পৃথিবীর বড় বড় নাট্যমঞ্চের মধ্যে অন্যতম বিয়ে বাড়ি। বিয়ে বাড়িতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর এবং বৃহৎ থেকে বৃহত্তর সকল বিষয় নিয়ে নাটক হয়।
বিয়ে বাড়ির সবথেকে কমন নাটক হলো বর বা কনের পালিয়ে যাওয়া। কনে পালায় প্রেমিকের হাত ধরে, বর পালায় স্বপ্নের হাত ধরে। অতন্দ্রিলার কোনো প্রেমিক নেই, রোদের স্বপ্নগুলোও পূরণ হয়ে গেছে। তাই তাদের বিয়েতে এই নাটকটি হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই।
বিয়ে বাড়িতে আরও একটি কমন নাটক – এক মেয়েকে দেখিয়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া। এই অন্য মেয়েটি হয় যাকে প্রথমে দেখানো হয়েছে তার জমজ বোন। অতন্দ্রিলার বিয়েতে এই নাটকেরও সম্ভবনা নেই।
বিয়ে বাড়িতে আরেক ধরনের মজার নাটক ঘটে ঠিক বিয়ে পড়ানোর পর পর। হঠাৎ পরিবারের মধ্য থেকে গুপ্ত প্রেমিক প্রেমিকার উত্থান ঘটে। প্রেমিক প্রেমিকার হাত ধরে কাজী সাহেবকে বলে, “কাজী সাহেব! আরেকটা বিয়ে পড়াতে হবে।”
অতন্দ্রিলার বিয়েতে এই নাটকটি হওয়ার কিঞ্চিৎ সম্ভবনা রয়েছে। মামাতো বোন টিকলি এবং খালাতো ভাই তিশানের ভাবভঙ্গি ভালো মনে হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর পরই এরা কানাকানি করছে।
অতন্দ্রিলা ভেবে রেখেছে, যদি সত্যিই এরা এই নাটকটি করে তাহলে সে কঠিন গলায় বলবে, “তোদেরকে ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়া হবে। দয়া করে আমার বিয়েটা নষ্ট করিস না!”
আজ অতন্দ্রিলা এবং রোদের বিয়ে। বাড়িতে বিরাট আয়োজন। আত্মীয় স্বজনেরা সবাই বিভিন্ন আজ নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। শহর হল থেকে বাড়িতে এসেছে। সেও ছোটাছুটি করছে, তবে সেটা কোনো কারন ছাড়াই।
শায়লা দুদিন আগেই এ বাড়িতে এসেছেন। রান্নাবান্নার দায়িত্বটা তিনি এবং তার বোনেরা নিয়েছেন।
বাড়িতে অন্যরকম একটা খুশির বাতাস বইছে। এমন বাতাস অতন্দ্রিলার বাবা মায়ের ডিভোর্সের পর আর এ বাড়িতে বয়নি।
অতন্দ্রিলা ঠিক করেছে আজ সেও এক নাটক করবে, ভয়ংকর নাটক। তবে সেই ভয়ংকর নাটকের ফলাফল হবে অসাধারন।
নাটকের পরিচালক অতন্দ্রিলা, মুখ্য চরিত্র শায়লা এবং হামিদ সাহেব।
বিয়ের সময়ে “নইলে আমি কিন্তু বিয়ে করবোনা” এই বাক্যটি জাদুর মন্ত্রের মতো কাজ করে। বর কনে সুলভ থেকে দুর্লভ যেকোনো বস্তু পাওয়ার জন্যে এই বাক্যটি ব্যাবহার করে থাকে।
অতন্দ্রিলার নাটকে এ বাক্যটা প্রধান সংলাপ।
ভোর ৬ টা। বিয়ের বাড়ির সকলে ঘুম থেকে উঠে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। শায়লা রান্নাঘরে, হামিদ সাহেব বাগানে।
অতন্দ্রিলা দুজনকে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে এল।
শায়লা বিরক্ত গলায় বললেন, “কি আশ্চর্য! রান্নাঘরে আমার হাজারটা কাজ, এখানে নিয়ে এলি কেন?”
হামিদ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, “আমারও তো সেই একই কথা! কি ভেবেছিস কি হ্যাঁ? তোর কোনো কাজ নেই বলে অন্য কারোরই কোনো কাজ নেই?”
অতন্দ্রিলা বলল, “তোমরা একটু শান্ত হয়ে বসবে প্লিজ!”
শায়লা বসলেন। তার থেকে একটু দূরে বসলেন হামিদ সাহেব।
হামিদ সাহেব বললেন, “বসলাম! এখন বল তোর জরুরি কথা!”
অতন্দ্রিলা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বাবা মা দেখো, তোমাদের মধ্যে কি ঘটেছিল তা আমি জানি না। জানতেও চাই না। তবে আমার ধারনা তোমরা নিতান্তই কোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অভিমান করে আছো। আপার বিয়ে হয়ে গেছে। আমিও আজ চলে যাচ্ছি। শহর থাকে হলে। তোমরা এখন কি নিয়ে বাঁচবে? একা একা বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে?
শায়লা বললেন, “কি বলতে চাচ্ছিস অত?”
“বলতে চাচ্ছি যে এখন তোমরা দুজনেই দুজনের বেঁচে থাকার সম্বল। তাই তোমরা সবকিছু ভুলে আবার এক হও, নইলে কিন্তু আমি বিয়ে করবো না।”
কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যে। তারা এক হলেও অতন্দ্রিলা বিয়ে করবে, এক না হলেও বিয়ে করবে। কিন্তু বাবা মাকে এক করতে কথাটা বলতে তো কোনো ক্ষতি নেই।
শায়লা বুঝতে পারছেন না কি প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিৎ, হাসা উচিৎ নাকি রাগ করা উচিৎ।
চোখে দু এক ফোঁটা অশ্রু নিয়ে বললেন, “সত্যিই করবিনা?”
“অবশ্যই করবোনা।”
শায়লা হামিদ সাহেবের দিকে তাকালেন। হামিদ সাহেব কাঁদছেন। তার দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছে খুশির অশ্রু।
শায়লা কন্নামাখা কণ্ঠে বললেন, “তোমার মেয়ে কিন্তু তোমার মতই জেদী।”
“কিন্তু তুমি কি করবে আমাকে ক্ষমা?”
“করবো।”
অতন্দ্রিলা দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
চিৎকার করে বলল, “আপা! আমরা আর ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে নই!”
অতন্দ্রিলা হাসছে। দু গালে টোল পরেছে। হাসলে তার সৌন্দর্য কয়েক গুন বেড়ে যায়। কিন্তু খুব কম হাসে বলে এই সৌন্দর্য আড়ালে ঢাকা পরে যায়।
দুপুরের দিকে সন্ধ্যা অতন্দ্রিলার ঘরে এল।
গম্ভীর গলায় বলল, “তার মানে এই কাজটা তুই আগেও করতে পারতিস?”
“কোন কাজটা?”
“এইযে বাবা মায়ের মিল করিয়ে দেওয়ার কাজটা!”
“হ্যাঁ পারতাম তো।”
“তাহলে করিসনি কেন? আজ করলি কেন?”
“কারন হলো আজ আমি বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি। আজকের পর বাবা মায়ের ঝগড়া আমাকে আর সহ্য করতে হবে না।”
“তোর ধারনা তারা এক হওয়ার পর আবার ঝগড়া করবে?”
“অবশ্যই করবে।”
সন্ধ্যা কিছুক্ষণ চুপ থেকে উৎসাহ নিয়ে বলল, “এই এখন তো আর তাহলে তুই ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে না?”
“না।”
“তার মানে এখন আর এই ছেলেটাকে তোর বিয়েও করতে হবে না।”
“আপা বাজে কথা বোলো না তো। যাও নিজের কাজ করো!”
বিকেলের দিকে ঘটলো আরেক নাটক।
অতন্দ্রিলাকে সাজাতে এসেছেন পার্লার থেকে।
হঠাৎ ঘরের সমস্ত লাইট ফ্যান বন্ধ হয়ে গেল!
শহর দৌড়ে এসে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মেইন সুইচ নষ্ট হয়ে গেছে, আজকে ঠিক হবে না!”
হামিদ সাহেব চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছেন। একটু পরে অন্ধকার হয়ে আসবে, বাড়িতে এক ফোঁটাও আলো না থাকলে বিয়েই বা হবে কি করে আর মেহমানরা খাবেই বা কি করে।
শায়লা অন্ধকার নামার আগে রান্না শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন।
অতন্দ্রিলা সাজগোজ বাদ দিয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমি কি কিছু সহৃদয়বান ব্যক্তিবর্গের সাহায্য পেতে পারি?”
অতন্দ্রিলার খালাতো বোন নীলা বলল, “কি বিষয়ে আপা?”
“বাড়িটাকে নতুন করে সাজানো হবে, আলো দিয়ে। ছাদে নতুন করে প্যান্ডেল করা হবে। কাজগুলো আমি একা করতে পারবোনা যে তা নয়, কিন্তু কাজগুলো একা করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। কেউ আমাকে সাহায্য করবে?”
অতন্দ্রিলাকে সাহায্য করতে পারে এমন সাতজন মানুষ পাওয়া গেল। শহর, সন্ধ্যা, নীলা, তিশান, টিকলি, হামিদ সাহেব এবং জরিনা।
প্রায় পাঁচ ছয়’শ মোমবাতি কিনে আনা হয়েছে। বাড়ির প্রতিটি কোণায় মোমবাতি জ্বালানো হচ্ছে। ডেকোরেটরের লোকজন ছাদে নতুন করে প্যান্ডেল করছেন।
ছাদটা সাজানো হয়েছে প্রদীপ দিয়ে। সাথে বেলি ফুল। বেলির ফুলের সুগন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পরেছে।
মেহমানরা হতভম্ব। কনে সাজগোজ বাদ দিয়ে সজ্জাছে ঘর! তাও আবার মোমবাতি দিয়ে।
আলোর সমস্যা মিটে গেলেই আরেক সমস্যা হাজির। সেটা হলো গরম। ব্যাটারি চালিত টেবিল ফ্যান দিয়ে আপাতত কাজ চালান হচ্ছে। কিন্তু ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেলে কি হবে তা নিয়ে বেশ চিন্তায় আছেন হামিদ সাহেব।
যখনই ফ্যান চলতে দেখছেন তখনি বলছেন, “আহ্ ফ্যান চালাচ্ছো কেন? বরপক্ষ আসলে কি করবে? বিয়ে পড়ানোর সময় চার্জ ফুরিয়ে গেলে?”
তিন’শ মেহমান দাওয়াত করা হয়েছিল, কিন্তু ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে বেশি মানুষ চলে এসেছে। খাবার কম পরে গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে। হোটেলে খবর দিয়ে রেখেছেন যাতে প্রয়োজনে খাবার দিয়ে যায়।
বর এল সাতটার দিকে। এবার মেহেমানরা খাওয়া দাওয়া শুরু করতে পারবেন।
বরযাত্রী তো বাড়ির সাজসজ্জা দেখে অবাক। তাদের ছাদে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বরকে দেখার জন্যে সকলের উৎসাহের সীমা নেই।
রোদের মনটা বিপর্যস্ত। ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে। তবে তার মুখ দেখে ব্যাপারটা বোঝার উপায় নেই। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে, সকলকে সালাম দিচ্ছে, সবার সঙ্গে কথা বলছে।
কিছুক্ষণ পর বর কনে একসঙ্গে করা হলো।
অতন্দ্রিলাকে দেখাচ্ছে পুরনো দিনের কনেদের মত। যখন সাজ নয়, সৌন্দর্য ছিল কনেদের মুখ্য বিষয়।
রাত প্রায় একটা। বিয়ে বাড়ি এখন শান্ত। মেহেমানরা চলে গেছেন। অতন্দ্রিলা এখন যাবে রোদের বাড়িতে। শুরু হবে তার জীবনের নতুন অধ্যায়।
বিয়ে বাড়ির প্রচলিত নাটক – বিদায়ের সময় মা মেয়ের জড়িয়ে ধরে কান্না। কিন্তু শায়লা কাঁদছেন না। আর অতন্দ্রিলার তো কাঁদার অভ্যেসই নেই!
৭.
‘শবনম! আমার চা কোথায়?’ নির্ঝর আদুরে গলায় ডাকল ।
আমি নির্ঝরের ডাক শুনে হন্তদন্ত হয়ে কিচেন থেকে চায়ের কাপ হাতে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম নির্ঝর বারান্দায় তার রকিং চেয়ারটাতে বসে দুলছে। চোখ বুজে আছে সে। আমি খুব ধীর পায়ে নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। চোখ বুজা অবস্থাতেই নির্ঝর হাত বাড়িয়ে দিল। আমি অবাক বিস্ময়ে বললাম,’কী করে বুঝলে আমি চা নিয়ে এসেছি?’
আমি হেসে বললাম,’তুমি বসো। আমি আব্বুকে চা’টা দিয়ে আসি।’
নির্ঝর মাথা নাড়ল । ইশারায় বলল দেরি না করতে। আমি দ্রুত পায়ে আব্বুর জন্য চা নিয়ে গেলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে করাঘাত করতেই ভিতর থেকে আওয়াজ আসল। ‘আমার শবনম মামুণি, জলদি নিয়ে এসো তোমার ম্যাজিকাল চা।’ আব্বু বললেন।
আমি সহাস্যে ধীর পায়ে আব্বুর কাছে গিয়ে তার হাতে চা’টা দিতেই তিনি প্রথমে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির সাথে বললেন,’মামুণি, কেমন লাগছে এখানে তোমার? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো এডজাস্ট করতে?’
আমি সহাস্যে বললাম,’আব্বু , যখন থেকে আমি আপনাকে আব্বু হিসেবে পেয়েছি তখন থেকেই সমস্যা আমাকে দেখলে পালিয়ে বেড়ায়।’
আব্বু আমার কথাটা শুনে খুব হাসলেন। বললেন,’হয়েছে, মামুণি । এবার নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসার ঝাঁপি খুলে বসবে । কিন্তু এখন আমি প্রশংসা শুনার মুডে নাই।’
আমি মৃদু হাসলাম। বললাম,’আব্বু, আমি এখন মোটেই প্রশংসা করব না। কারণ আমি জানি আমার আব্বুটার যতই প্রশংসা করা যায় ততই কম হবে।’
আমার কথা শুনে আব্বু চোখ বড় করে তাকালেন। আবার মুহূর্তেই হেসে ফেললেন। তারপর বললেন,’যাও তো নির্ঝর কী করছে দেখ। আমার ছেলেটা যে এবার সংসারে থিতু হয়েছে–তাতেই আমি তোমার কাছে ঋণী। নয়তো আমার ছেলেটা জীবন থেকে ছিটকে পড়েছিল ঠিক আকাশ থেকে পড়া কোনো এক তারার মতো। তোমার কারণেই আজ আবার আমার ছেলেটাকে ফিরে পেয়েছি আমি। নয়তো আমার ছেলেটা সব সময় অন্ধকার ঘরে পড়ে থাকত। সে তার সাথে ঘটে যাওয়া কষ্ট থেকে কখনোই বের হতে পারত না। কাঁচ যেমন কাঁচ কাটে। তেমনি দুঃখ ও দুঃখকে বিনষ্ট করে দিতে পারে। তা আমি তোমাদের দুজনকে না দেখলে কখনোই জানতে পারতাম না।’
আমি নীরবে বাবার কথা শুনছিলাম। কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলার মতো। তারপর আব্বু তাগাদা দিয়ে বললেন,’যাও মামুণি। এবার একটু রেস্ট কর গিয়ে ।’
আমি আর কোনো কথা বাড়ালাম না। আব্বু ততক্ষণে চা শেষ করে ফেলেছেন। আমি
ধীর পায়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
৮.
আমি রুমে এসে দেখলাম নির্ঝর চা শেষ করে ফেলেছে। আমি তার পাশে দাঁড়ালাম। সে আমার হাত ধরে তার পাশে বসাল। তারপর বলল,’শবনম, আমি চাই আজ বৃষ্টি নামুক সেদিনের মতো। যেদিন তোমাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম। মনে আছে তোমার?’
আমি লজ্জাবনত হাসি হাসলাম। কেন যেন নির্ঝর যখনই ওই রাতের কথা বলে লজ্জারা এসে ভীর করে আমার মুখে। আমি তৎক্ষনাত মুখ নত করে ফেলি। নির্ঝর আমার এই কাণ্ড দেখে খুব মজা পায়। আর তাই, প্রায় সময় এই রাতটির কথা সে বলে থাকে। আমাকে লজ্জা দিতে তার বেশ ভালো লাগে। আমার চিবুকে হাত দিয়ে মুখ তুলে নির্ঝর বলল,’আহা রে, আমার লজ্জাবতী বউটা!’ এটুকু বলে একটু থেমে নির্ঝর আবার বলল,’আচ্ছা, শবনম! তুমি এত লজ্জা পাও কোথায়? বলতো।’
আমার নির্ঝরের কথায় আরো বেশি লজ্জা লাগছিল। আমি তৎক্ষনাত সেখান থেকে উঠে যেতে উদ্যত হতেই নির্ঝর আমার হাত নিজের শক্তপোক্ত হাত দিয়ে ধরে ফেলল। বলল,’বিয়ের পর থেকে এতবার এই কথাটা তোমায় বললাম। তাও তুমি এখনও লজ্জা পাও। তবে যাই হোক আমার কাছে আমার এই লজ্জাবতী লতাকেই ভালো লাগে। এটাই তোমার ভূষণ। এটাতেই আমি বারেবারে ঘায়েল হই।’
আমি নিরুত্তর। নির্ঝর আমাকে তার শক্তপোক্ত হাতের বাহুডোরে খুব শক্ত করেই আবদ্ধ করলো এবার। যেন সেই বাহুবন্ধনে একটু ঢিল পড়লেই আমি হারিয়ে যাব! আমিও ছাড়া পাবার চেষ্টা করিনি। এই শক্ত বাহুবন্ধন’ই আমার একমাত্র বিশ্বাসের জায়গা। আমার ভরসার স্থল। যার উপর আমি চোখ বুজে ভরসা করতে পারি।
আমি আমার মাথাটা তার প্রশস্ত বুকে রাখলাম। নির্ঝর আলতো হাতে বিলি কাটছে আমার মাথায় । আর ফিসফিসিয়ে বলছে,’এবার আমার জুনিয়র শবনম চাই।’
আমি তৎক্ষনাত বললাম,’নাহ্! কোনো জুনিয়র শবনম নয়, জুনিয়র নির্ঝর চাই।’
কথাটা বলতেই আবার লজ্জারা এসে ভর করলো আমার মধ্যে । নির্ঝর বেশ বুঝতে পারছে। আমি তার দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারছি সে মুচকি হাসছে। আমি তার বুকের স্পন্দন বুঝতে পারছি। একটা নির্দিষ্ট তালে উঠানামা করছে তার বুক। শুনতে পাচ্ছি ঢিপ ঢিপ আওয়াজ, আর স্পষ্ট টের পাচ্ছি তার ছন্দপতন।
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা। যেন প্রকৃতিও নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছে চারপাশে। আমি সেই নিস্তব্ধতার জাল ভেদ করে আমি নির্ঝরের হৃদস্পন্দন কেবল অনুভব করছি আর শুনছি তার হৃদয়ের নানা অব্যক্ত কথন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি এলো। বৃষ্টির ঝাপটা গ্রিলের ফাঁক গেলে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের দুজকে। আমরা সেই স্নিগ্ধ পরশ অনুভব করছি। এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে ছেয়ে গেছে আমাদের মন।
নিস্তব্ধতার চাদর ভেদ করে নির্ঝর বলে উঠল,’আজ বৃষ্টি ছুঁবে না?’
আমি নিরুত্তর। আমি জানি নির্ঝর এখন সেই রাতের কথা ভাবছে। যেদিন প্রথম দেখেছিল আমাকে।
নির্ঝর আবার বলল,’জানো, শবনম! আমি কিন্তু বৃষ্টি পছন্দ করতাম না। রাইমা চলে যাবার পর থেকে আমি নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছিলাম ঘরের অন্ধকারে । দিনের আলোয় জানলা খুলতাম না। আমার ভয় হত খুব। বাবা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন আমাকে নিয়ে। আমি কেন স্বাভাবিক হই না! এরকম দুর্ঘটনা কি শুধু একা আমার জীবনেই ঘটেছে? বাবা বারবার আমাকে এই প্রশ্ন করতেন…….।’
আমি নির্ঝরকে বাধা দিলাম। তার মুখে আমার হাতটা রাখলাম। সে আমার হাতটা নিজ হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,’আমি বলতে চাই শবনম। সব না জানালেও কিছুটা তো তোমাকে বলতেই পারি। সেদিন বিদুৎ চমকাচ্ছিল। বৃষ্টি হচ্ছিল তুমুল। আমি তো বৃষ্টি পছন্দ করতাম না। সেদিন কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমি বারান্দার দরজা খুলে সৌদামিনীর ঝলকানিতে প্রথম তোমার মুখ দেখি।’
আমি নীরবে শুনছি নির্ঝরের কথা। নির্ঝর তার কথা থামাতে আমি তার দিকে মুখ তুলে তাকাই। নির্ঝর আমার দৃষ্টি পড়ে নেয়। তারপর আবার বলতে শুরু করল,’তখন আমার মনে হয়েছিল, আমিই পৃথিবীর সবচাইতে দুঃখী মানুষ নই। আমার চাইতেও অনেক অনেক বেশি দুঃখ বয়ে বেড়াচ্ছে এই মেয়েটা।’
নির্ঝর গলার স্বর স্বাভাবিকের চাইতে আরো একটু উঁচিয়ে বলল,’জানো শবনম, তখন ওই জীবনের কাছ থেকে নিরাশ আমার মনে একটা কথার’ই উদয় হয়েছিল যে, আমি এই মেয়েটার দুঃখ ঘুচাব। ব্যস! সেই থেকে শুরু। অবরুদ্ধ এই আমি সমস্ত অন্ধকারকে পেছনে ফেলে পা বাড়ালাম আলোর দিকে। আর তুমি হলে আমার সেই আলোকবর্তিকা।’
বৃষ্টি থেমে গেছে। প্রকৃতি নিস্তব্ধ । জানি , সজীবতায় ছেয়ে গেছে সমস্ত প্রকৃতি। ঠিক যেন আমার মতো। আজ অনেক বছর পর নির্ঝর তার জীবনের এক কালো অধ্যায়ের অতি ক্ষুদ্র অংশ আমাকে বলেছে। আমি তার কাছে কখনো জানতে চাইনি। সেও আমাকে কখনো বলেনি। তবে আজ বলেছে। হোক তা অতি ক্ষুদ্র অংশ কিন্তু বলেছে তো।
৪.
সকাল থেকেই আম্মু আয়োজনের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন । আজ নাকি আম্মুর দূর সম্পর্কের কোনো আত্মীয় আসবে। আর তাই আম্মুর কোনো রেস্ট নেই। সেই ভোর পাঁচটা থেকে কাজে লেগে পড়েছেন। আমিও উঠে পড়ি তখন। আমার খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস আছে। তাই ঘুম থেকে জলদি ওঠা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা হয় না।
রাফি গতকাল রাতেই বাজার করে এনেছে। আজ আম্মু কিন্তু বাড়াবাড়ি রকমের আয়োজন করছেন। আমি ভেবে পাচ্ছি না এতো আয়োজনের কী মানে!
নানান নাশতা, শরবত, আর পোলাও, মুরগির রোস্ট, খাসির রেজালা আরো কত কী! তারপর পায়েসসহ কয়েক প্রকার মিষ্টি জাতীয় খাবারের ব্যবস্থাও করেছেন। এতটা আয়োজন আমার কাছে বাড়াবাড়িই মনে হলো।
দুপুর নাগাদ মেহমান চলে আসলো। মোট পাঁচ জন সদস্য আসলেন। দুজন মাঝ বয়সী মহিলা, একজন বৃদ্ধা, আর একজন মাঝ বয়সী পুরুষ ও আরেকজন যুবক ছেলে।
আমি এনাদের পর্দার আড়াল থেকে দেখেই চলে গিয়েছি। রাফি তাদের বসার ব্যবস্থা করলো। কিছুক্ষণ পর আম্মু আমার রুমে এসে বললেন ভালো একটা কাপড় পরে নেবার জন্য। আমি তো পুরোই হতবাক। আমি বিস্মিত স্বরে বললাম,’আম্মু , এই ড্রেসে কী খারাপ আছে? ভালোই তো আছে এটা।’
তোকে পরতে বললাম পর। আর কোনো কথা না। আর একটু সাজগোজ করে নিস। আম্মুর এ কথায় খুব রাগ হলো। এই কথার মানে হলো এই মেহমানদের আগমন ঘটেছে আমাকে দেখার জন্য।আজকে যে আবার কত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে কে জানে!
আম্মুরই বা কী দোষ! উপযুক্ত মেয়ে বাসায় থাকলে কোনো মায়েরই মাথা ঠিক থাকার কথা না। আমি কোনোরকমে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। আম্মু ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে আমার রুম থেকে।
ব্লু আর সাদার মিশেলের একটা থ্রি পিস পরেছি। আম্মু জানেন যে আমি মোটেই শাড়ি পরতে রাজী হব না । তাই বোধহয় আজ আর শাড়ি পরতে বলেননি। মুখে হালকা ক্রিম মাখলাম আর চোখে দিলাম কাজল। আমি কখনোই কপালে টিপ পড়ি না।
রাফি হন্তদন্ত হয়ে আমার রুমে প্রবেশ করল। আমকে এক পলক দেখেই বলল,’আজকে বুঝি আমাদের ঘরে কোনো পরী চলে এসেছে? তাহলে আমার পেত্নী মার্কা বোনটা কই গেল?’
মাথা নাড়িয়ে এদিক সেদিক উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি এই বেয়াড়া ছেলেটা আমাকে খ্যাপানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ না দেখে সে আমার কাছে এসে পুনরায় প্রশ্ন করল,’পরী! আপনি আমার পেত্নী বোনটাকে দেখেছেন?’
আমি বড় বড় চোখ করে তাকালাম তার দিকে । তারপর তার কান মলে দিয়ে বললাম,’আমি পেত্নী? আবার বল কি যেন বলছিলি তুই?’
‘এহ্ রে! তোমার কথা আমার আপুনির মতো লাগছে কেন? তাহলে তুমিই কি? ইশ আপু একদম চিনতেই পারিনি। এত সুন্দর লাগছে কেন তাহলে? আমি ভাবলাম আমাদের বাসায় পরী চলে আসছে।’ রাফি মুখ কুঞ্চিত করে ব্যথা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল।
আমি আরও জোরে কান মলে ধরলে রাফি চিৎকার করে বলে,’আহ্ ! আপু লাগছে তো!’
‘পেত্নীরা এভাবেই মারে। জানিস না তুই?’ আমি খ্যাপাটে গলায় বললাম।
‘আপু ছাড় তো! আম্মু তোকে নিয়ে যেতে বলেছে। তোর হবু বর তোর জন্য অপেক্ষা করতেছে।’ মুখ ফুলিয়ে বলল রাফি।
রাফির কথা শুনে আমি তার কান ছেড়ে দিলাম। এর মধ্যেই আম্মু হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করে আমাদের দুজনকে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,’তাড়াতাড়ি আয় শবনম। রাফিটাও যে কী করে না! তাকে ডাকতে পাঠালাম আর সে নিজেই আটকে রইল।’
৫.
‘আপনার বাবা কী আপনাদের সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করেন না?’ আমার সামনে বসা ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।
তার প্রশ্ন শুনে আমার মাথা দপদপ করছে। আমি বুঝতে পারছি খুব ভালো মতোই যে শেষমেশ এই বিয়েটাও হবে না। আমি প্রচণ্ড রাগে হিসহিসিয়ে বললাম,’আপনি কি আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না?’
সামনে বসা ভদ্রলোক ইতস্তত করতে করতে বললেন,’ইয়ে মানে..একটু তো শুনেছি চাচীর কাছ থেকে। কিন্তু আপনার কাছ থেকে জানতে পারলে ভালো হয় না? তাই আরকি…!’
‘আমার সম্পর্কে জানতে চাইলে তো আমার কথাই জিজ্ঞেস করা দরকার। কিন্তু আপনি তো জানতে চাইলেন আমার বাবা সম্পর্কে !’ তেজী গলায় বললাম আমি।
ভদ্রলোক কেমন যেন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হয়তো আমার মতো বাবাহীন মেয়ের কাছ থেকে এমন তেজী স্বরের উত্তর আশা করেননি। একটু ধাতস্থ হয়েই
পরক্ষণেই বললেন,’শুনেছি আপনার বাবা আপনাদের ছেড়ে পালিয়েছে । সেই কারণটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এই কারণটা জানার উপর আমার মতামত নির্ভর করবে । তাই আপনাকে এই প্রশ্ন করতে বাধ্য হলাম।’
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,’একজন মানুষের পরিচয় বলতে কি বাবার সমস্ত ইনফরমেশনকে বুঝায়? মায়ের ইনফরমেশনকে বুঝায় না? বাবা–মার কথা বাদই দিলাম । একজন মানুষের পরিচয় বলতে তো তার নিজস্বতাকে বুঝায়। আর আপনি আমাকে বিয়ে করবেন কি না তা আমার বাবার পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে!’
এতটুকু বলেই আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম । একটা দোয়েল পাখি বারান্দার রেলিংয়ের উপর বসে তারস্বরে গাইল। আবার ফুরুৎ করে উড়াল দিলো। আমি পাখিটার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সামনের মানুষটার দিকে সরাসরি তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। তারপর বললাম,’আপনি কি আমার বাবার সাথে সংসার করবেন?’
ভদ্রলোক একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বোধহয় বুঝতে পেরেছেন যে আমি কারো হাতের পুতুল হয়ে চলার মতো মেয়ে নই। তৎক্ষনাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,’আপনাকে আমি কখনোই বিয়ে করব না। এত অভদ্র, বেহায়া মেয়েকে তো আমি কক্ষণো বিয়ে করব না। তার উপর পিতৃ পরিচয়হীন একটা মেয়ে! কিন্তু কথার কি ঝাঁঝ।’
আমি আবারো তার দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। কিছু বলাটা একেবারেই যুক্তিসঙ্গত হবে না। আমি এই বিষয়টা খুব ভালো করে জানি। তাই চুপ থাকলাম। এই ধরনের মানুষগুলো শুধু লেখাপড়াই করে কিন্তু আফসোস! এদের মধ্যে নূন্যতম মনুষ্যত্ব বোধটুকুও নেই। এরা আসলে শিক্ষিতের মুখোশের আড়ালে একেবারেই অঘা। আর এমন অঘাদের সাথে আমি কথা বলাই পছন্দ করি না।
৬.
বুষ্টির তোড় বাড়ছে। দু’হাঁটুর মাঝখানে মুখটা রেখে বারান্দায় বসে আছি । আরেকটা বিয়ে ভেঙে গেলো। আম্মু খুব কেঁদেছেন এটা নিয়ে । আম্মুর চোখের জল আমার হৃদপিন্ডটাকে যেন কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ার মতন করে খুঁড়ছে বারংবার। আর তাতেই রক্তক্ষরণ হচ্ছে। রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে আমার হৃদয়ের সমস্তটুকু । তবুও আমি নিঃশ্বাস নিচ্ছি, বেঁচে আছি।
বৃষ্টির পানির ঝাপটা আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমি সরছি না, নড়ছি না। আজ বৃষ্টির এই শীতল স্পর্শ আমার কাছে খুব আপন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি আমাকে তার পবিত্র স্পর্শে জানান দিচ্ছে আমার কষ্টে আমার সমব্যথী হবার। একটু পর উঠে দাঁড়ালাম। জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখছি। যদিও বৃষ্টির কারণে আকাশ অস্পষ্ট । তবুও দেখছি। ভালো লাগছে দেখতে। ডান হাতটা বের করে দিলাম। আমার হাতের তালুতে জমছে বৃষ্টির ফোঁটা টুপ টুপ শব্দ করে। আমি সেই পানি আবার ছিটিয়ে দিচ্ছে আমার চারপাশে।
হঠাৎ আমার চোখ পড়ল সামনের বাড়ির দিকে। এক জোড়া চোখ ঠিক আমার দিকে তাক করা। আমি সেই মানুষটাকে চিনতে পারলাম না। আমার কাছে খুব বিরক্ত লাগল এভাবে তাকিয়ে থাকাটা। আমি দ্রুত সরে গেলাম সেখান থেকে। যদিও আমার খুব ইচ্ছে করছিল বৃষ্টি ছুঁতে ।
ঘরের মধ্যে ঢুকতেই আমার মনটা আবার বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। আমি ভাবতে লাগলাম সে কে? হঠাৎ মনে পড়ল, ওখানে যে থাকে সেই ছেলেটাতো ঘর থেকে বের হয় না। রাফির কাছ থেকে শুনেছিলাম। ছেলেটা লন্ডন থেকে এসেছিল এই তো মাত্র কয়েক মাস আগে। আর আসার পর থেকেই দরজা বন্ধ করে, ঘর অন্ধকার করে পড়ে থাকে। কারো সাথে কথা বলে না, দেখা করে না। শুধু রুমে পড়ে থাকে।
হঠাৎ আমার মনের মধ্যে প্রশ্নের উদয় হলো। আচ্ছা কেন ছেলেটা এভাবে কারো সাথে কথা বলে না! কেন সে অন্ধকার ঘরে পড়ে থাকে! কেনই বা সে বাহিরে বের হয় না! কি হয়েছে ছেলেটার? কী এমন কষ্ট; যে কষ্ট তাকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে?
রাফি হুড়মুড় করে আমার রুমে ঢুকে পড়ল। সেই শব্দে আমার ভাবনার জগতে ভাটা পড়ল। আমি একটু খেয়াল করতেই দেখতে পেলাম রাফিকে খুব বিমর্ষ মনে হলো। আমি বিছানায় বসে ছিলাম। রাফি এসে আমার পাশে বসল। বলল,’ আপু, সবার বাবা কত্ত ভালো হয়। আমাদের বাবাটা এমন কেন? আমাদের কেন ছেড়ে চলে গেল? কেন আমাদের খোঁজ রাখে না? কেন আমাদের ভরণপোষণ করে না?’
আমি রাফির কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমি নিজের কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করলাম,’রাফি, ভাই আমার। কী হয়েছে?’
রাফি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,’বাবা নেই বলে তোর কতগুলো বিয়ে ভেঙে গেল। বাবা নেই বলে আমার সাথে অনেকে খেলতে চায় না। বাবা নেই বলে অনেকে আড়চোখে তাকায় আমাদের দিকে। কেউ কেউ আবার করুণ চোখে তাকায়।’ রাফি থামল।
এবার রাফি গলার স্বর উঁচু করে বলল,’আপু জানিস, ওই করুণ দৃষ্টি আমাকে বারংবার তীক্ষ্মভাবে আঘাত করে একেবারে হৃদয়ের গভীরে, বারবার আমি ওই দৃষ্টিতে মারা যাই। কেন বল না ওরা ওভাবে তাকায়?’
আমি বাকরুদ্ধ। বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে এটা জানার পর আমার অনেকগুলো বিয়ে ভেঙে গেছে। আমাদের আর্থিক অবস্থার জন্য তো অনেকে রিজেক্ট করেই–তবে বেশিরভাগ রিজেকশন আসে বাবা ছেড়ে চলে গেছে জানার পর। আর তাই আম্মুর আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। আমি ভাবি বিয়েই করব না। লেখাপড়া শেষ করে ভালো একটা জব করব। আম্মু আর ভাইকে নিয়ে কাটিয়ে দেব বাকি জীবন।
১.
‘বাবা’ শব্দটিতে আসলেই কি অদ্ভুত কোনো ক্ষমতা আছে?
ছোটোবেলা থেকেই আমার মনের গহীনে এই প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি চলছে ক্রমাগত। সময়ের পরিক্রমায় তা বেড়েছে বৈ কমে নি। এখনো মনে পড়ে ছোটোবেলার সেইসব স্মৃতি–যা আমি এখনো মনে করতে ভয় পাই, পাই এক দুর্জ্ঞেয় কষ্টানুভূতি।
যখন স্কুলে যেতাম তখন দেখতাম বাবা নামের মানুষগুলো তাদের সন্তানদের আদর করে করে খাবার খাওয়ায়। খুব যত্ন করে। আমি নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতাম সেই বাবা নামক মানুষগুলোর দিকে আর খানিক পর পর তাকাতাম সেই বাবা নামক মানুষগুলোর সন্তানের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে। আমার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরুতো না। আমার সামনে কোনো আয়না থাকত না। তবে আমি ওইটুকু বয়সেই বেশ ভালোই বুঝতে পারতাম; আমার মুখটা হয়ে যেত বিবর্ণ আর চোখ অশ্রুতে টলমল। যেন আমার গালে একটা মৃদু টোকা দিলেই গড়িয়ে পড়বে চোখের দেয়ালের উপর জমে থাকা স্বচ্ছ জলের ধারা।
আমি শবনম। এখন অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছি। সময়ের সাথে সাথে বয়সটাও বেড়ে গিয়েছে । কিন্তু মনটা এখনো না পাওয়ার কষ্টে আর্তনাদ করে। আমার কাছে কোনো ভাষা থাকে না নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য। অনেকটা সামলে নিয়েছি নিজেকে। কিন্তু ওই যে, বাস্তবতা বলে একটা শব্দ আছে। সেই শব্দটার কশাঘাত বড়ই নিদারুণ। যখনই কোনো বাবাকে দেখি; বিশেষ করে তাদের সন্তানের প্রতি গভীর ভালোবাসা দেখলে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে, চোখ ভারী ওঠে আর মনের মধ্যে ওঠে এক ভয়ংকর প্রলয়ঙ্কারী তুফান ।
আজও আমি খুঁজে পাই না আমার প্রশ্নের উত্তর। আজও আমি জানতে পারিনি বাবার এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবার কাহিনী। বাবার চলে যাবার গল্প কি অজানাই থাকবে চিরকাল? আমি ভেবে পাই না! কেন এমন হয়েছে আমাদের সাথে? বাবা কেন আমাদের রেখে চলে গেলেন? জন্ম দিলেই কি বাবার কর্তব্য শেষ হয়ে যায়? সব দায়িত্ব কি শুধু ‘মা’ নামক মানুষগুলোর উপর বর্তায়? আমার মনের মধ্যে প্রশ্নেদের আন্দোলন চলছে ক্রমাগত সেই শৈশব থেকে। তবে আজও উত্তর আমায় দেয়নি ধরা। প্রশ্নের বেড়াজালে আবদ্ধ মানুষের কষ্ট শুধু তারাই বুঝে যারা এমন হাজারও প্রশ্নের সম্মুখীন। এসব কষ্ট তারাই বুঝবে যারা প্রতিনিয়ত সমাজের মানুষগুলোর কাছ থেকে বারেবারে আঘাত পায়। আঘাতে জর্জরিত হয়, রক্তাক্ত হয় যাদের হৃদয় ।
‘শবনম! দেখতো রাফিটা কই গেলো?’ মায়ের চিৎকারে আমার চিন্তা থমকে গেল । আমি জবাবে বললাম,’দেখছি আম্মু।’
আমি এতক্ষণ বসেছিলাম আমার রুমের বারান্দায় । রাফি আমার ছোট ভাই। এবার এইচ এস সি দিবে। আমরা দু ভাই বোনকে মানুষ করতে আমার আম্মুর যে ত্যাগ তা অবর্ণনীয় । কখনোই বলে শেষ করা যাবে না। বসা থেকে উঠার আগে চোখ মুছে নিলাম। আম্মু আমাকে দেখলেই বুঝে যাবেন যে আমি কেঁদেছি। কী অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে মায়েদের! আমার খুব অবাক লাগে। আমি সাধারণত লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করি। কারো সামনে কান্না করতে পারি না। লজ্জা লাগে খুব বেশি। কিন্তু লুকিয়ে কান্না করলেও আম্মু কীভাবে যেন বুঝে যান! আমার সত্যিই অবাক লাগে বিষয়টা! পৃথিবীতে মায়েরা সব থেকে বেশি ক্ষমতার অধিকারী: আমি এই একটা বিষয় থেকেই তা বুঝতে পারি। তারা অপরাজেয় ।
দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে পরপর কয়েক ঝাপটা পানি দিলাম মুখে। যাতে আম্মু কোনোভাবেই বুঝতে না পারেন যে আমি আবার কেঁদেছি। যদিও আমি জানি এটা আমার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা। আম্মুর সামনে পড়লেই তিনি বুঝে যাবেন বিষয়টা ।
২.
