ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৩১+৩২

0
2271

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৩১
#Arshi_Ayat

একসপ্তাহ পরের কথা….

রাত ১২.০৩ বাজে ঘড়িতে।ঘরে মোমবাতির টিমটিমে আলো। দরজা,জানালা বন্ধ বলে আবহাওয়া গরম গয়ে উঠেছে।তিনটা চেয়ারে তিনজনকে পাটের মোটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাধা হয়েছে।ওদের চোখমুখ বাঁধা হয়েছে কাপড় দিয়ে।এদের মধ্যে একজনকে ইফাজ চিনে।এক সপ্তাহ আগে মধুকে উদ্ধার করতে গিয়ে এর সাথে কথা কাটাকাটি হয়।তারপর ওকে আর ধরতে পারে নি তবে ইফাজও বসে থাকার মতো মানুষ না।পুরোনো বন্ধু নিখিলকে কিডন্যাপের ঘটনা খুলে বলল।সব শুনে নিখিল বলেছিলো,’তুই তাহলে জিডি কর।’

‘না রে,আমি ব্যাপারটা পুলিশ কেসের মধ্যে জড়াতে চাইছি না।তুই কি আনঅফিশিয়ালি আমাকে হেল্প করতে পারবি?’

‘হুম,ব্যাপারটা কিন্তু রিস্কি।’

‘সমস্যা নেই।তুই শুধু ওদের সাথে একবার সাক্ষাৎ করিয়ে দিবি আমার।তারপর জমের বাড়ি পাঠানোর দায়িত্ব আমার।’

‘আচ্ছা,তাহলে আমার ওদের মধ্যে কারো ছবি লাগবে।তোর কাছে কি ছবি আছে?’

‘না তবে আমি ওদের মধ্যে একজনকে দেখেছি।আমার মনে হয় ওকে ধরতে পারলেই বাকিগুলোর খোঁজ পাওয়া যাবে।’

‘হুম।তুই যাকে দেখেছিস হুবুহু মনে করতে পারবি তো?’

‘হুম,পারবো।’
তারপর নিখিল একজন স্কেচ আর্টিস্টকে ডেকে নিয়ে ইফাজের কথামতো ছবি একে নিলো।আকা শেষে ইফাজ একবার ছবিতে চোখ বুলিয়ে বলল,’হুম,এটাকেই খুঁজে বের করতে হবে তোর।এটার মাধ্যমেই বাকিগুলোকে ধরা যাবে।’

‘ঠিকাছে,চিন্তা করিস না।পেয়ে যাবি অতি শীগ্রই।’

এরপর থেকে একসপ্তাহ ধরে খোঁজ চলার পর আজকে ধরতে পেরেছে একটাকে।ওইটার মাধ্যমেই বাকি দুইজনকে ধরেছে।তারপর ইফাজের কথামতো নিখিল ওদেরকে ইফাজের হাতে তুলে দিয়ে নিজের কাজ শেষ করে চলে গেলো।নিখিল যেতেই ইফাজ ঘরে আসলো।

এই জায়গাটা ঘনবসতি না।এই বাড়ির আশপাশে আর কোনো বাড়ি নেই।সবগুলো দূরে দূরে।তাই জায়গাটাই উপযুক্ত মনে হয়েছে ইফাজের কাছে।

ইফাজ ওদের তিনজনের চোখ আর মুখের বাঁধন খুলে দিলো।তৎক্ষনাৎ ওদের মধ্যে একজন গর্জে উঠে বলল,’আমাদেরকে বেঁধে রেখেছিস কেনো?পারলে বাঁধন খুলে দে তারপর দেখ কি করি।’

ইফাজ হাসলো।বাম হাতে মাথার পেছনের চুলগুলো টেনে ধরে বলল,’আমার হাতে বেশি সময় নাই তোদের সার্কাস দেখার।ভালোয় ভালোয় বলছি বলে দে কেনো মধুকে কিডন্যাপ করেছিস?’

‘বলবো না।’ওদের মধ্যে একজন রুড় গলায় বলল।

ইফাজ আর কিছু বলল না।উঠে দাড়িয়ে সবগুলোর মুখ আবার বেঁধে দিলো।তারপর ব্যাগ থেকে ধারালো একটা চাকু বের করে মোমবাতির আগুনে একটু গরম করে বামপাশের একজনের মুখ খুলে দিলো তারপর বলল,’বল,কেনো মধুকে কিডন্যাপ করেছিস?’

