Wednesday, July 9, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1499



প্রাক্তন পর্ব-০৪

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৪

তবে এখন মনে হচ্ছে কোনো কোনো সময় অতীত ধুয়ে মুছে বিনষ্ট হয়ে গিয়েও সময়ের পরিক্রমায় তা পুনরায় ব্যগরা দিয়ে বসে।

কারণ বক্সটা খুলে দেখলাম চারটা সাদা গোলাপ, চারটা চন্দ্রমল্লিকা,চারটা সূর্যমূখী ফুল দিছে। সে সাথে চারটা কিটকাট চকলেট। চারটা ছোটো টেডি। আমার প্রিয় কিছু জিনিস যেগুলো আমি অরন্যকে দিছিলাম। এতবছর পরও অরন্য জিনিসগুলো আগলে রেখেছে ভেবে কিছুটা বিস্মিত হলাম। বুঝায় যাচ্ছিল সে আমাদের বিয়ের চার বছর সিলেব্রেশন করেছে। কিন্তু এটা কেন সে করছে। সে বিয়ে করেছে চার বছর আগেই। আমার সাথে ওর লুকিয়ে বিয়ে হওয়ার বিষয়টা কেউ জানত না। ছয়মাস পড়েই অন্য মেয়েকে বিয়ে করে। বিয়ের ব্যপারটা পরিবারকে না জানিয়েই আমরা পরিবার মানিয়ে নিয়েছিলাম। হুট করে তার কী অনুভূতি হলো জানি না সে বিয়ে টা ভেঙ্গে দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে। তখন আমার কাছে বিয়ের কোনো কাগজ ছিল না। কোনো প্রমাণ ও ছিল না। রাস্তাঘাট খুব একটা চিনতাম না তখন। কোন কাজী অফিসে গিয়ে যে বিয়ে করেছিলাম সেটাও বেমালুম ভুলে গেছিলাম। যেখানে বিয়ে করেছি সেটারেই প্রমাণ ছিল না সেখানে এ বিয়ে নিয়ে লড়াটা যুক্তিহীন মনে হয়েছিল। কারণ আমি লড়তে গেলেই তখন আইন আমার কাছে প্রামাণ চাইত। কিন্তু সে প্রমাণ আমার কাছে ছিল না। সব প্রমাণ ছিল অরন্যের কাছে৷

পরবর্তীতে অরন্যের অন্যত্র বিয়ের পর এ বিষয়টা আমি ভুলার চেষ্টা করেছি বহুবার। একটা সময় পর নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছিলাম। অরন্যের সাথে যোগাযোগ টাও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল পুরোপুরি। তাই যেখানে বিয়ের অস্তিত্ব ছিল না সেখানে নতুন করে আমার ডিভোর্স দেওয়ার ও কোনো উপায় ছিল না। বলা যায় অনেকটা মাঝ নদীতে পড়ে ডুবে মরার মতো অবস্থা। এখন এত বছর পর অরন্যের হাবভাব দেখে কেন জানি না আমার কাছে ব্যপারটা বেশ স্বাভাবিক লাগছে না। বারবার বিষয়টা গোলমেল লাগছে। আবিরের সাথে অরন্যের যোগসূত্র কী। অরন্যই বা চারবছর পর অতীতটা সামনে আনতে কেন চাচ্ছে। যে অতীতটা সে নিজে বিলীন করে দিয়েছিল।

আমি বুঝতে পারছিলাম না কিছুই। বুঝতে গেলেও সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। অরন্যের প্রতি ঘৃনাটা আরও বাড়তে লাগল। এ মানুষটা সারাটা জীবন আমাকে কষ্টের অনলে পুড়িয়েছি। আর আজকেও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। আবিরকে আমার অতীত সম্পর্কে কিছুই বলে নি। কারণ আমি আমার অতীতটা নিচ্ছিন্ন করে সামনে এগুতে চেয়েছিলাম। আর সেটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবিরকে সবটা বলা দরকার। কিন্তু কীভাবে বলব। হাত পা কাঁপছে। জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার পরও যেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

এমন সময় আবিরের কল আসলো। রাত তখন বারোটা। ভাবতে ভাবতে কখন যে এত রাত হয়ে গেছে খেয়ালেই করিনি। কলটা ধরে হ্যালো বলার আগেই অবির উচ্ছাস নিয়ে বলল

– অরন্য তোমায় কী দিয়েছে বললে না তো?

আবিরের কথা শুনে আমার বিরক্তি বেড়ে গেল। বিরক্তির সুরে বলে উঠলাম

– অরন্যকে ছাড়া কী আর কোনো কথা তোমার মুখে নেই? এ পাঁচ মাসে এ লোকটার কথা একবারও শুনলাম না। আর আজকে হুট করে তোমাদের সাথে উনি আসলো আর আসার পর থেকে শুধু উনাকে নিয়ে প্রসঙ্গ উঠছে। আমাদের আজকে এনগেজমেন্ট হয়েছে আবির। আমাদের নিজেদের কত কথায় থাকতে পারে। তুমি তা ‘ না করে শুধু অরন্য ভাইয়ার কথায় বলে যাচ্ছ। একই প্রসঙ্গে কথা আর ভালো লাগছে না আবির।

আবির আমার রাগের কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে অনেককটা চুপ থেকে বলল

– অপ্সরা তুমি হঠাৎ করে এভাবে রেগে গেলে কেন? অরন্যের সাথে তোমার আগে পরিচয় ছিল না তাই ওর কথা তোমাকে বলিনি। আর আজকে তোমাকে কী দিয়েছে জানার জন্য প্রশ্ন করলাম। এতে রাগ করার মতো কী বলেছি বুঝতে পারিনি। যদিও একটু ঝামেলা আজকে হয়েছে অরন্যের এক্সিডেন্ট এই সেই মিলিয়ে তবুও তো দিনটা ভালোই কেটেছে। আর আমি তো তোমাকে যতদূর চিনি অল্পতে বিরক্ত হয়ে যাওয়ার মেয়ে না। যথেষ্ট শক্ত এবং গুছালো মেয়ে। আজকে তোমার মধ্যে আমি কেন জানি না খুব অস্থিরতা আর বিরক্তি লক্ষ্য করছি। আমাকে খুলে বলো। তুমি যদি মনে চেপে রাখো আমি তো বুঝতে পারব না।

আমি কী আবিরকে সবটা বলে দেবো এখনি নাকি সময় নিব। স্থির হয়ে ভাবতে লাগলাম। ভাবনাটা ব্যাগরা দিয়ে আবির বলল

– কী হলো অপ্সরা কখন থেকে হ্যালো হ্যালো বলে যাচ্ছি। চুপ হয়ে কী ভাবছো? নাকি ঘুমিয়ে পড়েছো?

আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী জবাব দেবো। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে বললাম

– আমার একটু ঘুমেই পাচ্ছে।

– আচ্ছা তাহলে ঘুমাও।

বলে ফোনটা রাখতে নিলে আমি আবিরকে ডেকে বললাম

– আমার কথায় কী রাগ করেছো?

– রাগ করিনি। তবে তোমাকে বুঝার চেষ্টা করেও আজকে বুঝতে পারছি না তাই নিজের প্রতি নিজের রাগ হচ্ছে।

– থাক এত বুঝতে হবে না। মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছিল তাই এমন করে ফেলেছিলাম। এখন একটু ভালো লাগছে। আচ্ছা আবির…

বলেই থেমে গেলাম। আবির আমাকে থেমে যেতে দেখে বলে উঠল

– কী বলবে বলো।

– কখনও যদি শুনো আমি তোমার কাছে কিছু লুকিয়েছি তুমি তা জানার পর কী করবে?

– লুকানো বিষয়টাতে যদি তুমি দোষী না হও। আর সেটা যদি তুমি তোমার সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করার জন্য লুকিয়ে থাকো এবং আমার দিক ভেবে লুকিয়ে থাকো আমি ক্ষমা করে দেবো। কারণ মানুষের জীবনে এমন কিছু থাকেই যেটা একমাত্র সৃষ্টি কর্তা ব্যতীত আর কাউকে বলা যায় না। বলতে গেলেও বারবার আটকে যায়। কিন্তু হঠাৎ এমন বলছো কেন?

আবিরের কথাগুলো শুনে মনে বেশ শান্তি পাচ্ছিলাম। আবিরকে হালকা গলায় বললাম

– না এমনি। তবে কিছু যদি তোমার কাছে কখনও আড়াল করেও থাকি সময় সুযোগ বুঝে সঠিক সময়ে বলব। তবে তুমি নিশ্চিত থাকো এমন কিছুই করব না যাতে করে তুমি কষ্ট পাও। একদম ঠকাব না তোমায়। কারণ ঠকানোর কষ্ট কতটা প্রখর সেটা খুব কাছ থেকে উপভোগ করেছি। তোমাকে একদিন বলেছিলাম না আজকের এ অপ্সরা এমনি এমনি নিজেকে গড়ে তুলে নি। বরং বাস্তবতার চরম আঘাতে নিজেকে শক্ত করে এ পর্যায়ে এসেছে।

– সে জন্যই তোমাকে আমার বেশি ভালো লেগেছিল। যদিও কারণটা বলো নি তবে যে মেয়ে একটা ধাক্কা থেকে নিজেকে শেষ করে না দিয়ে গড়ে নিতে পারে সে আর যাই করুক অন্যায় করবে না। আমি তোমাকে অনেক ভরসা করি বলেই তোমার প্রতিটা কথাকে সম্মান করি। অপ্সরা পাঁচ বছর যাবত হয়তো তোমাকে চিনি না, চিনি পাঁচমাস যাবত। তবে তোমাকে এতটা ভালোবেসেছি বুঝাতে পারব না। ভালোবাসতে যুগ যুগান্তরের সময় লাগে না কখনও কখনও ক্ষণিকের একটু দেখায় ভালোবাসা যায়। হাসপাতালে যেদিন তোমায় দেখেছিলাম সেদিন থেকেই তোমার প্রতি একটা দূর্বলতা কাজ করা শুরু করেছে। আর সে থেকেই এত কাছে পাওয়ার আকাঙ্খা তোমায়। মানুষ বলে দূর্বলতা প্রকাশ করা উচিত না এতে অবহেলা বাড়ে। কিন্তু তোমার কাছে দূর্বলতা প্রকাশ করে দিলাম অবহেলা করো না।

– আবির… যে তোমাকে চায় সে তুমি দূর্বলতা প্রাকশ করার পর আরও আগলে রাখবে আর যে চায় না সে তুমি দূর্বলতা প্রকাশ না করলেও চলে যাবে। আমি তোমায় কথা দিলাম তোমাকে কষ্ট দিব না। তোমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করব৷ তোমার দূর্বল জায়গা নিয়ে খেলব না বরং ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেবো। ঘুমাবে কখন?

– ঘুম তো উড়ে গেছে তোমার মিষ্টি কথায়। এত গুছিয়ে কথা বলো।

আমি মুচকি হাসলাম

– তুমিও তো কম কথা জানো না। এতক্ষণ তো ঘুমে গড়িয়ে পড়ছিলি এখন তো দেখি তোমার চোখের ঘুমও উড়ে গেছে।

– তা তো একটু গেছেই। আবির আকাশটার দিকে একটু তাকাও।

– বিছানায় আছি শুয়ে। জানালার পাশে যেতে হবে। ঠান্ডা, ঠান্ডা লাগছে একটু। বাইরে থেকে হালকা ঠান্ডা বাতাস ও আসছে। আর বিশেষ কথা অরন্য জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে কী যেন বিড়বিড় করছে। এখন ঐখানে যাওয়াটা কী ঠিক হবে।

আবিরের মুখে পুনরায় অরন্যের কথা শুনে একটু বিরক্তি আসলেও সামলে নিলাম। অরন্যের সাথে এখন আমার অদ্ভুত মিল আছে সে আকাশ দেখছে আর আমিও। আমি আবিরকে হালকা গলায় বললাম

– ভাইয়া কী তোমাদের সাথেই থাকে। আর ভাইয়াকে চেনো কতদিন যাবত?

– অনেকদিন। আর আমাদের সাথে থাকে না। আমাদের কমপ্লেক্সের পাশেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। আগে পোস্টিং ছিল গ্রামে। দুই বছর চাকুরির পর ঢাকায় পোস্টিং হয়েছে। এরপর থেকেই আমাদের পাশের কমপ্লেক্সেই থাকে।

– আজকে বাসায় যায়নি? উনার পরিবার কী চিন্তা করবে না?

– এখানে ও একাই থাকে। ওর বাবা,মা বাড়িতে থাকে। আর ভাই বোন গুলো যে জায়গায় পড়ে সে জায়গায় হোস্টেলে থাকে।

– উনার স্ত্রী?

আবির আমার কথায় আচমকা হেসে জবাব দিল

– ও তো এখনও বিয়ে করে নি। স্ত্রী আসবে কোথায় থেকে?

আবিরের মুখে কথাটা শুনে আমি চমকালাম। অরন্য বিয়ে করেনি এটা কী করে সম্ভব।৷ অরন্যের বিয়ের ছবি আমি নিজে দেখেছি। বিয়ের পর প্রতিদিন সে তার বউকে নিয়ে ঘুরতে যেত আর সেটার ছবি নিজের ওয়ালে দিত। আর সবাই সে ছবি আমাকে স্ক্রিনশট দিয়ে পাঠাত। এ ছবির অত্যচারে আমি আমার আইডি ডিএকটিভ রাখি বহুদিন। কারণ নিজেকে সামলে নিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিই। সে সময় টা কাটিয়ে উঠা এত সহজ ছিল না। বলতে যতটা সহজ লাগে সংগ্রাম করাটা ঠিক তার বিপরীতে ছিল। অতীত ভুলাটা সহজ না।

“যে অতীতে একবার দাগ লেগে যায় সে অতীত ভুলা কঠিন।কাগজে যেমন পেন্সিলের দাগ টানার পর তা রাবার দিয়ে ঘষে তুলার পরও অস্পষ্ট দাগ বিদ্যমান থাকে। অতীতও ঠিক তেমন তাকে যতই মন থেকে মুছে ফেলা হোক না কেন অস্পষ্ট হয়ে সেটা মনের এক কোণে গেঁথে থাকে।”

আর আমি সে অতীতটাকে পেছনে ফেলে নিজেকে যোগ্য করে তুলি। কিন্তু আবির এসব কী বলছে। মিনেট পাঁচেক আমি চুপ। আবির কথা বলে যাচ্ছে হ্যালো হ্যালো বলছে আমি কিছুই বলছি না। কী বলব ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারছি না। আবির একটু জোরালো গলায় বলল

– অপ্সরা তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছো?

আমি এবার উত্তরে বললাম

– হ্যাঁ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কী জানি বলতেছিলাম আমি?

– অরন্যের বিয়ে নিয়ে।

– হ্যাঁ। আচ্ছা উনাকে চেনো কতদিন যাবত?

– বারবার এত প্রশ্ন করছো কেন? ওকে আমি ছোট থেকেই চিনি।

বুঝতে পারলাম আবির একটু বিরক্ত হয়েছে।।এভাবে বারবার অরন্যের বিষয়ে জেরা করা উচিত হচ্ছে না। এ রহস্যের উদঘাটন আমাকেই করতে হবে। আমি আবিরকে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললাম

– ঘুম পাচ্ছে অনেক। ঘুমানো দরকার। মা কী কিছু বলেছে বাসায় গিয়ে?

– মা রাত দশটায় ঘুমিয়ে পড়েছে আমরা বাসায় আসি রাত সাড়ে এগারটায়। মায়ের সাথে কথা বলার সুযোগ এখনও হয়নি। হলে জানাব। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আর অপ্সরা….

বলেই আবির থেমে গেল। আমি আবিরকে ডেকে বললাম

– বলো আবির কী বলবে?

– বড্ড ভালোবাসি তোমায়?

– আমিও বড্ড ভালোবাসি।

বলেই কলটা রেখে দিলাম। কাল কলেজে ক্লাস নেই। তাই দেরি করে ঘুমালেও সমস্যা হবে না। তবে অরন্য বিয়ে করেনি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। হুট করেই আমার আইডির ব্লক লিস্টে গিয়ে অরন্যের আইডিটা খু্ঁজতে লাগলাম। এতদিন ব্লক ছিল আর মুভ করার পর থেকে তার আইডি দেখার মতো রুচিও জাগে নি কখনও। তবে আজকে আইডিটা দেখতে ইচ্ছা করছে। আমি সাথে সাথে ব্লক লিস্ট খুঁজতে লাগলাম। খুঁজতে খুঁজতেই অরন্যের আইডিটা দেখে আমি পুনরায় আশ্চর্য হলাম।

চলবে

প্রাক্তন পর্ব-০৩

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৩

চোখের জলটা মুছে দৌঁড়ে গেলাম গলির মাথায়। গলির মাথায় গিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। এপাশ ওপাশ তাকিয়েও আবিরকে পেলাম না। আবিরকে সাথে সাথে কল দিলাম। আবির কলটা ধরেই বলল

– তুমি কোথায়?

– আমি গলির মাথায়। তুমি কোথায় আর ঠিক আছো তো?

– আমি একটু সামনের দিকে। তুমি সামনের দিকে আগাও। আর কিছু ঠিক নেই। সব শেষ হয়ে গেল মনে হচ্ছে। অরন্যও যে কী করে বসে।

আবিরের কথাটা শুনে বুকটা মুচরাতে লাগল। চোখে মুখে শোকের গ্লানি ভেসে উঠল। পাগলের মতো গলির থেকে সামনের দিকে এগুলাম। গলির শেষ মাথায় তিন রাস্তার মোড়ে একটা বড় রেস্টুরেন্ট। সেটার সামনে যেতেই আচমকা পার্টি স্প্রে এর আক্রমণে মনে হচ্ছে সাদা মেঘে ভেসে যাচ্ছি। বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে এসব। বাসায় গেলাম মাত্র আধা ঘন্টা হলো এর মধ্যেই এত জরুরী তলব এখন আসার পর এসব আচমকা পার্টি স্প্রে ছাড়ার কারণটা বুঝতে পারছি না। আমি বেশ রেগে গিয়েই চোখে মুখে থাকা পার্টি স্প্রেটা হাত দিয়ে সরিয়ে বললাম

– কী শুরু করেছো এসব? হুট করে এমন করে ডেকেছোই বা কেন? আবির বিষয়টা বেশ বিরক্তিকর লাগছে।

বলেই যখন আবিরের দিকে তাকালাম তখন খেয়াল করলাম অরন্য দাঁড়িয়ে আছে। আমার জোরালো কন্ঠ শুনে অরন্যের পেছন থেকে আবির সামনে এসে বলল

– অপ্সরা রেগে গেলে নাকি?

– রাগব না তো কী করব বলো? এমনভাবে ডেকেছো আমি ভেবেছি কী না কী হয়েছে।৷ এসে দেখি এমন।আমি এর কোনো মানেই বুঝতেছি না।কতটা চিন্তিত ছিলাম আমি সেটা কী উপলব্ধি করতে পেরেছো?

আবিরের মুখটা চুপসে গেল। হালকা গলায় জবাব দিল

– অপ্সরা রাগ করো না। অরন্যের আজকে এক্সিডেন্ট হয়েছে তাই ওর কাছে বারবার মনে হচ্ছিল আজকের দিনটা ওর এক্সিডেন্টের জন্য মাটি হয়ে যাচ্ছে। ও আগে থেকেই আমাদের জন্য প্ল্যান করে রেখেছিল।তবে এক্সিডেন্ট হওয়ার জন্য সে প্ল্যান সঠিক সময়ে কাজে লাগাতে পারে নি। তুমি হাসপাতাল থেকে আসার পর ওর খুব ইচ্ছা হলো আমাদের জন্য কিছু করার। তাই তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এভাবে আসতে বলল।

আবিরের মুখে কথাটা শুনার সাথে সাথে আমার রাগটা সাথে সাথে দমে গেল। আমি চুপ হয়ে গেলাম। মাথায় কিছুই কাজ করছে না। অরন্যের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে রহস্যময় হাসি দিচ্ছে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই অরন্য বলে উঠল

– ভাবি আমি দুঃখিত যদি বিরক্ত করে থাকি। রাগানোর জন্য মোটেও এমন করি নি। আমি শুধু আপনাদের একটা সারপ্রাইজ দিতে এমন করেছি। আমি সত্যিই আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। বিষয়টা যদি বাড়াবাড়ি হয়ে যায় তাহলে আমাকে মাফ করে দিয়েন।

আমি কী বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অরন্যকে না বুঝেই উত্তর দিলাম

– আমি একটু চিন্তিত ছিলাম। ভাবলাম আবিরের কিছু হয়ে গেল কী না। সে সাথে আপনিও অসুস্থ ছিলেন। তাই সবমিলিয়ে এমনটা আশা করতে পারে নি। তাই একটু উচ্চ সুরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। মনে করার কিছু নেই।

অরন্য আমার কথা শুনে মুখে হাসির রেখা টানল। মুখটাকে প্রশস্ত করে হাসি দিয়ে বলল

– তাহলে চলুন ভেতরে গিয়ে বসা যাক। আপনার জন্য বিশেষ একটা সারপ্রাইজ আছে।

আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম

– আবার কিসের সারপ্রাইজ। আর আপনার শরীর ঠিক আছে তো?

