Monday, June 30, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1474



কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:১৫(শেষ পর্ব)
লিখা:জাহান আরা

বিয়ের ১ বছর পার হয়ে গেলো নির্বিঘ্নে। অভ্রর কথা আমি পুরোপুরি ভুলে গেছি বলতে গেলে।না ভুলি নি,মনে পড়ে মাঝে মাঝে।
যখনই মনে পড়ে তখনই করুণা হয় নিজের উপর নিজের।হায়,কাকে ভালোবাসলাম আমি?
একজন ধর্ষককে!
ছি!

নেহালের দিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটে,সকাল শুরু
হয় নাস্তা বানানোর কাজে,নাস্তা শেষ করে আমাকে কলেজে দিয়ে আসে,বাসায় এসে রান্না সেরে ফেলে।গোসল করে নামাজ পড়ে আবার হাজির হয় গিয়ে আমার কলেজের সামনে আমাকে নিয়ে আসার জন্য।
দুপুরে আব্বা আম্মাসহ এক টেবিলে বসে লাঞ্চ শেষ করি।বিকেলে ছাদে বসে গল্প,সন্ধ্যায় চা বানানো,তারপর ডিনার রেডি করা।সবকিছুই নেহাল নিজ হাতে করে।
কে জানতো কোনো একসময় আমার কপালেও এরকম সুখ লিখা থাকবে!
আমি তো ভাবি নি কখনো। অন্তত অভ্রর মৃত্যুর পর ভেবে নিয়েছি জীবনের সব রঙ মুছে গেছে।সব ত্যাগ করেছি জীবন থেকে,অথচ শেষে এসে দেখলাম আমার হিসাব আগাগোড়ায় ভুল।
যাকে ভেবে নিজের জীবনকে বিষাদময় করে নিয়েছি সেই মানুষটাই ভুল ছিলো।সেই ছিলো একজন ধর্ষক।

যার জন্য আমাকে হতে হয়েছে ধর্ষিতা। ভাবলেই আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে।নিজেকে তখন মনে হয় অশুচি।
ঘন্টার পর ঘন্টা ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকি শরীর থেকে নোংরা স্পর্শ মুছে ফেলার বৃথা চেষ্টায়। কিন্তু হায়!
এ ও কি সম্ভব!
এই কলঙ্কের দাগ কি দিয়ে মুছলে যাবে!জানা নেও আমার।গুম মেরে যাই যখনই এসব মাথায় আসে।কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।নিজেকে গুটিয়ে নিই শামুকের মতো খোলসের ভিতর।
রাতে নেহাল যখন কাছে টানে আমাকে,গভীর আদরের জন্য,সেই মুহূর্ত টা আমার কাছে মনে হয় নরকীয়।আমি পারি না সহ্য করতে।মন চায় শাস্তি দিই ওদের কিন্তু পারি না।

হতাশ হয়ে নেহাল হাল ছেড়ে দেয়।নেহালের এই জিনিসটা আমার ভালো লাগে,অন্তত যখন বুঝতে পারে আমি আপসেট তখন আর জোরাজুরি করে না।

তবে উদাস হয়ে বসে থাকে বাহিরের দিকে তাকিয়ে। মাঝে মাঝে আফসোস করে বলে তোমার খুব কষ্ট হয় না?
কেনো এতো ভাবছো তুমি?
এটা একটা এক্সিডেন্ট জাস্ট,এর বেশি কিছু না।মানুষের জীবনে এরকম কতো এক্সিডেন্ট থাকে।

হুট করে একদিন আব্বা আম্মা আমাকে নিয়ে যায় পাসপোর্ট করার জন্য,দেশের বাহিরে ঘুরতে যাবে বলে প্ল্যান করে যাতে রিফ্রেশমেন্ট হয়।
আমি ও আর আপত্তি করি নি,সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে আব্বা আম্মা।
দুজনের উৎসাহ আনন্দ দেখে আমার নিজেরই মন ভালো হয়ে যায়।
মাঝেমাঝে আম্মা আফসোস করে বলে এই দেশে আর থাকতে ইচ্ছে করে না রে বাবু,এই দেশের মানুষ খুবই খারাপ।আমার একটা বাবুকে তো হারিয়েছি,তোকে যেনো আর না হারাই।

আব্বা আম্মাকে জানাই নি কেনো অভ্র খুন হয়েছে,নিজের মৃত সন্তানের নামে এরকম কথা শুনতে কোনো বাবা মা-ই পারবে না।ভেঙে পড়বে খুব।

আরো মাস ছয়েকের মধ্যে আমাদের ভিসা হয়ে যায়,সব কিছু ঠিক করে নেহাল জানায় আমরা একেবারে লন্ডন চলে যাচ্ছি।
কথাটা শুনে আমি চমকে উঠি।দেশ ছেড়ে চলে যাবো ভাবতেই কেমন কষ্ট হয়। কিন্তু আব্বা আম্মা ভীষণ খুশী। নেহালকে জিজ্ঞেস করতেই নেহাল জবাব দিলো,”এই দেশে থাকলে এখানকার পারিপার্শ্বিক চাপে তুমি অতীত ভুলতে পারবে না।আমার চাকরি,বাসা সবই তো ওখানে।তাছাড়া আব্বা আম্মা ও এখানে থাকতে চায় না।

আমাদের ফ্লাইট সন্ধ্যা ৭টায়,সকাল থেকে সব রেডি করা শুরু করি আমরা। আব্বা অভ্রর বড় ভাইদের জানায় সব,সবাই প্রথমে আপত্তি করলেও আব্বা আম্মার দৃঢ়তার কাছে হেরে যায়।

দুপুরের দিকে নেহাল বের হয়ে যায় বাসা থেকে,জরুরি কোনো কাজ আছে বলে।বিকেল হতেই আমার কেমন যেনো অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়।নেহাল তো কখনো বাহিরে একা বের হয় না এতো সময়ের জন্য।নেহাল না থাকায় আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারলাম,নেহালের উপর আমি কতটা নির্ভরশীল,নিজের অজান্তে ওকে কতটা ভালোবাসি।

নেহাল ফিরে আসে সন্ধ্যার একটু আগে।দেখেই কেমন ক্লান্ত মনে হয় ওকে।বাসায় এসেই আমার দিকে কেমন ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকায় কিছুক্ষণ। তারপর কিছু না বলে চলে যায় তোয়ালে নিতে।হঠাৎ করে আমার চোখে পড়ে একটা দাগ।
নেহালের শার্টে লাল কিছুর দাগ।এই দাগ আমার চেনা।
প্রবল একটা ঝাঁকি খেলাম আমি।কিছু বলার আগেই নেহাল ওয়াশরুমে চলে যায়।গোসল করে আজ সময় নিয়ে।ভিতরে ভিতরে আমি যেনো মরে যাচ্ছি অস্থিরতায়।নেহাল কই ছিলো,কিসের রক্ত ওর শার্টে?

নেহাল বের হতেই আমি আর থাকতে পারি নি স্থির,ঝাঁপিয়ে পড়ি নেহালের বুকে।
বিয়ের পর এই প্রথম বারের মতো নিজ থেকে আমি নেহাল কে জড়িয়ে ধরেছি।আমার কান্না দেখে নেহাল আমার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে লতা?”

নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করি আমি,”কিসের রক্ত ছিলো নেহাল?”

নেহাল একটুও চমকায় নি আমার প্রশ্ন শুনে।একটা গভীর দম নিয়ে বলে,”যারা তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে তাদের শাস্তি দিয়ে এসেছি আমি লতা।তবে প্রাণে মারি নি।জীবনে যাতে কোনো মেয়ের সাথে আর এরকম করতে না পারে তার ব্যবস্থা করে এসেছি নিজ হাতে।
ওরা এখন থানায় আছে।”

আমার বুকের ভিতর একটা আগুন চাপা পড়ে ছিলো,হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম সেই আগুন নিভে গেছে।কেউ যেনো বরফ শীতল পানি ঢেলে দিয়েছে সেই আগুনে।
আজ থেকে আমি পরম নিশ্চিন্ত। শান্তির দিন শুরু আজ থেকে।

“কিভাবে করেছো?”

“তোমার ভাবীদের বাসা আমি চিনি,তুমি কলেজে চলে গেলে আমি বাসার কাজ সেরে চলে যেতাম ওই নজরদারি করতে।
আশেপাশের লোকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম ভাবীর ভাই আবদুল হক,একজন টিচার।
তারপর তাকে কিডন্যাপ করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি।
টিউশনির টোপ দিয়ে শিকার করে ফেললাম।
তাকে জিম্মি করে কৌশলে তার দুলাভাই রাহাতকে কব্জা করে ফেললাম।
তারপর আর কী!
নিজ হাতে ওদের পুরুষাঙ্গ কেটে দিলাম।বাকীদের ধরার জন্য মামা ফোর্স পাঠিয়েছে। ওরাই স্বীকার করেছে সব।আমি মামাকে সব খুলে বলেছি,ভাবীকে আড়ালে রাখা হবে সব কিছু থেকে।”

নেহাল আরো শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে নিলো।আজ আর আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করি নি।
সময় স্থির হয়ে যাক এখানে,আজীবন যেনো এভাবে থাকতে পারি। ”

(সমাপ্ত)

কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-১৪

0

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব: ১৪
লিখা:জাহান আরা

নেহাল কে সাথে নিয়ে যখন হাসপাতালে পৌঁছাই,তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভিতরে ভিতরে আমি ভীষণ অস্থির হয়ে আছি।কেনো এরকম হলো?
কেনো অপরাধী ভাবী-ই হলো!
কি ক্ষতি করেছি আমি তার?
যেই ভাবী সবসময় আমাকে বোনের মতো দেখেছে সেই ভাবী কিভাবে এরকম করলো?
কাকে জিজ্ঞেস করবো আমি?
মনে মনে বারবার চাইছি যেনো সব মিথ্যা হয়ে যায়,ভাবীকে যেনো না দেখি ওখানে গিয়ে।

রিসিপশনে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলো 36 নাম্বার কেবিন কোন দিকে।
রিসিপশন থেকে দেখিয়ে দিতেই আমি আর নেহাল এগিয়ে গেলাম সেদিকে।কেবিনের সামনে 36 লিখা দেখেই আমার গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেলো। ভীষণ তৃষ্ণা পাচ্ছে আমার।
নেহাল আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো।একটু সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে ভিতরে ঢুকলাম।

ভাবী বসে আছে বেডের উপর।ভাবীকে দেখে আমার বুকের ভিতর মুচড়ে উঠলো। কেমন শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে ভাবী।ভাবীর কোলে একটা মস্ত এলবাম।
আমাদের দেখে ভাবী এগিয়ে এলো সামনের দিকে।
আলতো হেসে বসতে বললো। আমি আর নেহাল ২টা চেয়ারে বসলাম।
ভাবীর চেহারায় কিছুটা উদভ্রান্তের ছাপ।এলবাম টা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ভাবী বললো,”দেখো এটা।”
হাত বাড়িয়ে নেহাল এলবামটা নিলো।তারপর খুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো।প্রথম ছবিটা দেখেই আমার চোখ আটকে গেলো।
অপূর্ব সুন্দর এক যুবতী তাকিয়ে আছে উদাস ভঙ্গিতে। চোখে মুখে রাজ্যের বিষণ্ণতা।
যেনো বন্দিনী কোনো রাজকন্যা,যাকে রাক্ষসেরা বন্দী করে রেখছে।একঝাঁক কোঁকড়া চুল কাঁধ বেয়ে এসেছে নিচের দিকে।

সাদা একটা ড্রেস পরনে মেয়েটার,যে কেউ এই মেয়ের প্রেমে পড়তে বাধ্য।
ভাবীর সাথে চেহারার কিছুটা মিল থাকলেও মেয়েটা ভাবীর চাইতে ২-৩ শেড ফর্সা।
আমার হঠাৎ করেই যেনো একটু হিংসা হতে লাগলো। নারী চরিত্রের চিরায়ত স্বভাব যেটা।
পুরো এলবামে মেয়েটার বিভিন্ন ছবি,প্রতিটি ছবি বুকে কাঁপন ধরায়।বারবার মনে হয় আল্লাহর সৃষ্টি কতো সুন্দর!

ভাবী বলে উঠলো,”আমার ছোট বোন,রিপা হক।”

রহস্যের একটা ঝট খুললো তাহলে এবার।আমি মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”কেনো ভাবী,কেনো দুইজন মানুষ কে খুন করেছো তুমি?”

