Thursday, July 10, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1850



শ্রাবণের মেঘ পর্ব_১৯

0

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১৯
#Tabassum_Kotha

আচমকা কেউ একজন নীল এর হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে নীল কে একটা ঘরের ভিতর টেনে নিয়ে গেলো। এই আকস্মিক আক্রমণে নীল খানিকটা ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে সামনে থাকা ব্যক্তিটির দিকে তাকায়।

নীল এর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে বিশ্বজয় করা হাসি দিচ্ছে কথা। নীল ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ কথার দিকে তাকিয়ে থেকে ঘরের বাইরে যেতে নিলে কথা আবার নীল এর হাত টেনে ধরে।

ঘরের দরজা ভিতর থেকে আটকে দিয়ে নীল এর বুকে নিজেকে চেপে ধরে ফিসফিস করে কথা বললো,
— চলে যাচ্ছেন কেনো? এতোদিনে একটা খবর নেন নি, উল্টো আমি ফোন করেছি সেটাও ধরেন নি।

— ব্যস্ত ছিলাম। তুই তো জানিস নিতুর বিয়ের জন্য ব্যস্ততা ছিল।

কথাটা বলতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নীল।

নীল এর অবস্থা বুঝতে পেরে নীলকে ছেড়ে দিয়ে কথা বললো,
— আমি আপনাকে অনেক ফোন করেছিলাম। নিতু আর কাব্য ভাইয়ার কথা বলার ছিল আপনাকে। নিতু কাব্য ভাইয়াকে ভালোবাসে। এই কথাটা জানানোর জন্য আপনাকে অনেকবার ফোন করেছি কিন্তু আপনি ফোন ধরেন নি।

কথার কথায় বেশ অবাক হয়ে নীল জিজ্ঞেস করলো,
— এক মিনিট! তুই জানতি কাব্য আর নিতুর কথা?

— হ্যাঁ জানতাম। আর আপনাকে বলতেও চেয়েছিলাম কিন্তু পারি নি। তারপর আমি নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে ভাইয়া আর নিতুর বিয়ে করিয়েছি।

— কিহ? তুই করিয়েছিস ওদের বিয়ে?

— হ্যাঁ! কেনো?

— কথা তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? এটা কি করেছিস? নিতুর বিয়ে কাব্য এর সাথে করিয়েছিস! তাও এভাবে। কথা সব কিছুতে তোর বাচ্চামো স্বভাব টা আনার কি দরকার বলতো? এতোটা বড় হয়েছিস কিন্তু ম্যাচিউরিটি আসে না কেনো তোর? এই বাচ্চামো স্বভাবের জন্য আর কতো ঝামেলায় পরতে হবে বলতো!

— এভাবে বলছেন কেনো? আমি যা করেছি নিতু আর ভাইয়ার ভালোর জন্যই করেছি। সবদিক বিবেচনা করেই আমি এভাবে বিয়ের প্ল্যান করেছিলাম।

— সবদিক? তা কোন দিক বিবেচনা করেছিস তুই আমাকে একটু শোনা তো! আমার বেষ্টফ্রেন্ডের সাথে আমার বোনের বিয়ে করিয়েছিস কোন দিক বিবেচনা করে? তাও আবার এভাবে পালিয়ে?

— কি বলতে চাইছেন আপনি? আপনি নিজেও তো আপনার বেষ্ট ফ্রেন্ডের বোনকেই বিয়ে করেছেন। আর পালিয়ে বিয়ে করার কথা বলছেন! আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন আমাদের বিয়ে টা কোন পরিস্থিতিতে হয়েছে! এটা কেমন কথা নীল নিজের বোঝ ষোলো আনা অন্যের এক আনাও না। যেই কাজ গুলো আপনি নিজে করেছেন সেগুলো আমার ভাইয়া করলে দোষের কি আছে?

— ওকে ফাইন। সব মানছি। কিন্তু এভাবে দুই পরিবার কে জানিয়ে ঝামেলা বাড়ানোর কি দরকার ছিল?

— দুই পরিবারকে জানানো তে ঝামেলা বাড়ে নি। বরং কমেছে। আদনান ভাইয়া আর নিতুর বিয়ে ভেঙেছে। কাব্য ভাইয়া জীবনে সুখী হওয়ার নতুন কারণ পেয়েছে। আর আমার বিশ্বাস দুই পরিবারের সবাই এই বিয়েটা মেনে নেবে।

— ইয়াহ রাইট!

— হ্যাঁ। আমার তো মনে হয় এটাই সুযোগ, সবাইকে আমাদের বিয়ের কথাটাও বলে দেওয়া উচিত। একই সাথে আমার আর নিতুর দুজনেরই শশুর বাড়ি যাওয়া হয়ে যাবে। কি বলেন?

— মাথা খারাপ তোর? এমনিতেই যেই আগুন লাগিয়েছিস এখন আবার সেই আগুনে ঘি ঢালতে চাস! আমাদের বাবা-মা যদি এখন আবার আমাদের বিয়ের কথা জানতে পারে তাহলে বুঝতে পারছিস কি হবে?

— কি হবে??

— ছাগলি। আস্ত একটা ছাগলি তুই?

— সব ভালো আর বুদ্ধিমান তো আপনি একাই তাই না?

— এখন যদি সবাইকে বলি যে আমরাও বিয়ে করেছি হয় তোর বাবা হার্ট ফেল করবেন না হয় আমার মা!

— কিন্তু কতোদিন এভাবে লুকিয়ে রাখবেন বিয়ের কথা? আমি আপনার স্ত্রী হয়েও আপনার প্রতি কোনো অধিকার দেখাতে পারি না। অধিকার নিয়ে বড় মুখ করে বলতে পারি না আমি আপনার বউ!

— আর একটু ধৈর্য ধর। আমি কিছু একটা চিন্তা করি, তারপর সুযোগ বুঝে বাবা কে সব বলে দেবো।

— আপনি আসলেই একটা মেরুদন্ডহীন। আপনাকে ভালোবাসা টাই আমার অন্যায় হয়েছে। বিয়ে করেছেন কিন্তু বাড়িতে সেই কথা বলার সাহসটুকু নেই আপনার। আপনার চেয়ে হাজার গুণ ভালো আমার ভাইয়া। আমি একপ্রকার জোর করে তার বিয়ে করিয়েছি তবুও সে সেই বিয়েটা সবার সামনে এক্সেপ্ট করেছে। আপনার মতো মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যায় নি।

কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে দম ছাড়লো কথা। বড়বড় কতোগুলো নিশ্বাস নিয়ে নিলো। অনেকটা হাপিয়ে গেছে সে। কিন্তু নীল কে এই কথা গুলো না বললেই না। বিয়ে করতে পেরেছে কিন্তু বলতে পারছে না কাউকে!

নীল কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে একটা দম টেনে কথাকে জরিয়ে ধরলো।

এভাবে কোনো কথা বার্তা ছাড়াই হুট করে কথাকে জরিয়ে ধরায় কথা পুরোই থ মেরে গেছে। আবার রাগও হচ্ছে, বিয়ের কথা কাউকে বলছে না কিন্তু চিপকাচিপকি ঠিকই করছে।

নীল কথা গলায় আস্তে আস্তে মুখ গুঁজে দিচ্ছে। যার কারণে কথার ভীষণ সুরসুরি লাগছে। লজ্জাও করছে অনেক। লজ্জায় কথা তার চোখ দুটো বন্ধ করে নিয়েছে। নীল কথার গলায় আলতো করে কয়েকটা চুমু খেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

এবারও কথা বেকুব বনে দাড়িয়ে আছে, সে কি ভেবেছিল আর কি হয়ে গেলো!

?

?

?

রাতে কাব্য এর ঘরে কলি বেগমের দেওয়া লাল একটা শাড়ি পরে মাথায় ঘুমটা টেনে দাড়িয়ে আছে নিতু। দাড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে পায়চারি করছে সারা ঘরে।

.

কিশোর সাহেব আর নজরুল সাহেব কথা বার্তা বলে নিজেদের মধ্যে নিতু আর কাব্য এর বিয়ের ব্যাপার টা মেনে নিয়েছেন। যদিও খুশি কেউই হতে পারে নি, তবুও এখন বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর কোনো ঝামেলা করা মানে লোক হাসানো। যেটা নজরুল সাহেব একদমই চান না। সামনেই চেয়ারম্যান পদের নির্বাচন। আর এই পারিবারিক ঝামেলার জন্য সে তার অতি কাঙ্ক্ষিত চেয়ারম্যান পদটা হারাতে দেবেন না কিছুতেই।

.

ঘোমটা খানিকটা খুলে যাওয়াতে নিতু সেটা টেনে মাথায় উঠাচ্ছিল তখন খট করে দরজা খুলার শব্দ হলো। দরজার ঠিক উল্টো দিকে ঘুরে দাড়ানো ছিল নিতু। সেখানে দাড়িয়েই একপ্রকার কাঁপা শুরু করে দিলো সে।

বিয়ের প্রথম রাত বলে কথা! এই রাত টা নিয়ে সবারই কম বেশি ভয় ভীতি থাকে। নিতুর তো হয়তো একটু বেশিই ভয় করছে, কারণ যেই পরিস্থিতিতে বিয়ে হয়েছে। না জানি কাব্য কিভাবে রিয়েক্ট করে!

.
পিছনে কারো উপস্থিত টের পাচ্ছে নিতু। দরজা খুলে লোকটা ঘরে ঢুকেছে। এই সময় ঘরে কাব্য ছাড়া অন্য কেউ আসবে না, মানে লোকটা কাব্য। কাব্য ঘরে এসেছে ভাবতেই যেনো নিতুর কাঁপাকাপি কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

নিতু তার ঘুমটা আরও খানিকটা নিচে টেনে ঠিক করতে গেলে ঘারে কারো গরম নিশ্বাস পরে তার। নিতু ভয়ে আর সংকোচে চোখ বন্ধ করে আছে। ঠিক তখনই পিছনে দাড়িয়ে থাকা লোকটা নিতুর কোমড় জরিয়ে ধরলো। নিতু যেনো লোকটার এই কাজে পুরোই ফ্রিজ হয়ে গেছে। লোকটার হাত ধীরে ধীরে শাড়ির ভিতর দিয়ে নিতুর পেট স্পর্শ করে। পেটে হাত দিতেই লোকটা জোরে একটা চিমটি কেটে দেয় নিতুর।

লোকটার এহেম কান্ডে নিতুর চোখ কপালে উঠে গেছে। নিতু ঘোমটা খুলে চোখ বড়বড় করে পিছন দিকে ঘুরতেই আরেক দফা থ মেরে যায়।

.
নিতুর সামনে দাঁতের পাটি বের করে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে কথা। আর নিতু বেকুবের মতো দাড়িয়ে আছে।

নিতু আর কাব্য এর বাসরঘর সাজানো হয় নি, তাই কথা কিছু ফুল নিয়ে এসেছিল ঘরটা কোনোরকম সাজাতে। ঘরের ভিতরে এসে নিতুকে ওভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে একটু মজা করার জন্যই কাব্য এর অভিনয় করেছে।

নিতু বাজখাই গলায় চেচিয়ে কথার উদ্দেশ্যে বললো,
— চুপ পেত্নি হাসবি না একদম বলে দিলাম। এমন করলি কেনো? আমি কি না কি ভেবেছিলাম!

কথা দুষ্টুমি ভঙ্গীতে চোখ মেরে বললো,
— কি ভেবেছিলে ভাবি? যে ভাইয়া বুঝি একটু দুষ্টু দুষ্টু কাজ করছে তাই না?

— ইশ পেকে গেছিস অনেক মনে হচ্ছে! তুই পুচকি এখনও বুঝলি। আমি তোর ভাবি হই।

— এহহ আমিই বানিয়েছি তোকে আমার ভাবি। নয়তো পুরো এলাকার মেয়েদের ক্রাশ ছিল আমার ভাই।

— সে থাকতেই পারে। কিন্তু জামাই তো আমার হয়েছে।

— থ্যাংক্ মি লেটার বেবস্।?

— যা দূর হ। এখনও পর্যন্ত নিজের বিয়ে টার কিছু করতে পারলি না কিন্তু আমাদের বিয়ে ঠিকই করিয়ে দিলি।

নিতুর কথা শুনে কথা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সে আর নীল বিয়ে করেছে, তারাও পালিয়ে বিয়ে করেছে। কিন্তু তার স্বামী সেটা কাউকে বলার সাহস রাখে না। কথাটা চিন্তা করতেই কথার বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

কথা টপিক চেঞ্জ করে, হাতে করে নিয়ে আসা ফুলগুলো দিয়ে কাব্য আর তানিয়ার ঘরটা কোনোমতে সাজিয়ে দিয়ে গেলো।

কথা বেরিয়ে যেতেই নিতু আবারও ঘুমটা টেনে বিছানার মাঝ বরাবর বসে পরলো।
.
.
.
.
কথা নিজের ঘরে এসে আলমারি খুলে লাল একটা শাড়ি বের করে। গতবছর ঘুরতে গিয়ে লুকিয়ে শাড়িটা কিনেছিল সে। শাড়িটা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে শাওয়ার শেষ করে শাড়িটা পরে বের হয় কথা। যদিও আজকে তার শাড়ি পরার কোনো কারণ নেই। তবুও কেনো যেনো সে শাড়িটা পরেছে।

মানুষের মনে হুট হাট অনেক ইচ্ছা জাগে। যেসব ইচ্ছা সম্পূর্ণই ভিত্তিহীন। তবুও সেই ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে পারলে মনে এক ধরণের ভালো লাগা কাজ করে।

আয়নার সামনে দাড়িয়ে শাড়ির আঁচল পেচিয়ে বুকের কাছে নিয়ে কথা তার ভেজা চুল গুলো পিঠে এলিয়ে দিলো। আজ কোনো কারণ ছাড়াই তার সাজতে ইচ্ছে করছে। ড্রেসিং টেবিলে রাখা কাজল টা হাতে নিয়ে চোখে দিতে শুরু করলো সে। হঠাত পিছনে একটা ছায়ামূর্তি দেখে ভয়ে কেঁপে উঠলো কথা। এতো রাতে এভাবে কে দাড়িয়ে আছে!

.

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই বেশ অবাক হয় কাব্য। বিছানার মাঝ বরাবর নিতু বড় একটা ঘোমটা টেনে বসে আছে আর ঘরটাও ফুল দিয়ে সাজানো। যদিও সাজানো টা অনেক জাকজমপূর্ণ নয়। কিন্তু সুন্দর লাগছে দেখতে।

কাব্য দরজা আটকে দিয়ে আলমারি খুলে কাপড় বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো।

ওয়াশরুমের দরজা লাগানোর শব্দে নিতু ঘোমটা উঠিয়ে দেখলো সবটা। কিছুক্ষণ সে চিন্তা করলো কাব্য এখন কি করবে? হয়তো ঝগড়া করবে, নয়তো নাটকের নায়কদের মতো বালিশ নিয়ে সোফায় শুয়ে পরবে! কাব্য কোনটা করবে?

নিতুর ভাবনার সুতোয় টান পরে ওয়াশরুমের দরজা খুলার শব্দে। নিতু পুনরায় ঘোমটা টেনে বসে পরে। কাব্য একনজর নিতু কে দেখে টেবিলের ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করে হাতে নিয়ে ব্যালকোনিতে চলে যায়।

চলবে..

শ্রাবণের মেঘ পর্ব_১৮

0

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১৮
#Tabassum_Kotha

কাজী অফিসের সামনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে কথা। আর তার সামনেই কাব্য অগ্নিমূর্তি ধারণ করে আছে। তাদের সাথে নিতুও উপস্থিত আছে আর বোঝার চেষ্টা করছে যে এখানে হচ্ছে টা কি!

কিছুক্ষণ আগে কথা শপিং করার নাম করে নিতুকে খান বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে এখানে। আর কাব্যকে এক্সিডেন্টের মিথ্যা কথা বলেছিল আগেই যার জন্য কাব্য এখানে এসেছে। অবশ্য আসার পর কথার উদ্দেশ্যটা কাব্য ভালোই বুঝতে পেরেছে।

কথা অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে ভয়ে কাচুমাচু করতে করতে বললো,
— আমি সব কিছু রেডি করে ফেলেছি ভাইয়া, আর নিতুরও কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। তোরা বিয়েটা করে নে।

রাগে কাব্য এর চোখে মুখে আগুন জ্বলছে। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে কথাকে বললো,
— তুই একবার বাড়িতে চল তোকে মিথ্যা বলার মজা আমি বোঝাবো। পাবলিক প্লেসে সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছি না। ভালো মতো বলছি এখান থেকে চল।

কাব্য এর রাগ কথা ভালোই বুঝতে পারছে। বাড়িতে যাওয়ার পর যে তার কপালে দুঃখ আছে এটাও সে ভালো করেই জানে। কিন্তু এই মুহূর্তে ভয় পেলে চলবে না। নিতু আর কাব্য এর বিয়ে টা একদম ঠিক আছে। এই বিয়ের মাধ্যমে নিতু আর কাব্য দুজনেরই সুখ আছে।

নিজের ভিতর কিছু টা সাহস সঞ্চার করে কথা বলতে শুরু করলো,
— ভাইয়া বিশ্বাস কর, এই বিয়েটা তোদের দুজনের জীবনেই সুখ এনে দেবে।

কথার দিকে কাব্য চোখ গরম করে তাকালে কথা মুখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে ফেললো।

কথার অবস্থা বুঝতে পেরে নিতু এবার বলতে শুরু করলো,
— কেনো কাব্য, আমাকে কেনো বিয়ে করতে পারবে না? আমি কি দেখতে খারাপ নাকি খারাপ মেয়ে? নাকি আমার সাথে তোমার শত্রুতা? কোনটা? নাকি অন্য কোনো মেয়ে কে ভালোবাসো?

নিতুর এতোগুলো প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় কাব্য।

— মনে অন্য কেউ থাকলেও তোমার জীবনে অন্য কোনো মেয়ে নেই এটা আমি খুব ভালো করেই জানি। তাই আমাকে রিজেক্ট করার কোনো কারণ তোমার কাছে নেই। আর সত্যি বলতে যতোটা আমি তোমাকে ভালোবাসি, অন্য কোনো মেয়ে তোমাকে এতোটা ভালোবাসতে পারবে না। যদিও আমি জানতাম না কথা আমাদের এভাবে বিয়ের প্ল্যানিং করছে, কিন্তু এখন আমি জানি আর এখন আমি প্রস্তুত। সো তুমিও রাজি হয়ে যাও।

.
নিতুর অ্যাটিটিউডে কাব্য বাকরুদ্ধ! কথা আর নিতু দুইটাই যে মহা পাগল এ ব্যাপারে কাব্য এর আর কোনো সন্দেহ নেই। এখন কাব্য এর ভীষণ টেনশন হচ্ছে এই জান যায় যায় পরিস্থিতি থেকে সে কিভাবে মুক্তি পাবে! কাব্য কিছুক্ষণ কৌশলে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো কথা আর নিতুর ইমোশনাল যুক্তির সামনে। অনেক চেষ্টা করেও কাব্য নিতু আর কথাকে বোঝাতে সফল হলো না। কাব্য নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করে বিয়ে করার জন্য মানা করে দেয়।

কাব্য এর মানা করায় মুহূর্তেই নিতুর চোখ পানিতে ভরে উঠে। শেষ আশার আলো টাও যেনো নিভে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কাব্য ছাড়া অন্য কাউকে কিভাবে সে স্বামী হিসেবে মেনে নেবে।

— এমন করো না কাব্য ভাইয়া। আমি নির্ঘাত মরে যাবো। ভালোবাসা ছেড়ে বেঁচৈ থাকা গেলেও সেই ভালোবাসা কে মাটি চাপা দিয়ে অন্যকারো সাথে সংসার করা অসম্ভব। আমাকে এতোবড় শাস্তি দিও না কাব্য ভাইয়া। আমি সত্যি তোমাকে ছাড়া পারবো না। আজ এখন যদি তুমি আমাকে আপন করে না নেও, তবে আদনান কে বিয়ে করার আগেই আমার মরা মুখ দেখবে সবাই। এই আমি বলে দিলাম। তোমাকে ভালোবাসি মানে শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। তোমাকে ভুলে অন্য কারো সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। হয় আজ আমি তোমার বউ হয়ে খান বাড়িতে প্রবেশ করবো নয়তো কাল আমার লাশ খান বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বেরুবে!

নিতুর কথায় কাব্য কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে, কিছু চিন্তা করার মতো শক্তি আর খুঁজে পাচ্ছে না সে। ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে বাঁচার শান্তি যে কি সেটা সে ভালোভাবেই জানে। প্রতিমুহূর্তে মুখে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ লুকানোর বিদ্যাটা কাব্য এর আয়ত্ত হয়ে গেছে এতোদিনে। যেই কষ্ট সে সহ্য করছে, সেই একই কষ্ট অন্য কেউ সহ্য করবে ভাবতেই ভিতর টা নাড়া দিয়ে উঠছে তার।

কাব্য কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে নিচে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা চিন্তা করে। কথা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে কিন্তু টেনশন কাজ করছে তার মাথায়। কাব্য যদি বিয়ে টা না করে তাহলে নিতু আর কাব্য কে এক করার তার প্ল্যান টা জলে যাবে। পালিয়ে নিতু আর কাব্য এর বিয়ে করানোর প্ল্যান টা নীল এর থেকেই ধার করা কথার। কারণ নীলও কথাকে এভাবেই বিয়ে করেছে। এদিকে নিতু কান্না করছে। নাকের পানি আর চোখের পানি এক করে ফেলেছে। কি যে হবে কে জানে। ওদিকে কাজী অফিসে কাব্য আর নিতুর বিয়ের সিরিয়াল এসে পরেছে। কথার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে টেনশনে!

?

?

?

দুপুর পেরিয়ে গোধূলী লগ্ন শুরু হয়ে গেছে। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পরায় সোনালী রোদের ঝলক তির্যক ভাবে চোখে মুখে এসে পরছে কিশোর সাহেবের বাড়ির উঠানে। উঠানের একটু ভিতর দিকে সদর দরজার সামনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে কথা। রোজকারের মতো আজও সে দুই বেণী করেছে আর সামনের চুলগুলো চোখে মুখে এসে পরছে। কথার ঠিক পিছনে দাড়িয়ে আছে কাব্য আর তার সাথে নিতু। একটু আগেই কাজী অফিস থেকে বিয়ের পাঠ চুকিয়ে কিশোর সাহেবের বাড়িতে এসে উঠেছে তারা। বাড়িতে এসে অবশ্য বিয়ের ব্যাপার টা খোলাসা করা হয়ে গেছে। এজন্যই অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে তিনজনই।

সবকিছু জেনে হতভম্ব হয়ে আছেন কিশোর সাহেব আর কলি বেগম। ছেলের বিয়ে আর বউ নিয়ে কলি বেগমের শখের অন্ত ছিল না, আর সেই ছেলে কি না বিয়ে করে বউ নিয়ে বাড়ির দরজায় দাড়িয়ে আছে। একা একা বিয়ে করার ব্যাপার টা একবার মেনে নিলেও ফুফাতো ভাইয়ের হবু বউ কে বিয়ে করে নিয়ে আসা টা হজম করতে পারছেন না কলি বেগম। ভীত দৃষ্টিতে একবার স্বামীর দিকে দেখছেন আরেকবার ছেলের দিকে। কি কাজ টা করলো তার কাব্য! ভাবতেই মাথা ঘুরে উঠছে কলি বেগমের।
কিশোর সাহেব বেশকিছুক্ষণ চিন্তিত মুখে বসে থেকে হাতে থাকা মোবাইল টা ঘেটে নজরুল খানের নাম্বার বের করে ফোন করলেন। অপর পাশ থেকে ফোন তুলতেই আংশিক কিছু ঘটনা প্রকাশ করে নজরুল সাহেব কে তার পরিবারসহ তাদের বাড়িতে আসতে বললেন।

কিশোর সাহেবের মতো রাগী একজন মানুষের এমন শান্ত ব্যবহার কিছুতেই হজম করতে পারছে না কথা আর কাব্য। ঝড়ের পূর্বের নীরবতার মনে হচ্ছে পরিবেশটা তাদের কাছে। কিশোর সাহেবের চোখে ইশারায় কলি বেগম নিতুকে কাব্য এর ঘরে নিয়ে গেলেন।

— কথা! তুমি তোমার ঘরে যাও। (গম্ভীর কন্ঠে বললেন কিশোর সাহেব)

কিশোর সাহেবের কন্ঠের গাম্ভীর্য বলে দিচ্ছে সে কতোটা রেগে আছেন। কথা ভয়ে বড়সড় একটা ঢোক গিলে তার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

পিছনে কাব্য আর কিশোর সাহেব একা দাড়িয়ে আছে ড্রয়িং রুমে। আতিকা বেগম তার নিজের বাসায় গেছেন জরুরি কিছু কাজে। তিনি এখানে উপস্থিত থাকলে হয়তো বোম টা আরও জোরে বিস্ফোরণ ঘটাতো। কিশোর সাহেব সোফা ছেড়ে উঠে কাব্য এর দিকে এগিয়ে গেলেন।

কাব্য আগের মতোই মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। হয়তো অনুশোচনা হচ্ছে তার এভাবে বিয়ে করে বাবা মা আর বাকি সবাইকে কষ্ট দেওয়াতে!

কিশোর সাহেব কাব্য এর মুখোমুখি হয়ে হাত দিয়ে কাব্য এর নত হওয়া মাথা টা উঁচু করিয়ে কাব্য এর চোখে চোখ রেখে বলতে শুরু করলেন,
— তুমি আমার গর্ব ছিলে কাব্য! কথা আমার সম্মাণে যেদিন আঘাত করেছিল সেদিন আমি আমার মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম এটা ভেবে যে তুমি আমাকে কখনও কারো সামনে ছোট করবে না। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তুমি যে এতো বড় হয়ে গেছো সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আতিকা আপা নিতুকে আদনানের জন্য পছন্দ করেছেন যেনে আমি একদমই খুশি হই নি। কারণ আমি কথা আর আদনানের বিয়ের কথা চিন্তা করছিলাম। কিন্তু তাই বলে আমি এটা চাই নি যে তুমি নিতুকে বিয়ে করে নেবে তাও আবার এভাবে!

সত্যি তুমি আমাকে অনেক হতাশ করেছো কাব্য। নজরুল সাহেব কে আমি একদমই পছন্দ করি না। কারণ সে দুই বিয়ে করেছে। তাও আবার ছেলের লোভে। আর তুমি কিনা সেই নজরুল সাহেব কে আমার আত্মীয় বানিয়ে দিলে! আমি ভেবেছিলাম বাবা মা সন্তানের ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু তোমরা দুই ভাই-বোন আমার সেই ধারণা সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিয়েছো। যাক তোমরা যদি সুখে থাকতে পারো আমার অসুবিধা কি! তবে আজ থেকে মনে রাখবো তোমাদের জীবনে আমাদের কোনো মূল্য নেই।

কিশোর সাহেবের কথায় কাব্য এর দুচোখ ভরে গেছে। কাব্য কখনও তার বাবাকে ছোট করতে চায় নি। তবুও কি থেকে কি হয়ে গেলো। একজনের ভালো করতে গিয়ে বাকি সবার সাথে অন্যায় করে ফেললো সে!
.
.
.
.
.
.
কিশোর সাহেবের বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে আছেন নজরুল খান আর কিশোর সাহেব নিজে। সাথে বসে আছে নীল আর নীরব। নজরুল সাহেব একা আসেন নি, সাথে তার দুই স্ত্রী, ছেলেরা আর মেয়ে তানিয়াও এসেছে। থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে পুরো বাড়িতে। কাব্য আর নিতুর এমন একটা কাজে কিভাবে প্রতিক্রিয়া করা উচিত সবার কেউই ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।


কলি বেগমের ঘরে নিতু আর নিতুর মা, বড় মা, কলি বেগম, তানিয়া সবাই উপস্থিত আছে। তাহেরা বেগম আর কলি বেগম মাঝে মধ্যে টুকটাক কথা বলছেন।

নয়নতারা বেগম নিতুর হাত ধরে সবার সামনে থেকে একটু আড়ালে নিয়ে গেলেন।

ব্যালকোনিতে নিয়ে গিয়ে দাড় করালেন নিতুকে। নিতু মাথা নিচু করে আছে। যা দেখে নয়নতারা বেগমের রাগ আরও বেড়ে যাচ্ছে। তবুও গলার শব্দ যথেষ্ট নিচু রেখে বললেন,
— তুই এই কাজ টা করার আগে গলায় দড়ি দিলি না কেনো? আমার মেয়ে যে এই ধরনের একটা কাজ করবে এটা ভাবতেই গা ঘিনঘিন করছে। নিজের উপর ধিক্কার আসছে আমার যে আমি তোর মতো একটা কুলাঙ্গার সন্তানকে পেটে ধরেছি। এই দিনই যদি দেখাবি তাহলে জন্মের পরপরই কেনো মরে গেলি না। আগে জানলে আমিই তোকে মেরে ফেলতাম।

— মা আমি যা করেছি তাতে তোমরা কষ্ট পেয়েছো জানি। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি যদি আজ স্বার্থপর না হতাম তাহলে হয়তো সারা জীবন জীবিত লাশ হয়ে থাকতে হতো। আমি আমার সুখটুকু সন্ধান করতে গিয়ে অনেক স্বার্থপর হয়েছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।

— ক্ষমা আর তোকে? কখনই না। তোর জন্য তোর বাবার সামনে সারা জীবনের জন্য আমি ছোট হয়ে গেলাম। কখনও মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারবো না আর।

নয়নতারা বেগম আর নিতুর কথোপকথনে বাঁধার সৃষ্টি করে কলি বেগম নিতুকে সেখান থেকে নিয়ে যায়। কলি বেগম নিতুকে কাব্য এর ঘরে নিয়ে যেতে থাকলে তানিয়াও পিছন পিছন যায়।
.
.
.
.
কাব্য তার ঘরের ব্যালকোনিতে দাড়িয়ে স্মোক করছিল। একদিনে এতো কিছু হয়ে গেছে যে সে বুঝতে পারছে না কিভাবে কি হয়ে গেলো। দরজার টোকা পরার শব্দে কাব্য দ্রুত হাতের সিগারেট টা ফেলে দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে দাড়ালো। দরজা ঠেলে কলি বেগম, নিতু আর তানিয়া ঘরে প্রবেশ করলো। কলি বেগম নিতুকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেলেও তানিয়া নিতুর পাশেই বসে রইলো।

কাব্য ঘরের ভিতর ঢুকতেই সবার আগে তার চোখ তানিয়ার ওপর পরে। কারণ তানিয়া আগে থেকেই কাব্য এর দিকে তাকিয়ে ছিল। তানিয়ার বিয়ের পর এই প্রথম কাব্য তানিয়া কে দেখলো। আজ সারাদিন নিতুর কথা চিন্তা করতে করতে কাব্য এর মাথায় একবারের জন্যও তানিয়ার কথা আসে নি। হঠাত করে আবার তানিয়ার মুখোমুখি পরতেই বুকের বা পাশের চিনচিনে ব্যথাটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।

তানিয়া তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কাব্য এর দিকে তাকিয়ে আছে। তানিয়ার এই দৃষ্টির মানে কাব্য খুব ভালোই বুঝতে পারছে। তানিয়ার অভিমান ভরা দৃষ্টি উপেক্ষা করার সামর্থ কাব্য এর নেই। নিতুকে বিয়ে করায় যে তানিয়া কষ্ট পেয়েছে এবং কাব্য এর সাথে অভিমান করে আছে সেটা কাব্য খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।

তানিয়া নিজে যেখানে বিয়ে করে সংসার করছে, সেখানে কাব্য এর বিয়ে করাতে তার কষ্ট পাওয়া কি আদৌ যুক্তিসংগত! কারো ভালোবাসা একবার সমাজের জাতাকলে পিষে গেলে কি দ্বিতীয়বার তার ভালোবাসার অধিকার নেই!!

চলবে…

শ্রাবণের মেঘ পর্ব_১৭

0

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১৭
#Tabassum_Kotha

পানির বোতল হাতে ঘরে ঢুকতেই একটা ছায়ামূর্তিকে ব্যালকোনির সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ঘাবড়ে যায় কাব্য।

— কে ওখানে!

— আমি কাব্য ভাইয়া!

— কে?

— নিতু!

— তুই এতো রাতে এখানে কি করছিস?

— তোমার সাথে অনেক জরুরি কথা ছিল। তাই এতো রাতে এসেছি।

— নিতু তুই কি পাগল হয়েছিস! যতো জরুরি কথাই থাকুক না কেনো এতো রাতে তোর এখানে আসা ঠিক হয় নি! তুই চলে যা।

— যাবো না। অনেক বড় ভুল করেছি আমি। আগেই তোমাকে বলে দেওয়া উচিত ছিল। আগে যদি বলে দিতাম তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না।

— কি কথা বলতে চাস তুই যার জন্য এই রাতের অন্ধাকরে লুকিয়ে এসেছিস?

— আমি,, আমি,,

— ভনিতা না করে জলদি বলে চলে যা!

— আমাকে তাড়াতে পারলে বুঝি অনেক খুশি হবে! কিন্তু আমি যাবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি।

— কিহ!!

— হ্যাঁ। আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তোমাকেই বিয়ে করবো। আদনান কে আমি বিয়ে করতে পারবো না। আমাকে ফিরিয়ে দিও না। (কাব্য এর হাত দুটো চেপে ধরে নিতু কথাগুলো বললো)

— তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস নিতু! কি সব আবোল তাবোল বকছিস! (কাব্য নিজের হাত দুটো এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো)

— হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি। যা ইচ্ছে তাই বলো। কিন্তু তবুও বলবো আমি ভালোবাসি তোমাকে!

— নিতু তুই যা তো এখান থেকে!!

— যাবো না,, ততোক্ষণ পর্যন্ত যাবো না যতোক্ষণ না তুমি আমাকে আপন করে নিচ্ছো! (কাব্য কে পুনরায় জরিয়ে ধরে)

এবার আর কাব্য সহ্য করতে পারলো না। ঠাস্ করে একটা চড় মেরে বসলো নিতুর গালে। আচমকা চড় পরায় নিজেকে সামলাতে না পেরে মেঝেতে ছিটকে পরে নিতু। থাপ্পড় মারার পর হঠাত করেই চরম অনুশোচনায় পরে যায় কাব্য। এভাবে নিতুকে চড় মারা তার ঠিক হয় নি। ভালোবাসা তো অন্যায় না, হয়তো নিতুর ভালোবাসার মানুষটা আর সময় টা ভুল।

মেঝে থেকে নিজেকে সামলে উঠে দাড়ালো নিতু। কাব্য এর চড়ের ফলে ফর্সা গালটা লাল হয়ে আছে। হাতের আঙুলের ছাঁপ ফুটে উঠেছে গালে। মনে হচ্ছে রক্ত জমাট বেঁধেছে সেখানে। নিতুর দুচোখ পানিতে টলমল করছে। কেনো যেনো কাব্য নিতুর মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার, সেই সাথে অপরাধবোধও কাজ করছে!

— মারো, আরও মারো। পারলে মেরে ফেলো! যেখানে আমার নিজের মা আমার কষ্ট টা বুঝে নি, সেখানে তোমার কাছে আশা করাটাই আমার অন্যায় ছিল। একটা কথার উত্তর দেবে? ভালোবাসা কি অন্যায় কাব্য ভাই?

নিতুর প্রশ্নের কাব্য এর কাছে কোনো উত্তর নেই। ভালোবাসা অন্যায় না, সে নিজেও তো ভালোবাসে। এমন একজন কে সে ভালোবাসে যে কি না অন্যকারো। তবুও তো সে ভালোবেসেই যাচ্ছে। তাহলে নিতুর ভালোবাসা,,,,

— এই ধরনের প্রশ্নের তো কোনো মানেই হয় না নিতু। আজ বাদে কাল তোর বিয়ে, এই তুচ্ছ আবেগকে ভুলে মন ভালো কর। আদনানের সাথে অনেক সুখে থাকবি তুই!

— আমার সুখের চিন্তা তুমি না করলেই খুশি হবো! লাগবে না তোমার ভালোবাসা,, কিন্তু আমার ভালোবাসাকে তুচ্ছ আবেগের নাম দিয়ে অপমান করতে পারো না। যতোটা ভালোবাসলে একটা মেয়ে বিয়ের আগে চরিত্রহীন উপাধি নিতে প্রস্তুত থাকে তার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসি আমি তোমাকে।

হঠাত কিছু পরে যাওয়ার শব্দে নিতু আর কাব্য দুজনেই চমকে পিছনে তাকায়। অন্ধকার ঘরে কেউ একজন দাড়িয়ে এতোক্ষণ নিতু আর কাব্য এর কথা শুনছিল টের পেতেই কপাল বেয়ে চিকন ঘাম দেয় কাব্য এর। সে বুঝতেই পারছে কতোবড় ঝামেলার সৃষ্টি হতে চলছে!

অন্ধকার ভেদ করে সামনে এগিয়ে আসতেই মানুষটার মুখে চাঁদের আলো পরে। এতোক্ষণ কথা দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাব্য আর নিতুর আলাপ সবটা শুনছিল। কথা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে নিতুর দিকে, হয়তো সে আশা করে নি তার ছোটবেলার এতো ঘনিষ্ট বান্ধবী এতো বড় একটা কথা তার কাছে থেকে লুকাবে। কথার দৃষ্টির মানে নিতু বেশ ভালোই বুঝতে পারছে, তার উচিত এখন কথাকে সব বুঝিয়ে বলা। কিন্তু তার মুখ দিয়ে কথা সরছে না। কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আছে। নিতু ভালো-মন্দ কিছু না বলে চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই চলে গেলো।

পরিস্থিতি এতোটাই জটিল রূপ ধারণ করেছে যে কাব্য আর কথা দুজনেই মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে আছে। হয়তো আজ রাতে এই ব্যাপারে তাদের মধ্যে আর কোনো কথা হবে না!

?

?

খান বাড়িতে খুব জোরে সোরে শুরু হয়ে গেছে বিয়ের কাজকর্ম। সবাই ব্যস্ততায় দিন পাড় করছে। দুই ছেলের উপর বিয়ের সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে আছেন নজরুল সাহেব।

নিশ্বাস নেওয়ার মতো সময়টুকুও পাচ্ছে না নীল। সকাল থেকে এই কাজে ঐ কাজে ছুটে চলছে। কিন্তু সকাল থেকেই যে তার ফোন টা অনবরত বেজে চলছে সেদিকে তার কোনো হুশ নেই। অস্থির হয়ে ফোন করে চলছে কথা নীল কে। কম করে হলেও বিশটা কল করেছে কিন্তু একবারের জন্যও ফোন ধরে নি নীল। কাল রাতে নিতুর বলা সব কথাই নীল কে বলার জন্য এতোবার করে ফোন করছে। কিন্তু নীল কাজের ব্যস্ততায় মোবাইল ঘরে রেখে দিয়ে ভুলে গেছে।
.
.
.
.
বাইশ বারের মাথায় কল টা কেটে দিয়ে মোবাইলটা বিছানায় ছুড়ে মারলো কথা। বিরক্ত হয়ে গেছে সে নীল কে ফোন করতে করতে। অস্থির চিত্যে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেও কিছু একটা ভেবে বিছানা ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে ছুট লাগালো কাব্য এর ঘরের দিকে। কাব্য তার ঘরেই কিছু একটা করছিল, কথা ঘরের ভিতর ঢুকে দরজা ভিতর থেকে লাগিয়ে দিলো। কাব্য কথাকে দেখেও তেমন কোনো রিয়েক্ট না করে পুনরায় তার কাজে মন দিলো।

— তুই এতো রিলাক্স ভাবে কিভাবে বসে আছিস?

কথার প্রশ্নে কাব্য খানিকটা বিচলিত হলেও কথাকে বুঝতে না দিয়ে স্থির কন্ঠে জবাব দিলো,
— আমার কি এখন খুব বেশি বিচলিত হওয়ার কথা ছিল?

— তোর এমন গা ছাড়া ভাব দেখে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে ভাইয়া!

— যা বলার বলে চলে যা।

— নিতু কে তুই বিয়ে কর।

— হয়ে গেছে বলা? চলে যেতে পারিস!

— ভাইয়া তুই বুঝতে পারছিস না। আমার মনে হয় তোর নিতুকে বিয়ে করে নেওয়া উচিত। এভাবে আর কতোদিন দেবদাসের মতো জীবন কাটাবি?

— কথা তুই এখনও অনেক ছোট। তাই এসব কথা তোর মুখে মানায় না।

— আমি ছোট হতে পারি কিন্তু অবুঝ নই। ভালো মন্দ বোঝার বয়স আমার হয়েছে।

— আমি তোর কোনো কথার উত্তর দিতে চাই না। তুই যা এখান থেকে।

— কেনো উত্তর দিতে চাস না? নিতু কে ভালোবাসতে পারবি না কেনো? তানিয়া আপুর জন্য? তুই যে এখনও তানিয়া আপুর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছিস সেটা আমার অজানা নয়।

— কথা আমি একবার বলেছি এই বিষয়ে কোনো কথা আমি বলতে চাই না। তারপরেও কেনো তুই!

— কেনো জীবনে আগাতে পারছিস না ভাইয়া? নিতুকে তো আমরা ছোটবেলা থেকে চিনি। নিতু যে একটা ভালো মেয়ে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে কেনো নিতুকে ভালোবাসতে পারবি না তুই?

— নিতুকে ভালোবাসার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। নিতু নীল এর বোন। আমার বেষ্টফ্রেন্ডের বোন। ওকে ভালোবাসা বা বিয়ে করার কথা আমি ভাবতেই পারি না।

— তাহলে তানিয়া আপুকে কেনো ভালোবেসেছিলি? সেও তো নীল স্যারেরই বোন। তখন তোর মনে হয় নি তুই অন্যায় করছিস।

— ভালোবাসার উপর কারো জোর চলে না কথা। ভালোবাসা অন্যায় নয়।

— ঠিক তাই। নিতুর ভালোবাসাও কোনো অন্যায় নয়। আর আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তুই আর নিতু অনেক সুখী হবি একসাথে।

— এই বিষয়ে আমি ভাবতেও চাই না।

— কেনো ভাইয়া? তুই ভাবতেও পারবি না একটা মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার বিয়ে হওয়াটা কতোটা কষ্টের। আজ যদি নিতু আর আদনান ভাইয়ার বিয়ে হয়ে যায় নিতু কখনই সুখী হবে না। কারণ নিতুর মন জুরে তুই আছিস। একমাত্র তোর সাথেই নিতু সুখী হবে। আর তানিয়া আপুর শোক পালন করা বন্ধ কর। সে তো তার স্বামী নিয়ে দিব্যি সুখে সংসার করছে। তাহলে তুই কেনো দেবদাস হয়ে নিজের মন কে পুড়াচ্ছিস?

— কথা প্লিজ চুপ কর। আমার একদম ভালো লাগছে না।

— আজ রাত টুকু সময় দিলাম তোকে, তুই নিতুর কথা ভালো মতো ভেবে দেখ। আমি আবারও বলছি, নিতু তোকে ছাড়া অন্য কারো সাথে সুখী হতে পারবে না। আর বিশ্বাস কর, নিতু নিজের ভালোবাসা দিয়ে তোর জীবন সুখে ভরিয়ে তুলবে। এটা আমার বিশ্বাস।

কথা কাব্য এর দিকে তাকিয়ে আছে কোনো একটা উত্তরের আশায়। কিন্তু কাব্য মুখে তালা লাগিয়ে ব্যালকোনির কাচে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকেও কোনো লাভ না হলে চরম বিরক্তি নিয়ে কথা বেরিয়ে যায় কাব্য এর ঘর থেকে। নিজের ঘরে এসে ঠাস্ করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ব্যালকোনিতে গিয়ে দাড়ায় কথা। কাব্য এর উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে কথার। এখনও তানিয়ার ভালোবাসা নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে কাব্য এটা ভাবতেই কথার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। তানিয়া চাইলেই সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে কাব্য এর হাত ধরতে পারতো। কিন্তু তানিয়া সমাজ টাকেই প্রাধান্য দিয়েছে, এখন স্বামী সংসার নিয়ে বেশ ভালোই দিন কাটাচ্ছে। তাহলে কাব্য কেনো পারছে না তানিয়া কে ভুলে এগিয়ে যেতে? নীল কে সব কিছু জানাতে হবে।

মোবাইলটা হাতে নিয়ে পুনরায় নীল কে ফোন করা শুরু করলো কথা। সৌভাগ্যক্রমে এবার ফোনটা রিসিভও হয়ে গেলো ওপাশ থেকে। কিন্তু কথা হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ে কন্ঠ কথা বলে উঠলো। ফোন রিসিভ হওয়াতে কথার মুখে যেই হাসি টা ফুটে উঠেছিল মুহূর্তেই সেটা গায়েব হয়ে গেলো।

— হ্যালো কে বলছেন? (ওপাশ থেকে)

— নীল স্যার কোথায়? আর আপনি কে?

— জি আমি মুনতাহা, নীল এর! সে যাই হোক আপনি কে?

— আমি কথা! নীল স্যারের ফোন আপনার কাছে কেনো? নীল স্যার কে ফোনটা দিন।

— নীল এখন কথা বলতে পারবে না। নীল শাওয়ার নিচ্ছে। আর মোবাইলটা আমার কাছে কারণ নীল নিজেই আমার কাছে দিয়েছেন।

— আপনি নীল কে ডেকে দিন। আই মিন নীল স্যার কে ডেকে দিন।

— কথা তুমি পরে ফোন করো। নীল শাওয়ার নিচ্ছে। এখন ডাকা সম্ভব নয়।

কথা কিছু বলার আগেই মুনতাহা ফোনটা কেটে দিলো। এভাবে ফোন কেটে দেওয়াটা কথার রাগের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে। এমনিতেই নীল সারাদিন কথার ফোন ধরে নি, তার ওপর মুনতাহা ফোন ধরেছে এটাও কথার ভালো লাগছে না।

মুনতাহা পেত্নি টা কেনো ধরলো নীল এর ফোন? আর আমার এতোগুলো ফোন কি সে দেখে নি? একটা বার ফোন কল ব্যাক করার প্রয়োজন মনে করেন নি। দুই দিন যাবত না কোনো ফোন না কোনো কথা! তার ওপর মুনতাহাকে দিয়ে গেছে ফোন!! হ্যাঁ আমি তো এখন পুরোনো হয়ে গেছি তাই আমার কথা আর মনে পরে না।

চলবে..

শ্রাবণের মেঘ পর্ব_১৬

0

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১৬
#Tabassum_Kotha

??

সকালের মিষ্টি এক ফালি রোদ ব্যালকোনির কাঁচ ভেদ করে কথার চোখে মুখে এসে পরেছে। সামনের ছোট চুল গুলো এলোমেলো ভাবে চোখে মুখে এসে পরেছে। নীল মুগ্ধ দৃষ্টিতে কথার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে রোদ পড়াতে কথার সৌন্দর্য যেনো আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কথার এই এলো চুলের সৌন্দর্য যেকোনো অপ্সরীকে হার মানাতে বাধ্য। কথার বাচ্চামোগুলো নীল কে খুব করে টানে তার দিকে। তাই তো এই পাগলির প্রেমে পাগল হয়ে বসে আছে সে। কথার চোখের উপর থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু খায় নীল। আলতো করে কথার ঠোঁট জোড়ায় ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে ব্যালকোনি টপকে নিচে নেমে যায়।

ঘুম থেকে উঠে আড়মোরা ভেঙে উঠে বসতেই বিছানার অপর পাশে ফিরলাম। পাশে তো নীল নেই, গায়ে থেকে চাদরটা সরিয়ে ওয়াশরুমের দরজা খুলেও নীল কে পেলাম না। খানিকটা হতাশ হয়ে বিছানার সামনে আসতেই বেড সাইড টেবিলে রাখা নোট প্যাডের দিকে নজর পরলো। গুটি গুটি অক্ষরে দুটো লাইন লেখা আছে।

” আমি চলে যাচ্ছি, ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসবি। একদম টাইম ওয়েষ্ট করবি না। চাচা হয়তো তোকে আর কোচিং এ আসতে দেবে না।”

নোট টা হাতে পেয়ে আমার কেমন রিয়েক্ট করা উচিত জানি না। নীল চলে গেছে ভাবতেই বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যথা করে উঠলো। কেমন পরিস্থিতিতে পরেছি, বিয়ে হয়েছে অথচ স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় দেওয়ার অধিকার নেই!!









সময় আপন গতিতেই চলে যায়,, মাঝে কেটে গেছে দুই দিন। এই দুইদিনে অনেক কিছু ঘটে গেছে। আতিকা ফুপি আব্বুকে নিয়ে খান বাড়িতে নিতু আর আদনান ভাইয়ার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। দেখা স্বাক্ষাতের পর তারা আদনান ভাইয়াকে পছন্দ করে বিয়েও পাকা করে ফেলেছেন। আদনান ভাইয়া অবশ্য প্রথম প্রথম বিয়েতে অমত দেখিয়েছিলেন। কিন্তু আতিকা ফুপির জেদের সামনে তাকে হার মানতেই হয়েছে। আব্বুও বিষয়টা সহজ ভাবে মেনে নিয়েছেন। আদনান ভাইয়ার ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে যেতে হবে খুব তাড়াতাড়ি যার জন্য নিতু আর তার বিয়ে সামনে সপ্তাহেই ঠিক করা হয়েছে। সবাই সবার মতো চলছে। মাঝখান থেকে আমার আর নীল এর দেখা করা বন্ধ হয়ে গেছে। আব্বু এই দুই দিনে একবারের জন্যও আমাকে বাসা থেকে বেরুতে দেন নি।

প্রথম দুই রাত নীল লুকিয়ে এলেও কালকে আসতে পারেন নি। ফোনেই টুকি টাকি কথা হয় উনার সাথে। সেটাও আবার লুকিয়ে।

খান বাড়িতে কাজের ধুম পরে গেছে। এই অল্প কয়েকদিন আগে এক মেয়ের বিয়ে করিয়েছেন নজরুল খান। মাস ঘুরতেই ছোট মেয়েরও বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ব্যস্ততা যেনো রাখার জায়গা নেই তার। নয়নতারা বেগম খুব করে চেয়েছিলেন আগে নীল আর মুনতাহার বিয়ে করাবেন। কিন্তু নিতুর বিয়ে স্বয়ং নজরুল খান ঠিক করেছেন। স্বামীর মুখের উপর কথা বলার সাহস তার নেই। তাই তো না চাইতেও কথার ফুফাতো ভাইয়ের সাথে নিজের মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন। নয়নতারা বেগমের ধারণা, কথা আর নীল এর সম্পর্কে খান বাড়িতে একমাত্র তিনিই সব জানেন। আর তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন যাতে অন্য কেউ এই ব্যাপারে টের না পায়। আদনান শিক্ষিত, ভদ্র ঘরের ছেলে, ভালো ব্যাবসা করে। সব দিক বিবেচনা করেই আতিকা বেগমের এমন হুট করে বিয়ে করানোর প্রস্তাবে রাজী হয়েছেন নজরুল খান।

আদনান আর নিতুর বিয়ে নিয়ে বাকি সবাই খুশি থাকলেও খুশি হতে পারছে না নিতু। এভাবে হুট করে তার বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে সে ভাবতেই পারে নি। নয়নতারা বেগমের ঘরের সামনে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে নিতু।

— নিতু! ওখানে দাড়িয়ে আছিস কেনো? আয় ভিতরে আয়, দেখে যা তোর বাবা কতো গয়না কিনেছে তোর জন্য! (নয়নতারা বেগম)

— মা! এভাবে হুট করে বিয়ে টা না করলে হয় না!

— কি বলছিস এসব? তোর বাবা বিয়ে ঠিক করেছেন। এখানে মানা করার প্রশ্নই আসে না।

— আসলে মা।

— কি হয়েছে বলতো!

— আমি বিয়ে করতে চাই না মা!

— নিতু! আমার দিকে তাকা। তুই বিয়ে করতে চাস না নাকি আদনান কে বিয়ে করতে চাস না? কোনটা?

— মা আমার একটা আবদার রাখা যায় না? আমি এই বিয়ে করতে চাই না!

— কারণ টা জানার অধিকার কি আমার আছে?

— এভাবে বলো না মা! আমি বুঝতে পারি নি এভাবে বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে। আমি বিয়ে করতে চাই না।

— কারণ জানতে চাইছি নিতু! আদনানকে পছন্দ নয়? কোনো খারাপি আছে আদনানের?

— আদনানের কোনো দোষ নেই। দোষ আমার। আমি ভালোবেসে ফেলেছি।

নিতুর কথায় যেনো নয়নতারা বেগমের মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো। তার নিজের মেয়ের মুখ থেকে তার এই কথা শুনতে হবে, তা সে স্বপ্নেও ভাবে নি।

— কিহ! কি বললি তুই?
নয়নতারা বেগম দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজা ভিতর থেকে আটকে দিলেন যাতে কেউ কিছু শুনতে না পারে।

— কি বললি তুই? শেষমেষ আমাকে এই দিন দেখালি তুই? বল ছেলেটা কে? কতোদিনের সম্পর্ক চলছে?