‘বলবো না।’লোকটা দৃড় কন্ঠে বলল।

ইফাজ ওর মুখটা আবার বন্ধ করে দিলো।গরম করা চাকুটা দিয়ে লোকটার বাম হাতের শাহাদাত আঙুলটা কেটে ফেললো।তারপর এক হাতে গলা চেপে ধরে আরেক হাতে মুখের বাঁধনটা খুলে বলল,’বল,কেনো মধুকে কিডন্যাপ করেছিলি?’

লোকটা ব্যাথায় কাতরাচ্ছে তবুও বলছে না।ইফাজ ওর মুখটা আটকিয়ে পাশের জনের কাছে গেলো।এভাবে সবাইকে টর্চার করার ফলেও কোনো ইনফরমেশন বের করতে পারলো না।ইফাজের শরীর ঘামে ভিজে গেছে।দরদর করে কপাল দিয়ে ঘাম পড়ছে।ইফাজ ঘরের এদিক সেদিক তাকিয়ে একটা লোহার রড দেখতে পেলো।রড টা এনে আগুনে গরম করে রুমাল দিয়ে ধরে মাঝের জনের মুখের বাঁধন খুলে বলল,’শেষবারের মতো বলছি কেনো মধুকে কিডন্যাপ করেছিলি?’

লোকটা তবুও বলছে না চুপ করে রইলো।ইফাজ চিকন রডটা চোখের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে নিলেই লোকটা মৃদু চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,’বলছি,বলছি।’

ইফাজ রডটা নিচে নামিয়ে বলল,’বল।’

‘আমরা কিছু জানি না।আমাদের শুধু বলা হয়েছিলো মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে বস্তিতে রেখে আসতে।’

‘কে বলেছিলো?’

‘একটা মেয়ে।’
ইফাজের ভ্রু কুঁচকে গেলো।কোনো মেয়ে কেনো মধুকে কিডন্যাপ করাবে।ইফাজ বলল,’ও কোথায় থাকে?’

‘জানি না।শুধু ওর নাম্বারটা আছে আমাদের কাছে।’

ইফাজ নিজের ফোন বের করে বলল,’নাম্বার বল।’
লোকটা ভীতু গলায় নাম্বার বলল।তারপর ইফাজ এক এক করে ওদের ফোন,মানিব্যাগ নিয়ে নিলো।এখন মেরে ফেললেও কোনো খোঁজ পাওয়া যাবে না।বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যাবে।ইফাজের আর খাটুনি করতে ভালো লাগছে না।এমনিতে এর বেশি ইনফরমেশন ওরা দিতে পারবে না।আর এদের ছেড়ে দিলেও ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।তাই মেরে ফেলেই উত্তম।

প্রথমে ইফাজ চেয়েছিলো গুলি করতে কিন্তু পরে ভাবলো গুলি করলে যদি কোনোভাবে ধরা পড়ে যায়!রিস্ক নেওয়া যাবে না।তাই হাই পাওয়ারের ড্রাগ দিয়ে দিলো ওদের তিনজনকে।তারপর হাত,পা খুলে এক একে তিনজনকেই গাড়িতে তুললো।যাওয়ার সময় নিখিল এই গাড়িটা ইফাজের জন্য ছেড়ে গিয়েছিলো।

ইফাজ গাড়ি ড্রাইভ করে নদীর পাড়ে নিয়ে এলো।আশেপাশে কেউ নেই এটাই মোক্ষম সময়!ইফাজ তিনজনকেই নদীতে ফেলে দিলো।অতিমাত্রায় ড্রাগ দেওয়ার ফলে তিনজনের কারোই জ্ঞান ছিলো না ফলে আস্তে আস্তে তলিয়ে যেতে লাগলো।

সবকাজ শেষ করে ইফাজ বাড়ির দিকে রওনা হলো।এখন ২.৩০ বাজে।নিশ্চয়ই সবাই ঘুমিয়ে গেছে।সন্ধ্যার সময় ইফাজ বাসায় ফোন করে বলেছিলো যে আজকে অপারেশন আছে তাই আসতে অনেক রাত হবে।গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই এক সপ্তাহ আগের কথা মনে হলো।যেদিন মধুকে ইফাজ বাচিয়েছিলো সেদিন রাতেই মধুকে ওকে ফোন দিয়েছিলো ঘটনাটা জানার জন্য।ইফাজ কৌশলে সবটা ধামাচাপা দিয়ে দিলো। মধুও আর কোনো প্রশ্ন করলো না।

বাসায় পৌঁছে এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খোলার আগেই নিহা দরজা খুললো।নিহাকে দেখে ইফাজ বলল,’ঘুমাও নি?’