আমাদের বাড়ির সামনেই বড় একটা উঠোন। উঠোন পেরিয়ে বড় একটা খেলার মাঠ আছে। রাফিকে খুঁজছি । ছেলেটা দিন দিন বেয়াড়া হয়ে উঠছে। সারাদিন খেলা আর খেলা। খেলা ছাড়া সে আর কিছুই বুঝে না। আমি হেঁটেই যাচ্ছি। রাফিকে দেখতে পাচ্ছি না। এদিকে আম্মু আবার দুশ্চিন্তা করতে শুরু করবে। সামনে নিঝুমকে দেখেই আমি মনে মনে স্বস্তি পেলাম। নিঝুম যেখানে আমার ভাইটাও সেখানে থাকবে। দুজন একেবারে প্রাণের দোস্ত ।
মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে নিঝুমকে ডেকে বললাম রাফিকে ডেকে দেবার জন্য। সে তৎক্ষনাত দিল এক ভৌ দৌঁড় । দু’তিন মিনিটের মধ্যেই রাফি আমার সম্মুখে হাজির হলো। আমি এবার তার কান মলা দিয়ে ধরে বললাম,’ আম্মু যে সেই কবে থেকে ডাকছে, তার কি কোনো খবর আছে তোর?’
‘আপু সরি রে! এবারের মত মাফ করে দে। দেখ, আমি আর জীবনেও খেলব না। এই তোকে ছুঁয়ে বলছি।’ রাফি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল।
আমি তৎক্ষনাত বললাম,’আমাকে ছুঁয়ে আর কত মিথ্যা কথা বলবি তুই? তোকে আর কোনো সুযোগ দেয়া যাবে না।’
‘আপু সরি বললাম তো।’ একটু থেমে রাফি আবার বলতে শুরু করল,’তুই জানিস না ক্ষমা করা মহৎ গুণ। তোর মধ্যে এই গুণটা একদম নাই। অর্জন কর, বুঝলি!’
আমি খ্যাপাটে গলায় বললাম,’লাগবে না আমার এই গুণ। তাড়াতাড়ি চল আম্মু ডাকছে। তখন আম্মু নিজেও আমাদের খুঁজতে বেরিয়ে পড়বে।’
রাফি তিরিক্ষি মেজাজে বলল,’তুই খুব নিষ্ঠুর আপু!’ তৎক্ষনাত আবার গলার স্বর নরম করে বলল,’আপু আজকে আম্মুর পিটানি থেকে বাঁচিয়ে নিস আমায়। প্লিজ আপু, প্লিজ।’ রাফির কণ্ঠে অনুনয় ঝরে পড়ছে।
আমি তার করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। আমার ভাইটা অত্যন্ত ফাজিল। আমি মুখে হাসি রেখেই বললাম,’চল এবার। বাকিটা দেখা যাবে বাসায় গেলে।’
৩.
আম্মু খাবার বেড়ে দিচ্ছেন আর সমানে চেঁচাচ্ছেন । রাফি মুখটা একেবারে করুণ করে রেখেছে। একেবারে যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে পারে না। আমি কোনোরকমে বললাম,’ আম্মু খাবার সময় এখন আর বকো না। খাবার শেষ হলে তখন নাহয় আবার শুরু করো।’
আম্মু সাথে সাথে বড় বড় চোখ করে তাকাল আমার দিকে। আমি ভয়ে মিইয়ে গেলাম। আম্মু বলল,’তোদের তো কোনো চিন্তা নাই । সব চিন্তা আমার। তোদের যে মানুষ করছি, সেইটাই আমার অপরাধ। একজন তো ফেলে রেখে বেঁচে গেছে। আপদ বিদেয় করে সে এখন সুখে আছে। সব জ্বালা হইছে আমার।’ এভাবে চিৎকার করতে করতে আম্মু হাতের সব বাটি , গ্লাস ধপাস ধপাস করে রাখছেন। আর শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছছেন।
আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। উঠে গিয়ে আম্মুর পাশে বসে জড়িয়ে ধরলাম আমার আম্মুকে। আমারও খুব কান্না পাচ্ছে। কান্নার তোড়ে আমার গলা ধরে গেছে। ধরা গলায় বললাম,’আম্মু, তোমাকে কতবার বলেছি, ওই অমানুষটার নাম আর কখনো মুখে উচ্চারণ করবে না। না আকারে না ইঙ্গিতে! আমাদের শুধু একজনই জন্মদাত্রী এবং সেটা তুমি। তুমি আমাদের আম্মু, তুমিই আমাদের সব। আমাদের কোনো বাবা নামক নিষ্ঠুর প্রাণীর দরকার নেই।’
আম্মুর চোখের জল আমি নিজ হাতে মুছে দিলাম। আমার আম্মুটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । আমি এবার রাফির দিকে তাকালাম। রাফির কান্নাভেজা মুখটা দেখে আমার বুক কেঁপে উঠলো। আমার ভাইটা খুব সহজে কাঁদে না। তার আমার মতো কাঁদার বাতিক নেই। কিন্তু আম্মুর চোখের জল সে সহ্য করতে পারে না। তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। হঠাৎ রাফি তার জায়গা থেকে উঠে এসে আম্মুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বলল, আম্মু আমি আর কক্ষণো তোমার অবাধ্য হবো না। তুমি যা বলবে তাই করব। তুমি যদি খেলতে নিষেধ করো। তবে আমি আর কখনো খেলতে যাব না। এই দেখ তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিলাম।’
আমি দেখছি আমার মা আর ভাইটা সমানে কেঁদে চলেছে। আমি দুজনকেই জড়িয়ে ধরলাম। আম্মু এবার কান্না থামিয়ে বললেন,’হয়েছে আমার সোনামণিরা! আর কাঁদতে হবে না। এবার খেতে শুরু কর।’
রাফি বলল,’আম্মু আজকে আমরা সবাই এক প্লেট থেকে খাব। তুমি খাইয়ে দেবে।’
আম্মুর চোখ তখন খুশিতে চকচক করছিল। সহাস্যে বললেন,’আচ্ছা ঠিক আছে। আজকে আমি আমার সোনামণিদের নিজ হাতেই খাইয়ে দেব।’
আমাদের দু’জনের মুখে আম্মু নিজ হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন । আর আমরা তৃপ্তির সাথে খাচ্ছি। আর আমি আর রাফিও আম্মুর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছি। এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি ।
“কাজটা কিন্তু তুমি মোটেও ঠিক করলে না মা।”
হতাশ গলায় বলল রোদ।
ফিরোজা বললেন, “কেন? কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক তা কি তোর কাছ থেকে শিখতে হবে নাকি?”
“পৃথিবীর অন্য যেকোনো ব্যাপারে শিখতে হবে না। কিন্তু আমার ব্যাপারে শিখতে হবে।”
“বেশ তো, বল না কি শেখাবি আমায়?”
“মা তুমি কিন্তু বলেছিলে শুধু দেখতে গেলেই চলবে। এখন এই বিয়ের কথা আসলো কোত্থেকে?”
“একটা মেয়েকে দেখে আসলাম, তাকে খুব পছন্দও করলাম। এখন তার সাথে তোর বিয়ের কথা আগাবো না?”
“না আগাবে না। তুমি খুব ভালো করে জানো আমি বিয়ে করতে পারবো না।”
“কেন পারবি না? বাবা একটু বোঝার চেষ্টা কর, তুই যার কথা ভেবে বিয়ে করতে চাচ্ছিস না সে তোর আর নেই এ পৃথিবীতে।”
“মা প্লিজ! ভালো লাগছে না আর এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে ভালো লাগছে না।”
আহত গলায় কথাগুলো বলে নিজের ঘরে চলে এল রোদ।
কাছের মানুষের মৃত্যুতে হ্যালুসিনেশন ব্যাপারটা স্বাভাবিক। কারো ক্ষেত্রে এর মাত্রা হয় বেশি, আবার কারো ক্ষেত্রে কম।
রোদের ক্ষেত্রে এই হ্যালুসিনেশনের মাত্রাটা তীব্র। শুধু তীব্র বললে ভুল হবে,ভয়ংকর তীব্র।
চার বছর হয়েছে ইরার মৃত্যুর, কিন্তু আজও রোদ বাড়ির প্রতিটি কোণায়, প্রতিটি কনায় অনুভব করে ইরাকে। ইরার হাসির শব্দ, কান্নায় শব্দ, নূপুরের শব্দ, গুনগুন করে গাওয়া গানের শব্দ এখনো কানে আসে রোদের।
এই ব্যাপারটা রোদের ভালোই লাগে। রোদ মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ভুলতে চায় না ইরাকে।
ঘরে আসতেই মনে হলো ইরা যেন কথা বলছে। কঠিন গলায় ইরা বলছে, “এই তুমি কেমন মানুষ বলো তো! আমি চলে যাওয়ার আগে না তোমাকে বলে গেলাম, চমৎকার একটা মেয়েকে বিয়ে করতে। তুমি বিয়ে করতে রাজি না কেন সত্যি করে বলতো? আমার কথার কোনোই মূল্য নেই না?”
রোদ ভড়কে উঠে আশেপাশে তাকায়। না, ইরা তো কোথায় নেই!
কথাগুলো তাহলে কে বলল? ইরা নাকি রোদের অবচেতন মন?
রোদকে বেশ বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে।
কিছুক্ষণ কাটতেই রোদ আবার মায়ের কাছে গেল। তার চোখভর্তি পানি। মনে হচ্ছে কয়েক মুহূর্ত আগে প্রচুর কান্নাকাটি করেছে।
রোদ ফিরোজার কোলে মাথা রাখতে রাখতে বলল, “ইরা যাওয়ার আগে তোমাকে আমার আবার বিয়ে করা নিয়ে কি বলেছে মা?”
ফিরোজা আহত গলায় বললেন, “বলেছে, অনেক কথাই বলেছে। সেগুলো আমি তোকে বলবো না। তুই কষ্ট পাবি।”
“আমার জীবনের সব কষ্ট আমি সেদিনই পেয়ে গেছি মা।”
“তোর কষ্ট আর বাড়াতে চাই না বাবা। শুধু এতটুকু বলতে পারি ইরা আমার বৌমা ছিল না ও ছিল আমার মেয়ে। অপারেশনের কয়েক ঘণ্টা আগে ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে মেয়েটা আমাকে বলেছিল তোকে আবার বিয়ে দিতে। আমি শুধু ইরার ওই কথাগুলো ভেবেই তোকে বিয়ে দিতে চাচ্ছি।”
রোদ এবার উঠে বসল।
মাকে জড়িয়ে ধরে, কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ইরা আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেল মা? কেন?”
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত কোনো ভাষা ফিরোজার জানা নেই। তিনি কেবল অসহায়ের মতো ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন।
আজ বুধবার।
অতন্দ্রিলাদের বাড়িতে আসবেন ফিরোজা ও রোদের চাচা, বিয়ের কথা পাকা করতে। সকাল থেকেই মহা উৎসাহের সঙ্গে রান্না বান্না সহ বাড়ির যাবতীয় কাজ করছেন শায়লা।
কেউ তাকে দেখলে ধারনাই করতে পারবে না, দুদিন আগে বাড়ি থেকে ঝগড়া করে চলে গিয়েছিলেন।
শায়লার একটা বিশেষত্ব হল, যখন তার কারো উপর রাগ হয় তখন সেই রাগের পরিমাণটা ক্রমেই বাড়তে থাকে। তবে যত দ্রুত রাগটা বাড়ে, তত দ্রুতই আবার কমে যায়। উনি বেশি দিন কারো উপর রাগ করে থাকতে পারেন না।
হামিদ সাহেবের উপর রাগটা ১৯ বছর ধরেও কমেনি। কিন্তু অতন্দ্রিলার বিশ্বাস, এই রাগ একদিন কমবে। কমতেই হবে।
নিচে বসার ঘরে চলছে অতিথি আপ্যায়নের দীর্ঘ পর্ব। বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক করার সময় অতন্দ্রিলাকে সেখানে ডাকা হবে। আপাতত
সে নিজ ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
তখনি সন্ধ্যা অতন্দ্রিলার ঘরে এলো।
হতাশ গলায় বলল, “আমার কিন্তু এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুই এ বিয়েতে রাজি!”
অতন্দ্রিলা বলল, “আর আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুমি এ বিয়েতে রাজি নও! বাবা, মা, দাদি সবাই যখন রাজি তখন তোমার এত আপত্তির কি হলো আপা?”
সন্ধ্যা বসতে বসতে বলল, “যাই বল না কেন, তুই কিন্তু অস্বীকার করতে পারবি না যে তোর বিয়ে হয়েছে একজন ত্রুটিপূর্ণ মানুষের সাথে!”
“আপা দেখো, আমি একজন ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। সেই অর্থে আমিও ত্রুটিপূর্ণ। তো ত্রুটিতে ত্রুটিতে কাটাকাটি!”
“আচ্ছা, তুই ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে হলে আমি কি? মধুর হাড়ি? আমার কি ভালো ঘরে বিয়ে হয়নি?”
“আপা তুমি তো প্রেম করে বিয়ে করেছো!”
“তাহলে তুইও প্রেম কর!”
“আপা আমি প্রেম করতে পারি না আর পারবোও না। তাইতো বাবার পছন্দের পাত্রের সাথে খুশি মনে বিয়ে করতে যাচ্ছি!
আর আপা শোনো, পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যেই কম বেশি ত্রুটি আছে। এটা কোনো বিষয় না।”
“আচ্ছা? তোর জাভেদ ভাইয়ের মধ্যে কি ত্রুটি আছে শুনি?”
“আপা জাভেদ ভাইয়ের ত্রুটির খাতা একবার খুললে তা বন্ধ করতে করতে রাত বারোটা বেজে যাবে।”
“বাজুক বারোটা! আমি শুনতে চাই, খোল তোর খাতা!”
“তাহলে শোনো। জাভেদ ভাইয়ের ত্রুটিগুলোর মধ্যে প্রধান এবং বিরক্তিকর ত্রুটিটি হলো, সে প্রতিটা কথা দুবার করে বলে। যেটা একটা সুস্থ মানুষকে মানসিক অসস্তিতে ফেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এছাড়া তিনি ভয়ংকর অগোছালো। একটা টুথপেস্ট জায়গা মত রাখতে পারেন না।”
“এগুলো তোর কাছে ত্রুটি?”
“অবশ্যই ত্রুটি! মানুষের স্বভাবগত ত্রুটিগুলো সমাজগত ত্রুটির থেকে বড়।”
সন্ধ্যা রাগে অভিভূত হয়ে বলল, “যা খুশি ভাব!”
ঘন্টাখানেক পর নিচে অতন্দ্রিলার ডাক পরল। বিয়ে ঠিক করা হয়েছে, দেড় মাস পর। ১৮ অক্টোবর। অতন্দ্রিলা কিছুটা শান্তির নিশ্বাস ফেলল, তার ধারনা ছিল হয়তো আগামী সপ্তাহেই বিয়ে ঠিক করা হবে।
ফিরোজা হাসি মুখে এত অতন্দ্রিলাকে বললেন, “মা, তুমি কিছু বলতে চাও?”
অতন্দ্রিলা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আপনাদের বাড়িতে কয়জন কাজের লোক?”
শায়লা ইতস্তত হয়ে বললেন, “আহ্ অত! কি বলছিস এসব?”
ফিরোজা বললেন, “না, না ঠিক আছে। আ আমাদের বাড়িতে আটজন কাজের লোক আছে। কেন বলো তো মা?”
“বিয়ে হওয়ার পর সেই আটজনের মধ্যে থেকে একজন যদি আমাদের বাড়িতে আসে এবং আমাদের জরিনা যদি আমার সাথে আপনাদের বাড়িতে যায় তাহলে কি আপনাদের কোনো অসুবিধা আছে?
“না, না মা কোনো অসুবিধা নেই। একজন কেন, প্রয়োজন হলে আরও আটজন পাঠিয়ে দেব এ বাড়িতে!”
“আমার বাবা এবং দাদীর জন্যে একজনই যথেষ্ট, আটজন এসে পরলে তারা নিজেদের আত্মনির্ভরশীলতা হারিয়ে ফেলবেন।”
বিকেলের দিকে অতিথি চলে গেলে, জরিনা অতন্দ্রিলার ঘরে যায়।
গম্ভীর গলায় অতন্দ্রিলাকে বলল, “আফা আমি আপনের লগে ওই বাড়িতে যামু না!”
“কেন?”
“ওইটা মরা বাড়ি আফা! মরা বাড়িতে ভূত থাকবো না তা কি হয়?”
“ভূত থাকবে ভূতের মতো, আর তুমি থাকবে তোমার মত! অসুবিধাটা কোথায়?”
“আফা কম বয়সী মাইয়ার ভূত! ভোর রাইতে আমার চুল ছিরা নিয়া যাইবে।”
“তুমি খালি ক্ষতিটাই দেখলে, সেখানে গেলে যে তোমার কত লাভ তা আর দেখলে না?”
জরিনা চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, “কি লাভ আফা?”
“দেখো, এখানে তোমাকে সব কাজ করতে হয়। ঘর মোছা, ঘর গোছানো, বাসন পরিষ্কার করা, কাপড় ধোয়া, রান্না করা – সব!
আমি চলে যাওয়ার পর তুমি পরবে আরেক বিপদে। সেটা হলো দাদীকে ওষুধ খাওয়ানো, দাদীর উদ্ভট সব শখ মেটানো।
কিন্তু ভেবে দেখো, আমার সাথে যদি তুমি ওই বাড়িতে যাও তাহলে কিন্তু তোমাকে তেমন কোনো কাজই করতে হবে না। তোমার প্রধান কাজ হবে আমার কাজে আমাকে হাতে হাতে সাহায্য করা।
আমি তোমাকে জোর করছি না, কিন্তু সিন্ধান্ত তোমার। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাকে ওই বাড়িতে নিয়ে যাবো না আমি।”
জরিনা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আফা আফনে না অনেক ভালা মানুষ। সত্যই তো আমি এই কথা ভাইবা দেখি নাই!”
“এখন তো ভাবলে! এবার যাও বেশি কথা না বাড়িয়ে আমার জন্য কফি বানিয়ে আনো।”
“অক্ষণি আনতেসি আফা!”
ঘর থেকে হড়বড় করে বেরিয়ে গেল জরিনা।
মানুষকে এমন ছোটখাটো লোভ দেখাতে ভালোই লাগে অতন্দ্রিলার।
অতন্দ্রিলার কোনো বন্ধু নেই। স্কুল কলেজে অসংখ্য বন্ধু-বান্ধবী থাকেলও তাদেরকে কখনোই ভরসাযোগ্য বন্ধু বলে মনে করেনি সে।
অতন্দ্রিলার দরকার এমন একজন বন্ধু, যাকে সে নির্বিকারে সকল সমস্যার কথা বলতে পারবে।
জরিনাকে অতন্দ্রিলা বন্ধু মনে করে না। কিন্তু জরিনার অযৌক্তিক কথাগুলো মন ভালো করে দেয় তার। তাই জরিনাকে সাথে নিয়ে যাওয়া।
কিছুদিন পরের ঘটনা।
সন্ধ্যা এবং শায়লা অতন্দ্রিলাকে নিয়ে বিয়ের শপিং করতে এসেছেন। হামিদ সাহেব তাদের সঙ্গে আসেননি। তার কথা, “শপিং-টপিং হচ্ছে মেয়েলি কর্মকাণ্ড। এর মধ্যে আমি জড়িয়ে নিজের সময় নষ্ট করতে চাই না।”
ওদিকে ফিরোজাও রোদকে এসেছেন বিয়ের শপিং করতে।
দুই পরিবার একসঙ্গে বিয়ের শাড়ি পছন্দ করছে। এসব কেনাকাটা অতন্দ্রিলার তেমন একটা পছন্দের না হলেও, আজ সে আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহন করছে।
কেনাকাটার পুরো সময়টায় রোদ সকলকে একটু এড়িয়ে চলে। অতন্দ্রিলার দিকে একবার তাকিয়েছিল, তাও আবার তিন সেকেন্ডের জন্যে।
রোদ চাইছে অতন্দ্রিলাকে রাগাতে। রোদের ধারনা এই মুহুর্তে মেয়েটাকে এড়িয়ে চললে, সে ভীষন রেগে যেতে পারে। রাগটা এতটাই তীব্র হবে যে মেয়েটা বিয়ে পর্যন্ত ভেঙে দিতে পারে।
এতে অতন্দ্রিলা মোটেও রাগ করেছে না। স্বাভাবিক ভাবেই দেখছে বিষয়টাকে।
কারন রোদের এই ধারনার কথাটা বুঝে গেছে অতন্দ্রিলা।
তাই আর যাই হোক, রাগ করা যাবে না।
রাত আটটা ত্রিশ।বিরক্তিকর সময় পার না করতে পারায় বিছানার উপর শুধু গড়াগড়ি খাচ্ছি।বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।এবার বর্ষার আগেই বৃষ্টি হচ্ছে কেনো কে জানে!সকাল থেকে সেই যে শুরু হয়েছে সারাদিনে আর থামার নাম নেই।এখন এই বৃষ্টির মধ্যে সারাদিন ঘরে বসে থাকায় ভীষন বোরিং লাগছে।বিকেলের দিকে তবুও স্নিগ্ধর হাত থেকে ওর মেকানিক্যাল পার্টসগুলো টেনেটুনে নিয়ে ছাতা মাথায় জোর করে বাইরে নিয়ে গিয়ে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে কাগজের নৌকা ভাসিয়েছি।
এখন সন্ধ্যার পর কিচ্ছু করার নেই।নিদ্র আমার সামনে টেবিলে বসে সেই যে একনাগাড়ে পড়ে যাচ্ছে আশেপাশে তার কোনো হুঁশ নেই।সেই সকাল থেকে পড়ে যাচ্ছে।তার এখন ফাইনাল পরীক্ষা চলছে,প্রায় শেষের দিকেই।
আমি বিরক্তি আর না কাটিয়ে উঠতে পেরে নিদ্রকে ডাক দিলাম,
-‘নিদ্র শুনছেন,চলুন না একটু লুডু খেলি।’
সে বই থেকে মুখ না তুলেই বলল,’হুম।’
মনে হয় না সে আমার কথা কিছু শুনেছে।আমি বিরক্তিস্বরে বললাম,’কি হুম?আপনি আমার কথা শুনেছেন?’
সে বই থেকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,’কি বলেছো?’
-‘লুডু খেলতে,লুডু।একটুও ভালো লাগছে না,চলুন না একটু খেলি।’
-‘না,এখন আমি পড়ছি।’
-‘সেটা তো আপনি সারাদিনই পড়েন।আপনার পরীক্ষা তো আবার সেই পাঁচ ছয় দিন পর,এখন একটু খেললে কি হয়?’
সে আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে আবার বইয়ের ভেতর মুখ ডুবিয়ে দিল।আমিও ক্ষেপে গিয়ে বিছানা থেকে উঠে তার সামনে থেকে বই ছিনিয়ে নিলাম।
সে বিরক্তস্বরে হাত বাড়িয়ে বলল,’সুপ্তি,এমন করো না,দাও তো।’
আমি দিলাম না।বই নিয়ে ছুটতে লাগলাম।সে বই ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।শেষে বলল,’ঠিক আছে শুধু আজকেই কিন্তু!’
আমিও ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম।
লুডুর নীল গুটি আমার আর লাল গুটি নিদ্রর।দু দুইবার খেলে ফেলেছি আর দুইবারই সে আমাকে হারিয়ে দিল।আমার সবগুটি শুধু খেয়ে দেয়।একটা গুটিও পাকা বানাতে পারি না।লুডুর চারকোণা কোটে শুধু তার গুটি একাই রাজ করে যাচ্ছে।আমি মুখ গোমড়া করে তৃতীয় দান খেলা শুরু করলাম।শেষমেষ একটি গুটি বহুকষ্টে টেনেটুনে পাকা বানালাম।আর একঘর পেরোলেই গুটি আমার ঘরে।ঠিক সেই সময় দুই ছয় পাঁচ উঠিয়ে তার লাল গুটি দিয়ে সে আমার নীল গুটি খেয়ে ফেলল।আর এখন হা হা হা করে হাসছে।আমার তো কেঁদে ফেলার উপক্রম।তার হাসি শুনে আরো রাগ চেঁপে বসল।একটা বালিশ নিয়ে তাকে ইচ্ছামত পেটাতে লাগলাম তবুও তার হাসি থামে না।খেলার এক ফাঁকে তার অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে হাতের কাঁচা গুটি কোটে রেখে দিলাম।সে হয়ত বুঝতে পারেনি।
এবার আমি তার একটি পাকা গুটির পেছনে আমার গুটি লাগিয়ে দিলাম।মাত্র তিন পড়লেই খাওয়া।কিন্তু কানা ছাড়া এখন আর কিছু পড়ছেই না।মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল।এখন আর একটা কানা পড়লেই তার গুটি পগারপার।কিন্তু এইবার আর কানা পড়লো না।পড়লো দুই।তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার এদিকে অত খেয়াল নেই।আমি একটু চুরি করে লুডুর ছক্কাটা ঘুরিয়ে দুইয়ের জায়গায় কানা এনে দিলাম।তারপর চেঁচিয়ে হাত তালি দিয়ে বলতে লাগলাম,
-‘এই আমার কানা পড়েছে।খাওয়া আপনার গুটি।’
তার দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।সে বলল,’খাওয়া না?একবার চুরি করে গুটি উঠিয়েছো আবার এখন চুরি করে আমার গুটি খাওয়া!’
আমি একটু ঢোক গিলে দৌড় দেবার প্রস্তুতি নিলাম।সে বুঝে ফেলেছে আমার চুরি!
নিদ্র আমাকে ধরার আগেই আমি বিছানা ছেড়ে দৌড় দিলাম,আমাকে ধরার ক্রমাগত চেষ্টা করছে সে।আমিও তার থেকে রেহাই পাবার আশায় ছুটে চলছি।হঠাৎ সে পেছন থেকে আমার ওড়না টেনে নিয়ে গেল।আমি থতমত খেয়ে তার দিকে ঘুড়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।সে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে দুষ্টু হাসি দিয়ে তার এক হাতে আমার ওড়না পেঁচাতে লাগল আর ধীরে ধীরে আমার দিকে আগাতে লাগল।আমিও পিছাতে লাগলাম।
একসময় দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গেল।আর সেও খুব কাছে ঘেষে দাঁড়ালো।তার এভাবে আমার ওড়না টেনে নেওয়ায় আমি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিলাম।তার থেকে চোখ নামিয়ে নিলাম।সে আমার চুলগুলো তার হাতের আঙ্গুল দিয়ে ধীরে ধীরে আমার কানে গুঁজে দিয়ে আমার কানের কাছে তার মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,’মেয়েদের লজ্জা পেলে যে এত সুন্দর লাগে আগে জানতাম না তো!এবার কিন্তু লোভে পড়ে যাচ্ছি।বারবার লজ্জা পাইয়ে দিতে ইচ্ছে করছে যে!’
তার কথায় অজান্তেই আমার ঠোঁটের কোণায় ফুটে উঠল লজ্জা মাখা মৃদু হাসি।
কথাটি বলে মুচকি হেসে সে আমার গায়ে ওড়না জড়িয়ে দিয়ে চলে গেল।আর আমি লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে ঠায় দাঁড়িয়েই রইলাম।
★
তারাভরা আকাশের বিশাল চাঁদটির দিকে নিদ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।বারান্দায় গিয়ে আমিও তার পিছনে দাঁড়ালাম।বাতাসে আমাদের দুজনের চুল মৃদু মৃদু উড়ছে।আমার পরণে একটি নীল তাঁতের শাড়ী।চোখে দেওয়া কাজল,আর পিঠে মেলা খোলা চুল।
অফিসে জয়েন করার পনের দিনের মধ্যেই আজ সে অনেক বড় ডিল ফাইনাল করেছে,সেই খুশিতে বাবা তাকে এডভান্স স্যালারি দিয়েছে।আজ সন্ধ্যার পর আমার হাতে একটি নীল তাঁতের শাড়ী আর নীল চুড়ি তুলে দিয়ে সে বলল তার নাকি এখন কোনো নীল শাড়ী পড়া মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করছে এবং আমাকে সেই ইচ্ছা পূরণ করতে হবে।কারণ ঐ যে আমার দেওয়া থাপ্পড়ের কারণে আমি তো তার আজগুবি আদেশে আবদ্ধ।
তার পেছন থেকে আমি হঠাৎ বলে উঠলাম,’আজকে কি আপনি খুব খুশি?’
বারান্দার রেলিং থেকে হাত সরিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,’হুম,খুব।’
আমিও হালকা হেসে দিলাম।
সে একটু ভ্রু ভাঁজ করে বলল,’আজকে নাকি তুমি আমার জন্য খুব টেনশন করেছো?
কথাটি সত্যি হলেও আমি তার সামনে স্বীকার গেলাম না।একটু ভাব নিয়ে পিছনে ঘুরে বললাম,’ইশ!আমার বয়েই গেছে আপনার জন্য টেনশন করার।আপনার জন্য আমি টেনশন করব কেনো!’
কথাটি বলে আমি চলে যেতে উদ্যত হলাম।সে আবারো চাঁদের দিকে তাকিয়ে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো,
আমি কত ছলে কৌশলে
তোমায় ভালোবেসে যাই,
এত করে চাই আমি বলো
আর কি ভাবে বোঝাই।
তুমি একবার বলো যদি
আমি পাড়ি দিবো কোন স্রোতা নদী
ভালোবাসা দিবো পুরোটাই।
তার মুগ্ধকর গানের আওয়াজে আমি থমকে দাঁড়ালাম।খালি গলায়ও কি সুন্দর গান গায়!
হঠাৎ আমি ভাবতে লাগলাম নিদ্রর প্রকৃত জীবনসঙ্গি কতটা ভাগ্যবতী হবে!সে আমারই কত খেয়াল রাখে তাহলে তার ভালোবাসার মানুষকে কতটা যত্নে আগলে রাখবে?
নিদ্রর মধ্যে কাউকে ভালোবাসার অসীম ক্ষমতা আছে।কাউকে পাগলের মত ভালোবাসার যোগ্যতা আছে।যেই ভালোবাসার সন্ধান খুঁজে চলেছি আমি।আর এতদিনেও সেই গাধী মেয়েটা কেন এখনো মানছে না কে জানে!
একদিন বিকেলে আমি বাসার ড্রয়িংরুমে বসে কমেডি মুভি দেখছিলাম।একটা হাসির সিন হচ্ছে তার মাঝে হঠাৎ হরর মুভির ভয়ংকর শব্দ আসতে লাগলো।আর এই শব্দটা ঠিক সেদিন রাতে শুনতে পাওয়া শব্দের মতোই,দিন হওয়ায় এখন আর তত ভয় পেলাম না।ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আমার পাশের সোফায় স্নিগ্ধ বসে বসে ফোনে এই শব্দ শুনছে আর খিলখিল করে হাসছে।আমি ঝট করে উঠে গিয়ে ওর হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে দেখলাম এটা নিদ্রর ফোন।
শব্দটা আবার প্রথম থেকে প্লে করে কিছুক্ষণ শুনলাম।এবার আমার কাছে সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে গেল।সেদিনের এই কাজ করার পেছনে নিদ্ররই হাত।কি ফাজিল ছেলে!
আমাকে কি ভয়টাই না দেখিয়েছিল।এবার হাতে নাতে ধরা পড়েছে,আজকে তার খবর আছে।
বাগানে হনহনিয়ে হেঁটে গেলাম।মাথায় রাগ হাই ভোল্টেজ পাওয়ারে চেপে বসেছে।আর উনি বিন্দাসে বাগানের দোলনায় বসে বসে চোখ বন্ধ করে হেডফোনে গান শুনে যাচ্ছে।তার কাছে পৌঁছানোর আগেই একটি ফুল গাছের সামনে এসে আমি থমকে গেলাম।
আমি নিজের হাতে বাগানে একটি গোলাপ ফুলের গাছ লাগিয়ে ছিলাম।প্রতিদিন গাছের কলি দেখতে আসতাম আর অপেক্ষা করতাম কবে এই গাছে ফুল ফুটবে।আর আজ সত্যি সত্যি গোলাপ ফুটেছে।জীবনে প্রথম নিজের লাগানো গাছে ফুল দেখে আমি এতটা খুশি হলাম যে রাগ টাগ সব ভুলে গেলাম।
দৌড়ে নিদ্রর হাত টেনে নিয়ে আসলাম।গাছের কাছে এনে দেখাতে লাগলাম তাকে সেই ফুল।পিছন থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখি সে আমার তাকে হাত ধরার দিকে তাকিয়ে আছে।আমিও হকচকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ছেড়ে দিলাম।নিদ্র অনেকবার আমার হাত ধরলেও আমি কখনো নিজ থেকে ধরিনি।কারণ ঐ যে ঠিক করেছিলাম আমার ভালোবাসার মানুষই আমার হাত প্রথম ধরবে আর আমিও শুধু সেই পুরুষের হাতই প্রথম ধরবো যাকে আমি ভালোবাসবো।প্রথম কথাটা নিদ্রর মাধ্যমে ভেঙে গেলেও আমি নিজ থেকে আমারটা ভাঙতে দেয়নি।আর আজ আমি নিজেই সেটা করে ফেললাম।কি করে আমার দ্বারা এটা হয়ে গেল।আর আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আমার কোনো খারাপও লাগছে না বরং আরেকটু ধরতে ইচ্ছে করছে।
★
ঘুমের চোখে মনে হল যেন কোনো এক উত্তপ্ত অগ্নির চাদরে আমাকে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে।অগ্নি যেন আজ তৎপর হয়ে আমার শরীরে যতটুকু শীতলতা আছে সবটুকু শুষে নিতে চাইছে।চোখ মেলে পুরো ব্যাপারটা অবগত হতে আমার কয়েক মুহুর্ত সময় লাগল।নিদ্র আমার বুকের উপর এসে শুয়ে রয়েছে।আমার ঘাড়ে তার উষ্ণ মুখ ডুবিয়ে হাতের শক্ত বাঁধনে আমাকে জড়িয়ে রেখেছে।তার শরীরের তাপমাত্রায় আমি আৎকে উঠলাম।এতো দেখি জ্বরে গা পুরে যাচ্ছে!
সে প্রায় অবচেতনের মতোই পড়ে রয়েছে।অফিস থেকে তার ফিরতে অনেক দেরি হওয়ায় আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি তা মনে নেই।এখন মাঝ রাতে তার এই অবস্থায় আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম।গায়ে এত জ্বর!এখন আমি কি করব?ডাক্তারকে কি ডাকবো?
আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠার বৃথা চেষ্টা করলাম।সে কিছুতেই আমাকে ছাড়ছে না।আমি তাকে হালকা ঝাঁকিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে বললাম,’নিদ্র প্লিজ আমাকে ছাড়ুন।আপনি ওষুধ খেয়েছেন?আপনার গায়ে ভীষণ জ্বর,ডাক্তার ডাকতে হবে।’
সে আমাকে ছাড়লো না,বরং কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে আধো ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,’কিচ্ছু করতে হবে না।তুমি চুপচাপ শুয়ে থাকো তো।আমি ঠিক হয়ে যাবো।আমি তো আমার মেডিসিনের কাছেই এসেছি।’
কথাটা বলে আরেকটু আমার ঘাড়ে তার মুখ ঘষে ডুবে রাখল।সে জ্বরের ঘোরে কি পাগলের মত প্রলাপ বকছে!জ্বর যেন বেড়েই যাচ্ছে।তার প্রখর উষ্ণ নিঃশ্বাসে আমার ঘাড় গলাও গরম হয়ে উঠছে,শরীরে ঘাম দিয়ে দিচ্ছে।আমার ভীষণ ভয় করতে লাগল।অনেক কষ্টে তাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ঠিক করে শুইয়ে দিলাম।ফার্স্ট এইড বক্স খুঁজে প্যারাসিটামল বের করে তাকে খাইয়ে দিলাম।মাথায় ভেজা কাপড়ের পট্টি দিলে ভালো হয় তাই ভেবে তা নেওয়ার জন্য উঠতে যাবো কিন্তু তার আগেই নিদ্র আমার হাত ধরে ফেলল।
বলল,
-‘কোথায় যাও বারবার তুমি।আমার কাছে একটু বসে থাকতে পারো না।’
নিদ্র ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না।কথাগুলো বারবার জড়িয়ে আসছে।ফর্সা মুখটা শুকিয়ে জ্বরে লাল রয়েছে,কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে,ঠোঁটটাও শুকিয়ে আছে।
সে জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আমার হাত নিয়ে তার ঘাড়ে ঘসতে লাগল।তার এই অবস্থায় আমার চোখে পানি চলে এলো।এদিকে জ্বরও কমার নাম নিচ্ছে না।
আমি জোর করে তার থেকে হাত ছাড়িয়ে এক ছুটে গিয়ে বাবা মাকে ডেকে আনলাম।মা এসে নিদ্রর পাশে বসে মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলো।বাবা ডাক্তারকে খবর দিল।ডাক্তার এসে তাকে চেকআপ করছে।
নিদ্র এখন পুরোপুরি অবচেতন হয়ে পড়ে আছে।তার এই অবস্থা দেখে হঠাৎ করে আমার খুব কান্না পেল।কিছুতেই আঁটকে রাখতে পারছি না।ফস করে কেঁদে দিলাম।আমার কান্নার আওয়াজে সবাই আমার দিকে ফিরে তাকালো।
আমি মুখে হাত দিয়ে কান্না সংবরণ করার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই হলো না বরং আরো বাড়তেই লাগলো।আমার কান্নার অবস্থা দেখে এই সিরিয়াস মুহুর্তেও সবাই মৃদু হেসে দিল।
বাবা আমার কাছে এসে মাথায় হাত রেখে বলল,’দূর পাগলি!এতটুকুর জন্য এভাবে কাঁদতে হয়।ডাক্তার ইনজেকশন লাগিয়ে দিয়েছে এখনই কমে যাবে।’
মা আমার পাশে এসে আমাকে বোঝাতে লাগল।আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।আমার কান্না থামার কোনো নামই নিচ্ছে না।যেনো কোনো অবাধ স্রোতের বাঁধ ভেঙে ভেতর থেকে সব বেড়িয়ে আসছে,যতক্ষণ না পর্যন্ত আসল মানুষ এসে একে আটকাবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ একে থামাতে পারবে না।আমার মন যে নিদ্রর এমন অবচেতনের মত পড়ে থাকা কিছুতেই মানতে পারছে না।আমি চাই এখন নিদ্র উঠে আসুক।তার ঘন কালো ভ্রুগুলো কুঁচকে একটা ধমক দিয়ে বলুক ‘এই মেয়ে এমন ফিছ ফিছ করে কাঁদছো কেনো?কান্না থামাও!নাহলে কিন্তু এখন তোমাকে নিয়ে এই মাঝরাস্তায় সাইকেলে চড়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াবো।আমার এখন একজন সাইকেলে চড়ার সঙ্গী দরকার।’
এই বাড়িতে আমার অনেকটুকু সময় যে কিভাবে কেটে গেল তা বুঝতেই পারলাম না।খুব আপন করে নিয়েছি এই বাড়িকে।খুব আপন করে নিয়েছে এই বাড়ির মানুষ আমাকে।এক অস্পৃশ্য মায়ার বাঁধনে অজান্তেই জড়িয়ে গেছি।মায়ের সাথে চায়ের টেবিলের উড়োধুরো গল্প,বাবার সাথে দাবার কোটে বারবার পরাজয়,স্নিগ্ধর স্টাইলিশ চুলগুলো এলোমেলো করে ওর গালগুলো আচ্ছা মতো টিপে দিয়ে ওর দৌড়ানি খাওয়া সবকিছুর অভ্যাসে পড়ে গেছি।অভ্যাসে পড়েছি নিদ্রর ঘুমন্ত মুখের,ওর অদ্ভুতভাবে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকার,এলোমেলো চুল,মন জুড়ানো সেই হাসি,ফট করে ধমক দেয়া,হঠাৎ আজগুবি আদেশ সবকিছুর।এসব যেন আমার জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে মিশে গেছে।আমাদের বিয়ে কিভাবে হয়েছে,কেন হয়েছে,এর স্থায়ীত্ব কতদিন এসব প্রশ্ন আর এখন আমার মনে জাগে না।একপ্রকার ভুলেই গেছি সেসব।নিদ্রকে আর এখন এই ব্যাপারে প্রশ্ন করে হয়রান করি না।বরং আরো ভয় হয় ওর মুখ থেকে যদি শিঘ্রই শব্দটা শুনে ফেলি!
আমার মন খুঁড়ে নিদ্রর সাথে আমার সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু তা আমার মাপতে ইচ্ছে করে না।ইচ্ছে করে না আমাদের সম্পর্কের সমষ্টির সমীকরণ বের করতে।কারণ জীবনে প্রথম এই কনফিউশন আমার খুব ভালো লাগছে।আমার ভালো লাগে সে যখন আমাকে ধমক দেয়,ভালো লাগে সে যখন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে,তার সেই পৃথিবী বিক্রি করে দেয়ার মত হাসি আমার ভালো লাগে,তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে।তার হঠাৎ’আমার একজন মানুষ দরকার’বলে আমার উপর জারি করা আজগুবি ইচ্ছে আমার ভালো লাগে,তার দরকার টাকেই আমার ভালোলাগে,তার দরকার পূর্ণ করতে আমার ভালো লাগে।আমার সমস্তটুকু ভালো লাগা জুড়েই যে শুধু নিদ্র রাজ করে চলছে।প্রিয়জন না হলেও তার শুধু প্রয়োজনটুকু মেটানোর জন্য হলেও আমি তার কাছে সারাজীবন থেকে যেতে চাই।তার সেই ‘দরকার’গুলোর পূর্ণকারক হতে চাই।
খুব ইচ্ছে করছে দু দিন জ্বরে ভুগে শুকিয়ে যাওয়া নিদ্রর মলিন মুখটি স্পর্শ করতে।আমার ছোঁয়ায় নিদ্র আবার জেগে উঠে বুঝে ফেলবে না তো!বুঝলে বুঝুক।ইচ্ছেটাকে একটু প্রশ্রয় দিয়ে নিদ্রর খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজানো গালে ধীরে ধীরে আলতো হাতে স্পর্শ করলাম।আমার স্পর্শে নিদ্র চোখ মেলে তাকালো।আমি চমকে উঠে লজ্জা পেয়ে দ্রুত হাত সরিয়ে নিলাম।নিদ্র মৃদু হেসে বলল,’তুমি নাকি আমার জন্য সেদিন খুব কান্না করেছিলে?’
আমি পিছনে ঘুরে মুচকি হেসে বললাম,’ইশ!আমার বয়েই গেছে আপনার জন্য কান্না করতে!
আমি তো শুধু এমনিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’
-‘যে যেটা করতে পারে না তার সেটা না করাই ভালো।নয়তো ধরা পড়ে যায়।’
দুদিন পর তার স্পষ্ট কথাগুলো শুনতে পেরে আমার চোখ ছলছল করে উঠলো।আমি কাঁদো কাঁদো ভাব নিয়ে বললাম,’আপনি সেদিন কেনো বৃষ্টিতে ভিজে অফিস থেকে আসতে গেলেন?
জানেন আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম।’
তার কোনো উত্তর না পেয়ে আমি তার দিকে ঘুড়ে দেখলাম সে আবারো ঘুমিয়ে পড়েছে।
যাহ!এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো।আর এদিকে আমার ঘুম যে কোথায় পালিয়ে গেছে!
★
ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে রোদে শুকোতে দেওয়া মায়ের বানানো কাঁচা আমের আচারের বোরম কোলে তুলে নিয়ে আচার বের করে খাচ্ছি।মৌসুমের নতুন আমের আচার মুখে দিতেই চোখ মুখ বন্ধ হয়ে আসে টকে।দারুন আয়েশে পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে খাচ্ছি।হঠাৎ নিদ্র তার বারান্দা থেকে আমাকে মুখ দিয়ে শব্দ করে ডাকল।আমি বসে আছি ছাদের পেছনের অংশের দিকে।এখান থেকে তার রুমের বারান্দা থেকে ছাদ অনেকটা কাছে।বারান্দার ডান সাইড থেকে সরাসরি দেখা যায়।আমি তার দিকে হালকা তাকিয়ে আবার আচার খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।সে মৃদু হেসে রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে বলল,’মেয়েদের আচার খাওয়ার দৃশ্য দেখতে খুব সুন্দর।কুমারী আর বিবাহিত মেয়ে দুটো দুই ধরণের সুন্দর।’
আমি ঈষৎ ভ্রু ভাঁজ করে বললাম,’কুমারী আর বিবাহিত মেয়েদের আচার খাওয়ার আবার মধ্যে পার্থক্য কি?’
-‘কুমারী মেয়েদের আচার খাওয়ার মধ্যে শিশুসুলভতা লুকিয়ে থাকে আর বিবাহিত মেয়েদের আচার খাওয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকে লাজুকতা।দুটোই দুই ধরণের সৌন্দর্য্য ব্যক্ত করে।’
তার কথার আগামাথা কিছু বুঝতে না পেরে আমি আবার আচার খাওয়ার মাঝে মন দিলাম।সে আবার বলল,’এত আচার খেয়ো না।তুমি কিন্তু বিবাহিত,দেখো আবার সবাই ওসব না ভেবে বসে!’
-‘ওসব মানে?’
সে হেসে দু হাত পেটের সম্মুখে ধরে দুলিয়ে দুলিয়ে মুখে বাচ্চাদের কান্নার মত শব্দ করতে লাগল উঁই উঁই…
তার কথা শুনে আমি আর মুখে আচার ঢুকাতে পারলাম না।সে হাসতে হাসতে চলে গেল।আর আমি লজ্জায় পুরো লাল হয়ে রইলাম।
★
রুমের মধ্যে সোফায় বসে বসে চিপস খাচ্ছি। আমার পাশেই বসানিদ্র,সামনের টি টেবিলে পা তুলে এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে রেখে সে গভীর মনোযোগে ইংলিশ মুভি দেখে যাচ্ছে তার পরনে একটি সবুজ শার্ট থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট।পায়ের বড় বড় লোমগুলো সব ফর্সা পায়ের সাথে লেপ্টে রয়েছে।দেখতে সুন্দর লাগলেও তার পায়ের দিকে বারবার চোখ পড়তেই আমার শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।তার উচিত সব সময় ফুল প্যান্ট পড়ে থাকা।
আমার একটু চিপস মুখে দিয়ে চাবানোতে তার ডিস্টার্ব হচ্ছে।আমিও আস্তে আস্তে চাবানোর চেষ্টা করলেও ক্রান্চি চিপসের শব্দ হয়েই যায়।
এর মাঝে রুমে এই বাড়ির কাজের লোক রহিমা খালা প্রবেশ করে।রহিমা খালা খুব বেশি কথা বলে।তার পেটে কোনো কথা পঁচে না।পঁচার আগেই সে অন্য পেটে রপ্তানি করে দেয়।রহিমা খালা এসেছে লন্ড্রি থেকে আসা কাপড় চোপড় দিয়ে যেতে।আমি উঠে সব ঠিক জায়গায় রাখতে গেলাম।নিদ্র আলমারি থেকে কিছু কাপড়চোপড় বের করে রহিমা খালার হাতে দিতে লাগল আগামীকাল লন্ড্রিতে দেওয়ার জন্য।
রহিমা খালার সেদিকে খেয়াল নেই,সে হা করে টিভির দিকে তাকিয়ে মুভি দেখে যাচ্ছে।
মুভিতে এখন একটি ছেলে মেয়ের হাগিং সিন হচ্ছে।ছেলে মেয়ে দুটি বেস্ট ফ্রেন্ড,অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় দুজন এক্সাইটমেন্ট আর খুশিতে দুজন দুজনকে লাফিয়ে লাফিয়ে হাগ করছে।একটা নরমাল সিনই।রহিমা খালা সেটাই দেখতে দেখতে মুখ একশ আশি ডিগ্রী কোণে গোল করে হা করে রয়েছে।একসময় নিদ্রকে জিজ্ঞাসা করলো,’ভাইজান এই দুইডা পোলা মাইয়ার কি বিয়া হইছে?
-‘না।’
সে এই কথা শুনে গালে দুই হাত দিয়ে বলল,’হায় ,এয়া কি কন,তাইলে এই পোলা মাইয়া টিভির মধ্যে ঢুইকা এমন জড়াজড়ি করতাছে কে?
রহিমা খালার কথা শুনে আমি খিলখিল করে হেসে দিলাম।
রহিমা খালা আমার হাসিতে আরো উৎসাহিত হয়ে একটু লাজুক ভঙ্গিতে বলল,’ভাইজান আপনি যেডা দেখতাছেন হেইডার নামটা একটু কইয়েন তো আমি আমার উনারে নিয়াও একটু দেখতাম।’
রহিমা খালার কথায় আমার এত হাসি পাচ্ছিলো,তার চলে যাওয়ার পরেও আমি মুখ টিপে হাসতে লাগলাম।
নিদ্র আবারো সেই অসহায়ের মত তাকিয়ে থেকে হুট করে বলল,’তোমাকে আর কতবার বলতে হবে আমার সামনে এভাবে হাসবে না।’
তার কথায় আমার মুখটা থমথম হয়ে গেল।আবারো সেই এক কথা।মাথায় জেদ চেপে বসল।তার কি শুধু ঐ মেয়ের হাসিই ভালো লাগে যে আর কারো হাসি ভালো লাগে না।
রাগ করে মুখ ফুলিয়ে বললাম,’আমার যেভাবে ইচ্ছা আমি সেভাবেই হাসবো তাতে আপনার কি?’
-‘দেখো আমি কিন্তু তোমাকে মানা করছি।পরে কিছু হলে কিন্তু আমার দোষ নেই।’
এই বলে আমি আরো ইচ্ছে করে বেশি বেশি মুখ টিপে হাসতে লাগলাম।সে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হেঁচকা টানে তার দুই হাতে আমার গাল ধরে আমার ঠোঁট তার ঠোঁটের আয়ত্তে নিয়ে গেল।ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটলো যে চোখ বড় বড় করে আমি পুরো ফ্রিজড হয়ে রইলাম।
চলবে,,
(রেগুলার গল্প দেওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না।এখন থেকে একদিন পর পর গল্প দিব।
Sorry,I am helpless……)
অতন্দ্রিলা মানুষটাই নিখুঁত। তার দীর্ঘ পল্লব যুক্ত চোখ দুটো নিখুঁত, লম্বা চুলগুলো নিখুঁত, হাসিটাও নিখুঁত। তবে অতন্দ্রিলা খুব একটা হাসে না আবার কাঁদেও না।
হামিদ সাহেব শেষ বার অতন্দ্রিলাকে কাঁদতে দেখেছিলেন যখন তার বয়স ১৩।
অতন্দ্রিলার কথা, “যুক্তিযুক্ত কারন ছাড়া কোনো মানুষের সামনে হাসি বা কান্নার মত শক্তিশালী অনুভূতি প্রকাশ করার কোনো অর্থ নেই।”
অতন্দ্রিলার হাতে গোণা দু একটা বাজে অভ্যাসের মধ্যে অন্যতম হলো, নিজের লেখা প্রতিবেদন বারবার পড়া।
আজ সকালে তার ভালোবাসা সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। এবারের প্রতিবেদনটা তুমলামুলকভাবে গুছিয়েই লিখেছে অতন্দ্রিলা। প্রতিবেদনটা এমন –
ভালোবাসা কারে কয়?
অতন্দ্রিলা আশরাফ
৩ জুলাই, ২০২০ | ১১:৫০ পূর্বাহ্ন
‘ভালোবাসা’ শব্দটির সাথে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। নাটক-সিনেমা দেখতে বসলে অহরহ শব্দটা শুনতে পাই । ছোটবেলায় সমাজ বইতে আমরা জেনেছি, পৃথিবীতে সব মানুষ একই পরিবেশে বাস করে না। সকলেরই বসবাসের পরিবেশ ভিন্ন, তাই ভালোবাসার উপলক্ষটাও ভিন্ন।
পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী মহামানবদের সকলে
একই পরিবেশে বসবাস করেননি। তাই ভালোবাসা সম্পর্কে তাদের মতামতও ভিন্ন।
চলুন জেনে নেই বিখ্যাত ব্যাক্তিদের ভালোবাসা সম্পর্কিত কিছু উক্তি –
১। ডেভিড রস – “ভালোবাসা এবং যত্ন দিয়ে মরুভূমিতেও ফুল ফোটানো যায়।”
২। লা রচেফউকোল্ড – “সত্যিকারের ভালোবাসা হল অনেকটা প্রেতআত্মার মতো। এ নিয়ে সবাই কথা বলে,কিন্তু শুধুমাত্র কয়েকজনই এর দেখা পায়।”
৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – “পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমেরমত সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নাই। প্রথমযৌবনে বালিকা যাকে ভালোবাসে তাহার মত সৌভাগ্যবানও আর কেহই নাই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়, কিন্তু সে প্রেমের আগুন সব বালিকাকে সারাজীবন পোড়ায়।”
৪। হুমায়ূন আহমেদ – “কাউকে প্রচন্ডভাবে ভালবাসার মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা আছে। নিজেকে তখন তুচ্ছ এবং সামান্য মনে হয়। এই ব্যাপারটা নিজেকে ছোট করে দেয়।”
৫। কীটস্ – “যে ভালোবাসা পেলো না, যে কাউকে ভালোবাসতে পারলো না সংসারে তার মতো হতভাগা কেউ নেই।”
৬। টেনিসন – “ভালবাসা যা দেয় তার চেয়ে বেশী কেড়ে নেয়।”
অনেক তো হলো বিখ্যাত ব্যাক্তিদের উক্তি, চলুন জেনে আসা যাক ভালোবাসা নিয়ে সাধারন মানুষদের মতামত।
১। হামিদ চৌধুরী, রিটেয়ারপ্রাপ্ত উকিল।
বয়স ৬০ এর কাছাকাছি, ১৯ বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ওনার মতে, “ভালোবাসার মত ন্যাকামি জাতীয় জিনিস পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
২। শায়লা হোসেন, পেশায় অধ্যাপক।
বয়স ৫২-৫৪, হামিদ চৌধুরীর প্রাক্তন স্ত্রী।
তার মতে, “একটা মানুষকে যথাযথ সময় দিতে পারলেই তাকে ভালোবাসা উচিত। যে সময় দিতে পারে না, তার ভালোবাসা উচিত নয়।”
৩। রওশন আরা, হামিদ চৌধুরীর মাতা।
বয়স ৭৫। তিনি মনে করেন, “স্বামী-স্ত্রী মধ্যে যাহা বিদ্যমান, তাহাই ভালোবাসা।”
৪। জরিনা, হামিদ চৌধুরীদের বাড়ির কাজের মেয়ে। বয়স ২১। ভালোবাসা সম্পর্কে তার মতামত কিছুটা এরকম – “এইসব বদ মাইয়া-পোলার করবার। যেগুলি এইসব ভালোবাসাবাসি করে, হেগুলি বদের বদ।”
ভ্রু সামান্য কুঁচকে বারবার প্রতিবেদনটি পরছে অতন্দ্রিলা, কিছুটা চিন্তিত সে। চিন্তার প্রধান কারন তার বাবা, মা এবং দাদীর মতামতগুলো আসল নয়। অতন্দ্রিলার বানিয়ে লেখা।
এই তিনজন মানুষকে ‘ভালোবাসা কি?’ – প্রশ্নটা করে মনের মতো কোনো জবাব পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তাই অতন্দ্রিলা সেই বৃথা চেষ্টা করে আর সময় নষ্ট করেনি।
দরজায় টোকা পরলো।
অতন্দ্রিলা ভেতর থেকে বলল, “কে?”
“আফা আমি জরিনা!”
“ভেতরে এসো জরিনা।”
জরিনা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ঘরে ঢুকে বলল, “আফা ঘটনা তো একখান ঘইটা গেছে! শিগগির নিচে আসেন!”
“কি ঘটনা?”
“ওইযে ওইদিন আপনারে দেইখ্যা গেলো যারা! তারা মেলা জিনিস পাঠাইছে। বাসার ঘরে ভাইসা যাইতেসে জিনিসপত্রে!”
“মেলা জিনিস পাঠাবে কেন?”
“অতো কথা বলার টাইম নাই! আফনে নিচে আসেন।”
অতন্দ্রিলা যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে উঠল। প্রতিবেদনটা আর কমপক্ষে দু থেকে তিনশ বার পড়ে উঠতে পারলে এই বিরক্তিটা কাজ করতো না।
জরিনার স্বভাবগত দোষ, সে যেকোনো বিষয়কেই বাড়িয়ে বলে।
কিন্তু আজ জরিনা সত্য কথাই বলেছে। বসার ঘর প্রায় ভেসেই যাচ্ছে উপহারে। ঝুড়ি ভর্তি শাক-সবজি, ফলমূল। মাটির হাঁড়িতে বিভিন্ন ধরনের মাছ। আদা, রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি নানা প্রকারের মসলা। আম, জলপাই ইত্যাদির আচার। সেগুলো অতি আগ্রহ নিয়ে ঘটাঘাটি করছেন হামিদ সাহেব।
অতন্দ্রিলা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল, “এসব কি বাবা?”
“ফিরোজা আপা পাঠালো!”
“ফিরোজা আপাটা কে?”
“এরমধ্যে ভুলে গেলি? ওইযে সেদিন
তোকে দেখতে এলো, ছেলের মা!”
“ওহ আচ্ছা! তা এরমধ্যে আপা বাঁধিয়ে ফেলেছো?”
“হ্যাঁ ফেলেছি। তোর কোনো সমস্যা আছে?”
“একদম না, আমার সমস্যা থাকতে যাবে কেন? আচ্ছা হঠাৎ তোমার ফিরোজা আপা এত কিছু পাঠালো কেন?”
“ওদের নাকি তোকে খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদের যদি কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে আগামী বুধবারই বিয়ের কথা পাকা করতে আসবে।”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “বাহ্! চমৎকার খবর।”
“তুই বিয়েতে রাজি তো?”
“অবশ্যই রাজি বাবা।”
“আমি মুগ্ধ! আমি আনন্দিত!”
“বাবা আমার ধারনা, আমার রাজি হওয়াটা তোমার আনন্দের প্রধান কারন না। আনন্দের প্রধান কারন এতগুলো উপহার। তাইনা?”
“আমার আনন্দের কারন যাই হোক, তাতে তোর কি? কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং কিসব প্রতিবেদন লিখিস, সেগুলো লেখ গিয়ে যা!”
“অনেক ধন্যবাদ বাবা।”
দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে হামিদ সাহেব ব্যাংকে যান। সামনে মেয়ের বিয়ে। আর বিয়ের ওপর নামই যেন খরচ।
অতন্দ্রিলার জন্মের পর পরই তার বিয়ের জন্য কয়েক লক্ষ টাকা ব্যাংকে রেখে দেন তিনি। এত বছর ব্যাংকে থেকে থেকে সেই টাকা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
অতন্দ্রিলা প্রতিদিন দুপুরে ছাদে হাঁটাহাঁটি করে, গুনগুন করে গান গায়। এই সময়টায় কেউ তার আশেপাশে থাকলে নাকি খুব অসহ্য লাগে। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না।
হঠাৎ জরিনা দৌড়ে ছাদে এলো।
“আফা!”
“জরিনা, তোমাকে না মানা করেছি আমি ছাদে হাঁটাহাঁটি করার সময় বিরক্ত করতে!”
“দুনিয়া উল্টায় যাইতেছে আর আফনে হাঁটতেছেন?”
“দুনিয়া উল্টানোর মত কি ঘটেছে?”
“খালাম্মা আসছে, সাথে বড় আফা! দুইজনেই খেইপ্পা আছে। আমারে বলে, যাও অতরে ডাইককা আনো। আমি বলছি, আফা ডিস্টাব করতে মানা করছে। আমারে ধমক দিয়া কয়, চাকরি বাঁচাইতে চাইলে অতরে ডাকো!”
“এত বেশি কথা বলো কেন জরিনা? বেশি কথা বললে তো তুমি বিপদে পরবে!”
অতন্দ্রিলা নিচে নেমে এলো। শায়লা ও তার বড় মেয়ে সন্ধ্যা দুজন বসার ঘরের দুই সোফায় বসে আছেন।
শায়লা প্রচন্ড রেগে আছেন। অতন্দ্রিলাকে দেখা মাত্র এমন একটা ভাব যেন এখনি তাকে আস্ত গিলে খাবেন।
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “কি ব্যাপার মা?”
শায়লা কঠিন গলায় বললেন, “কি ব্যাপার মানে? তুই কি ভদ্রতা বলতে কিছুই শিখিসনি? এত দিন পর দেখা, না সালাম দিলি, না হাই হ্যালো বললি। সোজা, কি ব্যাপার!”
অতন্দ্রিলা বসতে বসতে বলল,“সালাম দিতাম যদি তুমি আমার কোনো দূরসম্পর্কের আত্মীয় হতে। কিন্তু তুমি তো আমার দূরসম্পর্কের মা, তোমার সঙ্গে প্রতিদিনই আমার টেলিফোনে কথা হচ্ছে। তোমাকে আবার সালাম দেওয়ার কি হলো?”
“জ্ঞান দিবি না। তোর এসব জ্ঞান আমার একদম অপছন্দের।
বাড়িতে এত কিছু ঘটে গেলো, আর আমরা কিছুই জানতে পারলাম না!”
“কি ঘটেছে?”
“তোকে নাকি গত সপ্তাহে দেখতে এসেছিলো? বিয়েও নাকি ঠিক হয়ে গেছে?
এত বড় একটা কথা আমাদের না জানিয়ে কিভাবে পারলি তুই? আচ্ছা, তোর বাবা আর দাদি না হয় কোনো দিনও আমাদের বলবে না, কিন্তু তুই তো বলতে পারতিস? নাকি আমাদের জানানোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করিসনি? আমরা কি এতটাই পর হয়ে গেছি তোর কাছে?”
সন্ধ্যা আহত গলায় বলল, “পরই তো ভাবে মা। মনে নেই, ও এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিলো আর আমাদের জানিয়েছিল এক মাস পর। আজকে যদি জরিনা ওর বিয়ের কথাটা না বলতো, তাহলে তো ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও আমরা জানতে পারতাম না।”
অতন্দ্রিলা বলল, “আপা দুটো ঘটনা পুরোপুরি ভিন্ন। এইচএসসির রেজাল্ট যখন বের হয়েছিল তখন দাদি ভীষন অসুস্থ, হসপিটালে ছিলো। ওই অবস্থায় আমি নিজের রেজাল্টে নিজেই খুশি হতে পারিনি। একমাস পর যখন দাদি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেন, তখন আমি খুশি হয়েছি। এবং খুশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের টেলিফোন করে জানিয়েছি।
আর এই ব্যাপারটা কেন এখনো জানাইনি তার গঠনমূলক ব্যাখ্যা তোমাদের দিতে পারি।”
শায়লা কিছুটা শান্ত গলায় বললেন, “দে, দে তোর গঠনমূলক ব্যাখ্যা!”
“গত বৃস্পতিবার রাতে বাবা হঠাৎই আমার ঘরে এসে বললেন, কাল বিকেলে তোকে দেখতে আসবে।
বিনা নোটিশে দেখতে আসার কথা শুনে আমিও খানিকটা ধাক্কা খাই। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না। এক বেলার মধ্যে তোমাদের খবর দেওয়াটাও বোকামি হতো।
তারা দেখে যাওয়ার পরও আমি তোমাদের কিছু বলিনি তার কারণ হলো তখনো বিয়ে হবে কি হবে না সেই ব্যাপারে অনিশ্চয়তা ছিলো। কিন্তু আজ সকালেই সে অনিশ্চয়তা দূর হয়। তারা আজ আমাদের বাড়িতে এক সমুদ্র উপহার পাঠান এবং বলেন আগামী বুধবার বিয়ে ফাইনাল করতে আসবে। আমি আজ বিকেলে আমি নিজে তোমাদের বাড়িতে এই খবরটা নিয়ে যেতাম।”
শায়লাকে দেখে এখন বেশ স্বাভাবিক লাগছে।
তিনি একটা মৃদু্ হাসি নিয়ে বললেন, “তুই তাহলে রাজি এই বিয়েতে।”
“রাজি না হওয়ার কোনো কারন যেহেতু নেই, সেহেতু আমি রাজি।”
“ছেলের নাম কি?”
“রোদ। রোদ আহসান।”
“দেখতে কেমন?”
“রাজপুত্রের মতো।”
“পড়াশুনা?”
“গণিতে এম এ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।”
“করে কি?”
“বাবার বিজনেস দেখাশুনা করে। কিন্তু তার বাবা বেঁচে নেই, তাই বলা যায় নিজের বিজনেস দেখাশুনা করে।”
“গণিতে পড়াশুনা করে আবার বিজনেস সামলায় কিভাবে?”
“সেটা আমি কিভাবে বলতে পারি? তোমার সঙ্গে যখন সামনাসামনি দেখা হবে তখন তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করো।”
“তোর বাবা ঠিকই বলে, তোর সঙ্গে কথা বলাটাই বিপদ! আচ্ছা, এখন বল ছেলের কোনো খুঁত আছে?”
“অবশ্যই আছে। খুঁত ছাড়া আবার মানুষ হয় নাকি?”
“কি খুঁত? একটু ঝেরে কাঁশ তো!”
অতন্দ্রিলা কাঁশল।
“কি ব্যাপার কাঁশছিস কেন?”
“তুমিই তো বললে কাঁশতে!”
“ফাজলামো করবি না! ফাজলামো জিনিসটা আমার একদম পছন্দ না। সত্যি করে বল ছেলের খুঁতটা কি?”
“তার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। আমার চোখে ব্যাপারটা খুঁত না হলেও সমাজের চোখে খুঁত।”
শায়লা হতভম্ব হয়ে বললেন, “একবার বিয়ে হয়েছে এমন একটা ছেলের সঙ্গে তোর বাবা তোর বিয়ে ঠিক করেছে?”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “হ্যাঁ মা। আমি তো ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। সমাজের চোখে নিখুঁত কোনো ছেলের পরিবার আমাকে পছন্দ করবে না। তারা ভাববে আমিও হয়তো আমার বাবা-মায়ের ঝগড়া করার গুন পেয়েছি, বিয়ের পর তাদের ছেলের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করবো। এজন্য বাবা একটা খুঁতসম্পন্ন ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছে।”
“কেন আমার মেয়ে কি ভেসে এসেছে নাকি যে ওকে এমন একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে? তোর বাবা কি ভেবেছে? তোর বাবা আসুক আজকে, তার সঙ্গে এর একটা শেষ দেখে ছাড়বো। আমি কিছুতেই ডিভোর্সি একটা ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে হতে দেব না।”
“আহ্ মা, এভাবে বলছো কেন? তুমি নিজেও তো একজন ডিভোর্সি। তাছাড়া ছেলেটা ডিভোর্সি…”
অতন্দ্রিলাকে থামিয়ে দিয়ে শায়লা বললেন, “তোকে আর জ্ঞান দিতে হবে না। থাম তুই!”
“ঠিক আছে থামলাম। বাবা হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। ততক্ষণ তোমরা বসে থাকো, আমি আমার ঘরে যাচ্ছি। আমার কিছু কাজ আছে।”
অতন্দ্রিলা উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।
সন্ধ্যাতারা, অতন্দ্রিলার বড় বোন। অতন্দ্রিলার সাথে তার বয়সের পার্থক্য আট বছর। তাই বোধহয় দুজনের চিন্তাচেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি কোনো কিছুরই মিল নেই।
পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর মানুষগুলোর একজন হলো সন্ধ্যা। যেকোনো বিষয়েই সে মানুষকে জ্ঞান দিতে চেষ্টা করে, এমন একটা ভাব যেন পৃথিবীর সবকিছু তার জানা। কিন্তু এটা বিরক্ত করার মত কোনো বিষয় নয়। বিরক্তিকর বিষয়টা হলো সন্ধ্যার দেওয়ার জ্ঞানের কোনোই যুক্তি নেই।
অতন্দ্রিলা ঘরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় ঝড়ের গতিতে সন্ধ্যা তার ঘরে ঢুকে।
“কি ব্যাপার আপা দৌড়াচ্ছো কেন?”
সন্ধ্যা অতন্দ্রিলার পাশে বসতে বসতে বলল, “আমার কথা বাদ দে। আগে বল তো, কয় বছর আগে ছেলেটার ডিভোর্স হয়েছে?”
“ডিভোর্স? না, না আপা। তার ডিভোর্স হয়নি তো!”
“ডিভোর্স হয়নি? হায় আল্লাহ! তার মানে তুই এ যুগে সতীনের সংসার করবি?”
“আপা কি যাতা বলছো বলতো? সতীনের সংসার আবার কি? উনার আগের স্ত্রী চার বছর আগে মারা গেছেন।”
সন্ধ্যা হতভম্ব গলায় বলল,“মারা গেছে? সর্বনাশ! তাহলে তো তুই শেষ!”
“শেষ মানে?”
“শেষ মানে ফিনিসড!”
“আহ্ আপা! তোমার কাছে বঙ্গানুবাদ চাইনি। পরিষ্কার করে বলো কি বলতে চাচ্ছ!”
“দেখ ডিভোর্সি হলেও একটা কথা ছিল। আগের স্ত্রীর উপর ছেলেটার ঘৃণা থাকতো আর তাকে ভুলে তোর সাথে সুখে শান্তিতে সংসার করার চেষ্টা করতো। কিন্তু যেহেতু আগের স্ত্রী মারা গেছে, তার মানে ছেলেটা তাকে এখনো ভুলতে পারেনি। তাই তোর সাথে সুখে সংসারও করতে পারবে না। বারবার আগের স্ত্রীর সাথে তোর তুলনা করবে, তোকে ভালোবাসবে না। তুই বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা কতো ভয়ংকর?”
“আর আপা তুমি কি বুঝতে পারছো যে তোমার কথার কোনো যুক্তি নেই?”
সন্ধ্যা কিছু একটা বলতে যাবে তখনি নিচ থেকে আসা চেঁচামেচির শব্দ শুনে থেমে গেল।
বসার ঘরে চলছে শায়লা এবং হামিদ সাহেবের মধ্যে তুমুল ঝগড়া।
শায়লা উত্তেজিত গলায় বললেন, “তুমি আমার মেয়েকে ভেবেছোটা কি হ্যাঁ? আমার মেয়ে জলে ভেসে এসেছে? ওর কি একটা হাত বা পা নেই? নাকি ও চোখে দেখতে পারে না? আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়েটার সাথে এমন একটা ছেলের বিয়ের দেবার কথা ভাবলে কিভাবে?”
“আমার মেয়ে আমার মেয়ে করছো কেন? উনিশ বছর আগে যখন জ্বরের মধ্যে মেয়েটাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে, তখন কোথায় ছিল তোমার এই মাতৃত্ব?”
“বাজে কথা বলবে না। একদম বাজে কথা বলবে না। আমি কিছুতেই ডিভোর্সি একটা ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না!”
অতন্দ্রিলা দৌড়ে নিচে এসে বলল, “আহ্ মা,বাবা! কি শুরু করলে তোমরা?”
শায়লা উত্তেজিত গলায় বললেন, “অত তুই চল তো! আজকেই আমি তোকে আমার সাথে নিয়ে যাবো! ওই ডিভোর্সি ছেলেটাকে তোর বিয়ে করতে হবে না। আমি অনেক ভালো একটা ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব!”
“মা তুমি শান্ত হয়। প্রথমত, আমি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছি না। দ্বিতীয়ত, যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সেও অনেক ভালো একটা ছেলে। আর ছেলেটা ডিভোর্সি না, তার স্ত্রী চার বছর আগে মারা গেছে। বিপত্নীক হওয়ার পিছনে তার কোনো দোষ নেই।”
“সে রসগোল্লা পন্তুয়া যাই হোক, আমি তার সঙ্গে তোকে বিয়ে দেব না!”
“এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন মা? বিয়েটা তো আমি করবো নাকি? আমারই যখন কোনো আপত্তি নেই তখন তুমি এত রাগ করছো কেন?”
শায়লা কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুকনো গলায় বললেন,“তোর কোনো আপত্তি নেই?”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল,“না নেই মা।”
শায়লা সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।
(চলবে)#অতন্দ্রিলার_রোদ
পর্ব : ৪ – (আপত্তি নেই)
লেখা : শঙ্খিনী
অতন্দ্রিলা মানুষটাই নিখুঁত। তার দীর্ঘ পল্লব যুক্ত চোখ দুটো নিখুঁত, লম্বা চুলগুলো নিখুঁত, হাসিটাও নিখুঁত। তবে অতন্দ্রিলা খুব একটা হাসে না আবার কাঁদেও না।
হামিদ সাহেব শেষ বার অতন্দ্রিলাকে কাঁদতে দেখেছিলেন যখন তার বয়স ১৩।
অতন্দ্রিলার কথা, “যুক্তিযুক্ত কারন ছাড়া কোনো মানুষের সামনে হাসি বা কান্নার মত শক্তিশালী অনুভূতি প্রকাশ করার কোনো অর্থ নেই।”
অতন্দ্রিলার হাতে গোণা দু একটা বাজে অভ্যাসের মধ্যে অন্যতম হলো, নিজের লেখা প্রতিবেদন বারবার পড়া।
আজ সকালে তার ভালোবাসা সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। এবারের প্রতিবেদনটা তুমলামুলকভাবে গুছিয়েই লিখেছে অতন্দ্রিলা। প্রতিবেদনটা এমন –
ভালোবাসা কারে কয়?
অতন্দ্রিলা আশরাফ
৩ জুলাই, ২০২০ | ১১:৫০ পূর্বাহ্ন
‘ভালোবাসা’ শব্দটির সাথে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। নাটক-সিনেমা দেখতে বসলে অহরহ শব্দটা শুনতে পাই । ছোটবেলায় সমাজ বইতে আমরা জেনেছি, পৃথিবীতে সব মানুষ একই পরিবেশে বাস করে না। সকলেরই বসবাসের পরিবেশ ভিন্ন, তাই ভালোবাসার উপলক্ষটাও ভিন্ন।
পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী মহামানবদের সকলে
একই পরিবেশে বসবাস করেননি। তাই ভালোবাসা সম্পর্কে তাদের মতামতও ভিন্ন।
চলুন জেনে নেই বিখ্যাত ব্যাক্তিদের ভালোবাসা সম্পর্কিত কিছু উক্তি –
১। ডেভিড রস – “ভালোবাসা এবং যত্ন দিয়ে মরুভূমিতেও ফুল ফোটানো যায়।”
২। লা রচেফউকোল্ড – “সত্যিকারের ভালোবাসা হল অনেকটা প্রেতআত্মার মতো। এ নিয়ে সবাই কথা বলে,কিন্তু শুধুমাত্র কয়েকজনই এর দেখা পায়।”
৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – “পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমেরমত সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নাই। প্রথমযৌবনে বালিকা যাকে ভালোবাসে তাহার মত সৌভাগ্যবানও আর কেহই নাই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়, কিন্তু সে প্রেমের আগুন সব বালিকাকে সারাজীবন পোড়ায়।”
৪। হুমায়ূন আহমেদ – “কাউকে প্রচন্ডভাবে ভালবাসার মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা আছে। নিজেকে তখন তুচ্ছ এবং সামান্য মনে হয়। এই ব্যাপারটা নিজেকে ছোট করে দেয়।”
৫। কীটস্ – “যে ভালোবাসা পেলো না, যে কাউকে ভালোবাসতে পারলো না সংসারে তার মতো হতভাগা কেউ নেই।”
৬। টেনিসন – “ভালবাসা যা দেয় তার চেয়ে বেশী কেড়ে নেয়।”
অনেক তো হলো বিখ্যাত ব্যাক্তিদের উক্তি, চলুন জেনে আসা যাক ভালোবাসা নিয়ে সাধারন মানুষদের মতামত।
১। হামিদ চৌধুরী, রিটেয়ারপ্রাপ্ত উকিল।
বয়স ৬০ এর কাছাকাছি, ১৯ বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ওনার মতে, “ভালোবাসার মত ন্যাকামি জাতীয় জিনিস পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
২। শায়লা হোসেন, পেশায় অধ্যাপক।
বয়স ৫২-৫৪, হামিদ চৌধুরীর প্রাক্তন স্ত্রী।
তার মতে, “একটা মানুষকে যথাযথ সময় দিতে পারলেই তাকে ভালোবাসা উচিত। যে সময় দিতে পারে না, তার ভালোবাসা উচিত নয়।”
৩। রওশন আরা, হামিদ চৌধুরীর মাতা।
বয়স ৭৫। তিনি মনে করেন, “স্বামী-স্ত্রী মধ্যে যাহা বিদ্যমান, তাহাই ভালোবাসা।”
৪। জরিনা, হামিদ চৌধুরীদের বাড়ির কাজের মেয়ে। বয়স ২১। ভালোবাসা সম্পর্কে তার মতামত কিছুটা এরকম – “এইসব বদ মাইয়া-পোলার করবার। যেগুলি এইসব ভালোবাসাবাসি করে, হেগুলি বদের বদ।”
ভ্রু সামান্য কুঁচকে বারবার প্রতিবেদনটি পরছে অতন্দ্রিলা, কিছুটা চিন্তিত সে। চিন্তার প্রধান কারন তার বাবা, মা এবং দাদীর মতামতগুলো আসল নয়। অতন্দ্রিলার বানিয়ে লেখা।
এই তিনজন মানুষকে ‘ভালোবাসা কি?’ – প্রশ্নটা করে মনের মতো কোনো জবাব পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তাই অতন্দ্রিলা সেই বৃথা চেষ্টা করে আর সময় নষ্ট করেনি।
দরজায় টোকা পরলো।
অতন্দ্রিলা ভেতর থেকে বলল, “কে?”
“আফা আমি জরিনা!”
“ভেতরে এসো জরিনা।”
জরিনা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ঘরে ঢুকে বলল, “আফা ঘটনা তো একখান ঘইটা গেছে! শিগগির নিচে আসেন!”
“কি ঘটনা?”
“ওইযে ওইদিন আপনারে দেইখ্যা গেলো যারা! তারা মেলা জিনিস পাঠাইছে। বাসার ঘরে ভাইসা যাইতেসে জিনিসপত্রে!”
“মেলা জিনিস পাঠাবে কেন?”
“অতো কথা বলার টাইম নাই! আফনে নিচে আসেন।”
অতন্দ্রিলা যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে উঠল। প্রতিবেদনটা আর কমপক্ষে দু থেকে তিনশ বার পড়ে উঠতে পারলে এই বিরক্তিটা কাজ করতো না।
জরিনার স্বভাবগত দোষ, সে যেকোনো বিষয়কেই বাড়িয়ে বলে।
কিন্তু আজ জরিনা সত্য কথাই বলেছে। বসার ঘর প্রায় ভেসেই যাচ্ছে উপহারে। ঝুড়ি ভর্তি শাক-সবজি, ফলমূল। মাটির হাঁড়িতে বিভিন্ন ধরনের মাছ। আদা, রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি নানা প্রকারের মসলা। আম, জলপাই ইত্যাদির আচার। সেগুলো অতি আগ্রহ নিয়ে ঘটাঘাটি করছেন হামিদ সাহেব।
অতন্দ্রিলা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল, “এসব কি বাবা?”
“ফিরোজা আপা পাঠালো!”
“ফিরোজা আপাটা কে?”
“এরমধ্যে ভুলে গেলি? ওইযে সেদিন
তোকে দেখতে এলো, ছেলের মা!”
“ওহ আচ্ছা! তা এরমধ্যে আপা বাঁধিয়ে ফেলেছো?”
“হ্যাঁ ফেলেছি। তোর কোনো সমস্যা আছে?”
“একদম না, আমার সমস্যা থাকতে যাবে কেন? আচ্ছা হঠাৎ তোমার ফিরোজা আপা এত কিছু পাঠালো কেন?”
“ওদের নাকি তোকে খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদের যদি কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে আগামী বুধবারই বিয়ের কথা পাকা করতে আসবে।”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “বাহ্! চমৎকার খবর।”
“তুই বিয়েতে রাজি তো?”
“অবশ্যই রাজি বাবা।”
“আমি মুগ্ধ! আমি আনন্দিত!”
“বাবা আমার ধারনা, আমার রাজি হওয়াটা তোমার আনন্দের প্রধান কারন না। আনন্দের প্রধান কারন এতগুলো উপহার। তাইনা?”
“আমার আনন্দের কারন যাই হোক, তাতে তোর কি? কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং কিসব প্রতিবেদন লিখিস, সেগুলো লেখ গিয়ে যা!”
“অনেক ধন্যবাদ বাবা।”
দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে হামিদ সাহেব ব্যাংকে যান। সামনে মেয়ের বিয়ে। আর বিয়ের ওপর নামই যেন খরচ।
অতন্দ্রিলার জন্মের পর পরই তার বিয়ের জন্য কয়েক লক্ষ টাকা ব্যাংকে রেখে দেন তিনি। এত বছর ব্যাংকে থেকে থেকে সেই টাকা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
অতন্দ্রিলা প্রতিদিন দুপুরে ছাদে হাঁটাহাঁটি করে, গুনগুন করে গান গায়। এই সময়টায় কেউ তার আশেপাশে থাকলে নাকি খুব অসহ্য লাগে। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না।
হঠাৎ জরিনা দৌড়ে ছাদে এলো।
“আফা!”
“জরিনা, তোমাকে না মানা করেছি আমি ছাদে হাঁটাহাঁটি করার সময় বিরক্ত করতে!”
“দুনিয়া উল্টায় যাইতেছে আর আফনে হাঁটতেছেন?”
“দুনিয়া উল্টানোর মত কি ঘটেছে?”
“খালাম্মা আসছে, সাথে বড় আফা! দুইজনেই খেইপ্পা আছে। আমারে বলে, যাও অতরে ডাইককা আনো। আমি বলছি, আফা ডিস্টাব করতে মানা করছে। আমারে ধমক দিয়া কয়, চাকরি বাঁচাইতে চাইলে অতরে ডাকো!”
“এত বেশি কথা বলো কেন জরিনা? বেশি কথা বললে তো তুমি বিপদে পরবে!”
অতন্দ্রিলা নিচে নেমে এলো। শায়লা ও তার বড় মেয়ে সন্ধ্যা দুজন বসার ঘরের দুই সোফায় বসে আছেন।
শায়লা প্রচন্ড রেগে আছেন। অতন্দ্রিলাকে দেখা মাত্র এমন একটা ভাব যেন এখনি তাকে আস্ত গিলে খাবেন।
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “কি ব্যাপার মা?”
শায়লা কঠিন গলায় বললেন, “কি ব্যাপার মানে? তুই কি ভদ্রতা বলতে কিছুই শিখিসনি? এত দিন পর দেখা, না সালাম দিলি, না হাই হ্যালো বললি। সোজা, কি ব্যাপার!”
অতন্দ্রিলা বসতে বসতে বলল,“সালাম দিতাম যদি তুমি আমার কোনো দূরসম্পর্কের আত্মীয় হতে। কিন্তু তুমি তো আমার দূরসম্পর্কের মা, তোমার সঙ্গে প্রতিদিনই আমার টেলিফোনে কথা হচ্ছে। তোমাকে আবার সালাম দেওয়ার কি হলো?”
“জ্ঞান দিবি না। তোর এসব জ্ঞান আমার একদম অপছন্দের।
বাড়িতে এত কিছু ঘটে গেলো, আর আমরা কিছুই জানতে পারলাম না!”
“কি ঘটেছে?”
“তোকে নাকি গত সপ্তাহে দেখতে এসেছিলো? বিয়েও নাকি ঠিক হয়ে গেছে?
এত বড় একটা কথা আমাদের না জানিয়ে কিভাবে পারলি তুই? আচ্ছা, তোর বাবা আর দাদি না হয় কোনো দিনও আমাদের বলবে না, কিন্তু তুই তো বলতে পারতিস? নাকি আমাদের জানানোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করিসনি? আমরা কি এতটাই পর হয়ে গেছি তোর কাছে?”
সন্ধ্যা আহত গলায় বলল, “পরই তো ভাবে মা। মনে নেই, ও এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিলো আর আমাদের জানিয়েছিল এক মাস পর। আজকে যদি জরিনা ওর বিয়ের কথাটা না বলতো, তাহলে তো ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও আমরা জানতে পারতাম না।”
অতন্দ্রিলা বলল, “আপা দুটো ঘটনা পুরোপুরি ভিন্ন। এইচএসসির রেজাল্ট যখন বের হয়েছিল তখন দাদি ভীষন অসুস্থ, হসপিটালে ছিলো। ওই অবস্থায় আমি নিজের রেজাল্টে নিজেই খুশি হতে পারিনি। একমাস পর যখন দাদি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেন, তখন আমি খুশি হয়েছি। এবং খুশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের টেলিফোন করে জানিয়েছি।
আর এই ব্যাপারটা কেন এখনো জানাইনি তার গঠনমূলক ব্যাখ্যা তোমাদের দিতে পারি।”
শায়লা কিছুটা শান্ত গলায় বললেন, “দে, দে তোর গঠনমূলক ব্যাখ্যা!”
“গত বৃস্পতিবার রাতে বাবা হঠাৎই আমার ঘরে এসে বললেন, কাল বিকেলে তোকে দেখতে আসবে।
বিনা নোটিশে দেখতে আসার কথা শুনে আমিও খানিকটা ধাক্কা খাই। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না। এক বেলার মধ্যে তোমাদের খবর দেওয়াটাও বোকামি হতো।
তারা দেখে যাওয়ার পরও আমি তোমাদের কিছু বলিনি তার কারণ হলো তখনো বিয়ে হবে কি হবে না সেই ব্যাপারে অনিশ্চয়তা ছিলো। কিন্তু আজ সকালেই সে অনিশ্চয়তা দূর হয়। তারা আজ আমাদের বাড়িতে এক সমুদ্র উপহার পাঠান এবং বলেন আগামী বুধবার বিয়ে ফাইনাল করতে আসবে। আমি আজ বিকেলে আমি নিজে তোমাদের বাড়িতে এই খবরটা নিয়ে যেতাম।”
শায়লাকে দেখে এখন বেশ স্বাভাবিক লাগছে।
তিনি একটা মৃদু্ হাসি নিয়ে বললেন, “তুই তাহলে রাজি এই বিয়েতে।”
“রাজি না হওয়ার কোনো কারন যেহেতু নেই, সেহেতু আমি রাজি।”
“ছেলের নাম কি?”
“রোদ। রোদ আহসান।”
“দেখতে কেমন?”
“রাজপুত্রের মতো।”
“পড়াশুনা?”
“গণিতে এম এ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।”
“করে কি?”
“বাবার বিজনেস দেখাশুনা করে। কিন্তু তার বাবা বেঁচে নেই, তাই বলা যায় নিজের বিজনেস দেখাশুনা করে।”
“গণিতে পড়াশুনা করে আবার বিজনেস সামলায় কিভাবে?”
“সেটা আমি কিভাবে বলতে পারি? তোমার সঙ্গে যখন সামনাসামনি দেখা হবে তখন তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করো।”
“তোর বাবা ঠিকই বলে, তোর সঙ্গে কথা বলাটাই বিপদ! আচ্ছা, এখন বল ছেলের কোনো খুঁত আছে?”
“অবশ্যই আছে। খুঁত ছাড়া আবার মানুষ হয় নাকি?”
“কি খুঁত? একটু ঝেরে কাঁশ তো!”
অতন্দ্রিলা কাঁশল।
“কি ব্যাপার কাঁশছিস কেন?”
“তুমিই তো বললে কাঁশতে!”
“ফাজলামো করবি না! ফাজলামো জিনিসটা আমার একদম পছন্দ না। সত্যি করে বল ছেলের খুঁতটা কি?”
“তার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। আমার চোখে ব্যাপারটা খুঁত না হলেও সমাজের চোখে খুঁত।”
শায়লা হতভম্ব হয়ে বললেন, “একবার বিয়ে হয়েছে এমন একটা ছেলের সঙ্গে তোর বাবা তোর বিয়ে ঠিক করেছে?”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “হ্যাঁ মা। আমি তো ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। সমাজের চোখে নিখুঁত কোনো ছেলের পরিবার আমাকে পছন্দ করবে না। তারা ভাববে আমিও হয়তো আমার বাবা-মায়ের ঝগড়া করার গুন পেয়েছি, বিয়ের পর তাদের ছেলের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করবো। এজন্য বাবা একটা খুঁতসম্পন্ন ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছে।”
“কেন আমার মেয়ে কি ভেসে এসেছে নাকি যে ওকে এমন একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে? তোর বাবা কি ভেবেছে? তোর বাবা আসুক আজকে, তার সঙ্গে এর একটা শেষ দেখে ছাড়বো। আমি কিছুতেই ডিভোর্সি একটা ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে হতে দেব না।”
“আহ্ মা, এভাবে বলছো কেন? তুমি নিজেও তো একজন ডিভোর্সি। তাছাড়া ছেলেটা ডিভোর্সি…”
অতন্দ্রিলাকে থামিয়ে দিয়ে শায়লা বললেন, “তোকে আর জ্ঞান দিতে হবে না। থাম তুই!”
“ঠিক আছে থামলাম। বাবা হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। ততক্ষণ তোমরা বসে থাকো, আমি আমার ঘরে যাচ্ছি। আমার কিছু কাজ আছে।”
অতন্দ্রিলা উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।
সন্ধ্যাতারা, অতন্দ্রিলার বড় বোন। অতন্দ্রিলার সাথে তার বয়সের পার্থক্য আট বছর। তাই বোধহয় দুজনের চিন্তাচেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি কোনো কিছুরই মিল নেই।
পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর মানুষগুলোর একজন হলো সন্ধ্যা। যেকোনো বিষয়েই সে মানুষকে জ্ঞান দিতে চেষ্টা করে, এমন একটা ভাব যেন পৃথিবীর সবকিছু তার জানা। কিন্তু এটা বিরক্ত করার মত কোনো বিষয় নয়। বিরক্তিকর বিষয়টা হলো সন্ধ্যার দেওয়ার জ্ঞানের কোনোই যুক্তি নেই।
অতন্দ্রিলা ঘরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় ঝড়ের গতিতে সন্ধ্যা তার ঘরে ঢুকে।
“কি ব্যাপার আপা দৌড়াচ্ছো কেন?”
সন্ধ্যা অতন্দ্রিলার পাশে বসতে বসতে বলল, “আমার কথা বাদ দে। আগে বল তো, কয় বছর আগে ছেলেটার ডিভোর্স হয়েছে?”
“ডিভোর্স? না, না আপা। তার ডিভোর্স হয়নি তো!”
“ডিভোর্স হয়নি? হায় আল্লাহ! তার মানে তুই এ যুগে সতীনের সংসার করবি?”
“আপা কি যাতা বলছো বলতো? সতীনের সংসার আবার কি? উনার আগের স্ত্রী চার বছর আগে মারা গেছেন।”
সন্ধ্যা হতভম্ব গলায় বলল,“মারা গেছে? সর্বনাশ! তাহলে তো তুই শেষ!”
“শেষ মানে?”
“শেষ মানে ফিনিসড!”
“আহ্ আপা! তোমার কাছে বঙ্গানুবাদ চাইনি। পরিষ্কার করে বলো কি বলতে চাচ্ছ!”
“দেখ ডিভোর্সি হলেও একটা কথা ছিল। আগের স্ত্রীর উপর ছেলেটার ঘৃণা থাকতো আর তাকে ভুলে তোর সাথে সুখে শান্তিতে সংসার করার চেষ্টা করতো। কিন্তু যেহেতু আগের স্ত্রী মারা গেছে, তার মানে ছেলেটা তাকে এখনো ভুলতে পারেনি। তাই তোর সাথে সুখে সংসারও করতে পারবে না। বারবার আগের স্ত্রীর সাথে তোর তুলনা করবে, তোকে ভালোবাসবে না। তুই বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা কতো ভয়ংকর?”
“আর আপা তুমি কি বুঝতে পারছো যে তোমার কথার কোনো যুক্তি নেই?”
সন্ধ্যা কিছু একটা বলতে যাবে তখনি নিচ থেকে আসা চেঁচামেচির শব্দ শুনে থেমে গেল।
বসার ঘরে চলছে শায়লা এবং হামিদ সাহেবের মধ্যে তুমুল ঝগড়া।
শায়লা উত্তেজিত গলায় বললেন, “তুমি আমার মেয়েকে ভেবেছোটা কি হ্যাঁ? আমার মেয়ে জলে ভেসে এসেছে? ওর কি একটা হাত বা পা নেই? নাকি ও চোখে দেখতে পারে না? আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়েটার সাথে এমন একটা ছেলের বিয়ের দেবার কথা ভাবলে কিভাবে?”
“আমার মেয়ে আমার মেয়ে করছো কেন? উনিশ বছর আগে যখন জ্বরের মধ্যে মেয়েটাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে, তখন কোথায় ছিল তোমার এই মাতৃত্ব?”
“বাজে কথা বলবে না। একদম বাজে কথা বলবে না। আমি কিছুতেই ডিভোর্সি একটা ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না!”
অতন্দ্রিলা দৌড়ে নিচে এসে বলল, “আহ্ মা,বাবা! কি শুরু করলে তোমরা?”
শায়লা উত্তেজিত গলায় বললেন, “অত তুই চল তো! আজকেই আমি তোকে আমার সাথে নিয়ে যাবো! ওই ডিভোর্সি ছেলেটাকে তোর বিয়ে করতে হবে না। আমি অনেক ভালো একটা ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব!”
“মা তুমি শান্ত হয়। প্রথমত, আমি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছি না। দ্বিতীয়ত, যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সেও অনেক ভালো একটা ছেলে। আর ছেলেটা ডিভোর্সি না, তার স্ত্রী চার বছর আগে মারা গেছে। বিপত্নীক হওয়ার পিছনে তার কোনো দোষ নেই।”
“সে রসগোল্লা পন্তুয়া যাই হোক, আমি তার সঙ্গে তোকে বিয়ে দেব না!”
“এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন মা? বিয়েটা তো আমি করবো নাকি? আমারই যখন কোনো আপত্তি নেই তখন তুমি এত রাগ করছো কেন?”
শায়লা কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুকনো গলায় বললেন,“তোর কোনো আপত্তি নেই?”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল,“না নেই মা।”
খুব ভোরে ঘুম একটু হালকা হতেই মনে হল যেন কোনো এক শক্ত বাঁধন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে আমায়।চোখ খুলে খুব কাছ থেকে দেখলাম নিদ্রর ঘুমন্ত মুখ।তার উষ্ণ নিঃশ্বাসে তপ্ত হয়ে উঠছে আমার আঁখি প্রশস্ত ললাট।নিজেকে ছাড়ানোর কিঞ্চিৎ চেষ্টা করলাম।কিন্তু এই শক্ত বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়া যে দায়।
অনেক কষ্টে তার হাত ছাড়িয়ে উঠে বসলাম।আড়মোড়া ভেঙে সে চোখ মেলে চাইলো।আমি স্মিত বিস্মিত হয়ে বললাম,’আপনি ঘুমানো ছিলেন না!তাহলে আমাকে এভাবে ধরে রেখেছিলেন কেনো?’
দু হাত মাথার নিচে দিয়ে ঈষৎ ভ্রু ভাঁজ করে সে বলল,’বারে!তুমি স্বেচ্ছায় আমাকে ধরতে পারো আর আমি ধরলেই দোষ!’
আমি মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলাম বাথরুমে।এই ছেলেকে কি আর কথা দিয়ে কখনো জব্দ করা যায়!নেহাত কাল রাতে একটু ভয় পেয়ে হয়ত ধরেছিলাম তার জন্য এত কথা!
বাথরুম থেকে আমি বের হলে নিদ্র ঢুকে গেল।
আমি চোখ বুলিয়ে তার রুমটা দেখতে লাগলাম।কাল রাতে অতো খেয়াল করা হয়নি।বৃহৎ প্রশস্ত রুমে আসবাবপত্র কম।হয়তো সে ছিমছামই পছন্দ করে।হোয়াইট বেড শিটে ঢাকা নরম বিছানা ঘেষা দেয়ালটির রঙ হালকা আকাশি। বাকি দুই দেয়ালে সাদা রঙ করা হয়েছে।রুমের সাথে বারান্দার সংযোগস্থল দেয়ালটি পুরো কাচের।পুরোটা জুড়ে টেনে রাখা হয়েছে সাদা পর্দা।বিছানা থেকে নামার সম্মুখে ফ্লোরে রাখা একটি সাদা পশমের নরম তুলতুলে কার্পেট।কার্পেটের রঙটি এতো সাদা যে পা রাখতেও ইচ্ছে করে না।মনে হয় ময়লা হয়ে যাবে।বেডের পাশে রাখা ছোট্ট বেড সাইড টেবিল।তার পাশে হালকা আকাশি রঙের পাতলা পর্দায় আবৃত খোলা প্রশস্ত জানালা।জানালার কোন ঘেষে রাখা হয়েছে মাঝারী সাইজের সাদা রঙে আবৃত কাঠের টেবিল।আর আছে খুব সুন্দর একটি বড় সাদা আলমারি,বৃহৎ ড্রেসিংটেবিল আর আকাশি রঙের সোফা।সাদা আকাশি রঙের কম্বিনেশনের রুমটিতে কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব বিরাজমান।
আমি ধীরপায়ে নিচে নেমে এলাম।কেমন যেন একটু জড়তা কাজ করছে।আমাদের জন্য ভনিতা হলেও সবার কাছে তো এই সম্পর্ক সত্যি।সেই সূত্রে তো এটা আমার শ্বশুরবাড়ি।মেয়েদের বিয়ের পর খুব বিরাটভাবেই জীবনে পরিবর্তন নেমে আসে এই সত্যতা সম্পর্কে আমিও অবগত।এখনই কি একঝাঁক দায়িত্ব আমার উপর জেঁকে বসবে?তবে কি জীবনের সহজ সরল ধারাটা হারিয়ে ফেললাম বাস্তবতার ভীড়ে।
রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের জন্য পানি চড়াতেই অ্যান্টি হন্তদন্ত হয়ে এসে থমথমে গলায় বলল,’সুপ্তি,এসব কি হচ্ছে?’
আমি সচকিত হয়ে খুঁজতে লাগলাম কোথাও কোনো ভুল করে ফেললাম না তো!
আমতা আমতা করে বললাম,’অ্যান্টি সবার জন্য একটু চা বানাচ্ছিলাম।’
অ্যান্টি বলল,’তোকে কে বলেছে চা বানাতে।শোন,যতদিন তোর পড়ালেখা শেষ হবে না এই রান্নাঘর তোর জন্য নিষিদ্ধ।বাড়িতে কাজের লোকের কি কম পড়েছে নাকি যে আমাকে আমার বাচ্চা বউ দিয়ে কাজ করাতে হবে।আর আমাকে কি তোর বুড়া শ্বাশুড়ি মনে হয় যে বউকে একা খাটিয়ে খাবো।তোর পড়ালেখা শেষ হোক তারপর আমি নিজে তোকে সব শিখিয়ে দেব তার আগে কিচ্ছু করতে হবে না,যা রুমে যা।আমি তোর জন্য চা পাঠিয়ে দেব আর নিদ্রর জন্য কফি।নিদ্র কিন্তু শুধু কফি খায়,চা খায় না।
আমি মুচকি হেসে মনে মনে বললাম,হুম,তার জন্যই তো কফির সৃষ্টি।এত সুন্দর করে যে কফি খায় সে কফি ছাড়া আর অন্য কিছু কেনো খাবে?
আমি জ্বি অ্যান্টি বলে চলে যেতে ধরলেই অ্যান্টি আবার থামিয়ে বলল,’সুপ্তি,অ্যান্টি কিরে! মা বলবি মা।’
আমি মুচকি হেসে মা বলে চলে আসলাম।মা আসলেই কত ভালো।শ্বাশুড়ির মত তো একদম লাগে না,মায়ের মতই লাগে।আর কি সুন্দর তুই করে কথা বলে একদম আপন করে নেয়।
একটি রুম থেকে আসা ভাঙাচোরার আওয়াজ শুনতেই আমি থমকে দাঁড়ালাম।দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে একটু উঁকি দিতেই দেখতে পেলাম একটি তেরো কি চৌদ্দ বছরের সুন্দর ছেলে একটি রিমোট কন্ট্রোল কার ভেঙে ভেতরের অংশ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।ছেলেটির পরনে লাল টি শার্ট মাঝখানে ব্যাট ম্যানের ছবি দেওয়া।চুলগুলো জেল দিয়ে খাড়া করা।আমি কৌতূহল নিয়ে ভেতরে গেলাম।ভেতরে গিয়ে চোখে পড়ল প্রায় সবগুলো গাড়ির একই অবস্থা।আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম,’এসব কি করেছো?’
ছেলেটি গাড়ি থেকে মুখ না তুলেই বলল,’ইনভেনশন করছি।’
-‘এত সুন্দর গাড়ি ভেঙে কিসের ইনভেনশন?’
-‘এই গাড়ির মোটর আমি আমার বানানো হেলিকপ্টারে লাগাবো।’
এই বলে সে আমার সামনে প্লাস্টিক আর মোটা কাগজে বানানো অনেকটা হেলিকপ্টারের মত দেখতে কিছু একটা তুলে ধরল।
আমি বিস্ময় ভরা চোখে বললাম,’এই মোটর লাগালেই এটা উড়বে?’
-‘উড়বে না কেনো?আমি এর আগেও এমন করে একটি সি-বোট বানিয়েছি।’
ছেলেটির মাথায় তো দেখি ভালো বুদ্ধি।আমি উৎসুক হয়ে বললাম,’তুমি যখন উড়াবে আমাকেও ডাক দিয়ো ঠিকাছে।’
ছেলেটি ‘ওকে’ বলে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল,’তুমিই কি আমার ভাবু?’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’ভাবু আবার কি?’
ছোটো ছেলেটি ব্যাপক মুডে বলল,’ ভাবীর ভা আর বাবুর বু।আমি আরিয়ান ইসলাম নিদ্রর একমাত্র ছোটো ভাই আরশান ইসলাম স্নিগ্ধ।তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে তাই আমি তোমাকে বাবু বলেও ডাকবো।
আমি হেসে ছেলেটির গাল টিপে বললাম,’তুমি তো দেখি অনেক কিউট!’
ছেলেটি গাল ডলে বলল,’কিউট না বলো হ্যান্ডসাম।’
আমি শুধু দেখছি আর অবাক হচ্ছি দুই ভাই একই ক্যাটাগরির।বাচ্চা ছেলে তবুও দেখো কি গাম্ভীর্য্য নিয়ে কথা বলে!
এর সামনে মনে হচ্ছে আমিই এর থেকে ছোটো।
স্নিগ্ধ তার গাড়ি নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কথাবার্তা আমার সাথে করতে লাগলো।আমি তো মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।তবুও ঘাড় নাড়িয়ে ভাব করছি যে সবই বুঝতে পারছি।
আমি স্নিগ্ধকে সাহায্য করার নাম করে একটি গাড়ির স্প্রিং জাতীয় কিছু টান দিতেই সেটা ভেঙে আমার মুখে ছিটকে পড়লো।আমি থতমত খেয়ে গেলাম।
স্নিগ্ধ হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেয়ে বললো,’তুমি তো ভালো বোকা।এটা এভাবে ধরে টান দেয় নাকি!’
আমি একটু কনফিডেন্স নিয়ে তোতলিয়ে বললাম,’হ্যাঁ।তা তো জানি।আমি তো এমনিই একটু ট্রাই করে দেখছিলাম যে এভাবে করলে কেমন হয়।’
ও হাসতে হাসতেই বলল,’হুম আমি সবই বুঝি,এমা কি বোকা!
আমি একটু অপমানিত বোধ করলাম।একটি বাচ্চা ছেলের সামনেও বোকা বনে গেলাম।আর এই বাচ্চা ছেলে এতটুকু বয়সে এত ভাব নেয় কেনো।হাত দিয়ে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে মুখ ভেংগিয়ে চলে আসলাম।
এই দুই ভাই কি খায় কে জানে।মাথার ভেতর বুদ্ধি ঠেসে ঠেসে ভরা।
নিদ্রর রুমে যাওয়ার আগে কাজের মহিলা আমার হাতে তার কফি ধরিয়ে দিল।আমি চা নিচেই খেয়ে এসেছি।আমি কফি নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে শুধু একটি থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে।পানিতে ভিজে লেপ্টে থাকা তার লোমশ বুকটি দেখে আমার শরীরে একটি ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
কি ভয়ংকর ব্যাপার!এভাবে একটি মেয়ের সামনে সে চলে আসবে!তার কি লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই।কফির মগ হাতে সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।না চাইতেও বেহায়া চোখ বারবার সেখানে চলে যাচ্ছে।হঠাৎ হাতের কাঁপুনিতে মগ থেকে হালকা কফি ঝলকে পরলো আমার হাতে।আমি মৃদু শব্দে আহ্ করে উঠলাম।
সে টাওয়েল ছুঁড়ে ফেলে উদ্বিগ্ন মুখে আমাকে সোফায় বসিয়ে তার ঠান্ডা হাতে আমার হাত ধরে দেখে বলতে লাগলো কি হয়েছে।
এভাবে খালি গায়ে তার একদম আমার কাছ ঘেঁষে বসায় আমার শরীরে এক অন্যরকম শিহরণ বইতে লাগলো।আমি একটু একটু করে সরে বসতে চাইলাম।কিন্তু সে ততই আরো ঘেঁষে বসতে লাগল।
আমি বিরক্তি ছাপিয়ে হাত ছাড়িয়ে বললাম,’আপনি একটু প্লিজ সরে বসবেন।’
সে আমার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে আরো ঘেঁষে বসলো।আমি আবারো তোতলিয়ে একই কথা বললাম।সে এবার সোফার ব্যাকসাইড আর কর্ণারে হাত রেখে একটু একটু করে আমার দিকে আগাতে লাগলো আর বলতে লাগলো,’কেনো সরে বসবো,সামথিং সামথিং ফিল হয়?’
দু পাশে তার দুহাতের বেড়া জালে বন্দি হয়ে আমি পিছনে ঘেষতে লাগলাম।একসময় সোফার হাতলে আমার মাথা ঠেকে গেলে আমার পিছানো বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু তার আগানো আর বন্ধ হলো না।নিচের ঠোঁট কামড়ে মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে সে আমার দিকে এগিয়েই যাচ্ছে।খুব কাছে চলে এলে অজানা শঙ্কায় ঢোক গিলে আমি চোখ মুখ কুঁচকে বন্ধ করে ফেললাম।আমার গালে তার ভেজা খোঁচা খোঁচা দাড়ির আলতো পরশ দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার পেছন থেকে তার শার্ট টেনে নিয়ে ফট করে উঠে গেল।আমি চোখ মেলে তাকাতেই সে মুচকি হেসে আবার বাথরুমে চলে গেল।আমি উঠে বসে বুকে হাত দিয়ে একবার জোড়ে শ্বাস নিলাম।
এই ছেলে তো দেখি ভালো লুচু।অন্য মেয়েকেও পছন্দ করে আবার আমার সাথেও কেমন করে!
শার্ট নেওয়ার ছিলো বললেই তো হতো এভাবে আগানোর কি দরকার ছিলো।আমি কি সাংঘাতিক ঘাবড়ে গিয়েছিলাম!
এতো বেলা হয়ে গেছে আর বারান্দার পর্দা এখনো টানা।আমি উঠে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিলাম।এক ঝলক সকালের রোদ আমার মুখে এসে পড়লো।রোদের ঝলকানিতে মৃদু চোখ বন্ধ করে আবার আধো খুলতেই সামনে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।কাঁচের দরজা টেনে সরাতেই সকালের স্নিগ্ধ হাওয়া আর মৃদু ফুলের সুভাস আমার ঠোঁটের কোণায় আনমনেই একটি হাসি টেনে আনল।
কোনো বাড়ির এত সুন্দর বারান্দা আমি কখনো দেখিনি।পুরো মেঝেতে কাঠের পাটাতন।দুপাশের সাইড দেয়ালের রঙ হালকা সবুজ।দেয়ালের বাম সাইডের কর্ণারে একটি শেগুন কাঠের টেবিল।তার পাশে দেয়ালের সাথে সংযুক্ত বই ভর্তি বিশাল বুকশেলফ।বুকশেলফটি এমন ভাবে সাজানো যে দেখে মনে হয় একটি বটগাছের ডালে সারি সারি ফুল।বারান্দাটাও বিশাল।মাথার উপরের ছাদ অর্ধেক পর্যন্ত গিয়ে পুরো খোলা।টবে লাগানো বিভিন্ন ধরণের ফুল ফুটে রয়েছে।ডান পাশে একটি ঝুলা টাইপ গোল দোলনা।সামনের কাঠের রেলিং সোজা গিয়ে কর্ণারে এসে থেমে গেছে।সেখানে আবার সরু কাঠের সিড়ি সোজা বাড়ির পেছনে বাগানে গিয়ে নেমেছে।যেখানে বাহারী ফুলের মেলার মাঝে বড় একটি দোলনা।এতো দেখি পুরো স্বর্গপুরী!নিদ্রর রুমের ভেতরটা যেমনই মনে আকাশের অনুভূতি জাগ্রত করে তেমনি বারান্দাটা ফুটিয়ে তোলে সবুজ প্রকৃতির স্নিগ্ধতা।
টেবিলের দিকে তাকিয়ে একটি বস্তুতে আমার চোখ আটকে গেল।ধীর পায়ে এগিয়ে কলমদানী থেকে তা বের করলাম।আমার সেই চুলের কাঠি।নিদ্র এখনো এটা কলমদানীতে এত যত্ন করে রেখেছে কেনো!
★
মাঝে মাঝে কিছু করার না থাকলে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে আমার ভালো লাগে।নিদ্রর আলমারীটা তাই ঘাটাঘাটি করছিলাম।হঠাৎ চোখ পড়ল সাইডে আলাদা করে রাখা একটি সাদা শার্টের উপর।এটা সেই শার্ট যেটা নিদ্র আমাদের প্রথম দেখার দিন পড়ে ছিল,যেদিন আমি তাকে থাপ্পড় মেড়েছিলাম।যেই থাপ্পড়ই সবকিছুর সূচনা।
শার্টের ভাঁজ খুলে মেলতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম।সেদিনের আমার থেকে লাগা কাঁদার দাগ এখনো লেগে রয়েছে।মনে হচ্ছে সেদিনের পর শার্টের অবস্থা যেমন ছিল নিদ্র সেভাবেই খুলে রেখে দিয়েছে।আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম এর পেছনের কারণ কি হতে পারে।সে আবার রাগবশত এটা ফেলে রাখেনি তো!
শার্টটাকে ধুতে আমার প্রায় দেড়ঘন্টা লাগলে।
আট নয় মাসের পুরনো কাঁদার দাগ,সহজে কি আর উঠে।আমি দাগ ভরিয়েছি তাই আমিই ধুয়ে দিলাম।বারান্দায় হেঙ্গারে ঝুলিয়ে রোদে শুকাতে দিলাম।
বিকেলের দিকে নিদ্র বাড়ি ফিরল।আমি তখন সোফায় বসে উপন্যাস পড়ছিলাম।ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে সে একটা হুংকার দিল।আমি দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখতে পেলাম সে শুকিয়ে যাওয়া শার্ট হাতে বড় বড় চোখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,’কি হয়েছে?’
সে থমথম মুখ করে বলল,’এটা কে ধুয়েছে?’
-‘আমি ধুয়েছি।এটা আপনি এখনো ধুয়ে দেননি কেনো?যাক!আমি নষ্ট করেছি তাই আমিই ধুয়ে দিলাম।’
আমার কথা শেষ হতেই সে রাগে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে পরনের টি শার্টটি খুলে ফেলে সাদা শার্টটি গায়ে দিল।তারপর আমার হাত টানতে টানতে সিঁড়ি বেয়ে বাগানে নিয়ে দাঁড় করালো।আর একটা পানির পাইপ নিয়ে এসে আমার সামনের কিছু মাটি ভিজিয়ে কাঁদা বানিয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল।আমি তো শুধু হা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি এসব কি করছে।
কিছু মুহুর্ত পর সে ফিরে এলো বাইক চালিয়ে।আমার সামনে দিয়ে যেয়ে আমার গায়ে পুরো কাঁদা ছিটিয়ে দিল।তার অদ্ভুত কান্ডে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।তারপর বাইক থেকে নেমে কাছে এসে ফট করে আমাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।আমি তো একেবারে শকড হয়ে রইলাম।
আমাকে ছেড়ে গায়ের সাদা শার্টটিতে আবারো লেগে যাওয়া কাঁদার দাগ দেখে নিজে নিজে বলল,’এবার ঠিক আছে।’
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,’এই দাগ যেনো ভুলেও না উঠে।’
এই বলে সে চলে গেল।আর আমি আবারো গায়ে এক গাঁদা কাঁদা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম,এই ছেলে কি পাগল!
★
খুব ভোরেই আমার ঘুম ভেঙে গেল।গায়ে একটি সাদা চাদর জড়িয়ে বারান্দায় চলে এলাম।বাইরে ঢাকা কুয়াশার চাদর দেখে খুব হাঁটতে ইচ্ছে করলো।শিশির ভেজা ঘাসে খালি পায়ে হাঁটতে আমার খুব ভালো লাগে।কুয়াশা এতটাই প্রকট যে দু হাত সামনের বস্তুও দেখা যাচ্ছে না।।সকালের স্নিগ্ধ হাওয়ায় এক অদ্ভুত জাদু থাকে।মনের যাবতীয় জঞ্জাল দূর করে দেয়।
হঠাৎ কুয়াশার চাদর ভেদ করে নিদ্র এল।গায়ে একটি পাতলা সবুজ রঙের শার্ট আর কালো ট্রাউজার।এসেই দাঁড়িয়ে একটি মৃদু হাসি দিল।
বাহ্!প্রকৃতি যেন সঠিক সময়ে আরো একটি সঠিক সৌন্দর্য্যের প্রকাশ ঘটালো।
আরো কিছুক্ষণ দুজনে হাটাহাটি করে বারান্দায় ফিরে এলাম।আজকে মনটা কেমন যেন কাব্যিক হয়ে আছে।খেয়াল হল যে নিদ্র শুধু একটি পাতলা শার্ট পড়ে আছে।তার অবস্থা দেখে যেন আমার আরো শীত লেগে গেল।চাদরের নিচে হাত ঢুকিয়ে বললাম,’আপনার শীত করছে না।’
সে শুধু মৃদু হাসলো কিছু বললো না।আমি বললাম,একটি গান শুনান না।’
সে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বসে পাশে রাখা গিটারটা কোলে তুলে নিল।আর এলোমেলো টুন বাজাতে লাগল।
টবে ফুটন্ত একটি লাল গোলাপ আমার দৃষ্টি কেড়ে নিল।হাত বাড়িয়ে আমি গোলাপটিকে স্পর্শ করলাম।গোলাপের গায়ে বিন্দু বিন্দু জমে থাকা শিশিরকণা আমার আঙ্গুলে লেগে গেল।এই গাছের গোলাপগুলো যেন একটু বেশিই লাল।এর লাল রঙ খুব আকর্ষিত করে আমায়।হাতদুটো চাদরের নিচে গুটিয়ে নিয়ে একটু চোখ বন্ধ করে সবকিছু উপভোগ করলাম।আজকের সকালটা এত সুন্দর কেনো।নিদ্রর দিকে না তাকিয়েই বললাম
-‘এই গোলাপের রঙ কি সুন্দর তাই না!আমার খুব ভালো লাগে।আপনার কেমন লাগে?’
-‘জানি না।পৃথিবীর সেরা সৌন্দর্য্যে চোখ আটকে গেছে আমার,অন্য সৌন্দর্য্য এখন আর আমাকে আকর্ষণ করতে পারে না।’
আবারো তার কথার আগা মাথা কিছু বুঝতে না পেরে আমি চোখ গোল গোল করে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।সে মৃদু হেসে গিটারের তারে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠল,
তোমার অবাক দিক
দেখে মুগ্ধ চারিদিক,
দেখে মুগ্ধ ঐ আকাশ
মুগ্ধ ভোরের বাতাস।
করি সেখানে খোঁজ
যেথা স্বপ্ন মেশে রোজ,
যেথা তুমি আড়ালে
হেসে দাঁড়ালে।
আজকের দিনটা কি শুধুই সৌন্দর্য্য উপভোগের দিন।এক সাথে এত সৌন্দর্য্য সইবে তো!
★
চায়ের কাপের চুমুকে শুরু হল আমাদের বিকেলের আলাপচারণ।আমার শ্বাশুড়িমার সাথে আমি এখন পুরো বন্ধুর মতো মিশে গেছি।প্রতিদিনই বাগানে রাখা গোলাকার টেবিলে চলে আমাদের দুজনের বিকেলের এই চা ভোজন।মাঝে মাঝে যোগ দেয় স্নিগ্ধ।স্নিগ্ধর সাথে আমার এখন হয়ে গেছে বাজাবাজির সম্পর্ক।একদম ছোটো ভাই বোনদের মত।সারাদিন একজন আরেকজনের পেছনে লেগে থাকা আর ভেতরে ভেতরে কলিজা।
স্নিগ্ধকে পেয়ে আমার এতদিনে ছোটো ভাইয়ের অভাব ঘুচল।স্নিগ্ধ এখনো চায়ের টেবিলে বসে হাতের ঘড়ি খুলে নাড়িয়ে চারিয়ে দেখছে।এই ছেলে কি সোজাসোজি কিছু পড়তে পারে না।সবকিছু নিয়েই ইনভেনশন করতে চায়!
আজকে আমাদের চা পর্ব একটু শর্ট করতে হবে কারণ আমরা তিনজন আজ শপিংয়ে যাবো।আমার কিছু কেনার নেই,মা কিনবে,আমি যাচ্ছি পছন্দ করায় সাহায্য করতে।
আমার সামনে মুখোমুখি একটি চেয়ার টেনে নিদ্র হাত দিয়ে চোখ কঁচলে বসে পড়ল।দুপুরে ঘুমিয়ে ছিল,এখনো চোখে ঘুম ঘুম ভাব বিরাজমান।পরনে একটি হোয়াইট টি শার্ট আর ব্রাউন থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।
নাহ! বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না।অতি সুন্দর মানুষদের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে বুকের ভেতর চিন চিন ব্যাথা করে।
মা আর স্নিগ্ধর চা খাওয়া হয়ে গেছে।আমার এখনো অর্ধেকও হয়নি।মা বলল,’সুপ্তি,তোর দেখি এখনও শেষ হয়নি।আমরা গাড়িতে গিয়ে জিনিসপত্র উঠাচ্ছি।তুই চা খেয়ে আয়।’
আমি ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম।
মা আর স্নিগ্ধ চলে গেলে নিদ্র আমার চায়ের কাপ টেনে একটা চুমুক দিল।আমি সচকিত হয়ে বললাম,’আপনি আমার চা খাচ্ছেন কেনো?আপনি না চা খান না?’
সে হালকা ভ্রু কুঁচকে আমার কথার কোনো তোয়াক্কা না করে আরেক চুমুক দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে বলল,’কোথায় যাবে?’
-‘মার্কেটে।’
-‘যাওয়া লাগবে না।’
-‘যাবো না মানে!’
-‘যাবা না মানে যাবা না।আমি একা থাকবো নাকি!’
এর মাঝে স্নিগ্ধ আর মা আবার আমাকে ডাকতে আসে।আমি উঠতে যাবো ঠিক তখনই নিদ্র টেবিলের নিচ দিয়ে তার পা দুটো দিয়ে আমার পা আঁকড়ে ধরলো।আমি উঠতেও পারছি না আবার কিছু বলতেও পারছি না।মিনতি ভরা চাহনি নিয়ে নিদ্রর দিকে তাকিয়ে রইলাম।কিন্তু সে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে থেকে নির্বাক।
আর এদিকে মা বারবার তাড়া দিয়ে উঠতে বলছে।আমিও শুধু কাঁচুমাচু করে যাচ্ছি।সে কিছুতেই পা ছাড়ছে না।
হঠাৎ স্নিগ্ধর হাত থেকে ওর ঘড়ি পড়ে গেল।সেটা উঠাতে ও নিচে ঝুকলো।
মা আবার বলল,’কিরে উঠ।’
স্নিগ্ধ মাটিতে ঝুঁকে থেকেই বলে উঠল ,’মা ভাইয়া ভাবুর পা ধরে রেখেছে।ভাবু উঠবে কিভাবে।’
ওর কথায় নিদ্র ঝট করে আমার পা ছেড়ে দিল।আমরা দুজনেই লজ্জায় থতমত খেয়ে গেছি।
মা একটু মুচকি হেসে স্নিগ্ধর হাত ধরে বলল,
-‘চল।’
স্নিগ্ধ বলল,’ভাবু যাবে না?’
-‘না।’
মা আর স্নিগ্ধ চলে যাচ্ছে আর আমি লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছি।এই দুই ভাই আমাকে পাগল করে দিল!