শ্রাবণের মেঘ পর্ব_১২

0
1288

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১২
#Tabassum_Kotha

??

চৌরাস্তার মোড়ে স্কুল ব্যাগ কাঁধে দাড়িয়ে আছে কথা। রোজকার মতোই দুই বেনী আর ছোট চুলগুলো চোখের সামনে এসে পরছে বারবার। প্রায় ছয় মিনিট হয়ে গেছে সে দাড়িয়ে আছে নীল এর জন্য। নীল এর সাথে আজকের দিন ঘুরবে সে সেজন্যই সকাল সকাল বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে মিথ্যা কথা বলে।

নতুন নতুন প্রেমে পড়ে মিথ্যা কথা বলার মজাটাই আলাদা। এই মিথ্যা বলা বাকি সবার কাছে খারাপ হলেও যারা প্রেমে পড়ে তাদের কাছে অনুভূতি টা পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি জিনিস কেউ হার মানাবে।

ভীষণ লজ্জা, বুকে ধুকপুকানি, অপেক্ষার স্বাদ, রাগ সবকিছুই কাজ করছে কথার মনে। এত্তো এত্তো অনুভূতি কাজ করছে যে সব তালগোল পাকিয়ে জগা খিচুড়ী হয়ে গেছে। অপেক্ষার প্রহর কাটছেই না, আর এদিকে নীল এর দেখাও মিলছে না। তবুও কথা হতাশ হয় নি। আর হবেও না। নীল এর এই ভালোবাসার জন্য সে দুই বছর অপেক্ষা করেছে। এই নীল এর জন্য আরও দুই জনম অপেক্ষা করতে পারবে। কিন্তু নীল কে এতো ঢিল দেওয়া যাবে না। তুলি বলেছিল স্বামী আর বয়ফ্রেন্ডদের আঁচলে বেঁধে রাখতে হয়। “নীল কথার বয়ফ্রেন্ড” ভাবতেই কেমন সুরসুড়ি দিয়ে উঠছে কথার গা।

?

খান বাড়ির ড্রয়িং রুমে পুরো পরিবার একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডা দিচ্ছে বললে ভুল হবে, নয়নতারা বেগম তার বোনের মেয়ে মুনতাহার গুণ কীর্তণ করছেন নজরুল সাহেব আর তাহেরা বেগমের সামনে। নিজের ছেলের বউ হিসেবে ছোট বোনের মেয়েকে খান বাড়িতে আনবেন সেই পরিকল্পনা তো সে অনেক আগেই করে রেখেছেন। এখন শুধু পরিকল্পনা টা বাস্তবায়িত করতে হবে।

নয়নতারা বেগম একেরপর এক মুনতাহার গুণের পুটলি খুলে যাচ্ছেন আর মুনতাহা লজ্জায় মাথা নুইয়ে বসে আছে। তানিয়া আর রাজীব তাদের বাসায় চলে গেছে। নিতু বই হাতে নিয়ে বসে আছে ঠিকই কিন্তু দৃষ্টি তার সন্দেহ প্রবণ। মুনতাহার হঠাত এতো তারিফ নিতু কিছুতেই হজম করতে পারছে না। তার মা নয়ন বেগম যে কোনো একটা ফন্দি আঁটছে মনে মনে সেটা খুব ভালোই টের পাচ্ছে নিতু।

“নীরব তোর বাইকের চাবি টা দে তো আমাকে। আর আজ তুই আমার জিপ নিয়ে নিস।” — সবার আড্ডায় বিঘ্ন ঘটিয়ে নীল কথা টা বললো।

নীরব উঠে গিয়ে বাইকে চাবিটা নীল এর হাতে ধরিয়ে দিলো।

— নীল! মুনতাহা এতোদিন পরে এসেছে ওকে একটু ঘুরতে নিয়ে যাবি না? (নয়নতারা বেগম)

— এই সাত সকালে ঘুরার কি আছে মা? তবুও যদি মুনতাহার এতোই ইচ্ছা থাকে নিতু আছে নীরব আছে ওদের বললেই তো পারো।

— এ কি ধরনের অভদ্রতা নীল? মা এর সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? (তাহেরা বেগম)

— সরি বড় মা। আসলে আমি খুব দরকারি কাজে যাচ্ছি। আর মা এখন এসব বললো! সরি। আমি আসছি।

নীল আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নীরবের বাইক নিয়ে খান বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।

?

