#কলঙ্ক
#২০তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
অনেক অনেক দিন পর ভার্সিটিতে গিয়েছি ক্লাস করার জন্য। এখন থেকে নিয়মিত হবো। পরীক্ষা একেবারে দোরগোড়ায়। অনেকদিন ক্লাস না করায় জ্ঞাপে পড়ে গেছি। বন্ধুদের সাথে কথা বলে নোট সংগ্রহ করতে হবে।স্যার ম্যামদের অনুরোধ করে এটেন্ডেন্স বাড়াতে হবে। নয়তো আর পরীক্ষায় বসা যাবে না।
‘
ক্লাসে বসার পর দু চার জন অবশ্য ফিসফাস করেছে।এক স্যার এসে খুব ঘেঁটেছে।
বলেছে,’অতদিন কোথায় ছিলে?’
আমি স্পষ্ট বলেছি,’স্যার বাসায় ছিলাম।বাবা মার কাছে।’
‘পড়াশোনা ক্লাস এসব রেখে বাসায় কেন?’
তখন একটা ছেলে দাঁড়িয়ে মিনতির গলায় স্যারকে বললো,’স্যার,প্লিজ ওকে ঘাঁটাবেন না। কিছু জিজ্ঞেস করলে ওকে আড়ালে জিজ্ঞেস করুন।ওর বিষয়টা প্রাইভেট স্যার!’
ছেলেটার কথা শুনে একদল ছেলে মেয়ে বললো,হ্যা স্যার ওকে আপনি বিষয়টা আড়ালেই জিজ্ঞেস করুন। কিন্তু তিন চারজন ছেলে মেয়ে বলে উঠলো,তোরা কী স্যারের চেয়ে বড় পন্ডিত হয়ে গেছিস নাকি?স্যার কী করবেন না করবেন তা তোদের কাছে জিজ্ঞেস করে তারপর করবেন নাকি!’
ওদের এসবে নিজেকে এতো অসহায় লাগতে শুরু করলো তখন! ইচ্ছে হলো কাঁদতে কাঁদতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়লো মেহরাবের কথা।মনে পড়লো ম্যামের কথা।ম্যাম বলেছেন, পেছনে তাকানো যাবে না। লজ্জা পাওয়া যাবে না।কারণ দোষটা আমার না। আমাকে এগিয়ে যেতে হবে।
স্যার বললেন,’তূর্ণা তুমি এখন বসো। আমার সাথে পরে দেখা করো তুমি। এখন তোমাকে কিছুই বলতে হবে না!’
কিন্তু আমি বসলাম না।কারণ আড়ালে শুধুমাত্র স্যারের সাথে কথা বললে বিষয়টা শুধু স্যারই জানবেন।অন্যদের অজানা থেকে যাবে।এতে সমস্যা কমার বদল উল্টো বাড়বে। এই অজানা বিষয়টা নিয়ে ওরা আরো সাত পাঁচ করবে। তখন সমস্যাটা ক্রমাগত বড় হতে থাকবে। এরচেয়ে লজ্জা যা পাওয়ার একেবারে পাওয়ায় ভালো।
আমি বললাম,’স্যার,আমি এখানেই সবকিছু বলতে চাই!’
সবাই আমার দিকে অবাক চোখে তাকালো।
আমি বলতে শুরু করলাম। বললাম, আমানের সাথে আমার প্রেমের সম্পর্কের কথা।ওর সাথে গোপন বিয়ের কথা। প্রতারণার শিকার হওয়ার কথা। প্রেগন্যান্সি এবং তারপর এবরোশনের কথা। তারপর ঘুরে দাঁড়ানোর কথা। সবকিছু খুলে বলেছি আমি।যেন একটুও সন্দেহ না থাকে।স্যার ভরা ক্লাসের সামনেই হাত তালি দিতে শুরু করলেন।স্যারের সাথে সাথে সবাই। তারপর স্যার আমায় ডেকে বললেন,’তূর্ণা মা এদিকে আসো তুমি।’
আমি স্যারের কাছে গেলাম।স্যার আমার মাথায় হাত রাখলেন। তারপর বললেন,’আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন।’
তারপর গলার শব্দ তিনি আরো বড় করে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন,’আমি ভরা ক্লাসের সামনে বলে যাচ্ছি এই তূর্ণা সেই তূর্ণা নয়।এই তূর্ণা বদলে গেছে। মানুষ ওকে যে কলঙ্ক দিয়েছে সেই কলঙ্কে এখন দগদগে আগুন জ্বলছে।এই আগুন উত্থাল আগুন।এই আগুন সবকিছু পোড়িয়ে ছারখার করে দিবে।সব অশুচি, অশুদ্ধ আর নোংরা মানুষের চোখ পোড়িয়ে দিয়ে সে তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।সে খুব শিগগির ভোরের আলো ফোটাবে। ইনশাআল্লাহ!’
ক্লাসের সবাই আবার হাততালি দিয়ে উঠলো।যে ক্লাসে আমি লজ্জায় কোনদিন আর যেতে পারবো না ভেবেছিলাম সেই ক্লাসরুম,ক্লাসের সব বন্ধু,স্যার ম্যাম হয়ে উঠলো আমার ভরসার জায়গা। এখন শুধু মেহরাব একা নয়, আমার হৃদয়ে অনেক অনেক মানুষ জায়গা করে নিয়েছে।
সে রাতে বাসায় ফিরে আমি কী যে এক অন্যরকম উত্তেজনায়, অনুভূতিতে ঘুমোতে পারি না। কেন জানি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠি বারবার।আমি কোনদিন ভাবতেও পারিনি এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবো আমি। আমি আগে জানতাম না পথ চলতে শুরু করলে পথে যেমন কাঁটা পড়ে থাকে তেমন ফুলও থাকে। আমাদেরকে শুধু জানতে হবে আমরা পা টা কোথায় রাখবো! কাঁটার উপর নাকি ফুলের উপর!
‘
মাঝরাতে একটু চোখ লেগেছিল আমার। তারপর হঠাৎ স্বপ্ন কী বাস্তব জানি না , তবে দেখতে পেলাম আমার ভ্রুণটা আমার কাছে এসেছে।আজ সে ক্ষত বিক্ষত নয়।তার গায়ে সুন্দর জামা পরা।সে এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে।হাসছে মিষ্টি করে।
আমি প্রথম প্রথম তাকে দেখে চিনতেই পারিনি।তাই জিজ্ঞেস করলাম,’এই তুই কে?’
ভ্রুণ বললো,’ওমা আমায় ভুলেই গেলে।ভুলবেই তো। মানুষ সুখে পড়লে সব ভুলে যায়।’
আমি ওর আদিক্ষেতা দেখে রেগে গিয়ে বললাম,’এসব পাকা পাকা কথা রেখে বল তুই কে?তোর পরিচয় কী?’
ভ্রুণ মৃদু হেসে বললো,’আমার তো নাম নেই।নাম দেয়ার আগেই তোমরা আমায় খুন করে ফেলেছিলে।আমি তোমার সন্তান।
অতদিন খুব অশান্তিতে ছিলাম আমি মা। কিন্তু এখন আমার অনেক শান্তি। আমি এখন একটা সুন্দর ঘর পেয়েছি। ওখানে আমার অনেক খেলার সাথী। এখন তুমি যেমন আমার কথা মনে করো না আমিও কিন্তু তোমার কথা মনে করবো না আর।এই শেষবার তোমার কাছে এলাম।প্রাণ ভরে দেখে নেও আমায়। এরপর কিন্তু আর আসবো না!’
এই কথা বলেই ভ্রুণ উধাও হয়ে গেল।
আর ঠিক তখন আমার চোখ খুললো।চোখ খুলে দেখি ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে।সারা শরীর ঘেমে ভিজে আছে আমার।তেষ্ঠায় গলা ফেটে যাচ্ছে।
মোবাইলটা হাতড়ে খুঁজে বের করে লাইট জ্বালিয়ে দেখি পানির বোতল খালি। তাড়াহুড়ো করে উঠে বোতল নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম। ওখান থেকে পানি এনে ঢকঢক করে গিললাম। তারপর দখিন দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে জানলাটা খুলে দিলাম।জানলা খুলে দিতেই হো হো করে বাতাস বয়ে আসতে লাগলো ঘরের ভেতর। মুহুর্তে শরীর জুড়িয়ে এলো। শরীর জুড়িয়ে এলেও মনটা তখন কেমন খচখচ করতে লাগলো।কত কতদিন পর আমার ভ্রুণটা কাছে এসেছিলো। আগে ও আসলে আমার খারাপ লাগতো।ওর ক্ষত বিক্ষত দেহটা দেখলে নিজেকে পাপী মনে হতো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু আজ ওকে যেভাবে দেখেছি আমার মোটেও খারাপ লাগেনি। আমার মনে হয়েছে ও খুব ভালো আছে। এখন আর ও আমায় অভিশাপ দেয়না।ও অভিশাপ দিলে আমি পোড়ে ছারখার হয়ে যেতাম। আমার সব সফলতার পথ চিরতরে রোদ্ধ হয়ে যেতো!
‘
আমানের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মেহরাব আমার জীবনে আসার পর ,ও যখন আমায় আশার আলো দেখালো ভরসা দিলো তখন কেবল মনে হয়েছিল আমি একটা পথ খুঁজে পেয়েছি। এখন শুধু আলো জ্বালাবার প্রয়োজন। তারপর ম্যাম এলেন আমার জীবনে আলোর সন্ধান নিয়ে।ক্লাসের সব বন্ধু বান্ধব আর স্যার ম্যামেরা একটু একটু করে আলোর যোগান দিতে লাগলেন আমায়। এই মুহূর্তে আমি আমানকে ভেবে আমার চিন্তাকে অপবিত্র করতে চাই না। এখন আমার প্রয়োজন তাদের কথা ভাবা যারা আমার কথা ভাবে।যারা আমায় বড় হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দেয়।যারা আমায় ভালোবাসে।
‘
রাতে যেমন হুট করে আমার মন ভালো হয়ে গিয়েছিল সকাল বেলা ঠিক তেমন ভাবেই হুট করে মন খারাপ হয়ে গেল।মা ফোন করেছেন। মেহরাবের নাকি অন্য কোথাও বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মায়ের কাছে মেহরাবের মা ফোন করে বলেছে।তার মা নাকি সবকিছু জেনে গেছে। সবকিছু জানার পর তার মা কিছুতেই এই বিয়েতে রাজি না! এই জন্যই খুব দ্রুত অন্য একটা মেয়ে দেখে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। মেহরাবের মত অমত সম্পর্কে এখনও তেমন কিছু জানা যায়নি। তবে মায়ের অমতে সে কাজ করবে না এটা বলা যায়!
‘
মার মুখ থেকে এসব শোনার পর দুপুর পর্যন্ত বিছানায় পড়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদলাম। বারবার তখন শুধু মনে হচ্ছিল আমার জীবনটা এমন কেন!যাকেই আমি ভরসা করতে যাই সেই কেমন ছেড়ে চলে যায়!
এরপর হঠাৎ করে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়লাম।ঘুম থেকে উঠলাম চিৎকার চেঁচামেচি শুনে। হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসে দরজা দিয়ে সামনের দিকে তাকালাম। কিন্তু সামনের দিকে তাকাতেই বুকটা কেমন ধ্বক করে উঠে আমার। দরজার সামনে চোখ রেখে দেখি সবাই দৌড়ে যাচ্ছে পিয়ার রুমের দিকে। দৌড়ে যাওয়া সবার মুখেই ভয়ের ছাপ!
‘
#চলবে
কলঙ্ক পর্ব-২০
কলঙ্ক পর্ব-১৯
#কলঙ্ক
#১৯তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
পরদিন বিকেল বেলা ম্যামের সাথে দেখা করতে যাই।মনে প্রচন্ড ভয়।না জানি আবার ম্যাম ইউনিভার্সিটি প্রক্টোরিয়্যাল বডির কাছে কম্প্ল্যান করেছেন কি না!হতেও তো পারে যে আজ তিনি আমায় দেখা করার কথা বলে নিয়ে আমায় পানিশমেন্ট দিয়ে বসবেন।সারা দেশেই এমন চলছে।উপরমহল থেকে নীচ মহল পর্যন্ত সবাই তাদের অধীনস্থদের উপর তাদের মর্জিমতো যা তা করছে। পছন্দ হচ্ছে তো উপরে উঠিয়ে নিচ্ছে। পছন্দ হলো না কোন কারণে তো পায়ের তলায় পিষে মারছে।ম্যাম যদি এমন কিছু করেন!
তারপর হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় তিনি ঈচ্ছে করলেই যা তা করতে পারেন না আমার সাথে।কারণ আমি দূর্বল নয়।যারা বুক ফুলিয়ে সত্য বলতে জানে তারা কখনোই দূর্বল হয় না!
ম্যামের অফিসে যাই ভয়ে ভয়ে। গিয়ে সালাম দেই।
‘আসসালামু আলাইকুম ম্যাম।’
ম্যাম আমার দিকে তাকান। তারপর মৃদু হেসে বলেন,’ও তুমি এসেছো। আচ্ছা পাঁচ মিনিট বাইরে গিয়ে বসো।’
আমি বাইরে গিয়ে একটা বেঞ্চের উপর পা ঝুলিয়ে বসে থেকে দুশ্চিন্তা করি। হঠাৎ করে আমার মেহরাবের কথা মনে পড়ে। আচ্ছা মেহরাব কীভাবে আমায় ছেড়ে চলে যেতে পারলো এভাবে?ওর আসলেই আমার প্রতি কোন দরদ নাই! পৃথিবীর সব ছেলেরাই প্রতারক!
তারপর আবার নিজেই নিজের ভুলের জন্য জিভ কাটি।জিভ কেটে মনে মনে বলি,আমি তো ভুল কিছু ভাবছি।কারণ মেহরাব নিজের মুখেই তো বলেছে সে একদিন আমায় ভালোবাসবে। তবে তা এক্ষুনি নয়।আরো অনেক পরে।যখন আমার পড়াশোনার পাঠ শেষ হবে। নিজে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবো তখন!
এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা কন্ঠ শুনে তাকালাম।
ম্যাম কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমার সামনে। তিনি হাসিমুখে বললেন,’চলো।’
আমি ম্যামের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম।
ম্যাম বললেন,’পেছন পেছন নয়। আমার পাশাপাশি হাঁটবে।এসো।’
আমি ম্যামের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম।
ম্যাম এবার বললেন,’আমায় ভয় পাওয়ার কিছু নেই।আমায় তুমি এখন থেকে বন্ধু ভাবতে পারো!’
আমি ভীষণ রকম অবাক হয় ম্যামের কথা শুনে।ম্যাম এটা কেমন ধরনের কথা বললেন? আমার সাথে তার বয়সের কত প্রার্থক্য!তার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয় কী করে?
ম্যাম আমায় চুপচাপ হাঁটতে দেখে বললেন,’কী ভাবছো?’
আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম,’না ম্যাম। কিছুই ভাবছি না।’
ম্যাম বললেন,’তুমি যে বিষয়টা নিয়ে এখন ভাবছো তা আমি জানি। তুমি ভাবছো আমার সাথে তোমার বন্ধুত্ব কী করে হতে পারে ঠিক তাই তো?’
আমি অবাক হই।ম্যাম এটাও কীভাবে জেনে ফেললেন!
ম্যাম এবার বললেন,’শুনো তূর্ণা, আমাদের দেশের বড়রা মানে গার্ডিয়ানরা যে কমন ভুলটা করে তা হলো বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলে মেয়েদেরকে তারা কঠোর শাসনে রাখে।প্রেম, ভালোবাসা, ফিজিক্যাল বিষয়গুলোকে ওদের কাছে নিষিদ্ধ করে প্রকাশ করে। কিন্তু ওরা আদতে জানে না যে এই বয়সটা ছেলে মেয়েদের কৌতুহলের বয়স। এবং এই বয়সী ছেলে মেয়েরা নিষিদ্ধ জিনিসগুলোর প্রতিই সবার আগে ঝুঁকে!
এবং তা তাদের জানার কিংবা বোঝার উৎসাহ থেকেই। কিন্তু বাবা মা যদি এই সময়ে তাদের কাছে এসব বিষয় না লুকোতেন। সবকিছু ভেঙে ভেঙে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতেন। নিজেকে সন্তানদের কাছে এমন করে প্রকাশ করতেন যেন সন্তানও তাদের কাছে তাদের নিজেদের গোপন বিষয়ে কথা বলতে সাহস পায়, উৎসাহ পায়। তবে কিন্তু ছেলে মেয়েরা এই বয়সে ভয়ংকর কিছু করার সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না একা একা।এই যে তুমি একটা ছেলের সাথে রিলেশন করলে। তারপর বিয়ে করে ফেললে গোপনে। কেন করলে এটা? বিয়ের আগে কেন বাবা মাকে জানাওনি?একটা ভয়ে তাই না? তুমি ভেবেছিলে তখন বাবা মা জানতে পারলে তোমায় মেরেই ফেলবে।তেজ্য করবে!তাই না?
এটা তুমি শুধু একা না। আমাদের দেশের সবকটি ছেলে মেয়েই এমন ভাববে।কারণ আমাদের বাবা মা কিংবা শিক্ষকেরা বন্ধু সুলভ নয়।আজ যদি তোমার বাবা মা তোমার বন্ধুর মতো হতো তবে কিন্তু তুমি ওই ছেলেটাকে বিয়ে করার আগে তোমার মাকে জানাতে। তারপর তোমার মা সবকিছু শুনে সিদ্ধান্ত নিতো ছেলেটা আসলে ভালো মানুষ কি না!জেনে বুঝে দেখতো
সে তোমার জন্য যোগ্য কি না!না আমি অর্থ বিত্তের যে যোগ্যতা তার কথা বলছি না!সে মানুষ হিসেবে তোমার যোগ্য কি না তার কথাই বলছি। এখন তুমি বলো, বন্ধুত্বের বিষয়টা কী শুধু সম বয়সীদের জন্য প্রযোজ্য নাকি অসীম বয়সীদের জন্যও?’
ম্যামের কথাগুলো শুনে আমার ভেতরটা কেমন হু হু করে কেঁদে উঠে। চোখে কেমন জল এসে ঢেউ খেলে যায়। আমার তখন শুধু মনে হয়, আমার মা যদি আমার বন্ধু থাকতো তবে তো আমার অত বড় ভুলটা হতো না!
ম্যাম আমার দিকে তাকান। আমার আরো কাছে ঘেঁষে এসে আমার একটা হাত ধরেন। তারপর বলেন,’তূর্ণা, সবকিছু বুঝতে পেরেছো তুমি তাই না?’
আমি মাথা কাঁত করে হ্যা বলি।
ম্যাম এবার বলেন,’তোমায় ডেকেছি কেন জানো?একটা চরম সত্য বলতে।এটা আমার বিষয়ে।এসো আমার সাথে এসো।’
ম্যামের সাথে আমি হাঁটতে লাগলাম।ম্যাম আমায় ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে নিয়ে গেলেন। তারপর মাঠের দূর্বা ঘাসের উপর বসে বললেন,’বসো আমার পাশে বসো।’
আমি ম্যামের মুখোমুখি হয়ে বসলাম।
ম্যাম এবার বললেন,’আমিও তোমার মতো একটা ভুল করেছিলাম। আমার বাবা মা ছিলেন খুব কঠোর।একটা প্রেমের সম্পর্ক ছিল আমার। ছেলে গরীব ঘরের।আমি জানতাম বাবা মা আমার এই সম্পর্ক কোনদিন মেনে নিবেন না।তাই ছেলেটাকে হারানোর ভয়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েই ছেলেটাকে নিয়ে পালিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের কথা কী জানো? আমার একটা ছেলে হওয়ার পর সে হুট করে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তারপর অনেক খুঁজেও তাকে আর পাইনি।আমি অবশ্য তখন পড়াশোনাও ছেড়ে দিয়েছিলাম।কী ভয়ংকর বিপদে যে পড়েছিলাম তখন। ভেবেছিলাম মরে যাবো। কিন্তু মরতে পারিনি নিজের জন্ম দেয়া ছেলেটার মায়ায়। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম মরে যাওয়ার চেয়ে বাবা মার কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়া উত্তম।তারা আর যায় করুক, একেবারে জানে তো আর মেরে ফেলবে না।আর আমি তখন এটাও মেনে নিয়েছিলাম যে, লাজ লজ্জা মৃত্যুর চেয়ে অবশ্যই নিঠুর নয়! মানুষ কিছু বললে বলুক তাতে আমি কান দিবো না। আমার পথে আমি এগিয়ে যাবো। আবার পড়াশোনা করবো।
তূর্ণা, বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর ভাইয়েরা কী যে মার মেরেছে আমায়।বাবা মা কত কী যে বলেছে।পাড়া পড়শীরা আমাদের বাড়ির সবকজন মানুষকে নিয়েই হাসি তামাশা করতো।ওরা বলতো, বিয়ে ছাড়াই অসভ্যতামি করে সন্তান জন্ম দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসছি! প্রথম প্রথম খুব কাঁদতাম। একদিন বাড়ির ছাদ থেকেও লাফাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মরতে এবারও বাঁধা হলো আমার সন্তান।মনে হলো আমি মরে গেলে তো আমার ছেলেটা আনাথ হয়ে যাবে!
তারপর মৃত্যুর সিদ্ধান্ত বদলে নিলাম। বাবাকে হাতজোড় করে বললাম,বাবা আমায় শেষ একটা সুযোগ দাও।আমায় পড়তে দাও।
সেবার বাবা কীভাবে যেন গলে গেলেন আমার কথায়। তারপর পড়াশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়ে গেল। পড়লাম ইংরেজি বিভাগে। তারপর হয়ে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার। এছাড়াও আমার নিজের একটা বিজনেস দাঁড় করিয়ে ফেললাম।বইয়ের একটা ভালো ছাপাখানা,একটা ভালো লাইব্রেরী গড়ে তুললাম। তারপর গ্রামে ফিরলাম। গ্রামের মানুষ,ঘরের মানুষ তখন আমায় মাথায় তুলে ফেলতে চায়। কিন্তু সেই কদার্য গ্রামে আমি আর রইলাম না।কারণ ওখানে থাকলে আমায় নিয়ে তামাশা করা মানুষগুলোর মুখ দেখলে আমার ভেতর আগুন জ্বলে উঠতো।আমি চাইতাম না এমনটি হোক।আমি এদেরকে হিংসা করতে চাই না।এরা বুঝে না। মূর্খ মানুষ।আমি দূর থেকেই এদেরকে শিক্ষার আলোয় আনতে নিজের টাকায় গ্রামে স্কুল করে দিয়েছি। বয়স্কদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’
ম্যামের কথা শেষ হলে আমি তার দিকে তাকাই।ম্যামের চোখে জল। তিনি ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে নিয়ে চোখ মুছেন। তারপর বলেন,’আমার ছেলে এ বছর বুয়েট থেকে সিভিল ইন্জিনিয়ার হয়ে বের হয়েছে। দেশের বাইরে চলে যেতে চেয়েছিল ও।আমি যেতে দেইনি। ওকে বলেছি, তোদের মতো মেধাবীরা বাইরে চলে গেলে এই দেশের অন্ধকার দূর হবে কী করে!’
আমি কী বলবো ম্যামকে বুঝতে পারছিলাম না। পৃথিবীতে এমন ভালো মানুষ আজও আছে?অথচ কাল এই ম্যামকেই কত কঠোর ভেবেছিলাম আমি!
ম্যাম নিজেই তখন বিষয়টা পরিষ্কার করলেন। তিনি বললেন,’আসলে গতকাল তোমার সাথে যে খারাপ ব্যবহার করেছি আমি এটা শুধু তোমায় টেস্ট করার জন্য। আমি শুধু তোমায় দেখতে চেয়েছিলাম তুমি পারবে কি না টিকে থাকতে!আমি টেস্ট করে বুঝতে পেরেছি তোমার ভেতর সুপ্ত আগুন আছে।এই আগুন আস্তে আস্তে জ্বলতে শুরু করেছে। এভাবে যদি আগুনটা জ্বলতে থাকে তবে আর কেউ তোমায় আটকে দিতে পারবে না। কিন্তু সব সময় মনে রেখো তূর্ণা,বাজে লোকের কথায় কান দেয়া যাবে না।মন খারাপ করা যাবে না।তুমি সব সময় তাদের কথা শুনবে আর তাদেরকে মনে রাখবে যারা তোমায় এগিয়ে যেতে সাহায্য করে!’
আমি ম্যামের হাতটা শক্ত করে ধরলাম কারণ এই হাতটা ভরসার।এই হাতটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
ম্যাম আবারও বললেন,’আরেকটা বিষয় তোমায় পরিষ্কার করি। তোমার সিটটা আমি ওই মেয়েকে দেইনি।এই মেয়েকে সিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন আমাদের ইউনিভার্সিটির প্রক্টর মহোদয়।কারণ তুমিও তখন নাই।ওরা ভেবেছিলেন তুমি আর আসবে না।আর এই মেয়েটিও প্রক্টরের পরিচিত।’
‘
সন্ধ্যা হয়ে আসছে।আলোয় আলোয় ভরে উঠছে শহর।আমি তখন ভাবলাম, আহ্,আমি যদি সেদিন মরে যেতাম তবে এমন একজন মহৎ মানুষের দেখা পেতাম কী করে!তার কাছ থেকে এমন সুন্দর সুন্দর কথাগুলো শুনতে পেতাম কী করে?আর তখন খুব গভীর ভাবে বুঝতে পারি যে, আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়। বেঁচে থেকে জীবন গড়ার চেষ্টাটাই বরং সমাধানের পথ।আর মানুষ যখন নিজেকে গড়তে চায় তখন তাকে ভেঙে দিতে অনেকেই আসবে। তবে সত্য হলো এটাও যে তুমি নিজেকে গড়ে তুলতে চাইলে তোমাকে গড়ে দিতেও অনেকেই আসবে!সেই মানুষদের তোমায় চিনতে হবে। এবং তুমি এদের কথাই মনে রাখবে!
‘
#চলবে
কলঙ্ক পর্ব-১৮
#কলঙ্ক
#১৮তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
মেম চেয়ার থেকে উঠে এসে আমায় অবাক করে দিয়ে বললেন,’চলো।’
আমি ভয়ে ভয়ে মেমের পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগলাম।
মেম আমায় নিয়ে গেলেন আমার রুমেই। তারপর যে মেয়েকে আমার সিটখানা দেয়া হয়েছিল সেই মেয়েকে আলাদা একটা রুমে ব্যবস্থা করে দিয়ে আমার সিট আমায় ফিরিয়ে দিলেন তিনি। তারপর যাওয়ার সময় মেম পাংশু মুখে বলে গেলেন,’কাল আমার সাথে একবার দেখা করো তুমি!’
আমি ঘাড় কাঁত করে ভয়ে ভয়ে বললাম,’জ্বি আচ্ছা মেম।’
‘
মেম চলে যাওয়ার পর এলিজা বললো,’আপু ফিরে এসেছেন। খুব ভালো লাগছে আপনাকে দেখে!’
আমি এবার এলিজাকে বললাম,’এলিজা,পিয়া হোস্টেলে আছে রে?’
এলিজা বললো,’আছে।’
‘ও আমার বিষয়ে খুব প্রচার প্রসার করেছে তাই না?’
‘এটা বলতে হয় আপু!আমি তো আপুর সাথে এখন কথাই বলি না!’
‘কেন?কথা বলিস না কেন?’
‘সে আমায় বলেছিল আপনার নামে মিথ্যে বানিয়ে এর ওর কাছে বলতে।আমি বলিনি। এই জন্য সে রাগ। একদিন আমায় অনেক বকাঝকাও করেছে। বলেছে আপনি নাকি আমায় অনেক টাকা পয়সা দিয়ে গিয়েছেন।টাকা পয়সা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছেন!’
আমি ওর কথা শুনে মৃদু হাসলাম।হাসি ছাড়া কী বা করার আছে। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত একটা মেয়ের মন মানসিকতা এতোটা খারাপ হতে পারে তা আমি ভাবতেও পারি না!
এলিজা এবার বললো,’আপু, কদিন আগে প্রভোস্ট মেম পিয়া আপুকে ইচ্ছে মতো বকেছে!’
‘কেন?’
‘তা জানি না। তবে শুনেছি আপনার নামে কী যেন বলতে গিয়েছিলো মেমের কাছে এই জন্য বকেছে!’
‘ওহ।’
তারপর এলিজা বললো,’আপু শুনেন, আপনি আর ভেঙে পড়বেন না। এবার মনে সাহস রাখুন। ইউনিভার্সিটির সবাই যে আপনাকে খারাপ ভাবছে এমন না কিন্তু! অনেকেই আপনার জন্য আফশোস করছে।ওরা বলছে,যা ঘটেছে তা তো আপনার ইচ্ছাই ঘটেনি। আপনি বরং ভোক্তভোগী। সুতরাং আপনার তো পালিয়ে বেড়াবার প্রয়োজন নাই!’
‘কারা বলেছে এইগুলো?’
‘আপনার অনেক বন্ধু বান্ধব।’
‘আচ্ছা।’
এলিজার মুখ থেকে কথাগুলো শুনে খুব ভালো লাগছে।মেমের বিষয়টা শুনে কেমন সন্দেহ হচ্ছে।মেম যদি কদিন আগে পিয়াকে এ নিয়ে বকাঝকাই করেছেন তবে আজ আমায় এভাবে কথা বললেন কেন? আমার সাথে এমন কঠোর আচরণ করলেন কেন?
আমি এবার এলিজাকে বললাম,’এলিজ,তুই একটা কাজ কর তো!’
এলিজা বললো,’কী করতে হবে বলুন আপু।’
‘তুই তো পিয়ার সাথে কথা বলিস না অনেকদিন ধরে।আজ একটু কথা বলে আয়। পিয়াকে ডেকে নিয়ে আয়।বল গিয়ে তূর্ণা আপু আপনাকে ডাকছেন। জরুরী কথা আছে!’
‘
এলিজা চেয়ার থেকে উঠে পিয়ার ঘরের দিকে গেল। এবং মিনিট পাঁচেক পরই পিয়াকে নিয়ে এলো।পিয়া এসে মোলায়েম হেসে বললো,’কিরে কী খবর? কেমন আছিস?’
আমি হেসেই বললাম,’খারাপ না!’
‘তা তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বিয়ে টিয়ে করে ফেলেছিস নাকি?’
‘না।’
‘ওহ।আর তোকে বিয়েটা করবেই বা কে?যা ঘটিয়েছিস!’
আমার শরীর রাগে কাঁপতে থাকে।আমি তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলি,’পিয়া, আমার বিয়ে নিয়ে তোর এতো টেনশন কিসের রে!যেন আমায় নিয়ে আমার চেয়ে তোর বেশি টেনশন!’
পিয়া চুপ করে রইলো।গাল ফোলা ফোলা করে রেখেছে। আমার কথাটা তার পছন্দ হয়নি।
পিয়া এবার রাগের গলায় বললো,’আমায় কেন ডেকেছিস বল! অপমান করার জন্য?’
‘অপমান আমি করছি না।তুই করছিস।আর ডেকেছি অপমানের জন্য নয়।’
‘তবে কিসের জন্য ডেকেছিস?’
আমি দ্রুত ব্যাগ খুলে ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে বললাম,’তোর পাওনাটা নে।’
পিয়া ভীষণ রকম অবাক হয়ে বললো,’আমার পাওনা মানে?তুই আবার কবে আমার কাছ থেকে ধার করেছিলে!’
আমি মৃদু হেসে বললাম,’ধার কর্য কিছু না!’
‘তবে?’
‘পাওনা।’
‘কিসের পাও না?’
পিয়া চমকে উঠে গিয়ে বলে।
আমি ওর হাতটা ধরে ওর কাছে জোর করে টাকাটা ধরিয়ে দিয়ে বলি,’তুই যে আমায় কাজ করে দিলি সেই পাওনা।জনে জনে আমায় নিয়ে প্রচার প্রসার করলি এতে তোর কষ্ট হয়েছে তো অনেক।শ্রম দিয়েছিস।শ্রমের মূল্য।হাদিসে আছে, শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগে তার পাওনা বুঝিয়ে দাও।আমি অবশ্য একটু দেরি করে ফেলেছি।এর জন্য আমি দুঃখিত!’
পিয়া রেগেমেগে একেবারে আগুন হয়ে উঠলো। তারপর টাকাটা আমার দিকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে ছুঁড়ে মারলো।
তারপর একরকম চিৎকার করে উঠলো।
বলতে লাগলো,’তুই আমায় এভাবে অপমান করলি !এর বদলা আমি নিয়েই ছাড়বো!’
আমি হাসি।হি হি হি করে হাসি। তারপর ওর দু গালে দুটো শক্ত চড় বসিয়ে দিয়ে বলি,’তোকে চড় দিয়েছি।নে এর বদলাটাও নে!’
পিয়া যেন স্বপ্ন দেখছে এসব।নিজেকেই নিজে বিশ্বাস করতে পারছে না!
সে একরকম কেঁদে ফেললো। তারপর বললো,’এর ফল ভয়াবহ হবে কিন্তু!’
আমি বললাম,’কী করবি তুই?যা করেছিস এরচেয়ে ভয়াবহ আর কী হতে পারে?গুন্ডা দিয়ে আমায় রেফ করাবি?খুন করাবি?রেফ তো আমি আগে থেকেই হয়ে আছি।সবাই জানে এটা।আর মনে মনে অনেক আগেই খুন হয়ে গেছি। এখন আমি এসবের তোয়াক্কা করি না। সুতরাং তোকে নিয়ে তুই ভাব।আমায় এসব ভয় ডর দেখিয়ে লাভ হবে না!’
পিয়া আমার মুখ থেকে এমন উদ্ধত ভঙ্গীর কথা শুনে ভীষণ ভীষণ অবাক হয়।
সে এসব বিশ্বাস করতে পারে না। আবার কেন জানি আমায় আঘাত করতেও পারছে না। হয়তোবা তার সাহসে কুলিয়ে উঠছে না কিছুতেই!
সে একবার হাত মুঠো করছে। আবার খানিক পর সেই মুঠো ছেড়েও দিচ্ছে।
আমি এবার ওকে বললাম,’শোন, টাকাটা ফ্লোর থেকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যা।আমি আবার একটু টায়ার্ড।জার্নি করে এসেছি। তাছাড়া চাকর বাকরদের সাথে অত কথা বলাও উচিৎ না।এতে ওদের সাহস বেড়ে যায়।আর শোন, আগামীকাল থেকে আবার কাজে নেমে পড়। আবার প্রচার কর। এখন আরেকটু বাড়িয়ে ছাড়িয়ে বলিস।এতে তোর লাভ হবে।টাকা একটু বেশি করে দিবো তোকে!’
পিয়া কথাটা শুনে একবার আমার দিকে লাল এবং বড় বড় চোখ করে তাকায়। তারপর ফুঁস ফুঁস করতে করতে আমার রুম থেকে বের হয়ে চলে যায়।
ও চলে যাওয়ার পর এলিজা দরজা বন্ধ করে দিয়ে আসে। তারপর হি হি হি করে সে হেসে উঠে। আমিও হাসি। দুজন মিলে হাসতে হাসতে একেবারে ভেঙে খান খান হয়ে যেতে থাকি আমরা। হয়তোবা সে রাতে আমাদের হাসির শব্দ শুনে শত্রুদের মনে ভয় ঢুকে যায়।দূরে ঢাকা পড়া আলোর পর্দা ছিঁড়ে যায়। তারপর শুধু ভোরের অপেক্ষা।অন্ধকারের পর যে ফিরে আসে আলোর ভোর সেই ভোরের কথাই বলছি। এলিজা ঘুমিয়ে পড়ে।আর আমি বসে বসে এই অন্ধকারেই জানলা ধরে পূর্ব দিকে তাকিয়ে থাকি।অপেক্ষা করি আলো ফোটার জন্য।আমি জানি আলো ফুটতে আর খুব দেরি নেই!
‘
#চলবে
কলঙ্ক পর্ব-১৭
#কলঙ্ক
#১৭তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
ট্রেন তখনও প্লাটফর্ম ছেড়ে যায়নি একেবারে। তবে আগের চেয়ে খানিক গতি বেড়েছে।আমি এবার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে ট্রেন থেকে নামতে প্রস্তুত হলাম।যাইহোক হবে।মেহরাবের রাগ না ভাঙিয়ে কিছুতেই ঢাকা যাওয়া যাবে না!
দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে ট্রেন থেকে নামতে যাবো ঠিক তখন পেছন থেকে কেউ আমার কোমর পেঁচিয়ে ধরে ফেলে।আমি ভয়ে আঁতকে উঠে পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখি মেহরাব। ততোক্ষণে ঝকঝক করে ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। এখন অনেক গতিতে ছুটছে ট্রেন।
মেহরাবকে দেখে আমি নিছক বোকা বনে গেলাম।এটা কী করে সম্ভব? তখন তো আমি খুব ভালো করেই খুঁজেছি।সে তো বগিতে ছিল না!
‘
মেহরাবের বুকের কাছে মুখ আমার।ও তখনও আমায় ধরে আছে।আমি কী এক লজ্জায় আবিষ্ট হয়ে মরে যেতে চাচ্ছি। কিন্তু ওর কাছ থেকে কেন জানি ছুটতেও ইচ্ছে করছে না আর। তবে আমার এই ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছেয় তার কিছু যায় আসে না। মেহরাব আমার কোমড় থেকে হাত সরিয়ে নিলো। তারপর বললো,’ওখানে গিয়ে বসো।’
আমি আবার জানলার কাছে গিয়ে সিটে বসলাম। আমার পাশে এসে মেহরাবও বসলো।
খানিক সময় দুজনেই চুপচাপ বসে রইলাম।
তারপর মেহরাবই কথা শুরু করলো।সে পেছনে ঘটে যাওয়া বিষয়টা বাদ দিয়ে নতুন কিছু বললো।বললো,’জানলার কাছে এই আলো আঁধার মাখা সন্ধ্যায় তোমায় খুব ভালো লাগছে তূর্ণা!’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম।
মেহরাব এবার বললো,’আমি কী তোমার হাতটা একটু ধরতে পারি?’
আমি লজ্জা পাচ্ছি। খুব ইচ্ছে করছে ওর হাতটাই খপ করে ধরে ফেলতে। কিন্তু লজ্জার জন্য পারছি না। তবে ও যখন নিজ থেকেই বলেছে আমার হাত ধরার জন্য তবে আমার না বলার তো কোন প্রশ্নই আসে না!
আমি মাথা নত করে অন্য দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললাম,’শিউ্যর।’
আমি ভেবেছিলাম মেহরাব মজা করেছে। হয়তো সে আমার হাত ধরবে না। কিন্তু সে আমায় বড্ড অবাক করে দিয়ে আমার হাত চেপে ধরলো।
ধরেই রাখলো সারাক্ষণ।
তখন আঁধার নেমে এসেছে।ট্রেনের ভেতর লাইট জ্বলছে।ঠিক এই সময়টাতে আমি কোনদিন ঘুমাইনি। কিন্তু আজ আমার এতো ঘুম পাচ্ছে কেন?
পরপর দু তিনবার হাই উঠেছে। শরীর এলিয়ে পড়তে চাইছে।আমি জানি না ঠিক কখন যে ঝট করে এলিয়ে পড়লাম মেহরাবের গায়ের উপর। তারপর ঘুমে তলিয়ে গেলাম বিছানা ভেবে ওর বুকের ওপর!
টের পেলাম অনেক পর যখন ট্রেন এসে থামলো কমলাপুর রেলস্টেশনে।সব যাত্রী এক এক করে নেমে গেলো। তখন মেহরাব আমার পিঠে আলতো স্পর্শ করে ডাকতে লাগলো।
‘তূর্ণা,এই তূর্ণা?’
আমি পিঠে ওর স্পর্শের জন্য গায়ে শিরশির করা এক অনুভূতি নিয়ে ওর দিকে এলোমেলো চোখে তাকাতেই সে হাসলো।
আমি লজ্জায় গাঢ় লাল হয়ে ওর থেকে সামান্য সরে আসতে চাইতেই সে আমায় আরো কাছে টেনে নিলো। তারপর আমার কানের কাছে তার ঠোঁট এনে বললো,’একদিন খুব ভালো বাসবো তোমায়!’
আমার তখন খুব ইচ্ছে করছিলো যেন ও এক্ষুনি বলে ফেলে,তূর্ণা আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। তারপর সে আমায় তার বুকের কাছে টেনে নিক।আদর করে চুমু খাক। কিন্তু এসবের কিছুই তো করলো না ও।গাধার মতো করে বললো, তূর্ণা আমি তোমায় একদিন ভালো বাসবো!
ভালো বাসবে না ছাই করবে!এর আগে মরে ভূত হয়ে গেলে কী হবে?
আমাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে মেহরাব বললো,’ আমি ফিরতি ট্রেনেই চলে যাবো মেডাম। আপনি এখন উঠুন। আপনাকে দ্রুত পৌঁছে দিয়ে আসি।’
আমার যা রাগ পেলো তখন।আমি ওর দিকে রাগমাখা লাল লাল চোখে তাকিয়ে বললাম,’হয়েছে।আমি একাই যেতে পারবো। কাউকে আমায় দিয়ে আসতে হবে না গিয়ে!’
মেহরাব হাসলো। কিন্তু কিছুই বললো না।
আমি ওর সামনে দিয়েই ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বের হয়ে গেলাম। কিন্তু ও মুখ থেকে একটা রা পর্যন্ত করলো না!
‘
প্রচন্ড মন খারাপ আর কাঁদো কাঁদো চোখ নিয়ে হোস্টেলে গিয়ে উঠলাম। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো আমার সিটটা এখন আর খালি নেই।অন্য জনকে দিয়ে দেয়া হয়েছে।হোস্টেলে এখন আর আমার সিট নাই।অথচ আমি কদিন আগে যাওয়ার সময় ভাড়া মিটিয়ে গিয়েছি। তবুও ওরা কেন এমন করলো?
প্রভোস্ট মেমের সাথে দেখা করতে যখন গেলাম তখন তিনি আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন আমি ভিন গ্রহ থেকে একটা এলিয়েন এসেছি! তিনি এমন কাউকে আর কখনো দেখেননি!
আমি মেমকে সালাম দিলাম।
‘আসসালামু আলাইকুম।’
মেম সালামের উত্তর দিলেন না।উল্টো তিনি আমায় কড়কড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,’তোমার নামে উপরে উপরে অনেক কিছু শুনেছি।যা শুনেছি তা কী সত্যি?’
এমনিতে আমার অত সাহস নেই। কিন্তু মেহরাবের প্রতি একটা রাগ থেকে আমার মাথা এমনিতেই ধরে আছে। সেই রাগ থেকেই হয়তোবা এমনটা করেছি আমি।মেমকে সরাসরি বলে ফেলেছি,’মেম সত্যি।’
মেম খুব আশ্চর্য হয়ে বললেন,’তোমার লজ্জা করছে না এভাবে সত্যি বলতে?’
আমিও পাল্টা জবাব দিলাম।
‘মেম, আমাদের বিয়ে হয়েছিল। আমার হাসব্যান্ড আমায় ঠকিয়েছে।আমি তো তাকে ঠকাইনি। লজ্জা তো যে ঠকিয়েছে তার হওয়া উচিৎ। আমার কেন লজ্জা হবে?’
মেম খানিক সময় বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। হয়তো তিনি এখন ভাবছেন, এই মেয়ের অত সাহস হয় কী করে?অথবা এও ভাবতে পারেন যে তার জীবনে এতো নির্লজ্জ মেয়ে তিনি দেখেননি। তবে সত্যিটা হলো এই জগতে খুব কম ছেলে মেয়েই আছে যারা গোপনে কোন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেনি!ছেলেটা মেয়েটার ঠোঁটে চুমু খায়নি! জড়িয়ে ধরেনি। তাদের বিষয়টা গোপন বলেই তারা গলা বড় করে অন্যের দোষটা বলতে পারে। অথচ পাপ তো তাদেরটাও কম নয়!হতেও তো পারে যে মেম আজ আমায় এমন বড় বড় চোখ করে দেখছেন,মনে মনে নির্লজ্জ আর বেহায়া ভাবছেন তার নিজেরও এমন একটা অতীত আছে যে অতীত সম্পর্কে কেউ জানে না!হতে পারে না?
মেম বললেন,’কেন এসেছো আমার কাছে বলো?’
আমি বললাম,’আমার সিটটা অন্যজনকে দেয়া হলো কেন?’
মেম সামান্য ভিরমি খেয়ে গেলেন। খাওয়ার কথাও। তিনি এভাবে অন্য কাউকে এই সিট দিয়ে দিতে পারেননা। এই অধিকার তার নাই।কারণ সিটের ভাড়া এখনও আমি বহন করছি। তাছাড়া সিট এখনও আমার অধীনে!
মেম আমার দিকে অবাক চোখে তাকালেন।যেন তিনি ভাবতেও পারছেন না একজন ছাত্র তার সাথে এমন উদ্ধত আচরণ করতে পারে!
মেম হড়বড় করে হঠাৎ বললেন,’তুমি এরকম আচরণ করছো কেন আমার সাথে? তুমি জানো এর জন্য তোমায় আমি পানিশম্যান্ট দিতে পারি?’
আমি আলতোভাবে হেসে বললাম,’জ্বি না।আমি জানি আপনি আমার উপর কিছুতেই পানিশমেন্ট দিতে পারেন না।কারণ আমি আপনার সাথে কোন রকম বেয়াদবি করিনি!’
মেম যেন আমার এই সাহসিকতা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না।মেম না শুধু। এখানে অন্য কেউ হলেও এমন করতো। মানুষ স্বভাবগতভাবেই এমন।যারা উচ্চ পদস্থ তারা সব সময় তাদের চেয়ে ছোটদের প্রতি প্রভু সুলভ আচরণ করতে পছন্দ করে!
মেম রাগমাখা গলায় বললেন,’তুমি এখন এখান থেকে যাও বলছি। এক্ষুনি যাও। আমার তোমায় সহ্য হচ্ছে না!’
আমি মৃদু হেসে বললাম,’একশোবার যাবো আমি। কিন্তু এর আগে আপনি আমার সিট ফিরিয়ে দিন।’
‘যদি না দেই?’
‘না দিলে আমি এখান থেকে যাবো না!’
মেম বললেন,’এক চড় দিয়ে দাঁত ভেঙে ফেলবো বেয়াদব মেয়ে!’
আমি এর জবাব দিলাম না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম।
মেম এবার রাগের গলায় বললেন,’এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
আমি বললাম,’আমার সিটটা ফিরিয়ে দিন মেম।’
মেম এবার উঠে দাঁড়ালেন। তিনি প্রচণ্ড রকম ক্ষীপ্ত।এই মুহূর্তে তিনি কী করবেন বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্য আমার গায়ে হাত তোলার অধিকার তার নেই। কিন্তু যেভাবে তিনি রেগেছেন তিনি হাত তুলতেও পারেন!
‘
#চলবে
কলঙ্ক পর্ব-১৬
#কলঙ্ক
#১৬তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
মেহরাব বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।সালাম দেয়। কুশল বিনিময় হয় দুজনের মধ্যে। তারপর বাবা কিছু বলতে চাওয়ার আগেই সে বাবাকে বলে,’বাবা, আপনি টেনশন করছেন এবং নিরাশায় ভোগছেন যে আমি কী তূর্ণাকে বিয়ে করি কি না এ নিয়ে! সেটাই তো?’
বাবা কোন উত্তর করতে পারেন না।কী বলবেন বুঝতে পারেন না।
মেহরাব নিজেই ফের বলে,’বাবা,আমি কথা দিচ্ছি তূর্ণাকে আমি বিয়ে করবো। কিন্তু এর জন্য তুর্ণাকে পড়াশোনা করতে হবে। তূর্ণা আমার সাথে কথা দিয়েছে সে পড়াশোনা করবে।’
তারপর মেহরাব বাবার সামনে দাঁড়িয়েই আমায় ডাকে।বলে,’তূর্ণা, এদিকে আসো তো একটু!’
ওর মুখ থেকে তুমি ডাক শুনে চমকে উঠি আমি। মেহরাব এই প্রথম আমায় তুমি করে ডেকেছে।
আমি ধীরে ধীরে পা ফেলে লজ্জায় লাল হওয়া মুখ নিয়ে এসে ওদের পাশে দাঁড়াই। তারপর মাথা নত করে তাকিয়ে থেকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মাটি খুড়ি।
মেহরাব তখন বলে,’তূর্ণা, তুমি কী এবার জিততে পারবে?’
আমি চোখ জোড়া উপরের দিকে তুলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,’পারবো।’
‘
সে রাতেই বাবা বলেন,’আমি এই বিষয়ে আর কিছু বলবো না।মেহরাব যখন বলেছে তবে তার কথা শোনা উচিৎ। ছেলেটাকে মনে হচ্ছে অনেক ভালো। তাছাড়া তার বাবাও ভালো মানুষ ছিলেন।আমি খবর নিয়েছি ওদের সম্পর্কে।’
মা তখন কেমন যেন ধরা গলায় বলেন,’আমার কপালে আল্লাহ শান্তি দেয় নাই! মানুষের ছেলে মেয়েরা বাপ মার কথা শোনে।মান ইজ্জতের কথা ভাবে। আমারে যে আল্লাহ কোন জাতের সন্তান দিলো! তাদের যা ইচ্ছা তারা তাই করে।বাপ মা কী বলে না বলে সেই দিকে তাদের কোন নজর নাই!’
মা কথাগুলো বলে অভিমানে কেঁদেই ফেলেন।
মার কান্না দেখে আমার খারাপ লাগলেও আমি চুপ করে থাকি।আর মনে মনে তখন আমি ভাবি,মা তোমার এই কান্না আমি ঠিক একদিন হাসিতে পরিণত করবো। অবশ্য এর জন্য আমার অনেক কষ্ট করতে হবে। অনেক সংগ্রাম করতে হবে। তবে আমি এই কষ্টটুকু এখন করতে প্রস্তুত আছি। এবার আমি বিজয়ী বেশেই ফিরবো ইনশাআল্লাহ!
‘
ঢাকায় যাচ্ছি।এবারও ট্রেনে করে যাচ্ছি।ঝক ঝক করে ছুটছে ট্রেন। মেহরাবের কথা ছিল সে আমায় স্টেশন অবধি পৌঁছে দিবে। কিন্তু সে আমার সাথেই আছে এখন।ঢাকা পর্যন্ত যাবে আমার সাথে।
আমি প্রথম বেলা ভাবতেই পারিনি যে সে আমার সাথে যাবে। ভাবছিলাম সে এমনিতেই আমার পাশে বসে আছে। কিন্তু একটু পর যখন ট্রেন ছেড়ে দিল,স্টেশন কেটে ট্রেন চলে গেল অনেক দূরে তখনও বুঝতে পারছিলাম না কিছু। ভেবেছিলাম সামনের কোন একটা স্টেশন দেখে সে ঠিক নেমে পড়বে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো সে আমায় ভীষণ রকম অবাক করে দিয়ে সামনে আরো দু তিনটে স্টেশনেও নামলো না।
এবার আমি তার সাথে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু কী বলে সম্বোধন করবো বুঝতে পারছিলাম না তাকে।সে তো আমায় তুমি তুমি করে বলছে। আমার কী বলে তাকে এখন সম্বোধন করা উচিৎ? আপনি?
আরেকবার মনে হচ্ছে তুমি করেই বলে ফেলি।সে যদি তুমি করে বলতে পারে তবে আমি কেন পারবো না!
তারপর মনে হলো মেহরাব তো আমার চেয়ে বয়সে অনেক বেশি বড়ো।বড়োদের তো তুমি করে বলা উচিৎ নয়। তাছাড়া তার সাথে আমার এখনও বিয়ে হয়ে যায়নি।প্রেম টেমও হয়নি।আমরা ভালো বন্ধুও না।
এবার একটা বুদ্ধি খেলে যায় মাথায়।মেচ্যুয়ুর মেয়েদের মতো করে আমি বলি,’মেহরাব!’
মেহরাব আমার দিকে তাকায়।
আমি এবার ভয় ভয় করা গলায় বলি,’আমরা কী তুমি তুমি করে বলতে পারি?’
কথাটা বলার পর হঠাৎ কেন জানি নিজেকে নির্লজ্জ মনে হতে থাকে আমার।তাই শামুকের মতো নিজের খোলসে নিজেকেই হঠাৎ ঢেকে ফেলতে থাকি!
মেহরাব তখন বলে,’আমি তো অনেক আগে থেকেই তুমি তুমি করছি তোমায়। তুমি করছো না কেন?’
আমি সাহস করে বলে ফেলি,’কোন অধিকারে তুমি করে বলবো? আমার তো ভয় করে!’
মেহরাব সাদা মুক্তোর মতো দাঁত বের করে হেসে উঠে। তারপর বলে,’আমি যে তোমায় তুমি করে বলি সেই অধিকারেই ডাকো।’
আমি আরো লজ্জায় আবিষ্ট হই। তারপর ফিক করে হেসে উঠে বলি,’তুমি!’
মেহরাব বলে,’আমি কী?’
আমি হাসি।হাসতে হাসতে বলি,’তুমি কী তা আমি কী করে জানবো!আমি কী তোমার সম্পর্কে সব জানি নাকি!’
‘তবে কতোটুকু জানো!’
‘জানি তুমি একটা নাটক বাজ!’
বলে ফিক করে আবার হেসে উঠি আমি।
মেহরাব রাগ পায় প্রচন্ড।মুখ কালো করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।গাড়ি আরেকটু পরেই শ্রীপুর স্টেশনে পৌঁছাবে। মেহরাব আমার সাথে একদম কথা বলে না।আমি অনেক চেষ্টা করেও তাকে কথা বলাতে পারি না।সে হঠাৎ কানে ফোন ধরে বললো,হ্যা হ্যা আমি সামনের স্টেশনেই নেমে যাবো। একজন নাটকবাজের ঢাকায় যাওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না!
আমি জানি মেহরাব তখন কাউকে ফোন করেনি।এই কথাটা আমায় শুনাবার জন্যই সে বলেছে।
আমি তখন ওকে বলি,’সরি মেহরাব!’
মেহরাব আমার দিকে ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত করে না।
আমি এবার অনুনয়ের গলায় বলি,’মেহরাব,আমি অনেক সরি!মজা করেছি তোমার সাথে!’
মেহরাব তবুও শুনে না।
ট্রেন ছুটছে। পাগলের মতো ছুটছে। বাইরে বাতাস।রেলের পাতের ও পাশটায় ধুলো উড়ছে। বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে ধুলো। দূরে একটা মহিলাকে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল।আমি বুঝতে পারছি না কিছুই। মহিলা কী কারোর জন্য অপেক্ষা করছে?এই ট্রেনে করে কী তার কোন প্রিয়জনের আসার কথা!
এসব ভাবতে ভাবতেই ঝট করে ট্রেন এসে থেমে গেল শ্রীপুর স্টেশনে। হঠাৎ ও পাশে তাকিয়ে দেখি মেহরাব নেই। বুকটা আমার হঠাৎ ধুকপুক করে কেঁপে উঠলো।এ কী!ও কী আমায় না বলেই নেমে গেছে তবে?
‘
ট্রেনের বগির ভেতর খুব করে খুঁজি।ভিড়ের ভেতর একজন একজন করে দেখি। কিন্তু তার দেখা মিলে না। অবশেষে বগির দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে উঁকি দিয়ে এদিক ওদিক দেখলাম। কোথাও মেহরাব নেই।ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ওকে ফোন করলাম। ফোনের সুইচ অফ।কী মহা মুশকিল!
এমন না যে আমি ওকে ছাড়া ঢাকায় যেতে পারবো না! কিন্তু আমার ওকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে!এই যে আমার ঢাকায় ফেরা, পড়াশোনা শুরু করার ইচ্ছে সবটাই তো ওর জন্য!
নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে নিজেই নিজের সব চুল টেনে উপড়ে ফেলি!
‘
ট্রেন ছেড়ে দিবে।সময় হয়ে গেছে। বাঁশি বাজাচ্ছে। এখন আমি কী করবো? ওকে ছেড়েই চলে যাবো!নাকি নামবো?
কিন্তু নেমে যদি ওকে না পাই?
আর পেলেও যদি ওর রাগ না ভাঙ্গে?
ভয় হচ্ছে আমার। খুব ভয় হচ্ছে। এমনিতেও সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কেমন একটা আঁধার আঁধার ভাব বাইরে।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। সামান্য গতিতে ছুটছে। এখনও মানুষ ট্রেনে উঠছে। প্লাটফর্ম ছেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্তই এভাবে মানুষ উঠতে থাকবে। কিন্তু আমি কী করবো?
নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে হঠাৎ।মুখ ভেঙে কান্না পাচ্ছে। নিজের প্রতি কী যে রাগ হচ্ছে।কেন যে আমি ওকে এমন একটা কথা বলতে গেলাম!
‘
#চলবে
কলঙ্ক পর্ব-১৫
#কলঙ্ক
#১৫তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
জীবনে প্রথমবারের মতো বাবার কথার উপর কথা বলি আমি।বলি,’বাবা, জীবনে শেষ বারের মতো একটা সুযোগ চাইছি আমি।প্লিজ এই সুযোগটা আমায় দাও।কথা দিলাম আমি পড়াশোনা শেষ করেই ফিরবো!’
বাবা আমার কথা শুনে ঈষৎ কেঁপে উঠেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন,’তুই পারবি না মা।এর আগেও পারিসনি! তোকে ওরা খুব অপমান করবে।তুই সহ্য করতে পারবি না এসব কিছুতেই!’
আমি তখন অসহায় হয়ে পড়ি। পেছনের ব্যর্থতাগুলো এসে মস্তিষ্ক ঠুকরে ধরে। খুব ব্যথা করে। ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে কাঁদতে! তবুও কাঁদি না আমি।শান্ত স্বরে বাবার আরেকটু কাছে ঘেঁষি আমি। আমার সাহস হয়।আমি বলি,’পারবো বাবা। এবার যে আমায় পারতেই হবে।’
বাবা বলেন,’কার জন্য পারতে হবে?মেহরাবের জন্য?’
আমি ডান দিকে মাথা কাঁত করে হ্যা বলি।
বাবা তখন বলেন,’মারে, অতদিন সে তোর জন্য কিছুতেই অপেক্ষা করবে না। তাছাড়া কেউ ইচ্ছে করে ঘরে কলঙ্ক নিতে চায় না! হয়তো আমি কিংবা তোর মা,তোর ভাই তোকে কলঙ্ক ভাবছি না।কারণ আমরা তোর রক্ত।অথবা তুই আমাদের রক্ত।আমরা সত্যিটা জানি।আমরা জানি এটা তোর ভুল ছিল। কিন্তু অন্য মানুষ তো এটাকে ভুল বলে মানবে না। মেহরাব যদিও মুখে বলেছে সব মেনে নিবে সে, কিন্তু আসলে সে কিছুই মানবে না!’
আমি তখন খপ করে বাবার একটা হাত ধরে ফেলি। তারপর বলি,’বাবা,ও আমায় ছেড়ে দিক।এতে আমার কোন দুঃখ হবে না। কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে হবে যে সে আমায় ছাড়বে না। মানুষ লক্ষ্য ছাড়া কিছুই করতে পারে না।কারোর যদি কোন গন্তব্য না থাকে তবে সে জীবনে কিছুই করতে পারবে না।জীবনটা তার কাছে হবে তখন কর্মহীন,লক্ষ্যহীন।আমি এমন হতে চাই না বাবা।আমি চাই মেহরাবকে পাওয়ার জন্য পড়াশোনাটা করতে। এই আশাটা না থাকলে আমি পড়াশোনাটা করতে পারবো না! কিন্তু জেনে রেখো বাবা,ও যদি আমায় বিয়ে নাও করে আমি কিন্তু তখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবো। নিজের পায়ে নিজে দাঁড়িয়ে যাবো। তখন কিন্তু কারোর প্রতি আমার আশা নিয়ে থাকতে হবে না। নিজের কাজটা নিজেই করতে পারবো!’
বাবা কিছু বলেন না। রাগে,অভিমানে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে রাস্তার দিকে চলে যান। রাস্তার গা ঘেঁষে নদী আছে।কংশ নদী।আমি জানি বাবা এখন নদীর পাড় ঘেঁষা সবুজ তুলতুলে ঘাসের উপর বসে থাকবেন। নদীতে কমে যাওয়া স্বচ্চ জলের দিকে তাকিয়ে ভাববেন তার মেয়ে কী আসলেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কি না!আর রাতে ঘরে ফিরে জানাবেন, তিনি শেষ বারের মতো রাজি আছেন।
‘
রাতে ঘরে ফিরে বাবা ঠিক জানালেন তিনি রাজি আছেন। কিন্তু তার একটা শর্তও আছে। তিনি বললেন আমি যেন মেহরাবকে বলি,কাল সকালে একবার মেহরাব যেন আমাদের বাসায় আসে।
আমি রাতেই মেহরাবের সাথে কথা বলি।বলি,’মেহরাব কাল সকাল বেলা আপনার ডাক পড়েছে!’
মেহরাব বলে,’কোথায়?’
‘আমাদের বাসায়।’
‘কে ডেকেছে?’
‘বাবা।’
মেহরাব আশাহত হয়।সে হয়তোবা ভেবেছিল অন্যকিছু।সে হয়তোবা ভেবেছিল তাকে আমি ডেকেছি!
‘
সকাল বেলা মেহরাব আসে। তার পরনে নীল পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির বুকে মেঘের খন্ড খন্ড চিত্র।
কী যে সুন্দর লাগে তাকে এভাবে দেখতে!
বাবার সাথে কথা বলার আগেই সে আমায় বলে,’তূর্ণা, চলুন আমরা পুকুর পাড়ে যাই!’
আমার পরনে জামা ছিল। তাড়াহুড়ো করে আমি জামা পাল্টে সাদা রঙের একটা শাড়ি পরে নেয়। কপালে একটা নীল সরু টিপ পরি। চোখে কাজল মাখি।হাতে একটা চিকন কালো ফিতের ঘড়ি।দু পায়ে সাদা চকচকে রূপোর নূপুর। তারপর খালি পায়ে বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে বলি,’চলুন।’
মেহরাব আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। তারপর হাঁটে।আমরা গিয়ে দাঁড়াই গত পড়শুদিন সেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক সেখানেই। সেই ফাগুন বাতাস,তিরতির করে পাতার কাঁপুনি,মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণ এইসব কিছু নিয়ে আমরা মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াই।
মেহরাব বলে,’আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে!’
আমি মোলায়েম হাসি।
মেহরাব আবার বলে,’আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে!’
আমি আগের মতই হাসি।
মেহরাব আমার দিকে এগিয়ে আসে এক পা দু পা করে। আমার একেবারে কাছাকাছি এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তারপর পকেট থেকে একটা লাল টকটকে গোলাপ বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে,’আই লাভ ইউ।’
তখন আমার কাছে মুহূর্তে পৃথিবীটাকে স্বর্গের মনে হয়।আমের মুকুলের ঘ্রাণকে মনে হয় স্বর্গের কোন অচিন ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। দিঘির জলকে মনে হয় স্বর্গের নহরের মিষ্টি জল। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক মেহরাবকে মনে হয় সে যেন এ জগতের কেউ নয়।সে স্বর্গের এক যুবক।যে দেখতে আদি পিতা আদমের মতো লম্বা চওড়া। ইউসুফের মতো রুপবান তরুণ।তার গলার স্বর দাউদের গলার মতো (পড়ুন আঃ)।আমি উন্মাদের মতো হয়ে পড়ি কেমন। তারপর হাত বাড়াই।গোলাপটা টেনে নিয়ে বুকের কাছে চেপে ধরি।আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে বলি,’মেহরাব,আই লাভ ইউ টু ওওওও।’
মেহরাব আমার দিকে তাকিয়ে হাঁটু সোজা করে উঠে দাঁড়ায়। তারপর বলে,’আপনার বাবা আমায় কিসের জন্য ডেকেছে আমি জানি।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’কিসের জন্য?’
‘তিনি আমায় ওয়াদা করাতে চাইবেন। জিজ্ঞেস করবেন আমি সত্যি সত্যি আপনাকে বিয়ে করবো কি না। এই জন্যই আপনাকে আমি পরীক্ষা করে দেখলাম। পরীক্ষায় আপনি ফেল করে ফেলেছেন।আমি এখন আপনার বাবাকে বলবো, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করবো না। আপনি আপনার মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ রেখে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিন।কথা দিলাম ওর সম্পর্কে জানা কোন বিষয়ে আমি কোনদিন কারোর কাছে মুখ খুলবো না।আপনারা নিরাপদ!’
আমি উদভ্রান্তের মতো হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,’আমার ভুলটা কোথায় হয়েছে মেহরাব?’
মেহরাব রেগে যায় হঠাৎ।রেগে গিয়ে বলে,’আপনি জানেন না আপনি কী ভুল করেছেন?’
আমি বুঝতে পারি না। সত্যি সত্যি বুঝতে পারি না!ভুলটা আমি কোথায় করলাম?
আমায় চুপ করে থাকতে দেখে মেহরাব বললো,’আপনি ভীষণ বোকা আর প্রচন্ড রকম আবেগী।বোকা আর আবেগী বলেই আপনার জীবনটা আজ এমন।ওই যে আমান আপনাকে ঠকিয়ে গেলো তা আপনার আবেগের জন্যই।আর আপনার বোকামির জন্যও।আমায় আপনি চিনেন কতদিন হলো?এই দু থেকে তিনদিন। এই দু তিন দিনে আপনার সাথে আট দশটা বাক্যের উপর কথা হয়নি আমার।এই আট দশটা কথায় কী আপনি আমায় বোঝে গিয়েছেন?চিনে ফেলেছেন আমায় সবটুকু?’
আমি বুঝতে পারছি না মেহরাব এমন করছে কেন?
আমি ওর দিকে বোকার মতোই তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ করে মুখ ভেঙে কান্না এসে যেতে চায়। ঠোঁট কাঁপে তিরতির করে সবুজ সবুজ আম পাতাদের মতো। চোখে জল টলমল করে ঢেউ খেলে যায়।
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকি,’মেহরাব!’
মেহরাব তখন বলে,’আপনাকে আমি প্রপোজ করলাম আর আপনি সাত পাঁচ না ভেবেই হুট করে রাজি হয়ে গেলেন!কী আশ্চর্য!এর নাম কিন্তু ভালোবাসা নয়।এর নাম ঠকা। ভালোবাসার আগে হাজার বার ভেবে নেয়া উচিৎ।যাকে ভালোবাসবেন তাকে চিনে নেয়া উচিৎ। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করা উচিৎ।
আরেকটা কথা হলো, এই যে আপনি ঢাকায় যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলেন আপনি তো ঢাকায় গিয়ে থাকতে পারবেন না। আপনি বোকা আর আবেগপ্রবণ। আপনাকে যখন ওরা আঘাত করে কথা বলবে। অপমান করবে। তখন কিন্তু আপনি আবার বাড়িতে পালিয়ে আসবেন। এবং এটাই সত্যি!’
আমি এবার কেঁদে ফেলি।সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলি।
আমাকে কাঁদতে দেখেও মেহরাব মায়া দেখায় না।সে আমায় পেছনে ফেলে হেঁটে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বাবার সাথে দেখা করবে।কথা বলবে। হয়তো না করে দিবে।বলবে,আমায় বিয়ে করবে না।বলে দিবে আমাকে অন্য কোথাও বিয়ে দেয়ার জন্য!
না যদি করবেই তবে আগে এতো স্বপ্ন দেখালো কেন?এতো এতো স্বপ্ন!
তারপর আবার জিভে কামড় দেই শক্ত করে আমি।কান্নার মাঝেই মনে হয় আমি আবার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি।আসলে আমাকে এখন আর আবেগী হলে চলবে না। পৃথিবীতে আবেগপ্রবণ মানুষেরা জীবনভর কষ্ট পেয়ে যায়! এদের কপালে সুখ নামক বস্তু কোনদিন জোটে না!
‘
#চলবে
কলঙ্ক পর্ব-১৪
#কলঙ্ক
#১৪তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
ফাগুনের দিনগুলো বড়ই মধুর হয়। সেই মধুর এক বিকেলে আমার মা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে লাগলেন এই জন্য যে আমার হবু বর মেহরাব মাকে বলেছে,’তূর্ণা আবার ঢাকায় যাবে।ওর অনার্স মাস্টার্স শেষ করবে। তারপর ওকে আমি বিয়ে করবো।আর হ্যা আরেকটা কথা আছে।ও কিন্তু আগের হোস্টেলেই থাকবে।’
মা চমকে উঠে বললেন,’এটা কীভাবে সম্ভব বাবা!আমরা তো মেয়েকে আর পড়াবো না!’
মেহরাব বললো,’কিন্তু আমি পড়াবো।’
‘তূর্ণার তো ইচ্ছে নাই পড়ার।সে আর পড়াশোনা করবে না।’
মেহরাব বললো,’শুনুন মা, তূর্ণা কিংবা আপনারা যদি আমার এই কথা না রাখেন তবে কিন্তু আমি পাড়ার সব মানুষের কাছে তূর্ণার বিষয়টা বলে দিবো।’
মা চমকে উঠে বললেন,’কী বলে দিবে বাবা?’
মেহরাব মুখ শক্ত করে বললো,’তূর্ণা একটা গোপন বিয়ে করেছিলো।আরো অনেক কিছু।’
মা এই কথা শুনে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না মেহরাব এই কথা কীভাবে জানলো।
মা কিছু বলতে যাবেন এর আগেই মেহরাব বললো,’মা,আশা করি আপনি আমার এই কথা রাখবেন।কথা না রাখলে আপনাদের সম্মান নষ্ট হবে, আমার না।আজ আমি যাচ্ছি।কাল সকাল বেলা আপনারা আমায় জানাবেন আপনাদের সিদ্ধান্ত।যদি রাজি হন তবে আমি নিজে গিয়ে তূর্ণাকে স্টেশন অবধি পৌঁছে দিয়ে আসবো।’
মেহরাব এই কথা বলে চলে গেল।
মা বোকার মতো ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন ।
‘
রাতের বেলায় আমার ঘরে হঠাৎ করে মা এলেন। তারপর আমার ঘরের দরোজা ভেজিয়ে দিয়ে আমার পাশে এসে মা বসলেন। বসে আমার দিকে তাকিয়ে মা বললেন,’মেহরাব কী করে এসব জানে?’
আমি বললাম,’কী সব জানে?’
‘তোর গোপন বিয়ে।এবরোশন?’
আমি শান্ত গলায় বললাম,’আমিই বলেছি ওকে।’
মা রেগে গিয়ে বললেন,’কেন বলেছিস?’
আমি বললাম,’আমার মনে হয়েছে বলা প্রয়োজন তাই বলেছি।’
মা তখন আমার গালে শক্ত করে এক চড় বসিয়ে দিলেন। তারপর আমার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে বললেন,’সারাটা জীবন অবোঝের মতো কাজ করলি।তোর মন যা চেয়েছে তাই করেছিস।সব নিজের ইচ্ছেতে।এতে ফল কী হয়েছে?কার ক্ষতি হয়েছে?বিপদ কার হয়েছে? তোর।এবারও নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনছিস।’
‘বিপদের কথা বলছো কেন মা? বিপদের কী হলো?’
মা মুখ শুকনো করে বললেন,’মেহরাব কী বলে গিয়েছে তুই জানিস?’
‘কী বলে গেছে?’
‘তোকে আবার ঢাকায় যেতে হবে। হোস্টেলে উঠতে হবে। পড়াশোনা করতে হবে আবার।আর পড়াশোনা যদি না করিস তবে নাকি সে তোকে বিয়ে করবে না। মানুষের কাছে সবকিছু জানিয়েও দিবে।’
মার কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে উঠলাম।
মা এবার আমার প্রতি ক্ষীপ্ত হয়ে বললেন,’তুই হাসছিস?’
‘হুম হাসছি। তুমি কী ভেবেছিলে?আমি কাঁদবো?’
মার প্রচন্ড রাগ পেলো।মা বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে তরতর করে হেঁটে বাইরে চলে গেলো। তারপর আবার ফিরে এলো আমার কাছে। এসে রাগ মাখা গলায় বললো,’তুই কী ঢাকায় যাবি?’
আমি হেসে বললাম,’যাবো। আগামী পড়শুদিনই যাবো।’
‘ওই হোস্টেলেই উঠবি?’
‘হ্যা ওই হোস্টেলেই উঠবো।’
মা এবার সবচেয়ে বেশি চমকালেন।আর বললেন,’তো আগে চলে এসেছিলে কেন?’
‘আগে চলে এসেছিলাম কিন্তু এখন আর আসবো না!’
‘যদি আসিস?’
‘আসবো না।’
‘ফিরে আসলে কিন্তু কিছুতেই আমার কাছে আসা যাবে না!এই বাড়িতে তোর আর জায়গা হবে না!’
আমি জানি মা এসব কিছু আমার উপর অভিমান এবং রাগ থেকেই বলছে।মন থেকে একটা কথাও বলছে না।
আমি তাই শান্ত গলায়ই বললাম,’ফিরে আসলে তোমার কাছে আসবো না। সোজা বারহাট্টা চলে যাবো। একেবারে শশুর বাড়ি!’
মা এতো মন খারাপের মাঝেও হেসে ফেললেন। কিন্তু হেসে আবার মুখ আঁধার করে ফেললেন। তারপর মেঘ থমথমে গলায় বললেন,’তুই কী ভাবছিস তোর জন্য মেহরাব এতো দিন অপেক্ষা করবে?এই চার পাঁচ বছর?’
আমি বললাম,’হ্যা ঠিক তাই ভাবছি।সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।’
মা বললেন,’এটাও তোর ভুল ভাবনা।আমান তো তোকে মিথ্যে বলে দেশ ছাড়লো। আর মেহরাব করবে কী জানিস? তোকে ঢাকায় পাঠিয়ে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিবে!’
‘এমন করে বলছো কীভাবে?অত কনফিডেন্স?’
‘হ্যা এতো কনফিডেন্সই।আসলে মেহরাব তোর কাছ থেকে সবকিছু শোনার পর সে এটা মেনে নিতে পারেনি। জগতের কোন ছেলেই পারবে না তার হবু স্ত্রীর এমন একটা অতীত মেনে নিতে। কিন্তু মেহরাব সবকিছু শোনার পর তোকে সরাসরি নাও করতে পারছিলো না। উপায়হীন হয়ে সে একটা গেইম খেলেছে তোর সাথে।আমান যেভাবে খেলেছিলো।আমান বলেছিলো, বিসিএস দিবো, যোগাযোগ রেখো না।এই কথা বলে উধাও।আর এই ছেলে বলেছে,ঢাকায় গিয়ে তোর পড়াশোনা শেষ করে আসলে পরে বিয়ে। কিন্তু মোদ্দাকথা সে খুব ভালো করেই জানে যে ঢাকায় থেকে তুই পড়াশোনাটা কিছুতেই কম্প্লিট করতে পারবি না!’
‘মা আমি পড়াশোনা কম্প্লিট করেই আসবো এবার।’
‘পড়াশোনা কম্প্লিট করবি ভালো কথা। কিন্তু মেহরাবকে পাবি না। মেহরাব অন্য একটা মেয়ে দেখে ঠিক বিয়ে করে নিবে!’
আমি মার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,’মা,এটা কী তোমার অনুমান নাকি মেহরাবের পক্ষ থেকে বলা কোন কথা?’
মা বললো,’অনুমান।আর আমার অনুমান শতভাগ সত্য।’
‘বাহ্। কিন্তু আমার কষ্ট লাগছে এই ভেবে যে তোমার এবারের এই অনুমান মিথ্যে হয়ে যাবে।’
মা তখন বললেন,’সত্য মিথ্যা নিয়ে আমি ভাবছি না তূর্ণা ভাবছি তোর জীবন নিয়ে। তূর্ণা তুই এতো বেকুব কেন রে মা?কেন এতো সহজ সরল তুই?কেন সবকিছু মানুষের কাছে অবলীলায় বলে দিস?কেন তুই মানুষকে অত সহজে বিশ্বাস করে ফেলিস? তূর্ণা,তুই জানিস না।জানিস না বলেই বিশ্বাস করে ফেলিস। জগতের সবচেয়ে বড় কষ্ট তার হয় যে কাউকে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে ফেলে!’
আমি মার দিকে তাকালাম।মার চোখ বেয়ে জল নামছে। মাকে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর ব্যথা হচ্ছে কেমন।
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,’মা,বিশ্বাস এমন এক বস্তু যা মানুষকে জান্নাতেও পৌঁছে দিতে পারে। সুতরাং আমাদের বিশ্বাস করা উচিৎ।যার কোন কিছুতে বিশ্বাস নাই সে অসুখি মানুষ।আমি অসুখি থাকতে চাই না মা।আমি সুখি মানুষ হতে চাই!’
ঠিক তখন বাবা এসে ঢুকলেন ঘরে। তিনি খানিক সময় দাঁড়িয়ে থেকে থমথমে গলায় বললেন,’তূর্ণা, তোদের দু ভাই বোনের সব ইচ্ছে আমি পূরণ করেছি।মনে আছে একবার তোরা দু ভাই বোন আমার কাছে বায়না ধরলি তোদের জন্য সাইকেল কিনে দিতে হবে। তখন আমার সংসারই চলে না।স্কুলের বেতন নাই। তবুও তোদের জন্য সাইকেল কিনে দিলাম। কীভাবে কিনেছিলাম জানিস? আমার মা মৃত্যুর সময় আমায় রুপার একটা পিকদানি দিয়ে গিয়েছিলেন।এই পিকদানিটা আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিল।বড় যত্নে রাখতাম এটাকে আমি। সেদিন সেই পিকদানিটা বিক্রি করে দিয়ে তোদের আবদার পূরণ করেছিলাম আমি। কিন্তু এবারের আবদারটা কিছুতেই পূরণ করতে পারবো না আমি।ঢাকায় তোকে যেতে দিবো না।আমি তোকে অন্য কোন ছেলে দেখে বিয়ে দিবো। বিয়ে তোকে দিবো এটাই আমার শেষ কথা।’
‘
#চলবে
মেঘের আড়ালে ২ পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব
#মেঘের_আড়ালে ২(ফিরে আসা)
#লাস্ট পার্ট
#লেখিকা_ফাতেমা_জোহরা_নাভিলা
দশ কেজির ওজনের লেহেঙ্গা পরে দাতঁ দ্বারা হাতের নখ কেটে অস্থির হয়ে পুরো ঘরময় জুড়ে পায়চারি করছি।কিছুক্ষন আগে আমাকে ইয়াদ এর কিছু কাজিনরা মিলে ইয়াদের ঘরে রেখে গেছে বাসর ঘর নামক ফুলের মাঝে।তখন থেকেই টেনশনে ভয়ে আমার পিত্ত, আত্তা, রুহু,কলিজা হাত, পা অতি বরফ এর মতো জমে বেহাল হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তে । ঘড়িতে সুখনো ঢোক গিলে তাকিয়ে দেখি রাত একটা বিশ বাজছে, যতোই রাত গবির হচ্ছে তোতোই ভয় এসে আরো জোড়ো হচ্ছে মনে। অন্ধকার ডিম লাইটের আলোতে রুমে ভূতুড়ে মতো আওয়াজ করে উঠল আমার ফোনের ম্যাসেঞ্জার এর টোন।।।। আমি ভয়ে বুকে থু থু দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে, কাপা কাপা হাতে ড্রেসিং টেবিল থেকে হাত বাড়িয়ে ফোন নিলাম।
.
.
ফোনের লক খুলতেই নাম ভেশে উঠল চোখের সামনে “আয়াত হোসেইন নুর্যাহাত” মেজাজ গেলো আমার তিব্বো মান চ্রটে। একহৃাস বিরক্ত নিয়ে মেসেজিং ঢুকেই আয়াত এর মেসেজ সিনন করলাম।
“দোস্ত কি করস,,,ঘুমিয়ে পরেছিস”।।।একটা কথা ছিলো খুব দরকার বলা তোকে।।
_নাহ্ ঘুমাইনি,কি বলবি বল।।
“দোস্ত বেস্টিদের বেস্টি হোক ক্রিভেটি মাইন্ড থেকে” নিউটন একখানা গোপন সুএ সন্ধান জানা ছিলো তোর থেকে 🤔।
_ তুই এতো রাতে আমাকে ব্যাঙ এর নিউটন এর সুএ জানার জন্য মেসেজ দিয়েছিস। জানিস আমি কতো টেনশনে ছিলাম।।।
__জানিতো তাই তো খোজ খবর নেওয়ার জন্য তোকে মেসেজ দিলাম। যতোহোক বেস্টিতমা বলে একটা কথা আছে।আচ্ছা দোস্ত আজকের দিনে তোর থেকে একটা সাইন্স জনার ছিলো।
_কি। আমি বিরক্তি নিয়ে টাইপিং করলাম।
__বাসর রাতে বিলাই মারে কেমনেরে,,, আর মারলে ও কথাটা কি সত্য!!
আয়াত এর এমন মেসেজ দেখে আমার মেজাজ গেলো তিব্বো পরিমান চ্রটে কতোটা বেয়াদ্দপ। আমি রেগে বোম হয়ে কিছু টাইপিং করতে যাবো তখনই পিছে দরজা খুলার আওয়াজ পেলাম। আমি কাপা হাতে এক ঢোক গিলে ফোন নিয়ে গুরে পিছু তাকাতেই ঘরের মৃদু ডিম লাইট আলোতে দেখি ইয়াদ।উনি ধীরো পায়ে আমার দিকে আসতে লাগলেন। সামনে এসেই বিরক্ত নিয়ে কপাল বাজ করে বলে উঠলেন,,,,,
“এই কি তুমি চেঞ্জড কেনো করনি এখনো”
আমি কিছু বলতে নিবো বিপরীতে উনি আমাকে মাঝ পথে ব্রেককষে দিলেন হাত দিয়ে,,,আবার বলে উঠলেন,,, যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।।
আমি ছোট করে এক নিশ্বাস নিয়ে হাতে থাকা ফোনটা পূনরায় ড্রেসিং টেবিলে উপরে রেখে, তার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গায়ে থাকা সব গহনাগাঁটি এক এক করে খুলে রাখতে লাগলাম। এখন মনে হচ্ছে শরীলটা মধ্যে ফাইনালি একটু জান এসেছে আবার। গহনা সব খুলে হাফ ছেড়ে। আলমারির সামনে হাটাঁ দিলাম, আলমারি সামনে থেকে আমার রাখা লাল লাগেজটা সোফার উপর তুলে, ভিতর থেকে একটা সাদা কালো তাঁতের শাড়ি হাতে নিলাম। ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। পাক্কা আধা ঘন্টা পর ওয়াশরুম থেকে বের হলাম লং শাওয়ার নিয়ে, রুমে এসে চোখ বুলিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখি ইয়াদ রুমে কোথাও নেই, আমি হাতে থাকা তোয়ালে দিয়ে চুল গুলো মুছতে লাগলাম।হঠাৎ পিছু থেকে ইয়াদ বলে উঠল,,,,
“ওজু করেছে”
.
আমি পিছু তার দিকে তাকিয়ে দুই দিকে মাথা দুলালাম। যার অর্থ না।
.
উনি নিচের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে আমার দিকে পূনরায় আবার চেয়ে বলে উঠলেন,,ওজু করে এসে নুর নামাজ পরবো।
.
আমি হাতে থাকা তোয়ালেটা ড্রেসিং টেবিলের সামনে ছোট চেয়ারে রেখে, ওয়াশরুমে চলে গেলাম ওজু করতে। মিনিট পাচঁ পর ওজু করে এসে দেখি ইয়াদ মাথায় টুপি পরে দুইটো জানেমাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি লাগেজ থেকে নামাজের হিজাবটা খুঁজে পরে নিলাম। আর তার সাথে গিয়ে দাঁড়ালাম জানামাজে।
.
নামাজ শেষ হতেই ইয়াদ জানামাজ দুইটো বাজ করে নিজ জায়গায় রেখে দিলেন। আমার ঘুমে চোখ দুইটো ছোট হয়ে আসছে তাকিয়ে থাকতে আর পাচ্ছিনা। গত দুই দিন ধরে ঠিক করে ঘুম হয়নি ব্যাঙ এর বিয়ের প্রোগ্রমের জন্য।
আচ্ছা কি করবো এখন আমি, ঘুমিয়ে পরবো, হ্যাঁ তাই ভালো চুপ চাপ ঘুমিয়ে পরি। খাটের সামনে যেতেই ইয়াদ বলে উঠল।
“কফি খাবে নূর আমার সাথে”
আমি গুরে ইয়াদ এর দিকে তাকালাম, চোখের ঘুম গুলো নিমিষেই ছুটে পালাই পালাই করলো চোখ থেকে। মনে পরে গেলো ইয়াদ এর সেই দিনের দেওয়া মেসেজ এর কথা।
♣️♣️
বারান্দা নিচে ছোট করে একটা তোষক বিছানো তার মাঝ বরাবর একটা পিলো দেওয়া। বিছানার আশেপাশে কিছু মরিচা বাতি দিয়ে ডেকেরশন করা দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার হলো পুরো বারান্দা গ্রিলযুক্ত কোণায় কোণায় ক্যাকটাস লাগানো। ভূতরাও যে এখানে আসতে ভয় পাবে, আর আসার আগে এতো কাটা দেখে দুই বার যে মনে মনে ভাববে কোনো সন্দেহ নেই ।।।এই অদ্ভুতদর্শন সাইন্সটা আমার মাথায় ঢুকলো না। বারান্দা থাকে ফুলের রাজ্য আর এখানে কাটার রাজ্যসভা করে রেখেছে কেন।
.
কি দেখছো!!!
.
ফ্রিতে পাগল এর কারবার ক্রতি দেখছি। বিড়বিড় করে।।।
.
কিছু বললে?
.
কই নাতো।কি আর বলবে।।মেকি হাসি দিয়ে।।
.
উনি আমার পাশে এসে ঘা এর সাথে একদম ঘা ঘেঁষে বসলেন, আজ আমি আর কিছু বললাম না তাকে শুধু চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছি। উনার এতো কাছে আসায় মনের হাতুড়ি গুলো জোড়ে জোড়ে ডাক ঢোল বাজাতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে উফফফ বাচা যাই না এগুলার জ্বালায় ।
সাথে নিমিষেই মনে পরে গেলো সেই কিছুদিন আগে কথা উনি আমার সামনে এসে সামান্য কথা বললেই আমার কাপাকাপি শুরু হয়ে টাইটাই ফিস হয়ে যেতো ভয়ে। কিন্তু আজ মনের মধ্যে একঝাক ভালো লাগা কাজ করছে হয়তো এটাকেই বলে তিন কবুল বলার পরিনতি । আমি নিঃশব্দে আশেপাশে তাকিয়ে মূহুর্তকে অনুভব করছি। উনি পাশে থাকা ছোট ফ্লাক্স থেকে এক মগে কফি ডেলে আমাকে হাত বারিয়ে দিলেন এক গাল হাসি দিয়ে,, আর এক মগে নিজের জন্য নিলেন কিছু।
আমি ছোট করে মনের সুখে কফি মগে চুমুক দিতেই মুখ আর মুখ রইলনা আমার নিমিষেই ভালা লাগা থেকে সেকেন্ডে টনেডোর গতিতে পরিবর্তন হয়ে করলা জুসে চিরতা রসকস যুক্ত হয়ে গেলো। আমি খাক্ক করে কাশতে কাশতে নাকে মুখে কফি উঠে গেলো ফেলে দিলাম ইয়াদ এর উপর কিছু।ইয়াদ বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । বুঝার চেষ্টা করছেন আমার দিকে তাকিয়ে আসলে হলোটা কি।।
.
দোক্কা আমি কাশতে কাশতে,,, ফুঁসতে ফুঁসতে রাগে দুক্ষে বলে উঠলাম।।।। কতো বড় বদ্দ লোক আপনি এই ছিলো আপনার মনে। আমার আগেই বুঝা উচিৎ ছিলো। আপনি যে আমার সাথে সব সুদেআসলে প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তায় আছেন।
.
কি বলছো তুমি!!!এসব।। বলি, মাথা কি ঠিক আছে তোমার ।
.
ঠিক ছিলো,, এখন ঠিক নেই।সব আপনার জন্য হইসে। এই কি খাওয়াসেন আমারে। ইয়াজ্ঞজ্ঞজ্ঞজ্ঞ থু থু থু
.
এই কি করছো তুমি! আমার ক্যাকটাস গাছে ফেলছো কেন।রেগে।।।
.
এখানে বউ মরছে তাহার তা চিন্তা নাই। সে পরে আসে তার কাটা নিয়ে।। এতো যেহেতু চিন্তা তাহলে কাটার সাথেই সংসার শুরু করতেন রাগে দাঁতে দাতঁ চেপে,,,,
আব্ববুউউউউউ এই তুমি কার হাতে হাত তুলে দিলা আমার,,, অহ সরি। আব্বুতে দেইনি বরং আপনি জোড় করে তুলে নিয়েছেন ভুলে গেয়েছি।
.
সামাম্য একটা কফি খেয়ে যে কেউ এমন করতে পারে তা আমার জানা ছিলো না🙄।।
.
এটা কফি ছিলো না কফির নামে বিষ ছিলো কোনটা!!! এই কারনেই বলি আপনি যখনই মুখ খুলেন তখনই এমন চিরতাযুক্তা কথা কেন খই ফুটে,টাংকিরে যে চিরতা থাকে তাই।।
.
ইইইউ,,,,,,আর কিছু বলা আগেই
ইয়াদ এর ফোনে ভো ভো করে উঠল,,, ইয়াদ বসা থেকে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোন নিয়ে কানে ধরলো ।নূর ভ্রু কুঁচকে ইয়াদ এর দিকে তাকিয়ে মতিগতি বুঝার চেষ্টা করছে এতো রাতে কিঠা বা কল দিলো তাকে🙄।অই পাশ থেকে কি বলছে বুঝা যাচ্ছে না কিন্ত অই পাশের বিপরীতে ইয়াদ যে শুধু আচ্ছা আচ্ছা বলে মুখের বন্য করে ফেলছে তা শুনছি ।।।
.
ইয়াদ কথা শেষ করে পকেটে ফোন রেখে বলে উঠল,, উঠো।।
.
কেনো!!
.
আগে উঠো তারপর বলছি।
.
নূর বিরক্তি নিয়ে অলসতা জাহাজ নিয়ে হেলেদুলে বসা থেকে উঠলো।।
.
চলো।।
.
কোথায়।
.
কথায় কথায় এতো প্রশ্ন কেন করো বলো তো।। ঠাকুমার ঝুড়িতে এতো গল্প থাকেনা যেতোটা তোমার ঝুড়িতে প্রশ্ন থাকে।
.
সহজ সরল হিসাব নিকাস তার একটাই কারন আপনার উপর আমার বিন্দু মাএরো আর বিশ্বাস নাই তাই।
.
কিহহহহ্
.
আজ্ঞে জ্বী।
.
বড্ডো কথা বলো তুমি,,, এখন চলো তো গেলেই সব প্রশ্ন ঝুলি বুঝতে পারবা।
“বলেই ইয়াদ নূর এর হাত শক্ত করে ধরে ছাদে নিয়ে আসলো।।।
.
এই আপনি আমাকে এই মাঝ রাতে ছাদে কেনো নিয়ে এসেছেন , বলি ভূতের ভয় টয় নেই মনে।
.
হুসসসসসসসস,,,বলে নূরকে গুরিয়ে ইয়াদ এর বুকে পিঠ ঠেকিয়ে নুরের কাঁধে ইয়াদ এর থুৎনি রাখলো।।।
.
নূর কাপা কাপা গলায় বলে উঠল,, রোমান্স করবেন ভালো কথা তা ছাদে কেন এখন যদি ভূত মশায় এসে রাগে আমার ঘাড়টা কটমট করে মটকিয়ে দিয়ে যায় তখন।
.
ইয়াদ নূর এর কথা শুনে নিঃশব্দে হেসে দিলো।।। হাতের ইশারা করলো সামনে তাকাতে।।
.
কিহ্
.
আমার দিকে না তাকায়ি সামনে তাকাও তাহলে বুঝবা।।
.
নূর বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকাতে থ,,,,,
পুরো আকাশ জুড়ে চার দিকে ফানুস এর সমাহার।নূর হ্যাঁ করে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।হঠাৎ সামনের চার তালা ভবন থেকে কেই জেনো ওদের এই খানে বড় বড় দুইটি লাইট ছুড়লো, নূরের এখন মনে চাচ্ছে ঠ্যাঠিয়ে কষে দুইটো চড় দিতে তাদের,,,নূর চোখ হাত দিয়ে বিরক্ত নিয়ে পিছে তাকাতে আর এক দফা থ হয়ে গেলো,,,,ছাদের দেওয়ালে বড় বড় অক্ষরে সেই আলোতে ভেসে উঠেছে “ভালোবাসি প্রয়সি অফুরন্ত ভালোবাসি তোমাকে”। নূরে চোখে পানি গুলো চিকচিক করছে।।।
সাদা এই #মেঘের_আড়ালে শুভ্র সেজে তুমি আসবে তুমি আসবে আমার হয়ে নতুন সাজে, নতুন ভোর নিয়ে, সময় যেন থেকে গেছে,চারদিকে স্তদ্ধ এই অপেক্ষার অাদৌ প্রহর কি শেষ নেই,,,,,
“ইয়াদ পিছু থেকে ক্লান্তি সুরে চিল্লিয়ে বলে উঠল ”
হুমায়ূন স্যার এর একটা উক্তি আছে জানেন তো,,সাবাই অপেক্ষা করে কিন্তু সেই ভালোবাসা প্রমান করতে পারে না।
ইয়াদের বিপরীতে নূর বলে উঠল,,
মানে!!
দেখে ছিলাম, লাগবেনা কারো ভালোবাসা।। প্রত্যেক মানুষই প্রেমে পরে, কেউ প্রকাশ করে,,, আবার কেউ অপেক্ষা করে,,
তা তুমি কি করছিলে শুনি।।। প্রশ্ন বিন্দুতে জিজ্ঞাস করলো।।
অপেক্ষা,,,,, এটাও এই সাইকোর জন্য।
.
তাহলে বলোনি কেনো।। অসহায় সুরে।
.
কারন আমি আপনার মতো অতো শত অসভ্য আর বেয়লাজ না। আর আগে আপনি ওতো বহিঃপ্রকাশ করেননি নিজের কথা তাহলে আমি কেন বলবো বলুন । ভ্রু কুঁচকে।।
.
তা আজ কেন বলছেন এই কথা গুলো ।।। চোখ ছোট করে পাকিয়ে।।
.
আজ নেই কোনো বাধা মোদের মাঝে তাই।। ইয়াদ এর কাধেঁ নিজের দুই হাত দিয়ে।
.
ইয়াদ নূরের কমোড় দুইহাত দিয়ে চাপ দিয়ে নিজের আরো কাছে এনে কানের সামনে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,,,
.
অসভ্য, বেয়লাজ,, অভদ্র, সাইকো যাই হয়ে থাকি না কেনো সবই তোমার জন্য হয়েছি। কপাল এর সাথে কপাল ঠেকিয়ে 💓💓💓
♣️
৩ বছর পর,,
অপারেশন থিয়েটারের সামনে এদিক সেদিক পায়চারি করছে ইয়াদ। ভেতর থেকে নূরের আর্তনাদ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ইয়াদ কিন্তু কিছুতেই ভিতরে যেতে পারছে না। দিপ্ত,ইরফান এবং অনিক শান্তনা দিচ্ছে ইয়াদকে কিন্তু ইয়াদ কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না বারবার ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইশারা নিজের কোলে থাকা এক বছরের ছেলের কান্না থামাচ্ছে আর মাকে শান্তনা দিচ্ছে। আয়াত সাত মাসের ভারি পেট নিয়ে চুপচাপ এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে, দিপ্ত চোখের ইশারা দিয়ে বার বার বলছে বসতে কিন্তু ও কিছুতেই বসতে চাইছেনা।জ্বী হ্যাঁ দিপ্ত আর আয়াত এর বিয়ে হয়েছে দুই বছর হলো আর সাত মাস আগে তারা জানতে পেরেছে তাদের কোল ও আলো করে কেউ একজন আসবে । এই মূহুর্তে সবাই চিন্তিত নূরকে নিয়ে ।
.
.
হঠাৎ থিয়েটার এর ভিতর থেকে নূর চিল্লিয়ে বলে উঠে,,,, ইয়াদ এর বাচ্চা তুই কই শালা খচ্চোর আমি তোরে ছাড়মুনা বলে দিলাম,,, এই বলে জোড়ে চিৎকার করে , কিছুক্ষন পর নূরের সারা টু শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। এতে ইয়াদ ভয় পেয়ে গেলো এবং অপারেশন থিয়েটার এর দরজা সামনে পাগলের মতো এইইই নূর নূর বলে চিৎকার করে ধাক্কাতে লাগলো আর কান্না করতে লাগলো, কেউ অকে থামাতে পারছে না। এমন সময় বাহির থেকে থিয়েটারের ভিতর থেকে ভেশে আসা বাচ্চার কান্না শুনতে পেলো ইয়াদ। আসিফ সাহেব আর রফিক সাহেব দুই বন্ধু একে উপরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে চিল্লিয়ে বলে উঠে আলহামদুলিল্লাহ । থিয়েটার এর দরজা খুলে হাসি খুশী মুখে ডাক্তার এসে বললেন,”কংগ্রেস আপনার মেয়ে হয়েছে।”
.
.
ডাক্তারের কথা শুনে সবাই খুশীতে হেসে দিলো শুধু ইয়াদ বাদে। ইয়াদ উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠে,”আমার ওয়াইফ নূর কেমন আছে?” ও ঠিক আছে তো কিছু হইনি তো অর!!!
.
.
ডাক্তার – হুম বেশ ভালো আছে ভয় এর কিছু নেই। আসুন দেখে যান মা ও মেয়েকে আপনার ওয়াইফ আপনাকে ভিতরে ডাকছেন।
.
.
ডাক্তারের কথাটা বলতে দেরি কিন্তু ইয়াদের ঝড়ের গতিতে ভেতরে যেতে দেরি নেই।
.
.
ইয়াদ থিয়েটারে এসে দেখে এক নার্স নূরের পাশে দাঁড়িয়ে বেবি দেখাচ্ছে আর নূর চোখের পানি ঝেড়ে বাবুর হাত ধরে আছে। বাবু হাত মুখে কপালের সামনে এনে ছড়া ছুটি করে কেঁদেই যাচ্ছে,একবার আধো আধো ছোট নতুন হাত মুঠো করছে তো একবার খুলছে । নূর নার্স এর দিকে তাকাতেই নার্স মুচকি হেসে নূরের কোলে তার ছোট্ট রাজকন্যা টাকে নূরের হাতে দিলো। এখনো কেঁদেই যাচ্ছে বাবু হাত পা ছড়িয়ে। ইয়াদ দরজা সামনে দাঁড়িয়ে এইমূহুর্তকে তিপ্তি নিয়ে অনুভব করছে আর দেখছে। সুখের মুহূর্তেগুলো আসলেই এক অন্যরকম ভালো লাগা অনুভুতি হয়। এক পা এক পা করে নূরের দিকে যেতে থাকে ইয়াদ। নূর বাবুর ছোট ডান হাতটা নিজের হাতে নিয়ে ছোট করে চুম্বন করলো। নূর চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখলো ইয়াদ দাঁড়িয়ে আছে আর তার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। তার চোখগুলো বলে দিচ্ছে নূরকে সে যে কতো কান্না করছে বাহিরে । এতে নূর নিঃশব্দে হাসলো। ইয়াদ চুপচাপ নূরের পাশে বসে বাবুর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নূর ইশারা করলো বাবুকে নিতে কিন্তু সে ঠোটঁ কামড়িয়ে মাথা দুলিয়ে না করলো। এতে নূরের রাগ হলো।।। ক্ষণিক সময় বাদে বাবুর মাথায় হাত বুলালো ইয়াদ এবং তার কপালে গম্ভীর চুম্বন করে কান্না করে দিলো। তারপর নূরের কপালে কপাল রেখে বলে উঠল,,,,
“থ্যাংক ইউউ নূর আমাকে ইয়ান না দিয়ে ইনঅায়াত দেওয়ার জন্য। আজ জানোনা তুমি আমাকে ঠিক কতোটা খুশি দিয়েছো। তুমি আমাকে একটা রাজকন্যা উপহার দিয়েছো।” যাহ্ অবিকল তোমার মতো হয়েছে দেখতে।
.
.
নূর ইয়াদের চোখের পানি গুলো ক্যানালযুক্ত হাতে মুছে দিলো। ইয়াদের হাতে উপর নিজের হাত রেখে বলে উঠল তার বিপরীতে,,,
.
.
“উহু আমি কিছু করিনি সবটাই আল্লাহর রহমতে হয়েছে। আপনি জানেন কখন আল্লাহ্ প্রথম সন্তান হিসেবে কন্যাসন্তান দেন আমাদের। যখন আল্লাহ তালায় আমাদের উপর খুব খুব খুব করে বেশী খুশীহোন তখন আশিবাদ সরুপ আমাদের কোলে প্রথন সন্তান হিসেবে কন্যা সন্তান দেন। আর কে জানতো মশায় আমার মতো ভোলা ভালা একটা নিরহ বাচ্চা মেয়ের কপালে এমন সাইকো ছেলে লিখা ছিলো। যে কথায় কথায় খালি আমাকে ধমকাই সবই কিস্মাত বুঝলেন তাই তো গুরে ফিরে এসে এক করে দিলেন আমাদের । অতঃপর এই সাইকো ইয়াদ থেকে নূর মিশে আমাদের কোল আলো করে আজ কন্যাসন্তান ইনঅায়াত এসেছে। বুঝলে আমার ইনঅায়াতের বাবাই?”
.
.
ইয়াদ নিমিষেই হেসে দেয় নূরের কথা শুনে। বেচে থাকুক তাদের টকঝাল ভালোবাসা এভাবে চলুক সব সময় এবং ভালো থাকুক তাদের ছোট পরিবার।❤️
#মেঘের_আড়ালে(ফিরে আসা)
সমাপ্ত🖤
মেঘের আড়ালে ২ পর্ব-১২
#মেঘের_আড়ালে২(ফিরে আসা)
#পর্ব_১২
#লেখিকা_ফাতেমা_জোহরা_নাভিলা
সকালে রঙ খেলার শেষে ঘন্টাখানিকের জন্য সবায় ছোটখাটো রেস্ট নিয়ে নিলো। দুপুর থেকেই আবার বাসায় জোর কদমে আয়োজন চলছে।সবাই হাসি মজায় ব্যস্ততায় মও হয়ে আছে। আজ বাসার বড় থেকে ছোট সবায় একদমে কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেছে সকাল থেকেই। কেউ জেনো আজ এতো কাজের মাঝে ও কিছুতেই ক্লান্ত হতে চাচ্ছে না।
.
.
.
তিনটার দিকে আবারো গান বাজনা শুরু করা হয়েছে । নূর ইয়াদ দেওয়া সেই আড়ং এর লেমন মধ্যে কালো সুতার চারুকাজের বাঙালি স্টাইলে শাড়ি পরেছে। মাথায় মাঝ বরাবর সিঁথি করে একটা কাচা কাঠগোলাপের ফুল এর টিকলি, চোখে গাড়ো করে কাজল।কানে কাঠ গোলাপ ও বেলী ফুলের ছোট দুল, চুল গুলো কাঁধে নিচে ছড়ানো যাহ্ বাতাসে কিছুক্ষন পর পর দোল খেলছে , দুই হাতে বেলি ফুল আর লাল গোলাপ এর সংমিলিত চুরি পরেছে,চেহারাতে মেকাপের তেমন বিশেষ কোনো ছাপ নেই, শুধু ঠোটে লাল টুকটুক ক্লারে লিপিস্টিক দেওয়া। এই সামান্য হাল্কা সাজে নূরকে দেখতে আজ ভারি মিষ্টি লাগছে ।
ইশারা গাড়ো সবুজ মধ্যে কালো পাথরের কাজ করা ভারিযুক্ত লেহেঙ্গা পরেছে। কানে কাচা বেলী ও গোলাপ সংমিলিত ফুলের দুল , চুল গুলো এক সাইডে এনে এলোমেলো ভাবে বেনী করা। এক হাতে কালো পাথরের ঘড়ি,আর এক হাতে কাচা ফুলের চুড়ি। চেহারাতে হাল্কা মেকাপ এর সাজ। আজ অকে দেখতে কোনো ওরুপ্সী থেকে কম লাগছে না।
হঠাৎ কথা নেই বলা নেই বিন ভুলায় মেহেমান কি তারাফ বাহিরে অঝোড় দ্বারা বৃষ্টি হচ্ছে, তাই আপাতত বাসায় ভিতরেই হোলরুমের সোফা গুলো সব এক সাইডে রেখে, ছোটখাটো ভাবে মেহেদী প্রোগ্রাম এরেঞ্জমেন্ট করা হয়েছে। নূরকে মালিহা ও আয়াত মিলে মেহদী পরিয়ে দিচ্ছে আর ইশারাকে তার দুই ফ্রেন্ড মিলে পরিয়ে দিচ্ছে। নূর ও ইশারা ৩২ বাতি দিয়ে সামনে থাকা সিমিতো আকারের ছোটখাটো বিনোদন দেখছে আর খিলখিল করে চোখ বুঝে হাসছে, এতো বারি বিরক্ত হচ্ছে যারা অদের দুইজনকে মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছে,দুই বোনকে চোখ রাঙিয়ে কিছুতেই শাসিয়ে স্থির করতে পারছেনা বেচারিরা । অনিক , ফারদিন, দিপ্ত, তাসফি, বাকী কাজিনরা আর ইশারার কিছু ফ্রেন্ডরা মিলে, তুমি ছুঁয়ে দিলে হাত আমার কি জেনো হয়ে যায় গানে উড়াধুরা ভাবে ডান্স করছে।
.
.
পাক্কা দুই ঘন্টা পর মেহেদী পর্ব সম্পূর্ণ শেষ হতেই আম্মু খালামনি চ্রট করে আমাকে আপিকে উপরে পাঠিয়ে দিলো রুমে রেস্ট নেওয়ার জন্য,সন্ধায় পর আবার হলুদের প্রোগ্রাম আছে তাই। রুমে এসে আমি গাছ ফেন ছেড়ে দিলাম, আর দুই হাত তুলে সামনে দাঁড়িয়ে আছি একঝাক বিরক্তি নিয়ে মেহেদী শুখানোর জন্য। আপি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইফরান ভাইয়ার সাথে ভিডিও কলে তার প্রেম কথোপকথন চলছে । আয়াত, মালিহা খাটে বসে বসে আজকের তুলা ফোটসেকশন গুলো এফবিতে পোস্ট করা শুরু করে দিয়েছে রিতিমত । আমি কিছুহ্মন কপাল কুঁচকে ওদের কারবার কৃতি দেখে বিরক্তি নিয়ে চলে গেলাম ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে আর হাত ধুতে, আমার একটাই সমস্যা আমি মেহেদী দিলে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলি, পুরোটা হাতে নিয়ে গুরে গুরে শুখানোর মতো এতো ধর্য্য শক্তি কোনো কালেই ছিলো না আমার। আজ ও তা হলো অতিক্রম কিছু আলাদা হলো না আমার সাথে।
ফ্রেশ হয়ে বের হতে না হতেই মাথা দেড় কিলোকা বাজ পরলো,,,, সামনে তাকিয়ে দেখি পার্লারের মেয়েরা ইতিমধ্যে এসে হাজির আমার আর আপির জন্য। অলস ভঙিতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি মাএরো ছয়টা বাজে।
_ মরি যাই মরি যাই(অবাক হয়ে)।।। আপনারা আজকে কেন এসেছেন!!!
_বেকুব এর মতো কথা কেন বলছিস, ।।। উনারা আসবেন নাতো কে আসবেন।। আমাদের সাজাবে বলেই তো এসেছে । ইশারা।।
__বলি এখনই কি আমাদের সাজাঁবেন একটু হিসহুসসস করুন না আফারা আমার সাথে(করুন সুরে)। কালকে সাজালে টাজালে হয় না।বলি কি শুনেন কালতো তো সেই আমাকে সাজাবেনই, তাই আজকে এতো এক্সটা কষ্ট করা লাগবে না আপনাদের ।। কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল নূর।।।
_নাহ্ হয়না, কোনো হিসহুস না।।।বিয়ের কণেকে সাজানো কি সেই চারটি খানি মুখের কথা(বিরক্তি হয়ে)।।। এখনই তোকে সাজাবে তারা, বেশী পকপক করলে ডাইরেক্ট আন্টিকে ডাক দিবো বলে দিলাম নূর(কাঠ কাঠ গলায় বিরক্তি সুরে বলে উঠল) ।।।আয়াত।।।
_লো ঠ্যালা,,,, আমি আর বিয়েই করমু না কোনোদিন জিন্দেগীতে বাইচ্ছা থাকলে।
বিয়ে করলে যে এতো প্যারা নিতে হয় কে জানতো।এখন আমাকে দেড় ইঞ্চি আটা সুন্দরী হয়ে বসে থাকতে হবে অই উগন্ডার বদ্দ ফাজিল লোক এর জন্য।।।
” রুমে উপস্থিতি থাকা সবায় নূরের কথা বলা ভঙি রিয়েকশন দেখে হেসে দিলো ”
__বলি বইন, বাই এনি চান্স চারটে বিয়ে করা যে ফরজ, তুই কি ভুলে সেই হাদিস পালন করার চিন্তায় আছিস(ভ্রু নাচিয়ে) । আমার ভাসুর মশায় কি এই কথাটা জানে। তার বউ একবার বিয়ে হয়ে জাওয়ার শর্তে ও আবার পূনরায় বিয়ে করার পরিকল্পনায় আছে। ভুলে ও এই কথা মাথায় আনিস না,এটা আমাদের জন্য না ছেলেদের জন্য বরাদ্দ ।।। রোল পরা হাসি দিয়ে।। ইশারা।
__আপিইইইইইইই।।।
রাত আট টায় দিকে আমার সাজ কমপ্লিট হলো প্রায় ২ ঘন্টার প্রচেষ্টাই। এতো ভারী লেহেঙ্গা, গয়না, হেয়ার স্টাইল নিয়ে আমার নিঃশ্বাস ফেলতেই এখন ভার ভার লাগছে,লড়তে ও পারাচ্ছি ঠিক করে।।
ইশারা আর নূর তামিল স্টাইলে কাচা হলুদ আর সবুজ রঙ মিশিত ভারি শাড়ি পরে বসে আছে, সাথে আট্রিফিশিয়াল ফুলের গহনা পরানো।আজ দুই বোনকে দেখতে বেশ মিষ্টি লাগছে , দুইজনকে পুরো টুইনি টুইনি লাগছে সেইম সাজে, ওদের থেকে চোখ সরানো যেমন দায়।
বাব্বাহ এই লম্বা জামাই এর জন্য আমার মতো বাটুকে কতো বড় হিল ধরিয়ে দিলো । অবশ্য আমি অতোও বাটু না।।। কিন্তু এখন তো হাটঁতে হিমসিম খেতে হচ্ছে । কি আর করার অই বেটা সাইকো ৬ ফুট ২ ইঞ্চির জল্লাদ এর জন্য কষ্ট হলেও হাঁটতে তো হবেই। আজ থেকেই এমন হিল পরে হাটাঁ প্রেক্টিস শুরু কর দেয় নূর,কাল আর কষ্ট হবে না তাহলে।।।
.
.
স্ট্রজে আমাকে আর আপিকে বসিয়ে দিলো আমার গুনোধর ভাইরা আর ফ্রেন্ডারা মিলে। একে একে সব রিলেটিভ এসে এসে লে হামলা ফোটসেকশন করে যাচ্ছে । তার সাথে তো ফোটোগ্রাফার মশায় ফ্রি আছে এই স্টাইলে অই স্টাইলে দাঁড়িয়ে বসিয়ে পিক তুলছে। বলি বেটা কি ক্লান্ত হয়না। আমি তো ইতিমধ্যে তার বসানো দাঁড়ানো স্টাইলে মুভ অন করতে করতে হাপিয়ে যাচ্ছি কখন জানি এতো মুভমেন্ট এর জ্বালায় আমার ঘাড়টা তেড়া হয়ে যায় 🥴🥴। এর মধ্যে আয়াত হাসিখুশি ভাবে স্ট্রজে উঠে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো অর এতো অকারনে হাসি দেখে আমার পিত্ত আত্তা রুহু জ্বলে উঠল , যখনই ও আমার সামনে এসে এমন চিরল দাঁতের ক্লোজ আপ এর হাসি দিয়েছে হিহি করে তখনই আমাকে বেশ বড়সড় বাশ দিয়েছে এই ছেমড়ি।
“কি চাই”!! এখনে।।।চোখ ছোট করে বলে উঠলাম।
.
কিছুনা,
.
তাহলে, কোন সুখে এতো পুয়া মাছের মতো হ্যাংলা হয়ে দাতঁ দেখাচ্ছিস ।। তোর দাতঁ যে পুয়া মাছের মতো অতি অতি অতি মাএরায় রিক্ত সুন্দর সবায়কে তা বুঝাচ্ছিস।।।
.
দোস্ত, তুই আমারে এমনে সবার সামনে বলতে পারলি। অসহায় হয়ে।।
.
তুই কানা হইলি কবে আয়াত, এখানে সবায় আসলো কথায় থেকে,,,,🙄
.
নেয়।
.
কি নিবো।
.
ধোরতো।।।
.
আজিব তো।। কি হইছে তোর। এমন করছিস কেন।
.
তোর জামাইকে,
.
কথার মাঝে জামাই আসলো কোথা থেকে।।
আয়ায় বিরক্তি নিয়ে মুখের সামনে ফোন তুলে তাকাতে ইশারা করলো।
” আয়াত এর হাতে ফোনের স্কিনে দিকে তাকিয়ে দেখি ইয়াদ ভিডিও কলে, সাদা কালো, ইউনিফর্মে গাড়ীর সীটে হেলাল দিয়ে আছে,চোখ দুইটো তার অসম্ভব লাল, মুখে তার ক্লান্তির ধকলের ছাপ বুঝা যাচ্ছে তাকে দেখে, কিন্তু মুখে তার সব সময় এর মতো সেই ঘায়েল করার মাতাল করা হাসি দিতে আমাকে ভুলছেন না। এতো ক্লান্তির মাঝেও উনি উনার মাতাল করা হাসি থেকে বিরতিহীন থাকেন না। কিন্তু আজকের দিনে ও উনি ডিউটিতে গেছেন দেখেই রাগে আমার আকাশের মেঘ গুলো রাগে গর্জন করে উঠল,,,, আমি রাগে ফুসস করে অভিমানী সুরে বলে উঠলাম,,,
_এই আপনি আজকের দিনে ও অফিসে গেছেন।আজকে না গেলে কি মহাভারত আপনার অশুদ্ধ হয়ে যেতো বলুন,,,,চুপ কেন।।। রেগে।।।
“উনি আমার বিপরীতে শুধু হাসলেন” আর মাথা নাড়িয়ে ছোট করে উঁহু বলে উঠল
চলবে,,,,
মেঘের আড়ালে ২ পর্ব-১১
#মেঘের_আড়ালে২(ফিরে আসা)
#পর্ব_১১
#লেখিকা_ফাতেমা_জোহরা_নাভিলা
সন্ধায় থেকে বাড়ির পরিবেশ বিয়ের বাড়ি গন্ধে চারদিকে মৌঁমৌঁ গমগম আমেজে হট্রগোল বেধে আছে কিছু নিকটজন আত্নীয়-স্বজনের ভিরের মাঝে। বাচ্চাঁরা নিজেদের মতো চারপাশে আনন্দে ছুটা ছুটি করছে। হোলরুমে নিচে উপরে চেয়ারে সোফায় যে যেখানে পেরেছে বসে সবায় একজোট হয়ে হাসাহাসিতে গল্পে মেতে এক হয়ে আছে। আম্মু খালামনিরা আপাতত রান্নাঘরে গরম গরম সবজি পাকোড়া আর চা করছেন,আমি আপি অ্যাসিস্টান্স ডিউটি পেয়েছি আজ তাদের থেকে রান্নাঘর থেকে গরম গরম পাকোড়া প্লেট গুলো হোলরুমে সার্ভিসিং দেওয়ার।
.
.
আমার বেচারা তিন গুনোধর ভাইদের করুন নাজেহাল অব্যস্থা কাজ করতে করতে এক একটার টাইটাই ফিসস, দম ছাড়ার মতো ও ঠিক করে সময় পাচ্ছে না তারা। দুইদিন ধরে ডেকেরশন এই কাজ অই কাজ করেই চলছে কাজের আর শেষ নেই তাদের। কাল হলুদ, মেহেদী প্রোগ্রাম দুইটা একসাথে হবে তাই কাজের চাপ ও বেশী আপাতত তাদের উপর। সন্ধায় থেকে দিপ্ত, অনিক ভাইয়া বাহিরে লাইটিং এর কাজ গুলো দেখছে, ফারদিন স্ট্রজের জন্য ফুল অর্ডার করতে গিয়েছে সেই বিকালে । আব্বু, খালু, ফুপারা বাগানে মেন্ডেইল এর কাজ দেখছেন।এতো কম সময় মধ্যে হাতে সামনে তিন দিন এর জন্য ভালো কোনো কমিটি সেন্টার খুঁজে পাওয়া যায়নি, একটা পেয়েছে খুব কষ্টে তাও একদিনের জন্য। কমিটি সেন্টার বুকিং করতে হলে কমসেকম এক মাস বা পনেরো দিন আগে বুক করতে হয়, সে জায়গায় বিয়ে প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার তিনদিন আগে তো মুখের কথায় তো আর পাওয়া যাবে না। আব্বুর চেনা জানা এক কমিটি সেন্টার মালিক আব্বুর বন্ধু ছিলো তার থেকেই একদিনের জন্য আপাতত মেনেজ করা হয়েছে খুব কষ্টে বিয়ের দিনের জন্য।
.
.
রাত এগারোটায় সবায় নিচে একসাথে ঢালাই বিছানাতে বসে গরম গরম ভাত, আলুর ভর্তা, ডাল দিয়ে রাতের খাবার খাচ্ছি। এতো মানুষ এর জন্য তো কম সময় মধ্যে শত কাজের চাপে আলাদা কিছু করা অাদৌ সম্ভব না। তাই রাতের মেনুতে শর্টকাট খাবার রাখা হয়েছে,তাতেই আমরা মহা খুশি সবায়, আলুর ভর্তা আর ডাল যেখানে থাকে আর লাগেনা কিছু সেখানে। সবার চেহাতে নিমিষেই সারাদিন এর কাজের ধকল ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠেছে। রাতের খাবার খেয়ে যে যেখানে পারছে সেখানেই ছরিয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পরছে। সব ছেলেদের জন্য ছাদে বরাদ্দ ঢালাই বিছানা করা হয়েছে।
রুমে এসে দেখি আমার খাট পুরো বুকিং আন্ডাকান্ডা পিচ্ছি বাহিনী দিয়ে।নিচে পাতলা একটা চাদর বিছয়ে তার মধ্যে আপি আর মালিহা শুয়ে আছে । মালিহা আপাতত ঘুমের সমুদ্র তোল দেশে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে, আর আপি তার পাশে ফোনে স্কিনে তাকিয়ে মিটমিট করে হেসে প্রেম আলাপে হাবুডুবু খাচ্ছে।আমি বুঝিনা বাপু এরা সারাদিন এতো কথা বলে কেমনে ভাই হাউউউ🙄 আর এতো এতো কথার টাংকি আসে কোথা থেকে😒,, বলি তোমাদের কি কথার ঝুলির টাংকি কি শেষ হয় না আর মুখ কি ব্যাথা ট্যাথা করেনা। এখানে আমার জামাইরে কেউ দেখো, জোড়াজুড়িতে বিয়ে করে উদ্ধার করে ফেলছে আমাকে মহাশয় । সারাদিনে একটা ফোনতো দূরে থাক,,,, একটা ভুলে টুলে বাই এনি চান্স মিসডকল ও দেই না ঠিক করে, বেয়াদ্দপ বজ্জাত ছেমড়া।এই তাহার সাইকো গিরি অতিরিক্ত চাওয়া, উত্তলিয়ে পরা বল্কানো বরাদ্দ প্রেম ছিলো আমার জন্য, যা বল্কিয়ে শেষ। শালা খচ্চোর এই ছিলো এতোদিন জমিয়ে রাখা প্রেম তোর মনে,, বিয়ে করেই টাইটাই ফুসসসসস বজ্জাত হোলা। কতো শক ছিলো আমার এই ছোট মনে,,,,, ভার্সিটি লাইফে গিয়ে সিনিয়র ভাই এর সাথে চুটিয়ে হাতে হাত ধরে একটা প্রেম স্রেম করমু। তার জন্য এতোদিন ধরে ২৯টা প্রোপজাল ও রিজেক্ট করসি সেই চারটি খানি কথা। সরুপ ফলাফল হলোটা কি কচুঁউউউউ, বিয়ের আগে যে একটু জামাইর সাথে চুটিয়ে প্রেম করমু তাও কপালে সৌভাগো আর দেখা মিললো না আমার😭।।।নূররেয়য়য় এই জীবনে তোর কপালে আর প্রেম লিখা নাই। থাক হুদ্দাই কষ্ট করে আর বুক হাড্ডিয়া সেন্টি হইস না, এখন ঘুমায়😪।।।।
.
.
বাসার উঠান আজ রিতিমত নানাভাবে নানা রঙে চারদিকে নতুন সাজে নিজেকে সাজিয়ে উঠেছে। দরজার সামনে সাদা, রানী,হলুদ, রঙ দিয়ে ছোটখাটো আল্পনা করছে আয়াত, মালিহা মিলে।চারপাশে নানা ক্লার এর ছোট বড় নিসান এর ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে।ছোট থেকে বড় সবায় আজ নিজেকে সাদা রঙে সাজিয়েছে তুলেছে, রঙ খেলার আয়োজনের জন্য।মেয়রা, সাদা জামা,সাদা,প্লাজো আর নীল ক্লার এর চুন্ডিবাটিক ওড়নায়,হাতে কিছু রেশমি চুড়ি। ছেলেরা সাদা কাবলি সেট,আর ধুতিতে নিজেদের সাজিয়ে তুলেছে। সব যেমন সাদায় সাদা, সবায়কে আজ অসম্ভব সুন্দর লাগছে।বাগানের ছোট টেবিলে পাচঁ থেকে ছয়টা থালায় নানা ক্লার এর রঙ রাখা আছে আর তার পাশে ট্রেতে কিছু লাসির গ্লাস, পুদিনা জার্য রাখা আছে,সাথে কিছু ফাস্টফুড খাবার রাখা আছে। টেবিল থেকে কিছু দূরে গানের দুইটো বক্স রাখা হয়েছে। এর মধ্যে,,,
.
কড়ো তালিতে সবায় রিতিমত চারদিকে ছুটা ছুটি করা শুরু করে দিয়েছে হাতে নানা ক্লার এর রঙ নিয়ে একে উপর এর পিছে ছুট লাগাছে। রঙ দিচ্ছে চিল্লা,চিল্লি করছে হাসিতে।আমি চুপ করে এক কোণায় দাঁড়িয়ে নিরব দশকের মতো দেখছি তাদের এক একটা ভূত, প্রেত্নিকে আমার আপাতত এতো সেজে ভূত হওয়ার ইচ্ছে নেই তাই । ফাঁকেফাঁকে ফোনে টুক করে সেল্ফি কিল্ক করে নিচ্ছি এদের পরে সেইভাবে বিনোদন দিয়ে পচাতে পারবো ভেবে😁।আমার সামনে রঙ নিয়ে কেউ আসলেই আমি চোখ দিয়ে রাঙিয়ে শাসিয়ে দিচ্ছি দিতে না আমার রঙ এ এলার্জি আছে বলে(ডাহামিসা কথা)। এর মধ্যে ফারদিন চিল্লিয়ে ডিজের উদ্দেশে বলে উঠল,,, আবে ইয়ার গানাতো এক বাজাদো,,,,,
Itna maza kyu aa raha hai
tune hawa mein bhang milaiya
(আয়াত, দিপ্তকে কাধে ধাক্কা দিয়ে মাথা হাত দিয়ে, কমোড় দুলিয়ে স্টেপ করলো গানের এই লাইনের সাথে তালমিলিয়ে)
Dugna nasha kyu ho raha hai
Ankho se mitha tune khiliya
( দিপ্ত,ফারদিন,অনিক,মালিহা,তাসফি স্ট্রজে গিয়ে)
Oh teri mal mal ki kurti gulabi ho gayi
Manchali chaal kaise nawaabi ho gayi
(Tohhhhh)
(তাসফির মালিহার হাত ধরে এক টান দিলো আর দিপ্ত আয়াতের)
“Balam pichkari jo tune mujhe maari
toh siddhi saddhi chori sharabhi ho gayi ( আয়াত এর গালে রঙ দিয়ে দিপ্ত)
ha jeanse pahan ke jo tune maare thumka toh lattoo padosan ki bhabhi ho gayi(মালিহা কে হাতের দ্বারা গুরিয়ে পায়ের সাথে পা মিলিয়ে তাসফির)”
[🎶🎶🎶🎶🎶🎶🎶🎶🎶]
আপি আমার মনে হয় তাসফির কোনো ভাবে অর কাচা না গলা ডাল মালুর উপর গলানোর অতি প্রচেষ্টাই আছে বুঝসো। আমার হারামি বেস্টি আমার বোন এর সাথে লাইন দিচ্ছে। এটাও আমার বিয়ের প্রোগ্রমে এসে শালা, এতো সহজে তো আমি তোর ডাল গলতে দিবো না এইখানে তাসফির বাচ্চা। চোখ ছোট করে ডেবিল স্মাইল দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। নূর।।।
__তো, কি করবে শুনি!!! কানের সামনে ফিসফিস করে বলল।।
“হঠাৎ কানের সামনে পুরুষালী কণ্ঠো সুর পেয়ে নূর কেপে উঠল ” ভয়ে পিছে তাকিয়ে দেখে এক জোড়া চোখ ভ্রু উঁচু করে নাচিয়ে অর দিকে তাকিয়ে আছে মুখে তার আকা-বাকা দাঁতের এক দুষ্টু হাসি
__আপনি!!!বিস্মিত চোখে।।।
” তো কাকে চিন্তা করছিলে!!! শুনো মেয়ে এই ইয়াদবিহীন তোমার জীবনে এতো কাছে আসার কেউর দূর সাহস নেই”বুঝসো,তাই এই কথা দূর স্বপ্নেও ভুলে এনো না মনে। চোখ ছোট করে।
বলেই সবার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আড়ালে নূর হাত ধরে টেনে পিছনে হাঁটা ধরলো।।।
_ আরে আরে করতেছেন কি মশায় !! এমন কোওয়া নাই বলা নাই, হুটহাট কথা কথায় এতো কিল্লাই টানাটানি করেন আমায়।কপাল কুঁচকে।
_তা একটু পরেই জানতে পারবা। পিছে নূর এর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে।
“মেন্ডেইল এর পিছে নূরকে এনে এক প্রকার দাঁড় করালো ইয়াদ। নূর কপাল কুঁচকে নাক মুখ ফুলিয়ে ইয়াদ এর দিকে তাকিয়ে আছে বিপরীতে ”
_কথায় কথায় কপাল আর নাক এতো কেন কুঁচকাও ঠিক করো বলছি। কুইক।।। গম্ভীর হয়ে।ইয়াদ।
_করুমা, আরো বেশী করে করবো সন্দেহ দৃষ্টিতে ইয়াদ এর আরো সামনে এসে।
আপনার তাতে কি, কথা কথায় কেন এখন তো উঠতে বসতে খাইতে ঘুমাতে করবো আপনার সমস্যা, দাঁতে দাতঁ চেপে।।।
_ আমার তাতে সমস্যা হবে কেনো।। আমারই তো তাতে উল্টো আরো ভালো,,, সুবিধা হবে অনেক।।৩২ বাতি দিয়ে।।।
_মানে!! আমার কপাল নাক দিয়া কি করবেন আপনি!!
_আমি যখন তখন টুপুস করে তোমার লাল কিউট নাক টাই কামড় দিতে পারবো।।। শয়তানি হাসি দিয়ে উপরের ঠোটঁ দ্বারা নিচের ঠোটঁ চেপে।।।
_ইয়াজ্ঞজ্ঞজ্ঞজ্ঞগ থু কি চিন্তা ভাবনা আপনার ওয়াজ্ঞজ্ঞগ ।।। চোখ বুঝে বলে উঠল 😖 ভাবা,,,,
“আর কিছু বলা আগে ইয়াদ নূর এর টসটস গালে নিজের হাতে থাকা রঙ গুলো সাদা গালে রাঙিয়ে দিলো ”
নূর হ্যা করে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে মনের মধ্যে কিছু কিছু কঠিন থেকে কঠিনতম গালি মনে করছে বলার জন্য,,,
Oh kyu no vacancy ki hotto pe gali hai check kar tere dil ka kamora toh khali hai(গানের লাইনের সাথে সুর মিলিয়ে ঠোটঁ কামড়ি এক হাসি দিয়ে বলে ইয়াদ চলে গেলো)
চলবে,,,,,