Saturday, June 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1443



ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৪৩+৪৪

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪৩
#Arshi_Ayat

এখন দুপুর।মধু আর আইরিন রহমান রান্না করছেন রসুইঘরে।আর মিলি টিউশনি করাতে গেছে।মধুও প্রতিদিন দু’টো টিউশনি পড়ায় দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত।

আর এদিকে ইয়াদ ঘুরে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছে।অবশ্য কালরাত থেকে একফোঁটাও ঘুমায় নি তাই তো একটু আরামের ছোয়া পেতেই দুচোখ জুড়ে নেমে এলো ঘুম।

রান্না প্রায় হয়ে গেছে।তাই আইরিন রহমান মধুকে বললেন,’তুই আগে গিয়ে গোসল করে নে।তুই বের হলে আমি যাবো।আর দেখ তো ইয়াদ কি করে?’

‘আচ্ছা।’মধু মায়ের কথার উত্তরে সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে রসুইঘর থেকে ঘরে এলো।ঘরে এসে বিছানার ওপর চোখ যেতেই দেখলো ইয়াদ ঘুমাচ্ছে।
মধু সাবধানী পায়ে বিছানার সামনে এসে হাটু গেড়ে বসলো।নিজের আচল দিয়ে সস্নেহে ওর কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামটা মুছে দিয়ে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।তারপর একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলে জামা কাপড় নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
————-
মধু গোসল করে এসে দেখলো ইয়াদ এখনো ঘুমাচ্ছে।ভেজা চুল মুছতে মুছতে বিছানার সামনে এসে ইষৎ জোর গলায় ইয়াদকে ডাক দিলো,’এই যে শুনছেন?উঠুন।’

ইয়াদ একটু নড়েচড়ে উঠে আবার ঘুমিয়ে গেলো।মধুর মুখে অজান্তেই মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।ভেজা চুলে তোয়ালে পেচিয়ে মাথায় খোপা করে নিলো তারপর ইয়াদের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে মৃদুস্বরে বলল,’উঠুন না!’

বলা বাহুল্য মধুর কথা শেষ হতেই ইয়াদ আচমকা চোখ মেললো।আচমকা এমন হওয়ায় মধু লজ্জায় পড়ে গেলো।তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালো।বলল,’দুপুর হয়ে গেছে।হাত মুখ ধুয়ে আসুন।খাবার দিচ্ছি।’

‘আচ্ছা।তুমিও আসো।’

মধু মাথা নেড়ে রসুইঘরে চলে গেলো।আর ইয়াদ হাত মুখ ধুতে গেলো।হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখলো মধু মেঝে তে শীতলপাটি বিছিয়ে ভাত তরকারি সাজাচ্ছে।ইয়াদ পাটির একসাইডে সুন্দর করে বসে পড়লো।সবসময় চেয়ার টেবিলে খেলেও এভাবে খাওয়ারও অভ্যাস আছে ইয়াদের।মধু ইয়াদের পাশে বসে ওকে সবকিছু বেড়ে দিলো।কিন্তু নিজে নিলো না।ইয়াদ বিষয়টা লক্ষ করে বলল,’ডায়েটে আছো নাকি?’

‘না তো।’মধুর সরল জবাব।

‘তাহলে খাচ্ছো না কেনো?’

‘আমি পরে খাবো।আম্মুর সাথে।’

‘হ্যাঁ তো আন্টি,মিলি ওদের ও ডাকো।একসাথেই খাই।’

‘মিলি পড়াতে গেছে।আরো পরে ফিরবে।আর আম্মু গোসলে গেছে।’

‘তাহলে পরেই খাবার দিতে।আচ্ছা ঢেকে রাখো।পরে একসাথে খাবো সবাই।’

এটা বলে ইয়াদ উঠে যেতে নিলেই মধু বাঁধা দিলো।বলল,’আচ্ছা আমিও খাচ্ছি আপনার সাথে।আম্মু আর মিলি পরে খাবে।’

মধুর কথায় ইয়াদ আর উঠলো।অগত্যা মধুও নিজের জন্য খাবার বাড়লো।সত্যিকার অর্থে খেতে ইচ্ছে করছিলো না মধুর কিন্তু এখন ও না খেলেও ইয়াদও খাবে না তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেতে হবে।খাওয়া শেষ করে মধু সবকিছু ঘুছিয়ে রেখে ঘরে এসে বিছানায় বসলো।একদম ইয়াদের সামনাসামনি।ইয়াদ ওর মুখভঙ্গি দেখেই বুঝে ফেললো মহারাণী সিরিয়াস কিছু বলবেন।আর সেটা যে বিয়ের ব্যাপারে ওটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।ইয়াদ ভেতরে ভেতরে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো।

মধু কিছুক্ষণ চুপ থেকে।গম্ভীর কন্ঠে বলল,’ইয়াদ বাচ্চামি ভালো লাগে না।আপনি চলে যান।আপনি যেটা চাইছেন সেটা হওয়ার নয়।’

‘কেনো হওয়ার নয় এটা ১০০ শব্দে এক্সপ্লেইন করো।’

ইয়াদের গলা শুনেই বোঝা গেছে ও মোটেও সিরিয়াস নয়।মধু তীক্ষ্ণ ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,’আ’ম সিরিয়াস।’

‘আ’ম অলসো সিরিয়াস।তুমি বলতে থাকো।’

কোন লেভেলের সিরিয়াস এটা ইয়াদের কথা দ্বারা স্পষ্ট।এভাবে বলে লাভ হবে না খুব ভালো করে বুঝে গেলো মধু।তাই উঠে চলে যেতে নিলেই ইয়াদ ওর হাত ধরে ফেলল।বলল,’বসো না!’

মধু কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’হাত ছাড়ুন।’

‘ছাড়বো না তুমি বসো।’

মধু বসলো।ইয়াদ ওর একটু কাছে এসে বসলো।তারপর বলল,’এবার বলো।’

মধু বোঝানোর ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলো,’দেখুন বিয়ে এক দুই দিনের সম্পর্ক না।এটা সারাজীবনের সম্পর্ক।তাই এটাতে হেয়ালী চলে না।আমি আপনাকে ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু আমি চাই না আমাদের বিয়ে হোক।আমি চাই আপনি ভালো থাকুন।আপনার সুন্দর একটা সংসার হোক।কিউট কিউট বাচ্চা হোক।যাদের আপনি আদর করবেন।কিন্তু যদি আপনি আমাকে বিয়ে করেন তাহলে বাচ্চা হওয়া তো দূরে থাক আপনি শান্তিও পাবেন না।আমার গায়ে যে কলঙ্কের দাগ লেগেছে এটা নিয়ে অনেক কটুক্তি হজম করতে হবে।একটা সময় এটা নিয়ে আপনি বিরক্ত বোধ করবেন। আমাদের মাঝে ভালোবাসাটা আর বিদ্যমান থাকবে না।তাই প্লিজ আমার শেষ অনুরোধ টা রাখুন।’শেষ কথাটা মধু মরিয়া হয়ে বলল।

ইয়াদ এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলো তারপর বলল,’এতক্ষণ তুমি বলেছ আমি শুনেছি এখন আমি বলবো তুমি শুনবে আর এর মাঝে বামহাত ঢুকাবে না।আমার বলা শেষ হলে তোমার যা বলার বলবে।’

মধু ঘাড় নেড়ে সায় দিলো।এবার ইয়াদ বলতে শুরু করলো,’একটা কথা শুনেছো হয়তো প্রবাদ বাক্য তবুও আরেকবার শোনো ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে,তব ঘৃণা তারে তৃণসম দহে।’এটার মানে হলো তুমি যদি অন্যায়কে প্রশ্রয় দাও তাহলে মানুষও তোমাকে ঘৃণা করবে।চুপচাপ সয়ে না গিয়ে প্রতিবাদ করো!কিছু না হোক নিজের কাছে অপরাধী হবে না।সারাজীবন মানুষের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকতে চাও?
তারপর আসো তোমার সাথে যা হয়েছে তা নিয়ে।এটা একটা এক্সিডেন্ট।ধরো,তোমার সাথে এমন কিছু ঘটলো না কিন্তু আমার সাথে ঘটলো।আমি এক্সিডেন্ট করলাম এবং সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলাম।সবসময় আমাকে হুইল চেয়ারে কাটাতে হবে।এখন বলো তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে?

মধু ঘাড় নেড়ে না বলল।ইয়াদ মৃদু হেসে বলল,’তাহলে আমি কেনো যাবো?তারপর আসে বাচ্চা!এমন অনেক পরিবার আছে যাদের বাচ্চা হয় না।তারা আশ্রম থেকে বাচ্চা এডপ্ট করে।কয়টা বাচ্চা লাগবে তোমার?তিনটা?চারটা?ছয়টা?
তাহলে বাঁধা কোথায়?ও হ্যাঁ বাধা হলো মানুষের কথায়।শোনো আল্লাহ ওদের মুখ দিয়েছে বলার জন্য,আর আমাদের মুখ দিয়েছে উচিত জবাব দেওয়ার জন্য।এই তো সব সমস্যার সমাধান দিয়ে দিলাম।এবার বলো আর কোনো সমস্যা আছে তোমার?’

‘কিন্তু আপনার বাবা মা তো মানবে না।’

‘না মানলে মানাবো।সিম্পল!’

‘যদি তাও না মানে?’

‘এই তুমি শুধু নেগেটিভ ভাবো কেনো?পজিটিভ ভাবো!’ইয়াদ ধমকে বলল।

ইয়াদের ধমক খেয়ে মধু চুপ।এরইমধ্যে রাসেলও চলে এলো।হাতে তিনটা শপিং ব্যাগ।ঘরে এসে ব্যাগগুলো টেবিলের ওপর রেখে চেয়ার টেনে বসলো।তারপর মধুকে বলল,’ভাবী একগ্লাস পানি দিয়েন।’

মধু উঠে গেলো পানি আনতে।মধু যাওয়ার পরই রাসলে বলল,’কি কথা বলছিলি রে তোরা?’

‘ওর ক্লাস নিয়েছি এতক্ষণ।’

‘মানে?’

‘মানে সে বিভিন্ন রকম বাহানা দিয়ে বিয়ে করতে চাইছে না।তো সেটা নিয়েই দীর্ঘ বয়ান দিলাম।’

‘তো এখন মতিগতি কেমন মনে হয়?’

‘বুঝতে পারছি না।দেখা যাক।আচ্ছা যা বলেছিলাম করেছিস?’

‘হ্যাঁ কাজিকে ঠিকানা দিয়ে এসেছি।’

‘হ্যাঁ।দিয়ে আসলাম।

‘আচ্ছা শোন আরেকটা কাজ করতে হবে।’

‘কি কাজ?’

‘বাজারে গিয়ে ৮/৯ কেজি মিষ্টি নিয়ে আয়।’
ওদের কথার মধ্যেই মধু চলে এলো পানি নিয়ে।রাসেল পানি পান করে আবার বের হলো।
—————
সন্ধ্যা হতে বেশি দেরি নেই।ইয়াদ মধুকে ডেকে বলল,’যাও রেডি হয়ে নাও।একটু পরই কাজি চলে আসবে।’
মধু বিনাবাক্যে শাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো।এখন এছাড়া উপায়ও নেই।

মাগরিবের নামাজের পর কাজি এলো।আইরিন রহমান আর মিলি মধুকে রেডি করে নিয়ে আসলো।ইয়াদ আগে থেকেই রেডি ছিলো।তারপর বিয়ে পড়ানো শুরু হলো।প্রথমে কাজি মধুকে কবুল বলতে বলল।কিন্তু মধু বলল না।চুপচাপ রইলো।পাশ থেকে ইয়াদ ফিসফিস করে বলল,’তাড়াতাড়ি কবুল বলো মধু।’

মধু তারপরও বলল না।সবাই বলছে ওকে কবুল বলতে কিন্তু তবুও বলছে না।এবার ইয়াদ রেগে উঠে যেতে নিলেই মধু ওর হাত ধরে ফেললো।ধীর গলায় বলল,’কবুল,কবুল,কবুল।’

এরপর ইয়াদ কবুল বলার পর সবাই মিলে আলহামদুলিল্লাহ পড়লো।

বিয়েটা হয়েই গেলো।ইয়াদ কাজিকে সম্মানী দিয়ে বিদায় করলো। আইরিন রহমান আর মিলি মিলে আশেপাশের ঘরে মিষ্টি দিতে গেলো।রাসেল এক উছিলায় বাইরে চলে গেলো।ঘরে শুধু ইয়াদ আর মধুই আছে।মধু খাটের একপাশে চুপটি করে বসে ছিলো।ইয়াদও গিয়ে ওর পাশে বসলো।ওয়ালেট থেকে সেই রিং টা বের করলো যেটা মধু ফিরিয়ে দিয়েছিলো।রিংটা মধুর বা হাতের অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিয়ে বলল,’আর কখনো এটা খোলার সাহস করবে না।’
এটা বলেই জড়িয়ে ধরলো।মধুও ভালো মেয়ের মতো ইয়াদের বুকে মাথা রাখলো।
————
ইয়াদ ঘুমিয়ে গেছে।শুয়েছিলো একসাথেই কিন্তু ইয়াদ আগে ঘুমিয়ে গেছে এদিকে মধুর চোখে একফোঁটাও ঘুম নেই।এটা আর এমন কি!প্রতিটা রাতই এমন নির্ঘুমে কাটে মধুর।

খুব সাবধানে ইয়াদের পাশ থেকে উঠে পড়লো মধু।শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না।ঘুম না আসলে শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না মধুর।আস্তে আস্তে হেটে গিয়ে দরজা খুলে বাইরে চলে এলো মধু।বাড়ির পেছনে একটা মাটির রাস্তা আছে।কখনো মন খারাপ হলে মধু এই রাস্তা ধরে হাটে।আজও ধীর পায়ে হাটা শুরু করলো।চারপাশে চাদের আলো থৈথৈ করছে।গাছের পাতায় চিরুনির মতো বাতাস বয়ে যাচ্ছে।ভরা জ্যোৎস্নায় হাটলে কেমন ঘোর লাগে।হাঁটতে হাঁটতে মধু ঘাটে চলে এলো।এই ঘাট’টা বাঁধাই করা।পা চুবিয়ে বসা যায়।মধু ঘাট কিনারায় বসে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত চুবিয়ে বসলো।হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে পাশে তাকাতেই দেখলো ইয়াদ বসে আছে।মধু বিষ্মিত হয়ে বলল,’আপনি!আপনি না ঘুমিয়ে ছিলেন।’

‘হ্যাঁ কিন্তু বউ ছাড়া বেশিক্ষণ ঘুমানো যায় না।’

‘আপনি না আসলেই পারতেন।’

‘না আসলে যদি আবার পালিয়ে যাও!’

‘পালাতে পারলাম কোথায়!নিজের সাথে তো বেঁধেই নিলেন।’

‘কি করবো বলো তোমাকে ছাড়া তো আমার চলেই না।’

মধু কিছু বলল না।হাসলো শুধু।কিছুক্ষণ দুজনেই নিরব রইলো।তারপর নিরবতা ভেঙে মধুই বলল,’আচ্ছা আমি যদি মরে যাই তাহলে আপনি কি করবেন?’

‘কি আর করবো।এখন যা করছি তাই করবো।’

‘আর বিয়ে করবেন না?’

‘এক বউ থাকতে আবার কেনো বিয়ে করবো?’

‘আরে আমি মারা যাওয়ার পরের কথা বলেছি।’

‘আমিও তো তাই বললাম।তুমি মরে গেলেও আমারই থাকবে।তাই তোমাকে রেখে আরেকজনকে কিভাবে বিয়ে করবো আমি?’

ইয়াদের কথায় মধু হাসলো।তৃপ্তির হাসি!আনন্দের হাসি!মদু ইয়াদের কাঁধে মাথা রেখে চাদের দিকে তাকালো।চাঁদ’টা সুন্দর লাগছে!ভিষণ সুন্দর!কি জানি হয়তো প্রিয় মানুষ সাথে থাকলে সবই সুন্দর লাগে।

চলবে….

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪৪
#Arshi_Ayat

আশেপাশে মৃদু বাতাস,চারপাশে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে।গভীর রাতে একজোড়া কপত কপোত-কপোতী জোৎস্না বিলাস করছে।কারো মুখেই কথা নেই।দুজনেই সময়টা উপভোগ করছে।দুজনেই চাইছে সময়টা এখানেই থমকে যাক।কিন্তু সময় ও নদীর স্রোত তো কাহারো জন্য অপেক্ষা করে না!

মধু ইয়াদের কাঁধে মাথা রেখে পা দিয়ে পানি নাড়ছে আর গুনগুন করছে।ইয়াদ মধুর গুনগুন শুনে বলল,’একা একা গুনগুন না করে আমাকেও একটু শোনাও।’

মন ভালো থাকায় মধু অনুরোধটা রাখলো।গুনগুন করে যে গান টা গাইছিলো সেটাই গাইতে শুরু করলো।আগে যখনই মধু ইয়াদকে মিস করতো তখনই এটা শুনতো।

“”একলা হলেই বুঝতে পারি ভালোবাসি কত
আমি একলা হলেই বুঝতে পারি ভালোবাসি কত
একটা তুমি আছো বলে ভালো আছি এতো।।
এই জীবনে কেউতো আর হয়না তোমার মতো
একটা তুমি আছো বলে ভালো আছি এতো।।

দূরে গেলে তোমার প্রতি মায়া বাড়ে আরো
কেমন করে এমন প্রেমে বাধতে আমায় পারো।।
দিনগুলো সব তোমার নামে হোক না আমার গত
একটা তুমি আছো বলে ভালো আছি এতো।।

ইয়াদ মন দিয়ে গান শুনছিলো।আসলেই তো তার জীবনে একটা আছে বলেই তো সে এতো ভালো আছে।ইয়াদ মুগ্ধ হয়ে বলল,’এতো ভালো গাইতে পারো জানা ছিলো না।’

নিজের প্রশংসা শুনে মধু কিছু বলল না।শুধু হাসলো।তবে ইয়াদও ওর বলার অপেক্ষায় রইলো না।নিজেই আবার বলল,’আচ্ছা মধু বিয়ে তো হয়ে গেলো এখন হানিমুনটা বাকি আছে।কোথায় যাওয়া যায় বলো তো?’

‘কোথাও যাওয়া লাগবে না।’

‘তাহলে কি তুমি রুমেই হানিমুন সেরে ফেলতে চাচ্ছো?’

মধু কপট রেগে বলল,’আপনি এতো অসভ্য কবে থেকে হলেন বলেন তো?’

‘ও আচ্ছা অসভ্য হয়ে গেছি!তুমি না বললে জানতামই না।আর বিয়ের পর ছেলেরা একটু আট্টু অসভ্য হয় ই।এটা কোনো ব্যাপার না।আচ্ছা বলো না কোথায় যাওয়া যায়?’

‘এমন ভাবে জিগ্যেস করছেন মনে হচ্ছে এর আগেও আমি ৩/৪ বার হানিমুনে গিয়েছি।আপনার যেমন আইডিয়া নেই আমারও তেমন আইডিয়া নেই।’

‘হ্যাঁ তাও ঠিক।আচ্ছা গুগল করে দেখবো কোন জায়গাটা সুন্দর,নিরিবিলি একদম মনের মতো।’

‘আচ্ছা দেইখেন।এখন বাসায় চলেন।ঘুমাবেন না?’

‘তুমি যাবে না?’

‘যাবো তো।’

‘তবে চলো।’

ইয়াদ আর মধু যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো এমন সময়ে শাড়ির সাথে পা বেঁধে পানিতে পড়ে যেতে নিলেই ইয়াদ দ্রুত ধরে ফেললো।আর এদিকে মধু তো ভয়ে চোখমুখ খিচিয়ে ফেলেছিলো।তারপর আস্তে আস্তে চোখ খুলতেই দেখলো ইয়াদ ওর হাত ধরে রেখেছে।এটা দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলো কিন্তু ইয়াদ ওকে ওভাবেই ধরে রাখলো।উঠাচ্ছে না!

মধু ভ্রু কুঁচকে বলল,’কি হলো উঠান আমাকে।’

মধুর কথায় ইয়াদ হুশ আসলো।আসলে এইভাবে থাকায় মধুর ওপর চাদের আলোটা সরাসরি পড়ছিলো।চাঁদের আলোয় মধুর মুখটা দেখে ইয়াদ থমকে গিয়েছিলো!তখন একটা প্রশ্নই মনে এসেছিলো সেটা হলো মেয়েটা এতো মায়াবী কেনো?কেনো?আরেকটু কম মায়াবী হলে হতো না?

ঘোর ভাঙতেই ইয়াদ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’উঠাবো একটা শর্তে।’

‘কি শর্ত?’ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো মধু।

‘বলো ❝আমি তোমাকে ভালোবাসি ইয়াদ❞।

‘এটা কেমন পাগলামি ইয়াদ?’

‘আমি যেটা বলতে বলছি সেটা বলো।’

মধুর বেশ ভালো ভাবেই জানা আছে ইয়াদের স্বভাব।এখন না বললে ঠাশ করে পানিতে ফেলে দেবে।তার চেয়ে ভালো মাঝরাতেপানিতে হাবুডুবু না খাওয়ার চেয়ে বলে দেওয়া ভালো।

‘আমি আপনাকে ভালোবাসি ইয়াদ।’

‘না হয় নি।বলো আমি তোমাকে ভালোবাসি নট আপনাকে।’

‘ও আচ্ছা।ঠিকাছে বলছি।আমি তোমাকে ভালোবাসি ইয়াদ।’

ইয়াদ মুচকি হেসে বলল,’এবার বলো আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবো না।প্রমিস।’

‘আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবো না।প্রমিস।’

শর্ত পূরণ হওয়ায় ইয়াদ একটানে মধুকে উঠিয়ে আনলো।মধু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ হাঁপিয়ে নিলো।তারপর মুখ বাঁকা করে বলল,’ইশ!কতো শেয়ানা।সব সময় আমার মুখ থেকে শোনে।নিজে একবারও বলে নি।’
ইয়াদ হাসলো।তারপর বলল,’বলবো।সময় হলেই বলে দেবো।’

‘হ্যাঁ।আমি মরার পর।’

এতক্ষণ মজা করলেও এবার ইয়াদ রেগে গেলো।কোনো কথা না বলে হনহনিয়ে হাটতে লাগলো।এদিকে মধু কিছুই বুঝলো না।হঠাৎ এভাবে রাগার কারণ কি?পেছন থেকে শাড়িটা একটু উঁচিয়ে ধরে প্রায় দৌড়ে এসে ইয়াদের পাশাপাশি আসলো।ওর মতিগতি বোঝার জন্য বলল,’রাগ করলে?’

ইয়াদ কোনো কথাই বলল না।চুপচাপ হাটতে লাগলো।এদিকে মধু ভাবছে কি এমন কথা বলে ফেললাম যে রাগ করলো!

ঘরে এসে বিছানার একপাশে চুপটি করে শুয়ে পড়লো ইয়াদ।মধুও ওর পাশেই শুয়েছে কিন্তু ইয়াদকে ডাকতে সাহস পাচ্ছে না।পুরো রেগে বোম হয়ে আছে।এরপর ফেটে পড়লে শেষ!কিন্তু তবুও স্বামীর রাগ ভাঙানো তো উচিত।তাই মধু পেছন থেকে ইয়াদকে জড়িয়ে ধরলো।ইয়াদের কোনো রেসপন্স নেই।মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে গেছে।কিন্তু না ঘুমায় নি।খিচ মেরে শুয়ে আছে।মধু কাতর স্বরে বলল,’কথা বলবে না আমার সাথে?বলো না,বলো না,বলো না,বলো না,বলো না!….’

এভাবে ননস্টপ চলছেই।ইয়াদ বিরক্ত হয়ে বলল,’হয়েছে,হয়েছে এবার থামো।’

মধু থামলো।ইয়াদ ওর দিকে ঘুরলো।মধুকে বুকের মধ্যে টেনে ওর চুলে হাত চালাতে লাগলো।এক মিনিট চুপ থেকে বলল,’জানো পৃথিবীতে কেউই চায় না তার ভালোবাসার মানুষ তার আগে মরে যাক।সবার ভেতরে এই ভয়টা থাকে।তারা ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু তো দূরের কথা নাম শুনলেও ভয় পায়!আতকে ওঠে হারানোর ভয়ে!তবুও আমরা যেহেতু মানুষ আমাদের যেহেতু জন্ম আছে সেহেতু মৃত্যুও আছে।এই অপ্রিয় সত্যিটা আমাদের মানতে হবে।কিন্তু তার মানে এই না যে আমরা কথায় কথায় মরার কথায় বলবো।যতোদিন বাঁচবো একসাথে ভালোবেসে বাঁচবো।তাই আর কখনো মরার কথা বলবে না।বললে….’

এর পরের কথাটা ইয়াদ আর বলতে পারলো না।তার আগেই মধু ওর মুখ হাতে দিয়ে দিলো।তারপর নিজেই বলল,’বলবো না আর।’

ইয়াদ মধুর হাতে একটা আলতো চুমগ খেলো।তারপর এটা সেটা আলাপ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো দুজনেই।
—————-
ঘুমটা মধুর আগে ইয়াদের ভাঙলো।চোখমেলে ঘুমন্ত মধুকে দেখে আর জাগাতে ইচ্ছে হলো না।সাবধানে উঠে বাইরে এলো।এখনো আকাশ তেমন ফর্সা হয় নি।ইয়াদ কলপাড়ে গিয়ে হাতমুখ ধূয়ে ফ্রেশ হলো।

আজই,একটু পরই ওরা ঢাকায় ফিরবে।আজ শুধু মধুকে নিয়ে যাবে। এক/দুইদিন পর এসে ওর মা আর বোনকে নিয়ে যাবে।

ইয়াদ ফ্রেশ হয়ে ঘরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে নিজের ফোন বের করলো কিন্তু ওপেন করতে গিয়ে দেখলো ফোন বন্ধ।চার্জ নেই।অবশ্য থাকবেই বা কিভাবে।আসার পর থেকে তো একফোঁটাও চার্জ দেওয়া হয় নি।ফোনটাকে মধুর চার্জারে চার্জে রেখে ইয়াদ বাইরে বের হলো।ওইপাশের একটা ঘরে গিয়ে নক করলো।এই ঘরেই রাতে রাসেল শুয়েছিলো।এটা মধুর বড় চাচাদের ঘর।কালকে রাতে মধুর মা আর মিলি শুয়েছিলো মধুর ছোটো চাচাদের ঘরে রাসেলকে দিয়েছিলো বড় চাচাদের ঘরে শুতে।আর মধু ইয়াদ ওদের ঘরেই শুয়েছে।

রাসেক চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুললো।তারপর ইয়া বড়ো একটা হাই তুলে বলল,’কি রে এতো তাড়াতাড়ি উঠে পড়লি!নাকি রাতে ঘুমাস’ই নি।’

‘ধূর শালা চুপ কর।যা হাত মুখ ধুয়ে নে।আমরা একটু পরই বের হবো।’

‘ভাবী উঠেছে?’

‘না।ঘুমাচ্ছে।একটু পর ডাকবো।’

রাসেল ফ্রেশ হলো।তারপর দুই বন্ধু মিলে কাছাকাছি একটু ঘুরে এলো।

ঘন্টাখানেক এর মধ্যে সবাই উঠে গেছে।ইয়াদ আর রাসেলও ফিরেছে।ইয়াদ ফিরেই আইরিন রহমানকে বলেছে যে ওরা আজ ফিরবে।আইরিন রহমান অবশ্য আরো দুই/একদিন থাকার জন্য বলেছিলেন কিন্তু ইয়াদ রাজি হলো না।এমনিতে কাল ভার্সিটিতে যায় নি।প্রিন্সিপালকেও জানায় নি।আজকে হাজিরা দিতেই হবে।আবার এদিকে বাসায় ফিরে সবকিছু ম্যানেজও করতে হবে।

সকাল পৌনে সাতটার দিকে মধু,ইয়াদ আর রাসেল বেরিয়ে পড়ে।দেরি হবার আশংকায় খুব দ্রুতই বেরিয়েছে ওরা।তাই নাস্তাও খাওয়া হয় নি।তবে সমস্যা নেই অন দ্য ওয়ে খেয়ে নেওয়া যাবে।

যাওয়ার সময় মধু আর আইরিন রহমান অনেক কেঁদেছিলো পরে ইয়াদ বুঝিয়ে ওকে গাড়িতে তুলেছিলো।স্টিয়ারিং এ ইয়াদ ওর পাশে মধু আর পেছনে রাসেল বসেছে।

ঢাকা পৌঁছাতে ওদের সাড়ে নয়টা বেজেছে।ইয়াদ রাসেলকে ওর বাড়ির সামনে ড্রপ করে মধুকে নিয়ে সোজা ভার্সিটিতে চলে এলো।আজ আর ক্লাস করাবে না।হাজিরা দিয়ে একসপ্তাহের ছুটি নিয়ে নিবে।গাড়ি থেকে নেমে মধু বলল,’আমার ভার্সিটির সামনে এলপ যে।’

‘ম্যাম আপনার জামাই এখনকার লেকচারার।এখন থেকে আমি আপনার টিচার প্লাস হাজবেন্ড।’এটা বলেই ইয়াদ একটা ভাব নিলো।

তারপর দুজনেই ভার্সিটিতে ঢুকলো।ইয়াদ বলল,’তুমি একটু ওয়েট করো।আমি হাজিরা দিয়েই আসছি।’

‘আচ্ছা।’
ইয়াদ চলে গেলো।আর মধু নিজের ক্লাসের সামনে এসে দাড়ালো।ভেতর থেকে আরিয়া,মিতু,লাবনী,সায়রা ওকে দেখতে পেয়ে ক্লাস রেখেই ছুটে চলে এলো।আরিয়াতো আগে থেকেই ছিলো আর ওরা ভার্সিটিতে ওঠার পর থেকেই খুব ভালো বন্ধু হয়েছে।প্রথমে লাবণী বলল,’কোথায় হারিয়েছিলি রে?’
লাবণীর পর মিতু বলল,’বিয়ে টিয়ে করে ফেলেছিস নাকি?’
তারপর সায়রা বলল,’আরে এগুলো ছাড়।শোন তুই যাওয়ার পর নতুন একজন লেকচারার এসেছে ভার্সিটিতে।আমি তো দেখেই ক্রাশ খেয়েছি।ওনার নামটাও ওনার মতো সুন্দর ‘আবরাহাম খান ইয়াদ’।আমি সব খবর নিয়েছি উনি আনম্যারিড।তার মানে আমার চান্স আছে।’এটা বলেই সায়রা খুশীতে গদগদ হয়ে গেলো।এদিকে মধু ওর খুশী দেখে মিটিমিটি হাসছে।কিন্তু আরিয়া আসার পর একটা কথাও বলে নি।তাই মধুও প্রথমে বলল,’কি রে কথা বলবি না?’

‘মিথ্যুকের সাথে কিসের কথা।কোনো কথা নেই আমার তোর সাথে।’

‘তাহলে আমি এখানে আসায় তুই ছুটে এসেছিস কেনো?’

‘আ..আমি আসি নি।ওরা জোর করেছিলো।তাই এসেছি।’আরিয়া আমতা আমতা করে বলল।কিন্তু সত্যি তো এটাই ওরা কেউই মধুকে দেখে নি।সবার আগে আরিয়া ই দেখেছিলো আর ছুটে ক্লাস থেকে বেরিয়েছিলো।তারপর ওরাও এসেছিলো।মধু আরিয়া সহ সবাইকে অবাক করে দিয়ে আরিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।কাঁদতে কাঁদতে বলল,’সরি,রে।মাফ করে দে।আর কখনো এমন করবো না।’

আরিয়াও কাঁদছে।কিছুক্ষণ কাঁদাকাটার পর দুই বান্ধবী মান অভিমান শেষ হলো।এদিকে সায়রা হঠাৎ চাপা উত্তেজনায় চিল্লিয়ে বলল,’দেখ,দেখ আমার ক্রাশ বয় আসছে।’

সবাই তাকিয়ে দেখলো।ইয়াদ আসছে।ইয়াদ ওদের সামনে এসে দাড়ালো।তারপর আরিয়াকে দেখে বলল,’হেই,আরিয়া কেমন আছো?’

‘ভালো।আপনি?’

ইয়াদ একবার মধুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,’এতোদিন ভালো ছিলাম না।এই দুইদিন ধরে খুব ভালো আছি।’

ইয়াদের কথায় আরিয়া আর মধু হাসলো।কিন্তু বাকি তিনজন কিছুই বুঝলো না।সায়রাও বেশ কনফিউজড!

আরিয়ার সাথে দুই/একটা কথা বলে ইয়াদ মধুকে উদ্দেশ্য করে বলল,’চলো।এবার বের হই।’

‘হুম চলো।’

তারপর দুজনই গেটের দিকে এগিয়ে গেলো।এদিকে সায়রা বুঝতে না পেরে বলল,’তোর কিছু বুঝলি?’

আরিয়া বাদে বাকি দুইজন মাথা নাড়ালো।এদিকে আরিয়া ওদের কান্ড দেখে হাসতে হাসতে বলল,’আরে এখবো বুঝিস নি?ওরা কাপল।আর সায়রা তোর ক্রাশ বয় আরো চারবছর আগে থেকেই বুকিং।এই তো কালকে বোধহয় দুজনে বিয়ে করেছে।’

সায়রা অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,’ইশ!সব হ্যান্ডসাম ছেলেদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।আমার কি হবে?আল্লাহ আমার জন্য একজনকে বাঁচিয়ে রেখো প্লিজ!’

সায়রার কথায় বাকি তিনজন হাসতে হাসতে শেষ!

চলবে…

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৪১+৪২

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪১
#Arshi_Ayat

‘তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়
তোমার কথার শব্দ দূষণ
তোমার গলার স্বর
আমার দরজায় খিল দিয়েছি
আমার দারুণ জ্বর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর’

‘প্রাক্তন’ ছবির এই গানটা মধু বারান্দার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে শুনছে।অবশ্য শুনছে বললে ভুল হবে।ওটা নিজের মতো বাজছে কিন্তু মধুর কানে এর কথা,সুর,তাল কিছুই ঢুকছে না।অবশ্য ঢুকবেই বা কিভাবে যার জীবনের সুর,তালই ঠিক নেই তার আবার গান!

রাত যতো বাড়ে,দুঃখ ততই গভীর হয়।রাতের নিস্তব্ধতা মনে করিয়ে দেয় সেই ভয়াল রাতের কথা।চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে নিজের সর্বনাশের দৃশ্য!দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না মধু!
——————-
ছেলেরা নাকি সহজে কাঁদতে পারে না।অনেক ধৈর্য তাদের কিন্তু আজ বোধহয় সে ধৈর্যও ভেঙে গেলো।মধু ফোন কাটার পর ইয়াদের আর্তনাদে পুরো রেডিও স্টেশন কেঁপে উঠে। অভিসহ অফিসের অন্যান্য সদস্য মিলে ইয়াদকে স্বান্তনা দিচ্ছে কিন্তু কোনো স্বান্তনার বাণী ইয়াদের কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না।মন বলছে এখনি মধুর কাছে ছুটে যেতে।আজ মস্তিষ্কও মনের বিরুদ্ধে কথা বলছে না।শরীরের প্রত্যেকটা ইন্দ্রিয় বলছে মধুকে চাই,চাই মানে চাই।ইয়াদ চোখ মুছে অভির থেকে মধুর নাম্বারটা কালেক্ট করলো।তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়লো রেডিও অফিস থেকে।বাসার দিকে যেতে যেতে রাসেল কে ফোন দিলো।রাসেল ওর হবু বউয়ের সাথে কথা বলে মাত্রই শুয়েছিলো তখনই ইয়াদের কল আসে।রাসেল ঘড়ির দিকে তাকালো।রাত ১২ টা বাজে।তারপর ফোন ধরে বলল,’হ্যাঁ,বল।’

‘ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া যাবো।বের….’ ইয়াদের পুরো কথা শেষ করা লাগে নি এর আগেই রাসেল উত্তর দিলো,’বাসায় চলে আয়।আমি নামছি।ওখান থেকে রওনা দেবো।’

‘আচ্ছা।’
রাসেল ফোন রেখে ওয়াশরুমে গেলো শাওয়ার নিতে।দশমিনিটে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে একটা শার্ট আর একটা জিন্স নিয়ে নিলো।রাসেল ট্রাভেল করতে পছন্দ করে।মানে ওকে ট্রাভেলের জন্য চব্বিশ ঘন্টা পাওয়া যাবে আর আরেক হিসেবে ইয়াদ ওর বেষ্ট ফ্রেন্ড আর বেষ্ট ফ্রেন্ড মানে ভাইয়ের থেকে কম না।আর ভাইয়ের জন্য তো জানও কোরবান শুধু গার্লফ্রেন্ড ছাড়া!

ইয়াদ বাসায় পোঁছে দেখলো ওর মা বসে আছে সোফায়।ইয়াদ দেখেও না দেখার ভান করে ওপরে চলে যেতে নিলে ওর মা ডেকে বলল,’ইয়াদ খেতে আয়।’

‘ক্ষিধে নেই।’

‘মানে কি ইয়াদ!খাওয়া দাওয়ার একদম ছিঁড়ি নেই।আজকে সকালের পর আর খেয়েছিস কিছু?দিনের পর দিন নিজেকে কষ্ট দিয়ে কি মজা পাস।এদিকে তুই নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখ যার জন্য নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস সে তোকে ভাবেও না।মনে হয় এতোদিন বিয়ে করে সুখেই আছে।’

এবার আর ইয়াদ মুখ না খুলে থাকতে পারলো না।মায়ের মুখোমুখি এসে দাড়ালো বলল,’না মা বিসর্জন দিয়েছে ও বিসর্জন দিয়েছে নিজের সুখ তোমার ছেলেকে সুখে রাখতে।কিন্তু ও এটাই জানে না আমার জীবনের সুখের অপর নাম মধু।’

ইয়াদের গলার উচ্চ আওয়াজে ইফাজ,ইরিন,ইয়াফ খান সবাই রুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন।নিহা ঘুমিয়ে পড়েছে তাই বোধহয় শুনতে পায় নি।ইফাজ এসে ইয়াদের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,’কি হয়েছে রে?’

ইয়াদ ছলছল চোখে বলল,’ভাইয়া আমি মধুকে খুজে পেয়েছি।ওকে আনতে যাচ্ছি।’

ইফাজ বিষ্মিত হলো তবে খুশিও হলো।এতোদিন কম চেষ্টা করে নি মধুকে খোঁজার কিন্তু পাচ্ছিলো না।ইফাজ ইয়াদের কাঁধে ভরসার হাত রেখে বলল,’যা নিয়ে আয় ওকে।’

সাইদা খান কিছু বলতে নেওয়ার আগেই ইফাজ আবার বলল,’আম্মু,আব্বু এখন কিছু বলো না।ওরা আসুক তারপর শুনবো।’

ইয়াফ খান তবুও বললেন,’কিন্তু ওর তো এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে।আর আমি ওদের কথাও দিয়ে ফেলেছি।’

ইয়াদ কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু কষ্ট করে ওকে কিছু বলতে হয় নি ইফাজ ই বলল,’বাবা প্লিজ দয়া করে এসব কথা রাখো।জোর করে কিচ্ছু হয় না।আজকে তুমি জোর করে ইয়াদকে বিয়ে দিবে কিন্তু এরজন্য ইয়াদ যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলে তার জন্য কিন্তু তুমি দায়ী থাকবে আর যার সাথে বিয়ে দিবে ওই মেয়েটাও তো জানে না ইয়াদের জীবনেও কেউ আছে।শুধু শুধু মেয়েটাকে কেনো ঠকাচ্ছ তুমি?যাক বাদ দাও।’

ইফাজের কথার পর সাইদা খান আর ইয়াফ খান কেউই কিছু বললেন না।ইয়াদ ইফাজের গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।ইয়াদের সাথে যাওয়ার একটা তীব্র ইচ্ছা ইফাজের মনে জেগেছিলো কিন্তু নিহাকে এ অবস্থায় রেখে যাওয়া ঠিক হবে না যতোই হোক নিহা ওর স্ত্রী আর ওর বাচ্চার মা।একটু হলেও ওর প্রতি মায়া এসেছে ইফাজের এটা মানতেই হবে কিন্তু মন তো এখনো তাকেই চায়।কিন্তু সবসময় মানুষ যা চায় তা পায় না,আর যা চায় না তা ভুল করে পেয়ে যায়।

ইয়াদ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।রাসেলের বাসার সামনে গিয়ে ওকে পিক করবে তার পর ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়ার দিকে রওনা হবে।আর মধু লোকেশন ট্র্যাক করার জন্য নিখিল হেল্প করবে।ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া পৌঁছানোর পর ইয়াদ নিখিলকে কল দিয়ে মধুর নাম্বারটা দিলেই হবে।

গাড়িতে উঠে রাসেল একটু পানি খেয়ে বোতলটা পিছনে রেখে বলল,’হঠাৎ এতো রাতে ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া কেনো যাবি?’

ইয়াদ গাড়িয়া স্টিয়ারিং এ হাত রেখে বলল,’মধু ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া আছে।’

রাসেল একটু অবাক হয়ে বলল,’ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া গেছে কেনো মধু?’

ইয়াদ বলল,’বাংলা রেডিওর ইউটিউব চ্যানেলে গিয়ে একটু আগের একটা লাইভ কল রেকর্ড শোন।সব বুঝতে পারবি।’

‘এতো কষ্ট করার কি দরকার তুই বল।’

‘আমি বলতে পারবো না।’ইয়াদ থমথমে গলায় বলল।

ইয়াদকে আর না ঘেটে রাসেল ইয়াদের কথা মতো কল রেকর্ডটা শুনতে শুরু করলো।পুরোটা শুনে দীর্ঘক্ষণ চুপ ছিলো রাসেল।এক পর্যায়ে মুখ খুলেই ফেললো।বলল,’ভাই,কিভাবে মেয়েটা এতো কষ্ট সহ্য করলো বল তো!আমার তো শুনেই আমার হাত পা কাঁপছে।’

ইয়াদ কিছু বলল না।বাম হাত দিয়ে চোখ মুছলো।তারপর গাড়িটা সাইড ভেজা গলায় বলল,’তুই ড্রাইভ কর।আমি করলে এক্সিডেন্ট হতে পারে।আমি চাই না আর কিছু হোক।’

রাসেল ইয়াদের কথা মতো ড্রাইভিং সীটে বসলো।ইয়াদ পাশের সীটে বসে ঘনঘন চোখ মুচছে।নিজেকে শান্ত রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।কিন্তু শক্ত রাখতে হবে মধুর জন্য হলেও নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।
————-
ভোরের আলো ফুটছে,বাতাস বইছে।বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা।ইয়াদ’রা চলে প্রায় চলে এসেছে ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়ার কাছাকাছি।অনেক্ক্ষণ রাসেল ড্রাইভ করার পর ইয়াদ বসলো ড্রাইভিং সীটে।

সকাল ৭.০০ টায় ওর ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া সদরে পৌঁছে গেছে।ইয়াদ পৌঁছে নিখিলকে কল দিলো,’হ্যালো,নিখিল ভাইয়া।’

‘হ্যাঁ,ইয়াদ তুমি একটু অপেক্ষা করো।আমি অফিসে পৌঁছে লোকেশন ট্র্যাক করছি।’

‘আচ্ছা ভাইয়া।’

পাঁচ মিনিট পরই নিখিল লোকেশন ট্র্যাক করে ইয়াদকে নির্দেশনা দেওয়া শুরু করলো।গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে একটা গ্রামে ঢুকে পড়লো ইয়াদ।এরপর নিখিল নির্দেশনা অনুযায়ী যাচ্ছে কিন্তু কিছুদূর এগিয়েই বিপত্তিতে পড়লো।সামনে আর গাড়ি যাবে না।রাস্তা চিকন।এখানে গাড়ি ঢুকানো যাবে না।রাস্তার দুপাশে পুকুরও আছে।ইয়াদ আর রাসেল গাড়ি থেকপ নেমে সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো।হাঁটতে হাটতে বাজারে চলে এলো।এদিকে নেটওয়ার্ক নেই তাই ফোন ডিসকানেক্ট হয়ে যায়।ইয়াদ কয়েকবার নিখিল কে ফোন দেয় কিন্তু ফোন ঢুকছে না।এখন আর কি করার যেহেতু এতোটুকু পথ এসেই পড়েছে সেহেতু মধুকে না নিয়ে এখান থেকে এক পা ও নড়বে না।কিন্তু এখন খুঁজবে কি করে।বাজারের কাউকে কি জিগ্যেস করবে?আর জিগ্যেস করলেও কি জিগ্যেস করবে?ইয়াদের মাথায় কিছু আসছে না।এদিকে রাসেলের প্রচুর ক্ষিধে পেয়েছে।কিছু খাওয়া দরকার তাই বলল,’দোস্ত চল কিছু খেয়ে নেই।তারপর খুজি।’

‘তুই খা।আমাকে বিরক্ত করিস না।’

‘আচ্ছা ঠিকাছে তোকে খেতে হবে না এটলিস্ট আমার সাথে তো একটু আসতে পারিস।’

‘আচ্ছা চল।’
ইয়াদ আর রাসেল বাজারের একটা হোটেলে ঢুকলো।রাসেল নাস্তা করলেও ইয়াদ এক গ্লাস পানি ছাড়া কিছু খায় নি।রাসেলের নাস্তা করা শেষে ইয়াদ আর রাসেল হোটেল থেকে বের হলো।তারপর আশেপাশে কয়েকটা দোকানে মধুর নাম বলল কিন্তু তারা কিছু বলতে পারছে না ওর বাবার নাম বললে হয়তো কেউ চিনবে কিন্তু মধুর বাবার নামটা মনে পড়ছে না।একবার না দুইবার মধু বলেছিলো কিন্তু এখন মনে পড়ছে না।এমনই হয় দরকারের সময় কিছু মনে থাকে না।অনেক্ক্ষণ চিন্তা করার পর একপর্যায়ে মন পড়লো ওর বাবার নাম তো মিরাজ।ইয়াদ তৎক্ষনাৎ একটা দোকানে ওর বাবার নাম বলল।দোকানদার লোকেশন বলে দিলো।ইয়াদ আর রাসেল সেই লোকেশন বরাবর গিয়ে অনেকগুলো বাড়ি দেখতে পেলো।এখন কোনটা মধুদের ঘর কে জানে!ইয়াদকে কনফিউজড দেখে রাসেল বলল,’এতো ভাবছিস কেনো?মধু বলে জোরেজোরে চিল্লাতে থাক।’

ইয়াদ বিরক্ত কন্ঠে বলল,’চুপ থাকবি তুই।’

ইয়াদের ধমকে রাসেল চুপ হয়ে গেলো।হঠাৎ ওদের চোখ গেলো বা পাশের ঘর থেকে বের হওয়া একটা মহিলার ওপর।ইয়াদ দ্রুত গিয়ে মহিলার পথ রোধ করে বলল,’আন্টি,মধুদের বাসা কোনটা?’

‘আইরিন ভাবীদের বাসা?’মহিলাটা জিগ্যেস করলো

‘জ্বি আন্টি।’

‘ওই যে ওইপাশের ঘরটাই আইরিন ভাবীদের বাসা।তা বাবা তুমি কে?’

ইয়াদ এই কথার উত্তর দিলো না পাশের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।কিন্তু রাসেল মহিলার উত্তরে বলল,’আপনার ভাবীর মেয়ের জামাই।’

এটা বলেই রাসেল ইয়াদের পেছনে ছুটলো।ঘরের সামনে এসে দরজায় নক করলো ইয়াদ।ঘরে মধু ছাড়া কেউ নেই।আইরিন রহমান আর মিলি কোথায় যেনো গেছেন।অগত্যা দরজা মধুকেই খুলতে হলো।দরজা খুলতেই ইয়াদকে দেখে মধুর জানে পানি নেই।ইয়াদকে দেখে দ্রুত দরজা বন্ধ করতে নিলেই ইয়াদ দরজা ঠেলা শুরু করলো।ওদিক থেকে মধু ঠেলছে এদিক থেকে ইয়াদ ঠেলছে কিন্তু মধু বেশিক্ষণ ধরে রাখাতে পারে নি ইয়াদ ঘরে ঢুকেই পড়লো।

চলবে….

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪২
#Arshi_Ayat

ইয়াদ ঘরে ঢোকার পর মধু এক সেকেন্ডেও দেরি করে নি দৌড়ে অন্যরুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো ইয়াদ আসার আগেই।দরজা আটকে দরজার সামনে থম মেরে বসে রইলো।বুকটা অস্বাভাবিক ভাবে ওঠানামা করছে!মাথা কাজ করছে না!ও খবর পেলো কোথায়!আসলোই বা কি ভাবে!এগুলোই মধুর মাথায় ঘুরছে।এদিকে ইয়াদ দরজা ধাক্কানো শুরু করেছে।কয়েকবার ধাক্কানোর পরেও যখন খুললো না তখন ইয়াদ গলা হাঁকিয়ে বলল,’মধু ভালো হচ্ছে না কিন্তু!বেরিয়ে এসো বলছি!রাগ উঠালে কিন্তু দরজা ভেঙে ঢুকবো।’

মধু নিশ্চুপ!ইয়াদের এবার সত্যিই রাগ হলো।দুই/তিন লাথি দিয়ে দরজাটা সত্যি সত্যি ভেঙে ফেললো।প্লাস্টিকের দরজা হওয়ায় ভাঙতে বেশি কসরত করতে হয় নি!দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকতেই মধু আবার দৌড় লাগালো ওয়াশরুমে ঢোকার জন্য।কিন্তু এবার আর রেহাই পেলো না।ইয়াদ ধরেই ফেললো।নিজের এক হাত দিয়ে মধুর দুইহাত পিঠের পেছনে বন্দী করে আরেক হাতে ওর থুতনি চেপে ধরে বলল,’পালাচ্ছো কোথায়?’

মধু অনেক মোচড়ামুচড়ি করেও যখন হাত ছাড়াতে পারলো না তখন বলল,’আপনি কেনো এসেছেন এখানে।প্লিজ চলে যান।আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে!তারপরেও কেনো এসেছেন?’

মধুর কথা শুনে ইয়াদ ওর হাতের বাধন আলগা করে দিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,’ও আচ্ছা তাই নাকি!তা তোমার স্বামী কোথায়?’

মধু নিচের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল,’ও ও বাজারে গেছে।’

ইয়াদ মধুর একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে মধুর মুখটা তুলে ধরলো।তারপর বলল,’তাহলে চোখে পানি কেনো?নাকি তোমার স্বামী তোমাকে আমার মতো ভালোবাসে না।’এটা বলেই ইয়াদ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।

মধু ইয়াদের সামনে দাড়িয়ে কৃত্রিম অনুনয়ের সুরে বলল,’আপনি প্লিজ চলে যান ও এসে দেখলে সমস্যা হবে।’
মধুর কথা শুনে ইয়াদ রেগে গিয়ে ওকে নিজের সাথে চেপে ধরলো।তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল,’একের পর এক মিথ্যে বলছো!একবারও কি বুক কাপছে না এতোগুলো মিথ্যে বলতে।’

মধু অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,’মিথ্যে বলছি না আমি সব সত্যি।’

‘তাই?আচ্ছা তাকাও আমার দিকে।’

মধু তাকালো না।ইয়াদ আবার ধমকের সুরে বলল,’মধু,তাকাও বলছি।’

মধু এবার তাকালো।চার চোখ এক হলো।ইয়াদ মধুর গালে হাত দিয়ে বলল,’এবার বলো।কোনটা সত্যি?’

মধু কিছু বলল না।চুপচাপ তাকিয়ে রইলো।চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে।ইয়াদ ওর চোখের পানি মুছে জড়িয়ে ধরলো।মধু ইয়াদের বুকের ওপর মাথা রেখে কাঁদছে।ইয়াদের চোখেও পানি কিন্তু সেটা মধু দেখার আগেই মুছে ফেললো সে।কিছুক্ষণ পর মধু নিজেকে সামলে নিলো।ইয়াদের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে চোখের পানি মুছে বলল,’আমার বিয়ে হয় নি সত্যি কিন্তু আমি আপনার সাথে যেতে পারবো না।’

‘তাহলে আমি এখানে থেকে যাবো না।’ইয়াদের গলায় দৃঢ়তা।

‘পাগলামি করছেন কেনো?ফিরে যেতে বলছি আমি।’

‘তুমি বললেই আমি শুনবো কেনো?আমি যাবো না।আঠার মতো লেগে থাকবো তোমার সাথে।কিছুতেই ছুটাতে পারবে না তুমি।’

মধু এবার মরিয়া হয়ে উঠলো।কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,’প্লিজ বাচ্চামো করবেন না।আপনি জানেন না আমি কেনো এমন করছি।জানলে হয়তো চাইবেন না!’

ইয়াদ মধুর সামনের ক’গাছি চুল পেছন গুঁজে দিতে দিতে বলল,’সব জানি।সব জেনেও শত সহস্রবার তোমাকেই চাই।’

মধু বিষ্মিত হলো!সব জানে মানে?কিভাবে?ও তো কাউকে কিছু বলে নি।মধু ইয়াদের দিকে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকালো।ইয়াদ মুচকি হাসলো।কাল রাতের ঘটনাটা সংক্ষেপে বলল।সব শুনে মধু নিজের ওপরেই ক্ষেপে গেলো।ইশ!কি দরকার ছিলো রেডিও তে বলার।আগে জানলে এই ভুল কোনোক্রমেই করতো না মধু।

সবশুনেও মধুকে চুপ থাকতে দেখে ইয়াদ বলল,’এখন নিজেকে গালাগাল করে লাভ নেই।যা হয়েছে বেশ হয়েছে।’

মধু কিছু বলল না।ঘর থেকে বের হয়ে যেতে নিলেই ইয়াদ বলল,’আবার কোথায় পালাচ্ছো?’

মধু ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,’পালাচ্ছি না।বসুন।আসছি।’

‘হুম।তাড়াতাড়ি এসো।’মধু বের হতেই ইয়াদ খাটের ওপর আরাম করে বসলো।

রুমের চারদিকে একটু চোখ বুলাতে লাগলো।আসার পর দেখার সময় হয় নি।রুমে বেশি কিছু নেই।একটা খাট,একটা খাঠের আলমারি আর একটা ড্রেসিং টেবিল।ইয়াদ উঠে গিয়ে বিছানার পাশের জানালাটা খুলে দিলো।ঘরে এই একটাই জানালা।এটা না খুললে কেমন যেনো অন্ধকার,অন্ধকার লাগে।জানাল খুলে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলো মধু এসে পড়েছে।হাতে পরোটার প্লেট আর আলুভাজি।দু’টো প্লেট টেবিলের ওপর রেখে ইয়াদের সামনে এসে দাড়ালো।তারপর বলল,’আপনি একাই এসেছেন নাকি আরো কেউ আছে?’

‘রাসেল এসেছে।বোধহয় বাইরে আছে।’

‘কই,বাইরে তো কাউকে দেখলাম না।’

‘ওহ!হয়তো আশেপাশে কোথায় আছে।’

‘ওনাকে ডেকে আনুন।নাস্তা খাবেন।’

এটা বলে মধু চলে যেতে নিলেই ইয়াদ হাত ধরে ফেললো।শান্ত চোখে চেয়ে বলল,’তুমি খেয়েছো?’

মধু কিছু বলল না।কারণ ইয়াদকে ও মিথ্যা বলতে পারে না।কিভাবে যেনো ধরে ফেলে।তাই শুধু শুধু বাক্যব্যয় করে লাভ নেই।মধুর উত্তর না পেয়ে ইয়াদ যা বোঝার বুঝে গেলো। বলল,’পরোটা কয়টা এনেছো এখানে?’

‘চারটা।’সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো মধু।

‘আচ্ছা যাও হাত মুখ ধুয়ে এসো।একসাথে খাবো।’

‘কিন্তু আমি তো আপনাদের জন্য এনেছি।’

‘রাসেল নাস্তা করেছে সকালেই।ওর আর করা লাগবে না।তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো।’

মধু ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে কলপাড়ে চলে গেলো।আর ইয়াদ এই রুমের সাথে লাগোয়া ওয়াশরুমে গেলো ফ্রেশ হতে।

মধু হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখলো ইয়াদ ওর জন্য অপেক্ষা করছে। চুপচাপ এসে ইয়াদের পাশে বসলো।মধু মনে মনে ভাবছে ঝামেল না বাড়িয়ে কোনোমতে বুঝিয়ে ইয়াদকে বাড়ি পাঠিয়ে দিবে।অবশ্য এটা এতো সহজও না।ইয়াদকে শুধু ইয়াদ নিজেই বোঝাতে পারে।তবুও চেষ্টা তো করতে হবে।ওর কথায় গলে পড়া যাবে না।আর এদিকে ইয়াদের মনে মনে চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিয়েটা সারলে কেমন হয়?আচ্ছা এতো দ্রুত কাজি কোথায় পাওয়া যাবে আর কিছু কেনাকাটাও তো করতে হবে!দুজনের চিন্তাভাবনাই সাংঘর্ষিক!

নাস্তা করতে করতে ইয়াদ টুকটাক কথা বলছে আর মধু সেগুলো উত্তরে হ্যাঁ,হু বলছে।খাওয়া শেষ হতে হতে আইরিন রহমান আর মিলিও চলে এসেছে।ইয়াদ আইরিন রহমানকে সালাম দিলো আর মিলির সাথেও টুকটাক কথা বলল।মিলি এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে কিন্তু ঢাকা থেকে চলে আসায় কলেজ যাওয়া হচ্ছে না।তবে সামনের মাসে সে হোস্টেলে শিফট হবে।এই তো এমনই টুকটাক কথা হলো ইয়াদের সাথে। এদিকে মধু চিন্তায় পড়ে গেছে কি করবে এটা ভেবে।ইয়াদের স্বভাব চরিত্র ভালো ভাবেই জানা আছে।হয়তো মনে মনে এখন বিয়ের প্ল্যান করছে!

মধু কলপাড়ে এসেছে পানি ভরতে আইরিন রহমানও ওর পাশে এসে দাড়ালো।বলল,’কি করবি মধু?’

‘ওনাকে এখান থেকে ফেরাতে হবে।উনি যেটা চাইছে সেটা সম্ভব না।’

‘ও কি সব জানে?’

‘হুম সব জানে।’

‘সব জেনেও যদি চায় তাহলে আপত্তি কোথায়?’

‘না মা।আমার স্বার্থের জন্য কাউকে ঠকাতে পারবো না আমি।’

‘তুই ঠকাচ্ছিস কোথায়?ও তো সব জানেই।সব জেনেশুনেই তোকে বিয়ে করতে চাইছে।আমার মনে হয় না তোর এখানে আপত্তি করা ঠিক হচ্ছে।’

মধু কলসিটা কোমরে উঠিয়ে বলল,’মা তুমি বুঝবে না।শুধু উনি রাজি হলেই হবে না।ওনারা পরিবার আছে।ওনার মা,বাবা যদি না রাজি হয় তাহলে কিভাবে সম্ভব?তারপর যদিও রাজি হয় বিয়ের পর মত পাল্টাবে না তার গ্যারান্টি কি?একে তো আমি রেপড তার ওপর আমার বাচ্চাও হবে না এমন
মেয়েকে কে নিজের ছেলের বউ করতে চাইবে?কেউ চাইবে না।আমি এখন বাঁচা মরা সমান।তাই মা আবেগ দিয়ে না ভেবে বিবেক দিয়ে ভাবো। ভবিষ্যৎ চিন্তা করো।’

এটা বলেই মধু কলসি নিয়ে চলে গেলো।আসলেই কথাগুলো কিন্তু ভুল বলে নি কিন্তু মেয়েটা কি সারাজীবন এভাবেই থাকবে?জিন্দালাশ হয়ে?আইরিন রহমানের মনটা আনচান করে উঠলো।
—————–
মধু ঘরে এসে দেখলো ইয়াদ শুয়ে শুয়ে গেমস খেলছে।মধুকে ঘরে আসতে দেখে বলল,’এতক্ষণে আসার সময় হলো!সেই কখন বের হলে।’

‘তে কি আপনার কোলে উঠে বসে থাকবো?আমার কি কাজ নেই?’

মধুর কথা শুনে ইয়াদ বলল,’হ্যাঁ অবশ্য বিয়ের পর আমি তোমাকে কোলে নিয়েই বসে থাকবো।’

‘এহ!ঢং রাখেন।বাইরে গিয়ে রাসেল ভাইয়াকে নিয়ে আসেন।’

‘ধূর ও এমনিতেই আসবে।তুমি বলো তুমি কি রঙের শাড়ি নেবে?আপাতত ক্যাশ তত নেই।হালকা পাতলা কেনাকাটা করতে পারবো।’

‘আমার কিছু লাগবে না।’

‘আরে নাহ!বিয়েতে শাড়ি না পরলে কেমন যেনো লাগবে!একটা শাড়ি আরেকটা পাঞ্জাবি আর কিছু কসমেটিকস হলেই চলবে তাই না?’

‘আপনি কিনলে কিনুন কিন্তু আমার জন্য প্লিজ কিছু কিনবেন না।’

‘আচ্ছা দেখা যাক।’
এরমধ্যেই রাসেল চলে এলো।ঘরে ঢুকে মধুকে সালাম দিয়ে বলল,’মধু কেমন আছো?’

মধু উত্তর দেওয়ার আগেই ইয়াদ বলল,’ধূর শালা তোর ভাবি হয়।ভাবি বল।নাম ধরে ডাকবি না।নাম ধরে তো শুধু আমি ডাকবো।’

ইয়াদের কথা শুনে মধু চোখ পাকিয়ে বেরিয়ে গেলো।আর রাসেল হাসতে হাসতে বিছানায় বসলো।মধু যাওয়ার পর ইয়াদ বলল,’দোস্ত একটু কেনাকাটা করা লাগবে।একটা নীল পাঞ্জাবি আর নীল রঙের একটা শাড়ি আনবি।আর আসার সময় কাজি কে ঠিকানা দিয়ে বলে আসবি ঝড়,তুফান,জলোচ্ছ্বাস,ভুমিকম্প যাই হয়ে যাক না কেনো সন্ধ্যার সময় যেনো হাজির হয়।’

‘আচ্ছা কিন্তু ভাবি কি বলল।’

‘যতোদূর বুঝলাম ও আমাকে ভাগানোর প্ল্যান করছে।কিন্তু এটা হতে দেওয়া যাবে না।’

রাসেল উঠে দাড়ালো।বলল,’তুই আমার সাথে যাবি?’

‘পাগলে পেয়েছে আমাকে?একবার বহুত কষ্ট করে খুঁজে পেয়েছি এখন আমি বের হয়ে যাওয়ার পর যদি আবার ভেগে যায়!আমি এই ব্যাপারে রিস্ক নিবো না।’

ইয়াদের কথা শুনে রাসেল হাসলো।তারপর বেরিয়ে গেলো কার্য সম্পাদন করতে।

চলবে….

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৩৯+৪০

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৩৯
#Arshi_Ayat

মনে পড়ে গেলো দুইমাস আগের রাতের কথা…….
সেদিন ইফাজ জরুরি একটা কাজ করছিলো ল্যাপটপে।আর নিহা ড্রেসিং টেবিলে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিলো।চুল আঁচড়ে খোপা করে ইফাজের সামনে গিয়ে বলল,’কফি খাবে?’

ইফাজ ল্যাপটপে চোখ রেখেই বলল,’হ্যাঁ খাওয়া যায়।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই নিহা নিজের জন্য আর ইফাজের জন্য দুই মগ কফি নিয়ে আসে।ইফাজ নিজের কাজ করতে করতে কফি খাচ্ছিলো।কফি শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হলো কোনো ঘরের মধ্যে চলে গেছে!মাথাটা ঘুরছিলো!সামনে আবছা চোখে নিহাকে কাছে আসতে দেখেছিলো।এরপর আর কিছুই মনে নেই!সেদিন নেশাগ্রস্ত হয়ে কি করেছিলো কিচ্ছু মনে নেই ইফাজের।তবে যখন সকাল বেলা নিজেকে অনাবৃত অবস্থা দেখেছিলো তখনই বুঝেছিলো যা হওয়ার নয় তাই হয়েছে।

তারপর থেকে দুইদিন ইফাজ বাড়িতেই আসে নি।নিহা কাউকে কিছু বলতেও পারছিলো না কারণ বাসার সবাই জানে ইফাজ জরুরী কাজে বাইরে গেছে।সত্যিটা নিহা জানে।

দুইদিন ধরে ইফাজের চিন্তায় ঘুম আসছিলো না।দুইদিন পর যখন ইফাজ রাত একটার সময় বাড়িতে আসে তখন নিহা বাদে সবাই ঘুমিয়ে ছিলো।ঘরে আসতেই নিহা ইফাজের পা ধরতে নিলেই ইফাজ দ্রুত নিহার হাত ধরে ফেলে।নিহা কাঁদতে কাঁদতে বলল,’আমাকে ক্ষমা করো ইফাজ।আমি মানুষের কথা আর নিতে পারছিলাম না।সব কাজিন আত্মীয় স্বজন সবাই তোমার নামে বাজে বাজে কথা বলছিলো।আমি আর সহ্য করতে না পেরে…

নিহা আর বলতে পারলো না কান্নায় কন্ঠ রোধ হয়ে গেছে।ইফাজ আচমকাই নিহাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’না নিহা তোমার জায়গায় তুমি ঠিক আছে।আমিই তোমার যোগ্য নই।না তোমাকে শান্তি দিয়েছি না নিজে শান্তি পেয়েছি।আমি তোমার ক্ষমা পাওয়ারও যোগ্য নই।’

সেদিন বেশ কিছুটা সময় দুজনেই কেঁদেছিলো।তারপর থেকে আস্তে আস্তে ওদের সম্পর্ক ঠিক হতে থাকে।কিন্তু সত্যি এটাই সম্পর্ক ঠিক হলেও ভালো তো কেবল একজনকেই বাসা যায়!

‘হেই ডাক্তার সাহেব কোথায় হারালেন?’
নিহার কথায় সম্বিত ফিরে পেলো ইফাজ।ফিরে এলো দুইমাস আগের অতীত থেকে।নিহাকে কোল থেকে নামিয়ে একবার আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,’অনেক খুশী হয়েছি নিহা।’

নিহা মুখ বাঁকা করে বলল,’নাহ!শুধু খুশি হলে হবে না।আমাকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে।এখন থেকে বাবুর আর আমার যত্ন নিতে হবে।’

‘যথাআজ্ঞা ম্যাম।’ইফাজ হেসে বলল।

বাড়ির সবাই খুশী নতুন অতিথির আগমনে।ইয়াফ খান তো খুশীর ঠ্যালায় মিলাদও পড়িয়েছে।সবার জল্পনা কল্পনা চলছে ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে।এই নিয়ে বাড়িতে দুটো দলও হয়ে গেলো।যেমন ইয়াদ,ইয়াফ খান,ইরিন একদল তাদের মতে ছেলে হবে।
সাইদা খান আর নিহা একদল তাদের মতে মেয়ে হবে।আর ইফাজ আল্লাহ যেটা দেয় সেটাই আলহামদুলিল্লাহ!
ইফাজের কোনো দল নেই সে নিরপেক্ষ।
—————-
সবকিছু ভালোই চলছিলো।এতোকিছুর মধ্যেও ইয়াদ সবসময় মধুকে মনে করে।রাতের অর্ধেকটা সময় চলে যায় ওকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই কিন্তু পাষাণীটা এতো নিষ্ঠুর!

আজকে সাইদা বেগম কেনো জানি ইয়াদকে ক্লাস শেষ করে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বলেছিলো।যেহেতু মায়ের আদেশ তাই ইয়াদ ক্লাস শেষে বাড়িতে আসলো।কিন্তু বাড়ি এসেই মাথা ঘুরে গেলো।পাঁচ/ছয় জন নতুন মানুষকে দেখা যাচ্ছে।কারা এরা!আবার এদের দেখি আপ্যায়নও করা হচ্ছে।ইয়াদকে ঢুকতে দেখে সাইদা খান এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো।তারপর সামনে বসা মানুষদের উদ্দেশ্য করে বলল,’এই হলো আমার ছোটো ছেলে।’
ইয়াদ কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে।তবুও সালাম দিলো।কিন্তু হঠাৎ করে চোখ পড়লে সামনের সোফায় বসা একটা মেয়ের দিকে।মেয়েটা একটু পরপর ইয়াদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।ব্যাপারটা খেয়াল করতেই বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে গেলো।একটা ছেলে দেখলেই এভাবে তাকতে হবে!আজব!মেয়েটার জায়গায় যদি মধু থাকতো তাহলে অনুভূতিটা বিরক্তির হতো না বরং ভালোলাগার হতো!

ইয়াদ মায়ের দিকে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকালো।সাইদা খান ইয়াদকে উঠে একটু সাইডে আসতে বললেন।ইয়াদ সাইডে এসে মা’কে জিগ্যেস করলো,’এগুলো কি হচ্ছে মা?’

‘ওরা তোকে দেখতে এসেছে।আমি আর তোর বাবা গতকাল ওদের বাসায় গিয়ে মেয়েকে দেখে এসেছিলাম।তাই ওরা আজকে এসেছে।’

ইয়াদ তীব্র রাগ নিয়ে চাপাকন্ঠে বলল,’এগুলে কে করতে বলেছে তোমাকে?তুমি জানো না আমি মধুকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না।তুমি ওদের চলে যেতে বলো।’

‘ইয়াদ বেশি বাড়াবাড়ি করবি না!আমরা তোর ভালোর জন্যই করছি এগুলো।যদি তুই উল্টাপাল্টা করিস আমিও গলায় দড়ি দেবো মনে রাখিস।মায়ের কথার দাম ছেলে না দিলে মা হয়ে আর বেঁচে থেকে কি লাভ!’

এটা বলেই সাইদা খান চলে গেলো মেয়েপক্ষের সামনে।মায়ের এসব কথাবার্তা শুনে ইয়াদ মনেমনে খুব কষ্ট পেলো।একদিকে পরিবার অন্যদিকে ভালোবাসা!এর চেয়ে বেশি অসহায়ত্ব আর কি হতে পারে?

চুপচাপ গম্ভীর মুখে সোফায় গিয়ে বসলো ইয়াদ।ওরা আজকেই এঙ্গেজমেন্টে সেরে ফেলতে চায়।ইয়াদ কিছু বলতে নিলেও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারে নি।এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেলো!

ওরা যাওয়ার পর ইয়াদ আর কারো সাথেই কথা বলল না।চুপচাপ ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।ঘরে এসে এঙ্গেজমেন্টের রিং টা ছুড়ে ফেলে দিলো।

এরপর একান্তে কতক্ষণ মধুর ছবির দিকে চেয়ে চোখের জল ফেললো।
———–
সন্ধ্যায় ইফাজ বাসায় এসে সাইদা খানকে বলল,’মা ইয়াদ কোথায়?’

‘ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে।’

‘কেনো?’

সাইদা খান ইফাজকে সবটা খুলে বলার পর ইফাজ গম্ভীর মুখে বলল,’মা কাজটা একদম ভালে করো নি।জোর করে সংসার হলেও ভালোবাসা হয় না।’

এতটুকু বলেই ইফাজ ইয়াদের দরজায় নক করলো।ইয়াদ ভেতর থেকে কোনো রেসপন্স করলো না।

ইফাজ আবার নক দিয়ে বলল,’ইয়াদ!দরজা খোল।’

এবার ইয়াদ জবাব দিলো,’ভাইয়া আমার কিছু ভালো লাগছে না।আমি তোমার সাথে পরে কথা বলবো।’

‘আচ্ছা।’
ইফাজ নিজের ঘরে চলে গেলো।
————–
রাত নয়টার সময় ইয়াদকে বের হতে দেখে সাইদা খান বললেন,’কোথায় যাচ্ছিস?’

‘চিন্তা করো না।পালাচ্ছি না।তোমাদের পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করে তবে মরবো।’

এটা বলেই ইয়াদ বেরিয়ে গেলো।ইয়াদের কথায় সাইদা খান কষ্ট পেলো কিন্তু এটা তো তিনি ছেলের ভালোর জন্যই করছেন।আর কতোদিন ছেলেটা এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরবে একটা মেয়ের জন্য?

বাসা থেকে বের হওয়ার মূল কারণ হলো বাসায় দমবন্ধ লাগছিলো।তাই খোলা রাস্তায় হাটতে বের হলো।হাঁটতে হাঁটতেই ছোটোবেলার বন্ধু অভির সাথে দেখা হলো।ওর ভালো নাম অভিরুপ রায়।ছেলেটা বেশ মেধাবী!অবশ্য স্কুল পর্যন্ত পড়ে ও আলাদা হয়ে যায়।এরপর দেখা হলে সৌজন্যমূলক কথা ছাড়া আর কথা হয় নি।অভিকে দেখেই ইয়াদ প্রথম কথা বলল,’আরে অভি কেমন আছো?’

‘ভালো। তুমি?’

‘এইতো ভালোই আছি।বৌদি কেমন আছে?’

‘ভালোই আছে।তুমি বিয়েশাদি করো নি?’

‘না এখনো না।তা কোথায় যাচ্ছো?’

‘অফিসে।’

ইয়াদ অবাক হয়ে বলল,’কিহ!এতো রাতে অফিস।’

‘হ্যাঁ,আমাদের ডিউটি রাতেই।আমি রেডিও তে জব করি।আর আমার শো রাতেই হয়।দশটা থেকে দুইটা পর্যন্ত একটা শো হোস্ট করবো।’

‘ওহ!আচ্ছা।যদি কিছু মনে না করো তাহলে আজকে একবার তোমার অফিস ঘুরে আসা যাবে?না মানে আমার বহুদিনের ইচ্ছে রেডিও স্টেশন কেমন হয় দেখার।’

অভি মৃদু হেসে বলল,’সমস্যা নেই চলো।’

তারপর দুজনে হাটতে হাটতে লাগলো।হাঁটতে হাঁটতেই অভি বলল,’তা বয়স তো কম হচ্ছে না।বিয়ে করছো না কেনো?’

ইয়াদ উদাস গলায় বলল,’বিয়ে তো করতে চাই কিন্তু যাকে চাই তাকে তো পাই না।’

‘লাভ স্টোরি মনে হচ্ছে।’

ইয়াদ হাসলো।অভি হাসিতে তাল মিলিয়ে বলল,’সংক্ষেপে একটু বলতো তো তোমার প্রেম কাহিনি।’

‘প্রেম কাহিনি সংক্ষেপে বলা যায় না অভি।অনেক অনুভূতি,ভালোবাসা,ভালোলাগা,প্রতীক্ষা থাকে বলে সংক্ষেপে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।তবুও যদি তুমি শুনতে চাও তবে বলবো সে মধু ছিলো আর আমি মৌমাছি কিন্তু মধুটা মৌমাছি কে একা করে যে কোথায় চলে গেলো!’

অভি একটু হাসলো।বলল,’ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে!আসবে একদিন গেস্ট হয়ে আমার শো তে তোমার ভালোবাসার গল্প বলতে।’

‘আমার ভালোবাসা তো অপূর্ণ তাকে ছাড়া।তাকে পেলে অবশ্যই আসবো।’

এরপর আরো অনেক কথা বলতে বলতে ওরা রেডিও স্টেশনে পৌঁছে গেলো।শো শুরু হতে পাঁচ মিনিট বাকি!সব ঠিকঠাক করে দশটা বাজতেই মাইক্রোফোন কানে দিয়ে অভি স্পিচ দেওয়া আরম্ভ করলো,’হ্যালো,আপনারা শুনছেন বাংলা রেডিও ৯৫.২ এফ এম।শুরু হয়ে গেলো আমাদের আজকের অনুষ্ঠান ‘মনের কথা’।এখানে আপনি আমাদের জানাতে পারবেন আপনার মনের কথা।আমি আপনার বন্ধু অভি বসে আছি আপনার কথা শোনার জন্য।এখন ফোন দিন *******এই নাম্বারে।’

স্পিচ শেষ হতেই একজনের ফোন কল পেলো।অভি রিসিভ করে কথা বলা শুরু করলো।আর পাশে বসে ইয়াদ অভির সাথে সাথে কথাগুলো শুনতে লাগলো।যথারীতি অভি একটা ফোন কল রিসিভ করে বলল,’হ্যালো বন্ধু,কে বলছেন?কোথা থেকে বলছেন?’

‘হ্যালো,আমি তয়ত্রি রহমান।’

এতটুকু শোনার পরই ইয়াদ চমকে গেলো।পরিচিত কন্ঠ!মধুর কন্ঠ এটা!

চলবে…

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪০
#Arshi_Ayat

মধুর কন্ঠ’টা কানে লাগতেই ইয়াদের বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করতে লাগলো।ইশ!কতোদিন পর এই কন্ঠটা আবার কানে বাজছে।ইয়াদের চোখে অজান্তেই পানি চলে এলো।মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করছে,’কেন মধু?কেনো আমাকে ছেড়ে গেলে?কোন ভূলের শাস্তি দিচ্ছো আমাকে?’
কিন্তু না কান্না আটকে নিজেকে শান্ত রাখারা চেষ্টা করলো।অভিও পুরোটা বুঝতে না পারলে কিছুটা বুঝতে পারলো ইয়াদের উৎকন্ঠার কারণ।মধুর সম্পর্কে অনেক কিছুই বলেছে ইয়াদ।তার থেকে ধারণা করাই যায়।অভি ইয়াদ হাত ধরে ভরসা দিলো।তারপর ওপর পাশে মধুর উদ্দেশ্যে বলল,’বন্ধু শুনতে পাচ্ছেন আমাকে?’

ওপাশ থেকে উত্তর এলো,’জ্বি শুনতে পাচ্ছি।’

‘কষ্ট করে আপনার নামটা আরেকবার বলুন প্লিজ।’

‘আমার নাম তয়ত্রি রহমান মধু।’খুব ক্ষীণ কন্ঠে উত্তর দিলো মধু।

‘খুব সুন্দর নাম আপনার।আচ্ছা মধু আপনি কোথায় থাকনে?’

‘ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া থাকি।’

‘আচ্ছা বেশ।আপনি আপনার মনের কথা বলুন আমিসহ আমার সকল বন্ধুরা আপনার কথা শুনতে চাই।’

মধু এক মিনিট চুপ থেকে চোখের কোটরে জমে থাকা পানি মুছে বড় একটা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,’আচ্ছা এতো ভালোবেসেও কেনো দিনশেষে ভালোবাসাগুলো পরিপূর্ণ হয় না।কেনো দুঃখ নামক শব্দটা ভালোবাসার অনুভূতিকে ফিকে করে দেয়?কেনো নিষ্ঠুর বাস্তবতা মানতে হয়?কেনো না চাইতেও ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে আসতে হয়?কেনো?’

বলতে বলতেই মধু কেঁদে ফেলল।স্টুডিও তে অভির পাশে বসে কাঁদছে ইয়াদ আর মাইক্রোফোনের অপরপাশে বসে কাঁদছে মধু।দুমিনিট পর নিজেকে শান্ত করে মধু আবারও বলতে শুরু করলো,’জানেন আমাদের দুচোখ ভার্তি কতো রঙিন স্বপ্ন ছিলো!দুজনে একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখতাম।একটা ভালোবাসা,শ্রদ্ধা,বিশ্বাসের ঘর বাঁধতে চেয়েছিলাম।কিন্তু সব স্বপ্ন ভেঙে,তাকে ছেড়ে দূরে চলে এসেছি।এখন আর সংসারের স্বপ্ন দেখি না।আমার স্বপ্নের আকাশে অমাবস্যায় ছেয়ে গেছে আর কখনো সেখানে চাদ উঠবে না।’

এইপর্যায়ে আবারও মধু থামলো।বাম হাতে চোখের পানি মুছে বলল,’আমাদের সম্পর্ক চারবছরের।একবছরের মাথায় সে পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে চলে যায়।তবুও আমাদের যোগাযোগ হতো।প্রতিদিন নিয়ম করে ফোন দিতো।ও সারাদিন পড়াশোনা আর কাজে ব্যস্ত থাকতো আমি জানি তবুও মাঝেমধ্যে ওর সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলতাম এরপর আবার নিজেরই আফসোস কিন্তু সে কখনো আমাকে বকা দিতো না অভিযোগ করতো না।তো সব মিলিয়ে বেশ ছিলাম!তার আসার সময় হচ্ছিলো।আর আমার এক্সাইটমেন্ট বাড়ছিলো।কথাছিলো সে আসলেই বিয়ের পিড়িতে বসবো।এবার তাকে নিজের বর করেই ছাড়বো।ও আসার দশদিন আগে রাতে ফোন দিয়েছিলো।বলেছিলো আরো একবছর অপেক্ষা করতে হবে।ভিসা-পাসপোর্টে কি একটা সমস্যা হয়েছে এইজন্য।এমনিতেই এই তিনবছর তাকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হয়েছিলো।তার ওপর এখন আবার একবছর অপেক্ষা করতে হবে এটা শুনেই রেগে খুব বাজে ব্যাবহার করেছিলাম।কিন্তু তখনও বুঝতে পারি নি যে সে আমার সাথে মজা করেছিলো।পরেরদিন তার বোনকে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম আমাকে সত্যিটা কিন্তু তবুও ভান করলাম আমি কিছু জানি না।সারাদিনে আর ফোন ধরি নি।ভেবেছিলাম রাতে কথা বলবো কিন্তু সেদিন সন্ধ্যার সময় টিউশনি করিয়ে আসছিলাম।প্রতিদিন আমি ওই সময়ই বাসায় ফিরি।সেদিনও ফিরছিলাম।সন্ধ্যার আজান পড়ায় রাস্তায় তখন তেমন একটা মানুষ ছিলো না।আমি দ্রুতই হাটছিলাম কিন্তু কিছুদূর হাটার পর কয়েকটা বখাটে ছেলেদের দেখতে পেলাম।ওরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিলো।আমি যথাসম্ভব রাস্তার পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটছিলাম।আর মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম যেনো ওরা আমাকে খেয়াল না করে।কিন্তু কে জানতো বিপদ আমার চারপাশে ঘুরঘুর করছে।যেটা চাইনি সেটাই হলো।ওরা আমার পিছু নিলো।আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম পেছনে কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।আমার বুক কাপছিলো ভয়ে বারবার মা,ছোটো বোন আর ভালোবাসার মানুষটার মুখ সামনে ভাসছিলো মনে হচ্ছিলো মরণ বুঝি সামনে কিন্তু সেদিন আমার মরণ হয় নি,আমার আত্মার মরণ হয়েছিলো।’

এতটুকু বলে মধু থামলো।নিঃশব্দে চোখের পানি মুছলো।এদিকে ইয়াদও দাঁত মুখ খিচে নিজেকে শক্ত রেখেছে কিন্তু ওপরে শক্ত দেখালেও ভেতরে যে পাঁজরের হাড়গুলো ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে সেটা বাইরে থেকে কেউ টের পাবে না।

সময়টা থমকে গেছে।ফোনের ওপশেও কথা নেই এপাশেও কথা নেই।আধ সেকেন্ডের জন্য বোধহয় সবাই নিরবতা পালন করছিলো।মিনিমাম আধ সেকেন্ড পর মধু ভেজা গলায় নাক টেনে আবার বলতে শুরু করলো,’ওরা পেছন থেকে এগিয়ে এসে আমাকে রোধ করে ফেলে।চারজন চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে।তারপর আমি চিল্লানোর আগেই সুযোগ বুঝে আমাকে চেতনানাশক দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে।তারপর ওরা আমাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলো আমি জানি না।কিন্তু যখন জ্ঞান ফেরে তখন নিজেকে ঘরে আবিস্কার করি।রুমে ম্লান হয়ে যাওয়া হলদেটে একটা আলো জ্বলছিলো।চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম রুমের এককোনায় চারটা ছেলে বসে নেশা করছে।হঠাৎ নিজের শরীর দিকে তাকিয়ে পিলে চমকে উঠলো।সারা শরীর অনাবৃত অবস্থায় পড়ে আছে।নিজের ঘৃণা হতে লাগলো নিজের শরীরের ওপর।’

এতটুকু বলেই মধু মুখে হাত দিয়ে গোঙাতে লাগলো।প্রাণপণে কান্না গিলতে চেষ্টা করলো কিন্তু সে ব্যর্থ!হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।অভির চোখেও জল চলে এসেছিলো।কি নির্মম আর্তনাদ!বাঁধভাঙা কান্না!অভি চেষ্টা করও স্বান্তনা দিতে পারলো না।কি বলবে যেখানে নিজেরই কষ্টে চোখে জল চলে এসেছে সেখানে অপরজনকে কি স্বান্তনার বাণী শোনাবে?মধু মিনিট দুইয়েক নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো।

তারপর চোখমুছে আবার বলতে শুরু করলো,’সরি,আসলে নিজেকে আটকাতে পারছিলাম তাই কান্না করে দিয়েছি।’

অভি ভরসা আর স্বান্তনার গলায় বলল,’সমস্যা নেই।আপনি শুরু করুন।’

‘সেদিন রাত আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ কালো রাত ছিলো এরচেয়ে যদি মৃত্যু হতো তবুও আমি খুশি হতাম।প্রথমবারের মতো নিজের অসহায়ত্ব অনুভব করলাম।সারা শরীর অপবিত্রতায় ছেয়ে গেলো।হাত,পা,মুখ বাঁধা ছিলো।কিচ্ছু করতে পারছিলাম না শুধু নিজের সর্বনাশ দেখতে পাচ্ছিলাম চোখের সামনে!কি অসহ্য বেদানায় কাতরাচ্ছিলাম কেউ কখনো উপলব্ধিও করতে পারবে না!যখন সর্বনাশের আর কিছু বাকি নেই তখন ভোর।আলো ফুটতে শুরু করেছে।ওরা কেউ তখন রুমে ছিলো না।আর আমার হাত,পা ও খোলা ছিলো।আমি তাড়াতাড়ি উঠে কোনোরকম জামা কাপড় পরে দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে গেলাম।কিন্তু রাস্তায় আসার পর জায়গাটা আমি চিনতে পারলাম না।কোথায়? কিভাবে যাবো তাও জানি না।এদিকে শরীর ক্রমেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে।কোনোমতে একটা রিকশা নিয়ে সরাসরি বাসার সামনে এসে পড়ি।বাসার সামনে এসে আবার জ্ঞান হারাই।তারপর যখন জ্ঞান আসে তখন দেখি আমি নিজের ঘরে। মাথার পাশে মা বসে আছে।মা’কে সব বললাম।তারপর সেদিনই হাসপাতালে গেলাম।গাইনি ডাক্তারের পরামর্শে পরীক্ষা করলাম।এবং দুইদিন পর গিয়ে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই।ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বলেছিলেন গণধর্ষণের ফলে আমার ওভারিতে সমস্যা হয়েছে।যার জন্য আমি মা হতে পারবো না।…’
শেষের কথাটা বলে মধু থামলো।চোখের জল মুছলো না।শুধু ঠোঁট কামড়ে ধরে রইলো।একমিনিট পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’ডাক্তারের মুখে ওই কথাটা শোনার পর আমি দ্বীতিয়বারের মতো মরেছি।সেদিন বাসায় এসে অনেক ভেবেছি কি করবো!দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম।আত্নহত্যাও করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারি নি।আমার সেই সাহস নেই!
নিজেকে কেনো জানি অপরাধী মনে হচ্ছিলো।আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের চেহারা দেখতেও নিজের ঘৃণা লাগতো।ওইসময়ে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।নিজের ফোন বন্ধ করে দিয়েছিলাম।মা আর বোনকে নিয়ে শহর ছেড়ে আসি।আমি চাই না এগুলো ও জানুক।আমি চাইনা আমার নষ্ট জীবনের সাথে ও জড়িয়ে পড়ুক।আমি ওকে কিছুই দিতে পারবো না।তাই চিরদিনের জন্য ওর জীবন থেকে চলে এসেছি।আমি জানি ও আমাকে অনেক ভালোবাসে।আমাকে খুঁজবে পরে একসময় না পেয়ে নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিবে আর আমি এটা চাই।ভালো থাকুক আমার ভালোবাসা!…’

কথা শেষ করে মধু নিজেই ফোন কেটে দিলো।অভি স্টুডিও থেকে কয়েকবার হ্যালো,হ্যালো করেছিলো কিন্তু সংযোগ না থাকায় যোগাযোগ হয় নি।
———————
আজ অনেকদিন পর মন খুলে কষ্টের কথাগুলো বলতে পেরে ভালো লাগছে মধুর।বারান্দার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে অবিরাম ধারায় চোখের পানি ফেলছে।

ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া মধুর দাদার বাড়ি।অনেক বছর ধরে বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ নেই।মধুর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে এখানে আর আসা হয়নি।এখানে দুই শতাংশ জায়গা আছে মধুর বাবার নামে।চাচারা এই জায়গার দেখাশোনা করে।

মধু যখন শহর ছেড়ে কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছিলো না তখন ওর মা ওর দাদার বাড়ির কথা বলে।দাদার বাড়ি সম্পর্কে কেউই তেমন কিছু জানে না।আর ইয়াদও কখনো জানতে চায় নি মধুও বলে নি।এখন সেখানে যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো।যাতে ইয়াদ ওকে খুঁজে না পায় আর যাওয়ার সময় একটা মিথ্যা বিয়ের কার্ড আর ইয়াদের দেওয়া রিং টা আরিয়ার কাছে দিয়ে এসেছিলো ইয়াদকে দেওয়ার জন্য যেনো ও বিশ্বাস করে মধুর বিয়ে হয়ে গেছে এবং মধু ওকে ঠকিয়েছে!

‘কাঁদিস না মা।’আইরিন রহমান মধুর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।

মধু মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের বুকে মাথা রেখে বলল,’মা আমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো?সবসময় আমার সাথেই কেনো এমন হয়?না মরতে পারছি না বাঁচতে পারছি!

চলবে….

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৩৭+৩৮

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৩৭
#Arshi_Ayat

ইয়াদ নিজের বিছানায় সেন্সলেস অবস্থায় শুয়ে আছে।আর ওকে ঘিরে ইফাজ,ইয়াফ খান,সাইদা খান,ইরিন দাড়িয়ে আছে।আর নিহা পানির বালতি আনতে গেছে।ইফাজ মাত্রই প্রেশার চেক করলো।প্রেশার হাই হয়ে গেছে।মাথায় পানি দিতে হবে।নিহা পানি নিয়ে আসার পর ইফাজ ইয়াদের মাথায় পানি ঢালতে লাগলো।আর ইরিন পায়ের তালু মালিশ করতে লাগলো।ইফাজের নির্দেশে সাইদা খান তেতুল পানি আনতে গেছেন।

অনেক্ক্ষণ পানি দেওয়ার পর আস্তে আস্তে ইয়াদের জ্ঞান ফিরলো।ইয়াদের জ্ঞান ফিরতে দেখে সবাই একদফা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।ইফাজের বাধা স্বত্তেও ইয়াদ আস্তে আস্তে উঠে বসলো।কিছু একটা বলতে নিলেও ইফাজ বাধা দিয়ে বলল,’এখন কিছু বলবি না।পরে সব শুনবো।আগে তেতুল পানিটা খেয়ে নে।’

ইফাজ সাইদা খানের হাত থেকে তেতুল পানিটা ইয়াদের হাতে দিলো।ইয়াদ একটু খেয়ে ফিরিয়ে দিলো।তারপর চুপচাপ বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো।চোখের কোণায় পানি চিকচিক করছে।ইফাজ আবারও প্রেশার চেক করলো আগের তুলনায় এখন কম আছে কিন্তু তবুও শংকামুক্ত না।ইয়াদের সাথে একান্তে কথা বলা প্রয়োজন।তাই ইফাজ সবাইকে রুম থেকে চলে যেতে বলল।সবাই বের হয়ে যাওয়ার পর ইফাজ রুমের দরজা বন্ধ করে এসে ইয়াদের সামনাসামনি বসে ওর হাত দরে বলল,’কি হয়েছে তোর ইয়াদ?’

ইয়াদ সোজা হয়ে বসলো।ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারপর কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু ভেতর থেকে কথা বের হচ্ছে না কান্না আর কথা দলা পাকিয়ে আসছে।কন্ট্রোল করা বেশ মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।ইফাজ ভাইয়ের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,’রিল্যাক্স ইয়াদ!কন্ট্রোল কর।তাড়াহুড়োর কোনো প্রয়োজন নেই।আস্তে আস্তে বল।’

ইফাজের কথা শেষ হতেই ইয়াদ চট করে ইফাজকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।কান্না জড়ানো কন্ঠে সবটা বোঝা না গেলেও কষ্ট’টা ইফাজ গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে কারণ সেও তো এই রোগেই আক্রান্ত!যেখানে না শান্তিতে বাঁচা যাবে না মরা যাবে।কিন্তু ইয়াদের সাথে এমন কেনো হলো!ওকে ভালো রাখার জন্যই তো ইফাজ সেক্রিফাইজ করেছিলো।কিন্তু মধু এটা কেনো করলো!

ইয়াদকে বাড়ি নিয়ে আসার সময় গাড়িতে একটা বিয়ের কার্ড পেয়েছিলো ইফাজ সেটা পড়েই সবটা বুঝে গেছে ইফাজ।কিন্তু এমনটা করার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না ইফাজ।
আর এখন তো মধুর খোঁজও নেই।দুইমাস আগে বিপদের আশংকা নেই ভেবে মধুকে যারা ফলো করতো ওর নির্দেশে সবাইকে ইফাজ না করে দিয়েছিলো ফলো করতে।কিন্তু এখন ওই বোকামিটার জন্য আফসোস হচ্ছে।

ইয়াদ কিছুটা শান্ত হয়ে চোখ মুছে বলল,’ভাইয়া কিসের শাস্তি দিলো ও আমায়?ও কি জানতো না ওকে ছাড়া আমি শেষ হয়ে যাবো?ও কি জানতো না আমাকে এভাবে রেখে গেলে আমি পাগল হয়ে যাবো!তাহলে কেনো এমন করলো?কেনো?

ইফাজ নিরুত্তর।কি বলবে?কিছু বলারও নেই।যা স্বপ্নে কল্পনা করতে পারে নি তাই হলো!কেনো হলো এর উত্তর নেই!তবে উত্তর জানতেই হবে!কেনো করলো মধু এমন এর উত্তর মধুকে দিতেই হবে।

ইফাজ ইয়াদকে একটা প্রেশারের ঔষধ আর ঘুমের ঔষুধ খাইয়ে দিলো।তা নাহলে আবার হাইপার হয়ে যাবে।আর এতে দুর্ঘটনার সম্ভবনাও আছে।

ইয়াদ ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ইফাজ নিজের রুমে এসে নিখিলকে ফোন দিলো।নিখিল ফোন রিসিভ করতেই ইফাজ বলল,’দেখা করতে পারবি?’

নিখিল হাতঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো রাত ৯.০৪ বাজে।দেখা করাই যায়।তাই বলল,’হ্যাঁ পারবো।কোথায় আসতে হবে বল।’

‘বাসায় চলে আয়।’

‘আচ্ছা।’

নিখিল আধঘন্টার মাঝেই চলে এলো।ইফাজের বাবা মায়ের সাথে একটু কুশল বিনিময় করে ইফাজের সাথে ছাদে চলে গেলো।ছাদের দরজাটা বন্ধ করে ফিরে আসতেই নিখিল বলল,’এনি থিং রং ইফাজ?’

‘ইয়েস।একজনকে খুঁজতে হবে।’

‘কাকে?’নিখিল জিগ্যাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো।

ইফাজ সাথে করে ইয়াদের ফোনটা নিয়ে এসেছিলো।ফোনের গ্যালারি থেকে মধুর ছবিটা দেখিয়ে বলল,’এই মেয়েটাকে।’

‘ঠিকাছে।একটা মিসিং ডায়েরি করবি?’

‘না,আমি চাই তুই আনঅফিশিয়ালি আমাকে হেল্প কর।’

‘আচ্ছা।আমি চেষ্টা করবো।’

‘আচ্ছা।’
নিখিলের সাথে সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ করে ইফাজ ওকে বিদায় দিলো।তারপর নিজের বিশ্বস্ত কয়েকজনকেও খোঁজার দায়িত্ব দিলো।
—————–
গত চারদিন ধরে নিজেকে রুমে বন্ধ করে রেখেছে ইয়াদ।কারো সাথে কথা নেই।শুধু সাইদা খান জোরাজুরি করলে একটু খায় তা নাহলে সারাদিন ঘরে বসে থাকে।

আজকে ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করার কথা থাকলেও ইয়াদের কোনো হেলদোল নেই।

ইরিন ভাইয়ের রুমে এসে ঘরটা গুছিয়ে জানালা গুলো খুলে দিয়ে বিছানায় এসে বসলে।ইয়াদ বিরক্তমুখে বলল,’এখানে আসছিস কেনো?’

‘ভাইয়া আজকে তোমার জয়েনিং।যাবে না?’

‘না যাবো না।তুই এখান থেকে যা।’

‘ভাইয়া প্লিজ এভাবে পড়ে থেকো না।আমাদের খারাপ লাগে।তাকদিরের ওপর কারো হাত নেই।তুমি এভাবে বসে থাকলে কিচ্ছু পাল্টে যাবে না।তুমি জানো তোমার জন্য বাসার কারো মনই ভালো নেই
আব্বু,আম্মু তোমার কষ্ট দেখে ছটফট করছে।তুমি একটা বেইমানের জন্য তাদের কষ্ট দিবে?’

ইয়াদ ইরিনের দিকে তাকালো আসলেইতো এভাবে গুমরে মরলে তো কিচ্ছু হবে না।অন্তত বাবা মায়ের কথা তো চিন্তা করতে হবে।তবে আর যাইহোক বেইমানির কোনো ক্ষমা নেই।ইয়াদ দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বলল,’আমি যাবো ভার্সিটিতে।’

ইরিন খুশী হয়ে বলল,’আচ্ছা তুমি রেডি হয়ে আসো।আমি আম্মুকে বলি খাবার দিতে।’
ইয়াদ মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই ইরিন বেরিয়ে গেলো।ইরিন যেতেই ইয়াদ নিজের ওয়ালপেপারে একবার মধুর ছবিটা একবার দেখে মনে মনে বলল,’আমি যে কষ্ট পাচ্ছি তার থেকেও বেশি কষ্ট যেনো তুমি পাও।তাহলে বুঝতে পারবে মন ভাঙার কষ্ট!এত কষ্ট পাও যেনো কষ্ট লাঘব করতে আবার আমার কাছেই ফিরতে হয়!পাষাণী,খুব ভালোবাসি তোমাকে!

ইয়াদ রেডি হয়ে নিচে নামলো।সাইদা বেগম ডাইনিং টেবিলে খাবার বেড়ে অপেক্ষা করছিলো।ইয়াদ মায়ের পাশে এসে বালো।সাইদা ছেলের না বলা কথা বুঝতে পেরে খাইয়ে দিলেন।খাওয়া শেষে বাবা মাকে সালাম করে বেরিয়ে পড়লো।

রিকশায় বসে আশেপাশে তাকাতেই আগের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো।এই রাস্তার প্রতিটা ইট,বালু,কণা জানে ওদের ভালোবাসার কথা!প্রত্যেকটা মোড় মনে করিয়ে দিচ্ছে মধুর শূন্যতা!ইয়াদের এখন খুব করে একটা গান পড়ছে…

”এই. রাস্তা গুলো লাগে বড় অচেনা
আকাশটার সাথে নাই জানাশোনা
এই. রাস্তা গুলো লাগে বড় অচেনা
আকাশটার সাথে নাই জানাশোনা

আমি তোর. প্রেমেতে অন্ধ
ছিলো চোখ কান সব বন্ধ
থেমে গেছে জীবনের লেনাদেনা

সেই পুরোনো রাস্তাটায়.
আজ একা একা হেটে যাই
হচ্ছনা হিসাবের বনিবনা

এখন এমনি করে ভালো
কেমন করে বাসি অন্য কোনো পাখিকে
তার চেয়ে ভালো ছিল তুই নিজ হাতে খুন করে যেতি
আমাকে…’

একটা সময় গানটা এমনিতেই শুনতো ইয়াদ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে গানটা ওর জন্যই বানানো হয়েছে।যেনো প্রত্যেকটা লাইন অদ্ভুত ভাবে মিলে যাচ্ছে।
—————-
প্রথম ক্লাস বলে আজকে ক্লাস হয় নি।শুধু পরিচয় পর্ব হয়েছে।কলিগদের সাথে হালকা পরিচিত হলো।তারপর নিজের ক্লাস টাইম শেষে বাসায় আসার জন্য রওনা দিলে।রিকশায় উঠতেই রাস্তার পাশে দেখলো আরিয়া যাচ্ছে।ইয়াদ আরিয়াকে দেখে রিকশা থেকে নেমে ওর সামনে গিয়ে দাড়ালো।মলিন হেসে বলল,’কেমন আছো আরিয়া?’

‘ভালো আছি ভাইয়া।আপনি কেমন আছেন?’

‘তোমার বান্ধবী যেমন রেখেছে।’

এই পর্যায়ে আরিয়া চুপ রইলো।ইয়াদ পুনরায় ম্লান হেসে বলল,’আচ্ছা,আল্লাহ হাফেজ।ভালো থেকো।’

‘আপনিও ভালো থাকবেন ভাইয়া।’এটা বলে আরিয়া চলে যেতে লাগলো কিন্তু হঠাৎ ইয়াদের ডাকে থেমে গেলো।ইয়াদ পিছিয়ে এসে আরিয়ার সামনে দাড়িয়ে বলল,’আচ্ছা,মধুর স্বামীকে তুমি চেনো?’

‘চিনি না তবে শুনেছি ওর খালাতো ভাইকে বিয়ে করেছে।’

‘ওহ!আচ্ছা।’
তারপর আরিয়া চলে গেলো।আরিয়া যেতেই ইয়াদ রাসেল কে ফোন দিলো।এতোদিন পর বন্ধুর ফোন পেয়ে রাসেল রিসিভ করে বলল,’কি অবস্থা এতোদিন পর মনে পড়লো শালা!’

‘চুপ কর।ফালতু কথা বাদ দে।এখন কুমিল্লা যেতে পারবি আমার সাথে?’

‘হ্যাঁ পারবো কিন্তু কেনো?’

‘চলে আয় বাসায়।পরে সব বলবো।’

‘আচ্ছা।’
ইয়াদ ফোন কেটে বাসার দিকে রওনা হলো।আর মনে মনে বলল,’আজকে কি হবে আমি জানি না।তবে খুব খারাপ কিছু হবে!’

চলবে….

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৩৮
#Arshi_Ayat

আরো আধঘন্টা আগে রাসেল আর ইয়াদ বেরিয়ে পড়েছে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে।বাসায় তেমন কিছু বলে নি।ট্যুরের কথা বলে বেরিয়েছে।যেহেতু ছেলের মন ভালো নেই!এতোবড় একটা ঘটনা ঘটেছে সেহেতু ঘুরে আসুক।এটা ভেবেই কেউ আটকায় নি।
—————
ইয়াদ সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।কিছুই ভালো লাগছে না।মন চাইছে সব ভেঙে ফেলতে!কিভাবে মধু ওকে ছেড়ে আরেকজনের হতে পারলো!

রাসেল পাশের সীটে বসে কৌতুহলী চেহারায় ইয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে।কিন্তু ইয়াদ নিজে থেকে কিছু না বলায় ও ই জিগ্যেস করলো,’দোস্ত!হঠাৎ আমরা কুমিল্লা যাচ্ছি কেনো?’

‘কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে।’ইয়াদ চোখমুখ শক্ত করে বলল।

‘মানে?আমি কিছু বুঝতে পারছি না!’

রাসেলের বোঝার সুবিদার্থে ইয়াদ সবকিছু বলল।সব শোনার পর রাসেল চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,’আমার বিশ্বাস হচ্ছে না মধু এমনটা করবে।’
ও তোকে অনেক ভালোবাসে।আমার মনে হয় এখানে অন্যকোনো ঘাপলা আছে।’

‘আমিও বিশ্বাস করি নি কিন্তু বিয়ের কার্ডটা কি মিথ্যা?’

