Wednesday, July 9, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1498



প্রাক্তন পর্ব-১৪

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৪

সকালটা হলো নতুন ঘটনার সূচনা দিয়ে। সে ঘটনার সাথে না চাইতেও জড়িয়ে গেলাম পুনরায়। সেই সাথে আরও কতগুলো প্রশ্নের উদ্ভব ঘটলো আরও রহস্য ঝেঁকে বসলো।

সকালে উঠতেই মা আমার রুমে আসলো। মায়ের মুখটা হাসি মাখা। মনে হচ্ছে হালকা রুদ্দুর এসে মায়ের মুখে লেপ্টে গিয়েছে। মায়ের মুখটা দেখেই কেন জানি না প্রশান্ত লাগছিল। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম

– কিছু বলবে? এত খুশি দেখাচ্ছে ব্যপার কী?

– খুশি হওয়ার তো কারণ আছেই। আর তুই কত বেলা করে উঠেছিস দেখেছিস? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখ কয়টা বাজে৷

মায়ের কথায় দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। ১১ টা বাজে। এত বেলা করে উঠেছি কীভাবে বুঝতে পারছি না। সারা রাত ঘুম হয়নি তাই সকাল দিকে ঘুম ঝেঁকে বসেছিল। মা আমার পাশে বসে হাসতে হাসতে বলল

– আবিরের মা এসেছিল। উনি তো চাচ্ছে আবির সুস্থ হওয়ার আগেই তোর সাথে বিয়েটা সেড়ে ফেলতে পরে নাকি প্রোগ্রাম করবে। আমি আর অমত করেনি। তোকে ডাকতে নিছিলাম আবিরের মা বলল ঘুমুচ্ছিস তাই না ডাকতে। আমিও আর ডাকে নি। নাক ফুল দিয়ে গেল। আর একটু আগে বাসা থেকে গেল।

মায়ের কথাগুলো একটু অদ্ভুত লাগছিল। যেখানে গতকালকেও আবির এ বিয়ের বিপক্ষে ছিল আবিরের মা চাচ্ছিল না বিয়েটা হোক সেখানে আজকে কেনই মা এসব বলছে। কিছুটা অবাক হচ্ছিলাম। মনে প্রশ্ন জাগলেও দমিয়ে নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম

– আর আবির কী বলেছে? তোমার সাথে কী আবিরের কথা হয়েছে?

– আমার সাথে তো কথা হয়নি। আবিরের মা বলল আবির রাজি। আর আবির অমত কেন করবে সে তো নিজে তোকে পছন্দ করেছে। যা হাত মুখ ধুয়ে খেতে বস। অনেক বেলা হয়ে গেছে। কয়েকদিন পর তোর বিয়ে এখন একটু নিজের যত্ন নিতে শিখ। নিজেকে একটু গুছিয়ে নে। চোখ মুখের অবস্থা তো পুরো শেষ। একটু রূপচর্চা তো করতে পারিস। এখন যদি নিজের প্রতি এত অবহেলা করিস পরে নিজের যত্ন নিবি কী করে। আগে নিজেকে সুন্দর কর। ভেতর বাহির সবকিছু সুন্দর লাগবে। নিজেকে পরিপাটি করার মধ্যেও দেখবি অদ্ভুত একটা শান্তি পাচ্ছিস। তোর হাসি মুখটা যে আমি সবসময় দেখতে চাই রে মা। তাড়াতাড়ি উঠে খেতে আয় এবার। তোর পছন্দের আলু পরোটা বানিয়েছি।

কথা বলতে বলতেই মা রুম থেকে বের হলো। মা বের হতেই আমি আবিরের মাকে কল দিলাম। ওপাশ থেকে উনি কলটা ধরে বললেন

– হ্যাঁ, মা ঘুম থেকে উঠেছ?

– হ্যাঁ উঠেছি। আচ্ছা মা আপনি কি আমাদের বাসায় এসেছিলেন? বিয়েটা নাকি হচ্ছে? আপনি নিজেই তো বিয়েটা ভেঙ্গে দিছিলেন তাহলে আবার কী এমন হলো নাক ফুল দিয়ে গেলেন। আমি তো বুঝতে পারছি না।

মা হাসতে হাসতে বলল

– আবির বিয়েতে রাজি হয়েছে। আর মা যা হয়েছে তো হয়েছেই আমাদের তাতে কোনো মাথা ব্যথা নেই। এখন যত তাড়াতাড়ি হোক বিয়েটা হয়ে যাক।

– মা অরন্যকে ডিভোর্স দেওয়ার আগে কোনো স্টেপ নিতে চাচ্ছি না। আর আবিরের সাথেও আমার কথা বলার আছে। আমি আপনাকে এ বিষয়ে মতামত পরে দিচ্ছি।

– নতুন করে মতামতের কী আছে? আবির প্রথম বুঝতে পারে নি তাই এমন বলেছিল আর এখন বুঝতে পেরেছে বিষয়টা তাই সব মেনে নিয়েছে। সমস্যা নেই তুমি আবিরের সাথে কথা বলো।

আমি কলটা কেটে আবিরকে কল দিলাম। আবির কলটা ধরেই বলল

– পূর্বের ব্যবহারের জন্য দুঃখিত। আমি তখন মানতে পারছিলাম না। সব দিক বিবেচনা করে মনে হলো আমার তোমার সাথে এমন করা উচিত হয়নি। কারণ তুমি সে অবস্থায় যা করেছো সেটা তোমার দিকে দিয়ে সঠিক। আমি সব কিছু চিন্তা করে মাকে সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। মাও তোমাকে অত্যন্ত পছন্দ করে তাই বিষয়টা নিয়ে আর কোনো অমত করেনি। তোমার মতামত জানতে চাই। ভুল মানুষ করে আমিও করেছি সব ভুলে কী এক হতে পারি না আমরা?

আমি আবিরকে কী বলব বুঝতো পারছি না। আবিরকে হালকা সন্দেহ হচ্ছিল তবুও একটু বিশ্বাস করতে মন চাইল। আর আজকাল যা হচ্ছে তাতে সন্দেহ জিনিসটা হয়তো মনে আঁকড়ে ধরেছে। আমি কী উত্তর দিব বুঝতে পারছি না। চুপ হয়ে গেলাম। আবিরের হ্যালো, হ্যালো শব্দ কানে আসতেই আমি হালকা গলায় বললাম

– অরন্যকে আগে ডিভোর্স দিতে হবে তারপর এ বিয়ে করতে হবে। কিন্তু অরন্যকে তো পাচ্ছি না। ডিভোর্স কী করে দিব৷ আর কাগজ পত্রও পাচ্ছি না।

– অপ্সরা এত অস্থির হইয়ো না। অরন্যকে কবে বিয়ে করেছিলে সেটা মনে আছে তো? আমি উকিলের সাথে কথা বলেছি কাগজ ছাড়াও ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে নিব। যেদিন বিয়ে করব সেদিনেই ডিভোর্স আগে হবে তারপর বিয়ে। তুমি একদম চিন্তা করো না। আর আমি তো তোমার বাসায় যেতে পারব না। তোমাকে বিয়ের দিন আমার বাসায় আসতে হবে।

– সে নাহয় আসা যাবে। তবে বিষয়টা কেমন জানি গোলমেলে লাগছে।

– তোমার জীবনে অনেক নেতিবাচক বিষয় ঘটেছে তাই তুমি সব কিছু এখন সহজ ভাবে নিতে পারছো না। কালকে তোমার কথাগুলো শুনার পর আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গোলমেলে লাগার তো কিছু দেখছি না। খাওয়া দাওয়া কী করেছো?

– নাহ! মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম।

– খালি পেটে আছো তাই বিষয়গুলে গোলমেলে লাগছে৷ খাওয়া দাওয়া করো সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আমাকে ক্ষমা করে দাও। বিষয় টা সাথে সাথে মানতে পারে নি আমি। তাই কী থেকে কী করেছি জানি না৷ আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। সবমিলিয়ে আমি তোমাকে আর অসম্মান করব না। আমাকে কী ক্ষমা করে দেওয়া যায় না।

আবিরের কথাগুলো বেশ সাবলীল। মনে মনে ভাবলাম আবিরের জায়গা থেকে আবির এতটাও ভুল ছিল না। সে ভুল বুঝেছে তাকে তো একটা সুযোগ দিতেই পারি। আর এবার তো ও সবটা জেনে আমাকে মেনে নিয়েছে এখানে ও পরবর্তীতে কোনো কথাও শুনাতে পারবে না৷ আবিরের মা ও সবটা জানে। তারা যদি অতীত মেনে আমাকে মেনে নিতে পারে তাহলে অসুবিধা দেখছি না। হালকা গলায় বললাম

– আমার একটা ত্রুটি ছিল তোমাকে প্রথম বলিনি এজন্য দুঃখিত।

– চলো মান অভিমানের পালা মিটিয়ে নিই। আর নাকফুলটা দেখো পছন্দ হয়েছে কী না।

আমি মুখে হাই তুলতে তুলতে বললাম

– আচ্ছা রাখলাম। পরে কথা হবে।

মনটা বেশ প্রশান্ত লাগছে। সবকিছু আবার ঠিক হতে চলল। এত কাহিনি হওয়ার একটা ইতিবাচক দিক হলো এখন আবির আমার সব জেনে আমাকে মেনে নিয়েছে আর তার মাও। এখানে আমার আর কোনো ভুল বা মিথ্যা থাকবে না। হাত মুখটা ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলাম খেতে। মা পরোটা নিয়ে এসে বলল

– তোর পছন্দের আলু পরোটা করেছি।

আমি পরোটা খেতে খেতে বললাম

– আবিরের মা যে নাক ফুলটা দিয়ে গেছে দাও তো দেখি।

মা আমার কথায় নাকফুলটা নিয়ে আসলো। আমি নাক ফুলটা দেখার সাথে সাথে আঁৎকে উঠলাম। কারণ এটা তো সে নাকফুল যে টা অরন্য আমাকে দিয়েছিল। এ নাকফুলটা আবিরের মা কোথায় পেল? কারণ নাক ফুলটা আমি অরন্যকে ফেরত দিয়েছিলাম চার বছর আগে। আর এই নাকফুলেই বা কেন দিল।খাবারটা আটকে যেতে লাগল। খুব বেশি খেতে পারলাম না। নাকফুলটা নিয়ে ঘরে এসে আবিরকে কল দিয়ে বললাম

– আবির নাকফুলটা তো অরন্যের এটা মা পেলো কী করে?

– অপ্সরা কী বলছো? এটা মায়ের নাকফুল। অরন্যের হতে যাবে কেন?

– আমার স্পষ্ট মনে আছে এ নাকফুলটা আমি চার বছর আগে অরন্যকে ফেরত দিয়েছিলাম।

– অপ্সরা ডিজাইন হয়তো এক। কিন্তু অরন্যের নাক ফুল এটা না। আর তুমি নিজেই অরন্যের মধ্যে ডুবে আছো। নিজেকে সামলাও। নিজের প্রতি অস্থা রাখো। সব কিছুতে সন্দেহ আর কারণ খুজতে গেলে ভালো থাকবে না। আর আজকে কী ক্লাস আছে তোমার?

– আজকে ক্লাস নেই।

– তাহলে বিকেলে এসো।

– হুম আসবো।

কলটা কেটে দিলাম। সত্যিই তো এক ডিজাইনের নাক ফুল তো হতেই পারে। আমি সত্যিই একটু বেশি কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছি সবকিছুতে। যা হবে ভালোর জন্য কথাটা মনে মনে বলেই দীর্ঘ শ্বাস নিলাম। তবে অরন্য কোথায় গায়েব হলো সেটাও ভাবার বিষয়। এমন সময় ফোনে অচেনা নম্বর থেকে কল আসলো আমি কলটা ধরতেই একটু বিস্মিত হলাম। কারণ

(চলবে)

প্রাক্তন পর্ব-১৩

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৩

সকালে উঠেই অরন্যের দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম। সেখানে গিয়ে লক্ষ্য করলাম অরন্য নেই। এদিকে ওদিক তাকিয়ে অরন্যকে খুঁজতে লাগলাম। কোথাও ওকে পেলাম না। বেশ অদ্ভুত লাগল বিষয় টা। বেশ কয়েকবার ফোনে কল দিলাম ফোনটাও বন্ধ। রাগে মাথা ব্যথা শুরু করছিল। তবুও রাগটা দমিয়ে ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করলাম।অপেক্ষা করার পরও যখন অরন্য আসলো না সোজাসুজি কলেজে চলে গেলাম। রেটিনের দুটো ক্লাস করে বাসায় ফিরলাম বিকেলে। এর মধ্যে অরন্য একবারও কল দেয়নি। আমি পুনরায় ওর নম্বরে কল দিলাম নম্বর বন্ধ। বুঝতে পারছিলাম না অরন্য নতুন কী চাল চেলেছে। অরন্য ইদানীং বেশ গুটিবাজ হয়ে গেছে। কখন কী করে বসে তার গতিবিধি বুঝা বড় কঠিন। আমি চুপচাপ পড়ন্ত বিকেলের আলোছায়ার খেলা দেখতে লাগলাম আর এগুলো ভাবছিলাম। এর মধ্যে ফোনটা বেজে উঠল। আবির কল দিয়েছে। আমি কলটা কেটে দিলাম। পর পর তিনবার কল দিল তিনবারেই কলটা কেটে দিলাম। চতুর্থ বার কল ধরতেই ওপাশ থেকে বলে উঠল

– কেমন আছো?

– অনেক ভালো। কিছু বলবেন?

– হঠাৎ আপনি করে বলছো যে?

– অপরিচিত কাউকে তুমি বলতে কমফর্ট ফিল করি না।

– এত রাগ আর এত ভাব কী করে ধরো? এখানে আমার দোষ কোথায় বলতে পারো? দোষ তো তোমার, তুমি লুকিয়েছো। আমার জায়গায় যে কেউ হলে এটা মানতে পারবে না।

– তুমি কী এসব বলার জন্য কল দিয়েছো?

– তোমার খুঁজ নিতে কল দিয়েছিলাম।

– আমার খু্ুঁজ নেওয়ার দায়িত্ব কি তোমাকে দিয়েছি?

– অপ্সরা তুমি সে কখন থেকে উল্টা পাল্টা বলেই যাচ্ছ। আমি কী করেছি বলবে? আমার দোষটা কোথায় বলবে? এখানে সবচেয়ে বেশি কষ্ট আমি পেয়েছি। আমার কাছে তুমি আড়াল করে কম ভুল করো নি৷ তুমিও তোমার স্বার্থটাই দেখেছো। আমাকে তো প্রথম থেকে কিছু বলো নি। শুধু বলেছিলে তোমার জীবনে একটা অতীত আছে। এর বাইরে তো জানতাম না। অতীতটা যে এত নোংরা হবে সেটা কল্পনাও করিনি। তুমি অন্য কারও বউ সেটা মানা কী আদৌ সম্ভব? তোমার যদি সম্পর্ক হয়ে ফিজিক্যাল ও হতো তবুও মেনে নিতে পারতাম। কিন্তু বিয়েটা মেনে নিতে পারছি না।

আমি হালকা হেসে বললাম

– দোষটা তোমার না আবির, দোষটা সমাজের। এখানে একটা মেয়ের বিয়ের আগে প্রেমিকের সাথে সম্পর্ক হলে কোনো সমস্যা হয় না। সেটা মানতে সবাই পারে। আর একটা মেয়ের বিয়ের পর সম্পর্ক হলে ডিভোর্স হলে সেটা সমাজ মানতে পারে না। তখন মেয়েটার দোষ হয়ে যায়। বৈধ সম্পর্কে ডিভোর্স হলে সমাজ হাজারটা দোষ লেপ্টে দেয়। আর অবৈধ সম্পর্কে কিছু হলে সমাজ বলে বিয়ের আগে এসব এখন হয়েই।

এখানে আমার দোষ টা কোথায় বলবে? অতীত ভুলে বাঁচতে চাওয়া কী আমার ভুল? অতীতের গ্লানি মুছে সামনের দিকে এগিয়ে চলা কী আমার ভুল? যে অতীতের কোনো অস্তিত্ব নেই সেটা না বলে আমি ভুল করেছি? কতবার বলেছি তোমাকে অতীতটা বলব তুমিই তো বাঁধা দিয়েছো বারবার। আমার দোষটা কোথায় ছিল যেদিন বাচ্চা পেটে নিয়ে বারবার অরন্যের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। কত মেসেজ তাকে দিয়েছি সেটার হিসাব কী তুমি জানো। অস্থির হয়ে উপায় না পেয়ে নিজের বাচ্চা নিজের হাতে খুন করেছি। হ্যাঁ আমি স্বার্থের জন্য আমার বাচ্চা খুন করেছি কারণ তা না হলে এ সমাজ আমাকে নষ্টা বলত আমার বাচ্চাকে জারজ উপাধি দিত। তখন কেউ আমার আর অরন্যের বিয়ের কথাটা বলত না।এটা বলত না যে আমার বাচ্চাটা পবিত্র। তখন শুনতে হতো আমি আকাম করে পেট বড় করছি। হ্যাঁ আমি স্বার্থপর দিনের পর দিন একজনকে ভালোবেসে ১০ টা বছর পার করার পর তার পায়ে ধরেও তাকে পাইনি। হ্যাঁ আমি স্বার্থপর কারণ অরন্যের জন্য একের পর এক ভালো বিয়ের প্রস্তাব রিজেক্ট করে অরন্যের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। হ্যাঁ আমি স্বার্থপর অরন্যের জন্য নিজের আত্মসম্মানটাও একটা সময় বিলিয়ে দিয়েছিলাম। আর বাকি রইল বিয়ে। যে বিয়ের কোনো অস্তিত্ব প্রমাণ ছিল না, সেখানে আমি অতীতটা বর্তমান এনে কীভাবে ডিভোর্স দিব। যে বিয়ের কথা পরিবারেই জানত না। সে সময় সে পরিস্থিতিতে পরিবারকে বলার মতো কোনো সাহস আমার ছিল না। আমার কাছে কোনো প্রমাণও ছিল না যে বিয়ের বিষয় নিয়ে অরন্যের সাথে লড়ব। আর সে সময় সবাই প্রমাণ চাইত। প্রমাণ দিতে না পারলে দোষটা আমার ঘাড়েই পড়ত। পরিবারকে আরও ছোট হতে হত। আর আমি ছিলাম এক জলে ভাসা নৌকা যার কোনো শক্ত ভিত্তি ছিল না যে একা একা লড়ব।

বলাটা খুব সহজ। তবে করাটা কঠিন। আমার পরিবার আছে আমি তাদেরকে এত কষ্ট দিয়েছি এসব নিয়ে কী বলব। তাদের কথা ভেবে অতীত ভুলে সামনে এগিয়েছিলাম। আমি তো আবার সে অতীত সামনে এনে বাবা মাকে কষ্ট দিতে পারি না।

হ্যাঁ আমার একটা ভুল হয়েছে আমার উচিত ছিল অরন্যকে ডিভোর্স দেওয়া। সে সময়টায় ডিভোর্স দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতিতে আমি ছিলাম না। তবে এত বছর পর নিজেকে যখন আমি গুছিয়ে নিয়েছিলাম তখন এসব অতীত আমি পুরোপুরি ভুলে গেছিলাম। সে অতীত সামনে এনে বর্তমান নষ্ট করতে চাই নি। অরন্য যদি সামনে না আসত এ অতীত বিলীন হয়েই থাকত।

তুমি ঠিকেই বলেছো আমি স্বার্থপর। শুধু আমি না দুনিয়ার সবাই স্বার্থপর। সবাই নিজেকে ভালো রাখার জন্য স্বার্থপর হয়। সবাই হতে পারলে আমি কেন পারব না? অরন্য নিজের স্বার্থ তখন দেখেছে তখন অরন্যের দোষ ছিল না আর এখন আমি আমার স্বার্থ দেখেছি তাতেই দোষ? শুনো আমি স্বার্থপর হলেও সেটা সিমীত পরিসরে, অরন্যরের মতো অন্ধ হয়ে নিজের স্বার্থ খুঁজি না। আমি যদি অন্ধ হয়ে নিজের স্বার্থ খু্ঁজতাম তাহলে তোমাকে আমার জমে থাকা সব অতীত না জানিয়েই অরন্যের সাথে কৌশলে সব শেষ করতে পারতাম। আমি কিন্তু তা করে নি। আর তোমাকে ও তো বিয়ের জন্য জোর করে নি। মা বলেছে তুমি আমাকে চাও না আমি তো কোনো অনুগ্রহ তোমাকে বা মাকে করে নি। তাহলে এখন আমাকে এসব কেন বলা হচ্ছে? আমি কী তোমাকে এসবের জন্য কোনো কথা শুনিয়েছি নাকি কিছু বলেছি। তাহলে আমাকে কেন বলা হচ্ছে?

আবির বেশ রাগী গলায় বলল

– তোমাকে কল দেওয়ায় আমার ভুল হয়েছে। তবে কল দিয়েছি আরেকটা কারণে। অরন্য কোথায়? তোমার সাথে দেখা করার জন্য গিয়েছিল এখনও আসে নি। ফোন ও বন্ধ।

– আমি কী জানি সে কোথায়? আমার সাথেই তো তার দেখা হয়নি। ডিভোর্স দিবে বলে লা পাত্তা। আমাকে আর অরন্যের বিষয় নিয়ে কল দিবে না।

– অরন্যের বিষয় নিয়ে তুমি জড়িয়ে আছো বলেই তোমাকে কল দিই।

– আমি জড়িয়ে নেই। অরন্যের দেখা পেলে বলো আমার ডিভোর্স দরকার সেটা যেন তাড়াতাড়ি করে। আমারও অরন্য কোথায় সেটা জানা দরকার। ভালো থেকো।

বলেই কলটা কেটে দিলাম। ফোনটা কেটে জানালার গ্রিল ধরে বাইরের দিকে তাকালাম। পৃথিবীটা বড়ই অদ্ভুত। এখানে অতীত ভুলা গেলেও অতীত থেকে বাঁচা যায় না। সে সাথে ভাবতে লাগলাম অরন্য কোথায়। কেনই বা সে আমাকে আসতে বলে আসলো না। ফোনটাও বন্ধ। আবিরের কথায় মনে হলো অরন্যকে না পাওয়ার ব্যপারে আমাকেই সন্দেহ করছে। তবে অরন্য এখন কোথায় সেটাই একটা রহস্য। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে অরন্যের নম্বরে কল দিলাম। অরন্যের ফোন এখনও বন্ধ। ফোনটা রেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। এর মধ্যেই বাবা পিঠে হাত রেখে বলল

– কী হয়েছে? মন খারাপ? এনগেজমেন্ট হওয়ার পর থেকে খেয়াল করলাম মুখ গোমরা করে রাখো। আমরা তো তোমাকে জোর করে কিছু করতে বলে নি। তোমার পছন্দেই সবটা হয়েছে তাহলে মুখ এত কালো কেন? কিছু নিয়ে কী চিন্তিত?

এর মধ্যেই মা ঘরে ঢুকে বলল

– দুই দিন পর বিয়ে এখন কী চিন্তা করিস এত? চিন্তা করে দুদিনে মুখের কী অবস্থা করেছিস দেখেছিস? চোখের নীচে কালো দাগটা গাঢ় হয়ে গেছে। কী হয়েছে তোর?

মায়ের জোরালো কন্ঠ শুনে বাবা বলল

– অপ্সরার মা চুপ করো তো। চেঁচামেচি কেন করো সব বিষয় নিয়ে। চেঁচামেচির তো কিছু হয়নি। আর এত উত্তেজিত হওয়ার ও কিছু হয়নি। ও তো অবুঝ না। যথেষ্ট বয়স হয়েছে। হয়তো কোনো ব্যপারে চিন্তিত। আগে শুনতে দাও কী হয়েছে। এর আগেই চিৎকার করে বাসা মাথায় তুলতেছ কেন?

– চিৎকার কী আর স্বাধে করি? এত বড় মেয়ে কেন ঘরে সবাই এই কথা জিজ্ঞেস করে। যতই চাকুরী করুক। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত মানুষের মুখ তো আটকে রাখতে পারব না। বের হলেই মানুষ একটা কথায় বলে কবে মেয়ের বিয়ে দিবেন। বয়স তো ২৭ পার হতে চলল। ২৮ এ পড়তে বেশি দিন নাই।

মায়ের কথা শুনে আমার কেন জানি না হালকা রাগ জমলো। বেশ কটু গলায় বলে উঠলাম

– বিয়ে জরুরি। তবে একটা মেয়ের জীবনে তো বিয়েই সব না মা। যারা তোমাকে আজকে এসব জিজ্ঞেস করছে তারা কয় বেলা তোমার বাসায় খাবার দিয়ে যায় বলবে? মানুষের কথায় কান না দিয়ে নিজের মতো চলো।

– তোরে বুঝিয়েও লাভ হবে না। সেই চার বছর যাবত বুঝাচ্ছি। ইদানিং তোর হাবভাব ও ভালো না। আবিরের সাথে অরন্য আসলো কী জন্য বাসায়? এত কিছুর পর তুই আবিরের সাথে অরন্যকে বাসায় আনার সাহস দিলি কী করে? তোকে এ কয়দিন কিছু বলে নি তাই ভাবিস না আমি কিছু বুঝি না। তোর মধ্যে কী চলছে জানি না তবে কিছু একটা হচ্ছে সেটা টের পাচ্ছি। আমার পেটের থেকে তুই হইছস এটা মনে রাখিস।

– মা তুমি একটু বেশি বেশিই করছো না? এত বলার কী আছে? আমি তো কচি বাচ্চা না যে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। যথেষ্ট ম্যাচুউর। আমার ব্যপার আমাকেই ভাবতে দাও। এখানে এত কিছু টেনে আনার তো কিছু দেখছি না। আর কিছু হলে তো জানবেই। সময় মতো আমিই বলব। এখন আপাতত আমাকে একা থাকতে দাও।

– একা থাক সমস্যা নেই। আজকে আবিরের মাকে কল দিয়েছিলাম বিয়ের ব্যপারে উনি বলল তোর কাছ থেকে জেনে নেওয়ার জন্য। কী হয়েছে বল।

– মা অস্থির হইয়ো না আমিই সময় মতো বলব।

আমাদের কথা কাটাকাটি দেখে বাবা মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল

– তুমি থামো। অপ্সরা যথেষ্ট বড় এবং নিজেরটা বুঝার ক্ষমতা আছে। ওকে ওর মতো ভাবতে দাও। যাই হোক সেটা ভালোর জন্যই হবে৷ আর অপ্সরা আমি আর তোমার মা তোমাকে বকলেও সেটা ভালোর জন্য। তুমি অনেক বড় হয়ে গেলেও আমাদের কাছে এখনও সেই ছোট্ট পরীই আছো। মনের সাথে বুঝা পড়া করে বলার মতো হলে বলো। এভাবে চুপচাপ থাকলে আমাদের কাছে একটু খারাপ লাগে।

আমি হালকা হেসে বললাম

– বাবা আমি জানি তোমরা যা করো ভালোর জন্য। তবে এটা নিশ্চিত করতে পারি আমি যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিই তাহলে সেটা অবশ্যই আবেগে পড়ে নিব না। সবকিছু বিবেচনা করে নিব। আর মা মানুষের কথায় তো জীবন চলেও না আর থেমেও থাকে না। মানুষকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজেকে দাও। আমার জন্য চিন্তা হয় জানি তবে এতটা চিন্তাও করো না যেটা করতে গিয়ে তোমাদের উপর মানসিক চাপ পড়বে। শুধু আমার জন্য দোয়া করো। দোয়ায় আমাকে আরও সুন্দর সহজ রাস্তা দেখাতে পারে। আপাতত কিছুই বলতে পারছি না। খুব শীঘ্রই সবটা বলব।

কথাটা শেষ করতেই মা আর বাবা দুজনেই জড়িয়ে ধরে একসাথে বলল

– মা রে দোয়া চাইতে হবে না। আমাদের দোয়ায় তুই সবসময় থাকিস। তোর হাসি মুখটায় আমরা দেখতে চাই।

আমিও মাকে আর বাবাকে দুই বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। মা আর বাবাকে জড়িয়ে ধরার মধ্যে অসম্ভব প্রশান্তি কাজ করে। যেখানে সব দুঃখ ম্লান হয়ে যায়।

আস্তে আস্তে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলো। রাতের ব্যপার টা একটু অন্যরকম। এসময়টা ভীষণ একাকীত্ব গ্রাস করে। হতাশায় থাকা সময়ে রাতটায় সবচেয়ে বেশি দীর্ঘ মনে হয়। সারাদিন এটা সেটা করে চলে গেলেও রাতের প্রতিটা সেকেন্ড যেন দীর্ঘ সময়ের জানান দেয়। তখন শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। যন্ত্রণা তখন ঘিরে ধরে। শূন্য ঘরে শুধু আমি। এ দেয়াল গুলোও যেন হাহাকার করে তখন। রাতের বেলায় মনটা ভীষণ অবাধ্য সে না চাইতেও অতীতে ঘুরাঘুরি আবার কখনও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ব্যাকুল হয়। আমার মনেও ঝড় বইছে সে সাথে হাজার টা প্রশ্ন হাজারটা প্রশ্নের উত্তর মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা। চোখ বন্ধ করতেই যেন অতীতের সময়গুলো চোখে এসে উপস্থিত হচ্ছে। চোখ ও বন্ধ করতে পারছি না সে সাথে ঘুমাতেও। এ কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি কবে ঘটবে শুধু এ প্রশ্নই মনে চলছে।

আর আবারও হতাশায় ডুবে গেলাম। হতাশায় ডুবে গিয়ে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। শক্ত প্রাচীর দিয়ে নিজেকে আবদ্ধ করলাম। তারপর খুব সাহস নিয়ে চোখটা বন্ধ করলাম। চোখটা বন্ধ করতেই অতীত ভেসে উঠল চোখের পাতায় আর আমি সে অতীতের সাথে লড়াই করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম খেয়াল নেই।

সকালটা হলো নতুন ঘটনার সূচনা দিয়ে। সে ঘটনার সাথে না চাইতেও জড়িয়ে গেলাম পুনরায়। সেই সাথে আরও কতগুলো প্রশ্নের উদ্ভব ঘটলো আরও রহস্য ঝেঁকে বসলো।

(চলবে)

প্রাক্তন পর্ব-১২

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১২

আমি মৃদু গলায় বলা শুরু করলাম। বুঁকটা কাঁপছিল বলার সময় তবুও বলতে লাগলাম। বলতে বলতে কখনও আঁৎকে উঠছিলাম কখনও স্থির হয়ে যাচ্ছিলাম। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলা শেষ করলাম। সব কিছু বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে ছাড়লাম। আবির ততক্ষণে স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমার হাতের উপর যে হাতটা ছিল সেটাও ইতোমধ্যে চলে গেছে। আবিরের চোখ গুলো লাল হয়ে আছে। মুখটা ফ্যাকশে। আবিরের নিস্তবতায় বলে দিচ্ছে সে বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে নি। আমার চোখ দিয়ে ততক্ষণে অশ্রু গাল বেয়ে পড়ছিল। আমি চোখের জলটা মুছে আবিরের দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বললাম

– আবির কিছু একটা বলো। আমি জানি তোমার খারাপ লাগছে। তবে আমি চেয়েছিলাম এ অতীতটা নিশ্চিহ্ন করে সামনে এগুতে। তাই অতীতটা তোমাকে জানাইনি। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলেও একই কাজ করত। তবে অতীতটা সামনে আসায় তোমাকে না বলে পারলাম না৷ আমার ভুল হলে ক্ষমা করে দিও। তবু কিছু একটা বলো। এভাবে চুপ থাকলে বড্ড কষ্ট হয়৷

বলেই আবিরের হাতটা ধরলাম। আবির সাথে সাথে তার হাতটা আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল

– তুমি তো অন্য কারও স্ত্রী। তোমার হাত ধরাও ঠিক হবে না। আর সব মেনে নিতাম। রিলেশন সবার হয় কিন্তু তোমার বিষয়টা এত জটিল যে আমি মেনে নিতে পারছি না। অরন্যের জায়গায় অন্য একটা ছেলে হলেও কষ্ট হত না। ওর সাথে আমার সম্পর্ক গভীর। ওর সাথে এতকিছু আমি মানতে পারছি না। তার উপর তুমি এখনও অরন্যের স্ত্রী অরন্যও তোমার জীবনে আসতে চাচ্ছে। আর তোমাদের একটা বাচ্চাও হওয়ার কথা ছিল। এটা ঠিক অরন্য যা করেছে ভুল করেছে তবে সে তো তার ভুল বুঝতে পেরেছে। একদিকে তুমি একদিকে অরন্য আমি তো দুটানায় পড়েছি অপ্সরা। আমাকে নিয়ে এভাবে না খেললেও পারতে। আগে বললে হয়তো এত বড় সিদ্ধান্ত আমি নিতাম না। আমি সত্যিই মানতে পারছি না। আমার পক্ষে মানা বেশ কঠিন।

আমি আবিরের কথায় মৃদু হাসলাম। আশার আলোটা ধূপ করে নিভে গেল। এটা হওয়ারেই ছিল। কারণ আবির কোনো সুপার হিরো না। বাস্তবে সুপার হিরো নেই যে, যারা হিরোইনের সব মেনে নেবে। বাস্তবতা বড়ই কঠিন। এর কষাঘাতে প্রতিনিয়ত বলি হতে হয়। আমার হাসি দেখে আবির জিজ্ঞেস করল

– হাসার মতো কী বললাম হাসছো যে?

– তাহলে কী কান্না করা উচিত?

আবির নিশ্চুপ। আমি পুনরায় বললাম

– একটু আগেও বলেছিলে অতীত নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। অতীত যাইহোক মেনে নিবে। এর আগে বলেছিলে অতীতে আমার কোনো ভুল না থাকলে আর অতীতটা যদি আমাদের ভালো ভবিষ্যতের জন্য লুকিয়ে রাখি তাহলে সব মেনে নেবে। তোমার ঐ কথাগুলো মনে হয়ে হাসি পাচ্ছে। আমার তো এতে কোনো দোষ নেই। বিনাদোষে বারবার শাস্তি পেয়েছি। তবে শুনো তুমি চাইলে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারো আমার তাতে কিছু আসবেও না যাবেও না। আর আমি অরন্যকেও আমার জীবন থেকে মুছে ফেলব। সে জীবনে না থাকবে তুমি না থাকবে অরন্য। কারও খেলার পুতুল আমি না। আমি আমার জায়গায় পারফেক্ট। নিজেকে আমি বারবার ভাঙ্গতে দেখেছি আবার বারবার গড়ে নিয়েছি। আমি এবারও গড়ে নিব আরও শক্ত করে। এ মনের আবেগী জায়গায় আবারও প্রাচীর উঠবে সেটা হবে আরও শক্ত। প্রাচীরের এ পাশে থাকব আমি যেখানে আমি আমার মতো রাজ্য বিস্তার করব। আর প্রাচীরের ঐপাশে থাকবে তুমি যে কী না, চাইলেও আর আমার রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না।

– অপ্সরা তুমি ঠিকেই বলেছিলে আমি কথা গুলো যতটা সহজে বলেছিলাম বাস্তবতা তার ব্যতিক্রম। আমি চাইলেও মানতে পারছি না। আমি মানতে পারতাম যদি অরন্যের জায়গায় অপরিচিত কেউ থাকত। অরন্য আমার ভাই তার বউ তুমি। এখানে চাইলেও আমি কিছু করতে পারব না। আমার হাত পা বাঁধা।

আমি এবার অট্ট হাসলাম। হেসে হালকা গলায় বললাম

– ভালো থেকো।

বলেই উঠতে নিলাম। আবির আমার হাতটা টান দিয়ে বলল

– আমাকে কী সময় দেওয়া যায় না?

– সম্ভব না। আজকে তুমি বিষয়টা মানতে দ্বিধা করছো সে দ্বিধাটা তোমার আজীবন থাকবে৷ সারা জীবন তোমার কথা শুনতে হবে। আমি কেন এ পথ বেছে নিব বলো? তিলে তিলে মরার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমার জীবনে তুমি বা অরন্য কারও স্থান নেই। আমার রাজত্বে আমি একাই বিরাজমান। আমি নিজেকে এর আগে সামলে নিতে পেরেছি এখনও পারব। আর তোমার মাকে সবটা জানানো হয়নি আজকে মাকেও সবটা জানাব। আমার পরিবার জানা বাকি আমার পরিবারকেও জানাব। সব মিলিয়ে বিষয়টা শেকড় থেকে শেষ করে নতুন ভাবে নিজেকে গড়ে নিব৷ সেখানে আমি ব্যতীত আর কারও স্থান নেই। ভালো থাকবে।

কথাটা বলেই বের হলাম আবিরের রুম থেকে। আবিরের রুম থেকে বের হতেই অরন্যের সাথে দেখা। অরন্য আমার পথ আটকে দিয়ে বলল

– দয়াকরে মাফ করে দাও। আমার তো ভুল হয়েছে আমি স্বীকার করি। প্রতি পদে পদে আমি সেটা অনুধাবন করেছি।

কথাটা শুনার সাথে সাথে আমি অরন্যের গালে কষিয়ে চড় দিয়ে বললাম

– আমার সামনে যেন তোমার এ মুখটা কখনও না আসে। বেয়াদব,কুত্তা, আমার জীবনটা নরক করতে বিবেকে বাঁধল না? যদি ভালোইবাসতে আমাকে, তাহলে আমার সুখটা নষ্ট করতে না। তোমার বিয়ের পর তোমার জীবনে তো আমি ঝামেলা করে নি। কারণ আমি তোমায় ভালোবাসতাম। আজকে কেন তুমি আমার জীবনটা নরক করতে উঠে পরে লেগেছ।

বলেই অপর গালে আরেকটা চড় দিলাম। তারপর বললাম

– তুমি জানো? তোমার এ সামান্য আবেগ সামান্য লোভ আমার জীবনে কি ক্ষতি করেছে? ভালোবেসার সাগরে হাবুডুবু খেয়ে তো আমাকে বাচ্চার মা বানিয়ে ফেলেছিলে। সেদিন তোমার সাথে যোগাযোগের কম চেষ্টা তো করে নি। কই ছিল সেদিন তোমার ভালোবসা যেদিন আমার বাচ্চাটাকে খুন করতে হয়েছে। সেদিন অধিকার ফলাতে তো তোমাকে দেখি নি৷ আমি তোমাকে মন থেকে ঘৃনা করি। আবিরকে সবটা বললাম আমার পরিবারকেও সবটা বলে এ নাটক আমি শেষ করব। আমাকে যতটা আবেগী ভাবো প্রয়োজনে তার চেয়ে কঠিন হতে আমার সমস্যা হবে না। আমার জীবনের পাতাতেও আর তোমাকে রাখতে চাই না।

কথাগুলো বলেই দৌড়ে বের হতে নিলাম। মা আমার হাতটা ধরে বলল

– কী ব্যপার অপ্সরা কী হয়েছে? অরন্যকে চড় দিলে কেন?

আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম

– আপনি আমার মায়ের মতো। আপনাকে বলতে পারছি না। বলার ধৈর্য আমার নেই। অরন্য আর আবিরের কাছ থেকে বাকিটা জেনে নিবেন।

কথাটি শেষ করেই আমি বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। তারপর সে বাসায় কী ঘটেছে সেটা আমার জানা নেই। রিকশা নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। বরাবরেই আমি মানুষ চিনতে বড্ড ভুল করে বসি। যদিও এখানে আবিরের দোষ নেই কারণ আমি হলেও বিষয়গুলো স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারতাম না। প্রতিটা কাজের একটা ভালো দিক থাকে। এই যে আরন্যের আগমনটা হয়ে ভালোই হয়েছে। বিয়ের পর যদি অরন্যের আগমন হতো তাহলে হয়তো আরও বেশি কষ্টের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতাম। আজকাল আমি বড্ড ইতিবাচক স্বভাবের হয়ে গেছি। প্রতিটা বিষয়ে ইতিবাচক দিক গুলোই বের করি। হালকা কষ্ট হচ্ছে তবে এটা সাময়িক। রিকশায় বসে আকাশের দিকে তাকালাম। রাতের আকাশটা বড্ড সুন্দর। সে সাথে ধূলিমিশ্রিত বাতাস বইছে। এ আকাশে ডানা মেলে উড়ার জন্য একটা পাখা দরকার। সে পাখার সন্ধান কই পাব। মনে মনে এসব আওরাতে আওরাতে হাসতে লাগলাম। আজকাল বড্ড ছেলে মানুষী করি। চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু জড়ছে সেদিকে আমার খেয়াল নেই।

বাসায় এসে হাত মুখ ধুয়েই খেয়ে নিলাম। নিজেকে এতটায় স্বাভাবিক করে রাখলাম যে কিছু একটা হয়েছে সেটা কাউকে বুঝতেও দিলাম না। খাওয়া শেষে নিজের মতো করে ঘরে এসে বসলাম। যখন একা খাটের কোণে বসলাম তখন কান্নাটা বুক ফেটে আসতে লাগল। আমি চিৎকার দিয়ে মুখে হাত চেপে কাঁদতে কাঁদতে শুয়ে পড়লাম। আজকে নিজেকে বেশ ছন্নছাড়া লাগছে। নিজের পরিবর্তনটাও নিজের কাছে অদ্ভুত লাগছে। একটা সময় এই আমি অরন্যের জন্য রাতের পর রাত কান্না করতাম ওকে পাওয়ার জন্য আর আজকে ওকে আমি সহ্যই করতে পারছি না। অরন্যকে কেন জানি না আমি ক্ষমা করতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে একে ক্ষমা করলে আমি শান্তি পাব না।

রাত তখন ১১ টা। আমার ফোনে কল আসলো। আবিরের মা কল দিয়েছে। আমি কান্না থামিয়ে কন্ঠটাকে স্বাভাবিক করে হ্যালো বললাম। ওপাশ থেকে উনি বেশ মোলায়েম কন্ঠে বললেন

– আমি জানি তোমার সাথে যা হয়েছে অন্যায় হয়েছে। মা আবির তোমাকে আর চাচ্ছে না। আবিরের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। তুমি তোমার বাবা মা কে বুঝিয়ে বলো। আর আমি কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করে দিও।

– আপনি কেন কষ্ট দেবেন। আমি ব্যপারটা ম্যানেজ করে নেব। আর শুনেন আবির আমাকে চাই না বলে ওকে ছেড়ে দিচ্ছি তা কিন্তু না বরং এখন আবিরকেই আমি চাই না। আর আবিরকে এটা ভাবতেও নিষেধ করবেন যে আমি অরন্যের হয়ে যাব। আমি অরন্যকেও আমার জীবনে চাই না। সারা জীবন একা থাকব তবুও অরন্যকে চাই না। দুনিয়াতে একটা ছেলে অরন্য থাকলেও তাকে আমি মেনে নিব না। ভালো থাকবেন।

কলটা কেটে দিলাম। কথাগুলো বলতে পেরে একটু হালকা লাগছে। এর মধ্যেই অরন্য কল দিল। অরন্যের কলটা ধরে গালি দিতে যাব এমন সময় ও বলে উঠল

– অপরাজিতা আমি আর তোমার জীবনের কাটা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার সুখের পথে দুঃখ আনতে আর চাই না। তুমি চাইলে আমি কালকেই তোমাকে ডিভোর্স দিব। সময় মতো চলে এসো। কাগজপত্র আমি প্রস্তুত রাখব।

অরন্যের কথা শুনে একটু স্বস্তি পাচ্ছিলাম। আমি হালকা গলায় বললাম

– ঠিকানা টেক্সট করো। কালকেই আসতেছি আমি।

কলটা কেটে খাটে হেলান দিলাম। কালকে নরকীয় অতীত থেকে মুক্তি পাব ভেবে মনটা শত কষ্টের মধ্যেও স্বস্তি লাগছিল। জানালার পর্দাটা সরানো রাতের কালো আকাশটা দৃশ্যমান। এ আঁধার গুচিয়ে খুব শীঘ্রই আলোর রেখার খুঁজ মিলবে। হয়তো এ কয়দিনে জীবন থেকে অনেক কিছুই বিয়োগ হয়েছে তাতে কী, আবেগের মোহে না থেকে বাস্তবতায় তো নিজেকে সামলাতে পেরেছি এটাই অনেক। আবিরকে তো চিনতে পেরেছি। এসব যোগ বিয়োগের জীবনের অংকগুলো ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে উঠেই অরন্যের দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম।

চলবে

প্রাক্তন পর্ব-১১

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১১

সেই সাথে নতুন প্রশ্ন নতুন কাহিনির সূত্রপাত ঘটল। আইডিটা ঘেটে লক্ষ্য করলাম নাফিসার সাথে অরন্যের আইডি মেনশন দিয়ে অনেক পোস্ট করা। প্রায় প্রতিদিনেই একটার পর একটা পোস্ট হচ্ছে। নাফিসা কেনই বা নতুন করে এমন করছে তার কোনো কারণ আমার জানা নেই। বেশ কৌতুহল নিয়েই নাফিসার আইডিতে ঢুকলাম তার আইডিতেও প্রোফাইল পিক অরন্য আর তার দেওয়া। আর সেটা আপলোড হয়েছে ছয়মাস আগে। আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। আমার মনে বারবার আগের মতোই একটা প্রশ্নই আসছে যদি নাফিসা অরন্যকে নিজ থেকে ডিভোর্স দেয় তাহলে কেন সে অরন্য আর তার কাপল ছবি তার আইডিতে দিবে। যদি সে তার প্রেমিকের কাছে চলে যায় তাহলে তার এ কাজ করে কী লাভ । প্রশ্নের বেড়াজালে আটকে গেলাম। নাফিসার আইডির ইনফরমেশন গুলো ভালো করে দেখে নিলাম। নাফিসা প্রাইভেট একটা মেডিকেল থেকে পড়াশোনা করেছে।

চট করেই আমার মাথায় আসলো আমার একটা স্টুডেন্ট সে মেডিকেলে পড়ে। তার নাম টিপটিপ। আমি যখন স্টুডেন্ট ছিলাম তখন ওকে পড়াতাম। তাহলে নাফিসার ইনফরমেশন ভালো করে নেওয়া আমার জন্য অসাধ্য কিছু না। আমি টিপটিপ কে কল দিলাম। কল দেওয়ার পর টিপটিপ ফোনটা ধরেই বলল

– ম্যাম আসসালামুআলাইকুম। কেমন আছেন?

– হ্যাঁ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?

– আমিও ভালো আছি।

– আচ্ছা টিপ টিপ তুমি এবার কোন ইয়ারে?

– ম্যাম আমি চতুর্থ বর্ষে।

– তোমাকে যদি তোমার কোনো সিনিয়র আপুর ইনফরমেশন নিতে বলি তাহলে কী নিয়ে দিতে পারবে?

– ম্যাম নাম বলেন। আর কোন সেশন সেটা বলেন আমি চেষ্টা করে একবার দেখতে পারি।

– কোন সেশন সেটা তো জানি না। তবে ছবি আছে। আমি তোমাকে ছবিটা দিচ্ছি তুমি আমাকে একটু খোঁজ নিয়ে জানাও। আর শুনো বিষয়টা যেন উনি টের না পায়।

– আপনি যা বলেন তাই হবে। আমাকে ছবি দিন আগে আমি দেখি চিনি কি না।

আমি টিপটিপ কে ছবিটা পাঠালাম। ছবিটা পাঠানোর সাথে সাথে টিপ টিপ বলল

– ম্যাম আমি যখন প্রথম বর্ষে ছিলাম তখন উনি ইন্টার্ণ ডাক্তার ছিল। আমার সাথে উনি এড আছেন। এখন কোথায় আছে সেটা তো সঠিক করে বলতে পারব না। আর আমি তো পড়াশোনার চাপে এফ বিতে তেমন ঢুকি না। আইডিটা ডি একটিভ করে রেখেছি।

– আচ্ছা শুনো তুমি কী উনার সাথে একটু কথা বলতে পারবে? আমি যা বলব তাই বলবে। যেভাবে বলব ঠিক সেভাবে। আমি যা জিজ্ঞেস করতে বলি ঠিক তাই বলবে। আর তুমি যেহেতু ঐ মেডিকেলে পড়ো তোমার কাছে উনি মিথ্যা বলবেন না।

– ম্যাম আমি আপনি যা বলবেন করব। আজকে মেডিকেলে পড়ার পেছনে আপনার অবদান কম না। তবে কোনো সমস্যা?

– টিপটিপ একটু ব্যক্তিগত শেয়ার করতে পারছি না। তবে তুমি আমার বন্ধুর মতো তাই হালকা বললাম। তুমি কী পারবে কাজটা করতে?

– হ্যাঁ পারব। আমি এখনই মেসেজ দিব? আর ম্যাম আপনার সমস্যা না হলে আমি আমার আইডির পাসওয়ার্ড দিচ্ছি। আমার আইডিতে তেমন পারসোনাল কিছু নেই। আপনি উনার সাথে কথা বলা শেষ হলে জানাবেন আমি নাহয় পরে পাসওয়ার্ড চেন্জ করে ফেলব।

আমি যেন একটা আশার আলো পেলাম। হালকা গলায় বললাম

– তোমার সমস্যা না থাকলে দিতে পারো।

টিপটিপ আমাকে তার আইডির পাসওয়ার্ড দিল। আমি নাফিসার আইডিটায় মেসেজ দিলাম

– আপু আমি আপনার মেডিকেলের একজন জুনিয়র। কেমন আছেন?

সাথে সাথে মেসেজটা সিন হয়নি। তবে দশ মিনিট পর রিপ্লাই আসলো

– জি ভালো। তুমি কেমন আছো?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আচ্ছা আপু আপনি বিয়ে করেছেন কবে? আজকে হুট করে আপনার আইডি সামনে আসলো। ভাইয়া আর আপনার পিক দেখলাম। মশআল্লাহ অনেক সুন্দর লাগছে দুজনকে।

– ধন্যবাদ। বিয়ে করেছি চার বছর হয়েছে।

– এখন কোথায় জব করছেন?

– আমি তো দেশে থাকি না। লন্ডন থাকি।

– ওয়াও গ্রেট। কত বছর হলো গিয়েছেন?

– তিন বছর হলো।

– ভাইয়াও কী আপনার সাথে থাকে?

– নাহ ও ঢাকায় থাকে।

– সব মিলিয়ে ভালো আছেন আপু?

– জি আলহামদুলিল্লাহ।

– মাঝে মাঝে নক দিব। রাগ করবেন না তো।

– ফ্রি থাকলে অবশ্যই রিপ্লাই দিব।

– আচ্ছা ভাইয়ার নাম কী?

– অরন্য।

– আপু একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি।

– হ্যাঁ করো।

– আপনাদের কী লাভ ম্যারেজ নাকি এরেন্জ। আমার মনটা ভালো না। রিলেশন নিয়ে অনেক সমস্যা আর ভুগান্তিতে পড়েছি। সবাই বলে লাভ ম্যারেজ টিকে না। এরেন্জ ম্যারেজ টিকে। আপনাদের বিষয়টা একটু বললে আমার সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো।

– আমাদের এরেন্জ ম্যারেজ হলেও আমরা ভালো আছি। এই তো কিছুদিন পর দেশে ফিরব। তার সাথে দেখা নেই তিন বছর। কত ব্যাকুল হয়ে আছি দুজন দুজনকে দেখার জন্য। লাভ আর এরেন্জ কোনো ব্যাপার না। আন্ডারস্ট্যান্ডিংটাই মূল বিষয়। সেই দিক দিয়ে আমরা ভালো আছি।

– ধন্যবাদ এতটুকু বলার জন্য। আমি আপনাকে মাঝে মাঝে জ্বালাব।

– সমস্যা নেই ভালো থেকো।

– আপনিও ভালো থাকবেন।

নাফিসার কথায় আমি মিথ্যা পাচ্ছিলাম না কেন জানি না। বারবার মনে হচ্ছিল অরন্য আর নাফিসার মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। নাফিসা যা বলছে সত্যি আর অরন্য যা বলছে মিথ্যা। টুকি টাকি সমস্যা হয়তো ওদের মধ্যে হয়েছ তবে তারা ভালো আছে সেটা নাফিসার কথায় বুঝা যায়। তবুও একটা কিন্তু থেকে যায়। ধরে নিলাম নাফিসা লন্ডনে থাকে তাই সে অরন্যের বাসায় আসতে পারে নি। আর অরন্যও নাফিসার ব্যপারে আবিরকে কিছু বলে নি। তাহলে অরন্য কেনই বা এতদিন আমার কথা আবিরকে বলে গেছে। আর নাফিসাও যেভাবে রিপ্লাই দিল তাতেও কোনো মিথ্যা পাচ্ছি না। আমার রাগ টা বাড়তে লাগল। কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি টিপটিপের আইডি দিয়ে নাফিসাকে কল দিলাম। ওপাশ থেকে নাফিসা কল ধরে হ্যালো বলল। আমি খুব সাবলীল গলায় বললাম

– হ্যালো আমি অপ্সরা। চিনতে পারছেন কী না জানি না। তবে অরন্যের বন্ধু। এটা আরেকজনের আইডি দিয়ে আপনাকে মেসেজ দিয়েছিলাম। আপনার সাথে অরন্যের ব্যপারে কিছু কথা ছিল।

গম্ভীর কন্ঠে উত্তর আসলো

– জি চিনতে পেরেছি। কী কথা বলুন। আর এত বছর পর কেনই বা কল দিয়েছেন?