‘ঘুমালে নিশ্চয়ই এখন তোমার সামনে থাকতাম না তাই না!এখন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও আমি খাবার নিয়ে আসছি।’

ইফাজ অযথা কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে গেলো।জামা কাপড় ছেড়ে শাওয়ার নিয়ে একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে রুমে আসতেই দেখলো নিহা খাবার বেড়ে বসে আছে।ইফাজ এসে নিহার পাশে বসলো।নিহার দিকে চেয়ে বলল,’খেয়েছো তুমি?’

‘না,তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আর খাওয়া হয় নি।’

‘তোমাকে তো বলেছিলাম আমার দেরি হবে।তবুও কেনো খেলে না?শরীর খারাপ করার বুদ্ধি সব তাই না?এখন আমার সাথে খাবে।’ইফাজ একটু শাসনের ভঙ্গিতে বলল।

‘তুমি খাইয়ে দিলে খাবো।নাহলে খাবো না।’নিহা বাচ্চাদের মতো আবদার করে বসলো।ইফাজের আর কি করার মাঝরাত পর্যন্ত কেউ যদি ওর জন্য এভাবে অপেক্ষা করে তাহলে তার এই ছোটো আবদারটা না রাখা বড্ড অপরাধের শামিল!
ইফাজ ভাত মাখিয়ে নিহার মুখের সামনে এক লোকমা তুলে ধরলো।নিহা খুশীতে বাকবাকম করতে করতে খেয়ে নিলো।তারপর ইফাজ নিজেও খেলো নিহাকেও খাইয়ে দিলো।

সবকিছু গুছিয়ে এসে দেখলো ইফাজ ঘুমিয়ে গেছে।নিহাও ইফাজের পাশে শুয়ে কিছুক্ষণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো।

প্রায় আধঘন্টা পর ইফাজ শোয়া থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেলো।ইফাজ এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলো।ওদের কাছ থেকে কালেক্ট করা ফোন নাম্বারটা নিখিলকে মেসেজ করে পাঠিয়ে দিয়ে ওর ডিটেইলস বের করতে বলল।
———————
রাতে বারান্দায় চেয়ার বসে ইয়াদের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে মধু ঘুমিয়ে গিয়েছিল খেয়াল নেই।সকাল বেলা আইরিন রহমানের ধাক্কায় ঘুম ভাঙে।আড়মোড়া ভেঙে,হাই তুলে পিটপিট করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’কি হয়েছে?এমন ভয় পেয়ে আছো কেনো?’

আইরিন রহমান উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,’জানিস নিশিদের ঘরে পুলিশ এসেছে?’

মধু চমকে উঠে বলল,’কেনো?’

‘নিশি সুইসাইড করেছে।ওর লাশ নিতে আসছে পুলিশ।নিশির মা’কে সামলানো যাচ্ছে না।আহারে একটা মাত্র মেয়ে ছিলো।’আইরিন রহমান আফসোসের সুরে বললেন।

মধু চিন্তিত মুখে বলল,’পুলিশ কি লাশ নিয়ে গেছে?

‘হুম একটু আগে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ নিয়ে গেছে পুলিশ।’

‘তুমি গিয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ,সবার চিল্লাচিল্লি শুনে গিয়েছিলাম।’

‘আম্মু আমি গিয়ে একটু দেখে আসি।’

‘না একদম না।মরা বাড়িতে যাওয়া যাবে না।’আইরিন রহমান কড়া করে মধুকে বলে গেলেন।
তবুও মধুর মনটা কেনো জানি উশখুশ করছে।হঠাৎ করে নিশি সুইসাইড করতে যাবে কেনো?সব তো ভালোই চলছিলো।কালকেই তো ওর গায়ে হলুদ ছিলো।ও কতো খুশী ছিলো বিয়ে নিয়ে।তাহলে হঠাৎ করে এমনটা করার কারণ কি!মধুর মাথায় কিছুই ঢুকছে না।ব্যাপারটা ইয়াদকে জানানো দরকার মধু তৎক্ষনাৎ ইয়াদকে ফোন দিলো।ইয়াদ রিসিভ করে ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলল,’হ্যালো।’

