Saturday, June 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1442



love is like a Cocktail Part-04

0

#love_is_like_a_Cocktail
Writer: Abir Khan
Part: 04
অন্যসব দিনের মতো আজকের দিনটা হলেও হতে পারতো। কিন্তু আজ একটু ব্যতিক্রম হলো। জান্নাত কলেজের সামনে যেতেই ও পুরো অবাক। কারণ হৃদয় দাঁড়িয়ে আছে ওর দিকে তাকিয়ে। ও রিকশা থেকে নামতেই হৃদয় ওর কাছে চলে আসে আর রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিতে নেয়৷ জান্নাত ওকে দ্রুত থামিয়ে দিয়ে বলে,

~ আরে আরে কি করছো! তুমি ভাড়া দিচ্ছো কেন? আমি দিব ত।
– না আমি দিব৷ মামা ভাড়া কত?
~ প্লিজ হৃদয় এমন করো না৷ আমার ভাড়া আমিই দিব। প্লিজ।
– জান্নাত তুমি কি তাহলে আমাকে ফ্রেন্ড ভাবো নি? তাই এমন করছো?

জান্নাত দেখে হৃদয় মুখখানা কালো করে ফেলেছে৷ ওর খুব খারাপ লাগে৷ ও দ্রুত স্বরে বলে উঠে,

~ একদম না৷ ফ্রেন্ড তো মেনেছি তোমাকে। তাই বলে আমার ভাড়া তুমি দিবে তা তো ঠিক না। তাই না?
– আমি কোন কিছু জানি না৷ আজ তো আমি ভাড়া দিবোই দিব৷ এই মামা ভাড়া কত বলেন?
– ৬০ টাকা।
– এই নেন।

হৃদয় একপ্রকার জোর করেই ভাড়াটা দিয়ে দেয়৷ জান্নাত অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। হৃদয় ভাড়া দিয়ে বিজয় হাসি দিয়ে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে,

– এবার চলো ক্লাসে যাওয়া যাক৷
~ তুমি এটা ঠিক করলে হৃদয়? আমার এখন খারাপ লাগছে।
– আহ! আমি খুশি হয়ে দিয়েছি। আর তুমি এখনো ভাড়া নিয়ে ভাবছো? আমি যে সেই সকাল থেকে তোমার জন্য ভার্সিটির সামনে অপেক্ষা করলাম তার কি হবে বলো?

জান্নাত হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, আসলেই তো, হৃদয় ওর জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল! জান্নাত আস্তে করে বলে,

~ আমার মতো একটা মেয়ের জন্য কেন অপেক্ষা করলে? কত সুন্দরী ভালো মেয়ে আছে আরও।
– থাকুক। আমার ত তোমাকেই ভালো লেগেছে। আর আমার কাছে তুমি সবচেয়ে সুন্দরী আর ভালো বুঝছে?

জান্নাত হৃদয় এর কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যায়। সাথে একটু লজ্জাও পায়৷ হৃদয় সেটা বুঝতে পেরে ওর দিকে একটু তাকিয়ে ওকে দেখে আস্তে করে ওর একটু কাছে এসে বলে,

– লজ্জা পেলে তোমাকে দারুণ লাগে৷ মনে চায়…হাহা৷

হৃদয় এর কথা শুনে জান্নাত তো এখন লজ্জায় পুরো লাল টুকটুকে হয়ে গিয়েছে। হৃদয় যে ওর এত ক্লোজ হয়ে যাবে তাও আবার এত তাড়াতাড়ি জান্নাত তা কখনো ভাবে নি৷ ও ভেবেছিল হৃদয় হয়তো আজ ওকে তেমন পাত্তা দিবে না৷ কিন্তু এরকম কিছুই হলো না৷ ওর মতো এরকম একটা ফেমাস হ্যান্ডসাম ছেলের কাছ থেকে এত রেস্পন্স পাবে ও ভাবতেই পারে নি। জান্নাতের কাছে সবটা যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। এদিকে ওদের দুজনকে একসাথে দেখে ক্লাসের সব মেয়েরা হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। জান্নাত সেটা বেশ বুঝতে পারছে। হৃদয় জান্নাতকে নিয়ে ক্লাসে এসে ওর বাকি বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়৷

– ফ্রেন্ডস আজ থেকে ও তোদেরও ফ্রেন্ড। আমার ফ্রেন্ড মানে তোদেরও ফ্রেন্ড। সো ওর সাথে সবাই পরিচিত হ।
– পরিচয় আর কি হবো৷ আমরা তো একই ক্লাসের সবাই। তারপরও তুই যখন বলছিস তাহলে তো হতেই হয়৷ হাই, আমি রনি।
~ হাই। (হাসি দিয়ে)
– আমি শুভ।
– আর আমি জিহাদ। আমরা কি তোমার ফ্রেন্ড হতে পারি?
~ হ্যাঁ পারো।
– গুড গার্ল। তাহলে তুমি থাকো আমরা একটু ক্যান্টিন থেকে আসি৷ কোন প্রবলেম হলে কল দিও।
~ আচ্ছা। কিন্তু..
– কিন্তু কি?
~ তোমার নাম্বারটাই তো আমার কাছে নেই৷
– দেখছোছ অবস্থা। তাড়াতাড়ি নাম্বারটা দে।
– আমি বলছি তুমি লেখো। (রনি)
~ ওকে৷

জান্নাত হৃদয় এর নাম্বারটা ফোনে তুলে একটা কল দিয়ে দেয়৷ হৃদয়ও ওর নাম্বারটা পেয়ে যায়৷ এরপর হৃদয় ওর ফ্রেন্ডসদের নিয়ে চলে যায়৷ জান্নাত খুব খুশি হয়ে নিতুর কাছে যায়। নিতু এতক্ষণ ওদেরকেই দেখছিল। জান্নাতকে দেখে রসিকতা করে বলে,

~ হুম বুঝলাম, আমার বেস্ট ফ্রেন্ডটা এত হ্যান্ডসাম বয়ফ্রেন্ড পেয়ে তার বেস্ট ফ্রেন্ডকেই শেষমেশ ভুলে গেল। ভালো ভালো।

জান্নাত নিতুর পাশে বসে বলে,

~ কি আবোল তাবোল বকছিস চুপ কর। আমি তোকে কখনোই ভুলতে পারি না৷
~ জানি জানি। একটু মজা করলাম৷ হিহি। জানিস আমার কি মনে হয়, হৃদয় তোকে অনেক পছন্দ করে।
~ যাহ! কি বলছিস! অসম্ভব এটা৷
~ একদম না৷ তুই এখনো বুঝিস নাই হৃদয় তোকে পছন্দ করে? আরে পছন্দ করে বলেই তো তোর সাথে এত ভাব করলো আর আজ তোকে ওর বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তুই আসলে কিছুই বুঝিস না৷

জান্নাত ভেবে দেখে, আসলেই কি হৃদয় ওকে এত পছন্দ করে? ওর মতো এত সামান্য একটা মেয়েকে কেনই বা হৃদয় এত অ্যাটেনশন দিচ্ছে? কেন? তাহলে কি নিতুর কথাই সত্য? জান্নাত এসব ভেবে খুব লজ্জা পাচ্ছে। এ যেন অজানা একটা অনুভূতি। ওর মুখখানা লাল হয়ে গিয়েছে লজ্জায়। নিতু পাশ দিয়ে হাসতে হাসতে বলে,

~ একটু আগে তো কত কিছু বললি এখন লজ্জা পাস কেন হুম?
~ যাহ! বাদ দে তো৷ ওই যে স্যার আসছে। (ভীষণ লজ্জা পেয়ে)

এরপর ওদের ক্লাস শুরু হয়। হৃদয় ক্লাসের মাঝে অনেক বার জান্নাতের দিকে তাকাচ্ছিল। জান্নাত তো লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল। দুইটা ক্লাস হলে টিফিন পিরিয়ড আসে। টিফিন পিরিয়ডে জান্নাত আর নিতু একসাথে বসে গল্প করছিল, আসলে জান্নাতের কাছে এত টাকা নেই যে ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খাবে। তাই নিতুর সাথে বসে বসে গল্প করছিল। হঠাৎই পিছন থেকে হৃদয় এসে ডাক দেয়।

– জান্নাত…

জান্নাত পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে হৃদয় হাসি দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ও উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

~ হ্যাঁ বলো।
– চলো ক্যানটিনে যাবে৷
~ না মানে হঠাৎ ক্যানটিনে?
– বোকা মেয়ে একটা। টিফিন পিরিয়ড যেহেতু টিফিন খাবে না? চলো চলো।

জান্নাত আস্তে করে মাথা নিচু করে বলে,

~ হৃদয় আমার কাছে তেমন টাকা নেই। সরি।

হৃদয় খুব অবাক হয়ে বলে,

– আচ্ছা নিতু ও কি আসলেই এমন? একটা মেয়ে এমন হয় কিভাবে? এই বোকা মেয়ে, আমি খাওয়াবো। আর তুমি ভাবলে কীভাবে আমি তোমার কাছ থেকে টাকা নিব? চলো তো।
~ ছিঃ ছিঃ হৃদয় কি বলছো! এটা অসম্ভব। খুব খারাপ দেখায়৷ এমনিতেই সকালে ভাড়া দিয়েছো এখন আবার টিফিন। না না প্লিজ।
– জান্নাত আমি আমার অন্য ফ্রেন্ডদেরও খাওয়াই। কারণ আমার ভালো লাগে৷ উফফ চলো তো। নিতু তুমি আসবে?
~ না না তোমরা যাও। আমি তো খেয়ে ফেলেছি।
– ওকে।

হৃদয় একপ্রকার জান্নাতের হাত ধরে ওকে নিয়ে ক্যানটিনের দিকে যেতে থাকে। জান্নাত লজ্জায় চুপচাপ হৃদয় এর সাথে ক্যানটিনে চলে যায়। হৃদয়ের এমন আচরণে জান্নাত কিন্তু রাগ হচ্ছে না বরং ভালোই লাগছে ওর। ওকে যে কখনো কেউ এত কেয়ার করবে ও কল্পনাও করে নি৷ জান্নাতের খুব খুশি লাগছে৷ তবে কি হৃদয় ওকে সত্যিই এত পছন্দ করে? নাকি ভালবাসে? জান্নাতের কেমন জানি অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। ও ঠিক বুঝতে পারছে না৷ হৃদয় অনেক কিছু নিয়ে আসে জান্নাতের জন্য৷ জোর করে ওকে খাওয়ায়৷ জান্নাত বাধ্য হয়ে খায়৷ টিফিন খাওয়া শেষ হলে ওরা ক্লাসের দিকেই আসছে। ওরা দুজন একদম পাশাপাশি হাঁটছে। অনেক সুন্দরী মেয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। হৃদয় হঠাৎ বলে উঠে,

– উফ! কি যে করি…
~ কি হয়েছে? কোন সমস্যা?
– হুম।
~ কি সমস্যা আমাকে বলা যাবে?
– হুম যাবে৷ আসলে কাওসার স্যারের এসাইনমেন্টটা এখনো করা হয়নি। অথচ কাল জমা দিতে হবে৷ কি যে করি…
~.এই কথা। এক কাজ করো, তুমি আমার এসাইনমেন্টটা নিয়ে তোমারটা করে ফেলো।
– সত্যি বলছো জান্নাত? (খুব খুশি হয়ে)
~ হ্যাঁ সত্যিই।
– থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ সো মাচ। উফফ! কি যে চিন্তায় ছিলাম। অনেক থ্যাংকস তোমাকে।

জান্নাত হাসে। ওর এখন খুব ভালো লাগছে। কারণ শেষমেশ ও অন্তত হৃদয়ের কোন কাজে এসেছে। ওরা ক্লাসে আসলে বাকি দুইটা ক্লাস শুরু হয় একে একে। ক্লাস শেষ হলে জান্নাত ওর এসাইনমেন্ট কপিটা হৃদয়কে দেয়৷ হৃদয় খুব খুশি হয়ে সেটা নিয়ে ওকে বিদায় দিয়ে চলে যায়৷ জান্নাতও খুব খুশি হয়ে হৃদয়কে বিদায় দেয়৷ হৃদয় ক্লাসের বাইরে এসে শুভর কাছে জান্নাতের এসাইনমেন্টটা দিয়ে বলে,

– বয়েস, এসাইনমেন্ট। হাহা৷
– মাম্মাহ! অস্থির। (ররি)
– আমারটা যেন সুন্দর মতো হয়ে যায়৷ (হৃদয়)
– হয়ে যাবে মামা, নো টেনশন। (জিহাদ)
– মামা সেই একটা খেলায় নামছোছ। (শুভ)
– হাহা। আস্তে আস্তে দেখ কি করি। চিন্তা নাই তোরাও ভাগ পাবি। চল।

হৃদয় আর ওর ফ্রেন্ডরা হাসাহাসি করতে করতে চলে যায়৷ আর জান্নাত হৃদয়কে নিয়ে এটা ওটা ভাবতে বাসার দিকে চলে আসে।

অন্যদিকে আবিরের বাসায়,

আবির সেই সকালে ঘুম দিয়ে উঠেছে সন্ধ্যায়৷ তাও আবার মাইশার ডাকে।

~ বেবি…এই বেবিইই উঠো। দেখো কে এসেছে।

আবির আস্তে করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে মাইশা। ওর ঠোঁটের কোণায় সাথে সাথে হাসির রেখা ফুটে উঠে। আবির মাইশাকে দেখে খুব খুশি হয়। ও উঠে বসতে বসতে বলে,

– তুমি এসেছো? অনেক মিস করছিলাম তোমাকে।
~ জানি বেবি। আমিও খুব মিস করছিলাম। তাই তো চলে এসেছি তোমার কাছে।
– থ্যাঙ্কিউ।
~ হাতের অবস্থা কেমন এখন?
– এখন ভালো। সকালে অনেক ব্যথা করছিল।
~ ওহ! তুমি নাকি সেই সকাল থেকে ঘুম?
– হুম।
~ বলো কি কিছু খাও নি?
– না৷
~ তুমি বসো আমি খাওয়ার কিছু নিয়ে আসি।
– আহহা! মাইশা থাক। কষ্ট করতে হবে না৷
~ চুপ করো।

আবিরের খুব ভালো লাগে মাইশার কেয়ার৷ মাইশা ওর জন্য স্যুপ আর জুস নিয়ে আসে। এনে আবিরকে খেতে দেয়৷ আবির এখন হাত নড়াচড়া করতে পারে। স্যুপটা খেতে গিয়ে আবিরের হঠাৎ জান্নাতের কথা মনে পড়ে। জান্নাত ওকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছিল কিন্তু মাইশা ওমন মেয়ে না৷ তাও ওকে যে খাবার এনে দিয়েছে তাই অনেক। আবির খাবার খেয়ে মাইশাকে কাছে টেনে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,

– এবার বলো কি বলবে। কিছু যে একটা তুমি বলবে তা আমি বুঝেছি।

মাইশা অবাক হয়ে আবিরের দিকে তাকায়। আর বলে,

~ এই আবির সত্যি করে বলো তো তুমি কিভাবে সব বুঝে যাও?

আবির মাইশাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

– কারণ আমি তোমাকে সত্যিকারের ভালবাসি।
~ আমিও বেবি।
– জানি। এবার কি বলবে সেটা বলো।

মাইশা মাথা তুলে অসহায় মুখ করে বলে,

~ আসলে বেবি আমাকে প্রায় একমাসের জন্য ঢাকার বাইরে মানে সিলেটে যেতে হবে ফটোশুটের জন্য৷
– একমাস?
~ না না পুরো একমাস লাগবে না৷ তার আগেই চলে আসবো৷

আবিরের খুব খারাপ লাগে। কিন্তু ও মাইশাকে বুঝতে দেয় না৷ ও হাসি দিয়ে বলে,

– ঠিক আছে যাও। কোন সমস্যা নেই।
~ সত্যিই? তুমি কিছু মনে করো নি তো?
– না না৷ আচ্ছা এতদূর যাচ্ছো টাকা শপিং কিছু লাগবে?
~ উমম, লাগতো তো।
– আচ্ছা নিলয়কে বলে দিচ্ছি। যা লাগে নিয়ে নিও।
~ বেবিইইই তুমি এত্তো ভালো কেন? উম্মাহ।

আবিরের ঠোঁটে কিস করে দেয় মাইশা। আবির ওকে ছাড়িয়ে বলে,

– এইই বলেছি না বিয়ের আগে নো দুষ্টামি।
~ আচ্ছা বাবা৷ তুমি এমন কেন? সব ছেলেরা আমাকে পাওয়ার জন্য পাগল। আর তুমি আমাকে এত কাছে পেয়েও আপন করে নেও না৷
– কারণ আমি তোমাকে বিয়ে করবো। তারপর সারাজীবনের জন্য আপন করে নিব৷ বিয়ের আগে নো টাচিং মাচিং৷ হাহা৷

আবির হেসে দেয়৷ মাইশা আবিরের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসে। তারপর বলে,

~ আচ্ছা তাহলে এবার আমি যাই। প্যাকিং করতে হবে।
– ওকে। আমি নিলয়কে বলে দিচ্ছি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে নে৷
~ না না লাগবে না৷ আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।
– ওহ! তাহলে সাবধানে যেও।
~ ওকে বেবিইই৷

মাইশা আবিরকে বিদায় দিয়ে চলে যায়। ও আবার একা হয়ে যায়। আজকাল মাইশাকে একদম কাছে পায় না আবির। ঠিক মতো দুটো কথাও হয় না। আবির ভেবেছিল এই একমাস মাইশাকে নিয়ে কাটাবে৷ কিন্তু হলো তার বিপরীত। ও ঠিক করে ও সুস্থ হলে মাইশাকে সারপ্রাইজ দিয়ে সোজা বিয়ের জন্য প্রপোজ করবে৷ এই আশা নিয়েই ও একা ওর বিশাল বড়ো রুমটায় বসে থাকে। হঠাৎ নিলয় এসে বলে,

– স্যার একটা খবর আছে।

সেদিনের পর দীর্ঘ একমাস চলে যায়। আবিরের কাছে এই একমাস অনেক লম্বা একটা সময় মনে হয়েছে। সারাদিন বাসার ভিতরেই ও ছিল। আজ ও একদম সুস্থ। হাতের ক্ষতটা না থাকলেও দাগটা এখনো যায় নি। আবির এখন রেডি হচ্ছে মাইশাকে সারপ্রাইজ দিতে যাবে৷ আজ ও অনেক সুন্দর করে নিজেকে রেডি করেছে। ডার্ক কালারের ব্ল্যাক স্যুট আর প্যান্ট পরেছে। হাতে রোলেক্সের ঘড়ি। চুলগুলো জ্যাল দিতে সেট করা। একদম ড্যাসিং রিচ বয় লাগছে ওকে৷ আবির একটা অনেক দামী ডায়মন্ডের রিং আর একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে ওর পার্সোনাল বিএমডব্লিউ এস ক্লাস গাড়িটা নিয়ে সোজা রওনা হয় মাইশার বাসায়৷। মাইশা একটা এপার্টমেন্টে একা থাকে। আবির আজ পর্যন্ত কোন দিন রাতে ওর এপার্টমেন্টে থাকে নি। তবে দিনে অনেক সময় থেকেছে। কিন্তু কোন খারাপ কাজ করে নি। ও মাইশাকে এই এপার্টমেন্টটা কিনে দেওয়ায় ওর কাছে আরেকটা চাবি ছিল সেটা নিয়েই ও যাচ্ছে মাইশাকে সারপ্রাইজ দিতে। মাইশা জানে আবির গতরাতে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছে। আসলে ওকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আবির এটা বলে। এক ঘণ্টা ড্রাইভ করে আবির মাইশার এপার্টমেন্টের সামনে চলে আসে। এখন কিন্তু সকাল বেলা। মানে মাইশা ঘুমাচ্ছে৷ তাই আবির ওকে সকাল সকাল সারপ্রাইজ দিতে চলে এসেছে। ও চাবিটা নিয়ে আস্তে করে দরজার লক খুলে বাসার ভিতরে ঢুকে পড়ে। ভিতরে ঢুকতেই ওয়াইনের ঘ্রাণ এসে আবিরের নাকে লাগে৷ সাথে আবির সামনে তাকিয়ে দেখে ফ্লোরে ওয়াইনের বোতল পড়ে আছে কয়েকটা৷ আবিরের ভ্রুকুচকে যায়৷ মাইশা একা একা ওয়াইন খাবে কেন? আবির হাতে লাল গোলাপের গুচ্ছ আর পকেটে ডায়মন্ডের রিংটা নিয়ে মাইশার বেড রুমের দিকে যায়। আস্তে আস্তে গিয়ে যেই দরজা খুলতে যাবে ওমনি ওর কানে কেমন অদ্ভুত সব শব্দ ভেসে আসে৷ আবির জানে এসব শব্দ কেন হচ্ছে। কারণ দরজার ওপারে আদিম খেলায় ব্যস্ত কোন যুগল। ও আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ঠাস করে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে যায় আর দেখে….

চলবে…?

love is like a Cocktail Part-03

0

#love_is_like_a_Cocktail
Writer: Abir Khan
Part: 03
হৃদয় কি এমন কথা বলার জন্য এত সংকোচ করছে? জান্নাত ঠিক বুঝতে পারছে না। হৃদয় একটু সময় নিয়ে বলে ফেলে,

– আমরা কি ফ্রেন্ড হতে পারি?

জান্নাত পুরো হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ক্লাসের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলেটা নিজ থেকে ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে এসেছে! জান্নাতের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না৷ ওর সাথে কদিন যাবৎ সব অকল্পনীয় ব্যাপার স্যাপার হচ্ছে। ও আসলে কি উত্তর দিবে ভেবেই পাচ্ছে না৷ হৃদয় অনেক আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। জান্নাত অনেকটা লজ্জাও পাচ্ছে। হৃদয় আবার বলে,

– কিছু বলছো না যে? তার মানে কি তুমি আমার ফ্রেন্ড হতে চাও না?

জান্নাত মাথা তুলে হৃদয় এর দিকে তাকিয়ে দ্রুত স্বরে বলে,

~ না না তা না। আসলে তোমার জন্য এত মেয়ে পাগল, ক্লাসের সব মেয়ের ক্রাশ তুমি। তাই আমার মতো এরকম একটা মেয়ের ফ্রেন্ড হলে তোমাকে হয়তো অনেক কথা শুনতে হতে পারে। তাই আমাকে ভাবতে হচ্ছে তোমার ফ্রেন্ড হবো কি না৷

হৃদয় হঠাৎ করে জান্নাতের হাতটা শক্ত করে ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

– দেখো কে কি ভাবলো বা কি বললো আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার। আমি জাস্ট যা চাই আমি সেটাই করি। আমি তোমাকে আমার ফ্রেন্ড বানাতে চাই মানে চাই ই চাই। সো তুমি আমাকে নিয়ে টেনশন করো না৷ আমাকে কেউ কিছু বলার কোন ক্ষমতা নেই৷

জান্নাত চোখ নামিয়ে লজ্জাসিক্ত নয়নে হৃদয়ের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। হৃদয় সেটা খেয়াল করে ওর হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,

– সরি একটু এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা এবার বলো হবে আমার ফ্রেন্ড?

জান্নাত একটু সময় নিয়ে ভেবে আস্তে করে বলে,

~ তোমার কোন সমস্যা না থাকলে হতে পারি। (মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে)
– সত্যি বলছো? তুমি হবে আমার ফ্রেন্ড?
~ হুম। (লজ্জা পেয়ে)

হৃদয় প্রচন্ড খুশি হয়। আর হাসি দিয়ে বলে,

– জানো অনেক দিন ধরে সাহস করে আজ তোমার কাছে আসলাম। অনেক আগে থেকেই তোমার সাথে আমার ফ্রেন্ড হওয়ার ইচ্ছা ছিল। কারণ পুরো ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে ভালো, ভদ্র এবং সবচেয়ে বেশি সুন্দরী আর আকর্ষণীয় মেয়ে তুমি। বাকিদের আমার একদম পছন্দ হয় না৷ তাই একটু তাড়াহুড়ো করেই তোমাকে ফ্রেন্ড বানালাম। কজ আমি আর চাই না তুমি এরকম একা একা থাকো। তুমি অনেক ভালো কিছু ডিজার্ভ করো।

জান্নাত মুগ্ধ হয়ে হৃদয়ের কথা শুনছি। ও কল্পনাও করতে পারে নি হৃদয় এত ভালো একটা ছেলে। ওর কষ্টটা বুঝার চেষ্টা করেছে। জান্নাত আস্তে করে লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে বলে,

~ তুমি সত্যিই অনেক ভালো। আজ পর্যন্ত আমাকে এভাবে কেউ বলে নি৷
– জানি তো আমি৷ তাই তো তোমাকে আমার ফ্রেন্ড বানালাম। এখন থেকে কিন্তু আমার কাছে কাছেই থাকতে হবে৷ আর হ্যাঁ তুমি তো পড়াশোনায় অনেক ভালো। প্লিজ আমাকে একটু হেল্প কইরো। তাহলে তোমার সাথে অনেক সময় পাড় করতে পারবো।
~ আচ্ছা করবো। (জান্নাত খুব লজ্জা পাচ্ছে)

এভাবে জান্নাত আর হৃদয়ের মাঝে আরও কিছুক্ষণ কথা হয়। এদিকে ক্লাসে একজন এসে সবাইকে বলে দেয়, হৃদয় জান্নাতের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করেছে। ক্লাসের সব মেয়েদের মুখ মুহূর্তেই কালো হয়ে যায়। হৃদয় আজ পর্যন্ত কোন মেয়ের সাথে নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কথা বলে নি, সেখানে আজ ও নিজে জান্নাতের সাথে আগ বাড়িয়ে বন্ধুত্ব করলো! সব মেয়েদের চোখে জান্নাত এখন সবচেয়ে বড়ো শত্রু। সবাই রাগে সাপের মতো খালি ফুসছে। শুধু নিতু ছাড়া। ও তো অনেক খুশি। ওর বেস্ট ফ্রেন্ড মানে জান্নাত, এরকম ফেমাস হ্যান্ডসাম একটা ছেলে বন্ধু পেয়েছে বলে। জান্নাত হৃদয়ের সাথে কথা শেষ করে ক্লাসে চলে আসে। ও ক্লাসে ঢুকতেই অনেক মেয়ের সাথে চোখাচোখি হতেই ও বুঝে যায়, এরা এখন ওকে একা পেলে আস্ত গিলে খাবে। জান্নাত ভয়ে নিতুর পাশে গিয়ে বসে। নিতু মিটমিট করে হেসে বলে,

~ তোর ক্রাশ আবির আহমেদকে না পেলেও ক্লাসের সব মেয়েদের ক্রাশকে তুই শেষমেশ পেলি। হাহা৷ দেখ দেখ ডাইনি গুলা হিংসায় জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। হাহা।
~ এই চুপ কর কি যা তা বলছিস। আমরা শুধু ফ্রেন্ড আর কিছু না৷
~ হু, সে দেখা যাবে নে। হিহি।

জান্নাত লজ্জা পায় নিতুর কথা শুনে। আর নিতু হাসতে থাকে।

অন্যদিকে,

– বস ব্ল্যাক স্যাডো গ্যাং তো পুরা চুপচাপ হয়ে আছে৷ কোন অ্যাকশনে আসলো না৷
– চিন্তা করিস না৷ কিং রে আমি চিনি৷ ও কিছু না কিছু একটা করবেই৷ তোরা সাবধানে থাক। একটা কাজ তো ঠিক মতো করতে পারলি না। এখন পলায় থাক। কেউ জানি ধরা খায় না৷ তাইলে কিন্তু আমাদের আর জানে বাঁচা লাগবে না৷ মনে থাকে যেন৷
– ওকে স্যার৷ আর শুন, দ্বিতীয় অ্যাটাকের প্ল্যান রেডি কর। আর কিং এর লোকেদের দিকে খেয়াল রাখ৷
– ওকে বস৷
– কিং তোরে আমি ছাড়মু না৷ তুই আমার অনেক ক্ষতি করছিস। তুই শেষ।

আবিরের বাসায়,

আবির এখন পুরো বেড রেস্টে। অনেক ডিরেক্টরের সকাল থেকে কল এসেছে। সবার সিডিউল অফ করে দিয়েছে নিলয়৷ আবির কারো সাথে কথাও বলে নি। নিলয় আবিরের কাছে এসে জানায়,