– সেটার কারণ আছে বলেই দিয়েছি। অরন্যের সাথে কী আপনার ডিভোর্স হয়েছে কি না জানতে চাই।

– আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে আপনাকে বলতে বাধ্য নই। আমার অরন্যের সাথে সাময়িক ঝামেলা হয়েছে সেটা আবার মিটিয়েও নিব।

– অরন্যের সাথে আমার কথা হয়েছে সে আমার জীবনে ফিরে আসতে চায় আর আপনার সাথে ডিভোর্স হয়েছে বলেছে কথাটা কি সত্যি? আর অরন্যের আইডিটাও নাকি আপনার কাছে? কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা সেটাই আমি জানতে চাচ্ছি।

নাফিসা মৃদু হাসলো। তারপর বলল

– এখন থেকে তুমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং মূখ্য গুটি। তোমাকে পরিষ্কার করে বলায় যায় বিষয়টা। শুনো অরন্যের সাথে আমার সম্পর্কের সাময়িক বিচ্ছদ ঘটেছে তবে ডিভোর্স হয়নি। আমি আমার পরিবারকে বুঝিয়ে অরন্যকে ডিভোর্স দিতে চাইলে আমার পরিবার বলল অরন্য যেন ডিভোর্স দেয় সে ব্যবস্থা করতে তাহলে আমি কাবিনের পুরো টাকাটা পাব। যেহেতু তোমাকে নিয়ে সমস্যা ছিল তাই অরন্য আমাকে ৩০ লাখ কাবিন ধার্য করে বিয়ে করেছিল। তখন পরিবারের চাপে বিয়ে করেছিলাম। কারণ আমি ভালোবাসতাম সালমানকে। সালমানের সাথে বিয়ের পর সব ঠিক করে নিয়ে একটা সময় পর পরিবারকে নিজের মতো করে বুঝিয়ে সালমানের জন্য লন্ডনে চলে আসি। আর অরন্য আমার কাছে তিন বছর সময় চেয়েছিল, বলেছিল তিন বছরের মধ্যে কাবিনের সমস্ত টাকা দিয়ে ডিভোর্স দিবে।

তিন বছর প্রায় সম্পন্ন হতে চলল। এদিকে সালমানের সাথেও আমার সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। আমি নিজের কাছে নিজে অনুতপ্ত। পরিবারকে সব বলার পর পরিবার বলল অরন্যের সাথে সব ঠিক করে নিতে। অরন্যকে বলার পর সে রাজি হলো না। বরং বলল টাকা দিয়ে ডিভোর্স দিয়ে দেবে আর তোমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু আমি তো ডিভোর্স দিব না। যেহেতু আমাদের আইনগত ডিভোর্স হয়নি আর সাময়িক বিচ্ছেদের কথা কেউ জানে না সেহেতু আমি অরন্যের সাথে সম্পর্ক ঠিক করার জন্য যা করা লাগে করব। দরকার হলে আইনের সাহায্য নিব। আর এর মাঝে তুমি আসলে তোমাকেও ছাড়ব না।

আমি নাফিসার কথায় মৃদু হাসলাম। তারপর হালকা গলায় বললাম

– জাতে জাত মিলে। আপনিও যেমন স্বার্থপর অরন্যও তার ব্যতিক্রম না। আপনারা স্বার্থের জন্য যা ইচ্ছা করতে পারেন। কখনও ভালোবাসার মানুষকে ছুড়ে ফেলতে পারেন। আবার কখনও ভালোবাসার মানুষকে প্রয়োজনে বুকে টেনে নেন। আপনাদের আগা গোড়া পুরোটাই স্বার্থে মোড়ানো। আমিও চাই দুই স্বার্থপর এক হোক। ধন্যবাদ পরিষ্কার ভাষায় সবটা বলে দেওয়ার জন্য। ভালো থাকবেন।

বলেই কলটা কেটে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম। অরন্য কতটা জঘন্য হলে নাফিসাকে ডিভোর্স না দিয়েই আমার জীবনে ফিরে আসতে চায়তেছে সেটাই শুধু ভাবছিলাম। অরন্যের যে টাকা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না তা না বরং আমার মনে হয় তিন বছর সময় নিয়েছিল হয়তো ভেবেছিল এর মধ্যে নাফিসার সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। যখন কিছুই ঠিক হলো না তখন সে তীব্রভাবে আমাকে অনুভব করছিল তাই এখন নাফিসা তার জীবনে আসতে চাইলেও সে মেনে নিতে পারছে না। এ মানুষটা সব সময় নিজের স্বার্থটা আগে দেখেছে। এখন আমাকেও ভালো থাকতে দিচ্ছে আর সেও ভলো থাকতে পারছে না। আমি চট করেই মোবাইলটা নিয়ে অরন্যকে কল দিয়ে বললাম

– নাফিসাকে ডিভোর্স না দিয়েই আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছ তাই তো? এত নোংরা কেন তুমি?

– অপ্সরা আমি মুখে মুখে নাফিসাকে তালাক অনেক আগেই দিয়ে দিছি। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সে আমার স্ত্রী না। আর তখন কাবিনের টাকা পুরোপুরি ছিল না বলে তিন বছর সময় নিয়েছিলাম।

– তোমার তো টাকা দেওয়ার ক্ষমতা ছিলই তাহলে তিন বছর সময় কেন নিয়েছিলে? নাফিসা এর মধ্যে ফিরে আসে কি না সেটার জন্য?

– তুমি শুধু শুধু ভুল বুঝতেছো। আমি নাফিসাকে বিয়েটা আমার পছন্দে করেছিলাম। আর পরিবারও আমার কথায় তোমার সাথে আমার বিয়েটা ভেঙ্গেছিল। আর পরবর্তীতে নাফিসাকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য আমার কোনো টাকা ছিল না। চাকুরির এক বছরে তো আমি ৩০ লাখ ইনকাম করে ফেলে নি। আর পরিবার ও তখন আমাকে সাপোর্ট দেয়নি। সব মিলিয়ে আমি তিন বছর মসয় চেয়েছিলাম। আর নাফিসাও লন্ডন চলে যায় সালমানের কাছে। এখন নাফিসা আমার স্ত্রী না। আইনগত যে কাজগুলো বাকি সেটা আমি খুব শীঘ্রই ও আসার পর পরই পূরণ করে এ সম্পর্ক থেকে মুক্তি নিব। আর এ চার বছর এজন্যই তোমার সামনে যাইনি। কারণ আমি চেয়েছিলাম সব শেষ করে তোমার সামনে যাব। কিন্তু ভাগ্য এর আগেই তোমার সামনে আমাকে দাঁড় করাল।

– নাফিসা তো ভুল বুঝে ফিরে আসতেছে তাকে মেনে নাও।

– এটা কখনও সম্ভব না। যে মেয়ে আমাকে নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করতে পারে তাকে আমি আর চাই না।

– তাহলে আমি কেন তোমাকে চাইব? কেন আমি তোমার হব? তোমার আর নাফিসার মধ্যে পার্থক্য কী?

– অপরাজিতা আমি নাফিসাকে ভালোবাসে নি কখনও মোহে পড়ে বিয়ে করেছিলাম। আর তুমি আমাকে ভালোবাসো। তাই তোমার উচিত আমাকে মেনে নেওয়া। আর যত যাই বলো নাফিসা কিন্তু আমার স্ত্রী ন। আর এখন একমাত্র ইসলামিক দৃষ্টি কোণ থেকে আমরা স্বামী স্ত্রী। সুতরাং তোমার আর আমার বিষয়টা কখনও নাফিসার সাথে তুলনা যোগ্য না।

– তুমি বড্ড হাসালে অরন্য। আমাকে মাফ করো। নাফিসাকে তুমি কী করবে আমি জানি না। তবে এ সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে আমি মুক্তি চাই। আমি কখনও তোমাকে মেনে নিতে পারব না।

বলেই কলটা কেটে দিলাম। দিন দিন জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে আটকে যাচ্ছি। জানি না এর ভবিষ্যত কী। তবে আপাতত আাবিরকে সবটা বলতে হবে।

পরদিন সকালে তৈরী হয়ে কলেজে গেলাম। ক্লাস নিলাম যথারিতী। তারপর আবিরের কাছে গেলাম। আবির তখন ঘুমাচ্ছিল। আবিরের পাশে বসতেই সে আমার দিকে তাকাল ঘুম ঘুম চোখে। আমি আবিরের মাথায় আলতো হাত রেখে বললাম

– শরীর কেমন?

– এখন ভালো।

– আমার কিছু কথা ছিল। কথা গুলো শুনার পর তোমার যদি কষ্ট হয় আমাকে ক্ষমা করে দিও।

আবির আমার হাতটা তার বুকে নিয়ে বলল

– কী বলবে বলো।

আমি মৃদু গলায় বলা শুরু করলাম। বুঁকটা কাঁপছিল বলার সময় তবুও বলতে লাগলাম।

চলবে

প্রাক্তন পর্ব-১০

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১০

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

– কথাগুলো হয়তো তোমার শুনতে খারাপ লাগবে তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি। আর সবকিছু মিলিয়ে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

– জি মা বলুন। আমি শুনতে প্রস্তুত।

– দেখো কালকে এনগেজমেন্ট হওয়ার পর থেকেই ঝামেলা হচ্ছে শুধু। একের পর এক দূর্ঘটনা। আমার মাকে আমি বিষয়টা বলার পর আমার মা ও বলল এটা কোনো ভালো লক্ষণ না। তোমরা এ যুগের মেয়ে আবিরও এ যুগের ছেলে তোমাদের কাছে এসব কুসংস্কার ছাড়া কিছু না।

মায়ের কথা শুনে একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কারণ অরন্যের ব্যপারটা তাহলে মা দেখে নি। কিন্তু এখন কী মা এসব বলে বিয়ে ভেঙ্গে দিবে। বুকের ভেতরটা মুচড় দিয়ে উঠল। মুখটা ক্রমশেই মলিন হয়ে গেল। দৃষ্টি নীচের দিকে চলে গেল। কী বলব বুঝে উঠতে পারছি না। মা আমার থুতুনী ধরে মুখটা উপরে তুলে বলল

– কথাগুলো শুনে কী মন খরাপ লাগছে?

মায়ের মুখে মৃদু হাসি। হাসিটা দেখে কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলাম । তাই বেশ হালকা সুরে বললাম

– না মা মলিন কেন হবে? আপনি যা বলছেন আমি বুঝতে পেরেছি। এখন কী করতে হবে বলুন।

মা আমার কথা শুনে অট্ট হাসি দিয়ে বললেন

– পাগল মেয়ে এটা কী তুমি বাংলা সিনেমা পেয়েছো? তোমার কী মনে হয় আমি ডাইনি শ্বাশুরি তোমাকে বলব আমার ছেলের জীবন থেকে সরে যেতে? এতটা অসামাজিক আমি না। কুসংস্কার আমিও বিশ্বাস করিনা। তবে যা হচ্ছে সেটা ইতিবাচক ভাবেও নিতেও পারছি না। তাই আমি সব ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাদের চার হাত এক করে দেবো তাড়াতাড়ি। বিয়ে পড়িয়ে রাখব পরে তুলে আনব তোমায়। তোমার কোনো আপত্তি নেই তো? এক মাসের মধ্যে একটা তারিখ দেখে বিয়ের দিনক্ষণ পাকা করতে চাই। আমার মনে হয় এতে সব ঝামেলা দূর হবে। তোমার পরিবার কী বিষয়টা মেনে নেবে?

উনার কথা শুনে আমার চোখের জল ছলছল করতেছে। একটা মানুষ আমাকে এত বুঝে। আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা আমাকে ধরে বলল

– কী হয়েছে?

– প্রথমে ভেবেছিলাম আর সবার মতো আপনিও এসবের জন্য আমাকে দায়ী করবেন। আপনার গম্ভীর মুখটা দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম। এখন বেশ প্রশান্ত লাগছে। এতটা ভালো আপনি আমি যত বলব তত কম হবে।

মায়ের হাতটা আমার মাথার উপর দিয়ে হাত বুলাতে লাগল। আর আলতো গলায় বলল

– প্রথমে আমি একজন মেয়ে তারপর একজন মা। আমি মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের স্বপ্ন তো নষ্ট করতে পারব না। আবিরের মা হলেও আমি মায়ের জাত তোমার ও মা। একজন মা হয়ে মেয়েকে অপয়া অলক্ষী বলব ভাবলে কী করে। এগুলো হয়তো সাময়িক বিপদ আসতেছে তবুও মনটা আনচান করছে তাই তোমাকে এভাবে বলা। মা রে তোমার মায়া ভরা মুখটা আমার মনটা গতকালকেই কেড়ে নিছে। তুমি যে আমার বউমার জায়গা না মেয়ের জায়গা দখল করে রেখেছো। তোমার মা বাবা রাজি হয় কি না এ অবস্থায় বিয়ে দিতে সে চিন্তায় আছি।

আমি মায়ের বুক থেকে মাথাটা তুলে বললাম

– মা আমি রাজি করিয়ে নিব। উনারা আমার কথায় রাজি হবেন।

মা আমার কপালটা টেনে কপালে চুমু দিয়ে বলল

– আমার লক্ষী মেয়েটা। যাও আবিরের কাছে যাও। খাবার দিয়ে আসার সময় তোমাকে খুঁজতেছিল। আর অপ্সরা আরেকটা কথা অরন্যের ব্যপারে।

অরন্যের কথা বলতেই আমার বুকটা কম্পন দিয়ে উঠল। আমি হালকা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম

– কী কথা?

উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

– অরন্যকে আমি ছেলের মতো দেখি। তিন বছর যাবত আমার বাসায় আসে যায়। কত করে বলেছি এ বাসায় যেন থাকে কিন্তু তবুও আলাদা বাসা নিয়ে থাকে। ওর জীবনে একটা বড় ঝড় বয়ে গেছে সেটা আমি ছাড়া কেউ জানে না। আবিরও না। অরন্য আবিরের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে অনেক। সেদিনের পর থেকে অরন্যও আমার ছেলের জায়গা দখল করে আছে। ওর জীবনটা ছন্নছাড়ার মতো।

মায়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে আবির অরন্যের অতীত না জানলেও মা কিছুটা জানে। আমি মায়ের কথা আটকে দিয়ে বললাম

– কেন মা কী হয়েছে? কী ঝড় বয়ে গেছে।

– সেটা অন্য একদিন সময় করে তোমাকে বলব। শুনো অরন্যকে গতকাল থেকে কেমন জানি ছন্নছাড়া লাগছে তুমি পারলে একটু কারণটা জানার চেষ্টা করো। আর ওর খাবারটা টেবিলে রেখেছি তুমি একটু দিয়ে এসো। আমি এখন নামাজে দাঁড়াব। পারবে না মা এটুকু করতে?

যদিও অরন্যের খাবার নিয়ে যেতে আমার একদম ভলো লাগছে না তবুও মুখে হাসির রেখা টেনে বললাম

– হুম পারব।

মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবিরের কাছে আসলাম। যতদ্রুত সম্ভব আবিরকে সবটা বলা জরুরি। এ দোটানা নিয়ে থাকা যাবে না। আর এ খেলায় আবির নিরপেক্ষ একদম নির্দোষ। বরং এখানে আবিরের কাছ থেকে লুকিয়ে আমি আবিরকে ঠকাচ্ছি। বিষয়গুলো আজকে না বলে কাল পরশু আবিরকে সবটা বলব। এর মধ্যে আবির আমায় হালকা সুরে ডেকে বলল

– অপ্সরা সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছো। কোনো সমস্যা? কিছু ভাবছো নাকি?

আবিরের মোলায়েম কন্ঠ শুনে আমি আবিরের দিকে তাকালাম। তার পাশে বসে হাতটা ধরে বললাম

– মা চাচ্ছে আমাদের বিয়েটা যেন তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। এ মাসেই বিয়েটা সেড়ে ফেলতে চাচ্ছে।

কথাটা শুনে আবিরের মুখে ফিনকি হাসির রেখা সে সাথে মলিনতার টানও আছে। শান্ত গলায় জবাব দিল

– বিয়েতে তো আমার আপত্তি নেই। কিন্তু এ মাসে বিয়ে কী করে সম্ভব বলো। আমি তো সুস্থ হব না একমাসের মধ্যে।

– মা চাচ্ছে বিয়ে পড়িয়ে রাখতে পরে প্রোগ্রাম করবে। তুমি কী চাও?

আবির কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বলল

– তুমি মাকে কী বলেছো?

– আমি সম্মতি দিয়েছি।

– তাহলে তো সমস্যা নেই। তোমরা যা বলবে তাই হবে।

– কিন্তু আবির আমার কিছু কথা ছিল। আমি তোমাকে বলেছিলাম না আমার একটা অতীত আছে।

– হ্যাঁ। আর সেটা অতীত বর্তমান তো না। অতীত নিয়ে বলার দরকার নেই। বর্তমানে ভালো আছি এটাই যথেষ্ট নয় কী? আর আমি তোমাকে ভালোবাসি সেটা বর্তমান দেখেই, অতীত নিয়ে মাথা ব্যথা নেই।

– কিন্তু আবির অতীতটা যদি কোনোদিন এসে বর্তমানের সুখ কেড়ে নেয় সে ভয়ে আছি।

– কাড়তে পারবে না। আমি পাশে থাকব তোমার।

– আবির বলাটা অনেক সহজ তবে করতে গেলে দেখা যাবে সেটা অনেক কঠিন।

– কী হয়েছে অপ্সরা বলবে একটু পরিষ্কার করে? গতকাল থেকেই তোমার মধ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করছি।

– তেমন কিছু না। কিছু একটা থেকে নিজেকে লুকিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। সেটাই এখন সামনে এসে বাঁধা দিচ্ছে।

– হেয়ালি রেখে সোজাসুজি বলো।

– আজকে নাহয় না বলি। একটু বিশ্রাম করো। ঘুৃমানোর চেষ্টা করো। কালকে এক সময় এসে বলব। কলেজ থেকে আসব তিনটায়। কলেজ থেকে বাসায় না গিয়ে সরাসরি এখানে চলে আসব। তোমার সাথে সব কথা শেষ করে শান্ত মনে বাসায় যাব। আমি চাইনা তোমার কাছে কিছু লুকানো থাকুক। আমি চাই তুমি সবটা জানো। তারপর তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে মেনে নেব।

– এবার থামো তো। কালকের কথা কালকে ভাবা যাবে। তুমি কী খেয়েছো?

– নাহ!

– তাহলে আমার সাথে খেয়ে নাও। এখানে মা স্যুপ দিয়ে গেছে। তুমিও খাও আমাকেও খাইয়ে দাও। আর অরন্য কী খেয়েছে?

– ভাইয়া খয়নি। তুমি আগে খেয়ে নাও।

– আমার আর তোমার খাওয়া শেষ হলে অরন্যকে মনে করে খাবার দিও। মা কোথায়?

– নামাজে দাঁড়িয়েছে।

আবির আর কোনো কথা বলল না। আবিরকে স্যুপটা খইয়ে দিলাম সে সাথে নিজেও খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষে আবিরকে বিশ্রাম করতে বলে অরন্যের জন্য খাবার নিয়ে গেলাম। অরন্য আমাকে দেখেই উঠে বসল। আমি অরন্যকে খাবারটা এগিয়ে দিয়ে বললাম

– আমাদের বিয়ের কাগজ তোমার কাছে থাকলে একটু প্রস্তুত রেখো। আমি তোমাকে খুব শীঘ্রই ডিভোর্স দিতে চাই। যে সম্পর্কের কোনো শেকড় নেই সে সম্পর্কের ডালপালা রেখে লাভ নেই।

– কিন্তু আমি তো তোমাকে ডিভোর্স দিব না। আর এ সম্পর্কের জোরেই তোমাকে আমার করে নেব।

– তুমি আমাকে কখনও পাবে না। শুধু শুধু সহ্যের পরীক্ষা নিচ্ছ অরন্য।

– সেটা দেখা যাবে। তুমি খেয়েছো?

– আমার খাবার নিয়ে না ভাবলেও চলবে।

কথাটা বলেই রুম থেকে চলে আসলাম। খানিকক্ষণ পর মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় আসলাম। বাসায় আসার পর থেকেই মনটা বেশ ছটফট করে আছে। কালকে আবিরকে বললে আবির বিষয়টা কীভাবে নিবে জানি না। আবিরের মা সবটা জানার পর কী করবে সেটাও জানা নেই। অরন্যকে ডিভোর্স দিব কীভাবে কাগজ পত্র ছাড়া তাও জানি না।

একটা সময় এ অতীতটাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইতাম। আর আজকে অতীতটা আমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাচ্ছে। সময় সত্যিই রঙ বদলের পালা নিয়ে বাহিত হয়। একটা সময় অরন্যকে আমি পেতে চাইতাম। আজ অরন্য আমায় পেতে চাচ্ছে। আচ্ছা এটাকেই প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে।

ভাবতেই ভাবতেই মনে হলো অরন্যের আইডিটায় একটু অন্য আইডি দিয়ে পরিচয় গোপন করে মেসেজ দিলে কেমন হয়। যদি নাফিসার কাছ থেকে কোনো তথ্য জানা যায়। যদিও অতীত নিয়ে ঘাটা ঠিক না তবুও কখন কী কাজে লেগে যায় বলা যায় না। আমি চট করেই আমার একটা পুরনো আইডির নাম পরিবর্তন করে অরন্যের আগের আইডি যেটা অরন্য দাবি করছে যে এ আইডিটা নাফিসার কাছে সে আইডিতে রিকুয়েষ্ট দিলাম। অন্য একটা মেয়ের ছবি দিয়ে আইডিটা সাজালাম যাতে করে ফেক না ভাবে। আমার এক বান্ধবীর ছবি ব্যবহার করেছি। অরন্য তাকে চেনে না আর নাফিসাও না। আইডিটা যার কাছেই থাকুক না কেন এতে কারও সন্দেহের দৃষ্টিতে আমি যাবার কথা না।

রিকুয়েষ্ট দেওয়ার মিনেট ৩০ পর রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট হলো। আমি আইডিটা ভালো করে ঘুরে দেখালাম। আইডিটা ঘুরার পর নতুন সূত্র আবিষ্কার করলাম। সেই সাথে নতুন প্রশ্ন নতুন কাহিনির সূত্রপাত ঘটল।

চলবে

প্রাক্তন পর্ব-০৯

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৯

কারণ অরন্য আমার হাতটা চেপে ধরে বলল

– একটা সময় তুমি আমাকে পেতে চাইতে। তখন তো বলেছিলে আমার জন্য তুমি সারাজীবন অপেক্ষা করবে। এখন এমন কেন বলছো?

– এগুলো আবেগে বলেছিলাম। আর সবচেয়ে বড় কথা যে জায়গায় তুমি কথার বরখেলাপ করতে পার সেখানে আমি কেন পারব না। কারও জন্য কারও জীবন থেমে থাকে না। জীবনও সময়ের গতিতে রঙ বদল করে। তুমি আমার জীবনে মিশে থাকা অস্তিত্বে ছিলে, এখন নেই। এখন তুমি শুধু একটা অতীত এর বাইরে কিছু না। এর বাইরে তোমাকে আমি কিছু ভাবতেও পারব না। দয়াকরে আমার পিছু ছাড়ো। আমি চাই না আমার জীবনে কালো অতীতটা আবার ফিরে আসুক।

কথাটা বলতেই অরন্য আরও জোরে হাতটা চেপে ধরল। আশে পাশের মানুষগুলো বেশ অদ্ভুত ভাবে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল। কখনও আশাও করি নি অরন্য আমার জীবনে ফিরে এসে আমাকে পাবার জন্য এতটা পাগলামি করবে। আমি হাতটা জোরে ছাড়িয়ে নিলাম। অরন্য আর আমার আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে আমরা স্কুল কলেজে পড়ি। আমি কিছুটা রেগে গিয়ে পুনরায় বললাম

– যথেষ্ট বয়স তোমায় হয়েছে। এভাবে রাস্তায় কেন এমন করছো। পাগল হয়ে গেছো তুমি? নাকি তুমি অসুস্থ।

কথাটা বলার সাথে সাথে অরন্য আমার হাতটা আবার চেপে ধরে বলল

– আমি জানি তোমার মধ্যে অভিমান জমে আছে। আমার প্রতি তীব্র কষ্ট জমা হয়ে আছে। তোমার সব অভিমান মুছে দিব। আমিও দেখব তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও কীভাবে। দেখো হয়তো আল্লাহও চায় আমি আর তুমি এক হই। তাইতো হুট করে আবিরের এক্সিডেন্ট হয়ে তোমাদের বিয়েটা আটকে যায়।

– দিবা স্বপ্ন দেখা বন্ধ করো৷ আমার পেছনে না লেগে সামনে এগিয়ে যাও। মানুষের জীবনে দূর্ঘটনা ঘটেই সেটার জন্য নিজের জীবন থামিয়ে না দিয়ে গুছিয়ে নাও। আর আমি তোমাকে ভালোবাসতাম। এখন তোমাকে বাসি না। ভালোবাসতাম আর ভালোবাসি এর মধ্যে যথেষ্ট তফাৎ রয়েছে। আমাকে ছাড়ো।

কথাটা বলেই অরন্যের কাছ থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে শহীদ মিনার থেকে বের হয়ে এসে রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম। এমন সময় চিৎকারের আওয়াজ কানে ভাসলো। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম অরন্য রাস্তায় পড়ে আছে। তার কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। তাকে একটা বাইক এসে ধাক্কা দিয়েছে। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ওকে ছেড়ে আবিরের কাছে যাব নাকি ওকে গিয়ে ধরব। কিন্তু মানবিকতা মনুষ্যত্ত্ব বলতে একটা কথা আছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। অরন্যের কাছে গেলাম। তার মাথা ফেটে গড়গড় করে রক্ত পড়ছে। গত এক্সিডেন্টের আঘাতে আবারও আঘাত পয়েছে। অরন্যকে গিয়ে ধরলাম।হাতটা ধরে তুলে ইমারজেন্সির দিকে এগুতে লাগলাম। অরন্য আমার হতটা শক্ত করে ধরে আছে। আমি অরন্যেকে তার মাথাটা চেপে ধরতে বললাম অন্য হাত দিয়ে। সে মৃদু গলায় বলল

– তোমার হাত দুটো ধরতেই আমার বেশ ভালো লাগছে।

আমি অরন্যের কথার কোনো জবাব দিলাম না। একদম চুপ হয়ে গেলাম। ইমার্জেন্সিতে নেওয়ার সাথে সাথে অরন্যের মাথাটা পুনরায় বেন্ডেজ করে দিল। অরন্য এখন সুস্থ। এর মধ্যে আবির বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে ধরতে পারে নি। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে আবিরকে কল দিলাম। আবির বেশ উত্তেজিত গলায় বলল

– অপ্সরা সেই কখন বলেছো আসতেছো এখনও কী আসো নি? আর অরন্যও কোথায় যেন গেল কল ধরতেছে না।

আমি চাপা গলায় বললাম

– আমি অরন্য ভাইয়ার সাথে।

আবির কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল

– অরন্য তোমার সাথে?

– হ্যাঁ আবির অরন্য ভইয়া আমার সাথে।আমি এসেছি অনেক আগে। এসে দেখলাম উনি রাস্তার পড়ে আছে। আবারও এক্সিডেন্ট করেছে। এখন উনি একটু ভালো। উনাকে নিয়ে আসতেছি। সেজন্যই আমি আর উনি তোমার কল ধরতে পারে নি। তোমার শরীর কেমন এখন?

– এখন তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। জানি না কী হচ্ছে এসব। গতকাল এনগেজমেন্ট হওয়ার পর থেকেই শুধু অঘটন ঘটছে। কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। তুমি আসো তাড়াতাড়ি। ভালো লাগছে না একদম। আর অরন্যকে পারলে সাথে নিয়ে এসো।

– হুম আসতেছি এখনি। আরেকটু অপেক্ষা করো। আর সরি।

– সরি কেন?

– এই যে কল ধরতে পারিনি। মনে হচ্ছে আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি।

– বোকা মেয়ে একটা।

বলেই আবির হেসে দিল। আমি আবিরের হাসি দেখে কৌতুহল গলায় বললাম

– হাসছো কেন এভাবে?

– তোমার বোকা বোকা কথা শুনে। সমস্যা তো হতেই পারে অপ্সরা এতে এত আপসেট হওয়ার কিছু হয়নি। যাইহোক জলদি আসো।

আমি কলটা কেটে অরন্যকে বললাম

– আমি আবিরের কাছে যাচ্ছি তুমি এখানেই থাকো।

– আমিও তোমার সাথে যাব।

– এ শরীর নিয়ে তুমি এখন আবিরের কাছে যাবে নাকি? আর ঢাকা মেডিকেলের অবস্থা তো জানো। এমনিতে সিটের সংকট ঐখানে গিয়ে ঠিক মতো বসতেও পারবে না। আর আবিরের মাকেও বলা হয়নি। উনাকেও বলতে হবে। তোমার মনে হয় এখানে থাকলেই ভালো হবে। অরন্য দয়াকরে আর কোনো ঝামেলা করো না।

– ঝামেলার কী দেখছো এখানে? আমিও তোমার সাথে যাব। এখানে এভাবে শুয়ে থাকতে একদম ভালো লাগছে না আর আমার শরীর একদম ঠিক আছে।

অরন্য বেশ নাছোরবান্দা আমার সাথে সে যাবেই বুঝায় যাচ্ছিল। অরন্যকে নিয়েই আবিরের কাছে গেলাম। অরন্যকে আবিরের সিটের এক পাশে বসিয়ে আমি আবিরের দিকে তাকালাম। আবির আমাকে দেখে হালকা হেসে বলল

– প্রিয়তম এখন কী আমাকে দেখে চিন্তা কমেছে। একদম পাগলের মতো হয়ে গেছিলে। দেখো আমি একদম সুস্থ আছি।

আবিরের দিকে তাকালাম আমি। আবিরের চোখ গুলো আমার দিকে আবদ্ধ করা। আবিরের চোখে এক ভালোবাসার ছন্দ খুঁজে পাচ্ছিলাম। এ মানুষটার চাহনি এত নিষ্পাপ যে সে চাহনিতে নিমেষেই হারিয়ে যাওয়া যাবে।

– আমি জানি তোমার কিছু হবে না। আমি তোমার পাশে আছি সবসময় পাশে থাকব। ভালোবাসি আবির। কখনও সামনাসামনি বলা হয়নি আজকে বললাম। আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। কখনও ছেড়ে যাব না। সবসময় তোমার পাশে থাকতে চাই।

আবির হেসে দিয়ে অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল

– অরন্য তুই কিন্তু সাক্ষী অপ্সরা আমাকে কখনও ছেড়ে যাবে না ওয়াদা করেছে।

আবিরের কথা শুনে আমি অরন্যের দিকে তাকালাম। অরন্যের মুখটা কালো মেঘে ছেয়ে আছে। ঠিক চার বছর আগে অরন্যের বিয়ে শুনে যতটা বিরহ আমার মুখে ফুটে উঠেছিল সে বিরহ আজ অরন্যের মুখে। সৃষ্টিকর্তা ঠিকেই সব ফেরত দেন। আজকে মনটা কেন জানি না প্রাশান্ত লাগছে। অরন্য মৃদু গলায় বলল

– হুম। তবে সময় কখন কোন প্রান্তে কাকে নিয়ে যায় বলা যায় না।

আবির অরন্যের কথা শুনে অরন্যের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বলল

– তোর হেয়ালি কথার মানে বুঝতে পারছি না।

– সব তুই বুঝবি না। সময় হোক এমনিই বুঝবি।

– সব বুঝতেও হবে না। শুন অরন্য আমার বিয়েটা হলে অপ্সরার দায়িত্ব হবে তোর অপরাজিতাকে তোর জীবনে নিয়ে আসা। জানো অপ্সরা অরন্য একটা গাধা এ পর্যন্ত তার ভালোবাসার মানুষটাকে এখনও ভালোবাসি বলতে পারেনি।

আমার চোখে মুখে তখন বিরক্তির ছাপ। আমি বিরক্ত নিয়ে বললাম

– মানুষের সব চাওয়া তো পূরণ হয় না আবির। এমনও হতে পারে অপরাজিতা অন্য কারও হয়ে গেছে। অরন্য ভাইয়া কী জানে অপরাজিতা এখনও একা নাকি অন্য কেউ তার স্থান দখল করে আছে।

অরন্য আমার কথাটা কেড়ে নিয়ে বলল

– আমি জানি আমার অপরাজিতা এখনও আমারেই আছে। সময়ের কড়ালগ্রাসে হয়তো একটু বদলে গেছে তবে তার সে বদলে যাওয়ার পেছনে যে অভিমানটা আছে সেটা ঠিকেই আমি ভালোবেসে ভেঙ্গে দিব।

অরন্যের কথা শুনে আবির বিস্মিত গলায় বলল

– তোর কী অপরাজিতার সাথে কথা হয়েছে?

– বলার সময় চলে যায়নি। এখন তুই চুপ কর তো আবির। বিশ্রাম কর। আর আন্টিকে বল তোর এক্সিডেন্ট হয়েছে।আন্টি অনেকবার কল দিয়েছে আমি এটা সেটা বলেছি। এখন আন্টিকে বুঝানোর ব্যবস্থা কর। অপ্সরাকে দায়িত্ব দে, ও ঠিকেই বুঝিয়ে ফেলবে। ও আবার এসব ভালো জানে। কীভাবে কী করতে হবে ওর থেকে ভালো কেউ পারবে না।

– আরে অরন্য তুই কী অপ্সরাকে চিনিস নাকি? যেভাবে বলছিস মনে হচ্ছে তুই ওকে চিনিস।

অরন্য চুপ। দৃষ্টি নীচের দিকে। এদিকে আমার বুকের ভেতরটা প্রবল বেগে কম্পন দিচ্ছে। অরন্যের মতিগতি ভালো না কখন কী করে বসে বলাও যায় না। এর মধ্যেই অরন্য বলে উঠল

– আজকে চিনলাম ভালো করে। আমার এক্সিডেন্টের বিষয়টা এত সুন্দর করে হ্যান্ডেল করেছে যে কী বলব। সে বিশ্বাস থেকে বলছি।

– তা ঠিক বলেছিস। অপ্সরাকে যতদূর চিনি এটা ঠিক যে ওর মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা প্রখর। জানিস অরন্য অপ্সরা আজকের এ পজিশনে এসেছে নাকি বড় একটা ধাক্কা খেয়ে। জানি না কী ধাক্কা তবে সে সত্যিই একটা সাহসী নারী।হতাশায় ডুবে না গিয়ে নিজেকে গড়ে নিয়েছে। এজন্যই অপ্সরাকে আমার অনেক পছন্দ।

আবির আর অরন্যের কথোপকথন যতই চলছিল ততই আমার অস্থিরতার মাত্রা বাড়তে লাগল। আবিরকে সবটা জানানো দরকার। সব জানার পর আবির যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই মেনে নেব।সব আড়াল করে আমি আবিরকে এক প্রকার ঠকাচ্ছি যেটা আমার একদম উচিত হচ্ছে না।তবে এ মুহূর্তে আবিরকে বলা উচিত হবে না। আবির একটু সুস্থ হোক তারপর আবিরকে সবটা খুলে বলব। এখন এদের কথোপকথন আমাকে থামাতে হবে। তাই তাদের কথায় ব্যাগরা দিয়ে বললাম

– হয়েছে এখন এত কথা বলতে হবে না। আর আবির ঢাকা মেডিকেলের যে অবস্থা এখানে থাকার চেয়ে বাসায় চলে গেলে সবচেয়ে ভালো হয়। আর মাকে এখন কল দিয়ে এখানে আনার চেয়ে তোমাকে বাসায় নিয়ে গিয়ে মাকে সবটা বললে ভালো হয়। আর চিন্তা করো না। আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাব না।

আবিরও আমার কথায় সম্মতি দিল। আমি আবির আর অরন্যকে নিয়ে বাসায় গেলাম।বাসায় যেতেই মা আবিরকে আর অরন্যকে এ অবস্থায় দেখে চিৎকার করে উঠল।আমি মাকে স্থিত গলায় বললাম

-মা চিৎকার করবেন না। আবির ঠিক আছে। তিনমাস একটু বিশ্রাম নিলেই হবে। আর মা চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে।বিপদ আল্লাহ দেয় পরীক্ষা করার জন্য।অবশ্যই এ বিপদের পরিবর্তে উত্তম কিছুই রেখেছেন আমাদের জন্য। আপনি একটু স্থির হোন।

মা আমার কথায় কান্না থামাল। আমি আবিরকে খাটে শুইয়ে দিলাম।আপাতত আবির হাঁটা চলা করতে পারবে না। আবিরকে শুইয়ে আবিরের রুম থেকে বের হতে নিলাম আবিরের জন্য খাবার আনতে।অরন্যও আমার সাথে বের হলো। দরজা পার হতেই অরন্যের মাথাটা ঘুরে গেল।আমি হন্তদন্ত হয়ে অরন্যকে ধরলাম। কিছুটা শক্ত করেই জড়িয়ে ধরে পাশের রুমে নিয়ে গিয়ে অরন্যকে শুইয়ে দিলাম। অরন্যকে শুইয়ে রুম থেকে বের হতে নিলেই অরন্য আমার হাতটা টেনে ধরে বলল

– অপরাজিতা প্লিজ যেও না পাশে একটু বসো।

অরন্যের প্রতি কেন জানি না হালকা মায়া জমলো।তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে বের হতেই বুকটা কেঁপে উঠল। আবিরের মা দরজার সামনে দাঁড়ানো। আমার চোখ মুখ আবছা হয়ে গেল ভয়ে। উনি আমাকে দেখে বলল

– আবিরকে খাবার দিয়ে এসেছি। আর তোমার সাথে আমার একটু কথা আছে। আমার রুমে এসো।

কথাটা বলেই মা মায়ের রুমের দিকে এগুতে লাগল। আর আমি মায়ের পিছু পিছু যেতে লাগলাম। ভেতরটা কাঁপতে লাগল। মা রুমে প্রবেশ করল আমিও মায়ের সাথে রুমে প্রবেশ করলাম। মা খাটের কোণে বসে আমাকে তার পাশেই বসতে বলল। মায়ের মুখটা গম্ভীর । এটা নিশ্চিত মা এখন যে কথাটা বলবেন সেটা আমাকে নিয়েই। আমি চুপ হয়ে মায়ের পাশেই বসলাম। মা মুখটাকে আরও গম্ভীর করে আমার দিকে তাকাল। তারপর

চলবে

প্রাক্তন পর্ব-০৮

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৮

হয়তো কথাগুলো সে গুছাচ্ছে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– নাফিসার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে আড়াই বছর পার হয়েছে। বিয়ের এক বছর পরেই ডিভোর্স হয়ে যায়।

আমি অবাক হয়ে গেলাম অরন্যের কথা শুনে।নাফিসার সাথে যদি তার ডিভোর্সেই হয়ে থাকে তাহলে এক বছর আগে কেন ছবি আপলোড করেছে। কিছুটা সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– তেমার যদি ডিভোর্সেই হয় তাহলে এক বছর আগে কেন নাফিসার সাথে ছবি আপলোড করেছো? কারণটা কী জানতে পারি?

