Sunday, August 10, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 180



মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-১৫

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (১৫)

সায়রাদের ফেরার দিন চলে এল। ছোট্ট একটা ট্যুর হলো তাদের। সাঈদের ব্যাপারটা ছাড়া সময়টা ভালোই ছিল। সমুদ্রের গর্জন শুনেছে সে। ঢেউয়ের আদর নিয়েছে। সব মিলিয়ে খারাপ নয়। আমিরা এখনো ঘুমিয়ে। ওকে ডেকে নিল সায়রা। তারপর ব্যাগ প্যাকিং শুরু হলো। সব গুছিয়ে নিতে কিছু সময় লাগল। নাশতা করতে গিয়ে শুনল সকালে নয়,বিকেলে বের হবে। এতে অবশ্য ভালোই হলো। আরেকটু সময় পাওয়া গেল। সমুদ্রের ভালোবাসা নেওয়া যাবে। আমিরাকে আহনাফের সাথে খেলতে দিয়ে সায়রা গেল সমুদ্র পাড়ে। সেখানে আগে থেকেই অনুভব রয়েছে। তাকে দেখে মনে হলো রাতে ঘুম হয় নি। চোখ কেমন ফুলে, লাল হয়ে গিয়েছে। চাহনিতে প্রাণ নেই। সায়রা জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও থেমে গেল। শব্দহীন দুজন পথ চলছে। অনুভব ভীষণভাবে বুকের মাঝে ব্যথা উপলব্ধি করল। এই ব্যথাটা কোনো ঔষধের দ্বারা নিরাময় সম্ভব নয়। হঠাৎ সমুদ্র গর্জে ওঠল। সায়রা ভয় পেয়ে দু পা পিছিয়ে গেল। অনুভব পেছন ঘুরে বলল,”ভয় পেও না। চলো সামনে যাই।”

অনুভব কেমন বদলে গেল যেন। চঞ্চলতা নেই। সায়রা মৌন থেকে পথ চলতে লাগল।

“সায়রা, সমুদ্রের এই সামান্য গর্জনেই ভয় পেয়ে গেলে। আমার বুকের ভেতর যে গর্জন চলছে, সেটা আমি কেমন করে সইব বলো তো।”

কথাটা মিনমিনে সুরে বলল অনুভব। সায়রা ঠিকঠাক না বুঝতে পেরে শুধাল,”কিছু বললে?”

এক সেকেন্ড সময় নিয়ে, অনুভব জবাব দিল। “উহু।”

“আমার মনে হলো কিছু বললে।”

“না কিছু না।”

তারপর দুজনের আর কথা হলো না। সমুদ্র কেমন গর্জে ওঠেছে। সায়রার ভয় লাগছে। ভালো লাগছে না। তাই ওরা ফেরার জন্য পথ ধরল।

সমুদ্র হয়তো চেয়েছিল ওরা আরো কিছু সময় থেকে যাক। তাই নিজেকে মেলে দিয়েছে। আকাশ হুট করেই মেঘে ছেয়ে গেছে। আঁধার নেমে এসেছে। সামান্য পথটুকুও দেখা যাচ্ছে না। বালির বাতাস হচ্ছে! পথ চলতে চলতে ওরা অনেক দূর চলে এসেছিল। আবহাওয়া খারাপ হওয়াতে রাস্তা চেনা যাচ্ছে না। কি এক সমস্যার সৃজন হলো। সায়রা চিন্তিত হলো। অনুভব ও তাই। দুজনেই পথ হারিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সায়রা একটু বেশিই অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে। এদিক সেদিক ছোটার চেষ্টা করলেই অনুভব ওর হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলল,”কোথায় যাচ্ছ?”

“আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি অনুভব।”

“হ্যাঁ, কিন্তু এভাবে কোথায় ছুটছো?”

“জানি না। আমার ভয় হচ্ছে।”

অন্য সময় হলে অনুভব ও ভয় পেত। কিন্তু যার হৃদয়ে প্রেমের জোয়ার আসে তার হৃদয় আর ভয় পেতে চায় না। অনুভবের অবস্থাটিও তেমন হয়ে গেছে। ও একটু খেয়াল করে দেখল আশেপাশে সারি সারি ঝাউগাছ। রিসোর্টের সামনে এমন পরিবেশ ছিল না। ওরা কীভাবে যে এদিকে চলে এল। নেটওয়ার্ক ও কাজ করছে না। এদিকে সমুদ্র উতাল পাতাল করছে। আকাশ গর্জে ওঠছে। বাতাসের শনশন শব্দ কানে এসে লাগছে।

“এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয় অনুভব।”

“সায়রা দাঁড়াও।”

এগিয়ে চলেছে সায়রা। অনুভব ছুটে এসে ওর পাশাপাশি হলো।

“এভাবে কোথায় যাও। পথ না চিনে তো বিপদে পড়বে।”

সায়রার মাথা কাজ করছে না। দুর্যোগ ভয় পায় সে। অনেক বছর আগের কথা। এক দুর্যোগময় পরিবেশে হারিয়ে গিয়েছিল। সেখানেও এমন সমুদ্র ছিল। ঝাউবন ছিল। অন্ধকার ছিল। মেঘ গর্জন করছিল। সায়রার হৃদয়ে হুংকার বেজে ওঠল। সেই অতীত ও একেবারেই ভুলে বসেছিল। আজকের এই পরিস্থিতি হুট করেই সব জীবন্ত করে তুলেছে। সায়রা ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। কান্নায় ভে ঙে পড়ল। অনুভব একজন পুরুষ হয়েও বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত। ও ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কিয়ৎকাল পর নিচু হয়ে সায়রার বাহুতে স্পর্শ করল। মেয়েটির চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। ভয়ে চুপসে গেছে সে। আকাশ আর সমুদ্র পাল্লা দিয়ে গর্জন করছে। সে গর্জনে সায়রা যেন আরো বেশি ভীত হয়ে পড়ল। ও ক্রমশ অনুভবের শরীরের সাথে মিশে যেতে লাগল। ওর মাথার ঠিক নেই। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। যেন সব কিছু ছেড়ে প্রাণটা বেরিয়ে আসবে।

সায়রাকে কোনো মতে টেনে ঝাউগাছের দিকে নিয়ে এসেছে অনুভব। বাতাসের গতি প্রচুর। তবে বৃষ্টির দেখা নেই। শনশন শব্দে কথা বোঝা যাচ্ছে না।

“সায়রা, শক্ত থাকো। শক্ত থাকো প্লিজ।”

সায়রা শক্ত হতে পারছে না। ওর অতীত ওকে নুয়ে দিচ্ছে। ভয়ের চোটে দম বন্ধ হয়ে আসছে। অনুভব এবার চিন্তিত উদ্বিগ্ন হলো। রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করতেই সায়রা ওকে টেনে ধরল। ইশারায় বোঝাল ওর ভয় হচ্ছে। অনুভব থেমে রইল। নেটওয়ার্ক নেই। আশেপাশের অবস্থাও খারাপ। একটা সময় পর অনুভবের মস্তিষ্ক শীতল হলো। ও লম্বা করে শ্বাস নিল। ভরসা হারালে চলবে না। সায়রা ভয় পেয়ে আছে। তাকে সামলাতে হবে। ও সায়রার কাছেই থেকে গেল। ইষৎ হাতে মেয়েটিকে আগলে নিল। অন্য সময় হলে সায়রা নিশ্চিত তুরকালাম করে দিত। কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমন যে অনুভব তাকে জড়িয়ে থাকার পর ও সে কিছু বলছে না। বরং একদম চুপসে বসে আছে। চোখ দুটো বন্ধ করা। হাত দুটো অনুভবের শার্ট খামচে আছে। যেন ভীষণ বিপদে এক টুকরো ভরসা নিয়ে বেঁচে থাকার প্রয়াস।

অর্ধভেজা হয়ে রিসোর্টে ফিরল অনুভব আর সায়রা। আকাশ আর সমুদ্র হুট করেই গর্জে ওঠেছিল। এখন কিছুটা শীতল। সায়রাকে দেখে মনে হচ্ছে নিজের মধ্যে নেই। অনুভব ওকে আলগোছে রুমে পৌছে দিল। আমিরা চিন্তিত ছিল। তার চোখে মুখে ভয়।

“মিমি।”

সায়রাকে জাপটে ধরল আমিরা। অনুভব মৃদু সুরে বলল,”ভয় পেও না। মিমি কে ড্রেস চেঞ্জ করতে সাহায্য করো।”

কথাটি বলেই নিজের রুমে চলে এল অনুভব। এখন প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। অনুভব এসে ড্রেস বদলে নিয়ে কফি নিল। সায়রা তখনো স্বাভাবিক হয় নি। ওর বিষয়টা বুঝতে পারছে না অনুভব।

“একটু বাইরে আসবে?”

সায়রা শুনে নি। আমিরা ও হতবাক। সে ছোট্ট একটা বাচ্চা। আহামরি বোঝার মতন ক্ষমতা হয় নি তার। তবে ডেকে দিল সায়রাকে।

“মিমি, তোমায় ডাকছে।”

“হুম?”

বিছানায় বসেই জবাব দিল সায়রা। অনুভব দরজার বাইরে থেকেই বলল,”একটু বাইরে আসতে পারবে?”

মুখে কিছু না বলে বাইরে এল সায়রা। অনুভব সায়রাদের রুমে প্রবেশ করে নি। ওরা বাইরের সিটিং এরিয়ায় বসল। অনুভব কফি এগিয়ে দিল।

“থ্যাংকস।”

মেয়েটি যে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই অনুভব খুব করে বুঝতে পারছে। তাই সে চুপ করে রইল। কফি শেষ করে সায়রা নিজ থেকেই বলল,”আমাকে অনেক সাহায্য করলে অনুভব। আমি এই ঋণ কখনো শোধ দিতে পারব না।”

অনুভব কথাটি এড়িয়ে গিয়ে বলল,”হুট করে এত প্যানিক কেন করছিলে?”

“বেশ অনেক গুলো বছর আগে। আমি চট্টগ্রামের শহর থেকে হারিয়ে গিয়েছিলাম। কীভাবে যেন আমাকে সমুদ্রের পাড়ে পাওয়া যায়। আমি সেই দুর্যোগ এ মানসিক ভাবে আ ঘা ত পাই। কিছু মাস কথা বলাই বন্ধ করে দেই। ট্রিটমেন্ট করা হয়। তারপর ঠিক হই। তবে কীভাবে হারিয়ে, সমুদ্রে এসে পৌছাই আমার আসলে মনে নেই। তারপর অনেক বছর পার হলো। হুট করে আজকে ওমন পরিস্থিতি আমায় ব্যস্ত করে দিয়েছিল। তোমাকে ধন্যবাদ, আমায় সেইফ করার জন্য।”

অনুভব শুধুই ঠোঁট একটু প্রসারিত করল। তারপর চট করেই বলল,”তোমার মাথায় তেলাপোকা।”

তেলাপোকার নাম শুনে লাফিয়ে ওঠল সায়রা। সে বিশেষ ভয় পায় প্রাণীটিকে। এদিকে অনুভব হেসে যায় যায়। সায়রা বুঝতে পারল, ছেলেটা তার সাথে মজা করেছে।

“অনুভব! তুমি এমন কেন বলো তো?”

অনুভব শুধুই হাসে। মেয়েটিকে স্বাভাবিক করার জন্যই ওমন করল সে। এদিকে সায়রা রেগেমেগে চলে যায়। মন বলে,ছেলেটার মাঝে এত কম ম্যাচিউরিটি কেন?

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-১৪

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (১৪)

এ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছে সায়রা। আহনাফের জন্মদিনটা ভালোই ভালোই পার হলো। আগের মতন দামি উপহার না দিতে পারলেও যেই উপহারটি এনেছে সেটা সুন্দর। আর আহনাফের পছন্দ হওয়ার মতনই। তবে অনুষ্ঠানে হাসি খুশি মেজাজ দেখালেও সে ভেতরে ভেতরে আসলে বড়ো দুঃখী ছিল। অনেকদিন পর সাঈদকে দেখেছে কী না। ছেলেটা ওর প্রথম ভালোবাসা। কথায় আছে প্রথম ভালোবাসা বড়ো কাঁদায়। আহারে সায়রা। ছয়টা বছর গেল একটি সম্পর্কে। অথচ পাওয়া হলো না। না পাওয়ার এই গল্পে কারো দোষ নেই। না ওর, আর না সাঈদের। ওরা এখন কেবল একটি সুন্দর জীবনের জন্য প্রার্থনা করতে পারে। ব্যাস, এইটুকুই। সায়রা মন থেকেই চায় সাঈদ অসম্ভব ভালো থাকুক। হয়তো এক সাথে পথচলা হলো না। তবে দুজন দুজনের প্রতি যে শ্রদ্ধা সেটি তো মিথ্যে হতে পারে না। দুজনই চেষ্টা করেছিল। তবে পরিবার আর পরিস্থিতি তাদের এক হতে দেয় নি। হয়তো এটাই নিয়তি। ও এখন খুব করে চায় জীবনে সাঈদ কে নিয়ে ওর আর কোনো পিছুটান না আসুক। জীবন চলুক জীবনের মতন। সাগর পাড়ে এসে এসবই ভাবছিল ও। সে সময়েই একটি বল এসে লাগল ওর বাহুতে। ও ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল।

“বলটা এদিকে দেও সায়রা।”

সায়রা সেটি ওঠিয়ে অনুভবের দিকে ছুঁড়ে দিল। অনুভব সেটা নিয়ে আবার ছুটতে লাগল। দুজনের মাঝে বেশি দূরত্ব নেই। অথচ দুজন দুই দিকের যাত্রী। একজন সমুদ্রের কাছে দুঃখের গল্প করছে। আরেকজন ভীষণ আনন্দে সমুদ্র পাড়ে বল নিয়ে খেলছে।

সায়রার খুব কান্না পাচ্ছে। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ওর মনের ভেতর একটা দুঃখ চলছে। এত যন্ত্রণা কেন এই হৃদয়ে? ও আলগোছে বালিতে বসে পড়ল। ঢেউ এসে ছুঁয়ে গেল সমস্ত শরীর। সায়রার দু চোখ থেকেও নোনা জল নামল। একটা সময় পর মেয়েটি চিৎকার করে ওঠল। এই পৃথিবী ওকে অসহায় করে তুলেছে। ওর জীবনের সব রঙ হারিয়ে গেছে। আহারে কী এক যন্ত্রণা।

ভিজে একাকার হয়ে রিসোর্টে ফিরল সায়রা। অনুভব তখন ফোন নিয়ে ভিডিও করছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ একটিভ সে। কিছু ফ্যান ফলোয়ার ও আছে। তাদের নিয়েই ভবঘুরে অনুভবের দিন চলে। আর কোনো ভাবনা নেই তার মাঝে। সে মুক্ত ভাবে জীবন যাপন করে। ভিডিও করে র এক পর্যায়ে সায়রাকে দেখতে পেল। ভিজে শরীর মেয়েটার।

“এই সায়রা, ভিজেছ কেন?”

“এমনি।”

“হুম প্রেমিকের সাথে ভিজেছ?”

সায়রা এবার বিস্ফোরিত নয়নে তাকাল। অনুভব একটু ভরকে গেল। মেয়েটির চোখ থেকে যেন উত্তাপ নামছে। হুট করে কি যে হয়ে গেল।

“কী সমস্যা তোমার? সব সময় কেন প্রেমিক প্রেমিক করো। বলেছি না আমার কোনো প্রেমিক নেই। তাহলে কেন বার বার এমন বলো? তুমি এমন কেন অনুভব? কেন এমন?”

কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল সায়রা। অনুভব হা হয়ে চেয়ে রইল। কী এমন বলেছে সে? এতটা রিয়েক্ট করার মতন কিছু কী ছিল বাক্যটিতে?

পুরো সন্ধ্যা মন খারাপ করে রইল অনুভব। সে কখনোই সায়রাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কিছু বলে না। তবে প্রেমিক শব্দটি বললেই ও কেমন করে ওঠে। এটিই ভাবিয়ে তুলল ওকে। আমিরা আর আহনাফ খেলছিল। ওদের মাঝে গিয়ে দাঁড়াল অনুভব। আমিরা নাক ছিটকে রইল।

“আমিরা, এদিকে শোনো তো।”

অনুভব এত সহজ করে কথা বলছে! এটি ছোট্ট আমিরাকে অবাক ই করল।

“একটা কথা বলবে?”

আমিরা চেয়ে রয়। অনুভব সংকোচ ছাড়াই বলে,”তোমার মিমির কোনো প্রেমিক আছে?”

আমিরা এবার যেন বিরক্তই হলো। অনুভবের দৃষ্টিতে ভরা উদাসীনতা।

“কী হলো?”

“কেন বলব?”

“বলো না। বললে তো তোমায় কেউ মা র ছে না। সায়রার কোনো প্রেমিক আছে?”

“আমি মিমির কোনো কথা কাউকে বলি না।”

এটা বলেই চলে যায় আমিরা। অনুভব চেয়ে থাকে। মনে মনে বলে, যেমন খালামনি, তেমন হয়েছে ভাগনি!

রাতের খাবারের সময় অনুভব আর সায়রার দেখা। আজকে বার বি কিউ’র আয়োজন হয়েছে। একদম সমুদ্র ঘেঁষে। শান্ত সমুদ্রের পাড়ে মাঁদুর পেতে বসেছে সবাই। আগুন জ্বালানো হয়েছে। অনুভবের চোখ লাল হয়ে আছে। সে ভীষণ অনুতপ্ত। পুরো সন্ধ্যা সে ভেবেছে। হয়তো সায়রার মনে কোনো দুঃখ আছে। আর সেই দুঃখটি সে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

“সায়রা শোনো।”

অনুভব একদম কাছে এসে কথাটা বলল। সায়রা মাথা ঘুরিয়ে চাইতেই দুজনের চোখাচোখি হলো। সায়রা আশেপাশে চেয়ে দেখল অনেক মানুষ। ও একটু বিব্রত হলো।

“আমি আসলে খুবই দুঃখিত। জানি না কীভাবে তোমায় কষ্ট দিয়ে ফেললাম।”

“ইটস ওকে।”

“সত্যি বলছি ইচ্ছা করে ওমন করি নি…”

ফোঁস করে দম ফেলে সায়রা। নিজের মনকে শীতল করে বলে,”আমার ও ওভাবে রিয়েক্ট করা উচিত হয় নি। আসলে একটু মেন্টালি ডিস্টার্ব ছিলাম। কিছু মনে কোরো না।”

অনুভব চুপ। সায়রা ও চুপ। দুজন আর কথা বলছে না। একটা সময় পর দুজনই একই সঙ্গে বলে,”যা হবার হয়েছে।”

একই সাথে এক কথা বলে ফেলায় দুজনেই হেসে ফেলে। অনুভব মাথায় চুলকায়। হাত বাড়িয়ে বলে,”ফ্রেন্ড?”

হাতটি স্পর্শ না করে সায়রা হাসে। বলে,”ফ্রেন্ড হলে কিন্তু অনেক জ্বা লা। নিতে পারবে তো?”

“পারব।”

সায়রা হেসে নেয়। হাতের সাথে এক সেকেন্ডের মতন হাত মিশিয়ে বলে,”ওকে ডান।”

এই এক সেকেন্ড ই হয়তো অনুভবকে ধ্বং স করার জন্য যথেষ্ট হয়ে পড়ে। অনুভব নামের পাগল ছেলেটির মনেও মিষ্টি এক অনুভব জাগে। যাকে সহজ করে বলা যায় ভালোবাসা।

সাঈদ এক ঝলক দেখে নেয় সায়রা আর অনুভবকে। দুজন দুজনার প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে। এদিকে ওর অন্তর জ্ব ল ছে। ও একটা নিশ্বাস ফেলে। চোখ বন্ধ করে। সায়রা কে দেখতে পায়। ভীষণ ভাবে মনে পড়ে ছয়টা বছরের স্মৃতি। অর্ধ যুগ। কম সময় নয় নিশ্চয়ই।

“স্যার, আপনাদের লাগেজ গাড়িতে ওঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনার ওয়াইফ দাঁড়িয়ে আছেন।”

সাঈদ মৃদু সুরে বলে,”হু।” তারপর আবার ডুবে যায়। সায়রা আর অনুভব এখন পাশাপাশি হাঁটছে। দুজনের মাঝে যে সামান্য দূরত্ব সেটাও ক্রমে ছোট হয়ে আসছে। সাঈদের চোখে ভাসছে দুজন দুজনার হাত বেছে নিয়েছে। ওর চোখে ভাসছে দুজনার সুন্দর সংসার। বিভ্রম দেখে সে। অথচ মন বলে এই বিভ্রম সত্যি হতে চলেছে। সাঈদ ঠোঁট থেকে
জ্ব ল ন্ত সিগারেট নামিয়ে বালিতে ফেলে। পা দিয়ে পিঁষে বলে,”আমার প্রিয়তমা সায়রা। ভালো থেকো, সব সময়।”

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-১২+১৩

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল ১২+১৩

(১২)

ঠান্ডা শীতল বাতাস। ওরা একটা রিসোর্টে ওঠেছে। রিসোর্টটা ভীষণ সুন্দর। সমুদ্রের কাছে। সায়রার মন ভালো হলো অনেকটা। সে এমন একটা জায়গাই খুঁজছিল। ও ধীরে ধীরে সমুদ্রের পাড়ে এগিয়ে গেল। কিছুটা নেমে দাঁড়াল। ঢেউ গুলো ছুঁয়ে গেল পা। শীতল জলে অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে। চোখ বন্ধ করল সায়রা। এখন মনে হচ্ছে পৃথিবীটা ভীষণ সুন্দর। কোনো অশান্তি নেই। কারো কথা স্মরণ হচ্ছে না। মস্তিষ্ক যেন নিদ্রায় রয়েছে।

“এই সায়রা, এখানে কী করছো!”

অনুভব! ছেলেটা তার সুন্দর সময়টিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল সায়রা।

“কী সমস্যা?”

“সমস্যা তো অনেক। তোমাকে খুঁজে আমার পা ব্যথা হয়ে গেছে।”

“আমাকে কেন খুঁজো?”

“তোমার বেবি ডল কান্না কাটি করছে।”

“কী?”

অনুভব বেবি ডল বলতে কাকে বোঝাল সায়রা ঠিক বুঝল না। ও ভ্রু কুঞ্চিত করে রইল।

“আমিরা। সে কান্নাকাটি করছে।”

“কাঁদছে!”

“ইয়ে না মানে তোমায় খুঁজছে।”

“আশ্চর্য! তাহলে কান্না করছে কেন বললে?”

“বললাম।”

“আজব তো।”

“হুম। আজব ই ভালো। দুজন দুষ্টু মেয়ে।”

“কী বললে?”

“দুষ্টু বলেছি।”

“তুমি তো শ য় তা ন।”

“আমি শ য় তান?”

“এখানে আর কেউ আছে যে তাকে শ য় তা ন বলব।”

“ভারী ঝগড়া করতে জানো তো।”

“কথা বলিও না। সব সময় এমন মজা করো। অথচ ভাবো না অপর মানুষটি চিন্তিত হতে পারে।”

“এখন তোমার বেবি ডলের কাছে যাও।”

সায়রা কথা না বাড়িয়ে পানি থেকে পা সরিয়ে নিল। তারপর হাঁটতে লাগল রিসোর্টের পথে। অনুভব পেছন থেকে ডেকে ওঠল।

“আরে এই দুষ্টু মেয়ে।”

পেছন না ঘুরেই সায়রা বলল,”তুমি এই নামে ডাকলে আমি শুনব না অনুভব।”

“কিন্তু জবাব তো দিয়েছ।”

সায়রা হতাশ হলো। সে সত্যিই তো জবাব দিয়ে ফেলেছে। কি যে হচ্ছে তার সাথে। আজকাল নিজেকে বড়ো বোকা মনে হয়। আর সব থেকে বেশি বোকা হতে হয় অনুভবের কাছে। ছেলেটা এত বেশি করে ইদানীং।

আমিরা ঘুমিয়ে ছিল। বিকেলে ফিরে যে যার রুমে গিয়েই রেস্ট করছিল। সায়রার ভালো লাগছিল না বিধায় সমুদ্রের পাড়ে আসে। এর মধ্যে আমিরার ঘুম ভে ঙে যায় আর সে ভীত হয়ে পড়ে। তখনই অনুভব সায়রার খোঁজে বের হয়। আমিরা এখন চুপ করে বসে আছে। যেন শান্ত সমুদ্র।

“কী রে। ঘুম ভে ঙে গেল?”

“তুমি কোথায় ছিলে মিমি?”

“এই তো বাইরে।”

“অহ। আমার ভয় করছিল।”

“ঠিক আছে। এসে গেছি।”

“হুম।”

“কিছু খাবি?”

“না। আমি খেলব।”

“আচ্ছা চল।”

আহনাফ কে ও বের করে নিল আমিরা। তারপর আমিরা, আহনাফ আর সায়রা খেলতে লাগল একটি বল দিয়ে। ওরা বেশ আনন্দের সাথে সময় কাটাচ্ছে। অনুভব তখন নিজের গিটার নিয়ে বসল। এই গিটারের সাথে তার সবথেকে ভালো বন্ধুত্ব। এমন না সে ভালো গান গাইতে পারে। তবে গানের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা কাজ করে।

সন্ধ্যায় মারুফ কল করল। কল রিসিভ করে সায়রা বলল,”হ্যাঁ ভাইয়া কখন ফিরলে?”

“কিছু সময় হলো। তোরা সবাই ঠিক আছিস?”

“হুম ঠিক আছি।”

“শোন না, একটা কথা বলার ছিল।”

“হুম। বলো, শুনছি।”

“বাহাদুর কল করেছিল।”

“কেন?”

“আমিরার খোঁজ নিতে।”

“হঠাৎ।”

“বুঝতে পারছি না।”

সায়রা একটু চিন্তায় পড়ল। তারপর বলল,”ঠিক আছে। ফিরে বিষয়টা দেখব।”

“হুম। তবে কথা শুনে মনে হলো মেয়ের প্রতি দর‍দ এসেছে।”

“সত্যিই কী তাই ভাইয়া?”

“জানি না রে।”

“সে একটা নিকৃষ্ট মানুষ ভাইয়া। আমার আপুকে মে রে ছে এখন মেয়েটা কে ও মা র বে।”

মারুফ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল,”ভুল তো সবার ই ছিল রে। আমরা আসলে কারো জীবন নিয়েই বলতে পারি না। তবে বাহাদুর আমেনাকে ভালোবাসত।”

“ভালোবাসলে শেষ দিকে এত যন্ত্রণা কেন দিল বলতে পারো?”

“বোঝার ভুল আসলে।”

“ভুলে ভুলে আমার বোনটাকেই মে রে ফেলল।”

মারুফ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। সায়রা কিছুটা উত্তেজিত।

“সব মানলাম। তার যদি এতই ভালোবাসা থাকত তবে আপুর মৃ ত্যু র দশ দিনের মাথায় বিয়ে কেন করল?”

মারুফ নিশ্চুপ। আসলেই ভালোবাসা রঙ ব‍দলায়। এটা অস্বীকারের উপায় নেই শুরুর কিছু বছর বাহাদুর ছিল আমেনার জন্য রহমত স্বরূপ। অথচ শেষ কিছু মাস যে যন্ত্রণা তিরস্কার করল এটি কোনো ভাষাতেই ব্যক্ত সম্ভব নয়।

রাতের খাবারের আগ দিয়ে সায়রার মেজাজ আরো গরম হতে লাগল। বাহাদুর যেই মেয়েকে অস্বীকার করেছে সেই মেয়ের প্রতি এখন আবার দর‍দ দেখাচ্ছে। তাকে দেখতে চেয়েছে। সায়রা বলে দিয়েছে আমিরা আর কোথাও যাবে না। অন্তত সৎ মায়ের কাছে তো কখনোই না। তখনই বাহাদুর জ্বলে ওঠে। বলে তার মেয়েকে সে নিয়ে যাবে। দেখবে কে কি করতে পারে। সায়রা আসলেই তিক্ত হয়ে পড়ল। অসহ্য লাগল তার সব। সে খেল না। এখন রাত দশটার কিছু বেশি বাজে। ও এসেছিল হাওয়া খেতে। বাইরের শুনশান নীরব পরিবেশ। সে সময়েই মনে হলো তার পেছনে কেউ আছে। ও চট করেই ঘুরে তাকাল। দেখল অনুভব দাঁড়িয়ে। সায়রা ভয় পেয়ে গেল। জ্বলন্ত চোখে তাকাল।

“তোমার সমস্যা কী অনুভব?”

“ভয় পেয়েছ তাই না?”

“তো ভয় পাব না। আশ্চর্য মানুষ তো তুমি।”

“এত রাতে বাইরে কী করছো?”

“বাইরে কী করছি মানে?”

“এখানে তো কেউ নেই। একা কী করো?”

“এমনি এসেছি।”

“এমনি না। নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড ও এখানে এসেছে।”

“আজেবাজে কথা বলবে না।”

“হা, বয়ে গেছে আজেবাজে কথা বলতে।”

“আশ্চর্য! তুমি এত জ্বালাও কেন আমায়?”

“জানি না। ভালো লাগছে জ্বালাতে।”

“ধ্যাত।”

অনুভবকে পাশ কাটিয়ে চলে এল সায়রা। ছেলেটা এত বেশি বেশি করে। ও অনেকটা যাওয়ার পর হাতে টান অনুভব হলো। সায়রা চেচিয়ে ওঠল।

“এটা কী রকমের কাজ অনুভব!”

কোনো জবাব এল না। সায়রা ঘুরে তাকাল। দেখল অনুভব নয়। এখানে দাঁড়িয়ে অন্য একজন। যে ওর ভীষণ চেনা। এক সময় ভীষণ কাছের ছিল। ও শুকনো ঢোক গিলল। পুরুষটির ভরাট মুখের রোম রাজি বেশ বড়ো হয়ে গেছে। চুল গুলো এলোমেলো। দৃষ্টিতে ঘুম না হওয়ার ছাপ। কি এক আশ্চর্য ব্যথা সে মুখে। সায়রা তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখ ঘুরিয়ে নিল।

“কেমন আছ?”