– স্যার সবাইকে বলেছি আপনি একটু অসুস্থ। কদিন পর আবার চলে আসবেন কাজে৷
– গুড। কেউ কি বেশি ফোর্স করেছে?
– জি স্যার।
– কে?
– ডিরেক্টর আশিক। তার নাকি অনেক লস হয়ে যাবে আপনি না গেলে।
– বলিস নাই আমি অনেক অসুস্থ?
– বলছি। বলে, অসুস্থ হলে কি একটু সময় দেওয়া যায় না? কাজ নিয়া পারফেকশন না থাকলে কিভাবে হবে!
– ওরে কল লাগা৷ ও আমাকে কাজ শিখায় না৷ কল দে।
– ওকে স্যার।

নিলয় আশিককে কল দেয়৷ রিসিভ করলে নিলয় বলে,

– স্যার কথা বলবে আপনার সাথে।
– দেও।

আবির ফোন নিয়ে বলে,

– কিরে আপনি নাকি আমাকে কাজের পারফেকশন শিখাবেন?
– না না আবির কি বলছো তুমি! তোমাকে কাজ শেখানোর কারো ক্ষমতা নেই। আসলে আমি অনেক চাপের মধ্যে আছি তাই ভুল বলে ফেলছি।
– সে যাই হোক! আমার না আসাতে তো আপনার অনেক ক্ষতি হবে তাই না? আপনাকে কিছু পাঠাচ্ছি সেটা দিয়া ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েন৷ আর হ্যাঁ, আপনার সাথে আমি আর কাজ করছি না।
– না না আবির প্লিজ, তাহলে আমি তো একদম শেষ হয়ে যাবো। আমার কোন কিছু চাই না৷ তুমি প্লিজ আমার সাথে কাজ করো। প্লিজ আবির। তোমার পায়ে পড়ি।
– বেশি কথা বাড়াবেন না৷ আমি একবার যেটা বলি সেটাই করি। আপনার মতো ডিরেক্টর এর সাথে কাজ করার আমার কোন ইচ্ছা নেই।

আবির নিলয়ের কাছে ফোন দিয়ে দেয়। নিলয় ফোন কেটে দিয়ে বলে,

– স্যার কত দিব?
– হিসাব করে ওর যা ক্ষতি হয় তার ৩ গুণ দিয়ে দিও।
– ওকে স্যার৷ তাহলে আমি আসি। আপনি রেস্ট নিন৷
– হুম।

নিলয় গেলে আবির মাইশাকে ওর আরেকটা ফোন দিয়ে কল দেয়৷ এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। দুইটা রিং হতেই মাইশা ফোন রিসিভ করে। আবির বলে উঠে,

– হেই বেবি কোথায় তুমি? আসবে না বাসায়?
~ বেবি…আমি তো খুব বিজি৷ আরেকটা শুট আছে ৭ টার দিকে৷
– ওহ! কোন সমস্যা নেই। তুমি কাজ করো। আর বাসায় গিয়ে আমাকে কল দিও।
~ ওকে বেবি৷

এখন রাত প্রায় ১ টা নাগাদ বাজে। আবির ওর রুম ছেড়ে বের হয়ে করিডর ধরে হেঁটে শেষ মাথায় যে স্টোর রুমটা আছে সেখানে যায়৷ রুমের ভিতর ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে আবির সেখানেই থাকে। ওর সাথে যারা থাকে তারা কেউই জানে না আবির ওই স্টোর রুমটার ভিতরে গিয়ে ঠিক কি করে। একমাত্র নিলয় জানে। আবির পরদিন সকালে স্টোররুম থেকে বের হয়ে ওর নিজের রুমে চলে আসে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না৷ আবিরের কয়েকজন লোক নিলয় এর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

– ভাই, প্লিজ বলেন না, স্যার ওই রুমে সারারাত একা বসে কি করে? যে আমাদেরও বলা যাবে না?
– দেখ তোদের আগেও বলছি যে এই কথা কখনো জিজ্ঞেস করবি না। স্যারের একদম নিষেধ আছে। আমি যদি কাউকে বলি আমাকে জানে মেরে ফেলবে।
– ঠিক আছে ভাই ঠিক আছে। এই চল।

আবিরের লোকেরা নিরাশ হয়ে যে যার কাজে চলে যায়। নিলয়ও ওর কাযে চলে যায়। আবির ওর রুমে এসে বেডে শুয়ে পড়ে। শরীরটা আজ একদম ভালো লাগছে না ওর। হাতের ব্যথাটাও একটু বেড়েছে। আবির একসময় ঘুমিয়ে পড়ে এই সকালে। সারারাত রুমের মধ্যে কি করেছে তা ও আর নিলয় ছাড়া কেউ জানে না৷

অন্যদিকে জান্নাত সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মতো নাস্তা বানিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়ে কলেজের দিকে৷ অন্যসব দিনের মতো আজ দিনটা হলেও হতে পারতো। কিন্তু আজ একটু ব্যতিক্রম হলো। জান্নাত কলেজের সামনে নামতেই ও পুরো অবাক। কারণ হৃদয়…..

চলবে…?

love is like a Cocktail Part-02

0

#love_is_like_a_Cocktail
Writer: Abir Khan
Part: 02
জান্নাত পুরো থ হয়ে আছে। কোথাও আবির নেই। এমনকি নেই কোন রক্তের দাগও। পুরো ঘর টিপটপ হয়ে আছে৷ এ যেন স্বপ্নের মতো। জান্নাত অবাক পানে তাকিয়ে হেঁটে হেঁটে সোফার উপর এসে বসে। মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে থাকে, তাহলে কি ও স্বপ্নই দেখেছে? আবির গত রাতে ওর বাসায় আসে নি? এত কিছু হলো সবটাই কি স্বপ্ন! জান্নাত কোন উত্তর খুঁজে পায় না। ওর মাথায় কেমন জানি গন্ডগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই ওর নজর যায় টেবিলের উপর রাখা একটা চিরকুটের দিকে। জান্নাত দ্রুত সেটা নিয়ে পড়তে শুরু করে। সেখানে লেখা,

– অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে রাতে থাকতে দেওয়ার জন্য। এবং আরও ধন্যবাদ জানাই আমার সেবা করার জন্য৷ আপনার জায়গায় অন্যকেউ হলে হয়তো এমন কিছুই করতো না। আপনি আমার পরিচয় না জেনেই অনেক সেবা করেছেন। তাই আর কষ্ট দিতে চাই না। আপনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন তাই আর ডাকিনি৷ না বলেই চলে আসলাম। আর আসার আগে আপনার বাসাটা যেমন ছিল ঠিক তেমন করে দিয়ে গেলাম। ভালো থাকবেন।
– আবির আহমেদ।

জান্নাত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে চিরকুটটার দিকে। তারমানে রাতের সব ঘটনা সত্যি। এত বড়ো একজন ফেমাস নায়ককে ও স্পর্শ করেছে, তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে। ওর ক্রাশকে এত কাছ থেকে ও দেখেছে। জান্নাতের মন খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছে৷ মেয়েটা আবার লজ্জা পেয়ে নিজের মুখ ঢেকে বসে থাকে। তারপর মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আবিরের চিরকুটটা সুন্দর করে নিয়ে একটা সেইফ জায়গায় ও রেখে দেয়৷ যাতে কোন ক্ষতি না হয় চিরকুটটার। তবে জান্নাতের এখন চিন্তা হচ্ছে আবিরের জন্য৷ কারণ ওর হাতের ক্ষতটা অনেক গভীর ছিল। জান্নাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত উঠে পড়ে। ওকে ক্লাসে যেতে হবে৷ দেরি হয়ে যাচ্ছে। ও দ্রুত ফ্রেশ হয়ে সামান্য একটু নাস্তা বানিয়ে তা খেয়ে ক্লাসের জন্য রেডি হয়ে দরজাটা লাগিয়ে চলে যায়৷ জান্নাত নিচে এসে রাস্তায় দাঁড়াতেই ওর মনে হয় কেউ একজন ওকে ফলো করছে। ও এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায় না৷ তারপর একটা রিকশা পেলে সোজা ক্লাসে চলে যায়৷

আবিরের বাসায়,

আবির ওর বেডে শুয়ে আছে৷ একটু আগেই ওর বাম হাতটার বেশ ভালো ভাবেই ট্রিটমেন্ট হয়েছে। ওর পার্সোনাল ডাক্তার মানে ওর বন্ধু রিয়াদ ওর ট্রিটমেন্ট করেছে। রিয়াদ আবিরকে বলছে,

– অন্তত একমাস বেড রেস্টে থাকতে হবে তোকে৷ কোন শুটিং এ জাবি না একদম।
– বাট দোস্ত সিডিউল এ ঝামেলা হবে৷
– হোক। তুই যাবি না৷ একমাস রেস্ট নে। নাহলে হাত ভালো হবে না।
– আচ্ছা সে দেখা যাবে৷
– কথা শুনিস ভাই৷ এখন তোর বাইরে বের হওয়াটা রিস্ক।
– কাজটা যে কে করলো একবার জানতে পারলে হয়।
– আবির বাদ দে না এসব। কি হবে এগুলো করে?
– তুই বুঝবি না।

ওদের কথার মাঝে আবিরের সবচেয়ে কাছের লোক এবং বিশ্বস্ত, মানে নিলয় ওর রুমে আসে। আবির রিয়াদকে বলে,

– দোস্ত তুই তাহলে যা৷
– আচ্ছা নিজের খেয়াল রাখিস। আর কোন সমস্যা হলে আমাকে বলিস৷
– আচ্ছা৷

রিয়াদ গেলে আবির নিলয়কে বলে,

– হুম বল। কি নিউজ আছে।
– স্যার অল ক্লিয়ার। কোন ঝামেলা নেই।
– ওকে। বাট আমার উপর অ্যাটাক করলো কে? সেটা জানতে পেরেছিস?
– এখনো না৷ কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই জেনে যাবো।
– তাড়াতাড়ি নিলয় তাড়াতাড়ি। আমার রক্ত যে এখনো ঠান্ডা হয় নাই।
– জি স্যার। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি সব দেখছি। আপনি রেস্ট নিন৷
– হুম।

আবিরের কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ করে একটা মেয়ে আবিরের রুমে ঢুকে ওর উপর রীতিমতো ঝাপিয়ে পড়ে অস্থির হয়ে। সে আর কেউ নয় আবিরের একমাত্র ভালবাসা, মাইশা। মাইশা আবিরকে এভাবে দেখে অস্থির হয়ে কান্নাসিক্ত কণ্ঠে বলে,

~ আমার আবিরের কি হয়েছে? কিভাবে কি হলো? ইসস!

আবির নিলয় এর দিকে তাকালে ও মুচকি হাসি দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে যায়। এবার আবির ওর ডান হাতটা মাইশার গালে রেখে বলে,

– আহ! আমার বেবিটা শান্ত হও। আমি ঠিক আছি। তেমন কিছু হয় নি।
~ তুমি জানো আমি কতটা ভয় পেয়েছি? এখন কেমন আছো তুমি?
– একদম ভালো। তবে একমাস রেস্টে থাকতে হবে। তোমাকে হয়তো সময় দিতে পারবো না৷ তুমি কিছু মনে করো না প্লিজ।
~ কি যে বলো না তুমি! কোন সমস্যা নেই। একমাস পড়েই নাহয় তোমার বেবিটাকে সময় দিও।
– আচ্ছা দিব। জানো তোমাকে কাছে পেলে আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। মনে যে কতটা শান্তি পাই তা বলে হয়তো কখনো বুঝাতে পারবো না।
~ আমিও সেইম। তুমি ইঞ্জুর শুনে আমি দৌড়ে চলে আসছি৷ অনেক ভয় পেয়েছি আমি।

আবির মাইশাকে কাছে টেনে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

– চিন্তা করে না বেবি। আমি এখন ঠিক আছি। আর শোনো মিডিয়ার কেউ যাতে না জানে আমি অসুস্থ। ওকে?
~ কেন? জানলে কি হবে?
– আমার ফ্যানরা অনেক কষ্ট পাবে, অযথা চিন্তা করবে তাই।
~ আচ্ছা কেউ জানবে না৷ তুমি খালি তোমার ফ্যানদের কথাই চিন্তা করো আমার কথা একটুও ভাবো না৷
– তোমার কথা আমি সারাদিন সারাক্ষণ ভাবি। কারণ তোমাকে অনেক বেশি ভালবাসি আমি।
~ সত্যিই?
– হুম।
~ আচ্ছা বেবি একটা কথা বলি? কিছু মনে করবে না তো?
– না না বলো।
~ না থাক তুমি তো অসুস্থ। থাক লাগবে না।
– আরে বলো। সমস্যা নেই। বলো কি লাগবে?
~ আসলে সামনে কিছু স্যুট আছে। বাট আমার কাছে কোন নিউ কালেকশন নেই।
– ওহ! এই কথা? শোনো নিলয়কে আমি বলে দিচ্ছি। তোমার যত টাকা লাগে ওকে বলে দিও ও তোমার একাউন্টে পাঠিয়ে দিবে।

মাইশা অসম্ভব খুশি হয়ে আবিরকে জড়িয়ে ধরে বলে,

~ থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।

আবির মাইশার স্পর্শে হারিয়ে যায়। মাইশা কিছুক্ষণ পর ওকে ছেড়ে উঠে বলে,

~ তাহলে আমি আজ যাই। স্যুট শেষ হলে আসবো নি।
– আচ্ছা। নিজের খেয়াল রেখো।
~ ওকে বেবি৷

বলেই আবিরের গালে একটা চুমু দিয়ে মাইশা চলে যায়৷ আবির যেন মনে অজানা শান্তি অনুভব করে। মাইশার সাথে ওর সম্পর্কের প্রায় ২ বছর হলো। ওদের প্রথম দেখা হয় একটা স্টিডিওতে। আবিরের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলো মাইশা। আর এরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাইশার সাথে আবিরের দেখা হতে থাকে। আস্তে আস্তে ওদের মাঝে ভালো একটা বন্ধুত্ব হয়,ভালো একটা বন্ডিং হলে ওরা রিলেশনে চলে যায়। আবির মাইশাকে মনে প্রাণে অনেক ভালবাসে। মানে নিজের থেকেও বেশি। তাই তো প্রতি মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা আবির মাইশাকে দেয়। একবার ভাবেও না মাইশা টাকাগুলো নিয়ে কি করে। নিলয়ের পর আবির সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস এবং পছন্দ করে মাইশাকে। ওকে বিয়ে করার ইচ্ছাও আছে আবিরের। শুধু সময় আর সুযোগ খুঁজছে আবির।

অন্যদিকে জান্নাতের ক্লাসে,

জান্নাত ক্লাসে যেতেই ওর বেস্ট ফ্রেন্ড নিতু ওর কাছে আসে। ওরা একসাথে বসতেই নিতু জান্নাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,

~ কিরে আজ তোকে অন্যরকম লাগছে যে? কাহানী কি বলতো?
~ আরে না না তেমন কিছু না।
~ শোন সবার চোখ ফাকি দিতে পারলেও তুই আমার চোখ কখনো ফাকি দিতে পারবি না৷ কারণ আমি তোর অনেক পুরনো ফ্রেন্ড। সো বল কাহানী কি?
~ আগে প্রমিজ কর কাউকে কিছু বলবি না? আর আমার কথা শুনে শান্ত থাকবি? প্রমিজ কর।
~ এমন কি কথা? আচ্ছা যা প্রমিজ। এবার তো বল।
~ কালকে রাতে আবির আহমেদ আমার বাসায় এসেছিল।
~ কিহ! (জোর গলায়)

সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। জান্নাত নিতুর দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় আর বলে,

~ আস্তে আস্তে…..
~ সরি সরি দোস্ত। তুই সত্যি বলছিস? আবির আহমেদই ছিল?
~ হ্যাঁ। আসলে সে অনেক বড়ো একটা বিপদে পড়ে আমার কাছে আশ্রয় নিতে এসেছিল। সারারাত থেকে সকালে না বলেই চলে গেছে৷ (দুঃখি ভাবে বলল)
~ কি! সারারাত ছিল? এইইই কিছু উলটা পালটা করিস নি তোরা? বল না?
~ তোর মনে হয় আমি ওই ধরনের মেয়ে?
~ একদম না।
~ তাহলে জিজ্ঞেস করিস কেন?
~ না মানে আবির তো তোর ক্রাশ৷ তাই যদি কিছু করিস আর কি হাহা।
~ ধুর আমি ওই ধরনের মেয়ে না।
~ জানি জানি। মজা করছিলাম পাগলি।

জান্নাত আর নিতু যখন হেসে খেলে কথা বলছিল ঠিক তখন ওদের কাছে একটা ছেলে আসে। এসে বলে,

– জান্নাত…

জান্নাত মাথা তুলে উপরে তাকিয়ে দেখে ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর হ্যান্ডসাম ছেলেটা মানে হৃদয় ওকে ডাক দিয়েছে। জান্নাত আস্তে করে বলে,

~ জি?
– তোমার সাথে একটু কথা ছিল। আমার সাথে আসবে?

নিতু অবাক নয়নে জান্নাতের দিকে তাকায় আর জান্নাত নিতুর দিকে। যে ছেলের জন্য কলেজের হাজার মেয়ে পাগল সেই ছেলে জান্নাতের সাথে কি কথা বলতে চায়! নিতু ইশারায় যেতে বলে। জান্নাত না করলেই নিতু জোর করে বলে, যা। জান্নাত বলে,

~ আচ্ছা চলো।

হৃদয় খুব খুশি হয়ে জান্নাতকে নিয়ে ক্লাসের বাইরে আসে। ক্লাসের সব মেয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। অবশ্যই হিংসা করে। কারণ জান্নাত দেখতে কিন্তু অনেক সুন্দরী আর মায়াবী। গায়ের রঙ ফরসা, চোখগুলো ভাসানো, বড়ো বড়ো পাপড়িওয়ালা চোখ, নাকটা খাড়া, ঠোঁটগুলো একদম গোলাপি আর মিষ্টি। আর গায়ের গড়ন একদম মনকাড়া। তবুও ও অনেকের কাছে অবহেলিত। কারণ ও অনাথ, ওর কারিকারি টাকা নেই, নেই অনেক দামি ড্রেস। তাই অনেকেই ওর সাথে তেমন মিশে না৷ এছাড়া ওর সুন্দর রূপের জন্য ওর সাথে অনেক মেয়ে হিংসা করে। এতে অবশ্য জান্নাতের কোন কষ্ট নেই। ও সব কিছুই মেনেই নিয়েছে। জান্নাত আর হৃদয় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। হৃদয় কেমন আমতা আমতা করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। জান্নাতের হৃদস্পন্দন বেড়েই যাচ্ছে। হৃদয় কি এমন কথা বলার জন্য এত সংকোচ করছে? জান্নাত বুঝতে পারছে না। হৃদয় একটু সময় নিয়ে বলে,

চলবে…?

love is like a Cocktail Part-01

0

#love_is_like_a_Cocktail
Writer: Abir Khan
Part: 01

আবিরের বাম হাতে একটা গুলি লেগেছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে শুধু। রক্ত আটকাতে ওর পরনের শার্টটা খুলে হাতে পেচিয়ে ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে পালাচ্ছে ও। একটা ওয়েলকাম পার্টিতে ওকে ইনভাইট করা হয়৷ ও অনেক সিকিউরিটি নিয়ে গেলেও হঠাৎ করে ওর উপর এবং ওর লোকের উপর শত্রুপক্ষ অ্যাটাক করে। আবির ভাবতেই পারে নি এমন কিছু হবে৷ ওর অনেক লোককে শত্রুপক্ষ মেরে ফেলেছে। যারা বেঁচে ছিল তারা কোন মতে ওকে বাইরে বের করে দেয়। কিন্তু একটা গুলি এসে ওর বাম হাতে লাগে৷ রাত এখন প্রায় ২ টার মতো বাজে। আবির এদিক ওদিক দৌড়ে একটা বাসার ভিতর ঢুকে পড়ে। কারণ ওর পিছনে ছিল শত্রু পক্ষের বাকি লোকেরা। আবির যে বাসায় ঢুকে সে বাসার একদম উপর তলায় ও চলে যায়। যাতে ওকে খুঁজে না পায়৷ ব্যথায় ওর অবস্থা খুব খারাপ। যে করে হোক গুলিটা বের করতেই হবে। আবির দেখে একটা ফ্ল্যাট বাসা। ও দ্রুত বেল দেয়। কয়েক বার বেল দিতেই দরজাটা কে যেন খুলে৷ আবির ওর হাতের পিস্তলটা নিয়েই ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে যে দরজাটা খুলেছিল তার মুখ চেপে ধরে৷

আবির এবার খেয়াল করে ও একটা মেয়ের মুখ চেপে ধরে আছে। সে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে ওর দিয়ে ভীতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবির মেয়েটার মুখ চেপে ধরেই দরজাটা আগে লাগিয়ে দেয়। তারপর মেয়েটার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে রাগী ভাবে বলে,

– একটা যদি চিৎকার কিংবা উল্টো পালটা কিছু করেছিস তাহলে তোর মাথার খুলি এখনই উড়িয়ে দিব৷

মেয়েটা এই গভীর রাতে এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। আবির ওকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরেছিল। ও আবার বলে,

– আমি যদি মুখের উপর থেকে হাত সরাই তাহলে তুই কি চিৎকার চেচামেচি করবি?

মেয়েটা দ্রুত মাথা নাড়িয়ে ইশারায় না না বলে। আবির আবার জিজ্ঞেস করে,

– আমি যা যা বলবো তা তা ঠিক মতো করবি?

মেয়েটা এবার ভীষণ ভয়ে জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় হ্যাঁ হ্যাঁ বলে। আবির আস্তে আস্তে হাত সরায়৷ ওর শরীর থেকে অনেক রক্ত ঝরেছে। তাই মাথাটা সমানে ঘুরপাক খাচ্ছে। আবির মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে ওখানেই দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ে৷ মেয়েটা ওর কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে অস্থির হয়ে পিছনে সরে ছটফট করতে থাকে। মেয়েটার মনে হচ্ছে ওর পা দুটো তার সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। মুখটা চাচ্ছে চিৎকার করে কারো সাহায্য চাইতে। খুব ভয় করছে ওর৷ এদিকে আবির মাটিতে বসে হাত থেকে শার্টটা খুলতেই গলগল করে রক্ত ঝরছে। মেয়েটা এই দৃশ্য দেখে আরও ভয় পেয়ে যায়৷ টিভিতেই এমন দৃশ্য দেখেছে। কিন্তু বাস্তবে যে কখনো দেখতে হবে তা ও কল্পনাও করে নি। এদিকে আবির ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে মেয়েটাকে বলে,

– একটা ছুরিকে ভালো করে গরম করে নিয়ে আয়। সাথে একটা বাটি আর মেডিকিট আছে না সেগুলো দ্রুত নিয়ে আয়।

মেয়েটা আবিরের কথা মতো সেগুলো নিয়ে আসলো। একটুও দেরি করলো না। গরম ছুরিটা আবিরের দিকে এগিয়ে দিলে ও বলে উঠে,

– এখানে বস। আমি পারবো না৷ তুই এটা এখানে ঢুকিয়ে গুলিটা বের কর৷

মেয়েটা ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে ইশারায় না বলে। আবির ওর পিস্তলটা উঠালে মেয়েটা আবিরের কথা মতো কাজ শুরু করে৷ খুব সুক্ষ্ম ভাবে গুলিটা বের করে অনেক সুন্দর করে ড্রেসিং করে দেয় মেয়েটা। আবির অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কাজ শেষ হলে ও আবার জিজ্ঞেস করে,

– আপনি কি ডাক্তার?

মেয়েটা ভীতু কণ্ঠে বলে,

~ না। তবে ডাক্তারি পড়ছি।

এই প্রথম আবির মেয়েটার মিষ্টি মধুর কণ্ঠ শুনল। সে দেখতে যেমন বেশ সুন্দরী তার কণ্ঠটাও ঠিক একই। মিষ্টি মধুর। তবে এখন কান্না করায় আর ভয়ে তাকে অন্যরকম লাগছে৷ চোখমুখে ভীষণ ভয় আর ভয়। আবির সেটা বুঝতে পেরে বলে,

– অ্যাম রিয়েলি সরি, আপনাকে এভাবে ভয় দেখানোর জন্য। ভয় নেই আমি আপনাকে কিছু করবো না। আমার শত্রুরা আমাকে গুলি করেছে। তাই বাঁচতে আপনার এখানে আসা। আর গুলিটাও বের করা জরুরি ছিল। তাই একটু অভিনয় করে আপনাকে ভয় দেখিয়ে কাজটা করাই। থ্যাংকস হেল্প করার জন্য৷

মেয়েটা চুপচাপ আবিরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ওহ! একটা কথা তো বলাই হয় নি। আবির মুখে মাক্স পরা ছিল। যাতে ওকে কেই চিনতে না পারে। আবির কথা শেষ করে ওর ডান হাত দিয়ে আস্তে করে মাক্সটা সরায়৷ এবার মেয়েটা পুরো স্তব্ধ হয়ে যায়। মানে নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ ও কি ঠিক দেখছে! ও তো আবিরকে চিনে। শুধু ও না দেশের অনেক মানুষ আবিরকে চিনে৷ মেয়েটা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। কোন রকম নিজেকে সামলে মেয়েটা আবিরের কাছে এসে ওকে অবাক নয়নে দেখে বলে,

~ আপনি আবির আহমেদ? দেশের সুপার স্টার নায়ক আবির আহমেদ আপনি? (ভীষণ অবাক কণ্ঠে)
– জি।
~ আপনার এ অবস্থা হলো কিভাবে? আর আপনি পিস্তল এসব কই পেলেন? (চিন্তিত কণ্ঠে)
– শান্ত হন আমি বলছি। আমি কে তা তো বুঝতেই পারছেন। আসলে আমার যতটা না ফ্যান-ফলোয়ার তার চেয়ে আমার শত্রুর সংখ্যা বেশি। মিডিয়াতে যে কাজ করি তাই। আর এটা আমার না, আমার বডিগার্ডদের। জাস্ট আত্নরক্ষার জন্য সাথে এনেছি।
~ আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না এত বড়ো ফেমাস নায়ক আমার সামনে তাও আবার এভাবে! আমি বোধহয় এখনো স্বপ্ন দেখছি কিংবা ঘুমের ঘোরে হয়তো।
– জি না এটা সত্য। আর আমি সত্যিই সরি আপনাকে এরকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেওয়ার জন্য৷ আজ রাতটা একটু থাকতে দিন কাল সকালেই আমি চলে যাবো।
~ না না কোন সমস্যা নেই আপনি থাকুন। আসলে আমি তো ভেবেছিলাম আপনি কোন বড়ো গুন্ডা বা মাফিয়া। তাই অনেক ভয় পেয়েছিলাম আর ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
– আরে না না৷ আমি অভিনয় করছিলাম। আচ্ছা আমাকে একটু স্যালাইন দিবেন? অনেক রক্ত গিয়েছে শরীর থেকে। খুব ব্যথা আর খারাপ লাগছে।
~ জি অবশ্য দিব৷ একটু অপেক্ষা করুন।

মেয়েটা উঠে চলে যায়। আবির এই ফাঁকে ওর ফোনটা বের করে ওর লোকদের ম্যাসেজ করে দেয়৷ তারপর মেয়েটা চলে আসলে ও দ্রুত ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে। মেয়েটা এসে,

~ নিন।
– থ্যাংকস।

আবির একঢোকে স্যালাইন খেয়ে ফেলে। তারপর মেয়েটার দিকে গ্লাসটা এগিয়ে দিতে দিতে বলে,

– কিছু মনে না করলে আপনার নাম কি জানতে পারি?
~ আমি জান্নাত ইসলাম।
– বাহ! খুব সুন্দর নাম। উহহ!
~ ইসস! অনেক ব্যথা করছে? আপনার তো হাসপাতালে যাওয়া উচিৎ।
– না না। এখন বের হলে বিপদ। কাল যাবো।
~ আচ্ছা আপনি বসুন৷ আমি স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসি। খেলে ভালো লাগবে৷
– না না, আপনি আর কষ্ট করবেন না। এমনিতেই অনেক ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে আপনাকে।
~ দেখুন আমি তো ডাক্তারি পড়ছি এটা আমার দায়িত্ব রোগীর সেবা করা। আমি সেটাই করছি। আর আপনি এখানে না বসে বরং সোফাতে বসুন৷ ভালো লাগবে।
– না না। এখানেই ঠিক আছি। আমার সারা গা জুড়ে রক্ত। শুধু শুধু আপনার সোফাটা নষ্ট হবে। আমি এখানেই ঠিক আছি।
~ সমস্যা নেই। চাইলে বসতে পারেন। আমি ওয়াশ করে ফেলবো নি।
– এখানেই ঠিক আছি।
~ ওহ! তাহলে আমি স্যুপ নিয়ে আসছি।
– আচ্ছা একটা প্রশ্ন ছিল?
~ জি?
– আপনি কি এখানে একা থাকেন? আর কাউকে দেখছি না যে?
~ জি একাই। আমি ছাড়া আমার পরিবারে আর কেউ নেই।

জান্নাত কথা শেষ করে দ্রুত আবিরের সামনে থেকে চলে আসে। আবির অবাক নয়নে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। জান্নাত রান্না ঘরে এসে বুকে হাত দিয়ে আগে নিজেকে শান্ত করে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে ডকডক করে খেয়ে নেয়৷ গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল ওর। জান্নাতের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না ওর ক্রাশ মানে আবির আহমেদকে কখনো এভাবে ও দেখতে পারবে। ও নিজেকে শান্ত করতে করতে আবিরের জন্য স্যুপ বসিয়ে দেয়। ২০/২৫ মিনিট পর স্যুপ হয়ে গেলে ও সেটা নিয়ে আবিরের কাছে যায়। খুব লজ্জা লাগছে ওর। আবিরের মতো এত বড়ো একজন ব্যক্তি ওর বাসায়। ও কি রকম বিহেভ করবে ভেবে পাচ্ছে না। তাও নিজেকে কোন মতে সামলে আবিরের কাছে যায়। যেয়ে বলে,

~ আপনার স্যুপ রেডি।
– আমি সত্যিই অনেক দুঃখিত আপনাকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য৷
~ না না সমস্যা নেই। মানুষের সেবা করলে আল্লাহ তায়ালা অনেক খুশি হন৷ আমিও তাই করছি।

আবির জান্নাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দেয়। সত্যি বলতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। ও শুধু অপেক্ষায় আছে কখন সকালটা হবে৷ তবে জান্নাতের সেবা ওর অনেক ভালো লাগছে। জান্নাতের কাছ থেকে আবির স্যুপটা নিতে নিলে জান্নাত ওকে থামায়। আর আস্তে করে মাথা নিচু করে বলে,

~ আপনি তো দুই হাত ব্যবহার করতে পারবেন না। আর অনেক ক্লান্তও আপনি। যদি কিছু মনে না করেন আমি খাইয়ে দি আপনাকে?