‘ইয়াদ, নিশি সুইসাইড করেছে।’কোনোরকম কথা না বাড়িয়েই মধু বলে ফেললো।মধুর কথা শুনে ইয়াদ বড়সড় একটা শক খেলো।চোখ থেকে ঘুম একবারে উধাও!তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,’কিহ!কি বলছো এগুলো।’

‘আ’ম সিরিয়াস।বিশ্বাস না হলে আপনি নিজেই আসুন।’

‘আচ্ছা আসছি।’
মধু ফোনটা রেখে আবার ভাবতে বসলো।

চলবে…

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৩২
#Arshi_Ayat

“দিন যায়,ক্ষণ যায়
কেউ কারো নয়।”
নিশির মৃত্যুর তিনদিন হয়ে গেছে।কাল’ই ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এসেছে।রিপোর্ট লিখা ছিলো মৃত্যুর কারণ “ডিপ্রেশন”।ভেতরে ভেতরে ভয়ানক ডিপ্রেশনে ভুগছিলো নিশি।আর তার বশবর্তী হয়েই আত্নহত্যা করে।নিশির মৃত্যু কোনো খুন নয় আত্নহত্যা এটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে তাই ওর কেসটা বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ।

ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পরই নিশির লাশ ডিসচার্জ করা হয়েছে।আজকে সকালে লাশ নিয়ে ওর বাবা মা দিনাজপুর চলে গেছেন।গ্রামের বাড়িতে দাফান করবে নিশিকে।
————-
মাথাটা প্রচন্ড ভারী হয়ে আছে মধুর।কালকে থেকে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নিশির মৃত্যুর কারণ!কি এমন ডিপ্রেশন ছিলো যে এভাবে সুইসাইড করতে হলো!
এগুলো ভাবতে ভাবতেই হিজাব বাঁধলো মধু।প্রথমবারের মতো সাইকা আর ওর বর আসছে মধু’দের বাড়িতে।তাই ওদের রিসিভ করতে যেতে হবে।আইরিন রহমান নিজেই যেতো কিন্তু ডাক্তার ওনাকে বেশি হাটতে,ভারী কাজ করতে মানা করেছেন।তাই আইরিন রহমান যায় নি।ওনার বদলে মধু যাবে।

বাসার নিচে নেমে মধু ইয়াদকে ফোন দিলো।ইয়াদ রিসিভ করে বলল,’দুই মিনিট দাড়াও আমি আসছি।’

‘আচ্ছা আসো।’
মধু ফোন রেখে ইয়াদের জন্য অপেক্ষা করছে।একা যাওয়ার চেয়ে ওকে নিয়ে যাওয়াই ভালো মনে হলো তাই মধু ইয়াদকে আসতে বলেছিলো।

বেশিক্ষণ দাড়াতে হয় নি ইয়াদ চলে এসেছে।তারপর দুজনে কিছুটা পথ হেটে রিকশা নিলো বাস কাউন্টারে যাওয়ার জন্য।ওদের মাঝে টুকটাক কথা হচ্ছিলো।হঠাৎ মধু জিগ্যেস করলো,’আপনি কি আপসেট নিশির মৃত্যুর জন্য।’

‘না,তবে এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না কেনো যেনো।এতো দ্রুত ঘটলো যে বোঝাই গেলো না।’

‘হুম,কিন্তু ও আত্নহত্যা কেনো করলো এটা রহস্য রয়ে গেলো।আমার জানা মতে তেমন কোনো ডিপ্রেশনে ও ছিলো না।’

‘হয়তো ছিলো কিন্তু তুমি জানো না।’

‘হুম,হয়তো।’
এভাবেই কথা বলতে বলতে দুজনেই বাস কাউন্টারে পৌছালো।রিকশা থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো দূরে যাত্রী ছাউনিতে সাইকা আর হিমেল দাঁড়িয়ে আছে।মধু সাইকাকে দেখে দ্রুত পায়ে সেদিকে গিয়ে সাইকাকে জড়িয়ে ধরলো।ইয়াদ পেছনে ছিলো।যাতে ওকে কেউ না দেখে।ইয়াদ ওদের সাথেই আসবে তবে আলাদা।
—————
রাত আট’টা বাজে…
ইয়াদ প্রায় একঘন্টা ধরে মধুদের বাসার সামনে দাড়িয়ে আছে।মধুকে বারবার কল করছে,নামতে বলছে কিন্তু ও নামছে না।কারণ বাসায় মেহমান এসেছে।ইয়াদও ঘাড়ত্যাড়া দরকার পড়লে আজকে সারারাত এখানেই থাকবে তবুও মধুকে নিচে নামতে হবে।সাইকা আর হিমেলকে নিয়ে আসার সময় মধুর সাথে একটুও কথা বলতে পারে নি ইয়াদ।তাই মেসেজ করেছিলো যেনো ওর সাথে একটু দেখা করে।কিন্তু মধু মেসেজটা দেখে নি।বাসায় গিয়ে মেসেজটা চোখে পড়তেই আফসোস করতে লাগলো।কিন্তু বের হওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলো না।