– আমার শরীর একদম ঠিক। ডাক্তারদের এত সহজে ভেঙ্গে পড়লে হয় না। ( বলায় তো হয়নি অরন্য পেশায় একজন ডাক্তার)।

পাশ থেকে আবির আমার হাতটা টেনে ধরে বলল

– হয়েছে সব বিষয় নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না। চলো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। অরন্য আমাদেরকে কী সারপ্রাইজ দেয় দেখি।

বলেই হাতটা টেনে রেস্টুরেন্টের দিকে যেতে লাগল।আমিও রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে গেলাম। রেস্টুরেন্টের এক কোণে আমি আর আবির বসলাম।অরন্য সে মুহূর্তে একটা কেক এনে বলল

– তোদের এনিভার্সারি সরি এনগেজমেন্ট উপলক্ষে একটা কেক আনলাম। অপ্সরাকে কেটে সিলেব্রেশন করতে বলবি। কেমন?

আবির উৎকন্ঠা নিয়ে কেকের বক্সটা অরন্যের হাত থেকে নিয়ে বক্সটা খুলল। বক্সটা খোলার সাথে সাথে আবিরের মুখটা মলিন হয়ে গেল। আবিবের মুখটা মলিন হতে দেখে আমি কিছুটা উৎসুক হয়ে কেকের দিকে তাকালম। কেকের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম।কারণ কেকে লেখা ” শুভ ৪র্থ তম বিবাহ বার্ষিকী”।

লেখাটা দেখেই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। অরন্য কিসের সিলেব্রেশন করতে চাচ্ছে সে কী চার বছর আগে ঘটা বিয়ের সিলেব্রেশন করতে চাচ্ছে নাকি আমাদের এনগেজড এর। এসব ভাবতে ভাবতেই আবির অরন্যকে বলে উঠল

– কী রে অরন্য এ কেকের উপর এমন লেখা কেন?

অরন্য আবিবের কথায় সাড়া দিয়ে বলল

– কেন কী লেখা?

আবির অরন্যের দিকে কেকটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল

– দেখ কী লেখা।

অরন্য কেকটা দেখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে বলল

– হয়তো যারা লিখেছে তারা ভুল করেছে। এজন্যই সাথে দাঁড়িয়ে থেকে একটা জিনিস আনা উচিত।অনলাইনে অর্ডার দিলে এমনেই হয়। কী লিখতে বলে দিয়েছি আর কী লিখে দিয়েছে। এখন তো চাইলেও ঠিক করতে পারব না। এক্সিডেন্ট টা না হলে এমন হতো না।সব কাজে ঝামেলা হচ্ছে শুধু।

বলেই অরন্য উত্তেজিত হয়ে গেল।অরন্যের উত্তেজনা দেখে আবির অরন্যকে সাত্ত্বণা দিয়ে বলল

– এত রাগ করার মতো কিছু হয়নি।ভুল তো মানুষেই করে। হয়তো অন্য কাস্টমারেরটা ভুল করে এখানে লিখে ফেলেছে। সমস্যা নেই কেক তো কেটে খাবই।ভুল লেখা থাকলেই কী আর ঠিক লেখা থাকলেই কী। আমরা তো ভুল ঠিক জানি। কোনটা ভুল কোনটা ঠিক। আমরা বুঝে নিলেই হবে। তুই যে কষ্ট করে আমাদের জন্য এতকিছু করেছিস এটাই তো অনেক। ব্যপার না। এত প্যারা নিস না। আমি আর অপ্সরা কিছুই মনে করিনি।আমরা বিষয়টা ম্যানেজ করে নিচ্ছি।কী বলো অপ্সরা।

কথাটা শেষ করেই আবির আমার দিকে তাকাল।আবিরের চাহনী দেখে আমি কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম

– যা হয়েছে তো হয়েছেই। সমস্যা নেই এভাবে কেটে নিলেই হবে।

কথাটা বলা শেষ করতেই আবির আমার দিকে ছুরিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল

– নাও। এবার কাটি চলো।

আমি ছুরিটা নিয়ে যখনই কেকটা কাটতে যাব ঠিক তখনেই আরন্য আটকে দিয়ে বলল

– একটু থাম আবির, ভাবির জন্য একটা উপহার আছে।

বলেই একটা বড় বক্স আমার দিকে এগিয়ে দিল। আবির বেশ উৎসাহ নিয়ে বক্সটা খুলতে গেলে অরন্য আটকে দিয়ে বলল

– আরে আবির গিফট টা আমি অপ্সরাকে দিয়েছি তোকে না। তুই পরে জেনে নিস কী দিয়েছি। আমার সামনেই বক্স খুলা শুরু করেছিস কেন? সত্যিই তুই কিছু বুঝিস না। বোকা বোকা কাজ করিস। বিয়ের এক্সসাইটমেন্টে ইদানীং একটু বেশিই বোকা হয়ে যাচ্ছিস।

অরন্যের কথা শুনে আবির মাথা চুলকাতে চুলকাতে আমার দিকে তাকাল। গালটা হালকা ফুলা করে পরক্ষণেই গালের ভেতরের সবটা বাতাস বের করে বলল

– বাসায় গিয়ে বলো কিন্তু কী দিয়েছে। আর চলো কেকটা কেটে ফেলি।

আমি আর আবির কেকটাতে ছুরি লাগালাম। মনে হচ্ছিল ছুরিটা আমার বুকে আঘাত করছিলাম। কী থেকে কী হচ্ছে সব যেন এলোমেলো লাগছে। কেকটা কেটে হালকা কিছু খেয়ে নিলাম। রাত তখন নয়টা বাজে। মায়ের কল পাওয়ার পর মনে হলো বেশ রাত হয়ে গেছে। আমি কলটা ধরতেই মা বলল

– কী রে কোথায় তুই? রাত নয়টা বাজে এখনও বাসায় আসছিস না।

– মা আবিরের সাথে। এইতো চলে আসবো এখনি।

– আবিরকে দে তো।

মায়ের কথা মতো আমি আবিরের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিলাম। আবির মায়ের সাথে কথা বলে ফোনটা রেখে বলল

– তোমার মা তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে। চলো দিয়ে আসি তোমায়।

আমিও বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। এর মধ্যে অরন্য বলে উঠল

– আবির তুই অপ্সরাকে দিয়ে আয়। আমি অন্য গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছি।

– আরে বোকা তোকে একা ছাড়ব নাকি। এমনিই চুট পেয়েছিস। আমাদের সাথেই চল। অপ্সরাকে নামিয়ে আমি আর তুই চলে আসব।

অরন্য আর না করলো না। এর মধ্যে আবির বলল

– আমি ওয়াশ রুম থেকে আসতেছি একটু। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো অপ্সরা। দুই মিনিট লাগবে শুধু।

আমি মাথা নাড়লাম। আবির ওয়াশ রুমে গেল। অরন্য হালকা হেসে এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল

-চার বছর আগে যে ইচ্ছা পোষণ করেছিলে চার বছর পর সেটা পূরণ করে দিলাম। আমাদের চতুর্থ বিবাহ বার্ষিকী পালন করে ফেললাম। কেমন লেগেছে বলো?

আমার বুক তখন কাঁপতে লাগল। কেন জানি না সবকিছু একটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আর এত দ্রূতই সবকিছু হচ্ছে যে কী করা ঠিক বা ঠিক না সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। এখনও আমার আর অরন্যের ডিভোর্স হয়নি। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ বা আইনের দৃষ্টিতে ও আমি আর অরন্য স্বামী স্ত্রী। যদিও সে সম্পর্কটাকে আমি মন থেকে ঘৃনা করি। সে সাথে অরন্যকে। তবুও কেন জানি না তার প্রতি আমার ক্ষীণ অনুভূতি চলে আসে। যদি তার প্রতি আমার অনুভূতির ঘর ভর্তি শূন্যতা থাকত তাহলে এতটা দূর্বলতা তার প্রতি এত বছর পরও কাজ করত না। কিন্তু যত দূর্বলেই আমি তার প্রতি হই না কেন মন থেকে আমি তাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃনা করি। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী তাকে মনে করি। যে কী না আমাকে এতকিছুর পরও টাকার জন্য ছেড়েছিল। কিন্তু আজ চার বছর পর কেনই বা সে এমন করছে। হুট করে তার এ পরিবর্তন আমাকে একটু হলেও ভাবাচ্ছে। আমি চুপচাপ এসব ভেবে একের পর এক প্রশ্নের উত্তর মেলানোর চেষ্টা করছিলাম। এর মধ্যেই আবির এসে বলল

– চলো তাড়াতাড়ি।

তিনজনেই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠলাম। আমি আর আবির সামনে বসলাম আর অরন্য পেছনে। আমি এবার কিছুটা ইচ্ছা করেই আবিরের কাঁধে মাথাটা হেলিয়ে দিলাম। আবির আমার মাথার সামনে থাকা কয়েকটা চুল আঙ্গুলে প্যাঁচ দিয়ে একটু টেনে পরক্ষণেই তা ছেড়ে দিয়ে বলল

– কী হয়েছে?

– মাথা ব্যথা করছে। একটু এভাবে থাকি।

আমি মোটেও আবিরের সাথে এত খোলামেলা ছিলাম না। আবিরের সাথে আমার পরিচয় পাঁচ মাসের। পাঁচ মাসে আবিরের সাথে বেশ ফ্রি হয়ে গেলেও এভাবে কখনও মাথা রাখে নি৷ আজকে হুট করে এভাবে মাথা রাখতেই আবিরও হালকা অবাক হলেও চুপ ছিল। আবির গাড়িটা স্টার্ট দিল। গাড়ির সামনের আয়নায় পেছনে থাকা অরন্যের মলিন মুখটা ভেসে আসছে। বেশ শান্তি লাগছে এখন।

বাসার সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে বাসার দিকে পা টা বাড়াতেই অরন্য পিছু ডেকে বলল

– ভাবি গিফট টা রেখে যাচ্ছেন।

বিরক্তি নিয়ে পেছনে তাকিয়ে গিফটটা হাতে নিলাম। তাড়াতাড়ি করে বাসায় এসে রুমে ঢুকলাম। রুমে ঢুকেই শাড়িটা প্রথমে পাল্টে নিলাম। তারপর অনেকটা ফ্রেশ হয়ে বিছানার কাছে এসে বক্সটা খুললাম। বক্সটা খোলার পর আমার অস্থিরতা আরও বাড়তে লাগল। এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল সব। পুরনো অতীত,পুরনো স্মৃতি সব সামনে এসে জমা হলো। আগে সবাই বলত সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। অতীত ধুয়ে মুছে বিনষ্ট হয়ে যাবে। তবে এখন মনে হচ্ছে কোনো কোনো সময় অতীত ধুয়ে মুছে বিনষ্ট হয়ে গিয়েও সময়ের পরিক্রমায় তা পুনরায় ব্যগরা দিয়ে বসে।

চলবে

প্রাক্তন পর্ব-০২

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা।
#পর্ব- ২

কিন্তু তিন থেকে চার বার কল দেওয়ার পরও আবির কলটা ধরল না। আমি ফোনটা পাশে রেখেই অস্থির মনে আকাশের দিকে তাকালাম। তিনটা বছর পর এমন আনমনা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছি মনে হচ্ছে। বাইরে থেকে মৃদু মন্দ বাতাস তখন শরীরে এসে ঝাঁপটা দিচ্ছিল। এর মধ্যেই ভাবি এসে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল

– কী ব্যপার ননদীনি চুপ কেন? আর আনমনা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েই বা আছো কেন? তবে আজকে একটা ব্যপার খুব অদ্ভুত লেগেছে।

আমি নিজের মনকে সামাল দিয়ে বললাম

– কোন ব্যপারটা?

– ঐ যে তোমাকে আংটি পড়িয়েছে পাত্রের পাশের ছেলে। আমার তো একদম বলে দিতে মন চেয়েছিল যে পাত্র ছাড়া পাত্রের পাশের জন কেন আংটি পড়াবে। আর বাবা, মা ও একদম চুপ কেন ছিল বুঝতে পারছিলাম না।ঐ মুহূর্তে কেন জানি না মনে হচ্ছিল সবাই চিন্তিত। এত ফ্যাকশে হয়ে ছিল কেন বলো তো?

আমি ভাবি কে কী জবাব দিব বুঝতে পারছিলাম না। সারা গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠল। ভাবি এ বাসায় এসেছে দু বছর যাবত। উনি অরন্যের ব্যপারে তেমন কিছুই জানে না। নীরবতা বিরাজ করছে চারদিকে। আমি নিশ্চুপ। ভাবি হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল

– কী ব্যপার এত চুপ কেন? কখন থেকে একা একাই বকে যাচ্ছি।

এর মধ্যেই আমার ফোনে কল আসলো। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম অবির কল দিয়েছে। ভাবির কথা উপেক্ষা করে ফোনটা হাতে নিয়ে বেলকনির দিকে এগুলাম। ভাবি তেমন কোনো কর্ণপাত না করে রুম থেকে চলে গেল। আমি বেলকনিতে গিয়ে কলটা ধরতেই আবির বলে উঠল

– অপ্সরা সরি। অরন্য হুট করে এক্সিডেন্ট করে বসে যার কারণে ঐ সময়টায় খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কল ধরতে পারিনি।

অরন্য এক্সিডেন্ট করেছে শুনে বুকের ভেতরটায় তুলপাড় শুরু হয়ে গেল। পুরনো সে আবেগটা যেন মনে আবার বাসা বাঁধতে শুরু করলো। আমি অস্থির গলায় বললাম

– এখন উনার কী অবস্থা? আর কোথায় আছে?

– মাথায় হালকা চুট পয়েছে। আর এখন হাসপাতালে আছি একটু পর বাসায় যাব।

– কোন হাসপাতালে?

– তোমাদের বাসার কাছেই হাসপাতালে।

– আমি কী আসব?

– এখন আর তোমাকে আসতে হবে না। মা কে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। অরন্য একটু সুস্থ হলে ওকে নিয়ে আমি বাসায় চলে যাব।

– আসি একটু। তোমার সাথেও আবার দেখা হয়ে যাবে।

আবির হালকা হেসে জবাব দিল

– তা আমার সাথে দেখা করতে আসবে নাকি অরন্যকে দেখতে। মনে তো হচ্ছে অরন্য বাহানা মাত্র।

– তুমি যা ইচ্ছা ভাবো।

বলেই মুখটা গোমরা করে ফেললাম। আবির এবার হালকা গলায় বলল

– আচ্ছা আসো।

আমি আবিরের কথার কোনো জবাব দিলাম না। কলটা কেটে বেরিয়ে পড়তে লাগলাম।মা আমার পথ আটকে দিয়ে বলল

– কোথায় যাচ্ছিস?

– এই তো আবির কল দিয়েছিল। ওর সাথে একটু কথা আছে। সামনের গলিতে দাঁড়িয়ে আছে।

মা আমার দিকে তীব্র সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। মায়েরা হয়তো সত্যিই টের পায় সব। আমিও মায়ের দিকে তাকালাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে কটু গলায় বলল

– আমাকে আড়াল করছিস না তো কিছু?

– মা তুমিও না। এখন কী আড়াল করে কিছু করার বয়স আছে নাকি। চাকুরি করছি। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। এখন তো সব বলেই করার বয়স।হুট করে এমন কথা জিজ্ঞেস করছো যে?

মা চোখটা অন্য দিকে নিয়ে বলল

– না কিছু না এমনি। যা তোর কাজে যা।

বলেই মা ঘরের দিকে পা বাড়াল। আমিও ঘর থেকে বের হলাম। অরন্য আসার ব্যপার টা আমার পরিবারে প্রভাব ফেলেছে সেটা বেশ ভালোই বুঝা যাচ্ছে। আমার পরিবার হয়তো বিয়েটা নাকোচ করে দিত। তবে আমার পছন্দে ওরা এসেছে তাই না করেনি। এ চার বছর আমাকে বিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। কেন জানি না আবিরের সাথে কথা বলার পর তার প্রতি এক অদ্ভুত মায়া কাজ করেছিল তাই ফেলে আসা অতীতটা মুছে দিয়ে নতুন জীবনে পা রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে জীবনের শুরুতেই যেন অতীতটা আবার সামনে থুবরে পড়ল। ভাবতে ভাবতেই হাসপাতালের সামনে এসে আবিরকে কল দিলাম। আবির কল ধরে বলল

– তুমি বাইরে দাঁড়াও আমি আসছি।

বলেই কলটা কেটে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার সামনে হাজির হলো। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল

– কী ব্যপার এত অস্থির কেন? একটু আগে দেখলে আবার দেখার লোভ সামলাতে পারো নি তাই না?

আমি ভ্রুটা কুচকে বললাম

– মোটেও তা না। তোমার বন্ধু অসুস্থ তাকে দেখতে আসলাম।

– কে বলেছে অরন্য আমার বন্ধু?

আবিরকে এবার জিজ্ঞেস করার মূখ্যম সুযোগ পেলাম অরন্য তার কী হয় জানার। আমি চট করেই জিজ্ঞেস করে বসলাম

– ভাইয়া তাহলে তোমার কী হয়?

– ও আমার আত্মার ভাই হয়।

– মানে?

– সে এক লম্বা কাহিনি। পরে একদিন বলব। আপাতত চলো।

আমি আবিরের কথার কোনো মানে বুঝতে পারছিলাম না। কিসের আত্মার ভাই। আবির মাঝে মাঝে এমন হেয়ালি করে কথা বলে যার কোনো মানে আমি বুঝতে পারি না। এর মধ্যেই আবির হাত টানতে টানতে অরন্যের সামনে নিয়ে দাঁড় করাল। আমি অরন্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। অরন্য আমার দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা বলতে চেয়েও যেন আবিরের জন্য পারছিল না। অরন্য কিছু বলার আগেই আবির বলে উঠল

– তোর ভাবি তোকে দেখার জন্য ছটফট করছিল। তাই চলে এসেছে। বুঝ এবার তোর হবু ভাবির তোর প্রতি কত টান।

অরন্য চুপ। আমি আবিরের কথায় ব্যাগরা দিয়ে বললাম

– সবসময় তোমার হেয়ালি চলেই। চুপ করো তো একটু।

এমন সময় একজন নার্স এসে আবিরের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল

– স্যার এ ঔষধ আর ইনজেকশনটা আনতে হবে।

আবির কাগজটা হাতে নিয়ে আমাকে এক কোণে বসিয়ে বলল

– তুমি একটু বসো আমি ঔষধ গুলো নিয়ে আসতেছি।

বলেই অাবির বাইরে গেল। আমি এক কোণে বসে আছি। কোনো কথায় আমার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। শুধু বের হচ্ছে দীর্ঘ নিঃশ্বাস। এমন সময় অরন্যের কন্ঠ কানে আসলো। সে বলল

– কেমন আছো অপ্সরা?

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম

– এই তো বেশ ভালো। আপনি?

– ভালো আছি।

– আপনার স্ত্রী নাফিসা কেমন আছে?

অরন্য এবার চুপ। আমার প্রশ্নে যেন সে দ্বিধায় পড়ে গেল। আমি তাকে দুটানায় পড়তে দেখে আবারও জিজ্ঞেস করলাম

– বললেন না তো কেমন আছে আপনার স্ত্রী ।

ও হালকা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল

– ভালো আছে। আচ্ছা তুমি কী আজকের দিনটা ভুলতে পেরেছো?

– কেন আজকে কী কোনো স্পেশাল ডে ছিল নাকি?

– স্পেশাল কী না বলতে পারব না। তবে আজকে কত তারিখ বলো তো।

– ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখ।

– লিপ ইয়ার তাই না?

– হুম লিপ ইয়ার, কেন?

– আজ থেকে চার বছর আগে আমরা এদিনে একটা কাজ করেছিলাম সবাইকে আড়াল করে আর বলেছিলাম চার বছর পর সিলেব্রেট করব। ভুলে গেছ?

অরন্যের কথাটা শুনে আমি থমকে গেলাম। শরীরটা মেজমেজ করতে লাগল। এখানে বসে থাকার রুচিও জাগছে না। অরন্যের প্রতি একটা চাপা ক্ষোভ আমার সারা শরীরটা গ্রাস করছে। এত জঘন্য একটা মানুষকে আমি দেখার জন্য উতলা হয়ে পড়েছিলাম। আমার সারা শরীরে রাগটা ক্রমশ বাড়তে লাগল। কালো অতীতকে যতই ভুলতে চাচ্ছি ততই সেটা সামনে এসে চড়াও দিচ্ছে। অস্থিরতা কাজ করছে অনেক। নিজের অস্তিত্ব ক্রমশ বিলীন হতে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। আগের ভয়ানক সময় গুলো চোখের সামনে ভাসছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। সে মুহূর্তে আবির এসে বলল

– কী হলো যাচ্ছ কোথায়?

আমি হালকা গলায় বললাম

– ভালো লাগছে না বাসায় যাব। বলেই সামনের দিকে এগুলাম। আঁড়চোখে অরন্যের দিকে তাকালাম সে ও কোনো চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে।

আবির আমার হাতটা টেনে বলল

– কী হয়েছে? আমাকে বলো।

– মাথাটা ঘুরাচ্ছে।

– দাঁড়াও আমি দিয়ে আসছি তোমায়।

– তোমাকে যেতে হবে না। তুমি রোগী সামলাও। আমি যেতে পারব।

বলেই তড়িঘড়ি করে কেবিন থেকে বের হলাম। তাড়াহুড়ো করে একটা রিকশা নিলাম। রিকশায় বসে আকাশটার দিকে তাকালাম। তারা গুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ভেতরটা কেন জানি এত আলোর মাঝে থেকেও অন্ধকারে ডুবে আছে। আমি চুপ হয়ে রইলাম খানিক্ষন। রিকশাওয়ালা মামা বাসার সামনে এসে বলল

– মামা চইলা আইছি নামেন।

মামার কন্ঠে আমি ভাবনার ঘোর থেকে বের হলাম। মামাকে ভাড়া দিয়ে বাসায় আসলাম। বাসায় আসার পর চার বছর আগের স্মৃতিটা সামনে ভাসতে লাগল।

সেদিন ছিল ২০১৬ সালের লিপ ইয়ার। অরন্য সবে চাকুরিতে জয়েন করেছে৷ আমাকে সারপ্রাইজ দিবে তাই হুট করে ঢাকায় আসে। আমি অরন্যের সাথে দেখা করতে গেলাম। অরন্য আমার কাছে এসে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল

– তোমার জন্য চকলেট আনতে ভুলে গেছি।

– এ আর নতুন কী। সবসময় তো ভুলে যাও। এখন যাবে কোথায়?

– টি এস সিতে চলো। সেখানে তুমি আমাকে বাদাম ছিলে দিবে আর আমি খাব। পুডিং এনেছো তো?

– কখনও আনতে ভুল করেছি নাকি? এনেছি, ব্যাগেই আছে।

– তোমার বানানো পুডিং খেলে কী মনে হয় জানো?

– কী?

– মনে হয় বিষ খেয়েও অমৃত খাচ্ছি।

আমি রাগী চোখে তাকিয়ে বললাম

– তার মানে আমি তোমায় বিষ খাওয়ায়?

অরন্য আমার হাতটা ধরে বুকের কাছে নিয়ে বলেছিল

– হয়েছে রাগ করতে হবে না। কারণ রাগ করার জন্যই বলেছি। রাগ করলে বেশ সুন্দর লাগে তোমায়।

আমি মৃদু হাসলাম। এবার একটা রিকশা নিয়ে রিকশায় উঠে টিএসসির দিকে এগুতে লাগলাম। বরাবরেই অরন্যের কাঁধে মাথা রেখে ওর গায়ের গন্ধটা আপন করে নিচ্ছিলাম। এমন সময় মাথায় কী ঝেঁকে বসলো জানি না হুট করেই বলে উঠলাম

– চলো বিয়ে করে নিই। আজকে তো লিপইয়ার। চার বছর পর আমরা বিয়ে সিলেব্রেশন করব। পালিয়ে বিয়ে করার খুব ইচ্ছা।

অরন্যও আমার দিকে তাকাল। হুট করেই রিকশাওয়ালাকে বলল

– মামা আশে পাশে কোনো কাজী অফিস থাকলে চলেন।

মামাও কাজী অফিসে নিয়ে গেল। আমি অরন্যের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকালাম। সেদিন কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েটা করেও নিলাম। বিয়ে শেষে কাগজ পত্র গুলো অরন্যের কাছে রেখে দিলাম। আর অরন্যের দিকে যখন কবুল বলার পর তাকিয়েছিলাম তখন মনে হয়েছিল দুনিয়ার সবচেয়ে শুদ্ধতম পবিত্র চাহনীটা চাহিয়াছিলাম। সে চাহনী টা এখনও সামনে ভেসে আসছে। ধুপ করেই বর্তমানে ফিরে আসলো মন। অস্থিরতা বাড়তে লাগল। বিয়ের ব্যপারটা এখন পর্যন্ত পরিবার জানে না। আর যেদিন অরন্য বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছিল সেদিনও কেন জানি না লুকিয়ে করা বিয়ে নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে মন চাইল না। যেদিন শুনেছিলাম সে অন্যত্র বিয়ে করেছে সেদিন নিজের স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে না চাইতেও মেনে নিতে হয়েছিল। ক্রমশেই চোখটা ঝাঁপসা হয়ে গেল। জলটা গাল বেয়ে পড়তে লাগল। অতীত থেকে যতই দূরে যেতে চেয়েছিলাম না চাইতেও অতীতটা সামনে এসে পড়ল। আর অরন্যই বা কেন সে অতীতটা আজকে মনে করিয়ে দিল। সে তো তার পছন্দ মতো ময়েে বিয়ে করে সুখে আছে। আজকে কেন এত বড় ধাক্কাটা আমাকে দিতে হলো। আমাকে ভালো থাকতে দেখে অরন্যের বরাবরেই ভালো লাগে না। যতবারেই ভালো থাকি ততবারেই সে একটু একটু করে বিশাল বড় একটা ধাক্কা দিত। আজকে চারটা বছর পর ওর সাথে দেখা আজকেও তার ব্যতিক্রম করল না। ক্রমশেই নিঃশ্বাসটা ভারী হয়ে যেতে লাগল। এমন সময় আবির কল দিল। আবিরের কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে আবির অস্থির গলায় বলল

– অপ্সরা একটু তাড়াতাড়ি আসো। ভীষণ বিপদে পড়েছি।

বলেই আবির কলটা কেটে দিল। এর মধ্যে ভাবি এসে বলল

– অপ্সরা আবির কল দিয়েছিল, তোমাকে আবার একটু গলির মাথায় যেতে বলেছে। অনেক ইমারজেন্সি বললো।

আমার বুকটা ছেদ করে উঠল। আবিরকে এতটা সিরিয়াস হতে কখনও দেখি। বিষন্ন মনটায় ছটফটানি বাড়তে লাগল। অরন্যের অবস্থা খারাপ হলো না তো? চোখের জলটা মুছে দৌঁড়ে গেলাম গলির মাথায়।

চলবে।

প্রাক্তন পর্ব-০১

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা।
#পর্ব-১

আজকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসতেছে। বেশ সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন পাত্র পক্ষ আসবে দেখতে। অপেক্ষার প্রহর বেশিক্ষণ গুণতে হলো না। মিনেট পাঁচেকের মধ্যে পাত্রপক্ষ চলে আসলো। ঘরের দরজার ওপাশ থেকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম পাত্রকে। এর মধ্যেই ভাবি এসে কানটা টেনে ধরে বলল

– কিছুক্ষণ পর তো দেখতেই পারবে এখন এত উতলা হচ্ছ কেন?

আমি আর কোনো কথা বললাম না। সরাসরি চুপ করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ভাবি এসে আমার হাতে শরবতের গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে বলল

– যাও এবার সামনে যাও। আর মন ভরে দেখো।

আমি পাত্র পক্ষের সামনে গিয়েই কেঁপে উঠলাম। পাত্রের ঠিক পাশেই আমার প্রাক্তন বসে আছে।যার সাথে আমার সম্পর্কের ছেদ হয়েছে চার বছর হলো। তখন আমার বয়স ছিল তেইশ। আর আজকে সাতাশে পা দিয়েছি। তাকে দেখে শুধু আমি না আমার পুরো পরিবার অবাক হয়েছে। কারণ আমার প্রাক্তনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েও বিয়ের একদিন আগে বিয়েটা ভেঙ্গে গেছিল। কোনোভাবেই বুঝতে পারছি না আবিরের সাথে অরন্যের যোগসূত্র কী করে? আবির হলো আমাকে দেখতে আসা পাত্র আর অরন্য হলো আমার প্রাক্তন। অরন্যকে দেখার পর তার চোখে আমার চোখ পড়ল। তার সে চেনা চোখ যেন আজ বড্ড অচেনা। কেন জানি না তার চোখে চোখ পড়তেই আগের সব সামনে ভেসে উঠল।আমি দ্রূত তার চোখ থেকে চোখটা সরিয়ে নিলাম আর সে ও নীচের দিকে তাকিয়ে পড়ল। তার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার পরিবারের দিকে তাকালাম।লক্ষ্য করলাম আমার মতো তারাও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারাও হয়তো জানত না আবিরের সাথে অরন্যের যোগসূত্র আছে। আমি চুপ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। শরীরে বল পাচ্ছিলাম না। হাত দুটো কাঁপতেছিল। এর মধ্যেই আবিরের মা বলে উঠল

– কী ব্যপার মা দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।

বলেই আবিরের ঠিক পাশে জায়গা করে দিল। আমি শরবতের গ্লাসটা রেখে যতই আবিরের দিকে এগুচ্ছিলাম বসার জন্য ততই বুকটা কাঁপতে লাগল। বেশ সাহস সঞ্চয় করে আবিরের পাশে বসলাম। আবিরের ঠিক পাশেই অরন্য বসা। আবিরের পাশে বসতেই আবিরের মা আমার থুতুনীটা ধরে মুখটা তুলে বলল

– বাহ! আমার মা তো দেখতে মাশআল্লাহ। আমার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে।

আবিরের মায়ের মুখে এমন প্রসংশা শুনার পর মন না চাইতেই আমার প্রাক্তনের মায়ের কথা মনে পড়ল যিনি কী না আমাকে বলেছিল আমার মুখটা গ্রাস কার্প মাছের মতো বড়। আমার গায়ের রঙ এই শুধু ফর্সা।আমার চেহারা ভালো না। আমি খাটো অথচ আমি লম্বায় আমার প্রাক্তনের সমান ছিলাম। প্রাক্তনের মায়ের সে কথাতে আমি তখন কোনোকিছুই বলে নি শুধু শুনে গিয়েছিলাম। মনে কষ্ট পেলেও মনকে বুঝ দিয়েছিলাম মায়েরা তো সন্তানকে কত কিছুই বলে। আর আজকে যখন আবিরের মা এত প্রসংশা করল তাও প্রাক্তনের সামনে নিজের চোখে জলটা ছলছল করতে লাগল। আমি নিজেকে চাইলেও সামলাতে পারছিলাম না। চোখের কোণে জমে থাকা জলটা এই বুঝি পরে যাবে। এবার উনি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– তা তোমার নাম কী মা?

আমি মৃদু গলায় জবাব দিলাম

– অপ্সরা।

– সত্যিই তো তুমি অপ্সরী। নামের সাথে রূপের অনেক মিল আছে। তা তুমি কী করতেছ?

আমি গলার সুরটা একটু নীচু করে বললাম

– কলেজে শিক্ষকতা করছি পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে। আর সে সাথে একটা ব্যবস্যাও আছে।

কথাটা বলার সাথে সাথে আবিরের মা বলে উঠল

– আমার ছেলের পছন্দ এত ভালো হবে বুঝতে পারেনি। তোমার যদি কিছু নাও থাকত তোমাকেই আমার বাড়ির বউ করে নিতাম। এত কিছু করো মাশআল্লাহ।

আবিরের মায়ের মুখে এ কথাটাও শুনার পর মনটা কেমন জানি আনমনা হয়ে গেল। অতীতে ডুবে গেলাম পুনরায়। চার বছর আগে আমার প্রাক্তন আমাকে বাদ দিয়েছিল আমি সাধারণ একটা ভার্সিটিতে পড়ি,কোনো জব করি না,আমার জীবনে আমি কিছু করতে পারব না সেজন্য। অথচ তখন আমার জীবনে চাকুরী বা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রবল ইচ্ছা ছিল না। শুধু ইচ্ছা ছিল অরন্যের বউ হব। ওকে নিয়ে সংসার করব। কিন্তু যেদিন অরন্য দশ বছরের সম্পর্ক বিয়ের আগের দিন এই কারণে ভেঙ্গে দিয়েছিল সেদিন আমি জানি কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম। এত অপমান সহ্য করেছিলাম যে চারপাশের সবাই আমাকে নিয়ে উপহাস করত। অথচ অরন্যকে ভালোবাসতাম সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে। তার যখন চাকুরী ছিল না তখনও আমি তারেই ছিলাম। আর তার চাকুরী হওয়ার পর সে হয়ে গেল অন্য কারও। স্বার্থপরতা কাকে বলে সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম। অরন্যকে সেদিন বলেছিলাম আমাকে একটু সময় দাও। সময় দিলেই দেখবে ভালো কিছু করে দেখাতে পারব। প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হয়েই দেখাব আমি। তিনটা বছর সময় দাও। সেদিন তার থেকে তিনটা বছর সময় আমি পাই নি। বরং শুনতে হয়েছে আমার দ্বারা কিছু সম্ভব না। কিছুদিন পর তার অন্যত্র বিয়ের খবরটা কানে আসে। মানতে খুব কষ্ট হয়েছিল। দশ বছরের সাধনার বস্তুটা অন্য কেউ সাধনা না করেই পেয়ে গেল সেটা মানতেই পারছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছিল আল্লাহ আমার দরখাস্তটা কেন কবুল করল না। অথচ যে মেয়ে অরন্যকে চায়নি সে পেয়ে গেল। কোনোভাবেই মনকে সেদিন বুঝাতে না পেরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। মা বুঝিয়ে বলল কষ্ট পেও না। সব ঠিক হয়ে যাবে। বাসার সবাই শাত্ত্বণা দিতে লাগল। দু একবার মরতে গেছিলাম কিন্তু পরিবারের জন্য বারবার ব্যর্থ হয়েছি। মানা বা সহ্যের বাইরে চলে গেছিল ব্যপারটা তবুও মেনে নিয়েছিলাম। আজকে আমি ঠিকেই প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা তবে সে আজ প্রাক্তন।

মনটা অস্থির হয়ে যাচ্ছে। হালকা হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ছি। আবিরের মা আবারও আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– চুপ কেন মা? আমাকে বুঝি শ্বাশুড়ি হিসেবে পছন্দ হয়নি?

আমি এবার অতীত থেকে বর্তমানে এসে মোলায়েম কন্ঠে উত্তর দিলাম

– তা কেন হবে মা? আপনাকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।

আবিরের মা মৃদু হাসলো।

আবির পেশায় একজন গণপূর্ত ক্যাডার।আবিরের সাথে পরিচয় হয় একটা এক্সিডেন্টের মাধ্যমে।সেদিন আমি রাস্তা দিয়ে আনমনে হেঁটে কোথায় যেন যাচ্ছিলাম। হুট করে একটা গাড়ি এসে আমাকে ধাক্কা দেয়।তারপর কী হয় বুঝে উঠার আগেই আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাই। গাড়িটা আবিরের ছিল। আবির গাড়ি থেকে নেমে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার চোখ মুখ তখন ঘোলা। ঘোলা চোখে আবিরকে শুধু দেখেছিলাম। আবির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর জ্ঞান ফেরার পর আবিরের সাথে আমার আর দেখা হয়নি। আমার পরিবার বলেছে আবির ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিয়েছে।তার জরুরি একটা কাজ আছে সে কাজের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। সেখান থেকে সে আমার খোঁজ নেয়। তারপর ফোনে কল দেয় আর কিছুদিন কথা বলার পর আজকে পুরো পরিবার নিয়ে আসে। আবির আমার যোগ্যতা দেখেনি,রূপও না। তবে তার ভালো লাগার কারণটা আমি জানি না। শুধু অনুভব করতে পারি আবির আমাকে অনেক পছন্দ করে। আমার প্রাক্তনও একজন বিসিএস ক্যাডার ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা । সে আমাকে বাদ দেওয়ার আরেকটা কারণ ছিল আমাদের বন্ডিং নাকি স্ট্রং হবে না। কারণ আমি তখন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ছিলাম না। অনার্স পড়ুয়া একটা স্টুডেন্ট ছিলাম।আর সে তখন বিসিএস ক্যাডার। তাই সে এ বিষয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছিল বিয়ের ঠিক আগেরদিন। আর তখনই বিয়েটা ভেঙ্গে অন্যত্র বিয়ে করে নেয়।

অথচ সম্পর্ক ছেদের চার বছর পর এত সংগ্রাম করে সে পথ পাড়ি দিয়ে আজকে আমার বিয়ে ঠিক হতে যাচ্ছে অন্য একজনের সাথে আর আজকেই আমার কালো অতীতটা সামনে এসে হানা দিল। আবিরের মায়ের কথায় অতীতে ডুবে থাকা আমার মনটা বর্তমানে আসলো। আবিরের মা এবার সবাইকে বলল

– আমার তো মেয়ে বেশ পছন্দ হয়েছে। আপনারা বললে আজকেই রিং পড়িয়ে দিয়ে যাব। এ মেয়ে কে তো আমার আজকেই ঘরে নিয়ে যেতে মন চাচ্ছে। তবে সব কিছু গুছানো হয়নি বলে পারলাম না।

আমার বাবা, মা কথাগুলো শুনে হাসি মুখে বলল

– এ তো খুশির কথা। আপনার যা মর্জি। মেয়ে তো এখন আপনারেই।

– তা তো ঠিকেই বলেছেন। আবিরের বাবা থাকলে আজকে অনেক খুশি হতো। আমি আমার ছেলেটাকে তার বাবার মৃত্যুর পর অনেক আদর যত্ন করে মানুষ করেছি। একটা মাত্র ছেলে আমার। আপনার মেয়েকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার বাড়িতে তার কষ্ট হবে না। মা মেয়ে মিলে বেশ ভালো থাকব।

এরপর অরন্যের দিকে তাকিয়ে আবিরের মা বলল

– অরন্য পাত্রী পছন্দ হয়েছে তো?

আবিরের মা কথাটা বলার সাথে সাথে আমার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল।সেই সাথে আমার পরিবারেরও মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এমন একটা পরিস্থিতিতে এত বছর পর পড়ব বুঝতে পারি নি। কালো অতীতটা কাটিয়ে উঠার পরও যেন আজকে আবার সামনে এসে পড়ল।

আমি অরন্যের দিকে তাকালাম। অরন্যও আমার দিকে তাকাল। তার চোখে চোখ পড়তেই সে পুরনো ভালোবাসাটা চড়াও দিয়ে উঠল। হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগল। হার্টবিট বেড়ে যেতে লাগল। ঘামতেও লাগলাম। অরন্য চাপা গলায় জবাব দিল

– আমি তো আগেই বলেছিলাম আন্টি, আবিরের পছন্দ খারাপ হবে না। সব দিক দিয়েই পারফেক্ট মাশআল্লাহ।

অরন্যের কথা শুনে ভেতরে একটা ব্যাঙ্গ হাসি উঠল। একসময় যে বলত আমি ইমপারফেক্ট আমারা দ্বারা কিছুই হবে না। আজ সে বলছে আমি পারফেক্ট। আবিরের মা অরন্যের কথা শুনে আবিরের দিকে আংটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল

– আবির অপ্সরাকে পড়িয়ে দে তো।

আবির আংটিটা নিয়ে পড়াতে নেওয়ার সময় বাসার বিড়ালটা আবিরের পাশ ঘেষে যায়। ফলে আংটিটা আবিরের হাত কেঁপে নীচে পড়ে যায়। আংটিটা পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে অরন্য আংটিটা তুলে আবিরের দিকে বাড়িয়ে দিল। আবির একরাশ হেসে আমার হাতটা ধরে অরন্যের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল

– নে পড়া। আমি তো হাত ধরেই আছি। বিড়ালটা এমন সময় এমনভাবে আসলো হাতটা কেঁপে উঠেছিল। আমি আবার পড়াতে নিয়ে পড়ে যায় কী না ভয় লাগছে। তুই এই পড়া।

অরন্য আবিরের কথার জবাব না দিয়েই আমার হাতে আংটিটা পড়িয়ে দিল আর আবির হাতটা ধরে রাখল। এদিকে কেন জানি না বিষয়টা বেশ অসহ্যকর লাগতে লাগল৷ আমি নিজেকে তবু সামলে নিলাম।

আবিরের মা বেশ খুশি৷ আমার বাসার সবাই খুশি। আবির,অরন্য আর আমার হবু শ্বাশুড়ি আংটি পড়ানো শেষে নাস্তা করে বিদায় নিল।

আর আমি ঘরে এসে কাপড়টা না পাল্টেই জানালার পাশে বসলাম। আগের অতীতটায় কেন জানি ডুব দিতে মন চাচ্ছিল। কত ভালোবাসা আর আবেগ ছিল তখন। সেদিন ভালোবাসাটা হেরে গেছিল টাকার কাছে। কত ভাবনা মনে আসছে। অরন্য আবীরের কী হয়? সে প্রশ্নও বারবার মনে আসছে। প্রশ্নটা মনে আসতেই মনে হলো আবিরকে কল দিয়ে জানা দরকার অরন্য কী হয় তার। সাথে সাথে আবিরকে কল দিলাম। কিন্তু

চলবে

ভাবিনি ফিরে আসবে পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

0

ভাবিনি ফিরে আসবে
শেষ পর্ব
রোকসানা আক্তার

আমাদের কথাবার্তা শেষ হলে আমি সাথীর রুমে একটু উঁকি মারি।মেয়েটার সাথে এতটা মাস পর দেখা হলো,কিন্তু ভালোভাবে কথা বলা হয়ে ওঠেনি।
ওর রুমে প্রবেশ করতেই হালকা থমথমে পরিবেশে গটগট ফ্যানের আওয়াজ কানে বাঁজছে,ফাঁকা রুমটায় তাকাতে বেলকনিতে নজর পড়ে।সাথী একমগ্নে আকাশের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় নিঃশ্বাস ফেলছে।তার এলোমেলো কেশ বাতাসে হৈ হৈ উড়ছে।।আমি আস্তে হেঁটে ওর ডান পাশে গিয়ে দাড়াই বেলকনির রেলিং ধরে।।গলাটা ঝেড়ে বলি,
-সাথী কেমন আছিস??

হয়তো তার নয়ন পানিতে টলমল ,আমার শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি চোখদুটো মুছে নেয়।আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলে,
-এইতো ভালো ভাইয়া,আপনি??
আমি দু’হাত পকেটে গুঁজে বলি,
-হু,ভালো।।সবাই নিচে আর তুই এখানে একা একা কি করিস??
সাথী নীরবতার সহিত হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে পূব-আকাশের বড় ঔ চাঁদটিকে।
-তো চাঁদ দেখতে এসছিস??
-হু।(মাথানিচু করে)
আমি পকেট থেকে হাতদুটো বের করে হাই তুলতে তুলতে বলতে থাকি,
-রাতে নিরিবিলি আমারও একা একা চাঁদ দেখতে বড্ড ভালে লাগে।

সাথী আমার কথায় ড্যারা চোখে তাকিয়ে বলে,
-আপনার মনেতো কোনো দুঃখ নেই।দুঃখে ক্ষোভে ভরা মানুষগুলোই তার মনের যত অব্যক্ত কথা ঔ উজ্জ্বল্য চাঁদকে সপে।
-হিহিহিহিহিহি।
-হাসলেন কেন??
-সাথী,তুই কিন্ত আগ থেকে অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছিস।
-কেমন পরিবর্তন,ভাইয়া??
-এইযে আগে অনেকটা চঞ্চল ছিলি,কিন্তু এখন খুব গম্ভীর।মুখ দিয়ে যেন কথাই বের হয়না তোর।এইতো সেদিন,আমার কানের কাছে এসে মাছির মতো ভনভন করেছিলি।আর সেই ছোট্র মেয়ে এত বড় হয়ে গেল!?আমি পুরাই ফিদা।যাইহোক,ঘুমিয়ে পড়।রাত অনেক হয়েছে।আমিও ঘুমতে যাচ্ছি।
আমি পা বাড়াতেই পেছন থেকে সাথী বলে উঠে,
-মানুষ কখনো এমনি এমনি পরিবর্তন হয়না, ভাইয়া!পরিবর্তন তার পরিস্থিতিতে বাধ্য।

আমি ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে যাই।গূঢ়ার্থ কথার ব্যাখ্যা না বুঝতে পেরে আবার বলি,
-ম-মানে??

সাথী রেলিং থেকে হাতগুলো ছাড়িয়ে সরু হয়ে দাড়িয়ে বলে,
-আসলে মায়া জিনিসটা খুবই অদ্ভুত!এই মায়ার কারণেই মানুষ মানুষকে ভুলতে পারে না।বিধাতা আজন্ম পৃথিবীতে কেন মানুষের প্রতি মায়া,আবেগ,ভালোবাসা দিয়েছেন,নাহলে নিবৃওে কষ্ট পাওয়া মানুষগুলো রাত -ভোর জেগে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাতো না।।আর,আমি খুবই হ্যাপী,সোহানা আপুর মতো এমন দৃঢ় প্রত্যয়ী,সাহসী মনোবলের একজন লাইফ পার্টনার পেয়েছন।দোয়া করি,আপনারা আজীবন সুখী হোন।।(মুঁচকি হেসে বলে সাথী)
সাথীর কথায় আমি অনেকটা নাছোড়বান্দা।বুঝতেছি না কি থেকে কি বলবো।সাথী আবারও বলে উঠে,
-ভাইয়া,আপনি হয়তো ভাবেন আমি এখনো আপনাকে ভালোবাসি।হুম ভালোবাসি,তবে আমার ভালোবাসাটা জাস্ট ভালোলাগা।ক্ষণিকের দেখা ভালোবাসা থেকেও মনের ক্ষুদ্র কোণে অব্যক্ত ভালোবাসাটাই ট্রুলি লাভ যেটা সোহানা আপুর মধ্যে ছিল।নিজের জীবন দিয়েও নিজের প্রিয় মানুষটিকে এতটা কপটতার পর বিলিভ করেছেন,পাশে দাড়িয়েছেন,সে মানুষটিই আপনার যোগ্য ভাইয়া।আর আমার প্রিয় মানুষটির জন্যে যিনি এতটুকু করেছেন,আমি তার কাছে চির কৃতজ্ঞতা থাকবো।কারণ,আমার প্রিয় মানুষটির ঔ প্রিয় মানুষটিও আমার প্রিয়।। আসলে,পৃথিবীত
আমার মনে কোনো দুঃখ নেই ভাইয়া,বরং আমি সবথেকে বেশি খুশি নিজের লালায়িত ভালোবাসার মানুষটিকে এত বছর পর নিজের করে পেয়েছেন।।।ভালো থাকুক আমার সেই প্রিয় মানুষগুলো।এই দোয়াই করি।।।

সাথীর কথাগুলো অনেকটা স্বাভাবিক,কিন্তু গভীরতা বিশাল।সাথী হয়তো এখনো আমায় অনেক ভালোবাসে যা তার গভীর অনুভূতিরাই জানান দিচ্ছে।যদিও সে মুখে বলছে না।কিন্তু আমারতো আর কিছুই করার নেই।। কারণ,আমি একজনকে ভালোবাসি।

এরইমধ্যে কাকিমা এসে হাজির।
-কি শাওন,কথাবার্তা হচ্ছে???আর এইযে সাথী?একা একা এখানে কি করো?আমরা সবাই নিচে কত্ত এনজয় করতেছি।আর তুমি এখানে হাওয়া খেতে এসছো??
–কাকিমা,সাথীর নাকি চাঁদ দেখতে ভীষণ ভাল্লাগ। তাই চাঁদ দেখতে আসছে।

-তুমিও একটু দেখ না,কাকিমা?প্লিজজ??
-দূর,ছাই!আমার কি এখন চাঁদ দেখার বয়স আছে নাকি?
-হিহিহিহিহি হাহহাহা।
কাকিমার কথায় সাথী এবং আমি কটকটিয়ে হেসে উঠি।
-যাইহোক,বহুৎ হাসছেন দু’জন।সাথী তোকে আপা(আমার মা)ডাকেন।যাও।।
-জ্বী কাকি।

সাথী মাথা হেলিয়ে চলে যায়।সাথী চলে যাওয়ার পর কাকিমা আমায় আঁকড়ে ধরে বলেন,
-এই লেটকা,জানিস??তোরই কারণে তোর বাবার মন জয় করতে পেরেছি আমি এবং তোর কাকা।নাউ উই আর সো হ্যাপী এন্ড ইউনিটি ইন অল এগেইন।
-কিভাবে কাকি??
-আমার উছিলায় সোহানা,সোহানার উছিলায় সোহানার বাবা।আর সোহানার বাবার উছিলায় তুই।হিহিহিহি।
-বুঝি নি কাকি।একটু ক্লিয়ার করো না,প্লিজজ??
-হু!!এখনো তুই ছোট বাচ্চা নাকি??আর মাএ ক’দিন পর তোর বিয়ে!!
-য়ুয়ুয়ুয়ুয়য়ুয়ু।আচ্ছা বলো না??
-মানে সোহানার বাবা তোকে জেল থেকে মুক্ত করেছেন আর গোড়ায় ছিলাম আমরা।সোঁজা একটা বিষয়, হায়রে খোদা।।
-কাকিমা আমি বুঝছি।হিহিহি।তোমার মুখ থেকে সরাসরি শুনার জন্যে আমার একটু জাস্ট বাহানা।
-বোকা বানালি??
-স্যরি কাকিমা।
-দাড়া তুই….
এই বলে কাকিমা আমায় শতানীর ছলে একটা দৌড়ানি দেন।আমিও দৌড়াতে দৌড়াতে সোহানার রুমে এসে ধপ্পাস করে পড়ে যাই।সোহানা আয়নার সামনে দাড়িয়ে শাড়ির আঁচল ঠিক করছে।।আর হুট করে আমার প্রবেশে অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায়।লজ্জ্বায় জিব কাটে।।
আমি তড়িঘড়ি চোখবুঁজে রাখি।।সোহানা আঁচলটা তড়িঘড়ি ঠিক করে বলে উঠে,
-কমনসেন্স নেই?কোনো মেয়ের রুমে যখন-তখন ঢুকে পড়া এ কেমন অসভ্যতা!!

সোহানার কথা শুনে আমি নাজেহাল অবস্থায় পড়ে যাই।রাগে মুখটা ফঁসফঁস করতে থাকে।কারণ,ক’দিন পর ও আমার স্ত্রী হতে যাচ্ছে,এখনই এসব বলা শুরু করছে!??একমুহূর্তে আর দেরী না করে রুমের দরজাটা বন্ধ করে একদম সোহানার কাছে চলে আসি।আমার বামহাত দিয়ে সোহানাকে আঁকড়ে অন্যহাত দিয়ে সোহানার হাতের উপর চেপে ধরে বলি ,
-এখানে আমার আসতে হলে কি পারমিশন লাগবে??

আমার কথায় সোহানার চোখের পাতাদুটে ঘনঘন পলক ফেলে,আর দৃঢ় নিঃশ্বাস ছাড়ে।আর থরথর করে সোহানার ঠোঁটদুটো কাঁপতে থাকে।
হুট করে সোহানার গাঢ় গোলাপী ঠোঁটে আমার নজর পড়ে।আমার জিহবায় পানি আসার উপক্রম তার গোলাপী দু’ঠোঁট দেখে।নিজেকে সংযত না রাখতে পেরে সোহানর ঠোঁটের উপর আমার ঠোঁট দুটো চুবিয়ে নিই।সোহানাও তার ঠোঁটদুটো আমার মুখের দিকে মেলে দিচ্ছে।এভাবে আমাদের ঠোঁট আদুরে ভালোবাসা চলে অনেকক্ষণ। একটা মুহূর্তে সোহানা হাঁপিয়ে উঠে।পরে আমায় দু’হাত দিয়ে জোর করে সরিয়ে দেয়।।তবুও আমার মন মানছে না।আমি সোহানার দিকে আরো বেশি ঝুঁকে যাই।ওকে আমার দু’হাত দিয়ে একদম কোলে উঠিয়ে নিই।আর বিছানার উপর শুইয়ে আলতো ওর গাঁয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ি।সোহানা তার চোখদুটো বুঁজে রাখছে লজ্জ্বায়।
আমি সোহানার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে ঘাড়ের দিকে মুখটা গুঁজতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।বিরক্ত উঠে যায়।।বোধহয় শিমলা।
-এই শাওন,দরজা খোল?দরজা খোল?
-উফস,এই মেয়েটার আসার আর সময় হলো না। একটু ভালোবাসতেও দিবে তা না।।

সোহানা আমার কথায় খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।আমার ভীষণ রাগ উঠে যায়।
-হাসছো না?আর মাএ ক’দিন!!বিয়েটা ভালোয় ভালোয় শেষ হোক।তারপর ইচ্ছেমতো ভালোবাসবো।এখনকার জন্যে ছেড়ে দিলাম।।হু…

এ বলে বিছানা থেকে নেমে দরজাটা খুলতেই শিমলা বলে উঠে,
-আপনাদের ডিস্টার্ব করে ফেললাম নাকি???
আমি চুপসে থাকি।আর সোহানা থতমত খেয়ে লজ্জ্বায় লাল।

শিমলা ভ্রু কুঁচকে বলে,
-আচ্ছা বলতে হবে না।না বললেও আমি বুঝি।হিহিহি।
-এরে,বুড়ি!!দাড়া!!??
শিমলা জানে এখন ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বেচারীর আর রক্ষে নেই, কাজেই কেটে পড়া শ্রেয়।কিছু বলতে না বলতেই তৎক্ষনাৎ শিমলা উধাও।সোহানা হেসে দেয় এসব দেখে।

আমিও নিচে চলে আসি।সবাই আমাদের বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার জন্য গোল মিটিং এ বসছেন।মা আমায় দেখে ডেকে বলেন,
-শাওন,একটু এদিকে আসতো,বাবা??
-হু মা, বলো??
-আমরা সবাই মিলে আগামী শুক্রবার তোর বিয়ের দিন ঠিক করেছি।
-ওমা,সেকি!!এংগেইজমেন্ট বুঝি বাদ যাবে!?(কাকিমা)
-আসলে আপা,কি বলবো,বলেন!?আমার আবার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার খুব তাড়া।একটা প্রজেক্ট নিয়ে আমার বন্ধু কাজ করছে,তাই সেখানে আর্জেন্ট যাওয়া তার মর্জি।।নাহলে,আমার একমাএ মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে কোনোকিছুই কমতি থাকতো না।তাই বাধ্য হলাম এংগেইজমেন্ট উছিলায় শুভকাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে।।(সোহানার বাবা)
-ওহ আচ্ছা।
-তো,শাওন তুই কি চাচ্ছিস শুক্রবারেই বিয়ের ডেট ফাইনাল করতে?(বাবা)
-তা তোমাদের ইচ্ছে,বাবা।।
-হু,,,

আমার খুশি আর ধরে না।কারণ,আর মাএ ২ দিন পর আমার এবং সোহানার বিয়ে হতে যাচ্ছে।আমরা স্বামী-স্ত্রী হতে যাচ্ছি যে স্বপ্নটা দু’জন ভার্সিটিতে বসে বসে দেখতাম।স্বপ্নের যে পূর্ণতা হতে যাচ্ছে ভাবতেই মনের মধ্যে এক অন্যরকম শিহরণ জাগতে থাকে।।এই খুশির খবরটা সোহানাকে দিতে তার রুমে চলে আসি।।
-সোহানা?সোহানা?সোহানা????

-জ্বী বলেন,স্বামী।
এ বলে খিলখিল করে হেসে উঠে সোহানা এবং পাশ থেকে আরেকটা হাসির আওয়াজও শুনতে পাই।ভালোভাবে পরক্ষ করে দেখতে পাই সাথী এবং সোহানা বসে বসে গল্প-গুজব করছিল এতক্ষণ। সাথীর মুখটায় হাসির আভা ফুঁটে আছে।আমি শুধু এটুকুই চাই,সাথীর মুখ কখনো যেন বিষণ্নতায় না ছুঁয়ে যায়।।
-হাসি থামাবে দু’জন???
-আচ্ছা থামালাম।এবার বলেন স্বামী??
-এই এত্ত স্বামী স্বামী করছো কেন??বিয়েতো এখনো হয়নি!!

পাশ থেকে সাথী বলে উঠে,
-বিয়েতে কাল বাদে পরসু ভাইয়া।সো আর দেরী নেই।এখনই সোহানাকে আপু বউ বলার প্রস্তুতি নিয়ে নাও।।হিহিহিহি।।

এ বলে সাথী সোহানার মাথার সাথে মাথা মিলিয়ে খুশিতে গুড়গুড়ি খায়।আমার তা দেখে কেন জানি ভীষণ ভালো লাগছে।আমি চাই সাথী সবসময় এভাবে হাসি মুখ করে থাকুক।ওর মনে যেন কষ্টের ফুঁটোও না থাকে।।
-আচ্ছা,তোমরা দু’জন কথা বলো।আমি আসি ভাবী।
সাথী সোহানার গাল ছুঁয়ে মুঁচকি হেসে চলে যায়য়।।
আমি সং এর মত দাঁড়িয়ে ওদের দুজনের তামাশা দেখি।।
তারপর সোহানার পাশে এসে বসি।
-শাওন জানো??সাথী অনেক ভালো একটা মেয়ে।আমাদের বিয়েতে কিভাবে সাঁজবে,কিভাবে নাচবে তার প্রি-প্ল্যান করে ফেলেছে।।
-ওহ আচ্ছা,তাই??
-হু।।তোমার এখন ফিলিংস কেমন?আমায় একটু বলবে??
-জানতে চাওও??
-হু।
-তাহলে আমার বুকের পাশে মাথা মাথা গুঁজো।
-মাথা গুঁজবো কেন??

সাথীর ভাবাবেগ প্রশ্নে আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বলি,
-কারণ,তুমি যদি আমার বুকে মাথা রাখো,তাহলে শুনতে পাবে আমার হৃদয় স্পন্দনের গুণগান যে শুধু সোহানারই গায় গানন।
-য়ুয়ুয়ু,,পাগল একটা….আচ্ছা শুনো??দিবানির চিঠিটা তো এখনো দেওয়া হয়নি তোমায়!
-লাগবে না।
-কেন??
-তুমিতো সব বলে দিয়েছ।আর কি পড়বো!! চিঠিটা পড়ে এই মুহূর্তে কষ্টটা আরো দ্বিগুণ করতে চাচ্ছি না সোহানা
-আচ্ছা,শাওন।
এ বলে সোহানা আমার কাঁধে মাথা রাখে।।



আজ আমাদের বিয়ের ২বছর পূর্ণ হলো।সোহানা এখন কিচেন রুমে।। মায়ের সাথে রান্নাবান্না নিয়ে বিজি।আর আমি বৈবাহিক জীবনে বাবার ব্যবসাটা এবং ভার্সিটি দুটোই সামলাচ্ছি। জেলে গিয়ে তো ২’টো বছর শেষ!!তাই এখনো ভার্সিটির কোর্সটা শেষ হয়নি।এখন ১০ম সেমিস্টারে আছি।।তাই,বইপত্রগুলো ছড়াছড়ি করতে আমার সেই পুরনো একটা ডায়েরী টেবিলের উপর দেখতে পাই।।
ডায়েরীর পেইজ খুলতে প্রথম পৃষ্ঠায় একটা লেখা চোখে পড়ে।।
লেখাটি পড়া শুরু করি,
প্রিয় শাওন ভাইয়া,
আশা করি, এই মুহূর্তে আপনি অনেক ভালো আছেন।আমিও চাই আপনি সবসময় ভালো থাকেন।।আপনার মনে হয়তো এখনো সন্দেহ আমি আপনায় ভালোবাসি।আমার এই ভালোবাসার তাড়নায় আপনি হয়তো অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দে আছেন।তবে,সত্যটা কি জানেন ভাইয়া?যখন আপনি জেলে ছিলেন,তখন প্রথম শুনলাম আমার গার্লফ্রেন্ড আছে যেটা আপনি আমায় বলেননি।যদি আগেই জানতাম আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে,তাহলে আমি আপনার লাইফ থেকে তখনই সরে যেতাম।
আর,তখন কষ্টটির মুহূর্তের কথা সত্যি আপনাকে বলে বুঝাতে পারবো না। যখন শুনলাম,আপনার গার্লফ্রেন্ড মানে সোহানা ভাবীর বাবাই আপনাকে বাঁচানোর জন্যে দিনকে দিন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন,তখন বুঝছিলাম সোহানা ভাবীর থেকে আপনাকে আর কেউ বেশি ভালোবাসতে পারে না।যে ভাবী বিয়ের দিনই সব ভেঙ্গেচুরে আপনার কাছে চলে আসেনন,তখনই বুঝলাম ভালোবাসা কাকে বলে।
আমার হয়তো সামান্য একটু মন খারাপ থাকতেই পারে। কারণ,আমার ছিল ফার্স্ট সাইড এট লাভ।।তাই,সব ভুলে গিয়ে সত্যি আগ থেকে অনেকটা ঠিক আছি।সোহানার ভাবীর মুখটা যতবার দেখি,ততবারই আপনার থেকেও সোহানা ভাবীর প্রতি আমার ভালোবাসাটা একটু বেশি কাজ করে।প্রিয় আপুকে আমি অনেক ভালোবাসি।ভাবীকে আমার সালাম দিবেন।।
ভালো থাকবেন।
ইতি,
সাথী।
১০ ই ডিসেম্বর ২০১৮।

চিঠিটি পড়ে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ি।তাহলে চিঠিটা প্রায় ২ বছর আগে লিখেছে বউভাতের সময়।।এত মাস পর খুঁজে পেলাম!!ব্যস্তময় লাইফে বেখেয়ালিপনা হয়ে গেলাম।।

হুট করে নিচ থেকে কেউ আমার প্যান্ট ধরে টানতে থাকে।।।নিচে তাকিয়ে দেখি আমার ৯ মাসের ফুটফুটে বাচ্চা নিহাদের এই কান্ড!!
সবে হাঁটাহাঁটি পায়ে হাঁটতে শিখেছে।এক কদম পা বাড়ালেই ধপ্পাস করে ফ্লোরে পড়ে যায়।।।
আমি নিচ থেকে কোলে তুলে কপালে দু’টো চুমু লাগিয়ে দিই।
এরইমধ্যে সোহানা এসে নিহাদ কে খুঁজতে থাকে।
-নিহাদ পাপ্পু তুমি কোথায়??কোথায় তুমি??
-আমার ছেলে আমার কাছে।
-উহ,ক্লান্ত হয়ে গেলাম ওকে খুঁজতে খুঁজতে।রান্নাটা সবে বসালাম,কোনফাঁকে এখানে ববাবাকে খুঁজতে আসছে!!ছেলেটাও ঠিক বাবার মতো বাঁদর একটা।।

এ বলে সোহানা মুখ ভেঙ্গছি কাটে ।আমার মুখে হাসি চলে আসে।সোহানার দিকে তাকিয়ে একধরনের নারীর সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারছি।শাড়ির আঁচল টা কোমরে গুঁজে আছে, সারা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে।আজকের রান্নাটা বোধহয় ভালোই হবে।তাই বউ আমার রান্নায় উঠে পড়ে লাগার মতো।

সোহানা ঠিক আগের মতোই আছে।মুখে সেই এঁটো হাসি সবসময়।সোহানাকে আমি আমার লাইফ থেকেও বেশি ভালোবাসি।আর এই ভালোবাসার টানেই আমাদের নীড়ে ফুটফুটে বাচ্চার আগমন।ভালোবাসি প্রিয় নিহাদ এবং আমার স্ত্রীকে।।।

সমাপ্ত

—সবার হয়তো খারাপ লেগেছে।গল্পের নায়িকা সাথীকে দেওয়ার জন্যে।।কিন্তু দেখুন,আমি অনেক চেষ্ট করেছি।সম্ভব হয়নি।কারণ,গল্পের নামের সাথে কাহিনী সংযত রাখতে হয়েছে।আশা করি,এই দিকটা একটু দেখবেন।নাহলে,আমার গল্পটি অসমাপ্ত থেকে যেত এবং অসঙ্গতিপূর্ণ ।।।

ভাবিনি ফিরে আসবে পর্ব-১৫

0

ভাবিনি ফিরে আসবে
পর্ব-১৫
রোকসানা আক্তার

রুমে এসে বিছানার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ি।
ক্লিংব্লিং আমার ফোনে কল বেঁজে উঠে।নাম্বারটি দেখে আননউন মনে হলো।বুঝে উঠতে পারছি না কলটি রিসিভ করব কি করব না।
অতঃপর দ্বিধা নিয়ে কলটি রিসিভ করি।।
-হ্যা-হ্যা-হ্যালো?
-এই পুচকা, তাড়াতাড়ি গেইটের কাছে আয়।

কন্ঠস্বরটা শুনে আমি চমকে যাই।কতটা মাস পর আজ শিমলার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। ভীষণ মিস করেছিলাম প্রিয় এই ভয়েসটিকে।।
-শি-শিমলা,তুই!?
-আরেহ,বাবা!!এত্ত ঢংবং না করে একটু এখানে এসে গেইটটা খুলবি??
-তুই আমাদের বাড়ি আসছিস,শিমলা??
-হ্যাঁ-রে হ্যাঁ।পা,হাত ব্যথা হয়ে গেছে গেইটের সামনে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে।।
-ম-মানে??দারোয়ান চাচা ওখানে নেই??
-কি জানি,দেখতে পাচ্ছি না।তুই নেমে আয়য়।।

আমি কলটি কেটে তড়িঘড়ি শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বেরিয়ে পড়ি।গেইটের কাছে আসতেই দেখি দারোয়ান চাচা নাক ঢেকে নির্বিঘ্নে ঘুমচ্ছে।আর সেইসঙ্গে উনার বিশাল ভুঁড়িটা উঠানামা করতেছে।
সোহানার হাতে রাঁধা ডিমের চড়চড়ি আর ইলিশের কোরমা খেয়ে পেটটা এখন হাতি।
উনার একটা দিক দেখলে খুব হাসি পায়।উনি যখন উনার সুস্বাদু খাবার কাছে পান,তখন গরুর মতো গিলতে শুরু করেন।আজও তাই করেছেন,তার উপর সোহানার হাতের রান্না,সেই!!এমন ঘুমে আচ্ছন্ন মনে হয়বা সকাল ছাড়া আর জাগবেন।যাইহোক,বেচারীকে আর বিরক্ত না করে আমিই গেইট খুলতে যাই।
গেইট খুলেই শিমলাকে দেখতে পাই।সাদাসিধে মুখটায় শিমলার মৃদু হাসি লেগে আছে। হালকা ছাই কালারের একটা শাড়ি পড়ে এসেছে,চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা পড়া।দেখে মনে হয়,কোনো এক যুবতী সহস্র যুগ পাড়ি দিয়ে প্রিয় কারো সাথে দেখা করতে এসছে।।
শিমলার থেকে চোখ সরিয়ে তার বাম পাশে দেখতে পাই সাথীকে।।

সাথীকে দেখে আমি অনেকটা ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে যাই।সাথী আগ থেকে অনেকটা লম্বা হয়ে গিয়েছে এবং সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ বেড়েছে,চোখে-মুখে লজ্জ্বার আভা,বড় ঘোমটা টেনে নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে আছে।মেয়েটির মাঝে চাঞ্চল্যকর কোনো আভাস দেখতে পেলাম না।আগে যেমনটি ছিল,এখন সম্পূর্ণ উল্টো।

-আমাদের দেখে মনে হয় ভীষণ অবাক হচ্ছিস??
আমি ধ্যাণ দেখে বেরিয়ে বলি,
-কেমন আছিস তোরা দু’জন??

শিমলা মুচকি হেসে বলে ভালো আছি।কিন্তু সাথী একটু টু শব্দ না করে শিমলার সাথে সম্মতি দিয়েই মাথা নাড়ে শুধু। শিমলার এই বিহেভে আমি অনেকটা অবাক হয়ে যাই!!এই দু’বছরে মেয়েটির মধ্যে এতটা চ্যান্জ সত্যি তা আমার ধারণার বাহিরে ছিলল!!পরে আর কিছু না বলে ওদের হাত থেকে ট্রলি ব্যাগটা নিই।
সবাই বাড়ির দিকে পা বাড়াই। শিমলা হাঁটে আর শান্ত ধীরে বলে,
-যখন আন্টির থেকে শুনলাম তুই বাড়ি আসছিস,তখন এখানে আসার জন্যে আমার মন পাগলের ন্যায়।কখন আসবো,কখন আসবো এবং তোর সাথে কখন দেখা করবো।এমন একটা অস্থিরতা ছিল মনে।।না সাথী?

সাথী মাথানিচু করে হালকা মাথা নেড়ে শিমলাকে সম্মতি দেয়।
-আর হ্যা,শাওন শোন??আমি এখানে আসার জন্যে যতটা না হাইপার হলাম,এই সাথী ততটাই বিরক্ত!!বুঝলি??

আমি হতভম্ব শিমলার কথায়!!আসলেই শিমলা সত্য বলছে।সাথী এখন আর আগেই সেই ছুট্রি সাথী নেই!!আমি শিমলার কথায় উওর না দিতে পেরে মুঁচকি হাসি।সাথী শিমলার কথায় ক্ষাণিকটা রাগ হয়ে ভার গলায় বলে,
-আপু,তুমি না…?

এরইমধ্যে আমরা ঘরে প্রবেশ করি।মা,কাকিমা শিমলা এবং সাথীকে দেখে বুকে জড়িয়ে নেয়।।ওদিক দিয়ে সোহানাও ভারী খুশি ওরা আসাতে।
সবাই মিলে বসার ঘরে উৎফুল্ল মনে লাফিয়ে বসে পড়ে এবং নানান ধরণের গল্পগুজব,হাসি-ঠাট্টায় জমিয়ে বসে।আসলে,একে-অপরকে অনেক দিন পর দেখছে তো তাই মায়াটা একটু এইমুহূর্তে বেশিই কাজ করছে।আমি আর ওদের সামনে না দাড়িয়ে থেকে সিড়ির দিকে পা বাড়াতেই মা বলে উঠেন,
-এই শাওন,এখন কয়টা বাঁজে??
আমি ঘড়ির দিকে তাকাই এবং ছোট স্বরে বলি,
-এইতো ১০ টা।
-তো নিজ রুমে যাচ্ছিস কেন?ডিনার করবি না??
-হু।আচ্ছা তোমরা আগে কথা বলো পরে খাওয়াদাওয়া করবো সবাই।
-আরেহ না!!আন্টি প্লিজজ পেটটা পুরো ফাঁকা।৭৫০ কিলোমিটার পথ জার্নি করে নাউ সো ক্ষুধা।ডিনারটা শেষ করে তারপর গল্প,ওকে?(শিমলা)

শিমলার কথা শুনে আমরা সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠি।কাকিমা বলেন,
-গল্পতো অবশ্যই।ডিনারের পর আমাদের শাওনের জন্যে একটা দারুণ সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।সো ডিনারটা সেরেই সারপ্রাইজ। আমার আর তর সইছে না।প্লিজজ কাম অন অল ইন দ্য ড্রাইনিং??

-আগে তো ফ্রেশ আপু,তারপর খাওয়া।(সাথী)
-ওহ,হ্যাঁ হ্যাৃ।(শিমলা)
-শিমলা আপু ক্ষিধার ছোটে সব ভুলে গেছে। (চোখ টিপে সোহানা বলে)
শিমলা অভিমানের স্বরে বলে উঠে,
-সবাই আমার মুখটা আর রাখলে??চলরে সাথী আগে আমরা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি।
-হিহিহি হিহিহি।
তারপর কাকা,বাবা,আঙ্কেল সবাই মিলে ডিনারটা করে নিই।কাকিমার আর্জি খাওয়া শেষ হলে কেউ যেন চেয়ার ছেড়ে না উঠে।
খাওয়া শেষে সবাই দৃঢ় প্রত্যয়ে চেয়ারে গা গেঁড়ে বসে থাকে।কাকা কাকিমাকে ইশারা করে বলে উঠেন,
-তুমি শুরু করবে নাকি আমি??

কাকিমা গলা ঝেড়ে বলেন,
-তুমিই বলো।।
-আজকে একটা উদ্দেশ্যেই সবাইকে গোল মিটিং এ ডাকা।সবাইতো মিসেস সোহানাকে চিনেন,রাইট??আমি,রিয়াজুল ভাই, আসলাম ভাই,আপা(আমার মা) এবং শাওনের কাকিমার সম্মতিতে শাওনের হাতে সোহানাকে তুলে দিতে চাই।।আমরা এ ব্যাপারে সবাই দৃঢ় আগ্রহী।শাওন?এটাই তোমার জন্যে সারপ্রাইজ।আর এই সারপ্রাইজটি পেয়ে তুমি উই থিংক ইউ আর সো হ্যাপী!(কাকা)

আমি কাকার কথায় কিছু না বলে চুপসে থাকি।অতি আনন্দে এখন আমি পাথর।সোহানা কিছুক্ষণ আগে কি ভয় টাই না আমায় পাইয়ে দিল!!
শিমলা খুশির তালে ধুকধুকি বাঁজাতে থাকে।
-ইয়েস,ইয়েস,অনেক ভালো একটা সারপ্রাইজ । অবশ্য,আমি গ্রিফট পাওনা আছি সোহানা এবং শাওনের থেকে।কারণ,ওদের এতটা পথ পাড়ি দেওয়া অনলি ফর মি।।

তারপর কাকিমা বলেন উঠেন,
-সেদিন সোহানার বেডরুমে শাওনের জন্যে লিখা ডায়েরী যদি চোখে না পড়ত,নাহলে দু’টো ভালোবাসাকে আমরা হত্যা করে ফেলতাম।আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সোহানার মনের অনুভূতি বুঝার চেষ্টা করি তার আদৌ কি শাওনের জন্যে কষ্ট হচ্ছে???যখন সোহানাকে বধু সাঁজে একা রুমে বসে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদতেছিল,তখনই আমার সন্দেহ ক্লিয়ার হয়।আর তখনই আমি আমার বোনের ছেলেকে বিভিন্ন বাহানা দেখিয়ে বিয়েটা ঠেকাই।অতঃপর রিয়াজুল ভাইও বুঝতে পারেন তার মেয়ে অন্যকাউকে ভালোবাসেন,তিনিও মেয়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে আমার বোনদের বিয়ের লগ্নেই বিদেয় করেনন।অবশ্য,বিয়েতে একধরনের হট্টগোল ঘটে যায়,সাডেনলি বিয়ে বন্ধ করায়।নানান মানুষ সোহানাকে,রিয়াজুল ভাইকে নানান কথা বলেছিল।।তারপরও আমি আমরা যথেষ্ট চেষ্টায় অব্যাহত,স্বপ্নকে কখনো মরতে দিতে পারি না।।।

আমি কাকিমার মুখের দিকে তাকালে যেন উনাকে আমার দ্বিতীয় মা মনে হয়।নিজের বোনের ছেলের কথা না ভেবে আমার কথাই ভেবেছেন।কাকা-কাকিমা আমায় এত্ত ভালোবাসেন,সত্যি আগে জানতাম না।এ ভাবতেই আমার চোখে পানি চলে আসে।কেউ দেখবার আগেই মাথানিচু করে পানিটুকু মুছে নিই।।
কাকিমা আবারও বলে উঠেন,
-আমাদের বিয়ের পর আমরা দু’জন নিঃসন্তান।সন্তান বিহীন একজন মা অচল।তবে,সন্তান না হওয়ার বেদনা একটু ক্লান্তি করলেও আমি শাওনের মুখটি দেখলে তা ভুলে যেতাম।কারণ,শাওনের মুখটি একবার দেখলেই মনে হয় শাওন যেন আমার পেটের উদরেরই সন্তান।।জানি না ওর প্রতি কেন আমাদের এত টান।।

এ বলে কাকিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখের পানি মুছে নেন।
আমি কাকিমার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকি।।আর সোহানার দিকে দেখি।ও লজ্জ্বায় ভীষণ লালচে,এখনই যেন টেবিলের নিচে লুকিয়ে যায় এমন অবস্থা।আমি ওর দিকে একপলকে তাকিয়েই থাকি।দেখি মেয়েটির এত্ত লজ্জা কোথায় রাখে।যখনই ও কাকীর দিকে নজর দেয়,তখনই আমার চোখ বরাবর ওর চোখ পড়ে যায়।ও আর বসে থাকতে না পেরে তড়িঘড়ি বলে উঠে,
-আমি একটু আসছি।আর্জেন্ট কল আসছে একটা।।
এ বলে তরহর গো।সবাই খিলখিল করে হেসে উঠে।।কারণ,সবাই বুঝে যায় সোহানা যে লজ্জা পেয়েছে।আমিও ইদানীং সোহানার চলন-বলনে হতভম্ব !! দু’টো বছরের ব্যবধানে ও অনেকটা লাজুক হয়ে গিয়েছে।।

হুট করে সাথী কাউকে কিছু না বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়। কাকা বলেন,
-আরেহ সাথী,কোথায় যাচ্ছ? এখনো তো আমাদের সভা শেষ হয়নি।
-আঙ্কেল আমার বাথরুমে যেতে হবে।।আসি।।

সাথীও উধাও!!তবে সাথীর মুখের চাহনী অন্যকিছু বলছে।ওর মুখে আমি বিষণ্নতার ছাপ খুঁজে পাই।যদিও তা সবার চক্ষু আড়ালে।

চলবে….

ভাবিনি ফিরে আসবে পর্ব-১৪

0

ভাবিনি ফিরে আসবে
পর্ব-১৪
রোকসানা আক্তার

-আচ্ছা,তারপর বলো??
-তুমি এই বিমর্ষ ভিডিও রেকর্ডের কাছে জিম্মি ছিলে।
যেখানে তুমি আমাকে এবং তোমার আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়েছিলে।। আর তোমার ভাইয়ার সাথে শিপ্রার রিলেশন হয় ওই শিপ্রারই প্লানে।উনি চেয়েছিলেন তোমায় তিলে তিলে পুড়িয়ে নিজের অন্তঃ জ্বালা নিবৃত্তি করতে। তাই তোমার ভাইয়াকে পটিয়ে পাটিয়ে বিয়ে করে নিয়েছেন। অন্যদিকে শিপ্রাকে বিয়ে করে তোমার ভাইয়ার পথটাও ক্লিয়ার হয়ে গিয়েছে।কারণ,তোমার ভাইয়া তোমার মায়ের সম্পওির উপর অনেকদিনের লালায়িত লোভ ছিল।এসব কিছুতে শিপ্রার সাপোর্ট পেয়ে তিনিও তোমার বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন।
কিন্তু তুমি একটা দিক এখনো জানো না,ওই বিমর্ষ ভিডিওটি শিপ্রা ডাইনীর থেকে হারিয়ে গিয়েছিল তোমার ভাইয়ার সাথে বিয়ে হওয়ার আগেই।তারপরও তোমাকে শিপ্রা ভিডিওর ভয় দেখিয়ে থাবিয়ে রেখেছিল।নিদুর সাথে উনার ভিডিও ভাইরাল হওয়াতে উনি কি চুপসে থাকতেন,বলো?
নেভার!!!উল্টো তোমারটাও ভাইরাল করে দিতেনন।কিন্তু আপসেট!!তা আর পারেননি।পরে, নিদুকে হত্যার মাধ্যমে তোমায় ফাঁসানোর ফন্দি আঁটেন।।

-সোহানা?নিদুকে কে খুন করেছে??
-তোমার ভাই, শাওনন!!
-আমার ভাই!!!??
-ইয়েস!শিপ্রা তোমার ভাইকে দিয়ে নিদুকে খুন করায়।আর সেটা উনাদের পরস্পরের স্বার্থে।
-কেমন স্বার্থ??
-তোমার ভাই চেয়েছিলেন তোমায় ফাঁসিতে ঝুলালে উনার স্বার্থ হাসিল হবে এবং এই সুযোগে সব সম্পওির মালিক উনি হয়ে যাবেন।আর, ওদিক দিয়ে শিপ্রার সব প্লান বিনে পানি হওয়াতে
তার বোনের বদলার জন্যে তোমায় পৃথিবী থেকে বিদায় দিবেননন।
বাট,তা আর হলো না!!!

কপালে হাত রেখে সোহানা কিছুক্ষণ মাথাটা নিচু করে রাখে,আর একটা দৃঢ় নিঃশ্বাস ছাড়ে।।
-আচ্ছা সোহানা, এখন শিপ্রা এবং ভাইয়া কোথায়??
-এখন তাদের জিন্দেগী জেলখানায়।হিহিহিহিহি….
-ভাইয়ার জন্যে খুব কষ্ট লাগতেছে।।
-ইটস সিম্পল,শাওন।কারণ,তারা তাদের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতেছে।।এতে কষ্ট পাওয়াটা অর্থহীন।
-সোহানা একটা সত্য কথা বলবে??
-কি,বলো??(আমার দিকে তাকিয়ে)

-এত্তকিছু যে হয়ে গেল তুমি কিভাবে জানো? সোহানা?
সোহানা আমার কথা শুনে একটা মুঁচকি হাসি দেয়।মেয়েটিকে মুঁচকি হাসিতে বেশ মানায়।এই মুঁচকি হাসিটা যেন শুধুই সোহানার জন্যে বিধাতা গড়েছেন।।উফস,দেখলে বার বার ক্রাশ খাওয়ার মতো।

-জানতে চাও,কীভাবে জানি??
-হুম।
-শিমলা আপু আমায় সব বলেছিলেন,শাওন।।যেদিন আমার গায়েহলুদ ছিল,ওদিন সকালে আপু আমায় কল দিয়েছিলেন উনার সাথে আর্জেন্ট একটু দেখা করতে।তারপর আপু আমার সাথে ধানমন্ডি এসেই দেখা করেন।দেখা হওয়ার পর আপু বিস্তারিত সব খুলে বলেন আমায়।ইভেন,আমি বিলিভ করতে চাইনি,যদি না শিমলা আপু তোমার প্রতিটি কথার ভয়েস রেকর্ড না করতেন এবং আমায় না শুনাতেন।।
-ভয়েস রেকর্ড মানে সোহানা??
-মানে যখন তুমি তোমার মনে জমে রাখা সবটা কথা শিমলা আপুর সাথে শেয়ার করতে,তখন আপু মোবাইলে তার রেকর্ড অপশন অন করে রাখতেন।আর ওই ভয়েসগুলোই আমায় শুনালেন।দ্যান,আমি সবকিছু বুঝতে পারি।তোমাকে কতটা ভুল বুঝেছিলাম,কতটা দূরে রেখেছিলামম।।

-এখনো কি দূরে রাখবে??আচ্ছা সোহানা?তোমার কি সত্যিই বিয়ে হয়ে গেছে?
-তোমার মন কি বলে শাওন??
-মন বলে না।
-হিহিহিহি
-হাসলে কেন সোহানা?আমার ইমাজিন কি সত্যি??
-আচ্ছা,আচ্ছা পরে জানবে।।
-য়ু-হু,আমার কিন্তু তর সইছে না।।
-আচ্ছা,শুনো??আব্বু ডাকছেন।এখন যাচ্ছি।।

এ বলে সোহানা বিছানা ছেড়ে উঠতেই আমি সোহানার হাতটা ধরে ফেলি।
-কি হলো, শাওন?ছেড়ে দাও।কেউ দেখে ফেলবে তো!!
-ওয়েট দেখবে না।

এ বলে আমি দরজাটা বন্ধ করে ফেলি।সোহানা অনেকটা ভীত হয়ে যায়য়।।
-এএএইইইই,বলে দিলুম,উল্টাপাল্টা কিছু করবে না কিন্তু!!
-উল্টোপাল্টা না।কথা দিলাম,জাস্ট একটু আদর করবো।সোনা পাখিটিকে আমার অনেকদিন হয়েছে আদর করা হয়নি।।
সোহানা আমার কথায় লজ্জ্বা পেয়ে দরজার দিকে হেঁটে চলতেই বাম হাতটায় হ্যাঁচকা টান মেরে ঘুরিয়ে নিই আমার দিকে।।ওর লজ্জ্বা পাওয়ার প্রতিটি নিঃশ্বাসের আভা আমার মুখে আসছে।।।দু’হাতটা দিয়ে ওর কোমরে চেপে ধরি।।
-এই রূপবতী, লজ্জ্বা পাচ্ছ কেনন??অনেকটা দিন পর তোমায় আজ দেখলাম।মনে হচ্ছে,শতযুগ পর আজ কাছে পেলাম।।

এ বলে আমার একদম কাছে নিয়ে আসি।।আর আলতো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে মন ভোরে সোহানাকে দেখে নিই।সোহানা লজ্জ্বায় লাল হয়ে যায়।বার বার মাথা উবু করতে চায়,কিন্তু আমি দিই না।।আজ চোখজুড়ে সোহানাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। যত দেখি মনে নেশা লেগে যায়,এই নেশার ঘোরে শুধু ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়য়!!
যখন আমার মুখটা ওর ঘাড়ের দিকে গুঁজে দিতে যাবো,ওমনি ও আমায় সরিয়ে দিয়ে বলে,
-আমি অন্যজনের বউ!আমাকে ছোঁয়ার এখন তোমার কোনো অধিকার নেইইই!!
-হোয়াট?!সত্যি সত্যি তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে??
-ইয়েস,শাওন!!আজ রাত এ বাসায় তোমার কাকা-কাকি আসবেন।উনাদের থেকেই শুনতে পাবে।
-ম-ম-মানে??এসব কি বলছো তুমি???আমি এসব বিশ্বাস করি না,এ হতে পারে না সোহানা!!
-না বিলিভ করলে আমার কিছুই করার নেই, শাওন।আসি!

আমার হৃদয়ে মুহূর্তের মধ্যে এক দমকা ঝড় বয়ে যায়।
আমার পুরো শরীর থরথরে কাঁপতে থাকে।মোটা মোটা রেখায় কানের পাশ দিয়ে ঘাম বেয়ে পড়তে থাকে।

সোহানার কি সত্যিই তাহলে বিয়ে হয়ে গিয়েছে!?তাহলে কেন আমায় সে বাঁচালো!!কার আশায়?
-স-স-সোহানা?তাহলে মরে যাওয়াইতো আমার জন্যে ভালো ছিল।কেন বাঁচালে আমায়!!!?

সোহানা হাতদুটো ভাঁজ করল স্মিত মুখে বলে,
-অপরাধীকে অপরাধের জন্যে শাস্তি দিতে হয়।আর নিরপরাধকে মিথ্যে অপবাদ থেকে বাঁচাতে হয়।কারণ,এটাই মনুষ্যত্বের ধর্ম।আমার বাবা আমায় শিখিয়েছেনন।

এ বলে রুম ত্যাগ করে সোহানা।আমার ভাবনা গুলো মুহুর্তে দুমড়েমুচড়ে যায়।।আমার হৃদয়টা রক্তক্ষরণে জর্জরিত একসময় নিজে নিজেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে।কারো দয়ার হয়তো আর পরোয়া করবে না।।
মনের জগৎ এর ধ্যানে বিছানার উপর বসে পড়ি।মনটা কিছুতেই মানতেছে না!!

সন্ধের পর,কাকা-কাকিমা আমাদের বাড়ি এসে হাজির হোন।ছকিনা খালা আমায় নিচে ডেকে আনেন।কাকা-কাকিমা আমায় দেখতেই মুঁচকি হেঁসে বুকে জড়িয়ে নেন।আমি কোনোমতে নিজেকে সামলে উনাদের সাথে কুশল বিনিময় করি।

বাবাও কাকা-কাকিমাকে দেখে বড্ড খুশি হয়ে যান।কাকিমা বাবাকে সালাম করেন।আর বাবা কাকাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠেনন।
আমি অনেকটা অবাক হয়ে যাই। যে বাবা কাকা-কাকিমার কথা শুনতে অপারগ প্রকাশ করতেন,আজ সে বাবাই অনেক বেশি খুশি কাকা-কাকিমার উপস্থিতে।ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই সন্দিহানের বিষয়।।
আমি কোনোকিছু না ভাবতেই সোহানার বাবা পাশ থেকে বলে উঠেন,
-কি ভাবছো,মাই সন??
-ন-ন্না মানে!

উনি মুঁচকি হেসে দেন আর বলেন,
-তুমি না বললেও আমি জানি তুমি কি ভাবছো!

আমি উনার কথায় মাথা নিচু করে রাখি।পাশ থেকে কাকিমা ও বলে উঠেন,
-আমিও জানি শাওন কি ভাবছো!
আমি কাকিমার কথায় ঝলঝল চোখে তাকায়।কাকিমা ভ্রু উঠিয়ে আমায় ইশারা দিয়ে বলেন,
-শাওন?তোর সন্দিহানটা আপাতত সারপ্রাইজ। আর এউ সারপ্রাইজটা ডিনারের পর পেয়ে যাবি।ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা কর পাপ্পা।

অন্যদিকে,সোহানা কাকিমার কথায় শুধু হাঁসে।আমার খুব রাগ হতে থাকে।মনচায় সবাইকে আচ্ছামত বকি।দাৎ!!কোনোকিছুই ভাল্লাগতাছে না।রাগটাকে গলা পর্যন্ত সামাল দিয়ে বলি,
-কাকা-কাকিমা,আপনারা মনে হয় ভীষণ ক্লান্ত!!আপনাদের এখন রেস্টের প্রয়োজন।আর আমার যে সেমিস্টার গুলো ড্রপ গিয়েছিল,তারজন্যে অনলাইনে ভার্সিটির কিছু কাজ করতে হবে।আমি আসি।পরে কথা হবে।।
-বায়য়, শাওন খোকা।(কাকিমা)

তারপর নিজের রুমের দিকে চলে আসি।।

চলবে….

ভাবিনি ফিরে আসবে পর্ব-১৩

0

ভাবিনি ফিরে আসবে
পর্ব-১৩
রোকসানা আক্তার

তারপর আমি নিবু নিবু পায়ে হেঁটে জেলের বাহিরে চলে আসি।থানার দারোগা কাকা হাত দিয়ে ইঙ্গিত করেন আমার সামনে দাড়িয়ে থাকা কিছু প্রাণীকে।। আমি উনাকে অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই দেখতে পাই আমার সেই আদুল মাখা মায়ের মুখখানা।মা আমাকে দেখে মুঁচকি হেঁসে দেন।মায়ের চোখদুটো ঝলঝলে যেন শতযুগ পর ছেলেকে তার কাছে পেয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, বাবাকে দেখতে পাই।বাবা মৃদু হেঁসে হাতদুটো ভাঁজ করে দাড়িয়ে আছেন।তারপর, দেখতে পাই আমার সেই উকিল সাহেবকে যিনি আমায় এই বিমর্ষ জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছেন।।

দৌড়ে গিয়ে মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরি।অতি খুশির তালে আমার চোখদুটো পানিতে ভরে যায়।।
-বাবা,আজ এই উকিল ভাইয়ের জন্যে তোকে আমাদের কাছে ফিরে পেয়েছি।(মা)
বাবাও মায়ের কথায় তাল মিলিয়ে আমার পিঠে হাত বুলান।পরে,আমরা সবাই মিলে বাড়িতে আসি।বাড়িতে আসতেই চারদিকটা চোখ বুলাই।পুরো বাড়ি মানুষ বিহীন শূণ্য খা খা লাগছে।কোথা থেকে ছকিনা খালা দৌড়ে এসে বলেন,
-ছোট সাহেব, আপনে আইছেন?অনেকদিন পর দেখলাম আপনেরে।
-কেমন আছেন,খালা??
-হ সাহেব ভালা আছি।

মা? সাথী,শিমলা,পাবাজ,ফাহাদ ভাই কাউকে যে দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় সবাই??
মা আমার কাছে এসে বলেন,
-বাবা,শিমলার ঢাকায় সোনালী একটা ব্যাংকে চাকরি হয়েছে।সাথীও শিমলার সাথে। সাথী শিমলার সাথে ওখানে থেকে ইন্টারমিডিয়েটে পড়তেছে।আর পাবাজ বিদেশ চলে গিয়েছে।।
-আর ফাহাদ ভাইয়া??
ফাহাদ ভাইয়ার কথা বলাতে মা অনেকটা এড়িয়ে যান।পরে বলেন,
-বাবা, তুই এখন খুব ক্লান্ত।আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি,
-সবাইকে ছাড়া শূন্য এই বাড়িটিতে একা একা লাগতেছে।।এমন একটা খুশির দিনে প্রিয় মানুষগুলোই দূরে!!দ্যাৎ।
মন খারাপ করে আমার রুমে চলে আসি।আর, বাবা এবং উকিল আঙ্কেল বসার ঘরে বসে পড়েন।মা রান্না-বান্নার জন্যে কিচেনে তদারকি করতে যান।

রুমে ঢুকতেই একটা সুগন্ধি ঘ্রাণ বআমার নাকে আসে।রুমটা আজ অনেক সুন্দর করে গুছানো হয়েছে।দেখে মনে হয়,কোনো নিপুণ কারিগরের হাতের সজ্জিত এই রুমটা।ছকিনা খালা এমনভাবে রুম কখনোই গোছাতে পারবেন বলে মনে হয় না।তাহলে কে হতে পারেন….!!
মাথা কোনো ভাবনা না আসতেই এসব মাথা থেকে ঝেড়ে তাওয়াল নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ি।ময়লা শরীরটা আজ সাবান দিয়ে ঘঁষে ঘঁষে ধুঁয়ে নিই।কারণ,জেলের জীবনে নিয়মিত গোসল করাই ভুলে গিয়েছি।
তাওয়াল পেঁচিয়ে বিছানার সামনে আসতেই দেখি কেউ আমার জন্যে একটা ব্লু কালার গেন্জি,একটা জিন্স রেখে দিয়েছে।জামাকাপড়গুলো হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাই,কিন্তু রুমে কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না।।ব্যাপারটা সত্যি অবাক হওয়ার মতো।এরকমটা কাজ কে করতে পারে আমার রুমে!?সাথী তো বাসায় নেই,তার উপর শিমলাও!!

নাকি ওই শিপ্রা ডাইনী!?নাহ নাহ।তওবা, তওবা। ভুলেও যেন ওই মহিলা না হয়।।
তাড়াতাড়ি জিব কাটি।জামাকাপড় গুলো হাতে নিয়ে আয়নার সামনে এসে দাড়াতেই পেছন থেকে কেউ বলে উঠে,
-আজকে আমার পছন্দের ড্রেস পড়তে হবে,ওকে??
আমার রুমে মেয়ে মানুষের কন্ঠ শুনে অনেকটা ভড়কে যাই।তড়িঘড়ি পেছনে তাকিয়ে দেখি–সেই চেনা পাতলা সিমসাম মুখটি,সেই চেনা সিল্কি চুলগুলো,সেই চেনা মুখে লেগে থাকা হাসি, সেই চেনা টানাটানা চোখগুলো।এখন ব্লু কালার শাড়ি পরিহিত আমার মন কেড়েছে।রমণীর রূপে মুগ্ধ হওয়াটা বড় বিষয় নয়,বিষয়তো হল এই রমণী আমার এখানে কি করে!!আমার মুখ দিয়ে যেন কথা আসছে না।তোতলে তোতলে বলি,
-স-স-সোহানা, তুমি??
-হুম আমি।কেন? অবাক হচ্ছ?
দু’পাশে মাথা নাড়ি।
-কেমন আছো, শাওন??আজ অনেক দিন পর তোমায় দেখলাম!!
-ভা-ভা-লো, আজ অনেকদিন পর “কেমন আছো, শাওন” কথাটি শুনতে পেলাম। কতটা বছর পর মেয়েটিকে আজ দেখলাম।এখনো সেই আগের মতোই আছে সোহানা। মানুষ বলে,সময় বাড়লে মানুষগুলোও বদলে যায়,কিন্তু সোহানাকে দেখে এমন কোনো ভাবান্তর আসলো না মাথায়।প্রিয় সে সুচিস্মিতা হাসির মাঝে চাঞ্চল্য অনুভূতি।
স্মৃতির পাতা হুট করে সবকিছু জীবন্ত করে ফেলে যা বিশ্বাস করা যায়না!বলতে খুব ইচ্ছে হয়,সোহানা তোমার কি বিয়ে হয়ে গেছে?এখনো কি আমায় ভালোবাসো?নাকি ভুলে গেলে!কিন্তু ঠোঁট নড়লেও মুখ বলে না!
-হ-হঠাৎ করে আমাদের বাড়ি?তাও এ সময়??!!
সোহানা সাদামাটা একটা হাসি দিয়ে ফেলে,আর বলে,
-সারপ্রাইজ!! আচ্ছা শুনো?আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।পরে কথা বলছি।
-ওহ,হ্যাঁ হ্যাঁ।
এতক্ষণ পর আমার ধ্যান ভাঙ্গলো।

সোহানা সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুঁচকি হেসে রুম থেকে চলে যায়।পরে,আমি জামাকাপড় পরিধান করে নিই।
ছকিনা খালা আমার রুমে আসেন ডাকতে দুপুরের লাঞ্চ করতে যেতে।।
আমি গেন্জির কলার ঠিক করতে করতে সিড়ি বেয়ে নিচে নামি।সবাই ড্রাইনিং এ বসে পড়ে দুপুরের লাঞ্চে।মা আমায় দেখামাএই চেয়ার টেনে দেন।চেয়ারে বসতেই সোহানার মুখোমুখি চোখ পড়ে।অনেকটা লজ্জা অনুভূত হয়।সোহানা বুঝতে পেরে মাথানিচু করে মিটিমিটি হেসে উঠে।।
মা সবার প্লেটে ভাত বেড়ে দিচ্ছেনউ।এরইমধ্যে বাবা উকিল আঙ্কেলের উদ্দেশ্য বলেন,
-তো পরসু চলে যাবেন বলে ডিসাইড করলেন,রিয়াজুল সাহেব??
-জ্বী ভাই।আমার আরো কিছু ক্লাইন্টের কেইসগুলো এখনো লটকে আছে।তাই যাওয়া খুবই তাড়া।
-আপনি আমার ছেলের জন্যে দেড়টা বছর যা করলেন,সত্যি তা ভুলার নয়।
-এসব কেমন কথা বলছেন,আসলাম চৌধুরী ভাই?শাওন আমার মেয়ের সবথেকে ভালো বন্ধু।তাই মেয়ের বেস্ট মানুষের জন্যে একটু-আধটু করা তেমন কিছু না।।

আমি হকচকিয়ে উঠি উনার কথায়।অবাক দৃষ্টি দিয়ে সোহানার দিকে,মায়ের দিকে,বাবার দিকে এবং উনার দিকে তাকাই।উনার কথার অর্থ না বুঝতে পেরে উকিল আঙ্কেলকে বলে উঠি,
-আমি আসলে কিছু বুঝতেছি না।কে কার বন্ধু!?
-শাওন,তুমি না আমার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলে?
-জ্বী আঙ্কেল।
-আমি সোহানার বাবা এডভোকেট রিয়াজুল সাহেব।তুমি হয়তো আমার নামটি অবশ্যই জানো।
-জ্ব,জ্বী আঙ্কেল।সোহানার থেকে আপনার নামটা শুনেছিলাম।কিন্তু আপনি যে এডভোকেট তা জানি না।
-ওহ আচ্ছা,ওহ আচ্ছা।বায় দ্য ওয়ে,এখনতো জানলে।
-জ্বী।।

সোহানা আমার জন্যে এতকিছু করলো!আচ্ছা,ও জানলো কিভাবে আমি যে জেলে ছিলাম!ও-ই ওর বাবাকে সবটা বিষয় জানিয়েছে।কিন্তু সোহানার সাথে তো প্রায়ই কন্টাক্ট অফ ছিল কখনো ভাবতেই পারিনি ও আবার ফিরে আসবে।।
-কি হলো শাওন??খাচ্ছিস না কেন?ভাত খুঁটছিস কেন??
-ওহ,হ্যাঁ,হ্যাঁ মা এইতো খাচ্ছি।

তারপর আমি খাওয়াদাওয়া করে নিজের রুমে চলে আসি।এসেই ল্যাপটপটা একটু ঘাটাঘাটি করতে থাকি।হুট করে কেউ আমার দরজায় কড়া নাড়ে।তাকিয়ে দেখি সোহানা আসছে।
-আসতে পারি??
-হ্যা,হ্যা অবশ্যই আসো,আসো।

সোহানা আমার রুমে আসে।সোহানা আসা মাএই আমি বিছানা থেকে উঠে দাড়াই।তারপর একটা চেয়ার টেনে সোহানে বসতে দিই।আমি অনেকটা ইতস্ততাবোধ করতে থাকি।হুটহাট ওকে কি বলবো মাথায় কিছুই আসছে না!তারপর বলে ফেলি,
-সোহানা?তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
-ধন্যবাদ কেন??
-এইযে আমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে নিয়ে আসলে?
-এটা কেমন কথা, শাওন।এসব কিছু না।।যাইহোক,তোমার সাথে কিছু কথা বলার ছিল।বাড়িতে যাওয়ার জন্যে পাপ্পিতো ধাওয়া করতেছে,তাই পরে বলার আর সময় পাবো না।
-আচ্ছা বলো, সোহানা।
-শাওন??তোমাকে নিয়ে যে এত্তকিছু হলো।এইযে তুমি জেল খাঁটলে সবটা তোমার ভাইয়া এবং ভাবীর জন্যে।
খুবই অবাক হচ্ছ, না?হুম অবাক হওয়ার ই কথা।কারণ,ভাই যদি শএুতা করে সত্যিই কিছু আর বলার থাকে না।
-সোহানা আমায় একটু ডিটেলস ক্লিয়ারলি বলবে??
-ওয়েট শাওন,বলতেছি।

-তুমিতো দিবানিকে চেন,না??
-হুম, সোহানা।
-দিবানির চক্রে শিপ্রা তোমার উপর ক্ষেপে উঠেছিল।কারণ,দিবানি তোমায় অনেক ভালোবাসতো তাতো তুমি জানোই।তুমি দিবানির প্রপোজাল রিজেক্ট করায় দিবানি অনেকটা বিষণ্নতায় পড়ে যায়।দিনকে দিন তোমার কথা ভাবতো,একমুহূর্তের জন্যেও তোমায় ভুলতে পারতো না বাসায় ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতো না,কারো সাথে মিশতো না।একা একা সময় কাটাতো।এই নিয়ে বাসার সবার অনেকটা সন্দেহ হতো,তবুও ওতোটা মাথায় নেয়নি।
একদিন দিবানিকে বন্ধ দরজায় সবাই দেখতে পায়।শত কড়া নাড়ার শব্দেও দিবানি দরজা খুলে নি।সবাই ভয় পেয়ে দরজা ভেঙ্গে পেলে।আর দরজায় খোলার পর দেখে দিবানি ফ্যানে ওড়না ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করেছে।আর এই আত্মাহত্যার কারণও কেউ জানতো না যদি না তোমার নামে একটা চিঠি না লিখা হতো দিবানির।

-চিঠি??
-হুম, চিঠি।চিঠিটা এখন আমার কাছেই আছে।তোমাকে আমি দিব,পড়ে নিও।তারপর,ওই চিঠির মাধ্যমে শিপ্রা তোমার পরিচয় জানতে পারে।এই চিঠিটা কাউকে বেহুশ না করলেও সবথেকে জর্জরিত করে শিপ্রাকে।যে দিনের পর দিন রাগ ফুঁসতে থাকে মনে আগুন ধরানো প্রতিশোধের।তারপর যখন তুমি ভার্সিটিতে এডমিট হও,তখনই তোমায় খপ্পরে পেয়ে যায়।আর তখন থেকেই তোমার প্রতি লক্ষ রাখতে থাকে।তোমাকে কি থেকে কিভাবে ঘায়েল করবে।তার মিশন স্টার্ট টু ইউ।ও তোমায় পাওয়ার জন্যে অনেকদিনের সাধনা করে বেড়ায় যেখানে তোমার বন্ধুদের মাধ্যমে তোমাকে ড্রিংক পার্টিতে নিয়ে যায়।হয়তো তুমি এসবের কিছুই জানো না।

-সোহানা?দিবানি যে এমনটা করে ফেলবে আমি কখনোই ভাবতে পারিনি।তাছাড়া,আত্মাহত্যাকে হত্যায় রূপান্তর করলো কেন??হোয়াট ইজ দিস?আর এটা সম্ভব কিভাবে!??

-শিপ্রা বাসার সবাইকে থামিয়ে দেয় তার হিংস্র থাবায়।সবাইকে গোপন রাখতে বলে ওর আত্মাহত্যার কথা।সে তার ফ্যামিলওকে বুঝায় যে দিবানি কারো যন্ত্রণায় আত্মাহত্যা করেছিল।এতে তার ফ্যামিলিরনল তোমার প্রতি ঘৃণা জন্মায়।সবাই একটা প্রস্তুত নেয় তেমাকে ফাঁসানের জন্যে।যেহেতু,তোমার কারণে দিবানি মারা গিয়েছিল।।

-তারপর….???
-শিপ্রা ওদিনের জন্যেই অপেক্ষা করেছিল এবং পূর্ণও হয়েছিল।তোমায় হোটেলে নিয়ে যেই ভিডিও রেকর্ড করেছিল,তা নিজের কাছে রেখে তোমাকে প্রতি বার বার ওর শিকারী বানিয়ে রাখবে যাতে তুমি ওর প্রতিটা হুকুমে অস্বীকার না যাও।

-হুম।তোমার সাথে যে আমার ব্রেকাপ হয়েছিল তার কারণ কি জানো??
-জানি,শাওন।আমি সবটা খোলাসা জানি।

চলবে….

ভাবিনি ফিরে আসবে পর্ব-১২

0

ভাবিনি ফিরে আসবে
পর্ব-১২
রোকসানা আক্তার

দু’পা গুঁজে জেলের শিকের সাথে হেলিয়ে ফ্লোরের উপর উবু হয়ে বসে আছি।চোখের অশ্রু ঝরঝর বেয়ে পড়ছে গালের দু’পাশ দিয়ে।
মাথায় কত ভাবনার ছেদ বিচরণ করছে। যে ছেলে কখনো কারো সাথে গায়ে পড়ে তর্কে যায়নি,আজ সে দু’দুটো খুন করে চারদেয়ালে বন্ধি!

হুট করে, আমার সামনে একটা পএিকার পেপার এসে ধপসে পড়ে।হদিস করতে না পেরে সামনের দিকে তাকাই।কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হিংস্র প্রাণীর মত আমার দিকে চেয়ে আছেন থানার ওসি যেন এখনি খপ্পাস করে আমার মাথা মুচড়ে দিবেন।

আমি উনাকে দেখা মাএই উঠে দাড়াই।উনি আমায় হাত দিয়ে ইঙ্গিত করেন পএিকার কাগজের লেখার দিকে।
পএিকার কাগজে মোটা অক্ষরে লিখা আছে-“এবার নিদু হত্যার সাথে আরেকটা হত্যা যোগ হলো দিবানির।”

আমি চোখবুঁজে উনার সামনে দাড়িয়ে আছি।উনি ফ্লোর থেকে পএিকাটি হাতে নিয়ে বলেন,
-এবার বল,দিবানিকে কেন খুন করলি?মেয়েতো কোনো দোষ করেনি!!ও’তো তোকে জাস্ট ভালোবেসেছে।লাইফে এই প্রথম দেখলাম,কোনো হিরো প্রেমিকার প্রপোজাল রিজেক্ট করে তাকে হত্যা করতে।হা হা হা হা!!বিষয়টা খুবই বেমানান!!



-কি হলো কথা বলছিস না যে??(ধমকের সুরে)
-আপনাদের যদি এতই সন্দেহবসর,তাহলে এখনো গলায় দড়ি দিচ্ছেন না কেন!!??(জোরে)

আমার কথায় উনি খিলখিল করে হেসে উঠেন।উচ্চ তড়িত আওয়াজে পুরো বিল্ডিং যেন কাঁপতাছে। তারপর হাসি থামিয়ে উপহাসের ইঙ্গিতে বলেন,
-তোকে দেখলে আমার মাকাল ফলের কথা ধুমসে মনে পড়ে যেটির বাহিরে সুন্দর,ভেতরে ছাই।খুনীদের চোখগুলো লাল,চুলগুলো উসকোখুসকো,মুখে জানোয়ারের ছাপ থাকে,কিন্তু তোর ব্যাকগ্রাউন্ড ভদ্রতার পরিচায়ক।মনে হয়না তোর মতো ছেলে কাউকে খুন করতে পারে।তাও দু’দুটো।অবাক হচ্ছি বটে।হিহিহিহি

মনটাকে সংযত রেখে বলি,
-হ্যাঁ আমি খুনী!!আমি গ্লোবাল ক্রিমিনাল।আর কিছু জানতে চান??
-তুই এসব বলে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতেছিস নাকি,বলতো!
-আপনারাই যদি দোষী বলেন তাহলে নিজেকে কিভাবে নিরপরাধী বলবো!?
-তোর নামে অনেকগুলো সাক্ষ্য পেয়েছি,বুঝলি??এখন কোর্টে প্রমাণ ফ্রেশ হওয়ার পালা।

স্যার আপনার সাথে একজন দেখা করতে আসছে।
দারোগার কথায় মাথা ঘুরিয়ে তাকায় ওসি।
-আচ্ছা আসতেছি।
এ বলে ওসি আমার দিকে কটুভাবে তাকিয়ে বলেন,
-তোকে আমি পরে দেখতেছি।।

তারপর তড়িঘড়ি স্থান ত্যাগ করেনন।।এভাবে জেল জীবন চলতে থাকে।কোর্টে কাঠগড়ায় আমার বিপক্ষের উকিল টেকনিক খাটিয়ে বার বার আমাকে হেয় করে শাস্তির দরখাস্ত করতে থাকেন এবং আমার সাঁঝাও বাড়তে থাকে।।আমার পক্ষের উকিল উনাদের চাটুকারিতায় পেরে উঠতে না পেরে অতঃপর আমার পক্ষে লড়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেন।একমতে,আমার কেইসটা ক্যান্সেল করে ফেলেন।।

একরাত জেলখানার আনাচে-কানাচে নিবুনিবু হলুদ বাতির আলো জ্বলতেছে,চারদিকটা নিঃশব্দ।আমি ব্যর্থমনে বসে আছি মৃত্যুর প্রহর গুণতেছি।কারণ,আমার বিরুদ্ধে যেসব মিথ্যে সাক্ষ্য সবই সত্যপ্রমাণ সবার কাছে।পৃথুলী,তানহা সবাই আমার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিল এবং নিদুর বাবা,অন্যান্যরাও।
এতে জজ মৃত্যুর রায় যেকোনো মুহূর্তেও দিয়ে দিতে পারে।আমার মা-বাবা,ফ্যামিলির সবার সাথে দেখাশুনা বন্ধ। আগে যা-ই দেখাশুনা করতে পারতাম,এখন থানা কর্তৃপক্ষ তাদের ছায়াটুকুকে আসতেও কড়া নিষেধ আমার এখানে।

একদম আশাহত জীবন আমার।এই পৃথিবীর বুকে আমি খুব একা।মাঝে মাঝে নিজের মাঝে খুব একাকীত্ব অনুভূতি হয়।আগের সেই প্রতিটি আনন্দের মুহূর্তকে ভীষণ মনে পড়ছে।মনে পড়ছে সাথীর কথা,মনে পড়ছক শিমলার সেই কটকটি দুষ্টমির কথা,মনে পড়ছে অতি অতীত ভালোবাসার মানুষটির কথা,মনে পড়ছে মায়ের সেই হাসিমাখা মুখটির কথা,বাবার সেই কটু দৃষ্টির আড়ালে নিরবতা ভালোবাসা।আবার সেই কালোদিনের বিষণ্ন মুহূর্তগুলোর কথা যাদের জন্যে আমি আজ জেল জীবন পার করছি।যে মুহূর্তগুলো সুখের মাঝে অতি দুর্দশা,আক্ষেপ,কষ্ট নিয়ে এসেছে।সবগুলো স্মৃতির পাতাই যেন আমাকে ক্ষণে ক্ষণে বিষণ্ন করে তোলে।মন বলে,আমার মতো অভাগা এই পৃথিবীতে আর কেউ বুঝি নেই!!!আজ ৭টা মাস জেলে!!!

কারো গলার হালকা কাশির শব্দে আমার এসব ভাবনার ছেদ ঘটে।।
তাকিয়ে দেখি একজন কোট,টাই পড়া লোক সামনে দাড়িয়ে আছে।দেখতে অনেকটা লম্বা,চুলগুলো মাথায় গুছানো,মুখটা সুদর্শন,গালে হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি।বয়স প্রায়ই পঞ্চাশ হবে।লোকটির মাঝে ভদ্রতা আভাস।আমার দিকে তাকিয়ে মুঁচকি হেঁসে দেন।
আমি কিছু বুঝে না উঠতে অনেকটা জিজ্ঞাসু বাক্যে বলে উঠি,
-ক-কে আ-আপনি??
-কুল সন,কুল!!উওোজিত হয়ো না!!জানতে চাচ্ছো আমি কে হতে পারি??
জ্ব-জ্বী!!

উনি আমার পাশে এসে বসেন অতি পরিচিত মানুষের মতন।গলাটা ছোট করে বলেন,
-আমি তোমার পক্ষে লড়তে এসেছি। মানে আমি তোমার উকিল।।

আমি অনেকটা ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে উঠি,আর বলি,
-আমার পক্ষে লড়ে আর কোনো লাভ নেই স্যার।কারণ,অলরেডি আমি খুনী!!
-মানুষ খুনী বললেও আমি যে তা বিলিভ করবো এমনত নয় শাওন!!
-আমার মা আপনাকে পাঠিয়েছেন??
-নাহ!!
অবাকের উচ্চ মাএায় উঠে যাই।
-তাহলে কে পাঠিয়েছেন??
-কেউ না!!আমি নিজেই এসেছি।তোমাকে নিয়ে নিউজে বার্তা দেখেছি,তাই আমি নিজেই ডিসিশন নিয়েছি তোমার কেইসটা সলভ করবো।এজন্যই ঢাকা থেকে আসা।

উনার কথায় কেনজানি আমার বিলিভ হতে চাচ্ছে না।কারণ,কোনো অপরিচিত মানুষ দোষীর জন্যে এরকমটা সাপোর্ট নিয়ে কেউই আসবে না।পৃথিবীতে যদি এতই ভালো মানুষ আজও থাকতো তাহলে আমি আর এতটা মাস জেলে কাটাতাম না।মানুষ মানুষের জন্যে হলে মিথ্যে মামলায় আমায় ফাঁসানো হতো না।সো,এসব বিশ্বাস করার কোনো মতে প্রশ্নই আসে না।

-কি?তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না??
-প্লিজজ আপনি আসতে পারেন, স্যার!!ক’দিন পর আমায় ফাঁসিতে ঝুলানো হবে,খামোখা মিথ্যে মামলায় লড়ে নিজের শক্তি ক্ষয় করার কোনো মানে হয় না।
-আমি জানি শাওন,তুমি এসব অতিকষ্টে বলতেছ।মানুষ যখন ভীষণ কষ্ট পায় তখন আাশাগুলোকে মাটিতে চাপা দিয়ে দেয়।অতিকষ্টে জর্জরিত মন আরো আঘাত পেতে চায়,এমনকি নিজের জীবনটাকেও জীবন মনে হয়না।শাওন,আমি বুঝতেছি তোমার মনের অবস্থা।মনকে শক্ত করো।পৃথিবীতে কি মিথ্যেরাই আধিপত্য করে যাবে??আমরা কি সত্যকে সত্যতা বলে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি না?।মিথ্যের কি এতই শক্তি যে সত্যকে হারিয়ে দিয়ে নিজে জিতে যায়!?এমন নড়বড়ে হলে,জীবনটা দুঃখের স্রোতেই বয়ে যাবে,বুঝলে??
-দেখুন স্যার,আমি আর পারতেছি না।আর কত্ত,আর কত!!!

এ বলে চুল মুচড়ে ধরি।
-তোমার একটাই সমস্যা!!তুমি প্রতিবাদ করতে জানো না!!সবকিছু নিরবে সয়ে নিজেই কষ্ট পাও।।

-ঠিক বলছেন আমি প্রতিবাদ জানি না।আমি একটা কাপুরষ। এ কাপুরুষদের পৃথিবীতে বাঁচার কোনো অধিকার নেই।প্লিজজ,আমার কেইসে লড়বেন না।প্লিজজ আপনি চলে যান।।
-শান্ত হও সন।সবকিছু ভালোই হবে।তুমি আমায় বারণ করলেও তোমার কেইসটা আমি ছেড়ে দিবনা।আমি প্রতিবাদ করেই যাবো। লক্ষ যেথায় সফলতা সেথায়, আমি হাল ছাড়বো না।ভালো থেকো।।

উনি আমার পিঠে হাত বুলিয়ে চলে যান।।
আমি হা হয়ে তাকিয়ে আছি।আর হট্র হাসি দিয়ে বলি,
-এরকম কত্ত উকিল আসলো আর গেলো!!কেউ কিছুই করতে পারলো না।এডভোকেট শোবের খান-এর কাছে খ্যাতিমান অনেক উকিলই ফেইল।আর এডভোকেট শোবের খান-ই আমার বিরুদ্ধে লড়ছেন।।

তারপর অন্ধকার চারদেয়ালে সারাক্ষণ বসে বসে থাকি।কখন মৃত্যুর সংবাদ আসবে।এক প্রকার ভেবেই নিই যে মুক্তি আর আমার কপালে কখনোই মিলবে না।
ওই উকিলের সাথে শেষ দেখা হওয়ার পর আর কোনো প্রাণীকে আমার আশপাশ দেখতে পাইনি।কোউ কোনো রকম খবর নিয়েও হাজির হয়নি।যে উকিল কথা দিয়েছিল তাকেও আর পরবর্তীতে দেখতে পাইনি।দিনকে দিন সবকিছু কেমন যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে।।
আমার মুখটা যেন কথা বলাও ভুলে গেছে।দু’ঠোঁট সবসময় এখন মিলিত,একটু নড়েও না।।

এভাবে অনেকটা মাস পেরিয়ে বছর গড়িয়ে যায়।।তবুও,ফ্যামিলির অপেক্ষা!!তারা যদি হুট করে একদিন আমার সাথে দেখা করতো, একটুর জন্যে হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতাম।মনকে মানাতে পারতাম,যাক আমার এইতো আপনজন আছে!!কে বলছে আমার আপনজন নেই??

এভাবে আরেকটা বছর কেটে যায়।এ নিয়ে দু’দুটো বছর শেষ।তারপরও আমি বেঁচে আছি।মনের মৃত্যুতে দেহটা এখনো প্রাণ আছে।সেও যদি কখনো নড়াচড়া বন্ধ করে দেয়,তখন মনটাও পৃথিবী থেকে বিলীনন।।।।
জেলের কোণে বসে বসে হাঁফ ছেড়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছি।।এরইমধ্যে কেউ লোকাবের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে।।
আমায় উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
-আপনি মুক্তি পেয়েছেন।।
আমার ক্লান্ত দিশাহীন চোখগুলোয় হালকা পলক খুলে লোকটিকে দেখতে দৃষ্টিগোচর। কে এই কথাগুলো বলছে!?
তারপর,ঘোর ঘোর চোখে দেখতে পাই জেলখানার কর্তৃপক্ষ বলছেন।আমি এখনে ভালোভাবে বুঝতেছি না উনি কি বলতেছেন!

-ম-মানে বুঝি নি।।
খুব ক্লান্তভাবে প্রশ্ন করি।কারণ আমার শরীরটা একদম নিস্তেজ।কথা বলার শক্তিটুকু যেন শরীরে নেই।।
-মানে হলো আপনার জেলজীবন শেষ।আপনাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হলো।আপনি নিরপরাধ, তাই আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।।

আমি উনার কথাগুলো শুনে অনেকটা অবাক হয়ে যাই।আসলে কি আমার মুক্তি হয়েছে?আর উনি সত্যি বলছেন তো??
-সত্যি!!
-হু,কেন আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না??
আমি হালকাভাবে দু’পাশে মাথা নাড়ি।।
-তাহলে চলুন আমার সাথে।।

এ বলে উনি আমার হাতটা ধরে ফ্লোর থেকে উঠে তুলেন।আমি আস্তে আস্তে জেল থেকে বের হয়ে আমার গন্তব্যে চলতে থাকি।হয়তো,বাহিরে আমার জন্যে অনেকগুলো প্রিয় মানুষ খুব আকাঙ্খিত ভাবে অপেক্ষা করছেনন।কতগুলো মাসের পর আজ আমায় খুব কাছ থেকে দেখবেন।

চলবে…

ভাবিনি ফিরে আসবে পর্ব-১১

0

ভাবিনি ফিরে আসবে
পর্ব-১১
রোকসানা আক্তার

বাবার জরুরী কল আসাতে বাহিরে চলে যান।এতক্ষণ পর মনের মধ্যে দমিয়ে রাখা আনন্দের ছন্দ সাথী এক এক করে ফাঁস করতে থাকে।
মাকে, আন্টিকে,ছকিনা খালাকে বাদুড়ের মতো লাফ মেরে জড়িয়ে ধরে খুশির তালে।
-আহা,খালামণি জানো??আমার পথের কাঁটাটা অতঃপর গেলো।এখন নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো।আমাকে আর বিয়ের জন্যে জোর জবরদস্তি করবে না,টাকা-পয়সার জন্যে যখন তখন থ্রেট দিবে না।আহ,বিন্দাস লাইফ আমার।এখন,আমার সব সব ড্রিম সাকসেস করতে পারবো,ইয়াহু।।

আমি সাথীর কথায় পুরো ফিদা।চোখ টিপ মেরে বলি,
-নিদু চলে গেলো বুঝলাম,আহসান খিদ্দেরী তো এখনো বেঁচে আছে।
-ভাইয়া!! তুমি চাচ্ছো ওই বুইড়াও আবার আমার মাথার উপর চড়ে বসুক?
-হুম,চড়লেতো আমার রাস্তা একদম ক্লিয়ার।
-খালামণি, কিছু বলো ভাইয়াকে?

মা সাথীর কথায় আমায় বকতে যাবে,ওমনি চোখ ইশারা দিয়ে মাকে বলি,
মা, মা বুঝো না?একটু মজা নিচ্ছি।তুমিও পারলে আমায় সাপোর্ট করে সাথীর রাগী মুখটাকে দেখার একটু উপায় করে দাও,প্লিজজ মা(মনে মনে)
মা আমার ইশারা বুঝতে পেরে আরো রেগে বলেন,
-শাওন??এসব কি,হুম?যা তোর রুমে যা!!নিদু খিদ্দেরী মারা যাওয়া মানেই আহসান খিদ্দেরী প্যারালাইজড। সো, সাথী মা এই পাগলটার কথা মাথায় নিবা না,এ একটা পঁচা।

সাথী খিলখিল করে হেঁসে উঠে মাকে জড়িয়ে একটা চুমু দিয়ে বলে,
-এইতো আমার লক্ষী খালামণি।কেউ আমায় না বুঝুক,অন্তত লক্ষী খালামণিটি আমায় বুঝলো।যাও তোমরা সব পঁচা।হিহিহিহি।

আমি আর হাসি দমিয়ে রাখতে না পেরে নিজের রুমে চলে আসি।পিছু পিছু সাথী টুকী যে আসবে মাথায় ছিল না।।পেছন থেকে ঘুরে আমার সামনে এসে বলে,
-কি হ্যাঁ মেও?বোকা বানাতে পারলাম তো আজ??
-টুকী!!
-মানে!? টুকী কে ভাইয়া??
-কেন,তুই??
-এই এসব কিন্তু ঠিক না।আমার নাম টুকী না,আমার নাম সাথী!!
-আমার নামও মেও না,আমার নাম শাওন।ডু ইউ আন্ডার্সটেন্ড??
-বিড়ালের মতো সারাদিন ঘ্যাঁনঘ্যান করলে সে তো মেও হিসেবেই উপাধি পায়।
-আর সারাদিন চোরের মতো আঁকুপাঁকু করলেতে তাকে টুকীই বলা হয়।।
-ভাইয়া তুমি থামবে??(রাগ নিয়ে বলে সাথী)
-তুই এখান থেকে যাবি??
-যাবো না।দেখি কি করতে পারো।।
-তোকে এখন মারবো!!
-মারো??

হাতটা এগিয়ে নিয়েও পিছু টেনে সরু করে ফেলি।সাথী আমার দিকে একপলকে তাকিয়ে আছে।একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে বলে,
-ভাইয়া, তুমি খুশি না?নিদু যে মারা গেছে??
-নিদুর মৃত্যুকে এখানে আমার খুশি হওয়ার কি আছে সাথী??
-কারণ,নিদু আমার লাইফ থেকে চলে যাওয়া মানেই শাওন ভাইয়াকে আমার করে পাওয়া।আর অন্যকোনো শক্তি আমাদের মাঝে বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারবে না।
-এসব কি বলছিস তুই??
-ভাইয়া, আমি ভুল কিছু বলিনি। তোমার এত্ত ইগনোরের পরও এখনো পাগলের মতো তোমার পিছে পিছে ছুটি!!আমার ভালোবাসার কি কোনো দাম নেই??

-তুই এখনো অনেক ছোট সাথী।তোর এখনো বয়স হয়নি।তুই পড়ালেখা করবি, নিজের পায়ে নিজে দাড়াবি।দ্যান বিয়ের কথা ভাববি।
-তোমার সাথে বিয়ে হওয়ার পর কি আমি স্টাডি করতে পারবো না ভাইয়া??

ওর এসব পাগলামো কথা শুনতে শুনতে অনেকটা বিরক্তি চলে আসে।উপায়ন্তর না পেয়ে ডিরেক্ট জবাব দিই,
-সাথী আমার পক্ষে সম্ভব না।পারলে ক্ষমা করিস।
-ভাইয়া,কেন সম্ভব না কারণ বলো?বলো, কেন সম্ভব না?!

আমি সাথীর এসব প্রশ্নের উওর না দিয়ে চলে আসি।।
বেলকনিতে এসে বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি।বাহিরে কি সুন্দর দগদগ আলো,চারদিকের পরিবেশটা যেন ঝিকঝিকিয়ে উঠছে।পাখিরা কিচিরমিচির তুলে নিজেদের সুরে গান গাচ্ছে। ক্ষান্ত মনটাকে প্রশান্তি দেওয়ার জন্যে বাহিরের দিকে মুখটা এগিয়ে থমকা হওয়া গায়ে মাখি।।সারাদিনের কষ্ট ভুলতে প্রকৃতি অবিরল জেগে থাকে।মানুষের মনের দুঃখ নিবারণের জন্যে সে সদা প্রস্তুত।
এসব ভাবতে ভাবতে পেছন দিকে একটু ফিরে তাকাই। রুমটা শূন্য দেখতে পাই।সাথী হয়তো মন খারাপ করে রুম থেকে চলে গিয়েছে।এই মেয়েটাকে নিয়ে কি করবো,কিছুই মাথায় আসছে না।।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়।মা সবাইকে খাওয়ার জন্যে ডাকেন।আমি খাবার রুমে যেতেই সাথী ছাড়া সবাইকে চেয়ারে দেখতে পাই।ভাইয়াও এসছেন,হয়তো বাবা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে খাবার টেবিলে নিয়ে আসছেন।মা আমায় দেখে চেয়ার টেনে বলেন,
-বাবা,আয় বস।
-মা? সাথী খাবে না??
-ওর নাকি পেটভরা।সেজন্যে খাবে না।
– সে কেমন কথা!!সকালে নাস্তাতেই পেটভরা?
-জানি না।গিয়ে জিজ্ঞেস কর খাবে কি না।
-আচ্ছা যাচ্ছি।

সাথী যে রুমে থাকে, সে রুমে আসি।এসে দেখি দরজা বন্ধ।দরজায় কড়া নাড়তে থাকি।
-সাথী?সাথী?দরজা খোল??

কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না।
– আরেহ,এই মেয়ে দরজা খোল??তুই না খেলে আমি কিন্তু আজ সারাদিন খাবো না।

তারপর হালকা একটা আওয়াজ তুলে বলে,
-তা তোমার ইচ্ছে আমায় বলছো কেন?
-সত্যি,তাই???তাহলে আজ সারাদিন উপোস থাকবো।তোর নিজের জন্যে আমায় আজ না খেয়ে থাকতে হবে।ভালোবাসার মানুষটিকে এভাবে কষ্ট দিয়ে থাকতে পারবি??

সাথী আমার মুখ থেকে নিবৃও “ভালোবাসার মানুষ” শব্দটি শুনে খুশিতে আৎকে উঠে।কিন্তু এটাতো জাস্ট এক্সকিউজ টু রিমুভ হার আয়ার(রাগ)।
-তুমি যে আমায় এখন কষ্ট দিচ্ছ ভাইয়া??তুমি যেভাবে পারছো,ঠিক আমিও পারবো।

-দেখ, সাথী?পাগলামী বহু হয়েছে।প্লিজজ দরজাটা খোল।আমি হাঁপিয়ে উঠছি।প্লিজজ??

এভাবে অনেকক্ষণ ঘ্যাঁনঘ্যাঁনাতে থাকি।হুট করে সাথী দরজা খুলে আমায় জড়িয়ে ধরে। মুখে কাঁদো কাঁদো ভাব এনে বলে,
-আমার সাথে কেন এমনটি করছো ভাইয়া?আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।কত আর কষ্ট দিবে,বলো??

এরইমধ্যে বাবা ডাক দেন।
-শাওন??খেতে আসছিস না কেন??এখনো ওখানে কি করছিস??

আমি থতমত খেয়ে সাথীকে আগলে রেখে বলি,
-সাথী, বাবা ডাকছেন।চল লক্ষীটি আমরা খেতে যাই।
সাথী চোখের পানি মুছে অনেক কষ্টে বলে,
-আচ্ছা,চলো।।

খাওয়াদাওয়া শেষ হয়।আমি দুপুরে একটা ঘুম দিই।বিকেলে সাথীর ডাকে ঘুম ভাঙ্গে।
-বাহ,বাহ ভাইয়া?? তুমিতো বেশ ভালোই ঘুমতে পারো!এই নাও তোমার চা।
আমি কাচুমাচু দিয়ে বলি,
-ঘুম থেকে না উঠতেই চা!বাহহ!!তোর মতো এমন লক্ষী বউই আমার প্রয়োজন।

সাথী মুখটা গোমড়া করে বলে,
-চা আমি বানাইনি।খালামণি বানিয়েছেন।
-ওহ,তাহলেতো তুই কাঁচা!!ভাবলাম চা বানাতে পারলে তোকে বউ হিসেবে মেনে নেওয়া যায়,কিন্তু এখনতো…..

সাথী ক্রুদ্ধ হয় যায় আমার কথা শুনে।মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে আর বলে,
-হবো না তোমার বউ,দূর!!

এ বলে প্রস্থান ফ্রম মাই রুম।
আমি একটা মুঁচকি হেসে টেবিলের উপর থেকে চায়ের কাপটা হাতে নিই।আর একটা চুমুক দিই দুধ চায়ে।।দুধ’চা আমার অনেক ফেভারিট। যত খাই,ততই তৃপ্তী মেটে।।

পরদিন সকালে,
মা আমার দরজায় সজোরে আঘাত করে আমায় ডাকতে থাকেন।মায়ের এমন উচ্চ হৃদয় কম্পিত আওয়াজ শুনে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। কোনোকিছু এলক্ষ না করতে পেরে বিছানা থেকে তড়িঘড়ি উঠে দাড়াই এবং দরজার সামনে গিয়ে দরজা খুলতেই মা আমায় জড়িয়ে কেঁদে দেন,আর বলেন,
-বাবা,তুই রুম থেকে বের হইস না।ওরা তোকে ধরে নিয়ে যাবে।
আমি মায়ের কথা বুঝতে না পেরে অনেকটা নাজেহাল হয়ে যাই।বিষয়টি আরেকটু ক্লিয়ারের জন্যে মাকে ছেড়ে দরজার দিকে পা বাড়াই।মা আমার হাতটা জোরে আঁকড়ে ধরে বলেন,
-বাবা যাস নে নিচে,যাস নে রে বাপজান।।

আমি আরো বেশি অবাক হয়ে যাই।মায়ের এরকমটা করার কারণ কি!!মাথায় কোনো ভাবনা না আসতেই মায়ের সম্মতি অগ্রাহ্য করে সিড়ির কাছে আসি।সিড়ির কাছে এসে যা দেখলাম,মুখে ভাষা নেই কি বলবো!!একদল পুলিশ পিস্তল-টিস্তল নিয়ে আমাদের বাড়ি হাজির।আমাদের বাড়িতে উনাদের আসার কারণটাও বুঝতেছি না।
উনাদের উদ্দেশ্য করে বলি,
-এক্সকিউজ মি, স্যার?আমাদের বাড়ি আসার কারণটা কি??
আমার কথার আওয়াজ পেয়েই উনারা সবাই আমার দিকে তাকান এবং সাথে সাথে কয়েকজন আমাকে লক্ষ্য করেই আমার দিকে পিস্তল তাক করেন।
-এই সাবধান!কোথাও পালাবার চেষ্টা করবে না।পালাবার চেষ্টা করলে গুলি করতে বাধ্য হবো।

আমি তড়িঘড়ি হাতদুটো শূন্যে তুলে ফেলি।কোনোকিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উনারা বলে উঠেন,
-তুমও নিদুকে খুন করেছো।এবার জেলে চলো।

উনাদের এসব কথা শুনে আমার পরিবারের সবাই আৎকে মুখে হাত রাখে।আমি অনেকটা অবাক হয়ে যাই!!এরা এসব কি বলছে!??

-কোনো প্রমাণ আছে আপনাদের কাছে?আমি যে নিদুকে খুন করেছি??
-তোমার যা বলার কোর্টে বলবে।চলো!??
আর কোনো কথা বলতে না দিয়েই আমার হাতে হাতকড়া পড়িয়ে সিড়ি বেয়ে নিয়ে যাচ্ছে উনারা।সাথী,আন্টি,মা নিবৃও চোখের পানি ফেলছেন আমার দিকে চেয়ে।আর বাবা বিমূঢ় হয়ে মূর্তির মতন দাড়িয়ে আছেন।

বড় একটা জেলে আমায় ঢুকিয়ে লোকাবে তালা ঝুলিয়ে দেয়। আমি অবুঝ বাচ্চাদের মতো চেয়ে আছি শুধু।চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে হয়,কিন্তু পারতেছি না!!
কিছুক্ষণ পর ঝুলে থাকা তালা খুলে একজন ইনস্পেকটর আমার সামনে উপস্থিত হয়।।
আমার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসেন,আর মুখের কোণে হাত রেখে জিজ্ঞেস করেন,
-তুই নিদুকে কেন মারলি? কি উদ্দেশ্যে ওকে খুন করলি?কি লাভটা হলো ওকে খুন করে!??

আমি মুখ দিয়ে কিছু বলতে যাবো,তা গলায় এসেই আঁটকে যায়।তার গতিতে বাঁকটাও যেন হারিয়ে গেছে।

-কি কথা বলছিস না কেন??কেন খুন করলি নিদুকে???তোর এবং নিদুর কল লিস্ট চেক করে অনেকগুলো সূএ শনাক্ত করতে পেরেছি।
কাল রাত তোর সাথেই নিদুর শেষ কথা হয়েছিল ফোনে। তোর সাথে নিদুর ভালোই সম্পর্ক ছিল।অনেকগুলো ডায়ালিং কল,রিসিভিং কল,,বাহহহ!!!তবে বন্ধুর অনেকগুলো ডায়ালিং কল থাকার পরও ব্যাক করতি না কেন!!বন্ধু কি তোকে হুমকি দিয়েছিল নাকি??সে ভয়ে কল রিসিভ করিস নি!!তার বদৌলতে সোঁজা খুন।আর এই হুমকির প্রতিবাদের মূল কারণ কি?
বল???



-বুঝছি, তুই বলবি না।আচ্ছা, তাহলে আমি বলছি,শোন।
রাস্তার কাঁটা ক্লিয়ার করে সাথীকে নিজের করে পেতে???
জবাব দে??

উনার ধমকের সুরে আমার আত্মা কেঁপে উঠে।
উনি আমার থেকে কোনো জবাব না পেয়ে বলে উঠেন,
-ওকে বুঝলাম।তোর মুখে কথা আসবে না।কি মলম লাগালে তোর মুখদিয়ে শব্দ হবে তা আমি খুব ভালো করেই জানি।।

এ বলে মস্ত একটা লাঠি দিয়ে এক এক করে আমার পিঠে বাঢ়ী দিতে থাকেন।আর আমি চোখবুঁজে সহ্য করে নিচ্ছি!! তবুও আমার মুখ থেকে কোনো শব্দ আসছে না।অতঃপর উনি বিরক্ত হয়ে একমতে স্থান ত্যাগ করে নিজ কক্ষে চলে যান।।।

এভাবে ৫ দিন পর্যন্ত আমায় মেরে অবশ বানিয়ে ফেলে।আমি আর কোনো নড়াচড়া করতে পারছি না।চারদেয়ালের মধ্যে অসাড় হয়ে শুয়ে আছি।হুট করে কারো কান্নার শব্দ কানে বাঁজে। তাকিয়ে দেখি মা,শিমলা এবং সাথী আসছে।
আমি মাকে দেখে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে থাকি।উঠতে চেষ্টা করলেও উঠতে পারছি না।পরে লেচরাতে লেচরাতে জেলের শিক ধরে অনেক কষ্টে উঠে দাড়াই।সাথী আমার এ অবস্থা দেখে উচ্চ আওয়াজে কান্না করতে থাকে, আর মা সে’তো বুক ভেঁসে কান্নাকে উড়িয়ে দিচ্ছে।।
শিমলা শিকের মাঝখান দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে বলে,
-চিন্তা করিস না শাওন।যারা তোকে মিথ্যে অপবাদে ফাঁসিয়েছে,ওদের খুঁজে বের করবোই।ইনসাল্লাহ তোকে অপরাধী মুক্ত করবোই।আমরা একজন উকিলের সাথে কথা বলেছি।।

-মা,শিমলা তোমরা বলো?আমি কি নিদুকে খুন করতে পারি??
-নাহ,বাবা নাহ!!তুই কখনোই এই কাজ করতে পারিস না।এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস!!
-তাহলে কেন আমি আজ পএ-পএিকা,মিডিয়াতে খুনী হিসেবে সাব্যস্ত হলাম?বলো???
মা আমায় শুধু আশ্বাস দিতে থাকেন।আর আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদেন।কারণ,সবকিছুই অব্যক্ত,বলতেও গিয়েও কারো মুখে কথা আসছে না।।

আমি সাথীর দিকে মুখতুলে তাকিয়ে আবার বলি,
-সাথী?আমি কি তোকে পাওয়ার জন্যে নিদুকে খুন করেছি,বল?নাকি ভাইয়ার বউয়ের জন্যে!?

সাথী চোখগুলো কপালের দিকে উঠিয়ে বলে,
-ভাইয়া, তুমি এসব কি বলছো???
-হ্যা-রে, হ্যাঁ।
আর শুধু ফুঁপিয়ে কান্না আসে আমার।
-নিশ্চয়ই সব ওই শিপ্রা ডাইনীর কাজ হবে,শাওন!!আই এম সিউর!!এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই!তোর কিছুই হবে না শাওন।আমরা আছি তোর পাশে।মিথ্যাবাদীকে তার উচিত জবাব ঠিকই ফিরিয়ে দিব।জাস্ট একটু ওয়েট এন্ড সি!!(শিমলা)
-ভাইয়া,প্লিজজ তুমি কান্না করো না।(সাথী)

আপনাদের সময় শেষ।এবার আসতে পারেন(থানার হালদার)
আজ কেন জানি মায়ের হাতটা ছাড়তে ইচ্ছে না।অনেক কষ্টে মায়ের আদুরী মাখা হাতটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি।
পরে,মা,শিমলা,সাথী কেঁদে কেঁদে আমায় বিদেয় জানায়।
আমি ফ্লোরের উপর চোখবুঁজে বসে পড়ি।

এরইমধ্যে থানায় আরেকটা খবর রটায়।থানায় একজন পুলিশ হাতে একটা পএিকা নিয়ে ওসির সামনে হাজির হয়।
তা’হলো দিবানির হত্যাকান্ড,যেটিতেও আমি জড়িত।

চলবে…
(এক ঢিলে দু’পাখি😅।দেখা যাক মিশন সাকসেস হয় কিনা ট্রিকিবাজের😁।আর দিবানির ব্যাপারটা অনেকে বুঝতেছেন না।অবশ্যই সামনে বুঝবেন।দুঃখের পর সুখ আসে,এই গল্পটিতেও তাই হবে।তাই খামোখা বিচলিত হওয়ার দরকার নেই।গল্পটি অনেকটা শেষের দিকে।)