আবির বেশ অবাক হয়। নিজের দিকে তাকিয়ে বলে,

– ঠিক বলেছেন। আমার যা অবস্থা মনে হয় না নিজে কিছু খেতে পারবো। কিন্তু আপনাকে এভাবে কষ্ট দেওয়াটা…
~ প্লিজ…
– আচ্ছা আচ্ছা দিন৷

জান্নাত লজ্জাসিক্ত মুখখানা নিয়ে আবিরকে স্যুপটা খাইয়ে দেয়। আবির পুরোটা সময় জান্নাতের দিকে তাকিয়ে ছিল। খাওয়া শেষ হলে আবির বলে,

– এবার আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমি এখানেই ঠিক আছি।
~ কোন সমস্যা হবে না তো?
– না না একদম না৷ আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।

জান্নাত ভিতরে ওর বেড রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে। আবির মেইন গেইটের সামনে ওভাবেই বসে থাকে। ও পিস্তলটা হাতে নিয়ে সেটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর চোখগুলো লাল টকটকে হয়ে আছে। কিছু একটা আবির ভাবছে। কিন্তু কি?

পরদিন সকালে,

জান্নাত আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায়৷ ভোরের আলো এসে ওর চোখে পড়ছে। সাথে সাথে ও একলাফে উঠে বসে। আবির! আবিরকে দেখতে হবে৷ জান্নাত দ্রুত বেড ছেড়ে উঠে বাইরে এসে পুরো থ। নিজের চোখকে ও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না৷ জান্নাত দেখে….

চলবে..?

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৫৫ এবং শেষ পর্ব

5

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৫৫এবং শেষ
#Arshi_Ayat

রাত প্রায় একটা দশ…
ঢাকায় রাত আর দিন নেই সবসময়ই রাস্তায় গাড়ি থাকে।তবে দিনের তুলনায় রাতে জ্যাম কমই থাকে।আবার আজকে একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে।এখনো গুড়িগুড়ি পড়ছে।রাস্তাঘাট অন্যদিনের তুলনায় ফাঁকা।ইয়াদের গাড়ি মসৃণ গতিতে চলছে।ওর কাঁধে মাথা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে মধু।গাড়ির ভেতরে মিডিয়াম ভলিউমে রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীত চলছে।এই গানটা দু’জনারই ভীষণ প্রিয়।

ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো– তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো– তোমার
চরণমঞ্জীরে॥
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি– তোমার
প্রাসাদপ্রাঙ্গণে॥
মনে ক’রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী– তোমার
কনককঙ্কণে॥

গানের তালে তালে মধুও গুনগুন করছে।

অনেকদিন ধরেই অভি ইয়াদকে বারবার করে বলছিলো ওদের রেডিও স্টেশনে আসতে আর ওদের ভালোবাসার গল্প বলতে কিন্তু সারাদিনের ব্যাস্ততার পর আর যেতে ইচ্ছে করে না কারোই।আজ বৃহস্পতিবার ছিলো।আর শুক্রবারের অপর নাম বন্ধের দিন।বন্ধের দিন মানে সকালে অনেক্ক্ষণ ঘুমানো যাবে।তাই আজকে আর বন্ধু অভির আবদারটা ফেলতে পারলো না ইয়াদ।মধুকে নিয়ে রেডিও তে চলেই এলো তাদের গল্প বলতে।গল্প বলতে বলতে অন ইয়ারেই ওরা অনেক সময় হেসেছে,কেদেছে অবশেষে হাসিমুখে শেষ করেছে তাদের ভালোবাসার গল্প।অনুষ্ঠান শেষ করে রাত সাড়ে বারোটায় বাসার উদ্দেশ্যে ওরা রওনা দেয়।

ইয়াদ আদুরে গলায় বলল,’ঘুম পাচ্ছে মধু?’

‘না গো।প্রথম থেকে সবকিছু আজ যেনো আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে!দেখতে দেখতে সাতটা বছর কিভাবে তোমার সাথে পার করলাম টেরই পেলাম না।মনে হচ্ছে এই তো সেদিনই দেখা হলো আমাদের।’

ইয়াদ মধুর কথায় একটু হাসলো।তারপর বলল,’ভালোবাসা কখনো পুরোনো হয় না মধু।আমরা যখন বার্ধ্যকে উপনীত হবো তখনও মনে হবে আমরা নব যৌবনা প্রেমিক-প্রেমিকা।ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যেটা কমে না বরং সময়ের সাথে সাথে বাড়ে তবে সেটা শুদ্ধ হতে হবে!’

মধু ঠোঁট প্রশস্ত করে একটুখানি হাসলো।

ওরা দেড়টায় বাসায় পৌঁছে গেলো।রুমে এসে মধু বলল,’তুমি ফ্রেশ হও।আমি আরিয়ানকে নিয়ে আসছি।’

এটা বলে মধু বের হতে নিলেই ইয়াদ হেঁচকা টানে মধুকে ঘুরিয়ে তার বক্ষপিঞ্জরে আবদ্ধ করলো।মধু একটু লাজুক হাসলো।হাসি ধরে রেখেই বলল,’কি করছো?ছাড়ো না!আরিয়ান কে আনবো।’

ইয়াদ ফিসফিসিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,’থাক না আরিয়ান ওর দাদা দাদির কাছেই ঘুমাক।তুমি বরং আমার বুকেই থেকে যাও।’

মধু আপত্তি করলো না।আপত্তি করার ইচ্ছেও নেই।এটাই তো সুখের নীড়!এই নীড় ছেড়ে যাওয়ার কোনো স্পর্ধাই নেই মধুর।
———–
‘আপ্পা,আপ্পা,আপ্পা..’
ইয়াদের পিঠের ওপর কখনো শুয়ে অথবা কখনো বসে আধো আধো বুলিতে বাবাকে ডাকছে।আর ওর বাবা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।কিন্তু আরিয়ানের থামা থামি নেই।সে নিরলসভাবে বাবাকে ডাকছেই।

মধু রান্নাঘর থেকে ঘরে এসে বেডের সামনে দাড়িয়ে ইয়াদকে ডেকে বলল,’কেমন নিষ্ঠুর বাবা গো তুমি!ছেলেটা এতক্ষণ ধরে তোমাকে ডাকছে আর তুমি মরার মতো ঘুমাচ্ছে।এবার তো ওঠো।দশটা বাজে।’

মধুর ঝাঁঝালো গলা পেয়ে ইয়াদ চোখ খুললো।তারপর ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,’কয়টা বাজে বললে?’

‘দশটা বাজে মহাশয়।’

ইয়াদ আরিয়ানকে নিজের পিঠের ওপর থেকে নামিয়ে ওর নরম গালে একটা চুমু দিয়ে বলল,’আমার বাবাটা।’

ছোট্টো আরিয়ান ওর ছোট্টো ছোট্টো দাত গুলো বের করে খিলখিলিয়ে হেসে বাবার গালেও চুমু দিলো।মধু দাড়িয়ে দাড়িয়ে এই দৃশ্যটা প্রাণ ভরে দেখলো।প্রতিদিন সকালেই এরা এমন করে।আর প্রতিদিনই মধু এটা উপভোগ করে।এর চেয়ে স্নিগ্ধ আর কিছু হতে পারে না।

এবার বাপ ছেলেকে তাড়া দিয়ে মধু বলল,’বাপ,পোলা দুইটাই বান্দর।নামো এখন বিছানা থেকে।বিছানা ঝারতে হবে।’

আরিয়ানকে কোলে নিয়ে ইয়াদ বিছানা থেকে নামতে নামতে ন্যাকা স্বরে বলল,’দেখ,আরিয়ান তোর মা আমাদের বান্দর বলেছে।’

আরিয়ান কি বুঝলো কে জানে!তবে তার হাসা বন্ধ নেই।বাপের কথা শুনে আবার ও খিলখিলিয়ে হেসে দিলো।ইয়াদ কৃত্রিম রাগের ভান করে বলল,’ধূর বেকুব তুই হাসছিস কেনো?’
বাপকে রাগতে দেখে আরিয়ান হাসি থামিয়ে ইয়াদের গলা জড়িয়ে ধরে আবার চুমু দিলো।ইদানীং আরিয়ান এমনই করে যখনই ওর মনে হয় বাবা অথবা মা কারো মন খারাপ তখন তাদের গালে চুমু দেয়।ফলে যদি ওদের মন খারাপও থাকে তবুও অটোমেটিক মন ভালো হয়ে যায়।

আজকে শ্বাশুড়ি বউমা মিলে রান্না করছে।অনেক পদের আইটেম আছে আজ।অবশ্য এর একটা বিশেষ কারণও আছে আর তা হলো ইরিন ওর মেয়ে আর ওর জামাই আসবে।

রান্না শেষ হওয়ার আগ মুহুর্তে সাইদা খান মধুকে বলল,’তুই যা।গিয়ে গোসল করে নে।বাকিটা আমি দেখছি।’

‘না মা।তুমি যাও।গোসল করে নাও।আর অল্পই তো বাকি।আবার ওরাও চলে আসবে।’

‘আরে তোকে যেতে বলছি না!তুই যা না!আজ শুক্রবার ইয়াদ নামাজে যাবে।ওকে একটু ঠিকঠাক করে আতর দিয়ে দে।’

মধু মাংসটা নাড়তে নাড়তে বলল,’এহ!তোমার ছেলে মনে হয় ছোটো মানুষ।নিজেরটা নিজেই করতে পারবে।’

সাইদা খান হাসতে হাসতে বলল,’বিয়ের আগে ছেলেরা যা করতো সেগুলো সব ভুলে যায়।তোর শ্বশুরও তো…’

সাইদা খান কথা শেষ করতে না করতেই ইয়াফ খান গলা হাঁকিয়ে ডাক দিলেন।সাইদা খান স্বামীর গলা পেয়ে মধুকে একটু দেখতে বলে চলে গেলেন।শ্বাশুড়ি মা যাওয়ার পর মধুও মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলো।সাইদা খানের সাথে মধুর সম্পর্কটা এখন মা মেয়ের চেয়ে কম না।তবে এসব একদিনেই হয় নি।মধু শ্বাশুড়ির মন একটু একটু করে জয় করে নিয়েছে।এখন সবকিছুতেই শ্বাশুড়ি ছোটো বউকে খোঁজে।এইদিনগুলো যেনো স্বপ্নের মতো!

সাইদা খান কিছুক্ষণের মাঝেই আবার চলে এলো।এবার উনি আসতে না আসতেই মধুর ডাক পড়লো।ওপরের ঘর থেকে ইয়াদ ডাকছে।এমন অবস্থায় বউ শ্বাশুড়ি দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।তারপর মধু চলে গেলো।

ইয়াদ,ইয়াফ খান নামাজে গেলো।আরিয়ানও যেতো কিন্তু সে একটু আগেই ঘুমিয়েছে।যদি সজাগ থাকতো তাহলে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যেতো।ওরা নামাজে যাওয়ার পর বউ শ্বাশুড়ি রান্নার কাজ শেষ করে গোসল গেলো।
——————
খাওয়ার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে।ফাঁকে ফাকে মধু আর সাইদা খান সবাইকে সার্ভ করছে।আর ইরিন ওর মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছে।আরিয়ান এখনো ঘুম থেকেই ওঠে নি।আর এখন ঘুম থেকে উঠালে ও কেঁদে কেটে বাড়ি মাথা তুলবে।এটা ওর জন্মগত স্বভাব!তাই ও ঘুমালে কেউ ওকে ডাকে না।

খাওয়া শেষে ইরিন ওর মেয়ে আর স্বামী ওদের ঘরে গেলো বিশ্রাম নিতে। মধু আর সাইদা খান সবকিছু গুছিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।ঘরে এসে দেখলো আরিয়ান আর ইয়াদ খেলছে।মধু গিয়ে হাত বাড়াতেই খেলা ছেড়ে মায়ের কোলে চলে এলো।ইয়াদ আরিয়ানের গাল টেনে বলল,’যাও বাবা খেয়ে আসো।তারপর আবার খেলবো।’

মধু আরিয়ানকে খাওয়াতে নিয়ে গেলো।আরিয়ানকে খাইয়ে আবার ঘরে আসলো।তারপর ওকে ইয়াদের কোলে দিয়ে বলল,’তোমরা থাকো আমি একটু বনানী যাবো।’

‘আমরা আসি!’ইয়াদ অনুরোধ করলো।

‘আসবে?আচ্ছা আসো।’
মধু,ইয়াদ আর আরিয়ান বেরিয়ে গেলো।বনানী গোরস্তানের সামনে ইয়াদ গাড়ি থামালো।মধু আরিয়ানকে ইয়াদের কোলে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেট দিয়ে গোরস্তানের ভেতরে প্রবেশ করলো।পেছনে পেছনে ইয়াদ আর আরিয়ানও আসছে।মধু পেছনের সারির কোণার একটা কবরের সামনে গিয়ে দাড়ালো।কবরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।কবর কথা বলে না!প্রতিবারের মতো এবার মধু তার কান্না ধরে রাখতে অপারগ হলো।ঠোঁট কামড়ে ধরেও চোখের পানি আটকে রাখতে পারলো না।ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো।কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো।কান্না জড়ানো কন্ঠে অনেক কিছুই বলতে লাগলো।কিন্তু সেগুলো বোঝা যাচ্ছে না।ওর থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে আছে ইয়াদ।ওর চোখেও পানি।কিন্তু সেটা চোখের কোটরেই সীমাবদ্ধ!মধুর মতো কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে না।ছোট্ট আরিয়ান একবার বাবার দিকে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।তার মা বাবা কাদছে কেনো?

তবে কেউ না বুঝলেও ইয়াদ বোঝে মধুর কান্না মিশ্রিত শব্দ।মাঝেমধ্যে মনে হলেই ও ছুটে আসে এখানে।ইচ্ছেমতো কাঁদে এখন যেমন কাদছে!

ইয়াদের মনে পড়ে যায় দেড় বছর আগের এক রাতের কথা।ওইদিন রাত ১১ টার সময় ইয়াদ আর মধু দুজনেই শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।হঠাৎ মধুর ফোনে কল আসে।কলটা ছিলো আরিয়ার বরের।মধু চিন্তিত মুখে রিসিভ করতেই আরিয়ার বর কাপা কাপা গলায় বলল,’আপু আরিয়া হাসপাতালে।আপনি একটু আসবেন?ও বারবার আপনার নাম নিচ্ছে।’

মধু ঘাবড়ে গিয়ে জিগ্যেস করলো,’কি হয়েছে ভাইয়া?’

‘ওর আজকে ডেলিভারি।’

‘ওর ডেলিভারি ডেট তো আরো পরে ছিলো।’

‘হ্যাঁ আপু কিন্তু আজকেই লেবার পেইন ওঠে।আর আমরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে আসি।ডাক্তার বলেছেন এখনি সিজার করতে হবে।আপনি একটু আসুন না।’

‘আচ্ছা,আচ্ছা ভাইয়া আমি আসছি।আপনি সাহস রাখুন।ওর পাশে থাকুন।’

মধু ফোন রেখে ইয়াদকে সবটা বলল।ওরা আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লো।

অনার্স শেষ করেই আরিয়া বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করে ফেলে আর বিয়ের পরেই কন্সিভ করে।এই বাচ্চাটা নিয়ে অনেক উচ্ছ্বাস ছিলো আরিয়ার ও বারবার মধুকে বলতো।আমার প্রথম বাচ্চাটা আমি তোকে দিয়ে দেবো।মধুও হাসতো।

হাসপাতালে পৌঁছুতেই জানতে পারে ওকে ওটি তে নেওয়া হয়েছে।সবাই বাইরে বসে চিন্তিত মুখে অপেক্ষা করছে।আরিয়ার স্বামী শ্রাবণ চিন্তায় ছটফট করছিলো ইয়াদ ওকে ভরসা দিচ্ছিলো।অপারেশন শেষ হতেই ডাক্তার বেরিয়ে এলেন।সবাই মিলে তাকে ঘিরে ধরলো।ডাক্তার বললেন,’রোগীর কন্ডিশন ভালো না।আপনারা দেখা করে আসুন।আর বাচ্চা ভালো আছে।’

নার্স বাচ্চাকে শ্রাবণের হাতে তুলে দিলো।মধুর সেদিকে কোনো খেয়াল সে দ্রুত আরিয়ার কাছে চলে গেলো।আরিয়া ক্লান্ত চোখে মধুর দিকে তাকিয়ে বলল,’আমার প্রথম বাচ্চা তোকে দিবো বলেছিলাম মনে আছে?আমার বাচ্চাটা তোকে দিয়ে যাচ্ছি।ওর নাম আরিয়ান রাখবি!আজ থেকে ওর মা তুই।ওকে আগলে রাখিস।’

মধু আরিয়ার মুখে হাত দিয়ে বলল,’আর কিছু বলিস না।চুপ কর।’

আরিয়ার মধুর হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,’ আমায় বলতে দে বোন।আজই তো শেষবারের মতো কথা বলবো।’

মধু কাঁদতে কাঁদতে বলল,’তোর কিচ্ছু হবে না।শান্ত হ!’

আরিয়া কিছু বলতে নিলেই ওর শ্বাসকষ্ট উঠে যায়।পালস নিচে নামতে থাকে।এই অবস্থা দেখে মধু জোরে জোরে ইয়াদকে ডাকতে থাকে।মধুর গলা পেয়ে ইয়াদ,শ্রাবণ,আরিয়ার বাবা মা,শ্বশুর শ্বাশুড়ি সবাই এসেছেন।শ্রাবণ আরিয়ার কাছে যেতে আরিয়া ওর হাত শক্ত করে ধরলো।কিন্তু কিছু বলতে চেয়েও পারলো।প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।পরিবেশটা কান্না মুখর হয়ে গেলো।মধু ইয়াদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।শ্রাবণ কাঁদছে আরিয়ার গলা জড়িয়ে। সেই একটা রাত অনেক কিছু পাল্টে দেয়।কিছু পূর্ণতা অপূর্ণতার হিসেব লেখে।কিছু দিয়ে যায় কিছু নিয়ে যায়।তারপর আরিয়াকে বনানী কবর দেওয়া হয়।আর ওর কথা মতো ওর বাচ্চাটাকে শ্রাবণ মধুকে দিয়ে দেয় তবে ও এখনো বিয়ে করে নি।ছেলেটা বড্ড ভালোবাসে আরিয়াকে কিন্তু বাবা মায়ের জোরে একটা বিয়ে করতেই হবে।কয়দিন বাদেই ওর বিয়ে।বিয়েতে মধু ইয়াদও নিমন্ত্রণ পেয়েছে।

মাগরীবের আজানের পর মধু নিজের মায়ের সাথে কথা বলছে।আইরিন রহমান এখন নিজের বাবার বাড়ি আছে।কখনো মধুর কাছে থাকে আবার কখনো ভাইদের কাছে চলে যায়।আর মিলি স্কলারশিপ পেয়ে ডাক্তারি পড়াশোনার জন্য আমেরিকা চলে গেছে।
————–
কিছুদিন পরের কথা…
দিনকাল সবারই বেশ ভালোই যাচ্ছে।ইয়াদের সাথেও ইফাজের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে।ওরা কালই দেশে ফিরবে।তবে বেশিদিন থাকবে না।ওরা বছরে দুইবার আসে দেশে।
ওদের আসা নিয়ে বাড়ির সবার মধ্যেই উচ্ছ্বাস!ওদেরকে এয়ারপোর্টে নিতে যাবে ইয়াদ।

নির্দিষ্টি টাইমে ইয়াদ অপেক্ষা করছে ওদের জন্য।একটু পরেই ওদের দেখা গেলো।কাছাকাছি এসেই দুইভাই কোলাকুলি করলো।তারপর কুশল বিনিময় করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই ইফাজ দেখলো এয়ারপোর্টের বাইরে সারিবদ্ধ ভিক্ষুকদের দিকে।সারির মাঝে একজনকে চেনাচেনা লাগছে।ভালো করে তাকাতেই ইফাজ চিনে ফেললো।একটা বাঁকা হাসি দিয়ে ওদের এগিয়ে যেতে বলে ওই ভিক্ষুকটার মুখোমুখি এসে বসলো।ভিক্ষুকটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।পরনে একটা ছেড়া লুঙ্গি।গায়ে কাপড় নেই।সারা শরীর রোদে পোড়া আর মুখটা এসিডে!ইফাজ ওর কানে কানে বলল,’কেমন আছিস নিখিল?’

এই কথাটা কানে যেতেই নিখিল ছুটফট করে উঠলো।আবারও সেদিন রাতের মতো কাকুতি মিনতি করতে লাগলো।ইফাজ হাসলো।তারপর আবারও কানে কানে বলল,’না নিখিল তোর পাপের প্রায়শ্চিত্ত এখনো হয় নি।তোর গোটা জীবন দিয়ে তুই ভুগবি।কেউ আসবে না তোর কাছে! কেউ না!

এটা বলেই উঠে যেতে নিলেই কাটা হাত দিয়ে নিখিল ইফাজের পা চেপে ধরতে চাইলে কিন্তু পারলো না।ইফাজ চলে গেলো।আর নিখিল তার জায়গায় বসে মৃত্যু প্রার্থনা করতে লাগলো।

বাসায় আসার পর সর্বপ্রথম না চাইতেও মধুর দিকেই চোখ চলে গেলো ইফাজের।শুধু এক পলক দেখেই চোখ নামিয়ে ফেললো।আর মুচকি হেসে মনে মনে বলল

‘ডুবে ডুবে ভালোবাসি,তুমি না বাসলেও আমি বাসি।’

সমাপ্ত.

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।

লেখকের কিছু কথাঃ এই গল্পটা আমার প্রিয় গল্পটার মধ্যে একটি।এটার জন্য আমি অনেকের সাথে পরিচিত হয়েছে। অনেক পাঠকের ভালোবাসা পেয়েছি।আবার কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীনও হয়েছি।অনেকবার গল্পটা কপি হয়েছে।আমি বারবার বারণ করার পরও।যাক সেসব কথা।এবার পাঠকদের প্রশ্নের কিছু উত্তর দেই।#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি গল্পটার নাম মূলত ইফাজের জন্যই দেওয়া হয়েছে।সে মধুকে একতরফা ভালোবাসে।আর এক তরফা ভালোবাসার কোনো পরিণতি নেই।এটা প্রকাশও পায় না।সেই জন্য যারা বলছেন ইফাজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে তাদের বলছি যদি প্রকাশ করারই হতো তবে গল্পের নাম ডুবে ডুবে ভালোবাসি হতো না।তারপর আসি নিহার কাছে।অনেকে বলছেন ইফাজ নিহাকে ঠকিয়েছে তাদের বলছি গল্পটা আরেকবার পড়বেন ইফাজ কিন্তু নিহাকে বিয়ে বাড়িতে রেখে আসতে চেয়েছিলো ইভেন বিয়ের পরেও বলেছিলো চাইলে ডিভোর্স দিয়ে চলে যেতে পারে কিন্তু নিহা যায় নি।সে সেচ্ছায় থেকেছে।তাহলে ইফাজকেও পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না।তবে সে স্বামীর দায়িত্ব পুরোপুরি নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে।তারপর আরেকটা প্রশ্ন হলো নিখিল বোধহয় কিছু বলতে চেয়েছিলো।না ভাই ও কোনো রহস্যের কথা বলার জন্য সেদিন ছটফট করে নি।ওকে ইফাজ ওই অবস্থায় রেখে আসছিলো বলে ও যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো এবং বলতে চাইছিলো ওকে যেনো মাফ করে দেয় সাথে করে নিয়ে যায়।বুঝলেন?
আরেকটা কথা কেউ এই গল্পের সিজন ০২ চাইবেন না।প্লিজ!)

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৫৩+৫৪

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৫৩
#Arshi_Ayat

এখন মধু সম্পূর্ণ সুস্থ।দুইদিন আগে সেলাই কাটা হয়েছে।কিন্তু ঔষধগুলো আরো দুইমাস কন্টিনিউ করতে হবে।কাল থেকে ইয়াদের জোরাজোরিতে ভার্সিটিতে যেতে হচ্ছে,পড়াশোনা করতে হচ্ছে।সব কিছু ভালোই যাচ্ছে।সবাই মধুর প্রতি সহানুভূতিশীল কিন্তু শ্বাশুড়ি মা এখনো বোধহয় মন থেকে মেনে নিতে পারে নি।এটা নিয়ে খুব আফসোস মধুর!কবে যে শ্বাশুড়ি মা মুখ ফিরে চাইবে সেই আশায়ই আছে মধু!তবে একটা জিনিস ইদানীং মধু লক্ষ করছে সেটা হলো ইয়াদ আর ইফাজ দুজনের একজনও কারো সাথে কথা বলে না।এড়িয়ে যায়।কিন্তু কেনো?এটাই বুঝতে পারছে না মধু।ইয়াদকে কিছু জিগ্যেস করলেও কিছু বলে না।নিহাকেও জিগ্যেস করেছিলো সেও কিছু বলতে পারে না।

ক্যান্টিনে বসে মধু আর ওর ফ্রেন্ডরা হাসাহাসি করছিলো।আজকে আড্ডার বিষয় হলো ভার্সিটি থেকে একটা ট্যুর প্ল্যান হয়েছে যেখানে শুধু স্যারেরা আর তাদের ফ্যামিলি যাবে।কোনো স্টুডেন্ট যাবে না কিন্তু এই ট্যুরে মধুও যাবে কারণ ও স্টুডেন্ট হলেও ইয়াদের বউ।সবাই এটা নিয়েই হাসাহাসি করছিলো।সায়রা হাসতে হাসতেই মধুকে খোঁচা মারার উদ্দেশ্যে বলল,’ইশ!মধু তোর মতো আমরাও যদি একটা স্যার কে পটাইতে পারতাম।’

মধু কিছু বলার আগেই আরিয়া বলল,’সায়রা শোন তোকে আমি আগেও বলেছি ইয়াদ ভাই আর মধুর সম্পর্ক চার বছর ধরে।তখন ওরা দুইজন ই স্টুডেন্ট ছিলো।মধু কোনো স্যারকে পটিয়ে বিয়ে করে নি।’

সায়রা আমতা আমতা করতে করতে বলল,’ক্ষেপছিস কেনো তুই?আমি তো মজা করেই বললাম।’

‘মনে হলো না মজা করে বলছিস!কারণ দুইদিন থেকে দেখতেছি তুই ওকে খোঁচা মেরে কথা বলিস।তোর ভাগ্য ভালো ও তোকে এখনো কিছু বলে নাই।আমি হলে……’

শেষ কথাটা থ্রেড দিয়েই বলল আরিয়া।মধু দুজনকে থামাতে বলল,’ইশ!কি শুরু করছিস তোরা বাচ্চা পোলাপানের মতো।এই বিষয়ে কেউ আর একটা কথা বলবি না।আমরা এখানে আড্ডা দিতে বসছি।ঝগড়াঝাটি করতে বসি নাই।’

মধুর কথায় দুইজন আর ওই বিষয়ে কথা না বললেও ক্ষোভটা থেকেই গেছে।ক্লাস শেষ হওয়ার পর ভার্সিটির বাইরে মধু ইয়াদের জন্য দাড়ালো।আরিয়া চলে গেছে।ও অবশ্য চেয়েছিলো মধুর সাথে দাড়াতে কিন্তু মধুই জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে।পাছে মুখ ফসকে না আজকের ঘটনা বলে দেয়!

প্রায় পনেরো মিনিট পর ইয়াদ বেরিয়ে এসেছে।পাশাপাশি দাড়িয়ে দু’জনই টুকটাক কথা বলছিলো আর রিকশা খোঁজ করছিলো।কিন্তু রিকশা মিলছে না।আবার এদিকে হঠাৎ করেই আকাশ কালো মেঘেরা হানা দিতে শুরু করলো।একটু পরই হয়তো ঝরে পড়বে।প্রায় মাঝ দুপুরে একটুও ভেজার ইচ্ছে নেই ইয়াদের।এদিকে মধু খুব করে চাইছে রিকশা,বাস,অটো কিছু না পাওয়া যাক আর তাড়াতাড়ি শহরজুড়ে ভালোবাসার বৃষ্টি পড়ুক!বৃষ্টির দাপটে কেউ যাতে রাস্তায় না বের হয়।শুধু ওরাই রাস্তা ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাতে হাত রেখে হাটবে।

হ্যাঁ,মধুর কথাই সত্যি হলো।কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হলো।ইয়াদ বৃষ্টি পড়ছে দেখে মধুকে নিয়ে ভার্সিটির ভেতরে চলে এলো।মধু মনে মনে বিরক্ত হলো!দিনদিন বরটা কেমন যেনো নিরামিষ হয়ে যাচ্ছে।মধু বিরক্তি কন্ঠে বলল,’বাসায় যাবে না?’

‘বৃষ্টি থামছে না তো।এখন বের হলে ভিজে যাবো তো!’

মধু কিছু বলল না।গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইলো।আর এদিকে মধুর দিকে চেয়ে একটু মুচকি হাসলো।ইয়াদ প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলো এমুহূর্তে মধু কি চাইছে!কিন্তু সবসময় তো আবদার রাখ যায় না।এখন বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাত জ্বর আসবে।আর মধুর জ্বর আসা মানে ইয়াদের ঘাম ছুটে যাওয়া।অপারেশনের ১৫ দিন পর একবার হঠাৎ করেই জ্বর এসেছিলো তাও যেই সেই জ্বর না কাঁপুনি দিয়ে জ্বর ওঠে।জ্বরের জন্য কিছু খেতেও পারে না।রাতে ঘুমও আসে না।এদিকে ওর এই অবস্থা দেখে ইয়াদেরও ঘুম উড়ে গেছিলো।তখন থেকেই ইয়াদ ভয় পায়!তবুও ভেজা যেতো কিন্তু অপারেশনের পর যে ঔষধগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো এখনো খেতে হচ্ছে।এর ওপর যদি আবার জ্বর আসে তাহলে আবার এক্সট্রা জ্বরের ঔষধও খেতে হবে।এমনিতেই ওই ঔষধ গুলো খাওয়াতেই ইয়াদকে প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়!তাই আর বাড়তি ঝামেলা না বাড়ানোর জন্য মধুর আবদারে সায় দিলো না।এদিকে উনি তো গাল ফুলিয়ে রেখেছে।থাক!মাঝেমধ্যে গাল ফুলানো ভালো।দেখতে ভালো লাগে!

বৃষ্টি কমেছে।এখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে।ইয়াদ নিজের ব্লেজারটা খুলে মধুর মাথার ওপর দিয়ে বলল,’এটা মাথার ওপর ধরে রাখো।তাহলে মাথায় পানি পড়বে না।’

মধু কিছু বলল না।মুখটা গোমড়া করে ব্লেজারটা মাথার ওপর ধরলো।তারপর ওরা ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে দাড়ালো।এবার যদি একটা রিকশা অথবা বাস পাওয়া যায়।ভাগ্য ভালোই ছিলো বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হয় নি রিকশা না পেলেও বাস পাওয়া গেছে।ইয়াদ মধুকে নিয়ে বাসে উঠলো।বাসে অনেক মানুষ।খুব কষ্ট করে দাঁড়াতে হচ্ছে।ইয়াদ মধুকে একহাতে শক্ত ধরে আরেকহাতে বাসের ওপরের ঝুলানো হাতল ধরলো।মধুও ইয়াদের গলা জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে রইলো।পেছন থেকে খুব চাপ আসছে কিন্তু ইয়াদ শক্ত করে দাড়িয়ে রইলো যেনো মধুর গায়ে চাপ না পড়ে।মধু ইয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো!মানুষটা এমন কেনো!এতো ভালোবাসে কেনো?মধুর মনে পড়ে গেলো প্রথম দিনগুলোর কথা।মাঝেমধ্যে যখন ওরা বাসে উঠতো তখন ঠিক এভাবেই ইয়াদ ওকে আগলে রাখতো।এতো বছরেও একটুও পাল্টায় নি!উল্টো ভালোবাসা যেনো বাড়ছে।মধু মাঝেমধ্যেই ভাবে কোনো পূর্ণের কারণে যে এই মানুষটার সাথে ওর দেখা হয়েছিলো!
————-
ইফাজ চেম্বারে বসে একটা রিপোর্ট দেখছিলো খুব মনোযোগ দিয়ে হঠাৎ একটা কল আসতেই ওর মনোযোগ সরে যায়।রিপোর্টটা টেবিলে রেখে ফোনরে স্ক্রিনে চোখ দিলো।নিখিল ফোন করেছে।ইফাজ ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নিখিল বলল,’দোস্ত আজকেই ফিরলাম ট্রেনিং থেকে।তোর সাথে রাতে দেখা করবো।’

ইফাজের মুখে একটা রহস্যময়ী হাসি খেলে গেলো।বলল,’আচ্ছা।তুই ওই পুরোনো ফার্ম হাউসে চলে আসিস।’

‘আচ্ছা।’
সংক্ষিপ্ত আলাপে ওরা ফোন রাখলো।ফোন রাখার পর ইফাজের মুখে রহস্যের হাসিটা আবার দেখা গেলো।

মাগরিবের নামাজ পড়ে নিহা ফোনটা হাতে নিয়ে ইফাজকে ফোন দিলো।ইফাজ রিসিভ করতেই বলল,’আজকে আসবে কখন?’

‘আসতে দেরি হবে।একটা অপারেশন আছে।’

‘প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করো।আমার আজকে খুব খারাপ লাগছে।’

নিহার কথায় ইফাজ চিন্তিত হয়ে গেলো।মাত্র তো আটমাস চলে।ইফাজ বলল,’আচ্ছা ঠিকাছে আমি চলে আসবো।’

নিহার ফোন কেটে ইফাজ নিখিলকে ফোন করে আসতে মানা করলো।তারপর দ্রুতই ডিউটি শেষ করে বাসায় আসলো।নিহা চুপচাপ খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে।ইফাজ কাছে এসে বসলো।চিন্তিত গলায় বলল,’কেমন লাগছে নিহা?বেশি খারাপ লাগছে?’

নিহা ইফাজকে ভরসা দিয়ে বলল,’না একটু আগে অনেক বেশি খারাপ লাগছিলো কিন্তু এখন ঠিক আছি।তুমি প্লিজ আমার কাছেই থাকো।’

ইফাজ কোমল হেসে নিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’আমি আছি।তোমার কাছেই আছি।’

নিহা প্রসন্ন হাসলো।আসলে ভালোবাসার মানুষের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবহেলা যেমন কষ্ট দেয়,তেমনিই একটু ভালোবাসাও মনে শান্তি দেয়।

রাতের খাবার খাইয়ে ইফাজ নিহাকে শুইয়ে দিলো।আর নিজে সোফায় ল্যাপটপ নিয়ে বসলো।রুমে আলো নেই।তবুও নিহার ঘুম আসছে না।নিহা উঠে বসলো।ইফাজকে ডেকে বলল,’ইফাজ ঘুম আসছে না আমার।’

ইফাজ ল্যাপটপটা বন্ধ করে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে নিহার পাশে এসে বসলো।ওর সামনে আসা চুলগুলো পেছনে গুঁজে দিয়ে হালকা হেসে বলল,’আচ্ছা।আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। তুমি শোও।’

নিহা শুয়ে পড়লো।ইফাজ ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে একটা গান গাইতে শুরু করলো।বলা এটা প্রিয় একটা গান ওর।কিভাবে প্রিয় হলো এটা ও নিজেও জানে না।হঠাৎ করেই হয়ে গেলো।

“তুমি না ডাকলে আসবো না
কাছে না এসে ভালোবাসবো না
দুরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
নাকি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়?

দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরনো,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।।”

গান শুনতে শুনতেই নিহা ঘুমিয়ে পড়লো।নিহা ঘুমিয়ে পড়ার আরো কিছুক্ষণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো ইফাজ।তারপর হাতঘড়ি দেখলো।মাত্র ১১ টা বাজে।নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে নিখিলকে কল দিয়ে আবার আসতে বলল।ওরা রাত বারোটায় দেখা করবে।ইফাজ একটা ব্যাগে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নিলো যেগুলো আজ রাতে কাজে আসবে।রিভলবারটাও নিয়ে নিলো এবং চুপিসারে নিজের গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।নিখিলের আগে পৌঁছাতে হবে!

খুব দ্রুত ড্রাইভ করে নিখিলের আগেই পৌঁছেছে ইফাজ।সব প্ল্যান মতো সেটও করে ফেললো।এবার শুধু নিখিল আসার পালা।আধঘন্টা পর নিখিলও চলে এসেছে।নিখিলকে দেখে ইফাজ কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল,’আরে বন্ধু আয়।’

নিখিল ঘরে ঢুকতেই ইফাজ আচমকাই ওর মুখে ক্লোরফোম স্প্রে করলো।নিখিল সাথে সাথেই জ্ঞান হারালো।তারপর ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে ফেললো ইফাজ।এখন ঘন্টাদুয়েক অপেক্ষা করতে হবে জ্ঞান ফেরার জন্য।

ঘন্টাদুয়েক পর যখন নিখিলের জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলো ও একটা চেয়ারে বাধা সামনে ইফাজ পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে আর কফিতে চুমুক দিচ্ছে।বাসা থেকেই বানিয়ে নিয়ে এসেছিলো।ফ্লাস্কে ছিলো বলে ঠান্ডা হয় নি।নিখিল বিস্ময়ে বলল,’এসব কি ইফাজ?আমাকে বেঁধে রেখেছিস কেনো?’

নিখিলের কথা শুনে ইফাজ অট্টহাসি দিলো।সাধারণ এভাবে ইফাজ হাসে না।ওর হাসির শব্দ হয় না কখনো।কিন্তু আজকের হাসি ভিন্ন!ইফাজ হুট করেই হাসিটা থামিয়ে মুখটা গম্ভীর করে বলল,’কফি খাবি?এখনো গরম আছে।আসার সময় বানিয়ে এনেছিলাম।’

নিখিল বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,’এসব কি ইফাজ!আমি কি জিগ্যেস করছি আর তুই কি বলছিস?এভাবে বেঁধে রেখেছিস কেনো আমাকে?’

ইফাজ নিজের চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে নিখিলের পেছনে গিয়ে দাড়ালো।কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বলল,’আচ্ছা নিখিল!ধর,আজই যদি তোর জীবনের শেষ রাত হয় তাহলে কেমন হবে বল তো?’

নিখিল কিছুটা ঘাবড়ে গেলো।ঢোক গিলে বলল,’কি বলছিস তুই ইফাজ?’

‘তুই যা শুনেছিস তাই বলেছি।’

‘হেয়ালি ভালো লাগছে না ইফাজ।’নিখিল রেগে বলল।

ইফাজ আবারও হাসলো।বলল,’আচ্ছা যা খেলা শুরু করি।’

ইফাজ নিজের ফোন থেকে একটা ভয়সে রেকর্ড অন করলো।ভয়েস রেকর্ডটা শুনেই নিখিলের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেলো।এই ভয়েস রেকর্ডটা ওই চারটা ছেলের যারা মধুকে রেপ করেছিলো।ওদের কিছুদিন আগেই ইফাজের লোকেরা ধরে ফেলেছিলো।আর ওদের যখন জিজ্ঞেসাবাদ করা হয়েছিলো তখন সবাই নিখিলের কথা বলেছে।নিখিলের নির্দেশেই ওরা মধুকে তুলে এনেছিলো।সেদিন নাকি নিখিলও নাকি রেপ করেছিলো।ওরা সবাই মধুকে মেরেই ফেলতো যদি না মধু সেদিন সকালে পালাতো।এরপরেও মারতে চেয়েছিলো কিন্তু পারে নি।ওইদিন সব জানার পর ইফাজের মন চেয়েছিলো ওইমুহুর্তেই নিখিলের চরম মৃত্যু দিতে কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করেছিলো তবে ওই চারজনকে ইফাজ জীবিত ছাড়ে নি ওদের সাথে তেমনই করা হয়েছে যেমনটা ওদের প্রাপ্য!

চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৫৪
#Arshi_Ayat

ভয়ে নিখিলের মুখ এইটুকু হয়ে গেছে।কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে।চোখ নিচের দিকে স্থির!মুখে কথা নেই।অবশ্য অপরাধ ধরা পড়ে যাওয়ার পর অপরাধীর মুখে আর কোনো কথাই থাকে না।ইফাজ নিজের চেয়ারে বসে শান্ত গলায় বলল,’কেনো এমন করলি নিখিল?’

নিখিল ভয়ে ভয়ে ইফাজের দিকে তাকালো।ইফাজের দৃষ্টিতে ক্রোধ!নিখিল ঢোক গিললো।কিন্তু কিছুই বলল না।ইফাজ আবার বলল,’মধুর সাথে কি শত্রুতা ছিলো তোর?কেনো এমন করলি?কেনো এতোদিন এই নোংরা খেলাটা আমার সাথে খেললি?

নিখিল তারপরও কিছু বলল না।চুপ করে রইলো।এবার ইফাজ রেগে ওর গলা চেপে ধরলো।ইফাজের চোখেমুখে হিংস্রতা!দাঁত কটমট করে বলল,’জবাব দে আমার।চুপ করে থাকবি না।’

নিখিলের চোখ উল্টে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।হাত বেধে রাখায় বাধাও দিতে পারছে না।আধ সেকেন্ড ধরে রাখার পর নিখিল অতিকষ্টে বলল,’ব বলছি।’

নিখিলের কথা শুনে ইফাজ ছেড়ে দিলো।ইফাজ ওর গলা ছাড়তেই নিখিল কাশতে লাগলো।আসলে গলার মধ্যে চাপটা অনেক জোরে লেগেছে।কাশি থামলে নিখিল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’তোর সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই।আমার নেক্রোফিলিয়া আছে।মৃত মেয়েদের শরীরের প্রতি আমার আকর্ষণ!কিন্তু মধুকে আমার জীবিত,মৃত দুই অবস্থাতেই চাই।ওর মতো শরীরের অধিকারী আমি আর কাউকে দেখি নি।ওকে দেখলেই কামনা….

নিখিল নিজের কথা শেষ করতে পারলো না।আবারও ইফাজ ওর গলা চেপে ধরে বলল,’কুত্তার বাচ্চা তোকে আমি মেরে ফেলবো।’
বহুকষ্টে ইফাজ নিজেকে কন্ট্রোল করলো।নিখিলের গলা ছেড়ে দিলো।নিখিল আবার কাশছে।তারপর কাশি থামতেই বলল,’আমি মধুকে অনেক আগে থেকেই চিনি।ওকে আমি কাছে পেতে চাইতাম।প্রেম করে কাছে পাওয়ার চেয়ে আমি সরাসরি পেতে চাইতাম।শুধু একরাত তার পরেই আমি ওকে মেরে ফেলবো এবং ওর সাথে থাকবো।লাশ পঁচে যাওয়া পর্যন্ত।এমন অনেক মেয়ের সাথেই আমি করেছি।মাঝেমধ্যে মর্গেও যেতাম।মর্গের দারোয়ানরা আমার লোক ছিলো তাই সমস্যা হয় নি।অনেকদিন একই লাশের সাথে আর ভাল্লাগছিলো না তাই নতুন কাউকে প্রয়োজন ছিলো আমার।তো হঠাৎ একদিন আমি মধুকে দেখতে পাই দেখেই ভালো লেগেছিলো।তারপর অনেকদিন ফলো করছি ওকে।রাতের বেলা মাঝেমধ্যে ওর বাড়িতেও উকি দিতাম।এর কিছুদিন পরই লক্ষ করলাম তোর ছোটোভাই এর সাথে ওর মেলামেশা।বুঝতে পারছিলাম ওদের মধ্যে সম্পর্ক আছে।তখন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছিলো।ওকে অনেকভাবে কিডন্যাপ করতে চাইছিলাম কিন্তু পারি নাই।কোনো না কোনো ভাবে ও বেঁচেই যায়।আমি বুঝলাম যে এভাবে সম্ভব না।তাই ওদের বাড়ির একটা মেয়ের সাথে রিলেশন করি।মেয়েটার নাম নিশি।রিলেশন চলাকালীন মেয়েটার সাথে আমার কয়েকবার শারীরিক সম্পর্ক হয়।ওর অগোচরেই আমি ওগুলোর ভিডিও করি।পরে ওকে ওই ভিডিওগুলো দেখিয়ে ব্ল্যাক মেইল করি যেনো ও মধুকে কিডন্যাপ করতে সাহায্য করে।ভিডিও ছেড়ে দেওয়ার ভয়ে নিশি রাজি হয় করতে।ওকে দিয়ে মধুকে কিডন্যাপ করাই।কিন্তু তুই ওইখানে তাড়াতাড়িই পৌঁছে যাস তাই আমার প্ল্যানটা বাতিল হয়ে যায়।ওই যাত্রায় তুই মধুকে বাচিয়ে ফেললি।পরে যখন আমার কাছে এসে সব বললি।তখন আমি তোর বিশ্বাস রাখার জন্য ওই ভাড়াটে গুন্ডাগুলো কে ধরে আনি।ওরা আমাকে চেনে না ওরা নিশিকে চেনে তাই তোকে নিশির নাম বলেছে।কিন্তু এখন তুই যদি নিশির কাছে যাস তাহলে আমার ধরা পড়ার সম্ভবনা আছে।তাই আমি ওই রাতে নিশিদের বাসায় যাই।এটা নিশি ছাড়া আর কেউ জানে না।’

একটানা এই পর্যন্ত বলে নিখিল থামলো।ইফাজ ওকে একটু সময় দিলো।দুইমিনিট চুপ থেকে নিখিল আবার বলতে শুরু করলো,’তারপর ওকে আবার ব্ল্যাক মেইল করি।এবার ওকে নিজের গলায় ফাস দিতে বলি যেনো না মনে নাহয় এটা মার্ডার।নিশি অনেক কান্নাকাটি করেছিলো কিন্তু আমি ওর কান্নায় কর্ণপাত করি নি।ফলশ্রুতিতে নিশি নিজের গলায় নিজেই ফাস দিলো।ওর মৃত্যু নিশ্চিত করে তারপর আমি চলে গিয়েছিলাম সেখান থেকে।ওইদিন রাতেই তুই আমাকে নিশির নাম্বার টেক্সট করেছিলি ওকে খোঁজার জন্য।আমি দুইদিন খোঁজার নাটক করে পরে তোকে জানিয়েছিলাম যে নিশি মারা গেছে।এরপর সন্দেহজনক কিছু ঘটে নি।এর মধ্যেই মধুকে কিডন্যাপ করতে না পেরে আমার চোখ অন্য মেয়ে তে পড়েছিলো।এরপর ওদের সাথেও তাই করেছি।এভাবেই চলছিলো কিন্তু হঠাৎ করে একদিন মধুকে আবার রাস্তায় দেখি আমার আবার মাথা খারাপ হয়ে যায়।দুই তিন দিন ওকে ফলো করি।টার্গেটে রাখি ও কখন কোথায় যায়।এরপর একদিন সন্ধ্যায় আমার লোক দিয়ে ওকে তুলে আনি।ওর জ্ঞান ফেরার আগেই ওকে আমি কয়েকবার রেপ করি।তারপর ওকে মেরে ফেলতে চাইছিলাম কিন্তু পরে আর আমার লোকদের জন্য মারি নাই।সারারাত ওরাই রেপ করছে।আমি ছিলাম না।ওদের বলে গেছিলাম ভোর হওয়ার আগে মধুকে মেরে ফেলতে।কিন্তু ওরা মদ খেয়ে টাল হয়ে গেছিলো তাই সকালে মধু পালাতে পেরেছে।এরপর মধুর পালানোর কথা শুনে আমি ভয় পেয়েছিলাম।যদি ওর কারো চেহারা মনে থাকে তাহলে তো ধরে ফেলা যাবে তাই ওকে মারতে চেয়েছিলাম কিন্তু জানতে পারি ও পরিবার সহ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে কোথায় গেছে কোনো হদিশ নেই।আমি কিছুটা চিন্তা মুক্ত হলাম।তারপর তিন/চার মাস চিন্তা মুক্তই ছিলাম কিন্তু হঠাৎ একদিন তুই ফোন দিয়ে বললি মধুর লোকেশন ট্রেস করতে।মধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া আছে।ওই খবর শোনার পর প্রচুর চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।মনে মনে বারবার আসছিলো ওর কারো চেহারা মনে আছে কি না!তারপর তুই আমাকে ডেকেছিস রাতে।আমি ভয়েই ছিলাম কিন্তু যখন ইয়াদ বলেছিলো মধুর কারো চেহারা মনে নেই তখন কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়েছিলাম।কিন্তু যখন বলল একটা বন্ধ ফোন আছে মধুর কাছে তখন চিন্তা যাওয়ার বদলে আবার এসেছে।তাই তোদের বলেছিলাম ফোনটা তাড়াতাড়ি আমাকে দিতে।কিন্তু কপাল খারাপ আমার।পরেরদিনই জরুরি ভিত্তিতে ট্রেনিং এর জন্য চলে যেতে হয়েছিলো।আমি ভেবেছিলাম আমাকে ছাড়া তুই কিছুই করবি না।কিন্তু…..’

‘কিন্তু’ শব্দের পর আর কিছুই উচ্চারণ করতে দিলো না নিখিল তার আগেই ইফাজ বলল,’কিন্তু তোর ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দিলাম তাই তো?আসলে তুই ট্রেনিং এ যাওয়ার পর আমার মনে হয়েছিলো এটা নিয়ে বসে থাকা উচিত না।তাই ওই ফোনটা ওপেন করে ওই চারজনের মধ্যে একজনকে ধরলাম।তারপর বাকিগুলো একে একে ধরলাম।জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলাম কিন্তু প্রথমে মুখ খোলাতে পারি নি।তারপর আমার হিংস্রতা দেখে তোর কথা বলেছিলো সবাই।এছাড়াও ওই ফোনটায় আমি তোর নাম্বারও পেয়েছিলাম।আর কেনো জানি মনে হয়েছিলো এরা সাথে তুইও কোনো না কোনো ভাবে জড়িত।ওদের জবানবন্দিতে বুঝলাম এসবের মাস্টার মাইন্ড তুই।জানিস তোকে তখনই পুঁতে ফেলতে ইচ্ছে করেছিলো কিন্তু আমি কোনো কাজই তাড়াহুড়ায় করি না যেমন আজকেও করবো না।আমি কিন্তু চাইলেই তোকে এখনই শ্যুট করতে পারি কিন্তু তুই তো কোনো কষ্ট পাবি না।এতো মেয়েকে কষ্ট দেওয়ার পরেও তোকে এতো সহজে কিভাবে মৃত্যু দেই বল?তোকে আমি মরণ দেবো না।বাঁচিয়ে রাখবো।তুই মরতে চাইবি কিন্তু পারবি না।

কোথা থেকে যেনো ইফাজের মধ্যে ভয়ংকর হিংস্রতা ভর করলো।নিজের ব্যাগ থেকে এসিড বের নিখিলের মুখমন্ডলে মেরে দিলো।নিখিল চিল্লাতে চাইলেও পারলো না মুখ বাঁধা বলে তবে প্রাণপণে গোঙাচ্ছিলো।কিন্তু সেসব ইফাজের কর্ণ কুহরে পৌঁছালো না।ইফাজ ওর দুটো চোখ উপড়ে ফেললো।ধারলো চাকু দিয়ে জিহ্বা কেটে দিলো।তারপর হাত পায়ের আঙুলগুলো কেটে দিলো।সর্বশেষে পুরুষাঙ্গও কেটে ফেললো।এরপর আবার নিজেই কাটা জায়গা গুলো সুন্দর করে ব্যান্ডেজ করে দিলো।কারণ এখান থেকে রক্ত পড়লে ওর মরে যাওয়ার সম্ভবনা আছে কিন্তু এতো সহজে মরলে তো হবে না!ওকে অনেক কষ্ট পেতে হবে।যেনো মৃত্যু চেয়েও না পায়।

তারপর মাঝরাতে নিজের গাড়ি করে ওকে স্টেশন নামিয়ে দিয়ে গেলো।নিখিল বারবার কিছু বলতে চাইছে কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।অবশ্য যাবেও না।ও যতোই চিল্লাক কিছুই বোঝা যাবে না।ইফাজ নিখিলকে স্টশনের একটা কোনায় বসিয়ে দিলো।ওকে দেখে কারো চেনার সাধ্য নেই একমাত্র ইফাজ ছাড়া। যাওয়ার সময় ইফাজ কানেকানে বলল,’ইনজয় ইউর নিউ লাইফ।’

পেছন থেকে নিখিল বহুবার কিছু বলতে চেয়ে বলতে পারে নি।
—————-
এরপর প্রায় ৩ বছর পরের কথা….
‘মাম্মাম,বাবা কখন আসবে?’নিহান মায়ের কোলে শুয়ে জিগ্যেস করলো।

নিহা হাসিমুখে বলল,’তোমার বাবা একটু পরই আসবে।’

‘বাবা আসলে আমার খেলবো।’

‘আচ্ছা বাবা।’
ইফাজ নিহা দম্পতির একমাত্র সন্তান নিহান।দুজনেরই চোখের মণি।তবে সে মায়ের থেকে বেশি বাবা ভক্ত।বাবা বলতেই পাগল।এমনিতে সে মা ছাড়া একদন্ডও চলতে পারে না।সবাই বলে ছেলেরা মায়ের নেওটা হয়।কিন্তু এদিকে উল্টো।নিহান বাপের নেওটা।এতে অবশ্য নিহার অভিযোগ নেই।সে ব্যাপারটায় মজা পায়।তবে আরেকটা খুশীর খবর হলো নিহা আবার মা হবে।প্রথম বারের মতো ইফাজ এবারও একজন আদর্শ স্বামী ও বাবার দায়িত্ব পালন করছে।
নিহান জন্মানোর পর ইফাজ নিহা আর নিহানকে নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমায়।এখন আর সে স্বামী নেই একজন বাবাও।ইফাজের মনে হয় অনেক তো হলো এবার নাহয় নিজের ভবিষ্যতের দিকে তাকাই।সেই চিন্তা করেই ইফাজ লন্ডন চলে এসেছে তবে এই কারণটা কাউকেই বলে নি এটা এখনো অজানা সবাই জানে ইফাজ পি এইচ ডির জন্য লন্ডন গেছে।শেষ হলেই চলে আসবে।তবে এতো কিছুর পরেও এখনো দিনের মধ্যাহ্নে বা কখনো রাতের শেষে তাকে খুব করে মনে পড়ে।

চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৫১+৫২

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৫১
#Arshi_Ayat

‘ডাক্তার ইফাজ এটা কিন্তু অনেক রিস্কি!’সিনিয়র সার্জন ডাক্তার সাইদ বললেন।

‘আমি জানি এটা রিস্ক।কিন্তু এছাড়া আর উপায়ও তো দেখছি না।’ও’ নেগেটিভ ব্লাডও পাওয়া যাচ্ছে না আবার পারফেক্ট কিডনি ম্যাচিংও হচ্ছে না।’ইফাজ চিন্তিত মুখে জবাব দিলো।

ইফাজের কথার জবাবে হাসপাতালের সবচেয়ে সিনিয়র সার্জন নিয়াজ বললেন,’না ইফাজ এই ঝুঁকিটা নেওয়া সম্ভব না।তোমার লাইফ রিস্ক আছে।তোমার আর পেশেন্টের রক্তের গ্রুপ সেম আবার তোমাদের কিডনিও ম্যাচ করে কিন্তু কিডনি প্রতিস্থাপন করতে তোমারও কিন্তু রক্তের প্রয়োজন সেক্ষেত্রে যদি তুমি পেশেন্টকে রক্ত দাও তাহলে তোমার লাইফ ৯৯% রিস্কে চলে যায়।বুঝতে পারছো ইফাজ?’

‘বুঝতে পারছি স্যার কিন্তু এই অবস্থায় কি করবো?’ও’ নেগেটিভ রক্তেরও তো জোগাড় হচ্ছে না।রক্তের জোগাড় হলে তো কোনো সমস্যাই হতো না।’ইফাজ কাতর গলায় বলল।

ইফাজের আরেক কলিগ বলল,’ও’নেগেটিভ রক্ত খুব রেয়ার!হাসপাতালে শুধু তোমার আর দারোয়ানের ‘ও’নেগেটিভ রক্ত আছে।তাও দারোয়ানের রক্তে হেপাটাইটিস বি আছে।’

কথাটা শুনেই ইফাজের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো।ইফাজ হুট করেই বলল,’আচ্ছা একটা প্ল্যান আছে আমার কাছে।’

ইফাজের কথা শুনে সবাই আগ্রহী হয়ে চাইলো ওর দিকে।ডাক্তার নিয়াজ বললেন,’কি প্ল্যান ইফাজ?’

‘স্যার ভাবছিলাম কি দারোয়ানের রক্ত যদি আমি নেই আর আমার রক্ত যদি পেশেন্টকে দেই তাহলে কিন্তু কোনো সমস্যা থাকছে না।আর হেপাটাইটিস বি এর ট্রিটমেন্ট তো করা যায়ই।’

ডাক্তার নিয়াজ ধমক দিয়ে বললেন,’ইফাজ তুমি কি পাগল হয়েছো?বুঝতে পারছো কি বলছো?হেপাটাইটিস একবার শরীরে ঢুকতে পারলে কি হবে সেটা তুমিও জানো।তাহলে এমন অবুঝের মতো কথা বলছো কেনো?’

‘স্যার কিন্তু….’
ইফাজের কথা শেষ করতে না দিয়েই ডাক্তার নিয়াজ বললেন,’কোনো কিন্তু না ইফাজ।আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো কিন্তু তোমাকে রিস্কে ফেলতে পারবো না।একজনকে মেরে আরেকজনকে বাঁচানোর কথা কোনো জায়গায়ই নেই।’
ডাক্তার নিয়াজের কথায় সবাই সায় দিলো।অতঃপর কোনো সিদ্ধান্তে না পৌঁছাতে পেরে মিটিং এখানেই সমাপ্ত হলো।

ইফাজ মধুর অপারেশন এর বিষয়ে কথা বলতে একটা ইমিডিয়েট মিটিং অ্যারেঞ্জ করেছিলো।যেখানে হাসপাতালের কয়েকজন সিনিয়র সার্জন থাকবেন।মিটিং শেষে ইফাজ একবার মধুর কেবিনে গেলো।মধু ঘুমিয়ে আছে।ওর পাশে আইরিন রহমান আর মিলি বসে আছে।সাইদা খান আর ইয়াফ খান একবার দেখে চলে গেছেন বাসায়।ইরিন গেছে নিহাদের বাসায়।নিহা নাকি আসবে।তাই ওকে আনতে গেছে।এদিকে ইয়াদ হন্যে হয়ে ছুটছে রক্ত আর কিডনির জন্য।বেশ কয়েকটা ব্লাড ব্যাঙ্কেও খোজ করা হয়েছে।কিন্তু রক্ত মিলছে না।মিললেও হয় রক্তে নিকোটিনের পরিমাণ বেশি নয়তো এইচআইভি অথবা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত!অবশ্য ভালো রক্ত খুব কমই পাওয়া যায় ব্লাড ব্যাঙ্কে।কারণ ওখানে যারা ব্লাড বিক্রি করে ওদের মধ্যে অনেকেই নেশার টাকা জোগাড় করার জন্যই বিক্রি করে।

ইফাজ মধুর পালস’টা আবার চেক করলো।খুব ধীর গতিতে চলছে!যেনো মনে হচ্ছে শুধু জানটাই আটকে আছে!সারা শরীর নিথর হয়ে আছে!অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল।কালকের মধ্যেই অপারেশন করতে হবে।কিন্তু সবকিছু থেমে আছে দু’টো জিনিসের জন্য।ইফাজ কিছুক্ষণ অনিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার না হওয়া প্রিয়তমার দিকে যাকে ধরা ছোয়া যাবে না শুধু দূর থেকে ভালোবাসা যাবে।তবুও এতোদিন তো দূর থেকে ভালোবেসেই তো ভালো ছিলো সে কিন্তু নিয়তি যদি পৈচাশিক কোনো খেলায় মেতে উঠে!যদি ছিনিয়ে নেয়!তাহলে?আর ভাবতে পারলো না ইফাজ।চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরার আগেই মুছে বেরিয়ে গেলো।কিন্তু দরজার সামনে আসতেই নিহা আর ইরিনের মুখোমুখি হলো।নিহা উদ্বিগ্ন গলায় বলল,’কি অবস্থা ওর?’

‘ভালো না।ঘুমিয়ে আছে।কালকের মধ্যেই অপারেশন লাগবে।’

‘আমি একটু দেখে আসি?’নিহা অনুমতি চাইলো।’

‘যাও।’
অনুমতি পেতেই নিহা আর ইরিন কেবিনে গেলো আর ইফাজ ল্যাবে গেলো নতুন কয়েকজনের রক্তের রিপোর্ট দেখতে।
—————–
রাত ১০ টা…
ইয়াদ হাসপাতালে ফিরেছে।খুব ক্লান্ত লাগছে।অনেক জায়গায় ঘুরেছে কিন্তু আশানুরূপ কিছু পাওয়া যায় নি।হাসপাতালে ফিরে ভাইয়ের চেম্বারে গিয়ে বসলো।ইফাজ চিন্তিত মুখে বলল,’কি রে রক্তের কি খবর?’

ইয়াদ হতাশ গলায় বলল,’হয় নি।’

ইফাজ ভরসা দিয়ে বলল,’চিন্তা করিস না।কালকের মধ্যেই কিছু একটা হবে।কিচ্ছু হবে না মধুর।’

ইয়াদ মাথা নাড়লো।কিন্তু কথা বলল না।কি বলবে?কষ্টে মুখ দিয়ে কথাও বের হচ্ছে না।এতো কঠিন পরীক্ষা কি না দিলে হতো না?

ভাইয়ের চেম্বার থেকে বেরিয়ে ইয়াদ মধুর কেবিনে চলে এলো।কেবিনে এখন কেউ নেই আইরিন রহমান আর মিলিকে ইফাজ বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন জোর করে আর ইরিনও নিহাকে নিয়ে বাসায় চলে গেলো।তবে ইয়াদ,ইফাজ কেউই যাবে না।

সন্তপর্ণে বেডের কাছ থেকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলো ইয়াদ।পরম আদরে প্রিয়তমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।কয়েকদিনেই চেহারাটা শুকিয়ে গেছে!মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে।মধু আস্তে আস্তে চোখ খুললো।ইয়াদকে দেখে অক্সিজেন মাস্কটাও খুললো।তারপর ও হাতটা ধরে বলল,’ইয়াদ কি হয়েছে আমার?’

মধুর প্রশ্নটা শুনে এমুহূর্তে মন চাচ্ছে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে।কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে কষ্ট করে একটু হেসে বলল,’কিচ্ছু হয় নি তো!একটু শরীর দুর্বল তোমার।ঠিক হয়ে যাবে।’

মধু মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বলল,’যদি সত্যিই তোমার কথাই সত্যি হতো!’এটা ভেবেই মধু দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো।মধু আগেই জানতো!কিন্তু ইয়াদকে বলে নি।ওই বাড়ির প্রতি একটা অভিমান জমে গিয়েছিলো ওর!

তারপর কথা ঘুরিয়ে বলল,’খেয়েছো তুমি?’

‘না।’

‘যাও খেয়ে আসো।’

‘না মধু আজ খেতে ভালো লাগছে না।’

মধু কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’না খেলে কিন্তু আমি ভালো হবো না,তোমার সাথে কথাও বলবো না।’

মধুর এই বাচ্চামি কথাগুলো শুনে ইয়াদ মলিন হাসলো।এখন সুস্থ থাকলে সময়টা অন্যরকম হতে পারতো!মধুর কথা রাখতেই ইয়াদ খাবার আনতে বাইরে গেলো।এমনিতে গলা দিয়ে নামবে না খাবার কিন্তু এখন মধুর জন্য কিছু হলেও খেতে হবে।

খেয়ে এসে দেখলো মধু ঘুমিয়ে গেছে।ইয়াদ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ওর দিকে।তারপর বেডের পাশের চেয়ারে বসে ঘুমন্ত মধুর হাতটা শক্ত করে ধরে বসে রইলো।একটা সময় ইয়াদের ঘুম চলে আসলে সেও ঘুমিয়ে গেলো।
————-
একজন নার্সের ডাকে ইয়াদের ঘুম ভেঙে গেলো।ইয়াদ ঘুম থেকে উঠে বসলো।মধুর এখনো ঘুম ভাঙেনি।ইয়াদ নার্সকে স্যালাইন লাগানোর সুযোগ করে দিয়ে বাইরে চলে গেলো।চেম্বারে আসতেই দেখলো ইফাজ কি একটা রিপোর্ট খুব গুরুত্ব নিয়ে দেখছে।ইয়াদকে দেখে সহাস্যে বলল,’খুব ভালো খবর আছে ইয়াদ।চারজন ভলেন্টিয়ার পাওয়া গেছে।ওনাদের ব্লাড গ্রুপ ‘ও’ নেগেটিভ।ওনারা রক্ত দিবেন বলেছেন।’

‘রক্তের জোগাড় তো হয়েছে।কিন্তু কিডনি?’

‘কিডনির ব্যবস্থাও হয়েছে।একজন দিবে বলেছে।তবে নাম পরিচয় অজ্ঞাত রেখেছে।’

‘কিন্তু ওনার কিডনিতে যদি কোনো সমস্যা থাকে।’

‘আমরা চেকআপ করেছি।উনি সম্পূর্ণ সুস্থ।’

‘আচ্ছা তাহলে অপারেশন কবে হবে?’

‘আজ দুপুরেই কিন্তু আমি থাকতে পারবো না রে।’

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো,’কেনো ভাইয়া?’

‘আমাকে ইমিডিয়েট লন্ডন যেতে হবে।কল এসেছে।আজ দুপুরেই ফ্লাইট।’

ইয়াদ কাতর স্বরে বলল,’প্লিজ। ভাইয়া প্লিজ।এই সময়টা তোমাকে আমাদের খুব প্রয়োজন।যেও না প্লিজ।’

‘আমি জানি কিন্তু সম্ভব না ইয়াদ।তবে আমি সবকিছুর অ্যারেঞ্জ করেছি।মধুর অপারেশন অনেক সিনিয়র সার্জন করবেন।ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই।’ইফাজ ইয়াদের কাঁধে ভরসার হাত রেখে বলল।

‘কে অপারেশন করছে আমি জানি না।কিন্তু তোমাকে থাকতেই হবে ভাইয়া।’

‘না রে। আমি পারবো না।’
এতোবার অনুরোধ করার পরেও ইফাজের বারবার ‘না’ করার কারণে ইয়াদের প্রচন্ড মেজাজ গরম হয়ে গেলো।ও রেগে বলল,’কেমন ভাই তুমি?যে ভাইয়ের বিপদে পাশে থাকতে পারবে না?যদি আজকে তুমি না থাকো তাহলে তুমি আমার ভাই না।’

এটা বলেই ইয়াদ চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলো।ইয়াদের যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো ইফাজ।মনে মনে বলল,’আমার কিচ্ছু করার নেই রে।সত্যিই কিচ্ছু করার নেই।’

আসলে কিডনিটা ইফাজই দিবে।তবে নাম পরিচয় গোপন রেখে।এইজন্যই এই মিথ্যাটা বলতে হলো।যদি সরাসরি দিতো তাহলে নিহা মানতে পারতো না।আবার সবাই জেনে যেতো যা ইফাজ চায় না।ও চায় ওর ভালোবাসার কথা কেউ না জানুক।ডুবে ডুবেই ভালোবাসতে চায় সারাজীবন।

সবকিছু রেডি হচ্ছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই মধুকে ওটিতে নেওয়া হবে।এদিকে ইফাজও ফ্লাইটের জন্য বেরিয়ে গেছে।ওর সাথে নিহা আসতে চেয়েছিলো কিন্তু ইফাজ মানা করে কারণ আসলেই ধরা পড়ে যাবে।যাওয়ার সময় সবাই টুকটাক কথা বলেও ইয়াদ একটা কথাও বলে নি।ইফাজও কিছু বলে নি।

মধুর সাথে একে একে সবাই দেখা করছে।আরিয়াও এসেছে।কাল ওকে কেউই খবর দেয় নি।পরে ইয়াদকে ফোন করে জানতে পেরে ছুটে চলে এসেছিলো।সবাই দেখা করলেও সাইদা খান দেখা করেন নি।সবার সাথে দেখা হওয়ার পর ইয়াদ গেলো কেবিনে।কেউ নেই এখন।শুধু ওর দু’জন।দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক।ইয়াদ মধুর হাতটা ধরে বলল,’আমি আছি মধু।একদম ভয় পাবে না।তোমার কিচ্ছু হবে না।সাহস রাখো।তোমাকে ফিরতেই হবে।তুমি ফিরলে ওই কথাটা বলবো।’

‘কোন কথাটা?’মধু ধীর কন্ঠে জিগ্যেস করলো।

‘যেটা তুমি বারবার শুনতে চেয়েছিলে কিন্তু আমি বলি নি।’

মধু মলিন হাসলো।ইয়াদ আবার বলল,’ফিরবে তো?’

‘ফিরবো।’মৃদু হেসে দৃঢ় কন্ঠে বলল।

একটু পরই মধুকে ওটিতে নেওয়া হলো।পাশাপাশি দু’টি বেড।একটিতে মধু,আরেকটিতে ইফাজ!

চলবে…

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৫২
#Arshi_Ayat

মধুকে এনেস্থিসিয়া দিয়া অজ্ঞান করা হয়েছে।তারপর ইফাজকে এনেস্থিসিয়া দেওয়া হয়েছে।জ্ঞান হারানোর পূর্বে একবার নিজের পুরো পরিবার আর মধুর কথা মনে করলো তারপর কালেমা পড়তে পড়তে জ্ঞান হারালো।

ভেতরে অপারেশন চলছে আর বাইরে ইয়াদ কখনো চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে তো কখনো সাইডে পাতানো বেঞ্চে বসছে।ওর অস্থিরতা চোখে পড়ার মতো।সবাই বুঝতে পারছে ভেতরে ভেতরে কি চলছে ওর।মধুর মা আর বোনও হাসপাতালের বাইরে বসে আছে।ইরিন একটু আগে বাসায় গেছে আবার আসবে।নিহাকে নিয়ে সাইদা খান আর ইয়াফ খান বাসায় চলে গেছেন।

প্রায় তিনঘণ্টা পর ডাক্তার নিয়াজ অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হলেন।উনি বের হওয়ার সাথে সাথেই ওনাকে দ্রুত ঘিরে ধরলো ইয়াদ।উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,’ডাক্তার অপারেশন কেমন হয়েছে?সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?’

ডাক্তার নিয়াজ আস্বস্ত করে বললেন,’অপারেশন সাকসেসফুল মিস্টার ইয়াদ।কিন্তু ২৪ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরলে বোঝা যাবে বাকিটা।চিন্তা করবেন না।ওনার জন্য দোয়া করুন।’

‘ওকে একবার দেখে আসা যাবে?’ইয়াদের কন্ঠে অনুরোধ।

‘এখন না।জ্ঞান ফেরার পর আমরা বেডে শিফট করার পর দেখতে পারবেন।’

এগুলো বলেই ডাক্তার নিয়াজ চলে গেলেন।এদিকে অপারেশন এখানে হলেও সবার আড়ালে ইফাজকে অন্য হাসপাতালের আইসিইউতে হস্তান্তর করা হয়েছে।অবশ্য সব ইফাজের ইচ্ছাতেই হয়েছে।
———-
মধুর জ্ঞান ফিরেছে ১২ ঘন্টা পর।ওকে এখন বেডে দেওয়া হয়েছে।সবার আগে ইয়াদ গেলো দেখা করতে।মধুর মুখে অক্সিজেন মাস্ক।ও খুলতে চাইলে ইয়াদ বাঁধা দিয়ে বলল,’কথা বলো না।জমিয়ে রাখো।একটা সুন্দর পূর্ণিমায় আমার কাঁধে মাথা রেখে বলবে।আমি সেদিন তোমার প্রেমিক স্বামী হয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনবো।কিন্তু এখন না!সুস্থ হয়ে নাও তারপর।’

আরো কিছুক্ষণ মধুর সাথে কথা বলে ইয়াদ বের হয়ে আসলো।এরপর একে একে ওর মা,বোন,ইরিন গেলেন।সবার শেষে ইয়াফ খানকে ঢুকতে দেখে উপস্থিত সবাই একটু আঁড়চোখে চাইলো।ইয়াফ খান কেবিনে প্রবেশ করে সন্তপর্ণে মধুর বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসলো।তারপর ধীরে ধীরে মধুর মাথায় হাত রাখলো।কারো হাতের গভীর ছোঁয়া পেয়ে মধু চোখ খুলে তাকালো।ধীরে ধীরে হাতের মালিকের দিকে চাইলো।ইয়াফ খানকে দেখে মাক্স খুলতে চাইলে উনিও মধুকে থামিয়ে দিলেন।স্নেহময় গলায় বললেন,’থাক মা।কথা বলতে হবে না।বিশ্রাম নাও।বাড়ি ফিরেও কথা বলা যাবে।’

শ্বশুরের কথায় মধু আর মাস্ক খুললো না।আজকে কেউই ওকে কথা বলতে দিচ্ছে না।তবে শ্বশুরের এমন অপ্রত্যাশিত স্নেহময় আচরণে শত কষ্টের মধ্যেও ভালো লাগছে মধুর।ইয়াফ খান কিছুক্ষণ মধুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।মধু চোখ বন্ধ করে নিজের বাবার কথা মনে করতে লাগলো।সে থাকলে নিশ্চয়ই এভাবেই আদর করতো।

কেবিনের বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে ইরিন আর ইয়াদ দুজনেই এই দৃশ্যটা দেখে শান্তি পেলো।ইরিন ফিসফিস করে বলল,’বাবা মনে হয় মেনে নিয়েছে।এখন মা মানলেই হয়।’

ইয়াদও সমস্বরে উত্তর দিলো,’সমস্যা নেই।মা ও মেনে যাবে।তবে এই ভেবে শান্তি লাগলো যে বাবা সহজেই মেনেছে।’

‘হুম।ঠিক বলছো।’
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভাই বোন দুজনেরই কথোপকথন চলতে লাগলো।
————-
ইফাজের জ্ঞান ফিরেছে পনেরো ঘন্টা পর।জ্ঞান ফেরার পর ওকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে।নার্সরা সর্বাধিক তত্ত্বাবধানে রেখেছে।ইফাজ নিজের ফোনটা চেয়ে নিয়ে নিহাকে আর বাবা মাকে মেসেজ দিয়ে দিলো।এখন ফোনে কথা বললে ধরা পড়ে যাওয়া নিশ্চিত।তাই মেসেজ করতে হলো।সুস্থ হওয়া পর্যন্ত ওদের সাথে কথা বলা যাবে না।কিন্তু মনটা বড় ছটফট করছে মধুর জ্ঞান ফিরেছে কিনা জানার জন্য।এখন কেমন আছে?সবকিছু জানার জন্য কেবল অস্থির হয়ে পড়েছে ইফাজ।তাই একজন নার্সকে ডেকে বলল,’আপনি কি একটু ডাক্তার আশরাফকে ডেকে দিতে পারবেন?’

‘জ্বি,অবশ্যই।’নার্স ডাক্তার আশরাফকে ডাকতে বেরিয়ে গেলেন।ডাক্তার আশরাফ ইফাজের ব্যাচমেট।একসাথেই পড়াশোনা করেছে।তারপর দুজনেই ভিন্ন ভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত।তবে হাসপাতালদ্বয় এক কিলোমিটারের মধ্যেই।মাঝেমধ্যেই দেখা হয়,সৌজন্যমূলক কথাও হয়।আজকে ডাক্তার আশফাকের সার্বিক তত্ত্বাবধানেই আছে ইফাজ।আর এখন ওকে ডাকার কারণ হলো ওকে দিয়েই ডাক্তার নিয়াজকে ফোন দিয়ে মধুর খবর জানবে।অবশ্য ফোন নিজেই দিতে পারতো কিন্তু ধমক খাওয়ার ভয়ে দেন নি কেননা উনি ইফাজকে কোনো এক অজানা কারণে একটু বেশিই ভালোবাসেন।আর এখন ইফাজ ফোন দিলে কিছু তো বলবেনই না উল্টো রাম ধমক খাওয়ার সম্ভবনা একশোতে একশো।

পাঁচমিনিটের মধ্যেই ডাক্তার আশরাফ কেবিনে পৌঁছালো।উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,’এনি থিং রং ইফাজ?’

‘না না।তেমন কিছু না।তুমি একটু নিয়াজ স্যারকে ফোন দিয়ে জানতে পারবে রোগীর কি অবস্থা?’

‘হ্যাঁ জেনেছি আমি।একটু আগেই স্যার আমাকে ফোন দিয়ে বলেছেন রোগী সুস্থ আছে।জ্ঞান ফিরেছে।কেবিনে দেওয়া হয়েছে।’

‘ওহ!অনেক ধন্যবাদ।’
আশরাফ সৌজন্য হেসে বলল,’আচ্ছা।তবে তুমি বিশ্রাম করো।কোনো সমস্যা হলে আমায় ডাকবে।’

‘আচ্ছা।’
তারপর আশরাফ চলে গেলো।আর ইফাজ নিশ্চিন্ত মনে চোখ বুঝলো।যাক মধু ভালো আছে!
————
একসপ্তাহ পর মধুকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে।এখন মোটামুটি কাটা জায়গা শুকিয়েছে তবে ঔষধ কন্টিনিউ করতে হবে আর ভারি কাজ করা যাবে না একদম বেড রেস্টে থাকতে হবে।একমাস পর এসে সেলেই কাটাতে হবে।হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাওয়ার পর ইয়াফ খান নিজেই মধুকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেন।এতে সাইদা খান কিছু না বললেও মনে হলো না এই ব্যাপারে তিনি খুশী।কিন্তু এই অবস্থায় কোনো কথা বলাটা বোকামি তাই কিছুই বললেন না।সবাই মিলে মধুকে বাসায় নিয়ে এলো।বাসার সামনে এসে মধুকে কোলে করে নিজের বেডরুম পর্যন্ত নিয়ে আসলো ইয়াদ।পিছনে বাকিরাও ছিলো।সবাই কিছুক্ষণ থেকে চলে গেলো।ইয়াফ খান আইরিন রহমানকে বলেছিলেন মধুর কাছে থাকতে কিন্তু উনি থাকেন নি।মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থাকতে কেমন একটা লজ্জা লাগে।তবে না থাকলেও প্রতিদিনই আসবেন মেয়েকে দেখতে।

ইয়াদের বাসায় মধুর সেবা যত্নের তেমন কোনো ত্রুটি হয় না।ইয়াদ যখন ভার্সিটিতে যায় তখন মধু ঘরেই থাকে।কখনো একা একা গান শোনে আবার কখনো শ্বশুরের সাথে গল্প করে।এই কয়দিনে শ্বশুরের সাথে অনেকটাই ভালো সম্পর্ক হয়েছে মধুর।তবে শ্বাশুড়িকে একবারের জন্যেও আসতে দেখে নি।এই নিয়ে মধুর মন খারাপ হলেও কিছু বলে না।মাঝে মাঝে ইরিন আর নিহাও আসে।নিহার সাথেও এই কয়দিনে মোটামুটি কথা হয়েছে।আগে তেমন কথা হয় নি।আর ইয়াদ ফিরলে ইয়াদের সাথে কখনো কখনো রোমান্টিক কথাবার্তা হয় আবার কখনো মিষ্টি ঝগড়া করে।আবার কাল ইয়াদ মধুর বাসায় গিয়ে ওর বইগুলোও নিয়ে এসেছে।আজ থেকে নাকি পড়তে হবে।বই দেখেই মধু বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করেছিলো,’বই আনলে কেনো?’

‘কেনো আবার?তুমি পড়বে এইজন্য।’

‘আমি তো অসুস্থ!এখন অনন্ত অফ রাখি।’

‘অনেক ফাঁকিবাজি করছো তুমি।এটা কিন্তু ফাইনাল ইয়ার।এমনিতেও চারমাস নষ্ট করে ফেলছো।এবার থেকে খামখেয়ালি করলে চলবে না।ফাইনাল ইয়ারে আমি ভালো একটা সি জিপিএ চাই।’

মধু মুখ বাকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল,’এহ!ভালো একটা সি জিপিএ চাই!বললেই হলো?আমি কিচ্ছু পারি না।ফেল করবো।’

‘ফেল করলে আমি ভার্সিটিতে আমার নাক কাটা যাবে।স্টুডেন্টরা বলবে ইয়াদ স্যারের বউ ফেল্টু।এখন তুমিই বলো তুমি তোমার জামাইর বেইজ্জতি করতে চাও?’

ইয়াদ কথাও মধু একটু কনভিন্স হলেও জিদ ধরে বলল,’আচ্ছা বেশি পড়বো না।অল্প একটু পড়বো।’

ইয়াদ মধুর জিদ মেনে নিয়ে বলল,’আচ্ছা অল্পই।কিন্তু পড়তে হবে প্রতিদিন।’

‘আচ্ছা।’

এখন ভরদুপুর।মধু চোখে চশমা পরে বই পড়ছে।ইয়াদ বলেছে ও আসার আগেই যেনো পড়া শেষ হয়।এসে যদি দেখে পড়া হয় নি তাহলে নাকি কথা বলবে না।এই ভয়েই মধু পড়তে বসলো।হঠাৎ দরজায় নক হওয়ায় ও মুখ তুলে চাইতেই দেখতে পেলো নিহা এসেছে।মধু হাসিমুখে বলল,’ভাবি দাড়িয়ে আছো কেনো?আসো।বসো।’

নিহা ভেতরে এসে বিছানায় বসতে বসতে বলল,’কি করছো?’

‘কি আর করবো বলো।তোমার দেবর আমাকে পড়তে দিয়ে গেছে।পড়া নাহলে নাকি কথা বলবে না।তাই পড়ছি।’

নিহা হাসলো।বলল,’ও আচ্ছা।তাহলে বোধহয় বিরক্ত করলাম।পরে আসি তাহলে।’

এটা বলেই নিহা উঠতে নিলে মধু বাধা দিয়ে বলে,’আরে না ভাবি কোনো বিরক্ত করো নি।বসো তো।পরে পড়বো।এমনিতেও ভালো লাগছিলো না।’

নিহা আবারও হাসলো।মধুর অনুরোধে আর উঠলো না।তারপর দুই জা মিলে টুকটাক গল্পসল্প শুরু করলো।তারপর হঠাৎ কিছু একটা মনে হওয়ায় মধু বলল,’ভাবি,বাবুকি কিক মারে?’

নিহা মুচকি হেসে মধুর হাতটা নিজের পেটের ওপর রেখে বলল,’নিজেই বুঝে নাও।’

মধু অনুভব করলো একটা ছোট্ট পা পেটে লাথি মারে।কিছুক্ষণ পেটে হাত রেখে অনুভব করলো।তারপর হাত সরিয়ে ফেললো।নিহা দেখলো মধুর চোখে পানি।নিহা জিগ্যাসু গলায় বলল,’তুমি কাঁদছো?’

‘না।ভাবি।’মধু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল।তারপর ম্লান হেসে বলল,’ভাবি তুমি কতো লাকি।তোমার বাবু হবে।তুমি মা হবে।’

নিহা মধুর হাত ধরে বলল,’না বোন আমার চেয়ে বেশি ভাগ্যবতী তুমি।আল্লাহ সবাইকে সবদিক দিয়ে পূর্ণতা দেন না।তোমাকে একদিক দিয়ে অপূর্ণতা দিলেও অন্যদিকে দিয়ে কিন্তু পূর্ণ করে দিয়েছেন তেমন আমাকেও।’
মধু ভেবে পায় না নিহা ওকে বারবার ভাগ্যবতী বলে কিন্তু কেনো?ওর তো বাবুও হবে না তাহলে ভাগ্যবতী কিভাবে হলো?নিহাকে এইকথা জিজ্ঞেস করলে সে কিছু বলে না।শুধু একটু হাসে।

নিহার কথা শেষ হতে না হতেই ইয়াদের আগমন।দুই জা কে একসাথে দেখে ইয়াদ সহাস্যে বলল,’আরে দুই জা দেখি একসাথে।তা কি ফুসুরফাসুর চলছে?নিশ্চয়ই আমার নামে বদনাম করছে মধু।’

নিহা উঠে গিয়ে ইয়াদের সামনে দাড়িয়ে বলল,’আরে না দেবর সাহেব।আপনার নামে কোনো বদনাম হয় নি।আমরা তো আমাদের সুখ দুঃখের আলাপ করছিলাম।’

‘ওহ!তাহলে উঠে এলে কেনো ভাবি।যাও বসো।কথা বলো।’

‘না।তুমি ফ্রেশ হও।আমি ঘরে যাই।পরে আসবো।’

এই বলেই নিহা বেরিয়ে গেলো।
——————-
রাত ৮.১০…
বাইরে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব।আকাশ কালো হয়ে আছে।মাঝারি ধরনের বাতাস হচ্ছে বাইরে।নিহা বারান্দার ইজি চেয়ার থেকে বিরক্ত মুখে উঠে ঘরে চলে এলো।ওর বিরক্তি কারণ মোটেও মেঘলা আকাশ নয়।কারণটা ইফাজ।আজ একবারও ফোন ধরে নি।দশদিন হয়ে গেলো এখনো ফিরছে না ফেরার কথা বললে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে।এই সব মিলিয়েই নিহা চরম মাত্রায় বিরক্ত হয়ে আছে।মন চাচ্ছে ইফাজকে সামনে বসিয়ে ইচ্ছেমতো ঝাড়তে।কিন্তু ঝাড়া তো দূরের কথা কথাই তো বলা যাচ্ছে না।ধূর!নিজের রাগ নিজে হজম করে জানালা বন্ধ করতে লেগে গেলো।জানালা গুলো বন্ধ করে পেছনে ফিরতেই দেখলো ইফাজ কাক ভেজা হয়ে আছে।এভাবে হঠাৎ দেখে নিহা ভিষণ অবাক হলো।এটা সত্যি ইফাজ তো!নাকি ওর বেশে অন্য কেউ।নিহা ইফাজের সামনাসামনি এসে দাড়ালো।ইফাজ চুলের পানি ঝাড়তে ব্যস্ত।নিহা ইফাজের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,’তুমি সত্যিই ইফাজ তো?’

ইফাজ হেসে দিলো।হাসতে হাসতেই বলল,’এনি ডাউট?’

‘না কিন্তু তুমি তো বলো নি আজ আসবে।আর কখনো পৌঁছেছো?আমাকে বলো নি কেনো?বললে তো ইয়াদ অথবা বাবাকে পাঠাতাম।’

নিহার অস্থিরতা দেখে ইফাজ বলল,’এতো কথা একসাথে বলো কিভাবে।একটু জিরিয়ে জিরিয়ে বলো। আমি আজ সকালেই এসেছি।হাসপাতালে ছিলাম।তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো বলে ফোন ধরি নি।আর আমি একাই আসতে পারি।চিন্তা করতে হবে না।’

সবশুনে নিহা বলল,’আচ্ছা।তাহলে ফ্রেশ হয়ে নাও।ড্রেস চেন্জ করে আসো।’

‘আচ্ছা।’
ইফাজ জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।ওয়াশরুমে এসে শার্ট টা খুলে নিজের ক্ষত তে একবার হাত বুলালো।একবারের জন্যও নিহা ওকে সন্দেহ করে নি।যাক এখন কয়েকটা দিন সাবধানে চলতে হবে।সেলাই খোলার আগে ক্ষতটা যেনো কেউ না দেখে।

চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৪৯+৫০

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪৯
#Arshi_Ayat

দুইদিন পরের কথা….
বিকেলে ইরিনের শ্বশুরবাড়ির লোক আসবে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে।এঙ্গেজমেন্টের সময় কথা হয়েছিলো ইয়াদ ফিরলে বিয়ে হবে।এখন তো ইয়াদ ফিরেছে তাই আর শুভ কাজটা ফেলে রাখতে চাইলো না ওনারা।এতে ইরিনের বাবা মায়েরও কোনো আপত্তি নেই।এবার মেয়ের বিয়েটা দিয়েই দিবেন।

মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক আসবে সেইজন্য ইয়াদকে বাজারে পাঠিয়েছে সাইদা খান।কাজের লোকই যেতো কিন্তু ইয়াদ নিজেই চাইলো করতে।তাই সাইদা খান আর কিছু বললেন না।

ইয়াদ বাজার করলো দুইভাগে।একভাগ নিজের বাসার জন্য আরেকভাগ মধুর বাসার জন্য।আইরিন রহমান আর মিলি ওরা কালই নতুন বাসায় উঠেছে সাথে মধুও আছে।সেইজন্য ভাবলো ওদের জন্যও বাজার নিয়ে যাওয়া যাক।

বাজার করে ফিরতি পথে মধুর বাসায় গিয়ে বাজারটা দিয়ে এলো।আইরিন রহমান বসতে বললেন কিন্তু ইয়াদ তাড়া দেখিয়ে বেরিয়ে গেলো।যাওয়ার সময় মধুর ফোনটাও দিয়ে গেলো।
এই দুইদিন ধরে কথা বলা,কাছে আসা সবই গোপনে হচ্ছে।রাতের বেলা ইয়াদ মধুর বাড়ি থাকে ভোর হওয়ার আগেই নিজের বাড়ি চলে আসে।অবশ্য সাইদা খান এখনো ধরতে পারে নি বিষয়টা।তিনি মনে করেছেন ছেলে হয়তো নিজেকে কন্ট্রোল করছে তার জন্য!এইজন্য তিনি ইয়াদের ওপর একরকম বেশিই খুশী এইদিকে এই খবর নিহা,ইফাজ আর ইরিন জানে।ইয়াফ খান সন্দেহ করলেও হাতেনাতে ধরতে পারে নি তাই কিছু বলে নি।তবে ইয়াদের খুব মন খারাপ হয়।কাল সন্ধ্যার সময়ই ছাঁদে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের সাথে সুখ দুঃখের আলাপ করছিলো।ইফাজ স্বান্তনা দিয়ে শান্ত করেছিলো ওকে।
আপাতত ইরিনের বিয়ে মিটে যাওয়া অব্দি চুপই থাকতে হবে পরে নাহয় কিছু একটা করা যাবে।

ইয়াদ বাজার নিয়ে বাসায় আসলো।বাসায় রান্নাবান্না হচ্ছে।সাইদা খান সবকিছুর তদারকি করছে।সাথে ইরিনও আছে তবে সে একটু পরপর আসে আর যায়।নিহাও চেয়েছিলো সাহায্য করতে কিন্তু ইফাজের চোখ রাঙানি আর সাইদা খানের কঠিন বারণে নিহা আর কিছু করতে পারলো না।ইদানীং বোরিং লাগে সবকিছু নিহার।ইফাজ একটা কাজও করতে দেয় না।যখন বাসায় থাকে তখনও আবার বাইরে গেলে সাইদা খান আর ইরিন!কয়েকদিন ধরে বাবা মায়ের কাছেও যেতে ইচ্ছে করছে তাই ভাবছে ইরিনের বিয়েটা মিটে গেলেই কয়েকদিন গিয়ে থেকে আসবে।

একটু আগেই ইরিনের শ্বশুর বাড়ির লোকেরা চলে গিয়েছে।বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক।সামনের শুক্রবার বিয়ে হবে।সেই অনুযায়ী আগেরদিন গায়ে হলুদ পরেরদিন বৌ ভাত।সপ্তাহজুড়ে সবার ব্যস্ততা।ইয়াদের এই ভেবে মন খারাপ হলো এই আনন্দগুলোর শামিল মধু হতে পারবে না।অথচ ও কিন্তু এই বাড়িরই বউ!

সারাদিন ইয়াদ একা হাতেই সব সামাল দিয়েছে।ইফাজ হসপিটালে ছিলো।ওর ও থাকার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু ইমার্জেন্সি পড়ে যাওয়ায় আসতে পারে নি।

সন্ধ্যার সময় নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপ অন করলো।কিছু কাজ আছে ওগুলো শেষ করে খাওয়া দাওয়া করে সবাই ঘুমালে বেরিয়ে পড়বে।

কাজ করতে করতেই সাইদা খান ইয়াদের ঘরে আসলো চা নিয়ে।ওকে চা টা দিয়ে বলল,’ইয়াদ,একটু কথা বলবো তোর সাথে।’

ইয়াদ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,’হ্যাঁ বলো।’

‘তুই ওই মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে দে।তারপর ইরিনের বিয়ের পর তোর বিয়ে দিবো।’

ইয়াদ পূর্ণচোখে চাইলে মায়ের দিকে।কপাল কুঁচকে বলল,’মা,আমি মধুকে ডিভোর্স দিবো না।আর ওর সাথে আইনত আমার বিয়ে হয়েছে।আমি ওকে ছাড়া আর কাউকে আমার বউ হিসেবে মানবো না।’

সাইদা খান বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন,’দেখ ইয়াদ,এগুলো আবেগ।আবেগ কয়দিন পরই কেটে যাবে।’

ইয়াদ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,’মা তুমি আটাশ বছরের ছেলেকে আবেগ বোঝাও?আবেগের বয়স শেষ আমার।কোনটা আবেগ আর কোনটা ভালোবাসা আমি তা বুঝি মা।’

‘না ইয়াদ তুই ভুল করছিস।ওই মেয়েটার সাথে তুই শান্তিতে থাকবি না।একে তো মেয়েটা ধর্ষিতা তারওপর বাচ্চাও হবে না।এমন অনেক সংসার বাচ্চার জন্য ভেঙেছে।’

‘মা প্রথমত আমি ওকে ভালোবাসি।আমি সারাজীবন ওর সাথে থাকতে পারলেই সবচেয়ে শান্তিতে থাকবো বিশ্বাস করো।আর ও ধর্ষিতা বিয়ের আগে ছিলো বিয়ের পর না।বিয়ের পর শুধু ও ইয়াদের বউ।আর বাচ্চার জন্য যারা সংসার ভাঙে তারা আসলে ভালোবাসা কি সেটাই জানে না।’

সাইদা খান গম্ভীর গলায় বললেন,’ইয়াদ তুই কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস।আমার কথা শোন।’

‘দুইদিন আগেও তোমার একটা অন্যায় আবদার রেখেছি।আর পারবো না মা।তোমার অন্যায় আবদার রাখতে গিয়ে আমি আরেকজন কে কষ্ট দিতে পারবো না।’

এটা বলেই ইয়াদ ল্যাপটপটা অফ করে অর্ধপূর্ণ চায়ের কাপটা রেখে বাইরে চলে গেলো।

আর সাইদা খান গম্ভীরমুখ নিয়ে উঠে চলে গেলেন।
—————–
নিখিল কিছুদিনের জন্য ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলো তাই ওকে ওই ফোনটা দিতে পারে নি ইফাজ।নিখিল অবশ্য বলেছিলো ও আসলে তারপর কাজ শুরু করবে কিন্তু ইফাজের হাত গুটিয়ে রাখতে ইচ্ছে হলো না তাই কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে নিজের বিশ্বস্ত কয়েকজন লোককে দায়িত্ব দিয়ে দিলো।ফোনটা ওদের কাছে দিয়ে সিমটা নিজের কাছে রাখলো।ওই ফোনের গ্যালারিতে একটা ছেলের ছবি আছে।এখন উদ্দেশ্য ওই ছেলেকে খুঁজে বের করা।

রাত ১.০০ টা…
নিহা ঘুমিয়ে গেছে।ইফাজ ওর পাশ থেকে উঠে গেলো।ইফাজও ওর পাশেই শুয়েছিলো।অপেক্ষা করছিলো নিহা ঘুমানোর ও ঘুমিয়ে পড়লেই সিমটা নিজের ফোনে লাগিয়ে নাম্বারগুলো চেক করবে।হয়তো কোনো ক্লু পাওয়াও যেতে পারে।

ফোন চালু করে নাম্বারগুলো টুকে নিতে লাগলো হঠাৎ করেই ইফাজের চোখেট একটা পরিচিত নাম্বার ধরা পড়লো।ইফাজ শিউর হওয়ার জন্য নাম্বারটা আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।নাহ!কোনো ভুল নেই কিন্তু এই নাম্বার এখানে কি করে।ও অন্য একটা কগজে এই নাম্বারটাও টুকে নিলো।হতে পারে এটার সাথেও কোনো যোগসূত্র আছে।
————-
সারা সপ্তাহ জুড়ে শপিং থেকে শুরু করে যাবতীয় আয়োজন সব দায়িত্ব নিয়ে করেছে ইয়াদ আর ইফাজে
বোনের বিয়ের আয়োজনে ভাইয়েরা কোনো ত্রুটি রাখে নি।

আজ ইরিনের গায়ে হলুদ।ইয়াদের অনেক ইচ্ছে ছিলো পুরো বিয়েতে মধু থাকবে কিন্তু ওকে আসতে বলতো কোন মুখে?মাঝেমধ্যে নিজেরই ভিষণ খারাপ লাগে।মন চায় সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে কিন্তু পিছুটানের জন্য আর যাওয়া হয় না।

দুইভাই মিলে বোনকে স্টেজে নিয়ে বসালো।ইরিন আজ অনেক খুশী।নিজের বিয়েতে পরিবারের সবাই আছে কিন্তু একটা বিষয়ে খারাপ লাগছে যে তার ছোটভাই হাসিখুশি থাকলে ওর মনটা খারাপ।কেনো খারাপ সেটাও অজানা নয়।তাই ইরিন ভাইকে খুশী করতে ওর কানে কানে বলল,’ভাইয়া ভাবিকে মিস করছো?’

ইয়াদ মলিন হাসলো।কিছু বলল না।ইরিন আবারও ফিসফিসিয়ে বলল,’ভাবিকে আসতে বলেছি।’

ইয়াদ চমকে উঠে বলল,’ও কি বলেছে?আসবে?’

‘হ্যাঁ আসবে কিন্তু তোমার বউ হয়ে নয় আমার বান্ধবী হয়ে।’

‘সমস্যা নাই।ও আসলেই চলবে।’

‘এবার খুশীতো?’ইরিন দাঁত কেলিয়ে বলল।

ইয়াদ কিছু বলল না।কিন্তু ওর মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে ও অনেক খুশী।

মধু চকলেট কালারের একটা শাড়ি পরে তৈরি হয়ে নিলো।বের হওয়ার আগে শেষবারের মতো একবার আয়নাতে নিজেকে দেখে বের হতে নিলেই আইরিন রহমান বললেন,’কোথায় যাচ্ছিস মধু?’

‘মা,আজ ইয়াদের বোনের গায়ে হলুদ।ওখানেই যাচ্ছি।’

‘তোকে যেতে বলেছে?’

মধু আমতা আমতা করে বলল,’মা আসলে ইরিন বলেছিলো আসতে।’

‘আর ওমনি তুমি চলে যাচ্ছো?ইয়াদ কি একবারও বলেছিলো?বা ওর বাব মা কেউ বলেছে?’

মধু নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,’না।’

‘তাহলে যাচ্ছিস কেনো?আবার অপমানিত হতে?ওইদিন অপমান হয়ে শিক্ষা হয় নি।আজ আবার সবার সামনে অপমানিত হতে ভাল্লাগবে?’

মধু কিছু বলল না।চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।আসলেই মায়ের কথাগুলে সত্যি!আইরিন রহমান আবার বললেন,’তোর যেতে মন চাইলে যা কিন্তু কিছু হলে বাসায় এসে কাঁদতে পারবি না।এই বলে দিলাম।’

মধু আর দরজার দিকে পা বাড়ালো না।নিজের ঘরে চলে গেলো।দরজা বন্ধ করে দিলো।ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়ালো।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো নিজেকে।কি কমতি আছে ওর?একটা হাত নেই নাকি পা নেই?নাকি কানা?নাকি প্রতিবন্ধী?নাহ!কোনো কমতিই তো নেই তাহলে এতো অবহেলা কেনো?কেনো বিয়ের আগে যারা ভালোবাসতো একটা দুর্ঘটনার জন্য তারা বিয়ের পর ভালোবাসতে পারছে না?তাহলে কি তারা নারীকে নয় নারীর সতিত্বকে ভালোবাসে?
————-
প্রায় দশটা বেজে গেছে।এখনো মধু আসছে না।ইয়াদ বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছে।কয়েকবার ফোনও দিয়েছে কিন্তু ফোন রিসিভও হচ্ছে না।এখনো আসছে না কেনো?আসার তো কথা ছিলো।কোনো সমস্যা হয়েছে কি না কে জানে!এখন তো এদিকটা ছেড়ে যাওয়াও যাবে না।এদিকে ইরিনের সাথেও কথা বলা যাচ্ছে না অনেক আত্মীয়রা ওকে ঘিরে আছে।

মধুর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ।সবাই যে যার মতো ঘুমাতে চলে গেছে।ইয়াদও ঘরে এসেছে।হলুদের পোশাক পাল্টে বিছানায় বসে মধুকে কল দিলো।মধু রিসিভ করতেই ইয়াদ বলল,’আজকে আসো নি কেনো?’

‘আসার কি কথা ছিলো?’

‘ইরিন তো বলেছিলো আসতে।’

‘তুমি বলেছিলে?’

এই কথার উত্তর পেলো না ইয়াদ।নিজের কাছেই নিজের লজ্জা লাগছে।ইয়াদের জবাবের অপেক্ষা না করে মধু বলল,’রাত হয়ে গেছে অনেক।কাল বিয়ে।ঘুমিয়ে পড়ো।রাখছি।’

এটা বলেই মধু ফোনটা রেখে দিলো।ফোনটা রাখার পর চোখ ছাপিয়ে কান্না চলে আসলো মধুর।সন্ধ্যা থেকে একটুও কাঁদে নি কিন্তু এখন খুব করে কান্না পাচ্ছে।

চলবে…..

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৫০
#Arshi_Ayat

ভাইদের চোখের মণির আজকে বিদায়।দুই ভাইয়েরই মন ভার হয়ে আছে।ছোটবেলা থেকেই দুই ভাইয়ের আর বাবা মায়ের ভিষণ আদরের ছিলো ইরিন।কখনো ভালোবাসার কমতি অনুভব করে নি কিন্তু আজ যাবার বেলায় বাড়ির সবার মন খারাপ হয়ে আছে।সাইদা,ইয়াফ দুজনেই কান্না করেছেন মেয়ের বিদায়ে।ইয়াদ,ইফাজ প্রথমে কান্না করে নি।শক্তই ছিলো কিন্তু যখনই ইরিন এসে ভাইদের জড়িয়ে ধরে কান্না করা শুরু করলো তখন দুই ভাইয়ের কেউই তাদের কান্নার লাগাম টেনে ধরতে পারে নি।তিনভাই বোন খুব কাঁদল।তারপর ইফাজ বোনকে কোলে কোরে নিয়ে গাড়িতে বরের পাশে নিয়ে বসালো।বরের হাত ধরে ইফাজ ভেজা গলায় বলল,’ও আমাদের খুব আদরের বোন।আমাদের চোখের মণি।আজ আমরা আমাদের জানটাকে তোমার হাতে দিলাম কখনো কষ্ট দিও না।যদি আমার বোন কখনো তোমার কারণে কাঁদে আর আমি যদি জীবিত থাকি তাহলে ওইদিন তোমার শেষদিন হবে।’

এটা বলে বোনের কপালে একটা চুমু খেয়ে সরে এলো।তারপর ইয়াদ গেলো।ইয়াদ যেতেই ইরিন ওকে জড়িয়ে ধরে আরেক দফা কাঁদল।ইয়াদ নিজেকে সামলে ইরিনের চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে ইরিনের হাত বরের হাতে দিয়ে বলল,’আগলে রেখো সারাজীবন।’

তারপর বাকি আত্মীয় স্বজন মিলে ইরিনকে বিদায় দিলো।একমাত্র মেয়ের বিদায়ে সাইদা খান আর ইয়াফ খান দুজনেরই মন খারাপ।ইরিনের বিদায়ের পর বাড়ি আস্তে আস্তে খালি হতে শুরু করে।যাদের বাড়ি কাছাকাছি তারা চলে গেলো।আর বাকি আত্মীয়রা রয়ে গেলো।

ইরিনকে বিদায় দিয়ে ইয়াদ নিজের ঘরে আসলো।ঘড়িতে এখন রাত নয়টা।ড্রেস চেঞ্জ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো।ভালো লাগছে না।আজ একমাত্র বোনটার বিয়ে হয়ে গেলো।ভাই হয়ে বোনের বিদায়ে কতো কষ্ট এটা আজ বুঝতে পারছে ইয়াদ।কিছুক্ষণ সিলিং এর দিকে তাকিয়ে ইরিনের সাথে দুষ্টুমির মুহুর্তগুলো মনে করতে লাগলো।ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করেই মনে পড়লো মধুর কথা।কালকে রাতের পর থেকে এখন পর্যন্ত একবারও কথা হয় নি।এমনিতেও ইয়াদের ভালো লাগছে না হয়তো মধুর সাথে কথা বললে ভালো লাগবে তাই ফোন দিলো।কেটে যাওয়ার আগেই রিসিভ হলো।ইয়াদ শান্তকন্ঠে বলল,’ইরিনটার বিয়ে হয়ে গেলো আজ।সব খালি খালি লাগছে।ও যাওয়ার পর থেকেই ওর শূন্যতাটা চোখে লাগছে।কিছুই ভালো লাগছে না।’

স্বামীর অস্থিরতার কথা শুনে মধু স্বান্তনা দেওয়ার জন্য বলল,’মেয়েরা এমনই ইয়াদ।ওদের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই।জন্ম হয় বাবার বাড়িতে বিয়ে হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ি,বৃদ্ধ হওয়ার পর ছেলের বাড়ি নাহয় বৃদ্ধাশ্রম!’

ইয়াদ কিছু বলল না।চুপচাপ কানে ফোন চেপে বসে রইলো।এমুহূর্তে কারো সঙ্গ প্রয়োজন।মধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’খেয়েছো?’

‘না।ইচ্ছে করছে না।তুমি খেয়েছো?’

‘না।আমারও ইচ্ছে করছে না।’

তারপর আবারো কিছুক্ষণ নিরবতা।এবার ইয়াদ অনুরোধের স্বরে বলল,’আসবো?’

‘আসো।’মধুও সায় দিলো।
——————
ইরিনের বিয়ে মিটে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর পর নিহা কিছুদিনের জন্য বাবার বাড়ি চলে যায়।এদিকে ইফাজ নিজের চেম্বার আর ইয়াদ নিজের ভার্সিটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।মধুও নিজের বাসা থেকে যাওয়া আসা করে ক্লাস করা শুরু করে।ভার্সিটিতে এতোদিনে চাউর হয়ে গেছে ওরা বিবাহিত।তবে কয়েকদিন ধরে ইয়াদ লক্ষ করছে মধু ওকে এড়িয়ে চলছে।ফোন দিলে ফোন ধরে না,তেমন একটা কথা বলে না।কি হয়েছে সেটাও কয়েকবার জিগ্যেস করেছে ইয়াদ কিন্তু কোনো আশানুরূপ উত্তর পাওয়া যায় নি।এদিকে আবার আজকে ও ক্লাসেও আসে নি।আরিয়াকে জিগ্যেস করতেই বলল আজকে নাকি আসবে না।কি কারণ সেটা বলল না।তাই ইয়াদ নিজেই কল দিলো।কয়েকবার কল দেওয়ার পরও মধু কল ধরলো না।এখনই ওর বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু আরো ২ টা ক্লাস নিতে হবে।এখন ক্লাস ছেড়ে যাওয়াও যাবে না।তাই ইয়াদ কোনরকম দুইটা ক্লাস শেষ করে দুপুর তিনটার সময় বেরিয়ে গেলো মধুদের বাসার উদ্দেশ্যে।

ওদের বাসায় এসে নক করতেই মিলি দরজা খুললো।ইয়াদ মৃদু হেসে বলল,’কেমন আছো?’

মিলি থমথমে মুখে বলল,’ভালো না।আপুর শরীর খারাপ।’

মিলির মুখে মধুর শরীর খারাপের কথা শুনে ইয়াদে বুকটা ধড়াস করে উঠলো।ভয় পাওয়া গলায় বলল,’কি হয়েছে ওর?’

‘জানি না কয়েকদিন থেকেই।কেমন জানি দুর্বল হয়ে পড়েছে।অনেক শ্বাসকষ্টও হচ্ছে।আজকে ওয়াশরুমের সামনে জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলো।পরে আমি আর আম্মু বিছানায় আনি।’

ইয়াদ মিলির কথা শুনে আরো ভয় পেয়ে গেলো।মিলির পেছন পেছন মধুর ঘরে গেলো।দেখলো মধু লম্বা হয়ে শুয়ে আছে।আইরিন রহমান ওর শিয়রের পাশে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে।ইয়াদকে দেখে তিনি উঠে দাড়িয়ে বসতে বললেন।ইয়াদ বসলো।চিন্তিত ও ভয়ার্ত স্বরে আইরিন রহমানকে জিগ্যেস করলো,’কি হয়েছে মা ওর?’

‘জানি না বাবা।ডাক্তার দেখাতে চাইলাম বলল লাগবে না।এমনিই নাকি সেরে উঠবে।’

‘আপনি আমাকে একবারও জানালেন না কেনো?’

আইরিন রহমান কিছু বলার আগেই মধু বলল,’আমি বারণ করেছি।কিছু হয় নি আমার।সুস্থ হয়ে যাবো এমনিই।’

ইয়াদ চোখ রাঙিয়ে বলল,’তুমি চুপ থাকো।একটা কথাও বলবে না।’

মধুকে শাসিয়ে ফোনটা বের করে ইফাজকে ফোন দিলো।সব শুনে ইফাজ বলল হাসপাতালে নিয়ে আসতে।ইয়াদ মধুকে হাসপাতালে নিতে চাইলে মধু আর্তনাদ করে বলল,’প্লিজ ইয়াদ।আমি যাবো না হাসপাতালে।বললাম তো আমি ভালো আছি।’

ইয়াদ কোনো কথার উত্তর দিলো না।কোলে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগলো।রাস্তায় এসে একটা সি এন জি ডেকে নিলো।সেখানে মধুকে জোর করে উঠালো।সারা রাস্তা মধু কাঁদতে কাঁদতে এসেছে।মুখে একটাই কথা আমি হাসপাতালে যাবো না।কিন্তু কে শোনে কার কথা।হাসপাতালে নিয়ে আসার পর দুইজন নার্স মধুকে একটা কেবিনে নিয়ে গেলো।একটু পর ইফাজ এসে প্রেশার মাপলো।প্রেশার হাই হয়ে আছে।এরমধ্যেই আবার মধুর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে।ইফাজ দ্রুত অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করতে গেলো।আর ইয়াদ মধুর হাত শক্ত করে ধরে ওকে সামলানোর চেষ্টা করছে।হাসপাতালের বিছানায় মধু ছটফট করছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই অক্সিজেন দেওয়া হলো।তারপর মধু কিছুটা শান্ত হলো।এক দেড়ঘন্টা পর ইফাজ মধুকে কিছু পরীক্ষার জন্য পাঠালো।এই পরীক্ষাগুলো করলেই বোঝা যাবে সমস্যা কিন্তু।মধু পরীক্ষা করাতে নারাজ।তবে ইয়াদের শাসনের কাছে হার মেনে পরীক্ষাগুলো করতেই হলো।পরীক্ষা করিয়ে আবার বেডে শিফট করা হলো মধুকে।

ইফাজের কথায় ইমিডিয়েট রিপোর্টগুলো তৈরি করা হলো।রিপোর্টগুলো দেখে চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ বসে রইলো।যা সন্দেহ করেছিলো তাই হয়েছে।ইয়াদ ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করলো,’ভাইয়া রিপোর্ট কি খারাপ?’

ইফাজ নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,’যা বলবো মনোযোগ দিয়ে শুনবি।ওর দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে।ইমিডিয়েট কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে।আমরা দেখছি কিডনির ব্যাবস্থা করতে পারি কি না।কিন্তু তুই শক্ত থাকিস ভাই।ওকে কিছু বলিস না।এখন মানুষিক সাপোর্টটা খুব প্রয়োজন।’

ইফাজের কথা শুনে ইয়াদ কিছুক্ষণ বোবা হয়ে বসে রইলো।মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।এমন কিছু স্বপ্নেও চিন্তা করে নি ইয়াদ।কষ্ট হচ্ছে ভিষণ।মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে কেউ পাথর চেপে ধরে রেখেছে।চুপচাপ ভাইয়ের কেবিন থেকে বেরিয়ে মধুর কেবিনক গেলো।কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে!মুখে অক্সিজেন মাক্স।হাতে স্যালাইন লাগানো।নিঃশব্দে ইয়াদ মধুর পাশপ গিয়ে বসলো।একটা হাত ওর হাতের ওপর রাখলো।চেখভর্তি হয়ে গেলো জলে।কেনো?সব কষ্ট এই মেয়েটাকেই পেতে হবে কেনো?সেই প্রথম থেকে কিছু না কিছু হয়েই যাচ্ছে।একদন্ড শান্তি পায় নি।ভেবেছিলো বিয়ের পর শান্তি মিলবে তাও হলো না।শ্বশুরবাড়িতেই তো ঠাই হলো না!

ইফাজ মধুর ব্লাড স্যাম্পল পরীক্ষা করতে পাঠালো আর কিডনি ডোনেটের গ্রুপকে জানালো।কিন্তু আফসোসের বিষয় আপাতত এখন দেওয়ার মতো কোনো কিডনিই নেই।থাকলেও এটা মধুর টিস্যু, কোষের সাথে ম্যাচ করে না।এদিকে অতিদ্রুত অপারেশন করতে হবে।প্রচুর রক্তেরও প্রয়োজন কিন্তু মধুর রক্ত O নেগেটিভ হওয়ায় এই রক্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।এটা খুব রেয়ার রক্ত।এদিকে ভেতরে ভেতরে ইয়াদ আর ইফাজ টেনশনে মরে যাচ্ছে।আইরিন রহমান আর মিলিও চিন্তিত মুখে মধুর পাশে বসে আছে।তবে ওনারা এসবের কিছুই জানেন না।

কথায় আছে দুঃসংবাদ বাতাসের আগে পৌছায়।তেমনই মধুর হাসপাতালে ভর্তির খবর ইরিন,ইয়াফ খান,সাইদা খান ওনাদের কাছেও পৌঁছে গেছে।ওনারাও আসছেন।

কিন্তু কোনো আশার খবর নেই।না রক্ত জোগাড় হচ্ছে না কিডনি!

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।রি চেক করা হয় নি।)

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৪৭+৪৮

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪৭
#Arshi_Ayat

মধুর মাথা বুকে চেপে ধরে রেখেছে ইয়াদ।মধু দু’হাতে ইয়াদের গলা জড়িয়ে রেখে কাঁদছে।ইয়াদের চোখেও পানি তবে সেটা আড়ালে।দশমিনিট ধরে এভাবেই বসে আছে দুজন।দশমিনিট আগেও ওরা ঘুমিয়েই ছিলো।কিন্তু হঠাৎ মধু ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে বসে।সেই কালোরাতের দৃশ্য চোখে ভাসে!ইশ!কি কষ্ট!কি আর্তনাদ!কেউ শোনার ছিলো না!কেউ বাচায় নি সেদিন!মধুর চিৎকারে ইয়াদও শোয়া থেকে উঠে বসে।তড়িঘড়ি করে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দেখে মধু দুইহাতে মুখ ঢেকপ কাঁদছে।ইয়াদের বুঝতে বাকি রইলো মধু কেনো কাঁদছে।কিন্তু এই মুহুর্তে স্বান্তনা দেওয়ার মতো কোনো শব্দ ইয়াদের মাথায় নেই।ইয়াদ মধুকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে শান্তিতে কাঁদতে দিলো।যেনো কিছুটা সময় একান্তে কাঁদতে পারে।এর থেকে এখন বেশি কিছু করারও নেই ইয়াদের।

কান্না কিছুটা থেমে এলো মধুর।মধু নাক টেনে ইয়াদের বুক থেকে মাথা তুললো।চোখের পানিগুলো মুছে।পিঠময় ছড়া চুলগুলো হাতখোপা করে নিলো।তারপর ঠান্ডা গলায় বলল,’শুয়ে পড়ো।সকালে উঠতে হবে।’

‘তুমি শুবে না?’একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইয়াদ।

‘না,ঘুম আসছে না।’

‘আমারো না।চলো বারান্দায় গিয়ে বসি।চা খাবে?’

‘হ্যাঁ খাবো।’

‘আচ্ছা তুমি গিয়ে বসো।আমি চা নিয়ে আসছি।’

মধু ঘাড় নেড়ে বারান্দায় চলে গেলো।আর ইয়াদ কিচেনে গেলো চা বানাতে।

একটু পরই চা নিয়ে হাজির হলো ইয়াদ।তারপর দু’জনে চা খেতে খেতে কিছুটা সময় নিরবে কাটিয়ে দিলো।

কাল থেকে সাইদা খান ইয়াদের সামনে আসছে না।আজ নাস্তার টেবিলেও নেই।তবে ইয়াফ খান থাকলেও সে গম্ভীর হয়ে আছে।তেমন একটা কথাও বলছে না।এতে অবশ্য ইয়াদ মধু দুজনেরই খারাপ লাগছে কিন্তু কেউই প্রকাশ করছে না।

নাস্তা করে ওরা বেরিয়ে গেলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে।মধুর মা,বোন আর ওই বন্ধ ফোনটা আনতে যাচ্ছে ওরা।প্রথমে ইয়াদ বলেছিলো আইরিন রহমান আর মিলিকে ওদের বাসায় রাখবে কিন্তু মধু মানা করে দেয়।এমনিতেই ইয়াদের বাবা মা ওদের ওপর নারাজ।তার ওপর যদি ওনাদের এখানে আনা হয় তাহলে বিষয়টা খারাপ দেখায়।মধুর কথায় যুক্তি আছে!ইয়াদও চিন্তা করলো আসলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক নেই এখন।তাই ওরা একটা বাসা কাল শপিং করে আসার সময়ই ঠিক করে নেই।ভাগ্য ভালো যে ভাংতি মাসে বাসা পাওয়া গেছে।এমনিতে তো ভাংতি মাসে বাসা পাওয়াটা খুব কঠিন।
————-
আজকে আইরিন রহমান আর মিলি ওদের সাথে ফেরে নি কারণ শুধু আসলেই তো হবে না।আসবাব পত্রগুলোও আনতে হবে তাই ওরা কয়েকদিন পর আসবে।এতে মধু ইয়াদ কেউই বাঁধা প্রদান করে নি।ওরা শুধু ফোনটা নিয়েই চলে আসলো।

ইফাজকে ওই বন্ধ ফোনটা দিয়ে আবার বাড়ি ফিরলো দু’জনে।আজকে সন্ধ্যায় ওরা সাজেক রওনা হবে।তাই দুপুর থেকেই প্যাকিং শুরু করলো।ব্যাগ গুছাতে গুছাতে টুকটাক কথা হচ্ছিলো।হঠাৎ ইরিন দৌড়ে এসে হাপাতে হাপাতে বলল,’ভাইয়া একটু আসো তো।আম্মু কেমন জানি করতেছে।’

সবকিছু রেখেই ইয়াদ মধু দুজনই ছুটলো মায়ের ঘরে।ঘরে গিয়ে দেখলো সাইদা খান শুয়ে আছে।এসি চলছে তবুও তিনি ঘামছেন,প্রচুর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে আর বুকে হাত দিয়ে রেখেছেন।ইয়াদ দিক দিশা না পেয়ে ইফাজকে ফোন দিয়ে বলল।মধু আর ইরিন মাথায় পানি দিতে শুরু করলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ইফাজ অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিলো।ইয়াদ মাকে কোলে করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠালো।কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা হাসপাতালে পৌঁছে গেলো।ইফাজ আগেই জরুরি বিভাগ প্রস্তুত করে রেখেছিলো।সাইদা খানের অবস্থা বেশি খারাপ।উনাকে আইসিইউ তে নেওয়া হয়েছে।ইয়াফ খান জানতেন না।ওনাকেও খবর দেওয়া হয়েছে।আইসিইউ’র বাইরে সবাই চিন্তিত মুখে বসে আছে।কারো মুখে কথা নেই।ইয়াদ তো কতকিছু বসে তো কতক্ষণ পায়চারি করে।ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
———–
কিছুক্ষণ পর ইফাজ আইসিইউ থেকে বের হওয়ার পরই ইয়াদসহ সবাই এগিয়ে গেলো।ইফাজ মাক্স খুলে বলল,’আরেকটু দেরি হলে অনেক ক্ষতি হতো।প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারতো।কিন্তু এখন ঠিক আছে।বেশি ট্রেসের ফলে আর ঔষুধ নিয়মিত না খাওয়ার ফলে হয়েছে।এখন কোনো রকমের উত্তেজিত করে এমন কথা বলা যাবে না।কেবিনে দিচ্ছি একটু পর।’

সাইদা খানকে কেবিনে দেওয়ার পর প্রথমে ইয়াফ খান দেখা করলেন।তারপর ইরিন।এরপর ইয়াদ।কিন্তু ইয়াদের সাথে সাইদা খান কথা বললেন না।ইয়াদ মায়ের বেডের সামনে এসে অপরাধী কন্ঠে বলল,’মা কথা বলো।’

সাইদা খান অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।ইয়াদের দিকে তাকালো না।ইয়াদ কি করবে বুঝতে পারছে না।ওর ও তো কষ্ট হচ্ছে।মায়ের সাড়া না পেয়ে আবার বলল,’ও মা কথা বলো।’

তারপরেও সাইদা খান কিছু বললেন না।ইয়াদ নিরুপায় হয়ে চলে যেতে নিলেই সাইদা খান বলে উঠলো,’কথা বলবো তোর সাথে তবে এক শর্তে।তুই ওই মেয়ে কে চলে যেতে বলবি তোর জীবন থেকে।হয় ওই মেয়ে নাহয় মা।’

ইতিমধ্যে ইফাজও রুমে চলে এসেছে এবং সেও শর্তের কথা শুনেছে।ইয়াদ করুণ চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালো।ইফাজ ইশারায় বলল মা যা বলছে তা করতে।কিন্তু ইয়াদের মন মানছে না।কথা মুখে আটকে আসছে।

ইরিন মধুকে নিয়ে কেবিনে ঢুকলো।মধু ধীরে ধীরে সাইদা খানের বেডের দিকে এগিয়ে গেলো।সাইদা খান ইয়াদকে ইশারা দিলেন।ইয়াদ মধুর দিকে করুণ চোখে চাইলো।ইয়াদের চাহনী দেখেই মধু কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো।নিজেকে সামলে নিলো।যাইহোক সে মেনে নিবে।ইয়াদ অনেক্ক্ষণ ধরে বলার চেষ্টা করছে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ওর মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছে না।

অনেক চেষ্টা করে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,’মধু তুমি আ আমার জীবন থেকে চলে যাও।’এটা বলার পর ইয়াদ খেয়াল করলো ও কান্না করছে।ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।মধুর চোখেও পানি এসেছিলো কিন্তু নিজেকে সামলে একটা ম্লান হাসি দিয়ে মধু বেরিয়ে গেলো।ইয়াদও পেছনে যেতে নিলে সাইদা খান ওর হাত ধরে ফেলেন।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে মধু ফুটপাতের রাস্তা ধরে হাটতে থাকে।ভিষণ রোদ।দরদর করে ঘামছে মধু।তবুও হাটা থামাচ্ছে না।সাথে ফোন,টাকা কিছু নেই।জানেও না কোথায় যাবে।ফোন থাকলে নাহয় আরিয়াকে বলা যেতো কিন্তু এখন!

হাঁটতে হাঁটতে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলেই দেখলো ওকে কেউ ধরে ফেলেছে।সামনের মানুষটার দিকে তাকাতেই দেখলো আরিয়া ওকে ধরে আছে।কি অদ্ভুত!এখনই মনে মনে আরিয়াকে স্মরণ করছিলো আর এখনই দেখা হয়ে গেলো।
এমন বিধ্বস্ত চেহারা দেখে আরিয়া বিচলিত হয়ে জিগ্যেস করলো,’কি রে,কি হইছে তোর?এই অবস্থা কেন?ভাইয়া কই?’

মধু হাসলো।বলল,’কয়টার উত্তর দিবো।আস্তে আস্তে বল।’

‘একটা একটা করে উত্তর দে।’

‘দেব।আগে বল তোর বাসায় আজ রাতটা থাকতে পারবো তো?’

আরিয়া পূর্বের চেয়েও বেশি বিচলিত হয়ে বলল,’কি হয়েছে রে তোর?দাড়া আমি এখনি ভাইয়াকে ফোন দিচ্ছি।’

মধু বাধা দিয়ে বলল,’পাকনামি করিস না।যেটা জিগ্যেস করলাম সেটার উত্তর দে।তা নাহলে বলে দে আমি অন্য কোথাও যাই।’

‘থাকতে পারবি সমস্যা নেই।আগে বল কি হয়েছে?’

‘বলবো।তার আগে তুই বল এখন কোথায় যাচ্ছিস?’

‘বাসায় যাচ্ছি।’

‘তাহলে চল।বাসায় গিয়েই বলি।’

আরিয়া একটা রিকাশ নিলো।তারপর দুজনেই সেখানে চড়লো।বাসায় এসে মধুকে রুমে নিয়ে বসালো।তারপর বলল,’তুই শুধু একঘন্টা অপেক্ষা কর।আমি একটা প্রাইভেট পড়িয়ে আসছি।শাওয়ার নিলে নিয়ে নে।আমার জামা কাপড় আলমারিতে আছে।ফ্রিজেও খাবার আছে।খেয়ে নিস।বোরিং লাগলে টিভি/ল্যাপটপ যেটা ইচ্ছা চালাবি।আর কেউ নক করলে খুলবি না।আমার কাছে এক্সট্রা চাবি আছে।’

‘আচ্ছা এবার তুই যা।’মধু বালিশে হেলান দিয়ে বলল।

আইরিন একগ্লাস পানি খেয়ে বেরিয়ে গেলো।

একঘন্টার জায়গায় দেড়ঘন্টা পর এসেছে আরিয়া।ততক্ষণে মধু শাওয়ার নিয়ে খেয়ে টিভি দেখতে লাগলো।আরিয়া বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে দু’কাপ চা নিয়ে আসলো।এক কাপ মধুকে দিয়ে নিজের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল,’এবার বল কাহিনি কি?ভাইয়ার সাথে কি রাগ করেছিস?’

‘না।অন্যকিছু।’

‘তো বল না।’

মধু একে একে সব বলল।সব শুনে আরিয়া বলল,’এখানে ইয়াদ ভাইয়ের দোষ নাই।সে নিরুপায়।’

‘আমি জানি ইয়াদের দোষ নাই।দোষটা আমারই।বিয়েটাই করা উচিত হয় নি।’

‘এভাবে বলিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে।’আরিয়া স্বান্তনার স্বরে বলল।

এরইমধ্যে ইয়াদ আরিয়াকে ফোন দিয়েছে।আরিয়া ফোন ধরতে নিলেই মধু মানা করে দেয়।মধু বারণ করায় আর ধরে নি তবে আরিয়ার মনে হলো বলে দেওয়া উচিত কিন্তু মধুর জন্য পারবে না।

চা খেয়ে শাওয়ার নিতে গেলো আরিয়া।এরইমধ্যে আরিয়ার ফোনে অনেকবার কল দিয়ে ফেলেছে ইয়াদ।

চলবে…

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪৮
#Arshi_Ayat

আরিয়া ফোন না ধরায় বারবার মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা আসছে ইয়াদের।কোথায় গেলো মেয়েটা?ওর সাথে তো ফোনও নেই।সন্ধ্যাও হয়ে আসছে।এদিকে আরিয়াও ফোন তুলছে না।ইয়াদ আরিয়াকে প্রায় পঞ্চাশবারের মতো ফোন দিয়েছে কিন্তু আরিয়া ধরে নি।তাই আর ফোন না দিয়ে ওর বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

সন্ধ্যার সময় সাইদা খানকে বাসায় নিয়ে আসা হলো।এখন অনেকটাই ভালো আছেন তবে ইয়াদকে কাছ ছাড়া করছেন না এইজন্যই ইয়াদ চাইলেও আরিয়ার বাসায় যেতে পারছে না।এদিকে টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে।যদি মধু আরিয়ার বাসায় না যায় তবে?ইয়াদ মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করছে যেনো মধু আরিয়ার বাসায়ই যায়।যেনো ওর কোনো ক্ষতি না হয়।
————–
তিন/চার মাস ধরে বইয়ের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই মধুর।অনেকটা পিছিয়ে গেছে।তার ওপর মিডটার্মও দেয় নি।সামনে আরেকটা পরীক্ষা আছে।স্যারের সাথে কথা বলতে হবে।এবার তো ফাইনাল ইয়ার।কোনোমতেই খামখেয়ালি করা যাবে না।এই চিন্তায় মধু আরিয়ার সাথে বই নিয়ে বসলো।কিন্তু পড়ায় মন বসে না।অস্থির লাগছে!কোনো এক অজানা কারণে রাগ হচ্ছে ইয়াদের ওপর।কিন্তু ওর ওপর রাগ করে তো লাভ নেই।কতক্ষণ বইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু একি!মনোযোগের বালাই ও নেই।বইটা বন্ধ করে আরিয়াকে বলল,’তোর ফোনটা দে তো একটু।’

‘কেনো?ভাইয়াকে ফোন দিবি?’

‘না।এমনি সময় দেখবো কয়টা বাজে।’

‘দেয়ালেই তো ঘড়ি আছে।ওখানে দেখলেই তো পারিস।’

মধু দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’দিতে বলছি দিবি।এতো কথা বলিস কেন?’

আরিয়া আর বাক্যব্যয় না করে মধুকে ফোন দিয়ে দিলো।সময় দেখা তো কেবল বাহানা মধুতো দেখতে চেয়েছিলো ইয়াদ আর ফোন দেয় কি না!কিন্তু না আর দেয় নি।মধুর অভিমান হলো!এই তাহলে ভালোবাসা?একটু খোঁজও নিলো না!মধু মুখ গোমড়া করে আরিয়াকে ফোন আবার ফেরত দিলো।এদিকে একটু আগে আরিয়া মেসেজে বলে দিয়েছে মধু ওর বাসায়।আরিয়ার মেসেজ পেয়েই ইয়াদ নিশ্চিন্ত হয়েছে।মেসেজ দিয়েই আরিয়া ডিলিট করে দিয়েছে।যেনো মধু না দেখে।দেখলেই চুল টেনে ছিড়বে।
————
রাত ১১.০০ টা..
মাত্রই ইয়াদ ছাড়া পেয়েছে।সাইদা খান সবে মাত্র শুয়েছে।এতক্ষণ ওনার পাশেই বসিয়ে রেখেছিলেন প্রাণের ছেলে ইয়াদকে।মা’কে শুইয়ে দিয়ে ইয়াদ নিজের রুমে গেলো।রুমে আসতেই মন খারাপ হয়ে গেলো।ইশ!সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এতক্ষণে ওরা সাজেক থাকতো।

ইয়াদ অগোছালো অবস্থা পড়ে থাকা জামা কাপড়গুলো ভাজ করে আলমারিতে রাখলে।ট্রলিগুলোর চেইন বন্ধ করে খাটের পাশে ফেলে রাখলো।তারপর একটা শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে দেখলো ড্রেসিং টেবিলের ওপর ইফাজের গাড়ির চাবি আর ওটার নিচে একটা কাগজের টুকরা।ইয়াদ চাবিটা সরিয়া কাগজটা নিলো।কাগজে লেখা,”ইয়াদ,মা ঘুমালে তুই মধুর কাছে চলে যাস।ও ওর বান্ধবীদের বাসায় আছে আমি জানতে পেরেছি।গাড়ির চাবি দিলাম।ভোরের আগে ফিরে আসবি।তোর বারান্দায় আমি মই লাগিয়ে দিয়েছি।আর শোন যাওয়ার আগে দরজা লক করে যাবি।দেরি করিস না।’

লেখাটা পড়ে ইয়াদের ঠোঁটে হাসি ফুটলো।আসলেই এখন গাড়ির চাবিটার খুব প্রয়োজন ছিলো।মনে মনে ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে দরজা ভেতর থেকে লক করে ইয়াদ বেরিয়ে গেলো প্রিয়তমার অভিমান ভাঙাতে।
——————
দুই বান্ধবী খাওয়া দাওয়া করে কতক্ষণ গল্পগুজব করলো।এখন শুতে যাওয়ার পালা।কিন্তু আরিয়া আজ মধুর সাথে শোবে না কারণ রাতে ইয়াদ আসতে পারে।আসার সম্ভবনা নাইন্টি পার্সেন্ট।তাই বাহানা দিয়ে আরিয়া অন্যরুমে ঘুমাতে গেলো।মধু মন খারাপ করে রুমে এসে শুয়ে পড়লো।শুয়ে তো পড়লো কিন্তু ঘুম তো আসে না।তবুও অনেক্ক্ষণ চেষ্টা করার পর চোখটা লেগেছে।কিন্তু হঠাৎ করে রুমে কিছু একটার শব্দ হলো।মধুর ঘুম ছুটে গেলো।ভয়ে উঠে বসলো ও।অন্ধকারে একটা মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে।মধু ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো।আর সাথে সাথেই অবয়ব দ্রুত মধুর মুখ চেপে ধরে কানেকানে বলল,’চিল্লাইয়ো না মধু।আমি ইয়াদ।রিল্যাক্স।’

গলা শুনে মধু বুঝতে পারলো এটা ইয়াদ।ইয়াদ মধুর মুখ থেকে হাত সরাতেই মধু উঠে গিয়ে লাইট জ্বালালো।আশ্চর্য হয়ে বলল,’আপনি আসলেন কিভাবে?’

‘আরিয়া দরজা খুলে দিয়েছিলো।’

মধু কপট রাগ নিয়ে বলল,’ওর একদিন কি আমার একদিন।এইজন্যই বলি আমার সাথে শুলো না কেনো আজ!এই তার কারণ।’

‘জ্বি ম্যাম।’

‘তো আসছো কেনো?’কঠর গলায় বলল মধু।

‘বউয়ের অভিমান ভাঙাতে।’

মধু গম্ভীর স্বরে বলল,’আমি অভিমান করি নি।তুমি বাড়ি ফিরে যাও।তোমার মা যা বলে করো।’

ইয়াদ বসা থেকে উঠে গিয়ে মধুর সামনে দাড়ালো।দুইহাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো কিন্তু মধু নিজের দুইহাত দিয়ে ধাক্কা প্রদান করতে ব্যস্ত তবুও ইয়াদ ওকে বাহুতে আবদ্ধ করেই ফেললো।কিছুক্ষণ ওভাবে থাকার পর মধু শান্ত হলো।চুপচাপ লেপ্টে আছে ইয়াদের বুকের ওপর।মধু শান্ত হবার পর ইয়াদ শান্ত কন্ঠে বলল,’বউ,ও বউ শুনছো?’

‘বলো।’মধু ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিলো।

‘রাগ হয়েছে আমার ওপর?’

মধু মাথা নেড়ে ‘না’ বলল।ইয়াদ আবার বলল,’তাহলে কি অভিমান করেছে আমার বউ?’

পূর্বের ন্যায় মধু ঘাড় ওপর নিচ করে ‘হ্যাঁ’ বলল।ইয়াদ হাসলো।তারপর ফিসফিস করে বলল,’ঠিকাছে আজ তাহলে অভিমান ভাঙাই বউয়ের।’

দূরে কোথাও নিশাচর পাখি ডাকছে।হয়তো খাবারের সন্ধানে বের হয়েছে।রাতের এই প্রহরে সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে।কেউ হয়তো রাত জাগা পাখি হয়ে ভালোবাসার মানুষের সাথে কথাবলায় ব্যস্ত তো কেউ আবার ঘুমাতে।আবার কেউ কেউ তার ভালোবাসার মানুষের অভিমান ভাঙাতে।এই দলে ইয়াদও আছে।সে ব্যস্ত তার ভালোবাসার মানুষের অভিমান ভাঙাতে।

রাতের প্রায় শেষ প্রহর।মধু ইয়াদের বুকে চুপটি করে শুয়ে আছে।ইয়াদ চুপ।মধুর চুলগুলো একবার হাতে পেঁচাচ্ছে আবার খুলছে।একটা পর্যায়ে ইয়াদ বলল,’জানপাখি,আমার যে এবার যেতে হবে।ভোর হয়ে আসছে।’

মধুর নিমিষেই মন খারাপ হয়ে গেলো।সম্পর্কটা এমন কেনো হয়ে গেলো?বৈধতা থাকা স্বত্তেও বউয়ের কাছে লুকিয়ে আসতে হয়!মধু ক্ষীণ গলায় বলল,’আচ্ছা আমাদের সম্পর্কটা কি ঠিক হবে?’

‘হবে বউ।সব হবে।আমি সব ঠিক করবো।আমার মা তোমাকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিবে।কথা দিলাম।শুধু একটু সময় দাও।বিশ্বাস রেখো।’

‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি ইয়াদ।’

যাওয়ার সময় ইয়াদ মধুকে চেপে ধরলো নিজের সাথে।তারপর দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,’অভিমান কি এখনো আছে বউ?’

মধু লজ্জা লাল নীল হয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইলো।ইয়াদের মজাই লাগছে মধুকে লজ্জা দিতে তাই আবার বলল,’আমার এখন গিয়ে আবার গোসল করতে হবে।ভাই/ভাবি কি ভাববে বলো তো?’

এবার মধু কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’তাহলে আসছো কেনো?আমি আসতে বলছিলাম?’

‘জানপাখি রাগ করে না।আমি তো এখন চলে যাবে।যাওয়ার আগে একটা আদর দাও।’

‘ইশ!এতো বেহায়া তুমি?যাও তো!’

‘তাড়িয়ে দিচ্ছো?’

‘না না আসো আমার কোলে বসে থাকো।’

এবার সত্যি মধু রেগে যাচ্ছে বলে ইয়াদ ঠান্ডা করার জন্য বলল,’আচ্ছা ঠিকাছে যাচ্ছি।তুমি তো দিবে না।আমিই দিয়ে দেই।’
এটা বলেই ইয়াদ টুকুস করে কপালে একটা চুমু দিয়ে মধুকে ছেড়ে দিলো।

ইয়াদকে বিদায় দিয়ে মধু ঘরে এসে শাওয়ার নিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।এখন সাড়ে চারটা বাজে।ঘুমের চৌদ্দটা বেজে গেছে।তবুও মধুর মনের আঙিনায় বসন্তের হাওয়া দিচ্ছে,কোকিল ডাকছে,ফুল ফুটছে।মধু আনমনেই লজ্জা পেলো।তারপর দুইহাতে মুখ ঢেকে হাসলো।কিন্তু ইয়াদের মায়ের কথা মনে হতেই চোখে পানি চলে এলো।কোনোমতে নিজেকে শান্ত করে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টায় মেতে উঠলো।

এদিকে ইয়াদও ঘরে ফিরে শাওয়ার নিলো।তারপর হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিলো।নইলে চুল ভেজা দেখলে মায়ের সন্দেহ হতে পারে।কিছুদিন এভাবেই চলতে হবে।তারপর একটা ব্যাবস্থা নিতেই হবে।

সকাল দশটা বাজে ইয়াদ ঘুম থেকে উঠলো সাইদা খানের ডাকে।সাইদা খান ইয়াদের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল,’বাবা ওঠো।ফ্রেশ হও।চা নিয়ে আসছি।চা খাও।’

ইয়াদ আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো।সাইদা খান ছেলেকে ফ্রেশ হয়ে চা খেতে বলে চলে গেলেন।ইয়াদ ফ্রেশ হয়ে আরিয়ার ফোনে ফোন দিলো।মধু রিসিভ করতেই ইয়াদ বলল,’কি করো বউ?’

‘শুয়ে আছি।তুমি?’

‘তোমাকে মিস করি।’

‘এই যে ধান্দাবাজি কম করো সোয়ামি।আমি সব বুঝি।’

‘কিচ্ছু বোঝো না তুমি।আচ্ছা এখন ওঠো ফ্রেশ হও।নাস্তা করো।’

‘জ্বি জনাব উঠছি।আপনিও নাস্তা করেন।’

মধুর কথা শেষ হতেই ইয়াদ হুট করে বলল,’এই শোনো দেখো তো তোমার চুল শুকিয়েছে কি না?না আবার মানুষ সন্দেহ করতে পারো।’

‘ইশ!কি অসভ্য।’
এটা বলেই মধু ফোন রেখে দিলো।আর ইয়াদ হাসতে হাসতে চায়ে চুমুক দিলো।

চলবে….

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৪৫+৪৬

0

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪৫
#Arshi_Ayat

মধুর ভয় লাগছে ইয়াদের বসায় যেতে।প্রথম প্রথম যখন ইয়াদের বাসায় যেতো তখন এমন অনুভূতি হতো পরে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়।কিন্তু আজকে ভেতরে ভেতরে প্রথম দিনের মতো কেমন যেনো জড়তা কাজ করছে।

ইয়াদ দরজায় নক করলো।দুইবার নক করতেই সাইদা খান দরজা খুললো।সাইদা খানকে দেখে মধু সালাম করলো।কিন্তু সাইদা খানের কোনো ভাবান্তর নেই।বোঝা যাচ্ছে না ভেতরে কি চলছে।ইয়াদ মধুর হাত ধরে বলল,’মা,আমরা বিয়ে করেছি।’
সাইদা খান কিছু বললেন না।ভেতরে গিয়ে ইয়াফ খানকে ডেকে নিয়ে এলেন।তারপর রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,’বিয়ে করেছি মানে?তুই তো বলেছিলি ওকে আনতে যাবি।বিয়ে করবি তো বলিস নি।’

‘এটা বলার কি আছে মা?ওকে আমি এখানে হোক আর ওখানেই হোক বিয়ে করতাম ই।’

‘সেইজন্য কাউকে না জানিয়ে?’ইয়াফ খান গম্ভীর কন্ঠে বললেন।

‘এখানে না জানানোর কিছু তো দেখছি না আমি।তোমরা তো সব জানতে।তাহলে এতো অবাক হচ্ছো কেন?’

‘তোর কিন্তু সামিহার সাথে এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে ইয়াদ!’সাইদা খান রুষ্ট হয়ে বললেন।

তিন/চার দিন আগে যে মেয়েটার সাথে ইয়াদের এঙ্গেজমেন্ট হয়েছিলো ওই মেয়েটার নাম সামিহা।ইয়াদ এই প্রথম ওর নাম জানলো।অবশ্য এর আগে জানার প্রয়োজন বোধ করে নি।ইয়াদ মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখে বলল,’সো হোয়াট?এঙ্গেজমেন্ট কিন্তু আমার ইচ্ছাতে হয় নি।তোমরা ব্ল্যাকমেইল করেছো আমাকে।আর এমনিতেও ওই বিয়েটা এমনিতেও করতাম না।’

‘এখন তোর জন্য আমাদের কথার খেলাফ হলো।’ইয়াফ খান গম্ভীর কন্ঠে বললেন।

‘তোমাদের বলেছে কে কথা দিতে?আমি বলেছিলাম?আমার সাথে তোমরা এই বিষয়ে কথা বলেছিলে?বলো নি।নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছো।যেখানে আমারই মত নেই সেখানে কথার খেলাফ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না।’

‘এখন কি জবাব দিবো ওদের?ইয়াফ খান প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ইয়াদকে।

ইয়াদ ডাইনিং টেবিল থেকে একটা গ্লাস নিয়ে পানি পান করলো।তারপর রিল্যাক্স মুডে মধুর দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলল,’যেটা সত্যি সেটাই বলবে।বলবে তোমাদের ছেলে ইয়াদ তার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করেছে।তাকে ঠকায় নি,ছেড়ে যায় নি।সবসময় পাশে ছিলো,আছে,আজীবন থাকবে।’

এবার সাইদা খান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মধুর দিকে চেয়ে বলল,’সেটা নাহয় ঠিকাছে কিন্তু এতোদিন ও কোথায় ছিলো?আর এতো নাটক করলো কেনো?’

মধু নিচের দিকে তাকিয়ে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে আছে।ইয়াদ মধুর পাশে গিয়ে দাড়ালো।তারপর বলল,’আহা!মা।কি মুশকিল!সবে মাত্র আসলাম।এখনই তোমাদের সব কৈফিয়ত দেওয়া লাগবে?একটু ফ্রেশ হই।আর ও তো পালিয়ে যাচ্ছে না।’

সাইদা খানকে এটা বলেই ইয়াদ মধুকে উদ্দেশ্য করে বলল,’তুমি ঘরে যাও।আমি আসছি।’

এই মুহুর্তে এই কথাটার অপেক্ষাতেই ছিলো মধু।এখানে থাকতে অস্বস্তি লাগছিলো।তার ওপর কি বলবে ইয়াদের বাবা মা কে?ওনারা যদি না মানতে পারেন?এটা নিয়ে যদি ওদের সম্পর্ক খারাপ হয় তাহলে?টেনশনে মাথা কাজ করছে না মধুর।একদিকে নাছোড়বান্দা ইয়াদ অন্যদিকে ওর পরিবার।

মধু চুপচাপ স্বামীর আদেশে ঘরে চলে গেলো।ইয়াদ আসলো একটু পরে।মধু বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো।ইয়াদ বারান্দায় এসে মধুকে এমন উদাস দেখে ওর গা ঘেঁষে দাড়ালো।ইয়াদের উপস্থিতি টের পেয়ে মধু শুকনো মুখে ওর দিকে চাইলে।ইয়াদ ভরসার হাত রাখলো ওর হাতে।বলল,’চিন্তা করো না।আমি তো আছি।’

মধু ম্লান হেসে বলল,’হ্যাঁ,তুমি আছো বলেই তো আমি আছি।তুমি ছাড়া তো আমি নিজেকে কল্পনাও করতে পারি না।তবে জানো খুব চিন্তা হয় আমার!আমার জন্য সবকিছু তছনছ হয়ে যাবে না তো!’

ইয়াদ মধুকে ঘুরিয়ে এনে জড়িয়ে ধরলো।একহাত ওর মাথায় রাখলো।বলল,’কিচ্ছু হবে না।ধৈর্য রাখো।এখনো অনেক কিছু বাকি আমাদের জীবনের।ইনশাআল্লাহ জীবনের শেষ দিন অব্দি তোমার সাথে আছি।তোমার ছায়া তোমাকে ছেড়ে চলে গেলেও আমি যাবো না।নিজেই তোমার ছায়া হয়ে যাবো।’

মধু নিঃশব্দে কাঁদলো।এমন কেনো মানুষটা?এতো ভালোবাসে কেনো?এই মানুষটার জন্যই বোধহয় আরেকবার বাঁচার অনুপাতে পেলো সে।এইজীবনে কয়জনই বা এমন একজন পায়!সেদিক থেকে দেখতে গেলে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়!

ইয়াদ মধুর মুখটা তুলে ধরে চোখের পানি মছু দিয়ে বলল,’কাঁদবে না।নিজে হাসবে,অন্যকে হাসাবে।দেখবে জীবন সুন্দর।এখন যাও শাওয়ার নাও।আমি ইরিনের একটা শাড়ি এনেছি।আপাতত ওটা পরো।আমরা বিকেলে শপিং এ বের হবো।’
ইয়াদ মধুর কপালে একটা গভীর চুমু একে বাহুমুক্ত করলো।মধু শওয়ার নিতে চলে গেলো।
———–
দুপুরে খাবার টেবিলে সবাই আছে।শুধু নিহা আর ইফাজ ছাড়া।ইফাজ এখন টেবিলে খায় না কারণ নিহার সিড়ি দিয়ে নামতে কষ্ট হয়।তাই ওরা নিজেদের ঘরে খায়।আগে ইফাজ হসপিটাল থেকে দুপুরে না আসলেও এখন নিহার জন্য আসতে হচ্ছে।তবে আজ সে আসে নি কারণ দুপুরে একটা অপারেশন আছে ওর।সর্বপরি আদর্শ স্বামী হওয়ার কোনো ত্রুটি রাখে নি ইফাজ।আগের থেকে অনেক বেশি সময় দেয় নিহাকে।এতে নিহা খুশীই বটে!

খাওয়ার টেবিলে পিনপতন নিরবতা।সাইদা খান,ইরিন আর ইয়াফ খান একপাশে বসেছেন।আরেক পাশে মধু আর ইয়াদ।হঠাৎ খাওয়ার মাঝখানেই সাইদা খান বললেন,’আমাদের প্রশ্নের কিন্তু কোনো উত্তর পেলাম না ইয়াদ।’

ইয়াদ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’খাওয়া শেষ হোক।তারপর বলি?’

সাইদা খান কিছু বললেন না।কিন্তু মধুর মাথায় ঢুকছে না ইয়াদ এতো ঘুরাচ্ছে কেনো!

খাওয়া শেষে ইরিন,সাইদা খান,ইয়াফ খান এক সাথে সোফায় বসলেন।সামনাসামনি সোফায় মধু আর ইয়াদ বসল।কোনোরকম ভূমিকা না দিয়েই শুরু থেকে কি কি হয়েছে মধুর সাথে সব বলল।সব শুনে গম্ভীর মুখে সাইদা খান উঠে চলে গেলেন।আর ইয়াফ খান ইয়াদের দিকে চেয়ে বললেন,’বিয়ে করারা আগে এগুলো একবার আমাদের জানানো উচিত ছিলো।’

ইয়াদ তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,’জানালে বোধহয় শুভ কাজটা আমায় সারতে দিতে তোমরা!কবেই ব্ল্যাকমেইল শুরু করে দিতে।’

‘কাজটা ভালো করো নি তুমি।ভবিষ্যতে দেখো যেনো পস্তাতে না হয়।’গম্ভীর স্বরে কথাটা বলেই ইয়াফ খান চলে গেলো।এখন শুধু ইরিন ই বাকি।ইরিন উঠে এসে মধুর পাশে বসে বলল,’কে কি ভাবছে আমি জানি না।আমি শুধু এটুকুই জানি আমার ভাই তোমাকে ভালোবাসে।তুমি ওকে কষ্ট দিও না।আর আমি তোমাকে ভাবি হিসেবে মেনে নিলাম।তুমি আমার ছোটোভাবি।’

ইয়াদ মনে মনে ইরিনের ওপর সন্তুষ্ট হলো।যাক একজন মানুষ অন্তত ওকে বুঝেছে।
————
দুপুরের সময়টা অনেকেই ডিউটিতে থাকে আবার অনেকেই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে আর যাদের কাজ থাকে না তারা অভ্যাস মতো একটা ভাতঘুম দিয়ে নেয়।কিন্তু যদের অভ্যাস নেই ভাতঘুমের আবার কাজও নেই তাদের কাছে সময়টা বোরিং মনে হয়।এই দলে মধুও আছে।আগে যখন ভার্সিটিতে ক্লাস থাকতো,টিউশনি করতে হতো তখন ঘুমানো তো দূরে থাক শান্তিতে একদণ্ড বসারও সুযোগ পেতো না।আর আজ না ক্লাস,না টিউশনি,না ঘুম কিচ্ছু নেই।মধু উদাস হয়ে খাটের ওপর বসে আছে।আর ইয়াদ ল্যাপটপে দেখছে কোন জায়গাটা ভালো হবে।এক সপ্তাহ কি এমনিতেই কাটিয়ে দেবে নাকি?এই একসপ্তাহে ‘মধু উইথ মধুচন্দ্রিমায়’ যাওয়ার প্ল্যান আছে।ইয়াদ কয়েকটা জায়গা সিলেক্ট করে মধুকে দেখালো।মধু সবগুলোই দেখলো।সবগুলোই সুন্দর।তাছাড়া এইসব জায়গা গুলো ছবিতেই দেখেছে মধু।যাওয়ার আর ভাগ্য হয় নি।

দুজনে মিলে পরিকল্পনা করলো ওরা মেঘের শহর সাজেক যাবে।অবশ্য দুজনের পরিকল্পনা বলা ভুল!এটা মধুরই পরিকল্পনা।কারণ লোকমুখে সাজেকে এমন রসালো বর্ণনা শুনে সেখানেই যাওয়ার ইচ্ছে আছে।ইয়াদ অবশ্য এর আগেও কয়েকবার গিয়েছে।তবে তখন সিঙ্গেল ছিলো বউ ছিলো না।এবার বউ আছে।দেখা যাক বউয়ের সাথে মেঘের শহর কেমন লাগে।তাই আর মধুর কথায় দ্বিমত করলো না।হঠাৎ ইয়াদ মধুকে ডেকে বলল,’আচ্ছা তুমি আমার ওপর রেগে নেই তো?’

‘কেনো?’মধু অবাক হয়ে বলল।

‘এই যে আমার এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে কিন্তু আমি তোমাকে বলি নি।’

‘না রাগ লাগে নি কারণ তোমাকে বাধ্য করা হয়েছিলো।আর এমনিতেও এখন রাগ করলে কি সব কিছু ঠিক হবে?তবে শুধু শুধু রাগ করবো কেনো?’

ইয়াদ মধুর দিকে চেয়ে প্রসন্ন হাসলো।সম্পর্কে স্পষ্টতা থাকা ভালো এতে সম্পর্ক সুন্দর হয়।

দুজনের একজনও দুপুরে ঘুমায় নি।জায়গা সিলেক্ট করতে করতে আর রিসোর্ট বুকিং দিতেই সময় শেষ।তারপর বিকেলে দুজনে বের হলো।বের হওয়ার সময় ইয়াদ সাইদা খানকে বলতে এসেছিলেন কিন্তু সাইদা খান ইয়াদের কথা না শুনে রুমের দরজা আটকে দিলো।বিষয়টা মধু ইয়াদ দুজনেই লক্ষ করলো। মধুর খারাপ লাগলো বিষয়টা।ইয়াদেরও খারাপ লেগেছে কিন্তু ও বুঝতে দেয় নি বিষয়টা।বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিলো।রিকশায় উঠে মধু চুপচাপ বসে রইলো।কোনোকথা নেই।ইয়াদ নিজেই নিরবতা ভেঙে বলল,’মধু মন খারাপ করো না।ওনারা এখন একটু রেগে আছেন কিন্তু পরে ঠিক হয়ে যাবে।’

মধু কিছু বলল না।কেবল ইয়াদের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো।কি হওয়ার ছিলো আর কি হয়ে গেলো!যে মানুষগুলো একটা সময় এতো ভালোবাসতো তারা এখন ঘৃণা করে।একটা দুর্ঘটনা যেনো সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।যেখানে ওর কোনো দোষই নেই সেখানে সমাজ কিন্তু ওকেই দোষী বানাচ্ছে।আর যারা এগুলো করছে তারা সমাজে দিব্যি মাথা উঁচু করে হাঁটছে।এদের কি শাস্তি হবে না?

চলবে….

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪৬
#Arshi_Ayat

ফুটপাত ধরে ইয়াদ আর মধু দু’জনেই হাটছে।দুজনের হাতেই শপিং ব্যাগ।শপিং শেষে ইয়াদ বলল ফুচকা খাবে।মধু না করে নি।অবশ্য না করার কোনো বিষয়ই নেই।অনেকদিন ধরে ফুচকা খাওয়া হয় না।প্রায় তিন বছর।এর আগে যখন ইয়াদ ছিলো সপ্তাহে প্রতিদিনই খাওয়া হতো।অনেকদিন পর পুরোনো স্মৃতি গুলো ভেসে উঠলো।সে সময়টা তারা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলো আর সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক পাল্টে আজ ওরা স্বামী-স্ত্রী!সম্পর্কটা পূর্ণতা পেলো।মধু আনমনেই হাসলো।ইয়াদ মধুর হাসি লক্ষ করে বলল,’হাসছো যে?’

মধু হাসিটা বজায় রেখে বলল,’পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে।’

ইয়াদও হাসলো।বলল,’হ্যাঁ সময়গুলো মনে পড়ে খুব।তবে এখন থেকে মাঝেমধ্যেই বিকেলে আমরা বের হবো।ফিরে যাবো আমাদের সময়ে।’

টুকটাক কথা আর স্মৃতিচারণ করতে করতেই ওরা ফুচকার দোকানের সামনে পৌঁছে গেলো।এখন তেমন ভিড় নেই।এইদিকটায় বিকেলে প্রচন্ড ভিড় হয়।বেশিরভাগ প্রেমিকযুগল বিকেলে এখানে আসে।তিন বছর আগে ওরাও আসতো।আগে এখানে শুধু চটপটি আর ফুচকা বিক্রি হতো কিন্তু এখন তার সাথে ঝালমুড়ি,বিভিন্ন রকমের আচার,রোল,গ্রীল এগুলোও বিক্রি হয়।

ইয়াদ মধুকে জিগ্যেস করলো,’ফুচকা?চটপটি?নাকি ঝালমুড়ি?’

মধু দুষ্টু হেসে বলল,’তিনটাই।’

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে বলল,’পেট খারাপ করবে কিন্তু!’

‘করবে না।তুমি কি খাবে?

‘আমি শুধু ফুচকা।’

ইয়াদ অর্ডার দিয়ে দিলো।হঠাৎ একটা মেয়ে এসে ইয়াদকে সালাম দিয়ে বলল,’আরে স্যার আপনি এখানে?’

ইয়াদ অবাক হলেও প্রকাশ করলো না।সালামের উত্তর দিয়ে বলল,’এইতো বেড়াতে বের হলাম।’

‘স্যার আমি ফারিয়া।২য় বর্ষের বোটানি ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট।’

ইয়াদ বোটানি ডিপার্টমেন্টে ক্লাস নিলেও স্টুডেন্ট দু একজন ছাড়া আর কাউকেই তেমন চেনে না।তাই বলার মতো কিছু না পেয়ে বলল,’ওহ!’

কিন্তু ফারিয়া এমন জাবাবে মোটেও নিরুৎসাহিত হলো না।আবার আলাপ জমাবার জন্য বলল,’তো স্যার আপনি কি একা এসেছেন?’

‘না।তোমার ম্যাম ও আছেন সাথে।’এটা বলেই ইয়াদ কিছুটা দূরে অবস্থানরত মধুকে দেখালো।আসলে মেয়েটা যখন এসে আলাপ জমাতে চেষ্টা করলো তখনই মধু একটু সটকে গেলো।তারপর মজা নেওয়া শুরু করলো।

ফারিয়া মধুর দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটাকে সে চেনে।ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট।ফারিয়ার বোনও ফাইনাল ইয়ারে পড়ে তো বোনের ক্লাসে আসা যাওয়া করতে করতে কয়েকবার চেহারাটা দেখেছিলো।এই মেয়ে ইয়াদ স্যারের বউ এটা যেনো ফারিয়ার মানতে কষ্ট হচ্ছিলো।ফারিয়া কৌতুহলী গলায় ইয়াদকে বলল,’স্যার আপনি বিয়ে করলেন কবে?’

‘কালকে।বাদ মাগরিব।আসলে বিয়েটা ঘরোয়া হওয়ায় কাউকে জানানোর সুযোগ হয় নি।’

ফারিয়ার মুখটা চুপসে গেলো।শুকনো মুখে বলল,’ও।’

ইয়াদ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে মধুকে ডাকলো।তারপর ফারিয়াকে দেখিয়ে বলল,’ও আমার স্টুডেন্ট ফারিয়া।’

মধু ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসলো।ফারিয়াও কোনমতে সালাম দিয়ে ইয়াদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।ফারিয়া চলে যাওয়ার পর মধু মুখ ঢেকে হাসা শুরু করলো।ইয়াদ অবাক হয়ে বলল,’হাসছো কেনো?’

মধু হাসতে হাসতেই বলল,’তুমি মেয়েটার মনটাই ভেঙে দিলে।ইশ বেচারি!’

‘হ্যাঁ।এইরকম দু’চারটা মন ভাঙবেই।ওদের মন রাখতে গিয়ে আমি তোমাকে হারাতে পারবো না।’ইয়াদ ঠোঁট বাকিয়ে বলল।

‘আচ্ছা তাই।’এটা বলে মধু আবার হাসতে লাগলো।

আর ইয়াদ কৃত্রিম রাগের ভান করে বলল,’তুমি কি মধু?অন্য মেয়েদের দেখি তাদের স্বামীর সাথে কথা বলুক তো দূরের কথা তাকালেও জেলাস ফিল করে।আর তুমি দূরে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছিলে।’

‘হ্যাঁ তো কি করবো?’

‘তোমার কি জেলাস ফিল হয় না আমায় নিয়ে?’ইয়াদ অভিমানী কন্ঠে বলল।

‘না হয় না।বিশ্বাস করি আমি তোমাকে।আমি আমাদের ভালোবাসাকে বিশ্বাস করি,আমাদের সম্পর্কটাকে বিশ্বাস করি।তুমি যদি আমার হও তাহলে কেউ তোমাকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না,আর যদি আমারই না হয় তাহলে আমি তোমাকে শত চেষ্টা করেও ছিনিয়ে আনতে পারবো না।’

ইয়াদ তৃপ্তির হাসি হাসলো।বিশ্বাস এমনই হওয়া উচিত।সম্পর্কে ভালোবাসার থেকেও বিশ্বাস জরুরী।

দোকানদার অর্ডারমতো সব খাবার দিয়ে দিলো।ইয়াদের সাথে প্রথমে ফুচকা শেষ করলো মধু।তারপর চটপটি খাওয়া শুরু করলো।মাঝেমধ্যে ইয়াদকেও শেয়ার দিলো।তারপর খাওয়া দাওয়া শেষে সেখান থেকে রিকশা নিলো।ইয়াদ রিকশার হুড নামিয়ে দিলো।বাতাসে মধুর সামনের ছোটচুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।মধু বিরক্ত হয়ে সরিয়ে দিতে নিলে ইয়াদ বাঁধা দিয়ে বলল,’প্রেমিকার এই অবাধ্য চুলগুলো সরিয়ে দেওয়া একমাত্র অধিকার শুধু প্রেমিকের।’

মধু কিছু বলল না।ঠোঁট কামড়ে হাসলো।

বাসায় ফিরে ড্রয়িং রুমে দেখলো কেউ নেই।কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দিয়েছে।আগে সবসময় সাইদা খান দরজা খুলতেন কিন্তু আজ!ইয়াদের খারাপ লাগলেও প্রকাশ করলো না কারণ পাছে মধু যদি মন খারাপ করে!যদি ভাবে ওর জন্য এসব হচ্ছে!তাই ইয়াদ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মধুকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।এদিকে সাইদা খান দরজার ফাক দিয়ে ছেলেকে দেখেছেন।কষ্টের কোনো লক্ষণই নেই।ভালোই আছে ছেলে!এই মেয়েটাকে পাওয়ার পর ছেলেটা বদলে গেছে ভেবে সাইদা রহমান দুঃখ পেলেন।
———–
ইফাজ বাসায় এসে সাইদা খানের কাছে সব শুনেছে।সব শুনে মা’কে বুঝিয়েছে কিন্তু কোনো লাভ হয় নি।সাইদা খান অবুঝ!তাই ইফাজ আর ব্যাক ব্যয় না করে ঘরে চলে গেলো।ঘরে এসে দেখলো নিহা শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে।ইফাজকে দেখে বই বন্ধ করে উঠতে নিলেই ইফাজ বলল,’উঠছো কেনো?পড়ো।সমস্যা নেই।আর তোমাকে না বললাম এই সময়টা বেশি নড়াচড়া করা ঠিক না।’

নিহা প্রসন্ন হেসে বলল,’আচ্ছা ডাক্তার সাহেব করবো না।এবার যাও ফ্রেশ হও।’

ইফাজ ফ্রেশ হয়ে এসে বলল,’নিহা আমি একটু ইয়াদের সাথে কথা বলতে যাচ্ছি।আধঘন্টার মধ্যে চলে আসবো।তোমার কিছু লাগলে ডাক দিয়ো বা ফোন দিও।’

‘আচ্ছা।’
ইফাজ চলে যাওয়ার পর নিহা আবারও বইয়ে মনোযোগ দিলো।

মধু মায়ের সাথে কথা বলছিলো আর ইয়াদ ল্যাপটপে কাজ করছিলো।ইফাজ দরজায় নক করলো।ইয়াদ একটু হেসে বলল,’আসো ভাইয়া।’

ইফাজ ঘরে ঢুকলো।শুধু ইফাজ ছাড়া এমন করে দরজা কেউ নক করে না।সবাই হুটহাট ঢুকে যায়।বলা যায় অনেক ভদ্র স্বভাবের একজন।এই ম্যানারস গুলোর জন্যও বাইরে যখন পড়তো তখন অনেক মেয়েই প্রোপজাল দিতো কিন্তু ইফাজ তাদের ভদ্র ভাবেই ফিরিয়ে দিতো।

ঘরে ঢুকেই প্রথমে চোখ পড়লো মধুর দিকে।একনজর দেখেই ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,’কেমন আছিস রে?’

‘এইতো ভালো।হাসপাতাল থেকে আসলে কখন?’

‘দশ/পনেরো মিনিট হবে।আচ্ছা শোন একটু আসতে পারবি তোর সাথে একটু কথা আছে।’

ইয়াদ মধুর দিকে ইশারা করে ভাইয়ের সাথে বেরিয়ে গেলো।
————–
ছাঁদের দরজা লক তিনটা চেয়ারে তিনজন বসে আছে।নিখিল,ইফাজ আর ইয়াদ।সাইদা খানের কাছে সবটা শোনার পর ইফাজের মাথা আগুন ধরে গিয়েছিলো,শরীরের প্রত্যেকটা শিরা উপশিরা বিদ্রোহ করে বলল নাহ!এতো সহজে তো ওই নরপশুগুলো ছাড়া পেতে পারে না।তাই তখনই নিখিল কে ফোন করে আসতে বলেছিলো।

এখন এই আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে কিভাবে ওদের ধরা যায়।নিখিল ইয়াদকে জিগ্যেস করলো,’আচ্ছা তোমার ওয়াইফের কি ওদের কারো চেহারা মনে আছে?’

‘না,আমি ওকে জিগ্যেস করেছিলাম কিন্তু ও বলল মনে নেই।’

‘তাহলে কোনো ক্লু অথবা কোনো কিছু যেটা দিয়ে আমরা ওদের ধরতে পারবো।’

ইয়াদ মাথা চুলকে বলল,’ও বলেছিলো ওর কাছে একটা বন্ধ ফোন আছে।আর ওই ফোনটা ওদের মধ্যেই কারো।’

ইফাজ উত্তেজিত কন্ঠে বলল,’গ্রেট।এখন এইমুহুর্তে আছে ওটা?’

‘না বোধহয়।কারণ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসার সময় ও কিছুই আনে নি।’

নিখিল বলল,’ওটা কুইক নিয়ে আসার চেষ্টা করো।ওটা দ্বারাই ওদের ধরা সম্ভব।’

‘আচ্ছা আমরা কাল যাবো।’ইয়াদ বলল।

তারপর আলোচনা আরো কিছুক্ষণ চলার পর নিখিল বিদায় নিলো।আর ইয়াদ রুমে আসলো।মধু শুয়ে পড়েছে।হঠাৎ করেই ওর মাথা ব্যাথা উঠেছে।ইয়াদ ভেবেছিলো ওকে সব বলবে কিন্তু ওর মাথাব্যথা দেখে আর বলে নি।লাইট বন্ধ করে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে মধুর মাথাটা নিজের কোলের ওপর নিয়ে মাথা টিপে দিতে লাগলো।মধু মৃদু স্বরে বলল,’তুমি শুয়ে পড়ো।মাথা টেপা লাগবে না।’

‘চুপ করে ঘুমাও।’ইয়াদ শাসনের স্বরে বলল।
স্বামীর মিষ্টি শাসন মেনে মধু আর কিছু বলল না।আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো।একসময় ইয়াদেরও ঘুম পেয়ে গেলো।ও মধুকে বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুমিয়ে গেলো।

ইরিন খাওয়ার সময় ডাকতে এসে দেখলো ইয়াদের রুমের দরজা বন্ধ।কয়েকবার ডাকার পর ইয়াদ ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে দরজা খুললো।ইরিন বলল,’ভাইয়া খাবে না?’

‘না রে।মধুর মাথাব্যথা।ও ঘুমিয়ে গেছে।আর আমারও খেতে ইচ্ছে করছে না তুই একটু মাথাব্যথার বামটা নিয়ে আয়।’

‘আচ্ছা।আনছি।’

ইরিন বাম এনে দিলো।বামটা নিয়ে ইয়াদ আবার দরজা বন্ধ করে দিলো।বিছানায় ফিরে ঘুমন্ত মধুর ঠোঁটে আলতো একটা চুমু দিয়ে কপালে বামটা লাগিয়ে ওকে আবার পূর্বের মতো জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।

চলবে……
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)