জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো বসে আছি ফুলে ফুলে সাজানো বাসর ঘরে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দ্বিতীয় কেউ স্পর্শ করবে তার এই দেহে। ফোনটা বারবার রিং হচ্ছে! বারকয়েক বার রিং হতেই ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মা বললো’ কথা তোর মেয়েটা অনেক কান্না করছে। কোন ভাবেই থামাতে পারছি না। তুই একটু কথা বল। যদি কান্না থামা।
– আচ্ছা মা রাইসাকে দাও।
– রাইসা ফোনটা হাতে নিয়েই বলতে লাগল ‘ মম তুমি কোথায়? সারাবাড়ি খুঁজেছি কোথাও তোমাকে পেলাম না। ‘ মম তুমি জানো না তুমি বুকে না নিলে আমার ঘুম হয় না। মা তুমি আমার সাথে লুকোচুরি করছো তাই না? আমি যে দুষ্টমি করি। মম আমি আর তোমার সাথে দুষ্টমি করবো না। আর বলবো না মম আইসক্রিম কিনে দাও। বলো মম তুমি কোথায় আছো?
– রাইসার কথা শুনে কথা কি বলবে বুঝতে পারছে না । দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে।
– কি হলো মম তুমি এখনো রাগ করে থাকবে কথা বলবে না আমার সাথে?
– কথা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, আমার লক্ষী মা মন খারাপ করে না। আমি আসব। তোকে বুকে নিয়ে ঘুমাবো। হঠাৎ দরজায় আওয়াজ হলো। কথা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে তার বর ঘরে ঢুকছে।
– কথা আনোয়ারকে দেখে কিছু না বলেই ফোনটা রেখে দিল। চোখের পানি শাড়ির আচল দিয়ে মুছবে এমন সময় আনোয়ার কথার পাশে বসে বলল’ মেয়ের জন্য মন খারাপ? মন খারাপ করো না। কাল তো তোমাদের বাসায় যাচ্ছি।
-কথা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল।
– কথা আজ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। মনেই হচ্ছে না এর আগেও তোমার বিয়ে হয়েছিল।
– কথা কিছু না বলে দু’চোখ বন্ধ করে আছে। আনোয়ার কথার ঘোমটা টা খুলে কপালে চুমু একে দিল। কথাকে শুইয়ে দিয়ে বুকের ওপর থেকে যখনি কাপড় টান দিয়েছে তখন কেমন যেন কলিজাটা কেঁপে ওঠল কথার। নিজের ওপর নিজেরই ঘৃণা হচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আনোয়ারকে সরানোর ক্ষমতা তার নেই। বারবার রাজের কথা মনে পড়ছে। সত্যিই জীবনে প্রথম বাসর রাতটি স্বপ্নের মতো ছিল। দু’জনে নামায শেষ করে সারারাত গল্প করা। সেদিন রাজকে দেওয়া শপথ বার বার কানে ভারি খাচ্ছে। সেদিন দুজন দুজনকে ছুঁয়ে শপথ করেছিল নিজেদের ভালোবাসার ভাগ কাউকে দিবে না। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। আজ অন্যজনের কাছে নিজের সবটা সপে দিতে হচ্ছে।
– কথার অর্ধ -বিবস্ত্র! আনোয়ার কথার আস্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে আছে এমন সময় ফোনটা আবারো বেজে উঠল। কথা ফোন ধরতে গেলে আনোয়ার বলল’ থাক এখন ধরতে হবে না।’
– কিন্তু বারকয়েকবার ফোন রিং হতেই ফোনটা ধরল কথা ‘
– ফোনের ওপাশ থেকে রাইসার কান্না শুনা যাচ্ছে। কথা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আনোয়রকে বলল’ আমাকে একটু সময় দিবেন? জাস্ট একটু।
– আচ্ছা!
– কথা ফোনটা নিয়ে শরীরে কাপড় টেনে দিয়ে জানালার পাশে চলে গেল।
– হ্যালো কথা শুনতে পারছিস? রাইসা তোর সাথে কথা বলতে বলতে তখন সেন্সলেন্স হয়ে গিয়েছিল! এখন জ্ঞান ফিরে আবার তোকে না পেয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে মা মা বলে কাঁদছে। কারো কথায় শুনছে না। তুই একটু ভালো করে বুঝা তো মেয়েটাকে। এমনেই অসুস্থ আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যাবে।
– মা রাইসাকে ফোনটা দিয়ে বলো তো, তার মা কথা বলবে।
– আচ্ছা আমি রাইসাকে দিচ্ছি কথা বল।
– রাইসা ফোন হাতে নিতেই কথা বললো’ মামনি তুমি কান্না করছো কেন?
– কি করবো বলো? তুমি আমাকে রেখে কোথায় চলে গেছো? ‘ মম তুমি কোথায়? এখনো আসছো না কেন?
– মা আমি কাল সকালেই আসবো। তুমি ঘুমিয়ে যাও।
– আমি কিছু জানি না। তুমি এখন আসবা।
– রাইসা মা আমার আমি তোমার জন্য চকলেট আর আইসক্রিম নিতে এসেছি। কাল সকালে নিয়ে যাবো।
– আমার কিছু লাঘবে না। আমি তোমার কাছে যাবো। নিয়ে যাও। নয়তো আমিও বাবার কাছে চলে যাবো।
– কথা কিছু বলতে পারছে না। চোখ দিয়ে আষারো ঝরনা ধারা নেমে আসছে। ফোনটা রেখে খাটে গিয়ে বসল। আনোয়ার ধাক্কা দিয়ে কথাকে শুইয়ে দিলো। কথার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। এসবে কথার বরের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত।
– কথা চোখ বন্ধ করে আছে। বুকের ভেতরটা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। তার জীবনটা এমন ছিল না। দেখতে দেখতে কথার জীবনে অভিশপ্ত একটি রাত কেটে নতুন সূর্য উঠে। সকাল হতেই গোসল করে চলে যায় শাশুড়িকে সাহায্য করতে।
– যখন রান্না ঘরে প্রবেশ করবে তখন, তার বড় ভাবি কাকে যেন বলছে’ আনোয়ার এটা একটা কাজ করলো? মেয়ে সহ বিয়ে করা মেয়েকে বিয়ে করলো।
– কথাকে রুমে ডুকতে দেখে চুপচাপ হয়ে গেল।
– পরের দিন কথা তাদের বাসায় যেতেই ‘ রাইসা দৌড়ে এসে কথাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল ‘ মম তুমি কোথায় ছিলে? আর আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?
তিল কথা শেষ করতেই রিদ ঠাস করে থাপ্পড় মেরে বসলো ওর গালে। তিলের মাথার চুল টেনে ধরে বললো,
“” এই মুখ দিয়ে আর একটা শব্দ বের হলে তোর মুখ আমি টেনে ছিড়ে ফেলবো।””
“” ছিলে ফেলুন! আমি তো চাই আপনাল হাতে মলতে। আল এখন তো আপনি আমাল স্বামী,আপনাল হাতে মলা মানে বেহেস্তে যাওয়া!””
রিদ তিলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ মনে হচ্ছে বাংলাদেশে সে যে তিলকে রেখে এসেছিলো তার সাথে এর কোনো মিল নেই। চেহারায় বাচ্চামীর কোনো ছোয়া নেই আর কথাই তো নাই ই। এক বছরে তিল এতো বেশি পাল্টে গেলো কি করে? এতো বেশি মেচিউরড লাগছে ওকে। হঠাৎ করে বড়দের মতো এতো গুছিয়ে কথা বলতে শিখলো কিভাবে? আমি তো এমন তিলকেই বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। যে আমাকে নয় আমি তাকে ভয় পাবো! যে আমার কথায় মাথা নিচু করে না থেকে আমার চোখে চোখ রেখে বলবে,আরেকটু বেশি ভালোবাসতে পারোনা? আমি তো তোমার ভালোবাসায় খুন হতে চাই।
“” কি হলো থেমে গেলেন কেন? ছিলবেননা? আমি হেল্প কলবো?””
রিদের ভাবনার সাথে সাথে তিলের চুলে আটকে থাকা হাতটাও ঢিলে হয়ে এসেছিলো। তিল হাতটা সরিয়ে নিজের ঠোটের উপর ছুয়িয়ে বললো,,
“” নিন,ছিলুন। আমিও দেখতে চাই আপনাল ঠোটছিলা বউ কেমন দেখতে হয়।””
তিলের ঠোটদুটো রিদ নিজের হাত দিয়ে ছুয়ে ছুয়ে দেখছে। এই ঠোট সে কিভাবে ছিড়বে? যেখানে সে ভালোবাসার স্বপ্ন একে এসেছে এতো বছর।
“” নিন না আমাকে আপন কলে। আমাল তো কোনো অসুবিধে নেই তাহলে আপনাল কেন হচ্ছে??””
“” খুব তো বড়দের মতো কথা বলে যাচ্ছিস তাহলে বুঝতে পারছিস না,তোকে আপন করে নেওয়া মানে আমার অসুখ তোর মধ্যে প্রবেশ করানো?? ভালোবাসি তোকে আমি,আর নিজের ভালোবাসার মানুষকে মৃত্যুর দিকে ফেলতে পারিনা। এতোটাও স্বার্থপর না আমি যে নিজের চাহিদা পুরন করতে গিয়ে তোকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিবো।””
“” কিন্তু আমি তো চাই আপনাল সাথে মলতে। আপনাল মতো আমাল শলীলেও ভাইলাস প্রবেশ কলুক তবে সেটা HIV নয় আমাল লিদ ভাইয়াল ভাইয়াল ভাইলাস।””
“” তুই কি বলতে চাচ্ছিস?””
“” I need a baby.””
রিদের শান্ত হয়ে আসা চোখদুটো আবার অশান্তের রুপ ধারন করলো।
রিদ মাথার চুল হাতড়াতে হাতড়াতে বিছানায় বসে পড়লো। এমন একটা ভাব যেন দিশাহারা হয়ে পড়েছে, খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছে।
তিল রিদের দিকে তাকিয়ে মিস্টি করে হাসি দিয়ে রিদের পাশে বসে বললো,
“” আমাল আপনাল মতো একটা ছোট্ট লিদ চাই। যাকে নিয়ে আমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পালবো।””
রিদ রেগে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে তিলের হাত চেপে ধরে আকুতি গলায় বললো,
“” তুই কি চাচ্ছিস, যে এখনো পৃথিবীর মুখ দেখেইনি সে এমন একটা কঠিন রোগ নিয়ে জন্ম নিক? আমার আর তোর মতো সেও কষ্ট পাক?””
“” ব্যতিক্রমও হতে পারে!””
“” মানে?””
“” আপনার সন্তান বলে যে তাকেও এই রোগে ভুগতে হবে এমন তো কোনো কথা নাই। হতেও তো পারে আল্লাহ কোনো মিরাক্কেল কলে দিলো। আপনাকে আমাল কাছ থেকে কেলে নিয়ে তাকে দিয়ে দিলো। আল আমিতো শুনেছি এখন উন্নত টেকনোলজীল সাহায্যে অনেক কিছুই কলা যায়। আমিও চেষ্টা কলবো। আমাল বিশ্বাস আল্লাহ আমাল থেকে মুখ ফিলিয়ে নিবেননা।””
“” তুই বললেই তো আমি বিশ্বাস করে নিবোনা। আমি এসব হতে পারের মধ্যে নেই। অনেক রাত হয়েছে,এখন ঘুমা। কাল সকালে তোর ফেরত যাওয়া নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।””
তিলকে বিছানায় রেখেই রিদ নিচে শুয়ে পড়লো। তিলের ফুপানির শব্দ পাচ্ছে সে। তার ফুপানির শব্দে রিদের ভেতরটা চুরমার করে দিচ্ছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে,চোখের পাপড়ি ফেলতে ইচ্ছে করছেনা। পাপড়ি ফেলা মানেই চোখ বেয়ে পানি পড়া। কিন্তু তাকে যে এতো দুর্বল হলে চলবেনা। যে রাতের জন্য রিদ এতোটা বছর অপেক্ষা করেছিলো সে রাতটা আজ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে,তবুও সে ডাকের সাড়া দিতে পারছেনা সে। এর থেকেকষ্ট আর কি হতে পারে? যাকে কাছে পাওয়ার লোভে অন্য কোনো মেয়ের দিকে সেভাবে তাকানোই হয়নি অথচ আজ তার চাওয়াকেও দুরে ঠেলে দিতে হচ্ছে। এ কেমন পরীক্ষায় ফেলেছে তাকে সৃষ্টিকর্তা?? কি দরকার ছিলো তিলকে এভাবে সামনে আনার? ভাগ্যের বিধান মেনে নিয়ে তো আমি দুরেই চলে এসেছিলাম তাহলে কেন এতো বেশি কষ্ট দিয়ে আমাকে পৃথিবী থেকে নিয়ে যাবে?? আমি কি অজান্তে খুব বেশি পাপ করেছিলাম? আর সেই পাপের শাস্তিই কি এখন পাচ্ছি???
রিদ না চাইতেও চোখের পানি অঝোরে ঝরে যাচ্ছে। রিদ হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে তিলের দিকে তাকালো। পাগলিটা এখনো কাঁদছে! তিলের কান্নার সাথে সাথে হালকা করে কেঁপেও উঠছে। রিদের ইচ্ছে হলো এখনি ওকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে নিতে। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলতে,ভালোবাসি বউ,খুব ভালোবাসি তোমাকে!
রিদ তিলের দিক থেকে মুখ সরিয়ে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়তেই তিলের আগমন ঘটলো। পেছন থেকে জড়িয়ে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“” একটু ভালোবেসে দিননা প্লিজ! আমি আপনার সন্তানের মা হতে চাই। আপনার স্মৃতি আকড়ে ধরে বাঁচতে চাই।””
রিদ তিলের দিকে ঘুরতেই তিল চোখ বন্ধ করে বললো,
“” আমার একটা ছোট্ট রিদ লাগবে। দিবেনা রিদ????””
এই একটা দিনে তুই আমার সব ইচ্ছে পুরন করে দিলি তিল?? আজ নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। রিদের ইচ্ছে হলো চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে শুনিয়ে বলতে,আমার তিল আমাকে রিদ বলে ডেকেছে,তুমি করে বলেছে,বউ সেজে দেখিয়েছে তার তো আর কোনো ইচ্ছে অপুর্ন নেই তাহলে এবার সে হাসি মুখে মরতে পারবে। শুধু আরেকটা ইচ্ছে জাগছে, তিলের ঠোটে হাসি ফুটানোর। রিদ উপরের দিকে মুখ করে মনে মনে বললো,তোমার উপর সব ছেড়ে দিলাম,আমার বিশ্বাস তুমি আমার তিলকে কোনো কষ্টের মুখে ফেলবেনা!
রিদ তিলের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তখনো তিল কেঁদেই যাচ্ছে। রিদ ঠোটে হাসি ফুটিয়ে তিলের ঠোটে নিজের ঠোট ডুবিয়ে দিলো। আজ তার সতেরো বছরের অপেক্ষার অবশান ঘটানোর রাত। তার ভালোবাসার রাত। তিলের পুরো শরীরে রিদ তার ভালোবাসার ছোয়া একে দিচ্ছে।
রিদ তিলের পেটে আলতো করে চুমু একে দিতেই তিল খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বললো,
“” লিদ ভাইয়া,সুলসুলি লাগছে তো!””
রিদ কাথার নিচ থেকে মাথা বের করে বললো,
“”তোর এমন কঠিন সময়েও সুড়সুড়ি পায়?””
তিলের সাথে রিদও অট্টস্বরে হেসে উঠে।
#সাত বছর পর,
আয়নার সামনে দাড়িয়ে তিল মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে। তার কানে এখনো রিদের সেই কথাটাই ভাসছে,,
“” এমন কঠিন সময়েও তোর সুড়সুড়ি পায়?””
লজ্জায় চোখমুখ লাল হয়ে আসলো। আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পারছে তার ঠোট লাল হয়ে আসছে। সে রাতে তার রিদ ভাইয়া প্রমান করে দিয়েছিলো উনিও ঠোট লাল হওয়া চুমু খেতে পারেন।
“” তুমি এমন একা একা হাসছো কেন মামনি? আর রুম এমন অন্ধকার করে রাখছো কেন? ঔষুধ খেয়েছো?””
তিল আয়না থেকে চোখ সরিয়ে ঘুরে দাড়ালো। রিদ ভাইয়া তার চাওয়া পুরন করেছে তার কোলে ঠিকই একটা ছোট্ট রিদ এসেছে।
“” খাওনি তো? আমি জানতাম তুমি ঔষধ খাওনি। এতো বড় হয়েছো অথচ ডিসিপলিন শিখলেনা। তোমাকে যে কে বড় করলো!””
তিল মুচকি হেঁসে তার ছেলে রাতের কাছে এসে নাক টিপে বললো,
“” তোমাল আব্বু,সোনা।””
রাত তিল কে বিছানায় বসিয়ে পানির গ্লাস আর ওষুধ এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
তুমি আমাকে তোমার কষ্টের মুহুর্তগুলো থেকে আমাকে বঞ্চিত করলেও আমি আমার সুখের মুহুর্ত থেকে তোমাকে বঞ্চিত করবোনা রিদ। আমি জানি আমার চিঠির প্রতিটা অক্ষরের মধ্যে তুমি আনন্দ পাও,ভালোবাসার ছোয়া পাও,তোমার কষ্টগুলোকে কিছুক্ষনের জন্য হলেও ভুলে থাকতে পারো। আর আমিতো তোমার সেই হাসি আমার কল্পনায় দেখতে পাই। তুমি নাই বা আমার চিঠির জবাব দিলে তাতে কি আমি আমার সুখের দিনগুলোর প্রত্যেকটা সেকেন্ডের কথা তোমাকে লিখে যাবো যতদিন আমি বেঁচে আছি আর আমার হাত লিখতে পারবে ততদিন তোমার তিল তোমাকে লিখবে। আমার এই চিঠির মধ্যে তুমি বেঁচে থাকবে। হয়তো তুমি আমার থেকে দুরে আছো তাতে কি? তোমার দেওয়া সেই রাতের ভালোবাসার পুর্নতা হিসেবে আমাদের সন্তানকে এনেছি আমি। আর পুর্নতাকে বাস্তবে রুপ হিসেবে ওর নামও রেখেছি রাত। তোমার আমার ভালোবাসার রাত!
জানো,রাত দেখতে যেমন তোমার মতো হয়েছে রাগও তোমার মতোই পেয়েছে। উঠতে বসতে আমাকে ধমকাবে। মাঝে মাঝে তো মনে হয় আমি ওর মা না ওই আমার বাবা। তবে তোমার মতো ওর সামনেও আমি র বলতে পারিনা। সত্যিই কি পারিনা নাকি ইচ্ছে করে বলিনা। বড্ড ভয় হয় ওকে রাত বলে ডাকতে যদি তোমার মতো ওকেও হারিয়ে ফেলি? সেদিনের সেই ভয়ংকর স্বপ্নের ব্যখ্যা আমি পেয়েছি। মনে আছে,ছোটবেলা একবার তুমি রেগে বলেছিলে,যেদিন তুই ‘র’ বলতে শিখে যাবি সেদিন তুই আমাকে হারিয়ে ফেলবি? আমার কেন জানি মনে হয় হসপিটালে প্রথম তোমার সামনে ‘র’ বলাতেই আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। আর এই জন্যই হয় তো তুমি আমাকে স্বপ্নে এসে বলেছিলে আমি তোমাকে মেরে ফেলেছি। ব্যখ্যা কতটা সত্যতা আছে আমি জানিনা কিন্তু আমার দিক থেকে ১০০% সত্যি মনে হচ্ছে। তাই রাতের সামনেও ‘র’ বলতে সাহস পায়না। এখন তো ওই আমার বেঁচে থাকার সম্বল। ওর মধ্যেই আমি তোমাকে খুজে পাই। ৬ বছরের বাচ্চাও যে এতো ভালোবাসতে পারে আমি জানতামনা। হয়তো তোমার অপুর্নতাকে পুর্নতা করতেই ওর মধ্যে আল্লাহ একটু বেশি ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছে।
“” তুমি রাত জেগে আবার লিখালিখা করছো? তুমি এতো দুষ্টু কেন,আম্মু? আমার কথা একটুও শুনোনা। আড়ি!””
তিল পাশ থেকে নিজের ফোনটা নিয়ে তাৎক্ষনিক রাতের একটা ছবি তুলে নিলো নিজের ফোনে। রিদকে তো দেখাতে হবে তার ছেলে কেমন অভিমান করতে পারে। চিঠির সাথে এই ছবিটা পাঠাতে হবে। সেও দেখুক তার অভিমানি ছেলের অভিমান।
“” তুমি আমার রাগ না ভাংগিয়ে ছবি তুলছো? যাও তোমার সাথে কথা নাই।””
রাত চলে যেতে নিলেই তিল উঠে এসে ওকে কোলে তুলে নিলো।
“” এইটুকুন বাবুল এতো লাগ?””
“” এইটুকুন বলছো কেন? তুমি জানো আমার বয়স কত?””
“” কত?””
“” ৬ বছর,৩ মাস,৪ দিন,১৮ ঘন্টা।””
“” বাহ! তাহলে তো তুমি অনেক বল হয়ে গেছো সোনা। তা এতো লাতে আমাল লুমে আসাল কালন কি জানতে পালি?””
“” তোমাল সাথে ঘুমুতে ইচ্ছে করছে।””
তিল ছেলেকে নিজের বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে নিজের শরীরে কম্বল টেনে দিয়ে রাতের দিকে তাকালো।
তোমার ছেলের কিছু হতে দেইনি আমি। ডক্টর বলেছে তেমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নাই তবুও আমি রেগুলার চেকআপ করাচ্ছি। তবে আমার এখন তোমার মতো কম্বল ছাড়া ঘুম আসেনা। রাতে খুব শীত লাগে। তোমার ছেলে তো মাঝে মাঝেই বলে, রাত হলেই তোমার শরীর এতো গরম হয়ে যায় কেন,আম্মু? আমি তখন মুচকি হেঁসে বলি,তোমার আব্বুকে মিস করি যে তাই।
আল্লাহ হয়তো আমাকে আর বেশিদিন তোমার থেকে দুরে রাখতে চাননা। তুমি কেমন আছো আমি জানিনা শুধু এটাই জানি খুব শীঘ্রই তোমার সাথে আমার দেখা হচ্ছে।
তিল আবেশে চোখটা বুঝে নিলো। তার এখন ঘুম পাচ্ছে। শান্তির ঘুম যে ঘুমে সে তার রিদ ভাইয়াকে নিয়ে হারিয়ে যায় আরেকটা ভালোবাসার রাতের আশায়।
~~
“” আম্মু,উঠো,ও আম্মু উঠোনা।””
তিল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হঠাৎ রাতের ডাকে ধরফরিয়ে উঠে বললো,
“”কি হয়েছে,লাত। কোনো খালাপ স্বপ্ন দেখেছিস?””
“” নাতো,ভালো স্বপ্ন। তোমার ছেলের বউ আসছে। আমাদের এখনি যেতে হবে।””
“” ছেলের বউ?””
“” হুম। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। এখনি বের হতে হবে নাহলে সন্ধ্যা আমার উপর খুব রাগ করবে।””
“” সন্ধ্যাটা আবাল কে?””
রাত বিছানা ছেড়ে নিজের জামাটা পাল্টাতে পাল্টাতে বিরক্ত নিয়ে বললো,
“” উফ! তুমি দেখি কিছু জানোনা,মামনি! সন্ধ্যা হলো আমার বউয়ের নাম।””
“” তোর বউ? কই পেলি?””
“” স্বপ্নে। মাত্রই তো স্বপ্নে এসে বললো,আমি যদি এখন না যায় তাহলে নাকি ও ওর তিলে আমাকে চুমু খেতে দিবেনা।””
তিল অবাক হয়ে বললো,
“” তিল?””
“” হুম,তোমার মতো ওর ঠোটের কোনেও তো তিল আছে,কিন্তু তোমারটা ডানপাশে আর ওর টা বা পাশে।””
রাত নতুন জামা পড়ে তিলকে বিছানা থেকে নামাতে নামাতে বললো,
“” তাড়াতাড়ি করো। ও তো রেগে যাবে।””
“” কিন্তু আমরা যাবোটা কোথায়?””
“” রিমা ফুপির বাসায়।””
তিল কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে রিমার নাম্বার ভেসে উঠেছে। তিল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সিকান্দার সাহেব হাসিহাসি মুখে বললো,
“” তিল আপামনি,আমাদের ঘরে রাজকন্যা চলে এসেছে। রিমা আর বাবু দুজনেই সুস্থ। আপনারা সকালেই চলে…..””
সিকান্দারের বাকি কথা তিলের কানে ঢুকছেনা। নিজের ছেলে রাতের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো!
#সমাপ্তি
বিঃদ্রঃ [ আমি হয়তো চাইলে আপনাদের ইচ্ছেতে রিদকে সুস্থ করে দিতে পারতাম কিন্তু এতে আপনারা ক্ষনিকের জন্য খুশি হলেও পরে এটা নিয়েই মজা করতেন। তবে আপনাদের ইচ্ছের অক্ষুন্নও করিনি কিন্তু,রিদকে মারিওনি আবার বাচিয়েও রাখিনি?? সে আছে তার মতো করে ইউকে তে চিকিৎসাধীন☺☺ হয়তো তিলের পাঠানো চিঠি পরছে। বাকিটা আপনারা আপনাদের কল্পনা দিয়ে সাজিয়ে নিন❤❤ আর হ্যা,রিদ পাগলীদের বলছি,রিদের মতো তোমাদের আপনজনদের যাতে না হারাও সেজন্য ব্লাড দেওয়া এবং নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন। গল্পের ভুল ত্রুটি ক্ষার চোখে দেখবেন। এন্ডিংটা কেমন ছিলো জানাবেন প্লিজ। আপনাদের ভালোবাসা মাখানো কমেন্ট পড়ার অপেক্ষায় রইলাম,খারাপ ভালো দুটোই বলবেন। যাতে আমার নেক্সট গল্পে কাজে লাগাতে পারি। এতো ধৈর্য্য নিয়ে পড়ার জন্যা তোমাদের সবাইকে এতোগুলো ❤❤❤❤]
ইচ্ছে হলো দৌড়ে গিয়ে রিদকে জড়িয়ে ধরে তার শুকনো আত্মাকে ভিজিয়ে নিতে। তিল বিছানা ছেড়ে এসে রিদের সামনে দাড়ালো। কিন্তু রিদকে জড়িয়ে ধরার বদলে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো,রিদের ডানগালে। বা গালেও বসালো। তাতেও যেন তিলের মন ভরলোনা। নিজের হাত দুটো মুঠো করে রিদের বুকে মারতে মারতে বললো,
“” বলেন আপনি কাল সাথে এমন পঁচা কাজ কলছেন? কাল সাথে পঁচা কাজ কলে অসুখ বাধালেন? কাল জন্য আমাকে ছেলে এলেন…””
তিলের হাতদুটো চেপে ধরে রিদ ,
“” পঁচা কাজ মানে?””
“” এখন আপনাকে পঁচা কাজেল মানেও বুঝাতে হবে?? যখন কললেন তখন আপনাল মানেল প্লয়োজন ছিলোনা আল এখন লাগছে না? তাও আমাল কাছ থেকে মানে লাগবে? আপনি এতো পচা?””
রিদ তিলের দিকে হা করে তাকিয়ে রয়েছে। কি বলছে কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। কোন পঁচার কথা বলছে তিল?? বেশ চিন্তিত হয়েই রিদ তিলের দিকে তাকিয়ে রইলো। তিলের চোখ দিয়ে পানি টপটপ করে পড়ছে। তিলকে কাঁদতে দেখেছে অসংখ্যবার। সবগুলোর কারনও ছিলো ও নিজেই। আজকের কাঁদার কারনটাও ও কিন্তু এই প্রথম তিলের কান্নাজড়িত চোখগুলো খুব মায়াবী লাগছে। মনে হচ্ছে তিলের প্রত্যেকটা চোখের পানির ফোটার সাথে মিশে আছে রিদের জন্য অসংখ্য ভালোবাসা। তিল আমাকে এতো কেন ভালোবাসে? আমি তো ওর ভালোবাসা পাওয়ার মতো তেমন কিছু করিনি,ওকে খুশি করার জন্য,মুখে হাসি ফুটানোর জন্য কিছু করিনি। যা করেছি সব নিজের স্বার্থে। যার বিনিময়ে তিল তো শুধু কষ্টই পেয়েছে তবুও কেন ও আমাকে এতো ভালোবাসে??
তিল রিদের কলারটা চেপে ধরে বললো,
“” বলছেননা কেন? কোন বিদেশিনীকে ফাসিয়েছেন? ফাসিয়েছেন ভালো কথা তাই বলে পঁচা কাজও কলতে হবে? আল কললেন তো ভালো কথা তাই বলে এইডসে আক্লান্ত লোগিল সাথেই কলতে হলো??””
“” এইডস!””
তিলের মুখে এইডস নাম শুনে রিদ হকচকিয়ে গেলো। তারমানে তিল সব জেনে গেছে? কিন্তু কিভাবে জানতে পারলো? আমি তো ওকে কিছু বলেনি শুধু ওকে কেন কাউকেই বলিনি তবুও কিভাবে জানতে পারলো ও তাহলে কি সিজাত বলে দিয়েছে? কিন্তু ও তো আমাকে প্রমিস করেছিলো!
“” কিছু বলছেননা কেন? পঁচা কাজ না কললে কি হতো?””
তিল নিজের ভাবনা থেকে বেড়িয়ে তিলের দিকে তাকালো। তিল কোন পঁচা কাজের কথা বলছে এবার বুঝতে পেরেছে। শুকনো ঠোঁটটায় হালকা হাসি ফুটে উঠেছে। তিলকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে বললো,
“” শুধু পঁচা কাজ করলেই বুঝি এইডস হয়ে যায়?””
“” হুম!””
“” থাপ্পড় খাবি একটা। গাধী কোথাকার,তোদের বইতে তো তিনটা কারন আছে তার মধ্যে তোর পঁচাটাই মনে রইলো আর সবগুলোকি গিলে খেয়ে ফেলেছিস??””
“” আপনি যেমন আপনাল সাথে তো পঁচাটাই যায়। আমি সিউল আপনি কালো সাথে পঁচা কাজ কলেছেন তাই আপনাল…””
রিদ ভ্র কুচকে বললো,
“” আমি যেমন মানে? আমি কেমন?””
তিল খানিকটা লজ্জা নিয়ে বললো,
“” ঐ যে সেদিন আমাকে চুমু….””
তিল কথা শেষ করার আগেই রিদ তিলের পাশ থেকে সরে এলো। যা থেকে সে পালিয়ে এসেছে তা আবার মনে করতে চায়না। তিলকে কথা শেষ করতে না দিয়েই নিজে বলে উঠলো,
“” ছোটবেলা আমি একবার গুরুতর রোগে ভুগছিলাম,শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছিলো। ডক্টরের কথা অনুযায়ী আব্বু একজন ব্লাড ডোনার খুজে এনেছিলো। উনারা কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা না করেই আমার শরীরে রক্তের প্রবেশ ঘটিয়েছিলো। তাদের ঐ হেলার কারণেই আজ আমি ভুগছি। তারা যদি সেদিন ব্লাড টেস্ট করে নিতো তাহলে হয় তো আজ অন্যকিছু হতো।””
“” আপনি সিউল হলেন কি কলে যে ঐটার জন্যই হয়েছে?””
“” আমি খোজ নিয়েছিলাম। যিনি আমাকে ব্লাড দিয়েছিলো উনি মারা গিয়েছে ২ বছর হলো। এইডস আক্রান্ত হয়েই মারা গিয়েছেন।””
রিদ কথা শেষ করতেই তিল দৌড়ে এসে রিদকে জড়িয়ে ধরে। খুব শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
“” আমি আপনাল কিছু হতে দিবোনা,লিদ ভাইয়া!””
আজ একটা বছর পর তিলকে এভাবে দেখতে পাবে তা ভাবতেও পারেনি রিদ আর এভাবে ওর ছোয়া পাওয়াতো দুরে থাক। রিদের চোখটাও ভিজে আছে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার কিন্তু নিজের জন্য না তিলের জন্য! সবসময় কোনো না কোনো কারন দেখিয়ে অনেক কষ্ট দিয়েছে তিলকে তাতে তো রিদের এতো খারাপ লাগেনি কিন্তু আজ যখন চাইছেনা ও কষ্ট পাক তবুও কেন এতো কষ্ট পাচ্ছে তিল? তিলের কষ্ট দেখে যে রিদের বুকটা জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। তিল কেন আবার ওর সামনে এসেছে? এই একটা বছরে তো নিজের সাথে লড়েছি এই লড়ার মাঝখানে তিল কেন এলো? সবকিছু গোলমেল করার জন্য?? আমি তো মনের ভুলেও একবার ও ভাবিনি যে তিল আবার সামনে আসুক তবুও কেন সামনে এলো? কেন???
“” তুই এখানে কেন এসেছিস? কে নিয়ে এসেছে?””
“” বিয়ে কলাল জন্য এসেছি।””
তিলের ছোয়াকে অগ্রাহ্য করার সাহস পাচ্ছিলোনা, ইচ্ছেও করছিলোনা রিদের। কখনো কখনো ভালোবাসার মানুষের ছোয়াও অমূল্য হয়ে উঠে আর কেই বা চাইবে সে অমূল্য জিনিস হাত ছাড়া করতে?? ছাড়াতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলো কিন্তু ওর মুখে বিয়ের কথা শুনে রিদ চমকে যায়। তিলকে পেছন থেকে টেনে নিয়ে সামনে এসে দাড় করালো।
“” বিয়ে করতে?””
“” হুম।””
“” তুই বিয়ে করতে ইউকে চলে এসেছিস? কেন রে বাংলাদেশে কি ছেলের অভাব পড়েছে?””
“” হুম। যে দেশে আমাল লিদ ভাইয়া নাই সে দেশে শুধু ছেলে কেন সবকিছুল অভাব পলেছে। তাই তো এখানে চলে এসেছি।””
তিল কথা বলতে বলতে নিজের লাগেজটা খুলে একটা পান্জাবী বের করে রিদের সামনে ধরলো,
“” নিন এটা ঝটপট পড়ে ফেলুনতো।””
তিলের হাতে সাদা পান্জাবী দেখে রিদ আরো চমকে যায়।
“” আমি পান্জাবী পড়বো কেন?””
“” ওমা,এভাবে শার্ট পলে বিয়ে কলবেন নাকি? মানলাম কোনো আমেজ ছালা বিয়ে কলছি তাই বলে পান্জাবীও পলবেননা? আচ্ছা আপনাদেল এখানে বিয়ে কিভাবে হয়? কাজীলা কি ইংলিশে কবুল বলতে বলে? আমি তো ইংলিশে কবুল বলতে পালিনা। ইংলিশে কবুল কে কি বলে?””
রিদ তিলের হাত থেকে পান্জাবীটা নিয়ে ছুড়ে মাটিতে ফেলে দিলো। তিলের হাত চেপে ধরে দরজার দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
“” সিজাত এনেছে তোকে তাইনা? আজকে ওকে খুন করে তারপর আমি জেলে যাবো। এতোবড় সাহস আমার কথার খেলাফ করে? আর তোরই বা এতো সাহস হলো কি করে আমি যা ফেলে এসেছি তা নিয়ে আমার সামনে দাড়াস?””
রিদের রক্তবর্ন চোখ দেখে তিলের একটুও ভয় হলোনা। রিদের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“” আপনাকে ছালা আমি মলে যাবো লিদ ভাইয়া!””
তিলের এমন কথায় রিদ থমকে যায়। তিলের দিকে তাকাতেই রিদের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে,এতো অসহায় কেন লাগছে তার তিলকে???
“” বিয়ে কলে নিননা প্লিজ! আমাল আপনাল বউ হওয়াল খুব শখ! শুধু বউ হতেই তো চাইছি আল কোনোদিন কিছু চাইবোনা। আপনাল বউ হিসেবে নিজেল পলিচয় বানাতে চাই!
রিদের সব রাগকে পানি করে দেওয়ার জন্য যেন তিলের এই অসহায়ত্ব কথাই যথেষ্ট। তিলের হাতটা ছেড়ে দিলো রিদ। দরজার সাথে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। চোখ বন্ধ করেই রিদ বললো,
“” তুই কেন এমন অন্যায় আবদার করছিস?? যা আমি তোকে দিতে পারবোনা তা চেয়ে আমার কষ্টটাকে কেন দ্বিগুন করে দিচ্ছিস,তিল?””
তিল এবার প্রচন্ড রেগে যায়। চিৎকার করে বলে উঠলো,
“” কেন পালবেননা? যদি নাই পালবেন তাহলে আমাকে নিয়ে ভালোবাসাল খেলায় মেতে উঠেছিলেন কেন? আল এই যে আপনাল পুলো লুমে আমাল ছবি লাগিয়ে লেখেছেন কেন? ছবি লাগাতে পালেন আল আমাকে লাখতে পালবেননা? তাহলে এই ছবিও থাকবেনা।””
রিদের ছোট রুমটার আনাচে কানাচে সব জায়গায় তিলের ছবি দিয়ে সাজানো। তিল সেগুলো টেনে ছিড়তে থাকে।
তিলের এমন পাগলামী দেখে রিদ দৌড়ে এসে ওকে আটকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ যেন রিদের থেকে শক্তিতে তিল এগিয়ে। তিলকে কিছুতেই থামাতে পারছেনা রিদ। এক পর্যায়ে ওকে চেপে ধরে নিজের বুকের সাথে।
রিদের বুকের উষ্ণ ছোয়ায় তিল থেমে যায়। গভীরভাবে ছোয়া পাওয়ার জন্য তিলের বুকের সাথে নিজেকে ল্যাপ্টে নিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠে।
“” তিল,আমাকে বুঝার চেষ্টা কর প্লিজ। আমি একদম শেষ স্টেজে আছি। হয়তো আর ১-২ বছর তারপর কি হবে আমি জানিনা। আমি জেনেশুনে কি করে তোকে নিজের সাথে জড়াবো বল? আর বিয়ে মানে বুঝিস তো? বিয়ে মানে হলো একটা মেয়ের সম্পুর্ন দায়িত্ব নেওয়া। আর যেখানে আমি নিজেই নিজেকে বইতে পারছিনা তোকে কিভাবে সামলাবো? মাঝপথে তোকে ছেড়ে কিভাবে যাবো? তখন তো আমি মরেও শান্তি পাবোনা রে তিল। আর সব থেকে বড় কথা যে রোগে আমি নিজে ভুগছি সেই রোগে তোকে ভুগতে দিবো কি করে??””
তিল রিদকে ছাড়তে চাইলে ওকে আবার শক্ত করে চেপে ধরে রিদ।
“” এমন পাগলামী করিস না,তিল। যথেষ্ট বড় হয়েছিস,নিজের ভালো বুঝতে শিখ আর এখন তো তোকে শুধু তোর নিজের না আমার আর তোর পুরো ফ্যামিলির কথা ভাবতে হবে। তুই নিজেই যদি এভাবে ভেংগে পড়িস তাহলে….””
“” আপনার আর আমার ভালোবাসার পুর্নতা চাই আমি। আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিবেননা,প্লিজ। অনেক আশা নিয়ে এসেছি।””
রিদ তিলকে ছেড়ে বিরক্ত নিয়ে বললো,
“” উফ! তুই কেন বুঝতে চাইছিস না?””
“” আপনি কেন বুঝতে চাচ্ছেননা? আপনাকে ছালা আমি তো এমনিতেই মলে যাবো তাহলে আপনাল মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে মললে কি ক্ষতি?””
“” তিল,আমার কিন্তু মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।””
“” আমালও মাথা গলম হয়ে যাচ্ছে,লিদ!””
“” মানে?””
“” আপনি যদি আমাকে এই মুহুলতে বিয়ে না কলেন তাহলে…””
“” তাহলে?””
“” তাহলে আমি বিষ খাবো।””
“” বিষ?””
“” হুম বিষ। শুধু বিষ কেন বিষ খেয়ে গলায় লশিও দিবো। আপনাল জন্য তো একবাল সুইসাইড কললে চলবেনা তাহলে আমাল ভালোবাসাকে সবাই কম ভাববে কিন্তু আমি তো বেশি বেশি ভালোবাসি তাই ফাসিও নিবো!””
তিলের কথায় রিদ ধমকিয়ে উঠে,
“” তিল,কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলছিস? তোকে এসব শিখায় কে?””
“” তা জেনে আপনাল কি? আপনি বিয়ে কলবেন নাকি তাই বলেন,আমাল হাতে বেশি সময় নাই। দু দুবার মলাল জন্য মানসিকভাবে প্লস্তুতি নিতে হবে।””
রিদ তিলকে ভালো করে পরখ করে দেখতে থাকলো। বুঝার চেষ্টা করছে ও কি এগুলো সত্যি সত্যি বলছে নাকি ওকে ভয় দেখানোর জন্য মজা করছে। কিন্তু এই প্রথম মনে হলো ও তিলকে বুঝতে পারছেনা। কিন্তু কেন? দীর্ঘদিনের দুরত্বের জন্য??
“” আপনাল বিশ্বাস হচ্ছেনা তো? না হলে নাই। তালাতালি আমাকে বালিতে ফেলাল ব্যবস্থা কলুন মলাল আগে সবাইকে একবাল দেখে তো নিতে হবে! আল ওখানে মলতেও সুবিধে হবে আপনাকে কষ্ট কলে কাদতে হবেনা। আপনাকে তো জানানোও হবেনা আমি কখন মললাম,কেউ তো আপনাল খোজ জানেনা!””
তিল মনমরা হয়ে রিদের খাটের মাঝখানটাই পা তুলে বসে পড়লো। তার এখন কান্না পাচ্ছেনা। রিদের মুখ দেখে তার তো হাসি পাচ্ছে। ভীষন ভয় পাচ্ছে তা মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তার রিদ ভাইয়াও যে ভয় পাই আজকে না দেখলে তো সে জানতোই না।
রিদ তিলকে কিছু বলতে গিয়েও বললোনা। চট করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। কেন বেড়িয়ে গেলো তিল ঠিক বুঝতে পারলো। বিছানা থেকে নেমে রুমটা ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে নিলো। পান্জাবীটা তুলে ঝেড়ে নিয়ে নিজের শাড়ীটাও ঠিক করতে লাগলো। একটু পরেই তো সে তার রিদ ভাইয়ার বউ হবে। ঠিকঠাক মতো শাড়ী না পড়লে চলবে???? আচ্ছা আমাকে কি এখানে ইংলিশে কবুল বলতে হবে? আর এখানকার কাজীরা কেমন হয়? তারাও কি পান্জাবী আর টুপি পড়ে নাকি প্যান্ট,শার্ট,স্যুট পড়ে থাকে???
কাজী,সিজাত তিলের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আধঘন্টা ধরে কাজী বসে আছে কিন্তু তাকে দিয়ে কবুল বলানো যাচ্ছেনা। যেই কাজী বলছে বলো মা কবুল! অমনি তিল হাসি মুখে রিদের দিকে তাকাচ্ছে তো বেজার হয়ে মুখ ফিরিয়ে কাজীকে বলছে,হয়নি আবার প্রথম থেকে সব বলুন!
এবার সিজাত ধৈর্য্য হারিয়েই তিলকে বললো,
“”তিয়ামতী,তুমি কি কবুল বলবে?
“” কি করে বলবো? আমি অমন রাগী মানুষকে বিয়ে করতে পারবোনা। উনি অমন রাগ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? মনে তো হচ্ছে কবুল বললেই উনি আমাকে এক কামড়েই গিলে খেয়ে ফেলবেন! উনাকে বলুন একটু হাসি মুখ করতে তাহলেই আমি কবুল বলবো!হুহ!””
সিজাতের অনেক চেষ্টার ফলে রিদের ঠোটে কৃত্রিম হাসি ফুটেছে আর তিলও খুশিতে বেশ জোরেই কবুল বলে উঠলো।
কাজীকে বিদায় দিয়ে তিলের উদ্দশ্যে রিদ বললো,
“” হয়েছে তোর বউ হওয়া? শান্তি? আমি সিজাতকে সব বলে দিয়েছি সব ব্যবস্থা করতে। তুই কাল পরশুই বাড়ি ফেরত চলে যাবি।””
আজ রিদের জন্মদিন। এই দিনেও মানুষটার রুমটা এমন বাসি থাকবে?? তিল নিজের হাতে রিদের রুমটা গুছাচ্ছে,আজকে ফুল দিয়ে সে তার রিদ ভাইয়ার রুমটা সাজাবে,কিন্তু কি ফুল দিয়ে সাজানো যায়?? উনার কোন ফুল পছন্দ? আমি এটাও জানিনা? এই জন্যই উনি চলে গিয়েছেন। আপনি ঠিকি বলেছেন রিদ ভাইয়া আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্য করেন। তবে আপনি একটা কথা ভুল বলেছেন আপনি আমার জন্য বেস্ট ছিলেন,আমিই আপনার জন্য বেস্ট ছিলামনা!
তিল চোখের পানি মুছতে মুছতে রিদের ওয়াড্রভটা খুলে জামাকাপড় গুছাতে লাগলো। হঠাৎই কিছু কাগজ চোখে পড়ে। হাত দিয়ে সেগুলো বের করে চোখের সামনে ধরতেই বুঝতে পারলো মেডিকেলের কাগজ। পেসেন্টের জায়গায় রিদের নাম লিখা।
তিল কাগজটা মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করেছে। পুরোটাই ইংলিশে লিখা। এই মুহুর্তে এতো এতো বড় বড় ওয়ার্ডের মিনিং সে কোথায় পাবে?? ইংলিশে দুর্বল হওয়া যে কতটা কষ্টের সেটা তিল আজকে বুঝতে পারলো। পট পট করে ইংলিশ তো পরে ফেলছে কিন্তু কি পড়ছে তা সে কিছুই বুঝতে পারছেনা। এখন সে কিভাবে বুঝবে এটাতে কি আছে?? নাম যেহেতু রিদ ভাইয়ার নিশ্চয় কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কিছুই হবে। আর এতো যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছে মানে ভয়ংকর ইম্পর্ট্যান্ট কিছু হবে। কাকে দেখাবো? বড় আব্বুকে কি দেখাবো? উনি কি কিছু বুঝতে পারবেন??
তিল সবকিছু ফেলে মেডিকেলের কাগজগুলো নিয়ে বড় আব্বুর উদ্দশ্যে বের হয়ে গেলো। কি আছে এতে তাকে জানতেই হবে। কোনো বড় অসুখ নয় তো?? আজ অনেকদিন বাদে তিলের হার্টবিটগুলো কাঁপছে। কেন কাঁপছে? অজানা কোনো তথ্য পাবো বলে কি? নাকি কিছু পাওয়ার প্রবল ইচ্ছেটা মিথ্যে হয়ে যাওয়ার ভয়ে???
রিদের জন্মদিনের উপলক্ষ্যে খুব কাছের কিছু রিলেটিভদেরকেও দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। তেমন জাঁকজমকভাবে কিছু করা না হলেও কিছু খাবারদাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যা গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে। তার বিনিময়ে ছেলেটা যেখানেই থাক যেন ভালো থাকে সে দোয়াতো পাবে!
রিদের ছোটবেলার কিছু বন্ধুবান্ধবকেও দেখা যাচ্ছে। অনেকেই তিলের সাথে খুটিনাটি কথা বলে আটকাচ্ছে। তাদেরকে হাসিমুখে সাদরে গ্রহন করেই তিল বড় আব্বুর রুমের দিকেই এগুলো। দরজার কাছটাতে গিয়েই বড় আম্মুর কান্নার শব্দ পেলো তিল। সাথে অভিমান আর রাগ মিশ্রিত বড় আব্বুর কথাও কানে আসছে।
“” কার জন্য কাঁদছো তুমি? তোমার ছেলে কি একটাবার আমাদের কথা ভেবেছে?? সবসময় নিজে যা মনে হয় তাই করেছে। অমন ছেলের জন্য তুমি কেন চোখের পানি ফেলছো রিদের মা? আমার ক্ষুধা লাগছে যাও ভাত বারো।””
“” তুমি আরেকটু খুজে দেখলে ঠিক পেতে। তুমি কি বুঝবে মায়ের খালি বুকের কি বেদনা!””
“” হ্যা,হ্যা তাহলে তুমি এভাবে চোখের পানি না ফেলে কোমড়ে শাড়ির আচল গুজে বের হয়ে যাওনা,নিজের ছেলেকে খুজে আনো। যত্তসব!””
আমির সাহেব রাগে গজগজ করতে করতে বের হয়ে গেলেন। তিল আটকাতে গিয়েও থেমে গেলো। যাহ! বড় আব্বুও তো বের হয়ে গেলো। তাহলে এখন কাকে দেখাবো???
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে এলো কিন্তু বড় আব্বুর আর ফেরার কোনো নামগন্ধ নেই। আর কতক্ষন ওয়েট করবে সে? কাগজটার দিকে তাকিয়ে তিলের ভীষন কান্না পাচ্ছে সে কেন ইংলিশটা মন দিয়ে পড়লোনা? কেন বড় বড় ওয়ার্ডগুলোর মিনিং শিখলোনা??? তিলের ইচ্ছে হলো এখনি সে ডিকশনারীটা নিয়ে তুরি মেরে সব শব্দের অর্থ মুখস্ত ঠুটস্থ করে ফেলতে!
তিল আর ওয়েট করতে পারলোনা। কি আছে এতে জানার জন্য মনটা ছটফট করছে। ভালো হোক আর মন্দ হোক জানলেই তো ছটফটানি বন্ধ হবে। তারপর কি করা যাবে ভাবা যাবে আপাতত এই ছটফটানি থেকে নিজেকে শান্ত করতে হবে। তিল ওড়নাটা গলায় পেচিয়ে কাগজপত্র নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো।
~~
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে একটা প্রাইভেট হসপিটালের দিকে এগুতে লাগলো। সেবার তো এখানেই উনার সাথে আমিও এডমিট হয়েছিলাম। তিল দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে সামনে এগুতেই একটা ছেলের সাথে ধাক্কা খেলো! তিল নিজেকে সামলে নিলেও ছেলেটি নিজেকে সামলাতে পারেনি। হাতের আবদ্ধে থাকা সব কাগজপত্র নিচে পড়ে গেছে। ছেলেটি সেদিকে ভ্রক্ষেপ না নিয়ে বলে উঠলো,
“” তিয়ামতী?””
তিল নিজের নাম শুনে সামনে তাকিয়ে দেখে সিজাত। বেশ অবাকই হয়। এভাবে উনার সাথে দেখা হবে কখনো ভাবেনি।
“” আপনি এখানে?””
“” কিছু রিপোর্টস নিতে এসেছিলাম।””
“” কিসের? কার রিপোর্টস?””
তিলের প্রশ্নকে যেন এড়িয়ে গেলো সিজাত। বেশ তাড়াহুড়ো ভাব দেখিয়ে পড়ে যাওয়া কাগজপত্রগুলো তুলতে থাকে।
তিল নিজেও উত্তরের আশা না করে সিজাতকে হেল্প করতে হাত লাগায়। ততক্ষনে সিজাত সব গুছিয়ে নিয়েছে। তিল নিজের কাছটাতে একটা কাগজের টুকরো নিতেই ওখানে চোখ পড়ে তিলের। এটাতেও পেশেন্টের জায়গায় রিদের নাম লেখা। তিলের মনে হলো ও যে রিপোর্টসগুলো নিয়ে এসেছে কিছু জানার জন্য এটাও তারই একটা অংশ! কিন্তু এটা সিজাতের কাছে আসলো কিভাবে?? তিল অস্থির হয়ে সিজাতকে প্রশ্ন করতে উঠে দাড়াতেই দেখে কেউ নেই। চারপাশে চোখ বুলিয়েও সে সিজাতকে পেলোনা। গেলোটা কোথায়? মাত্রইতো এখানে ছিলো এর মধ্যে নাই হয়ে গেলো? আর এভাবে না বলেই বা কেন চলে গেলো? উনি কি আমার থেকে পালিয়ে গেলেন? কিন্তু কেন??
তিল নানা প্রশ্ন নিয়ে সামনে এগুতে এগুতে বার কয়েক পিছনে তাকিয়েছিলো যদি সিজাতকে দেখতে পায়!
পড়াশুনা বাদে সেভাবে কখনো একা একা চলা হয়নি তিলের। আর হসপিটাল তো দুরে থাক। এখানে কোথায় কি হয় কিছুই জানেনা। কার সামনে গিয়ে সে রিপোর্টের ব্যাপারে জানবে তাও জানেনা। কিন্তু তাকে তো জানতেই হবে! সাতপাঁচ ভাবা বন্ধ করে একটা মেয়ে ডক্টরের কেবিনে ঢুকে পড়লো।
তিল পলকহীন ভাবে তার সামনে বসে থাকা ডক্টরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। উনি যা বলছেন তা বিশ্বাস করবে নাকি বুঝতে পারছেনা। কানগুলো যেন কেমন অবশ হয়ে আসছে,চোখটাও সেই জন্যই হয় তো পাপড়িগুলো নড়ছেনা। নিশ্বাসটা নিতে ইচ্ছে করছে না। ডক্টরের বিপরীতে সে কি বলবে তাও খুজে পাচ্ছেনা। শুধু ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে আছে তিল। সে ঠিকঠাক লোকের কাছেই আসছে তো? উনি আসলেই ডক্টর তো? উনি ঠিকঠাক মতো ইংলিশ পড়তে পারেন তো?? তিল ভালো করে উনাকে পরোক্ষ করে দেখছে,মাঝবয়সীর মহিলা। হয় তো উনিও আমার মতো ইংলিশ না পরেই ডক্টর হয়ে গেছেন। আমি যদি ইংলিশে টেনেটুনে পাশ করে A+ আনতে পারি তাহলে কি উনি ডক্টর হতে পারেননা? অবশ্যই পারেন। উনি ঠিক বুঝতে পারছেন আমি এতোকিছু বুঝিনা তাই এমন ভুলভাল বলছেন!
তিলের মাইন্ডে হাজারও সন্দেহ থাকলেও তার মন ঠিকই মেনে নিয়েছে ডক্টর তাকে এক ফোঁটাও ভুল বলেনি তাই হয়তো চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি বাড়ি যেতে পারবো তো? এমন ভুলভাল কথা শুনেও শরীরটা এমন দুর্বল হয়ে আসছে কেন????
তিল বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলেও সিজাতের বাড়ির সামনে এসে পৌছিয়েছে। মনের অজান্তেই দরজায় নক করতে থাকে। দুবার কলিংবেল টিপতেই সিজাত দরজা খুলে দিলো।
“” তিয়ামতী,তুমি এখানে??””
তিল সিজাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার যে অনেককিছু জানার আছে,অনেক প্রশ্ন করার আছে। এতক্ষনে সে ঠিকই বুঝে গেছে তার না জানা তথ্যগুলো রিদ বাদে যদি আর কেউ জেনে থাকে সে হলো সিজাত। তিল কোন প্রশ্নটা আগে করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। সিজাতের দিকে তখনো তাকিয়েই রয়েছে। সবকিছু কেমন যেন গোলমেল লেগে যাচ্ছে। যা জানার জন্য মন এমন ছটফট করছে অথচ তার মুখোমুখি হতেই হাত পা কাঁপাকাঁপি করছে,মনের ভেতর ভয়েরা উকি দিচ্ছে।
“” তোমাকে এমন লাগছে কেন তিয়ামতী? তুমি কি অসুস্থ?””
তিল নিজের হাতের কাগজটা সিজাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“” রিদ ভাইয়া কোথায়?””
সিজাত কাগজে চোখ বুলিয়ে বেশ অবাক হয়েই তিলকে বললো,
“” আমি জানিনা,তিয়ামতী। তুমি আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ……””
সিজাত নিজের কথা শেষ করার আগেই তিল অজ্ঞান হয়ে দরজার সামনে পড়ে যেতেই সিজাত ওকে ধরে ফেলে।
জ্ঞান ফিরতেই তিল নিজের পাশেই সিজাতকে দেখতে পায়। বেশ অস্থিরতা নিয়েই বলে উঠলো,
“” তুমি ঠিক আছো তো? শরীরের কি হাল করেছো বলোতো? এভাবে হুট করে অজ্ঞান হয়ে গেলে,আমার তো প্রাণ যায় যায় অবস্থা””
“” রিদ ভাইয়া কোথায়?””
তিলের মুখে পুনরায় একি কথায় বেশ বিচলিত হয়ে যায় সিজাত। বেশ শক্ত কন্ঠে বললো,
“” তুমি এখন অনেকটাই সুস্থ তিয়ামতী,চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে…””
“” আমি কোথাও যাবোনা। আমি জানতে চাই আমার রিদ ভাইয়া কোথায়? তখন থেকে একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছি আপনি শুনতে পারছেননা? বলছেননা কেন আমার রিদ ভাইয়া কোথায়? কোথায় আমার রিদ ভাইয়া?””
তিলের চিৎকার করা কথাতে সিজাতও চিৎকার করে বলে উঠে,
“” আমি জানিনা। না জানলে কিভাবে বলবো?””
তিল বিছানা ছেড়ে সিজাতের সামনে এসে চোখ রাঙিয়ে বললো,
“” আপনি সব জানেন। সেদিন আপনার ফোনেই রিদ ভাইয়া আমাকে ফেলে এসেছিলো। বলুন সেদিন কি হয়েছিলো?””
“” আমি বলতে পারবোনা।””
তিল এবার অসহায়ের মতো কেঁদে কেঁদে হাতজোর করে বললো,
“” প্লিজ!””
সিজাত তিলের হাতদুটো নামিয়ে বললো,
“” সেদিন আব্বু হঠাৎ করেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। উনাকে হসপিটালে এডমিট করানো হয়। ডক্টররা চেকআপ করে জানায় ইমিডিয়েটলি অপারেশন করতে হবে এবং রক্তের ব্যবস্থা করে রাখতে,যাতে প্রয়োজনে ছুটোছুটি করতে নাহয়। আমার আব্বুর ব্লাড গ্রুপ এবি(-) ছিলো। তুমিতো জানোই এই গ্রুপের ব্লাড কত ডিমান্ডেড। আমার তখনি মনে পড়ে যায় রিদের কথা। ওর ব্লাড গ্রুপ ও এবি(-)। এক সাথে পড়াশুনা চলাকালেই জানা হয়েছিলো। আমি সাথে সাথেই ওকে কল দেই। যদিও তখন আমাদের মধ্যে তোমাকে নিয়ে ঝামেলা চলছিলো তবুও বাবার জীবনের কথা ভেবে সেদিন সব ভুলে গিয়েছিলাম আর রিদও। ও খুব রাগী হলেও ও যে খুব ভালো মনের মানুষ আমি এটাও জানতাম। আর জানা থেকেই ওকে সাহস করে কল দিয়েছিলাম। জানতাম ও ফেরাবে না আর তাই ই হলো। বাবার অপারেশন শুরু হওয়ার আগেই ও হাজির। ও ব্লাড দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলো কিন্তু তখনি একজন নার্স এসে জানালো ব্লাড দেওয়ার আগে কিছু টেস্ট করতে হবে। রিদ উনার সাথে চলে যায়। কিছুক্ষন পর নার্স এসে আমাকে জানায় ওর ব্লাডে এইচ আই ভি ভাইরাস পাওয়া গেছে। এ ব্লাড নেওয়া যাবোনা। আমি যেন অন্য কোনো ডোনার ব্যবস্থা করে রাখি। রিদ তখন আমার পাশেই দাড়িয়ে ছিলো। নার্সের কথায় আমি যতটা অবাক হই তার থেকে হাজারগুন বেশি অবাক হয় রিদ। রাগে ক্ষোবে ও নার্সের কলার চেপে ধরে। আমি ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,এরকম ভুলভাল রিপোর্ট৷ হতেই পারে রিদ,তুই আবার পরীক্ষা কর! তিল নার্সকে ছেড়ে দিয়ে হসপিটাল থেকে বের হয়ে যায়। তারপর কি হয়েছে আমি জানিনা। আমি অনেকবার ওকে কল দিয়েছি কিন্তু ওর ফোন অফ পেয়েছি,ওর বাসায় ও গিয়েছিলাম কিন্তু ও কোনোভাবেই আমার সাথে কন্টাক্ট করেনি। তার বেশকিছুদিন পরে হুট করেই আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। এটাও রিদের নাম্বার,তবে এটা ও ইউকে থাকতে ইউস করতো। আমি বেশ অবাক হয়েই ওর কল রিসিভ করি। খুব চিৎকার করে কান্না করছিলো ও। ওর সাথে আমার ৭ বছরের পথচলা,এর মাঝে ওকে কোনোদিন কাঁদতে দেখিনি। কি হয়েছে জানতে চাওয়াই কিছু বলেনি আমাকে শুধু বলেছে ওর কিছু ইম্পর্ট্যান্ট রিপোর্টস হারিয়ে গিয়েছে সেগুলো হসপিটাল থেকে কালেক্ট করে ওকে পাঠাতে। কিন্তু যতই হোক আমার খুব কাছের ফ্রেন্ড ছিলো ও। তাই আমি ওর রিপোর্ট কালেক্ট করে খোজখবর নিতেই জানতে পারি সেদিনের ঐ নার্সের বলা কথা ভুল ছিলোনা। আর তাই সে ব্যাপার নিয়ে ওকে জেরা করতেই ও সব খুলে বলে। ওর এই মুহুর্ত….””
“” আমি রিদ ভাইয়ার কাছে যাবো।””
তিলের এমন আবদারে সিজাত থমকে যায়। তিলের থেকে সরে এসে বললো,
“” না,তিল। আমি রিদকে কথা দিয়েছি।””
সেদিন তিলের আবদারের কাছে হার মানতে হয়েছিলো সিজাতকে। প্লেনে তার সিটের পাশেই তিলকে জায়গা করেও দিতে হয়েছিলো। হয়তো আল্লাহ চান তিল আর রিদের দেখা হোক। নাহলে এমন সময়ে কেন তিলের সাথেই সিজাতের দেখা হলো? আল্লাহর চাওয়া খন্ডন করার শক্তি কি মনুষ্যজাতির আছে???? তাহলে সিজাত কিভাবে পারবে???
~~
দরজা খুলে অন্ধকার রুমে ঢুকে সুইচে হাত দিলো রিদ। লাইটের আলো তার একদম ভালো লাগেনা,শুধু লোভ জাগে। বাচাঁর লোভ। নিজেকে লোভী ভাবতে রিদের একদম ভালো লাগেনা তাই অন্ধকারেই থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু আজ রুমে ঢুকেই কেমন জানি অনুভব হচ্ছে,মনে হচ্ছে তার গন্ধ ছাড়াও অন্য কারো গন্ধে পুরো রুমটা মুখরিত,তার নিশ্বাস ছাড়াও অন্য কারো নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছে,তার অস্তিত্ব ছাড়াও অন্য কোনো অস্তিত্বের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এই আজব অনুভূতিকে ধুলিসাৎ করতেই লাইটের সুইচটা চাপ দেয় রিদ। লাইটের আলোতে রিদের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে,অসহ্য লাগছে। তবুও চোখ মেলে সামনে তাকাতেই রিদ অবাক হয়ে যায়।
তার রুমের ছোট্ট বেডটাতে নীল বেনারশী জড়িয়ে একটা মেয়ে বসে আছে,ঘোমটা টানা তাই চেহারা দেখতে পাচ্ছে না। কে সে? আর তার রুমে এমন বউ সেজে কে বসে আছে? যার বসে থাকার কথা ছিলো তাকে তো সে বাংলাদেশে ফেলে চলে এসেছে। তাহলে এ কে?
রিদ বেশ তিক্ত কন্ঠেই চিৎকার করে উঠে,
“” কে আপনি? আমার রুমে কি করছেন?””
আর সাথে সাথেই ঘোমটাটা পড়ে যায়। তার মাঝখান থেকে লাইটের আলোতে তিলের মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠে।
“” তিল! তুই?””
তিল মুগ্ধ নয়নে রিদকে দেখছে,চোখ বড় বড় করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে,আজ এতোগুলো দিন পর তার রিদ ভাইয়াকে পেয়েছে,মন ভরে দেখতে হবে নাহলে কি তার ক্ষিধে মিটবে? ভালোবাসার মানুষকে দেখার ক্ষিধে?
রিদ শুকিয়ে গেছে,এতো বেশি শুকিয়ে গিয়েছে যে রিদের শার্টটা ঢিলে হয়ে ঝুলে আছে,চুল দাড়ি সব অগোছালোভাবে পড়ে আছে,দীর্ঘদিন চিরনির ছোয়া পায়নি,শেভও তো করেনি অনেকদিন,দাড়ির সাথে সাথে তাল মিলিয়ে মোচটাও বড় হয়ে ঠোটের অনেকাংশই ঢেকে ফেলেছে,মুখ শুকিয়ে গালের নিচের দিকে গর্তের ছাপ পড়ে গেছে,চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে,চোখের চাহনিটাও যেন শুকিয়ে গেছে,কেমন নেতানো চাহনি। ১ বছরেই মানুষটা এতো বদলে গেলো? তিলের হৃদয়টা কেঁপে উঠলো। শুকনো আত্মাটা পানির জন্য ছটফট করছে। তিলের চোখটাও ভিজে আছে,কিন্তু এটা রিদ ভাইয়ার কষ্টের জন্য না তাকে এতোদিন পর দেখতে পারার সুখের!
তিলের ইচ্ছে হলো দৌড়ে গিয়ে রিদকে জড়িয়ে ধরে তার শুকনো আত্মাকে ভিজিয়ে নিতে। তিল বিছানা ছেড়ে এসে রিদের সামনে দাড়ালো। কিন্তু রিদকে জড়িয়ে ধরার বদলে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো,রিদের ডানগালে।
রিদকে ছাড়া তিলের পড়ায় মন বসেনা,ঘুম আসেনা,খাওয়ার স্বাাদ আসেনা। মাঝরাতে ঘুম ভেংগে যখন রিদকে নিজের পাশে পাইনা তখন হুহু করে কেঁদে উঠে। আপনি আমাকে মারেন,কাটেন,বকেন যা খুশি তাই করেন তবুও এভাবে দুরে ঠেলে রাখবেননা প্লিজ,আমি যে আপনার বিরহ নিতে পারছিনা। আপনার মতো আমারও বুকে চিনচিন করে ব্যথা হচ্ছে। এ কেমন ব্যথা রিদ ভাইয়া? আবার কোন খেলায় আপনি আমাকে নামিয়েছেন?? কোন নেশায় আমাকে ডুবিয়েছেন? আমি যে ডুবে মরে যাচ্ছে,নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কেন এমন করছেন???
কালকে পরীক্ষা অথচ তিলের মনে হচ্ছে সে কিছুই পারেনা। যত পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে তত মনে হচ্ছে এগুলো তার পড়া হয়নি। তার মধ্যে রিদ ভাইয়াটারও কোনো খেয়াল নাই। কি হয় এসে একটু পড়ালে উনি সামনে বসলেই তো আমার সব পড়া হয়ে যাবে। ট্রেন যেমন রেললাইনের উপর দিয়ে গড়গড় করে ছুটে চলে যায় সেও তো রিদ ভাইয়ার সামনে গড়গড় করে সব পড়া বলতে পারবে!
তিল মনের দুঃখে বই,খাতা,কলম নিয়ে বাইরাবাইরি করতে থাকে। হঠাৎই নিজের ফোন বেজে উঠলো, অচেনা নাম্বার,এতো রাতে তাকে কে কল দিবে?? অনেকটা বিরক্ত নিয়েই তিল কলটা রিসিভ করে কানে ধরলো,
“” তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে,আমার রুমে একটু আসবি?””
“” লিদ ভাইয়া!””
রিদের কন্ঠ পেয়ে তিল চোখটা বুঝে ফেলে। খুশিতে ফোন কান থেকে নামাতেও ভুলে গেছে। এতোদিন পর উনার কন্ঠ শুনে মনে হলো উনার কন্ঠ শোনার জন্য কত দিনের তৃষ্ণা ছিলো তা এখন বুঝতে পারছে।
আপনি ডেকেছেন আর আমি আসবোনা এটা হয়?? তিল তখনি বই খাতা সব ফেলে উঠে পড়ে। ছুটে যেতে গিয়ে থেমে যায়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে নিজের চুলটা একটু আচড়িয়ে নিলো। আজ কত দিন বাদে রিদ ভাইয়া তার তিলকে দেখতে চাচ্ছে একটু ফিটফাট নাহলে চলে???
রিদের দরজার সামনে যেতেই তিলের পা থমকে গেলো। বুকের ভেতরে কিছু একটা চলাচলের শব্দ পাচ্ছে। খুব বেশি নার্ভাস লাগছে। হাতদুটো মুঠো করে নিজের জামাটা কুচকিয়ে ধরে জোরে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে নিলো। হঠাৎ এমন নার্ভাস লাগার কারন খুজে পাচ্ছেনা। দরজায় হাত রাখতেও কেমন একটা লাগছে। তাহলে ভেতরে গিয়ে রিদ ভাইয়ার সামনা সামনি হবো কি করে??? কেন এমন অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে? অনেকদিন বাদে দেখা হচ্ছে বলে? নাকি অনেকদিন বাদে কাছে যাচ্ছি বলে???
“” কি হলো,বাইরে দাড়িয়ে আছিস কেন? তোকে কি পালকি দিয়ে বয়ে আনতে হবে??””
পুরো রুমটা অন্ধকারে ঢাকা। এতো অন্ধকার কেন? বিদ্যুৎ কি চলে গেছে?? আমার রুমে তো ঠিকই ছিলো তাহলে এখানে কি হলো??? তিল পা বাড়িয়ে ভেতরে এগুতেই রিদ বললো,
“” ভয় পাচ্ছিস?? দাড়া!””
রিদ নিজের ফোনটার টর্চটা জ্বালিয়ে তিলের দিকে আলো ফেলে বললো,
“” তোর হাতের ডানদিকে ছোট টেবিলটায় দেখ মোম আর ম্যাচ আছে। মোমটা জ্বালিয়ে নে। তাহলে আর ভয় পাবিনা।””
রিদের কথা মতো তিল মোমটা জ্বালিয়ে রিদের কাছাকাছি এসে দাড়ায়। আজো উনি কম্বলটা মুড়ি দিয়েই শুয়ে আছে। রুমের ফ্যানটা অফ! এই গরমে উনি এভাবে থাকেন কিভাবে? উনার সব অদ্ভুত কাজের মধ্যে এটা বেশি অদ্ভুত যা তিলকে বারে বারে ভাবায়!
“” তুই কি মোম হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকার চাকরি নিয়েছিস? ওখানে রেখে আমার মাথার কাছে এসে বস।””
রিদের প্রত্যেকটা কথায় তিলের কাছে কেমন যেন ঠান্ডা বরফের ছোয়া লাগছে। এতো রাগী লোকটার ঝাঝালো কন্ঠ হঠাৎ এমন নিয়িয়ে গেলো কিভাবে? কথার ধরন না পাল্টালেও সেই আগের মতো ঝাঝটা আর নেই। কি হয়েছে উনার? উনি কি ভেতরে ভেতরে কোনো জিনিস নিয়ে খুব বাজে ভাবে ভুগছেন???
তিল রিদের মাথার কাছে বসতেই রিদ নিজের মাথাটা তিলের কোলে তুলে দিলো।
“” মাথাটা খুব ধরেছে,একটু চুলটা টেনে দেতো।””
তিল চুলে হাত দিতেই ওর হাতটা চেপে ধরে রিদ। হাতটা নিজের গালে ছুয়িয়ে নিয়ে বললো,
“” কেমন আছিস রে?””
রিদের অতি সাধারন প্রশ্নটাও যেন তিলের বুকের ভেতর ঝড় তুলে দিলো। কেমন আছে এটার উত্তর কি দিবে?? ভালো আছে? কিন্তু ও কি আসলেই ভালো আছে??
“” কিছু বলছিস না যে? রাগ করেছিস আমার সাথে??””
তিল এবার আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলোনা। ঠুকরে ঠুকরে কেদে উঠে, অভিমানি কন্ঠে বললো,,
“” আপনি খুব পঁচা খুব।””
রিদের মাথাটা সড়িয়ে তিল অভিমান করে উঠে চলে যেতে নিলে তিলের হাতটা চেপে ধরে নিজের বুকে।
“” সরিরে। এই দেখ কানে ধরেছি। এবার তো ক্ষমা করে দে। দেখতো তোর লিদ ভাইয়াকে কানে ধরে কেমন হনুমানের মতো লাগছে??””
তিল রিদের হাতটা কান থেকে সরিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো,
“” আমাল লিদ ভাইয়াকে যেমন খুশি তেমন দেখাক আপনাল কি? খবলদাল যদি আলেকবাল আমাল লিদ ভাইয়াকে হনুৃমান বলছেন তো””
“” তো কি করবি শুনি তুতলি রানী!””
“” আপনি এমন অন্ধকালে শুয়ে লয়েছেন কেন? আপনাল কি হয়েছে? আমাল খুব ভয় লাগছে।””
তিলের কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা রিদ। তিলের হাতটা বুক থেকে সরিয়ে চোখের সামনে আনলো। অনামিকা আঙুলটা দেখে হালকা শুকনো হাসি নিয়ে বললো,
“” ডায়মন্ডের সাথে স্বর্নের এমন হলদে কালারটা মানাচ্ছেনা। দেখি খুলে দেতো আমায়।””
“” আপনি আমার বাবুকে আলাদা কলছেন কেন?'”
“” তোর বাবু মানে? আংটিকে তুই বাবু বানিয়ে দিলি? বেশি পড়ার চাপে তোর মাথাটা কি গেলো?””
তিল হাতের আংটিটা ঠিক করতে করতে লাজুক হয়ে বললো,
“” আপনিই তো বাবুল গন্ধ নিয়ে পলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন বাবাল কাছ থেকে যেন সন্তানকে না সলায় তাহলে এখন সলাচ্ছেন কেন? বাবাল থেকে আলাদা কলছেন দেখলে কি ও কেঁদে উঠবেনা?””
তিল নিজের কথা শেষ করে রিদের দিকে তাকাতেই বুঝলো উনি তার দিকেই চেয়ে আছে। মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে, যে চাহনিতে কোনো কামুকতা নেই,কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই,কোনো চাওয়া নেই,রয়েছে শুধু মুগ্ধতা আর প্রাপ্তি।
রিদের এমন চাহনিতে তিলের লজ্জা যেন আরো প্রখর হলো। ঠোটে হালকা হাসি ফুটে উঠেছে।
রিদ তিলের কাছ থেকে সরে এসে নিজের বালিশটাতে শুয়ে বললো,
“” অনেক রাত হয়েছে, রুমে যা। কাল তো আবার পরীক্ষা। ঠিক মতো সব পড়েছিস তো?””
তিল মনে মনে বললো আপনাকে ছাড়া কি আমার পড়ায় মন বসে রিদ ভাইয়া?
“” হুম।””
“” গুড,রেজাল্ট খারাপ হলে কিন্তু খুব বকবো।””
“” হবেনা। আপনি পলিয়েছেন তো।””
রিদ আবার কিছু বলতে যাবে কিন্তু নিজের গলাটা ভার হয়ে গেছে বুঝতে পেরে কিছু বললোনা।
তিল তখনো রিদের মাথার কাছেই বসে আছে। আমার আপনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে রিদ ভাইয়া। একটু জড়িয়ে নিবেননা? আপনি হঠাৎ এতো শান্ত হয়ে গেছেন কেন? আপনার এই শান্ত টা যে আমার ভেতরে অশান্তের সৃষ্টি করছে।
“” এখনো বসে আছিস যে?””
তিল মন খারাপ করে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে নিলেই পেছন থেকে রিদ ডেকে উঠে,
আজ যেন লজ্জারা সব পণ করেছে তিলকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা।
তিল মাটির দিকে তাকিয়ে গুটি গুটি পায়ে আবার রিদের কাছে এগিয়ে যেতেই রিদ উঠে বসে পড়ে।
তিলের গালে নিজের ডান হাতটা ছুয়িয়ে কপালে চুমু খেতে গিয়েও থেমে যায়। কিছু একটা ভেবে কপাল থেকে ঠোটগুলো সরিয়ে তিলের বা গালে চুমু একে দিলো। ঠোটের কোনের তিলটা নিজের বা হাতের বৃদ্ধা আংগুল দিয়ে হালকা করে হাত বুলিয়ে বললো,
“” বেস্ট অফ লাক!””
তিল চলে যেতেই রিদ হুহু করে কেঁদে উঠে। যেখানটাই আমি নেই সেখানটাই ছুয়ে কি হবে????
রিদ ভাইয়ার কাছ থেকে এতো এতো আদর পেয়েও কি পরীক্ষা খারাপ হতে পারে? কখনোই না। তিল লুজের পর লুস পেজ নিয়ে লিখেই যাচ্ছে। কলমের কালি শেষ তো কি হয়েছে? আরেকটা নতুন কলম দিয়ে লিখা শুরু করে।
~~
“” এখনি ঘুমাবি?””
কালকেই তার শেষ পরীক্ষা,তারপর গায়ে হলুদ অবশেষে বিয়ে। খুশিতে আজ তিলের পড়াই হচ্ছিলোনা। তবুও রিদ ভাইয়াকে সে রাগাবেনা বলে অনেক কষ্টে এতক্ষন পড়ায় মুখ গুজে রেখেছিলো। কিন্তু এভাবে কতক্ষন? তাই বই গুছিয়ে সবেই বিছানায় উঠে কাথাটা মেলছিলো। আর তখনি রিদ ভাইয়ার আগমন।
রিদের দিকে তাকিয়ে তিলের বুকটা কেঁপে উঠলো। উনাকে এতো অগোছালো লাগছে কেন? চোখের নিচটা এতো ফুলে গেছে,মনে হচ্ছে কালচে দাগ ও পড়েছে। মাথার চুলগুলোতেও অনেকদিন চিরনি চালানো হয়নি,গালে খোচা খোচা দাড়িগুলো এখন আর খোচা নেই অনেকটাই বড় হয়ে গেছে।
তিলকে অবাক করে দিয়ে রিদ ওর বুকের উপর শুয়ে খুব গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো। অস্পষ্টট সুরে বললো,
রিদকে ছাড়া তিলের পড়ায় মন বসেনা,ঘুম আসেনা,খাওয়ার স্বাাদ আসেনা। মাঝরাতে ঘুম ভেংগে যখন রিদকে নিজের পাশে পাইনা তখন হুহু করে কেঁদে উঠে। আপনি আমাকে মারেন,কাটেন,বকেন যা খুশি তাই করেন তবুও এভাবে দুরে ঠেলে রাখবেননা প্লিজ,আমি যে আপনার বিরহ নিতে পারছিনা। আপনার মতো আমারও বুকে চিনচিন করে ব্যথা হচ্ছে। এ কেমন ব্যথা রিদ ভাইয়া? আবার কোন খেলায় আপনি আমাকে নামিয়েছেন?? কোন নেশায় আমাকে ডুবিয়েছেন? আমি যে ডুবে মরে যাচ্ছে,নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কেন এমন করছেন???
কালকে পরীক্ষা অথচ তিলের মনে হচ্ছে সে কিছুই পারেনা। যত পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে তত মনে হচ্ছে এগুলো তার পড়া হয়নি। তার মধ্যে রিদ ভাইয়াটারও কোনো খেয়াল নাই। কি হয় এসে একটু পড়ালে উনি সামনে বসলেই তো আমার সব পড়া হয়ে যাবে। ট্রেন যেমন রেললাইনের উপর দিয়ে গড়গড় করে ছুটে চলে যায় সেও তো রিদ ভাইয়ার সামনে গড়গড় করে সব পড়া বলতে পারবে!
তিল মনের দুঃখে বই,খাতা,কলম নিয়ে বাইরাবাইরি করতে থাকে। হঠাৎই নিজের ফোন বেজে উঠলো, অচেনা নাম্বার,এতো রাতে তাকে কে কল দিবে?? অনেকটা বিরক্ত নিয়েই তিল কলটা রিসিভ করে কানে ধরলো,
“” তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে,আমার রুমে একটু আসবি?””
“” লিদ ভাইয়া!””
রিদের কন্ঠ পেয়ে তিল চোখটা বুঝে ফেলে। খুশিতে ফোন কান থেকে নামাতেও ভুলে গেছে। এতোদিন পর উনার কন্ঠ শুনে মনে হলো উনার কন্ঠ শোনার জন্য কত দিনের তৃষ্ণা ছিলো তা এখন বুঝতে পারছে।
আপনি ডেকেছেন আর আমি আসবোনা এটা হয়?? তিল তখনি বই খাতা সব ফেলে উঠে পড়ে। ছুটে যেতে গিয়ে থেমে যায়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে নিজের চুলটা একটু আচড়িয়ে নিলো। আজ কত দিন বাদে রিদ ভাইয়া তার তিলকে দেখতে চাচ্ছে একটু ফিটফাট নাহলে চলে???
রিদের দরজার সামনে যেতেই তিলের পা থমকে গেলো। বুকের ভেতরে কিছু একটা চলাচলের শব্দ পাচ্ছে। খুব বেশি নার্ভাস লাগছে। হাতদুটো মুঠো করে নিজের জামাটা কুচকিয়ে ধরে জোরে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে নিলো। হঠাৎ এমন নার্ভাস লাগার কারন খুজে পাচ্ছেনা। দরজায় হাত রাখতেও কেমন একটা লাগছে। তাহলে ভেতরে গিয়ে রিদ ভাইয়ার সামনা সামনি হবো কি করে??? কেন এমন অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে? অনেকদিন বাদে দেখা হচ্ছে বলে? নাকি অনেকদিন বাদে কাছে যাচ্ছি বলে???
“” কি হলো,বাইরে দাড়িয়ে আছিস কেন? তোকে কি পালকি দিয়ে বয়ে আনতে হবে??””
পুরো রুমটা অন্ধকারে ঢাকা। এতো অন্ধকার কেন? বিদ্যুৎ কি চলে গেছে?? আমার রুমে তো ঠিকই ছিলো তাহলে এখানে কি হলো??? তিল পা বাড়িয়ে ভেতরে এগুতেই রিদ বললো,
“” ভয় পাচ্ছিস?? দাড়া!””
রিদ নিজের ফোনটার টর্চটা জ্বালিয়ে তিলের দিকে আলো ফেলে বললো,
“” তোর হাতের ডানদিকে ছোট টেবিলটায় দেখ মোম আর ম্যাচ আছে। মোমটা জ্বালিয়ে নে। তাহলে আর ভয় পাবিনা।””
রিদের কথা মতো তিল মোমটা জ্বালিয়ে রিদের কাছাকাছি এসে দাড়ায়। আজো উনি কম্বলটা মুড়ি দিয়েই শুয়ে আছে। রুমের ফ্যানটা অফ! এই গরমে উনি এভাবে থাকেন কিভাবে? উনার সব অদ্ভুত কাজের মধ্যে এটা বেশি অদ্ভুত যা তিলকে বারে বারে ভাবায়!
“” তুই কি মোম হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকার চাকরি নিয়েছিস? ওখানে রেখে আমার মাথার কাছে এসে বস।””
রিদের প্রত্যেকটা কথায় তিলের কাছে কেমন যেন ঠান্ডা বরফের ছোয়া লাগছে। এতো রাগী লোকটার ঝাঝালো কন্ঠ হঠাৎ এমন নিয়িয়ে গেলো কিভাবে? কথার ধরন না পাল্টালেও সেই আগের মতো ঝাঝটা আর নেই। কি হয়েছে উনার? উনি কি ভেতরে ভেতরে কোনো জিনিস নিয়ে খুব বাজে ভাবে ভুগছেন???
তিল রিদের মাথার কাছে বসতেই রিদ নিজের মাথাটা তিলের কোলে তুলে দিলো।
“” মাথাটা খুব ধরেছে,একটু চুলটা টেনে দেতো।””
তিল চুলে হাত দিতেই ওর হাতটা চেপে ধরে রিদ। হাতটা নিজের গালে ছুয়িয়ে নিয়ে বললো,
“” কেমন আছিস রে?””
রিদের অতি সাধারন প্রশ্নটাও যেন তিলের বুকের ভেতর ঝড় তুলে দিলো। কেমন আছে এটার উত্তর কি দিবে?? ভালো আছে? কিন্তু ও কি আসলেই ভালো আছে??
“” কিছু বলছিস না যে? রাগ করেছিস আমার সাথে??””
তিল এবার আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলোনা। ঠুকরে ঠুকরে কেদে উঠে, অভিমানি কন্ঠে বললো,,
“” আপনি খুব পঁচা খুব।””
রিদের মাথাটা সড়িয়ে তিল অভিমান করে উঠে চলে যেতে নিলে তিলের হাতটা চেপে ধরে নিজের বুকে।
“” সরিরে। এই দেখ কানে ধরেছি। এবার তো ক্ষমা করে দে। দেখতো তোর লিদ ভাইয়াকে কানে ধরে কেমন হনুমানের মতো লাগছে??””
তিল রিদের হাতটা কান থেকে সরিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো,
“” আমাল লিদ ভাইয়াকে যেমন খুশি তেমন দেখাক আপনাল কি? খবলদাল যদি আলেকবাল আমাল লিদ ভাইয়াকে হনুৃমান বলছেন তো””
“” তো কি করবি শুনি তুতলি রানী!””
“” আপনি এমন অন্ধকালে শুয়ে লয়েছেন কেন? আপনাল কি হয়েছে? আমাল খুব ভয় লাগছে।””
তিলের কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা রিদ। তিলের হাতটা বুক থেকে সরিয়ে চোখের সামনে আনলো। অনামিকা আঙুলটা দেখে হালকা শুকনো হাসি নিয়ে বললো,
“” ডায়মন্ডের সাথে স্বর্নের এমন হলদে কালারটা মানাচ্ছেনা। দেখি খুলে দেতো আমায়।””
“” আপনি আমার বাবুকে আলাদা কলছেন কেন?'”
“” তোর বাবু মানে? আংটিকে তুই বাবু বানিয়ে দিলি? বেশি পড়ার চাপে তোর মাথাটা কি গেলো?””
তিল হাতের আংটিটা ঠিক করতে করতে লাজুক হয়ে বললো,
“” আপনিই তো বাবুল গন্ধ নিয়ে পলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন বাবাল কাছ থেকে যেন সন্তানকে না সলায় তাহলে এখন সলাচ্ছেন কেন? বাবাল থেকে আলাদা কলছেন দেখলে কি ও কেঁদে উঠবেনা?””
তিল নিজের কথা শেষ করে রিদের দিকে তাকাতেই বুঝলো উনি তার দিকেই চেয়ে আছে। মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে, যে চাহনিতে কোনো কামুকতা নেই,কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই,কোনো চাওয়া নেই,রয়েছে শুধু মুগ্ধতা আর প্রাপ্তি।
রিদের এমন চাহনিতে তিলের লজ্জা যেন আরো প্রখর হলো। ঠোটে হালকা হাসি ফুটে উঠেছে।
রিদ তিলের কাছ থেকে সরে এসে নিজের বালিশটাতে শুয়ে বললো,
“” অনেক রাত হয়েছে, রুমে যা। কাল তো আবার পরীক্ষা। ঠিক মতো সব পড়েছিস তো?””
তিল মনে মনে বললো আপনাকে ছাড়া কি আমার পড়ায় মন বসে রিদ ভাইয়া?
“” হুম।””
“” গুড,রেজাল্ট খারাপ হলে কিন্তু খুব বকবো।””
“” হবেনা। আপনি পলিয়েছেন তো।””
রিদ আবার কিছু বলতে যাবে কিন্তু নিজের গলাটা ভার হয়ে গেছে বুঝতে পেরে কিছু বললোনা।
তিল তখনো রিদের মাথার কাছেই বসে আছে। আমার আপনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে রিদ ভাইয়া। একটু জড়িয়ে নিবেননা? আপনি হঠাৎ এতো শান্ত হয়ে গেছেন কেন? আপনার এই শান্ত টা যে আমার ভেতরে অশান্তের সৃষ্টি করছে।
“” এখনো বসে আছিস যে?””
তিল মন খারাপ করে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে নিলেই পেছন থেকে রিদ ডেকে উঠে,
আজ যেন লজ্জারা সব পণ করেছে তিলকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা।
তিল মাটির দিকে তাকিয়ে গুটি গুটি পায়ে আবার রিদের কাছে এগিয়ে যেতেই রিদ উঠে বসে পড়ে।
তিলের গালে নিজের ডান হাতটা ছুয়িয়ে কপালে চুমু খেতে গিয়েও থেমে যায়। কিছু একটা ভেবে কপাল থেকে ঠোটগুলো সরিয়ে তিলের বা গালে চুমু একে দিলো। ঠোটের কোনের তিলটা নিজের বা হাতের বৃদ্ধা আংগুল দিয়ে হালকা করে হাত বুলিয়ে বললো,
“” বেস্ট অফ লাক!””
তিল চলে যেতেই রিদ হুহু করে কেঁদে উঠে। যেখানটাই আমি নেই সেখানটাই ছুয়ে কি হবে????
রিদ ভাইয়ার কাছ থেকে এতো এতো আদর পেয়েও কি পরীক্ষা খারাপ হতে পারে? কখনোই না। তিল লুজের পর লুস পেজ নিয়ে লিখেই যাচ্ছে। কলমের কালি শেষ তো কি হয়েছে? আরেকটা নতুন কলম দিয়ে লিখা শুরু করে।
~~
“” এখনি ঘুমাবি?””
কালকেই তার শেষ পরীক্ষা,তারপর গায়ে হলুদ অবশেষে বিয়ে। খুশিতে আজ তিলের পড়াই হচ্ছিলোনা। তবুও রিদ ভাইয়াকে সে রাগাবেনা বলে অনেক কষ্টে এতক্ষন পড়ায় মুখ গুজে রেখেছিলো। কিন্তু এভাবে কতক্ষন? তাই বই গুছিয়ে সবেই বিছানায় উঠে কাথাটা মেলছিলো। আর তখনি রিদ ভাইয়ার আগমন।
রিদের দিকে তাকিয়ে তিলের বুকটা কেঁপে উঠলো। উনাকে এতো অগোছালো লাগছে কেন? চোখের নিচটা এতো ফুলে গেছে,মনে হচ্ছে কালচে দাগ ও পড়েছে। মাথার চুলগুলোতেও অনেকদিন চিরনি চালানো হয়নি,গালে খোচা খোচা দাড়িগুলো এখন আর খোচা নেই অনেকটাই বড় হয়ে গেছে।
তিলকে অবাক করে দিয়ে রিদ ওর বুকের উপর শুয়ে খুব গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো। অস্পষ্টট সুরে বললো,
তিল মুখটা ভেংচি কেটে কানে হাত দিয়েই দাড়িয়ে রইলো। রিদ কলটা রিসিভ করে কথা শেষ না করেই তিলকে রেখে বেড়িয়ে পড়লো,
“” কোথায় যাচ্ছেন?””
তিলের কথার উত্তর দেওয়ারও যেন সময় নেই!
রিদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো তিল। তখনো কানদুটো ধরে আছে। হুট করে কে কল দিলো যে এভাবে চলে গেলো? খারাপ কিছু নাতো?? তিল পিছু পিছু আসতে চেয়েও কেন জানি আসলোনা।
পড়ায় কিছুতেই মন বসছেনা। বারবার ঘড়ির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। পড়া কমপ্লিট না হলে যদি উনি বকেন সে ভয়ে বইয়ে মুখ গুজে আছে। ঘড়ির কাটা ঘুরতে ঘুরতে ১১ টায় ঠেকলো। আম্মুর ডাকে খাবারের টেবিলে চলে গেলো তিল।
বড় আব্বুর কথা শুনে কিছুটা সস্তি পেলেও খাবারটা কেন জানি খেতে পারলোনা তিল। মনে হচ্ছে রিদ ভাইয়াকে ছাড়া এই প্রথম সে খেতে বসেছে। অথচ এতোটা বছর তো উনাকে ছাড়াই খাওয়া দাওয়া হয়েছে তাহলে আজ এমন লাগছে কেন??? এতো বেশি একা একা লাগছে কেন? ভাতের দু তিন দলা মুখে দিয়ে খাবার ছেড়ে উঠে পড়ে তিল। কিছু ভালো লাগছেনা। এক অস্থিরতা ভর করছে শরীরে। মনে হচ্ছে হঠাৎ করেই শরীরের ওজনটা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিল শোওয়ার জন্য বিছানা ঝারতে ঝারতে ঘড়ির দিকে তাকালো। ১২ টা বেজে ২৫। সিজারের আব্বু কি খুব বেশি অসুস্থ এখনো এলো না যে?? উনি কি ডাক্তার যে উনাকে ওখানেই থাকতে হবে???
তিলের মেজাজ গরম হতে লাগলো। কয়দিন আগেই তো সিজারকে মেরে বাসা থেকে বের করে দিলো এর মধ্যেই সব ঠিক হয়ে গেছে যে এখন উনাদের জন্য উনি আমাকে টেনশনে মেরে ফেলতে চাচ্ছেন??? ইশ! কিছু ভালো লাগছেনা!
তিল বিছানায় শুয়ে শুয়ে এপাশওপাশ করছে,চোখে ঘুমের কোনো দেখা নাই। বারবার মনের ভেতর খারাপ চিন্তারা উকি দিচ্ছে। এমনি এমনি তো দিচ্ছেনা। ঐদিনের ঐ খারাপ স্বপ্নটা দেখার পর থেকেই কেমন জানি খারাপ চিন্তাভাবনা মাথায় ঘুরঘুর করে। আচ্ছা উনার সাথে খারাপ কিছু ঘটবেনা তো???
তিলের শরীর ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে। বিছানা ছেড়ে ফ্যানটা ফুল স্পিডে ছেড়ে দিয়েছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলো একটা কল দিয়ে দেখবে নাকি। পরক্ষনেই মনে হলো ওর কাছে তো রিদানের নাম্বার নাই তাহলে কিভাবে কল দিবে???
সামান্য একটা নাম্বারও আমার কাছে নাই?? এতোকিছু ঘটে গেলো অথচ নাম্বারটাই নেওয়া হলোনা??? রিদ ভাইয়া ঠিকই বলে আমার মাথায় আসলেই বুদ্ধীর ছিটেফোটাও নেই। থাকলে নিশ্চয় উনার নাম্বারটা আমার ফোনে থাকতো। একটা নাম্বার যে কতটা ইম্পর্ট্যান্ট হতে পারে তিল এখন বুঝতে পারছে। নিজের ফোনটা ঢিল মেরে বিছানায় ফেলে দিলো।
অবশ্য নাম্বারের প্রয়োজন কখনো পড়েইনি তাহলে নিবে কিভাবে??? তিলের প্রয়োজন অপ্রয়োজন সবসময় তো উনাকে পাশেই পেয়েছে। ফোনে কখনো কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি। রিদও তো কখনো ওকে কল দেয়নি তাহলে নাম্বারটা আসবে কিভাবে??? আচ্ছা উনার কাছে কি আমার নাম্বার আছে???
হঠাৎ করেই তিলের মনে পড়লো রিদের সাথে তাদের কখনো ফোন প্রেম হয়নি। ইশ! কি মিসটাই না করেছে। শুনেছি ফোনে কথা বলার সময় নাকি রোমান্টিকতার ছোয়া থাকে কন্ঠে। সেটাতো তিল পেলোইনা। এই ব্যাপারটা মাথাতে কখনো আসেনি। তিলের আবার মন খারাপ হয়ে গেলো। তার রিদ ভাইয়ার সাথে সে ফোনে একটুও প্রেমালাপ করলো না! তিলের ইচ্ছে হলো এখনি যদি একটু উনার ফোন ভয়েস শুনতে পারতো!
ভাবনায় ভাবনায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৩ টা বেজে ৫। মাঝরাত! রিদ ভাইয়াতো এখনো আসলোনা। তিলের ভেতরের অস্থিরতা এখন দ্বিগুন গুনে বাড়ছে। কি করবে না করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। উনি কি একটুও বুঝতে পারছেননা আমি কতটা চিন্তায় আছি?? আমাকে একটা কল দিলে কি এমন হয়???
তিল কাথা নিয়ে শুয়ে পরে আবার। ঘুমানোর চেষ্টা করে। হয় তো ঘুম ভেংগে দেখবো উনি আমার পাশে! এমন তো প্রতিরাতেই হয়। আজ কেন হবেনা? আজকেও হবে। উনি ঠিক আমার পাশে আসবেন। এসে বলবেন, তুই পড়া শেষ করিসনি কেন? যা কানে ধরে উঠবস কর। নাহলে বিয়ে ক্যানসেল।
এতো টেনশনে কি ঘুম আসে? আর ঘুম না আসলে রিদ ভাইয়া কিভাবে আসবে??? তিল আবার বিছানা ছেড়ে আম্মু আব্বুর রুমের সামনে চলে যায়। হালকা টুকা দিতেই রহমত আলী ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে দিলেন।
“” তুই এখনো ঘুৃুমুসনি মা? কিছু হয়েছে?””
বাবার কথার উত্তর না দিয়েই টুপ করে ভেতরে ঢুকে পড়ে তিল। আব্বুর ফোনটা নিয়ে রিদের নাম্বার খুজতে থাকে।
“” কি হয়েছে,তিল?””
“” কিছুনা,আব্বু। তুমি ঘুমাও। আব্বু তোমার মোবাইলটা একটু নিতে পারি?””
তিল নিজের রুমে এসে একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে রিদের নাম্বারে। প্রথম কয়েকবার রিং বাজলেও ঐদিক থেকে কোনো রেসপন্স আসেনি। তিল পুনরায় কল করতে গিয়ে দেখে ফোন সুইচঅফ! তিলের ভয় হচ্ছে,সাথে খুব খারাপভাবে কান্না পাচ্ছে। কিন্তু সে এখন কাঁদবেনা৷ মনে হচ্ছে কাঁদলেই খারাপ কিছু ঘটবে। তিল নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে নিজের আব্বুর ফোন থেকে নাম্বারটা নিজের ফোনে টুকে নিলো।নিজের নাম্বার থেকে কল দিয়েও যখন ফোনটা অফ পেলো,তিলের হাত পা কাঁপুনি উঠে গেলো। কিছুতেই আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছেনা। বারবার শুধু কল দিয়ে যাচ্ছে।
~~
সকালে বড় আব্বুর চিৎকার শুনে লাফিয়ে উঠে তিল। কাল রাতে রিদকে কল দিতে দিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তা তার জানা নেই। কিন্তু বড় আব্বু এভাবে চিল্লাচ্ছে কেন? উনি তো সচরাচর এমন চিল্লাচিল্লি করেনা। আর বাড়ি ভর্তি মেহমান সেখানে তো প্রশ্নই উঠেনা। রিদ ভাইয়ার কিছু হয়নি তো??? তিল দৌড়ে বড় আব্বুর রুমের কাছে চলে আসে।
“” বিয়ে হবেনা মানে? তোর মাথা কি ঠিক আছে রিদ? আজ তোদের গায়ে হলুূদ। বাড়ি ভর্তি মেহমান আর বলছিস বিয়ে হবেনা???””
রিদ চিৎকার করে বাবার উদ্দশ্যে বললো,
“” বিয়ে হবেনা সেটা কখন বললাম আব্বু? আমি বলেছি এখন হবেনা। তিলের পরীক্ষার পরে হবে!””
রিদের কথায় আমির সাহেব প্রচন্ড ক্ষেপে যান।
“” তোর কাছে কি বিয়েটা ছেলেখেলা মনে হচ্ছে? তুই যখন চাইবি তখন বিয়ে হবে? তোর ইচ্ছেতেই সব? আমাদের ইচ্ছের কোনো মুল্য নেই?””
রিদ নিজের সামনে থাকা শোকেসটায় লাথি মেরে বললো,
“” হ্যা, হ্যা,হ্যা, আমার ইচ্ছেতেই সব। আমার যখন ইচ্ছে হবে তখন বিয়ে হবে। বেড়িয়ে যাও আমার রুম থেকে এখখুনি!””
রাগে আমির সাহেবের শরীর কাঁপছে। বাসা ভর্তি মেহমান। একটু পরেই গায়ে হলুদের আয়োজন শুরু হয়ে যাবে। বিয়ের কনে আর বর যেহেতু এই বাসারই সেহেতু আয়োজনটাও সেরকমই করা হচ্ছে। তার উপর এই বংশের একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা, যাকে পেয়েছেন তাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। যাদের সাথে কোনোদিন যোগায়োগ ছিলোনা তাদেরও দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬০% মেহমান অলরেডি চলে এসেছে। অনেকেই রাস্তায় আছে। গায়ে হলুদ শুরু হতে হতে চলেও আসবে। আর এখন কিনা বলছে বিয়ে হবেনা। এটা কি হাতের মুয়া যে যখন তখন চিবিয়ে খেলে ফেলবে? আমির সাহেবের ইচ্ছে হলো ছেলেকে কয়েক গা বেত দিয়ে পিটাতে। নিহাত এতো বড় হয়েছে বলে এখনো নিজেকে বশে রেখেছে। সেই ছোট্ট রিদ হলে এতক্ষনে পিঠের ছাল তুলে বিয়ে পড়িয়ে দিতো।
আমির সাহেব ছেলেকে কঠিন কথা শুনাতে গিয়ে থেমে গেলেন। তিল সামনে এসে দাড়িয়েছে। চোখের ইশারায় বুঝাতে চাচ্ছে,বড় আব্বু আপনারা রুমে যান আমি দেখছি উনার কি হয়েছে!
রিদ তখনো উল্টো হয়ে দাড়িয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। তিল ঠিক বুঝতে পারছে খুব রেগে আছে। খুব বেশিই মনে হয়। তিল গুটি গুটি পায়ে রিদের দিকে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। তাতে রিদের উপর যেন প্রভাবই পড়লোনা। তিল আদুরী গলায় বললো,
“” কি হয়েছে আপনাল? কাল বাসায় আসেননি কেন? জানেন আমার কত কষ্ট হচ্ছিলো? এতো কলে কল দিলাম ধললেনও না। আবাল এখন বলছেন বিয়ে কলবেননা। কি হয়েছে বলুননা, আমি কি কিছু ভুল কলছি? তাহলে আমাকে শাস্তি দিন!””
“” তিল,ছাড় আমাকে!””
“” না,আগে বলুন আপনাল কি হয়েছে? এমন কলছেন কেন? আল বিয়েটাই বা কেন কলবেননা?””
তিলকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তিলের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো রিদ। সাথে সাথে তিলের চোখ ভিজে এলো।
“” আমি কেন বিয়ে করবো না তোর কাছে জবাবদিহি করতে হবে? তুই কি জবাবদিহির প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছিস? করবোনা আমি বিয়ে কি করবি তুই? আমাকে পুলিশে দিবি? ফাঁসিতে ঝুলাবি??? একটু ভালোভাবে কথা বলেছি দেখে খুব সাহস বেড়ে গেছে না? এখন আবার জবাবও চাস? আর তোর না কিছুদিন পর পরীক্ষা? তুই এখানে কি করছিস? যা পড়তে যা। খবরদার যদি আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখি তাহলে তোর বই খাতা সব ছিড়েছুড়ে তোকে খায়িয়ে দিবো। পরীক্ষা রেখে বিয়ে করার জন্য লাফাচ্ছে। পা কেটে ফেলে দিবো তখন দেখবো তুই কিভাবে এতো লাফাস। এখনো যাসনি তুই? আরেকটা চড় খাবি?””
আজ অনেকদিন পর রিদকে এমন আচরন করতে দেখে তিল শকড হয়ে যায়। কাল রাতেও তো ঠিক ছিলো। হঠাৎ করে কি এমন হলো?
তিল গালে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে এলো।
~~
নিজের জেদী ছেলের কাছে হার মানতেই হলো আমির সাহেবের। লজ্জায় যেন মাথা কাটা যাচ্ছে। সবার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে বিদেয় করেছেন। নতুন করে বিয়ের কার্ড ছাপানো হচ্ছে। সব কিছু ঠিক থাকলেও শুধু বিয়ের ডেটটা চেন্জ হয়েছে ১৭ মার্চের জায়গায় ৩ মে। রিদ কেন এমন করলো কেউ জানতে পারলোনা। অনেকবার জিজ্ঞেস করেও তার দিক থেকে কোনো উত্তর আসেনি। শুধু এটাই বলেছে তিলের পরীক্ষার পরেই বিয়ে করবে।
এদিকে তিল পড়ার থেকে বেশি কান্নাতে মনোযোগ দিচ্ছে। আজ কয়েক দিন যাবত রিদের সাথে তার কোনো কথা হচ্ছেনা,শুধু কথা বলা বললে ভুল হবে সেদিনের থাপ্পড় খাওয়ার পর থেকে তার সাথে দেখাও হচ্ছেনা। রুম থেকে বের হচ্ছেনা,যা লাগে সব রুমেই দিয়ে আসা হচ্ছে। সবাই ঐ রুমে যেতে পারলেও তিলের যাওয়া মানা। খুব কঠিন করে মানা করা হয়েছে!
রিদকে ছাড়া তিলের পড়ায় মন বসেনা,ঘুম আসেনা,খাওয়ার স্বাদ আসেনা। মাঝরাতে ঘুম ভেংগে যখন রিদকে নিজের পাশে পায়না তখন হুহু করে কেঁদে উঠে। আপনি আমাকে মারেন,কাটেন,বকেন যা খুশি তাই করেন তবুও এভাবে দুরে ঠেলে রাখবেননা প্লিজ,আমি যে আপনার বিরহ নিতে পারছিনা। আপনার মতো আমারও বুকে চিনচিন করে ব্যথা হচ্ছে। এ কেমন ব্যথা রিদ ভাইয়া? আবার কোন খেলায় আপনি আমাকে নামিয়েছেন?? কোন নেশায় আমাকে ডুবিয়েছেন? আমি যে ডুবে মরে যাচ্ছি,নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কেন এমন করছেন???
রিদ মহাআশংকার হস্তিনস্তি করার জন্য উঠতে নিলেই তিল টেনে ধরে রিদের হাত। রিদ থমকে দাড়াতেই রিদকে টেনে নিজের বেডের উপর ফেলে দিলো। পেটের উপর চেপে বসে নিজের হাত থেকে স্যালাইনের সুইটা খুলে রিদের গলায় ধরে বললো,
“” বিয়ে ক্যানসেলের কথা আরেকবার মুখে আনলে এটা ঢুকিয়ে আপনার গলার কন্ঠ বন্ধ করে দিবো! খুব শক্ত মানুষি দেখানো হচ্ছে?””
তিলের খোলা চুলগুলো তিলের মুখের সামনে এসে ভিড় করছে। রাগে চোখমুখ ফুলে আছে। রিদ তিলকে এমন রুপে এই প্রথম দেখেছে তবুও তার মধ্যে ঘাবড়ানোর কোনো লক্ষন নাই। তিলকে একটা মিস্টি হাসি উপহার দিয়ে নিজের হাত দিয়ে তিলের মুখ থেকে চুলগুলো সরানোর বাহানায় বললো,
“” তুই দেখি ‘র’ বলা শিখে গেছিস,তিল। দেখি আমার নামটা বলতো!””
রিদের এমন কথায় তিল নিমিষেই পানি হয়ে গেলো। মাত্রই যেন একটা অন্য রাজ্যে সে বিরাজ করছিলো। চারপাশটা দেখে নিয়ে নিজেকে রিদের উপর আবিষ্কার করে,তাও রিদের পেটের উপর বসে আছে। হাতে সুই, রিদের দিক তাক করানো। তিলের হাত, পা কাঁপছে। খুব খারাপভাবে কাঁপছে।
“” সলি,লিদ ভাইয়া। আমি আপনাল পেটে কিভাবে আসলাম???””
তিলের ভয়ংকর রুপটা যাকে এক বিন্দু অবাক করতে পারলোনা কিন্তু এই এখনকার পাংশুটে রুপটা রিদকে বেশ অবাকই করছে। শুধু অবাক বললে ভুল হবে তাকে খুবই হতাশ করেছে।
রিদ তিলকে নিজের পেট থেকে সরিয়ে বেশ বিরক্ত নিয়েই বললো,
“” মনে হচ্ছে বিয়েটা ক্যানসেলই করতে হবে””
তিল ফ্যালফ্যাল নয়নে রিদের দিকে তাকিয়ে আছে তাতে রিদের কিছু যায় আসলোনা। যেভাবে হুট করে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই হুট করে বেড়িয়ে গেলো।
~~
খাবার টেবিলে সবাই বসে বসে রিদের অপেক্ষায় থাকলেও রিদের আসার কোনো নাম গন্ধ নাই।
“” ছেলেটার যে কি হলো,খাবারের প্রতি এত অবহেলা কেন? দিনে দিনে কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে!””
“” ঐখানেই দাড়া,এক পা এগুবি তো তোর পা কেটে রেখে দিবো। সামান্য ‘র’ বলতে পারিস না। আবার আমার জন্য ভাত নিয়ে আসছিস? আগে ‘রিদ’ বলে ডাকবি তারপর খাবো।””
“” এমন কেন কলছেন লিদ ভাইয়া? আমি কি ইচ্ছে কলে….””
তিলের দিকে রিদ তেড়ে এসে বললো,
“” হ্যা,ইচ্ছে করেই এমন করিস। নাহলে সবার সাথে সব ঠিক শুধু আমার কাছে আসলেই তোমার কন্ঠ র তে আটকে যায় না? তোর কন্ঠ ছেচে ফেলতে ইচ্ছে করছে। যা আমার সামনে থেকে বেড়িয়ে যা!””
“” লিদ ভাইয়া,প্লিজ!””
“” থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো একে তো নামটার অপমান করছে আবার সাথে ভাইয়াও ডাকা হচ্ছে। আমি কোনো বোনকে বিয়ে করবোনা। যা বিয়ে ক্যানসেল!””
তিল যেভাবে নিশ্চুপ হয়ে রিদের রুমে ঢুকেছিলো ঠিক সেভাবে বের হয়ে আসছে। কথায় কথায় বিয়ে ক্যানসেল না? আসছে আমার বিয়েওয়ালা করবো না আমি আপনাকে বিয়ে। দেখি তখন আপনি কিভাবে বিয়ে ক্যানসেল করেন। যত্তসব!
তিল ঠাস করে ভাতের প্লেটটা বড় আম্মুর সামনে রাখলো।
“” তোমার ঐ ছেলেকে বলে দিবা তিল এতো বিয়ের জন্য লাফাই না। আমার তো এখনো বিয়ের বয়সই হয়নি। যখন হবে তখন যাকে তাকে করে নিবো। তোমার ঐ বুড়ো ছেলেকে তিল বিয়ে করবেনা। এই আমিও বিয়ে ক্যানসেল করে দিলাম,হুম!””
তিলের দিকে সবাই হা করে তাকিয়ে রইলো। কি হচ্ছে তারা কিছুই বুঝতে পারছেননা। তিল মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলো।
আয়নায় দাড়িয়ে তিল বারবার রিদ রিদ বলে প্রাকটিস করে যাচ্ছে। ঠিকই তো এতো বড় দামড়ী মেয়ে হলাম অথচ সামান্য রিদটাই বলতে পারছিনা? এটা কোনো কথা??? তিল সমানে রিদ রিদ বলে চিল্লিয়ে যাচ্ছে! নিজের ফোনটাতে ভয়েস রেকর্ড করেও বারবার প্লে করে দেখছে যে রিদই শুনা যাচ্ছে,একটাবারও সে রিদের জায়গায় লিদ বলছেনা। কিন্তু উনার সামনে গেলেই কেন এমনটা হয়??
হঠাৎই রিদের মুখটা ভেসে উঠে,পুরো শরীরে রক্তমাখা, এটা তো সেই ছোট্টকালের রিদ যে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়ে স্কুলে যেতো! সাদা শার্টটাও এমন রক্তে মাখা! চোখভর্তি পানি,ছলছল চোখ নিয়ে তিলের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা হাত তিলের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু কেন জানি সেখানে নিজেকে দেখতে পারছেনা,তিল। তবে স্পষ্ট বুঝতে পারছে রিদ তিলের দিকেই হাত বাড়িয়ে দিছে তাহলে সেখানে তিল নাই কেন?? ঘুমের ঘোরেই তিল ছটফট করতে করতে নিজেকে খুজতে থাকে। তার রিদ ভাইয়ার হাতটা ধরার জন্য তো তার নিজের হাতের প্রয়োজন! কিন্তু সে নিজেকে দেখতে পারছেনা সেখানে সে হাতটা কই পাবে???
রিদের হাতটা আসতে আসতে শক্তি হারিয়ে ফেলছে। তিলকে ছোয়ার যে তীব্র ইচ্ছে ছিলো সেটা আসতে আসতে অসার হয়ে আসছে। রিদের হাতটা শুন্য থেকে মাটিতে গিয়ে ঠেকছে। রিদের চোখগুলোও বন্ধ হয়ে আসছে। ঠোটদ্বয় বিড়বিড় করে বলছে,,,
“” তুই আমাকে মেরে ফেললি,তিল??””
তিল শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে,পুরো শরীরে ঘামে নেয়ে ফেলেছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে,মনে হচ্ছে কয়জনম ধরে সে পানির ছোয়া পায়নি।
“” এতো জোরে জোরে কেউ নাক ডাকে? তোর জন্য আমার ঘুম ভেংগে গেলো।””
হঠাৎ এমন কন্ঠ শুনেই তিল বুঝতে পারলো তার পাশে আরেকজন চুপটি মেরে বসে আছে। সে আর কেউ নয় একটু আগে যাকে নিয়ে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছে সে!
তিল রিদের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে অঝোরে কাদতে থাকে। তিলের এমন কান্ডে রিদ থতমত খেয়ে গেলো।
“” তোর নাকের ডাকে ঘুৃম ভাংলো আমার আর কাদছিস তুই?””
রিদের কথায় তিল আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ইচ্ছে করছে নিজের এই মানুষটাকে নিজের বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলে যাতে কোনো বিপদের আঁচ লাগতে না পারে।
“” তুই এভাবে জড়িয়ে ধরলে তো আমার এখনি তোকে বিয়ে করে ফেলতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু আমি তো বিয়ে ক্যানসেল করে দিয়েছি,তিল! এখন কি করি বলতো!””
“”আমার খুব ভয় কলছে,একটু জলিয়ে ধলুননা প্লিজ!””
তিলের কন্ঠে এমন কিছু ছিলো যা রিদের দুষ্টুমির ভাবটা কাটিয়ে দিলো। এভাবে সে তিলকে কখনোই কথা বলতে দেখেনি। কি এমন হলো মেয়েটা আমাকে এভাবে জড়িয়ে কাদছে কেন? কোন ভয়ের কথাই বা সে বলছে???
রিদ নিজের হাতদুটো দিয়ে তিলকে আবদ্ধ করে বললো,
“” কি হয়েছে আমার বউটার?? কিসের কান্না কাদছে শুনি?””
রিদের মুখে বউ ডাকটা শুনে নিমিষেই তিলের চোখের পানি শুকিয়ে গেলো। উপরংচ লজ্জায় লাল হয়ে রিদকে ছেড়ে দিতেই রিদ আবার চেপে ধরে বললো,
“” বিয়েটা আজকেই করে ফেলি,কি বলিস? নে কবুল বল!””
একটু আগেও যে মেয়েটা ভয়ে কেঁপে উঠেছিলো সেই মেয়েটাই লজ্জায় কেঁপে উঠছে। তিলের মনে হলো এই কবুল শব্দটাতেই মিশে আছে অসংখ্য রঙের লজ্জা যেগুলো একের পর এক তিলকে রাঙিয়ে দিচ্ছে। উনি এতো নির্লজ্জ কেন? আমাকে কি লজ্জা দিয়েই মেরে ফেলবে? এতো লজ্জা দিলেতো আমি মরেও আবার জীবীত হয়ে যাবো!
“” কি হলো,কবুল বল!””
“”ইশ! আমি এমনি এমনি কবুল বলবো কেন? দেনমোহর লাগবে!””
রিদ তিলকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে ওর থুতনিতে হাত রাখে। মুখটা উচু করে বললো,
“” আমার এই তুতলি বউয়ের আবার দেনমোহরও চাই?””
“” চাই ই তো!””
“” তা কেমন দেনমোহর শুনি,লাল নাকি নীল,নাকি হলুদ দেনমোহর?””
“” জানিনা। যান তো এখান থেকে।””
“” তাহলে কবুল বলবি কাকে?””
“” যাকে খুশি তাকে!””
“” কিহ!!””
রিদকে একপ্রকার ঠেলেঠুলে পাঠিয়েই তিল আবার বিছানায় এলিয়ে পড়ে। চোখের পাতা এক করলেই বারবার রিদের সেই রক্তমাখা মুখটা ভেসে উঠছে,কানে বারংবার বেজে যাচ্ছে একটা কথাই **তুই আমাকে মেরে ফেললি,তিল??**
আমি কেন উনাকে মারতে যাবো? তিল কিছুতেই ঘুমুতে পারলোনা। সারাটা রাত ছটফটিয়েই পার করে দিলো!
বিয়ের ব্যস্ততা,পরীক্ষার পড়ার ব্যাস্ততা আর রিদের ছোটখাটো শাস্তি নিতে নিতে বিয়ের ডেট খুব কাছেই চলে এসেছে। এদিকে তিল লাল জামা পড়তে পড়তে এই কালারটার প্রতি তার তেতো চলে এসেছে। তাই বিয়ের শাড়ি সে লাল কিনবেনা,রিদের সাথে ঝগড়া করে সে নীলকালারের বেনারশী কিনে নিয়েছে। কেন জানি এখন আর রিদের রক্তবর্ন চোখ তিলকে ভয় পাওয়াতে পারেনা। হয়তো রিদ নিজেই চাইনা তিল তাকে আর ভয় পাক। এবার নাহয় একটু ভালোবাসাই দেওয়া যাক। অনেকতো হয়েছে!
বিয়ে বাড়ি মানেই ব্যস্ততা,মেহমানের আনাগোনা আর গানবাজনা তো আছেই। তার মধ্যেও টাইম করে তিলের পড়াটা আদায় করে নেওয়ার কাজ নিয়েছে রিদ। আজকেও তার অনিয়ম হয়নি। তিলের ইংলিশ খাতায় দুটো রসগোল্লা একে দিয়ে বললো,
“” যা ২০০ বার কান ধরে উঠবোস কর!””
“” কিহ! পালবোনা!””
তিল নাকমুখ কুচকিয়ে না করে দেওয়াতে রিদ যেন আরো বেশি উৎসাহ পেলো। পড়ার সময় তিলের ভুল ধরে শাস্তি দিতে তার খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় ছোটবেলার সেই তিলকে পড়াচ্ছে!
রিদ কন্ঠটা একটু শক্ত করে বললো,
“” কি বললি আবার বলতো!””
তিল মনে মনে রিদকে হাজারটা বকা দিতে দিতে কানে হাত দিলো। উঠবস ও শুরু হয়ে গেছে। রিদের বেশ হাসি পাচ্ছে কিন্তু হাসিটাকে আটকে একটু রাগ রাগ হয়েই বললো,
“” মুখটা অমন লাল বানরের মতো করে লাভ নেই। পরীক্ষায় লাড্ডু পাবি পরে আব্বু এসে আমাকে সব দোষ দিবে। তুই তো এই সুযোগ খুজেই বেড়াস,কিভাবে আব্বুর কাছে আমাকে খারাপ বানাবি তাইনা?””
“” আপনাল মাথা! কাল গায়ে হলুুদ অথচ আজকেও আমাকে পলানো হচ্ছে! আপনাল সাথে বিয়ে ক্যানসেল!হুহ!
রিদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিজের ফোনের রিংটোন বেজে উঠে।
“” দাড়া, আমি আগে কথা বলে নেই তারপর আবার শুরু করবি। তুই যে ফুটকি দেখা যাবে একবার উঠবস করে ১০ বার করেছিস বলবি!””
তিল মুখটা ভেংচি কেটে কানে হাত দিয়েই দাড়িয়ে রইলো। রিদ কলটা রিসিভ করে কথা শেষ না করেই তিলকে রেখে বেড়িয়ে পড়লো,
রিদ মহাআশংকার হস্তিনস্তি করার জন্য উঠতে নিলেই তিল টেনে ধরে রিদের হাত। রিদ থমকে দাড়াতেই রিদকে টেনে নিজের বেডের উপর ফেলে দিলো। পেটের উপর চেপে বসে নিজের হাত থেকে স্যালাইনের সুইটা খুলে রিদের গলায় ধরে বললো,
“” বিয়ে ক্যানসেলের কথা আরেকবার মুখে আনলে এটা ঢুকিয়ে আপনার গলার কন্ঠ বন্ধ করে দিবো! খুব শক্ত মানুষি দেখানো হচ্ছে?””
তিলের খোলা চুলগুলো তিলের মুখের সামনে এসে ভিড় করছে। রাগে চোখমুখ ফুলে আছে। রিদ তিলকে এমন রুপে এই প্রথম দেখেছে তবুও তার মধ্যে ঘাবড়ানোর কোনো লক্ষন নাই। তিলকে একটা মিস্টি হাসি উপহার দিয়ে নিজের হাত দিয়ে তিলের মুখ থেকে চুলগুলো সরানোর বাহানায় বললো,
“” তুই দেখি ‘র’ বলা শিখে গেছিস,তিল। দেখি আমার নামটা বলতো!””
রিদের এমন কথায় তিল নিমিষেই পানি হয়ে গেলো। মাত্রই যেন একটা অন্য রাজ্যে সে বিরাজ করছিলো। চারপাশটা দেখে নিয়ে নিজেকে রিদের উপর আবিষ্কার করে,তাও রিদের পেটের উপর বসে আছে। হাতে সুই, রিদের দিক তাক করানো। তিলের হাত, পা কাঁপছে। খুব খারাপভাবে কাঁপছে।
“” সলি,লিদ ভাইয়া। আমি আপনাল পেটে কিভাবে আসলাম???””
তিলের ভয়ংকর রুপটা যাকে এক বিন্দু অবাক করতে পারলোনা কিন্তু এই এখনকার পাংশুটে রুপটা রিদকে বেশ অবাকই করছে। শুধু অবাক বললে ভুল হবে তাকে খুবই হতাশ করেছে।
রিদ তিলকে নিজের পেট থেকে সরিয়ে বেশ বিরক্ত নিয়েই বললো,
“” মনে হচ্ছে বিয়েটা ক্যানসেলই করতে হবে””
তিল ফ্যালফ্যাল নয়নে রিদের দিকে তাকিয়ে আছে তাতে রিদের কিছু যায় আসলোনা। যেভাবে হুট করে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই হুট করে বেড়িয়ে গেলো।
~~
খাবার টেবিলে সবাই বসে বসে রিদের অপেক্ষায় থাকলেও রিদের আসার কোনো নাম গন্ধ নাই।
“” ছেলেটার যে কি হলো,খাবারের প্রতি এত অবহেলা কেন? দিনে দিনে কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে!””
“” ঐখানেই দাড়া,এক পা এগুবি তো তোর পা কেটে রেখে দিবো। সামান্য ‘র’ বলতে পারিস না। আবার আমার জন্য ভাত নিয়ে আসছিস? আগে ‘রিদ’ বলে ডাকবি তারপর খাবো।””
“” এমন কেন কলছেন লিদ ভাইয়া? আমি কি ইচ্ছে কলে….””
তিলের দিকে রিদ তেড়ে এসে বললো,
“” হ্যা,ইচ্ছে করেই এমন করিস। নাহলে সবার সাথে সব ঠিক শুধু আমার কাছে আসলেই তোমার কন্ঠ র তে আটকে যায় না? তোর কন্ঠ ছেচে ফেলতে ইচ্ছে করছে। যা আমার সামনে থেকে বেড়িয়ে যা!””
“” লিদ ভাইয়া,প্লিজ!””
“” থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো একে তো নামটার অপমান করছে আবার সাথে ভাইয়াও ডাকা হচ্ছে। আমি কোনো বোনকে বিয়ে করবোনা। যা বিয়ে ক্যানসেল!””
তিল যেভাবে নিশ্চুপ হয়ে রিদের রুমে ঢুকেছিলো ঠিক সেভাবে বের হয়ে আসছে। কথায় কথায় বিয়ে ক্যানসেল না? আসছে আমার বিয়েওয়ালা করবো না আমি আপনাকে বিয়ে। দেখি তখন আপনি কিভাবে বিয়ে ক্যানসেল করেন। যত্তসব!
তিল ঠাস করে ভাতের প্লেটটা বড় আম্মুর সামনে রাখলো।
“” তোমার ঐ ছেলেকে বলে দিবা তিল এতো বিয়ের জন্য লাফাই না। আমার তো এখনো বিয়ের বয়সই হয়নি। যখন হবে তখন যাকে তাকে করে নিবো। তোমার ঐ বুড়ো ছেলেকে তিল বিয়ে করবেনা। এই আমিও বিয়ে ক্যানসেল করে দিলাম,হুম!””
তিলের দিকে সবাই হা করে তাকিয়ে রইলো। কি হচ্ছে তারা কিছুই বুঝতে পারছেননা। তিল মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলো।
আয়নায় দাড়িয়ে তিল বারবার রিদ রিদ বলে প্রাকটিস করে যাচ্ছে। ঠিকই তো এতো বড় দামড়ী মেয়ে হলাম অথচ সামান্য রিদটাই বলতে পারছিনা? এটা কোনো কথা??? তিল সমানে রিদ রিদ বলে চিল্লিয়ে যাচ্ছে! নিজের ফোনটাতে ভয়েস রেকর্ড করেও বারবার প্লে করে দেখছে যে রিদই শুনা যাচ্ছে,একটাবারও সে রিদের জায়গায় লিদ বলছেনা। কিন্তু উনার সামনে গেলেই কেন এমনটা হয়??
হঠাৎই রিদের মুখটা ভেসে উঠে,পুরো শরীরে রক্তমাখা, এটা তো সেই ছোট্টকালের রিদ যে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়ে স্কুলে যেতো! সাদা শার্টটাও এমন রক্তে মাখা! চোখভর্তি পানি,ছলছল চোখ নিয়ে তিলের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা হাত তিলের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু কেন জানি সেখানে নিজেকে দেখতে পারছেনা,তিল। তবে স্পষ্ট বুঝতে পারছে রিদ তিলের দিকেই হাত বাড়িয়ে দিছে তাহলে সেখানে তিল নাই কেন?? ঘুমের ঘোরেই তিল ছটফট করতে করতে নিজেকে খুজতে থাকে। তার রিদ ভাইয়ার হাতটা ধরার জন্য তো তার নিজের হাতের প্রয়োজন! কিন্তু সে নিজেকে দেখতে পারছেনা সেখানে সে হাতটা কই পাবে???
রিদের হাতটা আসতে আসতে শক্তি হারিয়ে ফেলছে। তিলকে ছোয়ার যে তীব্র ইচ্ছে ছিলো সেটা আসতে আসতে অসার হয়ে আসছে। রিদের হাতটা শুন্য থেকে মাটিতে গিয়ে ঠেকছে। রিদের চোখগুলোও বন্ধ হয়ে আসছে। ঠোটদ্বয় বিড়বিড় করে বলছে,,,
“” তুই আমাকে মেরে ফেললি,তিল??””
তিল শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে,পুরো শরীরে ঘামে নেয়ে ফেলেছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে,মনে হচ্ছে কয়জনম ধরে সে পানির ছোয়া পায়নি।
“” এতো জোরে জোরে কেউ নাক ডাকে? তোর জন্য আমার ঘুম ভেংগে গেলো।””
হঠাৎ এমন কন্ঠ শুনেই তিল বুঝতে পারলো তার পাশে আরেকজন চুপটি মেরে বসে আছে। সে আর কেউ নয় একটু আগে যাকে নিয়ে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছে সে!
তিল রিদের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে অঝোরে কাদতে থাকে। তিলের এমন কান্ডে রিদ থতমত খেয়ে গেলো।
“” তোর নাকের ডাকে ঘুৃম ভাংলো আমার আর কাদছিস তুই?””
রিদের কথায় তিল আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ইচ্ছে করছে নিজের এই মানুষটাকে নিজের বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলে যাতে কোনো বিপদের আঁচ লাগতে না পারে।
“” তুই এভাবে জড়িয়ে ধরলে তো আমার এখনি তোকে বিয়ে করে ফেলতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু আমি তো বিয়ে ক্যানসেল করে দিয়েছি,তিল! এখন কি করি বলতো!””
“”আমার খুব ভয় কলছে,একটু জলিয়ে ধলুননা প্লিজ!””
তিলের কন্ঠে এমন কিছু ছিলো যা রিদের দুষ্টুমির ভাবটা কাটিয়ে দিলো। এভাবে সে তিলকে কখনোই কথা বলতে দেখেনি। কি এমন হলো মেয়েটা আমাকে এভাবে জড়িয়ে কাদছে কেন? কোন ভয়ের কথাই বা সে বলছে???
রিদ নিজের হাতদুটো দিয়ে তিলকে আবদ্ধ করে বললো,
“” কি হয়েছে আমার বউটার?? কিসের কান্না কাদছে শুনি?””
রিদের মুখে বউ ডাকটা শুনে নিমিষেই তিলের চোখের পানি শুকিয়ে গেলো। উপরংচ লজ্জায় লাল হয়ে রিদকে ছেড়ে দিতেই রিদ আবার চেপে ধরে বললো,
“” বিয়েটা আজকেই করে ফেলি,কি বলিস? নে কবুল বল!””
একটু আগেও যে মেয়েটা ভয়ে কেঁপে উঠেছিলো সেই মেয়েটাই লজ্জায় কেঁপে উঠছে। তিলের মনে হলো এই কবুল শব্দটাতেই মিশে আছে অসংখ্য রঙের লজ্জা যেগুলো একের পর এক তিলকে রাঙিয়ে দিচ্ছে। উনি এতো নির্লজ্জ কেন? আমাকে কি লজ্জা দিয়েই মেরে ফেলবে? এতো লজ্জা দিলেতো আমি মরেও আবার জীবীত হয়ে যাবো!
“” কি হলো,কবুল বল!””
“”ইশ! আমি এমনি এমনি কবুল বলবো কেন? দেনমোহর লাগবে!””
রিদ তিলকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে ওর থুতনিতে হাত রাখে। মুখটা উচু করে বললো,
“” আমার এই তুতলি বউয়ের আবার দেনমোহরও চাই?””
“” চাই ই তো!””
“” তা কেমন দেনমোহর শুনি,লাল নাকি নীল,নাকি হলুদ দেনমোহর?””
“” জানিনা। যান তো এখান থেকে।””
“” তাহলে কবুল বলবি কাকে?””
“” যাকে খুশি তাকে!””
“” কিহ!!””
রিদকে একপ্রকার ঠেলেঠুলে পাঠিয়েই তিল আবার বিছানায় এলিয়ে পড়ে। চোখের পাতা এক করলেই বারবার রিদের সেই রক্তমাখা মুখটা ভেসে উঠছে,কানে বারংবার বেজে যাচ্ছে একটা কথাই **তুই আমাকে মেরে ফেললি,তিল??**
আমি কেন উনাকে মারতে যাবো? তিল কিছুতেই ঘুমুতে পারলোনা। সারাটা রাত ছটফটিয়েই পার করে দিলো!
বিয়ের ব্যস্ততা,পরীক্ষার পড়ার ব্যাস্ততা আর রিদের ছোটখাটো শাস্তি নিতে নিতে বিয়ের ডেট খুব কাছেই চলে এসেছে। এদিকে তিল লাল জামা পড়তে পড়তে এই কালারটার প্রতি তার তেতো চলে এসেছে। তাই বিয়ের শাড়ি সে লাল কিনবেনা,রিদের সাথে ঝগড়া করে সে নীলকালারের বেনারশী কিনে নিয়েছে। কেন জানি এখন আর রিদের রক্তবর্ন চোখ তিলকে ভয় পাওয়াতে পারেনা। হয়তো রিদ নিজেই চাইনা তিল তাকে আর ভয় পাক। এবার নাহয় একটু ভালোবাসাই দেওয়া যাক। অনেকতো হয়েছে!
বিয়ে বাড়ি মানেই ব্যস্ততা,মেহমানের আনাগোনা আর গানবাজনা তো আছেই। তার মধ্যেও টাইম করে তিলের পড়াটা আদায় করে নেওয়ার কাজ নিয়েছে রিদ। আজকেও তার অনিয়ম হয়নি। তিলের ইংলিশ খাতায় দুটো রসগোল্লা একে দিয়ে বললো,
“” যা ২০০ বার কান ধরে উঠবোস কর!””
“” কিহ! পালবোনা!””
তিল নাকমুখ কুচকিয়ে না করে দেওয়াতে রিদ যেন আরো বেশি উৎসাহ পেলো। পড়ার সময় তিলের ভুল ধরে শাস্তি দিতে তার খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় ছোটবেলার সেই তিলকে পড়াচ্ছে!
রিদ কন্ঠটা একটু শক্ত করে বললো,
“” কি বললি আবার বলতো!””
তিল মনে মনে রিদকে হাজারটা বকা দিতে দিতে কানে হাত দিলো। উঠবস ও শুরু হয়ে গেছে। রিদের বেশ হাসি পাচ্ছে কিন্তু হাসিটাকে আটকে একটু রাগ রাগ হয়েই বললো,
“” মুখটা অমন লাল বানরের মতো করে লাভ নেই। পরীক্ষায় লাড্ডু পাবি পরে আব্বু এসে আমাকে সব দোষ দিবে। তুই তো এই সুযোগ খুজেই বেড়াস,কিভাবে আব্বুর কাছে আমাকে খারাপ বানাবি তাইনা?””
“” আপনাল মাথা! কাল গায়ে হলুুদ অথচ আজকেও আমাকে পলানো হচ্ছে! আপনাল সাথে বিয়ে ক্যানসেল!হুহ!
রিদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিজের ফোনের রিংটোন বেজে উঠে।
“” দাড়া, আমি আগে কথা বলে নেই তারপর আবার শুরু করবি। তুই যে ফুটকি দেখা যাবে একবার উঠবস করে ১০ বার করেছিস বলবি!””
তিল মুখটা ভেংচি কেটে কানে হাত দিয়েই দাড়িয়ে রইলো। রিদ কলটা রিসিভ করে কথা শেষ না করেই তিলকে রেখে বেড়িয়ে পড়লো,
তিলের কথার উত্তর না দিয়েই ওর চোখটা বেধে ফেললো রিদ। তাও ওরি লাল ওড়না দিয়ে।
“” আলে, কি কলছেন? আমাল দম বন্ধ হয়ে আসছে।””
“” চোখ বাদলে দম বন্ধ হয়? আমি কি তোর গলা চেপে ধরে আছি?””
বলতে বলতে তিলকে কোলে তুলে নিলো রিদ। পায়ে পায়ে কদম ফেলে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে।
“” আমাকে কোলে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? আমি কি আবাল কিছু ভুল কলছি? আপনি কি ছাদে উঠছেন? আমাকে ছাদ থেকে ফেলবেননা প্লিজ,লিদ ভাইয়া! এতো উপল থেকে পললে আমাল ভয় লাগবে।””
“” এই জন্যই তো চোখ বেধে নিয়েছি। কতটা উপর থেকে পড়বি,তুই দেখতেও পারবিনা।””
রিদ তিলের দিকে তাকিয়ে শুধু মুচকি মুচকি হেসেই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তিলের অমন ভয়কাতুরে চেহারাটা দেখার জন্য হলেও সে অমন ভয়ংকর কাজগুলো করতে পারে। তিলের স্বাভাবিক চেহারার চেয়ে এমন ভয়কাতুরে চেহারাটা তাকে খুব বেশি টানে,খুব বেশি ভালোবাসতে বলে। কিন্তু ভালোবাসলে যে এই চেহারাটা নিমিষেই হাওয়াই মিলিয়ে যাবে,তিল যে তার ভালোবাসার চাওয়াতেই আটকে আছে। আর যার যেটা চাওয়া সেটা দিয়ে দিলে তো চাওয়া শেষ হয়ে যাবে। রিদ কখনোই চাইনা তিলের তার কাছ থেকে চাওয়া শেষ করে ফেলুক। তাই তো ভালোবাসা দেওয়ার জন্য আসলেও দিতে হয় ভয়ংকর কোনো কিছু। এই যে এতোটা জোর করে আমার কলারটা চেপে ধরে আছে কেন ধরেছে? ভালোবাসছি তাই নাকি ভয় দেখাচ্ছি তাই? এই যে ভয়ে নাকটা লাল হয়ে আসছে ভালোবাসলে কি এমন লাল হতো কখনোই না,ওই লালের থেকে এই লালের গভীরতা বেশি। এই যে ভয়ে কপালটায় ভাজ বসিয়ে নিয়েছে,ভালোবাসলে কি এখানে ভাজ পড়তো? পড়লেও এতোগুলো কখনোই পড়তোনা। এই ভাজের গভীরতাও বেশি,যেটা কেবল একজন ভয়ংকর ভালোবাসার মানুষগুলোই বুঝবে।
তিলের অমন ভয়কাতুরে চেহারায় ডুবতেই রিদ ছাদে চলে এসেছে। তিলকে কোলে নিয়েই ছাদের একপাশে ছোট্ট করে চিলেকোঠার খুপড়িটার কাছে এগিয়ে গেলো। নিজের কাধ দিয়ে দরজাটা মেলে নিয়ে তিলকে মেঝেতে বসিয়ে দিয়ে চোখের ওড়নায় হাত দিয়েছে।
“” আগেই তাকাসনা,তিল! তাহলে কিন্তু তুই বেশি ভয় পাবি তখন আবার আমার দোষ দিতে পারবিনা।””
তিলের চোখ থেকে ওড়ানাটা সরতেই তিল ঝট করে চোখ মেলে ফেলে। ভয়ে রিদের ছোট উপদেশটাও ভুলে গিয়েছে। আর সাথে সাথে চিল্লিয়ে উঠে,
“” বলেছিলাম তো তাকাসনা,তাও তাকালি কেন? এখন আমার দোষ?? আর তোর কি মনে হয় তোকে না মেরেই আমি দোযখে ফেলে দিবো?? দোযখে যাওয়া এতো সহজ?? তার জন্য কত পাপ করতে হয় জানিস? আজ কি কিছু পাপ করবি??””
এতো অন্ধকারে রিদের কন্ঠটাকেও তিলের কাছে ভুতুরে লাগছে। কেমন কাঁপা কাঁপা লাগছে। আচ্ছা এমন নয় তো রিদ ভাইয়ার ভেতরে কালাভুতরা জায়গা করে নিয়েছে? তিলের ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। শেষমেষ কিনা তার রিদ ভাইয়াটাও কালা ভুতের স্বীকার হলো? ইশশশ! আমার অতো সুন্দর রিদ ভাইয়া! কালা ভুত প্রবেশ করার ফলে উনিও কি দেখতে কালা ভুতের মতো কালো হয়ে গিয়েছে? তিলের ইচ্ছে হলো নিজেই একটা এনার্জি বাল্ব হয়ে রিদের মাঝে আলো ছড়িয়ে দিতে আর সে আলোয় জ্বলজ্বল করা তার কালো হয়ে যাওয়া রিদ ভাইয়াকে দেখতে।
রিদ তিলের দিকে একটু ঘেষে আসলো। তিলের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেই তিল আবার চিৎকার করে উঠে। কিন্তু এবার মন ভরে চিৎকার করতে পারেনি তার আগেই রিদ বলে উঠলো,
“” উফ! আমার কানটাকে একটু বাঁচতে দেনা,তিল। এতো চিল্লাসনা তো। আমার খুব মাথা ব্যথা করছে,আমার চুলগুলো টেনে দেতো। যদি একটু শান্তি পাই!””
রিদ কথার তালে তালে তিলের হাতগুলো নিজের চুলের উপরও এনে দিয়েছে। তিলকে আর কষ্ট করে অন্ধকারে কালা রিদ ভাইয়ের কালা চুল খুজতে হয়নি।
“” কি হলো,চুল টেনে দিচ্ছিস না কেন? তুই কি চাচ্ছিস আমি তোর চুল টেনে ছিড়ে ফেলি?””
নিজের চুলের কথা উঠতেই তিল সাথে সাথে রিদের চুলগুলো আলতো করে টেনে দিচ্ছে। সে আর যাই সহ্য করুকনা কেন,চুল টানা সহ্য করতে পারেনা। অন্যের চুলটানা দেখলেও নিজের মাথা ব্যথা উঠে যায়।
“” তোহ! চিল্লানিরানী,এমন অন্ধকারে আমার চুল টেনে আপনার কেমন অনুভূতি হচ্ছে? আপনি চাইলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন।””
এতোরাতে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে এমন অন্ধকারে নিয়ে এসে ফেলেছেন তাও কিনা নিজের চুল টেনে দেওয়ার জন্য? আপনি জানেননা আমি অন্ধকারকে কত ভয় পাই তাও কেন করলেন এমন? আপনি বললে আমি আপনার রুমে গিয়ে নাহয় সারারাত চুল টেনে দিতাম,একরাত নাহয় নির্ঘুমে কাটাতাম! আপনার জন্য আমি শতশত রাত নির্ঘুমে কাটাতে পারি তা কি আপনি জানেননা? শুধু শুধু কেন আমার সামনে এমন ভয়ংকর সিচুয়েশন সৃষ্টি করেন? তিলের ইচ্ছে হলো রিদের সবচুল ছিড়ে ফালা ফালা করে দিতে। তারপর একটা আয়না সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলতে,
“” দেখেন তো,এমন টাকরুপে আপনাকে কেমন লাগছে? আপনি চাইলে আপনার অনুভূতি আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন!””
“” কিরে,তোরে কি বোবায় ধরেছে? এমন বুবি হয়ে গেলি কেন?””
“” বুবি মানে?””
“” লিঙ্গান্তর করলাম আরকি,এটাও বুঝিস না? তুই তো বাংলা ব্যাকরনে ফেল করবি। তোর স্যারকে বলে দিস,কত বড় লাড্ডু দিতে হবে সেটা যেন আমাকে জিজ্ঞেস করে। উনি হয়তো পরিমানটা বুঝতে পারবেননা।””
রিদের কথার পিঠে তিলের একটা কঠিন কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু এমন ভয়ংকর অন্ধকারে নিজের কন্ঠটাকেও ভয়ংকর লাগছে।
রিদ হঠাৎই ডানপাশে কাত হয়ে তিলের পেটে নাকটা ছুয়ে নিলো। তিলের কোলে শুয়া অবস্থায় নিজের একটা হাত দিয়ে তিলকে পেছন থেকে জড়িয়ে একটু নিজের দিকে টেনে নিলো। যাতে নাকের ছোয়াটা আরেকটু ঘন হয়।
রিদের এমন কান্ডে তিল অবাক হলেও তা বেশিক্ষন স্থায়ী হলোনা। অনুভূতিরা জানিয়ে দিলো তার সুড়সুড়ি লাগছে। নিজেকে হালকা সড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টার তালে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে তিল।
তাতে রিদের হাত আরো গাঢ় হয়ে আসে,আরো গাঢ়ভাবে জড়িয়ে নিয়ে নাকের ছোয়াটাও গাঢ় করে বললো,
“” আমার বাবুর গন্ধটা কি মিস্টিরে,তিল। ইচ্ছে করছে একটু চেটে খেয়ে দেখি। কিন্তু গন্ধটা মেয়ে বাবু নাকি ছেলে বাবু বুঝতে পারছিনা। তোর হাসিটা আমার মনোযোগকে ক্ষুন্ন করছে। তুই কি একটু থামবি? ভালো করে না শুকলে আমি বুঝবো কিভাবে আমার মা হবে নাকি বাবা?””
রিদের কথার আগামাথা তিল কিছুই বুঝলোনা। তবুও নিজের হাসিটা থামিয়ে দিয়েছে। তবে সেটা রিদের কথায় নয়,রিদ কি সব অদ্ভুত কথা বলছে তার মানে খুজার জন্য। চিন্তায় ডুবে গেলো।
“” দেখি তোর হাতটা দেতো।””
“” কেন?””
“” কেটে নিয়ে গবেষনা করবো। তোর এমন সরু সরু আর লম্বা হাত কেন হলো তাই। তারপর তার বিপরীতে ঔষুধ বানাবো যাতে সেটা খেলে আর কারো তোর মতো কুৎসিত হাত কারো না হয়!””
“” আপনি কি ডক্টর যে ঔষুধ বানাবেন?””
“” তোকে কে বললো ডক্টটরা ঔষধ বানায়?””
“” তাহলে?””
“” আমি। কই হাত কই? তোর কালা ভুতরা খেয়ে ফেলেছে নাকি?””
তিল অন্ধকারেই রিদের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলো। অন্ধকারেও তিলের হাতে এনগেজমেন্টে পড়ানো হীরের আংটিটা জ্বলজ্বল করছে। তার সাথেই রিদ একটা সোনার আংটি পড়িয়ে দিতে দিতে বললো,
“” এটা হলো আমার বাবুর শরীরের গন্ধ সুকে দেওয়ার জন্য বুঝলি? মানুষতো বাবুর মুখ দেখে সোনা দেই আমি নাহয় গন্ধ শুকে দিলাম। আমরা বাবা আর সন্তান সবসময় একসাথে গেথে থাকবো তোর মাঝে। আমাদেরকে একসাথে থাকার সুযোগ দিবিতো,তিল? কখনো আমাদের আলাদা করবিনা,সবসময় তোর মাঝে গেথে রাখবি। কথা দে আমাকে! এই অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে আমার চুল ছুয়ে, আমার নিশ্বাস ছুয়ে প্রমিস কর!””
রিদের এমন কঠিন ভাষায় তিল কখনোই পড়েনি। এমন কঠিনভাবে কেউ প্রমিস করিয়ে নেয় তিল কখনো দেখেনি। হয়তো তার রিদ ভাইয়ার দ্বারা এসব সম্ভব। তবুও তিল এতোটুকু বুঝলো তার রিদ ভাইয়ার এই কঠিন কথার মাঝে রয়েছে অফুরন্ত ভালোবাসা যার কানাকড়িও তিল অন্য ভালোবাসার মানুষদের মধ্যে দেখেনি। কি বুঝলো না বুঝলো না জেনেই তিলের চোখ ভিজে এলো। সেই ভেজা ভেজা চোখেই বললো,
“” আমি আপনাল জন্য হাজালটা অন্ধকাল লাত দিয়ে নিজেকে সাজাতে পালবো,লিদ ভাইয়া। আপনি আমাকে কথা দিন আমাল সেই সাজ দেখার জন্য এভাবেই আমাকে ছুয়ে থাকবেন! সবসময়!””
“” আমাকে একটু পানি খাওয়াবি? খুব তৃষ্ণা পাচ্ছে,মাথাটা কেমন ঝিম ধরে আসছে, নিশ্বাসটাও কেমন ভাড়ী হয়ে আসছে। তিল,আই নিড অক্সিজেন।
দরজাটা মেলে দে!””
রিদ এমন কাকুতি কন্ঠে তিলের আবার কাপুনি উঠে গেলো। রিদ ভাইয়ার হঠাৎ করে কি হলো? হঠাৎই বুঝতে পারলো, যে গরম হাত দিয়ে তিলকে জড়িয়ে নিয়েছিলো সেটা ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আসছে। নিজের সব থেকে দুর্বল সমস্যাটাকে আজ নিজের শত্রু মনে হচ্ছে। এমন হাজারও মেয়ে আছে যারা অন্ধকারকে ভয় পায়না তাহলে সে কেন তাদের একজন হলোনা??? এই যে রিদ ভাইয়ার এতো কষ্ট হচ্ছে আমি কি কিছু করতে পারবো? আমার তো উনার ছোয়া থেকে নড়তেই ভয় লাগছে তাহলে আমি কিভাবে দরজাটা মেলবো? আর পানিই বা কিভাবে আনবো???
“” ঠিক মতো না খেলেতো এমন হবেই? আসছে পর থেকে দেখছি যত অবহেলা সব খাবারের উপর। একটা দিনও ঠিকমতো পাতের ভাতগুলো খেয়ে উঠেনি। কেন এমন করিস বলতো? আমার রান্নায় কি তুই সেই আগের মতো স্বাদ পাসনা,বাবা? ছোটবেলায় তোর খাওয়া দেখে কত মানুষ কত কথা বলতো জানিস? তোর পেটে নাকি হাঁসের বাচ্চা ছিলো তাই অমন গাবুসগুবুস করে খেয়ে যেতি।””
~~
রিদ চোখমেলে চারপাশে চোখ বুলালো। সবার উপর দিয়েই যে মোটামুটি ঝড় বয়ে গেছে তাদের চেহারাতে তা স্পষ্ট। একটু নড়াচড়া করতেই বুঝতে পারলো সে হসপিটালে।
“” একটু বেহুশ হয়েছি বলে আমাকে হসপিটালে ভর্তি করে দিলে? চোখে ঠান্ডা পানির ছোয়া দিলেই তো হতো,মা। আর কে বললো তোমার রান্নার স্বাদ পাল্টে গেছে?? আমি যেখানে থাকতাম ওখানের সবাই এমনি খাবার খাই। বাংলাদেশের মতো তো খেয়ে খেয়ে ভুড়ি টানার সময় তাদের নেই। সবাই পরিমান মতো খায়!””
“” তোর পরিমানে আমি ছাই ফেলি। আসছে আমার পরিমান দেখাতে! শুধু বাসায় যেয়ে নে না। তোকে প্রত্যেকদিন যদি দুকেজি চালের ভাত না খায়িছি তো আমিও তোর মা না। হুহ!””
“” তিল,কই আম্মু? ওকে দেখতে পাচ্ছি না যে?””
“” দেখবি কিভাবে ওতো অন্য কেবিনে আছে। ডাক্তার দেখছে ওকে!””
রিদ শোয়া থেকে উঠে পড়লো। শুধু উঠেই ক্ষান্ত হয়নি রীতিমতো নিজের বেড ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে স্যালাইনের সুইটা খুলতে শুরু করলো,
“” কি হয়েছে ওর? ডক্টর কেন দেখবে ওকে?””
“” আরে তুই কি করছিস? তেমন কিছু হয়নি,তুই দুর্বলতায় বেহুশ হলি আর তিল ভয়ে বেহুশ হলো!””
রিদ স্যালাইনটা খুলেই তিলকে খুজতে চলে গেলো। এতক্ষনে তিলেরও জ্ঞান ফিরেছে। ওর কেবিনে ডাক্টারকে না পেলেও নার্সদের পাওয়া গেলো। তাদের কে বের করে দিয়ে তিলকে টেনে শুয়া থেকে বসিয়ে দিলো,রিদ।
তিলের গলা চেপে ধরে বললো,
“” আমাকে হসপিটালে ভর্তি করে দিয়ে নিজেও ভর্তি হয়ে বসে আছিস? সামান্য অন্ধকারকে তুই মেনেজ করতে পারলিনা? তোর হার্ট এতো দুর্বল? এতো দুর্বল হার্টওয়ালা মেয়েকে আমি কখনোই বিয়ে করবোনা। বিয়ে ক্যানসেল!””
রিদের কথাই তিল হা করে তাকিয়ে রইলো। হসপিটালে ভর্তি হলাম বলে বিয়ে ক্যানসেল হয়ে যাবে? এটা আবার কেমন বিয়ে যে বিয়েতে হসপিটালে ভর্তি হলে বিয়ে ক্যানসেল হয়ে যায়? আর আমি কি ইচ্ছে করে ভর্তি হয়েছি উনি যদি আমাকে অন্ধকারে না নিয়ে যেতো,উনি নিজে বেহুশ না হতো তাহলে তো এমন হতোনা। এখন সব দোষ আমার?
ধর, তোর আর আমার যখন বিয়ে হবে। বাসররাতে তুই আর আমি তখন তো আর কেউ থাকবেনা। লাইটের আলোও থাকবেনা তাইনা? আমি তো আর তোর জন্য লাইটের আলো জ্বালিয়ে রেখে পাপ কাজ করতে পারবোনা। ইসলামে তো ঢেকেঢুকেই করতে হবে বলা হয়েছে! এখন ঢাকতে না পারলেও লাইটটা তো নিভাতে পারবো। আর ঠিক কঠিন সময়ে আমি বেহুশ হয়ে গেলাম।
“” কঠিন সময় মানে? আর আপনি বেহুশ হবেন কেন?””
“” বেহুশ হবোনা কেন? সারাদিন বিয়ের ঝামালায় তো আমার অনাহারেই থাকতে হবে। সেই অনাহারেই যদি কঠিন কাজ করতে যায় তাহলে তো বেহুশ হতেই পারি তাইনা? এখন তুই যদি অন্ধকার দেখে আমার পাশেই বেহুশ হয়ে পড়ে থাকিস তাহলে আমাদের হুশ ফিরাবে কে? আর হসপিটালে আনবে কে? যেহুতো ওটা বাসর রাত কেউ তো দেখতেও আসবেনা যে আমরা বেহুশ হয়েছে নাকি! তখন তো দুজনেই বেহুশে বেহুশে পরকাল চলে যাবো। তাহলে ভাব এতোকিছু জেনেও আমি তোর মতো দুর্বল মেয়েকে বিয়ে করতে পারি? আমার তো একটা শক্তিশালী বউ লাগবে যে কিনা আমার পাশে বেহুশ হয়ে পড়বেনা। সো বিয়ে ক্যানসেল! আমি এখনি সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি!””
রিদ মহাআশংকার হস্তিনস্তি করার জন্য উঠতে নিলেই তিল টেনে ধরে রিদের হাত। রিদ থমকে দাড়াতেই রিদকে টেনে নিজের বেডের উপর ফেলে দিলো। পেটের উপর চেপে বসে নিজের হাত থেকে স্যালাইনের সুইটা খুলে রিদের গলায় ধরে বললো,
“” বিয়ে ক্যানসেলের কথা আরেকবার মুখে আনলে এটা ঢুকিয়ে আপনার গলার কন্ঠ বন্ধ করে দিবো! খুব শক্ত মানুষি দেখানো হচ্ছে?””