দেশের মানুষ, দেশের রাস্তাঘাট, দেশের যানজট সবকিছুই অসাধারন লাগছে রোদের কাছে। রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেও যেন খুঁজে পাচ্ছে আপার আনন্দ।
রিকশায় রোদের পাশে বসে থাকা অতন্দ্রিলাও আনন্দ পাচ্ছে। তবে তার আনন্দের কারনটা একটু হয়তো ভিন্ন।
রোদ অন্যরকম গলায় বলল, “একটা ভাবের কথা শুনবে?”
অতন্দ্রিলা ক্ষীণ গলায় বলল, “নাহ্!”
“না কেন?”
“আমি ভাবের কথা পছন্দ করি না।”
“আমারটা শুনে দেখো, পছন্দ হতেও পারে।”
অতন্দ্রিলা অসহায় গলায় বলল, “বলো।”
“সময় এবং পরিস্থিতি মানুষকে ভালোবাসতে বাধ্য করে।”
“তুমি কাকে ভালোবাসতে বাধ্য হয়েছো? আমাকে?”
“এমন কেন মনে হলো তোমার? আমি কি অন্য কারো প্রেমে পরতে পারি না?”
“না। তোমার ভাবভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে না।”
রোদ চুপ করে বসে রইল।
অতন্দ্রিলা বলল, “ভালো কথা! তোমাকে একটা জিনিস দেওয়ার আছে।”
“কি?”
অতন্দ্রিলা হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটা খাম বের করে রোদের হাতে ধরিয়ে দিল।
রোদ কৌতুহলী হয়ে বলল, “কী এটা?”
“তোমার ফ্লাইটের টিকিট। আগামী মাসে তুমি লন্ডনে ফিরে যাচ্ছ না? সেটার টিকিট এসেছে আজ সকালে।”
“তো এটা হ্যান্ডব্যাগে নিয়ে ঘুরছো কেন?”
“এটা হাতে পাওয়ার পর, এই পরিস্থিতিতে তুমি কি করবে সেটা দেখার জন্যে।”
রোদ খাম থেকে টিকিটটা বের করে কুটিকুটি করে ছিড়ে ফেলল। অতন্দ্রিলা চমকে গেল, বেশ চমকে গেল। কিন্তু চমকে উঠে এক ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে সামলে নেওয়া অতন্দ্রিলার পুরনো অভ্যেস। এবারো তাই করলো। “এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
রোদ গম্ভীর গলায় বলল, “দেখলে কি করলাম?”
অতন্দ্রিলা অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ।”
“অবাক হলে না?”
“না।”
“কেন?”
“কারন আমি জানতাম তুমি এমন কিছুই করবে।”
“জানতে?”
“হুঁ! আমার ধারনা প্রকৃতির সঙ্গে আমার মনের একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে। তাই প্রকৃতি কি করবে আমি আগে থেকেই টের পাই। জানো, আমাদের বিয়ের সময় আমার পরিবারের অনেকেই তোমাকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু আমি জানতাম প্রকৃতি ঠিক করে রেখেছে, আমরা বাকি জীবন একসঙ্গে থাকবো।”
“তাহলে নিশ্চয়ই এটাও জানতে, আমার এতো ফুটফুটে একটা মেয়েকে রেখে আমি কখনই লন্ডনে ফিরে যাবো না!”
“হুঁ।”
“তোমার যুক্তি কিন্তু এবার হেরে গেলো। তুমি চেয়েছিলে আমি যাতে আমার স্বপ্ন পূরণে মনোযোগী হই। কিন্তু তোমার মাথায় এ বিষয়টা ছিলো না যে রাত্রির কথা একদিন না একদিন আমি জানতে পারবোই। জানতে পেরে আমি কখনোই ওকে ফেলে রেখে যাবো না।”
“ভুল করেছি, আমি তো স্বীকার করেছি যে ভুল করেছি।”
“ভালো, ভুল স্বীকার করে নেওয়াটা ভালো।”
অতন্দ্রিলা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “মনে আছে আমরা যেবার কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলাম, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম। বন্ধু হতে পারি কিনা। আজ সে ধরনের আরেকটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছি।”
“করো?”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “এখনকার সময় এবং পরিস্থিতি তোমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছে। কিন্তু আমাদের বিয়ের আগেকার পরিস্থিতি আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছিল। আমি কি তোমার হতে পারি, রোদ?”
রোদ চুপ করে বসে আছে। চিন্তা করছে এই প্রশ্নের জবাবে কি বলা যায়। এই প্রশ্নের সুন্দর একটা উত্তর দেওয়া দরকার।
পরিশিষ্ট –
রাত্রির বয়স এখন সাড়ে চার। এবছর তাকে ভর্তি করানো হয়েছে ইরাবতীর ইশকুলে।
আজ সকালে ক্লাসে আসার পর থেকেই তার মনটা খারাপ, বেশ খারাপ। সবথেকে প্রিয় বন্ধুদেরও কেন যেন আজ বিরক্ত লাগছে।
টিফিন ব্রেকে ছোট ছোট পা ফেলে রাত্রি গেল প্রিন্সিপালের অফিসে, মায়ের কাছে।
অস্পষ্ট গলায় বলল, “বাবা কোথায় মা?”
অতন্দ্রিলা নিচু গলায় বলল, “যেখানে থাকার কথা সেখানে।”
“কোথায় থাকার কথা?”
অতন্দ্রিলা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “অফিসে। কেন? তোর বাবাকে দিয়ে এখন কী কাজ?”
“বাবা বলেছিল আজকে স্কুলের পর শপিংয়ে নিয়ে যাবে।”
“তো যাবে। এখন কী?”
“বাবা তো আজকে, আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই চলে গেল। তুমি বাবাকে ফোন দাও, আমি কথা বলি!”
“রাত্রি! একদম ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করবি না তো। তুই ক্লাসে যা আমি দেখছি।”
রাত্রির বয়সে ছোট হলেও খুব ভালো করে জানে, তার মায়ের সঙ্গে তর্ক করে কোনো লাভ হবে না। তাই অসহায় মুখ করে ক্লাসে চলে গেল।
রাত্রি যাওয়ার পরপরই অতন্দ্রিলা টেলিফোন করল রোদকে।
ক্ষীণ গলায় বলল, “এই তোমার মেয়েকে কী সব উল্টা পাল্টা প্রমিজ করো বলোতো? সে তো ক্লাস না করে শপিংয়ের টেনশন করছে!”
রোদ শান্ত গলায় বলল, “উল্টা পাল্টা কেন হতে যাবে? অফিস থেকে এসে নিয়ে যাবো তো শপিংয়ে!”
“তুমি সকাল সকাল চলে গেছো দেখো তোমার মেয়ে ভাবছে, তুমি তাকে নিয়ে যাবে না।”
“আমার সকালে একটা কনফারেন্স ছিল তাই আগে আগে বেরিয়ে গেছিলাম। এখন তুমি একটু ওকে ম্যানেজ করবে?”
“উহু, মোটেও না! তোমাদের বাবা মেয়ের ঝামেলার মধ্যে আমি আর নেই।”
“তন্দ্রি,প্লিজ!”
অতন্দ্রিলা বিরক্ত গলায় বলল, “আচ্ছা বলো। কি করতে হবে?”
“স্কুল ছুটি হলে তুমি রাত্রিকে নিয়ে শপিং মলে চলে যেও। আমিও তিনটার মধ্যে সেখানে পৌঁছে যাবো!”
“তিনটা। মনে থাকে যেন।”
“অবশ্যই থাকবে ম্যাডাম!”
অতন্দ্রিলা মুচকি হেসে টেলিফোন রেখে দিল।
বেলা তিনটা আটচল্লিশ মিনিট। অতন্দ্রিলা মেয়েকে নিয়ে শপিং মলে পৌঁছেছে অনেক্ষণ হলো। রোদের কোনো নামগন্ধ নেই।
আরও কিছুক্ষণ পর রোদ দৌড়ে এসে রাত্রিকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “স্যরি মা। অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমি বুঝতেই পারিনি। আই অ্যাম সো স্যরি।”
রাত্রি অস্পষ্ট গলায় বলল,“আমি তোমার স্যরি নিব না বাবা!”
“কেন?”
“যে প্রমিজ রাখতে পারে না, তার স্যরি নিতে হয় না।”
রাত্রির এ কথা শুনে অতন্দ্রিলা ও রোদ ফিক করে হেসে দিলো।
রোদ বলল, “তোমার মেয়ে একদম তোমার মতো হয়েছে।”
“আমি তো আগে থেকেই জানতাম যে ও আমার মতো হবে।”
“কিভাবে জানতে? তোমার প্রকৃতি বলেছিল?”
“অবশ্যই।”
শপিং করতে করতে রাত্রি বাবার কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে বলে, ওরা বাসায় চলে আসলো।
রাত্রিকে খাটে শুইয়ে দিয়ে অতন্দ্রিলা এসে বসে বাগানের দোলনায়।
কিছুক্ষণ পর রোদ এসে অতন্দ্রিলার পাশে বসে তার ডান হাতটা ধরল।
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “হাত ধরাধরি করতে যেও না, আশেপাশে কিন্তু তোমার মা আছে।”
“থাকুক। উনার তো কিছু মনে করার কথা না। তুমিই তো বলে, মা আমাদের সবার থেকে অনেক বেশি আধুনিক!”
“ওহ্ হ্যাঁ তাইতো! তাহলে ধরে থাকো।”
রোদ আরও শক্ত করে অতন্দ্রিলার হাতটা চেপে ধরল।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রোদ আগ্রহ নিয়ে বলল, “এই তন্দ্রি তোমার আছে, কিভাবে আমাদের বাসর রাতে তিনটা পর্যন্ত জেগে তুমি বই পড়েছিলে?”
অতন্দ্রিলা ইতস্তত বোধ করে বলল, “ওসব মনে করিয়ে দিও না তো। তখন বাচ্চা ছিলাম, কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হয় তা জানতাম না।”
“এখন খুব জানো, না?”
“এখন মোটামুটি জানি।”
“আসো তোমাকে বিভ্রান্ত করি!”
“আমাকে বিভ্রান্ত করে লাভ কি?”
“মানুষকে বিভ্রান্ত করে আমি মজা পাই। এটা এক ধরনের খেলা বলতে পারো।”
অতন্দ্রিলা অসহায় গলায় বলল, “ঠিকাছে, করো বিভ্রান্ত।”
“বলোতো, ২+২-২+২ কত হয়?”
“এই বাচ্চাদের প্রশ্নটা আমাকে করছো কেন?”
“একটু আগে কিন্তু তুমি নিজেই বললে, তুমি বাচ্চা।”
“সেটা তো আগে ছিলাম!”
“এখনো আছো! এখন তর্ক না করে প্রশ্ন তার উত্তর দাও।”
অতন্দ্রিলা একটু ভেবে বলল, “চার?”
“হয়নি, উত্তর হবে শূন্য।”
“কিভাবে?”
“স্কুলে বদমাস নিয়ম শিখেছিলে না? সেই নিয়মে রাশিটা (২+২)-(২+২) – এরকম। এভাবে করে দেখো।”
“ওহ্ হ্যাঁ, তাইতো!”
“এটা মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটা ধরন। এখন যদি তুমি শূন্য বলতে তাহলে আমি বলতাম চার।”
“জানো আমি আগে ভাবতাম, ভালোবাসা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বিভ্রান্তিমূলক অনুভূতি হলো ভালোবাসা।”
“আর এখন কি ভাবো?”
অতন্দ্রিলা রোদের কাঁধে মাথা রেখে বলল, “এখন মনে হয়, ভালোবাসা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখময় অনুভূতি।”
রোদ মুখভর্তি হাসি নিয়ে বলল, “আমি জীবনে হয়তো কোনো মহাপুন্য করেছিলাম। তাই প্রকৃতি তোমাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে।”
শারীরিক অবস্থার অবনতির থেকে মানসিক অবস্থা অবনতির ভয়াবহতা বেশি। আর এই দুই অবস্থার অবনতি যদি একসঙ্গে ঘটে তাহলে একটা মানুষ যে কতটা বিপর্যস্ত হয়ে যায়, তা অতন্দ্রিলা জানে।
রোদ যেদিন উৎফুল্ল গলায় তাকে বলল, “আমি লন্ডনের এক ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করছি” – সেদিন সকালেই অতন্দ্রিলা জানতে পারে সে কনসিভ করেছে।
ব্যাপারটা আনন্দের, যথেষ্ট আনন্দের। কিন্তু রোদের ওই কথা শোনার পর আনন্দটা তার সঙ্গে ভাগাভাগির করার ইচ্ছে হয়নি।
গণিত বরাবরই রোদের অতি আগ্রহের বিষয়। কিন্তু মায়ের কথা রাখতে অনেকগুলো বছর সে গণিতকে ঘিরে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ পায়নি, এবার পেয়েছে।
এত বড় সুযোগ রোদের হাতছাড়া হয়ে যাক, এমনটা কখনোই চায়নি অতন্দ্রিলা।
তাই নিজের প্রেগন্যান্সির খবরটা গোপন রাখে সে।
রোদ যেদিন চলে যাচ্ছিল, সেদিন অতন্দ্রিলার খুব ইচ্ছে করছিল তাকে ডেকে কথাটা বলতে। কিন্তু বলতে পারেনি।
রোদ চলে যাওয়ার পরও টেলিফোনে অনেকবার কথাটা বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সাহস করে ওঠেনি।
অতন্দ্রিলা তার প্রেগন্যান্সির কথা সর্বপ্রথম জানায় শায়লাকে।
শায়লা শুনে হতভম্ব গলায় বলেন, “এই তুই কি পাগল? এত খুশির একটা খবর তুই রোদকে জানলি না?”
অতন্দ্রিলা অসহায় গলায় বলে, “মা তুমি তো বুঝতেই পারছো কেন বলিনি। ওনাকে কোনোভাবে আটকে রাখতে চাইনি।”
“বলা মানেই কি আটকে রাখা? তুই আজই ওকে ফোন করে বলবি! এক্ষনি বলবি!”
“আমি পারবো না মা।”
“ঠিক আছে, তুই না জানালে আমরা জানাবো।”
“মা প্লিজ। তোমরা তাকে কিচ্ছু বলবে না। তার স্বপ্ন তাকে পূরণ করতে দাও।”
“আর তোর স্বপ্ন? তোর স্বপ্নের কী হবে?”
“উনার স্বপ্নগুলোর মধ্যেই আমার স্বপ্ন লুকিয়ে আছে মা।”
“তোর যা ইচ্ছা, তাই কর!” “এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
রোদকে প্রেগন্যান্সির খবরটা জানানোর জন্যে অতন্দ্রিলাকে বহুভাবে জোরাজুরি করা হয়। কিন্তু সে কিছুতেই জানাবে না।
ফিরোজা বেশ কয়েকবার গোপনে রোদকে টেলিফোন করে বিষয়টা জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রত্যেকবারই অতন্দ্রিলার কাছে ধরা পরেন।
একদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই এক ধরনের অস্বস্তি হতে লাগল অতন্দ্রিলার।
সমস্ত শরীরে ঝিম ধরে আছে, চোখ কটকট করছে।
অতন্দ্রিলা ঘুম থেকে উঠে বিছানাতেই শুয়ে আছে।
ফিরোজা তার ঘরে এসে ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলেন, “নাস্তা করতে আসলে না মা?”
অতন্দ্রিলা ক্লান্ত গলায় বলে, “আমি উঠেতে পারবো না। আপনি আমাকে খাইয়ে দিন।”
ফিরোজা অতন্দ্রিলার কপালে হাত রেখে বলেন, “কেন মা? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”
“বুঝতে পারছি না।”
ফিরোজা লক্ষ করলেন অতন্দ্রিলা ঘামছে।
তিনি ভয়ে ভয়ে বলেন, “অত?”
“হুঁ?”
“রোদকে একটা ফোন দেই?”
“না।”
“ঠিকাছে। তুমি শুয়ে থাকো আমি নাস্তা আনছি।”
নাস্তা করার পর কিছুটা ভালো লাগে অতন্দ্রিলার।
বিকেলের দিকে ফিরোজা যান তার ভাইয়ের বাড়িতে। বাড়িতে আছে রোবটের সমতুল্য বেশ কয়েকজন কাজের লোক। কিন্তু তাদের দিয়ে কোনো কাজ হবে না। অতন্দ্রিলার এখন দরকার মানসিক সান্ত্বনা।
অস্থিরতা ক্রমেই বাড়তে শুরু করলো। অতন্দ্রিলা চুপ করে শুয়ে আছে।
তখনি জরিনা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় তার ঘরে ঢুকে বলে, “আফা! ঝড় আসতেছে তো। বৃষ্টি দেখবেন না?”
“না জরিনা, আমার কেমন জানি খারাপ লাগছে। একটু আমার কাছে এসে বসো তো।”
জরিনা অতন্দ্রিলার পাশে বসতে বসতে বলে, “আফা, আফনের চুল টাইনা দেই?”
“দাও।”
বাইরে তুমুল ঝড় হচ্ছে। জানলার কাঁচ ভেঙে পরছে।
জরিনা আতঙ্কিত গলায় বলে, “আফা, জানলার কাঁচ ভাঙতেছে মনে হয়!”
অতন্দ্রিলা উঠে বসল। তলপেটে একটা তীব্র এবং তীক্ষ্ম যন্ত্রণা অনুভব করল। এই যন্ত্রণা তো আগে কোনদিনও অনুভূত হয়নি!
ব্যাথার ধাক্কা সামলাতে বিছানা আকরে ধরে বসল সে।
জরিনা বলে, “কি হইছে আফা?”
“মরে যাচ্ছি জরিনা!”
জরিনা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না, তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। দ্রুত গিয়ে টেলিফোন করলো ফিরোজকে।
অতন্দ্রিলা জ্ঞান হারাচ্ছে। তবু চিন্তা করছে এই মুহূর্তে কি করা যায়। রোদকে টেলিফোন করতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু রোদকে টেলিফোন করে কি হবে? রোদ তো আর আসতে পারবে না! কিংবা হয়তো চলেও আসবে।
অতন্দ্রিলাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো রাত নয়টায়। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে থরথর করে কাঁপছেন ফিরোজা। এই অনুভূতিটা তার খুবই চেনা। জীবনে আরও একবার অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাড়িয়ে এভাবে কেপেছিলেন তিনি, ইরার অপারেশনের সময়ে। ফিরোজা বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পড়লেন।
নয়টা একত্রিশ মিনিটে একজন ডক্টর বাইরে এসে বললেন, “কংগ্রাচুলেশনস! আপনার নাতনি হয়েছে।”
ফিরোজা চোখভর্তি জল নিয়ে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ! বৌমা? বৌমা কেমন আছে?”
“মা-মেয়ে দুজনেরই সুস্থ আছে।”
পরেরদিন সকালে অতন্দ্রিলার ঘুম ভাঙলো। তার কোলে ফুটফুটে একটা বাচ্চা। বাচ্চাটা নাকি তার! অতন্দ্রিলা উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
অতন্দ্রিলার সামনে বসা তার পরিবারের লোকজন। তারা কি কি যেন বলাবলি করছে। সেসব কিছুই অতন্দ্রিলার কানে আসছে না।
অতন্দ্রিলার ভাবতেই অবাক লাগছে, সে নাকি এখন একজন মা!
ইশ! রোদকে যদি তার মেয়েটার কথা বলতে পারতো! রোদ নিঃসন্দেহে বোকাদের মতো কেঁদে ফেলতো।
ফুটফুটে বাচ্চাটা তার মুঠোয় অতন্দ্রিলার হাতের একটা আঙ্গুল চেপে রেখেছে।
শায়লা আনন্দিত গলায় বলেন, “কী নাম রাখবি, কিছু ঠিক করেছিস?”
অতন্দ্রিলা পরিষ্কার গলায় বলে, “রাত্রি।”
“বাহ্! চমৎকার! আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলি দেখছি।”
“আমি ঠিক করিনি মা। একজন ওর নাম রেখেছে।”
“কে সে?”
“আমার অনেক কাছের এক বন্ধু, তুমি তাকে চিনবে না। মা একটা কথা বলি?”
“বল!”
“থ্যাংক ইউ।”
“থ্যাংক ইউ কেন?”
“তুমি যে আমাকে পৃথিবীতে এনার জন্যে কতটা কষ্ট করেছ, সেটা আজ বুঝলাম।”
“মাকে থ্যাংক ইউ বললে যে তার কতটা রাগ হয় এটাও তুই একদিন বুঝবি!”
অতন্দ্রিলা ফিক করে হেসে দিল।
বাড়িতে ফিরেই রাত্রিকে নিয়ে ইরার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে
অতন্দ্রিলা বলে, “বুবু দেখো! তোমার রাত্রি। বিশ্বাস হয়? আমার তো হচ্ছে না।
মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। জানো, আমি না মাঝে মাঝে তোমাকে স্বপ্নে দেখি। দেখি তুমি হাসছো, আমার সঙ্গে গল্প করছো, আমার চুলে বেণী করে দিচ্ছ। এটাও কি স্বপ্ন বুবু? আমার না খুব আনন্দ হচ্ছে। এত আনন্দ, এত সুখ আমি সহ্য করতে পারছি না।”
রাত্রির জন্মের পর শুরু হলো নতুন সমস্যা। ফিরোজা সকাল-সন্ধ্যা নিয়ম করে বিনয়ী গলায় শুধু একটাই কথা বলে অতন্দ্রিলাকে। সেটা হলো, “মা এবার রোদকে দিদিভাইয়ের কথাটা বলো।”
প্রতিবারই অতন্দ্রিলা ক্ষীণ গলায় জবাব দিয়ে বলে, “না।”
রাত্রির জন্মের পর রোদ অতন্দ্রিলাকে টেলিফোন করেছে ততবারই তার গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছা করেছে, “তোমার জন্যে এক টুকরো ভালোবাসা যত্ন করে রেখেছি। প্লিজ এসে গ্রহন করো!”
কিন্তু বলতে পারেনি।
অতন্দ্রিলা তার মেয়েকে যতই দেখে ততই মায়ার জালে আটকা পরে যায়। এই জাল থেকে কোনো দিনও বের পারবে না সে, অবশ্য অতন্দ্রিলা বের হতেও চায় না।
গরম পানির সঙ্গে ঠান্ডা পানি মেশানো যে পৃথিবীর জটিলতম কাজগুলোর মধ্যে একটা, এটা অতন্দ্রিলার আগে জানা ছিল না। রাত্রিকে গোসল করানো হয় ঠিক বেলা দশটায়। গোসলের পরপরই ফিরোজা নাতনি কোলে নিয়ে বাগানে বসে থাকেন। দৃশ্যটা দেখার মতো। ইশ! রোদ যদি দৃশ্যটা দেখতে পেতো, তাহলে নিশ্চয়ই ছবি এঁকে রাখতো।
টুকটুক করে বড় হচ্ছে রাত্রি। ফিরোজা অনেক কষ্ট বসতে শিখেছেন তাকে। অতন্দ্রিলা ঘোষনা দিয়েছে, “রাত্রিকে হাঁটতে শেখাবো আমি!”
প্রতিদিন সকালে রাত্রির দু হাত ধরে বাগানে হাঁটতে নিয়ে যায় অতন্দ্রিলা। রাত্রি মায়ের হাত ধরে ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটে। কিন্তু অতন্দ্রিলা হাত ছেড়ে দিলেই সে পরে যায়।
অতন্দ্রিলা চিন্তা করে, জীবনে অন্যান্য ক্ষেত্রেও কি সে হাত ছেড়ে দিলে রাত্রি পরে যাবে? তাহলে তো কখনো মেয়ের হাত ছাড়া যাবে না।
রাত্রির বয়স এখন সাত মাস। এই বয়সে বাচ্চারা মা, বাবা, দাদা ইত্যাদি টুকটাক কথা বলতে পারে।
কিন্তু রাত্রি শুধু বলতে পারে একটি শব্দ – ভাভা। যাই দেখে উচ্ছসিত হয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলে ভাভা।
অতন্দ্রিলা রাত্রিকে নিয়ে সোফায় বসল।
পরিষ্কার গলায় বলল, “মা বলতো, বা-বা।”
রাত্রি তার দুটি দাঁত বের করে ফিক করে হেসে বলল, “ভাভা।”
“উহুঁ, হলো না মা। বল বা-বা।”
“ভাভা!”