ভাবী মুচকি হাসলো,তারপর বললো,”বিয়ের কয়েকমাস আগে থেকে রিপার পেটের ডানদিকে ব্যথা হতো।তখন আমরা কেউ বিশেষ আমলে নিই নি।গ্যাস্ট্রিক থেকে এরকম হয়েছে ভেবে ওকে আর ডাক্তার দেখানো হয় নি।
রিপার বিয়ের ৭ দিনের মাথায় প্রচন্ড পেট ব্যথা হয়।ব্যথা এতো অসহনীয় মাত্রায় চলে যায় যে রিপাকে ইমিডিয়েট হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।আবিদ হাসান ছিলো ডাক্তার রিপার।

চোকরা ডাক্তার রিপাকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে যায়,সরাসরি রিপার স্বামী কে জিজ্ঞেস করে,পেশেন্ট আপনার কে হয়,ওনার কি বিয়ে হয়েছে।
রিপার স্বামী জবাব দিতেই ডাক্তারের মুখ কালো হয়ে গেলো, যেনো আশাহত হয়েছে।
পরীক্ষা করে জানা গেলো রিপার এটা এপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা,যেকোনো সময় এপেন্ডিক্স ফেটে যেতে পারে।

অপারেশন করার জন্য রিপার স্বামী রাহাত তাৎক্ষণিক অনুমতি দিয়ে দেয়।
৭ বছর ধরে ভালোবাসার পর ওদের বিয়ে হয়েছে,রিপা যেনো রাহাতের প্রাণ ভোমরা। ওদের ভালোবাসা দেখেই আমার বিয়ের আগে বাবা মা’কে বুঝিয়ে আমি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলি।

অভ্র ছিলো হাসপাতালের সার্জন।অপারেশন থিয়েটারে অভ্র রিপাকে দেখে চমকে উঠে আবিদের মতো। রিপার সৌন্দর্য রিপার কাল হয়ে উঠে। ভাবতে পারো,অপারেশন থিয়েটারেই ওরা দুজন মিলে রিপাকে ধর্ষণ করে। এবং সেই সময়ের ভিডিও করে রাখে যাতে রিপা কাউকে কিছু না বলে।
অপারেশন করে বাসায় নেয়ার পর রিপা আমাকে জানায় বিষয়টা।সেদিন রাতেই রিপা ছাদ থেকে লাফ দেয়।মারা যায় রিপা ৫ তলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

কাজল,যেই মানুষকে তুমি হৃদয়ে দেবতার আসনে বসিয়েছিলে সেই মানুষটা তার যোগ্য ছিলো না।সে কোনো দেবতা ছিলো না বরং অমানুষ ছিলো।তোমার বিয়ের আগে আমি জানতাম না এই সেই ডাক্তার। যদি জানতাম কিছুতেই সাপোর্ট পেতে না তুমি আমার।
সব ঠিক হওয়ার পর ওরা যেদিন তোমাকে দেখতে আসে সেদিনই আমি অভ্রকে দেখি।তখন আর কিছুই করার ছিলো না আমার।
তবে তোমার সাথে ওরকম করার প্ল্যান আমার ছিলো না,তুমি কেনো আবিদের বউয়ের সাথে ও না।কিন্তু আমার ভাই আর রিপার জামাই জেদের বশে ওটা করে তোমাদের স্বামীর সামনে,যাতে বুঝতে পারে কতটা কষ্টের হতে পারে এটা কোনো মেয়ের জন্য।
ওরা অভ্রকে খুন করার পর বাসায় গিয়ে আমাকে বলে প্ল্যানের বাহিরে ওরা এরকম করেছে।আমার দুই ভাই আর রিপার স্বামী আর দেবর মিলে আমরা এসব করেছি।এ দেশে এসবের বিচার নেই,তাই আমরা নিজের হাতে ওদের শাস্তি দিয়েছি।জানি পাপ করেছি,তবুও মনে খুব শান্তি এখন।পৃথিবী থেকে দুইজন অমানুষ তো কমাতে পেরেছি।
আমার আর কোনো পিছুটান নেই,কিছু বলার ও নেই।যা করেছি বোন হত্যার প্রতিশোধ নিতে করেছি।যা শাস্তি দিবে মেনে নিতে রাজি আছি।”

আমি কী বলবো বুঝতে পারছি না।মাথা ঝিমঝিম করছে আমার।কখন যেনো জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম নেহালের গায়ে।

জ্ঞান ফিরতেই দেখি নেহালের কোলে মাথা রেখে আমি শুয়ে আছি।নেহাল অঝোরে কাঁদছে।ভাবী বসে আছে অন্য পাশে।
আমার ভিতরে সব ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে লাগলো।
কেনো এরকম হলো আমি বুঝতে পারছি না।অভ্রকে আমি এতো বিশ্বাস করতাম সেই অভ্র কি-না!
অপাত্রে ভালোবাসা দান করেছি আমি।
ভাবী যা করেছে ভালো করেছে।ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যু শুধুমাত্র।
ভাবীর প্রতি আমার তাই কোনো অভিযোগ নেই।আমি উঠে গিয়ে ভাবীর হাত ধরে বললাম,”তোমার প্রতি আর কোনো অভিযোগ নেই ভাবী,যা করেছো তুমি উচিৎ কাজ করেছো।ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যু ভাবী।আমার নিজের উপর রাগ হচ্ছে ভাবী এতোদিন ধরে এরকম একজনকে ভালোবেসেছি বলে।তুমি বাসায় চলে যাও।”

আমার কপালে আলতো চুমু খেয়ে ভাবী উঠে গেলো।যাওয়ার সময় বললো,”সব মানুষ খারাপ হয়
না কাজল,তবে আমরা খুঁজে নিতে পারি না,চোখের সামনে সাত রাজার ধন থাকলেও আমরা তা সঠিক সময়ে চিনি না।কেননা অমানুষেরা দেখতেও মানুষের মতো।আমাদের জীবনটাই এরকম সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের সাথে দেখা হয় না,ভুল মানুষের সাথে দেখা হয়।আর যখন ভুল বুঝতে পেরে সঠিক মানুষ খুঁজে পাই তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।সঠিক মানুষকে আর বিশ্বাস করতে পারি না আমরা তখন। ”

ভাবী চলে গেলো।আমি জানি কথাগুলো ভাবী নেহালকে উদ্দেশ্য করে বলেছে।নেহাল কিছু বললো না,আমিও কিছু বললাম না।
কিছুক্ষণ পর আমি উঠে দাঁড়ালাম।নেহাল ও উঠে দাঁড়ালো আমাকে উঠতে দেখে।বাসায় ফিরে দেখি আব্বা আম্মা পুরো বাসা সাজিয়ে রেখেছে। আমার বাবা মা ও আছে।
ঘটনা কী সেটা বুঝতে পারলাম কাজী আসার পর।আমার মা বাবা,শ্বশুর শাশুড়ী সবাই যখন এসে আমাকে ধরলো এভাবে আর থাকা যাবে না আমার।বিয়ে করতেই হবে,আর আজকেই সেটা হবে নেহালের সাথে।নেহাল এখানেই থাকবে বিয়ের পর।

ভাবী এলো ফুল নিয়ে,তখনই বুঝতে পারলাম প্ল্যান আসলে ভাবীর।

নেহালের দিকে তাকালাম,বেচারা করুণ চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।ঠিক যেভাবে অনেক বছর ধরে তাকাতো।
এই চোখের ভাষা আমি আজ পড়তে পারছি।আমি আর অমত করি নি।
একজন ধর্ষককে ভালোবেসেছি ভাবতেই লজ্জা লাগে,সেখানে সেই ধর্ষকের আশায় বাকি জীবন একা থাকার শপথ নেয়া সবচেয়ে বড় বোকামী।

বিয়ে হয়ে গেছে,আমি আর নেহাল আবারও যাচ্ছি সেই নদীর পাড়ে।
নেহালের চোখেমুখে আনন্দ উপচে পড়ছে যেনো।আনন্দে কথা বলতে পারছে না নেহাল।
ঠিক সেদিনের মতো যেদিন ওর জন্য বাইক এনেছিলো আংকেল ।

ভালো থাকুক সব ভালোবাসা,ভালোবাসা হোক সঠিক মানুষের সাথে।
অমানুষকে ভালোবেসে ভালোবাসার অপমান যাতে না করে কেউ নিজের অজান্তে।
সব সত্যি ভালোবাসা পূর্ণতা পাক।
পৃথিবী ভালোবাসাময় হোক।

চলবে

কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-১৩

0

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:১৩
লিখা:জাহান আরা

১০ তলা ভবনের ৭ তলায় ডাক্তার আবিদ হাসানের পরিবার থাকে।গেইটের দারোয়ান কে ডাক্তার আবিদ হাসানের পরিবারের সাথে দেখা করতে যাবো বলার সাথে সাথে লোকটার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো।
জিজ্ঞেস করলো,”আগে এপয়েন্টমেন্ট ছিলো কি-না। ”
“না,ছিলো না।”

“কোথা থেকে এসেছেন?”

আমি অভ্রর হাসপাতালের নাম বললাম।দারোয়ান সাথে সাথে কল দিলো আবিদ হাসানের ফ্ল্যাটে। ওপাশ থেকে গ্রীন সাইন্যাল পাওয়ার পর এন্ট্রি বুকে আমার নাম এন্ট্রি করে নিলো দারোয়ান। তারপর বললো,”৭ তলার ফ্ল্যাট নং D।”

দারোয়ান কে ধন্যবাদ দিয়ে আমি আর নেহাল উপরে উঠে এলাম।লিফটে করে ৭ তলায় এসে নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটে কলিং বেল টিপতেই ওপাশ থেকে কেউ দরজা খুলে দিলো।মনে হয় যেনো আমার অপেক্ষাতেই ছিলো ওপাশের ব্যক্তি।

ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম ৬০+ বয়সী এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। সালাম দিতেই সালামের জবাব দিলেন তিনি।তারপর আমাদের বসতে বললেন।
পাশাপাশি সোফায় আমি আর নেহাল বসতেই শুনতে পেলাম ভিতর থেকে নারী কণ্ঠে কেউ জিজ্ঞেস করছে,”কে এসেছে ভিতরে? ”

লোকটা জবাব দিলো আবিদের হাসপাতাল থেকে এসেছে।
পর মুহূর্তে ওপাশ থেকে এক মহিলা ছুটে এলেন।দেখেই বুঝা গেলো দুজন স্বামী স্ত্রী।
আমাদের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে মহিলা জিজ্ঞেস করলো,”আপনারা?
আবিদের খুনীদের ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছেন?”

কথাটা শুনে চমকে উঠলাম আমি।আবিদ হাসান তাহলে খুন হয়েছেন!
তার ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক মৃত্যু ছিলো না,খুন ছিলো?

আমি আগ্রহী হলে জিজ্ঞেস করলাম,”খুনী মানে?
আবিদ হাসান কী খুন হয়েছেন?”

আমার প্রশ্ন শুনে মহিলার ব্রু কুঁচকে গেলো।তারপর জিজ্ঞেস করলো,”আপনারা আসলে কে?
হাসপাতালের কেউ হলে তো জানতেন আমার ছেলে খুন হয়েছে আট মাস আগে।”

আমি বুঝতে পারলাম আমার পরিচয় দেওয়া উচিৎ এবং সব কিছু খুলে বলা উচিৎ। তাই সব কিছু খুলে বললাম ওনাদেরকে।আমার কথা শুনে দুজনেই হতবাক হয়ে গেলেন।
কিছুটা যন্ত্রচালিতর মতো লোকটি বলে উঠলো,”ঠিক এভাবে আমার ছেলেও খুন হয়েছে,বিয়ের ৭ দিনের মাথায়।”

চমকে উঠে আমি নেহালের দিকে তাকালাম।নেহাল নিজেও যথেষ্ট অবাক হয়েছে।

লোকটি আবার বলে উঠলো,”বিয়ের ৭ দিনের মাথায় বাসায় ডাকাত পড়ে।ওদের হাতেই খুন হয় আবিদ।আমাদের বুড়ো বুড়ী কে একা করে দিলো ওরা,আমার তো আর কোনো ছেলে ও নেই,মেয়ে ও নেই।”

আমার খুব কষ্ট হতে লাগলো ওনাদের জন্য।কি এমন ঘটেছে যার জন্য ওদের দুজনকেই একইভাবে খুন করলো?
আমি জানি এই প্রশ্নের উত্তর কে দিতে পারবে।

কিছুক্ষন চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলাম,”আপনারা কি রিপা হক নামে কাউকে চেনেন?”

লোকটা জবাব দিলো,”না তো,এই নাম তো আগে কখনো শুনি নি।কে এই মহিলা?”

আমি আর কিছু বললাম না।ওনাদের থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম।
এতোক্ষণে বুঝতে পারলাম গেইটে এরকম সতর্কতার কারণ কী ছিলো।
গাড়িতে বসে নেহাল কে বললাম,”বাসায় যাবো আমি,বাবার বাসায়।”

নেহাল কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো। আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে রিপা হক আর রূপা হকের কথা।
ফোন বের করে ভাবীকে কল দিলাম,”ভাবী,কোথায় তুমি?”
ভাবী যথেষ্ট অবাক হলো আমার প্রশ্নে আমি বুঝতে পারলাম,তার কণ্ঠে বিস্ময় ফুটে উঠেছে যদিও।তবু প্রশ্ন না করে উত্তর দিলো,”বাসায় আছি আমি। কেনো?”

“কিছু না ভাবী,আমি আসতেছি।”

ভাবীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি ফোন কেটে দিলাম। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে অনেক প্রশ্ন।
কেনো ভাবী এরকম করলো?
কি কারণ রয়েছে এর পেছনে?
কতোগুলো প্রশ্ন জমেছে মনে,ভাবী কি জবাব দিবে সব প্রশ্নের?
আমি জানি আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই।ভাবীকে হাতেনাতে ধরতে পারবো না আমি।উভয় সংকট বোধহয় এটাকেই বলে।
এতোদিন ধরে মাথায় যেই প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিলো,সেই প্রতিশোধ নেবার পথে আজ বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে ভাইয়ার সংসার। ভাইয়ার ভালোবাসা।

বাসায় পৌঁছে আমি দৌড়ে ভাবীর রুমে গেলাম।গিয়েই একটা শক খেলাম।ভাবী রুমে নেই।মা’কে জিজ্ঞেস করতেই মা বললো,কিছুক্ষণ আগেই ভাবী বের হয়ে গেছে।কী কাজ আছে নাকি বাহিরে তাই,বলে গেছে আসতে দেরি হবে।

আমি বুঝতে পারলাম পাখি উড়াল দিছে।যেকোনো ভাবেই হোক ভাবী বুঝতে পেরে গেছে আমার উদ্দেশ্য। নিজেকে মস্ত বড় আহাম্মক মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। কেনো বোকার মতো ভাবীকে জিজ্ঞেস করতে গেলাম তখন।আমি বুঝতে পারছি আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।নিজেকে সবচেয়ে বড় বোকা মনে হচ্ছে।
মাথায় ধরছে না কিছুই।

আমাকে হতাশ হয়ে বসে থাকতে দেখে নেহাল এগিয়ে এলো।একটা কাগজ বাড়িয়ে ধরলো আমার দিকে।
হাতে নিয়ে দেখি গোটাগোটা অক্ষরে লিখা,”আমি জানি তুমি সব বুঝে গেছো লতা,তোমার মতো মেধাবী মেয়ে খুব সহজেই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে পারবে।ভেবো না আমি পালিয়ে যাচ্ছি,আমার কর্তব্য পালন করেছি আমি।তবে তুমি যদি জানতে চাও তবে চলে এসো অভ্রর হাসপাতালের কেবিন নং থার্টি সিক্সে।
আমি সেখানেই অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।”

আবারও কেবিন নং থার্টি সিক্স!

আমি বুঝতে পারছি না এই নাম্বারটার মধ্যে কি আছে!
সব রহস্যের চাবিকাঠি এই নাম্বারে। নেহাল কে কিছু বলতে হলো না।নেহাল উঠে দাঁড়ালো।
গন্তব্য এখন কেবিন নং থার্টি সিক্স!

চলবে…???

(রিচেক দিই নি,ভুল হতে পারে)

কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-১২

0

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:১২
লিখা:জাহান আরা

ফাইলটি তালাবন্ধ করা দেখে আরেকটু সন্দেহ হলো।কী এমন আছে এই ফাইলে যে অভ্র তালা নেরে রেখেছে।তাও আবার যেখানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই?

অনেক খুঁজে ও চাবি পেলাম না কোথাও।ভিতরে একটা রোখ চেপে গেলো আমার। এটা খুলে দেখতেই হবে।
ড্রেসিং টেবিল থেকে চুলের কাঁটা এনে কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচি করতেই ক্লিক করে মৃদু একটা শব্দ পেলাম।তাকিয়ে দেখি তালা খুলে গেছে।
চুলের কাঁটা দিয়ে তালা খোলার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম।

ভিতরে একটা প্রেসক্রিপশন লিখা।কোনো এক রোগীর নাম,ঠিকানা দেওয়া।অন্য এক কোণে লিখা ডাক্তার আবিদ হাসান।
একজন মহিলা রোগীর নাম,ঠিকানা এরকম ফাইলে রাখার কি কারণ হতে পারে অভ্রর?
এই রোগী কে?
বিশেষ কেউ?
যার জন্য এভাবে তার বিষয়টা আলাদাভাবে মাথায় রাখার জন্য অভ্র এরকম ফাইল করে রেখেছে?
তারপর আবার মনে হলো,এককোনায় যখন ডাক্তার আবিদ হাসানের নাম লিখা আছে তবে হতে পারে আবিদ হাসানের চেনা কেউ,অথবা আত্মীয়।কিংবা হতে পারে তার স্ত্রী হয়তো।
ভালো করে দেখে নিলাম নামটা আবার;”রিপা হক”

রিপা হকের নামটা বারকয়েক আওড়াবার পর মনে পড়লো ভাবীর নাম রূপা হক।মুহূর্তে আমি চমকে উঠলাম এই সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়ায়।নিজে নিজে আমি যেই হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছি,তা কি সত্যি হয়ে যাবে?
তবে কি ভাবী ই আসল কালপ্রিট?

হাসপাতালে ফোন করে ডাক্তার আবিদ হাসান কে চাইতেই রিসিপশন থেকে জানালো আবিদ হাসান মারা গেছেন আজ থেকে ৮ মাস আগে।
খবর টা শুনে আমার ভ্রু কুঁচকে গেলো।ফোন কেটে দিলাম আমি।
ডাক্তার আবিদ হাসান ও মারা গেছেন?

বাহিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার।আকাশে ঘন ঘন বজ্রপাত। বজ্রপাতের শব্দ আমার সহ্য হয় না।বুক কেঁপে ওঠে কেনো জানি শুনলেই।
কিন্তু আজকে কোনোরকম অনুভূতি হচ্ছে না। আজ কেনো জানি ভয় পাচ্ছি না।রুমের ভিতর পায়চারি করতে করতে ভাবতে লাগলাম কোথাও একটা অসামঞ্জস্য আছে।

তারপর আবার হাসপাতালে ফোন দিলাম,ডাক্তার আবিদ হাসানের বাসার এড্রেস চাইলাম।৫ মিনিটের
মধ্যে এড্রেস পেয়ে গেলাম।
আমার কেনো জানি দেরি সহ্য হচ্ছে না।নেহাল কে কল দিলাম এক্ষুনি আসার জন্য।
কল দিতেই নেহাল সাথে সাথে রিসিভ করলো।যেনো ফোন হাতে নিয়ে আমার ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছে সে।

“তুই কোথায়?এক্ষুনি আসতে পারবি?”

ওপাশ থেকে নেহাল জবাব দিলো,”আমি তোর বসার সামনে,বসে আছি গাড়িতে।”

“আমাকে নিয়ে এক জায়গায় যেতে হবে তোকে,এখনই।”

“এখন রাত কয়টা তোর হয়তো সেই খবর নেই,এখন ১১টা বাজে।”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হলাম।কখন ১১টা বেজে গেছে আমি বুঝতেই পারি নি।এখন বের হওয়া মোটেও উচিৎ হবে না।
পরক্ষণেই মনে হলো,নেহাল এখনো এখানে কেনো?
নেহাল কে জিজ্ঞেস করতেই নেহাল মুচকি হেসে জবাব দিলো,”দেশে ফেরার পর থেকে আমি এখানেই থাকি রাতে,তোকে পাহারা দিই। ”

আমি ফোন কেটে দিলাম।আমি চাই না আমার মন এই মুহূর্তে অন্যকিছু নিয়ে ভাবনা চিন্তা করুক অভ্র হত্যার সূত্র ছাড়া।
সকালে উঠতে হবে ভেবে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম কি আর ছেলের হাতের মোয়া?
চাইলেই তো পাওয়া যায় না।বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে ২টা বেজে গেলো। তারপর কখন যেনো ঘুমিয়ে গেলাম।

ঘুম ভাঙলো সকাল ৮টায়।আজ আর বৃষ্টি হচ্ছে না।কি জানি কখন আবার শুরু হয় বৃষ্টি!
বৈশাখ আসতেই এখন জোর বৃষ্টি শুরু হয়,বর্ষা লাগে না।ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে গেলাম।কলেজে ক্লাস আছে সাড়ে দশটায়।
ড্রয়িংরুমে দেখি আব্বা আম্মা চুপ করে বসে আছে।ওনাদের কি মন খারাপ?
আমার বুক কেঁপে উঠলো। ওনারা এভাবে বসে আছে কেনো!

আব্বা কে সেই কথা জিজ্ঞেস করতেই আব্বা বললো,”কাল নেহাল ছেলেটা এলো,আমার তোমার শাশুড়ীর খুব ভালো লেগেছিলো। কিন্তু আজকে ছেলেটা আসে নি।ভেবেছিলাম ঘুম থেকে উঠবো কলিং বেলের শব্দ শুনে,অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছি।কিন্তু ও আসছে না আজ।”

আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। আমার কাছে সান্ত্বনা দেবার মতো কিছু নেই।পুত্রশোকে কাতর এক দম্পতি অন্য কারো মাঝে তাদের ছেলের ছায়া খুঁজে পেয়েছে। তাদের নিরাশ করার সাহস আমার নেই।আমি এতোটা নিষ্ঠুর নই।
কোনো জবাব না দিয়ে কিচেনে চলে গেলাম।দ্রুত রুটি বানাতে লেগে গেলাম চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে।
রুটি,ডিম ভাজি,চা টেবিলে নিয়ে আব্বা আম্মাকে নিয়ে খেতে বসলাম। কিন্তু দুজনে মনমরা হয়ে বসে আছে। খাচ্ছে না কেউ।আমি কি করবো?
নেহাল কে কি বলবো বাসায় আসতে?
মাথায় কিছু ঢুকছে না আমার।
দ্রুত কয়েক চুমুকে চা খেয়ে উঠে গেলাম। ক্লাসের দেরি হয়ে যাবে।

ক্লাস শেষে বাসায় এসে দেখি আব্বা আম্মার মুখ হাসিখুশি। জিজ্ঞেস না করেই বুঝতে পারলাম নেহাল এসেছে,কিচেন থেকে শব্দ আসছে।আব্বা কে দেখলাম বিপুল উৎসাহে ফ্রিজ খুলে কি যেনো নিয়ে যাচ্ছে কিচেনের দিকে।
আম্মা আমাকে বললো,”তুই চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নে,বাবু সব রান্না করছে। আজ আর তোর রাঁধতে হবে না।তুই ফ্রেশ হতে হতে সব রেডি করে ফেলবে বাবু।”

বাবু?
বাবু কে?
আম্মা’কে জিজ্ঞেস করতেই উনি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন,”,আরে তুই এটাও জানিস না,নেহালের কথা বলছি।”

আর কিছু না বলে রুমে চলে গেলাম।অভ্র স্নার ছোট ছিলো বলে আব্বা আম্মা ওকে বাবু বলে ডাকতো। অথচ আজ নেহাল কে বাবু বলে ডাকছে।সন্তান বাবা মায়ের কাছে কি আদরের আবার বুঝতে পারলাম।
আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো হঠাৎ করে। কতোদিন মায়ের কোলে মাথা রাখি না।
আমার মা ও তো আমার জন্য এরকম কষ্ট পাচ্ছে।
আমি তো বেঁচে থেকে ও মৃতর মতো আছি।আমার বাবা মা কিভাবে সেটা সহ্য করছে?

ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখি খাবার রেডি। সবাই মিলে খেতে বসলাম।খাওয়া শেষ করে আমি নেহালকে বললাম আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।নেহাল তাৎক্ষণিক উঠে দাঁড়ালো। আব্বা আম্মাকে বলে বের হতে যাবো, তখনই আম্মা নেহাল কে ডেকে বললেন,”সাবধানে গাড়ি চালাস বাবু,বাহিরে বেশীক্ষণ থাকিস না,বাসায় ফিরে আসিস শীঘ্রই।”

আমাকে অবাক করে দিয়ে নেহাল জবাব দিলো,”আচ্ছা মা।চিন্তা করো না।”

নেহালের এরকম ব্যবহারে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম।ও মা বলছে কেনো আম্মাকে?
ও কি ওনাদের এই ভালোবাসা কে দুর্বলতা ভাবছে?

ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”তুই আম্মা কে মা বলে ডাকলি কেনো নিজের মা থাকতে?
ওনাদের পুত্রস্নেহের সুযোগ নিচ্ছিস না-কি? ”

আমার প্রশ্নের জবাবে নেহাল আমার দিকে ১০ সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো।তারপর বিড়বিড় করে বললো,”তুই জানিস না লতা,মা মারা গেছে ১ বছর আগে।”

আমার মাথায় বজ্রপাত হলেও আমি এতটা অবাক হতাম না নেহালের কথা শুনে যতো অবাক হলাম।কাকী মারা গেছেন?
তাও ১ বছর হয়েছে?
অথচ আমরা কেউ জানি ই না।
আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে নেহাল কেঁদে উঠে বললো,”মা মারা যাবার পর আমি আসতে পারি নি দেশে,আমার একটা এক্সাম ছিলো। তারপর যখন সিদ্ধান্ত নিই দেশে ফিরার,শুনতে পাই বাবা আবার বিয়ে করেছে।
কিছুটা অভিমান হয় বাবার উপর। মা মারা যাবার ১মাস না পেরুতেই বাবা বিয়ে করলো সেটা বড় কথা না,বাবা আমাকে অথবা ভাইয়া আপাদের কে ও জানালো না।লোকে বলে মা মারা গেলে বাবা হয় তালুই,আসলেই ঠিক বলে।
দেশে আসার পর বাবাকে আর আগের মতো পাই না।কেমন যেনো দূরত্ব বজায় রেখে চলেন উনি।আমাদের সাথে খেতে বসেন না,কথাও খুব একটা বলেন না।নতুন মা ও কথা বলেন না।
আমি আসার ৫ দিন পর বাবা ডাইনিং টেবিলে এসে ঘোষণা দিলেন উনি আর এই বাড়িতে থাকবেন না,নতুন মা কে নিয়ে আলাদা থাকবেন,নতুন বাসা নিয়েছেন,আজকেই সেখানে শিফট করবেন।
আমার,ভাইয়া,ভাবীর কিছুই বলার ছিলো না।বাবা চলে গেলেন।
ভাইয়া ব্যস্ত ভাবী,বাচ্চাদের নিয়ে,আপারা ব্যস্ত যার যার সংসারে,মায়ের মৃত্যুর পর ওরা আর আসে না।সবাই খুব ব্যস্ত লতা,আমি ছাড়া।
আমার দিন কাটে না,আমার খবর নেয়ার ও কেউ নেই।প্রতি রাতে আমি গাড়িতে থাকি তোর বাসার সামনে,ফজরের আজান হলে চলে যাই বাসায়।কেউ আর আমার জন্য অপেক্ষা করে না লতা।কেউ জিজ্ঞেস ও করে না কই ছিলাম এতো রাত অবদি,অথবা খেয়েছি কি-না। আমার কেউ রইলো না।শাসন করার জন্য অথবা ভালোবাসার জন্য।
এতো বড় পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে একা।ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি বেহায়া,কাঙাল হয়ে গেছি।তোর বাসায় আসার পর মনে হয়েছে আমি আমার বাবা মা পেয়েছি। বিশ্বাস কর,আমি কারো সুযোগ নিচ্ছি না।আমি ওনাদের খুশি করতেও কিছু করছি না,আমি তো আমার জন্য করছি।এই যে মা আছে,বাবা আছে,ওনারা আমার জন্য ভাবে,আমার জন্য অপেক্ষা করে,আমার মনে হয় আমার আর অপ্রাপ্তি কিছু নেই।সব আছে আমার এখন।”

আমার কান্না আর বাঁধা মানলো না।নেহালের এসব কথা শুনে কেঁদে উঠলাম।আমাকে শান্ত হওয়ার সময় দিয়ে নেহাল বললো,”আমরা এসে গেছি লতা।”

চোখ মুছে গাড়ি থেকে নামলাম।আবিদ হাসানের মৃত্যুর কারণ আমাকে জানতে হবে।

চলবে……???

কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-১১

0

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:১১
লিখা: জাহান আরা

জানালায় দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখছি আর ভাবছি জীবন আর ঋতুর মধ্যে আসলে কোনো পার্থক্য নেই।
জীবন যেমন এক বার এক রকম রঙ বদলায় তেমনি ঋতুও একবার এক রকম রঙ বদলায়।
মেইন রোডের পাশে কিছুক্ষণ পর পর জারুল,সোনালু,কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখা যাচ্ছে।প্রতিটি গাছের যেনো আলাদা আলাদা সৌন্দর্য।
প্রকৃতির কি অপূর্ব সৌন্দর্য।
যখন যেই ফুল দেখি সেটাই ভালো লাগে,সেটা দেখলেই মনে হয় আল্লাহর সৃষ্টি কতো সুন্দর।

সোনালু গাছের হলুদ রঙা ফুল দেখলেই মনে হয় যেনো হলুদ পরী।কি সুন্দর ফুলে ফুলে সেজে আছে গাছটি।
প্রকৃতি দেখতে দেখতে আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। নেহাল
চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে।সেই কখন থেকে নেহাল চুপ হয়ে আছে, আমি লক্ষ্য করেছি যদিও তবুও কিছু বললাম না আর।
হঠাৎ করে মনে হলো আমরা কোন দিকে যাচ্ছি?
এটা তো আমাদের বাসায় যাওয়ার রাস্তা না।এই রাস্তা তো অন্যরকম। এতোক্ষণ অন্য জগতে থাকার ফলে আমি বুঝতেই পারি নি নেহাল আমাকে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে।নেহাল কে জিজ্ঞেস করতেই নেহাল চুপ হয়ে রইলো।যেনো কোনো মানুষ না ও,পাথরের কোনো মূর্তি।
জিজ্ঞেস করতে করতে ক্লান্ত হয়ে চুপ হয়ে গেলাম আমিও।সময় হলে নেহাল নিজেই বলবে।শহরের রাস্তাঘাট,দালান অনেক আগেই দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গিয়েছে,রাস্তার দুপাশে ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত। হঠাৎ করেই আমি চিনতে পারলাম রাস্তাটা।এই সেই রাস্তা যেই রাস্তায় নেহাল আমাকে প্রথম বার নিয়ে এসেছে বাইক কেনার পর।

সেই আগের জায়গায় থামতেই নেহাল আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো।সারি সারি গাছের মাঝ দিয়ে যেতে যেতে একটা গাছের সামনে নিয়ে দাঁড় করালো।
একটা বিশাল দেবদারু গাছ।আমার দৃষ্টি আটকে গেলো একটা লিখাতে।
লাভ সাইনের মধ্যে লিখা N+L।

বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি দুজন,কিন্তু নেহালের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
নেহালের দিকে তাকাতেই দেখলাম নেহালের চোখে যেনো একরাশ বিষণ্নতা এসে বাসা বেঁধেছে।নিচের দিকে তাকিয়েই নেহাল বললো,”তোর মনে আছে কাজল,এখানে আমরা আরো একবার এসেছি।সেদিন আমি তোকে এখানে নিয়ে এসেছি ভালোবাসার কথা বলতে।কিন্তু বলতে পারি নি।সেই কবে থেকে তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মনে আছে তোর?
বন্ধু থেকে কবে যেনো তুই আমার জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছিস আমি নিজেও বুঝতে পারি নি।আমার সকাল বিকাল রাত কিছুই ওকে ছাড়া কাটতো না।কিন্তু তোকে বলতে ও পারতাম না।তুই যদি ভুল বুঝিস আমাকে এই ভয়ে।ভেবেছিলাম মাস্টার্স শেষ করে কোনো জবে ঢুকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিবো।
তাই সেদিন এখানে এনেও তোকে আর বলা হয় নি ভালোবাসি। কিন্তু এই গাছটি তে লিখে গিয়ে গেছিলাম আমার ভালোবাসার কথা।

তোর মনে আছে আমার কাছে সবার আগে তুই ছিলি।পৃথিবীর সব এক দিকে আর তুই ছিলি অন্যদিকে।তোর আবদার মিটানোর জন্য আমি এক সময় টিউশনি শুরু করি।যখন তুই যা বলেছিস সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি তোর কথা রাখার।আমি ভেবেছি তুই বুঝবি আমি তোকে কতো ভালোবাসি কিন্তু হলো উল্টো।
তুই প্রেমে পড়ে গেলি অভ্রর।জানিস,যেদিন তুই আমাকে বলেছিলি অভ্রর কথা,সেদিন সারারাত আমি কেঁদেছি মা’কে ধরে।মা জানতো শুধু আমি তোকে কতোটা চাই,আর কেউ জানতো না।

আমার কান্না দেখে মা বারবার বলেছিলো তোর বাবা মায়ের সাথে কথা বলে রাখবে আমাদের বিয়ের জন্য কিন্তু আমি নিষেধ করেছি।
তুই তো তখন অন্য কাউকে ভালোবাসতি,আমি কিভাবে তোর মনে কষ্ট দিয়ে তোকে জোর করে আমার করার চেষ্টা করতাম বল?
পারি নি আমি সেটা।

কিন্তু কখনো তোকে বুঝতে দিই নি তবুও নিজের বুকের ভিতর কিসের শূন্যতা বয়ে বেড়াই।
অভ্র এক সময় বুঝতে পারে তোর প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা আছে হয়তো। তাই তোর আড়ালে আমাকে নিষেধ করে তোর সাথে কম মিশতে।
সেদিন আমার খুব জেদ চেপে যায়।ঠিক করেছিলাম আমি আর কখনো তোর সামনে আসবো না।
তাই মা’কে বলে বড় মামার সাথে কথা বলে কানাডা চলে যাই।

এই যে এতোগুলো দিন পার হয়ে গেলো কাজল,আমি আজও বুকের ভিতর তোর জন্য আমার ভালোবাসা বিন্দু মাত্র কমতে দেখি নি।আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি কাজল।কতো বেশি তা হয়তো কখনো বুঝাতে পারবো না।
তুই বিবাহিতা নাকি ডিভোর্সি নাকি বিধবা আমার তাতে কোনো মাথা ব্যথা নেই,আমার কাভহে আমার কাজল আজীবন পবিত্র। আমার পবিত্র ভালোবাসা।

আমাকে আর খালি হাতে ফিরিয়ে দিস না কাজল,আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না।আমাকে একটা সুযোগ দে লতা,আমি ভালোবাসা দিয়ে তোর বিষাক্ত অতীত মুছে দিবো।”

পবিত্র!
তাও আমি?
কথাটা শুনেই হেসে উঠলাম আমি।ঠোঁটে যদিও হাসি আমার কিন্তু দুই চোখ জলে টইটম্বুর হয়ে যায়।নেহাল আমার দিকে অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে থাকে।
নেহাল কাকে পবিত্র বলছে?
নেহাল কি জানে আমি যে অপবিত্র একটি মেয়ে?
আমি যে ধর্ষিতা?

নেহালের দিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছে বললাম,”তোর ছোট একটা ভুল হয়েছে নেহাল।তুই আমাকে যতোটা পবিত্র ভাবছিস আমি আসলে ততটা না।তুই জানিস না নেহাল,আমি যে ধর্ষিতা। অভ্রর সামনে ডাকাত দলের ২ জন লোক আমাকে সেদিন ধর্ষণ করেছে।আমার সারা শরীরে তাদের নোংরা ছোঁয়া আমি সারাক্ষণ টের পাই।আমার শরীরের প্রতিটি জায়গায় ওরা স্পর্শ করেছে।কি বিশ্রীভাবে স্পর্শ করেছে তা ভাবলেই আমার সমস্ত শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠে।নিজেকে ইচ্ছে করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলি।
আমি কাউকে বলতে পারি নি সেই কষ্টের কথা।সেই লজ্জার কথা।কেউ জানে না।কিভাবে বলবো বল?
তুই ভুল মানুষ কে ভালোবেসেছিস নেহাল।”

আচমকা নেহাল শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। শক্ত করে ধরে ফিসফিস করে বললো,”আমার কাজল আমার কাছে আজীবন পবিত্র থাকবে,আমার হৃদয় মন্দিরে যে কাজলকে বসিয়েছি আমি দেবী করে,সেই দেবীকে অপবিত্র করে সেই সাধ্য কার রে কাজল?
আমার কাজলের মনটা কে তো ওরা ছুঁতে পারে নি,আমার কিসের ভয়?
তুই আমার,আজ থেকে ১১ বছর আগেও জানতাম তুই আমার,আজও জানি তুই আমার,আজ থেকে এগারোশো বছর পরেও জানবো তুই শুধু আমার।”

মুচকি হেসে নেহালকে ছেড়ে দিলাম।সোজা গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।বৃষ্টিতে ভিজে,রাস্তার কাঁদায় আমার অবস্থা শোচনীয়।নেহাল এসে গাড়িতে বসলো।

বাসায় পৌঁছে দিয়ে আব্বা আম্মার সাথে দেখা করে নেহাল চলে যায়।আমার ভীষণ মাথা ধরেছে।আলমারি থেকে ঔষধ বের করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম।অভ্র আমার মাথাব্যথার ঔষধ,সর্দির ঔষধ,সব ঔষধ আলাদা আলাদা ভাগ করে সাজিয়ে রেখেছে।

ঔষধ খেয়ে আবার রেখে দিলাম।রাখতে গিয়ে বিয়ের শাড়িটি চোখে পড়লো।একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো বুকের ভিতর থেকে।শাড়িটি বিয়ের দিন এসে যে খুলে রেখেছি,অভ্র ভাঁজ করে রেখে দিয়েছে তারপর আর পরা হয় নি।দেখা ও হয় নি ছুঁয়ে।
দেখার জন্য শাড়িটি ধরে টান দিতেই একটা লাল ফাইল পড়ে গেলো শাড়ির ভিতর থেকে।
ফাইলের অদ্ভুত রকম নাম দেখে আমার কেমন যেনো সন্দেহ হলো।বুকের ভিতর একটা মোচড় দিয়ে উঠলো আচমকা।

ফাইলের উপর বড় অক্ষরে লিখা,”কেবিন নং থার্টি সিক্স ”

চলবে…..???

কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-১০

0

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:১০
জাহান আরা

নেহাল আজ গাড়ি নিয়ে এসেছে।গাড়ির সীটে বসে আমি সীট বেল্ট বেঁধে নিলাম।
নেহাল চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে।মৌনতা ভেঙে আমি আগে জিজ্ঞেস করলাম,”তোর সমস্যা কী?”

জবাব না দিয়ে নেহাল চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগলো।
আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো,চিৎকার করে বললাম,”মজা নিচ্ছিস তোরা আমার সাথে? আমি বিধবা বলে আমাকে দুর্বল ভাবছিস?
ভাবছিস আমি এখন খুব সস্তা হয়ে গেছি,চাইলেই পেয়ে যাবি?”

আমার এরকম নিষ্ঠুর অভিযোগ শুনে নেহাল হঠাৎ করে গাড়ি ব্রেক কষলো।তারপর অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। নেহালের চেহারায় বিস্ময় ভাব ফুটে উঠেছে।

নেহাল কে চুপ করে থাকতে দেখে আমার আরো জেদ চেপে গেলো।চিৎকার করে বললাম,”তোর এরকম ভালোমানুষির উদ্দেশ্য কি আমি ভালো করেই বুঝি নেহাল,আমাকে এতোটাও বোকা ভাবিস না।আমি একটা কলেজের ডিপার্টমেন্ট হেড এতো টা বোকা না যে তোর উদ্দেশ্য বুঝতে পারবেনা। ”

নেহাল কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।দুচোখ টলমল করছে। আমি না দেখার ভান করে বসে রইলাম।যেতে যেতে বৃষ্টি থেমে গেলো।
বাসায় পৌঁছে দেখি সবাই রেডি।নেহাল কে দেখে বাবা মা ভাইয়া আপুরা সবাই মহাখুশি। অনেক দিন পর নেহাল কে দেখেছে।রিটায়ারমেন্টের পর বাবা অন্য জায়গায় বাসা করে,নেহালের বাবা আরেক জায়গায়।তারমধ্যে নেহাল বিদেশ চলে যাওয়ায় অনেক দিন দেখা হয় নি।
ভাবী নেহাল কে চিনে না যদিও,ভাইয়া বিয়ে করেছে ১ বছর হয়েছে। নেহাল বিদেশ যায় ২ বছর আগে।

সবাই ড্রয়িং রুমে বসে নেহালের সাথে গল্প করছে।আমি উঠে চলে এলাম আমার রুমে।ভাবী এসে আমাকে দেখে কিছুটা হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইলেন।তারপর বললেন,”আজও তোমার এই সাদা শাড়ি পরতে ইচ্ছে করলো লতা?”

আমি মুচকি হেসে জবাব দিলাম,”আমার জীবনটাই তো এখন সাদা কালো ভাবী,আমার জীবনে এখন কোনো রঙ নেই,রঙের বড় আকাল চলছে।বসন্ত এখন তোমাদের,আমার জীবনে বসন্ত এসেছিলো ৭ দিনের জন্য।তারপর থেকে তো প্রচন্ড খরা ভাবী।তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যায় তবুও তৃষ্ণার জল মেলে না।”

ভাবী বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেন,আমি বুঝতে পারলাম না।৫ মিনিটের মধ্যে ভাবী আবারও ফিরে এলেন হাতে একটা লাল রঙের শাড়ি।
আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,”এটা পরে নাও লতা।”

ভাবীর কথা শুনে আমি যারপরনাই অবাক হলাম।কি বলছে ভাবী এটা?

“তুমি কি বলছো ভাবী বুঝতেছো?”

“আমি ঠিকই বুঝতেছি,কিন্তু তুমি কিছু বুঝতেছো না।নিজেকে তুমি কি ভেবেছো?
ভালোবাসার দেবী তুমি?
এরকম ভালোবাসা ভালোবাসা করে কি লাভ হবে?
অভ্র কি ফিরে আসবে?
নাকি ও দেখবে তুমি ওর বিরহে কি রকম জ্বলে পুড়ে যাচ্ছো?”

“ভাবী,তুমি কি বলছো বুঝতে পারছো?
আমি তো তোমাদের সাথে থাকছি না,তোমরা দেখতেও পাও না আমি বিরহে পুড়ি না-কি সুখে আছি।তবে কেনো এসব বলছো?”

“হ্যাঁ,ঠিকই বলেছো।তুমি আমাদের সাথে থাকো না।কারণ তুমি আমাদের তোমার আপন কেউই ভাবো না।আমরা তো তোমাকে ফেলে দিতে পারি না।প্রতি দিন তোমার জন্য বাবা কান্না করে,মা কান্না করে,তোমার ভাই প্রতি দিন আফসোস করে,বড় আপা মেজো আপা তোমার কথা ভাবলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে।আর আমি?
আমি তো তোমার রক্তের কেউ না তাই আমার কথা না জানলেও চলবে।কিন্তু যারা তোমার রক্তের তাদের কথাও তো ভাবো না তুমি।তুমি ভাবো তার কথা যে নাই তোমার কাছে,কখনো ফিরে আসার সম্ভাবনা ও নেই।যার কোনো অস্তিত্ব ও নেই।”

ভাবীর কথাগুলো তীরের মতো আমার কলিজায় লাগছে গিয়ে।ভাবী যদি দেখতো বুকের ভিতর কি পরিমাণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে ভাবীর কথার চোটে,তবে বোধহয় একটা কথা ও বলতো না আমাকে এসব নিয়ে।

আমাকে চুপ থাকতে দেখে ভাবী বললো,”তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম সত্যি জবাব পাই নি,তুমি কি প্রেগন্যান্ট? ”

“কেনো ভাবী,হলে কি সমস্যা?”

ভ্রু কুঁচকে ভাবী আমার দিকে তাকালো।তারপর বললো,”অবুঝের মতো কথা বলো না লতা,কি বলছো তুমি?
যে শিশু দুনিয়ায় আসবে সে কখনো তার বাবাকে চিনবে না,একটা বাচ্চার জন্য এর চাইতে বেশি কষ্টের আর কি হতে পারে?
সারাজীবন কাটবে তার পিতার আদর ছাড়া।তুমি বুঝতে পারো এই অভাববোধ তাকে কি পরিমাণ কষ্ট দিবে।”

ভাবীর কথাগুলো সত্যি কিন্তু তবুও আমার হজম হচ্ছে না।আর আসল কথা আমি প্রেগন্যান্ট নই।আমাকে গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখে ভাবী আর কিছু না বলে চলে গেলো।

কিছুক্ষণ পর সবাই রেডি হয়ে বের হলো।মা সাফ সাফ জানিয়ে দিলো নেহাল ও আমাদের সাথে যাচ্ছে। আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম শুনে।কিন্তু কিছু বললাম না।
নেহালের গাড়িতে বাবা ভাইয়া,দুলাভাই ২ জন বসলো।আমরা ভাইয়ার গাড়িতে।
ভাবীদের বাসায় যেতে ১ ঘন্টার মতো লাগলো। সবার মধ্যে আমাকে কেমন যেনো বেমানান লাগছে।

আমাকে দেখে সবাই কেমন যেনো অতিরিক্ত দরদ দেখাতে লাগলো।এই অতিরিক্ত দরদ আমার সহ্য হচ্ছে না।নেহাল আমার আশেপাশেই থাকছে।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই বসে বসে গল্প করছে,ঘরভর্তি অনেক মেহমান।এক পাশে ৫-৬ জন মহিলা দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।হঠাৎ করেই আমি বুঝতে পারলাম ওরা আমাকে দেখে কি বলছে।আজকে এখানে আসার মূল কারন কি তাও বুঝে গেলাম।

ভাবীর উপর প্রচন্ড রাগ হলো আমার।আমি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হয়ে যেতে নিতেই মা এসে আমার হাত ধরে ফেললেন।মায়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম মায়ের দুচোখে নিরব অনুনয় ঝরে পড়ছে।

কিছু না বলে নেহালের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।তারপর আস্তে করে বললাম,”আমার এখানে ভালো লাগছে না,আমাকে বের করে নিয়ে যা এখান থেকে।”

নেহাল কোনো প্রশ্ন না করে সোজা মা কে গিয়ে কিছু বললো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মা বললো আসার জন্য।আমি ও বের হয়ে এলাম সাথে সাথে।
কি বিশ্রী ষড়যন্ত্র!
আমাকে আবার বিয়ে দেয়ার ভাবনা?
এরা কি কখনো মানুষ হবে না?
যেখানে এখনো আমার স্বামীর হত্যাকারী কে আমি ধরতে পারি নি সেখানে নতুন জীবন শুরু করার কথা আমি ভাবতেই পারি না।

আমাকে গম্ভীর দেখে নেহাল জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে?”

আমি নেহাল কে সত্যি কথাটা বললাম।শুনে নেহালের মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।মুখ ফিরিয়ে নিলো সামনের দিকে।

হঠাৎ আমার মনে পড়লো,নেহাল কি আমাকে পছন্দ করে?
এই পছন্দ কবে থেকে?
না-কি শুধু মাত্র সিমপ্যাথি দেখানোর জন্য নেহাল এসব করছে?
আমি কি নেহাল কে ভুল ভাবছি?
নেহাল তো আগে থেকেই এরকম কেয়ারিং,তবু কেনো হঠাৎ আমার সন্দেহ হয়?

বুঝতে পারছি না।বাহিরে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে।গাড়ির উইল্ড শিল্ড ব্যস্ত হয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পরিষ্কার করছে।তাকিয়ে দেখতে দেখতে আমি জানালার গ্লাসে হেলান দিলাম।ভাবীর কথাগুলো মাথায় ঘুরছে তখনও।
ভাবতে ভাবতে কখন যেনো ঘুমিয়ে গেলাম।

ঘুম ভাঙতেই বুঝতে পারলাম,আবারও একটা অসঙ্গতি আমার মাথায় ঘুরছে?
ভাবী কেনো আমার প্রেগন্যান্সি নিয়ে এতোটা চিন্তিত?
আমি প্রেগন্যান্ট কি-না তা জানার জন্য কেনো এতো বার জিজ্ঞেস করছে?
ভাবীর বলা কথাগুলো আবারও ভাবতে লাগলাম।ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বুঝতে পারলাম ভাবীর কথাগুলোর মধ্যে একটা খটকা রয়ে গেছে।

পুরো বিষয় টা ভাবতেই আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। তবে কি ভাবী কোনোভাবে সন্দেহ করেছে?
ভাবীর এই অনিশ্চয়তার কারণ কি?
বাচ্চার বাবা কে তা নিয়ে ভাবীর মধ্যে এতো প্রশ্ন কেনো?

চলব…..???

কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-০৯

0

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:০৯
জাহান আরা

সকালে ঘুম ভাঙলো দেরীতেই।রাতে সারা রুমে পায়চারী করতে করতে ক্লান্ত হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও টের পাই নি।
ঘুম থেকে উঠার পর শরীর কেমন ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিলো।ঘড়িতে দেখি সাড়ে দশটা বাজে।
বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে এখনো।রাতে রুমে পায়চারী করার সময় ও শুনতে পেয়েছি বাহিরে বৃষ্টির শব্দ।
উঠে গিয়ে ব্রাশ করে গোসল করে নিলাম।সকাল বেলায় গোসল করার অভ্যাস হয়ে গেছে আমার।সকালে গোসল করে রুম থেকে না বের হলে নিজেকে কেমন অশুচি মনে হয়।মনে হয় যেটাতেই হাত দিচ্ছি সেটাই নোংরা হয়ে যাচ্ছে।

আমার যে কিছুটা শুচিবায়ুর মতো আছে তা আমি নিজেও কিছুটা অনুভব করি।কিন্তু চেঞ্জ করার চিন্তা করি না যদিও।কি দরকার চেঞ্জ করার!
গোসল করে রুমে আসার পর টের পেলাম আমার প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে।
মনে হচ্ছে যেনো আমি একাই দশ জনের খাবার খেয়ে ফেলতে পারবো।
নিজের এই অবস্থা দেখে নিজেই লজ্জিত হয়ে পড়লাম।
জানালার কাঁচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে।বাহিরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে।জানালার কাঁচ খুলে দিতেই বৃষ্টির ছিটা এসে আমাকে একদফা ভিজিয়ে দিলো।বরফের মতো ঠাণ্ডা বৃষ্টির পানি।
ইচ্ছে করছে আমার বৃষ্টিতে ভিজি কিছুক্ষণ,তাতে হয়তো ভিতরের জ্বালা কিছুটা কমবে।
কিন্তু ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিলাম না।আমি জানি এই জ্বালা যতোক্ষন থাকবে ততক্ষণ আমার মাথায় প্রতিশোধ নেবার একটা জেদ থাকবে।ভিতরের আগুন নিভে গেলে আমার জেদ ও নিস্তেজ হয়ে যাবে।
আমি তা কিছুতেই হতে দিবো না।

জানালার শিক গলিয়ে হাত বের করলাম।বৃষ্টির পানি হাতে এসে পড়ছে।গুনগুন করে গেয়ে উঠলাম হুমায়ুন আহমেদ স্যারের সেই বিখ্যাত গানটি ,
“যদি মন কাঁদে-
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…
এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কোমল শ্যামল ছায় ।

যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরি
কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি ।
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আরো
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…

নামিবে আঁধার বেলা ফুরাবার ক্ষণে
মেঘ মাল্লা বৃষ্টিরও মনে মনে ।
কদম গুচ্ছ খোঁপায়ে জড়ায়ে দিয়ে
জল ভরা মাঠে নাচিব তোমায় নিয়ে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…

গাইতে গাইতেই কেমন আনমনা হয়ে গেলাম।চোখের কোণ ভিজে গেলো।এই গান গেয়ে আমি কাকে আহবান করছি?
কে আসবে আমার কাছে,এই বৃষ্টিস্নাত দিনে?
অভ্র…..!
আমার অবচেতন মন কি এই গানের মধ্য দিয়ে অভ্রকে ডাকছে!
অভ্র কি আসবে আর কখনো?
আমার অভ্র ও তো আমাকে কথা দিয়েছিলো,এরকম বৃষ্টির দিনে আমাকে সাথে নিয়ে বৃষ্টি বিলাস করবে।আমি পরবো সাদা শাড়ী,নীল ব্লাউজ,অভ্র পরবে নীল পাঞ্জাবী।
সেদিন আমরা অনেক পথ হাটবো।হাটতে হাটতে কোনো এক টং দোকানে গিয়ে চা খাবো।
বৃষ্টির জল সেই চা’য়ে গিয়ে পড়বে,অভ্রর ভাষায় সেই চা হবে একেবারে পারফেক্ট চা।
কেননা সেই চা’টা আর ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করে খেতে হবে না।

কি অদ্ভুত,তখন কোনো বৃষ্টি হয় নি।অথচ বৃষ্টি শুরু হয়েছে গতকাল।এখন আর অভ্র নেই।

সবচেয়ে অদ্ভুত কথা হচ্ছে,আমার পরনে এখন সাদা শাড়ি ঠিকই আছে কিন্তু নীল পাঞ্জাবী পরার জন্য অভ্র নেই।
অভ্রর মৃত্যুর পর থেকে আমি আর রঙিন শাড়ি পরি নি।
কেনো পরবো?
কার জন্য পরবো?
কে দেখবে সেই সৌন্দর্য?
আমার তো স্বামী নেই।যার জীবনে স্বামী নেই,তার জীবনে আর রঙ চকচকানির কি দরকার।রঙ্গিন জীবন যদি কাটানোর ভাগ্য থাকতো তাহলে আল্লাহ স্বামীকে জীবিত রাখতো।
এ আমার এক নিরব আত্মাভিমান। নিজের উপর নিজের রাগ।এ জীবনের জন্য রঙিন কাপড় আমার জন্য নিষিদ্ধ করে দিলাম আমি নিজে।

বৃষ্টির জল হাতে নিয়ে মনে মনে বললাম,”অভ্র,তুমি ছাড়া এই বৃষ্টি বিলাস আমার কাছে অর্থহীন। ”

ভিতর থেকে কান্না আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বুঝতে পেরে জানালার গ্লাস বন্ধ করে দিলাম।এতোক্ষন ভাবনার জগতে থাকায় ভুলেই গেছিলাম আমার যে প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে।এই বৃষ্টিতে ভুনা খিচুড়ি,ইলিশ মাছ ভাজা,আর ডিম ভাজা খেতে ভীষণ ভালো লাগবে।

দুপুরে আবার ভাবীর বাবার বাড়িতে যেতে হবে।

রুম থেকে বের হয়ে গেলাম খিচুড়ি রান্না করার জন্য।
আমার ভাগ্য হলো না অভ্রকে বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি রেঁধে খাওয়াবার,অনন্ত অভ্রর বাবা মা কে তো খাওয়াতে পারবো।

রুমের দরজা খুলে বের হতেই আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম।ভুনা খিচুড়ির ঘ্রাণ ভেসে আসছে।কড়াইতে ইলিশ মাছ ভাজছে কেউ সেই ঘ্রাণ ও পাচ্ছি।
কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব!
আমি তো কাউকে কিছু বলি নি।

বের হয়ে ডাইনিং রুমে যেতেই দেখি আম্মা বড় একটা ডিশ থেকে প্লেটে খিচুড়ি সার্ভ করছে।আব্বা কিচেন নাইফ হাতে নিয়ে শসা কাটছে গোল গোল করে।
কিচেন থেকে ইলিশ ভাজার শব্দ ভেসে আসছে।
আমাদের বাসায় কোনো হেল্পিং হ্যান্ড নেই,ভাবীরা সবাই ভাইয়াদের চাকরী সূত্রে আরেক জায়গায় থাকে,বাসায় আমরা তিনজন মানুষ। কিন্তু কে ইলিশ ভাজছে কিছুই বুঝতে পারছি না।আম্মা কে জিজ্ঞেস করতেই আম্মা জবাব দিলেন,”আমার আরেকটা ছেলে আছে,সে এসব নিজ হাতে রেঁধেছে,কিচেনে গিয়ে দেখে আসো।”

আম্মার এই হেঁয়ালির কোনো মানে আছে?

আর কিছু জিজ্ঞেস না করে আমি কিচেনে চলে গেলাম।
নেহাল কে দেখে আমি থ হয়ে গেলাম।ও এখানে কেনো?
সে কথা জিজ্ঞেস করতেই নেহাল জবাব দিলো,”তুই ভুলে গেলেও আমার তো মনে আছে বন্ধু,বৃষ্টি হলেই যে তোর খিচুড়ি খাবার ক্রেভিংস হয়।তাই সকাল সকাল মাছ বাজার থেকে পদ্মার তাজা ইলিশ আর গরু মাংস নিয়ে চলে এলাম তোকে সারপ্রাইজ দিতে।”

কিছু না বলে আমি বের হয়ে এলাম কিচেন থেকে।নেহালের এরকম অতিরিক্ত কেয়ার আমার কাছে কেমন সন্দেহজনক লাগছে।নেহালের কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে এসবের পিছনে?
নাকি এসব শুধু মাত্রই বন্ধুত্বর জন্য করছে নেহাল?
এমন তো নয় ও এরকম আগে করে নি।ও আগেও এরকম ছিলো।কিন্তু তবু কেনো জানি আজকে আমার কাছে কেমন সন্দেহজনক লাগছে এসব কিছু।

৫ মিনিটের মাথায় নেহাল চলে এলো ইলিশ মাছ ভাজা নিয়ে,তারপর আবার গিয়ে নিয়ে এলো ডিম ভাজা।
আমি কিছু না বলে চুপচাপ খেতে বসলাম।খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম আমার শ্বশুর শাশুড়ির মুখে উপচে পড়া আনন্দ।কেমন হাসিখুশি দুজনেই আজকে।দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে দেখে তাদের আনন্দের সীমা নেই।অভ্রর মৃত্যুর পর এই দুজন মানুষকে আমি এরকম খুশী দেখি না আর।

নেহাল নিজে আব্বার প্লেটে মাছ,ডিম তুলে দিচ্ছে।বৃদ্ধ মানুষ টি আর খাবো না বলে অনুনয় করলেও নেহাল তা শুনছে না।জোর করে তুলে দিচ্ছে আব্বাকে।
আম্মার মুখ আনন্দে চিকচিক করছে।

তবুও কেনো জানি আমি খুশি হতে পারছি না।খাবারের প্রতি কিছুক্ষণ আগের সেই আগ্রহ আর পেলাম না।কোনোমতে কিছুটা খেয়ে উঠে চলে এলাম।

রুমে এসে বসে বসে ভাবছি অভ্রর কথা।তারপর উঠে গিয়ে আলমারি থেকে অভ্রর হাসপাতালের এপ্রোন টা বের করে নিলাম।এই এপ্রোনে এখনো অভ্রর গায়ের গন্ধ মিশে আছে।
মনে হলেই আমি এই এপ্রোন গায়ে দিই।তখন মনে হয় যেনো অভ্রকে জড়িয়ে ধরে আছি।

ভাবনার ব্যাঘাত ঘটাতে আমার ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভাবীর নামটা ভেসে উঠলো।

রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভাবী বলে উঠলো,”এই লতা,কখন আসবে তুমি?”

“ভাবী,বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি,এই বৃষ্টিতে বের হওয়া অসম্ভব। ”

“আমি তাহলে তোমার ভাইয়ার গাড়ি পাঠিয়ে দিই?”

বুঝতে পারলাম ভাবী জেদ করেছে আমাকে নিবেই।তাই বললাম,”লাগবে না,আমি সিএনজি নিয়ে আসছি।”

“আমার লক্ষ্মী ননদিনী। ”

ভাবীর আদরের কথাটা শুনে একটা তীর্যক হাসি এলো ঠোঁটের কোণে।
লক্ষ্মী!
তাও আমি!

এর চাইতে হাস্যকর আর কি হতে পারে?
এই পৃথিবীতে আমার মতো অলক্ষ্মী কয়জন আছে যার চোখের সামনে তার স্বামীকে খুন করে?
অথবা,যার স্বামীর সামনে দুর্বৃত্তরা তাকে…!

না এটা আমি কিছুতেই ভাবতে চাই না।কিছুতেই ভাববো না আমি।

দরজায় টোকা পড়তেই আমি বুঝতে পারলাম নেহাল এসেছে।কিছু না বলে আমার হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে বের হলাম।নেহাল কে অপ্রস্তুত করে দিয়ে আমি সোজা আব্বা আম্মার রুমে চলে গেলাম।আব্বা আম্মার থেকে অনুমতি নিয়ে বের হতে যাবো তখনই আব্বা ডাক দিলো।

আমি পিছনে ফিরতে আব্বা বললেন,”মা,নেহাল কে সাথে করে নিয়ে যাও।”

আমি কিছু বলে উঠার আগেই শাশুড়ি আম্মা বলে উঠলেন,”আমার অভ্রকে আমি দেখতে পাই এই ছেলেটার মাঝে,না করিস না মা।তোকে একা ছাড়তে ভীষণ ভয় করে।আমরা তো ঘরপোড়া গরু রে মা,তাই আমাদের ভীষণ ভয়,তোর সাথে কেউ থাকলে তবুও একটু ভরসা পাবো।”

আব্বা আম্মার ইচ্ছেকে মেনে নিয়ে নেহাল কে বললাম,”চল আমার সাথে।”

মুহুর্তেই নেহালের মুখ হাসিহাসি হয়ে গেলো আমার কথা শুনে।

চলবে…..???

কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-৭+৮

0

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব: ০৭
জাহান আরা

আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে।বৃষ্টি আসতে দেরি নেই,আমার বুকের ভিতরেও যেনো মেঘের ডাক শোনা যাচ্ছে।
বুকের ভিতরে একটা অচেনা ব্যথা অনুভব করছি।এই ব্যথার নাম কি আমি জানি না।শুধু জানি আজ কিছু একটা হবে।আমার প্রতিশোধ নেবার দিন এগিয়ে আসছে।এক পা এক পা করে আমি সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

মিরপুর বস্তির কাছাকাছি যেতেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো।কন্ট্রোল রুম থেকে নিয়াজ নামের একজন ইন্সপেক্টর নেহালের মামা আলতাফ আহাম্মেদকে কল দিলেন।
টার্গেট আমাদের থেকে ১০০ ফুট দক্ষিণে আছে।বস্তির চিপাগলি দিয়ে জীপ আর এগুতে পারলো না।মোড়ের একটা চায়ের দোকানের সামনে জীপ থামালেন ড্রাইভার।
এই প্রথম আমি কোনো বস্তিতে এলাম। চারদিকে ঝুপড়ির মতো অসংখ্য ঘর।
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।এটাও কি মানুষের জীবন হতে পারে?
বৃষ্টি হওয়ায় জায়গায় জায়গায় পানি জমে কাদা হয়েছে।
ছোট ছোট কতোগুলো ছেলে মেয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি করছে।
ওদের দেখলেই মনে হয় পৃথিবীর কোথাও কোনো কষ্ট নেই,কোনো অশান্তি নেই।ওদের মতো সুখী কোথাও কেউ নেই।ছোট ছোট কবুতরের খাঁচার মতো ঘরে ওরা কি অনাবিল শান্তিতে আছে।অথচ বিরাট অট্টালিকাতে থেকেও কেউ কেউ বুকের ভিতর আগুন পুষে বেড়াচ্ছে।
সৃষ্টিকর্তার হিসেব বড়ই অদ্ভুত!

গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে আমরা সবাই ভিজে যাচ্ছি। আশেপাশের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুটা হতাশ হলাম।
এ কেমন জীবন মানুষের!
মাথার উপর পলিথিনের চাউনি দেওয়া,এখানে ওখানে মহিলারা বসে আছে। কেউ রান্না করছে,পাশেই কেউ টয়লেটে যাচ্ছে তার সাথেই কেউ খাবার খাচ্ছে।

স্বাভাবিক অবস্থায় এই দৃশ্য দেখে আমার গা গুলিয়ে উঠতো।কিন্তু আজ তা হচ্ছে না।
আজ আমার মাথায় অন্য চিন্তা। নিয়াজ জানালো টার্গেট আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।কথাটা শুনে পুরো ফোর্স তৎপর হয়ে উঠে। সবার আগে কমিশনার আলতাফ আহাম্মেদ ছুটতে শুরু করে,তার পিছন পিছন বাকী সবাই ছুটতে শুরু করে।
কিছুদূর যাওয়ার পর নিয়াজ জানালো টার্গেট আমাদের থেকে বামে।
বাম পাশে চিপা একটা গলি।একজন মানুষের বেশি চলতে পারবে না এই গলি দিয়ে।কিছুদূর যাবার পর নিয়াজ জানালো আমরা টার্গেট ক্রস করছি।
আলতাফ আহাম্মেদ দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাকে ইশারা দিলো।সাথে সাথে আমি ফোন বের করে কল দিলাম সেই নাম্বারে। পাশের ঘরের ভিতর থেকে একজন লোক বের হয়ে এলো মোবাইল হাতে নিয়ে।তারপর হ্যালো হ্যালো বলতে লাগলো।

লোকটার দিকে তাকিয়ে আমরা সবাই হা হয়ে গেলাম।যে লোকটা এলো তিনি হাতে একটা লাঠি,চোখে কালো চশমা পরা,বয়স ৭০+
দেখেই বুঝা যাচ্ছে লোকটা অন্ধ।আমি বিরাট এক ধাক্কা খেলাম দেখে।
আমার মতো সবাই অবাক হয়ে গেছে লোকটা কে দেখে।শিওর হবার জন্য আমি আবারও কল দিলাম।লোকটার ফোন বেজে উঠলো লোকটার।

বুকের ভিতর যে চাপা আনন্দ অনুভব করছিলাম সেই আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদে রূপ নিলো।হঠাৎ করেই আমার সারা শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো। কান্না দলা পাকিয়ে গলায় এসে আটকে গেলো।চারপাশ যেনো থরথর করে কাঁপছে। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম।

জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমি নেহালের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি।
নেহাল আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সামনে বসে আছে কমিশনার আলতাফ আহাম্মেদ।একপাশে সেই অন্ধ লোকটি।
আমার জ্ঞান ফেরার পর আলতাফ আহাম্মেদ আমার সামনে লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো,ফোনটা কিভাবে উনি পেয়েছে।
উত্তরে লোকটা জানায়,ট্রাফিক মোড়ে ভিক্ষা করছিলো লোকটি,তখনই গাড়ি থেকে কেউ একজন ফোনটা তার থালায় ফোনটা ফেলে যায়।

বুকের ভিতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। একটা কষ্ট যেনো পাথরের মতো চেপে ধরে রেখেছে।
আমার বুক ফেটে কান্না আসছে।কিন্তু কান্না করতে পারছি না।অধিক শোকে পাথরের মতো হয়ে গেছি।

নেহালের চোখ থেকে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো আমার গালে।

আলতাফ আহাম্মেদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমাকে বললেন,”এতো ভেঙে পড়ছো কেনো তোমরা?
ভুলে গেছো কেনো আমাদের হাতে এখনো আরেকটা সুযোগ আছে।”

নেহাল জিজ্ঞেস করলো,”কি সুযোগ মামা?”

মুচকি হেসে আলতাফ আহাম্মেদ বললেন,”মোবাইল না হয় অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছে ওরা কিন্তু সিম কার্ড?
ওটা যার নামে রেজিস্ট্রেশন করা আছে,তা খুব সহজেই বের করে ফেলতে পারবো আমরা। ”

আরেকটা সম্ভাবনা দেখা দিলো।কিছুটা স্বস্তিবোধ করলাম কমিশনার সাহেবের কথা শুনে।

চলবে…..?

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:০৮
জাহান আরা

নেহালের মামা কমিশনার আলতাফ আহাম্মেদের হস্তক্ষেপের কারণে খুব দ্রুত সিম কার্ডের সব ইনফরমেশন হাতে পেয়ে যাই আমরা।
রায়ের বাগের কোনো এক শাহজাহান এর নামে সিম কার্ড রেজিস্ট্রেশন করা আছে।
সমস্ত ডিটেইলস হাতে পাওয়ার পর একটা ফোর্স নিয়ে আলতাফ আহাম্মেদ পরের দিন সকালেই বের হয়ে যান আমাকে আর নেহাল কে সাথে নিয়ে।
বের হবার আগে তিনি লোকাল থানাকে ইনফর্ম করে দেন বিষয় টা।

দুরুদুরু বুকে যেতে থাকি আমরা সামনের দিকে।গাড়ি যতো এগিয়ে যায়,আমার বুকের ভিতরের কাঁপুনি তত বেড়ে যায়।
তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আমার আমি টের পেলাম।
নেহাল কে বলতেই নেহাল গাড়ি থামিয়ে এক বোতল মিনারেল ওয়াটার নিলো আমার জন্য।এক চুমুকেই অর্ধেক বোতল শেষ করে ফেললাম আমি।

শনির আখড়ায় থাকাকালীন লোকাল থানার ওসি আনোয়ার হোসেন কল দিলেন নেহালের মামা কে।শাহজাহান নামক লোকটার সমস্ত ডিটেইলস তিনি জোগাড় করে ফেলেছেন।
আমরা রায়ের বাগ যাওয়ার পর আনোয়ার হোসেন উঠে এলেন আমাদের সাথে গাড়িতে।
কিছুদূর যাওয়ার পর আনোয়ার হোসেন গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিলেন।
কিছুদূর পায়ে হেঁটে যাওয়ার পর একটা টেইলার্সের সামনে গিয়ে হাজির হলাম আমরা।
তারপর সবাই ঢুকে পড়লাম ভিতরে।
দুজন লোক বসে সেলাই করছে,একজন কাটিং করছে।যে কাটিং করছে সম্ভবত সেই দোকানের মালিক।আমাদের দেখে সে-ই এগিয়ে এলো।
আনোয়ার হোসেন কিছুটা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন,”এই দোকানের মালিক কে?”

আনোয়ার হোসেনের প্রশ্ন শুনে সেলাইয়ের কাজে থাকা একজন মাথা উঁচু করে তাকালো,কিন্তু অন্যজন কোনো দিকে না তাকিয়ে তার কাজ করে যেতে লাগলো।
কাটিং করা লোকটি এগিয়ে এসে বললো,”আমার নাম হাবিবুর রহমান স্যার,আমি এই আনন্দ টেইলার্সের মালিক।”

“এখানে শাহজাহান কে?”

হাবিবুর রহমান নামের লোকটা ইশারা দিয়ে দেখালো কাজে মগ্ন হয়ে থাকা লোকটি কে।
লোকটি কোনোদিকে না তাকিয়ে কাজ করে যেতে লাগলো।

ওসি সাহেব তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”তোর নাম কি রে?”

লোকটা কোনো জবাব দিলো না।

ওসি সাহেব আবারও জিজ্ঞেস করলেন কিন্তু লোকটা কোনো জবাব দিলো না।
টেবিলের উপর জোরে একটা থাপ্পড় দিতেই লোকটা চমকে উঠলো।তারপর মুখ তুলে তাকালো আমাদের দিকে।

ওসি সাহেব আবারও জিজ্ঞেস করলেন কিন্তু লোকটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। পাশ থেকে হাবিবুর রহমান বললো,”ও বোবাকালা স্যার। কানে ও শুনে না,কথা ও বলতে পারে না। ”

কথাটা শুনে আমার মাথায় আবার বজ্রপাত হলো। কি হচ্ছে এসব আমার সাথে?
প্রথমে যখন ফোনটা পাওয়া গেলো তখন ছিলো এক অন্ধ লোকের কাছে। আর আজ যখন সিম কার্ডের সন্ধান মিললো তখন পাওয়া গেলো এক বোবা লোককে।

আলতাফ আহাম্মেদ আমার মুখের দিকে তাকালেন,আমি তাকিয়ে রইলাম শূন্যের দিকে।মনে হচ্ছে যেনো অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি আমি।চোখেমুখে সব অন্ধকার।
অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি আমি জ্ঞান হারাতে চলছি।কিন্তু আমার অবচেতন মন বলছে এখন জ্ঞান হারানো যাবে না।একটা মাস্টার মাইন্ডের ষড়যন্ত্র এখানে।

খপ করে আমি নেহালের হাত ধরে ফেললাম।না,আমি অজ্ঞান হবো না।কিছুতেই না।আমাকে সব খুঁজে বের করতে হবে।
নেহাল আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আলতাফ আহাম্মেদ হাবিবুর রহমান কে জিজ্ঞেস করলেন,”এ কবে থেকে এখানে কাজ করছে?”

“৬ বছর ধইরা কাম করতাছে স্যার।”

মোবাইল থেকে ফোন নাম্বার টা বের করে আলতাফ আহাম্মেদ জিজ্ঞেস করলেন,”এই নাম্বার টা কি চেনো তুমি?”

“জ্বি স্যার,চিনি তো।এইডা তো শাহজাহানের নাম্বার। ওর মোবাইলডা স্যার ৩-৪ মাস আগে চুরি হইয়া গেছে দোকান থাইকা।”

এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা আমাকে জেঁকে ধরলো।আমার যেনো সব শেষ। একটা শেষ ভরসা যা ছিলো তা এখন শেষ।
আমি এখন কি করবো?
এই ক্লু ছাড়া তো আমার হাতে আর কিছু ছিলো না।কিন্তু এখন দেখি সেটা ও ভুল।এতোদিন একটা কানাগলিতে ছিলাম আমি।
এখন তো আর কিছু রইলো না আমার হাতে।আমি এখন কোথায় থেকে শুরু করবো?

পরাজিত সৈনিকের মতো টেইলার্স থেকে বের হয়ে এলাম।আমি কোনো যুদ্ধ করি নি তবুও নিজেকে পরাজিত সৈনিক বলে মনে হচ্ছে।
ইচ্ছে করছে আমার চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু আমি ঠিক করে নিয়েছি আর কাঁদবো না।কিছুতেই কাঁদবো না।আবার ভাবতে হবে আমাকে শুরু থেকে।
আবারও শুরু করবো আমি।আমাকে অভ্র হত্যার সমাধানে পোঁছাতেই হবে।
যে মাস্টার মাইন্ড এতো প্লান করে এসব করছে,সেই মাস্টার মাইন্ডকে আমাকে ধরতে হবে।তার নিখুঁত প্ল্যানের মধ্য থেকে আমাকে খুঁজে বের করতে হবে।
কোনো ক্রাইম-ই পারফেক্ট ক্রাইম হতে পারে না।

প্রচন্ড শরীর কাঁপুনির মধ্যে ও বুঝতে পারছি ভিতরে ভিতরে একটা জেদ আবারও চেপে বসেছে আমার মধ্যে।

বাসায় গিয়ে বাকিটা সময় রুমের দরজা বন্ধ করে বসে রইলাম আমি।আম্মা কে বলে দিলাম আমি বের না হওয়া পর্যন্ত যেনো কেউ আমাকে না ডাকে।আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।
আমার মুখের দিকে তাকিয়েই আম্মা বুঝতে পারলেন বুকের ভিতরে একটা ঝড় বইছে।সেই ঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে।

শুকনো মুখ করে আম্মা ও সরে গেলেন আমার সামনে থেকে।

রুমের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলাম উদভ্রান্তের মতো। নিজেকে আমার মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। কিছুই করতে পারছি না আমি ঠিক মতো।নিজের স্বামীর হত্যাকারীদেরকে ও খুঁজে বের করতে পারি নি।
ভাবতে ভাবতে ভাবীর কল পেলাম।ইচ্ছে করছে না ফোন রিসিভ করতে। ফোন হাতে নিয়ে রকিং চেয়ারে বসে পড়লাম ধপ করে।ভাবী আবারও কল দিলো।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভাবীর ফোন রিসিভ করলাম।ওপাশ থেকে ভাবী যা বললো তা শুনে আমার মেজাজ কিছুটা খিটখিটে হয়ে গেলো।
আমার এই ভগ্ন মানসিক অবস্থায় কিভাবে দাওয়াতে যাবো আমি?
তাও আবার কাল!

কিন্তু না করতেও পারছি না।ভাবীর কথার মধ্যেই মা বলে উঠলো আমাকে যেতেই হবে,না হলে মা বাবা কাল সকালে এ বাড়িতে এসে হাজির হবে আমাকে নেয়ার জন্য।

অগত্যা আমি আর না করতে পারলাম না।

কল কাটার আগে ভাবী জিজ্ঞেস করলো আমাকে,”কাজল,একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো তোমাকে।”

“কি কথা ভাবী?”

“তুমি বিয়ের পর কি আর পিরিয়ড হয়েছো?”

ভাবীর কথা শুনে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম।এটা কেমন প্রশ্ন!

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভাবী বললো,”কিছু মনে করো না কাজল,আমি আসলে জানতে চাচ্ছিলাম বাই এনি চান্স তুমি প্রেগন্যান্ট কি-না? ”

নিজেকে সামলে নিয়ে আমি জবাব দিলাম,”হলেও দোষের কি ভাবী?”

“কি যে বলো তুমি,এটা একটা বোকামি হয়ে যাবে,তোমার উচিৎ প্রেগন্যান্সি টেস্ট করা।বাচ্চার বাবা কে না কে তা যদি বাচ্চার মা,বাচ্চা না জানে,সেই বাচ্চা জন্ম দেওয়ার মতো জ্বালা আর কি আছে।এই কাজ করো না কাজল।”

ভাবী ফোন রেখে দিলো।আমি থ হয়ে গেলাম ভাবীর কথা শুনে।কি বললো ভাবী এসব?
আমার বাচ্চার বাবা কে তা নিয়ে ভাবী ভাবছে কেনো?
আমার বাচ্চা হলেও কি ক্ষতি কার?
আমি তো সেকেন্ড ম্যারেজ করতে যাচ্ছি না।মাথাটা ভার ভার লাগতে লাগলো।
রুমের বাতি বন্ধ করে দিয়ে ধ্যানে বসলাম।নিজেকে কিছুটা নিরিবিলি সময় দেওয়া দরকার।মনের মধ্যে একটা খচখচানি রয়ে গেছে।মনে হচ্ছে যেনো একটু ভাবলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

চলবে….???

কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-০৬

0

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:০৬
জাহান আরা

কলেজ ছুটির পর বের হতে হতে আমার আরো দশ মিনিট সময় লেগে যায়।বের হতেই দেখি নেহাল দাঁড়িয়ে আছে বাইক নিয়ে।

আমার মনে পড়ে গেলো অনেক বছর আগের কথা।
এসএসসি তে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ায় ইন্টারে উঠার পর নেহাল কে আংকেল বাইক কিনে দেয়।নিজের বাইক হওয়ার পর নেহালের সে-কি উত্তেজনা।
সাথে সাথেই আমাদের বাসায় গিয়ে হাজির নেহাল।মুখে কথা নেই,প্রচন্ড উত্তেজিত থাকায় গলা দিয়ে ওর কথা বের হচ্ছিলো না।কোনো মতে আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নিয়ে এলো।
নেহালের হঠাৎ এই পাগলামি দেখে বাবা মা ও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়।বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে বাবা মা।

নিচে গিয়ে দেখি বাইক নিয়ে আংকেল দাঁড়িয়ে আছে।আংকেলের হাত থেকে বাইকের চাবি নিয়ে বাইক স্টার্ট দেয় নেহাল।তারপর আমাকে পিছনে বসিয়ে ছুটে চলে।
সেদিন আমরা অনেক অনেক অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছি।শহরের গণ্ডি পেরিয়ে গ্রামে চলে গিয়েছি।মাঠের পর মাঠ ধানক্ষেত,পাশে বয়ে চলা নদী।নদীর স্বচ্ছ টলটলে জল।দেখেই তৃষ্ণা জেগে গিয়েছিলো। বাইক থেকে নেমে দুজনে আঁজলা ভরে পানি পান করি।
বুনো ফুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে যাই।

বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।জীবনে প্রথম বাবা মা ভাইয়াদের ছাড়া একা এতো দূর গিয়েছি।
তারপর থেকে কলেজ আসা যাওয়া হতো নেহালের সাথে।

আমাকে থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নেহাল বাইকে হর্ণ দেয়।কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসি আমি।তারপর গিয়ে নেহালের বাইকে বসি।নেহাল যেতে যেতে আমাকে জিজ্ঞেস করে,”লাঞ্চ করেছিস তুই?”

“বাসায় গিয়ে করবো।”

“আমি করি নি,চল আজ বাহিরে খাই।”

“না আমি বাসায় গিয়ে খাবো,আম্মা অপেক্ষা করবে আমার জন্য।”

আমার কথা শুনে নেহাল কিছুটা আশাহত হলো।কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,”আজ এতো বছর পর তোর সাথে আমার দেখা কাজল,অথচ আজকের জন্যও তুই নিয়ম ভেঙে আমার সাথে খেতে পারবি না?
মনে আছে কাজল তোর,স্কুলে থাকার সময় তোর টিফিনের টাকা দিয়ে তুই সাজগোজের জিনিস কিনতি,সাজতে খুব ভালোবাসতি তুই।তোকে ক্ষেপানোর জন্য আমি তোকে ডাকতাম লিপস্টিক কোম্পানি বলে।কতো হাজার লিপস্টিক তোর কালেকশনে ছিলো সেটা ভেবেও আমি শকড হতাম।
টিফিন টাইমে তারপর দুজনে মিলে আমার টিফিন ভাগ করে খেতাম।দু’দিন পর পর তুই রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য ঘ্যানঘ্যান শুরু করতি।পথে আমাকে অসংখ্য চড়-থাপ্পড় খেতে হতো তোকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যাই না বলে।সবসময় তুই আমার সাথে খেতে পছন্দ করতি।”

নেহালের কথা শুনতে শুনতে আমার চোখে পানি চলে এলো।কি সুন্দর ছিলো সেই সময়টা।তবুও কিছুটা দূরত্ব আসে নেহাল যখন টিউশন শুরু করে।

“তুই মধ্যখানে আবার টিউশন শুরু করলি কেনো?”

আমার প্রশ্ন শুনে নেহাল হাসতে থাকে।আমি কিছুটা বিরক্ত হই।

হাসি থামিয়ে নেহাল জবাব দেয়,”তখন আমার বয়স ছিলো কতো বল,পকেট মানি পেতাম কতো আর?
তোর রেস্টুরেন্টে খাবার বায়না মেটাতাম কি করে নয়তো আমি টিউশন শুরু না করলে।”

আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম নেহালের কথা শুনে।কি বললো এটা নেহাল?

আমাকে চুপ থাকতে দেখে নেহাল আবার বলতে লাগলো,”তোর সব স্মৃতি আমার মনে আছে লতা,আজীবন মনে থাকবে।আমি আজও আগের নেহাল আছি লতা,কিন্তু তুই পালটে গেছিস।এখন আর আমার সাথে খেতেও তোর ইচ্ছে করে না।কতো দায়িত্ববোধ তোর এখন!
স্বামীর প্রতি,শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি,শিক্ষার্থীদের প্রতি।নেই শুধু নেহালের প্রতি।নেহাল কখনো তোর কেউ ছিলো না,কখনো তোর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো না।”

বলতে বলতে নেহালের কণ্ঠ কেমন হয়ে এলো।আমি জানি নেহালের এখন কান্না পাচ্ছে।ভীষণ কান্না পাচ্ছে নেহালের।কিন্তু এ ও জানি নেহাল এখন কাঁদবে না।কিছুতেই কাঁদবে না।

নেহালকে ধাতস্থ হবার সময় দিয়ে আমি বললাম,”আমি একজন বিধবা মহিলা নেহাল,আগের সেই কাজললতা নেই রে।এখন আর আমার ঝাড়া হাত পা নেই,চাইলেই মাইলের পর মাইল ছুটে যেতে পারি না তোর সাথে।
বাসায় কোনো খাবার পছন্দ না হলে এখন আর তোর বাসায় হাজির হয়ে বলতে পারি না,চল বাহিরে খেতে যাবো,ক্ষিধা লাগছে আমার।
রাস্তায় কারো গাছে বড়ই দেখলে এখন আর তোকে বলতে পারি না,ঢিল মার নেহাল,বড়ই খাবো।নিজের আইসক্রিম শেষ হয়ে গেলে তোর হাতের আইসক্রিম কাড়াকাড়ি করে খেতে পারি না নেহাল।আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি।তোর কল্পনার চাইতে বেশি বড় হয়ে গেছি আমি নেহাল।

এখন আমার মাথায় অনেক দায়িত্ব। অভ্রর খুনীদের খুঁজে বের করতে হবে।বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ির দেখাশোনা করতে হবে।তাদের ছেলের অভাব আমাকে পূরণ করতে হবে।
আমি এখন আর পুঁচকে কাজল নই,কতোদিন হয়ে গেছে আমি কাজল ছুঁয়ে দেখি নি।কাজল তো দূরের কথা,শেষ কবে চুলে চিরুনি করেছি,আমার তাও মনে পড়ে না।
আমার এখন সাদাকালো জীবন,এখন আর রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার বিলাসী জীবন আমার নেই।
এখন আর স্বাদ চেখে দেখি না খেতে বসলে,এখন খাই বেঁচে থাকতে হবে বলে।বেঁচে থাকার জন্য যতোটুকু না খেলেই নয়,সেটুকু খাই।”

নেহাল আর কিছু বললো না।ওর মামার বাসায় গিয়ে বসার ২ মিনিটের মাথায় ওর মামা বের হয়ে এলেন।নেহালকে দেখেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন।কুশল জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলে সমস্যা কী।

নেহাল বিস্তারিত খুলে বললো শুরু থেকে।সব শুনে নেহালের মামা আমাকে বললেন সেই নাম্বারে আবার কল দিতে।
আমি জানতাম নাম্বার বন্ধ থাকবে,কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম কল দিয়ে।নাম্বারটা অন পেলাম।

রিং হচ্ছে ওপাশে।
কিছুক্ষণ পর কেউ একজন রিসিভ করলো।কিছুক্ষণ হ্যালো,হ্যালো করে কল কেটে দিলো।
উত্তেজনায় আমার সারা শরীর কাঁপতে শুরু করলো।নেহালের মামা পুলিশ কমিশনার আলতাফ আহাম্মেদ কন্ট্রোল রুমের সাথে যোগাযোগ করলেন।নাম্বারটার লোকেশন জানার জন্য।

কন্ট্রোল রুম থেকে জবাব এলো,ফোনের লোকেশন মিরপুর বস্তি শো করছে।
আলতাফ আহাম্মেদ সাথে সাথে বললেন ফোর্স নিয়ে তার বাড়িতে চলে আসতে,এখনই একটা মিশনে যাবে।
আমাদের অপেক্ষা করতে বলে তিনি ভিতরে চলে গেলেন,ইউনিফর্ম পরতে।
আনন্দে আমি কেঁদে ফেললাম।আমার প্রতিশোধ নেয়ার স্বপ্ন পূর্ণ হতে যাচ্ছে।আর মাত্র কিছু সময়।তারপর আমি খুঁজে পাবো অপরাধীদের মধ্যে একজন কে।একজনকে পেলেই বাকীদের ধরা এক মুহূর্তের কাজ।

১০ মিনিটের মাথায় পুলিশ ফোর্স এসে হাজির।বাসায় কল করে আম্মাকে বলে দিলাম আমার দেরি হবে আজ আসতে,খেয়ে নিন আপনারা।
তারপর আমিও ওনাদের সাথে গাড়িতে উঠে বসলাম।

চলবে….

কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-০৫

0

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:০৫
জাহান আরা

নেহাল দেশে ফিরেই আমার সাথে দেখা করে।আমি তখন ক্লাস নিচ্ছিলাম।বাসায় না গিয়ে নেহাল প্রথমে আমার সাথে দেখা করতে চলে আসে আমার ডিপার্টমেন্টে।
আরদালি এসে আমাকে বললো,কেউ একজন আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।ডিপার্টমেন্টে বসে আছে।
কিছুটা বিরক্ত হলাম কথাটা শুনে।
মনে পড়ে গেলো কয়েকমাস আগের কাহিনী। অভ্রর মৃত্যুর পর বিভিন্ন টিভি,সংবাদপত্রের লোকজন সারাক্ষণ বাসায় আনাগোনা করতো কিভাবে কি ঘটেছে সেই কাহিনী বিশদ আকারে জানতে।
মানসিকভাবে অসুস্থ আমাকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলতেও তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে নি।
একই প্রশ্ন তারা বিভিন্নভাবে করেছে।সবচেয়ে নির্দয় মনে হয়েছে আমার যখন ওরা জানতে চাইতো,যখন অভ্রকে আমার সামনে টুকরো টুকরো করা হয়েছে তখন আমার কেমন লেগেছে?

কি নিষ্ঠুর,নির্দয় প্রশ্ন!
মানুষ পেশার খাতিরে এতোটা মনুষ্যত্ব বিবর্জিত হয় কিভাবে?
কমন সেন্স থেকে ভাবতে গেলেও তো এরকম সেনসিটিভ প্রশ্ন করতে মানুষ ইতস্তত বোধ করে,অথচ তারা নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করে।

তাদের প্রশ্ন শুনে আমি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তাম।
২ জন তো আরো এক কাঠি উপরে ছিলো।তারা এসেছে অভ্রর মৃত্যুর ৪ দিনের মিলাদের দিন।তারা একটা নাটক বানাতে চায়।তাই আমাদের প্রেম থেকে শুরু করে অভ্রর হত্যা পর্যন্ত সব কাহিনী জানতে চায়।
আমার ইচ্ছে করছিলো সৃষ্টিকর্তাকে জিজ্ঞেস করি,কিভাবে এরা এতো পাষাণ হয়?
অন্যের ক্ষত কে খুঁচিয়ে তুলে কি পৈশাচিক আনন্দ পায় এরা?
নয়তো আমার স্বামী মৃত্যুর ৪ দিন না যেতেই কিভাবে এরকম একটা প্রস্তাব নিয়ে আসে আমার কাছে?
ভাবতে ও অবাক লাগে আমার।

হঠাৎ করে মনে হলো এবারও নিশ্চয় ওরকম কেউ এসেছে।নিশ্চয় আমার কলেজে জয়েন করার খবর শুনে এসেছে আবার।

বিরক্ত হয়ে আমার রুমের দরজায় আসতেই আমি চমকে উঠি।অভ্র বসে আছে!
কালো শার্ট,নীল জিন্স পরে বসে আছে অভ্র।
আমার পায়ের শব্দ পেতেই নেহাল পিছন ফিরে তাকালো।
নেহাল কে দেখে আমার দুচোখ ভরে জল এলো।এক মুহুর্তে সেই জল দুচোখ ঝাপসা করে দিয়ে,চোখে স্থির না হয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

কিন্তু মাটিতে পরার আগেই নেহাল দুহাত দিয়ে আমার গাল মুছে দিলো।নেহাল কিছু বুঝে উঠার আগেই আমক ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম আমি নেহালকে পেয়ে।নেহাল আমাকে সান্ত্বনা দিলো না।কান্না করে হালকা হবার সুযোগ দিলো।
৫ মিনিট পরে নেহাল কথা বলে উঠলো।

“শান্ত হ দোস্ত,এভাবে ভেঙে পড়িস না।চোখের পানি তো তাদের অস্ত্র,যাদের কিছু করার নেই।আমাদের তো অনেক কিছু করার আছে।আমরা কেনো কাঁদবো।
আমরা ওদের ঠিক খুঁজে বের করবো।”

নেহালের কথা শুনে বুকে বল এলো আমার।নেহাল কে ছেড়ে দিয়ে আমার ডেস্কে গিয়ে বসলাম।নেহাল আগের জায়গায় বসলো।

তারপর সোজা কাজের কথায় চলে গেলো।

“তুই এখন পর্যন্ত কোনো ক্লু পেয়েছিস?”

এক মুহুর্ত ভাবনা চিন্তা করে আমি জবাব দিলাম,”ক্লু কিনা জানি না।তবু আমার মনে হচ্ছে ওটা একটা ক্লু হতে পারে।”

আগ্রহী হয়ে উঠে নেহাল আমার কথা শুনে।উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে,”কোন ক্লু?”

“অভ্র হত্যার আগ মুহুর্তে যখন আমার সাথে রুমে ছিলো,তখন ওর একটা কল এসেছে,জানিস তো,তোকে বলেছিলাম আমি।”

এক মুহুর্ত ও না ভেবে নেহাল জবাব দিলো,”হ্যাঁ,ওই যে ওপাশ থেকে একটা লোক বলে উঠেছিলো,সে অভ্র ভাইয়ে পুরোনো পেশেন্ট,নেটওয়ার্ক প্রব্লেমের জন্য কথা বুঝা যাচ্ছে না,অভ্র ভাই যাতে বাহিরে বের হয়ে কথা বলে।তার পরপরই অভ্র ভাই মেইন ডোর খুলে বাগানে বের হয়ে যায়?”

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম।”হ্যাঁ,ঠিকই বলেছিস তুই।এবার তুই ঠাণ্ডা মাথায় ভাব,যেখানে রুমে ফোর জি এভেইলএভেল,সেখানে ওপাশ থেকে এরকম কথা বলার মানে কি হতে পারে?
নিশ্চয় এটা একটা ট্রিকস ছিলো অভ্রকে ঘর থেকে বের করার।যাতে করে ওদের মধ্য থেকে কেউ ঘরে ঢুকে লুকিয়ে থাকতে পারে।আর আমিও অভ্র বের হওয়ার একটু সময় পরেই বাহিরের রুমে কারো শব্দ পাই।কিন্তু রাইফার বিড়াল ভেবে পাত্তা দিই নি।
এবার দুইয়ে দুইয়ে মিলিয়ে দেখ চার হয়ে যাবে।”

নেহালের মুখ একশো ওয়াটের বাল্বের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠে,লাফিয়ে উঠে নেহাল বলে,”দ্যাটস গ্রেট লতা,এবার আমাদের কাজ আরো সহজ হয়ে গেছে।
ওই ফোনটার লোকেশন বের করলেই খুব সহজেই আমরা খুনীদের খুঁজে বের করতে পারবো।”

আমি জবাব দিলাম না।

নিজের দুই ঠোঁটে তর্জনী আঙুল দিয়ে আলতো আঘাত করতে করতে নেহাল আবার আমাকে বললো,”ক্লাস শেষ করে ছুটি নে,আমি তোকে নিয়ে মামার সাথে দেখা করতে যাবো।”

নেহালের কথা শুনে আমি হেসে উঠলাম।নেহাল অভিমানির মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

নেহাল এখনো আগের মতোই পাগলা রয়ে গেছে ভেবে আমার হাসি পেতে লাগলো।সেই অনেক বছর আগেও যখন আমরা স্কুল,কলেজ,ভার্সিটি তে পড়তাম,নেহালকে আমি যখন যা বলতাম নেহাল তখনই তা করতে একপায়ে খাঁড়া থাকতো।
ঠিক তেমনি এখনো র‍য়ে গেছে ও।

হাসি থামিয়ে আমি বললাম,”তুই তো মনে হয় এখনো বাসায় ও যাস নি,আগে বাসায় যা,আঙ্কেল আন্টির সাথে মিট কর,এটা নিয়ে কাল ও যাওয়া যাবে।”

কিন্তু নেহাল গোঁ ধরে বসে রইলো।গজগজ করতে করতে বললো,”বাসায় যাওয়ার জন্য অনেক সময় আছে,কিন্তু আগে আমরা মামার সাথে গিয়ে কেসটা নিয়ে কথা বলবো।”

সেই আগের মতো জেদ ধরে রইলো নেহাল।অনেক কষ্টে বুঝিয়ে বাড়িতে পাঠালাম,তবে কথা দিতে হলো আমাকে,২টায় কলেজ ছুটির পর ও এসে আমার জন্য অপেক্ষা করবে কলেজের বাহিরে,তারপর ওর সাথে যেতে হবে,যত দ্রুত সম্ভব ও বাসায় এক নজর দেখা দিয়েই চলে আসবে।

নেহাল বের হয়ে যেতে আমি ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম অপলক।এই ছেলেটা কখনোই যেনো বড় হবে না।আজীবন ওকে আমি এরকম জেদি দেখে এসেছি।এখনো তাই আছে।

চলবে……???