‘বিদেশ থেকে পড়ে এসে ছাগলই রয়ে গেলি।এমন একটা বিয়ের কার্ড বানানো কোনো ব্যাপারই না।’

রাসেলের কথায় এবার ইয়াদের টনক নড়ে।আসলেই তো!কিন্তু এগুলো করার পেছনে কারণ কি?আর যদি এমনই হয় তাহলে মধুর বিয়ে হয় নি!
মধুর বিয়ে হয় নি এটা ভেবেই ইয়াদের মন কিছুটা শান্ত হলো।তবে পুরোপুরি শান্ত হলো না।যদি এতক্ষণ যা ভেবেছে এগুলো সত্যি নাহয় যদি সত্যি সত্যি মধুর বিয়ে হয়ে যায়!
————–
মাত্রই লাকসাম এসে পৌঁছালো ওরা।এখান থেকে একটা সি এন জি নিয়ে মধুর খালার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।বাড়িটা ইয়াদ চিনে মধুই চিনিয়েছিলো।

আধঘন্টার মধ্যে ওরা পৌঁছে গেলো।বাড়ির সামনে এসে সি এন জি থেকে নেমে রাসেল বলল,’তুই ওদের বাড়ি চিনিস?’

‘হুম,এসেছিলাম একবার।’

‘আচ্ছা।চল।’

রাসেল আর ইয়াদ হাটা শুরু করলো।একটু হেটে ওদের বাড়ির উঠানে এলো।সারাবাড়ি মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো।আর উঠানের গেটে বিয়ের গেট করা।ইয়াদ আর রাসেলকে দেখে সাইকা এগিয়ে এসে ওদের সামনে দাড়ালো।চেনার চেষ্টা করে বলল,’আপনারা কারা?’

ইয়াদ কিছু বলল না।আশেপাশে মধুকে খোঁজার চেষ্টা করলো।কিন্তু না ওর ছায়াও দেখা যাচ্ছে না।সাইকার কথার উত্তরে রাসেল বলল,’আপু আমরা ঢাকা থেকে এসেছি।’

‘বুঝলাম।কিন্তু কার কাছে এসেছেন?’

এবার ইয়াদ বলল,’মধু আছে?’

সাইকা ভ্রু কুঁচকে বলল,’না ওরা এখানে নেই।’

‘মিথ্যা বলছেন আপনি!দেখুন আমি ঝামেলা করতে চাই না।আপনি মধুকে ডেকে দিন।আমি শুধু কয়েকটা কথা বলেই চলে যাবো।’শেষ কথাটা ইয়াদ অনুরোধ করে বলল।

‘আরে বললাম তো মধু এখানে নেই।আর কয়েকদিন থেকে আইরিন খালার আর মধুর নাম্বার বন্ধ।আমরা নিজেরাই জানি না ওরা কোথায়।’

সাইকার কথা শুনে ইয়াদ দাঁত মুখ খিচিয়ে রাসেল কে বলল,’ইয়ার এবার আমি বুঝতে পেরেছি এরা আমার মধুকে জোর করে এখানে রেখেছে।যদি এমন কিছু হয় একটাকেও আস্ত রাখবো না।’

রাসল ইয়াদের পিঠে চাপড় দিয়ে ওকে শান্ত করলো।তারপর সাইকাকে বলল,’ও আচ্ছা।যা বলবেন তাই বিশ্বাস করে ফেলবো?যদি তাই হয় তাহলে বাড়িতে কার বিয়ে?নিশ্চয়ই আপনার ভাই আর মধুর!’

‘না,আমার ভাইয়ার সাথে মধুর বিয়ে হতে যাবে কেনো?আমার ভাইয়ের সাথে মধুর বিয়ে না।আর আপনারা এখানে এসে সিনক্রিয়েট করছেন কেনো?’সাইকা বিরক্ত হয়ে বলল।

‘সিনক্রিয়েট করি নি এখনো কিন্তু ভালোয় ভালোয় যদি মধুকে না নিয়ে আসেন তাহলে সিনক্রিয়েট কতো প্রকার ও কি কি সব বুঝিয়ে দেবো।’ইয়াদ উচ্চ গলায় থ্রেট দিয়ে বলল।

বাইরে চিল্লাচিল্লির শব্দ শুনে আরাফ,শিহাব,সাইকার মা,বাবা বাকি আত্মীয় স্বজন সবাই বেরিয়ে এলো।কেউ কিছু বুঝতে পারছে না আসলে কি হচ্ছে এখানে!আরাফ এগিয়ে গিয়ে বলল,’কি হচ্ছে এখানে আপনারা কারা?’

ইয়াদ আর রাসেল কিছু বলার আগেই সাইকা বলল,’ভাইয়া জানি না কারা এরা কিন্তু এসেই মধুকে খুঁজছে।আর বলছে মধুকে নাকি আমরা লুকিয়ে রেখেছি ওর সাথে নাকি তোমার বিয়ে!’
সাইকার মুখ থেকে সব শুনে আরাফ বলল,’দেখুন খালামনি,মধু,মিলি ওরা কোথায় গেছে আমরা কেউ জানি না।ওদের ফোনও বন্ধ।আর আমার বিয়ে মধুর সাথে না।দাড়ান আপনাকে বিয়ে কার্ড দেখাই।’
আরাফ বলার আগেই সাইকা ঘর থেকে বিয়ের কার্ড নিয়ে এলো।তারপর ইয়াদের হাতে দিয়ে বলল,’দেখুন!’

ইয়াদ কার্ডে কনের নাম খেয়াল করলো।ওখানে মধুর নামের বদলে,’তাসনিম চৌধুরী রাহা’ লেখা।আর বরের নামে ‘আরাফ তালুকদার’লেখা।এবার ইয়াদের কাছে সব পরিস্কার।আগের কার্ডটা ভুয়া আর এটা আসল কার্ড।ইয়াদ কার্ডটা আরাফের হাতে ফিরিয়ে দিলো।আরাফ কার্ডটা ফেরত নিয়ে বলল,’ওদের ফোন বন্ধ পেয়ে গতকাল আমি ঢাকা গিয়েছিলাম কিন্তু ওদের ফ্ল্যাটে অন্য ফ্যামিলি থাকে।ওরা বাসা পাল্টেছে।নতুন বাসাও চিনি না।আর কাউকে চিনিও না যে ওরা কোন বাসায় উঠেছে এটা বলবে।’

আরাফের কথা শুনে ইয়াদ হতাশ হলো।মধু এখানে নেই তবে এটা জেনে খুশী হলো যে মধুর বিয়ে হয় নি!কিন্তু এই মধুর কাজটা করার কারণ কিছুতেই আন্দাজ করতে পারছে না ইয়াদ।

যেহেতু এখানে মধু নেই সেহেতু এখানে দাঁড়িয়ে অযথা সময় নষ্ট করার মানেই হয় না।ইয়াদ আরাফ আর সাইকার কাছে ক্ষমা চেয়ে রাসেলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।আজকেই আবার ঢাকা ফিরবে।

রাত নয়টার বাসে উঠলো দুজনে।ইয়াদকে কিছু একটা চিন্তা করতে দেখে রাসেল বলল,’কি ভাবছিস?’

‘দোস্ত মধু এটা কেনো করলো?আর কেনোই বা আমাকে বোঝাতে চাইলো ওর বিয়ে হয়ে গেছে।আর আরিয়াই বা কেনো মিথ্যা বলল।’

‘আরিয়ার নাম্বার আছে তোর কাছে?’

‘হ্যাঁ আছে।’

‘ফোন করে জিগ্যেস কর।’

ইয়াদ ফোন দিলো আরিয়াকে।আরিয়া রিসিভ করতেই ইয়াদ বলল,’আরিয়া তুমি আমাকে মিথ্যে কেনো বললে?’

আরিয়া ঘাবড়ে গিয়ে বলল,’কি মিথ্যা বললাম ভাইয়া?’

‘নাটক করবা না প্লিজ।আমি আজকে কুমিল্লা মধুর খালার বাড়িতে এসেছিলাম।এখানে মধু নেই।আর মধুর বিয়ে ওর খালাতো ভাইয়ের সাথে হচ্ছে না।আমি সব জানি।দুই বান্ধবী মিলে কি ঢপ টাই না দিলে আমাকে।বাহ!’ইয়াদের কন্ঠে তাচ্ছিল্য।

‘ভাইয়া আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না তবে আমি এই বিষয়ে কিছুই জানি না।মধু আমাকে যা বলেছে আমি শুধু তাই আপনাকে বলেছি।আর ওর এমন করার কারণে আমি ওর ওপর খুব রেগেও ছিলাম তাই কিছু খতিয়েও দেখি নি।আমি জানতাম না সব মিথ্যে ছিলো।’

‘আচ্ছা বিশ্বাস করলাম তোমাকে কিন্তু কেনো এমন করেছে এগুলো কিছু বলেছে?’

‘না আমিও জিগ্যেস করি নি মধুও বলে নি।’

আরিয়ার কথা শুনে ইয়াদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারপর ফোন রেখে দিলো।গ্যালারিতে গেলো।গ্যালারি ভর্তি মধুর ছবি।ইয়াদ মনে মনে বলল,’অতি শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে।শুধু সময়ের অপেক্ষা!’
——————-
আরো দুইমাস চলে গেলো…
ভেতরে ভেতরে ইয়াদ,ইফাজ দুজনেই খুঁজে চলছে মধুকে।বাসার সবাই সবকিছু জানে।ইয়াদ সেদিন কুমিল্লা থেকে এসেই সব জানিয়েছে।

আজকে ক্লাস নেই ভার্সিটিতে।ইয়াদের অফ ডে।কোথাও যাওয়ার জন্য ইয়াদ রেডি হচ্ছিলো।হঠাৎ ওর মা রুমে এসে বলল,’ইয়াদ তোর খালা এসেছে।নিচে আয়।’

‘আসছি মা।’
ইয়াদ নিচে গিয়ে দেখলো খালা তো এসেছে কিন্তু সাথে আরেকজন মহিলাও আছে।ইয়াদ চিনতে পারলো না।মায়ের পাশ বসে খালাকে সালাম দিলো।ইয়াদের মা পাশের অপরিচিত মহিলাকে দেখিয়ে বলল,’ওনি তোর রেশমা আন্টি।আমার বান্ধবী।’

ইয়াদ সালাম দিলো।আর মনে মনে বলল,’এখন এই রেশমা আন্টির কোনো মেয়ে না থাকলেই হয়!’
কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।বলতে বলতেই রেশমা আন্টির মেয়ে হাজির!সাইদা খান মেয়েটাকে ইয়াদের পাশে বসতে বলল।মেয়েটা বসার আগেই ইয়াদ উঠে দাড়ালো তারপর বলল,’আমাকে যেতে হবে মা।’

‘কোথায় যাবি?তোর না আজকে ছুটি?’

‘মধু কে খুঁজতে।’ইয়াদ স্পষ্ট স্বরে বলল।

‘আর কতোদিন খুঁজবি ওকে?’

‘যতোদিন না পাই।’
এটা বলেই ইয়াদ দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো আর সাইদা খানের প্ল্যান ফেল হয়ে গেলো।উনি চেয়েছিলেন রেশমার মেয়ের সাথে ইয়াদের বিয়ে দিতে।আজকাল ছেলের বিষন্ন আর উদাস চেহারা ভাল্লাগে না।একটা বিয়ে দিতে পারলে হয়তো পরিবর্তন হবে কিন্তু ইয়াদকে দিয়ে কোনো কাজ জোর করে করানো যায় না।তার মর্জি হলে করবে নাহলে করবে না।
—————
সেই কখন থেকে নিহা ইফাজের জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু ইফাজ আসছে না।অবশ্য আজ যেনো সময়গুলোও চা নাস্তা করে জিরিয়ে জরিয়ে যাচ্ছে।অথচ অন্যদিন বিদুৎবেগে চলে যায়।নিহা অস্থির হয়ে কতক্ষণ দরজার সামনে দাড়াচ্ছে তো কতক্ষণ বারান্দায় গিয়ে দাড়াচ্ছে!এমন করতে করতে অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো ইফাজের আগমন ঘটলো।ইফাজ ঘরে ঢুকতেই নিহা দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো।আচমকা জড়িয়ে ধরায় ইফাজ একটু অবাক হলো।তারপর বলল,’আজকে এতো খুশী খুশী লাগছে যে?’

নিহা ইফাজের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলল,’খুশীর খবর আছে ডাক্তার সাহেব।’

‘কি খুশীর খবর।’ইফাজের চোখেমুখে কৌতুহল।

‘না না এতো সহজে খুশীর খবর দেওয়া যাবে না।আমাকে এক্ষুনি কোলে নিতে হবে।তাহলে বলবো।’

‘এখন?আমি মাত্রই তো আসলাম।একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।’

‘না ফ্রেশ হওয়া লাগবে না।এখন কোলে না নিলে আমি বলবোও না।ওকে বাই।’
এটা বলে নিহা চলে যেতে নিলেই ইফাজ ধরে ফেললো।হাতের ব্যাগটা সোফায় রেখে নিহাকে ঘুরিয়ে কোলে তুলি নিলো নিহাকে তারপর বলল,’এবার বলো।’

নিহা লজ্জা পাওয়া ভঙ্গিতে ইফাজের কানেকানে বলল,’তুমি বাবা হবে ডাক্তার সাহেব।’

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৩৫+৩৬

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৩৫
#Arshi_Ayat

মধু ইয়াদের বাবার সাথে কথা বলে জানতে পারলো আজকে ইরিনের এঙ্গেজমেন্ট।সেইজন্য ওদের দাওয়াত দিয়েছে।যেহেতু হবু শ্বশুর মশাই দাওয়াত দিয়েছে সেহেতু যেতেই হবে।তাই মা’কে ও জানিয়ে রাখতে হবে।মধু ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতে গেলো।

আইরিন রহমান এলোমেলো জামা কাপড় ভাজ করছিলেন।মধু ঘরে ঢুকে বলল,’আম্মু ইয়াদের বাবা দাওয়াত দিয়েছে।আজকে দুপুরে যেতে হবে।’

‘কেনো?’আইরিন রহমান কাপড় ভাজ করতে করতেই বললেন।

‘ইয়াদের ছোটবোনের এঙ্গেজমেন্ট।তাই আঙ্কেল ফোন করে তোমাকে আর আমাকে যেতে বলেছেন।’

‘আচ্ছা যাবো।তুই তাড়াতাড়ি চলে আছিস।’

‘আচ্ছা।’
মধু মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।আজকের টিউশনি গুলো করাবে না।আজকের বদলে অন্য একদিন পড়িয়ে দিলেই হবে।

ক্লাস শেষ করে মধু বাসায় ফিরে রেডি হয়ে নিলো তারপর মা’কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

এঙ্গেজমেন্টে তেমন কেউ ছিলো না।শুধু ইয়াদের ভাই,ভাবি,মা,বাবা ইরিনের দুই একজন বান্ধবী এছাড়া আর কেউ না।আর ছেলেপক্ষ থেকে ছেলের বাবা,মা,বোন,চাচা আর জ্যাঠা।

এঙ্গেজমেন্টের সময় ইয়াদকে ভিডিও কলে রাখা হয়েছিলো।ইয়াদ’দের ওইখানে রাত!ওর চোখ,মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে বেচারা ঘুমে ঢুলছে।মধুর দেখে বেশ হাসি পাচ্ছিলো কিন্তু এতো মানুষের সামনে হাসে নি।তবে ইয়াদের একটা বিষয় বড্ড খারাপ লেগেছে মধুর ভিডিও কলে থাকাকালীন একবারও মধুর দিকে তাকায় নি ও।এমন ভাব করলো যেনো কোনোদিন দেখেই নি।আবার এদিকে ইরিনের ননদটা ড্যাবড্যাব করে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে ছিলো।তাকাবেই তো এভাবে স্যান্ডো গেঞ্জি পরে কলে আসলে তো দেখবেই।একবার শুধু আজকে ফোন দে তারপর শরীর দেখায় ঘোরা আমি বের করবো!
মধু মনে মনে এগুলো বিড়বিড় করছে আর সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে।

আজকে আইরিন রহমানের সাথে ইয়াদের বাবা মায়ের বেশ ভালো করেই কথা হয়েছে।কথার ধাচ দেখে বোঝা যাচ্ছে দু পক্ষের কারোই বিয়ের বিষয়ে আপত্তি নেই কিন্তু তাতে কি বর নিজেই তো গায়েব।কি সুন্দর সবার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।কয়দিন পর ছেলে মেয়ে হবে।আর আমারই কপাল ফুটা!মনে মনে এমনই আফসোসের সুর তুলছে মধু।
————
সন্ধ্যার সময় ইয়াদের বাবা মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে মা আর মেয়ে দুজনই বসায় যাওয়ার জন্য রওনা হলো।হঠাৎ আইরিন রহমান বললেন,’মধু রিকশাটা থামাতে বল তো একটু।’

মধু মায়ের কথায় রিকশা থামাতে বলল।আইরিন রহমান রিকশা থেকে নেমে বলল,’তুই থাক আমি আসছি।’

‘কোথাও যাচ্ছো তুমি?’

‘সামনেই।যাবো আর আসবো।’

‘আচ্ছা চলো আমি যাচ্ছি।একা ছাড়া যাবে না।কয়দিন আগেই তো এক্সিডেন্ট হলো!’

মেয়ের ভালোবাসায় আইরিন রহমান ভালো লাগছে কিন্তু আবার খারাপও লাগছে এই ভেবে যে নিজের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জন্য মেয়েটা এতো কষ্ট দিয়েছে।মাঝেমধ্যে এগুলো মনে পড়লে বুকটা ফেটে আসে।এতো অত্যাচার করার পরও মেয়েটা তাকে আগলে রেখেছে।

আইরিন রহমান গিয়ে একটা ফুলের দোকানে গেলেন।মধু ভাবছে তার মা হঠাৎ এখানে এসেছে কেনো!আইরিন রহমান একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন তারপর দোকানীকে বললেন,’খোঁপা পরার জন্য একটা সুন্দর করে গাজরা বানিয়ে দেন।’

মধু ভ্রু কুঁচকে বলল,’মা তুমি গাজরা পরবা?’

‘আরে না তোর জন্য নিচ্ছি।তোর খোপাটা খালি খালি লাগছে।আর আমার তো এগুলো পরার দিন চলে গেছে।সময় এখন তোদের তোরা পরবি।’

‘ধূর তুমি কি যে বলো না।’মাকে এটা বলে দোকানী বলল,’আপনি দু’টো গাজরা দিয়েন।’

‘আরেকটা কার জন্য?’

‘কার জন্য আবার তোমার জন্য।তোমার খোঁপাটাও তো খালি।’

‘ধূর আমি বুড়ো হয়ে গেছি।এখন গাজরা পরলে মানুষ কি বলবে!’

‘মানুষ যা ইচ্ছা বলুক তোমার শুনতে হবে কেনো?মানুষ আমাদের খাওয়ায় না পরায় আমারা ওদের কথা শুনে চলবো কেনো?’

‘কিন্তু…’

‘কিন্তু, টিন্তু আমি বুঝি না।আমি পরলে তুমিও পরবা।’

আইরিন রহমান আর কিছু বললেন না।মেয়ের শাসনটাই চলুক আজ!

দুটো গাজরা নিয়ে রিকশায় উঠলো দুজনে।রিকশায় বসে প্রথমে মধুই মা’কে গাজরা পরিয়ে দিলো পরে আইরিন রহমান মেয়েকে পরিয়ে দিলেন।দু’জনে মুখেই হাসি!
—————
মধু বই সামনে নিয়ে অপেক্ষা করছে ইয়াদের ফোনের।এখন রাত ১২.০১ বাজে।মা আর মিলি তো আরো আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে।হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে আর মধু সাথে সাথেই ফোন রিসিভ করে।অবশ্য প্রতিদিনই এমনটা হয়!ইয়াদ ফোন দিতে দেরি মধুর ধরতে দেরি নেই।আজকে ফোন ধরেই মধু বলল,’আজকে আমার মন খুব খারাপ।’

ইয়াদ ওপাশ থেকে কৌতুহলী হয়ে বলল,’কেনো?’

‘সবার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।কয়দিন পর বাচ্চাও হয়ে যাবে।আর আমি এতিমের মতো ঘুরছি!আপনি আসেন না কেনো?’

মধুর কথা বলার ভঙ্গি আর অভিযোগ শুনে ইয়াদ হেসে ফেললো।কিন্তু ইয়াদের হাসি শুনে মধু ফায়ার হয়ে বলল,’হ্যাঁ হাসি তো আসবেই।হাসেন!আরো হাসেন!ও হ্যাঁ ভালো কথা মনে পড়ছে আপনি দুপুরে খালি গায়ে ভিডিও কলে আসছিলেন কেনো?মেয়েদের শরীর দেখাইতে ভাল্লাগে?’

ইয়াদ পুরোপুরি তাজ্জব বনে গেলো মধুর কথায়।মাথা চুলকে বলল,’আরে খালি গায়ে কোথায় ছিলাম গায়ে তো স্যান্ডো গেঞ্জি ছিলো।আর বাইরের কেউ তো ছিলো না।সব তো আমরা আমরাই।’

‘স্যান্ডো গেঞ্জি পরা আর না পরা একই।আর আপনি জানেন না ইরিনের ননদটা কি কু নজরে আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলো।’

‘ওহ!তুমি এবার মানুষের নজরও মাপা শুরু করছো!হায়রে!’

‘তো করবো না।নিজের জিনিস তো নিজেরই হেফাজত করতে হবে তাই না!আর শুনুন আপনি আর এভাবে খালি গায়ে আসবেন না।’

‘আচ্ছা ম্যাম আর এভাবে আসবো না।’
‘আচ্ছা আমরা বিয়ে করবো কবে?’

‘আবার।’ইয়াদ বিরক্ত হয়ে বললেও মধু হেসে দিলো।
——————-
ইদানীং নিহার মন অনেক খারাপ থাকে আর ওর এই মন খারাপের কারণ যে ইফাজ এটা ইফাজও বুঝতে পারে।তাই আজকে একটা ফয়সালা করবে সম্পর্কটার।এভাবে একটা মেয়েকে কষ্ট দিয়ে মিথ্যা সম্পর্কটা বয়ে বেড়ানো যায় না।ইফাজ ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরে রুমে আসতেই দেখলো রুম অন্ধকার। আর বারান্দা থেকে গানের আওয়াজ আসছে

“তোমার আমার প্রেম
আমি আজও বুঝিনি
ওই চোখের চাওয়াতে
প্রেম আজও দেখিনি

দূরে তবু দূরে
সরে থাকতে পারিনি
কাছে এসে কেন
কাছে আসতে পারিনি

আমি আজও বুঝিনি
আমি আজও বুঝিনি
তোমার আমার প্রেম
আমি আজও বুঝিনি

ওই চোখের চাওয়াতে
প্রেম আজও দেখিনি
সুরে সুরে গানে কবিতায়
তোমাকেই খুঁজে মন
তবু হায়
তুমি দাও না ধরা……

ইফাজ বিছানায় বসে চুপচাপ গানটা শুনছিলো।হঠাৎ গানটা বন্ধ হয়ে যায়।আর নিহা ধীর পায়ে বারান্দা থেকে উঠে এসে লাইট জ্বালিয়ে বলল,’কখন আসলে?’

‘এইতো একটু আগে।’

‘ও আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে নাও।খাবার দিচ্ছি।’
এটা বলে নিহা চলে যেতে নিলেই ইফাজ নিহাকে ডাক দেয়,’শোনো।’

নিহা ঘুরে দাড়াতেই ইফাজ ইতস্তত করতে করতে বলল,’তোমার সাথে কথা আছে।’

‘আচ্ছা। আমি আসছি।’এই বলে নিহা বেরিয়ে গেলো।

ইফাজের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে গেছে ও নিহার জন্য অপেক্ষা করছে।একটু পর নিহা রুমে এসে ইফাজের মুখোমুখি বসে বলল,’হুম,বলো।’

‘নিহা আমার মনে হয় আমাদের এই সম্পর্কটা বয়ে বেড়ানো উচিত না।দেখো আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোমার সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করার কিন্তু পারছি না।তোমাকেও কষ্ট দিচ্ছি নিজেও পাচ্ছি।তুমি প্লিজ ডিভোর্স দিয়ে দাও আমাকে।আমার জন্য তোমার জীবনটা নষ্ট হচ্ছে।তুমি ভালো কাউকে ডিজার্ভ করতে!’

এবার নিহা ইফাজকে থামিয়ে দিয়ে চট করে বলে উঠলো,’নাহ!আমি তোমার চেয়ে ভালো কাউকেই ডিজার্ভ করতাম না কারণ ভালো তো মানুষ একবারই বাসে।যেমন তুমি মধুকে বাসো তেমন আমি তোমাকে বাসি।তোমার নাতি নাতনি হয়ে গেলেও তোমার মনে মধুও থাকবে আর আমার মনে তুমি।এখন যদি আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করি তাহলে এখন যেমনটা তুমি আমার সাথে করছো তেমনটা আমিও তার সাথে করবো।কারণ আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।শুধু শুধু ভালো থাকার নাম করে আরেকজনকে ঠকাবো কেনো?আমি এই বাড়ি ছেড়ে যেতে পারবো না প্রথমত তুমি।দ্বিতীয়ত বাবা মা।মানুষ দুটোকে আমি খুব ভালোবাসি।পারবো না আমি তাদের ঠকাতে।’

একটানে নিহা কথাগুলো বলে উঠে আবার বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো।
——————
এখন ফোন রাখতে হবে কারণ অফিসে ফোন চালানো নিষেধ।তাই ও মধুকে বলল,’আচ্ছা এখন রাখি অফিসে চলে এসেছি।’

‘আমরা বিয়ে কবে করবো।’

‘ধ্যাত!’
বলে ইয়াদ ফোন রেখে দিলো আর মধু হাসতে হাসতে শেষ।আজকে কথা বলার সময় ‘আমরা বিয়ে কবে করবো’ এটা বলে বলে ইয়াদের মাথার তারছিড়ে ফেলেছে।
———
দেখতে দেখতে তিনটা বছরের অবসান ঘটিয়ে আজ ইয়াদ বাড়ি ফিরবে।বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের মাঝে একটা উত্তেজনা কাজ করছে।এতোদিন পর ছোটো ছেলে ঘরে ফিরবে।ইয়াদকে রিসিভ করতে ওর বাবা আর ভাই গেছে এয়ারপোর্টে।

চলবে…

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৩৬
#Arshi_Ayat

দশদিন আগের কথা….
মধু পড়াশোনা শেষ করে ইয়াদের ফোনের অপেক্ষা করছিলো।আর অনলাইনে বিয়ের লেহেঙ্গা দেখছিলো।বিয়েতে কোন লেহেঙ্গা পরলে ভালো লাগবে এটা নিয়েই গবেষণা চলছিলো।মধু মেরুন রঙের একটা লেহেঙ্গা দেখতে দেখতে বাঁকা হাসি দিয়ে মনে মনে বলছিলো ‘এই একসপ্তাহে আমি সব শপিং করে ফেলবো।আর দশদিন পর যেদিন ইয়াদ আসবে সেদিনই ওকে বিয়ে করবো।এবার আর পালাতে পারবে না চান্দু।’
মনে মনে এগুলো বলতে বলতেই কল এলো ইয়াদের।মধু রিসিভ করতেই ইয়াদ বলল,’কি করছো?’

‘আমার জন্য বিয়ের লেহেঙ্গা আর আপনার জন্য শেরওয়ানি দেখছি।’মধু হাস্যজ্বল কন্ঠে উত্তর দিলো।

ইয়াদ প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,’মধু একটা কথা বলবো রাগ করো না প্লিজ।’

ইয়াদের এমন কন্ঠস্বরে মধু অনেকটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল,’কি হয়েছে ইয়াদ?’

‘ভিসা আর পাসপোর্ট সংক্রান্ত ঝামেলার জন্য আমাকে আরো একবছর অপেক্ষা করতে হবে।একবছর পর আমি ফিরতে পারবো।’

ইয়াদের কথা শুনে মধু একদম চুপ হয়ে গেলো।মনে হচ্ছে ফোনের ওপাশে কেউ নেই।মধুর এমন নিস্তব্ধতা দেখে ইয়াদ আবার বলল,’মধু কিছু বলো।’

‘কি বলবো?’নিরুত্তাপ কন্ঠে জবাব দিলো মধু।

‘প্লিজ আরেকটা বছর অপেক্ষা করো।’

এবার মধু প্রচন্ড রেগে গেলো।এতক্ষণ চুপ থেকে রাগটা কন্ট্রোল করছিলো কিন্তু এখন আর পারলো না।সার ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলল,’তোর আর কোনোদিন আসা লাগবে না।ওখানেই বিয়ে করে সুখে শান্তি থাক।আমিও বিয়ে করে ফেলবো।তিনটা বছর আমাকে কষ্ট দিয়ে এখন বলতেছিস আরো একবছর অপেক্ষা করতে।’বলতে বলতেই মধু কেঁদে ফললো।তারপর ফোনটা বন্ধ করে দিলো।

ওপাশ থেকে ইয়াদ আর কিছুই বলার সুযোগ পেলো না।ইয়াদের রুমমেট তৌহিদ বলল,’ইয়ার তুই বেশি করে ফেলেছিস।ভাবী অনেক কষ্ট পাইছে।বলে দিলে কি হতো?বেচারি কি সুন্দর বিয়ের প্ল্যানিং করছিলো।আর তুই মুডটাই নষ্ট করে দিলি।এখন শান্তি?’

ইয়াদ মৃদু হেসে তৌহিদের পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,’বলে দিলে তো সারপ্রাইজ হতো না।এখন ও আরো একবছর অপেক্ষা করার প্রস্তুতি নিবে কিন্তু আমি যখন দশদিন পর গিয়ে ওর সামনে দাড়াবো।ওর ফিলিংসটা দেখার মতো হবে।আমি এটা মিস করতে চাই না।’

‘বাহ!ভালোই তো প্ল্যান করেছিস।তবে দেখিস সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে যাস না।’

ইয়াদ তৌহিদের কথা সিরিয়াসলি নিলো না।ইয়াদ ভাবছে পাগলিটা যখন হঠাৎ করেই ওকে সামনে দেখবে তখন কি করবে?শক্ত করে কি জড়িয়ে ধরবে!নাকি অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিবে!নাকি বলবে,’আপনি খুব খারাপ!শুধু আমাকে কষ্ট দেন।’
ইয়াদ নিজের মতো করেই মধুর রিয়েকশন কল্পনা করছে।

তবে এই দশদিনে একবারের জন্যও মধু ফোন রিসিভ করে নি এতোই রেগেছিলো।আজ প্রিয়তমার সমস্ত রাগ অভিমান ভাঙাতে প্রিয়তম স্বয়ং হাজির হবে তার প্রিয়তমার সামনে।
এগুলো ভাবতে ভাবতেই ইয়াদ লাগেজ নিয়ে হাটছিলো।সামনে বাবাকে দেখতে পেয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,’কেমন আছো বাবা?’

‘আলহামদুলিল্লাহ বাবা ভালো আছি।তুই কেমন আছিস?’

‘এতোদিন ভালো ছিলাম না।তোমাদের ছাড়া তিনটা বছর খুব কষ্টে কেটেছে।কিন্তু এখন ভালো আছি।’

এবার পাশ থেকে ইফাজ খোঁচা মেরে বলল,’এদিকে আমি আছি।’

ইয়াদ হেসে ভাইকেও জড়িয়ে ধরলো।তারপর তিন বাপ-বেটা বাসার দিকে রওনা হলো।ইফাজ ড্রাইভিং সিটে বসলো।ওর পাশে ইয়াদ আর পিছনে ইয়াফ খান।গাড়িটা ইফাজ নতুন কিনেছে কিছুদিন হলো।নিহা’ই অবশ্য পছন্দ করেছিলো।আর নিহার পছন্দের ওপর সবারই আস্থা আছে।

বাসায় পৌঁছে সাইদা খান, ইরিন আর নিহার সাথে দেখা করেই ইয়াদ মধুর বাসার দিকে ছুটলো।যাওয়ার সময় ভাইয়ের গাড়িটাও নিয়ে গেলো।আজকে প্রিয়তমার সাথে একটা লং ড্রাইভও হয়ে যাবে।বারবার গাড়ির মিররে নিজের চেহারা দেখছে আর নিজে নিজেই হাসছে ইয়াদ।যতোটা মধুর বাড়ির দিকে এগুচ্ছে মনে হচ্ছে যেনো হৃদয়টা ফেটে বেরিয়ে যাবে এতো জোরে লাফাচ্ছে!উত্তেজনায় ইয়াদের অবস্থাই কাহিল।তিনটা বছর পর আবার সামনাসামনি!মধুদের বাসার সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো।তিনতলায় পৌঁছে দরজায় নক দিলো।দুই/তিনবার নক দিতেই অচেনা একটা মেয়ে দরজা খুললো।ইয়াদকে একবার আগা গোড়া দেখে নিয়ে বলল,’কে আপনি?কি চাই?’

‘মধুকে চাই না মানে মধু আছে?’

‘না এই বাসায় কোনো মধু থাকে না।’

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে বলল,’জ্বি না,এই ফ্ল্যাটে মধুরা থাকতো।’

‘আরে ভাই আমরা নতুন আসছি এই বসায়।আগে কারা ছিলো আমরা জানি না।আপনি বাড়িওয়ালাকে জিগ্যেস করেন।’

এটা বলেই মেয়েটা ইয়াদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো।ইয়াদ চিন্তিত মুখে নিচতলায় গিয়ে বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটে নক করলো।বাড়িওয়ালার বউ বের হয়ে এলেন।ইয়াদ মহিলাকে সালাম দিয়ে বলল,’আন্টি মধুরা কি চলে গেছে?’

‘হ্যাঁ ওরা তো গত মাসেই রুম ছেড়ে দিয়েছে।’

‘ওহ!কোথায় গেছে বলতে পারবেন?’

‘না এটা জানি না।বলে নি ওরা।’

‘ওহ!আচ্ছা আন্টি।ধন্যবাদ।’
মহিলাটা দরজা আটকে দিলো।ইয়াদ চিন্তিত মুখে বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়ির দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাড়ালো।পকেট থেকে ফোন বের করে মধুকে কল দিলো।ফোন বন্ধ!দুইদিন ধরে ফোন বন্ধই আছে।ইয়াদ কল লিস্ট অনেক খুঁজে আরিয়ার নাম্বার বের করে আরিয়াকে ফোন দিলো কিন্তু আরিয়া কল ধরছে না।বেশ কয়েকবার ফোন করার পরও যখন কল ধরছে না তখন ইয়াদের ভেতর ভয় চলে আসলো পাশাপাশি চিন্তাও হচ্ছে।এখন আরিয়ার বাসায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।ইয়াদ আরিয়ার বাসার দিকে রওনা হলো।ওর বাসায় এসে নক করতেই আরিয়া দরজা খুললো।ইয়াদকে দেখে বলল,’আমি জানতাম আপনি আসবেন।একটু দাড়ান,আসছি।’

এটা বলেই আরিয়া ভেতরে গিয়ে দুইমিনিট পর আসলো।তারপর বলল,’চলুন।’

ইয়াদ আরিয়ার সাথে বিনাবাক্যে বের হলো।বাসা থেকে বের হতেই ইয়াদ বলল,’কি হয়েছে আরিয়া?’

আরিয়া কিছু না বলে একটা বিয়ের কার্ড ইয়াদের হাতে দিলো।ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে বলল,’এটা দিলে কেনো?এটা কার?’

‘খুলে দেখুন।দেখলেই বুঝবেন।’

ইয়াদ কিছুটা কৌতুহল কিছুটা ভয় নিয়ে কার্ডটা খুললো।কনের নামের জায়গায় ‘তয়ত্রি রহমান মধু’ লিখা।শুধু এতটুকু দেখেই ইয়াদের মাতা চক্কর দিলো।ইয়াদ আরিয়ার দিকে তাকাতেই আরিয়া বলল,’মধুর বিয়ে হয়ে গেছে।আরো একসপ্তাহ আগে।’

এটা বলেই ইয়াদের দেওয়া রিং টা ওর হাতে দিয়ে বলল,’যাওয়ার সময় এই রিং টা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলো আপনাকে এটা দিতে।

ইয়াদ এখনো বুঝে উঠতে পারছে না আসলে কি হচ্ছে এটা!মধু বিয়ে করবে কেনো?এইতো দশদিন আগেও তো কথা হলো।দশদিনের মধ্যে এমন কি হলো যে বিয়ে করে ফেলতে হবে।ইয়াদ বহুকষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল,’কিন্তু কেনো এগুলো করলো ও?’

‘আমি জানি না।বলে নি আমাকে।শুধু বিয়ের কার্ডটা আর রিং টা দিয়ে চলে গিয়েছিলো।’

‘ও এখন কোথায় থাকে? ঠিকানা আছে তোমার কাছে?’

‘না,ও ঠিকানাও দেয় নি।আমি বারবার জিগ্যেস করেছিলাম কিন্তু বলে নি।’
অতঃপর আরিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’আচ্ছা ভাইয়া আমি যাই।আমার যা বলার ছিলো আমি বলেছি।’
ইয়াদ হ্যাঁ,না কিছুই বলল না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো আর আরিয়া চলে গেলো।
———————
এই অবস্থায় কাকে কি বলা উচিত অথবা কি করা উচিত কিছুই মাথায় ঢুকছে না ইয়াদের।কোন কারণে মধু এতো বড়ো শাস্তি দিলো!ইয়াদ আরিয়ার সাথে কথা বলে আর বসায় যায় নি।নদীর পড়ে এসে বসেছিলো।বারবার মনে পড়ছে মধুর সাথে কাটানো সময়গুলো।এতো সহজে ও এই স্মৃতিগুলো ভুলে যেতো পারলো!

বাসা থেকে অনেকবার কল দিয়েছে সবাই কিন্তু ইয়াদ কারো কলই রিসিভ করে নি।
তাই ইফাজ,ইয়াফ খান দু’জনেই খুঁজতে বের হলো।অনেক খোঁজাখুঁজি করে ইফাজ নদীর পাড়ে গিয়ে দেখলো ওর গাড়িটা সেখানে পার্ক করা।কিন্তু ইয়াদকে দেখা যাচ্ছে না।ইফাজ আশেপাশে ভালো করে খুঁজলো কিন্তু পেলো না।ঘাট কিনারে নামতেই দেখলো ইয়াদ বসে আছে।ইফাজ পেছন থেকে ডাক দিলো,’এই ইয়াদ,ওইখানে কি করিস।উঠে আয়।’

ইয়াদের কোনো হেলদোল নেই।ইফাজ নেমে এসে ইয়াদের পাশে বসলো।ইয়াদকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,’কি রে কথা বলছিস না কেনো?’

ইয়াদ ইফাজের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’মধুর বিয়ে হয়ে গেছে।’
শুধু এতটুকু বলেই ইয়াদ ঢলে পড়লো।ইফাজ দ্রুত ইয়াদকে আকড়ে ধরলো।

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৩৩+৩৪

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৩৩
#Arshi_Ayat

মেঝেতে বসে হাঁটু মুড়ে চুপচাপ বসে আছে মধু।একটু আগে আইরিন রহমান অনেকবার ডেকে গেছেন কিন্তু মধু স্ট্যাচু হয়ে বসে ছিলো।কোনো জবাব দেয় নি।কাল ইয়াদের সাথে মনোমালিন্য হওয়ার পর থেকেই এই অবস্থা।

হঠাৎ দরজার বাইরে আরিয়ার গলা শোনা গেলো।আরিয়া বারবার ডাকছে।হঠাৎ আরিয়ার একটা কথায় মধুর প্রাণ টাই উড়ে যেতে নিলো।বসা থেকে উঠে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,’কি হয়েছে ইয়াদের?’

আরিয়ার মধুর হাত ধরে ওর টেনে এনে সোফায় বসিয়ে বলল,’শান্ত হ মধু।’

‘কি শান্ত হবো!কোন হসপিটালে ইয়াদ?তাড়াতাড়ি চল।এখনি যেতে হবে।সব দোষ আমার।আমার জন্য এই অবস্থা হলো।ওর কিছু হলে আমি মরে যাবো।’
মধু একনাগাড়ে এগুলো বলছে আর কাঁদছে। ইয়াদের কাছে যাওয়ার জন্য হন্তদন্ত হয়ে দরজা দিয়ে বের হতে নিলেই আরিয়া ওর হাত ধরে ফেললো।মধু বাঁধা পেয়ে বলল,’তাড়াতাড়ি যেতে হবে আমার।যেতে দে আমাকে।’
আরিয়া মধুকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’পাগলামি করিস না।ইয়াদ ভাইয়ার কিছু হয় নি।তুই দরজা খুলছিস না বলে মিথ্যে বলেছিলাম।’

মধু এটা শুনে আচমকা আরিয়ার গালে একটা চড় মেরে দিলো।রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,’এটা না বললেও পারতি।’

আরিয়া অনুতপ্ত গলায় বলল,’সরি রে,ইয়াদ ভাইয়া সকাল বেলা আমাকে ফোন দিয়ে অনেক অনুরোধ করে বলেছিলো তোকে যেনো এয়ারপোর্টে নিয়ে যাই।’

মধু চোখ মুছে কঠোর গলায় বলল,’যাবো না আমি।’

‘প্লিজ মধু।এমন করিস না।নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস।ভাইয়াকেও কষ্ট দিচ্ছিস।এমন করে কি সুখ পাচ্ছিস বল তো?’

‘না,আমি যাবো না।ও তো আমাকে ভালোবাসেই না।আমি গিয়ে কি করবো!আমি যাবো না।’মধু ভেজা গলায় বলল।

‘পরে আবার আফসোস করিস না।’আরিয়া থমথমে গলায় বলল।তারপর চলে যেতে নিলেই মধু বলল,’চলে যাচ্ছিস?’

‘হ্যাঁ তো কি করবো?তোকে নিতে এসেছিলাম।কিন্তু এখন তো তুই যাবি না তো থেকে কি করবো?’

মধু একমিনিট চুপ করে থেকে বলল,’বস,আমি পাঁচমিনিটে রেডি হয়ে আসছি।’

আরিয়া কিছু বলল না।নিঃশব্দে সোফায় বসে পড়লো।আর মধু ওয়াশরুমে চলে গেলো।মধু ওয়াশরুমে যাওয়ার পর আরিয়া মুচকি হাসলো।কারণ ও জানতো মধু যাবেই।
কাল যখন ওদের মনোমালিন্য হয়েছিলো তখন ইয়াদ আরিয়াকে ফোন দিয়ে সব বলেছিলো।ইয়াদের ভিষণ মন খারাপ ছিলো মধুকে ভুল বুঝেছে বলে।তারপর যখন অনেকবার ফোন দিয়েও মধুকে পায় নি তখন রাত বারোটার সময় আরিয়াকে আবার ফোন দিয়ে বলেছিলো,’তোমার বান্ধবী যেনো আমাকে বিদায় দিতে না আসে।আমি মরে গেলেও যেনো না আসে।’অনেকটা অভিমানী গলায়ই বলেছিলো।
তারপর আরিয়া বুঝেছিলো দু’পক্ষেই অভিমানের পাল্লা ভারী হয়ে গেছে।এখন ওকেই কিছু করতে হবে।তাই আরিয়া ভাবলো সকাল বেলা মধুকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে।এমনি বললে তো আরো ফুলে থাকবে তাই বানিয়ে বানিয়ে বলতে হলো।

মধু তৈরি হয়ে আসলো।তারপর আইরিন রহমানকে বলে ওরা দুইজন বেরিয়ে গেলো।
—————
ইমিগ্রেশনের পর ইয়াদ ওর বাবা,মা,বোন,ভাই,ভাবীর সাথে কথা বলছিলো।ওর বাবা,মা অবশ্য মধুর কথা জিগ্যেস করেছিলো।ইয়াদ কিছু একটা বলে কাটিয়ে নিলো।কিন্তু মন থেকে ভিষণ ভাবে চাইছে যেনো একবার দেখা হয়!কিন্তু ও তো আসে নি!কিভাবে দেখা হবে?একটু পরই ফ্লাইট!ইয়াদের মনটা খারাপ হয়ে গেলো।যাওয়ার সময় এমনটা সত্যিই চায় নি ইয়াদ!

আর এদিকে আরিয়া আর মধু এয়ারপোর্টে চলে এসেছে কিন্তু চেকপোস্টের দায়িত্বরত পুলিশ ওদের ঢুকতে দিচ্ছে না পাসপোর্ট ছাড়া।এখন পাসপোর্ট কোথায় পাবে?আর পাসপোর্ট ছাড়া তো ঢোকাও যাবে না।কি মুশকিল!
হঠাৎ করে আরিয়ার মাথায় এলো ইয়াদকে ফোন করলেই তো হয়।আরিয়া ইয়াদকে ফোন দিলো।ইয়াদ আচমকা কারো ফোন পেয়ে স্ক্রিনে দেখলো আরিয়া!ফোন রিসিভ করতেই আরিয়া বলল,’ভাইয়া একটু বাইরে আসেন।চেকপোস্টে আঁটকে আছি।মধুও এসেছে।’

মধুর কথা শুনে ইয়াদের যেনো জানে পানি এসেছে।আভিমান পায়ে ঠেলে বেরিয়ে এলো।হ্যাঁ মধু এসেছে।ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে ইয়াদের মায়া হলো।ইশ!কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।নিজেকে যেনো ভাগ্যবান মনে হচ্ছে কেউ একজন তার বিরহ ব্যাথায় কাতরাচ্ছে!ইয়াদ আশেপাশের লোকজন উপেক্ষা করে দুইবাহু মেলে ধরলো মধুর দিকে।এবার মধুর সাড়া দেওয়ার সময়।ছুটে এসে ইয়াদের বুকে নিজেকে সঁপে দিলো।ইচ্ছে করছে না ইয়াদকে যেতে দিতে।কিন্তু যেতে তো হবে!এই কথা মনে করেই আবারও আখিদ্বয়ে জলে পরিপূর্ণ হলো।ইয়াদ মধুর কপাল নিজের কপালে ঠেকিয়ে বলল,’এখনো কাঁদবে?’

মধু চোখের জল মুছে বলল,’না আর কাঁদবো না।’বলতে বলতেই আবার কেঁদে দিলো।আর ইয়াদের বুকে কয়েকটা কিল ঘুষি দিয়ে বলল,’আপনি অনেক খারাপ।আমাকে রেখে চলে যাচ্ছেন।যান,যান এসে দেখবেন আমি বিয়ে করে ফেলেছি।’

ইয়াদ মধুর চোখ মুছে।নাক টেনে মুচকি হেসে বলল,’তাই?মেয়ের সাহস কতো বড়।করাচ্ছি তোমাকে বিয়ে।’
এটা বলে মধুর বাম হাতটা টেনে নিয়ে পকেট থেকে একটা রিং বের করে পরিয়ে দিলো।তারপর কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল,’এই যে।ট্যাগ লাগিয়ে দিলাম।এখন থেকে তুমি শুধু আমার।এরপর কাউকে বিয়ে করা তো দূরের কথা মুখে আনলেও খবর আছে।’
মধু রিংটার দিকে তাকিয়ে হাসলো।ইয়াদ মধুর মুখটা তুলে ধরে বলল,’এই মেয়ে,কাদবে না একদম।যখনই আমার কথা মনে পড়বে মুচকি মুচকি হাসবে।যেনো সবাই বুঝে তুমি তোমার ইয়াদকে মন করছো।ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবে।আমি যেনো ফিরে এসে আটচল্লিশ কেজির মেয়েটাকে আটানব্বই কেজে দেখি।’এটা বলে ইয়াদ হাসলো।আর মধু গাল ফুলিয়ে ইয়াদের বুকে আরেকটা কিল দিয়ে দিলো।মুখ বাকিয়ে বলল,’আমি মোটা হয়ে গেলে আপনিই আমাকে কোলে নিতে পারবেন না।’

‘পারবো।’ইয়াদ দৃড়কন্ঠে বলল।
মধু কিছু বলল না।শুধু হাসলো।তারপর ইয়াদ আবার বলতে শুরু করলো,’ঠিকমতো পড়াশোনা করবে।মন খারাপ করবে না একদম।আর ভালোবাসা গুলো জমা করবে।তিনবছর পর যেনো আমি আসলে ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজতে পারি।’
মধু বলল,’আর কোনো আবদার আছে?’
‘আছে।’ইয়াদ দুষ্ট হসে বলল।
মধু ইয়াদ মতলব বুঝলো না।তাই বলল,’কি আবদার?’
ইয়াদ মুখে বলল না ইশারায় নিজের গাল দেখিয়ে বোঝালো।মধু চোখ বড় বড় করে বলল,’এসব কি হচ্ছে?’
‘ইশ!আমার থেকে তো প্রতিদিনই নাও।আর নিজে দিতেই কিপ্টামি।’

‘কিন্তু এখন…’

‘আমি কিছু জানি না।আমার চাই মানে চাই।না দিলে এয়ারপোর্টে গড়িয়ে গড়িয়ে কাঁদবো আর কেউ জিগ্যেস করলে বলবো তুমি আমাকে চুমু দাও না সেইজন্য কাঁদছি।’
মধু লাজুক হেসে বলল,’অসভ্য।’
তারপর ওর গালে আলতে করে একটা চুমু দিয়ে বলল,’খুশী?’

‘একটু একটু।তবে চলবে।এসে বাকিটা বুঝে নিবো।’

তারপর কিছুক্ষণ পর ইয়াদকে বিদায় দিলো মধু।ইয়াদ ভেতরে চলে গেলো।ইয়াদ চলে যাওয়ার পরপরই মধুর চোখে আবারও পানি চলে এলো।আরিয়া এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ফোন টিপছিলো।ইয়াদ চলে যাওয়ার পর মধুর কাছে আসলো।মধু আরিয়াকে জড়িয়ে ধরে আবারও কাঁদলো।
——————-
সারাদিনে কোনো কাজে মন বসে নি মধুর।সারাক্ষণ শুধু তাহারেই পড়ে মনে।ইয়াদকে বিদায় দিয়ে আর ভার্সিটিতে যায় নি মধু।বাসায় চলে এসেছিলো।সারাদিন তো যেমন তেমন কাটিয়ে দেওয়া গেছে।কিন্তু রাতে কেমন যেনো নিঃসঙ্গ অনুভূতি হচ্ছে।

মধু জানালায় মাতা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তিনটা বছর তাকে ছাড়া কিভাবে কাটবে!হঠাৎ মনে পড়লো ইয়াদের দেওয়া জ্যাকেটের জথা।মনে পড়ে গেলো প্রথম দেখা।ওয়ারড্রব থেকে জ্যাকেট’টা বের করে ওটা পরে বসে রইলো।পুরোনো স্মৃতিগুলো একের পর এক চোখের সামনে ভাসছে।

ঘুম আসছে না কিন্তু মাথাব্যথা হচ্ছে তাই।জ্যাকেট টা খুলে আবার ওয়ারড্রবে যত্ন করে রেখে দিলো।তারপর মায়ের রুমে পা বাড়ালো।রুম অন্ধকার!মা ঘুমিয়ে গেছে ভেবে মধু চলে যেতে নিলে আইরিন রহমান ডেকে বললেন,’আয় আমার পাশে শুয়ে পড়।’

মন খারাপের মাঝে এই কথাটা যেনো মধুর মনটা শীতল করে তুললো।বিনাবাক্যে মায়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো।আইরিন রহমান মধুর মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগলেন!আহা,কি শান্তি!
মধু পাশ ফিরে আইরিন রহমানকে জড়িয়ে ধরলো।এভাবে প্রায় কতো বছর আগে জড়িয়ে ধরেছে মাকে মনে নেই!

চলবে…

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৩৪
#Arshi_Ayat

মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলো মধু।হঠাৎ করেই বাইরে ঝড় বৃষ্টি শুরু হলো।ঝড়ো বাতাসে জানালা বারবার বাড়ি খাচ্ছে।মধু আর আইরিন রহমান শোয়া থেকে উঠে সব জানালা,বারান্দার দরজা আটকে দিলো।মধুর এখন ভয় হচ্ছে।ইয়াদ ঠিকমতো পৌঁছাতে পেরেছে কি না!এখনো তো ফোন করলো না।এগুলো ভাবতে ভাবতেই ফোন বেজে ওঠলো।মধু স্ক্রিনে দেখলো আননোন নাম্বার।আর এটা বাংলাদেশের নাম্বার না।তারমানে ইয়াদ ফোন দিয়েছে!মধু রিসিভ করতেই ইয়াদ বলল,’আমি আধঘন্টা হলো পৌঁছেছি।তুমি চিন্তা করো না।আর এবার ফোনটা রেখে ঘুমিয়ে পড়ো।একদম রাত জাগবে না।’

‘আচ্ছা,পাঁচ মিনিট কথা বলি?’মধু অনুরোধের সুরে বলল।
ইয়াদ ওর অনুরোধ ফেলতে পারলো না।বলল,’আচ্ছা,আমি ঘড়িতে দেখছি জাস্ট পাঁচ মিনিট।’

এরপর অবশ্য পাঁচ মিনিট না একটু বেশিই কথা হয়েছিলো।
—————
‘কে বাঁশী বাজায় রে
মন কেনো নাচায় রে
আমার প্রান যে মানে না
কিছুই ভালো লাগে না…..’

নিহা বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুনগুনিয়ে গান গাইছে আর বৃষ্টি উপভোগ করছে।বারান্দায় নিহাকে দেখে ইফাজ ওর পাশাপাশি এসে দাড়ালো।বলল,’আজ ভিষণ খুশী খুশী লাগছে যে?’

নিহা ইফাজের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,’আজকে আব্বু আম্মু আসবে আমাদের নিতে।’

ইফাজ ভ্রু কুঁচকে বলল,’আমাদের মানে আমিও যাবো নাকি?’

‘হ্যাঁ।’

‘নিহা তোমার কি মাথা খারাপ!আমার ডিউটি আছে।রোগীরা আমার জন্য অপেক্ষা করে!আমি পারবো না যেতে।’

‘আচ্ছা ঠিকাছে।একটা দিন অন্তত থাকো প্লিজ।’নিহা করুণ গলায় বলল।
‘একদিনও না।’
এই বলে ইফাজ বেরিয়ে গেলো।এতক্ষণ বাইরে বৃষ্টি পড়লেও এখন নিহার চোখও বৃষ্টিদের সাথে তাল মেলাচ্ছে।নিহা বারান্দার গ্রীল আঁকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বলল,’যেদিন তোমার নামে কবুল বলেছিলাম সেদিন ভেবেছিলাম আমি তোমাকে পেয়ে গেছি কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম আমি তোমাকে পাই নি।তুমি কখনোই আমার হবেও না।’

বৃষ্টির গতি সকাল সাড়ে দশটার সময় কমে এসেছে।ড্রইং রুমে নিহা আর ইরিন কথা বলছিলো।হঠাৎ দরজায় বেল বাজলো।নিহা উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো ওর আব্বু আম্মু এসেছে।নিহা মাকে জড়িয়ে ধরলো।তারপর দুজনকেই ভেতরে এনে সোফায় বসালো।এরমধ্যেই ইরিন সাইদা খান আর ইয়াফ খানকে ডেকে এনেছে।চার বেয়াই বেয়াইন মিলে খোশগল্প শুরু করলো।নিহা কিচেনে গিয়ে নাস্তা নিয়ে আসলো।গল্প করতে করতেই এক ফাঁকে নিহার মা ইফাজের বাবাকে বললেন,’আপনাদের আপত্তি না থাকলে নিহা আর ইফাজকে কিছুদিনের জন্য আমরা বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।’

‘না বেয়াইন সাহেব কোনো আপত্তি নেই।যাক ঘুরে আসুক।কিন্তু আপনার এই মেয়েটা না থাকলে আমার কষ্ট হবে।সকাল বলে উঠে ওর হাতের চা খেতে পারবো না।’এটা বলেই ইয়াফ খান হাসলেন।

নিহা শ্বশুরের পাশে এসে বসলো। বলল,’বাবা,আমি দুই তিন পরই চলে আসবো।’

ইয়াফ খান নিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।তারপর ইফাজকে ডেকে বললেন,’যা নিহার সাথে গিয়ে কয়দিন থেকে আয়।’

ইফাজ বলল,’কিন্তু বাবা…’

‘কোনো কিন্তু না।যা কয়দিন ঘুরে আয়।’

ইফাজ আর বাবার কথার ওপর কথা বলল না।এটা দিকে নিহা মনে মনে হাসলো।ও আগে থেকেই ইফাজের জামা কাপড় নিয়ে নিয়েছিলো কারণ ইফাজ না গেলে ও নিজেও যাবে না।অগত্যা ইফাজকে যেতেই হলো।
—————
মধু বিকেল বেলা বেরিয়েছিলো আরিয়াদের বাসায় যাওয়ার জন্য।বাসায় বসে বসে বোর হচ্ছিলো।ভেবেছিলো আরিয়ার সাথে একটু ঘুরে আসবে কিন্তু ওদের বসায় এসে দেখে দরজায় তালা মারা।তারপর আরিয়াকে ফোন দিয়ে জানতে পারলো ওরা সবাই গ্রামে গেছে।আরিয়াও নেই!ইয়াদও নেই!কি আর করার মধু একা একাই হাটছিলো।পেছনে ইফাজও ছিলো কিন্তু মধু দেখতে পায় নি।অবশ্য ইফাজও মধুকে খেয়াল করে নি।একটু হেটে রাস্তার মোড়ে দেখলো ভ্যানগাড়িতে গোলাপ ফুল,বেলি,আর বকুল ফুলের মালা নিয়ে বসেছে।মধু গিয়ে একটু বকুলের মালায় হাত দিলো সাথে সাথে ইফাজও সেই মালাটাই ধরলো।একদম অনিচ্ছাকৃত ভাবে হলো ঘটনাটা!কেউই কাউকে খেয়াল করে নি।ইফাজ যখন মধুর দিকে তাকালো মধুও তাকালো।ইফাজকে দেখে সালাম দিয়ে বলল,’কেমন আছেন ভাইয়া?’
ইফাজ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,’ভালো।’
তারপর অন্য একটা মালা কিনে চট করে ওখান থেকে চলে গেলো মধুকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই।ইফাজ চলে যাওয়ার পর মধু মনে মনে বলল “ইয়াদের ভাইটা এমন কাটখোট্টা কেনো?মনে হয় অহংকারে পা মাটিতে পরে না।ইয়াদের ভাই বলে না হলে জীবনেও কথা বলতাম না।’
মনে মনে এগুলো বলে মধুও একটা মালা কিনে আবার হাঁটা শুরু করলো।আর ইফাজ ওর হাতের বকুলের মালাটার ঘ্রাণ নিয়ে বলল,’আমি কখনো তোমার সামনে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করবো না।কখনো না!হ্যাঁ তবে তোমার সুখের সময় না থাকতে পারলেও দুঃখের সময় ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেবো।ভালো থেকো তুমি।’

এরপর ইফাজও অন্যদিকে চলে গেলো।
————–
ইয়াদ যাওয়ার প্রায় দুইবছর পূর্ণ হয়েছে।প্রথম প্রথম মধুর কষ্ট হলেও এখন মানিয়ে নিয়েছে।আর মাত্র একটা বছরই তো অপেক্ষা করতে হবে!সারাদিনে ভার্সিটি ক্লাস আর টিউশনি করিয়েই দিন যায় মধুর।আজও ব্যাতিক্রম হয় নি।সবকাজ শেষ করে সন্ধ্যার সময় বাসায় ঢুকলো মধু।ফ্রেশ হয়ে ফোন নিয়ে বসলে।এখনো ইয়াদ কল দেয় নি।ইদানীং ইয়াদ সময়ই দেয় না।খুব ব্যস্ত থাকে তাই।তবুও মধু কিছু বলে না।কিন্তু আজ কেনো জানি ইয়াদের সাথে সারা রাত কথা বলতে মন চাইছে।মন চাইছে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে।বলতে ইচ্ছে করছে,’আপনাকে ছাড়া আমি ভালো নেই।’

অপেক্ষা করতে করতে রাত বারোটা বেজে গেছে।কিন্তু ইয়াদের কল আর আসে না।আজকে কি ফোন দিবে না ইয়াদ?আইরিন রহমান ঘরে এসে মধুর পাশে বসে বললেন,’ঘুমাবি না?’

‘হ্যাঁ,একটু পরই ঘুমাবো।তুমি যাও।’

‘আচ্ছা তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়িস।’

‘আচ্ছা।’
আইরিন রহমান মধুর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।মধু ফোন সামনে রেখে টেবিলের ওপর মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো।

কাঁদতে কাঁদতে মধু ঘুমিয়েই পড়েছিলো।হঠাৎ ফোনের আওয়াজে মধুর ঘুম ছুটে যায়।ইয়াদ ফোন করেছে।মধু রিসিভ করে চুপ করে রইলো।ওইপাশ থেকে ইয়াদ অনুতপ্ত কন্ঠে বলল,’সরি,মধু একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টের কাজে বিজি ছিলাম।’

মধু তারপরও কথা বলল না।ইয়াদ আবারও বলল,’মধু প্লিজ কথা বলো।আমাকে একটু বুঝতে চেষ্টা করো।আমি ইচ্ছে করে এমন করি নি।’

মধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশ কন্ঠে বলল,’আপনি আর আগের ইয়াদ নেই।অনেক পাল্টে গেছেন।অবশ্য আপনার দোষ নেই।সময়ের সাথে সাথে তো সবাই পাল্টায় আপনি ও ব্যাতিক্রম নন।শুধু আমিই পাল্টাতে পারলাম না।আপনাকে এখনো পাগলের মতো ভালোবাসি।প্রতিদিন ছটফট করি আপনার সাথে কথা বলার জন্য কিন্তু আপনি ব্যস্ততা দেখিয়ে দায়সারা কথা বলে রেখে দেন।আপনি জানেন না আপনি কল রেখে দেওয়ার পর প্রতিটা সেকেন্ড আমার দমবন্ধ লাগতো!কখন আবার আপনি ফোন করবেন।যাক বাদ দেন এগুলো।এখন বলুন কি করছেন?’

এতক্ষণ সবকথা ইয়াদ মনোযোগ দিয়ে শুনেছে।মধুর কান্নভেজা কন্ঠটা ইয়াদের বুকে কঠিন ভাবে আঘাত করলো।কিন্তু কি করবে!লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপে এমনই হয়।ব্যস্ততার জন্য একটু সময় না দিতে পারলেই অপরপক্ষের মানুষটা ভেবে বসে তার ভালোবাসার মানুষটা হয়তো বদলে গেছে।কিন্তু সে তো এটা জানে না মনটা তারও পোড়ে।কিন্তু কি করার! বিদেশের মাটিতে টিকে থাকতে পড়াশোনার পাশাপাশি জবও করতে হয়।জব আর পড়াশোনা করে শরীর আর চলে না।তবুও যতোটুকু সময় পাওয়া যায় ততোটা সময় ভালোবাসা মানুষটাকেই দেয়।

ইয়াদ মধুর অভিযোগ গুলো শুনলো।কিন্তু কিছু বলল না।দেশে এসেই নাহয় সব অভিমান মেটানো যাবে।তাই ইয়াদ মধুর কথার জবাব দিয়ে বলল,’ক্লাস শেষ করে অফিসে যাচ্ছি।’

এবার মধু আবদার করে বলল,’আজকে আমার সাথে অনেক্ক্ষণ কথা বলবেন প্লিজ।’

‘আমিতো অফিসে যাচ্ছি।’

‘থাক বলা লাগবে না।’
মধু খট করে ফোনটা কেটে দিলো।তারপর ফোন বন্ধ করে ঘুমের ঔষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো।কারণ এখন ঘুমের ঔষুধ না খেলে ঘুম তো আসবেই না কাঁদতে কাঁদতে মাথাব্যথা হয়ে যাবে।

এভাবেই মধু আর ইয়াদের দিনগুলো যাচ্ছে।কখনো ঝড়, কখনো বৃষ্টি, কখনো পূর্ণিমা!
————
মধু ভার্সিটির জন্য বের হবে এমন সময় ইয়াদের বাবা মধুকে ফোন দিলো।মধু রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল,’কেমন আছেন আঙ্কেল?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আঙ্কেল।সবাই কেমন আছে?’

‘সবাই ভালোই আছে।শোনো আজকে তোমার মাকে নিয়ে বাসায় এসো।তোমাদের দাওয়াত আজকে।’

মধু কৌতুহলী হয়ে বলল,’আজকে কি স্পেশাল কিছু আঙ্কেল?’

‘হ্যাঁ।’

চলবে……

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৩১+৩২

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৩১
#Arshi_Ayat

একসপ্তাহ পরের কথা….

রাত ১২.০৩ বাজে ঘড়িতে।ঘরে মোমবাতির টিমটিমে আলো। দরজা,জানালা বন্ধ বলে আবহাওয়া গরম গয়ে উঠেছে।তিনটা চেয়ারে তিনজনকে পাটের মোটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাধা হয়েছে।ওদের চোখমুখ বাঁধা হয়েছে কাপড় দিয়ে।এদের মধ্যে একজনকে ইফাজ চিনে।এক সপ্তাহ আগে মধুকে উদ্ধার করতে গিয়ে এর সাথে কথা কাটাকাটি হয়।তারপর ওকে আর ধরতে পারে নি তবে ইফাজও বসে থাকার মতো মানুষ না।পুরোনো বন্ধু নিখিলকে কিডন্যাপের ঘটনা খুলে বলল।সব শুনে নিখিল বলেছিলো,’তুই তাহলে জিডি কর।’

‘না রে,আমি ব্যাপারটা পুলিশ কেসের মধ্যে জড়াতে চাইছি না।তুই কি আনঅফিশিয়ালি আমাকে হেল্প করতে পারবি?’

‘হুম,ব্যাপারটা কিন্তু রিস্কি।’

‘সমস্যা নেই।তুই শুধু ওদের সাথে একবার সাক্ষাৎ করিয়ে দিবি আমার।তারপর জমের বাড়ি পাঠানোর দায়িত্ব আমার।’

‘আচ্ছা,তাহলে আমার ওদের মধ্যে কারো ছবি লাগবে।তোর কাছে কি ছবি আছে?’

‘না তবে আমি ওদের মধ্যে একজনকে দেখেছি।আমার মনে হয় ওকে ধরতে পারলেই বাকিগুলোর খোঁজ পাওয়া যাবে।’

‘হুম।তুই যাকে দেখেছিস হুবুহু মনে করতে পারবি তো?’

‘হুম,পারবো।’
তারপর নিখিল একজন স্কেচ আর্টিস্টকে ডেকে নিয়ে ইফাজের কথামতো ছবি একে নিলো।আকা শেষে ইফাজ একবার ছবিতে চোখ বুলিয়ে বলল,’হুম,এটাকেই খুঁজে বের করতে হবে তোর।এটার মাধ্যমেই বাকিগুলোকে ধরা যাবে।’

‘ঠিকাছে,চিন্তা করিস না।পেয়ে যাবি অতি শীগ্রই।’

এরপর থেকে একসপ্তাহ ধরে খোঁজ চলার পর আজকে ধরতে পেরেছে একটাকে।ওইটার মাধ্যমেই বাকি দুইজনকে ধরেছে।তারপর ইফাজের কথামতো নিখিল ওদেরকে ইফাজের হাতে তুলে দিয়ে নিজের কাজ শেষ করে চলে গেলো।নিখিল যেতেই ইফাজ ঘরে আসলো।

এই জায়গাটা ঘনবসতি না।এই বাড়ির আশপাশে আর কোনো বাড়ি নেই।সবগুলো দূরে দূরে।তাই জায়গাটাই উপযুক্ত মনে হয়েছে ইফাজের কাছে।

ইফাজ ওদের তিনজনের চোখ আর মুখের বাঁধন খুলে দিলো।তৎক্ষনাৎ ওদের মধ্যে একজন গর্জে উঠে বলল,’আমাদেরকে বেঁধে রেখেছিস কেনো?পারলে বাঁধন খুলে দে তারপর দেখ কি করি।’

ইফাজ হাসলো।বাম হাতে মাথার পেছনের চুলগুলো টেনে ধরে বলল,’আমার হাতে বেশি সময় নাই তোদের সার্কাস দেখার।ভালোয় ভালোয় বলছি বলে দে কেনো মধুকে কিডন্যাপ করেছিস?’

‘বলবো না।’ওদের মধ্যে একজন রুড় গলায় বলল।

ইফাজ আর কিছু বলল না।উঠে দাড়িয়ে সবগুলোর মুখ আবার বেঁধে দিলো।তারপর ব্যাগ থেকে ধারালো একটা চাকু বের করে মোমবাতির আগুনে একটু গরম করে বামপাশের একজনের মুখ খুলে দিলো তারপর বলল,’বল,কেনো মধুকে কিডন্যাপ করেছিস?’

‘বলবো না।’লোকটা দৃড় কন্ঠে বলল।

ইফাজ ওর মুখটা আবার বন্ধ করে দিলো।গরম করা চাকুটা দিয়ে লোকটার বাম হাতের শাহাদাত আঙুলটা কেটে ফেললো।তারপর এক হাতে গলা চেপে ধরে আরেক হাতে মুখের বাঁধনটা খুলে বলল,’বল,কেনো মধুকে কিডন্যাপ করেছিলি?’

লোকটা ব্যাথায় কাতরাচ্ছে তবুও বলছে না।ইফাজ ওর মুখটা আটকিয়ে পাশের জনের কাছে গেলো।এভাবে সবাইকে টর্চার করার ফলেও কোনো ইনফরমেশন বের করতে পারলো না।ইফাজের শরীর ঘামে ভিজে গেছে।দরদর করে কপাল দিয়ে ঘাম পড়ছে।ইফাজ ঘরের এদিক সেদিক তাকিয়ে একটা লোহার রড দেখতে পেলো।রড টা এনে আগুনে গরম করে রুমাল দিয়ে ধরে মাঝের জনের মুখের বাঁধন খুলে বলল,’শেষবারের মতো বলছি কেনো মধুকে কিডন্যাপ করেছিলি?’

লোকটা তবুও বলছে না চুপ করে রইলো।ইফাজ চিকন রডটা চোখের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে নিলেই লোকটা মৃদু চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,’বলছি,বলছি।’

ইফাজ রডটা নিচে নামিয়ে বলল,’বল।’

‘আমরা কিছু জানি না।আমাদের শুধু বলা হয়েছিলো মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে বস্তিতে রেখে আসতে।’

‘কে বলেছিলো?’

‘একটা মেয়ে।’
ইফাজের ভ্রু কুঁচকে গেলো।কোনো মেয়ে কেনো মধুকে কিডন্যাপ করাবে।ইফাজ বলল,’ও কোথায় থাকে?’

‘জানি না।শুধু ওর নাম্বারটা আছে আমাদের কাছে।’

ইফাজ নিজের ফোন বের করে বলল,’নাম্বার বল।’
লোকটা ভীতু গলায় নাম্বার বলল।তারপর ইফাজ এক এক করে ওদের ফোন,মানিব্যাগ নিয়ে নিলো।এখন মেরে ফেললেও কোনো খোঁজ পাওয়া যাবে না।বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যাবে।ইফাজের আর খাটুনি করতে ভালো লাগছে না।এমনিতে এর বেশি ইনফরমেশন ওরা দিতে পারবে না।আর এদের ছেড়ে দিলেও ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।তাই মেরে ফেলেই উত্তম।

প্রথমে ইফাজ চেয়েছিলো গুলি করতে কিন্তু পরে ভাবলো গুলি করলে যদি কোনোভাবে ধরা পড়ে যায়!রিস্ক নেওয়া যাবে না।তাই হাই পাওয়ারের ড্রাগ দিয়ে দিলো ওদের তিনজনকে।তারপর হাত,পা খুলে এক একে তিনজনকেই গাড়িতে তুললো।যাওয়ার সময় নিখিল এই গাড়িটা ইফাজের জন্য ছেড়ে গিয়েছিলো।

ইফাজ গাড়ি ড্রাইভ করে নদীর পাড়ে নিয়ে এলো।আশেপাশে কেউ নেই এটাই মোক্ষম সময়!ইফাজ তিনজনকেই নদীতে ফেলে দিলো।অতিমাত্রায় ড্রাগ দেওয়ার ফলে তিনজনের কারোই জ্ঞান ছিলো না ফলে আস্তে আস্তে তলিয়ে যেতে লাগলো।

সবকাজ শেষ করে ইফাজ বাড়ির দিকে রওনা হলো।এখন ২.৩০ বাজে।নিশ্চয়ই সবাই ঘুমিয়ে গেছে।সন্ধ্যার সময় ইফাজ বাসায় ফোন করে বলেছিলো যে আজকে অপারেশন আছে তাই আসতে অনেক রাত হবে।গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই এক সপ্তাহ আগের কথা মনে হলো।যেদিন মধুকে ইফাজ বাচিয়েছিলো সেদিন রাতেই মধুকে ওকে ফোন দিয়েছিলো ঘটনাটা জানার জন্য।ইফাজ কৌশলে সবটা ধামাচাপা দিয়ে দিলো। মধুও আর কোনো প্রশ্ন করলো না।

বাসায় পৌঁছে এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খোলার আগেই নিহা দরজা খুললো।নিহাকে দেখে ইফাজ বলল,’ঘুমাও নি?’

‘ঘুমালে নিশ্চয়ই এখন তোমার সামনে থাকতাম না তাই না!এখন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও আমি খাবার নিয়ে আসছি।’

ইফাজ অযথা কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে গেলো।জামা কাপড় ছেড়ে শাওয়ার নিয়ে একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে রুমে আসতেই দেখলো নিহা খাবার বেড়ে বসে আছে।ইফাজ এসে নিহার পাশে বসলো।নিহার দিকে চেয়ে বলল,’খেয়েছো তুমি?’

‘না,তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আর খাওয়া হয় নি।’

‘তোমাকে তো বলেছিলাম আমার দেরি হবে।তবুও কেনো খেলে না?শরীর খারাপ করার বুদ্ধি সব তাই না?এখন আমার সাথে খাবে।’ইফাজ একটু শাসনের ভঙ্গিতে বলল।

‘তুমি খাইয়ে দিলে খাবো।নাহলে খাবো না।’নিহা বাচ্চাদের মতো আবদার করে বসলো।ইফাজের আর কি করার মাঝরাত পর্যন্ত কেউ যদি ওর জন্য এভাবে অপেক্ষা করে তাহলে তার এই ছোটো আবদারটা না রাখা বড্ড অপরাধের শামিল!
ইফাজ ভাত মাখিয়ে নিহার মুখের সামনে এক লোকমা তুলে ধরলো।নিহা খুশীতে বাকবাকম করতে করতে খেয়ে নিলো।তারপর ইফাজ নিজেও খেলো নিহাকেও খাইয়ে দিলো।

সবকিছু গুছিয়ে এসে দেখলো ইফাজ ঘুমিয়ে গেছে।নিহাও ইফাজের পাশে শুয়ে কিছুক্ষণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো।

প্রায় আধঘন্টা পর ইফাজ শোয়া থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেলো।ইফাজ এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলো।ওদের কাছ থেকে কালেক্ট করা ফোন নাম্বারটা নিখিলকে মেসেজ করে পাঠিয়ে দিয়ে ওর ডিটেইলস বের করতে বলল।
———————
রাতে বারান্দায় চেয়ার বসে ইয়াদের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে মধু ঘুমিয়ে গিয়েছিল খেয়াল নেই।সকাল বেলা আইরিন রহমানের ধাক্কায় ঘুম ভাঙে।আড়মোড়া ভেঙে,হাই তুলে পিটপিট করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’কি হয়েছে?এমন ভয় পেয়ে আছো কেনো?’

আইরিন রহমান উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,’জানিস নিশিদের ঘরে পুলিশ এসেছে?’

মধু চমকে উঠে বলল,’কেনো?’

‘নিশি সুইসাইড করেছে।ওর লাশ নিতে আসছে পুলিশ।নিশির মা’কে সামলানো যাচ্ছে না।আহারে একটা মাত্র মেয়ে ছিলো।’আইরিন রহমান আফসোসের সুরে বললেন।

মধু চিন্তিত মুখে বলল,’পুলিশ কি লাশ নিয়ে গেছে?

‘হুম একটু আগে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ নিয়ে গেছে পুলিশ।’

‘তুমি গিয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ,সবার চিল্লাচিল্লি শুনে গিয়েছিলাম।’

‘আম্মু আমি গিয়ে একটু দেখে আসি।’

‘না একদম না।মরা বাড়িতে যাওয়া যাবে না।’আইরিন রহমান কড়া করে মধুকে বলে গেলেন।
তবুও মধুর মনটা কেনো জানি উশখুশ করছে।হঠাৎ করে নিশি সুইসাইড করতে যাবে কেনো?সব তো ভালোই চলছিলো।কালকেই তো ওর গায়ে হলুদ ছিলো।ও কতো খুশী ছিলো বিয়ে নিয়ে।তাহলে হঠাৎ করে এমনটা করার কারণ কি!মধুর মাথায় কিছুই ঢুকছে না।ব্যাপারটা ইয়াদকে জানানো দরকার মধু তৎক্ষনাৎ ইয়াদকে ফোন দিলো।ইয়াদ রিসিভ করে ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলল,’হ্যালো।’

‘ইয়াদ, নিশি সুইসাইড করেছে।’কোনোরকম কথা না বাড়িয়েই মধু বলে ফেললো।মধুর কথা শুনে ইয়াদ বড়সড় একটা শক খেলো।চোখ থেকে ঘুম একবারে উধাও!তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,’কিহ!কি বলছো এগুলো।’

‘আ’ম সিরিয়াস।বিশ্বাস না হলে আপনি নিজেই আসুন।’

‘আচ্ছা আসছি।’
মধু ফোনটা রেখে আবার ভাবতে বসলো।

চলবে…

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৩২
#Arshi_Ayat

“দিন যায়,ক্ষণ যায়
কেউ কারো নয়।”
নিশির মৃত্যুর তিনদিন হয়ে গেছে।কাল’ই ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এসেছে।রিপোর্ট লিখা ছিলো মৃত্যুর কারণ “ডিপ্রেশন”।ভেতরে ভেতরে ভয়ানক ডিপ্রেশনে ভুগছিলো নিশি।আর তার বশবর্তী হয়েই আত্নহত্যা করে।নিশির মৃত্যু কোনো খুন নয় আত্নহত্যা এটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে তাই ওর কেসটা বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ।

ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পরই নিশির লাশ ডিসচার্জ করা হয়েছে।আজকে সকালে লাশ নিয়ে ওর বাবা মা দিনাজপুর চলে গেছেন।গ্রামের বাড়িতে দাফান করবে নিশিকে।
————-
মাথাটা প্রচন্ড ভারী হয়ে আছে মধুর।কালকে থেকে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নিশির মৃত্যুর কারণ!কি এমন ডিপ্রেশন ছিলো যে এভাবে সুইসাইড করতে হলো!
এগুলো ভাবতে ভাবতেই হিজাব বাঁধলো মধু।প্রথমবারের মতো সাইকা আর ওর বর আসছে মধু’দের বাড়িতে।তাই ওদের রিসিভ করতে যেতে হবে।আইরিন রহমান নিজেই যেতো কিন্তু ডাক্তার ওনাকে বেশি হাটতে,ভারী কাজ করতে মানা করেছেন।তাই আইরিন রহমান যায় নি।ওনার বদলে মধু যাবে।

বাসার নিচে নেমে মধু ইয়াদকে ফোন দিলো।ইয়াদ রিসিভ করে বলল,’দুই মিনিট দাড়াও আমি আসছি।’

‘আচ্ছা আসো।’
মধু ফোন রেখে ইয়াদের জন্য অপেক্ষা করছে।একা যাওয়ার চেয়ে ওকে নিয়ে যাওয়াই ভালো মনে হলো তাই মধু ইয়াদকে আসতে বলেছিলো।

বেশিক্ষণ দাড়াতে হয় নি ইয়াদ চলে এসেছে।তারপর দুজনে কিছুটা পথ হেটে রিকশা নিলো বাস কাউন্টারে যাওয়ার জন্য।ওদের মাঝে টুকটাক কথা হচ্ছিলো।হঠাৎ মধু জিগ্যেস করলো,’আপনি কি আপসেট নিশির মৃত্যুর জন্য।’

‘না,তবে এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না কেনো যেনো।এতো দ্রুত ঘটলো যে বোঝাই গেলো না।’

‘হুম,কিন্তু ও আত্নহত্যা কেনো করলো এটা রহস্য রয়ে গেলো।আমার জানা মতে তেমন কোনো ডিপ্রেশনে ও ছিলো না।’

‘হয়তো ছিলো কিন্তু তুমি জানো না।’

‘হুম,হয়তো।’
এভাবেই কথা বলতে বলতে দুজনেই বাস কাউন্টারে পৌছালো।রিকশা থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো দূরে যাত্রী ছাউনিতে সাইকা আর হিমেল দাঁড়িয়ে আছে।মধু সাইকাকে দেখে দ্রুত পায়ে সেদিকে গিয়ে সাইকাকে জড়িয়ে ধরলো।ইয়াদ পেছনে ছিলো।যাতে ওকে কেউ না দেখে।ইয়াদ ওদের সাথেই আসবে তবে আলাদা।
—————
রাত আট’টা বাজে…
ইয়াদ প্রায় একঘন্টা ধরে মধুদের বাসার সামনে দাড়িয়ে আছে।মধুকে বারবার কল করছে,নামতে বলছে কিন্তু ও নামছে না।কারণ বাসায় মেহমান এসেছে।ইয়াদও ঘাড়ত্যাড়া দরকার পড়লে আজকে সারারাত এখানেই থাকবে তবুও মধুকে নিচে নামতে হবে।সাইকা আর হিমেলকে নিয়ে আসার সময় মধুর সাথে একটুও কথা বলতে পারে নি ইয়াদ।তাই মেসেজ করেছিলো যেনো ওর সাথে একটু দেখা করে।কিন্তু মধু মেসেজটা দেখে নি।বাসায় গিয়ে মেসেজটা চোখে পড়তেই আফসোস করতে লাগলো।কিন্তু বের হওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলো না।

মধু মায়ের রুমের জানালা দিয়ে একবার রাস্তায় তাকালো।এই জানালাটা দিয়ে রাস্তাটা মোটামোটি দেখা যায়।ইয়াদ গেছে কি না সেটা দেখতেই মধু রাস্তার দিকে তাকালো।নাহ!যায়নি সে।এখনো দাঁড়িয়ে আছে।কি বলে বের হবে সেটাই বুঝতে পারছে না মধু।হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি আসতেই ও বসার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।ওখানে সাইকা,হিমেল আর আইরিন রহমান মিলে গল্প করছে।মধু মায়ের সামনে গিয়ে বলল,’আম্মু আরিয়া এসেছে নিচে।একটু দেখা করে আসি।’

আইরিন রহমান বললেন,’আচ্ছা যা।’
তারপর তিনি আবার আলোচনায় মনোযোগ দিলেন।মধু অনুমতি পেয়ে নিচে নামলো।ও নিচে নামতেই ইয়াদ অভিমানী স্বরে বলল,’ওহ!এসেছো তাহলে।আমি তো ভাবলাম ভুলেই গেছো।’

‘বাসায় মেহমান আসছে।সেইজন্যই তো আসতে পারি নি।’

‘হ্যাঁ বুঝি,আমি বুঝি।’

মধু আচমকা ইয়াদকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কন্ঠে বলল,’ইশ!কতো রাগ করে আমার জানপাখি টা।’

ইয়াদ হাসলো।বলল,’হয়েছে,হয়েছে।শোনো দুইদিনের জন্য আমি ট্যুরে যাচ্ছি।ভার্সিটি থেকে নিবে।সেইজন্য যেতে হবে।এইজন্যই তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম।’

মধু ইয়াদের কথায় কিছু বলল না।ওর বুকের ওপর লেপ্টে রইলো।ইয়াদ মধুর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল,’মধু,এভাবেই থাকবে?কিছু বলবে না?’

‘না,কিছু বলবো না।চুপচাপ সারাজীবন আপনার ঠিক এখানটায় থাকতে চাই।’

ইয়াদ হাসলো।মধুর কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলল,’নিজের খেয়াল রাখবে।খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করবে।আমি দুইদিন পর আবার আসবো।’

‘আপনাকে মিস করবো।’

‘আমিও।’
তারপর মধু ইয়াদকে বিদায় দিয়ে ঘরে চলে এলো।
———-
রাত দশটা!আজকে হাসপাতালে ওভার ডিউটি দিতে হয়েছি তাই দশটা বেজে গেছে।এখন বেরিয়ে পড়বে ইফাজ।আর আজকে নিখিলের আসার কথা ছিলো।হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই ইফাজ নিখিলকে দেখতে পেলো।গাড়িতে বসে আছে।নিখিল ইশারা দিলো গাড়িতে ওঠার জন্য। ইফাজ উঠে পড়লো গাড়িতে।গাড়ি কিছুদূর যাওয়ার পর নিখিল বলল,’দোস্ত তুই যে নাম্বারটা দিয়েছিস সেটা বন্ধ।আর সবচেয়ে রহস্যজনক বিষয় হলো মেয়েটা তিনদিন আগে সুইসাইড করেছে।’

ইফাজ বিষ্ময়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,’কি বলছিস তুই?’

‘হ্যাঁ সত্যি।আমি খোঁজ নিয়েই তোকে বলছি।’

ইফাজ মাথা চুলকে বলল,’ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে লাগছে।ওই মেয়ে কেনো সুইসাইড করতে যাবে?’

‘হতে পারে এটা সুইসাইড না এটা খুন!’

‘ধাঁধায় পড়ে গেলাম।যাকে ধরলে সব রহস্য খুলতো সেই টপকে গেলো।’ইফাজ চিন্তিত স্বরে বলল।

‘সাবধানে থাকিস।কারণ যদি এটা খুন হয় তাহলে তোর ওপরেই অ্যাটাক আসতে পারে।’

‘হুম।’
নিখিল ইফাজকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো।

এই ঘটনার পর অবশ্য আর কোনো সমস্যা হয় নি কিন্তু ইফাজ সবসময়ই সতর্ক ছিলো।
—————-
দেখতে দেখতে পাঁচ মাস কেটে গেলো।মধু আর ইয়াদের সম্পর্ক খুব ভালোই চলছে অপরদিকে ইফাজও নিহার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।কিন্তু মানিয়ে নেওয়া কে তো আর ভালোবাসা বলে না।ইফাজের মন জুড়ে এখনো তারই বিচরণ।এখনো লোক চক্ষুর অন্তরালে দুচোখ যেনো তারেই খোঁজে।এ যেনো নিঃশব্দে মরণ।

এইতো এইচ এস সি পরীক্ষা আর এডমিশন টেষ্ট শেষ করে কিছুদিন হলো মধু ভার্সিটিতে উঠেছে।আর ইয়াদ স্কলারশিপ পেয়েছে।ভিসা পত্র সব রেডি।কালই ফ্লাইট তাই আজকে মধুর সাথে সারাদিন ঘুরবে।প্রথমে মধু বাচ্চাদের মতো জেদ ধরেছিলো ইয়াদ যেনো না যায়।পরে ইয়াদ ভালোমতো বোঝানোর ফলে স্বাভাবিক হয়েছে।

মধু সকালে রেডি হয়ে ইয়াদ’দের বাড়ির দিকে রওনা হলো।পথে ইয়াদের সাথে দেখা হওয়ায় আর ওদের বাড়িতে গেলো না।

প্রথমে শপিং করবে।আজকে সব পছন্দ করবে মধু।শপিং করা শেষ হলে মধু আর ইয়াদ বের হলো শপিং মল থেকে।এরপর সারাদিন এদিক সেদিকে প্রচুর ঘুরাঘুরি করে শেষ বেলায় যখন বাড়ি ফিরবে তখন মধু ইয়াদের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,’চলুন না বিয়ে করে ফেলি।’

ইয়াদ মধুর কথা সিরিয়াসলি নিলো না।ঠাট্টা করে বলল,’চলো আজকে বিয়ে করে কালকেই হানিমুনে চলে যাই।’

‘আমি মজা করছি না।আ’ম সিরিয়াস।প্লিজ বিয়েটা করে ফেলি।’

ইয়াদ এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,’না মধু আমি আমাদের বিয়ে এতো সাদামাটা ভাবে করবো না।তিন বছর পর ফিরে এসে তোমাকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করে নেবো।’

‘তিনবছর পর আবার বিয়ে করবো আমরা কিন্তু আজকে আমরা বিয়েটা করে ফেলি।’

‘মধু বাচ্চামি করছো কেনো?তোমার পড়াশোনা এখনো শেষ হয় নি।নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করো।এই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ।বিয়ে আমরা পরেও করতে পারবো।’

মধু অক্ষিদ্বয়ে নোনা জ্বলে পরিপূর্ণ হয়েছে।অশ্রুসজল কন্ঠে বলল,’আপনাকে না পেলে আমি ক্যারিয়ার দিয়ে কি করবো।আপনি আমাকে ভালোবাসেন না ইয়াদ।’

এটা বলেই ইয়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মধু রিকশা ডেকে উঠে পড়লো।ইয়াদ বারবার ডাকলো কিন্তু মধু শুনলো না।

বাসায় এসে ফোনের স্ক্রিনে দেখলো ৩০+ মিসডকল।মধু রাগে ফোন বন্ধ করে দিলো।মায়ের ফোন থেকে ইয়াদের নাম্বার ব্লক করে দিলো।

আর এদিকে ইয়াদ ফোনের ওপর ফোন,মেসেজ পাঠিয়ে ফোন জ্যাম করে ফেলেছে।তবুও কোনো রেসপন্স নেই।

দুইপাশের কারোই ঘুম নেই।মধুর রাতটা গেছে কাঁদতে কাঁদতে।আর ইয়াদের চিন্তায়।সকাল দশটায় ইয়াদের ফ্লাইট কিন্তু মধু যাবে না।

দাত মুখ খিঁচে বসে রইলো।চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তবুও যাবে না।ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না!

চলবে….

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-২৯+৩০

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ২৯
#Arshi_Ayat

অন্ধকার কেটে গিয়ে চারদিকে হালকা আলো ফুটেছে।আজানের ধ্বনি কানে আসতেই মধুর ঘুম ছুটে গেছে।ইয়াদের ঘাড় থেকে মাথা উঠিয়ে আড়মোড়া ভেঙে ওর দিকে তাকাতেই দেখলো মহাশয় গেমসের ভেতর ঢুকে গেছে।এদিকে ওদিক কোনো খেয়াল নেই।মধু চট করে ফোনটা টেনে হাত থেকে নিতেই ইয়াদের হুশ আসলো।বাম হাতে মাথা চুলকে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,’ওহ!তুমি উঠে গেছো?’

‘হুম,এবার আপনি বাড়ি গিয়ে ঘুমান।সারারাত বসে বসে গেমস খেলে চোখমুখ তো ফুলিয়ে ফেলেছেন।’মধু চোখ রাঙিয়ে বলল।

‘এখনো পুরোপুরি আলো ফোটেনি।আকাশটা আরেকটু পরিষ্কার হোক তারপর যাবো।’

‘আচ্ছা তাহলে আমার কোলের ওপর মাথা রাখুন।’
মধুর বলতে দেরি ইয়াদের মাথা রাখতে দেরি হয় নি।মধু মুচকি হেসে ইয়াদের চুলগুলোতে হাত চালাতে লাগলো।

প্রায় ঘন্টাদেড়েক পর ইয়াদ হাসপাতাল থেকে বের হলো তাও মধুর জোরাজোরিতে।তবে এখন অবশ্য নার্স আর ওয়ার্ড বয় আছে।আস্তে আস্তে ডাক্তারও চলে আসবেন।

ইয়াদ বের হওয়ার পরেই মধু মায়ের কথাবার্তা বলে মিলিকে নিয়ে বের হলো।বাসায় গিয়া সবকিছু গোছগাছ করে রান্না করতে হবে।দুপুরে মায়ের জন্য খাবার নিয়ে যেতে হবে।অনেক কাজ আছে।
—————-
ইফাজ এখন সংসারে মনযোগী হওয়ার চেষ্টা করছে।যতোটুকু পারছে নিজের ডিউটি শেষে নিহাকে সময় দিচ্ছে।এইতো কাল সন্ধ্যায় ঘুরতে নিয়ে গেলো।আজকে সন্ধ্যায় এক কলিগের গায়ে হলুদের দাওয়াত আছে।তবুও কেনো যেনো নিহা খুশী না।অবশ্য না হওয়ারও কারণ আছে।নিহার সবসময় মনে হয় ইফাজ এগুলো দায়িত্ববোধ থেকে করছে ভালোবেসে করছে না।ইফাজ নিহার অবস্থানটা বোঝে কিন্তু সে আর কি করবে!মন তো চাইলেই কাউকে দেওয়া যায় না।

সন্ধ্যার একটু আগে নিহা রেডি হচ্ছিলো দাওয়াতে যাওয়ার জন্য।কিছুক্ষণের মধ্যে ইফাজও চলে আসবে।তারপর দুজনে একসাথে বের হবে।হাতে চুড়ি পরতে পরতে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো।এখনো আইলেনার দেওয়া বাকি।চুড়িগুলো পরে আইলেনার হাতে নিয়ে দরজায় খেয়াল করার আগেই কেউ একজন আচমকা এসে নিহাকে জড়িয়ে ধরলো।

‘কেমন আছিস নিহু।’

নিহা হাস্যজ্বল কন্ঠে বলল,’আরে প্রিতু তুই!কখন আসলি?কেমন আছিস?’

‘এটা কিন্তু ঠিক না।আগে আমার উত্তর চাই।’প্রিতু থ্রেড দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল।

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তুই কেমন আছিস?’

‘আলহামদুলিল্লাহ।তোর বর কই রে?’প্রীতু এদিক ওদিক তাকিয়ে জিগ্যেস করলো।

‘ইফাজ তো এখনো আসে নি।হাসপাতালে আছে।’

‘ও,তাই বল।তো এতো সাজুগুজু কেনো?’

‘কোথাও যাবি?’

‘হ্যাঁ ওর এক কলিগের গায়ে হলুদে।’

‘ও আচ্ছা।তাহলে তো ভুল টাইমে এলাম।’

নিহা প্রীতুর হাত ধরে টেনে এনে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলল,’কোনো ভুল টাইম না।ঠিক টাইমেই এসেছিস।চুপচাপ বস।যখন থেকে এসেছিস পটর পটর করেই যাচ্ছে।’

প্রীতু হেসে বলল,’বহুদিন পর তোকে পেলাম তো তাই পটর পটর করতে ইচ্ছে করছে।’

‘করিস,আগে দুইমিনিট স্বস্তি নিয়ে বস।’

প্রীতু মুখ আঙুল দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বুঝালে সে চুপচাপ বসেছে।নিহা প্রীতুর মাথায় একটা গাট্টা মেরে কিচেনে চলে গেলো।

একটু পর দুইমগ কফি নিয়ে ফিরে এলো নিহা।একমগ প্রীতুকে দিয়ে আরেকমগ নিজে নিয়ে প্রীতুর পাশে বসে বলল,’হ্যাঁ এবার শুরু কর তোর পটর পটর।’

প্রীতু এক চুমুক দিয়ে বলল,’ফ্যামিলি প্ল্যানিং করেছিস?’

‘আরে না,এখনো করি নি।’নিহা লাজুক হেসে বলল।

‘তা করবি কেনো?ইশ!কবে যে খালাম্মা হবো।কবে যে একটা পুচকু আসবে।’

নিহা হাসতে হাসতে বলল,’তুই পারিসও বটে।আচ্ছা প্রত্যুষ ভাইয়ার কি খবর?’

‘ভালোই আছে।’

‘ডাক্তার দেখিয়েছিলি আর?’

‘হ্যাঁ আরো দুটো ডাক্তার দেখিয়েছিলাম কিন্তু সবাই এক কথাই বলে।’

‘তো কি ভাবলি?ছেড়ে দিবি নাকি থাকবি?’

‘ছেড়ে দিবো কেনো পাগল নাকি!ছেড়ে দেওয়ার জন্য ভালোবেসেছি নাকি!আর এখানে তো ওর কোনো দোষ নেই।আল্লাহই ওকে অক্ষম করেছে।তাহলে আমি ওকে ছেড়ে যাবো কেনো?আর বাংলাদেশে কি এতিম শিশুর অভাব আছে না কি!বাবা মা ডাক শুনতে চাইলে ওদের মুখ থেকেও শোনা যায়।আর ওকে ছেড়ে গেলে আমি তো নিজেই থাকতে পারবো না।আমি নিজেই ভালো থাকবো না।নিজের ভালো থাকার জন্য হলেও ওকে আমি ছাড়তে পারবো না।’

‘ভাইয়া তোকে চলে যেতে বলে না?’

‘ও তো আরেক পাগল!যখনই মন খারাপ হয় তখনই বলে “আমি তোমাকে পূর্ণতা দিতে পারি নি।আমার জন্যই তুমি আটকে আছো।’কিন্তু গাধাটাকে কি করে বোঝাই যে ওর ভালোবাসাই আমাকে পূর্ণতা দিয়েছে।’

নিহা প্রীতুর হাত ধরে বলল,’তোকে নিয়ে আমার গর্ভ হয়।এভাবেই থাক সবসময়।’

প্রীতু হেসে বলল,’কিন্তু আমি জলদি খালাম্মা ডাক শুনতে চাই।মনে থাকে যেনো।’

নিহা কিছু বলল না শুধু হাসলে।দুজনের মধ্যে আরো কিছুক্ষণ কথা হলো।একপর্যায়ে প্রীতু উঠে দাড়ালো যাওয়ার জন্য।নিহা বলল,’আরেকটু থাক না ইফাজের সাথে দেখা করে যাস।ও এখনই চলে আসবে।’

‘না রে আজকে না।বেশি দেরি হলে প্রত্যুষ চিন্তা করবে।’

নিহা আর আটকালো না।প্রীতুকে জড়িয়ে ধরে বলল,’আবার আসিস ভাইয়াকে নিয়ে।’
প্রীতুও বলল,’তুইও যাস ইফাজ ভাইকে নিয়ে।’
প্রীতু নিহার থেকে বিদায় নিয়ে বের হতে নিলেই ইফাজের মুখোমুখি হলো।ইফাজকে দেখে প্রীতু সালাম দিলো।ইফাজ সালামের উত্তর দিয়ে বলল,’চলে যাচ্ছেন যে?’

‘আমি আগেই এসেছিলাম নিহার সাথে দেখা করতে।আজকে আর থাকা সম্ভব না।সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। বাসায় ফিরতে হবে।’

‘আচ্ছা।ভালো থাকবেন।আল্লাহ হাফেজ।’

‘আপনিও,আল্লাহ হাফেজ।’

ইফাজ ঘরে এসে দেখলো নিহা আইলেনার দিচ্ছে।নিহার পিছনে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলল,’অনেক সুন্দর লাগছে তোমাকে।’

নিহা একটা মলিন হাসি দিয়ে বলল,’ধন্যবাদ।তুমি রেডি হবে না?’

‘হ্যাঁ দশমিনিট সময় দাও।’
ইফাজ ফ্রেশ হতে চলে গেলো।দশমিনিটের মধ্যে ঝটপট রেডি হয়ে নিজের ঘড়িটা হাতে পরতে পরতে বলল,’চলো,আমি রেডি।’

নিহা ইফাজের কথা যেনো শুনলোই না এমন ভাব ধরে ওর সামনে এসে দাড়ালো।ইফাজ নিহার মুখভঙ্গি পরিলক্ষিত করে বলল,’কিছু বলবে?’

নিহা শাড়ির আচলে একবার গিট্টু দিচ্ছে আরেকবার খুলছে।নিঃসন্দেহে ভেতরে কিছু পাকাচ্ছে ইফাজ বুঝলো।তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে নিহা তার শাড়িতে গিট্টু লাগানোর কাজ আপন গতিতে চালিয়ে যেতে যেতে বলল,’আচ্ছা,ইফাজ আমাদের বাবা হবে কবে?আমি মা হবো কবে?তুমি বাবা….’

ইফাজ আর বলতে দিলো না।নিহাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’নিহা এই বিষয়ে আমরা পরে কথা বলবো।এখন দেরি হচ্ছে।চলো বের হই।’

নিহা কিছু বলল না।শুধু হাতে থাকা টিস্যু দিয়ে চোখের কোণায় জমে থাকা কান্না নামক নোনো জলের গুটি কয়েক ফোটা মুছে শাড়ির আচল টেনে ইফাজের সাথে বের হলো।
——————-
আজকে বিকেলেই আইরিন রহমানকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে।মধু আর ইয়াদ মিলে ওনাকে বাসায় নিয়ে এসেছে।মিলি বাসায়ই ছিলো।এই দুইদিনে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা আলাপ হয়েছে ইয়াদের সাথে আইরিন রহমানের।তাতে সরাসরি না বললেও তার কথা বলার ভঙ্গিতে বোঝা গেলো তিনি এই সম্পর্কে আপত্তি করবেন না।

ইয়াদকে বিদায় দিয়ে মধু মায়ের ঘরে গিয়ে বলল,’আম্মু একটু উঠে বসো।ঔষধের সময় হয়েছে।’

আইরিন রহমান মধুর সহযোগিতায় উঠে বসলো।ঔষধ খেয়ে আবার শুয়ে পড়লো।মধু ঔষধ খাইয়ে চলে গেলো নিজের ঘরে।অনেকদিন পর নিজের ঘরে আসলো মধু।একঘন্টা সময় ব্যয় করে ঘরটা ঠিক করলো।এখন পড়তে বসতে হবে কিন্তু বইতো হোস্টেলে।তবে গাইড বইগুলো ঘরে আছে।আপাতত গাইড বই দিয়েই পড়তে হবে।

একটু পর দরজায় নক পড়তেই মধু উঠে গিয়া দরজা খুললো।নিশির মা আর নিশি এসেছে মধুর মায়ের সাথে দেখা করতে।নিশির মা মধুর মায়ের রুমে চলে গেলো আর নিশি সামনের রুমেই বসলো।মধুর নিশির সাথে কথা বলার একদম ইচ্ছে সেইজন্য নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।কিন্তু পেছন থেকে নিশি বলল,’মধু শোনো।’

মধু ঘুরে দাড়ালো।নিশি উঠে গিয়ে মধুর সামনে দাড়িয়ে বলল,’দুই সপ্তাহ পর আমার বিয়ে।চলে যাবো এই বাসা থেকে।আর হয়তো দেখা না ও হতে পারে।তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি ক্ষমা করে দিও।’
এটা বলেই নিশি মধুকে জড়িয়ে ধরলো।প্রথম টাল সামলাতে না পারলেও কিছুক্ষণের মধ্যে ধাতস্থ হয়ে মধু বলল,’আরে আপু বাদ দাও তো ওইসব কথা।শুভকামনা তোমার জন্য।সুখী হও।’

‘তুমিও সুখী হও।’
মধু মৃদু হেসে নিশিকে ওর রুমে নিয়ে গেলো।তারপর ওকে বসিয়ে রেখে চা বানাতে গেলো।
—————-
হলুদের অনুষ্ঠান রাত বারোটায় ছেড়ে ইফাজ আর নিহা বেরিয়ে পড়লো।এর থেকে বেশি দেরি করা যাবে না।ওরা অবশ্য বলেছিলো থেকে যেতে কিন্তু নিহার আপত্তিতে আর থাকা হলো না।
বাসায় এসে নিহা সোফায় শুয়ে পড়লো।ইফাজ কিছু বলল না।এখন বললে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভবনা আছে।ইফাজও শুয়ে পড়লো।

মাঝরাতে মনে হলো কেউ কাঁদছে তাও ওর শিয়রে বসে।রুমে নিহা ছাড়া তো কেউ নেই।তাহলে কি নিহা!এতো রাতো ও কাঁদবে কেনো?কিছু হলো না তো!ইফাজ জিগ্যেস করবে এর আগেই নিহা ইফাজের চুল নিজের হাত বুলিয়ে বলল,’ইফাজ তুমি বড্ড পাষাণ।আমাকে এভাবে কষ্ট না দিলেও পারো।’

এভাবে হাজারো অভিযোগ করছে নিহা ঘুমন্ত ইফাজের কাছে এদিকে ইফাজ জেগেও নিশ্চুপ!

চলবে…

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৩০
#Arshi_Ayat

সপ্তাখানেকের মধ্যে মধুর মা পুরোপুরি না হলেও মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছে।আরো কিছুদিনের মধ্যেই পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে।এই কয়দিন মধুই মায়ের সেবা যত্ন করেছে।আজকে সকালে নাস্তা বানিয়ে মাকে খাইয়ে দিয়ে নিজে খেলো এরপর পড়তে বসলো।মিলি এখনো ঘুম থেকেই ওঠে নি।যখন উঠবে তখন খেয়ে নিবে।

মধু এখন বাসায়ই পড়ে।হোস্টেল থেকে নিজের বই,খাতাসহ যাবতীয় জিনস পত্র নিয়ে এসেছে।

টেবিলে বসে লিখছিলো মধু।এরমধ্যেই দরজায় বেল বাজলো।উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো নিশি হাস্যজ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছে।নিশিকে দেখে মধুও সহাস্যে বলল,’কেমন আছো আপু?’

‘ভালো,তুমি?’

‘আমিও ভালো।ভেতরে আসো।’

নিশি ভেতরের ঘরে সোফায় এসে বসলো।তারপর আবদারের ভঙ্গিতে বলল,’মধু,আমার সাথে একটু বের হবে প্লিজ।হালকা কিছু কেনাকাটা আছে।কাউকে পাচ্ছি না সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’

‘কিন্তু আপু আমার তো সামনে পরীক্ষা।পড়তে হবে।বেশিদিন নেই পরীক্ষার।’

‘আরে বেশিক্ষণ লাগবে না।আধঘন্টার মধ্যে চলে আসবো।’নিশি অনুরোধের স্বরে বলল।

মধু রাজি হলো।নিশিকে অপেক্ষা করতে বলে নিজের ঘরে চলে গেলো।রেডি হয়ে মধু আর নিশি দুজনই বেরিয়ে পড়লো।বাসা থেকে কিছুদূর এগিয়ে একটা রিকশা নিলো।রিকশায় বসে দুজনেই বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে লাগলো।হঠাৎ করে খেয়াল হলো রিকশাওয়ালা অন্য একটা রাস্তায় দিয়ে যাচ্ছে।মধু উত্তেজিত হয়ে রিকশাওয়ালাকে বলল,’মামা,এটা কোন রাস্তা?কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’

রিকশাওয়ালা কোনো কথার জবাব দিলো না।কিন্তু মধুকে শান্ত করার জন্য নিশি বলল,’আরে এই রাস্তা আমি চিনি।ওই রাস্তায় নাকি কোনো সমস্যা হয়েছে তাই এখান দিয়ে যাচ্ছে।তুমি এতো টেনশন নিও না।’

নিশির কথায় মধু কিছুটা শান্ত হলেও বুক ধড়ফড় করছে।অনেক্ক্ষণ পর একটা জায়গায় রিকশা থামালো।আশেপাশের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে বস্তি!কিন্তু এখানে কেনো?মধু কিছু বুঝে ওঠার আগেই রুমালের মতো কিছু একটা ওর নাকে ছোঁয়ানো হলো।এরপর কি হয়েছে মধুর মনে নেই!
——————–
ইফাজ চেম্বার থেকে নিজের লাইসেন্স করা রিভালবারটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লে কারণ একটু আগেই ইফাজের কানে এসেছে মধুকে কারা যেনো কিডন্যাপ করেছে।এই খবর শুনেই ইফাজ আর ঠিক থাকতে পারলো না।দ্রুত চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো।ইফাজ অনেক আগেই ওর একজন বিশ্বস্ত লোক লাগিয়েছিলো মধুর পেছনে।যাতে ওর সব খবর পাওয়া যায়।আজ ওর মধ্যমেই জানতে পারলো মধু কিডন্যাপ হয়েছে।ইফাজ লোকেশন অনুযায়ী বস্তির সামনে এসে হাজির হলো কিন্তু এখন কোনদিকে যাবে?এই বস্তিতে শ’খানেক ঘর তো হবেই।কোন ঘরে আছে এটাই তো বোঝা যাচ্ছে না।ইফাজ মুখে মাস্ক লাগিয়ে বস্তিতে ঢুকে পড়লো। কোনরকমে বস্তির সরু গলি দিয়ে এগুতে লাগলো।চারপাশ থেকে স্যাঁতসেঁতে গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে।অনেক কষ্টে পেছনে চলে গেলো ইফাজ।এরপর খোঁজা শুরু করলো।কয়েকটা ঘর খোঁজার পরও পেলো না।এতো বড় বস্তি!তার ওপর এতোগুলো ঘর!দুইদিন লাগবে এগুলো খুজতে।ইফাজ ভাবলো বস্তির কয়েকজনকে জিগ্যেস করে দেখা যায়!ওরা কিছু জানে কি না!কয়েকজনকে জিগ্যেস করলো কিন্তু কেউ কিছুই বলতে পারলো না।ইফাজ এখানে কিছু না পেয়ে অন্যগলিতে খুঁজতে আরম্ভ করলো।হঠাৎ এক লোক ইফাজকে আটকে বলল,’কে আপনি?এখানে কি চান?’

‘আমি একজনকে খুঁজতে এসেছি।আপনি কি একটা মেয়েকে দেখেছেন?বয়স বোধহয় আঠারো কিংবা উনিশ হবে।’

‘না!এমন কাউকে দেখি নাই।আপনি এখান থেকে যান।’

ইফাজকে আর ওই গলিতে থাকতেই দিলো না।ঠেলে বের করে দিলো।ইফাজের কেমন যেনো সন্দেহ হতে লাগলো।তাই লোকটার কলার চেপে ধরে চাপা হিংস্র গলায় বলল,’পুলিশের গায়ে হাত দেওয়ার সাহস কোথায় পাস তুই?’

লোকটা মনে হয় ঘাবড়ে গেলো।তবুও গলায় জোর এনে বলল,’কোথাকার পুলিশ আপনি?’

ইফাজ ওর রিভালবারটা বের করে বলল,’হাতে দেখেছিস এটা?তাড়াতাড়ি বল মেয়েটাকে কোথায় লুকিয়েছিস?নাহলে এখানে মেরে দিবো।’

ইফাজের কথা শুনে আর রিভালবারটা দেখে লোকটা ভীত কন্ঠে বলল,’আমি কিছু করি নাই।ওরা আমারে পাহারাতে রাখছে।’

‘চল,আমাকে নিয়ে চল তাড়াতাড়ি।চলাকি করলে একটাও বাঁচবি না।’

লোকটা ইফজকে একটা ঘরে সামনে নিয়ে গেলো।টিনের দরজা ভেতর থেকে লাগানো।ইফাজ পা দিয়ে কষিয়ে এক লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে ঢুকে পড়লো।

এককোণায় হাত,পা বাধা অবস্থায় পড়ে আছে মধু।ঘরে কেউ নেই।ইফাজ মধুর হাত পায়ের বাঁধন খুলে মধুকে কোলে তুলে নিলো।তারপর আস্তে আস্তে বস্তি থেকে বের হয়ে গেলো।আর ওই লোকটা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে ইফাজ আর ধরতে পারে নি।

বস্তি থেকে মধুকে সোজা হসপিটালে নিয়ে এলো ইফাজ।একটা কেবিনে শুইয়ে দিয়ে ইয়াদকে ফোন দিলো।ইয়াদ ফোন রিসিভ করতেই ইফাজ বলল,’কই তুই?’

‘বাসায়।কেন?’ইয়াদ কৌতুহলী হয়ে জিগ্যেস করলো।

‘একটু হাসপাতালে আয় তো।’

‘কেনো?’

‘আগে আয় তারপর বলছি।’
ভাইয়ের কথায় ইয়াদ হাসপাতালের দিকে ছুটলো।হাসপাতালে পৌঁছে চেম্বারে আসতেই একজন নার্স ওকে একটা কেবিনে নিয়ে গেলো।ইয়াদ ঢুকতেই দেখলো মধু বেডে শুয়ে আছে।আর ইফাজ ওর প্রেশার দেখছে।মধুকে এ অবস্থায় দেখেই ইয়াদের প্রচন্ড ভয় হতে লাগলো!কি হলো মধুর!ইয়াদ বেডের পাশে এসে ইফাজকে আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,’কি হয়েছে ওর ভাইয়া?’

‘আরে আমিও জানি না।এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম তো রাস্তায় দেখলাম ও সেন্সলেস হয়ে পড়ে ছিলো।তারপর আমি হাসপাতালে নিয়ে এলাম।হয়তো প্রেশার লো হয়েগিয়েছিলো।এইজন্যই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলো।’ইফাজ পুরো ব্যাপারটা চেপে গেলো।

ইয়াদ ভাইয়ের হাত ধরে বলল,’ভাইয়া ওর জ্ঞান ফিরছে না কেনো?’

‘চিন্তা করিস না।কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে।’

ইয়াদকে মধুর পাশে রেখে ইফাজ চেম্বারে চলে গেলো।

কিছুক্ষণ পর মধু আধো আধো চোখ খুললো।ইয়াদ মধুর হাত ধরেই বসেছিলো।মধুকে চোখ খুলতে দেখে বলল,’মধু,খারাপ লাগছে তোমার?’

মধু উঠে বসলো।তারপর ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,’আমি এখানে কেনো?আমাকে কে এনেছে এখানে?আমি তো…..’

‘তোমাকে ইফাজ ভাইয়া এনেছে।তুমি নাকি রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলে।’

‘ওহ!’তবে মধু কথাটা মানতে পারলো না।তবুও চেপে গেলো।আসল ঘটনা ইফাজ জানে।তাই ভাবলো পরে ইফাজের কাছে থেকে জেনে নিবে।মধু মনেমনে এগুলো ভাবছিলো।ওর ভাবনায় ছেদ পড়লো ইয়াদের কথায়।ইয়াদ ওর গালে হাত দিয়ে বলল,’তুমি একদম নিজের যত্ন নাও না।এইজন্যই শরীর খারাপ করে তোমার।এরপর থেকে যদি আমি তোমার খাবারের প্রতি অবহেলা দেখি তাহলে তোমার একদিন কি আমার যতোদিন লাগে।’

মধু মাসুম চেহারা বানিয়ে বলল,’আমি নিজের যত্ন নেই সত্যি বলছি।’

‘হয়েছে,বুঝেছি।এখন চুপচাপ বসো।আমি ভাইয়াকে নিয়ে আসি।’

ইয়াদ ইফাজের চেম্বারে গেলো।ইফাজ মনযোগ দিয়ে একটা রিপোর্ট দেখছিলো।ইয়াদ ওর মনোযোগ ভেঙে বলল,’ভাইয়া,মধুর জ্ঞান ফিরছে একটু আসো তো!”

ইফাজ ইয়াদের কথা শুনে ফাইলটা বন্ধ করে ইয়াদের সাথে কেবিনে গেলো।মধু চিন্তিত মুখে বসে আছে।ইফাজ বেডের সামনে এসে বলল,’এখন কেমন আছো?’

‘ভালো।’মধু সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো।

‘তোমার রেস্টের প্রয়োজন।আর খাওয়া দাওয়া ভালো মতো করবে।শরীর দুর্বল হয়ে পড়ায় এমন হয়েছে।ঘাবড়ানোর কিছু হয় নি।’

ইফাজের কথা শেষ হতেই ইয়াদ বলল,’ভাইয়া এখন কি ওকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবো?’

‘হুম,নিয়ে যা।এখন সমস্যা নেই।’
————-
ইয়াদ মধুকে কিছু ফলমূল কিনে দিয়ে বাসায় দিয়ে এলো।ইয়াদকে বিদায় দিয়ে মধু নিশিদের বাসায় গেলো।ওদের দরজায় নক করতেই নিশির মা দরজা খুললো।মধু বলল,’আন্টি নিশি আপু কোথায়?’

নিশির মা শুকনো মুখে বললেন,’ও তো ওর ঘরে শুয়ে আছে।কোথা থেকে যেনো মাথা ফাটিয়ে এসেছে।এসো দেখা করে যাও।’

নিশির মা দরজা থেকে সরে দাড়াতেই নিশি ভেতরে ঢুকলো।ওর ঘরে গিয়ে দেখলো।নিশি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।মধু এসে ওর পাশে বসতেই নিশি চোখ খুললো।কিছুটা চমকালো মনে হয়!তবুও সামলে নিয়ে বলল,’তোমার কিছু হয় নি তো মধু।’

‘না আমি ঠিক আছি।কিন্তু তোমার এসব কিভাবে হলো?’

‘আরে ওই রিকশাওয়ালা টা খারাপ ছিলো।আম নিজেও বুঝতে পারি নি ও যে ওই জায়গাটায় নিয়ে যাবে।রিকশা থেকে নামার পর কয়েকটা ছেলে তোমাকে অজ্ঞান করে ফেলে আর আমার মাথায় জোরে আঘাত করে পালিয়ে যায়।ওইখান থেকে আমি অনেক কষ্টে হাসপাতালে আসি।আমার কপাল অনেকটা কেটে গিয়েছে।কিন্তু তুমি এলে কি করে?কোথায় নিয়ে গিয়েছিলো তোমাকে ওরা?’

‘আমি জানি না।জ্ঞান হারানোর পর কিছুই মনে ছিলো না আমার। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করি।সামনে ইয়াদ বসা ছিলো।’

‘যাক,বাঁচা গেলো তোমার কিছু হয় নি।’

‘হুম,আচ্ছা তুমি রেস্ট করো।আমি বাসায় গেলাম।’

মধু নিশিদের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।দুইয়ে দুইয়ে চার তো মিলছে না!নিশিকে কেমন যেনো মিথ্যাবাদী মনে হচ্ছে!

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-২৭+২৮

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ২৭
#Arshi_Ayat

“তুমি দুরে দুরে আর থেকো না
এ চোখে চেয়ে দেখোনা
তুমি ভালোবেসে আমাকে ঐ রিদয়ে বেঁধে রাখোনা
তুমি দুরে দুরে আর থেকো না
আজ তোমায় আমি এনে দিবো জোছনা
তুমি কাছে এসে আমার পাশে বসনা [২]”
অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে আকাশে।পক্ষীকূল তাদের চিরচেনা নীড়ে ফিরছে।মৃদু হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো নড়ছে।
ইয়াদ আর মধু দুজনেই ছাদে দাড়িয়ে আছে তবে বেশকিছুটা দুরুত্ব বজায় রেখে।নিজের জায়গায় দাড়িয়েই কিছুটা দুরুত্বে অবস্থিত অভিমানী মধুকে উদ্দেশ্যে গানটা গাইলো ইয়াদ।মধুর কোনো প্রতুত্তর নেই।ইয়াদ ধীর পায়ে মধুর গা ঘেঁষে দাড়ালো।তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,’ও অভিমানী।’

মধু ফিরে তাকালো ইয়াদের দিকে।ইয়াদের অস্থির চোখজোড়া মধুর অভিমানী চোখের পানে নিবদ্ধ হলো।কি সীমাহিন অভিমান নিয়ে স্থির দৃষ্টিতে মধু তাকিয়ে আছে।ইয়াদ আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না।বুকের‘পর শক্ত করে চেপে ধরলো।মধুও অভিমান ভুলে তার প্রাণপ্রিয়ের বাহুতে আবদ্ধ হলো।কিছুক্ষণ পর ইয়াদ মধুর চিবুক উঠিয়ে তার চোখের পানে চেয়ে বলল,’এতো অভিমান কেনো চোখে?’

‘আপনি আমাকে না বলেই কোথায় গিয়েছিলেন?কতো খুঁজেছি জানেন?’

‘সরি,ভাইয়ার বাসর সাজানোর জন্য আমাকে আর রাসেলকে পাঠানো হয়েছিলো বাসায়।আসার সময় তোমাকে খুঁজেছিলাম কিন্তু পাই নি।তাই ইরিনকে বলে এসেছিলাম তোমাকে যেনো বলে দেয়।ইরিন তোমাকে বলে নি?’

‘না তো।ও হয়তো ভূলে গেছে।’

ইয়াদ মৃদু হেসে বলল,’এবার কি অভিমান শেষ হয়েছে?’

মধু মিষ্টি হেসে ইয়াদের বুকের‘পর মাথা রাখলো।
—————————–
নিহাকে মাঝখানে বসিয়ে তার চারপাশ ঘিরে আত্মীয় স্বজন আর ইয়াদের কাজিনরা বসে মজা করছে।নিহাও কম যায় না।অন্যান্য বউদের চুপ করে বসে বেই।সবার সাথে তাল দিচ্ছে।বোধহয় সেই কারণেই কিছুক্ষণের মাঝে সবার মধ্যমণি হয়ে উঠেছে।বড় বউকে নিয়ে রিতীমত শ্বাশুড়ি মা বেশ প্রশংসা কুড়াচ্ছে।কিন্তু ইফাজ বাসায় এসেই কাউকে না বলে কোথায় যেনো হাওয়া হয়ে গেছে।কারো ফোনই তুলছে না।সাইদা খান এসে সবার সামনেই নিহাকে বলল,’ইফাজ কোথায় গেছে তোমাকে কিছু বলেছে?ও তো বাসায় নেই।ফোনও ধরছে না।’

অনেক্ক্ষণ ধরে নিহাও বিষয়টা খেয়াল করেছে।আর কয়েকবার ফোনও করেছে।সবার মতো নিহার ফোনটাও ইফাজ ধরে নি।এখন যদি শ্বাশুড়ি মা কে বলে যে সে কিছু জানে না তাহলে সন্দেহ হবে।তাই সবদিক বিবেচনা করে নিহা ভরসা দিয়ে বলল,’মা চিন্তা করবেন না।ইফাজ একটা জরুরি কাজে বেরিয়েছে।আপনাদের বলে যাওয়ার সময় পায় নি।আমাকে একটু আগে ফোন দিয়ে বলেছে আপনাদের চিন্তা করতে না।ও তাড়াতাড়িই ফিরবে।’

নিহার কথা শুনে উপস্থিত সবাই হাসলো।তারপর নিহার খালা শ্বাশুড়ি ওর শ্বাশুড়িকে বলল,’দেখলি তোর ছেলের কান্ড বউ পেয়ে আমাদের আর পাত্তাই নেই।এখন বউকে সব বলে।’
ওনার কথা শুনে সবাই হাসলেও নিহা একটা চাপা কষ্ট অনুভব করে বুকের মাঝে।তবুও কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সবার সাথে তাল মেলায়।
——————-
ইরিন,ওদের কাজিনরা মিলে নিহাকে রাত দশটার সময় ঘরে দিয়ে এলো।ইফাজ আগে থেকেই ঘরে ছিলো।বাইরে থেকে কিছুক্ষণ আগেই এসেছে।ওকে আসতে দেখে সাইদা খান নিহাকে ঘরে দিয়া আসতে বলে।তার আদেশেই আজকের আড্ডার মুলতবি ঘোষণা করে নিহাকে ঘরে দিয়ে আসা হলো।ইফাজ রুমে নেই,বোধহয় ফ্রেশ হচ্ছে।নিহা দরজা আটকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে একবার ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখলো।এরমধ্যেই ইফাজ ওয়াশরুম থেকে বাইরে এসে হাত,মুখ মুছতে মুছতে নিহাকে বলল,’গয়না গুলো খুলে ফেলো।আর শাড়ি পাল্টে ফ্রেশ হয়ে নাও।’

নিহা এসব কিছুই করার লক্ষ্মণ প্রকাশ করলো না।ধীর পায়ে ইফাজের সামনে এসে দাড়ালো।কিছুক্ষণ দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিলো।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইফাজ দৃষ্টিচ্যুত করে অন্যদিকে তাকালো আর নিহা বসে পড়লো।ইফাজকে সালাম করে উঠে দাড়ালো।তারপর বলল,’ঘুম পাচ্ছে তোমার?’

ইফাজ একটা তপ্তশ্বাস ফেলে বলল,’না,তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।কথা আছে।’

নিহা বিনাবাক্যে ফ্রেশ হয়ে একটা সুতির শাড়ি পরে এলো।ইফাজ খাটে বসে ল্যাপটপে কি যেনো করছিলো!নিহাকে দেখে ল্যাপটপ’টা অফ করে ইশারা করে সামনে বসতে বলল।নিহা বসলো।ইফাজ পূর্ণদৃষ্টিতে নিহার দিকে তাকিয়ে বলল,’তোমার কি কিছু চাওয়ার আছে আমার কাছে?’

নিহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।তারপর বলল,’যা চাইবো তাই দিবে?’

‘আমার মন’টা বাদে আমার যা আছে সব তোমার।’

নিহা ম্লান হাসলো।ওর আখিদ্বয় ছলছলিয়ে উঠলো, ব্যথিত কন্ঠে বলল,’তাহলে আর কিছুই চাই না।শুয়ে পড়ো।’

নিহা উঠে দাড়ালো।চোখের পানিগুলো আড়াল করে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।ইফাজ বারান্দায় চলে গেলো।
——————–
ঘড়িতে ৭ টা বেজে ১০ মিনিট..
নিহা আড়মোড়া ভেঙে উঠলো।দেখলো বিছানায় ইফাজ নেই।নিহা সোফা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখলো ইফাজ ইজি চেয়ারে ঘুমিয়ে আছে।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।সামনের ক’গাছি চুল থেকে থেকে উড়ছে।নিহা পরম যত্নে চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিলো।অতি সাবধানে নিজের মুখটা ইফাজের মুখের‘পর আনলো।একটা মুচকি হাসি দিয়ে কপালে আলতো চুমু দিয়ে নিজের মনোবাসনা পূর্ণ করলো।তারপর ইফাজকে ঘুম থেকে না তুলেই ফ্রেশ হতে চলে গেলো।নিহা যেতেই ইফাজ চোখ খুললো।বলাই বাহুল্য ইফাজ এতক্ষণ জেগেই ছিলো।নিহার বারান্দায় আসা থেকে শুরু করে সবকিছুই ইফাজ টের পেয়েছে কিন্তু বুঝতে দেয় নি।নিহার জন্য কষ্ট হয় ইফাজের।কেনো যে মেয়েটা এভাবে তাকে ভালোবেসে বিলীন হচ্ছে!তবে এ কথা তো তার নিজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য সে কেনো মধুকে ভালোবেসে বিলীন হচ্ছে!

নিহা ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখলো ইফাজ খাটের ওপর বসে আছে।ইফাজকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল,’শুভ প্রভাত।’

প্রতুত্তরে ইফাজও বলল,’শুভ প্রভাত।’

‘যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।আমি নিচে যাচ্ছি।’

ইফাজ বিনাবাক্য ব্যয়ে ফ্রেশ হতে গেলো।আর নিহা তার মসৃণ চুলে কয়েকবার চিরুনি চালিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো।

নিচে গিয়ে দেখলো ইফাজের বাবা,খালু,মামা এরা একসাথে বসে চা খাচ্ছে আর গল্পগুজব করছে।নিহা মাথায় ঘোমটা টেনে শ্বশুর কাছে গিয়ে বলল,’বাবা,মা কোথায়?’

‘তোর মা তো কিচেনে।’

‘আচ্ছা বাবা।’বলে নিহা কিচেনের দিকে পা বাড়াতে নিলেই ইয়াফ খান নিহাকে ডেকে বলল,’ওইদিকে পরে যাস,আগে আমার সাথে এসে বস।’

নিহা আদেশ পালন করে শ্বশুরের পাশে খালি জায়গাটায় বসলো।ইয়াফ খান প্রশংসায় নিহার মাথায় হাত রেখে বলল,’এই হলো আমার বড় মা।’

ইয়াফ খানের কথায় উপস্থিত সবাই হাসলো।তারপর সবাই মিলে নিহার প্রশংসা শুরু করলো।নিহার এখন লজ্জা লাগছে।এখান থেকে উঠে যেতে পারলে ভালো হতো কিন্তু এখন ওঠা যাবে না।হয়তো নিহার অস্বস্তি দূর করতেই ওর শ্বাশুড়ি বলল,’বউ মা আসো তো একটু এদিকে।’

নিহা স্বতঃস্ফূর্ত জবাবে বলল,’জ্বি,মা আসছি।’
নিহা শ্বশুর মশাই এর পাশ থেকে উঠে এসে শ্বাশুড়ির কাছে চলে গেলো।সাইদা খান নিহাকে বললেন,’ইফাজ উঠে নি?’

‘হ্যাঁ,মা।ফ্রেশ হচ্ছে।চলে আসবে।’

‘আচ্ছা।তুমি বসে পড়ো।নাস্তা করে ঘরে গিয়ে রেস্ট নিও।

‘ইফাজ আসুক মা।সবাই একসাথেই খাই।আলাদা খেতে ভালো লাগে না।’

‘আচ্ছা নাস্তা খেয়ে একটু রেস্ট করে নিও।পরে বেলা বাড়লে আত্নীয় স্বজন আসতে শুরু করলে কিন্তু পারবে না।আবার রেডিও হতে হবে।’

‘আচ্ছা মা।’
সাইদা বেগমের কথা শেষ হতে না হতেই ইফাজ চলে এলো।চারপাশে কয়েকবার চোখ বুলিয়েও মধুকে দেখতে পেলো না।আর কেউ না বুঝলেও নিহা বুঝতে পারলো ইফাজের অনুসন্ধানী চোখ কাকে খুঁজছে।স্বামীর চোখে অন্য নারীর প্রতি ভালোবাসা কোনো মেয়েই মেনে নিতে পারে না।তেমন নিহাও তবে ওর দৃঢ়বিশ্বাস একদিন ইফাজ ঠিকই ভালোবাসবে ওকে।

নিহা,ইফাজ,আর খালা,খালুরা একসাথে বসেই নাস্তা সেরে নিলো।নাস্তা শেষে ইফাজ কি একটা কাজের বাহানা দিয়ে বাইরে চলে গেলো আর নিহা ঘরে।ওদের নাস্তা করা শেষে ইরিন,মধু,ইয়াদ আর বাকি কাজিনরা এলো নাস্তা করতে।
——————
দুপুরের একটু আগে ইফাজ বাসায় এলো।ও আসতেই সাইদা খান বললেন,’এতো দেরি হলো কেনো?বেলা কিন্তু গড়াচ্ছে।তাড়াতাড়ি রেডি হ।’

‘আচ্ছা,মা নিহা কোথায়?’
ইফাজের কথা শেষ হতে না হতেই পেছন থেকে কেউ একজন খোঁচা মেরে বলল,’আসতে না আসতেই বউয়ের খবর চায়।কি বউ পাগলা রে।’
ইফাজের খুব কড়া করে কিছু একটা বলতে ইচ্ছা হলেও চেপে গেলো।সাইদা খান হেসে বললেন,’নিহাকে ওরা পার্লারে নিয়ে গেছে।’

‘ও,আচ্ছা।’এটা বলেই ইফাজ নিজের ঘরে চলে গেলো।
.
.
মেহমানে ভরে গেছে পুরো বাড়ি।রিসেপশন বলে কথা!মধু খাওয়া শেষ করে ইফাজ আর মধুকে যেখানে বসানো হয়েছে সেখানে চলে গেলো।এক কোণায় দাড়িয়ে সবার কান্ড কারখানা দেখছে।

কালকের মতো হঠাৎ করেই ওই ছেলেটাই কোথা থেকে যেনো এসে মধুর পাশেই দাড়ালো।মধু দেখেও চুপ করে সামনে তাকিয়ে রইলো।ছেলেটাই নির্লজ্জের মতো কথা বলা শুরু করলো।

‘হাই,কেমন আছেন?’

‘ভালো।’ মধু সামনে তাকিয়েই সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো।

‘আচ্ছা আপনি সিঙ্গেল?’

মধু এটা উত্তর দেওয়ার আগেই ইয়াদের গলা শুনতে পেলো।পাশে তাকিয়ে দেখলো ইয়াদ ছেলেটার কাঁধে হাতে দিয়ে আছে।মধুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,’না ও সিঙ্গেল না।ওর বয়ফ্রেন্ড আছে।আমিই ওর বয়ফ্রেন্ড।সেই হিসেবে ও তোমার ভাবী হয়।সম্মান দিয়ে কথা বলবে।তুমি আমার একমাত্র ভাবীর ভাই হও তাই তোমাকে কিচ্ছু বললাম না।তা নাহলে এতক্ষণ হাসপাতালে থাকতে।’

এটা বলে ইয়াদ মধুকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।আসলে ইয়াদও জানতো না ছেলেটা যে ওকে বিরক্ত করছে।এটা ইরিনের অবদান।কালকেও এই ছেলেটা মধুকে বিরক্ত করছিলো আবার আজকেও তাই ইরিনই গিয়ে ইয়াদকে বলেছিলো।কালকে।

চলবে….

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ২৮
#Arshi_Ayat

আজকে বিকেলে নিহার বাবা মা ওকে আর ইফাজকে নিয়ে গেছে ওদের বাড়ি।ইফাজ যেতে চায় নি কিন্তু না গেলেও ব্যাপারটা কেমন যেনো দেখায়।সেইজন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেলো।আজকে মধুরও হোস্টেলে ফেরার কথা ছিলো কিন্তু বের হবার সময়ই আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টি এলো তাই আর ফিরতে পারে নি।
—————-
আজকে বৃষ্টি না থাকলেও সূর্যের তাপ নেই সকাল থেকেই।না রোদ, না বৃষ্টি এমন একটা অবস্থা।নাস্তা করে ইয়াদের সাথে বেরিয়ে পড়লো হোস্টেলের উদ্দেশ্যে।আজকে হোস্টেলে ফিরলেও কলেজে যাবে না।ইয়াদের সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলো মধু।হঠাৎ রাস্তার অপর পাড়ে চোখ যেতেই মধু স্থির হয়ে গেলো।স্বয়ং আইরিন রহমান মধুর দিকে তাকিয়ে আছে।প্রায় চার/পাঁচ মাস পর দেখা।অনেক শুকিয়ে গেছে আইরিন রহমান।মধুর ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলেও নিজেকে কন্ট্রোল করে অন্যদিকে ফিরে হাঁটা ধরলো।ওইখান থেকে কিছুটা সামনে আসার পর মধু কান্না করে দিলো।ইয়াদ ওর চোখের পানি মুছে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত রাখলো।স্বান্তনার স্বরে বলল,’কেঁদো না প্লিজ।’ মধু নিজেকে সামলে নিলো।তবে চোখে মুখে যেনো বিষন্নতা জেঁকে বসেছে।হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে ইয়াদ মধুর হাত ধরে বলল,’একদম কান্নাকাটি করবে না।সাবধানে থাকবে।পারলে বিকেলে একবার আসবো।আর পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস হও।নিজের লক্ষ্যের কথা মনে আছে তো?’

মধু মাথা নাড়ালো।ইয়াদ মধুকে আরেকবার জড়িয়ে ধরে বিদায় দিলো।

ইফাজ নিহার রুমে বসে কফি খাচ্ছিলো।নিহা কফি ভালো বানায়।একটা আলাদা টেস্ট আছে।ইফাজ কফি খেতে খেতেই নিহার কর্মকান্ড দেখছে।নিহা লাগেজ গুছাচ্ছে।হঠাৎ করেই আজকে সকালে বলল হানিমুনে যাবে।ট্রেনের টিকিটও নাকি কেটে ফেলেছে কক্সবাজার যাবে।ইফাজ কিছু বলল না।ওর যা ইচ্ছা করুক ইফাজ বাঁধা দিবে না।

লাগেজ গুছাতে গুছাতে বলল,’ইফাজ রেডি হয়ে নাও।’

‘আচ্ছা।’
ইফাজ কফির খালি মগটা টেবিলের ওপর রেখে উঠে দাড়ালো।তারপর শাওয়ার নিয়ে রেডি হলো।এতক্ষণে নিহাও লাগেজ গুছিয়ে নিজেও রেডি হয়ে নিলো।ট্রেন ছাড়বে বারোটায়।এখন দশটা বাজে।এখনই বেরিয়ে পড়বে ওরা।যাওয়ার আগে শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে একবার দেখা করে যাবে নিহা তাই একটু তাড়াতাড়িই বের হলো।ইফাজদের বাড়িতে এসে ওর বাবা মায়ের সাথে দেখা করে স্টেশনে চলে গেলো।নিজেদের কেবিনে গিয়ে বসলো ওরা।ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে।নিহা জানে ইফাজের আসার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না।কিন্তু নিহার খুব ইচ্ছে ইফাজের সাথে কিছুটা সময় একান্তে কাটানোর।ছুটি শেষ হলেতো ইফাজকে ছাই দিয়েও ধরা যাবে না।তাই এই সুযোগটা ভালো করেই কাজে লাগালো নিহা।ব্যাপারটা ইফাজও ধরতে পেরেছে।কিন্তু সে নিরুপায়!আইনত নিহা ওর স্ত্রী!
ভেবেছিলো নিহাকে বিয়ে করলে কষ্ট কমে যাবে কিছুটা হলেও কিন্তু এ যেনো আগুনের ওপর আরো ঘি ঢালা হলো!কমছে তো নাই বরং আরো বাড়ছে!
——————
বেশকিছুদিন পরের কথা….
এইচ.এস.সি পরীক্ষার আর একমাস আছে।পড়াশোনায় আগের চেয়েও সিরিয়াস হয়েছে মধু।এখন কলেজে যায় না।হোস্টেলেই পড়ে।আর বিকলে ইয়াদ আসলে নিচে নেমে ওর সাথে পাঁচ/দশ মিনিট কথা বলে আবার ওপরে চলে যায়।

আজকে বিকেলে মধু পড়ছিলো মনোযোগ দিয়ে।কিন্তু কোথা থেকে যেনো হন্তদন্ত হয়ে আরিয়া ছুটে এলো।মধু ওকে এভাবে আসতে দেখে বলল,’কি হইছে রে তোর?কোথা থেকে আসলি এভাবে?’

আরিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’মধু আন্টি এক্সিডেন্ট করেছে।’

‘কিহ!কখন এক্সিডেন্ট করছে?কি হইছে আম্মুর?কোন হসপিটালে নিছে?’মধু উত্তেজিত কন্ঠে একের পর এক প্রশ্ন করছে।

আরিয়া কোনো কথারই উত্তর দিচ্ছে না।মধু গায়ে ওড়নাটা ভালোভাবে জড়িয়ে ওকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।হাসপাতালে পৌঁছে মধু মায়ের কেবিনে গিয়ে দেখলো মাথায় ও ডান হাতে আর দুই পায়ে ব্যান্ডেজ করা আর বাম হাতে স্যালাইন লাগানো।কয়েকজন লোক মধু আর আরিয়ার দিকে এগিয়ে আসলো।তাদের মধ্যে একজন বলল,’পেশেন্ট কি হয় আপনাদের?’

মধু চোখের পানি মুছে বলল,’আমার মা।’

‘উনি রাস্তা পার হতে গিয়ে অসাবধানতায় এক্সিডেন্ট করেছেন।তারপর আমারাই ওনাকে হসপিটালে এনেছিলাম।ওনার সাথে ফোন বা পরিচয় পত্র কিছুই ছিলো না।তাই আমরা কাউকে খবর দিতে পারি নি।’

মধু কিছু বলল না।আস্তে আস্তে গিয়ে মায়ের পাশে বসলো।আরিয়া ওনাদের ধন্যবাদ দিয়ে টিয়ে বিদায় করলো।
আসলে আরিয়াও জানতো না মধুর মায়ের এক্সিডেন্টের কথা।নিজের মায়ের সাথে হাসপাতালে আসার পর মধুর মাকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখে আরিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটেছে মধুকে খবর দিতে।

ঘুমের ঔষুধ দেওয়ায় আইরিন রহমান ঘুমাচ্ছিলো।ডাক্তার বলেছে ঘন্টা তিনেক লাগবে জ্ঞান ফিরতে।মধু আরিয়াকে আইরিন রহমানের পাশে বসিয়ে বাসায় গেলো মিলিকে নিয়ে আসতে।মিলিকে নিয়ে হাসপাতালে এসে দেখলো কেবিনের বাইরে ইয়াদ আর আরিয়া কথা বলছে।মধুকে দেখে ইয়াদ কিছুটা এগিয়ে এসে বলল,’চিন্তা করো না।আন্টি ঠিক হয়ে যাবে।’

মধু আরিয়াকে ইশারা করলো মিলিকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।আরিয়া মিলিকে আইরিন রহমানের কাছে নিয়ে গেলো।ওরা ভেতরে যেতেই মধু ভীত বলল,’ইয়াদ আমার ভয় লাগছে।’

ইয়াদ মধুর হাত শক্ত করে ধরে বলল,’ভয় পেয়ো না।কয়েকদিন বিশ্রাম নিলে আন্টি ঠিক হয়ে যাবেন।’

‘হুম।’মধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবিনের বাইরে পেতে রাখা বেঞ্চিতে বসলো।

অবশেষে অনেক অপেক্ষার পর রাত নয়টায় আইরিন রহমানের জ্ঞান ফিরলো।মিলি বাইরে এসে মধুকে বলতেই মধু ডাক্তার ডাকলো।ডাক্তার এসে চেক আপ করে বাইরে এসে বললেন,’চিন্তা করবেন না।উনি এখন ঠিক আছেন।এখন শুধু বিশ্রাম নিতে হবে।আর ঔষুধগুলো কন্টিনিউ করতে হবে।’

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর ইয়াদ বলল,’তুমি ভেতরে গিয়ে আন্টির সাথে একবার দেখা করে আসো।’

‘না।আমি দেখা করবো না।’

‘মধু,গিয়ে দেখা করে আয়।আন্টি তোকে ডাকছে।’আরিয়াও বলল।

মধু যাবে না।কিন্তু শেষে ইয়াদ আর আরিয়ার জোরাজোরিতে ভেতরে গেলো।মধুকে দেখে আইরিন রহমান কাঁদতে কদতে বললেন,’আমাকে ক্ষমা করে দে মা।আমি তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি।আল্লাহ আমার অন্যায়ের শাস্তি আমাকে দিচ্ছে।তুই আমাকে ক্ষমা কর।’

মায়ের হাত ধরে মধু নিজের কেদে দিলো।কিন্তু তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে বলল,’বেশি কথা বলো না মা।তুমি অসুস্থ!ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেছে।’

‘তুই আগে বল আমাকে মাফ করেছিস।’

মধু আইরিন রহমানকে জড়িয়ে ধরে বলল,’মা তো মা’ই।সন্তানের কাছে মা কখনো অপরাধী হয় না।তুমি ঘুমাও।’

তারপর আস্তে আস্তে মধু আবার আইরিন রহমানকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।অবশ্য ওষুধের ডোজের কারণেই আইরিন রহমান তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলেন।আইরিন রহমান ঘুমিয়ে যাওয়ার পর মধু বাইরে এসে ইয়াদকে বলল,’আপনি আরিয়াকে একটু ওর বাসায় পৌঁছে দিন।আমি আর মিলি আজ এখানেই থাকবো।’

‘আচ্ছা আমি আরিয়াকে পৌঁছে দিয়ে আবার আসবো।’

‘না,আপনি আর আসবেন না।বাসায় চলে যাবেন প্লিজ।’

‘আচ্ছা।’
বলে ইয়াদ আরিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।ওকে বাসায় পৌঁছে মিলি আর মধুর জন্য খবার কিনে আবার হাসপাতালে এলো।মিলি আইরিন রহমানের পাশে একটা চেয়ারে বসে ঘুমে ঢুলছে।আর মধু বাইরে পায়চারি করছে।মধু পায়চারি করতে করতেই দেখলো ইয়াদ আসছে।ইয়াদকে আসতে দেখে মধু এগিয়ে এসে বলল,’বাসায় যান নি?’

‘না,বলে দিয়েছি আজকে এখানে থাকবো।’

মধু বিরক্তি নিয়ে বলল,’আপনাকে বলি একটা করেন আরেকটা।’

‘আচ্ছা সরি,খাবার আনছি মিলিকে নিয়ে খেয়ে নাও।’

‘মিলিকে একটু আগে খেয়েছে আর এখন বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে।’

‘ও তাহলে তুমি খেয়ে নাও।’

‘খাবো,কিন্তু আপনি প্লিজ চলে যান।’

‘না,আমি এভাবে তোমাকে রেখে যেতে পারবো না।আন্টি অসুস্থ,মিলি ছোটো মানুষ ঘুমিয়ে গেছে।তুমি একা।কিছু একটা হয়ে গেলে আমার কিছু করার থাকবে না।নিজেকে স্বার্থপর মনে হবে।আমি মানতে পারবো না।তাই আমি এখানেই থাকবো।এখান থেকে না যাওয়ার অপরাধে যে শাস্তি দাও আমি মেনে নেবো।’

মধু এরপর আর কিছু বলল না।অদ্ভুত একটা ভালোলাগা কাজ করলো ইয়াদের জন্য।খাবার বেড়ে ইয়াদকে ইশারা করে খেতে বলল।ইয়াদের যদিও ক্ষুধা নেই তবুও খেলো।খাওয়া শেষ করে বলল,’তুমি ভেতরে গিয়ে বসো।আমি বাইরেই আছি।’

মধু ভেতরে গিয়ে বসলো।অনেক্ক্ষণ বসে থাকার পরও ঘুম আসছে না।এখন রাত ১টা বাজে।পুরো করিডোর ফাঁকা।শুধু ওদের কেবিনের সামনে ইয়াদ বসে আছে।মধু বেরিয়ে এসে দেখে ইয়াদ বসে বসে ফোন টিপছে।মধু পাশে এসে বসে বলল,’ঘুম আসছে না?’

ইয়াদ ফোন রেখে বলল,’না,তুমি ঘুমাও নি কেনো?’

‘ঘুম আসছে না।’

‘চা খাবে?’

‘এতো রাতে চা কোথায় পাবেন?’

‘ওয়েট তুমি বসো।আমি দেখছি।’

ইয়াদ মধুকে আর কিছু না বলতে দিয়ে চলে গেলো।ফিরলো প্রায় আধঘন্টা পর।হাত দুইকাপ চা।মধুর পাশে বসে ওকে এক কাপ বাড়িয়ে দিলো।মধু কাপটা হাতে নিয়ে বলল,’এতো রাতে চা কোথায় পেয়েছেন?’

‘নিচের তলায় বুয়াকে ঘুম থেকে তুলে তারপর ওনাকে দিয়ে বানাইছি।’

মধু চা’য়ে চুমুক দিয়ে বলল,’আপনাকে যে কেনো রামধোলাই দেয় নাই সেটাই বুঝতে পারছি না।’

‘রাম ধোলাই দিলে তুমি খুশী হতে?’

এভাবেই চা খেতে খেতে দুজনের আলাপ চলতে থাকলো।একপর্যায়ে চা শেষ হয়ে গেলেও আলাপ চলতে থাকলো।ভোর রাতের দিকে মধু ইয়াদের কাধের ওপর ঘুমিয়ে পড়লো।ইয়াদের এখনো ঘুম আসছে না।তাই ফোনে গেমস খেলতে লাগলো।

চলবে..

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-২৫+২৬

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ২৫
#Arshi_Ayat

জাহাজ ছাড়ার শব্দ কানে আসছে।মাত্রই হয়তো কোনো দূরপাল্লার জাহাজ ছেড়েছে।আশেপাশে তেমন দোকানপাট নেই হাতেগোনা ৩/৪ টা ছাড়া।পাশেই একটা বটতলা আছে।বেশি রাত না হলেও জায়গাটা অনেক নিরিবিলি।নদীর ঠান্ডা জল ছুয়ে বাতাস শরীর স্পর্শ করছে।ইফাজ নিহার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ রইলো তারপর নিরবতা ভেঙে বলল,’ভালোবাসা সবার ভাগ্যে থাকে না নিহা।তেমন আমার ভাগ্যেও নেই।যাকে ভালোবাসি সে ইয়াদকে ভালোবাসে।ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে।ওদের মাঝে আমি থার্ড পার্সন।আর থার্ড পার্সন যতোই চেষ্টা করুক ফার্স্ট আর সেকেন্ড পার্সনের মাঝে আসতে পারে না।প্রথমে চেয়েছিলাম ইয়াদকে সব বলে দেই।তাহলে ইয়াদ মধুর জীবন থেকে সরে যাবে।কিন্তু যতোবারই বলতে গিয়েছে ইয়াদ আর মধুর হাসিখুশি মুখটা সামনে ভাসতো।আমি বড়ভাই হয়ে ওকে কিভাবে কষ্ট দিবো বলো!সেইজন্য বলতে পারি নি।কথাগুলো নিজের মাঝেই রেখেছি এতোদিন।আজ তোমায় বললাম।আমার ভরসা ভেঙো না।’

ইয়াদের কথা শেষ হতেই নিহা ইয়াদের হাতে হাত রেখে ভরসা দিলো।ইয়াদ নিহার হাত নিজের হাতে মুষ্টি বদ্ধ করে আবার বলতে লাগলো,’জানো,যেদিন দেশে এসেছি ওইদিন সন্ধ্যায় ওর সাথে আমার দেখা হয় প্রথম।ওইদিন থেকে ভালো লাগা শুরু।এরপর অনেকবার লুকিয়ে চুরিয়ে দেখেছি ওকে।একটা সময় যখন কিছুদিনের জন্য চোখের আড়াল হয়েছিলো তখন মনে আমি বুঝতে পেরেছি আমার কিছু হয়ে গেছে।আমি অনেকবার বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু বলতে পারি নি।আমি তখনও জানতাম না ইয়াদের সাথে ওর রিলেশন।কিছুদিন আগে যখন আমি চেম্বার থেকে বাসায় ফিরেছি তখন আমি ওকে দেখে অবাক হয়েছিলাম।পরে মা আর ইরিনের কথায় জানতে পারলাম মধু আর ইয়াদের রিলেশন চলছে।সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিলো।চেয়েছিলাম স্বার্থপর হতে কিন্তু বিবেকের কাছে বারবার হেরে গিয়েছিলাম।’

ইফাজ থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।নিহা ইফাজকে টেনে বটতলায় নিয়ে বসালো ইফাজের মাথাটা নিজের কাঁধে নিয়ে বলল,’জানো এইজন্যই তোমাকে ভালোবাসি।সেই ছোট থেকে তোমাকে দেখছি।নিজে গুমরে মরবে তবু কাউকে কিছু বলবে না।সেইজন্য সবাই তোমাকেই দোষী ভাবতো কিন্তু আমি জানি তুমি দোষী না।কেনো জানি মনে হতো একমাত্র আমিই তোমাকে বুঝতে পারি।’

ইফাজ নিহার কাঁধ থেকে নিজের মাথা উঠিয়ে বলল,’আমার কিছুদিন সময় লাগবে নিহা।শরীরের ওপর চললেও মনের ওপর তো জোর চলে না বলো!”

‘সারাজীবন সময় লাগলে তাও নিয়ে নাও,শুধু আমায় তোমার পাশে থাকতে দাও,ভালোবাসতে দাও।’

আরো কিছুক্ষণ সুখ দুঃখের আলাপ চললো।তারপর ইফাজ নিহাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো।বাড়িতে এসে বেল বাজাতেই ইরিন দরজা খুললো।ভাইয়ের সাথে একটা মেয়েকে দেখে বধূবেশে দেখে ইরিন অবাক হলো।মেয়েটাকে ইরিন চেনে।ভাইয়ের ক্লাসমেট।কিন্তু এইমেয়ে তাও আবার এই বেশে।ইরিন কিছু একটা ভাবলো।মানুষের মন বলে কথা।ইফাজ ইরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,’তোর ভাবী।যা মাকে ডাক।’

ইরিন দরজায় দাঁড়িয়ে গলা হাকিয়ে ডাকতে লাগলো,’মা,মা ও মা।’

সাইদা খান কিচেন থেকে চিল্লিয়ে বলল,’কি হইছে গরুর মতো চিল্লাচ্ছিস কেনো?’

‘এদিকে এসে দেখো তাহলে তুমি ষাঁড়ের মতো চিল্লাবা।’ইরিনও জোরেজোরেই বলল।

রান্না ঘর থেকে সাইদা খান বেরিয়ে এসে দরজার সামনে আসতেই ইফাজের সাথে নিহাকে দেখে প্রথম দফায় অবাক হলো।আর দ্বিতীয় দফায় চিল্লিয়ে ওদের বাবাকে ডাকলো।ইয়াফ খান নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে দরজার সামনে আসলো।ওদের দিকে এক পলক দেখে বলল,’ঘটনা কি ইফাজ?’

ইফাজ নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,’আমি বিয়ে করেছি বাবা।’

ইফাজ আর নিহা ছাড়া উপস্থিত সবাই একমুহূর্তের জন্য নির্বাক হয়ে গেলো।মনে হলো খুব সূক্ষ্ম একটা বাজ ইতিমধ্যে পড়ে গেছে।এখন শুধু রিয়াকশনের অপেক্ষা।ইয়াফ খান নিজেকে সামলে বলল,’ইফাজ,ওকে নিয়ে ভেতরে আয়।’

ইফাজ আর নিহা ভেতরে আসলো।দুজনকে একপাশের সোফায় বসিয়ে ইয়াফ খান আর সাইদা খান মুখোমুখি সোফায় বসলো।আর ইরিন ইয়াদকে ফোন দিলো ব্রেকিং নিউজ দেওয়ার জন্য।

ইয়াফ খান ইফাজকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ইফাজ হঠাৎ করে এমন করলি কেনো?’

ইফাজ কিছু বলার আগেই নিহা বলল,’বাবা,আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি কিন্তু এক সপ্তাহ আগে ইফাজ আমার সাথে রাগ করেছিলো।তাই আমিও উল্টো রাগে অন্যকাউকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই।তারপর আজ যখন বিয়ে হয়ে যাচ্ছিলো তখন ইফাজ আমাকে ফোন দিয়ে বলছিলো ‘নিহা প্লিজ তুমি বিয়ে করো না।আমি তোমাকেই ভালোবাসি।সরি আর রাগ করবো না।’ ওর এমন কথা শুনে আর আমি থাকতে পারি নি।বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছি।তারপর বিয়ে করে নিয়েছি।সরি আব্বু,সরি আম্মু।তোমাদের ছাড়াই বিয়ে করে ফেলেছি।’

নিহার কথা শুনে ইয়াফ খান হেসে বলল,’সমস্যা নাই।তোদের বিয়ে আবার দিবো।’

নিহা খুশিতে গদগদ হয়ে ইফাজকে টেনে নিয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়িকে সালাম করলো।সাইদা খান নিজের হাতের বালা জোড়া নিহার হাতে পরিয়ে দিয়ে বলল,’আমার ছেলেটাকে নিয়ে সুখী হও মা।’

ইয়াফ খান নিহাকে নিজের পাশে বসিয়ে বলল,’কালকে তোমার বাবা মাকে আসতে বইলো কেমন!’

‘আব্বু আম্মু অনেক বকা দিবে আব্বু।’নিহা কৃত্রিম ভীতকন্ঠে বলল।

ইয়াফ খান নিহাকে মাথায় হাত রেখে বলল,’তোর বাবার সাথে আমি কথা বলবো তুই চিন্তা করিস না।’

নিহা শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,’থ্যাংকিউ বাবা।’

এতক্ষণ ইফাজ নিহার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলো।কি বড় মিথ্যুক!তার চেয়ে বড়ো কথা কি সুন্দর সবাইকে হাত করে ফেলেছে।তবে ইফাজও অবশ্য মনেমনে বলার জন্য কিছু সাজিয়ে রেখেছিলো।কিন্তু নিহা যে মনেমনে এগুলো ভেবে রেখেছিলো ইফাজ ভাবে নি।তবে যাইহোক খুব সুন্দর ভাবে সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করে ফেলেছে নিহা।

এরমধ্যে ইয়াদও আসলো।ইয়াদ,ইরিন মিলে ভাবীর সাথে আড্ডা মারা শুরু করলো আর ইফাজ ফ্রেশ হতে গেলো।

রাতে ইয়াদ আর মধু কথা বলছিলো।তো কথার একপর্যায়ে ইয়াদ বলল,’ওহ!একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।’

‘কি কথা?’

‘ভাইয়া আজকে বিয়ে করেছে।’

মধু চমকে বলল,’কি বলছেন?কিভাবে কখন?’

ইয়াদ সবটা বলার পর মধু তেমন কিছু না বললেও আরিয়ার জন্য কষ্ট পেলো।তবে যাইহোক যা হয় ভালোর জন্য হয়।হয়তো আরিয়া আরো ভালো কিছু ডিজার্ভ করে।তবে আরিয়া এটা শোনার পর কষ্ট পাবে।
————————
পরেরদিন ইয়াফ খান নিহার বাবার সাথে কথা বলে বিয়ে দিন,তারিখ ঠিক করে ফেলে।তারপর নিহাকে সাথে নিয়ে ওর বাবা চলে যায়।বিয়ের আগ পর্যন্ত নিহা বাবার বাড়িতে থাকবে।বিয়ে সামনের শুক্রবার।মাঝখানের দিনগুলোতে সব ডেকোরেশন আর কেনাকাটা চলবে।ডেকোরেশন,শপিং এগুলো দেখবে মধু আর ইরিন আর ইয়াদ রান্নাবান্না,ইনভাইটেশন,আর ভাইয়ের শপিংয়ের দায়িত্বে।বিয়ে উপলক্ষে ইয়াদের মায়ের আবদার রাখতেই বিয়ে মিটে যাওয়া পর্যন্ত মধু ওদের বাড়িতে থাকবে।অবশ্য এই বুদ্ধি ইয়াদের মায়ের না এই বুদ্ধির মালিক ইয়াদ নিজেই।

মধু, ইরিন আর সাইদা খান সোফায় বসে নিহার আর ওর মায়ের অপেক্ষা করছে।নিহা এলে ওরা তিনজন আর দুই বেয়াইন মিলে শপিংয়ে বের হবে।
আর এদিকে ইয়াদ ওর বন্ধুদের নিয়ে যাবে শপিংয়ে।ইফাজের ডিউটি আছে।সে কিছুতেই ডিউটি মিস দিতে পারবে না।তাই ইয়াদকেই শপিং করতে হবে।

সব আয়োজন শেষ।এই কয়টা দিন সবাই মোটামুটি ব্যস্ত ছিলো।আজকে গায়ে হলুদ।ইফাজ সন্ধ্যা ডিউটি থেকপ আসতেই ওকে ওর বন্ধুরা আর ইয়াদ মিলে চেপেচুপে নিয়ে গেলো হলদু দিতে।ইফাজ তো যাবেই না তবুও জোরাজোরি ঠ্যালায় যেতেই হলো।গায়ে হলুদে সবাই এক এক করে এসে ইফাজকে হলুদ লাগাতে শুরু করলো।সবার লাগানো শেষ মোটামুটি।ইয়াদ এসে মধুকে হালকা করে ধাক্কা দিয়ে বলল,’তুমি ভাইয়াকে হলুদ লাগাও নি?’

‘না।আসলে…’

ইয়াদ মধুকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’আসলে,নকলে কিচ্ছু না যাও লাগায় আসো।’

মধু গিয়ে ইফাজের গালে হালকা একটু হলুদ ছুঁইয়ে বলল,’শুভ হোক আপনার বিবাহিত জীবন।’

ইফাজ কিছু বলল না।ম্লান একটা হাসি দিলো।এই হাসির অর্থ কেউ জানে না।মধু স্টেজ থেকে নেমে ইয়াদের সাথে এসে দাড়ালো।ইয়াদ লোক চক্ষুর আড়ালে নিঃশব্দে একটু হলুদ মধুর গালে ছোঁয়ালো।আর মধু ইয়াদের ঘাড়ে ছুঁইয়ে দিলো।এরমধ্যেই একটা মেয়ে এসে ইয়াদের সামনে দাড়িয়ে বলল,’আরেহ!ইয়াদ কেমন আছো?’

‘আলহামদুলিল্লাহ আপু ভালো।আপনি?’

‘ইশ!আমি কি তোমার আপু হই নাকি?আমি তোমার অনেক ছোটো হই।’

ইয়াদ মৃদু হেসে বলল,’ওহ!আচ্ছা ছোটো আপু।’

‘কোনো আপু না।নাম ধরে ডাকতে পারো না?ইয়াদ তুমি খুব নিরামিষ হয়ে যাচ্ছো দিনদিন।’

‘তাই নাকি ছোটো আপু।আমি তো জানতাম না।জানিয়ে উপকার করলেন।’

ইয়াদ এসব হেঁয়ালিপূর্ণ কথায় মেয়েটা ‘ধ্যাৎ’ বলে চলে গেলো।ও চলে যাওয়ার পরই মধু আর ইয়াদ দুজনেই বত্রিশ দাত কেলিয়ে হাসতে লাগলো।হাসতে হাসতেই ইয়াদ বলল,’আচ্ছা আসলেই কি আমি নিরামিষ হয়ে গেছি?’

মধু ইয়াদের দিকে চোখ মেরে বলল,’খেয়ে দেখতে হবে।’

চলবে…

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ২৬
#Arshi_Ayat

পুরো বাড়িতে মেহমান গিজগিজ করছে।শোয়ার জায়গা নেই।সব রুম ভরা।ইরিনকে খুঁজে পাচ্ছে না তখন থেকে।কোথায় যে আছে!কিন্তু এখন ঘুমাবে কোথায়?ইরিনের রুমেও জায়গা নেই।গেস্টরুমও খালি নেই।মধু ইরিনকে খুঁজতে খুঁজতে দুইতলায় এলো।হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হ্যাঁচকা টান মারে হাতে।

ইয়াদ নিজের ঘরের দরজাটা বন্ধ মধুর কাছে এসে দাড়ালো।তারপর দুষ্টহাসি দিয়ে বলল,’কি যেনো বলছিলে,খেয়ে দেখতে হবে তাই না?এবার তো কেউ নেই।খেয়ে দেখতে পারো।’

মধু ভীত গলায় বলল,’কি শুরু করেছেন আপনি?কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’

ইয়াদ আশে পাশে একবার তাকিয়ে বলল,’দরজা, জানালা সব বন্ধ।এইরুমে আমরা ছাড়া কেউ নেই।তাহলে কে দেখবে?’

‘আপনার মাথায় আজ ভুত ভর করেছে শিউর।’

ইয়াদ হুট করে মধুর কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কপালটা ওর কপালে ঠেকিয়ে বলল,’হ্যাঁ,সেই ভুত টা তুমি।তুমি ভর করেছ আমার মাথায়।’

মধু কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজায় কেউ নক করলো।ইয়াদ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেললো।তারপর মধুকে ছেড়ে দিয়ে দরজা খুললো।ততক্ষণে মধু ওয়াশরুমে লুকিয়ে লুকালো।দরজার বাইরে ইরিন দাঁড়িয়ে আছে।ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে বলল,’কি হইছে?’

‘ভাইয়া মধুকে দেখছো?’

‘না তো।আমি তো শুয়ে পড়ছিলাম।’

‘ওহ!আজকে তুমি ভাইয়ার রুমে শোও না প্লিজ।নিচে জায়গা নেই।আমি আর মধু তোমার ঘরে শুবো।’

ইয়াদ কিছু একটা ভেবে বলল’,আচ্ছা তার আগে মধুকে খুঁজে আন।দরজা লক করে শুবি।আর শোন তুই আর মধু ছাড়া আর কেউ যেনো এ ঘরে না আসে।স্পেশালি কোনো মেয়ে!আসলে তোকে উল্টো ঝুলিয়ে পিটাবো।’

‘আচ্ছা।আসবে না।’

এটা বলেই ইরিন সরল মনে মধুকে খুঁজতে গেলো।আর এদিকে ইয়াদ আবার ঘরে এসে ওয়াশরুমের সামনে দাড়িয়ে বলল,’ইরিন চলে গেছে।এখন বের হও।’

মধু বাইরে থেকে ইয়াদের কথা শুনে বেরিয়ে আসলো।
——————
ইরিন আবার খুজেও মধুকে পেলো না।তাই ইয়াদের রুমের কাছে যেতেই দেখলো মধু ছাদের সিড়ি ধরে নামছে।ওকে দেখে ইরিন বলল,’তুমি ছাদে ছিলে?আর আমি তোমাকে সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি।’

মধু নিচে নেমে এসে বলল,’আমিও তো তোমাকে খুঁজতে ছাদে গিয়েছিলাম।’

বলা বাহুল্য মধুর মিথ্যাটা ইরিন ধরতেই পারলো না।একটু আগেই ইয়াদ চলে গেছে।ও যাওয়ার পর মধু খেয়াল রেখেছিলো কখন ইরিন আসে।যেই ইরিনকে উপরে আসতে দেখলো সেই মধু ছাদের সিড়িতে দাড়ালো।তারপর ও ওপরে আসতে আসতে মধু নিজেও নিচে নামতে শুরু করলো।

‘ওহ!আচ্ছা চলো।আজকে আমরা ইয়াদ ভাইয়ার রুমে ঘুমাবো।নিচে তো জায়গা নেই সেইজন্য।’

‘ওহ!আচ্ছা তাহলে উনি কোথায় ঘুমাবেন?’

ইরিন হেসে বলল,’তোমার উনি ইফাজ ভাইয়ার সাথে ঘুমাবে।’

‘ওহ!”
তারপর ইরিন আর মধু ইয়াদের রুমে ঢুকে ইয়াদের কথা মতো দরজা লক করে শুয়ে পড়লো।
——————
ইয়াদ ঘুমিয়ে গেছে।কিন্তু ইফাজের চোখে ঘুম নেই।ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে একধ্যানে।ইতিমধ্যে চোখ থেকে গড়িয়ে দু’ফোটা পানিও স্ক্রিনের ভেসে থাকা মানুষটার ওপরে পড়েছে।

এতক্ষণ বসে বসে মধুর সবগুলো ছবি ডিলেট করেছে।যে ডাইরিতে ওকে নিয়ে লিখতো সেটাও পুড়িয়ে ফেলেছে।শুধু এই ছবিটাই আছে ওর ফোনে।এই ছবিটা যেদিন তুলেছিলো সেদিন ইফাজ রাস্তা দিয়ে আসছিলো আর মধু ছাদে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিলো।ওর চুলগুলো মাতাল হাওয়ায় উড়ছিলো।দূর থেকে দেখে ইফাজ দ্রুত পিকটা তুলেছিলো।প্রতিদিন রাতে শুতে যাওয়ার আগে ওর ছবি দেখা আর না বলা কথাগুলো ডায়েরীর পাতায় লিখা যেনো ইফাজের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু ইয়াদের সাথে রিলেশন এটা জানার পর থেকে নতুন করে ডায়েরিতে আর কিছুই লিখতে পারে নি ইফাজ।পারবেই বা কিভাবে!লিখতে গেলেই হৃদয় ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়।তবে আজ সবকিছুর অবসান করতেই মধুর সাথে সম্পৃক্ত সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে ইফাজ।

কাপাকাপা হাতে মধুর শেষ ছবিটাও ডিলেট করে দিলো।কিন্তু যেখান থেকে ডিলেট করা জরুরী সেখান থেকেই পারবে না।হায় আফসোস!
এখন মধুকে নিয়ে ভাবাও উচিত না কিন্তু মনের ওপর কি কারো জোর চলে!
—————-
মধু বুঝতে পারছে না কোন শাড়িটা পড়বে!সবগুলোই সুন্দর!ইয়াদের মা এগুলো দিয়ে গেছে।এখান থেকে যেটা পছন্দ সেটা পরার জন্য।কিন্তু মধুরতো সবগুলোই তো পছন্দ!সব’তো আর একসাথে পরা যাবে না।এই সময়ে ইরিন ওয়াশরুম থেকে বের হলো চুল মুছতে মুছতে।মধুকে ভাবুক চেহারায় শাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,’এখনো শাড়ি পছন্দ করতে পারলে না?’

মধু অসহায় মুখে বলল,’না গো।সবগুলোই পরতে ইচ্ছে করছে আমার।’

মধুর কথা শুনে ইরিন হাসতে হাসতে খাটে বসে পড়লো।তারপর বলল,’দাড়াও ইয়াদ ভাইয়াকে বলি তোমাকে শাড়ি সিলেক্ট করে দিতে।’

ইরিনের কথা শেষ হতে না হতেই ইয়াদ ওদের ঘরে উঁকি দিয়ে বলল,’কি কথা হচ্ছে আমাকে নিয়ে?’

‘আরে ভাইয়া,মধু একটাও শাড়ি পছন্দ করতে পারছে না।তুমি একটা পছন্দ করে দাও।’

ইয়াদ একটা শাড়ির ব্যাগ নিয়ে মধুর হাতে দিয়ে বলল,’ওইগুলা পড়া লাগবে না তুমি এটা পড়ো।’

আরেকটা ব্যাগ ইরিনের হাতে দিয়ে বলল,’এটা তোর জন্য।’

ইরিন বলল,’বাহ!ভাইয়া তুমি আমাকে শাড়ি গিফট করছো!’

‘আমার’তো টাকা গাছে ধরে যে আমি শাড়ি গিফট করবো।এই দুইটাই ইফাজ ভাই দিছে তোদের।’

‘ওহ!আচ্ছা।’
তারপর ইয়াদ চলে যেতেই মধু আর ইরিন শাড়ির ব্যাগ খুললো।এই শাড়ি দুইটা আগের গুলোর থেকে আরো বেশি সুন্দর।মধুরটা জাম কালারের আর ইরিনেরটা কালো।দুজনেই শাড়ী পড়ে তৈরি হলো।

বরযাত্রীদের মধ্যে প্রথম গাড়িতে ইফাজ,ওর দুই বন্ধু,আর ইয়াদ গেছে।দ্বিতীয়টায় মধু, ইয়াদের মা,ইরিন,ইয়াদের চাচি,মামি,ফুপুরা।এরপরের গাড়িতে ইয়াদের বাবা,খালু,মামা,চাচারা আর শেষের মাইক্রোতে ইয়াদের কাজিনরা।মোট তিনটা মাইক্রো আর একটা ফিয়াট গেলো নিহাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
——————
বিয়ে পড়ানো শেষ।নিহা ইফাজের সাথে সেলফি নিচ্ছে।কিন্তু ইফাজের সেদিকে মন নেই।ও তো মধুকে দেখছে।এই শাড়িতে ভালোই মানিয়েছে মধুকে।এই শাড়িটা ইফাজ কিনেছিলো মধুকে যেদিন ভালোবাসি বলবে সেদিন দিবে।নিজের হাতে আর দেওয়ায় হলো না,বলা ও হলো না ভালোবাসি।কালকে রাতে এই শাড়িটাও ফেলে দিতে চেয়েছিলো ইফাজ কিন্তু পরে ভাবলো থাক না নিজের দেওয়া কিছু একটা ওর কাছে।এইজন্যই আর শাড়িটা পোড়ায় নি ইফাজ।হঠাৎ ইফাজের ধ্যান ভঙ্গ করে নিহা বলল,’মধুকে দেখছো?’

ইফাজ নিহা কথায় হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে বলল,’না’
নিহা বুঝতে পারলেও প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,’হসপিটাল থেকে কয়দিনের ছুটি নিয়েছো?’

‘এক সপ্তাহের।এতোদিন নিতে চাই নি।আম্মুর জোরাজোরিতে নিতে হলো।’

নিহা কিছু বলার আগেই ইফাজকে ঘিরে ধরলো নিহার কাজিন’রা।এরপরই ওদের মজা নেওয়া শুরু।
——————
মধু ওয়াশরুম খুঁজে পাচ্ছে না।কিন্তু এখন ওয়াশরুমে যাওয়া জরুরি।এদিকে ইরিন বা ইয়াদের মা কাউকেই পাচ্ছে না।ইয়াদ ও গুম হয়ে আছে।অগত্যা ছেলেকে এদিকে আসতে দেখে বলল,’এক্সকিউজ মি।’

‘জ্বি বলুন।’

‘ওয়াশরুমটা কোথায় একটু বলতে পারবেন?’

‘সোজা গিয়ে ডানে।’

‘আচ্ছা ধন্যবাদ।’
মধু ওয়াশরুমে গিয়ে দেখলো ইরিনও এখানে মুখ ধুচ্ছে।তারপর দু’জনেই প্রসঙ্গ ছাড়া কথা বলতে বলতে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো।একটু যেতে না যেতেই ইরিনের কাজিন এসে ওকে কি যেনো বলতে নিয়ে গেলো।এখন মধু কি এখানে একলা দাঁড়িয়ে থাকবে!তাই ও সামনে হাটা শুরু করলো।
————–
খোঁজাখুজি করার পরও ইয়াদকে পেলো না।কোথায় যে গেলো!মধু এক কোণায় মুড অফ করে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো।হঠাৎ কেউ ওর পাশে এসে দাড়াতেই মধু পাশ ফিরে চাইলো।এটাতো ওই ছেলেটা যে ওকে একটু আগে ওয়াশরুমের খোঁজ দিয়েছিলো।ছেলেটা সামনের দিকে তাকিয়েই বলল,’আপনি ছেলের কি হন?’

‘কাজিন’।আবারো সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো মধু।ইয়াদের মা বলেছিলো কেউ কিছু জিগ্যেস করলে কাজিন বলতে।তবে মনেমনে মধু বিরক্ত বোধ করছিলো ছেলেটা উপস্থিতিতে।এসেই পিতলা আলাপ শুরু করেছে।মনে হচ্ছে না এ থামবে।ছেলেটা আবারও বলল,’ওহ!আপনার জানতে পারি?’

‘মধু।’

‘বাহ,অনেক সুন্দর নাম।’

‘ধন্যবাদ।’
ছেলেটা বুঝতে পারছে মধু যে বিরক্ত বোধ করছে তবুও বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে।কথা বাড়ানোর জন্য আবার বলল,’আমার নাম অন্তর।’

মধু মনে মনে দাঁত খিঁচিয়ে বলল,’তোর নাম অন্তর নাকি বন্দর আমি জানতে চাইছি।বেশরম পোলা।’কিন্তু মুখে বলল,’ও।’

ইয়াদের ওপর প্রচুর রাগ হচ্ছে মধুর।না জানি কোথায় গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।আর এদিকে আরেকজন এসে ফ্লাট করছে।
কিন্তু মধু জানেই না ইয়াদ বিয়ে বাড়িতে নেই।ইয়াদ আর রাসেল বিয়ে বাড়িতেই নেই।ওদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাসর সাজানোর জন্য।তাই ওরা খেয়েই বেরিয়ে পড়েছে।আশেপাশে মধুকে খুঁজে পায় নি তাই জানাতেও পারে নি।তবে ইরিনকে বলে গিয়েছিলো যেনো মধুকে বলে।কিন্তু ইরিন ভুলে গেছে মধুকে বলতে।

ছেলেটা আরো কিছু বলার আগেই ইরিন এসে বলল,’মধু চলো তোমাকে মা ডাকছে।’

মধু যেনো এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো।ইরিনের সাথে অন্যদিকে চলে গেলো।
———–
বাড়িতে আসার পর থেকে মধু শুধু দূরে দূরে থাকছে।হাসছে না,কথাও বলছে না।শুধু এড়িয়ে যাচ্ছে।হঠাৎ কি হলো ইয়াদের মাথায় ঢুকছে না।

চলবে…

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।