Thursday, August 7, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 181



মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-০৪

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৪)

দ্বিতীয় দিনের টিউশনিতে এসেছে সায়রা। আহনাফ একদম ই চুপচাপ বসে। সে কলমের দিকে চেয়ে আছে। এ রকমের পরিস্থিতির সাথে সায়রা পরিচিত নয়। তবে ও চেষ্টা করছে। যতটা সম্ভব ছেলেটার সাথে ফ্রি হতে।

“আহনাফ এদিকে তাকাও তো।”

আহনাফ তাকাল না। সায়রা আরো দু বার ডেকেও সাড়া পেল না। ও ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে এগিয়ে দিল।

“এটা খাবে তুমি?”

অন্য বাচ্চাদের মতন উচ্ছ্বাস নেই আহনাফের মাঝে। হতাশ হতে হলো সায়রার। ও আহনাফের পাশে এসে বসল,”তুমি কি কিছু খেলতে চাও?”

খেলা শব্দটি বোধহয় আহনাফের ভালো লাগল। ও ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। মনোযোগ পেয়ে সায়রা বলল,”চলো আমরা খেলি।”

আহনাফের হাত ধরিয়ে ওঠিয়ে নিল সায়রা। তবে কি খেলবে ঠিক বুঝতে পারল না। আহনাফ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে।

“আহনাফ,বলো তো তোমার প্রিয় খেলা কি?”

কোনো জবাব দিল না ও। তবে পাশে থাকা বলের দিকে তাকাল। সেটাকেই প্রিয় বলে ধরে নিল সায়রা। বলটা উঠিয়ে নিয়ে বলল,”ক্যাচ ধরবে,কেমন?”

আহনাফ কোনো কথা বলল না। তবে মনে হলো তার ভালো লাগছে। সায়রা দুজনের মাঝে কয়েক হাত দূরত্ব সৃষ্টি করে বলটা হালকা হাতে ছুড়ে দিল। আহনাফ অবশ্য ধরতে পারল না। তবে বল কুড়িয়ে আনল। তারপর চেয়ে রইল। ওকে ভরসা দিতে সায়রা বলল,”বল টা আমার দিকে ছুড়ে দেও।”

আহনাফ কথা মতন বল ছুড়ে দিল। এভাবে ওদের খেলা চলল অনেক সময়। খেলার এক পর্যায়ে আহনাফ নিজ থেকেই বলল,”আন্টি বাইরে গিয়‍ে খেলব।”

নিজ থেকে কথা বলায় সায়রার ভালো লাগল। ও একটু বুদ্ধি করে বলল,”বাইরেই খেলব যদি তুমি পড়াটা ঠিক মতন পড়ো।”

প্রস্তাবটা আহনাফের মনে ধরল। ও পড়তে বসল। সায়রা যতক্ষণ পড়াল খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ল।

আহনাফ কে পড়িয়ে বের হতেই সাঈদের কল এল। সায়রার মনে হলো ওর শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। ও চট করেই রিসিভ করল। ভা ঙা গলায় বলল,”হ্যালো।”

“কেমন আছ?”

“ভালো। তুমি?”

ছোট্ট শব্দটি উচ্চারণ করতে গিয়ে সায়রার হৃদয় ভে ঙে আসছে। সাঈদ মিনমিনে কণ্ঠে জবাব দেয়।

“ভালো।”

তারপর নীরবতা। দুজনেই যেন অদ্ভুত ভাবে কথা হারিয়ে ফেলেছে। সায়রার শরীর থরথর করে কাঁপছে।

“এখন কোথায় আছ?”

“টিউশনি করাতে এসেছি।”

“অহ,দেখা করতে পারবে?”

“পারব।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। এসো তবে।”

“হুম।”

কথাটি শেষ করেই সায়রার হৃদয় মন অশান্ত হয়ে পড়ল। ও দ্রুত নেমে এসে একটা রিকশা নিল।

“মামা একটু দ্রুত যাবেন প্লিজ।”

আজ ওরা ক্যাফেতে বসে নি। ওরা চলছে ফুটপাত দিয়ে। দুজনের মাঝের দূরত্ব কয়েক ইঞ্চি মাত্র। তবে মনের দূরত্ব? সেটা জানা নেই। সায়রা খোলা আকাশের দিকে চেয়ে পথ চলছিল। হুট করেই ওর পা হড়কে যায়। তবে সাঈদ ধরে ফেলল বিধায় ব্যথাটা পায় নি।

“সাবধানে চলো।”

সায়রা উত্তর দিল না। ওরা পুনরায় পথ চলতে লাগল। সময়টা আসলে মন্দ নয়।

“তোমার ডিসিশন কী এখনো বদলায় নি?”

সায়রা না তাকিয়েই বলল,”কোন ডিসিশন?”

“বিয়ের বিষয়ে।”

“আমার তো সমস্যা নেই সাঈদ। আমিও বিয়ে করতে চাই। আরো এক বছর আগেই বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু তোমার মা ই তো মানছিলেন না।”

কথাটি বলেই দীঘল একটি শ্বাস ফেলল সায়রা। সাঈদ চুপ। সায়রা পুনরায় বলল,”একটা সত্যি কথা বলবে,আসলেই কি তিনি চান আমি তোমার বউ হই?”

সাঈদ যেন ভাষাহীন কোনো প্রাণী। ওর মৌনতা দেখেই সায়রার হৃদয় ভে ঙে আসছে।

“চান।”

এত সময় পর সাঈদ জবাব দিয়েছে। কথাটির সত্যতা নিয়ে পুরোপুরি সংকোচ অনুভব করে সায়রা। হাসে, নীরবে।

“আমি জানি কথাটি স্বার্থপরের মতন শোনায়,তবে স্বাভাবিক ভাবেই কোনো বাবা মা চাইবে না তার ছেলের বউয়ের সাথে…..

কথাটি পুরো করতে পারল না সাঈদ। ওর অস্বস্তি হচ্ছে। নিচু মনে হচ্ছে। আমিরার মতন এতিম একটি বাচ্চাকে নিয়ে এ রকমের মন্তব্য সে সত্যিই করতে পারছে না। সায়রা এক বুক কষ্ট নিয়ে বলল,”আমার আপু নিজের জীবনের বিশাল সময় আমার জন্য সেক্রিফাইজ করেছে। আমাদের সংসারের জন্য সেক্রিফাইজ করেছে। তার মেয়েটা আজ এতিম হয়ে গেছে। আর আমি কী না ফেলে যাব? সাঈদ, তুমি তো জানোই ভাবি কেমন। তুমি একবার আমিরার জায়গাটা ভেবে দেখো। আমি এতটা স্বার্থপর হতে পারব না।”

সাঈদ জবাব দিতে পারল না। চুপ ই রইল। ওর কিছু বলার নেই আসলে। পরিস্থিতি ওকে মৌন করে তুলেছে।

রাস্তার ধারে ফুল বিক্রি হচ্ছিল। সাঈদ একটা গোলাপ কিনে বাড়িয়ে দিল। সায়রা সেটা তুলে নিয়ে মিথ্যে হাসিতে মুখশ্রী রাঙিয়ে বলল,”আমাদের সম্পর্কের শেষ ফুল?”

সাঈদ কথা বলতে পারল না। অন্যদিকে ফিরে রইল। সায়রা ও কিছু বলল না। কথায় আছে,পরিস্থিতি মানুষকে সব ভাবে রাঙাতে পারে।

শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে আমিরা। চোখের দৃষ্টি মৃ ত। সায়রা ওকে ডাকল।

“আমিরা, এই আমিরা।”

জবাব দিল না মেয়েটি। সায়রা ওর কাছে এসে দাঁড়াতেই আমিরা অন্যদিকে ফিরে রইল। কাহিনীর কিছুই বুঝল না ও। এদিকে শরীর ভীষণ ক্লান্ত। আমিরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। কি এক যন্ত্রণায় মেখে আছে সায়রার সমস্ত শরীর। তবে সেটাকে পাত্তা না দিয়ে ও বেরিয়ে এল। দেখল আমিরা পালাতে চাইছে। ভারী বিস্মিত হলো সায়রা।

“এই আমিরা।”

এবার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে গেল মেয়েটি। ওর পিছু পিছু ওঠল সায়রা ও। এসে দেখল কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাটির হিচকি ওঠে গেছে।

“কী হয়েছে তোর?”

জবাব দিল না বাচ্চাটি। আমিরার ক্রদনরত মুখশ্রী বুকের কাছে এসে হাহাকার মাখিয়ে দিল। ও শুকনো ঢোক গিলে শুধাল,”বল কী হয়েছে?”

“আমি খুব খারাপ তাই না মিমি?”

কথাটা বলার পরই সায়রা বুঝল জল অনেকদূর গড়িয়েছে। ও ভরসা দিয়ে বলল,”কে বলেছে?”

আমিরার বদলে জবাব দিল জুঁই। চোখ মুখ অন্ধকারে ডুবে আছে।

“মা বলেছে। ওকে খুব বকেছে আজ।”

“কেন? কী করেছে?”

“হরলিক্স বানাতে গিয়ে কাপ ভে ঙে ফেলেছে।”

“বুয়া কোথায় ছিল? ও কেন হরলিক্স বানাতে গিয়েছে।”

কথাটি শেষ করার মাঝেই আমিরার ফোস্কা পড়া হাত নজরে এল। সায়রা খপ করে ওর হাতটি ধরে বলল,”এটা কি হয়েছে!”

“পিপি আমি মলম লাগিয়ে দিয়েছি।”

সায়রার মুখশ্রী দেখে মনে হলো,আমিরার বদলে আ ঘা ত পেয়েছে সে। জুঁই কিছুটা নিচু সুরে বলল,”মা ওকে আবার মে রে ছে।”

চোখ বন্ধ করে নিল সায়রা। তারপর বলল,”ওকে নিয়ে নিচে যা তো জুঁই। আমি আসছি।”

সায়রার কথা মতন আমিরাকে নিয়ে নিচে চলে এল জুঁই। সায়রা আকাশের দিকে চেয়ে বলল,”ধৈর্য দাও আল্লাহ। আমায় ধৈর্য দাও।”

সাঈদের সাথে দেখা করে ফেরার পথে পুরো রাস্তায় নানান কথা ভেবেছে সায়রা। ও ভেবেছে কোনো ভাবে আমিরার একটা ব্যবস্থা করা যাবে। তবে বাড়ি ফিরে যা দেখল তাতে ওর সিদ্ধান্তের বদল‍ ঘটল। আমিরা এখানে একা থাকতে পারবে না। কিছুতেই থাকতে পারবে না। বোনের মেয়েটিকে একটা অসুস্থ জীবন দিতে চায় না ও। এসব ই ভাবছিল ও। সে সময়েই জুথির আগমন ঘটল। রোষানলে তপ্ত তার কণ্ঠস্বর।

“সাঈদের সাথে তোর সম্পর্কের কী হলো?”

“কী হবে?”

“লোকে বলাবলি করছে ওর জন্য নাকি মেয়ে দেখা হচ্ছে।”

কথাটি জানে সায়রা। অর্পা ফোন করে বলেছিল সাঈদের মা সবটুকু দিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। সায়রার জবাব দিতে ইচ্ছা করছে না। ও এড়াতে চাইছে। তবে জুথি থেমে রইল না।

“কথা বলছিস না কেন? ও ছেলে যদি অন্য মেয়েকেই বিয়ে করে তবে এতদিনের সম্পর্কের কী মানে?”

“এসব কথা রাখো ভাবি।”

“রাখব কেন? সমস্যাটা কোথায়?”

সায়রার অসহ্য লাগছে। ও চোখ দুটি বন্ধ করে বলল,”প্লিজ ভাবি। এসব আর বলিও না। আমার ভালো লাগছে না।”

“ও ছেলে যদি বিয়ে করে। তবে তুই কেন বসে থাকবি? তোর ভাইয়ের কলিগের ছোট ভাই আছে। ভীষণ ভালো চাকরি করে। অনেকদিন ধরেই বলছিল তোর কথা।”

এ কথা যে কতবার শুনেছে সায়রা। ও এবার শক্ত করেই বলল,”আমি কোথাও যাব না ভাবি। এখন আমিরার পুরো দায়িত্ব আমার। ওকে রেখে কোথাও যাব না।”

জুথি যেন এবার জ্বলে ওঠল। কেন যেন আমিরার প্রতি বিতৃষ্ণা তার।
“তবে, ও মেয়ের জন্য ঘরেই পড়ে থাকবি? আজীবন?”

কথাটা বাজে শোনালেও উচ্চ শব্দে প্রতিবাদ করল না সায়রা। বরং মৃদু কণ্ঠে বলল,”ভাবি, দোহাই লাগি। আমিরার প্রতি একটু দয়াশীল হও। ও তোমার ছেলেমেয়ের ভাগে ভাগ বসাবে না। বিশ্বাস করো আমায়।”

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-২+৩

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (২ +৩)

কান্না গিলে বাজার করেছে সায়রা। দু হাত ভরে গেছে জিনিসপত্রে। ও একটি রিকশায় ওঠে পড়ল। তারপর ভাবতে লাগল জীবনটি নিয়ে। সে চাইলেই সাঈদের সাথে ভালো থাকতে পারে। তবে, আমিরা, তার কি হবে? জুথি তো মেয়েটিকে দু চক্ষে সহ্য করতে পারছে না। এদিকে আমিরার বাবা মেয়েটিকে লালন করতে চায় না। সব মিলিয়ে আমিরা যেন সাগরে ভাসছে। যার কোনো কূল নেই। যদি সায়রা ওকে ভরসা না দেয়, তবে আমিরার পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন হবে। নানান রকমের সমস্যা তো আছেই। তাছাড়া আমিরাকে ভীষণ ভালোবাসে ও। বলা চলে নিজের সন্তানের মতন মনে করে। সাঈদ কি চাইলেই পারে না বাসায় একটু জোর দিতে? সে কী সত্যিই অতটা অসহায়। নাকি সবটা একটা ভ্রম। ওদের দুজনের সম্পর্কের টানাপোড়ন তো অনেকদিনের। বাসায় জানানোর পর থেকেই তো নানান সমস্যা হচ্ছিল। আমিরা কী কেবল একটা ইস্যু মাত্র? ও আর ভাবতে পারল না। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে ওঠল আমিরার মুখটা। মেয়েটির মাঝে নিজের বোনকে দেখতে পায় ও। সায়রা ভেবে নিয়েছে। কিছুতেই বোনের মেয়েটিকে এভাবে সাগরে ফেলে দিতে পারে না। নিজের সবটুকু দিয়ে হলেও আমিরাকে আগলে রাখতে হবে। সায়রা চোখ মুখ মুছে নিল। বার বার কান্না আসছে তার!

খাবার গুলো আগের মতই পড়ে আছে। আমিরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। এক মাস ও হয় নি মা কে হারিয়েছে সে। সায়রা এসে যখন এই অবস্থা দেখল তখন ভ্রু কুঞ্চিত করে রইল।

“আমিরা, খাবার খাস নি কেন?”

আমিরা জবাব দিচ্ছে না। ও কোথাও হারিয়ে গেছে। সায়রা ওর পাশে এসে বসল।

“এই আমিরা।”

ঘোর কাটতেই ফিরে চাইল আমিরা। তার চোখ দুটো প্রাণহীন। বুকের ভেতর দহন অনুভব করল সায়রা। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”কী হয়েছে?”

আমিরা জবাব দিচ্ছে না। ওর মাথাটা নত করা। সায়রা যেন মন পড়ার চেষ্টা করছে। কিছু সময় পর বলল,”মন খারাপ করে থাকলে আসলে কী কোনো লাভ হবে?”

আমিরা মাথা দোলাল। সত্যিই তো মন খারাপ করে কেউ কখনো লাভ করতে পারে নি। সায়রা মেয়েটিকে কাছে টেনে নিল। আদুরে স্পর্শে বলল,”কী? তখনকার বিষয় গুলো এখনো ধরে আছিস?”

আমিরা এবার ও চুপ। সায়রা একটা হতাশার শ্বাস ফেলল।

“কী?”

এবার আমিরার দু চোখ ভে ঙে কান্না এল। সায়রাকে জাপটে ধরে কান্নায় ভে ঙে পড়ল ও। সায়রা বিস্মিত। ও বুঝতে পারছে না কেন কান্না করছে মেয়েটি।

অনেকটা সময় পর কান্না থামল আমিরার। সায়রা ওর মুখটা হাতে তুলে বলল,”কাঁদছিস কেন?”

“মামি স্কুলে ভর্তি হতে দিবে না।”

সায়রার দু ভ্রু কুঞ্চিত হলো। কিছুদিন আগেই তো ঠিক হলো আমিরা স্কুলে ভর্তি হবে। তবে এখন কেন সিদ্ধান্ত বদল করল?

রাতের খাবারের আগে সায়রা কথাটা বলল,”আমিরাকে স্কুল ভর্তি কবে করাচ্ছ?”

বোনের কথায় দিক হারিয়ে ফেলল মারুফ। দ্বিধা খেলা করছে চোখে মুখে। সায়রা এবার জোর খাটিয়ে বলল,”কী হলো ভাইয়া? কথা কেন বলছো না? স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে যোগাযোগ করেছ? কী বলেছে?”

মারুফ কী বলবে বুঝতে পারছে না। জুথি এবার মুখ খুলল।

“কীভাবে পড়াবে? খরচ কত দেখেছিস? মাসে মাসে তিন হাজার টাকা বেতন দিতে হবে। কোচিং খরচ, টিফিন খরচ, যাওয়া আসার খরচ। এত সব কীভাবে সামলাবে?”

সায়রার মুখশ্রী শুকিয়ে এল। ও ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইল। মারুফ নিরুত্তর। অথার্ৎ এ ব্যাপারে তার কোনো মতামত নেই। তবু যেন অনেক কষ্টে স্ত্রীর মতামত না নিয়েই বাক্যটি উচ্চারণ করল।

“আমিরাকে আশেপাশের কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিব। এতে টিফিন আর যাওয়া আসার খরচ ও লাগবে না। বেতন ও কম।”

সায়রার গলাটা ধরে এল। আমিরা আরো বেশি দামি স্কুলে পড়ে এসেছে। আর এখন কী না সাধারণ নামে মাত্র একটি স্কুলে ভর্তি হবে!

আমিরার চোখে ঘুম নেই। ও নিরলসভাবে তাকিয়ে আছে। মাথার ওপর ঘুরছে ফ্যান। গোল গোল করে। কত সুন্দর সে দৃশ্য। অথচ মানুষের এই গোলাকার জীবনটা ভীষণ অসুন্দর। ছোট মেয়েটিকে দেখে সায়রার হৃদয় কম্পিত হয়। ও তাকায় বার বার। তবে কথা বলতে পারে না।

“আমিরা শুনছিস?”

আমিরা মৃদু সুরে জবাব দেয়,”হুম।”

“মন খারাপ?”

“উহু।”

কি দারুণ ভাবে উপেক্ষা করে গেল কথাটা। সায়রার বুকটা যে আরো ভারী হলো। ও চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিল।

“চিন্তা করিস না। তুই স্কুলে পড়বি। আর মাহিম আর জুঁইয়ের স্কুলেই পড়বি।”

আমিরা যেন লাফিয়ে ওঠল। সায়রাকে জড়িয়ে ধরে বলল,”সত্যি মিমি?”

মেয়েটির মুখে চুল লেপ্টে আছে। সেসব ঠিক করতে করতে সায়রা বলল,”একদম। আমি কাল ই যাব কথা বলতে।”

পরেরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়ল সায়রা। সে বড়ো মেধাবী। সারাটা জীবন স্কলারশিপ পেয়ে এসেছে। বর্তমানে পাবলিক ভার্সিটিতে পড়ছে। ভার্সিটির খরচ তো তেমন নেই। তবে যাতায়াত খাওয়া দাওয়া কিংবা হাত খরচ বলতে যে টাকাটা লাগে সেটা তো ওর ই জোগাড় করতে হয়। সেটাতেও তেমন অসুবিধা হয় না। একটা টিউশনিতেই হয়ে যায়। সংসার চলে বাবার জমাকৃত টাকার লাভ দিয়ে। তাই খাবারের চিন্তাটা করতে হয় না। আর থাকার চিন্তা ও নেই। বাবা তার সারা জীবন দিয়ে একটি বাড়ি করে গিয়েছেন। একটা টিউশনি করায় সায়রা। এতে যে টাকা আসে তাতে বেশ ভালো চলে যায় ওর। তবে এখন যে আমিরার দায়িত্ব ও নিতে হবে। বেশ কিছুদিন ধরেই একজন টিউশনির জন্য জোর করছিল। প্রয়োজন নেই বিধায় টিউশনিটি নেয় নি ও। কিন্তু ভাগ্য দেখো, সেই নিজে থেকে ফিরিয়ে দেওয়া মানুষের কাছেই যেতে হচ্ছে। সায়রার বুক ভেদ করে একটি দীর্ঘশ্বাস নেমে এল। ও ঠিকানা অনুযায়ী একটি বাড়িতে পৌছাল। লিফ্টের বাটনে চাপ দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল। ও মনে মনে প্রার্থনা করছে যাতে টিউশনিটা অন্য কেউ নিয়ে না থাকে। নতুবা বড়ো সমস্যায় পড়তে হবে।

লিফ্ট খুলে গেছে, অথচ সায়রার ধ্যান নেই। ও চোখ বন্ধ করে আছে। হুট করেই একটা শব্দ কানে এল ওর। ও চমকে তাকাল। দেখল একটি ছেলে দাঁড়িয়ে।

“লিফ্টে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছেন কেন?”

সায়রা একটু লজ্জা পেয়ে নেমে গেল। লিফ্ট চলে গেল। সায়রা ফ্ল্যাটের দরজায় নক করল। ওর বুকের ভেতর ধীম ধীম করছে।

নাশতার টেবিল থেকে শুধুমাত্র পানিটাই নিল সায়রা। সেটা নিয়ে এক নিশ্বাসে পান করে বলল,”আপু, আপনি টিউশনির কথা বলেছিলেন। তখন আমার সময় ছিল না তাই নাকোচ করেছিলাম। এখন কী……”

সায়রা ভয়ে ভয়ে কথাটা উচ্চারণ করল। রনু হেসে বলল,”এটা তো খুশির খরব। আমি আসলে একটু বুঝদার টিচার খুঁজছিলাম। যে আমার ছেলেকে ভালো করে বুঝিয়ে পড়াবে। তোমার বেশ প্রশংসা শুনেছি।”

সায়রার বুকের ভেতর থেকে পাথর যেন নেমে এল। ও খুশিতে আর কিছুই বলল না। এমনকি বেতনের কথা ও জিজ্ঞাসা করল না। যদিও ভা ঙা মাস তবু ও রনু বলল সায়রা যেন কাল থেকেই আসে। এতে আরো বেশি তৃপ্ত হলো ও। এ কদিনের টাকাটা পেলে আমিরার ভর্তিটা করাতে পারবে।

বাড়িতে ফিরে একটি ম্যাসেজের অপেক্ষা করতে লাগল সায়রা। সাঈদ কী সত্যিই তাকে ভুলে গেছে? এই যে গতকাল রেগে কথা গুলো বলেছিল, তারপর কি সাঈদের উচিত ছিল না সায়রাকে কল করা? কিংবা একটি টেক্সট দেওয়ার। ওর খুব খারাপ লাগছে। ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। মানুষের জীবন এমন কেন হয়? ভালোবাসার মানুষ গুলো এত দ্রুত কেন হারায়? একটা চাপা কান্নায় ভে ঙে পড়ল সায়রা। মা হারানোর পর যেই মানুষটিকে ধরে ওরা তিন ভাই বোন বেঁচে ছিল সেই মানুষটাও কিছু মাস পূর্বে এতিম করে চলে গেল। বাবার চলে যাওয়ার পর আমেনাপু ও চলে গেল। সায়রার মনে হলো এ পৃথিবীতে সে বড়ো একা। তার কেউ নেই। এই একাকিত্ব ওকে পাগল করে দিবে। ও কাঁদতে লাগল নীরবে। ঠিক সে সময়েই আমিরা ওর পাশে এসে বসল। ও ঘুমিয়ে ছিল। ঘুম ভা ঙ তেই মিমিকে খুঁজতে খুঁজতে বারান্দায় এল। সায়রা দ্রুত চোখ মুছে বলল,”ঘুমোস নি এখনো?”

“ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম ভা ঙা র পর তোমাকে না পেয়ে এখানে এলাম। তুমি কাঁদছ কেন মিমি?”

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩)

আমিরাকে কাছে টেনে বসিয়ে দিল সায়রা। গালে স্পর্শ করে বলল,”কাঁদছি না তো।”

“মিথ্যে,আমি স্পষ্ট দেখেছি।”

“ভুল দেখেছিস।”

কথাটি বলেই সায়রা মুখ ঘুরিয়ে নিল। যেন ব্যথা লুকানোর চেষ্টা। ও দুঃখের সময় কারো চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না। কেঁদে ফেলে। আমিরা ও চুপ রইল। তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। ও শুনেছিল, যারা ম রে যায় তারা আকাশের তারা হয়ে যায়। এটা মা বলত। সেটি মনে পড়ে গেল হঠাৎ। আকাশে আজ অনেক বেশি তারা দেখা যাচ্ছে। ওর মনে প্রশ্ন জাগে। এত তারার মাঝে মা কোনটা? আনমনেই ভাবতে বসে গেল আমিরা। ও আসলেই বুঝতে পারছে না মা কোনটা। হুট করেই ওর মৌনতা, মুখের কালো আঁধার সায়রার নজরে এল। সায়রা ওকে জাপটে ধরে শুধাল,”কী ভাবছিস?”

“ভাবছি, মা কোনটা। এত তারার মাঝে মা কোনটা মিমি? আমি তো বুঝতে পারছি না।”

সায়রার বুক ভে ঙে আসে। ও নিজেও এই ধরনের কথায় বিশ্বাস করে। আসলে ঠিক বিশ্বাস নয়, বরং ভাবতে ভালো লাগে। মনে হয় মানুষ গুলো আসলেই সার্বক্ষণিক সঙ্গে আছে। বেশ কিছু সময় পর সায়রার থেকে জবাব এল,”শোন, আকাশের সবথেকে উজ্জ্বল যে তারা সেটাই হলো তোর মা।”

আমিরার ঠোঁটের কোণ একুটখানি প্রসারিত হলো। ওর ছোট্ট মস্তিষ্ক যেন তৃপ্ততায় মেখে আছে। এদিকে সায়রার হৃদয় ছটফট করছে। জীবন তাকে কি এক পরীক্ষায় ফেলে দিল!

টিউশনির প্রথম দিন। সায়রা নিজের পড়ানো নিয়ে সবসময় তৃপ্ত। ও নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে। তাই কখনো চিন্তা হয় না। রনু নাশতা দিয়ে বেশ কিছু সময় পর ছেলেকে সাথে নিয়ে ফিরল। ছেলেটার স্বাস্থ্য ভালো। চোখে চশমা লাগানো। বয়সে আমিরার থেকে কিছু ছোট হবে। ক্লাসেও ছোট। থ্রি তে পড়ে। সায়রা হাত নাড়িয়ে বলল,”তোমার নাম কী বাবু?”

ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। কোনো উত্তর দিল না। সায়রা পুনরায় জিজ্ঞাসা করে ও কোনো উত্তর পেল না। রনুর চোখে মুখে অস্বস্তি।

“আসলে তোমাকে বলা হয় নি, ও কিছুটা স্পেশাল চাইল্ড।”

এ কথা বলেই রনু কেমন অস্বস্তিতে ভে ঙে পড়ল। সেটা দেখে সায়রার একটু খারাপ লাগল। তবে মুহূর্তেই ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে বলল,”এটা কোনো সমস্যা না আপু। আমি চেষ্টা করব সর্বোচ্চ।”

রনুর যেন বুকের পাথর নেমে এল। স্পেশাল চাইল্ডদের জন্য স্পেশাল স্কুল আছে। টিউটর আছে। তবে রনুর হাসবেন্ডের এই ব্যাপারে ভীষণ অমত। সে জানে তার ছেলের সমস্যাটা অনেক বেশি না। ডাক্তার ও বলেছে মানুষ জনের সাথে একটু বেশি মিশলেই ঠিক হয়ে যাবে। তবে সমস্যাটি হচ্ছিল স্কুল আর টিউটর নিয়ে। বাচ্চাটি স্পেশাল চাইল্ড শুনেই অনেকে নাকোচ করে দিচ্ছিল। যারা ও পড়াতে আসে এক দুই মাস পড়িয়েই চলে যায়। সব মিলিয়ে ভীষণ চিন্তায় যাচ্ছিল। তখনই বান্ধবীর থেকে সায়রার খোঁজ মিলে। সায়রা ও তো প্রথমবার নাকোচ করে দিয়েছিল। যখন নিজ থেকে আসল তখন উত্তেজনায় কথাটি আর বলা হয় নি।

আরহামকে পড়াতে সায়রার আসলেই কষ্ট হচ্ছে। ছেলেটা কোনো কথাই বলতে চায় না। আধা ঘন্টা চেষ্টা করে ওর মুখ থেকে নামটি বলাতে পেরেছে সায়রা। সবশেষে দু একটা শব্দ বলেছে। তবে ভে ঙে ভে ঙে। বাচ্চাটির মুখেও বেশ জড়তা। এর কারণ হতে পারে মানুষের সাথে না মেশা। রনুর থেকে জেনেছে কোনো সুস্থ বাচ্চাই আরহামের সাথে মিশতে চায় না। বাচ্চার মায়েরা চোখ মুখ আঁধার করে রাখে। আড়ালে আলোচনা সমালোচনা করে। তাদের মতে একটি বাচ্চার কারণে স্কুল নষ্ট হয়ে যাবে। কি এক আশ্চর্য ভাবনা! সবটা ভাবতেই সায়রার মন খারাপ হয়ে যায়। দরজা খুলে বের হতেই একদল ছেলের দেখা মিলল। সবার হাতে মিউজিকের নানান সরঞ্জাম। এত গুলো ছেলে দেখে থেমে রইল ও। সামনে গেল না আর। তবে ছেলে গুলো সরছেই না। তারা কথা বলছে নিজেদের মাঝে। তাদের একজন কাউকে একটা কল করে বলছে,”অনুভব তুই সব সময় এমন কেন করিস? আমরা কত সময় ধরে অপেক্ষা করছি। কোথায় তুই?”

ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তি কি বলল সায়রা জানে না। তবে এপাশে থাকা ছেলেটা এবার একটু নরম সুরে বলল,”প্লিজ দ্রুত আয়।”

তারপর দু মিনিটের মতন সময় পার হলো। সায়রা ঠায় দাঁড়িয়ে। ছেলে গুলো লিফ্টের সামনে এসেই ভীড় করেছে। এত গুলো ছেলের মাঝে যেতে ইচ্ছা করছে না ওর। কিংবা অস্বস্তি হচ্ছে। ও করিডোরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আরো কিছু সময় পর একটি কণ্ঠ শোনা গেল,”সরি দোস্ত। তোরা শুরু করে দিতেই পারতি।”

“ফর ইউর কাইন্ড ইনফর্মেশন চিলেকোঠার চাবি তুই সাথে নিয়ে গেছিস।”

কথাটা বলতেই অনুভব নামের ছেলেটা হাসল। লম্বা চুল গুলো হাতের সাহায্যে নাড়িয়ে বলল,”উফস, মনে ছিল না। এই নে।”

পকেট থেকে চাবি বের করে বন্ধুদের দিকে ছুড়ে দিল। তারপরই এপাশে তাকাল অনুভব। সায়রার সাথে চোখাচোখি হলো ওর। একটা অস্বস্তি এসে ভর করল মেয়েটিকে। অনুভবের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল ওর বন্ধুরাও। তবে সায়রা দ্রুত সরে যাওয়ায় অনুভব ছাড়া আর কেউ ই দেখল না মেয়েটিকে।

পর পর দুটো টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরল সায়রা। হাতে তার জিনিসপত্র। সব জিনিসপত্র নামিয়ে জুথিকে ডাকল।

“ভাবি, এগুলো একটু রেখে দাও তো।”

জুথি এল কিছু সময় পর। জিনিসপত্র গুলো দেখতে দেখতে বলল,”হরলিক্স কেন এনেছিস? লিস্টে তো এটা ছিল না। দাম দেখি, ৬৫০ টাকা!”

“আমার টাকা দিয়েই এনেছি।”

কথাটি বলতেই জুথির মুখে কিছুটা আঁধার ছেয়ে গেল। সে একটু আলগা সুরে বলল,”তুই কথাটা অন্যভাবে নিলি। আমি শুধু এমনিই জিজ্ঞাসা করেছি।”

সায়রা জানে জুথি কোন ভাবে বলেছে। কারণ আমিরা ছাড়া আর কেউ হরলিক্স খায় না। কোথায় কি খরচ হয়,এক একটা পয়সার হিসেব রাখে জুথি। অথচ সংসার চলে বাবার টাকাতেই। সত্যি বলতে সায়রার ইচ্ছা করে না তর্ক করতে। ও বিষয়টা এড়াতে বলল,”মাহিম আর জুঁই ফিরেছে?”

“হ্যাঁ। গোসল করছে।”

“ঠিক আছে। আমি ও তাহলে গোসল করে নিই। বুয়া কে বলো তো একটু আদা চা করে রাখতে। মাথাটা ভীষণ ধরেছে।”

কথা শেষ করে নিজের ঘরে এল সায়রা। আজ সে ফোন রেখে গিয়েছিল। সে কি এক কান্ড! ও দ্রুত ফোন চেইক করল। এক আকাশ সম আশা নিয়ে। তবে দেখল কোনো ম্যাসেজ বা কল আসে নি। ও হতাশ হলো। গোসল শেষ করে মাহিম আর জুঁইকে নিয়ে বসল।

“শোন তোরা। এটা খুবই সিক্রেট। আগে থেকে কেউ যেন না জানে।”

কথাটা বলতেই জুঁই আর মাহিমের মুখের উচ্ছ্বাস ভেসে এল। পিপির সাথে এ ধরনের রোমাঞ্চকর আলোচনায় ভীষণ আগ্রহ ওদের। সায়রা আশেপাশে দেখে বলল,”পরশু আমিরার জন্মদিন। আমরা ওকে ঠিক বারোটার সময় উইশ করব। আর কেক কাটিং ও করব।”

মাহিম আর জুঁই মাথা দোলাল। সায়রা আবার বলল,”মাহিম তোর দায়িত্ব কেক নিয়ে আসা। আর জুঁই তুই সাজানোর কাজ করবি। আমি আমিরাকে ঘরে রাখার ব্যবস্থা করব।”

“ঠিক আছে পিপি।”

তারপর ওরা হিসেব করতে বসল। অল্পবিস্তর সাজিয়ে একটা কেক আনতে গেলেও দুই হাজার টাকার মতন খরচ হবে। সায়রা টাকা দিয়ে বলল,”ভাইয়া আর ভাবিকেও বলার দরকার নেই। না হলে সব সারপ্রাইজ শেষ করে দিবে।”

সায়রা আরো কিছু বলতে নিচ্ছিল তখনই ওর মোবাইলটা বেজে ওঠল। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠল যেন। সায়রা চটপট ফোন হাতে নিল। হতাশ হলো। সাঈদ কল করে নি। কল করেছে ওর বান্ধবী অর্পা। অথচ বোকা সে ভেবেছিল মানুষটা বুঝি কল করেছে।

চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-০১

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (১)
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

“এক টুকরো মাছ ই তো ভাবি, এর জন্য তুমি এইটুকু বাচ্চার গায়ে হাত তুলবে?”

দশ বছর বয়সী আমিরাকে, জাপটে ধরে বাক্যটি বলল সায়রা। ও মাত্রই বাইরে থেকে এসেছে। আর তখনই আমিরার গায়ে হাত তুলে জুথি। মা হারানো আমিরা তখনো কেঁদে চলেছে। দুধে ভাতে বড়ো হওয়া তার ভাগ্য যে এমন হবে সেটা কেউ কি কখনো জেনেছিল?

জুথি সায়রার বাক্যের বিপরীতে জ্বলন্ত সুরে বলল,”এভাবে আদরে আদরে স্বভাব নষ্ট করছিস সায়রা। আর যথেষ্ট বড়ো ও। এই না কিছুই বুঝে না।”

“ভাবি,ঠিক আছে। আর কিছু বলা লাগবে না। এক টুকরো মাছ ই তো চেয়েছে, আমার ভাগেরটা দিতে।”

জুথি মুখ বাঁকিয়ে রইল। সায়রা নিজের মাছের টুকরাটা দিতেই আমিরা বলে ওঠল।

“আমি মাছ খাব না মিমি।”

কথাটি বলেই চোখের জল নিয়ে চলে গেল আমিরা। জুথি ভেংচি কেটে কাজ করতে লাগল। এদিকে সায়রার বুকের পাঁজর ভে ঙে আসার উপক্রম। বোনের মেয়েটিকে অসম্ভব ভালোবাসে সে।

আমিরা ছাদের এক কোণে বসে আছে। সে কাঁদছে। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে ওর। এক টুকরো মাছের জন্য মামি তাকে আ ঘা ত করেছে। সে কখনো এমন জীবন আশা করে নি। ছোট্ট সে অভিমানী খুব। সায়রা জানে সেটা। তাই ওর পাশে এসে চুপ করে বসেছে। দুজনেই চুপ। কেউ কোনো কথা বলছে না। এমন নয় আমিরা সায়রার উপস্থিতি বুঝে নি। সে বুঝেছে। তবে কথা বলছে না। অনেক সময় পর আমিরার চোখের জল ফুরাল। সায়রা ওর গা ঘেঁষে বলল,”এখনো কষ্ট হচ্ছে?”

আমিরা দু দিকে মাথা কাত করে বোঝাল কষ্ট হচ্ছে না। সায়রা ওর বাহু টেনে বলল,”কী হয়েছিল? আমাকে বলতি। আমি তো মানা করতাম না। ভাবি কে কেন বলেছিস?”

আমিরা চুপ। সায়রা তার আদুরে হাতে মেয়েটির চোখ মুখ মুছে দিচ্ছে।

“মামি আমাকে মাছের সবথেকে ছোট পিস দিয়েছে। অনেক বেশি কাঁটা। আমি বদলে দিতে বলেছিলাম, তাই মে রে ছে।”

সায়রার বুকটা ভারী হয়ে গেল। আমিরার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বলল,”কষ্ট পাস না সোনা। মিমি সব কষ্ট দূর করে দিব।”

আমিরা বিড়াল ছানার মতন চুপ করে থাকে। সায়রার এত খারাপ লাগছে। এক টুকরো মাছের জন্য নাকি মেয়েটি মা’র খেয়েছে! এটা ওর জন্য খুবই যন্ত্রণার।

আমিরা ঘুমিয়ে আছে। ওর পাশেই বসে আছে সায়রা। পড়াশোনা করছে সে। মাঝে মাঝে ফোন চেইক করছে। না কোনো ম্যাসেজ আসে নি। ও একটু হতাশ হলো। সাঈদের সাথে তার ছয় বছরের সম্পর্ক। সেই স্কুল থেকে। অথচ আজকাল দুজনের বোঝা পড়াটা একেবারেই হচ্ছে না। কেমন একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আগের মতন কথা হয় না।দেখা হয় না। কি এক আশ্চর্য শক্তি যেন ওদেরকে নিক্রিয় করে যাচ্ছে। সায়রার মন খারাপ হচ্ছে। ও ম্যাসেজ লিখল।

“কী করছো?”

চট করেই উত্তর এল না। কিছু সময় অপেক্ষা করে পড়ায় মন দিল ও। ম্যাসেজের রিপ্লে আসল ত্রিশ মিনিট পর।

“অফিস থেকে ফিরছি। তুমি?”

“আমি পড়ছি।”

“ও।”

“হুম।”

তারপর দুজনেই চুপ। সাঈদ ম্যাসেজ সীন করেছে। সায়রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বেশ কিছুটা সময় যাওয়ার পর সাঈদের রিপ্লে এল।
“ফ্রি কখন আছ? আজ সন্ধ্যায় দেখা করতে পারবে?”

“পারব।”

“ঠিক আছে।”

ঐ অবধিই কথা হলো ওদের। এখন কিছুটা ভালো লাগছে সায়রার। ও দ্রুত পড়া শেষ করে বারান্দায় গেল। গাছ গুলো নেতিয়ে পড়েছে। সেগুলোয় পানি ছিটিয়ে এল রান্না ঘরে। সন্ধ্যার নাশতাটা সে বানায়। যেহেতু আজ বের হবে তাই বিকেল বেলাতেই তৈরি করে নিচ্ছে সব। ওর নাশতা বানানো শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল। ও দ্রুত আলাদা বাটিতে কিছু ভাজা নিয়ে আমিরার জন্য রাখল। ছাদ থেকে ভেজা কাপড় এনে সেগুলো মেলে দিল। সব কাজ শেষ হতে হতে কিছুটা লেট হয়ে গেল। আমিরার ঘুম ভে ঙে ছে। ও দেখল, মিমি তৈরি হচ্ছে। ও চোখ কচলে বলল,”মিমি, কোথায় যাও?”

“একটু বাইরে বের হচ্ছি রে। তোর জন্য ভাজা এনে রেখেছি। খেয়ে নিস। কেমন?”

“ঠিক আছে।”

“বাইরে তো যাচ্ছি,কিছু খাবি?”

“না।”

“আচ্ছা, আমি গেলাম রে। দ্রুতই আসব।”

“আচ্ছা।”

ব্যস্ত পায়ে বের হলো সায়রা। জুথি পেছন থেকে ডেকে ওঠল।

“এই সায়রা বের হচ্ছিস?”

“হ্যাঁ ভাবি। লেট হয়ে গেল।”

“এই লিস্টটা নিয়ে যা। আসার সময় নিয়ে আসিছ।”

“ঠিক আছে।”

লিস্ট হাতে নিয়ে রীতিমতো ছুটতে লাগল সায়রা। আমিরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল। সে এইটুকু বয়সেই নিজের সবটুকু হারিয়ে বসেছে। যদি মিমি না থাকত, তবে কোথায় জায়গা হতো তার?

রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত পথ চলছে সায়রা। আসলেই লেট হয়ে গেল। মাঝে কত জ্যাম ঠেলে আসতে হয়েছে তাকে! সাঈদ এত দিন পর দেখা করতে চেয়েছে। অথচ সে কী না লেট করে ফেলল। ও একটু অনুশোচনায় ভুগছে। তবে কিছু করার ছিল না অবশ্য। সব কাজ না শেষ করে কেমন করে আসবে?

সাঈদ আর সায়রা বরাবরই একটি নির্দিষ্ট ক্যাফেতে আড্ডা দেয়। এটা হচ্ছে অনেক মাস ধরে। সেই ক্যাফেতেই এল সায়রা। সাঈদ আগে থেকেই বসে ছিল। সায়রা বসতে বসতে বলল,”সরি। লেট হয়ে গেল।”

“ইটস ওকে।”

ওয়েটারকে কফি আনতে বলে সাঈদ সায়রার দিকে তাকাল। সায়রা আর সাঈদের প্রেমটা খুবই সাদামাটা। সায়রাকে প্রথম দেখেছিল মেলাতে। তারপর মেয়েটির খোঁজ খবর নিয়েছিল। ক্লাস টেনের একটি বাচ্চা মেয়ে। এদিকে সাঈদ তখন ভার্সিটির তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। দুজনের বয়সের একটা গ্যাপ আছে। মন মেজাজের মিল না ও হতে পারে। এই ভেবে ভেবে সাঈদের দিন কাটছিল না। তবে সায়রা ও মাথা থেকে যাচ্ছিল না। মেয়েটিকে যখন মনের অনুভূতি জানাল তখন কী যে একটা অবস্থা। সায়রা তো রেগেমেগে আগুন। তবে দুদিন পর ই জবাবটি এসেছিল। সায়রা নিজের জীবনের প্রথম প্রেমটি বেছে নিয়েছিল। সেই অতীত, সেই সায়রা। সবটা একবার স্মরণ করল সাঈদ। আজ তার বয়স আটাশে ঠেকেছে। সায়রার বয়স বাইশ। দুজনেই বিয়ের বয়সে এসেছে। প্রেমের বয়স ও হলো ছয়। সব মিলিয়ে বলা যায় সুন্দর একটি সময়। সায়রা কফি কাপে চুমুক দিয়ে বলল,”আজকাল বেশ ব্যস্ত থাকো।”

সাঈদ কয়েক সেকেন্ড পরে বলল,”কাজের চাপ বেড়েছে। কিংবা বাড়িয়ে নিয়েছি।”

“বাড়িয়ে কেন নিয়েছ?”

“রোজকার ঝামেলা ভালো লাগে না।”

“কী ঝামেলা?”

“বাসা থেকে চাপ দিচ্ছে। বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে।”

বিয়ের কথা ওঠতেই শুকনো একটি ঢোক গিলল সায়রা। সাঈদ দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,”আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”

“আমার তো বিয়েতে অসুবিধা নেই সাঈদ। আমিও চাই বিয়ে করতে। তবে আমিরাকে ফেলে নয়। ও বাচ্চা একটা মেয়ে। সবে মা হারিয়েছে। বাবা থাকতেও হারিয়েছে বাবার ভালোবাসা। তুমি কেন বুঝতে চাইছো না?”

সায়রার হাতটি নিজের হাতে নিয়ে নিল সাঈদ। দুজনই একে অপরের দিকে চেয়ে আছে।

“সবটা বুঝতে পারছি সায়রা। তবে বাসায় এভাবে মানছে না।”

সায়রার গলাটা শুকিয়ে এসেছে। ওর চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে। দুজনের কেউ ই আর কথা বলল না। সাঈদ লম্বা একটি শ্বাস ফেলে বলল,”এবার সত্যিই আমার হাতে কিছু নেই সায়রা। আমি তোমায় ভালোবাসি। কেন বুঝতে চাইছো না?”

সায়রার কান্না পেল। তবে ও কাঁদল না। বরং কঠিন সুরে বলল,”তুমি চাইলে বিয়ে করে নিতে পারো সাঈদ। আমিরা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। ওকে রেখে আমি কোথাও যেতে পারব না।”

সাঈদের দৃষ্টিতে অসহায়তার ছাপ। সায়রা ওঠে পড়ল। ব্যাগ নিয়ে বলল,”সম্ভবত এই কথাটা শোনার জন্যই আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলে। আমি সব ক্লিয়ার করে দিয়েছি। হয়তো আমাদের পথচলাটা দীর্ঘ হলো না।”

একরাশ দুঃখ, কষ্ট বুকে চেপে রেখে সায়রা চলে এল। পথ চলতে চলতে ওর মনে হলো, মাথাটা ঘুরাচ্ছে। যখন তখন পড়ে যেতে পারে। তবে ও শক্ত থাকতে চাইছে। কিন্তু এই জীবন, এই পরিস্থিতি ওকে শক্ত থাকতে দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে গলার কাছটা ভীষণ জ্বলছে। আর কতক্ষণ কান্না আটকিয়ে রাখবে সে?

চলবে…..

তুমি আমার প্রণয়িনী পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0

#ধারাবাহিকগল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী

ভালোবাসার বদলে অবহেলা এসেছে বলে জোবায়দা আর ওদের বাসায় থাকতে চায়নি। যদিও ওর মা বার বার ওকে থাকার জন্য অনুরোধ করছিলো। কিন্তু ও থাকতে পারেনি। নিজের ভালোবাসার এমন বিসর্জন ও মেনে নিতে পারছিলো না। ওর আপন ছোটো বোনকে বিয়ে করে হিমেল কি বুঝাতে চাইলো। সারাক্ষণ ও জোবায়দার সামনে ঘুরে বেড়াবে আর ওর চোখের সামনে ওর বোনের সাথে প্রণয়ের উষ্ণতা ছড়াবে? আর এই দৃশ্য দেখে জোবায়দা জ্বলে পুড়ে খাক হবে এই তো চেয়েছিলো হিমেল? কিন্তু জোবায়দাও সেই সুযোগটা ওকে দিবে না। অথচ এই হিমেল ওকে বলেছিলো ওদের বাসর হবে পূর্ণিমা রাতে সাগরের বালুকাবেলায়।

আজ জোবায়দার বুকের ভিতরে হৃদয়ের দূকুল অবিরত ভাঙ্গছে। সেই ভাঙ্গনে সযতনে রাখা আবেগের সব জল ভেসে যাচ্ছে। সেই স্রোতে নিজের সব ক্লেশকে ভাসিয়ে দিয়ে জোবায়দা আজ মুক্তি পেতে চাইছে।

নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে মন থেকে চিরতরে মুক্তি দেওয়ার কথা মনে হতেই ওর বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠলো। ওর জীবনের যদি এই পরিনতি হওয়ার কথাছিলো তাহলে ওকে ভালোবাসার কি প্রয়োজন ছিলো?