– সে কারণ আমিও জানি না। আমার আগের আইডিটা বিয়ের সাতদিনের মাথায় নাফিসাকে পাসওয়ার্ড দিয়ে দিছিলাম। কারণ নাফিসা তোমার ব্যপারে জেনেই আমাকে বিয়ে করেছিল। সন্দেহ ছিল ওর আমার প্রতি তাই পাসওয়ার্ড দিয়ে দিছিলাম। ডিভোর্সের পর ও আইডিটা পুরোপুরি সব পরিবর্তন করে যার দরুণ আমি আইডিতে ঢুকতে পারি না। আইডিটা দিয়েই নাফিসা ডিভোর্সের পর আমার উপর মিথ্যা অপবাদ চাপায়।

অরন্যের কথাগুলো বুঝতে পারছিলাম না। বরাবরেই কথার বেড়াজালে আটকে পড়ছিলাম। তাই কিছুটা প্রশস্ত গলায় বললাম

– প্রথম থেকে কাহিনি বলো।

অরন্য কাহিনি বলা শুরু করলো। অরন্যের কাহিনি শুনে বারবার মনে হচ্ছিল আমার অতীতের গ্লানি মাখা স্মৃতিগুলো সামনে ভাসছে। অরন্য চাপা গলায় বলল

– আমি জানি না আমার কী হয়েছিল কেন এই ভিমরতি ধরেছিল। আমি তোমাকে ভালোবাসাতাম না এটা ভুল কথা। তোমাকে আমি ভালোবাসতাম তবে সেদিন আমি লোভে পড়ে যাই। তোমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে আমাকে আমার বন্ধু শরীফ নাফিসাকে দেখতে নিয়ে গেছিল। নাফিসা দেখতেও সুন্দর ছিল। ডাক্তার ছিল।

নাফিসাকে দেখে আসার পর শরীফ বলল

– অরন্য…অপ্সরা তোর জন্য কখনও পারফেক্ট না।অপ্সরা দেখতে শুনতে সুন্দর এর বাইরে কিছু নেই ওর।

আমি হালকা গলায় বললাম

– অপ্সরার এমনিতে গুণ আছে। ও অনেক কেয়ারিং, গুছালো। সবচেয়ে বড় কথা ও আমার কথা শুনে। আর চারিত্রিক কোনো সমস্যা ওর নেই। সেই ছোট থেকে ওকে চিনি। বয়স যখন ওর তেরো, তখন ভালোবাসি শব্দটা বলতেও পারত না এর আগেই ও হেসে দিত। সেই থেকে আমাদের ভালোবাসার শুরু। অপ্সরাকে ঠকানো ঠিক হবে না। আর অপ্সরা ভালো একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়তেছে। ও একদিন ভালো করতে পারবে। ও ঘরের সব কাজ করে। গুণ আছে মাশাআল্লাহ। ওর রান্নার হাত ও বেশ ভালো।

– দেখ আমি তোর বন্ধু তোর খারাপ কখনও চাইব না নিশ্চয়। অপ্সরা ভালো তা ঠিক আছে। তবে তোর যোগ্য না। ভালো সাবজেক্টে পড়লেও ভালো কোনো ভার্সিটিতে পড়ে না। আর ঘরের কাজ সেটা সব মেয়েই পারে। নাফিসাকে যতদূর চিনি সেও সব কাজ পারে। নাফিসা ডাক্তার। দেখতেও সুন্দর। আর মেডিকেল, ননমেডিকেল বড় একটা ফ্যাক্ট। তোর ব্যস্ততা অপ্সরা বুঝবে না। ডাক্তারদের জীবন সম্পর্কে তার ধারণা কম। আর নাফিসার সাথে তোর বন্ডিং ও ভালো হবে। দুজন একসাথে চাকুরি করবি। সমাজে একটা পরিচিতিও থাকবে। সবশেষে তোরা ভালো থাকবি। ভেবে দেখতে পারিস।

সেদিন শরীফের কথাগুলো মনে গেঁথে গেছিল। বাসায় আসলাম। আসার পর তোমার কল পেলাম। কেন জানি না সেদিন তোমাকে মনে হচ্ছিল আমার পারফেক্ট না। তোমার কথাবার্তা সেদিন কেন জানি না আমার কাছে মনে হচ্ছিল ইম্যাচুউরের মতো। তোমার পাগলামি গুলো ভালো লাগলেও সেদিন খুব বিরক্ত লাগছিল। তবুও তোমার সাথে হাসিমুখে কথা বলছিলাম। বেশ দুটানা নিয়ে ছিলাম। মাঝে মাঝে তোমার সাথে কথা বলতাম ভালো করে আবার তোমাকে উল্টা পাল্টা বলতাম। তুমি একবার আমার কথা শুনে কাঁদতে আবার হাসতে। আমি তোমাকে এ হাসি, কান্নার খেলায় মাতিয়ে রাখতাম এটা আমি মানতে নারাজ ছিলাম। আমার ধারণা ছিল তুমি সাইকো তাই একবার হাসো একবার কাঁদো। আস্তে আস্তে তোমার দূর্বলতা প্রকাশ পেতে থাকে আর আমার তোমার প্রতি আগ্রহ কমতে থাকে। তবুও দায়িত্ব বলে কথা ছিল,এতদিনের সম্পর্ক নাও করতে পারছিলাম না। এর মধ্যে তোমাকে বিয়েও করেছিলাম। সব মিলিয়ে তোমাকে ছাড়তেও পারছিলাম না। তাই তোমার আর আমার বিয়ের বিষয়টা পারিবারিকভাবে এগুতে লাগল কিন্তু আমি তাতে শান্তি পাচ্ছিলাম না। তোমাকে দেখতাম অনেক খুশি। বিয়েতে কী পরবে, কী করবে সবকিছু বেশ আনন্দ নিয়ে বলছিলে। আমিও তোমার সাথে বেশ নাটক করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মনে মনে বারবার মনে হচ্ছিল তুমি আমার পারফেক্ট না। তোমার থেকে নাফিসা বেস্ট। আমি অবশেষে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। তোমার দূর্বলতা দেখে কেন জানি না আমার আগ্রহ আরও ফিকে হয়ে গেল।

বিয়ের ঠিক আগের দিন মনে হলো আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা উচিত হবে না। মানুষের জীবনে কত কিছুই ঘটে, লুকিয়ে বিয়ের কথা কেউ জানে না সুতরাং সেটা তে তো আর কিছু আসবে যাবে না। বিয়ের আগের দিন মনে হয়েছিল তোমার সাথে আমার বিয়ে হলে আমি সারাজীবন আফসোস করব এটা ভেবে যে আমি এর চেয়ে ভালো ডিজার্ভ করতাম। শরীফকে বলার পরও সে ও বুঝাল। সবমিলিয়ে আমি লোভে পড়ে গেলাম। বিয়েটা ভেঙ্গে দিলাম।

পরিবারকে বুঝালাম আমার ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা করে দাও। আমি অপ্সরাকে বিয়ে করতে চাই না।পরিবারও আমার মতো যোগ্যতার লোভে অন্ধ ছিল। আমার কথা মেনে নিল। আমিও সাহস পেলাম। যার দরুণ বিয়ে ভাঙ্গতে আমার একদম বিবেকে আটকায় নি।

তার একমাস পর নাফিসাকে বিয়ে করি। নাফিসাকে বিয়ে করার পর তিনমাস বেশ ভালোই ছিলাম। তিনমাস পরেই সব এলোমেলো হতে লাগল। সংসারে অশান্তি শুরু হলো। তখন বুঝতে পরেছিলাম তুমি আমার কী ছিলে। নাফিসার অন্যত্র সম্পর্ক বের হলো। সেও আমাকে বিয়ে করেছিল পরিবারের চাপে পড়ে। আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্কের ভাঙ্গন ধরে। প্রতিদিন অশান্তি, প্রতিদিন ঝামেলা। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম টাকা পয়সা দিয়ে সংসার সুখের হয় না। সংসার সুখের হয় একজন মানুষের ভালোবাসায়।

তবুও ওকে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তোমাকে এত ঝামেলা করে বাদ দিয়েছি। এখন সংসার নষ্ট হলে সবাই হাসাহাসি করবে। সেটা ভেবে নাফিসাকে বুঝাতাম। সে বুঝেনি। আমাকে ছাড়বে কীভাবে সেটার মূখ্য কারণ খুঁজতেছিল। আর তখনই ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে আমার ইমেজ নষ্ট করত। বুঝাত আমি নাফিসাকে চাই না,আমার অনেক সমস্যা আছে,আমি পাগল। এসব কারণকে কেন্দ্র করে নাফিসা এক পর্যায়ে পরিবারকে বলে আমাকে ডিভোর্স দেয়। মিথ্যা কতগুলো অপবাদ মাথায় নিয়েছিলাম। সবার সামনে পাগল প্রামাণিত হয়েছিলাম। এক বছর পরেই আমাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে যায়। তোমাকে দেওয়া প্রতিটা আঘাত আল্লাহ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম তুমি আমার কী ছিলে। কিন্তু সাহস করে তোমার সামনে যাওয়ার সুযোগ হয়নি।

অরন্য কাঁদছে। অরন্যের কান্না দেখে আমার মোটেও কষ্ট হচ্ছে না। কারণ অরন্যের এটা প্রাপ্য ছিল। আমি অরন্যকে হালকা গলায় বললাম

– চার বছর আগের একটা কাহিনি কী তোমার মনে আছে?

অরন্য চাপা গলায় বলল

– কোনটা?

আমি আবার অতীতে ডুব দিয়ে অরন্যকে বলতে লাগলাম। সেদিন বিয়ে ভাঙ্গার খবরটা আমার কানে আসে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। বাসা থেকে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে অরন্যকে একরকম জোর করে ধরে আমার বাসায় আনলাম। এর কিছুক্ষণ পর ওর পরিবারও আসলো। দুই পরিবার আলোচনা করতে লাগল বিষয়টা। তাদের একটা কথায় আমি পাগল, আমার মতো পাগল মেয়েকে ঘরের বউ করবে না। আর অরন্যও এমন পাগল মেয়ে বিয়ে করবে না।তবে আমার পাগলামি কী ছিল আমি নিজেও জানি না। অরন্যের প্রতি থাকা ভালোবাসা টা কী আমার সত্যিই পাগলামি ছিল। অরন্যের কাছে গিয়ে বললাম

– শুধু শুধু কষ্ট দিয়ে আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি যদি পাগলামি করেও থাকি তোমাকে ভালোবেসে করেছি। এত বড় অন্যায় আমার সাথে করো না।

অরন্য চুপ কোনো কথায় বলছিল না। হুট করে টেবিলে থাকা ফল কাটার ছুরি নিয়ে সবার আড়াল করে হাতের একটু অংশ কেটে চিল্লায়ে বলল

– এ মেয়ে এখনি আমাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করছে এ পাগল মেয়েকে বিয়ে করলে তো আমাকে বিয়ের পর খুন করে ফেলবে।

আমি অরন্যের কথা শুনে অরন্যের পায়ে ঝাঁপটে ধরে বললাম

– আমাকে ছেড়ে যেও না আমি পাগল না। শুধু শুধু মিথ্যা বলো না।

সবাই আমাকে টানছে ওর পা ছাড়ার জন্য।আর আমি পা টা ধরেই ছিলাম। বাবা,মা ভাই বোন যে আছে সেটা ভুলে গিয়ে শুধু ওর পা ধরেই ছিলাম। মনে হচ্ছিল ওর পা ছেড়ে দিলে আমি ওকে হারিয়ে ফেলব। তাই বেশ জোর করে পা টা ধরে ছিলাম। আর সে ও আমাকে পাগল বলার সুযোগটা আরও পেয়ে গেল। একদিকে পরিবার ওর পা ছাড়ছি না বলে মারতেছে।আরেক দিকে আমি ওর পা ধরে শুয়ে আছি। আমার মা কাঁদতে লাগল। কেঁদে কেঁদে ওরে বলল

– বাবারে আমিও একজন মা। আমার মেয়ের সাথে যা অন্যায় করছো সব তুমি ফিরে পাবে। অভিশাপ দিতে হয় না। তবে কষ্টের দাবদাহ ঠিকেই আল্লাহর কাছে পৌঁছে।

বলেই আমার মা আমাকে টানতে লাগল ছুটানোর জন্য। আমার বড় ভাই আমাকে পিটাতে লাগল পা ছাড়ার জন্য। আর আমি অবুঝের মতো ওর পা টা আকঁড়ে ধরেই ছিলাম। একটা সময় আমার বড় ভাই না পেরে আমার গলা চেপে ধরল। আমি নিস্তেজ হয়ে ওর পা ছেড়ে দিলাম। ও আমাকে বুকে লাথি মেরে চলে গিয়েছিল।

ইশ কত কষ্টটায় না পেয়েছিলাম। অরন্যকে ঘটনা টা মনে করিয়ে দিয়ে বললাম

– নাফিসা তোমাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল কেন জানো? কারণ এটাই তোমার জন্য নির্ধারণ ছিল। সেদিন বিনা কারণে আমি আর আমার পরিবার অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। আমাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করেছিল। একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া স্বাভাবিক কোনো বিষয় না।অনেক কষ্ট সেদিন তুমি দিয়েছো।আমি আল্লাহকে সবসময় বলতাম তোমার কর্মফল যেন তুমি পাও৷ একটা সময় তোমাকে ভুলে গিয়েছি তোমাকে শাস্তি দেবার কথাও বলা বন্ধ করে দিয়েছি। আমি ভুলে গেলেও সেদিন আমার রব ভুলে নি। আজকে যা হয়েছে তোমার সাথে সেটা তোমার কর্মফল।সেদিন তুমি চাপিয়েছিলে আমার উপর মিথ্যা অপবাদ এরপর নাফিসা চাপিয়েছে তোমার উপর। আর এখন নাফিসার মনে কী চলছে সেটা সে জানে। কেন সে আবার তোমার আর ওর পিক আপলোড দিচ্ছে সেই ভালো জানে। তবে আজকে আমার জীবনে ফিরে আসার কথা বলো না। কারণ আমি আবিরকে পাগলের মতো ভালো না বাসলেও সম্মান করি।

কেন জানো?

অরন্যের দৃষ্টি তখন নীচের দিকে। দৃষ্টি নীচের দিক থেকে সরিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি পুনরায় বললাম

– কারণ এই ছেলেটা আমার যোগ্যতা বা সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসে নি। আমার মাথার দিকে তাকিয়ে দেখো চিন্তা করতে করতে চুল পড়ে তালু ফাঁকা হয়ে আছে। চোখের নীচে না ঘুমাতে ঘুমাতে দাগ পড়ে গেছে। চামড়াগুলো আগের মতো সজীব না নির্জীব হয়ে আছে। মুখে ব্রণের দাগে লেপ্টে আছে। আবির যেদিন জিজ্ঞেস করেছিল আমি কী করি। বলেছিলাম আমি বেকার। তবুও আবির আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। কারণ তার চোখে আমাকে আবদ্ধ করেছিল। এ মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে তোমার কাছে ফেরা সম্ভব না৷ আর শুনো অতীত যাইহোক আমি ভুলে গেছি। তুমি যা পেয়েছো তোমার কর্মফল পেয়েছো।

আজকে যদি তুমি আর নাফিসা সুখে থাকতে তাহলে ঠিকেই আমার কথা তোমার মনে পড়ত না।তুমি ঠিকেই আমাকে ইমপারফেক্ট ভাবতে। আজকে তুমি সুখী নও বলেই আমাকে অনুভব করতে পেরেছো। আমি কখনও আমার জীবনে এমন মানুষকে চাই না যে তার সুখের সময়ে ভুলে গিয়ে অসময়ে আমাকে খুঁজে মরে। তুমি নিজেও জানো না তোমার এ সামান্য লোভ আমার জীবনটাকে কতটা যন্ত্রণায় ফেলে দিছিল। আজকে আমার সব আছে সেদিন কিছুই ছিল না। কিন্তু আমি তোমাকে সেদিন পাগলের মতো ভালোবেসেছিলাম।

আমার জন্যও তো কম পাত্র আসেনি৷ তারা তোমার থেকে কম যোগ্য ছিল না। আমি তো লোভে পড়েনি। আমি তো তাদের জন্য তোমাকে বাদ দিই নি৷ তবে তুমি কেন বাদ দিয়েছিলে। কারণ তোমার ভালোবাসায় খাত আছে যেটা আমার ভালোবাসায় ছিল না। তুমি কোনোদিন আমাকে ভালোবাসতে পারো নি। এখনও যেটা আছে সেটা শুধু মোহ, মায়া,।

কথাটা বলেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। উঠে দাঁড়াতেই অরন্য এমন একটা কাজ করে বসলো যেটা আমি আশায় করিনি। অরন্যকে এতটা অদ্ভুত ভাবে আবিষ্কার করব কল্পনাও করেনি।

চলবে

প্রাক্তন পর্ব-০৭

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৭

আমি দৌড়ে ভাড়াটা দিয়ে অরন্যের কাছে যেতেই থমকে গেলাম। অরন্য তখন চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। আমি যতই ওর কাছে যাচ্ছিলাম ততই ভেতরটা মুচরে যাচ্ছিল। তবুও নিজেকে সামলে নিলাম। এত বছর পর ওর সাথে এভাবে কথা বলব সেটা কখনও চিন্তাও করি নি। ওর কাছে গিয়েই বলে উঠলাম

– তোমার সাথে আমার কথা আছে।

অরন্য আমার জোরালো কন্ঠ শুনে আমার দিকে তাকাল। অরন্য তাকাতেই যেন আমার কথার জড়তা বাড়তে লাগল। সে চায়ে চুমুক দিয়ে বেশ সাবলীল কন্ঠে বলল

– কী বলতে চাও বলো?

– তুমি বেশ ভালো করেই জানো আমি কী বলতে চাই। কিসের নাটক শুরু করেছো একটু বলবে? আবির তোমার কী হয়? আর কেনই বা অতীতটা সামনে আনতে চাচ্ছ? কী সমস্যা তোমার? সেদিন কোথায় ছিলে যেদিন সব কিছু লুকিয়ে আমাকে ছুরে ফেলে দিছিলে?

অরন্য চুপ হয়ে আছে। আর ঘন ঘন চায়ে চুমুক দিচ্ছে। কী বলবে হয়তো বুঝতে পারছে না। আর এদিকে আমি এক নিঃশ্বাসে সব বলেই যাচ্ছি। এবার অরন্য আমার দিকে তাকিয়ে তার হাতটা দিয়ে থামতে বলল। আমি কথা থামিয়ে চুপ হলাম।সে আমাকে বলল

– অপরাজিতা এত অস্থির হইয়ো না। তোমার মধ্যে অস্থির ভাবটা এখনও কমেনি।

– এ নামে ডাকার অধিকার অনেক আগেই হারিয়েছ। আমি চাইনা তুমি আমায় এ নামে ডাকো।

– এ নামে ডাকার অধিকার হারায়নি। বরং তোমাকে হারিয়েছি।

– এত জোরালো করে বলছো কীভাবে যে অধিকার হারাও নি? তুমি যেদিন সব ছিন্ন করে দিয়েছো সেদিনেই তুমি সব অধিকার হারিয়ে ফেলেছো। এখন কিসের অধিকার ফলাতে চাচ্ছ?

– তুমি হয়তো আমাদের বিয়ের বিষয়টা বেমালুম ভুলে গেছ। তুমি আমার স্ত্রী সেটা ভুলে যেও না। আর তোমাকে এখনও আমি ডিভোর্স দিই নি। তুমিও দাও নি। সব কাগজ পত্র আমার কাছে আছে। একজন স্বামী বর্তমান রেখে কীভাবে কোন মুখে বিয়ে করতে চাইতেছ?

অরন্যের কথা শুনে মন চাচ্ছিল তার গালে কষিয়ে একটা চড় দেই। তবে অরন্য যে খেলা শুরু করেছে সেটার শেষ আমাকেই করতে হবে। রাগের মাথায় তাকে কিছু বললে বিষয়টা হিতে বিপরীত হতে পারে। এ মুহূর্তে অরন্যের মনে কী চলতেছে সেটা জানার সাধ্য আমার নেই। তবে জানার চেষ্টা করা উচিত। আমি হালকা গলায় বললাম

– আমিও চাই তোমার কাছে ফিরে যেতে। আমিও তোমাকে এতদিনে ভুলতে পারি নি৷ আর তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। অরন্য তুমি আর কিছুদিন আগে আসলে এতটা ঝামেলা তো হত না। আবির নামক কোনো বাঁধা আমার জীবনে থাকত না। আমি তো ভেবে নিয়েছিলাম তুমি আর আসবে না। কারণ তুমি তো অন্যত্র বিয়ে করে নিয়েছিলে। কিন্তু তুমি যে আমার জীবনে ফিরে আসতে চাইতেছ সেটা কী তোমার বউ জানে? মানে নাফিসা কী সেটা মেনে নিবে।

– চলো একটু ভেতরের দিকে বসে কথাগুলো বলা যাক। আমি জানি তুমি আমাকে এখনও ভালোবাসো। আর সে ভালোবাসাটা আমি তোমার চোখে এখনও দেখতে পাই বলেই তোমার অতীত সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি৷ কখনও তোমার সামনে যাওয়ার সাহস পাইনি। যেদিন তোমার মুখোমুখি হলাম সেদিন এমন পরিস্থিতিতে হব চিন্তা করে নি। হয়তো সেদিনেই তোমাকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করার সুযোগ আল্লাহ করে দিছেন। নাহয় তো তোমার সামনে যাওয়ার সাহস আমার হত না।

বলেই দম ছাড়ল অরন্য। অরন্যের কথাটা আন্দাজ করতে পারলেও পুরোপুরি বুঝতে পারছিলাম না। আমি চাপা গলায় বলল

– ঘটনা নাহয় এক জায়গায় বসে শুনা যাবে। এখন একটু শান্ত হও। আবির কেমন আছে?

– আবির ভালো এখন। ওকে বেডে রেখে এসেছি।

– দেরিতে গেলে সমস্যা হবে না তো?

– সমস্যা হবে না।ও এখন ঝুঁকি মুক্ত।আর মোাবইল তো আছে কিছু হলেই কল দিবে।

– তোমার ডিউটি?

– আজকে রাতে ডিউটি, দিনের বেলায় নেই।

– তাহলে চলো মেডিকেলের পাশে শহীদ মিনারটায় বসি।

– চলো যাওয়া যাক।

অবশেষে মনের সকল প্রশ্নের সমাধান আজকে হতে চলল। বেশ প্রশান্তি নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে এগুতে লাগলাম। এগুতে এগুতেই পুরনো স্মৃতিতে আবারও ডুব দিলাম।

সেদিন অরন্যকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসতাম। সামান্য কথা কাটাকাটি হলেই অরন্যের একটা বদঅভ্যাস ছিল ফোন বন্ধ করে ফেলা। আমি অরন্যের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম ঢাকা মেডিকেলে। অরন্যের সাথে কী নিয়ে যেন ঝগড়া বেঁধে বসে। যার ফলে সে আমাকে রেখে মেডিকেলের ভেতর ঢুকে যায়। এদিকে আমি শহীদ মিনারে বসে আস্তে আস্তে কাঁদতে লাগলাম। রাস্তাঘাট চিনি না বাসায় যাব কী করে সেটা ভাবতে লাগলাম। বেশ কয়েকবার কল দিলাম অরন্যের নম্বরে বারবার বন্ধ বলছিল।অসহায় লাগছিল খুব।সে সাথে অরন্যের উপর অভিমান।সব মিলিয়ে চুপ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। আধঘন্টা তো হবেই।এবার আর বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না।বাসায় যেতে হবে। তবে পথ ঘাট তো চিনি না। শহীদ মিনারের এক কোণে এক ছেলে বসে সিগারেট টানছিল।বেশ ভয় হচ্ছিল তবুও ছেলেটার কাছে গিয়ে বললাম

– এখানে বাস পাওয়া যায় কোথায়? আর এ বাস কী খিলক্ষেত যাবে?

ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো।বুঝায় যাচ্ছিল ছেলেটা নেশায় ডুবে আছে। আমার তো এদিকে ভয়ে হাত পা কাঁপছিল। কোনো কথা না বাড়িয়ে দৌড়ে রাস্তার পাশে এসে কাঁদতে লাগলাম। এমন সময় কারও হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম পিঠে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম অরন্য দাঁড়িয়ে আছে। অরন্যকে দেখেই আমার অভিমানটা আরও গাঢ় হলো। রাগে বলে উঠলাম

– ছাড়ো আমায়। একদম কাছে আসবে না। ফেলে গিয়ে মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিলে যখন তখন একবারও কী ভেবেছিলে আমার কথা?

– ফেলে রেখে যায় নি। আড়াল থেকে সব দেখছিলাম। কতদূর যেতে পার ভাবছিলাম। এত বোকা একটা মেয়ে। এখন দেখি একটু বেশি পরিমাণ কাঁদছো। তাই আসলাম। একা যেতে দিতাম নাকি। ঠিকেই তোমার পিছু নিতাম। কারণ যত বকা দাও আর রাগ দেখাও আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারব না। বড্ড ভালোবাসি তোমায় অপরাজিতা।

আমি মুহূর্তেই গলে গেলাম। মুখটা ভার করে বললাম

– রাগ দেখাও বকা দাও যা ইচ্ছা করো ফোন বন্ধ করবা না বলো।

– ফোন তো আর ইচ্ছা করে বন্ধ করি না।ফোন বন্ধ করলেই তোমার ত্যাড়ামো কমে। এর আগে না।এবার চোখটা মুছো। নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলেছে।

বলেই টিস্যু হাতে নিয়ে চোখ চেপে চেপে মুছতে লাগল। এমন সময় অরন্য ডেকে বলল

– অপরাজিতা। কী ভাবছো? বসো এখানে?

সিঁড়িতে বসে ঠিক পাশেই হাতে ইশারা দিয়ে বসতে বলল। অভিমানঘন মধুময় অতীত থেকে বর্তমানের বাস্তবতার সম্মুখীন হলাম পুনরায়। অরন্যের ঠিক পাশেই বসলাম। অরন্য হালকা গলায় বলল

– মনে আছে ঐদিনের কথা যেদিন বাসায় যাওয়ার জন্য কোন বাসে যেতে হয় বুঝতে না পেরে একা একা ঐ জায়গাটায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলে।

অরন্যের কথা শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমার মতো সে ও সেই অতীতে ডুব দিয়েছিল। তাহলে কী আমার মনে যা চলছে অরন্যও সেটা ভাবছে নাকি এটা তার মিথ্যা ছলনা মিথ্যা নাটক। আমি কোনো কথা না বলেই অরন্যের পাশে বসলাম। এবার তীব্র কন্ঠে অরন্যের দিকে প্রশ্ন ছুরে বললাম

– তোমার স্ত্রী নাফিসা কোথায়? আর আবির কেন তোমার স্ত্রী এর ব্যপারে কিছু জানে না?

অরন্য দম নিল। চোখ গুলো তার ছলছল করতে লাগল। আমার দিকে তাকাল তারপর অসহায় গলায় বলল

– তুমি আমাকে বিশ্বাস করো কতটা?

সহজ গলায় জবাব দিলাম

– একদম বিশ্বাস করি না। বিশ্বাসের জায়গাটা অনেক আগেই নষ্ট করে দিয়েছো।

– বিশ্বাস না করলে ও এ কথাগুলো শুনে তোমার বিশ্বাস হবে। প্রয়োজনে যাচাই করে নিও।

– কী কথা বলো।

অরন্য চুপ। সে চুপ হয়ে একা একা কথাগুলো স্থিত গলায় আওড়াতে লাগল। হয়তো কথাগুলো সে গুছাচ্ছে। তারপর

চলবে

প্রাক্তন পর্ব-০৬

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৬

কারণ সকালে ঘুম থেকে উঠেই লক্ষ্য করলাম আবির কল দিয়েছে বেশ কয়েকবার। এর্লাম দেওয়া ছিল ফজরের সময়ে। সেটাও বেজে কখন বন্ধ হয়ে গেছিল খেয়াল নেই। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলাম সাড়ে নয়টা বাজে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছি আর এত প্রখর ঘুম হলো যে আবির ১১ বার কল দেওয়ার পরও ধরতে পারি নি। মুখে হাই তুলতে তুলতে আবিরকে কল দিলাম। আবির কলটা ধরতেই আমাকে ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো

– কোথায় ছিলে তুমি? এপর্যন্ত তো ফজরে তুমি আমাকে ডেকে দাও। আজকে তোমাকে এতবার কল দিলাম ফোন ধরলে না।

– মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম। মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বেড়েছিল তাই ঔষধ খেয়েছিলাম। তাতেই এত ঘুম হয়েছে। কিন্তু এতবার কল দিলে কেন? কোনো বিশেষ দরকার ছিল?

– তেমন বিশেষ দরকার ছিল না। তবে এদিকে তো আমার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গেছিল। হাসপাতালে আছি এখন।

আমি কিছুটা বিমূর্ত গলায় বললাম

– কেন কী হয়েছে তোমার? আর এখন কেমন আছো? হুট করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছো কেন?

– অপ্সরা অস্থির হইয়ো না। আমি এখন একদম ঠিক আছি। আর অরন্য যে হাসপাতাল জব করে সেটাতেই আছি।

– কিন্তু তোমার কী হয়েছিল?

– আরে বলো না প্রতিদিনের মতো মর্নিং ওয়াকে গেছিলাম। তবে ফাঁকা রাস্তায় হুট করে ট্রাক এসে ধাক্কা দেয়। পা টা ভেঙ্গে গেছে। মাথায় ও বেশ আঘাত পয়েছি,হাতের অবস্থাও খারাপ। ঐ মূহুর্তে অরন্য না থাকলে কী যে হতো। অরন্যের কাছে দ্বিতীয়বারের মতো ঋণী হয়ে গেলাম। ওর ঋণ শুধু বেড়েই যাচ্ছে।

– অরন্যের কাছে দ্বিতীয়বারের মতো ঋণী মানে? কী বলছো এসব? আর শরীর এখন কেমন? ডাক্তার কী বলেছে? কোন হাসপাতালে আছো বলো, আমি এখনি আসতেছি।

– আরে অপ্সরা এত প্রশ্ন করলে কোনটা রেখে কোনটার জবাব দিব? একটু স্থির হও। আমার কিছু হয়নি। এতটা অস্থিরতা তোমাকে মানায় না?

– তুমি কী পাগল আবির? তোমার ব্যপার নিয়ে আমি অস্থির হব না এটা কেমন করে বলো?

আবির আমার কথাটা শুনে হালকা হাসলো। হালকা হেসে বলল

– আরে আমার হবু বউটা যে আমায় এত ভালোবাসে সেটা তো জানতাম না। আস্তে আস্তে টের পাচ্ছি। এবার একটু শান্ত হও আমি তোমাকে সবটা বলছি। ঘটনা ঘটেছে সকাল সাতটায়। হাসপাতালে এসেছি সাড়ে সাতটায়। বড় কিছু হয়নি হাত পা ভাঙ্গা ছাড়া। ডাক্তার বলেছে তিনমাস বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাব। আর সময় মতো অরন্য না থাকলে আমার অবস্থা খারাপ হতো। এর আগেও অরন্য আমাকে এভাবে বাঁচিয়েছে। সেদিন অরন্য না থাকলে আমাকে পেতে না।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম

– কেন এর আগে কী হয়েছিল?

– তখন সবে চাকুরিতে জয়েন করি। ছুটি পেয়ে ঘুরতে গেছিলাম এক জায়গায়। সেখানে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে আমার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়। খালি রাস্তায় পড়ে ছিলাম। অরন্য সেদিন আমাকে বাঁচিয়েছে। হাসপতালে নিয়ে গেছে। নিজের রক্ত দিয়েছে। সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত সে আমার পাশে ছিল। অরন্যের সাথে সেখানেই পরিচয় আমার।

– কোথায় ঘুরতে গেছিলে তুমি?

– অরন্য যে উপজেলায় চাকুরি করে সেখানেই। সেটা তো হাওর এলাকা ছিল। তাই সেখানে ছিনতাইকারীর উপদ্রব ও বেশি ছিল। সেদিন পেটে ছুরির আঘাত খেয়ে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছিল। অরন্যের জন্যই সেদিন বেঁচে গেছিলাম।

– কত বছর আগের ঘটনা এটা?

– তিন বছর আগের। সেদিন থেকেই অরন্যের সাথে আমার বন্ধুত্বটা জমে উঠে। এরপর ঢাকায় পোস্টিং হওয়ার পর তো সে আমার ভাইয়ের মতোই হয়ে গেছে।

– আচ্ছা তখন অরন্য ভাইয়া কোথায় থাকত? আর পরিবার সাথে নিয়ে থাকত নাকি?

– তখন তো অরন্য ব্যাচেলর ছিল। সেখানের ব্যাচেলর কোয়াটারে থাকত।

উফ আবির এসব কী বলছে। অরন্য ব্যাচেলর ছিল। কী হচ্ছে এসব। এটা কী করে সম্ভব। কিছুটা উৎসুক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম

– ভাইয়ার চাকুরি হলো এতদিন বিয়ে করেনি কেন?

– ও একজনকে ভালোবাসে। সেখান থেকে বড় একটা আঘাত পেয়েছে। এরপর থেকে আর বিয়ের নাম নিলে সে রাজি হয়নি। কত মেয়ে দেখালাম কাউকেই নাকি ওর পছন্দ হয়না। একটা মেয়ের কথা অনেকবার বলেছে। বলেছে মেয়েটাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে আর সেটা বুঝতে পেরেছে একটা সময় পর। যখন তার হাতে করার মতো কিছু ছিল না।

আমার ধারণা অরন্যের স্ত্রী নাফিসাকে হয়তো সে খুব ভালোবাসত। আর তার সাথে ঝামেলা হয়েছে হয়তো। তাই কিছুটা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– মেয়েটার নাম কী? মেয়েটাকে কী তুমি চেনো? কথা হয়েছে কখনও?

– চিনি না, অরন্য কখনও ছবিও দেখায়নি, শুধু নামটা বলেছে।

– কী নাম মেয়ের শুনি?

– অপরাজিতা।

নামটা শুনে আমি থমকে গেলাম। ভাবনার সাগরে ডুবে গেলাম। চোখ মুখ ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে। আবির অরন্যকে চেনে তিন বছর যাবত অথচ তার বউ নাফিসার সাথে তার পরিচয় নেই। তার বউয়ের ব্যাপারে সে কিছু জানে না। যদিও তার বউয়ের সাথে লাস্ট ছবি আপলোড হয়েছে গতবছর। এ বিষয়টায় একটা ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। সে সাথে আবির যে নামটা বলল সে টা অরন্যের দেওয়া আমার একটা নাম। অরন্যের প্রিয় ফুল ছিল অপরাজিতা তাই সে ভালোবেসে আমাকে এ নামটায় ডাকত। আবিরের কাছে টানা তিন বছর সে আমার কথা বলে গেছে। তাহলে অরন্য আমাকে ছেড়েছিল কেন? আর অরন্য ব্যচেলর হলে নাফিসা কে? সব কিছু এলোমেলো লাগছে। এ মুহূর্তে এ প্রশ্নের উত্তর গুলো একমাত্র অরন্য দিতে পারবে। আমার উচিত তার সাথে কথা বলা। নাহয় রহস্যের গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে যাব।

– আবির হাসপাতালের ঠিকানা দাও। আমি এখনি আসতেছি।

– আমি ঠিকানা টেক্সট করে দিচ্ছি। আর অপ্সরা সরি।

– সরি কেন?

– আমার বোকামো আর অসচেতনতার জন্য বিয়েটা পিছিয়ে গেল। তিনমাস অপেক্ষা করতে হবে আমার জন্য। পারবে না অপেক্ষা করতে? হারিয়ে যাবে না তো? বড্ড ভালোবাসি তোমায়।

– একবার যখন তোমায় কথা দিয়েছি তোমাকে ছেড়ে আমি যাব না সেহেতু যাব না। আমি জানি কথা দিয়ে কথার বরখেলাপ করা কতটা কষ্টদায়ক। আবির আমি তোমার পাশে আছি, পাশে থাকব কথা দিলাম। এ তো তিনমাসের ব্যপার। আমি আসতেছি আর মা কোথায়?

– মাকে বলার সাহস পাইনি। তুমি এসে একটু মাকে বলো। তোমার দায়িত্ব তোমার হবু শ্বাশুড়িকে কীভাবে বুঝাবা।

– হয়েছে বকাগুলো আমাকে খাওয়ানোর ধান্দা।।যাইহোক রাখলাম। এখনি তৈরী হয়ে আসতেছি।

কলটা কেটে তৈরী হয়ে নিলাম। একটা সি এন জি নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম। মনে হাজারটা সংশয়ের অবসান আজকে ঘটাব আমি। অরন্যকে আজকে সব জিজ্ঞেস করব কেন এমন করছে।

সি এন জিটা তখন চলমান। শাহবাগ যেতে আরও কিছুক্ষণ বাকি। শাহবাগের পথ দিয়ে এগুতে এগুতেই পুরনো স্মৃতিতে ডুব দিলাম। আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা। অরন্য তখন এফ পি এস কোচিং করত নিকুন্জতে। দিলীপ স্যারের কোচিং নামেই সবাই চিনত। একদিন অরন্যের সাথে আমার বেশ ঝগড়া হলো। ঝগড়া করে ও ফোনটা অফ রেখেছে। আমি নিশ্চিত ছিলাম সে কোচিং-এ যাবে। যত যাই করুক সে তার ক্লাস মিস দিবে না। আমি তখনও রাস্তা ঘাট চিনতাম না। তবুও বেশ সাহস করে রাস্তা চিনে চিনে কোচিং এর সামনে গেলাম। কোচিং এ তখন টিফিনের ব্রেক চলে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে অনিশ্চয়তা নিয়ে অরন্যের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হুট করে অরন্য বের হলো। পরনে ছিল নীল রঙয়ের টি শার্ট। কালো মোটা ফ্রেমের চশমাতে চোখ গুলো আবদ্ধ। দোকানে এসে চা দিতে বলল। আমি দেখছিলাম দূরে দাঁড়িয়ে ও কী করছে। ও চা টা হাতে নিয়ে যখনেই চুমুক দিবে আমি ওর পেছনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখলাম। অরন্য পেছন ফিরে আমাকে দেখে চমকে গেল। চোখগুলো বড় বড় করে তাকিয়ে বলল

– তুমি এখানে?

– ফোন বন্ধ করেছো কেন?

– ভালো করেছি। সারাদিন ঝগড়া করো কেন? তোমার গালি খাওয়ার এত ইচ্ছা নাই। হুদাই গালি দাও।

– এতদিন তো গালি দিয়েছি এখন পিটাব কি না বলো?

– বাড়াবাড়ি করবা না।

আমি রাগী চোখে অরন্যের দিকে তাকালাম কথাটা শুনে। আর সাথে সাথে অরন্য গলে গেল। সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলো

– দাঁড়াও এখানে ব্যাগটা নিয়ে আসি। তোমার সাথেই ঘুরতে যাব এখন।

– ভয়ে পালাচ্ছ না তো এখন?

– তোমার কাছ থেকে পালিয়ে থাকা সম্ভব নাকি। অপেক্ষা করো আসতেছি।

বলেই ক্লাস রুমের দিকে গেল। পাঁচমিনিটের মধ্যেই ব্যাগ নিয়ে সামনে হাজির হলো। আমাকে হাসতে হাসতে বলল

– কোথায় ঘুরবা বলো।

– টি এস সি ছাড়া আর কোথায় গিয়েছি। সবসময় তো ঐ জায়গায়টাতেই যাই। টি এস সিতেই চলো।

অরন্যের সাথে সেদিন সি এন জি ভাড়া নিয়ে টি এস সির দিকে রওনা দিলাম। ফার্মগেট এসে আমার কী যেন হলো। হুট করে অরন্যকে বললাম

– ক্লান্ত বিকেলের রোদ হেলে পড়েছে চলো শাহবাগ পর্যন্ত হেঁটে যাই। ঐখান থেকে পরে রিকশা নিব। তোমার সাথে হাঁটতে মন চাচ্ছে।

– এত দূর হাঁটবা?

– ইচ্ছা হচ্ছে। হাঁটবা কি না বলো?

অরন্য সি এন জি থামিয়ে দিল। আমি অরন্যকে নিয়ে নেমে পড়লাম। দুজনের দুহাত একসাথে করে সেটা ধরে হাঁটতে লাগলাম। কখনও হাত মুষ্টি করে ধরছিলাম কখনও আলতো করে। কতশত পরিকল্পনা করছিলাম। বলতেছিলাম বিসিএস টা হয়ে গেলেই আর কোনো বাঁধা নেই। একসাথে হয়ে পড়ব দুজন। কত শত কথা আর স্বপ্ন দুজন মিলে গুছাচ্ছিলাম। কখন যে হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগের মোড়ে চলে আসলাম খেয়াল নেই। ফুলের দোকান গুলো সেখানে সারি বদ্ধভাবে সাজানো। ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অরন্য কেমন করে যেন বুঝে গেছিল ফুল গুলো আমার চাই। সে দৌঁড়ে গেল ফুল আনতে। দুটো ফুল এনে আমার কানে গুজে দিল। আমি হাসতে হাসতে অরন্যের দিকে তাকালাম। সে আমাকে দেখে বলল নতুন বউ লাগছে একদম।

গাড়ির হর্ণে মধুমাখা অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসলাম। আশ্চর্য জনক ভাবে সি এন জি সে ফুলের দোকানগুলোর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে এখন অনেকটা বদলে গেছে। ভেতরে ভতরে হালকা হাসলাম। আজকাল অতীত আর বর্তমান সব কিছু যেন আমাকে দেখে উপহাস করে।

সি এনজি টা আবার চলতে লাগল। গন্তব্য ঢাকা মেডিকেল। চলতে চলতেই গন্তব্যে পৌঁছালাম। গন্তব্যে পৌঁছানোর সাথে সাথে অরন্যকে দেখতে পেলাম মূল ফটকে। আমি সি এন জি এর ভাড়াটা তাড়াতাড়ি করে দিলাম। কারণ এখন অরন্যকে প্রশ্ন করব আগে তারপর যাব আবিরের সাথে দেখা করতে। আমি দৌঁড়ে ভাড়াটা দিয়ে অরন্যের কাছে যেতেই থমকে গেলাম।

চলবে

প্রাক্তন পর্ব-০৫

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৫

খুঁজতে খুঁজতেই অরন্যের আইডিটা দেখে আমি পুনরায় আশ্চর্য হলাম। আবির বলেছে অরন্য বিয়ে করেনি। আর আইডিতে প্রোফাইল পিকে দেখা যাচ্ছে অরন্যের বউ নাফিসার সাথে অরন্যের হস্যজ্জ্বোল ছবি যা ১ বছর আগে আপলোড করেছে সে। অরন্য সচরাচর ঘনঘন প্রোফাইল পিক চেন্জ করে না। হয়তো এখনও সে অভ্যাসটা রয়ে গেছে। তবে বাকি পোস্ট গুলো হয়তো ফ্রেন্ডস করা, তাই বাকি পোস্ট গুলো দেখতে পারছি না। কিন্তু আবির কেন বলছে অরন্য অবিবাহিত। আবিরের সাথে যদি অরন্যের পরিচয় ১ বছরও হয় তবুও তারা একে অপরের আইডিতে এড হয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে আবির কী করে বলছে অরন্য বিবাহিত নয়। আমার ভাবনাগুলো আরও প্রশ্নের ঘুরপাকে জড়িয়ে যাচ্ছে। কী করা উচিত বুঝতেও পারছি না। নিজের মতো বাঁচতে চেয়েছিলাম অতীতটা ফেলে এখন সে অতীতটায় ব্যাগরা দিয়ে বসেছে। সে সাথে হাজারটা রহস্যে মুড়িয়ে যাচ্ছি। মনের অস্থিরতা বাড়তে লাগল অনেক। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। অরন্যের সাথে কথা বলতে হবে। আবিরের সাথে অরন্যের সকল যোগসূত্র বের করতে হবে।

মাথাটা বেশ ঘুরপাক খেতে লাগল। অরন্য আর আবিরের রহস্যে মুড়িয়ে যাচ্ছি একের পর এক। আবার কোনো নতুন ভুল করার আগে সে রহস্যের উদঘাটন করতে হবে। কেন অরন্য চার বছর আগের সব সামনে আনতে চাইছে আর আবির এতদিন অরন্যের কথা বলল না কিন্তু এনগেজমেন্ট এর দিন হুট করেই কেন অরন্য কে নিয়ে আসলো। আংকটিটাও অরন্য পড়াল। একের পর এক ঘটনা এটাই জানান দিচ্ছে অরন্য চায় অতীতটা সামনে আসুক। কিন্তু তার স্ত্রী বর্তমান থাকার পরও কেন এমন চাচ্ছে? কেনই বা আবিরকে সে তার স্ত্রী এর কথা লুকিয়েছে। আর স্ত্রী থাকলে অবশ্যই অরন্যের বাসায় আসার কথা আবিরও তার স্ত্রী কে দেখার কথা। সেক্ষেত্রে তার স্ত্রী কখনও হয়তো অরন্যের বাসায় আসে নি। দু বছর আগে সে ঢাকায় এসেছে এর মধ্যে তো স্ত্রী আসার কথা। আর অরন্য যদি বিয়ে না করে তাহলে এ মেয়েটা কে অরন্যের প্রোফাইল দখল করে আছে। অরন্যের স্ত্রী কে ও মেনশন করা। অরন্যের স্ত্রী এর আইডি হয়তো ডিএকটিভ তাই আইডিতে ঢুকা যাচ্ছে না। অরন্যের স্ত্রী নাফিসার সাথে যদি সম্পর্কচ্ছেদও হয় তাহলে তো নাফিসার ছবি প্রোফাইলে থাকার কথা না।

উফ… সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে বারবার। কী করব কীভাবে এ রহস্যের উদঘাটন করব৷ আবেগের বশে আর কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। চুপ হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ । মনের অস্থিরতা বাড়তে লাগল। নিজেকে সামলে নিতে হবে। অস্থিরতা নিয়ে যেকোনো কাজ করলেই সেটা হিতে বিপরীত হতে পারে। মোবাইলটা রেখে চুপ হয়ে অতীতে ডুব দিলাম। সেই কালো অতীতটা সামনে এসে থুবরে পরলো যে অতীতটাকে ভুলতে চেয়েছি বহুবার। যে অতীতের করালগ্রাসে টানা তিন বছর পুড়ে মরেছি। কাউকে বলতেও পারে নি আবার সহ্যও করতে পারেনি।

সম্পর্কচ্ছেদ আর বিয়ে ভাঙ্গার দেড় মাস হয়েছিল সবে। সেদিন দুপুরের নাস্তা খেয়েছিলাম এশার সময়। খাবার টা হাতে নিয়েও গিলতে পারছিলাম না। অনেকটা জোর করেই খাবার টা খেয়ে নামাজে দাঁড়াই। নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে খুব কেঁদেছিলাম। মোনাজাত শেষে যখনই উঠে দাঁড়াই তখনই মাথাটা ঘুরে যায়। হালকা হালকা বমি ভাব হতে লাগে। নিজেকে সামলে নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নিই। মুখ ধুয়ে রুমে আসতেই আমার মনটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে। লুকিয়ে বিয়ে করার পর অরন্যের সাথে বেশ কয়েকবার ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। এখন কেন জানি না মনে হচ্ছে আমি মা হতে চলেছি। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। পাগলের মতো অরন্যকে কল দিলাম। বারবার মেসেজ দিলাম। ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পেলাম না। কারও কাছে বিষয়টা শেয়ার করে হালকা হব সেটারও উপায় পাচ্ছিলাম না। পুনরায় নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে কাঁদতে লাগলাম। অরন্য বিয়ে করেছে ইতিমধ্যে সেটা কানেও এসেছে। আমার সাথে লুকিয়ে বিয়ের ছয়মাস পর এবং পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক হয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার একমাস পরেই সে বিয়ে করে নেয় অন্যত্র। আর আজকে আমার এ অবস্থা হলে এর দায়ভার কে নেবে। কার কাছে আমি মুখ দেখাব। আমার এ সন্তান জারজ নামে পরিচয় পাবে। আর অরন্য যদি চাপে পড়ে আমাকে এর জন্য বিয়েও করে সেখানে আমি বা আমার সন্তানের কোনো মূল্য থাকবে না। আর আমার সন্তান বারবার পরিচয়হীনতায় ভুগবে। আমিও প্রতিষ্ঠিত না যে এ বাচ্চার দায়িত্ব নেব। সব মিলিয়ে বেশ অস্থির লাগছিল তখন।

তবুও শেষবার অরন্যের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অরন্যের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হলাম। সারারাত সেদিন এতটায় ছটফটানিতে কেটেছিল যে সেটা বলে প্রকাশ করার ভাষা আমার কাছে নেই। পরদিন নিজেকে সামলে নিয়ে টেস্ট করালাম পরিবারের থেকে লুকিয়ে। ক্লাস আছে বলে বের হয়ে হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করাই। টেস্ট করানোর পর, রিপোর্ট হাতে পেয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম। কারণ রিপোর্ট পজিটিভ ছিল। হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়েই আমি কাঁদতে লাগলাম। এ বাচ্চাকে আমি দুনিয়া দেখাতে পারব না ভেবেই আকুল হয়ে যাচ্ছিলাম। অথচ এ বাচ্চা ছিল পবিত্র। তবুও আমি মা হয়ে এ বাচ্চাকে খুন করব। অসহায় হয়ে সেদিন কাঁদছিলাম। এ অসহায়ত্বের মাত্রা ছিল প্রখর।

বাসায় এসে সেদিন কী পরিমাণ কেঁদেছিলাম বলতে পারব না। সবচেয়ে কাছের বান্ধবীকে কল দিলাম। সেও উপায় না পেয়ে বাচ্চা গর্ভপাত করাতেই বলল। হাতে তখন টাকা ছিল না। শুধু মোবাইলটা ছিল। এটা বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। সেদিন রাতে কাঁদতে কাঁদতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে আরও বড় একটা ধাক্কা খেলাম। অরন্য তার স্ত্রী এর সাথে ঘুরতে গেছে আর সেটার ছবি ওয়ালে আপলোড দিয়েছে সেটার স্ক্রিনশট অরন্যের এক বন্ধু আমাকে পাঠাল। ছবিটা দেখে যতটা কষ্ট পেয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম সে আমার গিফট দেওয়া শার্ট পরে বউয়ের সাথে ঘুরতেছে এটা দেখে। অথচ ভাবনায় আসলো শার্ট টা পরতে তার হাত কাঁপলো না একবারও। একটা বারও আমার কথা মনে হলো না। দশ বছর তো কুকুর, বিড়াল লালন পালন করলেও মায়া হয় আর আমিতো জলজ্যান্ত মানুষ ছিলাম। তার কী শার্ট টা পরার সময় আমার কথা মনে হয়ে বুক কাঁপে নি । যে শার্ট টিফিন, রিকশা ভাড়া, বইয়ের টাকা থেকে কিছু বাঁচিয়ে, জমিয়ে ওর জন্য কিনেছিলাম। একদিকে ও নাফিসাকে নিয়ে ঘুরছে আর এদিকে আমি ওর চিন্হ বহন করে কাঁদছি। সেদিন মনে হয়েছিল দুনিয়া এত নিষ্ঠুর না হলেও পারত। অন্তত বাচ্চাটাকে পরিচয় দিতে পারত। অনেক কষ্ট হচ্ছিল। নিঃশ্বাস ভরী হয়ে যাচ্ছিল।

সেদিনেই আমার আইডিটা ডিএকটিভ করি। ১৭ হাজার টাকার মোবাইল এক বন্ধুর সাহায্যে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করি। আর নিজের জমানো কিছু টাকা গুছিয়ে আমার সন্তানকে এক সপ্তাহ পরে খুন করি। যেদিন সন্তান খুন করি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম মাতৃত্ব কতটা মূল্যবান একটা মেয়ের জন্য। কেউ বাচ্চা পায় না আর আমি আমার বাচ্চাটাকে পরিচয় দিতে পারব না বলে খুন করেছিলাম। নিজেকে সবচেয়ে পাপী মনে হয়েছিল। বাসায় এসে বিছানায় শুয়ে পাগলের মতো করছিলাম । বারবার মনে হচ্ছিল কী করলাম আমি। কিন্তু হাত পা ছিল বাঁধা।

কথাটা মনে করেই আমি শুয়া থেকে দরফর করতে করতে উঠলাম। সহ্য হচ্ছে না আর। এ অতীত আমি ভুলতে চাই। কেন সে অতীতটা সামনে আসছে। কেন সে অতীতটা আমার বর্তমানের সুখটা গ্রাস করছে। কেন সে অতীতটা আমার গুছানো জীবনটা অগুছালো করছে। আমি এর উত্তর চাই।

আবার দরফর করতে লাগল বুক। আজকের মতো যদি সেদিন থাকতাম তাহলে আমার বাচ্চার পরিচয় আমি আদায় করে নিতাম। কিন্তু সেদিনের মানসিকতা আর পরিস্থিতি ছিল একদম বিপরীত যার জন্য এত নিকৃষ্ট কাজ করতেও আমি বাধ্য হয়েছিলাম। অরন্যের প্রতি তীব্র ঘৃনা বাড়তে লাগল।ঘৃনায় গা গুলিয়ে বমি আসা শুরু করল। পৃথিবীতে যদি আমি কাউকে ঘৃনা করি সেটা অরন্যকে। আর আজ এত বছর পরও অরন্য একটুও বদলায় নি আমাকে নিয়ে খেলার প্রবণতা এত বছর পরও তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে।

মনে মনে এসব বলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। নিজের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। নিভে যাওয়া আগুনটা যেন আবার জ্বলে উঠেছে।ছটফটানি বাড়তে লাগল আমার। সে সাথে মাইগ্রেনের চরম ব্যথা। মাথা দেয়ালে ঠুকতে লাগলাম অসহ্য এ যন্ত্রণায়। কড়া ডোজের ঔষধ সেবন করে মাথাটা খাটে এলিয়ে দিলাম। অনেক পরে ব্যথাটা মৃদু হলো। আর আমার চোখে হালকা ঘুম আসলো।

সেই সাথে সকাল হলো নতুন এক ব্যথার সূচনা নিয়ে। কারণ-

চলবে