Tuesday, July 1, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1476



পুতুল ছেলেটি পর্ব-০৯

0

#পুতুল_ছেলেটি
#Part_09
#Writer_NOVA

কফি হাউসে গোমড়া মুখে বসে আছে সাহিয়া।এই মুহুর্তে ওর যে কি পরিমাণ রাগ উঠছে একমাত্র ওই বলতে পারবে। বসে থাকতেও পারছে না আবার উঠে যেতেও পারছে না।ওর সামনে বকবক করেই যাচ্ছে তোরাব।সাহিয়ার এখন রাগ উঠছে ওর বোনের ওপর।সে তার হবু বরের সাথে দেখা করতে আসবে আসুক না।তাকে আবার জোর করে আনার কি দরকার।সে না আসলে তো এই তোরাবকেও সহ্য করতে হতো না।

তোরাবঃ সাহিয়া, এনি প্রবলেম?কখন থেকে দেখছি তুমি কিছুটা ছটফট করছো।ভাইয়া আর ভাবী ভেতরে আছে।তোমার যদি অসুবিধা হয় তাহলে আমি ডেকে আনি।(ব্যস্ত হয়ে)

সাহিয়াঃ আই এম ওকে মিস্টার তোরাব।আপনার ব্যস্ত হতে হবে না।এমনি একটু অস্বস্তি লাগছে। (মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে)

তোরাবঃ কি হয়েছে তোমার?কেন অস্বস্তি লাগছে? আমাকে বলো, আমি চেষ্টা করবো সলভ করার।

সাহিয়াঃ ইস,ঢং। এই ব্যাটার ঢং দেখে বাঁচি না।যত্তসব ন্যাকামো।এমন একটা ভাব দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে আমার বয়ফ্রেন্ড। ফালতু কাজ-কাম।(মনে মনে)

তোরাবঃ বললে না তোমার কেন অস্বস্তি লাগছে। আমি চেষ্টা করবো সেটা দূর করতে।

সাহিয়াঃ আমি যে গাউনটা পরেছি তাতে অনেক অস্বস্তি লাগছে। আপনি কি আমার গাউনটা পরবেন?আর আপনার শার্ট-প্যান্ট আমি পরবো।আসলে জামা-কাপড় এক্সচেঞ্জ করার কথা বলছি।

দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে একটা রাগী লুক দিলো সাহিয়া।তোরাব কিছুটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পরে গেল।এই মেয়ে যে এরকম কিছু বলবে তা ক্ষুণাক্ষরে টের পাইনি সে।তাই মুখটা চুপসে গেল তার।

সাহিয়াঃ কি মিস্টার, পারবেন না তো?তাহলে এখানে চুপ করে বসে থাকেন।একটা কথাও আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই না। (ধমকের সুরে)

সাহিয়ার ধমক শুনে তোরাব পুরো চুপ হয়ে গেল।সাহিয়া বিরক্তি সহকারে ওয়েটারকে ডাকলো।মোটামুটি ৫ ফুট ৮ ইঞ্চির কাছাকাছি একটা ছেলে সামনে এসে দাঁড়ালো। পরনের তার ওয়েটারের ড্রেস।সাহিয়া তার দিকে না তাকিয়ে মেনু কার্ড দেখে অর্ডার দিলো।

সাহিয়াঃ একটা কোল্ড কফি,আরেকটা ডার্ক কফি।তোরাব আপনি কি কোল্ড কফি খাবেন?দিদিয়ার থেকে শুনেছিলাম আপনি নাকি ডার্ক কফি ছাড়া অন্য কিছু খান না।তাই এটাই অর্ডার করলাম।

তোরাবঃ জ্বি আমি ডার্ক কফি ছাড়া অন্য কিছু খাবো না। আমার জন্য আর কিছু অর্ডার করতে হবে না।

সাহিয়াঃ এই দুটোই।আর কিছু লাগবে না।

—- Thanks ম্যাম।আপনারা একটু অপেক্ষা করেন। আমি নিয়ে আসছি।

শুদ্ধ বাংলার মনোমুগ্ধকর উচ্চারণ শুনে চট করে ওয়েটারের দিকে তাকালো সাহিয়া।তাকিয়ে আরেক দফা অবাক।এটা তো তার পুতুল ছেলেটি। নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো সাহিয়ার।তার বিনিময়ে নীলাভ মুচকি হাসি দিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। শুক্রবারের এই একটা দিন এই কফি হাউসে কাজ করে নীলাভ।সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় প্রচুর মানুষের আনাগোনা থাকে এই কফি হাউসে। তাই মালিক শুধু একদিনের জন্য কতগুলো ওয়েটার আলাদা রেখেছে। তাদের মধ্যে নীলাভও আছে।

💗💗💗

নিজ বাড়ির উঠোনে বসে চিন্তায় আছে হাবিবুর রহমান। বিকালে পড়ন্ত রোদ উঠোনের পাশে থাকা আমগাছের পাতায় চিকচিক করছে।এক ধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।নিজের জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হচ্ছে তার।বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না আজকাল।প্রচুর পেরেশানি তাকে ঘিরে ধরেছে। পাশেই এসে বসলো মিনারা খাতুন। আজও তার সাথে পানের বাটা নিয়ে বসেছে।

মিনারাঃ কি হয়েছে আপনের মাহিমের আব্বা? আমারে কিছু কন না কে?আপনে সারাদিন কি এমন চিন্তা করেন?

হাবিবুরঃ আমার পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গেছে মাহিমের মা।খুব শীঘ্রই তা ধ্বংস হইবো।সারাজীবন অন্যের সম্পদ মাইরা খাইছি।অন্যের জিনিস জোর-জবরদস্তি কইরা নিজের নাম করছি।এবার সেগুলোর বিচার হইবো আমার।টাকার গন্ধে, অন্ধ হইয়া গেছিলাম আমি।টাকার নেশা আমরে এতটা ধরছিলো যে আমি হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেছিলাম।কোনটা ভালো কোনটা মন্দ তা বিচার করি নাই।মনে করছি আমি যা করছি তাই ঠিক।কিন্তু এখন দেখতাছি কত অন্যায় করছি আমি এই গ্রামের মানুষের লগে।

মিনারাঃ আমার কথা তো হুনেন(শুনেন) নাই।কত কইছি এগুলা কইরেন না।মাইনষের বদদোয়া কামাইয়েন না।মজলুমের (অত্যাচারিত) বদদোয়া আল্লাহ কবুল করে। কিন্তু আপনে আমার কথা কানেই দেন নাই।উল্টা আমারেই তালাক দেওনের ডর দেহাইছেন।আমি সেই ভয়ে চুপ কইরা রইছি।কিন্তু ঐ যে ওপরে একজন আল্লাহ আছে।সে কিন্তু কারো লগে অবিচার করে না।কারণ তার কাছে সব বান্দাই সমান।এখন শেষ বয়সে আইয়া আফসোস করলে কি হইবো?

হাবিবুরঃ তখন আমার রাস্তায় বাধা দিতে আইছে তারে মারতেও আমার বুক কাপে নাই।কিন্তু এখন তো কলিজা শুইদ্দা কাঁপতাছে।সরকারের থিকা গ্রামের মানুষের লিগা যে ত্রাণ আইতো তার ১০ ভাগ বিলাইতাম।আর বাকি ৯০ ভাগ নিজের গোডাউনে ঢুকাইতাম।তারপর সেগুলো আবার চড়া দামে হাটে বিক্রি করতাম।কত টাকা মাইরা খাইছি তার কোন হিসাব নাই।ফ্যাক্টরীতে কাম করনের লোকগুলোরে ঠিক মতো বেতন দিতাম না।তাগো লগে ভালো ব্যবহার করতাম না।ফ্যাক্টরীতে দুই নাম্বার জিনিসপত্র বানাইতাম।আজ ভাইবা দেখি কি ভুল করছি জীবনে। ঐ পুতুল ছেলেটি আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করে ভালোই করছে।আমার তো ফাঁসি হওনের দরকার।ছেলেটা মনে হয় অনেক ভালো।তাই তো এখনো আমার কোন অপরাধ ফাঁস করে নাই।

মিনারাঃ হয়তো পোলাডায় আপনেরে ভালো হওয়ার একটা সুযোগ দিছে।আপনি এগুলো ছাইরা ভালো হইয়া যান।আর ঐ পোলার পেছনে লোক লাগাইয়েন না।ওরে ওর মতো থাকতে দেন।আপনে এবার ভালো পথে আইসা পরেন।গ্রামের হক্কল মানুষের থিকা মাফ চাইয়া তাগোর লিগা ভালো কাজ করেন।দেখবেন সবাই আপনেরে ভালোবাসবো।আপনিও নতুন কইরা বাঁচার আনন্দ পাইবেন।ভালো মানুষ হইয়া বাঁচার আনন্দই আলাদা।

হাবিবুরঃ হো তুমি ঠিক কথা কইছো মাহিমের মা।আমি সকলের থিকা মাফ চামু।তারপর সবার জন্য ভালো কাজ করমু।এটাই একমাত্র আমার মনের শান্তি দিতে পারবো।আমি এখুনিই রবিনরে কল কইরা কইতাছি। ঐ পুতুল ছেলেটির কোন খোঁজ না লাগাইতে।যদি ওরে কখনো পায় তাহলে আমাদের বাড়িতে দাওয়াত কইরা আইনা ভালো-মন্দ খাওয়ামু।ঐ ছেলেই আমার চোখ খুলে দিছে।আর ওরে যদি সেই খুশিতে একদিন দাওয়াত করে না খাওয়াই।তাহলে আমি মইরাও শান্তি পামু না।

হাবিবুর রহমান খুশিমনে নিজের রুমে চলে গেল। রবিনকে কল করে বলতে হবে তো। ঐ পুতুল ছেলেটি কে আর না খুঁজতে। যদি খুঁজে পায় তাহলে দাওয়াত করে আসতে।মিনারা খাতুন খুশি মনে পান সাজিয়ে তা মুখে পুরলো।আজ তার ভেতরেও একটা অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করছে।

💗💗💗

নীলাভ কফি দিয়ে খালি ট্রে হাতে ভেতরে ঢুকতে নিলেই দরজার আড়াল থেকে একজোড়া হাত এসে ওকে টেনে অন্যদিকে নিয়ে গেল।নীলাভ অনেকটা ভয় পেয়ে গেলো।সামনে তাকিয়ে দেখে সাহিয়া অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নীলাভের মুখে মাস্ক,চোখে সানগ্লাস না থাকায় সাহিয়ার ওকে চিনতে বেগ পায়নি।মাথায় কালো ক্যাপটা উল্টো করে রাখা।নীলাভ ওর হাত সরিয়ে কাজে মনোযোগ দিলো।

সাহিয়াঃ ও হ্যালো এমন একটা ভাব নিচ্ছো।মনে হচ্ছে আমাকে চিনোই না।জীবনেও দেখোনি।ভাব কম নেও।এই ভাবগুলো অন্য কারো সাথে দেখিয়ো।আমার সাথে নয়।

নীলাভ ভ্রু কুঁচকে নিজের কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো।সাহিয়া এবার ওর সামনে এসে দুই হাত কোমড়ে রেখে বললো।

সাহিয়াঃ এই যে বলে রাখছি তোমাকে।কান খুলে শুনে রাখো।এই পুতুল ছেলে,পুতুল ছেলে।তুমি আমার সাথে এরকম ভাব নিয়ে থাকবে না বলে দিচ্ছি। তোমার এই ভাব আমার একটুও ভালো লাগে না।

নীলাভঃ ম্যাম আমি কাজ করছি।আমাকে ডিস্টার্ব না করলে ভালো হয়।আপনার কিছু লাগলে অর্ডার করুন।আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসবো।

নীলাভের কথা শুনে সাহিয়ার মাথা গরম হয়ে গেল।আর নীলাভ মনে মনে ভাবছে, মেয়েটা কতটা এক্সপার্ট। সেদিন দেখা হলো আর আজ তুমি তে নেমে গেছে। কিন্তু ওর মুখে তুমি ডাক শুনতে খারাপ লাগছে না।বরং ভালো লাগা সারা হৃদয়ে ছেয়ে গেছে। কিন্তু বাইরের একটা মেয়ের সাথে নীলাভকে মালিক দেখলে তার মনে খারাপ ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। তাই সাহিয়াকে ইগনোর করছে সে।

সাহিয়াঃ একদম ঢং করবে না।তোমাকে তুলে নিয়ে পালাবো বলে দিলাম।

বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে কথাটা বললো সাহিয়া।তা দেখে নীলাভের হাসি এসে পরলো।কিন্তু সেটা আটকে রেখে গম্ভীর মুখে বললো।

নীলাভঃ আপনার মতো বাচ্চা মেয়ে আমাকে তুলে নিয়ে পালাবে?হাসালেন মিস।

সাহিয়াঃ এই এই তুমি কিন্তু আমাকে একটুও বাচ্চা মেয়ে বলবে না। আমার ২৩ বছর বয়স।আমি এবার অনার্স ২য় বর্ষে পড়ি।সবাই বাচ্চা মেয়ে বললেও তোমার মুখ থেকে বাচ্চা ডাক শুনতে চাই না।

নীলাভঃ ২৩ বছর বয়সে অনার্স ২য় বর্ষে কি করে পড়ে?২০ কিংবা ২১ বছরে অনার্স ২য় বর্ষে পড়ার কথা।(চোখ দুটো ছোট ছোট করে)

সাহিয়াঃ সেই কথা আর বলো না।আমি ছোট থাকতে আরো বেশি বাচ্চা দেখতে লাগতো।আমার যখন ৫ বছর বয়স।তখন স্কুলে ভর্তি হতে গেছি।তখন স্কলের টিচাররা কিছুতেই বিশ্বাস করেনি যে আমার বয়স ৫ বছর।আমাকে নাকি আরো কম বয়সের দেখা যায়।কি আর করার সেখানে এক বছর গ্যাপ।৬ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হলাম।যখন ক্লাশ ফাইভে পরীক্ষা দিবো।তখন হেড স্যার বাবাকে ডেকে বলে,আপনার মেয়েকে তো দেখে অনেক ছোট লাগে।ও এতো চাপ নিতে পারবে না। তাই ক্লাশ ফাইভে দুই বছর রেখে দেই।পরেরবার পরীক্ষা দিবে।আবারো আরেক বছর গ্যাপ।এই হলো দুই বছর গ্যাপের কাহিনি। এবার বলো আমি কেন ২৩ বছরে অনার্স ২য় বর্ষে পড়বো না।

সাহিয়ার কথা শুনে নীলাভের হাসি পাচ্ছে। কারণ সে তো এতদিন জানতো এই মেয়েটা একটা বাচ্চা মেয়ে। সাহিয়া হঠাৎ চিৎকার করে বললো।

সাহিয়াঃ পুতুল ছেলে ও পুতুল ছেলে। তোমার নাম কি বলো না?আমার নামও তো তুমি জানো না। আমার নাম হলো সাহিয়া আনজুম। তোমার নাম??

নীলাভঃ সাহিয়া আনজুম!!! খুব সুন্দর নাম।আমার নাম নীলাভ সফওয়াত।

সাহিয়াঃ মাশাআল্লাহ, কত সুন্দর নাম।তোমার চোখের রঙের সাথে তোমার নামটা পুরো মিলে যায়।তুমি কি বাংলাদেশী?

নীলাভঃ জ্বি ম্যাম, আমি বাংলাদেশী।জন্ম অন্য দেশে।কিন্তু এখন আমি বাংলাদেশের নাগরিক।

এর মধ্যেই সাজিয়া তার বোন সাহিয়াকে ডেকে উঠলো।সাহিয়া, নীলাভকে বিদায় জানিয়ে যাওয়ার পথে উদ্যত হলো।কিন্তু কিছু দূর গিয়ে আবার ফিরে আসলো।এগিয়ে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে নীলাভের গাল স্পর্শ করলো।আরেক হাতে আরেক গাল স্পর্শ করতে গেলে নীলাভ দুই হাত ধরে ফেললো।সাহিয়া নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। তারপর নীলাভের হাত টেনে নিয়ে তার উল্টো পিঠে আলতো করে চুমু খেলো।নীলাভের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। সাহিয়া এক চোখ মেরে দৌড়ে সেখান থেকে চলে গেল। আর নীলাভের এখন হার্ট অ্যাটাক করার অবস্থা। মেয়েটা সত্যি বাচ্চা। নয়তো এরকম বাচ্চামো কেউ করে।

#চলবে

পুতুল ছেলেটি পর্ব-০৮

0

#পুতুল_ছেলেটি
#Part_08
#Writer_NOVA

আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। গুড়ুম গুড়ুম শব্দের সাথে ভারী বাতাস বইছে।সকাল থেকে রিমঝিম বৃষ্টি ঝরছে।যখন গরমে সবাই হাঁপিয়ে উঠছিলো।তখনি প্রকৃতিকে শান্ত ও ঠান্ডা করে দিতে বৃষ্টিকন্যার আগমণ। সময়টা এখন বাংলা মাসের আষাঢ়ের মাঝামাঝি। গ্রামে থাকলে হয়তো এই সময়টাকে অনেক সুন্দরভাবে উপলব্ধি করা যেতো।কিন্তু শহরে বৃষ্টি মানেই তো রাস্তা আটকে যাওয়া,কাঁদার ছড়াছড়ি, অসহ্যকর সবকিছু। তবে এমন দিনে ঘরে টেকা দায়।ইচ্ছে করে দুই হাত মিলে নিজেকে প্রকৃতির কাছে সঁপে দিতে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে নীলাভ।বৃষ্টির দিন তার কাছে খারাপ লাগে না। আর সেই বৃষ্টিটা যদি হয় অসহ্য গরম থেকে বাঁচার জন্য। তাহলে তো কথাই নেই। এই ভরদুপুরে খিচুড়ির সাথে মুরগির গোশত হলে খারাপ হতো না। কিন্তু আকিবকে এই কথা বললে আস্ত রাখবে না।রান্নার দায়িত্বে আজ আকিব আছে।ওরা প্রত্যেকটা কাজ ভাগ করে নিয়েছে। একদিন আকিব রান্না করবে আরেকদিন নীলাভ।

আকিবঃ আজ কি বৃষ্টি দেখেই পেট ভরবি নাকি?

নীলাভঃ বৃষ্টি দেখে যদি পেট ভরতো তাহলে পৃথিবীতে কোন মানুষ কাজ করতো না। সবাই বৃষ্টির অপেক্ষায় আকাশ পানে মুখ দিয়ে বসে থাকতো।

আকিবঃ আমার রান্না কমপ্লিট।খেতে আসতে পারিস।

নীলাভঃ গতকালও ঐ মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছিলো?

আকিবঃ ঐ যে ঐ মেয়েটা!!! যে তোকে পুতুল ছেলে ভাবে।ওর হাত থেকে ছাড়া পেলি কিভাবে?

নীলাভঃ ওর সামনে পরলে আমি কিছু না কিছু একটা মিস করেই ফেলবো।মাস্ক পরলেও সানগ্লাসের কথা ভুলে গিয়েছিলাম।আমার চোখ দেখে সন্দেহ করে বসে।এগিয়ে এসে আমার মাস্ক খুলতে নিলে আমি উল্টো পথে দৌড় দিয়ে ওর হাত থেকে বেঁচেছি।বাপরে!!! কি ডেঞ্জারাস মেয়ে। আমার মাস্ক খুলতে চেয়েছে।সাহস দেখে আমি অবাক।

আকিবঃ আমি বুঝি না তুই ওকে দেখলে এমন পালিয়ে বেড়াস কেন?এতে তোকে আরো বেশি
সন্দেহ করে।

নীলাভঃ আমি জানি না কেন এমন করি।তবে ও আমার সামনে এলে আমার অন্যরকম কিছু ফিল হয়।সাথে প্রচুর অস্বস্তি ঘিরে ধরে।হার্ট খুব জোরে লাফানো শুরু করে। আমি নিজের মধ্যে থাকি না। সারা শরীর থেকে থেকে কেঁপে উঠে। সাথে ভালো লাগা ছেয়ে যায় সারা মন জুড়ে।

আকিবঃ বুঝছি।তোরে ভালোবাসার রোগে ধরছে।এই রোগের কোন ঔষধ আমার কাছে নেই। একমাত্র যাকে ভালোবাসছিস সেই তোর ঔষধ।

নীলাভঃ ধূর,কি যা তা বলিস।এমনটা কখনো নয়।আমার মনে হয় আমি অসুস্থ। তাই এরকম হয়।

আকিবঃ তুই কিসের অসুস্থ তাতো বললামই।ভালোবাসার রোগে আক্রান্ত হয়েছিস তুই। সেটা অবশ্য তুই আমার কাছে কখনো স্বীকার করতে চাইবি না।এটা তোর দোষ।

নীলাভঃ যা ভাগ এখান থেকে। (বিরক্তির সুরে)

আকিবঃ আগামীকাল যদি আবার তোর সাথে ঐ মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে যায়।তখন কি হবে বলতো?

নীলাভঃ যদি সত্যি ওর সাথে দেখা তাহলে তোকে মেরে রোদে শুকাতে দেবো।কাজের কথা তো কখনো সত্যি হয় না।তোর যদি আকাইম্মা আর ফালতু কথাগুলো কাকতালীয় ভাবে সত্যি হয়ে যায়।বাই চান্স যদি কালকে মেয়েটার সাথে দেখা হয় তোকে সত্যি আমি মোয়া করে দিবো।

আকিব নীলাভের কথা শুনে বড়সড় ঢোক গিলে চুপ হয়ে গেলো। সত্যিই তো।ওর ভালো কোন কথা তো কখনো সত্যি হয় না।কিন্তু যেগুলোর কোন দরকার নয় ফালতু কথাগুলো সত্যি হয়।যাতে নীলাভকে বিপদে পরতে হয়।নীলাভ বৃষ্টি দেখতে মনোযোগ দিলো।বৃষ্টির ঝাপটা এসে ছিটেফোঁটা নীলাভের টি-শার্ট ভিজেয়ে দিচ্ছে। কিন্তু পরিবেশটা মন্দ লাগছে না। শীতল বাতাসের সাথে মনটাও শীতলতায় ছুটে উঠছে।তার মধ্যে সাহিয়ার মুখটা ভেসে উঠলো।নীলাভ আপন মনেই সাহিয়ার কথা ভেবে মুচকি হেসে উঠলো।

💗💗💗

পরের দিন……

বিগত পাঁচ মিনিট ধরে সাহিয়াদের বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নীলাভ।কিন্তু করলি বেল বাজানোর সাহস পাচ্ছে না। আজ আকিবের খবর নিয়ে ফেলবে।ওর ফালতু কথা এবারো সত্যি হয়ে গেলো।আজও নীলাভ পিৎজা ডেলিভারি দিতে এসেছে। বাসার ঠিকানা দেখে ও কিছুতেই আসতে চায়নি।কিন্তু অন্য কেউ না থাকায় ওকেই আসতে হয়েছে। আকিবকে মনে মনে হাজারটা বকা দিয়ে বিসমিল্লাহ বলে কলিং বেলের সুইচে টিপ দিলো নীলাভ।কলিং বেল বাজতেই চোখ মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলো।

সাজিয়াঃ কে কে এসেছে? ওহ্ আপনি।পিৎজা ডেলিভারি দিতে এসেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে।আপনি এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?আমাকে কি পিৎজার বক্সটা দিবেন না।

ভিন্ন গলার স্বর পেয়ে পিটপিট করে চোখ খুললো নীলাভ।তারপর কিছুটা ইতস্তত করে বললো।

নীলাভঃ সরি ম্যাম।এই যে আপনার পিৎজা। দয়া করে অর্ডারটা কনফার্ম করুন।

সাহিয়াঃ ইট’স ওকে।কাগজ,কলম দিন।আমি সাইন করে দিচ্ছি।

নীলাভের হাত থেকে পিৎজার বক্সটা নিয়ে কাগজে সাইন করে দিলো সাহিয়া।তারপর হাসিমুখে নীলাভকে বিদায় জানালো।নীলাভ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে বুকে ফুঁ দিলো।

নীলাভঃ আল্লাহ, তুমি আজ আমাকে বাঁচিয়েছো।ঐ মেয়েটা দরজা খোলেনি।

নীলাভ খুশিমনে সিঁড়ি দিয়ে যেতে লাগলো।গাতকাল বৃষ্টি হলেও আজ গরম কমেনি।তাই মুখের মাস্ক ও সানগ্লাসটা খুলে হাতে নিলো।এই দুপুর সময় মানুষ বেশি থাকবে না।যদিও বিকেল হওয়ার পথে।মেইন গেইট দিয়ে বের হওয়ার আগেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে কিছুটা ছিটকে পরে যেতে নিলে নিজেকে সামলে নিলো নীলাভ।সামনে তাকিয়ে চোখ চড়কগাছ। এ তো সেই মেয়েটা।

সাহিয়াঃ কে রে ধাক্কা দিলো?চোখ কি পকেটে করে হাঁটেন নাকি?আমি—–

আর কথা বলতে পারলো না। সামনে তাকিয়ে সাহিয়ার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো।কলেজ থেকে ফিরে বাসার মেইন গেইট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে কারো সাথে ধাক্কা খেলো।না দেখেই তাকে বকতে আরম্ভ করেছিলো।কিন্তু নীলাভকে দেখে অবাক হয়ে গেলো।
ভুল দেখছে ভেবে চোখ দুটো ডলে নিলো।নিজের হাতে একটা চিমটি কাটলো।ব্যাথা পেয়ে সিউর হলো, সে সত্যি দেখছে।নীলাভের চোখে ধরা পরে যাওয়ার ভয় দেখা যাচ্ছে।

সাহিয়াঃ পপপপপুততততুল ছেলে!!!!

সাহিয়া তুতলিয়ে কথাটা বলে হা করে রইলো।ওর এই মুহুর্তে কি রিয়েকশন দেওয়া উচিত তাও ভুলে গেছে। হুশ ফিরতে কিছু সময় লাগলো।

সাহিয়াঃ আপনি কি ঐ শপিংমলের পুতুল ছেলেটি??

নীলাভঃ 😐😐

সাহিয়াঃ তার মানে আমার ধারণা ঠিক।ঐটা পুতুল ছিলো না।আপনি একজন মানুষ।আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনি একজন পুতুল মানুষ। আমি কি আপনাকে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে পারি? প্লিজ পারমিশন দিন।আমি অবাকের চরম পর্যায় আছি।আপনাকে ছুঁতে পারলে আমি বিশ্বাস করবো আমি চোখের সামনে যা দেখছি তা সত্যি।

নীলাভ কি বলবো তা বুঝতে পারছে না। এতক্ষণ ভয় থাকলেও এখন সে অবাক চোখে সাহিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার মুখের অঙ্গিভঙ্গি গুলো মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে নীলাভ।সারাটা মন জুড়ে ভালো লাগার এক শিহরণ বয়ে গেলো।

সাহিয়াঃ কি হলো কথা বলছেন না কেন?আমি কি আপনাকে ছুঁয়ে দেখতে পারি?আমি আসলে অনেক এক্সাইটেড। আমি কখনো ভাবতে পারি নি কোন পুতুলের মতো দেখতে মানুষকে নিজের চোখের সামনে দেখতে পারবো। আমার যে কি খুশি লাগছে। তা আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না।

সাহিয়া কথাগুলো বলার সময় অনেক খুশি ছিলো।খুশিতে সে অনেকটা লাফাচ্ছিলো।আর নীলাভ মুচকি হেসে ওর গতিবিধি লক্ষ্য করছিলো।মেয়েটার মধ্যে বাচ্চামো ভাবটা বেশি। যেটাই নীলাভকে বেশি আকর্ষণ করছে।কিছুতেই মেয়েটার মুখ থেকে তার দৃষ্টি সরাতে পারছে না।

নীলাভঃ আমাকে দেখে তুমি এত খুশি হবে তা আমি কল্পনায়ও ভাবতে পারিনি।যদি আগে জানতাম তাহলে তোমার সামনে আরো আগে আসতাম।তোমার হাসির কারণ হতাম।তোমার বাচ্চামো কান্ডগুলো খুব করে তোমার কাছে টানছে।ইচ্ছে করছে দুই গাল টেনে দিতে।কিন্তু তোমার গাল টানতে গেলে আমার হাত কাঁপবে। তাই আমি পারবো না।

সাহিয়াঃ আপনি কি সত্যি পুতুল? মানুষ হলে আমার কথার উত্তর দিচ্ছেন না কেন?(ভ্রু কুঁচকে)

নীলাভঃ আপনি ছুঁয়ে দেখতে পারেন।
(কাঁপা কাঁপা গলায়)

নীলাভ হাত বাড়িয়ে দিলো।সাহিয়া কাঁপা কাঁপা হাত সামনে নিয়ে এক আঙুল দিয়ে আলতো করে নীলাভের হাতে ছুঁয়ে আবার তুলে ফেললো।তারপর একিভাবে আরো দুইবার কাজটা করলো।নীলাভকে ছুঁতে পেরে আরো বেশি খুশি হয়ে গেলো।আর নীলাভ ওর কান্ড দেখছে।একসময় খুশির ঠেলায় সাহিয়া সামনে এগিয়ে এসে নীলাভকে জড়িয়ে ধরলো।ও এখন নিজের মধ্যে নেই। নীলাভ তো অবাকের ওপর অবাক।ও এখন এমনটা কিছুতেই ভাবেনি।সাহিয়ার হুশ ফিরতেই সে লজ্জা পেয়ে গেলো।লজ্জায় নীলাভকে ছেড়ে বাসার দিকে দৌড়ালো।আর নীলাভ এখনো ঘোরের মধ্যে আছে।তাই সে ঠায় দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা ছক আকারে সাজাতে লাগলো।কি থেকে কি হলো?তাই এখনো বুঝতে পারছে না নীলাভ।

#চলবে

পুতুল ছেলেটি পর্ব-০৭

0

#পুতুল_ছেলেটি
#Part_07
#Writer_NOVA

দুপুরের কাঠফাটা রোদের তেজে সব মানুষ অতিষ্ঠ। গরমের তীব্রতায় সবাই ঝিমিয়ে পরেছে।বাতাস তো দূরেই থাক গাছের পাতাগুলো একটুও নড়ে না।মাঠ-ঘাট চৌচির হয়ে আছে।কাজ থেকে হেঁটেই বাড়ি ফিরছে নীলাভ।রোদে ওর ফর্সা মুখটা টুকটুকে লাল হয়ে গেছে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে টোকা দিলেই রক্ত ঝরবে।গরমে হাঁপিয়ে পরেছে সে।আশেপাশে কোন রিকশাও দেখা যাচ্ছে না। কিছু দূর যেতেই গাছের ছায়ায় একটা বসার জায়গা দেখলো।সেখানে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে পরলো।বড্ড পানির তেষ্টা পেয়েছে। ঠোঁট শুকিয়ে আসছে।

নীলাভঃ সূর্যি মামার আজ হলো কি? এত তেজ দেখাচ্ছে কেন?বারবার ঠোঁট শুকিয়ে আসছে। পানি পাবো কোথায়?আজ এতো গরম পরবে কে জানে?

বারবার আকাশে দিকে তাকিয়ে হাঁটু ধরে দাঁড়িয়ে পরে সাহিয়া।গরমে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।ব্যাগ থেকে পানি বের করে গলা ভিজিয়ে নিলো।আশেপাশে একটা রিকশা নেই। পুরো রাস্তা ফাঁকা। তাই হেঁটেই কলেজ থেকে ফিরছিলো।ওর বাবার আরো ক্লাশ আছে।তাই সাহিয়াকে একাই আসতে হয়েছে। সামনে এগুতেই একটা বসার জায়গা দেখতে পেলো।যেখানে একটা ছেলে দুই হাতে মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে বসে আছে। সাহিয়া অনেকটা দুরত্ব রেখে বসে পরলো।

সাহিয়াঃ ছেলেটার বোধহয় অনেক খারাপ লাগছে।কিরকম ছটফট করছে। আমি কি তাকে জিজ্ঞেস করবো ওর কি হয়েছে? কি ভাববে ছেলেটা?মুখটাও তো দেখতে পাচ্ছি না। আমি এখন কি করবো বুঝতে পারছি না।

নীলাভের অনেক খারাপ লাগছে।এতক্ষণ রোদে থাকায় সারা শরীর জ্বলছে।সাথে পানির পিপাসা তো আছেই। সাহিয়া সেটা বুঝতে পেরে দ্বিধা-দ্বন্দে পরে যায়।একসময় কিছু না ভেবে সামনে এগিয়ে আসে।

সাহিয়াঃ আপনার কি অনেক খারাপ লাগছে? হ্যালো মিস্টার, আমি আপনাকে বলছি।

একটা মেয়ের কন্ঠ শুনে নীলাভ আঙুলের ফাঁক দিয়ে সামনে তাকালো।তাকিয়ে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো।সেই মেয়েটার সাথে আবারো দেখা হয়ে গেলো। শুধু মাথা নাড়িয়ে বুঝালো তার খারাপ লাগছে।

সাহিয়াঃ পানি খাবেন?আমার কাছে পানি আছে।

নীলাভ মাথা ঝাকালো।সাহিয়া ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে নীলাভের হাতে দিলো।নীলাভ অন্য দিকে ঘুরে বোতেলে থাকা অর্ধেক পানি খেয়ে নিলো।তারপর থুঁতনি থেকে মাস্কটা ওপরে উঠিয়ে নিলো।তারপর সাহিয়ার দিকে ঘুরলো।সানগ্লাসটা পরার কথা বেমালুম ভুলে গেলো।

নীলাভঃ ধন্যবাদ, পানি দিয়ে সাহায্য করার জন্য। এই নিন আপনার বোতল।

সাহিয়া কোন কথা না বলে ভ্রু কুঁচকে নীলাভের থেকে বোতলটা নিলো।তারপর কোন দ্বিধা না করে ফট করে জিজ্ঞেস করে ফেললো।

সাহিয়াঃ আপনি এই গরমে মাস্ক পরে আছেন কেন?ছিনতাইকারী নন তো।নিশ্চয়ই চোর,বাটপার কিংবা ছিনতাইকারী আপনি।নয়তো আপনার মুখটা আমাকে দেখে লুকাতেন না।

নীলাভ পরে গেল বিপদে।মেয়েটা শেষ পর্যন্ত ওকে চোর,বাটপার,ছিনতাইকারীর সাথে তুলনা করলো।এই দুঃখ নীলাভ কোথায় রাখবে?

নীলাভঃ এই জন্য বলে পৃথিবীতে ভালো মানুষের ভাত নেই। মিস আমার মুখের কোথাও কি লেখা আছে আমি এরকম? (কিছুটা রেগে)

সাহিয়াঃ আমি কি করে জানবো?আপনার মুখতো আটকানো।দেখলে বলতে পারতাম।

নীলাভঃ তাহলে একজনের বিষয় না জেনে এরকম উল্টো পাল্টা মন্তব্য কেন করলেন?মানুষের মুখ দেখে যদি তার চরিত্র সম্পর্কে জানা যেতো।তাহলে পৃথিবীতে এতো অপরাধ ঘটতো না। ওপর দেখে কখনো কারো ভেতর বিবেচনা করবেন না।এটা মারাত্মক ভুল।

নীলাভ উঠে চলে যেতে নিলো।সাহিয়া পেছন থেকে ডেকে বললো।

সাহিয়াঃ ওয়েট মিস্টার। আপনাকে আমার চেনা চেনা মনে হচ্ছে কেন?আপনার চোখ দুটো অনেক চেনা।কোথায় দেখেছি বলুন তো?আপনার মাস্কটা খুলুন।আমি আপনার চেহারা দেখতে চাই।

নীলাভ ঠিক এই ভয়টা পাচ্ছিলো।তাই জলদী করে এখান থেকে কেটে পরতে চেয়েছিলো।হার্ট খুব জোরে জোরে লাফাচ্ছে।এই মনে হয় ধরা পরে যাবে।নীলাভ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কোন কথা যে সাহিয়াকে শুনাবে তাও খুঁজে পাচ্ছে না। সাহিয়া কপাল কুঁচকে ওর পেছন এসে দাঁড়ালো। নীলাভ ঘুরে তাকালো।সাহিয়া হাত বাড়িয়ে যেই নীলাভের মাস্কে হাত দিবে।তখনি নীলাভ পেছনে ঘুরে এক ভো-দৌড়। সাহিয়া বেকুব হয়ে গেলো নীলাভের কাজে।আর নীলাভ আশেপাশে না তাকিয়ে দূর্বল শরীর নিয়ে প্রাণপণে দৌড়ে যাচ্ছে। এই মেয়েটা সামনে এলেই ওর মনটা পালাই পালাই করে।তা না চাইতেও নীলাভ ওর থেকে পালিয়ে বেরায়।যার কোন কারণ নেই।

💗💗💗

বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে সাহিয়া।মাথায় এখনো ঐ ছেলেটার কথা মনে হচ্ছে। হুট করে ছেলেটা ঐভাবে দৌড় দিলো কেন?তার উত্তর খুঁজতেই বয়স্ত সে।কিন্তু কোন সঠিক উত্তর সে আদোও খুঁজে পেলো না।ছেলেটার নীল রঙের চোখ দুটো দেখে সাহিয়ার বারবার মনে হচ্ছে এটাই সেই পুতুল ছেলেটি। কিন্তু আন্দাজে তো ঢিল মেরে বসে থাকলে হবে না। কফির মগ থেকে ধোঁয়াগুলো নিমিষেই বাষ্পে মিশে যাচ্ছে। কফি ঠান্ডা হওয়ার পথে।মোবাইলে ইমরানের মুসাফির গানটা বাজছে।কিন্তু কোন দিকে হুশ নেই সাহিয়ার।সে তো তার ভাবনায় মত্ত।

♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

তোর ঐ দু হাতের আলতো ছোঁয়াতে,
মন ছেয়ে যায় প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে।(×০২)
এসেছি তোর মনেরি দেশে,
আমি এক মুসাফির বেশে,
দে না ঠাঁই একটু হেসে, ভালোবেসে।(×০২)

একটা মন চাই,
যার পৃথিবী হবে শুধু ঘিরে আমায়,
মিশে রবো আমি সারাটা দিন যার চিন্তায়।
কেন এতো ভাবিস,
অনুভবে ঐ চোখ যদি এই চোখে রাখিস,
বুঝবি তবেই মনের কোথায় তুই থাকিস।
এসেছি তোর মনেরি দেশে,
আমি এক মুসাফির বেশে,
দে না ঠাঁই একটু হেসে, ভালোবেসে।(×০২)

যত দিন যায়,
পাবো কি পাবো না তোকে এই জটিল ধাঁধায়।
এই হৃদয়ে এসে যে ভীড় মনে জমায়।
ভুলে যা সবিই,
কথা দিলাম আজীবন তুই আমাতেই রবি,
এই হৃদয়ে আকা রবে শুধুই তোরি ছবি।
এসেছি তোর মনেরি দেশে,
আমি এক মুসাফির বেশে,
দে না ঠাঁই একটু হেসে,ভালোবেসে। (×০২)

♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

সাহিয়ার মনেও এখন মুসাফির বেশে পুতুল ছেলেটির আগমণ হয়েছে। না চাইতেও তার কথা ভেবে সারাটা দিন কেটে যায়।সাজিয়ার চিৎকারে সাহিয়ার হুশ ফিরে।

সাজিয়াঃ এই তোর কি হয়েছে রে?কোন ধ্যানে থাকিস?কখন থেকে চেচিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তোর কোন রেসপন্স নেই।

কিঞ্চিত বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে সাহিয়া ওর বোনের দিকে তাকালো। এই সময়ে সাজিয়াকে চাইনি সাহিয়া।সে তো তার ভালো লাগার পুতুলটাকে নিয়ে বিভোর ছিলো।মাঝখানে সাজিয়া ওর ভাবনার মধ্যে ভিলনের মতো এন্ট্রি নিলো।মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে অনেকটা ঝাঁঝালো গলায় সাহিয়া বললো।

সাহিয়াঃ কি হয়েছে দিদিয়া?কানের পর্দা কি ফাটিয়ে ফেলবে নাকি?কানের সামনে এসে এভাবে চেচাচ্ছো কেন?আমাকে কি একটু আমার মতো থাকতে দিবে না?যা বলার জলদী বলো।

সাজিয়াঃ আমি খুঁজে পাচ্ছি না, তোর হয়েছেটা কি?আমি যতদিন এই বাড়িতে আছি ততদিন তুই নিজের মতো থাকতে পারবি না। আমি চলে গেলে মন মতো নিজের মতো থাকিস।তখন আর আমি জ্বালাতে আসবো না।

সাহিয়াঃ হুম বুঝলাম।কি বলতে এসেছো তাই বলো?

সাজিয়াঃ কফি যে ঠান্ডা হয়ে পানি হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল আছে তোর? তুই এতো ভাবুক হলে কবের থেকে? কখন থেকে তোকে ডেকে চলছি।কিন্তু তুই এক ধ্যানে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছিস।

সাজিয়ার কথার মধ্যে সাহিয়ার মোবাইলের গান বেজেই চলছে।সাজিয়া বিরক্ত হয়ে গানটা বন্ধ করে দিলো।কিছুটা রেগে একটা চেয়ার জোরে টেনে তার মধ্যে বসে পরলো।

সাহিয়াঃ জানো দিদিয়া,আজ একটা অদ্ভুত মানুষের সাথে দেখা হয়েছে। তার চোখ দুটো গাঢ় নীল রঙের। তাকে দেখে সেদিনকার পুতুলের কথা মনে হয়ে গেলো।সে মাস্ক পরা ছিলো।আমি মাস্ক খুলতে বলতেই সে কিরকম ছটফট করছিলো।তার চোখে আমি ভয় দেখতে পেয়েছি। কিন্তু আমি যখন তার মাস্ক খুলতে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম তখনি সে উল্টো দিকে দৌড় দিলো।যার কোন কারণ আমি খুঁজে পেলাম না।তুমি আমার কথা শুনছো তো দিদিয়া?

সাজিয়াঃ তোর আজকাল কি হয়েছে আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।একবার মনে হচ্ছে তুই প্রেমে পরেছিস,আরেকবার মনে হচ্ছে তুই পাগল হয়ে গেছিস।কোনটা যে সত্যি তাই বুঝতে পারছি না।কফির মগটা এদিকে দে।আমি গরম করে নিয়ে আসছি।

সাজিয়া কফির মগ নিয়ে চলে গেল।সাহিয়া তার বোনের কথা কিছু সময় ভেবে আপনমনে হেসে উঠলো। কারণ তার বোনের কথার উত্তর সে পেয়ে গেছে।সাহিয়া এখন সিউর।সে ঐ পুতুল ছেলেটির প্রেমে পরেছে।যার কারণে তার কথা ভাবতে ভালো লাগে। তার ভাবনা নিয়ে সারাদিন পরে থাকতে ভালো লাগে। কিন্তু সে জানে না আদোও কি সেই ছেলের দেখা সে পাবে কিনা?তবে আজকের ছেলেটাকে দেখে তার বারবার মনে হয়েছে এটাই সেই পুতুল ছেলেটি।

#চলবে

পুতুল ছেলেটি পর্ব-০৬

0

#পুতুল_ছেলেটি
#Part_06
#Writer_NOVA

রাতের আঁধারে ছেয়ে গেছে পুরো পৃথিবী।ঘন কালো অন্ধকারে সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চাঁদের আলো থাকলেও এতটা কষ্ট হতো না পথ চলতে।খুব সাবধানে পা ফেলে চলছে আকিব ও নীলাভ।হাতে মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বালানো।পা টিপে টিপে সামনে এগুচ্ছে তারা।একসময় এক বিশাল পুরনো ফ্যাক্টেরীর সামনে এসে দাঁড়ালো। ভেতর থেকে খুটখাট শব্দ, হালকা আলো এসে জানান দিচ্ছে, ভেতরে কাজ চলছে।

আকিবঃ ভেতরে ঢুকবো কি করে? ধরা পরলে আমরা আস্ত থাকবো না নীলাভ।চল, বাসায় যাই।এখানে থেকে লাভ নেই। আমার জীবনটা অনেক দামী।

নীলাভঃ চুপ কর ব্যাটা।এত জোরে কথা বলিস কেন?ক্যামেরাটা সাথে এনেছিস তো?এটা যদি না আনিস তাহলে তোর একদিন কি আমার যতদিন লাগে।

আকিবঃ হ্যাঁ,এনেছি।নীলাভ চল, বাসায় চলে যাই।আমার ভয় করছে।নিশ্চয়ই ভেতরে ভুত আছে।

নীলাভঃ কানের নীচে মারবো একটা।উল্টাপাল্টা কথা বলা বন্ধ কর।কোন ভূত-প্রেত এখানে লাইট জ্বালিয়ে কাজ করবে না। আমরা কি এখানে সারাজীবন থাকতে এসেছি নাকি।কাজ শেষ হলেই চলে যাবো।এই ফ্যাক্টেরীর রহস্য আমি আজ বের করবোই।

আকিবঃ যদি বেঁচে না ফিরতে পারি?? আমি এখনো বিয়ে করিনি।আমার হবু বউ-বাচ্চার কি হবে🥺?

নীলাভঃ 🤬🤬

আকিবঃ আচ্ছা, সরি আর কিছু বলবো না।এখন গেইটের ওপারে যাবো কি করে? যদি গেইটের দারোয়ান চলে আসে।তাহলে কিভাবে যাবো?

নীলাভঃ দেয়াল টপকে।এছাড়া কোন উপায় দেখছি না।কেউ বোধহয় আসছে।জলদী লুকিয়ে পরতে হবে।

একটা লোককে আসতে দেখে দুজনেই দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে রইলো।সে ছিলো গেইটের দারোয়ান। এসেই দারোয়ান গেইটের সামনে টুল নিয়ে বসে রইলো।এবার আকিব,নীলাভ বিপদে পরে গেল।নীলাভ একটা খাইয়া ফালামু লুক নিয়ে তাকালো।

আকিবঃ আমার কোন দোষ নেই। আমি এমনি বলি।কিন্তু আল্লাহ তা সত্যি করে দেয়।আমিতো উদাহরণ স্বরূপ বলেছিলাম যদি গেইটের দারোয়ান চলে আসে। কিন্তু সত্যি সত্যি চলে এলো।

নীলাভঃ তোর ঐ মুখটা বন্ধ রাখ।যা বলিস তাই সত্যি হয়ে যায়।সেদিনও তোর কথা সত্যি হয়ে গেছে। ঐ মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে গেছে। ওদের বাসায় পিৎজা ডেলিভারি দিতে গিয়েছিলাম।তারপর কি বিপদে পড়েছিলাম।তা এখনো ভুলি নি।

আকিবঃ তুই ঐ মেয়েটার বাসায় পিৎজা ডেলিভারি দিতে গিয়েছিলি😮😮????

নীলাভঃ মুখ বন্ধ কর।মশা ঢুকে যাবে।সেই ঘটনা পরে বলবো।এখন দেয়াল টপকে ঐ ধারে যেতে হবে।

নীলাভ কথা না বাড়িয়ে সাবধানে দেয়াল টপকে ফ্যাক্টরেরীর সামনে চলে এলো।কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো আকিবকে নিয়ে। দেয়াল থেকে নামতে গিয়ে পায়ে হালকা ব্যাথা পেলো।ধপ করে শব্দ হতেই দারোয়ান নড়েচড়ে উঠলো। আর জোরে জোরে জিজ্ঞেস করলো।

—- কে কে কেডায় ঐখানে?কথা কও না কে?

দারোয়ান উঠে সেদিকে আসতেই আকিব ও নীলাভ আড়ালে লুকিয়ে পরলো।নীলাভ আবারো রাগী চোখে আকিবের দিকে তাকালো। তা দেখে আকিব ইনোসেন্ট ফেস করো ফিসফিস করে বললো।

আকিবঃ আমার কোন দোষ নেই। পা বেজে গিয়েছিল। যার কারণে ধপ করে শব্দ হয়েছে। আর আমি পায়ে ব্যাথা পেয়েছি। কিন্তু তুই —–

আকিব পুরো কথা শেষ হওয়ার আগে নীলাভ ওর মুখ চেপে ধরলো।দারোয়ান ওদের সামনে দিয়ে ঘুরে চলে গেল। দারোয়ানটা সম্ভবত চোখে কম দেখে। তাই আকিব বা নীলাভ কাউকে দেখলো না।ওরা যেভাবে লুকিয়ে ছিলো, ভালো করে খেয়াল করলে পেয়ে যেত।দারোয়ান চলে যেতেই নীলাভ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
খুব সাবধানে ফ্যাক্টরীর ভেতরে ঢুকে পরলো।

💗💗💗

সূর্যি মামা পূর্ব দিগন্তে উঁকি মারছে।কিছু সময়ের মধ্যে সারা ধরণী আলোকিত হয়ে উঠবে।আজ ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমায়নি সাহিয়া।চায়ের কাপ নিয়ে ছাদে চলে এসেছে। আজ সূর্য উদয় দেখবে।সাথে এক কাপ চা হলে মুহুর্তটা আরো আকর্ষণীয় লাগবে।সাজিয়া ঘুমাচ্ছে। অনেক রাত পর্যন্ত তুরাগের সাথে কথা বলেছে।যার কারণে নামাজ পড়ে ঘুম দিয়েছে।রেলিঙের সামনে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো।

—- কেমন আছো হিয়া?

একটা ছেলে কণ্ঠ পেয়ে পেছনের দিকে তাকালো সাহিয়া। পাশের দালানের ছাদে মারুফ ভাইকে দেখে মুচকি হাসলো। নিশ্চয়ই এক্সারসাইজ করতে এসেছে। মারুফ আবার সকাল হলে ছাদে এসে জিম করে।সে স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেক সচেতন। ছাদের একপাশে জিম করার নানা জিনিসপত্র। সাহিয়াদের পাশের দালানের বাড়িওয়ালার ছেলে মারুফ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এখন সেখানকার এক বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরীতে জয়েন করেছে।

সাহিয়াঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো মারুফ ভাই।আপনি কেমন আছেন?বাসার সবাই ভালো আছে?

মারুফঃ আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি।সাথে সবাই ভালো আছে। অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম।বাসা থেকে কি বের হও না??

সাহিয়াঃ বাসা আর কলেজ। এছাড়া কোথাও যাওয়া হয় না। তাছাড়া আপনি তো বাসায় থাকেন না।কবে আসলেন রাজশাহী থেকে?

মারুফঃ গত পরশু রাতে আসছি।তুমি অবশ্য ঠিক কথাটাই বলেছো।আমিই তো বাসায় থাকি না।তোমার সাথে দেখা হবে কি করে? বাসায় সবাই ভালো আছে তো?আসলে অনেক দিন হলো চাচা-চাচীর সাথে দেখা হয় না।তাই জিজ্ঞেস করলাম।

সাহিয়াঃ আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে।

মারুফের মনে অনেকক্ষণ ধরে প্রশ্নটা ঘুর ঘুর করছে।শেষে টিকতে না পেরে, আমতা আমতা করে সাহিয়াকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো।

মারুফঃ সাজিয়া কেমন আছে হিয়া?

সাহিয়াঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো মারুফ ভাই।আপুর তো বিয়ে কিছুদিন পর।বিয়েতে কিন্তু অবশ্যই আসবেন মারুফ ভাই।

মারুফঃ হ্যাঁ, মা বললো ওর বিয়ের কথা।ও ভালো আছে তাতেই ভালো।ওর পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে হচ্ছে। এটা শুনে ভীষণ খুশি হয়েছি।কয়জন বা নিজের মনের মানুষকে নিজের করে পায়।সত্যি ঐ ছেলেটা অনেক ভাগ্যবান।তাই তো সাজিয়াকে নিজের করে পাচ্ছে।

কথাগুলো বলতে বলতে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো মারুফ। তার এক তরফা ভালোবাসার মানুষটার কয়েকদিন পর বিয়ে।সে চাইলেও কিছু করতে পারবে না। মারুফ অনেক আগের থেকে সাজিয়াকে পছন্দ করে।একবার সাহস করে সাজিয়াকে প্রপোজও করেছিলো।কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। কারণ সাজিয়া তুরাগের সাথে রিলেশনশিপে জড়িয়ে গেছে। তাই নিজ থেকে সরে এসেছে সাজিয়ার জীবন থেকে। নিজের ভালোবাসাকে গলা টিপে হত্যা করেছে। তারপরেও বাসায় এলে সাজিয়ার খবর নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যায়।একনজর সাজিয়াকে দেখার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে।যদি একপলক দেখতে পায়।বেহায়া মনটা যে মানে না।সেই মানুষটা কিছু দিন পর অন্যের হয়ে যাবে।তারপরেও তাকে দেখতে ইচ্ছে হয়।

সাহিয়াঃ কি ভাবছেন মারুফ ভাই?

মারুফঃ কিছু না হিয়া।আচ্ছা, তুমি থাকো।আমার আজ কিছু ভালো লাগছে না। তাই বাসায় চলে যাই।সময় পেলে আমাদের বাসায় এসো।মা তোমার কথা অনেক বলে।

সাহিয়াঃ চাচীকে আমার সালাম দিবেন।সময় পেলে একদিন বিকেলে চাচীর সাথে দেখা করে আসবো।

মারুফ কোন কথা না বলে নিচে চলে গেল।সাহিয়া আবার আকাশ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।লাল কুসুমের মতো সূর্যটাকে দেখা যাচ্ছে। পাখিরা তাদের খাবার খুঁজতে বাসা থেকে বের হচ্ছে। কিছু সময়ের মধ্যে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পরবে।হাতের কাপটা নিচে রেখে সূর্যদোয় দেখতে মন দিলো সে।

💗💗💗

আজও না খেয়ে বের হতে হয়েছে। তাই রাস্তার পাশের এক দোকানে এসে বসলো নীলাভ।দোকানের কাজ করা ১২ বছরের বাচ্চাটাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো।

নীলাভঃ মামা,আজ খাবারের আইটেম কি কি আছে?

বাচ্চা ছেলেটির নাম সবুজ।সে সামনে এসে দাঁড়ালো। এক গাল হাসি দিয়ে বললো।

সবুজঃ কি খাইবেন মামা?

নীলাভঃ কি কি আছে?

সবুজঃ ভাত, ডাইল,মাংস,মাছ,রুটি,পরোটা,ভাজি।কোনডা লাগবে বলেন?

নীলাভঃ আমার জন্য তিনটা পরোটা আর ভাজি নিয়ে এসো।বেশি কিছু লাগবে না।

ছেলেটা অর্ডার পেয়ে দৌড় লাগালো।নীলাভ শিস বাজাতে বাজাতে এদিক সেদিক চোখ বুলালো।এক হাত দিয়ে টেবিলে তবলা বাজানোর মতো করে শব্দ করছে।আরেক হাতে থাকা কলম দিয়ে টেবিলে বারি মারছে।প্রায় দিনই এই দোকানে খেতে আসে।তখনি ওর কান গেল পূর্ব দিকে থাকা টিভির নিউজে। কলমটা মুখের ঠোঁটের মধ্যে নিয়ে এক ধ্যানে মনোযোগ দিলো নিউজে।

“আজ সকালে মেয়র আমিনুল ইসলামের ফ্যাক্টরী থেকে প্রায় হাজারের ওপর মদের বোতল উদ্ধার করেছে পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে অনেক আগের থেকে এই মদের ব্যবসা থেকে জড়িত আছেন উনি। বিভিন্ন দেশ থেকে নিম্বমানের মদ আমদানি করে সেগুলোকে নতুন করে মোড়কীকরণ করে বাজারে ছাড়েন তিনি।সেগুলো বিক্রিও হয় চড়া দামে।যুব সমাজ ধ্বংস করার হাতিয়ার যদি শহরের মেয়রের হাতে থাকে তাহলে অন্যরা কি করবে?এমনটাই বলছে জনগণ।প্রতিদিন রাতে খুটখাট শব্দ পেতো স্থানীয়রা।কিন্তু পরিত্যক্ত ও পুরনো ফ্যাক্টেরী হওয়ায় কেউ সেখানে যেতে সাহস করতো না।ফ্যাক্টরীটাকে সিল গালা করে দিয়েছে কতৃপক্ষ। গতকাল রাতে আননোন নাম্বার থেকে কল করে এক অজ্ঞাত শুভাকাঙ্ক্ষী পুলিশকে খবর জানায়।প্রথমে বিষয়টা আমলে না নিলেও কিছু সময় পর একটা ভিডিও পাঠায় সে অজ্ঞাত ব্যাক্তি।সেটা দেখে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে ১৭ জনকে আটক করে ও মদের বোতলগুলো জব্দ করে।আটকৃতরা জানিয়েছে মেয়রের আদেশ তারা কাজ করে।তাছাড়া আরেকজন অজ্ঞাত ব্যক্তি আমাদের টিভি চ্যানেলেও সেই ভিডিওটা পাঠিয়েছে। এখন প্রাথমিক সূত্রে ধারণা করা হচ্ছে, পুলিশকে ইনফর্ম করা ব্যক্তি, ভিডিও পাঠানো ব্যক্তি ও আমাদের কাছে যে ভিডিও পাঠিয়েছে সে একজনই হবে।তবে তার খোঁজ কেউ পাইনি।তার ব্যবহৃত নাম্বারটি বন্ধ করে দিয়েছে।আমরা এখন সরাসরি চলে যাবো সেই ভিডিওটি তে।চলুন আমরা দেখে আসি।সমাজসেবার নামে কি করেছেন মেয়র?

নীলাভ এতটুকু শুনেই সামনের প্লেটে থাকা পরোটা ছিঁড়ে ভাজি নিয়ে মুখে পুরলো।মুখে তার রহস্যময়ী এক বাঁকা হাসি।নিউজের মাঝখানে এসে সবুজ পরোটা ও ভাজি দিয়ে গেছে। এক কোণার টেবিলে উল্টো হয়ে বসায় তাকে কেউ খেয়াল করছে না।সবুজ আবারো এসে জিজ্ঞেস করলো।

সবুজঃ মামা,আর কিছু লাগবো।কিছু লাগলে কইতে পারেন।আপনি হইলেন আমগো দোকানের নিয়মিত কাস্টমার।

নীলাভঃ আর কিছু লাগবে না। তুমি আমাকে এক গ্লাস পানি দিয়ে যেয়ো।

সবুজঃ আইচ্ছা। একটা কথা কমু মামা।
(মুখটা কুচোমুচো করে)

নীলাভঃ হ্যাঁ বলো।

সবুজঃ আপনি না দেখতে একেবারে পুতুলের মতো।আপনে তো বড় কোন নায়ক হইতে পারতেন।তাইলে এই সামান্য কাম করেন কে?

নীলাভ মুখে হাসি ঝুলিয়ে গ্লাসে থাকা পুরো পানি ঢকঢক করে শেষ করলো।ছেলেটি এখন চাতক পাখির মতো নীলাভের দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। নীলাভ ওর দিকে তাকিয়ে বললো।

নীলাভঃ জীবনটা অনেক কঠিন।আমি হয়তো চেষ্টা করলে সত্যি নায়ক হতে পারতাম।কিন্তু আমি চেষ্টা করিনি।আর করতেও চাই না।সমাজের উঁচু স্তরের মানুষের সাথে মিশতে আমার ভালো লাগে না। মানুষ যত উপরে উঠে তত তার মধ্যে দাম্ভিকতা বেড়ে যায়।অনেক স্বার্থপর হয়ে উঠে।কিন্তু সমাজের নিচুস্তরের মানুষগুলো হয় সহজ,সরল।কোন প্যাঁচগোছে নেই। তাদের সাথে থাকলে কখনো মনে স্বার্থপরতা জাগায় না।বরং তাদের সাধারণ জীবন-যাপন আমাকে আকৃষ্ট করে।তাই আমি নিচুস্তরে থাকতে চাই। সাধারণ মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাই।তাছাড়া নায়কের প্রফেশনটা আমার পছন্দ নয়।তুমি আরেকটা কথা বলেছিলে।তা হলো আমি কেন সামান্য কাজ করি?সবসময় মনে রেখো,কোন কাজ ছোট নয়।সব কাজকে শ্রদ্ধা করা উচিত।কাজ তো কাজই হয়।সেটা সামান্য,দামী, ছোট,বড় কি করে হয়? আমরা নিজেরাই কাজকে এতগুলো ভাগে বিভক্ত করেছি।মুচি যদি আমাদের জুতো পলিশ না করে দিতো। তাহলে কিন্তু সে জুতো আমাদেরি পলিশ করতে হতো।এছাড়া অনেক উদাহরণ আছে।সেগুলো দিতে গেলে সারাদিন কেটে যাবে কিন্তু উদাহরণ শেষ হবে না। আচ্ছা, অনেক কথা বললাম।আজ উঠি।

সবুজঃ মামা,পানি খাইবেন না।

নীলাভঃ লাগবে না।তোমার নাম কি?এতদিন ধরে আসি অথচ তোমার নামটা জানি না। কেমন কথা দেখেছো?

সবুজঃ আমার নাম সবুজ।মায়ের সবুজ রং অনেক পছন্দ। হের লিগা আমার নাম রাখছে সবুজ।

নীলাভঃ মাশাল্লাহ, খুব সুন্দর নাম।এই নাও টাকা।আজ আসি।নয়তো দেরী হয়ে যাবে।

সবুজঃ মাত্র ৪০ টাকা হইছে।আপনি ১০০ টাকা দিলেন কেন?দাঁড়ান আমি ভাংতি টাকা নিয়ে আসতেছি।

নীলাভঃ দরকার নেই। বাকিটা তোমার বখশিশ।

কথাটা বলে এক মিনিটও দাঁড়ালো না নীলাভ।দোকান থেকে বের হয়ে গেলো।১০০ টাকার নোটটা নিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে নীলাভের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো সবুজ।মানুষটাকে অনেক অদ্ভুত লাগে ওর কাছে।

#চলবে

পুতুল ছেলেটি পর্ব-০৫

0

#পুতুল_ছেলেটি
#Part_05
#Writer_NOVA

হালকা কফি রঙের একটা প্রাইভেট কার চলছে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে। তার মধ্যে সফট মিউজিকের আওয়াজ ভেসে আসছে।ইংলিশ মিউজিক হবে হয়তো।কারণ শব্দগুলো অস্পষ্ট। গাড়ি চালাচ্ছে ৩৭ এর উর্ধ্বে বয়সী এক লোক।তার পাশের সিটে ৩২ বয়সী এক মহিলা।কিন্তু তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তার যে দুটো ছেলে সন্তান আছে।গায়ের রং মাত্রাতিরিক্ত ফর্সা।চোখ দুটো নীল বর্ণের।চুলগুলো ধূসর রঙের। পুতুলের থেকে কোন অংশ কম নয়।লোকটার চুলগুলো কালো।চোখ গুলো ধূসর।পেছনের সিটে বসে আছে ১২ বছরের ও ৮ বছরের দুটো ফুটফুটে ছেলে। বড় ছেলের চোখ নীল ও চুল তার মায়ের মতো ধূসর।আর ছোট ছেলের চোখ মায়ের মতো নীল হলেও চুলগুলো বাবার মতো কালো।সবার মুখে হাসি। ১২ বছরের ছেলেটা মুগ্ধ চোখে বাইরের পরিবেশ দেখছে।আর ছোট ছেলেটা তার হাতে থাকা স্পাইডার ম্যান নিয়ে খেলা করছে।

গতকাল রাতে বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তার আশেপাশে অনেকটা কাঁদাযুক্ত হয়ে আছে।পুরো রাস্তাও কাদায় মাখামাখি। পাহাড়ি রাস্তায় এভাবেই খুব সাবধানে ড্রাইভ করতে হয়।আর বৃষ্টি হলে তো কোন কথাই নেই। একটা বিশাল খাদের পাশ দিয়ে খুব সাবধানে ড্রাইভ করছিলো লোকটি।কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায় ছিলো না।বাঁকে মোড় নিতে গিয়ে কাঁদায় পিছলে গাড়িটা উল্টে খাদে পড়ে যায়। ১২ বছরের ছেলেটি ছিটকে গাড়ি থেকে অপজিট দিকে পরে যায়।আর বাকি তিনজন সহ গাড়িটা খাদে পরে গিয়ে আগুন ধরে যায়।গাড়ি থাকা কেউ বাঁচে না।বাচ্চাটি চোখের সামনে তার বাবা-মা, ও ছোট ভাইকে গাড়িতে জ্বলতে দেখে। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।কিন্তু জনমানবহীন বিরান এলাকায় কেউ ছেলেটার আর্তনাদ শুনতে পায় না।একসময় ছেলেটাও জ্ঞান হারায়।

লাফ দিয়ে ঘুমের থেকে উঠে পরে নীলাভ।আবারো সেই ভয়ানক স্বপ্নটা।সারা শরীর ঘেমে ভিজে একাকার। খাটের পাশে থাকা টুল থাকা জগ থেকে পানি খেয়ে নেয়।বুকটা এখনো ঢিপঢিপ করছে। পাশ থেকে আকিব ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠে।

আকিবঃ কি ব্যাপার তুই ঘুমাসনি?

নীলাভঃ আবার ঐ স্বপ্নটা দেখেছি।

আকিবঃ কোন স্বপ্নটা?

নীলাভঃ বাবা-মা আর ভাইয়ের মৃত্যুর স্বপ্নটা।আমি আজও কেন সেই ঘটনা ভুলতে পারছি না। যত চাইছি ঐ ভয়ানক মুহুর্তগুলো মনে করতে না।ততই আমার সামনে এসে হানা দিচ্ছে। আমি তো ঐ ঘটনাগুলো মনে করতে চাই না।১৪ বছর আগের সেই কালো অধ্যায় কেন আমার স্বপ্নে আসে?

আকিব চোখ দুটো ডলে উঠে বসলো।নীলাভ ছটফট করছে।ওর এখন কিছুই ভালো লাগবে না।

আকিবঃ তুই শান্ত হো।আমাদের জীবনের এমন অনেক বিষাক্ত স্মৃতি আছে।যা আমরা হাজার চেষ্টা করেও ভুলে থাকতে পারি না।ঘুরে ফিরে আমাদের কাছে হাজির হবেই।তোর অতীত তোকে হানা দেবেই নীলাভ। এখন এসব না ভেবে ঘুমিয়ে পর।

নীলাভঃ আমি তো চাই না ঐ ভয়ংকর স্মৃতি মনে করতে।সব ভুলে নিজেকে শক্ত করে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। তাহলে কেন আমার স্বপ্নে এসে সব এলোমেলো করে দেয়। তুই ঘুমিয়ে পড়।আমার আজ রাতের ঘুম হারাম।

নীলাভ উঠে তার রুমের সাথে ছোট বারান্দায় গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।আকিব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুয়ে পরলো।সেদিনের বেঁচে থাকা ১২ বছরের ছেলেটি আজকের নীলাভ সফওয়াত।তার বাবা-মা ও ছোট ভাইকে নিজের চোখের সামনে জ্বলে,পুড়ে যেতে দেখেছে।তীব্র ইচ্ছা থাকতেও সে পারেনি তাদেরকে বাঁচাতে।

💗💗💗

সকালের নাস্তা সেরে মাত্রই উঠেছে হাবিবুর রহমান। চিন্তায়, চিন্তায় তার ডায়বেটিসও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে।রুমে গিয়ে সোফায় মাথাটা হেলিয়ে দিলো। এখনো ঐ নীল চোখের ছেলেটাকে পাওয়া যায়নি।তার সব পাপের প্রমাণ আছে ছেলেটার কাছে।একবার খবরের কাগজে সেটা ছাপা হয়ে গেলে তার সুখের সম্রাজ্য শেষ। মিনারা খাতুন পানের বাটা নিয়ে তার স্বামীর পাশে এসে বসলো।

মিনারাঃ কি হয়েছে আপনের?কয়েকদিন ধইরা দেখতাছি আপনি সারাদিন কি জানি চিন্তা করেন?কাজ-কাম দেখতেও যান না।ফ্যাক্টরীতে একটা উঁকি মাইরাও তো আসতে পারেন।সারাদিন রুমে শুইয়া,বইসা না থাইকা ফ্যাক্টেরীতে গেলেও তো একটু ভালো লাগবো।

হাবিবঃ কানের সামনে ক্যাট ক্যাট করো না তো মাহিমের মা।আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। তোমার এই ক্যাট-ক্যাটানিতে আরো খারাপ লাগবে।

মিনারাঃ আল্লাহ,কি হইছে আপনার মাহিমের আব্বা?শরীর কি অনেক খারাপ লাগতাছে? ডাক্তার ডাকমু।কথা কোন না কে?ও মাহিমের আব্বা।

হাবিবঃ মাইয়া মানুষ নিয়া এই একটাই জ্বালা।সবসময় চার লাইন বেশি বোঝে।যেটা না বলবো তাতো বুঝবোই।সাথে আরো তিন লাইন বেশি জুড়ায় নিবো।তোমারে কি আমি বলছি আমার অনেক খারাপ লাগছে।বরং আমি বলছি এমনি ভালো লাগছে না। তোমার ফালতু প্যাঁচাল শুনলে আরো খারাপ লাগবে।

মিনারাঃ আমি ভালো কথা কইলেও তো আপনের ভালো লাগে না। আমি মূর্খ-সুর্খু মানুষ। গ্রামের মাইয়া।বেশি পড়ালেখা করবার পারি নাই।ক্লাশ সিক্স পর্যন্ত পড়ছিলাম।তারপর তো আপনে দেখতে আইয়া পছন্দ কইরা ফালাইলেন।আর আব্বায় আপনার সাথে বিয়া দিয়া দিলো। তবে আমি ভালো কইরা স্বামীর যত্ন-আত্তি করতে পারি।আপনি হইলেন মেট্রিক পাশ করা পোলা।গ্রামের চেয়ারম্যান। আপনার লগে কি আমার জোড়া।

হাবিবঃ মাহিমের মা,তুমি আবার শুরু করলা?এসব ছাড়া কি তোমার কোন কথা নাই?

মিনারাঃ মাহিমের আব্বা, পোলায় কি আপনেরে কল করছিলো?বউ,বাচ্চা লইয়া ভালো আছে তো?কতদিন ধইরা পোলাডারে একনজর দেহি না।একটামাত্র পোলা আমগো।কত আশা ছিলো আমগো সাথে থাকবো।কিন্তু ঐ বিদেশি মাইয়া বিয়া কইরা ঐ জায়গায় রইয়া গেল।

হাবিবঃ এই করোনার মধ্যে কি ছেলে আসতে পারবো?আমি তোমাকে ভিডিও কলে কথা বলায় দিবোনি।তাও তুমি এসব কথা বন্ধ করে তোমার কাজে যাও।আমাকে একটু একা থাকতে দেও।

মিনারা খাতুন পানের বাটা থেকে পান বের করে তার মধ্যে যাবতীয় জিনিসপত্র দিতে লাগলো।তারপর পানটাকে ভালোমতো মুড়িয়ে মুখে পুরে নিলো।আঙুলের ডোগায় চুনের ডিব্বা থেকে চুন নিলো।পানের বাটা পাশে রেখে স্বামীকে প্রশ্ন করলো।

মিনারাঃ আচ্ছা, আপনি কি করোনার ঔষধ বানাইতে পারেন না?আপনিও তো ম্যাট্রিক পাশ করা।সেই কালের ম্যাট্রিক পাশ তো এই যুগে অনেক দামী।আপনেও তো চেষ্টা করলে বানাইতে পারেন।আপনি পারেন না এমন কোন কাম আছে নাকি।আপনি হইলেন এই গ্রামের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আপনি করোনার ঔষধ বানাইলে তো আমগোর গ্রামের সবাই সুস্থ থাকবো।

স্ত্রীর কথা শুনে হাবিবুর রহমান হাসবে না কাঁদবে তাই বুঝতে পারছেন না।তাই আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলেন।মাথার ভেতর চিনচিন করে রাগ উঠছে।স্বামী তার দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে মিনারা খাতুন পান চাবাতে চাবাতে একটা মন কাড়া হাসি দিলো।তাতে হাবিবুর রহমানের আরো বেশি রাগ উঠলো।কিন্তু কোন কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

💗💗💗

সকাল থেকে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে সাহিয়া।বাসায় মেহমান মানেই তো একগাদা কাজ-কর্ম। তা যদি হয় বড় বোনের হবু শ্বশুরবাড়ির মানুষ। তাহলে তো কোন কথাই নেই। সারা রুম গুছিয়ে সবেমাত্র বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলো সাহিয়া।সেই মুহুর্তে মেহমান চলে এলো।সাজিয়ার হবু বর তুরাগ,তার বাবা-মা, ছোট ভাই তোরাব,বড় বোন তুশি ও তার হাজবেন্ড আরাফ এসেছে। তুশি ও আরাফের ছোট ২ বছরের মেয়ে আফিফাও আছে।

সাজিয়াঃ হিয়া,ওরা চলে এসেছে। শরবতটা ফ্রীজ থেকে বের করে সার্ভ করে দে।

সাহিয়াঃ কয়েকদিন তোমার বিয়ে। এখন তাদের আসার কি দরকার তা আমি বুঝলাম না।(বিরক্ত হয়ে)

সাজিয়াঃ চুপ কর মেয়ে। কি যা তা বলিস?তারা শুনতে পেলে খারাপ বলবে।আমার ননদের জামাই আমাকে সামনাসামনি দেখতে চেয়েছে। আর্মির চাকরী করে তো। তাই বিয়ের সময় ছুটি নিয়ে আসতে পারবে না।

সাহিয়াঃ তাহলে পরেই আসতে পারতো।এখন আসার কি দরকার ছিলো?

সাজিয়াঃ একটা চড় লাগাবো। চুপ কর।আর যা বলছি জলদী কর।তোর যে কি হয়েছে? আমিও বুঝতে পারছি না। আগে তো কখনও এসব কথা বলিস নি।

সাহিয়াঃ তোমায় ডাকছে। তুমি যাও।আর আমাকে নিয়ে গবেষণা করতে হবে না।

সাজিয়া চলে গেল। সাহিয়া নিজের মনে তার বোনের কথাগুলো ভেবে নিজেই অবাক হলো।তাই তো,ও তো কখনো এরকম করেনি। তাহলে হঠাৎ কি হলো?ঐ পুতুল ছেলেটি কে দেখার পর থেকে সে অনেকটা খিটখিটে মেজাজের হয়ে গেছে। কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না।একা থাকতেই ভালো লাগে। আর ঐ ছেলেটাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। কোন কাজেই মনোযোগ বসে না।

বেশি কিছু না ভেবে শরবত ও অনান্য খাবার নিয়ে তাদের সামনে গেলো সাহিয়া। সেখানে বেশি সময় থাকলো না।দুপুরের সবার সাথে খাবার খেতে বসতে চায়নি হিয়া।ওর হবু দুলাভাই জোর করে ওকে নিয়ে সবার সাথে বসালো।কিন্তু সেখানে গিয়ে পরলো বিপাকে।বার বার আড়চোখে তোরাব, সাহিয়াকে দেখছে।একসময় কথাও বলে উঠলো।

তোরাবঃ তা বিয়াইন এবার কি SSC দিবেন নাকি?পড়াশোনা কেমন চলছে?আপনাকে দেখতে কিন্তু অনেকটা বাচ্চা লাগে।আপনি কি আরো নিচের ক্লাশে পড়েন নাকি?

সাহিয়া তার বোনের দিকে তাকালো।সাজিয়া মিটমিট করে হাসছে।সাহিয়া নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে মুখে হাসি ঝুলিয়ে উত্তর দিলো।

সাহিয়াঃ নাহ্ ভাইয়া।আমি এবার অনার্স ২য় বর্ষে পড়ালেখা করছি।আর আমাকে দেখে যতটা বাচ্চা মনে হয় ততটা বাচ্চা আমি নই।তাই আমাকে বাচ্চা ডাকা বন্ধ করুন।আমি যথেষ্ট ম্যাচুউর।আমার বয়স ২৩ বছর।মুখে বাচ্চা ভাব আছে বলেই যে আমি বাচ্চা মেয়ে এমনটা ধরণা করেন না।

তোরাব হা করে তাকিয়ে রইলো।বলে কি মেয়েটা?এর নাকি ২৩ বছর।দেখে মনে হয় এবার SSC পরীক্ষা দিবে।তাই তো সে পরীক্ষার কথা জিজ্ঞেস করেছিলো।মেয়েটার মুখে বাচ্চা ভাব দেখে কখনো বুঝেনি যে এত বড় মেয়ে। সাহিয়া কিছুটা বিরক্ত হয়ে জলদি করে খাবার খেয়ে চলে এলো।

যদিও এটা প্রথম নয়।প্রায় সবাই তাকে বাচ্চা মেয়ে ভাবে।সাহিয়াকে দেখে বাচ্চা মনে হয় বলে, অনেকে তো বিশ্বাসও করতে চায় না যে ও অনার্সে পড়ে।নীলাভও তো ওকে বাচ্চা মেয়ে ভেবে বসে আছে।এই ধরনের পরিস্থিতিতে সাহিয়া আগেও বহুবার পরেছে। প্রথম প্রথম রাগ লাগলেও এখন কিছু মনে করে না। তাছাড়া সেখান থেকে চলে আসার আরেকটা কারণ আছে। সেটা হলো তোরাবের হাব-ভাব ভালো ঠেকছে না সাহিয়ার।তোরাবের কথার আকারে-ইঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে সে সাহিয়াকে পছন্দ করে ফেলেছে।বড় বোনের দেবর থাকলে এই আরেক সমস্যা। চান্স মারতে ভুলবে না।কিন্তু এই তোরাব কি করবে তা আল্লাহ মালুম!!!

#চলবে

পুতুল ছেলেটি পর্ব-০৪

0

#পুতুল_ছেলেটি
#Part_04
#Writer_NOVA

ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুললো সাহিয়া।তবে ঝামেলা বাঁধালো সিল্কের ওড়নাটা।দরজার ছিটকিনির সাথে বেজে গেল।মিনিট তিন পর অনেকটা টানাটানির পর ছুটাতে পারলো।কিন্তু সামনে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেলো।কারণ পিৎজার বক্সটা নিচে রাখা।আশেপাশে কোন মানুষ নেই। বাইরে বেরিয়ে এদিক-সেদিক ডেলিভারি বয়কে খুঁজলো। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না।তাতে রাগ উঠে গেলো সাহিয়ার।জোরে চিৎকার দিয়ে সাজিয়াকে ডাকলো।

সাহিয়াঃ দিদিয়া,দিদিয়া।কোথায় তুমি?

সাজিয়াঃ কি হয়েছে? এমন ষাঁড়ের মতো চেচাচ্ছিস কেন?আসছি আমি।(কিচেন থেকে উত্তর দিলো)

সাহিয়াঃ কোন অনলাইন শপ থেকে পিৎজা অর্ডার করেছিলে?তাদের কি কোন কমন সেন্স নেই। নাকি খাবারের সাথে সব খেয়ে ফেলেছে।কেউ এরকম করে পিৎজা ডেলিভারি দেয়।যেই বয়কে পাঠিয়েছে নির্ঘাত আস্ত এক গাধা।হিতাহিত জ্ঞান না থাকলে কেউ কি এমন বেআক্কল মার্কা কাজ করে।এরকম ডেলিভারি বয় কাজে রাখে কেন তারা?(রেগে)

সাজিয়া কিচেন থেকে টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে সাহিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো।

সাজিয়াঃ কি হয়েছে? এত চেচামেচি করছিস কেন?

সাহিয়াঃ কি হয়নি তাই বলো?কেউ এরকম করে পিৎজা ডেলিভারি দেয়।দরজার বাইরে, নিচে বক্সটা ফেলে রেখে চলে গেছে। আমি আজই কোম্পানির নামে কমপ্লেন করবো।

সাজিয়াঃ অর্ডার কনফার্ম করেছে?

সাহিয়াঃ কি করে করবে?আমি তো কোন মানুষই দেখতে পেলাম না।দরজা খুলে দেখলাম পিৎজার বক্সটা নিচে রাখা আছে।এটা দেখেই তো মেজাজটা আমার গরম হয়ে গেছে।

সাজিয়াঃ মাথা ঠান্ডা কর তুই। নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।তাই ডেলিভারি বয় এমন করেছে।

ওদের কথার মাঝখানে ১০ বছরের একটা পিচ্চি ছেলে আশিক হাতে অর্ডার কনফার্ম করার কাগজ নিয়ে ওদের সামনে দাঁড়ালো। আশিক ওদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে।

আশিকঃ হিয়া ফুপ্পি,জিয়া ফুপ্পি। এই নাও ধরো।এই টিক চিহ্নের জায়গায় একটা সাইন করে দেও তো।

সাজিয়াঃ তুই এই কাগজ কোথায় পেলি আশিক?

সাহিয়াঃ অর্ডার কনফার্মের কাগজ ওর হাতে কি করে এলো দিদিয়া?(অবাক হয়ে)

সাজিয়াঃ আমারও তো সেইম প্রশ্ন।আশিক, তুমি এই কাগজ কোথায় পেলে?

আশিকঃ একটা ক্যাপ পরা সুন্দর চাচ্চু, আমার হাতে এই কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে বললো তোমাদের বাসায় আসতে।তারপর তোমাদের দুজনের থেকে একজনের এই টিক চিহ্নে সাইন নিতে।আমি বললাম,তুমি করে নিয়ে আসো আমি পারবো না।সে বললো,তার নাকি একটু সমস্যা আছে।তাই যেতে পারবে না।

সাজিয়াঃ আচ্ছা দেও আমি সিগনেচার করে দিচ্ছি।

সাহিয়াঃ একদম না দিদিয়া।সিগনেচার করবে না। মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি।উনি দরজার সামনে পিৎজার বক্স ফেলে রেখে যাবে।আর আমরা তা মেনে নিয়ে অর্ডার কনফার্ম করবো।তা কখনও না।এই ডিলেভারি বয়ের নামে আমি অবশ্যই কমপ্লেন করবো।

সাজিয়াঃ বাদ দে তো।আশিক তো বললোই ছেলেটার সমস্যা আছে। এত ঝামেলা করার দরকার নেই।

সাজিয়া, আশিকের থেকে কাগজটা নিয়ে সাইন করে দিলো।এতে সাহিয়া রাগ করে মুখটা গোমড়া করে রাখলো।আশিক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেল।

💗💗💗

নীলাভ দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে।এত সময় হয়ে গেল কিন্তু বাচ্চা ছেলেটা আসছে না।এতক্ষণে তো চলে আসার কথা।এখন বেশ বিরক্ত লাগছে তার।

সাহিয়া দরজা খুলতেই নীলাভ ওর মুখ দেখে ওকে চিনে ফেলেছিলো।কিভাবে সেখান থেকে পালাবে তার চিন্তা করতে লাগলো।কিন্তু এবারো আল্লাহ সহায় ছিলো।তাই সাহিয়ার ওড়নাটা দরজার ছিটকিনির সাথে বেজে গেল।আর সাহিয়া ওড়না ছুটাতে এতটাই ব্যস্ত ছিলো যে সামনের দিকে নজর দেয়নি।যার ফলে নীলাভকে দেখতে পায়নি।এই সুযোগে নীলাভ নিচে পিৎজা বক্স রেখে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে চলে এসেছে। কিন্তু নিচে আসার পর সিগনেচারের কথা মনে হয়েছে। তখনি আশিককে দেখতে পায়।অনেক বুঝিয়ে, শুনিয়ে, চকলেট দেওয়ার কথা বলে ওকে ওপরে পাঠায়।

নীলাভঃ বাচ্চাটা আসছে না কেন?এখানে বেশি সময় থাকা আমার জন্য রিস্ক। বুঝি না ঘুরে ফিরে ঐ বাচ্চা মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে যায় কেন?আজকে গিয়ে আকিবকে মোয়া বানাতে হবে।ওর কথাই সত্যি হয়ে গেল।আমি যদি জানতাম এই বাচ্চা মেয়েটার বাড়িতে আমাকে আসতে হবে। তাহলে কখনি আসতাম না।যেখানে যাই সেখানেই এই মেয়েটাকে দেখতে পাই।ও সামনে এলেই আমি সবকিছু ভুলে যাই কেন?পুরো পৃথিবী অন্ধকার দেখি।হৃৎপিণ্ডটা অবাধ্য হয়ে যায়।নীলাভ, ডক্টর দেখা। তোর হার্টের প্রবলেম হয়েছে।

নিজের মনে বিরবির করতে লাগলো নীলাভ।পড়ন্ত বিকেলের আবছা আলো ওর মুখে পড়ছে।সবকিছু ঘোলাটে লাগছে।আশেপাশে কোন মানুষ না দেখে মাস্কটা খুলে চোখে সাধারণ চশমা পরলো।এটা ওর ব্যাগে থাকে।কিন্তু ঠিক সেই সময় পরলো আরেক বিপদে।বাজার থেকে ফিরছিলো মিজান সাহেব।তিনি সাহিয়ারা যেই দালানে ভাড়া থাকে সেই দালানের মালিক।তাকে দেখে নীলাভের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো।

নীলাভঃ এবার নিজেকে কিভাবে লুকাবো? যত চায় মানুষের সম্মুখে না থাকতে।তত তাদের সামনে পরে যাই।এখন তো আমাকে নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিবে।কিছু একটা কর নীলাভ।মাথা খাটা তুই। আইডিয়া!!! পেয়ে গেছি।পুতুলের মতো ক্যাপ ধরে দাঁড়িয়ে থাকি।

যেমন ভাবা তেমন কাজ।কালো টুপি ধরে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।মিজান সাহেব অনেকটা কাছে চলে এসেছে। যার কারণে নীলাভ এখন ব্যাগ থেকে মাস্ক ও পকেট থেকে সানগ্লাস বের করে পরতে গেলে দেরী হয়ে যাবে। মিজান সাহেব গেইট দিয়ে প্রায় ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিলেন।কিন্তু হঠাৎ মনে হলো তিনি কিছু দেখলেন।তাই পিছু ফিরে এগিয়ে সামনে চলে এলেন।

মিজানঃ এই পুতুল আনলো কেডায়?দেইখা তো জীবন্ত মানুষ মনে হইতাছে।ঐ আক্কাইসা? তোরে কি দিন দুপুরে ঘুমানের লিগা দারোয়ানের চাকরীতে রাখছি।এই পুতুল এইহানে রাখছে কে?তুইল্লা নিয়া ড্রেনে ফালায় দিয়া আয়।

নীলাভের সামনে এসে তার পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো খিলাল করতে করতে চিৎকার করে কথাগুলো বললো মিজান সাহেব। পড়াশোনা বেশি জানে না। তবে ঢাকায় তার নিজস্ব দুটো দালান আছে।সেগুলোর ভাড়া দিয়ে তার বহু ইনকাম হয়।তার দালানের ৪র্থ তালায় সাহিয়ার পুরো পরিবার ভাড়া থাকে।

💗💗💗

নীলাভ পরে গেলো বিপদে।নিজের মনে বিরবির করে নিজেকে বকতে লাগলো।এখন বিরক্তিটা বেশ জড়ালোভাবে তাকে জেঁকে বসেছে।

নীলাভঃ যত চাই ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে।তত ঝামেলা বেড়ে যায়।আল্লাহ বাঁচাও। কেন যে সানগ্লাস আর মাস্কটা খুলতে গেলাম।ঐ পিচ্চি ছেলেটারও আসার কোন নাম নেই। এদিকে এই চাচাতো আমাকে পুতুল ভেবে বসে আছে। নাহ্, আমি এখন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি। আল্লাহ, তুমি যখন আমাকে বাংলাদেশে রাখবে তাহলে কেন এইরকম পুতুলের মতো বানালে।যেখানে যাই বিপদে পরে যাই।(মনে মনে)

মিজানঃ ঐ আক্কাইসা।ডাকলে কি হুনোস না?তোর চাকরী নিয়া যামু।যদি আরেকবার ডাকতে হয়।

ছোট একটা রুম থেকে দৌড়ে ১৯ বছরের একটা ছেলে দৌড়ে বেরিয়ে এলো।নীলাভ সিউর হলো এটাই আক্কাস হবে।গেইটের দারোয়ান।

আক্কাসঃ জে চাচা বলেন।

মিজানঃ তুই কি মরছিলি?তোরে ডাইকা পাওয়া যায় না কে?এই পুতুল এইহানে রাখলো কে?জলদী কইরা এডারে সরা।আমি জানি ১০ মিনিট পর এডারে না দেহি।যদি পুতুল দেহি তাহলে তোরে এই বাড়িতে দেখতে চাই না।কারণ আমি দুই অকর্মা একসাথে দেখবার চাই না।

মিজান সাহেব চলে গেলেন।আক্কাস পরে গেলো বিপাকে।কারণ এত বড় পুতুল ওর মতো ছোকরা ছেলে উঠানোর মতো সামর্থ নেই। তাছাড়া এটা কোথা থেকে এলো তাও জানে না।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নীলাভকে দেখতে লাগলো আক্কাস।ঘুরে ঘুরে দেখছে সে।

আক্কাসঃ আমার কাছে মনে হইতাছে এডা একটা জ্যান্ত মানুষ।কিন্তু বাড়িয়ালা চাচায় যহন কইছে, এডা পুতুল।তার মানে এডা পুতুলই।কিন্তু এই পুতুল আনলো কেডায়?আমি তো কাউরে দেখলাম না।পরলাম তো বিপদে।এই গাট্টা-গোট্টা পুতুলডারে আমি তুলমু কেমনে?আর ড্রেনে ফালামু কেমনে?আমি তো এডারে উঠাইতে গেলে নিচে চাপা পইরা চেপ্টা হইয়া যামু।এই চাচায় যত ভেজালে আমারে হালায়।

আক্কাস ক্লাশ ফোর পর্যন্ত গ্রামের স্কুলে পরেছিলো।তারপর অভাব অনটনের কারণে আর পড়ালেখা করতে পারেনি।বছর দুয়েক ধরে মিজান সাহেবের এই দালানের দারোয়ানের চাকরী করে।খুব সহজ সরল,বোকা ছেলে আক্কাস।প্যাঁচগোছ বোঝে না।

গালে হাত দিয়ে চিন্তা করার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো আক্কাস।তখনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেইটের সামনে, আশিক কাগজ সহকারে ছুটে এলো।

আশিকঃ সরি চাচ্চু।আম্মু ডাকছিলো।তাই আসতে এতো দেরী হয়ে গেলো।এই নেও তোমার কাগজ।এবার আমার চকলেট দেও।

আক্কাসঃ এই পুতুলের লগে কি কথা কস আশিক?

আশিকঃ কি বলো আক্কাস ভাইয়া?এটা পুতুল হবে কেন?এটা তো একটা মানুষ।

এবার নীলাভ মুচকি হেসে ক্যাপের থেকে হাত সরিয়ে আশিকের দিকে তাকালো।পকেট থেকে কতগুলো চকলেট বের করে আশিকের হাতে দিলো।তারপর কাগজটা নিয়ে গেইট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।তা দেখে আক্কাসের তো চোখ কোটর থেকে বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ভূত,ভূত করে চিৎকার করতে করতে নিজের রুমের দিকে দৌড় লাগালো।আর আশিক, আক্কাসের কাহিনি দেখে হাসতে হাসতে বসে পরলো।একটা মানুষকে দেখে আক্কাস ভূত বলছে।সেটা ভেবে ছোট্ট আশিক হেসেই যাচ্ছে। নীলাভ এক মিনিটও দেরী করলো না।মুখে মাস্ক ও চোখে সানগ্লাস পরে বাইকে বসেই চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিলো।

#চলবে

রি-চেইক দেওয়া হয়নি।ভূল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন🙃🙃।

পুতুল ছেলেটি পর্ব-২+৩

0

#পুতুল_ছেলেটি
#Part_02_03
#Writer_NOVA

সেদিনের কথা মনে করে মিটমিট করে হাসছে নীলাভ।
অল্পের জন্য রক্ষা হয়েছিলো।মেয়েটা ওকে দেখে ভয় না পেয়ে সুন্দর করে ওকে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলো।হ্যাঁ সেই পুতুল ছেলেটি ছিলো নীলাভ সফওয়াত।চোখের রং নীল হওয়ার দরুন বাবা নাম রেখেছিলেন নীলাভ।চুলগুলো তার ধূসর বর্ণের হওয়ায় অসম্ভব সুন্দর লাগে দেখতে।আসলেই কিন্তু সে দেখতে একদম পুরো পুতুল ছেলে।

দুই দিন আগে…..

খুব দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে নীলাভ। আল্লাহ আজ তার সহায় ছিলো।নয়তো আর কয়েক সেকেন্ডে সে মেয়েটার কাছে ধরা পরে যেতো।যাদের ধরতে সে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো তাদের তো ধরতে পারলোই না।মাঝে থেকে বাচ্চা মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে গেল।ওকে নিয়ে মেয়েটা কতকিছু ভেবে বসে আছে। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে যেতেই ওর বন্ধু আকিবের সাথে দেখা।

আকিবঃ এতো দেরী হলো যে?ধরতে পেরেছিস।

নীলাভঃ কোথায় পারলাম?তার আগেই তো ঐ মেয়েটা সব গোলমাল করে দিলো।একটুর জন্য ধরা পরি নি।

আকিবঃ কোন মেয়েটা?

নীলাভঃ আর বলিস না।একটা বাচ্চা মেয়ে আমাকে নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলো।পুতুল সেজে দাঁড়িয়ে ছিলাম।অথচ মেয়েটা আমাকে নিয়ে কতকিছু ভাবলো।তবে আশ্চর্য ব্যাপার ও যখন আমার কাছে আসলো আমার হৃৎপিণ্ডটা খুব জোরে ধুকপুক করতে লাগলো।আমি না চাইতেও আমার নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছিলো।জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলাম।চোখের পলক খুব দ্রুত পরছিলো।এক মুহূর্তের জন্য আমার পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছিলো।

আকিবঃ আমায় পুরো ঘটনা খুলে না বললে,আমি তোর কথার আগামাথা কিছুই বুঝবো না।

নীলাভ ওর বন্ধুকে সব কিছু খুলে বললো।আকিব মুচকি হেসে বললো।

আকিবঃ দোস্ত তুই প্রেমে পরে গেছিস।একে বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট।যাক, তোর মতো একটা ছেলেও যে কারো প্রেমে পরতে পারে তা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। অবশ্য আল্লাহ তোকে পুরো পুতুলের মতো সৃষ্টি করেছে।এটা তে কোন ভুল নেই। তাহলে মেয়েটা তোকে কেন পুতুল বলবে না বল।তারপর আবার দাঁড়িয়েছিলি পুতুলদের মাঝখানে।

নীলাভঃ ধূর,তেমন কিছু নয়।এভাবেই হয়তো সকাল থেকে কিছু না খাওয়া বলে হয়েছে। তাছাড়া এতো কাছে একটা মেয়েকে আসতে দেখে নার্ভাস হয়ে গিয়ে ছিলাম।এছাড়া আর কিছু নয়।

আকিবঃ তুই কখনো কিছু স্বীকার করতে চাস না।চল,সামনের হোটেল থেকে কিছু খেয়ে নেই।

নীলাভঃ হুম চল।

নীলাভ ও আকিব সমান তালে একসাথে হাঁটতে লাগলো।বাইরের পরিবেশে পা রাখার আগে নীলাভ মুখটা মাস্ক দিয়ে ঢেকে ফেললো।চোখে কালো সানগ্লাস পরে নিলো।নয়তো রাস্তার সব মানুষ তাদের কাজকর্ম ফেলে ওর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে।যা নীলাভের সবচেয়ে বেশি অসহ্য লাগে।তাই সবসময় নিজেকে লুকিয়ে রাখে।তাছাড়া অন্য কারণও আছে।
সেটা নাহয় আমরা পরে জানবো।

ভাবনা থেকে ফিরে নিজের মনে হেসে উঠলো নীলাভ। মুচকি হেসে নিজের কাজে চলে গেল সে।

💗💗💗

সেদিনের পর থেকে কোনকিছু ভালো লাগে না সাহিয়ার।কিরকম মনমরা হয়ে গেছে সে।আসলে বিষয়টা নিয়ে সে অনেক বেশি চিন্তিত। যার কারণে অন্য কোন দিকে নজর দিতে পারছে না। কলেজ থেকে বাবার সাথে ফিরছিলো।দুই গালে হাত দিয়ে গাড়ির কাচ খুলে এক ধ্যানে বাইরে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ একটা ছেলেকে দেখে জোরে চেঁচিয়ে উঠলো।

সাহিয়াঃ বাবাই,বাবাই গাড়ি থামাও। আমি বলছি গাড়ি থামাও।ঐ যে ঐ পুতুলটা।

তানজিল আনজুম সাহেব গাড়ি ব্রেক কষে তার মেয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন।

তানজিলঃ কোন পুতুল হিয়া মা-মণি?

সাহিয়াঃ ঐ যে শপিংমলে যে পুতুলটাকে দেখেছিলাম।মাত্র সে ঐ দেয়ালের আড়ালে চলে গেল।

তানজিলঃ কোন শপিংমল, কোন পুতুল তুই কি বলছিস? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

সাহিয়াঃ আমি তোমাকে পরে সব বুঝিয়ে বলছি। তুমি এখানে বসো আমি এই যাবো এই আসবো।

তানজিলঃ হিয়া শোন,যাক বাবা চলে গেল। এই মেয়েটার আবার কি হলো?

সাহিয়া গাড়ির দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে সেদিকে দৌড়ালো।যেদিকে সেই পুতুল ছেলেটাকে দেখেছে।জুতা পরে দৌড়াতে পারছে না বলে জুতা খুলে হাতে নিয়েই দৌড় দিলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে নিরাশ হতে হলো।কারণ কোন ছেলেই নেই। এবারো নিজের চোখের ভুল বলে, নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে, গাড়ির দিকে পা বাড়ালো।

তানজিলঃ গাড়ি মাঝ রাস্তায় দাঁড় করিয়ে মেয়েটা কোথায় গেলো? এতবড় হয়েছে কিন্তু এখনো বাচ্চামো স্বভাব যায়নি।কিছু দিন পর ওর বোনের বিয়ে।কত কাজ বাকি?সেখানে এই মেয়ের জন্য দেরী হবেই হবে।

সাহিয়াঃ চলো বাবাই।কেউ ছিলো না। হয়তো আমি ভুল দেখেছি।আমার যে কি হয়েছে আমি নিজেও জানি না।

তানজিলঃ কোথায় গিয়েছিলি?

সাহিয়া কোন উত্তর না দিয়ে তানজিল সাহেবের পাশের সিটে গোমড়া মুখে বসে পরলো।তানজিল সাহেবের দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে সেও কথা না বাড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

আড়াল থেকে নীলাভ পুরো বিষয়টা দেখে বড় করে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো।আজও সে বেঁচে গেছে। মনে মনে আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া জানালো।

নীলাভঃ আল্লাহ আজও বাঁচিয়েছো।এই মেয়েটার সাথে এমন হুটহাট করে দেখা কেন হয়ে যায়?বুকের বা পাশটা এখনো ধুকপুক করছে।ওকে দেখলে সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে যায় কেন?নিজের আশেপাশের কোন খবর থাকে না।হৃৎপিণ্ডটাও অবাধ্য হয়ে যায়।এর আগে তো কখনো কোন মেয়েকে দেখে এমন ফিল করিনি।তাহলে এমনটা কেন হচ্ছে? ও আশেপাশে থাকলে আমি টের পাই।বুকটা হুট করে ধুক করে উঠে।নিশ্বাস ঘন হয়ে যায়।রিলেক্স নীলাভ।এটা তোর মনের ভুল ছাড়া অন্য কিছু নয়।তুই এসবকে পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দে।

আড়াল থেকে বের হলো নীলাভ।দুপুরের কাঠ ফাটা রোদে রাস্তায় কোন মানুষ না দেখে মুখের মাস্ক ও সানগ্লাসটা খুলে ফেলেছিলো।কিন্তু কে জানতো এই বাচ্চা মেয়েটার সাথে আবার দেখা হয়ে যাবে।সাত-পাঁচ না ভেবে বুকে ফুঁ দিয়ে তাড়াহুড়ো করে স্থান ত্যাগ করলো সে।

💗💗💗

রকিং চেয়ারে খুব গম্ভীর মুখে বসে আছেন হাবিব রহমান।রাত হয়েছে বেশ। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। থাকবে কি করে?তার পাপের সম্রাজ্য যে ধ্বংসের পথে নামছে।তার আগাম আভাস সে পাচ্ছে। হন্যি হয়ে পুতুলের মতো দেখতে ছেলেটাকে সারা বাংলাদেশ খুঁজে হয়রান হয়ে গেছে সে।কিন্তু সেই নীল রঙা চোখের পুতুল ছেলেটির কোন খবর কেউ এনে দিতে পারছে না।অথচ সে পুতুল ছেলেটি তার ও তার লোকের আগেচরে তার সমস্ত তথ্য জোগাড় করে ফেলছে।কিন্তু সে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে। কপাল ডলছে আর নানা বিষয় চিন্তা করছে।টেবিল থেকে নিজের মোবাইলটা নিয়ে তার সহকারি রবিনকে কল করলো।

রবিনঃ আসসালামু আলাইকুম চাচা।

হাবিবঃ অলাইকুম আস সালাম। খবর কি?আর কতদিন লাগবে ঐ ছেলেকে খুঁজতে? ও আড়ালে থেকে আমাদের সব তথ্য জোগাড় করে ফেলছে। আর আমরা হাত-পা গুটিয়ে কলের পুতুলের মতো বসে আছি। তোদের কিসের জন্য রেখেছি আমি?একটাও কাজের কাজ করতে পারিস না।একটা ভিন্ন দেশের ভিন্ন রকম পুতুলের মতো দেখতে ছেলে আমাদের নাকের ডোগা দিয়ে সব কিছু করে ফেলছে।আর তোরা এখনো সারা ঢাকা শহর খুঁজে ওকে বের করতে পারছিস না।তোদের একেকটাকে ইচ্ছে করছে জ্যন্ত পুঁতে ফেলতে।(রেগে)

রবিনঃ চাচা,আপনি রাগবেন না।আমরা আমাদের সাধ্যের মধ্যে সব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ব্যাটা অনেক চালাক।তাই বারবার পিছলিয়ে যাচ্ছে আমাদের হাত থেকে। কিছু দিন সময় দিন। আমরা ঐ ব্যাটাকে আপনার পায়ের সামনে হাজির করবো।

হাবিবঃ তোরা যে কি করবি তা আমার বোঝা হয়ে গেছে। আমাকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। তোদের আশায় থাকলে আমার সম্রাজ্য খুব শীঘ্রই গুড়িয়ে যাবে।আমি আর তোদের আশায় থাকছি না।(রেগে)

রবিনঃ চাচা আপনি খামোখা এত চেঁচামেচি করছেন।শালা,অন্য দেশে জন্ম হলেও কিন্তু বাঙালী। দাদা বাংলাদেশী ছিলো দাদী বিদেশী।ছেলেটার দাদা বিদেশি মেয়ে বিয়ে করে সেখানেই স্যাটেল হয়ে গিয়েছিল।ওর বাবা-মা পিউর বিদেশী।সেই হিসেবে দাদার দিক বিবেচনা করলে বাঙালি হবে।তাছাড়া মুসলিম ছেলে।শুধু দেখতে পুরো পুতুল। এটাই আমাদের থেকে আলাদা। অন্য কিছু তো নয়।

হাবিবঃ আমি তোকে ওর সাফাই গাইতে বলিনি।যেখান থেকে পারিস, যেই শহর থেকে পারিস ঐ ছেলেকে তুলে নিয়ে আয়।এট এনি কস্ট,আমার ঐ ছেলেকে চাই। কারণ আমার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ ওর কাছে আছে।তাছাড়া কিছু ইমপর্টেন্ট এভিডেন্স।পুলিশের হাতে সেগুলো লাগলে এতদিন আমি জানতে পারতাম এবং আমার কাছে চলেও আসতো।কিন্তু ও পুলিশের কাছে যায় নি।তার মানে সবকিছু ওর কাছে আছে। ওকে ধরতে পারলেই আমি আমার বিরুদ্ধের প্রমাণগুলো পেয়ে যাবো।তারপর না হয় ওকে মেরে গুম করে ফেলবো।

রাবিনঃ আমি আরো লোক পাঠাচ্ছি। ঢাকার অলি-গলি খুঁজে ওকে আমরা নিয়ে আসবোই আসবো।আপনি নিশ্চিন্তে নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমান।এই রবিনের কাছে কোন কিছু অসম্ভব নয়।

হাবিবঃ এই লাস্ট বারের মতো আমি তোকে সুযোগ ও সময় দিচ্ছি। এবার যদি না পারিস তাহলে তোর ঐ বাঁদড় মুখ খানা আমাকে দেখাস না।যদি দেখাস তাহলে সেদিনই হবে তোর শেষ দিন।

রবিন একটা শুকনো ঢোক গিলে কলটা কেটে দিলো।তাকে আরো সতর্ক থাকতে হবে।চারিদিকে কড়া নজরদারি দিতে হবে। নয়তো ওর ব্যন্ড বেজে যাবে।হয় হাসপাতালে এডমিট নয়তো চিরতরে কবরে এডমিট হতে হবে।

রবিন কল কাটার পর হাবিব রহমান হাতে থাকা মোবাইলটা সোফায় ছুঁড়ে মারলো।সারা শরীর তার রাগে থরথর করে কাঁপছে।এখন এই মুহুর্তে রবিনকে পেলে মেরে কবর দিয়ে ফেলতো।

কিন্তু পরেরদিন………….

#চলবে

#পুতুল_ছেলেটি
#Part_03
#Writer_NOVA

আজকাল কাজের চাপ একটু বেশি পরে গেছে নীলাভের।ওর যদিও কোন নির্দিষ্ট কাজ নেই। যখন যেই কাজ পায় তাই করে।কোন কাজকে নীলাভ ঘৃণা করে না।প্রত্যেক কাজকে সে সম্মানের চোখে দেখে।তাই বর্তমানে একটা অনলাইন পিৎজা ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি ওর সিক্রেট কাজ তো আছেই। সকালে মালিক কল করে বললো এক জায়গায় পিৎজা ডেলিভারি করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে গোসল করে রেডি হতে লাগালো ।যাওয়ার আগে কিছু কাজ ওর বন্ধু আকিবকে বুঝিয়ে দিলো।

আকিবঃ সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে তাহলে।তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস।তুই ছাড়া আমি অচল।

নীলাভঃ তুই চিন্তা করিস না।আমি ঠিক সময় চলে আসবো।তুই শুধু ওদের ওপর নজর রাখিস।

আকিবঃ কিছু খেয়েছিস।নাকি না খেয়েই দৌড় মারছিস।তোর তো সকাল হলেই ডিউটি শুরু হয়ে যায়।তখন খাবারের কথা ভুলেই যাস।

নীলাভঃ রাস্তার দোকান থেকে খেয়ে নিবো।তুই কিছু একটা বানিয়ে খেয়ে নিস।কাজ ছাড়া বাসায় বসে থাকতে আমার একটুও ভালো লাগে না। মনে রাখিস, পৃথিবীর কোন কাজই ছোট নয়।কাজ ছোট কিংবা বড় সেটা কথা নয়। কথা হলো আমি বাসায় বসে না থেকে কাজটা করছি।অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।বাসায় খামোখা শুয়ে, বসে না থেকে পিৎজা ডেলিভারির কাজটা করলেও আমার হাতে সামান্য টাকা আসবে।কিন্তু বাসায় বসে থাকলে সেই টাকাটা কি তোর শ্বশুর এসে দিয়ে যাবে??(বিরক্তির সুরে)

আকিবঃ আমার শ্বশুর দিবে কেন?তুই একটা বিয়ে কর।তাহলে তোর শ্বশুরই দিবে।ঐ মেয়েটার কি খবর রে? যে তোকে দেখে ফিদা হয়ে গিয়েছিল।

নীলাভ হাতে ঘড়ি পরতে পরতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আকিবের দিকে তাকিয়ে বললো।

নীলাভঃ কোন মেয়েটা?তুই কার কথা বলছিস?আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

আকিবঃ ঐ যে সেদিন বসুন্ধরা শপিংমলে দেখা হয়েছিলো।যে তোকে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলো।যাকে দেখে তোর দিলের ধরকান বেড়ে গিয়েছিল।আমি তার কথা বলছি।আমার মনে হয় তার সাথে তোকে ভালোই মানাবে।যদিও তুই মেয়েটার থেকে দ্বিগুণ সুন্দর।

নীলাভঃ জানিস কি হয়েছে?

আকিবঃ না বললে জানবো কি করে?

নীলাভঃ শোন তাহলে।গতকাল দুপুরেও ঐ মেয়েটার সাথে আমার দেখা হয়েছে। এবারো আল্লাহ বাঁচিয়েছে।নয়তো অল্পের জন্যে ধরা খেয়ে যেতাম।ভাগ্যিস ওকে দেখেছিলাম।তাই দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পরেছিলাম।মেয়েটা গাড়ি থামিয়ে আমাকে খুঁজতে এসেছিলো।

আকিবঃ আল্লাহ কি বলিস!!! দেখেছিস মেয়েটা তোকে নিয়ে কতটা সিরিয়াস।তোকে না বলছি,এরকম অর্ধেক কথা বলতে না।আমি কিছুই বুঝি না। পুরো ঘটনা খুলে বল।

নীলাভ খাটের ওপর বসে জুতো পড়তে পড়তে পুরো ঘটনা আকিবকে খুলে বললো। আকিব এক লাফে খাটের ওপর বসে পরলো।ভ্রু নাচিয়ে নীলাভকে বললো।

আকিবঃ বুঝতে পারছি না। ঘুরে ফিরে মেয়েটার সাথেই তোর দেখা কেন হচ্ছে? দেখ, আজকেও নাকি ঐ মেয়ের সাথে দেখা হয়ে যায়।নীলাভ, তুই যদি দেখলি ঐ মেয়েটার বাড়িতে তুই পিৎজা ডেলিভারি করতে গিয়েছিস।তখন তোর ফিলিংসটা কেমন হবে রে? যাকে দেখলে তুই নার্ভাস হয়ে যাস।সে তোর পুরো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। তুই একটু ভেবে দেখ।

নীলাভঃ বাজে একটা ফিলিংস হবে।গত দুই দিন যাস্ট এক্সিডেন্টলি মেয়েটার সাথে আমার দেখা হয়েছে। যাতে আমার কোন হাত ছিলো না। গত ২ দিন দেখা হয়েছে বলে যে আজও হবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। এসব আজগুবি কথা বাদ দিয়ে যে কাজ দিয়েছি তাতে নিজেকে ফোকাস কর।নয়তো তোকে মোয়া বানিয়ে বাজারে বিক্রি করবো।(বিরক্তির সুরে)

আকিবঃ এখন তো কথা ঘুরাবিই।তুই জীবনে কোন কথা আমার কাছে সহজে স্বীকার করতে চাইলি না।আমি জানি তুই ঐ মেয়েটার জন্য নিজের মনের মধ্যে একটা আলাদা ফিলিংস পাস।কিন্তু তাতো আমাকে মুখ ফুটে কখনও বলবি না।বললে আবার মেয়েদের দিকে না তাকানো ভদ্র ছেলে, নীলাভ সফওয়াতের জাত চলে যাবে তো।আমি তো আবার এই কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম।

নীলাভঃ ইদানীং তুই একটু বেশিই কথা বলিস।কাজের সময় তো ঠনঠনাঠন ঘন্টা। কথা বলার সময় মুখে খই ফুটে।তিলকে তাল বানাতে তোর কয়েক সেকেন্ড লাগে।আমার পিছে না লাগে নিজের কাজে মনোযোগ দে।তাহলে তোর জন্য মঙ্গল।

আকিবঃ এখন সব দোষ তো আমার। শাক দিয়ে আর মাছ ঢাকতে হবে না। আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি।তুই তোর কাজে যা।

নীলাভ মুচকি হেসে তার প্রিয় Duck ব্যাগটা দুই কাঁধে নিয়ে নিলো।মাথায় কালো টুপি আর মুখে মাস্ক পরলো।সানগ্লাসটা পকেটে ঢুকিয়ে, ড্রয়ার থেকে বাইকের চাবি নিয়ে বের হয়ে গেলো।আঙুলের ডোগায় চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে শিস বাজিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।নিজের লাইফের প্রতি কোন অভিযোগ নেই নীলাভের।বিন্দাস আছে সে।

বাবা-মা থাকলে হয়তো এতটা স্বাধীনতা সে পেতো না।তারা যখন নেই তখন আর ঐসব ভেবেও লাভ নেই তার।তবে বাবা-মা হীন ছেলে হিসেবে নীলাভ যথেষ্ট ভালো ছেলে।কারণ সে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে বড় হয়েছে। সে জানে কি করে বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করতে হয়।ওর বন্ধুসুলভ আচরণের জন্য খুব সহজে সবার সাথে মিশে যেতে পারে। সবাই ওকে এর জন্য অনেক পছন্দও করে।কিন্তু নীলাভ মানুষের সাথে খুব কম মিশে।ওর সব কথা ও অভিমান শুধু আকিবকে ঘিরে।কারণ নীলাভের মতো আকিবও কঠিন বাস্তবতার স্বীকার।

💗💗💗

বিকালে বিষন্ন মনে জানালার ধারে বসে আছে সাহিয়া।কিছু দিন ধরে কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছে না সে।তার কল্পনা -জল্পনা,স্বপ্ন, সবকিছুতে এখন পুতুল ছেলেটি। বারবার শপিংয়ের সেই দিনটার কথা চোখে ভেসে আসে। শুক্রবার হওয়ায় কলেজ বন্ধ। সাজিয়া ওর মায়ের সাথে রাতের খাবার বানাতে হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছে। ওর বাবা বিয়ের জন্য ডেকোরেশনের মানুষদের সাথে কথা বলতে গিয়েছে। আর সাহিয়া বিষন্ন মনে বসে আছে জানলার ধারে।মনের আকাশে তার কালো মেঘ হানা দিয়েছে।

জানালা দিয়ে যত দূর চোখ যায় শুধু উঁচু উঁচু দালান দেখা যায়।এসব হিয়ার একটুও ভালো লাগে না। ওর ইচ্ছে করে প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে।এই ব্যস্ত, কোলাহলপূর্ণ শহর তার বিরক্ত লাগে। বাবাকে সে বলেছে, তার একটা গ্রাম অঞ্চলে, ছোট একটা টিনের পাকা বাড়ি চাই।তাহলে বৃষ্টির দিনে ঝমঝম বৃষ্টির আওয়াজ সে শুনতে পাবে।টিনের চালে বৃষ্টি পরার শব্দটা মন্ত্রমুগ্ধকর লাগে সাহিয়ার কাছে।তার বাবা বলেছে তার কথা রাখবে।শত হোক ছোট মেয়ের আবদার বলে কথা।গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয় না বিগত কয়েক বছর ধরে। গ্রাম অনেক পছন্দের সাহিয়ার।

সাজিয়াঃ নে ধর।তোর জন্য গরম গরম কফি করে নিয়ে এলাম।

বোনের কথায় ভাবনায় ছেদ পরলো সাহিয়ার।মুখ ঘুড়িয়ে বোনের দিকে তাকালো। হাত বাড়িয়ে কফির মগটা নিয়ে নিঃশব্দে চুমুক দিলো ধোঁয়া উঠা গরম কফিতে।সাথে সাথে মন অনেকটা ভালো হয়ে গেলো।

সাজিয়াঃ তোর কি হয়েছে রে হিয়া?কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছি তুই অনেক চুপচাপ। সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকিস। খুব মনোযোগ দিয়ে কি জানি ভাবিস?আগে তো এরকম ছিলি না।হুট করে কি হলো?কারো প্রেমে পড়েছিস নাকি।

সাহিয়াঃ কিছু হয়নি।

সাজিয়াঃ কিছু তো একটা হয়েছে।কিছু না হলে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখার মতো চঞ্চল মেয়েটা এভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিতো না।

সাহিয়াঃ বললাম তো দিদিয়া কিছু হয়নি।তোমার বিয়ে হয়ে যাবে, আমি পুরো একা হয়ে যাবো। তার জন্য খারাপ লাগছে। (কথা ঘুরিয়ে)

সাজিয়াঃ ধূর,বোকা মেয়ে।এত তাড়াতাড়ি মন খারাপ কেন করছিস?আমি তো আরো কতদিন আছি তোর সাথে। তার জন্য এখন মন খারাপ করে থাকলে আমার কি ভালো লাগবে বল।

সাহিয়াঃ তোমার কত ভাগ্য দিদিয়া।নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পাচ্ছো।আর আমার এই পোড়া কপালে ভালোবাসার ছিটেফোঁটা তো দূরেই থাক,নাম-গন্ধও নেই। তোমার মতো আমার জীবনে ভালোবাসার মানুষ কবে আসবে বলো?

সাজিয়াঃ আসবে আসবে।আমার ছোট বোনের জন্য পুতুলের মতো দেখতে একটা রাজপুত্র আসবে।যে তোকে অনেক ভালোবাসবে।

সাহিয়াঃ পুতুলের মতো দেখতে রাজপুত্র!!!!

সাজিয়ার কথা শুনে অনেকটা চমকে উঠলো সাহিয়া।তাহলে কি ওর জন্য সত্যি ঐ পুতুল ছেলেটি এসেছে। এই কয়েকদিনে হিয়া বেশ বুঝতে পেরেছে ঐ ছেলের জন্য তার আলাদা একরকম ভালো লাগার ফিলিংস তৈরি হচ্ছে। আদোও হিয়া জানে না এই ফিলিংসের কি নাম।ভালোলাগা,ভালোবাসা নাকি খানিকের মোহ্।তবে তাকে নিয়ে ভাবতে খুব ভালো লাগে সাহিয়ার।

সাজিয়াঃ এই হিয়া, কোথায় হারিয়ে যাস কিছু সময় পর পর?(ধাক্কা দিয়ে)

সাহিয়াঃ কোথাও না।বলো আমি শুনছি।

সাজিয়াঃ আমি অনলাইনে পিৎজা ডেলিভারি দিয়েেছি।তোর পছন্দের চিকেন পিৎজা। অনেক সময় হয়েছে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই ডেলিভারি বয় চলেও এসেছে।

সাহিয়াঃ ওহ্ আচ্ছা।

সাজিয়াঃ তুই খুশি হোস নি?

সাহিয়াঃ হ্যাঁ হয়েছি।(কৃত্রিম হাসি দিয়ে)

অন্য দিন হলে সাহিয়া খুশিতে দুইটা লাফ দিতো।কিন্তু আজ তেমন কিছুই করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।বড্ড খারাপ লাগা ঘিরে ধরেছে তাকে।মন বলছে আরেক পলক যদি সেই পুতুল ছেলেটিকে দেখতে পারতো।বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বোনের দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেলো,সাজিয়া বড় এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন মুখে এঁকে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। যেই কিছু একটা বলবে, তখুনি ওদের মা মিসেস নিশাতা রহমান সাজিয়াকে ডেকে উঠলো।

নিশিতাঃ জিয়া এদিকে একটু আয় তো।আমাকে পেঁয়াজগুলো কুঁচি করে কেটে দিয়ে যা।আমি একা পারছি না।পেঁয়াজ কাটতে গেলে চুলোর তরকারি পুড়ে যাবে।

সাজিয়াঃ আসছি মা।হিয়া,আমি মাকে সাহায্য করতে যাচ্ছি। ডিলেভারি বয় এলে তুই একটু কষ্ট করে অর্ডার কনফার্ম করিস।ধ্যান মেরে এখানে আবার বসে থাকিস না।

সাজিয়া কফির মগ দুটো নিয়ে ছুট লাগালো কিচেনের দিকে।সাহিয়া নিষ্পলক চাহনিতে তা দেখলো।মিনিট পাঁচেক পরেই কলিং বেল বেজে উঠলো। সাহিয়ার না চাইতেও উঠতে হলো।নয়তো সাজিয়া ও তার মা দুজনে মিলে ইচ্ছে মতো ওকে বকবে।ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুললো সাহিয়া।তবে ঝামেলা বাঁধালো সিল্কের ওড়নাটা।দরজার ছিটকিনির সাথে বেজে গেল।মিনিট তিন পর অনেকটা টানাটানির পর ছুটাতে পারলো।কিন্তু সামনে তাকিয়ে সে অনেকটা অবাক হয়ে গেলো।কারণ……………

#চলবে

পুতুল ছেলেটি পর্ব-০১

0

#পুতুল_ছেলেটি
#Part_01
#Writer_NOVA

“রংবেরঙের সাজ” স্টোরের সামনে ডিসকাভারিতে থাকা ছেলে পুতুলটাকে চোখের পলক ফেলতে দেখে অবাক হয়ে গেল সাহিয়া।না,ভুল নয় স্পষ্ট খেয়াল করেছে পুতুলটা চোখের পলক ফেলেছে। তাছাড়া ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ার শব্দ ও বুকের ওঠানামাও সে দেখতে পেয়েছে। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সাহিয়া।কারণ পুতুলটাকে জ্যন্ত মানুষ মনে হচ্ছে। হাত বাড়িয়ে যেই ধরে দেখতে যাবে তখনি সাহিয়ার বড় বোন সাজিয়া ডেকে উঠলো।

সাজিয়াঃ হিয়া, এদিকে একটু আয় তো।তুই এই জয়গায়?আমি তোকে সারা শপিংমল খুঁজে হয়রান হয়ে গেছি।আর তুই এখানে?একটু জলদী আয়।

সাহিয়াঃ আসছি দিদিয়া।

একবার পুতুলের দিকে তাকিয়ে আরেকবার বোনের দিকে তাকালো সাহিয়া।পুতুল ছোঁয়ার ইচ্ছাকে দমিয়ে বোনের ডাকে সারা দিলো।দৌড়ে বোনের কাছে চলে গেল। মিনিট পনেরো পর যখন সাহিয়া এবার সেই স্থানে এলো তখন তার চোখ চড়কগাছ। এখানে তো সেই ছেলে পুতুলটা নেই। তন্নতন্ন করে আশেপাশে খুঁজেও সেই পুতুলটা চোখে পরলো না।তখন স্টোরের ভেতরে গিয়ে ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলো।

সাহিয়াঃ আসসালামু আলাইকুম।

ম্যানেজারঃ অলাইকুম আস সালাম।কি লাগবে বলুন ম্যাম?আমাদের স্টকে ভালো জর্জেটের, লিনেন, সুতি,সিল্কের থ্রি পিস কালেকশন আছে।তাছাড়া কিছু ভালো মডেলের শাড়িও আছে।খুব উন্নতমানের।গতকালই ইন্ডিয়া থেকে আনিয়েছি আমরা।এছাড়া হাই লেভেলের অনেক গাউন আছে।আপনার কোন কালেকশন লাগবে?

সাহিয়াঃ না না আমার কিছু লাগবে না।আমি একটা প্রশ্ন করতাম।যদি আপনি অনুমতি দিতেন।

ম্যানেজারঃ নিশ্চয়ই বলুন।

সাহিয়াঃ আপনাদের স্টোরের সামনে যে ছেলে পুতুলের ডিসকাভারি ছিলো সেই পুতুলটা কোথায়?মেয়েদের ড্রেস পরা পুতুলের মাঝখানে ছিলো ঐ পুতুলটা।

ম্যানেজারঃ সরি ম্যাম।আমাদের এখানে কোন ছেলে পুতুল ডিসকোভারিতে দেওয়া ছিলো না।

সাহিয়াঃ ছিলো,আমি ১৫/২০ মিনিট আগে এখানে দেখেছি। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে?

ম্যানেজারঃ ভুল আমার নয়, আপনার হচ্ছে ম্যাম।আমাদের স্টোরটা শুধুমাত্র লেডিস্ ফ্যাশনের।আমরা সেখানে ছেলে পুতুল কেন রাখবো?আমরা ছেলেদের কোন পোশাক বিক্রি করি না।তাহলে ডিসকাভারিতে ছেলেদের পোশাক পরিহিত পুতুল রাখা নিতান্ত বোকামী ছাড়া অন্য কিছু নয়।

সাহিয়াঃ আমি স্পষ্ট দেখেছি।এখানে একটা পুতুল দেখেছি।যেটার মাথায় গেরুয়া রঙের একটা হ্যাট,গায়ে সুরমা কালারের বডির সাথে লাগানো পাতলা লং হাতা গেঞ্জি,কালো প্যান্ট পরহিত, অতিরিক্ত সাদা বর্ণের একটা ছেলে পুতুল ছিলো।

ম্যানজারঃ ম্যাম আপনার হয়তো দেখায় ভুল হয়েছে। এখানে কোন ছেলে পুতুল ছিলো না।আপনি তাকিয়ে দেখুন পাঁচটা মেয়ে পুতুল ছিলো বিভিন্ন ফ্যাশনের পোশাক পরা। তারাই আছে।অন্য কিছু নেই।

সাহিয়াঃ ওহ আচ্ছা। সরি,আমার হয়তো ভুল হয়েছে। আপনার সময় নষ্ট করার জন্য আবারো সরি। কিন্তু আমি একটা ছেলে পুতুল সত্যি দেখেছিলাম।

ম্যানেজারঃ ইটস ওকে ম্যাম।আশা করি আমি আপনার ভুলটা ভেঙে দিয়েছি।

💗💗💗

সাহিয়া মন খারাপ করে চলে এলো।কিন্তু ওর তো দেখার ভুল ছিলো না।এক হাতে মাথায় থাকা হ্যাট-টাকে ধরে খুব সুন্দর একটা স্টাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো পুতুলটা।

সাহিয়াঃ আদোও কি সেটা পুতুল ছিলো নাকি অন্যকিছু।আচ্ছা এমন নয়তো পুতুলটা হেঁটে হেঁটে চলে গেছে। কিন্তু পুতুল আবার হাঁটবে কি করে? আমি কি কোন ভূত-টূত দেখলাম না তো।হরর মুভিগুলোর মধ্যে তো এরকমি দেখায়।পুতুল সেজে কিংবা পুতুলের ভেতরে আত্মা ভর করে প্রতিশোধ নেয়।আমার কাছে পুতুলটাকে জীবন্ত মনে হচ্ছিলো।ওর নীল চোখের পলক ফেলানো,নিশ্বাস নেয়া,ফুসফুস উঠানামা করা সবকিছু আমার চোখে পরেছে।সেটাকি মানুষ ছিলো?ইউরোপীয় অনেক ছেলেও তো এরকম পুতুলের মতো দেখতে হয়।কিন্তু বাংলাদেশে ঐরকম ছেলে কোথা থেকে আসবে?ধূর, দিদিয়ার জন্য। নয়তো আমি ছুঁয়ে বুঝতে পারতাম ঐটা কি ছিলো?মাথা ঝিম ঝিম করছে। কি অদ্ভুত সমস্যায় পরলাম।

সাহিয়া বিরবির করতে করতে ওর বোনের সামনে গেলো।সাজিয়া তখন বিয়ের জন্য শাড়ি পছন্দ করছে।সাহিয়া কে বিরবির করতে দেখে জিজ্ঞেস করলো।

সাজিয়াঃ কি বিরবির করছিস হিয়া?কোথায় ছিলি এতক্ষণ?তুই না থাকায় আমি একটা শাড়িও চয়েজ করতে পারিনি।তুই একটি চয়েজ করে দে না?আমার একটাও পছন্দ হচ্ছে না।

সাহিয়াঃ পাশের স্টোরে ছিলাম।এখানে বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছিলাম।তাই বাইরে থেকে একটু হাওয়া খেয়ে আসলাম।মম,ড্যাড কোথায়?তোর হবু বর তুরাগ ভাইয়াকে যে দেখছি না।তোর হবু শ্বশুর, শাশুড়ী বা কোথায়?

সাজিয়াঃ তুরাগের একটা জরুরি কল এসেছে। তাই বাইরে গেছে। মম,ড্যাড,তুরাগের বাবা-মা পাশের স্টোরে গিয়েছে তাদের জন্য পোশাক কিনতে।এদিকে আমি শাড়ির স্তুপ বানিয়েও একটা শাড়ি পছন্দ করতে পারলাম না।তুই একটু পছন্দ করে দে না?

সাহিয়া স্তুপের থেকে গাঢ় লাল রঙের মধ্যে গোল্ডেন পাথরের বেশ গর্জিয়াস কাজ করা একটা শাড়ি বের করলো।সাজিয়ার গায়ে ধরতেই ওর পছন্দ হয়ে গেলো।আয়নায় গিয়ে নিজেকে দেখে একটা লাফ দিয়ে খুশি মনে বললো।

সাজিয়াঃ ওয়াও হিয়া,তোর পছন্দ তো অনেক সুন্দর। আমি এত সময় ধরে একটাও পছন্দ করতে পারলাম না।আর তুই নিমিষেই একটা পছন্দ করে বসলি।এই জন্যই তো তোকে আমার এতো ভালো লাগে।

সাহিয়া ওর বোনের কথা কিছুই শুনতে পেলো না।সে শাড়ির স্তুপ থেকে না দেখে একটা শাড়ি টান দিয়ে বের করে ওর বোনের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো।সে এখনো মাথা থেকে পুতুলের ভূতটা ঝাড়তে পারেনি।

💗💗💗

একটা প্রাইভেট ভার্সিটির বেশ নামকরা প্রফেসর তানজিল আনজুম।তার দুই কন্যা।বড় মেয়ে সাজিয়া আনজুম ও ছোট মেয়ে সাহিয়া আনজুম।তাদের মা নিশিতা রহমান।তিনি গৃহিণী। বাবা-মা ও বড় বোন নিয়ে ছোট্ট পরিবার সাহিয়ার।সাহিয়া এবার অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে।বাংলা ডিপার্টমেন্ট পড়াশোনা করছে।২৩ বছর এই মেয়েটাকে দেখলে সবাই বাচ্চা বলে।মুখের মধ্যে বাচ্চা বাচ্চা ভাব আছে। কাজকর্মও তার বাচ্চাদের মতো।পরিবারের ছোট বলে সবার আদরের।সাজিয়া ও তুরাগের ৪ বছরের সম্পর্ক।ওদের দুজনের পরিবার সেটা মেনে নিয়ে ঘটা করে বিয়ে দিচ্ছেন তারা।যেহেতু মেয়ে ও ছেলের দুজনের পরিবার বেশ স্বচ্ছল। তাই কেউ অমত করেনি।

বোনের বিয়ের শপিং করতে পুরো পরিবারকে সাথে নিয়ে বসুন্ধরা শপিংমলে এসেছে সাহিয়া।সাথে ওর হবু জিজু তুরাগ ও তার পরিবার।সবাই মিলে বিয়ের শাড়ি পছন্দ করছিলো।সাহিয়া বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে উঠে বাইরে গিয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে “রংবেরঙের সাজ” স্টোরের সামনে থমকে গেলো। সেখানে দেখেছিলো পুতুলটাকে। কিন্তু ওর কাছে মনে হচ্ছিলো এটা একটা পুতুল নয় বরং জীবন্ত মানুষ। ভীষণ ভালো লাগেছে ওর পুতুলটাকে।তাই ঘুরে ঘুরে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো।

সাহিয়াঃ আল্লাহ কত সুন্দর দেখতে ছেলে পুতুলটা!!! ইস,আমার যদি এরকম একটা বর থাকতো।তাহলে আমি তাকে বলতাম পুতুল বর।কিন্তু এটাতো একটা পুতুল।কোন মানুষ নয়?মানুষ হলে এটাকে আমি বিয়ে করেই ছাড়তাম।ওয়াও,ঠোঁট দুটো টকটকে লাল। ইচ্ছে করছে জোরে টান দিয়ে দেই।চোখের মনির রংটা তো মাশাল্লাহ। নীল রঙা চোখ, সরু ভ্রু,চোখা নাক,দুধের মতো সাদা গায়ের রং সব মিলিয়ে মাশাল্লাহ। এ যদি মানুষ হতো তাহলে সব মেয়েরা এর জন্য হুমড়ি খেয়ে পরতো।চুলের রংটা কি কালার হবে?হ্যাট টা দিয়ে পুতুল তৈরি করায়, কোম্পানির লোকেরা চুলের ঝামেলা থেকে বেঁচে গেছে। নয়তো আমি জানতে পারতাম এত সুন্দর পুতুলের কি রঙের চুলে মানাবে?

তখনি মনে হলো পুতুলের চোখের পাপড়িগুলো কেঁপে কেঁপে নড়ে উঠলো। হালকা করে পলক ফেললো।সাহিয়া চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালো।আবারো চোখের পলক পরলো।এবার সে দুই হাত দিয়ে দুই চোখ ডলে আবার তাকালো।এবার দেখলো পুতুলটা খুব ঘনঘন নিশ্বাস ছাড়ছে।তার তালে তালে বুকটা উঠানামা করছে।নিজের কানটা পুতুলের বুকের কিছুটা সামনে নিয়ে যেতেই হৃৎপিণ্ডের ঢিপঢিপ শব্দ শুনতে পেলো।ভয় পেয়ে কেঙ্গারুর মতো দুটো লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেল।তারপর বুকের মধ্যে কয়েকটা ফুঁ দিলো।সামনে এসে হাত বাড়িয়ে যেই পুতুলটাকে স্পর্শ করবে তখনি ওর বড় বোন ওকে ডাকে।তারপরের ঘটনা তো আগেই বলে দিয়েছি।

সারা শপিংয়ে সাহিয়া মনযোগ দিতে পারলো না। ওর মাথায় এখনো পুতুলের কান্ড কারখানা ঘুরছে।চোখ দুটো এদিক সেদিক ঘুরিয়ে বারবার সেই পুতুলের খোঁজ করছে।কিন্তু তার দেখা পেলো না। ঘন্টাখানিক শপিং করার পর সবাই বাসার দিকে রওনা দিলো। গাড়িতে ওঠার আগেও একবার এদিক সেদিক তাকিয়ে নিলো। সব দিকে তাকালেও শপিংমলের উত্তর দিকে সে তাকালো না।তাকালে হয়তো দেখতে পেতো একজোড়া নীল রঙা চোখ মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়েছে।

#চলবে

❤️NOVA❤️

এক বসন্ত প্রেম পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

1

🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
শেষ পর্ব

শীতের একদম শেষ প্রান্তে এসে আবহাওয়াটা কেমন জানি অস্থির করে ফেলছে। তীব্র শীতের মাঝে ঘামে ভেজা গরমের আভাস যেন একি দেশে একি সময়ে দুই রকম ঋতুর অনুভুতি জানিয়ে দিচ্ছে। আদৌ কি সম্ভব? কিন্তু এই মুহূর্তে সেটাই তো হচ্ছে। কিছুক্ষন আগেই যে গ্রামের সকালের তীব্র শীতের অনুভুতি ছিল সেটা পেরিয়ে শহরে প্রবেশ করতেই রোদেলা দুপুর ঘামে ভেজা গরমের অস্বস্তি হানা দিচ্ছে। কামিজের লম্বা হাতা দিয়ে বারবার কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে ফেলছে স্নেহ। কান্নাকাটি করে চোখ মুখ সব ফুলে উঠেছে তার। হবেই না বা কেন বাবার অতো বড় অসুখ বলে কথা। সাদেকের ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে। তাই তাকে শহরের বড় হসপিটালে আনা হয়েছে। সবাই চিন্তিত মুখে বসে অপেক্ষা করছে ডাক্তারের জন্য।

সুমি সুহা আর লতাকে জোর করছে তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে তারপর আবার আসবে। কিন্তু কিছুতেই রাজি হচ্ছেনা তারা। অবশেষে শেফা মোটামুটি জোর করেই তাদেরকে পাঠিয়ে দিলো। স্নেহকে শুধু রেখে দিলো হসপিটালে।

ডাক্তার সাদেকের রুম থেকে বের হতেই শেফা তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। “এখন কেমন আছে?” শেফার কথা শুনে ডাক্তার খুব শান্ত ভাবে বলল “ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু কিছুদিন আরও হসপিটালে থাকতে হবে।”
ডাক্তারের কথা শুনে এক রাশ ভয় নিয়ে শেফা কাপা কাপা গলায় বলল “সুস্থ হয়ে যাবে তো?” ডাক্তার শেফার ভয় বুঝতে পেরে বললেন “চিন্তা করবেন না। ঠিক হয়ে যাবে। ওনার কন্ডিশন ভালই।”

স্নেহকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে নাবিল এসে তার পাশে বসলো। স্নেহর দিকে একবার তাকিয়ে আবার সামনে তাকিয়ে বলল “এখন আর ভয় নাই। ঠিক হয়ে যাবে সব।” নাবিলের কথাটা শেষ হতেই স্নেহ তার ঘাড়ে মাথা দিয়ে মুখে ওড়না চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলো। নাবিল কিছুক্ষনের জন্য অবাক হলেও পরক্ষনেই নিজেকে সামলে স্নেহকে এক হাতে জড়িয়ে নিলো। এতে যেন স্নেহর কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেলো। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না। শেফা দুর থেকে দাড়িয়ে সব কিছু চুপচাপ দেখছিল। নাবিলের হঠাৎ শেফার দিকে চোখ পড়তেই সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে স্নেহকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু স্নেহর যে সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে আনমনে কেদেই চলেছে। শেফা ধির পায়ে সামনে এসে বলল “স্নেহ!” শেফার গলার আওয়াজ শুনে স্নেহ ঠিক হয়ে বসলো। মাথা নিচু করেই বলল “জি ফুপু?”

শেফার ছায়ার দিকে তাকিয়ে বলল “ওকে বাড়ি নিয়ে যা। রেস্ট নিয়ে তারপর আবার আসবে।” ফুপুর কড়া কথার উত্তরে স্নেহ আর কিছু বলল না। ছায়ার সাথে চলে গেলো। শেফা নাবিলের পাশে বসে সামনে তাকিয়ে বলল “স্নেহর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে নাবিল।”

“জানি।” এক রাশ হতাশা নিয়ে কথাটা বলল নাবিল। শেফা নাবিলের দিকে তাকাল। তার মনের অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করলো। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আবার বলল “স্নেহ কি এই বিয়েতে খুশি না?”

শেফার কথার মানে বুঝতে পেরে নাবিল তার দিকে তাকাল। একটু হেসে সামনে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল “জানিনা খালামনি।”
“জানার চেষ্টা করনি?”
নাবিল না সুচক মাথা নাড়ল। “কেন?” শেফার প্রশ্নে নাবিল তার দিকে তাকিয়ে বলল “আমি জানতাম না স্নেহর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আমি চেয়েছিলাম ওর মনের মধ্যে জায়গা করে নিতে। তারপর জানতে চেয়েছিলাম ঠিক কতটুকু জায়গা করতে পেরেছি। কিন্তু আসলেই কোন জায়গা তৈরি করতে পেরেছি কিনা সেটা জানার সুযোগ হয়নি।”

শেফা মলিন মুখে বলল “একটা মেয়ে বিপদের সময় যাকে সব থেকে আগে মনে করে সেই তার মনের কাছে থাকে। স্নেহ কিন্তু অভ্রর কথা এক বারও বলেনি। তোমার কাধে মাথা রেখে ঠিকই মন খুলে কাঁদছিল।”

নাবিল একটু ভ্রু কুচকে তাকাল শেফার দিকে। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল “ঠিক কি বলতে চাইছ তুমি?”

“দেখ স্নেহ নিজের আবেগ সম্পর্কে এখনো অবগত নয়। তাকে সেটা বঝানর দায়িত্ব তোমার। তুমি যদি তোমার দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালোণ করতে সক্ষম হও তাহলে আমি বাকিটা দেখতে পারি।”

শেফার কথা শুনে নাবিল একটু হাসল। শেফার দিকে তাকিয়ে বলল “তুমি বাসায় যাও। রেস্ট নিয়ে তারপর আবার আসিও।”

শেফা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল “আমি এখানেই থাকবো। সবাই আসুক তারপর যাবো।”
————
শীত শেষে হাওয়ার রুপ বদল করে বসন্তের আগমন। ফাল্গুনের আগমনে মূর্ছা যাওয়া প্রকৃতি কেমন ঝলমলিয়ে উঠেছে। হাওয়ার মাঝেও যেন বসন্তের ঘ্রান। ছাদে দাড়িয়ে সেই হাওয়ায় নিজেকে বিলীন করতেই ব্যস্ত স্নেহ। এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। আনমনে ভাবছে। বেশ কয়েক দিন হল সাদেক হসপিটাল থেকে এসেছে। এখন পুরো সুস্থ। সুমির বাড়িতে আজ সবাই ভিড় করেছে কারন কাল ওরা গ্রামে চলে যাবে। সবাই মোটামুটি খুশি সাদেকের সুস্থতা নিয়ে। কিন্তু স্নেহর কেন জানি মন খারাপ। গ্রামে চলে যাবে ভেবেই তার চোখ ভরে উঠছে। কাউকে বলতে পারছে না।

“স্নেহময়ি!” নাবিলের উতফুল্য সরের কথা কানে আসতেই পিছনে ঘুরে তাকাল। নাবিল কে দেখে তার কোথাও একটা শান্তি অনুভুত হল। নাবিল ধির পায়ে এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ালো। পকেটে হাত গুঁজে সামনে তাকিয়ে আছে। স্নেহ সামনে তাকাল। মলিন ভাবে বলল “নাবিল ভাইয়া আমি কাল চলে যাচ্ছি।”

“জানি।” ছোট্ট করে উত্তর দিলো নাবিল। কিন্তু স্নেহর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। চোখ ভরে এলো। না চাইতেও টুপ করে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। নাবিল নিসচুপ সামনে তাকিয়ে আছে। নিজের চোখের পানি আড়াল করে আবার বলল “নাবিল ভাইয়া আমি গ্রামে চলে গেলে আপনি আসবেন না?”

নাবিল একটা শ্বাস ছেড়ে বলল “আমি কেন গ্রামে যাবো স্নেহ? বেড়াতে গিয়েছিলাম। তারপর তোমার বিয়ে। মামার অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় তোমার বিয়ে পিছিয়ে গেলো। আবার যখন তোমার বিয়ে হবে তখন যাবো।”

নাবিলের নির্লিপ্ত উত্তর শুনে স্নেহ তার দিকে একটু তাকাল। চোখ ভরে এলো তার আর কিছু না বলে নিচে যাওয়ার জন্য পিছনে পা বাড়াল। কিন্তু নাবিলের ডাকে থেমে গেলো।

“স্নেহময়ি।” স্নেহ পিছনে না ঘুরেই কাপা কাপা গলায় বলল “বলেন।” নাবিল খুব শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো “তোমার কি কোন কারনে মন খারাপ। মানে মন খারাপ হলে কারণটা আমাকে বলতে পার।” স্নেহ কিছু বলতে পারল না। মাথা নাড়িয়ে না বলে নিচে চলে গেলো। নিচে বাড়ির ভিতরে পা দিতেই দেখল একজন বয়স্ক মহিলা সোফায় বসে পান চিবুচ্ছেন। স্নেহকে দেখে নিজের চশমাটা ভালো করে চেপে দিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করলেন তার কাছে যেতে। স্নেহ আশে পাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল অনেক নতুন আত্মীয় এসেছে। সে কোন কথা না বলে সেই বয়স্ক মহিলার পাশে গিয়ে বসলো। মহিলা পান চিবুতে চিবুতে তাকে জিজ্ঞেস করলো “কি নাম?”

“স্নেহময়ি।” স্নেহ ভিত কণ্ঠে উত্তর দিলো। “আমি নাবিল দাদু ভাইয়ের দাদী। দাদু ভাই আমাকে দাদুমনি কয়। তুমিও তাই ডাকবা।” স্নেহ নত দৃষ্টিতে মাথা নাড়াল। উনি থুতনিটা ধরে বলল “মাশ আল্লাহ!”

তার কথা শেষ হতে না হতেই এক কম বয়সি মেয়ে এসে সহাস্যে বলল “তুমি স্নেহময়ি বুঝি!” স্নেহ মাথা নাড়াল। মেয়েটি কিছু বলতে যাবে তার আগেই নাবিল এসে ভিতরে ঢুকল। স্নেহর পাশে গিয়ে বসলো। নাবিলের এভাবে বসাতে কিছু অংশ স্নেহর শরীর ছুয়ে দিলো। খুব অস্বস্তি হল তার। কোন রকমে নিজকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দাড়িয়ে ঘরে যেতেই স্নেহর মা এসে বলল “তোর বাবা ডাকে।” স্নেহ মাথা নাড়িয়ে বাবার কাছে গেলো।

“বাবা ডাকছ?” সাদেক রাজ্জাকের সাথে জরুরী বিষয় নিয়ে কথা বলছিল। স্নেহর গলা শুনে দুজনি দরজার দিকে তাকাল। রাজ্জাক হাসি মুখে বললেন “কাছে আসো স্নেহময়ি।” স্নেহ বুঝতে পারল না কিছুই কিন্তু তার ভিতরে কেন জানি অনেক ভয় হল। বুকের ভিতরের দুরু কাপন বেড়ে গেলো। নত দৃষ্টিতেই বাবার পাশে গিয়ে বসলো। মাথার ওড়নাটা আর একটু টেনে দিলো। রাজ্জাক এবার খুব শান্ত ভাবে ডাকল “সুমি এদিকে এসো।” সুমি মুহূর্তের মধ্যে কত গুলো ব্যগ নিয়ে চলে এলো। স্নেহর পাশে বসে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে একটা ব্যাগ হাতে দিয়ে বলল “এখন এটা পরবি ঠিক আছে? আর …।”
কথা শেষ করার আগে স্নেহর দিকে চোখ পড়তেই দেখল স্নেহ কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সুমি ভ্রু কুচকে বলল “কি রে? এমন করে তাকায়ে আছিস কেন? এই জামা পরেই কি বিয়ে করবি নাকি?” স্নেহ যেন এবার আকাশ থেকে পড়লো। তার বিয়ে মানে? এখনি বিয়ে কেন? আর অভ্র কি এখানে এসেছে? তার মস্তিষ্ক শুন্য হয়ে গেলো। ভাবনা গুলো প্রচণ্ড অগোছালো। মাথা ঝিম মেরে গেলো। নিসশাসের বেগ বেড়ে গেলো। ঘামতে শুরু করলো। তার অবস্থা বুঝতে পেরে সুমি কিছু বলতে যাবে তার আগেই একজন মাঝ বয়সি মহিলা এসে বলল “কাজি এসে গেছে। সব লেখা লেখি করবে। ততক্ষনে স্নেহকে রেডি করে দিতে বলল।” স্নেহর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তাকে জিজ্ঞেস না করেই এতো আয়োজন! কিন্তু কেন? তাকে জানালনা কেন? আর এতো তাড়াতাড়ি করার কি আছে? সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
মাঝ বয়সি মহিলাটা স্নেহ কে শাড়ী পড়াতে শুরু করলো। শাড়ী পরাতে পরাতে বলল “আমি নাবিলের ফুপু।” স্নেহ কথা বলতে চেয়েও পারল না। গলায় আঁটকে গেলো। যত সময় যাচ্ছে নিঃশ্বাসের বেগ তত বাড়ছে। একজনের ডাকে মহিলাটা ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলো। স্নেহ বিছানায় বসে পড়লো। হাতের দিকে চেয়ে বসে থাকলো। এক ফোটা পানি চোখ বেয়ে হাতে টুপ করে পড়ার আগেই আরেক টা হাত তার উপরে চোখে পড়তেই স্নেহ ঝাপসা চোখে তাকাল মালিক টাকে দেখতে। নাবিল স্নেহর হাতের উপরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। স্নেহর চোখে চোখ পড়তেই একটু হাসল। পাশে একটা টুল টেনে নিয়ে বসলো। খুব শান্ত গলায় বলল “মনের কথা বলে দিতে হয় স্নেহময়ি। দেরি হয়ে গেলে দুঃখের শেষ থাকেনা।”

নাবিলের কথা শুনে স্নেহর আবার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এখন আর বলে কি লাভ? চুপ করে থাকলো। কোন কথা বলল না। নাবিল স্নেহর চুপ করে থাকা দেখে নিজে থেকেই বলল “তুমি চুপ করে থাকলেও আমি তো পারিনা।” স্নেহর এক হাত নিজের হাতের মধ্যে খুব যত্ন করে নিয়ে বলল “এই বসন্তের শুরুতে আমার মনে জমানো এক_বসন্ত_প্রেম আজ তোমার নামে দিলাম। গ্রহন করবে কি আমার এই প্রেম?”

স্নেহ ছল ছল চোখে নাবিলের দিকে তাকাল। বাইরে থেকে আওয়াজ আসতেই নাবিল দরজার দিকে তাকাল। উঠে দরজা পর্যন্ত যেয়ে আবার ফিরে তাকিয়ে বলল “উত্তরটা বাকি থাকলো। পরে দিও কিন্তু।”
স্নেহ অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো।
——–
অবশেষে সেই মুহূর্ত। স্নেহর বিয়ে। স্নেহ রীতিমতো কাঁপছে। কারণটা ঠিক বুঝতে পারছে না। তার পাশে নাবিল বর বেশে বসে আছে। স্নেহ অবশ্য একটু আগেই জানতে পেরেছে তার বর কে। তাই সে এখন খুশি।
আসলে এই সব কিছু তার বড় ফুপু শেফা আর নাবিলের দাদির কাজ। কিন্তু স্নেহর জন্য সারপ্রাইজটা নাবিলের পক্ষ থেকে ছিল। প্রথমে সবার মধ্যে একটু চিন্তা থাকলেও চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে কথা বলার পর সবার চিন্তা দূর হয়েছে। নাবিল নিজে অভ্রর সাথে কথা বলেছে। তাকে ভালো করে বুঝিয়েছে যে স্নেহর মনে তার জন্য অনুভুতি তৈরি হয়েছে। সব কিছু শোনার পর অভ্র মেনে নিয়েছে যার মনে তার জন্য অনুভুতি নেই তাকে জোর করে বিয়ে করা বোকামি। তাই সে আর বিষয়টা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনি। তবে চেয়ারম্যন সাহেব বেশ মন খারাপ করেছেন। তিনি সাদেকের পরিবারের সাথে কোন রকম সম্পর্ক রাখতে নারাজ। এতে অবশ্য সাদেকের তেমন কোন সমস্যা নেই। কারন শেফা তাকে বুঝিয়েছে সব সম্পর্কের আগে মেয়ের সুখ। সাদেক সব বুঝেই মেনে নিয়েছে।

বিয়ে শেষ করে নাবিলের ফুপুত বোন আর ছায়া দুজন মিলে স্নেহকে ছাদে নিয়ে গেলো। কিন্তু তারা তাকে ছাদে রেখেই নিচে চলে গেলো। স্নেহ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অসম্ভব সুন্দর তারা। হালকা বাতাস বইছে। বসন্তের বাতাস। স্নেহর বেশ লাগছে।

“স্নেহময়ি।” নাবিলের আওয়াজ শুনে স্নেহ হাসি মুখে তার দিকে ফিরে তাকায়। নাবিল ধির পায়ে স্নেহর কাছে এসে দাঁড়ায়। ভাল করে তার চেহারা দেখে নেয়। তারপর তার হাত ধরে বলে “আমার উত্তরটা!”

স্নেহ লজ্জায় মিইয়ে যায়। এতদিনের সব জমানো সাহস এই মানুষটার সামনে যেন কোথায় হারিয়ে গেলো। মুখ তুলতে পারছে না। তবুও নাবিলের অপেক্ষা যেন তার আর সহ্য হচ্ছে না। নিজেকে স্বাভাবিক করেই নত দৃষ্টিতে বলল “আপনার দেয়া ডাইরিতে কলমের আঁচড় কেটে লিপিবদ্ধ করবো আমাদের এক বসন্ত প্রেমের গল্প।” নাবিল একটু হেসে স্নেহকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।

সমাপ্ত।

এক বসন্ত প্রেম পর্ব-১০

0

🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১০
গত রাতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হওয়ায় ঠাণ্ডাটা আজ জেঁকে বসেছে। সোয়েটারের সাথে চাদরেও মানছে না। বাড়ির সবাই খুব ব্যস্ত। সবাই এদিক সেদিক দৌড়া দৌড়া করছে। লতা অনেক সকালে উঠে রান্না বসিয়েছে। আজ স্নেহর বড় ফুপু আসছে। সব কিছু ঠিক থাকলে কয়েকদিনের মধ্যেই স্নেহর বাগদান। স্নেহও সকাল সকাল উঠে পড়তে বসেছে। হালকা রোদের ছটা দেখতে পেয়েই গায়ে ভালো করে চাদর জড়িয়ে পুকুর পাড়ে গেলো রোদের মাঝে বসে পড়বে। সকাল সকাল এতো চেচামেচিতে নাবিলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে উঠে আড়মোড়া ভেঙ্গে বাইরে বের হয়। একটু হেঁটে সামনে গিয়ে এক পাশে দাড়িয়ে পকেটে হাত গুঁজে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে।

“নাবিল ভাইয়া!” কোমল মেয়েলি কণ্ঠের ডাক কানে আসতেই নাবিল কণ্ঠের মালিক কে টা বুঝে গেলো। এই কয়দিনে কয়েকটা কণ্ঠ তার কাছে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। তার মধ্যে এটা একটা। পিছন ফিরে স্নেহর দিকে তাকাল। স্নেহ মুখে হাসি টেনে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ফেরা দেখে দ্রুত পায়ে একটু কাছে আসলো। একটু হেসে জিজ্ঞেস করলো “কি করছেন?”

“কিছুনা। শীতের সকাল উপভোগ করছিলাম।” নাবিল কথা শেষ করে তার দিকে ঘুরে তাকায়। স্নেহ একটু হেসে নিজের ডান হাত পিছন থেকে বের করে সামনে এনে ডাইরিটা ধরল। এক গাল হেসে বলল “এই মুল্যবান উপহারটা সারাজীবন নিজের কাছে যত্নে রাখবো।”

নাবিল কিছুক্ষন ডাইরিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। একটু বাকা হেসে স্নেহর ঘন কাল মনিতে নিজের বাদামি কঠিন মনিটা স্থির করে বলল

“বিয়ের পর অচেনা মানুষের সাথে কাটানো বিশেষ মুহূর্ত গুলো্র সমন্বয় করে আমার মুল্যবান জিনিসটার উপরে আচর কাটতে পারবে তো? ভেবে দেখ ঠিক ঠাক! তোমার চালান সেই আঁচড় আমাকে আঘাত করবে। যদি বলি আমার সেই মুল্যবান জিনিসটা আমি ফেরত চাই দিতে পারবে? মানুষের জীবনের সব থেকে কঠিন মুহূর্ত তখনি আসে যখন সে বুঝতেই পারেনা যে সে আসলে কি চায়। এখন ঠিক সেই অবস্থাতে তুমি আছো। আমি জোর করবো না। জদি বুঝতে পার কখনও তোমার কোনটা দরকার তাহলে নির্দ্বিধায় চাইবে আমি তোমাকে ফেরাব না। ”

নাবিলের কথা স্নেহর মাথার উপর দিয়ে গেলেও কিশোরী মনে যে ঠিক ঠাক আঁচড় কেটেছে সেটা কিন্তু নিশ্চিত। স্নেহর মুখের ভাঁজটাই এখন আলাদা হয়ে গেছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে তার মন সেই কথার অর্থ উদ্ধার করতে নিজের ব্রেনের সাথে রীতিমত যুদ্ধ করে বিধস্ত হচ্ছে। কিন্তু তবুও সেটার অরথদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না।

————
দোতলার সেই জানালার পাশে বসে বই খুলে এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে স্নেহ। বই খুলেও কেন পড়তে পারছে না। এমন টা তো আগে হয়নি? পাশে পড়ে থাকা কাল ডাইরিটা হাতে নিয়ে এদিক সেদিক নাড়াচাড়া করছে বারবার।নাবিলের সেই শেষ কথাটার অর্থ স্পষ্ট নয়। বারবার সেই একটা শব্দ কানে বাজছে খুব করে ‘আঁচড়!’। সেই শব্দটা যে স্নেহর কোমল মনেও আঁচড় কেটেছে সেটা মোটামুটি স্পষ্ট। জীবনের বিশেষ মুহূর্ত গুলো লিপিবদ্ধ করার অভ্যাস থেকেই ডাইরিটা হাতে তুলে নিলো। সাথে পাশে পড়ে থাকা লাল কালির একটা কলমও। আজ সেই বিশেষ কথাটা রঙ্গিন কালির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতে ইচ্ছা হচ্ছে খুব করে। ডাইরিটা খুলে সাদা পাতার উপরে লাল কালির কলমটা খুব কাছাকাছি ছোঁয়াতেই আঁতকে উঠলো সে। কি লিখবে? সমস্ত অক্ষর হারিয়ে ফেলেছে সে। এই সচ্ছ কোমল জায়গায় লাল কালির আঁচড় কাঁটা যে তার সাধ্যের বাইরে। তার মন কিছুতেই এটার সায় দিতে পারেনা। তাহলে সেই বিশেষ মুহূর্তটা কি কখনও লিপিবদ্ধ করা হবে না? ভাবতেই এক রাশ মন খারাপ হানা দিলো।

তার ভাবনার মাঝেই নিচ থেকে সোরগোল কানে আসতেই জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখার চেষ্টা করলো। মিনা রান্না ঘর থেকে দ্রুত পায়ে ঘরের ভিতরে যাচ্ছে। কি মনে করে উপরে তাকাতেই স্নেহর মাথা দেখতে পেয়ে এক গাল হেসে বলল
“নিচে আয়। ফুপু আইছে।“
স্নেহ দ্রুত পায়ে নিচে দৌড় দিলো। সোফার ঘরে বড় ফুপু শেফা তার ছেলে সোহান আর মেয়ে ছায়া বসে আছে। স্নেহ ভিতরে ঢুকে সালাম দিতেই শেফা তাকে হাতের ইশারায় নিজের কাছে ডাকল। সে ফুপুর পাশে গিয়ে বসলো। শেফা তার মাথায় হাত দিয়ে হেসে বলল “মাশআল্লাহ! আরও সুন্দর হয়েছিস।”

“খালামনি কখন আসলে?” নাবিলের কথায় সবাই ঘুরে তাকায় তার দিকে। শেফা নাবিল কেও কাছে ডাকে। এক পাশে নাবিল আর এক পাশে স্নেহকে বসিয়ে তিনি তদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

“বুবু অনেক দূর থেকে আইছেন। গোছল সারে খাবেন।” লতার কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে তিনি উঠে জান। ছায়া নাবিলের দিকে একটু তাকিয়ে বলে “ভাইয়া তুমি কবে এসেছ? আমাদেরকে জানাওনি কেন?” নাবিল মাথা নামিয়ে ফোনে দেখতে দেখতে বলল “হুট করে চলে এসেছি তাই জানাতে পারিনি।”

সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল “কি রে কেমন আছিস?” সোহান হেসে বলল “বেশ ভালো। স্নেহর বিয়ে উপলক্ষে হলেও এতদিন পর গ্রামে আসা হল।” সোহানের কথাটার প্রতিবাদ স্বরূপ নাবিল বলল “এখনো বিয়ে হয়নি। আংটি পরাবে। আর আংটি পরালেই বিয়ে হয়না।” সোহান নাবিলের কথার মানে বুঝতে না পেরে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো বুঝতে।

—————

দুপুরে খাওয়া শেষ করে সবাই আড্ডা দিচ্ছিল। সুমি নিজের ব্যাগ থেকে একটা আংটি বের করে বলল “এটা আমার শাশুড়ি আমাকে দিয়েছিলেন। তার ইচ্ছা নাবিলের বউকে এটা দিয়েই বরন করবে।” শেফা আংটিটা হাতে নিয়েই বলল “বাহ! খুব সুন্দর তো।” এমন সময় সোহান আর নাবিল ঘরে ঢুকল। ছায়া তাদেরকে দেখে বলল “ভাইয়া দেখ তোমার বউয়ের আংটি।”

নাবিল আংটিটা হাতে নিয়ে সেটার দিকে মনোযোগ দেখছে। এদিক সেদিক নাড়িয়ে ভালো করে দেখে নিলো। সুমির বাইরে থেকে ডাক আসতেই সে বাইরে চলে গেলো। নাবিল এতক্ষন আংটিটার দিকেই দেখছিল। শেফা নাবিলের দিকে তাকিয়ে বলল “আছে নাকি আংটির মালিক?” নাবিল শেফার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে পিছনের ঘুরে স্নেহর দিকে তাকিয়ে বলল “দেখ খালামনি আংটির সাইজটা একদম স্নেহর হাতের জন্য পারফেক্ট তাই না?” নাবিলের প্রশ্ন শুনে সবাই তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। স্নেহ মাথা তুলে একবার নাবিল আর আংটির দিকে চোখ ফিরিয়ে আবার নামিয়ে নিলো।

“কি বলছিস তুই?” সোহানের কথা কানে যেতেই নাবিল ঘুরে তাকায়। সোহান কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিল ভ্রু কুচকে বলল “বিশ্বাস না হলে প্রমান করে দেখাচ্ছি।” বলেই স্নেহর সামনে গিয়ে তার হাত টেনে আঙ্গুলে পরিয়ে দিলো। সবাইকে অবাক দৃষ্টি তার উপর স্থির রেখেছে। স্নেহ আংটির দিকে তাকিয়ে আছে।

“আপা তোমারে মা ডাকে।” সুহার কথা শুনে স্নেহ যাওয়ার জন্য উঠে দাড়িয়ে আংটিটার দিকে তাকিয়ে সেটা খুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু আংটিটা আঙ্গুল থেকে বের করতে পারেনা। নাবিল একটু হেসে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সবাই স্নেহর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সুহা এগিয়ে এসে স্নেহর হাত উঠিয়ে আংটির দিকে তাকিয়ে বলে “এটা কই পাইলা আপা?”

“তুই যা সুহা স্নেহ আসছে।“ শেফার কথা শুনে সুহা তার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বের হতে যাবে তখনি পিছন থেকে আওয়াজ শুনে আবার থেমে গেলো।

“আংটির কথা বাইরে কাউকে বলিস না।” শেফা খুব শান্ত ভাবে সুহাকে নিষেধ করে দিলো। সুহাও বুঝে গেলো কিছু একটা হয়েছে যা বাইরে বলা যাবেনা। তাই একটু হেসে মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে গেলো। নাবিল স্নেহকে দেখছে। আর স্নেহ নিজের দৃষ্টি নত রেখেছে।

“স্নেহ।” শেফার গম্ভীর গলার আওয়াজে স্নেহ তার দিকে তাকায়। হাত দিয়ে তার কাছে যেতে ইশারা করে। স্নেহ নত দৃষ্টিতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শেফা তার হাত টেনে কোন রকমে টেনে টুনে আংটিটা খুলে নেয়।

স্নেহর দিকে তাকিয়ে বলে “কাজ সেরে আয়।” স্নেহ নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। শেফা নাবিলের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলে “আমার নাবিলের সাথে কথা আছে। একা।” মায়ের কথা শুনে সবাই বাইরে চলে যায়।

শেফাকে এই বিষয়ে এতো রিয়াক্ট করতে দেখে নাবিল খুব অবাক হয়।
“খালামনি আমি…।” নাবিল কথাটা শেষ করতে পারেনা তার আগেই বাইরে থেকে চিৎকারের আওয়াজ আসে। শেফা নাবিল দুজনি সেদিকে তাকায়। দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বাইরে যায়। বাইরে এসে দেখে সাদেক মাটিতে পড়ে আছে আর সবাই তাকে ঘিরে কান্না কাটি করছে। শেফা দৌড়ে গিয়ে সাদেকের মুখের দিকে তাকিয়ে ভিত গলায় জিজ্ঞেস করে “কি হইছে?”

চলবে……।