ঝড়ো হাওয়ার তান্ডবটা অনেকটা কমে এসেছে। গাড়ির জানালা দিয়ে জোবায়দা বাইরে তাকিয়ে দেখে বৃষ্টির বেগটা অনেকটা কমে এসেছে। মেঘ সরে গিয়ে চন্দ্রালোকিত রাতের দেখা মিলেছে। আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। তবে কি আজ ভরা পূর্ণিমা?
কমলাপুর পৌছে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ট্রেনের জন্য জোবায়দা অপেক্ষা করতে লাগলো।ও একটু আগেই এসে পড়েছে। ইচ্ছে করেই মোবাইলটা সুইচস্টপ করে রেখেছে। বাড়ি থেকে আসার সময় সবাইকে বলে এসেছে, ওকে যেন ফোন দিয়ে অযথা কেউ ডিস্টার্ব না করে। চোখ দিয়ে অনবরত নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। নিজের উপর ওর খুব রাগ হলো। কার জন্য ও কাঁদছে। যে ওর ভালোবাসার শতদলগুলো দুপায়ে মাড়িয়ে চলে গেল তার জন্য?
ট্রেন চলে এসেছে। সিক্ত চোখটা মুছে জোবায়দা ট্রেনের কামরায় উঠে পড়লো। জানালার কাছে সিটটাতে বসা মাত্রই সাইরেন বেজে উঠলো। ট্রেনের সাইরেনটা ওর বুকে বিচ্ছেদের ভায়োলিনের সুরের মতো বিঁধলো। ও জানালা দিয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। জোবায়দা যদিও জানে আজ তাকে কেউ খুঁজতে আসবে না। বরং ও সামনে না থাকাতে ঐ মানুষটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে।

সকাল সাতটায় ট্রেনটা চিটাগাং রেলস্টেশনে এসে থামলো। জোবায়দা ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ট্রেনের দরজার কাছে পৌঁছাতেই হঠাৎ একটা হাত ওর দিকে বাড়িয়ে দিলো। হাতের গড়নটা বেশ পরিচিত। চমকে মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর সামনে হিমেল দাঁড়িয়ে আছে।
—-কি ব্যাপার এতো সকালে আপনি এখানে কেন?
পরমুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
—-ও—-ও হানিমুনে এসেছেন বুঝি?
—-এবার কিন্তু আমি রেগে যাবো। অনেক জ্বালিয়েছো আমায়। সেই কোন ছোটোবেলা থেকে তোমার পিছে পড়ে আছি। অথচ তোমায় একটু ছুঁতে পর্যন্ত পারিনি।
একথা বলে হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে হিমেল জোবায়দাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে একদম নিজের বুকের কাছটায় নিয়ে এলো। জোবায়দা টাল সামলাতে না পেরে হিমেলের বুকের উপর ধাক্কা খেলো। পরমুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
—-করছেন কি আপনি? এখন কিন্তু আপনি আমার বোনজামাই। আশাকরি সম্পর্কটার কথা মনে রাখবেন।
—তোমার কি ধারণা আমি তোমার সাথে মজা করছি? কি মনে রাখবো আর কি রাখবো না সেটা পরে ভাববো। এখন তোমাকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছি চুপচাপ সুবোধ বালিকার মতো সেখানে যাবে। হিমেল ওকে সোজা কাজী অফিসে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে তো ও আরো অবাক হয়ে গেল। হিমেলের বাবা মা ওর মা, আদিবা আর ওর ফুফাতো ভাই রাসেল বসে আছে। ও সেখানে গিয়ে যেন গোলক ধাঁধার চত্বরে পড়ে গেল। ওর মনে হলো ও স্বপ্ন দেখছে নাতো! তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আম্মু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আদিবার বিয়ে হয়নি?
—-হয়েছে তো।
—-তাহলে ও আমাকে এখানে ধরে আনলো কেন?
—-রাসেলের সাথে আদিবার বিয়ে হয়েছে।
জোবায়দা আদিবার দিকে তাকিয়ে দেখে গা ভর্তি গয়না পরে আদিবা ওর দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। মনে মনে বললো, সোনার গয়না পড়ার এতো শখ যখন তখন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে হয়ে ভালোই হয়েছে। রাসেলের সাথে আই কন্ট্রাক হওয়াতে জোবায়দাকে বললো,
—-আপু আসসালামু আলাইকুম। শুভ কাজে দেরী করা ঠিক নয়। তাতে অনেক বাধা বিপত্তি হয়।
জমির মোল্লা কাজী সাহেবকে তাগাদা দিয়ে বললেন,
—-কাজী সাহেব, বিয়ে পড়ানো শুরু করেন। আমাদের আবার ঢাকায় ফিরতে হবে।
জোবায়দার আরো অনেক কিছু জিজ্ঞাসা ছিলো। সেটা জানতেই ও হিমেলের দিকে তাকালো। হিমেল ওকে ইশারায় বললো,
—-ও সব বুঝিয়ে বলবে।
তারপর দু,পক্ষের স্বাক্ষীর উপস্থিতিতে হিমেল আর জোবায়দার বিয়ে সম্পন্ন হলো। খুশীতে হিমেলের মা ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
—-সেই কোন ছোটোবেলা থেকে তোকে ছেলের বউ করার স্বপ্ন দেখেছিলাম। আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া সেই স্বপ্ন আজ পূরণ হলো। দোয়া করি তোরা দু’জনে অনেক সুখে থাক।
এরপর শেফালী বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-বেয়াইন দেখেন,দুটিতে কতো মানিয়েছে।
—-আমাকে আবার ভিলেন বানিও না। হিমেল যদি বলতো ও জোবায়দাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না তাহলে তো আর এতো ঝামেলা হতো না।
শেফালী বেগম মেয়ের দিয়ে তাকিয়ে বললেন,
—-তোকে সংসারী দেখার আমার খুব ইচ্ছে ছিলো। আল্লাহপাক আজ আমার সে ইচ্ছা পূরণ করেছে। দেখে নিস, তুই অনেক সুখী হবি। সন্তান যখন তার বাবা মায়ের পিছনে অর্থ ব্যয় করে, দায়িত্ব পালন করে আল্লাহ তা বহুগুন বাড়িয়ে সেই সন্তানের জীবনে ফিরিয়ে দেন।
আজ ঐ আসরে সবার চোখ ছলছল করছে। এতো দুঃখের কার্নিশের জল নয় এযে ভালোবাসার আনন্দঅশ্রু। আদিবা এসে জোবায়দাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-সারাজীবন মুখ বুঝে দায়িত্ব পালন করে গিয়েছিস। দায়িত্ব করতে করতে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকেও বিলিয়ে দিয়ে দায়িত্ব পালন করা নিছক আমার কাছে বোকামী মনে হয়েছে। ভালোবাসার মানুষকে পরম যত্নে আগলে রাখিস।
—-পড়াশোনাটা তো ভালো করে করলি না তবে প্রেমের পাট ভালোই নিয়েছিস। তা আমি ঢের বুঝতে পারছি। দেখ, পড়াশোনাটা আবার শুরু করতে পারিস কিনা।
শেফালী বেগম হিমেলের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
—-তোমাকে আমি আমার ঘরের সেরা রত্নটি আজ দিয়ে দিলাম। তাকে কখনও কষ্ট দিও না। অনেক যত্নে আর ভালোবাসায় ওকে রেখো।
—-মা, আমাদের দু’জনের জন্য দোয়া করবেন।

রাসেলের গাড়িতে করে সবাই এসেছিলো। আর ঐ গাড়িতে সবাই হিমেল আর জোবায়দার কাছে বিদায় নিয়ে ঢাকা ফিরে গেল। জোবায়দাও ঢাকায় ফিরতে চাইলো। হিমেল তখন ওকে বললো,
—মহারানীর তো ফেরা হবে না। ভুলে গেছো আমাদের বাসর হওয়ার কথা ছিলো সাগরের বালুকাবেলায়?আমার কতোদিনের ইচ্ছে সাগর সৈকতে নির্জন রাতে এক আকাশ চন্দ্রগর্ভা জোৎস্নার হাতছানিতে আমার ভালোবাসার মানুষটার সাথে বাসর জাগবো। উম্মত্ত যৌবনা জোৎস্নায় স্নান করে আমার প্রণয়িনীর প্রেমে মাতাল হয়ে রবো।
—-আপনার কাব্যেপনায় কবিরাও হার মেনে যাবে। চলেন কোথাও বসি।
পাশে রয়্যাল চাইনিজ রেস্টুরেন্টে দু’জনে নিরিবিলি বসলো। জোবায়দার তখনও হিমেলের উপর অভিমান ঝরে পড়ছিলো। তাই একটু খোঁচা দিয়ে বললো,
—-এতোই যদি আমার প্রতি প্রেম ছিলো তাহলে প্রেমিকার বোনকে কি করে বিয়ে করার সাধ জাগে?
—-এই তোমার আমার প্রতি বিশ্বাস? কি করে ভাবলে তোমার বোন তো দূরের কথা পৃথিবীর কোনো নারীকে আমার ভালোবাসা সম্ভব নয়। সে যদি স্বর্গের অপ্সরীও হয় তবুও জোবায়দার প্রেম ছাড়া হিমেল কখনও উষ্ণ হবে না।
—- থাক এতো কাব্য ছড়াতে হবে না। তবে আপনার পারমিশন ছাড়া আদিবাকে আঙ্কেল আন্টি কি করে আংটি পড়ালো এটা আমি বুঝতে পারলাম না।
—–বুঝেছি,এখনও আমার উপর আস্থা রাখতে পারছো না। ঠিক আছে পুরো ঘটনাটা বলি। আব্বা আসলে তোমাকে বউ করে আনতে চাইছিলো না। তার ধারণা, তুমি তোমার ফ্যামেলির প্রতি যে পরিমান দুর্বল তাতে তোমাকে বউ করে আনলে উনারা আমাকে হারাবেন। আর আমিও যে তোমার প্রতি দুর্বল এটা আমার মা বাবা দু’জনেই জানে। তবে এটা জানতো না তাদের ছেলে এই মেয়েটাকে বহু আগেই মনটা দিয়ে ফেলেছে। সেই কারনে ওরা ভেবেছে আদিবা যেহেতু একদম ঘরোয়া ওকে আনলে সব কুল রক্ষা হবে।
—তাই আপনিও ওদের তালে পড়ে আদিবাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন?
—+না—না,এখানে একটা ভুলবুঝাবুঝি হয়েছে। আমার বিসিএস হয়ে যাবার পর বাবাকে বলেছিলাম তোমাদের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাতে। তবে এটা বলেছিলাম পুরো কাজটা যেন তোমাকে না জানিয়ে করা হয়। আমার ইচ্ছে ছিলো বর সেজে তোমাদের বাড়িতে গিয়ে তোমায় চমকে দিবো। মাঝখানে আব্বু তো সব গুবলেট পাকালো। যদিও আমি এসবের কিছুই জানতাম না। এমনকি আমি আংটিও কিনিনি। কারণ তোমার সাথে আমার কথা ছিলো বাসর রাতে আমি তোমাকে আংটি পরিয়ে দিবো। যাই হোক বিয়ের আসরে বর সেজে যাবার পর যখন কাজী বিয়ে পড়াতে যাবে আমি তখনি তোমাকে নিয়ে এসে আমার পাশে বসিয়ে দেওয়ার জন্য ওমরকে বলি। আর তখনি জানতে পারি আমার বিয়ে হচ্ছে আদিবার সাথে। আমি চিৎকার করে তোমাকে ডাকতে থাকি। পরে জানলাম তুমি চিটাগাং এর উদ্দেশ্য রওয়ানা দিয়েছো। অবশ্য ঝড় বৃষ্টি না হলে আমি ঠিক তোমার কাছে পৌঁছে যেতাম। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়াতে ফুফু খুব খুশী হলেন। সুযোগটাও কাজে লাগালেন। আদিবাকে নিজের ছেলের বউ করে নিলেন। আমিও আমার ভালোবাসার মানুষটাকে চিরতরে আপন করে পাবার তরে এই চিটাগাং এ ছুটে আসলাম।
দু’জনে খাওয়া দাওয়া শেষ করে রেন্ট এ কার থেকে একটা প্রিমিয়াম গাড়ি ভাড়া করে কক্সবাজারের দিকে ছুটে চললো। হিমেল আগে থেকেই মারমেইড রিসোর্ট ভাড়া করে রেখেছিলো। খুব দ্রুতই ওরা পৌঁছে গেল। হিমেল আগে থেকেই ওদের সব বলেছিলো। হোটেলে ওদের রুমের পুরো খাটটা বাসর খাটের মতো সাজিয়েছে। বিছানায় হার্টসেভ করে গোলাপ বিছিয়ে দিয়েছে। রুমের দরজা খুললেই ওদের নিজস্ব সীবিচ দেখা যায়। বীচটা খুব নিরিবিলি। হোটেল কতৃপক্ষ ওদের দু,জনকে খুবই সুস্বাদু দুগ্লাস জুস দিয়ে বরণ করে নিলো। লাঞ্চ করে ওরা সী বীচের কাছে চেয়ারে বসে সাগরের গর্জন শুনতে লাগলো। তবে জোবায়দা হিমেলের দিকে না তাকিয়ে বুঝতে পারছে, হিমেল ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। ওর ভীষণ লজ্জা অনুভব হলো। তাই একসময় জোবায়দা উঠে এসে রুমের বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ওর কেন যেন আজ হিমেলের দিকে তাকাতে লজ্জা লাগছে। কিছুক্ষণ পর হিমেল এসে খাটের পাশটায় বসলো। জোবায়দা হিমেলকে দেখে জড়সড় হয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলো। তারপর একসময় বিছানা থেকে নামতে গেলে হিমেল আস্তে করে ওর পা,টা জোবায়দার দিকে ইচ্ছে করেই এগিয়ে দিলে জোবায়দার পড়ে যাবার উপক্রম হয়। হিমেল জোবায়দাকে ধরে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। জোবায়দা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই হিমেল ওর ঠোঁট জোড়া জোবায়দার ঠোঁটে ডুবিয়ে দিলো। এমনসময় হিমেলের ফোনটা বেজে উঠলো। দু,জনে তখন দু,জনের নেশায় ডুবে আছে। ফোনটা বেজে বেজে ক্লান্ত হয়ে একসময় থেমে যায়। আবারো ফোনট বেজে উঠলে প্রায় ৮/৯ মিনিট পর হিমেল জোবায়দাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
—-দেখো ভালোবাসায় কতো সুখ।
এরপর ফোনটা রিসিভ করে। হিমেলের বাবা ফোন দিয়েছে।
—-হ্যালো, বাবা ফোন দিয়েছো কেন?
—+বিয়ে মনে হয় বেটা তুমি একাই করেছো। পৌঁছে যে একটা ফোন দিতে হয় সে কথা কি ভুলে গেছো? বুড়ো বাবা,মায়ের তো চিন্তা হয়।
—-ফোন তো আমি দিতাম। তোমার তো তর সইলো না।
—-ঠিক আছে। টাইম টু টাইম ফোন দিও।
—-তোমাকে টাইমে টাইমে ফোন দিলে আমার আর হানিমুন করতে হবে না।
একথা বলেই হিমেল লাইনটা কেটে দিলো। হিমেল জোবায়দার দিকে তাকিয়ে দেখে, ও অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে ওর ভীষণ লজ্জা লাগছে। হিমেল পিছনদিক থেকে জোবায়দাকে জড়িয়ে ধরে। হিমেল আলতো করে জোবায়দার ঘাড়ে চুমু খায়। এরপর জোবায়দাকে ঘুরিয়ে নিজের বুকের কাছে নিয়ে আসে। তারপর মুখটা তুলে ধরে বলে,
—thanks.
—কারণটাতো বুঝলাম না।
—-আমাকে ভালোবাসার জন্য,
জোবায়দা হিমেলের লোমশ বুকে মুখটা লুকায়। আর মনে মনে বলে,” এ প্রহর যেন কখনও শেষ না হয়।”

সমাপ্ত।

তুমি আমার প্রণয়িনী পর্ব-০৭

0

#ধারাবাহিক গল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী

বিয়ের কেনাকাটা করতে গিয়ে জোবায়দার কতো পুরনো স্মৃতি মনে পড়ছে। হিমেল বলেছিলো, ওরা পাশাপাশি বসে কবুল বলবে। যদিও মেয়েদেরকে অন্দরমহলে কবুল পড়ানো হয় কিন্তু ওরা একসাথে কবুল বলবে। আর দু’জন দু’জনের অভিব্যক্তি লক্ষ করবে। অথচ নিয়তি আজ ওকে কোথায় টেনে এনেছে।
জোবায়দা এলিফ্যান্ট রোডে শেরওয়ানির দোকানগুলোতে এসেছে। হিমেলের জন্য শেরওয়ানি কিনতে হবে। মাপটা হিমেলের বাবা ফোন করে জোবায়দার মাকে জানিয়ে দিয়েছিলো। সাথে এও বলেছে যখন অনুষ্ঠান করে বউ তুলে নিবে তখন হিমেল আর আদিবাকে সাথে নিয়ে শপিং করবে। এখন যেহেতু আকদ হবে সেটা ঘরোয়াভাবে হোক। এটা হিমেলের ও ইচ্ছা। হিমেলের বাবা নিজের ইচ্ছাটাকে হিমেলের নাম বলে চালিয়ে দিলো। শেফালী বেগম জোবায়দার কাছে হিমেলের শেরওয়ানির মাপ, জুতোর মাপ, আংটির মাপ সব বুঝিয়ে দিলো। জোবায়দার একবার জানতে ইচ্ছে হয়েছিলো,ওর মা এই মাপগুলো কিভাবে পেলো। পরে আবার কি মনে করে জানতে চাইলো না।
অতএব শপিং করতে জোবায়দা একাই আসতে হলো। আদিবা আসতে চেয়েছিলো। ও ইচ্ছে করেই আনেনি। কারণ ও হয়তো বারবার নস্টালজিয়ায় ফিরে যাবে। সেটা আদিবার সামনে ঠিক হবে না। জোবায়দা জানে, হিমেলের পছন্দ কেমন? খুব গর্জিয়াস চাকচিক্য হিমেলের পছন্দ নয়। সাদামাটা নিটোল জিনিস হিমেলের খুব পছন্দ। তাই ক্রিমকালারের উপর হালকা জরিবুটি কাজ করা শেরওয়ানি ও হিমেলের জন্য পছন্দ করে। সোনার একটা আংটিও কিনে ফেলে। যদিও হিমেল ওকে একবার বলেছিলো, বাসর রাতে ও জোবায়দাকে ডায়মন্ডের আংটি পরিয়ে দিবে আর জোবায়দা যেন ওকে প্লাটিনামের আংটি পরিয়ে দেয়। এখন তো সে অবস্থা নেই। জোবায়দা ভাবে,কি অদ্ভূত ভাগ্য নিয়ে ও এই পৃথিবীতে এসেছে। সেই ছোটোবেলা থেকে মা ওকে বলতো মেয়ে হয়ে জন্মেছো সবার সাথে এডজাস্ট করতে শিখতে হবে। এডজাস্ট করতে করতে আজ ও নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে ছোটো বোনের বিয়ে দিয়ে নিজেকে এডজাস্ট করে নিয়েছে।

আজ আদিবার বিয়ের দিন। সকাল থেকে জোবায়দার অনেক ব্যস্ততা চলছে। এর মাঝে জোবায়দা বিয়ের সব কেনাকাটা কমপ্লিট করেছে। ও আগে থেকেই বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে, আজকের রাতের ট্রেনে ও চিটাগাং যাবে। বাড়ির সবাই প্রবল আপত্তি করেছে। তারপরও ওর এখানে থাকা আর সম্ভব নয়। নিজের ভালোবাসার মানুষকে যখন অন্যের হাতে তুলে দিতে হয় এযে কতো বড় কষ্ট এর ভিতর দিয়ে যে গিয়েছে সেই একমাত্র অনুভব করতে পারবে।
ওর চাকরি ক্ষেত্র রাঙ্গামাটি। চিটাগাং এ নামার সাথে সাথে হাসপাতালের মাইক্রোবাসে করে রাঙ্গামাটি রওয়ানা হবে। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হতে চললো। পারলার থেকে মেকাপ আর্টিস্ট চলে এসেছে। আদিবাকে সাজাতে শুরু করেছে। জোবায়দা ওর জন্য বানানো গয়নাগুলে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বললো,
—-এগুলো আদিবাকে পরিয়ে দাও।
গয়নার বাক্স হাতে নিয়ে শেফালী বেগমের চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে উনি ভালোই বুঝতে পারছেন, কি গভীর ক্ষত মেয়ে তার বুকে সযতনে লুকিয়ে রেখেছে। চোখের জল মুছে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-এগুলো তো তোর বাবা তোর জন্য বানিয়েছিলো। আদিবাকে দিতে গেলি কেন? তোর বিয়ের সময় আবার কোথা থেকে যোগাড় করবো।
—এ জীবনে আমি আর বিয়ে করছি না। আর তাছাড়া তোমার মেয়ে যদি খালি হাতে শ্বশুর বাড়ি যায় এতে কি তোমার সম্মান বাড়বে? এর থেকে এটাই ভালো। ওকে এই গয়নাগুলো পরিয়ে দাও।
পাশ থেকে স্বর্ণা খোঁচা মেরে বললো,
—-মা তো আমাকে কিছু দিলেন না। অবশ্য দিবেনই বা কোত্থেকে? মাথার উপর দু,দুটো ননদ থাকলে ভাইয়ের বউয়ের কপালে আর গয়না জোটে না।
শেফালী বেগম মনে মনে একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, নিজের জ্বালায় বাঁচি না। আর উনি এসেছেন দেনা পাওনার হিসেব মেলাতে। মা মেয়ের কথার মাঝখান থেকে ওকে সরাতে উনি স্বর্ণাকে বললেন,
—-দেওয়ার সময় তো পালিয়ে যাচ্ছে না। দেখ তো ওমর কোথায়?
যদিও শেফালী বেগম জানে ওমর কোনো কাজের না।তারপরও বোনের বিয়েতে খাবারের খরচটা দিতে চেয়েছে। এতেই উনি খুশী।স্বর্ণা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর শেফালী বেগম আদিবাকে ডেকে বললেন,
—-এই গয়নাগুলো অনেক যত্ন করে রাখিস। তোর বাবা আর বোনের অনেক কষ্টের টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে।
আদিবা গয়নার বাক্স খুলে গলার হারটা নেড়েচেড়ে বললো,
—-এরকম পাতলা ফিনফিনে হার গলায় জড়ালেই তো ছিঁড়ে যাবে। এ আর আমি কিভাবে যত্নে রাখবো?
জোবায়দা একটু রেগে গিয়ে বললো,
—-সোনার হিসাবে এই গয়নার হিসাব মেলাতে যাস না। এরসাথে বাবার ঘাম মেশানো রয়েছে।
—–অতশত বুঝি না। আমার বান্ধবীদের মধ্যে যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান চলেছে এক সপ্তাহ ধরে। ছেলেপক্ষ থেকে ডায়মন্ডের আংটি নাকফুল দিয়েছে। আর আমাকে পাতলা সোনার আংটি দিয়ে ওরা দায় সারলো। তুমি পাতলা একসেট গয়না দিয়ে তোমার দায় সারছো।
—-তোমার তাহলে আমার গর্ভে জন্ম না নিয়ে কোনো রানীর গর্ভে জন্ম নেওয়া উচিত ছিলো।
এমন সময় জাফর এসে জোবায়দাকে বললো,
—-আপু গেট কতো টাকা ধরবো?
—-জাফর, গেট ধরা নিয়ে বেশী ঝামেলা করিস না।
জোবায়দা ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-কেন মা, নিষেধ করছো কেন? ওরা একটু বন্ধুবান্ধব নিয়ে মজা করতে চাচ্ছে করুক না।
আদিবা রেগে গিয়ে জাফরকে বললো,
—-গেট সাজিয়েছিস যে গেটধরার টাকা চাইছিস?অত গেট ধরতে হবে না।
এমনসময় স্বর্ণা কোত্থেকে উদয় হয়ে বললো,
—কবুল না বলতেই বরের প্রতি এতো টান।
—-এখানে টানের কি দেখলে ভাবি? কথার পরে তোমার ফোঁড়ন না দিলে পেটের ভাত হজম হয় না,তাই না?
শেফালী বেগম ওদের দু’জনের কথায় বিরক্ত হয়ে স্বর্ণাকে বললো,
—খুব তো কথা জানো। বর কিভাবে বরণ করো সেটাই এবার দেখবো।
—আপু থাকতে আমি কেন বর বরণ করতে যাবো? ও–ও আপু তো আবার আইবুড়ো হয়ে বসে আছে। উনাকে দেখে নানাজনে হয়তো নানা কথা বলবে। ঠিক আছে আম্মা আমিই না হয় ছেলেকে বরণ করে ঘরে তুলবো।
আদিবা আর স্বর্ণার আচরণে জোবায়দার এখানে আর থাকতে ইচ্ছা হলো না। ও ওর মাকে বললো,
—-আমি ওদিকটায় গিয়ে দেখি। ওমর ঠিকঠাক মতো সব করছে কিনা।
এরমধ্যে ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে ফোন আসলো। জোবায়দা ফোনটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে বললো,
—-হ্যালো জোবায়দা ম্যাম বলছেন?
—হুম,
—-ম্যাম আমাদের পেমেন্ট তো পুরো বুঝে পাইনি। পেমেন্ট পুরো বুঝে না পেলে আমরা খাবার পাঠাই না।
—-আমি যতটুকু জানি পেমেন্ট তো সব ক্লিয়ার করার কথা।
—না ম্যাম,এখনও ক্লিয়ার করা হয়নি।
জোবায়দা ওমরকে ডেকে বললো,
—কিরে, তুই ক্যাটারিং সার্ভিসের সব বিল ক্লিয়ার করিসনি?
—-আমার যেটুকু সামর্থ আমি সেটুকু দিয়েছি।
—সেটা আমাকে জানাতে পারতি।
জোবায়দা ওর সাথে কথা না বলে ক্যাটারিং সার্ভিস সেন্টারে বিকাশের মাধ্যমে সব পেমেন্ট বুঝিয়ে দিলো।
ওদিকে ডেকোরেটরদের সব বিল পরিশোধ করা হলো। সব যখন শেষের পথে তখন ওর মামা, ফুফু এসে বললো,”ওদের কোনো হেল্প লাগবে কিনা।” আত্মীয়স্বজনের এরকম চেহারার সাথে অবশ্য ও আগে থেকেই পরিচিত। সব কিছু সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিয়ে নিজের রুমে এসে ব্যাগ গুছাতে লাগলো। পাশের রুমে ওর ফুফুর কথা জোবায়দা শুনতে পারছে।
—শোনো ভাবি, মন খারাপ করো না। জোবায়দা যেতে চাইছে যাক। ওমর ওর ছোটো হয়ে বিয়ে করে ফেললো। আবার তুমি এখন আদিবারও বিয়ে দিচ্ছো। লোকে ভাববে তোমার বড় মেয়ের হয়তো খুঁত আছে সেই কারনে বিয়ে হয়নি। নানাজনে নানা প্রশ্ন করবে। এর থেকে ওর চলে যাওয়াই ভালো।

জোবায়দা এসব কথা শুনে মনে মনে বললো,”আত্মীয়স্বজনের কথা হজম করতে করতে এখন বাইরের মানুষের কথা গায়ে বিঁধে না।” ওদিকে হিমেলদের আসার সময় হয়ে যাচ্ছে। ও আর দেরী না করে সবার কাছে বিদায় নিয়ে উবারে উঠে পড়লো। কিছুদূর যাওয়ার পর মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। আজ যেন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি ঝরছে। কালো মেঘের বুক চিরে বিদ্যুৎ এর ঝলকানি আর বজ্রপাতের কড়াৎ কড়াৎ শব্দে জোবায়দার একলা পথের যাত্রা শুরু হলো।

চলবে

তুমি আমার প্রণয়িনী পর্ব-০৬

0

#ধারাবাহিক গল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী

হঠাৎ শেফালী বেগমের চিৎকারে জোবায়দা চমকে উঠে। ও দৌড়ে বাবার ঘরে গিয়ে দেখে ওর মা শেফালী বেগম ওর বাবার কানের কাছে জোরে জোরে কলেমা পড়ছে আর চিৎকার করে বলছে,
—-তোর বাবা আর নেই। আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
জোবায়দা একথা শুনে ওর বাবার বুকে চাপ দিতে থাকলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দৌড়ে নিজের রুম থেকে প্রেসার আর পালসের মেশিনটা নিয়ে এসে মাপতে গিয়ে দেখে মেশিন আর কথা বলছে না। ও বিপর্যস্ত হয়ে ওর বাবার পাশে বসে পড়লো। আর মনে মনে বললো,”বাবা তুমিও আমায় ছেড়ে চলে গেলে। কেন চলে গেলে? বলনা আমি এখন কাকে নিয়ে থাকবো। কার স্বপ্ন পূরণ করবো। এখানে সবাই নিজের স্বার্থের কথা ভেবে চলে। আমারও আজ থেকে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা ফুরিয়ে গেল।”
আলতাফ সাহেবের মৃত্যুর কথা শুনে খবর পেয়ে রাতের বেলা ও বাড়ি থেকে হিমেল আর ওর বাবা মা জোবায়দাদের বাড়িতে আসে। হিমেলের ধারনা জোবায়দা কিছুই জানে না। কেননা হিমেল ওর বাবাকে জোবায়দাকে না জানিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে বলেছিলো। আর হিমেলের বাবা জমির মোল্লা প্যাঁচ কষে হিমেলের অজান্তে জোবায়দার পরিবর্তে আদিবাকে আংটি পরিয়ে দেয়। সেই কারনে হিমেল স্বাচ্ছন্দে এ বাড়িতে আসে। ওর ধারনা জোবায়দা কিছুই জানে না। আদিবাও হিমেল আর জোবায়দার কাহিনী জানতো না। তবে ওর এই বিষয়ে কোনো প্যারা নেই। ওর বিশ্বাস বিয়ে একবার হয়ে গেলে ও ছলে বলে কৌশলে হিমেলকে ওর আয়ত্বে আনতে পারবে। এখানে আসার পর থেকেই হিমেলের চোখ শুধু জোবায়দাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মেয়েটাকে ও কতোদিন দেখেনা। আচ্ছা ওর কি দেখতে ইচ্ছে হয় না। একটা সময়ছিলো দুজন দুজনকে না দেখে থাকতে পারতো না। তখন প্রেম কি জিনিস জোবায়দা ভালো করে বুঝতোও না। অথচ এখন ভালোবাসার মানে বুঝেও কিভাবে দূরে দূরে থাকতে পারে হিমেল বুঝে পায় না। বুকের গহীন থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

এদিকে জোবায়দা নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদছে। কারণ ও হিমেলের সামনে আর পড়তে চায় না। আজও হিমেলের গলারস্বর ওর হৃদয়কে আলোড়িত করে। কিন্ত সেই আলোড়িত অনুভবটা বড্ড প্রেমহীন। কষ্টের কন্টকে জর্জরিতো।চোখের কোল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। সে জল শোক আর অনুতাপে মাখামাখি।
জোবায়দার খোঁজে ওর রুমে এসে হিমেলের মা একসময় ওকে সান্তনা দিয়ে যায়। মেয়েটাকে দেখলে উনিও আবেগপ্রবন হয়ে উঠেন। এই মেয়েটাকে ছেলের বউ করার জন্য উনি কতোবছর ধরে স্বপ্নটাকে লালন করেছিলেন। অথচ উনি কি ভাবলেন আর বাস্তবে কি হলো।
এই সুযোগে আদিবা কয়েকবার হিমেলের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু হিমেল ওর সাথে তেমন কথা বলেনি। শুধু একবার ওকে ডেকে বলেছে,ও যেন জোবায়দার দিকে খেয়াল রাখে। এতে আদিবার অনেক অভিমান হয়। মনে মনে বলে,” বিয়েটা আগে হোক তখন বউ ফেলে জেঠুসের খবর রাখার মজাটা চিরদিনের মতো ঘুঁচে যাবে।”
আলতাফ সাহেবের শরীরে ঘা হওয়াতে খুব দ্রুতই দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। আত্মীয় স্বজন তেমন কেউ আসতে পারেনি। জোবায়দার একমাত্র ফুফু সাভারে থাকাতে উনি দ্রুত চলে আসতে পেরেছেন। জোবায়দার দুই মামা রংপুরে থাকে। উনাদের পক্ষে আসা সম্ভব হয়নি। লাশের গোসল শেষ করে কাফন পড়ানো শেষ হলে ফজরের আযান শুরু হয়। জানাযা পড়াতে মসজিদে লাশ নিয়ে যাওয়া হয়। লাশ নিয়ে ওমর আর জাফরের সাথে হিমেলও রওয়ানা দেয়। জানাযা পড়ানো শেষ হলে দাফন করানোর জন্য কবরস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। হিমেলের বাবা মাও বিদায় নিয়ে চলে যায়। জোবায়দাদের বাড়িওয়ালা এখানে থাকেন না। উনি গুলশানে থাকেন। উনিও আদিবার মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে চলে যায়।আর যাওয়ার সময় বলে যায় দুপুরের খাবারটা উনি পাঠিয়ে দিবেন।

এদিকে আদিবার বিয়ের বিষয়টা খুব কাছের আত্মীয়স্বজনরা জানে। আদিবার ফুফুর তো কথাবার্তার ছিড়ি নেই। তারউপর মনে মনে উনি আদিবাকে নিজের ছেলের বউ হিসাবে দেখে রেখেছেন। ছেলে উনার এইচএসসি পাশ। তাতে কি? বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করে। ওদের আছে স্বর্ণের দোকান। আদিবার ফুফুর কথা হচ্ছে জীবনে বেঁচে থাকতে গেলে টাকার দরকার। সেটা যখন আয়ত্বে থাকে তখন লেখাপড়ার পিছনে এতো সময় ব্যয় না করে ব্যবসার পিছনে ব্যয় করলে আখেরে লাভ বেশী হবে। উনি ভাবছেন বিয়েটা ভেস্তে দেওয়ার এই একটা সুযোগ। সে সুযোগটাই এখন উনি কাজে লাগাবেন।তাই শোকের বাড়িতে যেখানে তার ভাইয়ের জন্য মন খারাপ করা উচিত বরং সেটা না করে উনি
আদিবার বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে শেফালী বেগমকে বললেন,
—দেখো ভাবি, আমার মনে হচ্ছে তোমার মেয়ের সাথে ঐ ছেলের বিয়েটা শুভ নয়।
উনার কথার বিরুদ্ধে গিয়ে স্বর্ণা বলে,
—ফুফু এখানে শুভ অশুভের ব্যাপার কেন আসছে বুঝলাম না। উনার হায়াত শেষ উনি আল্লাহপাকের কাছে চলে গিয়েছেন। তাছাড়াও বাবা অসুস্থ ছিলেন। উনি কষ্ট পাচ্ছিলেন।
স্বর্ণা মনে মনে ভাবছে কোথায় ননদগুলোর তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়ার জন্য ও আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করছে আর উনি এসেছেন বাগড়া দিতে। বড় জনের তো বিয়ে নিয়ে কোনো হেলদোল নেই আর ছোটো টা যা রাজি হয়েছে আর এখন কানভাঙ্গানি দিতে একজন এসেছেন।
স্বর্ণাকে এভাবে কথা বলতে দেখে আদিবার ফুফুখুব বিরক্ত অনুভব করে। প্রসঙ্গ ঘোরাতে উনি স্বর্ণাকে বলেন,
—-,তোমার বাবা মা কেউ আসেননি?
—-না,মানে আমার এভাবে বিয়ে করাটা উনারা মেনে নিতে পারেননি। আর কেমন করে মানবে। লালবাগে আমার বাবার চারটা আড়ত আছে। সদরঘাটে দুইটা বড় দোকান আছে। সেই তুলনায় আপনার ভাতিজা কিংবা আমার শ্বশুরের তেমন কিছুই নেই।
—-তাহলে বিয়েটা করেছো কেন?
—-আপনাদের ছেলে আমাকে ভালোবাসে আর আমিও ওকে ভালোবাসি। আর আমি সেসব মেয়েদের মতো নই যারা বয়ফ্রেন্ডের সাথে লটরপটর করবে আবার বিয়ের কথা উঠলে পিছিয়ে যাবে।
এদিকে ওমর দাফনের কাজ শেষ করে ঘরে এসে এসব কথাবার্তা শুনে স্বর্ণা আর ওর ফুফুর উপর রেগে গিয়ে বললো,
—-কখন কোন কথা বলতে হয় সেটা মনে হয় আজকালকার মানুষ ভুলে গেছে।
এরপর শেফালী বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আপু,আদিবা আর জাফর কোথায়?
—-ওদের রুমে বসে আছে।
—-আম্মু তুমি আমার রুমে আসো। তোমার সাথে কথা আছে।

আসলে হিমেল কিছুদিনের জন্য এই বিয়েটা পিছিয়ে দিতে চায়। ও জানে, জোবায়দা ওর বাবার উপর খুব দুর্বল। বিয়ে পেছানোর কথা জানাতেই ওমর শেফালী বেগমকে নিজের রুমে ডেকে নেয়। ওমরের মুখে একথা শুনে শেফালী বেগমের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠে। না,জানি শেষপর্যন্ত বিয়েটা ভেঙ্গে যায়।এরপর শেফালী বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—তোমার চাকরির চেষ্টা কতদূর। বিয়ে করেছো এখন তো গায়ে বাতাস লাগিয়ে চললে হবে না। দায়িত্ব শুধু কাঁধে নিলে হবে না। সঠিকভাবে পালনও করে হবে।
—-বস বলেছে, সামনের মাসেই উনি আমার চাকরির ব্যবস্থা করবেন।
—-দেখো বাবা, ঐ সব নেতানেত্রীর হাতে পায়ে ধরে চাকরির চেষ্টা না করে নিজের যোগ্যতা দিয়েঅর্জন করা উচিত।
ছেলের উপর বিরক্ত হয়ে উনি একথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ওমরের উপর উনি একটু বিরক্ত। প্রাইভেটে পড়াশোনা করলো। কতোগুলো টাকা ওর পিছনে খরচ হলো। আজও নিজেকে প্রতিষ্টিত করতে পারলো না।
এদিকে আদিবার বিয়েটা তিনমাস পিছিয়ে গেল। এতে জোবায়দা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আর মনে মনে ভাবলো,ওদের বিয়ের দিন ও থাকবে না। সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে ও দূরে কোথাও চলে যাবে। জোবায়দার আজ সেই কবির কবিতাটার কথা মনে পড়ে গেল।
“বসন্ত নয় আমার দরজায় প্রথম কড়া নেড়েছিলো অবহেলা।
ভেবেছিলাম অনেকগুলো বর্ষা শেষে
শরতের উষ্ণতা মিশে এলো বুঝি বসন্ত
দরজা খুলে দেখি আমাকে ভালেবেসে এসেছে অবহেলা।”

চলবে

তুমি আমার প্রণয়িনী পর্ব-০৫

0

#ধারাবাহিক গল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী

আটচল্লিশ ঘন্টা ডিউটি সেরে ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন দেহে ঘরে ফিরে আসলো। ডোর বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো আদিবা। আদিবাকে এসময় ঘরে দেখে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে জোবায়দা ওকে বললো,
—-কিরে, তুই এসময় বাড়িতে?
—-হুম,আম্মু এখন কলেজ যেতে নিষেধ করেছে।
—-এভাবে ফাঁকি দিলে আর পড়াশোনা হবে না। তার থেকে বরং বিয়ে করে হাড়ি ঠেলার ব্যবস্থা কর। শুধু শুধু আমার টাকার শ্রাদ্ধ করবি না।
একথা বলে জোবায়দা ডাইনিং টেবিলের উপর ব্যাগটা রেখে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে বললো,
—-যে গরম পড়েছে, এতো পানি খাচ্ছি তারপরও মনে হচ্ছে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। সকাল দশটার মধ্যে সুর্যের তেজ এতো বেশী শরীরের কাপড় ঘামে ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। পানি সব ঘাম হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
এমনসময় শেফালী বেগম রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এসে জোবায়দার পাশে বসে বললো,
—-তোকে তো একটা কথা বলা হয়নি। আদিবার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি। ওমরটা যে কান্ড ঘটালো এইটা আবার কখন কি করে বসে তার কোনো ঠিক আছে? ভালো প্রস্তাব পেলাম। তাই হুট করেই ওর বিয়েটা ঠিক করে ফেললাম।
জোবায়দা ভীষণ অবাক হয়ে শেফালী বেগমকে বললো,
—এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলে আমাকে একবার বলার প্রয়োজন মনে করলে না? আর ছেলে সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ খবর নিয়েছো তো?
শেফালী বেগম কিছু বলার আগেই ওমরের বউ স্বর্ণা এসে বললো,
—-ছেলে তো আপনাদের পরিচিত। আপনার ভাইতে বললো, “ছেলে নাকি খুব ভালো।” আদিবার কপাল বটে! এমন ছেলে পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার।

জোবায়দা একটু নড়ে চড়ে বসলো। মায়ের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—মা,ও কার কথা বলছে?
শেফালী বেগম আমতা আমতা করে বললো,
—-হিমেল,
—মানে কি? হিমেল ভাই আদিবাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে?
স্বর্ণা জোবায়দাকে একটু খোঁচা মেরে বললো,
—-সবাই তো আর আইবুড়ো হয়ে বসে থাকতে চায় না। হিমেল ভাই নিশ্চয় রাজী হয়েছে। তা,না হলে উনার বাবা মা এসে আদিবাকে আংটি পড়িয়ে যাবে কেন? আর আমাদের আদিবাও তো রাজী।
জোবায়দা স্বর্ণার খোঁচাটা ভালোই বুঝতে পারলো। স্বর্ণা যে ওকেই আইবুড়ো বলেছে এটা জোবায়দা ভালোই বুঝতে পেরেছে। ও আদিবার দিকে একপলক তাকানো মাত্রই সামনে থেকে ও সরে গেল। জোবায়দা মনে মনে ভাবলো,
হিমেল ভাই এভাবে ওর উপর প্রতিশোধ নিলো। যাক ভালোই হয়েছে। মানুষ যাকে ভালোবাসে তার জন্য যুগযুগান্তর অপেক্ষা করতে পারে। অথচ হিমেলভাই ওর জন্য কটা বছর অপেক্ষা করতে পারলো না। না, ও আর তার কথা ভাববে না। যে তার হয়নি আসলে সে কোনোদিন তার ছিলো না। ভুল মানুষকে ভালোবেসে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে এই ঢের ভালো হয়েছে। আসলে সে হিমেলের মোহ ছিলো। যে করেই হোক তাকে ভুলে যেতে হবে। ওর বাবার স্বপ্ন পূরণে ও নিজেকে বিলিয়ে দিবে। ওকে অনেক বড় ডাক্তার হতে হবে। জোবায়দা মন থেকে এক হৃদয় কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ও টলতে টলতে নিজের রুমে গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে সবাইকে বললো,”কেউ যেন ওকে ডিস্টার্ব না করে। এদুদিন ওর ঘুম হয়নি। ও এখন ঘুমোবে। তারপর উপুড় হয়ে বিছানায় নিজেকে সঁপে দিলো। বুকের ভিতরে চাপা কান্নার ঢেউ উথলে উঠছে। না, ও কাঁদেনি। তবুও ফোঁটা ফোঁটা নোনা জল দু,চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। জোবায়দা ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো। চোখ দুটো জ্বালা করে উঠছে।

ওদিকে শেফালী বেগম মেয়ের মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছেন,ভিতরে ভিতরে মেয়েটা ভেঙ্গে চুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হচ্ছে। উনি কি পারতেন না জোবায়দার সাথে হিমেলের বিয়েটা দিতে? কিন্তু হিমেলের বাবাই তো জোবায়দার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখালো না। আবার হিমেলের মতো ভালো পাত্র উনার হাতছাড়া করতে ইচ্ছে হলো না। কিন্তু এখন আত্মদহনের অনলে উনি পুড়ছেন। বিছানায় শুয়ে আলতাফ সাহেব শেফালী বেগমের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। শেফালী বেগমও উনার দিকে তাকিয়ে ভাবছেন,ঐ মানুষটার আয়ু মনে হয় ফুরিয়ে আসছে। শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠে দুটো বেডশোর হয়েছে। দ্বিতীয়বার স্ট্রোক করার পর চলাচলের ক্ষমতাটা প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন। আদিবাটারও পড়াশোনায় মন নেই। ওমরটাতো বোনটার পাশে না থেকে বরং সাত সকালে বিয়ে করে সংসারের খরচা বাড়িয়ে দিলো। আর আদিবার ও চলা ফেরা খুব একটা সুবিধার নয়। সারাদিন সাজগোজ,আর বন্ধুদের সাথে হৈ হুল্লোড় করে বেড়ানোই যেন ওর প্রধান কাজ। জোবায়দার পায়ের নীচের মাটিটা শক্ত। সেই কারনে সে শক্ত মাটির উপর দাঁড়াতে শিখেছে। আর আদিবার তো নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। ওর তো অবলম্বন দরকার। সেই কারনে বিয়ে দিয়ে শেফালী বেগম দায় মুক্তি হতে চাইছেন।
জাফর এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে। উনি এবার জাফরের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিবেন। জাফরও যেন জোবায়দার মতো নিজেকে তৈরী করে নিতে পারে। উনিই বা আর কতোদিন বাঁচবেন? জোবায়দার ডাকে উনার ভাবনায় ছেদ পড়লো।
—-আম্মু খেতে দাও। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
—-তুই ডাকতে নিষেধ করেছিস বলে ডাকিনি। ক্ষুধা তো লাগারই কথা। বেলা তিনটা বাজে।
—+তুমি খেয়েছো?
—-তোকে ছাড়া আমি কিভাবে খাই?
—-চলো, খেয়ে নেই।
জোবায়দা বেগম মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। খেতে বসে জোবায়দা ওর মাকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-আদিবার বিয়ের কেনাকাটা তো করতে হবে।
—-হুম,তবে ওরা বলেছে, এক সপ্তাহ পর ওরা এসে আক্দ করাবে। তারপর সুযোগ মতো বৌ তুলে নিবে।
—-ঝামেলাটা একবারই মিটিয়ে ফেললে হতো না? আমাদের মতো টানাটানির সংসারে দুবার খরচ করার কোনো মানে হয় না।
—-মানে, আমি হিমেলের বাবাকে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লোকটা এমন ধড়িবাজ যে আমাকে কথা বলার সুযোগই দিলো না।
—-ঐ ধড়িবাজ লোকটা এখন তোমার বেয়াই হবে। সামলাতে পারবে তো? যাক বিয়ের পাকা কথা যখন দেওয়া হয়েছে শপিং আয়োজন সবই করতে হবে। আজ আর বেরোবো না। কাল আমার অফ ডে আছে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে কাজে নেমে পড়বো।

জোবায়দা ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-তোমার মুখটা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? শরীর ঠিক আছে তো? নিজের দিকে খেয়াল রেখো।বাবার সেবা যত্ন তো তোমাকেই করতে হয়।

—-এই যে সবার কথা এতো ভাবিস, নিজের কথা কবে ভাববি?
—-আমি তো সবসময় নিজের কথাই ভেবে চলেছি।
তোমরা কি আমার পর? আমার আত্মার অংশ। তোমাদের কথা ভাবা আর নিজের কথা ভাবা একই কথা।
আসরের আযান শোনা যায়। দিন ছোটো হয়ে আসছে। এখন ডিসেম্বর মাস। চারটার আগেই আসরের আযান পড়ে যায়। আযান শুনে জোবায়দা ওর মাকে বললো,
—-মা আমি নামাজ পড়ে নেই।
রুমে গিয়ে জোবায়দা আসরের নামাজটা আদায় করে আবারও নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দিলো। এমন সময় জাফর ঘরে ঢুকে জোবায়দার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আপু তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস?
আধো ঘুম আধো জাগরনে জোবায়দা বললো,
—-কিছু বলবি?
—-আমার কিছু টাকার দরকার। খাতা কলম কিনতে হবে।
ঘুম ঘুম চোখে জোবায়দা ওকে বললো,
—-ব্যাগ থেকে বের করে নিয়ে যা।
—-পাঁচশ টাকা নিয়ে গেলাম।
—-যা পারিস নিয়ে যা। আমাকে এখন একটু ঘুমাতে দে।
জাফর মনে মনে বেশ খুশী হলো। আপু যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন টাকা নেওয়ার এই একটা সুবিধা। ব্যাগ থেকে মনের মতো টাকা নেওয়া যায়। জেগে থাকলে তো একশত টাকার বেশী টাকা দিতে চায় না। কাল স্কুলে মন ভরে টিফিন খাওয়া যাবে।

মাগরিবের আযান শুরু হওয়াতে আদিবা এসে জোবায়দাকে ডেকে দিলো। ঘুম থেকে উঠে ওয়াশ রুমে গিয়ে ওজু করে মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিলো। ওর মাথাটা বেশ ভার হয়ে আছে। রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে চা বানাতে গিয়ে দেখে স্বর্ণা ওর নখে ডিজাইন করে নেইল পলিশ লাগাতে লাগাতে শেফালী বেগমকে বলছে,
—-মা, আমার মাথাটা ধরেছে। একটু চা হবে?
এই দৃশ্য দেখে জোবায়দার মাথার চাঁদিটা গরম হয়ে গেল। স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-পড়ালেখাটাতো ভালো করে শিখলে না তাই বলে কি আদব লেহাজও শেখোনি। নাকি তোমাদের বাড়িতে সেসবের চর্চা নেই।
—-আপু, আপনি আমাকে দেখলে এরকম তেঁতে উঠেন কেন? নাকি আপনার থেকে বয়সে ছোটো হয়ে দিব্যি স্বামীর সংসার করছি দেখে আপনার সহ্য হচ্ছে না। শুধু ডাক্তার ইন্জিনিয়ার হলেই হয় না, স্বামীর সংসার পেতে গেলেও মেয়েদের যোগ্যতা থাকতে হয়।

একথা বলে দুপদাপ করে স্বর্ণা নিজের ঘরে চলে গিয়ে সপাটে দরজা লাগিয়ে দিলো। জোবায়দাও অবাক বিস্ময়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-মা ও কি কথার কি উত্তর দিয়ে গেল। একমাত্র তোমার প্রশ্রয় পেয়ে ওর এতো সাহস বেড়েছে। অলস মস্তিস্ক শয়তানীর কারখানা। এ কথাটা মা তুমি ভুলে যেও না।
শেফালী বেগম খুব শীতল গলায় জোবায়দাকে বললেন,
—-তুই ঘরে গিয়ে বস। আমি আদিবাকে দিয়ে চা,টা পাঠিয়ে দিচ্ছে।
জোবায়দা ডানা ভাঙ্গা পাখির মতো আহত হয়ে নিজের রুমে চলে আসলো। লাইট অফ করে লাগোয়া বারান্দায় বসে ভাবলো,
“এই পৃথিবীটা ভীষণ কঠিন জায়গা। এখানে বেঁচে থাকতে গেলে প্রতিনিয়ত দেনা পাওনার হিসেব কষে চলতে হয়। হৃদয়ের কথা শোনা বা বোঝার মতো মানুষের দেখা মেলা ভার।”
—আপু, তোমার চা।
চা,টা নিতে গিয়ে চাঁদের আলোয় আদিবার আংটির উপর জোবায়দার দৃষ্টি পড়লো। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে চুমুক দিলো। একটু ঠান্ডা পড়েছে। গরম চায়ে চুমুক দেবার পর বেশ ওম ওম লাগছে। মনে হলো আদিবা দাঁড়িয়ে আছে। পিছন ফিরে তাকিয়ে বললো,
—-কিরে,কিছু বলবি?
—-তুমি তো আমার আংটিটা দেখলে না?
জোবায়দা মনে মনে বললো,”এই যে আর একজন এসেছেন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগিয়ে দিতে।”
—-পরে দেখবো। তুই এখন যা।
আদিবা চলে যাবার পর কেন যেন জোবায়দার চোখদুটো নোনা জলে ভরে গেল। জোবায়দার বুকের গহীনে থাকা কিছু অবিশ্বাস আর কিছু চাপা দীর্ঘশ্বাসের স্বাক্ষী হলো ঐ আকাশের চাঁদ। পাশে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারু গাছটায় টুপটাপ ঝড়ে পড়া শিশিরের শব্দ জোবায়দা শুনতে পারছে। ওর মনে হলো অন্য গ্রহে বাস করা হয়তো কোনো অভিমানী প্রেয়সীর কান্না মাটির পৃথিবীতে ঝরছে।
জোবায়দা অনুভব করছে, ওর বুকে আজ নেই কোনো প্রণয়ের ঢেউ। সেখানে রয়েছে শুধু তপ্ত মরুভুমি।

চলবে

তুমি আমার প্রণয়িনী পর্ব-০৪

0

#ধারাবাহিক গল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

নিজ ঘরে পরবাসী হয়ে থাকতে কার ভালো লাগে? ঘরের শান্তি বড় শান্তি। জোবায়দাও ঘরের এই শান্তির কাছে হার মেনে ওমরের বায়না মেনে নিলো। ও আরো একটা কোচিং এর ব্যাচ চালু করলো। জোবায়দার এই সিদ্ধান্তে মা শেফালী বেগম ভীষণ খুশী হলেন। সংসারের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে আসাতে উনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আসলে স্বামী আলতাফ সাহেব হঠাৎ অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হওয়াতে পানির মত টাকা খরচ হয়ে যাওয়াতে উনি কপর্দক শুন্য হয়ে পড়েন। যদিও ঘরের কর্তা ব্যক্তিটি পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে সংসারের হালটা আর ধরতে পারলেন না।
এদিকে এতোবড় সংসার চালাতে গিয়ে শেফালী বেগম জীবন সমুদ্রের অথৈ জলে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলেন। তখন তার এই বিশ বছরের কন্যাটি এসে তার হাত ধরে পাশে দাঁড়ায়। মনে মনে তার এই সন্তানটির মঙ্গল কামনায় আল্লাহপাকের কাছে তিনি সর্বদা প্রার্থনা করেন।

এর মাঝে পদ্মা মেঘনা যমুনা দিয়ে বহু পানি প্রবাহিত হয়ে গেছে। জোবায়দার জীবন নদী দিয়েও অনেক স্রােত বয়ে চলেছে। একদিকে ডাক্তারী পড়া অন্যদিকে ছুটির দিনগুলোতে কোচিং এর ব্যাচ পড়িয়ে সংসারের চাকাটা সচল রাখার জন্য জোবায়দা রাতদিন এক করে খেটে চলেছে। আর এদিকে ওমর প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পাংখা মেলে উড়ছে। জোবায়দা আর ওমর পিঠাপিঠি ভাইবোন হওয়াতে ওমরকে জোবায়দা বেশ ভালো করেই চিনে। হাজার তৈল মর্দন করলেও কুত্তার লেজ কখনও সোজা হয়না এই কথাটি ওমরের ক্ষেত্রে শতভাগ প্রযোজ্য।

জোবায়দার সামনে ফাইনাল প্রফ শুরু হবে। কিছুদিন ছুটি থাকায় বাড়িতে এসে জোরশে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি কোচিং ও সমানতালে চালাচ্ছে। এরমাঝে ওমর একদিন হুট করে কাউকে কিছু না বলে ওর সহপাঠি স্বর্ণাকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। ওমরের এই সিদ্ধান্তে জোবায়দা ভীষণ রেগে গিয়ে বলে,
—কোন সাহসে তুই এই কাজটা করলি? বউকে কি খাওয়াবি সেটা একবার ভেবে দেখেছিস?
—আর একবছর পরে আমি পাশ করে বের হয়ে যাবো। তখন চাকরি পেলে আর কোনো সমস্যা হবে না।
—-তোমার রেজাল্টের যা অবস্থা আদৌ কপালে চাকরি জুটবে তো?
—-তুমি নিজে ছাত্রী ভালো বলে আমার বউয়ের সামনে আমাকে অপমান করতে পারো না।
—-তোমার মান অপমান বোধ আছে?
কিন্তু ওমর জোবায়দার কথার গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো ওর মা শেফালী বেগমকে থ্রেট দিয়ে বলে,
—-আম্মু তুমি যদি ছেলে হাতছাড়া করতে না চাও তাহলে স্বর্ণাকে বরণ করে ঘরে তুলে নাও। নয়ত আমি ওর হাত ধরে চিরতরে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। ভেবে দেখো আমি কিন্তু তোমার উপকার করেছি। কষ্ট করে তোমার আর বউ খুঁজতে হলো না।
মায়ের সাথে এভাবে নির্লজ্জের মতো কথপোকথনে ওমরের সাথে জোবায়দার আর কথা বলতে রুচি হলো না। নিজের রুমে গিয়ে সপাটে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। একটু পরে আদিবা এসে বললো,
—-আপু,দরজাটা খোলো। আম্মু বলেছে ভাইয়ার বাসর এ ঘরে হবে।
—-কেন ওমর আর জাফরের রুমে বাসর সাজানোর ব্যবস্থা কর। আমি এখন এরুম ছাড়তে পারবো না।
—-ঐ রুমের খাটটা ভাঙ্গা। তাই এই রুমে খাটটা আম্মু সাজাতে বলেছে।
অগত্যা জোবায়দা ওর বইপুস্তক নিয়ে ঐ ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। এদিকে আলতাফ সাহেবের শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগলো। ওমরের এভাবে বিয়ে করে আনাটা উনিও হয়তো মেনে নিতে পারেননি। স্ট্রোকের পর উনার গলা দিয়ে তেমন সাউন্ড বের হয় না। নিরবে পরিবারের এসব কাহিনী দেখে গেলেন।রাতে উনার প্রেসার অনেক হাই হয়ে গেল। জোবায়দা ওর বাবার প্রেসার মেপে দেখে সিস্টোলিক ১৮০ আর ডায়াস্টোলিক ১১০। ও আর অপেক্ষা না করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আলতাফ সাহেবকে বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে ওর এক পরিচিত ডাক্তারের সহায়তায় হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে । তবে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়াতে ওর বাবা এবার বড় ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায়। জোবায়দা অবশ্য এতেই খুশী। মানুষটা বেঁচে তো আছে! একটা মেয়ের মাথার উপর বাবার ছায়া থাকাটা জরুরী। এটা জোবায়দা ভালোই বুঝতে পারে। এক সপ্তাহ হাসপাতালে থেকে জোবায়দা বাবাকে নিয়ে বাড়ী ফিরে আসে। এর দু,দিন পর জোবায়দার ফাইনাল প্রফ শুরু হয়। সব ঝড়ঝাপ্টা পেরিয়ে অবশেষে জোবায়দার প্রফ শেষ হয়। ভালোভাবে ডাক্তারী পাশ করে জোবায়দা ইন্টানী ডাক্তার হিসাবে ময়মনসিংহ মেডিকেলে জয়েন করে। মেয়ের সাফল্যে শেফালী বেগম খুশী হলেও মনে মনে ওমরের উপর বিরক্ত হন। উনি আশা করেছিলেন,উনার আদরের ওমর একদিন এই সংসারের হাল ধরবে। অথচ ওমরের সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। বরং বিয়ে করে নিয়ে এসে এই সংসারে আর একজন খাওয়ার লোক বাড়িয়ে ফেললো। এই কয়দিনে উনি যতটুকু বুঝেছেন, ছেলের বউটা তার মোটেই সুবিধার হয়নি। সারাদিন রুমে দরজা বন্ধ করে মোবাইলে কি যেন টিকটক করে। যদিও এসব বিষয়ে শেফালী বেগমের খুব একটা জ্ঞান নেই। মেয়েটার একদম চোখের চামড়া নেই। শেফালী বেগম সারাদিন সংসারের পিছনে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাঁটছেন অথচ বৌটা এসে একটুও কাজে হাত লাগায় না। পরের মেয়ের কথা বলে কি হবে। নিজের মেয়ে আদিবাটাও কম যায় না। সারাদিন নিজের রুপচর্চা নিয়ে থাকে। কলেজে উঠে যেন সাপের পাঁচপা দেখাচ্ছে। অথচ এসএসসি তে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে টেনেটুনে জিপিএ 4, পেয়েছে।
এরমাঝে হিমেল বিসিএস দিয়ে স্বাস্থ্য ক্যাডারে জয়েন করে। বাসায় ওর মা বাবাকে জোবায়দাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠানোর ব্যাপারে রাজী করায়। প্রথমে অবশ্য হিমেলের বাবা প্রস্তাব পাঠানোর ব্যাপারে রাজী হতে চায় না। কিন্তু হিমেল উনাকে বলে যদি প্রস্তাব না পাঠায় তাহলে ও বিদেশে চলে যাবে। দেশে আর ব্যাক করবে না। ছেলেকে হাতে রাখার জন্য জমির মোল্লা রাজী হয়।যদিও হিমেল জোবায়দাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে কিছু জানায় না। কিন্তু এখানে হিমেলের বাবা জমির মোল্লা একটা কূট চাল দেয়। কেননা হিমেল নতুন করে কনে দেখতে যেতে চায় না। একবারই বিয়ের আসরে বর সেজে গিয়ে জোবায়দাকে অবাক করে দিবে। নিজের আকাঙ্খিতো প্রেয়সীকে দুচোখ ভরে দেখার অপেক্ষায় হিমেল দিন গুনতে থাকে। মনের গোপন কোনায় জমিয়ে রাখা ভালোবাসার ফুটন্ত শতদলগুলো জোবায়দার হাতে তুলে দিয়ে প্রণয়ের চাদরে ওকে জড়িয়ে নেওয়ার স্বপ্নে হিমেল সেই কবে থেকে বিভোর হয়ে আছে। ও ভাবছে শীঘ্রই ওর অপেক্ষার অবসান হবে।

কিন্তু নিয়তির নিঠুর খেলায় জোবায়দা আর হিমেল দুই ভুবনের বাসিন্দা রয়ে গেল। জোবায়দার আটচল্লিশ ঘন্টা ডিউটি পড়েছে। এরমাঝে জমির মোল্লার কূটচাল অনুযায়ী উনারা জোবায়দাদের বাড়িতে এসে আদিবাকে আংটি পড়িয়ে দিলো। কারণ বেশী বুদ্ধীমতি মেয়েদের জমির মোল্লা পছন্দ করেন না। এদের বশে আনা মুশকিল। জোবায়দার তুলনায় আদিবার বুদ্ধির ধার বেশ কম। দেখতেও আদিবা জোবায়দার থেকে একটু বেশী সুন্দরী। জমির মোল্লার ধারনা বিয়ে হয়ে গেলে হিমেল আর বেশিদিন আদিবার থেকে দূরে থাকতে পারবে না। হাজারও হোক পুরুষ মানুষ বলে কথা। নিজের বউকে আর কতদিন দূরে সরিয়ে রাখবে।যদিও হিমেলের মা জোবায়দাকে বেশী পছন্দ করেন। কিন্তু হিমেলের বাবা রাজী না দেখে উনিও আর জোর করেননি। এই পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করার উনার খুব ইচ্ছে ছিলো। জোবায়দার পরিবর্তে আদিবাকে বউ করে আনতে জমির মোল্লা রাজী হয়েছে এতেই উনি খুব খুশী। আর ওদিকে জোবায়দার মা শেফালী বেগমও মনে মনে খুশী। কারণ এই মুহুর্তে উনিও জোবায়দাকে বিয়ে দিতে চান না। জোবায়দা ছাড়া উনার সংসারের হাল ধরার কেউ নেই। আলতাফ সাহেবের ওষুধের পিছনে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। ওমরের ফাইনাল পরীক্ষা কেবল শেষ হয়েছে। কবে চাকরি পাবে কে জানে। উনার ভয় হয় জোবায়দা বিয়ের পর যদি আর খরচ চালাতে না পারে তাহলে উনি কিভাবে এই সংসার সামলাবেন? তবে ওমরের চাকরি হলে উনি জোবায়দার বিয়ের ব্যাপারে তোড়জোড় শুরু করবেন। তাইবলে হিমেলের মতো ভালো পাত্রকে তো আর হাতছাড়া করা যায় না। আর উনিও দুটো মেয়ের মধ্যে একটা মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা হওয়াতে কন্যাদায় হতে কিছুটা মুক্ত হলেন। সবার স্বার্থবাদী চিন্তায় দুটো হৃদয় যে ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল এবিষয়টা একবারের জন্য কেউ ভাবলো না। মানুষের জীবন আসলেই বড় অদ্ভূত।

চলবে

তুমি আমার প্রণয়িনী পর্ব-০৩

0

#ধারাবাহিক গল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী

বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে ওর ছোটো মামা এসেছিলো। জোবায়দার মেডিকেলে চান্স পাওয়ার কথা শুনে ওর মাকে বললো,
—-মেয়েকে অতদূরে পাঠাসনে আপু। কি হবে ডাক্তারী পড়ে? কত এমবিবিএস ডাক্তার ডিসপেন্সারী গুলোতে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। কোনো রোগী তো ওদের কাছে আসে না। এর থেকে ঢাকা ভার্সিটিতে ভালো করে ভর্তি পরীক্ষা দিতে বল। এখানে চান্স হয়ে গেলে ঢাকার বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করার কি দরকার?
জোবায়দার সেদিন ওর মামার উপর খুব রাগ হয়েছিলো। কত কষ্ট করে দিনরাত এককরে পড়াশোনা করে ও সরকারী মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। কোথায় আরো এপ্রিসিয়েট করবে। অথচ সেটা না করে সমানে নেগেটিভ কথা বলে যাচ্ছে। আর ওর ফুফু তো আরএক কাঠি উপরে। ওর বাবাকে দেখতে এসে জোবায়দাকে দু,কথা শুনিয়ে গেল। বলে কিনা ওর বাপের রক্ত পানি করা পয়সা ও নাকি পানিতে ফেলেছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ একটা কলেজ হলো নাকি? ঢাকা মেডিকেলে তো চান্স পেলো না। সুতরাং ডাক্তারী পড়ে কোনো লাভ নেই। অন্য মেডিকেলে পড়াশোনা করলে নাকি ডাক্তার না কসাই হয়ে বের হতে হবে। একমাত্র ঢাকা মেডিকেলেই নাকি ডাক্তার হওয়ার জন্য ভালো পড়াশোনা হয়।
এছাড়াও ওর মাকে উপযাচক হয়ে ওর ফুফু বললো,
—-শোনো ভাবি,একটা কথা বলি। তুমি আবার অন্য কিছু ভেবে বসো না। জোবায়দা দেখতে বেশ সুন্দর। বয়সও কম আছে। তুমি বরং একটা ভালো অবস্থাপন্ন ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও। এতে তোমার মেয়েরও একটা গতি হবে আর তোমার সংসারটার দেখভালও ঐ ছেলে করবে। যদি বলতো আমার হাতে একটা ছেলে আছে। ওদের তিনটে চালের আড়ত আছে। সাভার বাজারে দুটো বড় দোকান আছে। ইটের একটা ভাটা আছে। তোমার মেয়ে সারাজীবন বসে খেলেও ঐ সম্পদ ফুরোবে না। কি হবে বলো ডাক্তার ইন্জিনিয়ার হয়ে? জন্মেছে তো মেয়েমানুষ হয়ে। সেইতো দিনশেষে হাড়ি ঠেলতে হবে।
যদিও ওর মা একটু দোটানায় ছিলো। কিন্তু জোবায়দা ওর মাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। ও এখন বিয়ে শাদি করবে না।
বিপদে পড়লে আত্মীয়স্বজনের চেহারাটা ভালো করে চেনা যায়। অথচ ওর বাবার একটাই বোন। সুস্থ থাকা অবস্থায় আলতাফ সাহেব বোনকে সবসময় চোখে হারাতো। ফলের সিজনে ঝুড়ি ভর্তি করে ফল বেনের বাড়িতে পাঠাতো। ঈদের সময় নতুন কাপড় পাঠিয়ে দিতো। কুরবানী ঈদে মাংস পাঠিয়ে দিতো। জোবায়দার ফুফুর শ্বশুরবাড়ির অবস্থাও বেশ ভালো। সাভার বাজারে ওদের দুটো সোনার দোকান আছে। তারপরও বোনের মুখটা উঁচু রাখার জন্য আলতাফ সাহেব নিজের দায়িত্বটুকু সুচারুরুপে পালন করতো। অথচ ওর বাবার এতোবড় একটা চিকিৎসার ধাক্কা গেল সেখানে দুপয়সা দিয়ে ওর ফুফু একটু সাহায্য করলো না।
অনেক রাত হলো। বেশ গুমোট গরম পড়েছে। ও উঠতে যাবে এমন সময় মনে হলো কেউ ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এযে হিমেল ছাড়া কেউ নয় তা জোবায়দা ভালোই বুঝতে পারছে। হিমেল যে পারফিউম ব্যবহার করে সেই সুবাসটা জোবায়দার ভালোই পরিচিত। কিন্তু ও যতটুকু জানে হিমেলের তো আজ হলে থাকার কথা। কারণ ওর তো পরীক্ষা চলছে। কিন্তু জোবায়দার পিছন ঘুরে দেখার সাহস হলো না। ও দ্রুত ছাদ থেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই হিমেল বলে উঠলো,
—-একটু দাঁড়া,তোর সাথে কথা আছে।
—-আমার সাথে তো আপনার কোনো কথা থাকতে পারে না।
—–কেন এমন অবুঝের মতো আচরণ করছিস?
আসলে এছাড়া যে জোবায়দার আর কোনো রাস্তা খোলা নাই। ওর কাঁধে যে অনেক দায়িত্ব। ও কিভাবে এই দায়িত্বকে অস্বীকার করে শুধু নিজের সুখের কথা ভাববে? মাঝে মাঝে মানুষের হাতে কিছু করার থাকে না। তখন সময়ের উপর সব ছেড়ে দিতে হয়। যদিও হিমেলের কাছ থেকে সরে যেতে জেবায়দার বুকটা ব্যথায় টনটন করছে। অন্ধকারে ওর দুচোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। কোনোরকমে নিজের গলার স্বরটা পরিস্কার করে বললো,
—-আমাকে আপনি যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন ততই আমাদের দু’জনের জন্য মঙ্গল হবে।
—তুই কি পারবি আমাকে ভুলে যেতে? আর বারবার আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে তুই খুব আনন্দ উপভোগ করিস তাই না? আর আমিও বোকার মতো মরীচিকার পিছনে ছুটে চলেছি।

জোবায়দাকে নিরব দেখে হিমেল আবারও বলে উঠে,
—–আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনও পাইনি।
—-এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আম্মু ডাকছে। আমাকে যেতে হবে।
জোবায়দা হিমেলকে আর কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে দ্রুত নীচে চলে গেল। এছাড়াও হিমেলের বাবার এভাবে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়াতে জোবায়দার আত্মসম্মানে খুব আঘাত লেগেছে।
জোবায়দা চলে যাবার পর মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। সেই বৃষ্টির জলে হিমেলের চোখের জল মিলে মিশে একাকার হলো।
দু,দিন পরেই জোবায়দারা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। তাই হিমেল আর হলে বসে থাকতে পারলো না। বাড়িতে চলে এসেছে। হিমেলের মায়েরও খুব মন খারাপ। তবে হিমেলের বাবা খুব খুশী। হিমেল যে জোবায়দাকে পছন্দ করে সেটা উনি ভালোই বুঝতে পারেন। কারণ হিমেলের মতো বয়স একদিন উনারও ছিলো। উনি চান না জোবায়দা বউ হয়ে এ বাড়িতে আসুক। উনার ধারনা জোবায়দাকে যে ছেলে বিয়ে করবে তার ঘাড়েই ওদের পরিবারের পুরো দায়িত্ব চেপে বসবে।

বাড়ী শিফটের দিন জোবায়দা ওর অসুস্থ বাবাকে নিয়ে বেশ সকালেই নতুন ভাড়া বাড়ীতে উঠে যায়। আগের দিন বাসার সব মালপত্র গুছিয়ে বেধে রাখে। ওমর আর জাফরের উপর সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে ও চলে যায়। আসলে ও আর হিমেলের মুখোমুখি হতে চায় না।
জোবায়দা নতুন ভাড়া বাড়িতে উঠে গিয়ে সবার আগে মিস্ত্রী ডেকে চুলাটা লাগিয়ে নেয়। এরপর একচুলায় ভাত আর একচুলায় ডাল বসিয়ে দেয়। ভাত আর ডাল হয়ে গেলে ডিম ভুনা করে নেয়। এরমাঝে আলতাফ সাহেবকে ভাত খাইয়ে দিয়ে ওষুধ ও খাইয়ে দেয়। ওদিকে সমস্ত মালপত্র নিয়ে দুটো ভ্যানে করে দুপুরের মধ্যে ওমর নতুন বাসায় উঠে যায়। আসলে তাজমহল রোড থেকে শিয়া মসজিদ খুব একটা দূর না হওয়াতে বাসা বদলানোর কাজ দ্রুতই সেরে ফেলা গেলো। জাফর আদিবা আর জোবায়দা মিলে সন্ধার আগেই পুরো ঘর গুছিয়ে ফেলে।

শুরু হলো জোবায়দার নতুন জীবন। প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে বাড়িতে চলে আসে। শুক্র শনি দুদিন সারাদিন বাড়িতে তিনটে কোচিং এর ব্যাচ পড়ায়। যারফলে আলতাফ সাহেবের পেনশন আর জোবায়দার কোচিং এর টাকা দিয়ে শেফালী বেগম কোনো রকমে সংসারটা চালিয়ে নেয়। তবে আলতাফ সাহেব অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকাতে ওমর আস্তে আস্তে বখে যেতে থাকে। জিপিএ ৩.৫ পেয়ে এইচএসসি পাশ করে। যারফলে কোনো সরকারী ভার্সিটিতে ও চান্স পায় না। অতঃপর ও মা শেফালী বেগমের কাছে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির বায়না ধরে। কিন্তু জোবায়দা বেঁকে বসে। ওর কথা হচ্ছে প্রাইভেটে পড়ার মতো অবস্থা ওদের নেই। তাই ওকে ঢাকা কলেজে ভর্তির চেষ্টা করতে বলে। কিন্তু ওমর ওর মায়ের কাছে গিয়ে বলে,
—–তোমার বড় মেয়েকে তো ডাক্তার বানিয়ে ওর জীবনটা গুছিয়ে দিলে। আর আজ তোমার মেয়ে আমাকে ইন্জিনিয়ারিং পড়ার খরচ দিতে রাজী হচ্ছে না। দেখলে তোমার মেয়ে কতো স্বার্থপর!

ওমরের এই কথাটা শেফালী বেগম মাথায় নেয়। জোবায়দা ছুটিতে বাড়ী আসলে ওকে বলে,
—-তোর বাবা তোকে কতো কষ্ট করে ডাক্তারী পড়ানোর ব্যবস্থা করলো। অথচ তুই আজ ওমরের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলি না। স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেরটাই ভাবলি।
মায়ের এই কথায় জোবায়দা ভীষণ কষ্ট পেলো। পাঁচদিন একটানা ক্লাস করে এমনিতেই ও হাঁপিয়ে উঠে। তারপর ছুটির দিনগুলোতে রেস্ট না নিয়ে কোচিং এর ব্যচ পড়ায়। তারপর ও আজ ওকে শুনতে হলো, “ও স্বার্থপর।”
মাকে ও কি করে বোঝাবে ও যে দিনরাত এককরে পড়াশোনা করে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। এখানে পড়া শুরু করার পর ওর বাবা মায়ের একটা কানা পয়সা ওর পিছনে খরচ হয়নি। অথচ প্রাইভেটে ইন্জিনিয়ারিং পড়াতে গেলে কম করে হলেও ছয় সাত লক্ষ টাকা খরচ হবে। ও কি করে এতো টাকা ম্যানেজ করবে। আর ও রাজী হচ্ছে না বলে মা ওর সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। ওমরও কথা বলে না। শুধু সেদিন রুমে একলা বসে প নিরবে চোখের জল ফেলছিলো। তখন বাবা আলতাফ সাহেব লাঠিতে ভর দিয়ে ওর পাশে এসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ওর খুব ইচ্ছা হয় বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে। কিন্তু বাবার সুস্থতার কথা ভেবে নিজেকে সামলে নেয়।

চলবে

তুমি আমার প্রণয়িনী পর্ব-০২

0

#ধারাবাহিক গল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

এতে জোবায়দার রাগের পারদ বাড়তে থাকে। সেদিন বাসায় ফিরে এসে ও ছাদে হিমেলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কারন হিমেল প্রতি সন্ধারাতে ছাদে থাকা ফুলের গাছগুলোতে পানি দেয়। সেদিন ছিলো আষাঢ়ের ভরা পূর্ণিমা। হিমেল ছাদে আসা মাত্রই জোবায়দা রেগে গিয়ে বলে,
—-আপনার বন্ধুদের নিষেধ করবেন আমারসাথে যেন এ ধরনের ঠাট্টা মশকরা আর কোনোদিন না করে?
হিমেল জোবায়দার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। চাঁদের আলো ওর মুখের উপর পড়েছে। এমনিতেই জোবায়দা দেখতে বেশ সুন্দরী। তারউপর ভরা যৌবনা চাঁদের আলো ওর মুখের উপর পরতেই মেয়েটাকে ভীষণ মায়াময় লাগছে। সেদিকে তাকিয়ে হিমেল ভাবছে,রাগলেও একটা মেয়েকে যে এতো সুন্দর লাগে তা জোবায়দাকে না দেখলে ওর জানা হতো না। জোবায়দা হিমেলের দিকে তাকিয়ে বলে,
—এভাবে ক্যাবলার মতো তাকিয়ে কি দেখছেন? আমার কথার জবাব দিন।

ওর রাগের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হিমেল কোনো উত্তর না দিয়ে ওর উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফুলগাছগুলোতে আপনমনে পানি ঢালতে লাগলো। জোবায়দা এবার সত্যি রেগে যায়। কাছে এসে বলে,
—-যতটুকু জানি আপনি তো ঠসা নন। আমার কথাগুলো ভালোই শুনতে পেয়েছেন।
—হুম,তো এখন কি করবো?
—-বন্ধুদের নিষেধ করবেন।
একথা বলে জোবায়দা চলে যাওয়ার জন্য উদ্যেগ নিতেই হিমেল ওর হাতটা টেনে ধরলো। জোবায়দা ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পালাতে গেলেই হিমেল ওর পথ আগলে দাঁড়ায়। জোবায়দা একসময় পিছু হটতে থাকে। তারপর ছাদের দেয়ালের কাছে সেঁটে দাঁড়ায়। হিমেলও দুহাত দেওয়ালের উপর চেপে ধরে। তারপর নিজের মুখটা জোবায়দার মুখের কাছে এনে বলে,
—-আমার বউ হতে তোর এতো আপত্তি কেন? ছোটো বেলায় যখন কেউ ভাবী বলে ডাকতো তখন তো মুচকি মুচকি হাসতি। এখন আবার কি হলো?
—-তখন আমি ছোটো ছিলাম। তাছাড়াও এসব কথার মানে পরিপূর্ণ বুঝতাম না।
—এখন কি বড় হয়ে গিয়েছিস? তা অবশ্য ঠিক। তখন তো গায়ে ওড়না দিতি না। এখন আবার আপাদমস্তক দোপাট্টায় নিজেকে জড়িয়ে রাখিস। ইস,তোর দোপাট্টাগুলোকে দেখলে আমার খুব হিংসে হয়। ওভাবে যদি একটু আমায় জড়িয়ে নি_তিস
হিমেলের কথা শেষ হওয়ার আগেই জোবায়দা ওর হাত দুটোকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে বলে,
—-আপনার মুখে না কিছুই আটকায় না।
সেই থেকে জোবায়দাও হিমেলকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এরমাঝে হিমেল গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে এইচএসসি পাশ করে ঢাকা মেডিকেলে চান্স পায়। পাশাপাশি দুই পরিবারের সখ্যতাও বাড়তে থাকে। যদিও হিমেলের বাবা একটু বিরক্ত হতো। বিশেষ করে হিমেলের মায়ের আদিখ্যেতা দেখে। হিমেলের বাবা জমির মোল্লা খুব হিসেবী মানুষ। যখন তখন জোবায়দাদের বাসায় হিমেলের মায়ের খাবার পাঠানো উনি খুব একটা পছন্দ করতেন না। কিন্তু হিমেলের মা জোৎস্না বেগম জমির মোল্লার এসব বিষয়ে পাত্তা দিতেন না। তবে সমস্যাটা শুরু হলো জোবায়দার বাবা অবসরে যাওয়ার পর। জমির মোল্লা লক্ষ্য করে জোবায়দা মেডিকেলে চান্স পাওয়াতে হিমেল আর ওর মা খুব খুশী হয়। মা ছেলের এমন খুশী দেখে জমির মোল্লার বিরক্ত অনুভব হয়। আর এদিকে ছেলের মন বুঝতে পেরে জোৎস্না বেগম জোবায়দাকে বউ করার জন্য মনস্থির করে। কথাটা জমির মোল্লার কানে তুলতে উনি রেগে গিয়ে বলেন,”উনার ছেলের এখনও বিয়ের বয়স হয়নি।” যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে হিমেলও জোবায়দাকে এখনও প্রপোজ করেনি।

তবে জোবায়দার বাবা আলতাফ সাহেব অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হওয়াতে জমির মোল্লা স্ত্রীর এই প্রস্তাবে বাধ সাধে। উনার কথা হচ্ছে এতোদিন আইসিইউতে থেকে আলতাফ সাহেবের সবটাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন ঐ পরিবারের সাথে সম্পর্ক করা মানে উলুবনে মুক্ত ছড়ানো। সারাজীবন ধরে ঐ পরিবারকে টানতে হবে। এভাবে পরের বোঝা কাঁধে তোলার জন্য উনি কষ্ট করে ছেলে মানুষ করেননি। বরং উনি জেবায়দার জন্য ছেলে খুঁজে দিয়ে আলতাফ সাহেব কন্যা দায় হতে কিছুটা মুক্ত করতে পারবেন।
তবে হিমেল বাবার এসব কথার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। জমির মোল্লা ছেলের কণ্ঠ চিরদিনের জন্য বন্ধ করতে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দেন। জোৎস্না বেগমকে জানিয়ে দেন সব সম্পত্তি উনি উনার ভাইয়ের বাচ্চাদের লিখে দিবেন। জমির মোল্লা বিএডিসির ডাইরেক্টর ছিলেন। তবে উনার ভাই আক্কাস মোল্লা গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করে। উনারও চার ছেলেমেয়ে। টানাটানির সংসার। স্কুলের আর কটা টাকা বেতন। বলা যায় জমির মোল্লাই ভাইয়ের সংসারটা চালিয়ে নেয়।
পরিবারের এই অবস্থায় হিমেল রমনা পার্কে জোবায়দার সাথে দেখা করে। বৈশাখের তপ্ত রোদে জোবায়দা মুখটা রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। পার্কের বেঞ্চটায় বসে ও একদৃষ্টিতে দূরের রাঁধাচূড়া গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে। গরম বাতাসের ঝাপটায় বিনুনী থেকে আলগা হয়ে যাওয়া চুলগুলো অবিন্যস্তভাবে জোবায়দার কপালে এসে পড়েছে। ও আজ মন শক্ত করে হিমেলের সাথে দেখা করতে এসেছে। পরিবারের এ অবস্থায় ওকে দুর্বল হলে চলবে না। পুরো পরিবার ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তাই হিমেলকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের ভালোবাসার ঘরটাকে ও নিজহাতে তালাবদ্ধ করে রেখেছে। হিমেলের হাজারো ইমোশনাল কথায় ও ঐ ঘরের তালা খুলবে না। মনে মনে এই শপথ নিয়ে ও এখানে এসেছে। এজন্য যতো কঠিন হতে হয় ও আজ তাই হবে। হিমেল ওকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে একসময় ওর হাতদুটো নিজের মুঠোর মধ্যে পুরে নিয়ে বলে,
—-তুই আমার সাথে পালিয়ে যেতে পারবি না?
জোবায়দা হিমেলের হাতের বন্ধন থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
—-বাবা মায়ের মুখে আমি চুনকালি মাখাতে পারবো না। তাছাড়া আপনার সাথে আমার প্রেম হলো কবে যে আমি আপনার হাত ধরে পালাতে যাবো?
—-একথা তুই বলতে পারলি? সেই কোন ছোটোবেলা থেকে আমরা দু’জন দুজনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। আর আজ তুই এই স্বপ্ন তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে দিলি?
—-আমার মতো এক হাভাতে ঘরের মেয়েকে বিয়ে করে কেন সারাজীবন কষ্ট করবেন? তার থেকে বরং রাজত্বসহ কোনো এক রাজকন্যাকে বিয়ে করে নিশ্চিম্ত জীবন যাপন করুন।
একথা বলে ও আর একমুহুর্ত অপেক্ষা না করে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। হিমেল ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, ভালোবাসা এমন এক অনুভব যার উৎপত্তি হয় হৃদয়ের গভীরে। ভালোবাসার অনুভূতীগুলো জানে না ধনী গরীব কিংবা সুন্দর অসুন্দরের মধ্যে পার্থক্য করতে। সমাজ সংসার যতবার দুটো ভালোবাসার মানুষের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ততবারই সত্যিকার ভালোবাসাগুলো সব বাধা ডিঙ্গিয়ে একে অপরকে চিরজীবনের মতো আপন করে নিয়েছে। হিমেলও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সব বাধা ডিঙ্গিয়ে ও একদিন ওর ভালোবাসার মানুষকে আপন করে নিবে।

আদিবার ডাকে জোবায়দা ভাবনার জগত থেকে ফিরে এসে বলে,
—-কিছু বলবি?
—আম্মু ডাকছে। এভাবে অন্ধকারে একা ছাদে বসে থাকা ঠিক নয়।
—-তুই যা। আমি আসছি।
জোবায়দার একটা বৈশিষ্ট আছে ও মানুষের বডিল্যাঙ্গুয়েজ দেখে অনেক কিছু বুঝতে পারে। হিমেল কিংবা ওর মা জোবায়দার ক্ষেত্রে পজিটিভ হলেও হিমেলের বাবা জমির মোল্লার এতে মত নেই। এটা জোবায়দা ভালোই বুঝতে পারে। পরমানুষের কথা আর কি বলবে যেখানে আপন মানুষগুলো জোবায়দাকে নিয়ে অনেক নেগিটিভ কথা বলে বেড়ায়।

চলবে