মধু মায়ের রুমের জানালা দিয়ে একবার রাস্তায় তাকালো।এই জানালাটা দিয়ে রাস্তাটা মোটামোটি দেখা যায়।ইয়াদ গেছে কি না সেটা দেখতেই মধু রাস্তার দিকে তাকালো।নাহ!যায়নি সে।এখনো দাঁড়িয়ে আছে।কি বলে বের হবে সেটাই বুঝতে পারছে না মধু।হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি আসতেই ও বসার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।ওখানে সাইকা,হিমেল আর আইরিন রহমান মিলে গল্প করছে।মধু মায়ের সামনে গিয়ে বলল,’আম্মু আরিয়া এসেছে নিচে।একটু দেখা করে আসি।’

আইরিন রহমান বললেন,’আচ্ছা যা।’
তারপর তিনি আবার আলোচনায় মনোযোগ দিলেন।মধু অনুমতি পেয়ে নিচে নামলো।ও নিচে নামতেই ইয়াদ অভিমানী স্বরে বলল,’ওহ!এসেছো তাহলে।আমি তো ভাবলাম ভুলেই গেছো।’

‘বাসায় মেহমান আসছে।সেইজন্যই তো আসতে পারি নি।’

‘হ্যাঁ বুঝি,আমি বুঝি।’

মধু আচমকা ইয়াদকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কন্ঠে বলল,’ইশ!কতো রাগ করে আমার জানপাখি টা।’

ইয়াদ হাসলো।বলল,’হয়েছে,হয়েছে।শোনো দুইদিনের জন্য আমি ট্যুরে যাচ্ছি।ভার্সিটি থেকে নিবে।সেইজন্য যেতে হবে।এইজন্যই তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম।’

মধু ইয়াদের কথায় কিছু বলল না।ওর বুকের ওপর লেপ্টে রইলো।ইয়াদ মধুর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল,’মধু,এভাবেই থাকবে?কিছু বলবে না?’

‘না,কিছু বলবো না।চুপচাপ সারাজীবন আপনার ঠিক এখানটায় থাকতে চাই।’

ইয়াদ হাসলো।মধুর কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলল,’নিজের খেয়াল রাখবে।খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করবে।আমি দুইদিন পর আবার আসবো।’

‘আপনাকে মিস করবো।’

‘আমিও।’
তারপর মধু ইয়াদকে বিদায় দিয়ে ঘরে চলে এলো।
———-
রাত দশটা!আজকে হাসপাতালে ওভার ডিউটি দিতে হয়েছি তাই দশটা বেজে গেছে।এখন বেরিয়ে পড়বে ইফাজ।আর আজকে নিখিলের আসার কথা ছিলো।হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই ইফাজ নিখিলকে দেখতে পেলো।গাড়িতে বসে আছে।নিখিল ইশারা দিলো গাড়িতে ওঠার জন্য। ইফাজ উঠে পড়লো গাড়িতে।গাড়ি কিছুদূর যাওয়ার পর নিখিল বলল,’দোস্ত তুই যে নাম্বারটা দিয়েছিস সেটা বন্ধ।আর সবচেয়ে রহস্যজনক বিষয় হলো মেয়েটা তিনদিন আগে সুইসাইড করেছে।’

ইফাজ বিষ্ময়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,’কি বলছিস তুই?’

‘হ্যাঁ সত্যি।আমি খোঁজ নিয়েই তোকে বলছি।’

ইফাজ মাথা চুলকে বলল,’ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে লাগছে।ওই মেয়ে কেনো সুইসাইড করতে যাবে?’

‘হতে পারে এটা সুইসাইড না এটা খুন!’

‘ধাঁধায় পড়ে গেলাম।যাকে ধরলে সব রহস্য খুলতো সেই টপকে গেলো।’ইফাজ চিন্তিত স্বরে বলল।

‘সাবধানে থাকিস।কারণ যদি এটা খুন হয় তাহলে তোর ওপরেই অ্যাটাক আসতে পারে।’

‘হুম।’
নিখিল ইফাজকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো।

এই ঘটনার পর অবশ্য আর কোনো সমস্যা হয় নি কিন্তু ইফাজ সবসময়ই সতর্ক ছিলো।
—————-
দেখতে দেখতে পাঁচ মাস কেটে গেলো।মধু আর ইয়াদের সম্পর্ক খুব ভালোই চলছে অপরদিকে ইফাজও নিহার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।কিন্তু মানিয়ে নেওয়া কে তো আর ভালোবাসা বলে না।ইফাজের মন জুড়ে এখনো তারই বিচরণ।এখনো লোক চক্ষুর অন্তরালে দুচোখ যেনো তারেই খোঁজে।এ যেনো নিঃশব্দে মরণ।

এইতো এইচ এস সি পরীক্ষা আর এডমিশন টেষ্ট শেষ করে কিছুদিন হলো মধু ভার্সিটিতে উঠেছে।আর ইয়াদ স্কলারশিপ পেয়েছে।ভিসা পত্র সব রেডি।কালই ফ্লাইট তাই আজকে মধুর সাথে সারাদিন ঘুরবে।প্রথমে মধু বাচ্চাদের মতো জেদ ধরেছিলো ইয়াদ যেনো না যায়।পরে ইয়াদ ভালোমতো বোঝানোর ফলে স্বাভাবিক হয়েছে।

মধু সকালে রেডি হয়ে ইয়াদ’দের বাড়ির দিকে রওনা হলো।পথে ইয়াদের সাথে দেখা হওয়ায় আর ওদের বাড়িতে গেলো না।

প্রথমে শপিং করবে।আজকে সব পছন্দ করবে মধু।শপিং করা শেষ হলে মধু আর ইয়াদ বের হলো শপিং মল থেকে।এরপর সারাদিন এদিক সেদিকে প্রচুর ঘুরাঘুরি করে শেষ বেলায় যখন বাড়ি ফিরবে তখন মধু ইয়াদের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,’চলুন না বিয়ে করে ফেলি।’

ইয়াদ মধুর কথা সিরিয়াসলি নিলো না।ঠাট্টা করে বলল,’চলো আজকে বিয়ে করে কালকেই হানিমুনে চলে যাই।’

‘আমি মজা করছি না।আ’ম সিরিয়াস।প্লিজ বিয়েটা করে ফেলি।’

ইয়াদ এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,’না মধু আমি আমাদের বিয়ে এতো সাদামাটা ভাবে করবো না।তিন বছর পর ফিরে এসে তোমাকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করে নেবো।’

‘তিনবছর পর আবার বিয়ে করবো আমরা কিন্তু আজকে আমরা বিয়েটা করে ফেলি।’

‘মধু বাচ্চামি করছো কেনো?তোমার পড়াশোনা এখনো শেষ হয় নি।নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করো।এই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ।বিয়ে আমরা পরেও করতে পারবো।’

মধু অক্ষিদ্বয়ে নোনা জ্বলে পরিপূর্ণ হয়েছে।অশ্রুসজল কন্ঠে বলল,’আপনাকে না পেলে আমি ক্যারিয়ার দিয়ে কি করবো।আপনি আমাকে ভালোবাসেন না ইয়াদ।’

এটা বলেই ইয়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মধু রিকশা ডেকে উঠে পড়লো।ইয়াদ বারবার ডাকলো কিন্তু মধু শুনলো না।

বাসায় এসে ফোনের স্ক্রিনে দেখলো ৩০+ মিসডকল।মধু রাগে ফোন বন্ধ করে দিলো।মায়ের ফোন থেকে ইয়াদের নাম্বার ব্লক করে দিলো।

আর এদিকে ইয়াদ ফোনের ওপর ফোন,মেসেজ পাঠিয়ে ফোন জ্যাম করে ফেলেছে।তবুও কোনো রেসপন্স নেই।

দুইপাশের কারোই ঘুম নেই।মধুর রাতটা গেছে কাঁদতে কাঁদতে।আর ইয়াদের চিন্তায়।সকাল দশটায় ইয়াদের ফ্লাইট কিন্তু মধু যাবে না।

দাত মুখ খিঁচে বসে রইলো।চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তবুও যাবে না।ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না!

চলবে….

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে