Tuesday, July 8, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1497



প্রাক্তন পর্ব-২৪

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২৪

ঘুম থেকে উঠার পর সোহান যা বলল তা শুনে নিজের মধ্যে ঝড় বইতে লাগল। অরন্যকে কেউ একজন খুন করেছে। আর সেটার দায় চাপানো হচ্ছে আমার উপর। সবাই সন্দেহের তীর আমার দিকে যে, আমি অরন্যকে খুন করেছি। এ অবস্থায় কী করব আমি জানি না। অরন্যকে আমি ভালোবাসি না এটা ঠিক, তবে অরন্যের মৃত্যু কামনা কখনও করিনি। যতই হোক একটা সময় আমি তাকে পাগলের মতো ভালোবাসতাম আজকে যেন তার মৃত্যুটা আমার গলায় কাঁটা হয়ে বিদে রইল। কথা বলতে পারছি না হাত পা কাঁপছে। ময়না তদন্তে পাঠানো হয়েছে ওর লাশ। জানি না অরন্যকে কে খুন করল। তার স্বার্থই বা কিসে নাকি অরন্য আত্মহত্যা করেছে। সে আত্মহত্যা করলে হয়তো নিজেকে কখনও সামলে নিতে পারব না। কষ্ট হচ্ছে অনেক। চাপা কষ্ট গুলো ভীষণ রকম যন্ত্রণা দেয়। জীবনের গতি হারিয়ে ফেললাম পুনরায়। ময়না তদন্তের রিপোর্ট দিবে সন্ধ্যায়। তবে আমি কী আমাকে স্থির রাখতে পারব? সোহান আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার ঠিক পাশে এসে বলল

– তোর সে রূপটায় এখন ফুটে উঠেছে। পরিস্থিতি হয়তো তোকে শক্ত করতে বাধ্য করেছে তবে তুই যে কোমল সেটা আবারও প্রকাশ পেল। নাহয় অরন্যের জন্য এতকিছুর পরও তোর চোখ ভার হয়ে আসতো না। অরন্যকে অনেক ভালোবাসিস তাই না?

উত্তরটা দিতে পারলাম না। চোখ দিয়ে দু ফুটো জল শুধু গড়িয়ে পড়ল। কারণ উত্তর দেওয়ার মতো কোনো উত্তর আমার অভিধানে পাচ্ছি না। চুপচাপ বসে রইলাম। মনে আওরাতে লাগলাম কে খুন করল অরন্যকে। অরন্যের মুখটা চোখে ভেসে আসতে লাগল। সামলাতে পারলম না জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। সোহান আমাকে ধরল। আমি যেন আরও জোরে কাঁদার সাহস পেলাম। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগলাম। জানি না কতক্ষণ কেঁদেছি। কাঁদতে কাঁদতে একটা পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সারাটাদিন ছন্নছাড়া হয়ে পার করলাম। বাবার খোঁজ পেলাম। বাবা আগের চেয়ে সুস্থ। আবির জেলে। সব মিলিয়ে একটু আশা একটু নিরাশা নিয়েই দিনটা পার হলো।

সন্ধ্যায় ময়না তদন্তের রিপোর্টটায় স্পষ্ট উল্লেখ করা হলো অরন্যকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। সে সাথে আরেকটা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিল। সেটা হলো অরন্যকে হত্যা করেছে নাফিসা। নাফিসার হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। কেন জানি না কথাটা শুনার পর অনেক খারাপ লাগল। চার বছর আগে এ নাফিসার জন্যই অরন্য আমাকে ছেড়েছিল। সে দেখেছিল টাকা। কিন্তু সে টাকা অরন্যকে সুখ দিতে পারল না। অরন্যের জীবনটা আরও তছনছ করে দিল। শেষমেষ যার জন্য আমাকে ছেড়েছিল তার হাতে খুন হলো।

নাফিসার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী অরন্যকে সে খুন করেনি। অরন্য তাকে অপমান করেছে, তাকে পুনরায় গ্রহণ করতে নাকচ করেছে এ বিষয়টা তার খারাপ লেগেছিল তাই খুনের হুমকি দিয়েছিল কিন্তু খুন করেনি। তবে সকল প্রমাণ সাক্ষ্য দেয় নাফিসায় অরন্যকে খুন করেছে। যদিও সব খুনী স্বীকার করে না সে খুন করেছে। জানি না অরন্যকে খুন করে তার কী লাভ হলো। কতটা জঘন্য হলে মানুষ এমন কাজ করে। অথচ বিয়ের পর নাফিসায় অরন্যকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। বুকের ভেতরটায় কম্পন দিতে লাগল। পরিণতি কখন কীভাবে রূপ নেয় তা বলা যায় না। টুকটুকি ঝোঁকের মতো পাশে বসে ছিল। সোহান ও এক মুহুর্তের জন্য আমাকে একা ছাড়ে নি।

নাফিসাকে জেলে নেওয়া হলো। অরন্যের বিষয়টাও আমার জীবনে অস্পষ্ট স্মৃতি করে এক কোণে জমা রাখলাম। আবিরকে চাকুরি থেকে পুরোপুরি বরখাস্ত করেনি৷ তবে ২ বছর সে চাকুরির কোনো বেতন পাবে না। আস্তে আস্তে আমার বিষয়টা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। কেউ আমাকে ভালো বলছে কেউ আমাকে দোষী করছে। তাতে আমার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বাবা এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন। তবে বাসায় যাবার অনুমতি এখনও পাইনি। কলেজে নিয়মিত ক্লাস করতে যাই। স্টুডেন্টরা আমাকে দেখে কেউ মুখ টিপে হাসে কেউ এসে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করে।

কেটে গেল এক মাস। টুকটুকিকে নিয়ে বেশ ভালোই ঘটরমটর করে চলছে জীবন। অরন্যকে খুব বেশি মনে পড়ে। আজকে একটু বেশিই মনে পড়ছে ওকে। কেন জানি না ওর হাসিটা না চাইতেও চোখের সামনে ভাসছে। পুরনো সেই স্মৃতি গুলো বারবার ব্যাগরা দিচ্ছে। প্রচন্ডরকম ভাবে অরন্যকে অনুভব করছি। কেন এমন হচ্ছে আমার। জানালার পাশে দাঁড়িয়েই সে মধুমাখা কালো অতীত গুলো মনে করে কখনও হাসছিলাম কখনও কাঁদছিলাম। এমন সময় কারও হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। সোহান পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি সোহানকে দেখে তার দিকে তাকালাম। সোহানও আমার দিকে তাকাল। হালকা গলায় বলল

– পুরনো আঁকড়ে আর কতদিন থাকবি। একটু তো নিজেকে শান্ত করতে পারিস। জীবনের সুখ গুলো খুঁজে নিতে পারিস।

– আমার জীবনে সুখ খোঁজা আর মরীচিকার পেছনে ছুটা এক কথা রে। আচ্ছা সোহান অরন্যের পরিণতি এমন না হলেও তো পারত। এমন কেন হলো।

– সব প্রশ্নের উত্তর তো আমার কাছে নেই। তুই এখনও অরন্যকে ভালোবাসিস বেশ ভালোই বুঝা যাচ্ছে। অরন্য তোর সাথে যা করেছে তার শাস্তি সে দুনিয়াতে পেয়েই ওপারে গেছে। তার জন্য দোয়া করিস যেন ওপারে ভালো থাকে।

সোহানের কথাটা শুনে হুহু করে কেঁদে দিলাম। সোহান হাত দুটো ধরে বলল

– কাঁদিস না। একটু সামলে নে নিজেকে।

সামলাতে পারছিলাম না। চোখগুলো ঘোলা হয়ে আসছিল। ভেতরটা অশান্তিতে পুড়ে যাচ্ছিল। বড্ড বেশি বেহায়া আমি এত কিছুর পরও অরন্যের এ পরিণতি মেনে নিতে পারছি না। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে লাগল। আমি সোহানের কোলেই ঢলে পড়লাম।

চোখ খুলে দেখলাম বিছানায় শুয়ে আছি। টুকটুকি আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছে। আন্টি পাশের চেয়ারটায় বসে আছে। সোহান ঘরে প্রবেশ করলো। আন্টি সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল

– অপ্সরার কী হয়েছে? ডাক্তার কী বলল?

– তেমন কিছু না। অনিয়ম করে চলে তো। প্রেসার লো। ওর জন্য একটু স্যুপ করে দিতে পারবে মা।

– এখনি আনছি।

বলেই আন্টি চলে গেল। সোহান টুকটুকিকে কোলে নিয়ে বলল

– মামনি দাদু মনিকে একটু সাহায্য করো গিয়ে মায়ের খাবার বানাতে।

টুকটুকি কোল থেকে নেমে দৌঁড়ে রুম থেকে বের হলো। সোহান আমার পাশে বসলো। আমি হালকা গলায় বললাম

– কিছু বলবি?

সোহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল

– তুই প্র্যাগনেন্ট। সিমটম দেখে ডাক্তার তাই বলে গেল। পুরোপুরি নিশ্চিত না তবে ডাক্তার বলল আল্ট্রা করতে। কাল গিয়ে একটা আল্ট্রা করে আসিস। আর বাচ্চাটা অরন্যের। অরন্যও বেঁচে নেই। কী করবি তুই।

– কাল আল্ট্রা করে আগে নিশ্চিত হই তারপর ভাবা যাবে। টুকটুকি কোথায়?

– পাশের রুমে খেলছে।

– আন্টি জানে কিছু?

– মাকে কিছু বলেনি। বললে স্বাভাবিক ভাবে নিবে না।

– হুম ভালো করেছিস।

– কিছু খেয়ে নে। আর মা স্যুপটা আনলে খেয়ে নিস।

– খাব পরে।

সোহান আর কোনো কথা বলল না, চলে গেল। আমি চুপ হয়ে শুয়ে আছি। অরন্য চলে গেলেও তার শেষ স্মৃতিটা আমায় দিয়ে গেছে। ভাবনার দেয়ালগুলোতেও আজকাল ফাটল ধরেছে। ভাবতে গেলেও যেন অতীত গুলো অস্পষ্ট হয়ে সামনে চলে আসে। অরন্যের জন্য একটু বেশিই খারাপ লাগছে। যদিও মানুষটার মৃত্যু আমি কামনা করে নি।

এর মধ্যেই আন্টি স্যুপ নিয়ে আসলো। আমার দিকে স্যুপটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল

– স্যুপটা খাও। আর নিজের একটু যত্ন নাও।

আমি তেমন কোনো কথা বললাম না। মাথাটা নেড়ে গেলাম। হালকা খেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরদিন হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করে নিশ্চিত হলাম আমি প্রেগন্যান্ট। প্র্যাগনেন্সি বিষয়টা বেশ জটিল একটা বিষয়। কেউ চায় মা হতে তবুও হতে পারে না। কেউ চায় না সময়ের আগে তার জীবনে এ অধ্যায় আসুক তবুও না চাইতেও চলে আসে। এ বাচ্চাটা নষ্ট করব না। এর কোনো দোষ নেই। একে মানুষ করার মতো ক্ষমতা আমার আছে। তবে সমাজ কী এ বাচ্চাটাকে মর্যাদা আদৌ দিবে? সে কথায় শুধু ভাবছিলাম।

এসব ভেবে ভেবেই বাসায় ফিরলাম। টুকটুকি এসে জড়িয়ে ধরল। ওকে কিছুক্ষণ আদর করে জড়িয়ে ধরে রুমে গেলাম। রুমে যেতেই সোহান এসে জিজ্ঞেস করল

– রিপোর্ট কী?

নম্র গলায় উত্তর দিলাম

– পজিটিভ।

– কী করবি?

– বাচ্চাটাকে পৃথিবীর মুখ দেখাব। তবে বাচ্চাটার জীবন হয়তো বাবা ছাড়া ছন্নছাড়া হবে। অনেক শক্ত করে ওকে মানুষ করতে হবে নাহয় এ সমাজ ওকে তিলে তিলে মেরে ফেলবে।

– আচ্ছা অপ্সরা তুই টুকটুকির মা হয়ে যা আর আমি তোর বাচ্চার বাবা। ভালো হবে না বিষয়টা? এ বাচ্চা নাহয় আমার পরিচয়ে মানুষ হবে আর টুকাটুকির মায়ের পরিচয়ে তুই। তোকে আমি পছন্দ করি কখনও বলা হয়নি। কারণ তুই যে অবস্থায় ছিলি কখনও তা বিশ্বাস করতি না। একটু এদিকে আয়।

বলেই সোহান আমার হাত ধরে টানতে টানতে তার ঘরে নিয়ে গেল। এ বাসায় আসার পরও একটাবারও আমি সেহানের ঘরে যাই নি। আজকে এ প্রথম আসলাম। টেবিলের উপর একটা ছোট্ট পুতুল বেশ সযত্নে সাজানো যেটা সোহানকে আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় দিয়েছিলাম। সোহান তার আলমিরা টা খুলে আমার দেওয়া সব স্মৃতি গুলো দেখাতে লাগল। আর হালকা গলায় বলল

– তুই যখন যা দিয়েছিস যত্ন করে রেখেছি। তোকে ভালোবাসি কখনও মুখ ফুটে বলতে পারিনি আমি। অরন্যের ব্যাপারটা জানার পর আরও বলেনি। কারণ তোকে সবসময় পাশে চেয়েছিলাম। একটা সময় পর তুই না বলেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিস। এর তার কাছে মাঝে মাঝে খোঁজ নিলেও পরে আর খোঁজ ও পাইনি। অপ্সরা বড্ড ভালোবাসি। আর এটা আবেগ না। আবেগের বয়স পার করে এসেছি বহুদিন হলো। আমি তোর ভালোবাসা চাই না। চাই তুই আমার পাশে থাক আমার ভালোবাসা গ্রহণ কর।

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। সোহানের ভালোবাসায় কোনো লোভ নেই। তবুও অন্যের বাচ্চা নিজের করে সে কী নিতে পারবে? এ ভাবনাটা আসতেই বলে ফেললাম

– অরন্যের বাচ্চা আমার পেটে তাকে কী তুই মানতে পারবি?

– নিজের বাচ্চার মতো দেখব। ঐ বাচ্চার কোনো দোষ নেই। কেউ জানবে না এটা অরন্যের বাচ্চা, সবাই জানবে এটা আমার বাচ্চা। তুই চাইলে আজ কালকের মধ্যে বিয়ে করব। বলব বিয়ের পর পরই বাচ্চা নিয়ে ফেলেছি। হাতে বেশি সময় নেই অপ্সরা কী করবি বল। না করিস না প্লিজ।

সোহানের দিকে তাকালাম। তার ভালোবাসায় আবদ্ধ চোখ গুলো আমার চোখে নিবিদ্ধ হলো। তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। তাই বেশ হালকা গলায় বললাম

– এখন থেকে তুমি করে ডেকো। স্ত্রী হলে তুই করে ডাকলে মানুষ কী বলবে।

আমার কথাটা শুনে সোহান আমাকে জড়িয়ে ধরে ফেলল। পরক্ষণেই ছেড়ে দিয়ে বলল মাকে জানিয়ে আসি। চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম

– মা কী রাজি হবে?

– অনেক আগেই রাজি করিয়েছি। তার ছন্নছাড়া ছেলে বিয়ে করবে এটাই তো বেশি। বাবা থাকলে হয়তো খুশি হতেন। তবে বাবা তো ভাইয়ের ব্যাপারটা সহ্য না করে ওপারে চলে গেছেন। মাকে বলতে হবে তোর বাবা মাকে জানাতে।

– আমার বাবা মা কে জানাতে হবে না। তারা তো বলেই দিয়েছে তাদের মেয়ে আমি না।

– তুই বোকা বোকায় রয়ে গেলি। মা, বাবা হয়তো একটু অভিমান করেছে সেটা ঠিক ও হয়ে যাবে। ওরা চাচ্ছিল তোর একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ হোক। তাই এমনটা করেছে। আর আমি কী পাত্র হিসেবে খারাপ নাকি যে পছন্দ হবে না।

কথাটা বলে সোহান নিজের কলারের এক কোণা একহাতে নিজে ধরে আমার দিকে তাকাল। আমি পরক্ষণেই হালকা হেসে দিলাম। অনেক কষ্টের মধ্যে একটু খানি প্রশান্তি। হালকা হেসে বললাম

– আমার সামনে থেকে যা তো।

সোহান আমার কানের কাছে এসে বলল

– বড্ড ভালোবাসি তোকে। সরি তুমি হবে। বড্ড ভালোবাসি তোমাকে। ধুর বাল তুই এই সুন্দর। বড্ড ভালোবাসি তোরে। গেলাম আমি মাকে বলতে।

বলেই চলে গেল সোহান। আর আমি সোহানের রুমে বসে রইলাম।।এদিক ওদিক চোখ বুলাতে লাগলাম। সারা ঘরেই আমার দেওয়া টুকুটাকি জিনিস পত্র। ক্যালেন্ডারে চোখ গেল। ক্যালেন্ডারটা বেশ পুরনো। এত পুরনো ক্যালেন্ডারও টানিয়ে রেখেছে। বিষয়টা দেখে মনে হলো সোহান একটু বেশিই পাগল। তাই বসা থেকে উঠে ক্যালেন্ডারের কাছে গিয়ে সেটা হাতে নিলাম। সাথে সাথে বেশ চমকে গেলাম। সোহান কী আমার সাথে নাটক করল?

(চলবে)

প্রাক্তন পর্ব-২৩

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২৩

আমি বুঝতে পারছিলাম না সোহান কী বলবে। তাই শান্ত গলায় বললাম

– কী বলবি বল।

সোহান মাথাটা নীচু করে বলল

– আংকেল তুই আসার পরেই স্ট্রোক করেছেন। কোন হাসপাতালে আছে জিজ্ঞেস করলাম বলল না। বারবার জানার চেষ্টা করলাম বলল না। তোর ভাই কল দিছিল। ওরা তোর বাবার এ অবস্থার জন্য তোকে দায়ী করছে। কারণ তোর বিষয়টা পত্রিকায় তোর ছবি দিয়ে ছাপা হয়েছে। অনেকে তা দেখে তোর বাবাকে কটুক্তি করে কথা বলেছে। তাই সেটা নিতে না পেরে এ অবস্থা।

সোহানের কথা শুনে মনটা ভেঙ্গে গেল। ভাবতে লাগলাম আমি দোষী না তবুও আমার ছবি ছাপিয়ে সবাইকে জানাতে হলো। আর যারা অপরাধ করল তাদের কেউ চিনল না। এ সমাজ শুধু ভূক্তভেগীদের ভোগান্তিতে ফেলতে ব্যস্ত। সবাই আমাকে দোষ দিচ্ছে তাতে তাদের কোনো হুঁশ নেই। সবাই যেন আমাকে দোষী করতেই ব্যতিব্যস্ত। মানুষ কিছু বুঝুক আর না বুঝুক কথা শুনাতে মহা ব্যস্ত। কাউকে কয়টা কথা শুনিয়ে যেন তারা শান্তি পায়। আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। চোখ দিয়ে গড় গড়িয়ে পানি পড়ছে। টুকটুকি আমার চোখের জল মুছে দিতে ব্যস্ত। আমার ফোনটা নিয়ে মামাকে কল দিয়ে বাবা কোন হাসপাতালে জিজ্ঞেস করলাম। মামাও আমাকে দুইটা কথা শুনিয়ে রেখে দিল। ঠিকানা দিল না বাবা কোথায় আছে। কষ্টে যেন আরও বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। যাদেরকে কল দিচ্ছিলাম সবাই কথা শুনাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে বড় অন্যায় করে ফেলেছি। অনেক খুঁজ নেওয়ার পরও জানতে পারলাম না বাবা কোন হাসপাতালে। মা,ভাই তো কল ও ধরছে না। বুকের ভেতরটা মোচড় দিচ্ছে। আজকে বাবার কিছু হলে সেটার দায়ভার আমার উপর পড়বে। সবাই বলবে আমি বাবার খুনী। আমার জন্য বাবা মারা গেছে। কেউ বলবে না কিছু মানুষের বিষের মতো জবানের জন্য বাবার মৃত্যু হয়েছে। চোখে যেন আপন গতিতে পানির ধারা বইয়ে চলেছে আর টুকটুকিও চোখের জল মুছতে মহা ব্যস্ত। সোহান পাশে দাঁড়িয়ে আছে তবে কী সান্ত্বনা দিবে সে ভাষা সোহানের নেই। আমার বুকটা ধরফর করছে বাবাকে এক মুহূর্ত দেখার জন্য তবে বাবার খুঁজ মিলল না।

এর মধ্যেই সোহানের মা আসলো। আমাকে সোফায় বসে কাঁদতে দেখে মোটেও চমকাল না। উনার কাছে বিষয়টা অতিস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। যদিও জানি না কেন। তবে মনে হচ্ছে সোহান আমার ব্যপারে আন্টিকে সব বলেছে। আন্টি আসার সাথে সাথে টুকটুকি কোল থেকে নেমে গিয়ে আন্টিকে ধরে বলল

– দাদুমনি মা কাঁদছে কেন? মা কে বলো, না কাঁদতে। মায়ের কান্না দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে তো। ও দাদুমনি। মাকে বলো না, কান্না না করতে।

আন্টি এবার টুকটুকির কথা শুনে একটু বিচলিত হলো। ইতোমধ্যে আমি যে টুকটুকির মা হয়ে গেছি সেটা উনি হয়তো বুঝতে পারে নি। সোহান নির্বাক। এ পরিস্থিতিতে সে কী বলবে সেটা সোহানের হয়তো জানা নেই। চুপ হয়ে আছে সে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কথোপকথন শুনছিল। আন্টি সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল

– কী রে অপ্সরা কাঁদছে কেন? আবার কী কিছু হয়েছে?

সোহান হালকা গলায় বলল

– ওর বাবা অসুস্থ। আর বাকি ব্যাপার তো তুমি জানো।

আন্টি আমার পাশে এসে বসলো। টুকটুকি এবার আমার কোলে বসলো। আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

– মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছ তো সহ্য একটু করতেই হবে। মেয়েরা বিয়ে করলেও দোষ,বিয়ে না করলেও দোষ। শান্তি কোথাও নাইরে মা। শান্তি খুঁজে নিতে হয়। রুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আগে কিছু খেয়ে নাও। মারে সামনের পথটা চলতে হবে। ভেঙ্গে গেলে হবে না। ছোট বেলায় তোমাকে দেখেছিলাম। কত সুন্দর ছিলে। আর আজ নিজের যত্ন না নিতে নিতে কেমন হয়ে গেছ দেখেছো কী। যাও ঘরে গিয়ে নিজের যত্ন নাও। নিজেকে আগে সুন্দর করো স্বাভাবিক করো বাকিসব দেখবে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তুমি স্বাবলম্বী মেয়ে তোমার চিন্তা কী এত।

আন্টির কথায় একটু সাহস মিলল। বসা থেকে উঠতেই যেন মাথাটা ঘুরপাক খেল। সোহান হালকা হাতে আমাকে ধরে ফেলল। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে সোহানকে ধরে বললাম কোন রুমে যাব বল। সোহান আমাকে ধরে নিয়েই পাশের রুমে গেল। আমাকে শুইয়ে দিয়ে বলল

– আগে বিশ্রাম কর।

আমি শুইয়ে রইলাম। কোনো উত্তর দিলাম না। সোহান রুম থেকে বের হয়ে গেল। ফোনটা বেজে উঠল। আবিরের মা কল দিয়েছে। আমি কলটা ধরতেই বললাম

– মা.. মা বলেও কথা ঘুরিয়ে বললাম আন্টি কী বলবেন বলুন।

আবিরের মা বেশ নরম গলায় বলল

– মা ডেকেও কেন পরে আন্টি ডাকলে? পূত্র বধূ করতে পারব না তবে মেয়ের জায়গাটা তো আগেই দিয়ে দিছি। মা রে আমি এসবের কিছুই জানতাম না। জানলে এত নোংরামো আমার ছেলেকে দিয়ে করতে দিতাম না। আমি জানি তোমার সাথে যা হয়েছে অনেক বড় অন্যায় হয়েছে। এর দায় এড়ানো যাবে না। তবে আবিরের চাকুরিতে কোনো সমস্যা করো না। আমার একটা মাত্র ছেলে। ওকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে পারমানেন্ট কোনো স্টেপ যেন না নেয় মা। আমার রোজগারের আর কেউ নেই পরিবারে। আবিরের ইনকাম ছাড়া সংসার অচল হয়ে পড়বে। এরকমটা করো না মা। যা হয়েছে তার জন্য আমি মা হয়ে আবিরের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। তুমি ক্ষমা করে দাও।

আমি চুপ হয়ে শুনে আবিরের মা কে বললাম

– আচ্ছা আমি বিষয়টা ভাববো। ভালো থাকবেন।

আর কিছু বলতে পারলাম না কলটা কেটে দিলাম। মনে হচ্ছে আমি কী সত্যিই বাড়াবাড়ি করছি নাকি ঠিক আছে। পরক্ষণেই মনে হলো তারাও আমার সাথে কম বাড়াবাড়ি করে নি। তাহলে আমি কেন ছেড়ে দিব। ফোনটা আবার বেজে উঠল। কলেজের প্রিন্সিপাল কল করেছে। কলটা ধরে সালাম দিলাম উনি সালামের উত্তর নিয়ে বললেন

– অপ্সরা যেভাবে তোমার বিষয়টা ফোকাস হয়েছে সেটা সত্যিই আমরা আশা করিনি। কলেজের প্রতিটি স্টুডেন্টের উপর এর প্রভাব পড়বে। আপাতত কী বাড়াবাড়ি না করলে হয় না। কলেজের একটা রেপোটেশন আছে সেটা যেন নষ্ট না হয়।

উনার কথাটা শুনে হালকা রাগ জমল। বেশ জোরেসোরেই বললাম

– অন্যরা না হয় অশিক্ষিত বোকা,আপনি তো শিক্ষিত। আমি কেন তাদের ছেড়ে দিব। কলেজের স্টুডেন্টরা আমার থেকে কী শিক্ষা নিবে তাহলে? তারা এ শিক্ষা নিবে কীভাবে অন্যায় করার পরও অন্যায় কারীকে ছেড়ে দিতে হয়? এটা কী আদৌ উচিত হবে তাদের ছেড়ে দেওয়া।

– তুমি বিষয়টা নেতিবাচক করে নিচ্ছ। বিষয়টা তা না। কলেজের বাচ্চাদের উপর এটার প্রভাব পড়বে। সে সাথে অভিভাবকদের উপর। কলেজের সুনামও নষ্ট হবে।

– কলেজের সুনাম কখনও একটা টিচারের ব্যাক্তিগত বিষয়ের উপর নির্ভর করে না। এটা পুরোপুরি আমার ব্যক্তিগত বিষয়। এটার সাথে কলেজের কোনো কিছু জড়িয়ে নেই। সুতরাং এ ব্যাপারে স্থগিত করব কী না সেটা শুধু আমার ব্যাপার। আমাকেই ভাবতে দিন। কলেজের কোনো ব্যাপার হলে আমি আপনার কথা মেনে নিতাম। তবে আমার ব্যাক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার অনুরোধ রইল।

– আচ্ছা করলাম না। তেমাকে জানানো বা সাবধান করার দরকার ছিল সেটা করলাম। বাকিটা একান্তই তোমার ব্যাপার।

বলেই কলটা কেটে দিল। আমি শুধু ভাবতে লাগলাম। সবাই যেভাবে আমার পেছনে উঠে পড়ে লেগেছে মনে হচ্ছে অন্যায় আমি করেছি। এ সমাজ তো বদলে দিবে না কাউকে আর এ সমাজ ও বদলানো যাবে না তাই নিজেকে বদলে নিজের স্থান তৈরী করে নিতে হবে।

সাহস জুগাতে লাগলাম মনে। আবির তার শাস্তি পাচ্ছে। নাহয় তার মা কল দিত না। অরন্যের হদিশ নেই। নাফিসাও আর কল দেয়নি৷ নোংরা সম্পর্কের থেকেও মুক্তি পেয়েছি৷ বাবা কোথায় আছে জানি না। বাবার জন্য খরাপ লাগছে। মন থেকে বাবার জন্য দোয়া করে যাচ্ছি। জানি এ খারাপ সময় বেশিদিন থাকবে না তবে খারাপ সময় গুলো বড্ড বাজে তাড়াতাড়ি যেন পার হয় না। টুকাটুকি এসে আমার পাশে বসল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল

– মা চোখ বন্ধ করো আমি মাথা টিপে দিচ্ছি। একটু ঘুম দাও তুমি।

বলেই কপালে হালকা চুমু দিল। টুকটুকির শীতল স্পর্শ আমাকে আলিঙ্গন করল। তাকে ধরে জড়িয়ে নিলাম বুকে। বেশ মিশে পড়েছে। জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না।

ঘুম থেকে উঠার পর সোহান যা বলল তা শুনে নিজের মধ্যে ঝড় বইতে লাগল।

(চলবে)

প্রাক্তন পর্ব-২২

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২২

সোহান আমার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। মনে হচ্ছে তার মনে কোনো ঝড় এসে ঝাঁপটা দিচ্ছে। চুপ রইল বেশ কিছুক্ষণ। আমি তার নীরবতা দেখে বললাম

– কথা কেন বলছিস না? এত চুপ কেন আছিস? কোনো সমস্যা?

– নাহ! এমনি। তোকে আজকে আমার বাসায় নিয়ে যাব। তারপর বলব কী হয়েছে। এখন কিছুই বলব না। আগে তুই খাবার খা। তারপর বিশ্রাম কর। সন্ধ্যায় আমার বাসায় নিয়ে যাব তারপর রাতে তোর বাসায় তোকে দিয়ে আসব।

– না রে সোহান। সরাসরি বাসায় যাব তারপর পরদিন কোনো এক সময় তোর বাসায় যাব। আপাতত কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছি কিছুদিন। সব ঠিক ঠাক হোক আগে।

– তোর ইচ্ছা। আর যেদিন বাসায় যাবি সেদিন নাহয় তোর উত্তরটা দিব। আর এখন একটু বিশ্রাম নে। বিকেলে তোকে বাসায় পৌঁছে দিব।

আমি খাওয়া শেষ করে চোখটা বন্ধ করলাম। কেন জানি না শুধু অরন্যকে চোখে ভাসছিল। এমন কেন হচ্ছে বারবার। মনে হচ্ছে সে কিছু বলতে চায় বলতে পারছে না। যদিও আমি তাকে ঘৃনা করি প্রবল। তবে এ মূহুর্তে অরন্যকে বারবার মনে পড়ছে। এতকিছুর পর তার প্রতি বিন্দু পরিমাণ ভলোবাসা অবশিষ্ট নেই। যেটা আছে সেটা রাগ,ক্ষোপ আর প্রখর ঘৃনার স্তূপ। চোখটা ভয়ে বন্ধ করেও খুলে ফেললাম। সোহান আমাকে বারবার চোখ খুলতে বন্ধ করতে দেখে বলল

– অপ্সরা এনিথিং রং?

– নাথিং সোহান। তবে অস্বস্তি হচ্ছে। মাথাটা ভার হয়ে আছে নাহয় বাসায় চলে যেতাম এখনি। এত খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ব পুনরায় বুঝতে পারে নি।

– একটু বিশ্রাম নে। শরীরটা ভালো লাগলেই বাসায় দিয়ে আসব। এত চিন্তা করিস না। পরিস্থিতি সবসময় অনুকূলে থাকবে না। একটু তো প্রতিকূলতা আসবেই।

আমি হালকা হালকা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। চুপ হয়ে শুয়ে রইলাম। অবচেতন মন শুধু বারবার অতীতে ঘুরপাক খাচ্ছে। সময় মানুষকে কতটা বদলে দেয় সেটা নিজেকে দেখেই বুঝতে পারতেছি। একটা সময় অরন্যকে পাগলের মতো চাইতাম। তাকে পাওয়ার জন্য জীবনে কত কিছুই না করেছিলাম৷ আর আজকে অরন্যের থেকে নিজেকে ছাড়াতে এত কিছু করছি। আচ্ছা আমি কী অরন্যকে ফিরিয়ে দিতে পারতাম যদি সে বিনয় নিয়ে আমার সামনে আসত। হয়তো পারতাম না। কিন্তু মিথ্যা নাটকের বেড়াজালে আটকে দিয়ে আমাকে যেভাবে আঘাত করা হয়েছে তারপর তাকে মেনে নিতে পারছি না। সম্পর্ক ভাঙ্গে সে সম্পর্ক আবার গড়ে। অরন্য তিনটা বছর আমাকে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছে সেটা আমি জানি। তবে তারপর সে আমাকে যেভাবে চেয়েছে তাতে আমার মন বিগড়ে গেছে।

মাথাটা টনটন করে ব্যথা করছে। শরীরের ক্লান্তি ক্রমশ বাড়ছে ক্রমশ কমছে। কেমন যেন ছটফট করছে সারা শরীর। আমি হালকা তাকালাম। সোহান নিজের হাতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। ক্লান্ত চেহারা সে সাথে মলিনতার ছাপ। এ হাসপাতালে থাকতেও ভালো লাগছে না। তাই সোহানকে বললাম

– আমাকে বাসায় নিয়ে দিয়ে আয়। ভালো লাগছে না এখানে থাকতে। ডাক্তারের সাথে একটু কথা বল। বাসায় গিয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

সোহান আমার কথা শুনে উঠে গিয়ে বাইরে গেল ডাক্তারের সাথে কথা বলতে। আমি শুয়ে শুয়ে অতীতেই বারবার ডুব দিচ্ছিলাম। জীবনের অধ্যায় গুলো বরাবরেই ছন্নছাড়া। কখনও কষ্ট কখনও মলিনতা আবার কখনও সুখে পরিতৃপ্ত।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সোহান চলে আসলো। আমার হাতটা ধরে বলল

– আমাকে ভর দিয়ে উঠ। উঠতে পারবি তো নাকি একটু বিশ্রাম করবি,নাকি হুইল চেয়ার আনব?

আমি সোহানের হাতটা শক্ত করে ধরে উঠে বললাম

– উঠতে পারব। সমস্যা নেই।

সোহান কে ধরে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গাড়ি দিয়ে বাসায় এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা নক করলাম। আমার কন্ঠ শুনতেই বাবা বললেন

– এতক্ষণ যেখানে ছিলে সেখানে যাও। এ বাসায় তোমার কোনো জায়গা নেই। আমাদের মেয়ে মরে গেছে। যে মেয়ে আমাদের কথা শুনবে না তাকে আমাদের মেয়ে হিসেবে পরিচয় দিতে ঘৃনা হয়। এ ঘরে তোমার কোনো জায়গা নেই।

বাবার কথা শুনে সোহান বাবাকে বুঝাতে লাগল। তবে বাবার একটা কথায় আমি যেন বাসায় ঢুকতে না পারি। আমি তাদের মেয়ে না। সোহান বেশ কতক্ষণ বুঝিয়ে আমাকে বলল

– এভাবে তো তোকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। তুই আপাতত আমার বাসায় চল তারপর আংকেল আন্টিকে বুঝিয়ে যা ব্যবস্থা করার করব।

আমি আর কী করব। সোহানের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কোনো দোষ না করেও আজকে নিজের বাসায় উঠতে পারলাম না। নিজের পরিবারের কাছে মৃত হয়ে গেলাম। হায়রে জীবন। এত ভয়ানক না হলেও পারত। এত ভয়ানক কেন জীবনটা?

সোহানকে নিয়ে তাদের বাসায় গেলাম। বাসায় ঢুকতেই একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে সোহানকে দৌড়ে এসে বাবা, বাবা বলতে লাগল। আমি বেশ বিস্মিত হলাম। সোহান তো বিয়ে করে নি বলেছিল তাহলে এ বাচ্চা কার? বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম

– বাচ্চা টা কী তোর? আর তুই তো বলেছিলি তুই বিয়ে করিস নি। তাহলে বাচ্চা এলো কোথায় থেকে?

সোহান বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দুগালে চুমু দিয়ে বলল

– এর জন্যই আমি এতদিন বিয়ে করে নি। বাচ্চাটা আমার না আমার বড় ভাইয়ের। ওর মা ওর যখন এক বছর ছিল তখন ছেড়ে চলে যায় অন্য একজনের হাত ধরে। এরপর থেকে ভাইয়া পাগল হয়ে গেছে। পাঁচ বছর সম্পর্কের পর বিয়ে। ভালোবাসার পূর্ণতা পেয়ে যখন হারিয়ে ফেলে সেটা আর মেনে নিতে পারে নি। ভাইয়া পাগলা গারদে আছে। ভাইয়ার ঘটনার পর থেকে কেন জানি না কোনো মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারিনি৷ বারবার মনে হয়েছে মেয়েরায় পারে একটা সাজানো স্বপ্ন ভেঙ্গে দিতে। এর পর থেকে টুকটুকি কে নিজের সন্তানের মতো দেখে এসেছি। নিজের চেয়েও বেশি ওকে ভালোবাসি৷ তোর যেমন ছেলেদের নিয়ে বাজে অভিজ্ঞতা ঠিক তেমনি আমার মেয়েদের নিয়ে। তোর কাছে একটা ছেলে মানেই অনেক খারাপ আর আমার কাছে একটা মেয়ে মানেই অনেক স্বার্থপর। দুজনের ঘটনা ভিন্ন তবে মূলপাঠ এক।

এর মধ্যেই টুকটুকি বলে উঠল

– বাবা উনি কে? উনি কি আমার মা? প্রতিদিন তোমাকে মা এনে দিতে বলি আজকে তো সত্যি সত্যিই নিয়ে এসেছো। আমি মায়ের কোলে যাব।

টুকটুকির কথা শুনে সোহান জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল

– আরে মামনি কী বলছো। উনি তোমার…

বাকি কথা সোহানকে বলতে না দিয়ে আমি সোহানের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম

– আমিই তোমার মা আসো আমার কোলে।

সোহান আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি সোফায় বসে সোহানকে বললাম টুকটুকিকে কোলে দিতে। শরীরটা এত ভালো না তবুও টুকটুকিকে কোলে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি টুকটুকিকে কোলে নিয়ে বললাম

– টুকটুকির বয়স কত?

– পাঁচ বছর।

আমি টকটুকিকে জড়িয়ে ধরে রইলাম। মনে হচ্ছিল নিজের সন্তান এটা। আমার সন্তানটা পৃথিবীতে আসলে হয়তো টুকটুকির মতোই কথা বলত। টুকটুকিকে কোলে নিয়ে একটা স্বস্তি পাচ্ছিলাম। এর মধ্যেই সোহানের ফোনে কল আসলো। সোহান কলটা ধরতেই কেমন জানি আনমনা হয়ে গেল। আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল।

– তুই একটু স্থির হয়ে বস। একটা কথা আছে। নিজেকে আগে সামলে নে।

আমি বুঝতে পারছিলাম না সোহান কী বলবে। তাই শান্ত গলায় বললাম

– কী বলবি বল।

(চলবে)

প্রাক্তন পর্ব-২১

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২১

তারপর থানায় গেলাম। থানায় যাওয়ার পর শুরু হলো নতুন নাটক। আমি চেয়ারে বসে মামলাটার কথা জিজ্ঞেস করতেই সামনের চেয়ারে বসা পুলিশ মহাশয় আমার দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গ করে বলল

– স্বামীর সাথে শারিরীক সম্পর্ক হলে ধর্ষণ হয় কোন যুক্তিতে?

আমি কিছুটা রাগান্বিত হয়ে উত্তর দিলাম

– মানে?

পুলিশ মাহাশয় একটা চোখের ভ্রূ উঁচু করে তাকিয়ে বললেন

– অরন্য সাহেব তো আপনার স্বামী হয়। চার বছর আগে বিয়ে করেছিলেন। আবির সাহেব আপনাদের বিয়ের কাগজ আমার কাছে দিয়েছে। এখন কথা হচ্ছে অরন্য আপনার স্বামী হলে সে তো আপনার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতেই পারে তাতে তো কোনো দোষ দেখছি না। স্বামী, স্ত্রীর সহিত মিলিত হলে সেটা তো ধর্ষণ হবে না। ধষর্ণের মামলা কেন করলেন। এক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের মামলা গ্রহণ যোগ্যতা পাবে তবে ধর্ষণের না। আজকাল মনে হয় মেয়েরা বেশি মর্ডান সাজতে গিয়ে স্বামীর সাথে মিলন বিষয়টাকে ধর্ষণ বলে উঠে।

আমি বেশ জোরেই বলে উঠলাম

– না জেনে এত কথা কেন বলছেন? আমার বিরুদ্ধে গিয়ে আমার সাথে মিলিত হলে সেটা ধর্ষণের সামিলেই। স্বামী স্ত্রী এর সম্পর্ক হয় মধুর। আর আমাদের সম্পর্ক ছিল বিষাক্ত। আর যাকে এত সাপোর্ট দিয়ে কথা বলেছেন সে কী করেছে জানেন? বিয়ে করে বিয়ের প্রমাণ লোপাট করে অন্যত্র বিয়ে করেছিল। সেখানে যখন শান্তি মিলছিল না তখন আমার কাছে এসেছিল ফিরে। আমাকে যখন পাচ্ছিল না তখন জোর করে ধরে নিয়ে আমার সাথে অন্যায় ভাবে এ সম্পর্ক গড়ে তুলে তাহলে সেটাকে আমি ধর্ষণ কেন বলব না? যাকে আমি স্বামী মানিই না সে তো আমার সাথে মিলিত হলে বিষয়টা নিশ্চয় আমার জন্য সুখকর হবে না। তাই ধর্ষণের মামলা করেছি। আর বাকি রইল বিয়ের ব্যপার। আজ থেকে এ সম্পর্ক থেকে আমি মুক্ত। ডিভোর্স দিয়ে এসেছি। এখন থেকে অরন্য আমার স্বামী না। সুতরাং আমার জায়গায় আমি ঠিক আছি।

– আপনি মনে হয় নিজেকে খুব বেশি স্মার্ট মনে করেন। শুনেন ডিভোর্স আজকে দিলেও যেদিন আপনার সাথে এমন হয়েছিল সেদিন অরন্য আপনার স্বামাী ছিল। আপনাদের মতো কিছু মহিলাদের জন্য ছেলেরা বিগরে যায় তখন ছলেরা অন্য জায়গায় সুখ খুঁজে। আপনাকে দেখে মনে হয় আপনার চরিত্রে যথেষ্ট গড়বড় আছে। পাশে এ ছেলেটা কে শুনি? তার জন্যই কী স্বামীর নামে এমন মামলা করেছেন।

কথাটা শুনে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলাম না। কেন জানি না বেশ জোরসোরেই চেঁচিয়ে উঠে বললাম

– আপনার সাহস কী করে হয় এমন কথা বলার। প্রতিটা কথা আমি রেকর্ড করে রেখেছি। একটা মেয়ের মামলা নেওয়ার নামে কীভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে সেটা আমি তুলে ধরব। আপানাকে মামলা নিতে হবে না। মামলা অন্য জায়গায় গিয়ে করব। দরকার হলে নিজের জীবন দিয়ে লড়ব তবুও হারব না। আর শুনেন নিজের ঘরে মেয়ে থাকলে তার কথা চিন্তা কইরেন একটু। ভেবে দেইখেন তার সাথে এমন হলে আপনি কী করতেন। আমার যতদূর মনে হচ্ছে আপনাকে মোটা অংকের টাকা খাওয়ানো হয়েছে। তবে চিন্তা নেই আপনি আপনার গতিতে চলুন আমি আমার গতিতে চলব। এর শেষ আমি দেখেই ছাড়ব।

বলেই টেবিল থেকে সকল কাগজ গুলো টেনে নিয়ে সোহানকে নিয়ে বের হলাম। সোহান শুধু আমার দিকে বিস্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিল৷ থানা থেকে বের হতেই সোহান বলে উঠল

– আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তুই এত স্ট্রং হয়ে গেছিস। যে মেয়ে কথা বলতে পারত না সহজে।।অল্পতে ভয় পেয়ে যেত। সে কী না পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে এত কথা বলে আসলো। আর তুই কথাগুলো রেকর্ড করে রেখেছিস। বাহ এত ভলো বুদ্ধি তোর মাথায় আসলো কী করে? মানুষ তো বিপদে পড়লে বিবেক দিয়ে কাজ করার শক্তি হারিয়ে ফেলে আর তুই তো পুরো কাজটা সুন্দর করে গুছিয়ে করছিস।

আমি হালকা দম ছেড়ে বললাম

– পরিস্থিতি মানুষকে অনেক শেখায়। প্রতিটা পদে পদে বাঁধা পেয়েছি। আর শিখেছি। এখন কী করব বুঝতে পারছি না। ঐ পুলিশ অফিসারটা মনে হয় ঘুষ খেয়ে টাল হয়ে আছে তাই এসব আবোল তাবোল বলে ধামা চাপা দিতে চাচ্ছে সব।

সোহান নিজের চিবুকে হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল

– আমার একটা বন্ধু পুলিশ ক্যাডার। ঢাকাতেই পোস্টিং হয়েছে। চল একবার তার কাছে যাওয়া যাক। পরামর্শ তো নিতে পারব। আর এ পুলিশের বিরুদ্ধে ও স্টেপ নিতে পারব।

শত রুক্ষতার মধ্যেও যেন একটু শীতলতা পেলাম। আমি সাবলীল সজীব নিঃশ্বাস টেনে পরক্ষণে তা ছেড়ে দিয়ে বললাম

– চল যাওয়া যাক।

গাড়িতে উঠলাম। সোহান গাড়ি চালাতে লাগল। আর আমি ভাবতে লাগলাম আজকে সোহানের মতো কেউ পাশে আছে বলে সংগ্রামটা সহজ মনে হচ্ছে। আজকে আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি বলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি। অথচ সেসব মেয়েদের অবস্থা চিন্তা করছি যারা কোনো চাকুরি করে না। যাদের কোনো বড় পুলিশ অফিসারদের সাথে পরিচয় নেই। যাদের দুনিয়ায় টাকাও নেই বড় কোনো হাত ও নেই। তাদের সংগ্রামটা কত কঠিন। ভাবতেই গা টা শিউরে উঠল। মনে মনে কয়েকবার আলহামদুলিল্লাহ বললাম। অন্তত আমার দশা তাদের থেকেও তো ভালো। সেসব মেয়েরা না পারে লড়াই করতে না পারে নিজের কথা কাউকে বলতে। এভাবে না বলতে বলতেই মেয়েগুলো একটা সময় পাথর হয়ে যায় আর না হয় দম বন্ধ করে বিলীন হয়ে যায়। কাফনের কাপড়কে আপন করে নেয়। মাটির সজীবতায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়। সত্যিই তাদের জীবন বড্ড কঠিন। তাদের কথা ভেবে যেন একটু প্রশান্ত পাচ্ছিলাম। ছোট বেলায় একটা বান্ধবী ছিল নাম মিলি। তখন আমি নবম শ্রেণীতে পড়তাম। সে সবসময় বলত দুনিয়া দেখলে সবসময় নীচের দিকে দেখতে হয়। মানে কে কত কষ্টে আছে সেটা আবিষ্কার করতে হয় তাহলে নিজেকে সুখী মনে হবে। কিন্তু অন্যের সুখ আবিষ্কার করলে কষ্ট ছাড়া কিছুই মিলবে না। আজকে তার বাস্তব উদাহরণ গুলো পাচ্ছি। মিলিকে প্রচন্ড রকম মিস করছি। মনে হচ্ছে ওর দেখা যদি পেতাম। কিন্তু সেটা আর সম্ভব না। কারা যেন মিলিকে হত্যা করেছে। কলেজে উঠার সাথে সাথে আমার কাছের বান্ধবীটাকে আমি হারিয়ে ফেলি। মিলিকে কারা হত্যা করেছে জানি না। তবে খুব ইচ্ছা হয় মিলির হত্যাকারীকে খুঁজে বের করে জিজ্ঞেস করতে কেন এমন করেছে সে উপায় আর নেই। মিলির আবছা মুখটা চোখে ভাসছে। হালকা হাসির রেখা যেন তার মুখে সবসময় ফুটে উঠত। না জানি মেয়েটা পরকালে কেমন আছে। দোআ করি সে যেন অনেক ভালো থাকে। আর তার জীবনের সমস্ত কষ্টগুলো যেন সেখানে সুখে পরিণত হয়। গাড়ির সিটে হেলান দিতেই যেন চোখটা লেগে আসলো। সারা রাতের ঘুম যেন এখন চোখে ঝেঁকে বসলো। চোখটা মেলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। খানিকক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠতেই লক্ষ্য করলাম আমি হাসপাতালে শুয়ে আছি। নিজেকে হাসপাতালে দেখে অবাক হলাম। সোহান আমার পাশে বসে আছে। আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– হাসপাতালে আসলাম কখন? আমার কী হয়েছিল?

সোহানের ক্লান্ত মুখটা বলে উঠল

– জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে।প্রেসার একদম কমে গেছিল। এতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরল তোর। তিন ঘন্টা হয়ে গেছে। যাইহোক স্যালাইন চলছে সবকিছু স্বাভাবিক। ডাক্তার বলল ঘুম থেকে উঠলে যেন কিছু খেতে দিই। ফুড পান্ডায় খাবার অর্ডার করেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে গরম স্যুপ চলে আসবে। এসময় তো খাওয়া দাওয়া একটু বেশি করবি। সারাদিন এত চাপ নিলে শরীর তো চলবে না। মনের জোরের সাথে তো শরীরের জোরও দরকার।

আমি বুঝতেই পারি নি যে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। আমার কাছে মনে হয়েছিল আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম। শরীরটা যদিও অসাড় লাগছিল। তবে বুঝতে পারি নি। আমি সোহানকে মৃদু গলায় বললাম

– বাবা, মা কে কী বলেছিস? তারা কী আসবে?

সোহান চুপ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– এখন এসব চিন্তা করতে হবে না। একটু বিশ্রাম কর।

– বাবা, মা কী কিছু বলেছে? লুকাস না। আমাকে বল।

– তারা তো তোর উপর একটু রেগে আছে জানিসেই। কল দিছিলাম। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তোর কোনো ব্যপারে তারা আর নেই। যদিও এটা অভিমান থেকে বলেছে। সময় মতো অভিমান কেটে গেলে ঠিক হয়ে যাবে। এসব নিয়ে ভাবিস না।

সোহানের কথা শুনে কেন জানি না বুকটা মোচড় দিতে লাগল। শুধু ভাবছিলাম আমি কী এমন করেছি যে বাবা মা আমাকে এভাবে ভুল বুঝলো। তাদের কত ভালোবাসি আমি। যা কিছু করছি সবকিছু একেবারে শেষ করার জন্যই। তাহলে কেন সবাই ভুল বুঝে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। মাথাটা ভার লাগছে। চোখটা বন্ধ করে রাখলাম। সোহান উঠে যেন কোথায় গেল। মিনেট পাঁচেকের মধ্যে আবার ফিরেও আসলো হাতে একটা স্যুপের বাটি নিয়ে৷ আমার পাশে বসে স্যুপটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল

– চিন্তা রেখে হা কর। নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখ। আর আমার বন্ধুর সাথে কথা হয়েছে। সে বলেছে সব ব্যবস্থা করবে। যতটুকু সাহায্য লাগে করবে। আর ঐ অফিসারের বিরুদ্ধে ও স্টেপ নিবে৷ এখন একটু খেয়ে নে। আস্তে আস্তে একটু একটু করে আমরা শান্তির দিকে যাচ্ছি। একদিন ঠিকই কাঙ্ক্ষিত শান্তির দেখা মিলবে। কী রে কথা শুনেই যাচ্ছিস। হা কেন করছিস না। হা কর।

আমি সোহানের কথায় যেন সম্ভিত ফিরে পেলাম। হা করে মুখে স্যুপ টা নিয়ে গিলতে লাগলাম। এর মধ্যেই সোহান বলে উঠল

– মনে আছে অপ্সরা কলেজে পড়ার সময় যখন তুই পরীক্ষায় লিখতে পারতি না আমি তোকে লিখে দিতাম। কী জ্বালানোই টা ‘না, তুই জ্বালিয়েছিস। নিজে তো কিছু পড়তিই না তবুও খবরদারি করতি। না দেখালেই পরীক্ষা হল থেকে বের হয়ে আমার চুল টেনে ধরতি। তোর জন্য কলেজের ফাস্ট বয় হয়েও কান ধরে বেঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে৷ বাবারে কি ডেন্জারাস ছিলি। আর কারও সাথে তো এমন করতি না। আমাকে বোকা পেয়ে আমার সাথেই এমন করতি।

সোহানের কথা গুলো শুনছিলাম। তবে চোখে যেন সে স্মৃতিগুলো সব ভাসছিল। মধুময় স্মৃতি গুলো আজ বড্ড দীর্ঘ নিঃশ্বাস হয়ে বের হয়। হালকা হেসে বললাম

– সে জীবনটায় অনেক ভালো ছিল।কোনো দায়িত্ব ছিল না। যতই বড় হচ্ছি ততই যেন সব ঘিরে ধরেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যেন বড় দায়।

– ভাবিস না জীবনটা আবার নতুন করে গড়ে উঠবে।

– আচ্ছা তুই এখনও বিয়ে কেন করিস নি? কাউকে কী পছন্দ করিস?

সোহান আমার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। মনে হচ্ছে তার মনে কোনো ঝড় এসে ঝাঁপটা দিচ্ছে।

(চলবে)

প্রাক্তন পর্ব-২০

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২০

আমি তাকাতেই লক্ষ্য করলাম বাবা দাঁড়িয়ে আছে। আমি আধ শুয়া থেকে উঠে বাবাকে দেখে লাইট জ্বালিয়ে বললাম

– বাবা তুমি। কী হয়েছে? কিছু বলবে?

বাবার মুখ গম্ভীর। চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো ব্যপারে রেগে আছে। বাবা আমার কথার জবাব যখন দিচ্ছিল না তখন আবারও জিজ্ঞেস করলাম

– বাবা কিছু বলবে?

বাবা কন্ঠটা গম্ভীর করে জবাব দিল

– তোমার মায়ের মুখে যা শুনেছি সেটা কী ঠিক?

আমার হাত, পা কাঁপতে লাগল। বাবাকে অনেক ভয় পাই আমি। কী জবাব দিব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শরীরটা বেশ ঝিমুচ্ছে। স্তব্ধ অসাড় লাগছে। বাবা কন্ঠটাকে জোরালো করে পুনরায় বলল

– কী হলো জবাব নেই কেন? এত চুপ হয়েই বা আছো কেন? প্রশ্নের উত্তরটা দাও।

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম

– মা তোমাকে কী বলেছে?

– এসব জিজ্ঞেস করতে তোমার লজ্জা হচ্ছে না? এগুলো তো মুখে আনতেও আমার বাঁধতেছে। তোমার এত অধঃপতন হয়েছে। স্বাধীনতা দিয়ে তোমাকে আমরা অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। ঘটনা সত্যি কী না জানতে চাই।

আমি মাথা নীচু করে বললাম

– হ্যাঁ বাবা সত্যি।

বাবার মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। আমার দিকে তাকিয়ে কন্ঠটা তীব্র করে বলল

– থানায় নাকি মামলা করে এসেছো?

– জ্বি বাবা।

– কালকে তোমার বড় ভাইকে সাথে নিয়ে গিয়ে মামলাটা তুলে আসবে। এসব নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করে সবার হাসির পাত্র হতে পারব না। তোমাকে নিয়ে এমনিতেই অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তোমার জীবনে তুমি কষ্ট পেয়েছো সেটা আমরা বুঝি। সে জন্য যথেষ্ট স্বাধীনতা তোমাকে দিয়েছিলাম। তুমি সেটার মূল্য দিতে পারো নি। তোমার কী মনে হয় মামলা যে করেছো সেটা কী চাপা থাকবে? কেউ জানবে না? সবাই জানবে। সবাই বলবে মেয়ের বয়স হয়েছে ঠিক সময় বিয়ে দেয়নি তাই বেপরোয়া চলাফেরা করেছে বলেই আজকে মেয়েটার এ হাল। তুমি বাইরে বের হলে কেউ অরন্যকে খারাপ বলবে না। বরং তোমাকে দেখে মুখ টিপে টিপে হাসবে আর হাজারটা কথা বলবে। চায়ের দোকানের গল্পের মূখ্যম চরিত্র হয়ে উঠবে তুমি। আমি এমনিতেই অসুস্থ আমি এসব নিতে পারব না। আমি চাচ্ছি না বিষয়টা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি হোক। বিষয়টা এখানেই শেষ করো। আমরা পাত্র দেখতেছি ১৫ দিনের মধ্যেই আমাদের পছন্দের পাত্রের সাথেই তোমার বিয়ে হবে৷ তুমি চাকুরী করো বলে আমাদের মাথা কিনে নাও নি। চাকুরীর থেকে মানসম্মান আগে। ভুলে যেও না তুমি সমাজে একা চলো না। তোমার সাথে আমরাও জড়িত। তোমাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে আমাদের তুলেও গালি দিবে।

আমি বাবার কথাগুলো শুধু মাথা নীচু করে শুনছিলাম। হালকা সুরে বাবাকে বললাম

– আমার কী দোষ বাবা। অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরবে আর আমি গুটি মেরে বসে থাকব? বাবা মানুষ তো না জেনেই হাজার কথা বলবে তাই বলে তাদের ছেড়ে দিব। আমি তো জানি আমার সাথে যা হয়েছে অন্যায় হয়েছে আমি কী তাদের শাস্তি দিব না? আজকে আমার সাথে যা হয়েছে কাল তো অন্য মেয়ের সাথে হবে। এভাবে সুযোগ দিতে থাকলে তো সবাই পেয়ে বসবে। তুমি কেন বাবা তোমার মেয়ের আর্তনাদ শুনতে পারছো না। আমাকে দয়াকরে সাপোর্ট দাও। তোমাদের সাপোর্ট আমার দরকার। আজকে ওদের ছেড়ে দিলে ওরা যে আমার ক্ষতি করবে না তার কী গ্যারান্টি আছে বলো তো। আমার বিয়ের পরও তো তারা আমার ক্ষতি করতে পারে। তাহলে কেন ওদের ছাড় দিব আমি। আমি তো দোষ করেনি।

বাবা আমার কথায় আরও চটে গেলেন

– তুমি একটু বেশিই কথা বলছো। দু কলম শিখেছো বলে বিদ্বান হয়ে যাও নি। বিয়ের পর কিছু করলে আমরা দেখে নিব। আপাতত যা করতে বলছি তাই করো। বিষয়টা চেপে যাও। সমাজে মুখ দেখানোর পরিস্থিতিতে রেখো। আর কথার নড়চড় যেন নাহয়। এ বাসায় থাকলে এসব করতে পারবে না। আর যদি কিছু করো তাহলে বাসা থেকে বের হয়ে যাও। তোমার মুখ ও যেন কোনোদিন দেখতে না হয়। আমি ধরে নিব আমাদের মেয়ে মারা গেছে। তোমার জন্য মানুষের কটু কথা আর শুনতে পারব না। তোমার বড় ভাইকে নিয়ে কেউ কোনো কথা আজও বলতে পারে নি অথচ তোমাকে নিয়ে আমি বহুবার ছোট হয়েছি। আর হতে পারব না। এমনিতেই শরীর ও এসব নিতে পারছে না।

– বাবা আমি জানি আমার জন্য তোমাদের অনেক সমস্যা হয়েছে তবে এখানে আমার দোষটা কতটুকু ছিল। আমি তো দোষ না করেও একটার পর একটা কষ্ট পাচ্ছি, যন্ত্রণা পাচ্ছি। আমার হাহাকার টা কেন বুঝতেছ না। আমার সাথে হয়েছে আমি বুঝতেছি আমার কেমন লাগছে৷ আর তুমি কী না বলছো সবাইকে ছেড়ে দিতে৷ বাবা তুমি যদি বলো বাসা ছেড়ে যেতে তবে তাই করব। তবুও আমি অরন্যকে ছাড়ব না। ওদের ছাড়লে আমি মরেও শান্তি পাব না।

কথা বলতেই বাবা কষিয়ে আমার গালে চড় দিল। আমি চড়টা খেয়ে অনুভূতি শূন্য হয়ে গেলাম। বাবা চড়টা দিয়ে চেঁচিয়ে বলল

– তুমি দিনকে দিন বেয়াদব বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছ।

বাবার চেঁচানো শুনে পাশের রুম থেকে বড় ভাই এসে কিছু না বুঝেই আমাকে আরও কয়েকটা চড় কষিয়ে দিল। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। বাবা, ভাইয়ের হাতে চড়গুলো দীর্ঘ চার বছর পর খাচ্ছি। এর আগে এরকম মেরেছিল অরন্যের জন্য, যাতে অরন্যকে ভুলে যাই অরন্যের আশা বাদ দিই। আর আজকে মার খাচ্ছি যাতে অরন্যকে শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দিই। কারণ তথাকথিত সমাজের লোক নানান কথা বলবে। বড় ভাই চড় গুলো দিয়েই বলে উঠল

– তোর জন্য বাবা এর আগে স্ট্রোক করেছে। আর তুই একটার পর একটা আকাম করে যাচ্ছিস। যা ইচ্ছা করে বেড়াচ্ছিস। সমাজে মুখ তো দেখাতে হবে। আর কত ছোট করবি। আর কত এভাবে সবার কথা শুনাবি। চাকুরী করছিস বলে কী মাথা কিনে নিয়েছিস। তোর এ বাসায় থাকা বন্ধ। সকালে দু চোখ যেদিকে যায় চলে যা। তোকে বোন বলে পরিচয় দিতেও আমার লজ্জা হয়।

বলেই বড় ভাই বাবাকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমি নীরব হয়ে খাটের কোণে বসেই আছি। এর মধ্যে ভাবী কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিয়ে বলল

– তোমাকে আমি কত ভালো মনে করতাম। কত আদর করতাম। আর তুমিই কী না যা তা করে বেড়াচ্ছ। মেয়েদের এত জিদ ভালো না। আজকে যা হয়েছে তোমার জেদের জন্য। তোমার বয়সী মেয়েরা একটা সম্পর্ক থেকে বের হয়ে দিব্যি সংসার করছে। আর তুমি অতীত আঁকড়ে ধরে পড়াশোনা করেছো। একের পর এক বিয়ে ভেঙ্গেছো। তার ফলে অবশ্য বিসিএস ক্যাডার হয়েছো। তবে এতে কী তুমি পূর্ণাঙ্গ হতে পেরেছো। একটা মেয়ের পূর্ণতা তখনই আসে যখন মেয়েটার সংসার হয়। তোমার জেদ তোমাকে আজকে এত নীচে নামায়ছে। ছেলেদের ভোগের পন্য বানিয়ে ছাড়ছে।

ভাবীর শেষ কথাটা শুনে আমি রেগে গিয়ে বললাম

– ভবী আজেবাজে কথা বলবে না একদম। এসবের পেছনে আমার হাত ছিল না। আর এসবের জন্য আমি দায়ী না। তাহলে এ দায় কেন আমাকে দিচ্ছেন। যারা করেছে তাদের দেন।

– তোমার মতো মেয়ের মুখে এসব মানায় না। অতি বিদ্যা যে মেয়েদের নষ্ট করে তোমাকে দেখে বুঝতেছি।

– আপনি একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এসব কী বলছেন ভবী। আপনি না ভলো ভর্সিটি থেকে গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করেছেন। তবুও এসব বলতে কীভাবে পারছেন। অশিক্ষিত হলে বুঝতাম এসব বলতে পারবেন। তবে আপনার মুখে এসব কথা মানতে পারছি না।

– শুনো শিক্ষিত হই আর যাই হই সমাজ নিয়ে চলতে হবে। আল্লাহ না করুক আমার একটা মেয়ে হলে তাকে শুনতে হবে তার ফুফু ধর্ষিতা। তার ফুফুকে নিয়ে মানুষ মাতামাতি করেছিল। আমার মেয়ের ভবিষ্যত টা তখন কতটা অন্ধকারে চলে যাবে সেটা কী ভেবে দেখেছো? আমি বর্তমান নিয়ে চিন্তা করি না। আমি অন্তস্বত্ত্বা। তিন মাস চলতেছে। এখনও কাউকে বলে নি। তোমার জন্য আমার পেটের বাচ্চাও কথা থেকে রেহাই পাবে না। আমি মা হয়ে তো এটা করতে পারব না। অপ্সরা যা হয়েছে তো হয়েছেই আর এমন করে নিজেকে ছোট করো না সাথে আমাদেরকেও না। বাবা আর তোমার ভাই যেখানে বিয়ে ঠিক করে সেখানে বিয়ে করে সুখে থাকো।

– ভাবী কথাগুলো বলা অনেক সহজ। আজকে অরন্য আমার এত ক্ষতি করেছে। কাল তো বিয়ের পর আরও করবে। এমনও হতে পারে আবার বিয়ে ভাঙবে। সে তো বিয়ের দিন এসেও ঝামেলা করতে পারে। ঘুরে ফিরে তো সেই পুলিশ আদালতের কাছে যেতে হবে। একই কথা। তাহলে কেন বারবার আমাকে ভোগান্তিতে পড়তে হবে। এর চেয়ে এটা ভালো হয় না, আমি সব শিকড় থেকে শেষ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। সমাজ কথা বলবে সেটা আমিও জানি। তবে সেটা সাময়িকের জন্য। পরবর্তী আমার ভালো হলে সে সমাজেই আমাকে নিয়ে প্রশংসা করবে। ভাবী আমি জানি আপনাদের সমস্যা হচ্ছে। চিন্তা করবেন না আমি বাসা ছেড়ে কালকেই চলে যাব। তবুও আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকব। আমাকে কেউ দমাতে বা নড়াতে পারবে না। আফসোস একটায় আমার পরিবার আমার সাথে নেই। আজ বুঝতে পারছি মানুষ কেন আত্মহত্যা করে। কারণ তার উপায় থাকে না।

ভাবী আমার কথা শুনে আর কোনো জবাব না দিয়েই চলে গেল। আমি বসেই রইলাম হাঁটু মুড়ি দিয়ে। কতটা অসহায় লাগছে আমি জানি। কতটা কষ্ট পেলে মনটা এমন অশান্ত হয় এখন বুঝতে পারতেছি। এ কষ্ট সহ্য করতেও পারতেছি না আবার সেখান থেকে বের হয়ে আসতেও পারতেছি না। কী করব আমি পরিবার দেখব নাকি নিজের শান্তি। অশান্ত লাগছে অনেক। মাথাটা হাঁটুর মাঝখানে দিয়ে এসবেই ভাবছিলাম। ফোনটা ভাইব্রেট শুরু করল। সোহান কল দিয়েছে। কলটা ধরে বললাম

– হ্যাঁ বল কী বলবি?

– খাওয়া দাওয়া করেছিস?

– হুম।

– কী করতেছিস মন খারাপ?

– নাহ।

– তাহলে এত চুপ কেন?

– তাহলে কী বকবক করা উচিত?

– তা না, তবে মনে হচ্ছে তুই কিছু নিয়ে ভবছিস।

– একদিকে পরিবার একদিকে আমি৷ জানি না কী করব।

– শুন আমি জানি তোর মধ্যে কী চলছে। তবে পরিবার এখন যতই বলুক তোর পাশে নাই। বিপদে পড়লে ঠিকেই তোর পাশে পাবি। পরিবার হয়তো সাময়িক চিন্তা করছে। তোর ভবিষ্যত ভাবছে। তোর মতো গভীর করে ভাবতে পারছে না। তবে মিলিয়ে নিস আজকে বিপদে পড়লে আমাকে নাও পেতে পারিস তবে তোর পরিবার ঠিকেই তোকে আগলে রাখবে। পরিবার নিয়ে চিন্তা করিস না। ওরা যা বলে তুই শুনে যা। আর এদিকে তুই তোর মতো এগিয়ে যা। অপ্সরা জীবনের জয় তো হুট করে আসে না। ছিনিয়ে আনতে হয়। নিজেকে সময় দে৷ অবশ্যই ভালো কিছু পারবি৷ বিয়ে আল্লাহর হাতে যেখানে হওয়ার হবে। তুই নিজেকে সামলা। বাবা,মা, যা বলুক বলতে দে। ওরা তোর ভালো চায়। তবে পরিবার মাঝে মাঝে ভালো চাইতে গিয়েও খারাপ করে ফেলে। তাই তুই একটু সাবধানে পা ফেল৷ আজকে পরিবার কথা বলছে কালকে বাইরের লোক বলবে। হজম করে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন কর। আর তুই কলেজে চাকুরি করিস। তোর স্টুডেন্টরা যখন এসব জানবে তখন তারাও দেখবি আড়ালে তোকে নিয়ে কথা বলছে৷ এসবকিছু তোকে মেনে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে সামনের পথ গুলো আরও কঠিন। একবার এ পথ পার হয়ে আসতে পারলে তখন সবাই তোকেই ইন্সপিরেশন হিসেবে নিবে। তুই নিজেকে সামলা। সময় দে। আবির আর অরন্যকে তার যোগ্য শাস্তি দে। আমি জানি তুই পারবি।

সোহানের প্রতিটা কথায় বাস্তববাদী। সত্যিই তো এত অপ্লতে ভেঙ্গে গেলে তো হবে না৷ আমাকে অবশ্যই আরও শক্ত হতে হবে। আমি সোহানকে বললাম

– সকালে চলে আসিস। মেডিকেলে যাব।

– হুম,কয়টায় আসব?

– এগারটায় চলে আসিস।

– আচ্ছা ঘুমা।

ফোনটা রেখে দিলাম। তবে মনে হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনোভাবেই ঘুমাতে পারছিলাম না৷ চোখ বন্ধ করলেই যেন এগুলো চোখে ভাসছিল। মনটা কেমন জানি অস্থির লাগছিল। একটু শান্তি যে কত বড় নেয়ামত সেটা অশান্তিতে না থাকলে টের পাওয়া যায় না। টাকা আছে পয়সা আছে সমাজে পরিচিতি আছে তবে শান্তি নাই। এ থেকে কষ্ট আর কী হতে পারে। ভাত সামনে নিয়ে গিলতে না পারার কষ্ট কী হতে পারে আমি জানি। তুলতুলে বিছানা পেয়েও ঘুমাতে পারছি না। অথচ ফুটপাতে কত মানুষ শক্ত ইটে মাথা দিয়ে শান্তিতে ঘুমুচ্ছে। সারা রাত তেমন ঘুম হলো না। মাথাটা তো ঝিমঝিম করছিল। সকালে উঠে জানতে পারি আবির আর অরন্যকে চাকুরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে আর আমার বিষয়টা তদন্ত করছে৷ সকালে এমন একটা সংবাদ আমার মনটাকে একটু শীতল করল। নিজের মধ্যে শান্তি পাচ্ছিলাম। তবে বাসার কেউ স্বাভাবিক না। সবাই আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। বাবা মা কেউ কথা বলছে না। তবুও নিজেকে স্থির রাখলাম। এগারটায় সোহান আসলো। সোহান কে নিয়ে হাসপাতালের পথে রওনা দিলাম। সোহান গাড়ি চালাতে চালাতে বলে উঠল

– আজকে মেডিকেলের কাজটা শেষ করে ডিভোর্সের কাজটাও শেষ করবি।

– কিন্তু সে টা তো বলেছিল সময় লাগবে দুই একদিন।

– আমি সেটা আজকে ব্যবস্থা করেছি। বন্ধু হয়ে এটুকু তো করতেই পারি৷ আর আবিরকে পুলিশ ধরেছে তবে অরন্য লাপাত্তা। এর কী হুট হাট লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার প্রবণতা কাজ করে নাকি

– কেন পুলিশ তাকে ঐ বাসায় পায়নি?

– নাহ৷ কোথায় জানি লুকিয়েছে।

অরন্যের এ লুকানোর বিষয়টা বরাবরেই একটা বিপদ ডেকে আনে। মনে হালকা ভয় লাগছিল তবুও সেটা প্রকাশ করলাম না।

– ওহ আচ্ছা বাদ দে। আজকে ডিভোর্সটা দিতে পারলে শান্তি।

তারপর মেডিকেলে গিয়ে সব কাজ শেষ করলাম। অরন্যকে ডিভোর্স দিলাম। ডিভোর্সের কাগজে যখন স্বাক্ষর করছিলাম মনে হচ্ছিল বন্দি একটা জীবন থেকে মুক্তি পাচ্ছি। ডিভোর্স দেওয়ার পর মনে হলো বুক থেকে শক্ত পাথর নেমে গেল। শান্তি আর প্রশান্তময় লাগছিল। সোহান ও আমার মুখের সজীবতা দেখে বুঝতে পারছিল আমি প্রশান্তি পাচ্ছি। সে হালকা হেসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল

– আস্তে আস্তে তোর সব কষ্টগুলো এভাবে মুছে যাবে। তুই মুক্ত হয়ে যাবি সকল শিকলে বাঁধা সম্পর্ক থেকে। জীবনটা সুন্দর হবে রঙিন হবে।

আমি হালকা গলায় বললাম

– রঙিন হওয়ার স্বপ্ন দেখি না তবে জীবনটা সুন্দর ভাবে এগিয়ে চলুক এটাই চাই। চল থানায় যেতে হবে।

– হুম চল।

তারপর থানায় গেলাম। থানায় যাওয়ার পর শুরু হলো নতুন নাটক।

(চলবে)

প্রাক্তন পর্ব-১৯

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৯

এমন সময় মনে হলো মাথাটা প্রচন্ড রকম ঘুরছে। চোখগুলো ঘোলা হতে শুরু করল। শরীরটা নিস্তেজ অসাড় হয়ে যাচ্ছে। অরন্যের দিকে তাকালাম। অরন্যের মুখ অবয়বটা ঝাঁপসা হয়ে আছে। বুঝতে পারছিলাম সে হালকা হাসছে। তবে আমার কেন এমন লাগছে। কখন যে কী হয়ে গেল টের পেলাম না। যখন টের পেলাম তখন আমি অন্য কোথাও। আমার সারা শরীর উলঙ্গ অবস্থায় পড়ে আছে বিছানায়। শরীরে কোনো কাপড় নেই। গা, হাত, পা নাড়াতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। সাদা শরীরে লাল লাল দাগ প্রতীয়মান হলো। কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিলাম আমার সাথে কী হয়েছে। আশে পাশে কাপড় খুঁজতেই লক্ষ্য করলাম অরন্য বিছানার পাশেই শুয়ে আছে। সে ও অর্ধ উলঙ্গ হয়ে আছে। আন্দাজটা পুরোপুরি নিশ্চিত হলো। অরন্যের কুৎসিত মনোভাবের সাথে পরিচিত হলাম। এখান থেকে আমাকে বের হতে হবে। আমার সাথে যাই হোক সেটা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। তবে অরন্য ভেবেছিল সে এভাবে আমাকে পেয়ে ছাড়বে। তবে সে এটা ভাবে নি এভাবে সে আমাকে আরও হারিয়ে ফেলবে। আমি জানি না আমার কী হয়েছিল কেন এভাবে মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠেছিল তখন। তবে আমাকে যে অজ্ঞান করা হয়েছিল সেটা আমি বুঝতে পারলাম এখন। অরন্য ঘুমুচ্ছে। যা করতে হবে খুব সাবধানে। আশেপাশে আমার মোবাইলটা খুঁজতে লাগলাম। টেবিলের ঠিক কর্ণারে মোবাইলটা পড়ে আছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলাম বিকেল ৪ টা বাজে। মা কল দিয়েছে অনেক বার। সাথে সোহানও কল দিয়েছে। অবশ্য মাকে অরন্য মেসেজ দিয়েছে আমি একটা কাজে আটকে আছি পরে কল দিব৷ এখন যেন কল না দেই। কিন্তু এখন আমি কাকে আগে কল দিব ভাবতে লাগলাম। মাকে কল দিলে মা বিষয়টা সহজে বুঝবে না। এ মুহূর্তে আমি ঠিক কোথায় আছি জানি না। তাই মাকে কল না দিয়ে সোহানকে মেসেজ দিয়ে বললাম

– তোর কী ওয়াট’স এপ আছে?

রিপ্লাইয়ে আসলো

-আছে, কেন?

– আমি তোকে ওয়াট’স এপে একটা লুকেশন দিচ্ছি সে ঠিকানায় তাড়াতাড়ি চলে আয়। আর কোনো প্রশ্ন করিস না।

– আসতেছি। তুই লুকেশন পাঠা।

আমি তাড়াতাড়ি ওয়াট’স এপে ঢুকে লুকেশনটা শেয়ার করলাম সোহানকে। তারপর কাপড়টা পরে বের হতে নিলেই অরন্য আমার হাতটা ধরে বলল

– কোথায় যাচ্ছ।

আমি অরন্যের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললাম

– বেহায়া নির্লজ্জ একটা মেয়ের সাথে এত জঘন্য কাজ করতে তোমার বিবেকে বাঁধে নি?

আমার কথায় অরন্যের কোনো ভ্রূক্ষেপ হলো না। সে কিছুটা কটু কন্ঠে বলল

– আমার স্ত্রী তুমি। তোমাকে পাবার যথেষ্ট অধিকার আমার আছে। আর তোমার এত অহংকার কেন বেড়েছে অপ্সরা? আমি যা করেছি তোমাকে ভালোবেসে। হ্যা আমি ভুল করেছিলাম। তার জন্য তো তিন বছর আমি প্রায়শ্চিত্ত কম করে নি। মানুষ ভুল করলে ক্ষমা করতে হয় তুমি তো তাও করছো না। আর তোমার পেটে আমার সন্তান ছিল সেটা আমি জানতাম না। জানলে অবশ্যই নিজের সন্তান কে শেষ করে দিতে বলতাম না। আমি এত পাপ করেছি বলেই শাস্তি পেয়েছি। প্লিজ অপ্সরা আমাকে মেনে নাও।

অরন্যের কথা শুনে আমার গা টা আরও জ্বলে গেল। আমি তীব্র গলায় উত্তর দিলাম

– যদি তোমার মধ্যে অনুশোচনা থাকত তাহলে আমার সাথে আবার নাটক করতে না। যদি তুমি আমাকে নূন্যতম সম্মান করতে তাহলে ঠিকেই আমাকে আমার মতো থাকতে দিয়ে মন জয় করে নিতে। আবির কে নিয়ে নাটক করে যে মানসিক যন্ত্রণা তুমি আমাকে দিয়েছো সেটার ক্ষমা আমি কী করে করি তোমায়?

– আমি যা করেছি তোমাকে পাবার জন্য।

– এ কথাটা বলে সব দোষ নির্দোষ হয়ে যাবে না। শুনো অরন্য তুমি যদি নিজে থেকে আমার কাছে এসে সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইতে আমাকে ভালো করে বুঝাতে আমাকে সময় দিতে আমাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা দিতে তাহলে আমি তোমাকে মেনে নিতাম। কিন্তু তুমি যা করেছো আর করতেছো তারপর তোমাকে আমি মেনে নিতে কোনোভাবেই পারব না। একটা ভুল শুধরে নিতে গিয়ে তুমি আরও হাজারটা ভুল করেছো। আমার মন নিয়ে আবার খেলেছো। আমাকে হতাশায় ডুবিয়ে দিয়েছো। আর আজকে যা করেছো তারপর তোমার কোনো ক্ষমা নেই। তোমার কী মনে হয় জোর করে শারিরীক সম্পর্ক গড়ে তুললেই একটা মেয়ে তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে যাবে। সবকিছু এত সস্তা। আজকের পর থেকে তোমার প্রতি যতটুকু টান,মায়া, সম্মান ছিল সেটাও চলে গেছে। আমি শুধু তোমাকে ঘৃনা করি। মন থকে ঘৃনা করি। এর বাইরে কিছু না। একদম পথ আটকাবে না। আমাকে ছাড়ো। আমি তোমার এ নোংরা কাজের শাস্তি দিব। তোমার আর আবিরের নামে অভিযোগ করব। প্রতিটা পদক্ষেপে যে যন্ত্রণা তুমি আর আবির দিয়েছো সেটা আমি ফিরিয়ে দিব।

অরন্য আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল

– আমি আমার চাকুরির চিন্তা করি না। এ চাকুরি চলে গেলেও আমার কিছু যায় আসে না। মনে শান্তি যার নেই তার প্রফেশন নিয়ে কোনো চিন্তাও নেই। আমি শুধু তোমাকে চাই। আর এজন্য যা করা লাগে করব। প্লিজ অপ্সরা আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

– কিন্তু আমি তোমাকে অনেক ঘৃনা করি। মন থেকে অনেক ঘৃনা করি। তোমার স্ত্রী নাফিসা এসেছে তাকে নিয়ে সুখী হও।

অরন্য আমার কথায় হালকা হাসলো। তারপর বলল

– গতকালকে নাফিসাকে তার সমস্ত টাকা পরিশোধ করে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছি। ইতোমধ্যে তার হাতে হয়তো সব পৌঁছে গেছে। সে এখন আমার স্ত্রী না। সে আমার শুধুই প্রাক্তন। আমার বর্তমান ভবিষ্যৎ যদি কেউ হয় সেটা শুধু তুমি। কারণ একমাত্র তুমিই আমার স্ত্রী। তোমার সাথে আমার ডিভোর্স হয়নি।

– হয়নি, হতে কতক্ষণ? আমি সব কাগজপত্র তৈরী করে রেখেছি। এ সপ্তাহের মধ্যে তুমিও ডিভোর্সের কাগজ পেয়ে যাবে। আমি তোমাকে আমার জীবনে চাই না। তোমার মতো নোংরা,পাগল,সাইকো মানুষ আমার জীবনে চাই না।৷ তোমার জীবনে কালো অধ্যায়ের সূত্র হয়েছে। একদিন তুমি আমাকে পাগল না হওয়া সত্ত্বেও পাগল সাইকো উপাধি দিয়েছিল। আজ এতবছর পর তুমি নিজেই সে তালিকায় চলে গিয়েছ। তোমারটা ছিল সাজানো নাটক তবে এখনের এটা পুরো বাস্তব। তুমি দয়াকরে আমার পিছু ছাড়ো। আমি তোমাকে আর চাই না। আর সবচেয়ে বড় কথা এ সম্পর্কে সম্মান জিনিসটা নষ্ট হয়ে গেছে। চাইলেও এ সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব না।

বলেই যেতে নিলাম। অরন্য আমাকে আটকে দিল। আমি বের হতে নিলে সে আরও জোরে ধরল। আমি অরন্যকে একটা ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে।। দরজাটা বাহির থেকে লাগয়ি দিয়ে বের হলাম। সোহানকে কল দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম

– তুই কোথায়?

– আমি প্রায় চলে এসেছি। আর ১০ মিনিট লাগবে তুই কোথায়?

আমি আশপাশ তাকিয়ে ওকে বললাম

– আমি রিকশা নিয়ে মোড়ের মাথায় এগুচ্ছি তুই তাড়াতাড়ি আয়।

বলেই কলটা কাটলাম। রিকশা নিয়ে মোড়ের মাথায় এগুতে লাগলাম। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।।তবে চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে না। শুধু হাহাকার হচ্ছে। মোড়ের মাথায় যেতেই সোহান চলে আসলো। আমি সোহানের গাড়িতে উঠেই বললাম

– তাড়াতাড়ি থানায় চল। কাজ আছে।

– কী কাজ। আর তোর এ অবস্থা কেন? সারা শরীরে কিসের দাগ এগুলা? আমাকে একটু বল। ব্যপার টা কী?

– ধর্ষিত হয়েছি।

আমার উত্তর শুনে সোহান চুপ। মিনেট পাঁচেক সে চুপ রইল। নিজের গতিতে গাড়ি চালাতে লাগল। তার হয়তো বোধগম্য হচ্ছে না আমি কী বলছি। গাড়িটা চালিয়ে থানার ঠিক কাছে এনে বলল

– আমাকে কী বলা যায় কী হয়েছে?

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম

– আগে মামলা করে আসি তারপর সব বলছি।

সোহান গাড়িটা থানার কাছে নিয়ে বলল

– যা এবার যা করার করে আয়।

আমি গাড়ি থেকে নেমে থানায় গিয়ে অরন্যের নামে নারী নির্যাতনের মামলা করলাম।।সাথে আবিরের নামেও অভিযোগ দিলাম। তারপর থানা থেকে বের হয়ে আবির আর অরন্যের অফিসে অভিযোগ দিলাম। এর মধ্যে অবশ্য মাকে কল দিয়ে বললাম আমি ঠিক আছি। যদিও মাকে সবটা বলে নি। তবে বাসায় গিয়ে বলব। পুরোটা সময় সোহান সাথে ছিল। মাথাটা অনেক ঘুরছে। সারাদিনের না খাওয়া। সোহান আমার দিকে তাকিয়ে একটা কেকের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল

– রাত হয়ে যাচ্ছে।।তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুই কিছু খাস নি। খেয়ে নে আগে।

আমি কেকটা সোহানের হাত থেকে নিয়ে খেয়ে নিলাম। এত সহজ ভাবে আমি সব মানতে শিখে গেছি এটা ভেবে যেন নিজেকে আজ বেশ অচেনা মনে হচ্ছে। কেকটা খাওয়ার পর শরীরটায় একটু বল আসলো। আমি গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সোহান আমার সামনে এসে বলল

– এবার বল কী হয়েছে। এতক্ষণ তুই যা বলেছিস সব করেছি। কোনো প্রশ্ন করেনি। এবার সব বল কী হয়েছে। কে তোর এ অবস্থা করেছে। অরন্যের বিষয়টা ও খুলে বল।

আমি হালকা গলায় সোহানকে সবটা বললাম। সোহান সমস্ত ঘটনা শোনার পর চুপ হয়ে গেল। তার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে আছে। রাগে গিজগিজ করে বলল

– আমি এখনেই অরন্যকে খুন করে আসব। তোর সাথে এমন করেছে। আমাকে আগে কেন বলিস নি। বলেই গাড়িতে হাত মুষ্টি করে জোরে ঘুষি দিল।

আমি সোহানকে হালকা ধমক দিয়ে বললাম

– তুই শান্ত হ। এ লড়াই আমার। আমাকে আমার লড়াই করতে দে।।আমি চাই না আমার এ লড়াইয়ে অন্য কেউ আসুক। আমার এ লড়াইটা শুধু আমি করতে চাই। বন্ধু হিসেবে যতটুকু পাশে থাকা দরকার ততটুকু থাকিস। এর বাইরে কিছুই লাগবে না। আর কালকে মেডিকেলে যাব, তারা বডি টেস্ট করবে। তুই কী আমাকে নিয়ে আসতে পারবি বাসা থেকে। একা বের হতে যথেষ্ট ভয় হচ্ছে। আর মাকে নিয়ে বের হওয়াও ঝুঁকি পূর্ণ। বাসার অন্য কেউ ব্যপারটা জানেও না। অন্যদের বললেও তারা মানসম্মানের অজুহাত দিয়ে আর সামনে এগুতে দিবে না। আমি চাই না এ লড়াইটা থেমে যাক এর শেষ আমি দেখে ছাড়ব।

– তুই যা বলিস তাই করব। আগের অপ্সরা আর এ অপ্সরার মধ্যে কত তফাত। আগে তুই একটুতে কান্না করে দিতি, স্থির থাকতে পারতি না। অল্পতেই তোর রাগ উঠে যেত। আর আজকে এত কিছু হওয়ার পর তুই কত স্থির কত শান্ত। মানুষ যে রঙ বদলায় পাল্টায় সেটার প্রমাণ তুই।

আমি দীর্ঘ দীর্ঘ কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম

– মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়। আর বেঁচে থাকলে রঙ বদলায় করণে অকারণে রঙ বদলায়। কথাটা যেন কোন ক্লাসে পড়েছিলাম। ধরে নে ঐরকম কিছুই। আমাকে বাসায় পৌঁছে দে এবার। কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছি কল দিয়ে। আর কালকে সকালে চলে আসিস।

-হুম আসবো। গাড়তে উঠ।

আমি গাড়িতে উঠলাম। গাড়িটা চলছে। আমি খুব শান্ত হয়ে বসে আছি। শরীরে, মনে হাজারটা ক্ষত নিয়েও আমি শান্ত। গাড়িটা বাসার সামনে আসলো। আমি কাপড় দিয়ে গা ঢেকে সোহানের থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় আসলাম। রুমে আসতেই মা আমার রুমে আসলো। আমি শরীরের কাপড়া সরাতেই মা আমাকে ধরে বলল

– কিসের দাগ এগুলা। কী করেছিস তুই।

মাকে জড়িয়ে ধরলাম। অনেক কাঁদতে ইচ্ছা করছে তবে পারছি না। তবে ভঙ্গা গলায় মাকে সব বললাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– যা হয়েছে বাদ দে। এসব থানা পুলিশ করলে লোক জানাজানি হবে আর মান সম্মান যাবে। মা রে জীবনে অনেক কিছু চেপে যেতে হয়। এসব জানার পর তোর আর বিয়ে হবে না। কোনো ভালো ঘরের ছেলে তোকে বিয়ে করবে না। আর আমারাও মুখ দেখাতে পারব না।

মায়ের কথা শুনে আমি রাগ হলাম না। কারণ মা মায়ের দিক ভেবে বলেছে। কারণ এ সমাজে ধর্ষকের ছবি ভইরাল হওয়ার আগে ধর্ষিতার ছবি ভাইরাল হয়। এ সমাজে মান সম্মানের ভয়ে এমন হাজারও অপরাধ মাটি চাপা থাকে। যারা অপরাধ করে তারা বুক ফুলিয়ে হাঁটে আর যারা অপরাধের শিকার হয় তারা মাথা নীচু করে চলে। এটাই আজকের সমাজ। চাইলে সমাজ পাল্টে দেওয়া গেলেও দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো সম্ভব না। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম

– তুমি যেমন বলবে তেমন হবে। আপাতত স্বাভাবিক কাজ কর্ম করতে বাইরে যেতে হবে। তাই সোহান আমার পাশে থাকবে। সোহানকে তো চিনই। আর আমি এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করব না।

মা কিছু না বলেই চলে গেল। তবে আমি হাল ছাড়ব না। যত বাঁধাই আসুক এর শেষ আমি দেখে ছাড়ব। দোষ আমার না যে আমি শাস্তি পাব,কষ্ট ভোগ করব। খারাপ লাগছে মায়ের কথা শুনে। আর এটা ভেবেও খারাপ লাগছে এ সমাজে মেয়েরা কত অসহায়। এর মধ্যেই গোসল করতে গেলাম। লাল দাগগুলো নীল হয়ে আছে। কষ্ট তো অনেক হচ্ছে তবে চাপিয়ে রাখছি। গোসল থেকে বের হতেই মা খাবার নিয়ে আসলো। আরও অনেক বুঝাল এসব নিয়ে যেন বাড়াবাড়ি না করি। কারণ মানুষ অনেক কিছু বলবে। আমি শুধু খাবার গিলছিলাম আর চুপ হয়ে শুনছিলাম। এখন বুঝতেছি অনেকে আত্মহত্যা কেন করে। কারণ তারা সব দিক থেকে সাপোর্ট না পেয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়। আমারও ইচ্ছা হচ্ছে তবে আমি দমে যাওয়ার মেয়ে না। আমি কেন আত্মহত্যা করব। আমি তো দোষ করে নি। মা চলে গেল।

আমি গা টা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। কষ্টের আগুনে পুড়ছি তবে সেটা প্রকাশ করতে পারছি না। চোখটা বন্ধ করে শুয়ে আছি। কখন যে চোখটা লেগে আসলো বুঝে নি। চোখটা হালকা লেগে আসতেই মনে হলো কেউ একজন আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকাতেই…

(চলবে)

প্রাক্তন পর্ব-১৮

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৮

যে এসেছে তাকে দেখে ভাবতে লাগলাম নতুন নাটকের সূচনা হবে নাকি আবার? কারণ আবিরের বর্তমান জি এফ সাহেরা এবং অরন্যের স্ত্রী নাফিসা এসেছে। দুজনকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলাম। তবে বিস্ময়টা মুখ অবয়বে আনলাম না। খানিকটা নিজেকে শান্ত করে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম

– আপনারা আমার বাসায় কী জন্য?

নাফিসা প্রশ্নের জবাবে বলল

– অরন্য কোথায়?

প্রশ্নটা শুনেই আমার রাগটা বেড়ে গেল। বেশ কটু গলায় বললাম

– অরন্য কোথায় আপনি খুঁজে বের করুন। আমার কাছে বলতে কেন এসেছেন? আর আবার নতুন নাটক করতে চলে এসেছেন। এর আগে অরন্য না হারিয়েও হারিয়ে যাওয়ার নাটক করেছে এখন আপনি শুরু করেছেন সে একই নাটক।

– শুনো মেয়ে আমি তোমাকে যা বলছি তার উত্তর দাও। দেশে এসেছি গতকাল। অরন্যকে কোথাও পাচ্ছি না। অরন্য কোথায় বলো। অরন্যকে না পেলে ভালো হবে না কিন্তু।

– দয়াকরে এসব নাটক বন্ধ করুন। আর আমার কাছে অরন্যকে না খুঁজে থানায় যান প্লিজ।
অরন্য আর আবিরের নামে জিডি করে এসেছি। আপনাদের নামেও এসব ঝামেলা করলে একই কাজ করতে বাধ্য হব। আপনারা দয়াকরে এসব নিয়ে আমাকে কিছু বলতে আসবেন না।

পাশ থেকে সাহেরা বলে উঠল

– তোমার জন্য আমার সম্পর্কে ভাঙ্গণ ধরেছে। তোমাকে আমি ছাড়ব না। অরন্য ভইয়ার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে তোমাকে দায়ী করে মামলা করব। যে অশান্তি আর ঝামেলা লাগাইছো সেটার শেষ করব।

সাহেরার কথা শুনে আমি একটু হেসে বললাম

– যে মেয়ে নিজের প্রেমিককে অন্যায় কাজে সাহায্য করার অনুমতি দেয় তার কাছ থেকে এমন কথা আশা করায় যায়। দোষটা আবিরের সাথে আপনারও। আপনি একই দোষে দোষী। একটা মেয়ের জীবন নিয়ে আবির আর অরন্য খেলেছে আর আপনি জানার পরও সায় দিয়েছেন। সেখানে সমান অপরাধে আপনিও অপরাধী। আর আপনাদের মামলা করার স্বাধীনতা আছে করতে পারেন। আমিও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার ক্ষমতা আছে সেটা আমি করব৷ আপনারা আপনাদের গতিতে এগিয়ে যান। আমি নাহয় আমার গতিত এগিয়ে যাই। এবার আসতে পারেন। আর চা কফি খেলে বসুন ব্যবস্থা করছি। যদিও বাইরে বৃষ্টি পড়ছে এখন বের হওয়াটা ঠিক হবে না। বসুন আমি চা কফি আনার ব্যবস্থা করছি। যতই হোক প্রথম এসেছেন। এ বাসার অতিথি আপনারা। কিছু খেয়ে যান।

আমার কথা শুনে দুজনেই ফুসিয়ে উঠল। প্রতিত্তোর না দিয়েই মূল দরজাটা বেশ জোরে সোরেই খোলে বের হয়ে গেল। আমি চুল গুলো হাত দিয়ে আঁচরাতে আঁচরাতে নিজের রুমে এসে বসলাম। মা আমার কাছে এসে বলল

– করা ছিল ওরা। আর ঐভাবেই কেন কথা বললি?

আমি মৃদু গলায় উত্তর দিলাম

– আবির যে মেয়েকে পছন্দ করে সে মেয়ে আর অরন্যের স্ত্রী।

মা কিছুটা বিস্মিত গলায় বলল

– আবিরের পছন্দ থাকলে তুই কী ছিলি আবিরের? আর অরন্যের স্ত্রী কেন তোর কাছে এসেছে? অপ্সরা সবটা খুলে বল আমাকে।

আমি মায়ের মুখে অশান্তির ছাপ লক্ষ্য করলাম। মাকে হালকা করে ধরে বসিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা সমস্ত বললাম। মায়ের চোখ টলমল করছে। মাকে দেখতে খুব অসহায় লাগছে। মা আমাকে ধরে বলল

– তোর যে এত সহ্য শক্তি জানতাম না। শুধু জানতাম আমার মেয়েটা অনেক রাগী। কিন্তু আমার মেয়ের যে এত সহ্য শক্তি জানতাম না। মানুষ যা ইচ্ছা বলুক তুই তাতে কান দিস না। তোর মতো করে তুই লড়াই করে যা। তোর বাবার হার্টের সমস্যা আস্তে আস্তে আমি সবটা খুলে বলব। তুই চিন্তা করিস না। কোনো দরকার লাগলে মাকে বলবি। নিজের মধ্যে এভাবে জমিয়ে রাখলে যে আরও কষ্ট পাবি। আমাকে বললে তোর হালকা লাগবে। যা এবার খয়ে নে কিছু।

আমি মায়ের কথায় যেন স্বস্তি পেলাম। এতদিন কাউকে বলতে পারতাম না। আজকে যেন বলার মতো সঙ্গী পেলাম। ভরসার একটা জায়গা পেলাম। ভালোবাসার একটা হাত পেলাম।।যে হাতে কোনো প্রতারণা নেই বরং পুরোটা হাতেই ভালোবাসায় মুড়ানো।

মা চোখের জল মুছতে মুছতে বসা থেকে উঠে রান্না ঘরের দিকে গেল। আমি আমার ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার ফোন ভাইব্রেট করছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম অপরিচিত নম্বর থেকে কল এসেছে। আমি কলটা ধরলাম। ওপাশ থেকে সোহানের কন্ঠ ভেসে আসল। কন্ঠটা শুনে বললাম

– কেন কল দিয়েছিস। আজকে দেখার পর থেকেই কেমন জানি করছিস।তোর কাজে আমি রিতীমতো বিরক্ত হচ্ছি সেটা বুঝতে পারছিস না?

– অপ্সরা আমি তো তোকে প্রেম নিবেদন করছি না।তোর ভালো বন্ধু আমি ছিলাম। হঠাৎ করে তুই যোগাযোগ বন্ধ করলি। আজকে হঠাৎ তোকে দেখে সে বন্ধুত্বটা জেগে উঠেছে। তোর বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা কী আমার নেই। আর তুই এত রেগে কেন যাচ্ছিস। তোকে কল দিতে বড্ড ভয় লাগে। এজন্যই এত বছর কল দেই নি। আজকে কেন জানি না মনে হলো তুই অনেকটা শান্ত হয়ে গেছিস তাই কল দেওয়ার সাহস পেলাম । আমাদের বন্ধুত্বটা তো ঠিক করে নিতে পারি।

সোহানের কথায় আর দ্বিমত করতে পারলাম না। হালকা করে বললাম

– ঠিক করে নেওয়ার তো কিছু নেই। বন্ধু ছিলাম আছি। তবে এর বাইরে কিছু না।

-আরে এর বাইরে কী হবে। এবার বল তুই কেমন আছিস?

– অনেক ভালো।

– আচ্ছা আমি একটা বিষয়ে দ্বিধায় আছি। তোর কথার মানে আমি বুঝি নি। একটু কী বলবি?

– এসব বিষয় বলতে চাচ্ছি না। আর এসব বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস ও করবি না।

– করলাম না।

– বিয়ে করিস নি?

– এখনও সুযোগ হয়ে উঠে নি।

– ভালো। রাখলাম। পরে কথা হবে।

– কালকে কী তুই ফ্রী আছিস?

– কেন?

– এক কাপ কফি খেতাম। তুই তো কফি অনেক পছন্দ করিস। বিশেষ করে কোল্ড কফি। একবার মনে আছে তোর কফিতে এক চুমুক দিয়েছিলাম তাই রাগে আমার কফিতে থুথু দিয়ে আমার মাথায় ঢেলে দিয়েছিলি। তোর কত রাগ ছিল। এখনও কী তেমনেই আছিস নাকি একটু রাগ, জেদ কমেছে।

– তোর কথা হয়েছে?

– হ্যাঁ অনেক আগেই।

– তাহলে কলটা রাখ। আর তোর কফি তুই খা।

বলেই কলটা কেটে হালকা হাসলাম। সে পুরনো দিনগুলো বেশ রঙ্গিন ছিল। সোহান ছিল আমার খুব কাছের বন্ধু। আমার যত অকর্ম আছে সব কাজে সে সহয়তা করত। স্কুল পালানো। ক্লাস ফাঁকি দেওয়া। আর কোনো ভাবে যদি ও সাহায্য না করত তাহলে সকল রাগ ওর উপর ঝেড়ে দিতাম। সে সময়গুলো সত্যিই অনেক রঙিন আর ঝলমলে ছিল। পুনরায় স্কুল আর কলেজের জীবনে যেতে পারলে অনেক ভালো হতো। যত বড় হয়েছি ততই জটিলতা যেন আকঁড়ে ধরল।

আবারও গর্জন দিয়ে বৃষ্টি নামছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। অরন্য কী সত্যি নিখোঁজ হলো নাকি আবার কোনো নাটক। ইদানীং যা হচ্ছে সব কিছুতেই একটা রহস্য লুকিয়ে থাকে।

পরদিন সকালে গেলাম কলেজে। ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরলাম বিকেলে। বিকেলে বাসায় ফিরতেই পুলিশের মুখোমুখি হলাম। কারণ নাফিসা মামলা করেছে। অরন্যকে পাওয়া যাচ্ছে না তাই আমাকে দায়ী করে মামলা করেছে সে। আমাকে জিজ্ঞাসা বাদ করল। আমি পুরো বিষয় খুলে বললাম। উনারা মামলাটা তদন্ত করবে বলে জানিয়ে গেল। সে সাথে জোরালো প্রমাণ না থাকায় তারা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারলো না। বাসায় সবাই বিষয়টা জানলো। এলাকায় ও জানাজানি হলো হালকা। আমাকে ধরে নিতে পুলিশ এসেছিল কথাগুলো যেন হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে পড়ল। বিব্রতকর একটা পরিস্থতির সম্মুখীন হলাম।

তবে পরিবারের যথেষ্ট সাপোর্ট পাচ্ছি এটাই বড় বিষয়। কে কী বলল সেটা গায়ে লাগানোর প্রয়োজন মনে করছি না। কিন্তু অরন্য কোথায়। অরন্য কী কোথাও ইচ্ছা করে লুকিয়ে পড়েছে নাকি গায়েব হয়ে গেছে বুঝতে পারছি না। চিন্তা যেন গ্রাস করছে আমাকে। সারাদিনের ব্যস্ততা সে সাথে এসব চিন্তা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। বাসার সবাই নিস্তব। তাদের মুখেও চিন্তার ছাপ। আমি ঘরে বসে আছি। এ জীবন থেকে মুক্তির পথ খুঁজছি। যতই বিষয়টা সহজ করার চেষ্টা করছি ততই জটিল হয়ে যাচ্ছিল।

রাতটা কোনোরকম কাটিয়ে দিলাম।।সোহান দু বার কল দিয়েছিল। ইচ্ছা করেই ধরে নি। সকাল সকাল উঠে বাইরে হাঁটতে গেলাম। সকালে হাঁটলে মন মানসিকতা শান্ত হয়।

রাস্তাটা বেশ শান্ত। দু একটা টঙের দোকান খোলেছে সবে। হালকা বাতাস আসছে। এ বাতাসে হাঁটতে বেশ ভলো লাগছে। একাকীত্ব টাকে বেশ উপভোগ করছিলাম। এর মধ্যেই মনে হলো কেউ একজন মুখ চেপে ধরল। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম অরন্য। আমার গা হাত পা কাঁপতে লাগল। আমি কিছুটা জোর খাটিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিলাম। তবে বলতে পারছিলাম না। হাতে আর মুখে এমন ভাবে ধরেছে যে নড়তে পারছিলাম না। পুরো রাস্তাটা ফাঁকা। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে এত নীরব রাস্তায় চলে এসেছি খেয়াল নেই। আর এ শহরে জোরে চিৎকার দিলেও কেউ সহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে না। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। এমন সময়..

চলবে?

প্রাক্তন পর্ব-১৭

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৭

সারাদিন আর রাত এসব ভাবনাতেই কেটে গেল। পরদিন সকালটা শুরু করলাম নতুন ঘটনার সূত্রপাত দিয়ে।

সকালে উঠেই আমি নিজেকে সামলে নিলাম। আকাশটা হালকা মেঘাচ্ছন্ন। কখনও মেঘ কখনও রুদ্দুরের খেলা করছে। কখনও বা অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে পরক্ষণে ধমকা বাতাস দিয়ে সবকিছু আলোকিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার মনের ভেতেরের খেলাটায় বাহিরে হচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি আরেকবার মনে হচ্ছে আশার আলো খুঁজে পাচ্ছি।

জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম। এমন সময় মা আসলো। এসেই আমার দিকে এগিয়ে বলল

– জানালা দিয়ে বাতাস আর এত ধূলো আসছে তুই জানালা খুলে রেখেছিস কেন? কী রে অপ্সরা তোর হয়েছে টা কী?

আমি মায়ের দিকে তাকালাম। চোখে জল তখন টলমল করছিল। এই বুঝি জলটা গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে। বুঝতে পারছি না কী করব। মাকে হুট করে জড়িয়ে ধরলাম। গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মা আমাকে টেনে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল

– কী রে… হয়েছে কী তোর? এ কয়েকদিন যাবত তোকে বেশ আনমনা লাগছে। কী হয়েছে বল তো।

আমি হালকা গলায় বললাম

– মা কখনও যদি তোমার মেয়ে তার ভালোর জন্য কোনো স্টেপ নেয় তুমি কী কষ্ট পাবে?

– তোর ভালো হবে এটা তে কষ্ট পাওয়ায় কিছু নেই। তোর কী হয়েছে বলবি?

– এখন বলতে পারছি না। কিছু কাজ বাকি। কাজগুলো করেই বলব।

– আবিরের সাথে কিছু হয়েছে?

মায়ের মুখে কথাটা শুনে হুহু করে কেঁদে উঠলাম। মা আমাকে ধরে বলল

– কী হয়েছে তোর? বল কিছু একটা।

আমি চোখটা মুছতে মুছতে বললাম

– কারও সাথে কিছু হয় নি। তবে মা আবিরের সাথে আমার বিয়েটা হচ্ছে না।

মা আমার দিকে তাকিয়ে আরও আড়ষ্ট হয়ে বলল

– এ বিয়ে ভাঙলে মানুষ কী বলবে মা। তুই হুজুগের বশে কোনো সিদ্ধান্ত নিস না।

– মা তোমার মেয়ের প্রতি তোমার কোনো ভরসা নেই? তোমার মনে হচ্ছে আমি হুজুগে এমন করছি? মা গো তুমি কী মানুষের কথা নিয়েই পড়ে থাকবে নাকি মেয়ের ভেতরে বয়ে যাওয়া কষ্টের নদীর গভীরতাটা পরিমাপ করবে। একটা বিয়ে ভাঙ্গার পেছনে অবশ্যই কারণ আছে। তোমাকে আমি কিছুই এখন বলব না। তবে চাই তোমরা পাশে থাকো। এমন হইয়ো না যেখানে বিয়ে বিয়ে করতে গিয়ে আমাকেই হারিয়ে ফেললে।

– দেখ এ চার বছর তোকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছি। বিয়ে করতে চেয়েছিস আবিরকে আমরা রাজি হয়েছি। সবাই জানে তোর এনগেজমেন্ট হয়েছে এখন বিয়ে ভাঙলে প্রতিটা মানুষ তোকে টেনে কথা বলবে। এ পাড়ার মানুষ তো তোর আগের ঘটনা জানে। তাদের মুখ আটকাবি কী করে। সবাই বলে মেয়েকে বেশি স্বাধীন করে আমি ভুল করেছি। যতই তুই চাকুরি কর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তোকে কেউ মূল্যায়ন করবে না। তোর দোষ খুঁটিয়ে বের করবে। এ বিয়েটা ভেঙ্গে গেলে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। মারে এমন করিস না। ঝামেলা টুকিটাকি হবেই। তাই বলে বিয়ে ভেঙ্গে দিবি। সমাজ নিয়ে চলতে হয়। সমাজের কথাটাও ভাব।

মায়ের কথা শুনে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল। যদিও এটা পুরোপুরি মায়ের দোষ না। একটা মেয়ের ২৫ পার হয়ে গেলেই সবার কানাকানি শুরু হয় মেয়েটা বিয়ে কেন করছে না। তখন পরিবারও বিবেকহীন হয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। সমাজ তখন পরিবারের মানুষ গুলোকেও পাগল করে দেয়। মস্তিষ্ক বিকৃত ঘটায়। এই তো কিছুদিন আগে খবরের কাগজে দেখালাম মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না বলে মা মেয়েকে খুন করে ফেলেছে। সেটার একটা মূখ্য কারণ হলো এ সমাজ। সমাজের মানুষ গুলো মেয়েদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে,এত এত কথা বলা শুরু করে যে তখন মেয়ের পরিবারও বুঝে উঠতে পারে না কী করবে। কখনও মাথা চাপড়ায় কখনও বা বুক চাপাড়াতে থাকে। এর মধ্যে কিছু মানুষের ঘটে মানসিক বিকৃতি। তখন সে কি করে ফেলে সে নিজেও টের পায় না। তাই তখন জঘন্য কাজ করতেও তার বিবেকে বাঁধে না। এখন মায়ের সাথে উগ্র আচরণ করলেও সেটা হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। আমি মাকে ধরে খাটে বসালাম। তারপর বললাম

– মা আমার বিয়ে হয়ে ডিভোর্স হয়ে গেলে তুমি মানতে পারবে?

– এসব কথা কেন বলছিস?

– কারণ আছে। বলো মানতে পারবে কী না।

– না, পারব না।

– আমাকে কী জেনে শুনে কোনো চরিত্রহীন ছেলের হাতে তুলে দেবে? বা এমন কোনো ছেলে যাকে তুমি বিয়ের আগেই জানো তোমার মেয়েকে সে কষ্ট দেবে তখন কী তুমি মেয়ের সুখের কথা ভাববে নাকি সমাজের কথা ভেবে সে ছেলের সাথে বিয়ে দিবে। ঠান্ডা মাথায় উত্তর দাও।

– অবশ্যই আমার মেয়ের সুখ আগে।

– তাহলে মা এখানেই থাকো। আমি এখন থেকে যা যা করব সুখে থাকার জন্য। তুমি শুধু সময়ে অসময়ে পাশে থেকো। আবিরের সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে না। এটার কারণ ও জানতে পারবে। আপাতত বিষয়টা সবাইকে বলার দরকার নেই। আর শুনো রিজিক যেখানে থাকে সেখানেই বিয়ে হবে চিন্তা করো না। ৪০ বছর বয়সী মেয়েদেরও বিয়ে হচ্ছে। আর আমার বয়স ২৭ পার হলো। তবে এত চিন্তা কেন? আমাকে যে রাজপুত্র আর অনেক যোগ্য ছেলে বিয়ে করতে হবে তা’ না। আমি এমন কাউকে বিয়ে করব যে সাবলীল,সাধারণ আর ভালো। আমি তোমাকে আস্তে আস্তে সব বলব। শুধু এটাই কামনা করি কখনও ভুল বুঝবে না। এবার আমার জন্য নাস্তা বানাও একটা কাজ আছে কাজে যাব।

মা আর কোনো কথা বলল না। হয়তো মায়ের বিষয়টা বোধগম্য হয়েছে হয়তো হয়নি। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আলমিরাটা খুলে সবচেয়ে সুন্দর শাড়ি বের করলাম। আজকাল নিজেকে গুছিয়ে রাখার একটা প্রবণতা ঝেঁকে বসেছে। শাড়িটা বের করে পরে নিলাম। নিজেকে পরিপাটি করে কলেজে কল দিয়ে ছুটি নিলাম।

তৈরী হয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে পেট পুরে খেয়ে নিলাম। যদিও খেতে ইচ্ছা করছে না তবুও জোর করে খেয়ে নিলাম। বাসা থেকে বের হয়েই থানায় গেলাম।

সেখানে গিয়ে লক্ষ্য করলাম সোহান বসে আছে। আমি ওকে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হলাম। ওকে দেখেও আমি তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। কিছুটা না দেখার ভান করেই পাশের একটা চেয়ারে বসলাম। এর মধ্যেই ও বলে উঠল

– আরে অপ্সরা না তুই? একদম বদলে গেছিস। আগের আর বর্তমানে তেমন কোনো মিল নেই। আমি তো চিনতেই পারছিলাম না। তবে কপালের পাশে কাটা দাগ দেখে নিশ্চিত হলাম এটা তুই। কেমন আছিস?

আমি হালকা হেসে বললাম

– ভালো তুই?

ওহ বলে নিই। সোহান হলো আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। স্কুল কলেজ আমরা এক সাথেই পার করেছি। আমি কোনো ছেলের সাথে কথা না বললেও সোহানের সাথে বলতাম। কিন্তু অনার্সে উঠার পর অরন্য পছন্দ করত না তাই সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলাম। এতদিনে ওকে আমি ভুলেই গেছিলাম। আজ হঠাৎ তাকে থানায় দেখে একটু চমকালাম। সে হালকা হেসে বলল

– ভালো। তা থানায় কী জন্য?

– একটা জিডি করব।

– কিসের?

– একটু ব্যক্তিগত। বলতে পারছি না। তা তোর দিন কেমন চলছে কোথায় আছিস?

– এই তো আছি ভালোই।

– কী করছিস?

– বাবার ব্যবস্যাটায় দেখছি। আর তুই তো কলেজে আছিস তাই না?

– তুই জানলি কী করে? আর বুয়েটে পড়ে জব না করে ব্যবস্যা করছিস কেন?

– তুই ভুলে গেলেও আমি তোর খু্ঁজ মাঝে মাঝে নিই। আর অন্যের অধীনে চাকুরি আমার মোটেও পছন্দ না।

আমি হালকা হেসে বললাম

– বাপের টাকা আছে তাই ভালো লাগে না অন্যথায় চাকুরি ছাড়া উপায় ছিল না। তা কী জন্য এখানে?

– বাসায় ডাকাতি হয়েছে গতকাল।

– কী বলিস। কী কী নিয়ে গেল?

– তেমন কিছু তো ছিল না। তবে ২৫ ভরির মতো মায়ের গয়না ছিল আর ৪ লাখ ক্যাশ টাকা ছিল।

– ভালোই তো নিয়ে গেছে তাহলে। কে বা কারা করতে পারে ধারণা আছে?

– ঐরকম সন্দেহ তো কাউকে আপাতত করতে পারছি না, দেখি কী করা যায়। য়দিও আমার কাজ শেষ। তবে তোকে বাইরে দেখেই বসে ছিলাম যাতে এড়িয়ে যেতে না পারিস। হুট করে কী এমন হলো সেই যে তুই কথা বলা বন্ধ করলি আর কোনো খুঁজ নেই।

সোহানের প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। কারণ যে মানুষটার জন্য তাকে আমি ছেড়েছিলাম সে মানুষটার জন্য আজকে থানায় এসেছি। আমার নীরবতা দেখে সোহান বলে উঠল

– হয়েছে উত্তর লাগবে না৷ ভালো থাকিস। আর তোর আইডিতে এখনও ব্লক লিস্টে হয়তো পড়ে আছি। আর ফোন নম্বরটা আছে তবে কল দেয়ার সাহস পাই নি। বরাবরেই তুই রাগী কী থেকে কী বলিস তাই৷ ভালো থাকিস।

– হুম আচ্ছা।

আর কোনো কথা এগুলাম না। ছেলে মানুষ দেখলেই কেন জানি না স্বার্থপর মনে হয়। সোহান বের হয়ে গেল। আমিও জিডি করে খানিক পর থানা থেকে বের হয়ে উকিলের কাছে গেলাম। উদ্দেশ্য অরন্যকে ডিভোর্স দেওয়া। ডিভোর্সের কাজটা আগে সাড়তে হবে। ডিভোর্সের সকল ব্যবস্থা করে বাসায় আসলাম। আগামি সপ্তাহে এ সম্পর্ক থেকে নিজেকে মুক্ত করব। অরন্য আর আবিরের অফিসে অভিযোগ দেওয়ার ব্যবস্থাও করে আসলাম। আজকে বেশ শান্তি লাগছে। নিজের অজান্তেই মনে হলো এক বড় পাথর বুকের উপর থেকে নেমেছে।

কাজ শেষে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। হুট করেই গর্জন দিয়ে বৃষ্টি নামা শুরু করল। আমি আমার ব্যাগটা মাথার উপরে ধরে দৌড়ে এক দোকানের নীচে দাঁড়ালাম। এর মধ্যেই সোহান আমার সামনে হাজির। সোহানকে দেখে পুনরায় অবাক হলাম। সে কি আমাকে অনুসরণ করছে নাকি অন্য কিছু। সোহানকে সামনে দেখেও আমি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করলাম না৷ সোহানেই হালকা কাশি দিয়ে বলল

– আবারও দেখা হয়ে গেল। তা এতক্ষণ কোথায় ছিলি। কোনো সমস্যা?

আমি বৃষ্টির পানিটা শাড়ি ধরে হাত দিয়ে মুছতে মুছতে বললাম

– কোনো সমস্যা নেই। কেন কিছু বলবি?

– নাহ। দেখলাম উকিলের কাছে গিয়েছিস।

আমি কিছুটা রাগী গলায় উত্তর দিলাম

– তুই কী আমাকে অনুসরন করছিস?

সোহান জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল

– তা কেন হবে। দেখলাম তাই বললাম। কিছু হয়েছে কী?

– কিছু না হলে তো উকিলের কাছে যেতাম না।

– বলা যাবে কী?

– বলা যাবে না কেন? ডিভোর্সের জন্য গেছিলাম।

সোহান কথাটা শুনে মুখটা কালো করে ফেলল। এরকম একটা উত্তর সে আশা করে নি। ফ্যাকাশে মুখে বলল

– তোর বিয়ে কবে হলো আর ডিভোর্সেই বা কাকে দিচ্ছিস।

সাবলীল কন্ঠে জবাব দিলাম

– বিয়ে হয়েছে চার বছর আগে এখন ডিভোর্সের প্রয়োজন তাই ডিভোর্স দিচ্ছি।

– কাকে বিয়ে করেছিস শুনলাম না তো।

– অরন্যকে।

আমার উত্তর শুনে সোহানের মুখটা আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বিস্মিত কন্ঠে বলল

– কিন্তু যতদূর জানি অরন্য অন্যত্র বিয়ে করেছে। তুই কী হেয়ালি শুরু করলি নাকি।

– হেয়ালি না সত্যি। আর জটিল সম্পর্ক সরল করার জন্যই এ ডিভোর্স। আর সবকিছু বুঝতে চাওয়াও উচিত না। ৭-৮ বছর তোর সাথে যোগাযোগ নেই এত দিনের কাহিনি তো একদিনে বুঝে যাবি না। যাইহোক বৃষ্টি কমেছে আমি গেলাম।

– যদি কিছু মনে না করিস আমি পৌঁছে দিই। তোদের কী আগের বাসাটায় নাকি পরিবর্তন করেছিস।

– বাসা পরিবর্তন করেছি অনেক আগেই। আর ধন্যবাদ কোনো সাহায্যের আমার প্রয়োজন নেই। ভালো থাকিস।

বলেই রাস্তায় এসে একটা রিকশা ভাড়া করে বাসায় আসলাম।

ভেজা শাড়িটা পাল্টে নিলাম। শুকনো কাপড় পরে ভেজা চুল গুলো চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতে লাগলাম। নিজের মধ্যে প্রশান্তি কাজ করছে যে আমি এখন নিজেকে শক্ত করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছি এটা ভেবে।

চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতেই কলিং বেলের শব্দ পেলাম। মা দরজা খুলে আমার রুমে এসে বলল

– কে জানি এসেছে তোর সাথে দেখা করতে। আমি ভাবলাম হয়তো সোহান এসেছে। কিন্তু সোহানকে তো মা চেনার কথা।

কিছুটা অনিশ্চয়তা নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে আঁৎকে গেলাম। কারণ সোহান আসে নি। যে এসেছে তাকে দেখে ভাবতে লাগলাম নতুন নাটকের সূচনা হবে নাকি আবার?

চলবে

প্রাক্তন পর্ব-১৬

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৬

মোবাইল খুলতেই আমার চোখ কপালে উঠল। কারণ আবিরের মেসেন্জারে সাহেরা নামে এক মেয়ে মেসেজের উপর মেসেজ দিয়েই যাচ্ছে। আমি মেসেজ গুলো যতই ঘাটছিলাম ততই আমার বুকে কম্পন হতে লাগল। বুঝতে পরলাম আবিরের সাথে এই মেয়ের সম্পর্ক দীর্ঘ তিন বছরের। মেয়েটার লাস্ট মেসেজ গুলো ছিল

– অপ্সরার ঝামেলা কবে শেষ করবে। অরন্যের জন্য আর কত করবে। এসব একদম ভালো লাগছে না। অরন্যকে সাহায্য করতে গিয়ে তুমি আমার মনে অনিশ্চয়তা ঢুকাচ্ছ। এ ৫ মাস যাবত আমি অনেক সহ্য করেছি আর করতে পারব না। হাত, পা ভাঙ্গার নাটক আর কত করবে? এভাবে শুয়ে বসে থেকে আর কত কী করবে? অরন্যকে ঘরে লুকিয়ে রেখে অপ্সরাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছো। তোমার মা তো কিছুই জানে না ভালো আর মন্দ। উনি তো ভেবেই নিয়েছে তুমি অপ্সরাকে পছন্দ করো। পরে তোমার মাকে কী বুঝাবে? আদৌ কী অপ্সরাকে অরন্য বিয়ে করবে নাকি তুমি৷ কী হলো মেসেজ সিন করে যাচ্ছ রিপ্লাই কেন দিচ্ছ না।

আমি মেসেজ গুলো পড়ে সামনে তাকাতেই দেখলাম আবির দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে আবির অসুস্থতার নাটক করেছিল এতদিন। সে আমার হাত থেকে মোবাইলটা টেনে নিয়ে বলল

– একদম বাড়াবাড়ি করবে না।

আমি আবিরের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে কোনো কথায় আমার বের হচ্ছিল না। কোন খেলায় ফেঁসে গেলাম আমি নিজেও টের পেলাম না। বিশ্বাসের খাতায় আবারও ভাঙ্গন ধরল। আমার নীরবতা যেন আমাকে ঘিরে ধরল। আবির এত বড় নাটক করল। আমি আবিরের দিকে তাকিয়ে কেঁদেই দিলাম। হালকা গলায় বললাম

– তুমি অসুস্থ না? আর সাহেরা মেয়েটা কে? কেন তুমি এসব নাটক করেছো আমার সাথে? তুমি আর অরন্য প্ল্যান করে এমন করেছো? আমার সব প্রশ্নের উত্তর চাই।

আবিরের মুখে ঘন কালো মেঘের আভা ফুটে উঠেছে। মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে চিন্তিত। জানতাম আবির সহজে মুখ খুলবে না। তাই আবিরকে নাড়া দিতে বললাম

– তুমি কী সহজে মুখ খুলবে নাকি তোমার নামে মামলা করব? তোমার অফিসে লিখিত অভিযোগ দিলে কিন্তুু তোমার চাকুরী থাকবে না। আশা করি তুমি সত্যিটা বলবে। আর না বলতে চাইলেও জোর নেই। বাকিটা আমি ব্যবস্থা করতেছি। যেমন কুকুর তেমন মুগুর আমি দিতে পারি। কুকুর কামড়ালে কুকুরকে কামড়ানো ঠিক না তবে একটা মুগুর দিয়ে আঘাত করে কুকুরকে তার স্থানটা বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। যতটা আবেগী আর সহজ সরল ভাবো ততটা আমি না। এ নাকফুলটা অরন্যের আমি নিশ্চিত হওয়ার পরও বাড়াবাড়ি করে নি। কারণ আমার হাতে প্রমাণ দরকার ছিল।

আবির ঢুক গিলতে লাগল। বেশ ভয় পেয়ে গেছে বুঝায় যাচ্ছে। কারণ প্রতিষ্ঠিত ছেলের দুর্বল জায়গা তার চাকুরি আমি তার সে জায়গায় নাড়া দিয়েছি। অবশ্য যা বলেছি ভয় দেখানোর জন্য না সম্পূর্ণ সত্যি। আবির হালকা গলায় বলল

– অরন্যের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে তোমার কথা বলত। আমি তোমাকে চিনতাম,ছবিও দেখেছি। মা তোমার ব্যপারে জানত তবে তোমাকে চিনত না। মা এসবের কিছুই জানে না। অরন্য এ তিন বছর তোমার খুঁজ নিয়ে গেছে৷ অরন্য জানত তুমি এ পর্যন্ত কোনো বিয়েতে রাজি হও নি। কিন্তু নাফিসাকে ডিভোর্স ও দিতে পারছিল না তাই তোমার সামনেও যেতে পারছিল না৷ অরন্য আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। আমি ওর কাছে ঋণী। এদিকে তোমার পরিবার একের পর এক পাত্র দেখেই যাচ্ছিল। অরন্য বেশ অনিশ্চয়তায় ছিল। কিন্তু নাফিসার সাথে ডিভোর্স হয়নি তাই তোমার সামনেও যেতে পারছিল না। কাকতালীয় ভাবে তোমার সাথে আমার এক্সিডেন্ট হয়। সেখান থেকেই আমাদের পরিকল্পনা শুরু। অরন্য চেয়েছিল তোমার বিয়ে যেন না হয় তাই আমি তোমার সাথে কথা বলে গেছি। আর এনগেজমেন্ট এর দিন ইচ্ছা করেই অরন্যকে দিয়ে আংকটি পড়িয়েছি। অরন্য জানত যে তোমার অতীতটা সামনে নিয়ে আসলে তুমি সবটা আমাকে বলবে। আর আমি সেই সুযোগে তোমাকে ছেড়ে দিব৷ সে সময়টায় অরন্য তোমার জন্য পাগলামি করবে। মানুষ একটা ধাক্কা পুনরায় খেলে সে আগের জায়গায় চলে যায়। আমরা ভেবেছিলাম তুমি আমার থেকে একটা ধাক্কা খেলে অরন্যকে মেনে নিবে৷ তাই বিয়ে পেছানোর জন্য এত নাটক করতে হয়েছিল আর তোমাকে মেনে না নেওয়ার পেছনেও এ কারণ ছিল। কিন্তু তুমি পুরো খেলাটা পাল্টে দিলে যখন এতকিছুর পরও অরন্যকে মেনে নিলে না।

তোমার জন্য পুরো খেলাটা পাল্টাতে হলো। আমি পুনরায় তোমাকে মেনে নেওয়ার নাটক করলাম। উদ্দেশ্য ছিল ডিভোর্সের নাম করে অরন্যকে বিয়ের কাগজটা পুনরায় পাকা পুক্ত করব। আমি দুঃখিত অপ্সরা। তোমার সাথে আমার ব্যক্তিগত কোনো আক্রোশ নেই। যা করেছি সেটা শুধু অরন্যের জন্য। আমি অরন্যকে তোমার জন্য কষ্ট পেতে দেখেছি। জানি না ঠিক করেছি নাকি ভুল। তবে অরন্যকে ভালো রাখতে এটুকু করা। এই যে আমি আজকে দাঁড়িয়ে আছি সেটাও অরন্যের জন্য।

আর সাহেরা আমার গার্ল ফ্রেন্ড। আমি বিয়ে করলে ওকেই করব। তিন বছরের সম্পর্ক আমাদের। শুধু অরন্যের জন্য বিষয়টা পিছিয়েছি। অরন্য আর তোমার বিয়ে টা হলেই আমি বিয়ে করে নিতাম। অপ্সরা অরন্যকে আর ফিরিয়ে দিও না। এই যে আমরা এতকিছু করেছি সেটা শুধু তোমাকে আর অরন্যকে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য। আর মা ও কিছু জানে না। আমার মা অনেক সহজ সরল।।দয়াকরে মাকে কিছু বলো না। আমি চাই তুমি আর অরন্য এক হয়ে যাও।

আরও কিছু বলতে নিবে আবির, আমি সুযোগ না দিয়ে আবিরের গালে জোরে চড় দিয়ে বললাম

– তোরা একেকটা কুত্তা। আমার সাথে যা করেছিস। তোদের প্রত্যেককে উপযুক্ত শাস্তি আমি দিব। অরন্য কোথায় বল।

আবির আমার রাগী কন্ঠ শুনে ঢুক গিলতে লাগল। কিছু বলছে না। আমি তার দিকে তাকিয়ে জোর গলায় পুনরায় বললাম

– অরন্য কোথায়?

– পাশের রুমে।

আমি আবিরের কাছ থেকে বের হয়ে পাশের রুমে গেলাম। অরন্য তখন ঘুমুচ্ছিল। ঘরের কোণে থাকা জুতো জোরার একটা জুতো পা দিয়ে চেপে ধরে দরজাটা লাগিয়ে অরন্যকে হালকা গলায় বললাম

– অরন্য উঠো। সমস্ত কাহিনি জেনে আমি তোমাকে মেনে নিছি। আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

অরন্য ঘুম থেকেই উঠেই হালকা হেসে বলল

– আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?

– কেন কী মনে হচ্ছে?

– মনে হচ্ছে মধুর স্বপ্ন দেখছি।

– এখন মনে হবে তুমি দুঃস্বপ্ন দেখছ।

– মানে?

কথাটা বলতেই আমি পায়ে চেপে রাখা জুতোটা হাতে নিয়ে এলোপাতারি কয়েকটা মেরে বললাম

– কু্ত্তার বাচ্চা,শুয়োরের বাচ্চা তোরা আমার সাথে যা করেছিস এর ফল তোদের পেতে হবে।

রুম থেকে বের হয়ে চলে আসলাম। আবিরের মা তখন বাসায় ছিল না। বাসায় এসেই দরজাটা লাগিয়ে ধুপ করে বসে পড়লাম। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এত বড় নাটকের নায়িকা হলে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। আমি দম নিতে লাগলাম। প্রতিটা মানুষকে আমি উপযুক্ত শিক্ষা দিব । এদের শাস্তি পেতেই হবে। তানা হলে এরা আরও জঘন্য হবে। যে ক্ষমতার জন্য আজকে এদের এত বড়াই সেটাই আমি কেড়ে নিব। মনে মনে কথাটা ভেবেই মাথায় গুজে থাকা ফুল গুলো টেনে বের করলাম। ছিড়ে ফেলে দিলাম মেঝেতে। শাড়িটা খুলে চোখগুলো মুছে ধুয়ে নিলাম। নিজেকে সামলে নিলাম। কারণ আমাকে লড়াই করতে হবে আর নতুন লড়াই এ জিততে হবে।

সারাদিন আর রাত এসব ভাবনাতেই কেটে গেল। পরদিন সকালটা শুরু করলাম নতুন ঘটনার সূত্রপাত দিয়ে।

চলবে

প্রাক্তন পর্ব-১৫

0

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৫

এমন সময় ফোনে অচেনা নম্বর থেকে কল আসলো আমি কলটা ধরতেই একটু বিস্মিত হলাম। কারণ কলটা দিয়েছে নাফিসা। নাফিসা কলটা ধরতেই জিজ্ঞেস করলো

– অরন্য কোথায়? অরন্যকে কোথায় গুম করেছো বলো।

বেশ রাগী গলায় জবাব দিলাম

– আমি কী করে জানব অরন্য কোথায়। আর এভাবে কথা বলছেন কেন? আমি কী কোনো চুর ডাকাত নাকি যে, জলজ্যান্ত একটা মানুষকে গুম করে দিব?

– তোমার সাথে কথা বলার পর থেকেই অরন্যের ফোন বন্ধ। যখনই শুনেছো আমি অরন্যের জীবনে ফিরতে চাই তখনই আমার জীবন থেকে অরন্যকে দূরে সরাতে তাকে গুম করে দিয়েছো?

– আপনার জীবনে আপদ টা চলে গেলে আরও খুশি হতাম। দুঃখের বিষয় আপদটা এখন আমার ঘাড়ে চেপে ধরতে বসেছে। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচি আপনি আর অরন্য এক হলে। তাড়াতাড়ি দেশে এসে আপদ নিয়ে যান। আপদকে খুঁজে বের করে নিজের করে নেন। শুধু শুধু আমাকে কল দিয়ে আপনার মূল্যমান সময় নষ্ট করবেন না। কারণ আমি অরন্যের খুঁজ জানি না। আর আমার কোনো ঠেকাও পড়ে নি অরন্যকে লুকিয়ে রাখা। আর অরন্য কোনো বাচ্চা না যে চকলেটের লোভ দেখিয়ে লুকিয়ে রাখব।

নাফিসা আমার কথা শুনে হালকা হেসে বলল

– তোমাদের মতো মেয়েদের চকলেটের লোভ দেখাতে হয় নাকি, শরীর আছে কী করতে। কীভাবে একটা বিবাহিত ছেলে পটিয়ে নিজের করতে হয় সেটা তো ভালোই জানো। লোভ দেখিয়ে হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা।

নাফিসার কথা শুনে শরীরটা রাগে কাঁপছিল। তবুও একটা হাসি দিয়ে বললাম

– আমিও দেখেছি কীভাবে স্বামী রেখে বিদেশ চলে যেতে হয়। আর বাকি রইল আপনার স্বামী। তার চরিত্রের উপর এটুকু ভরসাও আপনার নেই। অরন্যের চরিত্র এতই নড়বড়ে যে একটা মেয়ের সামান্য লোভ দেখানোতে নষ্ট হয়ে যাবে। এমন স্বামী বাঁধাই করে রাখেন। আপনার স্বামীর চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। আর আপনার চরিত্রের ব্যখা নাহয় নাই দিলাম। কারণ সেটা আপনিই ভালো জানেন। আপনাকে তুলনা করার কোনো উপমা পাচ্ছি না তাই চুপ রইলাম।

নাফিসা রেগে কঠোর গলায় বলল

– একদম উল্টা পাল্টা কথা বলো না। মুখ সামলে কথা বলো।

– আমি বললেই দোষ আর আপনি যখন বললেন? আর আপনাকে তুমি বলার অধিকার বা পারমিশন কে দিছে। আমাকে আপনি করে বলবেন। আর দ্বিতীয় বার কথা বললে ভেবে বলবেন। আপনি বলে যাবেন আর আমি ছেড়ে দিব এটা একদম ভাববেন না। অবলা নারী আমি না। নিজের সাথে লড়াই করে সংগ্রাম করে বড় হয়েছি। কীভাবে কোনটা সামলাতে হয় সেটার যথেষ্ঠ জ্ঞান আমার আছে। অরন্যকে পাচ্ছেন না দেশে এসে থানায় যান। থানায় জিডি করুন,মামলা করুন। আমাকে কল দিয়েছেন কেন? আমি তো হারানো মানুষ ফিরিয়ে দেওয়ার এজেন্সি খুলে বসে নি। আর একবার যদি কল দিয়ে বিরক্ত করা হয় সরাসরি থানায় গিয়ে হ্যারেসমেন্টের মামলা করব। মাথায় রাখবেন বিষয়টা।

নাফিসার রাগটা আরও প্রবল হলো। রাগে আর জোরে চেঁচিয়ে বলল

– তোমার সাহস তো কম না যা’ তা বলছো।

আমি কথা আটকে দিয়ে বললাম

– এখনও তো বলা শুরু করি নি। ভালোভাবে বলা শুরু করলে টিকতে পারবেন না। রাতের ঘুমও হারাম হয়ে যাবে। এর চেয়ে বরং ফোনটা কেটে শান্ত হয়ে বসে সমাধান বের করুন। অরন্যকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। ভালো থাকবেন।

বলেই কলটা কেটে দিলাম। জানি না তারপর নাফিসার কী হয়েছিল। কল কাটার আগে রাগী রাগী নিঃশ্বাস নেওয়ার শব্দ পাচ্ছিলাম শুধু। কিন্তু অরন্য কোথায় আছে সেটাও ভাববার বিষয়। হুট করেই বা সে কোথায় গেল। আজকাল সবকিছুতে অদ্ভুত রহস্য খুঁজে পাই। না চাইতেও যেন রহস্যে জড়িয়ে যাই। নাকফুলটা হাতে নিলাম আবার। যতবারেই নাকফুলটা এপিট ওপিট করে দেখছিলাম ততবারেই মনে হচ্ছিল এটা অরন্যের সেই নাকফুলটা যেটা ও আমাকে ওর সাথে এনগেজমেন্ট হওয়ার পর দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী তে বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ায় আমার পরিবার তা ফেরত দিয়েছিল। একই ডিজাইনের দুটো নাকফুলের এতটা মিল মানতে পারছি না। কেন জানি না মনে হচ্ছে আমি কোনো ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছি। নাক ফুলটা ধরেই হাজারটা কথা ভাবছিলাম। এমন সময় ভাবি এসে ধাক্কা দিয়ে বলল

– কী ব্যপার ননদীনি নাক ফুল হাতে নিয়ে কোন জগতে হারালে। এত কী ভাবছো? নাকি আবিরের সাথে কল্পনায় রোমান্স করছো?

ভাবির কথা শুনে ভাবনার জগত থেকে বের হলাম। হালকা হেসে বললাম

– আরে কী বলো না ভাবি। তেমন কিছু না। নাকফুলটা দেখছিলাম।

ভাবি আমার হাত থেকে টেনে নাকফুলটা ভাবির হাতে নিয়ে দেখে বলল

– এটা তো ডায়মন্ডের নাকফুল। তবে নাকফুলের নীচের দিকে ডাটায় এত এলোমেলো দাগ কেন?

ভাবির কথাটা শুনেই আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। আমি ভাবির হাত থেকে নাকফুলটা নিয়ে নাকফুলের নীচের দিকে তাকালাম। আর বুঝতে পারলাম এটা অরন্যের নাকফুলেই। কারণ অরন্য নাকফুল দেওয়ার পর, ডাটা টা বড় হওয়ায় আমি ছুরি দিয়ে কেটে ছোট করতে চেয়েছিলাম তাই ডাটার নীচের দিকটায় বেশ কয়েকটা দাগ পড়েছিল তবে কাটতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। বুঝতে আর বাকি রইল না এটা সেই নাকফুল। আর আমার সাথে যা হচ্ছে সেটা একটা খেলা। এ খেলার মূখ্য গুটি আমি যাকে বারবার চেক দিচ্ছে সবাই। আমার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আমার আঁধারে নিমজ্জিত মুখটা দেখে ভাবি বলল

– কী হলো তোমার? কথায় কথায় কোন জগতে চলে যাও। তোমাকে বড্ড অচেনা লাগে। বিয়ের পর থেকে কখনও তোমাকে এভাবে দেখে নি। কী হয়েছে বলো তো অপ্সরা। কিছু নিয়ে কী চিন্তা করছো?

আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম

– না তেমন কিছু না। এটা আবিরের মায়ের নাকফুল তাই হয়তো এমন দাগ পড়েছে। এখন তৈরী হয়ে আবিরদের বাসায় যাব। এসে তোমার সাথে কফি খেয়ে আড্ডা দিব কেমন?

– আচ্ছা যাও আর সাবধানে। আর নাকফুলটা দাও তো।

– কেন?

– আরে দাও তো।

বলেই হাত থেকে নাকফুলটা নিয়ে আমার নাকে পরিয়ে দিয়ে বলল

– হবু শ্বাশুড়ি নাক ফুল দিয়ে গেছে তাদের বাসায় নাকফুল না পড়ে গেলে কেমন দেখাবে বলো। এখন সুন্দর লাগছে। পরীর মতো সুন্দরী তুমি।

– একটু বেশি বেশি বলছো না।

বলেই হাসতে হাসতে ওয়াশরুমের দিকে এগুলাম। ওয়াশ রুমে গিয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখে কেন জানি না ভয় পাচ্ছিলাম। এ নাক ফুলটা পড়েছিলাম চার বছর আগে। নাকফুলটা পড়ার ১৫ দিন পরেই অরন্যের সাথে আমার বিয়ে ভেঙ্গে যায় সে সাথে জীবনে নেমে আসে কালো অধ্যায়। শুরু হয় অকৃত্রিম যন্ত্রণা। সেদিন নাকফুলটা পড়ে যতটা খুশি হয়েছিলাম আজ ঠিক ততটাই ভয় পাচ্ছি। অন্য কোনো অঘটন আমার জন্য অপেক্ষা করছে না তো? এ নাকফুলটা আবার আমার জীবনকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিবে না তো। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। চোখের পানিটা মুছে নিজেকে একটু শান্ত করে নিলাম। আামাকে আরও শক্ত হতে হবে। সবকিছু শক্ত হাতে মোকাবেলা করতে হবে। আবিরের কাছে গিয়ে অবশ্যই নাকফুলের রহস্য বের করতে হবে। এ বিয়েটা তো আমার প্রয়োজন না। তবে আবির নিজের ভুল স্বীকার করেছে বলেই আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু এর পেছনে যদি কোনো অজ্ঞাত কারণ থাকে আমি তাকে ছেড়ে দিয়ে কথা বলব না।

নিজেকে বুঝ দিয়ে মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে ওয়াশ রুম থেকে বের হলাম। সোনালী পাড়ের বেগুনী রঙের একটা শাড়ি আর সোনালী ব্লাউজ পড়লাম। মাথায় একটা খোঁপা করে বারান্দার টবে ফুটে উঠা চন্দ্রমল্লিকা ফুল এনে এক পাশে গুজে দিলাম। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর মুখে পাউডারের প্রলেপ দিলাম। চোখে গাঢ় কাজল। কানে বড় ঝুমকা। দু হাত ভর্তি করলাম কাচের চুড়ি দিয়ে। আজকে নিজেকে বেশি প্রাধান্য দিলাম। তারপর রুম থেকে বের হলাম। রুম থেকে বের হতেই মা আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দিল। মায়ের মনটা আমার এ সাজ প্রশান্ত করেছে বুঝতে পারছিলাম। আমি মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ভাবি এসে কানের কাছে বলে গেল আবির তো তোমায় দেখে চোখ ফেরাতে পারবে না। কথাটা শুনে আমি মৃদু হেসে বাসা থেকে বের হলাম।

সি এন জি নিয়ে আবিরের বাসায় চলে গেলাম। আবিরের বাসায় গিয়ে দেখলাম মা বাসায় নেই। বাসাটা পুরো ফাঁকা। আবিরের রুমে ঢুকলাম। আবির শুয়ে শুয়ে মোবাইল চাপছে। আবিরের পাশে বসতেই মোবাইলটা তাড়াহুড়ো করে সরিয়ে নিল। মনে হচ্ছিল চুরি করে ধরা পড়তে নিয়েছিল সে। আমি কিছুটা রহস্যের আভাস পেয়ে আবিরের হাত থেকে মোবাইলটা টেনে নিতে চাইলে সে দিতে চাইল না। এক পর্যায়ে বেশ জোর করেই মোবাইলটা টেনে নিই। মোবাইলটা নিয়ে আবিরের পাশ থেকে একটু দূরে যাই। মোবাইলে তেমন কোনো লক নেই। মোবাইল খুলতেই আমার চোখ কপালে উঠল। কারণ….

(চলবে)