়াল করিনি।অজান্তে এমনটা হয়েছ!এই মুখ বন্ধ করলাম!”
রাফিজ মনোযোগ দিয়ে শার্টের বাটন খুলতে লাগলো গায়ে দেবার জন্য !
বেলার মনে হচ্ছে এ তার ঝড়ের তান্ডবে নুব্জ্য বিধ্বস্ত রাফিজ নয়,এটা তার সেই সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া টগবগে যুবক রাফিজ।মাত্র একদিনেই ওর বয়স দশ বছর কমে গেলো কিভাবে?
গতকালও তো ওকে পঞ্চাশ বছরের আধাবুড়োদের মতো দেখাচ্ছিলো!!
বেলা নিজে প্রতিমাসে পার্লার যান,ফ্রুটস ফেসিয়াল করেন তবু তার বয়স ততটা কমিয়ে দেখাতে পারছেননা যতটা তিনি চান।অথচ নাযিয়াত যাবার পর থেকে তার ছেলেকে দেখছেন তুবড়ানো গালে এলোমেলো দাড়ী,চুলগুলো কয়দিনের না আঁচড়ানো কে জানে আর সেই ছেলে আজ একেবারে ব্যাকব্রাশ করে জেল টেল লাগিয়ে….?গায়ে মনে হয় বড়ি স্প্রে উপুড় করে দিয়েছে।পুরো ঘরটা ম্যাক্সফ্যাক্টরের গন্ধ ম’ ম’ করছে।
একদিনেই কি এমন হয়ে গেলো যে ও এতো বদলে গেলো ?তাছাড়া গত কয়েকদিন ধরে সে অফিসও করছেনা।বেলা খবর পেয়েছেন।
সে আজকাল গাড়ী না নিয়ে রিক্সা দিয়ে যেন কোথায় যায়!
হায় আল্লাহ্,শোকে দুঃখে ছেলে আবার বাজে কারো পাল্লায় পড়লো না তো?পুরুষ মানুষের এমন ভঙ্গুর মুহূর্তে অনেক সুবিধাবাদীরা সুযোগ নিতে দেরী করেনা।বিশেষ করে কিছু ফটকিবাজ মেয়েরা!তাছাড়া তার ছেলে ধনী পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকারী,লোভ তো হতেই পারে।
বেলা সন্ধিগ্ন কন্ঠে প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করলেন-
-“কি হয়েছে রে তোর?”
রাফিজ ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো! কিছুটা অবাক হয়ে বললো-“কিসের কি হয়েছে?”
-“বললেই হলো?আমি তোকে চিনিনা?তুই এই ক’দিন ধরে অফিসে যাচ্ছিস না!!যাস কোথায় তুই বলতো ?”
রাফিজ এবার সত্যিই বিব্রতবোধ করলো।মা হঠাৎ এভাবে এ্যাটাক করবে ভাবেনি।
কিছুক্ষণ ভেবে মুচকি হেসে বললো–
-“একটা মিশনে নেমেছি মা।সাকসেস হয়েই তোমাকে জানাবো।আপাতত কিছু জানতে চেওনা মা প্লিজ!”
-“খারাপ কিছু না তো?”গলার স্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে বললো বেলা।রাফিজ ঘুরে মায়ের দিকে তাকালো-“তোমার কি মনে হয়,তোমার ছেলে খারাপ কিছু করতে পারে?”
-“,না,তা না…!কিন্তু…..!”
-“কোনো কিন্তু না মা।তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারন নেই।অফিসে না গেলেও যোগাযোগ রেখেছি।সাইদ সাহেবকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।আর দুটো দিন তারপর দেখবে সব ঠিক,ইনশাআল্লাহ্!


রাফিজ টিচার্সরূমে ঢুকেই একনজরেই চারপাশ দেখে নিলো।নাহ্,নাযিয়াত নেই!কি ব্যাপার? আসেনি নাকি আজকে?
রাফিজ চেয়ারে বসতেই পাশে মিস নাযিয়াত এসে বসলো-“হাই…?”
রাফিজ সামান্য মুখ ফিরিয়ে মিস নাযিয়াতের উপস্থিতি টের পেয়ে মনোযোগ দিয়ে ট্রেবুলেশন শিট লিখতে লাগলো!
মনে মনে বিরক্তও হলো,কারন সে খোঁজে মিসেস নাযিয়াতকে আর মিস নাযিয়াত খুঁজে ওকে!
একেই বলে ভাগ্য!
তবু রাফিজ বিরক্ত বোধ করলেও হাবেভাবে ওকে নির্বিকার মনে হলো!
মিস্ নাযিয়াত পাশ থেকে বকবক করেই যাচ্ছে।এখন প্রসঙ্গ চলছে রাফিজের হাতের লেখা নিয়ে।
রাফিজ হঠাৎ মুখ তুলে বললো-“সব লেডি টিচাররা কি এখানে বসেন না নাকি ?মেলদের জন্যে কি আলাদা বসার ব্যবস্থা?
-“না…না..সবাই আমরা একসাথেই বসি।কারন আমাদের এখানে মেল পার্সন মাত্র তিনজন!আপনি,ড্রিল টিচার আর প্রিন্সিপ্যাল ম্যামের হাজবেন্ড মানে আমাদের চেয়ারম্যান স্যার!
-“ওহ্….চেয়ারম্যান স্যারকে তো কখনো দেখিনি!উনি কোথায় বসেন?”
-“প্রিন্সিপ্যাল ম্যাম পাশের কামরাটা !আপনি ওনাকে এখনো দেখেননি কারন উনি ওমরা করতে গেছেন!আজ কালের মধ্যেই চলে আসবেন! ভদ্রলোক খুবই অমায়িক!
আর বয়স…আপনার মতোই হবে।”
রাফিজ কথা শেষ করার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো!
মিস নাযিয়াত মুখ তুলে তাকালো–“ক্লাসে যাচ্ছেন?”
-“জ্বী!”সংক্ষেপে উত্তর দিয়েই রাফিজ গেটের দিকে এগোলো আর ঠিক তখনি মিসেস নাযিয়াতের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে হতে রয়ে গেলো!রাফিজের সমস্ত শরীরে অজস্র দমকল যেন ঘন্টা বাজাতে লাগলো!
রাফিজ থেমে গিয়ে মৃদুস্বরে বললো-“এই নিয়ে দ্বিতীয়বার!”
নাযিয়াত ঝট করে বিস্ফোরিত নেত্রে মুখ তুলে তাকালো!অবাক বিস্ময়ে সব ভুলে তাকিয়ে রইলো।ও কি সত্যি দেখছে না এটা তার ভ্রম?সে তার চারপাশে শুধু রাফিজকেই দেখে।মানুষটা নাহয় ভ্রম!কিন্তু তার বলা কথাটা?
রাফিজ কাতর দৃষ্টিতে নাযিয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে।ওর চোখ জোড়া যেন চঞ্চল প্রজাপতির মতো নাযিয়াতের মুখে কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে।রাফিজের মনে হচ্ছে সময়টা যেন থমকে গেছে দুজনের মাঝে।আহা,যদি এভাবেই কাটিয়ে দেয়া যেত কয়েকঘন্টা!
-“ওনার কথাই বলছিলাম!”
পেছন থেকে মিস নাযিয়াতের কথায় দুজনেরই সম্বিত ফিরলো।রাফিজ ভদ্রতা দেখিয়ে সরে দাঁড়ালো।নাযিয়াত ভেতরে প্রবেশ করে এককোণের চেয়ার দখল করে বসলো!আড়চোখে আরেকবার রাফিজের দিকে তাকাতে গিয়ে চোখাচোখি হয়ে গেলো।রাফিজ এখনো হা করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।নাযিয়াত মুখ নামিয়ে ব্যাগ থেকে খাতা বের করে সামনে রাখলো।মিস নাযিয়াত পরিচয় করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে রাফিজকে বললো-“উনিই আরেকজন নাযিয়াত! ওনারই বাচ্চা অসুস্থ ছিলো বলে একসপ্তাহ ধরে আসতে পারেনি!”
রাফিজ নাযিয়াতের দিকে তাকিয়ে ব্যগ্র কন্ঠে বললো-“এখন কেমন আছে রণ?”
মিস নাযিয়াত চমকে উঠে বললো-
-“আরে,আপনি কিভাবে জানলেন যে উনার বাবুর নাম রণ?”
নাযিয়াতও একবার ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে মুখ নামিয়ে নিলো।রাফিজ আমতা আমতা করে বলে উঠলো-
–“মমম,আপনিই তো গতকাল বললেন উনার একটা বাবু আছে নাম রণ!”
মিস নাযিয়াত কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে বললেন-“বলেছিলাম বুঝি?কি জানি মনে নেই!চলুন,ক্লাসে যাই!”
-“আপনি যান, আমি আসছি এক মিনিট!”
বলে রাফিজ নিজের বক্স খুলে অযথাই কিছু খাতা বের করলো!মিস নাযিয়াত “ওকে’ বলে পা বাড়াতেই নাযিয়াত(রণর আম্মু) হঠাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রূম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো!রাফিজ বোকার মতো সেদিকে চেয়ে রইলো!
পরের ক্লাসগুলো রাফিজ একটা ঘোরের মধ্যে করলো!বারবার মনের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।নাযিয়াত ওকে রুমে থামতে দেখে বেরিয়ে গেলো কেন?সে কি রাফিজের উপর রাগ?রাফিজের সাথে কথা বলতে চায়না নাকি কেউ দেখে ফেলার ভয়….. কোনটা?”
ছুটির সময়ও রাফিজ সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো নাযিয়াত বেরোলে ওর পিছু পিছু বেরিয়ে ওকে রাস্তায় হায়ার করবে কিন্তু ছুটির দশ মিনিট আগেই ও যে কখন লাপাত্তা হয়ে গেলো রাফিজ টেরই পেলোনা।
ধৈর্য্য ধরাটা রাফিজের জন্য ধীরে ধীরে অসহনীয় হয়ে পড়ছে।নাযিয়াতের সঙ্গে কথা বলার জন্য ওর মনটা ছটফট করছে।একেকটা দিন পাহাড়ের মতো কাটছে।বিশেষ করে দেখা হবার পর থেকে অস্থিরতাটা আরো বেড়েছে।একটুখানি সুযোগের অপেক্ষায় রাফিজ যেন মরমে মরে যাচ্ছে।
অবশেষে সুযোগ মিললো!
পুরো টিচার্স রুম খালি!নাযিয়াত এক কর্ণারে বসে খাতা দেখছিলো।সম্ভবত ওর এখন কোনো ক্লাস নেই!রাফিজ ভাবলো এটাই মোক্ষম সুযোগ।
একেবারে নাযিয়াতের সামনে সোজা হাজির!
-“কি ব্যপার? আমাকে দেখেও পালাই পালাই করছো কেন?”
নাযিয়াত চট করে মুখ তুলে তাকালো।ওর চেহারা মুহূর্তের মধ্যে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।রাফিজের কথার জবাব না দিয়ে ওর পেছন দিয়ে রুমটা একবার দেখলো।কেউ নেই দেখে নাযিয়াত দ্রুত খাতা ভাঁজ করে উঠে দাঁড়াতেই
রাফিজ ওর কব্জি চেপে ধরলো!
-“কি হলো?কথার জবাব না দিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”রাফিজের কন্ঠে দৃঢ়তা!
নাযিয়াত হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে বললো-
-“আরে কি করেন?কেউ এসে পড়লে কি ভাববে?”
-“যা খুশি ভাবুক আমার কিছু যায় আসেনা,নিজের বউয়ের সাথে কথা বলার সময় এতো ভেবে চলতে পারবোনা।তুমি আগে আমার কথার উত্তর দাও নইলে যেতে দেবোনা!”
-“এসব কি ছেলেমানুষী রাফিজ?পরেও তো কথা বলা যায়!”
-“পরে কখন কোথায় স্থান কাল সব বর্ণনা করো!”
নাযিয়াত মুখ খুলতে গেলেই দরোজায় কারো ছায়া পড়তে দেখে রাফিজ সেদিকে তাকাতেই নাযিয়াত দ্রুত রাফিজকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো!”
তার পরের দিনের পরের দিন!
সেদিনর পর থেকে নাযিয়াত পারতপক্ষে একা রুমে বসে না! কাউকে আসতে দেখলে আগেই নিজের পাততাড়ী গোটায়!ওর কেবলি মনে হয় এই বুঝি রাফিজ এলো!
অবশেষে একদিন সত্যি সত্যিই রাফিজ ওকে আবার একা পেয়ে ধরলো!
-“বাসার ঠিকানা দাও!”
নাযিয়াত অভিমানাহত চোখে চেয়ে বললো-“এতোদিন কোথায় ছিলেন?”
রাফিজ নাযিয়াতের দিকে গভীর চোখে তাকালো-“প্রশ্নটা বনলতা সেন করেছিলো জীবনানন্দ কে…!”
-“হেয়ালী রাখুন আর পথ,ছাড়ুন!কেউ দেখলে কেলেঙ্কারীর সীমা থাকবেনা!”
-“ঠিকানা বা ফোন নম্বর দাও নইলে পথ ছাড়বো না!”
-“উফ্…..লিখুন!”নাযিয়াত গড়গড় করে আওড়ে গেলো নাম্বারটা।তারপর সরে যেতে চাইলে রাফিজের বাঁহাতটা চট করে ওর সামনে বাড়ীয়ে ধরায় নাযিয়াত বাধা পেলো।নাযিয়াতের মনে হলো এক কারেন্টের শক লেগে ওর সমস্ত শরীর থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো!
-“রাফিজ,সরুন প্লিজ!”
রাফিজ মুচকি হেসে হাত সরিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে মিস নাযিয়াতের মুখোমুখি পড়ে গেলো!

মিস নাযিয়াত বড় বড় চোখে আশাহতের বেদনামাখা দৃষ্টিতে রাফিজের দিকে তাকিয়ে আছে।
রাফিজ সামান্য কেশে নির্বিকার চিত্তে “এক্সকিউজ মি”…. বলে বেরিয়ে গেলো !
রাফিজ চলে যাবার পর নাযিয়াত অসহায় চোখে মিস নাযিয়াতের দিকে তাকালো।
মিস নাযিয়াত জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওকে একবার দেখে বেরিয়ে গেলো!
ছুটির আগ দিয়ে নাযিয়াতের ডাক পড়লো প্রিন্সিপ্যালের রুমে।
ভীরু পায়ে প্রিন্সিপ্যালের রুমে আসতেই দেখলো রাফিজ সেখানে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আছে!নাযিয়াত সালাম দিয়ে প্রবেশ করতেই প্রিন্সিপ্যাল ওকে বসতে ইশারা করলেন!
নাযিয়াত অপরাধীর মতো মুখ করে বসে রইলো!
প্রিন্সিপ্যালই নিস্তদ্ধতা ভাঙ্গলেন!
খুক খুক করে কেশে বললেন –“মি.রাফিজ আমি আপনাকে নিতান্তই একজন ভদ্রলোক ভেবেছিলাম।জীবনে চলার পথে আমাদের কাউকে ভালো লাগতেই পারে,তারমানে এই না যে,আপনি বিদ্যালয়ের মতো একটি পবিত্র স্থানে আপনার ভাবাবেগের সীমারেখা অতিক্রম করবেন।দ্বিতীয়তঃ মিসেস নাযিয়াত একজন বিবাহিতা ও একজন পুত্র সন্তানের জননী এবং……!”
-“এবং……..এবং সে আমার স্ত্রী!”রাফিজের ভারী কন্ঠস্বরে তার দৃঢ়চেতা অভিব্যক্তি চরমভাবে ফুটে উঠলো!সে বলে চললো–
-“আর আমার স্ত্রী’র সাথে কথা বলার জন্য কোনো সীমারেখার বাঁধা মানতে আমি বাধ্য নই!প্রশ্ন হলো,স্কুলের মতো পরিবেশে এটা কতটা সঙ্গত!আমার মনে হয়না আমি এমন কোনো আচরণ করেছি যা স্কুলের পরিবেশ নষ্ট করতে পারে!যে এই কথাটা আপনার পর্যন্ত পৌঁছেছে এটা তার উর্বর মস্তিষ্কের অনুর্বর কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না!”
প্রিন্সিপ্যাল কিছুক্ষণ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন-“কে আপনার স্ত্রী?”
-“মিসেস নাযিয়াত চৌধুরী।যিনি আপনার সামনে বসে আছেন।”
নাযিয়াত সেই যে মুখ নিচু করেছে আর মুখ তুলেনি।প্রিন্সিপ্যাল কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই গেটে স্কুলের চেয়ারম্যান স্যার এসে দাঁড়ালে নাযিয়াত তাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো।
প্রিন্সিপ্যাল কিছু বলার আগেই চেয়ারম্যান হঠাৎ রাফিজের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে তর্জনী তাক করে বললেন-“রাফিজ,তুই এখানে?”
রাফিজের চেহারার বিমর্ষভাব কেটে গিয়ে সেখানে বিরাজ করলো একরাশ আনন্দাভা।রাফিজের গোটা মুখ আলোকিত হয়ে উঠলো!
-“আসিফ….তুই?”
চেয়ারম্যান আসিফুজ্জামান দুই হাত বাড়িয়ে দিলেন রাফিজের দিকে।প্রিন্সিপ্যাল পর্যায়ক্রমে একবার রাফিজের দিকে আরেকবার তার স্বামী আসিফুজ্জামানের দিকে তাকাতে লাগলো!তার মাথায় কিছুই ঢুকছেনা।এই রাফেজ আসলে কে?”



প্রিয়ন্তীকে নেবার জন্য শওকত চৌধুরী নিজেই এয়ার পোর্টে এলেন!
বাড়ী পৌঁছে প্রিয়ন্তী সোজা ফারিকের রুমে চলে এলো!যা ভেবেছিলো তারচে ভিন্ন পরিস্থিতি দেখে প্রিয়ন্তী যারপরনাই অবাক হলো!ছয়ফিট লম্বা টগবগে তরুন ফ্রিক এখন বিছানায় শায়িত এক রোগাক্রান্ত মৃত্যপথযাত্রী!
প্রিয়ন্তী চোখের পানি ধরে রাখতে পারলোনা।ওকে দেখে ফারিক হেসে বললো-
–“খুব বেশী মন খারাপ হলো?”
প্রিয়ন্তী মাথা নেড়ে মৃদুহাস্যে ফারিকের শিয়রে বসে বললো–“অনেক!”
-“আমাকে দেখে?”
-“হমম…!”
-“জানতাম….বিয়েটা করার জন্য তোর আফসোস হবে!”
-“আফসোস হচ্ছে, তবে বিয়ে করার জন্য নয়!এখানে দেরীতে আসার জন্য!”
ফারিক অবাক হয়ে তাকালে প্রিয়ন্তী ওর মুখে হাত বুলিয়ে বললো-“দাঁড়ীতে তোকে নুরানী লাগছে!”
ফারিক লজ্জিত হেসে বললো-“মৃত্যুর প্রস্তুতি নিচ্ছি!”
প্রিয়ন্তীর চোখ ভিজে এলো।ও নির্দ্বিধায় ফারিকের বুকে মাথা রাখলে ফারিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো-“আমার এলার্জিটা কিন্তু পুরোপুরি সারেনি!তুই এতো কাছে আসিস না!”
-“কেন,এলে কি হবে?”
-“তোরও হয়ে যাবে!”
-“সবাইকে সেকেলে বলিস,তুই নিজেই তো সেকেলে কথাবার্তা বলছিস!কিছু হবেনা আমার!”
-“তুই হঠাৎ আমার প্রতি এতো ঝুঁকে পড়লি কেন,বলবি?আমি তো আগের মতো সুন্দর নেই!”
-“কিন্তু তোর মনটা আগের চেয়ে অনেক বেশী সুন্দর হয়েছে বরং আগে তুই সুন্দর থাকলেও তোর মনটা কুৎসিত ছিলো।” বলে প্রিয়ন্তী ফারিকের দিকে তাকালো–“আমার নিজের ভুলে একবার ভালোবাসা হারিয়েছি।আরেকবার নিজের আরেকটি ভুলে তোকে হারাতে পারবোনা!”বলে প্রিয়ন্তী ফারিকের বুকে মাথা রাখলো!
ফারিক বিহ্বল হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলো!


স্কুলে আজ সাজসাজ রব পড়ে গেছে।রাফিজ পুরো স্কুলে মিষ্টি আনিয়ে খাইয়েছে।
প্রিন্সিপ্যাল বারবার ক্ষমা চাইতে লাগলেন রাফিজ আর নাযিয়াতের কাছে।
আসিফুজ্জামান রাফিজের পিঠ চাপড়ে বললো-“তুই এখনো আগের মতোই আছিস!দুষ্ট আর রোম্যান্টিক।বউ এর খোঁজে নিজের কোটি টাকার শিল্পপ্রতিষ্ঠান ফেলে রেখে শেষমেষ কিনা কিন্ডারগার্টেনে?হা হা হা….!”
প্রিন্সিপ্যাল অমায়িক হেসে বললেন-“মিসেস নাযিয়াতকে নিয়ে একদিন বাসায় আসেন!”
রাফিজ হাসলো।
মিস নাযিয়াত সেই যে মুখ লুকিয়েছে আর সামনে আসেনি!
…..
(আগামী খন্ডে শেষ)

উত্তরাধিকার (পর্বঃ-১৪)

0

উত্তরাধিকার (পর্বঃ-১৪)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
************************
আজ প্রিয়ন্তী তার নতুন সংসারে চলে গেলো!
স্বেচ্ছায়….আগ্রহে….ভালোবেসে।
শাজিয়ার মনের আকাশে মেঘের ঘনঘটা।একমাত্র আদরের মেয়ের জীবনের এমন করুন পরিণতি তিনি আশা করেননি।
মেয়েটার হঠাৎ করে এবরশন হয়ে যাওয়ার পর থেকেই ও কেমন যেন বদলে গেছে।
তাঁর মন বলছে ফারিকের কিছু একটা সমস্যা হয়েছে এবং সেটা প্রিয়ন্তী জানে।
সব জেনে শুনেও ফারিককেই বিয়ে করলো মেয়েটা।
বুকে পাথরচাপা দিয়ে তিনি মেয়েকে বিদায় দিলেন।
কিছুদিন আগেও তার বাড়ীটা দুই ছেলেমেয়ে দিয়ে গমগম করতো কিন্তু এখন চারিদিকে এক অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা।
শাজিয়া মন খারাপ করে শুয়ে রইলেন!
এমন সময় প্রান্তিকের ফোন এলো।প্রিয়ন্তী চলে যাবার পর থেকে তাঁর মনটা খারাপ ছিলো।ছেলের ফোন পেয়ে তার মনটা ভালো হয়ে গেলো!
-“কি রে বাবা,মায়ের কথা মনে পড়লো?”
-“তোমার কথা প্রতিদিনই মনে পড়ে মা।
কি করছিলে?”
-“এই তো শুয়েছিলাম।তোর খবর বল্!”
-“আমি আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।তোমরা সবাই কেমন আছো?”
-“ভালোই!এদিকে তোর শ্বশুড়বাড়ী থেকে দাওয়াত এসেছিলো।তোর বাবা আর আমাকে যেতে বলেছে।কিসব যেন ওরশ না কি!”
-“তোমরা গিয়েছিলে?”
-“ন্…না রে যেতে আর পারলাম কই!”শাজিয়া ইতস্তত করতে লাগলেন!
-“যাওনি, খুব ভালো করেছো!”
-“কেন?প্রথমেও দেখলাম ওদের এসব নিয়ে তুই আপত্তি করেছিস!কেন রে?”
-“শোনো মা,কুরআন হাদীসে প্রকৃত মুখলিস বান্দাদের সাহচর্য্য অর্জনের সাধারন একটি নির্দেশ দেয়া হয়েছে!এই নির্দেশের আলোকে মুত্তাকী লোকদের সঙ্গ লাভ একটি নফল ইবাদত।আর এটা যে কোনো মুত্তাকী মুখলিস বান্দার সাথে বসলেই এই ইবাদতের সাওয়াব পাওয়া হবে।সাহাবী গণ থেকে শুরু করে তাবেয়ী,তাবে-তাবেয়ীগণ উন্মুক্তভাবেই এসব পালন করেছেন।কখনোই তারা এই ইবাদত পালন করতে কোনো শাইখের সাহচর্য্য নির্দিষ্ট করে নেননি। এখন তাঁদের সুন্নাত ফলো না করে মনগড়াভাবে কুরআন হাদীসের অর্থব্যখ্যা দাঁড় করালে তো খিলাফে সুন্নাতের মধ্যে পড়ে যাবো।বর্তমানে নিজস্ব পীর-মুর্শিদকে এমনভাবে ফলো করা হচ্ছে যে,পীরের কথায় ওঠা বসা জীবন চালানো সব করা হচ্ছে।এটা তো কেবল গোটা পৃথিবীতে একজনকে অনুসরন করেই করতে বলা হয়েছিললো।আর তিনি হলেন রাসুল সাঃ!
তিনি ছাড়া কোনো মানুষই নির্ভুল-নিষ্কলুষ না তা তিনি যত বড় বুজুর্গই হোন না কেন!
অথচ অবস্থাটা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, পীরের মুরীদ হলেই সে পুলসেরাত পার আর পীরের মুরীদ না হলে সে যত বড় ইবাদত গুজারই হোক না কেন সে গুনাহগার।
আসলে,এসব কিছু স্বার্থান্বেষী লোকের ধান্ধা ফিকির ছাড়া আর কিছুই না।হাজারো মুরীদ আমি এমন দেখেছি যারা সুন্নতের পাবন্দী তো দুরের কথা,নামাজ রোজাটাও ঠিকমতো করেনা অথচ তাদের ধারনা তারা মুক্তিপ্রাপ্ত।এরা ফরয বাদ দিয়ে নফল নিয়ে টানাটানি করে বুঝলে?ব্যপারটা এমন হলোনা,সারা গায়ে মলমূত্র মেখে নাকে খানিকটা আতর লাগিয়ে নেয়া!
ইমাম সারহিন্দী রাঃ তো বলেছেন-“সকল পীরের হাকীকি পীর তো স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সাঃ)! ★{এহইয়াউস সুনান-(ডঃআঃজাহা
ঙ্গীর রাঃ) পৃঃনং-৪৮৮-৪৯০}★
শাজিয়া ক্ষীণ কন্ঠে বললেন-“বাবা,আমা
কে এতসব বলে লাভ আছে?আমি কি এসব বুঝি?”
-“বোঝা উচিত।পাশ কাটালে তো হবেনা।বাঁচতে হলে জানতে হবে! আচ্ছা,প্রিয়ন্তী কোথায়…ওকে দাও!
শাজিয়া কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন তারপর ধীরে ধীরে বললেন-“ওকে তো তোর বড়মামার ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছি!”
-“ওহ্,তা হঠাৎ?”
শাজিয়া বুঝলেন, ছেলের কাছে এই সত্যটা বেশিদিন চেপে রাখা সম্ভব হবেনা।আজ হোক কাল হোক সে জানবেই।তাকে সব জানিয়ে দেয়াই ভালো!
শাজিয়া যথাসম্ভব গুছিয়ে প্রিয়ন্তী বা ফারিককে অপরাধী না করে দুজনের ভালোবাসার দোহাই দেখিয়ে বিষয়টাকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলেন কেবল প্রেগন্যান্সি আর এবরশনের বিষয়টা চেপে গেলেন!
সব শুনে প্রান্তিক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো-“ওর ডিভোর্সের ইদ্দত শেষ হয়েছিলো?”
-“ইদ্দত?এটা কি?”
-“মানে তিন মাস পার হয়েছিলো?”
-“গুনে তো দেখিনি!”
প্রান্তিক ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“ইদ্দত হলো স্বামী হতে স্ত্রীর বিচ্ছেদের পর একটি নির্দিষ্ট সময়কাল যাবৎ স্ত্রী’র নিজেকে অপেক্ষা করিয়ে রাখার সময়টাই ইদ্দত।এটি এক ধরনের ইবাদত।ইদ্দত দুই ধরনের হয়।
একটি তালাকের ইদ্দত অপরটি বিধবাদের ইদ্দত।
যখন কোনো স্বামী স্ত্রীর মাঝে তালাক হয়ে যায় তখন স্ত্রীকে তিনমাস তেরো দিন ইদ্দত পালন করতে হয়,তখন সে অন্যত্র বিয়ে করতে পারেনা।তিনমাস তেরোদিন পার হবার পর সে স্বাধীন।
আর বিধবাদের ইদ্দত চারমাস দশদিন,বিধবা গর্ভবতী থাকলে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত!ইদ্দত পালনের সময় স্ত্রী’কে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়!”
-“কি জানি,এতোসব তো জানিনা বাবা ?”
-“না জানার জন্য তো এতবড় একটি ইবাদত থেকে বঞ্চিত হলে আর কিছু গুনাহ কামাই করলে!আমাকে জানালে কি ক্ষতিটা হতো? এতো লুকোচুরি করলে কেন,বুঝলাম না!!প্রিয়ন্তীও আমাকে ঘুণাক্ষরেও কিছু বললোনা।তাছাড়া ফারিকের সাথে ও কতটা সুখী হবে সেটাও একটা বিরাট প্রশ্ন!”
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর শাজিয়া ফোন রেখে ভাবনায় পড়লেন।
প্রান্তিকের কথা মিথ্যে না কিন্তু……!
আচ্ছা,প্রিয়ন্তী কি পৌঁছেছে?
ওখানে সবকিছু ঠিক আছে তো!



প্রচুর ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরলো রাফিজ।স্কুলে বাচ্চা পড়ানো যে এতো কঠিন কাজ তা রাফিজের আগে জানা ছিলোনা।
টানা চারঘন্টা কাজ করে একেবারে দুপুর দুটোয় বাড়ী ফিরেছে!
বেলা ছেলেকে দেখে অবাক হলেন-“কি রে,তুই সেই যে সকালে বেরিয়েছিস,আর এখন ফিরলি।গোসল সেরে ভাত খেয়ে নে!আমি ময়নাকে টেবিলে খাবার দিতে বলি!”
সত্যি, আজ রাফিজের ক্ষিধে লেগেছে।
খেতে বসে সে ভাবছে কাল আবার যেতে হবে।সার্টিফিকেট গুলো নিয়ে যাবার কথা বলে দিয়েছে প্রিন্সিপ্যাল।
তবে নাযিয়াতের সাথে দেখা হবে একথা ভাবলেই ক্লান্তিটা একদম কেটে যায়!ভাগ্য ভালো থাকলে কাল দেখা হয়েও যেতে পারে।
এক অদ্ভুত উত্তেজনা বিরাজ করছে রাফিজের মনে।
আজ প্রায় দেড় বছর পর নাযিয়াতের সাথে দেখা হতে যাচ্ছে।
নাযিয়াত ওকে দেখলে কি বলবে?রেগে যাবে? কেঁদে ফেলবে?নাকি হেসে দেবে খুশিতে!

পরদিন আর গাড়ী নিলোনা রাফিজ।
একটা রিক্সা ডেকে তাতে উঠে পড়লো রাফিজ।
এমনিতেই সেদিন দারোয়ান ওকে গাড়ী চালাতে দেখে নানান প্রশ্ন শুরু করেছিলো! রাফিজ কোনোরকম কাটিয়ে দিয়েছে।তাই
আজ একেবারে সাধারন বেশে চলেছে স্কুলে!
আজ ছাত্ররা রাফিজকে দেখে ওরাই আগে সালাম দিলো।
রাফিজ ওদের সাথে যখন কথা বলছে তখন এক ছাত্র এসে রাফিজের হাতে একটা টকটকা লাল গোলাপ দিয়ে বললো-“স্যার, এটা আমাদের গাছের গোলাপ!আজ সকালেই ফুটেছে!তাই আপনার জন্যই নিয়ে এসেছি।
ফুলটা হাতে নিয়ে হাসলো রাফিজ।ভাবছে, ছাত্র পড়ানোর এই এক মজা।তাদের আনুগত্যের পাশাপাশি তাদের নিখাদ ভালোবাসাটাও মেলে।
রাফিজের হঠাৎ কি মনে হতেই ফুলটা ছেলেটার হাতে দিয়ে বললো-
“ফুলটা তোমাদের মিস্ কে দিও!উনি খুশি হবেন।সুন্দর জিনিস সুন্দর মানুষের জন্য!”
সাথে সাথেই ছেলেমেয়েরা চেঁচিয়ে উঠলো-আপনিও তো অনেক সুন্দর স্যার।আমাদের কত আদর করেন!”
এরই মাঝে স্কুলের বুয়া এসে জানালো-
–“প্রিন্সিপ্যাল স্যার রাফিজকে ডাকছেন!”
রাফিজ ওদের শান্ত হয়ে বসতে বলে বেরিয়ে গেলো!বারান্দা দিয়ে হাঁটার সময় ওর পাশ দিয়ে এক মহিলা গেলো।
সে রাফিজের দিকে কিছুটা অবাক হয়েই তাকিয়েছিলো।
এমন লম্বা চওড়া হ্যান্ডসাম লোকটা স্কুলে চাকরী করতে এসেছে?
গালে চাপ দাঁড়ী থাকায় ওনাকে একদম হলিউডি সুপারষ্টার ওমর ফারুকের মতো লাগছে।এঁকে কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর জিএম টিএম হলে বেশ মানাতো!টিচার হিসেবে একদম বেমানান।
প্রিন্সিপ্যাল তাহলে এনার কথাই বলেছিলো?
বাহ্,দারুন গুড লুকিং তো!
ভেবে ভেবে অবিবাহিতা মিস নাযিয়াত শিহরিত হলেন!
ক্লাসে ঢুকতেই বাচ্চারা সব দাঁড়ালো।মিস ওদের সবাইকে বসতে বলে নিজের ব্যাগটা খুললেন কলম বের করার জন্য!
তখন এক ছাত্র এগিয়ে এসে ফুলটা মিসের দিকে বাড়িয়ে ধরলো-“মিস,এটা আপনার জন্য!”
মিস নাযিয়াত আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে বললেন-“ওয়াও…কি সুন্দর।এটা আমার জন্যে?”
পেছন থেকে আরেক ছেলে বলে উঠলো-“নো মিস,ও এটা নতুন স্যারকে দিয়েছিলো।স্যার আপনাকে দিতে বলেছে!”
মিস বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন-“আমাকে?”
-“জ্বী,স্যার বলেছেন, এটা তোমাদের মিসকে দিও….সুন্দর ফুল সুন্দর মানুষের জন্য!”
মিস নাযিয়াত আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়লেন।ওর বুঝতে কষ্ট হলোনা যে,ঐ হ্যান্ডসাম লোকটা ওকে বাচ্চাদের মাধ্যমে ইঙ্গিতে প্রপোজ করেছে।ওয়াও…দারুন।না চাইতেই মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!
এরই মধ্যে ছেলেগুলো ফিসফাস শুরু করেছে।নাযিয়াত মিস সবাইকে থামতে বলে ওদের একজনকে দাঁড় করালেন-“কি হলো ফিসফাস করছো কেন?”
একটা ত্যাঁদোড় টাইপ ছেলে আরেকটাকে দেখিয়ে বলে উঠলো-“মিস্,ও না বলে কি…!”
-“কি বলেছে বলো আমাকে?”
-“ও বলে কি,নতুন স্যার নাযিয়াত মিসের প্রেমে পড়েছে!”
-“হোয়াট?সবগুলোর পিঠের ছাল তুলে ফেলবো!তোমরা প্রেমের কি বোঝো?”
নাযিয়াত খুব বেশী রাগতে গিয়েও পারলেন না।ক্লাস ফোরের বাচ্চা গুলো একটু বেশীই পাকনা।এ নিয়ে কয়েকবারই হৈ চৈ হয়েছে।একবার এক পিচ্চি মেয়েকে এক পিচ্চি ছেলে নাকি প্রপোজ করেছিলো।বিষয়টা প্রিন্সিপ্যাল পর্যন্ত গড়িয়েছিলো।
প্রিন্সিপ্যাল আর কি করবেন,দুজনের বাবা মাকে ডেকে ছেলেমেয়েদের সামনে হিন্দী সিরিয়াল দেখতে এবং বিদেশী কার্টুনগুলো দেখাতে বারন করে দিলেন।ওসব কার্টুনের পশুপাখি গুলোও প্রেম করে!ওরাই আমাদের বাচ্চাগুলোকে হাতে ধরে এসব শেখাচ্ছে!
কিন্তু কে শোনে কার কথা।যেই কে সেই।
সেই ছেলে এখনো ঐ মেয়ের হোমওয়ার্কের খাতা নিজে গিয়ে তুলে আনে আবার টিচারের দেখা শেষ হলে ঐ মেয়েটির টেবিলে পৌঁছে দেয়!মেয়েটিও বেশ মজা নেয়।
আজকালকার বাচ্চা গুলো অল্প বয়সেই কেমন ম্যাচিওরডদের মতো ভাবসাব।
নাযিয়াত নিজেকে সামলে নিলো।এদের সামনে ভাবাবেগে ভেসে যাওয়া চলবেনা।সে গম্ভীর মুখে ক্লাস শেষ করলো।
মাঝখানে অফ পিরিয়ডে রাফিজ যখন বসে বাচ্চাদের খাতা দেখছিলো তখন ওর পাশ থেকে কেউ একজন বললো-“থ্যাংকস!”
রাফিজ চমকে তাকালো-“জ্বী…?”
-“তখনকার চমৎকার ফুলের জন্য ধন্যবাদ।”
মিষ্টি হেসে বললো লেডি টিচার।
রাফিজ মনে মনে প্রমাদ গুনলো।সর্বনাশ..
.ফুলটা এর হাতে পড়েছে?এর নাম কি নাযিয়াত নাকি ?”
রাফিজ ফ্যাকাশে হেসে বললো-“ন্..না..ঐ ইয়ে বাচ্চারা….!”
-“আপনি বুঝি নতুন জয়েন্ট করেছেন?”
-“জ্বী!”আড়ষ্ট কন্ঠে উত্তর দিলো রাফিজ।
মহিলা একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।রাফিজ হঠাৎ বলে উঠলো-
–“আপনার নামটা যেন কি?”
আবারও মিষ্টি হাসি-
–“নাযিয়াত!আমার নাম নাযিয়াত।আর আপনার নাম রাফিজ…তাই না?প্রিন্সিপ্যা
ল ম্যামের কাছে শুনেছি!চমৎকার রোম্যান্টিক নাম তো আপনার!”
রাফিজ তাকে পাত্তা না দিয়ে কাজে মুখ ডুবালো।নিজের আবেগতাড়িত সিদ্ধান্তের জন্য ওর রাগ হচ্ছে!
না জেনে বুঝে শুধু “উম্মুল রণ” দেখেই এখানে ঝোঁকের মাথায় চাকরী নেয়াটা চরম বোকামী হয়ে গেছে।
এই মেয়েটির নাম নাযিয়াত!!
ওহ্, এটা তাহলে ওর নাযিয়াত এটা নয়!!!নাহ্,কাল থেকে আসা বন্ধ করে দিতে হবে।অযথা এসে লাভ কি?
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ায় মুখ তুলে বললো-“আচ্ছা,আপনার বাচ্চাটা যে অসুস্থ শুনলাম,সে এখন কেমন আছে?”
-“কিহ্ ?বাচ্চা?ইয়াল্লাহ্….হিহিহি….করে খিলখিল শব্দে হেসে উঠলো মেয়েটা।
রাফিজ মনে মনে রাগ দমন করলো,মেয়েটার ঢংটা একটু বেশীই হয়ে যাচ্ছে!একেবারে চোখে পড়ার মতো!
কিন্তু আজকের দিনটা সহ্য না করে উপায় নেই।
নাযিয়াত হাসি শেষে বললো–
-“আমার তো এখনো বিয়েই হয়নি!বাচ্চা….
আল্লাহ্…হিহিহি….বলে দাঁতে জিভ কাটলো মেয়েটি!
–“না,ঐ দিন,প্রিন্সিপ্যাল বললেন কিনা, তাই ভাবলাম….!”
বলে রাফিজ কথা শেষ করেছে এমন ভঙ্গিতে কাজে মন দিতে চেষ্টা করলো!
কিন্তু এরপরে মেয়েটি হেসে যা বললো তাতে রাফিজের হার্ট প্রবল শব্দে বিট করতে শুরু করলো!মেয়েটি বললো-
-“আরে ও তো আমাদের আরেক নাযিয়াত! মানে আমাদের দুজনের নামই নাযিয়াত।ঊনি বিবাহিত,ওনারই ছোট্ট একটা বাবু আছে !”
রাফিজ কাজ ভুলে মেয়েটির দিকে তাকালো।ও আরো কিছু প্রশ্ন করতে চায় কিন্তু মেয়েটি কি না কি ভাববে….তাই সাহস করতে পারছেনা।
তাছাড়া সে একই ভুল দু’বার করতে চায়না!নাযিয়াত নামটা শুনেই গোলাপ দিতে বলাটা ছিলো ওর প্রথম ভুল!এবারের নাযিয়াতও যে ওর নাযিয়াতই হবে,না দেখে নিশ্চিত না হয়ে আর একপাও সে এগুবে না!
রাফিজ কাগজপত্র গুছিয়ে উঠে গেলো।যদিও ওর ক্লাস শুরু হতে আরো দশ মিনিট বাকী।তবু এখানে এই মহিলার সাথে টাইম স্পেন্ড করা মানে নিজেকে আরো বড় ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া!দরকার হলে ক্লাসে গিয়ে বসে থাকবে তবু এর সাথে টিচার্স রুমে একা বসাটা বিপজ্জনক মনে হলো রাফিজের।

পরদিন বিরসমুখে টিচার্সরুমে প্রবেশ করলো রাফিজ।অন্যান্য কয়েকজন টিচার বসে আছে।রাফিজ অভ্যাসবশতঃ সবার দিকে একবার নজর বুলালো!নাহ্,ওর নাযিয়াত এখানে নেই।তারমানে ওর ধারনাই ঠিক।নাযিয়াতের ব্যপারে ভুল করে ফেলেছে সে।ওর নাযিয়াত এখানে নেই।তবু রণ’র আম্মুটাকে দেখলে মনটা স্বস্তি পেতো!নিশ্চিন্ত হতে পারতো।
এখান থেকে চলে গেলেও মনের মধ্যে একটা খটকা থেকে যাবে ওর!
ওর জানতেই হবে রণ’র আম্মুটা কি আসলেই ওর নাযিয়াত না কি অন্য কেউ।
রাফিজ ক্লাসে রওনা দেবার জন্য রুম ছেড়ে বেরুতেই হঠাৎ ওর নিজের জায়গাতেই জমে স্থির হয়ে গেলো!
ওর প্রানভোমরা,ওর প্রিয়তমা ধীরপায়ে হেঁটে এদিকেই আসছে।আবায়ার ঢোলা হাতের ভেতর থেকে কালো রিষ্ট ওয়াচ পড়া বাঁ হাতের কব্জিটা উঁকি দিচ্ছে।
বাম হাতে কতগুলো খাতা ধরা ওর।
মাথায় কালো হিজাব, নাকে নিকাব ওকে অনন্যা করে তুলেছে।ওর হাঁটার ছন্দে ছন্দে শাড়ীর কুঁচিগুলো একবার বাম দিকে আরেকবার ডানদিকে আছড়ে পড়ছে।
রাফিজের হার্টবিট দ্বিগুন হলো।
আহা!
মায়াবন বিহারিনী হরিনী!
গহন স্বপন সঞ্চারিনী!
পরের দু লাইন ওর জন্যে না!
ভাবলো রাফিজ।
এই হরিনী ওর একার।
*
নাযিয়াত রাফিজের কাছ দিয়ে যাবার সময় তাকালো তো না’ই বরং নিকাবটা আরেকটু টেনে নাকের অনেকটা উপরে তুলে ফেললো!
তবু রাফিজের চিনতে এতটুকু ভুল হলোনা যে এটা নাযিয়াত।
নাযিয়াতের গোটা প্রোফাইল ওর মুখস্ত।
নাযিয়াত পরপুরুষের দিকে না তাকানোর অভ্যাস থেকেই রাফিজকে দেখেনি।
তাকালে দেখতে পেতো একজোড়া তৃষিত চোখ অনুক্ষণ ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে!
এখন পেয়ে কেমন তা তা থৈ থৈ করে নাচছে চোখজোড়া!
রাফিজ অপাঙ্গে ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে আওড়ালো-
“আমারি বধূয়া আন বাড়ী যায়
আমারই আঙিনা দিয়া!
ক্যামোনে বাঁধিবো হিয়া….!”
….
চলবে…..

উত্তরাধিকার (পর্বঃ-১৩)

0

উত্তরাধিকার (পর্বঃ-১৩)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************f
বিয়ে হয়ে যাবার পর প্রিয়ন্তী ফারিকের সাথে কথা বলতে চাইলো! ওদেরকে একান্তে কথা বলার সুযোগ দিয়ে বড়রা সরে গেলেন!
ফারিক কাতর স্বরে বললো-“এবার তো তোর সন্তানের নাম পেলি!এভাবে বিয়ে করার কোনো মানে হয়না।কি হতো বিয়ে না হলে?কিছু শব্দ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সন্তানটা হালাল হয়ে গেলো?তোদের এসব সিলি ইমোশন আমি বুঝিনা!”
প্রিয়ন্তী ভেজা কন্ঠে বললো-“তোর এই কথাগুলো একদিন আমিও বলেছিলাম।কি হয় বিয়ে করে?কিছু শব্দ উচ্চারন আর পায়ে বেড়ী ফেলে স্বাধীনতাকে হরণ করা।একজনের পছন্দ অপছন্দ মেনে নিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়া।এটার কোনো মানে আছে?কথাটার জবাব আমার ভাই প্রান্তিক দিয়েছিলো। ওই জবাবটা শোনার পর আমার মনে হলো এই শব্দগুলোর দ্বারা আমি আমার সন্তানটাকে অভিশাপমুক্ত করতে চাই।এই শব্দ(কালিমা)গুলোর প্রয়োজন আছে।
প্রান্তিক বলেছিলো,ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য!আমরা যে ভাতটা খাই সেটা পথে দাঁড়িয়ে কাঁচা চালটাই কিনে কখনো চিবিয়ে খাইনা, সেটাকে মূল্য দিয়ে কিনে এনে ধুয়ে রান্না করে এর সাথে নিজের সাধ্যমতো কিছু ব্যঞ্জনাদি যোগ করে তবে সেটাকে পরিতৃপ্তির সাথে আহার করি।তাতে পেটও ভরে স্বাস্থ্যও রক্ষা হয়।
একই ভাবে পথের একটা মেয়েকে দেখেই বিছানা খোঁজা পশুর কাজ!সেই মেয়েটাকে তার অভিভাবকের কাছ থেকে সসম্মানে এনে পবিত্র কলেমার উচ্চারণে তাকে নিজের করে নেবার পর নিজের সাধ্যমতো উপকরণ দিয়ে তাকে সাজিয়ে সংসার করি!
তাতে মনও ভরে বংশও রক্ষা পায়।
পথেঘাটের খোলা খাবার খেলে যেমন বিভিন্ন ভাইরাস এ্যাটাক করে তেমনি বিয়ে না করে খোলাবাজারে যে কোনো মেয়ের সাথে এ্যাফেয়ার করলেও শরীরে রোগ বাসা বাঁধে।
বাইরের কোন খাবার তা যতই দামী হোক না কেন, ঘরের যত্ন আর ভালোবাসা থাকেনা,ওগুলো পেট ভরায় ঠিকই কিন্তু জীবনটাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়!
আমি জানি,আমার অনাগত সন্তান আমার ভুলের ফসল কিন্তু আমি চাইনা আমার ভুলের কারনে আমার সন্তানের জীবন নষ্ট হোক তাই ঐ পবিত্র শব্দগুলোর আশ্রয় আমাকে নিতেই হলো।সবাইকে নিতে হয়।বিয়েটা নারী পুরুষের পবিত্র একটা বন্ধন।”
ফারিক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো-“একথাগুলো আমি আরো আগে কেন জানিনি রে…?তাহলে আমার জীবনটা এমন হতো না।অখাদ্য খেয়ে খেয়ে শরীরটা পচিয়ে ফেলেছি!এখন বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছি!”
প্রিয়ন্তী খুব অবাক হলো যখন অনুভব করলো ওর চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে ওর হাতের উপর পড়লো!
ফিসফিসিয়ে বললো-“আমার মধ্যে আবেগ জিনিসটা কম তবু কেন যেন মনে হচ্ছে নিজেকে তোর পাশে দেখতে পেলে ভালো লাগতো!”
-“কে জানে, তুই আসার আগেই…….!”
-“এমন হবেনা!আমি আল্লাহর কাছে দোয়া চাইবো,স্বামী হিসেবে একটি দিনের জন্যে হলেও যেন তোর মাথার কাছে বসতে পারি।জানিনা কেন যেন,যে আবেগ রাফিজের বেলাতে কাজ করেনি সেটা তোর বেলাতে কেন কাজ করছে!তোকে পাবার জন্য একটা বড় মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছি রে..!”
-“কি সেটা?”
-“আমার অনেক আগেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে এবরশন হয়ে যায়।আমি তোর সন্তানটাকে বাঁচাতে পারিনি!
ফারিক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো-
–“অসুখী বাবা মায়ের সন্তানরা ভালোভাবে বেড়ে ওঠেনা! এটাই আল্লাহর ইচ্ছা!কিন্তু এভাবে আমার জীবনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে কেন নিজেকে শেষ করে দিচ্ছিস?”
-“আমি জানি না,শুধু জানি তোকে না পেলে চলবেনা!”
ফারিক চুপ।
প্রিয়ন্তী মৃদু স্বরে বললো-
–“আজ তোর মতো আমারও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে জীবনের মূল্য আরো আগে কেন বুঝলাম না!আমি যে সত্যিই একজন সন্তানের মা হতে চাই!জানিনা পাবো কিনা।”
ফোনের দুপ্রান্তে দুজন নিঃস্ব মানুষের একরাশ বুকভরা হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলোনা!
****★****
পরদিন রাফিজ খুঁজে বের করলো সেই স্কুলটা।তারপর গাড়ী একপাশে পার্ক করে ভেতরে ঢুকতে গেলে দারোয়ান বাঁধা দিলো!
-“ভিতরে কই যাবেন?”
-“ইয়ে…মানে একটু কাজ ছিলো!”
-“কার কাছে যাবেন,কি কাজ,সব বলতে হবে নাইলে ভিতরে যাইতে দেবার নিয়ম নাই!”
রাফিজ দুহাত কোমড়ে রেখে ভাবলো,তাইতো।সে এখানে কার কাছে এসেছে? উম্মে রণ তো কারো নাম নয়।এটার অর্থ রণর আম্মু।সে রণর আম্মুকে কিভাবে চাইতে পারে?দারোয়ান একহাত কোমড়ে দিয়ে রাফিজের দিকে কটমটে চোখে তাকিয়ে আছে।রাফিজ কিছুটা বিব্রত বোধ করলো।দারোয়ান তাকে ছেলেধরাই না ভেবে বসে।রাফিজ ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বললো-“প্রিন্সিপ্যালের সাথে দেখা করবো!”
-“ও….তা আগে কইবেন তো।নতুন টিচার হিসেবে যোগ দিতে আসছেন?”
রাফিজ বিভ্রান্তের মতো উত্তর দিলো–“আ…হ্যাঁ..হ্যাঁ….!”
-“এই দিক দিয়া আসেন।”
অবশেষে দারোয়ান একজন বুয়াকে ডেকে রাফিজকে প্রিন্সিপ্যালের রুমে পাঠিয়ে দিলো।রাফিজ কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করছে।নাযিয়াতকে খোঁজার চক্করে ঘোরের মধ্যে এ পর্যন্ত তো এসে পড়েছে।এবার প্রিন্সিপ্যালকে কি বলবে ও।বলবে,আমার বউয়ের সাথে বিচ্ছেদের আগে কথা হয়েছিলো আমাদের অনাগত সন্তানের নাম রণ রাখবো। বউ হারিয়ে যাবার পর ফেসবুকে উম্মে রণ নামের একজনকে পেয়েছি যে আপনার বিদ্যালয়ের শিক্ষক!তাকে একটু ডাকেন চেক করে দেখি সে আমার হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী কিনা…?
এসব বলবে? প্রিন্সিপ্যাল তখন কি উত্তর দিবে রাফিজের জানা আছে।দু জায়গায় ফোন করবে, একটা থানাতে আরেকটা মেন্টাল হসপিটালে।
-“কি ব্যাপারে এসেছেন বলুন?”প্রিন্সিপ
্যালের ডাকে রাফিজের সম্বিত ফিরলো!
রাফিজ অবাক হয়ে দেখলো ও স্বাভাবিক ভাবেই বলতে পারছে-“আমি আপনার বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটা জেনেই এসেছি!”
-“অহ্,তাই নাকি।আসুন,বসুন।কোথায় পড়াশোনা করেছেন?”
রাফিজ সহজ সুরে কথা বলতে লাগলো।
প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম সব শুনে মাথা নাড়লেন!রাফিজের দিকে ভালো করে তাকালেন!রাফিজ হালকা কেশে নড়েচড়ে বসলো।ইস্,আরেকটু কমদামের একটা শার্ট পড়ে এলে ভালো হতো!
প্রিন্সিপ্যাল বললেন-
-“এতো ভালো কোয়ালিফিকেশন নিয়ে আপনি কিন্ডারগার্টেনে জব খুঁজছেন?আপনাকে তো অন্যরকম লাগছে!তাছাড়া আপনার বয়সটাও ঠিক সাপোর্ট করছেনা!আপনি এবাভ থার্টি হবেন, তাই না?তো অন্য কোথাও চাকরী না খুঁজে…….”
-“আসলে আমার এ মুহূর্তে এই চাকরীটার প্রয়োজন খুব বেশী!”
-“আচ্ছা…বাচ্চাদের সাথে বাচ্চাদের মতো মিশতে হবে কিন্তু,পারবেন ধৈর্য্য রাখতে?”
–“ইনশাআল্লাহ্!”
-“বেতন কিন্তু খুব কম।কিন্ডারগার্টেনে যেরকম হয় আরকি!”
–“না দিলেও চলবে!”মনে মনে এটা বললেও মুখে বললো-“এটুকুতেই চলবে!”
-“সাধারনত এই সেক্টরে আমরা আরো বাছাই করে লোক নেই,কিন্তু আমাদের দুজন টিচার অসুস্থ!আমার নিজেকে ক্লাস নিতে হচ্ছে।আপনি আপাতত সাব্সটিটিউট হিসেবে কাজ শুরু করুন, আপনার পারফরমেন্স দেখি তারপর আপনার ব্যপারে ভাববো।আর এই হিসেবে আপনি পার ক্লাস হিসেবে একটা অনারিয়াম পাবেন!
পার্মানেন্ট হলে স্যালারি এন্ড আদারস।ওকে?”
-“ইয়েস,থ্যাংকস আ লট!”
-“আজ ক্লাস নিতে পারবেন?”
-“আজ??জ্বী জ্বী…খুব পারবো।”
-“,আসুন,ক্লাস দেখিয়ে দিচ্ছি। আগামী কাল আপনার সার্টিফিকেটস গুলোর একটা করে কপি করে জমা দেবেন!”
-“জ্বী!”
লম্বা বারান্দাটা পেরিয়ে একটা ক্লাসে ঢুকলো রাফিজ।ওর মনে হলো একটা মাছের বাজারেও সম্ভবত এতো ক্রাউডি হয়না।বাচ্চারা বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে,নেচে গেয়ে হুড়োহুড়ি করে একাকার করেছে।প্রিন্সিপ্যালকে দেখে সবগুলো সোজা হয়ে দাঁড়ালো!প্রিন্সিপ্যাল কড়া কন্ঠে বললেন-
-“তোমাদের ক্লাস টিচার কে?”
-“নাযিয়াত মিস্…!”সমস্বরে বাচ্চারা চেঁচিয়ে জবাব দিলো।আর তা শুনে রাফিজের হ্রৎপিন্ড কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে গিয়েছিলো।ও ঠিক শুনছে তো?এই নাযিয়াত কি ওর নাযিয়াত?ওর রণর আম্মু?রাফিজের ভেতরে উথালপাথাল ঢেউ।নিজেকে সংযত রেখে নির্বিকারে দাঁড়িয়ে রইলো সে!
প্রিন্সিপ্যাল রাফিজের দিকে তাকিয়ে বললেন-“আপনি এই ক্লাসটা হ্যান্ডেল করুন।”
রাফিজ নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে উঠলো-“এই ক্লাসের মিস কি অসুস্থ?”
প্রিন্সিপ্যাল খানিকটা চমকে রাফিজের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন-“না না ওর বাচ্চাটা অসুস্থ।ও গতকালই আমাকে বলে ছুটি নিয়ে গেছে!”
-“ওহ্,আচ্ছা।”
“তো,ঠিক আছে,আপনি ক্লাস শেষে আমার রুমে দেখা করবেন!”
-“জ্বী!”
রাফিজ ক্লাসে ঢুকে প্রথমেই বাচ্চাদের সালাম দিলে বাচ্চারা সব চুপ হয়ে গেলো।রাফিজ হাসিমুখে বললো-“কই,সালামের জবাব দিন!”
বাচ্চারা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো-“ওয়াআলাইকুমুসসালাম…..বা
রাকাতুহ্!”
রাফিজের মুখে হাসি! নিজেকে নাযিয়াতের সাব্সটিটিউটর হিসেবে মন্দ লাগছেনা।
…….
চলবে…….

উত্তরাধিকার (পর্বঃ-১২)

0

উত্তরাধিকার (পর্বঃ-১২)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************
প্রান্তিকের মনে হচ্ছে এক লহমায় যেন জীবনটা কেমন বদলে গেলো!অনেক মানুষের ভীড়ে একটি অচেনা মুখ হঠাৎ করে বিশেষ হয়ে উঠলো!যাকে ভাবতে ভালো লাগে,যার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে,নিজের অনুভূতিগুলো ভাগাভাগি করতে মন চায়,তাকে দেখলে মনের ভেতরের সুপ্ত চাওয়াগুলো ডানা ঝাপটে বলে উঠে আমরা আছি…এতদিন ঘুমিয়ে ছিলাম,এখন জেগে উঠেছি।তখন সেই চাওয়াগুলোকে ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে সান্তনা দিয়ে বলতে হয়-‘একটুখানি সবুর করো রসুন বুনেছি!’
আর মাত্র দুদিন পরেই প্রান্তিকের ফ্লাইট।জান্নাতের সাথে দেখা করে বিদায় নিতে হবে।নাহ্,অফিসিয়াল দেখা না আনঅফিসিয়ালি!এই কোথাও একটু কফি খেতে খেতে নতুবা আইসক্রিমে দু একটা বাইট দিতে দিতে দুজনে একটু চটুল গল্প করা, চোখে চোখ রেখে বিরহ বেদনায় কাতর হওয়া আর পুনর্মিলনের স্বপ্ন দেখা।
কাজ করতে করতেই কীবোর্ডটা ঠেলে একটু ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে মোবাইলটা টেনে নিলো প্রান্তিক!
একটা বিশেষ নম্বর চাপলো!
কিছুদিন আগেও এই নম্বরটির কোনো অস্তিত্ব ওর মোবাইলে ছিলোনা আজ এটি ভিআইপির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে!
ওপাশ থেকে সালামের শব্দে হাসলো প্রান্তিক।
সহাস্যে সালামের উত্তর দিলো।
তারপর দুজনে বিভোর হলো কুহূ কূজনে!
প্রিয়ন্তী ঘরে ঢুকে হালকা কাশলো।প্রান্তিক কিছু একটা বলে ফোনটা কেটে দিলো।
প্রিয়ন্তী টিপ্পনী কাটলো-“বাব্বাহ,
দুদিনেই এতো প্রেম?এতো প্রেম কই ছিলো রে? যখন প্রথম দেখে এলি তখন তো খুব বুলি ঝাড়লি এরকম মুরীদ মার্কা ফ্যামিলি বিয়ে করবোনা…এই সেই!এখন কই গেলো দ্বীনদারী?”
-“খোঁচা দিচ্ছিস?দে!এটা বেশীরভাগ মেয়ের প্রধান অভ্যাস! কিন্তু তোর কথাগুলোর উত্তর আমি দিতে পারি।প্রথমতঃ প্রথম দেখায় মেয়েটা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না,ধরেই নিয়েছিলাম সি ইজ ওয়ান অফ দেম বাট সি ইজ নট সো!দ্বিতীয়তঃ আমার এক বন্ধুর সাথে সেদিন আলাপ করছিলাম! ও জানতো আমি বিয়ের জন্য দ্বীনদার পাত্রী খুঁজছি!আম্মু তো দ্বীনদারীর চেয়ে রূপসী আর মালদার খুঁজে বেশী।বন্ধু তখন পরামর্শ দিলো এই মেয়েটি যেহেতু দ্বীনদার।অন্তত ব্যাসিক দ্বীনদারীটা তো তার আছে যেমন নামাজ রোজা পর্দা ঈমান।বাকী যেটুকু নেই সেটুকু তুমি উত্তম নসীহতের মাধ্যমে আনতে পারবে ইনশাআল্লাহ্!ও একটা চমৎকার উদাহরন দিয়ে বুঝিয়ে দিলো।ও কি বলেছিলো জানিস?বললো-‘একটা চলন্ত গাড়ীর স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে তার দিক বদলানো যায় কিন্তু একটা থেমে থাকা নষ্ট গাড়ী কোনো দিকেই নেয়া যায়না বা চালানো যায়না।মেয়েটির মধ্যে আল্লাহর ভয় আছে, তাকে নসীহতের মাধ্যমে টার্ন করানো সম্ভব কিন্তু যে মেয়ের মধ্যে নামাজ রোজা পর্দার কোনো সেন্স নাই,আখেরাতের চিন্তা নাই তাকে কি দিয়ে ভয় দেখাবে?সে তো পুরো বসা গাড়ীর মতো বিকল।মেরামত করে চালানোর ঝুঁকি নেবার চেয়ে চলন্ত গাড়ী টার্ন করানোর ঝুঁকি তুলনামূলক সহজ ও সঠিক! তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম!”
প্রিয়ন্তী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“ভালোই তো, দুজনে চুটিয়ে প্রেম করছিস!পরশু চলে যাবি,দেখা করবিনা?”
-“আলবৎ দেখা করবো।আর ঐ যে বললি চুটিয়ে…ওসব চুটিয়ে ফুটিয়ে বুঝিনা। হালাল প্রেম করছি এটা জানি।সারা পৃথিবীতে এই একটি মেয়ে আল্লাহ আমার জন্য হালাল করেছেন।এর সাথে আমি ঘুরবো না তো কে ঘুরবে!”
-“খুব ভালো কথা।দুজনে মিলে প্রেমের রেকর্ড ব্রেক কর আমার কোনো আপত্তি নাই খালি হাত পা ভাঙ্গিস না!”
বলে প্রিয়ন্তী প্রান্তিকের মাথায় মৃদু চাঁটি মেরে চলে গেলো!প্রান্তিকের হঠাৎ মনে হলো,প্রিয়ন্তীর মেজাজ অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ বেশ ফুরফুরে,কারনটা কি!
রাফিজের সাথে ডিভোর্স হবার কোনো আক্ষেপই ওর মধ্যে নেই,এমনকি মা’কেও নরমাল দেখেছে।ব্যপারটা কি!
প্রান্তিক ওদের প্রশ্ন করেনি তবে বিষয়টা ওর চোখে ঠেকেছে।



প্রান্তিক চলে যাবার পরপরই শাজিয়া ক্যানবেরাতে যোগাযোগ করলো।প্রিয়ন্তীর বড়মামা শওকত জানালেন,আজ রাতেই সব ব্যবস্থা করে ওদের বিয়েটা পড়িয়ে দিতে চান তিনি।স্থির হলো,রাত আটটার দিকে স্কাইপের মাধ্যমে বিয়েটা পড়ানো হবে।
বড়মামা হালকা গলায় জানালেন, ফ্রিক সামান্য অসুস্থ বিধায় সে বসে থাকতে পারবেনা!শুনে শাজিয়া কিছুটা অবাক হয় বললেন,'”কি হয়েছে ওর?”
ফ্রিকের মা জানালেন-“নাথিং সিরিয়াস!সামান্য ফ্লু মতো হয়েছে!ডাক্তার দেখানো হয়েছে।”
মায়ের মন,সন্দেহ তবু গেলোনা।সন্দেহটা কাঁটার মতো বিঁধে রইলো।তবু মেয়ের দিক ভেবে খুব বেশী কিছু বললেন না।
প্রিয়ন্তী বউ সাজতে রাজী হলোনা।কেবল স্কার্ট টপস বদলে একটা শাড়ী পড়লো।
বিয়ের কিছুক্ষণ আগে ও মামীকে জানালো সে একটু ফ্রিকের সাথে কথা বলতে চায়।মামী আঁইগুঁই করছিলেন পরে ফ্রিক নিজেই ফোন চেয়ে নিলো।ফ্রিকের মা ইঙ্গিতে ছেলেকে নিষেধ করলেন তার অসুখের ব্যপারে অতিরিক্ত কোনো কথা না বলতে!ফ্রিক শুকনো মুখে হেসে ফোনটা কানে ঠেকালো।রিসিভার কানে চেপে ধরতেও অসুবিধা হয়।চাপ লাগলে ব্যথাবোধ হয় ওর।দিনকে দিন ওর র্যাশগুলো ঘা তে রূপ নিচ্ছে।ডাক্তাররা কেউই তেমন কোনো প্রতিকার দিতে পারছে না!
প্রিয়ন্তী জানতে চাইলো-“হঠাৎ বিয়েতে রাজী হলো কেন?”
ফ্রিক জানালো সে এখনো বিয়েতে রাজী না কারন তাতে প্রিয়ন্তীকে ঠকানো হবে!”
প্রিয়ন্তীর কপালে ভাঁজ পড়লো-“ঠকানো হবে মানে?”
ফ্রিক অকম্পিত স্বরে বললো-“জীবনে এ পর্যন্ত কেবল খারাপ কাজগুলোই করে এসেছি।তার পাপে ধরেছে আমাকে।এ জীবনে নারীকে শুধু ভোগ্যবস্তু হিসেবেই দেখে এসেছি।আজ একজন নারীর জীবনকে নষ্ট হতে দেয়া থেকে বাঁচাতে চাই!খুব সামান্য প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই!”
প্রিয়ন্তী বিভ্রান্ত বোধ করছে-“তুই এসব আবোল তাবোল কি বকছিস?”
-“বকছি না,সত্য বলছি।আমাকে মরণ রোগে ধরেছে রে প্রিয়।তুই এ বিয়েতে রাজী হোসনা।বাবা-মা তাদের উত্তরাধিকারীর আশায় আমাকে তোর সাথে বিয়ে দিয়ে আমাদের সন্তানকে বৈধ বানাবার চেষ্টা করছে।”
এতটুকু বলেই ফারিক হাঁপিয়ে উঠেছে।
প্রিয়ন্তী স্থানুর মতো ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে।ফারিক ফোন ছেড়ে দিয়েছে।প্রিয়ন্তীকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে শাজিয়া জিজ্ঞেস করলেন-“কি রে,কি হয়েছে তোর?”
প্রিয়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“কিছু না মা!কাজী সাহেব কখন আসবে?”
-“তোর বাবার ফোন দেবার পরপরই তো উনি চলে এসেছেন!ফারিকের সাথে কথা হলো?”
প্রিয়ন্তী মাথা নাড়লো!
-“কি বললো ও?সব ঠিক আছে তো?”
-“হ্যাঁ,সব ঠিকআছে।আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত মা।তোমরা ব্যবস্থা করো!”
দ্বিধান্বিত শাজিয়া মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করলেন তারপর চলে গেলেন।
প্রিয়ন্তী চুপচাপ বসে ভাবছে।
তার আচমকা গর্ভপাতের খবর ফারিক জানলে হয়তো বিয়ে করতে রাজী হবেনা।
কিন্তু প্রিয়ন্তী যে ওকে ভালোবেসে ফেলেছে।
অবশেষে গুটি কয়েকজনের উপস্থিতিতে প্রিয়ন্তী আর ফারিকের বিয়েটা অনলাইনে হয়ে গেলো!
সিদ্ধান্ত হলো আগামী মাসে প্রথম সপ্তাহেই প্রিয়ন্তী অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে।
মেয়ের সিদ্ধান্তের কাছে শাজিয়াকে হার মানতেই হলো!



ঢাকায় আসার পর থেকে বোনেরাই নাযিয়াতের দেখাশোনা করতে লাগলো!নাযিয়াতের শরীরটা এখন আগের চেয়ে অনেকটা ভারী হয়েছে। সে এখন ধীরে সুস্থে চলাফেরা করে। বাইরে একদমই যায়না।বোনেরা কেউই ওকে যেতে দেয়না!
ওরা প্রত্যেকেই টিউশনি করে সংসারটাকে কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছে!
দেশ থেকে কিছু চালডাল আসে আর বাকীটা ওরা চালাচ্ছে।নাযিয়াতের খুব খারাপ লাগে ও কিছু করতে পারছেনা।
তবু ও বসে নেই,হাতের কিছু কাজ জানতো।এই পরিসরে সেটাই করতে লাগলো।কলেজে থাকতে চমৎকার ওয়ালম্যাট বানিয়ে ফার্ষ্ট প্রাইজ জিতেছিলো।এবারও নাদিয়াকে বলে কিছু র’ম্যাটেরিয়াল আনিয়ে চার পাঁচটা ওয়াল ম্যাট বানিয়ে ফেললো নাযিয়াত।
নাদিয়া তো সেসব দেখে যারপরনাই মুগ্ধ।সে চট করে সেগুলো মোটামুটি একটা দাম ধরে অনলাইনে দিয়ে দিলো।অবাক হলেও সত্য যে,কয়েকদিনের মধ্যেই ওয়াল ম্যাট গুলো বিক্রি হয়ে গেলো।নাযিয়াত তো বেশ অবাক,শখের বশে বানিয়েছে সেটা যে এতো ভালো রেসপন্স করবে ও ভাবেনি!
নাদিয়ার পরামর্শে আবারও কিছু বানাবার চিন্তা করলো।তবে এবার আরো সুচিন্তিত ভাবে ডিজাইনগুলো সেট করলো।এগুলোও চড়া দামে বিক্রি হয়ে গেলো!
নাযিয়াত ভেবে অবাক হলো,এখন তো দেখি ঘরে বসেই আয় করার অনেক পথ হয়েছে!
দেখতে দেখতে নাযিয়াতের ডিলেভ্রী ডেট চলে আসলো।নাযিয়াতের মনে আনন্দ,উদ্বেগ, হতাশা আর দুশ্চিন্তার এক অদ্ভুত মিশেল।তবু রবের দয়া আর রহমতে নাযিয়াত নরম্যালি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলো।
বেলা চৌধুরীর অতি কাঙ্খিত উত্তরাধিকারী “রণ”!
ওর বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়ায় জাগতিক কৌতুহলে ভরপুর।নানু আর খালামনিদের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠতে লাগলো “রণ”!
সে এখন নানুর চোখের মনি,খালামনিদের হিরার খণি আর মায়ের চোখের পানি।
কারন ওকে দেখলেই নাযিয়াতের রাফিজের কথা মনে পড়ে।রণ’র থুতনীতে একটা খাঁজ আছে যা হুবহু রাফিজের মতো!গম্ভীর হয়ে যখন বসে থাকে দেখে মনে হয় রাফিজের ছোট্ট জেরক্স কপি বসে আছে।
ওকে নিয়েই নাযিয়াত সব দুঃখ ভুলে যেতে চায় তবু নির্জন মুহূর্তগুলোতে রাফিজ যখন স্মৃতি হয়ে হানা দেয় তখন নিজেকে ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে নাযিয়াতের!
‘রণ’কে দেখে রাখা নিয়ে এখন কোনো সমস্যাই হয়না।তাই নাযিয়াত এবার বাইরে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলো।নাদিয়ার স্বামী রিফাতকে আগে থেকেই বলে রাখা হয়েছিলো।সে একটা কিন্ডারগার্টেনে নাযিয়াতের চাকরীর ব্যবস্থা করলো।সেখানে চাকরীর সুবাদে ভালো কিছু টিউশনিও পেয়ে গেলো সে।
আধাবেলা স্কুল আর সন্ধ্যের পর টিউশণি এ দুইয়ের মাঝখানে বিকেলটা অলস লাগে নাযিয়াতের! ‘রন’ তো বেশীরভাগ সময় নানী আর খালাদের কাছেই থাকে।কেবল রাতে ঘুমুবার সময় তার মা’কে চাই!
স্কুলের ছোট বাচ্চাদের নিয়ে সময়টা বেশ কেটে যায় নাযিয়াতের।আয় কিছুটা বাড়ায় হাত খোলাসা হয়েছে ওর! নাযিয়াত আগে কখনো মোবাইলের ব্যবহার করেনি ।এর ওর মোবাইল থেকেই কথা বলতো।
এবার ওয়ালম্যাট বিক্রির সুবাদে নাদিয়া,নাঈমা ওরা একরকম জোর করেই একটা নতুন এন্ড্রয়েড কিনে দিয়েছে নাযিয়াতকে।ওকে আইডি খুলে তা চালাতে শিখিয়ে দিয়েছে।এখনও মাঝে মধ্যে ওর হস্তশিল্পের জিনিসগুলো প্রায়ই অনলাইনে এড দিয়ে দিলে আগ্রহী ক্রেতারা রিপ্লাই দেয়!
নাযিয়াতের আইডির নাম দিয়েছে “উম্মুল রণ”
এবং সেটাকে ওনলি সিষ্টার্স করে রেখেছে।
কিছুদিন পরেই একটা মেল আইডি থেকে ওর কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট আসলো।নাযিয়াত সেটা ডিলিট করে দিলো।নাযিয়াত নিজের কিংবা বাচ্চার কোনো ছবি ফেবু’তে দেয়নি, কেবল ওর স্কুলের নাম দিয়ে নিজের আইডেনটিটিতে এসিসট্যান্ট টিচারের পদবীটা উল্লেখ করেছে।


রাফিজ এখন একটা জীবন্ত রোবটে পরিণত হয়েছে।সারাদিন নিজেকে কাজে ডুবিয়ে রাখে আর গভীর রাত হলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারাগুলোর দিকে চেয়ে থাকে আর মনে মনে ফিসফিসিয়ে বলে-“নাযিয়াত, তুমি কোথায় আছো,কেমন আছো সোনা?”
তারপর ক্লান্ত হয়ে পড়লে বিছানায় আসে তার আগে না!মাঝেমধ্যে মোবাইলটা খুলে একটু ফেসবুক ঘাটাঘাটি করে।
রাফিজ একসময় নাযিয়াতকে খুব করে বলেছিলো একটা মোবাইল সাথে রাখো,কত কাজে লাগে।একটা সেটও দিয়েছিলো।যাবার সময় সব কিছু রেখে গেছে সে।
অভ্যেসবশতঃ মোবাইলটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ফেসবুক ঘাটলো।বন্ধ করতে যাবার মুহূর্তে হঠাৎ একটা নামের উপর চোখ আটকে গেলো রাফিজের।সে কি ভেবে ঐ আইডি টাতে গেলো কিন্তু দেখলো শুধু কিছু ওয়ালমেটের ছবি ছাড়া আর তেমন কিছু নেই।রাফিজ আঁতিপাতি করে আইডিটা ঘুরে এলো।সন্দেহ করার মতো কিছুই পেলোনা।
তবু সিদ্ধান্ত নিলো, ঐ কিন্ডারগার্টেনে যাবে ও!ব্যাপারটা কি জানতে হবে।
এই আইডির মহিলাটি কোন্ “রণ’র আম্মু? ”
……
চলবে…..

উত্তরাধিকার (পর্বঃ-১১)

0

উত্তরাধিকার (পর্বঃ-১১)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************
প্রান্তিক কম্পিউটারে কাজ করছিলো!
প্রিয়ন্তী এসে অদুরেই একটা সোফাতে বসলো!প্রান্তিক না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছে প্রিয়ন্তী কোনো প্রশ্ন করতে চায় ওকে!হয়তো ভাবছে করা ঠিক হবে কিনা।মেয়েলী কৌতুহল ছাড়া আর কি হতে পারে!প্রান্তিক নির্বিকারে টকটক শব্দে কিবোর্ডে ঝড় তুলে চললো!
প্রিয়ন্তী বললো-“বিয়ে করতে রাজী হয়েছিস শুনলাম?”
প্রান্তিক হাতের কাজটা শেষ করলো প্রথমে। তারপর রিভলবিং চেয়ারটা ক্যাঁচ শব্দ তুলে বোনের দিকে ঘুরালো।
নিঃশব্দ মাপা মুচকি হাসিতে বললো-“হমম,ঠিক শুনেছিস।”
-“হঠাৎ,এই সিদ্ধান্ত?”
প্রান্তিক দু একটা কাশি দিয়ে বললো-
-“সাধারনতঃ যে কোনো সিদ্ধান্ত হঠাৎই নেয়া হয়!আমিও নিয়েছি!”
-“হমম….আমি ভাবলাম মেয়েটা আবার তোকে ফোন করে পটালো টটালো কিনা!”
-“খুবই উর্বর মস্তিষ্ক সন্দেহ নেই! তা…সে পটালেই আমি পটে যাবো এটা কেন মনে হলো?”
-“না,জাষ্ট কিউরিসিটি থেকে বললাম!”
-“কিউরিসিটি ইজ প্রহিবিটেড ইন ইসলাম।কুরআনে ষ্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আছে,সুরা হুজুরতের ১২নম্বর আয়াতে- “তোমরা ধারনা করা থেকে বেঁচে থাকো,কোনো কোনো ধারনা পাপ” এটা আয়াতাংশ।মুল আয়াতটা আরো লম্বা!তাছাড়া সিহাহ সিত্তাহর প্রায় সবক’টি হাদীসে “ধারনা” না করার ব্যপারে কঠিন আদেশ এসেছে।”
-“উফ্,এই এক তুই আর নাযিয়াত কথায় কথায় এটা ভালোনা…ওটা হারাম, কুরানে আছে হাদীসে আছে!এতো রেষ্ট্রিকশন মেনে কি চলা যায়?”
-“যায় না মানে?আমরা সবাই কোনো না কোনো রেষ্ট্রিকশন মেনেই তো চলি!তুই সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমুতে যাবার আগ পর্যন্ত প্রত্যেকটা কাজই কোনো না কোনভাবে করিস।সেই কাজগুলোই যদি সুন্নত সম্মত ভাবে করা যায় তাহলে দুটো লাভ!এক.আমরা উপকৃত হবো!দুই,ইবাদতের সাওয়াব পাবো।যেমন ধর্,তুই সকালে উঠে কি করিস?দাঁত ব্রাশ বাথরুম ইত্যাদি। সেটাই যদি সুন্নতসম্মত ভাবে করিস যেমন ঘুম থেকে উঠে প্রথমে কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে নেয়া,তারপর মিসওয়াক করে অযু করা!বাথরুমে গেলে বাম পা আগে প্রবেশ করা,আরো অনেক কিছু আছে যার প্রত্যেকটা কাজ বিজ্ঞানসম্মত ও স্বাস্থ্যকর!”
-“হমম…বুঝেছি!”বলে প্রিয়ন্তী দাঁড়িয়ে গেলো!
-“চলে যাচ্ছিস?”প্রান্তিক জিজ্ঞেস করলো!
-“হ্যাঁ,লেকচার শুনতে ভাল্লাগছেনা!”
-“কেউ নিজেকে ভালো কিছু থেকে বঞ্চিত করতে চাইলে কার কি করার আছে!একটা কথার জবাব দিয়ে যা..!”
-“কি কথা?”
-“রাফিজ হঠাৎ ডিভোর্স লেটার পাঠালো কেন?”
-“কেন আবার নতুন বৌ পেয়ে মজেছে।হুকুমের বাঁদী পেলে স্বাধীনচেতা নারী কে চায়!”
প্রান্তিক প্রিয়ন্তীর দিকে তাকালো-
-“কেন যেন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা এতো সহজ না!দেয়ার ইজ সামথিং রং!তুই কি আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছিস?”
প্রিয়ন্তী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললো–
-“গুড নাইট!”
প্রান্তিক সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে মুচকি হেসে কাজে মন দিলো!



নাযিয়াত চিঠিটা লেখার সময় খুব যত্ন করে লিখেছে।সে বিশ্বাসে “বি”টা মোটা করে লিখেছে,পুরোটার “পু” মোটা করেছে এভাবে,ক্রমান্বয়ের “ক্র”,আমার এর “ম”আর আপনার এর “র” টা অনেকটা পুরু করে বেশ মোটা করে লিখেছে।একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়!নাযিয়াতের বুদ্ধির তারিফ করে মনে মনে হাসলো রাফিজ।
মোটা শব্দগুলো এক করলে দাঁড়ায় “বি,পু,ক্র,ম,র!
এটাকে সাজালে হয় বিক্রমপুর!
বিয়ের কিছুদিন পর একরাতে গল্প করতে গিয়ে নাযিয়াত তার নানাবাড়ীর অনেক সুন্দর সুন্দর ঘটনা রাফিজকে শুনিয়েছিলো!
বিক্রমপুরের বাড়ৈগাঁও নাযিয়াতের নানাবাড়ী।
নাযিয়াতের শৈশব নাকি ওখানেই কেটেছে।সেখানকার অনেক গল্পও করেছে নাযিয়াত।সেকারনেই বিক্রমপুর পড়েই রাফিজ চট করে বুঝে ফেলে।
ও সিদ্ধান্ত নিলো কালই বিক্রমপুর বাড়ৈগাঁও যাবে!



নাযিয়াতের নানা নানু কেউই বেঁচে নেই।নাযিয়াতের ছোট মামা তার পরিবার নিয়ে এখানে থাকেন।নাযিয়াতের নানার এক ভাই বেঁচে আছেন।
পাশেই তার ভিটাবড়ী।
তার খেতও নাযিয়াতের নানার খেতের সাথে লাগোয়া!সেই খেতের আইল নিয়ে কিছুদিন আগেও বিরাট ঝগড়া একেবারে কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে।
এদিকে ছোট মামার অংশের জমিতে ধান পেকে গেছে কিন্তু সেই নানার ছেলেরা এই জমির উপর ইনজাংকশন জারী করায় মামা ধান কাটতে পারছেন না।
দুদিন আগেও ছোটখাটো একটা হাতাহাতি হয়ে গেছে।এরই মধ্যে কে বা কারা এসে ঐ বাড়ীর গোলাঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।ওরা আবার পাল্টা কাউন্টার কেস করেছে।
এই বিশাল হুলুস্থুল দেখে নাযিয়াতের মা মেয়েদের নিয়ে ওখানে থাকার সাহস করছেন না।
কখন কে কি অঘটন করে বসে কে জানে!
নাযিয়াতের ছোটমামাও বউ ছেলেমেয়েকে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছে।কেস শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওদের ওখানেই রাখবে।
নাদিয়া মা’কে বললো-“চলো মা ঢাকায় চলে যাই,রিফাতকে বাসা ভাড়া করতে বলে দিয়েছি! ঐ এলাকাতেই যাবোনা নইলে বড়’পুর দজ্জাল শ্বাশুড়ী ঠিক আমাদের খুঁজে বের করে ফেলবে।তারপর বড়াপুকে ডিভোর্স দেয়াবে!”
নাযিয়াত কাছে বসেই শুনছিলো কথাগুলো–“আমার এই অবস্থায় তো সে ডিভোর্স দিতে পারবেনা!”
-“বড়লোকেরা সব পারে,তোমার বাবু হলে বাবুটা নিয়ে নিবে আর তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে।বেলা চৌধুরীরা সব পারে।”
-“কিন্তু রাফিজ যদি এখানে আমাকে খুঁজতে আসে তো?”
-“এখনো এই আশা করো?আমরা গ্রামে এসেছি এক মাস হতে চললো, তোমার জামাই ওর সময় হলোনা এই এক মাসে তোমাকে খুঁজে দেখার?”
-“ওখানে কি হচ্ছে তা তো আমরা জানিনা!ওকে দোষ দেবার আগে সত্যটা তো জানতে হবে!”
-“যত যা’ই বলো বড়াপু।তোমার ঐ বেলা চৌধুরীর কাছ থেকে দুরে থাকা উচিত।সে হাতপা ধরে তোমাকে বিয়ে করালো, এখন প্রয়োজন ফুরিয়েছে তো এখন আর তোমাকে লাগবেনা তার!”
নাযিয়াত নিরব হয়ে গেলো।
তার পরের দিন রিফাত ফোন করে জানালো ঢাকার শ্যাওড়াপাড়াতে একটা বাসা ঠিক করা হয়েছে।
নাদিয়ারা যেন সব গুছিয়ে তৈরী থাকে।সে বিকেলেই ওদের নিতে আসবে।
রিফাতের কথামতো ওরা দুপুরের খাবার খেয়েই সব গুছিয়ে তৈরী হয়ে গেল।
তিনটার দিকে রিফাত ক্যাব নিয়ে হাজির।নাদিয়া এটা নিয়েও কিছুক্ষণ চেঁচালো!
-“এতো খরচ করে ক্যাব আনতে কে বলেছে তোমাকে?ক্যাবের ভাড়া কত বেশী!
রিফাত বললো-“আমি বড়াপুর কথা ভেবেই ক্যাব নিয়েছি কারন তার জার্নিটা সহজ এবং আরামদায়ক হওয়া উচিত!”
নাযিয়াত মনে মনে কৃতজ্ঞ হলো ওর উপর। সত্যিই এই অবস্থায় জার্নিটা এভয়েড করতে পারলেই ভালো!কিন্তু এদিকের যা পরিস্থিতি তাদের ঢাকা না গিয়েও উপায় নেই!
অবশেষে বেলা সাড়ে তিনটা নাগাদ নাযিয়াতদের পুরো পরিবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো!ছোট মামা ওদের মালপত্র সহ গাড়ীতে তুলে দিলেন।
ওরা চলে যাবার পরপরই খবর পেলেন কারা যেন আজ রাতেই তার পাকা ধান কাটার ফন্দী করছে!শুনে ছোটমামা দ্রুত থানায় ছুটলেন।
তারই ঠিক দশ মিনিটের মাথায় রাফিজের গাড়ী বাড়ীটির সদর দরজায় থামলো।
রাফিজ আর বেলা চৌধুরী নেমে এলেন!আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে আসতে আসতে তাদের এতটা দেরী হয়েছে।
কিন্তু এসে কাউকেই দেখতে পেলেন না।
আশে পাশের কেউ তেমন কিছু বলতে পারলোনা।
রাফিজ বেরিয়ে কাছেই একটা চায়ের ছাপড়া পর্যন্ত ঘুরে এলো!সেই দোকানদার জানালো, এই বাড়ী নিয়ে মামলা মোকদ্দমা চলছে তাই এখানে কেউ থাকেনা।কোথায় থাকে জিজ্ঞেস করলে সে কোনো সদুত্তর দিতে পারলোনা!”
ঘন্টাদেড়েক ঘোরাঘুরি করে অবশেষে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে রাফিজকে বাড়ী ফিরতে হলো!
বেলা চৌধুরীর নিজেরও মনটা খারাপ হয়ে গেলো।না জানি তার পাপের শাস্তি হিসেবে তাকে আরো কি কি ভোগ করতে হয়।নিজের ভুলে আজ নিজের পরম চাওয়া নিজ উত্তরাধিকারটিকে হারাতে হলো!কে জানে ওরা কোথায় আছে, কেমন আছে।
তার দুদিন পরে রাফিজ আবার নাযিয়াতদের ঢাকার পুরোনো বাসায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসলো। সেখানে অন্য একটি পরিবার উঠেছে দেখে ফিরে আসলো।
রাফিজের বুকটা ফাঁকা হয়ে গেলো।
তাহলে কি সে নাযিয়াতকে চিরদিনের জন্য হারিয়েই ফেললো?



ফ্রিকের বেশিদিন একজনের সাথে ভালো লাগেনা।নিত্য নতুন বান্ধবী না হলে সময়টা ঠিক যেন জমেনা ওর কাছে।
গত দুদিন ধরে “লারা” নামের এক মেয়ের পরিচয় হয়েছে।ফ্রিকের মনে হচ্ছে “লারা”র জন্মই হয়েছে ওকে শরীরে মনে ভালোবাসা শেখাবার জন্য।লারা খুবই বুদ্ধিমতী এবং চৌকস মেয়ে।
ফ্রিক আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে লারাকে সাথে নিয়ে একটা প্লেজার ট্রিপে যাবে!
এদিকে বাসায় বাবা ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছেন ওকে বিয়ে করে থিতু হতে।ফ্রিক তাদের বলে বোঝাতে পারছেনা যে থিতু হওয়া ফ্রিকের ধাতে নেই!সে তার যৌবনটাকে পুরোপুরি উপোভোগ করতে চায়।
তাই এবার বাসায় না জানিয়েই লারাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।পরে এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করে দিলেই হবে।
এয়ার পোর্ট আসার পর থেকেই ফ্রিকের গা টা কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করতে লাগলো।
প্রথমটায় সে পাত্তা দিলোনা।
প্রচন্ড মাথা ব্যথায় বেশী খারাপ লাগায় পথে দুটা পেইনকিলার খেয়ে নিলো। পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই ফ্রিকের ঝাপিয়ে জ্বর এলো সেই সাথে সারা গায়ে লাল লাল র্যাশ বেরুলো।
লারা এসব দেখেই ইয়াক ইয়াক করে বিদায় নিয়েছে।ফ্রিক কোনোমতে ট্যাক্সি ধরে একটা হোটেলে উঠলো।সেখানে পৌঁছেই জানতে পারলো যে ‘লারা’ যাবার সময় ওর যাবতীয় টাকা পয়সা, ক্রেডিট কার্ড সব সাথে করে নিয়ে গেছে।ফ্রিক বেলবয়ের সাহায্যে বাবার কাছে ফোন করে নিজের দুরবস্থার কথা জানালে তিনি ছেলেকে রেসকিউ করার ব্যবস্থা করলেন!
বাড়ী ফিরেও ফ্রিকের জ্বর তেমন কমেনি,গায়ে র্যাশের পরিমানও বেড়েছে।
ডাক্তার জানালেন,ফ্রিক অন্য কারো শরীর থেকে প্রাপ্ত এক ধরনের জীবাণু বহন করছে।এটা ধীরে ধীরে আরো মারাত্মক রূপ নিতে পারে। ওকে হসপিটালাইজড করার পরামর্শও দিলেন ডাক্তার!
ফ্রিকের বাবা মায়ের দিশেহারা অবস্থা।ছেলের উচ্ছৃংখলতাকে বাধা দিতে না পারার পরিণতি এখন তাদের সামনে!
ফ্রিকের মা স্বামীকে বুদ্ধি দিলেন।
ফ্রিকের যা অবস্থা!
প্রিয়ন্তীর সাথে ওর বিয়েটা তাড়াতাড়ি করিয়ে না দিলে তাদের উত্তরাধিকারীটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে।কে জানে প্রিয়ন্তী এরই মধ্যে এবরশন করিয়ে ফেলেছে কিনা!
ফ্রিকের বাবা স্ত্রী’র মনের ইচ্ছা বুঝতে পেরে অতিসত্বর শাজিয়ার সাথে যোগাযোগ করলেন।
শাজিয়া কিছুটা দোটানায় পড়লেন যখন শুনলেন যে,টেলিফোনেই বিয়ে করিয়ে দিতে চান বড় ভাই।
পরে ধীরে সুস্থে প্রিয়ন্তী অস্ট্রেলিয়া আসুক,সমস্যা নেই! কিন্তু ওদের সম্পর্কটা একটা পরিণতি পাক।
প্রিয়ন্তীর গর্ভপাতের কথা তাদের জানানো হয়নি!তারা হয়তো উত্তরাধিকার আশা করছেন!
শাজিয়া ফোন রেখেই প্রিয়ন্তীকে সবকথা জানালেন।প্রিয়ন্তী মনের উচ্ছাস চাপতে দুহাতে মুখ ঢাকলো!
শাজিয়া বুঝতে পারছেন না,কি কেবেন,কি করা উচিত।
এদিকে প্রান্তিক বিয়ে করে সামনের সপ্তাহেই চলে যাচ্ছে!এবার ও আর অষ্ট্রেলিয়া যাবেনা,মালয়েশিয়ার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন্ট করবে।কাগজ পত্রও ইতোমধ্যেই হাতে পেয়ে গেছে।কিছুদিন পর দেশে ফিরে বউকেও সেখানে নিয়ে যাবে।
শাজিয়া বড়ভাইকে সবকথা জানিয়ে বললেন প্রান্তিকের বিয়েটা হয়ে গেলে ও বাইরে চলে গেলেই তিনি প্রিয়ন্তীর বিয়েটা করিয়ে দেবেন।প্রান্তিককে এক্ষুণি এসব জানাতে চাচ্ছেন না তিনি তাতে ঝামেলা বেড়ে যাবে।
অগত্যা শওকত চৌধুরী তাই মেনে নিলেন।


আজ প্রান্তিকের বিয়ে!
খুব অনাড়ম্বরে একেবারে ঘরোয়া আয়োজনে প্রান্তিকের আকদটা সম্পন্ন হয়ে গেলো!
প্রান্তিক আগামী সপ্তাহে মালয়েশিয়া চলে যাবে।দুমাস পর এসে বউকে একেবারে তুলে নিয়ে যাবে!
বরযাত্রী বিদায় নেবার আগে বর কনে একটি ঘরে মুখোমুখি হলো!
প্রান্তিকই প্রথমে সালাম দিয়ে নববধূকে অভ্যর্থনা জানালো!
নববধূ লজ্জায় গলে গিয়ে সালামের উত্তর দিলো।
প্রান্তিক কিছুক্ষণ ওর দিকে চেয়ে থেকে বললো-
–“কেমন আছেন?”
প্রান্তিকের গভীর চাহনী, ওর মুখের আপনি সম্বোধন জান্নাতকে বিহ্বল করে তুললো যেন।
সে মুখ নামিয়ে বললো-“আলহামদুলিল্লাহ্!”
প্রান্তিক হেসে বললো-“ভাবছি এলিফ্যান্ট রোডের সব দোকানদারকে আমাদের ফাংশানে দাওয়াত করবো!এমন সুন্দর করে আমাদের মিলটা করিয়ে দেবার জন্য,কি বলো?”
জান্নাত লজ্জায় লাল হয়ে বললো-“আপনি আমাকে নিশ্চয়ই বেহায়া ভাবছেন?”
প্রান্তিক সিরিয়াস কন্ঠে বললো-“হমম,ভেবেই তো বিয়ে করতে চাইলাম।”
জান্নাত চোখ তুলে তাকালো!
প্রান্তিকের মনে হলো ওর সামনে পৃথিবীর সবচে সুন্দর মেয়েটি বসে আছে।
…..
চলবে……

উত্তরাধিকার (১০ম পর্ব)

0

উত্তরাধিকার (১০ম পর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************
বেলা হতভম্ব অবস্থায় ঘরে প্রবেশ করলেন।
রাফিজ মায়ের দিকে তাকিয়ে স্থির কন্ঠে বললো-“এই সন্তান আমার নয় মা !”
বেলার মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠলো যেন।
তিনি দ্রুত পাশের সোফাটায় বসে পড়ে প্রিয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বললেন-“এসব কি হচ্ছে……? প্রিয়ন্তী?”
প্রিয়ন্তী কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে এবার মাথা তুলে দৃঢ় কন্ঠে বললো-“হ্যাঁ,যা শুনছেন তা সত্যি.এ সন্তান আপনার ছেলের নয়।বরং সত্য তো এই, আমার এই ভুলের মাধ্যমে আপনার ছেলের আসল রূপটা সামনে এসে গেলো!”
বেলা মেজাজী স্বরে বললেন-“মানে? কি বলতে চাও তুমি?”
-“কি বলবো?আপনার ছেলে সন্তান উৎপাদনে অক্ষম,বাঁজা পুরুষ…এটাই বলতে চাই!”
রাফিজ দুহাত পকেটে পুরে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলো ওদের।
এবার প্রিয়ন্তীর কথা শুনে মুচকি হেসে বললো-“আমার আসল রূপ উদঘাটনের পদ্ধতিটা মন্দ নয়!মুশকিল হলো আমার আসল রূপ বের করতে তোমাকে নিজের আসল রূপটা কাজে লাগাতে হয়েছে।আফসোস..!
যদি সত্যিই আমি সন্তান দানে অক্ষম হয়ে থাকি তবে সেটা সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছা যা মেনে নিতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই কিন্তু তুমি যেটা করেছো সেটা অত্যন্ত জঘন্যতম নোংরামীতে ভরা একটি ব্যাভিচার,অত্যন্ত নেক্কারজনক একটি কাজ!ইসলামের শাস্তির বিধান অনুযায়ী তোমার “রজম”‘এর দন্ড হয়ে যেতো কিন্তু তা না হওয়ায় আজ তোমার মতো কতশত মহিলা তার স্বামীর ছত্রছায়ায় এই গুনাহ করে বেড়াচ্ছে সেটা আল্লাহ্ মালুম।এর জাহান্নামের শাস্তি যদি তারা জানতো তাহলে ভুল করে হলেও এ পথে এগোতো না!কোন সাহসে তুমি পরের বোঝা আমার ঘাড়ে চাপাবার সাহস করেছো?এটা কত বড় পাপ সে সম্পর্কে তোমার কি বিন্দুমাত্র ধারনা নেই!ছিহ্…!”
বলে রাফিজ বেরিয়ে গেলো!
প্রিয়ন্তী হাতের ম্যাগাজিনটা ছুঁড়ে ফেলে বললো-“আমি বাড়ী যেতে চাই!এই পরিবেশে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে!”
বেলা ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন।তার চোখ দুটোতে যেন আগুন জ্বলছে।ধীরে এগিয়ে এসে পটকা ফাটার শব্দে প্রিয়ন্তীর গালে চড় কষালেন তিনি।প্রিয়ন্তী গালে হাত দিয়ে কেঁদে উঠলো-“আপনি,আমার গায়ে হাত তুললেন?আমার মা কখনো আমাকে মারেনি!”
-“তুলেছি,বেশ করেছি!তোমাকে তো স্যান্ডেল পেটা করা উচিত,নষ্টা মেয়েমানুষ।তোমার মা তোমাকে ঠিক সময় মতো মারলে আজকে এই রূপ দেখতে হতোনা!হায় হায়…তোমার জন্য আমি আমার পূতপবিত্র বউমাটাকে ঘর ছাড়া করেছি!হায় আল্লাহ্,এ আমি কি করলাম?”
বেলা সংযম হারিয়ে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন।
প্রিয়ন্তী ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।একটু পর বেলা শাজিয়াকে ফোন করে বললেন-“আপনার ভ্রষ্টা মেয়েকে এখান থেকে এসে নিয়ে যান!”
-“মুখ সামলে কথা বলবেন!”ওপাশ থেকে শাজিয়া চেঁচালো।বেলা ফোনের মধ্যেই কয়েকটা খিস্তি আউড়ে ফোন রেখে দিলেন।পনের বিশ মিনিটের মধ্যে শাজিয়া চলে এলেন থমথমে মুখে।
বেলা রাগে ক্ষোভে নিজের ঘর ছেড়েই বেরুলেন না।কারন তাহলে তিনি নিজেকে হয়তো সামলে রাখতে পারবেন না!
প্রিয়ন্তী সেই রাতেই মায়ের সাথে চলে গেলো।
প্রিয়ন্তী চলে যাবার পরপরই বেলা তার ল’ইয়ারকে ফোন করে তাকে আসতে বললেন!তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন-“আগামী কাল বিকেলে এই ল’ইয়ার নিয়ে যাবার হুমকি তিনি নাযিয়াতকে দিয়ে এসেছেন অথচ আজ কার জন্য তাকে ডাকতে হচ্ছে!মানুষ ভাবে এক হয় আরেক।
নাযিয়াতকে কত কটূ কথাই না শুনিয়েছেন তিনি।নাযিয়াতের সামনে কোন মুখে যাবেন!নাহ্,যত যাই হোক, লজ্জা সংকোচ ঝেড়ে ফেলে তাকে নাযিয়াতকে আনতে যেতে হবে!
নাযিয়াত কাল মাদ্রাসা যাবার আগেই ওদের বাড়ীতে যেতে চান তিনি!
রাতটুকু যেন কাঁটার মধ্যে কাটলো বেলার! সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারলেন না।নাযিয়াতের সৎ আচরন, উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার বেলার চোখে একের পর এক দৃশ্যপটের মতো ভেসে উঠতে লাগলো বেলার
উঠে এসে রাফিজের রুমের দরজায় মৃদু করাঘাত করলেন।
রাফিজ জানালো ‘তার ক্ষিধে নেই!’কেবল প্রশ্ন করলো-“মা,নাযিয়াতের কি হয়েছে তুমি জানো?তাকে অনবরত ফোন করেও পাচ্ছিনা।ফোন যাচ্ছেনা!”
বেলা চরম হতাশ কন্ঠে বললো-“নাযিয়াতকে আমি বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছি।ওকে অনেক কথা শুনিয়েছি আর তোর সাথে যেন যোগাযোগ না করে সে হুমকিও দিয়েছি।
আমি…আমি ভুল করেছি বাবা,আমি ভুল করেছি।কাল সকালেই গিয়ে ওর কাছে ক্ষমা চাইবো!তুই আমাকে ক্ষমা করে দে বাবা।আমিই তোর সংসার উজার করেছি।আমি নাযিয়াতকে নিয়ে আসবো!(বলে বেলা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।)সন্তান হোক না হোক,তুই একটা যোগ্য সঙ্গী পেয়েছিলি যে তোকে আগলে রাখতো,আমিই তোর সুখের সংসারে আগুন লাগিয়েছি!”
মায়ের আহাজারি দেখে অগত্যা রাফিজকে নরম হতে হলো-“থাক্,এতো কেঁদোনা।কাল সকালেই আমরা গিয়ে ওকে নিয়ে আসবো!এখন তো অনেক রাত হয়ে গেছে!”
বেলা চোখ মুছে ছেলেকে সামান্য কিছু মুখে দিতে বললেন।রাফিজ জানালো তার কিছুই খেতে ইচ্ছে করছেনা!
রাফিজ সে রাতে কিছুই খেলোনা!


পরদিন সকালে আটটার দিকেই মা ছেলে বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়লো!উদ্দেশ্য নাযিয়াতকে মাদ্রাসা যাবার আগেই ধরতে পারা।
কিন্তু নাযিয়াতদের বাড়ীর গেটে ইয়া বড় তালা দেখে বেলার বুক কেঁপে উঠলো।রাফিজ কেবল শান্ত চোখে তালাটা দেখলো যদিও ওর মনের খবর বাইরে থেকে বোঝা গেলোনা!
রাফিজ চারপাশে তাকালো।বেলা অপজিট ইউনিটের গেট নক করে জিজ্ঞেস করলেন-“সামনের ফ্ল্যাটের লোকজন কোথায় গেছে বলতে পারেন?”
সেই ফ্ল্যাটের মহিলা মাথা নেড়ে বললো-“জ্বী না।এসব কিছু জানিনা!”
হতাশ হয়ে বেলা আর রাফিজ বেরিয়ে এলো।গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালো রাফিজ যেন খুঁজলেই পেয়ে যাবে এমন একটা ছেলে ভুলানো অর্থহীন আশা!
মলিন মুখে মা ছেলে বাড়ী ফিরে এলো।বেলা ক্লান্ত হয়ে ড্রইংরুমেই বসে পড়লেন।তখনি ময়না একটা চিঠি এনে বেলার হাতে দিলো।বেলা ক্লান্ত সুরে জিজ্ঞেস করলো-“এটা কি?”
ময়না বললো-“কইতাম ফারিনা!এট্টু আগে একজনে আইস্সা দিয়া গেলো!”
বেলা কৌতুহলী হলেন।চিঠিটা ছিঁড়ে পড়তে শুরু করলেন তিনি।
কিছুদুর পড়ার পরই তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন-“রাফিজ” বলে!
রাফিজ মায়ের ডাক শুনে ড্রইংরুমে এসে জিজ্ঞেস করলো-“কি হয়েছে?”
বেলা উদগত কান্নাকে চাপা দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করে হাতটা রাফিজের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।রাফিজ সেটা হাত বাড়িয়ে নিতেই বেলা দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরলেন!
চলুন,রাফিজের পেছন দিয়ে আমরাও উঁকি দেই চিঠিটিতে….!
পরম শ্রদ্ধেয় আম্মা,
আস্সালামুআলাইকুম,আমি আপনার দরিদ্র বউমা বলছি।জানিনা,এই চিঠি আপনার হাতে পৌঁছুলেও আপনি এটা পুরোটা পড়বেন কিনা!আমি নিজেকে দরিদ্র বলছি এ কারনে, যে আপনার মনে নিজের জন্য এতটুকু জায়গা করে নিতে পারেনি সে তো দরিদ্রই !কিন্তু বিশ্বাস করুন,আমার চেষ্টায় এতটুকু ত্রুটি ছিলোনা।জানিনা কেন আমাকে আপনার লোভী মনে হয়েছিলো! তবে হ্যাঁ,আমি একটা ব্যপারে লোভী ছিলাম,আজো আছি আর তা হলো আপনার স্নেহ- ভালোবাসার প্রতি আমার লোভ সর্বদা !আমার ইচ্ছে ছিলো দুনিয়াকে দেখিয়ে দেই,আমাদের ঘর একটা সাহাবী ওয়ালা ঘর যেখানে হিংসা বিভেদ ভুলে আমরা দুই বোনের মতো সংসার করছি।ক্রমান্বয়ে নিজেদের কিছু স্বার্থত্যাগের মাধ্যমে নবীর আরেকটি সুন্নতকে জিন্দা করতে পারবো ভেবেছিলাম।কিন্তু তা আর হয়ে উঠলোনা।দোয়া করি,আপনি একজন চমৎকার সন্তানের দাদী হন।আপনার কাঙ্খিত উত্তরাধিকার আপনার জন্য বরকতময় হয়ে আসুক।শুনলে আপনার ভালো লাগবে কিনা জানিনা,আপনার আরেকটি উত্তরাধিকার আমি আমার শরীরে বহন করে চলছি।আপনাদের মতো বিলাসী জীবন হয়তো আমি তাকে দিতে পারবোনা তবে আমার সাধ্যমতো তাকে উত্তম তরবীয়ত দিয়ে আল্লাহর একজন খাঁটি বান্দা বানানোর চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ্।আমি আমার শরীরে এই ছোট্ট রাফিজকে নিয়ে আপনাদের জীবন থেকে বিদায় নিলাম।
পুনশ্চঃ এই অংশটুকু আপনার জন্যে রাফিজ।আপনাকে আলাদা করে লিখিনি কারন আমি জানিনা এই চিঠি আপনার হাতে পৌঁছুবে কিনা,তাই আম্মার চিঠিতেই আপনাকে শুভকামনা জানাই।আর আমাদের প্রথম সন্তানের নাম আপনার ইচ্ছেতেই হবে! রাফিজের ‘র’ আর নাযিয়াতের ‘ন’ দিয়ে !ইনশাআল্লাহ্,ছেলে হলে ওর নাম রাখবো “রণ” আর মেয়ে হলে ওর নাম রাখবো ‘রুণু’!
আপনি নিজের যত্ন নেবেন,ঠিকমতো খাবেন আর আমাকে ক্ষমা করে দেবেন যদি আপনার কোন হক ঠিকমতো আদায় না করতে পেরেছি তো!আমি আপনাকে দুনিয়াতে না পাই অন্তত জান্নাতে যেন পাই! মনে আছে আমাদের কত স্বপ্ন ছিলো জান্নাত নিয়ে!আমাদের জন্য দু’আ করবেন।ওহ্,আরেকট
া কথা লেখার লোভ সামলাতে পারছিনা সেটা হলো,আমি কোথায় আছি সেটার ক্লু এই চিঠিতেই আছে,যদি কোনোদিন প্রয়োজন মনে করেন তাহলে সময় করে ডাক দেবেন,নতুবা বিদায়….প্রিয়।
আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুন।
আস্সালামুআলাইকুম!”
ইতি
“আপনাদের নাযিয়াত”
—————–
চিঠিটা অন্তত দশবার পড়ে ফেললো রাফিজ।আঁতিপাতি করে খুঁজলো কিন্তু পুরো চিঠির কোথাও নাযিয়াতের ঠিকানা খুঁজে পেলোনা।ওর চোখের পানিতে সব ঝাপসা হয়ে যাওয়ায় লেখাগুলো এখন একদমই দেখা যাচ্ছেনা।
রাফিজ বাম হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছলো।তারপর চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দুহাতে মুখ ঢাকলো।ওর শরীর মুদু কাঁপছে।বেলা এসে ছেলের পিঠে হাত রাখতে রাফিজ চোখ মুছে সোজা হয়ে বসলো!
ওর নাকের ডগা লাল দেখে বোঝা যাচ্ছে ও কান্না চেপে রেখেছে!
বেলার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে!আহারে, তার কারনেই আজ তার সন্তান কষ্ট পাচ্ছে অথচ তিনি মা হয়ে কিছুই করতে পারছেন না!



প্রান্তিক ঘরে ঢুকে প্রিয়ন্তীকে দেখে কিছুটা চমকে গিয়ে বললো-“তুই কখন এলি?”
প্রিয়ন্তী কোনো জবাব দিলোনা।প্রান্তি
ক আবার বললো-“কি রে কথা বলছিস না যে?আম্মা কোথায়?”
-“জানিনা,যা তো এখান থেকে।আমাকে একটু একা থাকতে দে!”
প্রান্তিক আর কথা না বাড়িয়ে উঠে নিজের রুমে এসে পড়লো!
শাজিয়া ফোনে বড়মামার সাথে কথা শেষ করে প্রিয়ন্তীর কাছে এলো!শাজিয়ার মুখ থমথমে।প্রিয়ন্তী মা’কে দেখে ঔৎসুক্য নিয়ে তাকালো!
শাজিয়া বললো-“তোর বড়মামাকে কিছুটা আভাস দিয়েছি।সে তো রেগে কাঁই।
আমি বলেছি,ঝামেলার দরকার নেই,ওদের বিয়ের কথা ভাবতে বলেছি।বড়ভাই বললেন,তিনি ভেবে জানাবেন!
প্রিয়ন্তী ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।আকাশটা কি সুন্দর নীল হয়ে আছে।পশ্চিমাকাশে লালাভাটা এখনো পুরোপুরি মিশে যায়নি,অদ্ভুত সুন্দর লাগছে দেখতে।
আকাশের কত রঙ অথচ তার জীবন এখন স্বাদ বর্ণ সুগন্ধবিহীন।
ফ্রিক কি ওকে গ্রহন করতে রাজী হবে?যদি সবটা হেসে উড়িয়ে দেয়?অথবা যদি এবরশন করাতে বলে?না,প্রিয়ন্তী কোনোমতেই এবরশন করাবেনা।ফ্রিক তাকে গ্রহন করুক বা না করুক!
কিন্তু ভাগ্য তাকে সমর্থন করলোনা,সকালের দিকে প্রচন্ড পেটে ব্যথা নিয়ে চিৎকার করে উঠলো প্রিয়ন্তী।শাজিয়া ছুটে এলেন।দ্রুত ডাক্তারের কাছে নেয়া হলে জানা গেলো প্রিয়ন্তীর গর্ভপাত ঘটে গেছে।
সারাটা দিন ক্লিনিকে কাটিয়ে বিকেলে বাসায় ফিরলো প্রিয়ন্তী! রিক্ত নিঃস্ব অবস্থায়!


তিনচার দিন পরের কথা!
শাজিয়া রান্নাঘরে কি যেন একটা কাজ করছিলেন তখন প্রান্তিক ঢুকলো-“কি করছো মা?”
-“এই তো!কিছু বলবি?”
-“প্রিয়ন্তীকে দেখলাম মন টন খারাপ করে বসে আছে, জিজ্ঞেস করলাম কোনো কথাও বলছেনা,সমস্যা কি??
-“না,সমস্যা আর কি?”শাজিয়া বিষয়টা চেপে গেলেন।প্রান্তিকের কানে এই বিদঘুটে সমস্যার কথা গেলে সে আবার কি রিএ্যাক্ট করে কে জানে!সে গত কয়েকদিন ঢাকার বাইরে থাকায় এদিকের কোনো খবরই জানেনা।
তাছাড়া সে এই মাসটাই দেশে আছে তারপর তো চলেই যাবে!ওকে এসব না জানানোই ভালো!
প্রান্তিক হঠাৎ শাজিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো-“আচ্ছা মা,সেদিন যে মেয়েটাকে দেখে এলাম,ওদেরকে কি তুমি বারন করে দিয়েছো?”
-“হ্যাঁ,সে তো ওর পরের দিনই বলে দিয়েছি।তুই ই না জানাতে বলেছিলি?কেন,হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
-“না,ভাবছিলাম,পরিবারের সবার কারনে একটা নিরপরাধ মেয়েকে এভাবে রিজেক্ট করাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছেনা তাছাড়া তুমি মেয়েটাকে পছন্দ করেছিলে এটাও তো কম গুরুত্বপূর্ণ না!”
এত ঝামেলার মাঝেও প্রান্তিকের এই কথাগুলো শাজিয়ার মনের মধ্যে একটা স্বস্তির জোয়ার তুললো।
প্রান্তিক যদি শোনে প্রিয়ন্তীর কথা কিংবা নাযিয়াতের চলে যাবার কথা, তাহলে পরিস্থিতি বিগড়ে কোনদিকে যায় কিছু বলা যায় না,তারচে রাজী যখন একবার হয়েছেই ওদেরকে বলে বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করে ফেললেই বোধহয় ভালো হবে!
আজ বিকালেই ঘটককে ফোন করে ওদের খবর দিতে হবে!ভাবলেন শাজিয়া!


গত কয়েকটা সপ্তাহে রাফিজ একদম যান্ত্রিক হয়ে গেছে।রোবটের মতো অফিস যায়, বাড়ী আসে আর অফিসের কাজ নিয়ে ডুবে থাকে।প্রতি রাতে শোবার আগে নাযিয়াতের চিঠিটা পড়ে ও।তারপর সেটা বুকে চেপে ধরে।আর ওর চোখের কোল বেয়ে পানির একটা পাতলা ধারা নামে।
প্রতিদিনই চিঠিটা খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে রাফিজ কিন্তু কোনো ক্লু ওর মাথায় আসেনা।
আজও চিঠিটা সামনে বিছিয়ে এক হাত দুর থেকে সেটার দিকে অলস ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিল!কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ওর মুখটা হঠাৎ উজ্জল হয়ে উঠলো।দ্রুত চিঠিটা হাতে নিলো।ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলো চিঠিটার ভেতরে কিছু হরফ মোটা করে লেখা যা হরফগুলোকে অন্য হরফ থেকে পৃথক করে রেখেছে!রাফিজ মনোযোগ দিয়ে বিভিন্ন লাইনে আঁকা সেই মোটা অক্ষরগুলোকে জোড়া দিয়ে একটা শব্দ তৈরী করতে চেষ্টা করলো।অনেকটা জাম্বল ওয়ার্ডের মতোতো করেরে!
মিনিট পাঁচেক পরেই ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো!
সে এখন জানে নাযিয়াত কোথায় আছে!
….
চলবে…….

উত্তরাধিকার (৯ম পর্ব)

0

উত্তরাধিকার (৯ম পর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************
বেলা পাঁচ কেজি মিষ্টি কিনে আনালেন ড্রাইভারকে দিয়ে! মিষ্টি নিয়ে রওনা দিলেন বেয়াই বাড়ী!প্রিয়ন্তীদের বাড়ী!
প্রিয়ন্তীর মা বাবা তাঁকে দেখে দুজনেই অবাক।
বেলা প্রিয়ন্তীর মা’কে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন-“সুখবর নিন্,আপনি নানু হতে যাচ্ছেন!আজ সকালেই প্রিয়ন্তী মামনি সুসংবাদটা জানালো।খবর পেয়ে আর দেরী করিনি সোজা চলে এলাম দেখা করতে।
প্রিয়ন্তীর মা’র হাসি মুখটাতে হঠাৎ কালো কালির পোচ পড়লো যেন।বুকটা ধ্বক করে উঠলো!
তিনি কেবল ভাবলেন,বেলা চৌধুরী নাতি হবার আনন্দে সব গুলিয়ে ফেলেছেন,নাকি!
প্রিয়ন্তী এখনি কিভাবে মা হবার সুসংবাদ শোনাতে পারে?
তার প্রিয়ন্তীর সাথে কথা হওয়া দরকার!
বেলা চৌধুরীকে তিনি কিছু বললেন না!
প্রিয়ন্তীর বাবা একটু বাইরে গেলে বেলা খুশিতে হাত নাড়িয়ে বললেন-“আমি তো ভাবতেই পারিনি যে প্রিয়ন্তী আমাকে এতো বড় একটা গুডনিউজ দেবে।আপনাকে বলেছিলাম না,আমার নাতিনাতনী আসলে আমি তৎক্ষনাৎ ঘরের জঞ্জাল দুর করবো!তাই করেছি,নাযিয়াতকে মায়ের বাড়ী পাঠিয়েছি।রাফিজকে ঠান্ডা করা ওয়ান টু’র ব্যপার।
প্রিয়ন্তী এবার রাজত্ব করবে।
নিন্,সবই তো আমাদের মনমতো হয়ে গেলো!আপনি এবার খুশি তো?
বেলা হা হা করে হেসে উঠলেন।
-“কি ভেবেছিলাম আর কি হলো!ভেবেছিলাম,নাযিয়াতের বাচ্চা হবে আর নাযিয়াতকে সরিয়ে বাচ্চাটা রেখে দেবো,এখন তো সেসব কিছুই করতে হলোনা।সব একদম
সুন্দরভাবে সেটেল হয়ে গেলো!
আসলে সবই ভাগ্য,বুঝলেন,নইলে নাযিয়াতকে বিয়ে করানোর কি দরকার ছিলো!
অযথা কাবাবের মাঝে একটা হাড্ডি,আমি তো সাথে সাথেই ওকে ওর বাড়ী পাঠিয়েছি।কারন আমার ছেলেকে তো যেন যাদু করে রেখেছে,বুঝলেন।এখন তাকে সাইড করেছি এরপর এমন চাল চালবো যে আর দেখতে হবেনা!ছেলে দুদিন মুখ কালো করে থাকবে তারপর বউ বাচ্চা পেয়ে আবার সবই ভুলে যাবে।এ জীবনে তো আর এসব কম দেখলাম না!”
শুনে শাজিয়া ফাঁকা হাসি হাসলেন।
এক ঘন্টা বেলার ভ্যাজর ভ্যাজর সহ্য করে গেলেন। বেলা বিদায় নেয়া মাত্র তিনি প্রথমে শায়লাকে ফোন দিলেন।তার কুফরী কাজ করেছে,নাযিয়াত আজ ঘরছাড়া অথচ তিনি তো খুশি হতে পারছেন না।
কি হতে যাচ্ছে তার মেয়ের জীবনে কে জানে!
ফোন ধরলো শায়লার ছোট মেয়ে।সে জানালো শায়লা খুব অসুস্থ,হাসপাতাল
ে ভর্তি!
শাজিয়া ভাবছেন,কি করবেন,প্রিয়ন্তী কে আনিয়ে লুকিয়ে এবরশন করিয়ে দেবেন, নাকি বেলা যেমনটা ভাবছে সেই ভাবনার পালে হাওয়া দেবেন!
দ্বিতীয়টিই নিরাপদ।
এবরশনে ঝুঁকি বেশী।কিন্তু এটা কি ঠিক হবে,একজনের সন্তানকে আরেকজনের নামে চালিয়ে দেয়া?
শাজিয়া অনেক দিন থেকেই ধর্মকর্ম থেকে বহুদুরে।বরং না করতে করতে ধর্মটা তার কাছে বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান হয়েই রয়ে গিয়েছে!
তিনি নামাজ রোজার তেমন পাবন্দী করেন না।রোজার দিনগুলোতেও অসুস্থতা আর ঔষধ খাবার দোহাই দিয়ে রোজাগুলো তরক করে ফেলেন।তিনি জানেন,আল্লাহতা’লা বলে একজন আছেন যিনি সমস্ত সৃষ্টিকূলের স্রষ্টা,প্রতিপালক! কিন্তু সেই জানাটা কেবল জানা পর্যন্তই রয়ে গেছে।মান্যতার কোনো কার্যকলাপ তার কাজের মধ্যে ফুটে ওঠেনি!
তবু আজ কেন যেন তার মনটাতে একটা ভয় দানা বাঁধছে।কেবলি মনে হচ্ছে একটা পাপ ঢাকতে গিয়ে আরেকটা পাপে জড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি।এভাবে পাপের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছেন তিনি!এসব সময়ে ইবলিশ খুব সক্রিয় ভূমিকা পালন করে!সে বান্দাকে অভয় দেবার চেষ্টা করে।শাজিয়ারও তেমন হলো।তিনি হেরে গেলেন শয়তানি প্ররোচনার কাছে।
পরক্ষণেই মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিলেন তিনি…আরে দুর!আজকাল আবার এতসব কেউ দেখেনাকি?
বাচ্চা যারই হোক, মা তো প্রিয়ন্তীই!
শেষ পর্যন্ত ইবলিশ শয়তানেরই জয় হলো।
শাজিয়া নিজের মনে জন্ম নেয়া সংকোচটুকু নিঃসংকোচে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মেয়েকে ফোন দিলেন!


গাড়ী মসৃন গতিতে এগিয়ে চলছে।
বেলার মাথায় নানান ভাবনার ভীড়!ভাবনাগুলো যেন একে অন্যের গায়ে হুটোপুটি খাচ্ছে!
মোবাইল খুলে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সাঈদ সিকান্দারকে ফোন করলেন তিনি ।
সাঈদ সাহেব তখন প্রতি সপ্তাহের মতো আজো চিটাগং ব্রাঞ্চে যাবার প্রস্ততি নিচ্ছিলেন।
ম্যাডামের ফোন পেয়ে দ্রুত রিসিভ করে সালাম দিলেন!বেলা রাশভারী কন্ঠে বললেন-
-“সাঈদ সাহেব?”
-“জ্বী,জ্বী ম্যাডাম,বলছি!”
-“কেমন চলছে সব?”
-“জ্বী,খুব ভালো ম্যাডাম!রাফিজ স্যার তো চমৎকার সবদিক সামলে নিচ্ছেন!”
-“হমম…এ সপ্তাহের ব্রাঞ্চ ট্যুরে কে যাচ্ছে?”
-“বরাবরের মতো আমিই তো যাচ্ছি ম্যাম।রাফিজ স্যার তো গত কয়েক মাস ধরে….!”
-“এবার ‘ও’ যাবে!” সাইদ সিকান্দারের কথা ফিতা কাটার মতো একপোচে কেটে দিয়ে বললেন বেলা চৌধুরী!
-“জ্বী,ম্যাডাম?”সাঈদ সাহেব দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলেন!
-“কি বলেছি,শোনেন নি?বাংলা বোঝেন না?বলেছি এ সপ্তাহের ট্যুরে রাফিজ যাবে।”
-“ক্..কিন্তু ম্যাম যাবার দিন তো আজকেই! রাত এগারোটার ট্রেন!আমার তো টিকিটও কাটা হয়ে গেছে।”
-“ফেলে দিন! আর ফোন করে আর্জেন্টলি সন্ধ্যার ফ্লাইট বুক করুন রাফিজের জন্য!কি বলেছি,বুঝেছেন?”
-“জ্বী,ম্যাম।স্যারকে সন্ধ্যের ফ্লাইটে চিটাগং পাঠাতে হবে!আর্জেন্টলি!এনি হাউ!”
-“গুড…!এবার ধরতে পেরেছেন।আপনি ঐদিকটা ম্যানেজ করুন আই’ল ম্যানিজ রাফিজ!ক্লিয়ার?”
-“ইয়েস ম্যাম!”
ফোন কেটে সাথে সাথেই ছেলেকে ফোন দিলেন বেলা!


নাযিয়াতদের বাড়ীর সামনে গাড়ী থামিয়ে গাড়ী থেকে নেমে নাযিয়াতদের বাড়ীর গেট নক করলেন!বেলা নাকে এমনভাবে রুমাল চেপে ধরেছেন যেন কোনো ডাষ্টবিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।
ব্যপারটা ইচ্ছাকৃত তাচ্ছিল্য যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে নাযিয়াতকে তার ক্লাস স্মরন করিয়ে দেয়া!
গেট খুললো নাদিয়া!
বেলাকে দেখেই চমকে উঠলো সে।
সালাম দিয়ে ভেতর ঘরে নিয়ে এলো!
বেতের সোফাটা দেখিয়ে বসতে বললে বেলা সেদিকে তাকালো।
সোফাটা জায়গায় জায়গায় বেত খুলে গেছে।পিঠে বেতের খোঁচা লাগা এড়াতে নাযিয়াতের মা মোটা কাপড়ের কভার দিয়ে সেটাকে আড়াল করেছেন!
বেলা দাম্ভিক ভঙ্গিতে একটা সোফায় বসতেই সেটা মট্ করে উঠলো!বসে নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন-“তোমার বড়বোন কই?ডাকো তাকে!”
বলতে বলতেই নাযিয়াত পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে সালাম দিলো বেলাকে।
বেলা সালামের জবাব না দিয়ে কর্কশ স্বরে বলে উঠলেন-
-“তোমাকে একটা খবর জানাতে এলাম।আমার রাফিজ বাবা হতে চলেছে।প্রিয়ন্তী মা!এবার দয়া করে তুমি তাদের জীবন থেকে সরে দাঁড়াও!তোমার কারনে ওদের দুজনের মাঝখানে আজ এতবড়ো দেয়াল।আমার রাফিজ তো আগে এমন ছিলোনা!সে তোমার পাল্লায় পড়ে যতসব উদ্ভট আচরণ শুরু করেছে।”
বেলার আকস্মিক আক্রমনে নাযিয়াত দিশেহারা বোধ করলো!সে কিছু বলতে যাবার আগেই বেলা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো-
-“সে দাঁড়ী রেখেছে,প্যান্ট গুটিয়ে রাখে, মসজিদ ছাড়া নামাজ পড়বেনা,বৃহঃবার রোজা রাখবে…এসব ধর্মীয় গোড়ামী (নাউযুবিল্লাহ) তুমিই ওকে শিখিয়েছো, তাই না?”
নাযিয়াত বাকরুদ্ধ হয়ে বেলার কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলো কেবল!এবার মৃদুস্বরে বললো-
“এসব কি বলছেন,আম্মা?ধর্মীয় গোঁড়ামী?”
-“তা নয় তো কি?ও কি বুড়ো হয়ে গেছে যে এখনি ধর্মকর্ম নিয়ে পড়ে থাকবে?তুমি বোরকা পড়ে বুড়ি সেজে থাকো ভালো কথা,আমার ছেলেকে কেন টানছো?ওর এখন হেসে খেলে কাটানোর সময়!”
-“মৃত্যু কি বয়স দেখে আসে আম্মা?”
-“তারমানে তুমি চাও,আমার ছেলে তাড়াতাড়ি মরে যাক্ আর তুমি ওর সম্পত্তির উপর রাজত্ব করো!তাই না?”
-“ইন্নালিল্লাহ্…..আমি এমনটা কখন বললাম মা!আপনি…..!”
-“হয়েছে, আমাকে আর পট্টি লাগাতে এসোনা।যে জন্য এসেছি সেটাই বলি,কাল বিকেল পাঁচটার দিকে আমি ল’ইয়ার নিয়ে আসবো।তুমি পেপারস সাইন করে দেবে!ব্যস্,তোমার কাজ শেষ!”
নাযিয়াত ক্লান্ত স্বরে বললো-“কিসের পেপারস?”
বেলা ঠান্ডা স্বরে বললেন-“তোমাদের ডিভোর্সের!”
-“আম্মা…?”প্রায় কঁকিয়ে উঠলো নাযিয়াত।
বেলা ধমকে উঠলেন-“চুপ করো,লোভী মেয়ে কোথাকার!ভেবেছিলে,আমার ছেলেকে হাত করে আমাকে সাইড করে দেবে?তোমার সেই আশার গুড়ে বালি।প্রিয়ন্তী আজ মা হতে চলেছে।সত্যের জয় সবসময়ই হয়!তোমার চালাকি আমি বুঝি।ভালোমানুষির রূপ ধরে তো রাফিজকে ভুলিয়েছো।প্রিয়ন্তী সেরকম পরিবারের মেয়ে বলে এখনো চুপ আছে।নইলে ওর স্ট্যাটাসের সামনে তুমি যে কি তা তো ওর বাড়ী গিয়েই বুঝেছো!”
নাযিয়াত হাত বাড়িয়ে পাশের টেবিলটা ধরলো।ওর মাথা আবার ঘুরাচ্ছে,বমি বমি লাগছে।নাদিয়া দ্রুত এসে ওকে ধরলো।
বেলা উঠে বেরিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে বললো-“কাল পাঁচটায়! মনে থাকে যেন!আর রাফিজকে ফোন করে এসব জানাবার তালে যদি থাকো তবে এসব ধান্ধা বাদ দাও।সে এখন দেশে নেই!সে তোমার ছল বুঝতে পেরেছে।সে তোমাকে ঘৃণা করে!”
বলে বেলা বেরিয়ে গেলেন।
নাযিয়াত নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।নাদিয়া ওকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে ফেললো।
বেলা আসার কথা শুনে নাযিয়াতের মা নাস্তা নিয়ে আসছিলেন।ঘরে ঢুকে দু মেয়েকে কাঁদতে দেখে তিনি থমকে গেলেন-
-“বেয়াইন সাহেবা চলে গেছেন?”
নাদিয়া মাথা নাড়লে নাযিয়াতের আম্মু অবাক হয়ে বললেন-“আমার সাথে দেখা ও করলেন না?তাঁকে মিষ্টিমুখ করাবো বলেই দেরী হচ্ছিলো!মিষ্টি আনিয়েছি ভালো পেষ্ট্রি শপ থেকে।উনাকে বলেছিস তো নাযিয়াতের কথাটা?”
নাদিয়া রেগে বললো-“সে বলার কোনো সুযোগ রাখলে তো?যা তা বলে গেছে অভদ্র মহিলাটা।”
নাযিয়াত চোখ মুছে কাতর স্বরে বললো–
-“মা,আমাকে বাঁচাও,মা!আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো না…মা!পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি,আমি ওর বউ হয়েই থাকতে চাই!নিজ হাতে আমি ঐ পেপারে সাইন করতে পারবোনা।আমাকে তোমরা এখান থেকে নিয়ে চলো! যেখানে বেলা চৌধুরী আমাকে খুঁজে পাবেনা।কাল উনি আসার আগেই আমি এখান থেকে সরে যেতে চাই! ”
নাদিয়া হঠাৎ বললো-“তুমি ভেবোনা আপি,সারাজীবন তুমি আমাদের জন্য অনেক করেছো, আজ আমাদের পালা!তুমি যেভাবে চেয়েছো সেভাবেই হবে।তবে তুমি একা না,আমরা সবাই যাবো!নইলে বেলা চৌধুরীকে বিশ্বাস নেই।সে আমাদের মাধ্যমে হলেও ছেলের কাছ থেকে ডিভোর্স নিয়ে এসে ঠিক তোমাকে পাঠিয়ে দেবে!তখন তো ডিভোর্স ঠেকানো যাবেনা।আমরা যদি বাসা ছেড়ে দেই তাহলে তো আর সে তোমাকে খুঁজে পাবেনা!ডিভোর্স পাঠাবে কাকে?আমি ‘ও’কে বলছি,ও সব ব্যবস্থা করে দেবে!”
নাদিয়া আত্মবিশ্বাসের সুরে বললো!বিয়ের পর থেকেই ওর ধারনা হয়েছে পৃথিবীতে একমাত্র সৎ যোগ্য করিৎকর্মা সাহসী ভালো মানুষ হলো যদি কেউ থাকে তবে সেটা ওর স্বামী রিফাত!
সুযোগ পেলেই স্বামীর গীত গাইতে শুরু করে ও!
নাযিয়াতের মা বললো-“কিন্তু সবাই হুট করে যাবো কোথায়? তাছাড়া ওটা বেলা চৌধুরীর একার কথা।জামাই নিশ্চয়ই মানবে না!সে ডিভোর্স না দিলেই তো আর ডিভোর্স হবেনা!”
-“তোমার জামাই কে বিশ্বাস নাই! তোমার জামাই যে ঢিলা কোম্পানীর মানুষ, ওনার মা ওকে ধমক দিলে সে ঠিকই সুড়সুড় করে সই করে দেবে!আবাল একটা..!”
-“নাদিয়া তুই থামবি?তুই আমার সামনে ওকে এসব বলে আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস।ও ওর মা’কে অসম্ভব মানে এটা কি ওর অন্যায়?ওর মা,নিজের অহংবোধে ভুগেন,এতে ওর দোষ কোথায়?”
-“হম,জানি তো।রাফিজ ভাইয়ের কোনো দোষই তোমার কাছে দোষ না।যাক্,এসব কথা
বলে লাভ নেই!আমি রিফাতকে ফোন দিচ্ছি।দরকার হলে গ্রামে নানুবাড়ী চলে যাবো!”
*
নাযিয়াত নিঃশব্দে কাঁদছে।নাদিয়া ওর কাঁধে হাত রেখে ধীরে ধীরে বললো-
-“এতো ভালোবাসো তুমি রাফিজ ভাইকে।সেও যদি তোমাকে তেমনই ভালোবাসে।তাহলে তোমাকে সে পাতাল ফুঁড়ে হলেও ঠিকই খুঁজে বের করবে।ভালোবাসার পরীক্ষায় এবার তাকে পাশ করতে দাও!এটা নিয়ে এতো ভেবোনা।তুমিই না সবসময় বলো….আল্লাহ যা করেন,ভালোর জন্যেই করেন!আজ তোমার সাথে যা হচ্ছে তাতে নিশ্চয়ই তোমার জন্যে কল্যান রয়েছে!এটা মানো তো!”
নাযিয়াত মৃদু হাঁপাতে লাগলো।
মাথা ওপর নিচ করে বললো-“কথাগুলো বলার জন্য তোকে ধন্যবাদ!”

প্রান্তিক দোকান থেকে বেরিয়ে আসছিলো!তখনি পেছন থেকে বোরকা পড়া একটি মেয়ে ডাকলো তাকে-“ভাইয়া….একটু শুনুন!”
প্রান্তিক ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো দুটো বোরকা পড়া মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
সে সংকোচ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো!
-“জ্বী,আমাকে বলছেন?”
-“জ্বী,ভাইয়া! ও আপনার সাথে একটু কথা বলার অনুমতি চায়!”
প্রান্তিকের হাতে সদ্যকেনা পাঞ্জাবীর প্যাকেট।সে এলিফ্যান্ট রোডে এসেছিলো একটা কাজে।সেখান থেকে ফেরার পথে এই পাঞ্জাবীটা কিনেছে!
খানিক ইতস্তত করে দ্বিতীয় মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে রাস্তার দিকে তাকালো-“জ্বী,বলুন!”
মেয়েটি আপাদমস্তক বোরকা নিকাবে আবৃতা।
তার চেহারা দেখা যাচ্ছেনা।
সে মৃদু স্বরে বললো-“আসসালামুআলাইকুম!”
-“ওয়ালাইকুমুসসালাম!”
-“আপনি পরিচয় দিলে আমাকে হয়তো চিনবেন!আমি জান্নাত!”
-“আপনি জান্নাত মানে?”
-“ইয়ে আমি জান্নাতুল মাওয়া! আপনি গতমাসের এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় এসেছিলেন আমাকে দেখতে!”
প্রান্তিকের কুঁচকানো ভুরু সমান হয়ে গেলো-
-“ওহ্,আচ্ছা!তা কি ব্যপার বলুন!”
-“আপনি আমাকে দেখে যাবার পর মানা করে দিয়েছিলেন,তাই না?”
প্রান্তিক খানিকটা অস্বস্তিতে পড়লো-
–“ইয়ে,মানে…আসলে আম্মা……!”
-“আমি জানি আপনি কেন মানা করেছেন,কারন আমার পরিবার পীর মানে,ওরশ করে,সিরনী করে এসব আপনি মানেন না, তাই না?”
প্রান্তিক তাকালো-“এসব কি মানা উচিত,আপনিই বলুন?অবশ্য আপনারা তো সবাই……!”
-“না,সবাই না!এখানেই আপনার ভুল।আমি নিজে ওসব মানিনা কিন্তু আমার পরিবারের কাউকে আমি এসব বোঝাতে পারছিনা।তাই খুব করে চেয়েছিলাম,আল্লা
হ এমন একজনকে আমায় মিলিয়ে দিন যে এগুলোর বিপক্ষে!”
প্রান্তিক লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললো-
-“এখন আমি কি করতে পারি,বলুন?”
-“দেখুন,আমি তো আর আপনাকে বলতে পারিনা যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই কিন্তু একটা বাস্তব সত্য বলি,যেদিন আপনার পক্ষ থেকে না শুনলাম সেদিনই আমি আল্লাহর কাছে দু’আ করেছি যে,আপনার সাথে যেন দেখা হয় আমার।কারন আপনার ফোন নম্বর নেই,আপনার বাসাও চিনিনা।যোগাযোগের কোনো পথ নেই!কিন্তু মন থেকে আপনাকে ভুলতে পারছিলাম না।তাই আল্লাহকে বললাম,ছেলেটি যদি আমার জন্য কল্যানকর হয় তাহলে ওর সাথে যে কোনভাবে দেখা সাক্ষাতের একটা ব্যবস্থা করে দাও নতুবা ওর কথা আমাকে ভুলিয়ে দাও!তারপর একটা মাস গেছে আপনার সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি,আপনার আশা যখন ছেড়ে দিচ্ছিলাম তখনই আপনার দেখা পেয়ে গেলাম।ও আমার বান্ধবী,ওর সাথেই এখানে এসেছি একটা কাজে।হঠাত আপনাকে ঐ দোকান থেকে বেরুতে দেখে ওকে বললাম।সাহাবীদের সময় তো যে কেউ যে কাউকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারতো,কারন তখন বিয়েটা সহজ ছিলো,জেনা ছিলো অসম্ভব কঠিন আর সাড়ে চৌদ্দশত বছর পরে আজ জেনাটা খুবই সহজ! ইচ্ছে হলেই কেউ কাউকে প্রথম দেখায় বলতে পারে-‘আপনার ফোন নাম্বারটা কি দেয়া যাবে?আপনার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চাই! আপনাকে আমার ভালো লেগেছে চলুন না এককাপ কফি হয়ে যাক্…ইত্যাদী কিন্তু হাজার চাইলেও কেউ বলতে পারেনা,’প্লিজ,আপনি আমাকে বিয়ে করবেন,আপনার ধার্মিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে!”
প্রান্তিক অবাক হয়ে মেয়েটির কথা শুনছিলো!
কোনো মেয়ে যে এভাবে এতো গুছিয়ে এসব কথা বলতে পারে তা ওর জানা ছিলোনা!মেয়েটি তার বান্ধবীর দিকে একবার তাকিয়ে তারপর প্রান্তিকের দিকে তাকালো-“চলি!আস্সালামুআলাইকুম!”
প্রান্তিকের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে মেয়েটি দৃঢ়পদে হেঁটে চলে গেলো।প্রান্তিক বোবা সেজে দাঁড়িয়ে রইলো।তারপর ডান হাতটা পকেটে পুরে ফুটপাত ধরে এগোতে লাগলো।ওর।
হাঁটার ধরন বলে দিচ্ছে ও খুব চিন্তিত!


রাফিজ ক্রমাগত ফোন করেই যাচ্ছে কিন্তু নাযিয়াতের নাম্বারটা বারবার আনরিচেবল আসছে!
রাফিজের খুব অস্থির লাগছে।নাযিয়াত হঠাৎ ওকে না বলে বাড়ী চলে গেলো কেন?আর গেলোইবা, ফোন যাচ্ছেনা কেন?
তিন দিন পর সে আজ ঢাকায় ফিরেছে!
এসে শুনলো নাযিয়াত বাড়ী ফেরেনি! শুধু তাই না,নাযিয়াত নাকি রাগ করে চলে গেছে।রাফিজের মনে একটা চিন্তা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে,নাযিয়াতের সাথে প্রিয়ন্তীর কিছু হলো?নাকি ওর মা’র?আসলে কি ঘটেছে তার এই ক’দিনের অনুপস্থিতিতে?একেবারে হঠাৎ ব্রাঞ্চ ট্যুরের প্রোগ্রামটা এসে যাওয়ায় ওকে চিটাগং যেতে হয়েছে কারন ওদের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সাইদ সাহেব হঠাৎ নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছে যার ফলে ওকেই যেতে হয়েছিলো মায়ের আদেশে।
রাফিজ এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে কাপড় না বদলেই মোবাইলে নিয়ে অনবরত কল করেই যাচ্ছে।
এমন সময় বেলা ওকে দেখে বললেন-“কি রে রাফি, তুই এখনো কাপড় ছাড়িসনি,ফ্রেশ হোসনি?আজ রাতে আমরা তিনজন বাইরে ডিনার খেতে যাবো!
ইটস এ্যান অনার টু প্রিয়ন্তী!আমি তোদের দুজনকে নিয়ে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সবচে বড় আনন্দটাকে সেলিব্রেট করবো আজ।তোর ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম।আজ রাতে যাবো,ঠিকআছে?”
রাফিজ চরম বিরক্তি নিয়ে মোবাইল টিপতে টিপতে বললো-“এমন কি খুশির খবর পেয়ে গেলে যে ডিনার দিতে হচ্ছে প্রিয়ন্তীর অনারে?”
-“আমরা পার্ক টাউনে যাবো!ওটা প্রিয়ন্তীর পছন্দের রেষ্টুরেন্ট!সে আমাকে উত্তরাধিকার দেবার সুসংবাদ দিতে পারে আর আমি ওর অনারে একটা মিনি পার্টি থ্রো করতে পারবোনা?”
রাফিজের মোবাইল ধরা হাত স্থির হয়ে গেলো!
প্রিয়ন্তী উত্তরাধিকার দেবার খবর দিয়েছে মানে?
রাফিজ বেলার দিকে তাকিয়ে স্থির কন্ঠে বললো-“একথার মানে?”
-“মানে এখনো বুঝিসনি?উফ্,রাফি তুই এখনো বোকাই রয়ে গেলি!আরে বাবা,তুই বাবা হতে যাচ্ছিস রে বাপ!আর আমি দাদুমনি!প্রিয়ন্
তী কনসিভ করেছে !”
রাফিজের কপালে পরপর তিনটা ভাঁজ পড়লো-“কিইই?”
বেলা দু কাঁধ ঝাকিয়ে বললেন-“তোর এতো অবাক হবার কারন কি?এটা কি অসম্ভব কিছু?”
-“প্রিয়ন্তী কোথায়?”মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে রাফিজ বললো!বেলা কিছু বলার আগেই রাফিজ সোজা প্রিয়ন্তীর রুমে ঢুকল।প্রিয়ন্তী শুয়ে শুয়ে ম্যাগাজিন দেখছিলো।
রাফিজ গিয়ে সরাসরি বললো-“এসব কি শুনছি প্রিয়ন্তী?”
প্রিয়ন্তী ম্যাগাজিন সরিয়ে উঠে বসলো,কোনো উত্তর দিলোনা।
রাফিজ চড়া গলায় বলে উঠলো-“যেখানে তোমার সাথে গত ছয়মাসে আমার সাথে কোনো দাম্পত্য সম্পর্ক নেই সেখানে তুমি সন্তানসম্ভবা কিভাবে?আনসার মি!আই ওয়ান্ট টু নো ইট।বলো,চুপ করে আছো কেন?
বেলা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন!
প্রিয়ন্তী মুখ নিচু করে বসে রইলো!
…….
চলবে…….

উত্তরাধিকার (৮ম পর্ব)

0

উত্তরাধিকার (৮ম পর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************
নাযিয়াতকে দেখে ওর বোনেরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো!নাযিয়াতের মা আঁচলে চোখ মুছে এগিয়ে গিয়ে মেয়ের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বললেন-“এবার দুটো দিন থাকবি তো?”
নাযিয়াত হাসলো-“ইনশাআল্লাহ,সেরকমই ইচ্ছে আছে।তাছাড়া আমি না থাকলে তুমি একা এতো ধকল সামলাবে কি করে?”
-“হ্যাঁ,রে জামাই আসবেনা?”
-“আসবে,ওকে বলে দিয়েছি অফিস থেকে ফেরার পথে যেন দেখা করে যায়!”
-“তোর মুখটা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন রে মা,সব ঠিক আছে তো?”
নাযিয়াত হেসে ফেললো-“আলহামদুল
িল্লাহ,সব ঠিক আছে।মায়ের চোখে সব ছেলেমেয়েকেই অমন দেখায়!”
অনেক দিন পর বড়বোনকে কাছে পেয়ে বোনেরা এক্কেবারে ছেঁকে ধরলো নাযিয়াতকে।অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলো ওরা।
নাযিয়াত অন্যান্য অবস্থার খোঁজ নিলো!তারপর ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে মায়ের হাতে দিলো!নাযিয়াতের মা চমকে গেলেন-“এতো টাকা দিচ্ছিস কেন?কোথায় পেলি এতো টাকা?”
-“মা…এখানে আমার মাদ্রাসার তিন মাসের বেতন আর রাফিজের দেয়া বিশ হাজার টাকা আছে !”
-“তোর মাদ্রাসার বেতন আমাদের দিচ্ছিস, তোর শ্বাশুড়ী রাগ করবেনা?জামাই বা কি বলবে!”
-“ওরা কিছুই বলবেনা,ওদের দুজনের সম্মতিতেই এই টাকা দিচ্ছি মা,রাফিজের পরিস্কার কথা মাদ্রাসার বেতনের উপর শুধু তোমার মায়ের হক,এ টাকা খরচ করবেনা,ওনাকে দেবে!আর আমার শ্বাশুড়ীরও এ ব্যপারে কোনো দ্বিমত নেই!”
নাযিয়াতের মা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস চাপলেন।এমন সময়ে এতোগুলো টাকা হাতে আসায় তার অনেক চিন্তা হালকা হয়ে গেলো!

নাযিয়াত ফজরের নামাজ পড়ে শুয়েছে অমনি তার মোবাইল বেজে উঠলো!
মোবাইল হাতে নিয়ে অবাক হলো-“এতো সকালে রাফিজের ফোন?”
দ্রুত রিসিভ করলো-“আসসালামুআলাইকুম!”
-“ওয়ালাইকুমুসসালাম…..কি করছো?”
-“এই তো নামাজ পড়ে উঠলাম,আপনি জেগে আছেন এখনো?”
-“সারারাতই তো একরকম জেগে কাটিয়ে দিলাম।ভাবলাম ফজর পড়ে ঘুমাবো সেটাও আসছেনা!তাই ভাবলাম তোমাকেই ফোন দেই!”
-“সারারাত ঘুমাননি কেন?”
-“আমার পাশটা যে খালি….তাই!”
নাযিয়াত চুপ!
-“কবে ফিরবে?”
-“ইনশাআল্লাহ্,আগামী পরশু।কাল আকদের সময় থাকছেন তো?”
-“তোমার সাথে দেখা হবার এ সুযোগ ছাড়ি কি করে?”
-“ইস্,একেবারে আবেগে টইটুম্বর হয়ে আছেন দেখছি,প্রিয়ন্তী কোথায়?আসেনি?”
-“এসেছে…!”
-“তো?”
-“তো আবার কি,সে তার মতো আছে! আমার সাথে ভালো করে কথা বলেনা,মায়ের সামনে টুকটাক বললেও একলা ঘরে তো মনে হয় চেনেনা!”
-“দেখুন,আপনি ওর স্বামী,আপনারই উচিত ওর মনটাকে হালকা করা!ওর মনের ভার লাঘব করা।ওকে দিন ওর সাথে একটু কথা বলি!”
-“এখানে নেই!পাশের রুমে শুয়ে আছে,আমি তো ষ্টাডিরুমে!”
-“আপনার ওর কাছে যাওয়া উচিত!”
-“আচ্ছা, রাখছি!”
-“রাগ করলেন?”
-“নাহ্…!তবে অবাক হচ্ছি ভেবে যে তুমি কোন ধাতুতে গড়া!তোমার কি এতটুকু ভয় নেই? ”
-“ভয়ের কি আছে?বিপদ তো ও না থাকলেও ঘটতে পারে! আমার অংশের পাওনাটুকু পেলেই আমি খুশি,পাবো তো?”
-“সামনাসামনি বলবো,এখন রাখি।তোমার সাথে কথা বলেছি,এখন ঘুম পাচ্ছে!তুমি কি ঘুমের ট্যাবলেট?”
-“রাখি,আল্লাহ হাফিজ!”নাযিয়াত হেসে বললো
-“আল্লাহ হাফিজ!”



প্রান্তিক মেয়ে দেখে আসার পর শাজিয়া ধরলেন ছেলেকে!
-“মেয়ে কেমন লাগলো বাবা!তুই যেমন চেয়েছিলি তেমনি কিন্তু!পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে,পর্দা করে!”
-“হমম,সব তো বুঝলাম,কিন্তু শেষের কথাটা শোনোনি?মেয়েদের পুরো পরিবার যে কোন্ একটা পীরের মুরিদ?”
-“হ্যাঁ,তাতে সমস্যা কি?”
-“অনেক বড় সমস্যা আছে মা!ইসলাম খুব সরল একটা ধর্ম যার বুনিয়াদ হলো “লা…ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”!ইসলামের মূলনীতি হলো ইবাদত হবে শুধু আল্লাহর জন্য আর তা হবে শুধু এবং শুধুমাত্র রাসুল সাঃ এর আদলে যাকে আল্লাহ আমাদের জন্য নবী করে পাঠিয়েছেন।সাধারনত পীর ভক্তরা এই মূল ট্র্যাক থেকে সরে গিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বদলে পীরের ইতা’ত করা শুরু করে!আমি এই ঝুঁকি নিবোনা মা স্যরি!”
-“এতো কিছু দেখলে চলে?মেয়ের ফ্যামিলি ভালো।বাবার বিরাট সম্পত্তি…!”
প্রান্তিক বাধা দিলো-“মেয়ের বাবার বিরাট সম্পত্তি দিয়ে আমি কি করবো?”
শাজিয়া হতাশ কন্ঠে বললেন-“তাহলে এদের কি বলবো?”
-“বারন করে দাও!আমার ইচ্ছে নেই!”
শাজিয়া আর কিছু না বলে সরে গেলেন।

নাযিয়াতের মনে একটা খটকা ছিলো, পরে রাফিজের কিছু আচরণে তা সন্দেহে পরিণত হয়েছিলো।তারপর সে নিজের মতো কিছু প্রোটেকশন গ্রহন করার পর রাফিজের পরিবর্তনে পুরোপুরি নিশ্চিত হলো কেউ তার আর রাফিজের মধ্যে ঝামেলা লাগানোর চেষ্টা করছে এবং তা করছে খুব খারাপ ভাবে।
প্রথমে সে নিজের মতো সুরা ফালাক-নাস-ইখলাস এবং আয়াতুল কুরসীর আমল শুরু করলো।তারপর সে যখন কিছু বাহ্যিক সিমটমে বুঝতে পারলো,রাফিজ যাদুতে আক্রান্ত তখন দ্রুত বরই পাতার ট্রিটমেন্ট শুরু করলো!যেটা যাদু নষ্টের জন্য খুবই কার্যকরী একটি চিকিৎসা!নাযিয়াত জানে,পৃথিবীর যাবতীয় রোগের শেফা হলো আল কুরআন।সে তার পরিচিত একটি “রুকীয়া আশ শারইয়াহ” সেন্টারের একজন দ্বীনিবোনের নসীহত মতো ক্বুরআনী চিকিৎসা শুরু করলো!বোনটি একটা কথা অবশ্য জানিয়ে দিয়েছিলো, যে তোমাদের সংসারে ঝামেলা পাকাচ্ছে সে তোমার পাক কালামের চিকিৎসায় নিজে অসুস্থ হয়ে পড়বে কারন সে তোমাদের দুজনকে পৃথক করার জন্য খুব খারাপ একটি পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে!
নাযিয়াত আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহর কালাম দিয়ে সেই কুফুরী কালামকে প্রতিহত করার চেষ্টায় আপ্রাণ আত্মনিয়োগ করলো পাশাপাশি সেই অদৃশ্য শত্রুর হেদায়াত কামনা করলো বারবার!
সেই চিকিৎসায় রাফিজ এখন অনেকটা পরিবর্তিত!
নাযিয়াত তাকে বারবার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাবন্দী করতে বলে কারন এটা না হলে চিকিৎসা সহজ হয়না তবে এই চিকিৎসার মাধ্যমে মুসলিম ছাড়াও বিধর্মীরাও উপকৃত হচ্ছে। প্রয়োজন শুধু ধৈর্য্য ধরে আমলটা করা!
গত কয়েকদিন যাবৎ রাফিজের আচরন অনেকটা সহজ এবং প্রানবন্ত হয়ে গিয়েছে!
নাযিয়াত মায়ের বাড়ী বেড়িয়ে আসার পর থেকে সে আর প্রিয়ন্তী দুজনেই একসাথে এ বাড়ীতেই আছে কিন্তু প্রিয়ন্তী কথা খুব কম বলে!যেন তার কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসেনা!
নাযিয়াত তার মতো যথাসাধ্য সমতা বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে!তবু বেলা চোধুরী সুযোগ পেলেই প্রিয়ন্তীকে রাফিজের সাথে সময় কাটাতে দিয়ে নাযিয়াতকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন!
নাযিয়াত সব বুঝলেও মুখে কিছু বলেনা।সে ধৈর্য্যধারনের চেষ্টা করে!আর আল্লাহর উপর ভরসা করে নিজ দায়িত্ব পালনের পরিপূর্ণ চেষ্টা করে!
প্রতিদিনের মতো আজও দেরী করে ঘুম থেকে উঠেছে
প্রিয়ন্তী!
ওকে উঠতে দেখে বেলা চৌধুরী ময়নাকে নির্দেশ দিলেন ওর জন্য নাস্তা তৈরী করে দিতে!
রাফিজ প্রতিদিনের মতো অফিসে চলে যাবার কিছুক্ষণ পর নাযিয়াতও মাদ্রাসায় চলে গেছে!প্রিয়ন্তী ক্লান্ত পায়ে ড্রইং রূমে এসে বসলো!গত কয়েকদিন থেকেই তার শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা।কিছুই খেতে ইচ্ছে করেনা।খালি গা গুলায়!বেলা চৌধুরী পত্রিকা পড়ছিলেন।প্রিয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বললেন-“তোমার মুখটা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?”
প্রিয়ন্তী হাসার চেষ্টা করলো!তখনি ময়না একটা ট্রে তে করে নাস্তা এনে সেন্টার টেবিলের উপর রাখলো।
বেলা প্রিয়ন্তীকে কিছু বলতে যাবার জন্য মুখ খুলতেই দেখলেন প্রিয়ন্তী বেসিনের দিকে দৌড় দিলো!
বেলা চোখ থেকে চশমা খুলে হাতে নিয়ে সেদিকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
কিছুক্ষণ পর প্রিয়ন্তী খানিকটা স্বাভাবিক হলে তিনি প্রিয়ন্তীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন!প্রিয়ন্তীও ক্লান্ত মুখে জবাব দিয়ে চললো!
বেলা চৌধুরীর মনে হলো হঠাৎ করে তার চারপাশটা যেন আলোকিত হয়ে উঠলো।তবু মুখে কিছু বললেন না,মনের সন্দেহ নিরসনের জন্য তৎক্ষণাৎ তার গাইনী ডাক্তার বান্ধবীকে ফোন করলেন বিকেলে আসার জন্য।
ডাক্তার আসার আগ পর্যন্ত বেলা প্রিয়ন্তীর চুড়ান্ত যত্ন নেয়া শুরু করলেন।তার বুকের ভেতর হ্রৎপিন্ড এমন ভাবে লাফাচ্ছে যে মনে হচ্ছে ওটা বাইরেই বেরিয়ে পড়বে!
বেলা চৌধুরীর গাইনি ডাক্তার বান্ধবী বিকেলে এসে প্রিয়ন্তীকে খুব ভালো করে চেকআপ করে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন তারপর বেলাকে বললেন-“সমস্ত সিমটম তো প্রেগন্যান্সিকেই সাপোর্ট করছে তবু নিশ্চিত হবার জন্য তুমি ওকে কাল সকাল দশটার দিকে আমার চেম্বার নিয়ে আসো।একটা সনোগ্রাফী করে দেখি।আমি তো প্রথমেই বলেছিলাম তোমার ছেলে আর বৌ এর ফিজিক্যালি কোনো প্রবলেম নেই।বোওথ দে আর ওকে…!’
বেলার আনন্দ যেন আর ধরেনা।অবশেষে তার প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হতে চলেছে।তিনি দাদী হতে যাচ্ছেন।খুশিতে দৌড়ে এসে প্রিয়ন্তীর কপালে চুমু খেয়ে বললেন-“আমি খুব দোয়া করি,কাল সকালে তুমি আমাকে একটা গুডনিউজ শোনাও!ওহ্, ভালো কথা!আপাতত কনফার্ম না হওয়া পর্যন্ত এটা গোপন থাকবে,কেমন !নাযিয়াতকে একথা জানানোর কোনো দরকার নেই!শুনলে হিংসেয় মরবে।আমি চাইনা সে কোনো ঝামেলা করুক।কারন আমার নাতির এ বাড়ীতে আগমন মানে ওর দিন শেষ।আহ্,এতো খুশি কোথায় রাখি আমি।এটা তো বোনাস পাওনা হলো, নাতিও পেলাম সেও তোমার গর্ভে।
এখন আর আমার ওকে দরকার নেই।কালকে সকালে ওরা দুজন বেরিয়ে যাবার পর আমি তোমাকে নিয়ে আমার বান্ধবীর ক্লিনিকে যাবো,কেমন?”
প্রিয়ন্তী ফ্যাকাশে চোখে চেয়ে রইলো কেবল, কোনো উত্তর করতে পারলোনা।
বেলা উঠে চলে যেতে গিয়ে ফের দৌড়ে এসে বললেন-“একথা রাফিজকে ও বলবেনা,নইলে ঠিক নাযিয়াতের কানে তুলে দেবে।ইদানীং বউ পাগলা হয়েছে ছোঁড়াটা!এবার তোমার কাছ থেকে ছেলে পেলে মতি ফিরবে আমার ছেলেটার। নাযিয়াত নাযিয়াত করে তো পাগল হয়ে আছে,যত্তসব।কাল পাকা খবর পেয়ে নেই, তারপর মিষ্টি নিয়ে তোমাদের বাড়ী যাবো! ইস্,এতো খুশি লাগছে যে কি বলবো!”
প্রিয়ন্তী নিরবে সব কথা শুনে গেলো কিন্তু কোনো উত্তর দিতে পারলোনা।বেলা ওকে বিছানায় শুইয়ে খুশিতে গুণগুণ করতে করতে নিজের কামরায় চলে গেলেন।আজ তার বড় আনন্দের দিন।তার এতোগুলো বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে।আসলে তার আরেকটু ধৈর্য্য ধরা উচিত ছিলো।
অযথাই নাযিয়াতকে রাফিজ আর প্রিয়ন্তীর মাঝখানে আনা।ডাক্তার তো বলেই ছিলে যে আপনার ছেলে আর বৌ দুজনই ফিট।তবু কেন যে ঐ পাগলামোটা করতে গেলেন।যাক্,যা হবার হয়ে গেছে।কাল পাকা খবর পেলে নাযিয়াতকে কৌশলে ওর মায়ের বাড়ী পাঠিয়ে তারপর যা করার করবেন।এখানে থেকে ওকে বের করা অসম্ভব প্রায়। রাফিজের জন্য পারবেন না।যা করার তা করতে হবে রাফিজের অগোচরে!
বেলা মনে মনে বিভিন্ন পরিকল্পনায় মেতে উঠলেন!

প্রিয়ন্তী বেশ বুঝতে পারছে তার সাথে কি ঘটছে।এবং এও বুঝতে পারছে রাফিজ এই সন্তানের বাবা নয়।এটা ফ্রিকের সন্তান।কিন্তু একথা বেলা চৌধুরী জানেনা।
প্রিয়ন্তীর বুকের ভেতর এক যন্ত্রনার শুরু হয়েছে কাল থেকে।কি করবে সে?
পুরো ব্যপারটা চেপে যাবে?
এতো বড় সত্য ছাইচাপা দিবে?
কিন্তু কিভাবে সম্ভব!রাফিজতো ঠিকই ধরে ফেলবে।
প্রিয়ন্তীর মাথাটা কাজ করছেনা!
মা’কে ফোন দেবার জন্য রিসিভার তুলতেই নাযিয়াত হাসিমুখে ওর ঘরে ঢুকলো-“কেমন আছো তুমি?ময়না বললো সকালে নাকি বমি করেছো?”
-“ঐ এসিডিটি আর কি?”
-“হমম…তোমাকে কত বলি রাতে না খেয়ে থেকোনা।তুমিতো গতরাতেও কিছু খাওনি।এখন কিছু খাবে? এনে দেই?”
-“না না ধন্যবাদ।তুমি বাইরে থেকে এসেছো।তুমি বরং বিশ্রাম নাও গে,আমি ঠিকআছি!”
নাযিয়াত একটু মুচকি হাসি দিয়ে উঠে পড়লো!

বেলা বাকরুদ্ধ হয়ে ওর গাইনী ডাক্তার বান্ধবীর কথাগুলো শুনতে লাগলেন।তার মনে হচ্ছে তিনি যেন আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছেন।এতো সুখ তার কপালে ছিলো।প্রিয়ন্তী মা হতে যাচ্ছে!আহা!কি আনন্দ!
কিন্তু আবেগের বশে ছোট্ট একটা ভুল করে ফেলেছেন তিনি ।এখন সেই ভুল শোধরানোর সময় এসেছে।যা করার এরই মধ্যে করতে হবে!
যত্ন সহকারে প্রিয়ন্তীকে জাপটে ধরে গাড়ীতে তুললেন।প্রিয়ন্তী বুঝলো এসব যত্ন সেই অনাগত সন্তানের কারনে কিন্তু বেলা চৌধুরী যখন জানবে এটা তার বংশ প্রদীপ নয় তখন কি হবে?
কিভাবে কি করবে প্রিয়ন্তী?
মাথা কাজ করছে না!



নাযিয়াত বোকার মতো বেলা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে রইলো।মনে হলো যেন তার কথাগুলো ঠিকমতো কানে ঢোকেনি।অথবা ভুল শুনেছে।
বেলা চৌধুরী চশমা খুলে মুছতে গিয়ে বললেন-“বুঝেছো,কি বলেছি?তুমি কাল মাদ্রাসা থেকে তোমাদের বাসায় চলে যাবে!”
-“জ্বী,মা।কিন্তু কেন?”
-“কারনটা তোমাকে আমি পরে জানাবো।তোমার বোনদের খুব বিপদ! তোমার এখন ওদের পাশে থাকা উচিত।তোমার মা তো একদম একা, তাই না?”
-“জ্বী,কিন্তু কি বিপদ!মা তো আমাকে কিছু বললেন না?”
-“হয়তো সংকোচবশতঃ বলেনি!তুমি কাল যেয়ে দেখা করে এসো তারপর সবই বুঝতে পারবে!”
-“রাফিজকে না জানিয়ে….!”
-“ওকে এসব থেকে দুরেই রাখো তো ভালো।সে কি তোমাকে বিয়ে করেছে তোমার মায়ের সংসারের ঘানি টানার জন্য?”
নাযিয়াত চুপ হয়ে গেলো।তারপর মৃদু স্বরে বললো-“কিন্তু স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোথাও যাওয়াটা তো গুনাহের পর্যায়ভুক্ত। আমি নাহয় রাতে অনুমতি নিয়ে নেবো?”
-“একবার তো বলেছি,ওকে এসব থেকে দুরে রাখো তো ভালো হবে!এখন কথা না বাড়িয়ে যাও সামনে থেকে!ওকে যা বলার আমিই বলে দেবো! ”
নাযিয়াত চিন্তিত মুখে ঘরে এসে শুয়ে পড়লো।
রাতে খাবার টেবিলে ওকে নিরব দেখে রাফিজ দু’একবার ওর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলো কিন্তু বেলা চৌধুরীর কারনে বেশী কিছু বলেনি।তিনি যেন আজ ওদেরকে পাহাড়ায় রাখছেন।এমনকি রাফিজ যখন নাযিয়াতের রুমে ঢুকতে যাচ্ছিলো তখন পেছন থেকে বাধা দিয়ে বলে ওঠেন-
-“প্রিয় টার শরীর অনেক খারাপ।ওর দিকে একটু খেয়াল রাখিস।নাযিয়াত তুমি আমার রুমে এসো কথা আছে!”
অগত্যা রাফিজ প্রিয়ন্তীর রুমে ঢুকতে বাধ্য হলো আর নাযিয়াত বেলা চৌধুরীর রুমের দিকে এগিয়ে গেলো!

★★★
নাযিয়াতকে দেখে ওর মা অবাক হয়ে গেলেন কিছুটা-“কি রে মা?এই অসময়ে তুই?একটা ফোন না কিছু!তুই যে আসবি জানাবি তো?”
কি হয়েছে কোনো সমস্যা?তোর শ্বাশুড়ী ফোনে বললো তোকে কিছুদিন আমাদের বাড়ী রাখতে।রাফিজ নাকি তোর সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে?উনি এজন্য তোদের দুজনকে দুই দিকে রেখে পরীক্ষা করতে চায়!কিন্তু এটা কোনো সিষ্টেম হলো স্বামী স্ত্রী’র মাঝে দুরত্ব ঘোঁচাবার?কি হয়েছে, আমাকে বলতো?”
নাযিয়াত এবার কেঁদে ফেললো!
মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো-“আমি নিজেও কিছু বুঝতে পারছিনা মা,উনি কেন এমন করছেন!ওনার কথাবার্তার ধরন আমার ভালো ঠেকছে না।তোমাদের জামাই কিচ্ছু জানেনা,আমি যে আজ এখানে আসবো সেটা ওনাকে বলে আসতে পারিনি।চিন্তায় সে সারারাত ঘুমাতে পারবেনা!কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিনা।উনি মিথ্যে কথা বলে আমাকে বাড়ী পাঠালেন কেন!”
বলতে বলতে নাযিয়াত দুহাতে মাথা চেপে ধরলো।ওর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে।
নাযিয়াত আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা।
জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো!

চলবে…..

উত্তরাধিকার (৭ম পর্ব)

0

উত্তরাধিকার (৭ম পর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************
প্রিয়ন্তী কোনোভাবেই মনকে বোঝাতে পারছেনা যে,ইট ওয়জ আ গেইম।
ফ্রিক ব্যপারটাকে যতই হালকাভাবে নিক না কেন প্রিয়ন্তী বিশ্বাস করে শরীরের সাথে মনের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে।শরীর হলো মনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ!বরং মনের ইচ্ছা অভিলাষ বাস্তবায়নের মাধ্যমই হলো শরীর।সেখানে ফ্রিক কিভাবে বলতে পারে তার প্রিয়ন্তীর প্রতি কোনো ইন্টারেষ্ট নাই?
চলে আসার আগের দিন প্রিয়ন্তী ফ্রিককে জিজ্ঞেস করেছিলো যে,সে প্রিয়ন্তীকে ভালোবাসে কিনা বা বিয়ে করতে চায় কিনা।ফ্রিক প্রবল বিস্ময়ে ভাঙ্গা বাংলায় বলেছিলো-“এই তোমরা এশিয়ানরা বড্ড বেশী ইমোশনাল।তোমাকে দেখে ভালো লেগেছে এন জাষ্ট আই টুক দ্যা টেষ্ট, দ্যাটস ইট।আ’ম স্যরি টু সে,সারাজীবনের সঙ্গী বানাবার মতো ম্যাটেরিয়াল তোমার মাঝে নাই!তাছাড়া যেখানে আমি নিত্য নতুন গার্লফ্রেন্ড পাচ্ছি সেখানে কোনো একজনকে পায়ের বেড়ী বানাবার কোনো কারন তো দেখিনা।”
প্রিয়ন্তীর চোখে পানি চলে এসেছিলো ওর কথাগুলো শুনে!নিজেকে একটা সস্তা ছেঁড়া কাগজ মনে হচ্ছিলো ওর !
ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলেছিলো-“দেন হোয়াই ডিড ইউ টাচ মি?আমার সতীত্ব হরণের সময় তোমার মনে ছিলোনা, আমি আরেকজনের স্ত্রী?”
-“সতীত্ব?হোয়াট ইজ ইট?আ’ থিঙ্ক সতীত্ব ইজ আ সিলি ইস্যু লাইক আ ওয়েট ট্যিসু…হা হা হা!”
প্রিয়ন্তী চোখ মুছে বলেছিলো-“আমি আমার স্বামীর সামনে দাঁড়াবো কি করে?”
-“কেন,তাকে তো এসব বলার কোনো দরকার দেখিনা!দেশে যাও…গিয়ে ধুমসে সংসার কর অথবা এখানে ফিরে এসো ,দুজনে হেসেখেলে জীবনটা কাটিয়ে দেই!বাধাবন্ধনহীন জীবন! বাট স্যরি, নো ম্যারিজ এটসেটরা ওকে?”
প্রিয়ন্তী যা বোঝার বুঝে গিয়েছে।ফ্রিক অতি আধুনিক যুগের আধুনিক মনের মানুষ।সে এখন পুরোদমে অষ্ট্রেলিয়ান।ওর কাছে প্রিয়ন্তী এখন এশিয়ান।
বাঙালী সেন্টিমেন্ট ওর মাঝে নেই!ইসলাম বা মুসলিম শব্দ দুটো তো ওর কাছে পুরোপুরি অচেনা।ওর মনে রোজ কেয়ামতের ভয় নেই।কিন্তু প্রিয়ন্তী কি করবে!মনকে যে বহুবার বোঝাতে চেষ্টা করেছে যা হয়েছে ভুলে যাও,ফিরে গিয়ে রাফিজের সাথে সংসার শুরু করো!
কিন্তু রাফিজ আর তার মাঝখানে এখন নাযিয়াত নামের মেয়েটা আছে যে তাকে অনবরত আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।এক অজানা ভয়ে প্রিয়ন্তী শিউরে উঠে।
গতরাতে শোবার আগে জীবনে প্রথমবারের মতো সেই অদৃশ্য অথচ মহাক্ষমতাধর প্রতাপশালী বাদশার দরবারে হাত তুলে বলেছিলো!আমাকে শান্তি দাও।অন্তর্দহনে যে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি!আমি কি করবো?আমাকে পথ দেখাও!কাউকে বলতে পারছিনা আমার কষ্টের কথা।তোমাকেই জানালাম।তুমি আমার কষ্ট দুর করে দাও!”
বাকী রাতটা আর ঘুমাতে পারেনি প্রিয়ন্তী।সবার অগোচরে ওর জীবনে ঘটে যাওয়া এক নিরব বিপর্যয় ওকে ঘুমাতে দেয়নি!

***
***

সন্ধ্যার পরপরই ওরা প্রিয়ন্তীদের বাড়ী চলে এলো!নাযিয়াতকে দেখে প্রিয়ন্তী চোখ নামিয়ে নিলো!এক অদৃশ্য বাধা ওকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরেছে।নাযিয়াতই সালাম দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো!ওর স্পর্শে প্রিয়ন্তীর মনে পাপবোধ যেন আরো বেশী জেগে উঠলো!নিজেকে অচ্ছ্যুৎ মনে হচ্ছে ওর কাছে!
রাফিজ ওদের পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে গেলো!প্রিয়ন্তী রাফিজের দিকেও তাকাতে পারলোনা!
নাযিয়াত প্রিয়ন্তীর মা’কে সালাম দিয়ে মুসাফাহার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো!শাজিয়া ভদ্রতা রক্ষার্থে কোনোরকমে সালামের জবাব দিয়ে হাতটা ছুঁয়েই ছেড়ে দিলেন!
প্রান্তিক খুবই আন্তরিকভাবে রাফিজকে দরাজ গলায় সালাম দিয়ে কোলাকুলি করে মুসাফাহা করলেন।পেছনে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে আবৃতা রমনীকে দেখেই বুঝলো যে,ইনিই তাহলে রাফিজের নাযিয়াত।মাশাআল্লাহ্,প্রিয়ন্তীর ওর কাছ থেকে কিছু শেখা উচিত।প্রান্তিক ওদের দুজনকে দেখে মনে মনে রবের দরবারে ওদের অটুট বন্ধনের জন্য দু’আ করলো!
রাতে খাবার দাবারের সময়ও শাজিয়া কৌশলে নাযিয়াতকে সুক্ষ্মভাবে অপমানের চেষ্টা করলো!
নাযিয়াত তখন ভেতর ঘরে বোরকা খুলে মেয়েদের সাথে খেতে বসেছে।
অমনি শাজিয়া এসে পেছন থেকে নাযিয়াতকে ধরে বললেন-“তুমি একটু পরে বসো মা,তুমি তো আমাদের ঘরেরই মেয়ে,বাইরের ওরা খেয়ে নিক,কেমন?”
নাযিয়াত মৃদু হেসে উঠে পড়লো-“কোনো সমস্যা নেই আন্টি!”
নাযিয়াত অপমানটা গায়ে মাখলো না কেবল মনে মনে -“ক্বুলিল্লাহুম্সা মালিকাল মুলকি তু’তিল মুলকা মানতাশা.উ….থেকে বিগয়রি হিসাব”….পর্যন্ত আউড়ে গেলো!যার সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ এই,সম্মান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে।যাকে ইচ্ছা আল্লাহ সম্মাণিত করেন,যাকে ইচ্ছা অপদস্থ করেন,যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করে থাকেন(সুরা আলে ইমরান)!
এই আয়াতটি পাঠ করলে নাযিয়াতের মনে এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করে। আর মনে হয় যা হচ্ছে তাতে আল্লাহর ইচ্ছে শামিল রয়েছে!
নাযিয়াত উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই প্রিয়ন্তীর বাবা ঘরে ঢুকে এসব দেখে শাজিয়ার উপর ক্রোধে প্রায় ফেটে পড়লেন-“বাইরের কে আছে এখানে যে তুমি ওকে তুলে দিলে?তোমার আক্কেল বলে তো কিছু আগেও ছিলোনা এখনো নাই!”
বলে নাযিয়াতের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে ক্ষমা চেয়ে বললেন-“তুমি কিছু মনে করোনা মা!বসো…বসো!”
শাজিয়া চুপসে গেলেন।
প্রিয়ন্তীর বাবার এই এক স্বভাব,মানুষজন দেখেনা,হাউ হাউ করে চিৎকার শুরু করে দেয়।তিনি তৎক্ষণাত কিছু বললেন না!
পরে বারান্দায় আড়ালে এলে চাপা অথচ ঝাঁঝালো স্বরে শাজিয়া প্রিয়ন্তীর বাবাকে ধরলেন-“এই যে শোনেন,ঐ মেয়েটার জন্য দরদ একবারে উথলে উঠলো যে বড়?সে আপনার কোন জনমের মেয়ে যে সবার সামনে আমাকে অপমান করলেন?”
-“সে আমাদের মেহমান শাজিয়া!অন্তত আজকের দিনে তার সাথে তুমি এমন করতে পারোনা!”
শাজিয়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই পেছন থেকে প্রান্তিক বলে উঠলো-“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করে সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে!” বিষয়টা কতটা মারাত্মক ভেবে দেখেছো মা!তোমার চরম শত্রুও যদি তোমার ঘরে মেহমান হয়ে আসে তার অপমান করা তো দুরে থাক্ অনাদরটুকু করার অনুমতি নেই,করলে তুমি আল্লাহ ও আখিরাতে অবিশ্বাসী বে-ঈমান হয়ে যাবে”!
শাজিয়া মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেলেন সেখান থেকে!
বিদায় নেবার সময় সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে প্রিয়ন্তী হঠাৎ বেলাকে বলে উঠলো-“আমি কিছুদিন আম্মুর কাছে থাকতে চাই মা!”
শাজিয়া অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন-“সে কি রে,এতদিন পরে এলি।দুটো দিন ও বাড়ী হয়ে আয় তারপর নাহয় আমার কাছে এসে থাকিস।”
রাফিজ দ্রুত বলে উঠলো-“আমি তোমাকে যাবার জন্য চাপাচাপি করবোনা,আম্মার কাছে থাকতে চাইছো থাকো যেদিন ইচ্ছে হবে ফোন দিয়ো,এসে নিয়ে যাবো!”
প্রিয়ন্তী বুঝলো রাফিজ ভদ্রতা রক্ষার্থে কথাগুলো বলেছে!
নাযিয়াত প্রিয়ন্তীর হাত চেপে ধরে বললো-“তুমি এলে ভালো হয় প্রিয়ন্তী ,তাহলে আমি কিছুদিন আমার মায়ের ওখানে বেড়িয়ে আসতে পারতাম।আমি ভাবলাম তুমি আজই যাবে আমাদের সাথে।চলো না প্রিয়ন্তী!”
প্রিয়ন্তী নাযিয়াতের দিকে তাকিয়ে বললো-“না..না..আমার ক’টা দিন মায়ের কাছেই থাকার ইচ্ছা।তুমি মনের ওপর কোনো চাপ নিওনা!তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই!”
নাযিয়াত এর পরেও বারদুয়েক অনুরোধ করলো প্রিয়ন্তীকে যাবার জন্য,শাজিয়াও চাপাচাপি করলেন কিন্তু প্রিয়ন্তী যেন না যাবার পণ করেছে।
বেলা কিছু বললেন না,কেবল তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে প্রিয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
শুধু রাফিজ একবার সুযোগ মতো পেয়ে নাযিয়াতে কনুই আঁকড়ে ধরে বলেছে-“তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো!সে যেতে চাচ্ছেনা তারপরেও জোর করছো কেন?”
নাযিয়াত কোনো উত্তর দেয়নি!


ওরা চলে যাবার পর শাজিয়া প্রিয়ন্তীকে ধরলেন-“তুই গেলি না কেন?তোর অনুপস্থিতিতে ওই মেয়ে তো সুখের সংসার পেতে বসেছে!তুই আমার বাড়ী মুখ কালো করে পড়ে থাকবি আর ঐ মেয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসে তোর সংসারে রাজত্ব করবে, এটা আমি মা হয়ে বসে বসে দেখবো ভেবেছিস?”
প্রিয়ন্তী দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে কিন্তু কোনো কথা বলছে না!
শাজিয়া বুঝলেন,মেয়ে তার সংসারে ফিরে যেতে চায় কিন্তু নাযিয়াতের জন্য পারছেনা!তিনি মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন-“আমি জানি,তুই নিজের সংসারে ফিরে যেতে চাস কিন্তু ঐ চালাক মেয়েটার জন্য পারছিস না।আমি সব বুঝি।তুই ভাবিসনা,আমার বান্ধবী শায়লা এসব অনেকদিন থেকে করছে! ও এসব কাজে ওস্তাদ বলতে পারিস!ও তো বলেছে,কিছুদিনের মধ্যেই নাযিয়াতকে ওই বাড়ীছাড়া করবে।রাফিজের মনে….
এমন সময় প্রান্তিক ঘরে প্রবেশ করায় কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেলো শাজিয়ার।
ছেলের সামনে এসব কথা বলতে চান না তিনি!এমনিতেই একরোখা ছেলে তার উপর যে কথা বলেছে তাতে শাজিয়ার হার্ট এ্যাটাক হতে বাকী ছিলো!ওকে দেখে শাজিয়া মুড পাল্টে ফেললেন।
ছেলের পেছন পেছন গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-“খাবি এখন? আয় তোকে দিয়ে দেই!”
-“একটু পরে খাবো মা।সন্ধ্যের হেভী নাস্তা এখনো হজম হয়নি!আচ্ছা,প্রিয়ন্তী গেলো না কেন?”
-“কেন আবার ঐ নাযিয়াত….(স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে বলতে গিয়ে থেমে গেলেন শাজিয়া) স্বর পাল্টে বললেন-“ওর মন খারাপ,
নাযিয়াত রয়েছে সে বাড়ীতে,কি ভাবে যাবে ও!কোনো স্ত্রী কি নিজের স্বামীর পাশে অন্য মেয়েকে সহ্য করতে পারে?”
-“অন্য মেয়ে কোথায়?সে তো রাফিজ ভাইয়ের বিবাহিতা স্ত্রী!”
-“যত যাই হোক।সে তো সতীনই!
–“আসলে আমাদের এসব প্রেজুডিস থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।ধর্মটা এখন আমাদের পোষাকি হয়ে গেছে।ধর্মীয় বিধানের ওপর আমাদের আস্থা নেই বলেই এমনটা ভাবছো মা !আমাদের কাছে ধর্মটা এখন শুধু জন্মের সময় কানে আযান দেয়া আর মৃত্যুর সময় জানাযা পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে!মাঝখানের পুরোটা জীবন আমরা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো চলতে শুরু করেছি!নতুবা অন্যের রীতি ধার করে চলি! এজন্যই তো মুসলমানদের আজ এই অবস্থা!”
-“হয়েছে…লেকচার বন্ধ করে খেয়ে নে চল্!”
-“বন্ধ করলাম লেকচার কিন্তু ঐ কথাটা তোমাকে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেই।যে কারনেই হোক,নাযিয়াত যদি রাফিজের সংসার করতে না পারে, তাহলে তার জন্য ঘর আর বর দুটোই প্রস্তুত আছে।তোমাকেই তখন তাকে বরন করে নিতে হবে,বলে দিলাম! ”
শাজিয়া তেতে উঠলেন-“সে কোন রূপনগরের রাজকন্যা যে,তুই ওকে বিয়ে করবি?তুই তো ওকে চোখেও দেখিসনি!হতদরিদ্র ঘরের ফকিন্নী একটা।চারটা পাঁচটা বোন ঘরে…!”
প্রান্তিক হাসলো-“রূপ দেখে বিয়ে করার মতো বোকা আমি নই!তাহলে ঠকতে হবে কারন রূপ আলগা সাজে চমকানো যায় আর এটা সাময়িক।সংসার জীবনে রূপ কোনো কাজেই আসেনা মানসিক একটা সান্তনা ছাড়া!
বরং রূপসী মেয়ে বদচরিত্রের হলে তার রূপটাও তখন আর দেখতে ভালো লাগেনা!আমি তো বিয়ে করবো রাসুল সাঃ এর বলে দেয়া সিষ্টেমে!তিনি বলেছেন-“চার কারনে নারীকে বিয়ে করা হয়,তাদের ধনসম্পদের কারনে,তাদের বংশমর্যাদার কারনে,তাদের রূপ সৌন্দর্য্যের কারনে এবং তাদের ধার্মিকতার কারনে।সুতরাং ধার্মিক নারী লাভ করতে চেষ্টা করবে,তুমি ধ্বংস হও যদি অপর নারী চাও!”(বুখারী/
মুসলিম)!
প্রিয়ন্তী চুপ করে শুনছিলো কথাগুলো।প্রান্তিকের কথাগুলো ওর বুকের ভেতরে গিয়ে আঘাত করছিলো যেন!সে উঠে সেখান থেকে চলে গেলো।
শাজিয়া বিরক্ত হয়ে ছেলেকে বললেন-
–“তোকে না বলেছি,উল্টাপাল্টা কথা বলিস না!দিলি তো বোনের মনটা খারাপ করে।তোর কথাটা তো ওর ওপরেই যায়,কারন ও দেখতে সুন্দর কিন্তু ধার্মিক না, আর নাযিয়াত ধার্মিক?”
-“মা আমি এসব ভেবে কথাটা বলিনি!যাই হোক ওকে স্যরি বলে দেবো আর তোমাকে বিনীত অনুরোধ ঐসব গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থেকো।ওদেরকে শান্তিতে থাকতে দাও!তোমার ওসব কাজের পরিণতি কিন্তু ভয়ংকর!নাযিয়াতের কতটুকু ক্ষতি করতে পারবে জানিনা কিন্তু নিজের ক্ষতি যে করতে যাচ্ছো এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত!”
প্রান্তিক বেরিয়ে গেলে শাজিয়া চিন্তিত মুখে বান্ধবীকে ফোন লাগালেন।

দুদিন ধরে অফিসের কাজের প্রচুর চাপ যাচ্ছে রাফিজের।ব্যবসায় একটা ছোটখাটো লসও খেয়েছে এবার!মেজাজটা যেন অকারনেই খিঁচড়ে আছে।গতরাতেও হঠাৎ করে নাযিয়াতের উপর ক্ষেপে গিয়েছিলো ও।বলা নেই কওয়া নেই আচমকা নাযিয়াতের বাড়িয়ে ধরা চায়ের কাপটা ধাক্কা মেরে জমিনে ফেলে দিয়েছে রাফিজ।নাযিয়াত বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে ছিলো।রাফিজ নিজেও অবাক,ও এমন কেন করলো নিজেও বুঝতে পারছেনা!
বেচারী ওর সামনে চায়ের কাপ ধরে দাঁড়িয়েছিলো এটাই ওর দোষ।রেখে চলে যেতে পারতো!
যায়নি!
কেবল এই তুচ্ছ অযুহাতে এমনটা করার মানুষ রাফিজ নয়।কোনো কালে ছিলোনা!
অথচ……..কি হলো তার?
পরে নাযিয়াতের কাছে রাফিজ ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে।ও অবশ্য ব্যপারটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে।ওর সহনশীলতাটা রাফিজকে মুগ্ধ করে।চট করে কোনো ব্যপারেই উত্তেজিত হয়না!কিন্তু রাফিজ নিজে কষ্ট পেয়েছে ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করে।
আজকাল যে কি হয়েছে ওর।কিছুতেই টেম্পার ধরে রাখতে পারেনা!প্রায়ই ও ক্ষেপে যাচ্ছে নাযিয়াতের ওপর।এবং সে লক্ষ্য করেছে কেবল নাযিয়াতের সাথেই ওর এমনটা হচ্ছে!
অন্য সবার সাথে ও স্বাভাবিক থাকছে কেবল নাযিয়াতের সামনে এলেই ওর অস্থির লাগছে।
দুদিন ধরে মাথাটাও খুব ব্যথা করছে।ঠান্ডা লাগলো কিনা কে জানে!
জ্বর জ্বর লাগছে কিন্তু থার্মোমিটারে জ্বর ধরা পড়ছেনা।

রাতে শোবার সময় রাফিজ চিৎ হয়ে শুয়ে ডান হাতটা কপালে উল্টে রেখে নানান কথা ভাবছিলো!নাযিয়াত চুপ করে শুয়ে আছে ও মুখো হয়ে।গত কয়েক দিনের ওর উল্টাপাল্টা আচরণে ও বিভ্রান্ত।আজকে সন্ধ্যায়ও বাঁজখাই কন্ঠে ধমক দিয়ে বলেছে-“যাও তো এখান থেকে!”
নাযিয়াত তখন কথা না বাড়িয়ে সরে গেছে।
ওর ক্ষিপ্ত আচরণের কারনেই রাফিজকে না ঘাটিয়ে চলার চেষ্টা করছে ও!
বিয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত সবসময় নাযিয়াত ওর বুকে মাথা রেখে শুয়েছে।কিন্তু আজ রাফিজের কারনেই ও রাফিজ থেকে দুরে!রাফিজের খুব কষ্ট হচ্ছে।রাফিজ ভাবছে ওকে কাছে টেনে নেবে কিন্তু হাতপা যেন নড়াতেই ইচ্ছে করছেনা।
এমন কেন লাগছে?
কিছুক্ষণ পর মনের উপর জোর খাটিয়েই নাযিয়াতের বাহু ধরে ওকে নিজের দিকে ফেরালো।কিন্তু ততক্ষণে নাযিয়াত ঘুমিয়ে পড়েছ।
রাফিজ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
কি নিষ্পাপ একটা মুখ অথচ রাফিজ তাকে কষ্ট দিচ্ছে!নাযিয়াত সর্বক্ষণ ওর খুশির জন্য কি না করছে আর সে?
নাযিয়াতের ঘুম ভেঙ্গে গেলো রাফিজের তপ্ত নিঃশ্বাসে!চোখ মেলেই রাফিজকে ওভাবে দেখে চমকে গেলো সে।
রাফিজ কোমল স্বরে ডাকলো-
–“নাযিয়াত….আ’ম স্যরি সোনা!”
নাযিয়াত ফুঁপিয়ে উঠলো যেন।
রাফিজ ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো!

শাজিয়া মুখের ওপর হাত দিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলেন প্রিয়ন্তীর দিকে!
প্রিয়ন্তী ফুঁপাচ্ছে!
শাজিয়া ক্রোধে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন-
-“আমি আজই বড় ভাইয়ার সাথে কথা বলবো!ফারিকের এতো অধঃপতন?”
-“না,মা।বড়মামাকে কিছু বলতে যেওনা।অযথা একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে।তাছাড়া ফারিক অনেক বদলে গেছে!ভুলটা আমারই!ওর ওপর অনেক বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম।ভেবেছিলাম,ওর মতো প্রগতিশীল মানুষ এসব ব্যপারে আরো উদারমনা হবে!”
-“আরে কিসের প্রগতিশীল?ব্যাটা জাত মানেই নারীলোলুপ!শোন্,তুই কিন্তু এসব ব্যপারে আর কারো সাথে আলাপ করবিনা।এটা একটা দুর্ঘটনা,যে কারো সাথেই ঘটতে পারে!”
-“কিন্তু মা….!”
-“কোনো কিন্তু না!তুই তোর মতো স্বাভাবিক থাক।নাযিয়াতের ব্যপারটা শেষ করে তোকে ও বাড়ীতে পাঠানো না পর্যন্ত শান্তি নাই!এখন তো ব্যপারটা আরো জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে!”
-“এখন আমি ও বাড়ী যেতে পারবোনা মা!আমার শ্বাশুড়ী খুব অন্যরকম।সে কোন না কোনো ভাবে বুঝে ফেলবে!তাছাড়া আমি এখনো কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি!”
প্রিয়ন্তী চোখ মুছে বললো!
শাজিয়া অবাক হয়ে বললেন-“কিসের সিদ্ধান্ত!”
প্রিয়ন্তীর মুখ কিছুটা কঠিন দেখালো-
-“ফারিককে আমি এমনি এমনি ছেড়ে
দেবোনা মা!”
-“কি করবি?”
-“কি করবো তা এখনো জানিনা!”
শাজিয়া মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন!মেয়ের মধ্যে একধরনের প্রতিশোধ প্রবণতা কাজ করছে কিন্তু সে কিইবা করতে পারবে বরং আরো বদনাম হবে তারচে নাযিয়াতকে সরিয়ে ওকে ওর ঘরে পাঠিয়ে দেয়াই সবদিক থেকে ভালো হবে!তিনি শায়লার সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন!যা করার দ্রুত করতে হবে!
*★
*
রাফিজ অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বসেছে।নাযিয়াত নাস্তার প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বললো-“একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম!”
-“বলো…!”
-“আপনি অনুমতি দিলে আমি দুতিন দিনের জন্য বাসায় যেতে চাচ্ছিলাম।নাদিয়ার বিয়ের কথা পাকা হয়েছে!খালামনি শুক্রবার আকদ করাতে চাচ্ছে।আমাকে যেতে বলেছে!”
রাফিজ নিরবে নাস্তা খেতে খেতে ওর কথাটা শুনলো।কোনো জবাব দিলোনা!
নাযিয়াত আবার বললো-“আম্মা বলেছে,ঐ ক’দিন প্রিয়ন্তীকে আনিয়ে নিতে!”
রাফিজ গম্ভীর স্বরে বললো-“চা দাও!”
নাযিয়াত চায়ের কাপ বাড়িয়ে ধরলে রাফিজ কাপটা হাতে নিয়ে বললো-“এমন হলে তো তোমাকে যেতেই হবে।যাও,কি আর করা!”
নাযিয়াত ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল!
রাফিজ চিন্তিত মুখে চায়ে চুমুক দিলো!
*
বেলার ফোন পেয়ে শাজিয়া উচ্ছসিত হয়ে বললেন-“এটা তো খুবই ভালো কথা!প্রিয়ন্তীকে তো সেদিনই বলেছিলাম!ও আসলে বাইরে থেকে এসে ইজি ফিল করছিলো না।আমি কালই ওকে পাঠিয়ে দেবো!”
রাফিজ কখন আসবে ওকে নিতে?
-“অফিস থেকেই চলে যেতে বলে দেবো !”
-“তাহলে তো খুবই ভালো হয়!”
ফোন রেখে শাজিয়া আনন্দিত!
প্রিয়ন্তীকে জানালেন যাবার কথা।প্রিয়ন্তী মৃদু আপত্তি তুললেও তিনি ওর কথা কানে নিলেন না!মেয়েকে যে করেই হোক এবার ও বাড়ীতে পাঠাতে চান তিনি!
খুব ভালো হয়েছে যে নাযিয়াত বাপের বাড়ী যাচ্ছে।
এই যাওয়াই ওর শেষ যাওয়া হবে।
ওকে আর ফিরতে দেবেন না তিনি!
রাফিজের কাছে!
………..

উত্তরাধিকার (৬ষ্ঠ পর্ব)

0

উত্তরাধিকার (৬ষ্ঠ পর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************
হোটেল শৈবালের নিজস্ব মনোরম বীচে হাঁটছিলো ওরা দুজন!
নাযিয়াতের কাছে খুব ভালো লাগছিলো হাঁটতে!ভালো লাগার সবচে বড় কারন হলো চারপাশে কোনো লোকজন নেই।
রাফিজ ইচ্ছে করেই এই হোটেলটা নিয়েছে কারন বীচটা এদের নিজস্ব আওতাভুক্ত।কেবল এই হোটেলের বাসিন্দারাই এই বীচে বিচরণের অধিকার পাবে।ফলে বীচ একরকম খালিই প্রায়!দুরদুরান্তে দু একজন ইতিউতি ছড়িয়ে আছে!
রাফিজ নাযিয়াতের হাত ধরে সাগরে নামলো!নাযিয়াত প্রথমে নামতে চায়নি কারন ভেজা কাপড় গায়ে সেঁটে থাকবে,কিন্তু রাফিজ ওকে অভয় দিয়ে বলেছে,কোনো সমস্যা নেই!তোমাকে দেখার মতো এখানে আমি ছাড়া কেউ নেই!তাছাড়া শুকনো আবায়া সাথে নিয়ে এসেছি,চাইলে ফেরার সময় সেটা পড়ে নিলেই তো হলো!
নাযিয়াত কোমড় পানিতে নেমে আরো এগিয়ে যাচ্ছিলো দেখে রাফিজ টান দিলো ওকে-“আরে,ঐ দিকে কই যাচ্ছো?প্রথমে তো নামতেই চাওনি আর এখন একেবারে মাঝসাগরে রওনা দিয়েছো!”
নাযিয়াত যতই বারন করুক তবু রাফিজ এক মুহূর্তের জন্য ওর হাত ছাড়েনি!
তার ধারনা হাত ছাড়লেই কোনো একটা বিপত্তি ঘটবে!সে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজী না!
এমনিতেই সময়টা অফ সিজনের!
সাগর আজ সকাল থেকেই বৈরী আচরন শুরু করেছে।আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে।গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে।তিন নম্বর বিপদ সংকেত দেখাচ্ছে!
রাফিজ নাযিয়াতকে নিয়ে দুপুরের পরপরই বেরিয়েছে,পুরোটা বিকেল নিস্তদ্ধ বীচে ওরা দুজন!যেন জনমানবহীন প্রান্তরে এক জোড়া কপোত-কপোতী!নাযিয়াতের কোমর বেষ্টন করে দাঁড়িয়েছিলো রাফিজ।
বাতাসের প্রবল ঝাপটা ওদেরকে বিচ্ছিন্ন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে যেন !
নাযিয়াত একবার বলেই ফেললো-“ইস্,কি এলোপাতাড়ী বাতাস, মনে হচ্ছে দুজনকে দুদিকে উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে!”
রাফিজ ওর দিকে তাকিয়ে আরো শক্ত করে ওকে কাছে টেনে বলেছে-“এ বাঁধন বড় শক্ত।চাইলেই কেউ ছিঁড়ে ফেলতে পারবেনা!”
নাযিয়াত মৃদু হেসে ওর কাঁধে মাথা রেখেছে!রাফিজ ওর কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিসিয়ে বললো-“আশেপাশে কিন্তু কেউ নেই…দেখেছো?”
নাযিয়াত কিছুটা কুঁকড়ে গেলো যেন!
চারপাশে আরেকবার তাকালো!
রাফিজ অনেকটা জোর করেই নাযিয়াতকে নিজের দিকে ফেরালো!
নাযিয়াত দুচোখ বন্ধ করে ফেললো!
বাতাসের প্রবল ঝাপটা ওদের চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে!
কিন্তু ওরা দুজনই স্থির অবিচল!

রাতে প্রকৃতি আরো বিমুখ হয়ে গেলো!সন্ধ্যের পর মাগরিবের নামাজ সেরে ওরা দুজন ফের বেরোতে চেয়েছিলো।কিন্তু বাতাসের এলোপাথাড়ী আক্রমন আর সাগরের গর্জন দেখে রাফিজ মত বদলালো!সন্ধ্যেটা দুজনে খোলা বারান্দায় বসে সাগরের ক্রুদ্ধরূপ দেখেই কাটিয়ে দিলো!
ঈশার নামাজের জন্য নাযিয়াত রাফিজকে ধরলো ইমামতির জন্য!
-“দুজনেই তো সুন্দর জামাত হয়,আপনি থাকতে একা একা পড়ার কোনো যুক্তি নেই!নিন্,আজ আপনিই নামাজ পড়ান!”
*
রাফিজ মুচকি হেসে বললো-“তুমি দেখছি আমাকে পাক্কা মুসল্লী বানিয়ে ফেলবে!”
-“শুধু আপনাকেই বানাতে চাইনা নিজেও হতে চাই!তারপর একসাথে জান্নাতের বাগানে চিরযৌবনা হয়ে আপনার হাত ধরে হাঁটতে চাই,জান্নাতের নহরে গা ভেজাতে চাই,মোতির মতো তাবুর নিচে দুগ্ধফেনিল নরম পালকের মতো বিছানায় আপনার সাথে অবগাহন করতে চাই!আপনি চান না?”
রাফিজ গম্ভীর মুখে বললো-“আল্লাহ আমাদের দুজনকে কবুল করুন!
নাযিয়াত বললো-‘আমিন!”
*
পরের দিন প্রকৃতি অনেকটাই শান্ত! রাফিজ নাযিয়াতকে নিয়ে ইনানী বীচে যাবার পরিকল্পনা করলো!একটা চাঁদের গাড়ী ভাড়া করে দুজনে ইনানী সৈকতে রওনা দিলো!সারাটা দিন সেখানে কাটিয়ে বিকেলে হিমছড়ি হয়ে শৈবালে ফিরলো।
নাযিয়াতের কাছে নাকি শৈবালের বীচটাই বেশী ভাল লাগে।
রাফিজ হাসলো-“কারন ওখানে চারপাশে দুরদুরান্ত পর্যন্ত কেউ নেই,এইজন্য! আর ইনানী বীচতো মোটামুটি ভীড়।শান্তিতে বসার কোনো উপায় নেই!”
রাতে খাবার রুমে আনিয়ে খেলো ওরা।দুজনই খুব ক্লান্ত।নাযিয়াত বাসায় ওর মা আর বোনদের সাথে কথা শেষ করে দেখলো রাফিজ খুক খুক করে কাশছে!
তৎক্ষাণাৎ ব্যাগ থেকে সর্ষের তেলের বোতল বের করে ওর কাছে এসে বসলো!
রাফিজ অবাক হয়ে তাকালো-
-“এটা আবার কি?”
-“সর্ষের তেল।বুকে পিঠে মালিশ করে দিলে কাশিটা কমে যাবে!”
–“ও,তাই নাকি!আহ্ দারুন!নিজের সৌভাগ্যে নিজেরই ঈর্ষা হচ্ছে!এতো যত্ন শেষ কবে পেয়েছি মনে পড়েনা!”
-“বদনজরের দু’আ পড়ুন।কারন বদনজর কিন্তু মারাত্মক।আর নিজের নজরই বেশী লাগে।বদনজর সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল সাঃ বলেছেন-“বদনজর সত্য।বদনজর উটকে পাতিলে ঢোকায় আর মানুষকে ঢুকায় কবরে!যদি কোনো পোশাকে বা কোন ভালো কিছুর কারনে নিজেকে ভাল ও সুন্দর দেখতে পান তখনই আল্লাহর পানাহ চাইবেন নতুবা আপনার নিজের অথবা অন্য যে কারো বদনজর লেগে যাবে!
রাসুল সাঃ বলেছেন-“যদি কোনো জিনিস তাক্বদীর পরিবর্তন করতে পারতো তবে সেটা বদনজরই হতো!”
আর মা আঈষা রাঃ বলেছেন কারো উপর বদনজর লাগলে রাসুল সাঃ ঝাঁড়ফুঁক করতে নির্দেশ দিয়েছেন-!(বুখারী/মুসলিম)!
-“ঝাঁড়ফুক মানে তো দু’আ,তাই না?তা বদনজরের দু’আটা কি?”
-“জ্বী,দু’আ!এমনিতে বদনজর ছাড়াও বিভিন্ন বিপদাপদ থেকে বেঁচে থাকার জন্য পড়তে পারেন-“আ’উযুবি কালিমা তিল্লাহিত্তাম্ম
াতি মিন শাররি মা খলাক্ব!”(মুসলিম)
এছাড়া সুরা ফালাক্ব,নাস,ইখলাস পড়ে ঝাঁড়ফুক করা যায়!এগুলির ফজিলত অসীম!”
বলে নাযিয়াত সযত্নে রাফিজের বুকে তেল মালিশ করে দিতে লাগলো!

★★

আজ প্রিয়ন্তীর আর্ট এগজিবিশন চলছে!
বাঙালী পাড়ার মোটামুটি সবাই এসেছে! প্রিয়ন্তীর বড়মামা আজ প্রায় বিশ বছর ধরে এখানে আছেন তাই এখানকার সবাই তাকে বেশ ভাল ভাবেই চেনে।বিয়ের পরপরই তিনি অষ্ট্রেলিয়া চলে আসেন।পরে মামার একমাত্র সন্তান ‘ফারিক চৌধুরী’ জন্ম নেবার পর ওকে আর মামীকে অষ্ট্রেলিয়া নিয়ে আসেন।তারপর থেকে তিনি এখানেই সেটেলড!
আর ফারিক এখানে এসে কিভাবে যেন ‘ফ্রিক’ হয়ে গেছে।ওকে দেখতেও একদম অষ্ট্রেলিয়ান মনে হয়।লম্বা ফর্সা ইউরোপীয়ান লুক।
প্রিয়ন্তী ওর চালচলনে বেশ ইমপ্রেসভড।
বড়মামা চলে আসার পর এর মধ্যে মাত্র তিনবার বাংলাদেশে গিয়েছিলেন!তখন ফ্রিক সাথে যায়নি বলে ওর সাথে প্রিয়ন্তীর দেখা হয়নি!কিন্তু এবার প্রিয়ন্তী আসার পর ফ্রিকের উচ্ছাস ছিলো দেখার মতো!
ফ্রিকের ষ্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে প্রিয়ন্তীর জন্মই হয়েছে পুতুলের মতো শোকেসে সাজিয়ে রাখার জন্য!ঘরকন্নার কাজ ওকে একদম মানায় না!
প্রিয়ন্তী গোপনে দীর্ঘশ্বাস চেপে ভাবলো-“রাফিজ,তুমিই কেবল আমার কদর বুঝলে না!তুমি তো আমাকে বাঁধা বুয়াই বানিয়ে রাখতে চাও!”
প্রিয়ন্তীর একমাত্র ভাই প্রান্তিকও বছর তিনেক আগে স্টুডেন্ট ভিসায় এখানে এসেছিলো!
সেও মামার ছত্রছায়ায় এখানে পড়াশোনার পাশাপাশি অড জব চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে সে মামির বাড়ীতে থাকেনা।
কারনটা ফ্রিকের সাথে মানসিক দুরত্ব ছাড়াও প্রান্তিকের ধর্মীয় মনস্কতা!
তাছাড়া,বড়মামার বাড়ীর দ্বন্দমুখর পরিবেশটাও প্রান্তিকের পক্ষে অনুকূলে ছিলোনা!
প্রান্তিক এদের সাথে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছিলো না!
এদিকে প্রিয়ন্তী আবার বড়মামার বাড়ীতে বেশ মানিয়ে নিয়েছে।ফ্রিকের সাথে ওর বন্ধুত্বটাও বেশ জমে উঠেছে।এর আরেকটা বড় কারন হলো ফ্রিক যথেষ্ট উদারমনা।যেমনটি প্রিয়ন্তী চায়।মেয়েদের ব্যপারেও সে খুবই লিবারেল!ও’ই দৌড়ঝাঁপ করে প্রিয়ন্তীর এগজিবিশনটা একটা ফাইভ ষ্টার হোটেলের বলরুমে এরেঞ্জ করেছে!এগজিবিশন দেখতে আসা গেষ্টদের কাপাচিনো খাওয়াবার আইডিয়াটাও ওরই।
সব মিলিয়ে ইউনিক একটা প্রোগ্রাম হচ্ছে ।
প্রিয়ন্তী এজন্য ফ্রিকের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
এখানে আসার পর ও ফ্রিকের মতো বন্ধু পেয়েছে।ওরই উৎসাহে প্রিয়ন্তী তুলি হাতে তুলে নিয়েছে!গত একটি মাস টানা ছবি এঁকেছে প্রিয়ন্তী।
যার ফলশ্রুতিতে আজকের এই এগজিবিশন!
এগজিবিশনের শেষের দিকে ফ্রিক নাকি প্রিয়ন্তীকে একটা সারপ্রাইজ দেবে বলেছে।
প্রিয়ন্তী এখন সেটার প্রতীক্ষাতেই উন্মুখ।
*
লোকের আনাগোনা কমে এলে প্রিয়ন্তীকে নিয়ে ফ্রিক বত্রিশ তলার একটি সুসজ্জিত সুইটে এলো!
প্রিয়ন্তী তো পুরাই হতভম্ব।
কারন প্রিয়ন্তীকে চমৎকার ভাবে ওয়েলকাম করা হলো!ঢোকামাত্র ওর মাথার ওপর একরাশ ফুলের পাপড়ী ঝরে পড়ায় ও খুশিতে দুহাত চাপ দিয়ে উঠলো!
তারপর পুরো রুমটা একবার চক্কর দিয়ে খুশিতে বলে উঠলো-
–“ইউনিক..!রিয়েলি ফ্রিক ইউ আর অলওয়েজ আ ডার্লিং বয়!”
রুমটা খুব সুন্দর করে এমনভাবে সাজানো যেন এখানে এক্ষুণি ব্যালে ডান্স শুরু হবে!রুমের ঠিক মাঝখানে একটা গোল টেবিল দামী লাল টুকটুকে কভারে ঢাকা আর তার উপর লম্বা সুদৃশ্য ক্যান্ডেলপেয়ার !
প্রিয়ন্তী বোঁ করে এক পায়ের ওপর পাক খেলো!ও আজ পড়েছে একটা টাইট জিন্স আর ওপরে শর্ট টপস,যেটার কারনে ওর পেটের খানিকটা উন্মুক্ত হয়ে আছে।
প্রিয়ন্তীর কোমড় ছাড়ানো চুলগুলো সিল্কের মতো কোমড়ে ছড়িয়ে আছে!
ফ্রিক ওর সৌন্দর্য্যের ভূয়সী প্রশংসা করে রাফিজের নির্বুদ্ধিতাকে ধিক্কার জানালো!
ফ্রিক হলে তো ওকে সাজিয়ে বসে সারাদিন চেয়ে চেয়ে দেখতো!
প্রিয়ন্তীর মনের গভীর গোপন জায়গা ছুঁয়ে গেলো ফ্রিকের কথাগুলো।
ফ্রিক আজ ওর অনারে শ্যাম্পেন অর্ডার করেছে!
তবু প্রিয়ন্তী মৃদু আপত্তি করে বারন করতে চাইলে ফ্রিক বললো-“ও…প্লিজ !ডোন্ট বিহেভ লাইক আ ভিলেজ গার্ল।”
প্রিয়ন্তী আর আপত্তি করেনি কেবল মনে মনে বলেছে,দেখে যাও রাজিব,আমাকে খুশি করার জন্য একজনের চেষ্টার কোনো অন্ত নেই আর তুমি?তুমি তো…..!”
-“হ্যাভ আ নাইস টাইম!আ বিউটিফুল মুমেন্ট ফর দ্যা মোষ্ট বিউটিফুল গার্ল ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড!জাষ্ট ইউ এন মি…!”বলে ক্রিষ্টাল ক্লিয়ার পাণীয় ভর্তি গ্লাসটা প্রিয়ন্তীর দিকে এগিয়ে দিলো ফ্রিক !
প্রিয়ন্তী সব রকমের সংকোচ ঝেড়ে ফেলে বকের ঠোঁটের মতো লম্বা গ্লাসটিতে ছোট্ট একটা চুমুক দিলো!
তারপরের ঘটনাগুলো প্রিয়ন্তী মনে করতে পারছেনা!চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো।মাথার ভেতরে একটা মিষ্টি আবেশ।
চোখ মেলে দেখেছে ও একটা সুন্দর লাল টুকটুকে ওয়াটার বেডের উপর শায়িত।ডান হাত মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে বসতেই বাথরুমের দরোজা খোলার শব্দ হলো!
প্রিয়ন্তী তাকিয়ে দেখলো!সেখান থেকে ফ্রিক বেরিয়ে আসছে ভেজা শরীরে।
প্রিয়ন্তীকে দেখে হাসলো।সেই হাসিতে নেই কোনো অপরাধবোধ।
প্রিয়ন্তী কাঁপা স্বরে কেবল প্রশ্ন করলো-
-“আ..আমি এখানে কিভাবে!কি ঘটেছে এখানে!প্লিজ,টেল মি দ্যা ট্রুথ ফ্রিক!”
-“ও সুইট হার্ট!ইট ওয়াজ আ নাইস এক্সপিরিয়েন্স!আ’ম রিয়েলি গ্রেটফুল টু ইউ!”
-“হোয়াট ডাজ ইট মিন?”ঝাঁঝালো স্বরে বললো প্রিয়ন্তী!
-“আই থিঙ্ক ইউ নো!নাউ,প্লিজ বি অফ!জাষ্ট টেক ইট এজ আ গেম!ইউ এন্ড মি…বোথ আর গুড ফ্রেন্ড!সো…ইউ শুডন্ট বি সো মাচ্ ইমপেসেন্ট…!”
প্রিয়ন্তী কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারলোনা।ওর মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে!কোনমতে কেবল বললো-“ইউ চিট মি!তুমি আমাকে বললেই পারতে যে তুমি আমাকে চাও….বাট উইদাউট মাই পারমিশান এমনটা না করলেও পারতে!”
ফ্রিক হো হো করে হেসে দুহাত স্যারেণ্ডারের ভঙ্গিতে বললো-“স্যরি,আই ওঅজ টোটালি আউট অব মাই হেড!ওকে…নাউ স্টপ অল দিস ননসেন্স এন্ড কামন লেটস গো টু আ লং ড্রাইভ।”
প্রিয়ন্তী বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো-“আই উওন্ট গো এনিহোয়্যার,প্লিজ টেইক মি হোম!”
ফ্রিক কাঁধ ঝাকালো-“ওকে!”

কক্সবাজার থেকে ফিরে গোসল সেরে রাফিজ একটা ঘুম দিয়েছে।নাযিয়াত কাপড় গুছিয়ে বেলা চৌধুরীর রুমে এলো!
বেলা ওকে জানালেন যে,’আগামীকাল প্রিয়ন্তীদের বাসায় সবার দাওয়াত!দাওয়াত সেরে ফেরার পথে ওরা প্রিয়ন্তীকে নিয়ে বাড়ী ফিরবে।নাযিয়াত চাইলে কিছুদিন মায়ের বাড়ী থেকে আসতে পারে!”
নাযিয়াত মৃদু স্বরে বললো-“আমি বাসায় গেলে তো উনার কষ্ট হবে!তাছাড়া উনি যদি বলেন যেতে তাহলে অবশ্যই যাবো!”
-“হুঁহ্..উনি বললে যাবে নইলে যাবেনা?”
(বেলার স্বরে স্পষ্ট ব্যঙ্গ)”কেন,প্রিয়ন্তী আসছে শোনোনি!ওর প্রয়োজন দেখার তো লোক আছে,নাকি?”
নাযিয়াত তার কথার মর্ম বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে রইলো!

প্রিয়ন্তীদের বাড়ীতে আজ মহোৎসব!
ছেলে মেয়ে দুজনই বাড়ী আসছে।প্রিয়ন্তীর মা শাজিয়া হামিদের মনে আজ আনন্দের জোয়ার!তিনি ওদের পছন্দের সব খাবার তৈরী করেছেন।বিশেষ করে তার একমাত্র ছেলে প্রান্তিক আজ তিন বছর পর বাড়ী ফিরছে।
এবার ওকে বিয়ে করিয়ে তারপর তিনি ছাড়বেন!মেয়েও দেখে রেখেছেন।প্রান্ত
িক এলেই ওকে দেখানো হবে!পছন্দ হলে আর দেরি না!একদম কবুল পড়িয়ে দেবেন!
প্রিয়ন্তীর আগমন উপলক্ষে ওর শ্বশুড়বাড়ীকেও দাওয়াত করা হয়েছে।প্রিয়ন্তীর মা বেলাকে খুব করে নাযিয়াতের কথা বলে দিয়েছেন।তিনি যেন নাযিয়াতকে অবশ্যই সঙ্গে করে নিয়ে আসেন!
গত তিনচারটে দিন ধরে তার মনটা এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে।বেলা চৌধুরীর মুখে শুনেছেন রাফিজ নাকি নাযিয়াতকে নিয়ে কক্সবাজার গিয়েছে।শুনে তার অন্তর্জ্বালা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিলো!
বেলা চৌধুরীর নাতির খায়েশ মিটতে মিটতে নাযিয়াত নিজের রাজত্ব বানিয়ে নিজে মহারাণী সেজে বসবে আর তার প্রিয়ন্তীর তখন কপাল পুড়বে।
নাহ্,মেয়েটা জেঁকে বসার আগেই ওর সাথে রাফিজের মাখামাখিটা একটু কমাতে হবে।প্রিয়ন্তী না থাকার সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে মেয়েটা।এমনিতে তো খুব প্রিয়ন্তীর সাথে খাতির মেরে কথা বলে!
আসলে এগুলো সবই চালাকি!রাফিজের কাছে ভালো সাজার ঢঙ!ভাবলেন শাজিয়া!
*
তিনি তার এক পরিচিত এক বান্ধবীর সাথে গতকালই দেখা করে সব বন্দোবস্ত করে এসেছেন!বান্ধবীটি আবার এসব কাজে খুব ওস্তাদ।টাকাপয়সা একটু বেশী নিলেও কাজ হয় খুব সুইফট।এই পদ্ধতিতে সে নাকি বহু সংসার ভেঙ্গেছে।গতকালই সে একপুরিয়া চিনি পড়া দিয়ে গেছে।এটা মিষ্টি জাতীয় খাবারে দিয়ে খাওয়ালেই নাকি কাজ হয়ে যাবে!
একারনেই নাযিয়াতকে এতো গুরুত্ব দিয়ে আনা!

★★

এদিকে প্রিয়ন্তী আর প্রান্তিককে আনতে শাজিয়া নিজেই গেলেন গাড়ী নিয়ে!ছেলেকে এতদিন পরে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি।মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন!
ছেলের দাঁড়ীতে হাত দিয়ে বললেন-“এটা কি রে বাবা!এ বয়সেই একেবারে দাড়ী টাড়ি রেখে কি করেছিস?”
প্রান্তিক হেসে বললো-“মা,এটা সুন্নত! ”
বাড়ী ফেরার পর, শাজেদা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ওদের সাথে গল্প করলেন।তার মুখে আজ যেন খই ফুটছে!তবে লক্ষ্য করলেন প্রিয়ন্তী যেন কিছুটা মনমরা!
বললেন-“আমার আম্মুটার মন খারাপ কেন?”
প্রিয়ন্তী হাসলে তিনি ওকে সান্তনা দিয়ে বললেন-“তোমার মন ভালোর ব্যবস্থা করছি,দাঁড়াও!এমন টাইট দেবো যে,নাযিয়াতকে দেখলে রাফিজ উল্টো পথে হাঁটা দেবে!”
শুনে প্রিয়ন্তী শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললো!
শাজিদা প্রিয়ন্তীকে কথাগুলো বলার সময় অদূরে বসা প্রান্তিক কথাগুলো শুনে ফেললো! বললো-
-“সমস্যাটা কি মা?প্রিয়ন্তীর শ্বশুড়বাড়ীতে কোনো সমস্যা?”
শাজিয়া ছেলেকে বেলা চৌধুরীর নাতী পাগলামির নাতিদীর্ঘ বয়ান দিয়ে বললো-“উনি নাতি পেয়ে তারপর নাযিয়াতকে ঘর ছাড়া করবেন!ততদিনে আমার মেয়ের সংসার যাবে উল্টে।পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস কি!সে তো নাকি এরিমধ্যে ঐ ছলনাময়ীকে আপন করে নিয়েছে।”
প্রান্তিক অবাক হয়ে প্রিয়ন্তীকে বললো-“সেদিন না তুই বললি নাযিয়াত মেয়েটা খুব ধার্মিক প্রকৃতির।তোকে খুব অনার করে?তাহলে আম্মা এসব কি বলছে?”
শাজিয়া ছেলের নির্বুদ্ধিতা দেখে হতাশ হয়ে বললেন-“আরে বাবা,তোরা আজকালকার ছেলেরা মেয়েদের এসব চালাকি বুঝবি কি করে!এসব হচ্ছে সবাইকে হাতে রাখার মন্তর!আসুক না কাল,ওর সব ত্যাঁদড়ামী আমি বার করবো।আমার মেয়ের জায়গায় আসন গেড়ে বসেছে?বসাচ্ছি।র
াতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে!
প্রান্তিক প্রবল আপত্তি জানিয়ে জোর প্রতিবাদ করে বললো-“ছিঃ মা,তুমি না জেনেশুনে কেবল নিজের ধারনা অনুমানের ভিত্তিতে একজন দ্বীনদার মেয়েকে এভাবে বিপদে ফেলতে চাচ্ছো কেন?”
-“বিপদে ফেলছি কে বললো!সে তার মতো থাকুক!তাকে তো রাফিজের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর জন্য বিয়ে করানো হয়নি।এতো আদিখ্যেতা কিসের।রাফিজকে এমন বশ করবো যে সুরসুর করে নাযিয়াতকে তালাক দিয়ে বাড়ী থেকে বের করে দিবে!খালি সময়ের অপেক্ষা!কাল থেকেই মিশন শুরু!”
-“মা তুমি জানো, তুমি কত ভয়ংকর একটা কাজ করতে যাচ্ছো!যাদুর সাহায্যে একটি দম্পতি ভাঙ্গতে চাচ্ছো?কিন্তু কেন?নাযিয়াত মেয়েটা কি ক্ষতি করেছে তোমার?কেন তুমি ওর পেছনে লেগেছো?এটাতো ক্ববীরা গুনাহ।এসব থেকে ফিরে তওবা করো।ওসব ফালতু স্টেপ নেবার কোনো প্রয়োজন নেই!নাযিয়াত আর প্রিয়ন্তী দুজনেই সমান হকদার।কেন নিজের মেয়ের জন্য অন্যের সংসার ভাঙ্গতে যাচ্ছো?”
-“আচ্ছা,তুই আমার ছেলে হয়ে ওদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছিস কেন বলতো ?তোর এসবের মধ্যে আসার কোনো দরকার নেই।তুই তোর বিয়ে নিয়ে ভাব।শুক্রবার আমরা মেয়ে দেখতে যাবো!”
প্রান্তিক থমথমে মুখে বসে আছে।
মায়ের ডাকে সে স্থির কন্ঠে বললো-“মা,যদি তোমার কারনে নাযিয়াতের ঘর ভাঙ্গে তাহলে
সেটার প্রায়শ্চিত্ত তোমাকেই করতে হবে!”
-“মানে? কি বলছিস এসব?”
-“ঠিকই বলছি মা,তোমার কারনে নাযিয়াতের তালাক হলে তোমার ছেলেই নাযিয়াতকে সসম্মানে ওকে নিজের ঘরে ঠাঁই দেবে।
এখন ভেবে দেখো,তুমি কি করবে?”
…..
চলবে…..