— মা বিশ্বাস করো, আমার কোনো সম্পর্ক নেই। সেই মানুষটা তো জানেই না আমি তাকে ভালোবাসি। শুধু এটুকুই জানি আমি এক তরফা তাকে ভালোবাসি।

— পাগলের মতো কথা বলিস না নিতু। ছেলেটা কে সোজাসুজি বল।

— কিশোর চাচার ছেলে, নীল ভাইয়ার বন্ধু কাব্য ভাইয়া!

কথাটা নিতুর মুখ থেকে বের হতে সময় লাগলেও নিতুর গালে ঠাস্ করে একটা থাপ্পড় মারতে সময় নেয় নি নয়নতারা বেগম।

— ওরে মুখপুড়ি শেষ পর্যন্ত এই দিন দেখালি আমাকে। বিয়ের পাঁচ দিন আগে বলছিস অন্য একজন কে ভালোবাসিস। তাও আবার এমন একজনকে যে কি না জানেও না তুই তাকে ভালোবাসিস।

— মা তুমি কিছু একটা করো। আমি আদনান কে বিয়ে করতে পারবো না। আমি সত্যি কাব্যকে ভীষণ ভালোবাসি। অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।

— চুপ কর মুখপুড়ি। লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছিস! লজ্জা করছে না এসব কথা মুখে আনতে।

— তুমি কি সারাজীবন আমার কষ্ট সহ্য করতে পারবে? আমি তো কখনই অন্য কারো সাথে সুখী হতে পারবো না! মনে কাব্য এর নামের ভালোবাসা নিয়ে অন্যকারো সংসার কিভাবে করবো আমি!

— ছিঃ! ভাবতেই গা ঘিনঘিন করছে তোকে আমি পেটে ধরেছি। মায়ের সামনে এসব কথা বলার আগে গলায় দড়ি দিলি না কেনো?

কাব্য এর বিষয় নিয়ে নয়নতারা বেগম আর নিতুর মধ্যে বেশকিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হলেও নয়নতারা বেগম বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে রাজি হন না। নয়নতারা বেগম বিয়ে ভাঙতে চাইলেও তেমন কোনো লাভ হবে না সেটা সে ভালো করেই জানে। খান বাড়িতে নজরুল খানের কথাই শেষ কথা।

নিতু কান্না করতে করতে নিজের ঘরে এসে বালিশে মুখ গুজে দিলো। ছোট বেলা থেকেই কাব্য কে চিনে সে, নীল এর সাথে তাদের বাড়িতে আসতো কাব্য। যখন থেকে বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই কাব্য এর প্রতি অনুভূতি জন্ম নিয়েছে তার মনে। সময়ের সাথে সাথে সেই অনুভূতিটাকে সে ভালোবাসার নাম দিয়েছে। মুখ ফুঁটে কখনও বলতে না পারলেও অন্যকাউকে মনে জায়গা দেওয়া সম্ভব না তার পক্ষে।

?

?

সারাদিনের ব্যস্ততায় নীল আর কথার একবারও কথা হয় নি। আদনানের বাবা নেই যার জন্য ছেলে পক্ষের সব কাজ কিশোর সাহেব আর কাব্য এর কাঁধেই পরেছে। কিশোর সাহেব যদিও বিয়েতে খুশি নন তবুও বড় বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে মুখে কৃত্তিম হাসি ফুঁটিয়ে সব কাজ করে যাচ্ছেন।
.
.
.
.
.
.
.

রাত প্রায় নয়টার বেশি, কথাদের বাসায় সবাই খাওয়া দাওয়া শেষে যার যার ঘরে চলে গেছে। আদনান খুব জরুরি কাজে চট্টগ্রামে গেছে, যদিও পরদিন চলে আসবে। কাব্য তার ঘরের দরজা ভিতর থেকে আটকে লাইট বন্ধ করে রেখেছে। ভরা পূর্ণিমার রাত, চাঁদের আলোয় পৃথিবী মেখে আছে। সেই চাঁদের আলোই কাব্য এর ঘরের ব্যালকোনির কাঁচ ভেদ করে ঘরে এসে পরেছে। বিছানার পাশের পড়ার টেবিলে রাখা ডায়েরি টা থেকে একটা ছবি বের করে হাতে নিয়ে কাঁচের বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কাব্য। ছবিটার দিকে না তাকিয়েই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কাব্য এর। তার না হওয়া বউ এর ছবি এটা। তানিয়ার ছবি! এক বছর আগে তায়েবা আপুর মেয়ে রাইসার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে লুকিয়ে ছবিটা তুলেছিল সে। ছবিটা তুলার পর থেকে কতো হাজার বার দেখেছে আর কতো কথা বলেছে ছবিটার সাথে তার হিসেব রাখা হয় নি। অবশ্য সে চাইলেও সে হিসাব রাখতে পারতো না,, অগনিত বার সে তার প্রিয়তমার ছবি দেখেছে। তার না হওয়া বউ, তার প্রিয়তমা, তার ভালোবাসা,,, এখন অন্য কারো বুকে মাথা রেখে সুখ খুঁজে!!!

চলবে..

শ্রাবণের মেঘ পর্ব_১৫

0

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১৫
#Tabassum_Kotha

??

আম্মুর কথা শুনে আমার খুশিতে লুঙ্গি ডান্স দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমার কাছে তো লুঙ্গি নেই। চোখ বন্ধ করে কল্পনাতে আব্বুর একটা লুঙ্গি এনে দিলাম ইচ্ছে মতো কতোক্ষণ লুঙ্গি ডান্স। আতিকা ফুপি আম্মু কে ডাকায় আম্মু আমার ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। এখন আর কল্পনা নয় এখন সত্যি নাচ হবে। বেশ কিছুক্ষণ নাচার পর ক্লান্ত হয়ে হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে বিছানার সাথে লেপ্টে গেলাম। আজ আমার নতুন এক পরিচয় হয়েছে। আজ থেকে নীলের বউ আমি। নীল আমার স্বামী। ভাবতেই কেমন সুড়সুড়ি লাগে!
.
.
.
.
চিত হয়ে শুয়ে সিলিং ফ্যানের ঘুর্ণয়ণ দেখছিলাম আর লজ্জায় লাল হচ্ছিলাম তখন টুংটাং শব্দ করে মোবাইলে একটা মেসেজ এলো। মেসেজে নাম টা দেখেই আমার ঠোঁট দুটো একাই প্রসারিত হয়ে গেলো। নীল স্যার মেসেজ দিয়েছে, যদিও আজ থেকে উনি আমার স্বামী। মেসেজ টা পেয়ে যতোটা খুশি হয়েছিলাম ওপেন করে ততোটাই হতাশ হলাম।

” জলদি পড়তে বস। একদম টাইম ওয়েষ্ট করবি না।”

এটুকুই লেখা ছিল মেসেজে। বিয়ে হয়েছে কোথায় একটু রোমান্টিক মেসেজ করবে,, তা না করে এই মেসেজ করেছে! ইচ্ছে করছে মোবাইলটা ওই নীলের বাচ্চার মাথার ওপর আঁছাড় মারি। কিন্তু এখন মোবাইল ভাঙলে আমারই লস। তাই মোবাইলটা বিছানায় রেখে দিয়ে নিজেকে পড়ার টেবিলে নিয়ে গেলাম।

?

?

রাতে খাবার টেবিলে সবাই একসাথে বসে খাবার খাচ্ছি। আদনান ভাইয়া আমার ঠিক সামনের চেয়ারে বসে আছেন আর বারবার আঁড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। যদিও ব্যাপার টা বেশ অস্বস্তিকর তবুও মনের মধ্যে একটু শান্তি আছে ভেবে যে ফুপি আম্মু নিতুকে পছন্দ করেছেন। আর এমনিতেও আমি এখন অন্য কারো বিবাহিতা স্ত্রী। আমাকে তো আর আদনান ভাইয়া বিয়ে করতে পারবেন না।

— কিশোর, আজকে আদনানের জন্য একটা মেয়ে পছন্দ করেছি। (আতিকা বেগম)

আতিকা বেগমের কথায় খাওয়ার মাঝেই বিষম খেলেন কিশোর সাহেব। এভাবে হঠাত করে এই ধরনের কোনো কথা শুনতে হবে তার সেটা সে ভাবে নি।

— কোন মেয়ে আপা? (কিশোর সাহেব)

— মেয়েটাকে তুই চিনিস। আমাদের কথার ছোট বেলার বান্ধবী। নাম নিতু, ভারী মিষ্টি মেয়ে। আমার জীবন বাঁচিয়েছে আজ।

আতিকা বেগমের কথায় কিশোর রহমানের হাসি মুখটা মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেলো। আর এদিকে আদনান ভুত দেখার মতো চমকে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সে তো কথাকে বউ বানানোর স্বপ্নে বিভোর। আর তার মা নাকি অন্য মেয়ে পছন্দ করে বসে আছে।

খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। মনে হচ্ছে ঝরের পূর্বের নীরবতা এটা। আতিকা ফুপি যেই বম ফুটিয়েছেন, সেটার ধামাকার শব্দ কতোটা জোরে হবে কে জানে! পরিস্থিতি ক্রমেই বেগতিক মনে হচ্ছে। আব্বু খাওয়া বন্ধ করে চোয়াল শক্ত করে বসে আছেন। আমি আর আম্মু একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি। আর আদনান ভাইয়ার অবস্থা সবচেয়ে বেশি শোচনীয়। তাকে দেখে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে।

— মেয়েটাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমি মেয়েটার সাথে কথা বলে সব খোঁজ খবর নিয়ে নিয়েছি। বলি কি কিশোর তুই একটু মেয়ের বাবার সাথে আলাপ করে দেখ। আমার আদনান তো হীরের টুকরো, এমন ছেলে তারা আর কোথায় পাবে!

— আচ্ছা আপা আমি দেখছি।
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বললো কিশোর সাহেব।

আব্বু রীতিমত রাগে ফুসছেন। কোনোরকম খাবার গিলে উঠে পরলাম টেবিল থেকে। যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ হতে পারে। আমার এখানে না থাকাই শ্রেয়।








ফ্রেশ হয়ে টি শার্ট আর প্লাজু পরে ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই কেউ পিছন থেকে কোমড় জরিয়ে ধরলো। এমন আকস্মিক আক্রমণে আমি ভয়ে পুরোই ফ্রিজ হয়ে গেছি। হার্ট টাও অসম্ভব দ্রুত বিট হচ্ছে। রাত এখন কম করে হলেও দশটা বাজে। এই অসময়ে আমার ঘরে কে এভাবে আমাকে জরিয়ে ধরবে! আমি আগের ভঙ্গিতেই দাড়িয়ে আছি আর লোকটা ধীরে ধীরে আমার গলায় তার নাক ঘসছে। এতোক্ষণে লোকটার স্পর্শ আমার কাছে পরিচিত পেলো। আগুন্তকটা আর কেউ নয়, আমার স্বামী, নীল!

কথার ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে নীল তার ঠোঁট জোরা সেখানে বসাতেই হালকা কেঁপে উঠলো কথা। নীলের ঠোঁট জোড়া কথার গলা আর কাঁধে বিচরণ করছে। কথা চোখ মুখ খিচে ধরে রেখেছে, হয়তো লজ্জা পাচ্ছে সে। নীল কথার টিশার্ট খানিকটা উচু করে কথার নগ্ন পেটে হাত রাখতেই কথা চট করে চোখ খুলে ফেলে। নীল কে হালকার উপর একটা ধাক্কা দিয়ে কিছুটা দূরে সরে দাড়ালো কথা।

লজ্জায় লাল হয়ে গেছে কথা, সেই সাথে কপালে জমা হয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মাথা নুইয়ে দাড়িয়ে আছে কথা নীল এর সামনে। কথার এই অবস্থা দেখে নীল এর খুব হাসি পাচ্ছে। নীল একটু এগিয়ে গিয়ে কথাকে কোলে তুলে নিলো। হঠাত কোলে তুলে নেওয়াতে কথা চোখ বড় বড় করে নীল এর দিকে তাকিয়ে আছে।

— ওভাবে কি দেখছিস?

— আপনি এতো রাতে এভাবে এলেন যে?

— কেনো আসতে পারি না বুঝি?

— না একদমই আসতে পারেন না।

— কেনো গো বউ ভুলে যাচ্ছো নাকি আজ আমাদের বাসর রাত!

নীল এর কথায় কথা ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো।

— অ্যাঅ্যা কি বলছেন এসব? বাসররাত মানে!

— এখন কি ন্যাকা সাজা হচ্ছে? আজকে আমাদের বিয়ের প্রথম রাত। তাই তো এতো কষ্ট করে ব্যালকোনি টপকে এলাম। বাসররাত পালন করতে!

— আআপনি ককি সত্যি বববাসররাত করতে এসেছেন?

— কেনো কোনো সন্দেহ আছে নাকি?

— আমার না শরীর টা ভালো না আপনি চলে যান হ্যাঁ! আমাকে নামিয়ে দিয়ে যান!

— হুশ! যাবো না। এখন রোমান্স হবে। নিউলি ম্যারিড কাপল আমরা।

— আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে। আপনি চলে যান। আপনিও ঘুমান।

— আজ রাতে আর ঘুমানোর দরকার নেই।

— এই না না প্লিজ কিছু করবেন না।

নীল কথাকে খাটে শুইয়ে দিয়ে নিজের সব ভর কথার উপর ছেড়ে দিলো। কথা এখনও চোখ মুখ খিচে ধরে আছে। আর নীল মুগ্ধ নয়নে তার পরীকে দেখছে। বিয়ের প্রথম রাত নিয়ে সব মেয়েদের কতোরকম জল্পনা কল্পনা থাকে আর কথারাণী সে কিনা বাচ্চাদের মতো টিশার্ট পরে কান্না করছে! কথার মুখের দিকে তাকিয়েই হেসে পরে নীল।

কিছুক্ষণ নেশা ধরানো দৃষ্টিতে কথার দিকে তাকিয়ে থেকে কথার ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে নীল। প্রথমে কথা হালকা বাঁধা দিলেও একটু পরেএ শিথিল হয়ে যায়। নীল এর ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে কথাও নীল কে আঁকড়ে ধরে। বেশকিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর হঠাত কথা নীল এর শার্টের বোতাম খুলতে গেলে নীল কথার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে নিজেকে কথার উপর থেকে সরিয়ে নেয়।

নীল এর হঠাত এভাবে সরে যাওয়ার মানে না বুঝতে পেরে কথা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকায়। নীল একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে কথাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পরে। কথা নীল এর বুকে মাথা রেখে কিছুক্ষণ ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে।

— সরি রে! এভাবে তোকে বিয়ে করলাম, কিন্তু কাউকে জানাতে পারলাম না। জানি তুই আমার উপর ভীষণ রাগ করেছিস। কিন্তু বিশ্বাস কর, এভাবে হুট করে তোকে বাড়িতে নিলে আরও বড় ঝামেলা হবে। যেটা আমি চাই না। তোকেও হারাতে চাই না। এজন্য কিছুদিন সময় দে, সব ঠিক করে দেবো।

ওপাশ থেকে কথার কোনো সাড়া নি পেয়ে নীল কথার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো কথা ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেছে। নীল একটা মুচকি হাসি দিয়ে কথাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরলো।

চলবে…

শ্রাবণের মেঘ পর্ব_১৪

0

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১৪
#Tabassum_Kotha

রাতের অন্ধকার ভেদ করে সূর্য তার আলো দেওয়ার দায়িত্ব শুরু করেছে অনেকক্ষণ হয়েছে। সরু রাস্তার দুই ধারে স্থির দাড়িয়ে থাকা গাছ গুলোর ছায়া পিছনে ফেলে ছুটে চলছে নীল এর জিপ। জিপ এ অবশ্য কথাও আছে নীল এর সাথে। কাল রাতে মুনতাহা আর নীল এর বিয়ের কথা জানার পরপরই কিছু হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে নীল। সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত করার জন্যই তারা ছুঁটে চলছে। যদিও এই সিদ্ধান্ত তাদের ভাগ্যে সুখ আনবে নাকি কষ্ট সেই ধারণা এখনও নীল এর হয় নি। কিন্তু এই মুহূর্তে তার এই সিদ্ধান্তই সঠিক।

সারারাত চিন্তায় ঘুমাতে না পারায় ক্লান্তিতে গাড়িতেই চোখ লেগে গিয়েছিল কথার। হঠাত গাড়িতে ব্রেক কষায় আঁতকে উঠে কথা।

নিজেকে সামলে চোখ খুলতেই চোখ কপালে উঠে গেলো আমার। নীল জিপ থেকে নেমে দাড়িয়ে আছেন। আর সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা “কাজী অফিস!” কাজী অফিসের নাম দেখেই বড় সড় একটা ঢোক গিললাম। জানি না কেনো কপাল বেয়ে চিকন ঘাম দিচ্ছে। কি হতে চলছে আমার সাথে!

— এখনও বসে আছিস! নাম জলদি। আমাদের সিরিয়াল এসে পরেছে হয়তো এতোক্ষণে!

— অ্যা কিসের সিরিয়াল?।

— আমাদের বিয়ের। আমার বন্ধুরা সব কিছু রেডি করে ফেলেছে এখন শুধু আমরা গিয়ে কাবিননামায় সিগনেচার করবো আর কবুল পড়বো। চল।

— কি বলছো! বিয়ে তাও আবার এমন হুট করে! সে কি করে সম্ভব?

— হুট করে না আমি সারা রাত চিন্তা করেছি।

— পাগল হয়েছো? আব্বু আম্মু ভাইয়া তোমার পরিবার, কেউই তো জানে না। কিভাবে আমরা বিয়ের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ কারো অনুমতি ছাড়াই করতে পারি?

— অনুমতির অপেক্ষা করে তোকে হারাতে পারবো না আমি। তুই কি চাইছিস যে আমি সবার অনুমতির অপেক্ষা করি আর এদিকে কিশোর চাচা তোর বিয়ে করিয়ে দেন!

— আমরা সবাইকে রাজী করাতে পারি!

— তুই কি চাচা কে চিনিস না? সে কি কখনও মেনে নেবে আমাকে জামাই হিসেবে কখনও!

— কেনো মানবে না? আমরা বোঝাবো!

— চেষ্টা তো করেছিলি, কি লাভ পেলি? আজকে তো তোকে কোচিং এ ও আসতে দেয় নি। পালিয়ে এসেছিস।

— তবুও এভাবে একা একা বিয়ে করা টা ঠিক হবে না।

— তুই কি চাস আমাদের ভালোবাসা এভাবেই হারিয়ে যাক!














দুচোখ ভর্তি পানি আর মনে অনুশোচনা নিয়ে কাবিন নামায় স্বাক্ষর করে দিলাম। সন্তান হিসেবে আজ হয়তো সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজটাই আমি করলাম। কিন্তু সত্যি আমি নিরুপায়। নীল কে হারিয়ে বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আব্বু কখনও নীল কে মেনে নিবেন না এটাও আমি জানি। আমাকে ক্ষমা করে দিও আব্বু আম্মু। প্রতিবারের মতো এবারও তোমাদের সাথে আমি অন্যায় করলাম। একটা নতুন সম্পর্কের লোভে পরে আমি আমার রক্তের সম্পর্কের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলাম। আব্বু আম্মু আমাকে কখনও ক্ষমা করবেন না।

যেই নীল কে আমি আমার প্রতিটি নিশ্বাসে স্বামী হিসেবে চেয়েছি তাকে আজ স্বামী হিসেবে পেয়েও আমি খুশী হতে পারছি না। বাবা মা কে কষ্ট দিয়ে সুখী হওয়া যায় না। হয়তো এই কারণেই আমার জীবনের চরম কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে পেয়েও আমি খুশি নই।

কাজী অফিসের বারান্দায় দাড়িয়ে আছি কাবিন নামা টা হাতে নিয়ে। এক টুকরো কাগজের ভিত্তিতে নীল আর আমি স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলাম। খুব মনোযোগ সহকারে খুটে খুটে দেখছি কাবিন নামা টা। নীল এর নামের সাথে কথার নাম জুড়ে আছে। অবশেষে এই কথা তার নীল এর হয়েই গেলো! দেনমোহর এক লক্ষ্য এক টাকা ধারণ করেছে নীল। খান বাড়ির ছেলের কাছে এক লক্ষ্য টাকা খুবই সামান্য। কিন্তু আমার কাছে এই এক লাখ টাকা এক কোটি টাকা কেও হার মানাবে।

অবশেষে আমি আমার ভালোবাসা কে পেলাম। বারান্দায় রাখা বেঞ্চিতে বসে পরলাম। নীল তার বন্ধুদের সাথে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করছেন। আমার বিয়ে হয়ে গেছে, আমি এখন নীল এর বউ ভাবতেই কেমন গা সুরসুরি দিয়ে উঠছে। সেই সাথে ভয়ও করছে। যখন নীল আমাকে নিয়ে খান বাড়ি যাবেন তখন সবাই আমাদের মেনে নেবে তো? নাকি আমাদের তাড়িয়ে দেবে? আমাদ আব্বু তো কখনই মানবে না। তবুও আমি দৌড়ে গিয়ে আব্বুর পায়ের উপর পরে যাবো। ততোক্ষণ ছাড়বো না যতোক্ষণ না ক্ষমা করছেন। আচ্ছা আমি যতোটা সহজ ভাবছি আদৌ কি পরিস্থিতি ততোটা সহজ হবে?

” কথা!” — নীল এর ডাকে কথার ভাবনার ঘোর কাটে।

— কি ভাবছিস? সারাদিন কি এখানেই বসে থাকবি নাকি? চল বাসায় চল।

— সব কাজ হয়ে গেছে?

— হ্যাঁ এখানের সব কাজ শেষ। এখন বাসায় যাবো চল।

বেঞ্চি থেকে উঠে দাড়িয়ে নীল এর দিকে হাঁটা ধরলাম। আজ নীল এর দিকে তাকাতে বেশ লজ্জা লাগছে আমার। যদিও লাল বেনারসি পরি নি তবুও বউ বউ ফিলিং আসছে। মনে হচ্ছে গাল দুটো ফুল গেছে লজ্জায়। না না নীল এর সামনে এভাবে গেলে নিশ্চিত পচানি দেবে। কুল কথা কুল। নিজেকে নরমাল কর।

জিপে উঠে বসলাম। নীল এর দিকে তাকাতে পারছি না লজ্জায়। নতুন বউ হলেই বুঝি সব চেঞ্জ হয়ে যায়! এই কি সেই নীল যাকে কালকেও আমি জরিয়ে ধরেছিলাম! এসব কিছুই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল কিন্তু পরক্ষণেই আবার আব্বু আম্মুর কথা মনে পরলো। কতো বড় জঘন্য একটা কাজ করেছি আমি। তারা কি আমাকে কখনও ক্ষমা করবেন?

ভেবেছিলাম নীল আমাকে প্রথমে খান বাড়িতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু আমাকে বেশ অবাক করে দিয়ে আমার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে চৌরাস্তার মোড়ে জিপ থামালেন। আরও বেশি অবাক হলাম।যখন নীল আমাকে জিপ থেকে নেমে বাসায় যেতে বললেন। প্রথমে ভাবলাম হয়তো সেও সাথে যাবেন কিন্তু এবার আমাকে অবাকে শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়ে উনি আবার জিপে উঠে পরলেন।

— আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

— বাসায় যাচ্ছি। কেনো?

— আমাকে একা রেখে চলে যাচ্ছেন যে? আবার কি নিতে আসবেন?

— আবার নিতে কেনো আসবো? তুই তোর বাড়ি যাবি আমি আমার বাড়ি যাবো। এমনিতেও তোর পরীক্ষার বেশি দিন বাকি নেই। বাসায় গিয়ে সোজা পড়তে বসবি।

নীল এর কথায় আমি হ্যাবলা কান্তের মতো উনার দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে ডেট ওভার গঞ্জিকা সেবনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে উনার মধ্যে। একটু আগে বিয়ে করে এখন বলছে তুই তোর বাড়ি যা আমি আমার বাড়ি যাবো!!

— আপনি এসব কি বলছেন? আপনি না আমাকে একটু আগে বিয়ে করলেন? এখন এসব কি বলছেন!

— বিয়ে করেছি বলেই তো অর্ডার দিচ্ছি যে গিয়েই পড়তে বসবি।

— আমি তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারছি না। আমাদের বিয়ে হয়েছে, এখন তো তুমি আমাকে তোমার সাথে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে তাই না?

— না। এখন আমি তোকে আমার বউ হিসেবে খান বাড়িতে নেবো না। আমি এখন তোকে বিয়ে করেছি শুধু তোর বিয়ে আটকানোর জন্য। আমার বাড়ির কাউকে তোর আর আমার কথা বলা হয় নি, এছাড়াও আমি এখনও কোনো কাজ করি না। হুট করেই তোকে নিয়ে বাড়িতে উঠলে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেবেন।

— তোমার কি মাথা ঠিক আছে? তুমি নিজে বুঝতে পারছো তুমি কি বলছো? তুমি আমাকে বিয়ে করেছো কিন্তু তোমার বাড়িতে নিতে পারবে না। এটা কেমন কথা নীল? যদি দায়িত্বই নিতে না পারো তাহলে এভাবে হুট করে বিয়ে করলে কেনো? নিজে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছো কিন্তু আমার জীবনের সাথে ঠিকই খেলতে পারলে। কেনো এসব কথা তোমার বিয়ে করার আগে মনে পরে নি? কি ভেবে করলে বিয়েটা? উত্তর দাও!

— তোকে হারাতে চাই নি। এজন্যই ঠিক বেঠিক সব ভুলে আগে নিজের করে নিলাম। এখন আস্তে আস্তে সব ঝামেলা সামাল দেবো।

— ঝামেলা সামাল দেওয়ার কথা তো পরে আসবে। তুমি ঝামেলা আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছো।

নীল এর বোকামি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না আমি। ভীষণ রাগ হচ্ছে। রাগ করে নীল এর সামনে থেকে চলে এলাম। পিছন থেকে উনি অনেক বার ডেকেছেন কিন্তু আমি সাড়া দেই নি। কি সাড়া দেবো! বিয়ে করেছে কিন্তু সবার সামনে স্বীকার করার সাহসটুকু তার নেই। আসলে ভুল টা আমার। এমন একজন মেরুদন্ডহীন মানুষকে ভালোবেসেছি, বিশ্বাস করে বিয়ের মতো এতো বড় একটা ডিসিশন নিয়ে ফেললাম হুট করে। এখন মনে হচ্ছে নীল এর কথামতো তাকে বিয়ে করে ভুল করেছি।

?

?

ভীষণ বিরক্তি আর অপরাধবোধ নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকতেই আতিকা ফুপি আম্মু আর নিতু কে একসাথে বসে থাকতে দেখলাম। আমি বাড়িতে না থাকলে সাধারণত নিতু আসে না। তবে আজ হঠাত কি মনে করে। আর ফুপি আম্মুই বা কখন এলেন? তবে কি সে আমার আর আদনান ভাইয়ার বিয়ে ঠিক করতে এসেছেন? বুকে এতো জোরে জোরে ধুকপুকানি হচ্ছে মনে হয় সেই শব্দ বাইরের মানুষও শুনতে পারবে। একটু আগেই তো বিয়ে করে এলাম এখন আবার বিয়ের কথা চলবে। ইয়া খোদা আমার এই প্যাড়া আর ভালো লাগে না। দড়ি ফালাও আমি উপরে উঠে যাই!!

— কথা বাইরে দাড়িয়ে আছিস কেনো? এতোদিন পর আমি এসেছি তবুও কাছে আসছিস না যে! (আতিকা ফুপি)

— না আসলে হঠাত আপনাকে দেখেছি তো তাই সারপ্রাইজ্ড হয়েছি।

— আয় বস আমার কাছে।

ফুপি আম্মুর কাছে গিয়ে বসে পরলাম। নিতুও তার সাথেই বসে আছে। নিতুর এখানে থাকার কারণ টা এখনও স্পষ্ট হয় নি আমার কাছে। আম্মু খাবার টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন আর কটমট করে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। ভাগ্যিস ফুপি আম্মু ছিল, নয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এখনই বেঁধে যেতো।

ফুপি আম্মুর সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষে আমি আর নিতু আমার ঘরে চলে এলাম। নিতুর সাথে কথা বলে যেটুকু জানতে পারলাম তা হলো, ফুপি আম্মু আমাদের বাড়ি আসার পথে এক্সিডেন্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। আর তাকে বাঁচিয়েছে নিতু। নিতুই তাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে এসেছে আর এতোক্ষণ তারা দুজন গল্প করছিল।

— তোর কি কিছু হয়েছে কথা?

— কই না তো!

— আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে তুই একটু টেনশনে আছিস।

— না না তেমন কিছুই না। তুই তাহলে বাড়ি যা, পড়তে হবে তো।

— হুম। ভালো মতো পড়িস।

কি মনে করে নিতুর কাছে থেকে আমার আর নীল এর বিয়ের কথাটা লুকালাম জানি না। মনের মধ্যে ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করছে। মনে হচ্ছে বিয়ের কথাটা জানতে পারলে আব্বু আম্মুর মতো নিতুও আমাকে ঘৃণা করবে।

?

শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে আছি চোখ বন্ধ করে। সকাল থেকে অনেক কিছু ঘটে গেছে আমার জীবনে। কালকে পর্যন্ত আমি সাধারণ একটা মেয়ে ছিলাম যে কি না একটা যমরাজের প্রেমে পাগল ছিল। আজ আমি সেই যমরাজের বিবাহিতা স্ত্রী কিন্তু সে কথা কাউকে বলতে পারছি না! কি ভাগ্য আমার!!

অজান্তেই একটা ম্লান হাসি ফুঁটে উঠলো কথার ঠোঁটে।

বেশ লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হতেই আম্মু হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে গেলো।

— তোর হয়েছে টা কি বলতো কথা! সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিলি?

— ককোই কোথাও না তো। একটু কলেজে গিয়েছিলাম। সামনে পরীক্ষা কতো কাজ বাকি।

— তোর ফুপি আম্মুকে আজকে এক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচিয়েছে নিতু।

— হ্যাঁ নিতু বলেছে।

— আতিকা আপা যে আদনানের জন্য নিতুকে পছন্দ করেছে এটা বলে নি তোকে?

— কিহ! আদনান ভাইয়ার জন্য নিতুকে পছন্দ করেছে মানে?

— হ্যাঁ আসলে তোর আব্বু শুধু তোর ফুপিকে আসতে বলেছিল। আদনান আর তোর বিয়ের কথা বলে নি। তোদের বিষয়ে কথা বলার আগেই আতিকা আপা নিতুকে পছন্দ করে ফেলেছে। এমনিতেও নিতু অনেক ভালো মেয়ে। ছোট বেলা থেকে আমার সামনেই বড় হয়েছে। তাই আমি আপা কে বলেছি যে আদনানের জন্য একদম ঠিক আছে নিতু।

— আম্মু তুমি কি বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

— বুঝবি কি করে মাথায় তো শুধু গোবর ভরা। নিতু আর আদনানের বিয়ে টা হয়ে গেলে তোর আর নীল এর রাস্তা অনেকটা ক্লিয়ার।

— আম্মু তুমি সত্যি বলছো? তুমি আমার আর নীল এর সম্পর্ক মেনে নিয়েছো?

— না মানার কি আছে। তোরা একে অপরকে ভালোবাসিস। কিন্তু তোর বাবা কে রাজি করানো না অনেক কষ্টকর হবে।

চলবে…

শ্রাবণের মেঘ পর্ব_১৩

0

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১৩
#Tabassum_Kotha

” তুই এই অবেলায় এখানে কিভাবে এলি?”

খান বাড়ি পৌঁছে খুব সাবধানে সবার নজর এড়িয়ে নিতুর ঘরে ঢুকে পরলাম। এমন অবেলায়ায় নিতুর ঘরে আমাকে দেখে নিতু ভুত দেখার মতো চমকে উঠে কথাটা বললো।

— তোর এতো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় আমার নেই। নীল স্যার কোথায়? খুব প্রয়োজন তাকে একটু ডেকে দে।

— হয়েছে টা কি বলবি তো!

— পরে সব সময় করে বলবো এখন ডেকে দে না!

— তুই বস আর পানি খা আমি ডাকছি নীল ভাইয়া কে।

নিতু নীল কে ডাকার জন্য ঘরের বাহির হতেই সামনে রাখা কাঁচের জগ থেকে একগ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নিলাম। তবুও শান্তি পাচ্ছি না। শুনেছিলাম বিয়ের কথা শুনে বাঙালী মেয়েরা নাকি লজ্জা পায়। আর আমার তো টেনশনে কলিজার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। কি থেকে কি হবে কে জানে। সব দোষ আমার আমিই জেদ ধরে বসেছিলাম ডেট এ যাওয়ার। লাইফের ফার্স্ট ডেট এ গিয়েই ধরা খেয়ে গেলাম। তাও আবার আব্বুর সামনে! ডেট এ যাওয়া শখ আমার জনমকার মতো ঘুচে গেছে।

নীল কে কিভাবে বলবো বিয়ের কথা! আর আদনান ভাইয়াই বা কতো বড় ছ্যাঁচড়া, লুচি পরোটা, পেত্নি! কালকেই মাত্র বেড়াতে এলো আমাদের বাড়ি আর আজ কি না আমাকে বিয়ে করতে চায়! ওই লুচির যদি আমি দম আলু বের না করেছি তো আমার নাম ও কথা না। না থুরি আমিও নীল এর বউ না!! দেখে নেবো আদনানের বাচ্চা তোকে! তুই আমাকে এখনও চিনিস না। তোকে কুচি কুচি করে কেটে সেই কাটা জায়গায় মন্টু মামার ফুচকার টক পানি যদি না ঢুকিয়েছি তবে দেখে নিস!

“একা একা কি বকবক করছিস?”– নীল এর ডাকে কথার ভাবনার সুঁতো কাটে।

— দেখে তো মনে হচ্ছে কারো চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছিস। কিন্তু কারণ টা তো বল!

— তুমি তো কথাই বলো না। তোমার শ্বশুড় তোমার বউ এর বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।

— মানে! কি বলছিস তুই?

— আব্বু আমার বিয়ের কথা চালাচ্ছেন।

— হোয়াট! কিন্তু কেনো? আর কার সাথে?

নীল কে বাসায় যা যা হয়েছে সব খুলে বললাম। আমার কথা শুনে নীল ধপ করে সোফায় বসে পরলেন। আমি ভেবেছিলাম নীল রাগে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো ফেঁটে পরবেন। কিন্তু আমি তো তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না তার মধ্যে। সে তো খুব ঠান্ডাভাবে বসে আছে!
আমি ভ্রুঁ কুচকে তাকিয়ে আছি নীল এর দিকে আর বোঝার চেষ্টা করছি সে কি চিন্তা করছে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছি না। সে আগের ভঙ্গিতেই বসে আছে।


“নীল তোমার কফি।” — নীল কে কিছু বলার আগেই পিছন থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠ কথা টা বলে উঠলো।

ভীষণ মিষ্টি একটা কন্ঠের আভাস পেয়ে পিছনে তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড়া।

কমোলিকার মতো দেখতে একটা মেয়ে খুবই স্টাইল মেরে দুই মগ কফি হাতে দাড়িয়ে আছে নিতুর ঘরের সামনে। মেয়েটাকে প্রথম দেখাতেই আমার কসোটি জিন্দেগি কি এর কমোলিকার কথা মনে এলো কেনো? আমার আর নীল এর জীবনের কমোলিকা নয়তো কোনো দিক দিয়ে মেয়েটা! অবশ্য ঢং ঢাং ভ্যাম্পের মতোই। মেয়েটাকে আমি চিনি না জীবনে দেখি নি তবুও হিংসে হচ্ছে। কারণ মেয়েটা অনেক সুন্দরী! ফিগার তো পুরোই ভারতীয় নায়িকাদের মতো। আর আমি! এলোকেশী কন্যা সাথে জন্মগত গোলটুশী!

নিজের থেকে বেশি সুন্দর কাউকে আবার আমি সহ্য করতে পারি না। একটু জেলেসু টাইপ তো তাই আর কি!

— তোমার জন্য কফি এনেছি নীল। (মুনতাহা)

— তুমি কষ্ট করতে গেলে কেনো? রুপা দিয়ে যেতো।

— রুপা কেনো করবে! তোমার সব কাজ এখন থেকে আমিই করবো!

— তুমি আমাদের গেষ্ট মুনতাহা। তোমাকে দিয়ে কাজ করানো ভালো দেখায় না।

— গেষ্ট বলে অপমান করছো নীল। আমি তো তোমার আপনজন।

নীল আর কমোলিকা পেত্নির আদিক্ষেতা দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে আমার। এই মুনতাহা না মঞ্জোলিকা কে আমার সুবিধার মনে হচ্ছে না। পেত্নিটার পাতলা শিফনের শাড়ি দেখেই বুঝতে পারছি আমার নীল এর উপর কালা যাদু করার ফন্দি আটছে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে নীল কে বশ করার টোপ ফেলছে আর নীল মনের আনন্দে সেই টোপ গিলছে। ন্যাকা!

কথা গলা ঝাঁড়া দিয়ে মুনতাহা আর নীল এর আলাপের মাঝে বিঘ্ন ঘটালো। নীল মুনতাহা আর কথা কে পরিচয় করিয়ে দিলো নিতুর বান্ধবী হিসেবে।

— কথা তুমি আর নিতু আড্ডা দাও আমি আর নীল চলে যাচ্ছি। (মুনতাহা)

— সে কি কথা কোথায় যাবেন আপনারা?

— আমাদের মাঝে তোমরা ছোটরা বোর হয়ে যাবে। তাই আমি আর নীল একা সময় কাটাই। কি বলো নীল?

— মুনতাহা তুমি বরং মা বড় মার সাথে সময় কাটাও। কথা আর নিতুর ফাইনাল পরীক্ষা কিছুদিন বাদে আমি ওদের পড়াই।

— তুমি পড়াবে?

— হ্যাঁ নীল স্যার ই তো আমাদের পড়ায়। আর সে জন্যই তো এসেছি এখানে। তাই না নীল স্যার! (কথা)

— হ্যাঁ। তুমি যাও মুনতাহা।

?

মুনতাহা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে কথা নীলকে ঝাঁপটে ধরে নীল এর বুকের সাথে মিশে যায়। নীলও কথাকে পরম আবেশে জরিয়ে ধরে। নীল আস্তে আস্তে কথার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর নীল তার বুকের দিকে ভেজা ভেজা অনুভব করে। এতোক্ষণ নীলের চোখে মুখে প্রশান্তি থাকলেও নীল এর বুকের ভিতরটা হঠাত করেই মুচড়ে উঠে।

কথাকে সোজা করে কথার মুখ নীল তার দুই হাতের আঁজলে নিতেই নীল এর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠে। কথা এতোক্ষণ কান্না করছিল। দুচোখের পানিতে গাল ভিজে গেছে কথার। নীল একটা ম্লান হাসি দিয়ে কথার চোখের আর গালের পানি মুছে দিয়ে কপালে একটা চুমু এঁকে দেয়।

— তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে না তো?

— এসব কি বলছিস? ছেড়ে দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।

— আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আব্বু ভীষণ রাগী মানুষ। সে একবার যেটা ঠিক করেছেন সেটাই করবেন। আর কারো কথা শুনবেন না।

— তুই চিন্তা করিস না একদম। আমি আজকেই বাবার সাথে কথা বলে তোর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাচ্ছি।

— আব্বু রাজী হবেন না!

— কেনো? আমি কি ছেলে হিসেবে খারাপ নাকি?

— না কিন্তু তোমার বাবা দুই বিয়ে করেছেন এটা আব্বু ভালো চোখে দেখেন না।

— হুম জানতাম এটাই কারণ হবে। বড় মা বাবাকে ছেলে দিতে পারেন নি বলেই আমার মা কে বিয়ে করেছিল বাবা। তারপর অবশ্য বড় মাও ছেলের মা হয়েছে। কিন্তু সেটা নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ হয় না।

— জানি আমি সবই কিন্তু আব্বু মানবেন না! তুমি কিছু একটা করো।

— আচ্ছা দেখছি। কিন্তু তুই এখন বাসায় যা। কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা নেমে আসবে।

— হ্যাঁ আমাকে তাড়াতে পারলেই তো তোমার লাভ! ওই কমোলিকার সাথে তোমার চিপকা চিপকি করতে সুবিধা হবে। আমার সামনে তো আর ইটিশ পিটিশ করতে পারবে না!

— কমোলিকা টা আবার কে? আর কার সাথে ইটিশ পিটিশ করলাম!

— হু হু আমি সব জানি।

— কি জানিস?

— ওই মুনতাহার সাথে তুমি একদম কথা বলবা না। একদম ওর সাথে মিশবা না।

— কেনো কেনো? কোথাও কি কিছু পুড়ছে নাকি?

— আমি একদম জেলাস না। কিন্তু ওই মুনতাহা কে আমার সুবিধার মনে হচ্ছে না।

— মুনতাহা আমার খালাতো বোন কথা। (কথার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো নীল)

— তবুও। আমার ভয় হচ্ছে। সব দিক দিয়েই কেমন সবাই উঠে পরে লেগেছে তোমার থেকে আমাকে আলাদা করতে। এখন যদি এই মুনতাহা ওর রূপ দেখিয়ে তোমায় বশ করে ফেলে! দেখেছো কতো ঢং করে!

— পাগলি একটা! মুনতাহা কেনো, স্বর্গের কোনো পরীও আমার মনে তোর জায়গা নিতে পারবে না।

নীল আবারও কথাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। কথা নীল এর শার্ট পিছন থেকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। নিতুর ঘরের দরজা খোলাই ছিল। দরজার আড়ালে দাড়িয়ে মুনতাহা এতোক্ষণ সবটা দেখছিল। নীল আর কথার সম্পর্কের কথা জেনে বেশ ব্যথিত হয়েছে সে। ব্যথিত হওয়া অসঙ্গায়িত কিছু নয়। সেই ছোট থেকে স্বপ্ন দেখে আসছে সে নীল এর বউ হবে। নীল কে স্বামী হিসেবে কল্পনা করেই তো তার দিন রাত এক হয়েছে। সেই নীল তার চোখের সামনে অন্য মেয়েকে বুকে জরিয়ে ধরে রেখেছে এটা মেনে নেওয়া কি এতোটা সহজ হবে মুনতাহার পক্ষে! চোখের পানি আঁড়াল করে সেখান থেকে চলে গেলো মুনতাহা।

?

?

গোধূলী লগ্নের শেষ প্রহর চলছে, সূর্য দিগন্তের দিকে হেলে পরেছে অনেকক্ষণ আগেই। নীল এর থেকে বিদায় নিয়ে খান বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরেছে কথা। গন্তব্য তার নিজের বাড়ি। যদিও আজ এই পথ তার কাছে ভীষণ অচেনা লাগছে। যতোই বাড়ির কাছাকাছি যাচ্ছে ততোই নীল এর ভালোবাসা হারানোর ভয় উঁকি দিচ্ছে মনের মধ্যে। বিষন্নতা ছেয়ে আছে কথার মনে। এতোদিন নীল এর ভালোবাসা তার জীবনে ছিলো না আর কোনো প্যারাও ছিল না। আজ যখন তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে, তখনই রাজ্যের সমস্যা তাদের জাঁকড়ে ধরেছে। ভালোবাসায় এতো সমস্যা কেনো?

নীল এর বাবা দুই বিয়ে করাতে আব্বু তাদের পছন্দ করে না। আরেহ ভাই বিয়ে সে করতেই পারে এটা তার নিজস্ব ব্যাপার!

“কথা দাড়াও।”

একা একা বকবক করছিলাম। হঠাত পিছন থেকে কারো ডাক শুনে ঘুরে তাকালাম। নীরব ভাইয়া ছুঁটে আসছে আমার দিকে। দেবর জি এর কি কাজ পরলো হঠাত।

নীরব ভাইয়া আমার সামনে এসে একদন্ড নিশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলেন,
— কথা তুমি আমার প্রশ্নের আর কোনো উত্তর দিলে না!

— কোন প্রশ্ন?

— ঐ যে আমাকে বিয়ে করবে কি না?

— দেখেন নীরব ভাইয়া আমি আপনাকে সবসময় ভাইয়ের চোখে দেখেছি। সো প্লিজ ভাই বোনের সম্পর্কে এসব আনবেন না। আর এই ব্যাপারে আপনার সাথে আর কোনো কথা আমি বলতে চাই না।

নীরব ভাইয়াকে আর কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি বাড়ির দিকে ছুঁটে গেলাম। এমনিতেই ঝামেলার অভাব নেই, আবার তার উপর নতুন উটকো ঝামেলা!

বাড়িতে পৌঁছে ব্যালকোনির পাইপ বেয়ে খুব সাবধানে ঘরে ঢুকে খেলাম। ঘরে ঢুকতেই আরেক দ্বন্ড অবাক হওয়া যে আমার বাকি ছিল সেটা বুঝতেই পারি নি। আম্মু কিভাবে যেনো আগে থেকেই আমার ঘরে বসে আছে। আর তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আমাকে রান্না করা ছাড়াই খেয়ে ফেলবেন।

— কোথায় গিয়েছিলি?

— আসলে.. তুমি ভিতরে কিভাবে এলে!

— ব্যালকোনি টপকে যেভাবে পালিয়েছিলি সেভাবেই এসেছি। কোথায় গিয়েছিলি?

— নিতুদের বাড়িতে।

— নীল আর তোর কিসের সম্পর্ক?

— ……

— চুপ করে আছিস কেনো? উত্তর দে! নীল আর তোর কিসের সম্পর্ক?

— আমা নীল কে ভালোবাসি। নীলও আমাকে ভালোবাসে।

— তোর আব্বু তোর বিয়ে আদনানের সাথে ঠিক করছে জানিস এটা? তারপরেও কেনো নীল এর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি?

— আম্মু আমি নীলকে ভালোবাসি আর বিয়েও ওকেই করবো। অন্যকাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

কথাটা বলতে দেরি হলেও কথার গালে ঠাসস্ করে একটা চড় পরতে সময় লাগলো না। কলি বেগম এভাবে কথাকে থাপ্পড় মারবেন এটা কথার ধারণার বাইরে ছিল। নিজেকে সামলে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে কথা। হয়তো এই প্রথম কথার গায়ে হাত তুলেছে কলি বেগম।

— তোর বাবা নীল কে পছন্দ করে না এটা জানার পরেও তুই নীল এর সাথে সম্পর্ক রাখছিস! ভুলে যাস না কথা এই বাড়িতে সেটাই হয় যেটা তোর বাবা চায়। আর তোর বাবা তোর ফুপি আম্মুকে কথা দিয়ে ফেলেছে। আজ যে তুই নীল এর সাথে দেখা করার জন্য পালিয়ে গিয়েছিলি সেটা তোর বাবা জানতে পারলে কি অবস্থা হবে তুই বুঝতে পারছিস!

— মা আমি নীল কে ভালোবাসি। আর তোমার আর বাবার বোঝা উচিত সারাজীবন আমি সংসার আমি করবো! যার সাথে আমি সারা টা জীবন কাটাবো সেই মানুষ টা আমার পছন্দের হলে খুব বেশি কি ক্ষতি হবে! মানছি নীল এর বাবা দুই বিয়ে করেছেন এজন্য বাবা তাকে পছন্দ করেন না। কিন্তু আমি তো নীল কে ভালোবাসি। আমার জন্য কি আব্বু নীল কে মেনে নিতে পারবে না!

— এতো কথা আমাকে শুনিয়ে লাভ নেই কথা। আমি আমার দিক দিয়ে চেষ্টা করে দেখেছি। তোর আব্বু কিছুতেই রাজী না। তাই তুই নীল কে ভুলে যা। তোর আব্বু তোর আর আদনান এর আকদ্ সামনে সপ্তাহেই করে ফেলবেন। নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত কর।

মা আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। সময় খারাপ যাচ্ছে নাকি আমি খারাপ বুঝতে পারছি না। মাথাটা হ্যাং হয়ে আছে। বুকের বা পাশে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে, আমার কান্না করা দরকার। কিন্তু কান্না আসছে না। কেনো কান্না করতে পারছি না। চোখের পানি গুলোও আজ আমার সাথে বেইমানি করছে। কান্না করলে হয়তো আমার কষ্ট টা কমতো।।

☘️

☘️

খান বাড়ির ছাদের কার্নিশ ঘেসে দাড়িয়ে স্মোক করছে নীল। সিগারেট যে শুধু কষ্টেই খায় এই ধারণটা নীল কে দেখলে অনেকের পাল্টে যাবে। আজ নীল এর মনে খুশি আর দুশ্চিন্তা দুটোই বিরাজ করছে। কথার ভালোবাসা পেয়ে আজ সে অনেক খুশী। তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হয়তো কথা। কথার এলোমেলো চুলের দুই বেণী বারবার নীল কে তার প্রেমে ফেলে দেয়। কথার বাচ্চামোগুলোর প্রতি নীল আসক্ত। কিন্তু হঠাত করেই তার জীবনে এসব কি হচ্ছে। কথার বিয়ে তাও আবার অন্য কারো সাথে এটা তো নীল কল্পনাও করতে চায় না। কিভাবে কি করবে, কিভাবে কথার বিয়ে আটকাবে, বাড়ির সবাই কথা আর তার সম্পর্ক কিভাবে নিবে সবকিছু নীল কে খুব করে ভাবেচ্ছে। নিজেকে স্থির রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে নীল কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছে না।

সিগারেটে শেষ ফুঁ দিয়ে ধোঁয়া গুলো খোলা আকাশে উড়িয়ে দিয়ে সিগারেটের শেষাংশ পা দিয়ে পিষে ফেললো নীল।

” ভাইয়া মা তোর আর মুনতাহা আপুর বিয়ে পাকা করে দিয়েছে।” — হুড়মুড়িয়ে ছাদে উঠে হাপাতে হাপাতে কথাটা বললো নিতু।

মাথায় বাজ পরার চমকে উঠে পিছন দিকে তাকালো নীল।

— আমার তো আগেই সন্দেহ হয়েছিল হঠাত করে মুনতাহা আপু কে বাসায় আনার পিছনে কোনো কারণ আছে। কিন্তু সেটা যে তোদের বিয়ে সেটা বুঝতে পারি নি।

— কি বলছিস তুই মাথা ঠিক আছে তোর?

— হ্যাঁ ভাইয়া বিশ্বাস কর আমি এইমাত্র মা আর বড় মার কথা আড়ি পেতে শুনে এলাম। মুনতাহা আপু আর তোর আকদ্ করানোর প্ল্যানিং চলছে। তাও আবার এই সপ্তাহেই।

চলবে…

শ্রাবণের মেঘ পর্ব_১২

0

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১২
#Tabassum_Kotha

??

চৌরাস্তার মোড়ে স্কুল ব্যাগ কাঁধে দাড়িয়ে আছে কথা। রোজকার মতোই দুই বেনী আর ছোট চুলগুলো চোখের সামনে এসে পরছে বারবার। প্রায় ছয় মিনিট হয়ে গেছে সে দাড়িয়ে আছে নীল এর জন্য। নীল এর সাথে আজকের দিন ঘুরবে সে সেজন্যই সকাল সকাল বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে মিথ্যা কথা বলে।

নতুন নতুন প্রেমে পড়ে মিথ্যা কথা বলার মজাটাই আলাদা। এই মিথ্যা বলা বাকি সবার কাছে খারাপ হলেও যারা প্রেমে পড়ে তাদের কাছে অনুভূতি টা পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি জিনিস কেউ হার মানাবে।

ভীষণ লজ্জা, বুকে ধুকপুকানি, অপেক্ষার স্বাদ, রাগ সবকিছুই কাজ করছে কথার মনে। এত্তো এত্তো অনুভূতি কাজ করছে যে সব তালগোল পাকিয়ে জগা খিচুড়ী হয়ে গেছে। অপেক্ষার প্রহর কাটছেই না, আর এদিকে নীল এর দেখাও মিলছে না। তবুও কথা হতাশ হয় নি। আর হবেও না। নীল এর এই ভালোবাসার জন্য সে দুই বছর অপেক্ষা করেছে। এই নীল এর জন্য আরও দুই জনম অপেক্ষা করতে পারবে। কিন্তু নীল কে এতো ঢিল দেওয়া যাবে না। তুলি বলেছিল স্বামী আর বয়ফ্রেন্ডদের আঁচলে বেঁধে রাখতে হয়। “নীল কথার বয়ফ্রেন্ড” ভাবতেই কেমন সুরসুড়ি দিয়ে উঠছে কথার গা।

?

খান বাড়ির ড্রয়িং রুমে পুরো পরিবার একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডা দিচ্ছে বললে ভুল হবে, নয়নতারা বেগম তার বোনের মেয়ে মুনতাহার গুণ কীর্তণ করছেন নজরুল সাহেব আর তাহেরা বেগমের সামনে। নিজের ছেলের বউ হিসেবে ছোট বোনের মেয়েকে খান বাড়িতে আনবেন সেই পরিকল্পনা তো সে অনেক আগেই করে রেখেছেন। এখন শুধু পরিকল্পনা টা বাস্তবায়িত করতে হবে।

নয়নতারা বেগম একেরপর এক মুনতাহার গুণের পুটলি খুলে যাচ্ছেন আর মুনতাহা লজ্জায় মাথা নুইয়ে বসে আছে। তানিয়া আর রাজীব তাদের বাসায় চলে গেছে। নিতু বই হাতে নিয়ে বসে আছে ঠিকই কিন্তু দৃষ্টি তার সন্দেহ প্রবণ। মুনতাহার হঠাত এতো তারিফ নিতু কিছুতেই হজম করতে পারছে না। তার মা নয়ন বেগম যে কোনো একটা ফন্দি আঁটছে মনে মনে সেটা খুব ভালোই টের পাচ্ছে নিতু।

“নীরব তোর বাইকের চাবি টা দে তো আমাকে। আর আজ তুই আমার জিপ নিয়ে নিস।” — সবার আড্ডায় বিঘ্ন ঘটিয়ে নীল কথা টা বললো।

নীরব উঠে গিয়ে বাইকে চাবিটা নীল এর হাতে ধরিয়ে দিলো।

— নীল! মুনতাহা এতোদিন পরে এসেছে ওকে একটু ঘুরতে নিয়ে যাবি না? (নয়নতারা বেগম)

— এই সাত সকালে ঘুরার কি আছে মা? তবুও যদি মুনতাহার এতোই ইচ্ছা থাকে নিতু আছে নীরব আছে ওদের বললেই তো পারো।

— এ কি ধরনের অভদ্রতা নীল? মা এর সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? (তাহেরা বেগম)

— সরি বড় মা। আসলে আমি খুব দরকারি কাজে যাচ্ছি। আর মা এখন এসব বললো! সরি। আমি আসছি।

নীল আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নীরবের বাইক নিয়ে খান বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।

?

প্রায় আধা ঘন্টার মতো দাড়িয়ে আছে কথা, রাগে সাপের মতো ফুসছে সে। প্রথম প্রেমের প্রথম ডেট এ যাবে তাও কি না প্রেমিক লেট! এসব মেনে নেওয়া যায় না। এখন থেকেই নীল অবহেলা শুরু করে দিয়েছে আর তো দিন পরেই রয়েছে। না এর একটা বিহিত আজকে সে করেই ছাড়বে।

আরও তিন চার মিনিট পর একটা বাইক দ্রুত বেগে এসে কথার সামনে সজোরে ব্রেক কষলো। বাইকটা দাড় করিয়ে বাইকে বসা অবস্থাতেই স্টাইল মেরে হেলমেট টা খুললো নীল। কথা ভ্রুঁ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে নীল এর দিকে।

— উঠে বস। কেউ দেখে ফেলবে।

— ওরেহ আমার যমরাজ রে এলি তো এলি দেরি করে আবার এখন লোক দেখার ভয় পাচ্ছিস!

— এই তুই কি পাগল হয়েছিস? কি সব আবোল তাবোল বকছিস?

— আমি আবোল তাবোল বকছি! আমি! ঠিক আছে যাবোই না তোমার সাথে। যাও চলে যাও।

— আচ্ছা সরি আর দেরি করবো না। এখন তো আয়!

কথা একটা ভেঙচি কেটে বাইকে উঠে পরলো। যদিও সে ভেবেছিল অনেকক্ষণ রাগ দেখাবে নীল কে। কিন্তু নীল এর সামনে তার সব রাগ পানি হয়ে যায়।

— শক্ত করে ধরে বস। পরে গেলে কোমড় ভেঙে যাবে।

— আমার কোমড় ভাঙতে পারে এমন কোনো বাইক আজ পর্যন্ত তৈরি হয় নি। তুমি চালাও।

— দেখ কথা জেদ করিস না। বলছি ধরে বস। পরে গেলে ব্যথা পাবি।

— আমিও তো বলেছি পরবো না। চলো তুমি।

হাল ছেড়ে দিয়ে নীল বাইক স্টার্ট দিলো। শক্ত করে না বসায় বাইক স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে যেতেই কথা নিচে পর গেলো। আচমকা পরে যাওয়াতে কথা কোমড়ে বেশ ব্যথা পেলো।

— আম্মু গো আমি পরে গেলাম, মরে গেলাম গো!!

নীল বাইক সামনে ব্রেক করিয়ে কথার কাছে এসে কথাকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো।
— বলেছিলাম ধরে বস, কিন্তু না ম্যাডাম সবসময় দুই লাইন বেশি বুঝে। নে এখন ব্যথাটা কে পেলো।

— তুমি আমাকে বকছো! আমাকে একটুও ভালোবাসো না তাই না!

— ভালোবাসি বলেই বকছি।

— হুহ!

— এতো ন্যাকামো কিভাবে শিখলি বলতো!

— আমি ন্যাকামো করি!

— আর নয় তো কি?

— তুমি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসো?

— এই প্রশ্ন কেনো?

— জানি না।

নীল কথা কে বাইকে বসিয়ে আবার বাইক চালাতে শুরু করলো। এবার কথা নীল কে শক্ত করে জরিয়ে আছে। প্রথম প্রথম নীল কে ধরতে সংকোচ বোধ করলেও এখন সেই সংকোচ টা অনেকাংশে কমে গেছে।

?
?

সকালের স্নিগ্ধ সময়, রাতে বৃষ্টি হওয়াতে ভেজা রাস্তার অনেক জায়গায় পানি জমে আছে। রাস্তার দুই ধারে সোজা হয়ে সাড়িবদ্ধভাবে দাড়িয়ে থাকা গাছ গুলো রাস্তার সৌন্দর্য যেনো আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কথা চোখ বন্ধ করে নীল এর পিঠের সাথে লেপ্টে আছে। নীল লুকিং গ্লাস টা বাঁকা করে বারবার কথার মায়াভরা মুখটা দেখে যাচ্ছে। কথাকে দেখে অজান্তেই নীল এর মুখে এক প্রশান্তির হাসি চলে আসে। নীল আর কথা দিন দুনিয়া ভুলে ছুটে চলছে অজানার পানে!!




” মামা আমি কথা কে বিয়ে করতে চাই! যদি আপনার অনুমতি থাকে!”– কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই কিশোর রহমানকে কথা টা বলে দিলো আদনান।

কিচেনে দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় আদনানের কথা শুনে চমকে উঠে হাতে থাকা কাঁচের গ্লাসটা ফেলে দিলো কথা। ড্রয়িং রুমে বসে থাকা কিশোর সাহেব, কলি বেগম আর আদনানের কানে কাঁচ ভাঙার শব্দ এলেও সেই শব্দের তোয়াক্কা না করে কিশোর সাহেব বলা শুরু করলেন।

— ছেলে হিসেবে তোমার তুলনা হয় না আদনান। মেয়ে জামাই হিসেবে তোমাকে পাওয়া তো আমাদের ভাগ্য হবে। আমি আজই আতিকা বুবুর সাথে তোমার আর কথার বিয়ের আলাপ করছি।

আব্বু আদনান ভাইয়া আর আমার বিয়ের কথা চিন্তা করছেন! না না সে কি করে সম্ভব? আমি তো নীল কে ভালোবাসি। নীলকে ছাড়া অন্যকাউকে স্বামী হিসেবে ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাকে আব্বুর সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু আব্বুর সামনে দাড়িয়ে নীলকে ভালোবাসার কথা বলার মতো সাহস আমার নেই। কি করবো এখন আমি। ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। টেনশনে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছি। নীল এর সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু কিভাবে?

— কাব্য এর আব্বু! একটু ঘরে আসো তো। কাজ আছে! (কলি বেগম)

কিশোর সাহেব কলি বেগমের সাথে ঘরে গেলে কলি বেগম ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

— এসব কি বললে তুমি? আদনান বললো আর তুমি রাজি হয়ে গেলে! কথার কি বিয়ের বয়স হয়েছে?

— আমি যা করেছি ভেবে চিন্তেই করেছি। এতো বছর আমার সাথে সংসার করার পর তোমার এতোটুকু বোঝা উচিত কলি।

— সেটাই তো সমস্যা। এতো বছর সংসার করেও তোমাকে বুঝতে পারলাম না। কেনো দিতে চাইছো কথার বিয়ে এখন! আর আদনানই বা কেনো? আত্মীয়র মধ্যে আত্মীয়তা করার পক্ষে আমি না।

— আমি তোমাকে কোনো কটু কথা বলতে চাই না কলি। শুধু বলবো আমি যা করছি কথার ভালোর জন্য করছি।

— কিন্তু হঠাত করে কথার বিয়ে কেনো?

— আজকে কথা কে নজরুল খানের বড় ছেলে নীল এর সাথে বাইকে দেখেছি। নিজের মেয়ে বলে মাথা নিচু করে চুপচাপ চলে এসেছি। কথা যে এভাবে আমার মান সম্মাণ নিয়ে খেলবে সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল।

— হয়তো তোমার বুঝতে ভুল হচ্ছে কোথাও।

— যেই অবস্থায় ওদের দুজনকে একসাথে দেখেছি ভুল বুঝার প্রশ্নই আসে না। সে যাই হোক, আদনান কে আমার জামাই হিসেবে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। কথার পরীক্ষার আগেই আকদ্ করিয়ে রাখবো। আর এই ব্যাপারে দ্বিতীয় কোনো কথা আমি শুনতে চাই না।

দরজার আড়ালে দাড়িয়ে আব্বু আম্মুর কথা শুনছিলাম এতোক্ষণ। আজকে আব্বু আমাকে আর নীল কে একসাথে দেখে ফেলেছে। এখন আমার বিয়ে দিতে চায়! কথাটা নীল কে বলতেই হবে। কিন্তু এখন যদি আম্মুকে বলি নিতুদের বাসায় যাবো তাহলে আব্বু যেতে দেবেন না। ব্যালকোনি টপকে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।

যেই ভাবা সেই কাজ ব্যালকোনি টপকে প্লাজো টা উঁচু করে দৌড় লাগালাম খান বাড়ির উদ্দেশ্যে। যে করেই হোক নীল এর সাথে দেখা করতেই হবে।

চলবে..

শ্রাবণের মেঘ পর্ব_১১

0

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১১
#Tabassum_Kotha

” মুখ খুলো আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
খাবার প্লেট টা হাতে নিয়ে বিছানায় বসতে বসতে নীলকে কথাটা বললো কথা।

— তোকে দেখে বউ বউ ফিলিং আসছে কেনো জানি।

— কারণ আমি তোমার বউ এজন্যই আমাকে দেখে তোমার বউ ফিলিং আসছে।

— বা রে কবুল কোথায় পড়লাম?

— কবুল পড়তে কতোক্ষণ! কবুল! নাও পড়ে নিয়েছি। এখন আমি তোমার বউ।

— তুই একা পড়লেই কি আর হলো নাকি! আমাকেও পড়তে হবে। কবুল!

— হিহিহি। তুমি কিন্তু ফেঁসে গেছো। মি. জামাই এখন থেকে আমি যা বলবো সব শুনতে হবে।

— শুনবো মিসেস বউ।

— এই না তুমি আমাকে নীলবউ বলে ডাকবে।

— এটা আবার কেমন নাম হবে নীলবউ!

— যেমনই হোক। আমি চাই আমার আষ্টে-পৃষ্ঠে শুধুই নীল জরিয়ে থাকুক। সবাইকে জানতে হবে কথা শুধু নীল এর। আর এই ” নীল শুধু কথার।”

— এখন খাইয়ে দাও বউ। থুরি নীলবউ।

কথা আর নীল দুজন দুজনকে খাবার খাইয়ে দিলো। কথা আস্তে করে কিচেনে গিয়ে প্লেট রেখে পানির বোতল ভরে নিলো। নীল কে কথা তার ঘরে বসিয়ে রেখে দরজা ভালোমতো চাপিয়ে দিয়ে এসেছে যাতে কেউ নীল কে না দেখতে পায়। কিশোর সাহেব আর কাব্য যার্নি করে আসায় ক্লান্তিতে রোজকার থেকে আগে ঘুমিয়ে পরেছে। পুরো বাড়িতে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। তবুও কথা পা টিপে টিপে কিচেন থেকে বেরিয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছে।

হঠাতই কথা কিছু একটার সাথে ধাক্কা লেগে নিচে পরে যেতে নেয়। যদিও নিচে পরার আগেই কেউ একজন কথার কোমড় আঁকড়ে ধরে। অন্ধকার থাকায় কথা লোকটার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পায় না তবে বুঝতে পারে যে লোকটা আদনান। কারণ একমাত্র আদনানই এই বাড়িতে পরপুরুষ। কথা নিজেকে সামলে উঠতে নিলে আদনান কথার কোমড় আরও শক্ত করে ধরে।



আদনান ভাইয়ার এভাবে ধরাতে আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। এতো শক্ত করে ধরে রেখেছে যে রীতিমত আমার শরীর কাঁপছে ভয়ে। তানিয়া আপুর হলুদের রাতে নীরব ভাইয়াও এতো শক্ত করে ধরে নি। আর এই লোকটা এমন কাজ করছে। বাইরে ভীষণ ঠান্ডা। তবুও আমার কপাল বেয়ে চিকন ঘাম ঝরে পরছে। নিজেকে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করার জন্য নীরবতা ভেঙে আমিই বলা শুরু করলাম।

— ছাড়েন আমাকে। করছেন টা কি? আমি এখন ঠিক আছি। নিজেকে সামলাতে পারবো।

— জানি পুচকু তুমি নিজেকে সামলাতে পারবে। অবশ্য না পারলেও শিখতে কতোদিন।

— জি?

— শীঘ্রই তোমাকে এসবকিছু শিখে নিতে হবে।

— আমাকে যেতে দিন প্লিজ।

কথা নিজেকে আদনানের কাছে থেকে ছাড়িয়ে ঘরের দিকে ছুঁট লাগালো।

“আজকে পালিয়ে যাও পুচকু, একদিন না একনদিন তো আমার কাছেই আসতে হবে তোমাকে।” — একটা শয়তানি হাসি দিয়ে আদনান কথাটা বলে কাব্য এর ঘরে চলে গেলো।

“ছেলেটা কে আর তোকে ওভাবে জরিয়ে ধরার সাহস কোথায় পেলো?”
কথা তার ঘরে ঢুকতেই নীল তীরের মতো প্রশ্নটা কথার দিকে ছুঁড়লো। নীল এর এভাবে চোখ মুখ গরম করে প্রশ্ন করায় কথা থতমত খেয়ে যায়।

— কি হলো চুপ করে আছিস কেনো? কে সেই ছেলেটা। তোকে স্পর্শ করার সাহস কি করে হলো ওর!

— আআরেহ রাগ দেখাচ্ছো কেনো? উনি আমার ফুফাতো ভাই হয়। আব্বু আর কাব্য ভাইয়া আতিকা ফুপি আম্মুর বাসায় গিয়েছিল। তাই হয়তো আদনান ভাইয়াকে সাথে নিয়ে এসেছে।

কথাগুলো বলতে বলতে কথা একটু এগিয়ে সামনের দিকে যাচ্ছিল। পিছন থেকে নীল কথার চুলের মুঠি টেনে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। নীল এর ঠিক মুখ বরাবর কথার মুখ এনে চোখ মুখ গরম করে ফিসফিস করে নীল বললো,

— তুই শুধু আমার। তোকে অন্য কেউ স্পর্শও করুক সেটা আমি সহ্য করতে পারবো না!

নীল এর রক্তিম মুখোবয়ব দেখে আমার আত্মার পানি শুকিয়ে গেছে। নীল কে আমি রাগতে দেখেছি কিন্তু এই রূপ এর আগে কখনও দেখি নি। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
— উনি আমার ভাই হয় সম্পর্কে। উল্টা পাল্টা ভাবো কেনো?

— জানি না। শুধু জানি তুই আমার। তোর ছায়াটাও অন্যকারো হতে দেবো না আমি।

— এতো ভালোবাসলে কিভাবে আমাকে?

— জানি না। শুধু জানি ভালোবাসি।

— একটা চুমু দাও তো!
ঠোঁট নীল এর দিকে এগিয়ে দিয়ে কথাটা বললো কথা। কথা তার চোখ বন্ধ করে ঠোঁট এগিয়ে নীল এর কাঁধে দুইহাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে।

নীল কথার ঠোঁটের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কথার গোলাপী ঠোঁট দুটো নীল এর চোখে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। নীল ধীরে ধীরে তার ঠোঁট জোড়া এগিয়ে আনছে। কথা আগের ভঙ্গিতেই দাড়িয়ে আছে। ক্রমশ নীল আর কথার নিশ্বাস গরম হয়ে আসছে। এই মুহূর্তে কথার মধ্যে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে নীলের। নীল আর কথার মধ্যে হয়তো দুই ইঞ্চি জায়গাও ফাঁকা নেই।

নীল কথার ঠোঁটে ঠোঁট মিশাতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে দূরে সরে গেলো। কথা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নীল সড়ে গেলো কেনো? কথা প্রস্তুত ছিল নীল কে কিস করার জন্য।

— ঘুমা। আমি যাচ্ছি।

— কি বললে! চলে যাচ্ছো? কিস করবে না?

— না। ঘুমা তুই।

— কেনো কিস করবে না? সকালে তো জোর করে করলে এখন আমি চাইছি আর এখন তুমি কিস করবে না!

— সকালে আমার ইচ্ছা হয়েছিল তাই করেছি। এখন ইচ্ছা নেই।

— কেনো ইচ্ছা নেই। আমি কি দেখতে অসুন্দর?

— কথা এতো কথা বলিস না। ঘুমিয়ে পর। খুব ভোরে উঠে পড়তে বসবি। ভুলে যাস না সামনে মাসে তোর পরীক্ষা।

— হুম। যাও। সাবধানে যাবে। অনেক রাত হয়েছে। নিজের খেয়াল রেখো।

— তুইও নিজের খেয়াল রাখিস।

— ওগো শুনছো!

— কি বললি?

— বিয়ের পর তোমাকে এভাবেই ডাকবো। ” ওগো শুনছো “!

— পাগলি।

— কালকে বাইকে করে ঘুরাবে আমাকে?

— প্রমিজ। কালকের দিন শুধু তোর আর আমার।

নীল কথার কপালে একটা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে চলে গেলো। কথা লজ্জায় বালিশে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পরলো।

?

?

কানে হালকা সুরসুরি লাগাতে ঘুম ভেঙে গেলো নীল এর। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই নীল এর চোখ কপালে উঠে গেলো। স্কাই ব্লু রঙের শিফনের শাড়ি পরিহিতা একটা মেয়ে নীল এর বিছানার সামনে দাড়িয়ে আছে। হাতে এক কাপ ধোয়া উঠা চা নিয়ে। রাতে ঘুমানোর সময় টি শার্ট খুলে শুধু ট্রাওজার পরে ঘুমিয়ে ছিল নীল। এভাবে একটা মেয়ের সামনে থাকায় বেশ অস্বস্তিতে পরে গেছে নীল। খাটের আশপাশ হাতিয়ে টিশার্ট টা গায়ে জরিয়ে নিলো নীল।

সামনে থাকা মেয়েটা আগের ভঙ্গিতেই দাড়িয়ে আছে মুখে লজ্জা মেশানো হাসি নিয়ে। মেয়েটিকে নিঃসন্দেহে অপ্সরী বলা চলে। আকাশী রঙে আরও বেশি স্নিগ্ধ মনে হচ্ছে। নীল এর ঘরের ব্যালকোনির কাঁচ খুলা থাকায় দমকা বাতাসে মেয়েটির চুল গুলো উড়ে চলছে।

— মুনতাহা তুমি কবে এসেছো?

— আমি তো কালকেই এসেছি নীল। কিন্তু তুমি অনেক রাতে ফিরেছো। তাই তোমার সাথে দেখা হয় নি।

— হ্যাঁ কালকে একটু দেরি হয়েছিল।

— তা কি খবর? কাজিনদের যে কেউ এভাবে ভুলে যেতে পারে সেটা তোমাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না!

— আসলে ফাইনাল পরীক্ষা সামনে আবার কোচিং নিয়ে ব্যস্ততা। তাই আর কি।

— হুম। তুমি তো আর বলবে না, আমিই জিজ্ঞেস করছি কেমন দেখাচ্ছে আমাকে?

— সুন্দর!

— শুধুই সুন্দর?

— মুনতাহা তোমাকে আমি শেষ যখন দেখেছিলাম তখন তুমি আরো ছোট ছিলে। এখন বড় হয়েছো। সেই সাথে আরো সুন্দর হয়েছো। আর হ্যাঁ শাড়িটাতে তোমাকে ভালো লাগছে।

— চা টা আরও ভালো হয়েছে। খেয়ে দেখতে পারো। এই কয়েক বছরে রান্নার হাতটাও পাঁকা হয়ে গেছে।

— হ্যাঁ তুমি বানিয়েছো খেয়ে তো অবশ্যই দেখবো। কিন্তু আগে ফ্রেশ হবো। তুমি নিচে যাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

মুনতাহা কিছু না বলে একটা মুচকি হাসি দিয়ে নীল এর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। নীল কিছুক্ষণ তব্দা মেরে বসে থেকে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

চলবে..

শ্রাবণের মেঘ পর্ব_১০

0

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১০
#Tabassum_Kotha

“এই যে মিস উঠে পড়ো। মাঝ রাস্তায় আর কতোক্ষণ বসে থাকবা? তোমার একার জন্য সব গাড়ি ব্লক হয়ে আছে।” — গাড়ি থেকে অত্যন্ত সুদর্শন একজন পুরুষ বেরিয়ে এসে উপুর হয়ে বসে কথার দিকে হাত বারিয়ে দেয়।

লোকটার কথায় কথার ধ্যান ভাঙে। মাথা উঁচু করে তাকাতেই দেখে লোকটা এখনও কথার দিকে হাত বারিয়ে বসে আছে আগের ভঙ্গিতে। লোকটার হাত সরিয়ে কথা নিজেই উঠে দাড়ায়।

— মিস ক্যান ইউ হেল্প মি?

— জি বলুন।

— কিশোর রহমানের বাড়ি কোথায়?

— কিশোর রহমান আপনার কি লাগে?

— আমার মামা হয় তিনি। আসলে আমি এব্রোড ছিলাম ছোট থেকে তাই কিছুই চিনি না।

লোকটা তাহলে আতিকা ফুপি আম্মুর ছেলে!

— আপনার নাম কি আদনান?

— হাউ ডু ইউ নো? ডো ইউ নো মি?

— না। তবে আপনার আম্মুকে চিনি। সামনের বাড়িটাই কিশোর রহমানের বাড়ি।

— হেই মিস হু আর ইউ?

— কেউ না।

— মিস কেউ না!

কথা তাদের বাড়ির পিছনের রাস্তা ধরে বাড়িতে চলে যায় আর আদনান গাড়ি নিয়ে কিশোর রহমানের বাড়ি যায়।



দরজায় কলিং বেল দিতেই কলি বেগম দরজা খুলে দেয়। কলি বেগম আর আদনানের এর আগেও ভিডিও কলে অনেকবার কথা হয়েছে, তাই কলি বেগমের আদনানকে চিনতে সময় লাগে নি। দুজনের কুশলাদি বিনিময় শেষে কলি বেগম আদনান কে কাব্যর ঘরে থাকতে দিয়ে রান্নার জন্য চলে যায়।

?

শাওয়ারের নিচে বসে কান্না করছে কথা। তানিয়ার বলা কথাগুলো কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে। তানিয়ার বলা একটা কথা যেনো তার পুরো দুনিয়া উলোট পালট করে দিচ্ছে।

” সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। কিছু কিছু অসম্পূর্ণ ভালোবাসার কাহিনী সময়ের পাতায় চাপা পরে যায়।”

নীল এর প্রতি তার ভালোবাসাকে সে কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবে না। কিছু কিছু ভালোবাসা সময়ের গর্ভে বিলীন হলেও নীল কথার ভালোবাসা পৃর্ণতা পাবে। নীল তার ভুল বুঝতে পেরেছে। এখন আর কথা নীল কে নিজের থেকে দূর করবে না।

বুকের বা পাশে ভীষণ যন্ত্রণা করছে তার। নীল কে কি ক্ষমা করা যায় না? সব কিছু ভুলে নীলের ভালোবাসায় ধরা দেওয়া যায় না!! কথার ভিতরে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মন বলছে নীল এর কাছে ছুটে যেতে আর মস্তিষ্ক বলছে নীল কে দূরে ঠেলে দিতে। মন আর মস্তিষ্কের লড়াইতে খুব বাজে ভাবে পিষে যাচ্ছে কথা!!

শাওয়ার শেষ করে কাব্য এর ঘরের দিকে হাটা ধরলো কথা। তানিয়া আর কাব্য এর প্রেমের কথা জানার পর থেকে তার ভিতরে কষ্টের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কাব্য এর সাথে একটু কথা বলতে পারলেও তার ভালো লাগবে।

কাব্য এর ঘরের দরজা আগে থেকেই একটু ফাঁকা করা ছিল। যার জন্য কথা নক না করেই ভিতরে ঢুকে পরলো। ব্যালকোনিতে দাড়িয়ে কাব্য বাইরের দিকে মুখ করে সিগারেটে ফুঁ দিচ্ছিল। কাব্য কে কথা কখনও স্মোক করতে দেখে নি। তার সেই ভাই আজকে কতোটা কষ্ট নিয়ে স্মোক করছে সেটা কথার আন্দাজের বাইরে। এরই মধ্যে কথার দুচোখ ভরে এসেছে।

কান্নারত অবস্থায় কথা দৌড়ে গিয়ে কাব্য কে পিছন থেকে জরিয়ে ধরলো। কথার এভাবে হঠাত করে জরিয়ে ধরায় সামনে থাকা ব্যক্তিটির হাত থেকে সিগারেট টা নিচে পরে গেলো। যদিও লোকটা ভীষণ রকম ঝটকা খেয়েছে কিন্তু তবুও স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে। আর এদিকে কথা আগের ভঙ্গিতেই দাড়িয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে।

— তুই আমার সাথে শেয়ার করতে পারতি এটলিষ্ট। আমি কি এতোটাই পর হয়ে গেছি? জানি কিছু করতে পারতাম না কিন্তু তোর কষ্টের ভাগ তো নিতে পারতাম।

— আপনি কে আর এভাবে জরিয়ে ধরেছেন কেনো?

লোকটার কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম, এটা তো কাব্য ভাইয়া নয়। ঝট করে লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে এক হাত দূরে গিয়ে দাড়ালাম। লোকটা পিছন দিকে ঘুরতেই আরও বেশি অবাক হলাম। লোকটা আদনান ভাইয়া। কিন্তু সে কাব্য ভাইয়ার ঘরে কি করছে! আর ভাইয়াই বা কোথায়?

— তুমি সেই মেয়েটা না যে আমার গাড়ির নিচে পরতে পরতে বেঁচেছো?

— হ্যাঁ। কিন্তু আপনি ভাইয়ার ঘরে কেনো?

— ভাইয়া! তুমি কাব্য এর ছোট বোন কথা?

— জি। আর সরি আমি ভেবেছিলাম ভাইয়া দাড়িয়ে আছে।

— ইটস্ ওকে কথা মনি।

— আমি বাচ্চা নই। সো ডোন্ট কল মি মনি।

— কুল কুল। তোমাকে এমনিতেও পুচকিই মনে হয় তাই বললাম আর কি।

— আমি পুচকি নই।

— তোমার দুই বেণী আর সামনের এলো চুলগুলো কিন্তু তোমাকে পুচকিই বলে।

— আপনি একটা পঁচা লোক।

— এই যে প্রমাণ করে দিলে তুমি পুচকি।

— উফফ আপনার সাথে কোনো কথাই বলবো না আমি।

কাব্য ভাইয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আদনান ভাইয়ার আদৌ কোনো দোষ ছিল না, শুধু শুধুই তাকে এতোগুলো কথা শুনিয়ে দিলাম। এই নীল এর বাচ্চা আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বেন, নাকি অলরেডি বানিয়ে দিয়েছে কে জানে!
!
!
!
ড্রয়িং রুমে যেতেই আব্বু আর কাব্য ভাইয়াকে একসাথে বসে থাকতে দেখলাম। দেখে মনে হচ্ছে দুজনে খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে আলোচনা করছেন। কাব্য ভাইয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। এতোটা নিখুঁত অভিনয় করতে পারে আমার ভাইয়া সেটা তো আমার জানাই ছিল না। ভাইয়া কে দেখে মনে হচ্ছে দুনিয়ার সব চেয়ে সুখী মানুষ তিনি। হয়তো তানিয়া আপুর মতো কাব্য ভাইয়াও বাস্তবতা টা মেনে নিয়েছে। তানিয়া আপুর কথাগুলো জানা হলো কিন্তু ভাইয়ার মনের কথাগুলো আমাকে জানতে হবে!আব্বুর সামনে কথা বলার সাহস আমার নেই, তাই ঘরে চলে এলাম।

রাতের নিস্তব্ধ আকাশ, চারিদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। শ্রাবণ মাস চলছে, আকাশে ঘনঘন মেঘের আলোড়ন সাথে হালকা বিদ্যুতের ঝলকানি। সব মিলিয়ে রহস্যময়ী এক পরিবেশের জানান দিচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে এক ছায়ামূর্তি ঠিক আমার ব্যালকোনির সামনে দাড়িয়ে আছে। আজকে আমি চোখে চশমা পরে আছি। তাই মূর্তির ঠোঁটে লেগে থাকা মুচকি হাসিটাও খুব ভালো মতোই দেখতে পাচ্ছি। ভাবতেই অবাক লাগছে, সকালে এতো অপমান করার পরেও নীল এতো স্নিগ্ধতাপূর্ণ হাসি ঠোঁটে এঁকে আমার দুয়ারে দাড়িয়ে আছে। কেনো যেনো নীল এর উপর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার ভালোবাসায় ধরা দিয়ে তার বুকের সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।

আমার ভাবনার সুঁতো কাটে আম্মুর ডাকে। রাতের খাবারের জন্য আম্মু ডেকে চলছে। কিন্তু আমি কিভাবে খাবো! নীল নিজেও না খেয়ে আছে। এখন আবার আমার রাগ হচ্ছে, এতো কিছু করেও লোকটা শান্তি পায় নি। না খেয়ে রাত নয়টার পরে আমার বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে। এই লোকটাকে সত্যি আমি একদিন খুন করে ফেলবো।

আম্মুর কাছে থেকে বাহানা দিয়ে খাবার নিজের ঘরে নিয়ে এলাম। আমার সামনে নীল খাবার না খেয়ে মশার কামড় খেয়ে দাড়িয়ে থাকবে সেটা তো আমি মানতে পারবো না! খাবার প্লেট টা সেন্টার টেবিলে রেখে ঘরের দরজা ভিতর থেকে আটকে ব্যালকোনি টপকে নিচে নেমে পরলাম। এর আগেও অনেকবার ব্যালকোনি টপকে বাড়ি থেকে পালিয়েছি। সেই অভ্যাস টা আজকে কাজে এসেছে। নিজেকে সামলে উঠে দাড়িয়ে নীল এর কাছে চলে গেলাম।

— এতো রাতে নিচে নেমে এলি যে! ভুতের ভয় নেই বুঝি?

— আমি ভুত টুত ভয় পাই না। আর আপনিও তো এতো রাতে আমার বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছেন।

— কাব্যর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।

— মিথ্যাও এমন বলা উচিত যেটা মিথ্যার মতো মনে হয়! খুব ভালো করেই জানি কেনো এখানে দাড়িয়ে আছেন।

— জানিস যখন তাহলে আবার জানতে চাইছিস কেনো?

— পাগল যে আমি! বেহায়া, নির্লজ্জ, ছ্যাঁচড়া আরও না জানি কতো কি। তাই তো নিজেকে আপনার থেকে দূর করতে পারি না।

— এইবার তো আর দূরে যেতে বলি নি। তাহলে কেনো দূরে যাওয়ার কথা বলছিস!

— কাছে আসার কথাও তো বলেন নি!

— খেয়েছিস রাতে?

— আমার সামনে এভাবে একজন না খেয়ে দাড়িয়ে থাকলে আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে কিভাবে?

— যা খেয়ে নে। তারপর ঘুমিয়ে পড়।

— সবসময় তো অর্ডার দেন। আর আমি মেনেও নেই। আজ যদি কিছু আবদার করি রাখবেন সেটা?

— আজ যদি তুই এই জীবন টাও চেয়ে নিস সেটাও দিয়ে দেবো!

— তোমার জীবনে একটু জায়গা কি দেওয়া যায় না আমাকে? একটুও কি ভালোবাসা যায় না আমাকে? আমি যে ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে নীল! আমাকে কি তুমি ভালোবাসতে পারো না!

— এই প্রশ্নের উত্তর কি আমার স্পর্শ তোকে দেয় নি? আমি তো ভেবেছিলাম আমার প্রতিটি স্পর্শ তোকে জানিয়ে দেবে আমিও তোকে ভালোবাসি।

— কেনো এতো রহস্যময় তুমি? তোমার প্রতিটি কথা কেনো রহস্যের জাল মনে হয় আমার?

— সরাসরিই তো বললাম, ভালোবাসি তোকে। তবুও বুঝতে পারলি না। আর এতোদিন ভালোবাসি ভালোবাসি করে আমার মাথা খেয়ে নিয়েছিস। আজকে যখন আমি বলছি আমি তোকে ভালোবাসি তখন তুই বুঝতে পারছিস না!

— তুমি মজা করছো তাই না?

— যাহ বাবা ভালো না বাসলেও দোষ আবার বাসলেও দোষ।

— সত্যি বলছো?

— আমি নীরবের মতো গোলাপের গুচ্ছ নিয়ে মাঝ রাস্তায় প্রপোজ করতে পারি নি। আর পারবোও না। কিন্তু কালকে আমার পছন্দের কদমের গুচ্ছ আর নীল শাড়ি এনেছিলাম। কিন্তু সেটা তো তুই ফেলে দিয়েছিস।

— তুমি সত্যি আমাকে ভালোবাসো?

— এখনও সন্দেহ আছে?

— একবার বলো ভালোবাসি!

— একবার কেনো? বারবার বলবো হাজার বার বলবো ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি,,,, তোকে অনেক ভালোবাসি কথা।

নীল এর মুখ থেকে ভালোবাসি কথা শুনে কথা নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেললো। কথার কান্না দেখে নীল অট্টহাসি তে ফেঁটে পরে কথা কে বুকে জরিয়ে ধরলো।

— ওয়াদা করো সারাজীবন তোমার বুকে ঠিক এই ভাবে আগলে রাখবে আমাকে! কখনও নিজের থেকে দূরে যেতে দেবে না।

— ওয়াদা করছি। শেষ নিশ্বাস অব্দি এভাবেই বুকে জরিয়ে ধরে রাখবো তোকে। কখনও চোখের আড়াল হতে দেবো না।

— নীল!

— উম।

— এটা স্বপ্ন নয়তো? চোখ খুললেই স্বপ্নটা ভেঙে যাবে নাতো? আমরা আবার দূরে হয়ে যাবো নাতো!

— এমন কেনো মনে হলো?

— ভয় করছে ভীষণ। তোমাকে হারিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে তো?

— কেনো পূর্ণতা পাবে না আমাদের ভালোবাসা একটু শুনি?

— জানি নি। দেখেছি অনেকের ভালোবাসা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

— আমাদের ভালোবাসা সম্পূর্ণ হবে। আমরা করবো। আর তোকে তো আমি আমার বউ বানিয়েই দম নেবো।

— হ্যাঁ তোমার বউ আমিই হবো। “নীলের বউ” নিতু পেত্নির ভাবি হবো আমি। হিহিহি।

আরও একবার শক্ত করে জরিয়ে ধরলো নীল কথা কে।

চলবে..