“আচ্ছা, এখন বলতো মা! মা”
“ভাভা!”
“এই ভাভা আবার কি?
রাত্রি আবার হেসে দিলো।
যেদিন রাত্রি অতন্দ্রিলাকে ‘মা’ বলে ডাকবে, সেদিন নিঃসন্ধেহে তার আনন্দের সীমা থাকবে না। মা শব্দটা এত অদ্ভুত কেন?
একদিন সকালে অনেক সাহস করে অতন্দ্রিলা ঠিক করল, এবার রোদকে তার মেয়ের কথা তাকে জানাতে হবে।
অতন্দ্রিলা রোদকে টেলিফোন করতে যাবে, তখনি রোদ অতন্দ্রিলাকে টেলিফোন করে।
উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, “তন্দ্রি! আমি ইউনিভার্সিটির লেকচারার অফ দ্য ইয়ারের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি।”
মানুষটা এতটাই খুশি ছিলো, যে এবারো অতন্দ্রিলা তাকে রাত্রির কথা বলতে পারলো না। রোদ এতদিন যেটার স্বপ্ন দেখেছিল, এখনো সেটা তার হাতের মুঠোয়।
এমন সময় তাকে বাচ্চার কথা বলে ফিরিয়ে আনার কোনো অর্থ নেই।
মেয়েকে বাবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা এবং বাবাকে মেয়ের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা যে গুরুতর অপরাধ, সেটা অতন্দ্রিলা বুঝতে পারছে। সে অনুতপ্ত।
চোখের পলকেই কেটে গেল দেড়টা বছর। দেড় বছর, সময়টা খুব অল্প না। আবার খুব যে দীর্ঘ তাও না।
এই দেড় বছরে রোদদের বাড়ির তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। ফিরোজার বৃক্ষপ্রেমের পরিবর্তন হয়নি, অতন্দ্রিলার ঠোঁটকাটা স্বভাবেরও পরিবর্তন হয়নি।
তবে একেবারেই যে পরিবর্তন হয়নি তা নয়।
তাদের জীবনে একটা বিষয়ে পরিবর্তন এসেছে, অনেক বড় পরিবর্তন।
রোদের জীবনেও এসেছে পরিবর্তন। ম্যাথমেটিক্সের টপলজি ব্রাঞ্চে লেকচারার হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছে সে। তার এই সুখ্যাতি নিয়ে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় বেশ লেখালেখিও হয়েছে।
অতন্দ্রিলাও, ‘বাংলাদেশকে গর্বিত করা ১০ প্রবাসী’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে রোদের কথা উল্লেখ করেছে।
রোদকে নিয়ে তার গর্বের সীমা নেই।
রোদের সঙ্গে অতন্দ্রিলার সুনিবিড় যোগাযোগ।
তবুও একটা ব্যাপারে যেন সূক্ষ্ম এক দূরত্ব।
ইরাবতীর ইশকুলের বিল্ডিং তোলার কাজ শুরু হয়েছে কয়েক মাস হলো। বিল্ডিং তোলার কাজ দেখার কিছু নেই। তবুও অতন্দ্রিলা সময়-সুযোগ পেলেই চলে যায় কাজটা নিজ চোখে দেখতে।
আজও এসেছে।
অতন্দ্রিলার টেলিফোন বেজে উঠল। হ্যান্ডব্যাগ থেকে টেলিফোন বের করে দেখে, রোদের টেলিফোন।
অতন্দ্রিলা টেলিফোন তুলে বলল, “হুঁ, বলো।”
রোদ উৎসাহিত গলায় বলল, “একটা খারাপ খবর আছে এবং একটা ভালো খবর আছে। কোনটা আগে শুনবে?”
“আগে খারাপটা বলে দাও।”
“তোমার বাবা এবং দুলাভাই এই সপ্তাহে তৃতীয়বারের মতো গান রেকর্ড করে পাঠিয়েছেন।”
“সে কি! এবার কোন গান?”
“আমরা করবো জয়।”
“উনাদের গানগুলো শুনতে যথেষ্ট কুৎসিত হলেও তুমি অনেক প্রশংসা করো। তাই না?”
“বুঝলে কিভাবে?”
“তুমি যদি প্রশংসা না করতে, তাহলে তারা এত আগ্রহ এবং উৎসাহ নিয়ে গান গাইতেন না।”
“তন্দ্রি, তোমার না আসলেই অনেক বুদ্ধি।”
“জানি। এখন তোমার ভালো খবরটা বলো।”
“অবশেষে ১৫-২০ দিনের জন্য ছুটি পেলাম, দেশে আসছি।”
অতন্দ্রিলা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, “সত্যি? কবে?”
“এ মাসে, আঠারো তারিখে।”
“তোমার মাকে বলেছো?”
“এখনো বলিনি।”
“প্লিজ বোলো না, আমি বলবো। উনাকে চমকে দিবো। উনাকে চমকে দেওয়া আমার অসম্ভব পছন্দের।
মানুষটা এত দিন পর দেশে আসবে, বাড়ির ভাত খাবে। অতন্দ্রিলার ইচ্ছা ছিল সাদামাটা আয়োজন করার।
বাড়িটা মোমবাতি দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হবে। হালকা ধরনের রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতে পারে। সঙ্গে থাকবে রোদের পছন্দের সব খাবার।
কিন্তু অতন্দ্রিলার সেই ইচ্ছায় রীতিমতো পানি ঢেলে দেওয়া হলো।
রোদ আসবে জানতে পেরেই হামিদ সাহেব সপরিবারে চলে আসেন তাদের বাড়িতে। রোদ আসা পর্যন্ত এখানেই থাকবেন।
থাকবেন ভালো কথা, থাকতেই পারেন। কিন্তু রোদের আগমন উপলক্ষে উদ্ভট সব আয়োজনের পরিকল্পনা করছেন তিনি। ফিরোজাও তাতে সায় দিয়ে যাচ্ছেন।
আজ দুপুরে হামিদ সাহেব হাসি মুখে ফিরোজকে বললেন, “আপা লিস্ট তো করেই ফেললাম! সব মিলিয়ে ৩৮ জন আসবে।”
ফিরোজা কিছু বলতে যাবে তার আগেই অতন্দ্রিলা থমথমে গলায় বলল, “৩৮ জন? বাবা এটা কি বিয়ে বাড়ি নাকি জন্মদিনের উৎসব যে এত গুলো মানুষকে বলতে হবে?”
“যেটা বুঝিস না, সেটা নিয়ে কথা বলবি না। সব বিষয়ে তোর জ্ঞান দেওয়াটা না, আমার অসহ্য লাগে। এই ৩৮ জন হলো রোদের সবথেকে কাছের আত্মীয়। এত গুলো দিন তারা ছেলেটাকে দেখেনি!”
“বাবা আমার কথাটা কিন্তু একটু মাথায় রেখো প্লিজ! তুমি বুঝতে পারছো তো, আমাকে কি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।”
“তুই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাবি নিজের দোষে। তুই সব বিষয়ে বেশি বুঝিস, এটাই তোর দোষ।”
ফিরোজা শান্ত গলায় বললেন, “আহ্ থাক না ভাই। আর মা অত, তোমার বাবা যা করতে চাইছে করতে দাও। রোদ তো উনারও ছেলে। ভাই আপনি বলুন তো আর কী কী করতে চান!”
হামিদ সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, “আপা গরু জবাই দিতে হবে ২ টা আর ছাগল ৪ টা। এগুলো রান্না হবে বাড়িতে! বাইরে থেকে আসবে বিরিয়ানি এবং রোস্ট। বাড়ির সদর দরজার সামনে রঙিন কাপড় দিয়ে গেট করা হবে। গেটের ওপরে বড় বড় করে লেখা থাকবে ওয়েলকাম হোম।”
অতন্দ্রিলা বিরক্ত গলায় বলল, “গেট করা হবে মানে কি বাবা? সে কী মন্ত্রী না মিনিস্টার?”
“তুই আবার কথা বলছিস?”
“ঠিকাছে, আমি কিছু বলবো না। তুমি বলে যাও।”
“ব্যান্ডপার্টি ডাকা হবে। তাদের কাজ হবে বাদ্যবাজনা বাজানো।”
অতন্দ্রিলা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “বাবা এক কাজ করো, ঘোড়ার ব্যাবস্থা করো।
এয়ারপোর্ট থেকে তাকে আনা হবে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে।”
পরের দিন সকালে অতন্দ্রিলা ঘুম থেকে উঠে দেখে, হামিদ সাহেব সত্যি সত্যিই ঘোড়া নিয়ে হাজির। দুটো বিশাল সাইজের ঘোড়া দাড়িয়ে আছে বাগানে। তাদের সামনে দাড়িয়ে হামিদ সাহেব এবং জাভেদ।
অতন্দ্রিলা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “এসব কি বাবা?”
“দেখ তো কোন ঘোড়াটা পছন্দ হয়। কাল তোর আইডিয়াটা আমার দারুন পছন্দ হয়েছে।”
“বাবা তোমরা কি পাগল হয়ে গেছো?”
“পাগল হতে যাবো কেন? এই দুটোর মধ্যে যেকোনো একটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবো।”
“তুমি এটা করবে না।”
“অবশ্যই করবো।”
“বাবা এই পর্যন্ত আমার কোনো কথাই তো শুনলে না। অন্তত এই কথাটা শুনো। তুমি এই কান্ড করলে আমার মান সম্মানের কি হবে?”
জাভেদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে আনলে কি তোমার মানহানি হবে? মানহানি হবে তোমার?”
“আপনি দয়া করে চুপ করুন তো!”
অবশেষে অনেক জোরাজুরির পর হামিদ সাহেব ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে বরণ করার পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করলেন।
পুরো বাড়িটাকে মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হচ্ছে। অসাবধানতার কারনে এক এক করে সবাই মরিচ বাতি থেকে, ছোটখাটো ইলেকট্রিক শক খাচ্ছে।
মেহমানরা যাতে একসঙ্গে বসে খেতে পারে, সে জন্যে বড়সড় এক টেবিল অনানো হয়েছে। বর্তমানে সেই টেবিলে ভেলভেটের কাপড় লাগানো হচ্ছে। “এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
মিথ্যা বলার জন্যে আগে থেকে কথা গুছিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু সত্য বলতে কোনো পূর্বপরিকল্পনার প্রয়োজন হয় না।
অতন্দ্রিলা রোদকে একটা সত্য কথাই বলবে, তবুও সে নিজের অজান্তে কথা গোছাচ্ছে।
অতন্দ্রিলা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো ইরার ছবির সামনে।
বিনয়ী গলায় বলল, “বুবু! কাল তো সে আসছে। আমাকে একটু দোয়া করো হ্যাঁ?।
আর, কোন শাড়িটা পরা যায় বলোতো? তোমার একটা শাড়ি পরলে কেমন হয়?”
অতন্দ্রিলার ঘরে এক আলমারিতে ইরার শাড়ি এবং অন্যান্য ব্যাবহৃত বস্তু যত্ন করে তুলে রাখা। আলমারিটা সবসময় খোলাই থাকে।
অতন্দ্রিলা প্রায়ই আলমারি খুলে ইরার শাড়িগুলো দেখে। এগুলোর মধ্যেই যেন খুঁজে পায় তার বুবুকে।
অনেক ঘাটাঘাটির পর একটা নীল রঙের শাড়ি পাওয়া গেল। অতন্দ্রিলা কাল এ শাড়ীটাই পরবে।
রোদ বাংলাদেশে ল্যান্ড করবে সকাল দশটায়। ইমিগ্রেশন শেষ হতে হতে বারোটা বেজেই যাবে, বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে একটা। ঢাকার যানজটের যে অবস্থা, দুটো-তিনটাও বাজতে পারে।
এর মধ্যে ঘটল এক মজার ঘটনা। বাড়ির ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে, মেইন সুইচ নষ্ট। সন্ধ্যার আগে ঠিক হবে না। অতন্দ্রিলা পুরনো স্মৃতি মনে করে খিলখিল করে হেসে উঠলো। প্রকৃতি ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে পছন্দ করে। তাই হয়তো বিয়ের দিনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে, আবার মনে করিয়ে দিল তাকে।
এবার অবশ্য তেমন একটা অসুবিধা হয়নি। দিনের বেলা, সূর্যের আলোয় ঘর আলোকিত।
হামিদ সাহেব, জাভেদ এবং আরও কিছু মামা চাচা টাইপের লোকজন ফুল দিয়ে সাজানো মাইক্রোবাস নিয়ে গেছেন রোদকে আনতে।
বাড়িতে রান্নাবান্না হচ্ছে, হাসিঠাট্টা হচ্ছে, গানবাজনা হচ্ছে।
ছোট ছোট বাচ্চারা হইচই করছে অতন্দ্রিলার ঘরে। অতন্দ্রিলা বড়দের সামনে যতটা কঠিন, ছোটদের সামনে ততটাই কোমল। একদল বাচ্চাকাচ্চা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, আরেক দল বাচ্চাকাচ্চা অতন্দ্রিলার গাল ধরে টানাটানি করে। নয়-দশ মাস বয়সী একটা বাচ্চা অতন্দ্রিলার বিছানাতেই ঘুমিয়ে পরেছিল।
বাচ্চাটা ঘুম থেকে উঠেই শুধু বলছে, “ভাভা, ভাভা!” বাচ্চাটাকে তার বাবার কাছে রেখে আসা দরকার। কিন্তু ‘ভাভা’ বলতে সে বাবা বুঝিয়েছে নাকি অন্য কিছু তাও জানতে হবে।
নিচ থেকে অনেক কোলাহলের শব্দ আসছে। রোদ হয়তো এসে গেছে। অতন্দ্রিলা ঘর থেকে বের হলো। দোতলা থেকে দেখল, আসলেই রোদ এসে গেছে। কিন্তু তাকে দেখতে পাচ্ছে না অতন্দ্রিলা। বেচারাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে সকলে।
এখন নিচে গেলে কোনো লাভ হবে না। তাই অতন্দ্রিলা বাচ্চাগুলোকে নিয়ে ছাদে চলে গেল। রোদ অতন্দ্রিলার খোঁজ করতে করতে নিশ্চয়ই ছাদে যাবে।
অতন্দ্রিলার ধারনা ছিল, ছাদে কেউ নেই। বাচ্চারা নির্দ্বিধায় ছোটাছুটি করতে পারবে। কিন্তু সে ধারনা সঠিক হলো না। ছাদে গিয়ে সবগুলো বাচ্চা অতন্দ্রিলাকে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। ‘ভাভা’ করা বাচ্চাটা তো কেঁদেই উঠলো।
কিছুক্ষণ পর ছাদে দেখা মিলল রোদের। অতন্দ্রিলা প্রয়োজন ছাড়া তেমন একটা হাসতে পছন্দ করে না। কিন্তু রোদকে দেখে নিজের অজান্তেই তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।
রোদ অতন্দ্রিলার কাছে এসে দাঁড়ালো।
অতন্দ্রিলা আনন্দিত গলায় বলল, “আসলেন তাহলে!”
রোদ বিস্মিত গলায় বলল, “আপনি ডাকো নাকি আমাকে?”
“ওহ্ স্যরি! কেমন আছো?”
“দেখে কি মনে হচ্ছে?”
“মনে হচ্ছে ভালোই।”
“তাহলে ভালোই আছি।”
অতন্দ্রিলা বলল, “তোমাকে দেখতে কিন্তু অনেক ভালো লাগছে।”
“তোমাকেও অন্যরকম ভালো লাগছে। ”
“আমার বন্ধুগুলো কত বড় হয়ে গেছে দেখো।”
“কোথায় বড় হয়েছে? আগের মতোই তো আছে। তুমিও কিন্তু বদলাওনি।”
“বদলেছি, কিছু দিন যাক বুঝতে পারবে। এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমার সঙ্গে কথা বলার অনেক সময় পাবে। এখন নিচে চলো, তোমার প্রিয়জনেরা অপেক্ষা করছে।”
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে। মেহমানরা এক এক করে বিদায় নিচ্ছেন আর অতন্দ্রিলার হৃদস্পন্দন একটু একটু করে বাড়ছে।
সবাই চলে গেলে ফিরোজা ছেলেকে ডেকে নিজের ঘরে নিয়ে যান।
ফিরোজা কাঁপা গলায় বললেন, “বাবা রোদ, তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে।”
“হুঁ, মা বলো!”
“আগে তুই বোস।”
রোদ ফিরোজার পাশে বসল।
“বসলাম। এখন বলো কি বলবে।”
“দেখ বাবা, তুই একটু মাথা ঠান্ডা করে আমার কথাগুলো শোন।”
“বললে তো শুনবো মা।”
“বলছি। বাবা তুই যখন অতকে রেখে চলে গেলি, তখন শুধু ওকে রেখে যাসনি।”
ফিরোজা এই দেড় বছরে ঘটে যাওয়া সেই বিরাট পরিবর্তনের বর্ণনা দিলেন।
অতন্দ্রিলার গুছিয়ে রাখা কথাগুলো বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে কথাগুলোর এলোমেলো হওয়ার কোনো অর্থ হয় না।
অতন্দ্রিলা বাগানের দোলনায় এসে বসল। কেন জানি খুব অস্থির লাগছে তার। ভুলে জর্দা দিয়ে পান খেলে যেমন লাগে তেমন লাগছে। অনেক বড় একটা ভুল হয়ে গেছে। এই ভুল শোধরানোর আর উপায় নেই।
অতন্দ্রিলার কোলে ‘ভাভা’ করতে থাকা সেই বাচ্চাটি হা করে ঘুমাচ্ছে। তার নাম রাত্রি, দেখতে অবিকল অতন্দ্রিলার মতো। অতন্দ্রিলার ধারনা রাত্রি তার ঠোঁটকাটা স্বভাবটি পাবে, অবশ্যই পাবে।
কিছুক্ষণ পর রোদ এসে দোলনায়, অতন্দ্রিলার পাশে বসল।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আহত গলায় বলল, “আমার মেয়ের কথা আমাকে না জানানোর কারন কি?”
অতন্দ্রিলা অস্পষ্ট গলায় বলল, “আছে, অনেক কারন আছে।”
“কি সেই কারণ? আমাকে কি তুমি কখনো আপন বলে মনে করোনি নাকি আমার মেয়ের ওপর কোনো অধিকার আমার নেই?”
“কি বলছো এসব? তোমার অধিকার আছে, সবথেকে বেশি আছে।”
“তাহলে এতদিন ওকে আমার কাছ থেকে গোপন করলে কেন?”
“আমি যেদিন জানতে পারলাম আমি কনসিভ করেছি, সেদিনই তোমাকে বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সেদিন তুমি আমাকে বললে যে তুমি লন্ডনে চলে যাচ্ছ। তাই তোমাকে বলতে পারিনি।”
“আমার লন্ডনে যাওয়ার সাথে তোমার বলতে না পারার সম্পর্ক কী?”
“বাচ্চার টোপ দেখিয়ে তোমাকে আটকে রাখতে চাইনি। সবসময় তোমাকে সফল হতে দেখতে চেয়েছি, তোমার স্বপ্নগুলো পূরণ হতে দেখতে চেয়েছি। আমি বা আমরা, কেউই তোমার পিছুটান হতে চাইনি।”
“এই চিনেছিলে তুমি আমাকে? একবারের জন্যেও কি তোমার মনে হয়নি যে একদিন না একদিন সত্যিটা আমি জানতেই পারবো? ”
অতন্দ্রিলা বলল, “বিশ্বাস করো, আজকে রাতে আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। অপরাধবোধের বোঝা আমার মাথার ওপর থেকে নেমে গেল। আমি জানি আমি ভুল করেছি, অনেক বড় ভুল। কিন্তু যা করেছি শুধুমাত্র তোমার জন্যে করেছি।”
রোদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কেন?”
অতন্দ্রিলা কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “নাও তো এবার তোমার মেয়েকে। এতদিন আমাকে অনেক জ্বালিয়েছে। এখন তুমি জ্বলো!”
অতন্দ্রিলা রাত্রিকে রোদের কোলে তুলে দিল।
রোদ উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে রাত্রির দিকে। রোদ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করল, তার চোখ দিয়ে পানি পরছে। আহারে! এত সুন্দর একটা মেয়ে আছে তার, কেউ তাকে আগে জানালো না কেন? জানালে স্বর্গসম সুখ ত্যাগ করে চলে আসতে দ্বিধা বোধ করতো না রোদ।
সিঙ্গাপুর থেকে পাথরের মূর্তি অনানো হয়েছে। বাগানে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে সেগুলো বসানো হবে। অতন্দ্রিলা বলে, বাগানটাতে নাকি কোনো সৌন্দর্য নেই। তাই সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে ফিরোজার এই আয়োজন।
বাগানের দোলনায় বসে কাজের তদারকি করছেন তিনি। তার পাশে গুটিশুটি মেরে বসে আছে রোদ।
ফিরোজা ক্ষীণ গলায় বললেন, “কি যেন নাম বললি ইউনিভার্সিটির?”
“মরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটি।”
“লন্ডনের কোন জায়গায় সেটা?”
“মরহেডে।”
“এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলি, বৌমা জানে?”
“না, জানাইনি। তোমার অনুমতি পেলে জানাবো।”
“আমার অনুমতির কি আছে? তুই এত বড় একটা সুযোগ পেয়েছিস, অবশ্যই যাবি। কিন্তু তার আগে ব্যাপারটা বৌমাকে জানাতে হবে। সে কিন্তু আমাদের পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাকে না জানিয়ে কোনো কাজ করবি না।”
অতন্দ্রিলা রান্না করছে, চিংড়ি মাছের মালাইকারি। এই খাবারটি আমাদের সংস্কৃতিতে এসেছে মালয়েশিয়ান সংস্কৃতি থেকে। মালয়েশিয়ান মালাইকারির বিশেষত্ব হলো নারকেলের দুধ এবং চিনি।
বেশ উৎফুল্ল লাগছে অতন্দ্রিলাকে।
রান্না শেষ করে ঘরে গিয়ে দেখে রোদ বসে আছে।
অতন্দ্রিলা উৎসাহিত গলায় বলল,“আপনাকে একটা জরুরী কথা বলার আছে।”
রোদ গম্ভীর গলায় বলল, “আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তোমার সাথে।”
“তাহলে আগে আপনি বলুন।”
“তন্দ্রি, আমি লন্ডনের একটা ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করার অফার পেয়েছি। এত বছর আমি মায়ের কথা মত ব্যাবসাটাকে সামলে রেখেছি, এত দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন আমি চাই আমার স্বপ্ন পূরন করতে, নিজের পছন্দের কাজ করতে।”
অতন্দ্রিলা চমকে উঠল। তার চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে যাবার উপক্রম। চমকে ওঠার কোনো কারন নেই, রোদের প্রতি তো তার প্রেম নেই। কিংবা থাকতেও পারে। এক ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে সামলে নিল অতন্দ্রিলা।
স্বাভাবিক গলায় বলল, “কবে যাবেন?”
“আগামী মাসে।”
“আবার আসবেন কবে?”
“আমি ওখানে পার্মানেন্টলি থাকবো, গ্রিন কার্ডের জন্যে অ্যাপ্লাই করবো। মাঝে মাঝে যখন ছুটি থাকবে, তখন আসবো।
অতন্দ্রিলা চুপ করে রইল।
রোদ বলল, “তুমি কিন্তু চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারো।”
“আমি যাবো কেন? আমি তো আর ইউনিভার্সিটি থেকে কোনো অফার পাইনি! আর পেলেও যেতাম না। দেশ থেকে দূরে কোথাও বেশি দিন থাকতে পারি না আমি। “এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
রোদ লন্ডনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শীতের কাপড় কেনা হয়েছে। যদিও এসব কাপড়ে সেখানকার শীত মানবে না, সেখান থেকে আবার কিনতে হবে।
অতন্দ্রিলা চিন্তা করছে, এটা যদি নব্বইয়ের দশক হতো তাহলে কি ফিরোজা ছেলের জন্যে সোয়েটার বুনতে বসতেন? নাহ্, ফিরোজা যথেষ্ট আধুনিক।
এক নিমেষেই যেন একটা মাস কেটে গেল।
আজ রাতে রোদের ফ্লাইট। দুপুরের খাবারে করা হয়েছে এলাহি আয়োজন। কোরমা, পোলাও, আস্ত মুরগির রোস্ট। সবকিছু নিজের হাতে রান্না করেছে অতন্দ্রিলা।
ফ্লাইট রাত দশটায়। কিন্তু বোর্ডিং হবে সাড়ে আটটায়। সে অনুযায়ী আগে আগেই বের হতে হবে রোদকে।
দুটো বিশাল আকারের সুটকেস তোলা হয়েছে গাড়িতে। ফিরোজা রোদের সঙ্গে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাবেন। রোদের কিছু দুরসম্পর্কের চাচা মামা জাতীয় লোকও এসেছেন তাকে বিদায় দিতে। তারাও যাবে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত।
কিন্তু অতন্দ্রিলা যাবে না। চুপ করে সদর দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সে।
রোদ অতন্দ্রিলার কাছে এসে নিচু গলায় বলল, “এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসলেই পারতে।”
“এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। এতে কষ্ট আরও বাড়ে।”
“তার মানে তোমার কষ্ট হচ্ছে?”
“ঠিক কষ্ট হচ্ছে না, খারাপ লাগছে। আমার সবথেকে কাছের বন্ধু যে দূরে সরে যাচ্ছে।”
“দূরে কোথায় সরে যাচ্ছি। এই যুগে কেউ কি আর বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা? ফোনে তো কথা হবেই, দেখাও হবে।”
“তাও ঠিক। আচ্ছা আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন এখনো? সাতটা বেজে গেছে। এখন রওনা না দিলে কিন্তু দেরি হয়ে যাবে।”
“ওহ্, হ্যাঁ তাইতো। তাহলে এখন আসি। ভালো থেকো।”
“আপনিও ভালো থাকবেন।”
রোদ যাওয়ার সময় একবার তার তন্দ্রির দিকে ফিরে তাকালো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।
রোদ চলে যাওয়ার পর অতন্দ্রিলা লক্ষ করল, তার চোখে জল। সর্বনাশ!এরমধ্যে রোদের প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে গেছে সে?
আচ্ছা রোদ তো এখন বেশি দূর যেতে পারেনি। ফিরিয়ে এনে কি তাকে কথাটা বলবে?
না থাক! যাত্রাপথে পেছন থেকে ডাকা নাকি অমঙ্গলজনক।
পর্ব ১২ – (আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে)
রোদ লন্ডনে চলে গেছে এক সপ্তাহ হলো। অতন্দ্রিলা এসেছে তার বাবা মায়ের বাড়িতে। ফিরোজাকে একা রেখে আসেনি, তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।
অতন্দ্রিলার ধারনা ছিল তার বাবা মা আগের মতো সারাদিন পাড় করছেন ঝগড়া করে। কিন্তু তার সেই ধারনা ছিল ভুল।
হামিদ সাহেব এবং শয়লার মধ্যকার সম্পর্ক এখন মধুর, অত্যন্ত মধুর। এতটাই মধুর যে তাদেরকে একসঙ্গে দেখে মনে হচ্ছে নববিবাহিত দম্পতি ।
প্রতিদিন বিকেলে হামিদ সাহেব, শায়লা এবং ফিরোজা চায়ের কাপ নিয়ে আড্ডায় বসেন। মাঝে মাঝে সন্ধ্যা তাদের সঙ্গে যোগ দিলেও, অতন্দ্রিলা এসবের মধ্যে নেই।
আজ বিকেলে সন্ধ্যা এলো অতন্দ্রিলার ঘরে।
ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “কিরে মন খারাপ?”
অতন্দ্রিলা বলল, “মন খারাপ হতে যাবে কেন?”
“শোন, জীবন তো আর কারও জন্যে থেমে থাকবে না। রোদের জীবন তোর জন্যে থেমে গেছে? যায়নি তো! তুই কেন খামোখা এভাবে মন খারাপ করে বসে আছিস? নিজের মতো কাজ শুরু করে দে। তোর জীবন ওর জন্যে থেমে থাকবে কেন?”
“আপা, জীবন কারও জন্যে থেমে
থাকে না, এটা আমিও জানি। আমার জীবনও কারো জন্যে থেমে নেই।”
“তাহলে মন খারাপ করে বসে আছিস কেন?”
“আছে একটা কারণ, বলা যাবে না।”
“অতন্দ্রিলা আশরাফ কথা গোপন করছে দেখি? তুই রোদের কথা ভেবে মন খারাপ করছিস, কিন্তু বলতে পারছিস না। দেখলি তো, বিয়ে একটা মেয়েকে কতটা বদলে দেয়!”
অতন্দ্রিলা হাই তুলতে তুলতে বলল, “দেখেছি। দেখে আমার মন ভরে গেছে।”
সন্ধ্যা সাতটায় রোদের টেলিফোন এলো।
এরমধ্যে একটা মজার ব্যাপার ঘটেছে। অতন্দ্রিলা এখন আর রোদকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করে না।
অতন্দ্রিলার কথা, “এখন সে যেখানে থাকে সেখানে আপনি-তুই বলে কিছু নেই, সবাই তুমি। আমি কেন অযথা তাকে আপনি বলে ডাকতে যাবো?”
অতন্দ্রিলা টেলিফোন তুলে বিনয়ী গলায় বলল, “কি খবর?”
“এইতো ভালো। তোমার খবর কি?”
“ভালো খবর।”
“কি করছিলে?”
“তেমন কিছু না। তুমি?”
“এইতো মাত্র লাঞ্চ সারলাম।”
অতন্দ্রিলা উৎসাহিত গলায় বলল, “কয়টা বাজে জানি ওখানে?”
“২ টা।”
“ওখানে কি অনেক শীত?”
“হুঁ, মোটামুটি ভালোই শীত।”
“বৃষ্টি হয়?”
“বৃষ্টি এখন পর্যন্ত দেখিনি, তবে স্নোফল হয়। বাড়ির সকলে কেমন আছে?”
“ভালো আছে, আনন্দে আছে। গতকাল আপা জাভেদ ভাইকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে।”
“তুমি ভালো আছো তো তন্দ্রি?”
“হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
“জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো।”
অতন্দ্রিলা অস্পষ্ট গলায় বলল, “ভালো আছি, অবশ্যই ভালো আছি। তোমাকে আর জিজ্ঞেস করলাম না। কারন আমি জানি তুমিও ভালো আছো।”
আজকাল এগারটার আগে বিছানা থেকে উঠতে অসহ্য লাগে অতন্দ্রিলার। মনে হয়, সর্বশক্তি দিয়ে কেউ যেন তাকে আটকে রেখেছে।
কিন্তু আজ সকাল আটটার দিকেই ঘুম ভেঙে গেল, ছাদ থেকে আসা চেঁচামেচির শব্দে। কেউ অবশ্য ঝগড়া করছে না। অনেকগুলো মানুষ একসঙ্গে জড়ো হয়ে কথা বললে, খানিকটা চেঁচামেচির মতোই শব্দ হয়।
ট্রাকভর্তি গাছপালা এসেছে। দুজন মালি, একজন রাজমিস্ত্রীও এসেছে। অতন্দ্রিলাদের ছাদে বাগান করা হবে।
অতন্দ্রিলা ছাদে গিয়ে দেখল ফিরোজা অতি যত্ন সহকারে গাছ লাগাচ্ছেন। আর মালিদের অযথা তারা দিচ্ছে জাভেদ।
জাভেদ, সন্ধ্যার স্বামী। মুখ লম্বাটে, গাত্রবর্ণ শ্যামলা, হাসিটা বিশ্রী। জাভেদের ভয়ংকর বাজে স্বভাব হলো প্রতিটা বাক্য দুবার বলা।
এই স্বভাবের কারণেই তিনি অতন্দ্রিলার অপছন্দের ব্যাক্তিদের মধ্যে একজন।
অতন্দ্রিলাকে ছাদে আসতে দেখে জাভেদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “আরে অতন্দ্রিলা আসো। আসো অতন্দ্রিলা। দেখো কি সুন্দর বাগান হচ্ছে! কি সুন্দর বাগান হচ্ছে!”
অতন্দ্রিলা হতাশ গলায় বলল, “জাভেদ ভাই, আপনাকে দেখলেই আমার অস্বস্তি লাগে!”
“কেন আমি আবার কি করলাম? কি করলাম আমি?”
“এইযে প্রতিটা কথা দুবার করে বলেন।”
“ঠিকাছে, আর বলবো না। বলবো না আর।”
“এসব কি হচ্ছে একটি সংক্ষেপে বলবেন?”
“বাগান হচ্ছে, বাগান। হরেক রকমের গাছ লাগানো হচ্ছে। হরেক রকমের গাছ। সবই সবজির গাছ। সবগুলো সবজির গাছ।”
এনার সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই। তাই অতন্দ্রিলা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে যায়।
নিচে এসে অতন্দ্রিলা গম্ভীর গলায় বলল, “মা ছাদে এসব কি হচ্ছে?”
শায়লা হাসিমুখে বললেন, “ফিরোজা আপার কান্ড! আমাদের বাড়িতে বলে গাছের বংশও নেই। এজন্যে নিজ হাতে বাগান করছেন।”
“বাগান করছেন ভালো কথা কিন্তু এতগুলো গাছের পরিচর্যা করবে কে? আমার চলে যাওয়ার পর তো গাছগুলো মরে মরে ভূত হয়ে যাবে!”
“ভূত হলে হবে! সেই চিন্তা তোকে করতে হবে না।”
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে জাভেদ উজ্জ্বল চোখে বলল, “অতন্দ্রিলা শোনো একটা দারুন পরিকল্পনা করেছি। দারুন পরিকল্পনা করেছি একটা।”
অতন্দ্রিলা থমথমে গলায় বলল, “শুনতে পারি তবে এক শর্তে। আপনি একটা কথা দুবার বলতে পারবেন না।”
জাভেদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই হামিদ সাহেব বললেন, “ও একটা কথা দুবার করে না বললে কথা বলতে পারে না। আমি বলছি শোন। রোদকে একটা ভিডিও বার্তা পাঠানো হবে।”
অতন্দ্রিলা বলল, “কি পাঠানো হবে?”
“ভিডিও বার্তা। সেই ভিডিওতে থাকবো আমরা সবাই। আমরা সবাই সারিবদ্ধ হয়ে বসে গান গাইবো। সেই গানটাই ওকে পাঠানো হবে।”
“গান গেয়ে সেটা আবার ভিডিও করে পাঠাতে হবে কেন?”
“পাঠাতে হবে। এতে রোদের মনোবল বাড়বে। জানবে যে ও একা নয়। আমরা ওর সাথে আছি।”
“বাবা তার যথেষ্ট মনোবল আছে। গান গেয়ে তার মনোবল বাড়ানোটা অর্থহীন। তাছাড়া তোমাদের সকেলর গানের গলা তো তেমন একটা ভালো না।”
“তোকে গাইতে হবে না। আসলে তোকে বলাটাই ভুল হয়েছে।”
“বলা ভুল হয়নি বাবা। তোমাদের আমার সাহায্য লাগবে। তোমরা গান গাইবে আর আমি ভিডিও রেকর্ড করে দেবো।”
মুক্ত করো ভয়,
আপনা মাঝে শক্তি ধরো,
নিজেরে করো জয়।
হামিদ সাহেব, শায়লা, ফিরোজা, সন্ধ্যা, জাভেদ – সকলে সারিবদ্ধ ভাবে বসে গান গাইছে। এমনকি জরিনাকে দেখা যাচ্ছে সারিতে। তবে সে গানটা গাইতে পারে না, তাই শুধু হাতে তালি দিচ্ছে।
অতন্দ্রিলা ভিডিও রেকর্ড করতে করতে চিন্তা করছে, ভিডিওতে সে একা থাকলে কোন গানটা গাইত।
আজ তোমারে দেখতে এলেম
অনেক দিনের পরে।
ভয় কোরো না, সুখে থাকো,
বেশিক্ষণ থাকব নাকো
এসেছি দণ্ড-দুয়ের তরে॥
ঢাকার অদূরে সাভার এলাকায় রোদের বাবা ইউসুফ সাহেবের বিশাল জমি। মৃত্যুর আগে উনি জায়গাটি রোদের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। এখানেই শুরু হবে ইরাবতীর ইশকুলের কাজ।
আজ সকাল থেকেই অতন্দ্রিলা এখানে। ফাঁকা জমিতে দাঁড়িয়েও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে, গান গাইছে, লেখাপড়া করছে।
অতন্দ্রিলা আঙ্গুল উচিয়ে রোদকে বলল, “ওখানে, ওখানে হবে স্কুলের মূল বিল্ডিং। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে থাকবে ৫২ টা ক্লাসরুম, ১২ টা টিচার্স রুম, ৪ টা সাইন্স ল্যাব, ২ টা সিক রুম এবং এক সুবিশাল হলরুম।”
রোদ বলল,“বিল্ডিংয়ের ডিজাইন তুমি করবে নাকি?”
“আমি যদি আর্কিটেক্ট হতাম, তাহলে অবশ্যই করতাম। এখন আমি শুধু আপনাকে ধারনা দিচ্ছি।”
“ভালো। এখন বলো হোস্টেলটা কোথায় হবে?”
“স্কুল বিল্ডিংয়ের মুখোমুখি থাকবে আবাসিক হোষ্টেল। আমার অবশ্য ইচ্ছা আছে ছেলে এবং মেয়েদের জন্যে আলাদা আলাদা হোষ্টেল করার। কারন একটা ছেলে একটা মেয়েকে প্রাইভেসি দিতে পারে না, কিন্তু একটা মেয়েকে অন্য আরেকটা মেয়েকে প্রাইভেসি দিতে পারে।”
“তুমি কি কোনো ভাবে বোঝাতে চাইছো যে আমি তোমাকে প্রাইভেসি দেই না?”
“আপনার ব্যাপারটা আলাদা। কথা হচ্ছে স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের প্রসঙ্গে। যাইহোক, যেটা বলছিলাম। হোস্টেলের ঠিক পাশেই থাকবে অবসর কেন্দ্র।”
“অবসর কেন্দ্রটা আবার কি?”
“বাচ্চারা লেখাপড়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে আসবে অবসর কেন্দ্রে। এখানে থাকবে লাইব্রেরী, গান এবং বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র শেখার ব্যাবস্থা, ছবি আঁকার ব্যাবস্থা, নাচ শেখার ব্যাবস্থা। এই তিনটা বিল্ডিং ছাড়া যে ফাঁকা জায়গা অবশিষ্ট থাকবে, সেটাকে দুই অংশে ভাগ করা হবে। প্রথম অংশ হবে খেলার মাঠের। মাঠের একদিকে পিচ বানানো হবে, বাচ্চারা ক্রিকেট খেলবে। অন্যদিকে গোলপোস্ট টানিয়ে বাচ্চারা ফুটবল খেলবে।
দ্বিতীয় অংশটা হবে বাচ্চাদের ক্যাম্পাস। সেখানে থাকবে এক ভাস্কর্য।”
“কার ভাস্কর্য?”
“ইরাবতীর।” “এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
রোদ মনে মনে স্বীকার করল, অতন্দ্রিলা মেয়েটার চিন্তাভাবনা অত্যন্ত গোছানো।
রোদ শীতল গলায় বলল, “আচ্ছা ভালো কথা, স্কুলের অধ্যক্ষ হবে কে?”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি।”
“তুমি শিক্ষকতা জানো?”
“অধ্যক্ষ হতে শিক্ষকতা জানতে হয় না। একজন অধ্যক্ষের তিনটা বিশেষত্ব থাকে। সেগুলো হলো – চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান, তীক্ষ্ম নজর এবং নেতৃত্বে পারদর্শিতা। তিনটাই আমার মধ্যে কমবেশি আছে। আমার ধারনা আমি পারবো।”
“আমারও ধারনা তুমি পারবে। কারন তুমি যেকোনো কাজই অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে করো।”
“জানি। একটা মজার কথা শুনবেন?”
“হুঁ।”
“স্কুলের উপাধ্যক্ষ হতে আবার দুটি গুন লাগে। সেগুলো হলো – সকল ঘটনা তদারকি করতে পারা এবং যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে পারা। এই দুটি গুন আছে আমার আপার। তাই আমার আপা হবে এই স্কুলের উপাধ্যক্ষ।”
“কিন্তু তোমার আপা তো তোমার পছন্দের মানুষদের তালিকায় নেই।”
“তাতে কি হয়েছে? আপার মধ্যে এই দুটো গুন আছে। এছাড়া তিনি অতিরিক্ত কথা বলেন এবং মানুষকে অতিরিক্ত জ্ঞান দেন। এগুলোও একজন উপাধ্যক্ষের বৈশিষ্ট।”
রোদ ক্লান্ত গলায় বলল, “আকাশের অবস্থা কিন্তু ভালো না, যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। ফিরে যাবে তন্দ্রি?”
“চলুন।”
রোদ অতন্দ্রিলাকে পৌঁছে দিয়ে অফিসে চলে গেল। দুপুরের দিকে নামল ঝুম বৃষ্টি।
অতন্দ্রিলা চিন্তা করছে, এখন বৃষ্টিতে ভিজলে কি সেটা শিশুসুলভ কাজ হবে? নাহ্, বৃষ্টিতে অযথা নাচানাচি করা শিশুসুলভ কাজ। কিন্তু বৃষ্টিতে পাটি পেতে বসে থাকাটা শিশুসুলভ কাজ নয়।
অতন্দ্রিলা তা-ই করল। বৃষ্টির মধ্যে ছাদে পাটি পেতে বসে পরল। একদৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখছে সে।
একদৃষ্টিতে জানালার ভিতর থেকেও বৃষ্টি দেখা যেত। কিন্তু সেটা অনুভূত হত না।
এখন অতন্দ্রিলা একইসঙ্গে বৃষ্টি দেখছে এবং অনুভব করছে।
বৃষ্টিতে ভিজে অতন্দ্রিলার বেশ ভালো ঝামেলা হয়েছে। জ্বর এসেছে, মাথা ঝিমঝিম করছে, চোখ কটকট করছে।
জ্বর এসেছে, আসতেই পারে। এটা হৈচৈ করে বাড়ির লোকদের জানানোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাই অতন্দ্রিলা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো।
সন্ধ্যা সাতটা। অতন্দ্রিলা চাদরের নিচে। সে বুঝতে পারছে না জেগে আছে নাকি স্বপ্ন দেখছে। হঠাৎ, কপালে এক হিমবাহের মত ঠান্ডা হাত অনুভব করল। তাকিয়ে দেখল, হাতটা রোদের। অতন্দ্রিলা বুঝতে পারলো, তার ঘুম ভেঙেছে।
অতন্দ্রিলা এখনো শুয়ে আছে।
রোদ নিচু গলায় বলল, “জ্বর আসল কিভাবে?”
“বৃষ্টির মধ্যে বসে ছিলাম।”
“বৃষ্টির মধ্যে কেউ বসে থাকে?”
অতন্দ্রিলা ক্লান্ত গলায় বলল, “আমি থাকি। কেন থাকি সেটা এখন বলতে ইচ্ছা করছে না।”
“বলতে হবেও না। একটু উঠে বসো তো তন্দ্রি।”
অতন্দ্রিলা উঠে বসল। রোদ সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে থার্মোমিটার দিয়ে দিল। কয়েক মিনিট পর ব্যস্ত ভঙ্গিমায় থার্মোমিটার হাতে নিল রোদ।
অতন্দ্রিলা বলল, “কত জ্বর?”
“একশ দুই পয়েন্ট পাঁচ। তুমি ওষুধ খেয়ে আবার শুয়ে পরো।”
“খালি পেটে ওষুধ খাবো?”
রোদ অতন্দ্রিলার দিকে প্যারাসিটামল এবং পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “অ্যাসপিরিন জাতীয় ট্যাবলেট খালি পেটে খাওয়া যায় না। প্যারাসিটামল খাওয়া যায়।”
অতন্দ্রিলা বাধ্য মেয়ের মতো ওষুধ খেয়ে শুয়ে পরল।
রাত একটা। জ্বর কমার কোনো নামগন্ধ নেই।
রোদ অতন্দ্রিলা কপালে জ্বরপট্টি দিতে ব্যস্ত।
অতন্দ্রিলা বিড়বিড় করে বলল, “কেন করছেন আমার জন্যে এসব?”
রোদ হতাশ গলায় বলল, “অসুখ নামের দানবটা খুবই ভয়ংকর। এই দানবের থাবায় আমি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলোর একজনকে হারিয়েছি। দ্বিতীয়বার সেই দানবকে আমার আর কোনো প্রিয় মানুষকে কেড়ে নিতে দেব না।”
অতন্দ্রিলার গা বেয়ে শীতল হওয়া বয়ে গেল। রোদ কি বলল? “আর কোনো প্রিয় মানুষকে কেড়ে নিতে দেব না।”
এর মানে কি? অতন্দ্রিলা রোদের প্রিয় মানুষগুলোর একজন? তাহলে তো মন্দ হয় না।
আজ ১৪ই মার্চ, অতন্দ্রিলার জম্মদিন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ১৫ কিংবা ১৬ই মার্চে পালিত হয়ে আসছে তার জন্মদিন। এর কারন হলো অতন্দ্রিলার পরিবারের প্রায় সকলে তার জন্মদিন মনে রাখতে পারে না।
একবার হলো কি, জন্মদিনের পরের দিন অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় হামিদ সাহেবকে বলে, “বাবা জানো কাল না আমার জন্মদিন ছিল।”
হামিদ সাহেব এক দারুন অপরাধবোধে ভোগেন। সেই দিনই বাড়িতে ধুমধাম করে জন্মদিনের আয়োজন করা হয়।
গত বছর হামিদ সাহেব ঘোষনা দিয়েছিলেন, “এবার কিছুতেই অতর জন্মদিন ভুলে যাবো না।”
ঘোষণা অনুযায়ী তিনি ঠিক রাত বারোটায় ফুলের তোড়া নিয়ে অতন্দ্রিলার ঘরের দরজার সামনে উপস্থিত হন,জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। সময়টা একদম ঠিক থাকলেও, তারিখটা ছিল ভুল।
অতন্দ্রিলা ফুলের তোড়া গ্রহণ করে স্বাভাবিক গলায় বলে, “ধন্যবাদ বাবা। কিন্তু আজ আমার জন্মদিন না। আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসা দিবস। আমার জন্ম দিবস সামনের মাসে।”
অতন্দ্রিলার ধারনা, “জন্মদিন নিজস্ব আনন্দের দিন। এই দিনে নিজে নিজে আনন্দ করা উচিত।”
জন্মদিনে অতন্দ্রিলা সারারাত বই পড়ে। সকালে উঠে রান্না করে, ছাদে বসে গান গায়, নিজের সঙ্গে কথা বলে।
অতন্দ্রিলা বুঝে গেছে রোদ জন্মদিন উপলক্ষে কোনো আয়োজন করেছে। সে নিচে নেমে গেল।
নাহ্, নিচে কোথাও রোদ নেই। অতন্দ্রিলা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দেখে রোদ গাড়িতে বসা।
রোদ বলল, “তন্দ্রি গাড়িতে উঠে এসো।”
অতন্দ্রিলা কোনো প্রশ্ন না করে গাড়িতে উঠল।
রোদ উৎসাহিত গলায় বলল, “শুভ জন্মদিন।”
“জানলেন কি করে?”
“চাইলেই জানা যায়। চলো তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই!”
অতন্দ্রিলা বিস্মিত গলায় বলল,“কোথায়?”
“গেলেই দেখতে পাবে।”
রোদ অতন্দ্রিলাকে নিয়ে গেল ফাঁকা এক ব্রিজের ওপর। গাড়ি থেকে নেমে রোদ গাড়ির পেছন থেকে একটা খাঁচা বের করল।
খাঁচাভর্তি পাখি।
অতন্দ্রিলা কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “এসব কি?”
“আজ তোমার জন্মদিন উপলক্ষে আমরা এই চব্বিশটা পাখিদেরকে বন্দী জীবন থেকে মুক্তি দিব।”
“চব্বিশ বছর বয়স হয়ে গেল বলে চব্বিশটা পাখি?”