সায়রা ধীরে সময় নিয়ে বলল,”ভালো। তুমি?”

“হুম। আছি, ভালো।”

তারপর নীরবতা। দুজনেই যেন কথা বলতে পারল না। সায়রার চোখের কোণ থেকে একটা বিন্দু জল নেমে এল। ও চলে যেতে নিতেই পুনরায় ডেকে ওঠল সাঈদ।

“শোনো একটু।”

সায়রা দাঁড়াল। সাঈদ কাছে এল পায়ের জোরে। বরাবর হয়ে বলল,”সেদিন কল করেছিলে?”

সায়রা চুপ। ও মাথাটা নিচু করে রইল। সাঈদ যেন কিছু বলতেই যাচ্ছিল সে সময়েই বিকট এক আওয়াজ কানে ভেসে এল। মেয়েলি কণ্ঠ। চিৎকার করছে। সম্ভবত পড়ে গিয়েছে। সাঈদ তাকাল ঘাড় ঘুরিয়ে। চোখে মুখে বিরক্তি নেমেছে।

মেয়েটির নাম নম্রতা। সাঈদের স্ত্রী। সায়রা দেখেছে। ছবিতে। অল্প বয়সী। ভীষণ সুন্দর দেখতে। তার চেয়েও বেশি কী না সেটা সায়রা জানে না। তবে দেখতে সুন্দর। সায়রা শুকনো ঢোক গিলল। বলল,”তুমি ওর কাছে যাও।”

সায়রা পায়ের গতি বাড়াল। সাঈদ অলস চোখে তাকিয়ে রইল। আহারে জীবন তার। তার ভালোবাসার মানুষ। জীবন তাকে সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু সেই সুযোগটি সে নিতে পারে নি। একটা ব্যথা তার চোখ দুটোয় রিক্ততা এনে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে এই জীবনটাই বৃথা।

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (১৩)

সায়রা পালিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময়েই অনুভব এসে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল।

“কী হয়েছে? সামনে এসে দাঁড়ালে কেন?”

“আগে তো বলো নি বয়ফ্রেন্ড ও এসেছে। সন্দেহ তো ঠিক ই করেছিলাম।”

“কী!”

“বুঝো নি? এত ঢং কেন ধরো।”

“অনুভব পথ ছাড়ো। আমার ভালো লাগছে না।”

“হুম ভালো তো লাগবেই না।”

“সরো।”

অনুভব কে ঠেলে ভেতরে চলে গেল সায়রা। এসে কিছু সময় কান্না করল। সেই দিনটি তার জন্য বড়ো পরীক্ষার দিন ছিল। হয়তো ভুল ছিল অনেক কিছু। তবে ভালোবাসার কাছে কোনো ভুল ই তো ভুল নয়। কিন্তু ভাগ্য সে তো নিজের মতই পথ এগোলো।

সাঈদ সেদিন নিজের সব কিছু ফেলে সায়রার কাছে এসেছিল। সায়রা শুরুতে নাকোচ করে দিলেও পরে গিয়েছিল সাঈদের কাছে। তবে বাইরে ছিল না সাঈদ। তারপর কত কল করা হলো, রিসিভ হলো না। দুদিন পরে সায়রা জানতে পারল সাঈদ তার হলুদের অনুষ্ঠান ফেলে তার কাছে এসেছিল। এ কথা শোনার পর সায়রা ছিল ভীষণ লজ্জিত। যদি ওরা সেদিন পালিয়ে যেত, তবে আরেকটি মেয়ের ক্ষতি হয়ে যেত। মেয়েটি বিয়ে ভা ঙা র শোকে গ লা য় দড়ি দিত নিশ্চয়ই। কত কিছুই তো ঘটতে পারত। পরিস্থিতি এমন এক সংকট তৈরি করে যার ফলে কোন টা ঠিক আর কোন টা বেঠিক তা বোঝা যায় না। তবু যদি সায়রা আর সাঈদের একটি সংসার হতো, তবে খুব ক্ষতি হতো? হয়তো হ্যাঁ। নতুবা এই পৃথিবী কেন এমন এক সংকট তৈরি করল?

সকালটা সুন্দর। আহনাফের জন্মদিন। সবাই উইশ করেছিল রাতেই। তবে সায়রার শরীরটা খারাপ লাগছিল বিধায় সে বের হতে পারে নি। ও ঠিক করেছে একে বারে উপহার নিয়েই উইশ করবে। তাই ব্যাগ পত্র নামিয়ে বসেছে। আমিরা হাত মুখ ধুয়ে এসে বসল ওর পাশে।

“মিমি বাইরে যাবে?”

“যাব। আহনাফের উপহারটা নিয়ে যাই।”

সায়রা ব্যাগ নামিয়ে খুঁজতে লাগল। তবে যেখানে রেখেছিল সেখানে পাচ্ছে না। তাই অন্য অংশে খুঁজতে শুরু করেছে। এক পর্যায়ে পুরো ব্যাগ খুঁজে ফেলল তবে উপহার পেল না। ওর গলাটা শুকিয়ে এল।

“কী হয়েছে?”

“উপহারটা পাচ্ছি না।”

“বাসায় রেখে এসেছো?”

“না রে। আমি সাথেই নিয়ে এসেছিলাম।”

“তাহলে।”

“জানি না। কোথাও পড়ে গেল কী না।”

সায়রা চিন্তিত, ব্যথিত। এখন উপায় কী? সায়রা তার জমানো টাকা থেকে প্রায় ৬ হাজার টাকা দিয়ে একটি দামি ঘড়ি এনেছিল। এত বড়ো অনুষ্ঠান হচ্ছে, তাই সায়রা চায় নি সে ছোট হোক। তাই অত খরচ করে আনা। কিন্তু এখন কী উপায়? সায়রার নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। কষ্ট দেখা যাচ্ছে মুখশ্রী জুড়ে।

“মিমি।”

“তুই একটু বোস। আমি একটু বাইরে থেকে আসি।”

আমিরাকে রেখে দ্রুত বেরিয়ে পড়ল সায়রা। কল করল ভাইয়ার নাম্বারে। তবে নেটওয়ার্কে সমস্যা দেখা যাচ্ছে। যেই না একটু ঠিক হলো সায়রা শুধু বলল,”ভাইয়া আমায় দ্রুত হাজার দুয়েক টাকা পাঠাও।”

তবে ওপাশ থেকে কেউ কিছুই শুনতে পেল না। নেটওয়ার্কের অবস্থা খুবই খারাপ। সায়রার মাথা কাজ করছে না। ওর কাছে হাজার দুয়েক টাকা আছে। তবে একেবারে খালি করে তো কিছু কেনা যায় না। ও আবার ডায়াল করল। তবে কাজ হলো না।

এপাশেই ছিল সাঈদ। সায়রাকে সে দেখেছে। শুনেছে কথা। ও ওঠে এসে টাকা বের করে বলল,”এটা নাও।”

সায়রা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সাঈদ দাঁড়িয়ে। ও চোখ নামিয়ে বলল,”থ্যাংকস। বাট লাগবে না।”

এ কথা বলেই এগিয়ে গেল সায়রা। ও চায় না সাঈদের প্রতি তার অনুভূতি গুলো খুলে আসুক। ও এখন চায় সব অনুভূতি হারিয়ে যাক। মিশে যাক মাটির সাথে।

চেনা পরিচিত বলতে রনু আপুর ফ্যামেলি। তাদের কাছে তো টাকা চাওয়া যায় না। আর উপহার আজকে না দিতে পারলেও লজ্জায় পড়তে হবে। সায়রা পড়েছে ভীষণ সমস্যায়। সে সময়েই অনুভব কে দেখা গেল। তবে ছেলেটার কাছে টাকা চাওয়ার মতন সম্পর্ক কী আছে? উহু নেই। সায়রা চুপ করে বসে রইল। তারপর ভাবল ধার ই তো নিবে। ও একটা নিশ্বাস ফেলে অনুভবের কাছে এল। অনুভবের হাতে একটি বল। সেটা ছুঁড়ে দিল অনুভব। তবে ধরতে পারল না সায়রা। অনুভব একটু ছুটে গিয়ে বলটা কুড়িয়ে আনল।

“সামান্য বল ও ধরতে পারলে না!”

সায়রা এ কথার জবাব দিল না। ওর লজ্জা লাগছে। ও চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিল। তারপর বলল,”একটা ফেবর করতে পারবে?”

অনুভব ভ্রু কুঞ্চিত করে চাইল। সায়রা নামের দুষ্টু নারী তার কাছে ফেবর চাইছে?

“ফেবর?”

“হ্যাঁ। একটু সমস্যায় পড়েছি।”

“বলো শুনছি।”

“আসলে আহনাফের জন্য আমি একটা সুন্দর ঘড়ি কিনেছিলাম। তবে সেটা ব্যাগে পাচ্ছি না। নেটওয়ার্কের জন্য বাসায় যোগাযোগ ও করা যাচ্ছে না। আজকে উপহার না দিতে পারলে আমি লজ্জায় পড়ব। তুমি আমাকে কিছু টাকা ধার দিবে? আই প্রমিস বাসায় ফিরেই দিয়ে দিব।”

অনুভব এক মুহূর্ত থমকে রইল। জবাব দিল না। সায়রার যে কি লজ্জা লাগছে। ও চোখ বন্ধ করে রইল। অনুভব বলল,”ঠিক আছে। এত হেজিটেট করার কিছু নেই।”

“থ্যাংক ইউ। আমি ফিরেই,দিয়ে দিব।”

অনুভব ওর কথায় হাসল। সায়রার যেন দম ফিরে এসেছে। সত্যিই সে বড়ো লজ্জার হাত থেকে বেঁচে গেল।

অনুভব অনেক সময় ধরেই ছেলেটাকে লক্ষ্য করছে। গতরাতে সায়রার সাথে কথা বলতে দেখেছে। তার মানে পূর্বপরিচিত। বয়ফ্রেন্ড ও হতে পারে। বল নিয়ে খেলতে খেলতে সাঈদের কাছাকাছি এল ও। সাঈদ তখন খোলা দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে। উদাসীন ভরা তার মস্তিষ্ক। ভুলে ভরা জীবন তার। অপ্রাপ্তির বেড়াজালে ভীষণ ভাবে আটকে আছে সে। অনুভব ওর সঙ্গ পেতে বল খেলার অফার করল।

“ব্রো, খেলা যাক?”

সাঈদ মৃদু সুরে বলল,”থ্যাংকস। এখন ইচ্ছা করছে না।”

অনুভব মনে মনে বলল,”শালা ইচ্ছা কেন করবে। শুধু মেয়েদের সাথে ইচ্ছা করে।”

ভেতরে এ কথা বললেও মুখে হাসি টানিয়ে রাখল। পাশের সিটে বসল। তারপর কিছু সময় নীরবতা।

“কোন শহর?”

“ঢাকা।”

“ওয়াও, আমিও।”

অনুভবের উচ্ছ্বসিত ভাবের বিন্দু পরিমাণ দেখা গেল না সাঈদের মাঝে। অনুভব মনে মনে ভাবল লোকটা রোবট।

একটা সময় পর অনুভব আবার বলল,”সায়রা কে চিনেন?”

সায়রার নাম শুনে নড়েচড়ে ওঠল সাঈদ। অনুভব ঠোঁট কামড়ে ভাবল মেয়েবাজ ছেলে কোথাকার। এত সময় তো পাথর ছিল। যেই না মেয়ের নাম শুনেছে ওমনি নড়েচড়ে ওঠেছে।

“জি। কিন্তু আপনি…..”

অনুভব কিছু বলতেই নিচ্ছিল সে সময়েই নম্রতা এসে দাঁড়াল। তার চোখ মুখ ফুলে গেছে। সাঈদের কোনো ধ্যান নেই।
“আম্মু কল করেছে।”

সাঈদ হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিল। কানের কাছে নিতেই ওপাশ থেকে মা বলল,”সাঈদ, আজই চলে এসো বাবা। কেন এখনো ঐ মেয়েটার কথা স্মরণ করছো বলো তো। আর মেয়েটাই বা কেমন। এখন তোমার বিয়ে হয়ে গেছে তারপর ও পিছু ছাড়ছে না। আমি আগেই বলেছি ও মেয়ে সুবিধার না। পারিবারিক শিক্ষা নেই। দেখলে তো।”

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-১১

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (১১)

সায়রা আর আমিরা পুরো তৈরি। তাদের দুজনকেই ভীষণ সুন্দর লাগছে। তিনদিনের ট্যুর ওদের। আজকে সবাই মাইক্রোবাসে করে যাবে। বলা যায় এটা জন্মদিনের অনুষ্ঠান কম,ভ্রমণ বেশি। অন্য রকম এক উত্তেজনা কাজ করছে।

“সায়রা দাঁড়া।”

জুথি কিছু খাবার নিয়ে এসেছে। সেটা ব্যাগে তুলে দিয়ে দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দিল।

“উফ ভাবি। তুমি কেমন মায়ের মতন করো।”

“মায়ের চেয়ে কম কীসের? আমার যখন বিয়ে হয় তখন তোর বয়স কত?”

সায়রা হাসল। মনে করে বলল,”তিন?”

“হুম। তিন বছরের ছিলি। আমাকে ভাবি কম মা বেশি মনে করতি।”

সায়রা আবার হাসল। আমিরা ও তৈরি হয়ে এসেছে। মেয়েটির প্রতি শুরুর দিকে বিশেষ এক রাগ অনুভব হলেও এখন আর তেমনটি লাগছে না জুথির। তবে বিশেষ কোনো ভালোবাসা ও অনুভব হয় না। এই অনুভব না হওয়ার পেছনেও যে বিশাল কাহিনী জড়িয়ে। সব স্মরণ করে জুথি দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। মানুষের জীবন বড়ো আশ্চর্যের!

জুঁই আর মাহিম ও এসেছে। তারা কিছু চকলেট এনে দিয়েছে আমিরাকে। পথে খাওয়ার জন্য। মারুফ নেই। অফিসে গিয়েছে। তবে সকালে এক হাজার টাকা রেখে গেছে। বলেছে সায়রাকে দিতে। সেটাই মনে করে এনে দিল জুথি।

“ভাইয়া, আবার টাকা কেন রাখতে গেল।”

“নিয়ে যা। পথে দরকার হলে।”

টাকা নিয়ে ব্যাগ গুলো হাতে তুলল সায়রা। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,”আসছি রে। ভালো হয়ে থাকবি। কোনো দুষ্টুমি না।”

আগে থেকেই রিকশা ঠিক করা ছিল। সেটায় ওঠে বসল ওরা। রিকশা চলতে শুরু করেছে। মৃদু একটা হাওয়া চোখ মুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে। ভালো লাগায় মন তৃপ্ত পেল যেন।

“আমরা সমুদ্র দেখব মিমি?”

“এখনো বলতে পারছি না রে। তবে কক্সবাজার যেহেতু যাব সেহেতু একটা কিছু তো দেখা হবেই।”

আমিরার চোখে মুখে উচ্ছ্বাস। মা বলেছিল এ বছর তারা সমুদ্র দেখতে যাবে। তারপর পাহাড়। একে একে সব ঘুরে দেখবে তারা। অথচ কোথায় হারিয়ে গেল মা? আর কোথায় বা হারিয়ে গেল বাবা। মা ছাড়া এতিম সে,মন খারাপ করে রইল। মনে মনে বলল,”আমাকে সাথে কেন নিলে না মা? তোমাকে যে বড্ড মনে পড়ে আমার। বড্ড মনে পড়ে।”

বাসার সামনেই দুটো মাইক্রোবাস রাখা। মানুষ জনে ভরা। সায়রা রিকশা থেকে নেমে বলল,”দাঁড়া রনু আপুকে কল করি। কোনটায় ওঠব।”

ও কল করতে অন্যদিকে ফিরল। তখনই বাসা থেকে বের হয়ে এল অনুভব। আমিরা ব্যাগ পত্র হাতে দাঁড়িয়ে। অনুভব ওর কাছে এল। আমিরা চোখ পিট পিট করে চাইল। ছেলেটা এত লম্বা কেন আর চিকন কেন!

“নাম কী?”

“আমিরা।”

“এখানে দাঁড়িয়ে কেন?”

এ প্রশ্নের জবাব দিল না আমিরা। অনুভব বুঝল মেয়েটি তার জবাব না দিয়ে অন্যায় করেছে। তাই মুখশ্রী গম্ভীর করল।

“কার সাথে এসেছ?”

আমিরা এবার ও জবাব দিল না। শুধু চাইল অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা সায়রার দিকে। পেছন দিকে ফিরে থাকায় সায়রাকে চিনল না অনুভব। তবে আমিরাকে ভয় দেখাতে দুষ্টুমি বুদ্ধি মাথায় আনল।

“আমিরা, তোমার মাথায় সাপ।”

সাপের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল আমিরা। চিৎকার করে ওঠল। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল সায়রা। আমিরাকে জড়িয়ে ধরে বলল,”কী হয়েছে? এই আমিরা। এমন কেন করছিস?”

“মিমি সাপ, আমার মাথায় সাপ। মিমি, মিমি।”

“সাপ,কোথায় সাপ?”

“মিমি সাপ।”

আমিরা সাপ খুব ভয় পায়। ছোট থেকেই। তাই বেশি প্যানিক করে ফেলেছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে অনুভব। ও একটু বেশিই অবাক হয়েছে। সামান্য সাপের কথা শুনে বাচ্চাটি কী না দিন দুনিয়া এক করে ফেলল! কিয়ৎ কাল পর শান্ত হলো আমিরা। কান্নায় চোখ মুখ মেখে আছে।

“কীসের সাপ? ভয় পাচ্ছিলি কেন?”

আমিরা অনুভবের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। সায়রা এত সময় পর চিকনা ছেলেটাকে দেখতে পেল।

“কী?”

“ও বলেছে। আমার মাথায় সাপ।”

সঙ্গে সঙ্গে আমিরার কথার প্রতিবাদ করে অনুভব বলল,”আমি কখন বললাম?”

সায়রা বুঝতে পারল বিষয়টা। আমিরার মিথ্যে বলার কারণ নেই। বিপরীতে মিথ্যেটা অনুভব ই বলতে পারে। কোনো কারণ ছাড়াই।

“এসবের কোনো মানে হয়? তুমি এটা কেন বললে?”

“আমি বলি নি।”

“আমিরা মিথ্যে বলে না।”

“তো আমি বলি?”

“হ্যাঁ। মাত্রই বললে মিথ্যেটা।”

অনুভব অন্য দিকে ফিরে রইল। সায়রা বিরক্তি নিয়ে আমিরাকে নিয়ে গাড়িতে ওঠল। তারা একটু লেট করে ফেলায় সবাই বাসে ওঠে বসেছে। একদম শেষের দিকে তিনটে সিট খালি। আমিরা আর সায়রা সেখানেই ওঠে বসল। অনুভব হেলে দুলে গাড়িতে ওঠে দেখল একটি মাত্রই সিট খালি। ও হতাশ হলো। আমিরা আর সায়রা ও হতাশ। এই তিনজন কে এতটা পথ নাকি পাশাপাশি বসে যেতে হবে। হায়রে ভাগ্য!

অনুভব শরীর বিশেষ এক ধরনের পারফিউম ব্যবহার করেছে। যার সুবাস সায়রার মাথা ধরিয়ে দিল। ও বেশ বিরক্ত, আহত। বার বার মুখশ্রীতে সেটা ফুটিয়ে তুলছে। আর সেটা অনেক সময় ধরেই লক্ষ্য করছে অনুভব। সে অপমানিত বোধ করছে। এবার কথাটা বলেই ফেলল।

“এই তোমার সমস্যা কী? এমন কেন করছ?”

“তোমার গায়ের বাজে পারফিউম।”

এ কথা বলতেই অনুভব চোখ ছোট ছোট করে চাইল। বাজে ফারফিউম! এটা ভীষণ দামি এক ব্র্যান্ডের সুগন্ধি। আর সেটাকে কী না বাজে বলছে মেয়েটা! ও চোখ মুখ শক্ত করে রইল। যেন অপমানটি হজমের চেষ্টা চলছে।

দুটো মাইক্রোবাস নিয়ে যাচ্ছে ওরা। মোট ৩২ জন। এখন দুপুরের সময়। স্বাভাবিক ভাবেই লাঞ্চ করার জন্য গাড়ি থামানো হলো। ওরা কত দূর এসেছে সায়রা জানে না। তবে শহর ছেড়ে গ্রামীণ এক পরিবেশ। ভালো লাগছে।

“আমিরা এদিকে আয়।”

আমিরাকে কাছে নিয়ে নিল সায়রা। বলল,”ওখান টায় দাঁড়া।”

মিমির কথা মতন দাঁড়াল আমিরা। সায়রা চট করে দুটো ছবি তুলে নিল।
“দারুণ আসে তো। আমাকে ছবি তুলে দে।”

সায়রা গিয়ে দাঁড়াল। তবে আমিরা ভালো করে ছবি তুলতে পারছে না। একবার দুবার করে অনেক গুলো ছবি তুলল তবে সায়রার পছন্দ হলো না। ওদের ওই কাহিনী দেখে হেসে ম রে যায় অনুভব। সায়রা চোখ গরম করে তাকায়। এই ছেলেটির সমস্যা কী?

লাঞ্চে অনেক বেশি খেতে পারছে না সায়রা। আমিরা ও তাই। দুজনেই একটুখানি খাবার নিয়েছে। রনু সেটা দেখে বলল,”এইটুকুই খাবে তোমরা?”

“আমরা একটু কম খাই আপু।”

“তোমরা যে কি। এই বয়সেই ডায়েট শুরু! ডায়েট তো আমাদের করা উচিত। অথচ দেখ,জিহ্বা সামলাতেই পারি না।”

রনুর কথায় হেসে নিল সায়রা। আমিরা খাওয়া শেষ করে বলল,”মিমি, ঐ ছেলেটার জন্মদিন?”

একটু দূরের টেবিলে বসে আছে আরহাম। সায়রা লক্ষ্য করে বলল,”হুম।”

“ওর সাথে কেউ খেলতে চায় না?”

“না রে। একটু অন্য রকম দেখে স্কুলের বন্ধুরা খেলতে চায় না।”

“ইস। আমার স্কুলে হলে আমি ওর সাথে খেলতাম।”

আমিরার চোখে মুখে আফসোস। সায়রা হাসল। এটা ভেবে খুশি হলো এই ছোট্ট আমিরাও মানুষ কে সহজ ভাবে নিতে শিখেছে। তার মাঝে, স্পেশাল চাইল্ড বলে কিছু নেই।

লাঞ্চ করে ওরা আবার মাইক্রোবাসে ওঠে বসেছে। আমিরা আর সায়রা দুজনেই গ্রামীণ পরিবেশ পছন্দ করে। তাই দুজন দুপাশের জানালার সিটে গিয়ে বসে পড়েছে। যাতে পরিবেশ উপভোগ করতে পারে। অনুভব ওঠে দেখল সায়রা তার জায়গায় বসেছে।

“এটা তো আমার জায়গা।”

“লেখা আছে?”

“আশ্চর্য! আমি তো এখানে বসে এসেছি।”

“এখন মাঝে বসো।”

“মানে কী? তোমাদের দুজনের মাঝে বসব আমি?”

“সমস্যা কী?”

“উফ, অসহ্য।”

অনুভব মাঝেই বসল। সায়রা আর আমিরা দুজনেই হাসছে। তারা ভাবতেও পারে নি অনুভব মেনে যাবে। যা ঘাড়ত্যাড়া ছেলে!

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-১০

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (১০)

“অনুভব তুমি কি কখনো সিরিয়াস হবে না?”

আমিন সাহেবের শরীর কাঁপছে। তিনি যেন বিশাল ঝড় পাড় করে এসেছেন। এদিকে তার একমাত্র ছেলে বিছানায় ল্যাদ মে রে ঘুমিয়ে আছে। তিনি ছেলেকে এক প্রকার টেনে টুনেই ওঠালেন। তবে পুত্র অনুভব যেন স্বপ্নে ভাসছে। তার সেই স্বপ্ন যে ভা ঙ ছেই না।

“ইটস টু মাচ বাবা। কতবার বলব, আমি এই সময়ে এই বিরক্তিকর পানীয়টা খেতে পারব না।”

ঘুমন্ত অনুভবের মুখে এক গ্লাস পানি ছুড়ে দিলেন আমিন সাহেব। ছেলেকে তিনি সকাল বেলা লেবু পানি খেতে বলেছেন। সেটাই হয়তো স্বপ্নে দেখছে। অনুভব চোখ মেলে তাকাতেই দেখল তার বাবার পোক্ত দেহটা। ও ভয় পেয়ে ছিটকে দূরে সরে গেল। বিছানার এক মাথা থেকে আরেক মাথা। তারপর স্মরণ করল, কথা ছিল আজ সে অফিসে যাবে। তাদের বিজনেস পার্টনারদের সাথে তার পরিচয় করানো হবে। এদিকে সে কী না পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে!

অনুভব মাথা নত করে রইল। আমিন সাহেব ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লেন। কপালে হাত দিয়ে বসে রইলেন।

“খুব খারাপ করলে অনুভব। আমি এতটা অপমানিত হলাম।”

অনুভব কথা বলে না। সে কী বলবে? আমিন সাহেব দীঘল শ্বাস ফেলেন। ওঠে পড়েন বসা থেকে।

“ঠিক আছে। তোমাকে আর প্রয়োজন নেই। তুমি দায়িত্ব নিতে চাচ্ছ না। তাহলে, এই ফ্যাসিলিটি ও পাবে না। সব বন্ধ।”

বাবার মুখের ওপর একটা কথা ও বলতে পারল না অনুভব। সে ভেবে দেখল, সে ভীষণ অলস প্রকৃতির। তার শুধু ঘুমাতে ইচ্ছা করে। দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছা জাগে না। তবে বাবার টাকা ছাড়া তার গতি কী আসলেই আছে? উহু নেই। এবার সত্যিই তার চোখে মুখে অসহায়ত্ত্বের ছাপ দেখা গেল। পাতলা গড়নের মুখখানি যেন আরো শুকিয়ে গেল। আহারে অনুভব!

মন খারাপ করে বাসার গেটের কাছে বসে আছে অনুভব। বাবা খুব রেগে বের হয়েছেন। মা বাসায় নেই। নানা বাড়িতে আছেন। তাকে কল করার পর সে বলেছে বাবার কাছে ক্ষমা চাইতে। অনুভব তাই গেটের কাছে বসে আছে। দারোয়ান গিয়েছে চা আনতে। সায়রা বেশ কিছু সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে। গেট বন্ধ দেখাচ্ছে। এদিকে সে একটু লেট করে ফেলেছে। ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আছে। তাই একেবারে তৈরি হয়ে আহনাফকে পড়াতে এসেছে।

“দারোয়ান কাকা, গেট খুলুন।”

শব্দ নেই। সায়রা আবার বলল,”দারোয়ান কাকা, গেট খুলুন।”

এবার ও কোনো শব্দ নেই। শব্দ আসবে কেমন করে? গেটে তো দারোয়ান নেই। যে আছে সে অনুভব। আর অনুভব তো ডুবে আছে গভীর ভাবনায়। যেন এই পৃথিবীর সমস্ত কিছু থেকে সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তার এখন একটাই লক্ষ্য,বাবার কাছে ক্ষমা চাওয়া। সায়রা বিরক্ত হয়ে এবার গেটে আ ঘা ত করল। কিয়ৎকাল পর গেট খুলে গেল।

“দারোয়ান কাকা,কত সময় ধরে চিল্লাচিল্লি করছি, গেট কেন খুলছিলেন না?”

এ কথা বলেই হনহনিয়ে চলে যেতে নিচ্ছিল সায়রা। তবে ও আবছা আবছা দেখতে গেল দারোয়ান আজ ভীষণ লম্বা হয়ে গেছে। পেটের ভুড়ি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। মোটা শরীরটা যেন হাওয়া হয়ে গেছে! এই অতি আশ্চর্য ঘটনা কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওকে দ্বিধায় ফেলে দিল। অনুভব দাঁত কিড়মিড় করে বলল,”আমাকে তোমার দারোয়ান মনে হয়?”

ছেলেটাকে ভালো মতন দেখে নিয়ে সায়রা বলল,”তো এখানে বসে আছ কেন? দারোয়ান হও, আর যেই হও, এত সময় চিল্লাচিল্লি করার পর ও কেন শুনছিলে না?”

“তুমি কী আমার নাম ধরে ডেকেছ?”

“তোমার নাম ধরে ডাকব কেন। আমি তো দারোয়ান কাকা বলে ডেকেছি।”

“তাহলে আমি কেন শুনব?”

“উফ আশ্চর্য তো!”

“আশ্চর্য তো তুমি।”

“ধুর।”

এক প্রকার বিরক্তি নিয়েই ছুটে গেল সায়রা। তবে লিফ্টের কাছে এসে দেখল লিফ্ট অফ। অনুভব বেশ ভাব নিয়ে ওর কাছে এল।

“হা, যাও এবার হেটে হেটে।”

“অসহ্য!”

শাড়ির কুচি ধরে এক প্রকার দৌড়াতে লাগল সায়রা। নয় তলায় ওঠতে হবে। কি আশ্চর্য! অনুভব এত সময় পর দেখল, সায়রা আজ শাড়ি পরে এসেছে। দুনিয়ার কিছুর প্রতিই কী তার আগ্রহ নেই?

আমিন সাহেব ফিরেছেন। তবে ছেলেকে পাত্তা দিচ্ছেন না। তিনি ভীষণ রেগে আছেন। অনুভব ও বসে নেই। চেষ্টা চালাচ্ছে। বাবার সাথে সে ফ্রি নয়। তবে একমাত্র সন্তান হওয়ায় স্নেহের পরিমাণ বেশি। সেই জন্যেই কী না বাবার সম্মুখে উপস্থিত হতে পেরেছে অনুভব। সে মাথা চুলকোচ্ছে।

“কী?”

আমিন সাহেবের ভরাট কণ্ঠ। যেন, তিনি জিম ট্রেনার! আর অনুভব তার ছাত্র। অনুভব শুকনো গলা ভেজানোর প্রয়াসে ঢোক গিলল।

“কিছু বল‍তে চাই।”

“তাহলে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? না বলে?”

“জি, অনুমতির জন্য।”

আমিন সাহেব চোখ সোজা করে চাইলেন। ছেলে তাকে তেল দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে এত সহজে তো তিনি এসব মানবেন না। তিনি বরং মুখের কঠোরতা ধরে রাখলেন।

“বাবা, মাফ চাচ্ছি। অভ্যেস নেই তো।”

“অভ্যেস নেই, বলে বাবার সম্মান খোয়াবে নাকি?”

“এরপর আর হবে না।”

“কী হবে না?”

“এমন ভুল।”

“এসব ছেলে ভুলানো কথা অনুভব। আমি বাচ্চা নই। তোমার জন্ম আমার দ্বারা হয়েছে। আমার জন্ম তোমার দ্বারা হয় নি।”

বাবার সোজা কথায় অনুভবের কান গরম হয়ে যায়। সে কিছুটা লজ্জিত বোধ করে।

“দুঃখিত বাবা।”

“সত্যিই দুঃখিত?”

এবার কণ্ঠটা নরম। অনুভব চট জলদি জবাব দেয়।

“খুবই দুঃখিত।”

“সুযোগ চাও?”

“জি চাই।”

সুযোগের কথায় অনুভব তো সায় দিল। তবে সে মনে মনে আসলে সুযোগ চায় না। এত দায়িত্ব তার ভালো লাগে না। সে পাখির মতন উড়ে বেড়াতে চায়। তার ভালো লাগার গুরুত্ব দিতে চায়।

“চাইছো যখন, তবে সুযোগ তুমি পাবে।”

অনুভবের মুখশ্রীতে আঁধার নামে। আমিন সাহেব ছেলের এই অবস্থা বুঝতে পারেন। তবে তিনি সেটা আমলে নেন না। এক মাত্র সন্তান তার। যদি এমন দায়িত্ব জ্ঞান হীন হয় তাহলে তো ভবিষ্যত রসাতলে যাবে। এমনটি করা যাবে না। কিছুতেই না।

সায়রার দেহ ক্লান্ত। বাসায় ফিরে দেখল আমিরা ঘুমিয়ে আছে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ও গেল শাওয়ার নিতে। শাওয়ার শেষ করে এসে দেখল অনেক গুলো কল এসেছে। আহনাফের মায়ের নাম্বার থেকে। ও চট করে কল ব্যাক করল।

“হ্যাঁ আপু। আমি আসলে গোসল করছিলাম। তাই ধরতে পারি নি।”

“ঠিক আছে সায়রা। কোনো ব্যাপার না। তোমাকে একটি ব্যাপার জানানোর জন্য কল করেছি।”

“কী?”

“আহনাফ তোমার সাথে ভীষণ মিশে গেছে। তোমায় বন্ধুর মতন ট্রিট করছে।”

সায়রা মৃদু হেসে বলল,”আসলে ওর সময় প্রয়োজন। এটা হলেই ও ঠিক হয়ে যাবে। ওর ডক্টর ও তাই বলেছিল।”

“হ্যাঁ।”

রনুর কণ্ঠে হতাশা। সে যেন ক্লান্ত সব কিছুতে। সায়রা অপেক্ষা করল। রনুই বলল,”আমি আর আহনাফের বাবা বেশির ভাগ সময় অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। আসলে ওকে সময় দেওয়া হয় নি তেমন। তার ওপর ও স্পেশাল চাইল্ড। আমরা একটা নির্দিষ্ট সময় বিষয় গুলো ভুল করে বসেছি। বুয়ার কাছে থেকেছে বেশি সময়। বুঝতেই পারছো, জীবনে টাকার পেছনে দৌড়াতে গিয়ে ছেলেটার ক্ষতি হয়ে গেল।”

“আসলে আপু এটা আপনাদের দোষ না। ভাগ্যের বেশি আমাদের হাতে কিছু নেই।”

“তা ঠিক। আচ্ছা, শোনো যেটা বলার ছিল। আহনাফের জন্মদিন তিনদিন বাদেই। তোমার তো অফ ডে। তাই আগেই জানিয়ে রাখলাম। তোমাকে কিন্তু আসতেই হবে। শোনো, ওর বাবা এটা এরেঞ্জ করেছে কক্সবাজারে। সেখানে আমাদের ব্যবসায়ীক একটা পার্টি ও রয়েছে। সেই সাথে আহনাফের বার্থডে টাও সেলিব্রেট করতে চাইছিলাম। তুমি কিন্তু মিস দিবে না। আমি টাইম বলে দিব,সময় মতন আমাদের বাসায় চলে আসব। আমরা সবাই এক সাথে যাব।”

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-০৯

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৯)

আরো দুটো টিউশনি নিয়েছে সায়রা। প্রয়োজন ছিল না, তবু সে নিয়েছে। এর কারণ নিজেকে যতটা সম্ভব অধিক ব্যস্ত রাখা। ভীষণ ক্লান্তিতে ডুবিয়ে দেওয়া। কারণ এতে তার অতীত স্মরণ কম হবে। কাজের ব্যস্ততা দুঃখ লাঘব করবে। আর যদি, সে এমনটি না করে তাহলে সে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যাবে। সাঈদের কথা স্মরণ হলেই যে ওর বুক কাঁপে। একটু ফুসরত পেলেই ছেলেটার ছবি দেখার ভীষণ ইচ্ছে জাগে। সায়রার টিউশনি থাকে লম্বা সময় জুড়ে। তাই আজকাল বাসায় ফিরতে ও ভীষণ দেরি হয়। ও যখন ফিরে তখন দুপুরের খাবার সবাই খেয়ে নিয়েছে। কিন্তু আজকে ফিরে দেখল কেউ ই খাবার খায় নি। সবাই অপেক্ষা করছে। বাড়ি-ঘর কেমন চকচক করছে। ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে।

“এসেছিস, যা দ্রুত গোসল করে নে।”

সায়রা নিজের ব্যাগ রাখতে রাখতে বলল,”কেন ভাবি? এত তাড়া কেন আজ?”

জুথি তেমন একটা জবাব দিল না। ইনিয়ে বিনিয়ে বলে ওকে পাঠিয়ে দিল। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে ফিরল সায়রা। চুল গুলো মুছতে মুছতে দেখল নতুন জামা পরেছে আমিরা।

“কী রে, আজ এত ফিটফাট কেন?”

আমিরা চুপ। সায়রার চোখে মুখে বিস্ময়। ও খুব করে বুঝতে পারছে, তার অগোচরে বাড়িতে কিছু হচ্ছে। তবে বিষয়টা সহসাই ধরা যাচ্ছে না।

ডাইনিং এর খাবারের আয়োজন দেখে সায়রার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। সচরাচর এ রকমের আয়োজন তারা করে না। সংসার চলে ছিমছাম ভাবে যতটা প্রয়োজন ঠিক ততটাই। আজকের এই আয়োজন, নিশ্চয়ই সমস্যাটি গভীর হবে। সায়রা জানে, প্রশ্ন করে লাভ নেই। এরা বলবে না যেহেতু, তাই চুপ থাকাই ভালো। তাছাড়া এই জগতের কোনো কিছুতেই আজকাল ওর আগ্রহ থাকে না। মনে হয়, জীবন পানসে হয়ে গেছে।

যখন ঘড়িতে সাড়ে তিনটা বাজে তখন বাড়ির সামনে এক দল মানুষ এসে উপস্থিত হলেন। দরজা খুলে সায়রা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। ডাইনিং থেকে ছুটে এল জুথি। যথেষ্ট সমাদরের সাথে ভেতরে নেওয়া হলো মানুষ গুলোকে। এদিকে সায়রা চুপ, তার মন মস্তিষ্ক বিষয়টি ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে।

জুথি যখন নাশতা পানির আয়োজন করছে তখন সায়রা গিয়ে বলল,”ভাবি, ঘটনা কি বলো তো।”

“ঘটনা আবার কি?”

“এরা, ভাইয়ার কলিগের ফ্যামেলি তাই না।”

“হুম।”

“কেন এসেছে?”

“ওমা কেন আসবে? তুই কেমন করে বলছিস রে সায়রা।”

“ভাবি, আমি কিন্তু বুঝতে পারছি।”

“কী বুঝতে পারছিস?”

সায়রা থম ধরে থাকে। জুথি নাশতার ট্রে দিয়ে ফিরে আসে। তারপর বলে,”শোন, তোর প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে।”

“দায়িত্বের নাম করে তাড়িয়ে দিতে চাইছো ভাবি?”

জুথি হাসে। সায়রার গাল স্পর্শ করে বলে,”যদি তেমনটি ভাবিস, তবে তেমনটিই।”

“ভাবি।”

সায়রার মুখে অসহায়ত্ত্বের ছায়া। জুথি একটা নিশ্বাস ফেলে। কিছুটা গুমোট স্বরে বলে,”তুই কী সারাটা জীবন বিয়ে না করেই থাকবি?”

এ প্রশ্নের জবাবে সায়রা মৌন থাকে। ভাবে কি বলা যায়। আসলে উত্তরটি ওর হৃদয়ে আছে। তবে বের হতে চাচ্ছে না। ও একটু সময় গেলে জবাব দেয়,”হ্যাঁ ভাবি। আমি সারা জীবন এমনই থাকব। এই জীবন অনেক সুন্দর ভাবি।”

“এসব শুধুই কল্প খেয়াল সায়রা। জীবনে একা থাকা যায় না। ওসব মানুষ ভাবতেই পারে। ভাবনাতেই সুন্দর লাগে। আদতে এসব মানুষকে অসুস্থ করে তুলে।”

“কেন জীবনে একা থাকা যায় না?”

“অনেক কারণ আছে।”

“ছয় বছরের সম্পর্ক ছিল। অথচ আমি কিন্তু একাই আছি। সম্পর্কের কোনো মূল্য আছে বলো তো? যখন তখন ভে ঙে যেতে পারে। কোনো নিশ্চিয়তা নেই।”

“সব ই বুঝলাম। তবে তুই তো এভাবে থাকতে পারবি না। সঙ্গীর প্রয়োজন পড়বেই।”

“আমার কাছে আমিরা আছে ভাবি।”

“মানলাম আমিরা আছে। তবে তুই ই বল, ও কি সারাজীবন তোর কাছেই থাকবে? এটা সম্ভব?”

এবার সায়রার মাথায় চিন্তা ভর করে। সত্যিই তাই। আমিরা তো সারাজীবন তার কাছে থাকবে না। মেয়েটি বড়ো হচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর আমিরাকেও বিয়ে দিতে হবে। তখন সায়রার কি হবে? অনেক রকমের চিন্তা এসে ভর করল সায়রার মস্তিষ্কে। ও শুকনো ঢোক গিলল। গলা ভেজানোর প্রয়াস করল। তবে সবটাই ব্যর্থ।

মারুফের কলিগ সহ তার পরিবার খাবার খেতে বসেছে। আর পরিবেশন করে চলেছে সায়রা। ও যথেষ্ট নম্র, ভদ্র। খুবই সাধারণ আচরণ করছে। সেই সুযোগেই জুথি বলল,”তাহলে কী আজ ই কথা বলব?”

“ভাবি আমার সময়ের প্রয়োজন।”

এ কথার পর জুথি আর কিছু বলল না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাদের খাবারের তদারকি করতে লাগল। মেহমান দের বিদায় দিয়ে সায়রা এল নিজের ঘরে। তারপর পুরনো সব জিনিসপত্র বের করল। যার সব কিছুতে সাঈদের স্মৃতি মিশে আছে। ও ধীরে স্বস্তে সব গুলো স্মৃতি গুছিয়ে রাখল। জুথি সেসব দেখে বলল,”তোর উচিত, এসব ফেলে দেওয়া।”

“থাক না পুরো অতীত। ফেলে দিলেই তো মুছে যাবে না।”

“যেই মানুষ টাই তোর নেই, তার জিনিস ধরে রাখার কোনো দরকার কী আছে?”

“ভাবি, এসব যখন সাঈদ আমাকে দিয়েছিল, তখন ও কিন্তু আমার ই ছিল। আমি চাইলেই সেই সময় গুলো অস্বীকার করতে পারব না। এটা সম্ভব না।”

জুথি চুপচাপ সব দেখতে থাকে। সায়রা কাবাড বন্ধ করে পুনরায় বলে,”তবে আজকের বিষয়টা ঠিক হয় নি। তারা যে আসবে এটা আমাকে বলে নেওয়া উচিত ছিল।”

“তুই, বললে নিষেধ করে দিতি।”

“তা করতাম। তবে তোমাদের বলে নেওয়া উচিত ছিল। আমার খুব আন ইজি লেগেছে।”

জুথি বুঝল বিষয়টা আসলেই ভুল হয়েছে। ওর একটু মন খারাপ হলো। তবে যা হবার তা তো হয়েছেই। চাইলেই তো পরিবর্তন সম্ভব না।

রাতের খাবারের সময় মারুফ বলল,”আমিরা স্কুলে ভালো ফলাফল করছে। আজ ফেরার পথে ওর ক্লাস টিচারের সাথে দেখা হয়েছিল। স্যার বেশ প্রশংসা করলেন।”

সায়রার ভালো লাগল। ও আমিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,”ও তো সবসময়ই ব্রাইট ছিল ভাইয়া।”

“হুম। শুধু শেষ সময়ে ঐ জানোয়ারটা….”

ভাইকে আটকে দেওয়ার প্রয়াসে সায়রা বলল,”বাদ দাও ওসব কথা। আমিরা তোর খাওয়া হয়েছে? খাওয়া শেষ করে সোজা ঘুমাতে যাবি।”

আমিরা মাথা দু দিকে দুলিয়ে ভাতের শেষ লোকমা তুলে চলে গেল। সায়রা নম্র সুরে বলল,”ভাইয়া, আমি চাই, আমিরা যেন কখনো অতীত স্মরণ না করে। ওর বাবার প্রতি ঘৃণা এমনিতেই আছে। তবে চাই না সেটা স্মরণ করে ও কষ্ট পাক।”

মারুফ কথাটা বুঝতে পারল। ও সেটা মেনে নিয়ে বলল,”আচ্ছা ঠিক আছে। আর কখনো ওর সামনে বলব না এসব। এখন তুই বল, সামনে কী করবি?”

“গ্রাজুয়েশন শেষ করে জব নিব। আর সাথে মাস্টার্সটা ও কমপ্লিট করব।”

“সেটা না হয় করবি। তবে মাস্টার্সের আগে বিয়েটা করে নিলে হয় না?”

“এত বিয়ে বিয়ে কেন করছো ভাইয়া? আমি তো তোমাদের ঘাড়ে বসে খাচ্ছি না। তোমরা কেন বুঝতে পারছো না আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। সব সময় বিয়ে বিয়ে আর বিয়ে। বিয়ে ছাড়া জীবনে কী আর কিছু নেই?”

হুট করেই সায়রা যেন রেগে গেল। মারুফ কিছু বলতে যাচ্ছিল তবে ওকে চোখের ইশারায় থামিয়ে দিল জুথি। সায়রা খাবার না খেয়েই ওঠে গেছে। জুথি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল‍,”ওর সময় দরকার। মাত্রই বিষয় গুলো মেনে নিতে শিখেছে।”

মারুফ কথা বলে‍ না। চুপ করে থাকে। বোনের কষ্ট সেও উপলব্ধি করে। তবে বয়স হচ্ছে। এমনিতেই আশে পাশের মানুষ আড়ালে আবডালে মেয়েটির নামে সমালোচনা করে। কত সমস্যা রয়েছে। যা ওকে, বাধ্য করে বিয়ের কথা তুলতে।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ ন‍ৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-০৮

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৮)

তখন মধ্যরাত। সায়রা পড়ছে। ভীষণ মনোযোগে। টিউশনির কারণে তার সময়ের ঘাটতি ঘটেছে। পড়াশোনাটা ঠিক ঠাক হচ্ছে না। বাচ্চা পড়াতে ব্রেনের খরচ হয় বেশি। শরীরে ক্লান্তি আসে। তবে পড়াশোনা তো ছাড়া যাবে না। টিউশনি ও ছাড়া যাবে না। সেই জন্যে অধিক রাত অবধি পড়ছে সে। সি জি পি এ ভালো না হলে সামনে অনেক সমস্যায় পড়তে হবে। এ রকমের চিন্তা থেকেই কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে মেয়েটা। ওর ঠিক পাশেই ঘুমিয়ে আছে আমিরা। মেয়েটার বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামনে কত রকমের প্রতিবন্ধকতা আছে। ওর দিকে চাইলেই কেমন মা মা অনুভূতি আসে সায়রার। অথচ দেখতে গেলে আমিরা আর তার বয়সের পার্থক্য এক যুগের ও কম। তবে মমতার দিক থেকে তার বয়স যেন ঢের বেশি। ঐ যে তার আপার বয়সের কাছাকাছি। যদি তেমনটা না হতো তবে সে কি পারত এই সংগ্রামে অংশ নিতে? উহু পারত না। সায়রা আমিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কফি আনতে গেল। অনেক রাত অবধি জাগতে হবে। চোখে বেশ ঘুম ঘুম একটা ভাব রয়েছে। ও চুলোয় গরম পানি বসিয়ে ফোন অন করতেই দেখল, বেশ অনেক গুলো ম্যাসেজ এসেছে। সাঈদের একাউন্ট থেকে! ও একবার ভাবল ম্যাসেজ গুলো দেখবে না। আবার ভাবল, দেখাই যাক। কিংবা লোভ সামলাতে পারল না। ও ম্যাসেজ সীন করতেই সরাসরি কল এল সাঈদের থেকে। তার মানে ছেলেটা এখনো জেগে আছে! অপেক্ষা করছিল কী? সায়রা একটু ভরকে গেল। তবে রিসিভ করতে ও বিলম্ব হলো না।

“সায়রা, তুমি কি একটু বাইরে আসতে পারবে।”

অদ্ভুত! এত রাতে সে বাইরে কেন যাবে। হুট করেই প্রশ্ন করাতে কিছুটা মৌনতা এসে গেল ওর মাঝে। সময় নিয়ে নিজেকে শক্ত করে ও পাল্টা জবাব দিল।

“এত রাতে, বাইরে কেন যাব?”

“আমি আসছি।”

“তুমি আসছো মানে! পাগল নাকি। কটা বাজে দেখেছো? আর শীতের তীব্রতা দেখো না?”

বেশ কিছু দিন ধরেই শীত বেড়ে চলেছে। মনে হচ্ছে বরফ পড়বে। দিনে যা ও সহনশীল থাকে রাত হলে মনে হয়, পৃথিবীটা বুঝি ফ্রিজের মধ্যে ঢুকে গেছে। তার সাথে শির শির বাতাস। সব মিলিয়ে ভীষণ যন্ত্রণার।

“একটু আসবে প্লিজ?”

“সাঈদ, এখন অনেক রাত। তুমি ফিরে যাও। এসো না।”

“প্লিজ একবার আসো।”

সায়রার হৃদয় ধক করে ওঠছে। ওদের দুজনের কথা হলো প্রায় দু মাস পর। এই দু মাস যেন কীভাবে পার হয়ে গেল। হয়তো নানান ব্যস্ততা সংগ্রামে সায়রা টের পায় নি। কিংবা পেয়েছে, পাত্তা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে নি। সায়রা অবশ্য সেই দুঃখ, যন্ত্রণা স্মরণ করতে চাইল না। ও মিনমিনে কণ্ঠে বলল,”ঠিক আছে। আমি আসছি।”

দু কাপ কফি বানিয়ে বের হলো সায়রা। খুব গোপনে। যাতে বাসার অন্য কেউ জেগে না ওঠে। ওদের এই ছোট্ট দোতলা বাসাটার জন্য আলাদা কোনো দারোয়ান নেই। তাই, বের হতে সমস্যা হলো না একদমই। ও বের হয়েই দেখল সাঈদ দাঁড়িয়ে আছে। শরীরে কোনো শীতবস্ত্র নেই! জাস্ট একটা পাতলা টি শার্ট। চুল গুলো অগোছালো। মনে হচ্ছে অনেকদিন পরিচর্যা হয় না।

“এভাবে কেন এসেছো? জ্যাকেট কেন আনো নি?”

ওর কথার জবাব দিল না সাঈদ। সায়রা কিছু সময় অপেক্ষা করে কফি বাড়িয়ে দিল। সাঈদ সেটা নেওয়ার পর বলল,”আমি চাদর নিয়ে আসছি।”

সায়রার হাতটা ধরে ফেলল সাঈদ। কি এক সংকট তার হৃদয়ে। সায়রা থমকে রইল। ওর বুকের ভেতর কেমন ধীম ধীম করছে। ও শুকনো ঢোক গিলছে। যেন গলাটা ভীষণ তৃষ্ণায় কাঠ হয়ে আছে।

সাঈদের চোখ মুখ কেমন শুকনো। দু মাস পরের দর্শনের সায়রার মনে হলো অনেক কিছু বদলে গেছে। কিংবা বদলায় নি, তার দৃষ্টির বদল ঘটেছে। কে জানে। সায়রা তো বুঝে ওঠতে পারছে না। ওর মাঝে মাঝে মনে হয়, ও হয়তো পাগল হয়ে যাচ্ছে। প্রায় অনুভূতি আসে না। আবার কখনো সখনো ভীষণ কান্নায় বুক পাঁজর ভে ঙে আসে।

“কিছু বলবে?”

সায়রার কণ্ঠে যেন সাঈদের ঘোর ভা ঙে। ও ভীষণ ক্লান্ত, বিভ্রান্ত, অসহায়।

“হ্যাঁ।”

ছোট্ট শব্দটি উচ্চারণ করেই সায়রার দিকে অগ্রসর হলো সাঈদ। মেয়েটির মুখশ্রী ভালো মতন পরখ করে নিয়ে বলল,”তোমাকে এত ভালোবাসি কেন বলো তো?”

সায়রার অনুভূতি সব বের হতে চায়। তবে ও সেসব কে পাত্তা না দিয়ে বলে,”এটা বলার জন্য এই মাঝ রাতে চলে এসেছো?”

“হ্যাঁ।”

সায়রা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। মানুষটা পাগল নাকি? সময়ের সাথে সাথে কেমন বাচ্চামি চলে এসেছে! নাকি এসব খুবই স্বাভাবিক, কেবল ওর কাছেই অস্বাভাবিক লাগছে।

“অপেক্ষা করো, আমি চাদর নিয়ে আসি।”

“না,লাগবে না।”

“ঠান্ডা লাগছে না?”

“না।”

“সাঈদ।”

“আমাকে বিয়ে করবে?”

সায়রা চমকে তাকাল। ভালো মতন দেখল সাঈদের মুখশ্রী। বিভ্রান্ত, কষ্টের সাগরে ভেসে যাওয়া এক মুখ।

“বলো, বিয়ে করবে আমায়?”

সায়রা উত্তর না দিয়ে মৌন থাকে। সাঈদ আবার একই প্রশ্ন করে, তবে মৌনতা যায় না সায়রার।

“কী বলতে চাও?”

“আমি তোমাকে নিয়ে দূরে চলে যেতে চাই। আমিরাকেও নিয়ে যাব। আমরা অনেক দূরে চলে যাব সায়রা। অনেক দূরে।”

সায়রা চুপ। সাঈদ ওর হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে পুনরায় একই কথা বলতে থাকে। সায়রার থেকে উত্তর আসে না। ও হাত সরিয়ে নিয়ে অন্য পাশে তাকিয়ে থাকে। আরো কিছুটা সময় পার হলে সায়রা বলে,”এটা সম্ভব না। তুমি চলে যাও সাঈদ। প্লিজ চলে যাও।”

সাঈদ খোলা চোখে তাকিয়ে থাকে। ওর ঠোঁট দুটো কাঁপছে। সায়রা এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে না। চলে আসে বাড়ির ভেতরে। সাঈদ তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকে সে। পলকহীন ভাবে। বিভ্রান্ত, আর করুণ চোখে। এই তাকিয়ে থাকার যেন শেষ নেই।

বাড়িতে প্রবেশমাত্রই একটি ছায়ার মুখে পড়ে সায়রা। ভীতি ঠেকে ওর মুখশ্রী জুড়ে।

“একটু বাইরে গিয়েছিলাম ভাবি।”

“সাঈদ এসেছে?”

জুথির কণ্ঠে কঠোরতা নেমে এসেছে। সায়রা হেসে বলে,”এমনি। পাগল সে। চলে যেতে বলেছি।”

এ কথা বলেই পালানোর মতন করে চলে যেতে নেয় সায়রা। জুথি ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। ভালো মতন দেখে।

“বিয়ে করতে চাচ্ছে?”

সায়রা জবাব দেয় না। মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে। জুথি আবার বলে,”যাচ্ছিস না কেন?”

সায়রা এবার ও চুপ থাকে। জুথি ওর মুখশ্রী হাতে নেয়। এই মেয়েটিকে সেই কত ছোট দেখেছে। আজ কত বড়ো হয়ে গেছে!

“আমিরাকে আমি দেখব। কথা দিলাম। তুই নিজে সুখী হ। সাঈদ কে ফিরিয়ে দিস না।”

এ কথা বলতেই সায়রা এবার হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। জুথির ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্ব ল তে থাকে।

“ভাবি, আমি যে শেষ হয়ে গেলাম। শেষ হয়ে গেলাম আমি।”

সায়রা ওভাবেই কাঁদতে থাকে। জুথি ওকে আগলে নেয়। ওর চোখেও জল চলে এসেছে। পরিস্থিতি, সংকট, এ এক বড়ো কঠিন সত্য।

সমস্ত রাত ঘুম হয় নি সায়রার। ও আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি এক আশ্চর্য ব্যথা ওকে মে রে ফেলছে একটু একটু করে।

সকাল বেলাতেই প্রচন্ড জ্বর হলো সায়রার। ও কাঁপতে কাঁপতে রনুকে কল করল।

“হ্যাঁ সায়রা কেমন আছ?”

“কিছুটা অসুস্থ আপু। আমি আহনাফকে কিছুদিন পর পড়াতে আসব। কোনো সমস্যা হবে?”

“না না, সমস্যা কেন হবে। তুমি বরং সুস্থ হয়ে আসো।”

“ঠিক আছে আপু।”

“তুমি নিজের খেয়াল রেখো। সুস্থ না হয়ে আসবে না।”

“জি আপু, ধন্যবাদ।”

কল রাখতেই দেখল, জুথি গরম গরম চা নিয়ে এসেছে। সায়রা মৃদু সুরে বলল,”খেতে ইচ্ছা করছে না ভাবি।”

“গলা তো বসে গেছে। না খেলে তো সমস্যা।”

“কিছু হবে না ভাবি।”

“বেশি কথা বলিস না তো।”

জুথি চা এগিয়ে দেয়। তারপর বিছানাও গুছিয়ে দেয়। আমিরা হাত মুখ ধুয়ে আসলে তাকে ডাইনিং এ যেতে বলে। সায়রা উদাসীন ভরা নয়নে সামনে তাকিয়ে আছে। আহারে জীবন!

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-০৭

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৭)

ছোট্ট আমিরা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে সায়রাকে। মনে হচ্ছে কোনো ছোট্ট ছানা তার মা কে শক্তপোক্ত হাতে জড়িয়ে আছে। ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে যেন। কথায় আছে মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি। যদিও বাক্যটির প্রেক্ষাপট বিপরীত তবে সায়রার ক্ষেত্রে বাক্যটি ঠিকঠাক। বলা চলে শতভাগ সত্য। এই যে মা হীনা মেয়েটিকে নিজের সবটুকু দিয়ে মায়ের মতন আগলে রেখেছে সে। এই অনুভূতি অবশ্য ছোট থেকেই ছিল। আমিরা যখন দু বছরের তখন একবার বাচ্চাটির ভীষণ জ্বর হয়েছিল। জ্বরের সাথে লাগাতার বমি। চোখ মুখ ভয়ানক লাগছিল। তখনই তাকে হসপিটালে নেওয়া হয়। সেই জ্বরে প্রায় ম র তেই বসেছিল দু বছরের আমিরা। সায়রার বয়স ই বা তখন কত? ১২ কি ১৩। ঐ টুকু বয়সেই সে প্রায় তোলপাড় করে দিয়েছিল। হসপিটালের করিডোরে সে কী কান্না ওর। সেদিনই হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমেনাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তার চলে যাওয়ার পর ও আমিরাকে আগলে নেওয়ার মানুষ আছে। সে নিজের সব দিয়ে হলেও মেয়েটিকে আগলে রাখবে। আর তাই হয়তো এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে, নিজের বাচ্চাটিকে ফেলে সে চলে গেল সাত দিনের পেট ব্যথা আর জ্বরে। না ফেরার দেশে। একটা গভীর নিশ্বাস নেমে এল সায়রার ভেতর থেকে। আপুর মৃ ত্যু টা ভীষণ বেদনার। কি যে রোগ হয়েছিল কে জানে। সায়রার মনে পড়ে, আমেনা ওকে ফোন করে প্রায় বলত আমি বোধহয় আর বাঁচব না রে। আমার আমিরা এতিম হয়ে যাবে। ওকে কে দেখবে। আর কত কথা বলত আমেনা। সায়রা কি জানত, আপা মিথ্যে আশঙ্কা করে নি। সবটাই ছিল সত্যি। সায়রার বুকের ব্যথা বৃদ্ধি হয়। চোখ দুটো শুকিয়ে গেছে। কান্না আসছ না আপুর জন্য। বার বার মনে হচ্ছে আপু নিষ্ঠুর। নতুবা তাকে এত বড়ো দায়িত্ব দিয়ে কীভাবে ঘুমিয়ে আছে মাটির ঘরে? সায়রা চোখ বন্ধ করে। আপন মনে কিছু সময় আমিরার চুলে বিলি কাটতে থাকে। তারপর আদুরে কণ্ঠে ডাকে।

“আমিরা, আমিরা। ওঠ, বেলা হয়েছে।”

আমিরা ঘুমের কণ্ঠেই জবাব দেয়। “আরেকটু ঘুমাই মা।”

‘মা’ শব্দটি বলতেই কোথাও একটা আর্তনাদ শুরু হয়ে যায়। সায়রা কথা বলে না চুপ করে থাকে। যেন মেয়েটিকে বুঝতে দিতে চাইছে না তার মা পাশে নেই। সে চলে গেছে বহুদূরে। যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়।

আমিরার ঘুম ভা ঙে আরো কিছু সময় পর। ও চোখ থেকে ঘুমের ভাব সরিয়ে বলে,”মিমি কটা বাজে?”

“আট টা।”

“আরেকটু ঘুমাই?”

“না রে। আর ঘুমানো যাবে না। তোকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যাব।”

“এখনই?”

“হ্যাঁ।”

আমিরার অধর কোণে হাসির দেখা মিলে। ও চট জলদি ওঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। সায়রা ততক্ষণে বিছানা গুছিয়ে ফেলে।

নাশতার টেবিলে সায়রা বলল,”আমিরাকে জুঁই,মাহিম স্কুলে ভর্তি করাতে নিচ্ছি।”

“এত টাকা খরচ না করলেই কী হয় না? আশে পাশের স্কুল কিন্তু খারাপ না।”

জুথির কথায় আমিরা মুখটা শুকিয়ে আসে। সায়রা সেটা দেখে জুথির দিকে করুণ করে তাকায়। বলে,”না ভাবি, আমিরা ঐ স্কুলেই পড়বে।”

“দেখ, তুই হয়তো আমার কথাটা বুঝতে পারিস নি। যদি সব টাকা এখানেই খরচ করে ফেলিস, তবে তোর ভবিষ্যত টা কী?”

“আমার তো ভবিষ্যত একটাই ভাবি। আমিরা, ওকে নিয়েই এখন আমার সব।”

জুথি হতাশ হয়ে চেয়ে থাকে। যত যাই হোক, সায়রার প্রতি বিশেষ স্নেহ তার আছে। সে চায় সায়রা সুন্দর একটি সংসার পাক। কিন্তু এভাবে কিছু কী সম্ভব?

লুকিয়ে পাঁচশ টাকা দিল মারুফ। আমিরা নিতে চাচ্ছে না। তবে মারুফ নিচু স্বরে বলল,”চুপ। এটা রাখ, পরে কাজে লাগবে।”

আমিরা চুপ করে থাকে। মারুফের খারাপ লাগে। বোনের মেয়েটিকে সে ও ভালোবাসে। তবে নিজের সংসার গুছিয়ে আসলেই সব সম্ভব হয় না।

আমিরার জীবনের সবথেকে সুন্দর দিন আজ। সে আবার স্কুলে যাবে। মিমি তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। এখন তারা যাচ্ছে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কিনতে। ব্যাগ, স্কুল ড্রেস, জুতো, বোতল, টিফিন বক্স। সব কিছু কিনতে হবে। সায়রা তার জমানো টাকা বের করে এনেছে। আহনাফ কে পড়ানোর জন্য আট হাজার টাকা দিয়েছে এ মাসে। যদিও অর্ধেক মাস ছিল, তবু ও পুরো টাকা দেওয়া হয়েছে। আগের টিউশনি থেকে পাঁচ হাজার করে দেওয়া হয়। আহনাফ যেহেতু স্পেশাল চাইল্ড তাই তার জন্য বেশি টাকা দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে হিসাব করলে আমিরাকে পড়াতে সমস্যা হবে না। বরং ভালো ভাবেই সব করা যাবে। সায়রা আমিরার হাত ধরে রাস্তা পার হলো। তারপর রিকশা নিল।

“মিমি,তুমি কক্সবাজার গিয়েছিলে?”

“গিয়েছিলাম তো।”

“মা ও গিয়েছিল?”

“হ্যাঁ। আমরা সবাই গিয়েছিলাম। বাবা – মা, আপু,ভাইয়া সবাই। তখন ভাবি ছিল না। কিন্তু কেন বল তো?”

আমিরা চুপ করে রইল। সায়রা ওর দিকে চেয়ে বুঝল মেয়েটির মন খারাপ। ও বলল,”কেন? তোর যেতে ইচ্ছা হয়?”

আমিরা এবার ও চুপ। মা থাকলে নিশ্চয়ই আবদার করে বসত। তবে মিমির কাছে কথাটা বলতে পারছে না। তার হৃদয়ে সংকোচ হচ্ছে।

“বুঝেছি, সময় করে একবার যাব। ঠিক আছে?”

আমিরা কেবল মাথা দোলাল। গত রাতে জুঁই আপু আর মাহিম ভাইয়া ফটো অ্যালবাম বের করেছিল। কিছু বছর আগে তারা ও কক্সবাজার গিয়েছিল। আনন্দ করেছে খুব। ওসব দেখার পর থেকেই ওর কক্সবাজার যেতে ইচ্ছা করছে। তবে যার মা নেই, বাবা থাকতেও বাবা নেই। তার শখ, ইচ্ছা কতটা প্রাধান্য যোগ্য? ও শক্ত হাতে মিমিকে জড়িয়ে ধরল। সায়রা ও মেয়েটি ভরসা দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিল।

“যখন যা ইচ্ছা করবে আমাকে বলবি, আমি সবটা পূরণ করব। দেখিস, তোর সমস্ত ইচ্ছা পূরণ করব আমি।”

আজ আবার অর্পা কল করেছে। সায়রা পড়ছিল। স্কুলে ভর্তি করিয়ে প্রয়োজন জিনিস নিয়ে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায়। তাই আমিরাকে নিয়ে বাসায় ফেরার পর থেকেই সে পড়ছে। তার অনেক পড়া বাকি। এদিকে টানা কল করে চলেছে অর্পা। সায়রা না ধরে পারল না। এক হাতে ফোন আরেক হাতে কলম।

“হ্যাঁ অর্পা। বল কেমন আছিস?”

“চলছে। তোর কী খবর?”

“আমারো চলছে। আল্লাহ যেমন রেখেছেন।”

“তুই কী করছিস এখন?”

“পড়ছিলাম।”

“পরে কল করি তাহলে?”

“না, না এখনই বল। সমস্যা নেই।”

“আসলে…..”

সায়রা ওর সংকোচ অনুভব করে হাসল। মৃদু হেসে বলল,”আরে বল না কি বলবি।”

“ইটস আ ব্যাড নিউজ। পরে বলি, তুই এখন পড়।”

“না তুই এখনই বল। এমনিতেও আমার জীবনে ব্যাড এর শেষ নেই।”

“অ্যাকচুয়ালি সাঈদ ভাইয়ার মা, মেয়ে দেখতে গিয়েছেন। এবার হয়তো কিছু একটা ফাইনাল করেই আসবেন।”

সায়রার মাথায় আকাশ ভা ঙা র কথা থাকলেও তেমনটি হলো না। ও বরং মুখের হাসি বহাল রেখেই বলল,”এই ব্যাপার।”

“দোস্ত, তুই ভে ঙে পড়িস না।”

“না, ভা ঙ ব কেন? আমি আসলে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাছাড়া আরো আগে থেকেই ওনারা আমাকে পছন্দ করছিলেন না। তাদের ছেলে আরো ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে কী না।”

“দোস্ত এভাবে বলিস না। তোর কমতি কী বল তো?”

“কমতি আমার বাবা-মা নেই। ভাবির সংসারে আছি। নিশ্চয়ই স্বভাব খারাপ। শাসন করার মানুষ নেই। নিজের টাকায় চলি। চাকরি করতে চাই। সংসার হলেও মন টিকবে না। আর কত কমতি আমার।”

অর্পা কী বলবে বুঝতে পারছে না। ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে এসব কথা সাঈদের মা ই বলেছেন।

“ওনি আসলে এমনই রে। আশে পাশের কারো সাথেই সম্পর্ক ঠিক নেই।”

“যাক, তারপর বল তোর কী খবর? অনেক দিন দেখি না তোকে।”

“একদিন সময় করে আসব। আমিরাকেও দেখার আছে। বাচ্চাটা খুব মিষ্টি।”

সায়রা হাসল। দুজনের কথোপকথন চলল কিছু সময়। কল রেখে সায়রা পুনরায় পড়ায় মনোযোগ দিল। তবে কিছুতেই শব্দ গুলো উচ্চারণ করতে পারল না। বরং তার চোখ দিয়ে নোনা জল নামতে লাগল। এই অশ্রু তার জন্য বরাদ্দ হয়ে গেল যেন।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-০৬

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৬)

আয়োজন চলছে। লুকিয়ে, লুকিয়ে। জুঁই ঘর সাজানোয় ব্যস্ত। ছোট ছোট কালারফুল লাইট। আর বেশ কিছু বেলুন।অল্পতেই দারুণ সাজানো হচ্ছে। মাহিম গিয়েছে কেকের দোকানে। আমিরার ভীষণ পছন্দ রেড ভেলভেট। তবে আশেপাশের দোকানে লাল রং মাখিয়ে রেড ভেলভেট বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। সায়রা বার বার করে বলে দিয়েছে ভালো কেক আনতে। এদিকে আমিরা প্রায় ঘুমিয়ে জল। মেয়েটা রাতের খাবার খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়েছে। জন্মদিনের কথা হয়তো মনে ও নেই। কিংবা আছে। তবে পরিস্থিতি তাকে সেই আনন্দটা দিচ্ছে না। সায়রার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। আপা কি দেখে না, তার মেয়েটা আজ কত অসহায়? বাবা, নামক মানুষটি ফিরেও দেখে না। মাত্র তো কিছু দিন, এরই মধ্যে মানুষটা বদলে গেল। নাকি বদলে ফেলা হয়েছে। সায়রার চোখ জ্বলছে। কান্না আসতে চায়। তবে ও কাঁদে না। নিজেকে শক্ত করে। শক্তি জোগায়। নিচু হয়ে আমিরার কপালে চুম্বন করে। যেন আমিরা তার বোনের নয়, বরং নিজের সন্তান।

বাড়িতে যে কিছু হচ্ছে সেটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে জুথি। সে চোখ কান খাড়া করে বিষয়টা বের করার চেষ্টা করছে। তবে সঠিক কিছু বুঝতে পারছে না। সায়রা প্লেট গোছাচ্ছে। নীরব ভাবে।

“বাড়িতে কী চলছে বল তো।”

“কী চলবে?”

“কোথাও তো কিছু হচ্ছেই।”

“কিছুই না। তুমি গিয়ে ঘুমাও ভাবি।”

“আগে বল কী চলছে? তোরা কী মতলব করছিস?”

“উফ, কিছু না ভাবি।”

জুথি দমে থাকার নয়। সে কিছু সময় ঘুরে ফিরে এসে বলল,”মাহিম কোথায় রে?”

সায়রা ভণিতা ছাড়া স্বাভাবিক ভাবেই বলল,”বাইরে গেছে।”

“রাত দশটা বাজে। এখন বাইরে কেন?”

“আমি পাঠিয়েছি।”

“কেন?”

“কেক আনতে।”

“কেক….”

এটা বলেই তারিখের দিকে নজর গেল জুথির। খুব ভালো করেই বুঝল আমিরার জন্মদিনের জন্যেই কেক আনা হচ্ছে। আর সন্ধ্যায় পায়েস ও বানানো হয়েছে। সে একটু টিপ্পনি কেটে বলল,”কী লাভ জন্মদিনে কেক কেটে পায়েস করে? বাপ টা তো ফিরেও দেখছে না মেয়েকে। এতিম করে রেখেছে। বাপ থাকতেও বাপ ছাড়া।”

সায়রার একটু খারাপ লাগল। তবে কিছু বলল না। ও যদি কথা বাড়ায় তবে ভাবি আরো কথা শোনাবে। অবশ্য এর পেছনের, ইতিহাস ও কম নয়।

একটা মৃদু শব্দ কানে যেতেই ধরমরিয়ে ওঠল আমিরা। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে আলো জ্বলে ওঠল। ভেসে এল অনেক গুলো মানুষের মুখশ্রী, ও আওয়াজ।

“শুভ জন্মদিন আমিরা।”

একটা ঘোরে ডুবে গেছে আমিরা। এই মানুষ গুলোকে চিনতেও যেন ওর সময় লাগছে। ও একটু সময় নিয়ে স্মরণ করল। তারপর বুঝল, সময়টি তার জন্য বিশেষ। তার এগারো তম জন্মদিন! আমিরা কে একে একে জড়িয়ে ধরল সবাই। আদর করে দিল। জুথি ও উপস্থিত আছে। সে অতটা খুশি কী না বোঝা গেল না। তবে এক চামচ পায়েস এনে ঠিকই খাওয়াল। আমিরাকে নেওয়া হলো সাজানো নির্দিষ্ট কক্ষে। তারপর কেক কাটা হলো। ভীষণ সুন্দর সে মুহূর্তটি। আমিরা মুচকি হাসল। এই টুকু বয়সেই কত কিছু দেখল সে। তারপরই আকাশের পানে তাকাল, ভাবল মায়ের কথা। অথচ তার স্মরণ হলো না বাবা নামক মানুষটিকে। কেনই বা স্মরণ হবে, যেই বাবা মেয়েকে গলা ধা ক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারে। সেই বাবাকে কেনই বা স্মরণ হবে?

মারুফ অনেকটা সাহস করেই এক হাজার টাকা দিয়েছে আমিরাকে। জুথিও কিছু বলে নি। সব মিলিয়ে সময়টা সুন্দর। উপহার ও মানুষ গুলোর ভালোবাসা পেয়ে আমিরা খুশি। তবে বাচ্চা মন হলেও মায়ের কথা যে বড়ো স্মরণ হয়। প্রতি বছর মা সব থেকে দারুণ উপহার দিয়েছে তাকে। কত সুন্দর আয়োজন করে জন্মদিন হয়েছে। সময় আজ অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। তবে এই সময়টা মন্দ নয়। সবাই ভীষণ ভালোবাসা দিয়েছে। এমনকি মামি ও পায়েস এনে খাইয়েছে। সব মিলিয়ে আমিরার দিনটি সুন্দর। বেলা তখন নয়টা। সায়রার পড়ানো রয়েছে। আহনাফকে টানা পড়াচ্ছে সে। যাতে করে বাচ্চাটা ওর সাথে মিশতে পারে। তাছাড়া আহনাফকে গতকাল বলেছিল ভালো করে পড়লে বাইরে নিয়ে গিয়ে বল খেলাবে। সব মিলিয়েই যাচ্ছে,সে। রিকশায় ওঠার সময় রাস্তায় কিছু কাঠগোলাপের দেখা মিলল। সাদা, আর হাল্কা হলুদের আভা মেশানো ফুল। বিছিয়ে আছে। সুন্দর খুব। সায়রার মন ভালো হলো। ফুলটি একটু বেশিই সুন্দর যেন। ও কিছু ফুল তুলে নিয়ে রিকশায় ওঠল।

আহনাফকে নিয়ে বাসার পাশের মাঠটায় এসেছে সায়রা। আহনাফ,কে ভীষণ খুশি মনে হচ্ছে। বহু দিন পর সে হয়তো পরিবারের বাইরে খেলার সাথী পেয়েছে। কেউ তো তার সাথে খেলে না। কথা বলে না। তাই হয়তো উচ্ছ্বাসটা একটু বেশি। আহনাফের দিকে বল দিতেই আহনাফ সেটা লুফে নিল।

“গুড আহনাফ, এবার আমার দিকে দেও।”

আহনাফ কিয়ৎকাল চুপ করে রইল। সায়রা আবার বলল,”আহনাফ দাও।”

আহনাফ বল তো ছুড়ল তবে সেই বল গেল আরেক জায়গায়। সায়রার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আহনাফ। ওর কাছে এসে সায়রা বলল,”ইটস ওকে। এরপর থেকে সামনে ছুড়ে দিবে।”

আহনাফ চুপ। সায়রা ওকে নিয়ে বল খুঁজতে গেল। তবে বল যে কোথায় গেল। এদিকটা আবার ঘাস দিয়ে জঙ্গলের মতন হয়ে আছে।

“কোথায় গেল বলটা, বলো তো।”

আহনাফ ভয় পাচ্ছে। ও পথ চলতে চাইছে না। সম্ভবত ভেবেচে সায়রা তাকে বকা দিবে। তাই চোখ মুখ থম করে রাখা। সায়রা ওর হাত আগলে নিয়ে বলল,”ভয় পেও না। আমরা বল খুঁজে নিব।”

আহনাফের ভয় কমল কী না কে জানে। তবে দু এক মিনিট পর ই বল খুঁজে পেল সায়রা। বল তুলে নিয়ে ঘুরতেই দেখল আহনাফের সাথে দাঁড়িয়ে আছে অনুভব। কী যেন বলছে। সায়রা কাছে এগিয়ে এল। অনুভব বলছে,”একা কেন? সাথে কে এসেছে?”

আহনাফ চুপ। সায়রা পাশ থেকে জবাব দিল,”আমি।”

অনুভব ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। এই নিয়ে ওদের চতুর্থবার দেখা হলো।

“তুমি?”

“আমি ওর টিউটর।”

“অহ। টিউটর এখন খেলা ধুলো ও করায়!”

সায়রা অনুভবের দিকে তাকাল। ছেলেটার চেহারা ভরাট নয়। রোগা পাতলা গড়নের।

“যা আহনাফ, এখন এখানে বড়োরা খেলবে। ছোটরা এখানে খেলে না।”

আহনাফ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। সায়রা ওর কাছে এসে হাতটা ধরল।

“এভাবে কেন বললে? ও স্পেশাল চাইল্ড, জানো না?”

অনুভব মনে করার চেষ্টা করল। আসলেই সে জানে না আহনাফ যে স্পেশাল চাইল্ড। ওর ভাবনার মাঝেই আহনাফকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে সায়রা। সেদিকে তাকিয়ে অনুভবের মনে হলো সে দিন দুনিয়ার কোনো খবর ই রাখে না। এই যে আহনাফরা দু বছর হয়েছে এই বিল্ডিংয়ে। অথচ সে জানেই না বাচ্চাটা স্পেশাল!

বাড়িতে ফিরতেই জুথি বলল,”আমিরার বাবা একবার ও কল করে নি।”

“করবে না এটা তো আগে থেকেই জানা ভাবি।”

“কেন করবে না? মেয়ের জন্মদিন অথচ কোনো দায়িত্ব জ্ঞান নেই।”

সায়রা করুণ চোখ তাকাল। তারপর বলল‍,”এই বিষয়ে আরো কিছু বলতে হবে ভাবি? তুমি তো জানোই সমস্যাটা কোথায়। কী নিয়ে।”

জুথি তবু দমল না। আমিরার বাবার গোষ্ঠী উদ্ধার করতে লাগল। সায়রা ও হতাশ। সে একটা রাগ থেকেই আমিরার বাবা বাহাদুর কে কল করল। এক চোট কথা শুনিয়ে তবেই সে থামল। কথা শেষ করে সায়রা দেখল আমিরা ওর পেছনে দাঁড়িয়ে। নিশ্চয়ই সবটা শুনেছে।

“এদিকে আয়।”

আমিরা এগিয়ে এল। সায়রা ওর কাপলের চুল গুলো গুছিয়ে দিয়ে বলল,”মন খারাপ করবি না। তোর বাবা, মা সব আমি। বুঝলি?”

ছোট্ট আমিরা, সে জবাব দিতে পারল না। তবে তাকিয়ে রইল মমতাময়ী আরেক মায়ের দিকে। যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তাকে একটি সুন্দর সুস্থ জীবন দেওয়ার।

চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-০৫

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৫)

অনুভবের সকালটা বড়ো দেরিতে শুরু হয়। সে ভীষণ অনিয়ম করে চলে। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতন করে না। রাতের ঘুম দিনে ঘুমায়। সেই জন্যেই সে রোগা পাতলা। তবে এটা সত্য সে শক্তিশালী। ওর বাবা আমিন সাহেব আবার সচেতন মানুষ। যৌবনে ফিটনেস ট্রেইনার হিসেবে ও কাজ করেছেন। তবে ছেলেটাকে মানুষ করতে পারলেন না। তিনি রেগে অগ্নি হয়ে আছেন। একটু পর পর মুখের সামনে থেকে খবরের কাগজ সরিয়ে ছেলের ঘরের দিকে তাকাচ্ছেন। তবে ছেলেটার কোনো খবর নেই!

“এই তোমার চা।”

চা নিতে নিতে আমিন সাহেব বললেন,”এত বেলা হয়ে গেল অথচ তোমার ছেলের ঘুম থেকে ওঠার নাম নেই!”

“ছেলে কী আমার একা?”

স্ত্রীর কথায় একটু মৌন হলেন আমিন। কিছু সময় পর চায়ে চুমুক দিলেন। এই চা ছাড়া ওনি হয়তো এক মুহূর্তও চলতে পারবেন না। কি এক আশ্চর্য স্বাদ মিশে আছে!

“ছেলেকে ডেকে ওঠাও।”

স্বামীর আদেশ পেয়ে যেতে হলো রূপবান কে। তার এই নামটি দিয়েছেন আমিন সাহেব। তার চোখে সবথেকে সুন্দর নারী রূপবান।

ছেলে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। নিশ্চয়ই কিছু সময় আগেই ঘুমিয়েছে। এমন কাঁচা ঘুম ভা ঙা তে ইচ্ছা হচ্ছে না। তবে কিছু করার নেই। আমিন সাহেব রেগে আছেন আজ। তিনি ছেলের মাথায় হাত বুলালেন।

“অনুভব, অনুভব, বাবা ওঠ তো।”

অনুভবের মুখশ্রী জুড়ে বিরক্তি ছেয়ে গেল। ও মৃদু সুরে বলল,”এখন প্লিজ যাও মা।”

“তোর বাবা রেগে আছে। ওঠ বাবা। কতবার বলি ঠিক ঠাক ঘুমা, খাওয়া দাওয়া কর।”

“উফ মা।”

“ওঠ না বাবা।”

“মা।”

অনুভব বিরক্ত হয়ে ওঠল। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বলল,”একটু ঘুমাতে দাও না। আমি মাত্রই ঘুমিয়েছি।”

“তোর বাবা রেগে আছেন। যা এখন।”

“প্লিজ মা।”

“অনুভব, ওঠ বলছি।”

ছেলেকে একপ্রকার টেনেই ওঠিয়ে দিলেন রূপবান। অনুভব লম্বায় বিশাল। তার ওপর দেহ পাতলা। তাই তাকে আরো বেশি লম্বাটে লাগছে। ছেলেকে এক নজর দেখে রূপবান বললেন,”দ্রুত যা।”

এমনিতে চটপটে স্বভাবের হলেও বাবার সামনে অনুভব কিছুটা মিইয়ে যায়। আজ ও তার ব্যতিক্রম নয়। ছেলেকে আসতে দেখে আমিন সাহেব মুখের চোয়াল শক্ত করলেন।

“বোসো।”

বাবার বরাবর ডিভানে বসল অনুভব। চোখে মুখে ঘুমের ভাব।

“জি বাবা?”

“এত বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তুমি জানো না?”

“জানি বাবা।”

“তবে?”

“আর হবে না।”

“সব সময় ই তো এমন বলো। তবে ফল তো একই।”

অনুভব চুপ করে রইল। আমিন সাহেব হতাশ। তবে তিনি এই বিষয়ে আর কিছু না বলে বললেন,”বয়স হচ্ছে আমার। একমাত্র সন্তান তুমি। দায়িত্ব নিতে হবে নিশ্চয়ই।”

ভবঘুরে স্বভাবের অনুভব দায়িত্বের কথা বলতেই কেমন যেন মিইয়ে গেল। আমিন সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন,”দায়িত্ব নিতে হবে না? এখন বিজনেসের দায়িত্ব নিবে। ভবিষ্যতে বউ পোলাপানের দায়িত্ব নিবে। কি নিবে না? নাকি বিয়ে করবে না কখনো?”

ছেলেকে সরাসরিই কথা টা বললেন তিনি। অনুভব মৌনই রইল।

“ঠিক আছে। নিয়মের মধ্যে আসো। আর এখন ফ্রেশ হয়ে নাও। পরে আরো আলোচনা হবে।”

গলায় ঝোলানো তোয়ালে, মুখে ব্রাশ। অনুভব এভাবেই ছাদে যাচ্ছে। ওদের ফ্ল্যাট চার তলায়। বিল্ডিং নয় তলা। লিফ্টের বাটনে প্রেস করে দাঁড়িয়ে রইল অনুভব। তার বয়স কত? এইটুকু বয়সেই বাবা তার ঘাড়ে সব দায়িত্ব চাপাতে চায়। এদিকে সে গান বাজনা ভালোবাসে। ভার্সিটির ফাংশনে এটেন্ট করে। সে তো দায়িত্ব নিতে চায় না। ও এসব ই ভাবছিল। লিফ্ট এসে খুলে গেল। অনুভব আনমনেই ভেতরে প্রবেশ করল। তারপর অন্যমনস্ক থেকেই বলল,”অসহ্য!”

ওর থেকে এক হাত দূরে থাকা মেয়েটি বড়ো চোখে তাকাল। অনুভব তখনো মেয়েটিকে দেখে নি। হঠাৎ করেই গ্লাসে মেয়েটির মুখশ্রী দেখতে পেল। ও তাকাল ঝটপট।

“সরি, আপনাকে বলি নি।”

ব্রাশ মুখে, তোয়ালে গলায়, লম্বাটে দেহের একটি ছেলে! সায়রার কেন যেন হাসি পাচ্ছে। অনুভব কে আজ অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

“ইটস ওকে।”

লিফ্ট পুনরায় খুলে গেল। সায়রা গেল আহনাফদের ফ্ল্যাটে। আর অনুভব, ওঠল ছাদে।

আহনাফকে পড়িয়ে বাজারে এসেছে সায়রা। আমিরার জন্য গিফ্ট কিনতে হবে। কাল বাচ্চাটার পছন্দের খাবার রান্না হবে। সেটার জন্য ও কিছু জিনিসপত্র কিনতে হবে। সব মিলিয়ে ভালোই সময় লাগবে। ও ফোন বের করে আগে লিস্ট তৈরি করল। তারপর একে একে জিনিসপত্র কিনল। হাত ভরাট হয়ে আছে সরঞ্জামে। রিকশায় ওঠবে ওমন সময় দেখা মিলল সাঈদের। ও দূর থেকে আসছে।

“মামা একটু অপেক্ষা করুন।”

সায়রা নিজেও এগিয়ে গেল। সাঈদ এসে ওর হাতের জিনিসপত্র গুলো ধরল।

“কল দিয়েছিলাম, ধরলে না যে।”

“আমি দেখি নি। পড়ানোর সময় মিউট করে রেখেছিলাম।”

“ঠিক আছে, চলো।”

“কোথায়?”

“তোমার বাসায়।”

“এখন? কেন?”

“কথা বলতে।”

“কী কথা?”

“ভাবি কে বলব, আমিরার সাথে ঠিক মতন আচরণ করতে।”

“আশ্চর্য! এটা কোনো কথা হলো? এভাবে বললে সে অপমানিত হবে না?”

“কেন কথা হবে না? সে যদি একটু স্বাভাবিক হয় তবেই তো আমাদের সমস্যাটা মিটে যায়।”

“সমস্যাটা এখানে নয় সাঈদ।”

“তবে কোথায় সমস্যা?”

“সমস্যা আমার ভাগ্যে। আর ভাবি কে কিছু বলতে পারব না। যতই হোক সংসারটা তার। নানান সমস্যা রয়েছে। আমি তোমায় বোঝাতে পারছি না।”

এ কথা বলেই মিইয়ে গেল সায়রা। সাঈদের শরীর কাঁপছে।

“আমি বুঝতে পারছি না। আমি ক্লান্ত সায়রা। বেঁচে থাকা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”

সায়রা চুপ। ওর চোখ টলমল করছে। ও শুকনো ঢোক গিলে বলল,”তুমি চলে যাও সাঈদ। আমাদের দেখা না হওয়াই ভালো।”

সাঈদ গেল না। বরং দাঁড়িয়ে রইল। রিকশা অনেকটা সময় ধরে দাঁড়িয়ে। তাড়া দিচ্ছে। সায়রা ওঠে পড়ল। মৃদু হেসে বলল,”ভালো থাকো।”

না সাঈদ ভালো থাকল, আর না সায়রা। একটা শোক ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। সায়রা দু চোখের জল মুছে নিয়ে মৃদু সুরে বলল,”তুমি ভালো থাকো সাঈদ। ভালো থাকো।”

বাসায় পৌছে সব গুলো জিনিস রাখল সায়রা। আমিরা ঘরের এক কোণে বসে। মেয়েটির তো আর কাজ নেই। ওর খোঁজ খবর নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বসল সায়রা। তারপর ভাবল আজ সকালের কথা। সাঈদ তার পরিবারের সাথে খুব ঝামেলা করছে বেশ কদিন হলো। সায়রাকে ভীষণ ভালোবাসে সে। এদিকে তারা বলেছে আমিরা সমেত কিছুতেই মানবে না তারা। মুখে এ কথা বললেও অন্তরের চিন্তাটি ভিন্ন। সকালেই সাঈদের মা কল করেছিলেন। সোজাসাপ্টা বলেছে সাঈদের সাথে সম্পর্ক শেষ করতে। তাদের মুক্তি দিতে। শুধুমাত্র সায়রার জন্য তাদের সংসার ভে সে যাচ্ছে। ছেলে পাগলামি করছে। তাছাড়া,আমিরা কোনো ইস্যু না। তাদের মতে সায়রার থেকে ভালো কাউকে পাবার যোগ্যতা রাখে সাঈদ। মেয়েও দেখা আছে। সব মিলিয়ে সায়রা যেন সাঈদের সাথে সম্পর্ক ঠিক করার চেষ্টা না করে। সায়রা অবশ্য প্রতিবাদ করেছিল। বলেছিল সে এসব কেন বলবে। তবে দিনশেষে সত্য, সায়রার কিছু করার নেই। সাঈদের পরিবারের সাথে সে মানাতে পারবে না। যো চেষ্টাই করুক মানুষ গুলো তাকে মেনে নিবে না। আর এর থেকেও বড়ো সত্য আমিরাকে নিয়েও কোথাও শান্তি পাবে না। সব মিলিয়ে এই বাস্তবতা ওকে ভে ঙে দিয়েছে। ওর সমস্ত ধ্যান জ্ঞান এখন আমিরাকে নিয়ে। মেয়েটিকে সুস্থ জীবন দেওয়াই ওর লক্ষ্য। একমাত্র চিন্তা।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি