Saturday, August 16, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1985



ফিরবে ভাবিনি–এ ফেরা অর্থহীন

0

বিধ্বস্ত কায়ায়—হাঁটু গেড়ে,
বসেছিলাম পথের প্রান্তে,
তোমার পাদদেশে।

প্রচণ্ড অবহেলায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলে,
ভ্রু কুঁচকে, কপালে তিনটে ভাজ ফেলে।
যেন আমি রূপ–তোমার অধমাঙ্গে বিদ্ধ
পথের কাঁটা ,
হয় উপরে ফেলা নয়তো সমূলে উৎপাটন
এই দুইয়ের যে কোন একটি করলেই প্রশান্তি তোমার!

ভাবতেই বেরিয়েছিল বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস।
যেখানে এই তো কিছুদিন অগেও ছিল চিত্তগ্রাহী এক উদ্যান।

ঝরেছিল ফল্গুধারা অবারিত;
দৃষ্টি যেন হয়ে উঠেছিল
জলের এক মহা উৎস।

সদর্পে হেঁটে চলে গিয়েছিলে,
বিধ্বস্ত কায়ার এই আমাকে রেখে!

একবারও তাকাওনি ফিরে!
যদি তাকাতে তবে দেখতে,
কান্নাভেজা গণ্ডদেশ আর,
অনিরুদ্ধ অশ্রুতে লাল টকটকে লোচন।

অক্ষির দৃশ্যপটের শেষ সীমানায় যতক্ষণ ছিলে;
আশায় বেঁধেছিলাম বুক।।।

আমায় স্তম্ভিত করে দিয়ে সেদিন,
ফিরোনি! বাস্তবতার কশাঘাত;
তখনই বুঝতে শুরু করেছিলাম কেবল।

আজ সেদিনের সেই ফল্গুধারা প্রবাহিত
নেত্রদ্বয়–ভীষণ দক্ষ মানুষ পরখে।

এটাই যে অর্জন–যার সম্মুখে
সমস্ত মিছে—তাই অভিমান হয়নি।

শত কষ্টের মাঝেও ত্রাসিত হইনি ,
বরঞ্চ হয়েছি কৃতজ্ঞ, তোমার প্রতি।

সবেই তো পথচলা শুরু করেছিলাম তখন
তোমার দেয়া আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হৃদয় ,
আজ–কঠিন কোনো ধাতুর প্রলেপে আবৃত
তবুও আমি কৃতজ্ঞ তোমার প্রতি ।

আমার মনের সয়ে যাওয়া আর মস্তিষ্কের বিচক্ষণতায় আজ আমি কৃতজ্ঞ ।

আজ আমি একাই যথেষ্ট নিজের জন্য,
এমনই লগ্নে ফিরে এসেছ তুমি!

হয়তো তুমিও হয়েছ জর্জরিত ঘাত-প্রতিঘাতে ,
তবে জেনে রাখো, তুমি ফিরবে ভাবিনি।

আজ তোমার এ ‘ফেরা’ যে অর্থহীন
যেমনি পায়ে হেঁটে এসেছ, তেমনি ফিরে যাও।

আমি তো দিইনি হৃদয়ে কর্পূরের প্রলেপ ,
দিয়েছি প্রলেপ দস্তার নয়তো বোধহয় কর্পূর ও আজ দিতো আমায় ধোঁকা ।

তাই জেনে রাখো, তোমার সমস্ত সত্তা দিয়ে ,
ফিরবে ভাবিনি, তোমার এ ফেরা অর্থহীন।
তোমার দোলায়মান হওয়ার ভাবনা আজ অর্থহীন।
ফিরবে ভাবিনি–তাই আজ তুমি আমার কাছে অস্তিত্বহীন।

লেখা: ফাতিমা আক্তার অদ্রি

ভালো লাগে ভালোবাসতে-পর্ব ৮

2

#ভালো লাগে ভালোবাসতে
#পর্ব-৮
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

মাঝে মাঝে স্ব-ইচ্ছায় আমি আলসেমিকে নিজের উপর চড়াও হতে দেই।পৃথিবীর যাবতীয় সংস্পর্শ থেকে মুক্ত হয়ে আলসেমির পুকুরে ডুব দেওয়াটা মন্দ লাগে না।দুই দিন যাবৎ ভার্সিটি যাই না।গভীর ঘুমের রাজ্যে এখন আমার যোগাযোগ।ফোনের ব্যাটারি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।আলসেমি ভেঙে সেটা ঠিক করারও ভেতর থেকে কোনো তাড়া আসছে না।সোমা আপু গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ায় কিছু বলার মতও কেউ নেই।

তৃতীয় দিনের দিন যেতে হলো,কারণ অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার আজ লাস্ট ডেট।
কিন্তু যাওয়ার পর যা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
ভার্সিটি যাওয়ার পর নিদ্র ভাইয়া আমাদের ক্লাসে যাদের যাদের অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট হয় নি তাদেরগুলো আমার হাতে দিয়ে দিল।আমার অপরাধ দু দিন সে ফোন দিয়ে,ভার্সিটি এসে আমাকে পায়নি।প্রথমে উদ্বিগ্ন মুখে আমার আলসেমির গল্প শুনে রাগে গজগজ করে আমার মাথার উপর এই শাস্তি তুলে দিল।
নিজের ত্যানা ত্যানা জীবন নিয়ে আক্ষেপ করতে করতে লাইব্রেরীতে বসে বসে একগাঁদা কাগজপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে দিলাম।নিজেরটা করেছি দুই তিনদিন ধরে আর এতগুলো আধো আধো করে রাখা অ্যাসাইনমেন্ট আমি কিভাবে ভার্সিটি আওয়ার শেষ হওয়ার আগে কমপ্লিট করব?
আপনমনেই বিড়বিড় করতে লাগলাম,’ঐ নিদ্র আর কতদিন এই ভার্সিটিতে থাকবে!সময় যেন শেষও হচ্ছে না।আমি তার খপ্পর থেকে রেহাই পাবো কিভাবে?আল্লাহ্ একটু দয়া করো।
মাথা চুলকে,চোখ কঁচলে,কলম কামড়ে শুধু পাগলই হতে লাগলাম,অ্যাসাইনমেন্ট আর আগাচ্ছে না।
ঠিক সেই সময় নিদ্র ভাইয়া এসে চেয়ার টেনে আমার বাম সাইডের কর্ণারে বসে পড়ল।বই খাতা টেনে ভ্রু কুঁচকে নিচের ঠোঁট আলতো কামড়ে ধরে নিজে নিজে করে দিতে লাগলো।আমি তো শকড হয়ে তাকিয়ে রইলাম।যে শাস্তি দিয়েছে সেই আবার পূরণ করছে।যাক!আমার রাগটাও এখন পরে গেছে।

অনেকক্ষণ পর সব কমপ্লিট করা হলে সে বই থেকে মুখ তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,’তোমার ফোন দাও।’
আমিও চুপচাপ বের করে দিলাম।সে পুরাতন ব্যাটারী চেন্জ করে একটি নতুন ব্যাটারী লাগিয়ে দিল।
আমি খাতাগুলো চেক করে বললাম,’আপনি ফিজিক্স এর স্টুডেন্ট হয়েও আমাদের সেকশনের অ্যাসাইনমেন্ট কিভাবে করলেন?’
-‘না পাড়ার কি হল!অবশ্য সেম সেকশনের হলে আরো তাড়াতাড়ি হয়ে যেত।’
-‘অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট তো আপনিই করলেন।তাহলে শুধু শুধু আমাকে এই পানিশম্যান্ট দিলেন কেনো?’
-‘তুমি যে পারবে না এটা তো আমি আগেই জানি।তোমাকে যে এগুলো নিয়ে টেনশন করে করে মরতে হল এটাই তোমার পানিশম্যান্ট।
আমি উৎসুক চোখে তাকিয়ে বললাম,’কিন্তু মেইন কষ্ট তো শেষমেষ আপনাকেই করতে হলো!’

কথাটি বলে আমি মুখ টিপে হাসতে লাগলাম।সে কিছুক্ষণ অসহায় ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভির মুখে বলল,’তোমাকে না বলেছি আমার সামনে এভাবে হাসবে না।’
তার কথা শুনে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।আমি মুখ টিপে হাসলেই সে সব সময় এই কথা বলে কেনো?আমাকে এভাবে হাসলে কি এত খারাপ লাগে?

তার পরেরদিন ভার্সিটি যাওয়ার পথে তামিম ভাইয়ার সাথে দেখা।সে আমার হাতে একটি বই ধরিয়ে দিয়ে বলল ভার্সিটি গিয়ে নিদ্র ভাইয়ার কাছে দিয়ে দিতে।আমি রিকশা থেকে নামতেই চোখ পড়ল নিদ্র ভাইয়া আমার একটু সামনে দিয়েই ভার্সিটির গেটের ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছে।
হাতের মাঝে বই রেখে আমি তার পেছনে দৌড়ে চেঁচিয়ে নিদ্র ভাইয়া নিদ্র ভাইয়া বলে ডাকতে লাগলাম।আমি তার কাছে পৌঁছাতেই এক অচেনা অ্যান্টি নিদ্র ভাইয়াকে থামিয়ে বলল,’তোমার বোন তোমাকে ডাকছে কতক্ষণ ধরে।’
ততক্ষণে আমিও তার নাগালে পৌঁছে গেছি।
অ্যান্টি তো বলেই পগারপার।আর নিদ্র ভাইয়া যে
দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো মনে হচ্ছে আজকে আমাকে নির্ঘাত গিলে ফেলবে।আমি মুখটা কাচুমাচু করে রাখলাম।সে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,’তোমার এই ভাইয়া ডাকের জন্য আর কেউ যদি আমাদের ভাই বোন ভাবে তাহলে আই স্যয়ার, তোমাকে আমি জাস্ট শেষ করে ফেলব।’

আমি ভয়ার্ত গলায় বললাম,’তাহলে আর কি বলে ডাকব?সিনিয়রকে তো মানুষ ভাইয়া বলেই ডাকে!’
-‘আমার মাথা বলে ডেকো!এই তোমার বয়স কি সত্যিই ১৮+?আমার তো একদমই মনে হয় না।ভার্সিটিতে পড়ো বিয়ে হয়ে গেছে তবুও মাথায় এতটুকু বুদ্ধি বলতে নেই।’

‘সুপ্তির বিয়ে হয়ে গেছে?’
আমি চমকে উঠে পাশে তাকালাম দেখলাম আমারই এক ক্লাসমেট তিশা।ওর প্রশ্ন শুনে আমার গলা শুকিয়ে গেল।বুঝে ফেলল না তো আমার আর নিদ্র ভাইয়ার ব্যাপারে!
প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি আবারো করা হলে বুঝতে পারলাম ও শুধু নিদ্র ভাইয়ার শেষের কথাটিই শুনেছে।তিশার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি এবার নিদ্র ভাইয়ার দিকে।নিদ্র ভাইয়ার চেহারায় রাগ উড়ে গিয়ে শয়তানী হাসি ভেসে উঠেছে।আমি ঘাড় নাড়িয়ে প্রবল বেগে নিদ্র ভাইয়াকে না বলতে বললাম।
নিদ্র ভাই বলল,’হ্যাঁ,সুপ্তির তো বিয়ে হয়ে গেছে।’
তিশা বলল,’সত্যি সুপ্তি।’
আমি তো না বলতেই যাবো কিন্তু তার আগেই নিদ্র ভাইয়া আমার পেছনে এসে ফিসফিস করে দুষ্টমি ভঙ্গিতে বলল,’তোমার হাতে কিন্তু বই।বই ছুঁয়ে মিথ্যা কথা বলতে হয় না!’

আমি নিশ্চুপ হয়ে মুখ ফুলিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।আর তিশা মুখ টিপে হাসি দিয়ে চলে গেল।কি বুঝলো কে জানে!
নিদ্র ভাইয়াও মুচকি হেসে পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে গুন গুন করতে করতে গেট পেরিয়ে ভেতরে চলে গেল।
আমার এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে নিদ্র ভাইকে খুন করে ফেলি।সে এটা কেনো করলো?
এখন যদি সব জানজানি হয়ে যায় তবে আমার জীবনে আর ভালোবাসার মানুষ কচু আসবে!’

ভার্সিটি আওয়ার শেষ হতে না হতেই দেখলাম এই খবর সবাই জেনে গেছে।একটু পরপর প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে আমার কাছে একেকজন উপস্থিত হচ্ছে।সাফা চোখ কপালে তুলে আমার কাছে এসে বলল,’তোর নাকি বিয়ে হয়ে গেছে আর তুই আমাকেই জানালি না।কার সাথে হয়েছে?’
আমি কোনো জবাব না দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে চলে আসলাম।প্রচন্ড রাগ লাগছে নিদ্র ভাইয়ার উপর।সেদিন সারারাত রাগে আমি ঘুমাতেও পারলাম না।
শেষে ঠিক করলাম আর না!ঐ নিদ্র ফিদ্র আমাকে অনেক জ্বালিয়েছে।আর আমিও চুপচাপ সহ্য করেছি।এবার আমি তাকে জব্দ করবো।

একটি বিশাল সাদা দালান বিশিষ্ট বাড়ির সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি।বাড়িটির সামনে একটি নীল মাছের মূর্তির পানির ফোয়ারা।মাছের মুখ থেকে জল ছিটকে আশেপাশে পড়ছে।কাঠের মেইন দরজার সম্মুখ থেকে একটি প্রশস্ত রাস্তা ফোয়ারার চারিদিক বৃত্তাকার ন্যায় ঘুরে সামনের লোহার গেটের দিকে অগ্রসর হয়ে গেছে।রাস্তার দুপাশেই বাহারী রঙের ফুলের বাগান।বাগানের মাঝে হলুদ রঙের কিছু নাম না জানা ফুল নজর কেড়ে রেখেছে।

কঠোর আত্ম সংকল্প নিয়ে এলেও এখন আমার রীতিমত ঘাম ছুটে যাচ্ছে।নিদ্র ভাইয়ার মা যদি আমার গালে থাপ্পড় টাপ্পর মেরে বসে।নাহ!ভয় পাওয়া যাবে না,মারলে মারুক।নিদ্র ভাইয়ার অবস্থাও তো খারাপ হবে।তার বড়লোক বাবা মা নিশ্চয়ই মেনে নিবে না ছেলের এমন হুটহাট গোপন বিয়ে।তারপর নিশ্চয়ই আলাদা করার জন্য তারাই মরিয়া হয়ে উঠবে।আর আমিও রেহাই পাবো।সিনেমাতে তো তাই হয়।আমি যদি একটা থাপ্পড় খাইও নিদ্র ভাইয়া খাবে পাঁচটা।
এই ভেবে মনটাকে একটু শান্ত করলাম।প্রশস্ত কাঠের দরজাটি খুলে গিয়ে গোলগাল মুখের একজন অতি সুন্দরী মহিলা হাসিমুখে আমাকে জিজ্ঞাসা করল,’কাকে চাই?’
তার মায়া মায়া মুখের দিকে তাকিয়ে কেন জেনো মনে হল ইনিই নিদ্র ভাইয়ার মা।আমি একটু ঢোক গিলে চোখ নামিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে দিলাম,’আপনার ছেলে আমাকে গোপনে বিয়ে করেছে।’
কথাটি বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে মাথা উঠিয়ে দেখলাম সেই মহিলাটি আমার দিকে চোখ বড় বড় করে হা করে তাকিয়ে আছে।
আমি ভাবলাম কাজ হয়েছে।
কিন্তু তখনই সে আমার হাত টেনে ভেতরে নিয়ে উৎফুল্ল হয়ে কাজের লোকদের বলতে লাগল,’কইরে তোরা দেখ,তোদের নিদ্র ভাই বিয়ে করে ফেলেছে।নিদ্রর বউ এসেছে।’
নিদ্র ভাইয়ার মাকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে তিনি এই পৃথিবীর সব থেকে সুখী মহিলা।আমাকে সোফায় বসিয়ে বাচ্চাদের মত খুশিতে গদগদ হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
‘হ্যাঁ রে মা,তোরা কিভাবে বিয়ে করেছিস আমাকে সব বলতো।আমার অনেক ইচ্ছা ছিল আমিও পালিয়ে বিয়ে করবো,কিন্তু তোমার শ্বশুর একদম ভীতু,প্রেম করা সত্ত্বেও আমার বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে তারপর বিয়ে করলো।আমি তো নিদ্রকে বলেই রেখেছিলাম পালিয়ে বিয়ে করতে।ও তো দেখি সত্যিই করে ফেলেছে।’

আমি তো শুধু বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকে দেখে যাচ্ছি।প্রথম আলাপেই সে আমাকে কত কথা বলে দিচ্ছে।আমি কি ভেবেছিলাম আর কি হচ্ছে।
এবার এক অন্য ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসছে।
এরই মাঝে নিদ্র ভাইয়া দোতলা সিড়ির মুখে এসে দাড়ালো।তার পড়নে এখন একটি অরেঞ্জ টি শার্ট আর ব্লাক থ্রি কোয়ার্টারের প্যান্ট।সে আমাকে দেখে একটুও চমকালো না।যেনো আমার এখানে থাকাটাই স্বাভাবিক।
নিদ্র ভাইয়া সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলে তার মা তার কান ধরে বলল,’কিরে বিয়ে করেছিস আর এখনও আমাকে জানাতে পারলি না।’
নিদ্র ভাইয়া মৃদু হাসি দিয়ে কান ছাড়িয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরলো।
অ্যান্টি হেসে বলল,’যাহ!মাফ করে দিলাম।এত মিষ্টি মেয়েকে আমার বৌমা বানানোর জন্য।’
আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।নিজের করা গর্তে নিজেই পড়ে গেলাম না তো!
এরপর কিছু ঘটনা ঘটলো অতি দ্রুত।নিদ্র ভাইয়ার বাবাকে ফোন করে অফিস থেকে আনা হলো।তার থেকেও আমার কাঙ্খিত প্রতিক্রিয়া পেলাম না।তাকে দেখেও মনে হচ্ছে তার ছেলের কাজে সে গর্বিত।

বড় বিপত্তিটা তো বাধলো তখন যখন আমি হোস্টেলে ফিরে যাওয়ার কথা বললাম।আমার কথা শুনে নিদ্র ভাইয়ার বাবা মা এত অবাক হল যেন এমন আজগুবি কথা তারা কখনো শুনে নি।
তাদের মতে তাদের এত বড় বাড়ি থাকতে তাদের ছেলের বউ হোস্টেলে থাকবে এটা হতেই পারে না।আমাকে তারা কিছুতেই যেতে দিল না।ধরে বসিয়ে দিয়ে গেল নিদ্র ভাইয়ার রুমে।

সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।আমার এখন শুধু কাঁদাটাই বাকি।ঠোঁট ফুলিয়ে আমি মুখটা কাঁদো কাঁদো করে মনে মনে কপাল চাপড়াতে লাগলাম।এ আমি কোথায় ফেসে গেলাম!তার বাবা মা তো দেখি তার থেকেও ফাস্ট।তাকে জব্দ করতে এসে নিজেই জব্দ হয়ে রয়েছি।
আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ন্যাকাচ্ছি আর ওদিকে নিদ্র ভাইয়া হাসতে হাসতে শেষ।রীতিমতো গড়াগড়ি খাচ্ছে।হাসির চোটে যেন কথাই বলতে পারছে না।
তার হাসি দেখে আমার গা আরো জ্বলে গেল।
তাকে তো আবার এখন ভাইয়া বলা নিষেধ!তাই কিছু না ডেকেই রাগ করে বললাম,’আপনি এভাবে হাসছেন কেনো?’
সে হাসি থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে বলল,’তোমার দেখি শ্বশুরবাড়ি আসার বড্ড তাড়া!কিভাবে ম্যানেজ করলে?’
‘আমি মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বললাম,’আমি তো এসেছি আপনাকে ফাসাতে,কে জানতো যে এমন হয়ে যাবে!আপনি গিয়ে আপনার বাবা মাকে বোঝান।আপনার ঐ মেয়ে যদি শুনে এতকিছু তাহলে তো আর জিন্দেগীতেও আপনাকে মেনে নেবে না।’
-‘স্যরি,আমার বাবা মাকে আর থামানোর ক্ষমতা আমার নেই।এবার তো আর আমি কিছু করিনি।’

-‘আর আমার বাবা মা বুঝি নেই?তারা যখন শুনবে তখন আমাকে কি করবে জানেন?’
আমার কথা শেষ হতেই এই বাড়ির এক কাজের মেয়ে এসে মুখ টিপে নিদ্রকে বলল,’ভাই,ভাবীর বাপ মা আসছে।’
এই কথায় আমি আকাশ থেকে পড়লাম।তারা আমার এড্রেস জানলো কিভাবে?বাবা মাকে ডেকে এনেছে!
বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে নিদ্রর দিকে তাকালাম।সে দু হাত নাড়িয়ে ঠোঁট বাকিয়ে বোঝাল এখানে তার কোনো হাত নেই সে কিছু জানে না।

সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে দেখলাম আব্বুর সাথে আঙ্কেল কোলাকুলি করে খোশ গল্পে মেতে উঠেছে।দেখে মনে হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে তারা খুঁজে পেয়েছে।নিদ্র আমার পেছন থেকে এসে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগল।আমিও তার পিছনে পিছনে নিচে গেলাম।নিদ্র আব্বুকে সালাম দিলে আব্বু নিদ্রকে বুকে টেনে নিল।
আমি তখন নিদ্রকে মিথ্যা বলেছিলাম যে আমার আব্বু আম্মু জানলে আমাকে শেষ করে ফেলবে।
আমার আব্বু আম্মু আমাকে খুব ভালোবাসে।আমি যদি একটি রিকশাওয়ালাকেও বিয়ে করে তাদের সামনে নিয়ে যেতাম তবুও তারা হাসি মুখে মেনে নিত আর এদিকে তো নিদ্রর মত পারফেক্ট ছেলে পেয়ে কোনো কথাই নেই!
এবার আব্বু আমার কাছে এসে আমাকে বুকে টেনে বলল,’আমার সোনা আম্মু মামণিটা এত শুকিয়ে গেছে কেনো!’
তারপর নিদ্রকে বলল,’নিদ্র আমাদের মেয়েকে আমরা খুবই আদর যত্নে বড় করেছি।আমার মেয়েটা অনেক সহজ সরল।ওর মনে যেমন কোনো প্যাচ নেই তেমনই ও কোনো প্যাচ বোঝেও না।ওকে দেখেশুনে রেখো।আমার একটাই মেয়ে।’
নিদ্র ভাইয়া আব্বুর হাতের উপর হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বলল,’চিন্তা করবেন না বাবা।আপনার মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব এখন থেকে আমার।আমি ওকে সবসময় আগলে রাখবো।’

শুধু শুধু নিদ্রর নাটক করে এত কথা বলার কি দরকার আমি বুঝি না।চুপ করে থাকলেই তো হয়।
এই দুই পরিবারের এত সখ্যতার কারণ শেষমেষ জানতে পারলাম।নিদ্র আর আমার বাবা হাইস্কুল ফ্রেন্ড ছিল।এত দিন যোগাযোগ হারিয়ে গিয়েছিল।আমার ঠিকানা বের করে নিদ্রর বাবা গাজীপুর থেকে আমার বাবা মাকে আনিয়ে দেখতে পেল তার ছেলে আর অন্য কাউকে নয় তারই পুরোনো বন্ধুর মেয়েকেই বিয়ে করেছে।

গল্পে আনন্দে দুই পরিবার পুরো মেতে উঠল।এতকিছুর মাঝে শুধু আমি একাই অস্থিরতায় ভুগছি।এতো পুরো দেখি সত্যি সত্যি বিয়ের বাঁধনে রূপান্তর হয়ে যাচ্ছে।এরপর কি হবে?
দুই পরিবার মিলে ঠিক করলো আমাকে আর হোস্টেলে পাঠানো হবে না।আর কয়মাসের মধ্যেই যেহেতু নিদ্রর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে যাবে আর বিজনেসে যোগ দিবে তাই তার কিছু সময় পরেই বড় করে অনুষ্ঠান করা হবে।ততদিন আমি এখানেই থাকব নিদ্রর সাথে।
আমার হোস্টেলে একা একা থাকা আর সেখানের বিশ্রী খাওয়া নিয়ে আগে থেকেই আমার বাবা মার চরম আপত্তি ছিল।তারা তো এখন আরো নিশ্চিন্ত হতে পারলো।

রাত এখন অনেক।আমার আব্বু আম্মু সন্ধ্যার পরেই গাজীপুরে ফিরে গেছে।অাঙ্কেল অ্যান্টি থাকার জন্য অনেক বলেছিল।
আমার ইচ্ছে করছে নিজের চুলগুলো টেনেটুনে সব ছিড়ে ফেলি।কাল এই সময় হোস্টেলে ছিলাম আর আজ নিজের বোকামীতে ফেঁসে গিয়ে নিদ্রর রুমে বসে আছি।নিদ্রর বিছানার কর্ণার ঘেঁষে বসে বসে ঠোঁট ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে যাচ্ছি।নিদ্রর বাবা মা তো দেখি তার থেকেও বেশি ফাস্ট।আমাকে একবারের জন্যও হোস্টেলে ফিরে যেতে দিল না।নিদ্রকে দিয়ে আমার জিনিসপত্র আনিয়ে নিল।আর ঐ পলিটিক্যাল লিডারের কাছে তো এসব কোনো ব্যাপারই না।
এখন আমি তার সাথে একরুমে থাকব কিভাবে।ভাবতেই তো কেমন যেন লাগছে!
বাথরুমের দরজা ফাঁক করে নিদ্র একটি হোয়াইট টি শার্ট আর ব্লাক ট্রাউজার পড়ে টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো।
তার মুখে এখনো সেই স্মিত হাসি।আজকে সারাদিন ধরেই তার ঠোঁটে এই হাসি ঝুলে রয়েছে।
আমার যন্ত্রণাতেই তো তার খুশি!

আমি এখন হালকা গোলাপি রঙের সুতি কামিজ আর সাদা রঙের ধুতি সেলোয়ার পড়ে আছি।সে বিছানার কাছে এসে টাওয়ালটা সোফায় ছুঁড়ে মেরে বিছানায় শুয়ে পড়লো।আমি মুখ ভার করে বললাম,’আমি কোথায় ঘুমাবো?’
সে চোখ বন্ধ করেই বলল,’যেখানে ইচ্ছা।চাইলে আমার পাশেও ঘুমাতে পারো।কিন্তু এই আশা করো না যে আমি এখন ফিল্মের হিরোর মতো তোমায় পুরো বিছানা ছেড়ে দিয়ে নিচে গিয়ে ঘুমাবো।’

আমি মনে মনে তাকে একটা গালি দিয়ে হাত বাড়িয়ে বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে রাগে কষ্টে নিজের পাতলা ওড়নাটাই আষ্টেপিষ্টে গায়ে পেচিয়ে নিচে ফ্লোরে শুয়ে পড়লাম।
নিদ্রও সাথে সাথে লাইট অফ করে দিল।আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টায় আছি।হঠাৎ কানে ভেসে এলো কেমন একটা অদ্ভুত মৃদু আওয়াজ।যেমনটা হরর মুভিতে কেমন একটা ভয়ংকর গা ছমছমে সাউন্ড হয়।
আমি চোখ মেলে তাকালাম।পুরো রুমে ঘুটঘুটে অন্ধকার।বাইরে থেকে সোডিয়ামের হালকা আলো যেন অন্ধকারকে আরো ভয়ংকর করে তুলেছে।আওয়াজটা এখন আর আসছে না।নিস্তব্ধ চারিপাশ।নিঃশ্বাসের শব্দও যেন প্রকট শোনা যাচ্ছে।আমার গা ছমছম করতে লাগল।নিদ্রর দিকে তাকিয়ে মনে হলো পুরো বেঘোরেই ঘুমিয়ে আছে।আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম।আবারো সেই আওয়াজ।চোখ খুলে ভয়ে আমি ঢোক গিলতে লাগলাম।একে একে সবগুলো হরর মুভির ভয়ংকর সিন গুলো আমার চোখে ভাসতে লাগলো।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আর কখনো ভুতের ছবি দেখবো না।প্রচন্ড ভয় আমার উপর জেঁকে বসেছে।এখন এভাবে নিচে একা একা ঘুমানো আমার পক্ষে অসম্ভব।আমি কাঁপতে কাঁপতে ধীরে ধীরে বালিশ হাতে নিয়ে বিছানার অপর প্রান্তে নিদ্রর পাশে শুয়ে পড়লাম।নিদ্র এক হাত মাথার নিচে দিয়ে চিৎ হয়ে ঘুমাচ্ছে।আমিও চোখ বন্ধ করে নিলাম।এবার আবারো সেই সাউন্ড হলো,আরো জোরে।আমি ভয়ে নাক মুখ কুঁচকে নিদ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।

চলবে,,

ভালো লাগে ভালোবাসতে-পর্ব ৭

0

#ভালো লাগে ভালোবাসতে
#পর্ব-৭
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

সকালে আমার ঘুম ভাঙলো খুব বেলা করে।বলা বাহুল্য গতকাল রাতে খুব মজা করেছি।আমাদের ফিরে আসা হয়েছে অনেক রাতে।শরীরটা এখন অসাঢ় হয়ে এসেছে।বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে খুব কষ্ট করে বিয়ে বাড়িতে এক কাপ কফি জোগাড় করলাম।ঘাড়ে এক হাত রেখে আড়মোড়া ভেঙ্গে একটি চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।মাথাটা ঝিম মেরে রয়েছে।
আমার পাশে একটি চেয়ার টেনে সাফা বসে পড়লো।ফোন আমার মুখের সামনে ধরে বলল,’সুপ্তি দেখ দেখ,কালকের হলুদের অনুষ্ঠানে খুব সুন্দর পিক উঠেছে।’
আমি বিরক্তি নিয়ে ওর হাত ঠেলে সরিয়ে দিলাম।আর বললাম,’সকাল সকাল কি শুরু করলি?’
-‘আরে ভালো ভালো ছবিগুলো বেছে রাখতে হবে না।ফেসবুকে আপলোড করবো তো।’
আমি কফির কাপে একটা চুমুক দিতে না দিতেই সাফা আবারো ফোনটা এনে বলল,’দেখ তোর আর নিদ্র ভাইয়ার ছবি।’
আমি ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই আমাদের দুজনের একসাথে একটি ছবি।আমি সামনে মুখ করে মুখের সামনে হালকা হাত এনে খিল খিল করে হেসে আছি আর নিদ্র ভাইয়া একটু পাশ থেকে তার ঘন কালো ভ্রু অদ্ভুত ভাবে কুঁচকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ঠিক তখনই হয়তো কেউ ছবিটা তুলে নিয়েছে।
ছবিটা দেখতে অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে।

সাফা ওর কাঁধ দিয়ে আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,’সুন্দর হয়েছে না?ফেসবুকে ছেড়ে দেই কি বলস?’
আমি ফোন থেকে চোখ তুলে ওর দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হাত টেনে ওর গালে একটা চড় মারলাম।
আর বললাম,’হুম ফেসবুকে ছেড়ে দেই!যাতে সবাই জেনে যায় আমাদের ব্যাপারে?’
সাফা এতক্ষণ মুখ ফুলিয়ে ছিল।আমার কথা শুনে চোখ কপালে তুলে বলল,’তোদের ব্যাপারে কি জানবে?তোদের ভেতর হয়েছে কি?’
নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে যাওয়াতে আমার হেচকি উঠে গেল।কি বলব না বলব ভাবতে ভাবতে তোতলিয়ে বলে দিলাম,’আমরা দুজন যে এক হলুদের অনুষ্ঠানে গিয়েছি এটা জেনে যাবে না!’
-‘এটা জানলেই কি?’
-‘ঘোড়ার আন্ডা!তুই তো দেখি আমাকে পুলিশের মত জেরা করা শুরু করলি।’
কথাটা বলে পাশ কাটিয়ে চলে আসলাম।
কখন কি বলে ফেলি তার ঠিক নেই।কিছুতেই কাউকে জানতে দেয়া যাবে না।

একটা কথা আছে না,আগে গেলে বাঘে খায়।আমরাও তেমনি সবার আগে এসে বসেও সবার পিছনে এসে পড়েছি।প্রথম সিট থেকে উঠতে উঠতে আমরা বাসের পুরো শেষের সিটে গিয়ে পৌঁছালাম।মুরুব্বিদের জন্য সিট ছাড়তে ছাড়তে আমাদের এই দশা।সাফার বাবা সারাজীবন ব্যাংক ম্যানেজার হয়ে থাকলেও প্রচুর কিপ্টা।বিয়েতে কোনো গাড়ি রিজার্ভ করেনি।একটি বড় বাস ভাড়া করেছে মেয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য।আঙ্কেলের মতে যাওয়াটাই বড় ব্যাপার,কি দিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা না।
বাসের সবথেকে পিছনের সিটে আমি,সাফা,সোমা আপু গাদাগাদি করে বসে আছি।সাফা তো পারলে কেঁদেই ফেলে।গরমে বাসে ওর সব মেকাপ না উঠে যায় সেই চিন্তায়।কিন্তু বেচারা কাঁদতেও পারছে না।প্রথমত,চোখের কাজল লেপ্টে যাবে আর দ্বিতীয়ত আমাদের দুই সিট সামনেই আঙ্কেল বসেছে।
দ্বিতীয় কারণটার জন্য বেশি বিরক্ত হচ্ছে ছেলেরা।আমরা মেয়েরা সব পেছনে বসেছি বলে ছেলেরাও সব পেছনের দিকেই বসেছে কিন্তু তার মাঝে আবার আঙ্কেল এসে বসেছে সাজেদ ভাইয়ার পাশে।এর জন্য ছেলেরা কোনো মজাই করতে পারছে না।সাজেদ ভাইও মুখ ভার করে বসে আছে।আঙ্কেলের মন মেজাজও ভীষণ খারাপ।যে পরিমাণ লোক হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে বেশি হয়ে গেছে।অনেক বয়স্করা আবার সাথে করে নাতি নাতনিও নিয়ে এসেছে।বাসে জায়গা হচ্ছে না।
ছেলেরা অসহায় মুখ করে বারবার এদিকওদিক দেখছে।আঙ্কেলের জন্য মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করতে না পারায় সবথেকে বেশি বিরক্ত মামুন ভাই।একটু পরপরই সে মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করছে।তার হয়তো আজকে বিরক্ত হবারই দিন,সে কারণেই একটু পর এক বয়স্ক লোক কোমর ব্যাথার কথা বলে কিছুক্ষণের নাম করে তার কোলে একটি সাত আট বছরের বাচ্চা ছেলেকে বসিয়ে দিল।
বিরক্ত আমরাও কম হচ্ছি না।পেছনের সিটের সবার মাঝখানে বসেছি আমি।আমার বাম পাশে সোমা আপু আর ডান পাশে সাফা।সাফার পাশে আবার সব মেয়েদের ভেতর এসে বসেছে এক পান্জাবী পড়া দাড়ি গোঁফআলা বয়স্ক লোক।সেই চাচার মুখে আবার মুখ ভর্তি জর্দা দেওয়া পান।একটু পরপরই সে বাসের জানালা খুলে পানের পিক ফেলছে।জর্দার কড়া গন্ধে আমাদের সবার বমি আসার মত অবস্থা।সেই চাচা আবার পান চাবাচ্ছে আমাদের দিকে তাকিয়েই।
সাফা তো আমার দিকে মুখটা কাঁদো কাঁদো করেই রেখেছে।বেচারা ভুগছে যে সবথেকে বেশি।

বাস চলছে নিজস্ব গতিতেই।একসময় সবকিছু আমাদের সয়ে গেল।এখন আর অতো বিরক্ত লাগছে না।জীবনের প্রথম বাসে করে বরপক্ষ হয়ে বিয়েতে যেতে ভালোই লাগছে।
হঠাৎ করে মামুন ভাইয়ার সিট থেকে উৎকট গন্ধ নাকে ভেসে এলো।মামুন ভাই চরম বিরক্তি নিয়ে তার কোল থেকে ছোট ছেলেটিকে নামিয়ে নাক মুখ কুঁচকে বলল,’যাহ শালা এত সুন্দর বডি স্প্রে লাগিয়ে এসেছিলাম।আর এ পাদ দিয়ে সব দিল..!’
পুরো বাসে হাসির রোল পরে গেল।এই কর্মের জন্য দায়ী বাচ্চা ছেলেটি তার আগের সিটে গিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগল।যেনো এই কাজ করতে পেরে সে গর্বিত।
আমরা নাকে আঁচল চেপে হাসতে লাগলাম।এভাবে একটু মজা একটু বিরক্ত একটু গল্পে জমে আমরা একসময় বিয়ে বাড়ি পৌঁছে গেলাম।

গায়ে হলুদ কমিউনিটি সেন্টারে হলেও বিয়ের আয়োজন বাড়িতেই করা হয়েছে।এসব আঙ্কেলের জন্যই।অবশ্য আঙ্কেল ঠিকই বলেছে,নিজ বাড়ির উঠোনে বিয়ের অনুষ্ঠানে যে আনন্দ পাওয়া যায় তা কমিউনিটি সেন্টারে কোথায়!
সেখানে তো সব শুধু পটের বিবি সেজে বসে বসে ছবি তোলো।বিয়ের কাজে হাত না দিলে কি বিয়ের মজা উপভোগ করা যায়?
তামিম ভাইয়াদের বাড়ি ঢাকার শেষ প্রান্তে হওয়ায়
তাদের বাড়ির চারপাশে কিছুটা হলেও খোলা জায়গা আছে।সেখানেই প্যান্ডেল খাটিয়ে সব আয়োজন করা হয়েছে।
আজ আমরা মেয়েরা সবাই একরকম মিষ্টি রঙের শাড়ি পড়েছি।আমরা বাস থেকে নেমে বিয়ের জন্য বানানো রঙবেরঙের গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সাজেদ ভাইয়ায় শালীরা এসে ফিতা দিয়ে গেট আটকে রাখল।আগে টাকা তারপর ভেতরে ঢোকা।
অনেকক্ষণ দরকষাকষি চলার পর অবশেষে আমরা ভেতরে ঢুকতে পারলাম।ভেতরে ঢুকতেই গতকালের মত চোখে পড়ল নিদ্র ভাই আর তাদের গ্রুপের উপর।নিদ্র ভাইরা আজ সবাই হালকা আকাশী রঙের শেরোয়ানী টাইপ ড্রেস পড়েছে।আমাদের মত তারাও কি সব পরিকল্পনা করে একরঙের জামা পড়ল নাকি।
আমরা তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।আমি একটু মজা করে ভাব নিয়ে বললাম,’এখানে আমরা কারো জুনিয়র না,আমরা ছেলেপক্ষ।তাই আমাদের যেনো ভালোভাবে আপ্যায়ন করা হয়।’
নিদ্র ভাইয়া শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,’অবশ্যই।কিরে তামিম বিয়াইনদের কি কষ্ট করে হাঁটিয়ে নিব নাকি!আমরা আছি কি করতে!ধর।’
এই বলে নিদ্র ভাই আর তার বন্ধুরা সত্যি সত্যিই হাত বাড়িয়ে কাছে আসতে নিল কোলে নিতে।
আমরা এক ছিটকে সরে এসে দিলাম দৌড়।

বিয়ে বাড়িতে আমার নিদ্র ভাইকে ভাইয়া বলে ডাকায় আরো কয়েকজন আমাদের ভাই বোন ভাবল।নিদ্র ভাই তো কটমট চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল আমি ঢোক গিলে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম।
বিয়ের কাজ শেষ হলে সাজেদ ভাইয়াকে দিয়া ভাবীর পাশে বসিয়ে দেওয়া হলো।এটাই তো সবথেকে মজার সময়।তাদের হাতে ধরিয়ে দিল ফুলের মালা।কেউ কাউকে মালা পড়াতে দিচ্ছে না।এপাশ থেকে একদল আবার ওপাশ থেকে একদল ধরে টানাটানি করছে।অবশেষে সব হাঁপিয়ে উঠলে মালা পড়ানো হলো।তাদের মালা পড়ানো দেখে আমার মনে পরে গেল সেই দৃশ্য,কিভাবে নিদ্র ভাইয়া আমার হাত থেকে ফট মালা পড়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ আমাকে পড়িয়ে দিয়েছিল।আমি তো অবাক চোখে হা হয়ে ছিলাম আর সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শয়তানি হাসি দিচ্ছিল।
তার দিকে চোখ পড়তে দেখলাম এখনো আমার দিকে তাকিয়ে সেভাবে শয়তানি হাসি দিচ্ছে।
সে কি বুঝতে পারছে আমি ঐ ঘটনা মনে করছি।
আমি অন্য দিকে তাকিয়ে একটা মুখ ভেংচি দিলাম।

বর কনেকে এখন আয়না দেখানো হবে।খুব সুন্দর কারুকার্য খচিত গোল আয়নায় তাদেরকে একত্রে দুজন দুজনের চেহারা দেখানো হলো।ব্যাপারটা আমার কাছে দারুণ রোমান্টিক লাগে।
আমি যখন সত্যি সত্যি বিয়ে করব তখন আমিও সব থেকে সুন্দর আয়নার আমার ভালোবাসার মানুষের মুখ দেখব আর সে দেখবে আমার মুখ।

তাদের আয়না দেখানো শেষ হলে আয়নাটা আমার হাতে দিয়ে বলা হল সাইড টেবিলে রেখে দিতে।আমি রাখতে যাচ্ছিলাম,হঠাৎ করে আয়নাটা আমার হাত থেকে ফসকে পড়ে যেতে নিল।কিন্তু তার আগেই নিদ্র ভাইয়া কোথা থেকে এসে আয়নার তল পিঠে হাত রেখে ধরে ফেলল।আয়নাটি এখন আমার আর তার দুজনের হাতেই আছে।আর সেখানে স্পষ্ট হয়ে আছে আমাদের দুজনের চেহারা।ব্যাপারটায় আমি হকচকিয়ে গেলাম।আয়না থেকে মুখ তুলে তার দিকে একপলক তাকিয়ে আয়না তার হাতে ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম।
পথে মামুন ভাইয়ার সাথে ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গেলাম।সে আমাকে দেখেই দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল,’সুপ্তি চলো একটা সেলফি তুলি।’

আমি বিরক্তি লুকিয়ে বললাম,’মামুন ভাই আপনি একাই তুলুন আমার ভালো লাগছে না।’
কিন্তু সে প্যান প্যান করতেই থাকল।ফোন উপরে তুলে আমাকে ইনসিস্ট করতে লাগল।এর মাঝে হঠাৎ নিদ্র ভাই এসে ইচ্ছে করে তার সাথে ধাক্কা লাগিয়ে তার হাত থেকে ফোন ফেলে দিল।মামুন ভাই হায় হায় করতে করতে তার ফোন উঠাতে ব্যস্ত আর এদিকে নিদ্র ভাইয়া আমাকে ধমক দিয়ে বলল,’তোমার কাজ টাজ নেই?শুধু ঘোরাফেরা কর,যাও এখান থেকে!
আমি রাগে মুখ ফুলিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম।সবসময় শুধু ধমক দেয় কেনো!
সাফার কাছে গিয়ে দেখলাম সাফা একটি টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে কোল্ড ড্রিংক পান করছে।আমি ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ও বলল,’সুপ্তি দেখ নিদ্র ভাইয়া কত ভালো,ঐ রাফি ভাইরা আমার হাতে কোল্ড ড্রিংকের নাম করে পানি ভরা বোতল ধরিয়ে দিয়েছিল।আমি তো চুমুক দিয়ে বোকা বনে গেলাম আর তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।তারপর নিদ্র ভাইয়া তাদেরকে থামিয়ে আমার জন্য কোল্ড ড্রিংক নিয়ে এলো।’
আমিও একটি কোল্ড ড্রিংকের বোতল হাতে নিয়ে বললাম,’তোর নিদ্র ভাই ছাই ভালো।সবসময় তো শুধু আমার পেছনেই লেগে থাকে তুই বুঝবি কিভাবে।’
-‘সর,নিদ্র ভাইয়া অবশ্যই ভালো।’
আমি কোল্ড ড্রিংকে একটা চুমুক দিয়ে বললাম,’আরেকবার যদি ভালো বলেছিস তাহলে এই ড্রিংক তোর মাথায় ঢেলে দিব।’
এর মধ্যে নিদ্র ভাইয়া এসে আমার হাত থেকে কোল্ড ড্রিংক নিয়ে এক চুমুক দিয়ে বলল,’হাই গার্লস,কি নিয়ে কথা বলছো?’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’আপনি আমারটা নিলেন কেনো?’
-‘ও,খুব তেষ্টা পেয়েছিল।এই নাও।’
আমি তার বাড়িয়ে দেওয়া বোতল না নিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম,’আমি কারো ঝুটা খাইনা।’
-‘একদিন খাবে।’
এই বলে সে মুচকি হেসে চলে গেল।এদিকে সাফাও দাঁত কেলিয়ে হাসছে।আমি ওঁকে ধমক দিয়ে বললাম,’তুই হাসিস কেনো?’

শাড়ি ছেড়ে নরমাল ড্রেসআপে ফ্রেশ হয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছি।
এদিকে সাফা পাশের সোফায় বসে বসে ব্লাশ করছে।আমি ওঁকে দেখে বললাম,’তোর আবার কি হয়েছে?’
আমার কথায় ও থতমত খেয়ে বলল,’কিছু না।’
তারপর আমার পাশে এসে বলল,’তোকে আর নিদ্র ভাইকে দেখলে না আমার খুব ভালো লাগে।আমার মনে হয় কি নিদ্র ভাই তোকে পছন্দ করে।’
আমি ঝারি দিয়ে বললাম,
-‘ছাই করে!ধমক ছাড়া তো কোনো কথাই বলে না।
আর সে অন্য একটি মেয়েকে পছন্দ করে কিন্তু সেই মেয়েটি এখনো মানছে না।সে নিজে আমাকে বলেছে।’
-‘বাব্বাহ!তোর সাথে এতকিছু শেয়ার করে!ব্যাপার কি?’
-‘ব্যাপার তোর মাথা!যা এখান থেকে!

হঠাৎ ছাদ থেকে হাসাহাসির শব্দ কানে এলো।আমি আর সাফা দুজনেই অবাক হয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম।ছাদে গিয়ে দেখি নিদ্র ভাইয়া আর তাদের দল,সাজেদ ভাইয়ার বন্ধু আর কাজিনরাও আছে।সবাই এখন নরমাল গেট আপে আছে।আমাদের দেখে রাফি ভাই বলল,’আরে বেয়াইনরা যে!বসেন বসেন।’
আমরা তাদের থেকে একটু দূরত্বে চেয়ার টেনে বসলাম।
আমিই প্রথম বললাম,’আপনারা কখন এলেন?’
রাফি ভাই বলল,’আমরা তো দিয়ার সাথে এসেছি।কনের সাথে তার বাবার বাড়ির পক্ষ থেকে কিছু লোক আসার নিয়ম আছে না!’
-‘আপনারা এসেছেন টের পেলাম না তো?’
এতক্ষণে নিদ্র ভাইয়া মুখ খুলল।কিন্তু সে মুখ খুলেই আমাকে পঁচানোর জন্য।বলল,
-‘বাসের মধ্যে ভেড়ার মত বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়ে থাকলে টের পাবে কিভাবে!’
সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিল।মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে করে তার চুলগুলো গিয়ে খামছে ধরি।

তামিম ভাই উঠে গিয়ে নিচের থেকে কোল্ড ড্রিংক আনতে গেল।সোহেল ভাই বলে উঠল,’জামাই বউকে কি বাসর ঘরে ঢুকিয়ে ফেলেছে?’
সাফা বলল,’না,কেনো?’
-‘আরে গিয়ে কান পাততে হবে না!আমরা তো ফুল প্লান করে ফেলেছি।বিছানার নিচে পাপড় ভাজা রেখে দেওয়া হয়েছে।তারা গিয়ে বসলেই পাপড় ভাঙতে শুরু করবে।দুজনে হকচকিয়ে যাবে।তারপর করা হবে লোডশেডিং অপারেশন।একটু পরপর লাইট অন হবে অফ হবে।বেচারারা চমকাতে চমকাতেই শেষ হয়ে যাবে।’
আমরা তো থ মেরে রয়েছি তাদের কথা শুনে।
নিদ্র ভাইয়া বলে উঠল,’সোহেল,বেচারাদের এত জ্বালাস না।শেষমেষ কিন্তু বাসর না করতে পারলে তোদের সারাজীবন অভিশাপ দিয়ে যাবে।’
সোহেল ভাই বলল,’মামা তুমি আমাদের অভিশাপের ভয় দেখিয়ে কিছু করতে পারবে না।
তোর বাসর ঘরে তো আমরা সারারাত জ্বালামু।’
-‘আচ্ছা!এই নিদ্র করতে দিলে তো!’
ইশ কি কথার ছিরি!আমি সাফাকে চোখ ঘুরিয়ে দেখালাম ‘দেখ তোর ভালো ভাইয়ার গুণ।’

বর কনেকে বাসর ঘরে নেওয়া হয়েছে শুনে সবাই উঠে চলে গেল।বাকি রইলাম আমি,সাফা,তামিম ভাই আর নিদ্র ভাই।হঠাৎ তামিম ভাই বলে উঠল সে বাথরুমে যাবে।আর সাফাও লাফ দিয়ে বলে উঠল সে দেখিয়ে দিতে যাবে।আমি সাফাকে ফিসফিস করে বললাম,’তোর যাওয়ার কি দরকার।?’
কিন্তু ও একটু আসছি একটু আসছি বলে চলে গেল।আমিও ওর পিছু পিছু যাওয়া ধরলে নিদ্র ভাইয়া আমার হাত টেনে ধরে বলল,’কি করছো?দুজনের নতুন নতুন প্রেম শুরু হয়েছে,একটু একলা সময় দাও।’
আমি চরম অবাক হয়ে বললাম,’প্রেম শুরু হয়েছে মানে!কবে থেকে?’
-‘দুজনের মনে মনে তো আগের থেকেই ছিল,এপ্রুভাল আজকে পেল।’
-‘তারা দুজন তো শুধু লেগেই থাকে।প্রেম ছিল কিভাবে?’
-‘ঐ লেগে থাকার ভেতরেই তো প্রেম।’
আমি আরো অবাক হয়ে বললাম,’এত কিছু হয়ে গেল আর আমি বুঝালাম না কিভাবে?’
সে একটু পিছনে সরে গিয়ে এক হাতে কোল্ড ড্রিংক ধরে আরেক হাত পকেটে ঢুকিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
-‘তার জন্য না ঘিলু লাগে।’
আমি মুখ ফুলিয়ে রইলাম।সে আবার আমাকে পচাঁনো শুরু করছে!

চলবে,,

অতন্দ্রিলার_রোগদ (পর্ব : ২ ও ৩ – ইরাবতী)

0

#অতন্দ্রিলার_রোদ
পর্ব : ২ ও ৩ – (ইরাবতী)

লেখা : শঙ্খিনী

রৌদ্র বা রোদ শব্দটার আলাদা কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই। রোদ হচ্ছে একই সাথে সানশাইন এবং মুনশাইন।
নির্দিষ্ট কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ না থাকায়, বিদেশি কেউ যখন রোদের নামের অর্থ জিজ্ঞেস করে তখন বেশ ভালোই ঝামেলায় পড়তে হয় তাকে। রোদের এই ঝামেলা দেখে ইরা হাসতে হাসতে বলেছিল, “আচ্ছা যাও! আমি যখন বিখ্যাত ভাষাবিদ হয়ে যাবো, তখন রোদ শব্দের সুন্দর একটা ইংরেজি প্রতিশব্দ আবিষ্কার করে দেব।”
কিন্তু ইরা কথা রাখেনি।

বছর ছয়েক আগের কথা। রোদ তখন পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। আর ইরা ইংরেজি বিভাগে।
রোদের সঙ্গে ইরার পরিচয় হয় তানহার মাধ্যমে। তানহা রোদের মামাতো বোন এবং ইরার বান্ধবী।
ইরার একটা গুন হলো, সে খুব সহজেই একটা মানুষকে আপন করে নিতে পারে।
প্রথম দর্শনেই ইরা উৎসাহিত গলায় রোদকে বলেছিল, “এমা, অংক নিয়ে পড়েন কিভাবে? স্কুল-কলেজে অংকের নাম শুনলেই জ্বর আসতো!”
রোদ শুকনো গলায় বলে, “আর আমার জ্বর আসতো ইংরেজির নাম শুনলে।”

এমন কোনো হাসির কথা না হলেও ইরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে যায়।
ইরার এই হাসিটাই আকর্ষিত করেছিল রোদকে।

রোদ ভালোবাসা নিয়ে নিজের মতো করে একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছে। সেই থিওরি অনুযায়ী, একটা মানুষের প্রতি আরেকটা মানুষের ভালোবাসা সৃষ্টি হয় তিনটি ধাপে।

১ম ধাপ – আকর্ষন
২য় ধাপ – অনুভূতি
৩য় ধাপ – আসক্তি

একটা মানুষ তার হাসি, চোখ অথবা কথা বলার ভঙ্গি দিয়ে অন্য একটা মানুষকে আকর্ষণ করে। অন্য একটা মানুষের যদি সেই
আকর্ষণে আকর্ষিত হয়, তবেই ভালোবাসা প্রকিয়ার প্রথম ধাপ সম্পন্ন।
মানুষটার প্রতি আকর্ষিত হওয়ার পর তার পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে জানার আগ্রহ, তার হাসিতে নিজস্ব একটা সুখ খুঁজে পাওয়া, তার কান্নায় নিজস্ব একটা ব্যাথা খুঁজে পাওয়াই তার প্রতি এক ধরনের অনুভূতি। মানুষটার প্রতি এই অনুভূতি সৃষ্টি হলেই সে পৌঁছে যাবে ভালোবাসা প্রকিয়ার দ্বিতীয় ধাপে।
এর পরের ধাপ একটা মানুষকে পাগল করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।
মানুষটার প্রতি অনুভূতি সৃষ্টি হওয়ার পর যখন সেই মানুষটাকে নিয়ে দিবা-নিশী, আনন্দে-দুঃখে, শয়নে-সপনে তার কথা ভাবাই হলো আসক্তি।
এই ধাপ পর্যন্ত আশা মানেই একটা মানুষ অন্য আরেকটা মানুষকে গভীর ভাবে ভালোবাসে।

ইরাকে ভালোবাসার প্রথম ধাপে আছে রোদ।

হঠাৎই এক দুপুরে রাস্তায় রিকশার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে, ইরার সাথে দেখা রোদের।
ইরা রোদকে দেখে উৎসাহিত গলায় বলে, “আরে আপনি? কেমন আছেন?”
রোদ অন্যরকম গলায় বলে, “ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
“এইতো চলছে। তা আজ হঠাৎ এখানে?”
“একটা কাজে এসেছিলাম। আপনি?”
“আমাদের বাসা এখানেই।”
“ওহ্ আচ্ছা। কোথায় যাচ্ছেন?”
“পাবলিক লাইব্রেরির দিকে।”
“তাই নাকি? আমিও তো সেদিকেই যাচ্ছি।”
কথাটা নিতান্তই মিথ্যা। রোদ বাসায় যাচ্ছিল। মেয়েরা নিজেদের সঙ্গে মিল আছে এমন ছেলে পছন্দ করে। তাই বোধ হয় এই ছোট্ট মিথ্যাটি বলে সে।

ইরা ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলে, “বাহ্ ভালোই তো হলো, একসাথে যাওয়া যাবে। তবে যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে।”
“না, না। আমার আপত্তি থাকবে কেনো?”
“তাহলে চলুন, যাওয়া যাক।”

ইরা ও রোদ একটা রিকশায় উঠে যায়।
রিকশায় উঠে আনন্দিত গলায় ইরা বলে, “আচ্ছা, আপনার কতো ঘর পর্যন্ত নামতা মুখস্ত?”
“এটা কেমন প্রশ্ন?”
“না মানে, আপনি গণিত নিয়ে পড়াশুনা করেন তো, তাই ভাবলাম আপনার বোধ হয় একশ ঘর পর্যন্ত নামতা মুখস্ত!”
“একশ ঘর পর্যন্ত নামতা মুখস্ত রাখাটা একটু কঠিন। আমার কুড়ি ঘর পর্যন্তই মুখস্ত। তবে এই ক্যালকুলেটরের যুগে কুড়ি ঘরও মুখস্ত রাখার প্রয়োজন হয় না।”
“তাও বা কম কিসে? আমার তো নয় ঘর পর্যন্তই মুখস্ত!”
“দশ-এগার?”
“ওগুলো তো পানির মতো সহজ। ওগুলো তো আর মুখস্ত করার কিছু নেই। মুখস্ত নয় ঘর পর্যন্তই।”
“নয়ের ঘরের নামতার কিন্তু মজার একটা দিক আছে। কখনো খেয়াল করেছেন?”
“কি মজার দিক?”
“এই যেমন ধরুন, ৯×২=১৮। এখানে ডানপাশের দুটি সংখ্যা মানে ১ এবং ৮ কে যোগ করলে কিন্তু ৯ হয়। আবার, ৯×৩=২৭। এখানেও ২ এবং ৭ কে যোগ করলে ৯ হয়।
পুরো ৯ এর ঘরের নামতার ডানপাশের সংখ্যাকে যোগ করলে যোগফল ৯ হয়।”
“ওমা তাইতো! কখনো খেয়ালই করিনি। অন্য ঘরের নামতায় এমন হয় না?”
“না শুধু ৯ এর ঘরেই হয়। গণিত আসলে একটা বোঝার বিষয়। যে বুঝতে পারে, তার কাছে গণিত পৃথিবীর সবথেকে মজার বিষয়। আবার যে বুঝতে পারে না, তার কাছে এর থেকে জটিল বিষয় আর নেই।”

রোদের এই সুন্দর কথা,গাণিতিক জ্ঞান ইরার বেশ ভালো লাগে।

এরপরও বেশ কয়েকবার কাকতালীয়ভাবেই তাদের দেখা হয়। এই দেখা হওয়ার মাঝেই একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে।

একদিন বিকেলে ইরা রোদকে ফোন করে বলে, “আপনি কি ফ্রি আছেন?”
রোদ শান্ত গলায় বলে, “হ্যাঁ আছি। কেন বলুন তো?”
“আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবেন?”
“অবশ্যই পারবো। কোথায় দেখা করতে হবে?”
“শপিং মলে, আই উইল টেক্সট ইউ দ্য অ্যাড্রেস এন্ড টাইম। আসলে আমি একজনের জন্যে একটা উপহার কিনবো, আপনার সাহায্য দরকার।”
“নিশ্চই সাহায্য পাবেন। দেখা হচ্ছে তাহলে!”

সময়মতো শপিং মলে পৌঁছে রোদ দেখে, ইরা একটা পাঞ্জাবির দোকানে। কয়েকটা পাঞ্জাবি নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে।
রোদ ইরার কাছে গিয়ে চিন্তিত গলায় বলে, “ইরা?”
ইরা তাকাল।
রোদকে দেখে কিছু খুশি গলায় বলে, “আপনার অপেক্ষাই করছিলাম।”
“বেশি দেরি করে ফেললাম নাকি?”
“না, না! আচ্ছা, এখন এই পাঞ্জাবিগুলোর মধ্যে একটা বাছাই করুন।”
“আমি?”
“হ্যাঁ। আসলে ছেলেদের জিনিস, আমি অতো ভালো বুঝি না। তাই আপনাকে আসতে বলেছি।”
রোদ পাঞ্জাবি বাছাই করতে করতে বলে, “আচ্ছা আপনি তো বলেছিলেন একজনের জন্যে উপহার কিনবেন। এটাই কি সেই উপহার?”
ইরা অস্পষ্ট গলায় বলে, “হুঁ।”
“তা, উপহারটা কার জন্যে?”
“আমি আসলে একজন পছন্দ করি। পছন্দ বললে ভুল হবে। আমি আসলে তার প্রেমে পড়েছি। শুনেছি, বাঙালি মেয়েরা নাকি কারো প্রেমে পড়লে তাকে মুখ ফুটে বলতে পারে না। উপহার দিয়ে বুঝিয়ে দেয়।”

রোদ চমকে উঠে, তার মুখটা রক্তশূন্য হয়ে যায়। রোদ যে চমকে উঠছে এটা ইরাকে বুঝতে দেয়নি, খুব সহজেই নিজেকে সামলে নেয়।

কিছুক্ষণের মধ্যে রোদ সুন্দর একটা পাঞ্জাবি বেছে দেয়। ইরা সেই পাঞ্জাবি নিয়ে কাউন্টারের দিকে পা বাড়ায়।
পাঞ্জাবিটা কেনা হয়ে গেলে ইরা ও রোদ দোকানের বাইরে বের হয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে পায়চারি করে।
অবশেষে ইরা মুখ খুলে, “রোদ?”
“হুঁ?”
‌‌ ইরা পাঞ্জাবির প্যাকেটটা রোদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “আসলে এটা কিনেছি আপনার জন্যে। কারণটা আপনাকে বলেছি। তাই আবার জানতে চাইবেন না প্লিজ।”
রোদ হাত বাড়াল। রোদ প্যাকেটটা হাতে নেওয়ার সাথে সাথে ইরা প্রায় দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায়।

শুরু হয় রোদ ও ইরার গভীর প্রণয়।
প্রণয়ের কয়েক মাস যেতে না যেতেই তারা নিজের নিজের বাড়িতে পছন্দের কথা বলে।

রোদের মা এবং মামা বেশ আগ্রহের সঙ্গেই ইরাদের বাড়িতে তাকে দেখতে যান। মেয়ে সুন্দরী, শিক্ষিত,গুছিয়ে করে কথা বলতে পারে, রান্নাবান্নাও করতে পারে – তাদের ইরাকে খুবই পছন্দ হয়।
ইরার বাবা-মাও রোদকে পছন্দ করেন। করাটাই স্বাভাবিক।
মাস তিনেক পর বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হয় রোদ এবং ইরার।

বিয়ের পর তাদের প্রথম সকালটা শুরু হয় একটু অন্যরকম ভাবে।
“এই ইরা! ওঠো না!”, বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় কথাটি বলে রোদ।
ইরা ঘুমের মধ্যেই বলে, “কি হয়েছে?”
“আহ্ উঠো না!”
“কয়টা বাজে?”
“সাতটা।”
“উফফ, আরেকটু ঘুমাই না!”
“উঠো না প্লিজ! খুবই জরুরি একটা কাজ আছে!”

রোদ অসাধারন সুন্দর ছবি আঁকে। কোনো সুন্দর কিছু তার চোখে পরলেই সেটার ছবি আঁকা শুরু করে। ঘুমন্ত অবস্থায় ইরাকে দেখে তার ছবি আঁকতে খুব ইচ্ছে করছিল। তাই তো এত সকালে তাকে জাগিয়ে তোলা।

ইরা ফ্রেশ হয়ে এসে ক্ষীণ গলায় বলে, “এখন বলো, কি তোমার জরুরি কাজ?”
“ক্যানভাসটার ঠিক মুখোমুখি বসো।”
“রোদ! তুমি ফাজলামো করছো না? একে তো এই সাত-সকালে আমার ঘুমটা ভাঙালে, এখন আবার বলছো ক্যানভাসের সামনে বসতে?”
“হুঁ। তোমার ছবি আঁকবো।”
“সেটা কি পরে আঁকা যেত না?”
“যেত, কিন্তু আমার এখনি আঁকতে ইচ্ছে করছে।”

ইরার খুব রাগ করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার ওপর রাগ করা তার পক্ষে অসম্ভব। তাই হাসিমুখেই ক্যানভাসের সামনে বসে গেল সে।

ছয় ঘন্টা ধরে বিশাল এক ক্যানভাসে আঁকা হচ্ছে ইরার ছবি। ইরাকে অবশ্য পুরোটা সময় বসে থাকতে হয়নি।
ছবিটা অসাধারন হয়েছে। আঁকা শেষ করে রোদ ছবিটাকে খাটের পেছনের দেয়ালে টানিয়ে দিলো।
এভাবেই সূচনা ঘটে রোদ ও ইরার সুখের সংসার।

রোদের বাড়ির সামনে এক বিশাল বাগান।
বাগানের একদিকে চৌবাচ্চায় বিভিন্ন ধরনের দেশীয় মাছ চাষ করেন রোদের মা ফিরোজা।
কিন্তু তার একটাই আক্ষেপ, মাছগুলোর কোনোটাই বেশি দিন বাঁচে না।
বাগানের আরেক দিকে দেশীয় ফলমূল এবং তরি-তরকারির গাছের সমাহার। গ্রীষ্মকালীন আম-কাঠাঁল থেকে শুরু করে শীতকালীন বরই-আমলকি, সবই আছে ফিরোজার বাগানে।
বাগানের একটা কোণা এখনো ফাঁকা পরে আছে। রোদের বাবার ইচ্ছা ছিল সেখানে ছোট্ট একটা গলফ কোর্ট করার। তিনি মারা যাওয়ার পর সেই কোণাটা ওভাবেই পরে আছে।
ফিরোজার ইচ্ছা সেখানে মুরগির খামার করার। একটা খামার হলেই বাগানটা মাছ-মাংস এবং ফল-মূলে পরিপূর্ণ হবে।
কিন্তু বাগানে খামার করা নিয়ে রোদের ঘোর আপত্তি রয়েছে।
রোদের কথা, “বাগান ঘুরে বেড়ানোর জায়গা। এখানে খামার বানিয়ে সুন্দর জায়টাকে বাজার বানিয়ে ফেলার কোনো অর্থ নেই।”

সেই বাগানে বসেই এক ভোরে, সূর্যোদয় উপভোগ করছে ইরা।
রোদ তখন দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “তুমি এখানে? আর আমি তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজছি!”
ইরা ইশারায় রোদকে বসতে বলে। রোদ কথা না বাড়িয়ে ইরার পাশে বসে পড়ে।
ইরা রোদের কাঁধে মাথা রেখে বলে, “আমাদের বাগানটা না, অনেক সুন্দর।”
“হুঁ! মায়ের শখের জায়গা, সুন্দর তো হবেই।”
“আমি ঠিক করে এখন থেকে আমি গাছ লাগাবো। গোলাপ গাছ। লাল, গোলাপী, হলুদ,কমলা সব রঙের গোলাপ গাছ থাকবে এখানে!”
রোদ গম্ভীর গলায় বলে, “এখন তুমিও?”
“তুমিও মানে?”
“না মানে, মা এত দিন এই গাছ-গাছ করে আমার মাথাটা খেয়েছে! এখন তুমিও সেই দলে যোগ দিবে?”
“আম্মা যা করেন একদম ঠিক করেন।তাছাড়া আমরা যে পরিমাণে অক্সিজেন ব্যাবহার করি এবং যে পরিমাণে গাছ কাটি, সে অনুযায়ী সারা জীবনে আমাদের ৭ লক্ষ গাছ লাগানো উচিত। তুমি সারা জীবনে ৭ টা গাছও লাগিয়েছো?”
“ইরা, তোমার এই জ্ঞানের কথাগুলো একটা বই আকারে লিখে ফেলো! আমি নিজ খরচে ছাপিয়ে দেব।”
ইরা হাসতে হাসতে বলে, “অবশ্যই লিখবো। অসংখ্য ধন্যবাদ!”

পরেরদিন খুব গভীর রাতে ইরার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার পেছনের কারণ হলো একটা শব্দ। শব্দটা নির্ঘাত আসছে রান্নাঘর থেকে।
ইরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বিছানা থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো।

“রোদ?”
“হুঁ?”
“এই রাতে রান্নাঘরে কি করছো তুমি?”
“ ঘুম ভেঙে গেল। এখন কিছু না খেলে ঘুমও আসবে না। তাই ভাবলাম রান্নাঘরে এসে কিছু বানাই!”
“ভাবলেই হলো! তুমি আবার কিছু বানাতে পারবে নাকি?”
“চেষ্টা করলেই পারবো।”
“তুমি ঘরে যাও আমি বানাচ্ছি!”

রোদ বাধ্য ছেলের মতো ঘরে চলে যায়। মধ্যরাতে সবথেকে কম সময়ে, কম পরিশ্রমে যে খাবার বানানো যায় তা হলো মাইক্রোওয়েভ পাস্তা।
একটা মগে কাঁচা পাস্তা, দুধ এবং চিজ দিয়ে তিন মিনিট মাইক্রোওয়েভ করলেই তৈরি হয়ে যায় খাবারটি। খেতে অতটা আহামরি ধরনের না হলেও রাতের ক্ষুধা মেটাতে কার্যকরী।

ইরা ৫ মিনিটের মধ্যেই এটা বানিয়ে ঘরে চলে যায়।

রোদ হতভম্ব গলায় বলে, “এটা তুমি এখন বানালে!”
“হ্যাঁ!”
‌“কিভাবে সম্ভব?”
“চাইলেই সম্ভব! এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো আর আমাকেও ঘুমাতে দাও!”

ইরা অন্য মেয়েদের মত খুব ছোট ছোট বিষয় নিয়ে রাগ করেনা। কিন্তু ইরা যখন রেগে যায়, তখন বুঝতে হবে কেউ কোনো বিরাট অপরাধ করেছে।
ইরা এখন বেশ রেগে আছে, রাগ করার পেছনের কারনটা হলো সিগারেট।
একটা মানুষ ও তার পরিবারকে বিপর্যস্ত করে তোলার জন্য সিগারেট যথেষ্ট। তাই বিয়ের আগেই ইরা রোদকে সিগারেট খেতে নিষেধ করেছিল।
কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই রোদের শার্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট পায় ইরা।

রোদ তখন বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছে।
ইরা প্রায় ছুটতে ছুটতে বারান্দায় যায়।

“রোদ?”
“হুঁ?”
ইরা সেই সিগারেটের প্যাকেট রোদ দেখিয়ে বলে, “এটা কি?”
রোদ স্বাভাবিক গলায় বলে, “সিগারেটের প্যাকেট!”
“এটা তোমার পকেটে কি করছিলো?”
“কাল সন্ধ্যায় কিনেছিলাম।”
“কেন জানতে পারি?”
“অবশ্যই পারো। আসলে কাল আমার অফিসে খুব কাজের চাপ ছিল তো, তাই স্ট্রেস কমানোর জন্যে সিগারেট খেতে ইচ্ছে হলো।”
“স্ট্রেস কমাতে সিগারেট খেতে হবে এটা কোন দেশী লজিক? তাছাড়া আমি তো তোমাকে একদিন না হাজার দিন মানা করেছি সিগারেট খেতে! আমার কথার তো দেখছি কোনো মূল্যই নেই তোমার কাছে!”
“ইরা, তুমি এখন খুবই উত্তেজিত অবস্থায় আছো। একজন উত্তেজিত মানুষকে কোনো কিছু বোঝানো যায় না। তাই আমি এখন তোমাকে কিছু বোঝাবো না।”
“ফড়ফড় করা বন্ধ করো। তুমি খুব ভালো করেই জানো যে তুমি দোষ করেছো!”
“হ্যাঁ জানি। জানি এবং স্বীকারও করে নিচ্ছি।”

ইরা উত্তেজিত অবস্থায় বারান্দা থেকে বের হয়ে যায়।

ঘন্টা দুয়েক পর ইরার রাগ কমলে, বান্দায় গিয়ে দেখে রোদ মন খারাপ করে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে আছে।
ইরা কোনো কিছু না ভেবে দৌড়ে গিয়ে রোদকে জড়িয়ে ধরে।
“আই এম স্যরি।”
“তুমি স্যরি হতে যাবে কেন? আমি স্যরি। আমিই তো তোমার কথা শুনিনি।”
ইরা কাঁদতে কাঁদতে বলে, “রোদ, বিশ্বাস কর আমি কখনোই চাই না তোমার কোনো ক্ষতি হোক। তোমার কোনো ক্ষতি হলে আমি বাঁচতে পারবো না। তাই আমি তোমাকে সিগারেট খেতে নিষেধ করেছিল।”
রোদ ইরাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে বলে, “তোমাকে কথা দিচ্ছি, আর কোনো দিনও সিগারেট স্পর্শ করবো না!”

ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর যেকোনো বিষয় নিয়ে ফিরোজা একটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে না হওয়া পর্যন্ত তার শান্তি হয় না।
বাড়িভর্তি কাজের লোক। ফিরোজা যখনই যা চাচ্ছেন, হাতের নাগালে পেয়ে যাচ্ছেন। তাই ওনার বাড়াবাড়ি করাটা শোভনীয়।
কিন্তু এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের বাড়িতে কাজের লোকের নাম-গন্ধ পর্যন্ত নেই। তাদের ছোট ছোট বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়।
নাস্তা করা নিয়ে ফিরোজার বাড়াবাড়ি কিছুটা এমন – টেবিলে ইন্ডিয়ান, ইটালিয়ান, ইংলিশ, জাপানিজ এবং বাংলাদেশী সব ধরনের নাস্তা থাকতে হবে। যদিও তিনি বাংলাদেশী নাস্তা খাবেন, তারপরেও চোখের শান্তির জন্যে অন্যান্য দেশের নাস্তাগুলো থাকতে হবে।
বাসার সবাই যে যেখানে থাকুক না কেন, নাস্তার টেবিলে সময়মতো আসতে হবে।

রোদ ইরাকে নিয়ে নাস্তায় টেবিলে এসেছে।
ইরাকে দেখে ফিরোজা চিন্তিত গলায় বলেন, “কি ব্যাপার ইরা? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
ইরা বলে, “কেমন দেখাচ্ছে আম্মা?”
“মনে হচ্ছে তুমি যেন অনেক ক্লান্ত, সারা রাত ঘুম হয়নি!”
‌ “না, না আম্মা। ঘুম হয়েছে। কিন্তু কাল দেরিতে ঘুমিয়েছিলাম তো তাই কম ঘুম হয়েছে।”

ইরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় নাস্তা খেয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু চেয়ার থেকে উঠতেই ইরা মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
রোদ ইরাকে কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়।

মিনিট দশেকের মধ্যে ইরার জ্ঞান ফেরে।
“কি হয়েছে রোদ?”
“তুমি সেন্সলেস হয়ে পরেছিল।”
“সে কি!”
“দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরেই তোমাকে নিয়ে হসপিটালে যাবো।”
“একটু মাথা ঘুরে পড়ে গেছি, এজন্য আবার হসপিটালে যেতে হবে নাকি?”
“হ্যাঁ যেতে হবে। তুমি বেশি কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থাকো!”

বিকেলের দিকে রোদ ইরাকে নিয়ে হসপিটালে চলে যায়।
ড.হাফিজ, গাইনোকলোজিস্ট। ওনার চেম্বারটা বেশ সুন্দর করেই গোছানো।
দেয়ালে মা ও শিশুর যত্ন সম্পর্কিত বেশ কয়েকটা পোস্টার টানানো। পোস্টারগুলো পাশেই একজন বৃদ্ধার ছবি, সম্ভবত ওনার মায়ের ছবি।
কিছুটা দূরে একটা দেয়াল ঘড়ি। ইরা সেই ঘড়ি দেখে অবাক না হয়ে পারলো না, কারন ঘড়িটার কোনো কাঁটা নেই। একজন ডাক্তারের চেম্বারের ঘড়ি বন্ধ! হতে পারে তিনি বিষয়টা খেয়াল করেননি, কিংবা হতে পারে উনি সময়কে তোয়াক্কা করেন না। সময় চলবে সময়ের মতো, আমি চলবো আমার মত – টাইপ মানুষ তিনি।

ডাক্তাররা স্বভাবতই বেশি কথা বলেন। ড. হাফিজও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি অনবরত কথা বলছেন, শ্রোতা রোদ। ইরা কিছুই শুনছে না, শোনার চেষ্টাও করছে না। মনোযোগ দিয়ে দেখছে ঘরটার সাজসজ্জা।

চেম্বার থেকে বেরিয়ে ইরা আগ্রহ নিয়ে বলে, “কি বললেন উনি?”
“তুমি তো ভিতরেই ছিলে!”
“শুনিনি। ডাক্তারদের কঠিন কঠিন কথাগুলো আমার মাথায় ঢোকে না। উনি এতক্ষণ যা যা বলেছেন, তুমি সহজ বাংলায় আমাকে বুঝিয়ে বলো।”
“বলার মত অনেক কিছুই বলেছেন। কিন্তু সারমর্ম হলো উনি কতগুলো টেস্ট দিয়েছেন, যেগুলোর রেজাল্ট আজকের মধ্যেই ওনাকে দেখাতে পারলে ভালো হয়।”
“ডাক্তারদের এই একটা বিষয় আমার অসহ্য লাগে। সামান্য একটা সমস্যার জন্যেও টেস্ট!”
“কিছু করার নেই, নিজের ভালো চাইলে ডাক্তারদের কথা মানতে হবে।”
“আচ্ছা আজকে টেস্ট করালে, রিপোর্ট আজকেই দিবে?”
“অবশ্যই দিবে, কারন উনি প্রেসক্রিপশনে ‘ইমারজেন্সি’ কথাটা লিখে দিয়েছেন।”

ইরা বিরক্ত হয়ে টেস্টগুলো করাতে চলে গেল।

টেস্টগুলো করা শেষ হলে রোদ এবং ইরা রিপোর্টের জন্যে বসে আছে।
রোদ ক্লান্ত গলায় ইরাকে বলে, “ইরা? তোমাকে বাসায় দিয়ে আসবো?”
“নাহ্! কয়েক ঘণ্টার ব্যাপারই তো।”
“আমার কি ধারনা জানো?”
“কি?”
“আমাদের মাঝে জুনিয়র ইরা আসছে।”
ইরা হাসতে হাসতে বলে, “যদি তাই হয়, তাহলে আমার থেকে বেশি খুশি, আর কেউ হবে না।”
“তাই হবে দেখো!”

১ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট চলে এলো। রিপোর্ট হাতে পেয়ে রোদ সাথে সাথে ড.হাফিজের চেম্বারে চলে গেল।

ড. হাফিজ অনেক্ষণ যাবত ইরার রিপোর্টটা নাড়াচাড়া করে দেখছেন।
তিনি ভ্রু সামান্য কুঁচকে বলেন, “মি.রোদ, আপনি ড.নাহিদের চেম্বারে চলে যান। আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি যাতে আপনাদের অপেক্ষা করতে না হয়।”

ড. নাহিদের চেম্বারের সামনে এসে রোদ চমকে ওঠে। কারণটা হলো, ড. নাহিদ একজন নিউরোলজিস্ট।

নাহিদের চেম্বারে ঢুকে রোদ ইরার রিপোর্টের ফাইলটা নাহিদকে এগিয়ে দেয়।
ড. নাহিদ রিপোর্টগুলো ভালোমত দেখে ইরাকে বলেন, “আপনার নামই তাহলে ইরাবতী! এই রিপোর্টগুলো আপনার তাইতো?”
ইরা ঠোঁটে মুচকি একটা হাসি নিয়ে বলে, “জ্বী।”
“দেখুন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে আপনাদের মনোবল রাখতে হবে।”
রোদ শুকনো গলায় বলে, “সব কিছু ঠিক আছে তো ডক্টর?”
“দেখুন এমন কিছু বলার সময় আমাদেরও খারাপ লাগে। কিন্তু কিছুই করার নেই, বিষয়টা এই মুহূর্তে আপনাদের জানা খুবই জরুরি।
ইরাবতীর ব্রেইন টিউমার, বেশ অনেক দিন ধরেই। লক্ষণগুলো কখনো প্রকাশ পায়নি, তাই এত দেরিতে ধরা পরেছে।”

রোদ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তার গা বেয়ে শীতল হওয়া বয়ে গেল।
অবশেষে রোদ মুখ খুলে আহত গলায় বলে, “এটা কিভাবে বলতে পারেন আপনি? মাত্র কয়েকটা টেস্টের ভিত্তিতে আপনি এত বড় একটা কথা কিভাবে বললেন আপনি?”
“একজন মানুষ হয়ে অন্য আরেকজন মানুষকে এত কষ্টদায়ক কথা বলতে আমারও খারাপ লাগে।”

ইরার মধ্যে কোনো রকমের প্রতিক্রিয়া কাজ করছে না। চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছে, ব্রেইন টিউমার মানে কি? মরে যাওয়া? মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়া? নাকি সারাজীবন মৃতের মত বিছানায় পরে থাকা?

রোদ ইরা নিয়ে নাহিদের চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল। তারা দুজনে চুপচাপ বসে আছে।
রোদ কিছুক্ষণ পর শুকনো গলায় বলে, “ইরা শোনো, কাল সকালে অন্য আরেক ডাক্তারের কাছে যাবো। দেখো তিনি বলবেন যে এরা উল্টোপাল্টা কথা বলেছে, তোমার কিছুই হয়নি।”
ইরা চুপ করে বসে থাকে।

পরেরদিন রোদ ইরাকে নিয়ে অন্য এক হসপিটালে যায়।
সেখানকার ডক্টর ইরার রিপোর্টগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলেন, “ওনারা ঠিকই বলেছেন। এটা ব্রেইন টিউমারই।”

রোদ অনেক্ষণ চুপ করে থাকে। তার সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে।
নিজেকে সামলে রোদ বলে, “আমরা এখন কি করবো ডক্টর?”
“দেখুন ওনার টিউমারটা একবার অপারেশন করলে আর দ্বিতীয়বার হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। উনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন। কিন্তু ব্রেইনের যে জায়গায় টিউমার রয়েছে সেই জায়গায় অপারেশন করাটা বেশ রিস্কি।”
ইরা কাঁপা গলায় বলে, “যদি অপারেশন না করাই তাহলে কি হবে?”
“তাহলে আপনার অসুস্থতা বেড়ে যাবে। বমি বমি ভাব, মাথা ব্যাথা, চোখে ঝাপসা দেখা এসব মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে যাবে।
আর অপারেশনটা করলেই আপনি পুরোপুরি সুস্থ!”
“আপনি যে রিস্কের কথাটা বললেন, সেটা কি ধরনের রিস্ক?”
“টিউমারটি আপনার ব্রেইনের খুব সেনসেটিভ অঞ্চলে। তাই অপারেশনের সময়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে।”
ইরা হতাশ গলায় বলে, “প্রচুর রক্তক্ষরণ হলে কি আমি মারা যাবো?”
রোদ ইরাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “ইরা! একদম বাজে কথা বলবে না। কিচ্ছু হবে না তোমার। ডক্টর, আমরা অপারেশন করাবো।”
“তাহলে যত দ্রুত পারেন ওনাকে অ্যাডমিট করে ফেলুন। আমরা ৭ দিন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অপারেশনে যাবো।”

পরেরদিন ইরাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়। ওষুধ, সেলাইন, ইনজেকশন এসব নিয়ে ছোটাছুটি করছে।

মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত। মাত্র দুদিন আগে ইরা জানতে পেরেছে তার ব্রেইন টিউমার সম্পর্কে। খবরটা জানার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার মাথায় যন্ত্রণা করছিল না।
কিন্তু জানার পর থেকেই মাথায় একটা সুক্ষ্ম যন্ত্রণা অনুভব করছে।

সকালে ইরার বাবা মা এসেছিলেন। ঘন্টাখানেক কান্নাকাটি করে বাইরে গিয়ে বসেন তারা। পরের শিফটে কান্নাকাটি করেন ফিরোজা।
একটা অসুস্থ মানুষের সামনে কান্নাকাটি করে তাকে আরো অসুস্থ করে দেওয়ার কোনো অর্থ নেই। অসুস্থ মানুষটার চারপাশের সকলের উচিত তাকে সাহস জোগানো, বেঁচে থাকতে অনুপ্রেরণা দেওয়া।

ইরা চোখদুটো বুজে শুয়ে আছে। রোদ তখন কেবিনে ঢুকলো। ইরার পাশে বসে, তার ডান হাতটা ধরে।
ইরা স্বাভাবিক গলায় বলে, “কি রোদ? ভয় লাগছে?”
রোদ কোনো জবাব দেয় না।
ইরা আবার বলতে শুরু করে, “ভয় পেওনা। আমি তোমাকে ছেড়ে এত সহজে যাচ্ছি না! দেখো, আমার কিচ্ছু হবে না।”
রোদ অনেক কষ্টে স্বাভাবিক গলায় বলে, “আমি জানি তুমি কোথায় যাচ্ছ না। তোমার সাথে এখনো অনেক হিসেব-নিকেশ বাকি আমার।”
“কান্না চেপে রেখেছ কেন রোদ? কান্না চেপে রাখলে কিন্তু কষ্ট বেড়ে যায়। যাও, বাইরে গিয়ে মন খুলে কাঁদো। আমার সামনে আবার কেঁদো না। তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমার কষ্ট হবে।”
রোদ বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ চিৎকার করে কাঁদে। ইরা ঠিকই বলেছে, কান্না চেপে রাখলে কষ্টের ভার বেড়ে যায়।

ইরার কেবিনটা খুব সুন্দর করে সাজানো। চারিদিকে ফুলদানিতে গোলাপের গুচ্ছ, ঝুড়িতে ফলমূল। কেবিনে বড় বড় দুটো জানালা আছে। সেই জানালা দিয়ে ভরপুর আলো বাতাস আসে।
ইরা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশটা যেন তাকেই ডাকছে।

রোদ তখন এসে ইরার হাতটা ধরল।
ইরা হতাশ গলায় বলে, “জানো আমার না অনেক শখ শান্তিনিকতনের মত আমিও নিজের একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করবো। নাম দিব, ইরাবতীর ইশকুল। নামটা সুন্দর না?
“অনেক সুন্দর। অবশ্যই তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবে। আগে সুস্থ হয়ে ওঠো! তোমার কথা বলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। আর কথা বলোনা তো।”
“তোমার সাথে কথা বলতে অনেক ইচ্ছে করছে রোদ। আর তো কোনো দিনও বলতে পারবো না।”
“কে বলেছে বলতে পারবে না? অবশ্যই পারবে!”
ইরা রোদের কপালে হাত রেখে বলে, “তোমার তো জ্বর! ওষুধ খেয়েছ?”
“না না আমার কিছু হয় নি। আমি ঠিক আছি।”
“নিজের দিকে একটুও খেয়াল রাখছো না। তাই না?”
“আমি ভালো মতোই নিজের যত্ন নিচ্ছি।”
“তোমাকে দেখে বেশ বুঝতে পারছি, তুমি খাওয়া দাওয়া, ঘুম সব বাদ দিয়ে আমার কাছে পরে আছো!”
“আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না! তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো।”

ইরা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রোদকে দেখতে পাচ্ছে না। হয়তো রোদ আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
ইরা বিড়বিড় করে তার মাকে বলে, “রোদ কোথায় মা?”
“এই তো, বাইরেই আছে।”
“ওকে একটু ডেকে দাও তো।”

ইরার মা বাইরে গিয়ে রোদকে বলে, “বাবা ইরা ডাকছে!”

রোদ চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে ইরার কাছে যায়। ইরার কথা বলার শক্তি নেই। তারপরও কথাগুলো রোদকে বলা দরকার। কাল ইরার অপারেশন করা হবে। এই কথাগুলো হয়তো কখনো রোদকে বলা হবে না।
ইরা লক্ষ করল রোদের চোখভর্তি পানি। মনে হচ্ছে অনেক্ষণ কান্নাকাটি করছে।

ইরা বিড়বিড় করে রোদকে বলে, “রোদ? আমার কাছে বেশি সময় নেই।”
“তুমি এসব আজেবাজে চিন্তা বন্ধ করো তো ইরা।”
“আজেবাজে কথা নয়, সত্যি কথা। একজন মানুষ কিন্তু তার মৃত্যুর আগে বুঝতে পারে যে, সে মারা যাচ্ছে। আমিও পারছি।”

রোদ শক্ত করে ইরার হাত চেপে ধরে।
ইরা বলে, “তোমার অনেক কষ্ট হবে আমি চলে যাওয়ার পর। কিন্তু তাই বলে জীবনে থেমে যেও না কিন্তু।
তুমি কিন্তু অবশ্যই চমৎকার একটা মেয়েকে বিয়ে করবে, তার সঙ্গে সুখে শান্তি জীবন কাটাবে!”
“আহ্ ইরা! থামো তো এবার। তোমার কিচ্ছু হবে না। আমি তোমার সঙ্গেই সুখে শান্তিতে জীবন কাটাবো।”
“রোদ, আমার আয়ু আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো।
একদম ভেঙে পরবে না কিন্তু, নিজের খেয়াল রাখবে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবে, সিগারেট একদম খাবে না! আর দিন অন্তত একবার আমাকে মনে করবে।”

রোদ থমকে যায়। এসব কথার কোনো উত্তর তার জানা নেই। তার কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।

সকাল থেকেই নার্সরা বেশ ছোটাছুটি করছে। কিছুক্ষণ পরেই ইরার অপারেশন।
অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে ইরা শেষ বারের মতো রোদকে দেখে নিল। রোদকে এর আগে এত বিপর্যস্ত কোনো দিন বোধ হয় দেখেনি ইরা।
ইরা রোদকে জড়িয়ে ধরে বলে, “রোদ, তোমাকে একটা কথা কখনো বলা হয়নি। তোমর হাসিটা অনেক সুন্দর। তুমি না কখনো কাঁদবে না। কাঁদলে তোমাকে বিশ্রী দেখায়।”

অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো ইরাকে। রোদের বারবার মনে হচ্ছে এইতো কিছুক্ষণ পর ইরা হাসতে হাসতে বলবে,“কি বোকার মত কথা বলেছিলাম দেখেছো? আমার তো কিছুই হলো না! আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় নিয়ে চলো। ঢেঁড়স দিয়ে রুই মাছের একটা ক্লাসিক ঝোল রাঁধবো!”

কিন্তু তা হলো না।
১২ ঘন্টা পর রোদ ইরার সামনে বসে আছে। কিন্তু ইরার শরীরে নাকি প্রাণ নেই। সে নাকি আর তাকাবে না, আর কথা বলবে না।
প্রকৃতি খুব নিষ্ঠুর, খুব। ইরা তো সারাজীবন শুধু রোদের পাশে থেকে তাকে ভালোবাসতে চেয়েছিল। ইরার সেই একমাত্র ইচ্ছেটাও পূরণ হতে দিলো না প্রকৃতি।

রোদ দুহাতে ইরার ডান হাতটা চেপে ধরেছে।
অস্পষ্ট গলায় বলল, “ইরা তাকাও তো! তোমাকে বাসায় যেতে হবে, ইরাবতীর ইশকুলের কাজ শুরু করতে হবে। ইরা উঠো!
তোমাকে না নিয়ে আমি জাবো না।”

(চলবে)

Protected: হ্যালুসিনেশন

0

This content is password protected. To view it please enter your password below:

অতন্দ্রিলার_রোদ (পর্ব:১ – ভালোবাসা নাকি বিভ্রান্তি?)

0

#অতন্দ্রিলার_রোদ
পর্ব : ১ – (ভালোবাসা নাকি বিভ্রান্তি?)

লেখা : শঙ্খিনী

অতন্দ্রিলার মাথাটা ভ্নভ্ন করছে। তেইশ বছরের জীবনে এতটা বিভ্রান্ত এর আগে একবারই হয়েছিলো।

তখন তার বয়স মাত্র চার। এই বয়সে নানি-দাদি বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনেরা বাচ্চাদেরকে, “বাবা আর মায়ের মধ্যে কে বেশি আদর করে?” বা “বাবা আর মায়ের মধ্যে কাকে বেশি ভালোবাসো?” – এ ধরনের প্রশ্ন করে থাকেন।
কিন্তু অতন্দ্রিলার ক্ষেত্রে বিষয়টা ছিলো একটু ভিন্ন।
এক সন্ধ্যায় অতন্দ্রিলার দাদী তাকে
হতাশ গলায় বললেন, “অত, ঠিক করো কার সাথে থাকবে! মায়ের সাথে না বাবার সাথে?”

কথাগুলো অতন্দ্রিলার মাথার ওপর দিয়ে গেলো।

কিছুই বুঝতে না পেরে সে হতভম্ব গলায় বলল, “আমি তো দুজনের সাথেই থাকি!”
“সেটা তো এতদিন থাকতে। কিন্তু এখন তোমার বাবা-মা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তাই দুজনের মধ্যে থেকে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে তোমাকে।”
“আলদা হয়ে যাওয়া মানে কি?”
“ডিভোর্স! তোমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে।”
“ডিভোর্স মানে কি?”
“ডিভোর্স মানে তোমার বাবা-মা আর একসাথে থাকবে না।”
“একসাথে থাকবে না? কেন?”
“সেটা তোমার জানার বিষয় না! তুমি আগে বলো কার সাথে থাকবে?”

আলাদা হওয়া বা ডিভোর্স, এই ধরনের কঠিন কঠিন শব্দগুলোর অর্থ এখনো অতন্দ্রিলার সাথে পরিষ্কার না। তার ওপর আবার বাবা-মায়ের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নেওয়া, ভয়ংকর ব্যাপার!

এত বড় একটা সিদ্ধান্তের কথা বাচ্চাদেরকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে হয়। দুটো মানুষের মধ্যে মতের অমিল হলে যে, তারা আলাদা হয়ে যেতে পারে, এটা তাদের কল্পনারও বাইরে।

পরে অতন্দ্রিলার মা শায়লা বিষয়টা তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন।
“অত? আমাদের বাসায় বা তোমার ক্লাসে এমন কেউ কি আছে যাকে তুমি সহ্য করতে পারো না? যাকে দেখলেই তোমার রাগ হয়?”
“আছে, সন্ধ্যা আপা।”
“সন্ধ্যা যখন তোমার ঘরে ঢুকে অকারণে তোমাকে ফুটবল দিয়ে মারে তখন তুমি তাকে ঘর থেকে চলে যেতে বলো না?”
“হুঁ বলি তো!”
“তোমার বাবার আর আমার ঘটনাটাও কিছুটা এমন।”
“বাবা কি তোমাকে ফুটবল দিয়ে মারে?”
“না। সে মারে কথা দিয়ে। তুমি যেমন ফুটবলের আঘাত সহ্য করতে পারো না, আমিও তেমনি কথার আঘাত সহ্য করতে পারি না। তাই আমি তোমার বাবার বাসা থেকে চলে যাচ্ছি। তুমি চাইলে আমার সাথেও যেতে পারো আবার চাইলে তোমার বাবার সাথেও থাকতে পারো।”
অতন্দ্রিলা শুকনো গলায় বলল, “তুমি কোথায় যাবে?”
“তোমার নানাবাড়ীতে।”
“শহর তোমার সাথে যাবে?”
“শহর তো এখন অনেক ছোট, তাই আপাতত আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। ও যখন তোমার মত একটু বড় হবে, তখন ওকেও জিজ্ঞেস করবো কার কাছে থাকবে।”
“আর আপা?”
“সন্ধ্যাও আমার সাথে যাবে। এখন তুমি বলো কি করতে চাও! যাবে আমার সাথে?”
“না। আমি এখানেই থাকবো।”
“তোমার কিন্তু অনেক সমস্যা হবে আমাকে ছাড়া। আমি চাই তুমি আমার সাথে চলো।”
“না। আমি তোমার সাথে যাবো না।”
“তুমি ঠিক তোমার বাবার জেদটা পেয়েছো।”

এরপর এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে শায়লা ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে তার দুই ছেলমেয়েকে নিয়ে চলে যায়।
সেদিন অতন্দ্রিলা বুঝতেই পারেনি তার মা ভাইবোনকে নিয়ে কেন চলে গেল। ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তিতে পরেছিল সে।

তবে এবার তার বিভ্রান্তির কারনটা সম্পূর্ণই আলাদা।
সারাজীবন নাটক-সিনেমায় কিংবা গল্পে-উপন্যাসে ‘ভালোবাসা’ শব্দটা অহরহ শুনছে অতন্দ্রিলা। কিন্তু এই শব্দের অর্থটাই এখনো জানা হলো না। এই চার অক্ষরের শব্দটার অর্থ জানার জন্যই ইন্টারনেটে ছোটখাটো গবেষণা চালাচ্ছে। কিন্তু গবেষনা যতই এগুচ্ছে, অতন্দ্রিলার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

দস্তয়েভস্কি বলেছেন, “কেউ ভালোবাসা পেলে এমন কি সুখ ছাড়াও সে বাঁচতে পারে।”
আবার ডেভিড রস বলেছেন, “ভালোবাসা এবং যত্ন দিয়ে মরুভূমিতেও ফুল ফোটানো যায়।”
এদিকে রবীন্দ্রনাথ তো অতন্দ্রিলার মতোই বিভ্রান্ত। তিনি নিজেই প্রশ্ন করেছেন, “সখী ভালোবাসা কারে কয়?”
আবার লা রচেফউকোল্ড বলেছেন, “সত্যিকারের ভালোবাসা হল অনেকটা প্রেতআত্মার মতো। এ নিয়ে সবাই কথা বলে,কিন্তু শুধুমাত্র কয়েকজনই এর দেখা পায়।”
হুমায়ূন আজাদ বলেছেন, “প্রেম হচ্ছে নিরন্তর অনিশ্চয়তা; বিয়ে ও সংসার হচ্ছে চূড়ান্ত নিশ্চিন্তির মধ্যে আহার, নিদ্রা, সঙ্গম, সন্তান, ও শয়তানি।”
সবশেষে অতন্দ্রিলার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, “পৃথিবীতে অনেক ধরনের অত্যাচার আছে। ভালবাসার অত্যাচার হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক অত্যাচার। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলা যায় না, শুধু সহ্য করে নিতে হয়।”

বিখ্যাত ব্যাক্তিদের এসব বিখ্যাত উক্তি পড়ে অতন্দ্রিলা একটা কথাই বুঝতে পরলো যে, ভালোবাসা হলো একটি এবং জটিল এবং বিভ্রান্তিমূলক অনুভূতি।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রাপ্ত অতন্দ্রিলা আশরাফ,
বসে পড়ে প্রতিবেদন লিখতে। এ বছরের শুরুর দিকে বাবা হামিদ সাহেবের সুপারিশে, একটা অনলাইন পত্রিকায় চাকরি পেয়েছে সে।
চাকরি পাওয়ার খবরটা পেয়েই সর্বপ্রথম শায়লাকে টেলিফোন করে জানায় অতন্দ্রিলা।
চাকরির কথা শুনতেই শায়লা হাই তুলতে তুলতে বলেন, “তোর এই চাকরিটা কি ধরনের?”
“খুবই বাজে ধরনের। পেটে ভাতে চাকরি বলতে পারো! এমন সব প্রতিবেদন লিখবো যা হয়তো ওয়েবসাইটের কোণায় পরে থাকবে, কেউ খুলে পড়বে পর্যন্ত না।”
“তাহলে এমন চাকরি তুই করবি কেন?”
“দুটো কারন আছে। প্রথমত, এখানে প্রতিবেদন লিখতে লিখতে আমার লেখার হাত পাকবে। নতুন অভিজ্ঞতা হবে। আর দ্বিতীয়ত, চাকরিটা করতে ঘর থেকে বের হতে হবে না। যেহেতু অনলাইন পত্রিকা, তাই ঘরে বসেই লিখতে পারবো।”
“কি কি বিষয়ে প্রতিবেদন লিখবি?”
“হাবিজাবি বিষয়ে। এই যেমন, ‘জেনে নিন অতিরিক্ত পরিশ্রম করার কুফল’ অথবা ‘জেনে নিন অতিরিক্ত বিশ্রামের কুফল’- এই টাইপের প্রতিবেদন।”
“এসব কুফল সম্পর্কে তুই কি জানিস? তুই কি ডাক্তার?”
“একজন সাংবাদিক যেমন ডাক্তারি বিষয় সম্পর্কে প্রতিবেদন লিখতে পারে, তেমনি মহাকাশ সম্পর্কেও প্রতিবেদন লিখতে পারে।
তোমাকে তো মাত্র একটা ধারনা দিলাম। চেষ্টা করবো সব বিষয়েই লিখতে।”
“তোর জ্ঞানের কথা শুনতে ভালো লাগছে না, রাখলাম।”

প্রথম দিকে অতন্দ্রিলার এই ঘরে বসে সাংবাদিকতাকে সবাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও, পাঠকদের বেশ ভালোই সাড়া পেয়েছে সে। তাই হাবিজাবি ধরনের প্রতিবেদন লিখে যাচ্ছে ছয় মাস ধরে।

আজ সে বিষয়টা নিয়ে প্রতিবেদন লিখছে তার শিরোনাম, ‘ভালোবাসা কারে কয়?’
এই প্রতিবেদনটি সাজানো থাকবে বিখ্যাত ব্যাক্তিদের ভালোবাসা সংক্রান্ত উক্তি দিয়ে।
তবে অতন্দ্রিলা ভাবছে এবারের প্রতিবেদটা একটু ভিন্নরকম ভাবে সাজবে।
বিখ্যাত ব্যাক্তিদের পাশাপাশি এবারের প্রতিবেদনে থাকবে, ভালোবাসা নিয়ে তার আশেপাশের মানুষগুলোর মতামত। এই যেমন তার ৭৫ বছর বয়সী দাদি ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন কিংবা উনিশ বছর আগে যার স্ত্রী ছেড়ে যাওয়ার পর আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি সেই বাবা ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন অথবা স্বামীকে ছেড়ে যাওয়ার পর যে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন সেই মা ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন। রোদ সাহেবের মতামতও নেওয়া যেতে পারে, তবে সেটা পরিস্থিতিতে সাপেক্ষে বিবেচ্য। সঙ্গে অতন্দ্রিলার নিজস্ব মতামতও যোগ করা যেতে পারে।

আর কার কার মতামত নেওয়া যায় তা ভাবতে ভাবতে দরজায় টোকা পরল।
“খোলা আছে!”
বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ঘরে প্রবেশ করে অতন্দ্রিলাদের বাড়ির কাজের মেয়ে জরিনা।
“আফা নিচে আসেন, টেবিলে নাস্তা দিসি।
আইজ আপনের পছন্দের নাস্তা, পরটা দিয়া গরুর গোস্ত।”
“বাবা আর দাদি?”
“বইসা পরছে। আপনের জইন্যে দাঁড়াইবে নাকি? আপনে তো লিখতে লিখতেই দুপুর বাঁধায় ফেলবেন।”
“তুমি বেশি কথা বলো।”
“কি করবো আফা কন? আল্লাহর দুনিয়ার আসছি তো দুই দিনের জন্যে, কথা না কইলে কি করুম?”
“বেশি কথা না বলে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে?”
“এইটা কোনো কথা বললেন আফা? আপনি একটা কথা জিগাইবেন আর আমি বোলুম না এইটা হয়?”
“বলতো ভালোবাসা কি?”
“আফা, আমি মূর্খ মানুষ। পড়াশুনা বেশি দূর করতে পারি নাই! আমি আবার কি বোলুম ?”
“এমন অনেক বিষয়ই আছে যা সম্পর্কে জানতে লেখাপড়া করতে হয় না, চারপাশের পরিবেশ থেকেই জানা যায়। ভালোবাসা মানে তো তুমি নিশ্চই জানো!”
জরিনা খানিকটা সংকোচ নিয়ে বলল, “জানি, তয় আপনার মত সুন্দর কইরা বলতে পারমু না।”
“আমি তো তোমাকে সুন্দর করে বলতে বলিনি। তুমি যা জানো, নিজের মতো করে বলো।”
“আফা এইসব বদ মাইয়া-পোলার করবার। যেগুলি এইসব ভালোবাসাবাসি করে, হেগুলি বদের বদ।”
অতন্দ্রিলা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিকাছে, তুমি নিচে যাও আমি আসছি।”

অতন্দ্রিলা নিচে এসে দেখে জরিনার কথা একেবারেই সত্য নয়। বাবা এবং দাদি তার জন্য নাস্তার টেবিলে অপেক্ষা করছেন। যদিও অপেক্ষা করছেন নিতান্ত অনিচ্ছায়।

অতন্দ্রিলাকে দেখে তার বাবা হারুন সাহেব শান্তির দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বললেন, “গুড মর্নিং রাজকুমারী।”
অতন্দ্রিলা তার পাশে বসতে বসতে বলল “গুড মর্নিং।”
“তা, কেমন দেখলি ছেলেটাকে?”
“কোন ছেলে?”
“ঢং করবি না। পৃথিবীতে আমি সবকিছু সহ্য করতে পারি কিন্তু ঢং সহ্য করতে পারি না।”
“ভুল। তুমি ক্ষুদা সহ্য করতে পারো না, তাই এখন নাস্তা করছো। আবার তুমি শীত সহ্য করতে পারো না, তাই শীতকালে সোয়েটার পরো।”
“তোর সঙ্গে কথা বলাটাই বিপদ। কোনো আলোচনাকে কি হালকা পর্যায়ে রাখতে পারিস না?”
অতন্দ্রিলা বলল, “স্যরি বাবা, ভুল করেছি। আমার জীবনে তো অনেক ছেলেকেই দেখেছি তাই সত্যিই বুঝতে পারছি না তুমি কোন ছেলের কথা বলছো।”
“কার কথা আবার? কালকে যে ছেলেটা তোকে দেখতে এলো, সেই ছেলেটা।”
“ও সে! হুঁ ভালোই তো দেখেছি।”
অতন্দ্রিলার দাদি রওশন আরা অস্পষ্ট গলায় বললেন, “ভালো হলেই ভালো।”
অতন্দ্রিলা বলল, “তবে তার যে এর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিলো, এই বিষয়টা তোমরা আমার কাছ থেকে গোপন না করলেও পারতে।”
হামিদ সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, “তুই জানলি কিভাবে?”
“বাবা লোকটা না আহাম্মক নন। তাই যখন তার সাথে আমাকে আলাদাভাবে কথা বলতে পাঠিয়ে দিলে, তখনি সে তার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা আমাকে জানায়।”
রওশন হতাশ গলায় বললেন, “দেখ মা, তুই তো সবই জানিস আর বুঝিস।”
“হুঁ বুঝি তো। আমি ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে, তাই এর থেকে বেশি আমি ডিজার্ভ করি না।”
“আহ্! এভাবে বলছিস কেন?”
“সত্যিই তো বলছি। তোমরা কি ভাবছো, ওনার যে আগে একটা বিয়ে হয়েছিল এই বিষয়টা ভেবে আমি রাগে দুঃখে মরে যাচ্ছি? না দাদি! আমি ব্যাপারটাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছি। আমার দোষ হলো আমি ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। আর ওনার দোষ হলো উনি আগেও একবার বিয়ে করেছিলেন। দোষে দোষে কাটাকাটি! তাছাড়া লোকটাকে যে আমার পছন্দ হয়নি তাও না। পছন্দ হয়েছে। ওনার বুদ্ধি ভালো, সুন্দর করে কথা বলে আর দেখতে শুনতেও খারাপ না।”

হামিদ সাহেব কিছু বলতে যাবেন, তখনি জরিনা খাবার ঘরে প্রবেশ করে।
“আফা! ছোট ভাইজান ফোন দিসে।”
“শহরকে বলো, আমি নাস্তা করে কলব্যাক করছি।”

শহর, অতন্দ্রিলার আদরের ছোট ভাই। শহরের বয়স যখন ৬ মাস, তখন তার মা তাকে নিয়ে নানাবাড়ীতে চলে যায়। মা, বড় আপাসহ নানাবাড়ির সকলেই যে অত্যন্ত বিরক্তিকর মানুষ, এই ব্যাপারটা শহর একটু বড় হয়েই বুঝতে পারে। তাই তিন বছর বয়স থেকে বাবা, দাদি এবং ছোট আপার সাথে থাকতে শুরু করে সে।
বর্তমানে সে জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র।
হলে থাকাটা নিতান্তই তার শখের বসে নেওয়া সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তটা যে কত বড় ভুল ছিল, তা শহর এখন টের পাচ্ছে।

অতন্দ্রিলা তাড়াহুড়ো নাস্তা শেষ করে, ঘরে গিয়ে শহরকে কলব্যাক করে।
“আপা, তোমাকে নাকি কাল পাত্র দেখতে এসেছিল?”
“হুঁ এসেছিলো তো।”
“এটা আমাকে কেউ আগে জানায়নি কেন?”
“দেখতে আসবে আমাকে, তুই জেনে কি করবি?”
“তোমাকে দেখতে আসবে আর আমি সেখানে উপস্থিত থাকবো না?”
“না থাকবি না। কারন দেখতে আসা মানেই বিয়ে হয়ে যাওয়া না। আর তারা শুধু আমাকে দেখে গেছেন, বিয়ে পর্যন্ত ঠিক হয়নি। বলেছেন জানাবে।”
শহর বলল,“মা জানে?”
“না।”
“তোমার সাথে যার বিয়ে কথা চলছে, তার সম্পর্কে কিছু বলো।”
“কিছুই বলতে পারবো না। আগে সবকিছু ঠিকঠাক হোক, সব জানতে পারবি।”

শহরকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অতন্দ্রিলা ফোনটা রেখে দিলো।

(চলবে)#অতন্দ্রিলার_রোদ
পর্ব : ১ – (ভালোবাসা নাকি বিভ্রান্তি?)

লেখা : শঙ্খিনী

অতন্দ্রিলার মাথাটা ভ্নভ্ন করছে। তেইশ বছরের জীবনে এতটা বিভ্রান্ত এর আগে একবারই হয়েছিলো।

তখন তার বয়স মাত্র চার। এই বয়সে নানি-দাদি বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনেরা বাচ্চাদেরকে, “বাবা আর মায়ের মধ্যে কে বেশি আদর করে?” বা “বাবা আর মায়ের মধ্যে কাকে বেশি ভালোবাসো?” – এ ধরনের প্রশ্ন করে থাকেন।
কিন্তু অতন্দ্রিলার ক্ষেত্রে বিষয়টা ছিলো একটু ভিন্ন।
এক সন্ধ্যায় অতন্দ্রিলার দাদী তাকে
হতাশ গলায় বললেন, “অত, ঠিক করো কার সাথে থাকবে! মায়ের সাথে না বাবার সাথে?”

কথাগুলো অতন্দ্রিলার মাথার ওপর দিয়ে গেলো।

কিছুই বুঝতে না পেরে সে হতভম্ব গলায় বলল, “আমি তো দুজনের সাথেই থাকি!”
“সেটা তো এতদিন থাকতে। কিন্তু এখন তোমার বাবা-মা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তাই দুজনের মধ্যে থেকে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে তোমাকে।”
“আলদা হয়ে যাওয়া মানে কি?”
“ডিভোর্স! তোমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে।”
“ডিভোর্স মানে কি?”
“ডিভোর্স মানে তোমার বাবা-মা আর একসাথে থাকবে না।”
“একসাথে থাকবে না? কেন?”
“সেটা তোমার জানার বিষয় না! তুমি আগে বলো কার সাথে থাকবে?”

আলাদা হওয়া বা ডিভোর্স, এই ধরনের কঠিন কঠিন শব্দগুলোর অর্থ এখনো অতন্দ্রিলার সাথে পরিষ্কার না। তার ওপর আবার বাবা-মায়ের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নেওয়া, ভয়ংকর ব্যাপার!

এত বড় একটা সিদ্ধান্তের কথা বাচ্চাদেরকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে হয়। দুটো মানুষের মধ্যে মতের অমিল হলে যে, তারা আলাদা হয়ে যেতে পারে, এটা তাদের কল্পনারও বাইরে।

পরে অতন্দ্রিলার মা শায়লা বিষয়টা তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন।
“অত? আমাদের বাসায় বা তোমার ক্লাসে এমন কেউ কি আছে যাকে তুমি সহ্য করতে পারো না? যাকে দেখলেই তোমার রাগ হয়?”
“আছে, সন্ধ্যা আপা।”
“সন্ধ্যা যখন তোমার ঘরে ঢুকে অকারণে তোমাকে ফুটবল দিয়ে মারে তখন তুমি তাকে ঘর থেকে চলে যেতে বলো না?”
“হুঁ বলি তো!”
“তোমার বাবার আর আমার ঘটনাটাও কিছুটা এমন।”
“বাবা কি তোমাকে ফুটবল দিয়ে মারে?”
“না। সে মারে কথা দিয়ে। তুমি যেমন ফুটবলের আঘাত সহ্য করতে পারো না, আমিও তেমনি কথার আঘাত সহ্য করতে পারি না। তাই আমি তোমার বাবার বাসা থেকে চলে যাচ্ছি। তুমি চাইলে আমার সাথেও যেতে পারো আবার চাইলে তোমার বাবার সাথেও থাকতে পারো।”
অতন্দ্রিলা শুকনো গলায় বলল, “তুমি কোথায় যাবে?”
“তোমার নানাবাড়ীতে।”
“শহর তোমার সাথে যাবে?”
“শহর তো এখন অনেক ছোট, তাই আপাতত আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। ও যখন তোমার মত একটু বড় হবে, তখন ওকেও জিজ্ঞেস করবো কার কাছে থাকবে।”
“আর আপা?”
“সন্ধ্যাও আমার সাথে যাবে। এখন তুমি বলো কি করতে চাও! যাবে আমার সাথে?”
“না। আমি এখানেই থাকবো।”
“তোমার কিন্তু অনেক সমস্যা হবে আমাকে ছাড়া। আমি চাই তুমি আমার সাথে চলো।”
“না। আমি তোমার সাথে যাবো না।”
“তুমি ঠিক তোমার বাবার জেদটা পেয়েছো।”

এরপর এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে শায়লা ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে তার দুই ছেলমেয়েকে নিয়ে চলে যায়।
সেদিন অতন্দ্রিলা বুঝতেই পারেনি তার মা ভাইবোনকে নিয়ে কেন চলে গেল। ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তিতে পরেছিল সে।

তবে এবার তার বিভ্রান্তির কারনটা সম্পূর্ণই আলাদা।
সারাজীবন নাটক-সিনেমায় কিংবা গল্পে-উপন্যাসে ‘ভালোবাসা’ শব্দটা অহরহ শুনছে অতন্দ্রিলা। কিন্তু এই শব্দের অর্থটাই এখনো জানা হলো না। এই চার অক্ষরের শব্দটার অর্থ জানার জন্যই ইন্টারনেটে ছোটখাটো গবেষণা চালাচ্ছে। কিন্তু গবেষনা যতই এগুচ্ছে, অতন্দ্রিলার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

দস্তয়েভস্কি বলেছেন, “কেউ ভালোবাসা পেলে এমন কি সুখ ছাড়াও সে বাঁচতে পারে।”
আবার ডেভিড রস বলেছেন, “ভালোবাসা এবং যত্ন দিয়ে মরুভূমিতেও ফুল ফোটানো যায়।”
এদিকে রবীন্দ্রনাথ তো অতন্দ্রিলার মতোই বিভ্রান্ত। তিনি নিজেই প্রশ্ন করেছেন, “সখী ভালোবাসা কারে কয়?”
আবার লা রচেফউকোল্ড বলেছেন, “সত্যিকারের ভালোবাসা হল অনেকটা প্রেতআত্মার মতো। এ নিয়ে সবাই কথা বলে,কিন্তু শুধুমাত্র কয়েকজনই এর দেখা পায়।”
হুমায়ূন আজাদ বলেছেন, “প্রেম হচ্ছে নিরন্তর অনিশ্চয়তা; বিয়ে ও সংসার হচ্ছে চূড়ান্ত নিশ্চিন্তির মধ্যে আহার, নিদ্রা, সঙ্গম, সন্তান, ও শয়তানি।”
সবশেষে অতন্দ্রিলার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, “পৃথিবীতে অনেক ধরনের অত্যাচার আছে। ভালবাসার অত্যাচার হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক অত্যাচার। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলা যায় না, শুধু সহ্য করে নিতে হয়।”

বিখ্যাত ব্যাক্তিদের এসব বিখ্যাত উক্তি পড়ে অতন্দ্রিলা একটা কথাই বুঝতে পরলো যে, ভালোবাসা হলো একটি এবং জটিল এবং বিভ্রান্তিমূলক অনুভূতি।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রাপ্ত অতন্দ্রিলা আশরাফ,
বসে পড়ে প্রতিবেদন লিখতে। এ বছরের শুরুর দিকে বাবা হামিদ সাহেবের সুপারিশে, একটা অনলাইন পত্রিকায় চাকরি পেয়েছে সে।
চাকরি পাওয়ার খবরটা পেয়েই সর্বপ্রথম শায়লাকে টেলিফোন করে জানায় অতন্দ্রিলা।
চাকরির কথা শুনতেই শায়লা হাই তুলতে তুলতে বলেন, “তোর এই চাকরিটা কি ধরনের?”
“খুবই বাজে ধরনের। পেটে ভাতে চাকরি বলতে পারো! এমন সব প্রতিবেদন লিখবো যা হয়তো ওয়েবসাইটের কোণায় পরে থাকবে, কেউ খুলে পড়বে পর্যন্ত না।”
“তাহলে এমন চাকরি তুই করবি কেন?”
“দুটো কারন আছে। প্রথমত, এখানে প্রতিবেদন লিখতে লিখতে আমার লেখার হাত পাকবে। নতুন অভিজ্ঞতা হবে। আর দ্বিতীয়ত, চাকরিটা করতে ঘর থেকে বের হতে হবে না। যেহেতু অনলাইন পত্রিকা, তাই ঘরে বসেই লিখতে পারবো।”
“কি কি বিষয়ে প্রতিবেদন লিখবি?”
“হাবিজাবি বিষয়ে। এই যেমন, ‘জেনে নিন অতিরিক্ত পরিশ্রম করার কুফল’ অথবা ‘জেনে নিন অতিরিক্ত বিশ্রামের কুফল’- এই টাইপের প্রতিবেদন।”
“এসব কুফল সম্পর্কে তুই কি জানিস? তুই কি ডাক্তার?”
“একজন সাংবাদিক যেমন ডাক্তারি বিষয় সম্পর্কে প্রতিবেদন লিখতে পারে, তেমনি মহাকাশ সম্পর্কেও প্রতিবেদন লিখতে পারে।
তোমাকে তো মাত্র একটা ধারনা দিলাম। চেষ্টা করবো সব বিষয়েই লিখতে।”
“তোর জ্ঞানের কথা শুনতে ভালো লাগছে না, রাখলাম।”

প্রথম দিকে অতন্দ্রিলার এই ঘরে বসে সাংবাদিকতাকে সবাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও, পাঠকদের বেশ ভালোই সাড়া পেয়েছে সে। তাই হাবিজাবি ধরনের প্রতিবেদন লিখে যাচ্ছে ছয় মাস ধরে।

আজ সে বিষয়টা নিয়ে প্রতিবেদন লিখছে তার শিরোনাম, ‘ভালোবাসা কারে কয়?’
এই প্রতিবেদনটি সাজানো থাকবে বিখ্যাত ব্যাক্তিদের ভালোবাসা সংক্রান্ত উক্তি দিয়ে।
তবে অতন্দ্রিলা ভাবছে এবারের প্রতিবেদটা একটু ভিন্নরকম ভাবে সাজবে।
বিখ্যাত ব্যাক্তিদের পাশাপাশি এবারের প্রতিবেদনে থাকবে, ভালোবাসা নিয়ে তার আশেপাশের মানুষগুলোর মতামত। এই যেমন তার ৭৫ বছর বয়সী দাদি ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন কিংবা উনিশ বছর আগে যার স্ত্রী ছেড়ে যাওয়ার পর আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি সেই বাবা ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন অথবা স্বামীকে ছেড়ে যাওয়ার পর যে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন সেই মা ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন। রোদ সাহেবের মতামতও নেওয়া যেতে পারে, তবে সেটা পরিস্থিতিতে সাপেক্ষে বিবেচ্য। সঙ্গে অতন্দ্রিলার নিজস্ব মতামতও যোগ করা যেতে পারে।

আর কার কার মতামত নেওয়া যায় তা ভাবতে ভাবতে দরজায় টোকা পরল।
“খোলা আছে!”
বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ঘরে প্রবেশ করে অতন্দ্রিলাদের বাড়ির কাজের মেয়ে জরিনা।
“আফা নিচে আসেন, টেবিলে নাস্তা দিসি।
আইজ আপনের পছন্দের নাস্তা, পরটা দিয়া গরুর গোস্ত।”
“বাবা আর দাদি?”
“বইসা পরছে। আপনের জইন্যে দাঁড়াইবে নাকি? আপনে তো লিখতে লিখতেই দুপুর বাঁধায় ফেলবেন।”
“তুমি বেশি কথা বলো।”
“কি করবো আফা কন? আল্লাহর দুনিয়ার আসছি তো দুই দিনের জন্যে, কথা না কইলে কি করুম?”
“বেশি কথা না বলে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে?”
“এইটা কোনো কথা বললেন আফা? আপনি একটা কথা জিগাইবেন আর আমি বোলুম না এইটা হয়?”
“বলতো ভালোবাসা কি?”
“আফা, আমি মূর্খ মানুষ। পড়াশুনা বেশি দূর করতে পারি নাই! আমি আবার কি বোলুম ?”
“এমন অনেক বিষয়ই আছে যা সম্পর্কে জানতে লেখাপড়া করতে হয় না, চারপাশের পরিবেশ থেকেই জানা যায়। ভালোবাসা মানে তো তুমি নিশ্চই জানো!”
জরিনা খানিকটা সংকোচ নিয়ে বলল, “জানি, তয় আপনার মত সুন্দর কইরা বলতে পারমু না।”
“আমি তো তোমাকে সুন্দর করে বলতে বলিনি। তুমি যা জানো, নিজের মতো করে বলো।”
“আফা এইসব বদ মাইয়া-পোলার করবার। যেগুলি এইসব ভালোবাসাবাসি করে, হেগুলি বদের বদ।”
অতন্দ্রিলা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিকাছে, তুমি নিচে যাও আমি আসছি।”

অতন্দ্রিলা নিচে এসে দেখে জরিনার কথা একেবারেই সত্য নয়। বাবা এবং দাদি তার জন্য নাস্তার টেবিলে অপেক্ষা করছেন। যদিও অপেক্ষা করছেন নিতান্ত অনিচ্ছায়।

অতন্দ্রিলাকে দেখে তার বাবা হারুন সাহেব শান্তির দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বললেন, “গুড মর্নিং রাজকুমারী।”
অতন্দ্রিলা তার পাশে বসতে বসতে বলল “গুড মর্নিং।”
“তা, কেমন দেখলি ছেলেটাকে?”
“কোন ছেলে?”
“ঢং করবি না। পৃথিবীতে আমি সবকিছু সহ্য করতে পারি কিন্তু ঢং সহ্য করতে পারি না।”
“ভুল। তুমি ক্ষুদা সহ্য করতে পারো না, তাই এখন নাস্তা করছো। আবার তুমি শীত সহ্য করতে পারো না, তাই শীতকালে সোয়েটার পরো।”
“তোর সঙ্গে কথা বলাটাই বিপদ। কোনো আলোচনাকে কি হালকা পর্যায়ে রাখতে পারিস না?”
অতন্দ্রিলা বলল, “স্যরি বাবা, ভুল করেছি। আমার জীবনে তো অনেক ছেলেকেই দেখেছি তাই সত্যিই বুঝতে পারছি না তুমি কোন ছেলের কথা বলছো।”
“কার কথা আবার? কালকে যে ছেলেটা তোকে দেখতে এলো, সেই ছেলেটা।”
“ও সে! হুঁ ভালোই তো দেখেছি।”
অতন্দ্রিলার দাদি রওশন আরা অস্পষ্ট গলায় বললেন, “ভালো হলেই ভালো।”
অতন্দ্রিলা বলল, “তবে তার যে এর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিলো, এই বিষয়টা তোমরা আমার কাছ থেকে গোপন না করলেও পারতে।”
হামিদ সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, “তুই জানলি কিভাবে?”
“বাবা লোকটা না আহাম্মক নন। তাই যখন তার সাথে আমাকে আলাদাভাবে কথা বলতে পাঠিয়ে দিলে, তখনি সে তার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা আমাকে জানায়।”
রওশন হতাশ গলায় বললেন, “দেখ মা, তুই তো সবই জানিস আর বুঝিস।”
“হুঁ বুঝি তো। আমি ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে, তাই এর থেকে বেশি আমি ডিজার্ভ করি না।”
“আহ্! এভাবে বলছিস কেন?”
“সত্যিই তো বলছি। তোমরা কি ভাবছো, ওনার যে আগে একটা বিয়ে হয়েছিল এই বিষয়টা ভেবে আমি রাগে দুঃখে মরে যাচ্ছি? না দাদি! আমি ব্যাপারটাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছি। আমার দোষ হলো আমি ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। আর ওনার দোষ হলো উনি আগেও একবার বিয়ে করেছিলেন। দোষে দোষে কাটাকাটি! তাছাড়া লোকটাকে যে আমার পছন্দ হয়নি তাও না। পছন্দ হয়েছে। ওনার বুদ্ধি ভালো, সুন্দর করে কথা বলে আর দেখতে শুনতেও খারাপ না।”

হামিদ সাহেব কিছু বলতে যাবেন, তখনি জরিনা খাবার ঘরে প্রবেশ করে।
“আফা! ছোট ভাইজান ফোন দিসে।”
“শহরকে বলো, আমি নাস্তা করে কলব্যাক করছি।”

শহর, অতন্দ্রিলার আদরের ছোট ভাই। শহরের বয়স যখন ৬ মাস, তখন তার মা তাকে নিয়ে নানাবাড়ীতে চলে যায়। মা, বড় আপাসহ নানাবাড়ির সকলেই যে অত্যন্ত বিরক্তিকর মানুষ, এই ব্যাপারটা শহর একটু বড় হয়েই বুঝতে পারে। তাই তিন বছর বয়স থেকে বাবা, দাদি এবং ছোট আপার সাথে থাকতে শুরু করে সে।
বর্তমানে সে জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র।
হলে থাকাটা নিতান্তই তার শখের বসে নেওয়া সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তটা যে কত বড় ভুল ছিল, তা শহর এখন টের পাচ্ছে।

অতন্দ্রিলা তাড়াহুড়ো নাস্তা শেষ করে, ঘরে গিয়ে শহরকে কলব্যাক করে।
“আপা, তোমাকে নাকি কাল পাত্র দেখতে এসেছিল?”
“হুঁ এসেছিলো তো।”
“এটা আমাকে কেউ আগে জানায়নি কেন?”
“দেখতে আসবে আমাকে, তুই জেনে কি করবি?”
“তোমাকে দেখতে আসবে আর আমি সেখানে উপস্থিত থাকবো না?”
“না থাকবি না। কারন দেখতে আসা মানেই বিয়ে হয়ে যাওয়া না। আর তারা শুধু আমাকে দেখে গেছেন, বিয়ে পর্যন্ত ঠিক হয়নি। বলেছেন জানাবে।”
শহর বলল,“মা জানে?”
“না।”
“তোমার সাথে যার বিয়ে কথা চলছে, তার সম্পর্কে কিছু বলো।”
“কিছুই বলতে পারবো না। আগে সবকিছু ঠিকঠাক হোক, সব জানতে পারবি।”

শহরকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অতন্দ্রিলা ফোনটা রেখে দিলো।

(চলবে)#অতন্দ্রিলার_রোদ
পর্ব : ১ – (ভালোবাসা নাকি বিভ্রান্তি?)

লেখা : শঙ্খিনী

অতন্দ্রিলার মাথাটা ভ্নভ্ন করছে। তেইশ বছরের জীবনে এতটা বিভ্রান্ত এর আগে একবারই হয়েছিলো।

তখন তার বয়স মাত্র চার। এই বয়সে নানি-দাদি বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনেরা বাচ্চাদেরকে, “বাবা আর মায়ের মধ্যে কে বেশি আদর করে?” বা “বাবা আর মায়ের মধ্যে কাকে বেশি ভালোবাসো?” – এ ধরনের প্রশ্ন করে থাকেন।
কিন্তু অতন্দ্রিলার ক্ষেত্রে বিষয়টা ছিলো একটু ভিন্ন।
এক সন্ধ্যায় অতন্দ্রিলার দাদী তাকে
হতাশ গলায় বললেন, “অত, ঠিক করো কার সাথে থাকবে! মায়ের সাথে না বাবার সাথে?”

কথাগুলো অতন্দ্রিলার মাথার ওপর দিয়ে গেলো।

কিছুই বুঝতে না পেরে সে হতভম্ব গলায় বলল, “আমি তো দুজনের সাথেই থাকি!”
“সেটা তো এতদিন থাকতে। কিন্তু এখন তোমার বাবা-মা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তাই দুজনের মধ্যে থেকে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে তোমাকে।”
“আলদা হয়ে যাওয়া মানে কি?”
“ডিভোর্স! তোমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে।”
“ডিভোর্স মানে কি?”
“ডিভোর্স মানে তোমার বাবা-মা আর একসাথে থাকবে না।”
“একসাথে থাকবে না? কেন?”
“সেটা তোমার জানার বিষয় না! তুমি আগে বলো কার সাথে থাকবে?”

আলাদা হওয়া বা ডিভোর্স, এই ধরনের কঠিন কঠিন শব্দগুলোর অর্থ এখনো অতন্দ্রিলার সাথে পরিষ্কার না। তার ওপর আবার বাবা-মায়ের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নেওয়া, ভয়ংকর ব্যাপার!

এত বড় একটা সিদ্ধান্তের কথা বাচ্চাদেরকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে হয়। দুটো মানুষের মধ্যে মতের অমিল হলে যে, তারা আলাদা হয়ে যেতে পারে, এটা তাদের কল্পনারও বাইরে।

পরে অতন্দ্রিলার মা শায়লা বিষয়টা তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন।
“অত? আমাদের বাসায় বা তোমার ক্লাসে এমন কেউ কি আছে যাকে তুমি সহ্য করতে পারো না? যাকে দেখলেই তোমার রাগ হয়?”
“আছে, সন্ধ্যা আপা।”
“সন্ধ্যা যখন তোমার ঘরে ঢুকে অকারণে তোমাকে ফুটবল দিয়ে মারে তখন তুমি তাকে ঘর থেকে চলে যেতে বলো না?”
“হুঁ বলি তো!”
“তোমার বাবার আর আমার ঘটনাটাও কিছুটা এমন।”
“বাবা কি তোমাকে ফুটবল দিয়ে মারে?”
“না। সে মারে কথা দিয়ে। তুমি যেমন ফুটবলের আঘাত সহ্য করতে পারো না, আমিও তেমনি কথার আঘাত সহ্য করতে পারি না। তাই আমি তোমার বাবার বাসা থেকে চলে যাচ্ছি। তুমি চাইলে আমার সাথেও যেতে পারো আবার চাইলে তোমার বাবার সাথেও থাকতে পারো।”
অতন্দ্রিলা শুকনো গলায় বলল, “তুমি কোথায় যাবে?”
“তোমার নানাবাড়ীতে।”
“শহর তোমার সাথে যাবে?”
“শহর তো এখন অনেক ছোট, তাই আপাতত আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। ও যখন তোমার মত একটু বড় হবে, তখন ওকেও জিজ্ঞেস করবো কার কাছে থাকবে।”
“আর আপা?”
“সন্ধ্যাও আমার সাথে যাবে। এখন তুমি বলো কি করতে চাও! যাবে আমার সাথে?”
“না। আমি এখানেই থাকবো।”
“তোমার কিন্তু অনেক সমস্যা হবে আমাকে ছাড়া। আমি চাই তুমি আমার সাথে চলো।”
“না। আমি তোমার সাথে যাবো না।”
“তুমি ঠিক তোমার বাবার জেদটা পেয়েছো।”

এরপর এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে শায়লা ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে তার দুই ছেলমেয়েকে নিয়ে চলে যায়।
সেদিন অতন্দ্রিলা বুঝতেই পারেনি তার মা ভাইবোনকে নিয়ে কেন চলে গেল। ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তিতে পরেছিল সে।

তবে এবার তার বিভ্রান্তির কারনটা সম্পূর্ণই আলাদা।
সারাজীবন নাটক-সিনেমায় কিংবা গল্পে-উপন্যাসে ‘ভালোবাসা’ শব্দটা অহরহ শুনছে অতন্দ্রিলা। কিন্তু এই শব্দের অর্থটাই এখনো জানা হলো না। এই চার অক্ষরের শব্দটার অর্থ জানার জন্যই ইন্টারনেটে ছোটখাটো গবেষণা চালাচ্ছে। কিন্তু গবেষনা যতই এগুচ্ছে, অতন্দ্রিলার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

দস্তয়েভস্কি বলেছেন, “কেউ ভালোবাসা পেলে এমন কি সুখ ছাড়াও সে বাঁচতে পারে।”
আবার ডেভিড রস বলেছেন, “ভালোবাসা এবং যত্ন দিয়ে মরুভূমিতেও ফুল ফোটানো যায়।”
এদিকে রবীন্দ্রনাথ তো অতন্দ্রিলার মতোই বিভ্রান্ত। তিনি নিজেই প্রশ্ন করেছেন, “সখী ভালোবাসা কারে কয়?”
আবার লা রচেফউকোল্ড বলেছেন, “সত্যিকারের ভালোবাসা হল অনেকটা প্রেতআত্মার মতো। এ নিয়ে সবাই কথা বলে,কিন্তু শুধুমাত্র কয়েকজনই এর দেখা পায়।”
হুমায়ূন আজাদ বলেছেন, “প্রেম হচ্ছে নিরন্তর অনিশ্চয়তা; বিয়ে ও সংসার হচ্ছে চূড়ান্ত নিশ্চিন্তির মধ্যে আহার, নিদ্রা, সঙ্গম, সন্তান, ও শয়তানি।”
সবশেষে অতন্দ্রিলার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, “পৃথিবীতে অনেক ধরনের অত্যাচার আছে। ভালবাসার অত্যাচার হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক অত্যাচার। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলা যায় না, শুধু সহ্য করে নিতে হয়।”

বিখ্যাত ব্যাক্তিদের এসব বিখ্যাত উক্তি পড়ে অতন্দ্রিলা একটা কথাই বুঝতে পরলো যে, ভালোবাসা হলো একটি এবং জটিল এবং বিভ্রান্তিমূলক অনুভূতি।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রাপ্ত অতন্দ্রিলা আশরাফ,
বসে পড়ে প্রতিবেদন লিখতে। এ বছরের শুরুর দিকে বাবা হামিদ সাহেবের সুপারিশে, একটা অনলাইন পত্রিকায় চাকরি পেয়েছে সে।
চাকরি পাওয়ার খবরটা পেয়েই সর্বপ্রথম শায়লাকে টেলিফোন করে জানায় অতন্দ্রিলা।
চাকরির কথা শুনতেই শায়লা হাই তুলতে তুলতে বলেন, “তোর এই চাকরিটা কি ধরনের?”
“খুবই বাজে ধরনের। পেটে ভাতে চাকরি বলতে পারো! এমন সব প্রতিবেদন লিখবো যা হয়তো ওয়েবসাইটের কোণায় পরে থাকবে, কেউ খুলে পড়বে পর্যন্ত না।”
“তাহলে এমন চাকরি তুই করবি কেন?”
“দুটো কারন আছে। প্রথমত, এখানে প্রতিবেদন লিখতে লিখতে আমার লেখার হাত পাকবে। নতুন অভিজ্ঞতা হবে। আর দ্বিতীয়ত, চাকরিটা করতে ঘর থেকে বের হতে হবে না। যেহেতু অনলাইন পত্রিকা, তাই ঘরে বসেই লিখতে পারবো।”
“কি কি বিষয়ে প্রতিবেদন লিখবি?”
“হাবিজাবি বিষয়ে। এই যেমন, ‘জেনে নিন অতিরিক্ত পরিশ্রম করার কুফল’ অথবা ‘জেনে নিন অতিরিক্ত বিশ্রামের কুফল’- এই টাইপের প্রতিবেদন।”
“এসব কুফল সম্পর্কে তুই কি জানিস? তুই কি ডাক্তার?”
“একজন সাংবাদিক যেমন ডাক্তারি বিষয় সম্পর্কে প্রতিবেদন লিখতে পারে, তেমনি মহাকাশ সম্পর্কেও প্রতিবেদন লিখতে পারে।
তোমাকে তো মাত্র একটা ধারনা দিলাম। চেষ্টা করবো সব বিষয়েই লিখতে।”
“তোর জ্ঞানের কথা শুনতে ভালো লাগছে না, রাখলাম।”

প্রথম দিকে অতন্দ্রিলার এই ঘরে বসে সাংবাদিকতাকে সবাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও, পাঠকদের বেশ ভালোই সাড়া পেয়েছে সে। তাই হাবিজাবি ধরনের প্রতিবেদন লিখে যাচ্ছে ছয় মাস ধরে।

আজ সে বিষয়টা নিয়ে প্রতিবেদন লিখছে তার শিরোনাম, ‘ভালোবাসা কারে কয়?’
এই প্রতিবেদনটি সাজানো থাকবে বিখ্যাত ব্যাক্তিদের ভালোবাসা সংক্রান্ত উক্তি দিয়ে।
তবে অতন্দ্রিলা ভাবছে এবারের প্রতিবেদটা একটু ভিন্নরকম ভাবে সাজবে।
বিখ্যাত ব্যাক্তিদের পাশাপাশি এবারের প্রতিবেদনে থাকবে, ভালোবাসা নিয়ে তার আশেপাশের মানুষগুলোর মতামত। এই যেমন তার ৭৫ বছর বয়সী দাদি ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন কিংবা উনিশ বছর আগে যার স্ত্রী ছেড়ে যাওয়ার পর আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি সেই বাবা ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন অথবা স্বামীকে ছেড়ে যাওয়ার পর যে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন সেই মা ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন। রোদ সাহেবের মতামতও নেওয়া যেতে পারে, তবে সেটা পরিস্থিতিতে সাপেক্ষে বিবেচ্য। সঙ্গে অতন্দ্রিলার নিজস্ব মতামতও যোগ করা যেতে পারে।

আর কার কার মতামত নেওয়া যায় তা ভাবতে ভাবতে দরজায় টোকা পরল।
“খোলা আছে!”
বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ঘরে প্রবেশ করে অতন্দ্রিলাদের বাড়ির কাজের মেয়ে জরিনা।
“আফা নিচে আসেন, টেবিলে নাস্তা দিসি।
আইজ আপনের পছন্দের নাস্তা, পরটা দিয়া গরুর গোস্ত।”
“বাবা আর দাদি?”
“বইসা পরছে। আপনের জইন্যে দাঁড়াইবে নাকি? আপনে তো লিখতে লিখতেই দুপুর বাঁধায় ফেলবেন।”
“তুমি বেশি কথা বলো।”
“কি করবো আফা কন? আল্লাহর দুনিয়ার আসছি তো দুই দিনের জন্যে, কথা না কইলে কি করুম?”
“বেশি কথা না বলে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে?”
“এইটা কোনো কথা বললেন আফা? আপনি একটা কথা জিগাইবেন আর আমি বোলুম না এইটা হয়?”
“বলতো ভালোবাসা কি?”
“আফা, আমি মূর্খ মানুষ। পড়াশুনা বেশি দূর করতে পারি নাই! আমি আবার কি বোলুম ?”
“এমন অনেক বিষয়ই আছে যা সম্পর্কে জানতে লেখাপড়া করতে হয় না, চারপাশের পরিবেশ থেকেই জানা যায়। ভালোবাসা মানে তো তুমি নিশ্চই জানো!”
জরিনা খানিকটা সংকোচ নিয়ে বলল, “জানি, তয় আপনার মত সুন্দর কইরা বলতে পারমু না।”
“আমি তো তোমাকে সুন্দর করে বলতে বলিনি। তুমি যা জানো, নিজের মতো করে বলো।”
“আফা এইসব বদ মাইয়া-পোলার করবার। যেগুলি এইসব ভালোবাসাবাসি করে, হেগুলি বদের বদ।”
অতন্দ্রিলা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিকাছে, তুমি নিচে যাও আমি আসছি।”

অতন্দ্রিলা নিচে এসে দেখে জরিনার কথা একেবারেই সত্য নয়। বাবা এবং দাদি তার জন্য নাস্তার টেবিলে অপেক্ষা করছেন। যদিও অপেক্ষা করছেন নিতান্ত অনিচ্ছায়।

অতন্দ্রিলাকে দেখে তার বাবা হারুন সাহেব শান্তির দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বললেন, “গুড মর্নিং রাজকুমারী।”
অতন্দ্রিলা তার পাশে বসতে বসতে বলল “গুড মর্নিং।”
“তা, কেমন দেখলি ছেলেটাকে?”
“কোন ছেলে?”
“ঢং করবি না। পৃথিবীতে আমি সবকিছু সহ্য করতে পারি কিন্তু ঢং সহ্য করতে পারি না।”
“ভুল। তুমি ক্ষুদা সহ্য করতে পারো না, তাই এখন নাস্তা করছো। আবার তুমি শীত সহ্য করতে পারো না, তাই শীতকালে সোয়েটার পরো।”
“তোর সঙ্গে কথা বলাটাই বিপদ। কোনো আলোচনাকে কি হালকা পর্যায়ে রাখতে পারিস না?”
অতন্দ্রিলা বলল, “স্যরি বাবা, ভুল করেছি। আমার জীবনে তো অনেক ছেলেকেই দেখেছি তাই সত্যিই বুঝতে পারছি না তুমি কোন ছেলের কথা বলছো।”
“কার কথা আবার? কালকে যে ছেলেটা তোকে দেখতে এলো, সেই ছেলেটা।”
“ও সে! হুঁ ভালোই তো দেখেছি।”
অতন্দ্রিলার দাদি রওশন আরা অস্পষ্ট গলায় বললেন, “ভালো হলেই ভালো।”
অতন্দ্রিলা বলল, “তবে তার যে এর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিলো, এই বিষয়টা তোমরা আমার কাছ থেকে গোপন না করলেও পারতে।”
হামিদ সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, “তুই জানলি কিভাবে?”
“বাবা লোকটা না আহাম্মক নন। তাই যখন তার সাথে আমাকে আলাদাভাবে কথা বলতে পাঠিয়ে দিলে, তখনি সে তার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা আমাকে জানায়।”
রওশন হতাশ গলায় বললেন, “দেখ মা, তুই তো সবই জানিস আর বুঝিস।”
“হুঁ বুঝি তো। আমি ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে, তাই এর থেকে বেশি আমি ডিজার্ভ করি না।”
“আহ্! এভাবে বলছিস কেন?”
“সত্যিই তো বলছি। তোমরা কি ভাবছো, ওনার যে আগে একটা বিয়ে হয়েছিল এই বিষয়টা ভেবে আমি রাগে দুঃখে মরে যাচ্ছি? না দাদি! আমি ব্যাপারটাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছি। আমার দোষ হলো আমি ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। আর ওনার দোষ হলো উনি আগেও একবার বিয়ে করেছিলেন। দোষে দোষে কাটাকাটি! তাছাড়া লোকটাকে যে আমার পছন্দ হয়নি তাও না। পছন্দ হয়েছে। ওনার বুদ্ধি ভালো, সুন্দর করে কথা বলে আর দেখতে শুনতেও খারাপ না।”

হামিদ সাহেব কিছু বলতে যাবেন, তখনি জরিনা খাবার ঘরে প্রবেশ করে।
“আফা! ছোট ভাইজান ফোন দিসে।”
“শহরকে বলো, আমি নাস্তা করে কলব্যাক করছি।”

শহর, অতন্দ্রিলার আদরের ছোট ভাই। শহরের বয়স যখন ৬ মাস, তখন তার মা তাকে নিয়ে নানাবাড়ীতে চলে যায়। মা, বড় আপাসহ নানাবাড়ির সকলেই যে অত্যন্ত বিরক্তিকর মানুষ, এই ব্যাপারটা শহর একটু বড় হয়েই বুঝতে পারে। তাই তিন বছর বয়স থেকে বাবা, দাদি এবং ছোট আপার সাথে থাকতে শুরু করে সে।
বর্তমানে সে জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র।
হলে থাকাটা নিতান্তই তার শখের বসে নেওয়া সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তটা যে কত বড় ভুল ছিল, তা শহর এখন টের পাচ্ছে।

অতন্দ্রিলা তাড়াহুড়ো নাস্তা শেষ করে, ঘরে গিয়ে শহরকে কলব্যাক করে।
“আপা, তোমাকে নাকি কাল পাত্র দেখতে এসেছিল?”
“হুঁ এসেছিলো তো।”
“এটা আমাকে কেউ আগে জানায়নি কেন?”
“দেখতে আসবে আমাকে, তুই জেনে কি করবি?”
“তোমাকে দেখতে আসবে আর আমি সেখানে উপস্থিত থাকবো না?”
“না থাকবি না। কারন দেখতে আসা মানেই বিয়ে হয়ে যাওয়া না। আর তারা শুধু আমাকে দেখে গেছেন, বিয়ে পর্যন্ত ঠিক হয়নি। বলেছেন জানাবে।”
শহর বলল,“মা জানে?”
“না।”
“তোমার সাথে যার বিয়ে কথা চলছে, তার সম্পর্কে কিছু বলো।”
“কিছুই বলতে পারবো না। আগে সবকিছু ঠিকঠাক হোক, সব জানতে পারবি।”

শহরকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অতন্দ্রিলা ফোনটা রেখে দিলো।

(চলবে)#অতন্দ্রিলার_রোদ
পর্ব : ১ – (ভালোবাসা নাকি বিভ্রান্তি?)

লেখা : শঙ্খিনী

অতন্দ্রিলার মাথাটা ভ্নভ্ন করছে। তেইশ বছরের জীবনে এতটা বিভ্রান্ত এর আগে একবারই হয়েছিলো।

তখন তার বয়স মাত্র চার। এই বয়সে নানি-দাদি বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনেরা বাচ্চাদেরকে, “বাবা আর মায়ের মধ্যে কে বেশি আদর করে?” বা “বাবা আর মায়ের মধ্যে কাকে বেশি ভালোবাসো?” – এ ধরনের প্রশ্ন করে থাকেন।
কিন্তু অতন্দ্রিলার ক্ষেত্রে বিষয়টা ছিলো একটু ভিন্ন।
এক সন্ধ্যায় অতন্দ্রিলার দাদী তাকে
হতাশ গলায় বললেন, “অত, ঠিক করো কার সাথে থাকবে! মায়ের সাথে না বাবার সাথে?”

কথাগুলো অতন্দ্রিলার মাথার ওপর দিয়ে গেলো।

কিছুই বুঝতে না পেরে সে হতভম্ব গলায় বলল, “আমি তো দুজনের সাথেই থাকি!”
“সেটা তো এতদিন থাকতে। কিন্তু এখন তোমার বাবা-মা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তাই দুজনের মধ্যে থেকে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে তোমাকে।”
“আলদা হয়ে যাওয়া মানে কি?”
“ডিভোর্স! তোমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে।”
“ডিভোর্স মানে কি?”
“ডিভোর্স মানে তোমার বাবা-মা আর একসাথে থাকবে না।”
“একসাথে থাকবে না? কেন?”
“সেটা তোমার জানার বিষয় না! তুমি আগে বলো কার সাথে থাকবে?”

আলাদা হওয়া বা ডিভোর্স, এই ধরনের কঠিন কঠিন শব্দগুলোর অর্থ এখনো অতন্দ্রিলার সাথে পরিষ্কার না। তার ওপর আবার বাবা-মায়ের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নেওয়া, ভয়ংকর ব্যাপার!

এত বড় একটা সিদ্ধান্তের কথা বাচ্চাদেরকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে হয়। দুটো মানুষের মধ্যে মতের অমিল হলে যে, তারা আলাদা হয়ে যেতে পারে, এটা তাদের কল্পনারও বাইরে।

পরে অতন্দ্রিলার মা শায়লা বিষয়টা তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন।
“অত? আমাদের বাসায় বা তোমার ক্লাসে এমন কেউ কি আছে যাকে তুমি সহ্য করতে পারো না? যাকে দেখলেই তোমার রাগ হয়?”
“আছে, সন্ধ্যা আপা।”
“সন্ধ্যা যখন তোমার ঘরে ঢুকে অকারণে তোমাকে ফুটবল দিয়ে মারে তখন তুমি তাকে ঘর থেকে চলে যেতে বলো না?”
“হুঁ বলি তো!”
“তোমার বাবার আর আমার ঘটনাটাও কিছুটা এমন।”
“বাবা কি তোমাকে ফুটবল দিয়ে মারে?”
“না। সে মারে কথা দিয়ে। তুমি যেমন ফুটবলের আঘাত সহ্য করতে পারো না, আমিও তেমনি কথার আঘাত সহ্য করতে পারি না। তাই আমি তোমার বাবার বাসা থেকে চলে যাচ্ছি। তুমি চাইলে আমার সাথেও যেতে পারো আবার চাইলে তোমার বাবার সাথেও থাকতে পারো।”
অতন্দ্রিলা শুকনো গলায় বলল, “তুমি কোথায় যাবে?”
“তোমার নানাবাড়ীতে।”
“শহর তোমার সাথে যাবে?”
“শহর তো এখন অনেক ছোট, তাই আপাতত আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। ও যখন তোমার মত একটু বড় হবে, তখন ওকেও জিজ্ঞেস করবো কার কাছে থাকবে।”
“আর আপা?”
“সন্ধ্যাও আমার সাথে যাবে। এখন তুমি বলো কি করতে চাও! যাবে আমার সাথে?”
“না। আমি এখানেই থাকবো।”
“তোমার কিন্তু অনেক সমস্যা হবে আমাকে ছাড়া। আমি চাই তুমি আমার সাথে চলো।”
“না। আমি তোমার সাথে যাবো না।”
“তুমি ঠিক তোমার বাবার জেদটা পেয়েছো।”

এরপর এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে শায়লা ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে তার দুই ছেলমেয়েকে নিয়ে চলে যায়।
সেদিন অতন্দ্রিলা বুঝতেই পারেনি তার মা ভাইবোনকে নিয়ে কেন চলে গেল। ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তিতে পরেছিল সে।

তবে এবার তার বিভ্রান্তির কারনটা সম্পূর্ণই আলাদা।
সারাজীবন নাটক-সিনেমায় কিংবা গল্পে-উপন্যাসে ‘ভালোবাসা’ শব্দটা অহরহ শুনছে অতন্দ্রিলা। কিন্তু এই শব্দের অর্থটাই এখনো জানা হলো না। এই চার অক্ষরের শব্দটার অর্থ জানার জন্যই ইন্টারনেটে ছোটখাটো গবেষণা চালাচ্ছে। কিন্তু গবেষনা যতই এগুচ্ছে, অতন্দ্রিলার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

দস্তয়েভস্কি বলেছেন, “কেউ ভালোবাসা পেলে এমন কি সুখ ছাড়াও সে বাঁচতে পারে।”
আবার ডেভিড রস বলেছেন, “ভালোবাসা এবং যত্ন দিয়ে মরুভূমিতেও ফুল ফোটানো যায়।”
এদিকে রবীন্দ্রনাথ তো অতন্দ্রিলার মতোই বিভ্রান্ত। তিনি নিজেই প্রশ্ন করেছেন, “সখী ভালোবাসা কারে কয়?”
আবার লা রচেফউকোল্ড বলেছেন, “সত্যিকারের ভালোবাসা হল অনেকটা প্রেতআত্মার মতো। এ নিয়ে সবাই কথা বলে,কিন্তু শুধুমাত্র কয়েকজনই এর দেখা পায়।”
হুমায়ূন আজাদ বলেছেন, “প্রেম হচ্ছে নিরন্তর অনিশ্চয়তা; বিয়ে ও সংসার হচ্ছে চূড়ান্ত নিশ্চিন্তির মধ্যে আহার, নিদ্রা, সঙ্গম, সন্তান, ও শয়তানি।”
সবশেষে অতন্দ্রিলার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, “পৃথিবীতে অনেক ধরনের অত্যাচার আছে। ভালবাসার অত্যাচার হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক অত্যাচার। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলা যায় না, শুধু সহ্য করে নিতে হয়।”

বিখ্যাত ব্যাক্তিদের এসব বিখ্যাত উক্তি পড়ে অতন্দ্রিলা একটা কথাই বুঝতে পরলো যে, ভালোবাসা হলো একটি এবং জটিল এবং বিভ্রান্তিমূলক অনুভূতি।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রাপ্ত অতন্দ্রিলা আশরাফ,
বসে পড়ে প্রতিবেদন লিখতে। এ বছরের শুরুর দিকে বাবা হামিদ সাহেবের সুপারিশে, একটা অনলাইন পত্রিকায় চাকরি পেয়েছে সে।
চাকরি পাওয়ার খবরটা পেয়েই সর্বপ্রথম শায়লাকে টেলিফোন করে জানায় অতন্দ্রিলা।
চাকরির কথা শুনতেই শায়লা হাই তুলতে তুলতে বলেন, “তোর এই চাকরিটা কি ধরনের?”
“খুবই বাজে ধরনের। পেটে ভাতে চাকরি বলতে পারো! এমন সব প্রতিবেদন লিখবো যা হয়তো ওয়েবসাইটের কোণায় পরে থাকবে, কেউ খুলে পড়বে পর্যন্ত না।”
“তাহলে এমন চাকরি তুই করবি কেন?”
“দুটো কারন আছে। প্রথমত, এখানে প্রতিবেদন লিখতে লিখতে আমার লেখার হাত পাকবে। নতুন অভিজ্ঞতা হবে। আর দ্বিতীয়ত, চাকরিটা করতে ঘর থেকে বের হতে হবে না। যেহেতু অনলাইন পত্রিকা, তাই ঘরে বসেই লিখতে পারবো।”
“কি কি বিষয়ে প্রতিবেদন লিখবি?”
“হাবিজাবি বিষয়ে। এই যেমন, ‘জেনে নিন অতিরিক্ত পরিশ্রম করার কুফল’ অথবা ‘জেনে নিন অতিরিক্ত বিশ্রামের কুফল’- এই টাইপের প্রতিবেদন।”
“এসব কুফল সম্পর্কে তুই কি জানিস? তুই কি ডাক্তার?”
“একজন সাংবাদিক যেমন ডাক্তারি বিষয় সম্পর্কে প্রতিবেদন লিখতে পারে, তেমনি মহাকাশ সম্পর্কেও প্রতিবেদন লিখতে পারে।
তোমাকে তো মাত্র একটা ধারনা দিলাম। চেষ্টা করবো সব বিষয়েই লিখতে।”
“তোর জ্ঞানের কথা শুনতে ভালো লাগছে না, রাখলাম।”

প্রথম দিকে অতন্দ্রিলার এই ঘরে বসে সাংবাদিকতাকে সবাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও, পাঠকদের বেশ ভালোই সাড়া পেয়েছে সে। তাই হাবিজাবি ধরনের প্রতিবেদন লিখে যাচ্ছে ছয় মাস ধরে।

আজ সে বিষয়টা নিয়ে প্রতিবেদন লিখছে তার শিরোনাম, ‘ভালোবাসা কারে কয়?’
এই প্রতিবেদনটি সাজানো থাকবে বিখ্যাত ব্যাক্তিদের ভালোবাসা সংক্রান্ত উক্তি দিয়ে।
তবে অতন্দ্রিলা ভাবছে এবারের প্রতিবেদটা একটু ভিন্নরকম ভাবে সাজবে।
বিখ্যাত ব্যাক্তিদের পাশাপাশি এবারের প্রতিবেদনে থাকবে, ভালোবাসা নিয়ে তার আশেপাশের মানুষগুলোর মতামত। এই যেমন তার ৭৫ বছর বয়সী দাদি ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন কিংবা উনিশ বছর আগে যার স্ত্রী ছেড়ে যাওয়ার পর আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি সেই বাবা ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন অথবা স্বামীকে ছেড়ে যাওয়ার পর যে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন সেই মা ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন। রোদ সাহেবের মতামতও নেওয়া যেতে পারে, তবে সেটা পরিস্থিতিতে সাপেক্ষে বিবেচ্য। সঙ্গে অতন্দ্রিলার নিজস্ব মতামতও যোগ করা যেতে পারে।

আর কার কার মতামত নেওয়া যায় তা ভাবতে ভাবতে দরজায় টোকা পরল।
“খোলা আছে!”
বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ঘরে প্রবেশ করে অতন্দ্রিলাদের বাড়ির কাজের মেয়ে জরিনা।
“আফা নিচে আসেন, টেবিলে নাস্তা দিসি।
আইজ আপনের পছন্দের নাস্তা, পরটা দিয়া গরুর গোস্ত।”
“বাবা আর দাদি?”
“বইসা পরছে। আপনের জইন্যে দাঁড়াইবে নাকি? আপনে তো লিখতে লিখতেই দুপুর বাঁধায় ফেলবেন।”
“তুমি বেশি কথা বলো।”
“কি করবো আফা কন? আল্লাহর দুনিয়ার আসছি তো দুই দিনের জন্যে, কথা না কইলে কি করুম?”
“বেশি কথা না বলে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে?”
“এইটা কোনো কথা বললেন আফা? আপনি একটা কথা জিগাইবেন আর আমি বোলুম না এইটা হয়?”
“বলতো ভালোবাসা কি?”
“আফা, আমি মূর্খ মানুষ। পড়াশুনা বেশি দূর করতে পারি নাই! আমি আবার কি বোলুম ?”
“এমন অনেক বিষয়ই আছে যা সম্পর্কে জানতে লেখাপড়া করতে হয় না, চারপাশের পরিবেশ থেকেই জানা যায়। ভালোবাসা মানে তো তুমি নিশ্চই জানো!”
জরিনা খানিকটা সংকোচ নিয়ে বলল, “জানি, তয় আপনার মত সুন্দর কইরা বলতে পারমু না।”
“আমি তো তোমাকে সুন্দর করে বলতে বলিনি। তুমি যা জানো, নিজের মতো করে বলো।”
“আফা এইসব বদ মাইয়া-পোলার করবার। যেগুলি এইসব ভালোবাসাবাসি করে, হেগুলি বদের বদ।”
অতন্দ্রিলা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিকাছে, তুমি নিচে যাও আমি আসছি।”

অতন্দ্রিলা নিচে এসে দেখে জরিনার কথা একেবারেই সত্য নয়। বাবা এবং দাদি তার জন্য নাস্তার টেবিলে অপেক্ষা করছেন। যদিও অপেক্ষা করছেন নিতান্ত অনিচ্ছায়।

অতন্দ্রিলাকে দেখে তার বাবা হারুন সাহেব শান্তির দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বললেন, “গুড মর্নিং রাজকুমারী।”
অতন্দ্রিলা তার পাশে বসতে বসতে বলল “গুড মর্নিং।”
“তা, কেমন দেখলি ছেলেটাকে?”
“কোন ছেলে?”
“ঢং করবি না। পৃথিবীতে আমি সবকিছু সহ্য করতে পারি কিন্তু ঢং সহ্য করতে পারি না।”
“ভুল। তুমি ক্ষুদা সহ্য করতে পারো না, তাই এখন নাস্তা করছো। আবার তুমি শীত সহ্য করতে পারো না, তাই শীতকালে সোয়েটার পরো।”
“তোর সঙ্গে কথা বলাটাই বিপদ। কোনো আলোচনাকে কি হালকা পর্যায়ে রাখতে পারিস না?”
অতন্দ্রিলা বলল, “স্যরি বাবা, ভুল করেছি। আমার জীবনে তো অনেক ছেলেকেই দেখেছি তাই সত্যিই বুঝতে পারছি না তুমি কোন ছেলের কথা বলছো।”
“কার কথা আবার? কালকে যে ছেলেটা তোকে দেখতে এলো, সেই ছেলেটা।”
“ও সে! হুঁ ভালোই তো দেখেছি।”
অতন্দ্রিলার দাদি রওশন আরা অস্পষ্ট গলায় বললেন, “ভালো হলেই ভালো।”
অতন্দ্রিলা বলল, “তবে তার যে এর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিলো, এই বিষয়টা তোমরা আমার কাছ থেকে গোপন না করলেও পারতে।”
হামিদ সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, “তুই জানলি কিভাবে?”
“বাবা লোকটা না আহাম্মক নন। তাই যখন তার সাথে আমাকে আলাদাভাবে কথা বলতে পাঠিয়ে দিলে, তখনি সে তার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা আমাকে জানায়।”
রওশন হতাশ গলায় বললেন, “দেখ মা, তুই তো সবই জানিস আর বুঝিস।”
“হুঁ বুঝি তো। আমি ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে, তাই এর থেকে বেশি আমি ডিজার্ভ করি না।”
“আহ্! এভাবে বলছিস কেন?”
“সত্যিই তো বলছি। তোমরা কি ভাবছো, ওনার যে আগে একটা বিয়ে হয়েছিল এই বিষয়টা ভেবে আমি রাগে দুঃখে মরে যাচ্ছি? না দাদি! আমি ব্যাপারটাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছি। আমার দোষ হলো আমি ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। আর ওনার দোষ হলো উনি আগেও একবার বিয়ে করেছিলেন। দোষে দোষে কাটাকাটি! তাছাড়া লোকটাকে যে আমার পছন্দ হয়নি তাও না। পছন্দ হয়েছে। ওনার বুদ্ধি ভালো, সুন্দর করে কথা বলে আর দেখতে শুনতেও খারাপ না।”

হামিদ সাহেব কিছু বলতে যাবেন, তখনি জরিনা খাবার ঘরে প্রবেশ করে।
“আফা! ছোট ভাইজান ফোন দিসে।”
“শহরকে বলো, আমি নাস্তা করে কলব্যাক করছি।”

শহর, অতন্দ্রিলার আদরের ছোট ভাই। শহরের বয়স যখন ৬ মাস, তখন তার মা তাকে নিয়ে নানাবাড়ীতে চলে যায়। মা, বড় আপাসহ নানাবাড়ির সকলেই যে অত্যন্ত বিরক্তিকর মানুষ, এই ব্যাপারটা শহর একটু বড় হয়েই বুঝতে পারে। তাই তিন বছর বয়স থেকে বাবা, দাদি এবং ছোট আপার সাথে থাকতে শুরু করে সে।
বর্তমানে সে জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র।
হলে থাকাটা নিতান্তই তার শখের বসে নেওয়া সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তটা যে কত বড় ভুল ছিল, তা শহর এখন টের পাচ্ছে।

অতন্দ্রিলা তাড়াহুড়ো নাস্তা শেষ করে, ঘরে গিয়ে শহরকে কলব্যাক করে।
“আপা, তোমাকে নাকি কাল পাত্র দেখতে এসেছিল?”
“হুঁ এসেছিলো তো।”
“এটা আমাকে কেউ আগে জানায়নি কেন?”
“দেখতে আসবে আমাকে, তুই জেনে কি করবি?”
“তোমাকে দেখতে আসবে আর আমি সেখানে উপস্থিত থাকবো না?”
“না থাকবি না। কারন দেখতে আসা মানেই বিয়ে হয়ে যাওয়া না। আর তারা শুধু আমাকে দেখে গেছেন, বিয়ে পর্যন্ত ঠিক হয়নি। বলেছেন জানাবে।”
শহর বলল,“মা জানে?”
“না।”
“তোমার সাথে যার বিয়ে কথা চলছে, তার সম্পর্কে কিছু বলো।”
“কিছুই বলতে পারবো না। আগে সবকিছু ঠিকঠাক হোক, সব জানতে পারবি।”

শহরকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অতন্দ্রিলা ফোনটা রেখে দিলো।

(চলবে)#অতন্দ্রিলার_রোদ
পর্ব : ১ – (ভালোবাসা নাকি বিভ্রান্তি?)

লেখা : শঙ্খিনী

অতন্দ্রিলার মাথাটা ভ্নভ্ন করছে। তেইশ বছরের জীবনে এতটা বিভ্রান্ত এর আগে একবারই হয়েছিলো।

তখন তার বয়স মাত্র চার। এই বয়সে নানি-দাদি বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনেরা বাচ্চাদেরকে, “বাবা আর মায়ের মধ্যে কে বেশি আদর করে?” বা “বাবা আর মায়ের মধ্যে কাকে বেশি ভালোবাসো?” – এ ধরনের প্রশ্ন করে থাকেন।
কিন্তু অতন্দ্রিলার ক্ষেত্রে বিষয়টা ছিলো একটু ভিন্ন।
এক সন্ধ্যায় অতন্দ্রিলার দাদী তাকে
হতাশ গলায় বললেন, “অত, ঠিক করো কার সাথে থাকবে! মায়ের সাথে না বাবার সাথে?”

কথাগুলো অতন্দ্রিলার মাথার ওপর দিয়ে গেলো।

কিছুই বুঝতে না পেরে সে হতভম্ব গলায় বলল, “আমি তো দুজনের সাথেই থাকি!”
“সেটা তো এতদিন থাকতে। কিন্তু এখন তোমার বাবা-মা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তাই দুজনের মধ্যে থেকে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে তোমাকে।”
“আলদা হয়ে যাওয়া মানে কি?”
“ডিভোর্স! তোমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে।”
“ডিভোর্স মানে কি?”
“ডিভোর্স মানে তোমার বাবা-মা আর একসাথে থাকবে না।”
“একসাথে থাকবে না? কেন?”
“সেটা তোমার জানার বিষয় না! তুমি আগে বলো কার সাথে থাকবে?”

আলাদা হওয়া বা ডিভোর্স, এই ধরনের কঠিন কঠিন শব্দগুলোর অর্থ এখনো অতন্দ্রিলার সাথে পরিষ্কার না। তার ওপর আবার বাবা-মায়ের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নেওয়া, ভয়ংকর ব্যাপার!

এত বড় একটা সিদ্ধান্তের কথা বাচ্চাদেরকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে হয়। দুটো মানুষের মধ্যে মতের অমিল হলে যে, তারা আলাদা হয়ে যেতে পারে, এটা তাদের কল্পনারও বাইরে।

পরে অতন্দ্রিলার মা শায়লা বিষয়টা তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন।
“অত? আমাদের বাসায় বা তোমার ক্লাসে এমন কেউ কি আছে যাকে তুমি সহ্য করতে পারো না? যাকে দেখলেই তোমার রাগ হয়?”
“আছে, সন্ধ্যা আপা।”
“সন্ধ্যা যখন তোমার ঘরে ঢুকে অকারণে তোমাকে ফুটবল দিয়ে মারে তখন তুমি তাকে ঘর থেকে চলে যেতে বলো না?”
“হুঁ বলি তো!”
“তোমার বাবার আর আমার ঘটনাটাও কিছুটা এমন।”
“বাবা কি তোমাকে ফুটবল দিয়ে মারে?”
“না। সে মারে কথা দিয়ে। তুমি যেমন ফুটবলের আঘাত সহ্য করতে পারো না, আমিও তেমনি কথার আঘাত সহ্য করতে পারি না। তাই আমি তোমার বাবার বাসা থেকে চলে যাচ্ছি। তুমি চাইলে আমার সাথেও যেতে পারো আবার চাইলে তোমার বাবার সাথেও থাকতে পারো।”
অতন্দ্রিলা শুকনো গলায় বলল, “তুমি কোথায় যাবে?”
“তোমার নানাবাড়ীতে।”
“শহর তোমার সাথে যাবে?”
“শহর তো এখন অনেক ছোট, তাই আপাতত আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। ও যখন তোমার মত একটু বড় হবে, তখন ওকেও জিজ্ঞেস করবো কার কাছে থাকবে।”
“আর আপা?”
“সন্ধ্যাও আমার সাথে যাবে। এখন তুমি বলো কি করতে চাও! যাবে আমার সাথে?”
“না। আমি এখানেই থাকবো।”
“তোমার কিন্তু অনেক সমস্যা হবে আমাকে ছাড়া। আমি চাই তুমি আমার সাথে চলো।”
“না। আমি তোমার সাথে যাবো না।”
“তুমি ঠিক তোমার বাবার জেদটা পেয়েছো।”

এরপর এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে শায়লা ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে তার দুই ছেলমেয়েকে নিয়ে চলে যায়।
সেদিন অতন্দ্রিলা বুঝতেই পারেনি তার মা ভাইবোনকে নিয়ে কেন চলে গেল। ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তিতে পরেছিল সে।

তবে এবার তার বিভ্রান্তির কারনটা সম্পূর্ণই আলাদা।
সারাজীবন নাটক-সিনেমায় কিংবা গল্পে-উপন্যাসে ‘ভালোবাসা’ শব্দটা অহরহ শুনছে অতন্দ্রিলা। কিন্তু এই শব্দের অর্থটাই এখনো জানা হলো না। এই চার অক্ষরের শব্দটার অর্থ জানার জন্যই ইন্টারনেটে ছোটখাটো গবেষণা চালাচ্ছে। কিন্তু গবেষনা যতই এগুচ্ছে, অতন্দ্রিলার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

দস্তয়েভস্কি বলেছেন, “কেউ ভালোবাসা পেলে এমন কি সুখ ছাড়াও সে বাঁচতে পারে।”
আবার ডেভিড রস বলেছেন, “ভালোবাসা এবং যত্ন দিয়ে মরুভূমিতেও ফুল ফোটানো যায়।”
এদিকে রবীন্দ্রনাথ তো অতন্দ্রিলার মতোই বিভ্রান্ত। তিনি নিজেই প্রশ্ন করেছেন, “সখী ভালোবাসা কারে কয়?”
আবার লা রচেফউকোল্ড বলেছেন, “সত্যিকারের ভালোবাসা হল অনেকটা প্রেতআত্মার মতো। এ নিয়ে সবাই কথা বলে,কিন্তু শুধুমাত্র কয়েকজনই এর দেখা পায়।”
হুমায়ূন আজাদ বলেছেন, “প্রেম হচ্ছে নিরন্তর অনিশ্চয়তা; বিয়ে ও সংসার হচ্ছে চূড়ান্ত নিশ্চিন্তির মধ্যে আহার, নিদ্রা, সঙ্গম, সন্তান, ও শয়তানি।”
সবশেষে অতন্দ্রিলার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, “পৃথিবীতে অনেক ধরনের অত্যাচার আছে। ভালবাসার অত্যাচার হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক অত্যাচার। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলা যায় না, শুধু সহ্য করে নিতে হয়।”

বিখ্যাত ব্যাক্তিদের এসব বিখ্যাত উক্তি পড়ে অতন্দ্রিলা একটা কথাই বুঝতে পরলো যে, ভালোবাসা হলো একটি এবং জটিল এবং বিভ্রান্তিমূলক অনুভূতি।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রাপ্ত অতন্দ্রিলা আশরাফ,
বসে পড়ে প্রতিবেদন লিখতে। এ বছরের শুরুর দিকে বাবা হামিদ সাহেবের সুপারিশে, একটা অনলাইন পত্রিকায় চাকরি পেয়েছে সে।
চাকরি পাওয়ার খবরটা পেয়েই সর্বপ্রথম শায়লাকে টেলিফোন করে জানায় অতন্দ্রিলা।
চাকরির কথা শুনতেই শায়লা হাই তুলতে তুলতে বলেন, “তোর এই চাকরিটা কি ধরনের?”
“খুবই বাজে ধরনের। পেটে ভাতে চাকরি বলতে পারো! এমন সব প্রতিবেদন লিখবো যা হয়তো ওয়েবসাইটের কোণায় পরে থাকবে, কেউ খুলে পড়বে পর্যন্ত না।”
“তাহলে এমন চাকরি তুই করবি কেন?”
“দুটো কারন আছে। প্রথমত, এখানে প্রতিবেদন লিখতে লিখতে আমার লেখার হাত পাকবে। নতুন অভিজ্ঞতা হবে। আর দ্বিতীয়ত, চাকরিটা করতে ঘর থেকে বের হতে হবে না। যেহেতু অনলাইন পত্রিকা, তাই ঘরে বসেই লিখতে পারবো।”
“কি কি বিষয়ে প্রতিবেদন লিখবি?”
“হাবিজাবি বিষয়ে। এই যেমন, ‘জেনে নিন অতিরিক্ত পরিশ্রম করার কুফল’ অথবা ‘জেনে নিন অতিরিক্ত বিশ্রামের কুফল’- এই টাইপের প্রতিবেদন।”
“এসব কুফল সম্পর্কে তুই কি জানিস? তুই কি ডাক্তার?”
“একজন সাংবাদিক যেমন ডাক্তারি বিষয় সম্পর্কে প্রতিবেদন লিখতে পারে, তেমনি মহাকাশ সম্পর্কেও প্রতিবেদন লিখতে পারে।
তোমাকে তো মাত্র একটা ধারনা দিলাম। চেষ্টা করবো সব বিষয়েই লিখতে।”
“তোর জ্ঞানের কথা শুনতে ভালো লাগছে না, রাখলাম।”

প্রথম দিকে অতন্দ্রিলার এই ঘরে বসে সাংবাদিকতাকে সবাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও, পাঠকদের বেশ ভালোই সাড়া পেয়েছে সে। তাই হাবিজাবি ধরনের প্রতিবেদন লিখে যাচ্ছে ছয় মাস ধরে।

আজ সে বিষয়টা নিয়ে প্রতিবেদন লিখছে তার শিরোনাম, ‘ভালোবাসা কারে কয়?’
এই প্রতিবেদনটি সাজানো থাকবে বিখ্যাত ব্যাক্তিদের ভালোবাসা সংক্রান্ত উক্তি দিয়ে।
তবে অতন্দ্রিলা ভাবছে এবারের প্রতিবেদটা একটু ভিন্নরকম ভাবে সাজবে।
বিখ্যাত ব্যাক্তিদের পাশাপাশি এবারের প্রতিবেদনে থাকবে, ভালোবাসা নিয়ে তার আশেপাশের মানুষগুলোর মতামত। এই যেমন তার ৭৫ বছর বয়সী দাদি ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন কিংবা উনিশ বছর আগে যার স্ত্রী ছেড়ে যাওয়ার পর আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি সেই বাবা ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন অথবা স্বামীকে ছেড়ে যাওয়ার পর যে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন সেই মা ভালোবাসা নিয়ে কি ভাবেন। রোদ সাহেবের মতামতও নেওয়া যেতে পারে, তবে সেটা পরিস্থিতিতে সাপেক্ষে বিবেচ্য। সঙ্গে অতন্দ্রিলার নিজস্ব মতামতও যোগ করা যেতে পারে।

আর কার কার মতামত নেওয়া যায় তা ভাবতে ভাবতে দরজায় টোকা পরল।
“খোলা আছে!”
বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ঘরে প্রবেশ করে অতন্দ্রিলাদের বাড়ির কাজের মেয়ে জরিনা।
“আফা নিচে আসেন, টেবিলে নাস্তা দিসি।
আইজ আপনের পছন্দের নাস্তা, পরটা দিয়া গরুর গোস্ত।”
“বাবা আর দাদি?”
“বইসা পরছে। আপনের জইন্যে দাঁড়াইবে নাকি? আপনে তো লিখতে লিখতেই দুপুর বাঁধায় ফেলবেন।”
“তুমি বেশি কথা বলো।”
“কি করবো আফা কন? আল্লাহর দুনিয়ার আসছি তো দুই দিনের জন্যে, কথা না কইলে কি করুম?”
“বেশি কথা না বলে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে?”
“এইটা কোনো কথা বললেন আফা? আপনি একটা কথা জিগাইবেন আর আমি বোলুম না এইটা হয়?”
“বলতো ভালোবাসা কি?”
“আফা, আমি মূর্খ মানুষ। পড়াশুনা বেশি দূর করতে পারি নাই! আমি আবার কি বোলুম ?”
“এমন অনেক বিষয়ই আছে যা সম্পর্কে জানতে লেখাপড়া করতে হয় না, চারপাশের পরিবেশ থেকেই জানা যায়। ভালোবাসা মানে তো তুমি নিশ্চই জানো!”
জরিনা খানিকটা সংকোচ নিয়ে বলল, “জানি, তয় আপনার মত সুন্দর কইরা বলতে পারমু না।”
“আমি তো তোমাকে সুন্দর করে বলতে বলিনি। তুমি যা জানো, নিজের মতো করে বলো।”
“আফা এইসব বদ মাইয়া-পোলার করবার। যেগুলি এইসব ভালোবাসাবাসি করে, হেগুলি বদের বদ।”
অতন্দ্রিলা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিকাছে, তুমি নিচে যাও আমি আসছি।”

অতন্দ্রিলা নিচে এসে দেখে জরিনার কথা একেবারেই সত্য নয়। বাবা এবং দাদি তার জন্য নাস্তার টেবিলে অপেক্ষা করছেন। যদিও অপেক্ষা করছেন নিতান্ত অনিচ্ছায়।

অতন্দ্রিলাকে দেখে তার বাবা হারুন সাহেব শান্তির দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বললেন, “গুড মর্নিং রাজকুমারী।”
অতন্দ্রিলা তার পাশে বসতে বসতে বলল “গুড মর্নিং।”
“তা, কেমন দেখলি ছেলেটাকে?”
“কোন ছেলে?”
“ঢং করবি না। পৃথিবীতে আমি সবকিছু সহ্য করতে পারি কিন্তু ঢং সহ্য করতে পারি না।”
“ভুল। তুমি ক্ষুদা সহ্য করতে পারো না, তাই এখন নাস্তা করছো। আবার তুমি শীত সহ্য করতে পারো না, তাই শীতকালে সোয়েটার পরো।”
“তোর সঙ্গে কথা বলাটাই বিপদ। কোনো আলোচনাকে কি হালকা পর্যায়ে রাখতে পারিস না?”
অতন্দ্রিলা বলল, “স্যরি বাবা, ভুল করেছি। আমার জীবনে তো অনেক ছেলেকেই দেখেছি তাই সত্যিই বুঝতে পারছি না তুমি কোন ছেলের কথা বলছো।”
“কার কথা আবার? কালকে যে ছেলেটা তোকে দেখতে এলো, সেই ছেলেটা।”
“ও সে! হুঁ ভালোই তো দেখেছি।”
অতন্দ্রিলার দাদি রওশন আরা অস্পষ্ট গলায় বললেন, “ভালো হলেই ভালো।”
অতন্দ্রিলা বলল, “তবে তার যে এর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিলো, এই বিষয়টা তোমরা আমার কাছ থেকে গোপন না করলেও পারতে।”
হামিদ সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, “তুই জানলি কিভাবে?”
“বাবা লোকটা না আহাম্মক নন। তাই যখন তার সাথে আমাকে আলাদাভাবে কথা বলতে পাঠিয়ে দিলে, তখনি সে তার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা আমাকে জানায়।”
রওশন হতাশ গলায় বললেন, “দেখ মা, তুই তো সবই জানিস আর বুঝিস।”
“হুঁ বুঝি তো। আমি ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে, তাই এর থেকে বেশি আমি ডিজার্ভ করি না।”
“আহ্! এভাবে বলছিস কেন?”
“সত্যিই তো বলছি। তোমরা কি ভাবছো, ওনার যে আগে একটা বিয়ে হয়েছিল এই বিষয়টা ভেবে আমি রাগে দুঃখে মরে যাচ্ছি? না দাদি! আমি ব্যাপারটাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছি। আমার দোষ হলো আমি ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। আর ওনার দোষ হলো উনি আগেও একবার বিয়ে করেছিলেন। দোষে দোষে কাটাকাটি! তাছাড়া লোকটাকে যে আমার পছন্দ হয়নি তাও না। পছন্দ হয়েছে। ওনার বুদ্ধি ভালো, সুন্দর করে কথা বলে আর দেখতে শুনতেও খারাপ না।”

হামিদ সাহেব কিছু বলতে যাবেন, তখনি জরিনা খাবার ঘরে প্রবেশ করে।
“আফা! ছোট ভাইজান ফোন দিসে।”
“শহরকে বলো, আমি নাস্তা করে কলব্যাক করছি।”

শহর, অতন্দ্রিলার আদরের ছোট ভাই। শহরের বয়স যখন ৬ মাস, তখন তার মা তাকে নিয়ে নানাবাড়ীতে চলে যায়। মা, বড় আপাসহ নানাবাড়ির সকলেই যে অত্যন্ত বিরক্তিকর মানুষ, এই ব্যাপারটা শহর একটু বড় হয়েই বুঝতে পারে। তাই তিন বছর বয়স থেকে বাবা, দাদি এবং ছোট আপার সাথে থাকতে শুরু করে সে।
বর্তমানে সে জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র।
হলে থাকাটা নিতান্তই তার শখের বসে নেওয়া সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তটা যে কত বড় ভুল ছিল, তা শহর এখন টের পাচ্ছে।

অতন্দ্রিলা তাড়াহুড়ো নাস্তা শেষ করে, ঘরে গিয়ে শহরকে কলব্যাক করে।
“আপা, তোমাকে নাকি কাল পাত্র দেখতে এসেছিল?”
“হুঁ এসেছিলো তো।”
“এটা আমাকে কেউ আগে জানায়নি কেন?”
“দেখতে আসবে আমাকে, তুই জেনে কি করবি?”
“তোমাকে দেখতে আসবে আর আমি সেখানে উপস্থিত থাকবো না?”
“না থাকবি না। কারন দেখতে আসা মানেই বিয়ে হয়ে যাওয়া না। আর তারা শুধু আমাকে দেখে গেছেন, বিয়ে পর্যন্ত ঠিক হয়নি। বলেছেন জানাবে।”
শহর বলল,“মা জানে?”
“না।”
“তোমার সাথে যার বিয়ে কথা চলছে, তার সম্পর্কে কিছু বলো।”
“কিছুই বলতে পারবো না। আগে সবকিছু ঠিকঠাক হোক, সব জানতে পারবি।”

শহরকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অতন্দ্রিলা ফোনটা রেখে দিলো।

(চলবে)

ভালো লাগে ভালোবাসতে-পর্ব ৬

0

#ভালো লাগে ভালোবাসতে
#পর্ব ৬
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

বিয়ে বাড়ি মানেই একরাশ হৈ হুল্লোড়,অযথা হাসাহাসি আর বাচ্চাদের ছোটাছুটি।কোনো কাজ ছাড়াই যদি বসে বসে এসবকিছু উপভোগ করা যায় তবে বিয়ে বাড়ি ব্যাপারটা মন্দ না।আমিও এখন এমনি একটি বিয়ে বাড়িতে বসে বসে মুড়ি মাখানো খাচ্ছি।শুধু পেয়াজকুঁচি,কাঁচা মরিচ আর সরিষার তেল দিয়ে বানানো।গাঁদা খানেক বানানোর জন্য সেই উপাদানগুলোও খুবই কম মাত্রার।কিছু করার নেই বলেই জানালার পাশে বসে ঘাসের মতো এগুলো চিবিয়ে যাচ্ছি।আমার খানিক দূরে সাফা বড় ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একটি লেহেঙ্গার নিচের পার্ট কোমড়ে ধরে রেখে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখে যাচ্ছে।
সাফা আমার কুট্টি কালের ফ্রেন্ড।ওদের মূল বাড়ি ঢাকাতেই হওয়ায় ওর আমার মতো হোস্টেলে থেকে পড়তে হয় না।সাফার বাবা যখন গাজীপুরে পোস্টিং এ ছিল তখন থেকেই আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব হয়।সাফার বড় ভাই সাজেদ ভাইয়ার বিয়ে।সেই সুবাদেই অ্যান্টি মানে সাফার মা আমাকে এক সপ্তাহ আগেই এখানে এনে রেখেছে।
সেই ঘটনার পর থেকে আমি আর নিদ্র ভাইয়ার সামনে বেশি পড়িনি।যেভাবে ছল করে আমাকে বিয়ে করে নিল সেকারণে তার প্রতি মনে এখন আরো দ্বিগুণ ভয় চেঁপে বসেছে।আবার আমাকে দিয়ে কখন না কি করায়!নিদ্র ভাইয়াও এখন খুব ব্যস্ত থাকে।হবারই কথা তাদের এখন পড়ালেখা জীবনের লাস্ট ইয়ার চলছে।তাই দেখা খুব কমই হয়।
কিন্তু মাঝে মাঝেই হুটহাট করে গভীর রাতে ফোন দিয়ে বলবে,’ফোনটা তোমার কানের কাছে পাঁচ মিনিট ধরে রাখো তো।আমি পড়তে পড়তে টায়ার্ড,আমার এখন একজন কথা বলার মানুষ দরকার।’
বেশিরভাগ সময়ই পাঁচ মিনিট হবার আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি কিন্তু সকালে উঠে দেখি কল এখনো চলছে।আমি উঠে হ্যালো বলার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে দেওয়া হয়।
মানুষটা কি রোবট না কি বুঝি না।এত্ত পড়ে কিভাবে!

-‘এই সুপ্তি দেখতো লেহেঙ্গাটা দেখতে কি ভালো লাগছে?’
-‘হুম।’
সাফা মুখ ফুলিয়ে বলল,’কিসের হুম?লেহেঙ্গাটা তো ফিটই হয় নি!ঐ দর্জি ব্যাটাকে মন চাচ্ছে পঁচা পানিতে ধরে চুবাই।এখন আমি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এই ঢুলা ঢুলা এইটা কিভাবে পড়ে যাবো?’
-‘হুম।’
-‘আবারো হুম!তুই আমার কথা শুনছিস?’
-‘আরে একটুই তো ঢিলা।এতটুকুতে কি হয়?’
-‘এতটুকুতে কি হয় মানে!অনেক কিছু হয়।তোর তো এসব নিয়ে কিছুই যায় আসে না।তুই কি পরবি কিছু ঠিক করেছিস?আজকে কিন্তু মেয়ে বাড়িতে তুই একটা চমক পাবি।’
আমি আবারো হুম বলে বিছানায় গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।সাফা হন্তদন্ত হয়ে এসে আমার কাঁথার কোণা ধরে টানাটানি শুরু করে দিল।আমিও আমার শেষ অবলম্বনের মত কাঁথাকে শক্ত করে ধরে রাখলাম।
সাফা বলতে লাগলো,’এই সুপ্তি তুই কি এখন ঘুমাবি নাকি!সন্ধ্যা বেলা ঐ বাড়ি যাবো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে আর এখন তুই ঘুমাবি।চল না পার্লারে যাই।’.
অবশেষে আমার ঘুমের কাছে ব্যর্থ হয়ে সাফা হাল ছেড়ে দিল।এখন জেগে থাকলে এই মেয়ে জামা,জুয়েলারি নিয়ে আমার মাথা খারাপ করে দিবে।আর আমার ঘুমও পাচ্ছে বেশ।তাই যখন যাবো সেটা তখন এর উপর ছেড়ে দিয়ে আমি পাড়ি দিলাম ঘুমের রাজ্যে।

আমার ঘুম ভাঙলো শেষ বিকেলের একটু আগে।
ঘুম ঘুম চোখ হাত দিয়ে কঁচলে রুমের বাইরে গিয়ে দেখলাম সবাই সাজগোঁজে ব্যস্ত।আঙ্কেল মানে সাফার বাবা রাগে গজগজ করছে।ফুলের ঝুরিটা কার ধাক্কা লেগে যেন সব ফুল মাটিতে পড়ে গেছে সেটা নিয়েই সে চেঁচামেচি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে।
আমি আঙ্কেলের সামনে পড়তেই সে মুখে হাসি এনে বলল,’মামণি তুমি এখনো রেডি হওনি কেনো?তাড়াতাড়ি করো যাও।ভালো করে সাজগোজ করতে হবে না!’
আমার জায়গায় এখন অন্য কেউ হলে আঙ্কেল ধমক দিয়ে তার কান বয়রা বানিয়ে ফেলতো।সে খুব বদমেজাজী।কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আঙ্কেল আমাকে খুব স্নেহ করেন।সবসময় হাসি মুখে কথা বলে।
আমি গিয়ে রেডি হওয়া শুরু করলাম।সাফা সেই কখন থেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার চুল খুলছে আবার বাঁধছে।দেরিতে আসলেও আমি ওর আগেই রেডি হয়ে গেলাম।আমি আজকে পড়েছি সোনালী রঙের মোটা পাড় দেওয়া হলুদ রঙের লেহেঙ্গা।উপড়ের জামাটাও পুরো সোনালী।
দুই হাত মুঠ করে গোল্ডেন কালার স্টোনের চুড়ি আর কানে পড়েছি গোল্ডেন কালারের স্টোনের মাঝারী সাইজের দুল।চুলগুলো মাঝখানে সিঁথি করে খোলা রেখেছি।সোনালী লেজ দিয়ে ঘেরা হলুদ ওড়নাটা ডান পাশে মেলে রেখে বাম দিকে অর্ধেক চুল সামনে এনে ঠোঁটে হালকা গোলাপী লিপস্টিক আর চোখে হালকা কাজল।ব্যাস,আমার সাজ কমপ্লিট।

সাফাকে বিরক্ত হয়ে বললাম,’তোর এখনো হয়নি?শুরু তো করেছিস আমার আগে!’
-‘দেখ না সুপ্তি,গোলাপী লিপস্টিক একদম ম্যাচ করছে না।লাল টা দিবো?’
-‘আমি যদি না ও বলি তবুও তো তুই দিবি।তাহলে এখনই দিয়ে ফেল।’
এরই মাঝে আঙ্কেল এসে সাফাকে দিল এক ধমক।বলল,’আজকে কি তোর বিয়ে দিতে যাচ্ছি যে সাজতে এতক্ষণ লাগে!দুই মিনিটের ভেতর নিচে না আসলে তোকে রেখেই কিন্তু চলে যাবো।’

মেয়ে বাড়িতে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম সন্ধ্যার একটু পরেই।আমরা যেমন সবাই হলুদ রঙের পড়েছি তেমন এখানে সবাই পড়েছে টিয়া রঙ।
ডেকোরেশনও হালকা হলুদ আর টিয়া মিক্স করে করা হয়েছে।বাহারী রঙের লাইটের আলোয় চারপাশ খুব সুন্দর লাগছে।আমাদের সবাইকে বরণ করার জন্য দাঁড় করানো হলো প্রধান ফটকে।সাজেদ ভাইয়াকে তার শালা শালীরা বরণ করে নিচ্ছে।এই ফাঁকে সাফাও একটু আয়না দেখে ঠিকঠাক হতে লাগলো।আমি ওকে হাতে বারি দিয়ে থামালাম।সাফা বলল,
-‘আরে দোস্ত দাঁড়া একটু ঠিক হয়ে নেই।ভেতরে বেয়াইরা আছে না!তুই ও একটু ঠিকঠাক হয়ে নে,বলেছিলাম না তোর জন্য চমক আছে।’
আমি ওকে দাঁত ভেটকিয়ে একটা হাসি দিয়ে চুপ করে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর বরণ শেষ হলে ভেতরে যাওয়ার পথে দেখলাম নিদ্র ভাই,তামিম ভাই,রাফি ভাইসহ আরো অনেকে ছেলেপক্ষের লোকের উপর ফুল আর গোলাপ জল ছিটাচ্ছে।নিদ্র ভাইয়াকে দেখে আমি একটুও চমকালাম না।যেনো তার এখানে থাকাটাই স্বাভাবিক।আমার সব চমক হওয়ার ক্ষমতা সে ভেঙে ফেলেছে।তার দ্বারা সবই সম্ভব।এই অচেনা বিয়ে বাড়িতে দাঁড়িয়ে ফুল ছিটানোও সম্ভব।
সাফা আমাকে পাশ থেকে খোঁচা দিয়ে বলল,’কি চমকে গেলি না!আরে নিদ্র ভাই আর তোর খুনসুটি ছাড়া কিছু জমে নাকি?ইশ!তোরা যদি সবসময় এভাবেই লেগে থাকতি।’
আমি সাফাকে চোখ গরম করে বললাম,’তার মানে তোর দোয়াতেই এসব হয়েছে,আমাকে এমন ঝামেলায় পেঁচাতে হলো।তোর খবর তো আমি পড়ে নিচ্ছি।আগে বল এরা এখানে কি করছে?’
সাফা লজ্জায় রাঙা হয়ে বলল,’তামিম ভাইয়ার ছোটো বোনই তো আমার ভাবী।’
-‘এই খবর আমাকে বললি না কেনো?’
-‘ঐ যে তোকে চমকে দিতে চাইছিলাম।’
তামিম ভাই সাফাকে উদ্দেশ্য করে বলল,’বেয়াইন,আপনাদের ঘরে তো মনে হয় কেউ রুটি খেতে পারে না তাই না?’
-‘পারবে না কেনো?’
-‘কারণ আপনাকে তো দেখে মনে হয় ঘরের সব আটা ময়দা আপনিই মুখে মাখেন।’
সব ছেলেরা হাসাহাসি শুরু করে দিল।সাফাকে আর পায় কে!মুখ ফুলিয়ে চলে গেল।
তামিম ভাইও চলে গেল ওর পিছু পিছু।আমার চোখ পড়ল নিদ্র ভাইয়ার উপর।সে আজ টিয়া রঙের পান্জাবীর উপড়ে হলুদ রঙের কোটি পড়েছে।পান্জাবীর হাতা ফোল্ড করে রাখা আর হাতে দামী ব্রান্ডের ঘড়ি।সবসময়ের মতই তাকে দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে।দেখলাম নিদ্র ভাইয়া কেমন শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ফুল ছিটিয়ে যাচ্ছে।
তার দৃষ্টি শান্ত হলেও আমি বুঝে গেলাম সে আমার উপর রেগে আছে।আমি ভাবতে লাগলাম আমি এমন কি করেছি।ভাবনার কোনো কুল না পেয়ে সেখান থেকে কেটে পড়াটাই শ্রেয় মনে করলাম।আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছি কিন্তু তার আগেই নিদ্র ভাইয়া আমার সামনে এসে বলল,’তোমার যে একটা ফোন নামের কিছু আছে সেটা কি মাথায় আছে?’
আমি একটি ঢোক গিলে বললাম,’থাকবে না কেনো?’
-‘তাহলে কেউ ফোন করলে যে কষ্ট করে সেটা রিসিভও করতে হয় এটা কি ভুলে গেছো?’
আমি পার্স থেকে ফোনটা বের করে দেখলাম নিদ্র ভাইয়ার অনেকগুলো মিসডকল।
আমি বললাম,’স্যরি ভাইয়া।আমি আসলে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।’
-‘হ্যাঁ তোমারই তো ঘুমের সময়।আমার ঘুমের তো বারোটা বেজে গেছে।’
-‘ভাইয়া…..
এর মাঝেই সাফার একটা কাজিন এসে আমাকে বলল,’সুপ্তি তোমরা কি রিলেটিভ।’
তার কথা শুনে তো আমার আত্মা শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা।বুঝে ফেললো না তো যে আমাদের বিয়ে হয়েছে!
আমি বললাম,’কেন বলুন তো?’
-‘নাহ্ মানে তুমি ভাই ভাই করছো তাই আমি ভাবলাম হয়তো তোমরা ভাই বোন।’
এটা বলে সে চলে গেল।আমি তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম।বিয়ে হয়েছে জানার থেকে ভাই বোন জানাটাও বেটার।
নিদ্র ভাইয়া থমথম গলায় আমাকে বলল,’তুমি আমাকে এখনও ভাইয়া বলে ডাকো কেনো?আমাদের না বিয়ে হয়েছে!’
আমি চোখ গোল গোল করে বললাম,’আপনিই তো বলেছিলেন এটা এমনিই বিয়ে।’
-‘এমনি বিয়ে হলে কি বিয়ে তো!তোমার ভাইয়া ডাকের জন্য যে আমাদের সবাই ভাই বোন ভাবছে।’
-‘আমাদের যে বিয়ে হয়েছে এটা জানার থেকে তো ভাই বোন ভাবাও ভালো।’
-‘কেনো আমাদের বিয়ে হয়েছে এটা জানলে কি হবে?’
তার কথা শুনে মনে মনে বললাম,’হ্যাঁ জানলে কি হবে!তুমি তো তোমার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে আরামছে ফুটে যাবে আর মাঝখান থেকে আমার জীবনে আর ভালোবাসার মানুষ আসবে না।’
আমি তো যে করেই হোক কাউকে বুঝতে দিব না এই বিয়ের কথা।

সবাই একে একে বর কনেকে হলুদ লাগাতে লাগল।যারা কাপল তারা হলুদ একসাথে গিয়ে লাগাল।একসময় আমি গেলাম হলুদ লাগাতে।আমি যাওয়ার সাথে সাথেই নিদ্র ভাইয়াও আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল হলুদ নিয়ে।আমি ফিসফিস করে বললাম,’আপনি এখানে এখন আসলেন কেনো?’
সে আমার থেকেও বেশি ফিসফিস করে বলল,’চলো তো,এখন সময় নেই।সবাইকে তাড়াতাড়ি হলুদ লাগাতে বলেছে।’
আমি সাজেদ ভাইকে হলুদ লাগিয়ে কনেকে লাগাতে গেলাম।তার নাম দিয়া।দিয়া ভাবী আমার হাত ধরে মিষ্টি হেসে বলল,’তুমিই কি সেই সুপ্তি?’
সে এভাবে বলল যেনো আমি কোন সেলিব্রেটি।
আমি কিছুই বললাম না,শুধু একটা হাসি দিলাম।
দিয়া ভাবী হেসে বলল,’সুপ্তি,এটা কিন্তু ঠিক না আমি আজকে বউ আর আমার থেকে বেশি সুন্দর তোমাকে লাগছে।’
দিয়া ভাবী দুই হাত দিয়ে আমাদের দুজনের গালে একটু হলুদ লাগিয়ে দিল।
নিদ্র ভাইয়া দিয়া ভাবীকে হলুদ লাগিয়ে যেতে নিলে ভাবী তার পান্জাবীর কোনা ধরে বলল,’নিদ্র ভাইয়া আজকে কিন্তু নাচ গান দুটোই করতে হবে।আর তুমি কিন্তু এখনো নিজের মুখে বললে না।’
তারপর আমার দিকে একটু তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হাতের আঙ্গুল তুলে চোখ দিয়ে ইশারা করে বোঝাল,’দারুণ চয়েজ।’
নিদ্র ভাইয়া মুচকি হেঁসে দিয়া ভাবীর মাথায় একটা টোকা দিয়ে চলে গেল।

সাজেদ ভাইকে ভাবীর পাশ থেকে উঠিয়ে আমরা মেয়েরা সব ভাবীর সাথে ছবি তুলতে লাগলাম।
এর মাঝে হঠাৎ মিউজিক বেঁজে উঠল।আমরা সবাই সেলফি তোলা বাদ দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলাম নিদ্র ভাইয়া ডান্স ফ্লোরে নেমে এসেছে।
একে একে তার বন্ধুরাও সব যোগ দিল।মিউজিক প্লেয়ারে গান চলছে,
♪♪দো ন্যায়ন সিতারে হে চান্দ সা মুখড়া
কেয়া কেহনা উসকা….আফরিন!
দাওয়াত মে যেইসে হো শাহী টুকরা
উসকে যেসি না ক্যোয়ি নাজনীন
শাহী জোড়া পেহ্যান কে
আয়ী যো বান থান ক্যা
য়োহী তো মেরি সুইটহার্ট হে
শারমায়ী সি বাগাল মে
যো বেঠি হে দুলহান ক্যা
য়োহী তো মেরি সুইটহার্ট হে।♪♪

নিদ্র ভাইয়া খুব সুন্দর ডান্স করল।এতক্ষণে এটাকে একটা প্রকৃত বিয়ে বাড়ি মনে হচ্ছে।তানিয়া আপু এর মাঝে তাদের সাথে একটু যোগ দিতে গিয়েছিল কিন্তু নাঈম ভাইয়া তার পায়ে পাড়া দিয়েছে।এই নিয়ে তাদের আবার মান অভিমান পর্ব চলছে।
এত এত নাচ গানে হয়তো আমাদের সাজেদ ভাইয়ারও মন উৎসুক হয়ে উঠল।তাই সে একটু ড্যাশিং ভাব নিয়ে স্টেজে যাওয়ার আগেই পা পিছলে আঙ্কেলের উপর পড়ে গেল।আঙ্কেল দাঁত কড়মড় করে বললেন,’অপদার্থ।এখন নাচতে গিয়ে আমার অবশিষ্ট মান সম্মানও খুইয়ে আয়।’
তার ধমকে চুপসে গিয়ে সাজেদ ভাই আর নাচার সাহস করলো না।
সাজেদ ভাইয়ার এক বন্ধু আছে নাম মামুন।নিজেকে মহা হ্যান্ডসাম ভেবে মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করাই তার স্বভাব।সে আমাদের সব মেয়েদের মাঝে দাঁড়িয়ে ভাব দেখাতে লাগল।আমি মামুন ভাইকে বললাম,’কি ব্যাপার ভাইয়া,সবাই তো ডান্স করে স্টেজ কাঁপিয়ে ফেলছে।আপনি একটু ডান্স করছেন না কেনো?’
মামুন ভাই ব্যাপক ভাব নিয়ে বলল,’এটাই তো চিন্তা সুপ্তি,সবাই তো শুধু স্টেজ কাপাচ্ছে আমি গেলে স্টেজ ভেঙে যাবে।’
সোমা আপু বলে উঠল,’হ্যাঁ ডান্স না করে শুধু লাফালাফি করলে তো স্টেজ ভাঙবেই।’
আমরা সবাই হেসে দিলাম।
মামুন ভাই সেভাবে ভাব নিয়েই বলল,’মেয়েদের হাসলেই বেশি সুন্দর লাগে।তার জন্য তারা অর্থহীন জোকস ক্রিয়েট করে হাসতেই পারে,আই লাইক ইট।’
সাফা বলে উঠলে,’মামুন ভাই আপনার স্টেজের চিন্তা করতে হবে না।যান ডান্স না পারলে একটা গান গেয়ে শোনান।’
মামুন ভাই বলল,’ওকে গার্লস।তোমরা যেহেতু আমার পারফরমেন্স দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছো তোমাদের জন্য আমি এতটুকু করতেই পারি।’
মামুন ভাই স্টেজের মাঝ বরাবর দাড়িয়ে এই রাতের বেলা সানগ্লাস চোখে দিয়ে মাইক হাতে নিয়ে একটি হিপ হপ সং গাইতে লাগল।তার অদ্ভুত ভঙ্গিতে গাওয়া গান শুনে আমরা সব শুধু মুখ টিপে হাসছি।আঙ্কেল স্টেজ বরাবর পিঠ দিয়ে বসে জুস খাচ্ছিলো।মামুন ভাইয়ার গান শুনে না দেখেই ধমক দিয়ে বলে উঠল,’এমন ছাগলের মত ম্যা ম্যা করছে কে রে!কানটা ঝালাপালা করে দিল।’
সব মেয়েরা হো হো করে হেসে দিল।মামুন ভাই গান থামিয়ে মুখ ভার করে নিচে নেমে আমাদের কাছে এসে বলল,’এই ওল্ড পিপলদের নিয়ে এই সমস্যা!মডার্ণ সংয়ের কিছুই বুঝে না।’
আমরা আবার সবাই হেসে দিলাম।আমার হাসতে হাসতে চোখ পড়ল নিদ্র ভাইয়ার দিকে।সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হসে ভ্রু উঁচা করে ইশারা করছে।আমিও অন্য দিকে তাকিয়ে একটু মুখ ভেঙ্গিয়ে দিলাম।
সবাই নিদ্র ভাইয়ার গান শুনার জন্য নিদ্র নিদ্র করছে।সবার রিকোয়েস্ট রাখতে সে স্টেজে উঠে গেল তার সেই কালো গিটার কাঁধে ঝুলিয়া।
গিটারে এক সুন্দর মিষ্টি সুর তুলে গাইতে
লাগল,
ভাললাগে হাঁটতে তোর হাত ধরে
ভাবনা তোর আসছে দিন রাত ভরে
এলোমেলো মনটাকে কি করে আর রাখে
কেন আমি এত করে তোকে চাই….
পারবো না.. আমি ছাড়তে তোকে
পারবো না.. আমি ভুলতে তোকে
পারবো না.. ছেড়ে বাঁচতে তোকে
হয়ে যা না রাজি একবার…..

ভাললাগে চাইলে তুই আড় চোখে
চাইছি তোর অই দু চোখ আর তোকে
এলোমেলো দিস করে,সারাটা দুপুর ধরে
বসে বসে বুনে চলি কল্পনায়…..
পারবো না..আমি ছাড়তে তোকে
পারবো না..আমি ভুলতে তোকে
পারবো না..ছেড়ে বাঁচতে তোকে
হয়ে যা না রাজি একবার….

লাইটিংয়ে পরিষ্কার আলো বন্ধ করে এখন হালকা নীল গোলাপী আলো ছড়াচ্ছে।পরিবেশটাই যেন মুহুর্তের মধ্যে বদলে গেল।তার গান শেষ হলে সবাই করতালিতে চারপাশ মুখরিত করে তুলল।
এমন সময় রাফি ভাইয়া বলে উঠল,
-‘ সব পারফরমেন্স কি শুধু মেয়েপক্ষরাই দিবে।ছেলেপক্ষরা কি কিছু করবে না?নাকি পারে না।’
সব হাসাহাসি শুরু করে দিল।তামিম ভাই বলে উঠল,’এদের জন্য বোলে চুড়িয়া গান ছেড়ে দে।এই গান ছাড়া মনে তো হয় না অন্য কোনো গানে নাচতে পারবে!’
ইশ!দেখে মনে হচ্ছে সবগুলো হাসিতে যেনো লুটিপুটি খাচ্ছে।আমরা যথেষ্ট অপমানিত বোধ করলাম।
আমি বলে উঠলাম,’সাফা গিয়ে গান ছেড়ে আয়।আমরাও দেখিয়ে দিব আমরা কি পারি আর না পারি।জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ।’
আমরাও উঠে এলাম স্টেজে সাফার কাজিনদের সাথে।
য়ো লাড়কি আখ মারে গানে আমরা নেচে যাচ্ছি।

সবাই হা করে তাকিয়ে আছে।কারণ ডান্স আমরাও খারাপ পারি না।একে একে উপস্থিত সবাই যোগ দিতে লাগল নাচে।আমার ডান্সের মাঝে হঠাৎ হেঁচকা টানে কেউ আমায় বুকের সাথে মিশিয়ে নিল।পারফিউমের ঘ্রাণে বুঝে গেলাম নিদ্র ভাই।ঘটনার আকস্মিকতায় আর তার এভাবে জড়িয়ে ধরায় আমি কুঁকড়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলাম।তাকে একটু ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই সে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠল,’আস্তে,তোমার জামার পেছনে ফিতা খুলে গেছে।’
আমি চোখ বন্ধ করেই রইলাম।সে সেভাবে জড়িয়ে রেখেই পেছনে হাত দিয়ে আমার ফিতা বাঁধতে লাগল।
আমার একটু অস্বস্তিও লাগছিলো কেউ যদি আমাদের এভাবে দেখে ফেলে।সে হয়তো বুঝতে পারছিলো তাই বলল,’চোখ খুলে দেখো।লাইট অফ করাই আছে।’
আমি চোখ মেলে দেখলাম ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই ছেলে সব কাজ গুছিয়েই করে।দ্বিতীয়বারের মতো তার সাথে এভাবে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলাম।প্রথমবারের থেকেও বেশি এইবার যেন হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে।আমার আর তারও।ফিতা বাঁধা শেষ হলে সে আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।আর সাথে সাথে লাইট অন হয়ে গেল।সবাই বিরক্তি থেকে রেহাই পেয়ে স্বস্তি পেল।তার ছোঁয়ায় আমি এখনো কুঁকড়ে আছি।সাফা আমার কাছে এসে বলল,’তোর আবার কি হয়েছে?এমন করে আছিস কেনো?’
আমি মুখ ঘুরিয়ে বললাম,’কিছু না।’

চলবে,,

নরপশু বর ৫ম খন্ড

2

নরপশু বর
৫ম খন্ড
সত্য ঘটনা অবলম্বনে
Nusrat Haq
চেয়ারম্যান এর লোকেরা যখন তাকে ধরে নিয়ে যায় আর মারে তখন আমি চেয়ারম্যান এর কাছে ছুটে যায়।
চেয়ারম্যান টাকা চায় আমার কাছে।
আমার বরের বন্ধু দের ছেড়ে দেয় কারণ ওরা টাকা দেয়। আমার কাছে ৫ হাজার টাকা চায় কিন্তুু আমার থেকে তো টাকা নাই।
পরেদিয়ে তাকে ইচ্ছে মতো মাইর খাওয়াই এরপর আমার কানের দুল গুলো বেচে টাকা দিয়ে তাকে ছুটাই।
মাইর খাওয়ার পর সে বেশ কিছু দিন অসুস্থ ছিলো।
ভালো হওয়ার পর চেয়ারম্যান খবর পাঠায় আর বলে তোর বউকে কিছু দিনের জন্য আমার কাছে পাঠা। তোকে টাকা দিবো।
এরপর আমার আর চেয়ারম্যান এর কাছে পাঠায় আমাকে।
খুব লজ্জার বিষয়।
চেয়ারম্যান এর কাছে ২ দিন ছিলাম এরপর ওখানে থেকে এসে বলি তোর সাথে আর সংসার করবো না।
তখন বাপের বাড়ি চলে যায়।
প্রায় ২ বছর পর বাপের বাড়ি যাই।
যাওয়ার সময় খালি হাতে যায়। টাকা ছিলো না নাস্তা পানি কোথা থেকে নিবো।
এরপর মা আমাকে দেখে ১ প্রকার তেড়ে আসলো। কিছু বললাম না। গিয়ে দেখি ওমা আমার বড় ভাই বিয়ে করছে তার বউ আবার গর্ভবতী।
সে আমার মাকে জিজ্ঞেস করতেছে মা এটা কে। তো আমার মা উওর দেয় আমাদের ঘরে কাছ করতো।
আগে নিজের মেয়ে বলে নাই।
এরপর মা আমাকে বলে দুপুরে খেয়ে যাবি নাকি এখন যাবি।
আমার আর কিছুই বলি নি শশুর বাড়ি চলে আসি।
আসার পর বর আমাকে খুব মারে। বলে মা তো জায়গা দিলো না গেলি কেন। আরো বললও আমার চুলোই ছাড়া তোর আর কি কারো কাছে জায়গা হবে।
আরো অনেক বাজে বাজে গালাগালি করলো।
সে রাতে মরতে চেয়েছি কিন্তুু সাহসে দেয় নি।
গ্রামের মোটামুটি সবাই আমাকে খারাপ বলতো।
তেমন কেউ মিশতে চায়তো না।
আর এদিকে বাড়ি বন্ধকির টাকার জন্য আসলো। বললও কিছু টাকা হলে ও দে কিস্তি হিসাবে।
এসে উনারা আমাদের গালাগালি করে গেলো।
৮০ হাজার টাকা ছিলো বাড়ি বন্ধকির টাকা।
এরপর আমার বর অনেক পুরুষ আনে আর আমাকে তাদের চাহিদা মিটাতে বলে৷
যাইহোক এরকম চাহিদা মিটিয়ে ১০ হাজার টাক যোগার হয়।
আর তাকে বললাম যাও টাকা দিয়ে এসো।
সে টাকা দিতে গিয়ে ১ দিন আর আসলো না। আর এদিকে ওনারা টাকা দেওয়ার জন্য অনেক কথা বললও। আর বললও টাকা না দিলে কালকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।
বর আসলো তো আমি জিজ্ঞেস করলাম ওনাদের টাকা দিলে না বর বললও জুয়া খেলে ফেলিছি টাকা নাই কোথা থেকে দিবো।
সমস্যা নাই আজকে ১০ জন আসবে ৫০০ টাকা করে দিলে ৫ হাজার হবে। শুধু তুই ২ দিন একটু কস্ট করবি।
বিশাস করেন সে রাতে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি।
আমি মরেই গিয়েছে।
প্রচুর রক্ত পাত হয়েছে।
কিন্তুু আমাকে সে ডাক্তার কাছে নিলো না সারাদিন কস্ট করলাম শুধু রক্ত যাচ্ছে বন্ধ হচ্ছে না।আমার বর অমানুষটা আমার অসুস্থতা দেখে ও রাতে তিন জন আনলো।
তারা কোনো কিছুই মানলো। অনেক কেঁদেছি চিৎকার করেছি।
উলটো অনেক গুলো মাইর খেতে হলো।
আমার বর মাতাল সে কি বুজবে।
তারপর আর জানি না।
নিজকে হাসপাতালে দেখতে পেলাম। এক আয়া বললও আমাকে নাকি ভোর ৪ টা বাজে হাসপাতাল এনেছে অজ্ঞান অবস্থায়।
রক্ত দিয়েছে ১ ব্যাগ।
আরো ২ ব্যাগ এর মতো দরকার।
আমার বর আসলো আমি তখন ও কথা বলতে পারছিলাম না।
সে আমায় বললও নাটক করে উলটে কত টাকা খরচ করতেছোস।
আমি কেঁদে দিলাম। খুব ব্যাথা হচ্ছিলো গায়ে। আর বললাম তোর বিচার খোাদায় করবে।
বিকালের দিকে অবস্থা আপুটার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায় উনাকে ইমার্জেন্সি চিটাগাং মেডিকেল এ পাঠায়।
এর পর উনার বর লাপাত্তা হয়ে যায়।
আপুটার মা আসে৷ কিন্তুু দেখা করে চলে যায়।এরপর উনার অবস্থার অবনতি হলে ওনার পরিবারের লোকদের ডাকে হাসপাতাল কর্মরত রা।কিন্তুু কাউকে পায় না। আর আপুটা ও বলে উনার কেউ নেই।
এরপর হাসপাতাল থেকে পুলিশ ডাকা হয়।
আর পুলিশকে আপুটা সব বলে।
আপুটার রক্ত শুন্যতা দেখাদেয়।
এরপর রাত ২ টায় ওনি চিটাগাং মেডিকেল এ মারা যান৷
মারা যাওয়ার আগে ওনি এগুলো পুলিশ কে বলেছিলো। আর এ ঘটনা চট্টগ্রাম এর সংবাদ পএে ২০১২ তে ব্যাপক ভাবে ছড়াই। দৈনিক আজাদিতে।
আপুটার মা আপুটার লাশটা নেয়নি।
ওনার বাড়িতে যোগাযোগ করা হলে কেউ যোগাযোগ করে নি।
উনি যখন মারা যায় হাসপাতালে কেউ ছিলো না উনার।
এমনকি উনার মা ও না।
পরে মেডিকেল এর কর্মরতরা পুলিশ কে আবার খবর দেয় আর উনার লাশ পুলিশ রাই দাফন করে।
কারন ওনার পরিবারের কেউই যোগাযোগ করেনি। আর যোগাযোগ করে ও কাউকে পাওয়া যায় নি।
হাসপাতালের বিলটা সরকার বহন করে৷
এরপর কেউ আর মামলা টা নিয়ে ঘাটেনি।
কারন পুলিশ তো টাকা ছাড়া নড়ে ও না
দোয়া করবেন আপুটার জন্য।
পরিশেষে এটাই বলবো সবাই সাবধান। কারন দিন শেষে আমরা নারীরা অনেক অসহায়।
আর অনেকেই বলে এটা কি সত্যি হতে পারে তাদের বলব আমার পুরো গল্পের সব গুলো কমেন্ট চেক করুন ওখানে অনেক বোনই লিখেছেন আপন ভাইয়ের ধারা ও অনেকে রেপ হয়ছে।
তাছাড়া সত্য মিথ্যা যাচাই করার দায়িত্ব আপনাদের দিলাম।
ভালো থাকুন সবসময় পাশে থাকুন।
আর কেমন হলো কমেন্ট এ জানাবেন। কারন এটাই আমার পাওয়া।
এত কস্ট করে লিখে যদি এতটুকু ও না পায় তাহলে লিখে আর কি করব বলুন।
সালাম।

নরপশু__বর চতুর্থ খন্ড

0

নরপশু__বর
চতুর্থ খন্ড
সত্য ঘটনা অবলম্বনে
Nusrat Haq
এর পর একদিন রাতে সে তার একটা বন্ধু নিয়ে আসে।
সাথে তারা খাওয়ার জন্য কি কতগুলো আনে।
আমি খেলাম।
আমার খুব মজা লাগলো।
কিন্তুু এর কিছুখন পরেই আমার খুব ঘুম আসলো৷
ঘুম থেকে উঠে অনুভব করলাম আমার শরীর খুব ব্যাথা।
ব্যাথার জন্য উঠতে ও পারছিলাম না।
নাপা খেলাম৷
আর সেদিন কাজে গেলাম না।
মানুষের বাড়ি থেকে খাওয়ার পানি আনতে গেলে তারা নানা রকম করতো।
অনেক সময় কলে তালা মেরে দিতো৷
তারপর নানা রকম কটু কথা বলতো।
আর সবাই আমাকে নিয়ে অনেক আফসোস করতে।
আমার বরকে এলাকায় মদতি রফিক বললে সবাই চিনে শুধু রফিক বললে কেউ চিনে না।
আমি শুধু আল্লাহকে ডাকতাম। আমার বর বছরের ঈদের দিনে ও নামাজ পড়তো না কতবড় কাফের ছিলো।
তারপর থেকে প্রায় সময় বন্ধুটা আসতো।
আর সে যেদিন আসতো সে দিন আমার খুব ঘুম আসতো।
তো একদিন সনধ্যা বেলায় বন্ধুটা ঘরে আসে। আমার গায়ে হাত দেয় আর আমি বলি কি সমস্যা। সেটা আমি আবার আমার বরকে বলি। তখন বরের বন্ধু আমায় উওর দেয় প্রতিদিনই তো তোমার গায়ে হাত দেয় তখন সমস্যা হয় না।
আমি কথা শুনে থ হয়ে গেলাম মানি কি।
তারপর বরের বন্ধু আমার বরের সামনে আমার রেপ করে।
আমি কাঁদলে আমাকে অনেক মারে আর বলে এমনি এমনি করে না আমাকে টাকা দেয়।
আমি আর এই অত্যাচার নিতে পারতেছিলাম না৷
সবসময় আল্লাহ ডাকতাম আর বলতাম আমার বরের মৃত্যু হয়না কেন।
এরপর থেকে বন্ধুটা প্রায় আসতো আর আমার বাজারের কস্ট হতো না।
আমি কোনো প্রতিবাদ করলে আমাকে অমানুষের মতল মারতো।
আর সবসময় বলত বাপের বাড়ি থেকে টাকা আন।
টাকা না আনলে এভাবে টাকা ইনকাম করে দিবি।
তারপর কিছু দিন পর বাবার বাড়ি যায়। মাকে টাকার কথা বলতে এক প্রকার আমাকে ঝেটিয়ে বিদায়,করলো।
আমিও নিরুপায় কি করবো। শশুর বাড়িতে চলে আসলাম৷
বর এর পর অনেক রকম লোক আনতো ঘরে৷ আর আমি তাদের চাহিদা মিটাতে হতো। আর না মিটালে আমাকে খুব মারতো৷ ছেলে মানুষের মাইর সেটা তো বুজেনি৷
এর ২ মাস পর ঘরের ভিতর বাথরুম আর কল দিলো।
কারন লোকগুলো আসে৷
এক প্রকার আমাকে আমার বর দেহব্যবসায়ী বানাই দিছে।
শুধু আল্লাহ কে ডাকতাম আল্লাহ হেদায়েত করো।
তারপর গ্রামের অনেকেই বলতো মদতিদের ঘরে এত মানুষ কেন যায় ছেলে মানুষ দের আড্ডা।
আরো অনেক কথা।
তারপর একদিন শুনলাম আমার বর বাড়ি বন্ধক দিছে জুয়াই হারি যাওয়াই।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এটা কি হলো।
তারপর আমায় আমার বর বললও এভাবে টাকা জমালে আর ১ বছর দেহ ব্যবসা করলে টাকা জোগায় হয়ে যাবে।
সেদিন নিজের উপর অনেক ঘৃনা চলে আসলো। বলার মতো না।
আমি একরাতে বাড়ির পাশে এক চাচির অনেক অসুখ থাকায় তাদের বাড়িতে রাতটা থাকি।
রাতে আমার ঘরে গ্রামের চেয়ারম্যান এর লোক এসে আমার বর সহ সবাইকে ধরে নিয়ে যায়।
আর জুয়া খেলার জন্য,সবাইকে অনেক মারে।
সেটা আবার আমি শুনি।
চলবে…

নরপশু_বর ৩য় খন্ড

0

নরপশু_বর
৩য় খন্ড
সত্য ঘটনা অবলম্বনে
Nusrat Haq..
আমার মনে হলো আমি দোযখ খানায় এসে পড়েছি।
সে দিনের ২ টা বাজে ঘুম থেকে উঠলো। উঠে বললও ভাত দাও।
আমি দিলাম। তারপর তাকে বললাম আচ্ছা বাথরুম কোথায় তারপর পানি কোথা থেকে আনবো।
সে ভাত খেয়ে উঠে আমাকে বাথরুমে নিয়ে গেলো৷ কি বলব বাড়ি থেকে অনেক দুরে একটা জঙ্গলের মত জায়গায়।
রাত বিরাতে তো আসায় যাবে না। আর বষার সময় ভুলেও না।
তারপর সে একটা বাড়ি দেখালো ওখান থেকে পানি আনতে বললও।
আর রাস্তার পাশে মসজিদের পুকুর থেকে গোসল করতে বললও।
আমি তো কান্নায় শেষ এটা কি হলো।
নসিবে এটা কি হলো৷
যায় হোক আমাকে আমার বাপের বাড়ি থেকে কেউ দেখতে ও আসলো না।
দিন যেতে লাগলো আর তার অত্যাচার বাড়তে লাগলো।
অহেতুক গালাগালি করা।আমাকে বিয়ের ৭ দিনের দিন রাতে মারতে শুরু করলো।
সে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আসলো আর আমার জামা খুলতে একটু দেরি হয়েছিলো চাহিদা মিটানোর জন্য।
কি জঘন্য সময় ছিলো বলে বুজাতে পারবো না।
খুব লজ্জা লাগতো অন্যের বাড়িতে পানি আনতে যেতে৷
তারপর মসজিদের পুকুরে গোসল করতে।
আমি ২ দিনেও গোসল করতাম না লজ্জায়। আর রাতের বেলা প্রসাব ধরলে ও বালতি ভরে করতাম তাও বাথরুমে যেতাম না।
বাথরুমে না যাওয়ার জন্য একদম কম খেতাম।
আর তার তো কোনো খবরই থাকতো না। সে ঠিক মত কাজ ও করতো না।
একদিন বাজার আনলে ১০ দিন আনতো না।
বলে বুজাতে পারবো না আমার কস্টের কথা গুলো।
শুধু আল্লাহকে বলতাম আল্লাহ তুমি একি রাখছো নসিবে জীবনে কি সুখ দিবা না।
তো বিয়ের ১ মাস পর আমাদের বাড়িতে যায়। গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করি।
আর মা আমাকে বললও এত ডং করতে হবে না অনেক ডং করছস।
বাড়িতে ১ দিন থাকার পর বাবা বললও কিরে যাবি না বিয়ে দিয়ে দিছি এখানে কি।
শশুর বাড়িতে যা।
তাদের আমি খুলে বললাম এই এই অবস্থা। কিন্তুু তারা বললও বিয়ে দিছি এটাই বেশি৷
তারপর মাকে বললাম।
মা ও মা আমি তো তোমার মেয়ে কেন আমার সাথে এমন করলে।
মা বললও পেট বাঁধানোর সময় মনে ছিলো না।
আমি এটা বলতে পারলাম না বাহিরের মানুষ না ঘরের মানুষই করেছে।
নসিব খারাপ হলে যা হয় আরকি।
এরপর সব মেনে নিলাম আর নিজে নিজে যুদ্ধ শুরু করলাম৷
শশুর বাড়িতে এলাম।
মনোবল আরো শক্ত করলাম। এখানেই আমার থাকতে হবে।
কিন্তুু বর প্রতিরাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আসতো।
বিয়ের ১ মাস পর চালের কথা বললাম। ঘরে চাল ডাল কিছু ছিলো না।
চালের কথা বলার সাথে সাথে মাইর।
বলত কাজ করে খা।
আমি বিয়ের ১ মাস পর থেকে মানুষের বাড়ি কাজ করতাম৷ তারা যা দিতো চাল ডাল তাই খেতাম।
আমার মা আমার একটা বার খোঁজ ও নেয়নি
মানুষের ধান ঝাড়তাম উঠান লিপতাম।
তারা যা দিতো তাই খেতাম কারন বর বাজার করতো না। আর সে কাজ ও করতো না।
বিয়ের সময় আমাকে আমার বাপের বাড়ি থেকে ১ জোড়া কানের দুল আর চেইন দেয়।
একদিন সনধ্যা বেলা এসে বলে তোমার চেইন টা দাও তো।
সাধারণত সে সনধ্যার দিকে বাড়ি আসে না।
আমি সরল বিশাসসে তাকে চেইন টা দিলাম।
তো সে যখন মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরলো আমি কিছু বললাম না তাকে।
সকালে চেইনের কথা জিজ্ঞাস করে আমাকে মাইর বলে তোর বাড়ি থেকে আমাকে ১০ হাজার টাকা ছাড়া আর কি দিছে।
আমি ও মাইর খেয়ে পড়ে রইলাম কি বলব আর।
প্রায় সে আমাকে যৌতুকের জন্য নিযাতন করতো।
না পারতাম বাচতে না পারতাম মরতে।
মানুষের বাড়িতে সারাদিন কাজ করার পরে ও ঘরে এসে কাজ করতে হতো। রান্নার জন্য লাড়কি আর পাতাটা ও আমাকে খুজে আনতে হতো।
সে একদিন কাজে গেলে ১০ দিন যেতো না।
আর মদ খেয়ে টাকা সব শেষ করে ফেলতো।
আমি আমার কানের দুল জোড়া লুকিয়ে রাখলাম।
চলবে….