প্রায় আধা ঘন্টার মতো দাড়িয়ে আছে কথা, রাগে সাপের মতো ফুসছে সে। প্রথম প্রেমের প্রথম ডেট এ যাবে তাও কি না প্রেমিক লেট! এসব মেনে নেওয়া যায় না। এখন থেকেই নীল অবহেলা শুরু করে দিয়েছে আর তো দিন পরেই রয়েছে। না এর একটা বিহিত আজকে সে করেই ছাড়বে।

আরও তিন চার মিনিট পর একটা বাইক দ্রুত বেগে এসে কথার সামনে সজোরে ব্রেক কষলো। বাইকটা দাড় করিয়ে বাইকে বসা অবস্থাতেই স্টাইল মেরে হেলমেট টা খুললো নীল। কথা ভ্রুঁ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে নীল এর দিকে।

— উঠে বস। কেউ দেখে ফেলবে।

— ওরেহ আমার যমরাজ রে এলি তো এলি দেরি করে আবার এখন লোক দেখার ভয় পাচ্ছিস!

— এই তুই কি পাগল হয়েছিস? কি সব আবোল তাবোল বকছিস?

— আমি আবোল তাবোল বকছি! আমি! ঠিক আছে যাবোই না তোমার সাথে। যাও চলে যাও।

— আচ্ছা সরি আর দেরি করবো না। এখন তো আয়!

কথা একটা ভেঙচি কেটে বাইকে উঠে পরলো। যদিও সে ভেবেছিল অনেকক্ষণ রাগ দেখাবে নীল কে। কিন্তু নীল এর সামনে তার সব রাগ পানি হয়ে যায়।

— শক্ত করে ধরে বস। পরে গেলে কোমড় ভেঙে যাবে।

— আমার কোমড় ভাঙতে পারে এমন কোনো বাইক আজ পর্যন্ত তৈরি হয় নি। তুমি চালাও।

— দেখ কথা জেদ করিস না। বলছি ধরে বস। পরে গেলে ব্যথা পাবি।

— আমিও তো বলেছি পরবো না। চলো তুমি।

হাল ছেড়ে দিয়ে নীল বাইক স্টার্ট দিলো। শক্ত করে না বসায় বাইক স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে যেতেই কথা নিচে পর গেলো। আচমকা পরে যাওয়াতে কথা কোমড়ে বেশ ব্যথা পেলো।

— আম্মু গো আমি পরে গেলাম, মরে গেলাম গো!!

নীল বাইক সামনে ব্রেক করিয়ে কথার কাছে এসে কথাকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো।
— বলেছিলাম ধরে বস, কিন্তু না ম্যাডাম সবসময় দুই লাইন বেশি বুঝে। নে এখন ব্যথাটা কে পেলো।

— তুমি আমাকে বকছো! আমাকে একটুও ভালোবাসো না তাই না!

— ভালোবাসি বলেই বকছি।

— হুহ!

— এতো ন্যাকামো কিভাবে শিখলি বলতো!

— আমি ন্যাকামো করি!

— আর নয় তো কি?

— তুমি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসো?

— এই প্রশ্ন কেনো?

— জানি না।

নীল কথা কে বাইকে বসিয়ে আবার বাইক চালাতে শুরু করলো। এবার কথা নীল কে শক্ত করে জরিয়ে আছে। প্রথম প্রথম নীল কে ধরতে সংকোচ বোধ করলেও এখন সেই সংকোচ টা অনেকাংশে কমে গেছে।

?
?

সকালের স্নিগ্ধ সময়, রাতে বৃষ্টি হওয়াতে ভেজা রাস্তার অনেক জায়গায় পানি জমে আছে। রাস্তার দুই ধারে সোজা হয়ে সাড়িবদ্ধভাবে দাড়িয়ে থাকা গাছ গুলো রাস্তার সৌন্দর্য যেনো আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কথা চোখ বন্ধ করে নীল এর পিঠের সাথে লেপ্টে আছে। নীল লুকিং গ্লাস টা বাঁকা করে বারবার কথার মায়াভরা মুখটা দেখে যাচ্ছে। কথাকে দেখে অজান্তেই নীল এর মুখে এক প্রশান্তির হাসি চলে আসে। নীল আর কথা দিন দুনিয়া ভুলে ছুটে চলছে অজানার পানে!!




” মামা আমি কথা কে বিয়ে করতে চাই! যদি আপনার অনুমতি থাকে!”– কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই কিশোর রহমানকে কথা টা বলে দিলো আদনান।

কিচেনে দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় আদনানের কথা শুনে চমকে উঠে হাতে থাকা কাঁচের গ্লাসটা ফেলে দিলো কথা। ড্রয়িং রুমে বসে থাকা কিশোর সাহেব, কলি বেগম আর আদনানের কানে কাঁচ ভাঙার শব্দ এলেও সেই শব্দের তোয়াক্কা না করে কিশোর সাহেব বলা শুরু করলেন।

— ছেলে হিসেবে তোমার তুলনা হয় না আদনান। মেয়ে জামাই হিসেবে তোমাকে পাওয়া তো আমাদের ভাগ্য হবে। আমি আজই আতিকা বুবুর সাথে তোমার আর কথার বিয়ের আলাপ করছি।

আব্বু আদনান ভাইয়া আর আমার বিয়ের কথা চিন্তা করছেন! না না সে কি করে সম্ভব? আমি তো নীল কে ভালোবাসি। নীলকে ছাড়া অন্যকাউকে স্বামী হিসেবে ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাকে আব্বুর সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু আব্বুর সামনে দাড়িয়ে নীলকে ভালোবাসার কথা বলার মতো সাহস আমার নেই। কি করবো এখন আমি। ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। টেনশনে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছি। নীল এর সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু কিভাবে?

— কাব্য এর আব্বু! একটু ঘরে আসো তো। কাজ আছে! (কলি বেগম)

কিশোর সাহেব কলি বেগমের সাথে ঘরে গেলে কলি বেগম ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

— এসব কি বললে তুমি? আদনান বললো আর তুমি রাজি হয়ে গেলে! কথার কি বিয়ের বয়স হয়েছে?

— আমি যা করেছি ভেবে চিন্তেই করেছি। এতো বছর আমার সাথে সংসার করার পর তোমার এতোটুকু বোঝা উচিত কলি।

— সেটাই তো সমস্যা। এতো বছর সংসার করেও তোমাকে বুঝতে পারলাম না। কেনো দিতে চাইছো কথার বিয়ে এখন! আর আদনানই বা কেনো? আত্মীয়র মধ্যে আত্মীয়তা করার পক্ষে আমি না।

— আমি তোমাকে কোনো কটু কথা বলতে চাই না কলি। শুধু বলবো আমি যা করছি কথার ভালোর জন্য করছি।

— কিন্তু হঠাত করে কথার বিয়ে কেনো?

— আজকে কথা কে নজরুল খানের বড় ছেলে নীল এর সাথে বাইকে দেখেছি। নিজের মেয়ে বলে মাথা নিচু করে চুপচাপ চলে এসেছি। কথা যে এভাবে আমার মান সম্মাণ নিয়ে খেলবে সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল।

— হয়তো তোমার বুঝতে ভুল হচ্ছে কোথাও।

— যেই অবস্থায় ওদের দুজনকে একসাথে দেখেছি ভুল বুঝার প্রশ্নই আসে না। সে যাই হোক, আদনান কে আমার জামাই হিসেবে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। কথার পরীক্ষার আগেই আকদ্ করিয়ে রাখবো। আর এই ব্যাপারে দ্বিতীয় কোনো কথা আমি শুনতে চাই না।

দরজার আড়ালে দাড়িয়ে আব্বু আম্মুর কথা শুনছিলাম এতোক্ষণ। আজকে আব্বু আমাকে আর নীল কে একসাথে দেখে ফেলেছে। এখন আমার বিয়ে দিতে চায়! কথাটা নীল কে বলতেই হবে। কিন্তু এখন যদি আম্মুকে বলি নিতুদের বাসায় যাবো তাহলে আব্বু যেতে দেবেন না। ব্যালকোনি টপকে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।

যেই ভাবা সেই কাজ ব্যালকোনি টপকে প্লাজো টা উঁচু করে দৌড় লাগালাম খান বাড়ির উদ্দেশ্যে। যে করেই হোক নীল এর সাথে দেখা করতেই হবে।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে