Tuesday, July 1, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1477



এক বসন্ত প্রেম পর্ব-০৯

0

🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৯

“সাদেক আছো?” দরজার বাইরে পরিচিত কণ্ঠের ডাকে সাদেক ঘর থেকে সাড়া দেয় “আছি। ভাই সাহেব নাকি? ভিতরে আসেন।” কথাটা বলতে বলতে বাইরে জান তিনি। বাইরে গিয়ে দেখে তার ধারনাই ঠিক। চেয়ারম্যান সাহেব তার ছেলেকে নিয়ে বাইরে দাড়িয়ে আছেন। গলার আওয়াজ শুনেই তিনি আন্দাজ করেছিলেন। এক গাল হেসে বললেন “ভিতরে আসেন ভাই সাহেব।”

মাজেদ চেয়ারম্যান তার ছেলে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন “আসো।” বলেই পা বাড়ালেন দরজার দিকে। বাবার পথ অনুসরন করে সেও এগিয়ে গেলো। সাদেক ভিতরে ঢুকে রাজ্জাক কে উদ্দেশ্য করে বললেন “চেয়ারমেন ভাইজান আসছে।” তার কথা শেষ হতেই মাজেদ তার ছেলেকে নিয়ে ঘরে ঢুকল।

“মেহমান আসছে নাকি?” রাজ্জাক কে দেখে বলল। “হ ভাইসাহেব। আমার ছোট বোন জামাই আর তার ছেলে আইছে।” সাদেক নম্র সূরে উত্তর দিলো।

“ওহ আচ্ছা তাহলে তোমার বোন জামাই।” বলেই সহাস্যে রাজ্জাকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন মাজেদ। রাজ্জাক ও হাত মেলাল। হাত ধরেই পিছনে ঘুরে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল “আমার ছেলে। ডাক্তারি পড়ে শহরে। ছুটি টুটি তেমন পায়না। অনেক দিন পর আসছে তো তাই ভাবলাম বেড়ায়ে নিয়ে আসি।” বাবার কথা শেষ হতেই অভ্র সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিলো।

রাজ্জাক সালাম নিয়ে “বেশ ভালো করছেন। বসেন!” সহাস্যে উত্তর দিলো। তারা ঘরে বসলো। মুহূর্তের মধ্যে সারা বাড়িতে রোল পড়ে গেলো চেয়ারম্যান তার ছেলেকে নিয়ে এসেছে। বাড়ির পুরুষ সবাই ওই ঘরে দৌড়ে গেলো তাদের সাথে কথা বলার জন্য। আর মহিলারা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো আপ্যায়নের জন্য। এই মুহূর্তে আপ্যায়ন টা কোন ভাবেই খারাপ হওয়া যাবেনা। যতই হোক বাড়ির হবু জামাই বলে কথা। তাকে কোন ভাবেই নিরাশ করা যাবেনা। তার কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ার লোভে ব্যস্ত হয়ে উঠলো লতা। নিজে হাতে সব নাস্তা বানাতে বসে পড়লো। স্নেহ কে আদেশ করলো তার সেই বিখ্যত মসলা চা বানাতে। হবু জামাই ও তো বুঝুক মেয়ের রান্নার স্বাদটা। স্নেহর সমস্ত মনোযোগ চায়ের দিকে নিবিষ্ট থাকলেও সে স্থির থাকতে পারছেনা।

“আপা অভ্র ভাই আসছে মা তোমারে ডাকে।” সুহার মুখে উক্ত নামটা শুনেই তার বুকের ভিতরে দুরু দুরু কাপন যেন তীব্র হল। একটা শুকনো ঢক গিলে বলল “যা আসছি।” সভাবিক ভাবে কথাটা বললেও তার আচরনের অস্বাভাবিকতা সুহার চোখ এড়ায় নি। ধির পায়ে রান্না ঘরে ঢুকতেই মায়ের আদেশে চুলায় পানি দিলো চায়ের জন্য। চায়ের পানি নাড়ার দরকার না পড়লেও একটা চামুচ তাতে ডুবিয়ে এক মনে নেড়েই যাচ্ছে সে। মিনার বিষয়টা দৃষ্টিতে ঠেকল। একটু ঠাট্টা করে বলল “কি রে স্নেহ, চা কি ঘাটা হবে নাকি?”

পুরো রান্না ঘরে হাসির রোল পড়ে গেলো। লতা মা হয়ে মেয়ের এই অবস্থায় হাসাটা তার কাছে শোভনীয় মনে হল না। তাই ঠোঁট চেপে নিজের হাসি আটকাতে চেষ্টা করলো। লজ্জায় মিইয়ে গেলো স্নেহ। কিন্তু এই মুহূর্তে সে লজ্জাটাকে চাপা দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল “চিনি মিশাই চাচি।” তার কথা শুনে সবাই ঠোঁট টিপে আবারো হাসল। কারন স্নেহ এখনো পানিতে চিনি মেশায়নি। তার অবস্থা বুঝে কেউ আর কথা বাড়াল না।

স্নেহর চা বানা শেষ হতেই লতা বলল “স্নেহ নাস্তা নিয়ে যা।” কথাটা কানে আসতেই স্নেহ জোরে জোরে শ্বাস ফেলে বলল “আমি!” লতা একটু কঠিন দৃষ্টিতে তাকাতেই স্নেহ আর কথা বাড়াল না। মাথার ওড়নাটা একটু বেশি করে টেনে দিয়ে সামনে সাজিয়ে রাখা নাস্তার ট্রে টা হাতে তুলে নিলো। ধির পায়ে ঘরের সামনে যেতেই স্নেহ থেমে দাড়িয়ে গেলো। হঠাৎ তার মাঝে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলো। বুকের মাঝের দুরুদুরু কাপন বেড়ে গেলো। নিশ্বাস ভারি হয়ে আসলো। হাত পা কেমন যেন শিরশিরিয়ে উঠলো এক অজানা ভয়ে।

“আপা তাড়াতাড়ি যাও। তোমারে সবাই ডাকে।”সুহার চাপা গলার আওয়াজেও চমকে উঠলো। আরও বেশি ভয়ের আভাষ জড়িয়ে ধরল। কিন্তু এই সময় ভয় পেলে চলবে না। ঘর থেকে সবার কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে স্পষ্ট। স্নেহর অজানা অনুভুতি যেন আরও গাড় হল। সাথে এক রাশ লজ্জাও ঘিরে ফেললো। প্রাক্রিতিক নিয়মে মেয়েরা শরীরে বড় না হলেও মনে যে তাড়াতাড়ি বড় হয় সেটারি বোধ হয় বহিপ্রকাশ এই অচেনা অনুভুতি। ‘বিয়ে’ শব্দটা মেয়েদের মাঝে হঠাৎই একটা পরিপক্কতা এনে দেয়। যেটা অনেক সময় বয়সের ভারেও আসেনা। এখন আর ঘরে ঢোকার মতো সাহস পাচ্ছে না। নত দৃষ্টিতে দাড়িয়ে দুই হাতে ট্রে টা ধরে দাড়িয়ে আছে।

“আরে তুমি ওখানে কেন? ভিতরে আসো।”একটা ভারি গম্ভীর গলার আওয়াজে কেঁপে উঠলো সে। আওয়জের মালিকটাকে চোখ তুলে দেখার সাহস হল না। ভিতরে না গেলে এই মুহূর্তে সেটা চরম বেয়াদবি হবে। তাই সে ভিতরে ঢুকল। দৃষ্টি নামিয়েই রাখল। সবাই তার দিকেই দৃষ্টি স্থির রেখেছে। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। সামনে টেবিলটা চোখে পড়তেই ট্রেটা সেটার উপরে রেখে আবার আগের জায়গাতে এসে দাঁড়ালো।

যেই মানুষটাকে ভেবে এতদিন কাটিয়েছে তাকে সামনে থেকে দেখার প্রয়াসটা ভালভাবেই ঘিরে ফেলেছে তাকে। কিন্তু সেই মানুষটাকে চোখ তুলে দেখার সাহস তার নেই। সেই মানুষটা আদৌ তার দিকে তাকিয়ে আছে কিনা সেটাও বুঝতে পারছে না।

“ওইখানে দাড়ায়ে আছো কেন? আমার কাছে আসো।” মাজেদের কথা শুনে স্নেহ কিছুটা চমকে উঠলো। নাবিল এতক্ষন স্নেহকেই দেখছিল। তার অদ্ভুত আচরণ চোখ এড়ায় নি তাই বোঝার চেষ্টা করছিলো কারণটা। এখন জেরকম আচরণ করছে স্নেহ সে সেরকম মেয়ে কিন্তু না। তাহলে তার এরকম আড়ষ্ট হয়ে যাওয়ার কারন কি?

মাজেদের কথার মান রাখতে স্নেহ ধির পায়ে তার পাশে বসলো। মাজেদ স্নেহর মাথায় হাত দিয়ে বললেন “কেমন পড়াশুনা হইতেছে?”

“জি আলহামদুলিল্লাহ!” এক রাশ লজ্জা ভরা কণ্ঠ নিয়ে স্নেহ কথাটা বলল। তার মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠের রেশ অভ্রর কানে পৌছাতেই সে স্নেহর দিকে ফিরে তাকাল। নত হওয়া মাথার ঘোমটার আড়ালে তেমন কিছুই দেখা না গেলেও আন্দাজ করা যাচ্ছে তার সৌন্দর্য। সেই দিকেই নিস্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে মাজেদ হাসল। আসলে আজ তার ছেলেকে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যই তারা ঘরোয়া ভাবে আংটি পরিয়ে রাখতে চায়। বিয়েটা পরেই হোক তাতে সমস্যা নেই। আর তার ছেলের সেই স্থির দৃষ্টির মানে বুঝতে পেরে ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত করে বলল “ঠিক আছে তুমি এখন যাও।”

কথাটা কানে আসতেই স্নেহ যেন শক্তি ফিরে পেলো। দ্রুত পায়ে চলে এলো ঘরে। হাফ ছেড়ে বার কয়েক জোরে জোরে শ্বাস নিলো। এতক্ষন প্রান পাখিটা যেন সারা ঘরময় উড়ে বেড়াচ্ছিল। এই মুহূর্তে নিজের মধ্যে ধরা দিলো।

——————
মসজিদের সেই শান বাঁধানো পুকুরের পাশেই একটা গাব গাছ। সেই গাছ নাকি অনেক পুরাতন। নুরুল মজুমদার সেই মোটা গাছের গুড়ির চারপাশে সিমেন্ট দিয়ে ঘিরে বসার জায়গা তৈরি করেছিলেন। অতিরিক্ত গরমে তিনি সেখানে বসে প্রশান্তির শীতল ছায়া উপভোগ করতেন। সেখানের হাওয়া যে শহরের নামিদামি এয়ারকন্ডিশনকেও হার মানাতে পারে তাতে সন্দেহ নেই। সেখানেই বসে শীতল হাওয়ায় গুন গুন করে পড়ছে স্নেহ। সুহা পাশেই একটা বরশি ফেলে চুপ চাপ অধির আগ্রহে বসে আছে কখন একটা মাছ উঠবে।

“এটা কি বরশি?” পিন পতন নিরবতায় আচমকাই এমন কথা শুনে দুই বোনই চমকে উঠে। তাদের এভাবে চমকান দেখে নাবিল একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়।

“যা বাবা! আমি কি ভুত নাকি যে এভাবে ভয় পাচ্ছ?” নাবিলের এমন কথায় স্নেহর কোন হেলদোল প্রকাশ পেলো না। সে আবার নিজের বইয়ের মাঝেই মুখ ডুবিয়ে দিলো। কিন্তু সুহা উত্তর দিলো ফিস ফিস করে। “এতো জোরে কথা বলা যাবেনা। মাছ পালায়ে যাবে তো!” নাবিল অনভিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে সুহার পাশে বসে পড়লো। ফিস ফিস করে দুজনে কথা চালিয়ে গেলো।
“কি দিয়ে মাছ ধরছ?”
“এটা দিয়ে” হাতে থাকা মাখান আটা দেখিয়ে বলল সুহা।
“এটা দিয়ে মাছ ধরে?” নাবিলের উত্তরে অভিজ্ঞর মতো মাথা নাড়াল সুহা।
“তুমি সাঁতার কাটতে পার?”
“হুম!” বলেই প্রশ্নবিধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল “আপনি পারেন না?”
নাবিল হতাশা নিয়ে না বোধক মাথা নাড়াল। সুহারো মন খারাপ হয়ে গেলো। এতো সুন্দর একটা মানুষ কত কিছু পারে অথচ সাঁতার কাটতে পারেনা। কি আজব দুনিয়া! নাবিল আড় চোখে স্নেহর দিকে তাকাল।

“তোমার হবু দুলাভাইকে কি তোমার ভালো লাগে? মানে তোমার আপুর সাথে বিয়ে হলে কি তুমি খুশি হবে?” সুহার উদ্দেশ্যে বলা নাবিলের এমন কথা কানে পৌছাতেই স্নেহ পড়া বন্ধ করে দিলো। একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। তার মানে এই মুহূর্তে বাড়িতে এটা নিয়েই আলোচনা চলছে। এই মানুষটার কান পর্যন্ত যাওয়া মানেই বিষয়টা বেশ গভীর। সুহা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল “দেখাই হইছে কয়েকবার! একবারো কথা হয়নি। কেমন যে তাই জানিনা।”

নাবিল সামনে তাকিয়েই বলল “কেন ভয় পাও? কথা বল না কেন?” সুহা কোন কথা বলল না। একটু থেমে কিছু একটা ভেবে বলল “আপাই তো কোনদিন কথা কয়নি।” তার কথা শুনে নাবিল প্রথমে তার দিকে নিজের দৃষ্টি ফেরাল তারপর স্নেহর দিকে তাকাল। পুরো বিষয়টা তার সামনে আয়নার মতো খুলে গেলো। আজ পর্যন্ত যার সাথে কথাই হয়নি তার প্রতি কোন অনুভুতি তৈরি হওয়া অসম্ভব! স্নেহ একটু রাগী গলায় বলল “বকবক করিস না তো। পড়তেছি।”

স্নেহর এমন কথায় সুহা চুপসে গেলো। নাবিল ভালো করে স্নেহর দিকে তাকাল। বইয়ের দিকে দৃষ্টি থাকলেও এই মুহূর্তে সে যে গভীর ভাবনায় ডুবে আছে। স্নেহ যে নিজের ইচ্ছাতে বিয়ে করছেনা সেটা নাবিলের বুঝতে ওসুবিধা হল না। পরিবারের কথা ভেবে না বলাটা অন্যায় সেটা ভেবেই সে না বলছেনা। নাবিলের ঠোটের কোণে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো।

“ভাইয়া ফুপু তোমারে ডাকছে।” মুবিনের কথায় তার দিকে ঘুরে তাকায় নাবিল আর সুহা দুজনি। এবার সুহাকে উদ্দেশ্য করে বলে “তুইও আয়। তোরে মা ডাকে।” বলেই তারা তিনজন চলে গেলো বাড়ির ভেতরে। স্নেহ তাদের যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিজের পড়ায় মনোযোগ দিলো।

“স্নেহ!” আচমকাই কারও অপরিচিত গলার আওয়াজ পেয়ে স্নেহ চমকে ঘুরে তাকায়। অভ্র হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। স্নেহ একটা শুকনো ঢোক গিলে তাড়াতাড়ি নিজের ওড়নাটা মাথায় লম্বা করে টেনে দেয়। অভ্র স্নেহর পাশে বসে। খুব ঠাণ্ডা গলায় বলে “কেমন আছো স্নেহ?” স্নেহ কোন কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে ইশারা করে।

“তোমার সাথে একটু কথা ছিল।” অভ্রের কথার উত্তরে স্নেহ ছোট্ট করে বলে “বলেন!”
“আসলে আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে তোমার সাথে তো সেভাবে কথা হয়নি। আর আমি জানিনা যে তুমি এই বিয়েতে রাজি কিনা। তাই সম্পর্ক এগিয়ে যাওয়ার আগে আমি তোমার কাছে জেনেই তবে সিদ্ধান্ত নিতে চাই।”

স্নেহ একটা শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল “বাবা যা বলবে তাই।” অভ্র স্নেহর কথা শুনে তার দিকে একবার তাকিয়ে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল “তোমার জন্য একটা গিফট এনেছিলাম। হাতটা দিবে?” অভ্রের হাতের দিকে একবার তাকিয়ে স্নেহ কাপতে কাপতে নিজের হাত এগিয়ে দিলো।
“স্নেহময়ি!” অভ্র স্নেহর হাত স্পর্শ করার আগেই নাবিলের ডাকে দুজনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে ঘুরে তাকায়। কিন্তু পরিচিত কণ্ঠের ডাকে স্নেহ নিজের মনের মধ্যে এক অনাবিল শান্তি অনুভব করলো। এতক্ষন যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেটা দূর হয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। নাবিল একটু ভ্রু কুচকে বলে “আরে মিস্টার অভ্র! আপনি এখানে কি করছেন? আপনার জন্য সবাই ভিতরে অপেক্ষা করছে।“

নাবিলের কথা শুনে অভ্র একটু লজ্জা পেলো। ম্লান হেসে বলল “যাচ্ছি।” বলেই উঠে চলে গেলো।

স্নেহ মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। সে এই ঘটনায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। নাবিল ধির পায়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। স্নেহর হাতটা তুলে তার সামনে ধরে বলল “আমি যে জিনিস একবার স্পর্শ করি সেটা অন্য কেউ করুক আমি পছন্দ করিনা। মাথায় রেখো।”

চলবে………।

এক বসন্ত প্রেম পর্ব-০৮

0

🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৮

আচমকা শক্ত হাতের হ্যাচকা টানে টাল সামলাতে না পেরে কারও বুকের উপরে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো স্নেহ। কিছুক্ষনের জন্য অবাক হলেও তীব্র পারফিউমের তেজে মাথা ঘুরে উঠলো তার। গা গুলিয়ে এলো। নিজেকে সামলাতে খানিকক্ষণ চোখ বুজে রাখল। পরক্ষনেই অনুভব করলো কেউ একজন পরম যত্নে তাকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সেই মানুষটা যে দূর দুরান্ত পর্যন্ত তার চেনা না সেটা বুঝতে একটুও কষ্ট হল না। চোখ খুলে ফেললো সে।

“ভয় নাই সময় মতো আমি ধরে ফেলছি।” আশ্বাসের সূরে বলা শান্ত পরিচিত কণ্ঠে স্নেহর ঘোর কাটে। মাথা তুলে দেখে নাবিল তাকে দুই হাতে জড়িয়ে রেখেছে। বেশ কিছুক্ষন দুজনের নিরব দৃষ্টি বিনিময় হয়। কিন্তু খানিক বাদেই স্নেহ এক ধাক্কা দিয়ে নাবিল কে সরিয়ে দেয়। নাবিল তার এমন কাজে অবাক হয়। এমন করার কি দরকার ছিল। সে তো এমনিতেও তাকে ছেড়েই দিত। কিন্তু বেশি ভয় পাওয়ার কারনে তার বুকে মাথা রেখে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। তাই তো সে তাকে শান্ত করার জন্য জড়িয়ে নিয়েছে। তাকে যে পানিতে পড়া থেকে বাঁচাল সেটার কথা মেয়েটা ভুলেই গেলো। উলটা তার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে।

“লিসেন! আমার ওভাবে ধরার কোন উদ্দেশ্য ছিলোনা। তুমিই একটু বেশি ভয় পেয়ে গেছিলে তাই ধরতে বাধ্য হইছি।” নাবিলের কোমল সরে স্নেহর রাগ এবার চরমে পৌঁছে গেলো। সে কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারল না। দাতে দাঁত চেপে বলল “আপনার জন্য আমার ডাইরিটা পুকুরে পড়ে গেছে।”

স্নেহর কথা শুনে নাবিল মাথাটা একটু বাড়িয়ে পুকুরে দেখল। তারপর স্নেহর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল। সত্যিই সে স্নেহকে একটা ডাইরিতে কিছু একটা লিখতে দেখেছিলো। কিন্তু এখন তার হাতে সেই ডাইরি নেই। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল “একটা ডাইরিই তো। কিন্তু ডুবতে যেয়ে বেঁচে গেলে সেটা কি কম নাকি?”

স্নেহ এবার রাগে কেঁদে দেয়ার মতো অবস্থা। নাকের ডগা লাল হয়ে গেল তার। চোখে মনে হয় পানিও এসে গেছে। চোখের পাতা পিটপিট করে সেটা আটকাবার চেষ্টা করছে। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে।

“একটা ডাইরির জন্য এতো রিয়াক্ট করার কি আছে?” নাবিলের প্রশ্নে সুহা তীব্র গর্জনে চেচিয়ে বলল “আপনাকে কে ধরতে বলছে? এরকম কয়েকটা পুকুর নিমিষেই পার করার ক্ষমতা আমি রাখি। আমি গ্রামের মেয়ে সাঁতারটা ভালই আয়ত্তে আছে।” বলেই দ্রুত পায়ে ভিতরে চলে গেলো। নাবিল এবার একটু অপ্রসস্তুত হয়ে গেলো। এটা তার মাথাতেই আসেনি। গ্রামের মেয়ে হিসেবে সাঁতার তার জানার কথা। আর বাড়ির সামনেই তিনটা পুকুর। তার আরও ভালো করে ভাবা উচিৎ ছিল।

নাবিল দাড়িয়ে পুকুরের পাড়েই ভাবছে। এমন সময় মুবিন এসে দাঁড়ালো পাশে। “ভাইয়া কি ভাবতেছ?” নাবিল পাশ ফিরে তাকায় মুবিন তার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেছে। সে একটু ভেবে বলল “আচ্ছা এখানে কোথাও ডাইরি কিনতে পাওয়া যায়?” মুবিন প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হল।

“ডাইরি কি করবে ভাইয়া?” তার কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব এই মুহূর্তে নাবিল দিতে চাইছেনা। কারন সে ওই ডাইরিটা স্নেহ কে গিফট করতে চায়। তার ভুলের জন্য স্নেহর ডাইরিটা পুকুরে পড়ে গেলো। কিন্তু এই কথা মুবিন কে বললে সে অন্য কিছু ভাবতে পারে। অল্প বয়সি ছেলে তো। মনে এখন শুধুই আবেগ। তার বাইরে কিছুই ভাবতে পারেনা। তাই সে চেপে গিয়ে বলল “আমি কিনব। কই পাওয়া যায়?”

“আসো।” বলেই মুবিন সামনের দিকে পা বাড়াল। নাবিলও তাকে অনুসরন করলো।

দুজনে মিলে বাজারে গিয়ে অনেক কষ্টে একটা ডাইরি খুঁজে বের করলো। খুব একটা সুন্দর না হলেও আপাতত এটাই মেলা ভাগ্যের ব্যাপার। পরে নাহয় একটা সুন্দর কিনে পাঠিয়ে দিবে। তাই আর দেরি না করে কিনে ফেললো।

————

মজুমদার বাড়ির সামনে কাচারি ঘর নামে একটা পুরাতন ঘর আর সাথে বারান্দা আছে। নুরুল মজুমদার বেঁচে থাকতে সেই ঘর বানিয়েছিল। কথিত আছে সেই ঘরে নাকি সেই সময় গ্রামের সব বিচার হতো। তখন থানা পুলিশ এসব তেমন ছিলোনা। গ্রামের সব বিচার তিনিই করতেন। তিনি অত্যান্ত ন্যায় বিচারক ছিলেন তাই সবাই তার উপরেই ভরসা করত। সেখানে মেয়েদের যাওয়া নিষেধ ছিল। বাড়ির বউ বা মেয়েরা কখনও সেই বারান্দা বা ঘরের সামনে যেতেন না। কিন্তু এখন গ্রামের শহরের ছোঁয়ায় সবাই এখন বিচারের আসায় থানা পুলিশ বা গ্রাম প্রতিনিধির কাছে যায়। তাই এখন আর এই বাড়ির মেয়েদের সেখানে যেতে বাধা নাই। তারা এখন সব জায়গায় নিশ্চিন্তে বিচরন করতে পারে। সেই বারান্দাতেই একটা বেঞ্চের উপরে বসে গল্প করছে লতা, মিনা আর সুমি। নিজেদের স্মৃতি চারন করতেই ব্যস্ত তারা। কথার মাঝে ভেসে উঠছে দুঃখে হাসিতে ভরা অতীত।

“তোমার দুঃখের কথা কে না জানে ভাবি? তুমি এই সংসারের জন্য কি ত্যাগ স্বীকার করেছো সেটা আমরা সবাই জানি। ” অতি আবেগি হয়ে সুমির বলা কথাটা লতার বুকে গিয়ে ঠেকল। চোখ জোড়া ছল ছল করে উঠলো। কি বলবে বুঝতে পারল না। তার এই অবস্থা মিনার চোখে ঠিকই ধরা পড়লো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মিনা একটু হেসে বলে উঠলো “নাবিল বাবার বিয়া দিবেনা বুবু?”

মিনার কথা শুনে সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল “একটাই ছেলে আমার ভাবছিলাম বিয়ে দিয়ে বউ সহ নিজের কাছে রাখবো। কিন্তু সে তো মানেনা। বিদেশেই যাবে। সেখানেই নাকি বাকি জীবনটা কাটাবে।”

লতার খুব মন খারাপ হল। সামনের দিকে তাকিয়ে কাপা কাপা গলায় বলল “ছেলে মেয়ে ছাইড়া কিভাবে থাকা যায়? আমার মেয়ে দুইটারে আমি গ্রামের কাছেই বিয়া দিবো ভাবছি। দূরে বিদায় দিয়ে থাকতে পারব না গো বুবু। ওর বাপেরো তাই ইচ্ছা। সেও একি কথা কয়।”

“মেয়ে মানুষ তো পরের ধন। তারপরেও যত কাছে রাখা যায় আর কি! আচ্ছা বুবু স্নেহর যে চেয়ারমেনের ছেলেরে দিয়ে বিয়ার কথা কইছিল? সেটার কি হল?” মিনা লতার দিকে সপ্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়।

“চেয়ারমেনের ছেলে ঢাকায় পড়ে। ওর পড়ালেখা শেষ হলেই এই বিষয়ে কথা কব। ততদিনে স্নেহরো পরীক্ষা শেষ হবে।” লতা হাসি মুখে উত্তর দিলো। কারন এই ছেলেকে লতারো খুব পছন্দ। আর চেয়ারম্যান নিজে স্নেহকে পছন্দ করে রেখেছে তার ছেলের জন্য। তার ছেলে কয়েকবার স্নেহকে দেখছে। তাই স্নেহর কথা বলায় সেও কোন আপত্তি করেনি। স্নেহর বাবার কাছে সব থেকে খুশির খবর যে তার মেয়ে তার গ্রামেই থাকবে। কারন চেয়ারম্যানের ছেলে ডাক্তারি পড়া শেষ করে গ্রামে চলে আসবে। আর এখানেই একটা চেম্বার খুলে গ্রামের লোকজনের সেবা করবে। সব কথা শুনে সুমি বলল “বেশ ভাল তো। সোনায় সোহাগা। স্নেহ গ্রামেও থাকবে আবার জামাই ডাক্তার হবে। ” বলেই তিনজনে হাসতে লাগলো।

—————-

রজনির গভীরতম প্রহরে নিস্তব্ধ প্রকৃতির ঝি ঝি পোকার ডাকের সাথে গুন গুন আওয়াজ এক রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। নাবিলের ঘুম আসছিল না বলে বাইরের সেই কাচারি ঘরের বারান্দায় দাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে আছে সে। তার জানা মতে পুরো বাড়ি এখন ঘুমে বিভোর। কিন্তু এই গুন গুন আওয়াজ আসছে কোথা থেকে? চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল সে। কিছুই চোখে পড়লো না। কিন্তু এই আওয়াজের রহস্য উদঘাটন না করে তার শান্তি হচ্ছে না। বাড়ির ভিতরে চলে এলো সে। কোথাও কিছুই নেই তাহলে এই আওয়াজের উতপত্তি স্থল কোথায়? এদিক সেদিক চোখ চালাতেই হঠাৎ তার মস্তিষ্ক জানিয়ে দিলো এই আওয়াজের উতপত্তি স্থল। দ্রুত পায়ে সেদিকে চলে গেলো। পা টিপে টিপে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। কারন আওয়াজটা দোতলা থেকেই আসছে। শেষ সিঁড়িটা পার করে উপরেই উঠেও কিছু চোখে পড়লো না। ধির পায়ে পাশের ঘরে যেতেই দেখল। জানালার কাছে বসে গুন গুন আওয়াজে পড়ছে স্নেহ। বেশ অবাক হল নাবিল। হাত উপরে তুলে তাতে পরা কাল ঘড়িটার দিকে চোখ ফেরাল। রাত ১ টা বাজে। এই সময় গ্রামের একটা কাক পক্ষিও জেগে নেই মনে হয়। অথচ এই মেয়ে একা একা জেগে পড়ছে। দেয়ালে হেলানি দিয়ে নিস্পলক তাকিয়ে আছে নাবিল। হালকা হলদে আলোয় স্নেহর সাদা রঙ মিশে কি অপূর্ব দৃশ্য তৈরি করেছে। এই দৃশ্য যে কোন পুরুষের মুহূর্তেই নজর কাড়তে সক্ষম।

পড়ার মাঝেই কারও উপস্থিতি বুজতে পেরে অবাক হল স্নেহ। এতো রাতে কারও জেগে থাকার কথা না। চমকে পিছনে ঘুরে তাকাল। নাবিল দেয়ালে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিলের অমন স্থির চাহুনি স্নেহর বেশ বিরক্তি ধরিয়ে দিলো। বিরক্তি নিয়ে বইটা বন্ধ করে দাড়িয়ে গেলো। একটু চাপা সরে বলল “আপনি এখানে?”

“এতো রাতে একা একা পড়ছ তোমার ভয় করেনা?” স্নেহর প্রশ্নের বিপরিতে পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে দিলো নাবিল। স্নেহ নিজের দৃষ্টি ফিরে নিয়ে বলল “ভয়ের কি আছে? আমি ভুতে ভয় পাই না।”

স্নেহর এমন নির্লিপ্ত উত্তরে নাবিল ধির পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখেই দাড়িয়ে ধির কণ্ঠে বলল “মানুষকে তো ভয় পাও। মাঝ রাতে একটা ছেলে মানুষের সাথে কথা বলতে ভয় লাগেনা?”

স্নেহ নাবিলের দিকে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল “আপনি যেমন ভাবেন আমি অমন মেয়ে না। আর শুধু ছেলেই কেন মাঝ রাতে একটা মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলতে আপনারও তো ভয় পাওয়া উচিৎ!”

স্নেহর অমন উত্তর শুনে নাবিল যা বলতে এসেছিলো সব ভুলে গেছে। কারন স্নেহর সাহস সম্পর্কে তার ধারণা ইতিমধ্যে হয়েই গেছে। কিন্তু সে যে এভাবে পাল্টা আক্রমন করতে প্রস্তুত সেটা তার ধারনার বাইরে ছিল। এই মেয়েকে কেউ হালকা ভাবে নিলে সেটা তার জীবনের সব থেকে বড় ভুল হবে। নাবিলের এভাবে চুপ করে থাকা দেখে স্নেহ আবার নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল “ভয় পাইলেন না তো আবার?”

নাবিল এবার বেশ অবাক হল। মেয়েটা জোর করে তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। সে নিজের এই ভিতু মনটাকে আড়াল করে নরম কোমল কণ্ঠে বলল “আমি ভয় পাইনা ভয় দেখাই।”

নাবিলের কথা শুনে স্নেহ হাসল। সেই হাসির ধরন স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে যে কথা নাবলেও একটা মানুষকে অপমান করা সম্ভব। হেসে স্নেহ দ্রুত পায়ে সিঁড়ির দিকে গেলো।

“স্নেহময়ি!” নাবিলের ডাকে থেমে গেলো। কিন্তু লোকটার বার বার এভাবে তার পুরো নাম ধরে ডাকার কারণটা তার কিছুতেই স্পষ্ট হলনা। একটা শ্বাস ছেড়ে পিছনে ঘুরে বলল “বলেন!”

নাবিল তার সামনে এসে দাঁড়ালো। হুডির ভিতর থেকে ডাইরিটা বের করে স্নেহর সামনে ধরল। ডাইরিটা চোখে পড়তেই স্নেহর মেজাজ দপ করে জলে উঠলো। মনে পড়ে গেলো বিকেলের সেই দুঃখ জনক কাহিনি। আরও বেশি মেজাজ খারাপ হল তার জন্য নাবিলের কিনে আনা ডাইরি দেখে। সে ডাইরির দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে নিলো।

নাবিল খুব শান্ত সরে বলল “তখনের অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য সরি। এটা নাও।” নাবিলের শান্ত সরের কথা গুলো স্নেহর শিরায় শিরায় রাগের মাত্রা টা বাড়িয়ে দিলো নিমেষেই।

“ওই ডাইরির মধ্যে যেগুলা লেখা ছিল সেগুলা কি ফেরত পাব? ওইটা শুধু ডাইরি ছিলোনা আমার এক ঝাক সুন্দর মুহূর্তের সমন্বয় ছিল। ওটার সাথে কনটারই তুলনা হয়না। কষ্ট করে আনছেন ধন্যবাদ! কিন্তু এটা আপনার কাছে রেখে দিলেই খুশি হবো।” কড়া বাক্য গুলো নাবিলের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিয়েই আবার সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল সে। কিন্তু নাবিল তার এক হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে তার পথ আটকে দিলো। স্নেহ বেশ অবাক হল। কিছুক্ষন হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নাবিল তার এক হাত টেনে তাতে ডাইরিটা ধরে দিয়ে দাতে দাঁত চেপে বলল “না করবানা। এই শব্দটা আমার অপছন্দ। এমন কোন আচরণ করবানা যাতে আমি অধিকার খাটাতে বাধ্য হই। আমার অধিকার বড়ই ভয়ংকর কিন্তু!”

চলবে………।

এক বসন্ত প্রেম পর্ব-০৭

0

🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৭

গ্রামের পশ্চিমের সরু পাকা রাস্তা ধরে কিছুদুর গেলেই বিশাল মাঠের দর্শন পাওয়া যায়। রাস্তা থেকে একটু নেমে জমির উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয় মজুমদার বাড়ির বাগানে। বিশাল একটা পুকুর। এই মাথা থেকে ওই মাথা দেখতে বেশ কষ্ট হয়। সেই পুকুরের চারিদিকেই আম গাছ আর কিছু অংশ জুড়ে লিচু গাছ লাগান। বাগানের সাথেই একটা ছোট বেড়ার ঘর। সেখানেই বাগানের পাহারাদার থাকেন। পুকুরের এক পাশে ছোট জায়গায় শান বাঁধানো। সেখানে সম্ভবত বসার জন্য তৈরি করে রাখা হয়েছে। সেই পাশেই রাখা একটা ডিঙ্গি নৌকা। পুকুরের মাছ গুলোকে খাবার দেয়ার জন্য সেটা ব্যবহার করা হয়। গাছের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া আকা বাকা রাস্তা অনুসরণ করে হাঁটছে সাদেক, রাজ্জাক আর নাবিল। পিছনে স্নেহ আর সুহা। তার পিছনে গাছের ডাল ধরে ঝুলছে মুবিন। স্নেহর মুবিন কে দেখে মনের দশ্যি ইচ্ছা গুলো চাড়া দিয়ে উঠলেও বাবার ভয়ে আর ভদ্রতার খাতিরে দমিয়ে রাখছে। গাছে উঠার জন্য হাত পা কেমন উস খুস করে উঠছে। নিজেকে সংযত করা কঠিন হওয়ার আভাষ পেয়েই দ্রুত পায়ে পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটের উপরে বসে পড়ে। তার সেখানে বসা দেখে সুহাও মুবিন কে ইশারা করে নিজে দৌড় দেয়। মুবিনও তাকে অনুসরণ করে সেখানে গিয়ে বসে। সূর্যের আলোর ছটায় পুকুরের মাঝখানের কিছু পানি তাল মিলিয়ে সোনালি রঙ ধারন করেছে। পাড় থেকে দেখে মনে হচ্ছে তরল সোনা যেন ঝলমলিয়ে চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে। স্নেহর দৃষ্টি তাতেই আটকে যাচ্ছে বারবার। মন সেই তরল সোনার ফোটা চোখে মুখে ছোঁয়াতে চাইছে খুব করে। কিন্তু নৌকা চালিয়ে সেখানে যাওয়ার কথা বাবাকে বলবেই বা কি করে। অসহায় দৃষ্টি নৌকার উপরে ফেলে এক মনে ভাবছে। নাবিল একটু হেঁটে গিয়ে কিছু দূরত্ব বজায় রেখে তার পাশে বসলো। স্নেহর কোন ভাবান্তর হল না। নাবিল ঘাড় বেকিয়ে তার দিকে তাকাল। স্নেহকে এমন ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে বুঝতে চাইলো তার মনের ভাব। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে স্নেহ তার দিকে তাকাল। তার তাকানো দেখে নাবিল একটু অপ্রসতুত হয়ে গেলো। স্নেহ এক গাল হেসে বলল “নৌকায় চড়বেন?”

স্নেহর মুখে এমন কথা শুনে নাবিল একটু ভাবল। তারপর হেসে নিজের সম্মতি জানালো। স্নেহ আর দেরি না করে গলা তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল “বাবা নাবিল ভাই নৌকায় চড়তে চায়।”

সাদেক গম্ভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হেসে সম্মতি দিলো। স্নেহ বাবার সম্মতি পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। তার ঠোটের হাসি প্রশস্ত করে নাবিলের দিকে তাকাতেই থেমে গেলো। সে চোখ ছোট ছোট করে ভ্রু কুচকে কঠিন দৃষ্টি তার দিকে নিক্ষেপ করেছে। তার মিথ্যে বলার কারন সে বেশ বুঝতে পারছে। সেই দৃষ্টিও স্নেহর খুশির মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ালো না। সে বরং আরও ঠোঁট জোড়া চেপে হাসতে লাগলো। চোখ জোড়া নিচের দিকে নামিয়ে নিজের মনের আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো। তার সেই হাসি দেখে নাবিলও হেসে ফেললো। স্নেহ আড় চোখে নাবিলের দিকে দেখে নিয়ে এক দৌড়ে নৌকার পাশে গিয়ে দাড়িয়ে হাত উঠিয়ে সবাইকে ইশারা করলো। মুবিন প্রথমে উঠলো। তারপর সুহা কে উঠালো। নাবিল উঠে পিছনে ফিরে স্নেহর দিকে তাকাল। নিজের হাত টা বাড়াতে যাবে তার আগেই স্নেহ লাফ দিয়ে তার পাশে দাঁড়ালো। নৌকাটা এক মুহূর্ত বেশ ভয়ংকর ভাবেই দুলিয়ে উঠলো। মুবিন সুহা বসে ছিল বলে তেমন ভয় না পেলেও নাবিল দাড়িয়ে থাকার কারনে বেশ ভয় পেলো এবং পিছনে হেলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই স্নেহ তার হাত টেনে ধরল। নাবিল নিজেকে সামলে নিয়ে ভ্রু কুচকে স্নেহর দিকে তাকিয়ে এক ধমক দিলো।

“এভাবে কেউ লাফ দেয়? ইডিয়েট!” উক্ত কথায় সবাই একটু ভয় পেয়ে যায়। নাবিল সবার দিকে একবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচে বসে পড়ে। স্নেহ নত দৃষ্টিতে দাড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল

“তোমাকে কেউ বসার জন্য ইনভাইট করবে না? বস!” পুনরায় ধমকে স্নেহ বসে পড়ে। মুবিন বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকার কিনারে বসে পড়ে। আনমনেে নৌকা চালাতে থাকে। সুহা নিজের দৃষ্টি এদিক সেদিক ফেরাতে লাগলো। স্নেহ তার কাঙ্ক্ষিত জায়গায় নিজের দৃষ্টি স্থির রেখেছে। নাবিল প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত। এলোমেলো হাওয়ায় পানির অস্বাভাবিক তোড়ে নৌকা হালকা ভাবে দুলেই চলেছে। নাবিল মাঝে মাঝে একটু ভয় পেয়ে নৌকার কিনারে জোরে চেপে ধরছে। মাঝে মাঝে হাওয়ার দুলুনি লাগতেই সে যেন নড়াচড়া করতেই ভুলে যাচ্ছে। একদম রোবটের মতো বসে পড়ছে। আবার একটু লজ্জাও কাজ করছে। সামনে দুইটা মেয়েকে অবিচল ভাবে বসে থাকতে দেখে সে নিজের এই ভয় টাকে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছেনা। মাঝে মাঝেই সেটা ভীষণ ভাবে চাড়া দিয়ে উঠছে। সেই সোনালি পানির কাছে পৌছাতেই স্নেহ আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। একটু ঝুকে সেই পানির ছিটা চোখে মুখে ছোঁয়াতেই নৌকা হেলে দুলে গেলো। আর নাবিল ভীষণ ভয় পেয়ে কেপে উঠলো। স্নেহ মুখ তুলে নাবিলের সেই ভয়ার্ত চেহারা চোখে পড়তেই। নাবিলের হাত শক্ত করে ফেললো।

“ভয় পাবেন না। কিছু হবে না।” আশস্তের সূরে বলল স্নেহ। কিন্তু নাবিলের সেই কথা কানের পর্দা ভেদ করতেই পারল না। সে তার হাতে রাখা স্নেহর হাতের উপরে দৃষ্টি স্থির করেছে। কিছু সময় সেখানে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে উপরে চোখ তুলে তাকাতেই তার বুকের সেই দুরু দুরু কাপন কিছু সময়ের জন্য থমকে দাঁড়ালো। পুরো শরীর অনুভুতি শুন্য হয়ে গেলো। সোনালি রোদের আদুরে আলিঙ্গনে স্নেহর রুপ ঝলসে দিচ্ছে সব কিছু। তার সাথে সেই তরল সোনা নামক গলিত পদার্থ গুলো সারা মুখ ছুয়ে চিবুক বেয়ে ঝরে যাচ্ছে। কপালে কিছু চুলের গোছা এলোমেলো ভাবে লেপটে গেছে। ঘন পাপড়ির উপরে বিন্দু বিন্দু ভাবে জমে থেকে সেই তরল পদার্থ থেমে আছে ঝরে পড়ার অপেক্ষায়। প্রশস্ত করে রাখা গোলাপি ঠোঁট গুলো সোনালি বিন্দু গুলো নিজের আয়ত্তে নিয়ে যেন বিজয়ির বেশে হেসে উঠছে কেঁপে কেঁপে।

“তুমি নড়লা কেন আপা? এই জন্যই তো ভাইয়া ভয় পাইছে।” সুহার কথায় নাবিল নিজের সম্বিত ফিরে পেলো। নিজের চোখ বন্ধ করে ফেললো। চোখ খুলে দেখল স্নেহ ঠোঁট টিপে হাসছে। নাবিল ক্ষীণ হাসল। স্নেহ নাবিলের হাত ছেড়ে দিয়ে পাশ ফিরে তাকাল। নাবিল স্নেহকে দেখছে। তার মনের চঞ্চলতা ঠোটের মাঝে ফুটে উঠেছে এক অনাবিল হাসির মাধ্যমে। মেয়েটা বেশ উতফুল্য। নাবিল আসার পর থেকে তাকে কখনও মন খারাপ করে থাকতে দেখেনি। তপ্ত শ্বাস ছাড়তেই সাদেকের অস্পষ্ট সর কানে আসলো।

“ফিরে আসো ওই পাশটায় জাইতে হবে।” সাদেকের কথা শুনে মুবিন বৈঠা স্নেহর হাতে দিয়ে দিলো। কারন ফিরে যেতে হলে এখন উলটা পাশ থেকে বৈঠা চালাতে হবে। স্নেহ বৈঠা নিয়ে চালাতে লাগলো। নাবিল মুগ্ধ হয়ে দেখছে তাকে। এই মেয়ের কত রুপ। দুনিয়াতে কি কোন কাজ এমন আছে যা এই মেয়ে পারেনা। স্নেহ চোখ ফেরাতেই নাবিল কে অমন ভাবে দেখে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে নিলো। খানিক বাদেই অমন দৃষ্টির কারন উৎঘাটন করতে পেরে একটু হেসে বলল

“খুব সোজা! শিখায়ে দিলে আপনিও পারবেন।” স্নেহর কথায় নাবিল অদ্ভুত ভাবে হাসল। সেই হাসি স্নেহকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিলো। স্নেহর মুখের হাসি হাওয়ায় উড়ে গেলো। সে নিজের চোখ ফিরিয়ে নিলো। স্নেহর অবস্থা বুঝতে পেরে নাবিল নিজের হাসি আরও প্রশস্ত করে ফেললো।

অবশেষে নৌকা পাড়ে এসে দাঁড়ালো। সবাই এক এক করে নৌকা থেকে নেমে গেলো স্নেহ ছাড়া। স্নেহ নামতে যাবে তার আগে নাবিল নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো। স্নেহ একটু থমকে হাতের দিকে কিছুক্ষন দেখে নিয়ে চোখ তুলে নাবিলের দিকে তাকিয়ে বলল

“লাগবে না। আমি নামতে পারব।” নাবিল তার কথার গুরুত্ব না দিয়ে কঠিন ভাবে বলল “নিজে থেকেই ধরতে পার আর আমি বাড়ায়ে দিলেই অজুহাত!”

নাবিলের কথার মানে স্নেহ কত টুকু বুঝতে পারল কে জানে। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে হাত ধরে ফেললো। নাবিল হাসল। কিন্তু সেই হাসি স্নেহ বুঝতে পারল না। পায়ের তলায় শক্ত মাটির স্পর্শ পেতেই স্নেহ নিজের হাত টেনে নিতে চাইলো। কিন্তু নাবিল তার হাতের বাধন আলগা করার পরিবর্তে আরও শক্ত করে ধরল। স্নেহর এবার খুব অসস্তি হতে লাগলো। অস্থিরতা বিরাজ করছে। সহ্য করতে না পেরে কঠিন গলায় বলেই ফেললো

“ছাড়েন নাবিল ভাইয়া।” কোন কথা না বলে নাবিল হাতের বাধন আলগা করতেই স্নেহ তার হাত ছাড়িয়ে নিলো। নাবিল সামনে তাকিয়েই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেলো।

কিছু সময়ের জন্য স্নেহ থেমে গেলো। আচমকাই এক অজানা অভিমান যে নাবিলের পুরো হৃদয় জুড়ে গ্রাস করেছে সেটা বুঝতে পেরেই স্নেহ থমকে গেলো। অভিমান টা বুঝলেও সেটার কারণটা স্পষ্ট হল না। কিন্তু এই অভিমান যে তীব্র ভয়ংকর কিছুর আভাষ জানিয়ে দিচ্ছে। সেই ভয়ংকর জিনিসটা হল অধিকার। তার উপরে নাবিলের কিসের এতো অধিকার যার ফলে এতো সহজেই সে তীব্র অভিমানের চাদর নিজের হৃদয়ে জড়িয়ে নিলো?

—————–

বিকেলের ফুরফুরে হাওয়ায় বাড়ির পাশের পুকুরের পাড়ে নরম ঘাসের উপরে পা মেলে বসে আছে স্নেহ। ডাইরি লেখার অভ্যেস আছে তার। মাঝে মাঝে জীবনের কিছু মুল্যবান মুহূর্ত স্মরণীয় করে রাখতে এই ডাইরির সাদা পাতায় কলমের আঁচড়ে লিপিবদ্ধ করে নেয়। এখন মনোযোগ দিয়ে সেই কাজটিই করছে সে। কি এক বিশেষ মুহূর্ত তার মনে ধরেছে। সেটাই কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াশ চালাচ্ছে আনমনে। মাঝে মাঝে এদিক সেদিক তাকিয়ে চার পাশের পরিবেশ দেখে ভেবে নিচ্ছে কিছু একটা। খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে লিখে আবার একটু হেসে নিচ্ছে নিজের মনেই। লেখা শেষ করে ডাইরির ভিতরে কলমটা রেখে এক হাতে সেটা ধরে আর এক হাত থুত্নির নিচে আলতো করে রেখে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। টুপ করে একটা রঙ্গিন মাছ লাফ দিতেই আবার হেসে দিলো সে। সামনে একটু পা বাড়িয়ে মাথা ঝুকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো সেই মাছ। কিছু চোখে না পড়ায় আবার উঠে দাঁড়ালো। মাথাটা অনেক টা ঝুকিয়ে পানির দিকে তাকাল। বেশ খানিকটা ঝুকার কারনে পাশে গাছটা ধরতে নিতেই দৃষ্টি সামনে থাকায় সেই কাঙ্ক্ষিত গাছটা ধরতে পারল না। আর তখনি বাধল বিপত্তি।

চলবে……।

এক বসন্ত প্রেম পর্ব-০৬

0

🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৬

মজুমদার বাড়ির পিছনে অনেকটা জায়গা দখল করে আছে এক বিরাট তেতুল গাছ আর তার কিছু সাথী। এই তেতুল গাছটা অনেক পুরাতন। স্বয়ং নুরুল মজুমদার নিজেও এর কোন হদিশ দিতে পারেন নি। ঠিক কোন সময়ে এর জন্ম সেটা এখন জীবিত কেউ জানেনা। গাছের তেতুল যেমন বিস্বাদ সেটাকে নিয়ে প্রচলিত কাহিনি গুলাও ঠিক তেমনই। কথিত আছে যে ওই গাছের নিচে নাকি কোন এক বৃদ্ধের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায় বীভৎস অবস্থায়। তাই সবার ধারণা ওখানে কোন অশরীরীর বসবাস। আর তার সেখানে কোন রকম মানুষের অস্তিত্ব অসহ্য। কেউ অবশ্য চোখে দেখেনি। তবুও এসব কথা গ্রামে বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়ে। তাই সেখানে এখন কেউ যায়না। তাছাড়াও ওখানে এখন সাপের আঁকড়া। ওই জায়গাটা মুলত এক সময় মজুমদার বাড়ির অংশ ছিল। কিন্তু এমন কথা প্রচলিত থাকার কারনে সেটার সামনে মস্ত এক দেয়াল দিয়ে সেটাকে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। সেই দিকটায় এখন ঝপে ঝাড়ে ছোট খাটো জঙ্গলে পরিনত হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের গাছ চোখে পড়ে। কোন কোনটা আবার সেই দেয়াল ভেদ করে বাড়ির ভিতরেও উকি ঝুকি দিচ্ছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল দো তলার সিঁড়ির ঘরের জানালা দিয়ে সেই তেতুল গাছের ছড়ানো ডালপালার অনেক টাই হাতের মুঠোয় চলে আসে। তেতুল বড় হওয়ার পর গাছের দিকে তাকালে মনে হয় পাতার চেয়ে তেতুলের সংখ্যাই বেশি। স্নেহ কিন্তু এই কারনে খুব খুশি। কারন সে দো তলা থেকেই হাত বাড়িয়ে সেই টক তেতুল পেড়ে লবন মাখিয়ে খেয়ে ফেলে। গাছে উঠারও কোন ঝামেলা থাকে না। আর তাছাড়াও ওই জঙ্গলে গিয়ে গাছে উঠার মতো কোন সাহস করা মানেই চরম বোকামি। এভাবেই ঢের সুবিধা কেউ জানতেও পারেনা। দেয়ালের এই পাশ থেকেই মাথা উচু করে সেই তেতুল গাছের দিকে তাকিয়ে সুমি নাবিল কে সেই ভয়ংকর ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে যা সে তার ছোট বেলায় শুনেছিলো। নাবিলও নিজের মাথা উচু রেখে তেতুল গাছের উপরে বসে থাকা এক পাখির দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে মায়ের সব কয়টা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নিচ্ছে। নিজের দৃষ্টি ওই জায়গাতে স্থির রেখেই নাবিল জিজ্ঞেস করলো “এতক্ষন যা বললা দেখছ কখনও?”

সুমি হতাশা নিয়ে মাথা নাড়ায়। যেন তার দেখার সুযোগ না হওয়াটা একটা চরম দুর্ভাগ্য। নাবিল আবার বলল “কেউ আদৌ দেখছে?”

নাবিলের এমন প্রশ্ন করা দেখে সুমি খুব বিরক্ত হল। চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে বলল “আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছেনা?”

নাবিল মায়ের দিকে দৃষ্টি ফেরাতেই দেখে তার মা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে যে তার কাছ থেকে কোন না সুচক শব্দ মোটেই আশা করছে না সেটা তার দৃষ্টি ভঙ্গি স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে। আর এই মুহূর্তে এরকম কোন ভাব প্রকাশ করা নাবিলের জন্য বড়ই বোকামি হয়ে যাবে। কারন সুমি যে এতো সময় ধরে অনেক বাক্য ব্যয় করে একটা গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করতে চাইলো, সেটা কোন ভাবেই নাবিলের উপরে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি সেটা জানা মাত্রই তার রাগের মাত্রাটা ঠিক কোথায় পৌঁছাবে সেটা আন্দাজ করেই নাবিল বিপদ বাড়াতে চাইছেনা। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল “না, আসলে কেউ দেখে থাকলে তার কাছ থেকে আরও ভালো ভাবে শুনতাম। আমার আবার এগুলা শুনতে খুব ভালো লাগে।”

নাবিলের কথায় সুমির ঠোঁট প্রসারিত হয়ে গেলো। তার বিদেশে বড় হওয়া ছেলে যে এতো সহজে তার এসব কথা বিশ্বাস করবে সেটা ভেবেই নিজের মনের আনন্দ তার ঠোটের সেই হাসির মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। হাস্যজ্জল চেহারা নিয়ে বলল “এক বয়স্ক লোক আছে। এই গাছ সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। মুবিন কে বললেই নিয়ে যাবে।”

নাবিল আর কিছু বলল না। আবার আগের জায়গায় দৃষ্টি ফিরে পাখি দেখায় ব্যস্ত হয়ে গেলো। সুমি এখনো নাবিলের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেছে। হাজারো হোক মা তো! ছেলের মিথ্যেটা ধরার এই অস্বাভাবিক ক্ষমতা তারা অলৌকিক ভাবেই পেয়ে থাকে। তারপরও সুমি নিজের মনের কথার চেয়ে ছেলের মুখের কথাকেই প্রাধান্য বেশি দিচ্ছে। একটু সময় নাবিলের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বলল “বলব মুবিন কে?”

নাবিল দৃষ্টি ফিরে মায়ের দিকে দেখে নিজের ঠোঁট প্রশস্ত করে একটা হাসি দিলো। সেই হাসির মানে সুমি হ্যা ধরে নিয়ে খুশি মনে চলে গেলো মুবিন কে খুঁজতে। নাবিল আবার সেই একি জায়গায় একি ভাবে নিজের দৃষ্টি স্থির করলো। কিন্তু খানিক বাদেই নিজের পায়ের উপরে শীতল কোন স্পর্শ অনুভব করতেই তার মস্তিষ্ক সাপের আভাষ জানিয়ে দিলো। কারন সে পড়েছে সাপের স্পর্শ অনেক শীতল হয়। আর তার মা কিছুক্ষন আগেই বলেছে সেই তেতুল গাছের ওখানে নাকি অনেক সাপ থাকে। সেই সাপ এই দেয়াল ভেদ করে আসাটা কোন ভাবেই অসম্ভব না। তাই ভয় পেয়ে চমকে উঠে চিৎকার করলো “সাপ! সাপ!”

পরক্ষনেই কোন মেয়েলি কণ্ঠের খিল খিল হাসির শব্দে পিছনে ফিরে তাকায়। স্নেহ মুখে ওড়না চেপে হাসি আটকাতে চেষ্টা করেও পারছে না। তার হাসির শব্দ আরও যেন বেড়েই চলেছে। সুরময়ী সেই হাসি চারিদিকে যেন এক মাদকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে যাতে যে কেউ সহজেই আসক্ত হয়ে পড়বে।

“কি হইছে বাবা?” মিনার এমন বিচলিত কণ্ঠে নাবিলের মনে পড়ে গেল যে তার পায়ে সাপ উঠেছিলো। সে আবার চোখে মুখে ভয়ের রেশ নিয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল “সাপ! মামি।”

বেশ কিছুক্ষন পরও যখন কারও কোন আওয়াজ পেলো না তখন চোখ তুলে তাকাল সামনে। ইতিমধ্যে পুরো মজুমদার পরিবার সেখানে উপস্থিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু কারও তেমন কোন হেলদোল না দেখে নাবিল বেশ অবাক হল। উলটা তারা আরও তার দিকে প্রশ্নবিধ্য দৃষ্টি ছুড়ে দিয়েছে যেন সাপ নামক প্রাণীটি তাদের কাছে বড়ই অপরিচিত। সে এবার ভাল করে ভাবতে লাগলো। উত্তেজিত হয়ে সাপের জায়গায় আবার অন্য কিছু উচ্চারন করে ফেললো না তো? নাহ! ঠিকই তো আছে। তাহলে সবার আচরণ এমন অস্বাভাবিক কেন?

“সাপটা কি শহর থেকে সাথে আনছেন?” স্নেহর এমন ঠাট্টার সূরে বলা কথার মানে খুঁজতে নাবিল তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়। স্নেহ নাবিলের অমন দৃষ্টি দেখে আবারো মুখে ওড়না চেপে হাসতে থাকে। কিছুক্ষন হেসে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলে “শীতের সময় কোথায় সাপ পাওয়া যায়? পাইলে আমারেও একটু দেখায়েন!”

স্নেহর এমন ঠাট্টা করায় নাবিল বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকায়। সবাই নাবিলের সেই দৃষ্টি বুঝতে পেরে ঠোঁট চেপে হাসে। তাদের হাসি দেখে নাবিল বিরক্তির রেশ নিয়ে তাকায়। তার সেই দৃষ্টির মানে বুঝতে পেরে যে যার মতো কাজে চলে যায়। নাবিল বিরক্তি নিয়ে বলে“সাপ কি ঋতু বুঝে কামরায় নাকি?”
স্নেহ আবারো হাসে। ঠোটের কোণে হাসি রেখেই সামনে তাকিয়ে বলে “শীতের সময় সাপ বাইর হয়না।”
“সাপ কি তোমাকে বলে বাইর হয় নাকি? সাপ নাহলে ওটা তাহলে কি ছিল?” আবারো বিরক্তি নিয়ে বলল নাবিল।
“শুধু আমারে না। এই সময় যে সে বের হবেনা তা সবাইরে জানায়ে দেয়। আর ওটা সাপ না…।”
সামনে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে বলে “ওই হাসের বাচ্চাটা আপনার পায়ের উপর দিয়ে গেছে। গায়ে পানি ছিল তাই ঠাণ্ডা লাগছে।”
স্নেহর আঙ্গুলের দিকে তাক করে তাকিয়ে নাবিল বুঝতে পারল তার কথার যুক্তি আছে। কিন্তু সেটা স্নেহকে বুঝতে না দিয়ে সে তাকে হালকা অপমান করার উদ্দেশ্যে কণ্ঠে অবাকের সুর টেনে বলে “আচ্ছা! তোমাদের গ্রামে এমনও হয় বুঝি? সাপ কবে বের হবে তা জানিয়ে দেয়!”
“শুধু আমাদের গ্রামে না আপনাদের শহরেও হয়। শীতের সময় সাপ শীতনিদ্রায় যায়। বইতেই তো লেখা আছে।”
স্নেহর কথা মাথায় ঢুকতেই নাবিল একটু লজ্জা পেলো। আসলেই তো! সাপ যে শীত নিদ্রায় যায় সেটা সে পড়েছে কিন্তু মাথাতেই নেই। তাকে অপমান করার উদ্দেশ্যে বলা কথাটা তার উপরেই ভারি পড়ে গেলো। অযথা একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির স্বীকার হল। একটু ভালো করে ভাবলেই এমন টা হতোনা। নিজের বোকামির কথা ভেবেই নাবিল নত দৃষ্টিতে নিঃশব্দে হাসল। স্নেহ আড় চোখে তার হাসি দেখে নিয়ে নিজের ঠোঁট আরও প্রসারিত করে আবার সামনে দৃষ্টি স্থির করে বলল “ আপনার মতো বিচক্ষণ ব্যক্তির এমন ভুল মানা যায়না।”

স্নেহর কথা শুনে নাবিল বেশ অবাক হল। নিজের দৃষ্টি তার দিকে ফিরিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো তার কথার মানে। স্নেহ নিজের ঠোঁট টিপে হাসছে। তার দৃষ্টি সামনে কোথাও একটা স্থির।

“আমি যে বিচক্ষণ তুমি কিভাবে জানলে?” স্নেহর দিকে তাকিয়ে ভ্রু জোড়া সংকুচিত করে প্রশ্ন করলো নাবিল। আড় চোখে একবার দেখে নিয়ে একটু হেসে আবার সামনে তাকিয়ে বলল “ফুপুরে যেভাবে বোকা বানাইতেছিলেন তা দেখেই আন্দাজ করা যায়।”

স্নেহর কথা শুনে নাবিলের ঠোটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ঠোঁট জোড়া আর একটু প্রসারিত করে স্নেহর দিকে তাকাল। তার ঠোঁটেও অমায়িক হাসি। অদ্ভুত এক মায়া সেই হাসিতে। মাথায় দেয়া ওড়নার নিচে দিয়ে বের হওয়া ছোট ছোট চুল গুলো বাতাসে অবাধ্যের মতো উড়েই চলেছে। এক আঙ্গুল দিয়ে অনবরত সেগুলোকে চোখের উপরে পড়া থেকে আটকাতে চেষ্টায় ব্যস্ত সে। নাবিল নিজের ঠোটে হাসি রেখেই কণ্ঠে দুষ্টুমির রেশ টেনে বলল “তাহলে দূর থেকে আমাকেই দেখছিলা?”

নাবিলের দুষ্টুমি ভরা কণ্ঠের বাক্য কানে আসতেই স্নেহর হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। ভ্রু জোড়া আপনা আপনি সংকুচিত হয়ে গেলো। কণ্ঠে গম্ভীর ভাব এনে বলল “কাউরে ওভাবে দেখতে হয়না। তার কথা শুনলেই বোঝা যায় কি বলতে চায়।”

নাবিল ঠোঁট চেপে হেসে সামনে তাকিয়ে আবার একি সরে বলল “তাহলে চুপ করে আমার কথা শুনছিলে? আমি কি এতোটাই মহনীয় কথা বলি যে চুপ করে হলেও শুনতে হবে?”

স্নেহ এবার এরকম কথায় বেশ বিরক্ত হয়। মেজাজ টাও নিমেষেই বিগড়ে যায়। বয়সে বড় জন্যই কিছু বলতে পারলো না। ছোট হলে এমন হেয়ালি কথা বলার কারনে এতক্ষনে থাপড়ায়ে গাল ফাটায়ে দিত। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে ফেলে। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল “শুনতে চাইনি। পাশেই দাড়ায়ে ছিলাম তাই কানে আসছিল। আপনি যত জোরে বলতেছিলেন।”
স্নেহর এমন নির্লিপ্ত উত্তরে নাবিল নিজের হাসি আটকে কোমল সরে বলল “আম্মু পাশে দাড়িয়ে যেটা বুঝতে পারল না তুমি দূর থেকেই সেটা বুঝলা? বেশ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তো!”

নাবিলের এমন কথা স্নেহর বিরক্তি আরও বাড়িয়ে দিলো। সে কোন বেয়াদবি করতে চায়না তাই নিজেকে সংযত রাখতেই তার কথার পাল্টা উত্তর করলো না। স্নেহর দিকে ঘুরে তার মুখের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেশ গম্ভীর গলায় নাবিল আবার বলে উঠলো “তো এই পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা কি সবার জন্যই নাকি শুধুই আমার জন্য!”

স্নেহ এবার রেগে নিজেকে সংযত না করতে পেরে তার দিকে দৃষ্টি ফেরাতেই তার সেই সম্মোহনী দৃষ্টির জালে আটকে গেলো। মুখ দিয়ে আর কোন কথাই বের হচ্ছে না। সেই প্রথম দিনের মতো আজও তার সমস্ত আবেগ নিজের মতো ছুটে বেরোতে চাইছে। নিজের অবাধ্য দৃষ্টি চাইলেও কিছুতেই নিজের আয়ত্তে আনতে পারছে না স্নেহ। নাবিলের সেই সম্মোহনী দৃষ্টির মাঝেই নিজের সম্মোহিত হওয়া বেহায়া চোখ জোড়া নিবদ্ধ হয়ে আছে।

“আপা! তোমারে ডাকে।”সুহার চাপা সরেও চমকে গেলো সে। বেহায়া চোখ জোড়া সংযত করে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেলো। নাবিল মাথা বাকিয়ে তার দিকে একবার দেখে সামনে তাকাল। তার দুই ঠোটের মাঝে এক বিশ্ব জয়ী হাসি জায়গা করে নিলো।

চলবে………।

এক বসন্ত প্রেম পর্ব-০৫

0

🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৫

শীতের আমেজ শেষ হয়ে বসন্ত ছুই ছুই। এমন সময় শীতের নির্মমতায় নুইয়ে যাওয়া প্রকৃতিকে প্রাণবন্ত করতে এক পশলা বৃষ্টির আগমনে চারিদিকে ঝলমলিয়ে উঠলো। প্রকৃতি যেন প্রান ফিরে পেয়ে তার আগের রুপ ধরতে চাইছে। গাছপালা গুলো নিজেদের ডাল পালা মেলে এক তাণ্ডব নৃত্যে মেতে উঠেছে সেই খুশিতে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে বাইরে যাওয়ার কোন উপায় নেই। বাইরে তো দুরের কথা বাড়ির খোলা উঠোনেই নামার উপায় নেই। তাই সবাই ঘরের মধ্যেই ভিড় করে বসে আছে। বেশ জমিয়ে উঠেছে আড্ডা। স্নেহর বাবা চাচা আর ফুপা এক ঘরে। মা আর ফুপু আরেক ঘরে। মিনা চাচি আর সুহা তার সাথে রান্না ঘরে। তারা এই মুহূর্তে পাকোড়া বানাচ্ছে। এই বৃষ্টির বিকেলে গরম গরম চায়ের সাথে পাকোড়ার মজাই আলাদা। স্নেহ মনোযোগ দিয়ে তার সেই মসলা দুধ চা বানাচ্ছে। এই চায়ের রেসিপি টা শিখেছে সে তার বড় ফুপু শেফার কাছে। তার ফুপু যখন ভারতে বেড়াতে গিয়েছিলো তখন সেখান থেকে তিনি এই বিখ্যাত চা খেয়ে এসেছেন। আর স্নেহকেও খুব যত্ন করে শিখিয়েছেন। বৃষ্টির এমন দিনে স্নেহ প্রায়ই এই চা বানায়। আজও সে এই চা বানাচ্ছে।

দোতলার ঘরে নাবিল আর মুবিন জানালার ধারে বসে বৃষ্টি দেখছে। অনেক্ষন বসে থাকার ফলে নাবিলের হাত পা অসাড় হয়ে আসছিল তাই একটু উঠে দাড়িয়ে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। দোতলায় পাশা পাশি দুইটা ঘর। সিঁড়ি বেয়ে উঠেই একটা ঘর সেখানে একটা ছোট চৌকি রাখা আছে। সেই ঘর পেরিয়ে এই ঘরে আসলেই আগে চোখে পড়ে রাজকীয় একটা খাট। মনে হয় বেশ পুরাতন। কেউ খুব যত্নে এটা নিজের মন মতো বানিয়েছে। তার পাশেই দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে রাখা পুরাতন কাঠের আলমারি। নাবিল ধির পায়ে সেই আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভালো করে খেয়াল করে বুঝল সব কিছুতে ধুলো পড়ে থাকলেও খাট আর আলমারিতে তেমন ধুলো নেই। মনে হচ্ছে কেউ প্রায় সময়ই খুব যত্ন করে এই দুইটা জিনিস নাড়াচাড়া করে। আলমারির হাতল ঘুরাতেই সেটা খুলে গেলো। আলমারি খুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো নাবিলের। তাক ভর্তি বই। কত রকমের বই।

“এগুলা কে পড়ে?” বইগুলোতে আঙ্গুল চালাতে চলাতে আগ্রহ নিয়ে মুবিন কে জিজ্ঞেস করলো নাবিল। মুবিন সেই দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল “আপা। আমরাও মাঝে মাঝে পড়ি। কিন্তু অতো ধৈর্য নাই।”

“ইংলিশ বই গুলাও পড়ে?” নাবিল একটা ম্যাক্সিম গরকির বই হাতে নিয়ে বলল। “অইখানে যত বই আছে সবই আপা পড়ে। তার খুব পছন্দ বই পড়া। এই খানে আসে সারাদিন শুয়ে শুয়ে বই পড়ে।” মুবিনের কথা শেষ নিচ থেকে ডাক আসলো মিনার “মুবিন নিচে একবার আয় তো!”

“আসি।” বলেই এক দৌড় দিলো সে। খট খট শব্দে নিচে নেমে গেলো। নাবিল ইংলিশ বইটা রেখে সমরেশ মজুমদারের একটা বই তুলে হাতে নিলো। পাতা উলটাতে উলটাতে নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলো। আবার সেই সিঁড়ির খট খট আওয়াজ কানে আসলো। নাবিল ধরেই নিয়েছে যে মুবিন ফিরে এসেছে। তাই বইয়ের দিকে তাকিয়েই বলল “তোমার পছন্দের লেখক কে?”

“আমি সব লেখকের বই পড়ি।” চিকন মেয়েলি কণ্ঠ কানে বাজতেই সে ঘুরে তাকায় তার দিকে। স্নেহ এক হাতে চায়ের কাপ আর আরেক হাতে পাকোড়া ভর্তি একটা প্লেট নিয়ে দাড়িয়ে আছে। বেশ খানিকক্ষণ সারা মুখে চোখ চালিয়ে নিয়ে নাবিল নিজের দৃষ্টি পা থেকে মাথা পর্যন্ত চালিয়ে নিলো। বেশ ছিপছিপে গড়ন। লাল ওড়না মাথা অব্দি টেনে দেয়া। চোখ গুলো বেশ বড় বড়। ঠোঁট জোড়া গোলাপি। লাল ওড়নার মাঝখানে বের হয়ে থাকা ফর্সা মুখটা বেশ আকর্ষণীয়। যে কারও চোখ আটকে যাবে। ঠোটের কোণে ক্ষীণ হাসি। অনেক সুক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই সেই হাসি চোখে পড়বে।

“চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।” স্নেহর কথাটা কানে আসতেই সম্বিত ফিরে পেলো নাবিল। একটু নড়েচড়ে বইটা রেখে স্নেহর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিলো। পাকোড়ার প্লেট টা পাশের টুলে রেখে স্নেহ দ্রুত পায়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।

“স্নেহময়ী!” নিজের পুরো নামটা কানে আসতেই পা থেমে গেলো তার। পিছন ফেলে অবাক দৃষ্টি ফেললো নাবিলের দিকে। নাবিল মাত্র চায়ে চুমুক দিয়ে থমকে দাড়িয়ে আছে।

“কিছু বলবেন?” স্নেহর সুরেলা কণ্ঠ শুনে ঠোটের কোণে হাসি নিয়ে বলল “চা তুমি বানাইছ?”
“হুম!” নাবিলের প্রশ্নের ছোট্ট উত্তর দিলে সে। “অপূর্ব!” না চাইতেও নাবিলের মুখ থেকে উক্ত শব্দটা বের হয়ে গেলো। সেটা ঠিক চা নাকি স্নেহর উদ্দেশ্যে ছিল সেটা বোঝা দায় হয়ে গেলো। এমন সময় মুবিন হাতে চায়ের কাপ নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল “আপা ফুপা নিচে তোমারে ডাকছে।”

স্নেহ কোন কথা না বলে নাবিলের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট জোড়া খানিক প্রসারিত করে নেমে চলে গেলো। তার সেই প্রসারিত ঠোঁট নাবিলের দৃষ্টি স্থির করে দিলো। কি অদ্ভুত! তার পরিবারে যে এতো সুন্দর মেয়ে আছে সেটা সে জানতইনা। আবার তারই নাকি আপন মামাতো বোন! সে অবশ্য মায়ের কাছে শুনেছে অনেকবার। কারন তার মা মাঝে মাঝে দেশে আসত। আর আসলে এই মজুমদার বাড়িতে আসতে কখনও ভুলতনা। এখান থেকে গিয়েই তিনি স্নেহর কথা বার বার বলতেন। বর্ণনা দিতেন তার সৌন্দর্যের। কিন্তু নাবিল সেসবে কখনও মনোযোগ দেয়নি। দিলে হয়ত আজ এতো অবাক হতোনা। আগেই এই রূপবতী রমনি সম্পর্কে তার ধারণা হয়ে যেত।

——————
গতকাল এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় আজ কুয়াশার তেমন জোর নেই। সকাল সকাল সূর্যি মামা তার দু হাত খুলে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ ছড়িয়ে দিয়েছে দুনিয়াতে। সেই মিষ্টি উষ্ণ পরশের ছোঁয়ায় আজ সকাল সকাল স্নেহ আর সুহা আবার সেই জলপাই গাছের নিচে এসেছে। সেদিন যা পেড়েছিল এতদিনে সব খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। তাই আজ আবার এসেছে কিছু জলপাই পেড়ে নিয়ে যেতে। বরাবরের মতো স্নেহ গাছে উঠে পড়েছে। সুহা নিচে দাড়িয়ে এদিক ওদিক চোখ ফেরাচ্ছে পাহাদারের মতো।

“সুহা এইদিকে আয়।” স্নেহর গলা পেয়ে গাছের নিচে এগিয়ে গেলো সুহা। নিজের আচল পেতে ধরল। স্নেহ দ্রুত কিছু জলপাই সেই আচল বরাবর ফেলে দিলো। একটু উপরে হাত বাড়াতেই সুহার গলার আওয়াজ পেয়ে থেমে গেলো।

“আপা কে যেন এইদিকে আসছে।” সুহা নিজের আচল মুড়িয়ে দৌড়ে গাছের পিছ্নে লুকাল। স্নেহ কিছু বুঝতে না পেরে লাফ দিয়ে গাছ থেকে নামল। নিচে লাফ দিয়ে দাড়াতেই তার চুল গুলো খুলে সারা গায়ে বিছিয়ে পড়লো। অবাধ্য চুল বাতাসে এলোমেলো হয়ে মুখের সামনে এসে পড়লো। পাশ ফিরতেই চমকে চোখ বড় বড় করে ফেললো। নাবিল নিজের অবাক দৃষ্টি তার দিকে স্থির রেখেছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ চালিয়ে নিলো একবার। ওড়না কোমরে গুঁজে এলোমেলো দুই হাতে ঘন কাল এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করার চেষ্টা করছে। নাবিল মুগ্ধ হয়ে দেখছে।

“আপা তুমি আবার গাছে উঠছ?” মুবিন ভীত কণ্ঠে বলল। নাবিল মুবিনের কথা শুনে তার দিকে তাকাল। সুহা ততক্ষণে তাদেরকে দেখে একটু স্বস্তি পেল। তাই ধির পায়ে গাছের পিছন থেকে বের হয়ে আসলো সে। নাবিল এবার নিজের চোখ তার দিকে ফেরাল। সুহার দৃষ্টিতেও ভয় ধরা পড়েছে।

“তুই এইদিকে আসলি কেন? এইদিকে তো এই সময় কেউ আসেনা?” স্নেহর উত্তপ্ত কণ্ঠ নাবিলের কান ভেদ করতেই সে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে তার দিকে তাকাল। তার চোখে মুখে ভয়ের কোন ছাপ নেই। খুব সাহসি মেয়ে। মুবিন তার সম্পর্কে এক বিন্দুও মিথ্যে বলেনি। স্নেহ নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নাবিলের দিকে তাক করতেই তার কোমল দৃষ্টি নাবিলের সেই ভয়ংকর সম্মোহনী দৃষ্টির সাথে সংঘর্ষে হার মেনে নত হয়ে গেলো। নাবিল বুঝতে পেরে কিঞ্চিত হেসে বলল “কোন কোন গাছে উঠতে পার তুমি?”

নাবিলের উক্ত প্রশ্ন স্নেহর মনে নিজের দশ্যি মনোভাবের আভাষ তীব্র গাড় বানিয়ে দিলো। সে চোখ তুলে এক ঝলক হেসে বলল “এই গ্রামে খুব কম গাছই আছে যেখানে আমার ছোঁয়া পড়েনি।”

স্নেহর কথায় নাবিল হাসল। মেয়েটা যে সাহিত্যপ্রেমি তা তার কথা শুনেও আন্দাজ করা সম্ভব। সাহিত্য পড়ে সেই সাহিত্যর ভাব নিজের চালচলন কথা বার্তায় নিখুঁত ভাবে ধারন করে ফেলেছে। নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিঃশব্দে হাসল নাবিল। স্নেহ তার সেই হাসির মানে বুঝতে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার তাকানো দেখে নাবিল একটু বিব্রত হল।

“ওই স্নেহ এইহানে কি করস?” মাঝ বয়সি এক মহিলার কণ্ঠ সর শুনে সবাই সেদিকে ফিরে তাকায়।
“ঘুরতে আইছি চাচি।” স্নেহ নির্লিপ্ত কণ্ঠে মিথ্যা ছুড়ে দিলো সেই মহিলার উত্তরে। নাবিল অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এতে স্নেহর কোন হেল দোল নেই। মহিলা দুকদম এগিয়ে তাদের কাছে এসে দাঁড়ালো। নাবিল কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে স্নেহর উদ্দেশ্যে বলল “ওমা! বেটা ছেড়ার সামনে অমন খোলা চুলে কেমন কোমরে ওড়না পেচায় দাঁড়ায় আছে। শরম করেনা বুঝি?”
কথাটা কানে আসতেই স্নেহ নিজের অবাধ্য চুল গুলো তড়িৎ গতিতে হাত খোপা করে ফেললো। কোমর থেকে ওড়নাটা খুলে মাথায় পরে নিলো। মহিলাটা নাবিল কে দেখে কিছু বলার আগেই স্নেহ বলল “সুমি ফুপুর ছেলে। বেড়াইতে আইছে।”

“ও আমাগো সুমির ছেড়া। বড় হইছে।” বলেই নাবিলের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গি করে চলে গেলেন। উনি চলে যেতেই নাবিল স্নেহর দিকে ফিরতেই পুনরায় চোখ আটকে গেলো। একটু আগেই এক রকম ছিল আর এখন এক রকম। মুহূর্তেই ওই রুপ যেন ঝলসে উঠছে। আচ্ছা এক রমনির কি হাজার রুপ হয়?

————
শীতের দুপুরের হালকা রোদের মিষ্টতা যেন হৃদয় জুড়িয়ে দেয়। সেই সাথে মনে অনাবিল এক প্রশান্তি বয়ে আনে। এই মুহূর্তে সেই মিষ্টতাই উপভোগ করছে নাবিল, মুবিন আর সুহা। বাড়ির পাশের পুকুর পাড়ে নরম ঘাসের উপরে বসে ্নাবিল অভিজ্ঞের ভঙ্গিতে সুহার হাত দেখে তার ভাগ্য নির্ণয় করতে ব্যস্ত। বেশ খানিকক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ভালো করে হাত দেখে বলল “বাহ সুহা! তোমার ভাগ্য তো বেশ ভালো। তুমি জীবনে অনেক সুখি হবে। যা চাবে তাই পাবে।” নাবিলের এমন কথা সুহা কতোটুকু বিশ্বাস করলো সেটা সেই ভালো জানে কিন্তু খুশি যে হয়েছে সেটা তার মুখের তৃপ্ত হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নাবিল তার সেই হাসি দেখে নিজেও হাসল।

“আরে আপা আসো। ভাইয়া হাত দেখতে পারে। তোমারও হাত দেখে দিবে।” সুহার কথা শুনে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখল স্নেহ তাদের দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে। হাতে সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’। বইটা তার পড়া। কিন্তু আবারো পড়বে বলে পুকুর পাড়ে এসে দেখে তারা এখানে বসে আছে। মুবিনও একটু বিচলিত হয়ে বলল “আসো না আপা!”। দুজনের আগ্রহ দেখে স্নেহ আর কিছু বলতে পারল না। নরম ঘাসের উপরে নাবিলের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পা ভাজ করে বসলো। সুহা স্নেহর ডান হাতটা মেলে ধরল নাবিলের সামনে। অতি আগ্রহ নিয়ে বলল “দেখেন না আপার ভাগ্যে কি আছে?”
স্নেহও ভ্রু কুচকে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিল সুহার হাতে অবস্থানরত স্নেহর হাতের তালুটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে অতি নরম কণ্ঠে বলল “ভাগ্য বেশ খারাপ!” তার কথা শুনে সবাই ভ্রু কুচকে ফেললো। মুবিন একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো “তাহলে কি আপা যা চাবে তা পাবে না?” সবাই নাবিলের দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির রেখেছে প্রশ্নের উত্তরের জন্য।

নাবিল হাত থেকে চোখ সরিয়ে স্নেহর চোখের মাঝে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল “তোমার ভাগ্যে নিজের চাওয়ার চেয়ে তোমাকে যে চায় তার পাওয়ার পাল্লাটাই ভারি । আর সেটা এতোটাই তীব্র যে কোন ভাবেই পরিবর্তন হবেনা।”

চলবে……

এক বসন্ত প্রেম পর্ব-০৪

0

🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৪

হাড় কাঁপানো শীতের রাতে গায়ে একটা মাত্র চাদর জড়িয়ে স্নেহর পাশে বসে আছে লতা। গা জরে পুড়ে যাচ্ছে। অনেকটা সময় ধরে মাথায় জল পট্টি দিচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই জর নামছেনা। পুরো মুখ লাল হয়ে আছে। মুখ দেখেই আন্দাজ করা সম্ভব ঠিক কতটা জর এই মুহূর্তে তার শরীরে থাকতে পারে।

“বুবু জর তো কমতেছেনা। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে হয়না?” স্নেহর মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হয়ে বলল মিনা। মিনার কথার উত্তরে লতা কিছু বলার আগেই সুমি ভিতরে ঢুকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল “এই ঔষধ টা খেলে ঠিক হয়ে যাবে ভাবি। খাওয়ানোর ব্যবস্থা কর।”লতা এক দৃষ্টিতে স্নেহর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। জ্ঞান শুন্য অবস্থায় হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে বিছানায়। তার চোখ ছল ছল করে উঠলো। সুমি বুঝতে পেরে লতার ঘাড়ে হাত রেখে বলল “কিছু হবেনা ভাবি। এই ঔষধটা খাইলে জর এমনিতেই নেমে যাবে।”
লতা কথা বলল না। মিনা উঠে গিয়ে স্নেহর মাথাটা একটু তুলে ধরল। সুহাকে উদ্দেশ্য করে বলল “পানি আন।” সুহা উঠে জগ থেকে পানি ঢেলে মিনার দিকে এগিয়ে দিলো। সে মিন মিনে সরে বলল “স্নেহ! মা স্নেহ! একটু হা কর। ঔষধ খা।”

মিন মিনে সর কানে যেতেই স্নেহ কিঞ্চিত ঠোঁট দুটো ফাকা করলো। “অইত জ্ঞান আছে। আপা শুনতে পাইছে।” সুহা চিৎকার করে উঠলো। মিনা সযত্নে তাকে ঔষধটা খাইয়ে দিলো। আবার বিছানায় মাথাটা রেখে কাথা দিয়ে মুড়ে দিলো।

——————–

চারিদিকে মোটা কুয়াশার চাদরে মোড়ানো। যতদূর চোখ যায় ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সামনের পুকুর তিনটা বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পুকুরের উপরে কুয়াশার বিচরন ধোঁয়ার মতো মনে হচ্ছে। মজুমদার বাড়ির সামনে পর পর তিনটা পুকুর। খুব কাছাকাছি সামনে একটা। কয়েক কদম গেলেই সেখানে উপস্থিত হওয়া যায়। পূর্ব পাশের টাও বাড়ির কোল ঘেঁষে। বাড়ির পিছনের দরজায় যেতে হলে একদম পাড়ের উপর দিয়েই চলতে হয়। পশ্চিম পাশের টা একটু দুরে। কিন্তু ততটাও না। পশ্চিম পাশে মসজিদ আছে আর সেখানেই পারিবারিক কবর স্থান। মসজিদের সাথেই শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। মসজিদের ব্যাবহারের জন্যই সেটা নুরুল মজুমদার শান বাধিয়ে দিয়েছে। মাথার উপরে কুয়াশার বিচরন হিম ধরিয়ে দিচ্ছে। তার সাথে এই নিস্তব্ধ প্রকৃতির মাঝে টিনের চালে টুপ টুপ করে কুয়াশা পড়ার আওয়াজ শরীরে আরও বেশি কাপুনি ধরিয়ে দিতে সক্ষম। মাথায় একটা লম্বা ঘোমটা টেনে গায়ে চাদর জড়িয়ে যবুথবু হয়ে বাইরে দাড়িয়ে আছে সুহা। বরাবরি তার ঠাণ্ডাটা একটু বেশি। শীত তার একদম পছন্দ না। এতো ঠাণ্ডা যে কিভাবে সবাই সহ্য করে সেটা তার বোধগম্য নয়।

“শীত লাগছেনা?” আচমকাই গম্ভীর পুরুষশালী কণ্ঠ সুহাকে নাড়িয়ে দিলো। পিছন ফিরে দেখে একটা কাল হুডি দিয়ে মাথা পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে নাবিল। হাত গুঁজে শীত আটকাতে চেষ্টা করছে। ফর্সা মুখটা কাল হুডির মাঝে দেখতে বেশ লাগছে। অবাধ্য চুল গুলো হুডি পার করে কপালে বিচরন করছে। শীতের হিমেল হাওয়ায় তারাও কেঁপে কেঁপে উঠছে। সুহার দিকে উত্তরের অপেক্ষায় চাতকের মতো চেয়ে আছে।

“আপার জন্য অপেক্ষা করছি।” সুহা কিঞ্চিত হেসে উত্তর দিলো।
“কোথাও জাচ্ছ?” নাবিলের সরল প্রশ্নের উত্তরে উপর নিচে মাথা নাড়াল সুহা। তারপর হাসি মুখেই বলল “স্কুলে যাচ্ছি। আপা কলেজে যাবে।”

“ওহ আচ্ছা।” বলেই ঠোঁট কামড়ে নাবিল ভাবছে। আজ তিনদিন হয়ে গেলো অথচ স্নেহ নামের মেয়েটার চেহারাটা এখন অব্দি দর্শনের ভাগ্য হলনা। মায়ের কাছে শুনেছে মেয়েটা নাকি বেশ সুন্দর। তাদের মজুমদার পরিবারে ওরকম সুন্দরি মেয়ে আর নেই। তাই তার মাঝে দেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটা যে কোনভাবেই দেখা দেয়না। তবে আজ সে দেখেই ছাড়বে। তাই দাড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই স্নেহ হন্তদন্ত করে বের হয়ে এলো বাড়ি থেকে। কোনদিকে না তাকিয়েই সামনে হাটতে লাগলো। মাথায় অনেক দূর পর্যন্ত ঘোমটা টেনে দেয়া। “যা বাবা মুখটাই তো দেখতে পেলাম না।” আসতে করে বলেই নাবিল আবার গলা তুলে বলল “বড়দেরকে সালাম দিতে হয় জানোনা?”

নাবিলের এমন ধমকের রেশে বলা কথা কানে আসতেই দুজনি ঘুরে তাকায়। কিন্তু কাকে উদ্দেশ্য করে বলল সেটা বুঝতে পারছে না। দৃষ্টি তাক করে স্নেহ বুঝে গেলো তাকেই বলা হয়েছে কথাটা। দ্রুত পায়ে হেঁটে নাবিলের সামনে এলো। কিন্তু ওড়নাটা নাক অবধি টেনে দেয়া। এতে চোখ জোড়া ছাড়া আর কিছুই দেখার সুযোগ হল না।

“আস সালামু আলাইকুম!” স্নেহর নির্লিপ্ত কণ্ঠের কথায় নাবিলের ঘোর কাটে। কিন্তু উত্তর দেয়ার আগেই স্নেহর চোখ জোড়ায় তার চোখ আটকে যায়। পুরো মুখটা না দেখা গেলেও। ঘন কাল পাপড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকা কুচকুচে কাল মনি দেখে সৌন্দর্য কিছুটা আন্দাজ করা সম্ভব। কিছুটা উপরে চোখ তুলতেই বাতাসে কয়েকটা চুল এলোমেলো হয়ে নড়াচড়া করা দেখার সৌভাগ্য হল। কয়েকটা চুল দেখেই আন্দাজ করে ফেলেছে কতটা কাল আর সিল্কি।

“কি হল? সালাম দিছি তো। উত্তর দিলেন না যে?” স্নেহর এমন চটপটে কণ্ঠের জেরে নাবিলের ঘোর কাটলেও সে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। “ওয়ালাই কুম আস সালাম!” হালকা সরে বলতেই স্নেহ ঘুরে চলে গেলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাড়া আছে। কিন্তু স্নেহর এমন কথার সর নাবিলের ঠোঁট জোড়া অনেক টা ফাকা করে দিলো। এই কয়দিনে সুহার সাথে কথা বলে যা ধারণা করেছিলো স্নেহ সম্পর্কে সে তার পুরো উলটা। সুহার কোন বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে নেই। দুই বোনের মধ্যে এতোটা পার্থক্য হতে পারে সেটাই নাবিল মানতে পারছে না।

“ভাইয়া কোথাও যাবে?” একটু চমকে মুবিনের দিকে ঘুরে তাকায় নাবিল। “ভাবছি সামনে থেকে একটু ঘুরে আসি। গ্রামের শীতের সকাল উপভোগ করি।” সামনে তাকিয়ে বলল নাবিল। তার কথা শুনে মুবিন আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। সামনে হাটতে হাটতে বলল “চল তোমারে স্কুলের দিকটায় ঘুরে আনি।” নাবিল তার পিছু পিছু হাটতে শুরু করলো।

কিছুদুর এগিয়েই দেখতে পেলো সুহা আর স্নেহ কে। দুজনেই মাথা নামিয়ে হাঁটছে। কুয়াশায় তেমন স্পষ্ট না দেখা গেলেও অবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে। নাবিল একটু ভেবে মুবিন কে বলল “স্নেহ কি খুব চঞ্চল?”

“বাপ রে বাপ! আপার জন্য সুহা বেচারি সব সময় ভয়ে থাকে। কখন জানি বড় মায়ে মারে।” মুবিনের কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকাল নাবিল। আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। এমন কথায় আন্দাজ করতে পারছে বিষয়টা। তারপরেও আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললো “কেন?”

মুবিন এবার তার দিকে মুখ ফিরিয়ে স্নেহর এক এক করে ঘটানো সমস্ত ঘটনা বলতে শুরু করলো। স্নেহর যত অপকর্ম মুবিনের চোখে ধরা পড়েছে এই পর্যন্ত তার কিছুই বাদ রাখলনা। এক এক করে শুনছে আর নাবিলের চোখ কপালে উঠছে। যা ভেবেছিল তার থেকেও অনেক গুনে বেশি। আজ পর্যন্ত এসব কিছু সে একজন ছেলে হয়েই করেনি যা এই মেয়েটা করেছে। মুবিনের কথা অনেক সময় পর্যন্ত চলল। এর মাঝে তারা স্কুলে পৌঁছে গেলো। মুবিন স্কুলের গেটে দাড়িয়ে বলল “এই সময় মেয়েদের ক্লাস হয়। তাদের শেষ হলেই আমাদের শুরু।”

“এই নিয়ম কেন? এক সাথে ক্লাস হলে কি সমস্যা?” নাবিল কৌতূহল বশত জিজ্ঞেস করলো। “আসলে ছাত্র ছাত্রি অনেক বেশি। আর একটাই স্কুল। তাই এক সাথে ক্লাসে জায়গা হয়না।” মুবিন স্কুলের ভিতরে তাকিয়ে কথাটা বলল।

“ওহ আচ্ছা! তার মানে গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে হলে এই সময় ছাড়া উপায় নাই তাই তো।” নাবিল দুষ্টুমির সূরে মুবিনের দিকে তাকিয়ে বলল। মুবিন নাবিলের দিকে অবাক দৃষ্টি ফেরাতেই তার হাস্যজ্জল মুখ দেখে একটু লজ্জা পেলো। চোখ নামিয়ে হাসল। নাবিল জোরে হেসে বলল “লজ্জার কিছু নাই। এই বয়সে এসব স্বাভাবিক। তবে বেশি থাকা কিন্তু অস্বাভাবিক।” বলেই আবার শব্দ করে হাসল।

—————
গোছল সেরে চনমনে রোদে গা এলিয়ে দিয়ে একটা চেয়ারে বসে আছে রাজ্জাক। তার পাশেই নাবিল বসে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে নিচের ঠোঁট কামড়ে পা ঝাকাতে ঝাকাতে মোবাইলে খুব ব্যস্ততার সাথে কি যেন করছে। আশে পাশে দিয়ে সবাই যাওয়া আসা করছে তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।

“স্নেহ সকাল থেকে তোমাকে দেখলাম না যে।” রাজ্জাকের প্রশ্নে স্নেহ মাথা বাকিয়ে সহজ ভাবে বলল “কলেজে গেছিলাম ফুপাজি।” তাদের কথোপকথন কানে আসতেই নাবিল ফোন থেকে দৃষ্টি তুলে সামনে তাকাল। ততক্ষনে স্নেহ সামনে ঘুরে উঠান পেরিয়ে বারান্দায় পা তুলেছে। ব্যস্ততার মাঝে মাথায় পুরো ওড়নাটা টেনে দিতে বোধ হয় ভুলে গেছে। বড় খোপার উপরে আংশিক ওড়নাটা কোন রকমে আটকে আছে। সামনের পুরো অংশটাই ফাকা। “তাই বলি সকালে স্নেহময়ীর হাতের চা নাই কেন?” ঠাট্টা করে রাজ্জাক কথাটা বলতেই নাবিল চাপা সরে জিজ্ঞেস করলো “কি নাম?” রাজ্জাক নাবিলের দিকে ঘুরে হেসে একটু চড়া গলায় বলল “স্নেহময়ী মজুমদার!” কথাটা হালকা ভাবে স্নেহর কানেও আসলো। কিন্তু ফিরে তাকাতে চেয়েও পারল না। সামনে তার চাচির ডাকে দ্রুত পায়ে সেদিকে গেলো। নাবিল বিড়বিড় করে বার কয়েক নামটা আওড়াল “স্নেহময়ী!”

রোদের তেজটা বাড়তেই নাবিল গরমে শ্বাস ছাড়ল। সুমি এসে তার পাশে দাড়িয়ে বলল “গোছল করে নাও।”

“আমার কাপড় গুলা বের করে দাও।” নাবিলের কথা শেষ হতেই সুমি হতাশ হয়ে বলল “আর কতদিন আমাকে জালাবি? এবার তো বিয়ে কর। আমি দায়িত্ব থেকে মুক্তি চাই।” নাবিল একটু হেসে মোবাইলে চোখ রেখেই দুষ্টুমির সূরে বলল “তোমার ছেলের দায়িত্ব নিবে এমন মেয়ে খুঁজে বের কর। আমি তো না বলিনি।” নাবিলের কথা শুনে রাজ্জাক ফিক করে হেসে বলল “তোমার মা এখন পর্যন্ত জাদের দেখছে সেগুলার মধ্যে কাউকে বিয়ে করলে তোমার দায়িত্ব বাদ তাদের দায়িত্ব তোমাকে নিতে হতো।” বলেই বাপ ছেলে দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠলো। স্নেহ বারান্দায় দাড়িয়ে তাদের কথা শুনছিল। আচমকাই এভাবে দাঁত বের করে নাবিল কে হাসতে দেখে স্নেহর চোখ আটকে গেলো। মাথা নিচু করে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে গা দুলিয়ে হেসেই যাচ্ছে। অদ্ভুত সেই হাসি। সেও ঠোঁট এলিয়ে হাসল। স্নেহর কেমন এক অনুভুতি হল। আচ্ছা মানুষের হাসির মাঝে কি এমন কিছু থাকতে পারে যা সহজেই আর একটা মানুষকে আকর্ষণ করতে পারে। একেই কি সেই কবি সাহিত্যিকের ভাষায় ‘ভুবন ভুলান হাসি’ বলে। যা দেখে যে কেউ হারিয়ে যায় সেই হাসির মাঝে। বড্ড ভয়ংকর এই মায়া। যা একবার দেখার প্রয়াশে হাজারো লজ্জা সংকোচ বিসর্জন দেয়া যায়। ভেবেই দৃষ্টি ফিরে অন্যদিকে তাকালেও আনমনেই আবার সেই হাস্যজ্জল চেহারার দিকেই বেহায়া চোখ ফিরে গেলো। একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চমকে উঠলো। সেও কি এই মায়ায় জড়িয়ে গেলো নাকি? সেই ভুবন ভুলান হাসির ভয়ংকর মায়ায়?

চলবে…….

এক বসন্ত প্রেম পর্ব-০৩

0

🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৩

রজনির প্রথম প্রহরেই সারা গ্রাম জুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। এমনিতেই গ্রামে সন্ধ্যার পর তেমন কেউ ঘর থেকে বের হয়না। তারপর আবার শীতের রাত। সবাই এতক্ষনে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘরে বসে আছে। চারিদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেছে। ঝি ঝি পোকারা অন্ধকারে পাল্লা দিয়ে ডেকে উঠছে। আলো জলছে শুধু মজুমদার বাড়িতে। এই বাড়িটা গ্রামের অন্যান্য বাড়ি থেকে আলাদা। অনেক দূর থেকে এই বাড়ির মাথা দেখা যায়। এই বাড়ির ঐতিহ্য হচ্ছে মাটির দো তলা। গ্রামে আরও মাটির দো তলা আছে কিন্তু এই বাড়িটা সাদেকের বাবা নুরুল মজুমদার তার রুচি মতো বানিয়েছেন। দো তলার আকর্ষণীয় নকশাটা বেশ চোখ ধাঁধানো যেটা গ্রামের রাস্তায় ঢুকলেই চোখে পড়ে। নকশার মাঝখানে বড় করে লেখা ‘মজুমদার বাড়ি’। মাটির দো তলার উপরে জানালার পাশে বসলেই পুরো গ্রামটা একবার চোখ বুলান যায়। সেখানে বসেই আশে পাশে চোখ বুলিয়ে দেখছে নাবিল। তার পাশেই বসে আছে মুবিন। দুজনি চুপচাপ শীতের নিস্তব্ধ রাতে ঝি ঝি পোকার ডাক উপভোগ করছে। নাবিল স্নেহর ছোট ফুপু মানে সুমি আর রাজ্জাকের ছেলে।

দুজনি যখন জানালা দিয়ে দৃশ্য উপভগে ব্যস্ত তখনি কানে ঠক ঠক আওয়াজ আসতেই সেদিকে দৃষ্টি ফেরায় তারা। কেউ একজন কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ঠক ঠক শব্দে উপরে উঠছে। উপরে উঠেই এক ঘর পেরিয়ে আর এক ঘরের দরজা মাড়াতেই সুহার পায়ের তালে তালে দোতলা কেঁপে উঠছে। নাবিল সেই বিষয়টাকে খুব উপভোগ করছে। মাটির দোতলা এভাবেই অল্পতেই কেঁপে উঠে কিন্তু আবার ভেঙ্গেও পড়েনা। কি অদ্ভুত! ছোট বেলা থেকে বিদেশে থাকায় গ্রামের এই রূপটা চরম ভাবে মিস করেছে। কিন্তু এখন এখানে এসে মনে হচ্ছে ছেলে বেলার সেই অপূর্ণতা সবটা পুরন করে তবেই শহরে ফিরবে। মুড়ির বাটিটা এগিয়ে দেয় সুহা। মুবিন তার হাত থেকে সেটা নিয়ে নাবিলের সামনে ধরে। মুড়ি দেখে প্রথমে একটু বিরক্ত হলেও ভদ্রতার খাতিরে না বলতে পারেনা। তাই হাত বাড়িয়ে এক মুঠো মুড়ি নিয়ে মুখে পুরে দেয়। মুখে দিয়েই স্তব্ধ হয়ে যায় নাবিল। সামান্য মুড়িও যে এতোটা সুস্বাদু হতে পারে তা না খেলে বুঝতেই পারতোনা। বিরক্ত হয়ে যদি না খেত তাহলে আজ অনেক সুস্বাদু একটা খাবার মিস করে ফেলত। তাই এখন থেকে সে আর কোন কিছুতেই না বলবে না। যা পাবে সবটাই টেস্ট করে দেখবে। বাটির দিকে ভালো করে দেখে নেয় সে। বুঝতে চেষ্টা করে ঠিক কি কি দিয়ে মুড়িটা মাখান হয়। পেয়াজ, কাঁচা মরিচ, টমেটো ছাড়া তেমন বিশেষ কিছুই চোখে পড়ছে না।

“একটু পরেই চা আনতেছি।” হেসে কথাটা বলেই ফিরে যেতেই সামনে পা বাড়াল সুহা। কিন্তু যেতে পারল না। নাবিলের কথা শুনে থেমে গেলো।
“তোমার নাম কি?” নাবিলের প্রশ্ন শুনে ফিরে তাকিয়ে একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে বলল “সুহাসিনি।”

“বাহ! খুব সুন্দর নাম। কিসে পড় তুমি?” প্রশ্ন শেষ করে আবার এক মুঠো মুড়ি নিয়ে মুখে দিলো নাবিল।
“ক্লাস এইটে।” সে ধিরে ধিরে মুখ নাড়াতে নাড়াতে সুহার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। বেশ মজা লাগছে মুড়ি মাখাটা। এই সময় যেন এটারই দরকার ছিল। মুড়ি চিবুতে চিবুতে ধির কণ্ঠে বলল “কে মাখছে এই মুড়ি?”

“আপা।” সুহার নির্লিপ্ত উত্তরে নাবিল তার দিকে তাকাল। “তখনের সেই সাদা জামা পরা মেয়েটা তোমার আপু?” নাবিলের শান্ত কণ্ঠের প্রশ্নে সুহা উপরে নিচে মাথা নাড়াল। কিছু একটা ভেবে আবার জিজ্ঞেস করলো “তোমার আপু যেন কিসে পড়ে?”
“এবার উচ্চ মাধ্যমিক দিবে।” সুহা খুব শান্ত ভাবে উত্তর দিলো।

“তোমার আপুর নাম কি?” নাবিলের প্রশ্নটা শেষ হতেই মুবিন চিৎকার করে উঠলো “ও মাগো! ঝাল।” একটা আসত কাঁচা মরিচ চিবিয়ে খেয়েছে। কথাও বলতে পারছে না। এক দৌড়ে নিচে চলে গেলো পানি খেতে। তার যাওয়ার দিকে দুজনি ফিরে তাকাল। সুহা একটু শব্দ করে হেসেও নাবিলের দিকে ফিরে থেমে গেলো। নাবিল সুহার দিকে তাকাল। সে শব্দ করে হাসার জন্য লজ্জা পেয়েছে। তাই একটু ইতস্তত করে বলল “আমি চা আনছি।” ঘুরে সিঁড়ির দিকে যেতেই নাবিল আবার ডাকল।

“সুহা!” সুহা আবার ঘুরে নাবিলের কাছে এলো। প্রশ্নবিধ্য চোখে তাকাল। নাবিল তাকে মাদুরে বসতে ইশারা করলো। বিনা বাক্য ব্যয়ে সে বসে পড়লো। নাবিল একটু অবাক হল। মেয়েটা বেশ ভদ্র। নিজের দৃষ্টি নত রেখেছে। সবুজ রঙের একটা থ্রি পিস পরেছে। ওড়নাটা বড় করে মাথায় টেনে দেয়া। মাথা নুইয়ে নিলে আর মুখ দেখা যায়না। ঠিক এই কারনেই সে তখন স্নেহর মুখটাও ভালো করে দেখতে পায়নি। মুড়ির বাটিটা এগিয়ে দিলো নাবিল।

“খাও।” নাবিলের কণ্ঠ শুনে সুহা চোখ তুলে তাকে দেখে নিলো। দৃষ্টি আবার নামিয়ে সাবলীল ভাবে বলল “নিচে আপার সাথে খাবো।”
নাবিল একটু হেসে বলল “কোথায় বলা আছে আপুর সাথে খেলে ভাইয়ার সাথে খাওয়া যাবে না।” নাবিলের কথা শুনে সুহা তার দিকে তাকাল। হাস্যজ্জল মুখ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে সে। এতক্ষন একটা জড়তা থাকলেও নাবিলের মাত্র বলা কথাটা সেটা কিছুটা কাটিয়ে দিয়েছে। সেও যে মুবিনের মতো তার আরেক ভাই সেই বিষয়টা এবার স্পষ্ট। এখন সুহার একটু স্বস্তি লাগছে। সেও একটু হেসে হাত বাড়িয়ে বাটি থেকে মুড়ি নিলো। নাবিল তার সাথে কথোপকথন চালিয়ে গেলো।

“তুমি কি গ্রামের স্কুলে পড়?”
“জি।?”
“আমি কে হই জানো?”
লজ্জা ভাব নিয়ে হ্যা সুচক উত্তর দিলো সুহা। নাবিল একটু হেসে বলল “ বলত কে হই?”
“নাবিল ভাইয়া।” মিন মিনে কণ্ঠে উত্তর দিলো সুহা।
“আমি আসার পর থেকে তোমাদেরকে আমাদের বাসায় যাইতে দেখিনি। জাওনা কেন?”
সুহা নত দৃষ্টিতে বলল “আসলে আপা সব সময় পড়ালেখা করে তো। পড়ালেখার সমস্যা হবে জন্য কোথাও জাইতে চায়না।”

“তোমার আপু সারাক্ষন পড়ে?” সুহা হা সুচক মাথা নাড়ে।

“সুহা চা নিয়ে যা!” নিচ থেকে নরম কোমল কণ্ঠের ডাকে সুহা উঠে দাঁড়ায়। নাবিল জানালা দিয়ে নিচে তাকায়। এই জানালা দিয়ে রান্না ঘরের দরজা অব্দি দেখা যায়। কোমল কণ্ঠের অধিকারিণীকে দেখার উদ্দেশ্যে দৃষ্টি রান্না ঘরের দরজায় রাখলেও ঠিক মতো তেমন দেখতে পেলো না। শুধু সাদা রঙের ওড়না পরিহিত এক অবয়ব দেখা যাচ্ছে। সেদিকেই তাকিয়ে থাকলো। বুঝতে বাকি থাকলো না এই সেই রমনি যার সাথে গ্রামে ঢোকার পথে তার দেখা হয়েছিলো। তবে গ্রামে ঢোকার রাস্তায় তার দেখা পেলেও তখন রোদের তীব্র তেজে তেমন চেহারার দর্শন সম্ভব হয়নি। মুবিন তাকে দেখে চিনে ফেলে। আর সেই ফাকেই স্নেহ নিজেকে আড়াল করে ফেলে। তাই নাবিল আর তাকে দেখতে পায়নি।

নাবিল চোখ ফিরিয়ে নিলো। মুবিন এসে বসলো তার আগের জায়গাতেই। সুহা নিচে চলে গেলো। খানিকবাদেই আবার সে ঠক ঠক আওয়াজে চা নিয়ে ঢুকল। নাবিল তার হাত থেকে কাপ নিয়েই চায়ে চুমুক দিয়ে থেমে গেলো। “নাইচ টি!” চাপা সরে বলল।

“কিছু বললেন ভাইয়া?” সুহা অকপটে জিজ্ঞেস করলো। নাবিল হকচকিয়ে বলল “কে বানাইছে চা?”

“আপা বানাইছে।” নাবিল হাসল। চায়ে চুমুক দিয়ে জানালা দিয়ে নিচে রান্না ঘরের দরজায় তাকিয়ে বলল “তোমার আপু কি রান্না ঘরে?” সুহা মিষ্টি হেসে মাথা নাড়াল। নাবিল তার দিকে তাকাল। “তোমার আপু খুব সুন্দর রান্না করে!” সহাস্যে কথাটা বলল নাবিল। সুহা এমন ভাবে খুশি হল যেন কথাটা তার উদ্দেশ্যেই বলা। একটু হেসে সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলে গেলো।

গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে বাইরে তাকাল সে। বেশ কুয়াশা পড়েছে। অল্প সামনেই ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। চা টাও বেশ লাগছে। মেয়েটার রান্নার হাত খুব ভালো। গ্রামে জন্ম হলেও মজুমদার বাড়ির শহরের সাথে যোগাযোগ ছিল অনেক আগে থেকেই। তার নানা নুরুল মজুমদার ৪ ছেলে মেয়েকেই সর্বোচ্চ শিক্ষিত করেছেন। ছেলেরা নিজেদের জমি আর এই বাড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে এই গ্রাম ছেড়ে বাইরে কোথাও যায়নি। কিন্তু দুই মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছেন তিনি। এই বাড়ির মেয়েরা গ্রামে বড় হলেও বেশ স্মার্ট হয়। সব রকম পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। তার মা সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি বিদেশে গিয়েও নিজেকে খুব সুন্দর ভাবে মানিয়ে নিয়েছেন। এমনকি এ পর্যন্ত তার কখনও মনে হয়নি যে তার মা গ্রামের মেয়ে।

——————

রাতে খাওয়ার সময় ঘরে সবাই উপস্থিত থাকলেও স্নেহ নেই। সুমি চারিদিকে ভালো করে দেখে নিলো। স্নেহকে কোথাও দেখতে না পেয়ে বলল “স্নেহ খাবেনা? ও কোথায়?”

“শরীর টা ভালো না। মাথা ধরছে। মাথা ধরলে খাইতে চায়না।” লতার চিন্তা দেখে রাজ্জাক বিচলিত হয়ে বলল “ঔষধ খাবেনা? খেলেই তো ঠিক হয়ে যাবে। রাতে এভাবে না খেয়ে থাকলে তো আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যাবে।”

“খাইছে ফুপাজি।” নিচু সরে উত্তর দিলো সুহা। “হঠাৎ মাথা কেন ধরল?” চিন্তিত সরে বলল সুমি।

“আপা আজকে ভেজা চুল খোপা বাধছিল। সারাদিন আর চুল শুকায়নি। চুল ভেজা থাকলে আপার মাথা ধরে।” সুহা বলেই নাবিলের দিকে ডালের বাটি এগিয়ে ধরে বলল “ভাইয়া ডাল দিবো?” নাবিলের সাথে এতটুকু সময়েই সুহার অনেক ভাব হয়েছে। কারন নাবিলের কথা বলার ভঙ্গি দেখে তাকে মুবিনের মতো ভাবতে শুরু করেছে সুহা। যার ফলে তার মধ্যেকার জড়তাটা কাটিয়ে উঠেছে। নাবিলও খুব সহজ করে নিয়েছে বিষয়টাকে।

নাবিল একটু হেসে মাথা নাড়াল। সুহাও হেসে ডাল তুলে দিলো তার প্লেটে। নাবিল মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে। খাবার টা বেশ মজা হয়েছে। নাবিলের খাওয়া দেখে সুমি বলল “খাবার কেমন লাগছে বাবা?”

“খুব মজা হইছে।” নাবিল তার মায়ের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিয়েই প্লেটের দিকে চোখ নামিয়ে আবার বলল “কে রান্না করছে?”

“তোমার বড় মামি।” লতার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল সুমি। নাবিল চোখ তুলে লতার দিকে তাকাল। সে এই প্রশংসা নিতে পারছেনা। সবার সামনে এভাবে প্রশংসা করায় সে একটু লজ্জা পেলো। নাবিল একটু হেসে বলল “তোমার হাতে জাদু আছে মামি। মা অবশ্য সব সময় তোমার এই রান্নার কথা বলতো। আমার তো খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। এখন বুঝতে পারছি কি মিস করছি।”

লতার মনে একটু চাপা কষ্ট নাড়া দিয়ে গেলো। অসহায়ের মতো আবেগি হয়ে বলল “সেই ছোটবেলায় বিদেশ গেছো। তোমারে ভালো মতো আদর করতেও পারি নাই।” থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাসি মুখে উতফুল্ল্য হয়ে আবার বলল “এখন পাইছি এত সহজে আর ছাড়বো না। সব আদর পুশাইয়া তারপর জাইতে দিবো।“

লতার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। নাবিল কিছু বলবে তার আগেই তার ছোট মামা সিরাজ বলল “নাবিল বাবা তুমি কি আবার বিদেশ জাইতে চাও নাকি?”

নাবিল কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল “জি মামা। ওখানেই শিফট করার চিন্তা আছে।”
হতাশ হয়ে বলল “ওখানে আমাদের ছাইড়ে থাকতে খারাপ লাগেনা?” নাবিল সিরাজের কথা শুনে চোখ বন্ধ করে ফেললো। একটু ভেবে বলল “লাগে মামা। এই জন্যই তো মাঝে মাঝে দেশে আসবো। তোমাদের সবার সাথে দেখা করতে।”

তাদের এই কথোপকথনের মাঝেই পাশের ঘর থেকে সুহার তীব্র চিতকারের আওয়াজ আসে। “মা তাড়াতাড়ি আসো। আপা………।”

সুহার চিৎকার শুনেই সবাই থেমে যায়। লতা আর কিছু না ভেবেই এক দৌড় দেয় তার মেয়েকে দেখতে।

চলবে………

এক বসন্ত প্রেম পর্ব-০২

0

🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২

“তুই রান্না ঘরে গেইছিলি?” লতার কড়া কথায় সুহা না সুচক মাথা নাড়ায়। ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে। কারন তাকে আর বেশি ধমক দিলে ভয়ে মুখ ফস্কে বলে দিতে পারে যে স্নেহ রান্না ঘরে লবন আনতে গিয়েছিলো। তখনি মা কারন জিজ্ঞেস করবে আর সে সত্যি কথাটা বলে দিবে। লতা কিছুক্ষন চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলো “কে গেছিলো জানিস?” সুহা একটা শুকনো ঢোক গিলে আবার না সুচক মাথা নাড়ে।

“কে যে রান্না ঘরের দরজা খুলে রাখছে আর বিড়াল ঢুকছিল। ব্যক্কেল কোথাকার!” লতার এমন ধমকে সুহা ভয়ে কেঁপে উঠে। লতা সুহার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে। অযথা মেয়েটা এমন ভয়ে কেঁপে উঠছে। নিজের রাগ সংযত করে বলল “ঘরে যা।” সুহা হাফ ছেড়ে বাচল। এক দৌড়ে ঘরে চলে গেলো। ঘরে ঢুকে হাপাতে লাগলো।

——————
মাঘের শেষের দিকে হঠাৎ সকাল থেকেই রোদের তেজটা বেশ। আজ কুয়াশারা তেমন ভিড় করেনি। আকাশটাও বেশ স্বচ্ছ। শীতের রুক্ষতা শেষে প্রকৃতি কেমন ঝলমলিয়ে উঠছে। মিনা এক বালতি কাঁদা গুলে উঠোনে লেপটে দিচ্ছে। লতা দুই মেয়েকে নিয়ে পিঠা বানাতে ব্যস্ত। বিভিন্ন রকমের পিঠে হচ্ছে আজ। কারন আজ শহর থেকে স্নেহর ছোট ফুপু সুমি তার ছেলেকে নিয়ে আসছে। সুমি বিয়ের পর তার সামির সাথে ছেলেকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয়। ছেলের পড়ালেখা শেষ হয়েছে তাই সবাই মিলে দেশে ফিরে এসেছে। এত বছর পর বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসছে পরিবার নিয়ে। সবাই খুব খুশি। এক উৎসব মুখর পরিবেশ বাড়িতে। সারা বাড়ি পরিপাটি করে সাজাচ্ছে মিনা। আর লতা রান্না নিয়ে ব্যাস্ত। হরেক রকমের পদ রান্না হচ্ছে।

“চাচি মুবিন ভাইয়া কখন আসবে?” সুহার প্রশ্নে তার দিকে একবার দেখে আবার বালতির সেই কাদার মধ্যে হাত ডুবিয়ে ছোট্ট করে বলল “আসতেছে।”ফুপু আসার কথা শুনে মিনা তাড়াতাড়ি আসতে বলেছে। সেও রওনা দিয়েছে বাড়ির উদ্দেশ্যে। পৌঁছে গেলো বলে।

“মিনা রে কাজ শেষ হলে এই দিকে হাতি দে। ওরা এলো বলে।”লতার কথা শুনে মিনা স্নেহর দিকে তাকিয়ে বলল “স্নেহ তুই গোছলে যা। আমি হাত ধুয়ে আসতেছি।”স্নেহ চোখ তুলে চাচির দিকে একবার তাকাল। মিনা বালতির কাঁদা থেকে হাত তুলে ঝেড়ে নিয়ে দাড়িয়ে গেলো। স্নেহ হাতে রাখা শেষ পুলি পিঠাটা মুড়িয়ে রেখে নিঃশব্দে উঠে গেলো। বারান্দায় পা ফেলতেই মিনা আবার বললেন “সাদা জামাটা পরিস। ওটাতে তোরে খুব মানায়।”স্নেহ মাথা বাকিয়ে ছোট্ট করে “হুম।”বলেই চলে গেলো ঘরে।

মিনা হাত ধুয়ে এসে স্নেহর জায়গায় বসে সুহার দিকে একবার তাকাল। হাতে একটা পুলি পিঠা নিয়ে মোড়াতে মোড়াতে বলল “স্নেহর হলে তুই যাস। ওরা আসার আগেই রেডি হয়ে থাক।” সুহা মাথা নাড়াল।

বিরক্তি নিয়ে পুরাতন কাঠের আলমারি থেকে সাদা জামা বের করে নিলো স্নেহ। এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন সেই জামার দিকে চেয়ে থাকলো। মিনার কথাটাই মাথায় ঘুরছে। সাদার মতো একটা ফ্যাকাসে রঙ্গে কি এমন আছে যা একজন মানুষকে আরও বেশি সুন্দর করতে পারে। এই মুহূর্তে মাথায় ঢুকছে না। আর বৃথা চেষ্টাও করলো না। গোছল খানার দিকে চলে গেলো। টিউবওয়েল চেপে বালতিতে পানি ভরলো। কয়েক মগ পানি গায়ে ঢেলে নিজের ভেজা কাপড় গুলো বদলে সেই সাদা জামা পরে নিলো। ভেজা কাপড় নিয়ে বের হয়ে দেখল সুহা দাড়িয়ে আছে। সামনে হাটতে হাটতে ছোট্ট করে বলল “যা!” সুহাও আর অপেক্ষা না করে চলে গেলো গোছল খানায়।

উঠোনের মাঝখানে খুব সাবধানে পা ফেলে কাপড় মেলে দিলো স্নেহ। কারন লেপা উঠোনের কোন কোন জায়গা এখনো কাচা আছে। পায়ের ছাপ পড়লে বিষয়টা খারাপ দেখাবে। মাথার গামছাটা খুলে ফেলে চুল গুলো ঝেড়ে নিলো। হাত দিয়ে কয়েকবার কাল ঘন লম্বা চুল গুলো মেলে দিলো রোদে। গামছাটা দরিতে মেলে দিয়ে ভেজা চুলগুলো রোদে এলিয়ে দাড়িয়ে আছে। সুহাও খুব দ্রুত গোছল শেষ করে বের হয়ে এলো। সেও তার পাশে দাড়িয়ে কাপড় মেলে দিলো। এমন সময় সাদেকের চাপা সর কানে এলো “কই সবাই? দেখ কে আইছে?”

স্নেহ দ্রুত ভেজা চুল গুলো হাত খোপা করে নিলো। ওড়নাটা মাথায় টেনে দিয়ে সুহাকে উদ্দেশ্য করে বলল “চুল বাধ।” সুহাও তাড়াতাড়ি নিজের চুল বেধে মাথায় ওড়না টেনে দিলো। দরজা দিয়ে ঢুকল দুজন মানুষ তার ফুপা আর ফুপু। মিনা তাদেরকে ঘরে নিয়ে গেলেন।

সুহা স্নেহ দুই বোনই ঘরে ঢুকল। লতা ইশারা করে সালাম করতে বলছে। মাথার ওড়নাটা আরেকটু টেনে দিয়ে সামনে চোখ তুলে দেখে নিল। সামনে ফুপু আর ফুপা বসে আছে। এগিয়ে গিয়ে সবাইকে পা ছুয়ে সালাম করল। ফুপাকে সালাম করা শেষ হলে তিনি দুজনকে তার দুই পাশে বসিয়ে নেন। পরম আদরে মাথা ঝুকিয়ে মুখের দিকে দেখে নিয়ে বলেন “তোমার নাম কি?”

“স্নেহময়ী! স্নেহময়ী মজুদার।”চাপা সরে বলল স্নেহ।

“বাবা রাখছে। দুজনের নামই বাবা রাখছে।”সাদেক সহাস্যে কথাটা বলল। স্নেহর ফুপা রাজ্জাক সাহেব সুহার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন “তোমার নাম কি?”

“সুহাসিনী মজুমদার।”এমন ভাবে উচ্চারন করলো যেন এই নামটাই তার গরবের এক মাত্র কারন।

“বাহ! দুজনের নামই তো বেশ। স্নেহ আর সুহা।”বলেই তিনি সশব্দে হাসলেন। সারা ঘরে তার হাসির গুঞ্জন এক উতসব মুখর পরিবেশ সৃষ্টি করলো।

স্নেহকে পাশে বসিয়ে তিনি সাদেকের সাথে গল্পে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। তিনি খুব একটা গ্রামে আসেন নি কারন বেশিরভাগ সময় বিদেশে থেকেছেন। তাই গ্রামের আত্মীয় সজনের সাথে তার খুব একটা সখ্যতা নেই। কিন্তু তিনি খুব ভালো মানুষ বলেই পরিচিত।

সবাই একসাথে খেতে বসেছে। মিনা আর লতা খাবার বেড়ে দিচ্ছে।স্নেহ আর সুহা পানি ঢেলে দিচ্ছে। রাজ্জাক দুই বোনের দিকে তাকিয়ে বলল “তোমরাও বসে পড়।”সুহা চোখ তুলে তাকালেও স্নেহ দৃষ্টি নতই রেখে দিলো। লতা দুই বোনের দিকে তাকালেন। মিনা লতার কানের কাছে এসে ফিস ফিসিয়ে বলল“দেখছ বুবু স্নেহর আচরণ। সুহার রুপ ধরেছে।”লতা মিনার কথা শুনে ভালভাবে খেয়াল করলো। সত্যিই তাই। সুহা নিজের আচরণ স্বাভাবিক রাখলেও স্নেহ আজ বেশ আড়ষ্ট। মেহমান আসার পর থেকে মেয়েটার সকল চঞ্চলতা যেন হারিয়ে গেছে। কেমন পরিপক্কতা একটা ভাব ফুটেছে চেহারায়।

“তোরাও বস। নে প্লেট নে।”মিনার কথায় লতা নিজের হাতে থাকা তরকারির বাটিটা একবার দেখে নিলো। সেটা বাড়িয়ে চামুচে তরকারি তুলে সুমির পাতে দিলো।

“আর না ভাবি অনেক খেয়েছি।“ সুমি হাত বাড়িয়ে বাধা দিয়ে বলল।
“কিছুই তো খেলেনা বুবু।”লতা একটু হেসে বলল।
“তোমার হাতের রান্না যা মজা। সেই কবে খেয়েছি বলত। কত বছর হয়ে গেলো।” একটু মন খারাপ করে বলল সুমি।

“বাবা এখনো আসলো না যে?” লতা সুমিকে প্রশ্ন করলো। সুমি প্লেটের দিকে তাকিয়েই বলল “ওর আস্তে একটু দেরি হবে ভাবী। কাজ আছে।”

লতা একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল “বাড়ি চিনবে তো? আসেনি তো আগে!” সুমি একটু হেসে বলল “চিন্তা করোনা চলে আসবে।”

“কি রে? এখন প্লেট হাতে নেস নি?” লতার জোরে কথায় একটু চমকে তার দিকে তাকিয়ে কমল কণ্ঠে স্নেহ বলল “নিচ্ছি মা।”বলেই একটা প্লেট সুহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আর একটা নিজে তুলে নিলো। ভাত সুহার প্লেটে বেড়ে দিয়ে নিজেও নিয়ে নিলো। যা যা খেতে ভালবাসে সবটা এক এক করে বাটি থেকে তুলে নিলো। নত দৃষ্টিতে খেতে শুরু করলো। সবাই খেতে খেতে গল্প করছে। কিন্তু স্নেহর কথা যেন হারিয়ে গেছে। সব কথা ভুলে গেছে সে। খাওয়ার মাঝেই লতা বলে উঠলো “ভাই সাহেবের কি চায়ের অভ্যাস আছে নাকি?”

লতার কথা শুনে তার দিকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে একটু ম্লান হেসে হ্যা সুচক মাথা নাড়াল রাজ্জাক। লতা স্নেহর দিকে তাকিয়ে বলল “খাওয়া শেষ করে চা বানাস। তোর ফুপাজি খাবে।”স্নেহ চোখ তুলে লতার দিকে একবার দেখে আবার প্লেটে চোখ নামিয়ে মাথা নাড়াল।

সুহা খাওয়া শেষ করে উঠে যেতে বলল “আপা আমি চায়ের পানি বসাইতেছি। তুমি খাওয়া শেষ করে আসো।”স্নেহ মাথা নাড়াল। নিসচুপে শেষ লোকমাটা মুখে ঢুকিয়ে প্লেট নিয়ে বের হয়ে গেলো। বারান্দার পাশেনিজের এঁটো প্লেট তা পরিস্কার করে নিয়ে হাত ধুয়ে পানি খেয়ে নিলো। তারপর প্লেট তা রেখে পা বাড়াল রান্না ঘরের দিকে। চায়ের পানি বসিয়ে ফুটতে দিয়েছে সুহা। “দেখি কতগুলা পানি দিলি?” বলেই পাতিলের উপরে চোখ চালিয়ে ভালো করে দেখে নিলো স্নেহ। সব ঠিক আছে। নিশ্চিন্ত হয়ে বসে পড়লো চুলার পাশে।

———————–

শীতের শেষ বেলায় তাড়াতাড়ি রোদ চলে যায়। তবুও আজকের রোদটা একটু তীব্রই। এখনো আছেই। বড় রাস্তার পাশে খেতে নানান রকম শীতের সবজি লাগান আছে। লতা সেখান থেকেই টাটকা সবজি আনতে পাঠিয়েছে তিন ভাই বোনকে। রাতে রান্না করবে খেতের টাটকা সবজি। মুবিন আর সুহা খেতের ভিতরে ঢুকে সবজি তুলছে। আর স্নেহ পাশেই দাড়িয়ে আছে। সাদা জামা পড়ে আছে জন্য আর ভিতরে ঢুকেনী। জামায় দাগ লেগে গেলে মুশকিল হয়ে যাবে। সাদা জামায় রোদ পড়ায় নিচের অংশটা বেশ চকচক করছে। সেটাই হাতে একটু তুলে নিয়ে দেখছে স্নেহ। সাদা রঙটার কোন সৌন্দর্য আছে কিনা আজও সেটা সে বুঝতে পারেনা। কিন্তু তাকে নাকি সাদা জামায় অনেক মানায়। মিনার কাছে অনেকবার এই কথা শুনেছে সে।

“আপা বড় মা কি কাঁচা মরিচ নিতে কইছে?” মুবিনের কথায় তার দিকে দৃষ্টি ফেরায় স্নেহ। রোদের তেজে ভালো করে দেখা যাচ্ছেনা। কপালে হাত দিয়ে রোদ আটকাল। ভ্রু জোড়া সংকুচিত করে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। “কয় নাই। তাও নে। সন্ধ্যায় চায়ের সাথে কাঁচা মরিচ পেয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখব।” একটু গলা তুলে বলল স্নেহ। মুবিন তার কথা শুনে বেশ কিছু কাঁচা মরিচ তুলে দুই হাতের তালু ভরে তার দিকে উঠিয়ে বলল “হইছে? না আরও?” স্নেহ একটু দেখে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল “হইছে।”

“এক্সকিউজ মি!” অপরিচিত ভারি গলার আওয়াজে সবাই রাস্তার দিকে ফিরে তাকাল। স্নেহ নিজের ভ্রু সংকুচিত করে ঘুরে দাঁড়ালো। একটা চকচকে কাল গাড়ির ভিতরে একজন সুদর্শন পুরুষ সান গ্লাস পরে বসে আছে। সামনে মনে হয় ড্রাইভার। পিছনের সিট থেকে সেই সান গ্লাস পরিহিত ব্যাক্তি নিজের মাথাটা একটু বের করলেন। সান গ্লাসটা খুলে ফেললেন। রোদের তেজে পিটপিট করে কয়েকবার নিজের দৃষ্টি ঠিক করে স্নেহর দিকে স্থির করে নিলেন। ভ্রু ভাঁজ করে স্নেহকে উদ্দেশ্য করে বললেন “আচ্ছা আপনি কি এই গ্রামে থাকেন? মানে আপনার বাড়ি কি আশে পাশে কোথাও?”

তার চোখের ঘন পাপড়ির আড়ালে পিটপিট করা বাদামি বর্ণের সেই মনি স্নেহর বুকের ভিতরে আলোড়ন তুলে দিলো। কি এক অদ্ভুত অনুভুতি। স্নেহ পলকহীন দৃষ্টি তার দিকে স্থির রেখেছে। মানুষটাকে এই প্রথম দেখল সে। কিন্তু এক অদ্ভুত টান অনুভব করছে তার প্রতি। কিন্তু কেন? কে এই পুরুষ যার চোখের চাহুনিতে স্নেহর ভিতরের সমস্ত লুকান আবেগ বেহায়া রুপে বের হয়ে আসতে চাইছে!

চলবে……..

এক বসন্ত প্রেম পর্ব-০১

0

🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
সূচনা পর্ব

“আপা তাড়াতাড়ি কর। কেউ এসে পড়বে।” তীব্র শীতের স্পর্শে ঠক ঠক করে কাপতে কাপতে কথাটা বলল সুহা তার বড় বোন স্নেহ কে।

স্নেহ সেই সময় জলপাই গাছ বেয়ে অনেকটাই উঠে গেছে। সুহার কথা শুনে মাথা বাকিয়ে নিচে তাকাল। চার পাশে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল “তুই এতো ভয় পাশ কেন সুহা? সবে মাত্র সকালের আলো ফুটেছে। এখন এই পাশটায় কেউ আসেনা।”

কথা শেষ করে মাথা ফিরিয়ে বাকি পথটা উঠতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। গাছে উঠার জন্য শারীরিক পরিশ্রম হচ্ছে স্নেহর। তাই তার তেমন ঠাণ্ডা লাগছেনা। একটা পাতলা সোয়েটার গায়ে দিয়ে আছে সে। তার চাদরটা সুহার হাতে। কিন্তু সুহা গায়ে একটা সোয়েটার আবার তার উপরে চাদর জড়িয়েও কাঁপছে। বেশ ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। এখনো সূর্যের দেখা মেলেনি। চারিদিকে ঘন কুয়াশার চাদরে ঘেরা। মাঘের মাঝামাঝি সময়ে শীতটা বেশ জাঁকিয়ে বসে। আজ আদৌ সূর্যের দেখা মিলবে কিনা তা নিয়ে বেশ সন্দেহ আছে। নিজের এক হাত আরেক হাতে ঘোষতে ঘোষতে চারিদিকে দেখছে সুহা। দেখছে বললে ভুল হবে আসলে পাহারা দিচ্ছে। জলপাই গাছটা পুকুর পাড়ের কাছে। এই সময় এই পাশটায় খুব একটা কেউ আসেনা। তাই তো স্নেহ এতো নিশ্চিন্তে উঠছে। কিন্তু সুহা কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারছেনা। স্নেহর এসবের কারনে অনেক বার মায়ের হাতে মার খেয়েছে। সুহা এই গাল, মার এগুলকে ছোট বেলা থেকেই ভয় পায়। কিন্তু স্নেহর এসবে তেমন কিছুই যায় আসেনা। দাঁত কামড়ে মার সহ্য করে। মাঝে মাঝে সুহার মনে হয় আল্লাহ স্নেহকে লোহা দিয়ে বানিয়েছে। মনটাও তেমনই শক্ত। সুহার মতো এতো আবেগি নয়। প্রচুর মার খেয়েও মুহূর্তেই হাসার মতো ক্ষমতা রাখে স্নেহ। এই ক্ষমতাটা সুহা আয়ত্ত করার চেষ্টা করেও পারেনি। একটু কড়া ধাচের কয়েকটা কথাই সুহাকে কাদাতে যথেষ্ট।

“আমি নিচে ফেলছি। তুই চাদরটা মেলে ধর।” মগ ডাল থেকে চেচিয়ে বলল স্নেহ। সুহা চার পাশে ভালো করে দেখে নিলো। তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে স্নেহ যে ডালে বসে আছে ঠিক সেটার নিচে চাদরটা মেলে ধরল। স্নেহ একটা একটা করে জলপাই নিচে ফেলে দিলো। অনেক গুলো জলপাই নিমেষেই জমা হয়ে গেলো চাদরে।

“শেষ।” কথাটা কানে আসতেই সুহা চাদরটা ভাঁজ করে নিলো। গাছের নিচ থেকে সরে এসে দাড়ালো। স্নেহ ততক্ষনে অর্ধেকটা নেমে এসেছে। এই কাজটায় সে একদম পটু। একজন পুরুষ মানুষকে হার মানাতে পারবে খুব সহজে। কিন্তু তার এই প্রতিভা নিছক বেয়াড়াপনা ছাড়া আর কিছুই না। একজন মেয়ে মানুষ হয়ে এভাবে গাছে উঠা কেউ ভালো চোখে দেখেনা। আর সেটা যদি হয়ে থাকে এই বয়সে তাহলে তো পাপের সমতুল্য। কারন স্কুলের ছোঁয়া পেলেই গ্রামে মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিকের দার প্রান্তে এসে এভাবে ঘুরে বেড়ানো তার জন্য পাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।

“আপা রহিম চাচা আসছে।” সুহা ভিত কণ্ঠে বলতেই স্নেহ তার হাত টেনে পাশের ঝোপে লুকিয়ে পড়লো। কারন এই লোকটা একটু অন্য রকম। নিজের কাজ বাদ দিয়ে মানুষের বিষয়ে নাক গলাতেই বেশি পছন্দ করে। তাদেরকে দেখলে এখনি বাড়িতে জানিয়ে দিবে। আর বাড়িতে জানালে তাদের রক্ষা নেই।

রহিম চাচা চলে যেতেই দুই বোন ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো। “এখন কি করবে আপা?” স্নেহ সুহার হাতে মোড়ান চাদরের দিকে একবার দেখে নিয়ে তার হাত টেনে সামনে যেতে যেতে বলল “বাসায় রেখে দিবো। মাঝে মাঝে বের করে লবন মাখিয়ে খাবো।”

“যদি মা দেখে ফেলে!” সুহার অমন কথায় তার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্নেহ। সুহা ভয় পেয়ে চাদরটা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। “সব সময় এমন কথা কস কেন রে?” গম্ভীর গলায় ধমক দিলো স্নেহ। তার মাথায় সব সময় এমন চিন্তা আসলে সেটাতে তার কি দোষ? বেশ বিরক্ত হল। কিছু নাবলে স্নেহর পিছু পিছু চলতে লাগলো।

————————
কুয়াশা কেটে গিয়ে এখন ঝলমলে রোদ উঠেছে। কিন্তু এই সময় রোদের তেমন তেজ থাকেনা। বরং একটা মিষ্টি ভাব থাকে যা শরীরে আরাম দেয়। সেই রোদে বসেই লতা তরকারি কাটছে। সুহা বারান্দা থেকে একটা টুল এনে মায়ের পাশে বসলো। এক দৃষ্টিতে মায়ের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল “আমি কেটে দিবো মা?” লতা চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকাল। দুই মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়েটি বেশ শান্ত আর লক্ষি। খুব নরম সূরে কথা বলে। মিষ্টি গলার আওয়াজ। শুনতে বেশ লাগে। সূর্যের আলোতে চাপা গায়ের রঙটা ঝলমলিয়ে উঠছে। চোখ নামিয়ে কাজে মনোযোগ দিয়ে লতা বলল “আমারে না। পারলে তোর মিনা চাচিরে সাহায্য কর। তার শরীরটা আজ ভালো নাই। মনে হয় জর। মুখ ফুটে তো কাউরে বলবে না।”

লতার কথা শুনে সুহা আর দেরি করলো না। উঠে তার চাচির কাছে গেলো। “চাচি! চাচি!” বলতে বলতে ঘরে ঢুকল। মিনা এতক্ষন বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ছিল। সুহার ডাকে উঠে বসে। “আয়।” হাতের ইশারায় পাশে বসতে বলল। সুহা বসতে বসতে বলল “তোমার নাকি জর?”

মিনা একটু অবাক চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলো “তোরে কে বলল?”

“মা বলল।” সুহার কথা শুনে মিনার ঠোঁটে চাপা হাসি ফুটে উঠলো। লতা এই বাড়ির বড় বউ হিসেবে একদম নিখুঁত। সবার খোঁজ খবর রাখে। কারও কোন কিছুই তার চোখ এড়ায় না। শরীরটা ভালো লাগছিলনা বলে সে সকাল থেকেই ঘরে। ফজরের নামাজ পড়ে শুয়ে ছিল। তখন একটু ঘুমিয়েছিল। আর সেই ফাকেই বুঝি লতা এসে দেখে গেছে।

“তুমি ঔষধ খাইছ চাচি?” কপালে হাত দিয়ে বলল সুহা। মিনার কপাল বেশ গরম। “ওমা! চাচি তোমার তো অনেক জর।” ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিত ফাকা করে বলল সুহা।

“আরে তেমন কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে।” মিনা হাসি মুখে সুহার হাত সরিয়ে দিতে দিতে বলল। কিন্তু সুহা এমন কথা শোনার পাত্রি না। এক দৌড়ে চলে গেলো ঘরে। টেবিলের উপরে তার বাবার ঔষধের বাক্স রাখা আছে। সেটাতে হাতড়াতে লাগলো। স্নেহ বিছানায় হেলানি দিয়ে বই পড়ছিল। তার হাতড়ানো দেখে মাথা তুলে বলল “কি খুজিস অমন করে?”। সুহা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল “মিনা চাচির জর। ঔষধ খায়নি এখনো। তাই খুজতেছি।”

ঔষধ হাতের নাগালে পেতেই বাক্সটা বন্ধ করে আগের জায়গায় রেখে আবার দৌড় দিলো। “থাম সুহা! খালি পেটে খাওয়ান যাবেনা। কিছু খাইছে কিনা দেখ।” স্নেহ জোরে আওয়াজ করে বলল। কিন্তু সুহা ততক্ষনে দৌড়ে চলে গেছে। সুহার কানে গেলো কিনা সেটা নিশ্চিত না হতে পেরে সেও এক দৌড় দিলো।

এক দৌড়ে এসে দেখে সুহা ঔষধ হাতে পানি এগিয়ে দিচ্ছে। স্নেহ হাপাতে হাপাতে বলল “কিছু খাইছ চাচি? খালি পেটে কিন্তু খাওয়া যাবেনা।” মিনা ঔষধ হাতে নিয়ে বলল “চিড়া খাইছি।” বলেই পানি দিয়ে ঔষধটা গিলে ফেললো।

এইদিকে দুই মেয়ের দৌড়ানি দেখে লতাও উঠানে সব ফেলে ঘরের দিকে দৌড় দিলো। “কি হইছে রে মিনা?” বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো। মিনা এক হাত কপালে রেখে বলল “হায় আল্লাহ! সামান্য জ্বরেই এই অবস্থা। আমি মরলে জানি কি হয়।”

“তোরে কইছি না এসব আজে বাজে কথা কবিনা!” লতার ধমকে মিনা চুপ হয়ে যায়। পিটপিট করে তাকিয়ে বলে “ঔষধ খাইছি। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা করোনা বুবু।”

“তুই একটু ঘুমা। ঘর থেকে বের হস্ না।” লতার আদেশের ভারে মিনা আর কোন কথা বলল না। কথা বলেও যে লাভ হবে তাও না। লতার রাগ খুব সাংঘাতিক। তার কথার অমান্য হলে সেই রাগ হজম করার সাধ্য খুব কম জনেরি আছে।

————
দুপুরের খাবার শেষে বিছানায় শুয়ে আছে স্নেহ আর সুহা। স্নেহ বই পড়ছে। স্বভাবটা ডান পিটে হলেও পড়ালেখায় বেশ ভালো সে। খুব তাড়াতাড়ি পড়া আয়ত্ত করতে পারে। বই পড়ার ধৈরযটাও বেশ। সুহার তেমন বই পড়ার ধৈর্য নেই তবে সেও খারাপ না। স্কুলে কলেজে তাদের দুই বোনের বেশ নাম ডাক। দুপুরে খাবার পর সুহার একটু ঘুমিয়ে না নিলে হয়না। এটা বহুদিনের অভ্যাস। ১০ মিনিট হলেও একটু চোখ বন্ধ করতে হবে তার। সুহার ঘুমান দেখে স্নেহও বেশ কয়েকবার হাই তুলে বুকের উপরে বই রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো। লতা কাথা সেলাইয়ের জন্য সুতা নিতে ঘরে এসে দেখে মেয়ে দুইটা ঘুমিয়ে পড়েছে। একটু দাড়িয়ে দুজন কেই দেখে নিলো। বড় মেয়েটা তার মতো ফর্সা রঙের। ছোটটার রঙ বাবার মতো চাপা। কিন্তু দেখতে খারাপ লাগেনা। সেটারও এক ধরনের সৌন্দর্য আছে। চোখ ধাধিয়ে যায়। স্নেহ পড়ালেখা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। সব সময় হাতে বই তার। কিন্তু সুহা পড়ার পাশাপাশি ঘরের কাজেও পটু। মায়ের মতো সেলাইটা বেশ রপ্ত করে নিয়েছে। দুপুরের রোদটা স্নেহর গায়ে পড়তেই লতা এগিয়ে গিয়ে জানালার পর্দা ফেলে দিলো। সুতা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।

মেঝেতে মাদুর পেতে বড় কাথা সেখানে বিছিয়ে দিলো। নিজে বসে পায়ের উপরে কাথা নিয়ে এক মনে সুই চালাতে লাগলো সেটার ভাঁজে ভাঁজে। স্নেহর বাবা সাদেক বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলেন। গ্রামের মোড়ে তার বড় দোকান আছে। পাশেই ছোট ভাইয়ের একটা দোকান। আসলে মোড়ের এক পাশের সব দোকান তাদের। সেখান থেকেই দুই ভাই দুইটা দোকান নিজেদের জন্য রেখে বাকি গুলো ভাড়া দেয়।

সাদেকের বাবা গ্রামের সম্পদ শালীদের মধ্যে একজন ছিলেন। তার দুই ছেলে দুই মেয়ে। সবাইকে তিনি শিক্ষিত করেছেন। মেয়েদের শহরে ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা মোটামুটি পড়ালেখা করে এসে তাদের জমিজমা সামলায়। সাথে ব্যবসা করে। তাদের গ্রামটা বেশ উন্নত। শহরের হালকা ছোঁয়া আছে। এই গ্রাম থেকেই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে অনেকেই। তাই তো তাদের বাড়ির ছেলে মেয়েরা পড়াশুনা করার যথেষ্ট সুযোগ পায়।

“আসার সময় বাজার করে আনিও।” লতা সেলাই করতে করতে বলল। “আচ্ছা।” ছোট করে উত্তর দিলো সাদেক। মাথা চিরুনি করে বের হয়ে গেলো। সাদেকের বের হওয়া দেখে মিনা ঘরে এসে ঢুকল। লতার সেলাই করা দেখে কোন কথা না বলে বসে পড়লো তার পাশে। লতা একবার চোখ তুলে মিনাকে দেখল। মিনা একটা সুইয়ে সুতা ভরিয়ে এক পাশের কাথা তার পায়ের উপরে নিয়ে লতার সাথে তাল মিলিয়ে কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে সুই চালাতে লাগলো।

“জর কমছে?” লতার গম্ভীর প্রশ্ন শুনে মিনা তার দিকে তাকাল। সে সুইয়ের দিকে চোখ রেখেই প্রশ্ন করেছে। “কমছে।” ছোট করে উত্তর দিলো। লতা আবার গম্ভীর সরে জিজ্ঞেস করলো “মুবিন আসেনা কেন? পড়ালেখা কি বাদ দিছে নাকি?”

“কাল আসতে কইছি।” মিনা ব্যস্ত ভাবেই উত্তর দেয়। মুবিন মিনার এক মাত্র ছেলে। কয়েকদিনের জন্য নানা বাড়ি বেড়াতে গেছে। বেশ কয়দিন হয়ে গেলো সেখানে থেকে গেছে। বাড়িতে তিন ছেলে মেয়ে। লতা আসলে তিন ছেলে মেয়ের পড়াশুনা নিয়ে খুব সচেতন। কেউ অবশ্য পড়ালেখায় গাফিলতি করেনা। কিন্তু করলেও লতার হাত থেকে রক্ষা নেই। সে কাউকে ছাড় দেয়না। লতাকে সবাই খুব ভয় পায়।

স্নেহর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। এই মুহূর্তে কয়টা জলপাই খেতে পারলে মন্দ হতোনা। সে ঘর থেকে বের হয়ে ভালো করে দেখে নিলো কে কোথায়। তার মা চাচি ঘরে কাথা সেলাই করেছে আর গল্প করছে। তাই পা টিপে টিপে রান্না ঘরে গেলো। একটা বাটিতে লবন নিয়ে ঘরে চলে এলো। বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখা জলপাই বের করে লবন মাখিয়ে খেতে শুরু করলো। তার নড়াচড়াতে সুহার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘুম ঘুম চোখে তাকাল সে। জলপাই দেখে এক ঝটকায় উঠে বসলো। তার এভাবে বসা দেখে স্নেহ চমকে উঠে বলল “স্বপ্ন দেখছিস নাকি?”

সুহা ভ্রু কুচকে বলল “মা জানতে পারলে খারাপ হবে আপা!”। স্নেহ অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হালকা হাতে সুহাকে মেরে বলল “সব সময় এমন অলুক্ষনে কথা না বললে ভাত হজম হয়না না? মা না দেখলেও তুই জোর করে দেখাইতে চাস।”

স্নেহর এমন ধমক শুনে সুহা চুপসে গেলো। আর কোন কথা বলল না। কিন্তু এই মুহূর্তে স্নেহর এমন সাহস দেখানোটাও তার ঠিক ভালো মনে হল না। লতা দেখলে বুঝে যাবে যে তারা গাছে উঠে জলপাই পেড়েছে। আর এই কথা জানলে সে লাঠি দিয়ে পিটাবে। তাতে স্নেহর কোন সমস্যা না থাকলেও সুহার অনেক সমস্যা। কারন সে এই মার খুব ভয় পায়। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো সে। বার বার ঘরের দরজার দিকে উকি ঝুকি মারতে লাগলো। তার এমন আচরণ দেখে স্নেহ বিরক্ত হয়ে জলপাই গুলো আবার লুকিয়ে রাখল।

“নে রাখছি। এখন আর ভয় নাই।” চোখ মুখ কুচকে বলল। সুহা মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ঠোটের কোণে চাপা হাসি নিয়ে উঠে গেলো বাইরে। কিন্তু বাইরে যেতেই দেখল লতা অগ্নি মূর্তি ধারন করে দাড়িয়ে আছে। লতাকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সুহা ভয়ে ঘামতে লাগলো।

চলবে

হৃদয় হরণী পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0

@হৃদয় হরণী
#শেষ_পর্ব
#লেখিকা_নুসরাত_জাহান_নিপু

সার্থক রাস্তা পার করতে চাইলে ঝড়ের গতিতে একটি বাইক তাকে ছুঁয়ে গেল।সে টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল।পায়ের হাঁটুতে বেশ আঘাত পেয়েছে।

আলোর আত্মা কেঁপে উঠলো।সে দ্রুত সার্থকের কাছে গিয়ে বললো,”পাগল হয়ে গেছো তুমি?”বলতে বলতে তার গাল চোখের জলের স্পর্শে ভিজে গেল।আলো কান্না করতে করতে হৃদয়কে ডাক দিলো।

হৃদয় তাদের থেকে কয়েক হাত দূরে ছিল বিধায় আলোর চিৎকার শুনে পেছন ফিরলো।সার্থকের এমন অবস্থা দেখে সে দৌঁড়ে এলো।আর দু’জনে মিলে তাকে হসপিটাল নিয়ে গেল।
.
নুপূরের দিনগুলো বেশ কাটছে।সে এখন বাংলোতে একা না।তার দেখাশুনার জন্য একজন বয়স্ক মহিলা আছেন।সারাদিন তার সাথে গল্প করেই কেটে যায়।তার প্রেগ্ন্যাসির সময় ৬মাস এখন।সে মনেপ্রাণে চাইছে তার সন্তান সুস্থ থাকুক,সুস্থভাবে জন্ম নিক!

কলেজে সে প্রথম প্রথম গিয়েছিল।এখন বাড়িতেই পড়াশোনা করছে।নুপূরের পড়াশোনার খরচ সব তার শুভাকাঙ্ক্ষীই চালাচ্ছে।সে পণ করেছে,একদিন যখন সে সফলের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যাবে তখন এই ব্যাক্তির সমস্ত টাকা শোধ করে দিবে।কিন্তু অর্থ শোধ করলেও উপকার কী শোধ করতে পারবে?সারাজীবন সে শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছে ঋণী হয়েই রইলো।
.
আলো কাঁদতে কাঁদতে নিজের চোখ-নাক লাল করে ফেলেছে।এক সেকেন্ড তার মানুষটির প্রাণ চলে যেতে পারতো!কী করে ক্ষমা করতো আলো তখন নিজেকে?

এই দুই মাসে সার্থকের দিকে ফিরেও তাকায়নি।আজ তাসনিনের প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট আনতে গিয়েছিল হৃদয় আর সে।তখন রাস্তায় সার্থক তাকে ডাক দিলে মুখ ফিরিয়ে চলে অথচ।আর এখন..এখন কী অঘটন’টাই না ঘটলো!

সার্থক পা নাড়তে চাইলে আলো অগ্নি-দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”আবার কী নাটক করতে চাইছো?”

সার্থক অসহায় কন্ঠে বলে,”আমি নাটক করছি?”

আলো তার সুর না পাল্টিয়ে বলে,”মাঝ রাস্তায় তামাশা করাটা নাটক নই?কে বলেছিল আমার পিছু পিছু আসতে?”
-“আফসোস আজ মরে যায়নি!”

আলোর বুক কেঁপে উঠে।কী সব বলছে সার্থক!সে মরে গেলে..আলো বাঁচবে কী নিয়ে?সার্থক কী তার মনের অবস্থা বুঝছে না?

সার্থক আবারো বললো,”আমার ভুলের শাস্তি হয়তো একমাত্র মৃত্যু!নাহলে এতদিনেও কিচ্ছুটি পরিবর্তন হলো না।”

আলো চুপ করে রইলো।সার্থক কী খুব বড় অন্যায় করেছে?আলো নিজেও জানেনা সে কেন পারছে না সার্থকের সাথে নরমাল হতে।তার কারণ কী ইগো?নাকি রাগ?

আলো উঠে আসতে চাইলে সার্থক বললো,”আলো,আমি বলবো না আমাকে ক্ষমা করো।তুমি নিজের জীবনটা বরং আমি বিহীন গুছিয়ে নাও।আমি সেই কীট যে তোমার জীবনের অন্ধকার!”

আলো পেছন ফিরে তাকালো।সার্থকের চাহনিতে অনুশোচনা স্পষ্ট।তারমানে আলো নিজে সফল হয়েছে!

‘অনুশোচনা’ শব্দটা সার্থককে প্রতি মুহুর্তে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।এই শাস্তি সব কিছুর উর্ধ্বে।কারো শারীরিক শাস্তির চেয়ে মানসিক শাস্তিটাই বেশি কার্যকর।
.
আলো কেবিন থেকে বের হতে হৃদয়ের সামনে পড়লো।তারা কেবিন থেকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো।হৃদয় বললো,”সার্থকের কথা বার্তায় অনুতাপ স্পষ্ট।দেখ আলো,দুই মাস হয়ে গেছে তুই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস।সার্থক শাস্তি পাচ্ছে এখন।আজ বা কাল আমরা যে কেউ মারা যেতে পারি।আজ দেখলি না,এক সেকেন্ডের জন্য সার্থক বেঁচে গেল।তখন কিন্তু উল্টে টাও হতে পারতো।ফলাফল তখন তুই নিজে বেঁচে থেকেও মরে যেতি।আজ আছি,কাল নেই।কী দরকার নিজের ইগো দেখিয়ে এড়িয়ে চলার?যতদিন আছি ভালো থাকি,ভালো রাখি।বাকিটা তুই বুঝিস।”
.
হৃদয়ের কাঁধে ভর দিয়ে সার্থক হাঁটতে লাগলো।পিছু পিছু আলো আসছে।সার্থক প্রথমে ভ্রু কুঁচকালেও কোনো প্রশ্ন করলো না।হৃদয় সিএনজি দাঁড় করিয়ে দিতে আলো সার্থককে নিয়ে গাড়িতে বসলো।হৃদয় ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে দিলো।এবারে সার্থক প্রশ্ন করলো,”তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

আলো স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,”কেন?আমার বাড়িতে যাচ্ছি।”
.
আজ পুরো নয় মাস দুইদিন পর নুপূরের পেইন শুরু হয়েছে।বয়স্ক মহিলাটি তাদের এলাকা বেশ কয়েকজন মহিলাকে ডেকে এনেছেন।নুপূরের চিৎকারে গাছের পাখিরাও ভয় পাচ্ছে।তখন এক মহিলা তার মুখে কাপড় দিলো।এত কষ্ট বোধ-হয় অন্য কোনো নারী পায় না যতটা একজন মা পায়।

এক ঘন্টার ব্যবধানে নুপূরের জন্ম হলো ফুটফুটে কন্যা সন্তান।নুপূর এক পলক তার সন্তানের দিকে তাকালো। কেমন কাঁদছে কন্যাটি!নুপূর তার চোখের কোণের জল মুছে নিলো।আজ থেকে যুদ্ধের প্রথম দিন।কাঁদতে মানুষ দূর্বল হয়।নুপূর কখনই দূর্বল হবে না।

বয়স্ক মহিলাটি নুপূরের কাছে তার মেয়েকে দিতে চাইলে নুপূর বহুকষ্টে বলে,”না চাচি।ও কে আমি ছুঁ’বো না।”

নারীর অন্যতম দূর্বল জায়গা তার প্রথম সন্তান।নুপূর জানে মেয়েটার দিকে আর কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলে পুরো দুনিয়া ভুলে তাকেই নিয়েই পালিয়ে বাঁচতে চাইবে।তাই সে মুখ ফিরিয়ে নিলো।কষ্ট কী তার নিজের হচ্ছে না?হচ্ছে,অবশ্যই হচ্ছে!কথায় আছে,”কোনো মা পারেনা তার সন্তানকে দূরে সরাতে।” কিন্তু নুপূর তো এখন সেই কঠিন কাজটাই করছে!

আরো দুই ঘন্টা বাদে নুপূরের কাছে সেই শুভাকাঙ্ক্ষীর ফোন এলো।তিনি বললেন সন্তানটিকে দিনাজপুরে হাসপাতালে রেখে আসতে।কিন্তু নুপূরের অবস্থা বেগতিক হওয়ায় সে যেতে পারলো না।বয়স্ক মহিলাটিই তার কন্যাকে সুখ সাগরে নিয়ে গেল।আদৌ কী তার কন্যাকে আলো মায়ের রুপ দেখাবে?না-কি দূরেই ঠেলে দিবে?এমনটা হলে নুপূর মেয়েকে নিজের কাছেই রাখবে,অন্য কোথাও সুরক্ষিত রাখবে।
.
তৃতীয় বারের মতো মিসক্যারেজ হওয়ার পর আলো খুব ভেঙ্গে পড়েছে।সে জানে না তার উপর কোন অভিশাপের ছায়া দাঁড়িয়ে।কিন্তু সে যে কোনোদিন মা হতে পারবে না তা স্পষ্ট।সংসারী নারী যেমনটা তার স্বামীকে ভালোবাসে তেমনই তারা সন্তানের চাহিদাও রাখে।সন্তান তাদের কাছে অমূল্য সম্পদ।আলো বার বার তার ছায়া দেখেও হারাচ্ছে।এটা কী মরিচীকা নই?

আনমনে আলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো ভাবছিল।তার এখন কান্না পায় না,অথচ খুব করে চায় কাঁদুক।সার্থক তার আশে-পাশে পুরোটা সময় থাকছে।এই একটা বিষয়ে আলো অতি মুগ্ধ।

এ যদি আগের সার্থক হতো, তাহলে আলোর উপর রেগে থাকতো।বলতো,”তোমাকে বলেছিলাম কনসিভ না করতে,আমরা দত্তক নিবো।কিন্তু তুমি?তোমার বার বার কষ্ট পেতে ভালো লাগে।”

তবে এখনকার সার্থক বলছে ভিন্ন কথা।বলছে,”আলো,যা হওয়ার হয়ে গেছে।আল্লার যা চান তাই তো হবে।তুমি নিজেকে শক্ত রাখো।ইনশাআল্লাহ,একদিন সব ঠিক হবে।”

এই পরিবর্তন হয়েছে সেদিনের পর থেকে।নুপূর নামের ঝড়টা তার জীবনে এসে ভালো কিছু উপহার দিয়ে গেছে।সব খারাপের পেছনে কিছু ভালোও লুকিয়ে থাকে।কিন্তু ভালোটা থাকে ধূলোই ঢাকা,তাকে ঝেড়ে তার অস্তিত্ব খুঁজতে জানতে হয়।

এমন ভাবনায় আলো ডুব দেয় যে তাই সেলফোন বেজে উঠলে কেঁপে উঠে।আলো মোবাইলেট দিকে তাকিয়ে দেখে টেলিফোন নাম্বার।ভ্রু কুঁচকে সে রিসিভ করে।তখন ওপাশ থেকে এক নারী কন্ঠ বলে,”আপনি কী মিসেস আলো বলছেন?”
-“হ্যাঁ।আপনি কে?”
-“আমি দিনাজপুর মেডিক্যাল হসপিটালের স্টাফ বলছি।আপনার নামে একজন বাচ্চা রেখে গেছেন।যত দ্রুত সম্ভব বাচ্চাটিকে নেওয়া ব্যবস্থা করুন।”
-“বাট ম্যাম…”
-“তাড়াতাড়ি আসুন।”

আশ্চর্যের উঁচু চূড়ায় পৌঁছে যায় আলো।তার নামে বাচ্চা কে রাখবে?আলো তার রুমে এসে সার্থককে সবটা জানালো।একই ভাবে সার্থকও অবাক হলো।কিন্তু দু’জনে ভাবা-ভাবি শেষ করে দিনাজপুরের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করলো।
.
আলো অনেকটা হাঁপিয়েই হাসপাতালে পৌঁছালো।খোঁজ নিয়ে সে স্টাফের কাছে গেল।আলোকে দেখে স্টাফটি বললো,”ঢাকা থেকে এসেছেন নাকি?আসুন..”

আলো আর সার্থক স্টাফের পেছন পেছন গেল।দোলনায় বাচ্চাটি কান্না করছে।আলোর চোখে জল চলে এলো।তখন তার মনে প্রশ্নও জাগলো না কার সন্তান এটি?সে আলতো করে বাচ্চাটিকে কোলে নিলো।এই ছোট্ট বাচ্চাটি জাদু জানে,না-হয় এতদিন কান্না না করা আলো এত কাঁদতো না।নাকি মেয়েদের চোখের জল কখনও শেষ হয়না?

সার্থক স্টাফের সাথে কথা বলে জানতে পারলো একজন বয়স্ক মহিলা এসে তাকে সন্তানের সাথে তাদের নাম্বার দিয়ে গিয়েছিল।সার্থকও ভেবে পাচ্ছিলো না কে করতে পারে এই কাজ?দিনাজপুরে তার জানা-শোনা তো কেউ নেই।

আলো বাচ্চাটিকে কোলে নিলে সার্থক খেয়াল করে বেডে একটা চিরকুট পড়ে আছে।ভ্রু কুঁচকে সে সেটি হাতে নিলো।আলো বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বিষয়টি তার নজর এড়ালো।সার্থক দেখলো চিরকুটে মাত্র দুটি শব্দ।”ইতি-নুপূর”

চমকে উঠলো সার্থক।এতদিনে মেয়েটির কথা তার মাথায় বিন্দুমাত্রও আসেনি।এই কন্যা তাহলে নুপূরের?নুপূর দিনাজপুরে?

সার্থক এক পলক আলো আর বাচ্চাটির দিকে তাকালো।কতদিন পর আলো সুখের কান্না কাঁদছে।নুপূরের বাচ্চা বললে আলো কী দূরে সরাবে?

মনের মধ্যে খুঁত খুঁত তা বেড়েই চলছে।অবশেষে সার্থক সিদ্ধান্ত নিলো আলোকে জানাবে না এই কন্যা কার।তার হৃদয় হরণীর কাছে এটা ধাঁধায় থাকুক।হয়তোবা কোনো একদিন সন্দেহ করবে কিন্তু নিশ্চিত হবে না।

সবসময় সব কিছু পরিষ্কার করা ভালো নই।কখনও কখনও গোলকধাঁধায় রাখা উচিত।উত্তর সে নিজে খুঁজে বেড়াক!

(সমাপ্ত)

(রিচেক করা হয়নি,অনেক ব্যস্ততায় লিখেছি,বানান ভুলগুলো ধরিয়ে দিবেন।)