Nusrat Haq
যখন আমি কনসিভ করি ব্যাপারটা বুজতে পারি নি আমি। আমার ৩ মাস পিরিয়ড অফ ছিলো।
৩ মাস যখম পিরিয়ড হচ্ছিলো না তখন ব্যাপার টা বুজতে পারি।
আর ব্যাপারটা আরো পরিস্কার বুজতে পারি ক্লাস ৯ এর শারিরীক শিক্ষা বই থেকে। আপনারা অনেকেই জানেন সেখানে পুরোপুরি পরিস্কার ভাবে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যাপারটা।
আমার তখন মাথা ব্যাথা বমি ভাব ছিলো। কিছু খেতে পারতাম না। আর ব্যাপারটা মা আমলে নেয় আর ভালো করে বুজে।
তখন মা আমাকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে তোর। আমি কিছুই বলিনা।
পরে মা কিট এনে পরিখা করালো আর ব্যাপারটা পরিস্কার হয়।
এর আগে আমি আমার ভাইকে ব্যাপার টা জানাই সে উল্টো আমাকে অত্যাচার করে। বলে এটা আমার না।
আমি বললাম এত বছর ধরে আমার সাথে শারিরীক সম্পক করলেন যে।
আমি সবাইকে বলে দিবো। সে আমাকে হুমকি দিছে বললে তোর খবর আছে।
আমি ও ভয় পেয়ে যায়।
মা আমাকে অনেক মারধোর করে ব্যাপারটা গোপনে রাখে। বাবা ভাইদের কাছ থেকে।
আর বলে এটা কার বাচ্চা কার থেকে পেট বাধিয়েছিন।
আরো অনেক কথা।
পরে মা বাচ্চাটা গোপনে নসট করে ফেলে। তারপর আমাকে আর স্কুলে যেতে দেয় না।
আমি স্কুলে যাওয়ার কথা বললে বলে যেতে হবে না তোর স্কুলে। আবার পেট বাঁধানোর জন্য।
তারপর মা তরি ঘরি করে আমার বিয়ের জন্য বাবাকে বলে।
বাবা তো এমনি তে আমাকে দেখতে পারেনা। তাই কোনো রকম চাইছে আমাকে বিদায় করতে। কারন আমি উটকো ঝামেলা।
এর মধ্যে আমার ছোট ভাই মালেশিয়ায় চলে যায়।
আমি ওই সময় অনেক বার মরতে চেয়েছি। পারিনি।
অনেক মানুষিক হতাশায় ভুগছিলাম।
এরপর একটা ছেলে আসে আমাদের পাশের গ্রামের।
বাবা মা কোনো খোঁজ খবর নেওয়া ছাড়া আমাকে বিয়ে দিয়ে ফেললও।
কি অদ্ভুত ব্যাপার বিয়ের দিন আমার কপালে একটা নাকফুল ও জুটে নি। আমার বাবা বলেছে ওনার মেয়ে না।
ওনাদের বাড়িতে থাকতাম তাই বাবা ডাকি৷ এটা শুনার পর কস্টে বুকটা ফেটে গিয়েছে৷
যাইহোক শশুর বাড়িতে আসলাম।
একদম ভাংগা চোরা ঘর৷ ২ টা রুম মাএ।
ঘর দেখে মাথা ঘুরালো আমার।
বর আমাকে বিয়ে করে এনে কোথায় গেছে সেটা জানি ও না।
শ্যামলা গায়ের রং বরের যা দেখলাম।
আমাকে খাটের উপর বসানো হলো।
বলে রাখি আমার শশুর শাশুড়ী কেউ নেই।
আমার বর এতিম তার কেউ নেই। তার বাবা মারা যাওয়ার সময় এই বাড়িটা তাকে দিয়ে গেছে।
তার যে কজন আত্মীয়সজন আছে তারা আমার বরকে পরিচয় ও দেয় না।
আমি রাতে বরের অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম। সে রাতে আসলো না।
সে আলো ফজরের আজানের পর। তাও মাতাল হয়ে।
বিশাস করবেন কিনা জানি সে কোনো কিছু বলা ছাড়া আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো৷ চাহিদা শেষে ঘুমিয়ে পড়লো
আমি কাঁদতে লাগলাম। হায় আল্লাহ এ কি হলো আমার কপালে। সারা জীবনেও সুখ পেলাম না।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে বাথরুম খুজতে লাগলাম। ঘরে আর কেউ ছিলো না।
তাই তাকে ডাকলাম। সে আমাকে খুব খারাপ ভাষায় গালি দিয়ে বললও ঘুমাতে দে।
আমি ও আর কিছু বলিনি।
আমি ঘরের মধ্যে বালতিতে প্রসাব করলাম।
ঘরের আশে পাশে একটা কল ও ছিলো না। অন্যের বাড়ি থেকে পানি আনতে হয়৷ আমি নতুন বউ কোথায় যাবো কিছুই চিনি না।চলবে..
আমি যখন ৮ম শ্রেনিতে পড়ি তখন আমি আমার নিজের ভাইয়ের দারা প্রতি দিন রেপ হতাম।
আমার যখন ৩ বছর বয়স তখন মায়ের সাথে বাবার ডিভোর্স হয়ে যায়। আমি আজও জানি না আমার বাবাকে।
তারপর ৩ বছরের মত নানার বাড়ি ছিলাম। নানার বাড়িতে মোটামুটি সুখেই ছিলাম। মায়ের আবার বিয়ে হয় এক লোকের সাথে তার আবার ২ টা ছেলে৷
বড় ছেলের বয়স তখন ছিলো ১৭ আর ছোটটার ১২..
তারা মায়ের সাথে আমাকে মেনে নেয়নি।
মায়ের বিয়ের পর ১ বছরের মত নানার বাড়ি ছিলাম। ১ বছর পর আমার নানি মারা যায়।
আর তখন আমি একা হয়ে যায়। আমার ১ মামা সে চাকরি সুএে ঢাকা থাকতো। তার পরিবার নিয়ে চিটাগাং এ আর কেউ থাকতো না৷
বলে রাখি আমার নানার বাড়ি খাগড়াছড়িতে।
তখন মা আমাকে নিয়ে যায়। তার সাথে।
আমার নতুন বাবাটা কিছু না বললেও কিন্তু তারছেলেরা আমায় কোনো রকমই মেনে নেয় নি।
তারা ছোটবেলা থেকেই আমাকে মারতো। আমাকে কিছু খেতে ও দিতো না।
তারা সবসময় আমাকে বকাঝকা করতো। এভাবেই আমার বেড়ে উঠা।
আমাকে মা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলো।
শত বাবা আমাকে দেখতে না পারলে ও কখনও বকা ঝকা করে নি৷
আমার মা ও আমায় খুব বকতো।
অনাদর অবহেলায় আমার বেড়ে উঠা।
যখন আমি ৭ম শ্রেণিতে পড়ি ছোট ভাই আমার গায়ে হাত দিতো সবসময়।
ব্যাপার টা আমার ভালো না লাগতো না৷ আর ভয়ে কাউকে বলতাম ও না।
একদিন আমার গায়ে হাত দেয় আর আমি খুব ব্যাথ্যা পায়। ছোট ভাই সবসময় বলতো তার পা টিপে দিতে গা টিপে দিতে।
আমি ব্যাপারটা আমার মাকে বলি। মা উল্টো আমায় বকা দেয়।
তার পর থেকে আমি ভয়ে আর কাউকে কিছু বলিনি।
৮ম শ্রেনিতে উঠার পর একদিন বাড়িতে কেউ ছিলো না। সবাই দাওয়াত খেতে গেছে। তো ছোট ভাই কোথা থেকে এসে আমার উপর পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়লও।
আমার চিৎকার দিয়েও চিৎকার দিতে পারলাম না।
আমি ব্যাথ্যা মরে যেতে লাগলাম।
তো সে তার চাহিদা মিটিয়ে যখন উঠলো সে আমায় বললও কাউকে বলবি না খবরদার।
আমি ও ভয় পেয়ে কাউকে বললাম না কারন আমার কথা কেউ বিশাস করবে না।
উল্টো আমাকেই মারবে।
এর পর থেকে ছোট ভাই প্রায় সময় আমার উপর ঝাপিয়ে পড়তো।
আর মাঝে মাঝে ছোট ভাই আমাকে টাকা দিতো।
এভাবে আমার বেড়ে উঠা। যখন আমি ক্লাস টেন এ উঠলাম। তখন বুজতে পারলাম আমি কনসিভ করি।
ভালো লাগলে দিবো…
যার পড়তে ভালো লাগবে না ইগনোর করুন। তারপরে ও বাজে কথা বলবেন না।চলবে…
গল্প : নরপশু বর…
সত্য ঘটনা অবলম্বনে
Nusrat Haq.
“কাজী অফিস”
নামটা শুনলেই কেমন একটা পালিয়ে বিয়ে করা ব্যাপারটা মাথায় আসে।নিদ্র ভাইয়া আমাকে কাজী অফিসে যেতে বলছে কেনো?সে আবার পালিয়ে বিয়ে করছে না তো!নাকি সেই মেয়েকে ধরে নিয়ে এসেছে?কোনটা?আর যাই হোক,আমাকে যেতে বলছে কেনো?সাক্ষী দিতে?
এসব ঝামেলার ব্যাপার আমার একদম পছন্দ না।কিছু হলে তো শেষে মেয়ের পরিবার আমাকে এসে ধরবে।আমি তো সাফাকে আগেই বলে দিয়েছি আর যাই করুক না কেনো লুকিয়ে প্রেম,পালিয়ে বিয়ে এসবে যেনো আমার সাহায্য না চায়।
আমি চিন্তিত গলায় বলে উঠলাম,ভাইয়া আমি গিয়ে কি করবো? ভাইয়া আপনার তো কত বন্ধু বান্ধব আছে তাদের দিয়েই সাক্ষী দিন না।আমাকে এসবে জড়াবেন না।প্লিজ ভাইয়া।
নিদ্র ভাইয়া ধমকের সুরে বলে উঠল,
-‘চুপ।এক নিঃশ্বাসে কয়বার ভাইয়া বলো!মানুষ নিজের আপন ভাইকেও তো মনে হয় এত বার ভাইয়া বলে ডাকে না।আজকে আমার বিয়ে তাই যা বলছি তাড়াতাড়ি করো।পনের মিনিটের মধ্যে যেন তোমাকে এখানে পাই।’
অগত্যা আর কি করার এই ছেলেকে আমি যথেষ্ট ভয় পাই।তার মুখের উপর এর থেকে বেশি বলার ক্ষমতা আমার নেই।কোনোমতে হাত মুখ ধুয়ে হলুদ কামিজের সাথে লাল উড়না মাথায় দিয়ে সিএনজি করে কাজী অফিসে চলে এলাম।
ভেতরে গিয়ে দেখি নিদ্র ভাইয়া একটি খয়েরী রঙের সুতি পান্জাবী পড়ে সোফায় বসে তার বন্ধুদের সাথে হাসাহাসি করছে।তানিয়া আপু সহ তাদের আরো কয়েকটা মেয়ে বান্ধবীও আছে।
আমি চোখ ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগলাম কোন মেয়েটা হতে পারে।নিদ্র ভাইয়ার কাছে গিয়ে বললাম,
-‘আপনার অনেক ফ্রেন্ডরাই তো এসেছে তবুও আমাকে ডেকেছেন কেনো?’
আমার কথায় সে আমার দিকে হালকা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আবার বন্ধুদের সাথে হাসাহাসি করায় মনোযোগ দিল।রক্ত মাংসে গড়া গোটা একটি মানুষ যে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তা যেন সে টেরই পাচ্ছে না।আমি যথেষ্ট অপমানিত বোধ করলাম।
আমাকে অপমান অনুভব করার আর সুযোগ না দিয়ে কাজী সাহেব বলে উঠল,’কই তাড়াতাড়ি চলে আসুন।আমাকে আরো এক জায়গায় গিয়ে বিয়ে দিতে হবে।’
নিদ্র ভাই কাজী সাহেবের চতুর্কোন টেবিলের সামনে রাখা একটি চেয়ার টেনে বসে পড়ল।তানিয়া আপু আমাকে টেনে তার পাশের চেয়ারটায় বসিয়ে দিল।আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।বরের পাশের চেয়ারে সাক্ষী দাতা বসে নাকি!
কিছু ফর্মালিটি পূরণ করে কাজী সাহেব আমাদের দিকে একটি কাগজ বাড়িয়ে দিল।নিদ্র ভাই সাইন করলে আমিও বিরক্তি নিয়ে সাইন করে দিলাম।এরপর কাজী সাহেব বলল,’বলুন কবুল।’
নিদ্র ভাইয়া এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট না করে তার বলার সাথে সাথেই তিন কবুল বলে দিল।এরপর কাজী সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বলল,’এবার আপনি বলুন।’
তার কথায় আমি অ্যাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।আমতা আমতা করে বললাম,’আমি বলবো?’
কাজী সাহেব বিরক্ত হয়ে বলল,’তাহলে আর কে বলবে!উফ আপনারা দেখি অনেক সময় নষ্ট করছেন।’
এই কাজী সাহেবের দেখছি অনেক তাড়াহুড়া।পারলে মুখ থেকে কথা টেনে বের করে আনে!
কিছু মানুষ আছে যাদের জন্মই হয় শুধু বিরক্ত হওয়ার জন্য।তারা সব ব্যাপারেই বিরক্ত হয়।এমনকি তাদের সামনে যদি আপনি তার প্রশংসা করেন এতেও সে মহাবিরক্ত।যেনো শুধু শুধু তার কান দিয়ে কতগুলো কথা শুনতে হলো।
আমাদের সামনে বসা খাটো করে বয়স্ক পান খাওয়া কাজী সাহেবটাও বুঝি তাদের মধ্যে একজন।
এদিকে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।আমি তো শুনেছি বর কনে কেই তিনবার কবুল বলতে হয়।যারা সাক্ষী দেয় তাদেরকেও কি কবুল বলতে হয় নাকি!
বিয়ে বাড়িতে গিয়ে সবসময় বউর কাছেই বসে থাকায় বিয়ে পড়ানোর সময় ঠিক কি কি করা হয় তা আমি কখনো দেখিনি।শুধু দেখি বউ সেজেগুজে একটি রুমে বসে থাকে তারপর একজন দাড়িওয়ালা পান্জাবী টুপি পড়া লোক এসে কনের মুখ থেকে তিনবার কবুল শুনে তার সিগনেচার নিয়ে চলে যায়।তার একটুপর শালী বান্ধবীরা নেচে নেচে গিয়ে বরকে দুষ্টামি করে টানতে টানতে নিয়ে এসে কনের পাশে বসিয়ে দেয়।আর অযথা রাজ্যের সব হাসাহাসি শুরু করে দেয়।
এখন এর অগোচরেও আরো কিছু করা হয় কিনা তাতো জানি না।একটু ইতস্তত করে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম সবাই আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।যেনো আমার মুখের জবাবের অপেক্ষায় সব বুদ হয়ে আছে।আমিও একটু আমতা আমতা করে কবুল বলেই দিলাম।
আমার মুখ থেকে কবুল শুনে সবাই একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।
কাজী সাহেব আবারো ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন,
-‘নিন বিয়ে হয়ে গেলো।এবার মালা বদলটা তাড়াতাড়ি করে ফেলুন।’
নিদ্র ভাইয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে একটু ভাব নিয়ে কলারটা ঠিক করে মালা হাতে নিয়ে দাঁড়াল।
তানিয়া আপু আমাকে তার সামনে দাঁড় করিয়ে আমার হাতেও ফুলের একটি মালা ধরিয়ে দিল।
কাজী সাহেব আবারো তাড়া দিতে লাগল।ঘড়ি দেখে আমাকে বলল,’তাড়াতাড়ি করুন।’
আমি শুধু চমকের উপর চমক হচ্ছি।বিয়ে হয়ে গেলো অথচ কনের কোনো কাজ দেখলাম না।এ আবার কেমন বিয়ে!আর আমি কেনো মালা পড়াবো?অদ্ভুত তো!
তাই আমি চোখ গোলগোল করে কাজী সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম,’আমি কেনো মালা পড়াবো?’
কাজী সাহেব আমার কথায় চরম বিরক্ত হয়ে বলল,’আপনি দেখছি ভালো বোকা।আপনার সাথে বিয়ে হয়েছে তা আপনি মালা পড়াবেন না তাহলে কি অন্য কেউ এসে মালা পড়াবে!’
কাজী সাহেবের কথায় আমার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ল।আমি হা করে বাংলা সিনেমার স্টাইলে হাত আলগা করে মালাটা ছেড়ে দেওয়ার আগেই নিদ্র ভাইয়া তার মাথাটা নিচু করে মালার ভেতর ঢুকিয়ে নিল।আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে দুষ্ট হাসি দিয়ে আমার গলায় ও মালা পড়িয়ে দিল।সবাই হাত তালি দিয়ে উঠল।আর একে একে কনগ্রেচুলেশন বলে বিদায় নিতে লাগল।আমি এতটাই চমৎকৃত হয়েছি যে কতক্ষণ যাবৎ আমার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরোলো না।
সবাই চলে গেলে নিদ্র ভাই বলল,’এবার অন্তত মুখটা বন্ধ করো নাহলে সব মাছি ঢুকে যাবে।’
আমি অস্থির ভঙ্গিতে বললাম,’এটা কি হল?’
সে আমার সামনে থেকে সরে সোফায় থাকা ব্যাগটি ঠিক করতে করতে বলল,’কি হল আবার, বিয়ে হল।’
আমি তার পেছন পেছন গিয়ে বলতে লাগলাম,’আপনি আমাকে কেনো বিয়ে করলেন।আপনার পছন্দের মেয়েকে বাদ দিয়ে।’
-‘এত অস্থির হওয়া লাগবে না।তোমার জন্যই সব করতে হয়েছে।’
-‘আমি আবার কি করলাম।’
-‘তুমি যে আমাকে ভার্সিটির প্রথম দিন চড় মেরেছো তার জন্য জানো আমার রেপুটেশন কতটা নষ্ট হয়ে গেছে, এখন আমার সেই পছন্দের বালিকা তো আমার প্রপোজাল একসেপ্ট করছে না।’
-‘তার জন্য আমাকে কেনো বিয়ে করলেন?’
-‘সেদিন বললাম না আমি একটি পাত্রী দেখতে গিয়েছিলাম সেই মেয়েতো আমার জন্য পুরো পাগল হয়ে গেছে।কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না।এখন এই ম্যারিজ সার্টিফিকেট নিয়ে আমি বলব আমার বিয়ে হয়ে গেছে তারপর সে আমার পিছু ছেড়ে দেবে।আর আমি আমার পছন্দের মেয়েকে পটানোর জন্যও সময় পাবো।ততদিন তোমাকে আমার সাথে ঝুলে থাকতে হবে।’
তার কথার আমি কিছুই বুঝি না।সেদিন পাত্রী দেখতে যাওয়ার আগে সেই মেয়ে তাকে পছন্দ করবে কিনা এই নিয়ে এমন ভাব করছিলো যেন সেই মেয়ে পছন্দ না করলে তার আর বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন থাকবে না।আর আজ কিনা ঐ মেয়ের থেকে বাঁচতেই আমাকে বিয়ে করেছে!
আমি মুখটা ভার করে বললাম,’আপনার তো আরো অনেক বান্ধবী ছিল তাদেরই বিয়ে করতেন।’
-‘সমস্যা শুরু তো তুমি করেছো থাপ্পড় মেরে।আমি তো আগেই বলেছিলাম এর ভরপুর তোমাকে করতে হবে।আর এত সিরিয়াস হচ্ছো কেনো?টেক ইট ইজি।এটা তো এমনিই বিয়ে।’
এই মুহূর্তে আমার ইচ্ছা করছে তার মাথার চুলগুলো টেনে ধরি।নাহ!তার মাথার চুল না,ধরা উচিত আমার মাথার চুল।চার মাস আগে একটা থাপ্পড়ের জন্য আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।আর এই ছেলে এমন ভাব করছে যেনো কিছুই হয়নি,নরমাল একটা ব্যাপার।কি সুন্দর মুখ দিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে গাড়িতে গিয়ে উঠছে।আমাকে বিয়ে করে নিয়েছে আর বলছে টেক ইট ইজি।
পেটের ভেতর কথা কিলবিল করছে তাকে বলার জন্য।কিন্তু কিছুই বলতে পারছি না।
হায় আল্লাহ!আমাকে আর কতদিন এসব পোহাতে হবে?
টেনশনে যেখানে মানুষের খাওয়া দাওয়া লোপ পায় সেখানে টেনশনে পড়লে আমার ক্ষিধে বহু গুনে বেড়ে যায়।বিছানার উপর পা তুলে বসে রাত ১টা বাজে বসে বসে চামচ দিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছি আর টেনশন করছি।আমার বিয়ে হয়ে গেলো?কি সাংঘাতিক ব্যাপার!এত সহজে বিয়ে হয়ে যায়!কেউ যদি জেনে যায় তাহলে কি হবে!
আর কতদিন তার সাথে এভাবে ঝুলে থাকতে হবে?সেটা তো পরিষ্কার করে কিছু বলল না।
আজ আবার ভরা জ্যোৎস্না।চাঁদের আলো উপচে এসে পড়ছে রুমে।অন্ধকার রুমকে মায়াবী আলোতে আলোকিত করে রেখেছে।তার মধ্যে পুরো রুমে আমি একা একা বসে আছি।সোমা আপু আজকে তার অন্য ব্যাচম্যাটের রুমে গিয়ে ঘুমিয়েছে।ব্যাপারটা কি আমিও বুঝিনি।মিটিমিটি করে হেসে বলল আজকে নাকি তার এই রুমে কিছুতেই ঘুম আসবে না।আমিও বেশি জোর করিনি।এমনিতেই টেনশনে আছি পাছে সে আবার না বুঝে যায়!
বেলকনি থেকে টুক করে কিছু পড়ার অদ্ভুত আওয়াজ আসায় আমি চামচ মুখে ঢুকিয়েই ভ্রু কুঁচকে সেই বরাবর তাকালাম।আবারও কেমন আওয়াজ আসছে।তাই এবার বিছানা ছেড়ে ধীরে ধীরে খালি পায়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম।এই হোস্টেলের বেলকনিগুলো খোলা,কোনো গ্রীল দেওয়া নেই।
আমি সেখান দাঁড়িয়ে আশেপাশে চোখ বুলাতে লাগলাম।হঠাৎ মনে হল আমার পেছনে কিছু একটা আছে।ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেলো।
তখনই ফ্লোরে আমার পাশে আরো একটি ছায়ার মতো দেখতে পেয়ে আমি কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার দিতে গেলাম,’ভূ…ভূ..উত।’
তার আগেই এক জোড়া হাত এসে আমার মুখ চেপে ধরে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নিল।
আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আধো আলো আঁধারে দেখতে পেলাম সেই সুন্দর ঘন কালো ভ্রু।
সাদা টি শার্টের উপরে বোতাম না লাগিয়ে আকাশি রঙের শার্ট পড়ে সে ঠোঁটের কোনায় একটি হালকা হাসি ঝুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
সে ফিসফিস করে বলল,’পাগলী আস্তে।এখানে ভূত আসবে কোনদিক থেকে!’
আমি তাকে ইশারায় চোখ দিয়ে আমার মুখ থেকে হাত সরাতে বললাম।সে ওহ্ বলে সাথে সাথে ছেড়ে দিল।আমি বুকে হাত দিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম।কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!
নিদ্র ভাইয়া হাত মেলে আড়মোড়া ভেঙে রুমের ভেতরে গিয়ে ঢুকল।
এতক্ষণে আমার হুঁশ হল সে এখানে কি করছে!
আমি পিছন থেকে গিয়ে চিন্তিত স্বরে বললাম,’আপনি এখানে এসেছেন কেনো?’
-‘আজকে না আমাদের বাসর রাত।বাসর রাতে স্বামী স্ত্রী কে আলাদা থাকতে হয় না জানো না?’
তার কথা শুনে আমি চরম পর্যায়ের অবাক হয়ে গেলাম।বললাম,’বাসর রাত মানে!আপনি না বলেছেন এটা এমনি এমনিই বিয়ে।তাহলে আবার এসব কি?’
-‘আরে আমাদের জন্য এটা এমনি এমনিই কিন্তু বিয়েটা তো সত্যি সত্যিই হয়েছে।এখন বাসর রাতে যদি আমরা আলাদা থাকি তাহলে তো অমঙ্গল হতে পারে।এখন তুমি কি চাও আমার অমঙ্গল হোক?’
আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম।আমি চাই না তার কোনো অমঙ্গল হোক।কেনো চাই না তা জানি না,তবে একটুও চাই না।
আমি আবারো বললাম,’আপনি দোতলায় উঠে আসলেন কিভাবে?’
-‘কিভাবে আবার,মই বেঁয়ে।রাফি আর তামিম ধরে রেখেছিল।’
-‘যদি কেউ দেখে ফেলতো?’
-‘তোমার কি মনে হয় আমি এতো কাঁচা প্লেয়ার!’
বিশাল চাঁদ এখন মাঝ আকাশে উঠে এসেছে।নিদ্র ভাইয়া আমার বিছানার কাছে গিয়ে পকেট থেকে দুটি তাজা গোলাপ ফুল বের করে বিছানার সাথে ঘেষানো ছোট্ট টেবিলটিতে রেখে বলল,বাসর রাতে একটু ফুলের ছিটেফোঁটা না থাকলে মোটেও ভালো লাগবে না।’
এই বলে সে শুয়ে পড়ল আমার বিছানায়।কিছু মুহূর্তের মধ্যেই যেন ঘুমিয়ে পড়ল।আমি সোমা আপুর বিছানায় শুয়ে বারবার এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম।টেনশনে কিছুতেই যেন ঘুম আসছে না।আর উনি কি সুন্দর শান্তিতে ঘুমিয়ে যাচ্ছে।
খোলা জানালা থেকে ভেসে উঠছে পূর্ণিমার
স্নিগ্ধ মায়াবী চাঁদ।জানালার পর্দা দুলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে ঠান্ডা মৃদু হাওয়া।হঠাৎ তার ঘুমন্ত মুখের দিকে আমার চোখ পড়ল।জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোয় তার ঘুমন্ত মুখ চাঁদের থেকেও বেশি মায়াবী লাগছে।অদ্ভুত হলেও সেই দুটো গোলাপ থেকে মনে হল মিষ্টি সুভাস ছড়াচ্ছে।টকটকে লাল গোলাপ দুটি যেন পলক না ফেলে আমাকেই দেখে যাচ্ছে।যেমনটি আমি দেখে যাচ্ছি নিদ্র ভাইয়াকে।টেনশন যেন সব কোথায় উড়ে গেল।কোন এক অজানা জগৎ থেকে ভেসে এলো এক অচেনা সুর।সেই মায়াবী আলোয় মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে একটি অদ্ভুত ইচ্ছা আমার মনে জাগলো,তার ঘুমন্ত মুখটিকে একটু ছুঁয়ে দিতে।
ইচ্ছে টা যেন ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে।
অদ্ভুত তো!
আচ্ছা কচুপাতা রঙের কি কোনো নাম নেই?
নাকি একে শুধু কচুপাতার রঙই বলে।অদ্ভুত সুন্দর এই রঙ,না একে টিয়া বলা যায় না সবুজ।যা মনকে দোটানায় বেঁধে রেখেও এক স্নিগ্ধতা দিয়ে চোখকে ধাঁধিয়ে রাখে।অনেকটা নিদ্র ভাইয়ার মতো।তার প্রতি নিজের অনুভূতিও আমি
ধরতে পারি না।পারি না সেই অনুভূতিকে নাম দিয়ে বাঁধতে।ভালো লাগা আর বিরক্তির দোটানার মাঝে তাকে ঠাঁই ঠিয়ে বুঝে উঠতে পারি না কিছুই।দ্বিধাগ্রস্তে বিরাজ করাই যেহেতু আমার স্বভাব তাই দোটানায় গা ছেড়ে দিয়ে আমিও ভাসতে লাগলাম।কারণ যখন কিছুই বোঝা যায় না তখন কিছু না বোঝার চেষ্টা করেই পালের হাওয়ায় তাল মেলানোই ভালো।
চোখ ধাঁধানো সেই স্নিগ্ধতাকে উন্মুক্ত করে দিয়ে জড়িয়ে নিলাম গায়ে।বাঙালীপ্রাণ আমার মনকে প্রাধান্য দিয়েই কচুপাতা রঙের শাড়ির সাথে মানিয়ে পড়ে নিলাম হাতে একগুচ্ছ লাল চুড়ি।কানে ঝুমকো কানের দুল আর চোখে লাগিয়ে দিলাম এক চিমটি মেঘবরণ কাজল।সামনের চুলগুলো পিছনে ঠেলে পিঠ বেয়ে উন্মুক্ত করে দিলাম ঈষৎ কোঁকড়া কালো কেশ।
ভার্সিটির গেটের কাছে এসে মনে হল হয়তো একটু বেশিই তাড়াতাড়ি এসে পড়েছি।বেশি কাউকে দেখা যাচ্ছে না।চলতে থাকা ধীর পদক্ষেপ থামিয়ে দিতে হল সামনে তাকিয়ে।নিদ্র ভাইয়া নীল রঙের পান্জাবী আর সাদা পায়জামা পড়ে গেটের সামনে লেডারে দাঁড়িয়ে গাঁদা ফুলের লম্বা ঝোলন লাগাচ্ছে গেটে।পান্জাবীর হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করে তার সেই ঘন কালো ভ্রু ঈষৎ ভাঁজ করে খুব মনোযাগ দিয়ে বেঁধে যাচ্ছে।কিছু মুহূর্তের জন্য চোখ আটকে গেল তার দিকে।
অতিরিক্ত সুন্দরী মেয়েদের অপ্সরা,বেহেশতের
হুর বলে সম্বোধন করা হয় কিন্তু অতিরিক্ত সুন্দর ছেলেদের ঠিক কি বলা হয়?তাকে কোনো শব্দ দিয়ে বিশেষন করা যাচ্ছে না।সবই কম মনে হচ্ছে। সে এখন ফুলের লম্বা ঝোলনটা খাটো করে মুখ দিয়ে কামড়ে ধরে রেখেছে।
নাহ!আর তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না।দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলাম।মনকে বোঝালাম সে আমার সিনিয়র।সিনিয়ররা বড় ভাইয়ের মত।আড়চোখে আরেকবার তাকাতেই তার আমার উপর নজর পড়ল।আমাকে দেখেই তার মুখ থেকে ফুলের ঝোলন পড়ে গেল।সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল হা করে।এবার আমার অস্বস্তি লাগছে। এভাবে তাকিয়ে রয়েছে কেনো!সে সম্বিৎ ফিরে পেল লেডার ধরে রাখা ছেলের ডাকে।
সে নিচে নেমে এলো।ছেলেটি বলতে থাকল,
-‘নিদ্র ভাই থ্যাংকস।কতক্ষণ ধরে চেষ্টা করেছি।কিছুতেই লাগাতে পারছিলাম না।’
ছেলেটি একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু নিদ্র ভাইয়ার সেখানে কোনো হুঁশ নেই।আমার দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই।
আমিও কিছু না বলে মাথা নিচু করে পাশ দিয়ে চলে আসলাম।ভেতরে গিয়ে দেখি শুধু ছেলেরাই এসেছে মেয়েরা এখনো একজনও আসেনি,সব নিশ্চয়ই সাজতে ব্যস্ত।ফাংশন শুরু হবে দুপুরের পর থেকে।আর আমি দুপুরের আগেই চলে এসেছি।বেশ বিরক্ত লাগছে,কেন যে সোমা আপুর সাথে আসলাম না।আমি ভাবলাম সোমা আপুর সাজতে অনেক দেরি হবে তাই আগেই চলে যাই।আর সাফার তো আরো দেরি লাগে।
চারপাশে ছেলেরা হাঁটা চলা করছে।আমি মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ফোন ঝাঁকিয়ে চারপাশের সাজগোছ দেখছি।
হঠাৎ নিদ্র ভাই আমার হাত টেনে মাঠের সাইডে নিয়ে গেল।আমি ঘটনার আকস্মিকতায় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম।
সে বলল,’একেবারে মাঠের মাঝখানে গিয়ে যে দাঁড়িয়ে রয়েছো,সব ছেলেরা যে তোমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে সেদিকে কোনো খেয়াল আছে।আমি তো জানতাম মেয়েদের সাজতে অনেক সময় লাগে।এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে কি করে?’
-‘দেখুন মেয়েদের সাজতে সময় লাগাটা স্বাভাবিক।আর আমার বেশি সময় লাগেনি কারণ আমি বেশি সাজগোছ করি না।’
সে একটু মুচকি হেসে বলল,
-‘তোমার এই জিনিসটাই আমার বেশি ভালো লাগে।তুমি সবসময় ন্যাচরাল থাকো।তোমরা মেয়েরা খুব বোকা যার কারণেই যুগের সাথে তাল মেলানোর জন্য চুল কালার,হাতে নেইলপলিশ,গাঢ় লিপস্টিক,মেকআপ এসব লাগিয়ে আসল সৌন্দর্য্যই হারিয়ে ফেলছো।আসলে কিন্তু ন্যাচরালটাই বেশি ভালো লাগে।চুলের রঙ যেমন কালোই বেশি মানায় তেমনি নেইলপলিশ বিহীন পরিষ্কার হাত দেখতেই বেশি ভালো লাগে।’
একটি সুদর্শন ছেলের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে আমি মনে মনে ফুলতে লাগলাম।এর মধ্যে সাফা এসে বলতে লাগল,’ভাইয়া আপনি তো দেখি পাম দিয়ে ওঁকে আরো সেকেলে বানিয়ে দিচ্ছেন।ভার্সিটি লাইফে যেখানে আমরা সবাই টপস জিন্স ছাড়া কিছু পড়ি না সেখানে ম্যাডাম সবসময় সেলোয়ার কামিজ,শাড়ি এসবই পড়ে।’
আমি সাফার কাঁধে মৃদু থাপ্পড় মেরে বললাম,’তো! সবদেশেরই যেমন নিজস্ব সংস্কৃতি আছে তেমনি আমাদের দেশের সংস্কৃতি তো এটাই।বাঙালী মেয়েদের ওয়েস্টার্ন ড্রেসে যতই ভালো লাগুক না কেনো শাড়ির মতো সুন্দর আর কোনো পোশাকেই লাগে না।আর শালীনতা এসব পোশাকেই বজায় থাকে বেশি।’
নিদ্র ভাইয়া বলল,’একদম ঠিক।মেয়েদের এভাবে দেখতেই বেশি লাগে।’
পিছন থেকে তানিয়া আপু হেসে বলে উঠল,’নিদ্র তুই মেয়েদেরকে যাই পড়তে বলবি মেয়েরা চোখ বন্ধ করে তাই পড়বে।তোর জন্য যেমন পাগল!’
নিদ্র ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বলল,’চুপ কর তো।’
সাফা বলে উঠল,’যাক সুপ্তি তুই তোর স্বপ্নের রাজকুমার না পেলেও অন্তত একজনের মুখে তোর বাঙালী গেটআপের প্রশংসা তো শুনলি।’
তানিয়া আপু কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলো,’স্বপ্নের রাজকুমার?’
সাফা হাসতে হাসতে বলল,’সবার যেমন লাইফে একটি গোল থাকে তেমনি সুপ্তির লাইফের গোল হলো একজন ভালোবাসার মানুষ পাওয়া।সুন্দর একটি চটপটা লাভ স্টোরি হওয়া।’
আমি চিমটি দিয়ে সাফাকে থামালাম।তবে হ্যাঁ,ও যা বলছে একদম সত্যি।আমি চাই আমার একটি সুন্দর লাভ স্টোরি হোক।আরে! বুড়ো বয়সে যদি নাতি নাতনিকে নিজের রোমাঞ্চকর লাভ স্টোরিই না শোনাতে পারি তবে ইয়াং থেকে করছি টা কি!
রাফি ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল,’সে ব্যাপারে তোমাকে আর চিন্তা করতে হবে না সুপ্তি।আমাদের নিদ্র…..
এতটুকু বলতেই নিদ্র ভাইয়া তার মুখ চেপে ধরে নিয়ে গেলেন।আর রাফি ভাইয়া তার হাত ছাড়িয়ে বলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।তারা সবাই চলে গেল।
সাফা অবাক হয়ে বলল,’নিদ্র ভাইয়ার আবার কি হল?’
আমিও মুখ বাকিয়ে কি জানি বললাম।
বিরক্তি হওয়ারও একটি সীমা থাকে।
এই মুহুর্তে আমি আর নিদ্র ভাইয়া দুজনেই চরম বিরক্ত।কাল এত ঘুরেফিরে যে ফুলের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল সে ফুল এখনও এসে পৌছায়নি।অগত্যা আর কি করার,আমাদের আবারো গিয়ে দেখতে হবে সেখানে।সেকারণেই তো নিদ্র ভাইয়ার সাদা দামী গাড়ি ছুটিয়ে আমরা চলছি।আজ আর কালকের মত ভুল করেনি।তাই সাথে গাড়ি নিয়েই যাচ্ছে।নিদ্র ভাইয়া সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে আমি গাড়ির জানালা নামিয়ে হালকা মুখ বের করলাম।বাতাসে আমার চুলগুলো উড়ছে।চোখ বন্ধ করে তা অনুভব করতে লাগলাম।নিদ্র ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চুলগুলোও মৃদু উড়ছে।
তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,’আচ্ছা আপনি না একবার বলেছিলেন আপনি একটা মেয়েকে পছন্দ করেন?’
-‘পছন্দ করি না,ভালোবাসি।’
-‘ঐ তো।সেই মেয়েটাকে বলেছেন?’
-‘তাকে বলে বোঝাতে গেলে আমার মাথার চুল পেকে যাবে।’
-‘তাহলে এখন কি করবেন?’
-‘কি আর করব,তার থেকে বেশিদিন আমি দূরে থাকতে পারবো না।একদিন হুট করে জোর করেই বিয়ে করে ফেলবো।’
তার কথা শুনে আমার চোখ বড় বড় হয়ে অটোমেটিক হাত মুখে চলে গেল।কি সাংঘাতিক কথা!জোর করে বিয়ে করবে মানে?আমি তো আগেই জানতাম পলিটিক্স করা সিনিয়ররা এমনই হয়।শুধু শুধু কি আর ভয় পাই। ঐ সাফাকে এই কথা শোনাতে পারলে ভালো হতো।ও তো নিদ্র ভাই এই নিদ্র ভাই সেই নানা প্রশংসায় ভরিয়ে রাখে।
না জানি কোন মেয়ে ফেঁসে গেল!
ফুলের দোকানে গিয়ে দেখলাম তারা এখনই ফুল পাঠাতো।সব ঠিক করে রেখেছে।তাই আমরাও অপেক্ষা করতে লাগলাম ফুল নিয়ে একসাথেই যাব।সেই সময় জোহরের আযান দিয়ে দিল।আমরা বাঙালি মেয়েরা অন্য সময় মাথায় কাপড় থাকুক আর না থাকুক আযানের সময় ঠিকই উড়নার কোনা তুলে মাথায় দিয়ে নিব।না হলে মনে হয় পুরো মাথাটাই যেন শিরশির করতে থাকে।আমিও শাড়ির কোনা মাথায় তুলে নিলাম।একেবারে নতুন শাড়ি প্রথম ভাঁজ ভেঙে পড়ায় মাথায় কাপড় থাকছে না পড়ে যাচ্ছে।তাই বুকের কাছে শাড়ির কোনা দুটো একসাথে হাত দিয়ে ধরে রাখলাম।নিদ্র ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,’তোমাকে তো একদম বউ বউ লাগছে!’
আমাকে দেখে তার কেমন লেগেছে জানি না কিন্তু তার পৃথিবী বিক্রি করার মতন হাসি আর মুখের বউ শব্দটা শুনে আমার কেমন যেন লাগল।আবার সেই বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল।
ফুলের দোকানে দেখলাম নিদ্র ভাইয়া বারবার ঘুরেফিরে সরাসরি আড়চোখে আমাকেই দেখে যাচ্ছে।আমি উদ্বগ্ন হয়ে ভাবতে লাগলাম আমার চেহারায় কি অস্বাভাবিক কিছু হয়েছে এত দেখছে কেনো!
ফিরে যাবার সময় সে আমার হাত পিছন থেকে টেনে ধরে মিনতির স্বরে বলল,
-‘সুপ্তি প্লিজ তোমার চুলগুলো একটু বেঁধে নিবে।’
সে এমনভাবে বলল আমি আর না করতে পারলাম না।যেন এই মুহুর্তে আমার খোলা চুল থাকলে তার আর নিস্তার নেই।
তাকে কি শুধু শুধুই আমি বুঝতে পারি না!
এই তো কিছুদিন আগে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।আমার চুল ছিল চুলের কাঠি দিয়ে খোঁপা করা।কোথা থেকে নিদ্র ভাই এসে পিছন থেকে আমার চুলের কাঠি খুলে দিয়ে আমার ঘন কালো চুলগুলো পিঠ ভরে উন্মুক্ত করে দিল।আমি চমকে উঠে পিছনে ঘুরে তাকালাম।
কিছু বলার আগেই তিনি ব্যাপক মুড নিয়ে বলে উঠলেন,’কাঠিটা আমার লাগবে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’চুলের কাঠি দিয়ে আপনি কি করবেন?’
-‘তুমি প্রশ্ন খুব বেশি করো।আমি তোমার সিনিয়র এটা কি মাথায় থাকে না?’
এতটুকু বলায় এতকথা শুনে আমি মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম।সে আবার সেই হাসি দিয়ে বলল,’খোলা চুলেই তো বেশি ভালো লাগে তবুও এদের উড়তে না দিয়ে বেঁধে রেখেছো কেনো?’
আমি তার হঠাৎ এত আবেগী সুর শুনে অবাক চোখে তার দিকে তাকালাম।সে ধীর পায়ে গুন গুন করতে করতে সেখান থেকে চলে গেল।আর আমি তাকিয়ে রইলাম তার যাওয়ার পথে।
সেই দোকান থেকেই একটি বেলি ফুলের মালা এনে সে আমার হাতে দিল।তার হাতের সানগ্লাসের দিকে তাকিয়ে আমি মাথায় খোঁপা করে বেলি ফুলের মালাটি খোপার চারপাশে পেঁচিয়ে কাটা ক্লিপ মেরে নিলাম।খোঁপা করা হয়ে গেলে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,’ঠিক হয়েছে?’
সে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল,আমি তাকানোর পর একটু ইতস্তত করে মাথা চুলকিয়ে হুম বলল।
গাড়িতে উঠে বসলাম।গাড়ির আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখে বললাম,’এই আয়না দেখেই তো খোঁপা করতে পারতাম,দেখেছেন একদম খেয়াল ছিল না!’
সে আমার কথায় কান না দিয়ে গাড়ির সিটবেল্ট লাগাতে থেকে আনমনে বলতে থাকল,’যার জন্য বললাম কিছুই হল না।বরং আরো বেড়ে যেয়ে আমাকে জ্বালাচ্ছে।’
আমি হা করে তার কথা শুনে সামনে তাকিয়ে মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলাম।সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।তার মাথা বোধহয় পুরোপুরিই গেছে।কি বলে না বলে তার কোনো ঠিক নেই।
আমি বললাম,-‘আচ্ছা আপনি যে বললেন সেদিন কোন মেয়ে দেখতে যাবেন।সেই মেয়েটিই কি আপনার পছন্দ করা মেয়ে?’
সে মুচকি হেসে বলল,’তোমার দেখি আমার প্রতি ব্যাপক ইন্টারেস্ট।ব্যাপার কি?’
আমি লজ্জায় রাগে চুপসে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।আমি তো শুধু এমনিই জানতে চেয়েছি।একটা ছেলের মুখে এই ধরণের কথা শুনলে কেমন লাগে!
ভার্সিটিতে পৌছে দেখলাম সবাই এসে পড়েছে।মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা পান্জাবী পড়ে ঘুর ঘুর করছে।কেউ আবার সেলফি তোলায় নিমগ্ন।আমি গিয়ে সাফা আর সোমা আপুর পাশে দাড়লাম।
তখন তামিম ভাই এসে বলল,’হাই গাইস।’
আমরাও মিষ্টি হেসে হ্যালো বললাম।
তামিম ভাইয়া সাফাকে দেখে বলল,’আজকে তোমাকে আফা বলা যাবে না।’
তার এতটুকু কথায় সাফার দিকে তাকিয়ে দেখি ও একেবারে লজ্জায় লাল টুকটুক করছে।এত লজ্জা পাওয়ার কি হল!
আমি মজা করে বললাম,’কেন বলা যাবে না?’
-‘কারণ আজকে বলতে হবে অ্যান্টি।’
সাফা মুখটা কাঁদো কাঁদো করে রাগ দেখিয়ে চলে গেল।তামিম ভাই আমাকে বলল,’বেশি বলে ফেললাম বোধহয়।’
এই বলে সেও চলে গেল সাফার পিছু পিছু স্যরি বলতে বলতে।তাদের কান্ড দেখে আমি হাসতে হাসতে শেষ।
তানিয়া আপু এসে আমার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে বলল,এত হেসো না মায়াবতী,তোমার হাসির খপ্পরে পড়ে একজনের দম আটকে যায় যায় অবস্থা।কথাটা বলে সোমা আপুকে একটা চোখ মেরে দিল।
আমি হাসি থামিয়ে বললাম,’মানে?’
তানিয়া আপু একটু কাশি দিয়ে বলল,’মানে আবার কি?দেখছো না কত ছেলেরা তোমাকে দেখছে,তাদের কথাই বলছি।তোমাকে যে আজ কি মারাত্মক সুন্দর লাগছে তা কি তুমি জানো!’
তানিয়া আপুর কথায় বেশ লজ্জা পেলাম।বললাম,যান আপু!কি যে বলেন।আপনারা তো আমার থেকেও বেশি সুন্দর।
তানিয়া আপু আফসোসের সুরে বলল,’ঐ,ধলা চামড়াটাই আছে।শ্যামাবতীর মতো চেহারায় মায়া তো নেই!’
নাঈম ভাইয়া বলল,’হুম।’
তানিয়া আপু কটমট করে বলল,’হুম মানে?তুমি হুম হুম করছো কেনো!তার মানে আমাকে সত্যিই দেখতে ভালো লাগছে না।’
নাঈম ভাইয়া কানে ধরতে ধরতে বলল,’জানু আমি ওটা বুঝাতে চাই নাই।তুমি নিজেই তো বললে।’
-আমি বললেই তুমি বলবা।এখন তো ভালো লাগবেই না,পুরাতন হয়ে গেছি না।’
তাদের এই কথার মাঝেই মাইকে শোনা গেল নিদ্র ভাইয়ার গলা।নাঈম ভাইয়া মুচকি হেসে বললো,’সবাই চলো ওখানে।আওয়ার হিরো ইজ ব্যাক অন স্টেজ।’
আমরা সবাই গিয়ে স্টেজের সামনে সবার ভীড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম।সবাই নিদ্র নিদ্র করে চেয়ার আপ করছে।পাশ থেকে আরেকজন মাইকে বলছে,
‘আমাদের সবার প্রিয় নিদ্র ভাইয়ার কাছে আমরা আবারো লাস্ট ইয়ারের মতো সালমান খান স্টাইলে “ওহ ওহ জানে জানা”গানে ডান্স পারফরমেন্স চাই।’
তারপর তিনি দুই লাইন গেয়ে উঠলেন।
“ওহ ওহ জানে জানা,ঢুন্ডে তুঝে দিওয়ানা
সাপনোমে রোজ আয়ে,য়া জিন্দেগীমে আনা”
নিদ্র ভাইয়া মুচকি হেসে মাইকে বলল,’এখন আর সেই গান গাওয়ার প্রয়োজন নেই।’
সামনে দাঁড়ানো রাফি ভাইয়া মুখে হাত দিয়ে সিটি বাজিয়ে হেসে বলল,’এখন আমাদের হিরো গাইবে
” দ্যাশ বাহানে কারকে লে গেয়ে দিল।”
সবাই মুখ দিয়ে হো করে চিৎকার করে শব্দ করতে লাগল।ফাংশন খুব ভালোই জমে উঠেছে।
হোস্ট করা ছেলেটা বলল,’নিদ্র ভাই সবাই খুব অধীর আগ্রহে আছে আপনার মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য।আপনি অন্তত আপনার মনের ভাব একটি গান গেয়ে শোনান।’
নিদ্র ভাইয়া কাঁধে তার কালো গিটার ঝুলিয়ে সামনে তাকিয়ে গিটারের টোনের সাথে মিলিয়ে মুখে সুর তুলল।গাইতে লাগল,
আমার অজানায়,হলো কি
তোমাকে তা কখনো বুঝতে দেবো না
বৃষ্টির পানে আকাশ চেয়ে তোমাকে
আমি খুঁজবো না…
আকাশের পানে চেয়ে চেয়ে
ভালোবাসি তা বলবো না।
তুমিও কি আমার মতো করে
একটু ভালোবাসবে না?
তুমিও কি আমার মতো করে
একটু কাছে ডাকবে না?
তার গানে শুনে আমি পুরো বিমোহিত হয়ে গেলাম।এত সুন্দর গান গায়!মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসলো,’কি সুন্দর গান গায়!’
আমার কথা শুনে পাশ থেকে তানিয়া আপু বলে উঠল,’হুম,নিদ্র খুব সুন্দর গান গায় আর খুব ভালো গিটার বাজাতে পারে।’
আর কি বলবো খুঁজে পেলাম না।তার গান আবার টেনে নিল ছন্দে ঘেরা সুরের জগতে।
শুক্রবার মানেই এক্সট্রা ঘুমের দিন।আমিও শান্তিতে ঘুমিয়ে আছি উপুড় হয়ে।কিন্তু এই ফোন নামের পদার্থটা হয়তো আমার শান্তির ঘুম সহ্য করতে পারে না।জোড়ে আওয়াজ করে কারো আমায় স্মরণ করার কথা জানিয়ে দিচ্ছে।চোখ না খুলেই একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন হাঁতড়ে বালিশের পাশ থেকে খুঁজে বের করে কানে দিয়ে বললাম,’হ্যালো।’
ওপাশ থেকে কেউ উফ!করে উঠল।তারপর বলল,’মেরে ফেলতে চাও?’
আমি হালকা চোখ খুলে কপাল ভাঁজ করে বললাম,’কে?’
ওপাশ থেকে সেই চিরচেনা গলায় ভেসে আসল,’তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।’
এতক্ষণে ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটিকে বুঝতে পেরে আমি বললাম,’ভাইয়া আজকে তো শুক্রবার।ভার্সিটি বন্ধ।’
-‘আমি জানি ভার্সিটি বন্ধ।তুমি এখন ভার্সিটিতে না তার পাশে কাজী অফিসে চলে আসো।’
দুই তিনবার নক করতে দরজা খুলে দিল।
ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ম্লান হয়ে থাকা ছোট্ট নিপার চেহারার উপর নজর গেল নিরুর।ওকে দেখতে পেয়ে নিপার চেহারায় পূর্ণিমার চাঁদের মতন আলোর ঝলক দেখা গেল। জিনিস পএ রেখে নিরু নিপার দিক ঝুকতেই খিলখিলিয়ে হেসে এক লাফে তার গলা জড়িয়ে ধরল। মূহুর্তের মধ্যেই নিরু তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে চেপে ধরল।সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক চুমু এসে নিরুর দুই গালে আছড়ে পড়ল। প্রত্যহের মত নিপার বায়না অনুসারে তিনটা ডেইরী মিল্ক চকোলেট দিতে হল তাকে। আমার চকোলেট কোথায়?আপু!নিরু সামনে তাকিয়ে দেখে নীলা দাড়িয়ে আছে। উওর না দিয়েই ব্যাগ থেকে একটা চকোলেট বের করে নীলার দিকে এগিয়ে দিল। নিপাকে নীলার কোলে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল সে।ফ্রেশ হয়ে বাবার রুমের দিকে চলে গেল সে। বাবা একমনে পত্রিকা পড়ছেন। নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসল।নিরুর বাবা ডাক শুনে চমকে উঠে পাশে বসা নিরুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
চার বছর আগেও যে মেয়েটি ছিল হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল কিশোরী, তাকে আজ দেখলে মাঝবয়সী মনে হয়।চার বছর আগেও যে মেয়েটির চোখে সম্ভাবনারা জ্বলজ্বল করত,সেখানের দখলদার আজ একরাশ হতাশা।
তোর কি খুব কষ্ট হয় রে মা? রহমান সাহেবের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি নিরু। তীব্র কালো চোখের কোনে মুক্তো কনার মতো জ্বলজ্বল করতে লাগল। নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে ছিল মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে।
বাবা জানইত আজ নিপার জন্মদিন।তাই ভালমন্দ কিছু রান্না করতে হবে। আমি যাই।
পালাচ্ছিস??
না বাবা। বাস্তবতা বড়ই কঠিন চাইলেও পালাবার পথ নেই। রহিমা আপা আর রাহি, রাফি আসবে।নিপার জন্মদিন উপলক্ষ্যে রাতের খাবারের দাওয়াত দিয়েছিলাম।
ভাল করেছিস মা।যা কিছু রান্না কর গিয়ে।
নিরু মেয়ে আমার জাহানারার মতো হয়েছে সব কষ্ট নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখবে আর আনন্দ ভাগ করবে সবার মাঝে। মায়ের মতো এতটা ফর্শা হয়নি কিন্তু তীব্র কালো চোখ আর ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে এদিকটা পুষিয়ে নিয়েছে। তীব্র কালো চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হবে অন্তর্দৃষ্টিতে সব পড়ে নিয়েছে। চোখে কর্তৃত্বের ধার যেন মূহুর্তেই সব নিয়ন্ত্রণে নিবে।কিন্তু লাজুক মেয়ে কারো দিকে তাকায় না।হাসলে নিটোল গাল রক্তিম হয়ে উঠে।চোখ জোড়া সামান্য ছোট হয়, ভ্রু জোড়া রংধনুর বাঁকের আকৃতি ধারণ করে। ঠোঁট কিছুটা সম্প্রসারিত হয় ফলে দুই জোড়া দাঁতের সামান্যই দেখতে পাওয়া যায়। তার এই অনিন্দ্য সুন্দর হাসিতে অন্তর জুড়িয়ে যায়। তার হাসি যেন এক ছোঁয়াচে রোগ।তাকে হাসতে দেখলে সবাই তার সাথেই হাসে। কিন্তু গত চার বছরে তার একবারও হাসি দেখেনি।
আপি!রাহি,রাফি এসেছে।চল আমার সাথে। একটুখানি দাঁড়াও সোনা আমি ভাতের মাড় ফেলে আসছি। ততক্ষণে নীরুর রুমে উৎসব মূখর পরিবেশে সৃষ্টি হয়েছে। নিপা ,রাহি ,রাফি খেলছে আর নিরু, নীলা, রহিমা আপা মুগ্ধ হয়ে দেখছে। একটুপরে কেকের ওপর রাখা মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়।নিপা ফু দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দেয়।সবাই নিপাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল।নিপা কেক কেটে প্রথমে নিরু ও বাবাকে দিল। তারপর সবাই সবাইকে কেক খাইয়ে দিল। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসে সবাই মুরগির মাংস,ডাল,বেগুন ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে রাতের খাবার শেষ করল।সবাই মিলে বস্তির পাশের মাঠে গিয়ে ফানুস উড়িয়ে দিল। কিছুক্ষণ আনন্দ করার পর রহিমা আপাকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ঢুকল সবাই।নিপা আজ নীলা ও নিরুর সাথে থাকবে।তাই নিপা কে নিয়ে নীলা রুমে ঢুকল।
আজকে তোর হাসিমাখা মুখটা দেখে খুব আনন্দিত হলাম।সবসময় হাসিখুশি থাকবি।হুম বাবার কথার
জবাব না দিয়ে নিরু রুমে এসে নিপাকে মাঝখানে রেখে জড়িয়ে ধরে ওর ক্লান্ত দেহটাকে বিছানায় এলিয়ে দিল।নিপা আর নীলার ভবিষ্যতের চিন্তায় ডুব দিল।নিরুর মন অনুভূতি শূন্য হতে লাগল ,ইন্দ্রিয়গুলোর কাজ বন্ধ করে দিল, মস্তিষ্কের নিউরনে প্যাচ লাগতে শুরু করলো।আস্তে আস্তে নিরু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
আরেক বার ভেবে দেখ!
এক মাসের বেতনের চেয়ে বেশি পাবে।১৫,০০০ পাবে। ব্যাপারটা আমি তুমিতে সীমাবদ্ধ থাকবে।কেউ জানবে না!!!
কথা গুলো সিনিয়র স্টাফ লাবিব ভাই গার্মেন্টস কর্মী নিরুর উদ্দেশ্যে বললেন।কাঠঠোকরার ঠোঁটের মত অন্তর্ঘাত করল নিরুর অন্তরে। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল নিরু। জানাবেন না কেন? অন্তত ভাবীকে জানালে দোষের কিছুই দেখি না আমি! নিতুর সরীসৃপের মত শান্ত চাহনি আর বলার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে থতমত খেলেন লাবিব ভাই। নিঃশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন।ভ্রু কুঁচকে নিজের কাজে হাত চালাল নিরু।
নিরু! অনামিকা আক্তার নিরু। রহমান সাহেবের বড় মেয়ে।মেজো মেয়ে নীরা আর ছোট মেয়ে নিপা।তিন মেয়েকে নিয়ে রহমানের সংসার।পুএ সন্তানের আশায় বুক বেধে নিপাকে জন্ম দিতে গিয়ে জাহানারা আক্তারের রক্তের ক্ষরন হয়।সময়মত রক্তের অভাবে মারা যান জাহানারা আক্তার ও রক্ত যোগাড় করতে ব্লাড ব্যাংকে পৌঁছানোর সময় সড়ক দুর্ঘটনায় এক পা হাড়ান পুলিশ কনস্টেবল রহমান সাহেব।ফলে চাকুরী হারাতে হয় তাকে। পদ্মার ধস নামে রহমানের সংসারে। মাতৃ মৃত্যুর শোক আর পঙ্গু বাবা ও অপাপ্ত দুই বোনের ভার কাধে নিয়ে জীবন যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের মতো আকাশ পানে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।বাস্তবতার চরম কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে ফলবান বৃক্ষের মত নুইয়ে পড়ে যায় সংসারের ভারে। ভার্সিটি পড়ে কলেজের লেকচারার সপ্নকে মনের মধ্যে মাটি চাপা দিয়ে দেয়। সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা সতেরো বছরের নিরু হন্যে হয়ে চাকুরী খুঁজে বেড়ায়। প্রতিবেশী মহিলাদের সাথে যোগ দিল গার্মেন্টসে। গার্মেন্টসে চাকুরী করার সময় নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। কখনো চিৎকার করে প্রতিবাদ করেছে কখনো কখনো দুচোখে চির সহিষ্ণু ভাব নিয়ে নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে ছিল। দেখতে দেখতে চার বছর পার হয়ে গেল।নীরা এস.এস.সি পরিক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। ছোট্ট নিপা চার বছরে পা দিল। নিপার আধবুলি বলার ভঙ্গি আর নেচে নেচে চলা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।আজ নিপার জন্মদিন।
“কিরে নিরু বাসায় যাবি না?” রহিমা আপার কথাই অতীতের রোমন্থন থেকে ফিরে এল নিরু। হকচকিয়ে গিয়ে উওর দিল হ্যা,চল আপা।বাম হাতে টিফিন ক্যারিয়ার আর ডান হাতে ছোট পার্টস ব্যাগ নিয়ে মাথায় আধ হাত ঘোমটা দিয়ে বের হয়ে গেল গার্মেন্টস থেকে।
রহিমা আপা নিরুদের প্রতিবেশী।সে প্রত্যেকদিন তার সাথে আসা যাওয়া করে। রহিমা আপার স্বামী পিকআপ ভ্যান চালক।সব সময় কাজ না থাকায় স্বামীর আর্থিক সমস্যা মিটাতে নিরুর সাথে কাজ করে সে। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে মেয়েরা উভয়েই মিরপুরের বস্তির পাশের আয়ডিয়াল স্কুলে ক্লাস টু পড়ে।
নিতুর বাসা থেকে গার্মেন্টসের দুরুত্ব আধা মাইল হওয়ায় পায়ে হেঁটে বাসায় যায়। বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার পাশে কনফেকশনারির দোকান থেকে জমানো টাকা দিয়ে ছোট্ট একটি জন্মদিন কেক ও একটা মোমবাতি কিনে নেয়।সাথে করে কিছু ডেইরী মিল্ক চকোলেট নেয়। চকোলেট নিপার কাছে খুব প্রিয়। দেখতে দেখতে নিরু বাসার সামনের গলিতে এসে পড়ে।একটু দূরে থেকে সে রংচটা টিনসেড দোতলা বাড়িটা দেখতে পায়। দোতলায় ভাড়া থাকে নিরুর পরিবার। দুই রুম ও একটা ছোট্ট রান্নার ঘর আছে।একটা রুমে নিতুর বাবা ও নিপা থাকে।অন্যটায় নিরু ও নীরা।গলি পেরিয়ে বস্তির মধ্যে দিয়ে হেঁটে বাসার সামনে এসে পড়ে এবং কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা নক করে। দুই তিনবার নক হতে দড়জা খুলে যায়।
এই মুহূর্তে আমার নিজের চোখকে একদম বিশ্বাস হচ্ছে না।কিন্তু তবুও করতে হচ্ছে।কয়েকদিনের পরিচয়ের হলেও আমি যতদূর জানি সোমা আপুর সাথে আমার যথেষ্ট সখ্যতা গড়ে উঠেছে।এতবড় কথা আমার থেকে লুকানোর কোনো মানেই হয় না।আমার চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ফোনের স্কিনে আই লাভ ইউ সোমা উঠে রয়েছে।যেই মেসেজটা কিনা রাফি ভাইয়ার নামে সেভ করা নাম্বার থেকে এসেছে।
সোমা আপু রুমে ফিরে আসতেই আমি তার হাতে ফোন তুলে দিয়ে মুখ ভার করে বললাম,’যার তার হাতে ফোন দিয়ে দিওনা।তোমাদের পারসোনাল মেসেজ দেখে ফেলতে পারে।’
সোমা আপু অপরাধী ভঙ্গিতে হেসে বলল,’তুই দেখে ফেলেছিস।বিশ্বাস কর আমি তোকে আজ না হয় কাল ঠিক বলতাম।তুই তো তাদের কথা উঠালেই নিদ্র ভাইয়ার নামে এত গালি দিতে থাকিস বলে কিছু বলতে পারি না।’
-‘হ্যাঁ নিদ্র ভাইয়া!তুমি যদি বলতে রাফি ভাই তোমার বয়ফ্রেন্ড তাহলে আমিও একটু তাকে দিয়ে নিদ্র ভাইয়ার কাছে সুপারিশ করে রেহাই পেতাম।জানো ঐ নিদ্র আমাকে কতটা জ্বালাচ্ছে!উঠতে বসতে সবকিছুতেই এসে ডেকে পাঠায়।’
সোমা আপু হেসে বলল,’তোর কি মনে হয় রাফি বললেই নিদ্র ভাইয়া তোকে মুক্তি দিবে!ভাইয়ার যেটা একবার মাথায় আসে তা থেকে কেউ তাকে বের করতে পারে না।তবে একটা আশ্চর্যের কথাই!এতদিন হয়ে গেল ভাইয়া তোকে এখনও মাফ করছে না,এতটা রুড তো ভাইয়া না!নিদ্র ভাইয়ার হয়েছে টা কি?’
আমি কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বললাম,’হ্যাঁ আমার যে কপালটাই খারাপ তাই আমার ক্ষেত্রেই সবকিছু বেশি বেশি।’
নিদ্র ভাইয়াকে আমার এখন কাঁঠালের আঠার মত লাগছে।যতই আমি তাকে ছাড়াবার চেষ্টা করছি সে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে আমাকে ততই জড়িয়ে রাখছে।
নবীন বরণের অনুষ্ঠানে সকল নিউ স্টুডেন্টদের কোনো না কোনো ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।সাফাকে সিলেক্ট করা হল নাচের জন্য।তা নিয়ে বেচারা ন্যাকাতে ন্যাকাতেই শেষ।আমিও পূর্ব প্রতিশোধের সূত্র ধরে খুব করে হেসে মজা উড়ালাম।
কিন্তু সময়টা তো খারাপ যাচ্ছে আমার।হাসি আর দীর্ঘক্ষণ টিকলো না।আমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে ফাংশন অর্গানাইজ করায় হেল্পের জন্য।আর এই পুরো ফাংশনের দায়িত্ব যে কার উপর পড়েছে তা তো ভালো করেই জানি।নিদ্র ভাইয়ার সাথে সবকিছুতে যে কেন এভাবে জড়িয়ে যাচ্ছি!
এই খবরে সব থেকে খুশি হল সাফা।যেন ঈদ বোনাস হাতে পেয়েছে।নিজের ন্যাকামো ভুলে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতে লাগলো।
করিডোরে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশ দেখছিলাম।কোথা থেকে আমাদেরই এক ব্যাচম্যাট রাশেদ এসে গল্প জুড়ে দিল।একথায় সেকথায় তাকে আমার উপর অর্পিত দায়িত্বের প্রতি অসন্তুষ্টর কথা জানিয়ে দিলাম।সে পরামর্শ দিল অন্য কোন এক্টিভিটিতে যোগ দিতে তাহলে হয়ত প্রিন্সিপাল স্যারকে বলে আগেরটা বাদ দেওয়া যাবে।বিরক্তিকর সমস্যার হঠাৎ পাওয়া সমাধানের কথা শুনে ব্যাপক খুশি হলাম।খুব মিষ্টি করে হেসে রাশেদকে ধন্যবাদ বললাম।এতেই সে বেশ খুশি।ইদানিং আমার সাথে একটু বেশিই ভাব করতে চাইছে।
আড়চোখে পাশ ফিরে দেখলাম নিদ্র ভাইয়া পাশ দিয়ে যাচ্ছে।আমার দিকে একটু রাগী চোখে তাকিয়েই দ্রুত সামনে দৃষ্টি দিল।সব এক্টিভিটির প্রধান দায়িত্বে যেহেতু সেই আছে তাই তার পিছনে দৌড়ানোই আমি শ্রেয় মনে করলাম।
পিছন থেকে ডাকলেও কোনো সাড়া না দিয়ে সে হনহনিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।অবশেষে দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।সে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
আমি বললাম,’ভাইয়া আমাকে অন্য কোনো এক্টিভিটি দিন।আমি এটা করতে পারবো না।’
-‘সব কিছুই সিলেক্ট হয়ে গেছে এখন কোনো চেন্জ আনা যাবে না।’
-‘তাহলে আমার নাম ওখান থেকেও কেটে দিন কোন বেকুব না গাধা আমার নাম দিয়ে বসে আছে!আমি এসব করতে পারব না।’
কথাটা বলে তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন আস্ত গিলে খাবে।বিপদ সংকেতের পূর্ব মুহূর্তে অবচেতন মনে প্রশ্ন জাগলো নামটা সেই দেয় নি তো!’
সে এক পা এক পা করে সামনে আগাতে থেকে বলতে লাগল,’আমি বেকুব?গাধা?ভালো লাগুক আর না লাগুক তোমাকে তোমার পানিশম্যান্ট কমপ্লিট করতেই হবে।নিদ্রর গালে চড় মেরেছো তুমি।এত সহজে ছাড়া পাবে!’
পা পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আমি ভয়ে একটা ঢোক গিললাম।জীবনে এই মানুষটিকেই আমি সবথেকে বেশি ভয় পাই।নিজের হাতটাকে কেটে কুচি কুচি করে এখন বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।এই থাপ্পড়ই আমার কাল।আর কত কি যে পোহাবো এর জন্য!
কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে মাঠের দিকে আসতেই দেখলাম সোমা আপু,তানিয়া আপু আর রাফি ভাইয়া একসাথে দাঁড়িয়ে আছে আর কোনো বিষয় নিয়ে খুব হাসছে।
আমাকে দেখে সোমা আপু বলল,
-‘সুপ্তি দাঁড়া।আমিও এখনই যাবো।ও…স্যরি তোকে তো এখন নাম ধরে ডাকা যাবে না।ডাকতে হবে ভা….
এতটুকু বলেই রাফি ভাইয়ের চোখের ইশারাতে সে চুপ হয়ে গেল কিন্তু হাসিটুকু আর থামলো না।
তাদের এই অহেতুক হাসির কোনো কারণ ধরতে না পেরে আমি মুখ ফুলিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম।এমনিতেই মন মেজাজ ভালো না।
পথে ধাক্কা খেলাম মিথি আপুর সাথে।সে কিছু না বলে চোখ গরম করে চলে গেল।আমার কেন যেন মনে হয় এই আপুটা আমাকে ঠিক পছন্দ করে না।
ভাবনার মাঝেই সেখানে সাফা কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে উপস্থিত।ওকে দেখে আমার নিজের কাঁদো ভাব চলে গেল।সাফা বলতে লাগল,
-‘সুপ্তি নিদ্র ভাইয়ার ঐ বন্ধু রাফি ভাই এত খারাপ কেনো বলতো!আমি প্রাকটিস করতে গিয়েছিলাম আর আমাকে দেখে কি বলে জানিস।’সাফা আফা
ডান্স কোনো আফার কাজ না।আপনি এখান থেকে ফুটুন।’
সাফার কথা শুনে আমি না হেসে পারলাম না।সাফা বলল,’তুই হাসছিস!নিদ্র ভাইয়া কত ভালো।তার বন্ধুটা এত ফাজিল কেনো?’
নিদ্র ভাইয়ার প্রশংসা শুনে রাগ চেপে বসল মাথায়।আমি বললাম,’শোন ঐ নিদ্র না আরো ফাজিল।আমি জানি তাই আমাকে বোঝাতে আসিস না।পলিটিক্যাল লিডার সব আতরা ফাতরা ছেলেরাই হয়।’
-‘নিদ্র ভাইয়া কিন্তু টপারও,ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট।এটা ভুলে যাস না।’
সাফার এই কথায় আমতা আমতা করে আর কোনো জবাব খুঁজে পেলাম না।সত্যিই!সে কিভাবে যে রাজনীতি করে আবার পড়ালেখাও এত ভালো সামলায়।
সদ্য কাঁচা ঘুমটা ফোনের রিংটোনে ভেঙে যাওয়ায় ইচ্ছে করছে মোবাইল নামক পদার্থটাই পৃথিবী থেকে গায়েব করে দেই।বিরক্তি মাখা মুখ নিয়ে ফোনের দিকে তাকাতেই স্কিনে ভেসে উঠা নামটা দেখে সব ঘুম পালিয়ে গেল।নিদ্র ভাইয়া রাত বারোটা বাজে আমায় ফোন করছে কেনো?
মনের ভেতর চলতে থাকা প্রশ্নের ঝুরি বন্ধ করে ফোন রিসিভ করলাম।ওপাশ থেকে ভেসে এলো মিষ্টি ভারী গলা,
-‘হ্যালো, সুপ্তি ঘুমিয়ে গেছো?’
মনে মনে বললাম,হ্যাঁ এখন জাগিয়ে জিজ্ঞেস করো ঘুমিয়েছি কিনা!
কিন্তু চাইলেই তো আর সব বলা যায় না।তাই নরম গলায় বললাম,
-‘ভাইয়া এত রাতে আমায় ফোন করলেন যে।’
-‘ঘুম আসছিল না।সন্ধ্যা থেকে টানা পড়েছি,আই ফিল টায়ার্ড নাউ।’
-‘ভাইয়া তাহলে ঘুমিয়ে পড়ুন।আমি কি করব?’
-‘কিছুই করতে হবে না।শুধু কানের কাছে ফোনটা ধরে রাখো জাস্ট।’
-‘আপনি এত পড়েন কিভাবে।আমি তো আধা ঘন্টা হলেই যেখানে থাকি সেখানেই ঘুমে চিৎপটাং।’
সে শব্দ করে হেসে দিল।আবার সেই হাসি!ভাগ্যিস সামনে ছিল না!আমি বললাম,
-‘আপনি ঘুমাবেন না?’
-‘জানি না।স্বপ্নেও সে বড্ড জ্বালায়।ঘুম কুমারী যে আমারই ঘুম কেড়ে নিয়ে আমাকে নিদ্র থেকে জাগ্রত করে রাখলো।বলো তো সে কোন অদৃশ্য প্রতিশোধ নিচ্ছে?’
তার কথায় আমি খিলখিল করে হেসে দিলাম।পড়তে পড়তে কি মাথা খারাপ হয়ে গেল।কি আবোল তাবোল বকছে!
হাসি থামিয়ে বললাম,’কে?আপনার গার্লফ্রেন্ড?’
আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে সে গুনগুন করে গেয়ে উঠল,’ফন্দি আটে মন পালাবার,বন্দি আছে কাছে সে তোমার।’
-‘বাহ!আপনি তো খুব সুন্দর গান গাইতে পারেন।আপনার গার্লফ্রেন্ডকে গান শোনান না?’
-‘গাধী!’
আমি এমন কি বললাম যে আমাকে গাধী বলল।রাগ করে বললাম,’এখন রাখছি।আমার সকালে ক্লাস আছে,ঘুমাবো।’
সে হঠাৎ একটু রাগী স্বরে বলল,
-‘তুমি আবার ক্লাস করো?খুব তো দেখি ক্লাস বাদ দিয়ে ছেলেদের সাথে হেসে হেসে কথা বলো।’
আমায় আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা কেটে দিল।একদিন মাত্র ক্লাস বাদ দিয়েছি তার জন্য আমাকে এত কথা বলল।বিড়বিড় করে বললাম,
তোমার জন্য আর অন্য ছেলেদের সাথে কথা বলতে পারি কই।আমার সব সময় তো তুমিই নিয়ে যাও।আমার ভালোবাসার মানুষও আর খুঁজতে পারলাম না!
অফ পিরিয়ডে সবাই জুটিতে পরিণত হয়ে যায়।যেখানেই তাকাবে সব জোড়া জোড়া।সোমা আপুর কাছে গিয়েছিলাম কিন্তু সে রাফি ভাইয়ার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।সাফাও ইদানিং হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়।তাই আমার মতো আর সিংগেল মানুষের কি করার!
বসে আছি গার্ডেনে রাখা কাঠের বেঞ্চে আর মুখের সামনে ধরে রেখেছি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমের উপন্যাস পরিণীতা।কি সুন্দর ভালোবাসা আর অদৃশ্য অধিকারে শেখর ললিতাকে জড়িয়ে রেখেছে।ললিতা নিজের মনের ভাবকে না বুঝেও অজান্তেই সেই ডাকে সাড়া দিয়ে যাচ্ছে।
ফুলের সুভাসে মুখরিত বাগানের মৃদু হাওয়ার মাঝে আমি আলতো করে এক এক পাতা পাল্টে ডুবে যাচ্ছি সেই অনুভূতিতে।ঠোঁটের কোনায় লেগে রয়েছে এক চিলতে হাসি।বারবার মনে হচ্ছে আমারও যদি একজন শেখর থাকতো!
হঠাৎ সেখানে নিদ্র ভাইয়া এসে ধপ করে আমার পাশে বসে পড়ল।বেঞ্চে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে সামনে এসে পড়া চুলগুলো হাত দিয়ে পিছনে নিতে লাগলো।দেখে মনে হচ্ছে হাঁপিয়ে গেছে।আমি বই থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সে আড়চোখে আমার হাতের দিকে দেখল।আমিও উৎসাহিত হয়ে বললালম,
-‘আপনি এই উপন্যাসটা পড়েছেন?খুব রোমান্টিক!
সে সোজা হয়ে বসে বলল,’আমি ভালোবাসার গল্প পড়ি না,গল্প তৈরি করি।’
হঠাৎ সেখানে একটি মেয়ে এসে বলল,’ভাইয়া আমি আপনার সাথে নবীন বরণ নিয়ে কিছু বলতে চাই।’
নিদ্র ভাইয়া বলল,’অডিটোরিয়ামের সেকেন্ড ফ্লোরে রাফি আর তামিম আছে,যা জানার ওদের থেকে জেনে নাও।’
তার এই কথায় মেয়েটি নড়লো না,এক দৃষ্টিতে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো।মনে হচ্ছে তার সাথেই মেয়েটির কথা বলতে হবে।নয়তো আর উপায় নেই।
মেয়েটি নড়ছে না দেখে নিদ্র ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত চোখে মেয়েটির দিকে তাকালো।এতে মেয়েটি চলে গেল।কিন্তু যাবার পথেও বারবার পিছনে ফিরে তাকে দেখে যাচ্ছে।
কেসটা কি আমি পুরোপুরিই বুঝে গেলাম।এই মেয়ে দেখি নিদ্র ভাইয়ার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে কিন্তু তার সামনে হাসতে পারছি না।হাসি চেপে রাখার তুমুল চেষ্টায় ঠোঁট চেঁপে মৃদু হাসছি।নিদ্র ভাই কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘তুমি সবসময় এভাবে হাসো কেনো? আমার সামনে আর এভাবে হাসবে না!’
আমি চরম অবাক হয়ে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।এভাবে হাসলে কি হয়।সিরিয়াস মুহূর্তে হেসে ফেলার রোগ আমার আছে।সেই অভ্যাস দূর করার চেষ্টাতেই এই হাসি আমার আয়ত্ত হয়েছে।এখন এটাতেও সমস্যা!
গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরমে তার কপালে মৃদু মৃদু ঘাম জমে যাচ্ছে।একটি রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে সে বলল,’আজকে আমি মেয়ে দেখতে যাচ্ছি।বলো তো আমাকে মেয়ের পছন্দ হবে তো?’
তার কথা শুনে না অবাক হয়ে পারলাম না।বললাম,
-‘আপনার মত এত সুন্দর ছেলেকে আবার কে অপছন্দ করবে?’
একটু উৎসুক হয়ে সে বলল,’আচ্ছা!আমি যদি মেয়েটাকে বলি মেয়েটা বিয়ে করতে রাজী হবে তো?তোমার মতো করে ভেবে বলো।
আমি সোজা তাকিয়ে বললাম,
-‘আমার মত করে যদি বলতে যাই তবে আমি এত সুন্দর ছেলেকে বিয়ে করতে কখনোই রাজী হতাম না।সুন্দর ছেলেকে বিয়ে করা অনেক জ্বালা।দুনিয়া সুদ্ধ মেয়ে তার উপর ক্রাশ খাবে তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে।অফিসে গেলে সেখানে মেয়ে কলিগ আবার বাইরে বেরোলে সেখানকার মেয়ে!সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকো আবার বরের মনও নাকি ফসকে যায়।এত ভয় ভয় নিয়ে আমি থাকতে পরবো না।আবার সুন্দর ছেলেরা বউকে অত দামও দেয় না।আমার বর আমাকে ফার্স্ট প্রায়োরিটি দিবে।সবসময় আমার দিকেই তার নজর থাকতে হবে।অন্য মেয়েরা তাকে এত দেখবে কেনো?তাই আমি তো বিয়ে করবো আমার থেকে কম সুন্দর ছেলেকেই।’
কথাগুলো বলে পাশে তাকিয়ে দেখলাম নিদ্র ভাইয়া রাগে ফুলে ফেঁপে একাকার হয়ে গেছে।বলল,-‘এখন সুন্দর হয়েছি তাতেও আমার দোষ!’
তারপর সেখান থেকে উঠে হনহন করে চলে গেল।
আমি হতভম্ব হয়ে ভাবতে লাগলাম,সে এতো রাগ করলো কেনো!আমি কি তাকে কিছু বলেছি,আমি তো শুধু আমার মতটা বললাম।এই ছেলের কিছুই আমি বুঝতে পারি না।অদ্ভুতে পরিপূর্ণ।
আকাশ মেঘলা হয়ে আছে।বাতাসে রাস্তার ধুলো উড়ছে।ঢাকা শহরের রুক্ষ ধূলোমাখা রাস্তাও যেনো খুব করে আজ বৃষ্টি চাইছে।মেঘলা বিকেল,শীতল হাওয়া হুডখোলা রিকশায় ঢাকা শহরের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করা এক অন্য ধরণের অনুভূতি।পাশে বসে আছে নিদ্র ভাইয়া।রিকশার ঝাঁকুনিতে একটু পর পর কাঁধে কাঁধে ধাক্কা খাওয়ায় একটু কেমন জেনো লাগছে।
আগামীকালই ভার্সিটির ফাংশন।এ নিয়ে সবাই খুব ব্যস্ত।আমি যাচ্ছি নিদ্র ভাইয়ার সাথে মার্কেটে ফুলের অর্ডার দিতে।
সারা মার্কেট ঘুরেও কোথাও কালকের জন্য তাজা ফুলের অর্ডার দেওয়া গেল না।এত তাড়াতাড়ি এত ফুল কেউ সরবরাহ করতে পারবে না।তাই ঘুরতে ঘুরতে অনেক দূর পর্যন্তই চলে এলাম।বাজারের পেছনেই বস্তি।অবশেষে এক দোকানে অর্ডার দেওয়া গেলো।ফেরার পথে একটি রিকশাও আর খুঁজে না পাওয়ায় আমরা হাঁটতে হাঁটতে বাজার ছেড়ে ফাঁকা রাস্তায় চলে এলাম।সেখানেই ঝুম করে বৃষ্টি নেমে পড়ল।নিদ্র ভাইয়া আমার হাত ধরে রাস্তার পাশে শনের বানানো এক ঝুপড়ি ছাউনির নিচে এনে দাঁড়া করালো।
দৌড়ে এসেছি তবুও দুজনেই খানিকটা ভিজে গেছি।তার অ্যাশ কালারের শার্টের উপর খানিকটা ভিজে গেছে।সে হাত দিয়ে ভেজা চুলগুলো ঝাড়তে লাগলো।আমারও মাথা আংশিক ভিজে গেছে।গায়ের গোলাপি রঙয়ের কামিজ আর জর্জেট উড়নার কিছু কিছু অংশও ভিজেছে।
বৃষ্টি খুব জোড়ে সোড়েই নেমেছে।পড়ন্ত বিকেলের ঝুম বৃষ্টিতে আমার বেশ ভালো লাগছে।হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি নাড়াচাড়া করছিলাম।নিদ্র ভাইয়া ছাউনির বাঁশের খুটিতে হেলান দিয়ে দুই হাত বুকে গুঁজে দাড়িয়ে মুচকি হেসে আমাকে দেখে যাচ্ছে।
হঠাৎ আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম সেই ছাউনিতেই ভুট্টা পোড়া বিক্রি করছে।
আমি একটি কিনতে চাইলাম কিন্তু নিদ্র ভাইয়া টাকা দিয়ে দিল।বৃষ্টির মাঝে ভুট্টা পোড়া খাওয়ার মজাই আলাদা।আমার খুব পছন্দের।বৃষ্টি দেখছি আর খুশি হয়ে মজা করে খাচ্ছি নিদ্র ভাইয়া তাকিয়ে হাসছে হাসুক।
এদিকে এখন বাসায় ফিরাও দরকার।একটুপর সন্ধ্যা হয়ে যাবে।নিদ্র ভাইয়া ভুট্টা বিক্রেতার থেকে জানতে পারলো সামনের রাস্তা পেরোলেই মোড়ে অটো স্ট্যান্ড।একটু হেঁটে যেতে হবে।এদিকে বৃষ্টি হালকা কমে এলেও এখনো ভালোই আছে।রাস্তা দিয়ে খালি গায়ে কিছু বাচ্চারা মাথায় খুব বড় বড় কচুপাতা দিয়ে খেলতে খেলতে দৌড়াদৌড়ি করছিলো।নিদ্র ভাইয়া ওদের থেকে একটি কচু পাতা চেয়ে নিলো।
দুজনে এক কচু পাতার নিচে ফাঁকা রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছি।বৃষ্টির থেকে মাথাটিই রেহাই পাচ্ছে।শরীরে ঠিকই বৃষ্টির ছাট লাগছে।রাস্তা পার হওয়ার সময় বিশাল ছাগলের পাল নিয়ে এক চাচা সামনে এসে পড়ল।আমরা থমকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।ভুট্টা পোড়া খেয়ে পানি না খাওয়ায় এখন বেশ তেষ্টা পেয়েছে।হোস্টেলে ফিরতেও এখন অনেক দেরি।
কি করব কি করব ভেবে কচুপাতা বেয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানিই মুখ উঁচু করে একটু একটু করে পান করতে লাগলাম।তৃষ্ণা মিটতে দেরি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কাজ হচ্ছে।বৃষ্টির ফোঁটা বেশিরভাগই আমার ঠোঁটের বাইরে গড়িয়ে গলা বেঁয়ে পড়ছে।
কতক্ষণ সেভাবে পানি পান করে ঠিক হয়ে পাশে নিদ্র ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে আমার দিকে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আমি বাচ্চাদের মতো উৎসুক হয়ে বললাম,
-‘আপনারও তেষ্টা পেয়েছে?তাহলে আমার মতো করেই পান করুন।’
সে বলল,-‘এখন সম্ভব না।আমাকে তৃষ্ণা মেটাতে অপেক্ষা করতে হবে।’
তার কিছু কথার মানে আমি একদমই বুঝতে পারি না।চোখ গোলগোল করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
বৃষ্টি তার বেগ আবারো বাড়িয়ে দিয়েছে।খোলা আকাশের নিচে ফাঁকা রাস্তায় দুজন তরুণ তরুণী যে শুধুমাত্র একটি কচুপাতার আশ্রয়ে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে তার কোনো পরোয়া নেই।তাদের মাথার উপরে কচুপাতা ঘিরে এখনও টপটপ করে পানি পড়ছে।চারিপাশে অজস্র বারি ধারা।তবুও সেই যুবককে কেনো তার তৃষ্ণা মেটাতে অপেক্ষা করতে হবে তা কি এই প্রকৃতিও বুঝতে পারছে না।নাকি তারা জানে!
আশ্চর্য পরিমাপের যদি কোনো থার্মোমিটার থাকতো তবে আমার ক্ষেত্রে পারদের মাত্রা সর্বোচ্চ ঘর ছাপিয়ে উপরে উঠে যেত।আমি চরম আশ্চর্য হলাম যখন জানতে পারলাম নিদ্র ভাইয়ের এই সাজাকে সবাই মজা বলছে।ভার্সিটির সবচাইতে হ্যান্ডসাম ছেলের সর্বদা সান্নিধ্যে থাকার চেয়ে বড় ভাগ্য নাকি আর কিছুই হতে পারে না।তাকে দেখলেই এখন ভয়ে আমার হাত পা কাঁপতে থাকে আর তার সাথে সাথেই থাকতে হবে শুনে যেখানে আমার অবস্থা খারাপ সেখানে কিছু মেয়ে আফসোসে শেষ হয়ে যাচ্ছে তারা কেনো এই পানিশম্যান্ট পেলো না।
চিন্তার অথৈ সাগরে ডুবে একাকার হয়ে আমি বিছানায় বসে ওড়নার প্রান্ত কুট কুট করে কামড়ে শেষ করে দিচ্ছি।
আর এদিকে সোমা আপু হেসে খুন হয়ে যাচ্ছে।
-‘আপু তুমি হাসছো।আমি তোমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র রুমমেট।আর তার দুঃসময়ে তোমার হাসি পাচ্ছে!’
-‘তো আর কি করব সুপ্তি?শেষমেষ তুই কিনা নিদ্র ভাইয়ার সাথে ফেঁসে গেলি।তোদের দুজনকে দেখলে আমার সিংহ ইঁদুরের ঐ গল্পটা মনে পড়ে যায়।তোর অবস্থা এখন সেই ধরা পড়া ইঁদুরের মত লাগছে।’
-‘আচ্ছা তোমাদের ঐ নিদ্র ভাইয়া কোন ইয়ারে পড়ে?’
-‘মাস্টার্সে।কেনো?’
-‘তার মানে তাকে আমার পুরো একবছর সহ্য করতে হবে!হায় আল্লাহ আর একবছর এদিকসেদিক হলেই তো হত!আজকেই আমি বাবাকে ফোন করে বলব আর একবছর পর বিয়ে করলে তাদের কি এমন হয়ে যেত।বরং আমি বেঁচে যেতাম ঐ ধলা লম্বুশ ডেভিলটার হাত থেকে।’
-‘চুপ থাক নটাঙ্কি, নিদ্র ভাইয়া মোটেও ডেভিল নয়।আমি ভাইয়ার দুই বছরের জুনিয়র।কত দিন ধরে তাকে দেখছি,হি ইজ এ রিয়েল জেন্টেলম্যান।কত জুনিয়রদের পড়ার খরচ দিয়ে সে সাহায্য করেছে।সব মেয়েরা তার জন্য পাগল অথচ সে কারো দিকে ফিরেও তাকায় না।তুই জানিস নিদ্র ভাইয়ার জন্যই এই ভার্সিটির মেয়েদের কোনো ছেলে টিজ করতে পারে না।এই ভার্সিটি সবথেকে পপুলার হলে কি হবে এর রেগিং ইতিহাস খুব খারাপ ছিল।নিদ্র ভাই এসে এসব বন্ধ করিয়েছে।রেগিং তো বলতে গেলে হয়ই না,তুই তো ভাইয়াকে থাপ্পড় মেরে ক্ষ্যাপিয়ে তুললি।ভাইয়া এমন কিই বা তোকে করতে বলেছে!কত মেয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে তার সাথে একটু কথা বলার জন্য।আর তুই তো বাম্পার অফার পেয়ে গেছিস!’
-‘যারা আছাড় খেয়ে পড়ে তাদেরই করতে বলো।আমার জায়গায় থাকলে না বুঝতা।’
-‘হুম, এখন এসব বাদ দিয়ে খেতে চল।সাড়ে নয়টার পর কিন্তু আর খাবার পাবি না।’
হোস্টেলের এই একটি নিয়ম আমার অসহ্য লাগে।এখন আমার একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না।কোথায় বিছানায় আরেকটু গড়াগড়ি করে নিজের শোক পালন করব!কিন্তু না!এখানে এখনই খেতে হবে মানে এখনই খেতে হবে।নো হেরফের।এদের কি মন বলতে কিছু নেই।ধূর!
বাংলা ব্যাকরণের মত বিরক্তিকর ক্লাসে আমি শত চেষ্টা করেও মনোযোগ বসাতে পারছি না।গালে হাত দিয়ে শুধু হাম দিয়ে যাচ্ছি।মধ্যবয়স্কের প্রফেসরটি নাকের ডগায় রাখা চশমার ফাঁকে তীক্ষ্ণ চোখে বারবার আমায় দেখে যাচ্ছে।এই বুঝি ধমক দিল বলেই!
কিন্তু তার আগেই ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়ে গেল।কালকের ঘন্টাটা আমার আনুকূল্যে না হলেও আজকের ঘন্টায় আমার সুবিধা হওয়ায় আমি খুশিতে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলাম।ঠিক তখনই আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসল।
-‘হ্যালো কে বলছেন?’
-‘তোমার নামের অর্থের মিতা।’
এমনি সময় হলে এমন প্যাচানো কথার আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না।কিন্তু আজ তার গাম্ভীর্য্য গলার আওয়াজেই বুঝে গেলাম কে।একটি ঢোক গিলে বললাম,
-‘আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?’
একটু হেসে বলল,’আরিয়ান ইসলাম নিদ্র সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাও নেই।এখন চট করে ক্যান্টিনে চলে আসো তো।বাদাম খাবো।’
খুব নরম স্বরেই বললাম,’ভাইয়া আপনি বাদাম খাবেন আমি কি করব?’
-‘আমার বাদাম খেতে ইচ্ছে করছে খোসা ছাড়াতে নয়।তুমি খোসা ছাড়িয়ে দিবে আমি খাবো।’
সে ফোন কেটে দিলে আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম।এর থেকে তো সেই স্যারের বোরিং ক্লাসটাও ভালো ছিল।আমার এই অবস্থা আর আমার নেমকহারামী বান্ধবী সাফা পাশে বসে মিটিমিটি হাসছে।সত্যি বিপদে পড়লে সব পর হয়ে যায় এখন তার প্রমাণ হাতে নাতে পেলাম।
ক্যান্টিনের মাঝারি ধরণের গোলাকার টেবিলের এক প্রান্তে নিদ্র ভাইয়া এক হাত টেবিলে উপর রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে আর তার বিপরীত প্রান্তে আমি খুব মনোযোগ সহকারে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছি।দুই আঙ্গুলের মাঝে বাদাম রেখে মৃদু চাপ দিতেই খোসা ছুটে যাচ্ছে।তার মধ্যে থেকে বাদাম বের করে এনে তার উপরের খয়েরি রঙের আবরণটা দু হাতের মাঝখানে রেখে একটু পিষে দিতেই সব আলগা হয়ে যায়।মুখ দিয়ে ফু দিয়ে সেই আলগা আবরণ ফেলে দেওয়ার কাজটা আমার কাছে যথেষ্ট মজার লাগে।অনেকক্ষণ ধরেই মাথা নিচু করে নিজের মত করে যাচ্ছি।অনেকগুলো একসাথে জমা হওয়ার পর মাথা উঁচু করে তার হাতে বাদামগুলো দিতে গিয়েই দেখলাম সে আমাকে এক নজরে দেখে যাচ্ছে।আমার সাথে চোখে চোখ পড়তেই একটু ইতস্তত বোধ করে অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।আমার দেওয়া বাদাম একটি একটি করে মুখে পুরে খেতে লাগল।বাদামের মতই আজ সে বাদামি রঙের শার্ট পড়ে এসেছে।
আমি বললাম,’ভাইয়া এখন যাই।আমার ক্লাস আছে।’
-‘এখন তো তোমার অফ পিরিয়ড।আরো চল্লিশ মিনিট থাকতে পারবে।’
আমি মনে মনে রেগে বললাম,’আমার একেবারে সবকিছু জেনে বসে আছে।অসহ্য!’
একটি বারো তেরো বছরের ছেলে এসে বলল,
-‘ভাই আপনার কফি।’
নিদ্র ভাইয়া বলল,’ছোটকু তুই স্কুলে যাস নাই?’
-‘যাই তো ভাই,আইজ ইশকুল বন্ধ।আপনের টেকা দিয়া বই কিনছি,জামা কিনছি ভাই।নতুন বইয়ের গন্ধ খুব ভালা লাগে।’
নিদ্র ভাইয়া পিঠ চাপড়ে বলল,’টাকা লাগলে আবার বলবি,বুঝলি!আমাকে যেনো জিজ্ঞেস করতে না হয়।’
ছোটকু বত্রিশটি দাঁত বের করে হেসে বলল,’আইচ্ছা।’
আমি অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখছিলাম তাদের দুজনকে।এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মন ছেঁয়ে গেল।
গরম গরম ধোঁয়া উঠা কফির মগ মুখের কাছে নিয়ে সে নিচের ঠোঁট আলতো করে চেঁপে ধরে তার ঘন কালো ভ্রু ঈষৎ ভাঁজ করে ঘ্রাণ নিতে লাগল।
আহা! কি সুন্দর দৃশ্য।যেনো এই সুদর্শন যুবকের ঘ্রাণ নেওয়ার এই অপূর্ব মুখভঙ্গির জন্যই কফির সৃষ্টি।কফিও তার জন্মের সার্থকতা লাভ করতে পেরে প্রথম আলতো চুমুকেই তার ঠোঁটের কোণে লেগে রইল।
আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে চোখ দিয়ে ইশারা করল কি!
আমি তাকে ইশারায় ঠোঁট দেখিয়ে বললাম।
সে শার্টের বুক থেকে সানগ্লাস বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে বলল,’ধরো তো একটু।’
মনে মনে বললাম,’এখন এটাও আমায় করতে হবে।’
সবাই নতুন ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে দেখছে আর আড্ডা দিচ্ছে আর আমি কিনা এখানে বসে ফুট ফরমায়েশ খাটছি।
আমি মুখ ফুলিয়ে সানগ্লাস ধরে রাখলাম আর সে সানগ্লাসের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট মুছতে লাগল।
সে বলল,’এভাবে মুখ ফুলিয়ে রেখেছো কেনো?
তোমার নিজের জন্যই এখন এখানে বসে থাকতে হচ্ছে।’
-‘আমি আবার কি করলাম?’
-‘সেদিন যে হিরোইন স্টাইলে আমার গায়ের উপর পড়ে গেলে আর শার্টের বারোটা বাজিয়ে দিলে তার জন্য জানো আমি কত ইম্পর্টেন্ট একটা কাজ মিস করে ফেলেছি।সেই কাজ কভার করে প্লাস একরাতের মধ্যে অ্যাসাইমেন্ট কমপ্লিট করতে আমার কত খাটতে হয়েছে।এখন রিল্যাক্স এর জন্য আমার এতটুকু প্রয়োজন।’
আমার পেটের ভেতর কথা সুড়সুড় করছে।বলতে ইচ্ছে করছে তাহলে আপনি কেনো আমাকে কাঁদা পানিতে ভিজিয়ে দিলেন?সেখান থেকেই তো সব শুরু।কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না।শুধু মুখ ভার করে বললাম,’হ্যাঁ এখন তো চাঁদ মামা দিনে কেনো উঠে না তাতেও আমার দোষ!’
আমার কথা বলার ভঙ্গিতে তিনি হেসে দিলেন।
আমার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল।এই প্রথম তাকে হাসতে দেখলাম।একটা মানুষের হাসিতে কতটা সৌন্দর্য্য লুকিয়ে থাকে তা হয়তো তাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।এই বুঝি সেই হাসি যে হাসিতে পুরো পৃথিবী বিক্রি করে ফেলা যায়।সে যে কম হাসে তাই ঠিক করে,নাহলে সে তো হাসি দিয়ে খুনও করে ফেলতে পারে।হৃদয়ের খুন। অতিরিক্ত সৌন্দর্য্য মানুষের হজম হয় না।একধরণের বিষন্নতা এনে দেয়।
বিষন্নতা ছাপিয়ে যাওয়ার আগেই সেখানে নিদ্র ভাইয়ার পুরো গ্যাং উপস্থিত।তামিম ভাইয়া বলল,
-‘কি খবর স্লিপিং কুইন আমাদের স্লিপিং কিং কে ভালো মতো সেবা করছো তো?তা তোমার সেই সাফা আফা কই?’
সবাই হো হো করে হেসে দিল।সাফা এখানে উপস্থিত থাকলে তার নামের বারতি যোগ করা অংশটুকু শুনে নিশ্চিত কেঁদে দিত।
তাদের মধ্যে থেকে একটি মেয়ে বলে উঠল,
-‘এই সেই মেয়ে?বাহ্! দেখতে তো দারুন মিষ্টি।’
আরেকটি ছেলে বলল,’তানিয়া রে!নিদ্রর মত সুন্দরী মেয়েদের থাপ্পড় খেয়ে এই সুবিধাজনক লাভ আমারো পেতে ইচ্ছে করছে।’
তানিয়া আপু হেসে বলল,’সোহেল,সুন্দরী মেয়েদের থাপ্পড় খেতেও না যোগ্যতা লাগে।তোর মতো বান্দরের তা নেই।’
-‘তাই নাকি!নাঈম শালা এখনো আসছে না কেনো?তোর হাতে তো ও ভালোই মাইর খায়।তাকে জিজ্ঞাসা করতাম পেত্নীদের হাতের থাপ্পড় খেতেও কি যোগ্যতা লাগে নাকি!’
-‘তবে রে!’
বলে তানিয়া আপু সোহেল ভাইয়াকে মারতে লাগল।
আমার ভীষণ লজ্জা লাগলো তানিয়া আপুর মত এত সুন্দরী মেয়ে নাকি আমাকে সুন্দর বলছে।আমি তো বেশি ফর্সাও না।
এই ফাঁকে রাফি ভাইয়া নিদ্র ভাইয়ার হাত থেকে খোসা ছাড়া বাদাম নিতে ধরলেই নিদ্র ভাই চট করে হাত সরিয়ে বলে,
-‘একদম না।খেতে হলে ওখান থেকে খোসা ছাড়িয়ে খা।এর ভেতর একদম স্পর্শ করবি না।’
-‘হায় রে দোস্ত!দে না একটা।খোসা ছাড়াতে ইচ্ছে করছে না।’
নিদ্র ভাইয়া নিজে খোসা ছাড়িয়ে রাফি ভাইকে দিতে লাগল তবুও আমার দেওয়া বাদামগুলো দিল না।এটা দেখে সবাই একে অপরের সাথে চোখাচোখি করে মুচকি হেসে মুখ দিয়ে হুম করে অদ্ভুত সাউন্ড করতে লাগলো।
ইতিমধ্যে নাঈম ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে এসে তানিয়ে আপুকে বলল,’স্যরি জানু।এখন তুমি মুখ ভার করে থাকলেও তোমার রাগ ভাঙাতে পারবো না।’
তারপর নিদ্র ভাইয়াকে ডেকে বলল,’নিদ্র তোকে প্রিন্সিপাল স্যার ডাকছে,মে বি নবীন বরণ নিয়ে কথা বলবে।’
তারা সবাই একসাথে চলে গেল।নিদ্র ভাইয়া দু কদম যেয়ে আবার পিছিয়ে এসে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমাকে বলল,’ডোন্ট ওয়ারি,দশ মিনিট পরে কভার করে নিব।’
তারপর সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে একটু মুচকি হেঁসে চলে গেল।
এমন ভাব করলো যেনো দশ মিনিট আগে যাওয়ার আফসোসে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।আমার বয়েই গেছে তার জন্য আফসোস করার।আমি তো আরো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
ভার্সিটির দ্বিতীয় দিনেই যদি সবার চোখের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া যায় তবে তার প্রতিক্রিয়া ঠিক কি হওয়া উচিত আমি আদৌ বুঝতে পারছি না।যতটুকু আমি জানি ভার্সিটিতে আসার পর সবাই একটু আধটু চায় সকলের মনোযোগ অর্জন করতে।কিন্তু আমি না চাইতেই পেয়ে গেছি।
-‘দেখ দেখ এটাই ঐ মেয়েটা না?’
-‘হ্যাঁ,এই মেয়েটাই তো।’
গেটে পা রাখার পর থেকেই এই ধরণের ফিসফিস আমি শুনতে পাচ্ছি।আর সকলের নজরও যে সরাসরি বা ঘুরে ফিরে আমার দিকেই আছে তাও বেশ বুঝতে পারছি।কোথাও কিছু একটা ঘাবলা যে হয়েছে তা আমার অবচেতন মনে প্রবল বেগে সাড়া দিচ্ছে।
ক্লাসে ঢোকার মুখেই দেখতে পেলাম সবাই পলকহীন ভাবে আমাকে দেখে যাচ্ছে।চুপচাপ সামনের বেঞ্চে গিয়ে বসতেই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সাফা আমার কাঁধ ঝাঁকিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে বলল,’কিরে,কাল নাকি তুই কোন সিনিয়রকে থাপ্পড় মেড়েছিস?’
সাফার এতটুকু কথায় আমার মাইন্ড রিঅ্যয়ান্ড করে চলে গেল কালকের ঘটনায়।
ভার্সিটির প্রথম দিন তাই আমার সব থেকে পছন্দের হালকা আকাশি রঙের ওয়েটলেস জর্জেট সেলোয়ার কামিজ পড়ে গিয়েছিলাম।জামাটি আমার খুব পছন্দের।তার সাথে ম্যাচিং করে জুতো,সিলভার রঙের একমুঠ চুড়ি,কানে ছোটো ঝুমকো কানের দুল পড়ে আমার হালকা কোঁকড়া চুলগুলো খোলাই রেখেছিলাম।খুব স্বাচ্ছন্দ্যেই সব ক্লাস করে বাসার উদ্দেশ্য বের হয়ে মাত্র ভার্সিটির গার্ডেন এরিয়া পর্যন্ত এসেছি কোথা থেকে একটা বাইক এসে গতরাতের বৃষ্টিতে রাস্তায় জমে থাকা কাঁদা পানি আমার গায়ে ছিটিয়ে দিল।কপালের একাংশ আর নিজের পছন্দের জামাটি এভাবে কাঁদাপানিতে লুটোপটি হওয়া দেখে আমার মেজাজ সপ্তম ডিগ্রীতে পৌছে গেল।আর সেখানে, সেই বাইকে বসা হোয়াইট কালারের শার্ট আর ব্লাক কালারের জিন্স পড়া ছেলেটা সানগ্লাস চোখে দিয়ে কি ভাব নিয়ে বাইক থেকে নামছে!শার্টের সাদা রঙ যেন ছেলেটার গায়ের রঙের সাথে মিশে যাচ্ছে।
আমি রাগে গজগজ করতে করতে ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেলাম।ছেলেটি চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে শার্টের বুকে ঝুলিয়ে পিছনে ফিরে ঘুরতেই আমি কাঁদায় স্লিপ খেয়ে একেবারে ছেলেটার গায়ে গিয়ে পড়লাম।সেও আচমকা হতভম্ব হয়ে আমাকে সামলাতে গিয়ে পিছনে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল।
এভাবে স্লিপ খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে যাওয়ায় আমার বুকে কয়েকগুণ জোড়ে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল।একটু কান পরিষ্কার হতেই বুঝলাম ধ্বক ধ্বক শব্দ আমার একার না ছেলেটির বুকেও হচ্ছে।আমার মাথা এবার আরো গরম হয়ে গেল।আজ পর্যন্ত কোনো ছেলে আমার হাত পর্যন্তও ধরেনি।আমি ঠিক করেছি আমার ভালোবাসার মানুষই আমার হাত প্রথম ধরবে আর সেখানে একটি অপরিচিত ছেলের গায়ে এভাবে জড়িয়ে থাকা…ছি! ছি!
এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম।তার উপর পড়ে যাওয়ায় তার সাদা শার্টেও আমার থেকে কাঁদা ভরে গেছে।ছেলেটি বিষ্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।আমি তার বিষ্ময়ের পরিমাণ আরেকটু বাড়িয় দিয়ে ঠাস করে গালে একটি চড় বসিয়ে দিলাম।আর রাগে গজগজ করে বলতে থাকলাম,’বাইক দেখেশুনে চালাতে পারো না তাহলে চালাও কেনো!
আমাকে কাঁদার ভূত বানিয়ে এখন আবার জড়িয়ে ধরা হচ্ছে!’
এবার ছেলেটি আমার দিকে রক্তবর্ণ চোখে ফিরে তাকালো।ধবধবে ফর্সা মুখটা রাগে লাল হয়ে রয়েছে।এমন রাগের প্রতিমূর্তি দেখে আমি এবার পুরো চুপসে গেলাম।ছেলেটি দ্রুত বাগানের ভেতর ঢুকে মালীর হাত থেকে পানির পাইপটি নিয়ে এসে আমার দিকে তাক করে রাখল।পানির জোড়ে আমার চোখমুখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।কিছুক্ষণ এভাবে ধরে রেখে আমাকে পুরো ভিজিয়ে চুপচুপ বানিয়ে পাইপটা ফেলে দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
‘হয়েছে এবার।’আরো কিছু বলতে নিলেই তার ফোন বেজে উঠে।সে একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে আর একবার তার গায়ের শার্টের কাঁদা অংশের দিকে তাকিয়ে কটমট করে বলল,’তোমার ক্লাস তো আমি পড়ে নিচ্ছি।বলেই সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে চলে গেল।’
এবার আমার চোখে চরম বিস্ময়।ভিজে টুইটুম্বর হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভাবতে লাগলাম এটা কি হলো!
সাফার আরেক ঝাঁকুনিতে সেই ভাবনা থেকে ফিরে এলাম।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।ভয়ার্ত গলায় বললাম,
-‘বিশ্বাস কর সে যে সিনিয়র আমি একদম বুঝতে পারিনি।’
-‘ভার্সিটিতে সবথেকে জুনিয়র তো আমরাই।আর সবাই তো হয় প্রফেসর না হয় সিনিয়র হবে।আর তুই কিছু না ভেবেই এভাবে যাকে তাকে থাপ্পড় মেড়ে বসবি।’
-‘আমি এমনিতেই ভয় পাচ্ছি আর তুই দেখি আরো ভয় পাইয়ে দিচ্ছিস।’
-‘এখনো কিছুই বলিনি সোনা।তুমি যাকে মেরেছো সে কোনো নরমাল সিনিয়র না।শুনেছি এই ভার্সিটির টপার,পলিটিক্যাল লিডার প্লাস বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়ন।ভার্সিটির চকলেট বয়,সকল মেয়েদের ক্রাশ,স্যারদের চোখের মধ্যমণি,কোটিপতি বাবার ছেলে।ভার্সিটির সবথেকে ফেমাস বয়কে তুই কিনা থাপ্পড় মেড়েছিস!পুরো ভার্সিটিতে ছড়িয়ে গেছে এই কথা।এখন তোর কি অবস্থা হয় তা আল্লাহই
জানে।’
সাফার মুখে এই কথা শুনে আমার আত্মা যায় যায় অবস্থা।উপর থেকে শক্ত দেখালেও আমি ভেতরে ভেতরে অনেক ভীতু।ঝামেলা খুব ভয় পাই।আর এসব সিনিয়র,পলিটিক্যাল লিডার এগুলো এমনিতেই ভয় পাই।নিজের সম্পর্কে যদি কিছু বলতে হয় তবে আমি এটাই বলব একটা প্রবাদ বাক্য আছে ‘ভাবিয়া করিও কাজ,করিয়া ভাবিও না।’আমার জীবনে হয়তো এর সূত্র পুরো উল্টোভাবেই নিয়েছে।’করিয়া কাজ,ভাবিয়া মরো।’আমি এমনই, হুটহাট করে একটা কাজ করে ফেলি তারপর ভাবতে ভাবতে মরি।অলয়েজ কনফিউশনে থাকা আমার স্বভাব।কেনো যে তখন থাপ্পড়টা মারতে গেলাম!
প্রফেসর ক্লাসে লেকচার শুরু করে দিলেও আমার তাতে মন নেই।মাথাটা যেন হ্যাং হয়ে গেছে।আমি যেখানে বসেছি সেখান থেকে ক্লাসরুমের দরজা দিয়ে সরাসরি বাহিরে দেখা যায়।হঠাৎ চোখ পড়তেই দেখলাম ছয় সাতজনের একটি গ্যাং আসছে যার সামনে সানগ্লাস চোখে দিয়ে পায়ে ব্লাক হোয়াইট কেডস,হাতে ব্লাক ব্রান্ডেড ঘড়ি,চকলেট কালার শার্ট আর হোয়াইট কালার জিন্স গায়ে কালকের সেই ছেলেটা।ছেলেমানুষও যে এত সুন্দর হয় আমার জানা ছিল না।লম্বা ছয় ফুটের মত।তার চেহারায় সব থেকে আকর্ষণীয় জিনিসটি হলো তার ঘন কালো ভ্রু। যা ফকফকে ফর্সা চেহারায় নজর কেড়ে রেখেছে।এত সুন্দর চেহারা অথচ কি গাম্ভীর্য্য!রাগ যেনো সেখানে বাসা বেঁধে রয়েছে।এই রাগগুলো নিশ্চয়ই আমার জন্যই জমিয়ে রাখা। তাকে দেখে ভয়ে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।দেহের রক্তকণিকা যেন দ্রুত বেগে ছুটছে।
কি ভাগ্য!ক্লাস শেষের ঘণ্টা টাও এখনি পড়তে হল!
বেড়িয়ে যাবার মুখে স্যার ছেলেটার সাথে হেসে হেসে কিছু কথা বলে চলে গেল।
তারা সবাই ক্লাসে ঢুকতেই পুরো ক্লাস পিন ড্রপ সাইলেন্ট হয়ে গেল।হঠাৎ ছেলেটা চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে একটি ডেম কেয়ার ভাব নিয়ে আমায় বলল,
-‘তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।সিনিয়ররা ক্লাসে এসেছে,কোনো রিসপেক্টও বলতে নেই।’
আড়চোখে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলাম এই কথা কেনো বলছে,সবাই দাঁড়িয়ে গেছে তাদের দেখে শুধু আমি ছাড়া।এখন আমি তাকে কিভাবে বোঝাই আমার শরীর ভয়ে জমে রয়েছে।দাঁড়ানোর মত শক্তিটুকুও পাচ্ছি না।
সে পুরো ক্লাসের উদ্দেশ্যে বলল,’তোমাদের জন্য একটি গুড নিউজ আছে।তোমাদের কারো রেগিং করা হবে না।কারণ তোমাদের সবার রেগিং এই পুচকি মেয়েটা পূরণ করবে।কারণ তার অসীম সাহস।এগুলো নিশ্চয়ই তার কাছে কিছুই না।’
তার কথা শুনে আমার এখন কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে।কি বলে এসব!
তাদেরক মধ্যে থেকে শ্যাম বর্ণের একটি ছেলে সাফাকে উদ্দেশ্যে করে বলল,’এই যে মিস আপনাম নাম কি?’
সাফা কাঁদো কাঁদো গলায় উত্তর দিল,’সাফা।’
ছেলেটি মুখ ভেংগিয়ে বলল,’তো সাফা..আফা আপনি দয়া করে পাশের বেঞ্চে চলে যান আর আমাদের কৃতার্থ করুন।’
বলে তারা সবাই জোরে জোরে হাসতে শুরু করল।সাফা আমতা আমতা করে যাচ্ছে না দেখে তাদের মধ্যে থাকা ছিপছিপে গড়নের সুন্দর একটি মেয়ে ধমক দিয়ে বলল,
-‘তামিম কি বলল কানে যায় নি নাকি তোমারও রেগিংয়ে ভাগ নেওয়ার ইচ্ছা আছে,যাও এখান থেকে।’
সাফা উঠে চলে গেলে আমি একা ফাঁকা বেঞ্চে পড়ে রইলাম।এবার সেই ছেলেটি আমার সামনের হাই বেঞ্চে দু হাত দিয়ে জোড়ে বাড়ি দিয়ে হাতের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কটমট করে বলল,
-‘আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না একটি দু দিনের পুঁচকে মেয়ে নাকি আমাকে থাপ্পড় মেরেছে!তুমি ভাবতেও পারছো না কত বড় ভুল করে ফেলেছো।’
বেঞ্চে বাড়ির শব্দে আমার শরীর কেঁপে উঠল।আমার চোখের থেকে মাত্র দু ইঞ্চি দূরে তার এই রক্তবর্ণ দৃষ্টি দেখে আমি চোখ গোল গোল করে ভয়ে একটি ঢোক গিললাম।এখন আমার অনেক কিছুই বলা দরকার।ক্ষমা চেয়ে ব্যাপারটা চুকিয়ে নিলেই হয়।কিন্তু গলা দিয়ে কিছু বের হলে তো!
মনে হচ্ছে যেন কথা বলাই ভুলে গেছি।
-‘নাম কি?’
-‘সু..সুপ্তি।’
আমার নামটা শোনার সাথে সাথেই কৌতুহলী দৃষ্টিতে তার ভ্রু কুঁচকে গেল।আমার নামে এমন ভ্রু কুঁচকে রাখার কি আছে আমি বুঝতে পারলাম না।
সে বেঞ্চ থেকে দু হাত সরিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করে বলল,’সুপ্তি…মানে ঘুম!’
পেছন থেকে আরেক ছেলে তার কাঁধে হাত রেখে দুষ্টুমির ছলে বলল,
-‘কিরে নিদ্র,হোয়াট এ কো-ইনসিডেন্স!সুপ্তি মানে ঘুম,নিদ্র মানে ঘুম।এতো দেখি দুই নাম এক মানে।’
পেছন থেকে সেই মেয়েটে আবারো বলে উঠল,’রাফি তোদের ফাজলামোটা এখনের মতো একটু স্কিপ রাখ।যে কাজটা করতে এসেছি সেটাতেই ধ্যান দেই।’
-‘যথা আজ্ঞে মিথি ম্যাডাম।’
এবার সেই ছেলেটি মানে নিদ্র আমার সামনে একটি ব্যাগ উপুড় করে মেকআপের সব ইনস্ট্রুম্যান্ট ঢেলে বলল,
-‘আমি কি ভাবছি রাফি নাচ,গান,রেম্প ওয়াক এগুলো তো প্রতিবারই করি এবার কিছু ডিফারেন্ট করলে কেমন হয়।সুপ্তি তোমার উপর একটি খুব বড় কাজ দিলাম।আমাদের না সবার খুব মুড অফ হয়ে আছে তো তুমি তোমার সিনিয়রদের এন্টারটেইন করবে।এই যে মেকআপের সব দেখছো এগুলো দিয়ে নিজেকে সাজিয়ে নাও কিন্তু একটু অন্য ভাবে।’
-‘মানে?’
তাদের মধ্যে থেকে আরেকটি ছেলে বলল,
-‘মানে হল তোমার এই সুন্দর টানা টানা চোখে দিবে লিপস্টিক আর এই গোলাপি গোলাপি ঠোঁটে দিবে কাজল।তারপর রীতিমতো একটি জোকার সেজে মাঠের মধ্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে ফানি ফানি পোজ দিবে।’
-‘কি?’
-‘আচ্ছা আরেকটা অপশন দিচ্ছি প্রিন্সিপাল স্যারের কেবিনের সামনে গিয়ে নাগিন ডান্স দিবে।মে নাগিন নাগিন….’
সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
তাদের এই কথায় দরদর করে আমার মুখের ঘাম ছুটে গেল।এখন কি আমাকে পুরো ভার্সিটির সামনে এসব করতে হবে।কি লজ্জা!
নিদ্র ভাইয়া বলল,-‘আমাদের হাতে সময় নেই তাড়াতাড়ি কর।’
আমি নিশ্চুপ হয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলাম।
প্রচন্ড ধমক দিয়ে সে আবার বলল,’কি হল করো!’
এবার আমি আর নিজেকে আটকিয়ে রাখতে পারলাম না।ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম।আমার কান্না দেখে সে এবার একটু নরম হয়ে গেল।কিছু না বলেই পুরো দলবল নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
ভার্সিটির ফেমাস বয়কে চড় মেরে আমি যে একটা ভয়ংকর ভুল করে ফেলেছি সেটা আমি হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছি।এবং এই জল গড়িয়ে যে অনেকদূর চলে গেছে তাও বুঝতে পারলাম।তবে এই জল থেকে নদী হওয়ার আগেই আমাকে তা আটকাতে হবে।ঠিক করেছি খুব করে মাফ চাইবো দরকার হলে হাত জোরও করবো।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর থেকে রেহাই পেতে হবে।একবার মাফ পেয়ে গেলে আর সেই সিনিয়রদের ছায়াও মাড়াবো না।ভার্সিটির সিনিয়র মানেই সাংঘাতিক ব্যাপার।এদের থেকে যতদূরে থাকা যায় ততই ভালো আর আমি তো আগে থেকেই চড় মেরে ফেঁসে রয়েছি।
তার পরেরদিন সাফাকে সাথে নিয়ে স্পোর্টস গ্রাউন্ডের দিকে এগিয়ে গেলাম।যেখানে নিদ্র আর তার টিম মিলে বাস্কেটবল খেলে যাচ্ছে।এখন সে হাতাকাটা স্পোর্টস টি শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে আছে।শরীর থেকে টপ টপ করে ঘাম ঝরছে।কিছু মেয়েরা হা করে তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।এই মেয়েদের কি কোনো লজ্জা বলতে কিছু নেই একটা ছেলের দিকে এভাবে তাকিয়ে রয়েছে!
আমাকে দেখে সে খেলা থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।আমি তার কাছে গিয়ে একটি ঢোক গিলে মাথা নিচু করে বললাম,
-‘ভাইয়া আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে।আমি না বুঝে হঠাৎ করে ফেলেছি।আই এম এক্সট্রিমলি স্যরি।প্লিজ মাফ করে দিন।’
-‘তোমার কি মনে হয় একটি ছোট্ট স্যরি শব্দ বলেই তুমি আরিয়ান ইসলাম নিদ্রর গায়ে হাত তোলার পরিণাম থেকে বেঁচে যাবে।এখন যদি আমি তোমাকে মাফ করে দেই তবে তো যে কেউ আমার গায়ে হাত তুলে স্যরি বলে চলে যেতে পারে।সবকিছু এত্ত সহজ না ম্যাম।’
-‘ভাইয়া তাহলে আর কিভাবে ক্ষমা চাইবো।’
-‘ক্ষমা নয় পানিশম্যান্ট।’
-‘পানিশম্যান্ট?’
-‘হ্যাঁ,তোমাকে পানিশম্যান্ট পেতে হবে।আর তোমার পানিশম্যান্ট হলো এখন থেকে তোমাকে সব কাজে আমার সাথে থাকতে হবে।অনেকটা ব্যাক্তিগত সম্পাদক এর মতো।’
-‘মানে?’
-‘বাংলা ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট হয়ে তুমি দেখও বাংলা কম বুঝো!পি.এ. বুঝো তো?
পারসোনাল সেক্রেটারী,তুমি এখন থেকে আমার পারসোনাল সেক্রেটারী।আমি যা বলব তোমাকে তাই করতে হবে।’
তার কথা শুনে আমার মাথায় বাজ পড়ল।কোথায় আমি ভাবছি তার থেকে দূরে দূরে থাকবো আর সেখানে নাকি আমাকে তার সাথে সাথে থাকতে হবে।অসম্ভব!
-‘ভাইয়া প্লিজ এমন বলবেন না।আমি ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে।’
-‘ক্ষমায় কাজ হবে না।এই শাস্তিতে তুমি রাজি না হলে আরো বেটার অপশন আছে।তবে বেটারটা আমার জন্য তোমার জন্য না।গট ইট।
আমিও মুখ ভার করে মাথা নেড়ে সায় দিলাম।এই ছয় ফুট ধলা লম্বুশের সাথে আর কথা বলে যে কোনো লাভ নেই তা স্পষ্ট বুঝে গেছি।পিছনে ঘুরে দেখলাম পুরো ক্যাম্পাসের সবাই এখানে এসে জড়ো হয়ে গেছে।এদের কি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই!আমাকে আর নিদ্র ভাইকে একসাথে দেখলেই সব কোথা থেকে চলে আসে।অসহ্য!
উত্তরাধিকার (১৬-শেষপর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************
প্রান্তিক আজ দেশে ফিরেছে।
ওর ওয়ালিমার যাবতীয় আয়োজন প্রায় সম্পন্ন।আর এসব একহাতে করতে গিয়ে শাজিয়ার নাভিশ্বাস উঠছে।তবু এই কষ্টের মধ্যে একধরনের আনন্দ মিশে আছে।আনন্দটাতে আরো বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে তার আদরের মেয়ে প্রিয়ন্তীর ফোনটা।
গতকালই ফোন করেছিলো সে।
এই প্রথম প্রিয়ন্তীর কন্ঠে এতো উচ্ছাস শুনেছেন শাজিয়া।ও জানিয়েছে,ফারিক এখন আগের চেয়ে অনেক সুস্থ।ওকে মেলবোর্নের নামকরা স্কিন স্পেশালিষ্ট দেখানো হয়েছে।চাঁদের কলঙ্কগুলো নাকি ধীরে ধীরে মুছতে শুরু করেছে!
প্রিয়ন্তী আরো জানালো,ফারিক নাকি অসম্ভব বদলে গেছে।সে এখন নিয়মিত নামাজ পড়ে,প্রিয়ন্তী ঠিকমতো পড়ে না বলে রাগ করে!
ও বলে,এই অসুখটা আমাকে জানোয়ার থেকে মানুষ বানিয়েছে,সত্যমিথ্যার পার্থক্য করতে শিখিয়েছে।আপন পরকেও চিনে নিয়েছি।আপন রবের মহিমা বোঝার তৌফিক হয়েছে।
জীবনে আর ভুলের পথে হাঁটতে চাইনা!
সব শুনে শাজিয়ার মনে আনন্দের জোয়ার।
সত্যি, পরম প্রভু মহান আল্লাহতাবারাকাল
্লাহু তা’লার দরবারে নিজেকে সঁপে দেবার মতো শান্তি জীবনে আর দ্বিতীয়টি নেই!
প্রান্তিক এবার ওয়ালিমা শেষে বউ নিয়ে মালয়েশিয়া ফিরবে বলে সেরকমভাবেই সব কিছু গোছানো হচ্ছে !
ওয়ালিমার আর মাত্র চারদিন বাকী।
তবু প্রান্তিকের মন মানছেনা।
জান্নাতের সাথে দেখা হওয়া দরকার।
যেমন ভাবা তেমন কাজ,জান্নাতকে কাঁটাবন বুক মার্কেটে আসতে বললো,বই কিনবে বলে।
অবশেষে জান্নাত এলো!
প্রান্তিক কাঁচঘেরা দোকানের ভেতর থেকে ওকে রিক্সা থেকে নামতে দেখে তাকিয়ে রইলো!
তাকিয়ে থাকতে অসম্ভব ভালো লাগছে ওর।
কেন এতো ভালো লাগছে ও নিজেও জানেনা!
সম্ভবতঃ কখনো কোনো মেয়ের দিকে না তাকানোর এটা নগদ পুরস্কার।
চুরি করে নজরমারা আর একান্ত নিজের হালাল জিনিসের প্রতি দৃষ্টিপাত করার পরিতৃপ্তিই অন্যরকম।
বুকষ্টলের নামটা ওকে আগেই বলা ছিলো।জান্নাতকে ট্রান্সপারেন্ট গ্লাসের এপাশ থেকে দেখতে বেশ মায়াবী লাগছে।ওকে দরোজা খুলে ঢুকতে দেখেই প্রান্তিক পাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালো।খুব মনোযোগ দিয়ে বই দেখছে।জান্নাত চারপাশ তাকিয়ে ওকে খুজছে।
দেখেই এগিয়ে এসে সালাম দিলো!প্রান্তিক মুচকি হেসে সালামের জবাব দিলো!তারপর কিছু কুশল বিনিময়ের পর প্রান্তিক ওর পছন্দের কিছু বই কিনলো!
জান্নাতের কাছে শাইখ আতিকউল্লাহর লেখা নাকি খুব ভালো লাগে!
শুনে প্রান্তিক তাঁর কয়েকটা বই কিনলো!
জান্নাতের জন্য সুন্দর বোরকাও কিনে ফেললো!
জান্নাত অবশ্য বারবার আপত্তি করছিলো!
‘বিয়েতে তো সব দিচ্ছেনই!
আবার আলাদা করে বোরকা কেন কিনছেন ?
বই না দেবেন বললেন?”
প্রান্তিক মৃদু ধমকের সুরে বললো-“বই তো কিনবোই,বই সাথে করে নিয়ে ধীরে সুস্থে পড়া যাবে!আর বোরকাটা তুমি এখন থেকেই পড়বে।দুটো কি এক হলো?”
কেনাকাটা শেষে দুজনে আইসক্রিম পার্লারে ঢুকে আইসক্রিম খেলো!
প্রান্তিক নিজের জীবনের কিছু পরিকল্পনার কথা ওকে জানালো!
‘ঘর ভর্তি বাচ্চাকাচ্চা চাই,উম্মতের পরিমাণ বাড়াতে হবে!’জান্নাত যখন লজ্জায় লাল নীল বেগুনী হচ্ছিলো তখন প্রান্তিকের শেষ কথাটা ওকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচালো!
-“আমাদের সবগুলো ছেলেমেয়েকে আলেম বানাবো!কারন আলিমের মর্যাদা আবেদের চেয়ে অনেক বেশী!”
ঘোরাফেরা শেষে জান্নাতকে ওর বাড়ীর কাছে নামিয়ে দিয়ে প্রান্তিক বাড়ী ফিরলো!
★
★
★
রাফিজ একমনে গাড়ী চালাচ্ছে!
নাযিয়াত নিঃশব্দে বাইরে তাকিয়ে আছে!
রাফিজ মাঝেমধ্যেই ওর দিকে তাকাচ্ছে।ডান পাশ থেকে ওর হিজাব নিকাব করা মুখের একপাশ দেখা যাচ্ছে।
স্কুল থেকে বাসার দুরত্ব বেশী নয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেলো!
নাযিয়াত নেমে যাবার আগমুহূর্তে রাফিজের দিকে তাকিয়ে বললো-“কই,ভেতরে আসুন।
রাফিজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-
-“যাক্,অবশেষে ডাকলে! আমি তো ভেবেছি তুমি আমাকে গেট থেকেই বিদায় দিয়ে দেবে…..চলো!”
গেট লক করে নাযিয়াতের সাথে ওদের বাড়ীতে ঢুকলো!
রাফিজকে দেখে ওর শ্বাশুড়ী অত্যন্ত খুশি হলো।রাফিজ তাকে সালাম দিয়ে কথা বলার ফাঁকে নাযিয়াত ভেতরে চলে গেলো!
কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ফুটফুটে শিশুকে নিয়ে নাযিয়াতের পুনরাগমন ঘটলো।
রাফিজের বুকের ভেতর যেন হাতুড়ীর ঘাই পড়ল !ও নিজের জায়গাতেই স্থির হয়ে গেলো যখন ‘রণ’কে দেখলো।তার পাশাপাশি নাযিয়াতকে ঘরোয়া পোশাকে দেখলো।
অপূর্ব দেখাচ্ছে ওকে রাফিজের চোখে!দুটো অভূতপূর্ব দৃশ্য রাফিজকে ভাবাবেগে কাবু করে ফেললো প্রায়।ওর চোখ ছলছল করে উঠলো!রাফিজ ‘রণ’ কে দেখলো!
কি ছোট্ট মায়াবী মিষ্টি একটা মুখ।
নাযিয়াত কাছে এসে ‘রণ’কে ওর কোলে তুলে দিলো।রণ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।রাফিজের চোখ ভর্তি পানি !
বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বললো-
“ও কি কথা বলতে পারে নাযিয়াত ?”
নাযিয়াত হেসে বললো-
-“নাহ্,কেবল বাবা আর মা এদুটো শব্দ কোনোরকম বলতে পারে।মাত্র তো সাত মাস বয়স।কথা আরো পরে বলবে!”(বলে নাযিয়াত ‘রণ’র দিকে তাকিয়ে বললো)
-“আব্বু,এটা বাবা! বলো বাবা…বলো!!
‘রণ’ আধো আধো বুলিতে বলে উঠলো–“বাব্বা…বাব্বা…বাবাবা!”
রাফিজ ‘রণ’কে বুকে জড়িয়ে ধরলো!ওর চোখের কোল বেয়ে পানি নেমে এলো! নাযিয়াতের মা আঁচলে চোখ মুছে ভেতরে চলে গেলেন নাস্তার ব্যবস্থা করতে।
নাযিয়াত মৃদু স্বরে বললো-“আম্মা কেমন আছেন ?”
রাফিজ ‘রণ’র মাথায় কপালে গালে চুমু দিচ্ছে বারবার!
–“তোমার কথা খুব বলেন! আর দুঃখ করেন।এখন আফসোস করাই তার একমাত্র কাজ!”
শুনে নাযিয়াত মুখ নামিয়ে নিলো।
‘রণ’ বিছানায় পড়ে থাকা একটা খেলনা দেখে সেটা নেবার জন্য ঝুঁকে গেলো!রাফিজ ‘রণ’কে আস্তে করে বিছানায় বসিয়ে ছোট্ট খেলনাটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সোজা হলো।
-“একটু বসুন…আমি এক্ষুণি আসছি!”বলে নাযিয়াত দরোজার দিকে পা বাড়াতেই রাফিজ ডাকলো-“নায্…এক মিনিট!”
নাযিয়াত ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই রাফিজ একপা বাড়িয়ে ওর ডানবাহু চেপে ধরলো! তারপর ওকে নিজের দিকে টানলো।
নাযিয়াত কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর ঠাঁই হলো রাফিজের বুকে!
রাফিজ সর্বশক্তিতে ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে !যেন সে এই ক্ষণটির অপেক্ষাতেই ছিলো!ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো-
-“কিভাবে পারলে আমাকে ছেড়ে এতোদিন থাকতে?বলো…আমাকে কি একবারো দেখতে ইচ্ছে করেনি,কথা বলতে ইচ্ছে করেনি?আমার ফোন নম্বর তো তুমি জানতে,একটা ফোনও তো করতে পারতে!”
নাযিয়াত রাফিজের বুকে মুখ গুঁজে বললো-
-“অনেকবার চেয়েছি কিন্তু সাহস পাইনি,ভেবেছি….রাফিজ দুহাতে ওর মুখ তুলে ধরে ওর কথা থামিয়ে দিয়ে বললো-
–“অনেক কষ্ট দিয়েছো আমাকে।জানো,এতোদিন বেঁচেও মরে ছিলাম!”
রাফিজ মুখ নামাতে গেলে নাযিয়াত মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো-
–“আম্মা,নাস্তা নিয়ে আসছে !”
রাফিজ নাযিয়াতকে ছেড়ে রণ’র দিকে মন দিলো!-“আমার বাবাটা কি করে?”বলে রাফিজ পরম যত্নে রণকে কোলে তুলে নিলো!
★
রাতে খাবার টেবিলে রাফিজ বেলা চৌধুরীকে জানালো সে আগামীকাল নাযিয়াতকে বাড়ী আনতে যাচ্ছে।
বেলা চৌধুরী অবাক বিস্ময় বললেন-“মানে?কোত্থেকে?ও কোথায় তুই জানিস?”
-“আমি ওদের নতুন বাসার সন্ধান পেয়েছি!”রাফিজ সংক্ষেপে জানালো।
বেলা চৌধুরী ছটফটিয়ে উঠে বললো-“তুই একা ওকে আনতে যাবি,আমাকে নিবি না?”
–“তুমি যাবে?”
বেলা অভিমানাহত স্বরে বললো-“দোষটা তো আমিই করেছিলাম ওর সাথে।আমারই তো যাওয়া উচিত।আচ্ছা,ওর তো বাবু হবার কথা ছিলো!কি হয়েছে?আমার নাতী না নাতনী হয়েছে?”ব্যগ্র কন্ঠে জানতে চাইলেন বেলা!
রাফিজ স্বাভাবিক সুরে বললো-“নাতি/
নাতনী না হলে বুঝি তুমি নাযিয়াতকে আনতে যাবেনা?তোমার শুধু নাতি নাতনীই চাই??আমার সুখটা তোমার কাছে কোনো ফ্যাক্ট না?”
-“তুই এভাবে কথা বলছিস কেন?আমি কি বলেছি যে ফ্যাক্ট না বরং আমি তো মনকে বুঝিয়েছি,এবার আর নাতি নাতনীর জন্য আমি নাযিয়াতকে কষ্ট দেবোনা।ও খুব ভালো মেয়ে!আল্লাহ আমার ভাগ্যে নাতি নাতনী না রাখলে নাই! সম্পত্তি সব চ্যারিটি ফান্ডে দান করে দেবো!”
রাফিজ আর কিছু বললো না।
★
পরদিন বেলা চৌধুরী সহ রাফিজ নাযিয়াতদের বাসায় এলো!
নাযিয়াত এসে সালাম দিতেই বেলা চৌধুরী ওকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলেন।দুহাতে ওর মুখ ধরে কপালে চুমু খেলেন।
এমন সময় আধো সুরের “দাদাদাদাদা….”শুনে চমকে তাকিয়ে দেখলেন রাফিজের কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা।রাফিজই রণর কানের কাছে মুখ রেখে দাদা বলতে শেখাচ্ছিলো।
বেলা বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন।তার মনে হচ্ছে এক ঝটকায় তার বয়স ত্রিশ বছর কমে গেছে।কারন তিনি স্বচক্ষে তার ছোট্ট রাফিজকে দেখতে পাচ্ছেন।ঠিক এভাবেই একদিন রাফিজকে কোলে ণিয়ে ওর বাবা দাঁড়িয়ে ছিলো।
তারপর একদিন…রাফিজকে বেলার কোলে দিয়ে মানুষটা চিরতরে হারিয়ে গেলো!
বেলার চোখ ভিজে উঠলো।দুহাত বাড়িয়ে রণ কে কোলে নিয়ে আবেগে কেঁদে ফেললেন তিনি আপন উত্তরাধিকারীকে দেখে!
রাফিজ মৃদুস্বরে বললো-“পুরো সম্পত্তির সব চ্যরিটি ফান্ডে দেবার আগে তোমার নাতির চকলেটের পয়সাটা রেখে নিও!”
বেলা মুখ ঝামটে বলে উঠলো-“চ্যারিটি ফান্ডে কেন দিতে যাবো? আমি কি আঁটকুড়ে নাকি?আমার ওয়ারিশ আছে না?”
এমন সময় নাযিয়াতের মা আর ছোট বোনেরা প্রবেশ করলো!বেলা তাদের হাত ধরে আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চাইলেন।
বেলাশেষে বেলাচৌধুরী তার বহুকাঙ্খিত ওয়ারিশ নিয়ে ঘরে ফিরলেন।
★
★
★
রণ কে বেলার কাছ থেকে নেয়াই যাচ্ছেনা।
বাড়ী আসার পর থেকে ওকে নিয়ে সেই যে তিনি ঘরে ঢুকেছেন বেরোনোর আর নাম নেই! নাযিয়াত দুবার গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসেছে রণ খাবে কিনা।
এদিকে রণও যেন বুঝে ফেলেছে এটা তার নিজের বাড়ী,নিজের ঘর।সে স্বচ্ছন্দে বেলা চৌধুরীর ঘাড়ে মাথায় পা রাখছে,উঠছে,নামছে…. আবার নরম বিছানায় গড়িয়ে পড়ছে আর বেলা চৌধুরী শিশুদের মতো হাসছেন ওর কান্ড দেখে।
নাযিয়াত নিরবে দুই শিশুর কান্ড দেখলো খানিকক্ষণ।
তারপর পেছন থেকে রাফিজের কথা শুনে ঘাড় ফেরালো-“চলো তোমার ঘরে চলো!”
রাফিজের ‘তোমার ঘরে’ শব্দটা নাযিয়াতের বুকে বাজলো!
রাফিজ ওকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরোজা আটকে দিলো।তারপর নাযিয়াতকে হাত ধরে নিজের মুখোমুখি বসালো।
কাতর স্বরে বললো-
-“তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছিনা।অন্যায়টা অনেক বড় হয়ে গেছে নায্।
*নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: “নিঃস্বার্থ ভালোবাসা”*
আমি বুঝতে পারিনি ব্যপারটা এদিকে টার্ণ করবে।তারপরে তোমাকে পাগলের মতো খুঁজেছি।তোমার চিঠির মর্ম উদ্ধার করতেই লেগেছে একমাসেরও বেশী।তারপর মা’কে নিয়ে বিক্রমপুর গেলাম সেখানেও কাউকে পেলাম না।তারপর তুমি হারিয়ে গেলে আমার জীবন থেকে।কত যে খুঁজেছি তোমায়।”
-“আমাকে ক্ষমা করুন,আমি আসলে আপনাকে ফোন করতে গিয়েও আম্মার সাথে দেয়া ওয়াদার কারনে ফোন করিনি!”
-“অন্যায় ওয়াদাও কি রাখতে হয়?ভবিষ্যতে আমি তোমার জীবন থেকে সরে যেতে চাইলেই তুমি দেবে? আমাকে আটকাবে না?এ তোমার কেমন ভালোবাসা নায্?আজ যদি আমি মরে যেতাম…..?”
নাযিয়াত দ্রুত নিজের ডান হাত রাফিজের ঠোঁটের উপর রাখলো।তারপর মুচকি হেসে দুহাতে নিজের কান ধরলো-“স্যরি…আর এমন হবেনা,ইনশাআল্লাহ্ !”
রাফিজ ওর হাত নিজের মুঠোয় টেনে নিয়ে বললো-“শাস্তি পাওনা হয়েছে তোমার।তবে সেটা একদিনে দেবোনা।ধীরে ধীরে প্রতিদিন দেবো!”
-“আচ্ছা, দেবেন নাহয় !তবে একটা কথা না বলে পারছিনা,দাঁড়ীতে কিন্তু আপনাকে বেশ লাগছে।সেইরকম!”
-‘”আর তোমাকে কেমন লাগছে জানো!কাছে এসো কানে কানে বলি!”
-“জ্বী,না ধন্যবাদ।আ’ম কোয়াইট কমফোর্টেবল হিয়ার!”
রাফিজ গম্ভীর সুরে বললো-‘”পঁচিশেও তুমি সুন্দর ছিলে কিন্তু সাতাশে তুমি কি হয়েছো, তা তুমি নিজেও জানো না।বিয়ের পরপর তোমার রুগ্ন স্বাস্হ্যের জন্য শাড়ী পড়লে মনে হতো শাড়ীটা হ্যাঙ্গারে ঝুলছে।আর এখন মনে হয়…..!”
নাযিয়াত ঝট করে উঠে দাঁড়াতে গেলে রাফিজ ওর হাত ধরে টান দিয়ে ওকে নিজের কোলে বসিয়ে বললো-“বেলা চৌধুরীর সম্পত্তিগুলো চ্যারিটি ফান্ডে না দেবার জন্য কমপক্ষে এক হালি উত্তরাধিকারী দরকার।একজনে খেয়ে শেষ করতে পারবেনা।বাকীগুলোকে আনতে হবেনা?”
নাযিয়াত রাফিজের ঘাড়ে মুখ লুকালো!
★★★
কয়েক বছর পরের কথা……
জেদ্দা বিমান বন্দরে রাফিজ যখন ইহরামের কাপড় পড়ে নামলো তখন দেখা গেলো ওর ঘাড়ের উপর একটা বাচ্চা ওর দুকান ধরে আছে।আরেকটু ছোটটা ওর গলা জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে লেপ্টে আছে।ওদিকে নাযিয়াতের হাত ধরে হাঁটছে ওদের দ্বিতীয় সন্তান নাশরাহ চৌধুরী।এই একটাই মেয়ে নাযিয়াতের।বাকী তিনজন পুত্র।
আর তাদের সবার পেছনে লাঠি হাতে চলেছেন বেলা চৌধুরী আর তার হাত ধরে হাঁটছে তাঁর বড় নাতি “রণবীর চৌধুরী”!
রাফিজ যখন তার বরকতময় পরিবার নিয়ে এগোচ্ছিলো তখন মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলো প্রান্তিকের সাথে।
প্রান্তিক রাফিজকে দেখেই সশব্দে সালাম দিয়ে বললো-“ভাই,কোলাকুলি করার তো জায়গা নাই,বুক পিঠ সবতো দখলদার বাহিনীর কবলে।
হাহাহা করে হেসে উঠলো দুজন।
প্রান্তিক ইশারায় তার নিজের বাচ্চাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো!এক ছেলে,দুই মেয়ে!
জান্নাত এগিয়ে গিয়ে নাযিয়াতের সাথে মুসাফাহা করলো।
প্রান্তিক আজ ওমরা শেষে মালয়েশিয়া ফিরে যাচ্ছে।সে এখন সপরিবারে সেখানেই স্থায়ী হয়েছে।
★
★
★
ফারিক এখন পুরোদস্তর মুসলমান।কিছুদিন আগেই সে অষ্ট্রেলিয়ার মুসলিম কমিউনিটির চীফ এ্যাডভাইজরও নির্বাচিত হয়েছে।
তার নিজের এখন দুই সন্তান। দুটোই কন্যা।সে অকপটে প্রিয়ন্তীকে বলে,সারাজীবন মেয়েদের অমর্যাদা করেছি তো,আল্লাহ আমাকে দু’ দুটো মেয়ের বাপ বানিয়ে দিয়েছে।
আমাদের প্রথম সন্তান নষ্ট হয়ে গিয়েছে,ওটাও আমাদের জন্য কল্যানকরই ছিলো। কারন ওটা ছিলো আমাদের বিবাহপূর্ব জেনার সন্তান।
আর যেনা হারাম।
আলহামদুলিল্লাহ্।
দুটো পাক্ কন্যা সন্তান তিনি আমাকে দান করেছেন!গুনাহ মাফের কতবড় সুব্যবস্থা মা’বুদ আমাকে করে দিয়েছে।কন্যা সন্তান উপযুক্তরূপে লালন পালন করে তাদের যথাসময়ে পাত্রস্থ করতে পারলে সেই ব্যাক্তির জন্য জান্ন্তের সুসংবাদ রয়েছে!
অথচ দেখো,পুত্র সন্তান পালনকারীর জন্য এই সুসংবাদটা নাই।”
প্রিয়ন্তী ওর কথাশুনে মুচকি হেসেছে।
সব কিছুতে রাব্বুল আলামীনের অপূর্ব হিকমা রয়েছে।
আমরা মহামূর্খের দল তার কতটুকুই বা বুঝি!”
সমাপ্ত
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