“হুঁ!”
অতন্দ্রিলা মহা আনন্দে পাখিদের খাঁচা থেকে মুক্ত করছে। এভাবে কোনো মানুষকে যদি বন্দী জীবন থেকে মুক্তি দিতে পারতো, তাহলে আরও বেশি আনন্দ হতো।
শীতের সকাল। চারিদিকে বইছে দমকা হাওয়া। সমুদ্রের তীরে থাকা সাত-আট জন মানুষ ঠকঠক করে কাঁপছে।
কিন্তু অতন্দ্রিলা কাঁপছে না। কফির মত রঙের একটি চাদর গায়ে জড়িয়ে বসে আছে সমুদ্রের তীরে। অতন্দ্রিলা চিন্তা করছে, এই সুবিশাল সমুদ্রে ভয়ংকর এক পাপীকে যদি চুবিয়ে আনা হয় তাহলে কি হবে? তার সব পাপ ধুয়ে যাবে? নাহ্! ত্বকে এসিডের দাগ আর মনের পাপ কখনই সম্পুর্নভাবে ধোয়া যায় না। কিছু না কিছু চিহ্ন থেকেই যায়।
অতন্দ্রিলার পাশে বসে চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে রোদ, চাটা বেশ ভালোই লাগছে তার।
রোদ উৎসাহিত গলায় বলল, “অতন্দ্রিলা, তুমি কি গুগলপ্লেক্স সম্পর্কে জানো?”
অতন্দ্রিলা ভ্রু সামান্য কুঁচকে বলল, “কি সম্পর্কে?”
“গুগলপ্লেক্স।”
“সেটা কি? গুগলের নতুন কোনো অ্যাপ?”
রোদ ঠোঁটের কোনো হাসি নিয়ে বলল, “না। গুগলপ্লেক্স হলো একটা সংখ্যা।”
“সংখ্যা? সংখ্যার এমন নাম কেন?”
“এই সংখ্যাটি এত বড় যে, তা লিখে রাখার মতো জায়গা এই মহাবিশ্বে নেই। ১০ হিসাবে ১০ এর শক্তি হিসাবে ১০০ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 10(¹⁰^¹⁰⁰)।”
“আসলেই কি এই সংখ্যা লিখতে গেলে মহাবিশ্ব সমান জায়গা লাগবে?”
“কিছুটা সেরকমই। গুগলপ্লেক্স সংখ্যাটি শুনতে তোমার ৩১,০০০ বছর সময় লাগবে।”
“অসাধারন ব্যাপার তো! ভালোবাসার পরিমাণ বোঝাতে,গুগলপ্লেক্স উদাহরন হিসেবে ব্যাবহার করা যেতে পারে। যেমন, আমি তোমাকে গুগলপ্লেক্সের সমান ভালোবাসি।” “এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
রোদ কোনো জবাব দিলো না। এতে অতন্দ্রিলা কিছুটা বিব্রত বোধ করল। ভালোবাসার প্রসঙ্গ তোলাটা বোধ হয় ঠিক হয়নি।
অতন্দ্রিলা অস্পষ্ট গলায় বলল, “আবার ঘৃণার কথাও বলা যায়। আমি তোমাকে গুগলপ্লেক্সের সমান ঘৃণা করি।”
“গুগলপ্লেক্স অনেক বৃহৎ, অনেক। একটা মানুষের প্রতি আরেকটা মানুষের এতটা ঘৃণা থাকতে পারে না।”
“ভালোবাসা থাকতে পারে?”
“পারে।”
“কেন?”
“কারন ভালোবাসা মানুষকে আনন্দ দেয়। মানুষ ভালোবাসতে ভালোবাসে, তাই ভালোবেসে যায়। কিন্তু ঘৃণা মানুষকে আনন্দ দেয়, বরং তার দুঃখকে কয়েক গুন বাড়িয়ে দেয়। তাই একপর্যায়ে ঘৃণা ফুরিয়ে যায়। কিন্তু ভালোবাসা ফুরোয় না।”
মূল কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ইনানী বীচ। এই বীচ অন্যান্য বীচের থেকে যে আলাদা তা নয়। তবুও মানুষ কক্সবাজারে বেড়াতে এলে সেখানেই যাবেই।
অতন্দ্রিলা এবং রোদও যাচ্ছে।
অতন্দ্রিলার ধারনা, মানুষ ইনানীতে যায় বীচটাকে উপভোগ করার জন্যে নয়। বরং সেখানে যাওয়ার রাস্তাটাকে উপভোগ করার জন্যে।
রাস্তার ডানদিকে সমুদ্র এবং বামদিকে পাহাড়। প্রকৃতির দুই আশ্চর্যজনক সৌন্দর্য মুখোমুখী। তবে প্রকৃতির এই দুই সৌন্দর্যকে মুখোমুখি দেখা যাচ্ছে মানুষের কারনেই। মানুষ যদি বুদ্ধি করে পাহাড় ও সমুদ্রের মাঝে রাস্তা তৈরি না করতো, তবে এত সুন্দর দৃশ্য দেখতে হতো না।
সেই রাস্তা দিয়ে চলছে অতন্দ্রিলাদের জিপ গাড়ি। অতন্দ্রিলা বসেছে রোদের সামনে।
অতন্দ্রিলা আগ্রহ নিয়ে বলল, “আপনার কোনটা পছন্দ, পাহাড় নাকি সমুদ্র?”
“যখন যেটার কাছাকাছি থাকি, তখন সেটাই প্রিয়।”
“এখন তো দুটোরই কাছাকাছি আছেন!”
“তাহলে এখন দুটোই প্রিয়। তোমার পছন্দের কোনটা?”
“সমুদ্র।”
“কেন?”
“কারন ঢাকায় সমুদ্র নেই। সমুদ্র দেখতে আসতে হয় কক্সবাজারে। তাই সমুদ্রের প্রতি অন্যরকম একটা টান আছে।”
“ঢাকায় পাহাড়ও তো নেই!”
“পাহাড় নেই কিন্তু আপনাদের বাগান আছে। সবুজে ঘেরা ওই বাগানটা আমাকে পাহাড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।”
রোদ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “ইরাও একই কথা বলত।”
“আপনার এই ব্যাপারটা না আমার অনেক ভালো লাগে।”
“কোন ব্যাপারটা?”
“এইযে বারবার ইরাবতীর কথা বলা এবং আমাকে মনে করিয়ে দেওয়া যে আপনি তাকে ভোলেননি, এখনো তার জন্যে অফুরন্ত ভালোবাসা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যাতে আমি আপনার মনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা না করি।”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “রোদ সাহেব?”
“হুঁ।”
“আপানার ধারনা ভুল, সম্পূর্ণ ভুল। আমি ইরাবতীর জায়গা নিতে চাই না।”
“আমার এমন কোনো ধারনা নেই।”
“আমি আপনার স্ত্রী হতে চাই না। আমি আপনার বন্ধু হতে চাই।”
রোদ নিশ্চুপ। অতন্দ্রিলাও কথা বলছে না।
নীরবতার সঙ্গে পা ভেজাচ্ছে।
সূর্যাস্ত হয়েছে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এল।
রোদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “চল এবার যাই।”
“যাচ্ছি। তার আগে একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন?”
“কি প্রশ্ন?”
“বন্ধু হতে পারি?”
রোদ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “পারো, চাইলেই পারো।
“ধন্যবাদ।”
“তাহলে আমিও কি তোমাকে আমার বন্ধু ভাবতে পারি?”
“ভাবতে পারেন না। আপনি আমার বন্ধু, আমিও আপনার বন্ধু। এর মধ্যে ভাবাভাবির কি আছে?”
ফাইভ স্টার হোটেলগুলোর নাস্তা তেমন একটা ভালো লাগে না অতন্দ্রিলার। নাস্তায় এত আয়োজন অসহ্য লাগে। তার মতে, “দিনের প্রথম আহারটি হওয়া উচিত সাদামাটা ধরনের। যা দেখে চোখ শান্তি পাবে, যা খেয়ে মন শান্তি পাবে।”
আজ অতন্দ্রিলাকে একাই নাস্তা করতে হচ্ছে। রোদ গেছে ক্যাম্প ফায়ারের আয়োজন করতে।
সন্ধ্যা ফোন করেছে, অতন্দ্রিলা নিতান্ত অনিচ্ছায় টেলিফোন তুলল।
সন্ধ্যা উৎসাহিত গলায় বলল, “কিরে তোদের হানিমুন কেমন চলে?”
অতন্দ্রিলা বিরক্ত গলায় বলল,“কি কেমন চলে?
“হানিমুন! আরে শোন না আমাদের হানিমুনের সময়ে কি হয়েছে। আমরা গিয়েছিলাম সিলেটে। কনকনে ঠান্ডা! তোর জাভেদ ভাইয়ের মাথায় সারাক্ষণ কমলা রঙের মাফলার পেছানো। ছবি তোলার সময়ও মাথায় ঘোমটা দিয়ে রেখেছিল। তাই রাগে, দুঃখে হানিমুনের ছবিগুলো আর প্রিন্টই করিনি। রোদ আবার সেরকম কিছু করছে না তো?”
“তোমার কি মনে হয় আপা?”
“আমার তো মনে হয় করছে না।”
“তাহলে করছে না!”
“আচ্ছা তোকে একটা কাজের কথা বলি! শোন সবসময় রোদের কাছাকাছি থাকবি, বিশেষ করে বিয়ের প্রথম বছরটা। কখনো ওকে চোখের আড়াল করবি না। পারলে ওর কাছে ঘেঁষে থাকবি। এতে হবে কি, ও আর অন্য মেয়েদের দিকে তাকানোর সুযোগ পাবে না।”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “আপা তোমার তো খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই, তুমি গিয়ে জাভেদ ভাইয়ের কাছে ঘেঁষে থাকো। আমি রাখলাম।”
সন্ধ্যাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অতন্দ্রিলা টেলিফোন রেখে দিল।
রাতে সমুদ্রের তীরে ক্যাম্প ফায়ার করা হয়েছে, তাবু খাটানো হয়েছে। তাবুর পাশে আবার রয়েছে বারবিকিউয়ের ব্যাবস্থা।
তাবু খাটানোর কোনো অর্থ নেই, রোদ অতন্দ্রিলা কেউই রাতে সেখানে থাকবে না।
তবুও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যে খাটানো।
অতন্দ্রিলা সেখানে বসে আছে। রাতের সমুদ্রে এক অন্যরকম রহস্য রয়েছে। সমুদ্রের জলকে জল মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে পারদ। পারদ দেখতে চকচকে তবে সে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাকে ধরতে গেলেই ছুটে পালায়।
সমুদ্রের জলও কি এখন ধরতে গেলে ছুটে পালাবে? ব্যাপারটা পরীক্ষা করা দরকার।
রোদ এসে অতন্দ্রিলার পাশে বসল।
আনন্দিত গলায় বলল, “আয়োজন কেমন হয়েছে অতন্দ্রিলা?”
“এই অর্থহীন তাবুটাকে বাদ দিলে, ভালো।”
“আচ্ছা তোমার নামটা কে রেখেছে?”
“আমার বাবা। আমাদের তিন ভাইবোনের নামই উদ্ভট। আমার বাবা মনে করেন, উদ্ভট নামের অধিকারীকে মানুষ মনে রাখে। সাধারন নামের অধিকারীদের মানুষ অন্য কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে।”
“অতন্দ্রিলা নামের অর্থ কি?”
“যাকে তন্দ্রা স্পর্শ করতে পারে না।”
“তোমাকে তন্দ্রা স্পর্শ করতে পারে না?”
“এখন পারে কিন্তু হয়তো আমার জন্মের পরপর পারতো না। তাই এমন নাম রাখা হয়েছে আমার। তা, হঠাৎ এই নামের প্রসঙ্গ?”
“না মানে, বারবার তোমার নামটা উচ্চারন করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার।”
“কষ্টসাধ্য ব্যাপার হলেও কিছু করার নেই। অতন্দ্রিলা বলেই ডাকতে হবে।”
রোদ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আচ্ছা তুমি তো আমাকে অত ডাকতে মানা করেছো। কিন্তু অ-তন্দ্রি-লা থেকে যদি শুধু ‘তন্দ্রি’ ডাকি, তাহলে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে?”
অতন্দ্রিলা ঠোঁটভর্তি হাসি নিয়ে বলল, “আপত্তি থাকবে কেন? আমার নামের ভেতরেই যে এত সুন্দর একটা নাম লুকিয়ে আছে, তা আগে খেয়ালই করিনি!”
রোদ আজ প্রথম অতন্দ্রিলাকে হাসতে দেখছে। বেশির ভাগ মানুষ যখন হাসে, তখন কেবল তাদের ঠোঁট হাসে। চোখ হাসে না। অতন্দ্রিলার চোখ এবং ঠোঁট একসঙ্গে হাসছে।
অতন্দ্রিলা বলল, “আপনার দেওয়া নামটা আমার অস্বাভাবিক পছন্দ হয়েছে। এই পৃথিবীতে আমাকে ‘অত’ নামে ডাকার অধিকার আছে ছয়জন মানুষের। তারা হলেন আমার বাবা, মা, দাদি, আপনার মা, শহর এবং জরিনা। কিন্তু আমাকে ‘তন্দ্রি’ নামে ডাকার অধিকার শুধুমাত্র আপনার। কারন এই নামটা আপনি দিয়েছেন।”
“তাহলে তো আমি ধন্য, তন্দ্রি।”
“বেশিবেশি তন্দ্রি ডাকবেন। যতবার শব্দটা শুনি, আমার ভালো লাগে।
আমি এতটাই আনন্দিত যে এখন আপনাকে গান শোনানো হবে। আমি যখন কারও ওপর অনেক বেশি খুশি হই, তখন তাকে গান শোনাই।”
“গান পারো নাকি?”
“যে মানুষ কথা বলতে পারে, সে গানও গাইতে পারে। গুনুন তো এখন।”
এতদিন যে বসেছিলেম
পথ চেয়ে আর কাল গুনে,
দেখা পেলেম ফাল্গুনে।
স্বর্গে মানুষের মতো দেহবিশিষ্ট সুকন্ঠী গায়িকাদের বলা হয় কিন্নর। এদের থাকে ত্রিকাল ভুলানি কণ্ঠ। অতন্দ্রিলা জন্মেছে কিন্নর কণ্ঠ নিয়ে।
রোদ আজ দেখল অন্য এক অতন্দ্রিলাকে। খুশি হলে যে একটা মানুষ এতটা বদলে যেতে পারে তা রোদের জানা ছিল না।
রোদের খুব ইচ্ছে হচ্ছে অতন্দ্রিলাকে বলতে, “তুমি কি সারাক্ষণ এভাবে হেসে গেয়ে থাকবে?”
অতন্দ্রিলা মুখের ওপর “না” বলে দিবে অথবা সঙ্গে সঙ্গে মুখটা আবার গোমড়া করে ফেলবে ভেবে, রোদ আর বলল না।
ঝিম ধরা মাথায় চোখটা আধো খুলতেই ক্যামেরার ফ্লাসে আমার চোখ আবার বন্ধ হয়ে এলো।কানে ভেসে এলো ‘এই জ্ঞান ফিরেছে,জ্ঞান ফিরেছে’ শব্দের একরাশ হৈ হুল্লোড়।ঘোর কাটিয়ে চোখ পুরোপুরি খুলতেই দেখলাম কতগুলো একত্রিত উৎফুল্ল মুখ আর তাদের হাতের অ্যান্ড্রয়েড ফোনগুলোর ফোকাস সব আমার বেহুঁশ হয়ে থাকা মুখের দিকেই।এরা কি ছবি তোলার আর কিছু পেলো না,আমার অজ্ঞান মুখের ছবিই তুলতে হবে।খোলা আকাশের নিচে গার্ডেনের বিশাল চত্বরের চারিদিকে ঝলমল আলো আর সাজসজ্জায় ভরপুর লোকজনের ভীড় দেখে আমি খানিকটা চমকে উঠলাম।আরো চমক লাগলো যখন নিজের গায়ে সেই সাধারণ সুতি শাড়ীর পরিবর্তে লাল বেনারসি শাড়ি আর গা ভর্তি গয়না দেখতে পেলাম।গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠে পাশে চোখ যেতেই দেখি নিদ্র আমার সাথেই সিংহাসন টাইপ সোফায় গোল্ডেন কালারের সেরোয়ানী পড়ে বর বেশে পাশে বসে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে যাচ্ছে।আমি পুরোপুরি চোখ খুলে বড় বড় করে তার দিকে তাকাতেই সামনে থাকা ভীড়ের সকলেই হাততালি দেওয়া শুরু করলো আর বলতে লাগলো ‘বউয়ের জ্ঞান ফিরে গেছে,জ্ঞান ফিরে গেছে’।আমি চমকে ঈষৎ নড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরলাম।হচ্ছে কি এসব!
-‘মিসেস আরিয়ান নিদ্রর জ্ঞান এতক্ষণে ফিরলো তবে!’
আমি পুনরায় চমকে উঠে নিদ্রর দিকে তাকালাম।সে আমার পাশে দাঁড়িয়ে শুধু দুষ্ট হাসি দিচ্ছে। তার না আজকে রাইশার সাথে বিয়ে হয়ে গেছে।সেকারণেই তো আমি জ্ঞান হারালাম।তাহলে এসব কি!আমি বউয়ের সাঁজে স্টেজে নিদ্রর পাশে কি করছি?রাইশা কোথায়?আর সবাই এভাবে হাত তালিই বা দিচ্ছে কেন?
আমার এভাবে হাবার মতো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকায় নিদ্র বলল,
-‘কি,এখনো বুঝতে পারলে না?জানি বুঝবে না।’
বিশাল স্টেজের সাইড দিয়ে তামিম ভাইয়া,রাফি ভাইয়া,সাফা,সোমা আপু,তানিয়া আপু আর রাইশা উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। রাইশার পড়নে সবার মতোই অন্য পোশাক।
তানিয়া আপু বললো,
-‘উফ!সুপ্তি ভাগ্যিস তোমার জ্ঞানটা ফিরলো!সবাই সেই একঘন্টা যাবৎ এখানে স্টেজের সামনে বসে তোমার দিকে মনোযাগ সহকারে ঝুঁকে আছে।কখন বউয়ের জ্ঞান ফিরবে আর কখন সব অনুষ্ঠান শুরু হবে।আজ পর্যন্ত কারো জ্ঞান ফিরায় হয়তো এতো মানুষ একসাথে খুশি হয়নি যতটা তোমার জ্ঞান ফিরায় হলো।হি হি হি!’ “এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
আমি তাদের কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।তারা এসব কি বলছে!
সাফা আমাকে একটা ঝাঁকি দিয়ে বললো,
-‘এতো অবাক হতে হবে না,গাধী!নিদ্র ভাইয়া অন্য কাউকে বিয়ে করেনি।তুই নিদ্র ভাইয়ার বউ ছিলি,আছিস আর আজীবন থাকবি।’
তামিম ভাইয়া বললো,
-‘তোমার নিদ্র তোমারই আছে সুপ্তি।নিদ্র আবার থাকবে সুপ্তিকে ছাড়া! এও কি কোনোদিন সম্ভব!’
রাফি ভাইয়া বললো,
-‘কাভি নেহি।যেখানে আল্লাহ বানিয়ে দিয়েছে তোমাদের দুজনকে জোড়ায়,সেখানে ঘুম থেকে ঘুমকে আলাদা করার আর সাধ্য কার।’
সোমা আপু বললো,
-‘এবার বুঝতে পারলি বুদ্ধু!আজকের বিয়ের অনুষ্ঠানটা তোদের দুজনেরই।নিদ্র ভাইয়া শুধু তোকে একটু বোকা বানালো।’
চারপাশ থেকে সবার কথা শুনে আমি এখনো হতভম্ব হয়ে আছি।কেনো যেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না।মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি।’
রাইশা বললো,
-‘ভাবী তোমার সাথে এবার আসল পরিচয়টা করে নেই।আমি তোমার ননদ,নিদ্রর কাজিন।বলতে গেলে বন্ধুর মতোই।’
রাইশা এবার নিদ্রর দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘নিদ্র, ভাগ্যিস এই নাটকীয় জটটা তাড়াতাড়ি খুলে দিলি নয়তো ভাবী প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে আমার দিকে যেভাবে চোখ গরম করে তাকাচ্ছিলো আরেকটু হলে হয়তো আমাকে গিলেই ফেলতো।’
সবাই রাইশার কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।আমি খুশিতে টলমল চোখে নিদ্রর দিকে ঘুরে তাকালাম।সে মুচকি হেসে পলক ফেলে আমাকে বিশ্বস্ত করলো।আমি ঝপ করে তার বুকে মুখ লুকিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।
-‘আমি স্বপ্ন দেখছি না তো!’
নিদ্র মৃদু হেসে আমাকে আগলে ধরে বলল,
-‘না স্বপ্ন না,এসব সত্যি,সব সত্যি।পাগলী!এবার কান্না থামাও।যেভাবে জড়িয়ে রেখেছো সামনে কিন্তু সিনিয়র সিটিজেনরাও আছে।’
নিদ্র আর আমার বাবা মা একটু খুকখুক করে কেশে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে মুখ টিপে হাসতে লাগলো।আমি খানিক লজ্জা পেয়ে তাকে ছেড়ে মৃদু হেসে চোখের পানি মুছে নিলাম।
আমার অবস্থা প্রকাশ করার মতো না।এই হাসছি তো এই চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।খুশিতে কি করবো বুঝতেই পারছি না।হঠাৎ এই অপ্রত্যাশিত অবাধ আনন্দ আমি সামলাতেই পারছি না।
নিদ্র হঠাৎ পেছন থেকে তার কাঁধ দিয়ে আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
-‘কবুল বলার জন্য তৈরি আছেন তো?’
-‘কবুল বলবো মানে!বিয়ের সময় কবুল তো একবার বলেছিলামই।’
নিদ্র একটু মৃদু হেসে কিছু না বলে হাতের তুড়ি বাজিয়ে কাউকে কিছু ইশারা করলো।তারপর নাঈম ভাইয়া এসে আমার আর নিদ্রর হাতে দুটো মাউথ স্পিকার দিয়ে গেল।
নিদ্র মাউথ স্পিকারে বলতে লাগলো,
-‘জীবনের অন্তিম মুহুর্ত পর্যন্ত তবে একটা চুক্তি হয়ে যাক।আজ একবার এই হাত ধরলে কিন্তু আর কখনোই ছেড়ে দেওয়া যাবে না।হাঁটতে হাঁটতে একজন এগিয়ে পড়ুক বা পিছিয়ে পড়ুক হাতের একটা টান কিন্তু সবসময়ই থাকবে।সবসময় সাথে করে চলার টান।মুষ্টিবদ্ধ দুটি হাত কখনোই উন্মুক্ত হতে পারবে না।’
কাজী সাহেব নীচ থেকে বলে উঠলেন,
-‘যদি রাজী থাকো তাহলে মা বলো কবুল।’
আমি লাজুক মুখে মাইক মুখের কাছে নিয়ে বললাম,
-কবুল।’
নিদ্র বলল,
-‘যখন যেই সমস্যাই আসুক না কেনো কখনই নিজে একা একা সামলানো যাবে না।জীবনসঙ্গী তো একারণেই হয় তাই না যে সমস্যাগুলোকে ভাগ করে নিয়ে বোঝটা হালকা করে নেওয়ার জন্য।যতটা সুখের ভাগীদার ততটাই দুঃখের।তাই এরপর থেকে যাই হয়ে যাক না কেনো সব সমস্যাগুলো একসাথেই লড়তে দিতে হবে।’
কাজী সাহেব বললেন,
-‘যদি রাজী থাকো তাহলে মা বলো কবুল।’
আমি বললাম,
-‘কবুল।’
-‘দুজনের মধ্যে কখনোই কোনো কথা লুকানো থাকবে না।দুজন দুজনের জন্য হতে হবে একটি উন্মুক্ত বই।যেখানে মন চাইলেই বারবার ডুব দেওয়া যায়।আর এখন বাকীটা হয়তো বলার প্রয়োজন হবে না।কারণ ভালোবাসা শব্দটার মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে সহস্র প্রতিশ্রুতি।ভালোবাসা মানেই সেসব মেনে চলা।আর ম্যাম এবার কিন্তু বুঝে শুনে কবুল বলবেন এই চুক্তিটার কিন্তু কোনো রিনিউয়্যাল অপশন নেই।’
কাজী সাহেব বলতে নিলেন ‘যদি রাজী থাকো….
তার আগেই আমি একফোঁটা খুশির অশ্রু ঝড়িয়ে বলে দিলাম, কবুল,কবুক,কবুল।’
আকাশে অনবরত আতশবাজি ফুটতে লাগলো আর আমাদের মাথার উপর দিয়ে হতে লাগলো লাল গোলাপের পাঁপড়ির অবিরাম বর্ষণ।
নিদ্র একটু মুচকি হেসে বলল,
-‘তবে কথা দেওয়া থাক,গেলে যাবি চোখের বাইরে না।’
আমিও হেসে ফেললাম আর মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম।
সোহেল ভাইয়া বলে উঠল,
-‘শুধু কি আমাদের ভাবীই একা কবুল বলে যাবে নাকি!শালা তুই বলবি না?’
নিদ্র বলল,
-‘আমাকে তোর ভাবীর দেওয়া কোনো চুক্তি দিতে হবে না।এই ঘুমকন্যার সকল চুক্তিতেই আমি না শুনেই বলে দিলাম,কবুল,কবুল,কবুল।
মাইকে তার চেঁচিয়ে বলা কবুল শব্দ রাতের ঝিকিমিকি তারা ভরা আকাশ অব্দিও যেনো পৌছে গেলো।আকাশে আবারও আতশবাজি ফুটতে লাগলো।
সেই মুহুর্তেই দুটি বৃহৎ রূপার থালায় দুটি ফুলের মালা নিয়ে আসা হল।নিদ্র মুচকি হেসে ফিসফিস করে আমাকে বলল,
-‘এই যে মিসেস আরিয়ান নিদ্র আজকে কিন্তু গলায় মালা ভালো করে পড়াতে হবে।আগেরবারের মতো আমি নিজে গিয়ে মালার মধ্যে ঢুকতে পারবো না।’
আমি মুচকি হেসে মাথা নিচু করলাম।থালা থেকে ধীর হাতে মালা তুলে নিদ্রর দিকে বাড়িয়ে ধরলাম।নিদ্র তার সেই হৃদয় খুন করা হাসি দিয়ে আমার হৃদয়কে আরো একবার খুন করে দিল।মালার ভেতর দিয়ে তার হাসি মুখটা দেখতে কি সুন্দরই না লাগছে।
সোমা আপু বলে উঠল,
-‘একই এভাবেই মালা পড়ানো হবে নাকি!সাজেদ ভাইয়ার বিয়ের মতো একটু দুজনকে উপড়ে তুলে হয়রানি করানো হবে না?’
রাফি ভাইয়া বললো,
-‘হয়রানি!আমরা এখন ওঁকে মালা পড়ানোতে এক বিন্দু হয়রানি করলে দেখা যাবে আমাদের বিয়েতে শালায় মালাই পড়াতে দিলো না।সেভাবে মালা হাতে থাকতে থাকতে মালা শুকাইয়া ছাড়বে।এই আইফেল টাওয়ারের সাথে আমরা আবার পারবো!’
তাদের কথা আর একটু হাসির গুঞ্জন শেষ হলে আমি গভীর আবেগে তার দিকে তাকিয়ে তার গলায় ধীরে ধীরে মালাটা পড়িয়ে দিলাম।নিদ্রও তার হাতের মালাটা আমার গলায় পড়িয়ে দিল।
আমি এক মুহুর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে সেই সুখ অনুভূতিটা অনুভব করছিলাম।খুশিতে আমার চোখে পুনরায় পানি এসে পড়ল।তারপর আমাদের দুজনকে সোফায় বসিয়ে আমাদের সম্মুখে একটি গোলাকার বৃহৎ সুন্দর কারুকার্য খচিত আয়না ধরা হলো।সাথে সাথে দুজনের মাথার উপর একটি বড় নেটের পাতলা লাল ওড়না দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো।আমি লজ্জামাখা দৃষ্টি নিয়ে আয়নায় নিদ্রর চাঁদমুখটা আড়চোখে দেখতে লাগলাম।নিদ্রও আয়নায় আমার চেহারা দেখে একটি চোখ টিপ দিল।তাতে আমি লজ্জায় মাথা নিচু ফেললাম।
আমরা দুজন স্টেজের সামনে সোফায় বসে আছি।আর স্টেজে নিদ্রর বন্ধুরা মিলে সবাই পারফর্ম করছে।রাফি ভাই হঠাৎ মাইক নিয়ে বলতে লাগলো,
-‘আমাদের বন্ধু সবকিছুই ব্যাতিক্রম করে।তাই আমরাও তার বিয়ের অনুষ্ঠানে একটু ব্যাতিক্রমের ছোঁয়া আনতে চাই।আমরা অনেকবারই দেখেছি গানের মাধ্যমে নিদ্রকে তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে।কিন্তু সুপ্তি আই মিন আমাদের ভাবীকে এখনো দেখা হয়নি।তাই আমরা আজ আমাদের ভাবীর মুখে একটা গান শুনতে চাই।নিদ্রর জন্য তার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।’
রাফি ভাইয়ার মুখে এই কথা শুনে সবাই আগ্রহে হাত তালি দেওয়া শুরু করলো আর এদিকে আমি ঘাবড়ে গেলাম।কোনোদিন দশজন মানুষের সামনেও গান গাইনি আর আজ এত মানুষের সামনে গাইবো।নিদ্রর দিকে তাকাতেই সে আমার দিকে তাকিয়ে হাতের উপর হাত রেখে একটি ভরসা মাখা মৃদু হাসি দিল।সাথে সাথে আমার সব জড়তা কোথায় কেটে গেল।তার সেই মুগ্ধকর হাসিতে আমি আরেকবার তার মধ্যে হারিয়ে গেলাম।ধীর পায়ে স্টেজে উঠে মাইক হাতে নিলাম।উজ্জ্বল আলোগুলো সব বন্ধ করে হালকা নীল,গোলাপী আলো দেওয়া হলো।পাশ থেকে গিটারে সুর দেওয়া হলো।লজ্জায় লাল আভায় দীপ্তময় হয়ে আমি ধীরে ধীরে গাইতে লাগলাম,
ভালো লাগে তোমাকে,কাছাকাছি পেলে
ভালোবেসো তুমিও কাছাকাছি এলে,
অন্য তখন চোখের ধরণ
অন্য রকম পায়ের চলন।
হঠাৎ নিদ্র পাশ থেকে স্টেজে উঠে এসে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে গাইতে লাগলো,
তুমি আশেপাশে ছায়া হয়ে মায়ায় জড়ালে
তুমি একই মেশে ভালোবেসে আমায় বাঁচালে
তুমি একলা রাতে একটা চিঠি আমায় পাঠালে।
আমি খুশি হয়ে নিদ্রর দিকে তাকিয়ে গাইলাম,
ভালো লাগে তোমাকে কাছাকাছি পেলে
ভালোবেসো তুমিও কাছাকাছি এলে
♪♪♪♪♪♪
আমি গাইলাম,
তোমায় নিয়ে ব্যস্ত যখন
অন্য কিছু আমি শুনতে না পাই।
নিদ্র আমার গালে দু হাতে রেখে চোখে চোখ রেখে গাইলো,
তোমার হাতে বাচন মরণ
আমার পাশে শুধু তোমাকে চাই
তুমি আশেপাশে ছায়া হয়ে মায়ায় জড়ালে
তুমি একই মেশে ভালোবেসে আমায় বাঁচালে
তুমি একলা রাতে একটা চিঠি
আমায় পাঠালে……
আমি আমার গালে রাখা তার হাতকে বাম হাত দিয়ে ধরে গাইলাম,
ভালো লাগে তোমাকে কাছাকাছি পেলে
ভালোবেসো তুমিও কাছাকাছি এলে।
পেছন থেকে গানের সফট মিউজিক বাজতেই লাগলো।নিদ্র আমার গালে হাত দিয়ে কপালে আলতো করে একটি ভালোবাসার পরশ ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দিল।আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।উপর থেকে অনবরত ফুলের বর্ষণ হতে লাগলো।নিদ্র গভীর আবেগে তার বুকে আমাকে টেনে নিল।আমিও অনাবিল প্রশান্তিতে আমার প্রিয় শান্তির নীড়ে ঠাঁই নিলাম।
স্টেজ থেকে নিচে নেমে আমি আর নিদ্র মা বাবা আব্বু আম্মুর দোয়া নিতে গেলাম।আব্বুকে কিছু না বলে শুধু জড়িয়ে ধরে রাখলাম।কতো অভিমান হয়েছিল আব্বুর উপর।আর আব্বু তো আমাকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটাই ফিরিয়ে দিচ্ছিলো।আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
-‘আমার আম্মু,সোনা,মামুনিটার অভিমান হয়েছিল আমার উপর তাই না?আরে পাগলি,তোকে আমরা কখনো কষ্ট দিতে পারি!
আর আরেকটা কথা,কখনো এমন বোকামি আর করবি না ঠিকাছে?পরিবার থাকেই তো এই জন্য যাতে আমরা আমাদের সব দুঃখ,কষ্ট,সমস্যাগুলো পরিবারের সাথে ভাগাভাগি করে হালকা হতে পারি।মনে থাকবে?’
আমি চোখ মুছে হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম।
পাশে তাকিয়ে দেখলাম স্নিগ্ধ মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে।আমি ওর গাল টেনে বললাম,
-‘কিরে তোর আবার কি হলো?’
স্নিগ্ধ বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে মুখে একটা গম্ভীর ভাব এনে বললো,
-‘এটা কি হলো ভাবু!তোমার একটা ছোট বোন টোনও নেই।এখন আমি পার্টনার খুঁজবো কিভাবে?’
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম,
-‘তুই পার্টনার খুজবি মানে?’
-‘আরে!ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গেল।এখন লাইনে তো আমিই আছি।তাহলে আমাকে আগের থেকে খুঁজে রাখতে হবে না।কিন্তু এখানে তো কেউ আমার সমান নেই।হায় রে!একটা বেয়াইনও পেলাম না।তাই আমার মুড অফ।’
নিদ্র ওর কান মলে বলল,
-‘তবে রে!এই বয়সে এত পাকনামি কথা।তোর পার্টনার খোঁজা আমি বের করছি।’
স্নিগ্ধ জিহ্বায় কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলো।কান ছাড়িয়ে এক ছুটে দৌঁড়ে চলে গেল।
কাকু হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে বলল,
-‘হা হা হা।আই লাইক ইট,নিদ্র তোমার ভাইও তোমার মতো সব গুছিয়ে করার চেষ্টা করে।তাইতো এতো ভালো লাগে।আই লাইক ইট,আই লাইক ইট।আগে থেকেই খুঁজে রাখা ভালো,কথাটা মজার ছিলো।হা হা হা।’
আমি বললাম,
-‘কাকু লাইক ইট,লাইক ইট যে করছো,তোমার তো পঁয়তাল্লিশ বছর হয়ে গেল তুমি এখনো একজন পার্টনার আনলে না কেনো?’
-‘এটা তুই কি বললি সুপ্তি?বউ না থাকতেই মাথার চুল সব পড়ে গেল আর বউ থাকলে যে কি হতো আমি তো সেই চিন্তায়ই মরি।হা হা হা।’
কাকুর অট্টহাসির মাঝেই সাফার বাবা মুখটাকে মহা বিরক্তির কারখানা বানিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো।আব্বু গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-‘কি হয়েছে ভাই সাহেব?’
-‘আরে বলবেন না ঐ সাজেদের একটা শালা আছে না কি জানি নাম তামিম না লামিম,ঐ ছেলেটা এত তুড়তুড় করে না!খাবার দিতে গিয়ে আমার পান্জাবীতে ঝোল ভরিয়ে দিল।এখন এই ঝোলের দাগ কি সহজে যাবে?’
সাফা এসে আমার পাশে মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলো আর তামিম ভাইও এগিয়ে এসে একটা সাবান এনে দিল।তার মুখেও ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
আঙ্কেল থমথমে মুখে বলল,
-‘দেখেছেন মাথায় বুদ্ধি!এনেছে সাবান,আরে এখন পানি ছাড়া সাবান লাগালে তো এই দাগ আরো গাঢ় হয়ে যাবে।এই ছেলে তে মনে হয় তাই চায়!’
আব্বু বলল,
-‘থাক ভাই,ছোটো মানুষ না বুঝে করে ফেলেছে।মাফ করে দিন।’
-‘না না এদেরকে মাফ করা ঠিক না।শাস্তি দেওয়া দরকার,কঠিন শাস্তি।আর সেই কঠিন শাস্তি হলো শ্বশুড় হয়ে সারাজীবন জ্বালিয়ে মারা।’
আমরা সবাই অবাক হয় থমকে রইলাম।আর আঙ্কেল হঠাৎ পেট ফাটিয়ে হাসতে হাসতে বলতে লাগলেন,
-‘কি সবাইকে চমকে দিলাম তো!মজা কি শুধু তোমরা ইয়াং জেনারেশনই করতে পারো।হা হা।’
আঙ্কেল কি মজাটাই না করলো!আমরা তো তার থমথমে মুখ দেখেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম না জানি কি হয়!সাফা লজ্জা পেয়ে আমার পেছনে মুখ লুকালো আর তামিম ভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাজুক মুখ নিচু করে মাথা চুলকাতে লাগলো।
আঙ্কেল আবার তামিম ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘এই ছেলে কালকেই আমার বেয়াই বেয়াইনকে আমাদের বাড়ি পাঠাবে।লুকিয়ে লুকিয়ে যে রাস্তা থেকে ব্যালকনিতে কাগজ ঢিল মারতে সে সব কয়টা তো পড়ত আমার মুখে।সেদিকে কোনো হুঁশ আছে?কই নিদ্রর মতো প্রেমের আগে সোজা বিয়ে করে ফেলবে তা না!সুপ্তি মামুনিকে কি সুন্দর দু দুইবার বিয়ে করে ফেললো আর সুপ্তি বুঝলোই ন।একেই বলে ইনটেলিজেন্ট।এমন সাহসী ছেলের বন্ধু হয়েও হবু শ্বশুড়ের থেকে শিক্ষা নিতে হয়?’
কাকু বলল,
-‘ভাই দারুণ একটা মজা করেছেন।আই লাইক ইট,আর এটাও ঠিক বলেছেন,নিদ্রর জবাব নেই।সুপ্তটা যেমনই হয়েছে হাঁদা,জামাই পেয়েছে একটা সেই রকম ইনটেলিজেন্ট ছেলে!হা হা হা।
আমি হা হয়ে নিদ্রর দিকে তাকালাম।ইনি তো দেখি আমাকে বোকা বানিয়ে বিয়ে করে ভালো নাম কামিয়ে ফেলেছে।মজা তো উড়াচ্ছে সবাই আমার!
নিদ্র আমার দিকে তাকিয়ে একটা গর্বিত হাসি দিয়ে কলার ঠিক করতে লাগলো।আমি চোখ কুন্চিত করে তাকিয়ে রইলাম।
রাত বারোটা ত্রিশ।নিদ্রর রুমে তৈরী করা রীতিমত একটি ফুলের বাগানের মধ্যে আমি বসে আছি।মুখ খানিকটা ফুলানো।আর ফুলবেই বা না কেনো?আমাকে এই দুই দিন কি বোকাটাই না বানালো!শুধু কি দুইদিন সেই প্রথম থেকেই তো বোকা বানিয়ে আসছে।আমি কি সাংঘাতিক ভয়ে ছিলাম এই দুই দিন।আরেকটু হলে তো হার্ট অ্যাটাকই হয়ে যেত।দু দুইবার আমাকে বোকা বানিয়ে বিয়ে করে নিল।আর আমি কিছুই করতে পারলাম না।সবাই মিলে মজা করে গেছে আর আমাকে জ্বালিয়ে গেছে।আগে থেকে কি কেউ একটু আভাস দিতে পারলো না।ছবিগুলোও ভালোমতো তুলতে পারলাম না।আজকে আসুক সে তারপর মজা দেখাবো,সবসময় শুধু আমাকে বোকা বানানো!
ভাবতে ভাবতেই উনি এসেও পড়লেন।দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে পিছনে ঘুরতেই আমি তার দিকে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে তার বুকে ইচ্ছেমতো কিল ঘুষি দিতে লাগলাম।তিনি হেঁসে আমার হাত ধরে বললেন,
-‘ওরে বাবা এতো দেখি ডাকাত বউ।বাসরঘরে স্বামীকে সালাম না করে ডাইরেক্ট মারছে।সেই ভার্সিটির প্রথম দিনের সিনিয়রকে থাপ্পড় মারা সেই সাহসী ঘুমকন্যা আবার ফিরে এলো নাকি!’
-‘চুপ!আপনি খুব পচাঁ।আমাকে কি ভয়টাই না পাইয়ে দিয়েছিলেন।আগে থেকে বললে কি হতো? একটু ভালোমতো ছবি তুলতে পারলাম না।আমার গায়ে হলুদও তো হলো না!’
উনি দুষ্ট হাসি দিয়ে হেসে বলল,
-‘কে বলেছে গায়ে হলুদ হয়নি।তোমার কোমড়ে এতো রোমান্টিক ভাবে যে আমি হলুদ লাগিয়ে দিলাম সেটা ভুলে গেছো?’
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
-‘সেটা আপনি লাগিয়েছেন?’
-‘ইয়েস ম্যাম,আর ছবির কথা বলছো!আমাদের ছবি মানে তোমার সেই চোখ বড় বড় করা অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকাই তো আমাদের সিগনেচার পোজ।আর সেটাই পারফেক্ট।’
কথাটি বলে তিনি আমাকে ঘুরিয়ে বিছানার উপরের দেয়ালের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করলেন।সেখানে দেখতে পেলাম আমাদের সেই কাজী অফিসে বিয়ের একটা দেয়ালজুড়ে বড় ছবি।যেখানে আমার হাতের মালা গলায় পড়ে তিনি দাঁত কেলিয়ে আমাকে মালা পড়াচ্ছেন আর আমি চোখ কপালে তুলে বড় বড় করে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।কি সুন্দর ছবিটা!
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-‘আচ্ছা আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি তো আগেই করা আছে তাহলে আমি তখন কোন কাগজে স্বাক্ষর করলাম?’
নিদ্র একটি চোখ টিপ দিয়ে বলল,
-‘ওটা আমাদের হানিমুনে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেছো।বাব্বাহ!যেই ভাবে জ্ঞান হারিয়েছিলে!তারপর যে তোমাকে শাড়ি গয়না পড়িয়ে সাজগোজ করানো হলো তাতেও জ্ঞান ফিরলো না।কত কষ্ট হয়েছে ওভাবে সাজাতে!’
আমি হঠাৎ হকচকিয়ে বললাম,
-‘আমার শাড়ি পাল্টিয়ে বিয়ের শাড়ি পড়ালো কে?’
নিদ্র দাঁত কেলিয়ে হেঁসে একটা চোখ টিপ দিয়ে বললো,
-‘কেনো আমি পড়িয়েছি!’
আমি চোখ বড় বড় করে জোড়ে বললাম,
-‘কিহ?’
নিদ্র জোরে জোরে হেঁসে বললো,
-‘থাক এতো ঘাবড়াতে হবে না।শাড়ি তোমার বান্ধবীই পড়িয়ে দিয়েছে।কিন্তু এতো অবাক হলে কেন?আমি পড়িয়ে দিলে কি খুব বেশি অসুবিধা হয়ে যেতো?ম্যাম এখন থেকে অভ্যাস করে নিন,আমি কিন্তু খুবই রোমান্টিক একজন হাজবেন্ড হতে চলেছি।’
আমি লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে বললাম,
-‘ছি!আপনি একটা লুচু।’
-‘কি আমি লুচু।এতদিন ধরে বিয়ে করে তোমার অবুঝ হওয়ার জন্য এখনও বিবাহিত ব্যাচেলর হয়ে থাকছি আর আমি এখন লুচু হয়ে গেলাম।’
-‘দোষটা তো আপনারই।এমন প্যাচ গোছ করে কাজ করেন কেন?কেনো!আমাকে কি সরাসরি প্রপোজ করা যেতো না সরাসরি হুট করে বিয়ে করলেন কেনো?এমন প্যাচের কান্ড করলে আমি বুঝবো কিভাবে?এন্ড পয়েন্ট বি নোটেড,আপনি কিন্তু এখনো আমাকে নিজের মুখে ভালোবাসি বলেননি।’
-‘সম্পর্কটা যেখানে আত্মার সেখানে মুখ ফুটে বলাটা অনর্থক।আর কথা যদি হুট করে বিয়ে করার বলো তবে বিয়ে করবো না তো কি করবো!তোমার বোঝার আশায় বসে থাকলে আমার মাথার চুল সব পেকে সাদা হয়ে যেত তবুও তুমি বুঝতে পারতে না।তাই কোনো রিস্ক না রেখে বিয়ে করে নিলাম তারপর যা হবার হবে।আর এবার এই কাজটা করা হয়েছে কারণ এটা তোমার শাস্তি।আমি তো জানি এই দুইদিন তুমি প্রচুর ভয় পাবে,কষ্ট পাবে,টেনশনে শেষ হয়ে যাবে আর সেটাই তোমার পানিশম্যান্ট।তুমি যা করেছো তার কাছে এতটুকু কিছুই না।আর আমাদের সবকিছু এমন অদ্ভুত ভাবে করলাম কারণ তুমিই তো বলেছিলে তোমার একটা চটপটা রোমান্টিক লাভ স্টোরি চাই।যাতে বুড়ো বয়সে নাতি নাতনিদের শোনাতে পারো।নাও এখন তো পেয়ে গেলে একদম আনকমন মসলাদার রোমান্টিক লাভ স্টোরি।আমাদের নাতি নাতনিরা মুখ হা করে শুনবে তাদের দাদা বা নানা তাদের দাদী বা নানীকে কিভাবে বারবার বোকা বানিয়েছিলো।’
কথাটি বলে তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।
আমি দাঁত কিড়মিড়িয়ে মুখ ফুলিয়ে বললাম,
-‘কিহ আমি বোকা! যান আপনার সাথে আমি সংসার করবো না।’
কথাটি বলে আমি অন্য দিকে ফিরে বুকে হাত গুজে মুখ ঘুড়িয়ে রাখলাম।
তিনি ভ্রু কুঁচকে আমার সামনে এসে বললো,
-‘বললেই হলো করবো না!বলেছিলাম না অপেক্ষা করতে হবে,আজকে সেই আমার অপেক্ষার প্রহরের সমাপ্তি ঘটলো।এতদিন ধরে ধৈর্য্য ধরে তোমার না বোঝার কারণে বিবাহিত হয়েও সিংগেল এর মতো বেঁচে আসছি আর এখন বাসর ঘরে বললেই আমি শুনবো!এই এবার একটা ছোট্ট কিউট তন্দ্রাকে ঘুমপুত্র ঘুমকন্যার রাজ্যে এনে ঘুমের ফুল প্যাকেজ কমপ্লিট করে ফেলি কি বলো!’
আমি কিছু না বলে মুখ ফুলিয়েই আবার অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম।তিনি তার কুঞ্চিত ভ্রু আরেকটু কুঞ্চিত করে তাকালেন।সাথে সাথে লোডশেডিং হয়ে আকাশে আতশবাজি,পটাকা ফোটানোর প্রচন্ড আওয়াজ হতে লাগলো।
আমি ভয় পেয়ে চমকে উঠে নিদ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।নিদ্রও ব্যাপক খুশি হয়ে আমাকে শক্ত করে আগলে ধরে বলল,
‘যাক!বান্দরগুলা এই প্রথম একটা ভালোর মতো ভালো কাজ করলো।বাসর রাতে আমাকে উত্ত্যক্ত করতে গিয়ে আরো সুবিধে করে দিল।’
তারপর চেঁচিয়ে বললো,
-‘লাভ ইউ দোস্ত।’
সেই রাতের মতো আজ রাতেও আকাশে একটি বিশাল পূর্ণিমার চাঁদ তার শুভ্র আলোয় চারিপাশ মায়াবী করে রেখেছে।তবে আজ শুধু দুটি লাল গোলাপ নয় সহস্র লাল গোলাপ যেন উদাস চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কারণ আমার লাজুক লাল মুখের কাছে তাদের একত্রিত লাল রঙও যে ফ্যাকাসে হয়ে আছে।ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে লাগলো তার সাথে গাঢ় হতে লাগলো আমাদের ভালোবাসার রঙও।আমার আকাশ জুড়ে আজ অবিশ্রান্ত নিদ্রর ভালোবাসার বর্ষণ হয়ে চলেছে যেই বৃষ্টিতে আজ আমিও উজাড় হয়ে ভিজে যাচ্ছি,আমার নিদ্রতে।
চারিদিকে রঙ বেরঙের ফুলে সুরভিত হয়ে আছে আজ পবন।প্রজাপতিরা মনের সুখে উড়ে বেড়াচ্ছে এই ফুল থেকে ঐ ফুলে।কোকিলের মিষ্টি কুহু কুহু ডাক সর্বত্র জানান দিয়ে যাচ্ছে,বসন্ত এসে গেছে।ফাল্গুনের রঙিন বৈচিত্র্যময় সাজে প্রকৃতি এখন নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত যেমন আমি ব্যস্ত আমার নিদ্রকে দেখতে।পড়ন্ত বিকেলে বাগানে মাঝখানে দোলনায় বসে আকাশী রঙের একটি শার্ট পড়ে নিদ্র তার সেই সুন্দর অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে কফি খেয়ে যাচ্ছে।তার পাশে বসে আমিও কফির মগ হাতে তার মতো মুখভঙ্গি করার গভীর চেষ্টায় মগ্ন হয়ে আছি।চোখটাকে ঈষৎ কুঞ্চিত করে ভ্রু যুগল হালকা ভাঁজ করে নিচের ঠোঁটটাকে আলতো চেঁপে ধরে মুখের সামনে কফির মগ তুলে ধরে…না না হচ্ছে না।কফির মগটা থেকে প্রথমে ঘ্রাণ নিতে হবে…..আর আর…এই পর্যায়ে আমার দিকে নিদ্র ভ্রু কুঁচকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ইশারা করল কি!
আমি বাচ্চামো একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় বললাম কিছু না।
হঠাৎ তার ফোনে মেসেজ আসায় সে হাতের মগটা আমাদের মাঝখানে রেখে পকেট থেকে ফোন বের করে চেক করতে লাগল।আর আমি এই সুযোগে তার কফির মগটা হাতে নিয়ে কালো লাল পাড়ের সাদা শাড়িসহ পা দোলনার উপড়ে গুটিয়ে তুলে একটু সরে দোলনার বাম সাইডের হাতলে ঠেস দিয়ে তার দিকে সরাসরি মুখ করে বসলাম।আর ঝটপট মুচকি হেসে তার খাওয়া কফি খেতে লাগলাম।তিনি ফোন রেখে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আমার দিকে ঘেঁষে এসে আমার হাতসহ কফির মগ ধরে বলল,
-‘এবার আমি খাবো।’
কথাটা বলে তিনি আমার হাতসহ কফির মগ ধরেই কফি খেতে লাগলেন।কিছুক্ষণ পর আমি পা ঝুলিয়ে সোজা হয়ে বসে বললাম,
-‘একটা জিনিস খেয়াল করেছেন?আমাদের যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিলো সেদিন আপনার
পরণে ছিল সাদা রঙের শার্ট আর আমার পরণে ছিল আকাশী রঙের কামিজ।আর আজ আপনি পরে আছেন আকাশী রঙের শার্ট আর আমি পড়ে আছি সাদা রঙের শাড়ী।অদ্ভুত মিল না!’
নিদ্র বলল,
-‘হুম।আমাদের প্রথম দেখার রঙের কম্বিনেশনটা ছিল পুরো আকাশের মতো।আকাশের সীমাহীন ভালোলাগা রঙ তার মতোই সীমাহীন ভালোবাসা এনে দিয়েছিল।আর বৃষ্টির ছোঁয়াও তো ছিল।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
-‘বৃষ্টির ছোঁয়া?’
-‘হুম।ঐ যে তোমাকে আমি বৃষ্টিতে জমে থাকা কাঁদা পানিতে ভিজিয়ে দিলাম।’
তারপট গালে হাত দিয়ে বলল,
-‘তারপরই তো যেই একটা থাপ্পড় খেয়েছিলাম।’
আমি খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললাম,
-‘একটা কথা বলবো,আমার কিন্তু আপনাকে থাপ্পড় মারতে বেশ মজা লেগেছিল।প্রথম কোনো ছেলেকে ঠাস করে চড় মেরেছিলাম।হি হি হি!’
নিদ্র আমার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আমার কোমড়ে হাত দিয়ে কাছে টেনে বলল,
-‘এই ব্যাপার।’
কথাটা বলে আমার ঘাড়ে তার খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা মুখ মৃদু ঘষে দিল।তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ছোঁয়ায় এক অদ্ভুত শিহরণে আমি শিউরে উঠে তাকে কাঁধ দিয়ে ঈষৎ ধাক্কা দিয়ে লাজুক হাসি দিয়ে বললাম,
-‘ধূর!কি করছেন?সুড়সুড়ি লাগে।’
এই কথায় নিদ্র দোলনায় গা এলিয়ে দিয়ে নকল আফসোসের সুরে বলল,
-‘হায়রে আমার কপাল!এমন একটা বউ পেয়েছি রোমান্স করলে বলে সুড়সুড়ি লাগে!’
আমি তার আফসোসের ভঙ্গি দেখে মুখ টিপে হাসতে লাগলাম।
সে তার পা দিয়ে আমার পা চেপে ধরে হাত দিয়ে আমার গাল চেপে ধরে গালে একটা শক্ত গভীর চুমো দিয়ে বলল,
-‘মানা করেছিনা এভাবে হাসতে।’
পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম সূর্য আকাশ থেকে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।নীল দিগন্তে ছড়িয়ে দিয়েছে তার লাল আভা।নিদ্রর কাঁধে মাথা রেখে আমি তাই গভীর মনোযোগে প্রদক্ষিণ করতে লাগলাম।কিছুক্ষণ পর অস্ফুট স্বরে বললাম,
-‘নিদ্র।’
-‘হুম।’
-‘ভালোবাসি।
সে মৃদু হেসে বলল,
-‘হুম।’
আমি কাঁধে মাথা রেখেই তার দিকে চোখ উঁচু করে তাকিয়ে বললাম,
-‘হুম কি?আপনিও বলুন।’
সে নিচের ঠোঁট আলতো চেপে ধরে বলল,
-‘হুম।’
এবার আমি ক্ষেপে গিয়ে একটা চিমটি দিয়ে বললাম,
-‘আবারও হুম!তাড়াতাড়ি বলুন।আমাকে কি শুধু জ্বালাতেই আপনার ভালোলাগে?’
-‘নিদ্র আমার পেছন দিয়ে কাঁধে হাত রেখে আরেকটু নিজের সাথে জড়িয়ে বলল,
-‘হুম ভালো লাগে,অনেক অনেক ভালোলাগে।ভালোবাসি বলেই ভালোলাগে।’
আমিও মুচকি হেসে আবারও তার কাঁধে মাথা রেখে পরম শান্তিতে ডুবন্ত সূর্যটিকে দেখতে লাগলাম।দিনশেষে ঘরে ফেরা ঝাঁক বাঁধা পাখিরা সেই লাল আভায় রাঙানো রক্তিম আকাশের বুক দিয়ে উড়তে থাকার সময় একটু যেন অদ্ভুতভাবে থমকে থমকে ঘুরে যেতে লাগলো।কিন্তু কেনো?
কে জানে!হয়ত তাদেরও বসন্তের থেকেও প্রগাঢ ভালোবাসার রঙে রঙিন হয়ে থাকা সিক্ত প্রেম যুগলকে দেখতে ভালো লাগে।
কষ্টগুলো যখন অবাধ হয়ে যায় তখন বোধশক্তিও আর সীমাবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে না।
নিদ্রর দেওয়া তীব্র কষ্টের আঘাতে আমারও বুদ্ধি লোপ পেল।টিকতে পারলাম না আর সেই বাড়িতে।সেই বৃষ্টির মধ্যেই ভিজে ভিজে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লাম।উদ্দেশ্য যেদিকে চোখ যায় সেদিকে চলে যাব তবুও সেই বাড়িতে বসে বসে নিদ্রর বিয়ে দেখতে পারবো না।পারবো না তাকে ডিভোর্স দিতে,সবকিছুই তো শেষ হয়ে যাচ্ছে।অন্তত তার স্ত্রীর পরিচয়টা তো থাক আমার।
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাথা নিচু করে হেঁটে বাড়ির গেট পেড়িয়ে একটু সামনে এগোতেই পথে লম্বা কোনো কিছুর সাথে মৃদু ধাক্কা খেয়ে বাঁধা পেলাম।ল্যাম্প পোস্টের হালকা আলোয় চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি সামনে নিদ্র বৃষ্টিতে ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।থমথমে গলায় সে বলল,’কোথায় যাচ্ছো?’
আমি চোখের পানি মুছে অভিমানী গলায় বললাম,
-‘যেখানে খুশি সেখানে যাচ্ছি তাতে আপনার কি!আপনি তো আরেকটা বিয়ে করছেনই।এখন আমার আল্লাহর উপর খুব অভিমান হচ্ছে জানেন!ঐ রিপোর্ট টা কেনো সত্যি হলো না,সব ঝামেলা চুকে যেত।আমি মরে যে….
কথাটি সম্পূর্ণ শেষ করতে না দিয়েই ঠাস করে তিনি আমার গালে একটা চড় মারলেন।আমি গালে হাত দিয়ে তার দিকে তাকাতেই শক্ত হাতে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,
-‘আমাকে মেরে ফেলতে চাস তাই না!খুব ভালো লাগে আমাকে জ্বালাতে!’
তার ভেজা শার্টের সামনের অংশ খামছে ধরে আমি ডুকরে কেঁদে উঠে আধো ভাঙা গলায় বলতে লাগলাম,
-‘মেরে তো এখন আপনি ফেলছেন আমাকে।প্লিজ নিদ্র আমাকে এত বড় শাস্তি দিবেন না।আমি সহ্য করতে পারবো না।’
তার বুকের বা পাশে হাত রেখে গভীর ভালোবাসায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে প্রবল বৃষ্টিতে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমি জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম।তিনি হাতের মুঠ শক্ত করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।তার চোখেও অশ্রু সাথে রাগও।
অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও আমি পারছি না।কান্নার জন্য কথাগুলো গলায় আটকে যাচ্ছে। “এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
-‘আমি পারবো না নিদ্র,পা…রবো….না।আমি আপনাকে ভালোবাসি…খুব খুব ভালোবাসি।আমাকে…মাফ করে দিন।খুব কষ্ট…হচ্ছে….আমার।খুব….!’
তিনি আমাকে ছাড়িয়ে হাত শক্ত করে ধরে বললেন,
-‘কষ্ট হচ্ছে?বুঝতে পারছো এই কষ্ট কি?আমি যেই কষ্ট পেয়েছি তার কাছে তোমার কষ্ট কিছুই না।যন্ত্রণায় ছিঁড়ে গেছে ভেতরটা প্রতিটা মুহুর্তে।প্রতিটা মুহুর্তে তোমাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা আমার হৃদয়কে কাঁপিয়ে তুলতো।এক একটা কেটে যাওয়া দিন আমাকে প্রতিনিয়ত খুন করতো।তোমার কোনো ধারণাও নেই সেই যন্ত্রণার গভীরতা কতটুকু।তাই তোমাকে পারতেই হবে।নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব আয়োজন করে আমার বিয়ে দেবে।বিয়ের প্রথম সাক্ষী দেবে।’
আমি মুখ শক্ত করে চোখের পানি মুছে আবার পিছু হাঁটা দিতে লাগলাম।তিনি পেছন থেকে হেঁচকা টানে আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
-‘কোথায় যাচ্ছো?’
-‘আপনি বললেই হলো!আমি আপনাকে ডিভোর্স দেবো না।আমি থাকবোই না এখানে।’
আমার ভেতর এই মুহুর্তে একটা জেদ চেপে বসেছে এই বাড়ি থেকে চলে যাবার।মনে হচ্ছে দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে যাক তবুও কিছুতেই আমি নিদ্রর বিয়েতে উপস্থিত থাকবো না।মাথা ঠিকমতো কাজও করছে না।
তাই কথাটা বলে জেদ করে আবারো তার হাত ছাড়াতে নিলাম কিন্তু সে আমাকে না ছেড়ে আমাকে উঁচু করে তার কাঁধে তুলে নিল।আমি কেঁদে কেঁদে তার পিঠে অনবরত হাত দিয়ে আঘাত করতে লাগলাম ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু তার তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপই হলো না।আমাকে সোজা রুমে এনে বিছানায় ফেলে দিল।আমি আবারো উঠতে নিলে তিনি আমার উপর উঠে তার শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিলেন।আমি হাত দিয়ে তাকে সরানোর জন্য ক্রমাগত ধাক্কা দিতে লাগলাম।তিনি রাগী চোখে আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে থামিয়ে দিলেন।আমি এবার কাঁদতে কাঁদতে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম।এতে তিনি আমার হাত দুটো বিছানায় শক্ত করে চেপে ধরে রাখলেন।আমি কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলাম,
-‘আমাকে ছাড়ুন,আমি চলে যাবো।কিছুতেই থাকবো না এখানে।’
তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
-‘আরেকবার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা বললে পা কেটে ফেলবো কিন্তু!’
বিছানায় চেপে রাখা আমার হাতের নখ দিয়ে তার হাত প্রচন্ড জোরে খামছে ধরলাম কিন্তু তার তাতে কোনো ভাবান্তরই হলো না।আমি জেদ চেপে বললাম,
-‘আমিও দেখি আপনি কি করে আটকান।আমি যাবোই।’
তিনি আমার দিকে একটি অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে কামড় লাগিয়ে দিলেন।তার সমস্ত রাগ আর কষ্ট যেনো দাঁতের তীক্ষ্ণ আঘাতে আমার ঘাড়ে ঝারতে লাগলেন।ঘাড়ে তার চোখ থেকো গড়িয়ে পড়া নোনাজলের ঠান্ডা স্পর্শও অনুভূত হতে লাগলো।আমিও পুরো শান্ত হয়ে গেলাম।অন্তত এই আঘাতের মাধ্যমে তার কষ্টগুলো যদি একটু হলেও কমতে পারে।তাকে খামছে ধরা আমার হাত শীথিল করে নিলাম।ধীরে ধীরে তার কামড় ভালোবাসার পরশে পরিণত হতে লাগল।তার গভীর পাগলামোময় ভালোবাসা।
কিছুক্ষণ পর আমার শান্ত হয়ে যাওয়া উপলব্ধি করতে পেরে তিনি আমায় ছেড়ে চলে যেতে নিলে আমি উঠে খপ করে তার হাত ধরে বললাম,
-‘আমি কিন্তু সত্যিই আপনাকে ছাড়বো না।’
তিনি আমার হাত ছাড়িয়ে একটি বাঁকা হাসি দিয়ে বললেন,
-‘সেটা বিয়ের দিনই দেখা যাবে।’
সকালে আমার ঘুম ভাঙলো খুব বেলা করে।রাতে করা আমার পাগলামো গুলোর কথা মনে পড়ে এখন আমার নিজেরই লজ্জা লাগছে।যেই চলে যাওয়া নিয়েই এত কান্ড হলো সেই আমিই নাকি আবার তাকে চলে যাওয়ার কথা বলছিলাম।
দোতলা থেকে নিচে নেমে দেখি পুরো বাড়িতে মেহমানরা গিজগিজ করছে।আব্বু সবাইকে দু দিন আগের থেকেই আনিয়ে রেখেছে।আব্বু এত বেশি বেশি করছে কেনো,নিজের মেয়ের কষ্ট কি তার একটুও চোখে পড়ছে না!
যেসব কিছু আমার বিয়েতে করার কথা বলেছিল সেসব করছে আমার সতীনের বিয়েতে।আব্বু সবসময় বলতো আমার বিয়ের দু দিন আগে থেকেই সকল মেহমানদের আনিয়ে রাখবে।তারপর সবাই মিলে জম্পেশ মজা করবে।
সাফার পুরো পরিবার,সোমা আপু নিদ্রর সব বন্ধুরা সবাই এসেছে।এই সাত মাসে কতকিছু হয়ে গেছে।তানিয়া আপু আর নাঈম ভাইয়া লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে।নাঈম ভাইয়া তার মাকে ভয়ে আর তাদের সম্পর্কের কথা জানাতেই পারেনি।তাই তানিয়া আপু নাঈম ভাইয়ার কান ধরে নিয়ে গিয়ে একেবারে বিয়ে করে তার মার সামনে উপস্থিত হয়েছে।অবশ্য তার মা হাসিমুখেই তানিয়া আপুকে মেনে নিয়েছে আর ছেলেকে একশোবার কান ধরে উঠবোস করিয়ে শাস্তি দিয়েছে।নাঈম ভাইয়ার এখন করুণ অবস্থা।বউ আর মা দুজন একজোট হয়ে তাকে কান ধরে উঠবোস করায়।
সোমা আপু আর রাফি ভাইয়ার এনগেজমেন্ট হয়ে আছে।সাফা আর তামিম ভাই চুটিয়ে প্রেম করে যাচ্ছে।শুধু আমি আর নিদ্রই আজ আলাদা।আমাদের মাঝেই অদৃশ্য বেড়াজালের দেয়াল।
নিচে নেমে সোফার দিকে নজর পড়তেই দেখি নিদ্র আর ঐ রাইশা না ফাইশা নামের মেয়েটি পাশাপাশি বসে আছে।দেখেই শরীরটা পুরো জ্বলে উঠলো।রাইশা মেয়েটি নিদ্রর হাত ধরে বলল,
-‘নিদ্র তোমার হাতে এমন করে এত খামছি দিলো কে?’
নিদ্র আমার দিকে তাকিয়ে সোফায় গা হেলিয়ে বলল,
-‘দিয়েছে,এক বান্দরনি।’
-‘সো স্যাড!’
ঐ রাইশা ফাইশার ন্যাকামোতে এমনিতেই গা জ্বলে যাচ্ছিলো আর এখন তার কথা শুনে মাথা আরো গরম হয়ে গেল।আমাকে বান্দরনি বলা!
ইচ্ছে করছে ঐ রাইশার হাতটা ছিটকে দিয়ে তার থেকে সরিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড় থেকে চাদর সরিয়ে বলি,
-‘দেখুন মিস রাইশা,খামছি শুধু আমি একাই দেইনি।আপনার হবু মিস্টারও কাল রাতে আমাকে এখানে কামড় দিয়েছে সাথে অসংখ্য কিসও করেছে।এখন আপনি আপনার ন্যাকামো বন্ধ করে আমাদের মাঝ থেকে ফুটে যান।’
কিন্তু কিছু বলার ভাগ্য আর আমার কই!আমাকে তো শুধু শুনতে হয়।তাই আম্মু এসেও আমাকে শোনাতে লাগলেন,
-‘কিরে তুই এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে রইলি যে?আর বিয়ে বাড়িতে মুখটাকে এমন পেঁচার মত বানিয়ে রেখেছিস কেনো?’
আম্মুর কথা শুনে আমি জাস্ট হতবাক হয়ে গেলাম।মুখটাকে ফুলিয়ে বললাম,
-‘তাহলে বলো লাউড স্পিকারে গান ছাড়তে আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে সবাইকে নাচ দেখিয়ে বেড়াই।’
নিদ্র হেলান দেওয়া থেকে উঠে কফির মগটা ধরে বলল,
-‘তাহলে তো ভালোই হয়।আমাদের আর এক্সট্রা নাচের মানুষ আনতে হবে না।তা কোন গান ছাড়তে বলবো?কালা চাশমা নাকি ডিজে ওয়ালে বাবু?’
আমি রাগে,দুঃখে,ক্ষোভে সেখান থেকে চলে এসে রুমে বসে রইলাম।একটু পর সত্যি সত্যিই কালা চাশমা গানটা ছেড়ে দিয়ে নিচ থেকে সবার উল্লাসের প্রতিধ্বনি কানে আসতে লাগলো।রাগের চোটে আমার চোখে পানি এসে পড়লো।সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে আছে।কষ্ট তো শুধু আমার।
নাচ,গান,উল্লাসে আমি আর বাড়িতে টিকতে পারলাম না।ঠিক করলাম বাইরে থেকে বেড়িয়ে আসবো।সঙ্গে নিলাম আমার চিরকুমার ছোট্ট কাকুকে।কাকু সেই দুবাই থেকে এসেছে কিনা নিদ্রর বিয়ে খেতে।সবার আহ্লাদ দেখে আমি হতভম্ব।তাদের মেয়ের যে আজ বিয়ে ভাঙতে যাচ্ছে সেদিকে কারো কোনো কষ্ট নেই।বের হওয়ার সময় আব্বু বলে দিল সাবধানে যেতে গাড়িতে একটু ডিস্টার্ব আছে।আমাদের ব্রিটিশ আমলের দাদার আদিম যুগের গাড়ি।এর মধ্যে অলয়েজ ডিস্টার্ব থাকে।বছরে চলে পাঁচবার আর মেকানিকের কাছে যায় দশবার।গাড়ির রঙটাও একদম টকটকে লাল।আব্বুকে কত বলা হয়েছে এই গাড়িটা বিক্রি করে একটা নতুন গাড়ি কিনতে।কিন্ত নাহ্! আব্বু আর কাকু মিলে তাদের পূর্বপুরুষের সম্পদ বুকে আগলে রেখেছে।কিছুতেই বিক্রি করবে না।এই গাড়িতেই তারা চলাফেরা করবে,এই গাড়িতে চড়ার মতো শান্তি নাকি আর অন্য কোনো গাড়িতে নেই।
টাক মাথা ঢাকতে কাকু মাথায় ক্যাপ পড়ে ড্রাইভারের সিটে বসে পড়ল।গাড়ির দরজা খুলে আমি তার পাশে বসতে যাবো তার আগেই নিদ্র এসে কাকুর পাশে বসে পড়ল।আমি হতভম্ব হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে তাকে বললাম
-‘আপনাদের চার পাঁচটা দামী পাজোরা গাড়ি থাকতে আপনি আমাদের এই ব্রিটিশ আমলের গাড়িতে বসলেন কেনো?’
তিনি আমার প্রশ্নে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে কাকুকে বললেন,
-‘কাকু আপনারা নাকি শালবনের দিকে যাচ্ছেন?আমাদেরও একটু তার একটু পেছনে নিয়ে যান।গায়ে হলুদের জন্য হলুদ আনা হয়নি।’
কাকু বললেন,
-‘তা বুঝলাম কিন্তু হলুদ তো তুমি এখানের বাজার থেকেও কিনতে পারো ইয়াং ম্যান।’
-‘তা পারি কিন্তু আমি চাই একদম খাঁটি হলুদ।শালবনের পরে শহরের বাইরে গ্রাম্য বাজারে তা ভালো পাওয়া যাবে তাই।আর পুরনো গাড়িতে যেই মজা তা নতুনত্বে কই,ঠিক বললাম তো কাকু?’
-এক্সিলেন্ট!তোমাকে আমার এর জন্যই বেশি পছন্দ ইয়াং ম্যান।একদম সব কাজ গুছিয়ে পারফেক্ট টাই করো।দেখলি সুপ্তি তুই এতদিনেও বুঝলি না আর ও দু দিনেই বুঝে গেল।আই লাইক ইট!হা হা হা।
তাদের দুজনের কথায় আমার মাথা ধরে গেল।পেছনে তাকিয়ে তো আরো জ্বলে উঠলো ঐ রাইশাও যাচ্ছে দেখি।আমিও মুখ বাঁকিয়ে পিছনে রাইশার পাশে বসে পড়লাম।বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম,
-‘আজকাল কার ছেলেমেয়েদের লজ্জা শরম সব গেছে দেখছি।নিজেদের বিয়ের হলুদ নিজেরাই কিনতে যায়।’
নিদ্র গাড়ির ব্যাক মিররে তাকিয়ে শয়তানী হাসি দিয়ে আমাকে বলল,
-‘ঐ পদার্থটা তো আমার মধ্যে কোনো কালেই ছিল না সুপ্তি।তুমি তো জানোই!’
তার শয়তানী হাসি দেখে মনে চাচ্ছে তার চুলগুলো খামছে ধরি।এতদিন আমার সাথে লুচুগিরি করে এখন আবার আরেকজনকে নিয়ে গায়ে হলুদের প্রস্তুতি নিচ্ছে।যার জন্য ঘর থেকে বের হলাম সেই বিয়ের আয়োজন আবার আমার পিছু নিল।মনটাই দমে গেল।
আমার দাদার গাড়ি তার নিজস্ব নিয়মে ধীর গতিতেই গটগট শব্দ করেই চলছে।গাড়ির কাঁচটা নামিয়ে দিয়ে আমি জানালার পাশে ঠেস দিয়ে আনমনে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।বাইরে থেকে আসা বাতাসে আমার চুলগুলো মৃদু মৃদু উড়ছে।হঠাৎ গাড়ির সামনের আয়নায় চোখ পড়তেই দেখলাম নিদ্র আড়চোখে আমাকে আয়নায় দেখছে।আমার সাথে চোখ পড়ার সাথে সাথেই নিদ্র দৃষ্টি সরিয়ে নিল।এক মুহুর্তের জন্য মনে হল হয়তো সে আমাকে দেখছিলো পরে ভাবলাম হয়তো দূর্ঘটনা বশত চোখ পড়ে গিয়েছে।নয়তো সে এখন আর আমাকে দেখবে কেনো।সে তো দেখবে তার হবু বউ রাইশাকে।
হলুদ কিনে ফিরতি পথে হঠাৎ একটা টঙ দোকানের সামনে এসে সেই ব্রিটিশ আমালের দাদার গাড়িটা ঘটঘট শব্দ করে থেমে গেল।আমি বলে উঠলাম,
-‘ঐ যে আবার হয়ে গেল।তোমাদের গাড়ির মেকানিকের কাছে যাওয়ার সময় এসে পড়েছে।আমি তো বলি ঐ মেকানিকের সাথেই এই গাড়ির বিয়ে দিয়ে দাও।’
কাকু বলল,
-‘তুই একটু চুপ থাকবি।গাড়িটা কতটা পথ এসেছে এর রেস্ট দরকার তো হতেই পারে।’
রেস্ট না ছাই!গাড়ী যে আর চলবে না সেটা কাকুও বুঝে গেল।এখন এই ফাঁকা ভাঙাচোরা রাস্তায় আমরা চারজন আটকে রইলাম।শহর থেকে বেশ দূরে এসে পড়েছি।এদিকটায় গাড়ি পাওয়া যায় কিনা তারও ঠিক নেই।চারদিকে ধূ ধূ বিস্তর ফাঁকা মাঠ।তারপরে সব বড় বড় গাছপালার জঙ্গল।টঙ দোকানের সামনে পাতা কাঠের বেঞ্চে আমি আর নিদ্র পাশাপাশি বসে রইলাম।আর এদিকে রাইশা আর কাকু ফোনের নেটওয়ার্ক খুঁজে যাচ্ছে।নিদ্র গভীর মনোযোগে ফোন টিপছে আর টঙ দোকানের সস্তা কাঁচের গ্লাসে চা খাচ্ছে।তিনি না চা খান না,এখন আবার খাওয়া শুরু করলেন নাকি!সাত মাসে কি সত্যিই অনেক কিছু বদলে গেল।আমার হাতেও চায়ের কাপ কিন্তু আমি এখনো এক চুমুকও দেইনি,আমি তো এখন তাকে দেখায় ব্যস্ত।যতই দেখি তবুও দেখার হয় না যেন শেষ।তার অর্ধেক খাওয়া চায়ের গ্লাস আমাদের দুজনের মাঝখানে রেখে তিনিও নেটওয়ার্কের খোঁজে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে হাত নাড়াতে লাগলেন।তার চায়ের গ্লাসের দিকে অপলক তাকিয়ে দেখে আমার দুটি পুরনো কথা খুব মনে পড়ল।
-“আমি কারো ঝুটা খাই না।”
-“একদিন ঠিকই খাবে।”
সত্যিই তার অর্ধেক খাওয়া চায়ের কাপ থেকেই চা খেতে আমার খুব ইচ্ছে করছে।আমি আস্তে আস্তে তার চায়ের কাপটা হাতে তুলে আলতো দু হাতে ধরে ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে খেতে লাগলাম।সত্যিই এক পরম উষ্ণতায় আমার শরীর শিহরিত হতে লাগল।এমন মজার চা যেনো আমি কখনো খাইনি।এক একটা চুমুক আমি চোখ বন্ধ করে উপলব্ধি করতে লাগলাম।হঠাৎ নিদ্র এসে খপ করে চায়ের কাপটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
-‘এটা আমার চা।’
কথাটি বলে তিনি সেই চা খেতে লাগলেন।
আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।তার এত অবহেলা আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
ফাঁকা মাঠের দিকে উদাস মনে আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম।শেষ বিকেলে ফাঁকা মাঠ থেকে শো শো করে পৌষ মাসের শীতল হাওয়া বইছে।আমার পরণে শুধু একটা হালকা গোলাপি রঙের পাতলা সুতির থ্রিপিছ।ওড়নাটাও শিফনের,বাতাসে তা ক্রমাগত উড়ছে।
ভেবেছিলাম পৌষ মাসের সবে শুরু তাই শীত করবে না।কিন্তু এখন মোটামুটি শীত শীতই লাগছে।হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে রেখে আমি মৃদু ঘষতে লাগলাম।এসময় রাইশা এসে আমাকে বলল,
-‘সুপ্তি,একটা হেল্প দরকার ছিল।নিদ্রর নাকি গরম লাগছে,তাই জ্যাকেটটা খুলে আমার হাতে দিয়ে দিল।এখন হাতের মধ্যে একটা জ্যাকেট নিয়ে ঘুরতে আমার বিরক্ত লাগছে।তুমি প্লিজ জ্যাকেটটা তোমার কাছে রাখো।’
কথাটি বলেই রাইশা আমার গায়ে নিদ্রর কালো জ্যাকেটটা জড়িয়ে দিয়ে চলে গেল।আমি পাশে তাকিয়ে দেখি নিদ্র খানিকটা দূরে একটা চেক চেক বাদামী রঙের শার্ট গায়ে দাঁড়িয়ে আড়চোখে আমাকে দেখছে আবার সামনে দেখছে।আমি হেঁটে তার কাছে গিয়ে বললাম,
-‘আমি তো আপনার কেউ না।আপনার জ্যাকেট আপনার হবু বউ রাখতে পারলো না তাহলে আমি রাখবো কেনো?’
কথাটি বলে আমি জ্যাকেট খুলে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।তিনি একবার তীক্ষ্ণ চোখে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে জ্যাকেটটা তার হাতে তুলে নিয়ে সামনে হাঁটা দিলেন।আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।আমি ভেবেছিলাম আমার শীত লাগা বুঝতে পেরে হয়তো তিনিই জ্যাকেটটি পাঠিয়ে ছিলেন।তাই আমিও একটু পরখ করতে গেলাম,এখন দেখছি রাইশা যেকারণ বলেছে তাই সত্যি।রাগে আর দুঃখে আমার শরীর গরম হয়ে শীতটাই চলে গেল
অবশেষে একটি ভ্যানগাড়ি পাওয়া গেল।কিন্তু রাইশা আর কাকু ভ্যানগাড়িতে যাওয়া বাঁধ সাধলেন।রাইশা যাবে না কারণ ভাঙা রাস্তায় ভ্যানগাড়ির ঝাকুনিতে ওর চুল নষ্ট হয়ে যাবে আর কাকু যাবে না কারণ তার কোমড় ব্যাথা শুরু হয়ে যাবে।ভাগ্য সহায় ছিলো বলেই হয়তো তারা একটা পিকআপ ভ্যান পেয়ে গেল।সেখানে ড্রাইভারের পাশে দুজনই বসতে পারবে তাই তারা দুজন উঠে চলে গেল।আমি আর নিদ্র ভ্যানগাড়ির পেছনের দিকে পা ঝুলিয়ে বসে পরলাম।আমরা ছাড়াও গাড়িতে আরো দুজন বোরকা পড়া মহিলা উপরে পা উঠিয়ে বসে আছে।
ভ্যানগাড়ি চলতে শুরু করলো।নিদ্র ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো
আর আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।একসময় অস্ফুট স্বরে বললাম,
-‘একটা সত্যি কথা বলুন তো আপনি কি আমাকে এখন আর এক বিন্দুও ভালোবাসেন না?’
তিনি আমার কথার কোনো জবাব দিলেন না।
হঠাৎ করে গাড়ির ঝাঁকুনিতে আমি তার হাতের উপর হাত রাখলাম।ঝাঁকুনি থেমে গেলেও আমি আর হাত সরালাম না।তার কালো ঘড়ির উপরে ফোল্ড করে রাখা শার্টের হাতার একটু নিচে হাত উঠিয়ে আরো শক্ত করে ধরলাম।কিন্তু তিনি আমার হাত ছাড়িয়ে পেছনের মধ্যবয়স্কের একজন মহিলার হাতে ধরিয়ে বলে উঠলেন,
-‘অ্যান্টি,ওর হাতটা আপনি একটু ধরে রাখবেন,আসলে একটু পর পর গাড়িতে ঝাঁকুনি হচ্ছে তো তাই।’
আমি ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।এখন কি আমার হাত ধরাও তার সহ্য হচ্ছে না।এতটা অচেনা হয়ে গেছি আমি!
হলুদ নিয়ে আসতে দেরি হওয়ায় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানেরও দেরি হয়ে গেল।সবাই এখন হৈ হুল্লোর করে হলুদ বাটায় ব্যস্ত।আমি রুম অন্ধকার করে বসে আছি।আর নিচে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে।রাত আটটার দিকে আম্মু এসে রুমের লাইট অন করে বিছানায় একটা হলুদ শাড়ি রেখে বলল,
-‘সুপ্তি তুই এখনো এই কাপড়েই বসে আছিস।নিচে অনুষ্ঠান এক্ষুণি শুরু হয়ে যাবে।যা একটা শাড়ি পড়ে আয়।’
-‘আমি চোখের পানি মুছে চেঁচিয়ে বললাম,
-‘অনুষ্ঠান শুরু হলে হোক।আমার তো আর গায়ে হলুদ না।তুমি যাও এখান থেকে আমি যাবো না নিচে।’
কথাটি বলে আমি আম্মুকে জোর করে রুম থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে দিলাম।কিছুক্ষণ পর আবার দরজায় বারি পড়তে লাগলো।আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
-‘আম্মু আমি বলেছি না আমি যাবো না।তুমি যাও এখান থেকে।’
বাইরে থেকে কেউ কোনো সাড়া না দিয়ে ক্রমাগত দরজা পেটাতে লাগল।শব্দে আমার মাথা ধরে যাওয়ার উপক্রম।আমি চরম বিরক্তি নিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখলাম নিদ্র দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে আমি পুনরায় দরজা লাগাতে গেলাম কিন্তু সে জোর করে ভেতরে ঢুকে গেল।
আর বলল,
-‘তুমি এখনো তৈরি হওনি কেনো?বলেছি না আমার বিয়ের সব আয়োজন তুমি করবে।আমার গায়ে হলুদও তুমি প্রথমে লাগাবে।নাও তাড়াতাড়ি তৈরি হও।’
আমি কেঁদে কেঁদে রাগ করে বললাম,
-‘না,আমি হবো না তৈরি।যাবো না নিচে।’
সে বিছানা থেকে শাড়িটা তুলে আমার সামনে ধরে বললো,
-‘বেশি কথা বলে সময় নষ্ট করো না তো!তাড়াতাড়ি রেডি হও।’
আমি তার হাত থেকে শাড়িটা ফ্লোরে ছুঁড়ে মেরে বললাম,
-‘বলেছি না পড়বো না!’
এতে সে রেগে ফ্লোর থেকে শাড়িটা তুলে দরজা লাগিয়ে বলল,
-‘ঠিকাছে,আমি নিজেই পড়িয়ে দিচ্ছি।’
তার কথায় আমি চমকে গিয়ে পিছনে যেতে নিলাম।সে কি সত্যিই সত্যিই আমাকে জোর করে শাড়ি পরাবে নাকি!সে দ্রুত আমার একেবারে কাছে চলে এসে কামিজের পেছনের ফিতায় হাত দিতেই আমি চোখ বন্ধ করে কাঁচুমাচু হয়ে বললাম,
-‘আমি পড়বো।’
সে আমার সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কানের কাছে মুখ এনে বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
-‘গুড গার্ল।’
সে চলে গেলে আমি নিজে নিজেই শাড়িটা পড়ে নিচে গেলাম।নিচে গিয়ে দেখি নিদ্র আর রাইশাকে পাশাপাশি বসিয়ে রাখা হয়েছে।দেখেই বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ ব্যাথা শুরু হয়ে গেল।নিদ্র আজ সাদার মধ্যে কলারের কাছে হলুদ সুতোর এমব্রয়ডারি করা একটি সুন্দর পান্জাবী পড়ে আছে।তাকে দেখতে কি সুন্দরই না লাগছে।সাদা রঙের জামায় তাকে ঠিক আর পৃথিবীর কেউ বলে মনে হয় না।মনে হয় জান্নাতের কোনো বাসিন্দা।আল্লাহ তাআ’লা তাকে কি সুন্দর করেই না তৈরি করেছেন!
কি সুন্দর হেসে হেসে সবার সাথে কথা বলছেন।কোনো দুঃখের ছিটেফোঁটাও তার মধ্যে নেই।তবে আমি কেনো একটু ঠিক হতে পারছি না।সামনে যে আমার জন্য গভীর আঘাত অপেক্ষা করছে।নিদ্র আমাকে তার বিয়ে দেখিয়েই ছাড়বে।
আমি একটু আগাতেই নিদ্রর মা কাছে এসে আমার চিবুকে হাত রেখে বললেন,
-‘বাহ্!কি সুন্দর লাগছে আমার মেয়েটাকে।একদম হলুদ পরী।’
সোমা আপু এসে বলল,
-‘সুপ্তি,তাড়াতাড়ি আয়।সবাই কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে।’
নিদ্রর মা বলল,
-‘হ্যাঁ,তুই নাকি সব আয়োজন নিজের হাতে করবি নে শুরু কর।’
তারা আমাকে নিদ্রর কাছে নিয়ে যেতে লাগলো।যতই তার কাছে আগাতে লাগলাম,আমার চোখ ছুটে অশ্রু বেড়িয়ে আসতে চাইলো।কিন্তু নাহ্!
আমার এই অশ্রু বের হতে দেওয়া যাবে না।নিদ্র যদি এতেই খুশি থাকে তবে তাই হোক।
তার খুশির জন্য আমি সবকিছুই করতে পারি।
আমি ঝুকেঁ নিদ্রর সামনে রাখা হলুদের বাটি থেকে হলুদ নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে তার গালে হলুদ লাগিয়ে দিলাম।সে আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো।আমার চোখ টলমল করতে লাগলো।তারপর পাশে রাইশার গালেও লাগাতে গেলে নিদ্র বলে উঠল,
-‘রাইশাকে কেউ হলুদ লাগাবে না।রাইশার হলুদে এলার্জি।’
আমার চোখে আগুন জ্বলে উঠলো।এত ধ্যান রাখে ওর।আমি বলে উঠলাম,
-‘তা কি হয়!গায়ে হলুদে তো একটু হলেও হলুদ ছোঁয়াতে হবে।’
কথাটি বলে হলুদ নিয়ে ওর গালের কাছে যেতেই নিদ্র আমার হাত খপ করে ধরে তার বুকের বা পাশে নিয়ে সাদা পান্জাবীতে আমার হাত জোর করে মুছাতে লাগলো।তার কান্ড দেখে আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম।হাত মুছানো হয়ে গেলে ছেড়ে দিয়ে পাশে থাকা বন্ধুদের সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলতে লাগলো।আমি সেখান সরে আসলাম।নিজেকে আজ বড্ড তুচ্ছ মনে হচ্ছে।
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান খুব ভালো ভাবেই জমে উঠেছে।সবাই আনন্দে মেতে উঠেছে।যে যার গালে পারছে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে।আমি মেহমানদের ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম।সব ঠিক থাকলে এই গায়ে হলুদটা হয়তো আমার হতো!
কথাটি ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ নামিয়ে সামনে থাকা খোলা চুলগুলো কানে গুঁজে নিলাম।
হঠাৎ কোমড়ের পাশে আলতো শিহরিত ঠান্ডা স্পর্শ অনুভব হতেই চমকে উঠে হাত দিয়ে দেখলাম কে যেন হাত দিয়ে পাশ থেকে আমার কোমড়ে এক মুঠ হলুদ লাগিয়ে চলে গেছে।পেছনে ঘুরে মেহমানদের ভীড়ের জন্য কাউকেই দেখতে পেলাম না।কে লাগিয়ে গেলো এভাবে!হয়তো কোন বাচ্চা এমন করেছে ভেবে ব্যাপারটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম।
আজ নিদ্রর বিয়ে।সকাল থেকেই কথাটা যতবার ভাবছি ততবারই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠছে।হাত পা গুলো ক্রমাগত কাঁপছে।কাল রাতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের পর থেকে আমি আর সারারাত ঘুমাইনি।পুরো বাড়ির চেহারাই পাল্টিয়ে ফেলা হয়েছে সাজিয়ে।পড়ন্ত বিকেলের সূর্যটার দিকে তাকিয়ে আমার এই মনে হতে লাগলো,আমার জীবনের সূর্যটাও আর কিছুক্ষণ পর এভাবেই ডুবে যাবে।আজ সারাদিন যে আমি কিভাবে কাটিয়েছি তা আমিই জানি।আর কিছুক্ষণ পরই সব শেষ,সব।আমার নিদ্রর উপর আর কোনো অধিকার থাকবে না।তার জীবনে অন্য কেউ এসে পড়বে।আমাদের ভালোবাসার গল্পটা খুব বিশ্রী ভাবে অসম্পূর্ণ হয়ে থাকবে।
সাফা সোমা আপু,তানিয়া আপু মহা আনন্দে সাজগোজ করছে অথচ আমার এমন অবস্থায় আমার কাছে কেউ নেই।আমার পরণে শুধু একটা সাধারণ হালকা আকাশী রঙের সুতি শাড়ি।কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখ লাল হয়ে গেছে।কিছুক্ষণ পর আমার ডাক পড়ল বিয়ের আসরে সাক্ষীর জন্য সিগনেচার দিতে।
আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে।দেখলাম নিদ্র বর বেশে বসে আছে।কতটা খুশি সে,তাকে দেখে আমার বুকের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে উঠলো।শ্বাসও যেনো নিতে কষ্ট হচ্ছে।রাইশাকে দেখা যাচ্ছে না।হয়তো ওকে অন্য রুমে সাজিয়ে বসে রাখা হয়েছে।
নিদ্রর পাশে চোখে পড়লো আমাদের বিয়ের সেই বিরক্তমুখো কাজী সাহেব।আজ সেও হাসিখুশি।আমাকে দেখে হেসে বলল,
-‘এইযে মা জননী আজকে কিন্তু সময় নষ্ট করো না।এই যে সবাই সিগনেচার করে দিয়েছে এবার তুমিও করে দাও।’
কথাটি বলে তিনি আমার সামনে কলম বাড়িয়ে দিলেন।আমি নিদ্রর দিকে একবার আহত চোখে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কলম ধরলাম।কলমটা ধরে রাখতেও খুব কষ্ট হচ্ছে।মনে হচ্ছে আমার হাত অবশ হয়ে গেছে।আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো।কাঁপা কাঁপা হাতে আমি কষ্টে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কাগজে স্বাক্ষর করে দিলাম।
কাজী সাহেব আলহামদুলিল্লাহ বলে সাবইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-‘নিন,এবার সব সম্পূর্ণ হলো।’
কথাটা শুনে আমি জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম।
-ফাদার যোসেফ!আপনি কোথায়?
-ওয়েলকাম মাই চাইল্ড!ওয়েলকাম টু দ্যা হেল!
খালি গির্জাতে প্রতিধ্বনি টা ভেসে আসছে স্পষ্টভাবে।কিন্তু প্রতিধ্বনিটা কোথা থেকে ভেসে আসছে?মুহুর্তের মাঝে উল্টে গেলো গির্জাটা।ওমেগা খেয়াল করলো সে এখন পাতালপুরীর নিচে চলে গিয়েছে।
একটা অন্ধকার জায়গায় নির্বিঘ্নে দাড়িয়ে টলছে ওমেগা।মনে হচ্ছে মাটিতে কিছু নড়ছে কিন্তু কি নড়ছে তা বুঝতে পারছেনা সে।হঠাৎ করে মনে হলো দুই তিন জন যেন তার পা কামড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।ওমেগা চিৎকার দিয়ে উঠলো ব্যথায়।
-ব্লাডি ডিয়ারস।ওনাকে কামড়িও না।উনি আজকে আমাদের অন্দরমহলের মাননীয় বিশেষ অতিথি।হা হা হা!
ভয়ংকর এই হাসিতে চারিপাশ কেঁপে উঠলো।ওমেগা বলে উঠলো-
-মিয়াকো আপনি? “এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
সাথে সাথে অন্ধকার থেকে সবকিছু আলোতে ভরে গেলো।ওমেগা ঠিকমতো তাকাতে পারছেনা আলোর কারণে।কুমির গুলো তার পাশ থেকে সরে দৌড়ে যেয়ে ঝাপিয়ে পড়ে মিয়াকোর কোলে।এতক্ষনে মিয়াকো কে দেখতে পেলো ওমেগা।সারা শরীরে ইলুমিনাতির চিহ্ন আঁকা।এমনকি সে যেখানে দাড়িয়ে আছে সে জায়গাটাতেও সম্পুর্ণ ইলুমিনাতির ব্যবহার প্রদর্শন করছে।ওমেগা বুঝতে পারলো যে সেই মৃত্যুপুরীতে এসেছে সেদিন যেখানে সে পড়ে গিয়েছিলো।
-তোমরা সি আই ডি অফিসার রা বড্ড বোকা ওমেগা।সেদিন অফিসে আমার ছোট ভাইয়ের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে এতো সুন্দর কাহিনী বানালাম তোমরা বুঝতেও পারলে না।অবশ্য দানবদের ষড়যন্ত্র বুঝতে পারে না কেউ!!!হা হা হা!
হাসিতে আবার কেঁপে উঠলো সমগ্র।ওমেগা বলে উঠলো –
-মানে?
-মানে টা আমি বুঝিয়ে বলছি ওমেগা।।।মানুষের মাথার খুলি খেতে খেতে এলো ফাদার যোসেফ।
-ফাদার যোসেফ!ইউ ব্লাডি ফুল!
-আহা ওমেগা এতো উত্তেজিত হচ্ছো কেন?এতো উত্তেজিত হওয়া ভালো বলো?যতই শরীরে গরম রক্ত থাকুক।আমি জানি তুমি আগে থেকেই সব জানো।এখন উত্তেজিত হওয়ার শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে।
সাথে সাথে কিছু বাদুর এসে তুলে নেয় ওমেগাকে।এরপর সোজা ফিকে মারে ফাদার যোসেফ আর মিয়াকোর সামনে।মুখ থুবড়ে পড়ে যায় ওমেগা।গর গর করে রক্ত পড়তে থাকে।মিয়াকো বলে উঠে-
-মাই ডিয়ার ক্রোকোডাইলস!নতুন অতিথির সেবা করবে না তোমরা?যাও ট্রিট হিম!!!
সাথে সাথে কুমিরগুলো হামলে পড়লো ওমেগার শরীরে।ওমেগার হাত পা টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে তারা।রক্তে ভরে গেছে এক এক জনের মুখ।ফাদার যোসেফ বলে উঠলো-
-অনেক সেবা যত্ন করেছো অতিথিদের।এবার তাকে ছেড়ে দাও।আমরাও সেবা যত্ন করি একটু।
কুমিরগুলো চলে গেলে ওমেগার মুখ ধরে উঠায় যোসেফ।ওমেগা ততক্ষণে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
-আজ তোমার তাজা রক্ত আমরা খাবো এবং আমাদের ডাইনামিক দল কে চেটেপুটে খাওয়াবো সেদিন যেভাবে তোমার প্রেমিকাকে খেয়েছিলাম।
-কিন্তু যোসেফ মরার আগে ওর তো সব কিছু শুনে যাওয়া উচিত।তাই না?বেচারা এতো চেষ্টা করলো!!!হা হা হা!!!
-ইউ আর রাইট মিয়াকো।তাহলে শুনো ইয়াং বয়!আমি যোসেফ কিন্তু ফাদার যোসেফ না।আমি শয়তান উপাসক!ইলুমিনাতি নিয়ে উপাসনা করা আমার প্রধান কাজ।
-আর আমি মিয়াকো ক্যামেরন।ব্রাদার অফ ডেভিড ক্যামেরন।আমিও একজন আদর্শ শয়তান উপাসক।এই যে দেখছো এত কিছু সব আমাদের তৈরি করা।এবার তোমাকে আসল ঘটনা বলি।যেই ডেভিড ক্যামেরন এর নিখোঁজ হওয়ার কেস টা নিয়েছিলে সেই মানুষ একজন আদর্শ খুনি।কিভাবে বলি?এই যে এতো ব্র্যান্ডেড কোম্পানির ব্যাগ,জুতা সব কি দিয়ে তৈরি জানো?মানুষের চামড়া!!আর এই মানুষ খুন করতাম কারা জানো?আমরা দানবেরা!!!আর এই ডাইনামিক ভ্যাম্পায়ার আবিষ্কার করেছি কারা জানো?এই যে আমরা!!!!
-পিশাচসিদ্ধ, শয়তানের উপাসনা এসব তো জানোই?তোমার বাপ দাদাদের প্রিয় একখানা টপিক।সেই টপিকের উপর আমারও প্রবল আগ্রহ ছিলো।সবার সামনে আমি সাধু ফাদার যোসেফ।কিন্তু আড়ালে আমি একজন শয়তান উপাসক।অমরত্ব লাভ করার নেশা আমার মনে!!!
-আর আমি মিয়াকো ফাদার যোসেফর সহোদর।আমি কখনোই ইলুমিনাতিতে বিশ্বাসী ছিলাম না।কিন্তু যোসেফ আমাকে তার গোপন কুঠুরিতে নিয়ে আসে।আমার মনে ইলুমিনাতি নিয়ে বিশ্বাস করিয়ে দেয়।এরপর আমিও হয়ে যাই ইলুমিনাতির উপাসক।সরাসরি শয়তানের উপাসনা শুরু করি।
-একবার শয়তান উপাসনা করতে করতে আমি ডাইনামিক ভ্যাম্পায়ার দের কথা জানতে পারি এবং এটাও জানতে পারি যে আমি যদি মানুষ খুন করে একটা ভ্যাম্পায়ার জাতি বানিয়ে ফেলতে পারি আমি তাহলে অমরত্ব পাবো।বলে উঠে যোসেফ।
-ডেভিড ভাইয়ের ব্যবসার জন্য সমস্ত টাকা আমি দিয়েছিলাম কিন্তু ডেভিড ভাই আমাকে প্রাপ্য টাকা দিলেও আমাকে আমার সম্মান দেয়নি।সবসময় খোটা দিতো।আমি আর পারছিলাম না।যোসেফের কথা শুনে আমার মন প্রতিশোধী হয়ে উঠলো সেই সাথে অমরত্ব পাওয়ার লোভ।ব্যাস খুন করলাম নিজের ভাইকে।টুকরা টুকরা করলাম তার মাংসগুলোকে।এরপর সেই দিয়ে উপাসনা করে বানিয়েই ফেললাম ডাইনামিক ভ্যাম্পায়ার। ওদের সৃষ্টি আগুনে জ্বালানো রক্ত থেকে!!কিন্তু একটা ব্যাপার জানো ওমেগা?আমি যখন আমার ভাইকে কুচি কুচি করে কাটছিলাম তখন তার মাংসগুলো আমাকে টানছিলো।খুব চেখে দেখতে ইচ্ছে করছিলো নিজের ভাইয়ের রক্ত আর মাংসগুলো।খাওয়ার পর মনে হলো আমি যেন অমৃত খাচ্ছি।সাথে সাথে হয়ে উঠলাম দানব।ডাইনামিক ভ্যাম্পায়ার দলের দানব!
-মিয়াকো আমাকে ব্যাপার টা জানায়।আমি রিসার্চ করা শুরু করি।এরপর জানতে পারি যে এক ধরণের অদ্ভুত শক্তির মাধ্যমে আমরা এ ক্ষমতা লাভ করি যার সময়সীমা মাত্র কয়েক ঘন্টা।আমরা এটাও জানতে পারি যে আমরা নিজ হাতে দানব হয়ে মানুষ খুন করে ডাইনামিক ভ্যাম্পায়ার জাতি উৎপন্ন করতে পারলে আমরা চিরকালের জন্য এই দানব বেশ ধারণ করতে পারবো।তারপর থেকে শুরু করি হত্যাযজ্ঞ।মানুষ খুন করা!আর তা থেকে ভ্যাম্পায়ার তৈরি করার কাজে লাগিয়ে বাকিটুকু নিজেদের আয়েশ করা।
-এর জন্য এরিন আর মিলান্ড কে মেরে ফেললেন?
-আজ এতো বোকার মতো কথা কেন বলছো ওমেগা?বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে নাকি?আমরা শয়তানের উপাসক।আমাদের পথে যে বাঁধা দিতে আসবে তাকে কি পালং এ তুলে রাখবো?সবাইকে মেরে দিয়েছি।এতে লাভ ও হয়েছে।সৃষ্টি করেছি ভ্যাম্পায়ার আর মাংস খেয়ে হয়েছি দানব।
-এরিনকে তো সেদিনই মেরে ফেলেছিলাম ওমেগা যেদিন নিজের ভাগনী ডায়ানাকে মেরে ফেলেছি।তারপর যে তোমার সাথে হেঁটেছিলো সে ভ্যাম্পায়ার ই ছিলো।আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো তোমাকে আমাদের ফাঁদে আনার।আর তার জন্য তোমাকে স্বপ্নের মাধ্যমে হ্যালুসিয়েট করাই।এরপর নিয়ে আসি নিজেদের কাছে।কেন নিয়ে আসি জানো?নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের সামনে খুন হতে দেখা।মিলান্ডকেও আমরাই মারি।এমন কি সব মানুষ আমরাই মেরেছি।যা ভ্যাম্পায়ার রা মেরেছে বলে তুমি মনে করেছিলে।ভ্যাম্পায়ার রা আমাদের নিয়ন্ত্রণে তাই তাদের আমাদের অনুমতি ছাড়া কিছু ক রতে পারবে না।তখন অবশ্য টের পাওনি।এখন তো পাচ্ছো।এখন নিশ্চয়ই জানো তোমাকে কেন মারি নি?
-কারণ আমার কাছে রক্ষা কবজ আছে।
-তা বটে!এই রক্ষা কবজ যতদিন আছে গায়ে টোকা লাগাতেও পারবো না।তবে রক্ষা কবজ সাধারণ কবজ হতে দেরি নেই।তুমি তো জানোই এই কবজ তোমার গলায় থাকলে কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না।কিন্তু তুমি নিজ থেকে বাঁচার জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে যা কেবল তিনবার প্রযোজ্য।তুমি ইতিমধ্যে দুই দুইবার ব্যবহার করে ফেলেছো।আর একবার ব্যবহার করলেই ক্ষমতা শেষ।
-একবার স্বপ্নে আর একবার ভ্যাম্পায়ার দের হাত থেকে রক্ষা পেতে কবজ ব্যবহ্রত হয়েছিলো আপনাদের প্ল্যানে।তাই না ফাদার যোসেফ?
-তুমি নিতান্তই সঠিক বৎস।সি আই ডি অফিসার বলে কথা।আহা এতো রেগে যাচ্ছো কেন?একটু পর তো পৃথিবী থেকে চলেই যাবে।হাসিমুখে বিদায় নাও।
-তোমাকে ভ্যাম্পায়াররা এতদিন না ছুতে পারলে কি হয়েছে আজ আমরা তোমাকে মারবো।ভ্যাম্পায়ার রা খুব বোকা জানো?ওদের সাথে না পেরে উঠলেও বুদ্ধির দিক থেকে ওরা একদম শূন্য।কেবল মানুষের রক্ত খেতে জানে।নাহলে তোমাকে কায়দা করে মেরেই ফেলতো।যেমন টা আমরা কোদাল দিয়ে দুইভাগ করি।এতোদিন তোমার সাথে তোমার রক্ষা কবজ থাকায় তোমাকে মারা সম্ভব হয়নি।ওহ ভালো কথা জানো ওমেগা?তুমিও কিন্তু মানুষ খুন করেছো।মনে আছে সেদিন হাওয়ায় উড়ে গিয়েছিলে যে?এটা এক ধরণের কালো জাদু ছিলো।যা প্রথমবার তোমাকে দিয়ে ট্রাই করেছিলাম।তোমার চুল দিয়ে।হা হা হা!সেদিন ও তোমাকে মেরে ফেলা যেতো। বাট তুমি আমার খুব পরিচিত ছিলে ওমেগা।তাই সে যাত্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম।হা হা হা!!!!!কিন্তু আজ লকেট টা আমাদের হাতে।কিভাবে নিয়েছি এটা তো শুনবে তাই না?বলতে পারো চুরি করিয়েছি।তুমি সেদিন আমাদের সব কথা শুনে ফেলেছিলে।তাই তো আমি আমার গির্জার এক শিষ্য দিয়ে চুরি করাই লকেট টা।সব ক্লাইমেক্স শেষ।এবার ট্রাজেডি শুরু।
যোসেফ কোদাল উঠাতে নিলেই সাথে সাথে সব ভ্যাম্পায়ার একসাথে জড়ো হয়।ভয় পেয়ে যায় মিয়াকো এবং যোসেফ।
-যোসেফ এরা এভাবে কেন?
-ওদের সম্পর্কে বাজে কথা শুনে নিয়েছে ওরা।আর ওদের নামে বাজে কথা শুনলে ওরা জেগে উঠে নিজ আপন শক্তিতে।
-কিন্তু এখন তো রাত তিন টা বাজে না।তিনটার আগে তো ওদের অস্তিত্ব থাকেনা।
পাশে থাকা ঘরিতে তাকালো মিয়াকো।টং টং করে ৩:০৫ বাজছে।পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপাকে।
-ওদের শান্ত করার মন্ত্র টা পড়ো যোসেফ।
-আমার মাথায় আসছে না।যজ্ঞ করার সময় পড়েছিলাম।
মিয়াকো মন্ত্র পড়তে যাবে ততক্ষণে ভ্যাম্পায়ার গুলো হামলে পড়ে দুই নরপিশাচের উপর।নখের আচড় বসিয়ে দেয়।পিশে ফেলে দুইজনকে।অবশেষে সমাপ্তি ঘটে এক নোংরা খেলার।
ওমেগা মৃদু হেসে যেতে নেয়।কিন্তু হঠাৎ করে হাপিয়ে এসে এরিন রক্ষা কবজ টা ছুড়ে মারে।ওমেগা সেটা নিয়ে গলায় পড়ে নেয়।
-যেও না ওমেগা।তোমার কাজ এখনো শেষ হয়নি।ওরা ধ্বংস হয়েছে ঠিকই কিন্তু ডাইনামিক ভ্যাম্পায়ার জাতি বিনাশ হয়নি।একমাত্র তুমিই পারবে এখন সব শেষ করতে।
-আমি কিভাবে?
-ওরা একবার রেগে গেছে ওমেগা।এদের শেষ না করলে কেলেন্কারি হয়ে যাবে।এরা এখন ছন্নছাড়া।এরা যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারবে।রাতের বেলায় মানুষ খুন করতে পারবে।তোমাকে এখন কিছু করতে পারবে না।তাই তুমি এক্ষুনি উপাসনা ঘরে যাও সেখানে বইয়ে ওদের ধ্বংস করার উপায় বলা আছে।
ওমেগা দেখলো এরিনের বলা মুহুর্তেই ভ্যাম্পায়ার রা এরিনের দিকে তেড়ে আসছে।
-আমার দিকে তাকিও না।ওরা যা মন চায় তাই করুক আমার সাথে।তুমি যাও!
দৌড়ে ভিতরে চলে গেলো ওমেগা।এর মধ্যে অনেক ভ্যাম্পায়ার চেষ্টা করলো তার উপর হামলে পড়তে।কিন্তু রক্ষা কবজের জন্য পারলো না।ওমেগা যেয়ে বই গুলো খুঁজতে লাগলো।অবশেষে পেয়েও গেলো।মন্ত্রটা মুখে আসছে না তবুও বহু কষ্টে মুখস্ত করে ফেললো।এরপর ম্যাচ খুঁজে বের করলো অনেক কষ্টে।আগুন জ্বালিয়ে এক কুন্ডলী তৈরি করলো সে।মন্ত্রগুলো পড়ে বইটা আগুনে ফেলে দিলো ওমেগা।সাথে সাথে ভ্যাম্পায়ারগুলোর বিভৎস চেহারাগুলো সামনে পড়লো তার।ভ্যাম্পায়ারগুলো চিৎকার করছে সাথে সাথে গলে গলে পড়ছে।চোখ কান বন্ধ করে রইলো ওমেগা।বিনষ্ট হলো ডাইনামিক জাতি।হুট করে নিজেকে প্রবেশ করলো গির্জার সামনে।একদম অক্ষত অবস্থায় ফিরে পেলো নিজেকে।ওমেগা খুঁজতে লাগলো এরিন কে।
-আকাশের দিকে তাকাও ওমেগা।
ওমেগা আকাশের দিকে তাকালো।স্বচ্ছ আকাশে এরিনের মায়াবী চেহারা ভেসে উঠেছি।
-আমি তোমার কাছে যেতে চাই এরিন।আই ডোন্ট হ্যাভ এনিওয়ান উইথআউট ইউ।কান্না স্বরে বললো ওমেগা!!!
-সেটা আর সম্ভব না ওমেগা।আমি আর তুমি এখন সম্পুর্ণ ভিন্ন পথের পথিক।এ পৃথিবীতে তুমি যেদিন আসবে সেদিন আবার আমি তোমার হায় ধরে হাটবো কেমন?যেমনটা বারো টা বছর হেঁটেছি একসাথে।
-আই মিস ইউ।
-আই মিস ইউ টু।চিন্তা করো না আমি তোমার সাথেই আছি সব সময়।তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।মনে করবে আমার তরফ থেকে।আজ আসি!!দেখা হবে অন্য কোনো এক সময়।
-এখনি যেতে হবে?
-হ্যাঁ এখুনি যেতে হবে।ওমেগা আই লাভ ইউ।
-আই লাভ ইউ টু এরিন।
কাঁদতে লাগলো ওমেগা।গায়েব হয়ে গেলো এরিন।কে জানে আবার কবে দেখা হবে!আকাশ থেকে স্নো ফল হচ্ছে।ওমেগা হেঁটে যাচ্ছে আপনমনে।মনের ভিতর প্রিয়জন হারানোর আর্তনাদ।হঠাৎ একটা প্রাইভেট কার থেকে একটা মেয়ে গড়িয়ে গিয়ে পড়লো ওমেগার পায়ের সামনে।ওমেগা নিচু হয়ে মেয়েটাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে উঠলো-
-এরিন!!!!!!!!
ওমেগা প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে।এরিন কোথায়,কিভাবে আছে আদো বেঁচে আছে কিনা সে তাও জানে না।প্রিয় মানুষ হারানোর বেদনা ভালো করে জানে সে।সে সময় এরিন ছিলো তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য।কিন্তু এখন?এখন কে তাকে স্বান্তনা দিবে?এরিন যদি চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়?মাথা ফেঁটে যাচ্ছে ওমেগার।পকেট থেকে সেলফোন টা বের করলো সে।লকস্ক্রিনে এরিনের হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখা যাচ্ছে।
-আই মিস ইউ মাই লাভ।আই নিড ইউ।
বলেই চোখের পানি ফেললো ওমেগা।চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার।কিন্তু কাঁদলে তাকে চলবে না।এরিন কে খুঁজে বের করতে হবে।
ফাদার যোসেফের সাথে গির্জায় দেখা করতে এসেছে ওমেগা।রাত প্রায় ১২টার কাছাকাছি।গির্জাটা একদম জনমানবহীন হয়ে আছে।এই গির্জাতেই তো সেদিন এরিন নিয়ে এসেছিলো ওমেগা কে।বিয়ে করার প্রস্তাব ও রেখেছিলো সেদিন।কিন্তু ওমেগা তাকে না করে দেয়।এখনো সে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত না।এরিনের কিছুটা মন খারাপ হয় তাতে কিন্তু সে সামলে নেয় নিজেকে।আজ অনেক আফসোস করছে ওমেগা।সেদিন বিয়েটা করে নিলে হয়তো আজ এরিন তার চোখের সামনেই থাকতো।
-ফাদার যোসেফ কোথায়?
-উনি ওনার নিজস্ব কামড়ায় আছেন।
ওমেগা সন্ধিহানে পড়ে গেলো এই ভেবে যে তার কি ভিতরে যাওয়া উচিত হবে নাকি উচিত হবে না?ফাদার যোসেফের সাথে তার মোটামুটি ভালো সখ্যতা রয়েছে।সুতরাং গেলেও খারাপ হবে না।আর তাছাড়া তাকে যে এক্ষুনি এরিনের নিখোঁজ সম্পর্কে জানাতে হবে যদি তিনি কোনো পরামর্শ দেন।ওমেগা আর কিছু ভাবলো না।সোজা হাঁটা ধরলো ফাদার যোসেফের ঘরের দিকে…
———————————————-
আকাশে মেঘ গর্জন ডাকছে।মনে হচ্ছে তারা তাদের আর্তনাদটুকু গর্জনের মাধ্যমে বিলীন করছে।ওমেগা চুপ করে রাস্তায় হাঁটছে।আজ কান্না আসছে না তার।কান্না করে লাভ টা কি?কেউ স্বান্তনা দিতে আসবে না।এমনকি এরিনও না।কারণ এরিন যে আর এই দুনিয়াতেই নেই।তারা মেরে ফেলেছে।হ্যাঁ তারাই মেরে ফেলেছে।আর মেরেছে ফেলেছে তার সামনেই।সেদিন যেই মানুষটার মৃত্যু দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলো ওমেগা।সেই মানুষটা আর কেউ না তার এরিনই ছিলো।সেদিন সবচাইতে কাছের মানুষটার মৃত্যু দেখেও চিনতে পারলোনা সে।তারা তাকে দেখতে দেয়নি।আজ হয়তো চেহারাটা একবার দেখতে পেলে নিজের জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে নিতো এরিন কে।বুক ফেঁটে কান্না আসছে তার।কিন্ত কিছুই যে হাতে নেই আর!!!কিছুই না!!!
প্ল্যানচ্যাটে বসেছে ওমেগা।উদ্দেশ্য একটাই এরিনের সাথে যোগাযোগ করা।সে মনোযোগ দিতে পারছেনা।ভিতরে থাকা আর্তনাদ যেন প্রাণ ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে।কিন্তু তাকে যে মনোযোগ দিতেই হবে নাহলে চলবে না।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।তারপর চোখ মুখ শক্ত করে এরিনের আত্না কে ডাকতে লাগলো সে।বাহিরের জানালা খুলে গিয়ে জোরে জোরে বাতাস বইছে।মাঝখানে থাকা মোমবাতিটাও প্রায় নিভু নিভু পর্যায়ে।আত্নাগুলো চারপাশে এসে চিৎকার চেচামেচি করছে।কিন্তু ওমেগা নির্বিকার।সে যে এরিনের জন্য অপেক্ষা করছে।অবশেষে সকল অবসাদ ঘটিয়ে এলো এরিন।
-এরিন মাই ডিয়ার!!!
চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে এলো ওমেগার।হাত বাড়িয়ে এরিন কে জড়িয়ে আহবান জানালো সে।এরিন কেবল হাসলো।
-আমি যে আর তোমাকে কখনো ছুতে পারবো না ওমেগা।তোমার হাত ধরে যে আর হাঁটতে পারবো না। “এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
এরিন যেন আর্তনাদ করছে।যেই আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে খুব ভয়ংকরভাবে।
-এরিন এগুলো সত্যি না।আমি স্বপ্ন দেখছি এরিন।বাজে স্বপ্ন!!!
হু হু করে কেঁদে উঠলো ওমেগা।এরিন এদিকে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে।তার হাতে যে কিছু নেই।সে যে পৌঁছে গিয়েছে এক অন্য জগতে।যে জগত থেকে আর কখনো আসা যাবে না।
-কিছু স্বপ্ন না ওমেগা।সব সত্যি সব!!ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে।ফাদার যোসেফ এবং তার ডাইনামিক দল আমার মাংসের টুকরা টুকরা করেছে সেদিন।
-তার মানে আমি একটু আগে দরজার আড়ালে যা শুনেছি সব অক্ষরে অক্ষরে সত্যি?
-হ্যাঁ সব সত্যি।এই যে এতো খুন এতো কিছু সব সত্যি সব!!!সেদিন তোমার সামনে যে মানুষটা খুন হয়েছিলো সেটা আমি এই এরিনই ছিলাম।তোমার দাদার দেওয়া যে রক্ষাকারী কবজ টা আছে তার জন্য তোমাকে কিছু করতে পারছে না।কিন্তু কবজের শক্তি শেষ হওয়ার সাথে সাথে তারা তোমাকেও মেরে ফেলবে।আমি এখন এর থেকে বেশি কিছু তোমায় বলতে পারবো না।ওরা আমাকে ভ্যাম্পায়ার বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।আর তা নাহলে আমার আত্নাকে ধ্বংস করে দিবে।আর তাহলে আমি তোমাকে পরবর্তীতে কোনো সাহায্য করতে পারবো না।
-আমি এসবে যেতে চাই না এরিন।আমি শুধু তোমার সাথে থাকতে চাই।তোমার হাত ধরে হাঁটতে চাই অনন্তকাল।
-জীবনে কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনার ফলে বহু বিচ্ছেদ ঘটে ওমেগা।অনেক আশা ভরসা বিলীন হয়ে যায় তার যাতাকালে পড়ে।মনে করো যে আমরাও সেই যাতাকালে হারিয়ে গিয়েছি।
-আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না এরিন।ট্রাস্ট মি!
-আই ট্রাস্ট ইউ মাই লাভ।এখন এসব বলার সময় না।উঠে পড়।তোমার যে অনেক কাজ বাকি।ওই নোংরা খেল যে তোমাকে শেষ করতে হবে।।
-আমি পারবো না এরিন।আমি নিঃস্ব।আমাকে দিয়ে হবে না।
-আমি তো এই ওমেগাকে চিনি না।তোমাকে আমার জন্য লড়তে হবে।আমি যাদের কারণে তোমার থেকে দূরে সরে গিয়েছি তাদের জন্য লড়তে হবে।আর তাছাড়া তুমি একজন সাহসী অফিসার।তুমি কি চাও তোমার শহরের ক্ষতি হোক?
-আমি কিছু চাই না।আমার কিছু লাগবেনা।কাম ব্যাক এরিন।
-পাগলামি করো না ওমেগা।এখন পাগলামি করার সময় না।এতে তোমার সুযোগ নিবে তারা।যাও প্রিপেয়ার হও।ডাইনামিক দের বিনাশ করতে হবে তোমায়।আমাকে যেতে হবে এখন।পরে দেখা হবে কোনো এক সময়।
গায়েব হয়ে গেলো এরিন।ওমেগার চোখে মুখে এখন ভয়ংকর এক ছাপ।প্রিয় মানুষকে হারানোর স্পষ্ট বেদনা ভাষা যেন ফুটে উঠেছে।